You dont have javascript enabled! Please enable it! অপারেশন ফায়ার ব্রিগেড - সংগ্রামের নোটবুক
অপারেশন ফায়ার ব্রিগেড
বাংলার প্রতিটি ক্ষেত্রে বর্বরদের অনাচার চলছে। বাংলার সােনার ছেলেরা রুখছে। এদের। মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণঘাতি আক্রমণে বর্বর পাকহানাদার গােষ্ঠী দিশেহারা। বাংলার প্রতিটি বালু কণা বলছে, জয়, হবে জয়। পূর্বাকাশে দেখা দিয়েছে সােনালী রােদের ঝিলিক। লাল বৃত্তের রক্তাক্ত সবুজ পতাকা হাতছানি দিয়ে ডাকছে। বলছে পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল, রক্ত লাল, রক্ত লাল। পাকহানাদার সৈন্যরা রাস্তা থেকে একজন পথচারীকে ধরে নিয়ে যায়। বন্দি করে রাখে দেওয়ানহাট ফায়ার সার্ভিসের ভিতর। এখানে পাকবাহিনীর একটি বড় ধরনের ক্যাম্প রয়েছে। ভদ্রলােকটি কর্ণফুলী বাজার থেকে সওদা নিয়ে ফিরেছিলেন। ফায়ার ব্রিগেডের সামনে দিয়ে যেতেই দু’জন পাকসেনা তার ব্যাগ চেক করে। কিছুই পায়নি। তারপরও ভিতরে নিয়ে যায়। ভদ্রলােককে মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যকারী মনে করে আটক রেখেছে। ফায়ার ব্রিগেডের চাকুরে আব্দুল মােত্তালেব সুকৌশলে বন্দির সাথে দেখা করে সমস্ত ব্যাপারে জেনে নেয়। বন্দি মােঃ আবুল বশরবন্দরে চাকুরি করেন। বাড়ি সিলেট। থাকেন ধনিয়া পাড়ায়। বাসায় স্ত্রী, এক মেয়ে ও এক ছেলে। ছােট্ট সুখী সংসার। মেয়ে সুমীর বয়স ষােল। ছেলের বয়স বারাে। মেয়েটি নাসিরাবাদ সরকারী কলেজের প্রথম বর্ষের ছাত্রী। ছেলেটি চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলের ৭ম শ্রেণীর ছাত্র। সুমী দেখতে সুন্দরী ।
কিছুদিন আগে ইয়াকুব খান নামক একজন যুবক তার বাসায় আসে। দ্রলােকের সাথে কথাবার্তা বলে চলে আসে। প্রথম ঘুরঘুর করতে শুরু করে। এতে বশর সাহেবের স্ত্রী ভীত হয়ে পড়েন। তিনি স্বামীকে সব কথা খুলে বলেন। সে রাতেই পাকহানাদাররা ইয়াকুব খানের সহযােগিতায় ঐ অঞ্চল ঘেরাও করে তল্লাশি শুরু করে। বশর সাহেবের বাসায় তালা ঝুলতে দেখে। তালা ভেঙ্গে দেখে পাখি পালিয়েছে। তিনদিন পর বশর সাহেব ফিরে এলেন। বাসার সব লুট হয়ে গেছে। আশে পাশের মানুষের সহযােগিতায় তিনি থাকতে শুরু করেন। এভাবে কেটে যায় ক’দিন। সেদিন ছিল ৩রা ডিসেম্বর। তিনি এলেন কর্ণফুলী বাজারে। সামান্য কিছু কিনতে। পথেই দেখা সেই ইয়াকুব খানের সাথে। তার ইঙ্গিতে পাকসৈনিকের দু’জন এসে তাকে ধরে নিয়ে আসে ক্যাম্পে। বন্দি করে রাখে অন্ধকার ঘরে। চলে অত্যাচার, নির্যাতন। অত্যাচারের প্রথম পর্যায়ে সুমী কোথায় জানতে চায়। তাদের ধারণা সুমীকে শহরের কোথাও লুকিয়ে রেখেছেন। সুমীকে এনে দিলে তাকে ছেড়ে দেয়া হবে।
পিতার নিকট থেকে কন্যার সংবাদ পেতে ব্যর্থ হয়ে বর্বর হানাদারবাহিনী আরাে ক্ষেপে যায়। অত্যাচার তীব্র থেকে তীব্রতর হয়। অবশেষে অর্ধমৃত অবস্থায় বন্দিকে শিবিরে ফেলে রাখা হয়। প্রচুর রক্তক্ষরণে বশর সাহেব মারা যান। কন্যার ইজ্জত রক্ষা করতে যেয়ে পিতা প্রাণ দিলেন। এ সংবাদ আব্দুল মােত্তালেব মাধ্যমে পৌছে গেলে পানওয়ালাপাড়া সবুজবাগের শেল্টারে। ক্ষিপ্ত হলেন মুক্তির সৈনিকরা। যথাসময়ে বসলেন তারা। সর্বজনাব বাফসার উদ্দীন, মৌলভী সৈয়দ আহমদ, আবু সাইদ সরদার, ডাঃ মাহফুজ রহমান, এনামুল হক দানু, আব্দুল্লা আল-হারুন, ডাঃ মাহবুব, ডাঃ জাফর উল্লাহ মােহাম্মদ হারেস, জালাল উদ্দিন আহমেদসহ আরাে ক’জন বৈঠকে বসেন। সিদ্ধান্ত হল। বিভিন্ন গ্রুপের সূর্য সৈনিকদের সাথে যােগাযােগ হল। প্রয়ােজনীয় সামগ্রী জোগাড় করা হল। সমস্যা দেখা দিলে পাকসৈনিকদের পােষাক নিয়ে। কারণ যারা ফায়ার ব্রিগেডের ভিতরে প্রবেশ করবে তাদের পাকসৈনিকদের পােষাক পরেই যেতে হবে। যেন প্রথম পলকে কেউ বুঝতে না পারে।
দেখেই যেন মনে করে পাকসৈনিক। রাত দু’টা ত্রিশ মিনিট। মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন দল এগিয়ে আসছে। আগ্রাবাদ অঞ্চলের শেল্টার থেকে এসেছে ক’টি দল। ফজলুল হক, অমল মিত্র, জাফর উল্লাহ বােরহান, জাহিদ হােসেন, ফয়েজুর রহমানের নেতৃত্বে ক’টি দলে মুক্তিযােদ্ধারা ফায়ার ব্রিগেডকে ঘিরে ফেলেছে। কেউ অবস্থান নিয়েছে উত্তর দিকে, কেউ অবস্থান নিয়েছে ফায়ার ব্রিগেডের সামনে মসজিদের কোণে, কেউ কায়েদে আযম রােডের বিভিন্ন দোকানের পাশে আবার কেউ বংশাল পাড়ায় মুসলিম খান ও গফুর খান সওদাগরের বাড়িতে। হারুন গ্রুপ ও লােকমান গ্রুপের ক’জন ভারী অস্ত্র নিয়ে প্রকাশ্যে রাস্তায় এ্যাম্বুস বসিয়েছে। ফায়ার ব্রিগেডের সামনের অংশ আক্রমণের দায়িত্ব নিয়েছিলেন অমল মিত্র, ফজলুল হক, জাফর উল্লাহ, বােরহান, মফিজুর রহমান, জাহিদ হােসেন, হারুন গ্রুপ ও লােকমান গ্রুপ। তারা কায়েদে আজম রােডের বিভিন্ন আনাচে-কানাচে এমন ভাবে অস্ত্রসজ্জিত করে বসেছিলেন যদি পাকবাহিনী ফায়ার ব্রিগেডের সামনে দিয়ে বেরিয়ে আসে তাহলে সবার জন্য এটাই হবে কবরস্থান।
অমল মিত্র, ফজলুল হক ও জাফর উল্লাহ বােরহান অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করেন। বংশাল পাড়ায় যারা অবস্থান নিয়েছেন তাদের নেতৃত্বে রয়েছেন ফয়েজুর রহমান। তারা ফায়ার ব্রিগেডের মূল ভবনে প্রবেশ করে অপারেশন সম্পন্ন করবে। আর একই সময়ে অমল মিত্র, ফজলুল হক, জাফর উল্লাহ বােরহান ফায়ার ব্রিগেডের মূল ভবনের গেইটে গার্ডদের নিরস্ত্র করে সেই কক্ষে বিস্ফোরক বসাবে। সময়ে গড়িয়ে চলেছে। হঠাৎ করে ফায়ার ব্রিগেডের কারেন্ট চলে গেল। বংশাল পাড়ার গােপন শেল্টার থেকে দ্রুত বেরিয়ে পরেন ফয়েজুর রহমান, গরীব উল্লাহ, শফিসহ আরাে ক’জন। তাদের সহযােগিতা করেন নুরুন নাহার বেগম ও আনােয়ার হােসেন। তারা ফায়ার ব্রিগেডের পূর্বদিকের বড় ড্রেনের মধ্য দিয়ে প্রবেশ করেন জনাব মােত্তালেবের বাসায়। তিনি ফায়ার ব্রিগেডের একজন চাকুরে। তাদের পরনে সামরিক পােষাক। আব্দুল মােত্তালেব স্থানীয় লন্ড্রী থেকে পাকবাহিনীর পােষাক সংগ্রহ করে দিয়েছেন। তার প্রয়ােজনীয় নির্দেশে নিয়ে তারা বের হলেন। চারদিকে অন্ধকার।
কৌশলে তারা উঠে গেলেন দোতলায়। পাকবাহিনীর গার্ডরা তখন কেউ ঘুমাচ্ছে, কেউ ঝিমুচ্ছে। পা টিপে টিপে উপরে ওঠে তারা বসাল প্রায় ১০ পাউড বিস্ফোরক । এদিকে অমল মিত্রের নেতৃত্বে সম পরিমাণ বিস্ফোরক বসানাে হয়েছে বাইরের গার্ড রুমে। গার্ডদের নিরস্ত্র করে একাজ সম্পন্ন করেছে। ফয়েজুর রহমান, গরীবউল্লাহ দ্রুত চলে এলেন ড্রেন পেরিয়ে বংশাল পাড়ায়। আসার সময় বিস্ফোরক কর্ডে আগুন ধরিয়ে দিয়ে আসেন। রাত ৩-২৫ মিনিটে প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটে। পর পর প্রচন্ড বিস্ফোরণ। একটি ভিতরে, অন্যটি গেইটে। মুসলীম খান পূর্বেই বিদ্যুৎ বিভাগের সাথে যােগাযােগ করে ঐ সময়ে কারেন্ট বন্ধ করে দিয়েছেন। প্রচন্ড বিস্ফোরণে পাকবাহিনীর ঘাবড়ে যায়। তারা সবাই জেগে উঠে। পুরাে এলাকা কেঁপে ওঠে। অন্ধকারে পাকবাহিনীর এদিকে-ওদিকে ছুটতে শুরু করেছে। কায়েদে আজম রােডে এ্যাম্বুস গ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা অপেক্ষায় পাকবাহিনী বেরিয়ে আসলে তীব্র আক্রমণ করা হবে। অধীর আগ্রহে বসে রয়েছেন সবাই। কিন্তু পাকবাহিনী ভীত হয়ে রাস্তায় আসেনি। ক্যাম্পের ভিতর থেকে শূন্যে ফায়ার করতে থাকে। ( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত