গােয়ালন্দে প্রতিরােধ
১২ই এপ্রিল খবর এল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বিরাট অংশ আরিচা থেকে জলপথে গােয়ালন্দের দিক অগ্রসর হচ্ছে। বুঝতে পারলাম এদেরকে যদি গােয়ালন্দে নামতে দেয়া হয়, তাহলে আমার যশাের পরিকল্পনা ভেস্তে যাবে। আমার ক্ষুদ্র সেনাবাহিনী থেকে কোনরকমে এক প্লাটুন সৈন্য, ২টি এলএমজি, ১টা এমজিও একটা ট্যাঙ্কবিধ্বংসী ছােট কামান সহকারে পাঠিয়ে দিলাম নায়েব সুবেদার শামসুল হকের নেতৃত্বে গােয়ালন্দে। তাদের উপরে আমার নির্দেশ ছিল যে, পাকসেনারা যেন কোনমতেই পদ্মার এপারে অবতরণ করতে না পারে। ১৩ই এপ্রিল এই অগ্রগামী সৈন্যের সাথে পদ্মার পারে আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের এক তীব্র সংঘর্ষ হয়। এতে পাকবাহিনীর একটি জাহাজ ডুবে যায় এবং তারা উত্তরাভিমুখে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। পরে খবর পেলাম যে পাকবাহিনী একই সময়ে নগরবাড়ীতেও অবতরণ করার চেষ্টা করছে। বুঝতে পারলাম নগরবাড়ীতে যদি পাকবাহিনী বিনা বাধায় নামতে পারে, তাহলে তারা পাবনা ইশ্বরদী হয়ে আমার পেছন দিক থেকে আক্রমণ চালাতে পারে। তাতে আমার পজিশন অত্যন্ত সংকটময় হয়ে যাবে। তাই রাজশাহীতে যুদ্ধরত মেজর মরহুম নজমুল হককে টেলিফোন করে নগরবাড়ীতে এক কোম্পানী সৈন্য জরুরি ভিত্তিতে পাঠাবার জন্য অনুরােধ করলাম। কিন্তু তিনি যদিও এক প্লাটুন সৈন্য পাঠিয়েছিলেন, তারা সময় মতাে পৌছতে পারেনি। এদিকে শুনতে পেলাম তদানীন্তন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন খােন্দকার নজমুল হকের নেতৃত্বাধীন এক কোম্পানী পরিমাণ মুজাহিদ ছিল নগরবাড়ী রক্ষণাবেক্ষণে লিপ্ত।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ২/৪টা গােলা নগরবাড়ীতে পড়বার সাথে সাথেই তারা সব পালিয়ে যায় এবং পাকবাহিনী ১৫ই এপ্রিল পুরােপুরিভাবে নগরবাড়ীতে অবতরণ করতে সক্ষম হয়। অবতরণের পর পরই পাকসেনারা তীব্র গতিতে পাবনার দিকে অগ্রসর হয়। ১৬ই এপ্রিল ভেড়ামারায় অবস্থিত আমার ক্ষুদ্র সেনাদলের সাথে প্রচণ্ড গােলাগুলির পর পাকবাহিনী ভেড়ামারায় অবতরণ করে। ভেড়ামারার কমাণ্ডার তখন ছিল সুবেদার মেজর মুজাফফর। উপায়ান্তর না দেখে সে তার সৈন্যদল নিয়ে পিছু হটে যায়। ওদিকে যুগপত্তাবে পাকসেনাবাহিনী ও বিমান যশাের থেকে আমাদের উপর হামলা চালায়। এই দুই দিক থেকে (সামনে ও পিছন দিক থেকে) হামলা প্রতিহত করার মতাে সৈন্যবল ও অস্ত্রবল আমার ছিল না। কাজেই, আমার সম্মুখভাগ (ফ্রন্ট লাইন) সঙ্কুচিত করার উদ্দেশ্যে দু’দিক থেকেই সৈন্যদের অপসারণ করে পিছিয়ে নিয়ে আসি পর্যায়ক্রমে এবং পুনঃ প্রতিরক্ষাব্যুহ গঠন করি কোটচাদপুর, ঝিনাইদহ, শৈলকুপা (রাস্তা), পােড়াদহ লাইনে। কিন্তু ১৬ই এপ্রিল অপরাহ্নেই পাকবাহিনীর হাতে ঝিনাইদহের পতন হয়। বাধ্য হয়ে আমার প্রতিরক্ষাব্যুহ আরও পিছিয়ে নিয়ে আসতে হয়। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার উদ্বোধন ও অপরপক্ষে ১০ই এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর চুয়াডাঙ্গাকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাজধানী বলে ঘােষণা করার সাথে সাথেই চুয়াডাঙ্গার উপর চলতে থাকে তীব্র বিমান হামলা।
এতদসত্ত্বেও বাংলাদেশ সরকার মনস্থির করলেন যে, চুয়াডাঙ্গার কোন মুক্ত এলাকাতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করা হবে ১৭ই এপ্রিল। নির্বাচন করা হল । আমার পূর্বতন ইপিআর যুদ্ধে ওতপ্রােতভাবে লিপ্ত থাকা বিধায় স্টেজ ও আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাপনার ভার নিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী। স্থানীয় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থাও করলেন তিনি। আমাকে শুধু নির্দিষ্ট সময়ে উপস্থিত হবার জন্য খবর দেয়া হল। ওদিকে ১৬ই এপ্রিল আমার সদর দপ্তর স্থানান্তরিত করা হয় চুয়াডাঙ্গা থেকে মেহেরপুরে। অত্যন্ত প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যে ঐ রাতেই সদর দপ্তর মেহেরপুর থেকে ভৈরব নদীর অপর ইছাখালী বিওপিতে স্থানান্তরিত করি। এই বিওপি থেকে ভারতীয় বিওপি’র দূরত্ব ছিল প্রায় ৬০০ গজ। বিওপিতে থাকবার মতাে কোন ব্যবস্থা না থাকায় সৈন্যদের যথাস্থানে প্লেস করিয়ে গাড়িতে করে আমার স্ত্রী-কন্যাদের নিয়ে এই প্রথম বারের মতাে ভারতে পদার্পণ করি। অসহায় অনুভব করে হাউমাউ করে কেঁদে ফেলেন আমার স্ত্রী। সাথে সাথে কন্যাদের অবস্থাও তথৈবচ। আমার স্ত্রী যতক্ষণ সম্ভব বাংলার মাটিতেই কাটাবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়। তাই ফিরে আসা হল আবার সেই ইছাখালী। বিওপি’র ভাঙ্গা ঘরে ছিল না কোন বিছানাপত্র, ছিল না কোন শােবার জায়গা। মাটিতে শুয়ে ওরা রাত কাটিয়ে দিল। পরদিন ১৭ই এপ্রিল সকাল ১০টায় বৈদ্যনাথতলার আম্রকানন লােকে লােকারণ্য।
অথচ তখনও আমি মেহেরপুরে। পূর্বনির্ধারিত পরিকল্পনা অনুযায়ী নবগঠিত সরকারকে সালাম দেবার কথা আমারই কিন্তু এদিক নিশ্চিত না করে রওনা করা সম্ভব হয়ে ওঠেনি। ওদিকে দেশ-বিদেশের সাংবাদিক সমভিব্যাহারে বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে পৌঁছে যান অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং অন্যেরা। ভাগ্যবশত তৌফিক এলাহি ও মাহবুবকে আমি ভাের ৭টায় পাঠিয়ে ত্রস্ত গতিতে মাহবুব উপস্থিত কিছু সংখ্যক যুদ্ধক্লান্ত ইপিআর ও আনসার-মুজাহিদের মিলিত সৈন্যদের একত্রিত করে সদ্য আগত প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীকে সালাম প্রদান করে। তার কিছুক্ষণ পরেই আমি ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিন (বর্তমানে মেজর), ক্যাপ্টেন হাফিজ, আমার স্ত্রী-কন্যা এবং সামান্য সৈন্য সমভিব্যাহারে সেখানে উপস্থিত হই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা ও সনদপত্র পাঠের পর এই নবগঠিত সরকারকে আমি সামরিক অভিবাদন দিই। তারপর আনুষঙ্গিক আলাপ-আলােচনা, পরিচয়, ভাষণ ও সবশেষে মধ্যাহ্ন ভােজনের পর এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষ হয়।
গৌরবের বিষয় এই যে, পলাশির আম্রকাননে বাংলার স্বাধীনতা লুপ্ত হবার পর আবার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীনতার উন্মেষ অনুষ্ঠানের মতাে এতবড় একটা ঐতিহাসিক পর্বে স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত কমাণ্ডারদের মধ্যে একমাত্র আমি এবং বাংলার নারীজাতির প্রতিনিধি হিসাবে আমার স্ত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ফিরে এলাম আমার অস্থায়ী আড়ম্বরহীন সদর দপ্তর ইছাখালী বিওপিতে। এখানে একটি কথা বলে রাখা আবশ্যক যে, ১৬ই এপ্রিলে যখন দেখতে পেলাম সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে সরিয়ে নিতে হবে, ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তখনই নির্দেশ দিলাম সমস্ত স্থানীয় ও দূরবর্তী অন্যান্য ব্যাঙ্কের টাকা-পয়সা, সােনা-গয়না সাথে নিয়ে নেয়ার জন্যে। নির্দেশ অনুযায়ী ডাঃ আসহাবুল হক, ক্যাপ্টেন তৌফিক এলাহি, ক্যাপ্টেন মাহবুব এবং আরও কয়েকজন গণ্যমান্য লােকের মিলিত প্রচেষ্টায় আনুমানিক সাড়ে চার কোটি টাকা ও আধ মণ সােনা আমরা সাথে নিয়ে যাই। স্থানীয় যত গুদামে চাউল ও আটা ছিল সবগুলাে আমাদের গাড়িতে উঠিয়ে নিই। ১৮ই এপ্রিল সকালবেলা ঐ সীমান্তে ক্যাপ্টেন আজমের নেতৃত্বাধীনে এক কোম্পানী সৈন্য রেখে বাকী সৈন্য ও সদরদপ্তর নিয়ে আমি চলে যাই বেনাপােলে এবং সেখানে স্থাপন করি আমার সদর দপ্তর। ঐ দিনই আমি বেনাপােলে ও যশাের রােড এবং তার দক্ষিণাঞ্চলের কর্তৃত্বভার প্রত্যক্ষভাবে নিজের অধীনে নিয়ে বেনাপােল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষা ব্যুহ গঠন করি।
২০শে এপ্রিল সকাল ১০টায় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর নবনিযুক্ত সেনাপতি কর্নেল এমএজি ওসমানী (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) বেনাপােলে আমার সদর দপ্তর পরিদর্শনে আসেন। বেনাপােলে তাকে যথাযথভাবে সামরিক সালাম দেওয়া হয়। আমি সেনাপতিকে প্রতিরক্ষা পরিকল্পনা বুঝিয়ে দিই এবং আমার সামরিক সরঞ্জামাদির.অভাব সম্বন্ধে তাকে অবগত করাই। বেনাপােল থেকে পূর্বদিকে কাগজপুকুর এলাকায় আমার প্রতিরক্ষা ব্যুহ স্থাপন করি। কিন্তু প্রথাগত প্রতিরক্ষার জন্য অস্ত্রশস্ত্র ব্যুহের সবচেয়ে মারাত্মক দুর্বলতা ছিল যে প্রতিরক্ষার জন্য আমাদের সাপাের্টিং অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। ফিল্ড অয়ারলেস বা ফিল্ড টেলিফোন এবং ডিগিং যন্ত্রপাতির ছিল মারাত্মক অভাব। এতদসত্বেও ২টি কোম্পানী ইপিআর সৈন্য নিয়ে আমি এই প্রতিরক্ষা ব্যুহ যথাসম্ভব পরিপূর্ণভাবে গড়ে তুলতে চেষ্টা করি। আমার কাছে মাত্র ২টি ৩ ইঞ্চি মর্টার ও কিছু সংখ্যক গােলা ছিল, সেগুলাে আমি রিজার্ভে রেখেছিলাম স্থান ও কালভেদে প্রয়ােজন মতাে ব্যবহার করার আশায়। এই প্রতিরক্ষা ব্যুহে আমার সাথে ক্যাপ্টেন তৌফিক, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন (বর্তমানে মেজর) ও ডাঃ আসহাবুল হক উপস্থিত ছিলেন। উল্লেখ্য যে, ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও ক্যাপ্টেন মুস্তাফিজুর রহমান (বর্তমানে মেজর) ১০ই এপ্রিল ঢাকা থেকে পালিয়ে এসে আমার সাথে যােগদান করেন। প্রথম বঙ্গশার্দুল থেকে পালিয়ে আসা ১৫০ জন সৈন্য নিয়ে ক্যাপ্টেন হাফিজকেও বেনাপােল কাস্টম কলােনীর দক্ষিণ ভাগে রিজার্ভ বাহিনী হিসাবে পজিশন নেবার জন্য নির্দেশ দিই।
২৩শে এপ্রিল সকাল ১০টায় তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেব আমার সদর দপ্তর বেনাপােলে এসে উপস্থিত হন বাংলার মাটিতে বৃটিশ এমপি মিঃ ডগলাস ম্যানকে স্বাগত জানানাের জন্য। দীর্ঘ ৩ ঘন্টা অপেক্ষা করার পর বৃটিশ অতিথি আমার সদর দপ্তরে এসে মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে ১ ঘন্টাব্যাপী আলােচনা করেন। সুখের বিষয় যে, বৃটিশ এমপি ভারত থেকে এসে বাংলায় পদার্পণ করার সাথে সাথেই আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকা দেখতে পান ও তার পতপত আওয়াজ শুনে অনেকটা আশ্বস্ত হন আমাদের ভবিষ্যৎ স্বাধীনতাপ্রাপ্তির সম্ভাবনায়। মাননীয় অতিথি বিদায় নেবার ১ঘন্টা পরে জনাব তাজউদ্দীন মুজিবনগরে চলে যান। তিনি বিদায় নেবার ঠিক ১৫ মিনিটের মধ্যে ২৩শে এপ্রিল বিকেল সাড়ে ৩টায় পাকিস্তানসেনাবাহিনী আমাদের উপর আঘাত হেনে আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ কাগজপুকুর থেকে বেনাপােলের পূর্বসীমানা পর্যন্ত সঙ্কুচিত করতে বাধ্য করে। যাই হােক, রাতারাতি আবার আমরা নতুন করে প্রতিরক্ষা পজিশন সংগঠিত করে নিই। | ২৪শে এপ্রিল ভাের ৪টায় পাকিস্তানসেনাবাহিনী ২ ব্যাটালিয়ন সৈন্য সহকারে আমাদের পজিশন আক্রমণ করে। আমার বাম দিকের কোম্পানী পজিশনে প্রথম আক্রমণ করা হয়। ২ কোম্পানীর মধ্যে যােগাযােগের জন্য রানার ব্যতিরেকে আমার আর কোন ব্যবস্থা ছিল না। অন্ধকারে এই কোম্পানীর সাথে তুমুল যুদ্ধ চলে। ভাের ৬টায় একটা ১টন ডজ গাড়িতে করে ৩ ইপিআরগুলাে পাঠিয়ে দিই তাদের সাহায্যার্থে।
তারা কিছুটা। অগ্রসর হয়ে সুবিধাজনক স্থানে পজিশন নিয়ে শত্রুর উপর মুহুর্মুহু গােলাবর্ষণ করতে থাকে। এমন সময় শত্রুর আক্রমণের চাপে আমার ভাইটাল পজিশন থেকে এমজি ওয়ালা তার এমজি সহকারে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু ঠিক সে সময় পূর্বতন হাবিলদার-মেজর তখনকার নায়েক-সুবেদার মুজিবল হক সেখানে উপস্থিত হন এবং তার কাছ থেকে এমজি ছিনিয়ে নিয়ে ঐ ভাইটাল পজিশন থেকে ক্ষিপ্র গতিতে অগ্রগামী শত্রুর উপর সুইপিং ফায়ার চালাতে থাকে। সুবিধা ছিল এই যে, শত্রুর অবস্থান ছিল তখন খােলা এবং নিচু জায়গায়। মুজিবল হকের এই তীব্র আক্রমণে শত্রুপক্ষের অধিকাংশ সৈন্য ধরাশায়ী হয় এবং তাদের আক্রমণ প্রায় ব্যর্থ হবার উপক্রম হয়। ওদিকে পাকিস্তানবাহিনীর দ্বিতীয় ব্যাটালিয়ান আমার ডানদিকের কোম্পানীর উপর আক্রমণ চালায় সকাল ৬টায়। তারা এসেছিল ইপিআর পােশাক পরে। কাজেই, প্রথমতঃ আমার ইপিআর বাহিনী ধােকা খেয়ে যায় কিন্তু পরক্ষণেই তারা এই চালাকি বুঝতে পেরে তাদের আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য তীব্র প্রচেষ্টা চালায়। ওদিকে মুজিবল হকের একক অথচ তীব্র এমজির সুইপিং ফায়ারে যখন শত্রুসৈন্য বিধ্বস্ত প্রায়, তখনই ডানদিকে থেকে ইপিআর পােশাকের বেশে ১ পাটুন শত্রুসৈন্য তার দিকে অগ্রসর হয়। মুজিবল হক তাদেরকে দেখতে পেয়েও ইপিআর বাহিনী ভ্রমে তাদের উপর ফায়ার করেনি। এটাই হল তার ও আমাদের চরম দুর্ভাগ্য। প্রকৃত এমজি ম্যান ল্যান্সনায়েক বার বার মুজিবল হককে হুঁশিয়ার করা সত্বেও সে ইপিআর বাহিনী বলে শত্রুর উপর ফায়ার করতে অস্বীকার করে। কিন্তু মিনিট পরেই এই ইপিআর বেশি শক্ত প্লাটুন তার উপর আক্রমণ চালায়। শত্রুর এলএমজির বুলেট মুজিবল হকের বক্ষ ভেদ করে তখনই তার জীবন শেষ করে দেয় (ইন্না… রাজেউন)। এলএমজি ম্যান হামাগুড়ি দিয়ে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়।
নায়েক সুবেদার মুজিবল হকের অপরিসীম সাহস, কৃতিত্ব ও আত্মত্যাগের ঋণ বাংলার আপামর জনসাধারণ কোনকালেই শােধ করতে পারবে না। প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণে জানা যায়, মুজিবল হকের এমজি সহকারে তীব্র যুদ্ধে আনুমানিক ১৫০ জন শত্রুসৈন্য নিহত হয়, যার জন্য সামরিকভাবে শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত হয়। ইত্যবসরে, আমার বামদিকের কোম্পানী মুজিবল হকের ফায়ারের আড়ালে থেকে সীমান্তবর্তী এলাকায় পশ্চাদপসরণ করতে সক্ষম হয়। ওদিকে ডানদিকের কোম্পানীও সাপাের্ট ফায়ারের অভাবে ক্ষণিক যুদ্ধের পর সীমান্তবর্তী এলাকায় অপসারণ করে। দুঃখের বিষয়, মুজিবল হকের পতনের সাথে সাথেই আমার মর্টারবাহিনী গুটিয়ে গাড়িতে করে পশ্চাদপসরণ করার চেষ্টা করে কিন্তু অল্প দূরে শত্রুসৈন্যের অবস্থান লক্ষ্য করে ড্রাইভার গাড়ি দাঁড় করিয়ে রাস্তার আড়ালে হামাগুড়ি দিয়ে পিছনে পালিয়ে যায়। উপায়ান্তর না দেখে মর্টার বাহিনীর কমাণ্ডার মােমিনুল হককেও একই পদ্ধতিতে পশ্চাদপসরণ করতে হয়। গাড়ি ও মর্টার শত্রুর হস্তগত হয়। এদিকে সীমান্ত এলাকা থেকে আমার বাহিনী প্রাণপণে শত্রুর মােকাবিলা করতে থাকে। সমস্ত দিন গােলাগুলির পরেও সেনারা আমার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বাংলার মাটি থেকে উৎখাত করতে পারেনি। এবং আমার সদর দপ্তরে উড্ডয়নরত বাংলার জাতীয় পতাকার পতপত ধ্বনিকে শত চেষ্টা সত্ত্বেও তারা কোন দিন শুদ্ধ করতে পারেনি। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত ঐ পতাকা উড্ডয়নরত থাকে। (সূত্রঃ বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত