বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ১৯শে ফেব্রুয়ারী, মঙ্গলবার, ৭ই ফাল্গুন, ১৩৮০
তেলের মূল্যবৃদ্ধিঃ আনুষঙ্গিক কথা
আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের মূল্যবৃদ্ধির দরুণই সরকারকে দেশে পেট্রোল ও তৈলজাত দ্রব্যের পরিবর্তিত মূল্য ঘোষণা করতে হয়েছে। প্রাকৃতিক সম্পদ, বৈজ্ঞানিক ও কারিগরি গবেষণা এবং আনবিক শক্তি দপ্তরের মন্ত্রী ডঃ মফিজ চৌধুরী গত রোববার এক সংবাদ সম্মেলনে এ কথা জানান।
ডঃ চৌধুরী বলেন যে, মধ্যপ্রাচ্যের যুদ্ধের দরুণ গত দু’বছরে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অপরিশোধিত অপরিশোধিত তেলের দাম ৩ থেকে ৫ গুণ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। সেজন্যে বিশ্বের সর্বত্র উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তেলের দাম অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি করতে হয়।
মন্ত্রী আরো বলেন গত বছর আমাদের জ্বালানি তেলের বিল যেখানে ছিল ৪০ কোটি টাকা এ বছরে তা ১৫০ কোটি টাকায় বৃদ্ধি পাবে।
মন্ত্রী এ প্রসঙ্গে বিশ্বের বাজারে গত দুই বছরে বিভিন্ন জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধির কথা উল্লেখ করেন। গত দু’বছরে ভালো কেরোসিনের তেল শতকরা ৩শ’ ৬২ দশমিক ২২ ভাগ, নিম্নমানের কেরোসিন শতকরা ৪শ’ ৩২ দশমিক ২০ ভাগ বৃদ্ধি পেয়েছে। অস্বাভাবিক হারে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পরিপ্রেক্ষিতে তিনি বলেন, অস্বাভাবিকভাবে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি বিশ্বে আজ অত্যন্ত স্বাভাবিক নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তেলের আকস্মিক মূল্য বৃদ্ধির প্রসঙ্গে ডঃ চৌধুরী যা বলেছেন, সে সম্পর্কে দ্বিমত কেউ হয়ত পোষণ করবেন না। তেল সমস্যা শুধুমাত্র বাংলাদেশেরই সমস্যা নয়- আন্তর্জাতিক সমস্যা। বিশ্বের উন্নত দেশগুলোও আজ তেল সংকটে নিমজ্জিত হয়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। কিন্তু তেলের মূল্য বৃদ্ধিতে হয়তো ক্রেতারা এ সমস্যা ও সংকটকে উপলব্ধি করতে সক্ষমও হবেন। মূল সমস্যা তা নয়। বর্তমানে আমাদের মূল সমস্যা হলো (যেটা স্বাধীনতার পর থেকেই দেখা দেওয়া যাচ্ছে) দ্রব্যমূল্যের ফ্রাঙ্কেস্টাইন। আর এ ফ্রাঙ্কেস্টাইন তৈরি হয়েছে মুষ্টিমেয় চোরা কারবারি, মজুদদার আর তথাকথিত ব্যবসায়ী নামধারী টাউটদের বদৌলতে। সরকার তেলের পরিবর্তিত মূল্য ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই দেখা গেল যে, বাজার থেকে কেরোসিন উধাও হয়ে গেছে। যদিও পাওয়া যাচ্ছে তার মূল্য হচ্ছে গ্যালন প্রতি ৮ টাকা। এ যেন ঠিক গোদের উপর বিষফোঁড়ার মত অবস্থা। ইস্টার্ন রিফাইনারির চিমনির ধোঁয়া বন্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তেলের দাম বেড়ে যায়। আবার ধোঁয়া দিলে তেলের দাম কমে। এভাবে তো একটা দেশ চলতে পারেনা।
তেলের দাম বৃদ্ধি পেয়েছে এবং কেন পেয়েছে তার নেপথ্য কাহিনী শুনে দেশের মানুষ হয়তো খানিকটা আশ্বস্ত হতো যদি দেখতো যে, শহর অঞ্চলের রেশন দোকান গুলোতে নিয়মিত ভাবে তেল পাওয়া যাচ্ছে এবং গ্রামাঞ্চলের মানুষগুলো নির্ধারিত ডিলারের মাধ্যমে ন্যায্যমূল্যে তেল পাচ্ছে। কিন্তু বাস্তবে তা হচ্ছে কোথায়? একেকবার করে তেলের দাম বাড়ে এবং তারই পরিণতিতে আনুষঙ্গিক অন্যান্য নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের বাজারে আগুন লাগে। চাল, ডাল, তেল, সাবান, কাপড় থেকে আরম্ভ করে সামান্য ম্যাচের দাম দিনের পর দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। একটা ম্যাচ বাজার বিক্রি হচ্ছে চল্লিশ পয়সা। রিকশা, বাস, স্কুটার, লঞ্চ থেকে আরম্ভ করে যাতায়াতের যে কোন মাধ্যমের ভাড়া চক্রবৃদ্ধি হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এ কথা কে বলবে না যে, সমস্যা ও সংকট নেই। আছে। কিন্তু সংকট যেমন আছে তেমনি তার সমাধানও আছে। সেই সমাধানের পথটিই সরকারকে সন্ধান করতে হবে। এমন একটা অবস্থার সৃষ্টি যেন না হয় যাতে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির যাঁতাকলে পড়ে দেশের মানুষের দম এসে গলায় আটকায়।
এবার সরিষায় আগুন লেগেছে
গতকালের একটি জাতীয় সংবাদপত্রে একটি চাঞ্চল্যকর খবর প্রকাশিত হয়েছে। ময়মনসিংহের কুলিয়ারচর সরিষা মিলের প্রায় এক লাখ মণ সংরক্ষিত সরিষা নাকি পুড়ে গেছে। রহস্যজনকভাবে এই বিপুল পরিমান সরিষায় আগুন লেগেছে। সংবাদে প্রকাশ, ইতিমধ্যেই প্রায় পঞ্চাশ হাজার মণ পুড়ে বিনষ্ট হয়ে গেছে এবং বাকি অর্ধেকটাও নাকি এখনো পুড়ছে। বাজারের মূল্য অনুযায়ী প্রতি মণ সরিষার মূল্য দুশো টাকা করেও হয় তাহলেও মোট এক লাখ মণ সরিষার মূল্য দাঁড়ায় দুই কোটি টাকায়। ওয়াকিবহাল মহলের মতে মূল্য দুই কোটি টাকারও বেশি হবে। সংবাদে বলা হয়েছে- গত বুধবার দিন সরিষাতে আগুন লাগার গন্ধ পাওয়া যায়। গন্ধের কারণ জানতে চাওয়া হলে নাকি মিল কর্তৃপক্ষ এড়িয়ে যান। এবং মানুষ মরার গন্ধ বলে তারা মতামত জানায়। গত বুধবার এ আগুন লাগার আশঙ্কা করা সত্বেও মিল কর্তৃপক্ষ মিল খুলেননি ফলে ভিতর আগুন ব্যাপক আকার ধারণ করে। যখন আগুন ব্যাপক আকার ধারণ করে তখন মিলের দরজা খোলা হয়। কিন্তু ততক্ষণে ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়ে গেছে। আগুন লাগার প্রায় তিন দিন পর দমকল বাহিনীকে কর্তৃপক্ষ খবর দেয়। অর্থাৎ গত শনিবারে এই সংবাদ দমকলকে জানানো হয়েছে। দমকল বাহিনীর লোকেরা পানি দিলে সকল সরিষাই বিনষ্ট হয়ে যাবে এই আশঙ্কায় লোক দিয়ে ভালো সরিষা সরিয়ে নেবার চেষ্টা চালাচ্ছে। দমকল সূত্রে জানা গেছে যে, মিল কর্তৃপক্ষ নাকি তাদের সঙ্গে সামান্যতম সহযোগিতা করেনি। দমকল বাহিনীর লোকদের মধ্যে মিল এর বাণিজ্যিক ম্যানেজার সংরক্ষিত সরিষার যে হিসাব জানিয়েছে তা সন্দেহজনক এবং তার বক্তব্য পরস্পর বিরোধী। স্থানীয় জনসাধারণের মতে এই বিপুল পরিমান সরিষায় আগুন লাগার পেছনে নিঃসন্দেহে একটা ষড়যন্ত্র লুকায়িত আছে।
বস্তুতপক্ষে, দেশে আজ একটা বিরাট ষড়যন্ত্র চলছে গুদামজাত জিনিস পুড়িয়ে ফেলার ব্যাপারে। স্বাধীনতার পর থেকেই এ ধরনের ঘটনা ঘটে আসছে। গত চার-পাঁচ মাস আগুন লাগার ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে। দেশের এক বিরাট সংখ্যক পাটগুদামে বর্তমানে রপ্তানি জনিত নানা কারণে পাট মজুদ রয়েছে। ইতিমধ্যে বহু পাট পুড়ে গেছে। এর মূল্য হবে প্রায় ছয় থেকে সাত কোটি টাকার মতো। নারায়ণগঞ্জ ও খুলনায় যে বিরাট অগ্নিকাণ্ড হয়েছিল তাতে কোটি কোটি টাকার পাট পুড়ে গেছে। পাটে আগুন লাগার প্রাক্কাল থেকেই আমরা সন্দেহ পোষণ করে ছিলাম এই বলে যে, পাটে আগুন লাগা কোন দুর্ঘটনা নয় কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনাও নয়। দেশের যারা শত্রু যারা স্বাধীনতাকে সংহত করতে দিতে চায় না তারাই বিভিন্ন উপায়ে দেশের প্রগতিকে বানচাল করতে চায়। পাট গুদামে আগুন লাগা এমনি একটি ঘটনা। দেশের একমাত্র প্রধান বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী ফসল পাটকে পুড়িয়ে দিয়ে সমাজ ও রাষ্ট্রবিরোধী শক্তিগুলো জাতির ধ্বংস অনিবার্য করে তুলতে চায়। সরকারকে এ ব্যাপারে প্রথম থেকেই সবিশেষ সতর্ক হওয়ার আহবান আমরা জানিয়েছিলাম। কিন্তু আমরা পূর্বাপর লক্ষ্য করেছি সরকারী যন্ত্রগুলো এব্যাপারে নৈরাজ্যজনকভাবে পশ্চাদপদ। আমরা এক লাখ মণ সরিষায় আগুন লাগার উল্লেখিত এ সংবাদে আশ্চর্য আজ আর হই না। কেননা আমরা জানি দেশের এই সকল অসৎ দেশদ্রোহী বাণিজ্যিক মহল সমূহ দেশের সকল মজুত মালের বিনষ্ট সাধন করে জাতির ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মাঝে ঠেলে দেবেই। আর আমাদের সরকার তাদের এই সকল পুড়িয়ে দেওয়া জিনিসের বীমার টাকা প্রদান করে দেশ প্রেমিক সরকারের নামাবলী গায়ে নিয়ে নিজেরাই বাহাবা নেবেন। এক লাখ মণ সরিষার মূল্য প্রায় দুই কোটি টাকা। এই বিপুল পরিমান টাকার জিনিস যারা পুড়িয়েছে তাদের বীমার টাকা দূরে থাক সমাজে বাঁচবার নিশ্চয়তা তাদের থাকবার কথা নয়। তবু সরকারি প্রযত্নে এরা দিব্যি তাদের ইচ্ছাকৃত ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে। আমরা দেশের আপামর মানুষের দুর্ভাগ্যের ভাগী হিসেবে সরকারের কাছে অনুরোধ করব জনসাধারণের ভাগ্য নিয়ে আপনারা আর পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাবেন না। একটি নিয়ম অনুসরণ করে জাতিকে পরিচালিত করুন। যারা জাতীয় সম্পদ পুড়িয়ে আপামর মানুষের অকল্যাণ ডেকে আনছে তাদের বীমা পরিশোধেরর মাধ্যমে সরকারের যে সরকারী নীতি প্রচলিত রয়েছে দেশের জনগণ তাতে বিশ্বাসী নয়। তদন্ত করে এ ধরনের আগুনলাগা সম্পদের বিনষ্টকারীদের সমাজ দেহ থেকে উচ্ছেদ করা হোক। কোন প্রকার শৈথিল্য এ ব্যাপারে আমরা দেখতে রাজি নই। দেশের জনগণ ও নয়।
কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক