গােয়ালডাঙ্গার যুদ্ধ
আমাদের সদর দপ্তর তখন আশাশুনি থানার বড়দল ইউনিয়নের কাজলনগর ক্যাম্পে। টাউনশ্রীপুরের যুদ্ধের অমর শহীদ কাজলের নামানুসারে এই ক্যাম্পের নামকরণ করা হয়েছে কাজলনগর ক্যাম্প। গ্রামটার নাম অবশ্য হেতালবুনিয়া। কাজলনগর ক্যাম্পের চারদিকে ৩/৪ মাইল বিল আর বিল, বিলে শুধু ধান আর ধান। চারদিকের প্রতিটি গ্রামে আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বেশ কিছু অনিয়মিত মুক্তিযােদ্ধা ও স্বেচ্ছাসেবক আছে। যারা শত্রুর আগমন, চলাচল বা কোন প্রকার আক্রমণের প্রস্তুতি সম্পর্কে খবর পাওয়া মাত্রই আমাদের খবর দেবে। কালাম, বাকার, রফিক অন্যত্র চলে গেছে। রহমত উল্লাহ দাদু, লেঃ আরেফিনসহ অন্যান্য সবাই দূরে অপারেশনে, মুজিবর রহমান ও গাউস গেছে চাঁদখালিতে খোঁজখবর আনতে। চাদখালি হাইস্কুলে নাকি শীঘ্র রাজাকার ক্যাম্প হবে, সে বিষয়ে প্রকৃত সংবাদ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে। মনােরঞ্জন ২৫/৩০ জন ছেলেকে সকালের নাস্তার পর রাইফেল ট্রেনিং দিচ্ছে। গতকালই তারা রাইফেল ফায়ারিং শিখেছে। মােট কথা ক্যাম্পে যােদ্ধা বলতে মনােরঞ্জন এবং আমি উপস্থিত। এমন সময় একটা তালের ডােঙ্গায় দু’জন লোেক ক্যাম্পে আসে, সেন্ট্রি তাদেরকে আমার নিকটে নিয়ে এল। আমি তখন অস্ত্রাগারে (কোথ) বসে অভিনিবেশ সহকারে নবম সেক্টরের জন্য একটা জরুরি রিপাের্ট তৈরিতে ব্যস্ত। খবর পেয়ে আমি তাদের সাথে দেখা করতে এসে দেখি দু’জনই আমাদের বিশ্বস্ত গােয়েন্দা। তাদের নাস্তা দিতে বলে কথা শুরু করলাম।
তারাও অতি ব্যস্তসমস্ত হয়ে বলল, চাপড়ার পুরাে রাজাকার বাহিনী আজ বেলা ১০টায় পার হয়ে বড়দল বাজার লুট করতে আসবে ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেবে। তাদের অপরাধ হল মুক্তিবাহিনীকে খাবার যােগান দেয়। অভিযােগটা অবশ্য পুরােপুরি সত্য। ঐ সময় বড়দলের সিদ্দিক সানা ছিলেন আমাদের খাবার-দাবার যােগানের দায়িত্বে। তিনি আমাদের খাবার যােগার করার জন্য দিন-রাত কষ্ট করতেন এবং বড়দল বাজারে ব্যবসায়ীরা আমাদের প্রয়ােজনে সবরকম সাহায্য করতেন। সিদ্দিক সানাকে আমরা কোন সময় সিদ্দিক ভাই আবার কোন সময় খাদ্য মন্ত্রী বলে ডাকতাম। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তার অন্তর ছিল দরদে ভরা, আমাদের সামান্য আরাম আয়েশের জন্য তার দুশ্চিন্তার অন্ত ছিল না। ছােটখাট এই মানুষটি যুদ্ধে অস্ত্র ধরেনি, কিন্তু আমরা যুদ্ধে গেলে আমাদের সাথে যাবে, পাশে বসে দোয়া করবে অথবা একটা ঝুঁকিপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবে। যা হােক চিন্তায় ছিলাম, কারণ ক্যাম্পে তেমন কেউ নেই মনােরঞ্জন ও আমি ছাড়া। তারিখটা ছিল ১৭ই সেপ্টেম্বর। আমি মনােরঞ্জনকে ডেকে পাঠালাম, দু’জনে আলাপ করলাম। গােয়ালডাঙ্গা বাজারসহ ফকরাবাদ পুরাে এলাকাটা আমার নখদর্পণে । কারণ আশাশুনি স্কুলে পড়াকালীন আমার ছাত্র জীবনের একটা স্মৃতিময় বছর এ অঞ্চলে কেটেছে। গােয়ালডাঙ্গা বাজারের শেষ প্রান্তে ও ফকরাবাদ গ্রামের সীমান্তে একটা বড় খাল এবং সুইস গেট আছে। একদিকে বড় খাল, একদিকে নদী, অন্য দিকে ধানবন। সুতরাং কোনমতে একটা রাইফেল নিয়ে এখানে বসতে পারলে শত্রুর মােকাবেলা করা সম্ভব সব বুঝিয়ে বলায় মনােরঞ্জন বেশ আগ্রহ প্রকাশ করল। যেমন কথা তেমন কাজ, আমরা দ্রুত দুটো নৌকোয় করে ৫/৭ জনকে ক্যাম্পের দায়িত্বে রেখে ২৫ জন রওনা হয়ে গেলাম। তালের ডােঙ্গাটা আগে আগে চলেছে, আমি ও মনােরঞ্জন আলাপ করে নিলাম।
আমরা যখন এই ফ্লুইস গেটে এলাম তখন প্রায় বেলা বারােটা বাজে এবং প্রায় ২০০ রাজাকারের এক বাহিনী বড়দল বাজারের দিকে পদব্রজে চলে গেছে। নৌকায় বসেই প্ল্যান করেছি। আমি পূর্বদিকে আর মনােরঞ্জন পশ্চিম দিকে রেকি করতে গেলাম। দেখি যাওয়ার সময় রাজাকারেরা ৫ জনকে এই গুরুত্ত্বপূর্ণ স্থানে পাহারায় রেখে গেছে। মনােরঞ্জনও রেকি করে এসে প্রস্তাব দিল আমরা অতর্কিতে গিয়ে ওদের ধরে ফেলব। আমরা পাঁচজন যাব, যেহেতু তারাও পাঁচজন। খালের মধ্য দিয়ে এগিয়ে দেখি একটা তালগাছের গায়ে রাইফেল পাঁচটা রেখে তারা একটু দূরে গল্পে মশগুল। আমরা এক লক্ষ দিয়ে রাইফেলগুলাে কজা করে ওদের হ্যান্ডস আপ করালাম। ঘটনাটা এত আকস্মিক ছিল যে, তারা এতটুকু নড়াচড়া করার সময় পেল না। এদেরকে মনােঞ্জন ও আরাে দু’জন মিলে বেঁধে ফেলল। সুইস গেটের কাছে এসে দেখি সেখানে কে বা কারা অনেক ইট ঝেড়ে রেখেছে। আরাে সুবিধা, যেন আল্লাহ প্রদত্ত ফেরেস্তাদের সহযােগিতা, দ্রুত আড়াল তৈরি করে ফেললাম। প্ল্যান হল আমি ১০ জন নিয়ে রাজাকারদের মােকাবেলা করব আর মনােরঞ্জন পশ্চিম দিকে বাকি ১৫ জন নিয়ে চাপড়া এলাকার দিকে থেকে রাজাকাররা যেন আক্রমণ করতে না পারে তার ব্যবস্থা নেবে, পিছনের দিক সামলানাের দায়িত্ব তার।
আমরা প্রস্তুত। রাজাকারদের বড়দল থেকে ফেরার কথা কমপক্ষে আরাে ঘন্টা দু’য়েক পর। অথচ পাঁচমিনিটের মাথায় কিলবিল করতে করতে তারা আসছে। প্রথমেই আমি গুলি করে উদ্বোধন করলে, একসাথে সবাই ফায়ার করবে। পরে আমি একা ফায়ার করব। আমার হাতে এসএলআর। গুলি করার জন্য হাতটা নিশপিশ করছে। শত্রু নিধনের এ সুবর্ণ সুযােগ কে হারাতে চায়? আমার রেঞ্জের আওতায়, গুড়ুম-গুড়ুম-গুড়ম, কাঁচা কবুতরে মতাে গুলি খেয়ে আচমকা পড়ল গােটা কয়েক। ওদের ফায়ার করার তেমন কোন সুযােগই হচ্ছে না। ওরা ওয়াপদার রাস্তা দিয়ে আসছিল, চোখের নিমেষে যুদ্ধের গতি ও আমাদের এই এ্যামবুশকে ওরা কল্পনাই করতে পারেনি। বিশৃঙ্খল অবস্থায় রাজাকাররা এদিক-ওদিক ছুটেছে। কিন্তু ওদের সাথে ছিল কয়েকজন বিহারী। আহসান ছিল তাদের নেতা, সে অতি দ্রুত ক্রলিং করে ৩/৪ জনসহ গুলি করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিল। তার গতি ছিল বেশি এবং এঁকে বেঁকে চলছিল। আমার কয়েকটা গুলি মিস হল। তারা দুঃসাহসিকভাবে এগুচ্ছে, আহসানের ক্রলিং ছিল প্রশংসার যােগ্য এবং সাহস ছিল অদম্য। এমন সময় আমার এসএলআর খারাপ হয়ে গেল, পাশ থেকে আর একটা নিয়ে গুলি করতেই মাথায় গুলি খেয়ে আহসান লাফ দিয়ে উঠে মাটিতে পড়ে সাথে সাথেই মৃত্যুবরণ করল। আর ওরা সামনে অগ্রসর হতে সাহস করল না। মরিচ্চাপ নদীতে ঝাপিয়ে পড়ল, কেউ কেউ বাগানে, কেউ পাশের ধানক্ষেতে অস্ত্র ফেলে পালায়। নদীতে আমরা ব্যপক গুলি বর্ষণ করলাম। নতুনরা গুলি করে হাত পাকা করছে। সামনে, ডাইনে, বায়ে বেশ কিছু গুলি করে, যুদ্ধ জয়ের সঙ্কেত দিয়ে সবাইকে আমার কাছে আসতে নির্দেশ দিলাম। কেবলমাত্র পশ্চিম দিকের প্রতিরক্ষা থাকবে।
কিন্তু বিজয়ের আনন্দে আমরা যখন উদ্বেলিত, ৩০/৪০ গজ দূরে দেখি আমার ঘনিষ্ঠ যুদ্ধসঙ্গী মনােরঞ্জনের প্রাণহীন দেহ মাটিতে পড়ে আছে। দ্রুত গিয়ে তার মাথা কোলে তুলে নিলাম, না প্রাণ নেই। চোখের জলে আমরা সবাই তখন শােকার্ত হয়ে ছিলাম। মনােরঞ্জন এখানে কিভাবে এসেছিল জিজ্ঞাসা করায় সঙ্গীরা বলল, যুদ্ধ শুরু হলে সে আমাকে সহযােগিতা করার জন্য এসেছিল, যেহেতু তেমন অভিজ্ঞ যােদ্ধা আমার পাশে ছিল না তাই। আমার জন্য তার কি মায়া! জীবন দিয়ে তা প্রমাণ করল। অতঃপর এই বীর যােদ্ধার মরদেহ কাজলনগর নেয়ার নির্দেশ দিয়ে আমরা অশ্রুসজল নেত্রে শত্রুর খোঁজে বের হলাম। দেখি সে এক এলাহী কান্ড, এখানে। ওখানে ১৫/১৬ টা রাজাকারের লাশ পড়ে আছে। আহসান বিহারীর পাশে গিয়ে ক্ষণিক দাঁড়ালাম তার অস্ত্রটা পিঠের তলায়। গ্রামবাসীরা এ যুদ্ধে আমাদের সহযােগিতায় এগিয়ে এল। নদীর চরের কাঁচাবন, হারগাজা ও কেওড়াবন থেকে কয়েকজন রাজাকারকে ধরে আনল, আমরা অস্ত্র পেলাম ৪৫টা।
ওদিকে গাউস ও মুজিবর চাদখালির শাহপাড়া থেকে খবর পেয়েছে যে, আমি নাকি রাজাকাদের দ্বারা ঘেরাও হয়ে গেছি। তারা কয়েকজন মিলে উধ্বশ্বাসে ছুটতে ছুটতে চলে আসে তেঁতুলিয়ার পার দিয়ে। কিন্তু ঘটনাস্থলের অপর পারে এসে প্রকৃত খবর পায় যে, যুদ্ধে আমাদেরই জয় হয়েছে। তখন তারাও তাড়িয়ে গ্রামবাসীদের সাহায্যে কয়েকজন রাজাকার ধরে ও তাদের কাছ থেকে রাইফেল উদ্ধার করে। দারুণ ক্ষুধার্ত। গ্রামবাসীরা আমাদের নারকেল গুড় ও চিড়া দিল সবাই পেটপুরে খেল। নতুন মুক্তিযােদ্ধাদের আনন্দের সীমা নেই। কারণ এতদিন তারা অস্ত্র পায়নি, এখন তারা অস্ত্র পাবে। আমরা কাজলনগর চলে যাই। এত বড় সম্মুখ সমরের বিজয় সত্বেও মনােরঞ্জনের মতাে বন্ধু বিয়ােগে দারুণ আঘাত পাই। তাঁকে সমারিক কায়দায় শ্রদ্ধা জানিয়ে ক্যাম্পের ও গ্রামবাসীদের সহযােগিতায় তার মরদেহ দাহ করা হয়। কাপরুষ গদাইপুরের মােকছেদ ভাই তখন এসে গেছেন। তিনিও সবসময়ই আমাদের সাথে আমরা কোথাও গেলে তিনি নামাজ পড়তে বসেন, নৌকায় থাকলে নামাজ পড়ে দোয়া করেন, সিদ্দিক ভাইয়ের মতাে আর এক ব্যক্তি এই মােকছেদ ভাই। | এই যুদ্ধে সেদিন যারা আমার সঙ্গে ছিল, তাদের মধ্যে আশাশুনির মান্নান, মনিরুজ্জামান— এদের অবশ্য কিছুটা পূর্ব অভিজ্ঞতা ছিল। আব্দুর রব, আঃ খালেক, অজিয়ার রহমান, শ্যাম, হাবিবুর রহমান, শহিদুল ইসলাম, আব্দুল কুদ্দুসসহ অন্যান্যরা ছিল শিক্ষানবীশ। ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত