পাটকেলঘাটা গণহত্যা
হানাদারবাহিনী বাংলাদেশে তাদের অবৈধ অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য পােড়ামাটির নীতি গ্রহণ করে। তৎকালীপ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল টিক্কা খান ছিলেন অত্যন্ত কঠোর ও নির্মম প্রকৃতির মানুষ। তাই প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের দায়িত্ব দিয়েই তাকে পাঠান। তিনি এসে গােটা দেশে লুট-হত্যা-সন্ত্রাস সৃষ্টির মাধ্যমে বাঙালিদের দমনের প্রয়াস নেন। কৌশল হিসেবে তিনি ঢালাও ভাবে শুধু সামরিক বাহিনী ব্যবহার করেননি, এদেশীয় দালাল, রাজাকার ও বিহারীদের ব্যবহার করে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হাসিলের চেষ্টা নেন। এদের মাধ্যমে গােটা দেশে পরিচালিত হয়েছে অসংখ্য গণহত্যা। পাটকেলঘাটা গণহত্যা এমনি ধরনের নৃশংস একটা গণহত্যার ভয়ংকর উদাহরণ। খুলনা সাতক্ষীরা রােডে কপােতাক্ষ নদের তীরে পাটকেলঘাটা বাজার তালা থানায় অবস্থিত হলেও বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে পাটকেলঘাটার গুরুত্ব অনেক বেশি। কপােতাক্ষ নদের উপর নির্মিত হয়েছে এক ব্রীজ, যাতায়াত ব্যবস্থায়ও পাটকেলঘাটা ব্রীজের গুরুত্ব অপরিসীম। ২৩শে এপ্রিল শুক্রবার, জুমার নামাজের দিন; তাই বাজারের লােকজন সকাল সকাল দোকানপাট বন্ধ করে বাড়ির দিকে যাচ্ছে এমন সময় চারদিকে কেমন যেন কানাঘুষা, আজই সাতক্ষীরা থেকে পাটকেলঘাটা বাজারে মিলিটারী আসবে। খবরটা মুখে মুখে দ্রুত ছড়িয়ে পড়ায় আরাে দ্রুত সবাই দোকান বন্ধ করে ঘরে ফেরে। এই সময় গােটা বাংলাদেশে হিন্দুদের এবং আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের উপর চলছে চরম নির্যাতন। মুসলীম লীগ, জামাত ও শান্তি কমিটির লােকজনের অমানুষিক নির্যাতন ও অত্যাচারে হাজার হাজার মানুষ ভিটামাটি ছেড়ে ভারতে যাচ্ছে আশ্রয়ের সন্ধানে। পথিমধ্যেও তাদের উপর চলছে হামলা, লুট, খুন জখম ইত্যাদি। এমনিভাবে বাড়ি ও গ্রাম ত্যাগ কর বহুলােক ভারতের পথে রওয়া না হয়ে পাটকেলঘাটা ব্রীজের কাছাকাছি কুমিরা স্কুল ও গ্রামে বিভিন্ন বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। সামান্য বিশ্রাম, খাওয়াদাওয়া ইত্যাদি শেষে হয়ত আবার তাদের অনিশ্চিত যাত্রা শুরু হবে।
এমন সময় চারদিক দৌড়াদৌড়ি, হৈচৈ কি ব্যাপার? সাতক্ষীরা থেকে মিলিটারী এসে পাটকেলঘাটা বাজার ঘিরে ফেলেছে, তাদের সামনে দেখা গেল মনু কসাইকে। মনু কসাই যেন মিলিটারীদে কমান্ডার, সে যা বলছে তারা তাই করছে; কুমিরা থেকে শরণার্থীদেরও ধরে আনা হল, বাজার থেকে অনেককে বেছে বেছে ধরে আনা হল, সবকিছু করছে এই মনু কসাই। কে এই মনু কসাই? সে একজন অবাঙালি, ভারতের বিহার থেকে পাটকেলঘাটা বাজারে এসে কসাইয়ের ব্যবসা করে। ইতিমধ্যে প্রায় ৪০/৪৫ জনকে ধরে এনে গরুর দড়ি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তাদের কাছে টাকাপয়সা, ঘড়ি, আংটি, চশমা যা কিছু মূল্যবান দ্রব্যাদি ছিল সবই লুট করে নেয়া হয়েছে। তারপর একযােগে শুরু হল অমানবিক নির্যাতন। বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করা হল কয়েকজনকে বাকীদের গুলি করে দিল যারা কিছুক্ষণ বেঁচে ছিল তাদের আর্তচিৎকারে বােধহয় আল্লাহর আরশ কেঁপে গেল। কিন্তু মিলিটারী আর মনু কসাইয়ের কলিজা কাঁপল না। বরং তারা যেন পাশবিক আনন্দ উপভােগ করল। পাটকেলঘাটার আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠল। এদৃশ্য দেখার মতাে নয়, তবুও সাহস করে দু’একজন হাউজের কাঁটা তারের বেড়ার ধারে উপস্থিত হল। সুন্দর করে বেড়া দেয়া, তাই ঢােকা মুশকিল। ঢােকার জায়গা সাবধানে খুঁজতে খুঁজতে একজনের ঢােকার মতাে একটা জায়গা পাওয়া গেল। কাঁতারী’ (তার কর্তন করার যন্ত্র বিশেষ) দিয়ে কেটে জায়গা বড় করা হল এবং সােনা মিয়া ও আব্দুল্লাহ সেই জায়গা দিয়ে পাওয়ার হাউজের সীমানার ভেতর প্রবেশ করল অত্যন্ত সাবধানে। তারের বেড়ার পাশে ছিল প্রশস্ত ও গভীর পাকা ড্রেন। বাকীরা ড্রেনের আশ্রয় নিয়ে সােনা মিয়া ও আব্দুল্লাহ ACTION-এর অপেক্ষায় বসে থাকল।
সাবধানে, অত্যন্ত সাবধানে এগুচ্ছে সােনা মিয়া আর আব্দুল্লাহ; জীবনে এই প্রথম ওরা পাওয়ার হাউজে ঢুকল, ঢুকেই দেখল কাঁটাতারের রােল করা বড় বড় বান্ডিলের পাশে ওরা লেপ্টে পড়ে। প্রায় নিঃশ্বাস বন্ধ করে একসময় ইঞ্জিন রুমে ঢুকে পড়ে। কাঁটা তারের বেড়া থেকে ইঞ্জিন রুম প্রায় ২০০ গজ দূরে ছিল, ইঞ্জিন রুমের পাশে শ’খানেক ডিজেলের ব্যারেল ছিল আর ৫০ গজ দূরে টুলে বসে ঝিমােচ্ছিল নিরাপত্তা প্রহরীরা ওরা দেখল লােহার পাতের উপর মােট ৮টা জেনারেটর সেট করা হয়েছে এবং নিচে একটা ফাক ছিল—যা দেখে ওদের মনে হল টাইম বােমাটা বসানাের জন্যই বােধহয় কেউ ফাকাটা আগে থেকেই তৈরি করে রেখেছে। ওরা দ্রুত কাঁতারী দিয়ে ডেটোনেটারের মুখ কেটে মাত্র ৪ মিনিটে বােমা দুটো জায়গা মতাে সেট করে ডেটোনেটারে আগুন দিল। বাইরে তখন কেন যেন কুকুরে প্রচন্ড চিৎকার করছিল। কাজ শেষ, দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে ফেরার পালা, মাত্র আধ ঘন্টার মধ্যে বােমা দুটো বিস্ফোরিত হবে। রাত ১১-২০ মিনিটে বােমা দুটো সেট করে নিরাপদে ওরা স্টেডিয়ামের পাশে এল, প্রাণ ভরে লম্বা নিঃশ্বাস নিল।
এ সময় আব্দুল্লাহ প্রস্তাব দিল যেহেতু খায়রুল ক্যাম্পে সেহেতু ওর বাড়িতে সংবাদ দিয়ে আসা যাক। কারণ স্টেডিয়ামের কাছেই খায়রুলের বাড়ি। আব্দুল্লাহ নিজেই তার বাড়ি গেল। চারদিকে অন্ধকার। শুধু একটা ঘরে মিট মিট করে হারিকেন জ্বলছে। সন্তর্পণে জানালা খুলে দেখল খায়রুলের ছােট ভাই আফজাল ঘুম জড়ানাে চোখে পড়ছে। আস্তে করে তাকে ডাকতেই প্রচন্ড ভয় পেয়ে সে বই, টেবিল, হারিকেন সব উল্টে দিল। আব্দুল্লাহ কোন মতে বলল, আমরা মুক্তিযােদ্ধা। খায়রুল ভাল আছে এবং ক্যাম্পে সুস্থ অবস্থায় আছে।’ এটুকু বলেই সে কেটে পড়ল। ঘড়িতে তখন রাত ১১-৪০ মিনিট অর্থাৎ হিসেব মতাে আর ১০ মিনিটের মধ্যেই বােমা দুটো বিস্ফোরিত হবে। সাবধানে ওরা সাতক্ষীরা শহর পার হচ্ছিল। হঠাৎ পাহারারত লাঠি হাতে কিছু রাজকার ‘হল্ট’ বলে ওদের থামাল। সােনা মিয়া স্টেনগান ঠেকিয়ে রাজাকারদের হটিয়ে দিল। ঠিক রাত ১১-৫০ মিনিটে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে বিস্ফোরিত হল বােমা দু’ টিনড়ে উঠল সাতক্ষীরা শহর। একের পর এক ডিজেল ব্যারেলে আগুন লেগে তার লেলিহান শিখায় রক্তবর্ণ ধারণ করল পাওয়ার হাউজ এলাকা, অনেক দূর থেকে তা বােঝা যাচ্ছিল। মিলিটারী ও রাজাকার ক্যাম্প থেকে অনবরত গুলি হচ্ছিল। রাত ১২টায় মুক্তিযােদ্ধারা তেজমহল (তােজাম্মেল হােসেন)-এর বাড়ি গিয়ে পান্তা ভাত খেল। গােলাগুলি কিছুটা থামলে ওরা পরাণদহে রজব আলী ও মােক্তার সরদার প্রমুখের বাড়ি আশ্রয় নেয়। পরদিন জানল ওদের পাতান বােম বিস্ফোরিত হয়ে পাওয়ার হাউজ এমন ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে, ২/১ মাসেও তা ঠিক করা যাবে না। এ ঘটনায় জড়িত থাকার সন্দেহে পাওয়ার হাউজের হেড ক্লার্ক ও কিছু কর্মচারীকে মিলিটারীরা পিটিয়ে মেরে ফেলে। নিরীহ কর্মচারীদের এই নারকীয় হত্যার ঘটনা ওদের আজ পীড়া দেয়। ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত