পাক নৌ-বাহিনীর সাথে
মেজর জলিলের নৈশযুদ্ধ | মেজর জলিল একজন উঁচুদরের দেশপ্রেমিক ও যােদ্ধা ছিলেন। ভারতের বুকে বসে থেকে বরিশাল অঞ্চলে পাকবাহিনীকে মােকাবিলা করার ইচ্ছায় তিনি দুটি লঞ্চ যােগে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের সিদ্ধান্ত নেন। মে মাসের ৫ তারিখ হবে, আবহাওয়া মােটেই ভাল ছিল না, তবুও তিনি আনােয়ারা’ ও ‘সােহাগ’ নামক দুটি লঞ্চে অস্ত্র ভর্তির ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দিলেন। ইছামতিতে নােঙর করা ডবল ডেকার লঞ্চ দুটোয় প্রকাশ্যে দুদিন যাবত অস্ত্রশস্ত্র তােলার দৃশ্য সবার চোখে পড়ল। নদীর পূর্ব পারেই হানদার পাকসেনাদের ক্যাম্প, দূরবীন দিয়ে দেখতে তাদের মােটেও অসুবিধা হওয়ার কথা নয়। আবার এই সময় পাকহানাদারবাহিনীর এদেশীয় দালালরা মুক্তিবাহিনীর চলাচল ইত্যাদি সম্পর্কে খোঁজখবর নেয়ার জন্য এই অঞ্চলে শরণার্থীর ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত, যার কয়েক জন বিভিন্ন সময়ে ধরা পড়ে।
৫ই মে দুটো লঞ্চই বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে যাত্রা করে। একটি লঞ্চে বরিশালের এমএনএ মঞ্জুর নাসের, ডাঃ আসিফুর রহমান, ইস্কান্দার কবীর বাচ্চুসহ ২০/২৫ জন এবং পিছনের একটি লঞ্চে মেজর জলিলসহ অন্যান্যরা। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, ঝড়াে আবহাওয়ার মধ্যে এ যাত্রা। ভারতীয় বিএসএফ-এর টহলবােট ‘চিত্রাদা’ শমসেরনগর সীমান্ত পর্যন্ত ‘আনােয়ারা’ ও ‘সােহাগ’কে নিরাপদে পৌছে দিয়ে শুভ কামনা করে বিদায় নিল । লঞ্চের সারেং ও অন্যান সব কর্মচারীদের এসব পথঘাট চেনা জানা ছিল তাই লঞ্চের সকল মুক্তিবাহিনী সদস্য শত্রু এলাকায় এবং খারাপ আবহাওয়ায় হানাদার পাকবাহিনী টহলে থাকতে পারে না এই দৃঢ় বিশ্বাসে সবাই ছিল গভীর ঘুমে। আড়পাঙ্গাশিয়া পার হয়ে লঞ্চ দুটো রাতের সূচীভেদ্য অন্ধকারে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে চলতে থাকে। পরে শ্যামনগর থানার দক্ষিণ অঞ্চল দিয়ে এগিয়ে চলছিল, একদিকে বিশ্ববিখ্যাত গভীর সুন্দরবন এবং অন্যদিকে লােকালয়। সারেংরা ছিল দক্ষ, এ অঞ্চলের পথ-ঘাটও তাদের চেনা। শ্যামনগরের গাবুরা ইউনিয়নের হাজী সােহরাব হােসেনের বাড়ির রাইস মিলে বরিশালের একজন চাকুরি করত। এই সময় সেও মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয়। হাজী সাহেবের সাথে তার সম্পর্ক নিবিড়। তাই যাওয়া-আসার পথে এই লােক সােহরাব হাজী সাহেবের বাড়িতে অবস্থান করত এবং মুক্তিবাহিনী সম্পর্কে তার কাছে সরল বিশ্বাসে সব গল্প করত। হাজী সােহরাব অস্থিমজ্জায় একজন পাকিস্তানী ও মুসলীম লীগের, তাই তিনি সুকৌশলে এ যাত্রার খবর শুনে হানাদার বাহিনীকে খবর দেন ও গানবোেট এনে নদীতে টহল দেয়ার ব্যবস্থা নেন।
পাকনৌবাহিনীর দুটো গানবােট প্রস্তুত হয়ে আনােয়ারা ও ‘সােহাগ’-এর আগমনের অপেক্ষায় আলাে নিভিয়ে ওৎ পেতে বসেছিল। লঞ্চের শব্দ পেয়ে তারা প্রস্তুত হয়ে যায় এবং কাছাকাছি রেঞ্জের মধ্যে এলেই গুলি করে লঞ্চ থামানাের জন্য নির্দেশ দেয়। সারেং হতবুদ্ধি হয়ে পড়ে, গভীর ঘুমের কারণে সকলকে জাগালেও তারা ছিল হতবিহ্বল, কিংকর্তব্যবিমূঢ়। তবুও মেজর জলিল বিদ্যুৎ গতিতে প্রস্তুত হয়ে শত্রুর উপর অসীম সাহসিকতার সাথে প্রতিউত্তর দেন। সারেং বুদ্ধি করে লঞ্চ ওয়াপদা বেড়ী বাঁধের আড়ালে চলে যায়। মেজর জলিল এবং তার ২/৩ জন সঙ্গী তখন পাক গানবােটের উপর আক্রমণ করেই চলেছেন। কিন্তু তাদের গুলি ছিল সীমিত, অস্ত্র প্রচুর, তবে সবই ছিল লঞ্চে, আর ঘুটঘুটে অন্ধকার, অজানা-অচেনা জায়গা তাই উল্লেখযােগ্য কিছুই করা যাচ্ছিল না। গানবােট থেকে অবিরত মেশিনগানের গুলি আসছে, কিন্তু সবাই ওয়াপদা বেড়ী বাঁধের আড়ালে থাকায় কারাে তেমন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। তবে সবাই আতঙ্কিত, সন্ত্রস্ত । মেজর জলিলের সাথে সিদ্দিক, হাবিলদার জ্বার, মােকছেদ ও ইউসুফ বীর বিক্রমে শত্রুপক্ষের উপর পাল্টা আক্রমণ অব্যাহত রাখায় গানবােট থেকে কেউ তীরে নামতে সাহসী হয়নি। মুক্তিবাহিনীর লঞ্চ দুটোতে প্রায় ৪৮টা এলএমজি ৬০০ রাইফেল, ৩০০ এসএলআর, ২ইঞ্চি মর্টার, এনাগা, হাজারখানেক গ্রেনেড, অনেকগুলাে এসএমজি, স্টেনগান ইত্যাদি অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রচুর পরিমাণে গােলাবারুদ ছিল। আরাে ছিল চাল, ডাল, আটা, লবণ, ভােজ্য তেল এবং ১০০ ব্যারেল পেট্রোল ও ৭৫ ব্যারেল ডিজেল।
খানসেনাদের গুলির আঘাতে পেট্রোল ও ডিজেলের ব্যারেলগুলিতে আগুন লেগে বিরাট বিরাট অগ্নিকুন্ডের সৃষ্টি করে। সব মিলিয়ে সৃষ্টি হয় এক ভয়াবহ দৃশ্যের। এ সময় নায়েক সিদ্দীক অসীম সাহসিকতার পরিচয় দিয়ে বার বার এনাগা ফায়ার করে। এর্নাগা পাকগানবােটে প্রচন্ড আঘাত হানে এবং এক পর্যায়ে গানবােটটি কাত হয়ে দ্রুত পিছিয়ে যায়। নায়েক সিদ্দিক তখন আরও ফায়ার করতে থাকে। গােলাগুলির শব্দে মাইলখানেক দূরের গ্রামগুলােও জেগে উঠেছে। গানবােটের সার্চলাইটের আলাে, শত্রুর ট্রেসার বলের ফায়ারে দ্বিগ্বিদিক আলােকিত হচ্ছে, আবার কখনও বা আকাশের হাসি-কান্নায় পাশের সঙ্গীরা দেখে নিচ্ছে একে অপরকে। তারপর ধীরে ধীরে উভয় পক্ষ এক সময় গােলাগুলি বন্ধ করে। গানবােটের খানসেনারা মুক্তিবাহিনীর ডুবন্ত লঞ্চের নিকটে আসে এবং অনেক অস্ত্রশস্ত্র পায় কিন্তু মুক্তিবাহিনীর কাউকে পায় না। এদিক-ওদিক খোঁজও করে। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনীর কোন আভাস না পেয়ে তারা খুলনা চলে যায়। তাদের ১ জন নিহত এবং একজন ক্যাপ্টেনসহ ৭জন মারাত্মক জখম হয়। গানবােট চলে যায় খুলনায়। মুক্তিবাহিনী রাতে এভাবে যুদ্ধ করবে এটা ছিল তাদের কল্পনারও বাইরে। ভােরের আগেই মুক্তিবাহিনীর সবাই যে যেদিকে পারে চরম হতাশায় অনিশ্চয়তার দিকে পা বাড়ায়। কেউ চলে যায় হাজী ওয়াজেদ আলী জোদ্দারের বাড়ি। কেউ যায় সােহরাব হাজীর বাড়ি। কেউ যায় গাবুরা গ্রামের নওশের আলী গাইনের বাড়ি। কপােতাক্ষ পার হয়ে তৎকালীন পাইকগাছা থানার ঘুছিলাল গ্রামের জনাব আলী খানের বাড়ি।
এই এলাকা তখন ইয়াহিয়া খান, মুসলীম লীগ ও পাকিস্তানের দালালে ভর্তি। তাদের কাছে। পাকিস্তান নাকি পবিত্র আমানত, তাই এদেরকে ধরিয়ে দেয়ার চিন্তায় ছিল। অনেকেই। আবার স্বাধীনতার পক্ষে ছিলেন। সােহরাব হাজীর একটি ছেলে মেজর জলিল ও তার সঙ্গীদের বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করেন, টাকা পয়সা দেন, এমনকি পথ দেখিয়ে সীমান্ত। পর্যন্ত পৌঁছে দেন। আজিজ তরফদার ও এলাহী বক্স মােড়ল মইনুল ইসলাম ও একজন মেডিকেল ছাত্রকে ভালভাবে সেবা যত্ন ও খাওয়া দাওয়া করিয়ে পথ খরচ দিয়ে ভারতে। পাঠিয়ে দেন। | কিন্তু বারােজন ধরা পড়ে স্থানীয় শান্তি কমিটির হাতে। এলাকার শান্তি কমিটির সেক্রেটারী গাবুরা গ্রামের আবদুস সালাম ধৃত ব্যক্তিদের ভাগ্য নির্ধারণের জন্য ঐদিন বিকেল ৪টায় কায়রা মদিনাবাদ হাইস্কুলে এক জনসভা আহ্বান করে। সভা যথারীতি শুরু হয়, সভায় মহিউদ্দিন মােল্লা ও ভাদ্দর আলী হালদার ধৃত ব্যক্তিদের খানসেনাদের হাতে তুলে দেয়ার সুপারিশ করে। পক্ষান্তরে স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তির পক্ষে ঐ স্কুলের অন্যতম শিক্ষক মুসাদ্দেক হােসেন প্রমুখ ওদেরকে মুক্ত করে দেয়ার পরামর্শ দেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত স্বাধীনতা বিরােধী শক্তিরই জয় হয় এবং তাদেরকে পাকসেনাদের হাতে সমর্পণ করার সিদ্ধান্ত হয়। তখন ধৃত মুক্তিবাহিনীর লােকেরা তাদেরকে পাকবাহিনীর হাতে তুলে না দেয়ার জন্য বহু অনুনয় বিনয় করেন কিন্তু তাদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেননি। বরং যারা সহানুভূতিশীল হয়ে এদের মুক্তির সুপারিশ করেছিল তাদেরকে কয়রার কাশেম হালদারের বাড়িতে আটকিয়ে রাখে এবং খুলনায় খবর দিয়ে গানবােট আনিয়ে পাকবাহিনীর নিকট এই ক’জনকে ধরিয়ে দেয়। দেশের স্বাধীনতার প্রতি কি চরম বিশ্বাসঘাতকতা! এদের পাকিস্তান প্রীতির কি তুলনা হয়?
দুর্যোগ-দুর্বিপাক একা আসে না, বিচ্ছিন্ন আতঙ্কিত মুক্তিযােদ্ধারা একেকজন এক এক দিকে চলে গেল। ক্যাপ্টেন আসিফুর রহমানের বাবুর্চি কাম ব্যাটসম্যান আবদুর রশিদ ওয়াপদা বেড়ী বাঁধের নিচে একটা পঁচা ডােবায় গলা পর্যন্ত পানিতে ডুবে ক্ষণিকের জন্য সব কিছু অবলােকন করছিলেন। এমন সময় পাকসেনার গানবােট থেকে মাইকে ইংরেজী ও বাংলায় বলা হচ্ছিল, ‘মেজর জলিল, ক্যাপ্টেন আসিফ আপনাদের সমস্ত শক্তি শেষ, এখন আপনারা আর যুদ্ধ করতে পারবেন না বরং আপনারা আমাদের কাছে আত্মসমর্পণ করুন। আমরা আপনাদের সাথে বন্ধুর মতাে ব্যবহার করব এবং এক সাথেই পাকিস্তান গড়ে তুলবাে। ‘ইত্যাদি। ক্যাপ্টেন আসিফ ও রশিদ বিপদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করে ওয়াপদা ভেড়ী বাঁধ থেকে উল্টো দিকে অনুমান করে চলতে চলতে এক গ্রামে এসে উপস্থিত। আরাে কিছুদূর অগ্রসর হয়ে তারা একজন কৃষকের বাড়িতে এসে পড়ে। তখনও ভাের হয়নি, কৃষকের দরজায় ধাক্কা দিলে কৃষক তার ঘরের দরজা খুলে দেয় কারণ গােলাগুলির আওয়াজে তারা জেগেই ছিল। ক্যাপ্টেন আসিফ অতি দ্রুত ঘরে ঢুকে কৃষকের ঘুমন্ত ছেলেকে কোলে তুলে নিয়ে বললেন, মা আমরা মুক্তিযােদ্ধা, ভয়ানক বিপদে পড়েছি এবং তােমাদের সাহায্য চাই। যা হােক তখন কৃষক পরিবারও খানসেনাদের ভয়ে গ্রাম ছেড়ে গ্রামান্তরে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিল। ডাঃ আসিফ কৃষকের একটা হেঁড়া লুঙ্গি পড়ে তাদের বাচ্চা কোলে নিয়ে পদব্রজে রওয়ানা হয়ে আরেকটি গ্রামে উপস্থিত হন। তারপর পথিমধ্যে বহু বিপদ আপদ অতিক্রম করে নগ্নপদে সীমান্ত এলাকায় উপস্থিত হন এবং এক সময় নৌকাযােগে ইছামতি নদী পার হয়ে ভারতের হিঙ্গলগঞ্জে পৌছেন। পরবর্তীকালে আমরা অবশ্য কাশেম হালদার পরিবার পুড়িয়ে দিয়ে এ ঘটনার প্রতিশােধ গ্রহণ করি। ঘটনা যাই হােক না কেন, এই অভিযান মুক্তিবাহিনীর জন্য ছিল চরম আঘাত, অধিনায়কের সামান্য ভুলের জন্য এবং এই গুরুত্বপূর্ণ অভিযানের গােপনীয়তা রক্ষা না করাই এই দুর্ঘটনার মূল কারণ। অন্যদিকে যুদ্ধের প্রাথমিক অবস্থায় এই বিপর্যয় ও অস্ত্রের ক্ষতি ছিল অপূরণীয়। এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে মুক্তিযােদ্ধাদের বেশ সময় লাগে। ( সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত