You dont have javascript enabled! Please enable it! শিরােমনির ঐতিহাসিক যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
শিরােমনির ঐতিহাসিক যুদ্ধ
১২ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে সাতক্ষীরার কলারােয়া এলাকা থেকে চুকনগর দিয়ে খুলনার পথে রওনা হয়। পথিমধ্যে বিনেরপােতা ব্রীজ খানসেনারা ধ্বংস করে দেয়ায় ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ এখানে একটি ভাসমান ব্রীজ তৈরি করে। এই ব্রীজের উপর দিয়ে ভারী মেশিন গান, ট্যাঙ্কবহর, সাঁজোয়া গাড়ি পার হয়ে মিত্রবাহিনীর একটি শক্তিশালী শিখ রেজিমেন্ট পাটকেলঘাটা, চুকনগর, কেশবপুর, মনিরামপুর, রাজারহাট, নােয়াপাড়া হয়ে ফুলতলা থানার ১৪ মাইল এলাকায় এসে শক্তিশালী প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। উল্লেখ থাকা আবশ্যক যে, মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী পাকবাহিনীর সবচেয়ে শক্তিশালী ঘাঁটি যশাের ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। কারণ এই ক্যান্টনমেন্টই বৃটিশ-ভারতের অন্যতম মজবুত ও নিরাপদ ঘাঁটি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন সময়ে এই ক্যান্টনমেন্ট বিশেষ ব্যবস্থায় গড়ে তােলা হয়; এখানে এমন জায়গা আছে যেখানে শত বিমান হামলায় কোনই বিপদের আশঙ্কা নেই। পাকিস্তান আমলেও এ ক্যান্টনমেন্টে ব্যাপক সংস্কার ও সম্প্রসারণের কাজ হয়। মুক্তিবাহিনীর দুশ্চিন্তার কারণ ছিল এই যে, সকল যুদ্ধ পারদর্শী জেনারেলরা যখন ভাবছিলেন যশােরঘাঁটি দখলে হয়ত মিত্রবাহিনীর ১/২ মাস সময় লাগবে তখন একদিন অষ্টম সেক্টর কমান্ডার মেজর এম মঞ্জুর ওয়ারলেসে মিত্রবাহিনীকে জানালেন যে, পাকবাহিনী যশাের ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে যশাের রােড ধরে অতিদ্রুত খুলনা শহরের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। কিন্তু মিত্রবাহিনী মেজর মঞ্জুরের দেয়া এ তথ্য বিশ্বাসই করলেন না, বরং এটাকে গাঁজাখুরী সংবাদ বলে উড়িয়ে দেয়। মেজর মঞ্জুর আবার তােক পাঠিয়ে খবর নিয়ে পুনঃ মিত্র বাহিনীকে একই খবর দিলে ভারতীয় বাহিনী নিজস্ব গােয়েন্দা মারফত খবরের সত্যতা যাচাই করে তারা নিশ্চিত হন যে, সত্যিই পাকবাহিনী অজ্ঞাত কারণে যশাের ক্যান্টনমেন্ট তাড়াহুড়াে করে পরিত্যাগ করে খুলনাভিমুখে যাচ্ছে। অতঃপর মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী তাদের পূর্ব পরিকল্পনা পরিবর্তন করে খুলনা শহরের পথে অগ্রসর হওয়ার নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করেন।
মিত্রবাহিনীকে পথ দেখিয়ে ফুলতলা এলাকায় আনার জন্য মেজর মঞ্জুর প্রয়ােজনীয় সংখ্যক গাইড তাদের সাথে দেন। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যখন ফুলতলায় ১৪ মাইল এলাকায় অবস্থান গ্রহণ করে তখন পাকবাহিনী শিরােমনি শিল্প এলাকার ইস্টার্ণ জুট মিল, আফিল জুট মিল, আলীম জুট মিল, টেলিফোন ফ্যাক্টরী ভবনসহ ২/৩ কিলােমিটার ব্যাপী এলাকায় এক বিরাট প্রতিরক্ষা ব্যুহ রচনা করে। এই এলাকায় পাকসেনারা প্রতিদিন ১৫/২০ গজ অন্তর মরিচা, বাঙ্কার তৈরি করে এবং জনসাধারণের পাকা বাসা বাড়ি সব দখল কের নেয়। যশাের ক্যান্টনমেন্ট ত্যাগ করে প্রকৃত পক্ষে তারা শিরােমনি এলাকাকে মজবুত ক্যান্টনমেন্টে রূপান্তরিত করে। চূড়ান্ত যুদ্ধের জন্য পাকবাহিনী, ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীকে এখানেই মােকাবিলা করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং রাতারাতি এলাকার লােকজনদের সরিয়ে দিয়ে শিরােমনিকে পাকবাহিনীর দুর্ভেদ্য দুর্গে পরিণত করে। মরিচা, বাঙ্কার ইত্যাদি নির্মাণে পাকবাহিনী জোর পূর্বক বিনা মুজুরীতে এলাকার লােকজনদের দিন-রাত কাজ করতে বাধ্য করে। পক্ষান্তরে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে পাকবাহিনীকে সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত করে খুলনা শহর দখলের ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। খানসেনাদের প্রধান সদর দপ্তর স্থাপিত হয় শিরােমনির ক্যাবল ফ্যাক্টরীতে।
১৩ই ডিসেম্বর। মেজর মঞ্জুর রাজপূত ডিভিশনের বিরাট এক বহর নিয়ে পূর্ব উল্লেখিত রুটে রেজোওয়ান, আলকাছ, কুদ্স এবং গণিকে গাইড হিসেবে নিয়ে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী ফুলতলার ১৪ মাইল এলাকায় অবস্থানরত শিখ বাহিনীর সাথে মিলিত হয়। মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর একটা অংশ ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও ট্যাঙ্কসহ ভৈরব নদী পার হয়ে অপর পারে অবস্থান নেয়, ভারতীয় বাহিনীর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগ ভৈরব নদীর উপর একটা ভাসমান ব্রীজ তৈরি করেন এবং বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা এসে ব্যারাকপুর, লাকোহাটি, সিদ্দিপাশা, ধূলগ্রামে অবস্থান নেয়। উদ্দেশ্য হল পাকবাহিনী যেন পালিয়ে ভৈরব নদী পার হয়ে কোথাও না যেতে পারে। অনুরূপভাবে রংপুর, শলুয়া, গাইকুড়, আড়ংঘাটা, অর্থাৎ খুলনা-দৌলতপুরের পশ্চিম দিকেও মুক্তিবাহিনী ব্যাপক সমাবেশ ঘটায়। ১২ই ডিসেম্বর রাত থেকে শুরু হয় পাকবাহিনী ও ভারতীয়বাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীর শেষ লড়াই। গােলাগুলিতে এলাকা কম্পিত-প্রকম্পিত হতে থাকে। মেজর মঞ্জুর আলকাছ ও রেজোয়ানের নিকট। ইষ্টার্ণ জুট মিল, আফিল, আলিম জুট মিল এবং ক্যাবল ফ্যাক্টরীর ম্যাপে অবস্থান দেখিয়ে দিতে বলে। তারপর এসব পয়েন্টে শুরু হয় ভারী মেশিনগানের গােলাবর্ষণ। মিত্রবাহিনী কোলকাতার দমদম বিমান বন্দরের সাথে যােগাযােগ করে বিমান আক্রমণের পরামর্শ দেয়। তারপর শুরু হয় সর্বাত্মক বিমান আক্রমণ। পাকবিমানবাহিনী পূর্বেই ধ্বংস হওয়ায় ভারতীয় বিমান আক্রমণ মােকাবিলায় কিছুই করার ছিল না। তাই পাকিস্তান স্থলবাহিনী প্রচন্ড মার খায়। পাকবাহিনীর পক্ষ থেকে তুমুল গােলাগুলি শুরু হয়।
দিবারাত্র অবিরাম এ যুদ্ধ চলতে থাকে। মিত্রবাহিনী বিমান আক্রমণের সাথে সাথে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পনের জন্য জেনারেল মানেক শা’র ইংরেজী ও উর্দুতে ছাপা প্রচারপত্র ফেলে যায়। মিত্রবাহিনীর বােমা আক্রমণে শিরােমনি অঞ্চল ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় এবং পাকসেনারা সীমাহীন জানজীবনের ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। খানসেনাদের বহু ট্যাঙ্ক, জীপ ও গােলাবারুদের স্তুপ পুরােপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। এবং পাকসেনারা অত্যন্ত কাবু হয়ে পড়ে। ১৩ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর ৩০/৩৫টি গাড়ির একবিরাট বাহিনী মেজর গেনি ও মেজর মহেন্দ্র সিংহ এর নেতৃত্বে যশাের রােড হয়ে শিরােমনি ঢুকে পড়ে। তাদের ধারণা ছিল পাকবাহিনী পশ্চাদপসারণ করে খুলনা শহরে চলে গেছে, কিন্তু তাদের তথ্য ছিল সম্পূর্ণ ভুল। যখন এই কনভয় ইস্টার্ণ, আলীম, আফিল জুটমিল অতিক্রম করে বাদামতলা অর্থাৎ চক্ষু হাসপাতালের নিকট পৌছয় তখন পাকসেনাদের ভারী কামানগুলাে একযােগে গর্জে ওঠে। মিত্রবাহিনীর এ কনভয় সামনে-পিছনে কোথাও যেতে পারেনি খানসেনাদের প্রচন্ড আক্রমণে তারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। এমন কি সামান্য প্রতিরােধ বা নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার কোন সুযােগও তারা পায়নি। এই এ্যামবুশে প্রায় ২৫০/৩০০ ভারতীয় সৈন্য নির্বুদ্ধিতার জন্য জীবন দিতে বাধ্য হয়। তাদের বিরাট কনভয় পাকসেনাদের হামলায় চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়। ভারতীয় বাহিনীর জন্য এ ছিল এক প্রচন্ড অভাবনীয় আঘাত।
ইস্টার্ণ জুট মিলে ঘটে আর এক অদ্ভুত ঘটনা। এখানে প্রচন্ড যুদ্ধের পর পাকবাহিনী। ও মিত্রবাহিনীর বেয়নেট যুদ্ধ ও হাতাহাতি যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এখানে পাকসেনারা ভারতীয় বাহিনীর নিকট বন্দীত্ব বরণ করে। এ যুদ্ধ ছিল এক স্মরণীয় ঘটনা। শিরােমনির মীর আব্দুল গফফারের বাড়ির নিকট চারটি পাকবাহিনীর ট্যাঙ্ক প্রচন্ড গােলাবর্ষণ করে কিন্তু ভারতীয় বিমানবাহিনীর আক্রমণে চারটি ট্যাঙ্কই ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। শিরােমনি রেলস্টেশনের নিকট দিয়ে পাকবাহিনীর গােলাবারুদ নিয়ে এক বিরাট ট্রাক বহর আসছিল, কিন্তু ভারতীয় বিমানবাহিনীর প্রচন্ড হামলায় ট্রাক ও গােলাবারুদ পুরােপুরি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। এখানে ছিল দিশারী ক্লাব।’ এ ক্লাবও বােমার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। শিরােমনি রেল স্টেশনের কাছাকাছি পােস্ট অফিসের একটা দালানে পাকবাহিনীর প্রচুর গােলাবারুদ ও অস্ত্রশস্ত্র ছিল, মিত্রবাহিনীর বিমান আক্রমণে সেসবই নষ্ট হয়ে যায়। আটরা গিলেতলা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও শান্তি কমিটির সভাপতি মিয়া নুরুল হুদার পাকা বাড়িটি পাকবাহিনীর প্রধান যােগাযােগের দপ্তর হিসেবে ব্যবহৃত হত। এখানে শক্তিশালী ওয়ারলেস, টেলিফোন ইত্যাদির সুব্যবস্থা ছিল, ঘরের ভেতর ইট ও নারিকেল গাছের গুড়ি দিয়ে মজবুত প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা তৈরি করা হয়। কিন্তু বিমান আক্রমণে সবই তছনছ হয়ে যায়।
দৌলতপুর থানা এবং লঞ্চঘাটের অপর পাড়ে মুনসুর সাহেবের জুটপ্রেস ছিল রাজাকারদের ঘাঁটি। রাজাকাররা এই ঘাঁটি থেকে ভারতীয় বিমানবহরের উপর গুলি চালায়, এর কিছুক্ষণ পরই জঙ্গী বিমান এলে মুসলীম লীগ নেতার জুটপ্রেস ও গােডাউন চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়, বােমার আঘাতে যেসব গর্ত সৃষ্টি হয় তা আজও বিদ্যমান। | শিরােমনি বাজারে খবির উদ্দীনের পাইওনিয়ার রাইস ও ফ্লাওয়ার মিল নামে একটি মিল ছিল, গুলি ও বােমার আঘাতে মিলটি বিক্ষত ও নষ্ট হয়ে যায়। ডাক্তার সাহেবের বড় ভাইয়ের মেয়ে রেখা বােমার স্পিল্টারের আঘাতে আহত হয়ে বেঁচে যায়। যুগীপােল, মীরেরডাঙ্গা, গিলাতলা, ডাকাতিয়া, মশিয়ালী, আটরা, গাবতলা অর্থাৎ শিরােমনি বিসিক এলাকা জুড়ে এই ভয়াবহ যুদ্ধ সংঘটিত হয়। শত শত ট্রাক, জীপ, গাড়ি, অস্ত্র ও গােলাবারুদ ভর্তি কনভয় ধ্বংস হয়ে বিকট চেহারা নিয়ে স্থানে স্থানে পড়ে থাকে; গাছ, গাছের পাতা, এলাকার সমস্ত বাড়িঘর, পাঁচিল, ইলেক্ট্রিক পােষ্ট এযুদ্ধে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। এলাকার গরু, ছাগল, মহিষ, হাসমুরগী পর্যন্ত প্রাণ হরায়। পাকসেনারা পরিত্যাক্ত বাড়ির লেপকাঁথা ইত্যাদি নিয়ে ব্যাঙ্কারে থাকে। মানুষও মারা যায় এবং এলাকায় বারুদ ও মৃতের দুর্গন্ধে এক শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশ সৃষ্টি হয়। এখানে যারা মারা পড়ে তাদের মধ্যে ওসমান গণি, সেকেন্দার আলী, আতিয়ার, মজিদ, জলিল, মতলেব প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এদের বাড়ি শিরােমনির উত্তর পাড়ায়।
১৫ই ডিসেম্বরের পর থেকে যুদ্ধের প্রচন্ডতা কমে আসে। পাকবাহিনীর গােলাবারুদ একদম কম হওয়ায় তারা একপ্রকার বাধ্য হয়ে যুদ্ধবিরতি করে। তাদের কোন খাবারের ব্যবস্থা ছিল না। অনাহারে তারা আরাে কাহিল হয়ে পড়ে। পাকসেনারা হতাশায় দারুণভাবে আক্রান্ত হয়ে মানসিক দিক থেকে বিধ্বস্ত হয়ে অনুশােচনা করতে থাকে।  ১৬ই ডিসেম্বর সারা বাংলাদেশ পাকসেনারা ভারতীয় বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেক শা’র আত্মসমর্পণের আহ্বানে আত্মসমর্পণ করলেও খুলনায় পাকবাহিনী আত্মসমর্পন করেনি। ফলে ১৬ই ডিসেম্বর দিবাগত রাতে মিত্র বাহিনী পুনরায় গােলাগুলি শুরু করলে পাকসেনারা আত্মসমর্পণে রাজী হয়। ১৭ই ডিসেম্বর সকালে খানসেনারা অস্ত্রপরিত্যাগ করে আত্মসমর্পনের জন্য প্রস্তুত হয়; আলকাছ, রােজায়ানসহ আরাে কয়েকজন নিরস্ত্র মুক্তিযােদ্ধা শিরােমনি বিসিক রােডে ওদের সাথে কথাবার্তা বলার জন্য যায়। পাকসেনারা বলে, তুম হামারা ভাই হাে, হামারা স্টার ব্যাজ খােল লে লাে’। অর্থাৎ তুমি আমাদের ভাই, আমাদের স্টার ও ব্যাজ খুলে নাও। একজন পাঠান অফিসার অন্য খানসেনাদের বলতে থাকে, বাইনচোৎ, তােম লােগুকো বােলা মুসলমান আওরাত পর জুলুম মাত করাে, তুম নেহী ছুনা, আভি খােদা নারাজ হােগিয়া, তবপাে জং হাম মে হারগিয়া’।
অর্থাৎ আমি তাে বলেছিলাম যে, মুসলমানের মেয়েদের উপর অত্যাচার করাে , তােমরা আমার কথা শােননি, খােদা অখুশী হয়েছে সুতরাং আমাদের পরাজয় হয়েছে।  এসব কথাবার্তা চলাকালীন সময় অষ্টম সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর গিয়ে তাদের স্টার ও ব্যাজ খুলে দিতে বলেন। তখন পাকসেনারা কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে এবং ব্যাজ ও স্টার খুলে দেয়। ইতিমধ্যে লােকজন এলাকায় ঢুকে পড়ে। পুকুরের গর্তে, বাড়িতে সর্বত্রই অস্ত্র আর গােলাবারুদ ভরা। গাড়ি আর গাড়ি, চারদিকে মাইন পােতা, মানুষ-পশুর মৃতের দুর্গন্ধে বমি আসে এমনি অবস্থা, আলকাছ দু’জন মেজরকে ধরে আনে এবং তাদের জয় বাংলা’ শ্লোগান দিতে বললে একজন শ্লোগান দেয় এবং অপরজন অস্বীকার করলে মতে পালিয়ে গিয়ে আটগ্রামে অবস্তানরত পাকসেনাদের খবর দিতে সক্ষম হয়। ক্যাপ্টেন রবের নির্দেশে রাস্তার দু’পাশে দ্রুত ব্যাংকার খুঁড়ে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তােলা হয়।
মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযানের খবর পেয়ে পাকসেনাদের একটি দল সামনে অগ্রসর হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর সংখ্যা কত হতে পারে তা পাকসেনাদের জানা ছিল না। তারা মুক্তিবাহিনীকে গালাগালি করতে করতে খােলা মাঠের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল। ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। পাকসেনারা রাইফেল রেঞ্জের মধ্যে আসামাত্র ক্যাপ্টেন রব গুলিবর্ষণের আদেশ দিলেন। এই অপ্রত্যাশিত আক্রমণের ফলে পাকসেনারা দিশেহারা হয়ে পড়ে। আনুমানিক চল্লিশজন পাকসেনা নিহত ও ১১ জন রাজাকার জীবিত আত্মসমর্পণ করে। মুক্তিবাহিনীর ২ জন শহীদ ও ৫ জন আহত হন। বিগ্রেডিয়ার রব এই সংঘর্ষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন। They were shouting and saying ‘MUBJIB KA BACHAYHATIAR CHORDAO AGOR NA TO KUEZINDA WAPTES ANTHI AZOGAYE. They were advancing from both sides of the road. They were about a platoon strenght, when they came within hundred yards. I ordered to fire four light machine Guns, two from each side of the road, They got a shock of their jives. Within two minutes 18 of them fell on the ground and the rest of them took shelter of a Nallah and fled away.
প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য যে, আটগ্রামে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক কোম্পানি নিয়মিত সৈন্য, একটি রাজাকার কোম্পানি ও এক কোম্পানি খাইবার স্কাউটস অবস্থান করছিল। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকে আটগ্রাম, জাকীগঞ্জের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। পাকসেনা কর্তৃক রাতের অন্ধকারে আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জ থেকে ভারত সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতীয় রেল লাইনের ওপরে মাইন পুঁতে রাখায় যাত্রীরা হতাহত হন। সেক্টর কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল (বর্তমানে অরবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) চিত্তরঞ্জন দত্ত আটগ্রাম দখলের পকিল্পনা করলেন এবং দুই কোম্পানিসহ ক্যাপ্টেন এনামকে আটগ্রামের উদ্দেশ্যে অভিযানের নির্দেশ দিলেন। কিন্তু বিশেষ জরুরি প্রয়ােজনে ক্যাপ্টেন এনামকে কামালপুর যুদ্ধে পাঠান হলে লেঃ জহির ও লেঃ গিয়াস তাঁদের বাহিনী নিয়ে আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জে অবস্তানরত পাকসেনাদের আক্রমণ করে। প্রথম ইস্টবেঙ্গলের এক কোম্পানি সৈন্য যােগ দিলে সংঘর্ষ তুমুল আকার ধারণ করে। মুক্তিবাহিনী আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জ দখলের জন্য মরণপন লড়াইয়ে লিপ্ত থাকে। প্রায় দশ দিন ধরে এই সংঘর্ষ অব্যাহত থাকার পরে ২০/২১শে নভেম্বরের রাতে আটগ্রাম ও জাকীগঞ্জ মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ দখলে আসে। 
২১শে নভেম্বর রাতেই ক্যাপ্টেন রব এক কোম্পানি নিয়ে সালামটিলা এবং লেঃ জহির দুই কোম্পানি নিয়ে রাজটিলা আক্রমণ করেন। ২২শে নভেম্বরের মধ্যেই সালামটিলা ও রাজাটিলা শত্রুমুক্ত হয়। পাকসেনাদের প্রচুর গােলা বারুদ মুক্তিবাহিনীর হস্তগত হয়। সুরমা নদীর তীর কানাইঘাট থানা সদর দপ্তর অবস্থিত। রণকৌশলগত কারণে এবং মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান অব্যাহত রাখার স্বার্থে কানাইঘাট দখলের নির্দেশ দিলেন। ক্যাপ্টেন রবকে কানাইরঘাট দরবশত সড়কে প্রতিরােধ গড়ে তােলার জন্য বলা হল। ক্যাপ্টেন রব ২৫/২৬ শে নভেম্বর তার বাহিনীসহ লুকাছড়া চা বাগান এলাকায় অবস্থান নিলেন। উল্লেখযােগ্য যে, কানাইঘাটে পাকসেনাদের শক্তঘাঁটি ছিল। কানাইঘাট দখল করা জেড ফোর্সের দায়িত্ব থাকলেও চার নম্বর সেক্টরের ওপরের শেষ পর্যন্ত এই দায়িত্ব এসে পড়ে। ক্যাপ্টেন রব তার বাহিনী নিয়ে কানাইঘাট-দরবশত সড়কে অবস্থান নেয়ার ফলে পাকসেনাদের গতিবিধি সীমাবদ্ধ হল। পাকসেনারা ১০৫ মিলিমিটার গােলন্দাজ কামানের গােলা নিক্ষেপ করে অগ্রসর হওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়।
ডিসেম্বর ২/৩ তারিখে রাত ১-৩০ মিনিটে পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অবস্থানের উপর কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী ৩ ইঞ্চি মর্টারের গােলা নিক্ষেপ করে পাল্টা জবাব দেয়। ৩রা ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর শত্রুর অবস্থানের ৩০০ গজের মধ্যে আসে। ভাের সাড়ে পাঁচটায় মুক্তিবাহিনীর ওপরে পাকসেনারা ব্যাপক হামলা চালায়। মুক্তিবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে পাকসেনাদের মােকাবিলা করে। পাকসেনাদের তিন দিক থেকে ঘিরে ফেলে ক্যাপ্টেন রবের নেতৃত্বে মুক্তিবাহিনী সকাল ৭-১৫ মিনিটে পাকঅবস্থান চার্জ করলে অধিকাংশ পাকসেনারা নিহত হয়। অনেক পাকসেনা নদীতে ঝাপিয়ে পড়ে প্রাণে বাঁচতে পারেনি। সকাল ৮-৩০ মিনিটের মধ্যেই মুক্তিবাহিনী কানাইঘাট দখল করে নেয়। এই সংঘর্ষে ১১ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন ও ২০জন আহত হন।  লেঃ জহিরের নেতৃত্বে এক কোম্পানি মুক্তিযােদ্ধাকে প্রথম ইস্টবেঙ্গলের সাহায্যে পাঠানাে হল। পাকসেনারা দরবশতে সমবেত হতে লাগল। ৭ই ডিসেম্বর পাকসেনা মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে দরবশত পরিত্যাগ করে হরিপুরে অবস্থান নিল। ১১ই ডিসেম্বর পাকসেনারা নদী অতিক্রম করে অপর তীরে পৌছে মুক্তিবাহিনীর ওপরে আক্রমণ চালায়। মুক্তিবাহিনী এই আকস্মিক আক্রমণে বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ১২ই ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে হরিপুর আক্রমণ করে দখল করে নেয়। সিলেট দখলের জন্য নিম্নলিখিত পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় । 
লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৪ নং সেক্টর ট্রপস-এর একটি কোম্পানি নিয়ে সালুটিকার বিমান বন্দরের দিকে অগ্রসর হলেন। ভারতীয় সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন হেলিকপ্টার যােগে সিলেট শহরের দক্ষিণ দিকে নামবে এবং লেঃ কর্নেল জিয়া এবং ভারতীয়বাহিনী যৌথভাবে সিলেট আক্রমণ করবে। ৪ নং সেক্টর বাহিনী দরবশত এবং খাদিমনগর হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ৫নং সেক্টর ট্রপস সম্মিলিতভাবে গােয়াঘাটা, ছাতক হয়ে সিলেটের পিছন দিক থেকে আক্রমণ করবে। একটি কোম্পানি নিয়ে ক্যাপ্টেন এনাম ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় মৌলভীবাজার হয়ে সিলেটের দিকে অগ্রসর হবে। লেঃ ওয়াকিউজ্জামান এবং ফ্লাইট লেফেটেন্যান্ট কাদের সেক্টর ট্রপস নিয়ে ভারতীয় বাহিনীর সহায়তায় ফেঞ্চুগঞ্জ হয়ে সিলেট আক্রমণ করবে। হরিপুর সংঘর্ষের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে মেজর জেনারেল চিত্তরঞ্জন দত্ত বলেন ঃ “আমাকে বলা হল হিমুর (পাকিস্তানীদের ঘাঁটি) পেছন দিকে থেকে পাকসেনাদের আক্রমণ করতে এবং যেখানেই থােক হিমু শত্রুমুক্ত করে হরিপুরের উপর আক্রমণ চালাতে। খাওয়া-দাওয়া সেরে গ্রাম থেকে দু’জন গাইড নিয়ে চললাম হিমুর উদ্দেশ্যে। সারা রাত নদী, খাল-বিল পার হয়ে পৌছলাম আটগ্রাম নামক এক গ্রামে। এখানে থেকে হিমুর দূরত্ব প্রায় দু’মাইল। আটগ্রামে পৌছলাম ভাের ৪টায়। সঙ্গে সঙ্গে মৌলভীবাজার সাহেবের আযান শােনা গেল। মনটা যেন কেমন করে উঠল। মেজর রব এবং ডাঃ নজরুলকে বললাম এই আযানের কি অর্থ হতে পারে ? তর্ক করার সময় তখন ছিল না।
গ্রামের পাশেই নদী। এই নদী পার হতে হবে। অনেক কষ্টে দুটো নৌকা যােগাড় করা গেল। ওপারে সবাই পৌছলাম। প্রায় ৭০০/৮০০ গজ দূরে খােলা মাঠ এবং মাঠের মধ্যে অনেকগুলাে উঁচু টিলা পুরাে আটগ্রামকে ঘিরে রেখেছে। সকাল হতে চলেছে। দেখলাম হিমু পর্যন্ত খােলা মাঠ। তাই আটগ্রামেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। সবাই মিলে আবার নদী পার হয়ে আটগ্রামে ফিরে আসলাম। আমার সৈন্যরা কোথায় থাকবে, কি খাবে ইত্যাদি চিন্তা ভাবনারও সময় পাওয়া গেল না। সকাল প্রায় ৬টায় পাকিস্তানীরা আমাদের উপর হঠাৎ করেই 3 মর্টারের গােলা বর্ষণ শুরু করে। সঙ্গে সঙ্গে আমাদের উপর আরম্ভ হল মেশিনগান ও এলএমজির গুলিবর্ষণ। সৈন্যরা যে পজিশন নেবে তারও সময় নেই । হঠাৎ করে আক্রমণ হওয়ায় আমার সৈন্যরা একেবারে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। মৌলভীকে খোঁজে পাঠালাম, কিন্তু পাওয়া গেল না। চারধার থেকে খবর আসছে শুধু মৃতের এবং আহতের। তাদের সংখ্যা ক্রমাগতই বেড়ে চলেছে। আটগ্রাম ছােট গ্রাম। বৃষ্টির মতাে গােলাগুলি হচ্ছিল। আমাদের এখন কিছুই করবার নেই। চিন্তা করলাম যদি আটগ্রামেই থাকি তাহলে সবাই মারা পড়ব। কারণ পাকিস্তানীরা আমাদের অবস্থান জেনে ফেলেছে। তাই সবাইকে যে যেভাবে পারে পেছনে দু’তিন মাইল দূরে আর এক গ্রামে চলে যেতে বললাম। যখন আমরা আটগ্রাম ছেড়ে পেছনে গ্রামের দিকে যাচ্ছিলাম তখন দেখলাম আমার ১১জন ছেলে শহীদ হয়েছে এবং ৫ জন গুরুতররূপে আহত।
পাকসেনাদের শেষ অগ্রবর্তী ঘাঁটি ছিল খাদিমনগরে। ১৫ই ডিসেম্বরে ডান দিকে মিত্রবাহিনী এবং বাম দিক থেকে মুক্তিবাহিনী অগ্রসর হল। খাদিমনগর সন্নিকটস্থ ঈদগা থেকে পাকসেনাদের অবিরাম গুলিবর্ষণ অব্যাহত ছিল। হাবিলদার গােলাম রসুল বিকেল পাঁচটায় একাই ক্রলিং করে সামনে অগ্রসর হয় এবং পাকঅবস্থানের উপর গ্রেনেড চার্জ করল। পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে গেল, কিন্তু গােলাম রসুল জীবন নিয়ে ফিরে আসতে পারল না। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ লগ্নে গােলাম রসুল জীবন বিসর্জন দিল স্বাধীনতার জন্য আর অবশিষ্ট মুক্তিযোেদ্ধা বীর বিক্রমে খাদিমনগর দখল করে নিল। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সৈন্যরা ১৬ই ডিসেম্বর আত্মসমর্পণ করল এবং সেই সাথে সিলেট শহর বিজয় মিছিলের শহরে পরিণত হল।

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত