You dont have javascript enabled! Please enable it! মাধবপুরে প্রতিরােধ যুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
মাধবপুরে প্রতিরােধ যুদ্ধ
 
প্রতিরােধ ব্যবস্থা গড়ে তােলার ক্ষেত্রে মাধবপুর হচ্ছে বেশ উপযােগী এলাকা। হরিণবেড়ের কাছে তিতাসের প্রশস্ত বাঁক। বিশাল এবং বিস্তৃত এর নিম্নাঞ্চল। বর্ষাকাল ছাড়া অন্যান্য মওসুমে শুষ্ক, ভগ্ন এবং তরঙ্গিত। মাধবপুরের পূর্বপাশে আন্তজাতিক সীমান্ত। এটি হচ্ছে একটি বিচ্ছিন্ন এবং সংকীর্ণ এলাকা যেখানে সহজেই প্রতিরােধ যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়া যায়। | মাধবপুরে আমার সৈন্যরা প্রতিরােধ তৈরির জন্যে প্রস্তুতিকালে শাহবাজপুরে একটি অস্থায়ী ব্যবস্থা নেয়া হয়। সেখানকার সেতুটি উড়িয়ে দেয়া হয় এবং ক্যাপ্টেন মতিনের ইপিআর সৈন্যদের মাধ্যমে গঠিত কোম্পানীকে মােতায়েন করা হয়। ১৫ই এপ্রিল আশুগঞ্জ থেকে আসার পরে শক্ররা নিশ্চিত হয়ে যায় যে, আমরা পিছু হটে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অবস্থান নেব। দু’দিন ধরে ওরা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় গােলাবর্ষণ করে। তারপর শাহবাজপুরের দিকে এগােয়। আমরা শত্রুপক্ষের উপস্থিতি জানতে পারি। শাহবাজপুরে সুদৃঢ় প্রতিরােধ ব্যবস্থা আগেই নেয়া হয়েছে। নদীবক্ষ থেকে সব ধরনের নৌকা অপসারণ করা হয়। আমাদের সৈন্যদের ফেরী পারাপারের জন্যে শুধু একটি নৌকা রাখা হয়। ২১ই এপ্রিল শত্রুরা দুব্যাটালিয়ন শক্তি নিয়ে নৌ এবং সড়ক পথে এগিয়ে আসে। এর সাথে চলে গােলন্দাজ গােলাবর্ষণসহ বিমান আক্রমণ। বিমান আক্রমণের ফলে সৈন্যরা সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। অথচ তাদেরকে প্রতিরােধ করার মতাে আমাদের হাতে কিছুই নেই। ২১ এপ্রিল, পাকিস্তানী সৈন্যরা শাহবাজপুরে দখল করে।
আমার সৈন্যরা তাদের অগ্রযাত্রা বিলম্বিত করে দিয়ে মাধবপুরে চলে যায়। আমাদের প্রতিরােধ অবস্থান চান্দুরাইটাখােলা সড়কে। এখানে সােনাই নদী পূর্ব থেকে পশ্চিমে এলাকাটিকে দু’ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছে। আমাদের অগ্রবর্তী প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে সােনাই নদীর লাগােয়া এলাকা। ডান পাশে ক্যাপ্টেন মতিন কৈতরা গ্রামে তার কোম্পানীকে মােতায়েন করে। ক্যাপ্টেন নাসিম সেতু রক্ষার দায়িত্বে নিয়ােজিত। নাসিমের কোম্পানীকে দেয়া হয় তিনটি ৮২ মিলিমিটারী মর্টার। সুবেদার মুজিবুর রহমানকে তার ইপিআর কোম্পানী নিয়ে দু’টি শাখায় বিভক্ত রাস্তার মােড়ে অবস্থান করার নির্দেশ দেই। উদ্দেশ্য হচ্ছে ক্যাপ্টেন নাসিম এবং ক্যাপ্টেন মতিনকে সম্ভাব্য ক্ষেত্রে পেছনে ফেরার সুযােগ করে দেয়া। আরাে পেছনে লেঃ মান্নানের নেতৃত্বে হেলিকপ্টারে অবতরণকৃত সৈন্যবিধ্বংসী একটি প্ল্যাটুনকে মােতায়েন করা হয়।
তেলিয়া পাড়া শিবির থেকে প্রেরিত প্রথম ব্যাচ-এর প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বিভিন্ন উপাদানে গঠিত একটি প্ল্যাটুনের নেতৃত্বে লেঃ মােরশেদকে পাঠিয়ে দিই শাহবাজপুরে শক্রদের নির্মিত সেতুবন্ধের পরিস্থিতি নির্ণয়পূর্বক আকস্মিভাবে হানা দেয়ার জন্যে। এপ্রিল ২৬/২৭ তারিখে রাতের অন্ধকারে প্ল্যাটুনটি সাফল্যের জন্য যুদ্ধ করে। উক্ত তৎপরতায় পাকিস্তানবাহিনীর কিছু সংখ্যক হতাহত হয়। ২৮শে এপ্রিল, সকাল ৮টায় মাধবপুরে আমাদের অবস্থানে গােলন্দাজ বাহিনী গােলাবর্ষণ করে। ওরা উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরকসহ আগুনে বােমার বেপরােয়া ব্যবহার করে। আমাদের প্রতিরক্ষার চারদিকে ভয়াবহ অগ্নিকান্ড শুরু হয়। খোঁজ-খবর নিয়ে শক্রদের প্রধান অংশ দুপুর ১২ টায় আমাদের এলাকার সামনে এসে দাঁড়ায়। ওরা তিনটি কলামে বা দলবদ্ধ হয়ে আক্রমণ করে। একটি কলাম ডান পাশে ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানীকে, আরেকটি কলাম অগ্রবর্তী দুটি কোম্পানীর মাঝামাঝি স্থানের দিকে আক্রমণ চালায়। তৃতীয় কলামটি ক্যাপ্টেন নাসিমের ওপরে সামনাসামনি আক্রমণ করে। এভাবে সূত্রপাত হয় ব্যাটালিয়নের মুখােমুখি তৎপরতা। তার পেছনেই অনুসরণ করে আরেকটি পাকিস্তানী ব্যাটালিয়ন। বিশেষভাবে তৈরি পরিখা থেকে আমার সৈন্যরা এলএমজি মটার এবং রাইফেল নিয়ে আক্রমণ প্রতিহত করে। যুদ্ধে আমাদের মটার-ডিটাচমেন্ট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। শক্রদের মধ্যবর্তী কলাম ক্যাপ্টেন নাসিম এবং ক্যাপ্টেন মতিনের সম্মিলিত অবস্থানে ভাঙ্গন সৃষ্টি করে। আমাদের দুটি কোম্পানীই শক্রদের ঢেউয়ের পরে ঢেউয়ের মতাে আক্রমণ ক্ষমতা খর্ব করে দেয়। যা হােক, শক্ররা প্রচন্ড ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও ডানদিকে অগ্রসরমান ক্যাপ্টেন নাসিমের প্ল্যাটুন এবং বামদিকে এগিয়ে যাওয়া ক্যাপ্টেন মতিনের প্ল্যাটুনের মধ্যবর্তী স্থান দিয়ে আংশিকভাবে ভেতরে ঢুকে যায়।
বেলা ৩ টায়, এ কলামটি আরাে উত্তর দিকের অভ্যন্তরে আসে এবং ডান পাশের প্রধান সড়কে মােড় নিয়ে ক্যাপ্টেন নাসিমের অবস্থানে আঘাত করে। এ অবস্থায় অগ্রবর্তী দুটি কোম্পানীর পারস্পরিক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। আক্রমণকারী সৈন্যদের প্রবল চাপে ক্যাপ্টেন মতিনের বাম পার্শ্বের অবস্থান ভেঙ্গে যায় এবং তার অবস্থান অকেজো হয়ে পড়ে। শক্র পরিবেষ্টিত হওয়ার আশংকায় আমি তাদের পিছনে সরে যাবার নির্দেশ দিই। বেলা ১১ টায় এ ধরনের পরিস্থিতির সম্ভাবনায় আমি লেঃ মােরশেদের রিজার্ভ প্ল্যাটুনকে শক্রর ডান পার্শ্বদেশে আক্রমণ করার নির্দেশ দিই। শত্রু যখন ক্যাপ্টেন নাসিম এবং ক্যাপ্টেন মতিনের মধ্যকার এলাকায় ঢুকে পড়ার উদ্যোগ গ্রহণ করে তখন আলীনগর গ্রাম থেকে শক্রর ডানদিকের পেছনের পার্শ্বদেশে আক্রমণ পরিচালনা করে। এর ফলে শত্রুর সম্মুখ আক্রমণ প্রতিহত হয় এবং সৈন্যদের পেছনে হটে যাবার সুযােগ সৃষ্টি হয়। এটি হচ্ছে একটি জীবনরক্ষাকারী অভিযান যা লেঃ মােরশেদ চমৎকারভাবে সম্পন্ন করে।
ক্যাপ্টেন মতিনের অবস্থানের সবচে’ হিংস্র যুদ্ধ আকস্মিকভাবে থেমে যায়। পরে বুঝতে পারি ক্যাপ্টেন মতিনের রিজার্ভকৃত যুদ্ধসরঞ্জাম নিঃশেষ হয়ে গেছে। ব্যাটালিয়ন সদর দফতর বেতার যােগাযােগের অভাবে কোনাে সাহায্য পাঠানাের ব্যবস্থা করা যায়নি। এ দূরবস্থার সুযােগ নিয়ে পাকিস্তানবাহিনী ক্যাপ্টেন মতিনের পেছনে সমাবেশ করে। এর ফলে তার সৈন্য প্রত্যাহার করার মতাে সুযােগও আর ছিল না। এ অবস্থায় ভাগ্য আমাদের প্রতি সুপ্রসন্ন হয়। লক্ষ্য করলাম পাকিস্তানীরাও পশ্চাদপসরণ করছে। অর্থাৎ ওদের অবস্থাও একই ধরনের। পলায়মান পাকিস্তানবাহিনীর একটি দল ক্যাপ্টেন মতিনের প্রতিরক্ষা অবস্থানে ঢুকে পড়ে। শুরু হয় হাতাহাতি যুদ্ধ। ক্যাপ্টেন মতিনের কোম্পানীর সিপাহী মফিজ শত্রুদের ১৪ জনকে হতাহত করে। এ যুদ্ধে আমার সৈনিকরা দৃষ্টান্তমূলক সাহস এবং দৃঢ়তার পরিচয় দেয়। সাহস এবং কর্তব্যের প্রতি নিবেদিত মানসিকতা প্রদর্শনের কারণে ক্যাপ্টেন নাসিম, ক্যাপ্টেন মতিন, লেঃ মােরশেদ এবং শাহজাহান (শহীদ), মফিজ এবং ওয়াহেদ-এর নাম বিশেষভাবে উল্লেখ করতে হয়। এছাড়া আমদের কয়েকজন হতাহতও হয়েছে। এ যুদ্ধে পাকিস্তানীদের ২৭০ জনের মতাে নিহত এবং আহত হয়।
(সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ, মেজর জেনারেল কে এম শফিউল্লাহ, বীর উত্তম )

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত