You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.04 | নগরকান্দা থানা আক্রমণ ও বন্ধুক উদ্ধার - সংগ্রামের নোটবুক
নগরকান্দা থানা আক্রমণ ও বন্ধুক উদ্ধার
নগরকান্দা থানার অস্ত্র উদ্ধারের পর নয় দশদিন পর্যন্ত থানায় কোন পুলিশ আসেনি। অতঃপর ওসি কার্ত্তিক বাবু মিলিটারীর সাথে হাত মিলিয়ে কিছু পুলিশ নিয়ে আবার থানায় এলেন। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে কোন রাইফেল আনতে সাহস পাননি। আমাদের এলাকার সিভিলগান কৌশলে থানায় জমা নিতে চেষ্টা করছিলেন কার্তিক বাবু। কিন্তু তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়। যা হােক, পাকমিলিটারীর নির্দেশ অনুসারে তকালীন ভাঙ্গার সার্কেল ইন্সপেক্টর সিভিলগান থানায় জমা দিতে বললেন। এই সংবাদ পেয়ে আজিজ মােল্লা পুনরায় থানা আক্রমণ করে সমস্ত সিভিলগান উদ্ধারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন। ১৯৭১ এর ৪ঠা মে। প্রায় ৪০ জন মুক্তিবাহিনী নিয়ে নগরকান্দা থানা আক্রমণের জন্য রওয়ানা হলাম। পরিকল্পনা মতাে আমি কিছু পূর্বেই নগরকান্দা পৌছেছিলাম। আমার কাজ ছিল পােষ্ট অফিস থেকে টেলিফোনের লাইন কেটে ফরিদপুরে অবস্থানরত পাকসেনাদের সাথে সহজে যােগাযােগের পথ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। আমি গিয়ে পােষ্ট মাষ্টারের সাথে আলাপ করতে লাগলাম। কিছুক্ষণ পর দেখি লােকজন দিকবিদিক ছুটোছুটি করছে। পােষ্টমাষ্টার ভয়ে এতটুকু হয়ে গেলেন। আমি তাকে অভয় দিয়ে বললাম, মুক্তিবাহিনী আমাদের লােক।’ মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা থানায় এসে পুলিশদের হ্যান্ডস-আপ করাচ্ছিল। আমি তাড়াতাড়ি থানায় গিয়ে সিপাইদেই থানা ত্যাগ করার নির্দেশ দিলাম। মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা সিআই সেকেন্ড অফিসার ও একজন জমাদার এবং সার্কেল অফিসারকে (উন্নয়ন) গ্রেপ্তার করে। আমি ওসি কার্তিক বাবুর খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম তিনি নদীর কূল বেয়ে দৌড়ে পালিয়ে গেছেন। ওই দিন যদি কার্তিক বাবু ধরা পড়ত তাহলে তার অবস্থা কি হত তা অতি সহজেই অনুমেয়। আমরা থানা হতে ২৫টি সিভিলগান, একটি রিভলবার, কয়েকটা ৩০৩ রাইফেলের গুলি এবং খাকী রঙয়ের বেশ কিছু পােশাক উদ্ধার করি। পােষ্ট অফিস থেকে টেলিফোন রিসিভার এনে থানার সামনে পুকুরে ফেলে দিলাম ।
আমাদের এসব কাজ করতে প্রায় আধ ঘন্টার মতাে সময় লাগল। আমরা তাড়াতাড়ি ওখান থেকে ফিরে আসি। আসার সময় পূর্বে গ্রেপ্তারকৃত জমাদারকে ছেড়ে দেয়া হয়। কিন্তু আমাদের সাথে ভাঙ্গা থানার মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা সিআইকে ছেড়ে দিতে রাজি হল । পাকবাহিনীর দালাল বলে তাকে রাতে গুলি করে হত্যা করে। থানা আক্রমণ করার সময়ই বুঝতে পেরেছিলাম পরের দিন খান সেনারা এখানে আক্রমণ করবে। কাজেই আমরাও ওদের আক্রমণ প্রতিহত করার প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিলাম। ৪ঠা মে রাত্রিবেলা তালমার নিকটবর্তী খালের উপর ব্রীজের দুই পার্শ্বের রাস্তা কেটে দেওয়ার মতলব করি। কিন্তু রাতে অতদূর এসে ঝুঁকি নিয়ে রাস্তা কাটার জন্য সাহসী লােক পেলাম না। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের দুই দলে বিভক্ত করে একদল মেঘারকান্দি ক্যাম্প রক্ষার জন্য এবং অন্যদল নিয়ে রাত প্রায় দশটার দিকে লস্করদিয়া অভিমুখে রওয়ানা হই। আমাদের দলে ছিল সব দক্ষ মিলিটারী ও ইপিআরের লােকজন। সিদ্ধান্ত হয়েছিল জপরখালীর পশ্চিম পাড়ে ওবায়েদ ভাইদের বাড়ির নিকট ভাল জায়গা দেখে ডিফেন্স পজিশন ঠিক করা। ফরিদপুর হতে খানসেনারা গাড়িতে করে জেলা বাের্ডের রাস্তা দিয়ে যাবার সময় তাদের উপর হামলা করার জন্য এ জায়গায়-ই ছিল বেশ উপযােগী। রাত প্রায় তিনটার সময় আমরা লস্করদিয়া এসে পৌছেছিলাম। জপরখালীর পশ্চিম পাড়ে বটগাছের নিকট ডিফেন্স পজিশন ঠিক করে ট্রেঞ্চ কাটার জন্য কোদাল আনার উদ্দেশ্যে ওবায়েদ ভাইদের বাড়ি গিয়ে ঝামেলায় পড়তে হল। ঐ বাড়িতে কোন লােকজন ছিল না বললেই চলে। কেননা পূর্বেই খানসেনাদের ভয়ে মেয়ে-ছেলে সবাই অন্যত্র চলে গেছেন। ওবায়দুর রহমানের ছােট দুই ভাই তারু ও জামানের সাথে দেখা হল। তারুও অন্যত্র ছিল। আমাদের সংবাদ পেয়ে দেখা করতে আসে। খবর পেয়ে ঐ গ্রামের বেশ কিছু লােক আমাদের কাছে আসে।
আমাদের দেখে প্রথমে সবাই ট্রেঞ্চ খননের জন্য কোদাল যােগাড় করে দিয়ে গেলে তখনই তাদের মুখ শুকিয়ে গেল। তারা ওখানে ডিফেন্স পজিশন না নেওয়ার জন্য বার বার অনুরােধ করতে লাগল ও বলল, যদি আপনারা ওখানে ডিফেন্স নিয়ে আক্রমণ করেন তবে প্রথমে খানসেনারা না পারলেও পরে ভারীভাবে আক্রমণ করলে আপনারা তাে পালিয়ে যাবেন। কিন্তু ওরা তাে আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেবেই এবং যাকে পাবে তাকেই গুলি করে মারবে।’ আরও বলল, আপনারা ভাের হওয়ার পূর্বেই এখান থেকে পালিয়ে যান। ভােরে যদি কেউ দেখে এবং দালালদের কানে একথা পৌঁছায় তাহলেও বিপদের ভয়। একে তাে ওবায়দুর রহমানের গ্রাম তারপর যদি আপনারা এই সব করেন তাহলে আমাদের আর বিপদের সীমা থাকবে না। স্থানীয় লােকজনের ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনকিছু করা সম্ভব হল না। দলের কেউ কেউ বলল, একে তাে ভিন্ন এলাকা, দ্বিতীয়ত স্থানীয় জনগণ এ সবে ভয় পাচ্ছে। এখানে আর থাকা সম্ভব নয়। প্রায় ভাের হয়ে আসছিল। সবাইকে নিয়ে রওয়ানা হলাম।
বিনােকদিয়া হাটে পৌছলে ভাের হয়। অতঃপর কয়েকখানা নৌকা নিয়ে নদীপথে রওয়ানা হলাম। সকাল প্রায় সাতটা হবে। আমাদের নৌকা তখন খৈলাশপুটি খালের মধ্যে ছিল। হঠাৎ নগরকান্দা বাজারের দিকে ৩ ইঞ্চি মর্টারের ফায়ার এবং মেশিনগানের ঠাঠা আওয়াজ হতে লাগল। আমরা সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়লাম। চারদিকে হৈ চৈ রব উঠল। পাশের গ্রামের লােকজনেরা ছুটোছুটি শুরু করেছিল। মাঝিকে তাড়াতাড়ি নৌকা বাইতে বললাম। মনের গতির চাইতে নৌকার গতি সহস্রগুণ কম বলে মাঝির উপর সন্তুষ্ট হতে পারছিলাম না। কিন্তু মাঝিকে ধমক দিয়েও কিছু বলতে সাহস হচ্ছিল না। মনে হচ্ছিল নগরকান্দার সব লােকজনই বুঝি আমাদের বিরুদ্ধে। পরিচয় পেলেই যেন বিপদে পড়তে হবে। বেশ কিছুক্ষণ পরই গুলির শব্দ থেমে গেল। দেখতে পেলাম বাজারের উপর আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলছে। আস্তে আস্তে সর্বনাশী আগুনের ঘােড়াগুলি দক্ষিণ দিকে আমাদের বাড়ির দিকে দৌড়াতে শুরু করল। পুড়াপাড়া হাট পর্যন্ত পৌছবার আগেই ঈশ্বরদী গ্রামে আগুন জ্বলছিল। আগুনের সেকি ভয়াবহ দৃশ্য। সেই করালগ্রাসী বিভীষিকাময় দৃশ্যের কথা মনে উঠলে চোখের পানি রােধ করা যায় না। প্রত্যক্ষদর্শী না হলে শুধু বইয়ের ভাষায় সেই বেদনাময় ছবি বুঝানাে সম্ভব না। আমরা একসঙ্গে যারা ছিলাম একে অপরের সাথে কথা বলার শক্তি হারিয়ে ফেলেছিলাম।
পলায়নরত নীরিহ নারী-পুরুষ, আবাল-বৃদ্ধ-বণিতায় মাঠ-ঘাট ছেয়ে গেল। তারা গালাগালি করতে লাগল, মুক্তিবাহিনী না চুক্তিবাহিনী হয়েছে—এদের জন্যই আমাদের এই অবস্থা। আমরা নৌকার ছইয়ের মধ্যে লুকিয়ে রইলাম। তখন জনসাধারণের মনের অবস্থা আমাদের উপর এমন চটা যে পেলেই খতম করে। পাকসেনাদের চেয়ে তখন জনসাধারণের ভয়ই বেশি পেতে লাগলাম। পুড়াপাড়া হাটে পৌছলে মাঝিকে অস্ত্রসহ চান্দহাটে যেতে বলে দলের সবাইকে নিজ নিজ বাড়িতে যেতে বলে স্থল পথে রওয়ানা হলাম। কেউ দেখে সহজে চিনতে না পারে সেই জন্য মাথায় কাপড় দিয়ে মুড়ালাম। পুনরায় সংগঠিত না হয়ে ঐদিন আর যুদ্ধ করার মতাে অবস্থা ছিল না। কারণ অন্য দল ক্যাম্পে কি করছিল তা জানা ছিল না। আমরাও ঘটনাস্থল হতে কয়েক মাইল দূরে ছিলাম।
হানাদার বাহিনী ঐদিন মেঘারকান্দি ক্যাম্প দু’দিক থেকে আক্রমণ করছিল। নগরকান্দা ও ভাঙ্গার কুমার নদী পার হয়ে দু’দল মেঘারকান্দির দিকে আসছিল ঘরবাড়ি জ্বালাতে জ্বালাতে। হাজার হাজার লােকজন বিষয় সম্পত্তি ফেলে প্রাণভয়ে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে লাগল। ঘরবাড়ি জ্বালানাে সর্বশান্ত পালায়নরত মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট ও দুঃখের করুণ কাহিনী মনে করে আমার মন ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ছে। চোখে পানি আসছে, কথা বলার ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত এ হৃদয় বিদারক বেদনা বিধুর করুণ কাহিনী ভুলতে পারব না। ১৯৭১ সালের ৫ই মে’র দুঃখের ইতিহাস নগরকান্দা থানার ঐদিনের ক্ষতিগ্রস্ত এলাকার লােকজনের হৃদয়ে চির অক্ষয়, চির অম্লান হয়ে থাকবে। বেলা ১২টার সময় বাড়ি পৌছিলাম। সবাই বলছিল, তােমাদের বাড়ি না পুড়িয়ে পাকসেনারা যাবে না। তােমরা আবার আসছাে কেন? রাইফেল নিয়ে যাও, মিলিটারীর সাথে যুদ্ধ করে আইস।’ অর্থাৎ যে যা বলে মনে শান্তি পায় সে তাই বলতে লাগল । বিনাবাক্যে তাদের কথা করুণ চাহনিতে শুনছিলাম। বেলা ১টা নাগাদ দুই দলে পােড়াতে পােড়াতে ঝাটুরদিয়া হাটের উপর এসে কয়েকজন তােক হত্যা করে ভাঙ্গা ও ফরিদপুরের দিকে রওয়ানা হয়ে যায় হানাদার বাহিনীর দস্যুরা।  ওদের ফিরে যাওয়ার পর পরই মেঘারকান্দি ক্যাম্পের খবর জানার জন্য তােক পাঠালাম। খবরে জানলাম ক্যাম্পের অস্ত্র প্রায় ২৫টি হারানাে গেছে। শুধু ছিল সিভিলগান ও গুলির বাক্স। বাকী অস্ত্রগুলাের কোন হদীস পেলাম না। শুধু আমাদের নিকট ঐদিন যে সকল অস্ত্র ছিল ঐগুলােই সম্বল রইল। সন্ধ্যা পর্যন্ত খানসেনাদের হিংস্র ছােবলের ঘটনাবলী সব জানতে পারলাম। ঐ দিন পাকসেনারা প্রায় ৫টি গ্রাম জ্বালায় ও ৫জন লােককে গুলি করে হত্যা করে।
(সূত্র : মুক্তিযুদ্ধে বৃহত্তর ফরিদপুর, মােঃ সােলায়মান আলী)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত