লেঃ সামাদ আর লেঃ আবদুল্লাহ ২৫ মাইল রেঞ্জের অয়ারলেস হাতে দুই গ্রুপ কমাণ্ডে নিয়ে বেরিয়ে পড়েছিল ১৯শে নভেম্বর পাকিস্তানীদের শক্ত ঘাঁটি রায়গঞ্জ দখলের জন্যে। সবার হাতে একটা করে স্টেন আর কিছু গ্রেনেড। প্রতিজ্ঞা নিয়ে তারা বেরুল রায়গঞ্জ দখলের। লেঃ সামাদের গ্রুপে ছিল কমাণ্ডো মাহবুব, কাসেম ও অন্যরা এবং লেঃ আবদুল্লাহর গ্রুপে ছিল ১৫জন শক্তিশালী কমাণ্ডো। দুই গ্রুপ রায়গঞ্জে অবস্থিত ২৫পাঞ্জাব রেজিমেন্টকে লক্ষ্য করে দুই দিক থেকে যাত্রা শুরু করে। ঠিক হয় ৫০০ গজের মধ্যে গিয়ে অয়ারলেসে সামাদ ও আবদুল্লাহ দু’জনের পজিশন জানিয়ে দেবে। চাদর গায়ে জড়িয়ে মুক্তিযােদ্ধারা রাত ন’টায় নিঃশব্দে বেরিয়ে পড়ে ৬নং সাব-সেক্টর ভুরুঙ্গামারী থেকে ঈদের আগের রাতে। সােয়া ঘণ্টা যাত্রার পর রায়গঞ্জ ব্রীজের সন্নিকটে পৌছে লেঃ সামাদ সহসা দেখলেন তার গ্রুপের সবাই ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের ট্র্যাপে পড়ে গেছেন। তিনি বুঝলেন ভুল রেকি হয়েছে। রায়গঞ্জ ব্রীজের নিচে ২৫ পাঞ্জাবের এলএমজিসহ বাঙ্কার রয়েছে এ খবর তিনি পাননি। ছােট শিসের সংকেতে তিনি সবাইকে শুয়ে পড়তে বললেন। অয়ারলেস সেট ওপেন করে ‘হ্যাল আবদুল্লাহ’ বলতেই শুরু হয়ে গেল ক্রস ফায়ারিং। সেই সাথে পাকিস্তানীরা তাদের ওপর আর্টিলারী গান ও ৩ ইঞ্চি মটার চালাতে লাগল। বীর সামাদ বলেন ‘কেউ এক ইঞ্চি পিছু হটবে না, মরলে সবাই মরব, বাঁচলে একসাথেই বাচঁব।’ শুরু হয়ে গেল মুক্তিযােদ্ধাদের জীবনমৃত্যু পাঞ্জা লড়াই। অনেক শক্তিশালী ও দক্ষ এবং অনেকগুণ ভারী অস্ত্রে সজ্জিত ২৫ পাঞ্জাব বাহিনীর ঘেরাও-এর মধ্যে পড়ে বাংলার তরুণ বীরেরা সেদিন ফুলের মতাে ঝরে ঝরে পড়তে লাগল। কিন্তু কেউ সামাদের আদেশ অমান্য করেনি।
নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে থেকে, মুহুর্মুহু মর্টার শেল ও বুলেটের মুখে পড়ে মুক্তিযোেদ্ধারা কেউ এতটুকু দমেনি। নিজের শেষ বুলেটটি শক্রর প্রতি নিক্ষেপ করেছে, তারপর নিজে শহীদ হয়েছে। আমাদের ১৫/২০ জন বীর মুক্তিযােদ্ধা সেদিন এক ব্যাটালিয়ন ২৫ পাঞ্জাবের বিরুদ্ধে যে অসম সাহস ও বীরত্ব নিয়ে লড়াই করেছে পৃথিবীর যে কোন বীরত্বব্যঞ্জক লড়াইয়ের সাথে তার তুলনা হতে পারে। অপরদিকে লেঃ আবদুল্লাহ হেডকোয়ার্টারকে ডেভলপমেন্ট জানিয়ে দিল। ৬ নং সেক্টর কমাণ্ডার উইং কমাণ্ডার বাশারের নেতৃত্বে মূল বাহিনী এগিয়ে এল। ১৯ তারিখ ভাের থেকে ২০ তারিখে সন্ধ্যা পর্যন্ত কামান ও আর্টিলারী দিয়ে তিনি আঘাত হানলেন ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের উপর। গ্রাম থেকে লােক এসে বলল খানসেনারা ভেগে যাচ্ছে। ২১শে নভেম্বর সকালে সেই শক্তিশালী ট্রেইন্ড ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বিধ্বস্ত হয়ে রিট্রিট করল ৫ মাইল দূরে নাগেশ্বরীতে।
এই যুদ্ধে ২৫ পাঞ্জাবের কমপক্ষে সাড়ে তিনশ’ থেকে পাঁচশ’ জন নিহত অথবা আহত হয়েছে। রণাঙ্গনেই পড়ে ছিল ৩০/৩৫ জনের মৃতদেহ। লেঃ সামাদের গ্রুপে মাহবুব ও কাশেম (অন্য রণাঙ্গনে তিনি পরে শহীদ হন) ফিরে আসতে পেরেছিল। এই যুদ্ধ ছিল আমাদের একটা বড় বিজয় এবং পাকিস্তানী ফোর্সের জন্য একটি আঘাত। কেননা ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ছিল তাদের গর্ব। কিন্তু এই যুদ্ধে যেসব মুক্তিযযাদ্ধাকে আমরা হারিয়েছিলাম তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন বীর। এবং সেই যুদ্ধে প্রত্যেকেই বীরের মৃত্যু বরণ করেছিলেন। আমরা তাদের সবাইকে সালাম জানাই সালাম জানাই সেই নির্ভীক যােদ্ধা লেঃ সামাদকে। ২১ তারিখ ভাের রায়গঞ্জ ব্রীজের কাছে খোঁচা খোঁচা দাড়ি মুখে, প্যান্টের ভিতর হাফশার্ট ঢােকানাে, মাটির উপর মুখ থুবড়ে পড়ে থাকা অবস্থায় লেঃ সামাদকে সবাই দেখল। জীবনে যেমন সে বীরবিক্রমে লড়াই করেছে, মরণেও তেমনি বীরবিক্রমে মাতৃভূমিকে আলিঙ্গন করে শুয়ে রয়েছে। উইং কমাণ্ডার বাশার সামরিক কায়দায় ডান হাত কপালে তুলে সেলুট করলেন তাকে। সেলুট করল সবাই। লালমনিরহাট মসজিদের পাশে তাকে কবর দেয়ার ব্যবস্থা করা হল। কিন্তু জানাজা পড়ার জন্য মৌলভী পাওয়া গেল না। সীমান্তের ওপার থেকে এক মসজিদের ইমামকে আনা হল জানাজার জন্য। ৪১ বার গান সেটের সাথে সাথে রণাঙ্গনে বেজে উঠল লাস্ট পােস্ট। সব শহীদের জানাজা ও দাফন সম্পন্ন করে সবাই চলল ফ্রন্টের দিকে, হাতে ইস্পাতের চকচকে অস্ত্র, চোখে পানি। উইং কমাণ্ডার বাশার অন্যদের চোখ মুছিয়ে দিচ্ছিলেন। নিজে কাঁদছিলেন। ফ্রন্টে ফ্রন্টে বিজয় হয়েছে, সেই সাথে বেদনার সুর বেজেছে। অশ্রুজলে সবাই সিক্ত হয়েছে। (সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র অষ্টম খণ্ড,মুসা সাদিক রচিত।)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত