ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন
দিনটা ছিল ২৮শে এপ্রিল, ভােমরা ক্যাম্প। পাকহানাদারবাহিনীর বিরুদ্ধে কতদিন যুদ্ধ করতে হবে তার ঠিক নেই। যুদ্ধের জন্য যেমন প্রয়ােজন অস্ত্র-গােলাবারুদ, তেমনি সৈন্যদের আহার যােগানােও একটা বড় প্রশ্ন। কিন্তু টাকা কোথায়? কিভাবে দৈনন্দিন প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি ক্রয় করা হবে? এমএনএ আব্দুল গফুর বিজ্ঞ রাজনীতিবিদ। বিপ্লব রাজনীতির উপর তার পড়াশােনা অনেক। তিনি প্রস্তাব দিলেন যে কোন ব্যাংক থেকে টাকা আনতে হবে। সকলে একমত। কিন্তু কাজটা তাে অতীব কঠিন ব্যাপার। সিদ্ধান্ত হল ইপিআর সুবেদার আয়ুব আলীর সাথে আলাপ করতে হবে। ইতিমধ্যে তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে যুদ্ধের জন্য সর্বপ্রকার প্রস্তুতি নিয়েছেন। আলাপের দায়িত্ব নিলেন এমএনএ জনাব আব্দুল গফুর, আলাপ হল ঐ দিন দুপুরেই। সুবেদার আয়ূব শুধু ঐক্যমত পােষণ করলেন না বরং শহরে গিয়ে খোঁজ নিয়ে জেনে এলেন যে, ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের শাখায় দুই কোটি টাকা এবং অনেক সােনা দানা আছে যা দিয়ে ছােটখাট একটা সরকার বা সেনাবাহিনী কয়েক মাস পরিচালনা করা সম্ভব। এমএনএ গফুর ও সুবেদার আয়ূব আলী ব্যাংকের প্রহরায় নিয়ােজিত রিজার্ভ ফোর্স ও পুলিশের সাথে আলাপ করলেন এবং তারাও দেশমাতৃকার কল্যাণে ব্যাংক অপারেশনে সহায়তা করার নিশ্চয়তা দিলেন। অবশেষে আলাপ আলােচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্ত হল ২৯শে এপ্রিল দিনগত রাতে ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের সাতক্ষীরা শাখার অপারেশন করে টাকা এনে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকারের নিকট জমা দেয়া হবে। ২৯শে এপ্রিল। বিকেল বেলা সাতক্ষীরার যুব ও ছাত্র নেতাদের মাধ্যমে শহরে কারফিউ দেয়া হল যাতে কোন লােক অহেতুক ভীড় না করে।
আরাে সিদ্ধান্ত হল যে, পুলিশের এসডিপি ওর সাথে আলাপ করলেন। খুলনা জেলার পুলিশ সুপার এআ খন্দকার বাঙালি জাতীয়তাবাদের ধারক ও বাহক ছিলেন। তিনি পূর্বেই আওয়ামী লীগ নেতৃত্বে। গঠিত সংগ্রাম পরিষদের সাথে যােগাযােগ রেখে তাদের কথা মতাে কাজ করার জন্য তাঁর অধীনস্ত পুলিশ বাহিনীকে গােপন নির্দেশ দেন। সুতরাং এসডিপিও (মহকুমা পুলিশ অফিসার) অস্ত্র দিয়ে দিতে রাজী হলেন। সাতক্ষীরা ট্রেজারী থেকে ৩৫০ টা ৩০৩ রাইফেল ও ৩০/৪০ বাক্স গুলি পাওয়া গেল। মুস্তাফিজ, কামরুল ইসলাম খান, মাসুদ, এনামুল, হাবলু প্রমুখ অস্ত্র ও গােলাবারুদ গ্রহণ করে। এই সময় পুলিশের ভূমিকা ছিল প্রশংসার যােগ্য। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে এসব অস্ত্র লাভ মুক্তিযুদ্ধের গতিপ্রকৃতিতে নতুন মাত্রা যােগ করে এবং ছাত্র-যুব-তরুণদের মনে প্রচন্ড আশার সঞ্চার করে। তারা আরাে আত্মপ্রত্যয় নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। | ছাত্র-যুবকদের এই সময় সশস্ত্র যুদ্ধ সম্পর্কে যেমন কোন ধারণা ছিল না তেমনি ওদের ছিল না অস্ত্রের কোন প্রশিক্ষণ। কিন্তু দেশকে হানাদার মুক্ত করার জন্য এসব তরুণ ছাত্র যুবক বুকের তাজা রক্ত অকাতরে ঢেলে দিতে সদা প্রস্তুত। সাহস আর প্রাণপ্রাচুর্য্যে এদের কোন তুলনা হয় না। কাজল নামক একটা ছেলে আসে, সে ছিল পিএন দশম শ্রেণীর ছাত্র। তার আব্বা আশরাফ উদ্দিন খান ভােমরায় এসে স্বীয় পুত্র, কাজলকে বাড়ি নিয়ে যেতে চান। কাজলের বাড়ি ছিল সাতক্ষীরার পলাশপােলে। কাজলে আব্বার আগমনের খবর পেয়ে অনেক ছাত্র যুবকই তাকে ঘিরে ধরে এবং সাতক্ষীরার মােস্তাফিজ কাজলের আব্বাকে বলে, “চাচা কাজল আপনার ছেলে একথা ঠিক, কিন্তু আমরা কি আপনার কেউ নই?’ তখন কাজলের আব্বা জবাব দেন যে, কাজলের মা ছেলের জন্য খুবই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। আর চারদিকে যে অবস্থা তাতে কাজলের মা খুবই কান্নাকাটি করছে। তখন অন্যান্য ছেলেরা বলে, চাচা আমাদের বাড়িতে আমাদের মা-বাবাও তাে কান্নাকাটি করছে। তখন কাজলের আব্বা সবাইকে দোয়া করে, কাজল শহীদ হয়। কাজল ছিল হৃষ্টপুষ্ট চমৎকার চেহারার সুন্দর প্রাণবন্ত একটা ছেলে।
সাতক্ষীরা মহকুমায় ঐ সময় এসডিও ছিলেন পাঞ্জাবী, নাম তার খালেদ মাহমুদ, একজন সিএসপি অফিসার। এই পাঞ্জাবী এসডিও নিশ্চিতভাবে ভবিষ্যতে পাকিস্তানীদের পক্ষে এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে কাজ করবে। তাই তাকে ধরে ফেলার সিদ্ধান্ত হয়। এমএনএগফুর সুবেদার আয়ুবসহ ছাত্রনেতৃবৃন্দ এসডিও খালেদ মাহমুদকে গ্রেফতার করে মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের বাড়িতে তার জিম্মায় রাখেন। সাতক্ষীরায় এই সময় দু’জন গফুর ছিলেন। একজন মুসলীম লীগের গফুর যিনি পরবর্তীতে সংগ্রাম পরিষদের কোষাধ্যক্ষ হন। কিন্তু পরে পাকিস্তানীদের সেবাদাস বনে যান এবং অন্যজন সংগ্রামী বীর এমএনএ গফুর, যিনি নবম সেক্টরে মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক। | ২৯শে মার্চ, এসডিও খালেদ মাহমুদকে ভােমরায় আনার জন্য গফুর ভাই সহ কয়েকজন ছাত্রনেতা গফুর সাহেবের বাড়িতে যান। কিন্তু তিনি এসডিও কে হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। সাথে সাথে ভােমরায় খবর পাঠানাে হয় সুবেদার আয়ূবকে। তিনি খবর পেয়েই এক গাড়ি ইপিআর সহ অতি দ্রুত মুসলীম লীগের গফুর সাহেবের বাড়িতে উপস্থিত হন। কিন্তু গফুর সাহেব এসডিওকে হস্তান্তর করতে একদম নারাজ।
বহু কথা কাটাকাটি হয়, কিন্তু কাজ হল না। অতএব তাকে বন্দি করে গাড়িতে তােলা হল। তার বন্দুক নিয়ে নেয়া হল। এমন সময় গফুর সাহেবের পুত্রবধু (সিরাজের স্ত্রী) গফুর সাহেবের প্রাণের বিনিময়ে তাদের বাড়ির এক বাথরুমের ভিতর থেকে এস. ডি. ওকে যদিও পুলিশ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে তবুও তাদেরকে বৃহত্তর নিরাপত্তার স্বার্থে নিরস্ত্র করা হবে এবং ব্যাংকের ম্যানেজারকে এনে ষ্ট্রংরুম খুলে টাকা ও সােনাদানা নিয়ে যাওয়া হবে। পরিকল্পনা মাফিক সবকিছু এগিয়ে চলল। ২৯শে এপ্রিলের সূর্যটা যখন ডুবু ডুবু তখন এমএনএ গফুর ও সুবেদার আয়ুবের নেতৃত্বে ৩০/৩৫ জন সশস্ত্র ইপিআর যুবনেতা সালাম, মুস্তাফিজ, হাবলু, এনামুল, খসরু, কামাল প্রমুখ প্রস্তুতি নিচ্ছে এক দুর্বার অভিযানের। একদিকে মনে অজানা আনন্দ যে দেশের জন্য তারা আজ ব্যাংক অপারেশনে যাচ্ছে, অন্যদিকে কত শঙ্কা, না জানি কি হয়, কি ঘটে। দুরু দুরু বুক, সাতক্ষীরার এসডিও-র জীপ, ওয়াপদার জীপ এবং পাবলিক হেলথের একটা পিকআপ ভ্যানসহ রাত ৮টায় এমএনএ গফুর ও সুবেদার আয়ূব এলেন ব্যাংকের দরজায়। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। পুলিশদেরক কৌশলে নিরস্ত্র করে তালা ভেঙ্গে ব্যাংকে ঢুকলেন এই অপারেশনের দুই নেতা এমএনএ গফুর ও সুবেদার আয়ূব আলী। কিন্তু ঢুকলে কি হবে, ঠুংরুমের তালার আকার দেখে সবার চক্ষু চড়ক গাছ। তালা ভাঙ্গা সম্ভব নয়। তাই তড়িৎ সিদ্ধান্ত হল ব্যাংকের ম্যানেজারকে চাবিসহ ধরে আনতে হবে। যেমন চিন্তা তেমনি কাজ।
জানা গেল ম্যানেজার থাকেন সবসময়। সুবেদার আয়ূব জীপ নিয়ে ছুটলেন। এমএনএ গফুর এবং অন্যান্যরা ভাবলেন শুধু বসে থাকা কেন, চেষ্টা করা যাক না, তালা ভাঙ্গার। মুহূর্তের মধ্যে একটা লােহার শাবল যােগাড় করে তালা ভাঙ্গা, বােল্ট ও হ্যান্ডেল খােলার চেষ্টা হল— কিন্তু কাজ তাে হল না বরং উল্টো ফল হল। সুবেদার আয়ূব খা চাবিসহ ম্যানেজারকে আনলেন। তখন দেখা গেল, তালা কোন মতে খােলে না এবং বােল্ট ও হ্যান্ডেল বেঁকে যাওয়ার কারণে স্ট্রংরুম ভাঙ্গা ছাড়া আর কোন গত্যন্তর নেই। সবাই তখন চরম উত্তেজনায়, কি হয়, কি হয়। খবর পাওয়া যাচ্ছে যশাের থেকে মিলিটারী আসে আসে ইত্যাদি। শাবল, কুড়াল যোগার করে অগত্যা স্ট্রংরুম ভাঙ্গার কাজ চলল, কাজও এগিয়ে গেল দ্রুত। কিন্তু শেষ পর্যায় এসেছিল মহা বিপত্তি। স্ট্রংরুমের সবদিকে মােটা লােহার রডের নেট। সকলেই সিদ্ধান্তে অটল এ ব্যাংক অপারেশন সফল করতেই হবে। নির্দেশ এল হ্যাক্স ব্লেড যােগাড় করে আনার। যে যেদিক পারে গেল এবং অবশেষে কয়েকটা হ্যাকস ব্লেড পাওয়া গেল এবং রড কেটে প্রথম স্ট্রংরুমের ভেতর ঢুকে পাওয়া গেল সেই কাক্ষিত টাকা। যে টাকা ছাড়া দুনিয়া অচল, যুদ্ধও অচল। টাকা বের করে প্রথমে পুরাে এক জীপ টাকা সুবেদার আয়ূব নিয়ে চলে গেলেন ভােমরায়, দ্বিতীয় একজীপ ভর্তি টাকা নিয়ে গেলেন এমএনএ গফুর এবং পরে ট্রাকে করে ভােমরা কাষ্টম অফিসে এলেন বাকী সবাই। রাত হল প্রায় ভাের। তবুও কারাে যেন ক্লান্তি নেই। ক্লান্তি নেই, কারণ যুদ্ধ চালানাের সবচেয়ে বড় প্রয়ােজনীয় রসদ টাকা পাওয়া গেছে। টাকা দেখে সবাই অবাক, এত টাকা একসাথে কেউ কখনও দেখেনি।
৩০শে এপ্রিল, সকাল বেলা। ঠিক হল, সমুদয় টাকা নিয়ে ভারতের বসিরহাটের এসডিও এর নিকট জমা দেয়া হবে। বেলা ১০টায় বসিরহাটের এসডিও এর নিকট নেয়া হল এমএনএ গফুর আর সুবেদার আয়ুবের নেতৃত্বে। এত টাকা দেখে এসডিও সহ সবাই অবাক। অতঃপর রিজার্ভ ব্যাংক অব ইন্ডিয়ার ৮০জন অফিসার টাকা গুণে ১,৭৫,০০,০০০/(এক কোটি পঁচাত্তর লক্ষ টাকা) বাংলাদেশ সরকারের নামে জমা করলেন। সত্য কথা বলতে কি, সাতক্ষীরার ন্যাশনাল ব্যাংক অপারেশন ছিল মুক্তিবাহিনীর এক
অভিনব দুঃসাহসিক অভিযান। এ অভিযানের সফলতা মুক্তিযােদ্ধাদের মনে এনে দিয়েছিল অসীম সাহসিকতা ও যুদ্ধ জয়ের তীব্র আকক্ষা। বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধের এ তাৎপৰ্যপূর্ণ ঘটনা ইতিহাসের পাতায় অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। আর এই টাকা পেয়ে প্রাথমিক পর্যায়ে নবগঠিত বাংলাদেশ হাতে যেন চাঁদ পেয়েছিল। পরে আরাে সাত লক্ষ টাকা পাওয়া যায়, সর্বমােট এক কোটি বিরাশি লক্ষ টাকা হয় এবং নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার এই টাকা দিয়েই তার নবযাত্রা শুরু করে।
( সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী ।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত