You dont have javascript enabled! Please enable it! কপিলমুনির যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
কপিলমুনির যুদ্ধ
কপিলমুনি খুলনা শহর থেকে ৬০ কিলােমিটার দূরে, পাইকগাছা থানা হতে ১২ কিলােমিটার উত্তরে কপােতাক্ষ নদের পূর্ব পাড়ে দক্ষিণ খুলনার অন্যতম বৃহত্তম বাজার। এই বাজারের দোকানপাটের সংখ্যা অনেক বেশি। এখানেই অবস্থিত বাজারের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও রূপকার রায় সাহেব বিনােদ বিহারী সাধুর দোতালা বিরাট ভবন। বাড়ি তাে নয় যেন মােগল আমলেন দুর্গ বাড়ির চারদিকে উঁচু মােটা পাঁচিল। রাজাকাররা জোরপূর্বক এই বাড়িটা তাদের সুরক্ষিত দুর্গ হিসেবে গড়ে তােলে। প্রায় ২০০ জন রাজাকার ও মিলিশিয়া এখানে সশস্ত্র অবস্থায় থাকে। তাদের অত্যাচারে লােকজনের জানপ্রাণ ওষ্ঠাগত। অন্যের গরু-ছাগল, হাস-মুরগী জোরপূর্বক আনা তাদের নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার ছিল। হিন্দুদের উপর অমানবিক অত্যাচার, তাদের ধন-সম্পদ লুটসহ নানা অপকর্মে লিপ্ত ছিল। রাজাকাররা জোরপূর্বক ১। মনি সিং ২। জ্ঞান সিং ৩। নরেন সিং ৪। কানু পােদ্দার ৫। তারাপদ ডাক্তার ৬। জিতেন্দ্র নাথ সিং ৭। শান্তি রাম সাধু প্রমুখদের হিন্দু ধর্ম থেকে ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত করে। এদের মধ্যে মনি সিংকে সপরিবারে মুসলমান হতে বাধ্য করা হয়। এদেরকে নিয়মিত নামাজ পড়তে ও মসজিদে যেতে হত। এককথায় সকল প্রকার অত্যাচার আর অনাচারের ঘাঁটি হিসেবে কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প পরিচিতি লাভ করে।
মাঝে মধ্যে এখানে মিলিটারী ও মিলিশিয়া এসে থাকত। রাজাকাররা রায় সাহেবের শ্বেত পাথরের মূর্তিটা ভেঙ্গে পুকুরে ফেলে দেয়। এই রাজাকার দুর্গ আক্রমণ ও ধ্বংস করা খুবই শক্ত ছিল। লেঃ আরেফিনের নেতৃত্বে। ১১ই জুলাই লতিফ, সরদার ফারুক আহমেদ, মনােরঞ্জন , রহমত আলী, মাহতাপ, দীদার, আবদুর রহিম, আনােয়ারুজ্জামান বাবলু, জাহান আলী ও আরাে অনেক মিলে কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটিতে প্রথম আক্রমণ চালায়। তারা তালা থানার জালালপুর থেকে রাত ১২ টায় রওনা হয়ে রাত ৩টার দিকে কপিলমুনি এসে পৌছয় এবং বাজারের দক্ষিণ প্রান্তের পায়খানার দিক থেকে ক্যাম্পের দিকে গুলিবর্ষণ করে। ভাের হয়ে যাওয়ায় তারা কপােতাক্ষ পার হয়ে পুনরায় জালালপুর চলে যায়। কিন্তু পরে রাজাকাররা লঞ্চযােগ সেখানে পৌছয় এবং মুক্তিবাহিনীকে আক্রমণ করে। ফলে তারা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় এবং অস্ত্রপাতি হাতছাড়া হয়ে সেসব অস্ত্র নক্সালদের হাতে পড়ে। এভাবে কপিলমুনির প্রথম আক্রমণ ব্যর্থ হয়। আর একবার তালা থানার নক্সালদের সমবেত চেষ্টায় এই রাজাকার ঘাঁটির উপর আক্রমণও ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয় এবং রাজাকারদের মনােবলও বেড়ে যায়। এবং তাদের ভয়ে স্থানীয় জনগণ মুক্তিবাহিনীকে সহযােগিতা করতে ভয় পেত। তাই শত্রু মনে করে যে কোন লােককে রাজাকাররা প্রকাশ্যে হত্যা করে ক্ষমতার দাপট প্রকাশ করত। তাই কপিলমুনি রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণের পরিকল্পনা তৈরিতে অংশ নেন রহতম উল্লাহ্ দাদু, স ম বাবর আলী, ইউনুস আলী ইনু, সহিদুর রহমান কুটু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম প্রমুখ।
কামরুজ্জামান টুকুর চিন্তা ছিল বিরাট এলাকা জুড়ে রাজাকার। তাই বহু পরীক্ষা-নিরীক্ষার দরকার হয়। বহু চিন্তাভাবনা ও খোজ খবরের পর কপিলমুনি রাজাকার ক্যাম্প আক্রমণের সিদ্ধান্ত মুক্তিবাহিনীর প্রধান সদর দপ্তরে বসে প্রস্তুত হয়। কপিলমুনি ঘাঁটিতে শত্রুর শক্তি ও অস্ত্রশস্ত্রসহ অন্যান্য বিষয়ের উপর খোঁজ-খবর ও রেকি করার দায়িত্ব দেয়া হয় মােঃ ইউনুস আলী ইনুর উপর। অন্য দিকে হরিঢালীর লতিফের নেতৃত্বে তিনজনের আর একটি দল আসেন ঐ একই উদ্দেশ্যে। তাদের কপিলমুনি পাঠায়, যেন ইউনুস ভাই এবং লতিফের রিপাের্ট মিলিয়ে ব্যবস্থা নেয়া যায়। ৭ই জুনের টাইন শ্রীপুরের ট্রাজেডীর পর সব পরিকল্পনা প্রস্তুতিতে আমি একটু অতিরিক্ত সাবধানতা নিতাম এবং ফলও ভাল হত।  ৩রা ডিসেম্বর, মুক্তিবাহিনীর সব কমান্ডারগণ রাড়ুলীতে মিলিত হন এবং পরিকল্পনার চূড়ান্ত রূপ দেন এবং সর্বশেষ নির্দেশ দিতে দেয়া হয়। এখানে রহমত উল্লাহ দাদু, মােঃ ইউনুস আলী, লেঃ আরেফিন, শেখ শাহাদাৎ হােসেন বাচ্চু, আবুল কালাম আজাদ, গাজী রফিকুল ইসলাম ও আমি মিলিত হই। ৪ঠা ডিসেম্বর রাত ৩টায় শত্রু শিবিরে আঘাত হানার সিদ্ধান্ত হয়; আমি ও আবুল কালাম আজাদ ৫০ জনের একটা দল নিয়ে নাসিরপুর ব্রীজ পার হয়ে কপিলমুনি বালিকা বিদ্যালয়ে অবস্থান নেব। রহমতউল্লাহ্ ও ওমর ফারুখ তার বিস্ফোরক বিশেষজ্ঞ দল নিয়ে উভয় দিক থেকে শিবিরের নিকট পৌছবেন, আবু ওবায়দা তওফিক আর সি এলসহ কানাইদিয়ার পর থেকে রাজাকার ক্যাম্পে ফায়ার করবে। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবরের নেতৃত্বে একদল থাকবে আরসনগুর।
তারা সেখানকার কালভার্ট উড়িয়ে দেবে ঐ রাস্তা দিয়ে যেন পাকবাহিনী খুলনা বা পাটকেলঘাটা থেকে কপিলমুনি আসতে না পারে সেই ব্যবস্থা সুদৃঢ় করার জন্য। নৌবাহিনীর বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে রশীদ, সালাম, মকবুল হােসেন, সামাদ মাষ্টার, জিল্লুর রহমানসহ ২০ জনের একটি দল রাজাকার ঘাটির ২৫/৩০ গজ দূরে সুবিধা মতাে স্থানে অবস্থান নিয়ে রাজাকারদের বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করবে। খুলনা থেকে পাইকগাছার শিববাড়ি মােহনা দিয়ে কপিলমুনিতে গানবােটের যাতায়াত ছিল। শত্রুপক্ষ খবর পেয়ে এই পথে গানবােট নিয়ে কপিলমুনি রাজাকারদের সাহায্যার্থে আসতে পারে তাই আজিজুল হককে প্রধান করে দশজনের একটি দল হয়। উল্লেখ করা আবশ্যক যে, এই সময় মুক্তিযােদ্ধারা মাইনের সাহায্যে নৌযান ও গাড়ি ধ্বংসের কলাকৌশল প্রয়ােগে পারদর্শিত লাভ করে।  পরিকল্পনা প্রণয়ন এত সময়, এত পরিশ্রম এবং এতজন মিলে কখনও তৈরি করিনি। তবে পরিকল্পনার মধ্যে আরাে একটা বিষয় ছিল যে, এই রাজাকার ঘাঁটির পতন না হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে এবং শত্রুপক্ষের পানি নেয়া ও বাজার করা প্রভৃতি বন্ধ করে দেয়া হবে। এ অস্ত্র বিশেষ কাজ দিয়েছিল।
স্ব স্ব স্থানে পৌছবার আগে দায়িত্ব সব অধিনায়করা গ্রহণ করেছিল। কথা ছিল পারস্পরিক যােগাযােগ এবং সিদ্ধান্ত ছাড়া কোন বাহিনী কোন অবস্থায় প্রত্যাহার হবে না। অন্যান্য দলগুলাের যাত্রাপথ ছিল কন্টকমুক্ত। কিন্তু আমার দল নিয়ে নাসিরপুর ব্রীজের কাছে এসে দেখি, ওপারে রাজাকাররা ধানের খামারে একটা ক্যাম্প করে কয়েকজন পাহারা দিচ্ছে আর কয়েকজন মধ্যে ঘুমুচ্ছে। থমকে দাড়িয়ে গেলাম। কি করা যায়, কালামের সাথে পরামর্শ করলাম, পরিকল্পনা মতাে গুলি করা নিষেধ কিন্তু বিরাট খাল পার হওয়ার কোনই ব্যবস্থা নেই। অতঃপর বেটাদের গুলি করার সিদ্ধান্ত নিলাম। কয়েকজনকে টার্গেট করে গুলি করার নির্দেশ দিলাম। সবার হাতই পাকা, কারও গুলি ব্যর্থ হয় না, ঢলে পড়ল, ক’জন রাজাকার। বাকী ক’জনকে নিরস্ত্র ধরে চড় থাপ্পর দিয়ে পালিয়ে যেতে বললাম। গ্রেফতার করে আনলে কেইবা এদের দেখবে। অস্ত্রগুলাে সব আমাদের অতিরিক্ত বােঝা হল। বহু কষ্টে পথ চলে জায়গামত পৌছলাম। তারপর একসময় আরসিএল এর বহু কাঙ্খিত ফায়ার-শুরু হল যুদ্ধ। রাজাকারদের ধারণা ছিল অন্যান্যবারের মতাে এবারও মুক্তিবাহিনী ঘন্টাখানেক গােলাগুলি করে চলে যাবে।
ভাের হল, দুপুর গেল কিন্তু যুদ্ধ আর থামে না। ইতিমধ্যে সব অধিনায়কের সাথে পাস্পরিক যােগযােগ হল। সবাই স্ব স্ব অবস্থানে মজবুত প্রতিরক্ষা তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। স্থানীয় জনগণ তেমন কাছে আসছে না। কারণ তাদেরও ধারণা মুক্তিবাহিনী গােলাগুলি করে চলে যাবে। পরে তাদেরকেই রাজাকারদের বাড়তি অত্যাচারের শিকার হতে হবে। আমরা স্ব স্ব উদ্যোগে খাবার ব্যবস্থা করলাম। কিন্তু রাজাকাররা ভীষণ বিপদে, তাদের। পায়খানা ও পস্রাবও ঘরের মধ্যে করতে হচ্ছে। তবুও ওদের মুখের জোর কমে না, মাইক ছিল ওদের ঘাটিতে, বিশ্রী নােংরা ভাষায় আমাদের আত্মসমর্পণ করার জন্য নির্দেশ। (?) দিচ্ছে। বেটাদের স্পর্ধা দেখে করুণা করা ছাড়া আর গত্যান্তর ছিল না। আমরাও মাইক একটা যােগাড় করে ওদেরকে আত্মসমর্পণ করতে আহ্বান করছি। কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা, কার ডাক কে শােনে?
৫ই ডিসেম্বর বেলা ডুবল। এলাকার লােকজন কিছুটা বুঝেছে যে, রাজাকার ক্যাম্প ধ্বংস না করে আমরা যাচ্ছি না। আমাদের অস্ত্র গােলাগুলি দেখে তারা স্থির সিদ্ধান্তে এল যে, এবার এই অত্যাচারী বেঈমানদের খতম না করে আমরা ফিরছি না। তখন এলাকার জনগণের সহযােগীতা, খাবার পানি, ডাব, চিড়া, মুড়ি, পিঠা খায় কে! আমরা অধিনায়করা পারস্পরিক যােগাযােগ করে রণকৌশলে কিছুটা পরিবর্তন আনলাম। পালাক্রমে বিভিন্ন দিক থেকে অল্প গুলি করব আর তারা সারাক্ষণই গুলি করে চলল। অনেক সময় কোন কোন দোকানকে আড়াল করে আমরা যাচ্ছি, পজিশন বদলাচ্ছি এবং বিভিন্ন খোঁজ খবর নিচ্ছি। সকলে মিলে আরামে বিশ্রাম নিয়ে ধীর স্থিরভাবে যুদ্ধ পরিচালনার সিদ্ধান্ত নিলাম। ঐ রাতে অতিমাত্রায় আত্মবিশ্বাসী হয়ে গুলি করতে করতে এগুচ্ছিল আমাদের বয়সী যােদ্ধা গাজী আনসার, আশাশুনি থানার গােয়ালডাঙ্গা গ্রামে তার বাড়ি। হঠাৎ করে একটা গুলি এসে র বক্ষ ভেদ করে যায় এবং সে মৃত্যুবরণ করে। সাথে সাথে তার উদ্ধারের জন্য কভারিং ফায়ার দেই এবং জামালনগর ও গােয়ালডাঙ্গার ছেলেদের দিয়ে সামরিক কায়দায় এই বীর মুক্তিযােদ্ধাকে শেষ শ্রদ্ধা জানিয়ে লাশ পাঠিয়ে দেই এবং এই খবর কমান্ডার ছাড়া অন্যান্যদের নিকট গােপন রাখি।
 তওফিকের খবর নিলাম। আর সি এল দিয়ে তারা রাজাকার ক্যাম্পের বাঙ্কার উড়িয়ে দিয়েছে। তারা আর ছাদে আসতে পারছে না, পাঁচিলের অংশ বিশেষও ধ্বংস করা হয়েছে এবং ৫ই ডিসেম্বর রাতে বিস্ফোরক স্লাব লাগাতে গিয়ে খালেক মােশাররফ, আবু জাফর, বড় খােকা, জোয়ার্দার রসুল বাবু, আনােয়ার প্রমুখ বহু চেষ্টার পর ব্যর্থ হয়। তারা ৬ই ডিসেম্বর রাতে পুনঃ প্রচেষ্টা চালাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। ইঞ্জিনিয়ার মুজিবর, রবিউল ইসলাম খান (তিনু) চৌধুরী, কামরুল ইসলাম খান প্রমুখ তাদের দায়িত্ব পালনে রত, তারা অগ্রসর হয়ে অন্যান্যদের সাথে মিলে ফায়ার নিচ্ছে। রহমতউল্লাহ দাদু তার দল নিয়ে ক্যাম্প ধ্বংসের বিভিন্ন পরিকল্পনায় ব্যস্ত, কখনও বা নির্দেশ দিচ্ছেন দরাজ গলায়। কালাম বালিকা বিদ্যালয় থেকে তার দলবল নিয়ে তার দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কালামের নির্দেশ অমান্য করে আগড়ঘাটায় তােরাব আলী অন্যপথে এগুতে গেলে ক্যাম্প থেকে ২২বােরের গুলিতে আহত হয়। গুলি তার পেটের একদিক থেকে ঢুকে অন্য দিকে বেরিয়ে যায়। আমাকে খবর দেয়া হয়, কালাম তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে দেয় অন্যত্র। বাসাখালির রুহুল আমিনও যুদ্ধ করতে করতে অগ্রসর হচ্ছিল এমন সময় রাজাকারেরা তাকে দেখে পরপর কয়েকটা গুলি করে। গুলিতে তার সামনের দুর্বল ইটের দেয়াল ভেঙ্গে তার গায়ে পড়ে এবং পরের গুলি কুঁচকিতে লাগে এবং সে আহত হয়, তাকেও চিকিৎসার জন্য পাঠানাে হয়। এই যুদ্ধ যেমন ছিল ভয়াবহ বিপজ্জনক ও অনিশ্চিত, তেমনি ভাল লাগছিল কারণ এত আরামে খেয়ে দেয়ে লােকজনের সহযােগিতায় যুদ্ধ করার সুযােগ আর হয়নি। বার বার তাই রফিকের কথা মনে হচ্ছিল, সে এই যুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্য বহু অনুরােধ করেছিল। কিন্তু সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র ও ক্যাম্পগুলাের দায়িত্ব আমার অবর্তমানে কে পালন করবে তাই ওকে রেখে আসি। রফিকের সারাজীবনের আফসােস সে কপিলমুনি যুদ্ধে অংশ নিতে পারল না।
আবার এই সময় গাজী মিজানুর রহমান মন্টু এসে এই যুদ্ধে যােগ দেয়। রাজাকারদের হাতে গাজী শামসুর রহমান (তার বড় ভাই) মারা যাওয়ায় সে ছিল শােকার্ত। তবুও সে গুরু দায়িত্ব পালন করে। কিছুক্ষণ রেখে তাকে দাদুর নিকট পাঠিয়ে দেই। | কমান্ডার বজলুর রহমান ও হুমায়ুনের নেতৃত্বে মােশাররফ, ইসলাম বন্দ, শফিক আহমেদ, আবুল হােসেন, আব্দুল আজিজ, আব্দুল খালেক, আব্দুর রশীদ, অচিন্ত, আবুল কালাম সরাসরি দাদুর নির্দেশ ও পরিচালনায় দুঃসাহসিকভাবে রাজাকার ক্যাম্পে গিয়ে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে ওদের নাস্তানাবুদ করে  দেয়। আর্ত চিৎকারে ক্যাম্প কাঁপিয়ে তােলে। নৌবাহিনীর এ টিমের নিকট ১০ জোড় ফিঞ্চ, জয় বাংলা মাইনসহ প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক দ্রব্যাদি ছিল। সত্যি বলতে কি দাদু হাতিয়াডাঙ্গার মনােরঞ্জন ক্যাম্পের পার্শ্ববর্তী নদী খাল ব্যবহার করে কঠোর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দুঃসাহসী একটা নৌকমান্ডাে বাহিনী প্রস্তুত করেন। তারা ছিল সবাই সেই বাহিনীর সদস্য। দাদু তাদের উপর সর্বদা কঠিন ও গুরুদায়িত্ব দিতেন। তারা দাদুকে খুবই ভক্তি শ্রদ্ধা করত, দাদুও এদেরকে প্রাণ দিয়ে ভালবাসতেন ও স্নেহ করতেন।
কিন্তু পরের দিন অভিযান চালাতে গিয়ে খড়িয়ার আব্দুল খালেক মারাত্মকভাবে আহত হয়। তার দু’পা ভেঙ্গে যায়, সে মরার মতাে পড়ে থাকে। খালেক ঐ সময় একা একা ছিল, সে আহত হয়েছে কেউ জানে না বা তার সন্ধানও কেউ বলতে পারে না। সালাম এই সময় খালেকের আর্তনাদ শুনতে পেয়ে খবর দেয় এবং পরে তাকে উদ্ধার করে চিকিৎসার জন্য পাঠান হয়। এই সময় কভারিংয়ে ছিল আনােয়ার। সে খালেক আহত হওয়ায় বেশ বেপরােয়া হয়ে উঠে যুদ্ধ করতে থাকে এবং হঠাৎ তার মুখে গুলি লেগে পিছন দিক দিয়ে বের হয়ে যায়। সাথে সাথে এই বীর মুক্তিযােদ্ধা মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। সবাই সাময়িকভাবে স্তব্ধ হয়ে পড়ে। সাহিদুর রহমান কুটুদা’র উপর আনােয়ারের লাশ হেফাজত ও দাফন কাফনের ব্যবস্থার দায়িত্ব দেয়া হয়। প্রথমে তাকে তালা থানার শাহজাদপুরে কবর দেয়া হয়। স্বাধীনতার পর পুনঃ তাকে তার বাড়ি খুলনা শহরের অপর পার বেলফুলিয়ায় কবর দেয়া হয়।
ইতিমধ্যে কালিগঞ্জ, শ্যামনগর পুরােপুরি মুক্ত হয়ে যাওয়ায় বড়দা সুবােল চন্দ্র মন্ডল টাকী থেকে লঞ্চযােগে সরাসরি কালিগঞ্জ আশাশুনি হয়ে কাপিলমুনি থেকে কিছু দূরে থামে। আমাদের জন্য লঞ্চ ভর্তি অস্ত্র আনে। সুবােলদা’কে আমরা সবাই বড়দা’ বলেই ডাকতাম। এক বাপের এক ছেলে সুবােল চন্দ্র মন্ডল খুবই সাহসী। তাই মুজিবনগরের সাথে যােগাযােগ করার দায়িত্ব দেয়া হয়। আমরা তাকে অনেক সময় সেই কারণে যােগাযােগ মন্ত্রী বলে ডাকতাম। যাই হােক, কাপিলমুনির ঐতিহাসিক যুদ্ধ তখন ব্যাপক আশার সঞ্চার করে। জনগণের সাহায্য সহযােগীতা বৃদ্ধি পায়। মুক্তিযোেদ্ধাদের থাকা বা খাওয়ার কোনই সমস্যা রইল না। নতুন করে অস্ত্র ও গােলাবারুদ পাওয়ায় যুদ্ধ তীব্রতর করার নির্দেশ দেয়া হল। জনজীবনের ক্ষয়ক্ষতি এড়িয়ে সকলকে সাবধানে যুদ্ধ পরিচালনা করতে বলা হয়। শীতকাল। তাই মুক্তিবাহিনী রাতে বেশ কষ্ট স্বীকার করে যুদ্ধ করে। রাজাকারদের তেজ ও কথা বেশ নরম হয়ে যায়। এইভাবে নিরলস যুদ্ধ চলে। ৬ই ডিসেম্বর পার হয়ে গেল। ৭ই ডিসেম্বর সকাল থেকে মুক্তিবাহিনী নতুন উদ্যামে যুদ্ধ শুরু করে। আমরা মাইকের মাধ্যমে রাজাকারদের আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেই, ওদের পালানর সব পথ রুদ্ধ বলে জানাই। তখন তারা বলে, আমরা বাবর আলী সাহেবের সাথে আলােচনা করতে চাই।’ আমি আশেপাশের সবার সাথে এ বিষয়ে কথা বললে তারা অমত করে। কারণ শত্রুদের এ মুহূর্তে বিশ্বাস করা ঠিক হবে না।
কিন্তু আমাকে কেউ তাদের কাছে যেতে দিতে রাজী নয়। তখন বটিয়াঘাটার ওমর ফারুখ কৌশলের আশ্রয় নেন। তিনি বাবর আলী’ পরিচয় দিয়ে ওদের সাথে কথা বলে, যেহেতু আমার নাম তারা জানে কিন্তু আমাকে প্রকৃতপক্ষে চেনেও না। তাই তারা কিছু বুঝতে পারেনি। তারা অনেকগুলাে অবাস্তব শর্ত দিলে আলােচনা ব্যর্থ হয়। আমরা শুরু করি প্রাণপণ যুদ্ধ। আরাে ঘন্টা দুয়েক প্রচন্ড গােলাগুলি চলে। এমন সময় এক অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে। কপিলমুনির আকাশে উড়ে এল এক জঙ্গী বিমান। বেশ নিচু দিয়েই একটা চক্কর দিয়ে উড়ে গেল। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের সরকার ও ভারতীয় সরকারের মধ্যে এক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং বাংলাদেশ সরকারের সেনাবাহিনী ও ভারতীয় সরকারের সেনাবাহিনীর মধ্যে এক সরকারী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে এবং গঠিত হয়েছে দু’বাহিনীর যৌথ কমান্ড। মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী যৌথভাবে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত করার দুর্বার যুদ্ধে লিপ্ত। প্রতিদিন বাংলাদেশ বেতার, ভারত রেডিও ছাড়াও বিশ্ব খবর দিচ্ছে যে, অদ্রুিত গতিতে পাকবাহিনীকে পরাজিত করে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ কমান্ডে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বাংলাদেশের বিভিন্ন শহর দখল করে নিচ্ছে। রাজাকারদের নিকট রেডিও ছিল প্রায় প্রত্যেকের কাছে। তারা সব খবর শােনে, তাদের কাছে যুদ্ধের অবস্থা অজানা ছিল না। সুতরাং কাপিলমুনির আকাশে বিমান দেখে তারা দারুণভাবে ভীত হয়ে পড়ে। অতএব তাদের এমনিতেই মনােবল ছিল না; বাকী যা ছিল জঙ্গী বিমান দেখে শেষ। যুদ্ধে ওরা কাবু হয়ে পড়ে এবং তাদের গােলাবারুদও শেষ হয়ে যায়। তখন বিনাশর্তে তারা অস্ত্র সমর্পণ করতে বাধ্য হয়। তারা দল বেঁধে হাত উঁচু করে করে আত্মসমর্পণ করতে থাকে। সে এক দেখার মতাে দৃশ্য। কাপিলমুনি হাইস্কুল জাকারদের স্ত্র দখল করা জাকার ক্যাম্পে প্রথমে প্রবেশ করে গাজী মিজানুর রহমান মন্টু। সে ঢুকে আঁতকে উঠে ফিরে এসে খবর দেয় একজনকে ঘরের দেয়ালে পেরেক মেরে হত্যা করে লটকিয়ে রাখা হয়েছে। সে নির্মম দৃশ্যের বিবরণ শুনে সবাই কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে। কে এই হতভাগ্য যার উপর পাষন্ড রাজাকাররা এমন ব্যবহার করেছে? শীঘ্রই তার পরিচয় পাওয়া গেল, সে তালা থানার মাছিয়াড়া গ্রামের রহীম বক্স গাজীর ছেলে সৈয়দ গাজী।
সর্বমােট ১৫৫ জন রাজকারকে বন্দি করে দড়ি দিয়ে বেঁধে কাপিলমুনি হাইস্কুলের মাঠে রাখা হয়েছে। ক্ষিপ্ত লােকজন এসে ইচ্ছা মতাে কিল চড়, ঘুষি লাথি মারছে—সে এক অভিনব দৃশ্য। অধিনায়কবৃন্দ এক সংক্ষিপ্ত সভায় বসে একটা গণ আদালত গঠন করে ওদের বিচার করার সিদ্ধান্ত চায়। কিন্তু জনগণের এক কথা, এক দাবী। ওদেরকে হয় আমাদের হাতে তুলে দিন অথবা মৃত্যুদন্ড দিন। ওরা আমাদের বহু আত্নীয়-স্বজনকে হত্যা করেছে। এ সময়ে বেশ কিছু কাগজপত্রসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা ছুটে আসে। একটা কাগজে ওরা। যাদের মেরেছে তার এক তালিকা পাওয়া যায়। দেখা গেল ১৬০১ (এক হাজার ছয়শত এক) জনকে রাজাকাররা হত্যা করেছে এবং আরাে প্রায় ১০০০ জন লােককে হত্যার নীল নকশা তাদের কাগজে পাওয়া গেল। মনে হয় তারা এত ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে যায় যে, এসব কাগজপত্র নষ্ট করতে বা পােড়াতে ভুলে গিয়েছে। আর যায় কোথায়? শ্লোগান উঠল এদের মৃত্যুদন্ড চাই। এ সময় পাইকগাছা, তালা, ডুমুরিয়া থেকে প্রায়৪০/৫০ হাজার লােক জমায়েত হয়। লােকে লােকারণ্য! তখন জনতার দাবীর সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে গণআদালত তাদের সবাইকে মৃত্যুদন্ড দেয়। মােট চারজন কোন ফাঁকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করে। বাকী ১৫১ জন রাজাকারকে আলাদা করে ঐ মাঠেই গুলি করে গণআদালতের রায় কার্যকর করা হয়।

(সূত্র : স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স, ম, বাবর আলী ।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত