অপারেশন ময়কং চায়নিজ রেস্টুরেন্ট
চারিদিকে যুদ্ধের ছায়া পড়েছে। মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা কৌশল আর পাকবর্বরদের নিরীহ মানুষের উপর আক্রমণ। সৈনিকের আদর্শ পাকবাহিনীর মাঝে নেই। ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে শপথ করেই ওরা এসেছিল সেনাবাহিনীতে। কিন্তু পদদলিত করেই চলেছে সব অঙ্গীকার। আজ তারা সৈনিক নামের কলঙ্ক। মুক্তিযােদ্ধারা আঘাত করছে বর্বরদের। উদ্দেশ্য, দেশকে মুক্ত করা। মায়ের উপর অত্যাচার ওরা সইতে পারছে না। তাই মুক্তিযােদ্ধারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে ওদের আড্ডা-আসর ভাঙ্গতেই হবে। স্থানীয় দোসরদের তথ্যকেন্দ্রের বিনাশ ঘটাতে হবে। বন্ধ করতে হবে স্থানীয় দোসরদের যােগাযােগ সূত্র। তাই তাে মুক্তিযােদ্ধারা কখনও ফকিরের বেশে কখনও আয়েশী যুবকের বেশে, কখনও রাস্তার কাজে শ্রমিক হয়ে চলাফেরা করে। পাকবাহিনীর লালসা কাতর চোখে তখন রঙিন। স্বপ্নের ছন্দ। এরই সুযােগে মুক্তিযােদ্ধারা ঝাপটে ঝাপটে ধরেছে ওদের। ভেঙ্গে দিচ্ছে পাজরের হাড়। অন্যায় করতে করতে তাদের মনােবল তখন শূন্যের কোঠায়। প্রতিদিন সন্ধ্যায় ওরা আসে। কখনও সামরিক গাড়িতে আবার কখনও টেক্সীতে করে। টেক্সীতে যখন আসে টেক্সী ভাড়া পরিশােধ করে না। টেক্সীর ড্রাইভার সাহস করে ওদের কিছু বলতে পারে না। প্রতিনিয়ত তাদের আগমনে আসকার দিঘীর উত্তর পাশের জনগণ সব সময়ই ভয়ের মধ্যে থাকে। বলা তাে যায় না কখন কি হয়ে যায়। এ ছাড়া প্রতিনিয়ত বর্বর পাকবাহিনীর ক’জন সদস্য ময়কং চায়নিজ রেষ্টুরেন্ট ঢােকার পূর্বে আশেপাশের দোকান থেকে সিগারেটের প্যাকেট নিয়ে নিত, টাকা পয়সা পরিশােধ করত ।
কেউ কোন সময় দাবী করলে তার কপালে জুটত বেয়নেটের খোঁচা অথবা অস্ত্রের আঘাত। এ কাজগুলাে করেই কিন্তু বর্বরের দল থেমে থাকেনি। পথচারীদের মধ্যে কাউকে তাদের সন্দেহ হলে ধরে নিয়ে যেত। এমন কি রাস্তার মাঝে দাঁড় করিয়ে হিন্দু না মুসলমান তা কাপড় খুলে পরীক্ষা করত। তাদের অত্যাচার সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়। আশেপাশের বাড়িগুলােতে কোন মহিলা থাকতে পারত না। স্থানীয় ক’জন দালাল প্রতিনিয়তই থাকত তাদের সাথে। তারা কোন ঘরে সুন্দরী মেয়ে আছে তা বর্বরদের জানাত। রাতের অন্ধকারে এসে তারা ঐ বাসায় হানা দিত। পাকসৈনিকরা প্রতিদিন সন্ধ্যায় ঐ ময়কং চায়নিজ রেষ্টুরেন্টে এলে সব ধরনের তথ্য স্থানীয় দালালদের নিকট থেকে পেয়ে যেত। সার্কিট হাউজে অবস্থানকারী পাকহানাদার বাহিনী তখন বেপরােয়া। প্রতিদিন এরা ধরে নিয়ে যাচ্ছে অসহায় মানুষজনদের। কেউ ফিরছে পঙ্গু হয়ে আবার কেউ লাশ হয়ে পড়ে রয়েছে ওদের বধ্য ঘরে। সার্কিট হাউজ ও ষ্টেডিয়াম হয়ে গেছে নির্যাতনের শিবির। এখানে অবস্থান নিয়ে বর্বরের দল আসকার দিঘীর পুরাে অঞ্চলে চালাচ্ছে অত্যাচার। ময়কং চায়নিজ রেষ্টুরেন্টের পশ্চিমে লালখান বাজার অঞ্চল, উত্তরে ত, ‘লমাস থেকে মেহেদীরা অঞ্চল এবং দক্ষিণে সিআর বিএ সব অঞ্চলগুলােতে তারা অমানবিক অত্যাচার শুরু করেছে। তাদের অত্যাচারের মুখে ৭০/৮০ বছরের বৃদ্ধও রেহাই পাচ্ছে না। বিশেষ করে স্থানীয় দালালরা ওদের প্রত্যহ পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে নতুন স্থানে।
ধরে নিয়ে যাচ্ছে বাঙালিদের। কাউকে আনছে মুক্তিযােদ্ধার আত্মীয় বলে। কাউকে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়দাতা বলে। কাউকে মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগী বলে। বিভিন্ন অজুহাতে । সিআরবির আব্দুল আলী পেশায় টেলিকমনিকেশন ইঞ্জিনিয়ার। তার আবাস সিআরবি সংলগ্ন পাহাড়ে। তাকে একরাতে ধরে নিয়ে আসা হল। কেন তাকে আনা হল তিনি বুঝতে পারেননি। বসিয়ে রেখেছে স্টেডিয়ামের একটি কক্ষে। প্রায় ঘন্টা দুই বসিয়ে রেখে তাঁকে নিয়ে আসা হল সার্কিট হাউজে সরাসরি মেজর আনসারির সামনে। মেজর আনসারি তখন গভীর মনোেযােগে টেবিলের সামনে নুয়ে কি যেন পড়ছিলেন। চোখ ঘুরােতেই একজন সৈনিক সেলুট দিয়ে দাঁড়াল। সৈনিকটি উর্দুতে জানাল, উনি সবাইকে চেনেন। মেজর সাহেব একটি কাগজ তার হাতে দিল। জিজ্ঞেস করল যাদের নাম এ কাগজে আছে তাদের চেনে কিনা। কাগজ পড়ে মাথা নেড়ে বলল সবাইকে তিনি চেনেন, জানেন। সবাই রেলের কর্মচারী ও কর্মকর্তা। ব্যাপার বুঝতে পেরে আলী সাহেব ঘাবড়ে গেলেন। যাদের নামের তালিকা তিন দেখলেন সবাই বাঙালি আওয়ামী লীগের সমর্থক। যুদ্ধ শুরুর প্রথম থেকেই এরা অফিসে আওয়ামী লীগ, শ্রমিক লীগের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। সম্ভবত অবাঙালি রেল কর্মচারীদের তরফ থেকে এ লিষ্ট এখানে পাঠান হয়েছে। মেজর আনসারী তার সাথে ভাল ব্যবহার করল। তিনি এর কারণও বুঝতে পারলেন। তাকে ব্যবহার করা হচ্ছে এবং হবে। না বুঝার ভান করে তিনি চুপ করে বসে আছেন। এমন সময় সে কক্ষে প্রবেশ করল সিআরবি অঞ্চলের এক বখাটে অবাঙালি যুবক। তার নাম মনে করতে পারেননি।
সে কক্ষে প্রবেশ করেই দ্রুত বাইরে চলে গেল। সাথে গেল আর একজন সৈনিক। তারা দু’জন আড় চোখে মােঃ আলী সাহেবকে দেখল। আড়ালে শুনতে পেল যিতু, মিতুর কথা। যিতু ও মিতু আলী সাহেবের কন্যা। তারা সরকারী মহিলা কলেজে আইএ ও বিএ শ্রেণীর ছাত্রী। তার অন্তরাত্মা কেঁপে উঠল। তিনি মনে মনে আল্লাহকে ম্যানেজারের টেবিলে এলেন। বয়কে ডেকে বললেন, দশ পনর মিনিট পর খাওয়া সার্ভ করতে। কারণ বাকী ৩জন এলে খাবে। তারা দোকান থেকে সিগারেট আনার ভান করে। বেরিয়ে এল। দূরে দাড়ান টেক্সীতে দ্রুত উঠে গেল। কেউ কিছু বুঝতে পারেনি। মাত্র স্বল্প সময়ের ব্যবধান। প্রচন্ড বিস্ফোরণ ঘটল। ময়কং চায়নিজ রেষ্টুরেন্ট চোখের পলকে ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেল। এ অপারেশনটি অত্যন্ত সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছেন জনাব মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, ডাঃ মুলকুতুর রহমান, আহমদ উল্লাহ, আবুল কালাম যিনি টেক্সী ড্রাইভারের ভূমিকায় ছিলেন। এ দুঃসাহসী অভিযান পাকহানাদারদের যত্রতত্র যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করে। তারা ভীত হয়। বুঝতে পারে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আশেপাশেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেদিনের এ অপারেশন সার্কিট হাউজে অবস্থানকারী পাকসৈনিকরা ভীষণ ভয় পেয়েছিল। এছাড়াও তাদের দোসররা প্রকাশ্যে অত্যাচার বন্ধ করে। আশেপাশের এলাকায় প্রতিরাতে যে অত্যাচার করত তা সাময়িরকভাবে বন্ধ করে দেয়। ময়কং চায়নিজের আস্তানা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ হয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধাদের এ অপারেশন শহরে অবস্থিত অন্যদের মনােবল বাড়িয়ে দেয়। অপর দিকে হানাদার গােষ্ঠীরা বুঝে নেয় মুক্তিযােদ্ধাদের রণ কৌশল। তাদেরকে আর দুর্বল ভাবা ঠিক নয়।
(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত