বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৯ই ফেব্রুয়ারী, শনিবার, ২৬ মাঘ, ১৩৮০
আগামীকাল আদম-শুমারি
আগামীকাল ১০ই ফেব্রুয়ারি। সেই বহু প্রতীক্ষিত ও বহুল আলোচিত লোকগণনা দিন। স্বাধীনতার পর এটাই হবে বাংলাদেশের প্রথম আদমশুমারি, যথার্থ সাফল্যের উপরেই নির্ভর করছে আমাদের আগামীদিনের জাতীয় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নতি।
মোট ১৯ দিনে গণনার কাজ চলবে গতকাল ছিল গণনাকারী ও সুপারভাইজারদের ট্রেনিংদানের শেষ দিন। পহেলা মার্চের সূর্যোদয় পর্যন্ত সময় এই ১৯ দিনের অন্তর্ভুক্ত বলে গণনা করা হবে। পহেলা ও ২রা মার্চে সময় গণনাকেও আবার পরীক্ষা করে দেখা হবে বলে কমিশন সূত্রে জানা গেছে।
শুমারীর প্রথম দিনে অর্থাৎ আগামীকাল একজন গণনাকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বেসরকারি বাসভবনে গিয়ে তাঁর সাথে দেখা করবেন এবং প্রথম শুমারির শুভসূচনা করবেন। এরপর, সুপারভাইজার সহ মোট ১লক্ষ ২০ হাজার গণনাকারী সারাদেশে গণনার কাজ চালাবেন। যাদের নিজস্ব কোনো ঘরবাড়ি নেই, তাদের গণনা করা হবে আটাশের রাতে।
আদমশুমারি কাজ ঠিকমতো সম্পন্ন হয়েছে কিনা তা দু’এক মাস পরে চূড়ান্তভাবে তল্লাশি করে দেখা হবে বলে কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
সাধারণত দশ বছর পর পর দেশে আদমশুমারি করা হয়। তবে নানান কারণে এবারের শুমারি প্রায় ১২ বছরের মাথায় অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগের আদমশুমারি হয়েছিল ১৯৬১ সনে সাবেক পাকিস্তান আমলে। তবে, সেবারের চেয়ে এবারের শুমারির ক্ষেত্রে অনেক বৈশিষ্ট্য ও প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ করার আছে।
আগের শুমারি কাজটা অনেকটা কর্তৃপক্ষের সাথে ও নির্দেশে নানারকম ঘাপলা, দুর্নীতি ও অব্যবস্থার মাধ্যমে বেগারশোধের সম্পন্ন করা হয়েছিল। তাতে দেশের মানুষ বা গণনাকারীদের মধ্যে খুব একটা প্রাণ উদ্দীপনা ছিল না।
কিন্তু, এবার স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে প্রত্যেকের মনেই একটা অভূতপূর্ব প্রাণচাঞ্চল্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। জনসাধারনের সুবিধার জন্য ২৭টি খুব সহজসাধ্য প্রশ্নের মাধ্যমে গণনা কাজ চালানো হবে। আবার গণনাকারীরা যাতে কর্মক্লান্ত হয়ে কাজে অনীহা বা অবহেলা দেখাতে অবকাশ না পায়, সেজন্য তাদের জন্য কিছু বর্ধিত পারিশ্রমিক দানেরও ব্যবস্থা করা হয়েছে। এটা আগে ছিল না। আবার আগে এত বিপুল সংখ্যক গণনাকারী দিয়ে এত বৈজ্ঞানিক উপায়ে গণনা সফল করার কোন নিশ্চিত প্রয়াস ছিল না। সুতরাং এসব দিক থেকে এবারের গণনা অনেক সফল হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
একথা পৃথিবীর সব সভ্য দেশে এক বাক্যে স্বীকার করেন যে, যে কোন প্রকৃত জাতীয় উন্নয়ন মূলক পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আদমশুমারি একান্তই অপরিহার্য। আদমশুমারির সারাদেশে সত্যিকারের উন্নয়নোপযোগী পরিকল্পনা নেওয়া সম্ভব নয়।
সুতরাং, এর গুরুত্ব সম্পর্কে এবং একে সর্বতোভাবে সঠিক ও সফল করার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে যত্নবান ও আগ্রহী হওয়া প্রয়োজন। এজন্য বিশেষ করে প্রয়োজন জনসাধারণের সহযোগিতা। কারণ কর্তৃপক্ষ যতই সজাগ থাকুন না কেন, কিংবা যতই ব্যাপক ব্যবস্থা গ্রহণ করুন না কেন, জনসাধারণের পূর্ণ ও আন্তরিক সহযোগিতা না হলে কোন শুমারিই সঠিক ও সার্থক হতে পারে না।
আবার, আদমশুমারির প্রয়োজনীয় কতৃপক্ষের স্বার্থে নয়, দেশের আপামর জনসাধারণের আগামী দিনের স্বার্থে। সুতরাং এ কাজে কতৃপক্ষকে সাহায্য না দেয়া আর নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারা একই কথা। বাংলাদেশের দুঃখ জর্জরিত মানুষ কোন মহলের উস্কানিতে, ইন্ধনে বা প্রলোভনে এমন ভুল করবে না বলেই সবাই আশা করছে। আপনারা আপনাদের নিকটস্থ গণনাকারীকে সর্বতোভাবে সাহায্য করুন এবং এ পরিসংখ্যানকে সফল করে তুলুন। কারণ এর সঠিক পরিসংখ্যানের উপর আপনার, আমার ও সবার ভাগ্য নির্ভর করছে।
এবারের আদমশুমারি সম্পূর্ণ সঠিক, সফল ও নির্ভেজাল হয়ে আমাদের জাতীয় জীবনের আগামী সুখ-স্বাচ্ছন্দ নিশ্চিত করুক আমরা সর্বতোভাবে এই কামনাই করি।
জাতিকে আন্দোলনের নতুন আশ্বাস
বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের প্রথম জাতীয় কংগ্রেস সম্প্রতি শেষ হয়ে গেল। যুবলীগের এই মহা কংগ্রেসের শুভ উদ্বোধন করেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। দেশের যুব সমাজকে তিনি সমাজের সকল অনাচার অধিকারের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রাম পরিচালনা করার উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন। কংগ্রেসকে সামনে রেখে যুবলীগের পক্ষ থেকে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, সমাজের সকল প্রকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে একটি সংঘবদ্ধ অভিযান চালানো হবে। যুব লীগ সরকারের দুর্নীতির ভাগী হতে আর রাজি নয়। জাতীয় কংগ্রেসেও সেই অভিযান পরিচালনা করার কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে হাজার হাজার কর্মী ঢাকায় এসে মিলিত হয়ে সোচ্চার কণ্ঠে শপথ গ্রহণ করেছে সমাজকে কলুষমুক্ত করার মানসে। বঙ্গবন্ধুর মহান ভাবমূর্তিকে সমুন্নত রেখে তার আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য। ক’দিন হলো কংগ্রেস সমাপ্ত হয়ে গেছে। নতুন সাংগঠনিক পরিষদ ঘোষিত হয়েছে। নতুন নেতৃত্বও সংগঠনের প্রাণচাঞ্চল্য এনেছে। কর্মসূচিকে সামনে রেখে যুবলীগকর্মীরা যে শপথ গ্রহণ করেছে তার বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্ব দান করবে কেন্দ্রীয় পরিষদ। বিশেষ করে দেশে বর্তমানে যে সকল অর্থনৈতিক অনাচার শুরু হয়েছে তার বিরুদ্ধে জনমত গঠনের সার্বিক দায়িত্ব যুবলীগের প্রত্যেকটি কর্মীর। মুদ্রাস্ফীতির দরুন আজ জনজীবনে যে দুর্যোগ নেমে এসেছে তার কারণ উদঘাটন করা এক মহান কর্তব্য। মধ্যবিত্ত জীবনে যে অর্থনৈতিক নৈরাজ্য নেমে এসেছে তা অত্যন্ত ভয়াবহ ও উদ্বেগজনক। রাজনীতির আন্দোলনসমূহ সমাজতন্ত্র নির্মাণের পথে অতন্ত নৈরাশ্যজনক। সর্বোপরি বঙ্গবন্ধুর জনপ্রিয়তাকে মূলধন করে এক শ্রেণীর রাজনৈতিক টাউটদের ফায়দা লুটার বিভিন্ন কৌশল আজ সমাজ জীবনে নিদারুণ হতাশার সৃষ্টি করেছে। যুবলীগের কংগ্রেসে এসকল বিষয় অত্যন্ত সুক্ষ্মাতিসুক্ষ্মভাবে আলোচিত হয়েছে। এবং বঙ্গবন্ধুর অনুসারী সংগঠনগুলোর মধ্যে তেমন উল্লেখযোগ্য সম্পর্কের অভাবে যে অনৈক্য সৃষ্টি হয়েছে তা অত্যন্ত মারাত্মক। নব্য পুঁজি যেভাবে সমাজদেহে জেঁকে বসার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে তা উদ্বেগের কারণ। শুধু তাই নয় যদি এই নব্য পুঁজির আগ্রাসনে বন্ধ করা না হয় তাহলে অনতিবিলম্বে সামাজিক বিদ্রোহ অনিবার্য হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগের পক্ষ থেকে এ সকল বিষয়েরও চুলচেরা বিশ্লেষণ হয়েছে। এবং সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার জন্য কর্মসূচিও প্রণয়ন করা হয়েছে। যুবলীগ তার লক্ষ্য স্থানে পৌঁছানোর জন্য কাজ করে যাবে বলে আমাদের বিশ্বাস। বঙ্গবন্ধুর মহান আদর্শ বাস্তবায়নের জন্য যদি যুবলীগ উল্লেখিত অনাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলন পরিচালনা করতে সক্ষম হয় তাহলে জনগণের মনে আশার আলো বিচ্ছুরিত হবে। আজ দেশের এই মুহূর্তে এমন একটি বক্তব্য নিয়ে জাতির সামনে কোন সংগঠন উপস্থিত হোক- এটাই জনগণ আশা করছিল। আমরা যুবলীগের এই যাত্রাকে স্বাগত জানাই।
দেশে নার্সের সংখ্যা
ওরা সেবিকা। ওরা নার্স। রোগ জরাগ্রস্ত আর্ত মানবতার সেবায় উৎসর্গকৃত ওদের জীবন। হাসপাতালে মুমূর্ষু রোগী যেন ওদের হাতের উষ্ণ পরশে পুনর্জীবন লাভ করেন। ওরা আছেন, তাই জীবনের চরম মুহূর্তেও মৃত্যুর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একজন রোগী আশ্বস্ত হতে পারেন- অনেক সময় স্বস্তিতেও শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করতে পারেন। এ সত্ত্বেও আমাদের দেশে কোন কোন সময় হাসপাতালগুলোতে অন্যান্য দুর্ভোগের সাথে সাথে নার্সদের দুর্ব্যবহারের কথাও শোনা যায়- শোনা যায় কোনো কোনো সময় রোগীদের প্রতি ওদের অবহেলা দেখানোর অভিযোগ। কোন কোন সময় ওদের কেউ কেউ হয়তো বা এসব অভিযোগে যথার্থভাবে অভিযুক্ত হতে পারেন কিন্তু সব সময় সব অভিযোগে ওরা সবাই কি ভালোভাবে অভিযুক্ত হন? না হওয়া উচিত? ‘যত দোষ নন্দ ঘোষ’ এর মত সব অভিযোগ গুলোর জন্য ওদের বা সার্বিকভাবে দায়ী করাটা কি যুক্তিসঙ্গত? তাছাড়া ওদের বিরুদ্ধে এমন ঢালাওভাবে অভিযোগ আনার আগে ওদের দিকটা এবং তার সাথে সাথে বাস্তব অবস্থাটাও কি ভালোভাবে বুঝে দেখাটা উচিত নয় কি?
স্বাস্থ্য মন্ত্রী জনাব আব্দুল মান্নান বলেছেন বাংলাদেশের প্রতি ১২ হাজার লোকের জন্য একজন করে ডাক্তার এবং প্রতি ১ লাখ ২০ হাজার লোকের জন্য একজন করে নার্স রয়েছেন। এতে ডাক্তার ও নার্সের আনুপাতিক হিসাব দাঁড়ালো ১০ জন ডাক্তারে একজন করে নার্স। স্বাস্থ্যমন্ত্রী গত বৃহস্পতিবার ঢাকা নার্স ট্রেনিং স্কুলের প্রথম বর্ষের ছাত্রীনার্সদের শিরাবরণ অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। মন্ত্রীর কথা মতো দেশের নার্সদের যদি এ অবস্থা হয়- সারাদেশের নার্সের সংখ্যা যদি জনসংখ্যার তুলনায় এহেন অবস্থায় দাঁড়ায় অর্থাৎ যদি একজন নার্সকে ১ লক্ষ ২০ হাজার লোকের সেবা-শুশ্রূষার দায়িত্ব নিতে হয়, তবে তার অবস্থা কি হতে পারে, তা সহজেই অনুমেয়। এরপরও কি ওদের সম্পর্কে ঢালাও অভিযোগ করার কোনো কারণ থাকতে পারে?
ওই অনুষ্ঠানে স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশ্বাস দিয়েছেন। বলেছেন, দেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা কালে দেশের নার্সের সংখ্যা বাড়ানোরও একটা সিদ্ধান্ত সরকার নিয়েছেন। এখন যেখানে প্রতি দশ জন ডাক্তারে একজন নার্স সেখানটায় প্রতি একজন ডাক্তারে পাঁচজন করে নার্স থাকবেন। সত্যিই যদি সরকারের এহেন কোন পরিকল্পনা থাকে এবং তা সঠিকভাবে বাস্তবায়িত হয়, তবে তা আমাদের চিকিৎসা ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক উন্নয়ন সাধন করবে বলেই আমাদের বিশ্বাস।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক