কেয়ারগাতি গানবােটের সাথে যুদ্ধ
খুলনার দক্ষিণ অঞ্চলে পাক নৌবাহিনীর সাথে যে ক’টা সংঘর্ষ ঘটে কেয়ারগাতির গানবােট যুদ্ধ তাদের মধ্যে অন্যতম। কেয়ারগাতি গ্রামটা আশাশুনি থানার বড়দল ইউনিয়নে মরিচ্চাপ নদীর তীরে অবস্থিত। কেয়ারগাতি আশাশুনি থানা থেকে ৪/৫ কিলােমিটার উত্তর-পূর্ব দিকে এবং বড়দল বাজার থেকে ৮/৯ কিলােমিটার পশ্চিমে। কেয়ারগাতির অপর পারেই চাপড়া গ্রাম। কেয়ারগাতি ও চাপড়া উভয় গ্রামেই রাজাকারদের শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। কিন্তু কেয়ারগাতি গ্রামে গড়ে তােলা হয় মুক্তিবাহিনীর শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ, যদিও নদীর অপর পারেই ছিল রাজাকার মিলিশিয়াদের শক্ত ক্যাম্প। আবার আশাশুনি থানাতেও পুলিশ ছাড়া রাজাকাররাও থাকত। চাপড়ার রাজাকার মিলিশিয়া ক্যাম্পে প্রায়ই সাতক্ষীরা থেকে মিলিটারী এসে অবস্থান করত। চাপড়ার সাথে সাতক্ষীরার উত্তম পাকা রাস্তার যােগাযােগ ছিল। চাপড়ার মিলিটারী, রাজাকার আর মিলিশিয়াদের সাথে কেয়ারগাতির মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিদিন দু’তিনবার রুটিন মাফিক গুলিবিনিময় হত। কেয়ারগাতিতে আমরা খেজুর গাছ, কলা গাছ, নারকেল গাছ, মাটি ইত্যাদি দিয়ে ৮/১০টা শক্ত বাঙ্কার তৈরি করি এবং গােটা পচিশেক ট্রেঞ্চ তৈরি করি। এ অঞ্চলের বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আজিজ সানার (বড় ভাই) উৎসাহে আমরা কেয়ারগাতিতে এই গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা রচনা করি। এসব বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ তৈরিতে কেয়ারগাতিবাসী যে ভূমিকা ও সহযােগিতা দিয়েছিল তা কখনও ভুলবার নয়।
পাকসেনারা যেহেতু সাতক্ষীরা থেকে মাত্র আধা ঘন্টায় চাপড়ায় আসত তাই আমাদের সদা সতর্ক থাকতে হত। আর পাকসেনারা যেদিন চাপড়ায় অবস্থান করত সেদিন রাজাকারদের তেজ বেড়ে যেত এবং সারারাত গােলাগুলি করত। পরে অবশ্য আমরা বুঝতে পারি যে, খানসেনাদের খুশি করার জন্য তারা এমন করত। কেয়ারগাতির দক্ষিণ পশ্চিম দিকে খােলপাটুয়া নদী মাত্র ২/৩ কিলােমিটার, পূর্ব দিকে ৪/৫ কিলােমিটার দূরে কপােতাক্ষ ও মরিচ্চাপের মােহনা। যে কোন সময় এই দু’দিক থেকে গানবােট আসতে পারে এবং পশ্চিম পাড়ে চাপড়ায় শক্তিশালী রাজাকার ঘাঁটি। তাই এখানে মুক্তিবাহিনীর অবস্থান বিপজ্জনক। এখানকার কয়েকটা বড় গাছে আমাদের ওপি বা অবজারভেশন পােস্ট ছিল। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত পালাক্রমে এই গাছে উঠে সেন্ট্রি দিত আমাদের ছেলেরা। ১৫ই আগস্ট আশাশুনি থানা ঘাটে অসময় দুটো লঞ্চ আসায় খবর নেয়ার জন্য মনিরুজ্জামান ও মান্নাকে দুটো গ্রেনেড দিয়ে আশাশুনি থানার উপর পাঠালাম। ওদের বাড়ি ঐ এলাকায়, তারা দুজনই ছােট বাচ্চা, তাই ওদের তেমন সন্দেহ করার কথা নয়। ১৬ই আগষ্ট, আমি নাস্তা খেয়ে এক বাঙ্কারে বসে আছি, এমন সময় বড় ভাই এসে খবর দিল ঐ দূর খােলপাটুয়া নদী দিয়ে দু’খানা গানবােট আসছে। গানবােটের মাস্তুলে পাকিস্তানী পতাকা স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে। দ্রুত আমি দূত পাঠিয়ে তাদের দীর্ঘ প্রায় আধা মাইল প্রতিরক্ষা লাইনে সকলকে গানবােট আগমনের খবর দিলাম এবং সকল গ্রুপকে নির্দেশ দিলাম তারা গানবােটে কিছু গুলি করে যেন দ্রুত সুবিধা মতাে পিছু হটে কাজলনগর ক্যাম্পে চলে যায়।
রাতে এখানে এই এলাকার ছেলেরা ও গ্রামবাসীরা ছাড়া কেউ থাকবে না। আমি খবর পাঠিয়ে একটা গাছে উঠলাম, দেখি ঠিকই গানবােট আসছে। গানবােটের আগমন বার্তা পেয়ে আশাশুনি লঞ্চঘাট থেকে নােঙ্গর করা দুটো লঞ্চ রাজাকার ভর্তি করে আমাদের দিকে আসছে। সবাই খবর পেয়েছে, সর্বদক্ষিণ পশ্চিমে কমান্ডার রেজাউল করীম ও তার দল। তার কাছে এলএমজি আছে একটা। তারপর প্রতাপনগরের মতিয়ার ভাইয়ের দল। এরপর গাজী রফিকুল ইসলাম এবং সবশেষে আবুল কালাম আজাদের দল; রেজাউল, মতিয়ার ভাই, রফিক, কালাম সবাই পরীক্ষিত অধিনায়ক, তাই আমি অনেকটা নিশ্চিত মনে বসে আছি। সবার প্রতি একই নির্দেশ ১০/১৫ মিনিট গােলাগুলি করেই আমরা পিছু হটে যাব। আজকের পলিসি Hit and Run. কারণ তাদের শক্তি ও আধুনিক অস্ত্রের সাথে সম্মুখ সমরে যাওয়া বােকামী ছাড়া আর কি? আমার এক পাশে বিশ্বস্থ সহচর মুজিবুর রহমান, অন্য দিকে মনােরঞ্জন। নদীতে ভাটা, সহজে খানসেনারা বা রাজাকাররা কাদা ঠেলে নামতে পারবে না।
দেখতে দেখতে গানবােট চলে এল আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহের কাছাকাছি। রেজাউল ও তার দল সর্বপ্রথম এলএমজি-র ফায়ার দিয়ে যুদ্ধের উদ্বোধনী ঘােষণা দিল। আর যায় কোথায় পাকনৌবাহিনীর গুলির অবিরাম বৃষ্টি। দুই গানবােট এবং লঞ্চ তীরে আসার আপ্রাণ চেষ্টা করছে, কিন্তু আমাদের ছেলেরাও জীবন পণ করে গুলি চালাচ্ছে। গানবােট একবার পিছনে যায় আবার সামনে আসে, লঞ্চ দুটো সামনে আসতে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর গুলি খেয়ে গানবােটের পিছনে গিয়ে আশ্রয় নেয়। ইতিমধ্যে ১০/১৫ মিনিট কেন, আধা ঘন্টা পার হয়ে গেছে। কিন্তু এই যুদ্ধ রেখে কেউ উঠছে না। আমি প্রতি বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চে খবর পাঠাচ্ছি দ্রুত প্রত্যাহার করে বিলের মধ্য দিয়ে কাজলনগর যাওয়ার জন্য। কিন্তু আজকের এ যুদ্ধে সবাই যেন কেমন অপূর্ব মজা পাচ্ছে, তাই কেউ আর উঠছে না। কালাম ও রফিকের গ্রুপ আপ্রাণ গুলি করে যাচ্ছে যেন গানবােট তীরে ভীড়ে খানসেনারা নামতে না পারে। গানবােট একবার নামাতে পারলে মুক্তিবাহিনীকে তারা নাস্তানাবুদ করে ছাড়বে। না কালাম, রফিক মােটেই ঘাবড়ায়নি, তারা আজ অতি কঠিন দায়িত্ব পালন করছে। ওদের গুলির প্রচন্ডতায় গানবােট বার বার নামতে এসে ফিরে ফিরে যাচ্ছে। রাজাকারের লঞ্চ সামনেই আসতে পারছে না, কিন্তু যে কোন মুহূর্তে বড় ধরনের বিপদের সমূহ আশঙ্কা। অতএব পুনরায় সকলকে কড়া ভাষায় প্রত্যাহারের নির্দেশ দিলাম। দক্ষিণ দিকের রেজাউল ও উত্তর দিকের কালাম ও তাদের দল সর্বশেষ প্রত্যাহার করবে।
আমরা কেয়ারগাতি গ্রাম রেখেই বিলের মধ্যে এসে ছিলাম, তখন ধানের চারা ১০/১৫ দিন রােয়া হয়েছে। তার ভিতর দিয়ে খালবিল পার হয়ে চলে এলাম কাজলনগর । সকলের সাথে তখনও যােগাযােগ হয়নি। এক এক দল একএক জায়গায় গিয়ে সুবিধামতাে আশ্রয় নিয়েছে। কিন্তু বেলা ৩টার দিকে বড়ভাই কাজলনগর ক্যাম্পে এসে এক মারাত্মত দুঃসংবাদ দিল, খানসেনারা কেয়ারগাতি নেমে বড়ভাইদের ঘরবাড়িসহ ঐ গ্রামের বহু ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। তবে তার চেয়ে খারাপ সংবাদ হল যে, আমাদের হাবিব, কুদুস ও শহীদকে খানসেনারা বাঙ্কার থেকে অস্ত্রসহ ধরে নিয়ে গেছে। মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল, তিন তিনটা ছেলেকে ওরা ধরে নিয়ে গেল অথচ এত গােলাগুলির মধ্যে আমাদের কেউ হতাহত হয়নি বরং ওদের রাজাকার লঞ্চের বেশ কিছু রাজাকার নিঃসন্দেহে আহত হয়েছে। ওদের নিশ্চয়ই চরম নির্যাতন করে অবশেষে হত্যা করবে। ওদের মুখের করুণ ছবি আমার চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠতে থাকে। কতবার আমি ওদের প্রত্যাহারের সঙ্কেত দিয়েছি অথচ সবকিছু উপেক্ষা করে তারা বাঙ্কারে থেকে গানবােট মােকাবিলা করছিল। সবাই দারুণ দুশ্চিন্তায় ডুবে গেলাম। এই যুদ্ধে আর যারা অংশ নেয় তারা হল, আব্দুর রহমান, জমাত আলী, আবুবকর সিদ্দীক, মহীউদ্দিন সানা, আজহারুল ইসলাম, শামসুর রহমান, হাবিবুর রহমান, রফিকুল, আব্দুল কাদের মােনাজাত, আব্দুল মজিদ, এমএ বারীসহ অনেকে।
সেদিন রেজাউল, রফিক ও কালামের রণকৌশল ও দৃঢ়তা মুক্তিবাহিনীর জন্য গর্বের বস্তু ছিল। পাকহানাদার বাহিনীর উপর অব্যাহত ভাবে গুলিবর্ষণ না করলে যে কোন একদিক থেকে সহজে তারা নামতে পারলে আমাদের বহু জানজীবনের ক্ষতি হত।
ওমা! স্বাধীনতার পর খুলনা জেলখানা থেকে হাবিব, শহীদ, কুদুস সশরীরে বেরিয়ে এসে আমাদের অবাক করে দেয়। তাদের পেয়ে বুকে জড়িয়ে ধরি, সেকি আনন্দ! ওদের ফিরে পাব ভাবিনি, খােদার দরজায় লাখাে শুকরিয়া জানালাম, রাখে আল্লা মারে কে? ওদের কাছে জানতে পারলাম, তারা রাজাকার পরিচয় দিয়ে মিলিটারীদের পুরােপুরি সন্দেহের মধ্যে ফেলে দেয়। ওদের গায়ে ছিল রাজাকারের শার্ট। মকবুল চেয়ারম্যানের বাড়ি অপারেশনের সময় কয়েকটা রাজাকারের পােষাক পাওয়া যায়, ঐ সময়ে পােশাকের সমস্যা ছিল, তাই ওরা রাজাকারের শার্ট ব্যবহার করত। যেহেতু গানবােটে করে তাদের খুলনায় নিয়ে যায় এবং রাজাকাররা চাপড়ায় থেকে যায়, তাই সনাক্ত করার কেউ ছিল না। অতএব মিলিটারীরা ওদেরকে খুলনা জেলখানায় পাঠিয়ে দেয়। একেই বলে ভাগ্য! ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত