You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.04.05 | ভারতের সাথে যােগাযােগ - সংগ্রামের নোটবুক
ভারতের সাথে যােগাযােগ
৫ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন, সময় সকাল ১০টা। সীমান্তবর্তী জীবননগর থানা থেকে খবর এল আমার সদর দপ্তরে যে, মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতীয় কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসার আমার সাথে দেখা করার জন্য জীবননগর সীমান্তে অবস্থান করছেন। যথাসম্ভব দ্রুতগতিতে আমার সেখানে যাওয়া উচিত। একটি জীপে চড়ে ২জন সৈনিক সাথে করে রওনা হলাম। সীমান্ত পার হয়ে ভারতের মাটিতে পা দিতেই লে. কর্নেল এইচআর চক্রবর্তী (সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ৭৬ নং ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার, কৃষ্ণনগর) আমাকে জোর আলিঙ্গন করে গ্রহণ করেন ও আমার বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধের ভূয়সী প্রশংসা করেন। সেখানে দেখা হয় তাজউদ্দীন সাহেব এবং ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর আইজি সাহেবের সাথে। মনোেযাগ সহকারে তারা শুনলেন আমার রণাঙ্গনের আদ্যেপান্ত ইতিহাস। শুনতে চাইলেন আমার যশাের আক্রমণের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আরও শুনতে চাইলেন ঐ পরিকল্পনাকে সার্থক করতে হলে আমার কি কি পরিকল্পনা। বললাম সবকিছু। তাজউদ্দীন সাহেব আশ্বাস দিলেন যে, যথাশীঘ্রই আমরা সব পাব। লেঃ কর্নেল চক্রবর্তী এত বেশি আবেগপ্রবণ হয়ে গেলেন যে, তখনই তিনি সাথে করে আনা একটা চেকোস্লোভাকিয়ান এলএমজি দিতে চাইলেন। এটার ব্যবহারকৌশল আমাদের জানা ছিল না বলে তিনি আমাকে দুপুরের খাবারের পর নিয়ে গেলেন ওটার কৌশল শিখাবার জন্য। এমন সময় আমার সদর দপ্তর চুয়াডাঙ্গা থেকে টেলিফোনে খবর এল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটা বড় দল ঝিনাইদহের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। এখানে একটু বলে রাখা ভাল যে, ৩রা এপ্রিল চুয়াডাঙ্গায় বিমানহামলা চলাকালীন যশাের থেকে পাকসেনাবাহিনীর একটা দল অগ্রসর হতে গিয়ে কালীগঞ্জ এলাকায় আমাদের ফাইটিং পেট্রোলের এ্যামবুশে পড়ে কিছুসংখ্যক প্রাণ হারিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়।

যাই হােক, খবর পেয়ে আমি আমার একজন সৈনিককে ঐ চেকোশ্লোভাকিয়ান এলএমজি’র কৌশল শিখিয়ে ওটা নিয়ে আসবার জন্য ওখানে রেখে আমি সদর দপ্তরের দিকে দ্রুতগতিতে চলে আসি। সদর দপ্তরে তখন ছিলেন ডাঃ আসহাবুল হক সাহেব ও আমার স্ত্রী। এই খবরে স্বাভাবিকভাবেই ওরা একটু মুষড়ে পড়েছিল। যাই হােক, আমি যাবার পর প্রয়ােজনীয় খবরাখবর ও সৈন্য 

মােতায়েন করার পর অবস্থা আয়ত্বে আসে। পাকিস্তানীরা আর অগ্রসর হয়নি। বুঝতে পারলাম এটা ছিল তাদের নকল আক্রমণের প্রহসন। জীবননগর থেকে চলে আসার পূর্বে লেঃ কর্নেল এইচআর চক্রবর্তী আমাকে সবরকম আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, অচিরেই আমরা আমাদের ভারী অস্ত্রাদি পাব, যার জন্য তিনি আমাকে আইজি-এর অফিসে মেজর বিএন ভট্টাচার্যের সাথে সর্বক্ষণ যােগাযােগ রাখার উপদেশ দিলেন। তাঁর নিজের টেলিফোন নাম্বারও দিলেন। সেই থেকে প্রতিক্ষণ ইণ্ডিয়ান বিএসএফ-এর আইজি সাহেবের অফিসে মেজর ভট্টাচার্যের কাছে টেলিফোনে সর্বশেষে সিচুয়েশন রিপাের্ট দিতাম এবং জীবন নগরে প্রস্তাবিত আমার জন্য ভারী অস্ত্রশস্ত্রের সরবরাহের সর্বশেষ অবস্থা কি জানতে চাইতাম। তিনি আমাকে প্রতিবারই আশ্বাস দিয়ে বলতেন যে আমার ডিমাণ্ড দিল্লীর অফিসে বিবেচনাধনি আছে, শীঘ্রই এসে যাবে। এদিকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যশাের থেকেই ৬ই এপ্রিল ভােরবেলা আমার বিশাখালী সৈন্যাবস্থান আক্রমণ করে, কিন্তু তাদের ভাগ্যের পরিণতি কে এড়াবে। আমার বাহিনী সর্বতােভাবে প্রস্তুত ছিল, সতর্ক ছিল।
এদের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ছত্রভঙ্গ হওয়ায় তাদের বহু প্রাণের ক্ষয়ক্ষতি হয়, কেবল সামান্য কিছু লােক যশাের সেনানিবাসে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে সমর্থ হয়। এটা ছিল পাকিস্তানসেনাবাহিনীর আক্রমণের মুখে আমাদের সামরিক গুরুত্বপূর্ণ প্রথম বিজয়, যার জন্য আমার সেনাবাহিনী ও স্থানীয় জনসাধারণের মনের বিশ্বাস ও উদ্দীপনা আকাশচুম্বি অবস্থা গ্রহণ করে। আমিও এই সুযােগে আমার বাহিনীর অবস্থান সীমা পরিবর্তন করে কালীগঞ্জের দক্ষিণে যশাের সেনানিবাস থেকে ৫ মাইল দূরে অর্ধবৃত্তাকারে স্থাপন করি। ব্যাপকভাবে পেট্রোলিংও কায়েম রাখি যার জন্য যশােরে পাকবাহিনী বের হতে আর সাহস করেনি। অন্যদিকে জীবননগরের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আশ্বস্ত হয়ে আমি দর্শনা-গেদের রেলওয়ে স্টেশনের মধ্যবর্তী উঠিয়ে ফেলা রেললাইন জোড়া দিয়ে বাংলাদেশে ও ভারতের মধ্যে রেল যােগাযােগ স্থাপন করি এবং ৭ই এপ্রিল অপরাহ্নে একটা লম্বা খালি মালবাহী ট্রেন গেদে স্টেশনে দাড় করিয়ে রাখি আমাদের ইস্পিত ভারী অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ বহন করে নিয়ে আসার দূরাশায়। এটা যে সত্যি দূরাশা ছিল তখন ভেবে দেখার ফুরসত পাইনি, সন্দেহও হয়নি। এদিকে ৬ই এপ্রিলের পর থেকে তীব্র গতিতে চলতে লাগল পাকিস্তানসেনাবাহিনীর রি-ইনফোর্সমেন্ট প্রােগ্রাম—জল ও আকাশ পথে। আকাশপথে বাধা দেবার আমার কোন শক্তি ছিল না। জলপথেও বাধা দিতে পারিনি, কেননা যশাের সেনানিবাস থেকে আরম্ভ করে দক্ষিণ দিকে খুলনা-মঙ্গলা বন্দর পর্যন্ত তখনও আমার আয়ত্তাধীন ছিল না। ইপিআর ৫ নং উইং-এর অবস্থান ছিল খুলনা।
তার কমাণ্ডার ছিল অবাঙালি। তারা পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী সেখানে ইপিআর সেনাবাহিনীকে প্রায় পুরােপুরিভাবে নিরস্ত করে রেখেছিল। লড়াই লাগার সাথে সাথে অনেকে প্রাণ দিল, অনেকে আত্মগােপন করে রইল। যারা আত্মগােপন করে রইল তাদের সামান্য সংখ্যকের কাছে রাইফেল ও স্টেনগান ছিল। তৎকালীন ইপিআর সেক্টর হেকোয়াটার ছিল যশােহরে। বেশির ভাগই বাঙালি । ক্যাপ্টেন হাশমত (পদাতিক বাহিনী) ও ক্যাপ্টেন আওলাদ হােসেন (সিগন্যালস) এই দু’জন ছিলেন বাঙালি অফিসার। ২৬শে মার্চ আমি ক্যাপ্টেন হাশমতের কাছে আমাদের বিদ্রোহ করার খবর জানিয়ে তাদেরকেও জরুরি অবস্থা গ্রহণ করতে অয়ারলেসে খবর পাঠাই। কিন্তু দুর্ভাগ্য, আমার সেখানকার বাঙালি সুবেদার ও জওয়ানদের দৃঢ় মনােবল সত্ত্বেও এই দু’জন অফিসার আত্মগােপন করে। পরবর্তী এক সপ্তাহকাল পর্যন্ত এই ক্ষুদ্র। সৈন্যদল নায়ে সুবেদার আবদুল মালেকের নতৃত্বে সীমিত কিন্তু প্রচণ্ডভাবে লড়াই করে শেষে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। তারা বেনাপােলের দিকে পালিয়ে যায়। সেখানেও তারা পাকিস্তানসেনাবাহিনীর সাথে খণ্ড খণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং এপ্রিল মাসের ২০ তারিখ পর্যন্ত পাকিস্তানসেনাবাহিনীকে নাভারন থেকে দূরে রাখতে সমর্থ হয়। তৎকালীন লেঃ হাফিজের মুখে শুনেছি, ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীর ব্যাটালিয়ন কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল মেঘ সিং তাঁর এক কোম্পানী সৈন্য নিয়ে লেঃ হাফিজ ও ইপিআর বাহিনীর সাহায্যার্থে বাংলাদেশের মাটিতে ঢুকে পড়েন এবং নাভারনে পাকিস্তানসেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করেন।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত লেঃ কর্নেল মেঘ সিং-এর ২/৩ জন সৈন্য পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে, যার পরিণামে আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক মহলে সত্যি বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। তবে ভারত তাদের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর প্রত্যক্ষভাবে বাংলা মাটিতে ঢুকে যুদ্ধে লিপ্ত হবার কাহিনী অস্বীকার করে। লেঃ কর্নেল মেঘ সিং তার সৈন্যদের নিয়ে নিজের মাটিতে ফিরে যেতে বাধ্য হন।  অপরিহার্য কারণবশত বেনাপােল-যশাের রােডসহ দক্ষিণাঞ্চল সরাসরি এবং প্রত্যক্ষভাবে আমার নিয়ন্ত্রণে আসেনি এপ্রিল মাসের ১৯ তারিখ পর্যন্ত। এদিকে মেহেরপুরের তদানীন্তন এসডিও জনাব তৌফিক এলাহি চৌধুরী ও ঝিনাইদহের তদানীন্তন এসডিপিও জনাব মাহবুবউদ্দিন আহমদ আমার সাথে যােগদান করেন। মাহবুবুদ্দিন সাহেব পুলিশ অফিসার হওয়া বিধায় আমি তখনই তাঁকে ঝিনাইদহ রক্ষণাবেক্ষণের ভার ও ঝিনাইদহে প্রেরিত সকল সৈন্যের নেতৃত্ব প্রদান করি। কুষ্টিয়া যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে মাহবুব সাহেব সুনিপুণভাবেই ঝিনাইদহে তার কর্তব্য পালন করেন। এপ্রিল মাসের ২/৩ তারিখে ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজের প্রফেসর সফিকউল্লাহ সাহেবও আমার সাথে যােগদান করেন। এদের মধ্যে আমি অশেষ দেশপ্রেম ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে যুদ্ধে কঠিন সংকল্প দেখতে পেলাম।
আগেই বলেছি আমার কাছে ক্যাপ্টেন আজম ছাড়া দ্বিতীয় কোন অফিসার ছিল না। তাই ৭ই এপ্রিল সেক্টর অর্ডার-এর মাধ্যমে যুদ্ধক্ষেত্রে সৈন্যবাহিনী পরিচালনা করার জন্য আমি তাদেরকে সরাসরি ক্যাপ্টেন র্যাঙ্ক কমিশন দিয়ে তাদেরকে র্যাঙ্ক পরিয়ে দিই। সেক্টর অর্ডারে আমি লিখেছিলাম—”On behalf of the Bangladesh High Command I hereby award Commission to the following persons directly in the rank of Captain to meet operational requirements: (a) Mr. Toufiq Elahi Chowdhury. (b) Mr. Mahbubuddin Ahmed. (c) Mr. Md. Safiqullah. এই তিনজন অফিসারই পরবর্তীকালে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত আমার সেক্টরে কোম্পানী কমাণ্ডার হিসাবে যুদ্ধ করেছেন। তাদের বীরত্ব ছিল সত্যিই অতুলনীয়।
কুষ্টিয়া যুদ্ধের পর ২রা এপ্রিল প্রথম বঙ্গ শার্দুলদের দুঃখময় পরিণামের খবর আমার গােচর করা হয়। আরও বলা হয় যে তাদের কিছুসংখ্যক লােক পালিয়ে চৌগাছায় একত্রিত হয়েছে এবং লেঃ হাফিজ নামে একজন বাঙালি অফিসারও সেখানে আছে। ঐদিনই আমি আমার কাছে উপস্থিত হবার জন্য লেঃ হাফিজকে লােক মারফত চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিলাম, কিন্তু হাফিজ আসেনি। ৪ঠা এপ্রিল তাই ঝিনাইদহের কমাণ্ডার মিঃ মাহবুবকে লেঃ হাফিজের খোঁজে পাঠাই। লেঃ হাফিজ তার ২/৩ জন লােক সাথে করে মাহবুবের গাড়ি করে আমার কাছে উপস্থিত এবং আমার খবর পাওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে দেখা না করার একটা কারণ খুঁজে পেলাম। যাই হােক, আমার পরিষ্কার মনে আছে যে আমার অধীনস্থ ইপিআর বাহিনীর জামাকাপড়, ইউনিফর্ম, বুট, ইকুইপমেন্ট এবং কুষ্টিয়া থেকে অধিকৃত ভারী ও হাল্কা অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ এবং গাড়ি দিয়ে ওদেরকে সজ্জিত করে চৌগাছা এলাকায় সন্নিবেশিত করলাম। পূর্বেই বলেছি যে বিশাখালী (ঝিনাইদহ থেকে ৩ মাইল দক্ষিণে) যুদ্ধে আমার সৈন্যদের ডিফেন্স লাইনকে অগ্রগামী করে যশাের ক্যান্টনম্যান্ট থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে রেখেছি। তার কারণ ছিল এই যে, ক্যান্টনমেন্ট থেকে আমার অবস্থান তাদের দূরপাল্লার কামানের আওতার বাইরে রাখা।
দ্বিতীয়ত আমার কোন ভারী অস্ত্রশস্ত্র না থাকায় প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সীমান্তে মাননীয় তাজউদ্দীন সাহেবের প্রতিশ্রুত ভারী অস্ত্রাদির অপেক্ষায় থাকা ও একইসঙ্গে ক্যান্টনম্যান্টের উপর চাপ সৃষ্টি করে রাখা। পরিকল্পনা ছিল, ভারত থেকে কিছু পরিমাণ ভারী অস্ত্রাদি পেলেই আমরা যশাের ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করব। এদিকে ঐ অস্ত্র আসার অপেক্ষায় থাকতে থাকতে বুঝতে পেরেছিলাম যে প্রতিদিনই পরিস্থিতি পাকিস্তানসেনাবাহিনীর অনুকূলে চলে যাচ্ছে। কারণ জল ও আকাশ পথে তাদের রিইনফোর্সমেন্ট পুরােদমেই চলছিল।  ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত অফিসারের কাছে প্রতি পলে পলে সিচুয়েশন রিপোর্ট দিয়েও শুধু আশ্বাস ছাড়া আর কিছুই পাইনি। অবশ্য এটা যে শুধু আশ্বাসই ছিল তখন তা বুঝতে পারিনি। এভাবে কেটে গেল ১১ই এপ্রিল, ১৯৭১ সন।
(সূত্র : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র অষ্টম, খণ্ড)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত