This is a temporary draft copy to collect quotations for other posts.
প্রথম সংস্করণ প্রণয়নে
কৃতজ্ঞতা
আমার প্রথম গ্রন্থ বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১। জান্নাতবাসিনী স্ত্রী ইসমাতের স্মৃতি বইটি লেখায় প্রেরণা জুগিয়েছে। ছেলে জামিল; তিন মেয়ে মুনমুন, মিতু ও মুক্তি আমাকে সব সময়েই লেখার তাগিদ দিয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় ওরা আমার সাথেই ছিল। ছােট মেয়ে মুক্তির জন্ম ১৯৭১ সালে। স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতির প্রতি আমার পরিবারের সদস্যদের বিশেষ দরদ রয়েছে।
আমার এবং শহীদ কর্নেল এস. এ. হাইয়ের নাতনী প্রিয়াংকাকে আমেরিকায় তার স্কুল থেকে মুক্তিযুদ্ধের ওপর একটি রচনা লিখতে বলা হয়। মুক্তিযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণের কথা নাতনী জানত। সে আমাকে তথ্য দিয়ে সহযােগিতা করতে বললে আমি ঢাকা থেকে ইমেইলে বিভিন্ন ঘটনা লিখে পাঠাতাম। আমার লেখার সূত্রপাত তখনই। তিন জামাতা সাদেক, আশফাক ও হাবিব আমাকে সময়-সময় এই বই লেখায় উৎসাহ দিয়েছে।
এক দশকেরও আগে আগামী প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী ওসমান গনি আমাকে স্বাধীনতাযুদ্ধ এবং প্রবাসী বিপ্লবী সরকারকে কেন্দ্র করে বই লিখতে অনুরােধ করেছিলেন। তাঁর সেই অনুরােধ আমি ভুলিনি। বই লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে তার নানাবিধ উপদেশ ও পরামর্শে, বিশেষ করে কারিগরি বিষয়ে আমি যথেষ্ট উপকৃত হয়েছি।
গত কয়েক মাস যাবৎ প্রায় সার্বক্ষণিকভাবে আমাকে সাহায্য করেছেন আমার দুই অনুজপ্রতিম সহকর্মী আশফাক-উল-আলম এবং কাজী আবু জাফর সিদ্দিকী। বই লেখার বিভিন্ন দিক, এমনকি বানান ও ভাষা সম্পর্কেও তারা উভয়ে আমাকে সবসময় সহায়তা দিয়েছেন। বইপত্র, আমার পুরােনাে নথি ঘেঁটে গবেষণা করার মতাে কঠিন কাজটিও এঁরা করেছেন। প্রাথমিক সম্পাদনার কাজ আশফাক-উল-আলম করে দিয়েছেন। স্বাধীনতা আর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শের প্রতি নিবেদিতপ্রাণ এই দুই ব্যক্তির প্রতি আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকব।
বই লেখার বিভিন্ন পর্যায়ে নানা বিষয়ে শ্রদ্ধেয় জ্যেষ্ঠ সহকর্মী এ.এম.এ. মুহিতের সাথে আলােচনা করে আমি উপকৃত হয়েছি। অনেক তথ্য তিনি আমাকে দিয়েছেন এবং প্রকৃত তথ্য সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ করেছেন। আমার প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর রেহমান সােবহানও মুক্তিযুদ্ধ কালের অনেক না-জানা ঘটনা বলেছেন আমাকে। মুহিত ভাই এবং প্রফেসর সােবহানের দেওয়া তথ্য আমার বইকে সমৃদ্ধ করেছে।
মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মূল সমর-পরিকল্পনাকারী এয়ার ভাইস মার্শাল এ.কে. খন্দকার বীর-উত্তম অনেক বিষয়ে তথ্য দিয়ে, আলােকপাত করে আমাকে সাহায্য করেছেন। লেখার নানা পর্যায়ে বিশিষ্ট কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা এবং আমার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীর সাথে আলােচনা করে প্রভূত উপকৃত হয়েছি। সামারিক বাহিনী সদস্য যাদের নাম মনে আছে তারা হলেন মেজর জেনারেল কে. এম. সফিউল্লাহ (অব.) বীর-উত্তম, মেজর জেনারেল হারুন আহমেদ চৌধুরী (অব.) বীর-উত্তম, মেজর জেনারেল সুবিদ আলী ভূইয়া (অব.), ব্রিগেডিয়ার জেনারেল খালিকুজ্জামান (অব.), ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল শামসুদ্দীন আহমেদ (অব.) প্রমুখ। আমার সহকর্মীদের মধ্যে বন্ধুবর মঞ্জুরুল করিম, আ. ন. ম. ইউসুফ, ড. সৈয়দ আবদুস সামাদ, সৈয়দ রেজাউল হায়াত, ড. সা’দত হুসেইন, ড. তৌফিক এলাহী চৌধুরী বীরবিক্রম, এবং আরও অনেকে আমাকে বিভিন্ন পরামর্শ দিয়ে, আলােচনা করে সাহায্য করেছেন।
নিরলস পরিশ্রম, উৎসাহ আর ধৈর্য সহকারে আমার দুই ব্যক্তিগত সহকারী কমল কুমার দাস এবং আমিনুল ইসলাম (রবি) এই বইটি একাধিকবার টাইপ করেছেন। পাণ্ডুলিপির প্রথম অংশ টাইপে রবির অবদান অনস্বীকার্য। পরে সম্পূর্ণ কাজ করেছে কমল। এরা দুজন মনেপ্রাণে আমার গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রণয়ন প্রকল্পের অংশীদার। এছাড়া আমাদের প্রতিষ্ঠান পাথমার্ক অ্যাসােসিয়েটস লিমিটেড-এর অন্যান্য সহকর্মী এই গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রণয়নে বিভিন্নভাবে সহযােগিতা করেছেন। তাদের নিকট আমি কৃতজ্ঞ।
টাইপকৃত পাণ্ডুলিপিকে গ্রন্থাকারে রূপদান এবং প্রত্যেক পৃষ্ঠার অঙ্গসজ্জার কাজ আগামী প্রকাশনীর কর্মীবৃন্দ যত্নের সঙ্গে করে দেওয়ায় তাঁদের প্রতি আমি কৃতজ্ঞ রইলাম। গ্রন্থটি প্রকাশের শেষ পর্যায়ে আগামী প্রকাশনীর ওসমান গনি নিজেও পরামর্শ প্রদান করে এর সৌষ্ঠব বৃদ্ধিতে সহায়তা করায় তাকে আবার ধন্যবাদ।
গ্রন্থের প্রচ্ছদ এঁকে দিয়ে বাংলাদেশের প্রথিতযশা শিল্পী কাইয়ুম চৌধুরী আমাকে বিশেষ কৃতজ্ঞতাপাশে আবদ্ধ করেছেন। গ্রন্থে মুদ্রিত আলােকচিত্র শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা সিমিন হােসেন রিমি, বাংলাদেশ টেলিভিশনের সাবেক জি এম আবু জাফর সিদ্দিকীর ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং নূরুল কাদের ফাউন্ডেশন কর্তৃপক্ষ সূত্রে প্রাপ্ত।
মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সঙ্গে আমি সরাসরি সংশ্লিষ্ট ছিলাম। দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার সুদীর্ঘ তেত্রিশ বছর পেরিয়ে গেল, বয়সও হয়েছে—অনেকের পুরাে নাম মনে করতে পারি না, কোনাে-কোনাে সময় স্মৃতিবিভ্রম হয় ঘটনার তারিখ নির্ণয়ে, কোথায় কাকে দেখেছিলাম মনে পড়লেই তা যথাসাধ্য নির্ভুল করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছি। যেসব গ্রন্থের সহায়তা নিয়েছি সেইসব গ্রন্থের রচয়িতাদের সকৃতজ্ঞ ধন্যবাদ জানিয়ে তাদের কথা উল্লেখ করছি: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্যমন্ত্রণালয় কর্তৃক প্রকাশিত ও কবি হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধঃ দলিলপত্র, এ.এস.এম, সামছুল আরেফিন-কৃত সংকলন-গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান, মঈদুল হাসান রচিত মূলধারা ‘৭১ প্রভৃতি।
বইটিকে মুদ্রণ-প্রমাদ ও অসঙ্গতিমুক্ত করার যথাসাধ্য চেষ্টা করেছি। তা সত্ত্বেও কিছু ক্রটি থেকে গেল। আশা করি, পাঠকবৃন্দ এসব প্রমাদ ক্ষমাসুন্দর চোখে দেখবেন। গ্রন্থের পরবর্তী সংস্করণে এ দোষ-ত্রুটি সংশােধন এবং প্রয়ােজনে পাঠকবৃন্দের সুপারিশ ও প্রস্তাব গ্রহণ করার প্রতিশ্রুতি প্রদান করছি।
হােসেন তওফিক ইমাম
এইচ. টি. ইমাম)
ঢাকা
২৪ জানুয়ারি ২০০৪
আমার কথা
বাঙালি জাতির হাজার বছরের ইতিহাসে স্বাধীনতা ও মহান বিজয় দিবস—শ্রেষ্ঠতম অর্জন এবং স্মরণীয় দিন। আনন্দ, উচ্ছলতা আর পবিত্রতম দিন। নিজের কথা লেখার আগে যে মহান ব্যক্তির কথা বারবার স্মৃতিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতা, মহান বিজয় দিবসের সাথে তাঁর নাম মিশে আছে। আমার নিজের কথা লিখতে বসে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অতি নিকট থেকে দেখার এবং মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলিতে তাঁর অদৃশ্য শক্তির স্মৃতি চোখের সামনে উজ্জ্বল হয়।
সুদীর্ঘ ৯ মাস পর, ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাঙালি জাতি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের পবিত্রভূমিতে তার জনককে ফিরে পায়। সেদিন মনে হয়েছিল বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষেই অবিসংবাদিত নেতা এবং জাতির জনক। দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে সৃষ্ট পাকিস্তানে তৎকালীন শাসকচক্রের বৈষম্যমূলক আচরণ ও কার্যকলাপের বিরুদ্ধে তিনি সুদীর্ঘ চব্বিশ বৎসর বাংলার স্বাদীনতার জন্য সংগ্রাম করেছেন, সােনার বাংলার স্বপ্ন দেখেছেন, জাতিকে দেখিয়েছেন মুক্তির পথ। ব্যক্তিগত সকল সুখ-শান্তি বিসর্জন দিয়ে, কারাগারে দিন কাটিয়েছেন জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান দিনগুলােতে। মুক্তির স্বপ্ন দেখা, তাকে লালন করা এক কথা; আর জাতির আপন সত্তাকে জাগ্রত করে মুক্তির পথ দেখানাে, দিকনির্দেশনা দিয়ে জাতিকে তার চরম লক্ষ্যে নিয়ে যাওয়া আরেক কথা। কঠিনতম কাজ। পৃথিবীর ইতিহাসে তার নজির খুবই বিরল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সেই নেতাদের একজন। এটি আমার কোনাে দাবি নয়—গােটা দুনিয়াই তাকে, তার জীবদ্দশায় এই সম্মান দিয়েছিল।
প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে অবাঙালি পাকিস্তানিদের পেছনে ফেলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক আন্দোলনের গতিপ্রকৃতি বুঝতে সচেষ্ট ছিলাম। তিনি বাঙালি জাতির জন্য যে-ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছিলেন, তা ছিল একজন পিতারই ভূমিকা। মায়া-মমতা, কল্যাণ ও মঙ্গল করাই পিতার কাজ। বঙ্গবন্ধুও তাই করেছিলেন। তার ভালােবাসা-স্নেহ ছিল অকৃত্রিম ও দরদমাখা।
১০ জানুয়ারি সেই এক মুহূর্ত সেদিন তাঁকে দেখেছিলাম। বিজয়ী বীর বিমানের দরজা দিয়ে উন্নতশির হেঁটে এলেন; হাত তুলে বাঙালি জাতিকে জানালেন: আমি তােমাদেরই লােক। আমি শিহরিত হয়েছিলাম। আনন্দে-গর্বে বুক ভরে গিয়েছিল। দ্রুত আমাকে উঠতে হয়েছিল হেলিকপ্টারে। হেলিকপ্টারের ব্যবস্থা করেছিলেন সেদিনের গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার। আমাদের সঙ্গী ছিলেন রুহুল কুদুস সাহেব, নূরুল কাদের। বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন উপলক্ষে তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সােহরাওয়ার্দি উদ্যান পর্যন্ত সমস্ত পথের পাশে পতাকা-ফেস্টুন আর জাতির জনকের প্রতিকৃতি দিয়ে সাজানাে হয়েছিল। ৭ মার্চ ১৯৭১ যেখান থেকে তিনি স্বাধীনতার ডাক দিয়েছিলেন, গেরিলাযুদ্ধের রূপরেখা দিয়েছিলেন জাতিকে; যেখানে বর্বর দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর নিরানব্বই হাজার সৈনিকসহ সেনাপ্রধান, সেনা-কর্মকর্তা অবনত মস্তকে বাঙালি জাতির আশার প্রতীক নৌকা-আকৃতির মঞ্চ। এই মঞ্চ থেকে জাতির উদ্দেশে বক্তৃতা দেন স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মহামান্য রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিমানবন্দর থেকে সােহারাওয়ার্দি উদ্যান পর্যন্ত রাস্তার উভয় পাশে দাঁড়িয়েছিল হাজার হাজার মানুষ।
১৯৭২ সালের ১১ জানুয়ারি সকালবেলা তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের মিন্টো রােডের বাসায় প্রথম অত্যন্ত কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখলাম। দীর্ঘ নয় মাস পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার পরও তাঁর চোখ-মুখ উদ্দীপ্ত। যেমন দীর্ঘদেহী সুপুরুষ, তেমনই সুদর্শন। তার চেয়েও তার ব্যক্তিত্ব আরাে বিশাল। প্রথম দেখাতেই কাছে ডেকে নিলেন; জিজ্ঞেস করলেন: কেমন আছ? মনে হল কত দিন থেকে চেনেন। দীর্ঘদিন পর সন্তানকে দেখে পিতা যেমন কুশল জিজ্ঞেস করেন, ঠিক তেমনি। বঙ্গবন্ধুকে সেদিন দেখে ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের লাহাের সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে আমাদের প্রিয় শিক্ষকের দেওয়া সার্থক নেতার সংজ্ঞা মনে পড়ে গেল। তিনিই প্রকৃত নেতা যার আছে ‘Radiating Permeative Virtue’। এটি চীনের মান্ডারিন শাসকদের দেওয়া সংজ্ঞা। ভাবার্থ হল: সার্থক এবং সফল নেতা তাঁর গুণাবলি আশেপাশে সকলের মাঝে বিকিরণ ও অভিস্রবণ করেন। সেই গুণ ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। উৎসারিত হয়, বিচ্ছুরিত হয়।
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধে রক্তঝরা দিনগুলােতে তিনি আমাদের মাঝে সশরীরে উপস্থিত ছিলেন না, তবু তাঁরই নামে আমরা যুদ্ধ করেছি। তার দেয়া অগ্নিমন্ত্র জয় বাংলা ধ্বনি উচ্চারণ করে আমরা এগিয়ে গেছি স্বাধীনতার পথে। তিনি যেন সেদিন প্রতিটি বাঙালির পাশে, মুক্তিযোেদ্ধাদের সর্বদেহমনে। তিনি শক্তি, তিনিই প্রেরণা, আর তাঁর বজ্রকণ্ঠে সেই ঐতিহাসিক উচ্চারণ ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ছিল সংগ্রামী পথের দিকনির্দেশনা।
সাড়ে তিন বছরের বেশি সময় অত্যন্ত কাছে থেকে বঙ্গবন্ধুকে দেখেছি। তাঁর সান্নিধ্য পেয়েছি। অনেক কিছু শিখেছি। কখনও ধমকের স্বরে কথা বলেননি। করেননি তিরস্কার। আমরা যারা তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মী ছিলাম, তাদের স্নেহভরে ‘তুমি’ সম্বােধন করতেন। আমরা বলতে আমি, রফিকুল্লাহ চৌধুরী, মনােয়ারুল ইসলাম, কাজী হাবিবুল হক, মনসুর আহমেদ, ড. সাত্তার, ড. মশিউর রহমান, ড. ফরাসউদ্দীন এঁরা; সবাই ছিলেন সি.এস.পি.। তাঁর স্নেহধন্য আমরা আমাদের স্মৃতির মণিকোঠায় এখনাে তার উজ্জ্বল উপস্থিতি অনুভব করি সারাক্ষণ। প্রতিটি মুহূর্তে, বিশেষ করে প্রতি বছর বিজয়ের আনন্দ-উৎসবে অন্তরের সমস্ত শ্রদ্ধা, ভক্তি, সম্মান ও কৃতজ্ঞতা দিয়ে স্মরণ করি পিতৃতুল্য মহান নেতাকে। আরাে স্মরণ করি মুক্তিযুদ্ধে সকল শহীদ মুক্তিযােদ্ধা, শহীদ বুদ্ধিজীবী এবং জাতীয় চার মহান নেতা-তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী আর এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানকে। আমার প্রয়াত সহধর্মিণী ইসমাৎ ইমাম—যার প্রেরণা ছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে পারতাম কি না সন্দেহ, তার কথাও মনে পড়ছে এ প্রসঙ্গে। গভীরভাবে মনে পড়ছে আমার সহমুক্তিযােদ্ধা এবং সহকর্মী ও ঘনিষ্ঠজনদের যারা আমাদের মাঝে আজ আর নেই। – বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক এই গ্রন্থে আমার কথা লিখতে গিয়ে প্রাসঙ্গিকভাবে জাতীয় জীবনে ও ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে দু-একটি কথা লিখতেই হলাে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের। সাধ্য ছিল, সুযােগ হয়ে ওঠেনি। আমার স্ত্রী ইসমাৎ, ছেলেমেয়েরা প্রতিনিয়ত তাগিদ দিয়েছে; যেমন দিয়েছেন আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব, শুভানুধ্যায়ীরা। বাংলাদেশ এবং স্বাধীনতাযুদ্ধ সম্পর্কে যাঁরা প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনা শুনতে উৎসাহী; যারা তাদের বিজয়ের, জাতির আত্মত্যাগের কাহিনী জানতে চান—এরকম অনেকেই আমাকে লেখার অনুরােধ করেছেন। আজ লিখব, কাল লিখব করে আর হয়ে ওঠেনি। কোনাে-না-কোনাে ঝামেলা, বিপদ, ঝড়-ঝঞা এসে পড়েছে।
স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রথম তিন-চার বছর বিরতিহীনভাবে পরিশ্রম করতে হয়েছে। ছিল নানামুখী প্রচণ্ড চাপ। চারদিকে ষড়যন্ত্র সরকার এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে। অত অল্পবয়সে এবং জুনিয়র হওয়া সত্ত্বেও সবচাইতে দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল ছিলাম আমি (মন্ত্রিপরিষদ সচিব), নূরুল কাদের (সংস্থাপন), খন্দকার আসাদুজ্জামান (অর্থ ও বাণিজ্য) এবং সামাদ (প্রতিরক্ষা)। একে একে বাকি তিনজনকে অন্যত্র চলে যেতে হল। কেন জানি না, আমি টিকে গেলাম। একটি কারণ সম্ভবত বঙ্গবন্ধু আমাকে খুব স্নেহ করতেন। আরেকটি কারণ আমার পরিশ্রম, দক্ষতা এবং কাজের মান অন্যান্য সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। এজন্যই হয়তাে আমার স্থলাভিষিক্ত করার মতাে বিকল্প কাউকে বঙ্গবন্ধু খুঁজে পাননি।
প্রথম কয়েক বছর আমাকে বেশ কয়েকবার হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয়েছে (ব্লাডপ্রেশার রােগ আমার যৌবনকালের সঙ্গী)। ১৯৭৫ সালের আগস্ট থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কারারুদ্ধ। স্বাধীনতাবিরােধী চক্র আমাকে কারান্তরালে প্রেরণ করায় মানসিকভাবে মর্মাহত হই এবং উৎসাহ হারিয়ে ফেলি। সেইসাথে লেখার ইচ্ছেটাও ফিকে হয়ে গেলেও মনে হয়েছে আর সময় নেই, বড় দেরি হয়ে গেছে। আর দেরি করা যায় না ভেবেই ২০০৩ সালের শেষার্ধে আমার সংরক্ষণে থাকা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের যাবতীয় মূল দলিল-দস্তাবেজের নিদর্শনগুলােসহ গ্রন্থের পাণ্ডুলিপি প্রস্তুতে মনােনিবেশ করি। কারণ এই দীর্ঘদিন মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ সরকার সম্বন্ধে কিছু না-লেখার জন্য নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী মনে হয়েছে। বিবেকের কশাঘাতে জর্জরিত হয়েছি—কেন লিখিনি এই কথা ভেবে।
আমার সহধর্মিণী প্রায়ই অনুযােগ করতেন, তােমার কাছে শুনে-শুনে আর তথ্য নিয়ে অন্যেরা বই লিখে ফেললেন, তােমার আর লেখা হলাে না। ইংরেজিতে একটা কথা আছে Better late, than never অর্থাৎ একেবারে না-করার চাইতে দেরিতে করাও ভালাে। তাই প্রবাদটির কথা স্মরণ করে অনেকটা তৃপ্তি আর আনন্দ লাগছে এই ভেবে যে শেষ পর্যন্ত লিখতে পেরেছি। সেই সাথে গভীর দুঃখ আর বেদনা এই যে, প্রিয়তমা ইসমাৎ আজ পাশে নেই।
আমার বিরাট গৌরব আর গর্বের কথা যে, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমগ্র সময়, তারপর দেশগঠনের (এবং সরকার সংগঠন) চরম উত্তেজনাপূর্ণ ও কখনাে কখনাে সংকটময় চারটি বৎসর একেবারে কেন্দ্রবিন্দুতে থেকে অংশগ্রহণ করেছি; প্রত্যক্ষভাবে দেখেছি বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনা। আনন্দের আর পরিতৃপ্তির কথা এই যে, অধিকাংশ ঘটনার দালিলিক প্রমাণ আমার কাছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ: দলিলপত্র সংকলনের সময় কবিসাহিত্যিক হাসান হাফিজুর রহমান এবং তার অত্যন্ত সুযােগ্য ও অনলস কর্মী আফসান চৌধুরী আমার সাথে অনেক আলােচনা করেছেন, তথ্য সংগ্রহ করেছেন। পরবর্তীকালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর উদ্বোধনের সময় আলী যাকের, আকু চৌধুরী প্রমুখের অনুরােধে সেখানেও তথ্য এবং কিছু দলিলপত্র দিয়েছি। বি.বি.সি-র আতিকুস সামাদ, আফসান চৌধুরী, ভয়েস অব আমেরিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী এবং বাংলাদেশ টি.ভি-র আবু জাফর সিদ্দিকী বিভিন্ন সময় আমার সাক্ষাৎকার নিয়ে প্রচার করেছেন।
সুদীর্ঘ দেড় বৎসর কারাবাসের সময় লেখার একটা বড় সুযােগ ছিল। পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত সাহিত্যকর্ম, আত্মজীবনী ইতিহাস-প্রণয়ন কারাগারে আটক অবস্থায় অথবা নির্বাসনে থাকার সময় সম্পন্ন হয়েছে। জেলে পাঠানাের পর খন্দকার মােশতাক, তাহের ঠাকুর, মাহবুব আলম চাষী গয়রহ আমাকে বিন্দুমাত্র স্বস্তি দেননি। প্রতিদিন বিভিন্ন গােয়েন্দা-সংস্থার অফিসার এবং তদন্তকারী কর্মকর্তা আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করতে আসত। সেজন্য কাগজপত্র সংগ্রহ করে তৈরি থাকতে যথেষ্ট সময় প্রয়ােজন ছিল।
১৯৭৫ সালের নভেম্বরে দ্রুত ঘটে গেল আমাদের তথা সভ্যজগতের জঘন্যতম, নৃশংসতম হত্যাকাণ্ড। আমি থাকতাম ২৬ নম্বর সেলে (যেখানে একসময় বঙ্গবন্ধুও ছিলেন)। পাশেই ভিন্ন আরেক কারাপ্রাচীরের ভেতর ছিল সদ্যনির্মিত নতুন জেল (New jail)। সেখানে ছিলেন আমাদের চার জাতীয় নেতা এবং আবদুস সামাদ আজাদ, বন্ধুবর খন্দকার আসাদুজ্জামান, পুলিশের মাহবুবউদ্দীন (এস.পি.মাহবুব) এবং আরও অনেকে। ৩ নভেম্বর রাতে ঘাতকের উপর্যুপরি গুলিতে চরম নির্মমতার শিকার হলেন আমার আদর্শের চার নেতা। তার আগে জেলগেটে পাগলা-ঘণ্টা (alarm) বেজেই চলে রাতের শেষ প্রহরে। চারদিকে বুটের শব্দ, মানুষের কথা। আমাদের কানের পাশেই যেন গগন বিদীর্ণকারী সাবমেশিনগানের প্রচণ্ড আওয়াজ, কিছু আর্ত-চিৎকার। মনে হল যেন আমাদের প্রাচীরের মধ্যেই পাশের ঘরে প্রচণ্ড গােলাগুলি হচ্ছে। ঐ পরিবেশে কি মাথা ঠিক থাকে? কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমি। তবে বুঝতে পারছিলাম সাংঘাতিক কিছু-একটা ঘটানাে হচ্ছে। পাল্টা কোনাে গুলির শব্দ নেই। শুধুই একতরফা গুলির শব্দ, আর তার সাথে তীব্র আর্তনাদ, কান্নার রােল শুনতে পাচ্ছিলাম। বলে রাখি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে মাঝে মধ্যেই পাগলা-ঘণ্টা বাজত। সেরাতেও ভীতিকর অবস্থা সৃষ্টি করে পাগলা-ঘণ্টা বেজে ওঠে। একটানা বেজেই চলছিল। পাগলা-ঘণ্টা বাজলে আমাদের হতাে হৃদকম্পন। ঐ রাতেও হয়েছিল।
আমাদের ঐ সেলে ঐ সময়ে ছিলেন নূরুদ্দীন আহমেদ (প্রাক্তন বন-সচিব), খায়রুল কবির (জনতা ব্যাংকের), ড. মতিন চৌধুরী (প্রাক্তন ভাইস চ্যান্সেলর), জাসদের রুহুল আমিন ভূইয়া, মেসবাহউদ্দীন, একরামুল হক, খুলনার The Wave পত্রিকার সম্পাদক (মাহমুদ), সেনাবাহিনীর প্রাক্তন মেজর জয়নাল আবেদীন, শ্রমিক লীগের বিখ্যাত নেতা আবদুল মান্নান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাড়াজাগানাে সেভেন মার্ডার কেসের চারজন অভিযুক্ত ছাত্রনেতা (রঞ্জু, বিটু, আরও দুজন), আর ছিলেন শহীদুল্লা কায়সার হত্যা মামলার দণ্ডপ্রাপ্ত আসামী মওলানা খালেক। মান্নান আর খালেক আমাদের মেস চালাতেন।
৩ নভেম্বর হত্যাকাণ্ডের পর ঘটল ৭ নভেম্বরের পাল্টা অভ্যুত্থান সিপাহী বিপ্লব। খন্দকার মােশতাক ইতােমধ্যে ক্ষমতা হারিয়েছেন। বীর সেনানায়ক জেনারেল খালেদ মােশাররফ, মেজর হায়দার প্রমুখ নৃশংসভাবে নিহত হলেন। এর পরপরেই জেল থেকে ছাড়া পেলেন জাসদের নেতৃবৃন্দ। পাল্টে গেল দাবার ছক। ২৬ নম্বর সেলে নতুন অতিথি হলেন কর্নেল শাফায়াত জামিল, অপর এক সেলে গেলেন মেজর হাফিজউদ্দীন।
এর কিছুদিন পরেই ঘটল আরেক নাটক। কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে জাসদের গণবাহিনী এবং বিদ্রোহী সিপাহীরা ক্ষমতা দখলের ব্যর্থ প্রয়াসের পর সকলেই বন্দি হলেন। ২৬ নম্বর সেলে ঘটল আরও অতিথির আগমন—ড. আখলাকুর রহমান এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের নবীন প্রভাষক মােস্তফা সরওয়ার। কর্নেল তাহেরও বন্দি হলেন।
এই ঘটনার কিছুদিন পর আমাদের বেশ কয়েকজনের (আমি, আসাদুজ্জামান, ড. মতিন চৌধুরী, খায়রুল কবির এবং আরও অনেকের) বিরুদ্ধে মার্শাল-ল কোর্টে মামলা দায়ের করা হল। অবশ্য আমাদের জেলে আটক করার বেশ কদিন পর বিশেষ ক্ষমতা আইনে আমাদের গ্রেপ্তার দেখানাে হয়। অভিযােগ: দেশের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করা, ষড়যন্ত্র, দেশদ্রোহিতা ইত্যাদি। ভাগ্যের পরিহাস এই যে, স্বাধীন বাংলাদেশে আমাদের বিরুদ্ধে যে সমস্ত অভিযােগ এনে কারারুদ্ধ করা হলাে তা প্রায় হুবহু ১৯৭১ সালের আগস্টে আনীত পাকিস্তান মার্শাল-ল কোর্টের অভিযােগের অনুরূপ। পাকিস্তান-কর্তৃপক্ষ (টিক্কা খানের সরকার) আমাদের প্রত্যেককে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেছিল। দৈনিক Pakistan Observer-এ আমাদের কারাদণ্ডের খবর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়। ঠিক ৪ বছর পরও স্বাধীন বাংলায় ফিরে এল টিক্কা খানের প্রেতাত্মা খন্দকার মােশতাক রূপ নিয়ে।
১৯৭৬ সালের গােড়ার দিকে আমি বেশি অসুস্থ হয়ে পড়লে একজন বিশেষজ্ঞডাক্তারের পরামর্শে আমাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়। সেখানে ছিলাম প্রায় তিন মাস। ফিরে এসে জানতে পারলাম ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেটের অফিসে বিশেষ সামরিক আদালত দেশদ্রোহিতার দ্রুত মামলা পরিচালনা করে কর্নেল তাহেরকে মৃত্যুদণ্ড দেয় এবং দ্রুতগতিতে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে সেই মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। জেলখানার পরিবেশ কেমন যেন থমথমে। নভেম্বরের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড, তারপর তাহেরের ফাঁসি এবং অন্যান্য শ্বাসরুদ্ধকর সব ঘটনা আমাদের পূর্বের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা (জেলের অভ্যন্তরে যতটা স্বাভাবিক হতে পারে) এলােমেলাে করে দিয়েছিল। এর পরই শুরু হলাে মার্শাল-ল কোর্টে আমার বিচার—দু-দুটি কেসে।
দুটি কেসেই আমি বেকসুর খালাস হলাম এবং আমাকে সসম্মানে মুক্তিদানের নির্দেশ দিলেন মার্শাল-ল কোর্ট। প্রথম কোর্টের চেয়ারম্যান (উইং কমান্ডার সদরুদ্দীন) পুলিশের তদন্তকারী কর্মকর্তাকে তিরস্কার করলেন একটি ভিত্তিহীন কেস আনার জন্য। দ্বিতীয় কোর্টের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন জেলা জজ সাহেব। প্রথম কোর্টে আমাকে আটকানাে গেল না। অতএব দ্বিতীয় কোর্ট খালাস দিলেও সরকারের মুখরক্ষার জন্য যেন অন্তত একটি বিরূপ মন্ত ব্য করেন—এ-ধরনের ফিসফাস কথা কোর্টপ্রাঙ্গণে রটে যায়। দ্বিতীয় কোর্টের জজ সাহেব আমার সম্পর্কে যে-রায় দিলেন—কোর্টপ্রাঙ্গণে রায় প্রদানের পূর্বে যে গুজব আমার কানে আসে—প্রায় সে-রকমই একটি রায় প্রদান করা হলাে। আমি মুক্ত হলাম বটে, কিন্তু পেছনে একটা শঙ্কা রয়ে গেল। জজ সাহেব মন্তব্য করলেন: ইমাম সাহেব এত গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়েছেন। এটি ঠিক হয়নি। অভিযােগ ছিল দুর্নীতি এবং ক্ষমতার অপব্যবহার। ব্যাংক থেকে ঋণ যে-কেউ নিতে পারেন নিয়ম-নীতি অনুসরণ করে। সরকারি ক্ষমতায় না-থেকেও নিতে পারেন, থেকেও নিতে পারেন শর্ত পালন করে। যে ঋণ পরিশােধ করা হয়েছে সুদসমেত, ক্ষমতার অপব্যবহার করলে তাে আমি অনুরােধ করেই সুদ মওকুফ করাতে পারতাম। তাও তাে নয়। এসব মামলায় জড়িয়ে আমার ব্যক্তিগত মান-সম্মানের অপূরণীয় ক্ষতিসাধন করা হয়েছে। আমার অতি কাছের মানুষও আমাকে ভুল বুঝেছেন। তাঁদের কারাে কারাে সঙ্গে আমার দূরত্বও সৃষ্টি হয়েছে।
কারাগার থেকে মুক্ত হলাম বটে, এরশাদ সাহেব পিছু ছাড়লেন না। সরকারের কাছে চাকুরিতে পুনর্বহাল হওয়ার দরখাস্ত করতেই (আমাকে সাময়িক বরখাস্ত অর্থাৎ suspend করা হয়েছিল) সরকার নতুন করে আমার বিরুদ্ধে ডিপার্টমেন্টাল তদন্তের নির্দেশ দিলেন। সাসপেনশনের হুকুম বহাল রইল। বিভাগীয় অসদাচরণের জন্য অভিযােগগুলি সামরিক আদালতের শুধু অনুরূপ নয়, হুবহু এক ও অভিন্ন। ১৯৭৫ সালের আগস্ট (২৬) থেকে ১৯৭৬ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত কারাগার (এবং সামরিক আইনে বিচার); তারপর পুরাে ১৯৭৬ সাল বিভাগীয় তদন্ত ও বিচার। সৌভাগ্যবশত বােরহানউদ্দীন আহমেদ সাহেবকে (১৯৫০ ব্যাচের সি. এস. পি.), যিনি সততা এবং নির্ভীকতার জন্য অত্যন্ত সুপরিচিত ছিলেন, সরকার তদন্ত কারী অফিসার নিয়ােগ করলেন। সেখানেও দুর্নীতি দমন বিভাগ আগের মতােই তাদের সুদীর্ঘ বক্তব্য বয়ান করল। আমি মাথা উঁচু করে আগের মতােই তাদেরকে নস্যাৎ করলাম। সব শুনে আগের প্রথম মার্শল-ল কোর্টের মতাে বােরহানউদ্দীন সাহেব আমাকে নির্দোষ বলেই ক্ষান্ত হলেন না, পুলিশ এবং সরকারকে তিরস্কার করলেন আমাকে হয়রানি করার জন্য। আমাকে অবিলম্বে চাকুরিতে বহালেরও পরামর্শ দিলেন।
আমি যাতে কোনােক্রমেই ভালাে পদে ফিরে যেতে না পারি তার ষড়যন্ত্র চলতেই থাকল। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরােধী শফিউল আজম তখন মন্ত্রিপরিষদ-সচিব। ২৬ আগস্ট ১৯৭৫ (আমি গ্রেপ্তার হবার দিন) থেকেই মােশতাক কর্তৃক নিয়ােজিত। তিনি ইতিমধ্যে নানা টালবাহানা করে, আমরা যারা ইতােপূর্বে সচিব ছিলাম তাদেরকে, একধাপ নিচে নামিয়ে অর্থাৎ পদাবনতি করে অতিরিক্ত সচিবের পদে নিয়ােগ করেছেন। অতিরিক্ত সচিব পদে অধিষ্ঠিত করেও বিশেষ দায়িত্বে নিযুক্ত কর্মকর্তা (অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি) নিয়ােগ করা হলাে সংস্থাপন বিভাগে। আমাদের সহকর্মী তুখােড় মেধাবী (সি.এস.পি.) মনােয়ারুল ইসলাম (যিনি জীবনে সব পরীক্ষায় প্রথম হয়েছেন, ম্যাট্রিক থেকে সি.এস.পি. পরীক্ষা পর্যন্ত) বঙ্গবন্ধুর অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রীর যুগ্মসচিব ছিলেন। ১৯৭৩-৭৪ সালে বেশ কয়েকজন অফিসারকে অফিসার অন স্পেশাল ডিউটি (O.S.D.) করা হল পরপর।
প্রসঙ্গক্রমে আমার বেশ কয়েকটি কথা মনে পড়ছে। স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও প্রতিষ্ঠা এক প্রচণ্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর। এর সরকার ছিল বিপ্লবী সরকার, প্রথম সরকার; কোনাে উত্তরসূরি সরকার নয়। সাবেক পাকিস্তানি বা পূর্বপাকিস্তানি সরকারের সাথে আমাদের কোনাে সম্পর্কই ছিল না। তাদের কর্মকর্তা/কর্মচারীদের আমাদের বহাল করার কোনাে কারণ ছিল না। তবুও মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে, দেশকে দ্রুত এগিয়ে নেবার যুক্তিতে তাদের পুনর্বহাল করা হয়েছিল। এরাই ক্ষমতা দখল করে আমাদের জেলে পুরল, চাকুরিতে পদাবনতি ঘটাল।
দ্বিতীয়ত আমাদের যখন পদাবনতি ঘটিয়ে বা বিভাগীয় শাস্তি দেওয়া হয়, সে-সময় সেনাবাহিনীতে যারা মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন, তাদের বেলায় তাে পদাবনতির প্রশ্ন ওঠেইনি। তারা তাে দুই ধাপ, তিন ধাপ প্রমােশন পেয়েছিলেন (মেজর থেকে জেনারেল, লেফটেন্যান্ট থেকে কর্নেল ইত্যাদি)। আমি খুবই আশা করেছিলাম শহীদ জিয়াউর রহমান, যিনি আমাদের সাথে এত ঘনিষ্ঠ ছিলেন, ন্যায়বিচার করবেন—মুক্তিযােদ্ধাদের অধিকার রক্ষায় রুখে দাঁড়াবেন। পরে বুঝলাম স্বৈরাচারী এরশাদ এবং তার দোসরদের কাছে তিনি কত অসহায়—যার চরম মূল্য তাকে দিতে হয়েছে।
তৃতীয়ত এর আগে বঙ্গবন্ধু এমন এক সিদ্ধান্ত নেন যার মূল্য তাঁকে জীবন দিয়ে দিতে হয়েছিল বলে আমার মনে হয়। পাকিস্তান প্রত্যাগত পাকিস্তানি বাঙালি সেনা অফিসার এবং জোয়ানদের কোনােরকম যাচাই-বাছাই না-করে ঢালাওভাবে চাকুরিতে বহাল করেছিলেন। তাদের পদোন্নতিও দিয়েছিলেন। বেসামরিক কর্মকর্তাদের বেলায়ও তাই। (অবশ্য শফিউল আজমের মতাে পাকিস্তানপ্রেমী দেশদ্রোহীদের চাকুরিতে বহাল করার প্রশ্নই ওঠে না, বঙ্গবন্ধু তা করেনও নি। খুনী মােশতাক এই কর্মটি করেছিলেন।)।
১৯৭৭ সালের শেষদিকে বিভাগীয় তদন্ত থেকে সসম্মানে মুক্ত হবার পর আবার আবেদন করলাম আমাকে সচিব-পদে নিয়ােগের এবং ১৯৭৫ থেকে ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত আমার প্রাপ্য বকেয়া বেতন-ভাতা প্রদানের বিধি অনুযায়ী আমার এটা অবিলম্বে পাওয়ার কথা। তখন দুয়েকজন সহকর্মীর বিদ্বেষ এবং হীনমন্যতা এত প্রকট ছিল যে তা কোনােদিন ভুলবার নয়। মেজর জেনারেল (অব) নূরুল ইসলাম (শিশু), যিনি শহীদ তাজউদ্দীনের সামরিক সচিব ছিলেন, ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়ার প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার হিসেবে কাজ করেছিলেন তিনি ঐ সময় বিরাট ক্ষমতাধর ব্যক্তি। রাজনৈতিক দল ভাঙছেন, গড়ছেন। পরবর্তীকালে মন্ত্রীও হলেন। গেলাম তার সাথে দেখা করতে। আমার চাকুরি ফিরে পাবার কথা শুনে তার প্রথম প্রশ্নই হল: আপনি এত টাকা একসাথে পাবেন?’ তার প্রশ্নে ব্যঙ্গাত্মক সুর ধ্বনিত হল।
আইনের বাইরে যেতে না-পেরে অবশেষে আমার সাসপেনশনের আদেশ বাতিল করা হলাে। কিন্তু ও.এস. ডি. পদে রেখেই আমাকে দায়িত্বও দেওয়া হল: প্রজেক্ট ডিরেক্টর, বাংলাদেশ প্রশাসনিক স্টাফ কলেজ; যার প্রিন্সিপাল পুলিশের প্রাক্তন অফিসার আবদুর রহিম মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার বাহিনীর সাথে যুক্ত ছিলেন বলে অভিযােগ পাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু যে-কুমিরকে খাল কেটে নিয়ে গিয়েছিলেন তাঁর সচিব পদে, রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে সরিয়ে—১৫ আগস্ট পট পরিবর্তনের সাথে সাথেই দেখা গেল তার আনুগত্য কোথায়। মােশতাক এবং সামরিক বাহিনীর বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট; রাষ্ট্রপতির সচিব থেকে স্টাফ কলেজের প্রিন্সিপাল এবং পরে সংস্থাপন-সচিব।
প্রজেক্ট ডিরেক্টর (কিন্তু ও. এস. ডি.) পদটি পাওয়ার আগে কয়েক মাস আমার খুবই কষ্টে গিয়েছে—মানসিক ও দৈহিক। আমাকে কোনাে গাড়ি দেওয়া হয়নি, টেলিফোন ছিল না। একমাত্র সরকারি বাংলােটি ছিল—–আমাকে পূর্বের বরাদ্দকৃত ৩ নম্বর টেনেমেন্ট হাউস, ইস্কাটন গার্ডেন রােড। প্রচণ্ড চাপের মুখে অনেক সময় মনে করেছি পদত্যাগ করব, তারপরেই মনে হয়েছে: আমি তাে কারাে দয়ায় বা করুণায় চাকুরি পাইনি—সরকারে থাকা আমার অধিকার। সমগ্র পাকিস্তানে প্রতিযােগিতামূলক পরীক্ষা দিয়ে সর্বোচ্চ স্থান অধিকার করে সি.এস.পি. হয়েছিলাম। আত্মিক তাগিদে স্বেচ্ছায় মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছি, সরকার সংগঠন করেছি, দেশ স্বাধীন করেছি; এদেশ আমার, সরকারও আমাদের। সাময়িকভাবে বহিঃশত্রুর এজেন্ট, দেশদ্রোহী কিছু লােক ক্ষমতা দখল করেছে, সুদিন একদিন আসবেই। যথাসময়ে, আমার পছন্দ মতাে ক্ষণে সরকার থেকে অবসর নেব, এই ছিল সিদ্ধান্ত।
স্টাফ কলেজ উন্নয়ন প্রকল্প প্রণয়ন করার সময় মনে হলাে: এত ব্যয় করে শুধু স্টাফ কলেজ কেন? মধ্যম সিনিয়রিটি অফিসারদের জন্য নিপা (NIPA) এবং নতুন রিক্রুট (প্রবেশনার)-দের জন্য COTA (Civil Officers Training Academy)-কেও একই জায়গায় (Campus-এ) একটি বড়সড় কমপ্লেক্স করলে কেমন হয়? NIPA (National Institute of Public Administration) এবং COTA-এর দুটোরই স্থান সঙ্কুলান যেমন। হচ্ছিল না, তেমনি এদের অবস্থান ছিল ঝুঁকিপূর্ণ। নিপাছিল বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের ভিতর; কোটাছিল পি.জি. হাসপাতালের পার্শ্বে। আমার প্রস্তাবটি সকলেই মেনে নিলেন। ভালাে সমর্থন পেলাম কোটা-র তৎকালীন অধ্যক্ষ খালেদ শামস্-এর কাছ থেকে। আর পেলাম মুজিবুল হক সাহেবের সমর্থন, তিনি তখন পরিকল্পনা কমিশনে সদস্য। ঢাকা শহরে স্থানাভাব থাকায় স্থির করলাম সাভারে নিয়ে যাব পরিকল্পিত লােক প্রশাসন প্রশিক্ষণ কমপ্লেক্স (Public Administration Training Complex), সংক্ষেপে (PATC)। এই প্রকল্পের উদ্ভাবক আমি, প্রকল্প-প্রণয়নকারী আমি এবং সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন ও উদ্বোধন আমার দ্বারাই। এটি আমার গর্বের বিষয়। পরে এটার নাম হয় লােক প্রশাসন প্রশিক্ষণ সেন্টার (Public Administration Training Centre)। অবশ্য সাভারে যাবার প্রস্তাব করার পর। প্রবল বাধা এসেছে। সমালােচনা হয়েছে প্রচুর।
এই প্রকল্প প্রণয়ন, সংগঠন, বাস্তবায়ন, অর্থ সংগ্রহ ইত্যাদি কাজে আপ্রাণ চেষ্টা করতে হয়েছে; করেছি অক্লান্ত পরিশ্রম। ছয়টি বছর ছিলাম প্রকল্প-পরিচালক (এবং অতিরিক্ত সচিবের পদমর্যাদায় ও.এস.ডি.)। ঐ সময়টাতে নিজের একটি ভিন্ন জগৎ সৃষ্টি করে নিয়েছিলাম ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু থেকে অনেক দূরে, ক্ষমতাধরদের দৃষ্টির আড়ালে। নিজেই চেষ্টা করে বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং ইউ.এন.ডি.পি. (UNDP)-কে এই প্রকল্পে আকৃষ্ট করি। তাদের সাহায্য আর সমর্থনে আস্তে আস্তে গড়ে তুলি প্রতিষ্ঠানটি। ঐ সময়টাতে (৬ বছর) পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছি ঐসব দেশের প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠানগুলাে দেখার জন্য; অবশ্য ব্যয়ভার বহন করেছে বিশ্বব্যাংক (World Bank) এবং ইউ.এন.ডি.পি. (UNDP)।
১৯৮৩ সালে পি.এ.টি.সি.-র উদ্বোধন করলেন বিচারপতি সাত্তারকে সরিয়ে দিয়ে তখনকার চিফ মার্শাল-ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (CMLA) এবং রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ। ছয় বছর অক্লান্ত পরিশ্রম করে আমি তখন ক্লান্ত। যথেষ্ট বয়সও হয়েছে, চাকুরিতেও জ্যেষ্ঠ। তৎকালীন সংস্থাপন-মন্ত্রী মেজর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর সাথে দেখা (অবশ্য এমনিতেও ঘন ঘন দেখা হতাে) করে বললাম যে, আমার মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ফিরে আসার সময় অতিক্রান্ত, আমি রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাৎকার চাই। চৌধুরী সাহেব ব্যবস্থা করে দিলেন।
সেনাভবনে রাষ্ট্রপতি এরশাদের সাথে দেখা করতে গিয়ে অন্য আরেক এরশাদের সাক্ষাৎ পেলাম। অনেক কথা বললাম তাকে। মােদ্দা কথা, সিভিল সার্ভিসে আমার অবস্থান, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সংগঠনে আমার অবদান এবং ত্যাগ, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব ইত্যাদি। একটি কথা বিশেষ করে মনে করিয়ে দিলাম। বঙ্গবন্ধু এবং তার সুযােগ্য সহকর্মী সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান প্রমুখের নেতৃত্বে আমরাই এদেশের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছিলাম। শুধু তাই নয়, ঐ ভিত্তির ওপর অট্টালিকাও আমাদেরই নির্মিত। স্বাধীন, সার্বভৌম সরকারের যা যা বৈশিষ্ট্য, যেমন সংবিধান, সরকারের সংগঠন, বিন্যাস, মন্ত্রণালয় বিভক্তি, মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বণ্টন ও কার্যপ্রণালী বিধি (Rules of Business, Rules for the Allocation of Business এবং Rules for the Transaction of Business), অত্যাবশ্যক অঙ্গসংগঠন, যেমন জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিল বা NEC, তার কমিটি (EC of NEC), পরিকল্পনা কমিশন; বহিঃসম্পদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও বিদেশে দূতাবাস স্থাপন, জাতীয় সংগীত এবং জাতীয় পতাকা বিধি, জাতীয় প্রতীক ( national emblem) এবং আরও অজস্র কাজ আর প্রতিষ্ঠান গঠন—সবই আমার আমলে এবং আমার চোখের সামনে হয়েছে। এসব এখন যারা সরকার পরিচালনা করছেন এবং তাদের আগে যারা পরিচালনা করেছেন তারা ১৯৭১ থেকে ১৯৭৫ পর্যন্ত সরকারের হাতে-গড়া সবকিছু উত্তরাধিকার-সূত্রে প্রাপ্ত হয়েছিল বলেই সরকার পরিচালনা করতে পারছেন। যেমন রাষ্ট্রপতির শপথ, মন্ত্রীদের শপথ এবং অন্যান্য যে-সমস্ত অত্যাবশ্যকীয় কাগজপত্র (মনে হয় সামান্য কাজ কিন্তু সময়ে অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ) তারা ব্যবহার করেন—সব আমার নিজের এবং আমার সহকর্মীদের পরিশ্রমের ফসল। আজ পর্যন্ত এর কোনােটির দাড়ি-কমাও পরিবর্তন হয়নি।
আমার কথা অত্যন্ত ধৈর্যের সাথে সেদিন শুনেছিলেন এরশাদ সাহেব। পরে আমাকে বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু বিরাট নেতা ছিলেন। বিশাল ব্যক্তিত্ব ছিলেন। তার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার জন্য আপনার এত ঝামেলা যাচ্ছে। আমি দেখব।’ তিনি কথা রেখেছিলেন। সংস্থাপন মন্ত্রীর কাছে আমি শুনেছিলাম যে PATC উদ্ভাবন এবং সৃষ্টিতে উনি আমার খুবই প্রশংসা করেছিলেন।
১৯৮৪ সালে সড়ক ও সড়ক যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের সচিব নিযুক্তির পর আবার প্রচণ্ড চাপ পড়ল। ঐ সময়টাতে সারাদেশে উপজেলা সংযােগকারী সড়ক, বড় বড় সেতু, বিচ্ছিন্ন স্থানগুলিতে নতুন নতুন সড়ক নির্মাণ-বিরাট একটা কর্মযজ্ঞ যেন। অধিকন্তু প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজে কাজ দেখতেন, তদারক করতেন, যখন-তখন টেলিফোন করে খবর নিতেন। এবং আমাকে সঙ্গে নিয়ে যেতেন নতুন প্রকল্প এলাকায় বা নির্মাণ স্থলে। উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গে যত বড় সেতু ও সড়ক, বড় বড় জনপথ (highway), বুড়িগঙ্গা সেতু (চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী), মেঘনা-গােমতি (জাপান), মেঘনা (জাপান), শম্ভুগঞ্জ (ময়মনসিংহ-ব্রহ্মপুত্র-চীন), নওয়াবগঞ্জ (মহানন্দা-চীন), গাইবান্ধা (ঘাঘট), দিনাজপুর (কাঞ্চন) ইত্যাদি প্রত্যেকটি উল্লেখযােগ্য যােগাযােগব্যবস্থা সম্পন্ন হয়েছে ঐ সময় (১৯৮৪-৮৬)। ভােলায় হেলিকপ্টারে আমাকে নিয়ে গেছেন ভােলা-চরফ্যাশন রাস্তা নির্মাণের জন্য। এক বছরের মধ্যে সেটি নির্মিত হলে আবার আমাকে সাথে নিয়ে গিয়ে উদ্বোধন করেছেন। সাথে নাজিউর রহমান মঞ্জু আর মেজর হাফিজউদ্দীন।
যমুনা বহুমুখী সেতু নির্মাণ প্রকল্প আরম্ভ করার যাবতীয় কাজ, যেমন প্রাক-সম্ভাব্যতা (pre feasibility), সম্ভাব্যতা (feasibility), যমুনা সেতু কর্তৃপক্ষ স্থাপন; বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক, জাপান ও অন্যান্য দাতাদের সম্পৃক্তকরণ, প্রকল্প সাহায্য সংগ্রহ, বিশেষজ্ঞ দল (Panel of Experts) নিয়ােগ, দেশের অভ্যন্তরে সম্পদ আহরণের উদ্দেশ্যে যমুনা সেতু সেস (cess) আরােপ—এই সমস্ত কাজ আমি করেছি এরশাদ সাহেবের অনুমােদনক্রমে। আমার প্রস্তাবেই সেস (cess) আরােপ করা হয়। যমুনা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন জাতীয় কমিটি গঠন করা হয় প্রেসিডেন্টের নেতৃত্বে, যার সদস্য-সচিব ছিলাম আমি। বাংলাদেশের ভৌত অবকাঠামাে স্থাপন ও উন্নয়নে প্রেসিডেন্ট এরশাদের ভূমিকা উল্লেখযােগ্য।
১৯৮৭ সালে আরম্ভ হল আরেক খেলা। বছরের প্রথমদিকে যমুনা সেতু নির্মাণের যাবতীয় প্রস্তুতি-পর্ব শেষ। বিশ্বব্যাংক তাদের সমীক্ষা শেষ করে লন্ডনের উপকণ্ঠে আলােচনাসভা আহ্বান করে। এই সভার আয়ােজক ছিলেন (Feasibility study-র) মূল ঠিকাদার পরামর্শক প্রতিষ্ঠান RPT (Rendel, Palmer &Tritton) এবং বিশ্বব্যাংক বিশেষজ্ঞ দল এতে অংশ নেয়। এই বিশেষজ্ঞ দলে আমি আমাদের দেশীয় দুইজন প্রখ্যাত বিশেষজ্ঞ ড. জামিলুর রেজা চৌধুরী ও ড. আইনুন নিশাতকে অন্তর্ভুক্ত করিয়েছি। এঁদের নিয়ে আমি বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দিলাম। চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হয়ে গেল সেতুর স্থান, নির্মাণশৈলী, প্রকৃতি (ডিজাইন), নদী-শাসন, গাইড বাঁধ নির্মাণ, সংযােগ সড়ক (Approach Road) ইত্যাদি বিষয়ে।
আমি যখন লন্ডনে, সেই সময় আমার স্ত্রী সংবাদ দিলেন যে আমাকে পরিকল্পনামন্ত্রণালয়ে বদলি করা হয়েছে। দেশে ফিরে ষড়যন্ত্রটা টের পেলাম। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে (যােগাযােগের) এরশাদ সাহেব যখন আমার ওপর নির্ভর করতে আরম্ভ করলেন, আমি আমার যােগ্যতা দিয়ে তার আস্থা অর্জন করলাম, তখনই শুরু হলাে পুরােনাে ফিসফাস, কানকথা। তদুপরি যমুনা সেতু নির্মাণের যারা বিরােধী ছিলেন (দুর্বলতম প্রতিপক্ষ ভেবে) লেগে পড়লেন। আরেক দলের আক্রমণ শুরু হলাে যমুনা সেতু নির্মাণের স্থান নির্বাচন নিয়ে। আমি (এবং বিশেষজ্ঞরা) আগাগােড়া বলে এসেছি যে, স্থান নির্বাচন বিষয়টি সম্পূর্ণ নদী নিয়ন্ত্রণ এবং সেতু নির্মাণ প্রকৌশলের ওপর নির্ভরশীল। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ এবং প্রকৌশলীরা যা বলবেন সেটাই মানতে হবে। রাজনৈতিক বা আঞ্চলিক আবেগ দিয়ে স্থান নির্বাচন করা যায় না। ছয়টি সম্ভাব্য স্থানের মধ্যে বিশেষজ্ঞরা বিভিন্ন বিষয় বিচার-বিশ্লেষণ করে বৈজ্ঞানিকভাবে যে সিদ্ধান্তে উপনীত হলেন সেটি ভূঞাপুর-সিরাজগঞ্জ করিডােরের পক্ষে।
আমাকে যারা পছন্দ করতেন না (আড়ালে আবডালে বাকশালী, মুজিববাদীগাল দিতেন, যার অপর অর্থ মুক্তিযােদ্ধা) তারা একটা সুযােগ পেলেন। যােগাযােগ মন্ত্রী (তখন ড. এম. এ. মতিন) ও আমি দুজনেই সিরাজগঞ্জের, অতএব এটা আমাদেরই কারসাজি। এই একটা ইস্যুতে নির্মাণকাজ পিছিয়ে গেল। আরেকটি বড় বিষয় এই সময়ে পরিষ্কার হতে শুরু করল। যমুনা সেতু নির্মাণ যখন একরকম নিশ্চিত, আন্তর্জাতিক টেন্ডার আহ্বান করা হবে, পৃথিবীর বড় বড় কোম্পানি আসা-যাওয়া শুরু করল—তাদের সাথে দেশীয় এজেন্টরাও হলেন তৎপর। চারদিকে টানাপড়েন এবং ফিসফাস (whisper) কথাবার্তা। অনেকেরই প্রকৃত রূপ জানতে পারলাম। নেপথ্যের অনেক নায়কের নাম পরে জেনেছি। এরা প্রথমে আমাকে পরিকল্পনামন্ত্রণালয়ে স্থানান্তর করলেন সচিব পদে। সেখানে পদাধিকার বলে আমি ভৌত অবকাঠামাে বিভাগের দায়িত্বপ্রাপ্ত পরিকল্পনা কমিশন সদস্য। আর এই দায়িত্ব পালনে আবার যমুনা সেতু প্রকল্পে জড়িয়ে পড়লাম। ফলে নতুন ষড়যন্ত্র আর টেনশন।
অবশেষে ঠিক করলাম, যথেষ্ট হয়েছে আর নয়। মান-সম্মান নিয়ে নিজে বেরিয়ে যাওয়াই ভালাে। চাকুরি যখন ২৭ বছরের বেশি, পেনশন নিয়ে অবসরে যেতে পারি। ১৯৮৭ সালের মাঝামাঝি অবসরের (retirement) আবেদন করলাম। আমার আবেদনের সময় জানতে পারলাম সরকার আমাকে রিটায়ার (retire) করিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করছে। সেজন্য আমার ইচ্ছা তৎক্ষণাৎ মঞ্জুর হল। ১৯৮৮ সালে সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন। মাঝখানে এক বছর প্রস্তুতিমূলক ছুটি LPR (Leave Preparatory to Retirement)। এই সুদীর্ঘ সময় অখণ্ড অবসর। এটাই ছিল লেখার প্রকৃষ্ট সময়। এটা নষ্ট করাটা মারাত্মক ভুল হয়েছে।
সরকারি চাকুরি থেকে বের হয়ে প্রতিজ্ঞা করলাম আর পরের গােলামি নয়। ১৯৮৮ সালে আমার বয়স ৫০-এর কোঠায়। তখন যথেষ্ট কর্মক্ষম। ১৯৮৯-৯০ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময় রাজনীতিতে কিছুটা সক্রিয় হলাম বন্ধুবর মােনায়েম সরকারের অনুরােধে। গ্রামেও ঘুরলাম অনেক। ‘৯৩-৯৪ সালে ঢাকার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বেশ কাজ করে দিলাম হানিফের পক্ষে। ১৯৯৬ সালে আবার অনুরােধ। ঐ সময় বেশ কাজ করেছিলাম। আমি আর আমার সহকর্মী আসাফউদ্দৌলা পরিশ্রম করলাম। সময়ও দিলাম অনেকটা। নির্বাচনের পর আমাকে অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলাে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও গ্রহণ করলাম (অনীহার কারণ আমার পূর্বের অভিজ্ঞতা এবং সরকারি মর্যাদার তুলনায় এই কাজটি নিতান্ত তুচ্ছ মনে হয়েছে)। চাকুরিজীবনের ঘাত-প্রতিঘাতে ক্ষতবিক্ষত হওয়ায় আমার এই অনিচ্ছা কিন্তু সঠিক প্রমাণিত হল। যারা আমাকে এই দায়িত্বে বসালেন, তাঁদেরই কেউ কেউ আমার আড়ালে ভিত্তিহীন কথাবার্তা শুরু করলেন। যারা এমন কথাবার্তা বলছিলেন, তারা নিজেদের সৎ নাগরিক মনে করলেও প্রকৃতপক্ষে তারা তা নন। বন্ধুপ্রতিম ও একই মতাবলম্বী সহকর্মীগণ অনর্থক কুৎসা রটান বটে, কিন্তু এতে তাদের কোনাে লাভ নেই। বরং প্রতিপক্ষকে তারা সুযােগ করে দেন রটনা থেকে ফায়দা লুটতে।
জীবনের শেষপ্রান্তে যখন নিজের সামনেই প্রশ্ন: শেষ করতে পারব তাে? বিরাট একটা তাগিদে আমার এই বই লেখা। দেশ ও জাতির কাছে আমার দেনা পরিশােধ—এটাই বড়াে তাগিদ। ইতিহাসের চরম সংঘাতপূর্ণ এবং ঘটনাবহুল সময়ে আমি অনেক কিছুরই প্রত্যক্ষদর্শী এবং জিম্মাদার। আমার সমসাময়িক ব্যক্তিরা জানতে চান স্বাধীনতাযুদ্ধের, মুজিবনগরে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের পূর্ণ তথ্য আর বিবরণ। আর বর্তমান প্রজন্ম এবং আমাদের উত্তরসূরিদের অবশ্যই জানার অধিকার আছে পূর্ণ ইতিবৃত্ত। স্বাধীনতার পর দীর্ঘ সময়ে অনেক অপচেষ্টা হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি মুছে ফেলার। মুজিবনগরে গঠিত সরকারের ভাবমূর্তি স্নান করার পরিকল্পনা চলছেই। এই প্রবণতায় বাধা দিতে আমার ক্ষুদ্র চেষ্টায় এই লেখা। একই সাথে আমার জান্নাতবাসিনী স্ত্রী আর আমাদের সন্তানদের বহুদিনের দাবি পূরণ করব বলেই এই বিনম্র প্রয়াস।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ: জনযুদ্ধ
জনযুদ্ধ বা People’s war বলতে আমরা যা বুঝি সেই সংজ্ঞাতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই একটি অনন্য জনযুদ্ধ ছিল। সর্বস্তরের মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণ এবং অসীম ত্যাগ স্বীকারই তাে জনযুদ্ধের প্রধান উপাদান। আমাদের সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর জন্ম জনগণের মধ্যে, লালনও জনতার আশ্রয়ে। মুক্তিযুদ্ধে এত ব্যাপকভাবে অংশগ্রহণ পৃথিবীর ইতিহাসে খুব কমই হয়েছে। ভিয়েতনামে আমরা সেটি দেখেছি। হাতেগােনা কয়েকজন দক্ষিণ ভিয়েতনামী সেনা অফিসার ও পুতুল রাজনীতিবিদ ছাড়া কেউই দক্ষিণ ভিয়েতনামী সরকার তথা আমেরিকানদের সমর্থন করেনি। শহরে, গ্রামে, বন্দরে, ধানক্ষেতে, খাল-বিলে, দেশের আনাচে-কানাচে নির্ভয়ে বিচরণ করত ভিয়েতকং গেরিলারা। জনগণের মাঝে ওঁৎ পেতে থাকত, সুযােগ-সুবিধামতাে আকস্মিক হামলা চালাত শত্রুর ওপর। এর পরিণাম কোনাে–কোনাে সময় ভয়াবহ হয়েছে নিরীহ জনগণের জন্য। গ্রামের-পর-গ্রাম পুড়িয়ে ছারখার করা হয়েছে, নির্বিচারে গুলি চলেছে গ্রামবাসীদের ওপর, বােমা ফেলে গ্রাম-জঙ্গল ভস্ম করে দিয়েছে আমেরিকান আর দক্ষিণ ভিয়েতনামী তাঁবেদার বাহিনী, মাইলাইয়ের মতাে কুখ্যাত হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। এই হত্যাকাণ্ডে নারী-শিশু-বৃদ্ধ কেউ বাদ যায়নি। আমাদের এই বাংলার মাটিতে সৃষ্টি হয়েছে সহস্র মাইলাইয়ের। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে লেখা হয়েছিল “Bangladesh-A Thousand Mai Lai” শিরােনামে। ফিলিস্তিনেও চলছে মানবতাবিরােধী হামলা। বাড়িঘর ধূলিসাৎ করা হচ্ছে, নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে নারী-শিশুকে, হাতিয়ার তুলে নিচ্ছে তাই মেয়েরা, মানব-বােমা হয়ে ধ্বংস করছে ইসরাইলীদের। এই যে, জনযুদ্ধের দুই মহােত্তম উদাহরণ, এর চাইতে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ কি কম ছিল ১৯৭১ সালে? এখানেও তাে আবালবৃদ্ধবনিতা এগিয়ে গেছে মুক্তিবাহিনীর পাশাপাশি, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। সকল স্তরের মানুষ যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের আশ্রয় দিয়েছে, খাদ্য দিয়েছে, বহন করেছে রসদ। প্রয়ােজনবােধে কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে শত্রুর মােকাবিলার জন্য নিজেরাও অস্ত্র তুলে নিয়েছে। বাংলাদেশের চারদিকে গড়ে-ওঠা অজস্র আশ্রয়-শিবির পরিণত হয়েছে যুবশিবিরে। সেখান থেকে বের হয়েছে মুক্তিযােদ্ধা। সম্মুখসমর, গেরিলাযুদ্ধ, শত্রুর ওপর আকস্মিক ঝাপিয়ে পড়া, সড়ক-সেতু, বিদ্যুৎ লাইন ধ্বংস ও বিচ্ছিন্ন, সরবরাহ লাইন গুড়িয়ে দেওয়া, তথ্য সংগ্রহ, গােয়েন্দাগিরি, চিকিৎসাসেবা প্রদান, মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিটে সংযােগ স্থাপন, দেশের অভ্যন্তরে অস্ত্রভাণ্ডার (arms cache) গড়ে-তােলা—হেন কাজ নেই যা আমাদের বীর জনগণ করেনি। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, কৃষক, শ্রমিক বুদ্ধিজীবী, সকলে এই কাতারে শামিল ছিল—নির্ভয়ে এবং স্বেচ্ছায়।
পরিণামে ভিয়েতনামে যা ঘটেছিল, ফিলিস্তিনে যা ঘটছে, আমাদের এই বাংলাদেশেও তাই ঘটেছে। সাধারণ মানুষের ওপর, জনগণের ওপর নেমে এসেছে পাকিস্তানি বাহিনীর নির্মম অত্যাচার। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিকাণ্ড, সাধারণ মানুষকে বাড়িঘর থেকে উৎখাত করে নিরাশ্রয় করা হয়েছে এদেশে। পাকিস্তানিদের সাথে তাদের এদেশের দোসর রাজাকার, আলবদর, জামায়াত, মুসলিম লীগ নামধারি ইসলামের তথাকথিত ধ্বজাধারী খুনি-লুটেরা বাহিনীও উল্লিখিত দুষ্কর্মে যােগ দেয়।
পৃষ্ঠা: ২
এটা নতুন কিছু নয়। যে-কোনাে দেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে বিদেশি শত্রুর পদলেহনকারী কিছু লােক থাকে। শুধু ভিয়েতনাম, প্যালেস্টাইনে নয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক প্রশাসনের পদলেহী বিশ্বাসঘাতক কিছু বাঙালি সমগ্র জাতির সঙ্গে বেইমানি করেছে। বাংলাদেশে বেইমানরা কেমন আছে! তারা স্বাধীনতার শত্রু, জনগণের শত্রু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিশ্বাসঘাতকদের বলা হতাে পঞ্চম বাহিনী (Fifth Column)। নরওয়েতে পুতুল প্রধানমন্ত্রী (জার্মানদের তাঁবেদার) কুইসলিং-এর নামানুসারে ষড়যন্ত্রকারীদের গােটা ইউরােপে অত্যন্ত ঘৃণাভরে বলা হতাে কুইসলিং। জনগণের শত্রু বােঝাতে এই ‘গালি’ ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হতাে।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাত থেকেই সারা বাংলাদেশে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিল জনগণ। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর বিখ্যাত ভাষণের পর মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে নেতৃত্ব এসেছে স্বতস্ফূর্তভাবে। ঐ রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর আকস্মিক হামলায় সমগ্র জাতি হতচকিত হয়ে যায়। কিন্তু হতাশ হয়নি কেউ। জাতি যাদের কাছে নেতৃত্ব আশা করেছে, তারা সাধ্যমতাে এগিয়ে গিয়েছেন। কোনাে জায়গায় সেনা অফিসার, কোথাও জেলা ও মহকুমা প্রশাসক, অন্যান্য সিনিয়র কর্মকর্তা ও কর্মচারী, কোথাও ইপিআর বা পুলিশ অফিসার, কখনও নির্বাচিত এম.এন.এ., এম.পি.এ, কখনও স্থানীয় আওয়ামী লীগ বা ন্যাপ না হয় অপরাপর রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। কোনাে-কোনাে স্থানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বা অন্য কোনাে বুদ্ধিজীবী। ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর সেই উদাত্ত আহবান—তােমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে; ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তােলােজনগণের মধ্যে দুর্বার প্রতিশােধ স্পৃহা এবং এক অপূর্ব প্রেরণা জুগিয়েছে। পাকিস্তান বাহিনীর অতর্কিত আক্রমণে কিংকর্তব্যবিমূঢ় আওয়ামী লীগ-নেতৃবৃন্দকে সেনাবাহিনীর বাঙালি অফিসার ও জওয়ান এবং স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসনকে (কমিশনার, ডি. সি., এস.ডি.ও-দের) যুদ্ধপ্রস্তুতির জন্য পৃথকভাবে কোনাে ডাক দিতে হয়নি, ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর আহ্বানের পর থেকে সমগ্র দেশে একটা সাজ-সাজ রব উঠেছিল। এ স্মৃতি এখন ইতিহাস।
সেনাছাউনি বা সেনানিবাস (cantonment) ছিল, এমন সব স্থানেই অধিকাংশ অফিসার মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছিলেন—অপেক্ষা করছিলেন তাঁরা তাঁদের করণীয় কাজে আত্মনিয়ােগ করতে। আমরা যারা বেসামরিক প্রশাসনের দায়িত্বে ছিলাম তারা দ্রুত প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। তবে সীমান্ত-অঞ্চলের জেলাগুলিতে যেভাবে প্রকাশ্যে প্রস্তুতি সম্ভব ছিল, ভেতরকার জেলাগুলিতে তা ছিল না। আবার বেশ কয়েক জায়গায় পাকিস্তানি সেনা হাইকমান্ড বাঙালি ইউনিটগুলি (বিশেষ করে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়নগুলিকে) বিক্ষিপ্তভাবে সরিয়ে দিয়ে পরস্পরের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দুর্বল করার প্রচেষ্টা চালিয়েছিল। ই.পি.আর-এর ইউনিটেও পশ্চিমা অফিসারদের গােপনে নির্দেশ দিয়েছিল বাঙালি ইউনিটের বর্ডার আউটপোেস্ট (B.O.P.)-গুলাে থেকে ভারী অস্ত্রশস্ত্র সরিয়ে ফেলতে। ঐ তৎপরতা আমাদের বীর অফিসাররা অনেকেই পূর্বাহ্নে আঁচ করেছিলেন এবং তার পাল্টা ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। গাজীপুরে মেজর কে.এম. সফিউল্লাহ, ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর শাফায়াত জামিল; যশােরে মেজর আবু ওসমান; চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর মীর শওকত আলী; ময়মনসিংহে মেজর নূরুল ইসলাম (শিশু), কাপ্তাইয়ে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী এবং আরও অনেকে এর উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
খােদ ঢাকায় ক্যান্টনমেন্টে যারা ছিলেন বিভিন্ন ইউনিটে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, কিংবা ই.পি.আর.-এর পিলখানায়, রাজারবাগ পুলিশ লাইনে, অথবা চট্টগ্রাম সেনানিবাসের অভ্যন্তরে (পাকিস্তান বাহিনী পরিবৃত হয়ে) ই.বি.আর.সি.-তে তাঁদের অবস্থা ছিল সর্বাপেক্ষা নাজুক। পরিণামে যুদ্ধের প্রথম রাতে এদের উপর আকস্মিক হামলা-প্রতিরােধ করা সম্ভব ছিল না। অজস্র হতাহত হয়েছেন; শহীদ হয়েছেন ঐ রাতের আক্রমণে।
আমরা যারা ঢাকা থেকে দূরে ছিলাম, বিশেষত সীমান্ত অঞ্চলে, তাদের অবস্থান সুবিধাজনক ছিল। আর এই কারণেই ঢাকার বাইরে প্রতিরােধ হয়েছে প্রবল। জেলা-মহকুমা শহরগুলিতে শত্রুদের পৌছুতে যেমন দেরি হয়েছে, তেমনই হয়েছে ক্ষয়ক্ষতি। সেই সময়ে আমরা পুনগঠিত হওয়ার এবং শক্তি সঞ্চয়ের সুযােগ পেয়েছি। জেলাগুলির দিকে তাকালেই আমরা বুঝতে সক্ষম হব কী অসীম সাহসিকতার সাথে বেসামরিক প্রশাসকগণ স্থানীয় নেতৃবৃন্দ, সেনা অফিসার (কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত), ই.পি.আর, পুলিশ সকলকে নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন প্রতিরােধযুদ্ধে জনতার কাতারে। ছাত্র, শিক্ষক, যুবক, শ্রমিক, কৃষক, সামরিক অফিসার, পুলিশ, বেসামরিক আমলা একাত্ম হয়ে গেছেন এক লক্ষ্যে: শাসনশােষণ অত্যাচার থেকে মুক্তি চাই।
বেশ কয়েকটা স্থানে, যেমন বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে, কলেজে প্রবীণ-নবীন শিক্ষকগণ প্রতিরােধে নেতৃত্ব দিয়েছেন, সংগঠন করেছেন। আবার বেশ কয়েকটি স্থানে নেতৃত্ব দিয়েছেন প্রকৌশলী অথবা ডাক্তার। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ড. এ. আর. মল্লিক নিজে সংগঠিত করেছেন পুলিশ, ই.পি.আর, ছাত্র-জনতাকে। এক জায়গায় সমবেত করে, প্রয়ােজনীয় প্রাথমিক প্রশিক্ষণ ও নির্দেশনা দিয়ে তাদের চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে পাঠিয়েছেন। তেমনই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকগণ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের বাংলাদেশের মানচিত্র লক্ষ্য করলে একটা ধারণা হবে বাংলাদেশের জনযুদ্ধের ব্যাপকতা এবং প্রকৃতি সম্পর্কে। দেশের প্রতিটি নগরে, জেলাশহরে, মহকুমায়, থানায়-থানায়, বড় বড় গঞ্জে-বন্দরে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে, টেকনাফ থেকে তেঁতুলিয়া, মেহেরপুর থেকে তামাবিল, কুয়াকাটা থেকে পঞ্চগড় একসাথে জনগণের রােষানল জ্বলে উঠেছিল ১৯৭১ সালের মার্চের সংগ্রামী দিনগুলিতে। গােটা বাঙালি জাতি ফুঁসে উঠেছিল পশ্চিমাদের নৃশংস আক্রমণের খবর পেয়ে। জাতির ঐ ক্রান্তিলগ্নে আমাদের স্বতস্ফূর্তভাবে গড়ে-ওঠা জনগণের বাহিনী, সামরিক, আধা-সামরিক বাহিনীগুলাে, স্থানীয় প্রশাসন জাতির পাশে এসে দাঁড়িয়েছে এক কাতারে। যুদ্ধ করেছে একসাথে, শহীদও হয়েছে একই আদর্শের জন্য। তখনাে তাে কোনাে ভেদাভেদ ছিল না। জনগণের বিভিন্ন স্তর থেকে নেতৃত্বও এসেছে। স্বতস্ফূর্তভাবে-কখনও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, জনপ্রতিনিধিরা, কখনও সেনা নায়কেরা, আবার কখনও স্থানীয় প্রশাসন বা উপস্থিত স্বনামধন্য কোনাে ব্যক্তি।
এই জনযুদ্ধে সীমান্তবর্তী জেলা বা অঞ্চলগুলিতে স্বাভাবিক ভৌগােলিক অবস্থাগত কারণে একটা বাড়তি সুবিধা ছিল। পার্শ্ববর্তী ও পৃথিবীর অন্যান্য দেশ থেকে প্রচুর সাহায্য এসেছে। প্রয়ােজনে অস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহ করা গেছে সহজে। বিপদে আশ্রয় পাওয়া গেছে, যেখান থেকে আবার নবােদ্যমে শত্রুর বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা সম্ভব হয়েছে।
রাজধানী ঢাকায় এই সুবিধা ছিল না। উপরন্তু এখানেই শত্রুসেনা সমাবেশ, ভারী অস্ত্র এবং ট্যাংক বহর থাকায় নিরস্ত্র, অসহায় জনগণ মৃত্যু আর ধ্বংসের কবলে পড়েছে বেশি। ঢাকার চতুর্দিকে, যেখানে সামান্যতম সময় ও সুযােগ পেয়েছেন আমাদের সেনা-অফিসার, ই.পি.আর.পুলিশ, স্থানীয় প্রশাসন সেখানেই রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের, বিশেষ করে আওয়ামী লীগ নেতাদের সহায়তায়, প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন। ঢাকার গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, কুষ্টিয়া, পাবনা, বরিশাল, বগুড়া—সবখানেই এই জনযুদ্ধের পরিচয় পাওয়া যায়।
আন্তর্জাতিক সীমানায় অবস্থিত জেলাগুলােতে অতিরিক্ত সুবিধার কথা আগেই বলেছি। কিন্তু এর ব্যতিক্রমও ছিল কোনাে কোনাে স্থানে, যেমন রংপুরে সেনানিবাস থাকায় সাধারণ মানুষের তথা জনগণের অসুবিধা হয়েছে বেশি। তার ওপর ওখানে বসবাসরত অবাঙালিদের বিরাট একটা অঞ্চল ছিল সৈয়দপুরে। এরা স্বাভাবিকভাবেই স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রকাশ্য বিরােধিতা করেছে। রাজশাহীতেও পাকিস্তানি বাহিনীর সেনা-সমাবেশ ছিল। এখানে আমাদের অনেকেই শহীদ হয়েছেন। যশাের সেনানিবাসে পাকিস্তানিরা অনেকদিন অবরুদ্ধ ছিল। ময়মনসিংহে মেজর নূরুল ইসাম (সফিউল্লাহ্-র ব্যাটালিয়নের এবং তাঁর নির্দেশে) স্থানীয় ই.পি.আর, পুলিশ ও জনতাকে সাথে নিয়ে পাকিস্তানিদের পর্যদস্ত করেন, কিন্তু যথেষ্ট বেগ পেতে হয় তাকে। কুমিল্লায় পূর্বপরিকল্পিতভাবে পাকিস্তান বাহিনী প্রথমেই আক্রমণ চালিয়ে আমাদের ভয়াবহ ক্ষতিসাধন করে। নােয়াখালীতে জনযুদ্ধের চিত্র ছিল ভিন্ন। জেলা প্রশাসক মনযূর-উল-করীমের নেতৃত্বে এবং বেশ কয়েকজন সেনা-অফিসারের সহায়তায় তারা বিরাট প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন। সিলেট-ব্রাহ্মণবাড়িয়া সমগ্র অঞ্চলে শত্রুবাহিনী তেমন সুবিধা করতে পারেনি মেজর খালেদ মােশাররফের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন প্রখর চিন্তা এবং ক্ষিপ্র তৎপরতার কারণে—যেমনটি করেছিলেন গাজীপুরে মেজর কে. এম. সফিউল্লাহ, চট্টগ্রামে ক্যাপ্টেন রফিক, কুষ্টিয়ায় মেজর আবু ওসমান।
মুক্তিযুদ্ধের বীর-গাথা অজস্র। তেমনই অসংখ্য ঘটনা আছে প্রতিরােধ যুদ্ধের। সেসব কাহিনী অনেকে লিপিবদ্ধ করেছেন, আবার অনেক কথা বিস্মৃতির অতলে চলে গেছে। কিন্তু ইতিহাস সত্য তুলে ধরবে। ইতিহাসের প্রকৃতিই তাই। যেভাবে মুছে ফেলার অপচেষ্টা হচ্ছে পাকিস্তানি এবং তাদের দোসরদের গণহত্যার বিবরণ, তাতে শুধু করুণা হয় এই ভেবে যে, কুশাসকগণ ও তাদের পারিষদবর্গ ইতিহাস থেকে কোনাে পাঠ গ্রহণ করে না। কারণ তারা এক ধরনের মােহে আচ্ছন্ন থাকে। যখন কোনাে গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়, তখন আমাদের জাতীয় চেতনা জাগ্রত হয়। এ-বিষয়ে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সকল শক্তি ও সংবাদপত্র দায়িত্ব পালন করে আসছেন বটে, তবু অনেক করার আছে এখনও। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ তথা জনযুদ্ধের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরার দায়িত্ব প্রতিটি বাঙালির। সরকারেরও বিশেষ দায়িত্ব আছে।
ওপরে চট্টগ্রামে প্রতিরােধ যুদ্ধের তেমন বর্ণনা দেইনি একটি মাত্র কারণে। সেটি হল স্বাধীনতাযুদ্ধে বীর চট্টলা পৃথক আলােচনার দাবিদার। জিয়াউর রহমান, মীর শওকত আলী, রফিকুল ইসলাম, খালেকুজ্জামান, হারুন-অর রশিদ, লে. শমসের মুবিন চৌধুরী—এইসব বীর মুক্তিযােদ্ধার সমাবেশ ছিল এখানে। এখানেই আগ্রাবাদ ও কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘােষণা এবং স্বাধীন বাংলা বেতারের পথযাত্রা। এই চট্টগ্রামে ৩ মার্চ জনতার ঢলের ওপর পাকিস্তানি এবং অবাঙালিদের নির্বিচার গােলাগুলি বর্ষণে অগণিত মানুষ হতাহত হয়। মুক্তিযুদ্ধের সফল প্রতিরােধ এবং বড় বড় সংঘর্ষও চট্টগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ঘটেছিল। শুভপুর ব্রিজ, কালুরঘাট, মহালছড়ি, রামগড় চা-বাগানে ঘটেছিল বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ যুদ্ধ। এসব প্রতিরােধ যুদ্ধে পাকিস্তানিদের বিপুল ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হয়।
চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রামকে ঘিরেই রামগড়ে মেজর জিয়াউর রহমান এবং আমি ইস্টার্ন সেক্টর আর পূর্বাঞ্চল প্রশাসন গড়ে তুলি। বাংলাদেশের আর কোথায়ও এত দীর্ঘদিন শত্রুকে প্রতিরােধ করা যায়নি—২৬ মার্চ থেকে ২ মে পর্যন্ত। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিকের সমাবেশ এখানে ঘটেছিল সর্ববৃহৎ। রামগড় থেকে মেজর জিয়াউর রহমান শুভপুর ফেনী সেতু রক্ষা করার জন্য ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামকে পাঠিয়েছিলেন
পৃষ্ঠা: ৫
একদিকে, আবার অন্যদিকে মহালছড়ি অঞ্চলে যুদ্ধরত মেজর মীর শওকত আলীর সাথে সমন্বয় করতে হয়েছে তাঁকে। এই সম্বনয়-কাজে আমি প্রত্যক্ষভাবে বহুবার জড়িত হয়ে পড়ি। অতি ঘন ঘন মীর শওকত আলী আমার শরণাপন্ন হতেন মেজর জিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ ও পরামর্শের জন্য ওয়ারলেস বা টেলিফোনের মাধ্যমে। আমাদের সাথে আরাে যােগ দেন মেজর শামসুদ্দীন (ই.পি.আর.), ক্যাপ্টেন আফতাবুল কাদির (মহালছড়ি যুদ্ধে শহীদ), ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইঞা প্রমুখ। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম আর ক্যাপ্টেন অলি আহমদ আগে থেকেই ছিলেন আমাদের সাথে।
চতুর্দিকে যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনী আর স্বেচ্ছাসেবকরা আহত হলে নিয়ে আসা হচ্ছে রামগড় হাসপাতালে ডাক্তার সেরাজুল ইসলামের তত্ত্বাবধানে। জেলা কাউন্সিলের প্রকৌশলীরা পার্বত্য অঞ্চলের ভেতরে প্রতিরক্ষার জন্য কখনও সেতু নির্মাণ করছেন, কখনও আবার তা ভাংতে হচ্ছে।
এ সময়ে আরাে দু-দল প্রকৌশলীর কথা মনে পড়ে যারা প্রথম থেকেই মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে অসীম সাহসের পরিচয় দিয়েছিলেন। এক দল The Engineers নামক ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের, যারা করেরহাট-রামগড় সড়ক সেতুগুলি নির্মাণ করছিলেন, তাঁরাই আবার ঐসব সেতু ধ্বংস করেন পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ করতে। আরেক দল এসেছিলেন সেমুতাং-এর গ্যাস/তেল অনুসন্ধান প্রকল্প থেকে। রাশিয়ার সহযােগিতা ও সাহায্যে পাকিস্তান তেল ও গ্যাস অনুসন্ধান কর্পোরেশনের অধীনে প্রকৌশলীদের অধিকাংশ ছিলেন রুশ ও মাত্র কয়েকজন ছিলেন বাঙালি। এখানে বেশ কয়েকজন বাঙালি মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। The Engineers-এর প্রকৌশলীদের নেতৃত্বে ছিলেন মি. দত্ত। পার্বত্য চট্টগ্রাম জেলা পরিষদের প্রকৌশলী মাে. তাজুল ইসলাম এবং সড়ক ও জনপথ বিভাগের প্রকৌশলী জ্যোতিবিকাশ চাকমাও এই সময়ে রামগড়ে চলে আসেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের পাশাপাশি সাহসিকতার সাথে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন।
রামগড় চা-বাগানের ম্যানেজার আওয়াল সাহেব তার বাগানের সমস্ত সম্পদ এনে জমা করেছেন আমাদের প্রতিরােধযুদ্ধ জোরদার করতে। ইলেকশন অফিসার আসাদুজ্জামান আর কৃষি ব্যাংকের শাহাবুদ্দীন সংগ্রহ করেছেন অর্থ, অন্যান্য রসদ আর জনবল। স্থানীয় বাজারের ব্যবসায়ীগণ যে যা পারছেন তাই দিচ্ছেন পশ্চিমদিক থেকে আগত মানুষের ঢলকে আশ্রয় আর খাবার সরবরাহের জন্য। রামগড় থানার দারােগা এবং ও.সি. রামগড়ে সমবেত অবাঙালিদের হাজতে নিরাপদে রাখার দায়িত্বে নিয়ােজিত। একই সাথে পুলিশ প্রশাসন দেখাশুনা করা, পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মুক্তিবাহিনীতে সম্পৃক্ত করে কাজে লাগানাে এবং মােটামুটিভাবে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা—এ-সমস্ত কাজ হাসিমুখে বলতে গেলে ২৪ ঘণ্টাই করে গেছেন এই ভদ্রলােক। গাজীপুরে, টাংগাইলে, ময়মনসিংহে মেজর সফিউল্লাহ ও মেজর নূরুল ইসলামের সাথে স্থানীয় প্রশাসন, নেতৃবৃন্দ ও জনগণ কীভাবে সম্পৃক্ত হয়ে গিয়েছিল সেটা সর্বজনবিদিত।
প্রাসঙ্গিকভাবে আমি যা বলতে চেয়েছি তা হলাে সর্বস্তরের মানুষের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে এসবই ছিল বড় দৃষ্টান্ত। এটাই জনযুদ্ধ। চট্টগ্রাম, রামগড়-এর মতাে আরও অজস্র উদাহরণ সারা বাংলাদেশে সৃষ্টি হয়েছিল। জানার ইচ্ছা থাকলে, দেখার মতাে দেখলে আমাদের কাছে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত স্বরূপ উন্মােচিত হবে।
চট্টগ্রামে আওয়ামী লীগ-নেতৃবৃন্দ অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে শ্রমিকরা পুরােপুরি কাজ বন্ধ রেখে সােয়াতনামক জাহাজ থেকে বিশাল অস্ত্রসম্ভার খালাসে অস্বীকৃতি জানায় এবং পরে বাধা দেয়। এই প্রক্রিয়ায় অনেকে প্রাণও বিসর্জন দেয়। সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে একাত্ম হয়ে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেব, এম. আর. সিদ্দিকী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মেজর জিয়াউর রহমান এবং মেজর মীর শওকত আলীর সাথে যান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারের জন্য।
কুষ্টিয়ায় কৃষক-পুলিশ, ই.পি.আর-এর সম্মিলিত বাহিনী পাকিস্তানিদের পাঁচটি অবস্থানে হামলা চালায় (৩১ মার্চ)।
৫ এপ্রিল যশাের থেকে কুষ্টিয়া অভিমুখে যাবার সময় একটি পুরাে পাকিস্তানি সেনা কোম্পানি মুক্তিবাহিনীর হাতে নিশ্চিত্ত হয়। নিহত হয় স্থানীয় কৃষকদের আক্রমণে। তাদের হাতিয়ার ছিল দা, কুড়াল, বল্লম, সড়কি ইত্যাদি।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মেজর কে. এম. সফিউল্লাহ বিভিন্ন স্থানে একটা বেতার-বার্তা পাঠান। প্রত্যুত্তরে এক ঘণ্টার মধ্যে তিনি সাড়া পান দিনাজপুর, রাজশাহী, পাবনা, বগুড়া, কুষ্টিয়া, হবিগঞ্জ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া এবং ফেনী থেকে। একইভাবে রাঙামাটি থেকে আমরা ই.পি.আর. এবং পুলিশের বেতার (wireless network) থেকে যেসব নির্দেশ পাঠাচ্ছিলাম, বর্ডার আউটপােস্ট (B.O.P.) এবং থানাগুলিতে তা অনেকে শুনতে পেয়েছেন বলে আমাকে জানিয়েছেন (রেজাউল হায়াত তাদের মধ্যে অন্যতম)। তবে আমাদের জন্য শঙ্কার কারণ এই ছিল যে, এই একই বেতার-তরঙ্গ পাকিস্তান সেনাবাহিনীও ব্যবহার করছিল—অতএব ওরাও আমাদের কথাবার্তা শুনছিল (intercept-ও বলা যায়)। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী পিলখানা এবং রাজারবাগে আকস্মিক আক্রমণের সময় পুলিশ/ ই.পি.আর. রেডিওতে উভয় স্থানের বাঙালিদের যে অকথ্য ভাষায় গালাগাল দিয়ে আদেশ করছিল, আমরা রাঙামাটিতে বসে পুরােপুরি শুনেছিলাম। একই সাথে অবিরাম গােলাগুলির আওয়াজও পাওয়া যাচ্ছিল। এ থেকেই আমরা প্রথম আক্রমণের প্রচণ্ডতা বুঝতে পারি।
মৌলভীবাজার-সিলেট অঞ্চলে মেজর সি.আর.দত্ত শুধুমাত্র ই.পি.আর. এবং স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকদের সমবায়ে দুই কোম্পানির সমতুল্য একটি বাহিনী গঠন করেন। যশাের-কুষ্টিয়া অঞ্চলে মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, লে. হাফিজ ও অন্যান্যরা স্থানীয় জনসাধারণের এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে প্রতিরােধ গড়ে তুলেছেন। প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি সাধন করেছেন পাকিস্তানিদের। মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা, মাগুরা, নড়াইল, ঝিনাইদহ, রাঙামাটি সর্বত্র স্থানীয় প্রশাসন এবং জনসাধারণ যুদ্ধ করেছেন, বিরাট অঞ্চল মুক্ত রেখেছেন। নড়াইলে কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী, মাগুরায় ওয়ালিউল ইসলাম, মেহেরপুরে তওফিক এলাহী চৌধুরী, যশােরে অ্যাসিসট্যান্ট কমিশনার (প্রবেশনার) তরুণ সাদত হুসাইন, ঝিনাইদহের এসডিপিও (পুলিশ বিভাগ) মাহবুবউদ্দীন—সবাই জনতার সাথে মিলেমিশে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন, নেতৃত্ব দিয়েছেন। তওফিক এলাহী এবং মাহবুব তাে সরাসরি যুদ্ধে শামিল হয়েছিলেন। দুজনেই যুদ্ধে আহত হন। তওফিক যুদ্ধ চলাকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আদেশে সেনাবাহিনীর ক্যাপ্টেন নিয়ােজিত এবং বীরত্বের জন্য বীর বিক্রম উপাধিতে ভূষিত হন। আরেক বীরযােদ্ধা ছিলেন ঐ অঞ্চলের প্রকৌশলী এম.এইচ.সিদ্দিকী (ডাক নাম কমল নামেই খ্যাত)। তিনি যুদ্ধক্ষেত্রে তাঁর মূল্যবান একটি চোখ হারান। যশাের-মেহেরপুর-চুয়াডাঙ্গা অঞ্চলে যুদ্ধের প্রথমদিকে কিংবদন্তি হয়ে যান মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, তওফিক এলাহী, মাহবুব, কমল সিদ্দিকী এবং আওয়ামী লীগ নেতা ডা. আসহাবুল হক।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে দিনাজপুর, রংপুর, পার্বতীপুর, বগুড়া সব অঞ্চলে সর্বস্তরের মানুষ নেমে পড়ে সেনাবাহিনী, ই.পি.আর, পুলিশ, প্রশাসনের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য। এভাবে বাংলাদেশের সর্বপ্রান্তের সাধারণ মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে জনযুদ্ধে পরিণত করে।
রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জ, পাবনা প্রভৃতি এলাকায়ও বীর জনতা পিছিয়ে ছিল না। রাজশাহী পুলিশ লাইনে পুলিশবাহিনীর প্রতিরােধ, রাজশাহী-নওয়াবগঞ্জে জওয়ান, ই.পি.আর, পুলিশ এবং স্বেচ্ছাসেবকদের সমবায়ে গঠিত বাহিনী নিয়ে মেজর গিয়াস, ক্যাপ্টেন রশিদ সেনাছাউনি ঘিরে রাখে। পাকিস্তানিদের বিশ্বাসঘাতকতা আর প্রতারণার শিকার হয়ে বিপুল সংখ্যক পুলিশ এখানে শহীদ হন।
নগরবাড়িতে পাকিস্তানিরা যমুনা নদী পারাপারের চেষ্টায় অগ্রসর হওয়ার পথে পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদের এবং মেজর নাজমুল হক সংগঠিত ই.পি.আর. পুলিশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রতিরােধ করে দাঁড়ায়। এখানকার যুদ্ধেও আমাদের অনেক হতাহত হন।
নাটোরের লালপুরে অবস্থিত নর্থবেঙ্গল সুগার মিল মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অনন্য গাথা হয়ে আছে। সেখানকার জেনারেল ম্যানেজার অবসরপ্রাপ্ত বিমানবাহিনী অফিসার আনােয়ারুল আজিম স্থানীয় জনসাধারণ, মিলের সকল অফিসার ও শ্রমিক সমন্বয়ে বাহিনী গঠন করেন পাকিস্তানিদের প্রতিরাধের জন্য। তাদের সাথে যােগ দেয় এলাকার সাঁওতাল যুবকেরা তাদের আদ্যিকালের অস্ত্র, তীর-ধনুক নিয়ে। বলাবাহুল্য এই প্রতিরােধ ছিল আত্মঘাতী। নারী-পুরুষ-শিশু নির্বিশেষে সকল মানুষকে গােপালপুর সুগার মিলে হত্যা করা হয়। আজিম সাহেব শহীদ হন। ওখানে কর্মরত আমার বড় ভাই তফাজ্জল ইমাম বহুকষ্টে আমার অন্তঃসত্ত্বা ভাবী এবং তাদের তিন সন্তানকে নিয়ে পদ্মানদী পাড়ি দিয়ে ভারত-সীমান্তে উপস্থিত হন।
মুক্তিযুদ্ধের বিশেষ করে সেনাবাহিনী, ই.পি.আর., পুলিশ, স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবকবৃন্দ, প্রশাসন এদের সকলের সমন্বয়ে গঠিত, আমি বলব গণফৌজেরবীরত্বের সম্পূর্ণ, সর্বাঙ্গীণ ইতিহাস এখনও রচিত হয়নি। আমরা মােটামুটি আমাদের নিজ নিজ এলাকার কাহিনী বর্ণনা করতে পারি। তার সাথে সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবসহ মুক্তিযােদ্ধাদের কাছ থেকে শােনা বা উদ্ধৃত ঘটনা আমরা জানতে পারি, লিখতে পারি। বাংলাদেশের ইতিহাস অবিকৃতভাবে রচিত হবে প্রকৃত ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের দ্বারা। বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর সরকারিভাবে এই ইতিহাস রচনার কাজ অতি অবহেলিত ছিল। ক্ষমতা দখলকারী রাজনৈতিক দলগুলাের দৃষ্টিভঙ্গি দলীয় স্বার্থের উপরে ওঠেনি। এমনকি, রাজনৈতিক নিরপেক্ষ নয়। একমাত্র নিরপেক্ষ ব্যক্তিই বাংলাদেশের প্রকৃত ইতিহাস লিখতে পারবেন। এসব কাহিনী ও গাথার অবতারণা করার উদ্দেশ্য একটিই, আর তা হল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সত্যিকার ব্যাপকতা এবং সকল স্তরের জনগণের সম্পৃক্ততা তুলে ধরা। আশার কথা, ২০০৯ সালে গঠিত সরকার মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরতে প্রয়াসপর হয়েছে। এটিই আমাদের জনযুদ্ধের চরিত্র ও বৈশিষ্ট্য সম্বন্ধে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জানবে।
প্রাথমিক পর্যায়ে প্রতিরােধযুদ্ধে পাকিস্তানিদের ঠেকানাে গেলেও পরবর্তীতে উন্নততর অস্ত্রশস্ত্র এবং ভারী কামান, ট্যাঙ্ক ইত্যাদির সম্মুখে শুধু বীরত্ব আর সাহসিকতা দিয়ে আমাদের মুক্তিবাহিনী আর জনগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়টি মাস বেশি সময় টিকে থাকতে পারেনি। একটি কারণ হল: ইতােমধ্যে সমুদ্রপথে আনীত বিভিন্ন জাহাজে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ইউনিটগুলাে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে নেমে পড়েছে। কাজেই সংখ্যায় তারা অধিক ছিল। দ্বিতীয়ত, ওদের ছিল বিমানবাহিনী যারা আমাদের শক্ত অবস্থানগুলােতে অবিরাম বােমা ও গুলিবর্ষণ করেছে। অনেকে শহীদ হয়েছেন, আহত হয়েছেন অসংখ্য।
ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করেও আমাদের যােদ্ধারা পিছু হটেছেন সুবিধামতাে নিরাপদ স্থানে, যেখানে তাঁরা শক্তি সঞ্চয় করেছেন। নতুন নতুন রিক্রুট হয়েছে, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা হয়েছে, পাওয়া গেছে হাতিয়ার আর গােলাবারুদ। ঐ সময়টাতে, অর্থাৎ এপ্রিল, মে, জুন, জুলাই মাসে পাকিস্তানিরা সারা বাংলাদেশে হত্যা, ধ্বংস, লুটতরাজ, ধর্ষণ—এক কথায় ব্যাপক গণহত্যায় মেতে উঠেছিল পৈশাচিক উম্মতায়। আর তখনই অগণিত বাঙালি ঘরবাড়ি ছেড়ে নিরাপদ আশ্রয়ে ছুটে গিয়েছে পার্শ্ববর্তী ভারতে। এ সময়ই ছিল বৃহত্তম শরণার্থীর ঢল।
জুলাই থেকে আরম্ভ হল আমাদের পাল্টা আক্রমণ। অগণিত নতুন সেনানী যােগদান করল আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর। তখন অস্ত্র এবং অন্যান্য সাহায্য আসতে আরম্ভ হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিক ধাক্কা কাটিয়ে সুসংহত হয়েছে। প্রতিষ্ঠিত হয়েছে অসংখ্য যুবশিবির, প্রশিক্ষণ শিবির। আমাদের সুশৃঙ্খল সেনা-কমান্ড সৃষ্টি হয়েছে—প্রধান সেনাপতি, চিফ অব স্টাফ, উপ-প্রধান চিফ অব স্টাফ এবং সেক্টর কমান্ডারদের নিয়ে চেইন-অব-কমান্ড স্থাপিত হয়েছে। সামরিক পরিকল্পনা কেন্দ্রীয়ভাবে সমন্বিত হচ্ছে। এদেরকে সমর্থন এবং সহযােগিতা করার জন্য বেসামরিক প্রশাসন, আঞ্চলিক প্রশাসন পরিষদ (Zonal Administrative Council), যুবশিবির ইত্যাদি দিনরাত পরিশ্রম করে চলেছে।
আমাদের পাল্টা আঘাত শুধু সম্মুখ সমরে নয়, বস্তুত গােটা দেশে গেরিলা-পদ্ধতিতে চোরাগােপ্তা হামলা চালিয়ে শত্রুকে পর্যুদস্ত করা হয়েছে। সুবিধা মতাে অবস্থানে থেকে সম্মুখ সমরেও লিপ্ত হয়েছে মুক্তিবাহিনী। আমাদের আক্রমণ শুধু সীমান্ত অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রত্যেক সেক্টর কমান্ডার এবং মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক কমান্ডার গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে হামলা চালিয়ে পাকিস্তানিদের হত্যা করতে শুরু করল। ঢাকা নগরী, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী সর্বত্র গেরিলা-আক্রমণে দিশেহারা হয়ে শক্র শুধুমাত্র বড় কয়েকটি সেনানিবাসেই আবদ্ধ হয়ে পড়ল। তাদের আরাধ্য কাজ, অর্থাৎ হত্যা, ধ্বংস, লুটতরাজের পরিকল্পনা সমাধা করার জন্য তারা লেলিয়ে দিল তাদের এদেশীয় দোসরদের।
মুক্তিবাহিনী প্রতিদিন শক্তি সঞ্চয় করেছে, সংখ্যায় ও গুণে-মানে। নতুন অস্ত্রসম্ভার সংগ্রহ করা হয়েছে তাদের জন্য। সমর-পরিকল্পনা এবং কৌশলও পরিবর্তন করা হয়েছে প্রয়ােজন। মতাে। সাথে সাথেই জনসমর্থন এবং সর্বস্তরের মানুষের যুদ্ধে সম্পৃক্ততা (প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ) বৃদ্ধি পেয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা মাও সেতুং-এর সেই বিখ্যাত উক্তি একজন গেরিলা হলাে পানিতে মাছের মতাে বাংলাদেশে সত্য প্রমাণিত করেছে। মাছ যেমন তার স্বাভাবিক আবাসে নির্ভয়ে, বিনা বাধায় চলাফেরা করে—আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা তেমনই দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক শহরে, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-শিক্ষক সকলের আশ্রয়ে, সাহায্যসহায়তায় মূল শিবির (base camp) থেকে দূরে এসে অপারেশন করে ফিরে গেছে। বাংলাদেশের প্রতিটি শহরেই অসংখ্য অপারেশন করেছে আমাদের ছেলেরা। শত্রুর শক্তি, অবস্থান, চলাচল, সরবরাহ লাইন— এসব তথ্য সংগ্রহ করে সেক্টর-কমান্ডার ও সেনাকমান্ডারদের দিয়েছে তাদের কৌশল ও আক্রমণে সিদ্ধান্ত নেবার জন্য। আবার প্রয়ােজনে আমাদের নিয়মিত বাহিনী বা সেক্টর ট্রপসদের পাশাপাশি সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী এবং হেমায়েতউদ্দীনের নাম চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। জাতি এদের কখনও বিস্মৃত হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সারাটা সময় এরা তাঁদের বাহিনী নিয়ে যেভাবে পাকিস্তানিদের ব্যস্ত রেখেছেন এবং পর্যদস্ত করেছেন সেটা আমাদের গৌরবােজ্জ্বল ইতিহাসের বিশেষ অংশ। এঁদের মতাে আরও যারা শত্রুকে বিভিন্ন অঞ্চলে বিশেষ করে ঢাকায় ব্যতিব্যস্ত রেখেছিলেন তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন মােফাজ্জল হােসেন চৌধুরী মায়া, নাসিরউদ্দীন ইউসুফ, তসলিম মােহাম্মদ আজিজ, মানিক (শহীদ), বাকী (শহীদ), ইঞ্জিনিয়ার নজরুল ইসলাম (শহীদ), রুমি (শহীদ জননী জাহানারা ইমামের পুত্র) এবং আরও অনেকে। মির্জাপুরের বাতেনের কথাও উল্লেখযােগ্য। এছাড়াও যারা বিভিন্ন স্থানে অপারেশন করেছেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন মানিকগঞ্জের হালিম-বাহিনী (ক্যাপ্টেন হালিম), ভালুকার আফসার-বাহিনী, রৌমারির আফতাব-বাহিনী, নােয়াখালীর লুঙ্করবাহিনী, যশােরের আকবর-বাহিনী ইত্যাদি। আরও অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধা বিভিন্ন অঞ্চলে সাহসিকতা ও দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখেছে পুরাে নয় মাস। অনেকে সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে শহীদ হয়েছেন। এঁদের সকলের কথা জাতিকে জানানাে আমাদের কর্তব্য। সেটি পালনের দায়িত্ব সরকারের। আমরা যে যতদূর জানি অবশ্যই তা দিয়ে সর্বাত্মকভাবে সরকারের সহায়তা করব। মুক্তিযােদ্ধাদের ইতিবৃত্ত নিয়ে কোনাে রাজনীতি করা সমীচীন নয়। সঠিক তথ্যে তাদের ইতিহাস রচিত হওয়া আবশ্যক। প্রকৃত ইতিহাসবিদগণ এ-কাজে সফল হতে পারেন।
এখানে আরেকটি কথা বলা প্রয়ােজন। দেশের অভ্যন্তরে ঘাপটি-মেরে-থাকা কিছুসংখ্যক দেশদ্রোহী- যারা তথাকথিত রাজাকার বা আলবদর নামে পাকিস্তানিদের ভাড়াটিয়া বলে কুখ্যাত হয়েছিল ঐ সময়, তারা মুক্তিবাহিনীর চলাচলের খবর শত্রুকে দিত। অনেক সময় অত্যাচার করে গ্রামবাসীদের কাছ থেকে খবর নেওয়া হতাে। এই ধরনের অপতৎপরতার ফলে অনেক মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়েছেন, আহত বা পঙ্গু হয়েছেন। অনেক গ্রাম-গঞ্জ পুড়ে ছারখার হয়েছে। মেয়েরা হয়েছে লাঞ্ছিত। সবরকম ভয়, জুলুম, অত্যাচার সহ্য করেও জনগণ তাদের মহান দায়িত্ব থেকে পেছপা হয়নি। সেজন্যই আমরা তখন দেখেছি প্রতিদিন মুক্তিবাহিনীর অসংখ্য তৎপরতা (action); ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, সিলেট, পাবনা, ভৈরববাজার, দিনাজপুর, খুলনায় এক কথায় দেশের সর্বত্র।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের ব্যাপ্তি ও প্রকৃতি সম্বন্ধে উপরে যে-বর্ণনা তা আরাে সমৃদ্ধ করতে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্তরে ও পদে নিয়ােজিত সরকারি, আধা-সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের এবং বিদেশে কর্মরত বা প্রশিক্ষণরত সহকর্মীদের মেধা, ত্যাগ, দেশসেবা, পরিশ্রম সম্পর্কে বিবরণ সংযুক্ত করা সঙ্গত কারণেই আবশ্যক।
আমার নিজের ঘনিষ্ঠ বন্ধুবান্ধব ও সহকর্মীদের কথা উল্লেখ করেই উপরে উল্লিখিত প্রসঙ্গের অবতারণা করতে চাই। আমরা ১৯৬১ ব্যাচের (সালের) প্রাক্তন সি.এস.পি.। ছাত্রজীবনেও আমরা অনেকেই সহপাঠী ছিলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদে (DUCSU) কমনরুম সেক্রেটারি ছিলাম ১৯৫৬-৫৭ শিক্ষাবর্ষে, ইকনমিকসে এম.এ. (১৯৫৮) পড়ার সময় আ.ন.ম. ইউসুফ ছিলেন ইতিহাসের। নূরুল আমিন খান ইংরেজির। মােহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা পাকিস্তানের উভয় অংশে পরিচিত গায়ক এবং সাঁতারু (কয়েকটি রেকর্ডের অধিকারী)। নূরুল কাদেরকে সবাই চিনত তুখােড় বক্তা, সুদর্শন এবং স্মার্ট ছাত্র বলে। মাসুদ আহমেদ ছিলেন ফজলুল হক হলের টেনিস ক্যাপ্টেন। মােহাম্মদ সিরাজউদ্দীন এবং রফিকুল্লাহ চৌধুরী পরিচিত ছিলেন ইতিহাসে ফার্স্ট ক্লাস এবং ভালাে ছাত্র। সৈয়দ শামীম আহসানকে সবাই জানত স্মার্ট এবং প্রতিশ্রুতিময় ছাত্র বলে (ও আমাদের দু- বছরের জুনিয়র বিশ্ববিদ্যালয়ে)। জালালউদ্দীন আহমেদও ছিলেন ইতিহাসের ভালাে ছাত্র এবং সুদর্শন। আরেক সুদর্শন, সপ্রতিভ সহকর্মী (আমাদের ব্যাচের) ছিলেন, নূরুল ইসলাম খান। উনি গণিতশাস্ত্র এবং পদার্থবিজ্ঞানে (Mathematics and Physics) ডাবল অনার্স নিয়ে পাস
পৃষ্ঠা: ১০
করেছিলেন। বিজ্ঞান-অনুষদের ছাত্র বলে কলাভবনে যাতায়াত ছিল কম, তাই তেমন একটা পরিচিত ছিলেন না।
স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে আমরা যথাক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রাম (আমি), ফরিদপুর (ইউসুফ), বরিশাল (নূরুল আমিন), পাবনা (নূরুল কাদের), রংপুর (শামীম), টাংগাইল (জালাল), খুলনা (নূরুল ইসলাম) জেলায় ডেপুটি কমিশনার এবং ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলাম। সিরাজউদ্দীন, আসাফউদ্দোলা, মাসুদ-এই তিনজন ছিলেন কেন্দ্রীয় সচিবালয়ে, ইসলামাবাদে কর্মরত। রফিকুল্লাহ চৌধুরীকে ১৯৬৯ সালে সামরিক জান্তা বাধ্যতামূলক অবসর দিয়েছিল (সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে)। প্রতিরােধযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার আগে থেকেই যাদের পক্ষে প্রস্তুতি গ্রহণ করা সম্ভব ছিল তার মধ্যে ছিলাম আমি, নূরুল কাদের খান, ইউসুফ, জালাল প্রমুখ। পরবর্তীকালে আমরা সকলেই তার খেসারত দিয়েছি। আমি আর নূরুল কাদের খান যুদ্ধরত অবস্থায় মুক্তিবাহিনীর সাথে ক্রমান্বয়ে পশ্চাদপসরণের পর একপর্যায়ে ভারতে চলে যাই। নূরুল আমিনকে মার্চ মাসে প্রাদেশিক সচিবালয়ে উপসচিব পদে বদলি করে আনা হয়। বদলির কারণ কোনাে-এক পাঞ্জাবি অফিসারের সাথে মনােমালিন্য, যা আক্রোশ এবং জিঘাংসার রূপ নেয়। ইউসুফ বেশ কিছুদিন মুক্তিবাহিনীর সাথে থেকে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন সাথে বন্দি হন তার এস.পি. (পুলিশ সুপার) নূরুল মােমেন খান এবং রাজবাড়ির এস.ডি.ও. সৈয়দ রেজাউল হায়াত। বিজয়ের পর ডিসেম্বর মাসে তারা কারামুক্ত হন। জালালউদ্দীন আমাদের সহকর্মী এবং সহপাঠী খন্দকার আসাদুজ্জামানের সাথে টাংগাইলে প্রতিরােধযুদ্ধে লিপ্ত হন। তাদের সাথে ছিলেন কাদের সিদ্দিকী। টাংগাইল থেকে জালাল ও আসাদ যমুনা নদী অতিক্রম করে চলে যান সিরাজগঞ্জে। কাদের সিদ্দিকী বীরবিক্রমে লড়াই চালিয়ে যান। সেখানকার এস.ডি.ও. শামসুদ্দীন, পাবনার জেলা প্রশাসক নূরুল কাদেরের সাথে একযােগে দীর্ঘদিন প্রতিরােধ বজায় রাখেন। পরবর্তীতে জালাল ফিরে আসেন টাংগাইলে। শামসুদ্দীন তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের (তার বড় ভায়রা) প্ররােচনায় ঢাকা আসেন এবং বন্দি হন সেনাবাহিনীর হাতে। অমানুষিক অত্যাচারের শিকার হন তরুণ শামসুদ্দীন এবং পরিশেষে শাহাদাত বরণ করেন। শামসুদ্দীনকে প্ররােচনাদানকারী তাঁর ভায়রা চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজম সেদিন হতভাগ্য শামসুদ্দীনকে পাকিস্তানি শত্রুদের হাত থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এই দৃষ্টান্ত কলঙ্ক হিসেবেই চিহিত হবে।
আমাদের ব্যাচের নূরুল আমিন খানকে, যিনি বরিশাল থেকে বদলি হয়েছিলেন ঢাকায়, ক্যান্টনমেন্টে ডেকে পাঠানাে হয়। প্রথমবার ছাড়া পেলেও দ্বিতীয়বার আর তিনি ফিরে আসেননি। মুক্তিযুদ্ধের আরেক শহীদ নূরুল আমিন খান। তাকে হত্যার আরেকটি কারণ হতে পারে তার শ্যালক (স্ত্রীর ভাই) ক্যাপ্টেন হারুন, যিনি কাপ্তাইয়ে ই.পি.আর. ইউনিটের দায়িত্বে ছিলেন। পশ্চিমাদের গ্রেপ্তার করে তিনি চট্টগ্রাম যান এবং ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ও মেজর জিয়াউর রহমানের সাথে যােগ দেন। হারুনুর রশিদ অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল।
আমাদের দুই বন্ধু (আমরা বলি ব্যাচ-মেট) মােহাম্মদ সিরাজউদ্দীন এবং মােহাম্মদ আসাফউদ্দৌলা ইসলামাবাদ থেকে পালিয়ে বহু কষ্টে যথাক্রমে খাইবার গিরিপথ এবং বেলুচিস্তান হয়ে আফগানিস্তান পৌঁছেন। সেখান থেকে কাবুল হয়ে দিল্লি এবং পরিশেষে ঢাকা। সেটা ১৯৭২ সালের মাঝামাঝি অথবা শেষার্ধে।
বন্ধুবর নূরুল কাদের যুদ্ধের সময়েই খানসেনাদের অত্যাচারে প্রতিবাদে নিজে নাম থেকে খানঝেড়ে ফেলেন। হয়ে যান শুধুই নূরুল কাদের, আমাদের ঝিলু ভাই। উনি আর এখন আমাদের মাঝে নেই। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিচারণমূলক তার বইয়ের নাম ‘একাত্তর আমার’। তার পদাঙ্ক অনুসরণ করেন আমাদের আরেক সহকর্মী নুরুল ইসলাম খান। মুক্তিযুদ্ধের পর তিনি তার নাম কিঞ্চিৎ পরিবর্তন করে পরিচিত হন নুরুল ইসলাম শামস নামে। নূরুল ইসলামও আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন।
১৯৬১ সালে আমাদের ব্যাচের সকলে বাঙালি সিভিল সার্ভিসের দুর্গ, সিভিল সার্ভিস একাডেমিতে একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে কালাে ব্যাজ লাগিয়ে খালি পায়ে ক্লাস করেছিলাম। একাট্টা থাকার ফলে ডিরেক্টর এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ আমাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলাজনিত কোনাে অভিযােগ আনেননি। আমি তিন নূরুলকে—আ-উ-ই যােগ করে যথাক্রমে নাক, ক, আর নিকউপাধি দিয়েছিলাম। আজ তিনজনই জান্নাতবাসী। আমি আজও তাঁদের শূন্যতা প্রকটভাবে অনুভব করি।
রফিকুল্লাহ চাকুরিতে না-থেকেও মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকায় অপারেশনে আসা গেরিলাদের সাহায্য করতেন। ১৯৭২ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর বঙ্গবন্ধু রফিকুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রীর সচিব নিয়ােগ করেন।
আমাদের ব্যাচের বাইরে অন্যান্য সি.এস.পি. দেশপ্রেমিক অফিসার যারা শহীদ হয়েছেন, কারারুদ্ধ হয়েছেন, ত্যাগ স্বীকার করে নানাভাবে নির্যাতিত হয়েছেন, তাঁদের সম্পর্কে বলতে গেলে কোনাে তথ্য বা আলােচনাই নেই কোথায়ও। একইভাবে সাবেক ই.পি.সি.এস. (পি.এস.পি. এবং প্রাদেশিক সার্ভিস), প্রকৌশলীবৃন্দ, অন্যান্য কর্মকর্তা যারা দেশমাতৃকার জন্য চরম ত্যাগ স্বীকার করেছেন, তাদের নিয়ে আমরা আলােচনা করি না কেন? এঁরা তাে সকলে জনযুদ্ধে শামিল সৈনিক।
অপর সি.এস.পি. শহীদ অফিসার হলেন শামসুল হক খান (কুমিল্লার ডি.সি.)। আমাদের সহপাঠী, চাকুরিতে একবছরের জুনিয়র (১৯৬২)। তিনি ও তার এস.পি. (পুলিশ সার্ভিসের) এঁদের উভয়কে যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই কুমিল্লার কুখ্যাত কশাই ব্রিগেডিয়ার ইকবাল শফির আদেশে কুমিল্লা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয় জিজ্ঞাসাবাদের জন্য। দুজনকে একই কামরায় আটকিয়ে চরম নির্যাতন করা হয়। পরিশেষে ২৫ মার্চ রাতে উভয়কে গুলিতে ঝাঁঝরা করা হয়।
তখনকার তরুণ লেফটেনান্ট ইমামুজ্জামানকে পাশের ঘরে আটকিয়ে রাখা হয়েছিল। সাহস, বুদ্ধি এবং আল্লাহর মর্জিতে তিনি পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। তিনি এখন অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ইমামুজ্জামান।
সি.এস.পি. শামসুদ্দীন ছাড়াও আরও একজন শামসুদ্দীন দেশের জন্য শহীদ হয়েছেন। কাপ্তাই পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্পের ম্যানেজার বা সুপারিনটেন্ডিং ইঞ্জিনিয়ার, যার সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। ২৫ মার্চ রাতে আমার সাথে টেলিফোনে কথা হয় তাঁর। তারপর বেশ কয়দিন তিনি কার্যত কাপ্তাইয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন (ক্যাপ্টেন হারুন চট্টগ্রাম যাত্রা করার পর)। হানাদার বাহিনী কাপ্তাই দখলের পর তাকেই প্রথম হত্যা করে।
রাঙামাটি সদরের এস.ডি.ও. আবদুল আলী এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি হন। সে সময় তিনি মুক্ত-অঞ্চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। অমানুষিক নির্যাতন করেও পাকিস্তানিরা তার কাছ থেকে আমাদের সম্পর্কে কোনাে তথ্য আদায় করতে পারেনি। প্রচণ্ড ক্রোধ এবং আক্রোশে পাকিস্তানিরা তাঁকে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধের কয়েক সপ্তাহ, ধরা পড়ার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত শহীদ আবদুল আলী প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন স্বাধীন বাংলার পক্ষে প্রতিরােধ-সংগ্রামে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের আরেক নায়ক সৈয়দ আবদুস সামাদ, যিনি আমার সাথে ঐ জেলার অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক এবং কাপ্তাই পুনর্বাসন প্রকল্পের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলেন। মার্চ মাসের শুরু থেকেই আমি, সামাদ এবং সহকর্মী, সহকারী পুনর্বাসন অফিসার এম. ই. শরিফ (ই.পি.সি.এস.), আবদুল আলী, (এস.ডি.ও. রাঙামাটি সদর) রুহুল আমিন (ম্যাজিস্ট্রেট) আমাদের তৎপরতা আরম্ভ করি। আমাদের সাথে ছিলেন, সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘােষণা করে এস.পি. (পুলিশ সুপার) বজলুর রহমান।
১৯৭১ সালের ১ মার্চে ইয়াহিয়া খান কর্তৃক ৩ মার্চে অনুষ্ঠেয় গণপরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘােষণার পর থেকেই সারা বাংলায় প্রতিবাদের ঝড় উঠল। সেই উত্তাল সময়ে মনে হয়েছিল এখনই বুঝি চারদিকে আগুন জ্বলে উঠবে। ঐদিনই বঙ্গবন্ধু তাঁর বিখ্যাত ভাষণ দিলেন হােটেল পূর্বাণীর চত্বরে। আমি সেদিন ঢাকায় সরকারি কাজে এসেছিলাম। সেই রাতেই রওনা হয়ে পরদিন সকালে চট্টগ্রাম। সেখানেও মনে হলাে গােটা শহর ফুঁসে উঠেছে যেন। ২ এবং ৩ মার্চে শুধু প্রতিবাদ মিছিল আর জনসভা। সম্ভবত ২ মার্চেই অনুষ্ঠিত হলাে লালদিঘির ময়দানে বৃহত্তম জনসভা। ঐদিন বিভিন্ন অবাঙালি কললানির পাশ দিয়ে যাবার সময় মিছিলের ওপর আক্রমণ চালায় পাকিস্তানিরা। তাদের সাথে শাদা পােশাক পরিহিত সৈন্যরাও ছিল। লাঠি, ইট-পাটকেল, গরম পানি এবং বন্দুকের গুলিতে অনেক চট্টগ্রামবাসী অগ্নিদগ্ধ এবং হতাহত হন। ঐ সময়ে আমরা এই সিদ্ধান্তে উপনীত হই যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আর থাকা যাবে না। তারপর এল ৭ মার্চ, বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ; শুরু হল অসহযােগ আন্দোলন এবং দেওয়ালে পিঠ-ঠেকে-যাওয়া (point of no return)। তখন থেকে আমরা আওয়ামী লীগের নির্দেশমালাই পালন করেছি। তদুপরি আমাদের পক্ষে ছিল পূর্ব পাকিস্তান সি.এস.পি. অ্যাসােসিয়েশন (C.S.P Association)-এর সিদ্ধান্ত।
এত কিছুর পরেও আমাদের উল্লেখযােগ্য সংখ্যক সহকর্মী সহযােগিতা করেননি। তাঁদের কেউ কেউ দ্বিধান্বিত ছিলেন। কেউ কেউ বাংলাদেশের বিরােধিতা করেছেন—প্রকাশ্যে বা অপ্রকাশ্যে। এই পটভূমিতে আমরা সকল অফিসার বা সহকর্মীকে আস্থায় নিতে পারিনি। যাদের বিশ্বাস করা যেত পুরােপুরি, তাদেরকেই আমরা বিভিন্ন রকম দায়িত্বে নিয়ােগ করি। উপরে সৈয়দ আবদুস সামাদ, এম. ই. শরিফ, আবদুল আলী (শহীদ) এবং বজলুর রহমান (এস.পি.) প্রমুখের নাম উল্লেখ করেছি। এ ছাড়াও আমাদের ছােট দলে (core group) ছিলেন কাপ্তাইয়ের প্রকৌশলী শামসুদ্দীন (শহীদ), ড. ফারুক আজিজ খান, তালুকদার (ডি.এস.পি.), রাঙামাটিতে পাবর্ত্য-চট্টগ্রাম উন্নয়ন প্রকল্পের পরিচালক ড. আলতাফ আলী, জেলা কাউন্সিলের প্রশাসনিক অফিসার বরেন ত্রিপুরা ও প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম। আমাদের সাথে সার্বক্ষণিক যােগাযােগ রাখতেন ই.পি.আর. বাহিনীর জে.সি.ও., বেতার কর্মী ও অন্যান্যরা। মাধ্যম ছিলেন রাঙামাটির তরুণ ছাত্রনেতা—সুনীল, দীপঙ্কর, দিদারুল এবং আরও অনেকে। এদের মধ্যে বেশ কয়েকজন অপারেশনে শহীদ হয় পরবর্তী সময়ে।
ম্যাজিস্ট্রেট শরিফ সাহেবকে নিয়ে সৈয়দ আবদুস সামাদ মার্চের প্রথম দিকেই চলে যান কাপ্তাইয়ে। তাঁদের দায়িত্ব ছিল কাপ্তাইয়ে ক্যাপ্টেন হারুনের ইউনিট এবং পুলিশের আর্মড ব্যাটালিয়নের (Armed Battalion) সাথে যােগাযােগ করে আসন্ন বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা এবং পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ। একই সাথে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ভারতের মিজোরাম রাজ্য বরাবর সীমান্ত এলাকায় আমাদের যে সমস্ত সীমান্ত চৌকি (অর্থাৎ বি.ও.পি.) ছিল সেখানে ই.পি.আর.-এর অফিসার (J.C.O. এবং N.C.O.) এবং জওয়ানদের উদ্বুদ্ধ করে আসন্ন সমরের জন্য ক্ষেত্র প্রস্তুত করা। এতে সামাদ কৃতকার্য হয়েছিলেন, যার ফলাফল আমরা চট্টগ্রাম এবং পার্বত্য চট্টগ্রামের যুদ্ধে পেয়েছি। কাপ্তাই এবং বরকল অঞ্চলে তৎপর থাকাকালীন অগ্রসরমান পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণে সামাদ এবং আমাদের অন্যান্য সহকর্মী পিছু হটতে বাধ্য হন। পরে তারা মিজোরামের আইজলে সমবেত হন। সেখান থেকে তাদেরকে ত্রিপুরা রাজ্যে নেওয়া হয়। পরবর্তীকালে পূর্বাঞ্চল (Eastern Zone) আঞ্চলিক প্রশাসন পরিষদে প্রশাসক নিযুক্ত হন সামাদ। সেই দায়িত্ব ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যােগ্যতা ও সাহসিকতার সাথে সামাদ তা পালন করেন। শরিফ কোলকাতায় আমার সাথে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে যােগ দেন উপসচিব পদে। সৈয়দ আবদুস সামাদ বাংলাদেশ সরকারের সময় (১৯৯৬-২০০১) প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছিলেন। শরিফ সাহেবকে বিজয়ের পর পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেন।
আমার সাথে আরাে যেসব সহকর্মী ছিলেন তাদের মধ্যে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন থানা ম্যাজিস্ট্রেট খান আমীর আলী। তিনি ছিলেন মারিশ্যায় কর্মরত থানা ম্যাজিস্ট্রেট। ২৫ মার্চের পর তিনি অন্যান্যদের সাথে মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। তিনি দিঘিলার দিকে অগ্রসর হয়ে পরবর্তীতে মেজর মীর শওকত আলীর (২০১১ সালে প্রয়াত) সাথে ছিলেন। একপর্যায়ে পায়ে গুরুতর আঘাত পান। ঐ অবস্থাতেই রামগড় এসে আমার সাথে। যােগদান করেন।
আমাদের সি.এস.পি. সহকর্মীদের মধ্যে ২৫ মার্চ থেকে এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত বিশেষ তৎপর ছিলেন বন্ধুবর মনযূর-উল করীম, নােয়াখালীর ডি.সি.। ফেনি থেকে তিনি বেশ কয়েকবার আমার সাথে টেলিফোনে যােগাযােগ করেন। পাকিস্তান বিমানবাহিনী ফেনিতে বােমাবর্ষণ করার পর তিনি আর এগিয়ে এসে আমাদের সাথে যােগদান করতে পারেননি। বিচ্ছিন্ন অবস্থায় কিছুদিন মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে সহযােগিতা করে তিনি মােটামুটি অসহায় ও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন।
আমাদের সাথে যােগদান করেছিলেন এমন দুজন সাহসী মুক্তিযােদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদ ও ফয়েজ আহমেদ, যথাক্রমে রাজশাহীর কমিশনার ও দিনাজপুরের ডেপুটি কমিশনার। আরাে যাদের কথা মনে পড়ছে তারা হলেন আবদুল মোেমন, জে.জি. ভৌমিক, বি.বি. বিশ্বাস প্রমুখ। এঁরা ই.পি.সি.এস. কাডারের সদস্য। মুক্তিযুদ্ধের সময় এঁদের সকলকেই গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল এবং তারা উল্লেখযােগ্যভাবেই তা পালন করেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রথম পর্যায়ে যারা শহীদ হন তাঁদের কয়েকজনের কথা উপরে উল্লেখ করেছি।
আমাদের পুলিশবাহিনী মুক্তিযুদ্ধে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এ-কথা সর্বজনবিদিত। পুলিশবাহিনীর সদস্য এবং অফিসারদের সাহসিকতা এবং ত্যাগ জাতি কখনও ভুলবে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদের আকস্মিক এবং ঘৃণ্যতম আক্রমণ যুগপৎ শুরু করে পিলখানায়, ই.পি.আর. এবং রাজার বাগ পুলিশ লাইনে গােলাবর্ষণ করে। ২৫ মার্চের কালে রাত্রিতে বিপুল সংখ্যক পুলিশ ভাইয়েরা শহীদ এবং আহত হন। যারা বেঁচে ছিলেন তাঁদের অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে শরিক হন। যে-সমস্ত জেলায় ভালাে এবং সুবিধাজনক অবস্থান ছিল সেসব জায়গায় পুলিশ ভাইয়েরা যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন।
মুজিবনগরে যারা যােগ দেন তাদের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম ছিলেন এম.এ. খালেক, রাজশাহীর সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল। তিনি পরে বাংলাদেশ পুলিশের প্রথম ডি.জি. এবং স্বরাষ্ট্র-সচিব পদে নিযুক্ত হন। অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন বজলুর রহমান, পার্বত্য চট্টগ্রামের এস.পি.। বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মকর্তা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হন। তাদের কথা কোনােদিন ভুলব না। জাতি তাঁদের কাছে অসীম কৃতজ্ঞ। আমি ব্যক্তিগতভাবে তাদের সকলকে চিনতাম। এখনও তাদের চেহারা আমার চোখে ভাসে।
সর্বপ্রথম যে পুলিশ অফিসারের মুখ আমার মনে পড়ে তিনি হলেন এস.পি. শাহ এম.এ. মজিদ (পি.এস.পি.)। গৌরবর্ণ (একেবারে লাল টকটকে) সুন্দর সুঠাম চেহারা, আমাদের সমবয়সী। চাকুরিতেও একই বছরের। আমার সাথে বন্ধুত্ব হয় আমি নারায়ণগঞ্জের এস.ডি.ও. থাকাকালীন, ১৯৬৪ সালে। উনি এস.ডি.পি.ও.। পরে উনি ফরিদপুরের এস.পি. হন। সেখানে ১৯৬৯-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিষদৃষ্টিতে পড়েন, কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীকে গ্রেফতার না-করায় রাতারাতি বদলি হয়ে যান সারদা পুলিশ ট্রেনিং কলেজে উপাধ্যক্ষ পদে (ভাইস প্রিন্সিপ্যাল), সেখানে অধ্যক্ষ ছিলেন খালেক সাহেব। ১৯৭০ সালে আবার এস.পি., রাজশাহীতে নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম কয়দিনেই রাজশাহী জ্বলে ওঠে প্রতিবাদে। নানারকম ছল-চাতুরী করে, মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে পুলিশ লাইনের সেপাইদের নিরস্ত্র করে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের লােকজন এবং পরে নির্বিচারে গুলি চালিয়ে হত্যা করে বহু পুলিশকে। ঐ সময়ে তারা ধরে নিয়ে যায় শাহ আবদুল মজিদ সাহেব এবং রাজশাহীর রেঞ্জ ডি.আই.জি. মামুন মাহমুদকে। উভয়েই পুলিশ লাইনে উপস্থিত ছিলেন ২৬ মার্চ। পরে সেখান থেকে চলে গিয়ে আবার ফিরে আসেন। ৩১ মার্চ গ্রেপ্তার হন। আর ফিরে আসেননি। উভয়েই শহীদ হন। মামুন মাহমুদও আমার পূর্বপরিচিত ছিলেন। অত্যন্ত ভালাে এবং অমায়িক ভদ্রলােক। কবি বেগম শামসুন্নাহার মাহমুদের বড় ছেলে। ছােট ছেলে মাইনুউদ্দীন মাহমুদ (ওরফে মাইনু) আমাদের সহপাঠী, স্কুলজীবন থেকে। পাকিস্তান আমলে পূর্বপাকিস্তান ক্রিকেটের উজ্জ্বল নক্ষত্র। সবাই বলত মাইনু ভাই। আমাদের মাইনু – ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সবচাইতে দুষ্ট আর হাসিখুশি ছাত্র। দুই ভাইয়ের কেউই আমাদের মাঝে নেই।
ফদিপুরে আমাদের বন্ধু ইউসুফের কথা আগেই বলেছি। তার সাথে কারারুদ্ধ হন তার এস.পি. আমাদের বন্ধু নূরুল মােমেন খান (মিহির)। তিনিও আমাদের ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আমরা একই সাথে ১৯৫৬-৫৭ সালে ডাকসুর সদস্য ছিলাম। শাহ আবদুল মজিদের পি.এস.পি. ব্যাচমেট। ওঁদের সাথে আরও কারাগারে ছিলেন সৈয়দ রেজাউল হায়াত, মাদারিপুরের এস.ডি.ও.। এদের সকলকে পরে ঢাকায় তখনকার সেকেন্ড ক্যাপিটাল শেরেবাংলা নগরে অন্ত রীণ করা হয়। জায়গাটির নামকরণ হয় পি.ও.ডব্লিউ. (Prisoners of War) ক্যাম্প। এর সকলেই সতিকার অর্থে যুদ্ধবন্দি (POW), কেননা তারা ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা। এখানে আরও ছিলেন আইয়ুবুর রহমান (বরিশালের ডি.সি.), রাজবাড়ির এস.ডি.ও. শাহ্ মােহাম্মদ ফরিদ, ডাক ও টেলিযােগাযােগের (Post and Telecommunication) উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী লােকমান হােসেন। প্রচণ্ড নির্যাতনের ফলে লােকমান সাহেব গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন। বিজয়ের পরে পরেই তাকে আমরা চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠাই। সুস্থ হয়ে দেশে ফেয়ার পর তাঁকে ডাক ও তার মন্ত্রণালয়ের সচিব পদে নিয়ােগ করা হয়।
আইয়ুবুর রহমান আমার ছেলেবেলার বন্ধু এবং সহপাঠী। আমরা কোলকাতা পার্কসার্কাস হাই স্কুলে একসাথে পড়তাম পাকিস্তানে চলে আসার পূর্বে। পরে আবার উভয়ে সহপাঠী হই ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলে এবং পরবর্তীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিক্স পড়ার সময় এম.এ. ক্লাসে। আইয়ুবুর রহমান অত্যন্ত সৎ, দক্ষ এবং দৃঢ়চেতা ব্যক্তিত্ব। ১৯৯৬ সালে মন্ত্রিপরিষদ-সচিব ছিলেন। দক্ষতা এবং নিরপেক্ষতার সাথে নিজের দায়িত্ব পালন করেন। এ.এন.এম. ইউসুফেরও একই রকম সুনাম আছে। তিনি দীর্ঘকাল প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ছিলেন। রেজাউল হায়াতও তাই। তিনি দক্ষতার সঙ্গে ২০০৩ সালেও যােগাযােগ সচিব পদে কর্মরত ছিলেন। ড. শাহ মােহাম্মদ ফরিদ বিজয়ের পরে টাঙ্গাইলের জেলা প্রশাসক নিযুক্ত হন। ২০০১ সালে বিচারপতি লতিফুর রহমানের অন্তর্বর্তী সরকারের মুখ্য
পৃষ্ঠা: ১৫
সচিব ছিলেন স্বল্পকালের জন্য। ঐসময় তার ভূমিকা যথেষ্ট বিতর্কিত ছিল। উনি ২০০৪ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ছিলেন।
আমাদের বন্ধু কুমিল্লার জেলা প্রশাসক (১৯৭১) শহীদ শামসুল হক খানের কথা আগে বলেছি। তারই সাথে একই কামরায় নির্মমভাবে নিহত হন কুমিল্লার এস.পি.। পুলিশের আরেক জনপ্রিয় এবং সিনিয়র অফিসার চট্টগ্রামের এস.পি. শামসুল হক- মুক্তিযুদ্ধে তিনিও শহীদ হন। চট্টগ্রামে শহীদ হন দুজন উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী। একজন চট্টগ্রাম বন্দরের প্রধান প্রকৌশলী। আরেকজন পূর্বাঞ্চল রেলের উচ্চপদস্থ প্রকৌশলী। এঁদের নাম মনে করতে পারছি না।
মুক্তিযুদ্ধে কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীদের ভূমিকা ছিল অবিস্মরণীয়। এই যুদ্ধেই আমরা দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তানদের হারিয়েছে। তাও স্থানীয় তাঁবেদারদের ষড়যন্ত্রের ফলে। এই কষ্টের কথা কোনােদিন মুছে যাবার নয়। আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা শুধু তাদের লেখায়ই নয়, অনেকে সরাসরি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। মসি ছেড়ে অসি হাতে নিয়েছেন। আমাদের শিল্পীরা শুধু পশ্চিমবাংলায় নয়, বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এলাকায়, মুক্তিবাহিনীর ঘাটিতে, মুক্তাঞ্চলে গান গেয়ে আবৃত্তি করে যােদ্ধাদের মনােবল চাঙা করেছেন। কবি আল মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ, রফিক আজাদ, মহাদেব সাহা, শিল্পী কামরুল হাসান, শাহাবুদ্দীন, কণ্ঠশিল্পী আবদুল জব্বার, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, কাদেরী কিবরিয়া, রথীন্দ্রনাথ রায়, তপন ভট্টাচার্য (মাহমুদ), সনজিদা খাতুন, সমর দাস, হাসান ইমাম, রফিকুল আলম; আরও অনেক নামী ও গুণী শিল্পীর অংশগ্রহণে আমাদের জাতীয় জনযুদ্ধ সমৃদ্ধ হয়েছে। শিল্পী কামরুল হাসান তাে আমাদের সবসময় প্রেরণা ছিলেন। তাঁর বিখ্যাত কার্টুন এই জানােয়ারটাকে হত্যা করতে হবেইয়াহিয়া খানের বীভৎস চরিত্র-চিত্র ছিল। বিজয়ের পর বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তার অনেক চিরে সাথেই জড়িত ছিলেন তিনি। জাতীয় পতাকার রাষ্ট্রীয় ডিজাইন (সঠিক মাপ ও রং), জাতীয় প্রতীক, জাতীয় ফুল শাপলা ফুল, যা নির্বাচন করেছিলেন কবি সানাউল হক, আমাদের জ্যেষ্ঠ সহকর্মী), জাতীয় পাখি দোয়েল—এগুলাে ছিল শিল্পী কামরুল হাসানের অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এই সব কাজই মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অমর দেশাত্মবােধক গান এবং এম. আর. আখতার মুকুলের চরমপত্র আমাদের অবিরাম উজ্জীবিত করেছে। রেখেছে মনােবল তুঙ্গে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পীবৃন্দ এবং কলাকুশলীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জাতি এঁদের চিরকাল শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে।
বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ড. এ.আর. মল্লিক, প্রফেসর আনিসুজ্জামান, প্রফেসর আলী আহসান, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, প্রফেসর রেহমান সােবহান, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর মােশাররফ হােসেন, প্রফেসর খান সরওয়ার মুরশিদ, প্রফেসর মযহারুল ইসলাম প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে নতুন মাত্রা যােগ করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধকে গতিশীল করেছেন এঁরা। ড. মযহারুল ইসলাম ছিলেন বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতির সদস্য। তিনি লােকসাহিত্য প্রকল্পের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি জুলাই ১৯৭১ সালের ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে ও অঞ্চলে জনসংযােগ কাজে গমন করেন। প্রফেসর মযহারুল ইসলাম স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রেও নিয়মিত অংশগ্রহণ করে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন। বিশ্বের দরবারে আমাদের, বাংলাদেশের, স্বাধীনতাযুদ্ধের যৌক্তিকতা, ন্যায় এবং বৈধতা তুলে ধরেছেন এইসব মহৎ ব্যক্তিত্ব।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান প্রসঙ্গে বিশেষভাবে স্মরণ করি আমাদের আরেক প্রিয় শিক্ষক প্রফেসর রেহমান সােবহানকে। ড. মাহমুদ আর প্রফেসর রেহমান সােবহান পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের বৈষম্য এবং পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তানে অর্থনৈতিক শােষণের ওপর নিবিড়ভাবে গবেষণা করতেন। রাজনীতির বাইরে মানুষ হিসেবে তারাই সবচাইতে সরব ছিলেন। রেহমান সােবহান বঙ্গবন্ধুর ৬-দফা প্রণয়নেও বিশেষ ভূমিকা রাখেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী ২৬ মার্চের ধ্বংসযজ্ঞের পর ২৭ তারিখে স্বল্পকালীন সময়ের জন্য কারফিউ আদেশ শিথিল করে। ঐ অল্প কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই তিনি স্ত্রী সালমা এবং দুই ছেলেকে ঢাকার বাসায় রেখে বের হয়ে পড়েন আগরতলার পথে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন ড. আনিসুর রহমান। আগরতলাতে তাদের দেখা হয় এম. আর. সিদ্দিকীর সাথে, যিনি ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রীর সহযােগিতায় দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। রেহমান সােবহান সাহেবের উদ্দেশ্যও দিল্লিতে যাওয়া, কেননা সেখানে তাঁর পূর্ব-পরিচিত অনেকেই বাস করতেন। সবাই একসাথে দিল্লি যাত্রা করেন। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের ওপর পাকিস্তানি আক্রমণের প্রকৃত চিত্র তুলে ধরা এবং ভারত ও বিশ্বমানবতার কাছে সাহায্যের আবেদন করা। এই সফর আমাদের সকলের জন্য সুদূরপ্রসারী ফল নিয়ে আসে। দিল্লিতে ড. অমর্ত্য সেন, ড. সুখময় চক্রবর্তী এবং অন্যান্য নামকরা বুদ্ধিজীবী তাে ছিলেনই, উপরন্তু তাদের মাধ্যমে ভারত-সরকারের সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকদের সাথেও দেখা করতে পারেন। সংগ্রামের সেই প্রথম পর্যায়ে এপ্রিলের ৭ তারিখের মধ্যেই রেহমান সােবহান ও সিদ্দিকী ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ে শ্রী পি.এন. ধর ও শ্রী পি. এন. হাকসারের সাথে দীর্ঘ আলােচনার সুযােগ পান। সেখানে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামেরও সাক্ষাৎ পান। ঐ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যবর্গ এবং ঝানু আমলারা কেউই বাংলাদেশের ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞের ব্যাপকতা সম্পর্কে জানতেনই না। অধিকন্তু এদেশের নেতৃবৃন্দ কে কোথায়, বঙ্গবন্ধু কেমন আছেন, সৈয়দ নজরুলসহ আওয়ামী লীগের অন্য নেতাদের কী অবস্থা সে সম্বন্ধে তাদের কোনাে ধারণা ছিল না। এই কঠিন অবস্থার মধ্যে তাজউদ্দীন আহমদের জন্য রেহমান সােবহানের উপস্থিতি ও পরামর্শ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা তখন প্রথম গুরুত্বপূর্ণ কাজ। তার পরেই প্রয়ােজন মন্ত্রিসভা গঠন ও শপথ গ্রহণ এবং আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের কর্মকাণ্ড আরম্ভ করা। এই সময় ভারতীয়রা খবর দিলেন যে পাকিস্ত নি সরকার তাদের প্রবীণ ও ঝানু অর্থনীতিবিদ-আমলা এম.এম. আহমেদকে আমেরিকা পাঠাচ্ছে সাহায্যের আবেদন নিয়ে। তাজউদ্দীন সাহেবের অনুরােধে রেহমান সােবহান বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে রওনা হয়ে গেলেন আমেরিকায়।
আমেরিকাতে রেহমান সােবহান তাঁর গভীর দেশপ্রেম, মেধা আর বাকচাতুর্য দিয়ে এম.এম. আহমেদ এবং পাকিস্তানি দলের উপস্থাপিত সমস্ত মিথ্যা তথ্য ও ভ্রান্ত যুক্তি খণ্ডনই শুধু করলেন না, যুক্তি তর্ক এবং বাংলাদেশের সঠিক চিত্র তুলে ধরে সকলের মন জয় করলেন। পাকিস্তানের বর্বর আক্রমণের আসল মুখােশ উন্মােচিত করলেন রেহমান সােবহান। বড় বড় পণ্ডিত ব্যক্তি, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ তার কথা শুনলেন। সত্যের জয় হলাে। নিউইয়র্ক টাইমস্, ওয়াশিংটন পােস্ট, বাল্টিমাের সান, শিকাগাে ট্রিবিউন (The New York Times, The Washington Post, The Bultimore Sun, The Chicago Tribune) ইত্যাদিন মতাে পত্রিকা সম্পাদকীয় লিখল বাংলাদেশের ওপর, পাকস্তিানকে ধিক্কার জানিয়ে। আমেরিকান কংগ্রেসের হাউস অব রিপ্রেজেনটেটিভস এবং সিনেটের প্রধান নেতারা তার কথা শুনলেন। রেডিও-টিভিতে তাঁকে ডাকা হলাে ঘন ঘন বক্তব্য শােনার জন্য এবং সাক্ষাৎকার প্রদানের জন্য। এর ফলে সিনেটে চার্চ-স্যাক্সবি সংশােধনী (ChurchSaxby Amendment) আনা হলাে পাকিস্তানকে সাহায্যের জন্য কংগ্রেসে উপস্থাপিত বিলে (Aid to Pakistan Bill).
বিশ্বব্যাংকের (The World Bank) প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা প্রফেসর রেহমান সােবহানকে সাক্ষাৎকার দিলেন, যার প্রভাব পড়েছিল বিশ্বব্যাংকের পাকিস্তান নীতির ওপর।
নিক্সন এবং কিসিঞ্জারের পাকিস্তান প্রীতির কারণে বাংলাদেশের কেউই হােয়াইট হাউস এবং পররাষ্ট্র দপ্তরে (The White House এবং State Department) ঘেষতে পারত না। তা সত্ত্বেও স্টেট ডিপার্টমেন্টের দুই নম্বর ব্যক্তি হ্যারল্ড সন্ডার্স (Harold Saunders) রেহমান সােবহানকে সাক্ষাৎকার দান করেন। বিশ্বব্যাংক এবং আমেরিকার এইড দপ্তরে (World Bank এবং US AID) অনেক কর্মকর্তাই তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে যা ঘটছিল সে সম্পর্কে সম্পূর্ণ অবহিত ছিলেন। এইসব সংস্থায় তাই বাংলাদেশের প্রতি সংবেদনশীল মনােভাবাপন্ন লােকের অভাব ছিল না। রেহমান সােবহানের উপস্থিতি এবং এ.এম.এ. মুহিত ও অন্যান্য বাঙালির গণসংযােগ তৎপরতা আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে শক্ত জনমত গড়ে তােলে।
রেহমান সােবহান আমেরিকায় যাওয়ার ফলে সকলে তার চাক্ষুষ বর্ণনা শুনলেন। শিহরিত হলেন; ঘৃণা ও ধিক্কার প্রকাশ করলেন। যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত বাঙালিরা একত্র হলেন, দূতাবাসে ও অন্যান্য জায়গায় কর্মরত বাঙালিদের মধ্যে নতুন প্রেরণার সঞ্চার হলাে। রেহমান সােবহান মে মাসে ফিরে এলেন মুজিবনগরে। কিছুদিন পর তাকে সরকারের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয়।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের আরেকটি বৈশিষ্ট্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষতা এবং জাতি, বর্ণ, ধর্মনির্বিশেষে সকলের অংশগ্রহণ। মুসলমান, হিন্দু তাে বটেই, বৌদ্ধ এবং পার্বত্য উপজাতিরাও পিছিয়ে ছিলেন না। বিখ্যাত বৌদ্ধভিক্ষু আচার্য জ্যোতিপাল মহাথেরাে বিদেশে, বিশেষ করে বৌদ্ধ-প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ত্রিপুরার হরিণার কাছে এক বৌদ্ধবিহারে গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ভ্রাম্যমাণ দূত নিয়ােগের কথা জানালে তিনি সানন্দে সম্মত হন। তাঁর অবদান ছিল অনেক।
উপজাতিদের অনেকেই আমাদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে সহযােগিতা করেছেন। এদের অন্যতম ছিলেন মানিকছড়ির মং রাজা। তিনি সরাসরি মেজর মীর শওকত আলীকে মার্চএপ্রিল মাসে সহযােগিতা করেন। পরবর্তীকালে ভারতে আশ্রয় নেবার পর সরকার তাঁর জন্য বিশেষ ভাতা মঞ্জুর করে। তিনি পার্বত্য অঞ্চলগুলিতে ঘুরে-ঘুরে উপজাতিদের মধ্যে আমাদের প্রচারকাজ চালাতেন। বরেণ ত্রিপুরার কথা আগেই বলেছি। চাকমাদের একটা বিরাট অংশ আমাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন। মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বেশকিছু চাকমাত্রিপুরা যুবক ছিলেন। কয়েকজন শহীদ হয়েছেন। মেজর রফিক (বীরউত্তম) তাঁর সহযােদ্ধাদের মধ্যে চাকমাদের কথাও উল্লেখ করেছেন। বিখ্যাত ফুটবলার মারির উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছেন তিনি।
বাংলাদেশের জনযুদ্ধের আকৃতি-প্রকৃতি সম্পর্কে কয়েকজন বিখ্যাত বীর মুক্তিযােদ্ধাকে উদ্ধৃত করা যেতে পারে। মীর শওকত আলী তাঁর লেখা মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা ও প্রসঙ্গ কথা প্রবন্ধে লিখেছেন: মুক্তিযােদ্ধাদের সম্বন্ধে আমার একটা অভিমত আছে। আমার এলাকায়, আমি মনে করি, যত বেসামরিক জনসাধারণ ছিলেন, অত্যন্ত নগণ্য সংখ্যক কিছু ব্যক্তি যারা ইচ্ছাকৃতভাবে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যভিচারে সাহায্য করেছে তারা ব্যতিত আমার সিলেট এলাকায় তালিকাভুক্ত এবং তালিকাবিহীন মুক্তিবাহিনী বাদে আর যারা ছিলেন সবাই আমার মুক্তিবাহিনী ছিলেন। এমনকি কোনাে-কোনাে রাজাকারও ছদ্মবেশে মুক্তিবাহিনী ছিলেন। কারণ, এরাও সাহায্য করত। রাতে এসে আমাদের খবর দিয়ে দিত, কিংবা আমরা গেলে তারা ইশারায় আমাদের বলে দিত পাকিস্তানি সৈন্য আছে কি না, তাদের অবস্থান কোথায় ইত্যাদি।
পুনরুক্তি করেই বলছি, যারা উদ্দেশ্যপ্রণােদিত হয়ে পাকিস্তানিদের সাহায্য করত, এমন কিছু রাজাকার ছাড়া বাকি সবাইকে আমি মনে করি মুক্তিযােদ্ধা(মুক্তিযুদ্ধ: পঁচিশ বছর, রহীম শাহ সম্পাদিত, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ৮৩)।
আরেকটি উদ্ধৃতি জনযুদ্ধঅধ্যায়ে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা মেজর রফিকুল ইসলাম, বীর উত্তম-এর লেখা থেকে উদ্ধৃতিটি এ রকম: বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ।’ শীর্ষক প্রবন্ধে তিনি লিখেছেন: ‘…মুহূর্তে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে যায় পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে। বাঙালি জাতির ভাগ্যনির্ধারণী রাজনৈতিক চূড়ান্ত সংগ্রামে জড়িয়ে পড়ে ঐ তরুণ। ঐ অচেনা তরুণ আর বাংলার প্রতিটি স্বাধীনতাকামী মানুষের সঙ্গে আমি আমার মতাে অনেকেই জড়িয়ে পড়ল মুক্তির মহাআন্দোলনে। ইতিহাসের স্রোতােধারায় ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে একই অভীষ্ট লক্ষ্যে আমাদের যাত্রা শুরু হল (আমি তখন সামরিক বাহিনীর অফিসার, ডেপুটেশনে চট্টগ্রাম ইপিআর-এর অ্যাডজুটেন্ট পদে নিয়ােজিত)। ঐসব তরুণ, যুবক, বাংলার মানুষেরা আমাকে চেনে না, জানে না। আমাদের মতাে ক্যাপ্টেন, মেজর, কর্নেল তাে দূরের কথা, পাকিস্তানের সিনিয়র জেনারেলদের কয়েকজন ছাড়া আর কারাে নামও সাধারণ মানুষ জানে না জানবার প্রয়ােজনও নেই। কারণ, জনতার এই সংগ্রাম, এই মহান আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের, জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের। পৃথিবীর ইতিহাসের প্রতিটি রাজনৈতিক আন্দোলনে, স্বাধীনতার সংগ্রামে সবসময়ই জনগণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের নির্দেশে সংগ্রাম করেছে। অতীতে, বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও এর কোনাে ব্যত্যয় ঘটবে না।’ (মুক্তিযুদ্ধ: পঁচিশ বছর, রহীম শাহ্ সম্পাদিত, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৭, পৃষ্ঠা ১৬২-১৬৩)।
আরাে একটি উদ্ধৃতি জনযুদ্ধবিষয়ে খুবই প্রাসঙ্গিক। মুক্তিযােদ্ধা মেজর এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন তাঁর গবেষণামূলক মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থাননামক গ্রন্থের ৪৬ সংখ্যক পৃষ্ঠায় লিখেছেন: রাজনৈতিকভাবে বাঙালি সৈনিকদের প্রতি সুস্পষ্ট পূর্বনির্দেশনার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সামরিক, আধাসামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা পক্ষত্যাগ করে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের সহযােগিতায় স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ মতাে করে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এ-ব্যাপারে সহযােগিতায় এগিয়ে আসে।
এই অধ্যায়টি শেষ করার আগে আমার নিজের একটি ক্ষোভ প্রকাশ না করে পারছি। স্বাধীনতার পর সুদীর্ঘ কাল ধরে মুজিবনগর সরকারের কৃতিত্ব সম্বন্ধে কোনাে আলােচনা হয় না। যার নেতৃত্বে সবকিছু পরিচালিত হয়েছে তাকে অসম্মান করার পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছে কোনাে কোনাে মহল।
বেসামরিক ব্যক্তি যেমন মানিক, বাকী, রুমী (জাহানারা ইমামের পুত্র), স্বপন চৌধুরী, শামসুদ্দিনসহ ড. জি সি দেব, অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা, ড. মনিরুজ্জামান, ধীরেন, দত্ত, যােগেশ চন্দ্র ঘােষ প্রমুখ মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন তাদেরও কোনাে স্বীকৃতি নেই। তাদের দেওয়া হয়নি কোনাে রাষ্ট্রীয় মর্যাদা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ওপরে লেখা বইপত্র, আলাপ-আলােচনা সবক্ষেত্রেই ব্যক্তিবিশেষের বীরত্ব আর অবদানের কথা উল্লেখ করা হয়। উৎসাহের আতিশয্যে কাউকে আমরা আকাশছোঁয়া মর্যাদায় নিয়ে যাই। আবার একই রকম বীরত্ব বা অবদানের জন্য পাশাপাশি আরেকজনের অবদান উল্লেখই করি না। আমার মতবাদের বা আদর্শের ব্যক্তি হলে তিনি সব সমালােচনার উর্ধ্বে। আর ভিন্ন মতাদর্শের হলে মুক্তিযুদ্ধের নায়কও খলনায়ক বনে যান। ১৯৭১ সালে যুদ্ধের সময় যাদের নাম মুখে-মুখে শােনা যেত অসম সাহসিকতা আর বীরত্বের জন্য; সম্মুখ সমরে আর নেতৃত্বে যারা ছিলেন তুলনাহীন-কী স্বচ্ছন্দে আমরা তাদের আঁস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করলাম। কিন্তু সত্যকে তাে চিরদিন লুকিয়ে রাখা যায় না। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন ঘটনা, কর্মকাণ্ড, মুক্তিবাহিনীর বীরত্বগাথা, পাকিস্ত নিদের নির্মম অত্যাচার ও গণহত্যা- এসবই দেশে-বিদেশে পত্র-পত্রিকায়, টি.ভি-রেডিওতে প্রচারিত হয়েছে, বিভিন্নভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে এবং সযত্নে সংরক্ষিত হয়ে আছে। ভারতে, ব্রিটেনে ব্রিটিশ মিউজিয়াম, আরকাইভস ইত্যাদিতে, আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে (লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে) মুক্তিযুদ্ধের অসংখ্য দলিলপত্র ও তথ্য পাওয়া যাবে। আমরা তাে যে রেকর্ড আমাদের অনুকূলে আসবে না সেটা হয় পরিহার করি, না হয় ফেলে দেই। যাই হােক, ইচ্ছা করলেই তাে ইতিহাস পাল্টানাে যাবে না। যা সত্য তা সবসময়েই সত্য। মিথ্যা, মিথ্যাই।
আরেকটি বিষয় হলাে ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু ও জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি সাধারণভাবে বৈরি মনােভাব প্রকট করে তােলা। এই মনােভাবের সৃষ্টি অবশ্য ১৯৭২ সাল থেকেই। জনগণের মধ্যে ঘাপটি মেরে থাকা গণশত্রুরা তখন থেকেই সক্রিয় ছিল। ভােল পাল্টাতে সময় লাগেনি। আরেক দল ক্ষমাপ্রাপ্ত, বাংলাদেশি পােশাকে জাত পাকিস্তানি, সুযােগ পেলেই আঘাত হেনেছে। পাকিস্তান-প্রত্যাগত সামরিক বাহিনীর বিরাট অংশ ১৯৭৩ সালে ফিরে আসার পর সামগ্রিকভাবে কখনই বাংলাদেশের প্রতি আন্তরিক আনুগত্য পােষণ করেনি। বাইরে তারা স্বাধীনতা, বাংলাদেশ, দেশপ্রেম, বঙ্গবন্ধু বলতে অজ্ঞান ছিলেন। এরা নানাভাবে, নানা কৌশলে দুটো জিনিস অর্জন করে। এক, মুক্তিযােদ্ধাদের সম্বন্ধে জনমনে, বিশেষ করে শহরে এবং শিক্ষিত সমাজের মধ্যে এমন একটা ধারণা দেয় যে মুক্তিযােদ্ধারা (আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ, সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ) ভারতে চলে গিয়েছিলেন প্রাণ বাঁচাতে। তারা যুদ্ধ করেননি; আরাম-আয়েশ করেছেন। দুই, মুক্তিযােদ্ধারা কোনাে কাজের নয়; এরা লেখাপড়ায় ভালাে নয়; পড়াশুনা জানে না; এদের ভালাে পােস্টিং দিলে কাজ হবে না ইত্যাদি। এরকম এক অপপ্রচারের ফলে সাধারণভাবে মুক্তিযােদ্ধারা সর্বত্র অসুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে দীর্ঘকাল, বলতে গেলে স্বাধীনতার পর অধিকাংশ সময় পর্যন্ত। (অবশ্য ১৯৭২-৭৪ এবং ১৯৯৬-২০০০) সময়কাল এর ব্যতিক্রম)।
সামরিক বাহিনীর ভেতরে চলেছে অন্য আরেক রকম ষড়যন্ত্র। সেটা হলাে কাঁটা দিয়ে কাঁটা তােলা, Divide and Rule নীতি (বিভাজন করে শাসন করাে)। খুব সূক্ষ্ম এবং সুচতুরভাবে মুক্তিযােদ্ধা সেনা-অফিসারদের মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ এবং অবিশ্বাসের বীজ বপন করা হয়। এদের মধ্যে কেউ কেউ অবশ্যই উচ্চাভিলাষী ছিলেন; দুয়েকজনের আচরণও ভালাে ছিল না; আবার কয়েকজন অতিবিপ্লবী দেশে অবিলম্বে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্বপ্নে বিভাের হন। এসব কারণে সামগ্রিক এবং সমষ্টিগতভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের চরম ক্ষতি হয়। সুযােগসন্ধানী এবং স্বাধীনতাবিরােধী চক্রের সাথে হাত মেলায় স্বার্থান্বেষী মহলের অফিসাররা। লক্ষ্য করলে দেখা যাবে স্বাধীনতার পর যত ষড়যন্ত্রমূলক অভুত্থান হয়েছে তার সবগুলােতেই বলি হয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা। নিজেরা হানাহানি করেও প্রাণ বিসর্জন দিয়েছেন বা বিতাড়িত হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে বলতে ইচ্ছে হয়: আমরা মুক্তিযুদ্ধ চাই, মুক্তিযােদ্ধাদের চাই না। দেশের কল্যাণে কাজ করবেন যিনি, তিনিই প্রকৃত সমরবিদ, অন্য কেউ নয়। তার গলায় শােভা পাবে বিজয়মাল্য।
স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাগরিক আজ খুঁজে পাওয়া কঠিন। এই রূঢ় সত্যটি চরম হতাশাব্যঞ্জক এবং বেদনাদায়ক। একবিংশ শতাব্দীর প্রথম দশকের বাংলাদেশের মূল সমস্যাও এখানেই।
পৃষ্ঠা: ২০
স্বাধীন বাংলাদেশে বিশ্ববাসী, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আস্থাশীল এবং প্রকৃত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে আমি কোনাে পার্থক্য দেখি না। জনযুদ্ধের যে- বৈশিষ্ট্যগুলি সম্বন্ধে আলােচনা করেছি তাতে বাংলাদেশের প্রায় সবাই মুক্তিযােদ্ধা। কিন্তু তার একটি শর্ত আছে। সেটি হলাে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ নাগরিক হতে হবে।
পরিশেষে, জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল মুক্তিযােদ্ধার স্বীকৃতি দাবি করা আমার সর্বোচ্চ কর্তব্য বলে মনে করছি। সহ-মুক্তিযােদ্ধা যারা দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছেন, রক্ত দিয়েছেন, তাদের কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে লিখতেই হবে জাতীয় ঐক্য সুদৃঢ় করতে। প্রয়ােজনে আইন করে সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নিতে হবে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের একজন মুক্তিযােদ্ধা-কর্মকর্তা হিসেবে আমার এই প্রস্তাব সকল মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় প্রদীপ্ত বাঙালি জাতির দাবি হিসেবে পরিগণিত হােক।
স্বাধীনতা: ইতিহাসের ধারাবাহিকতা
এই বিষয়টিকে ঘিরে ইদানীং বেশ বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। যারা এর সূত্রপাত করেছেন তারা মুক্তিযুদ্ধ বা এর ঐতিহাসিক সত্যগুলাের সাথে আদৌ কখনও সম্পৃক্ত ছিলেন কিনা সে বিষয়ে আমার ঘােরতর সন্দেহ আছে। অন্য এক অধ্যায়ে আমি বলেছি যা সত্য, তা সব সময়ই সত্য। শ্বাশ্বত সত্য কয়েক জনের উক্তি বা বক্তব্যে মিথ্যা হয়ে যায় না। কথাটি আরেকটু পরিষ্কার করে বলি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ একজনে, এককভাবে কেউ করেননি। এটি ছিল সত্যিকার অর্থে জনযুদ্ধ। সকলের মনে এর স্মৃতি গভীর রেখাপাত করে আছে। যারা ঐ সময় প্রাপ্তবয়স্ক ছিলেন, কিন্তু এখন প্রৌঢ়ত্বের শেষ সীমায়, তাদের তাে খুব ভালােভাবে মনে আছে কখন কী ঘটেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের সন্তান-সন্ততি এখন প্রাপ্তবয়স্ক। তাঁরাও সব ঘটনা জানেন। মুক্তিযােদ্ধারা অনেকেই জীবিত আছেন। তাঁদের বক্তব্যও শােনা প্রয়ােজন। সর্বোপরি সেনানায়কেরা, যাদের অবলম্বন করে অমুক্তিযােদ্ধারা এই অপ্রয়ােজনীয় বিতর্কের সূত্রপাত করেছেন, তাঁরা কবে কী বলেছিলেন তা জানা দরকার। না-দেখে, না-শুনে, অজ্ঞানতাপ্রসূত বক্তব্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সর্বশ্রেষ্ঠ বীরদের ছােট করা হচ্ছে। তার চেয়েও বড় কথা ১৯৭১ সালের সম্পূর্ণ ঘটনাবলি, কাগজপত্র, দলিল সকলের কাছেই রক্ষিত আছে। এর ওপর বিভিন্ন সময় দেশে-বিদেশে অনেকে গবেষণা করেছেন। গবেষণালব্ধ জ্ঞান এবং তথ্যের ওপর ভিত্তি করে অনেকে বিস্তর লেখালেখি করেছেন।
আমাদের দেশের প্রামাণ্য দলিলপত্র অযত্নে, অবহেলায়, এবং কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে ইচ্ছাকৃতভাবে নষ্ট করে ফেলা হয়েছে। কিন্তু বিদেশে সব দলিলপত্রই সযত্নে রক্ষিত আছে। ব্রিটিশ মিউজিয়াম, লাইব্রেরি, বিশ্ববিদ্যালয় সব জায়গাতেই এগুলাে পাওয়া যাবে। আমেরিকার লাইব্রেরি অব কংগ্রেসে তাে খুব ভালােভাবে বিরল সব নথিপত্র রক্ষিত আছে। ভারতে বাংলাদেশের ওপর কাগজপত্র, দলিল, প্রামাচিত্র ভূরিভূরি এন্তার ছড়িয়ে আছে। তাছাড়া তাদের সরকারি-বেসরকারি সব গবেষণা প্রতিষ্ঠানে এগুলাে রক্ষিত আছে।
আজ যদি আমরা দেশে-বিদেশে সযত্নে রক্ষিত, প্রমাণিত ও পরীক্ষিত দলিলপত্র, তথ্য অস্বীকার করে আকস্মিক নতুন বক্তব্য দিতে শুরু করি তাতে কি দুনিয়ার দরবারে জাতি হিসেবে ছােট হয়ে যাই না? সত্যকে ধারণ করে, মুক্তিযােদ্ধাদের অবদান স্বীকার করে, তাদের যথাযােগ্য মর্যাদা দিয়ে (এবং কাউকে হেয় না করে) আমরা তাে সত্য, সুন্দর, সুস্থ বক্তব্য দিতে পারি। আমার সন্দেহ হয়, বর্তমান বিতর্কটি স্বাধীনতার শত্রুদের আরেকটি কূটচাল। তারা অতি সূক্ষ্মভাবে আগের মতােই মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে। কোনাে কোনাে মুক্তিযােদ্ধা, যারা কোনাে সময়েই নেতৃস্থানীয় ছিলেন না এবং মুক্তিযুদ্ধের নীতিনির্ধারণী বৃত্তের বাইরে অবস্থান করেছেন, তাঁরাও উৎসাহের আতিশয্যে নিজেদের পায়ে কুড়ােল মারছেন। মুক্তিযােদ্ধার পরিচয়দানকারী এঁরা আদৌ মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন কি না সে-বিষয়ে আমার সংশয় আছে। অপরদিকে এটা আমাদের সেই পুরােনাে পরিচিত সােড়শ বাহিনীর কাজ নয় তাে? দিন, তারিখ, ক্ষণ ঘােষণা নিয়ে অসত্য বক্তব্য দিলে মুক্তিযুদ্ধই কি বিতর্কিত হয়ে পড়ে না?
পৃষ্ঠা: ২২
বড় দুঃখে আরেকটি বক্তব্য দিতে ইচ্ছা করছে। এদেশ হলাে চাটুকারদার চারণক্ষেত্র। এই চাটুকারদের নিজেদের সম্পর্কে কোনাে ভালাে বক্তব্য থাকে না। এদের কাজ হলাে প্রথমে মনিবের মনের ভাব কৌশলে জেনে নেওয়া। অতঃপর, মনিবের পছন্দ মতাে বক্তব্য দিতে থাকা। আর মনিব যাকে পছন্দ করেন না বা যার সম্বন্ধে কটু কথা বললে মনিব মনেমনে খুশি হবেন, ঐরকম বক্তব্য দেওয়া। মনিব বা তার নেতা-নেত্রীর স্তুতি গাইতে গাইতে এরা দেবতার পর্যায়ে নিয়ে যায়। এক পর্যায়ে একজন আপাত দৃষ্টিতে সত্য-সত্যই দেবতা, আরেকজন দানব বনে যান। আমাদের দেশে তােষামােদের কোনাে সীমা নেই। এই তােষামােদকারীরা সবসময় ক্ষমতার আশেপাশে থাকে অথবা যেতে আগ্রহী। ক্ষমতাধরদের তুষ্টিসাধন করে নিজের স্বার্থ হাসিল করাই এদের প্রধান লক্ষ্য। পরিণামে যার তােষামদ তারা করছে তাদেরই চরম সর্বনাশ করছে। ১৯৭২ সাল থেকে শুরু হবার পর এই ধারা অব্যাহত রয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধের সেনানায়কদের বক্তব্যগুলি বিবেচনা করার আগে আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উল্লেখ করতে চাই। স্বাধীনতা-ঘােষণা কখনও কোনাে দেশে আকস্মিক ঘটনা নয়। দেশের সামগ্রিক অবস্থা এবং রাজনৈতিক পটভূমিতে এটি বিচার করতে হয়। দীর্ঘদিনের মানসিক এবং বাস্তব প্রস্তুতির ফলে একটি জাতি তার নিজস্ব স্বাধীন সত্তা নিয়ে, অধিকার নিয়ে সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়। একজন মহাপরাক্রমশালী ব্যক্তি বা সমরনায়ক এলেন, ঘােষণা দিলেন আর তারপরেই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করলেন, এরকম কখনও ঘটেনি। এমনকি অপর একটি জাতির বা রাষ্ট্রের স্বাধীনতাও আকস্মিকভাবে হরণ করা যায়। না। আক্রমণকারী দেশকে অপর একটি দেশ দখল করার পূর্বে দীর্ঘপ্রস্তুতি নিতে হয়। নিজের জাতিকে, আন্তর্জাতিকভাবে অন্যান্য দেশকে তৈরি করে বা তাদের সমর্থন আদায় করে ধীর পদক্ষেপে এগুতে হয়। ইরাকের কথাই ধরা যাক। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বুশ সাহেবকে ইরাক-আক্রমণ করার আগে কত পাঁয়তারা আর সমরসজ্জা করতে হয়েছিল। কী পরিশ্রম আর কাঠ-খড় পােড়াতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য। তাও তিনি স্বীকৃতি পাননি। সফল স্বাধীনতা সংগ্রামের অনন্য দৃষ্টান্ত আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, ভারত, চীন এবং বাংলাদেশ। জর্জ ওয়াশিংটন, হাে চি মিন, সুকর্নো, মহাত্মা গান্ধী, মাওসেতুং এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান—এঁরাই ছিলেন তাঁদের নিজ নিজ দেশের স্বাধীনতার স্বপ্নদ্রষ্টা এবং সফল নেতা। তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে কেউ তাঁদের বিচ্যুত করতে পারবে না। ইতিহাসের পাতায় তাদের আসন নির্ধারিত হয়ে গেছে।
একটি জাতির স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম অনেক দিনের কঠোর পরিশ্রম, ধৈর্য আর ত্যাগের বিনিময়েই সফল হতে পারে—কখনও আইনানুগভাবে সাংবিধানিক পদ্ধতিতে, কখনও সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে, কখনও বা কোনাে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের ফলে।
ইতিহাসের এই ধারা থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কোনাে ব্যত্যয় নয়। কোনাে একটি জাতির অভ্যুদয় আকষ্মিক হয় না। এজন্য প্রয়ােজন দীর্ঘ প্রস্তুতির। আন্দোলন সংগ্রামের মধ্যে এই প্রস্তুতি নিতে হয়। এই যে দীর্ঘ প্রস্তুতির কথা বললাম তার জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্ব প্রয়ােজন, যে-নেতৃত্ব জাতির আশা-আকাঙ্ক্ষা ধারণ করে, লালন করে তা বাস্তবায়নের জন্য ধীর কিন্তু দৃঢ় পদক্ষেপে এগিয়ে যান। সেখানে বাধা-বিপত্তি, জেল-জুলুমনির্যাতন নিশ্চিত জেনেও এমন বিরল নেতা নিজেকে কখনও লক্ষ্যচ্যুত করেন না। এমন নেতৃত্ব এবং ব্যক্তিত্ব জাতিকে স্বাধীনতার পথে এগিয়ে নিয়ে যান। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে, শুধু ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে নয়, সেই সুদীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এটি ঐতিহাসিক সত্য। একে বিকৃত করে জাতি লাভবান হবে না। তার সামগ্রিক নেতৃত্ব দিয়ে কখনও জনগণের মাঝ থেকে, কখনও কারান্তরালে থেকে, জাতিকে তার মূল লক্ষ্যবস্তুর দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। একই সাথে আরও অনেকে অন্যান্য ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিয়েছেন। স্থান-কাল বুঝে নেতৃত্ব উঠে এসেছে—কখনও যুদ্ধক্ষেত্রে, কখনও জাতিগঠনে, কখনও সরকার পরিচালনায়। এদের কারাে ভূমিকা বা অবস্থান অস্বীকার বা ছােট করার অর্থ জাতি হিসেবে নিজেদের তুচ্ছ করা। প্রত্যেককে যথার্থ মূল্যায়ন করতে হবে। সম্মান দিতে হবে, যে স্থান ইতিহাস তাদেরকে দিয়েছে। আপনি, আমি তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলেই কেউ ছােট হবেন না, আবার কারাে মর্যাদা বা কীর্তি গগনচুম্বী করতে চাইলেও তা সম্ভব হবে না।
এই প্রসঙ্গে অর্থাৎ স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে আরাে আলােচনা করার আগে এর প্রেক্ষিত এবং তার সপক্ষে ঐতিহাসিক পটভূমি ও ধারাবাহিকতা সম্বন্ধে সংক্ষেপে আলােচনা করা প্রয়ােজন মনে করি। সাথে-সাথে বিংশ শতাব্দী এবং সমকালীন কিছু ঘটনার কথা উল্লেখ করাও দরকার।
১৯৭১ সালে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের কয়েক বছর আগেই নাইজেরিয়ার বিয়াফ্রা প্রদেশে স্বাধীনতার দাবিতে সশস্ত্র সংগ্রাম, অনেক প্রাণহানি ও রক্তপাতের পর ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অবশ্য এর পেছনে তেল-কোম্পানি ও ভাড়াটে সৈন্যদের বড় ভূমিকা ছিল। নাইজেরিয়ার এই ঘটনার পর বিচ্ছিন্নতাবাদ সম্পর্কে (Secessionist Movements) বিশ্বব্যাপী একটা সন্দেহের এবং আশঙ্কার সৃষ্টি হয়। ফলে বৃহৎ শক্তিগুলাে বিভিন্ন দেশের স্বাধীনতা-আন্দোলনকে অবহেলার দৃষ্টিতে বিবেচনা করতে থাকে। বাংলাদেশের প্রতি যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও ইউরােপের কোনাে-কোনাে দেশের প্রাথমিক মনােভাব বেশ বিরূপ ছিল। আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, এর যৌক্তিকতা, ন্যায়নীতি এবং প্রয়ােজন তুলে ধরার বিষয়টি ছিল গুরুত্বপূর্ণ। সেখাইে প্রধান ভূমিকা পালন করেন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ। যেহেতু আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে সমগ্র পাকিস্তানে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং যেহেতু এই সংখ্যাগরিষ্ঠতা অধিকারী রাজনৈতিক দল জনগণের ম্যান্ডেট-এর ভিত্তিতে (অর্থাৎ ৬-দফার ভিত্তিতে) সরকার গঠন বৈধ, আইনগত এবং নীতিগত ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়; সেহেতু তাঁদের যিনি অবিসম্বাদিত নেতা, তার ঘােষণাই আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হবে, এটাই স্বাভাবিক। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহির্বিশ্বে সুপরিচিত ছিলেন। সবাই জানত তিনিই নেতা। তিনি ভিন্ন অন্য কেউ স্বাধীনতা ঘােষণা করলে বৈধতা পাবে না। জিয়াউর রহমান এই সত্য উপলব্ধি করেই তার প্রাথমিক ঘােষণা সংশােধন করে বঙ্গবন্ধুর নামেই স্বাধীনতার ঘােষণা সম্বলিত বাণী পাঠ করেছিলেন ২৭ মার্চ অপরাহ্বে চট্টগ্রামের নিকট অবস্থিত কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে। পৃথিবীর যেসব জাতি গণতন্ত্র এবং আইনের শাসনে বিশ্বাসী তারা স্বাধীন বাংলার সংগ্রামে সহানুভূতিশীল হবেন এটাই ছিল স্বাভাবিক।
ইতিহাসের ধারাবাহিকতা
স্বাধীনতার ঘােষণা একটি মুহূর্তের বা দিনের কোনাে বিষয় নয়। একটি জাতির জীবন-মরণ প্রশ্ন জড়িত থাকে স্বাধীনতা লাভের ক্ষেত্রে। ইতিহাসের পথ-পরিক্রমায় স্বাধীনতার বীজ রােপিত হলেই তা থেকে বাস্তব রূপ নেয় স্বাধীনতা। বাংলাদেশের স্বাধীনতারও ইতিহাস আছে। সে ইতিহাস সুদীর্ঘ, হঠাৎ কোনাে সংক্ষিপ্ত ঘটনায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে, এ-কথা আগেই বলেছি। সংক্ষেপে ইতিহাসের ধারাবাহিকতা তুলে ধরা আবশ্যক মনে হচ্ছে।
বাংলাদেশ-ভারত-পাকিস্তান উপমহাদেশের পূর্ববাংলানামে অভিহিত অঞ্চলের জনগণ অতি প্রাচীনকাল থেকেই তাদের একটি পৃথক সত্তা বজায় রেখেছে। বহিরাগত কোনাে শক্তির আধিপত্য মেনে নেওয়ার ব্যাপারে তারা বরাবর অনীহা প্রকশ করেছে। ইতিহাসই বলে দেয়, বৃটিশ শাসনামলে বঙ্গদেশেই প্রথম জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতার বীজ অঙ্কুরিত হয়। পরিণতিতে বৃটিশ শাসনের অবসানে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়। বৃটিশ-শাসন অবসানে যেসব আন্দোলন গড়ে ওঠে তার মধ্যে ১৯০৬ সালের মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা, ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাব ছিল বাংলার জননেতাদের উল্লেখযােগ্য অবদান। দেশবিভাগের পর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগের শােচনীয় পরাজয়কে ১৯৫৮ ও ১৯৬৯ সালে সামরিক আইন জারি করেও যেমন আড়াল করা যায়নি, তেমনি পাকিস্তানি শাসকবর্গের পক্ষে স্বাধিকারের আন্দোলন প্রতিহত করা সম্ভব হয়নি। ১৯৪৮ সালে সৃষ্ট পাকিস্তানের দুটি অংশের পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদ, পুঁজিপতি, আমলা ও সামরিক ব্যক্তিবর্গের উপনিবেশবাদী মনােভাব পূর্ববাংলার আঞ্চলিক ভাবধারাকে শক্তিশালী করে তোলে। এই অনুভূতি থেকেই পূর্ববাংলায় জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের সূত্রপাত হয় পাকিস্তান সৃষ্টির অব্যবহিত পরেই। সরকারিভাবে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘােষিত হওয়ার পূর্বক্ষণে ১৯৪৭ সালের ১১ আগস্ট তারিখে পাকিস্তান গণপরিষদের সভাপতির ভাষণে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ জোর দিয়ে বলেছিলেন যে, পাকিস্তান ধর্মীয় রাষ্ট্র নয়। পাকিস্তানে বসবাসকারী বিভিন্ন সম্প্রদায়ের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছিলেন:
আপনারা স্বাধীন। পাকিস্তান রাষ্ট্রে আপনারা স্বাধীনভাবে আপনাদের মন্দিরে বা মসজিদে বা অন্য যে-কোনাে উপাসনালয়ে যেতে পারেন। আপনারা যে-কোনাে ধর্ম, গােত্র বা মতাদর্শের অনুসারী হতে পারেন, রাষ্ট্রের কার্যাবলির সাথে তার কোনাে সম্পর্ক নেই। …আমরা এই মৌলিক নীতি নিয়ে যাত্রা শুরু করছি যে, আমরা সকলেই এক রাষ্ট্রের নাগরিক, সমান নাগরিক। … এখন আমি মনে করি আমাদের সামনে এই আদর্শ রাখতে হবে এবং কালক্রমে আপনারা দেখতে পাবেন, হিন্দু আর হিন্দু থাকবে না; মুসলমান মুসলমান থাকবে না, ধর্মীয় অর্থে নয়, কারণ সেটা প্রত্যেকের ব্যক্তিগত বিশ্বাসের বিষয়, রাজনৈতিক অর্থে, রাষ্ট্রের নাগরিকরূপে।
মি. জিন্নাহ বলেছিলেন যে, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে টিকে থাকতে হলে তার ভিত্তি হবে ধর্মনিরেপেক্ষতা। তা না হলে পাকিস্তান টিকে থাকবে না। জিন্নাহর ধারণাই ঠিক ছিল, কিন্তু দুর্ভাগ্যক্রমে তিনি তার ধারণার বাস্তবায়ন দেখে যেতে পারেননি। তাঁর মৃত্যু ধর্মনিরপেক্ষতার গতিধারা স্তব্ধ করে দেয়। এরূপ এক অবস্থায় ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পাকিস্তান ইসলামী প্রজাতন্ত্ররূপে ঘােষিত হয়। কিন্তু পাকিস্তানের এই শাসনতন্ত্র ১৯৫৮ সালে সেনাবাহিনীর ক্ষমতা-দখলের ফলে বাতিল হয়ে যায়। গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্রের ভিত্তি নস্যাৎ হয়।
পাকিস্তানে ক্ষমতা-দখলের প্রতিযােগিতা শুরু হয়। মি. জিন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করে লিয়াকত আলী খান, খাজা নাজিমুদ্দিন, গােলাম মােহাম্মদ (বেসামরিক আমলা) শাসনকাজ পরিচালনা করেন। গােলাম মােহাম্মদের রাজনৈতিক কোনাে ভিত্তি ছিল না, ছিল উচ্চাকাঙ্ক্ষা। তিনি আমলা এবং পাঞ্জাবি-প্রভাবিত সেনাবাহিনীর সঙ্গে আঁতাত গড়ে তােলেন। পাকিস্তানের রাজনীতিতে ইসলাম ধর্মের নাম ব্যবহৃত হতে থাকে। আর এ-সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থে পূর্ব পাকিস্তানকে (পূর্ববাংলাকে) শােষণ করা হয়। পূর্ববাংলার
পৃষ্ঠা: ২৫
জনগণ বঞ্চনা আর শােষণে ক্রমেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। কিন্তু এই ক্ষুদ্ধ মনােভাব সুস্পষ্টরূপে প্রকাশ করতে বাঙালিদের দীর্ঘ সময় লেগেছে। পূর্ববাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সত্তা সম্পর্কে নতুন চেতনা ১৯৪৮ থেকে ১৯৫২ সালের ভাষাআন্দোলনের সময়েই গড়ে ওঠে।
এই সময় মুসলিম লীগের বিভক্তি এবং আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম পাকিস্তানের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায় সৃষ্টি করে। ১৯৪৯ সালে আওয়ামী সুসলিম লীগের জন্মের পর আরাে কিছু ধর্মনিরপেক্ষ সংগঠন যেমন যুবলীগ, গণতন্ত্রী দল ইত্যাদি গড়ে ওঠে। ১৯৫৫ সালে দলের নাম থেকে মুসলিমশব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগনামে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে কৃষক-শ্রমিক পার্টি, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি নামে আরাে দুটো নিরপেক্ষ দলের জন্ম হয়। পাকিস্তানে কমুনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ থাকলেও পূর্ববাংলায় এর গােপন তৎপরতা ছিল। পূর্ববাংলার রাজনীতিতে এসব দলের তৎপরতা ক্ষুন্ন করতে ১৯৬২ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল আইয়ুব খান একনায়কতন্ত্রের সংবিধান জনগণের ওপর চাপিয়ে দেন। মৌলিক গণতন্ত্রের নামে স্বৈরতন্ত্রী ব্যবস্থা চালু করেন। বিচারবিভাগের স্বাধীনতা খর্ব করা হয় এবং শাসনবিভাগকে সকল ক্ষমতার অধিকারী করা হয়। বাঙালি জনগণ এতে ক্ষুদ্ধ হয়ে ওঠে এবং অনুধাবন করে যে, একমাত্র বয়স্থ ভােটাধিকার (adult franchise) ও প্রত্যক্ষ নির্বাচনের (direct election) ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যম ব্যতীত তারা দেশের শাসনব্যবস্থায় অংশ নিতে পারবে না।
১৯৬৬ সালের মধ্যেই আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের গতিশীল নেতৃত্বে জনগণের একটি জাতীয় প্ল্যাটফর্ম প্রস্তুত হয়। আওয়ামী লীগ প্রণীত ৬-দফা দাবি বাঙালি জাতির ম্যাগনাকার্টারূপে পরিগণিত হয়। আগেই উল্লেখ করেছি ঐতিহাসিক ৬-দফার ভিত্তিতে অংশগ্রহণকারী আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে জয়লাভ করে প্রমাণ করে যে, জনগণের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশ ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক কর্মসূচির পেছনে রয়েছে। কিন্তু পাকিস্তানি সামরিক শাসকচক্র আওয়ামী লীগ নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা দিতে টালবাহানা শুরু করে। এতে সমগ্র বাঙালি জাতি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে ফুসে ওঠে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সংলাপের নামে সময় ক্ষেপণ করতে থাকেন এবং বাঙালি জাতির উপর চরম আঘাত হানতে প্রস্তুতি সম্পন্ন করেন। অতর্কিতে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ গভীর রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং গণহত্যা শুরু করে। রুখে দাঁড়ায় সমগ্র জাতি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। এর আগে বঙ্গবন্ধু তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে (সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে) ৭ মার্চ ঘােষণা করলেন: এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ঐ ভাষণেই তিনি আহবান জানালেন:… তােমাদের যা কিছু আছে, তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলা করতে হবে…। আবার এ-ও বলেছিলেন: …আমি যদি হুকুম দেবার না পারি …। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধু তাঁর ভাষণে বাঙালি জাতিকে সুস্পষ্ট নির্দেশনা দিয়েছিলেন এবং তার ৭ মার্চের ভাষণ বাঙালি জাতির প্রতিটি মানুষকেই অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রসঙ্গত সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের অনুভূতির কথা উল্লেখ না করে পারছি না। তিনি তার লেখা একটি জাতির জন্মশীর্ষক প্রবন্ধে একস্থানে লিখেছিলেন: ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমানের ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলাে। (রুহুল আমিন সম্পাদিত জিয়াউর রহমান স্মারকগ্রন্থ, হীরা বুক মার্ট, ঢাকা, ১৯৯১, পৃ. ২৭)। যথার্থ অনুভূতি! নিরস্ত্র বাঙালি-নিধনে পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র মেজর জিয়াউর রহমানের মতাে প্রত্যেক দেশপ্রেমিক বাঙালিকেই প্রতিরােধ-যুদ্ধে তথা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর আহবান, যার যা আছে, তাই নিয়ে, তকালীন মেজর জিয়ার বিবেককে কীভাবে নাড়া দিয়েছিল সেদিন, পরবর্তীতে তা তার লেখাতেই ফুটে উঠেছে।
জিয়াউর রহমান ছাড়াও সেনাবাহিনীর আরাে অনেকেই বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণে উদ্বুদ্ধ হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন। মেজর রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম এবং মেজর মীর শওকত আলী বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণায় উদ্বুদ্ধ হওয়ার কথা উল্লেখ করেছেন। প্রথমােক্ত সেনা-কর্মকর্তা তাঁর লেখার এক স্থানে বলেছেন: … তাই ওরা ছুটে যায় নেতার কাছে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের কাছে নির্দেশ চাই।… ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু সুস্পষ্ট ঘােষণা দিলেন …। (রহীম শাহ সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধ: পঁচিশ বছর, (রফিকুল ইসলাম বীরউত্তম রচিত বিশ্বের ভাণ্ডারী শুধিবে না এত ঋণ?), জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, প্রথম প্রকাশ, ১৯৯৭, পৃ. ১৬৩]। দ্বিতীয়ােক্ত সেনা অফিসার লিখেছেন: ‘… কার আহবানে বাঙালি সেদিন পেয়েছিল স্বাধীনতার প্রেরণা? ৭ মার্চ, ‘৭১ ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে (পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দি উদ্যানে) কে জাতিকে স্বাধীনতার ডাক শুনিয়েছিলেন? ২৬ মার্চ ‘৭১ সন্ধ্যা হতে পরবর্তী সময়ে চট্টগ্রামের মূল বেতার কেন্দ্র থেকে নিরাপদ দূরত্বে কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে অবস্থান করে যারা স্বাধীনতার কথা বললেন, বিভিন্ন ঘােষণা প্রচার করলেন, কে তাদের সেদিনের প্রেরণার উৎস ছিল? কার পক্ষে তারা প্রচার করেছিলেন সেসব ঘােষণা, স্বাধীনতার কথা? কাজেই বলুন কে আমাদের স্বাধীনতার স্থপতি? কে বা কারা ঘােষক ছিলেন, সেটা কি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকতা ছিল না?’ (মীর শওকত আলী রচিত মুক্তিযুদ্ধের ভূমিকা ও প্রসঙ্গ কথা), পৃ. ৬৯]। একই প্রবন্ধে মীর শওকত আলী বলেছেন: … চট্টগ্রাম বেতারে স্বাধীনতা ঘােষণা যেটা নিয়ে সব সময় বিতর্ক চলে যে জেনারেল জিয়া করেছেন নাকি আওয়ামী লীগ থেকে করেছেন। আমার জানা মতে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে হান্নান ভাইর কণ্ঠই লােকে প্রথম শুনেছিলেন। কিন্তু যেহেতু চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের প্রেরকযন্ত্র খুব কম শক্তিসম্পন্ন ছিল, সেহেতু পুরা দেশবাসী সে কণ্ঠ শুনতে পাননি। কাজেই যদি বলা হয়, প্রথম বেতারে কার বিদ্রোহী কণ্ঠে স্বাধীনতার কথা উচ্চারিত হয়েছিল, তাহলে আমি বলব যে, চট্টগ্রামের হান্নান ভাইর সেই বিদ্রোহী কণ্ঠ। তবে এটা সত্য যে পরদিন অর্থাৎ ২৭ মার্চ, ৭১ মেজর জিয়ার ঘােষণা প্রচারের পরই স্বাধীনতাযুদ্ধ গুরুত্বপূর্ণ মােড় নেয়। (প্রাগুক্ত, পৃ.৬৯)।
আরাে একজন বীর মুক্তিযােদ্ধা ৯ নম্বর সেক্টরের খুলনা জেলার সাব-সেকটরের অধিনায়ক সামরিক কর্মকর্তা এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন তার তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থ মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থাননামক গ্রন্থের ৪৬ পৃষ্ঠায় লিখেছেন: “রাজনৈতিকভাবে বাঙালি সৈনিকদের প্রতি সুস্পষ্ট পূর্বনির্দেশনার অনুপস্থিতি সত্ত্বেও সামরিক, আধা-সামরিক, পুলিশ ও আনসার বাহিনীর সশস্ত্র সদস্যরা পক্ষ ত্যাগ করে স্থানীয় রাজনৈতিক কর্মী ও জনগণের সহযােগিতায় স্থানীয়ভাবে নিজ নিজ মতাে করে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে চেষ্টা করেন। প্রায় সর্বত্রই স্থানীয় বেসামরিক প্রশাসন এ-ব্যাপারে সহযােগিতায় এগিয়ে আসে। এভাবে প্রতিরােধের ধারাবাহিকতায় সমগ্র জাতি পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী তথা অবাঙালিদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয় এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠে।”
বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী চাকমা ব্যতীত বেশির ভাগ উপজাতিও এই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়, আমি (গ্রন্থকার) নিজেও ২৭ মার্চ বিকেলের দিকে অতি ক্ষীণ স্বরে রেডিওতে স্বাধীনতার ঘােষণা প্রচারিত হতে শুনেছি। আমার মতাে অনেকেই (এ-মুহূর্তে ক্যাডার কর্মকর্তা রেজাউল হায়াতের নাম মনে পড়ছে) শুনেছিলেন। আমার কানে আজও স্পষ্টভাবে স্বাধীনতার ঘােষণার কথাগুলাে অনুরণিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে দেশের অভ্যন্তরে থাকা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে ওঠে। ফলে, সীমান্ত অতিক্রম করার সিদ্ধান্ত নেই। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রামগড় পর্যন্ত পৌঁছুতে পৌছুতে রাত হয়ে যায়। পথিমধ্যে বিকেলে রেডিওতে একটি কণ্ঠে ইংরেজিতে কিছু শুনতে পাই। প্রথমে কিছুই তেমন বুঝা যাচ্ছিল না। তবে বাংলাদেশশব্দটি শুনে উৎকর্ণ হয়ে উঠি পুরােটা শােনার জন্য ঘােষণায় বলা হচ্ছিল, আই মেজর জিয়াউর রহমান, অন বিহাফ অব আওয়ার গ্রেট লিডার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান …’। ব্যস, আমাদের জন্য এ ঘােষণাই যথেষ্ট ছিল। তা-ও আবার একজন সেনা-অফিসারের মাধ্যমে। আমার সহযাত্রীসহ সকলেই আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলাম। ভাবলাম, আমরা শুধু একা নই। সাথে রয়েছেন সেনাবাহিনীতে কর্মরত আমাদেরই ভাইয়েরা। আর পিছনে ফিরে তাকানাে নয়। অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুনােই এখন আমাদের একমাত্র কাজ।’
বঙ্গবন্ধুর পক্ষে জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ সমগ্র বাঙালি জাতির মধ্যে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতাে মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ে। বিদেশি পত্র-পত্রিকা, রেডিও ইত্যাদিতেও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা-ঘােষণা প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। ২৭ মার্চ The Times পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ব্যানার হেডিং ‘Heavy Fighting as Sheikh Mujibur Rahman Declares East Pakistan Independent’ (শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছেন, সেখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ চলছে) প্রকাশিত হয়। একই দিনে Financial Times পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘Civil War after East Pakistan Declares Independence’ (পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীনতা ঘােষণা করায় গৃহযুদ্ধ) শিরােনামের সংবাদে বলা হয়: গতকাল (২৬ মার্চ) শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘােষণা দিলে সেখানে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র নামে একটি রেডিও থেকে শেখ মুজিবের পক্ষে স্বাধীনতার এ-ঘােষণা প্রচার করা হয়(ভাষান্তরিত)। ২৭ মার্চ The Guardian পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ‘Heavy Fighting after UDI (Unilateral Declaration of Independence] by East Pakistanশিরােনামে এতদ্সংক্রান্ত সংবাদ পরিবেশন করা হয়।
প্রসঙ্গত একটা বিষয় সকলের গােচরে আনা প্রয়ােজন মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা প্রকৃতপক্ষে দুটো পর্যায়ে বিবেচ্য। কেননা, নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও পাকিস্তানি শাসকচক্র ষড়যন্ত্র করে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতার আসনে বসতে দিল না। ঐতিহাসিক ৬-দফার ভিত্তিতে নির্বাচনে জয়লাভকারী (নিখিল পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে) রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসনের দাবি বৈধ ছিল। দাবি মেনে নেওয়ার পরিবর্তে শাসনযন্ত্রের প্রচলিত রীতিনীতি ভঙ্গ করায় বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে অনানুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের ভাষণ ছিল একজন সুদক্ষ রাজনীতিবিদের বক্তব্য। তাঁর এই অনানুষ্ঠানিক স্বাধীনতা-ঘােষণার বিরুদ্ধে আইনগতভাবে কোনাে অভিযােগ উত্থাপন করা সম্ভব ছিল না। The Daily Telegraph পত্রিকার সংবাদদাতা ডেভিড লােশাক ঢাকা থেকে লিখেছিলেন: The End of old Pakistan শিরােনামে এক প্রতিবেদন। তিনি লিখেছিলেন On Sunday (7 March) Sheikh Mujib came as near declaring this (independence) as he could without inviting harsh reaction from the Army (10 March 1971)। তার এই ঘােষণার প্রতিধ্বনি স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র থেকেও প্রচারিত হয়েছে।
হান্নান সাহেব বা জিয়াউর রহমান উভয়েই বঙ্গবন্ধুর ঘােষণায় অনুপ্রাণিত হয়ে বাঙালি জাতির জন্য এক স্মরণীয় কাজ করেছিলেন, সন্দেহ নেই। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণা, হান্নান সাহেব ও জিয়াউর রহমানের ঘােষণাপত্র পাঠ, এসবই ছিল অনানুষ্ঠানিক। স্বাধীনতা ঘােষণার এটি ছিল প্রাথমিক পর্যাগণপ্রজাতন্ত্রীয়। দ্বিতীয় পর্যায়ে, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত সদস্যগণ ১০ এপ্রিল বৈধভাবে মুজিবনগরে বংলাদেশ সরকার গঠন ও শপথ গ্রহণের পর উক্ত সরকার কর্তৃক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে ঘােষিত এবং প্রচারিত স্বাধীনতার ঘােষণা অনুমােদন ছিল আনুষ্ঠানিক। এই ঘােষণার শিরােনাম ছিল: ‘The Proclamation of Independence’ উল্লেখ্য, এই ঘােষণার খসড়া অতি দ্রুততার সঙ্গে এক পৃষ্ঠা শাদা কাগজে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম লিখে দিয়ে এক ঐতিহাসিক কাজ করেছিলেন। পরবর্তীকালে বাংলাদেশের সংবিধান রচনার সময় এটিই ছিল মূল ভিত্তি। এই ঘােষণার শেষ অনুচ্ছেদের অব্যবহিত পূর্বের অনুচ্ছেদ নিম্নরূপ:
We further resolve that this Proclamation of Independence shall be deemed to have come into effect from 26th day of March, 1971.
(দ্রষ্টব্য: হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দলিলপত্র: তৃতীয় খণ্ড, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, ১৯৮২, পৃ. ৪)।
কাজেই বলা বাহুল্য যে, বৈধভাবে গঠিত এবং পরবর্তীকালে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তে সুস্পষ্টভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘােষণার বিষয় উল্লেখ রয়েছে। অধিকন্তু প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখের ভাষণে যুদ্ধরত সকল বীর সেনানায়কের বীরত্বের বর্ণনা দেন। এ থেকে প্রমাণিত যে, যুদ্ধরত সকল সেনানায়কসহ অন্যান্য সরকারি কর্মকর্তা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কর্মরত ছিলেন। সরকারের কোনাে কর্মচারীর স্বাধীনতার ঘােষণা আন্তর্জাতিকভাবে কখনই বৈধ নয়, এ সত্য অনুধাবন করতে পারলে জাতির জন্য তা সম্মানজনক হবে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার প্রথমদিকে স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগ কর্তৃক বাংলাদেশ, কনটেম্পরারি ইভেন্টস অ্যান্ড ডকুমেন্টসশীর্ষক একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। খন্দকার মােশতাক। আহমেদ এতে ছােট্ট একটি ভূমিকা লেখেন। মুখবন্ধে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার বিভাগ ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদকে ধন্যবাদ জানিয়ে লেখেন যে, This division remains thankful to Mr.Moudud Ahmed, Barrister-at-law for his untiring efforts to arrange these documents. স্বাধীনতার ঘােষণা প্রসঙ্গে এই পুস্তিকার ১১৮ পৃষ্ঠায় আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১’ যেভাবে প্রকাশিত হয়েছে তা উল্লেখ করা হলাে। বাংলাদেশের সংবিধানের প্রস্তাবনায় স্বাধীনতার ঘােষণার তারিখ ২৬ মার্চ উল্লেখ করা হয়েছে। কোনাে নাগরিক সংবিধান-বহির্ভূত কথা বললে তা অপরাধের পর্যায়ে পড়ে।
আমি সে-সময় সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত থেকে এসব ঘােষণা, আদেশ, নির্দেশ ইত্যাদি সম্পর্কে প্রত্যক্ষভাবে এবং বিশদভাবে প্রমাণসহ জানি। বঙ্গবন্ধুর ২৬ মার্চের স্বাধীনতা-ঘােষণা নিয়ে যে ধূমজাল সৃষ্টির অপচেষ্টা চালানাে হয়েছিল তা পৃথিবীর ইতিহাসে বিকৃতির সামিল ছিল। কারণ পৃথিবীর সর্বত্রই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত তথ্যাদি সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশেও সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশে সংরক্ষিত তথ্য-প্রমাণ ধ্বংস করা সম্ভব হলেও পৃথিবীর অন্যত্র সংরক্ষিত তথ্য বিকৃত করা অপচেষ্টাকারীদের পক্ষে সম্ভব হবে না।
স্বাধীনতার ঘােষণায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তারিখে আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ- ১৯৭১ (Laws Continuance Enforcement Order-1971)জারি করেন। এটি ছিল নিম্নরূপ:
আইনের ধারাবাহিকতা ও প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১
মুজিবনগর
১০ এপ্রিল, ১৯৭১
আমি, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি) ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার ঘােষণায় আমাকে প্রদত্ত ক্ষমতাবলে এই মর্মে আদেশ প্রদান করছি যে, বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছার পরিপ্রেক্ষিতে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সৃষ্টি হওয়ায় ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে যেসব আইন ও বিধিবিধান কার্যকর ছিল সে-সমস্তই প্রয়ােজনীয় অবস্থাগত পরিবর্তনসহ পূর্বোক্ত ঘােষণাসাপেক্ষে বলবৎ থাকবে এবং সকল সরকারি, কর্মকর্তাকর্মচারী, বেসামরিক, সামরিক, বিচারবিভাগীয়, কূটনৈতিক যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করবেন তারা সকলেই তাদের স্ব স্ব পদে চাকুরিবিধির শর্তানুযায়ী যেভাবে কর্মরত ছিলেন তারা সেভাবেই কর্মরত থাকবেন এবং বাংলাদেশ ভূখণ্ডের সকল জেলা জজ ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং অন্যত্র কর্মরত কূটনৈতিক প্রতিনিধিবৃন্দ তাদের আওতাধীন সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীদের আনুগত্যের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার ব্যবস্থা করবেন। এই আদেশ ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ থেকে কার্যকর হয়েছে বলে গণ্য হবে।
স্বা: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি
Laws Continuance Enforcement Order-1971
Mujibnagar,
Dated 10th day of April, 1971
I, Syed Nazrul Islam, the Vice President and Acting President of Bangladesh, in exercise of the powers conferred on me by the Proclamation of Independence dated tenth day of April, 1971 do hereby order that all laws that were in force in Bangladesh on 25 March, shall subject to the Proclamation aforesaid continue to be so in force with such consequential changes as may be necessary on account of the creation of the sovereign independent State of Bangladesh formed by the will of the people of Bangladesh and that all government officials civil, military, judicial and diplomatic who take the oath of allegiance to Bangladesh shall continue in their offices on terms and conditions of service so long enjoyed by them and that all District Judges and District Magistrates, in the territory of Bangladesh and all diplomatic representatives elsewhere shall arrange to administer the oath of allegiance to all government officials within their jurisdiction.
This order shall be deemed to have come into effect from 26th day of March, 1971.
Signed: SYED NAZRUL ISLAM
Acting President
পৃষ্ঠা: ৩০
উপসংহারে বলতে পারি যে, স্বাধীনতার ঘােষণা নিয়ে যে-বিতর্ক ইচ্ছাকৃতভাবে শুরু করা হয়েছে তা বিভ্রান্তিকর সন্দেহ নেই। কারণ, উপরে বর্ণিত আইনের ধারাবাহিকতা প্রয়ােগ আদেশ-১৯৭১সকল বিতর্ক অবসানে এক অকাট্য দলিল। এ-সত্যকে ইতিহাসের পাতা থেকে কোনােভাবেই মুছে ফেলা সম্ভব নয়। মুখের কথায় সত্যকে উৎখাত করা যায় না, যাবে না। নতুন প্রজন্মকেও এই সত্য অনুধাবন করেই বাংলাদেশের অভ্যুদয় সম্বন্ধে ইতিহাসের পাঠ মেনে নিতে হবে। সত্যকে বিকৃত করে ছােট হওয়া অপেক্ষা সত্যকে প্রতিষ্ঠা করাই শ্রেয়। এতেই জাতির মঙ্গল ও কল্যাণ হবে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন: বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জন্মলগ্ন ১০ এপ্রিল, ১৯৭১। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র (Proclamation of Independence) হলাে আমাদের ম্যাগনাকার্টা, স্বাধীনতার সনদ। এই ঘােষণায় সুস্পষ্টভাবে বর্ণিত হয়েছে কেন, কোন্ ক্ষমতার বলে এবং পরিস্থিতিতে একটি স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা হলাে, যে-রাষ্ট্রের নাম হলাে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ (People’s Republic) যেহেতু এই সরকার মুজিবনগরে তার প্রধান দপ্তর স্থাপন করেছিল তাই এর ব্যাপক পরিচিতি হলাে মুজিবনগর সরকাররূপে। স্বাধীনতাযুদ্ধ চলাকালে এই সরকারের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় স্থাপন করা হয় প্রধানত নিরাপত্তা এবং মুক্তিযুদ্ধে নির্বিঘ্ন নেতৃত্ব দেওয়ার কারণে। আমাদের সরকারের বিভিন্ন কার্যাবলি পর্যালােচনা করলেই বােঝা যাবে কত ব্যাপক এবং সুসংগঠিত ছিল সরকারের কর্মসূচি এবং গঠন-কাঠামাে।
এই প্রসঙ্গে একটি কথা বল বিশেষ প্রয়ােজন যে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে কেবলই মুজিবনগর সরকার নামে আখ্যায়িত করে (যেহেতু তার প্রধান কার্যালয় ভারতে অবস্থিত ছিল তাই) তাকে নানাভাবে হেয় প্রতিপন্ন করার অনেক অপচেষ্টা হয়েছে বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর সরকারের মাত্র সাড়ে তিন বছর এবং শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছর এবং ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সাল মেয়াদি সরকারের প্রথম ৩ বৎসর বাদে সুদীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর যাবৎ। স্বাধীনতাবিরােধীরা নানাভাবে চেষ্টা করেছে একে পুতুল সরকার বলে পরিচয় দেওয়ার। বিশেষ করে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শহীদ হওয়ার পর থেকে ১৯৯৬ সালের জুলাই মাস পর্যন্ত এবং ২০০১ সালের অক্টোবর মাস থেকে ২০০৮ সাল পর্যন্ত এই স্বাধীনতাবিরােধীচক্র ইতিহাস বিকৃত করে লেখায়, আলােচনায়, টিভি, রেডিও ও সমস্ত প্রচারযন্ত্রকে ব্যবহার করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশকে ছােট করার চেষ্টা করেছে এবং তাদের সে অপচেষ্টা অব্যাহত আছে। ইতিহাসকে তাে আর বিকৃত করা যায় না, তবে স্বাধীনতা যারা চায়নি তারা এই অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী তাদের পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে চাইবে, এটাই স্বাভাবিক। ইতিহাস-বিকৃতির কাজে আমাদের মধ্যে মীরজাফরের মতাে বিশ্বাসঘাতকের অভাব নেই। যারা এই বিশ্বাসঘাতকতায় অংশগ্রহণ করেছে তাদের নামের তালিকা ইতিহাসের পাতায় ঠিকই অন্ত ভুক্ত হবে। কালের অমােঘ নিয়মই এটা।
বিপ্লবী প্রবাসী সরকার: সমকালীন ইতিহাস
প্রবাসী সরকার সম্পর্কে ঐতিহাসিক বিবরণ প্রদানের জন্য উপরের কথাগুলাে প্রাসঙ্গিকভাবেই বলতে হলাে। বিংশ শতাব্দীতে এরকম সরকারের অনেক উদাহরণ পাওয়া। যাবে। স্থান ও কালভেদে এদের স্বরূপ এবং চরিত্র বিভিন্নরূপে দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জেনারেল চার্লস দ্য গলের স্বাধীন ফরাসি সরকার (Free French Government) এবং পােল্যান্ডের প্রবাসী সরকার লন্ডনে তাদের প্রধান কার্যালয় স্থাপন করেছিলেন। অবশ্য আমাদের সাথে তুলনা করলে আজকের দিনের মাপকাঠিতে এগুলােকে সরকার বলা চলে না। সাম্প্রতিককালের প্রবাসী সরকারগুলাের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য হচ্ছে, পি.এল.ও.। দীর্ঘকাল তারা প্রথমে লেবাননের বৈরুতে, জর্দানের আম্মানে এবং সর্বশেষে তিউনিসিয়ার তিউনিসে সদর-দপ্তর স্থাপন করেছিলেন। পৃথিবীর অনেক দেশই পি.এল.ও.-কে স্বীকৃতি দিয়েছিল এবং তাদের সাথে যােগাযােগ করেছিল যদিও তাদের নিজস্ব কর্তৃত্বাধীনে কোনাে ভূখণ্ড ছিল না। আফগানিস্তানের মুজাহেদীনদের শুধু স্বীকৃতি নয়, তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য, প্রশিক্ষণ, সহযােগিতা দিয়েছে আমেরিকা এবং পাশ্চাত্যের দেশগুলি। সুদীর্ঘ দশবছর তাদের সদর-দপ্তর ছিল পাকিস্তানের পেশােয়ারে। সেখানে তারা কী পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র, আর্থিক সাহায্য পেয়েছে তা আজ আর কারাে অবিদিত নেই। এ সবকিছুই পাকিস্তানের আই.এস.আই. মারফত গিয়েছে।
একটি সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু প্রবাসী সরকারের প্রকৃষ্ট উদাহরণ হলাে কম্বােডিয়ার প্রিন্স নরােদম সিহানুকের সরকার, যার সাথে পলপটের খেমুররুজ (যা বিশ্বব্যাপী ধিকৃত এবং নিন্দিত) যুক্ত ছিল। এদের সদর-দপ্তর দীর্ঘকাল চীনের বেইজিং-এ অবস্থিত ছিল। কোনােকোনাে সময় এরা থাইল্যান্ডেও অবস্থান করতেন। সিহানুকের স্বাধীন কম্বােডিয়া সরকার একদিকে প্রবাসী ছিলেন, অন্যদিকে দেশের অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ অঞ্চল তাদের দখলে ছিল যেখানে তারা সরকার পরিচালনা করতেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার বহুলাংশে এই সরকারের সাথে তুলনীয়। অবশ্য স্বাধীন অঞ্চলে নেতৃত্ব, বিদেশে ব্যাপক গণসমর্থন ও সহানুভূতি, স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি, নিজস্ব আয়-ব্যয়, স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকারের ন্যায় কার্যকলাপ এবং সর্বোপরি দেশের অভ্যন্তরে সর্বস্তরের জনসাধারণের নজিরবিহীন সমর্থন ও ত্যাগ স্বীকার এবং মুক্তিবাহিনীর নেতৃত্বে যুদ্ধে অংশগ্রহণ আমাদের সরকারকে দিয়েছিল একটি বিশেষ পরিচয় যার তুলনা কোনাে প্রবাসী সরকারের সাথেই চলে না।
পঁচিশে মার্চের ভয়াল রাতের পর আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি জেনারেল তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ২৭ মার্চ প্রথমে ঝিনাইদহ যান। সেখানকার এস.ডি.পি.ও. মাহবুব আহমদ এবং মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরীর সহায়তায় তারা সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। মার্চের ৩০ তারিখে পশ্চিমবাংলা সরকারের সঙ্গে যােগাযােগ করে ২ এপ্রিল দিল্লিতে গমন করেন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী তাদের সর্বপ্রকার সাহায্য প্রদানের প্রতিশ্রুতি দিলে তাজউদ্দীন আহমদ আওয়ামী লীগের এমএনএ এবং এমপিএ-দের কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তে অধিবেশন আহ্বান করেন। অধিবেশনে সর্বসম্মতিক্রমে মুক্তিযুদ্ধ ও সরকার পরিচালনার জন্য মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
এই মন্ত্রিসভা এবং এমএনএ ও এমপিএ-গণ ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি করে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ঘােষণা করেন। সৈয়দ নজরুল ইসালামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করা হয়। তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, খন্দকার মােশতাক আহমেদ ও এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান-কে মন্ত্রিসভার সদস্য নিয়ােগ করা হয়। ১১ এপ্রিল এম. এ. জি. ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত করা হয়। প্রধানমন্ত্রী ১১ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতারে মন্ত্রিসভা গঠনের ঘােষণা দেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভা ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার আকারে বিশাল না হলেও অত্যন্ত সুসংগঠিত ছিল। প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে এই সরকার গঠন করে স্বল্পতম সময়ের মধ্যে একদিকে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব, অন্যদিকে এক কোটির ওপর শরণার্থীর জন্য ত্রাণব্যবস্থা দেশের অভ্যন্তর থেকে লক্ষ লক্ষ মুক্তিপাগল ছাত্র-জনতা যুবাদেরকে যুবশিবিরে পাঠিয়ে প্রশিক্ষণ দিয়ে গেরিলা বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানিদের মধ্যে ত্রাসের সৃষ্টি, স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনগণকে উদ্বুদ্ধ রাখা এবং সাথে সাথে সারা বিশ্বে আলােড়ন সৃষ্টি—এ সবই ছিল প্রবাসী সরকারের অবিস্মরণীয় কীর্তি যা সমকালীন ইতিহাসের বিচারে অতুলনীয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে প্রথম থেকেই পাকিস্তান-সমর্থক এবং স্বার্থন্বেষী মহল পুরােনাে পাকিস্তানি কায়দায় অপপ্রচার এবং মিথ্যাচার শুরু করে দেয়। এদের প্রচার কখনও সূক্ষ্ম, কখনও ভুল; কিন্তু মূল বিষয়বস্তু একই। আর তা হলাে মুজিবনগর সরকার মানেই, ভারত। চোরা না শুনে ধর্মের কাহিনী– এদের সদুপদেশ দিয়ে লাভ নেই। কিন্তু দেশবাসীকে সত্যকথা জানাতে হবে। তথাকথিত ভারত-বিরােধী চক্র, যারা অতি প্রাচীন পাকিস্তানি ভাঙা রেকর্ড বাজিয়ে চলেছে ক্রমাগত, তাদের মুখােশ উম্মােচন করতে হবে। এদের প্রকৃত পরিচয় জনগণকে, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্মকে যাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে ধারণা স্পষ্ট নয়; বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর বেআইনিভাবে ক্ষমতা দখল করে স্বাধীনতার পর অধিকাংশ কাল পর্যন্ত যাদেরকে মিথ্যা, ভ্রান্ত এবং বিকৃত গল্প দিয়ে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করা হয়েছে ও হচ্ছে– জানাতে হবে।
একটি স্বাধীন দেশের সরকারের বৈশিষ্ট্য কী, সে-সম্বন্ধে কিছু উল্লেখ করলেই মুজিবনগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের যথার্থ চরিত্র ও রূপ পরিষ্কার হবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের প্রচলিত সংজ্ঞায় গণতান্ত্রিক সরকারপদ্ধতি দুই রকমের হতে পারে:
(ক) রাষ্ট্রপতি শাসিত এবং (খ) সংসদীয়। আওয়ামী লীগের মতাদর্শ এবং নির্বাচনী ঘঘাষণা (ম্যানিফেস্টো) অনুসারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকার গঠন করা হয় সংসদীয় পদ্ধতিতে। এই পদ্ধতিতে রাষ্ট্রের নির্বাহী ক্ষমতা ন্যস্ত থাকে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলীয় নেতার হাতে। তিনি হলেন সরকারপ্রধান। রাষ্ট্রপ্রধান হলেন রাষ্ট্রপতি। সংসদীয় পদ্ধতিতে রাষ্ট্রপ্রধান নিজে কোনাে নির্বাহী ক্ষমতা প্রয়ােগ করতে পারেন না, দুয়েকটি বিষয় ব্যতীত (যেমন নির্বাচনের পর তাঁর বিবেচনা অনুযায়ী কোনাে দলনেতাকে সরকার গঠন করতে আহ্বান করবেন)।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’ নামকরণেই বােঝা যায় এটা প্রজাতন্ত্র এবং গণতান্ত্রিক। এক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন সংসদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের অবিসম্বাদিত নেতা। তার অনুপস্থিতিতে দলনেতা নির্বাচিত হয়েছিলেন শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ। মুজিবনগরে তিনি গঠন করেছিলেন মন্ত্রিসভা। সৈয়দ নজরুল ইসলাম নির্বাচিত হয়েছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিরূপে। কর্নেল ওসমানী সশস্ত্র বাহিনীপ্রধান নিযুক্ত হন, অধিকন্তু তাঁকে মন্ত্রীর পদমর্যাদা দেওয়া হয়। আগের অনুচ্ছেদে এ-কথা বলা হয়েছে। এত ছােট আকৃতির মন্ত্রিসভা এবং সরকারি দপ্তর নিয়ে সরকারের কাজকর্ম চালানাে এবং রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার অনুপ্রেরণা ছিল।
সংসদীয় গণতন্ত্রের রীতি-পদ্ধতি অনুসরণ করে যেভাবে রাষ্ট্রের শাসনকাজ পরিচালিত হয়ে থাকে তা থেকে যুদ্ধকালীন অস্বাভাবিক অবস্থায় দুটো বিষয়ে ব্যত্যয় করা হলাে। এক, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি প্রতিটি মন্ত্রিসভা-বৈঠকে উপস্থিত থেকে সভাপতিত্ব করতেন। দুই. যেহেতু অধিকাংশ বৈঠকে প্রতিরক্ষা এবং যুদ্ধ পরিচালনা বিষয়সমূহ মুখ্য আলােচ্য বিষয় থাকত, তাই কর্নেল ওসমানী প্রায় প্রত্যেক বৈঠকেই যােগদান করতেন।
মূলত প্রধানমন্ত্রীকে ঘিরেই সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হতাে। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়, স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ, শিক্ষা, স্থানীয় প্রশাসন, শ্রম, অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও পরিকল্পনা। খন্দকার মােশতাক আহমেদকে দেওয়া হয়েছিল পররাষ্ট্র, আইন ও সংসদীয় বিষয়। ক্যাপ্টেন মনসুর আলীর উপর দায়িত্ব ছিল অর্থ, জাতীয় রাজস্ব, বাণিজ্য ও শিল্প, পরিবহণ। এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান ছিলেন স্বরাষ্ট্র, সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং কৃষি মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে (মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ দ্রষ্টব্য)।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অপর তিন মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি এঁরাই ছিলেন সরকার-পরিচালনায়। নীতি-নির্ধারণের সর্বময় কর্তৃত্ব ছিল তাদের। প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার নির্দেশনায় আমরা, অর্থাৎ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়/বিভাগের সচিববৃন্দ সরকারের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতাম। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রধান সেনাপতি মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত যাবতীয় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন সেক্টর কমান্ডারদের মাধ্যমে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের গঠন-কাঠামাে এবং কার্যাবলির দিকে একটু নজর দিলেই বােঝা যাবে কী অসাধারণ নেতৃত্বে অসম্ভবকে সম্ভব করেছিলেন এই সরকার, তাও মাত্র নয় মাস। সময়ে। অবশ্যই এটি সম্ভব হয়েছিল দেশপ্রেম ও গণসমর্থনের কারণে। কোনাে দেশে জনগণের এত বড় অংশকে এমন ব্যাপকভাবে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়তে দেখা যায়নি। এই দেশপ্রেম, ত্যাগ, মুক্তিকামনাকে সঠিক খাতে প্রবাহিত করে দেশে ও বিদেশে সমর্থনের ব্যবস্থা করে স্বাধীনতা অর্জন করাই ছিল আমাদের বিপ্লবী প্রবাসী সরকারের সবচেয়ে বড় কৃতিত্ব। মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন কর্মকর্তা, বিশেষ করে বিভিন্ন বাহিনীর প্রধানগণ এবং অন্যান্য কর্মকর্তাগণ যেভাবে আত্মপ্রচারে নেমে পড়েছিলেন, তার পাশাপাশি তুলনা করুন শহীদ চার নেতার প্রচার-বিমুখতা আর বিনয়।
আগেই বলেছি ১৯৭১ সালের বাংলাদেশ সরকার আকারে বিশাল ছিল না, কিন্তু অত্যন্ত কার্যকর এবং দক্ষ ছিল। মন্ত্রিসভার প্রাত্যহিক বৈঠক ছাড়াও যে-কোনাে সময় যে-কোনাে স্থানে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতাে প্রয়ােজন ও সময়ের তাগিদে। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় যেভাবে সরকার পরিচালনা করতে হয়, ঠিক সেইভাবে প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভা এবং আমরা সকলে কাজ করেছি। সিদ্ধান্তগ্রহণ পদ্ধতি ছিল দ্রুত এবং দৃঢ়। বাস্তবায়ন তদারক ক্ষিপ্র গতিতে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আমার বড় দায়িত্ব ছিল সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন তদারক এবং পরিবীক্ষণ (monitor) করা। এ সবই করতাম আমরা জাতীয় দায়িত্ববােধ থেকে। এজন্য কারাে তাগিদের প্রয়ােজন হতাে না। যে যেভাবে পারতেন সেভাবেই দায়িত্ব পালন করতেন।
মুক্তিযুদ্ধ ছিল আমাদের বাঁচা-মরার প্রশ্ন। এ লড়াইয়ে আমাদের জিততেই হবে, অন্যথায় আমরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাব; আমরা ন্যায়ের জন্য, সত্যপ্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করছিএই বিশ্বাস আমাদের আত্মপ্রত্যয় এবং সাহস জুগিয়েছে। সরকারের লক্ষ্য একটাই: যুদ্ধে জয়লাভ করা। এই লক্ষ্য সামনে রেখে আমাদের তাবৎ কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়েছে। এজন্যই সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে কালবিলম্বের কোনাে অবকাশ ছিল না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের গঠন: মন্ত্রণালয় ও দপ্তরসমূহ
তৎকালীন মন্ত্রিপরিষদ সচিব ১৯৭১ সালের ২০ অক্টোবর গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংগঠন এবং কার্যাবলির ওপর একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। সেই প্রতিবেদন থেকে এখানে উদ্ধৃতি দিলাম। এতে সরকারের কার্যাবলি সম্পর্কে একটা চিত্র পাওয়া যাবে।
পৃষ্ঠা: ৩৫
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিম্নলিখিত মন্ত্রণালয়/বিভাগে সংগঠিত হয়েছিল:
১. প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
২. পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৩. অর্থ, শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
৪. মন্ত্রিসভা সচিবালয়
৫. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
৬. স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
৭. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়
৮. স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
১০. সংসদ বিষয়ক বিভাগ
১১. কৃষি বিভাগ
১২. প্রকৌশল বিভাগ
মন্ত্রণালয়ের বাইরে আরও কয়েকটি সংস্থা ছিল যারা সরাসরি মন্ত্রিসভার কর্তৃত্বাধীনে কাজ করত, যেমন:
১. পরিকল্পনা কমিশন
২. শিল্প ও বাণিজ্য বাের্ড
৩. নিয়ন্ত্রণ বাের্ড, যুব ও অভ্যর্থনা শিবির
৪. ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি
৫. শরণার্থী কল্যাণ বাের্ড
এছাড়া মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক হিসেবে নিম্নলিখিত বেসরকারি সংস্থা, দল, গােষ্ঠী, সমিতি, বাহিনী ইত্যাদি ভূমিকা পালন করেছে। নিম্নবর্ণিত সংগঠনগুলির নাম থেকেই বােঝা যাবে তাদের ভূমিকা কী প্রকৃতির ছিল।
বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন
যুব নিয়ন্ত্রণ পরিষদ ও প্রশিক্ষণ বাের্ড
বাংলাদেশ হাসপাতাল
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
জয় বাংলা পত্রিকা
বাঙলাদেশ বুলেটিন
বহির্বিশ্বে মুক্তিযুদ্ধের সহযােগী সংগঠন
বাংলাদেশ শিক্ষক সমিতি
স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল
বঙ্গবন্ধু শিল্পী গােষ্ঠী
বাংলাদেশ তরুণ শিল্পী গােষ্ঠী
বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি
বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ
নিউইয়র্ক বাংলাদেশ লীগ
বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি, লন্ডন
লিবারেশন কাউন্সিল অব ইন্টেলিজেন্টসিয়া
সরকারের নিজস্ব ভূখণ্ড: বৈশিষ্ট্য ও সাফল্য
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার শুধুমাত্র প্রবাসী ছিল না। সরকারের সব দপ্তর মুজিবনগরে হলেও দেশের অভ্যন্তরে বিস্তীর্ণ এলাকা যুদ্ধ চলাকালে শত্রুমুক্ত করা হয়েছিল। তাছাড়া দেশের অভ্যন্তরে বহু এলাকা শত্রুবাহিনী আদৌ দখল করতে পারেনি। সেসব অঞ্চল দীর্ঘ নয় মাস মুক্তিযুদ্ধকালে শত্রুমুক্ত ছিল। এসব অঞ্চলে সরকারের ঘােষণা অনুযায়ী মুক্তিযােদ্ধারা এবং জনগণ সর্বাত্মক সহযােগিতা প্রদান করেছিল। জনগণের আন্তরিক সহযােগিতা বাংলাদেশ সরকারের অগ্রগতিতে বিপুল প্রাণ সঞ্চার করেছিল। রংপুরের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে, উত্তরে, দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চলে যেসব এলাকা মুক্তিবাহিনী দখল করেছিল, তা মুক্তই রাখা হয়েছে সর্বশক্তি দিয়ে। শুধু তাই নয়, ক্রমান্বয়ে সেই মুক্ত-অঞ্চল সম্প্রসারণ করা হয়েছে। আমাদের লাল-সবুজ পতাকা যেখানে একবার উড্ডীন হয়েছে সেখানে আর নামেনি। রৌমারি মুক্ত এলাকার কথা প্রায় সবাই জানেন। সেখানে আমাদের আঞ্চলিক প্রশাসন সুপ্রতিষ্ঠিত ছিল। চিলমারী এবং দিনাজপুরের বড় অংশ মুক্ত ছিল। ফেনীবেলােনিয়াতেও মুক্ত-অঞ্চল আমাদের বেসামরিক প্রশাসনের আওতায় ছিল।
‘মুক্তির গান’ ছবি দেখার পর অবিশ্বাসীরা অনেকে হয়তাে সম্বিত ফিরে পেয়েছেন। আমাদের স্বাধীনতার কথা এবং মুক্ত-অঞ্চলের হুবহু বাস্তব বিবরণ আছে মুক্তির গাননামে নির্মিত ভিডিও-সিডিতে। এ থেকে সর্বস্তরের জনসাধারণ, বিশেষ করে নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়রা ইতিহাস-বিকৃতির রাহুগ্রাস থেকে মুক্ত হতে পারে। এ-কারণে পাকিস্তানের ভক্তরা সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছে ঐ ছবি যেন এদেশে চলতে না পারে। কিন্তু তাদের অপচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সত্য কখনও চাপা থাকে না। তিন দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়েছে বটে, কিন্তু আজ বাংলার মানুষ জানতে পারছে বুঝতে পারছে, তাদের মুজিবনগর সরকার কত শক্তিশালী ছিল।
আমাদের সামরিক ও বেসামরিক প্রশাসন মুক্ত-এলাকাগুলােতে অবাধে যাতায়াত করতেন। ঐসব অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত হয় নিকটতম আঞ্চলিক প্রশাসনের (zonal council) অধীনে। ঐ অঞ্চলে বসবাসকারী জনগণের জন্য খাদ্য ও বস্ত্র এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের সরবরাহ নিশ্চিত করা হয় সরকারের পরিকল্পনার ভিত্তিতে। আমাদের বীর সেক্টর কমান্ডারররা মুক্ত-অঞ্চল থেকেই অধিকৃত অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করতেন। গেরিলাদের পাঠানাে হতাে অভ্যন্তরে। সরকারের পরিকল্পনা ও নির্দেশ অনুযায়ী কমান্ডারগণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৭১ সালের মাঝামাঝি থেকে হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণ পর্যন্ত সেক্টর এবং সাব-সেক্টর কমান্ডাররা সার্বক্ষণিকভাবে মুক্ত-অঞ্চলে প্রহরা এবং প্রতিরক্ষার ব্যবস্থা রাখেন। তারা ঐসব অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত অসংখ্যা ঘটনার ওপর ভিত্তি করে অনেক প্রামাণ্য চিত্র তৈরি হয়েছে। সেগুলাে দেশে যেমন আছে, বিদেশের মাটিতেও আছে অজস্র ছবি যাতে দেখা যাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রীবর্গ মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শন করছেন, জনসভায় বক্তৃতা করছেন; আর তাদের সাথে আছেন মুক্তিযােদ্ধা সেনানায়কেরা। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ক্রমাগত অনেক অনুষ্ঠান প্রচার করেছে মুক্তআঞ্চলভিত্তিক। এসব অনুষ্ঠানের মধ্যে জনপ্রিয় অনুষ্ঠান চরমপত্রের কথা মানুষ আজো স্মরণ করে। যুগ-যুগ ধরে এসবই স্মরণীয় হয়ে থাকবে। তথ্য মন্ত্রণালয় প্রকাশ করেছেন পুস্তিকা, প্রচারপত্র ইত্যাদি। এর কিছু কিছু দৃষ্টান্ত আমার কাছে এখনও যেমন আছে, তেমনি জাদুঘর প্রভৃতি স্থানেও সংরক্ষিত আছে।
বিদেশি সংবাদমাধ্যম, পত্রপত্রিকার প্রতিনিধিরা মুজিবনগরে এসেই মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শনে যেতে চাইতেন। Time Magazine, Newsweek, Reader’s Digest, London Times, Guardian, New York Times, Washington Post, La Monde, Reuter, AFP, AP সহ আরও অনেক সংবাদমাধ্যমের প্রতিনিধিরা মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শন করে ফিরে এসে তাদের প্রতিবেদন ছেপেছেন। এসব প্রত্রপত্রিকা ও জার্নালের কিছু কিছু কপি আমার কাছে সংরক্ষিত আছে। এগুলি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দলিল যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। (পরিশিষ্ট-১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭ এবং ৮ দ্রষ্টব্য)। এসব প্রতিনিধিদের মুক্ত-অঞ্চল পরিদর্শনের যাবতীয় ব্যবস্থা বাংলাদেশ সরকারই করতেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সহায়তাও গ্রহণ করা হতাে।
প্রাসঙ্গিকভাবে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের সদর দপ্তরে যে-শক্তিশালী প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল সে-সম্বন্ধে এখানে সংক্ষেপে পরিচয় তুলে ধরা আবশ্যক। প্রকৃতপক্ষে মুজিবনগরে গঠিত সরকারের সদর দপ্তর পশ্চিমবাংলার কোলকাতায় অবস্থিত ছিল। সেনাবাহিনীর দপ্তরও একই সঙ্গে ছিল। সরকারের সদর দপ্তরে যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী যােগ দিয়েছিলেন তাদের মধ্যে অনেক বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্ববাংলার সরকারি দপ্তর পরিত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে যুক্ত হন; সরকারের প্রশাসনেও দায়িত্ব পালন করেন। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও কিছু বাঙালি কর্মকর্তা পালিয়ে এসে মুজিবনগর সরকারে যােগ দেন। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের শক্তিশালী প্রশাসন। গঠনে যাঁদের অবদান অনস্বীকার্য তাঁদের কয়েক জনের নাম নিচে দেওয়া হলাে:
কর্মকর্তাগণের নাম- মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনে পদবি
১. মি. খন্দকার আসাদুজ্জামান, সিএসপি- সচিব
(যুগ্ম-সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়)
২. মি. নূরুল কাদের, সিএসপি- সচিব সংস্থান
(পাবনার ডিসি)
৩. মি. এম. এ. সামাদ, সিএসপি- সচিব প্রতিরক্ষা
(সিলেটের ডিসি)
৪. মি. মাহবুবুল আলম চাষী, (প্রাক্তন পি.এফ.এস.)- সচিব পররাষ্ট্র
৫৷ মি. আনােয়ারুল হক খান- সচিব তথ্য
৬. মি. আবদুল খালেক, পি.এস.পি.- সচিব স্বরাষ্ট্র ও ডিজি পুলিশ
(অধ্যক্ষ, পুলিশ একাডেমী, সারদা)
৭. ডা. টি. হােসেন- সচিব স্বাস্থ্য
৮. মি. নূরুদ্দীন আহমেদ- সচিব কৃষি
(প্রধান বন সংরক্ষক)
৯. মি. আবদুল হান্নান চৌধুরী- সচিব আইন
(জেলা জজ, দিনাজপুর)
১০. মি. এমদাদ আলী- প্রধান প্রকৌশলী
১১. মি. জয়গােবিন্দ ভৌমিক- ত্রাণ কমিশনার
১২. মি. রুহুল কুদুস, প্রাক্তন সিএসপি- মহাসচিব
১৩. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ- গণহত্যা ও স্নায়ুযুদ্ধ সেলের দায়িত্বে
১৪. মি. এইচ. টি. ইমাম, সিএসপি- মন্ত্রিপরিষদ সচিব
(ডিসি পার্বত্য চট্টগ্রাম)
এছাড়া মি. আবদুল মান্নান, এম. এন. এ. বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন। তাছাড়া তিনি মুক্তিযুদ্ধের মুখপত্র জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদক পদ অলঙ্কৃত করেছিলেন। যুবশিবির বাের্ডের চেয়ারম্যান ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এম.এন,এ এবং পরিচালক ছিলেন উইং কমান্ডার মির্জা। পরিকল্পনা বাের্ড সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করা হয়েছে ভিন্ন অধ্যায়ে।
আঞ্চলিক প্রশাসন
আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম চালু থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়ােজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযােগিতা- এই ছিল আমাদের ভাবনা। এই লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় ১১টি সেক্টরের সাথে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Councils) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলােতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এম.এন.এ/এম.পি.এ.-রা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। তাদের মধ্য থেকেই আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন। এই কাউন্সিলকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা (Zonal Administrative Officer) নিয়ােগ করা হয়। সেইসাথে নিযুক্ত হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্বপর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামাে কার্যকর ছিল।
আঞ্চলিক পরিষদ এবং দপ্তরগুলাে থাকার ফলে দেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হবার আগেই আমাদের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। সে-কারণে ১৬ ডিসেম্বরেই (কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে তার আগেই) আমাদের নিয়ােজিত সকল জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা স্ব-স্ব পদে যােগদান করে কালবিলম্ব না করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।
যুদ্ধ-পরবর্তী পুনর্বাসনের জন্য কার্যকর কর্মসূচি
যুদ্ধে জয় আমাদের নিশ্চিত—এই বিশ্বাস থেকেই আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তী বিভিন্ন সমস্যাবলি সম্পর্কে অগ্রিম চিন্তা-ভাবনা এবং কার্যকর কর্মসূচি (Plans and Programs) গ্রহণ ও পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছি। এই আগাম পরিকল্পনার মূল লক্ষ্য ছিল:
ক. পুলিশ প্রশাসন ও বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করে আইন-শৃঙ্খলা পুনস্থাপন
সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ ঘােষণা ছিল আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার বিষয়ে। নভেম্বর-ডিসেম্বরে বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর আসতে শুরু করে যে, দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা এবং স্থানীয় জনসাধারণ রাজাকার/শান্তি কমিটি এবং অন্যান্য দেশেদ্রোহীদের অথ্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে নিজেরাই আইন হাতে তুলি নিচ্ছে। কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে গণআদালত বসিয়ে বিচারও করা হচ্ছিল। যদিও এই গণদুশমনদের নির্মম শাস্তি প্রাপ্য ছিল তাদের জঘন্যতম অপরাধের জন্য (হত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ), তবু সরকার মনে করেছেন যে, এই ধরনের বিচার বা স্থানীয় প্রতিশােধ স্বাধীনতা ঘােষণার পরিপন্থি। স্বাধীনতার মূল্যবােধের অন্যতম ছিল আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, যা করতে হলে বিনাবিচারে অথবা আদালতের বাইরে কোনাে ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ক্ষমতা দেওয়া যায় না। স্বাধীন বাংলা বেতারে তাই আমরা বারবার ঘােষণা করেছি: আপনারা আইন নিজের হাতে তুলে নিবেন না। ভুলে যাবেন না আমাদের যুদ্ধ হলাে গণতন্ত্র আর আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার জন্য, শান্তি আর অগ্রগতির জন্য।
খ. বেসামরিক প্রশাসন চালু করে সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা
স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার ঘােষণা প্রসঙ্গে পূর্বেই বলেছি যে, দেশ মুক্ত হবার আগেই প্রতিটি জেলার জন্য আমরা জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পূর্ণাঙ্গ টিম গঠন করেছিলাম, যাতে প্রশাসনে কোনাে শূন্যতা দেখা না দেয়। একদিকে প্রশাসনের অনেকেই গােপনে আমাদের সাহায্য করেছেন, অপরদিকে অনেকে জ্ঞাতসারেই বিরােধিতা করেছেন। আবার অনেকের সম্পর্কে আমাদের কোনাে তথ্য ছিল না। তারা হয়তাে স্বাধীন দেশে জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য নাও হতে পারেন। এই কারণেই আমাদের সম্পূর্ণ নতুন টিম গঠন করতে হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের পূর্বেই প্রতিটি জেলায় স্বাধীন সরকারের জেলা-প্রশাসক এবং পুলিশ সুপার (এস.পি. নিয়ােগদান ছিল উপরের (ক) ও (খ) এর প্রথম পদক্ষেপ।
গ. ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থা
মুজিনগরে অবস্থানকালেই শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য সরকারকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হয়। এক কোটির ওপর লােক ভিটেমাটি ছেড়ে প্রায় নিঃস্ব হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছিল। অনেক শরণার্থী অসুস্থ, গােলাগুলিতেও আহত। বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। গরু, মহিষ, গৃহপালিত জন্তু কিছু নেই। হালের বলদ নেই। সব লুটপাট করেছে পাঞ্জাবি সেনা আর অবাঙালি-রাজাকার-আলবদর-এর সদস্যরা। শুধুমাত্র স্বস্থানে প্রত্যাবর্তন করলেই আশ্রয় মিলবে না, আশ্রয় থাকতে হবে, ঘর তৈরি করতে হবে। তার জন্য প্রয়ােজন ঢেউটিন, কাঠ, খড় ইত্যাদি। গৃহনির্মাণসামগ্রী, হালের বলদ, ফসলের বীজ, সার, কয়েক মাসের খাদ্যসামগ্রী এ সবকিছুর জন্য আমরা ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। অর্থাৎ মুজিবনগর সরকার সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চিন্তাভাবনা করেছিল।
এই লক্ষ্যে, বিশেষ করে এত বিশাল মানব-সমুদ্র সামাল দিতে যে-আয়ােজন দরকার ছিল, তা আগেই পরিকল্পনা করে খুঁটিনাটি পর্যন্ত ব্যবস্থা করতে হয়েছিল। পুরাে অক্টোবর, নভেম্বর মাসে আমরা বিভিন্ন টাস্ক ফোর্স (Task Force) গঠন ও দায়িত্ব বণ্টন করে ভারতীয় প্রতিপক্ষের (counterpart) সাথে প্রতিদিন আলােচনা করেছি। কোন্ কোন্ পয়েন্ট দিয়ে শরণার্থীরা ফিরে আসবে; কী ধরনের ও কত সংখ্যক যানবাহন প্রয়ােজন হবে; অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কোন ব্যক্তিদের আগে আনতে হবে; পথে কোথায় এরা বিশ্রাম নেবে; কীরকম খাবার দিতে হবে (শিশু, বয়স্ক, বৃদ্ধ বাছবিচার করে); জরুরি চিকিৎসা ব্যবস্থা কোথায় হবে; ডাক্তার ও ওষুধপত্রের ব্যবস্থাসহ এরকম অসংখ্য সিদ্ধান্ত নিয়ে প্রয়ােজনীয় জনবল নিয়ােগ করতে হয়েছে। অবশ্য এ-কথা অনস্বীকার্য যে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে সময়ােচিত সাহায্য ও সহযােগিতা না
পৃষ্ঠা: ৪০
পেলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের এত বড় সমস্যা সমাধান আমাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না হয়তাে। তাছাড়া আমাদের রাষ্ট্র তখন শিশুরাষ্ট্র। সময়ােচিত ব্যবস্থা না নেওয়া হলে অনেকে মৃত্যুবরণ করতেন।
ঘ. একই সাথে আমাদের আরও একটি সমস্যার অনুরূপ সমাধান করতে হয়েছে। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী শরণার্থীরা ছাড়াও দেশের অভ্যন্তরে বিরাট সংখ্যক অধিবাসীকে তাদের ঘরবাড়ি ছেড়ে অন্যত্র নিরাপদে আশ্রয় নিতে হয়েছিল। এদের পুনর্বাসনের দিকেও আমাদের লক্ষ্য রাখতে হয়েছে।
ঙ. উপরের (গ) ও (ঘ) উভয় কাজের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে যেসব বিষয় জড়িত ছিল তার মধ্যে গৃহনির্মাণ সামগ্রী (যেমন ঢেউটিন, কাঠ, খড়, সুতলি, দড়ি, পেরেক, ধাতব তার ইত্যাদি) সংগ্রহ, চাষাবাদের উপকরণ (হালের বলদ, ফসলের বীজ, সার, নতুন ফসল ঘরে না-ওঠা পর্যন্ত কয়েক মাসের খাদ্য সামগ্রী) এবং গবাদিপশু সরবরাহ অন্যতম।
চ. দ্রুত চলাচল, খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ, শরণার্থীদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রেরণ-এসব বিষয় নির্ভরশীল ছিল সড়ক ও যােগাযােগ ব্যবস্থার ওপর, যার অধিকাংশ ছিল বিধ্বস্ত। অতএব, পাশাপাশি যে-বিষয়টি অগ্রাধিকার পায় তা হলাে ভৌত অবকাঠামাে, সড়ক ও সড়ক সেতু সংস্কার ও পুনঃস্থাপন। নদীপথগুলােকেও নৌচলাচলের উপযােগী এবং নিরাপদ করার প্রয়ােজন ছিল। মুজিবনগর সরকার এসব বিষয় দক্ষতার সঙ্গেই মােকাবিলা করেছিলেন।
ছ. শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবার সকল প্রতিষ্ঠান পুনরায় নিয়মিতভাবে চালু করার জন্য প্রয়ােজন ছিল অতি দ্রুত এগুলাের সংস্কার, শিক্ষক ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিতকরণ এবং শিক্ষা ও চিকিৎসার উপকরণ সংগ্রহ ও সরবরাহ। বিজয়ের আগেই সরকার এসব বিষয় দূরদৃষ্টি নিয়ে অনুধাবন করেন এবং স্বাধীন দেশে সরকারের কার্যক্রম সার্বিকভাবে প্রচলন করতে সক্ষম হয়।
উপরে যেসব কর্মসূচি ও সাফল্যের কথা উল্লেখ করলাম তা সামগ্রিকভাবে বিচার ও বিশ্লেষণ করলে তিনটি বিষয় আমাদের সামনে সুস্পষ্ট হয়; এগুলাে হচ্ছে: (১) আইন ও শৃঙ্খলা এবং বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও পরিচালনা; (২) অর্থনীতি পুনর্গঠন; (৩) গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা। প্রতিটি ক্ষেত্রেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার অভূতপূর্ব সাফল্য অর্জন করেছিল। এই সাফল্যের পেছনে যাদের অবদান, চিন্তা-ভাবনা ও শ্রম সব চাইতে বেশি তারা হলেন:
ক. বাঙলার বীর জনগণ (যারা এই বিশাল যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে একে জনযুদ্ধে পরিণত করেছিলেন)।
খ. মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার (যাদের দূরদর্শিতা এবং অগ্রিম পরিকল্পনা অবিশ্বাস্য ছিল)।
গ. ভারত-সরকার ও তার অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা (যাদের সাহায্য ও সহযােগিতা এবং ভারতীয় জনসাধারণের সহযােগিতা, বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার জনগণের ও সাহায্য সংস্থার)।
১০ ডিসেম্বর অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা এক অতি গুরুত্বপুর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তে বলা হয় যে: ভারতের এবং বিদেশের যেসব ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ জমা আছে তা অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের নামে পরিবর্তন করা হলাে। যেসব কর্মকর্তা-কর্মচারী শত্রুর অধীনে দখলকৃত এলাকায় চাকুরিরত ছিলেন তাদের বিনা-বিচারে শাস্তি দেওয়া হবে না। যে-সকল কর্মকর্তা-কর্মচারী অফিস ছেড়ে দেশের অভ্যন্তরেই আছেন তাদের অবিলম্বে পূর্বের পদে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলাে। ২৫ মার্চের আগে যারা ভারতে গিয়েছিলেন তাদের পূর্ব-পদে যােগদান করার নির্দেশ দেওয়া হলাে। বর্তমানে যারা এইসব পদ দখল করে আছেন তারা সবাই ও.এস.ডি. হবেন।
অগ্রিম পরিকল্পনা: প্ল্যানিং সেল
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন সাফল্যের পেছনে যে-পদক্ষেপটি উল্লেখযােগ্য তা হলাে পূর্ব-পরিকল্পনা প্রণয়ন। বিজয়ের অনেক আগে সরকার (মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত) পরিকল্পনা সেলগঠন করেন। দেশের কয়েকজন বরেণ্য চিন্তাবিদ, অর্থনীতিবিদ ও শিক্ষক এই সেলের সদস্য নিযুক্ত হন। এঁরা হলেন: (১) ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, (২) ড. খান সরওয়ার মুরশিদ, (৩) ড. মুশাররফ হােসেন, (৪) ড. স্বদেশ বােস ও (৫) ড. আনিসুজ্জামান। পরবর্তীকালে এই সেলকেই পরিকল্পনা সেল/বাের্ড দুই রকমের পরিকল্পনা হাতে নেন: একটি স্বল্পমেয়াদী (যা মূলত পুনর্বাসন পরিকল্পনা); অপরটি দীর্ঘমেয়াদী (যা হবে ভবিষ্যৎ অর্থনীতির ভিত্তি)।
পরিকল্পনা সেলের কাজে নানাভাবে সাহায্য ও সহযােগিতা করেন ভারতীয় প্রতিপক্ষ (counterpart)। সেপ্টেম্বরের ২৩ তারিখে ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য, বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ড. সুখময় চক্রবর্তী কোলকাতায় আসেন। ২৪ তারিখে তাঁরা মিলিত হন। আমাদের পরিকল্পনা সেলের সদস্যদের সাথে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎও করেন। ড. চক্রবর্তীর সাথে ছিলেন মি. ডি. কে. ভট্টাচার্য এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যুগ্মসচিব মি. রমাচন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে সহযােগিতার বিষয়ে আলােচনা হয়। এই সহযােগিতার বিশেষ তাৎপর্য এই ছিল যে: ভারতীয়দের কাছে পাকিস্তান, বিশেষ করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কিত যেসব তথ্য, পত্র-পত্রিকা, বই ইত্যাদি সংরক্ষিত ছিল সেগুলাে তারা আমাদের ব্যবহার করতে দেন। আমাদের প্ল্যানিং সেলের নিজস্ব লাইব্রেরি বা দলিলপত্র কিছুই ছিল না। যার ভিত্তিতে তারা এগুতে পারেন। কয়েকটি ক্ষেত্রে ভারতীয়রা বিশেষজ্ঞ (experts) পাঠিয়ে আমাদের পরিকল্পনায় সাহায্য করেন। পানিসম্পদ, যােগাযােগ ও পরিবহণ, মানব-উন্নয়ন পরিকল্পনা এগুলাে বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল। মন্ত্রিপরিষদ-সচিব হিসেবে আমি এইসব আলােচনা ও বৈঠক সমন্বয় করি। বাস্তবায়ন নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল আমার।
পরিকল্পনা সেলের পাশাপাশি আমরা সচিব এবং বিভাগীয় প্রধান পর্যায়ে বেশ কয়েকটি কমিটি গঠন করি ঢাকায় সরকার স্থানান্তর, আইন ও শৃঙ্খলা, বেসামরিক প্রশাসন, পুনর্বাসন, শরণার্থী প্রত্যাবর্তন এইসব বিয়য়ের ওপর। বিদেশ থেকে আগত বেশ কয়েকজন সিনিয়র কর্মকর্তা, যেমন জনাব আবুল ফাতেহ, জনাব এম. এ. মােমেন, জনাব আতাউর রহমান প্রমুখ। আমাদের সাথে এই কমিটিতে কাজ করেছিলেন। প্রতিটি কমিটি একটি করে কর্ম-পরিকল্পনা (action programme) প্রস্তুত করেন যা মন্ত্রিসভায় আলােচিত ও গৃহীত হয়। এই কমিটিগুলােরও সমন্বয়কারী ছিলাম আমি। একই সময়ে ভারত-সরকার কোলকাতায় তাঁদের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরগুলােকে পুনর্গঠন ও শক্তিশালী করেন যাতে তারা সংস্থা শরণার্থী, ত্রাণ ও পুনর্বাসন, আইন-শৃঙ্খলা (পুলিশ), বেসামরিক প্রশাসন, যােগাযােগ ইত্যাদির জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন তারা ভারতীয় প্রতিপক্ষের (counterpart) সাথে নভেম্বর-ডিসেম্বর মাসে দিনে-রাত্রে আলােচনা করে আপৎকালীন পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তা বাস্তবায়নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। [বিস্তারিত তথ্যের জন্য ঘটনাবহুল সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১’ অধ্যায় দেখুন]
গণহত্যা সেল
গণহত্যা সেল গঠন ছিল সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ তৎপরতা। বাংলাদেশ হাইকমিশনে এই সেল প্রতিষ্ঠা করা হয়। প্রাথমিকভাবে দায়িত্বে ছিলেন মওদুদ আহমদ। পরে রাষ্ট্রদূত ফাতেহ সাহেব এবং মােমেন সাহেব দায়িত্ব নেন। প্রতিটি অঞ্চলের (zone-এর) কর্মকর্তাদের প্রতি নির্দেশ ছিল তারা যেন তথ্য সংগ্রহ করেন, সাক্ষী-সাবুদ প্রস্তুত রাখেন, পরবর্তীকালে আদালতে ব্যবহারের জন্য। দেশের ভেতরে এবং বিভিন্ন ক্যাম্পে ঘুরে-ঘুরে প্রচুর তথ্য, সাক্ষী সংগ্রহ করা হয়। আমাদের মস্তবড় দুর্ভাগ্য যে, আমরা স্বাধীনতার পর এইসব তথ্য ও সাক্ষী-সাবুদ ব্যবহার করে গণহত্যার বিচার করতে ব্যর্থ হয়েছি। যদি আমরা যথাসময়ে এইসব গণশত্রু এবং দেশদ্রোহীর বিচার করতে পারতাম, তাহলে আর আজ দেশে রাজাকার, আলবদর, পাকিস্তানিদের পুনর্বাসন হতাে না। এরা কখনােই হত্যা আর কু-র মাধ্যমে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে সত্যিকার দেশপ্রেমিকদের বিচারের প্রহসন করার সুযােগ পেত না। পাকিস্তানের ভাঙা রেকর্ডও বাজত না।
উপদেষ্টা পরিষদ গঠন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি বিশেষ প্রচেষ্টা ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধে ধর্ম-দল-মত নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে তাদের সমর্থনে যুদ্ধ-পরিচালনা করা। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সব কয়টি আসনে জয়লাভ করলেও, স্বাধীনতাযুদ্ধে ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মােজাফফর), কংগ্রেস ইত্যাদি দলও প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে। এই কারণে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁদের সমর্থন আদায়ে সচেষ্ট ছিলেন। মুজিবনগর সরকারের আন্তরিক চেষ্টায় সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করা সম্ভব হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ, মণি সিং, শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর প্রমুখ ছিলেন এই উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য।
বঙ্গবন্ধুর মুক্তিলাভের জন্য বিশ্বব্যাপী প্রচার, পাকিস্তানের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ
মুজিবনগর সরকারের মন্ত্রিসভার প্রায় সব সভা এবং বৈঠকে বঙ্গবন্ধু শেষ মুজিবুর রহমানের প্রসঙ্গ উঠত। বাঙালি জাতির চোখের মণি বঙ্গবন্ধু কোথায়, কীভাবে আছেন তা জানার জন্য সকলের, বিশেষ করে মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের কথাবার্তায়, আচার-আচরণে আমি এক উদ্বেগাকুল বন্ধুকে দেখেছি। নেতা বঙ্গবন্ধু সঙ্গে নেই, এ-কথা প্রধানমন্ত্রী একটি মুহূর্তের জন্যেও ভাবতে পারতেন না। মন্ত্রিসভার সভায় বা অন্য আলােচনায় বঙ্গবন্ধুর কথা উঠলেই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে উঠত। তিনি তার হাতের তালু দিয়ে, কখনও বা রুমাল দিয়ে চোখ দিয়ে গড়িয়ে-পড়া পানি মুছতেন। এ-দৃশ্য আমি প্রায়শই লক্ষ্য করেছি। উপস্থিত সকলেই ভারাক্রান্ত হতেন। পরিবেশ ভারী হয়ে উঠত।
পাকিস্তানি দস্যুদের কবল থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার জন্য কতভাবেই-না চেষ্টা করেছে বাংলাদেশ সরকার। সরকারের মন্ত্রিসভার দুটি সভার সিদ্ধান্ত দৃষ্টান্ত হিসেবে তুলে ধরলেই এ-কথা বুঝা সহজ হবে যে, বঙ্গবন্ধুর জন্য সরকারও কত উদ্বিগ্ন ছিল। ১৯৭১ সালের ২ মে তারিখে গৃহীত একটি সিদ্ধান্ত বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য আন্তর্জাতিক ও জাতীয় পর্যায়ে চাপ সৃষ্টির ওপর জোর দেওয়া হয়। যখন সরকার বিভিন্ন সূত্রে জানতে পারে যে, পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধু বন্দি আছেন এবং তার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার প্রহসনমূলক বিচার করার আয়ােজন করা হয়েছে তখন উদ্বিগ্ন প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত নেন:
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হলাে।
আবার ৫ মে তারিখে সংবাদমাধ্যম, গােয়েন্দা মাধ্যম ও কূটনৈতিক মাধ্যমে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভার সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
মন্ত্রিসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি অনুযায়ী মহান নেতার গ্রেফতারের খবর সত্যি হলে তাঁর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
উপরের সিদ্ধান্তে বঙ্গবন্ধুকে মহান নেতা হিসেবে উল্লেখ করার মধ্য দিয়ে সরকারের আন্তরিকতা ও ভালােবাসা ফুটে উঠেছে। সরকারের দায়িত্বশীল পদে কাজ করা কালে আমার অনুভূতিতে এমন অবিস্মরণীয় ঘটনা ঘটতে আর কখনও দেখিনি। বঙ্গবন্ধুর বিচার-প্রহসন বন্ধ করার অনুরােধ জানিয়ে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নিবিড় কূটনৈতিক তৎপরতা ছাড়াও প্রচারমাধ্যমেরও সহায়তা নেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর বিভিন্ন সরকার, বিশেষ করে সােভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত, ব্রিটেন ইত্যাদি রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে এবং রেডিওটেলিভিশনের মাধ্যমে জনমত সৃষ্টি করে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল। একথা তাে সকলেরই জানা যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগর্নি ব্যক্তিগত পর্যায়ে পর্যন্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ-বিষয়ে সতর্ক করে দিয়েছিলেন। এ সবই বাংলাদেশ সরকারের কর্মতৎপরতার ফল ছিল।
বৈদেশিক নীতি ও স্বীকৃতি আদায়
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ কেন? এটা বহির্বিশ্বে প্রচার করা এবং এর প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি এবং সম্ভব হলে স্বীকৃতি আদায় করাও ছিল আমাদের অন্যতম লক্ষ্য। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে, ইংল্যান্ড, আমেরিকা ও এশিয়ার বিভিন্ন দেশে আমাদের প্রতি, বাঙালির প্রতি যে-সহানুভূতি সৃষ্টি হয়েছিল, তা প্রবাসী সরকারের বিভিন্নমুখী প্রচেষ্টার ফলেই। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার যে সে-দেশের একমাত্র বৈধ সরকার, তা অধিকাংশ দেশ ও সরকারের কাছে স্পষ্ট হতে বেশি সময় লাগেনি। তার কারণ আমাদের নৈতিক ও আইনগত ভিত্তি এবং পাকিস্তানিদের গণহত্যা। পাকিস্তান ও তার দোসরদের ব্যাপক অপপ্রচার সত্ত্বেও আমাদের সরকারের প্রতি সহানুভূতি ও নৈতিক সমর্থন বিশ্বব্যাপী গড়ে উঠেছিল, তার প্রধানতম কারণ ছিল আমাদের প্রবাসী সরকারের স্বাধীন ও সার্বভৌম নীতিসমূহ এবং কার্যকলাপ। যুদ্ধের সময়ে ও পরবর্তীকালে এই সরকারকে ভারতের পুতুল বা পাপেট সরকার বলে পাকিস্তানি সমর্থকরা অনেক ঢাক-ঢােল পেটালেও তা ধােপে টেকেনি।
সেনাবাহিনী পুনর্গঠন, শক্তিবৃদ্ধি, সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠা
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে তৎকালীন পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যে-কয়টি ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্যাটালিয়ান ছিল তাদেরকে পাকিস্তানিরা ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বিচ্ছিন্ন ও শক্তিহীন করে ফেলার অপচেষ্টা চালিয়েছিল। ঐ কঠিন সময়ে দৃঢ় প্রত্যয়ের সাথে আমাদের বাঙালি অধিনায়করা যে যেখানে পেরেছেন সেখানেই প্রতিরােধ গড়ে তুলেছিলেন অধীনস্থ সেনাদের নিয়ে। অন্যান্য পাকিস্তানি ইউনিটে যে-সমস্ত বাঙালি অফিসার ও সেনা ছিলেন তারাও হাতিয়ার তুলে নিয়ে সুবিধামতাে স্থানে মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করেন। এছাড়াও ছিলেন মুক্তিবাহিনীতে ই.পি.আর., পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনীর সদস্য। বিমানবাহিনী ও নৌবাহিনীও পিছিয়ে ছিল না। এই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা বাহিনীকে গড়ে-তােলার দায়িত্ব নেন কর্নেল এম.এ.জি ওসমানী। তাঁকে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে সাহায্য করেন গ্রুপ-ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। কর্নেল রবও ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ছিলেন, কিন্তু তার কোনাে সক্রিয় ভূমিকা লক্ষ্য করা যায়নি।
মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন সিনিয়র অফিসার, পরবর্তীতে যারা সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেন যােগ্যতা এবং বীরত্বের সাথে, তাঁরা প্রথমে বিচ্ছিন্ন থাকলেও অতি সত্বর নিজেদের মধ্যে যােগাযােগ স্থাপন করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের অধীনস্থ সেনা-কমান্ডের নেতৃত্বে চমৎকার শৃঙ্খলার সাথে চেইন অব কমান্ড স্থাপন করেন। পারস্পরিক সমঝােতার বিরল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন আমাদের কমান্ডারবৃন্দ। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর মীর শওকত আলী, ক্যাপ্টেন রফিক, মেজর মঞ্জুর, মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর সি.আর.দত্ত, মেজর নূরুজ্জামান (অব.), মেজর তাহের, উইং কমান্ডার বশর, মেজর জলিল, ফ্লাইট লেফটেনান্ট হামিদুল্লাহ-এঁদের সকলের নামই করতে হয় একসাথে। এই সেক্টর কমান্ডারদের সাথে অনেক সাব-সেক্টর কমান্ডারও তাঁদের বীরত্ব, সাহস আর দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন মুক্তিযুদ্ধে। এঁদের মধ্যে তৎকালীন ক্যাপ্টেন শাফায়ত জামিল, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন মতিন, মেজর মইনুল, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, মেজর শামসুদ্দিন, ক্যাপ্টেন ভুইঞা, লেফটেনান্ট ইমামুজ্জামান, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ক্যাপ্টেন অলি আহমেদ, মেজর জাফর ইমাম, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, ক্যাপ্টেন মেহেদী আলী ইমাম, ক্যাপ্টেন আবদুস সালেক চৌধুরী, মেজর আমিনুল হক, ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন এম.এ. গাফফার, মেজর জিয়াউদ্দীন প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য। এঁদের পাশাপাশি নৌকমান্ডে অফিসারদের কথাও অবশ্যই মনে রাখতে হবে। আরও অনেক, অনেক সেনানায়ক ছিলেন যাদের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধে স্মরণীয়। এইসব বীরের স্মৃতি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে একটি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য বিষয় হলাে সকল সেনানায়কই কেন্দ্রীয় কমান্ডের নির্দেশ এবং পরিকল্পনামতাে যুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। কেউই কেন্দ্রীয় সরকারের আদেশ/নির্দেশ অমান্য করেননি। শৃঙ্খলা ভঙ্গের কারণে যে দু’একজনের শাস্তি হয়েছে তা তারা মাথা পেতে নিয়েছেন।
বাংলাদেশ সরকারের আরেকটি সুদূরপ্রসারী পদক্ষেপ ছিল সামরিক বাহিনী গঠনের জন্য নিজস্ব অফিসার কোর (corps) তৈরি করা। এই লক্ষে মুক্তিবাহিনী থেকে বাছাই করে প্রথম অফিসার ক্যাডেট নিয়ােগ করা হয়। মুর্তী নামক একটি জায়গায় অস্থায়ী মিলিটারি কলেজ স্থাপন করা হয়। নভেম্বর মাসের কোনাে একসময় প্রথম ব্যাচের পাসিং আউট প্যারেড (Passing out parade) অনুষ্ঠিত হয়। সালাম গ্রহণ করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সাথে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আমার পরম সৌভাগ্য যে, আমিও সেখানে উপস্থিত থেকে অফিসার ক্যাডেটদের সনদপত্রে (Certificate-এ) দস্তখত করি। ঐ ব্যাচ একাডেমী থেকে বের হওয়ার সাথে সাথেই যুদ্ধে অংশগ্রহণ এবং অসীম বীরত্ব প্রদর্শন করে। এদের মধ্যে কোনাে-কোনাে ক্যাডেট শাহাদৎ বরণ করেন। আজও ঐ ব্যাচের কোনাে-কোনাে অফিসার (কেউ জেনারেল, কেউ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল বা কর্নেল) আমার কাছে এসে পরিচয় দিয়ে বলেন, আমি ১৯৭১ সালের কোর্স করেছি। আপনি আমার সনদে দস্তখত করেছিলেন।
পৃষ্ঠা: ৪৫
‘বাংলাদেশের সশস্ত্র বাহিনী’ দিবস ২০০৩ সালে ২১ নভেম্বর পালিত হয়েছে। এই ২১ নভেম্বর, ১৯৭১ ছিল আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সম্মিলিত সশস্ত্র বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। আজও আমরা গর্বের সাথে, আনন্দের সাথে, এবং সাড়ম্বরে এই দিনটি উৎসবের মতাে পালন করি। কারও কি একবারও মনে হয় ২১ নভেম্বর, ১৯৭১ সশস্ত্র বাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সামরিক বাহিনী সদর দপ্তর (Head Quarter)-দ্বারা; এককভাবে কোনাে ব্যক্তি বা কমান্ডার এর কৃতিত্ব দাবি করেন না। সমষ্টিগতভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ (প্রতিরক্ষা মন্ত্রীও), প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী, ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার এবং প্রতিরক্ষা সচিব এম.এ. সামাদের নাম উল্লেখ করতে হয় শ্রদ্ধাভরে।
প্রধানমন্ত্রীর সীমাবদ্ধতা/প্রতিকূলতা
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রচণ্ড প্রতিকূলতার মধ্যে যেভাবে হাল ধরে রেখে চূড়ান্ত বিজয়ের দিকে সরকার, মুক্তিবাহিনী ও পরিশেষে জাতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন সেই আলােচনা অনেকেই আজ আর করেন না। স্বাধীনতা-উত্তর কালের এবং আজকের প্রজন্মের জন্য যে সমস্ত তথ্য প্রকাশিত হওয়া প্রয়ােজন সেটা হলেই আমরা আমাদের নেতৃবৃন্দের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারব। বিভিন্ন সময়ে আমাকে অনেকে ব্যক্তিগতভাবে প্রশ্ন করেছেন, জানতে চেয়েছেন মন্ত্রিসভার ভিতরের কথা, নেতৃত্বের কথা, অন্তর্দ্বন্দ্বের আর ষড়যন্ত্রের তথ্য। কোনাে কোনাে বিষয় আছে যা অনুক্ত থাকাই ভালাে। আবার অনেক বিষয় আছে যা দীর্ঘকাল কার্পেটের তলায় লুকিয়ে রাখা যায় না। তাজউদ্দীন সাহেব যেসব প্রতিকূল অবস্থার মােকাবিলা করেছেন এবং তা থেকে সাফল্যের সাথে উত্তরণ করেছেন তার সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দিলে বােধহয় বিষয়টি পরিষ্কার হবে।
প্রথম সমস্যা ছিল তাজউদ্দীন আহমদের উত্তরাধিকার প্রশ্ন। বঙ্গবন্ধু তাঁকে ২৪ তারিখে অন্যত্র নিরাপদ এবং নির্দিষ্ট স্থানে থাকতে বলেছিলেন, যথাসময়ে নির্দেশ পাঠাবেন এই কথা বলে। ২৫/২৬ মার্চের বিশৃঙ্খল ও ভয়াবহ অবস্থার মধ্যে এবং বঙ্গবন্ধুর সাথে যােগযােগ করতে ব্যর্থ হয়ে তিনি সীমান্ত অতিক্রমের সিদ্ধান্ত নেন ৩০ মার্চ। প্রাথমিক অবস্থায় নেতৃস্থানীয় কেউই তাঁর সাথে ছিলেন না (একমাত্র ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম ব্যতীত)। অসীম ধৈর্যের সাথে তিনি একে একে সকলের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন করেন।
সম্মিলিতভাবে তারা সিদ্ধান্ত নেন স্বাধীনতা এবং আইনের প্রয়ােগ সম্পর্কিত ঘােষণার। সংগ্রামের সেই গােড়ার দিকেই তাজউদ্দীন আহমদ সিদ্ধান্তে উপনীত হন যে, পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ করে বাংলাদেশকে হানাদারমুক্ত করার একমাত্র উপায় সশস্ত্র সংগ্রাম। এই মুক্তিযুদ্ধকে সফল করার যেটি চূড়ান্ত লক্ষ্য-ভারত ও অন্যান্য জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল (অর্থাৎ সমাজতান্ত্রিক) দেশসমূহের সাহায্য ও সহযােগিতা লাভ করা। এই জিনিস অর্জন করতে হলে পূর্বশর্ত একটি সরকার গঠন করা, যা সকলের কাছে গ্রহণযােগ্য। গ্রহণযােগ্যতা পেতে হলে প্রয়ােজন পূর্ববাংলা থেকে নির্বাচিত সকল (অথবা অধিকাংশ) জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমর্থন। কঠোর পরিশ্রম আর ধৈর্যের সাথে তাঁকে এটি অর্জন করতে হয় ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণার আগেই। কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে যুদ্ধরত সেক্টর কমান্ডাররাও সরকারের পেছনে এসে দাঁড়ান, যার প্রত্যক্ষ প্রমাণ আমরা পাই প্রধানমন্ত্রীর ১১ এপ্রিলের ভাষণে এবং পরে মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে।
এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদ দুই দফা বৈঠক করেন। সেটিই ছিল ভারত-বাংলাদেশ সহযােগিতার প্রথম ধাপ। তাজউদ্দীন আহমদকে এই বৈঠকের বিষয়ে সাহায্য করেন ভারতীয় বি.এস.এফ.-এর তৎকালীন পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান (আই.জি.) গােলক মজুমদার, বি.এস.এফ-এ অধিনায়ক (ডি.জি.) রুস্তমজী। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের (হাই-কমান্ড) সাথে যােগাযােগেও তাঁরাই সহযােগিতা করেন।
এপ্রিলের পরেই নানারকম ষড়যন্ত্র দানা বাঁধতে শুরু করে। খন্দকার মােশতাক ও তার ককেজন সহযাত্রী কখনই তাজউদ্দীন আহমদের নেতৃত্ব মেনে নেননি। উপরন্তু তাদের সার্বক্ষণিক প্রচেষ্টা ছিল কীভাবে সরকারের ভিত নড়ানাে যায়। তাদের উদ্দেশ্যই ছিল অশুভ। পাকিস্তানের সাথে গাঁটছড়া বাঁধতে তাদের উৎসাহ ছিল প্রচণ্ড। শুধু তাই নয়, খন্দকার মােশতাক প্রথম থেকেই বৈদেশিক একটি পরাশক্তির মাধ্যমে ইয়াহিয়া খানের সাথে আপােষ ফর্মুলায় যাবার চেষ্টা করছিলেন। ঐ বৈদেশিক শক্তির কোলকাতাস্থ মিশনের সাথে তাদের গােপন যােগাযােগ ছিল। খন্দকারের বক্তব্য ছিল এই যে, তিনি ছিলেন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি, অতএব তিনি বঙ্গবন্ধুর পর প্রথম নেতা। কামারুজ্জামান মনে করতেন। তিনি সর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, অতএব তিনিই প্রধানমন্ত্রীর পদ দাবি করতে পারেন। তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, তাই তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী কেমন করে হন? এই প্রতিকূল মনােভাবের মধ্যেও তাজউদ্দীন আহমদ অচঞ্চল ছিলেন।
বাস্তব অবস্থা ছিল এই যে দুই দশকেরও বেশি সময় তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহকর্মী ছিলেন, যাকে বলা হয় ডান হাত। ১৯৬৪ সাল থেকে সকল দলীয় নীতি ও কর্মসূচির অন্যতম মুখ্য প্রণেতা ছিলেন তিনি। এখানে বন্ধুবর মঈদুল হাসানের গ্রন্থ মূলধারা ১৯৭১’ থেকে উদ্ধৃতি দেওয়ার লােভ সম্বরণ করতে পারছি না। তার বিশ্লেষণের সঙ্গে আমি একমত। তাজউদ্দীন ছিলেন, দলের সকল মূল কর্মকাণ্ডের নেপথ্য ও আত্মপ্রচার-বিমুখ সংগঠক। ৭১-এর মার্চে অসহযােগ আন্দোলনের সামগ্রিক পরিকল্পনা ও পরিচালনার ক্ষেত্রে মুজিবের পরেই ছিল সম্ববত তার স্থান। (মঈদুল হাসান; মূলধারা ১৯৭১; ইউ.পি.এল.; ঢাকা, ১৯৯৯; পৃষ্ঠা ৯। অত্যন্ত খাটি ও যথার্থ মূল্যায়ন। মার্চের ঐ দিনগুলিতে আমরা ঢাকায় এবং জেলায় যেসব নির্দেশ পেতাম তা তাে তাজউদ্দীন আহমদই জারি করতেন।
উপদলীয় কোন্দলের যদিও মূল হােতা খন্দকার মােশতাক, তবু অন্যান্য কোনােকোনাে নেতার ভূমিকাও নিতান্ত কম ছিল না। শিলিগুড়িতে ৫-৬ জুলাই অনুষ্ঠিত দলীয় সভায় মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রকাশ্যেই প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ দাবি করেছিলেন। তাঁর বক্তৃতা রীতিমতাে নৈরাশ্যজনক ছিল। এতে উপস্থিত সকলেই স্তম্ভিত হন। যেহেতু স্বাধীনতার প্রশ্নে অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি অবিচল থাকেন এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী উভয়েই আপােষহীন দৃঢ় অবস্থান নেন, সেহেতু সুবিধাবাদীরা পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হন। হয়তাে সেটা সাময়িক ও কৌশলগত ছিল, কেননা কোলকাতার বিদেশি দূতাবাসের মাধ্যমে পাকিস্তানের সাথে যােগাযােগ শেষ অবধি অব্যাহত ছিল, যার চূড়ান্ত পরিণতি ১৫ আগস্ট ও ৩ নভেম্বর, ১৯৭৫। ইতিহাসের কলঙ্কজনক অধ্যায়, বঙ্গবন্ধু হত্যা, জেলহত্যা।
জনপ্রতিনিধিদের সম্মেলন এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সাবেক নিখিল পাকিস্তান কার্যকরী কমিটির পরিবর্তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটিই মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বে থাকবে। এতে করে আপাতত মােশতাক ও কামারুজ্জামানের দাবি পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। এই সিদ্ধান্ত অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান মজবুত করে, যার প্রতিফলন পরবর্তী সব মন্ত্রিসভার-সভায় আমরা দেখতে পাই। মন্ত্রিসভার-সভায় খােদ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করতেন বিধায় প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়ন সহজতর ও দ্রুত হতে থাকে। কামারুজ্জামানের উচ্চাভিলাষ থাকলেও তিনি দৃঢ়ভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী একজন খুঁটি দেশপ্রেমিক ছিলেন। তিনি চক্রান্তকারী ছিলেন না। আমার জানামতে তিনি কারও ক্ষতি করেননি। সাবেক পাকিস্তান গণপরিষদে (আইয়ুব আমলে), ১৯৬৫-৬৭-তে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত এম.এন.এ. কামারুজ্জামান ও মিজান চৌধুরীর বক্তৃতা অ্যাসেমব্লিতে বসে বসে শুনতাম। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শােষণ আর বঞ্চনার চিত্র তারা তুলে ধরতেন। তবে মিজান চৌধুরীর পরবর্তী কার্যকলাপের সাথে আমার দেখা ও শােনা সেই চৌধুরী সাহেবের কোনাে মিল সেদিন দেখিনি।
স্বাধীনতা সংগ্রামের কঠিনতম সময়ে আরেকটি বিশৃঙ্খলা এবং মাঝে মাঝে অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হতাে মুজিববাহিনীর কার্যকলাপে। বিশেষ করে শেখ মণি কেন জানি না, কিছুতেই মন্ত্রিসভার কর্তৃত্ব মানতে চাইতেন না। আমার সন্দেহ হয় তাঁর এই আচরণের পেছনে অদৃশ্য কোনাে শক্তির হাত থাকতে পারে। খন্দকার মােশতাক কোনাে-কোনাে সময় ইন্ধন জোগাতে পারেন। তবে শেখ মণির ক্ষমতার উৎস ছিল ভারতীয় র(RAW) নামক গােপন প্রতিষ্ঠান। এরাই মুজিববাহিনীকে সংগঠিত করে এবং ট্রেনিং ও অস্ত্র সরবরাহ করে। সমস্যার সৃষ্টি হতাে তখনই যখন মুজিববাহিনীর সদস্য, বিশেষ করে কমান্ডােরা নিয়মিত বাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব করতে চাইত। তাতে সেক্টর কমান্ডাররা ক্ষুব্ধ হতেন, অভিযােগ করতেন প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর কাছে; তিনি মন্ত্রিসভার বৈঠকে উত্তেজিতভাবে এটা উত্থাপন করে দ্রুত প্রতিবিধান চাইতেন। প্রধানমন্ত্রী সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারত-সরকারের কাছে এই বিষয়ে প্রতিকার পাননি। আমার উপস্থিতিইে কর্নেল ওসমানী কয়েকবার অব্যাহতি চেয়েছেন মুজিববাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হওয়ায়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অনেক বুঝিয়ে তাকে শান্ত করতেন। আরেকটি ঘটনার আমি প্রত্যক্ষদর্শী। সেটা অক্টোবর মাসে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী পূর্ব-রণাঙ্গন পরিদর্শনে গিয়ে আগরতলা সার্কিট হাউসে অবস্থান করছিলেন। শেখ মণি এবং তাঁর কয়েকজন সহযােগী অত্যন্ত উত্তেজিতভাবে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীকে আক্রমণাত্মক বক্তব্য দিতে থাকেন। সকলেই বেশ অবাক হয়েছিলাম সেদিন। যৌথ কমান্ড গঠনের চিন্তা-ভাবনা শুরু হতেই এই বিশৃঙ্খলা থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়। সেটা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকেই। ভারত-সরকারের পক্ষ থেকে মি.ডি.পি. ধর-কে নীতি-নির্ধারণী কমিটির চেয়ারম্যান (মন্ত্রীর মর্যাদায়) নিয়ােগের পর ধীরে ধীরে বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থার মধ্যে বাংলাদেশের ব্যাপারে সমন্বয় অনেক স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সম্ভবত RAW তখন থেকে মুজিববাহিনীর রাশ টেনে ধরে। এরপর কর্নেল ওসমানীর জন্য, বিশেষ করে মুক্তিবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বজায় রাখতে বড় কোনাে অসুবিধা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। অবশ্য অস্ত্রসম্ভারের সমস্যা আগাগােড়াই ছিল, যা নভেম্বর-ডিসেম্বরের দিকে অনেকটা সুরাহা হয়।
ভারত-সােভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরের পর ভারতের দক্ষিণপন্থী কোনাে গ্রুপ আওয়ামী লীগের দক্ষিণপন্থী চক্রের সাথে হাত মেলায়। স্বাধীনতা সংগ্রামে সর্বদলীয় এক্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে এরা ক্রমাগত প্রচারণা চালাতে থাকে। এতে আমাদের জাতীয় ঐক্য প্রায় বিনষ্ট হতে চলেছিল। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে শুধুমাত্র আওয়ামী লীগের স্বাধীনতাযুদ্ধে পরিণত করার চেষ্টা অব্যাহত থাকলে আমরা কোনােমতেই সােভিয়েত ব্লকের সমর্থন তাে দূরের কথা ভারতের সক্রিয় এবং প্রত্যক্ষ সাহায্যও পেতাম না, এ-কথা বলা যেতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র সরকার এবং চীন প্রত্যক্ষভাবে আমাদের সংগ্রামকে নস্যাৎ করার চেষ্টা করছিল। তাদের কুঠনৈতিক দাবাখেলায় পাকিস্তান ছিল শক্ত খুঁটি। পাকিস্তানের সব রকম আবদার তাদের মেনে নিতে হয়েছে এটাই ছিল ১৯৭১ সালের ভূ-রাজনৈতিক (Geo-political) বাস্তবতা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে বিজয় ত্বরান্বিত করার নানাবিধ প্রয়ােজন ছিল। সেটা যেমন মিসেস গান্ধী জানতেন, তেমনি উপলব্ধি করতেন তাজউদ্দীন আহমদ। সেটা অর্জন করতে হলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন যে কত প্রয়ােজন ছিল তা আর নতুন করে বিশ্লেষণ করার প্রয়ােজন দেখছি না। এ-বিষয়ে জাতীয় ঐকমত্য: সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ অধ্যায়ে আমি আরও আলােকপাত করেছি।
সােভিয়েত ইউনিয়ন মানেই গােটা সােভিয়েত-ব্লক এবং তার সাথে জোটনিরপেক্ষ ব্লকেরও বেশ কয়েকটি দেশের সমর্থন। সােভিয়েত ইউনিয়ন, পূর্ব-ইউরােপের দেশসমূহ, কিউবা, ভিয়েতনাম, মঙ্গোলিয়া, আলজেরিয়া, ইরাক, যুগােস্লাভিয়া, নেপাল, ভূটান ইত্যাদি দেশ ভারতের সাথে এক কাতারে দাঁড়িয়ে আমাদের সমর্থন করেছে, পক্ষে প্রকাশ্যে কথা বলেছে। সােভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর থেকে, বিশেষ করে পাশ্চাত্য পরাশক্তির বিপুল পরাক্রমে আমরা ইতিহাস বিস্মৃত হতে চলেছি। আজকের বাংলাদেশে, আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী অশুভ শক্তির উত্থানের ফলে সােভিয়েত-ব্লক- তাে বটেই, অন্যান্য সমর্থনকারী দেশ, বিশেষ করে ভারতের সমর্থন আর সাহায্যের কথা স্মরণই করতে চাই না; কৃতজ্ঞতা প্রকাশ তাে দূরের কথা।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিবর্গ, কর্নেল ওসমানী
সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫)
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে ১০ এপ্রিল তারিখে স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘােষণা (The Proclamation of Independence) প্রচার করা হয়। উক্ত ঘােষণায় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ থেকে ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখ পর্যন্ত অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সঙবিধান রচনার জন্য বিজয়ী সদস্যদের কথা উল্লেখপূর্বক বাংলাদেশকে সার্বভৌম প্রজাতন্ত্ররূপে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ঘােষিত স্বাধীনতা-ঘঘাষণাকে অনুমােদন দেওয়া হয়। এই ঘােষণায় আরাে বলা হয় যে, সংবিধান রচিত না-হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপতি হবেন এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপতি হবেন। উক্ত ঘােষণায় নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ সিদ্ধান্ত নেন যে, যে-কোনাে কারণে বঙ্গবন্ধু অনুপস্থিত থাকলে উপরাষ্ট্রপতিই রাষ্ট্রপতির সকল ক্ষমতা, কর্তব্য ও দায়িত্ববলি পালন এবং কার্যকর করবেন। এভাবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম তৎকালীন বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার প্রাপ্ত হন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিয়ে অসাধারণ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার সঙ্গে তিনি দায়িত্ব পালন করেন। বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে সেই দুঃসময়ে কৃতিত্বের সাথে জাতি এবং বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্ব দেন। রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে থেকে সাহস যুগিয়েছেন। যুদ্ধ-পরিচালনায় তাঁর বিচক্ষণতা ছিল অসাধারণ। মুক্তিযুদ্ধের দীর্ঘ নয় মাস বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার প্রায় সব সভাতেই সভাপতির আসন অলকৃত করে সরকারের সকল কাজকর্মের সাথে তিনি নিজেকে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত করেছিলেন। সে-সময় অসুস্থতা, শারীরিক অসুবিধা কোনাে কিছুই রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালনে ও যুদ্ধ-পরিচালনায় তাকে নিবৃত্ত করতে পারেনি।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি থাকার কারণে সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের এই গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করতে হয়। অসাধারণ দক্ষতা ও বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়ে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন। মানুষজনের সঙ্গে তার ব্যবহার ছিল অমায়িক। সদা প্রশান্ত ও মিষ্টভাষী সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতকালে কৃতিত্বের সাথে জাতিকে নেতৃত্ব দেন। তিনি সময়-অসময় মানেননি, বারে বারে ছুটে যেতেন রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের পাশে। যুদ্ধ-পরিচালনায় তাঁর বিচক্ষণতা দেশে-বিদেশে সকলের প্রশংসা অর্জন করে। জাতি ও দেশের কঠিন সংকটকালে তাঁর দেশপ্রেম, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব, অন্তহীন কর্মপ্রচেষ্টা মুক্তিযুদ্ধের জয়কে নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করেছিল। স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় তিনি শিল্পমন্ত্রী নিযুক্ত হয়েছিলেন। পরে তিনি উপ-রাষ্ট্রপতি মনােনীত হন। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত সাধারণ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম কিশােরগঞ্জ জেলার যশােদলের সাহেববাড়িতে ১৯২৫ সালের জানুয়ারি মাসে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ এম.এ. ডিগ্রি নিয়ে তিনি আইনশাস্ত্রেও ডিগ্রি লাভ করেন। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের সেন্ট্রাল সুপিরিয়র সার্ভিসের ট্যাকসেশন সার্ভিসে চাকুরি লাভ করেন। সৎ ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন সৈয়দ
পৃষ্ঠা: ৫০
নজরুল ইসলাম মাত্র এক বছরের মধ্যে চাকুরি ছেড়ে দিয়ে অধ্যাপনায় (ময়মনসিংহ আনন্দমােহন কলেজে) যােগ দেন। পরে এ-পেশাও তিনি ছেড়ে দেন এবং ময়মনসিংহ বারে আইনব্যবসা শুরু করেন। ছাত্রজীবনেই তিনি রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছিলেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ভিপি নির্বাচিত হন এবং ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। কর্মজীবনে প্রবেশ করে তিনি রাজনৈতিক জীবনের সঙ্গেও যুক্ত হন। ১৯৫৭ সালে ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি এবং ১৯৬৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সিনিয়র সহসভাপতি নির্বাচিত হন। বঙ্গবন্ধুর কারান্তরালে থাকাকালে তিনি প্রায়শই দলের সভাপতির দায়িত্ব পালন করেছেন। ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনে দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি হিসেবে তাঁর সংগ্রামী ভূমিকা চিরস্মরণীয়।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম আকর্ষণীয় চরিত্রের মানুষ ছিলেন। তিনি বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত ছিলেন তার স্বভাবসুলভ গুণে। তাকে দেখলে মনে হতাে এক শান্ত শুভ্র ব্যক্তি সামনে দৃশ্যমান। তার পরনে সব সময়ই দেখা যেত শ্বেতশুভ্র শাদা পােশাক। ইস্তিরির সদ্য ভাজভাঙা শাদা পাজামা-পাঞ্জাবি পরার অভ্যাস তার সারাজীবনের। মন্ত্রিসভার বৈঠকে তিনি আসতেন ঐ পােশাকে এবং দেরিতে। দেরি হওয়ার কারণ ছিল তাঁর শারীরিক অসুস্থতা ও অসুবিধা। স্বাধীনচেতা এই মানুষ ছিলেন আপােষহীন ও দৃঢ় মনােবলসম্পন্ন।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেওয়ার জন্য সৈয়দ নজরুল ইসলামকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সে-মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ৩ নভেম্বর (১৯৭৫) ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে তাজউদ্দীন আহমদ, এম. মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
মুজিবনগরের ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানে ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। ভাষণের বিবরণ নিম্নরূপ:
আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিল। বিগত বহু বৎসর যাবৎ বাংলার মানুষ, তাঁদের নিজস্ব সংস্কৃতি, নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব অধিকার নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্ত যনি কায়েমী স্বার্থ কখনই তা হতে দিল না। ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালাল। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে আমাদের জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদারদের বিতাড়িত করবই। আজ না জিতি কাল জিতব। কাল না জিতি পরশু জিতবই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই। আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শােষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। জাতির সংকটের সময় আমরা তাঁর নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্রে আজ যে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হল তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোনাে শক্তি তা মুছে দিতে পারবে না। আপনারা জেনে রাখুন, গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পাকিস্তানের স্বার্থবাদী, শিল্পপতি, পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রীরা। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা, ঐ পশ্চিমারা শেরে বাংলাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। তাই ওদের সঙ্গে আপােষ নেই, ক্ষমা নেই। আমাদের রাষ্ট্রপতি জনগণ-নন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব। বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দি। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম হবেই।
তাজউদ্দীন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন একজন আদর্শ ব্যক্তি। রাষ্ট্র ও সরকারের নামকরণ তাঁরই। জাতির কঠিনতম সময়ে বঙ্গবন্ধুর অনুপস্থিতিতে তিনি শক্ত করে হাল না ধরলে আমাদের সরকার গঠন করা হতাে না, স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্ব দেওয়ারও কেউ থাকত না। সত্যি কথা বলতে কী, শহীদ তাজউদ্দীনের মতাে খাঁটি দেশপ্রেমিক এবং সৎ ব্যক্তিত্ব খুব-একটা দেখেছি বলে মনে হয়। অতবড় মাপের নেতা হয়েও কী সহজ, সরল মানুষ ছিলেন তিনি।
আমার মস্তবড় ক্ষোভ আর দুঃখ যে, শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ আমাদের ইতিহাসে যােগ্য কোনাে স্থানই পেলেন না। তার সম্পর্কে আলােচনাও তেমন নেই, মূল্যায়ন তাে দূরের কথা। অসহযােগ আন্দোলনের সময় অর্থাৎ ৭ থেকে ২৫ মার্চ তিনিই আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সমস্ত নির্দেশ জারি করতেন। তিনি প্রবাসী বিপ্লবী সরকারপ্রধানই ছিলেন না। শুধু, প্রাণও ছিলেন। বলতে গেলে তিনি ছিলেন সরকারের স্থপতি।
স্বাধীন বাঙলাদেশের মাটিতে ফিরে আসার পরই শুরু হয়ে যায় তাঁর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার মানেই তিনি। তাঁকেই সবাই জানত। অতএব সরকারের বিরুদ্ধে যার যা-কিছু বলার, সব ক্ষোভ আর অভিযােগ প্রকাশ মানেই শহীদ তাজইদ্দীন আহমদের বিরুদ্ধে বক্তব্য। বঙ্গবন্ধু ফিরে আসার অব্যবহিত পরেই আরম্ভ হয় প্রবাসী সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র যার মূল লক্ষ্য তাজউদ্দীন। বেশ কয়েকটি ক্যাম্প থেকেই আছে আক্রমণ। প্রথমত, ঘাপটি-মেরে-থাকা পাকিস্তানি এজেন্টরা; দ্বিতীয়ত, স্বাধীনতাবিরােধী মৌলবাদী গ্রুপ; তৃতীয়, অতি বামপন্থী তথাকথিত বিপ্লবীরা (আসলে চীনপন্থী বাংলাদেশ বিরােধী শক্তি); চতুর্থত, উচ্চাভিলাষী সরকারি এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যাদের প্রধান কাজই ছিল শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম, শহীদ ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, শহীদ এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে মিথ্যা রটনা করা। সবকিছু মিলিয়ে স্বাধীনতার শুভলগ্ন থেকেই শুরু হয় এইসব অশুভ তৎপরতা যার ফলে সরকার-পরিচালনার পাশাপাশি নেতৃবৃন্দকে সময় ব্যয় করতে হতাে অপশত্রুদের প্রতিহত করার কাজে।
শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান, তথা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শত্রুদের প্রধান নেতা ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমদ। মুজিবনগরে থাকতেই তার ষড়যন্ত্র আবিষ্কৃত হয়। সে-কারণে তাকে জাতিসংঘের অধিবেশনে যাত্রার পূর্বমুহূর্তে বিরত করা হয়। পরবর্তীতে স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে, ঢাকায় মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ এবং পুনর্বিন্যাস করার সময় মােশতাকের পরিবর্তে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয়। একদিকে স্বাধীনতা নস্যাৎকারীদের চক্রান্তে পাকিস্তানের পক্ষে সহযােগিতা প্রদান, অন্যদিকে প্রতিহিংসার আগুন–এই দুটোই তার ষড়যন্ত্র ত্বরান্বিত করে। বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের সাথে সাথেই তার তৎপরতা শুরু হয়; অনুপ্রবেশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভিতর। অত্যন্ত দ্রুত, বিভিন্ন ছলচাতুরীর মাধ্যমে মােশতাক বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। দিনে-রাতে তাঁদের কান ভারী করতে থাকেন—তাজউদ্দীন এটা করেছে, তাজউদ্দীন সেটা করেছে ইত্যাদি। পাশাপাশি তােষামােদ। এই দুটি কাজে নির্লজ্জ বেহায়া ছিলেন খন্দকার; আর ঠিক তার বিপরীত ছিলেন তাজউদ্দীন। তােষামােদ, পরনিন্দা, পরচর্চা এসব তিনি কখনও করতেন না-পারতেনও না। নীতিগতভাবে চরম ঘৃণা করতেন এসব। অন্যদিকে সুচতুর মােশতাক শুধু নিজে নয়, তার পক্ষের নেতৃবৃন্দ, যারা বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ছিলেন, তাদেরকে দিয়ে, চরম মিথ্যাচার করিয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন দুজনের দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। এর ফল ছিল অতন্ত সুদূরপ্রসারী। আমার ধারণা, খন্দকার মােশতাক আওয়ামী লীগ এবং যুবলীগের কয়েকজন উদীয়মান এবং উচ্চাভিলাষী নেতাকেও প্রভাবান্বিত করে তার জাল আরও বিস্তৃত করে। এই নেতারাও তাজউদ্দীন-মন্ত্রিসভা ও সরকার সম্পর্কে বিরূপ মন্তব্য করতে থাকে।
আমি অবশ্যই বলব খন্দকার মােশতাক এবং অনুগামীদের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে অপসারণ এবং ক্ষমতাগ্রহণ। এর সাথে কাজ করেছে তার প্রতিহিংসাপরায়ণতা এবং নীচ স্বভাব (স্বভাবতই এই ব্যক্তি ছিলেন লােভী এবং হিংসুক)। বেছে বেছেই পাকিস্তান এবং সহযােগী শক্তিরা একে নিয়ােগ করে তাদের বাহনরূপে। খন্দকার মােশতাক একাধিকবার দীর্ঘদিনের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছিলেন দল-বিরােধী অপতৎপরতা এবং শৃঙ্খলাভঙ্গের অপরাধে। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের পর অনেক হাতে-পায়ে ধরে ফিরে আসেন। এহেন দুষ্কৃতকারীকে কীভবে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে এতখানি বিশ্বাসে নিলেন তা আমার বােধগম্য হলাে না। বাকশালের গঠনতন্ত্র ও রূপরেখা প্রণয়নে তার ছিল সক্রিয় ভূমিকা। বুদ্ধিপরামর্শ দিতে থাকেন অতি-সংগােপনে। তার সাথে যােগ হয় খন্দকারের কুটিলতা আর লােভ। যে-পরিকল্পনার মাধ্যমে তারা ষড়যন্ত্র কার্যকর করে তা অনেকটা এইরকম:
এক: বঙ্গবন্ধুকে তার ঘনিষ্ঠতম, সবচাইতে ত্যাগী ও বিশ্বস্ত শুভানুধ্যায়ী সহকর্মীদের থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়া; দুই: উপরােক্ত লক্ষ্যে এঁদের মধ্যে বিভাজন, অবিশ্বাস ও দূরত্ব সৃষ্টি করা; তিন: আওয়ামী লীগ এবং সরকারের বিভিন্ন স্তরের নেতৃবৃন্দের মধ্যে সন্দেহ ও অবিশ্বাসের বীজ বপন, যেমন মুজিবনগর মন্ত্রিসভার প্রধান তিন নেতাকে (সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান) প্রথমে তাজউদ্দীন ও পরে একে-অপরের বিরুদ্ধে ব্যবহার ও অবিশ্বাস সৃষ্টি। ঢাকায় এই নেতৃবৃন্দকে বঙ্গবন্ধুর কাছে হেয় প্রতিপন্ন করাও আরেক কাজ। চার: প্রবীণ ও নবীনদের মধ্যে প্রথমে অবিশ্বাস ও সন্দেহ এবং পরে বিভেদ সৃষ্টি; পাঁচ: বঙ্গবন্ধুর পরিবারপরিজনকে মুজিবনগর-নেতৃবৃন্দের পেছনে খেপিয়ে তােলা ছিল আরেক ষড়যন্ত্র; ছয়: সবচাইতে ক্ষতিকর এবং অব্যর্থ অস্ত্র ছিল বঙ্গবন্ধু এবং তার পরিবারকে বােঝানাে যে, মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার তাঁর (বঙ্গবন্ধুর) প্রত্যাবর্তনে যথাযথ পদক্ষেপ নেননি। যে-কোনাে মানুষ, তা তিনি যতবড় ব্যক্তিত্বই হােন আর বিশাল মনেরই হােন—এই কথাগুলাে কখনও কি সহজভাবে নিতে পারেন? মন্ত্রিপরিষদের সচিব থাকাকালে বঙ্গবন্ধুর পরিবারের সদস্যবর্গের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা থাকায় এ-ধরনের কথা শুনতে পেতাম। কিন্তু, কোনাে মন্তব্য করা বা তাদের কথায় কোনাে সায় দেওয়া আমার নীতিতে ছিল না। শুধু নীরবে অবলােকন করেছি। বিবেকের তাড়নায় আজ এসব কথা ব্যক্ত করছি শুধু মনকে হালকা করার জন্য। পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছিল—তিনি মুক্ত হয়ে ফিরে না-আসার অর্থ তার মৃত্যু কামনা। এমন অসম্ভব কামনা শহীদ তাজউদ্দীনের পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না। তাজউদ্দীন বঙ্গবন্ধুকে প্রাণাপেক্ষা ভালবাসতেন। বঙ্গবন্ধুর জন্য মুক্তিযুদ্ধকালে তাকে আমি অশ্রুবিসর্জন করতে দেখেছি। বঙ্গবন্ধু সম্বন্ধে মন্ত্রিসভার সভায় আলােচনা উঠলেই তাঁর চোখ ছলছল হয়ে উঠত এ দৃশ্য আমার চোখে এখনও ছবির মতাে ভাসে।
এই বিভেদ আর অবিশ্বাস মােশতাক একা করেননি। তার তাঁবেদারদের নিয়েই করেছেন। দু-একজনের কথা বলা যাক। তাহেরউদ্দীন ঠাকুরকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন। ড. কামাল হােসেনের মতােই তাকে কখনও কখনও বলতেন ‘My blue-eyed boy’। শাহ মােয়াজ্জম হােসেন, তুখােড় ছাত্রনেতা; বঙ্গবন্ধুর কাছের লােক নূরুল ইসলাম মঞ্জুর প্রমুখ। পৃথক পৃথকভাবে একই বক্তব্য রাখতেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এভাবে এরা একজনের বক্তব্য এবং পরিবেশিত খবর আরেকজন সমর্থন (corroborate) করতেন। পাশাপাশি সুযােগসন্ধানী এবং উচ্চাভিলাষী কিছু আমরা এবং গােয়েন্দাবাহিনীর কর্তাব্যক্তি (যারা পাকিস্তান সরকারকে ভালােভাবেই খেদমত করেছেন একসময়) বঙ্গবন্ধুকে অনেক কথাই পরিবেশন করতেন নেতৃত্বে ফাটল ধরানাের জন্য। আমার সন্দেহ, প্রয়াত জেনারেল ওসমানী এবং বিচারপতি আবু সাঈদ চৌদুরীকে এরা সুচতুরভাবে ব্যবহার করেছিল এ-সময়। বঙ্গবন্ধুর আপনজনের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মণিরও একটা ভূমিকা ছিল—মনে হয় না-বুঝে। মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি মণির একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল যার বহিঃপ্রকাশ আমি কয়েকবার দেখেছি (একেবার প্রকাশ্যে আগরতলায়)। মণি ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং প্রচণ্ড রাগী মানুষ। তাকে ক্ষেপানাে খন্দকার মােশতাক গয়রহের বাম হাতের কাজ। তাজউদ্দীনের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক বক্তব্য দেওয়ায় আরও কয়েকজনের ভূমিকা ছিল। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরেই দৈনিক ইত্তেফাকের ভূমিকা কি স্বচ্ছ ছিল?
এরই পাশাপাশি শহীদ তাজউদ্দীনকে আমি কেমন দেখেছি? কী আমার অভিজ্ঞতা? থিয়েটার রােডের পুরানাে একটি বাড়িতে আমাদের অফিস। তার সামনে মাঠের মাঝখানে বড় একটা পুরােনাে বাড়িতে আমাদের অফিস। তার সামনের মাঠের মাঝখানে বড় পুরােনাে বটগাছ। দালানে বড় বারান্দা পার হলেই মস্তবড় একটা হলঘর। ঐ হলঘরে ঢােকার আগে বারান্দার সাথে দুইদিকে দুটো কক্ষ, মাঝারি মাপের। একপ্রান্ত থেকে উপরে উঠে গিয়েছে। প্রশস্ত সিঁড়ি। বারান্দা থেকে করিডাের দিয়ে ঢুকলে বাঁ-দিকের কামরাটি ব্যবহার করতেন। সচিবরা এবং তাদের সহকারীবৃন্দ। আর ডানদিকের করিডাের দিয়ে গেলে ডান ও বাম উভয় পাশে দুটো মােটামুটি ধরনের ঘর। ডানদিকে কর্নেল ওসমানী ও তার এ.ডি.সি., বাদিকেরটি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের জন্য সংরক্ষিত। আমাদের মন্ত্রিসভার সভাও হতাে এই কক্ষটিতে। বড় হলঘর অতিক্রম করে সমুখে এগিয়ে গেলেই হাতের বামদিকে মােটামুটি বড় একটা কক্ষ, সংলগ্ন বাথরুমসহ। এই কক্ষটিতে থাকতেন স্বাধীন বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী। সহজ, সরল এই মানুষটি থাকতেনও খুব সাদাসিধেভাবে। কোনাে আড়ম্বর তাে দূরের কথা, কাপড়-চোপড়েও ছিলেন নিতান্ত সাধারণ। আমার যতদূর মনে পড়ে তার দুটো শার্ট আর দুটো ফুলপ্যান্ট ছিল। জামার নিচে গেঞ্জি পরতেন। সাধারণত ঘরের ভিতর লুঙ্গি পরে থাকতেন। নিজের জামা-কাপড়-গেঞ্জি-লুঙ্গি নিজেই ধুয়ে নিতেন।
শহীদ তাজউদ্দীনের সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎকার মােটেই ঘটনাবহুল ছিল না। ফর্সা, বেশ স্বাস্থ্যবান বলিষ্ঠ চেহারার, বয়সও তেমন বেশি নয়। আমাকে দেখেই বললেন-ইমাম সাহেব এসেছেন? ভালােই হলাে। কাজকর্ম বুঝে নিন। নূরুল কাদের সাহেব, আসাদুজ্জামান সাহেব আছেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে দেখা করুন। তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে আমাকে প্রথম নিয়ে যান এম. আর. সিদ্দিকী সাহেব। খুব সম্ভবত নূরুল কাদেরও ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী আমার নিয়ােগপত্র (appointment letter) লিখে আনতে বললেন। ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব দিয়ে আমার নিয়ােগপত্রে তাজউদ্দীন সাহেবই দস্তখত করেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী মহােদয়ের স্বাক্ষরিত নিয়ােগপত্র দীর্ঘ সময় পর আর খুঁজে পাইনি।
এমন যে-ব্যক্তি তার উত্থান ছিল চিত্তাকর্ষক ও চমকপ্রদ। গাজীপুর উপজেলার কাপাশিয়ার দরদরিয়ায় ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই তারিখে তাজউদ্দীন আহমদের জন্ম। ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে প্রবেশিকা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতি শাস্ত্রে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। কারাগারে অন্তরীণ থাকাকালে তিনি আইনবিদ্যায় ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৫২ সালে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সদস্য হিসেবে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ১৯৫৪ সালে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত হন ১৯৬৬ সালে। ঐতিহাসিক ৬-দফা আন্দোলনের সময় তিনি গ্রেফতার হন এবং ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থানের সময় মুক্তি পান। একাত্তরের ১০ মার্চ থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘােষিত অসহযােগ আন্দোলনের অন্যতম রূপকার ছিলেন তাজউদ্দীন। আন্দোলনের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সার্বিক সমন্বয়ের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত ছিল। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতম সহযােগী হিসেবে তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর সাথে ত্রিপক্ষীয় আলােচনায় অংশগ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু সে-আলােচনা কীভাবে ব্যর্থ হয় তা এখন সর্বজনবিদিত।
পাকিস্তান সামরিক বাহিনী ২৫ মার্চ তারিখ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে সীমান্ত পাড়ি দেন। তাজউদ্দীন আহমদ কুষ্টিয়া-যশাের হয়ে পশ্চিমবঙ্গে অবস্থান নেন। বন্ধুরাষ্ট্রের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর বাংলাদেশ সম্পর্কে ঐতিহাসিক ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
১০ এপ্রিল আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধনতা ঘােষণার অব্যবহিত পরেই শহীদ সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ আত্মনিয়ােগ করেন সরকার-গঠনে এবং সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনায়। এপ্রিলের সেই প্রথমদিকে, যখন পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞ আর নির্বিচার গণহত্যায় মেনে উঠেছে, কারও থাকা-খাওয়া-নিরাপত্তা কিছুই ভালােভাবে বন্দোবস্ত হয়নি, সেই সময়ে শহীদ তাজউদ্দীন ঠাণ্ডা মাথায় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে চিন্তা করেছেন, সমাধানের পথ খুঁজেছেন, অন্যদের উৎসাহিত করেছেন, দিকনির্দেশনা দিয়েছেন। (পরিশিষ্ট ৯, ১০ দ্রষ্টব্য।)
তিনি নিজে সৎ ও ভালাে মানুষ ছিলেন, অন্যদেরও তাই মনে করতেন। তার খেসারতও দিয়েছেন। প্রচণ্ড চাপের মুখেও সহজে মেজাজ খারাপ করতেন না। কারও সাথে দুর্ব্যবহরা করতেন না। কথা বললেই বােঝা যেত পারিবারিক ঐতিহ্য এবং আভিজাত্য আছে তার। তাজউদ্দীন সাহেবের মতাে অত সুন্দর ঝকঝকে পরিষ্কার হাতের লেখা খুব কম দেখেছি। মুক্তোর মতাে। বাংলা এবং ইংরেজি দুটোই ছিল caligraphy। বাংলা ব্যাকরণ এবং ইংরেজি ব্যাকরণে (grammar)-এ ভালাে দখল ছিল। তাঁর নিজ হাতের লেখা মন্ত্রিসভা-সিদ্ধান্ত এবং নােটগুলি দেখলেই বােঝা যাবে তার ভাষায় দখল এবং পাণ্ডিত্য। (পরিশিষ্ট ১১, ১২ দ্রষ্টব্য।)
একটি বিষয় উল্লেখ না করে পারছি না। পাণ্ডিত্যের কারণেই হােক অথবা কিছুটা বামপন্থী-উদার রাজনৈতিক চেতনা ও বিশ্বাসের কারণেই হােক, তাজউদ্দীন মাঝে মাঝে প্রচণ্ড বাস্তবতার মুখে ভাববাদী, আদর্শবাদী হয়ে পড়তেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও মুক্ত
পৃষ্ঠা: ৫৫
বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তিনি ছিলেন অত্যন্ত আশাবাদী। প্রকাশ্যে নয়, ঘরােয়াভাবে আমাদের সাথে আলােচনায় লাতিন আমেরিকায় কী ঘটছে, আফ্রিকায় বর্ণবাদী ধনতন্ত্রের পতন কেন অবশ্যম্ভাবী, আমাদেরও সুদিন অবশ্যই আসবে—এরকম কথা বলতেন। তাঁর বিশ্লেষণ যে সঠিক ছিল তার প্রমাণ তাে আমরা পেয়েছি। অন্যান্য জাতির মুক্তিসংগ্রাম থেকে তিনি উৎসাহ আর প্রেরণা পেতেন। আমাদেরও উৎসাহিত করতেন।
শহীদ তাজউদ্দীন আরেকটি বিষয়ে স্পর্শকাতর এবং ভাবপ্রবণ ছিলেন। সেটি বঙ্গবন্ধু প্রসঙ্গে। গভীর শ্রদ্ধা ছিল, বড়ভাইয়ের মতাে ভালােবাসতেন। ছিলেন নিত্যসঙ্গী। নেতার কথা মনে পড়লেই চুপ করে থাকতেন, চোখের কোণে পানি টলমল করত। ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররােচনায় আর গােয়েন্দাদের দেয়া ক্রমাগত ভুল ও একপেশে বক্তব্যে একসময় বঙ্গবন্ধু শহীদ তাজউদ্দীনের কাজকর্ম সম্পর্কে অসন্তোষ প্রকাশ করতে আরম্ভ করলেন। তাজউদ্দীনকে নিজে জিজ্ঞাসা না করে অপরের কথায় গুরুত্ব দেওয়ায় তিনি খুবই মর্মাহত হন। তিনি বেশ আবেগপূর্ণ (emotional) এবং ভাবপ্রবণ (sentimental) হয়ে পড়েন। কিন্তু কখনও তাঁকে তাঁর নেতা সম্পর্কে কটু কথা বলতে শুনিনি। আমি এখনও মনে করি যে, ১৯৭৩-৭৪-এ যখন চারদিকে চক্রান্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে; সেই সময় তাজউদ্দীনের উচিত ছিল বঙ্গবন্ধুর মুখােমুখি হওয়া এবং নিঃসঙ্কোচে সব বিষয় আলােচনা করা। কিন্তু তিনি তা না করে নিজেকে খােলসের মধ্যে গুটিয়ে নিলেন। বঙ্গবন্ধুর সাথে আজীবন কাজ করেছেন নেতার প্রতি তার আনুগত্য ছিল তুলনাবিহীন। তাঁর অটল বিশ্বাস আর আনুগত্য সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু আস্থা হারানােয় শহীদ তাজউদ্দীন যেন কেমন মিয়মাণ হয়ে পড়েন। একসময় নিজেই মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি শহীদ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন, মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানের ছিল অবিচল আস্থা আর আনুগত্য। তা না হলে ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫ সকালে আমি যখন টেলিফোনে জিজ্ঞাসা করলাম আপনারা কি খন্দকার মােশতাকের আহ্বানে সাড়া দেবেনতারা সকলে একই উত্তর দিলেন: Over my dead body (আমার মৃতদেহের উপর দিয়ে)। খন্দকারও এ-কথা জানতেন বলেই ৩ নভেম্বর কেন্দ্রীয় কারাগারে, রাতের অন্ধকারে ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটালেন।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নৃশংস হত্যার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেয়ার জন্য তাজউদ্দীন আহমদকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সেমন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখান করেন। কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম. মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামানসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণের পর তিনি বাংলাদেশ সরকারের সার্বিক বিষয় নিয়ে চিন্তাভাবনা করতেন। সরকারের কাজকর্ম সুশৃঙ্খল করতে তিনি মন্ত্রিসভার-সভায় আলােচনার জন্য বহু বিষয় ঠিক করতেন। আলােচ্যসূচির এসব বিষয় মনে রাখার জন্য তিনি সেগুলি প্রায়ই নােট আকারে লিখে রাখতেন তার ডায়েরিতে। তাঁর নিজ হাতে লেখা এসব নােটের ঐতিহাসিক গুরুত্ব রয়েছে। তাই এই গ্রন্থে নােটের কিছু কিছু এখানে উল্লেখ করা হলাে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ভিন্ন অধ্যায়ে বিন্যস্ত করা হয়েছে। মনে রাখা প্রয়ােজন যে, এসব তথ্য দ্বিরুক্তি মনে হলেও ঐতিহাসিক গুরুত্বের কারণে তার স্বহস্তে লিখিত নােট প্রাসঙ্গিকক্রমে উল্লেখ করা হলাে।
নিচের নােটটি (প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের স্বহস্তে লেখা) লক্ষ্য করলেই বােঝা যাবে কী অভিনিবেশ সহকারে তিনি সবকিছু পর্যবেক্ষণ করেছেন। গুরুত্ব অনুয়ায়ী ক্রমিক নম্বর দিয়ে তা লিপিবদ্ধ করেছেন। (পরিশিষ্ট ১৩ দ্রষ্টব্য)
১. ভাসানী ১. স্বীকৃতি
২. রাইস ২. কোলকাতায় লিয়াজোঁ অফিস
৩. মনােবল ৩. ঠিকানা: হাইকমিশন অফিস
৪. যােদ্ধাদের জন্য সরবরাহ ৪. দিল্লিতে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে সাক্ষাৎকার
৫. বেসামরিক সরবরাহভ ৫. জয়প্রকাশ নারায়ণ
৬. প্রলম্বিত যুদ্ধ ৬. প্রচার সেল-নেতৃত্বে রদবদল শরণার্থী সমস্যা
৭. অস্ত্র ও গােলাগুলি ৭. রেডিও ট্রান্সমিটার সারাক্ষণ ধাক্কা দিতে হবে
৮. অ্যাকাউন্ট
৯. সাহায্য গ্রহণ
১০. মােটর যান- পাওয়া যাচ্ছে না
১১. ঋণ
(১) মি. অজয় মুখার্জিকে চিঠি
নােটের অপর পৃষ্ঠায় লেখা আছে:
১. একটি এলাকা দখলে রাখা
২. পাকিস্তানি মুদ্রা সমান মূল্যে বিনিময়।
এরপর আরেকটি নােট, তাতেও কোনাে তারিখ নেই (পরিশিষ্ট ১৪ দ্রষ্টব্য।) খুব সম্ভবত এপ্রিলের প্রথমেই লেখা। ক্রমিক নম্বর দিয়ে লেখা প্রতিটি বিষয়ের ঐ সময়ে অপরিসীম গুরুত্ব ছিল।
১. স্বীকৃতি
২. সাহায্য
ক. অস্ত্র ও সমরসম্ভার (কক) সমরাস্ত্র ও যন্ত্রপাতি, খাদ্য
খ. গােয়েন্দা সংস্থা
গ. যােগাযােগ – (১) টেলিফোন, বেতার (২) পরিবহণ-যান্ত্রিক, মােটরযান – আকাশে (এরােপ্লেন, হেলিকপ্টার) – নৌপরিবহণ
ঘ. প্রকাশনা ও প্রচার
(১) রেডিও (মিডিয়াম ওয়েভ) (২) ছাপানাের ব্যবস্থা
(৩) পত্রিকা।
ঙ. চিকিৎসা সাহায্য-জনগণের জন্য
চ. খাদ্য, লবণ, কেরােসিন ছ, মুদ্রা জ. মুক্তি অঞ্চল-ময়মনসিংহ, সিলেট, পার্বত্য চট্টগ্রাম চট্টগ্রাম পুরােপুরি প্রতিরােধ ও রক্ষা করতে হবে।
– থানা ও মহকুমায় সেনা চৌকি বসাতে হবে।
মন্ত্রিসভার আরাে একটি সভা অনুষ্ঠিত হয় একই দিন অর্থাৎ ২৩ এপ্রিল তারিখে। এই সভার সিদ্ধান্তগুলােও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজে লিখেছিলেন। (পরিশিষ্ট ১৫ দ্রষ্টব্য।) সভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ:
জনাব এ. এইচ. এম কামারুজ্জামান ব্যতীত সকলেই উপস্থিত।
নিম্নলিখিত সদস্যদের তাদের নামের বিপরীতে উল্লেখিত দায়িত্ব দেওয়া হলাে:
১. জনাব এম. এ. সামাদ, এম. এন. এ. – মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক সহকারী।
২. জনাব এ. মান্নান, এম. এন. এ. – প্রচার ও গণমাধ্যম।
৩. জনাব আমীর-উল ইসলাম, এম. এন. এ. – প্রধানমন্ত্রীর সহকারী
একই নােট-শিটে ১৬-৪-৭১ তারিখ লিখে প্রধানমন্ত্রী মন্ত্রিসভার নিম্নরূপ সিদ্ধান্তের নােট স্বহস্তে নিখেছেন।
কর্নেল ওসমানি।
১. বিভিন্ন ট্রেজারি থেকে দ্রুত টাকা সংগ্রহ করে নিরাপদ এলাকায় আনতে হবে।
২. যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন প্রদান-প্রাপ্তব্য।
৩. বেসামরিক কর্মচারিদের বেতন প্রদান
৪. বাংলাদেশের বেসামরিক নাগরিকদের জন্য প্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরবরাহ- লবণ, ভােজ্য তেল, চাল, ম্যাচ, কেরােসিন, পেট্রোল, ডিজেল, মবিল।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত ধীর-স্থিরভাবে সামগ্রিক সমস্যাগুলাে মােকাবেলা করতেন। তাঁর চিন্তাধারা এবং পরিকল্পনা ছিল পরিষ্কার এবং সুদূরপ্রসারী। বিভিন্ন জাতীয়সমস্যা আন্তর্জাতিক প্রেক্ষিতে তিনি পর্যালােচনা করতেন। তার কিছু প্রমাণ তাঁর নিজের লেখা বাংলাদেশ সরকারের প্রথম দিকের নােট।
১৩।৪।৭১
১৬।৪।৭১
সভার বিবরণী সংক্ষিপ্ত (Precise to the point) কিন্তু বাস্তব এবং সিদ্ধান্ত কার্যকর করার উপযােগী করে লেখা।
সম্ভবত ১২ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সভা শুরু হয়। আমি তখনও রামগড়ে।
স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনাই ছিল প্রধানতম বিষয়। কয়েকদিন পর, ১৭/৭-এ সিদ্ধান্ত হয় যে Defence-এর জন্য সভা নির্ধারিত থাকবে প্রতি রবিবার। অন্যান্য বিষয় সােমবার। অনির্ধারিত সভা ছিল প্রাত্যহিক। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তের জন্য বিষয়সমূহ পেশ করা হতাে।
৯ আগস্ট সন্ধ্যা ছয়টায় মন্ত্রিসভার একটি বৈঠক বসে। তাতে সিদ্ধান্তগুলাে তাজউদ্দীন সাহেব নিজ হাতে লিখেন। সভার আগে তিনি একটি কাগজে উভয় পৃষ্ঠায় বেশকিছু বিষয়বস্তু লেখেন, যা মন্ত্রিসভায় আলােচিত হয়েছিল কিন্তু সিদ্ধান্ত হয়নি। এটাকে প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব এজেন্ডা বলা চলে। এসব বিষয় নিয়ে তিনি তখন বিচলিত ছিলেন। বেশ গাঢ় করে লেখাদৃশ্যত একবার লিখে, তার ওপর আবার কলম ব্যবহার করেছেন। একই বিষয়ে চিন্তা করতে থাকলে আমরা সাধারণত এরকম আন্ডারলাইন করি অথবা লেখার ওপর কলম চালাতে থাকি। ক্রমিক নম্বর ১, ২ এবং ৭ টিক-চিহ্নিত, তার অর্থ আলােচিত এবং গৃহীত। ৩ থেকে ৬ একটি দীর্ঘবন্ধনী (bracket) দিয়ে দেখানাে হয়েছে, অর্থাৎ এই দুটি বিষয় একটি আরেকটির পরিপূরক। (পরিশিষ্ট- ১৬ দ্রষ্টব্য)
৯। ৮।৭১
মন্তব্য
১. যুব শিবির: অভ্যর্থনা শিবিরগুলি বাংলাদেশ সরকার দেখাশুনা করবে। ২. আঞ্চলিক প্রশাসন এবং আঞ্চলিক কাউন্সিল। ৩. প্রশিক্ষণ শিবিরসমূহ এবং প্রশিক্ষিত (ট্রেনিংপ্রাপ্ত) গেরিলাদের সমস্যাগুলি। ৪. স্নায়ুযুদ্ধ (Psy warfare) সেল। ৫. তথ্য ও বেতারের সমস্যাবলি। ৬. প্রতিরক্ষা বিষয়াবলি-সচিব। ৭. বাসস্থান: এই বাড়িটি হবে প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর। মন্ত্রিপরিষদ এখানে কাজ করবে।
কোনাে সাক্ষাৎকার এখানে হবে না। সচিবালয় অন্য ভবনে স্থানান্তর করতে হবে। উপরে লেখার অপর পৃষ্ঠায় ছােট অক্ষরে আবার কয়েকটি বিষয়। চারটিতে টিক চিহ্ন। দুটো বিষয়ের পাশে একটা দাগ দেওয়া। (পরিশিষ্ট-১৭ দ্রষ্টব্য।)
ক. হাজী নূর বকস খ. শেখ আবদুল আজিজ গ. বাদশাহ ঘ. ফরিদপুর ঙ. ছাত্রবৃন্দ চ. আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ ছ. অস্ত্র ও গােলাগুলি সংগ্রহে সংগঠিত বেসরকারি (private pressure groups) চেষ্টা।
৯। ৮।৭১, সন্ধ্যা ৬টা
সকল সদস্য উপস্থিত। প্রধান সেনাপতি এবং প্রফেসর ইউসুফ আলী উপস্থিত।
১। যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের পােষ্যদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় অর্থসাহায্য করবেন ৫,০০,০০০/= টাকা-ত্রাণমন্ত্রী।
২। রাজনৈতিক কর্মী, নেতৃবৃন্দ, এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ. ব্যতীত, শিল্পী, শিক্ষক প্রমুখকে সাহায্য প্রদান = ২,৫০,০০০.০০ + ২,৫০,০০০.০০ আঞ্চলিক কাউন্সিল (Zonal council) কর্তৃক
প্রধানমন্ত্রীর উপযুক্ত সিদ্ধান্তে এবং ছােট ছােট নােট থেকে বুঝা যায় যে, তিনি কত বিচক্ষণ ছিলেন। প্রকৃত অর্থেই তিনি দেশের কর্ণধারদের একজন ছিলেন।
দেশ পরিচালনায় তার প্রজ্ঞার পরিচয় মুক্তযুদ্ধকালীন তাঁর প্রদত্ত ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে। এমন এক ভাষণ তিনি ২৩ নভেম্বরে দেন। এটি বেতার-ভাষণ ছিল। বক্তৃতায় বাংলার দুর্ধর্ষ দামাল ছেলে মুক্তি সৈন্যদের রণনিপুণতার প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে তিনি বলেন:
গত সেপ্টেম্বর মাসে আপনাদের কাছে আমাদের মুক্তিসংগ্রামের পর্যালােচনা করেছিলাম। তারপর আড়াই মাস কেটে গেছে। এর মধ্যে আমাদের সাফল্য এসেছে নানাদিক থেকে। দখলদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ যে সর্বক্ষেত্রে তীব্রতর হয়েছে, সে-কথা শক্রমিত্র নির্বিশেষে সকলেই স্বীকার করেছেন। মুক্তিবাহিনী এখন যে-কোনাে সময়ে যে-কোনাে জায়গায় শত্রুকে আঘাত করতে পারে; এমনকি শত্রুর নিরাপদ অবস্থানের কেন্দ্রে অতর্কিতে আক্রমণ চালিয়ে তাকে বিমূঢ় করে দিতে পারে। জলে-স্থলে চমকপ্রদ অগ্রগতি ঘটেছে। মুক্তিবাহিনীর, নদীপথে হানাদাররা বিপর্যস্ত। মংলা ও চট্টগ্রাম বন্দর প্রায় অকেজো, বাংলাদেশের বিস্তৃত অঞ্চল শত্রুমুক্ত। ক্রমেই অধিকতর এলাকায়, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কার্যকর প্রশাসন চালু হচ্ছে। সৈন্য, সামগ্রী, মনােবল হারিয়ে শত্রুপক্ষ হতাশায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে।
একদিকে রণক্ষেত্রে শত্রুর বিপর্যয় ঘটেছে, অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি-আন্দোলনের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ইসলামাবাদের দুষ্কৃতিকারীরা আজ দিশাহারা ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কেই সংশয় ও ভীতির উদ্রেক হয়েছে তাদের মনে। বাংলাদেশের জনগণের অপরিমেয় দুর্দশা ঘটাবার সঙ্গে সঙ্গে তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেও টেনে নিয়ে গেছে অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও রাজনৈতিক ভাঙনের মুখে। এখন তারা চায় ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধিয়ে একটি আন্তর্জাতিক সংকট সৃষ্টি করতে। তারা আশা করে যে, এখন একটা যুদ্ধ হলে বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে পৃথিবীর দৃষ্টি অন্যদিকে নিবদ্ধ হবে, মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের পরাজয়ের গ্লানি গােপন করা যাবে এবং এমন একটা পরিস্থিতির উদ্ভব হবে যাতে তাদের পৃষ্ঠপােষকেরা হস্তক্ষেপ করার সুযােগ পাবে। কিন্তু আমি প্রত্যয়ের সঙ্গে বলছি যে, এর একটি উদ্দেশ্যও সিদ্ধ হবে না। বরঞ্চ এতে তাদের ভ্রান্তি, অপরাধ ও আত্মঘাতের মাত্রা বৃদ্ধি পাবে মাত্র এবং পরিণামে তাদের আত্মবিনাশ সুনিশ্চিত হবে।
সামরিক শাসকচক্র আত্মহত্যার যে-ব্যবস্থাই করে থাকুক-না কেন, আর এই উপমহাদেশের জন্য যে-ব্যবস্থাই বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রের মনঃপূত হােক-না কেন, বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য ব্যবস্থা একটিই—আর তা হলাে পূর্ণ স্বাধীনতা। ইতিহাসের অন্যতম রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে প্রতিদিন প্রমাণিত হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতার সংকল্প ও সে-স্বাধীনতা রক্ষার শক্তি। ইতিহাস মানুষকে অন্তত এই শিক্ষা দিয়েছে যে, জনসাধারণের ইচ্ছাশক্তির পরাজয় নেই—এমনকি, এক বিশ্বশক্তির সমরসম্ভার দিয়েও জনগণের মুক্তিসংগ্রাম দমন করা যায় না।
এশিয়ায় গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে কোনাে-কোনাে পাশ্চাত্য দেশের নিরাসক্তি লক্ষ্য করার মতাে। মনে হয় মানুষ হিসেবে মানুষের মর্যাদার চাইতে এখানে তারা সরকারের স্থিতিশীলতার গুরুত্ব দেন বেশি। এটা শােচনীয়। কিন্তু ভারতকে অর্থসাহায্যের বিনিময়ে বাংলাদেশের শরণার্থীদের সেখানে স্থায়ীভাবে বসবাসের প্রস্তাব যখন কোনাে রাষ্ট্র উত্থাপন করে তখন আমরা শিউরে না-উঠে পারি না। এই প্রস্তাবে গণহত্যা ও তার ফলাফলকে নীরবে মেনে নেওয়া হয়েছে, পর্বতপ্রমাণ অবিচার ও অন্যায়কে বিনাবাক্যে স্বীকার করে নেওয়া হয়েছে এবং ভবিষ্যতে গণহত্যা ও ব্যাপক বাস্তুত্যাগের পথ প্রশস্ত করা হয়েছে। পাকিস্তানি সন্ত্রাসের ফলে যারা ছিন্নমূল হয়েছেন তারা অস্থাবর সম্পত্তি নন যে, অর্থের বিনিময়ে তাদের হাতবদল করা হবে। সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে নিজ বাসভূমে ফেরার জন্মগত অধিকার তাদের আছে এবং তারা সেখানে সেভাবেই ফিরে আসবেন। আর আমি বলছি যে, তার খুব বেশি দেরি নেই। ঠিক এই সময়ে এই উপমহাদেশে তথ্য সংগ্রহের জন্য একটি বিশেষ দল পাঠিয়ে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কী উদ্দেশ্য সাধন করতে চান? তার দেশের কূটনীতিবিদ ও আইনসভার সদস্যরা অবগত নন এমন কী নতুন তথ্য তিনি জানতে ইচ্ছুক? দশ লক্ষ বাঙালিকে সুপরিকল্পিত হত্যা এবং প্রায় এক কোটি মানুষকে বাস্তুত্যাগে বাধ্য করা সত্ত্বেও পাকিস্তান-সরকারকে তার প্রশাসন নিন্দা করেননি। এখন তথ্য-সংগ্রাহক পাঠিয়ে কী ফল তারা লাভ করতে চান, জানি না। তবে এতে আমাদের সংকল্পের কোনাে ব্যত্যয় হবে না। সে-সংকল্প হলাে দেশকে শত্রুমুক্ত করে নিজেদের অভিপ্রেত সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। অঞ ও রক্তের বিনিময়ে যে-স্বাধীনতার জন্য আমরা লড়ছি, সে-স্বাধীনতা লাভের দিনটি নিকটতর হয়েছে। কিন্তু তার জন্য আরাে আত্মত্যাগ, কষ্ট স্বীকার ও জীবনদানের প্রয়ােজন হবে। স্বাধীনতার ধারণা অশেষ অর্থগর্ভ। স্বাধীনতার তাৎপর্য নির্ভর করে যুদ্ধাবস্থায় এর জন্য আমরা কী মূল্য দিই এবং শান্তির সময়ে এর কী ব্যবহার করি, তার উপর। শত্ৰু-সংহারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে তার শহীদের রক্তের উপযুক্ত সমাজগঠনের প্রতিজ্ঞাও আমাদেরকে নতুন করে নিতে হবে। বাংলাদেশের শহরে ও গ্রামে তরুণেরা যে-যুদ্ধে লিপ্ত, তা বিদেশি দখলদারদের বিতাড়িত করার সংগ্রাম এবং
পৃষ্ঠা: ৬০
অসাম্য ও সুবিধাভােগের অবসান ঘটানাের সংগ্রাম। আমাদের আজকের সংগ্রাম সেদিনই সার্থক হবে, যেদিন আমরা বঙ্গবন্ধু-প্রতিশ্রুত ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হব। সমাজের সে ভবিষ্যৎ-রূপ আজ বাংলাদেশের জনসাধারণ প্রত্যক্ষ করছেন, সেখানে সকলের সমানাধিকারের ভিত্তিতে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক জীবন গঠিত হবে এবং উন্নয়ন ও পরিপূর্ণতার সাধারণ লক্ষ্যে উপনীত হবার প্রয়াসে সকলে অংশগ্রহণ করবেন।
বাংলাদেশের জনসাধারণের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আজও পাকিস্তানের সামরিক চক্রের হাতে বন্দি হয়ে রয়েছেন। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস তাকে মুক্ত করার একমাত্র উপায় হচ্ছে বাংলাদেশ থেকে হানাদার সৈন্যদের নির্গমনের সকল পথ রুদ্ধ করে দেওয়া। তা করবার শক্তি আমাদের আছে এবং আমরা তাই করতে যাচ্ছি। জলে-স্থলে-অন্তরীক্ষে শত্রুকে আমরা চরম আঘাত হানব আর তখনই জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্রুর সত্যের মুখােমুখি হবেন।
বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমাদের আহ্বান: মুক্তিসংগ্রামের বর্তমান পর্যায়কে চূড়ান্ত স্তরে নিয়ে চলুন। যেসব সরকারি কর্মচারী, রাজাকার, পুলিশ বা অন্যান্য ব্যক্তি বিবেকের নির্দেশের বিরুদ্ধে হানাদারদের কাজ করতে বাধ্য হচ্ছেন, তাঁরা সামরিক চক্রের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার সুযােগ গ্রহণ করুন। শত্রুপক্ষের সঙ্গে যারা স্বেচ্ছায় হাত মিলিয়েছেন, তাদেরকে আমি শেষবারের মতাে বলতে চাই: বিশ্বাসঘাতকতার পথ পরিহার করুন। অনুতাপহীন বিশ্বাসঘাতকদের আর তাদের বিদেশি প্রভুদের পরিণতি একই হবে—আর তা হল গ্লানিকর মৃত্যু। হাজার হাজার মুক্তিসেনা আজ শত্রুকে ঘিরে রেখে তার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছে। সকলে প্রস্তুত থাকুন: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহ্বানে চরম মুহূর্তে যেন সর্বশক্তি দিয়ে শত্রুকে একযােগে চরম আঘাত করতে পারেন।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে যারা সাফল্যের বর্তমান স্তরে নিয়ে এসেছেন, সেই বীর শহীদ, অকুতােভয় যােদ্ধা ও সংগ্রামী জনগণকে আমি সালাম জানাই।
জয় বাংলা।
প্রধানমন্ত্রী তাঁর প্রতিটি ভাষণে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির বিষয়ে বলতে কখনও ভুলতেন না। উপযুক্ত ভাষণে তার প্রমাণ রয়েছে। স্বাধীনতার সূর্যোদয়ের পরের দিন ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রধানমন্ত্রী যে-ভাষণ দেন, তাতেও তিনি বঙ্গবন্ধুর কথা স্মরণ করে পাকিস্তানি শাসকবর্গকে শুভবুদ্ধির পরিচয় দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। নিচে এই গুরুত্বপূর্ণ ভাষণের বিবরণ তুলে ধরা হলাে:
বাংলাদেশে দখলদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তিসংগ্রাম আজ সাফল্যের তােরণে উপনীত হয়েছে।
গতকাল বিকেল পাঁচটা এক মিনিটে সম্মিলিত ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার কাছে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খার নিযুক্ত খঅঞ্চলের সামরিক প্রশাসনক লেফটেন্যান্ট জেনারেল নিয়াজী তার অধীনস্থ পাকিস্তান স্থল, বিমান ও নৌ-বাহিনী, আধা-সামরিক ও বেসামরিক সশস্ত্র বাহিনীসহ বিনা শর্তে আত্মসমর্পণ করেছেন।
পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশের জনসাধারণের যে-দুঃস্বপ্নের রাত্রি শুরু হয়েছিল, এতদিনে তার অবসান হলাে। বাংলাদেশে আমাদের নিজেদের কর্তৃত্ব পূর্ণরূপে প্রতিষ্ঠিত হলাে। এত অল্প সময়ে বােধহয় আর কোনাে জাতির স্বাধীনতার সংগ্রাম সফল হয়নি। স্বাধীনতার জন্য এত মূল্যও বােধ হয় আর কোনাে জাতি দেয়নি। আজকের বিজয়, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিজয়, ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রীর বিজয়-সত্য, ন্যায় ও গণতন্ত্রের বিজয়।
আমরা যারা আজ স্বাধীনতার সূর্যোদয় দেখার সৌভাগ্য লাভ করেছি, আসুন, শ্রদ্ধাপ্লুত হৃদয়ে, কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করি সেই বীর মুক্তিযােদ্ধাদের, যারা নিজেদেরকে উৎসর্গ করেছেন সকলের জন্য। পাকিস্তানের সামরিক-চক্র চেয়েছিল বর্বর শক্তি দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে দমন করে রাখতে। হানাদারেরা দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, পঙ্গু করেছে, ঘরবাড়ি জ্বালিয়েছে, আমাদের জাতীয় সম্পদ ধ্বংস করেছে। এই দুঃসময়ে আমাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে আসে ভারত। আর তাই পাকিস্তানি সমরনায়কদের আক্রোশ গিয়ে পড়ে ভারতের উপর। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধকে তারা রূপান্তরিত করে ভারতের সঙ্গে যুদ্ধে। পশ্চিম-রণাঙ্গনে ভারতীয় সেনারা পাকিস্তানি আক্রমণ প্রতিহত করেছেন। আর পূর্ব-রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর সাথে মিলিতভাবে সংগ্রাম করে তারা মাত্র বারাে দিনের যুদ্ধে দখলদার সেনাদেরকে আত্মসমর্পণে বাধ্য করেছেন।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিপর্যয় এত দ্রুত গতিসম্পন্ন হতে পারল ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধ্যক্ষ জেনারেল মানেকশার নেতৃত্বে এবং সম্মিলিত বাহিনীর অধ্যক্ষ লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরার নিপুণ রণকৌশলে। এই দুই সেনাপতির কাছে এবং ভারতের স্থল, নৌ ও বিমানবাহিনীর কাছেও আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ।
আমাদের সাফল্যের এই মুহূর্তে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর কাছে বাংলাদেশের আবালবৃদ্ধবণিতা গভীর কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করছে। তিনি যেভাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার ও নেতাদের কাছে আমাদের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামের ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং যেভাবে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন, ইতিহাসে তার নজির নেই। আমাদের সংগ্রামের ফলে ভারতের জনসাধারণকে যে বিপুল ভার বহন করতে হয়েছে, সে-বিষয়েও আমরা সচেতন। তাঁদের এই কষ্ট স্বীকার সার্থক হয়েছে। শরণার্থীরা এখন মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যেকে নিজের ঘরে ফিরে আসবেন। আমাদের সংগ্রামের প্রতি দৃঢ়তাপূর্ণ সমর্থন দানের জন্য বাংলাদেশের মানুষ সােভিয়েত ইউনিয়নের কাছে গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। পােল্যান্ড এবং অন্য যেসব দেশ আমাদের ন্যায়-সংগ্রামকে সমর্থন করেছে, তাদের কাছেও আমরা কৃতজ্ঞ।
আমরা এ-কথাও ভুলিনি যে, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের জনগণ, সংবাদপত্র, বেতার ও টেলিভিশনের সাংবাদিকেরা গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য আমাদের সংগ্রামকে যথার্থরূপে তুলে ধরে এই সংগ্রাম সফল করতে সাহায্য করেছেন।
বাংলাদেশের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষ হয়েছে, আমাদের সংগ্রাম শেষ হয়নি। আমাদের মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এখনাে শত্রুর কারাগারে। পাকিস্তানি শাসকদেরকে আমি আহ্বান জানাচ্ছি তারা শেষ মুহূর্তেও অন্তত শুভবুদ্ধির পরিচয় দিন, বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করুন। এই দাবি মেনে নেবার সুফল সম্পর্কে পাকিস্তানকে অবহিত করাও তার বন্ধুদের কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা এল এক রক্তাল্পত ভূমিতে, এক ধ্বংস্তুপের মধ্যে। জনগণের আশা ও আকাক্ষা অনুযায়ী এই দেশকে নতুন করে গড়ে-তােলার দায়িত্ব এখন আমাদের সামনে। দেশের দ্রুত পুনর্গঠনের কাজে আমরা ভারতের সহযােগিতা ও সাহায্য কামনা করব। শুধু পুনঃনির্মাণ নয়—নতুন সমাজ গঠনের দায়িত্ব আমরা নিয়েছি। সংগ্রামের কালে সমগ্র জাতির যে ঐক্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় আমরা দিয়েছি, সেই ঐক্য ও ত্যাগের মনােভাব অটুট রাখতে হবে। তবেই গণতান্ত্রিক, ধর্মনিরপেক্ষ, সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশের ভিত্তি দৃঢ় হবে। সেই নতুন আলাের পথে আজ আমরা যাত্রা করলাম।
জয় বাংলা।
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী (১৯১৯-১৯৭৫)
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর এম. মনসুর আলী অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তাঁর প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা, নেতৃত্বের দৃঢ়তা এবং সামরিক ও বেসামরিক ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতার ছাপ ছিল স্পষ্ট। বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ সহযােগী হিসেবে তিনি সর্বদা নীতির প্রশ্নে ছিলেন আপােষহীন।
সিরাজগঞ্জ জেলার কুড়িপাড়ায় ১৯১৯ সালের জানুয়ারি মাসে মনসুর আলী এক সম্ভ্রান্ত মুসলিম পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৩৭ সালে প্রবেশিকা, ১৯৪১ সালে কোলকাতা ইসলামিয়া কলেজ থেকে বি.এ. এবং এলএলবি ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি ১৯৫৫ সাল থেকে পাবনায় আইনব্যবসা শুরু করেন। ১৯৫১ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করে ১৯৫২ সালের ভাষা-আন্দোলনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর দক্ষতার সঙ্গে তিনি তার দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৭৫ সনের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেয়ার জন্য ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সে-মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবর্তীতে ‘৭৫ সনের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন। মুক্তিযুদ্ধকালে প্রদত্ত তার একটি ভাষণ নিচে উদ্ধৃত হলাে:
গত চার মাস ধরে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালি স্বাধীনতা রক্ষার এক মরণপণ সংগ্রাম করে চলেছি। পশ্চিম পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীর নগ্ন-আক্রমণের মুখে রুখে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি করেছি নতুন ইতিহাস।
এই সংগ্রামে যেসব স্বাধীনচেতা অকুতােভয় বীরসন্তান শহীদ হয়েছেন তাদেরকে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। দেশমাতৃকার এইসব বীর সন্তানের জন্য জাতি গর্বিত। আমাদের মৃত্যুঞ্জয় মুক্তিপণে আমরা সবাই দীক্ষিত।
শক্রর বর্বর আক্রমণে যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছেন তাদের আমরা পূর্ণ সহানুভূতি জানাচ্ছি। আর যেসব অগণিত বীরসন্তান মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে হানাদার পশুদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে লড়ে চলেছেন, স্বাধীনতা রক্ষার শপথে যারা রােদ-বৃষ্টি-ঝড় উপেক্ষা করে দুর্গম এলাকায় দিনের-পর-দিন বিদ্রি রজনী কাটাচ্ছেন; শেল, গােলা, বেয়নেটের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা শত্রু নিধন করে চলেছেন; তাদেরকে জানাচ্ছি আমরা প্রাণঢালা অভিনন্দন। চরম দুঃখ-কষ্টের মাঝেও বাংলার শ্রমিক-কৃষক-ছাত্র-জনতা এই আন্দোলনে যে অকুণ্ঠ সমর্থন জোগাচ্ছেন বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা নেই।
আমাদের এ-সংগ্রাম সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ চব্বিশ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানি শােষণের ইতিহাস আজ আবার নতুন করে বলার প্রয়ােজন নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এ-কথা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী প্রথম থেকেই পূর্ববাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং কীভাবে এই উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখা যায় সেই ষড়যন্ত্রেই সবসময় লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের উৎপাদিত অর্থকরী ফসল বিদেশে রপ্তানি করে তারা পেয়েছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, এখানকার কাঁচামালে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের শিল্পসংস্থা আর বাংলাদেশে হয়েছে তাদের পণ্যের বাজার মাত্র।
শুধু তাই নয়, বাংলার অগণিত মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমে লব্ধ অর্থে তারা গড়ে তুলেছে এক বর্বর সৈন্যবাহিনী। বাংলার স্বার্থকে দমন করাই হচ্ছে সে-সেনাবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ। বাঙালি যখনই নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তিসংগ্রামে এগিয়ে গেছে, এই বর্বর সেনাবাহিনী তখনই তাদের পশুশক্তি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ছে মুক্তিকামী মানুষের উপর। এরই নগ্নরূপ আমরা দেখেছি ১৯৬৮ সালে, ১৯৬৯ এবং সর্বশেষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে। বাঙালির এই অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতেই প্রণীত হয়েছিল ৬-দফা কর্মসূচি। এর ভিত্তিতেই মুক্তির এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শহরে, বন্দরে হাটে, মাঠে, গ্রামেগঞ্জে সর্বত্র লাখাে জনতা একই রায় দিয়েছিল: ৬-দফা বাঙালির বাঁচার দাবি। ৬দফা আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ। কিন্তু পশ্চিমা সেনাবাহিনী বরদাশত করতে পারল না এই মুক্তি-আন্দোলন। ৬-দফা আন্দোলনের নায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন বাঙালিকে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে জনগণের কাছে নিজেদের করল হাস্যাস্পদ। জনতার রুদ্ররােষে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। জনতার রায়ে শেখ মুজিব মুক্ত হলেন। আসল ষড়যন্ত্রকারী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট কুখ্যাত আইয়ুব খান উপায়ন্তর না-দেখে গদি ছাড়লেন। শান্তিরক্ষার নামে গদিনশিন হলাে ইয়াহিয়া খান।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা চালু করবে বলে ইয়াহিয়া দেশে সাধারণ নির্বাচন দিল। সে-নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ৬-দফার পক্ষে তাদের সুস্পষ্ট রায় ঘােষণা করলেন। বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক ৬-দফা আন্দোলনের সমর্থনে আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট পেয়ে জয়যুক্ত হলাে। পৃথিবীর ইতিহাসে এ বিজয় নজিরবিহীন।
পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদীদের এ বিজয় সইবে কেন? জনতার রায়কে নস্যাৎ করার জন্যে তারা মরিয়া হয়ে উঠল। চিরাচরিত উপায়ে এবারও তারা তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে নিয়ােগ করল তাদের যাবতীয় দুষ্কর্মের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানি বাহিনী। তাদের এই ষড়যন্ত্রে হাত মিলাল পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মহল। নেমে এল ২৫শে মার্চের ভয়াল রাত। তারপরেই ইতিহাস একদিকে যেমন বর্বরতার দূরপনেয় কলঙ্কে কালিমাময়, অন্যদিকে তেমনি মুক্তিকামী মানুষের আত্মপ্রত্যয়ে ভাস্বর। পশ্চিম পাকিস্তানি নৃশংসতা মানব সভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কময় অধ্যায়। নাদির শাহ, চেঙ্গিস খান আর হিটলারকেও নৃশংসতায় হার মানিয়েছে নরখাদক ইয়াহিয়া-টিক্কা খান।
ওরা শুধু লাখে লাখে নিরাপরাধ নিরস্ত্র বাঙালি হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি, সুপরিকল্পিত উপায়ে ওরা আমাদের অর্থনীতিকে করেছে সম্পূর্ণ ধ্বংস।
ওরা আমাদের খাদ্যের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে, বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, গৃহস্থের সােনাদানা, গরু-ছাগল লুট করে তাদেরকে পথে বসিয়েছে। এক কথায়। গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই দিয়েছে চুরমার করে।
শহরাঞ্চলে ওরা দোকানপাট ভেঙে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে এবং অবাঙালিদের দিয়ে। দোকানের জিনিসপত্র লুঠ করিয়েছে। অনেক শিল্পসংস্থা জ্বালিয়ে দিয়েছে; যন্ত্রপাতি খুলে পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার করেছে। বাকি যে-কয়েকটি রয়েছে সেগুলােতে বাঙালি কর্মচারীর শতকরা নব্বইজনকে তাড়িয়ে দিয়ে অবাঙালি বসিয়ে দিয়েছে। বাঙালি শ্রমিকরা আজ বেকার, বাঙালির শিল্পের কাঠামাে আজ সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিয়েছে।
শুধু তাই নয়, শহরে-বন্দরে বােমা নিক্ষেপ করে ওরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালত, সড়ক-সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। হাটে-মাঠের লােককে ভীত-সন্ত্রস্ত করে সাধারণ ব্যবসাবাণিজ্যকে করেছে বিপর্যস্ত। বিভিন্ন সরকারি ও আধাসরকারি সংস্থার হাজার হাজার কর্মচারীকে বরখাস্ত করে অসংখ্য পরিবারকে ঠেলে দিয়েছে অনাহার আর মৃত্যুর মুখে। সবশেষে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়কে ধ্বংস করে, অধ্যাপক-শিক্ষার্থীদের হত্যা করে, মানসিক সম্পদে আমাদের বিনিয়ােগের পথকে করেছে রুদ্ধ; যার ফলে ভবিষ্যতে আক্রান্ত হতে পারে আমাদের দক্ষতা আর পারদর্শিতা।
কিন্তু বন্ধুগণ, সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা আর কুকর্মের খেসারত পােহাতে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকেও। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে-ঘরেও আজ কান্নার রােল পড়েছে; সেখানকার অর্থনীতিও সম্পূর্ণরূপে ভেঙে পড়েছে। বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল যাওয়া, বন্ধ হবার ফলে তাদের রপ্তানি-বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের বাজার হারিয়ে ফেলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব-উৎপাদিত শিল্পদ্রব্যগুলােই গুদামে পচতে শুরু করেছে। নতুন উৎপাদনের সুযােগ-সম্ভাবনা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে। ফলে বহু শিল্প-কারখানা ইতমধ্যেই বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাকি অনেকগুলােয় প্রতিদিন শত শত শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বেকারদের অভিশাপ নেমে আসছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে।
তার উপর রয়েছে সমর-পরিচালনা বিরাট ব্যয়ভার। বাংলাদেশে সমরাভিযান অব্যাহত রাখতে ইসলামাবাদ সরকারকে প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে গড়ে এক-কোটি টাকা। মুক্তিবাহিনী গেরিলার হাতে প্রচণ্ড মার খেয়ে ওরা দিশেহারা হয়ে পড়েছে আর ডিভিশনের-পর-ডিভিশন সৈন্য পাচার করছে বাংলাদেশে। ফলে খরচের পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে প্রতিদিন। অথচ আয়ের সাধারণ পথ দিন-দিন বন্ধ হয়ে আসছে। ইসলামাবাদ সরকার একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।
তাই ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ থেকে প্রায়ই জোর করে নতুন ট্যাক্সের নামে টাকা-পয়সা লুট করে চলেছে। কতিপয় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়ে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলেছে বিষময়। তাই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে ধরনা দিয়েছিল ইসলামাবাদ সরকারের বিশেষ দূত। কিন্তু তাতেও বিশেষ সাড়া মেলেনি। অগত্যা উন্নয়ন-পরিকল্পনাকে শিকেয় তুলতে হয়েছে। হতাশায় ভেঙে পড়েছে ইয়াহিয়া-সরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সাহায্য সংস্থা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করায় আমরা তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সাথে সাথে আমি এ-কথা সুস্পষ্ট জানিয়ে দিতে চাই—পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আজ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র সুতরাং বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোনাে অধিকারই ইসলামাবাদ-সরকারের নেই। একমাত্র সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশের বৈদেশিক সাহায্য আসতে পারে।
ইয়াহিয়া-সরকারকে সাহায্য করার মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলাদেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাস্ত করবে না।
ভারত-সরকার ও জনসাধারণ নানারূপ অসুবিধার মধ্যে লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগী বাঙালিকে বাঁচানাের দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা এজন্য তাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর আরাে যেসব বন্ধুরাষ্ট্র বিভিন্ন রকম সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদেরকেও আমাদের কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আমরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। যেহেতু বাংলাদেশের বেশকিছু এলাকা এখনও শক্রকবলিত রয়েছে তাই এ-মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ণ সম্ভব হচ্ছে না। তবু সীমিত পরিসরে আমরা যে-কয়েকটি অর্থনৈতিক কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছি তা হচ্ছে এই-
১. এই মুক্তিসংগ্রামে যে-সমস্ত বাঙালি সন্তান জীবন দিয়েছে, বাংলাদেশ সরকার তাদের পরিবারবর্গের ভরণ-পােষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছে তাদের পরিবারকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার সমূহ-চেষ্টা করে যাবে।
২. শত্ররা আমাদের অর্থনীতিকে ভেঙে দিয়েছে। মুক্ত-এলাকায় এই বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারের দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। মুক্ত-এলাকায় সরকার এ-ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন।
পৃষ্ঠা: ৬৫
৩. যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামাে প্রণয়নে যে-কথাটি আমরা সবসময়ই মনে রেখেছি সেটি হচ্ছে:চরম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করেও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এই মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেছে। এবং সেই ফল থেকে তারা যেন বঞ্চিত না হন তার যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। মােট কথা, সমগ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।
যেসব দুস্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙালিদের বাড়িঘর জোর করে দখল করেছে; ধন-সম্পত্তি লুঠ করেছে; তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তার ধন-সম্পত্তি অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হবে। জাতির এই চরম সংকটময় মুহূর্তে নিঃস্ব মানুষের বাঁচার অধিকার যারা পশ্চিমী শত্রুদের সহায়তায় জোর করে কেড়ে নিয়েছে, স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কোনাে অধিকার নেই।
জানি আপনারা চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন। জানি এ-মুহূর্তে আপনাদের এই অর্থনৈতিক সংকট নিরসন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবুও আপনাদের কাছে অনুরােধ: বিপদে ধৈর্যচ্যুত হবেন না। আজ আমরা এক অগ্নি-পরীক্ষার সম্মুখীন। একমাত্র চরম ত্যাগতিতিক্ষার শপথেই আমরা এই পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে পারি। স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে-কর্তব্য রয়েছে সেগুলাে সম্পর্কে আপনাদের আবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়ােজন বােধ করছি।
১. যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সেহেতু ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা-ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই প্রাপ্য। কোনাে বিদেশি সরকারের এ-ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধকার নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে এ-কথা অবশ্যই মনে রাখতে হবে।
২. শত্রুরা সুপরিকল্পিত উপায়ে বাংলাদেশে চরম দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্যাভাব সৃষ্টি করেছে। লাখাে লাখাে বাঙালিকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করতে চাইছে।
এমতাবস্থায় প্রতিটি গ্রামকে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে হবে। গ্রামবাসী ভায়েরা আমার, খাদ্য উৎপাদনে আপনাদের যথাশক্তি নিয়ােগ করুন। শক্রকবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখুন। কারণ এ ফসল বিক্রি করে শত্রু হাতিয়ার কিনবে বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য।
গ্রামীণ অর্থনীতির উপর জোর দিয়ে গ্রামগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ংসম্পূর্ণ করে তুলুন। গ্রামে গ্রামে কুটিরশিল্প গড়ে তুলুন। পরস্পর সহযােগিতার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচার পথ বেছে নিন। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট ও অন্যান্য ফসল ইয়াহিয়া-সরকার নানারূপ ভয়ভীতির মাধ্যমে বিনামূল্যে কিংবা নামমাত্র মূল্যে কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য মারণাস্ত্র কিনছে। আপনাদের অবগতির জন্য জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই বাণিজ্য বাের্ড গঠন করেছে। এইবাের্ড বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল বিদেশের বাজারে বিক্রির সমূহ-ব্যবস্থা করবে। আমাদের ভাইয়েরা যাতে তাদের উৎপন্ন ফসলের উপযুক্ত মূল্য পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য বাের্ডের কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছি।
সর্বশেষে নাগরিক ভাইদের কাছে আমার একান্ত অনুরােধ, আপনারা শত্রুর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযােগিতা চালিয়ে যান। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত যাবতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণরূপে পরিহার করুন। কারখানার উৎপাদন বন্ধ করুন। শত্রুকে সদাসর্বত্র নাজেহাল করে তার অর্থনৈতিক কাঠামাে সম্পূর্ণরূপে ভেঙে দিন।
মনে রাখবেন, আপনাদের অসহযােগিতায় শত্রুর তথা পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতিমধ্যে প্রায় ভেঙে পড়েছে। আপনাদের পরিপূর্ণ অসহযােগিতায় অচিরে তা ভেঙে খানখান হয়ে যাবে। আপনাদের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
এখানে একটি কথা আপনদের মনে করিয়ে দিতে চাই। এ-কথা সত্যি যে, শত্রুকবলিত এলাকায় আমাদের মুক্তিবাহিনী পুল, সেতু উড়িয়ে দিয়ে সড়ক-যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। প্রয়ােজনে রাস্তাঘাট কেটে শত্রুর পরিবহণ-ব্যবস্থাকে অকেজো করে দিচ্ছে। এতে আমাদের অর্থনীতিতে কিছু ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ-করা ছাড়া আমাদের অন্য কোনাে উপায় নেই।
শত্রুনিধনই আমাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। নিজেদের কিছু ক্ষয়ক্ষতি সহ্য করেও আমাদের এ কর্তব্য সমাধান করতে হবে। দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি হানাদার সৈন্যও উপস্থিত থাকবে ততক্ষণ আমরা শনিধন-পর্ব চালিয়ে যাব। সামনে যত বাধাই আসুক না কেন। অবশ্য দেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হলে আমরা প্রথমেই এসব রাস্তাঘাট পুনঃনির্মাণের কাজ শুরু করবাে। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এসবের পুনঃনির্মাণে বেশি সময় লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস। বাঙালি জাতির ইতিহাসের আজ এক চরম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হতে চলেছে। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে বেঁচে থাকার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে যারা পশুশক্তির বলে বঞ্চিত করতে চাইছে তাদের সাথে আমাদের কোনাে আপােষ নেই। রক্তভেজা পথে এগিয়ে চলেছে বাঙালির মুক্তি-কাফেলা। কালের দেয়ালে পড়ছে রক্তের ছাপ। রক্তের আঁখরে লেখা নবযুগের ইতিহাস।
লক্ষ লক্ষ নিরাপরাধ বাঙালিকে হত্যা করে ইয়াহিয়া-টিক্কা যে পাপ করেছে, ইতিহাসের কাঠগড়ায় তাদের জবাবদিহি করতে হবে। ইতিহাসে অমােঘ দণ্ড এড়ানাের উপায় কারাে নেই। সাম্রাজ্যবাদের দিন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীর সব দেশেই মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাভূত হয়েছে। সবক্ষেত্রে এ-কথাই প্রমাণিত হয়েছে যে অস্ত্রপ্রয়ােগে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম স্তব্ধ করা যায় না।
বাঙালির এ-মুক্তিসংগ্রামকেও তাই বুলেট-বেয়নেট, শেলগােলায় স্তব্ধ করা যাবে না। রক্তে যখন মাতম জেগেছে, পদ্মা-মেঘনায় বান ডেকেছে, তখন তাকে রুখতে পারে এমন সাধ্যি কারাে নেই।
মর্জি খােদা। জয় আমাদের সুনিশ্চিত এবং সেদিন বেশি দূরে নয়। জয় বাংলা।
এ. এইচ.এম কামারুজ্জামান (১৯২৩-১৯৭৫)
বর্তমান নাটোর জেলার অন্তর্গত বাগাতিপাড়ার মালঞ্চা গ্রামে ১৯২৩ সালের ২৬ জুন তারিখে এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান জন্মগ্রহণ করেন। পিতা আবদুল হামিদ ও মাতা বেগম। জেবুন্নিসার ঐকান্তিক ইচ্ছায় তিনি তাঁর বাল্যজীবন রাজশাহী ও চট্টগ্রাম স্কুলে কাটান। কোলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে অনার্স এবং রাজশাহী আইন কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করে ১৯৫৬ সাল থেকে রাজশাহী জজকোর্টে আইনব্যবসা শুরু করেন। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি রাজনীতিতে সক্রিয় হন। ১৯৫৭ সালে আওয়ামী লীগে যােগদান করেন। ১৯৫৭ সালে রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৬২ ও ১৯৬৫ সালে তিনি দুবার জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হয়েছিলেন।
কামারুজ্জামান ছিলেন বনেদি পীর-পরিবারের মানুষ। তাদের জমিদারিও ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময় মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য হিসেবে তিনি ত্রাণ ও পুনর্বাসনের দায়িত্বে ছিলেন। কামারুজ্জামান ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী। ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, সীমান্ত এলাকা, শরণার্থী শিবিরে গিয়ে দিনরাত খাটতেন।
তিনি ছিলেন পরিচ্ছন্ন রুচিবান কৌতুকপ্রিয় প্রিয়ভাষী মানুষ। তার ব্যক্তিগত সংস্কৃতি উঁচু দরের ছিল। তিনি উন্মুক্ত এবং বিদ্বেষহীন মনের অধিকারী ছিলেন। নিস্পাপ মনের এই মানুষ দায়িত্ব পালনে সুদক্ষ কর্মী ছিলেন। কামারুজ্জামানের সব স্বভাবের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ও দৃষ্টি-আকর্ষণীয় ছিল তার অনবরত পান-চিবানাে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর অস্থায়ী বিপ্লবী সরকারের তিনি স্বরাষ্ট্র এবং ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। দায়িত্ব পালনে তিনি যে ত্যাগ ও নিষ্ঠার পরিচয় দিয়েছেন তা স্মরণীয় হয়ে থাকবে। কঠিন প্রতিকূল অবস্থায়ও তিনি ধীরস্থিরভাবে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। তার দক্ষতা ও বিচক্ষণতা ছিল প্রশ্নাতীত।
মুক্তিযুদ্ধের সামরিক দিকেও তিনি পারদর্শিতার পরিচয় দেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রম, বলিষ্ঠ নেতৃত্ব এবং সর্বোপরি তার দেশপ্রেম মুক্তিযুদ্ধে জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছে এবং মুক্তিযুদ্ধের বিজয়কে নিশ্চিত ও ত্বরান্বিত করেছে।
স্বাধীনতার পর তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ১৯৭৩ সনের সাধারণ নির্বাচনে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের সদস্য নির্বাচিত হন এবং পরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নৃশংসভাবে হত্যা করার পর খন্দকার মােশতাক আহমদের নেতৃত্বে যে অবৈধ সরকার গঠিত হয় তাতে যােগ দেয়ার জন্য এ.এইচ.এম কামারুজ্জামানকে নানাভাবে ভয় ও প্রলােভন দেখানাে হয়। কিন্তু তিনি সে প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন। পরবতীতে ৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও এম. মনসুর আলীসহ তিনি নির্মমভাবে নিহত হন।
মুজিবনগরে মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন কালে তিনিও দেশবাসী, মুক্তিযােদ্ধা, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে বহু জ্বালাময়ী ভাষণ দেন। তার ভাষণের বিবরণ প্রতিবেদনরূপে তৎকালীন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কর্তৃক প্রকাশিত স্বাধীনতার রজত জয়ন্তী স্মারকগ্রন্থ থেকে এরূপ একটি প্রতিবেদন নিচে উদ্ধৃত হল:
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র ও পুনর্বাসন মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু দানব বলে অভিহিত করেছেন।
সাবেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত দ্বিতীয় দফা ভাওতাবাজি সম্পর্কে মন্তব্য করতে বললে জনাব জামান উপরােক্ত মত ব্যক্ত করেন। জনাব জামান বলেন, ইয়াহিয়া খানের মতাে এত বড় মিথ্যাবাদী, বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক দুনিয়ার বুকে দুটি জন্মায়নি। তার কথায় বাংলাদেশের মানুষ তাে দূরের কথা, বহির্বিশ্বের কোনাে মানুষও বিশ্বাস স্থাপন করবে না। ইয়াহিয়া নিজেকে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বিশ্বাসঘাতক ও রক্তপিপাসু বলে প্রমাণ করেছে। জনাব কামারুজ্জামান বলেন, শেখ মুজিবের সাথে আলােচনায় ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগের সমস্ত দাবি মেনে নিয়েছিলেন। তিনি কথা দিয়েছিলেন ২৫ মার্চ এক ঘােষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করার ব্যবস্থা করা হবে। কিন্তু তার বদলে ইয়াহিয়া ঐ রাতে বাঙালিদের উপর লেলিয়ে দেয় তার বর্বর সৈন্যবাহিনীকে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ক্ষমতা সম্পর্কে প্রশ্ন করার অধিকার জঙ্গীচক্রের নেই। শতকরা ৯৮ ভাগেরও বেশি লােক আমাদের সমর্থন করেছেন। আমাদের বিচার করার ক্ষমতা কেউ জঙ্গীচক্রকে দেয়নি। তারা গণতান্ত্রিক মূল্যবােধহীন ক্ষমতামত্ত দানব। আওয়ামী লীগ আলােচনা ভেঙে দেয়নি। এখন যখন যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে, তখন আমাদের পবিত্রভূমি থেকে হানাদান বিতাড়িত না-করা পর্যন্ত আমরা তা চালিয়ে যাব। নির্যাতিত মানবের পাশে যারাই এসে দাঁড়াবেন তারাই মহৎ। তাদেরকে আমরা বন্ধু বলে মনে করব।
জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী
মন্ত্রিসভার সদস্যদের সঙ্গে কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানীর নাম অতি নিবিড়ভাবে যুক্ত হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের সময়। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাঁকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে নিয়ােগদানের কথা ঘােষণা করেন ১৭ এপ্রিল। এই আনুষ্ঠানিক নিয়ােগ লাভের আগে থেকেই তিনি পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠন করার কাজ শুরু করে দিয়েছিলেন। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর অনৈতিক আক্রমণের আগে এই বাঙালি সামরিক অফিসার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চাকুরি থেকে অবসর গ্রহণ করেছিলেন। বাংলাদেশের সিলেট জেলায় জন্মগ্রহণকারী কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকেটে জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তান বাহিনী নিরস্ত্র বাঙালি জনগণের উপর ঝাপিয়ে পড়ে ব্যাপক গণহত্যা শুরু করায় এবং আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের খুঁজতে থাকায় তিনি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতের সীমান্তে অবস্থান নেন। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা তাজউদ্দীন আহমদ জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যগণকে একত্র করার সময় তাকেও পান। অন্যান্য নেতার সঙ্গে তাকেও নিয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা নির্ধারণকল্পে আলােচনা করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনী সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের প্রশাসন-ব্যবস্থা ভেঙে দিয়ে সারাদেশে এক অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করায় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ তাদের করণীয় সম্বন্ধে আলােচনা করেন। রাতদিন অনিশ্চিত অবস্থার মধ্যে নেতৃবৃন্দ আলাপ-আলােচনা করেন। তার আগে তাজউদ্দীন আহমদ এবং আমীর-উলইসলাম দিল্লিতে গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করে এসেছিলেন। ভারতের অন্যান্য রাজনৈতিক নেতা এবং সরকারের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার সঙ্গে আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে তারা বুঝেছিলেন যে, বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে বাংলাদেশের মানুষকেই ব্যবস্থা নিতে হবে। ভিন্ন কোনাে দেশ সরাসরি সাহায্যে এগিয়ে আসবে না,এ-কথা নেতৃবৃন্দ বুঝেছিলেন। তাই, দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ও বিচক্ষণ নেতা তাজউদ্দীন আহমদ নির্বাচিত সদস্যগণকে (যাদেরকেই তখন কাছে পেয়েছিলেন, তাদের নিয়ে আলােচনা করেছেন। কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী, এম.এন.এ. বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কিত এই গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় অংশ নিয়েছিলেন।
১৭ এপ্রিলে তাকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে ঘােষণা করা হলেও কার্যত তিনি ১২ এপ্রিল থেকে ঐ পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। আনুষ্ঠানিক নিয়ােগ লাভের আগেই তিনি মুক্তিবাহিনী সংগঠন গড়ে তােলেন। ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের ১ম, ২য়, ৩য়, ৪র্থ ও ৮ম ব্যাটালিয়ন এবং সাবেক ই.পি.আর.-এর উইংসমূহ স্বতন্ত্রভাবে পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে বিভিন্ন অঞ্চলে এবং সীমান্তবর্তী এলাকায় ঘােরতর যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। সমরবিদ্যায় পারদর্শী ব্যক্তিদের সঙ্গে যােগ দেয় পুলিশ, আনসার ও মুজাহিদ। এপ্রিল মাসের শেষের দিকে যােগ দেয় পূর্ববাংলায় কর্মরত পাকিস্তান বিমানবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা, ওয়ারেন্ট কর্মকর্তা ও অন্যান্য পদস্থ সদস্য। ফ্রান্স থেকে পাকিস্তানি ডুবােজাহাজ পরিত্যাগকারী নৌবাহিনীর বাঙালি ওয়ারেন্ট কর্মকর্তা ও অন্যান্যপদস্থ নাবিকসহ নৌবাহিনীর অনেক সদস্য বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। এছাড়া, দেশের তরুণ ছাত্র, কৃষক-তনয়, শ্রমিকরা এসে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ই.পি.আর.-এর সঙ্গে স্বতস্ফূর্তভাবে যােগ দেয়। কর্নেল (অব) ওসমানীর নির্দেশনায় এসব তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
এপ্রিল মাসেই তিনি এক বিশাল গেরিলা বাহিনী এবং নৌকমান্ড গঠনসহ নিয়মিত বাহিনীর সম্প্রসারণ ও পুনর্গঠনের পরিকল্পনা নেন। তার পরিকল্পনা অনুযায়ী জুন মাসের শেষদিক থেকে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য গেরিলা বাহিনীকে রণক্ষেত্রে পাঠানাে শুরু হয়। বিমান বাহিনী গড়ে তুলতে কিছু বিলম্ব হওয়ায় তিনি বিমান বাহিনীর উল্লেখযােগ্য সংখ্যক সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাকে স্থলবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। স্থলযুদ্ধেও এঁরা সকলেই কৃতিত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন।
সংগঠিত গেরিলা বাহিনী পরিচিতি লাভ করে গণবাহিনী নামে। বেসামরিক তরুণদের নিয়ে এই বাহিনী গঠিত হওয়ায় ওসমানী এমন নামকরণ করেছিলেন। নিয়মিত বাহিনী ও গণবাহিনীর সম্মিলিত পরিচয় ছিল মুক্তিবাহিনী নামে। পরিকল্পনা অনুযায়ী এরা বিভিন্ন সেক্টরে যুদ্ধে অংশ নেয়। ঝড়, বৃষ্টি, প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যেও মুক্তিযােদ্ধারা মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করতে মরণপণ লড়াই করেছে।
প্রসঙ্গত একটি কথা বলতেই হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী যখন সেক্টর-কমান্ডারদের সাথে স্বশরীরে আলােচনার জন্য তাদের মাঝে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন সকলের মধ্যে যে প্রতিক্রিয়া এবং মনােভাব ফুটে ওঠে তা অনির্বচনীয় ও অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা করে। সকলেই সেদিন আবার দেশকে শত্রুমুক্ত করতে নবপ্রেরণায় শপথ গ্রহণ করে।
কর্নেল (অব) ওসমানী ছিলেন একজন বাঙালি সামরিক অফিসার। বাংলাদেশের রণাঙ্গনে তার মতাে একজন সামরিক ব্যক্তিকে পাওয়া গৌরবের বিষয়। তার সম্বন্ধে জেনারেল মীর শওকত আলীর মন্তব্য প্রণিধানযােগ্য। তিনি বলেছিলেন: ওসমানী ভারতীয় জেনারেলদের সমকক্ষ ছিলেন, এবং কারাে কারাে সিনিয়র ছিলেন। জেনারেল অরােরা যিনি ইস্টার্ন কমান্ডের (ভারতীয় বাহিনীর) সি.ইন.সি. ছিলেন, তার চাইতেও ওসমানী সিনিয়র। ছিলেন এবং খুব সম্ভবত জেনারেল মানেকশ (ভারতীয় বাহিনীর তৎকালীন প্রধান সেনাপতি) থেকে জুনিয়র ছিলেন। তিনি যদি না-থাকতেন, আমার মনে হয় না, ভারতীয় সেনাবাহিনীর জেনারেলগণ আমাদের যেভাবে সাহায্য করেছেন, সেভাবে সাহায্য করতেন। কারণ আমরা অনেক জুনিয়র ছিলাম। আমরা ছিলাম মেজর, আর তারা ছিলেন জেনারেল, লে. জেনারেল।
ওসমানী যখন বাংলাদেশ সেনাপ্রধানের দায়িত্ব লাভ করেন, তখন তাঁর বয়স পঞ্চাশ পার হয়েছে। কিন্তু বয়স তাঁকে হার মানাতে পারেনি। রণাঙ্গনের কঠোর শৃঙ্খলা ও নিয়মানুবর্তিতা থেকে তিনি পিছু হটেননি। যে-কোনাে বিশৃঙ্খলা তিনি কঠোর হস্তে নিয়ন্ত্রণ করতেন। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তিনি জাতির উদ্দেশে এক ভাষণ দিয়েছিলেন। ভাষণে তিনি মুক্তিযুদ্ধের পূর্বাপর ঘটনা বর্ণনা করেন।
পৃষ্ঠা: ৭০
মন্ত্রিপরিষদ ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর প্রবাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাস থেকে দেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার তারিখ এবং তারপরও আরাে কয়েকদিন পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিভিন্ন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। সেসব সিদ্ধান্ত স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় বিশেষ অবদান রাখবে সন্দেহ নেই। কিন্তু এইসব সিদ্ধান্ত, সরকারি আদেশনির্দেশ, চিঠিপত্রের বিষয়ে এখন পর্যন্ত কেউই বিশেষভাবে আলােকপাত করেননি। আমাদের দুর্ভাগ্য যে, স্বাধীনতার পর আজ তিনটি দশক পার হয়ে গেল, অথচ স্বাধীনতা অর্জনের পটভূমিতে যেসব ঘটনা সংঘটিত হয়েছে তার প্রকৃত চিত্র সঠিকভাবে কেউ তুলে ধরেননি। নানান ভিত্তিহীন কথাবার্তা বলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে বিভ্রান্তি সৃষ্টির অপপ্রয়াস লক্ষ্য করছি। আমি লেখক বা ইতিহাসবিদ নই। সরকারের গুরুত্বপূর্ণ পদে থেকে দায়িত্ব পালন করেছি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত থেকে সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে দায়িত্ব পালনকালে আমি সকল সরকারি কাজকর্ম প্রত্যক্ষ যেমন করেছি, তেমনি মন্ত্রিসভার সকল প্রকার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে কার্যকর ভূমিকা পালন করেছি। মন্ত্রী পরিষদ বিভাগের সাংগঠনিক কাঠামাের বিবরণ পরিশিষ্ট ১৮-তে দেয়া হলাে।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালনায় আমি অসংখ্য সহকর্মী ও সহযােগীসহ ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিলাম বলে বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক অবস্থার অবক্ষয় দেখে খুবই পীড়িতবােধ করি। বাংলাদেশের মুক্তির জন্য শত্রুর বিরুদ্ধে যেভাবে কাজ করেছি তা কি সবই অসার হয়ে যাবে? এই আশঙ্কা আর প্রশ্ন আমাকে আমার অন্তর থেকে একটা তাগিদ দেয়। এদেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য তাে বটেই, গবেষক এবং ইতিহাস-লেখকদের জন্য কিছু উপাদান রেখে যাওয়া আবশ্যক। কিন্তু কীভাবে তা উপস্থাপন করব! আগেই বলেছি, আমি লেখক নই, সরকারি আমলা ছিলাম মাত্র। তবু যেভাবেই হােক, ইতিহাস-বিকৃতির অপপ্রয়াস থেকে জাতিকে সতর্ক করতেই হবে।
বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে প্রবাসে তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার যেসব কর্মকাণ্ড ও প্রয়াস চালিয়েছিলেন আমি তার একজন প্রত্যক্ষ সাক্ষী। আমার স্বাক্ষরে সরকারের বহু আদেশ-নির্দেশ জারি করা হতাে। তৎকালীন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শহীদ তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে প্রায় সর্বক্ষণ আমাকে ছায়ার মতাে থাকতে হতাে। তাঁর মৌখিক, লিখিত, সব নির্দেশ আমি পালন করতাম। তিনি নিজে তাঁর ব্যক্তিগত ডায়েরি সংরক্ষণ করতেন। আমি নির্দিষ্টভাবে কোনাে ডায়েরি সংরক্ষণ না-করলেও হাতে সার্বক্ষণিকভাবে একটা ডায়েরি থাকত। তাতে আমি বিভিন্ন নােট, টেলিফোন নম্বর ও অন্যান্য টুকিটাকি বিষয় লিখে রাখতাম এবং আমার দাপ্তরিক কাজে তা কাজে লাগাতাম। আজ এসব আমার নিকট খুবই মূল্যবান প্রতীয়মান হচ্ছে। বাংলাদেশের ইতিহাস রচনায় এসব তথ্য অপরিসীম গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে, সন্দেহ নেই। আমার এসব তথ্য সবই প্রাথমিক উৎস হিসেবে পরিগণিত হবে, কারণ আমি কোনাে শােনা-কথা (hearsay) লিপিবদ্ধ করিনি।
আমার তথ্যগুলােকে প্রাথমিক (primary) বলার কারণ এই যে, আমার ডায়েরির পৃষ্ঠা, সরকারি আদেশ-নির্দেশের মূল কপি, মন্ত্রিপরিষদের সভার কার্যবিবরণী ও, সিদ্ধান্তের মূল খসড়া (draft.) এবং অন্যান্য দলিলপত্রের মূল কাগজপত্রের সমুদয় বিষয় আমি উল্লেখ করেছি। মনগড়া কোনাে বিষয় অথবা স্মৃতি থেকে কোনাে কিছু বলার আমার প্রয়ােজন নেই।
পাঠক, লেখক, ইতিহাসবিদ ও গবেষকদের জন্য চিত্তাকর্ষক খবর এই যে, আমি সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব পদে আনীন থাকায় খসড়া (draft) পযায়ের, এমনকি দাপ্তরিক চিঠিপত্রের মূল আদেশ-নির্দেশের কপিও আমার কাছে থাকা খুবই স্বাভাবিক। অবশ্য আমার স্বাক্ষরিত এসব অফিস আদেশ-নির্দেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সংরক্ষিত আছে। কারণ, এসব চিঠিপত্র অথবা অফিস-আদেশ অবগতি অথবা প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য প্রেরণ করা হতাে। সংশ্লিষ্ট সেসব দপ্তরে খোঁজ করলেও আমার নিকট সংরক্ষিত চিঠিপত্র, দলিল-দস্তাবেজের অনুরূপ কপি খুঁজে পাওয়া কঠিন হবে না। আমার আশঙ্কা, দেশ যে-পথে অগ্রসর হচ্ছে, তাতে প্রকৃত তথ্য-সম্বলিত দলিল-দস্তাবেজ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন কাগজপত্র ঠিকঠাক আছে কিনা! তবে, আশার কথা এবং বাস্তবতা এই যে, এসব তথ্য দেশ-বিদেশের তথ্যভাণ্ডারে সংরক্ষিত আছে। কাজেই, আমার মাতৃভূমি স্বাধীন বাংলাদেশে এসব তথ্য বিকৃত করা সম্ভব হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের তথ্যভাণ্ডার থেকে তা কখনই সরানাে যাবে না অথবা বিকৃতভাবে তা বলা যাবে না। এরকম একটি মনােবল নিয়েই আমি এই গ্রন্থের বর্তমান অধ্যায়ে মন্ত্রিসভার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্তের বিষয়ে আলােচনা করছি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে যায় পাক-হানাদার বাহিনী কর্তৃক ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতের অপারেশন সার্চলাইটের মুহূর্ত থেকে। পাকিস্তান-বাহিনীর অতর্কিত ও অমানবিক হত্যাকাণ্ডে বাঙালি জাতি গর্জে ওঠে এবং প্রতিরােধ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষিত হয় এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের সরকার গঠিত হয়। এ-সম্বন্ধে আরাে বিস্তারিত আমি অন্যত্র আলােচনা করব। এখানে শুধু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা প্রসঙ্গেই বলি।
এখন হয়তাে অনেকেরই মনে নেই যে, আমাদের সরকারে প্রথম যে-নামকরণ করা হয় তাতে আঞ্চলিকভাবে শব্দের সামান্য তফাৎ ছিল। পূর্বাঞ্চলে প্রথম কয়েকদিন আমরা কেউ কেউ গণপ্রজাতান্ত্রিক সরকার বলতাম এবং চিঠিপত্র ও অফিস আদেশ ইত্যাদিতে তা উল্লেখ করা হতাে। গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকার শিরােনামে লেটারহেড ছাপানাে হয়েছিল (পরিশিষ্ট-১৯ দ্রষ্টব্য)। পরে গণপ্রজাতান্ত্রিক শব্দ সংশােধন করে গণপ্রজাতন্ত্রী ব্যবহার শুরু হয় যা আজ পর্যন্ত বহাল আছে। ইংরেজি Government of the People’s Republic of Bangladesh-কে বাংলায় ভাষান্তর করার সময় গণপ্রজাতন্ত্রীর জায়গায় গণপ্রজাতান্ত্রিককরা হয়েছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম থেকে ডিসেম্বর মাসে পাকিস্তানিদের আত্মসমর্পণের তারিখের (১৬ ডিসেম্বর) পর আরাে ৪ দিন পর্যন্ত অর্থাৎ ২০ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুজিবনগরে মন্ত্রিসভার যেসব সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল এবং সেসব সভায় যেসব গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়েছিল তার কিছু-কিছু অংশের বিবরণ নিচে দেওয়া হলাে। যুদ্ধ পরিচালনা, প্রশাসনিক কাজকর্ম সুষ্ঠভাবে সম্পন্ন করা এবং আত্মসমর্পণের পর যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন করার সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ এসব তথ্যে পাওয়া যাবে।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ন্ত্রিত বেতার-কেন্দ্র থেকে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ প্রত্যুষে প্রচারিত হয়। পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বহিঃপ্রচার থেকে প্রকাশিত Contemporary Events And Documents’ শীর্ষক পুস্তিকায় উল্লিখিত ১০ এপ্রিল তারিখের স্বাধীনতার ঘােষণা (The Proclamation of Independence) এবং আইনের ধারাবাহিকতা এবং প্রয়ােগ আদেশ—১৯৭১’ (The Laws Continuance Enforcement Order 1971) আনুষ্ঠানিকভাবে পরবর্তী পর্যায়ে প্রচারিত হওয়ার পর মন্ত্রিসভার বহু গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভার উল্লেখযােগ্য সিদ্ধান্তগুলােই শুধু এখানে বিধৃত হলাে।
যেহেতু স্বাধীনতা ঘােষণা (The Proclamation of Independence) ১০ এপ্রিলেই হলাে, তাই প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক শপথ গ্রহণের জন্য ১৭ এপ্রিল নির্ধারণ করলেন। অবশ্য এর সাথে নিরাপত্তার প্রশ্নও জড়িত ছিল। মন্ত্রিসভার প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ১২ এপ্রিল। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ভাষণ দেন ১১ এপ্রিল। (পরিশিষ্ট-২০ দ্রষ্টব্য)। অবশ্য এটা ছিল অনানুষ্ঠানিক। নিরাপত্তার খাতিরে এবং গােপনীয়তা রক্ষার জন্য কোথায় সভা অনুষ্ঠিত হলাে তা কাউকে জানানাে হয়নি। প্রধানমন্ত্রী তাঁর ভাষণে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণমানসের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে সকলকে সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে কেন দেশকে শত্রুমুক্ত করার যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে হলাে তার আনুপূর্ব বর্ণনা দেন। কোন্ কোন সেক্টরে কার অধীনে যুদ্ধ চলছে তার বিবরণও তুলে ধরেন তিনি। তাঁর সুদীর্ঘ ভাষণে বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি দস্যুদের গণহত্যার কথা উল্লেখ করে তিনি পৃথিবীর সকল দেশের নিকট থেকে অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান। যুদ্ধের সময় শত্রুকে সহযােগিতা না-করার আহ্বান জানিয়ে সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি নিয়ে দেশবাসীকে যুদ্ধে নিয়ােজিত মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা দিতে নির্দেশ দেন।
আমি অনেক পরে মুজিবনগর গিয়েছিলাম (জুন) বিধায় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন নিজেই প্রথম দুইমাসের সভাগুলির কার্যবিবরণী লিপিবদ্ধ করেন তার নিজ হাতের লেখায়। কাউকে টাইপও করতে দেননি, যদি গােপনীয়তা রক্ষা করা না যায় তাই। দুইমাসের বেশি সময় যতগুলি সভা অনুষ্ঠিত হয় তার সবগুলির কার্যবিবরণী (minutes) এবং সিদ্ধান্ত (decisions). এবং বেশ কিছুর টেকা (note) শহীদ তাজউদ্দীন আমার হাতে তুলে দেন আমি মুজিবনগর যাবার পরেই। চমৎকার হাতের লেখা—পরিষ্কার এবং পরিচ্ছন্ন। কি ইংরেজি, কি বাংলা দুটোই চমৎকার লিখতেন। অন্যান্য আওয়ামী নেতৃবৃন্দের মতাে জনসভায় অতটা অনলবর্ষী আবেগময় বক্তৃতা দিতে পারতেন না। ভাষা এবং লেখার পরিচ্ছন্নতার ওপর খুব গুরুত্ব দিতেন। তার হাতের লেখা রেকর্ড, নথি, সব আমি সযত্নে রেখে দিয়েছিলাম এই গ্রন্থ ২০০৪ সালে যখন প্রথম প্রকাশিত হয় তখন পর্যন্ত। স্বাধীনতার ৩২ বছরের বেশি সময় পার হয়ে যাওয়ায় আর গােপনীয়তার প্রয়ােজন নেই। এখন জনগণের এবং বর্তমান প্রজন্মের এগুলাে জানা উচিত। তাই কিছু কিছু অংশ টাইপ করে নিচে তুলে ধরা হলাে।
প্রথম সভা: ১২ এপ্রিল, ১৯৭১
আলােচ্যসূচি অতি সংক্ষেপে ক্রমিক নম্বর দিয়ে। প্রথমে লেখা ১., ২., ৩., ৪.; পরে আবার ১.থেকে ১০.; মাঝে ৮. নেই। নিচে দাগ দিয় আবার ১.।
কী ছিল আলােচ্যসূচি?
১. সরকারের দপ্তর স্থাপন (Set up Seat of Govt.)/স্থান নির্ধারণ
২. সচিবালয় প্রতিষ্ঠা-মহাসচিব (Secy. Gen.)
৩. মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় (Cabinet Secretariat)।
৪. পুলিশের মহাপরিদর্শক (I.G.P.)। ১. প্রতিরক্ষা, যুদ্ধ, যুদ্ধের সরবরাহ। স্বরাষ্ট্র (Defence, War, War Supply, Interior) ২. পররাষ্ট্র (Foreign Affairs) ৩. অর্থ (Finance) খাদ্য, ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং বেসামরিক সরবরাহ (Food, Relief & Rehabilitation and Civil Supply) ৫. বাণিজ্য ও শিল্প (Commerce &Industries) ৬. সাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার (Health and Local Govt.) ৭. যোগাযোগ (Communications) ৯. তথ্য (Information) ১০. পূর্ত (ভবন, মহাসড়ক (Buildings, Highways)
১. কর্নেল ওসমানীর পদের মান (Posting of Col. Osmani)
এরপর প্রতিটি সভার কর্মসূচি, সিদ্ধান্ত এবং প্রধানমন্ত্রীর নােটের বাংলা অনুবাদ ক্রমিক অনুসারে নিচে দেওয়া হলাে। উপরের নােটে পরিষ্কার প্রতীয়মান হয় মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন কীভাবে করা হবে তার একটা রূপরেখা প্রধানমন্ত্রীর মনে ছিল। এছাড়াও সরকার যাতে দ্রুত দায়িত্ব গ্রহণ এবং কাজকর্ম পরিচালনা করতে পারেন সেজন্য সর্বপ্রথম স্থান নির্বাচন ও সচিবালয় স্থাপন বিশেষ গুরুত্ব পায়। ১৮ এপ্রিলের বৈঠকে বিষয়গুলি চূড়ান্তভাবে স্থির করা হয়। নিচে এগুলাে উল্লেখ করা হলাে।
১৩/৪/১৯৭১
১৩ এপ্রিলের সভার বিষয়গুলি ছিল:
১. সাহায্য
ক. সামরিক খ. বেসামরিক জনগণের জন্য খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ গ. অর্থ ঘ. নােট ছাপানাে
২. রাজনৈতিক
জনগণের মধ্যে নেতৃত্বের শূন্যতা। আওয়ামী লীগ-নেতৃবৃন্দ এবং নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদেরকে পূরণ করতে হবে অবিলম্বে।
৩. সামরিক সংগঠন
ক. নিয়মিত সামরিক বাহিনী খ. কর্মীবাহিনীকে উদ্বুদ্ধকরণ ৫টি ক্যাম্প স্থাপন প্রশিক্ষক নিয়ােগ (কারিগরী অর্থাৎ বিষয়ভিত্তিক প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং উপকরণ সরবরাহ)।
১৪/৪/১৯৭১
১৪ এপ্রিলের লেখায় শহীদ তাজউদ্দীন স্বহস্তে স্পষ্ট লিখেছেন:
১. মন্ত্রিসভার সদস্য অথবা মন্ত্রিসভা কর্তৃক ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যতিরেকে কোনাে ব্যক্তি ভারত সরকার, কোনাে রাজ্য সরকার অথবা কোনাে বিদেশি সরকার অথবা কোনােরূপ প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি বা সংবাদমাধ্যমের সাথে যােগাযােগ করবেন না এবং ভারতে অবস্থানরত কোনাে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি তার নিজ পরিচয় গােপন করে চলবেন।
পরিশিষ্ট ১১-তে প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা নােট দেখুন। তাঁর মূল ইংরেজি লেখা এত সুন্দর, এত সাবলীলভাবে লিখেছিলেন যে ভাবাই যায় না। এই লেখা দেখে বুঝেছিলাম যে এত লােক থাকতে বঙ্গবন্ধু অসহযােগ আন্দোলনের সময় কেন তাজউদ্দীন সাহেবকে দায়িত্ব দিয়েছিলেন নির্দেশাবলির মুসাবিদা প্রস্তুত এবং দৈনিক প্রেসনােট জারি করতে। নিচে মূল ইংরেজি লেখার বাংলা অনুবাদ দেওয়া হলাে।
২. ক্যাবিনেট কর্তৃক দায়িত্বপ্রাপ্ত না হলে কোনাে আওয়ামী লীগ নেতা বা নির্বাচিত প্রতিনিধি বা অন্য কোনাে ব্যক্তি বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করবে না। ৩. সরকার কর্তৃক নতুন নােট অথবা মুদ্রা না-ছাড়া পর্যন্ত দ্বৈত মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে। বাংলাদেশে মুদ্রা প্রস্তুত ও ছাপানাের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে পুরােনাে পাকিস্তানি নােটের ওপর বাংলাদেশের ছাপ দেওয়া হবে। ৪. প্রাক্তন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকরূপে কাজ করবে। ৫. ভারত এবং অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে সরকার পরিচালনার জরুরি এবং তাৎক্ষণিক ব্যয় নির্বাহে ঋণ পাওয়া যাবে। প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকার মতাে প্রয়ােজন হবে। ৬. বেসামরিক জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় খাদ্য সরবরাহ, লবণ, কেরােসিন, ভােজ্য তেল, দেয়াশলাই ইত্যাদি অতি জরুরিভাবে সংগ্রহ করতে হবে। ভারত-সরকারের সাহায্যে এই খাদ্যদ্রব্য বাংলাদেশের সীমান্ত অঞ্চল পর্যন্ত পরিবহণের ব্যবস্থা করতে হবে। সেখান থেকে দেশের অভ্যন্তরে সরবরাহের বিশেষ পথ খুলতে হবে। ৭. দৈনন্দিন এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি ন্যায্যভাবে বিতরণের জন্য রেশনিং ব্যবস্থা চালু করতে হবে। ৮. মুক্ত-অঞ্চলের জনগণের জন্য ওষুধ সরবরাহ, মহামারী রােগসমূহের জন্য টীকা, রােগবীজনাশক ওষুধ এবং অস্ত্রোপচার-এর যন্ত্রপাতির প্রাপ্যতা নিশ্চিত করতে হবে। যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা এবং বেসামরিক জনগণের জন্য সীমান্ত বরাবর সহায়ক (auxiliary) হাসপাতাল স্থাপন করতে হবে। ৯. নেতৃত্বদানের প্রশিক্ষণ (Leadership Training) এবং নির্দেশাবলি দিতে হবে। ক. উদীয়মান প্রতিশ্রুতিশীল ই.পি.আর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধস্তন অফিসার ও জোয়ানদের খ. প্রাক্তন সামরিক বাহিনী সদস্যদের; গ. আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর প্লাটুন কমান্ডারদের; ঘ. রাজনৈতিক বিশ্বাসে বলীয়ান যুবকদল এবং ইউ.ও.টি.সি সদস্যদের। নেতাদের জন্য জরুরি অপারেশনের প্রশিক্ষণ পৃথকভাবে ব্যবস্থা করতে হবে এবং তা হবে ক্রমান্বয়ে। ১০. সীমান্ত এলাকার যত কাছে সম্ভব সহজে যােগাযােগযােগ্য কিন্তু নিরাপদ দূরত্বে দেশ থেকে আগত প্রশিক্ষণার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করতে হবে।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
পৃষ্ঠা: ৭৫
১৫/8/১৯৭১
প্রধানমন্ত্রী বেশকিছু বিষয় লিপিবদ্ধ করেন ক্রমানুসারে। এগুলাে তাঁর কাজের তালিকা। লিখেছেন এইভাবে: (পরিশিষ্ট ২১ দ্রষ্টব্য)।
১. ক. বেসামরিক কর্মকর্তা এবং খ. পুলিশের সাথে যােগাযােগ স্থাপন। ২. টিপু, কমল হাসান। ৩. নূতন দিল্লির সাথে রাজনৈতিক সংযােগ। ৪. পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর সাথে যােগাযােগ রাখা। ৫. আইনগত সাহায্য, সচিবালয় গঠন, সহকারীবৃন্দ। ৬. প্রেস ব্রিফিং-এর কাজ এমনভাবে সমন্বয় করা যেন তারা শুধুমাত্র সরকারি ভাষ্য প্রচারের ব্যাপারে সহযােগিতা করেন। ৭. বিভিন্ন ভারতীয় সংস্থা বা ব্যক্তি বাংলাদেশকে যে সাহায় করবেন তা সরকারের অ্যাকাউন্টে জমা করতে হবে (?)। ৮. প্রশিক্ষণ ক্যাম্প কবে (?) ৯. লন্ডনে ভাবী। ১০. ওসমানী+আরেকজন, মি. সিদ্দিকী। ১১. মেজর ওসমান+এস.ডি.ও.+এস.ডি.পি.ও.। ১২. হাসান আলীর সাথে সংযােগ করতে হবে–১৮ এপ্রিলে সাক্ষাৎকার। ১৩. টেপ রেকর্ড।
ওপরের ক্রমিক (২)-এ যাঁদের নাম লেখা হয়েছে তারা সুবিদ আলী টিপু, এম.পি.এ. (ঢাকা) এবং ইঞ্জিনিয়ার কমল হাসান সিদ্দিকী, যিনি প্রত্যক্ষ যুদ্ধে একটি চোখ হারিয়েছিলেন। ক্রমিক (৭) ও (৮)-এ প্রশ্নবােধক চিহ্ন দিয়েছিলেন, খুব সম্ভবত তার এবিষয়ে সন্দেহ ছিল। লন্ডনে ভাবী, এটা কি বেগম মুজিব-কে লন্ডনে নিয়ে যাওয়ার কথা বুঝিয়েছেন? সম্ভবত, তাই হবে, আমার অনুমান। হাসান আলী কে তা জানতে পারিনি। টেপ রেকর্ডতাঁর বক্তব্য বা ভাষণ রেকর্ড করার জন্য।
সংক্ষিপ্ত বাক্যে তাঁর এসব নােট খুবই প্রণিধানযােগ্য। এই নােট সম্পর্কে গবেষকগণ তাদের পদ্ধতিতে হয়তাে আরাে বিস্তারিত জানাতে পারবেন, আশা করি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আমারই উপর আস্থা রেখে এসব ব্যক্তিগত নােট আমার নিকট হস্তান্তর করেছিলেন। তিনি কি বুঝতে পেরেছিলেন এসব নােট নিরাপদ স্থানে আস্থাভাজনের নিকট সংরক্ষণ করা জরুরি!
১৬/৪/১৯৭১
প্রধানমন্ত্রীর এই নােটটি ১৭ এপ্রিলের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের আগের দিন। শুধু আলােচনার জন্য কয়েকটি বিষয় লেখা রয়েছে। (পরিশিষ্ট ২২ দ্রষ্টব্য)।
১. জনাব মালেক উকিল ২. বক্তব্য পাঠ ৩. পােষাক ৪. নিরাপত্তার ব্যবস্থা- আমাদের নিজস্ব। বন্ধুদের যেন দেখা না পাওয়া যায়। ৫. অনুষ্ঠানটি যেন সাজানাে মনে না হয়। সাংবাদিকদের সাথে যােগাযোেগ।
১৭/৪/১৯৭১
একই তারিখে প্রধানমন্ত্রী ডায়েরির পাতায় নিচের বিষয়গুলাে লিখেছেন। (আগেই উল্লেখিত ১৫ সংখ্যক পরিশিষ্টের শেষাংশ দ্রষ্টব্য)।
কর্নেল ওসমানী
১. বিভিন্ন সরকারি ট্রেজারি থেকে দ্রুত অর্থ সংগ্রহ করে নিরাপদ স্থানে আনয়ন।
২. যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন।
৩. বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন।
৪. দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক জনগণের জন্য নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ-লবণ, ভােজ্য তেল, চাল, দেয়াশলাই।
৫. সরবরাহ লাইন সংরক্ষণ (Line of Supply)
চট্টগ্রাম জেলা – রামগড়-সাবরুম
নোয়াখালী – পরশুরাম-বেলােনিয়া
কুমিল্লা- সিংগাইরবিল, কসবা, কমলসাগর
সিলেট- কৈলাশহর, তেলিয়াপাড়া, সূত্রনগর-ধর্মনগর
ময়মনসিংহ – তােরা
খুলনা- বনগাঁও, বশিরহাট
যশাের – বেনাপােল
উত্তরবঙ্গের জেলাসমূহ – বালুরঘাট, শিলিগুড়ি, গােলকগঞ্জ
৬. আমাদের উৎপাদিত ফসল/দ্রব্যাদির বিক্রয়—চা, পাট, মাছ, কাগজ, শুটকি মাছ, চামড়া।
৭. বিভিন্ন সংস্থা/সংগঠন কর্তৃক ভারতে সংগৃহীত অর্থ বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে যেতে হবে।
৮. ভারত থেকে ১০ কোটি রুপির ব্যবস্থা।
৯. মুদ্রা—পাকিস্তানি মুদ্রা/কারেন্সি (currency) ভারতীয় মুদ্রায় বদলানাে (exchage) এবং আমাদের নিজস্ব currency-র তারল্য বজায় রাখা।
১০. কূটনৈতিক আলােচনা
ক. ড.এ.আর. মল্লিক খ. মি.এ.কে.খান গ. ড. এস. মুরশেদ ঘ. ড. এ. করিম ঙ. মাহবুব আলম
১১. Care (কেয়ার) লন্ডন আর্থিক এবং পণ্য সাহায্য
১২. এক লক্ষ রুপীর একটি ইমপ্রেস্ট ফান্ড জরুরিভাবে সচিবালয় স্থাপনের জন্য।
১৩. এস. আলমকে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়ােগ।
১৪. শর্টওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার চালুমিডিয়াম ওয়েভের পরিবর্তে একটি।
১৫. সরবরাহ ব্যবস্থা বা লাইন অবশ্যই চালু রাখতে হবে।
১৬. আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ।
উপরের এসব প্রসঙ্গ (points) প্রধানমন্ত্রী লিখেছিলেন কর্নেল ওসমানীর বক্তব্য এবং সুপারিশ লিপিবদ্ধ করে।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সভায় যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তার বিবরণ নিজেই লিখেছিলেন। তাঁর স্বহস্তে লেখা সিদ্ধান্ত সমূহের বিবরণ নিচে দেওয়া হলাে। প্রাসঙ্গিকভাবে এই গ্রন্থের ১২ সংখ্যক পরিশিষ্ট দেখা যেতে পারে।
১. মন্ত্রণালয় বণ্টন:
জনাব তাজউদ্দীন আহমদ-প্রধানমন্ত্রী
ক. প্রতিরক্ষা। খ. তথ্য ও বেতার এবং টেলিযােগাযােগ। গ. অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন। ঘ. শিক্ষা, স্থানীয় সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম, সামাজিক উন্নয়ন। ঙ. সংস্থাপন এবং প্রশাসন। চ. অন্য সকল বিষয় যা কোনাে মন্ত্রীকে বণ্টন করা হয় নাই।
খন্দকার মােশতাক আহমেদ
ক. পরারাষ্ট্র মন্ত্রণালয় খ. আইন ও সংসদ বিষয়াবলি।
ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী
ক. অর্থ ও রাজস্ব। খ. বাণিজ্য ও শিল্প। গ. যােগাযােগ।
জনাব.এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান
ক. স্বরাষ্ট্র। খ. সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন। গ. কৃষি।
২. বেসামরিক কর্মচারীদের বাংলাদেশ সরকারের কোষাগারের অবস্থা অনুযায়ী নিচের হারে বেতন দেওয়া হবে:
ক. চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণী–পূর্ণ বেতন খ. দ্বিতীয় শ্রেণী: শতকরা ২০(%) হার কম কিন্তু সর্বোচ্চ ৪০০/= প্রতি মাসে গ. প্রথম শ্রেণী: শতকরা ২৫ (%) হার কম কিন্তু সর্বোচ্চ ৫০০/= প্রতি মাসে
(স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম)।
৩. জনাব এম.আর. সিদ্দিকীকে পূর্বাঞ্চলের কর্মচারীদের বেতন বিতরণের ক্ষমতা দেয়া হলাে। তিনি ঐ অঞ্চলে রক্ষিত বাংলাদেশের অর্থ থেকে বেতন দেবেন। আরও সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে যে জনাব এম.আর. সিদ্দিকী বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারূপে সাহায্য করবেন।
৪. ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একটি বৈঠক অতি সত্বর আয়ােজন করতে স্থানীয় সংযােগকারীকে অনুরােধ করা হবে।
৫. সিদ্ধান্ত হলাে যে-প্রধান সেনাপতি সাহায্যকারী কর্তৃপক্ষের সহায়তায় বিভিন্ন কার্যকর ভূমিকায় নিয়ােগের জন্য বাংলাদেশের ছাত্র ও যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবেন। সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক (মণি), সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ এবং আবদুর রাজ্জাককে প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ নিতে ক্ষমতা দেওয়া হলাে।
৬. জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরীকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক শক্তিকে সচল ক’রে রাজনৈতিক প্রতিরােধের দায়িত্ব দেওয়া হলাে।
৭. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন ব্যাংক এবং ট্রেজারিতে গচ্ছিত অর্থ যাতে শত্রুর হাতে না পড়ে সেজন্য প্রধান সেনাপতির পরিকল্পনা অনুমােদন করা হলাে। দুজন অফিসারের সমন্বয়ে একটি বাের্ড গঠন করা হলাে যারা এই অর্থ সংগ্রহ করে যথােপযুক্ত রশিদ রেখে নিরাপদ এলাকার বন্ধুদের নিকট গচ্ছিত রাখবেন।
৮. সমন্বয়কারীর সাথে বন্দোবস্ত অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী মহােদয়ের ব্যক্তিগত নামে একটি ব্যাংক অ্যাকাউন্ট খুলতে হবে।
শপথ গ্রহণের ঠিক পরের দিন, অর্থাৎ ১৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত এই মন্ত্রিসভার বৈঠক শুধু সুদুরপ্রসারী নয়, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণও বটে। দপ্তর বণ্টনের সাথে সাথে যুব মুক্তিবাহিনী গঠন; বাংলাদেশের অ্যাকাউন্ট স্থাপন, মিজান চৌধুরী ও সিদ্দিকী সাহেবকে বিশেষ দায়িত্ব প্রদান, সরকারি কর্মচারীদের বেতনের হার নির্ধারণ ও প্রদান-এইসব সিদ্ধান্ত শুধু মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নয়, পরবর্তীকালে বিভিন্ন সরকারি নীতিমালা প্রণয়ন, রাজনৈতিক সংগঠন ও ঘটনাবলির ওপর প্রভাব ফেলেছে।
ক. হাজী নূর বকস খ. শেখ আবদুল আজিজ গ. বাদশাহ ঘ. ফরিদপুর ঙ. ছাত্রবৃন্দ চ. আওয়ামী লীগের সদস্যবৃন্দ ছ. অস্ত্র ও গােলাগুলি সংগ্রহে সংগঠিত বেসরকারি (private pressure groups) চেষ্টা।
১৮/8/১৯৭১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সভায় চারজন মন্ত্রীর দপ্তর বণ্টনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। নিম্নলিখিতভাবে মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে এসব বিষয় সভা-অনুষ্ঠানের আগেই তার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলেন। পূর্ববর্তী পৃষ্ঠায় তা উল্লেখ করা হয়েছে। নিচে মন্ত্রিসভার সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত হিসেবেও একই বিষয় উল্লেখ করা হলাে এইজন্য যে, প্রধানমন্ত্রী তাঁর অবসর মুহূর্তে যেসব বিষয় চিন্তা-ভাবনা করে লিখতেন তাই-ই তিনি মন্ত্রিসভার সভায় নিয়মিতকরণ করে নিতেন সরকারি ভিত্তি দেওয়ার জন্য। তার এই কার্যপ্রণালী থেকে একজন দক্ষ ও প্রাজ্ঞ প্রশাসকের চিত্র ফুটে উঠেছে। মন্ত্রিসভার বিভাগ থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সভার সিদ্ধান্ত নিম্নরূপভাবে অবহিত করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট ২৩ দ্রষ্টব্য):
মি, তাজউদ্দীন আহমদ-প্রধানমন্ত্রী
ক. প্রতিরক্ষা খ. তথ্য, বেতার ও যােগাযােগ গ. অর্থনৈতিক বিষয়, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন। ঘ. শিক্ষা, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসন সরকার, স্বাস্থ্য, শ্রম ও সমাজকল্যাণ ঙ. যেসব বিষয়ের দায়িত্ব মন্ত্রিসভার অন্য কোনাে সদস্যকে প্রদান করা হয়নি।
মি. খন্দকার মােশতাক আহমেদ
ক. পররাষ্ট্র বিষয় খ. আইন ও সংসদ বিষয়
মি. এম. মনসুর আলী
ক. অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব খ. বাণিজ্য ও শিল্প।
গ. পরিবহণ
মি. এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান
ক. অভ্যন্তরীণ খ. সরবরাহ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন গ. কৃষি
এদিনের সভায় অন্যান্য যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেগুলির মধ্যে সরকারি কর্মচারীদের বেতন-ভাতা প্রদানের বিষয় বেশ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। এঁদের বেতনাদি শত্রু-অধিকৃত বাংলাদেশ ট্রেজারি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দ্বারা মেটানাের সুপারিশ করা হয়। প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কীভাবে ও কী পরিমাণ মাসিক বেতন হবে তার হার নির্ধারিত হয়।
মি.এম.আর. সিদ্দিকীকে বাংলাদেশের পূর্ব সেক্টরে সংগৃহীত অর্থে সরকারি কর্মচারীদের বেতন প্রদানের কর্তৃত্ব দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অধিকন্তু, বাণিজ্য ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টারূপে তাঁকে দায়িত্ব পালনের অনুরােধ জানানাে হয়। ঐদিনের আর-একটি সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে অতি দ্রুত ভারতের প্রধানমন্ত্রীর একটি বৈঠকের আয়ােজনের বিষয়ে স্থানীয় যােগাযােগ-রক্ষাকারীদের সঙ্গে কথা বলতে হবে। ছাত্র ও যুবশক্তিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন দায়িত্ব দেওয়ার জন্য সহায়তাকারীকর্তৃপক্ষের সহযােগিতায় কমান্ডার-ইন চিফ পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং সর্বজনাব শেখ ফজলুল হক (মণি), সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ ও আবদুর রাজ্জাক এতদবিষয়ে প্রয়ােজনীয় কাজ করার দায়িত্বপ্রাপ্ত হন। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগের তৎপরতা জোরদার ও সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য মি.মিজানুর রহমান চৌধুরীকে দায়িত্ব প্রদান করে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
অপর এক সিদ্ধান্তে শক্রর হস্তগত হওয়ার আগেই বাংলাদেশের ব্যাংক ও ট্রেজারির ভাণ্ডার থেকে দ্রুত অর্থ সংগ্রহের জন্য কমান্ডার-ইন-চিফের প্রণীত পরিকল্পনা অনুমােদিত হয়। সশস্ত্র বাহিনীর দুজন কর্মকর্তার সমন্বয়ে গঠিত বাের্ড এই অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করে তা নিরাপদ এলাকায় বন্ধুদের নিকট যথােপযুক্ত রশিদ রেখে গচ্ছিত রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
পৃষ্ঠা: ৮০
অর্থমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নামে ব্যাংকের হিসাব খােলার সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়। ত্রাণ তৎপরতা সুসমন্বিত ও প্রবহমাণ করার লক্ষ্যে একটি রিলিফ কমিটি নিম্নলিখিভাবে গঠনের সুপারিশ গৃহীত হয়:
১. ত্রাণ মন্ত্রী- চেয়ারম্যান (পদাধিকার বলে)
২. অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী- সচিব
৩. আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী- সদস্য
৪. মি.এ. সামাদ- সদস্য
৫. মি. সােহরাব হােসেন- সদস্য
আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, সাধারণত তহবিল থেকে পৃথক একটি রিলিফ-হিসাব খােলা হবে যার নাম হবে, বাংলাদেশ সাহায্য তহবিল (Bangladesh Relief Fund) এবং কমিটির চেয়ারম্যান ও সচিব যৌথভাবে অথবা পৃথকভাবে এই হিসাব পরিচালনা করবেন।
২৩/৪/১৯৭১: (পরিশিষ্ট ২৪)
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ:
১. মি.এম.এ. সামাদ, এম.এন.এ- কে মন্ত্রিসভার রাজনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়েছে।
২. মি.এ.মান্নান, এম.এন.এ.- কে জনসংযােগ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত সদস্য নিযুক্ত করা হয়েছে এবং
৩. মি. আমীর-উল-ইসলাম, এম.এন.এ.-কে প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা নিযুক্ত করা হয়েছে।
জনাব আবদুস সামাদ আজাদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সমগ্র ভারতবর্ষ এবং বহির্বিশ্বে, বিশেষ করে পূর্ব-ইউরােপ স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার করেছেন। নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে সাক্ষাৎ করে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছেন। বিশ্ব শান্তি পরিষদ (World Peace) এবং শ্রমিক ও বামপন্থী নেতৃবৃন্দের সাথে তার বিশেষ সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
জনাব এম. এ. মান্নান প্রচারের পুরাে দায়িত্বই নিয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, জয়বাংলা পত্রিকা এবং বিভিন্ন পােস্টার, লিফলেট, পত্র-পত্রিকা প্রকাশের দায়িত্ব ছিল তাঁর। দপ্তর ছিল বালিগঞ্জ সংলগ্ন পার্ক সার্কাসের বালু হক্কক লেনে।
জনাব আমীর-উল-ইসলাম (ব্যারিস্টার), তাজউদ্দীন আহমদের ঘনিষ্ঠ সহযােগী ছিলেন। তিনি অধিকাংশ সময় নিজেকে রহমত আলী বলে পরিচয় দিতেন। হয়তাে তার এমন কতকগুলি দায়িত্ব ছিল যার জন্য ভিন্ন নামে পরিচয় দিতে হতাে। তবে তিনি- যে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ সহকারী এটা আমরা মন্ত্রিসভার বিভাগের সকল কর্মকর্তাকর্মচারীসহ সরকারের অন্যান্য সকলেই জানতাম।
জনাব আজাদ এবং আমীর-উল ইসলাম প্রায়ই বাইরে থাকতেন। আজাদ সাহেব বিদেশ থেকে প্রত্যাবর্তন করেই প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভাকে তাঁর অভিজ্ঞতা ও অন্যান্য বিষয়ের বিবরণ (briefing) প্রদান করতেন। আবার কোনাে কোনাে সময় প্রধানমন্ত্রী অথবা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বিশেষ বার্তা বহন করতেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দের নিকট।
উপরােক্ত তিন ব্যক্তিই ১৯৭২ সালে মন্ত্রিসভায় স্থান পান। সামাদ আজাদ সাহেব পররাষ্ট্র মন্ত্রী (পরে কৃষি), মান্নান সাহেব তথ্য (পরে স্বাস্থ্য) এবং আমীর-উল-ইসলাম সাহেব প্রতিমন্ত্রী হন।
২৯/৪/১৯৭১
উপযুক্ত তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ (পরিশিষ্ট ২৫)। ২৯ এপ্রিল মন্ত্রিসভার সভা দু-দফায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। নিচে উক্ত দুটি সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত উল্লেখ করা ছাড়াও প্রধানমন্ত্রীর স্বহস্তে লেখা তার ডায়েরির পাতার টোকাও (notes) উল্লেখ করা হলাে।
(প্রথম দফা সিদ্ধান্ত)
১. বাংলাদেশ টাকার আমানত (deposit) আদায় (collect) করে তা স্থানীয় মুদ্রায় অবিলম্বে বিনিময় (exchange) করতে হবে।
২. শান্তি-আলােচনায় বাংলাদেশকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্য মি. সামাদকে নির্বাচিত করা হলাে। তাঁকে অপর একজন প্রতিনিধি সহায়তা প্রদান করবেন।
৩. প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী মি. নাহার ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সঙ্গে যােগসূত্র (liaison) রক্ষা করবেন।
৪. সশস্ত্র বাহিনী প্রসঙ্গে এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কমান্ডার-ইন-চিফ মুজিবনগরে উপস্থিত সকল কর্মকর্তার একটি বিবরণী প্রস্তুত করবেন। সশস্ত্রবাহিনীর কর্তৃত্ব (command) একক নিয়ন্ত্রণ ও কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশ বাহিনীতে উপযুক্ত প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচনের সময় যথােপযুক্ত সতর্কতা অবলম্বন করা হবে।
৫. তথ্য ও বেতারে একটি তিন-সদস্যবিশিষ্ট কমিটি নিয়ােগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মি. এম. এ. মান্নান এমএনএ-র নাম কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে বিবেচিত হয়।
৬. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল নির্বাচিত সদস্য এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য প্রত্যেকে মাসিক ১৫০/= টাকা হারে ভরণপােষণের (maintenance) জন্য পাবেন। সদস্যগণকে এই মর্মে পরামর্শ দেওয়া হয় যে, তারা যেন বাংলাদেশের জনগণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন এবং তাঁদের, বিশেষ করে সদস্যগণের নিজ এলাকার মানুষের দুর্গতি লাঘবে সম্ভাব্য সকল প্রচেষ্টা নেন।
৭. মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত নেন যে, অতি জরুরি পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে রাজস্ব তহবিল থেকে অগ্রিম প্রদান করা যেতে পারে।
(দ্বিতীয় দফা সিদ্ধান্ত)
১. রাজনৈতিক কর্মতৎপরতার অর্থ যােগান দিতে মি. মহসিনের নামে হিসাব খােলার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ত্রাণ-তহবিলের একটি অংশ এতদুদ্দেশ্যে প্রদান করতে মি. মহসিন মন্ত্রিসভার নিকট হিসাব পেশ করবেন।
২. স্টকহােমে ১৩-১৬ মে পর্যন্ত অনুষ্ঠেয় শান্তি-আলােচনায় মি. সামাদ প্রতিনিধিদ্ব করবেন। একজন সহায়তাকারী (aide) নির্বাচন করতে হবে, মি.এ. ইসলামকে ছাড়া যায় কি না বিবেচনা করতে হবে।
৩. স্বীকৃতির বিষয়ে মি. নাহারের সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাক্ষাৎ করা উচিত। অন্যান্য রাজনৈতিক যােগাযােগ স্থাপন করা উচিত।
৪. কমান্ডার-ইন-চিফের সঙ্গে যােগাযােগ করতে হবে। যেসব কর্মকর্তা উপস্থিত হয়েছেন তাদের সকলকে একসূত্রে আনা প্রয়ােজন এবং কঠোরভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। কাকে এবং কিভাবে প্রশিক্ষণার্থী নির্বাচন করা হয়েছে?
৫. প্রচার ও বেতারের জন্য গঠিত তিন-সদস্যবিশিষ্ট কমিটির চেয়ারম্যান হবেন মি. মান্নান।
৬. নির্বাচিত সদস্য এবং কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যগণ ভরণপােষণের জন্য প্রতি মাসে ১৫০/= টাকা পাবেন (সীমান্ত-সংলগ্ন সদস্যগণ)।
৭. মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে পরিশােধযােগ্য (repayable) ঋণ(loans) বাংলাদেশ সরকার দিতে পারবেন।
৮. বাংলাদেশ টাকার আমানত আদায় এবং তা ভারতীয় মুদ্রায় পরিবর্তন করতে হবে।
৯. বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ হিসেবে কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীর নিয়োেগ অনুমােদিত হলাে।
শুধু ওপরে তারিখ এবং নিচে ক্রমিক নম্বর দিয়ে বিষয়বস্তু এবং সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করা আছে, প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা: ১ থেকে ১২। মাঝখানে ১০ নম্বরের হদিস পাইনি। ক্রমিক নম্বর ১১ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বিধায় পৃথকভাবে আলােচনা করেন। কিন্তু এটি ২ বার একটু রদবদল করে লেখা। ১ নম্বর-এর পাশে ক্রসচিহ্ন। হয়তাে অনুমােদিত হয়নি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর আছে তিন বার অত্যন্ত স্পষ্টভাবে।
১. জনাব মােহসিনের নামে একটি একাউন্ট খুলতে হবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অর্থ জোগান দেওয়ার জন্য। ত্রাণ-তহবিলের একটি অংশ এজন্য দেওয়া হবে। জনাব মােহসিন মন্ত্রিসভায় তার হিসাব উপস্থাপন করবেন।
২. স্টকহােমে ১৩ থেকে ১৬ মে তারিখে অনুষ্ঠিতব্য শান্তি পরিষদ (World Peace) কনফারেন্সে জনাব সামাদ বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন। তাঁর সাথে একজন সহকারী থাকবেন। জনাব ইসলামকে পাঠানাে যায় কিনা।
৩. প্রধানমন্ত্রী এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্বীকৃতির বিষয়ে মি.নাহারের* সাথে দেখা করবেন। অন্যান্য রাজনৈতিক যােগাযােগ করতে হবে।
৪. প্রধান সেনাপতির সাথে যােগাযােগ করতে হবে। অফিসারদের** তালিকা প্রণয়ন করা প্রয়ােজন। এক (unified) কমান্ডের অধীনে সকলকে আনতে হবে – সমন্বিত অর্থাৎ এই কমান্ডে কঠোরভাবে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে। প্রশিক্ষণার্থী কারা এবং কিভাবে তাদের বাছাই করা হয়েছে?
৫. প্রচার ও বেতার-এর জন্য জনাব মান্নানকে সভাপতি করে তিন সদস্যবিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হলাে।
৬. নির্বাচিত প্রতিনিধি এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যদের জন্য মাসিক ১৫০/= টাকা (রুপি) ভাতা নির্ধারণ করা হলাে। সদস্যদের সীমান্ত এলাকায় থাকতে হবে।
৭. সরকারের তহবিল থেকে মন্ত্রিসভার সদস্যদের পরিশােধযােগ্য ঋণ মঞ্জুর করা যেতে পারে।
৮. বালাদেশের গচ্ছিত অর্থ সংগ্রহ করে ভারতীয় মুদ্রায় বিনিময় করতে হবে।
…………………………………..
* মি. নাহার ভারত-সরকারের সাথে যােগসূত্র বা লিয়াজো ছিলেন।
** এখানে খুব সম্ভবত মুক্তিযুদ্ধকালীন নিয়ােগপ্রাপ্ত প্রথম শর্ট কমিশনের অফিসার বা রিক্রুটদের সম্পর্কে ইঙ্গিত করা হয়েছে। এই ব্যাচে ১৯৭১ সালে কমিশনপ্রাপ্ত হয় এবং স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রভূত শৌর্যবীর্যের পরিচয় দেন। কয়েকজন শহীদও হন। শিলিগুড়ি (জলপাইগুড়ি, কাছে মূর্তি নামক স্থানে প্রশিক্ষণ-শিবির ছিল। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এদের পাসিং আউট কুচকাওয়াজ-এ সালাম নেন ও সার্টিফিকেট এবং পদক দেন। আমার ব্যক্তিগত বিরাট একটা তৃপ্তির বিষয় এই যে, ঐ ব্যাচের অর্থাৎ স্বাধীন বাংলার প্রথম কমিশনপ্রাপ্ত অফিসারদের সার্টিফিকেট সরকারের পক্ষে আমি দস্তখত করেছিলাম। “Unified”chain of command-এর বিষয়টি কর্নেল ওসমানীর বিশেষ উদ্বেগের কারণ ছিল বিধায় মন্ত্রিসভা এই সিদ্ধান্তটি নেন। মুজিববাহিনীর সদস্যরা কিছুতেই তাঁর কমান্ডে না আসাতে প্রভূত সমস্যা হচ্ছিল।
…………………………………………..
৯. ত্রাণ ও পুনর্বাসনের কাজ সমন্বয় ও সঠিক খাতে ব্যয়ের জন্য একটি রিলিফ কমিটি গঠন করা হলাে, যার সদস্য নিম্নরূপ:
ক. ত্রাণ মন্ত্রী – চেয়ারম্যান (পদাধিকার বলে) খ, অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলী – সচিব গ. আলহাজ জহুর আহমদ চৌধুরী – সদস্য ঘ. মি.এ. সামাদ – সদস্য ঙ. মি. সােহরাব হােসেন – সদস্য
আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, সাধারণত তহবিল থেকে পৃথক একটি রিলিফ-হিসাব খােলা হবে যার নাম হবে, বাংলাদেশ ত্রাণ তহবিল (Bangladesh Relief Fund)’ এবং কমিটির চেয়ারম্যান ও সেক্রেটারি যৌথ অথবা এককভাবে এই অ্যাকাউন্ট পরিচালনা করবেন।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
২৯/৪/৭১
১১। কর্নেল আতাউল গনি ওসামানীকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বাংলাদেশ বাহিনীর প্রধান সেনাপতি (Commander-in-Chief) পদে নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
১২। লে. কর্নেল আবদুর রবের বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
২৯/৪/৭১
খুব সম্ভবত উপরের ১১ ও ১২ ক্রমিক নম্বরে উল্লেখিত সিদ্ধান্তদ্বয়ের গুরুত্বের কারণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঐদিনের (২৯/৪/৭১) সিদ্ধান্তে দুইবার স্বাক্ষর করেন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে খুব ঘন ঘন মন্ত্রিসভার সভা অনুষ্ঠিত হতাে। এপ্রিল মাসের মতাে মে (১৯৭১) মাসেও এমন অনেক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এসব সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্তসমূহ প্রধানমন্ত্রী গােপনীয়তা রক্ষার স্বার্থে নিজ হাতেই লিখতেন। উল্লেখ্য, উপরের ৯ সংখ্যক সিদ্ধান্ত পূর্বে ১৮ এপ্রিলে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় গৃহীত হয়েছিল।
সরকারের কার্যক্রম পরিচালনায় মন্ত্রিসভার সভার সকল সিদ্ধান্ত ও সুপারিশ গুরুত্বপূর্ণ। এবং ঐতিহাসিক এসব সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব অপরিসীম। মুজিবনগরে গঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সব কটি মন্ত্রণালয় তাদের স্ব স্ব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করত। মন্ত্রিসভা ২ মে এবং ৫ মে তারিখে অনুষ্ঠিত সভা দুটিতে বঙ্গবন্ধুর বন্দিদশা সম্বন্ধে উদ্বেগ এবং তার মুক্তির জন্য ব্যবস্থাগ্রহণ সংক্রান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সিদ্ধান্তগুলি ছিল নিম্নরূপ।
২/৫/১৯৭১
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সকল পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে (পরিশিষ্ট ২৬)।
৫/৫/১৯৭১
মন্ত্রিসভার ৫ মে তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু অবস্থান সম্বন্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে আরাে একটি সিদ্ধান্ত (পরিশিষ্ট ২৭ দ্রষ্টব্য) গৃহীত হয়। সিদ্ধান্তটি ছিল নিম্নরূপ:
মন্ত্রিসভা এই মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, বঙ্গবন্ধুর শেখ মুজিবুর রহমানের অবস্থান সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে। পাকিস্তান সরকারের দাবি অনুযায়ী মহান নেতার গ্রেফতারের খবর সত্যি হলে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সরকার সম্ভাব্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।
আরাে একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ২ মে তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় নেওয়া হয়েছিল। সরকারের স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন স্বাস্থ্য বিভাগের মহাপরিচালক হিসেবে ডা. টি. হােসেনকে নিয়ােগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
বঙ্গবন্ধু-সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত ছাড়াও ৫ মে তারিখের সভায় অন্যান্য সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ:
ক. তহবিল ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে এই মর্মে সিদ্ধান্ত হয় যে, ভারত সরকার কর্তৃক প্রদত্ত অগ্রিম ঋণসমূহ অনতিবিলম্বে অর্থমন্ত্রির হিসাবে স্থানান্তর করতে হবে। জমাদানকারীর নাগরিকত্ব নিয়ে এবং এক্ষণে তহবিলের ভবিষ্যৎ নিয়ে কোনাে প্রশ্ন নেই।
খ. দিল্লি সফরের সময় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও অর্থমন্ত্রী মহােদয় প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দপ্তরসমূহ তদারক করবেন।
গ. মন্ত্রিবৃন্দের বাসস্থান স্থানান্তরের বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অর্থমন্ত্রীকে ক্ষমতাপ্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হলাে। এতদুদ্দেশ্যে তাঁকে অপরপক্ষে কিছু কর্মকর্তার সঙ্গে যােগাযোেগ করতে অনুরােধ জানানাে হয়।
ঘ. প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর অনুপস্থিতিকালে মুজিবনগরে উপস্তিত মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে ৬ জন আওয়ামী লীগ সেক্টর লিডার নির্বাচিত করার ক্ষমতা অর্পণ করা হলাে।
এসব সিদ্ধান্তের কথা অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবদের সরকারের মেমাে মারফত জানিয়ে দেওয়া হয়।
১৬/৫/১৯৭১
মন্ত্রিসভার ১৬ মে তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভায় সকল সদস্যই উপস্থিত ছিলেন।
১. দিল্লি সফরের ওপর প্রতিবেদন। ২. প্রধান সেনাপতির নানাবিধ সমস্যা। ৩. প্রধান সেনাপতি কর্তৃক উপস্থাপিত বীরত্বের পুরস্কার প্রস্তাবনা অনুমােদিত। ৪. ইতিমধ্যে যুদ্ধে শহীদ যােদ্ধা এবং ভবিষ্যতেও যারা শহীদ হতে পারেন তাঁদের পরিবার/ পােষ্যদের দেখাশুনার দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। এদের বিধবা স্ত্রী অথবা পােষ্যদের পেনশন ভাতা দেওয়া হবে।
অতি সংক্ষেপে লিপিবদ্ধ এই সিদ্ধান্ত গুরুত্বপূর্ণ এবং অত্যন্ত গােপনীয় বিধায় এভাবে লিখিত হয়।
পূর্বেই উল্লেখ করেছি মন্ত্রিসভার সভা ঘন ঘন অনুষ্ঠিত হতাে। এসব সভায় কী কী বিষয় আলােচিত হবে তার সূচি প্রধানমন্ত্রী নিজ হাতে লিখে ঠিক করতেন। নিচে একটি সভার
পৃষ্ঠা: ৮৫
আলােচ্যসূচি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা হলাে। পরিশিষ্ট অংশে প্রধানমন্ত্রীর হাতে লেখা সূচি দেখা যেতে পারে।
একটি আলােচ্যসূচি এবং ব্যক্তিগত নােট:
১. শেখ সাহেব ২. এম. আলম এবং টি. ঠাকুর – রিলিফ ৩. জেনারেলদের সভা সন্ধ্যা ৬টায় ৪. দিল্লি যাত্রা ৫. পররাষ্ট্রমন্ত্রী যােগাযােগ করবেন ৬. ডা. টি. হােসেন বাংলাদেশ হেলথ সার্ভিসের ডিরেক্টর জেনারেল
২২/৬/১৯৭১
জুন মাসের ২২ তারিখ সকাল ১০ টায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভার কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত ছিল নিম্নরূপ (পরিশিষ্ট ২৮ দ্রষ্টব্য):
সকল মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি উপস্থিত
১. শত্রুকে মােকাবিলার জন্য সশস্ত্র ব্যক্তিদের নিয়ােগের চেষ্টা। ২. বিভিন্ন সরকারি দপ্তর কর্তৃক পরস্পরবিরােধী আদেশ জারি; মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অমান্য করে প্রতিরক্ষা স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর। ৩. দায়িত্বপ্রাপ্ত এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ.-গণ অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রশিক্ষণার্থীদের ছাঁটাই বাছাইয়ের কাজ সুষ্ঠুভাবে করছেন না। এতে করে শত্রুদের অনুপ্রবেশ ঘটেছে। ৪. যুবশিবির সংস্থা মাত্র একটি মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে; ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ এই চেষ্টা করবেন না যাতে সঙ্গতি নষ্ট হয়। পােষাক এবং হেলমেটের সমস্যা।
ক. যুব শিবির পরিকল্পনা/ছক অনুমােদন করা হলাে।
ঐদিন সন্ধ্যা ৬টায় পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা হয়। কিন্তু অনিবার্য কারণে তা অনুষ্ঠিত না-হওয়ায় কোনাে আলােচনা হয় নাইমন্তব্য নােট করা হয়েছে। মন্ত্রিসভার কাজকর্ম করতে গিয়ে এসব বিষয়ও সতর্কতার সঙ্গে মনে রাখতে হয়েছে। পরবর্তী সময়ে এ-সম্বন্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে কি-না অথবা হচ্ছে কি-না তা মনে রাখতে এমন ধরনের নােট লিখে রাখা হতাে।
২৩/৬/১৯৭১
২৩-৬-৭১ তারিখ সকাল ১০টায় এবং ২৪-৬-৭১ তারিখ সকাল ১০টায় অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত। এই সভায় সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। (পরিশিষ্ট ২৯ দ্রষ্টব্য)।
ক. পরিবর্তিত আকারে যুবশিবির প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমােদিত। খ. এম.এন.এ এবং এম.পি.এ.- দের চলাফেরা এবং ছােটখাটো ব্যয় নির্বাহের জন্য মাসে
৫০/=রুপি মঞ্জুর করা হলাে।
২৪/৬/১৯৭১ সকাল ১০টা
ক. পাঁচটি অঞ্চল (Zones) নিয়ে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ (Zonal Administrative Council) ব্যবস্থা অনুমােদন করা হলাে। প্রতিটি জোনে অবস্থানরত নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত এই পরিষদ মন্ত্রিসভার নীতি ও নির্দেশাবলি বাস্তবায়ন করবেন। পরিষদ নিজেদের মধ্য থেকে একজনকে চেয়ারম্যান নির্বাচন করবে এবং আঞ্চলিক প্রশাসক এই পরিষদের সদস্য-সচিবরূপে কাজ করবেন।
খ. প্রেসিডেন্টের যুদ্ধ তহবিল: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ
১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম –অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ২. তাজউদ্দীন আহমদ – প্রধানমন্ত্রী। ৩. খন্দকার মােশতাক আহমেদ – পররাষ্ট্র মন্ত্রী ৪. মি. ফণি ভূষণ মজুমদার, এম.পি.এ ৫. মি. এম.আর. সিদ্দিকী, এম. এন.এ
১৭/৭/১৯৭১ বিকেল ৫.৩০টায় অনুষ্ঠিত
(পরিশিষ্ট ৩০ দ্রষ্টব্য)
সকল সদস্য ও প্রধান সেনাপতি উপস্থিত।
(জনাব মনসুর)
১. প্রতিরক্ষা ব্যতীত অন্যান্য বিষয় আলােচনার জন্য মন্ত্রীসভার বৈঠক হবে প্রতি সােমবার। শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বিষয়াদি আলােচনার জন্য শুক্রবার নির্ধারিত হলাে।
২. ১০ থেকে ১৫ জুলাইতে অনুষ্ঠিত সেক্টর কমান্ডারদের সভার প্রেক্ষিতে প্রধান সেনাপতি বিশেষ প্রতিবেদন পেশ করলেন।
৩. (৭) বেতার-প্রচার
সংবাদ
প্রচারকাজ ছবি (ফিল্ম) লিখিত
সরকারি বিজ্ঞপ্তি
৪. (৬) আঞ্চলিক প্রশাসন কাঠামাে। ৮টি অঞ্চল (zone) অনুমােদন করা হলাে। তবে প্রয়ােজনবােধে আগরতলা অঞ্চলকে খণ্ডিত করা যাবে।
৫. (৫) যানবাহন-ব্যক্তি মালিকানাধীন গাড়ি সরকারি কাজে ব্যবহৃত হলে ভাড়া দিয়ে ক্ষতিপূরণ করতে হবে।
৬. (৪) স্থগিত
৭ (৩) অনুমােদিত
৮. (৯) ব্যবসা/বাণিজ্য উন্নয়ন বাের্ড উপদেষ্টা কমিটি।
৯. (৮) দুটি বিষয় স্থগিত।
১৮/৭/১৯৭১, রাত ১০.৩০ টায় অনুষ্ঠিত
(পরিশিষ্ট ৩১ দ্রষ্টব্য)
৮. ক. অর্থনৈতিক বিষয়ে প্রফেসর রেহমান সােবহানকে বিশেষ দূত নিয়ােগ করা হলাে। খ. জনাব এম. আর. সিদ্দিকী-যুক্তরাষ্ট্রের বিশেষ দূত যদুর মনে পড়ে আগের দিনের, অর্থাৎ ১৭/৭/৭১ তারিখের সভার স্থগিত বিষয়াদি ১৮/৭/৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় নিস্পত্তি করা হয়।
২৯/৭/১৯৭১ সন্ধ্যা ৬টায় অনুষ্ঠিত
(পরিশিষ্ট ৩২ দ্রষ্টব্য)
সকলেই উপস্থিত। প্রফেসর ইউসুফ আলী বিশেষভাবে আমন্ত্রিত।
প্রফেসর ইউসুফ আলী ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং যুবশিবিরের উপর তাঁর প্রতিবেদন উপস্থাপন করলেন।
১. যুবশিবির। বিশেষ সময়(zero hour) কি কিছু ক্যাম্প বন্ধ করার জন্য?
২. এখান থেকে ত্রাণসামগ্রী বণ্টন করা হবে না। আঞ্চলিক পরিষদ (zonal council) বিশেষ ক্ষেত্রে উপযুক্ততা বিচার করবেন।
৩. War on Want প্রকল্পের শিবির সম্পর্কে আলােচনা মন্ত্রিসভার পরবর্তী বৈঠকে হবে।
অন্যান্য বিষয়:
১. অবিলম্বে কর্মচারী নিয়ােগ। ২. ৩০/৬/৭১ পর্যন্ত বেতন প্রদান। ৩. সচিবালয় প্রতিষ্ঠা- বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা এবং অন্যান্য সহকারী। ৪. কর্মচারীদের আবাসনের জন্য একটি পৃথক বাড়ি।
২৯/৭/১৯৭১
(পরিশিষ্ট ৩৩ দ্রষ্টব্য)
১. জীবনধারণ ভাতা
ক. সরকারি/স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী খ. শিক্ষক গ. পেনশন
২. মুক্ত এলাকায় প্রশাসনযন্ত্র স্থাপন যথা, তেতুলিয়া, রৌমারি সমস্যা পর্যালােচনা করে সমাধান খুজতে হবে।
৩. তদন্ত কমিশনে ব্যক্তি নিয়ােগ ক. জনাব হান্নান। খ. মি. ভৌমিক গ. মি. বড়য়া-সদস্য সচিব
৪. অফিসের স্থান-সমগ্র ভবন।
৫. এখানে বসবাসকারীদের জন্য অন্যত্র ব্যবস্থা
৬. বেতারের লােকদের জন্য বাসস্থান
৭. ছাত্রলীগ-অর্থ
৮. আওয়ামী লীগ-অর্থ
(আঞ্চলিক অফিসের জন্য সাময়িক বাজেট)
এখানে ত্রাণ দেওয়া হবে না
রবিবার সকাল ৯টায় সি.আই.টি. রােডে সভা।*
………………………….
উপরের আলােচনা ২৯/৭/৭১ তারিখের স্থগিত সভার, যা পরে অর্থাৎ রবিবার বিবেচনা করা হয়।
…………………………
১. সেক্টর কমান্ডারদের সাথে যুক্ত সি. অ, অ. (সিভিল অ্যাফেয়ার্স উপদেষ্টাদের) জন্য সম্ভাব্য ব্যয়। ২. এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ. দের পরিবারবর্গ ৩. বিচারপতি চৌধুরী।* ৪. যুদ্ধ তহবিল হিসাব- যথােপযুক্ত নাম দিতে হবে। ৫. দাপ্তরিক লিয়াজে
৯/৮/১৯৭১ সন্ধ্যা ৬টা
সকল সদস্য উপস্থিত। প্রধান সেনাপতি এবং প্রফেসর ইউসুফ আলী উপস্থিত।
১। যুদ্ধে শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের পােষ্যদের ত্রাণ মন্ত্রণালয় অর্থসাহায্য করবেন ৫,০০,০০০/=টাকা-ত্রাণমন্ত্রী।
২। রাজনৈতিক কর্মী, নেতৃবৃন্দ, এম.এন.এ এবং এম.পি.এ. ব্যতীত, শিল্পী, শিক্ষক প্রমুখকে সাহায্য প্রদান=২,৫০,০০০/- +২,৫০,০০০/=- আঞ্চলিক পরিষদ (zonal council)
১৩/০৮/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সচিব হিসেবে আমি একটি গােপনীয় সিদ্ধান্ত সকল সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিবের নিকট প্রেরণ করি (পরিশিষ্ট ৩৪ দ্রষ্টব্য)। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সরকারের সকল সচিবকে সমম্বয় ও ব্রিফিংয়ের উদ্দেশ্যে সপ্তাহে অন্তত একদিন আন্ত-বিভাগীয় বৈঠকে মিলিত হবেন। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এই সাপ্তাহিক বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। আমি প্রস্তাব রেখেছিলাম যে, সাপ্তাহিক এই বৈঠক প্রতি সােমবার সকাল ৯.০০টায় অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে একই তারিখে ১৮(৬) ক্যাব সংখ্যক এক গােপনীয় ও জরুরি পত্র দিয়ে সকল সচিবকে ১৪ আগস্ট সন্ধ্যার মধ্যে তাদের কার্যপত্র (Working paper) পাঠানাের অনুরােধ জানিয়েছিলাম (পরিশিষ্ট ৩৫ দ্রষ্টব্য)।
১৬/৮/১৯৭১
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ১৬/৯/৭১ তারিখে ১৩৫(২৫ক্যাব সংখ্যক একটি অফিসআদেশ জারি করে। আমার স্বাক্ষরে এই আদেশ মি.এ. হান্নান চৌধুরীর নিকট প্রেরিত হয়। এই আদেশে বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল থেকে আনীত সম্পদ ও অর্থের পরিমাণ তদন্ত করে দেখার জন্য একটি কমিশন নিয়ােগ করার কথা উল্লেখ করা হয়। কমিশনে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন:
১. মি. এ. হান্নান চৌধুরী – চেয়ারম্যান ২. মি. জে. জি. ভৌমিক – সদস্য ৩. মি. বড়য়া- সদস্য-সচিব।
কমিশনের দায়-দায়িত্ব ও কাজের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ঐ আদেশ যত শীঘ্র সম্ভব কমিশনকে প্রতিবেদন পেশ করতে বলা হয়েছিল। (পরিশিষ্ট ৩৬ দ্রষ্টব্য)।
…………………………
* বিচারপতি চৌধুরী মানে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, যিনি তখন লন্ডনে বসবাস করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্ব দিচিছলেন।
…………………………
২১/৮/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সচিব হিসেবে আমার অফিস থেকে ১৬/৮/১৯৭১ তারিখে প্রেরিত ২১(৬) ক্যাব সংখ্যক স্মারকের উপর প্রধানমন্ত্রীর আদেশ সম্বন্ধে সকল সচিবকে অবহিতকরণ ও তাদের প্রয়ােজনীয় দিক-নির্দেশনা লাভের জন্য ২১/৮/১৯৭১ তারিখের ৩১(৬) ক্যাব সংখ্যক স্মারক প্রেরণ করা হয়।
২৩/৮/১৯৭১
আলােচ্যসূচিতে যাওয়ার পূর্বে মন্ত্রিসভার কমান্ডার-ইন-চিফকে মুক্তিবাহিনীর কর্মতৎপরতা সম্বন্ধে প্রতিবেদন প্রদানের আহ্বান জানালে তিনি তাঁর বিবৃতিতে বলেন (পরিশিষ্ট ৩৭ দ্রষ্টব্য):
ক. মুক্তিবাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে কিছু উল্লেখযােগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। হতাহতের আনুপাতিক হার ৬: ১০০। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, চালনা ও সুনামগঞ্জে আমাদের বাহিনী কয়েকটি হামলায় শত্রুপক্ষের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে। অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী বােঝাই জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। যন্ত্রচালিত লঞ্চ এবং বার্জ আমাদের বাহিনী দখল করে নিয়েছে। কমান্ডার ইন চিফের মতে এসব সাফল্য উৎসাহজনক হলেও আমাদের প্রত্যাশা আরাে বেশি। মুক্তিবাহিনী আরাে ভালাে করবে বলে সি-ইন-সি তাঁর মনােভাব ব্যক্ত করেন।
২. আমাদের বিভিন্ন সংগঠনের মধ্যে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভারের পতি সি-ইন-সি উপস্থিত সদস্যদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। নিরাপত্তা ব্যবস্থায় মারাত্মক শৈথিল্যের জন্য শত্রুরা বহু মূল্যবান দলিলপত্র বিনষ্ট করে ফেলেছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। এ অসুবিধা থেকে পরিত্রাণের জন্য বর্তমান ভবনকে অবিলম্বে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের নিকট হস্তান্তর করা দরকার বলে তিনি মনে করেন। বলা হয় যে বেসামরিক সচিবালয় একটি নতুন ভবনে স্থানান্তরের ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
গ. যুবশিবির ও মুক্তিবাহিনীর সমস্যা সম্বন্ধে আলােচনা হয়। আলােচনায় বলা হয় যে, যেসব কর্মকর্তাকে অনুপ্রেরণা প্রদান ও নির্বাচন করার দায়িত্ব দেওয়া হয় তাঁরা তাঁদের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন করছেন না। এতে শিবিরগুলিতে অনিবার্যভাবে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
ঘ. যুক্তরাজ্যে সংগৃহীত অর্থ অপব্যবহার সম্বন্ধে অভিযােগ উত্থাপিত হয়। বলা হয় যে, যুক্তরাজ্যে বসবাসরত বাঙালি বিশেষত সিলেটিদের সমর্থন নষ্ট করে দেওয়ার প্রচেষ্টা জোরদার করা হচ্ছে। শত্রুদের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে প্রতি-ব্যবস্থা (counter-measures)
গ্রহণের জন্য মন্ত্রিসভাকে অনুরােধ জানানাে হয়।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সূচনা-বক্তব্য এবং সি-এই-সি.-র প্রতিবেদন পেশের পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও সি-ইন-সি অন্যত্র জরুরি কাজে প্রস্থান করেন। তারা উভয়ে ফিরে আসার পর সভার কাজ পুনরায় আরম্ভ হয়। উক্ত সভায় আরাে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় মুক্তিবাহিনীর অসুবিধা সম্বন্ধে কথা হয়। যুবকদের প্রশিক্ষণ প্রদান সম্পর্কিত প্রতিবেদন, অভ্যন্তরীণ কাজকর্ম এবং অন্যান্য অসুবিধার প্রতি মন্ত্রিসভার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়।
সভায় এই অভিমত প্রকাশ করা হয় যে, বন্ধুরাষ্ট্রের সরকার (Host govt.) কিছু অসুবিধার কারণে তাদের নিম্ন পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের গুরুত্বপূর্ণ নির্দেশ পৌছাতে পারেননি। যেভাবে নির্দেশাবলি উচ্চ পর্যায় থেকে নিম্ন পর্যায়ে পৌঁছার কথা সেভাবে তা
পৃষ্ঠা: ৯০
যাচ্ছে না। বন্ধু-সরকারের বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা সম্বন্ধে মন্ত্রিসভা অবহিত আছেন এবং বন্ধুসরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যথােপযুক্ত পর্যায়ে এসব সমস্যা নিয়ে আলােচনা করার পক্ষে অভিমত ব্যক্ত করা হয়। এই সভায় মুক্তিবাহিনীর বিভিন্ন প্রয়ােজনীয়তার কথাও উপস্থাপন করা হয়।
মন্ত্রিসভার ২৫ আগষ্ট ১৯৭১ সালে যে-সভা অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই সভায় বিভিন্ন সিন্ধান্তের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, স্বাধীন বাংলা বেতার এবং জয় বাংলা পত্রিকা সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এই সভায় সভাপতিত্ব করেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। সভায় উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রীসহ অর্থ, পররাষ্ট্র ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিবর্গ এবং প্রতিরক্ষা-সচিব। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত অধ্যাপক খােরশেদ আলম এম.এন. এ সভায় বিবেচনার জন্য তার প্রতিবেদন পেশ করেন। তথ্য ও বেতার কমিটির আহ্বায়ক এ.মান্নান এম.এন.এ আর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
উভয় প্রতিবেদন সম্পর্কে এবং আরাে অন্যান্য বিষয়ে সভায় বিস্তারিত আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্তসমূহ গৃহীত হয়।
সিদ্ধান্ত
ক. নবগঠিত বিভাগ/অধিদপ্তরের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে ১১,৬৮৮/৫৩ রুপি বরাদ্দের জন্য সাধারণ প্রশাসন বিভাগের (G.A.Deptt.) সুপারিশ অনুমােদিত হলাে।
খ. নবসৃষ্ট ৪টি অঞ্চলের (zones) দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহে আনুমানিক হিসাব ২৮,৪০০/০০ রুপির বাজেট অনুমােদন করা হলাে।
গ. বাংলাদেশেরে জনগণের ভালােবাসা ও শ্রদ্ধার প্রতীক হিসেবে কবি নজরুল ইসলামকে মাসিক ৩৫০/০০ রুপি ভাতা মঞ্জুর করা হলাে। কোলকাতাস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনার বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে শয্যাশায়ী কবিকে প্রথম মাসের ভাতা ব্যক্তিগতভাবে পৌছে দেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
উপরে বর্ণিত সিদ্ধান্তগুলির দুইটি ঐতিহাসিক এবং অবিস্মরণীয় ছিল। প্রথমত জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা প্রশ্নে সরকারের তথা সমগ্র বাঙালি জাতির গভীর উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেয়েছে। দ্বিতীয়ত বাঙালি জাতির গৌরব জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রতি শ্রদ্ধা দেখানাে হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর নামে এবং নজরুলের গানে-কবিতায় উদ্বুদ্ধ বাঙালি জাতি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে আমাদের সাথে প্রায়ই আলােচনা করতেন প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য মন্ত্রী। ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি তখনও ব্যাপক প্রচলিত হয়নি। শহীদ তাজউদ্দীন তাঁকে ডাকতেন মুজিব ভাই বলে। সরকারি বা আনুষ্ঠানিক সভায় শেখ সাহেব। মে মাসেই সরকার নিশ্চিত হন যে তিনি পাকিস্তানি কারাগারে। এই সময় তাঁর নিরাপত্তার প্রশ্নটি অগ্রাধিকার পায়। দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীকে বিশেষভাবে অনুরােধ করেন যাতে ভারত-সরকার নিজে এবং অন্যান্য সরকারের মাধ্যমে পাকিস্তানের ওপর এ-বিষয়ে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টি করেন।
২৩/৮/১৯৭১
সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধানমন্ত্রী। নিম্নলিখিত সচিববৃন্দ উপস্থিত ছিলেন:
সচিব, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
সচিব, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়
সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়
সচিব, সাধারণ প্রশাসন
সচিব, মন্ত্রিসভার বিভাগ
সভায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব বিগত কয়েক সপ্তাহের প্রতিবেদন পেশ করেন এবং আলােচনা শেষে কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট ৩৮ দ্রষ্টব্য)।
২৩/৮/১৯৭১
২০ জুলাই তারিখের আমার অফিসের অফিস-আদেশের কথা উল্লেখ করে পূর্ব-অঞ্চলের আয়-ব্যয় ও হিসাব সংক্রান্ত বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করি। ২৩/৮/৭১ তারিখের ৩৮(৩)/ক্যাব সংখ্যক পত্র অর্থমন্ত্রী মহােদয়, অর্থসচিব ও প্রতিরক্ষা সচিবের নিকট প্রেরণ করি। (পরিশিষ্ট ৩৯ দ্রষ্টব্য)।
ব্যয়ের কিছু নীতিমালা এবং বিভিন্ন সেক্টরের আনুমনিক ব্যয়ের হিসাব (budget) সম্বন্ধে পত্রে উল্লেখ করেছিলাম। একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, ২৮/৭/৭১ তারিখে আমি পূর্বঅঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে এবং ২৩/৮/৭১ তারিখে মন্ত্রিসভার-সচিব হিসেবে মন্ত্রিসভার বিভাগে যােগদানের পূর্বের অফিস-আদেশের ধারাবাহিকতা রক্ষার্থে আমি প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে এই পত্র প্রেরণ করেছিলাম।
২৪/৮/৭১
মন্ত্রিসভার মুলতবি সভায় পররাষ্ট্র-সচিব জুলাই ও আগস্ট ১৯৭১ মাসের বিভিন্ন কর্মতৎপরতার বর্ণনা করে একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। প্রতিবেদনে শান্তি ও সহযােগিতার জন্য ভারত-রাশিয়া চুক্তির বিশ্লেষণ তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া পররাষ্ট্র-বিষয়ক আরাে বহু বিষয় নিয়ে আলােচনা হয়। বাংলাদেশ বাহিনী এবং যুবশিবিরের জন্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর বিষয়ও আলােচনায় স্থান পায়। (পরিশিষ্ট ৪০ দ্রষ্টব্য)।
২৫/৮/৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার মুলতবি সভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সভায় উপস্থিত ছিলেন। প্রতিরক্ষা-সচিবও এতে উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত অধ্যাপক খােরশেদ আলম এম.এন. এ ঢাকা জেলার শিবপুর, মনােহরি, রায়পুরা ইত্যাদি স্থানের কিছু অনভিপ্রেত ঘটনার বর্ণনা দেন। মুক্তিবাহিনীর নামে পরিচালিত কিছু লােকের অপতৎপরতা কীভাবে মােকাবিলা করা যায়, সে-সম্বন্ধে আলােচনা হয়। অন্যান্য আরাে বিষয়ে আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (পরিশিষ্ট ৪১ দ্রষ্টব্য):
১. সাধারণ প্রশাসন বিভাগ নবসৃষ্ট বিভাগ/অধিদপ্তরের উপনিমিত্ত (contingent) ব্যয় মেটানাের জন্য ১১,৬৮৮/৩৩ রুপি বরাদ্দের প্রস্তাব অনুমােদিত হয়।
২. চারটি নতুন অঞ্চলের (zones) জন্য প্রণীত ২৮,৪০০/= রুপির বাজেট অনুমােদিত হয়।
৩. বাংলাদেশের জনগণের ভালােবাসা ও শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্য প্রতি মাসে ৩৫০/= রুপি ভাতা মঞ্জুর করা হয়।
২৮/৮/৭১
কমান্ডার ইন চিফ কর্তৃক পেশকৃত বীরত্ব খেতাব প্রদান স্কিম অনুমােদন সংক্রান্ত একটি চিঠি ২৮-৮-১৯৭১ তারিখের ৫৪৪/ক্যাব সংখ্যক স্মারকে প্রতিরক্ষা সচিবের নিকটও প্রেরিত হয় (পরিশিষ্ট ৪২ দ্রষ্টব্য)।
১/১৯/১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব আলােচনার জন্য সভায় একটি প্রতিবেদন পেশ করেন। মি.ডি.পি. ধরের নেতৃত্বে ভারতীয় প্রতিনিধি দলের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মন্ত্রিসভার সদস্যগণের আলােচনা অনুমােদন ছাড়াও অর্থ-সচিব ও বাণিজ্য-বাের্ডের চেয়ারম্যান আমদানি-রপ্তানি বিষয়ে ভারতের স্টেট ট্রেনিং করপােরেশনের সঙ্গে আলােচনাক্রমে অনতিবিলম্বে পরিকল্পনা প্রণয়ন করবেন মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। প্ল্যানিং সেলের পুনঃনামকরণ করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। অধ্যাপক মুজাফফর আহমেদকে প্ল্যানিং বাের্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে নিযুক্ত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বটে, কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে এ ব্যাপারে কোনাে ঘােষণা না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। [তাঁর পরিবারের আটকে পড়া সদস্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করে ঐরূপ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল— লেখক] (পরিশিষ্ট ৪৩ দ্রষ্টব্য)।
৪/৯/১৯৭১
স্মারক-সংখ্যাবিহীন প্রধানমন্ত্রীর ৪ সেপ্টেম্বরের দুইটি আদেশ মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব হিসেবে আমি ৬ সেপ্টেম্বর তারিখের সংখ্যাবিহীন স্মারকে সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরণ করি। একটি আদেশে মি. আবদুল খালেককে স্বরাষ্ট্র বিভাগের সচিব পদে নিয়ােগ দান করা হয় এবং অপর আদেশে তাকে ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ হিসেবে নিযুক্ত করা হয় এবং পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত এই দায়িত্ব পালন করতে বলা হয় (পরিশিষ্ট ৪৪ দ্রষ্টব্য)।
৬/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশ সরকারর শিক্ষা-উপদেষ্টা হিসেবে ড.এ.আর. মল্লিককে নিযুক্তি দেওয়ার কথা ঘােষণা করেন। সভায় এই মর্মে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, সাবেক পাকিস্তান সার্ভিস-কে এখন থেকে বাংলাদেশ সার্ভিসনামে অভিহিত করা হবে। পুলিশ অফিসারদের ব্যাজ ইত্যাদিতে চাঁদ-তারার পরিবর্তে নৌকা প্রতীক ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এজন্য নতুন ডিজাইন তৈরির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় (পরিশিষ্ট ৪৫ দ্রষ্টব্য)।
৭/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার ১০ সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠেয় সভার চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিব মাহবুব আলম, প্রতিরক্ষা-সচিব এ. সামাদ এবং ওএসডি আনােয়ারুল করিম চৌধুরীকে দেওয়া হয়। সভার আলােচ্যসূচি ছিল পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা বিষয়ক, বিদেশ প্রত্যাগত প্রতিনিধি দলের প্রতিবেদন ও মুক্তিবাহিনীর কল্যাণ বিষয়ক। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির অফিসকক্ষে বিকেল সাড়ে পাঁচটায় সভা অনুষ্ঠানের সময় নির্ধারিত হয়েছিল। (পরিশিষ্ট ৪৬ দ্রষ্টব্য)।
১০/৯/১৯৭১ ও ১১/৯/১৯৭১
এই দুই দিনের মন্ত্রিসভা-সভায় কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মি. আবদুস সামাদ আজাদের মৌখিক প্রতিবেদন সভায় উপস্থিত সদস্যগণ ধৈর্যের সঙ্গে শােনেন। বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত এলাকায় বিভিন্ন নামে প্রশাসন-ব্যবস্থা স্থাপনের বিষয় আলােচিত হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মন্ত্রিপরিষদ-সচিব সাধারণ প্রশাসন বিভাগের সঙ্গে আলােচনাপূর্বক এই সম্পকে পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণয়ন করে বিবেচনার জন্য পরবর্তী সভায় পেশ করবেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যােগদানের জন্য বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের তালিকায় অন্তর্ভুক্তির জন্য পররাষ্ট্র সচিব কয়েক ব্যক্তির নাম প্রস্তাব করলে মন্ত্রিসভা তা বিবেচনা করে। (পরিশিষ্ট ৪৭ দ্রষ্টব্য)।
১৩/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সভায় বাংলাদেশের পাট বাজারজাত করার বিষয়ে বাের্ড অব ট্রেডের চেয়ারম্যান পূর্বে-প্রণীত একটি পরিকল্পনার ব্যাখ্যা প্রদান করেন। মন্ত্রিসভা অর্থ-মন্ত্রণালয়ের পেশকৃত পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক দেখে কিছু কিছু বিষয়ে মন্তব্য দেয়। বাণিজ্য মন্ত্রীকে এ বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় একই সভায় আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলােচনা হয়। বিশেষ আমন্ত্রণে উত্তর পূর্ব অঞ্চল-১-এর দেওয়ান ফরিদ গাজী এম.এন.এ এবং মতিউর রহমান এম.এন.এ সভায় উপস্থিত ছিলেন। উক্ত অঞ্চলের জন্য ৫০০০/=রুপি বরাদ্দ করা ছাড়াও অভ্যর্থনা শিবিরে কর্মরত কর্মকর্তাগণকে বাছাই করার বিষয়েও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুবশিবিরের বাের্ড অব কন্ট্রোলের চেয়ারম্যানকে বিষয়টি অবহিত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এই সভায় আঞ্চলিক পরিষদে ভাইস-চেয়ারম্যান পদ সৃষ্টির কথা ওঠে। (পরিশিষ্ট ৪৮ দ্রষ্টব্য)।
১৪/৯/১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে ২৩ আগস্ট তারিখে অনুষ্ঠিত আন্তসচিব সভার সিদ্ধান্তে সপ্তাহান্তে সরকারের প্রত্যেক বিভাগকে প্রতিবেদন প্রদান এবং প্রধানমন্ত্রীর অফিস কক্ষে প্রতি সােমবার সকাল ৯টায় সভা অনুষ্ঠানের বিষয়ে জানানাে হয়।
২০/৯/১৯৭১
মন্ত্রিসভার সভায় আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের সমস্যা সম্পর্কে আলােচনা শেষে নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
ক. দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল-১ এর সদর দপ্তর সাবরুম থেকে উদয়পুরে স্থানান্তর করা হবে;
খ. বিদ্যমান পশ্চিম ও দক্ষিণ অঞ্চল ভেঙে পশ্চিম অঞ্চল-১ এবং পশ্চিম অঞ্চল-২ নামে, দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল-১ ও দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল ২ নামে পুনর্গঠিত হবে।
বর্তমানে গঠিত অঞ্চলগুলি নিম্নরূপ হবে:
১. পশ্চিম-অঞ্চল-১: দিনাজপুর, বগুড়া (বালুরঘাটে সদর দপ্তর)
২. পশ্চি-অঞ্চল-২ : রাজশাহী (মালদহে সদর দফতর)
৩. দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল-১: পাবনা ও কুষ্টিয়া (কৃষ্ণনগরে সদর দপ্তর)
৪. দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল-২: যশাের ও ফরিদপুর (বনগাঁয়ে সদর দপ্তর)
এছাড়া মন্ত্রিসভার সভায় ২ম শ্রেণী ২য় শ্রেণীর পদে নিয়ােগ সরকারের অনুমােদিত সাংগঠনিক কাঠামাে অনুযায়ী করার বিষয়ে পুনর্বার নিশ্চিত করা হয়। প্রতিরক্ষা সচিব এ. সামাদকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সচিবের অতিরিক্ত দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মন্ত্রিপরিষদ সচিব-প্রতিরক্ষা-সচিবকে সময়-সময় তাকে সহযােগিতা করবেন মর্মে মন্ত্রিসভার সভায় অভিমত ব্যক্ত করা হয় (পরিশিষ্ট ৪৯ দ্রষ্টব্য)।
১/১০/১৯৭১
পররাষ্ট্রমন্ত্রী পূর্বেই মন্ত্রিসভা সদস্যগণের নিকট সারসংক্ষেপ বিতরণ করেছিলেন। সভায় তিনি একটি বিবৃতি উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে সামান্য আলােচনার পর নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়:
ক. পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বিবৃতির খসড়া মন্ত্রিসভার সকল সদস্যকে ২রা অক্টোবর সকালের মধ্যে বিতরণ করবেন।
খ. মন্ত্রিসভা ২রা অক্টোবর সাড়ে ৬টায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বাসায় মিলিত হয়ে উক্ত খসড়া সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করবে।
এর আগে মি. রফিকুদ্দিন ভূইয়া এম.এন.এ.-র বক্তব্য সদস্যগণ শােনেন। যুদ্ধরত বাহিনীর জন্য উলের পােশাক, কম্বল, ওষুধ, পরিবহণ এবং খাদ্য সরবরাহ বিষয়ে আলােকপাত করা হয় এ সম্বন্ধে মন্ত্রিসভা কতিপয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
৫/১০/১৯৭১
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি মন্ত্রিসভার সভায় অভিমত প্রকাশ করে বলেন যে, মন্ত্রিপরিষদ সচিব সদস্যবর্গের কর্মসূচি সম্পর্কে আলােচনার জন্য সকল একান্ত-সচিবকে আহ্বান জানাবেন। প্রচার-প্রচারণা সম্পর্কে প্রাথমিক আলােচনায় সিদ্ধান্ত হয় যে, এ সম্বন্ধে আরাে যাচাই করা প্রয়ােজন। প্রতিরক্ষা সচিব কর্তৃক পেশকৃত বক্তব্য পর্যালােচনা করে দেখার জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ জানানাে হয়। আঞ্চলিক পরিষদ কর্তৃক গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সম্বন্ধে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভা আপাতত কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ না করার পক্ষে মত ব্যক্ত করেন। মন্ত্রিসভা মি.এ. আলমের পদত্যাগপত্র গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিশেষ আমন্ত্রণে উপস্থিত স্বাস্থ্যসচিব তাঁর দপ্তর সম্পর্কিত প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন। তাঁকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বলা হয়। উক্ত সভায় আহত মুক্তিযােদ্ধ, গেরিলা এবং শহীদ পরিবারের বিষয়ে আলােচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বাণিজ্য মন্ত্রী চা উৎপাদকদের সমস্যার বিষয় উত্থাপন করলে তাকে নির্দিষ্ট সুপারিশ প্রদানের জন্য বলা হয়।
৭/১০/১৯৭১
আহত মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের পুনর্বাসন সম্পর্কিত বিষয়ে মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তাছাড়া, তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের কার্যপ্রণালী সুনিয়ন্ত্রিত করার বিষয়ে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। ও.এস.ডি. মি. আনােয়ারুল হক খানকে এই দায়িত্ব দেওয়ার বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট ৫০ দ্রষ্টব্য)।
২০/১০/১৯৭১
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন বিভাগের কর্মের অগ্রগতি সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন প্রস্তুত করা হয়। এটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম, কারণ এই প্রতিবেদনে প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ
পৃষ্ঠা: ৯৫
সম্বন্ধে সংক্ষেপে তাদের কর্মকাণ্ডের বিবরণ লিপিবদ্ধ হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ড পরিচালনার চিত্র এই প্রতিবেদনে উজ্জ্বল হয়ে আছে। বিস্ময়করভাবে আমরা হাতে-গােনা কিছু মানুষ (নেতা-কর্মী, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচিত সদস্যবৃন্দ, গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, সাবেক পূর্ববাংলার সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীবৃন্দ, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী, লেখক, সাহিত্যিক-সাংবাদিক, কৃষক-শ্রমিক নেতা-কর্মী প্রমুখ)। প্রতিবেদনে উল্লিখিত কাজ সম্পন্ন করেছিলাম। ভারতীয় উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা মি.ডি.পি. ধর এবং প্ল্যানিং কমিশনের ড.এস. চক্রবর্তীর সাথে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, সরকারের প্রধানমন্ত্রী, প্ল্যানিং কমিশনের বহু বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল। সহযােগিতা ও পারস্পরিক সাহায্য প্রদান সম্বন্ধেও তাঁদের সঙ্গে আমাদের আলােচনা হয়। (পরিশিষ্ট ৫১ দ্রষ্টব্য)।
২৩/১০/১৯৭১
উপজাতীয় যেসব কর্মচারী আমার সঙ্গে সীমান্ত পাড়ি দিয়েছিলেন আমাদের যুদ্ধ বিষয়ক কাজে তাদের সেবা প্রতিরক্ষা-সচিবের প্রয়ােজন হলে আমরা তাদের নিযুক্ত করতে পারি মর্মে আমার দপ্তর থেকে পত্র প্রেরণ করি। (পরিশিষ্ট ৫২ দ্রষ্টব্য)।
৩০/১০/১৯৭১
এদিনের সভায় বিভিন্ন বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যুদ্ধরত সৈনিকদের ভাতা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত বিশেষ উল্লেখযােগ্য। নভেম্বর ‘৭১ মাস থেকে উক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের কথা বলা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাধ্যমে সিদ্ধান্তের কপি প্রতিরক্ষা সচিবের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৫৩ দ্রষ্টব্য)।
১/১১/১৯৭১
মন্ত্রিসভার এই সভায় ৭টি বিষয়ে আলােচনা হয়। এসবই ছিল নীতিনির্ধারণী বিষয়ক। আলােচনায় প্রশাসনিক সাংগঠনিক কাঠামাে, আঞ্চলিক পর্যায়ে কর্মচারী নিয়ােগ, ব্যয় নিয়ন্ত্রণ, এম.এন.এ. এবং এম.পি.এ-দের যাতায়াত ও মহার্ঘ ভাতা (T.A. &D.A.), কৃষি মন্ত্রণালয়ের সংগঠন ইত্যাদি বিষয়ে আলােচনা ও সুপারিশ গৃহীত হয়। (পরিশিষ্ট ৫৪ দ্রষ্টব্য)।
৮/১১/১৯৭১
আমার বিভাগের ২৯-১০-১৯৭১ তারিখের ইউ.ও.২৮৬ সংখ্যক পত্র মারফত বাংলাদেশ সরকার ও মন্ত্রিসভার ব্যবহারের জন্য যানবাহন সংগ্রহ সম্পর্কিত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর অবগতির জন্য প্রেরণ করি। (পরিশিষ্ট ৫৫ দ্রষ্টব্য)।
১১/১১/১৯৭১
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলসমূহের বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদের সকল সদস্য ছাড়াও, মন্ত্রিপরিষদ-সচিবও সভায় উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে সি.ইন.সি. মি. ফতেহ, প্রতিরক্ষা-সচিব সভায় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় সমস্যাবলি নিয়ে আলােচনা হয়। (পরিশিষ্ট ৫৬ দ্রষ্টব্য)।
১৪/১১/১৯৭১
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে অর্থসচিব মি.কে.এ. জামানকে লিখিত পত্রে ১৯৭১ সালের অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত সময়ের বাজেট সম্পর্কে জানানাে হয়। পত্রে বলা হয় যে, ১৫ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিসভার সভায় আলােচ্যসূচির অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পূর্বে যে বিষয় নিশ্চিত করতে হবে তা হলাে সরকারের প্রতিটি মন্ত্রণালয়, বিভাগ এজেন্সির অর্থ বরাদ্দের সঠিক প্রতিফলন যেন বাজেটে থাকে। (পরিশিষ্ট ৫৭ দ্রষ্টব্য)।
২২/১১/১৯৭১
অক্টোবর ‘৭১ থেকে ৩১ ১৯৭২ পর্যন্ত সময়ের বাজেট বিষয়ে মন্ত্রিসভার সভায় আলােচনা হয়। সভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সভাপতিত্ব করেন। প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মন্ত্রিপরিষদ সচিব এবং বিশেষ আমন্ত্রণে সি.ইন.সি, মি. ফতেহ ও প্রতিরক্ষা-সচিবও সভায় উপস্থিত ছিলেন। মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়েও আলােচনা হয়। কতিপয় মন্তব্যসহ বাজেট অনুমােদিত হয়। তবে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কিত কয়েকটি সমস্যার কথা আলােচনায় আসে।সমস্যা পরীক্ষা করে দেখে রিপাের্ট দেওয়ার জন্য নিম্নলিখিত উপ-কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
সচিব, প্রতিরক্ষা
সচিব, স্বরাষ্ট্র
সচিব, মন্ত্রিপরিষদ
সচিব, অর্থ
সচিব, সাধারণ বিভাগ
আরাে সিদ্ধান্ত হয় যে, সি-ইন-সি, প্ল্যানিং বাের্ডকেও উপ-কমিটির সঙ্গে যুক্ত করা হবে।
২৪/১১/১৯৭১
২২ নভেম্বর তারিখের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ২৪ নভেম্বর বিকেল ৪.০০টায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে উপ-কমিটির সভা অনুষ্ঠানের বিষয় জানিয়ে পত্র লেখা হয়। (পরিশিষ্ট ৫৮ দ্রষ্টব্য)।
৩০/১১/১৯৭১ বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২-১২-৭১ তারিখে ৪১৫ (২)/ক্যাব সংখ্যক অতি গােপনীয় পত্র মারফত প্রতিরক্ষ-সচিব ও সাধারণ প্রশাসন সচিবকে বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরসমূহ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরােধ জানায়। (পরিশিষ্ট ৫৯ দ্রষ্টব্য)।
প্রায় একই সময় মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সভায় কার্যবিবরণী ও সিদ্ধান্ত জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে (৫)/ক্যাব সংখ্যক স্মারক সংশ্লিষ্ট সকল সদস্যের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৬০ দ্রষ্টব্য)।
১/১২/১৯৭১
মুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় কাঠামাে সম্পর্কে সচিব-উপ কমিটিতে ১০টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কার্যপত্র তৈরির বিষয়টি সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট ৪১৩ (৬)/ক্যাব সংখ্যক স্মারক মারফত জানানাে হয়। (পরিশিষ্ট ৬১ দ্রষ্টব্য)।
৬/১২/১৯৭১
মি. রুহুল কুদ্সকে বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী মহাসচিব নিয়ােগ সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরিত হয়। সাধারণ প্রশাসনের সচিবকে অস্থায়ী মহাসচিবএর অফিস-কক্ষ ও তার সহকারী নিয়ােগের ব্যবস্থা করতে ৭ ডিসেম্বর তারিখে অনুরােধ জানানাে হয়। (পরিশিষ্ট ৬২ দ্রষ্টব্য)।
১০/১২/১৯৭১
ভারত এবং বিদেশের ব্যাঙ্কে পরিচালিত সরকারের তহবিলের নাম পরিবর্তনের জন্য মন্ত্রিসভা বৈঠকের একটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত প্রধানমন্ত্রীসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করা হয়। (পরিশিষ্ট ৬৩ দ্রষ্টব্য)।
১১/১২/১৯৭১
দখলীকৃত বাংলাদেশে কর্মরত সরকারি কর্মচারীদের প্রতি বাংলাদেশ সরকারের নীতিমালা প্রচারের জন্য তথ্যসচিবকে ১১ ডিসেম্বর তারিখে লিখিত ৪৪৬/ক্যাব সংখ্যক স্মারক প্রণিধানযােগ্য। এই চিঠির কপি অস্থায়ী সাধারণ সম্পাদক, সচিব কমিটির চেয়ারম্যান, পুলিশ মহাপরিদর্শক, অর্থসচিব, সাধারণ প্রশাসন বিভাগ সচিবের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৬৪ দ্রষ্টব্য)।
১৫/১২/১৯৭১
১৩ ডিসেম্বর তারিখে মন্ত্রিসভা বৈঠকে বাংলাদেশে বিদেশি কর্মকর্তা নিয়ােগ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় (পরিশিষ্ট ৬৫ দ্রষ্টব্য)। এ ছাড়া দালালদের বিচার ও সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের কর্মচারীদের আনুগত্য যাচাই সম্পর্কে সিদ্ধান্ত ১৫ ডিসেম্বর সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরিত হয়। (পরিশিষ্ট ৬৬ দ্রষ্টব্য।)
১৬/১২/১৯৭১
প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র, স্বাস্থ্য, কৃষি, অর্থ সচিববৃন্দকে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে লেখা ৪৬৯(৫)/ক্যাব সংখ্যক স্মারকে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে মন্ত্রিসভা-সভার সিদ্ধান্তের কথা অবহিত করা হয় (পরিশিষ্ট ৬৭ দ্রষ্টব্য)। ১৮ ডিসেম্বর তারিখে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুসারে মন্ত্রিসভা বৈঠকের আলােচ্যসূচিতে গণবাহিনীর সদস্যগণকে জাতীয় সশস্ত্র বাহিনীতে অন্তর্ভুক্তকরণ ও সরকারি কর্মচারীদের পুনঃদায়িত্ব বণ্টন প্রস্তাব দেওয়ার কথা জানিয়ে ১৬-১২-৭১ তারিখে ৪৭২(৩)/ক্যাব সংখ্যক বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। সরকারি প্রশাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় মন্ত্রিসভা ১০ ডিসেম্বর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। (পরিশিষ্ট ৬৮ দ্রষ্টব্য)।
সাধারণ প্রশাসন বিভাগ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বেসামরিক যে বিভাগ প্রথম কার্যক্রম শুরু করে তা হলাে সাধারণ প্রশাসন বা General Administration (GA)Department। এই নামকরণটি হয়েছিল তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের Services and General Administration Department (S &GAD) এর অনুকরণে। কাজের সুবিধার জন্য এটি আর পরিবর্তন করা হয়নি তবে এটি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বাধীন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনুরূপ আরেকটি বিভাগই ছিল। এই বিভাগের সচিব ছিলেন নূরুল কাদের।
১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মন্ত্রিবর্গের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে যে কয়জন বাঙালি মুক্তিযােদ্ধা কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন নূরুল কাদের তাদের অন্যতম। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কর্মকাণ্ডের আরম্ভ থেকেই নূরুল কাদের তার সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন। ২৫ মার্চ রাতে বর্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণের সাথে সাথে আমার মতাে যেসব বাঙালি জেলাপ্রশাসক ও অন্যান্য সামরিক কর্মকর্তা, বিশেষ করে সাবেক সি.এস.পি., ই.পি.সি.এস. এবং পুলিশ সার্ভিসের সদস্য রুখে দাঁড়ান, নূরুল কাদের ছিলেন তাঁদের অন্যতম। দীর্ঘ ২ সপ্তাহের মতাে সময় শত্রুকে প্রতিহত করার পর তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে ১৬ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সদর দপ্তর কৃষ্ণনগরে পৌঁছান। সেখানে তখন ছিলেন মাগুরার এস.ডি.ও. ওয়ালিউল ইসলাম এবং আরও কতিপয় কর্মকর্তা।
মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণের আগেই অনানুষ্ঠানিকভাবে ১২ এপ্রিল তারিখে যে বৈঠকে মিলিত হন তার অন্যতম আলােচ্য বিষয় ছিল সরকারের দপ্তর স্থাপন। কবে, কখন, কীভাবে এই প্রশাসনিক দপ্তর কাজ শুরু করবে এটি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বড় একটা চিন্তার কারণ ছিল। তখনও তিনি পরিষ্কারভাবে জানতেন না, কোন কোন কর্মকর্তাকে পাওয়া যাবে, কে বা কারা তাকে সরকারের প্রশাসনিক যন্ত্র সংগঠনে সাহায্য করবেন। নীতিগতভাবে ঐদিনই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ও সাধারণ সচিবালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে এবং বেসামরিক কর্মকতাদের সংগঠিত করে সচিবালয় চালু করা হবে। প্রধানমন্ত্রী নিজেই এই বিভাগগুলির দায়িত্বে থাকবেন এটাও স্থির করা হয়। ঐ দুঃসময়ে ন্যূনতম কত ভাতা প্রদান করলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা জীবনধারণ করতে পারবেন সেটাও আলােচিত হয়।
১৮ এপ্রিল তারিখে মন্ত্রিসভার প্রথম আনুষ্ঠানিক সভা হয়। সভায় মন্ত্রীদের দপ্তর বণ্টন করে প্রধানমন্ত্রী সংস্থাপন ও সাধারণ প্রশাসন নিজের অধীনে রাখেন। সরকারি কোষাগারের তৎকালীন অবস্থা বিচার করে কর্মকর্তা/কর্মচারীদের বেতনের হার নির্ধারিত হয়:
ক. চতুর্থ ও তৃতীয় শ্রেণী: পূর্ণ বেতন।
খ. দ্বিতীয় শ্রেণী ২০% কম, কিন্তু প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৪০০/- রুপি।
গ. প্রথম শ্রেণী ২৫% কম, কিন্তু প্রতি মাসে সর্বোচ্চ ৫০০/- রুপি।
থিয়েটার বাের্ডের (বর্তমান শেক্সপিয়ার সরণি) যে বাড়িতে প্রধানমন্ত্রী থাকতেন, সেটিই আপাতত সরকারের প্রধান কার্যালয়ে পরিণত হয়। বন্ধুবর নূরুল কাদেরকে এই দপ্তর স্থাপনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নূরুর কাদের ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার নিযুক্ত প্রথম সচিব। ঐ কঠিন দায়িত্ব সুচারুভাবেই সম্পন্ন করেছিলেন নূরুল কাদের। সেদিন তার সহযােদ্ধা ছিলেন ওয়ালিউল ইসলাম (সি.এস.পি., মাগুরার এস.ডি.ও.), কামালউদ্দীন (ই.পি.সি.এস.এস.ডি.ও., নাটোর), মতিউর রহমান (ই.পি.সি.এস.), আবদুর রশিদ (ওয়াপদার তৎকালীন কর্মকর্তা) এবং আরও বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কর্মচারী। কোনাে অতিরিক্ত সচিব বা যুগ্ম-সচিবের বালাই ছিল না তখন। আমরা যারা সচিব নিযুক্ত হয়েছিলাম তাদের অধিকাংশের চাকুরির জ্যেষ্ঠতা সে সময় ১০ থেকে ১২ বছর। প্রবীণ যারা ছিলেন তারা কেউই প্রশাসনিক সার্ভিসের ছিলেন না। পরের দিকে অবশ্য ফরেন সার্ভিসের বেশ কয়েকজনকে সচিবের মর্যাদা দিয়ে বিভিন্ন কাজে নিয়ােগ করা হয়।
সাধারণ প্রশাসন বা জি.এ.বিভাগে যাদের ভূমিকা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিল তাঁরা হলেন:
১. ওয়ালিউল ইসলাম, উপ-সচিব
২. কামালউদ্দীন আহমেদ, উপ-সচিব
৩. মতিউর রহমান, সহকারী সচিব
৪. দীপক কুমার চৌধুরী, সহকারী সচিব
৫. অজিত কুমার ভাদুড়ী, সহকারী সচিব
৬. নরেশচন্দ্র রায়, সহকারী সচিব
৭. মােহাম্মদ হেদায়েতউল্লাহ, সহকারী সচিব
৮. আল-আমীন চৌধুরী, সহকারী সচিব
৯. শাহ্ মতিউর রহমান, সহকারী সচিব
১০. ইঞ্জিনিয়ার কামাল সিদ্দিকী, ট্রান্সপাের্ট অফিসার
১১. আবদুর রশিদ, প্রশাসনিক অধকর্তা
উপরের ক্রমিক নম্বর ৩, ৪, ৬ এবং ৮-এর কর্মকর্তারা ছিলেন প্রাক্তন ই.পি.সি.এস.। অজিত কুমার ছিলেন পুলিশের এবং আল আমীন তৎকালীন পাকিস্তান অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের। আমার বিশেষভাবে মনে পড়ে কামালউদ্দীন, ওয়ালিউল ইসলাম, মতিউর রহমান আর রশিদের কথা। এঁরা সকলেই অত্যন্ত তৎপর ছিলেন এবং প্রচণ্ড পরিশ্রম করতেন। রশিদ ছিলেন ওয়াপদার কর্মচারী। তাকে দেওয়া হয়েছিল প্রশাসনিক কর্মকর্তার (Administrative Officer) দায়িত্ব। মূলত তার কাজ ছিল বাড়িঘর, জিনিসপত্র এবং প্রয়ােজনে জনবল সরবরাহ করা। সারাক্ষণ দৌড়ের উপরেই থাকতেন। ইঞ্জিনিয়ার কামাল সিদ্দিকীকে আমরা ডাকতাম কমল বলে। তার দায়িত্বের নাম যাই থাকুক, কাজ করতেন চারদিকেই।
সার্কাস অ্যাভিনিউয়ে বাংলাদেশ মিশনে (ইতিপূর্বে পাকিস্তান ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিসে) আমাদের একজন প্রটোকল অফিসার বসতেন; তিনি ছিলেন সাধারণ প্রশাসনের কর্মকর্তা। তাঁর প্রধান দায়িত্ব ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে আসা সমস্ত সরকারি কর্মকর্তাকর্মচারীকে অভ্যর্থনা করা। যারা সরকারের কাজ করতে চাইতেন তাঁদের প্রত্যেককে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করে শপথ-নামা দস্তখত করতে হতাে। একই সাথে তাদের সত্যিকারের পরিচয়, কোথায় কাজ করতেন, কী ধরনের কাজ করতেন ইত্যাদি বিষয়ে প্রমাণ দাখিল করতে হতাে। এই যাচাই-বাছাইয়ের কাজটি খুব কঠিন ছিল। কাজটি যিনি করতেন তিনি একজন ই.পি.সি.এস. কর্মকর্তা। নাম মনে নেই।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। যুদ্ধরত একটি বিপ্লবী প্রবাসী সরকারের কাজের কোনাে নির্দিষ্ট সীমা ছিল না। প্রধানতম দায়িত্ব ছিল যুদ্ধ পরিচালনা করা এবং সে যুদ্ধে সফলতা অর্জনের জন্য যা যা করা প্রয়ােজন সেটাই ছিল মূল লক্ষ্য ঐ রকম একটি পরিস্থিতিতে আমাদের সামনে আইন ছিল একটি: স্বাধীনতার ঘােষণাআর আইনের ধারাবাহিকতা রক্ষা আদেশ (Proclamation of Independence এবং Laws Continuance Enforcement Order 1971)। আইনের ধারাবাহিকতা আদেশ দিলেই তাে হলাে না, কোন কোন আইন বলবৎ থাকবে, কোনটি সংশােধন করতে হবে, কোনটি আমূল পরিবর্তন প্রয়ােজন এসব তাে আমরা জানতাম না। আইনের বই দেখার সময় তখন কোথায়? বিশেষ করে সরকারি কার্যবিধি বলতে তাে কিছু ছিল না, যা আমরা অনুসরণ করতে পারি।
স্বাভাবিক অবস্থায় দেশের সংবিধানে বর্ণিত উপায় ও পন্থায় সরকারের কাজকর্ম পরিচালিত হয়। সেখানে সাধারণত বলা থাকে যে, এই বিষয়ে সরকার বিধি (Rules) প্রণয়ন করবে এবং সেই সব রুলস অনুসরণ করে সরকার পরিচালিত হবে। এক বলা হয় কার্যপ্রণালী বিধি বা (Rules of Business)। এই কার্যপ্রণালী বিধিতে দুটো ভাগ থাকে:
পৃষ্ঠা: ১০০
একটি কার্যবন্টন বিধি (Rules for the Allocation of Business) যাতে করে কোন্ মন্ত্রণালয় বা দপ্তর কী কাজ করবে তার বর্ণনা; দ্বিতীয়টি কার্য পরিচালনা বিধি (Rules for the Transaction of Business)। এতে বলা হয়ে থাকে কে কীভাবে কাজ করবেন, কোন্ কোন্ বিষয়ে কে সিদ্ধান্ত দিতে পারবেন, কোন্ বিশেষ বিষয় বা সমস্যা বা সিদ্ধান্ত নিয়ে অন্যান্য মন্ত্রণালয় বা প্রতিষ্ঠানের সাথে পরামর্শ করতে হবে, এইসব।
যুদ্ধকালীন সময়ে এ ধরনের নিয়মকানুন, বিধি মেনে চলার কোনাে অবকাশ থাকে না, আমাদেরও ছিল না। তাহলে আমরা কীভাবে কাজ করতাম? পূর্ব-অভিজ্ঞতালব্ধ জ্ঞান যার যা ছিল তাই প্রয়ােগ করতাম। খন্দকার আসাদুজ্জামান দীর্ঘকাল অর্থবিভাগে কাজ করেছিলেন বলে আর্থিক বিধি, বাজেট প্রণয়ন, ব্যয়-বরাদ্দ এবং প্রকৃত ব্যয় এসব বিষয়ে তাঁর ভালাে জ্ঞান ছিল। আমিও জেলা প্রশাসক পদে কাজ করার আগে অর্থবিভাগে ছিলাম; জেলা প্রশাসক থাকাকালীনও সরকারি ব্যয়-বরাদ্দ, ব্যয় এসব ব্যাপারে প্রত্যক্ষ জ্ঞান ছিল। নূরুল কাদের দীর্ঘকাল জেলা প্রশাসক থাকায় নিয়ম-কানুন ভালােই জানতেন।
তবে আমার একটা অতিরিক্ত সুবিধা ছিল। আমি প্রাদেশিক সরকারে ফিরে আসার আগে তৎকালীন পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে প্রায় আড়াই বছর চাকুরি করেছিলাম। আমার যে অবস্থান ছিল তাতে মন্ত্রিসভার জন্য কীভাবে সারসংক্ষেপ তৈরি করতে হয়, কীভাবে তা উপস্থাপন করতে হয়, গৃহীত সিদ্ধান্ত কীভাবে সংশ্লিষ্ট সকলকে জানাতে হয়, বাস্তবায়ন, নিরীক্ষণ করতে হয়— ইত্যাদি বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে জানতে পারি। স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম দিকে কেউ এসব বিশেষ একটা তােয়াক্কা করতেন না। প্রধানমন্ত্রীকে বলে তার মাধ্যমে ধীরে ধীরে আমি আর আসাদুজ্জামান সরকারে কাজের শৃঙ্খলা, নিয়ম-কানুন চালু করি।
কার্যবন্টন বিধি (Rules for the Allocation of Business) না থাকায় অনেক সময় একে অপরের কাজ করে ফেলতাম। আমি মুজিবনগর যাবার আগে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অনেক কাজ নূরুল কাদের করতেন। প্রধানমন্ত্রী প্রায় সময় আমাকে পররাষ্ট্র, স্বরাষ্ট্র, তথ্য ইত্যাদি বিষয়ে দায়িত্ব দিতেন যেগুলাে জরুরি ভিত্তিতে আমাকে সম্পাদন করতে হতাে। কাজের বা দায়িত্বের খুব স্পষ্ট এবং লিখিত বণ্টন বা সীমা নির্দিষ্ট না থাকলেও যার যার দায়িত্ব পালনে আমাদের কখনও কোনাে অসুবিধা হয়নি। মােটামুটিভাবে সাধারণ প্রশাসন বা জি.এ. বিভাগের প্রধান দায়িত্বগুলাে নিচে বর্ণনা করলাম:
ক. সকল সরকারি কর্মকর্তার নিয়ােগ, পদোন্নতি, বদলি, শৃঙ্খলা এবং এই সংক্রান্ত সবকিছু।
খ. কর্মচারীদের নিয়ােগ সংক্রান্ত সাধারণ নির্দেশাবলি (স্থানীয় কর্মচারীদের স্থানীয়ভাবে, অর্থাৎ আঞ্চলিক প্রশাসন নিয়ােগ সংক্রান্ত সাধারণ নির্দেশাবলি (স্থানীয় কর্মচারীদের স্থানীয়ভাবে, অর্থাৎ আঞ্চলিক প্রশাসন নিয়ােগ করতেন।
গ. মুজিবনগরে কর্মরত কর্মচারীদের নিয়ােগ, বদলি ইত্যাদি।
ঘ. স্থানীয় প্রশাসনিক কাউন্সিল (Zonal Administrative Council)-গুলােকে প্রশাসনিক সহায়তা প্রদান; তাঁদের কর্মকর্তাদের নিয়ােগ, বদলি ইত্যাদি।
ঙ. যুবশিবির বাের্ডকে সাচিবিক সহায়তা (নূরুল কাদের নিজে বাের্ডের সদস্য ছিলেন)।
চ. মুজিবনগরে অবস্থিত সকল দপ্তরের জন্য স্থান-সঙ্কুলান, যানবাহন ইত্যাদি ব্যবস্থা করা।
ছ. প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর, মন্ত্রিপরিষদ ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগের জন্য সকল সহায়তা ও সরবরাহ (Logistics) নিশ্চিতকরণ।
জ. প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক আদিষ্ট হয়ে অন্য কোনাে দায়িত্ব সম্পাদন।
আঞ্চলিক প্রশাসনগুলাের সহায়তা করার দায়িত্ব জি.এ. বিভাগকে অর্পণ করা হয়েছিল বিধায় সচিব নূরুল কাদেরকে প্রায়ই মাঠপর্যায়ে সফরে যেতে হতাে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন নিজে কখনও কখনও নূরুল কাদেরকে তাঁর সফরসঙ্গী করতেন।
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সূচনাকাল থেকে এবং কয়েক দিনের ব্যবধানে পাকিস্তান সরকারের তদানীন্তন উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মকর্তাদের মধ্যে অনেকে মুজিবনগরে পৌঁছান এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে বিশেষ বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে কর্মে আত্মনিয়ােগ করেন। এদের মধ্যে অবসরপ্রাপ্ত সি.এস.পি. কর্মকর্তাও ছিলেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীন মুজিবনগরে নিয়ােগপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের সংখ্যা নিম্নে দেওয়া হলাে:
সি.এস.পি.– ১৪ জন
ই.পি.সি.এস. – ৬২ জন
অন্যান্য ক্ষেত্রে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন— ৫১ জন
এই পরিসংখ্যানে ভারতসহ বিদেশে কর্মরত (দূতাবাস ও অন্যান্য) কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।
মন্ত্রিসভা তাঁদের বিভিন্ন বৈঠকে সাধারণ প্রশাসন সম্পর্কে নানাবিধ আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্তগুলি নিচে তারিখসহ উল্লেখ করলাম:
তারিখ সিদ্ধান্ত
১২-৪-৭১ সরকারের দপ্তর স্থাপন: কোথায় এবং কীভাবে করা হবে। মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় ও সাধারণ সচিবালয় প্রতিষ্ঠা (প্রথম সভা)।
১৫-৪-৭১ বেসামরিক কর্মকর্তা: সচিবালয় গঠন।
১৮-৪-৭১ মন্ত্রিদের দপ্তর বণ্টন: সংস্থাপন-প্রশাসন-প্রধানমন্ত্রী। বেসামরিক কর্মচারী ও কর্মকর্তাদের বেতন/ভাতা।
২৩-৬-৭১ ও ২৪-৬-৭১ যুবশিবির প্রতিষ্ঠা: সংস্থাপন বিভাগের প্রতিষ্ঠানিক সাহায্য।
১৭-৭-৭১ আঞ্চলিক প্রশাসনিক কাঠামাে: সংস্থাপন বিভাগের দায়িত্ব সম্প্রসারণ।
২৯-৭-৭১ সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থার কর্মচারী-ভাতা; মুক্ত এলাকায় প্রশাসন স্থাপন; অফিসের স্থান।
২৫-৮-৭১ সাধারণ প্রশাসনের জন্য অতিরিক্ত ব্যয় বরাদ্দ।
৬-৯-৭১ বাংলাদেশ সিভিল সার্ভিস প্রবর্তন।
২০-৯-৭১ আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের সমস্যা ও সমাধান।
২০-৯-৭১ প্রথম/দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা নিয়ােগ বিধি।
৩০-১১-৭১ দপ্তরসমূহ ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা বিধানকল্পে নির্দেশ।
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়: গঠন, সেক্টর কমান্ডার, বিশেষ বিগ্রেড
স্বাধীনতার ঘােষণা (Proclamation of Independence) ১০ এপ্রিল প্রচারিত হওয়ার পরের দিন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি ভাষণ দেন। এর আগে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীনতার ঘােষণায় প্রদত্ত ক্ষমতাবলে তাজউদ্দীন আহমদ আহমদকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। একই সাথে অন্য চারজন মন্ত্রীও নিযুক্ত হন।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আহমদ ১১ এপ্রিলের ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং বাঙালি জাতিকে সশ্রদ্ধ সালাম জানান। বাংলাদেশকে স্বাধীন এবং মুক্ত করার পবিত্র ব্রত নিয়ে যেসব বীর বঙ্গসন্তান শহীদ হন তাদের প্রতিও প্রধানমন্ত্রী গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করেন। ২৫ মার্চ রাত থেকেই বাঙালি জাতি যদি প্রতিরােধ গড়ে না তুলত তাহলে আমরা দাঁড়াতেই পারতাম না— এ কথা ঘােষণা করে প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যেসব বীর মুক্তিযােদ্ধা সেনা অফিসার এবং সেনানী, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর., পুলিশ, আনসার,মুজাহিদ, বেসামরিক প্রশাসন, আওয়ামী লীগ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ, কর্মীবাহিনী বীরবিক্রমে যুদ্ধরত ছিলেন তাঁদের পরিচয় এবং বীরত্বের কথা জাতির কাছে এবং বিশ্বের দরবারে তুলে ধরেন। প্রধানমন্ত্রীর বক্তৃতা ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। তখন থেকেই প্রকৃত অর্থে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সূচনা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের যাত্রা শুরু সে সময়েই। গর্বের সাথে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর ভাষণে যুদ্ধরত সকল বীর সেনানায়কের বীরত্বের বর্ণনা দেন:
১. সিলেট-কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফ। তাঁকে ঐ অঞ্চলের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়েছে। তিনি এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন বাহিনী ইতােমধ্যেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সিলেট ও কুমিল্লা সেনাছাউনিতে সীমাবদ্ধ করে রেখেছেন।
২. চট্টগ্রাম-নােয়াখালী অঞ্চলে মেজর জিয়াউর রহমানকে সমস্ত সামরিক তৎপরতার দায়িত্ব (কমান্ড) দেওয়া হয়েছে। তার প্রতিরােধের ফলে চট্টগ্রাম এখনও শক্রর জন্য নিরাপদ নয়। যার ফলে চট্টগ্রাম ও নােয়াখালীর বিস্তীর্ণ অঞ্চল এখন শত্রুমুক্ত।
৩. ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল অঞ্চলে আমরা কমান্ড দিয়েছি বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর সফিউল্লাহকে। তিনি ইতােমধ্যে বড় একটি এলাকা মুক্ত করেছেন এবং ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এই তিন কমান্ডার ইতােমধ্যেই মিলিত হয়েছেন এবং তাদের দখলকৃত এলাকায় যুদ্ধ-পরিকল্পনা প্রণয়ন করেছেন।’ (সমন্বিত পরিকল্পনা গ্রহণের লক্ষ্যে সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ সদস্যগণ ৪ এপ্রিল একাত্তর-এ তেলিয়াপাড়ায় মেজর খালেদ মােশাররফের অস্থায়ী দপ্তরে মিলিত হন)।
৪. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে আমরা ই.পি.আর.-এর মেজর ওসমানকে কুষ্টিয়া-যশাের
এলাকার কমান্ডার নিযুক্ত করেছি। ফরিদপুর-বরিশাল-খুলনা-পটুয়াখালী অঞ্চলে কমান্ড দেওয়া হয়েছে মেজর জলিলকে। কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক জয়ের পর মুক্তিবাহিনী কুষ্টিয়া শহর শত্রুমুক্ত করেছে এবং শত্রু এখন যশাের সেনানিবাস এবং খুলনার মাত্র কায়েকটি এলাকাতেই আবদ্ধ হয়ে আছে।
৫. উত্তর বাংলায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই.পি.আর.-এর যােদ্ধাদের নিয়ে কমান্ড সংগঠিত করা হচ্ছে, যার নেতৃত্বে আছেন মেজর আহমেদ। রাজশাহী থেকে শত্রু পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। মেজর নজরুল এবং মেজর নওয়াজিশ পর্যুদস্ত পাকবাহিনীকে সৈয়দপুর ও রংপুরে ঘিরে রেখেছেন। দিনাজপুর, বগুড়া, পাবনা, রংপুর থেকেও শত্রু বিতাড়িত।
‘আমাদের যুদ্ধরত বাহিনীর চমৎকার সাফল্য এবং সেই সাথে প্রতিনিয়ত তাদের লােকবল ও অস্ত্রবল (যার অধিকাংশই শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া) বৃদ্ধি পাওয়ায় আমরা এখন যুদ্ধাঞ্চলে একটি কার্যকর (operational) ঘাঁটি প্রস্তুত করতে সক্ষম হয়েছি।’ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণা যার মাধ্যমে দেওয়া হয়েছিল সেই মেজর জিয়াউর রহমানকেই এই অপারেশনের কমান্ড দেওয়া হয়েছে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যেতে পারে যে, এই ঘাটি আমাদেরই মুক্ত-অঞ্চল চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম-রামগড়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের বক্তৃতা উচ্ছ্বসিত ছিল কারও কারও প্রশংসায়। অতিশয়ােক্তি এবং অতিরঞ্জনও ছিল, কিন্তু জনগণের মনােবল বৃদ্ধি ও তাদের উৎসাহিত করতে এর প্রয়ােজন ছিল।
আমার সেদিন খুব ভালাে লেগেছিল (আজও লাগে) এই ভেবে যে, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী বীর সেনানীদের এবং যুদ্ধরত সকল শ্রেণীর যােদ্ধাদের মর্যাদা এবং স্বীকৃতি দিয়েই জাতির উদ্দেশে দেওয়া তাঁর প্রথম ভাষণ আরম্ভ করেছিলেন। ‘এঁরা সকলেই আমাদের জাতির সম্পদ, জাতির গর্ব কোনাে বিশেষ দলের নয়।’
আমরা মনে করি, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এপ্রিলের প্রথম দিকেই অঙ্কুরিত হয়েছিল। তারপর অতি দ্রুত এটি সম্প্রসারিত হয় ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক পলাশীর কাছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগরে (মেহেরপুর) আগত অসংখ্য সাংবাদিক, রেডিও.টি.ভি. প্রতিনিধি, আমন্ত্রিত অতিথি এবং বিশাল জনসমুদ্র-সমাবেশে প্রজাতন্ত্রের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করেন। ১৮ এপ্রিল মন্ত্রিসভা-সভায় দপ্তর বণ্টন হয়, যা প্রধানমন্ত্রী স্বহস্তে লিপিবদ্ধ করেন। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং যে ধারা এখনও অব্যাহত।
বাঙালি জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রধানতম বৈশিষ্ট্য হল এই যে, এই যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছে বাঙালি জাতির ভােটাধিকার প্রয়ােগে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সম্পূর্ণ অসামরিক সরকারের নেতৃত্বে। আরাে উল্লেখযােগ্য, যে-দিকটি আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তা হলাে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীতে সেই সময় কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা, সৈনিকসিপাই সকলেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন প্রত্যক্ষভাবে। আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশবাহিনীর বাঙালি সদস্যরাও বাঙালি জাতির মুক্তি এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের প্রতিজ্ঞায় যুদ্ধে অবতীর্ণ হয় দখলদার বর্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে।
ই.পি.আর.-পুলিশবাহিনীতে সেদিনের কর্মরত বাঙালি সদস্যরা বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিতে বলীয়ান হয়ে প্রতিরােধযুদ্ধে অগ্রসর হয়। প্রতিরােধের প্রথম প্রহরে তাদের সংগ্রামী বিক্রম আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে হয়ে থাকবে অম্লান। আর একথা তাে মনে রাখতেই হবে যে পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনে বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন বিজয়ী আওয়ামী লীগকে দেশ-পরিচালনার ক্ষমতা না দেওয়ায় পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে বাঙালির সর্বাত্মক অসহযােগ আন্দোলন আহূত হয়। এই আন্দোলনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত বাঙালি সেনা কর্মকর্তারা প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে এসব সেনা-কর্মকর্তা বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধুর সরাসরি আনুগত্যে আন্দোলনে যােগ দেন।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক ভাষণে ঘােষণা করলেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এই ভাষণে প্রতিরােধ যুদ্ধের জন্য বাঙালি জাতিকে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দিয়ে গেরিলাযুদ্ধের কৌশল জানিয়ে দিলেন। আর এই ভাষণ-ই পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘােষণা বাঙালির স্বাধীনতার ঘােষণা। বঙ্গবন্ধুর এই ভাষণ শুনে ও হৃদয়ে ধারণ করে সমগ্র জাতি সংগ্রামী শক্তিতে উজ্জীবিত হয়। ঐতিহাসিক এই ভাষণের পরপরই দেশের বিভিন্ন জেলায় অবস্থানরত বাঙালি সামরিক কর্মকর্তা ও সৈনিকরা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে ছাত্র-শিক্ষক, কৃষক-শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশাজীবী তরুণদের অস্ত্র-প্রশিক্ষণ দান আরম্ভ করেন। যারা তখন পাকিস্তানি সরকারের সামরিক বাহিনীতে নিয়মিত চাকুরিরত ছিলেন তাদের মধ্যে অনেক বাঙালি সদস্য মনে মনে প্রস্তুত হচ্ছিলেন। অপেক্ষা করছিলেন বিদ্রোহের মুহূর্তটির জন্য।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের মধ্যরাতে বাংলাদেশের জনগণের উপর বর্বরােচিতভাবে অতর্কিত হামলা শুরু করে। এই আক্রমণ শুধু নিরস্ত্র জনগণ বা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধেই নির্দিষ্ট ছিল না, তারা সামরিক বাহিনীর বাঙালি সেনাদেরও নিরস্ত্র করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এমতাবস্থায় নিজেদের নিরাপত্তার খাতিরে হলেও সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনীর বাঙালি সদস্যদের পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে অস্ত্র তুলে নেয়ার প্রয়ােজন অনিবার্য হয়ে পড়ে।
প্রতিরক্ষাবাহিনীর প্রায় সকল বাঙালি ইউনিট ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে সুযােগমতাে নিজেদের প্রতিরক্ষায় পাকিস্তানি সেনা ইউনিট থেকে আপাতনিরাপদ দূরত্বের সন্ধান করতে থাকে। কোনাে কোনাে ইউনিট প্রাথমিক অবস্থাতেই বিদ্রোহের মাধ্যমে পক্ষত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম ই.পি.আর. বাহিনীর বাঙালি সদস্যগণ ক্যাপ্টেন রফিকের নেতৃত্বে ২৫ মার্চ রাত সাড়ে নয়টায় বিদ্রোহ ঘােষণা করে। উল্লেখ্য যে, ই.পি.আর. বাহিনীর অফিসারগণ ছিলেন মূলত সেনাবাহিনীর অফিসার; সে কারণে সেনাবাহিনী ও ই.পি.আর. সদস্যদের মধ্যে সমন্বয়ে কোথাও কোনাে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি হয়নি।
প্রাথমিক অবস্থায় ই.পি.আর. ও সামরিক বাহিনী স্থানীয় ভিত্তিতে প্রতিরােধ গড়ে তােলে। ক্রমে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আক্রমণ তীব্র হয়ে উঠলে পক্ষ ত্যাগকারী সৈনিক, ই.পি.আর. ও সশস্ত্র ব্যক্তিদের আঞ্চলিক ভিত্তিতে একত্র করে সমন্বিতভাবে বৃহত্তর প্রতিরােধের প্রচেষ্টা নেয়া হয়। কিন্তু সীমিত অস্ত্র ও গােলাবারুদ বেশিদিন এই প্রতিরােধকে ধরে রাখতে পারেনি। নিরাপদ আশ্রয়, সুষ্ঠু সমন্বয় ও পর্যাপ্ত গােলাবারুদের সন্ধানে পুরাে বাহিনীকেই পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে অবস্থান নিতে বাধ্য করে। বাংলাদেশের ভৌগােলিক সীমানার ৭০ ভাগের বেশি অংশ জুড়ে ভারতের অবস্থান। সঙ্গত কারণেই প্রায় সকলেই ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী ১১ এপ্রিল কালুরঘাট যুদ্ধে আহত অবস্থায় কিছু সৈন্যসহ বার্মায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। এই ঘটনা প্রমাণ করে যে, বাংলাদেশের পার্শ্ব সীমানায় অন্য কোনাে দেশের অবস্থান থাকলে এই সেনাসদস্যরা সেখানেও অবস্থান গ্রহণ করতে ইতস্তত করতেন না। বাংলাদেশের
পৃষ্ঠা: ১০৫
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আহমদের সাথে পার্শ্ববর্তী দেশের সরকারের সঙ্গে অলিখিত সমঝােতা আগেই হয়ে গিয়েছিল বলে সশস্ত্র অবস্থায় এসব বাঙালি সামরিক-বেসামরিক লােকজনের পক্ষে এভাবে সীমান্ত পাড়ি দেওয়া সম্ভব হয়।
১২ এপ্রিলে অনানুষ্ঠানিক বৈঠকে ১ নম্বর বিষয় প্রতিরক্ষা যুদ্ধ, যুদ্ধের সরবরাহ, স্বরাষ্ট্র এবং ১৪ এপ্রিলের মন্ত্রিসভা কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তের ক্রমিক ৮ ও ৯ প্রণিধানযােগ্য:
মুক্ত অঞ্চলে ওষুধ ইত্যাদি। যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা এবং জনগণের জন্য সীমান্তে সহায়ক হাসপাতাল। উদীয়মান, প্রতিশ্রুতিশীল ই.পি.আর/বেঙ্গল রেজিমেন্টে অধঃস্তন অফিসার ও জোয়ান; সামরিক বাহিনী প্রাক্তন সদস্য; আনসার-মুজাহিদ, প্লাটুন কমান্ডার; রাজনৈতিক শিক্ষিত ও ইউ.ও.টি.সি. সদস্যবৃন্দের জন্য লিডারশিপ প্রশিক্ষণ (Leadership Training)।
উদ্ধৃতি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ আহমদের নােট থেকে। তাঁর দূরদর্শিতা কত সুদূরপ্রসারী ছিল, তা পাঠককেও ভাবনার খােরাক দেবে!
এপ্রিল মাসের কোনাে এক সময় কর্নেল (অব.) ওসমানী রামগড় পরিদর্শন করেছিলেন। তাঁর সাথে ছিলেন এম.আর. সিদ্দিকী, এম.এ. হান্নান, ড. মােশাররফ হােসেন, মির্জা আবু মনসুর ও আরও অনেকে। দুপুরে তারা আমাদের অস্থায়ী বাসস্থানে খাবার খান; আমার স্ত্রীর হাতের রান্না। তিনি এ সময় সেনা-অফিসারদের তদারকি করছিলেন, কিন্তু তখনও তাঁকে সরকারিভাবে প্রধান সেনাপতি নিয়ােগ করা হয়নি। মন্ত্রিসভা সম্পর্কে শহীদ তাজউদ্দীনের বিভিন্ন নােট দেখলে বােঝা যায় (অব.) কর্নেল ওসমানী তখন বিভিন্ন অঞ্চল সফর করে প্রধানমন্ত্রীকে অবহিত রাখছিলেন এবং মাঝে মাঝে গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশও করছিলেন। ১৫ এপ্রিল তিনি প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেন। তার সাথে এম.আর. সিদ্দিকী ও আরেকজন ছিলেন। এটা পূর্বাঞ্চল সফরের অব্যবহিত পরেই। ১৬ এপ্রিল কর্নেল (অব.) ওসমানী প্রতিরক্ষা-বিষয়ে মােট ১৬টি বিশেষ বক্তব্য রাখেন। এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য চারটি ছিল নিম্নরূপ:
১. বিভিন্ন ট্রেজারি থেকে দ্রুত অর্থ সংগ্রহ করে মুক্ত ও নিরাপদ অঞ্চলে আনয়ন; ২. যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন;। ৩. সরবরাহ লাইন সংরক্ষণ (Line of Supply); ৪. আগ্নেয়াস্ত্রের ক্ষমতাবৃদ্ধি (অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর হাতে অধিকতর শক্তিশালী আগ্নেয়াস্ত্র, Fire Power, দেওয়া)।
এ সবই সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত যা মুক্তিফৌজের জন্য অপরিহার্য ছিল। প্রতিরক্ষা সংগঠনেও সহায়ক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দীর্ঘায়িত হতে পারে সেই লক্ষ্যে প্রতিরক্ষাকে প্রস্তুত এবং মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে সর্বাত্মক মনােনিবেশ বিশেষ উল্লেখযােগ্য।
১০ এপ্রিলে প্রধানমন্ত্রীর নােটে লেখা: যােদ্ধাদের জন্য সরবরাহ, প্রলম্বিত যুদ্ধ, অস্ত্র ও গােলাগুলি/সমরাস্ত্র ও যন্ত্রপাতি।
প্রতিরক্ষা সংগঠনে ২৯ এপ্রিলের সিদ্ধান্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্ত নিম্নরূপ:
১১. কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি (Commander-in-Chief) পদে নিয়ােগ অনুমােদন করা হল।
১২. লে. কর্নেল আবদুর রবের বাংলাদেশ বাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়ােগ অনুমােদন করা হলাে।
স্বাক্ষর: সৈয়দ নজরুল ইসলাম
১৬/৫/৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় প্রধান সেনাপতির নানাবিধ সমস্যা, শহীদ মুক্তিযােদ্ধাদের পরিবারের ভরণপােষণ/ভাতা সম্পর্কে বিশদ আলােচনা হয়। এই সভা পরের দিন পর্যন্ত গড়ায়। ১৭/৭/৭১ তারিখের সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, শুধুমাত্র প্রতিরক্ষা বিষয়াদি আলােচনার জন্য শুক্রবার নির্ধারিত হলাে। এই সিদ্ধান্ত গৃহীত হলেও প্রয়ােজনবােধে অন্যান্য দিনেও প্রতিরক্ষা বিষয় আলােচনায় স্থান পেত, গুরুত্ব অনুযায়ী।
মুক্তিবাহিনী এবং সেক্টর-কমান্ডারদের নানাবিধ সমস্যা প্রতিদিনই আলােচনা হত (মন্ত্রিসভাও বৈঠকে বসত প্রতিদিন)। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রস্তাবনা, যা সারসংক্ষেপ আকারে প্রতিরক্ষা-সচিব পেশ করতেন, শুধুমাত্র সেসব বিষয় এবং প্রধান সেনাপতির প্রতিবেদন, বিশেষ রিপাের্ট এবং সুপারিশসমূহ শুক্রবারে আলােচনার জন্য নির্ধারিত ছিল। ঐদিন অন্য কোনাে বিষয় আলােচনা করা হত না। মুক্তিবাহিনী-সংশ্লিষ্ট বিষয়, যেমন যুবশিবির, চিকিৎসা, হাসপাতাল, সরবরাহ, যানবাহন ইত্যাদি বিষয় অবশ্যই আলােচিত হত। এই সিদ্ধান্তটি অতি গুরুত্বপূর্ণ।
২৯ এপ্রিলের সভায় অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। তাতে বলা হয়: সশস্ত্র বাহিনী সম্পর্কে সিদ্ধান্ত হলাে যে প্রধান সেনাপতি অফিসারদের একটি তালিকা প্রস্তুত করবেন। সেনা কমান্ডকে (Army command) সমন্বিত করে কঠোর শৃঙ্খলার মধ্যে আনতে হবে। বাংলাদেশ বাহিনীতে প্রশিক্ষণার্থীদের (trainees) বাছাইপর্বে যথাযথ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।’ সুসংগঠিত সেনা কমান্ডের (Army Command-এর) শুরু এভাবেই হয়।
আগস্ট-এর ১০ তারিখে সিলেটের ডেপুটি কমিশনার জনাব আবদুস সামাদকে প্রতিরক্ষা-সচিব নিয়ােগ করা হয়। এর কয়েকদিন আগেই তিনি রিপাের্ট করেন। সামাদের যােগদানের ফলে প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ে প্রাণের সঞ্চার হয়। তিনি এসেই মন্ত্রণালয়-সংগঠনে আত্মনিয়ােগ করেন এবং সেনা সদর-দপ্তর এবং সেক্টর-কমান্ডারদের সাথে সরকারের সমন্বয় ও যােগাযােগ সুদৃঢ় করেন। আমরা সকলে অর্থাৎ খন্দকার আসাদুজ্জামান, নূরুল কাদের ও আমি এবং অন্যান্য সহকর্মী সামাদকে সর্বাত্মক সহযােগিতা, সমর্থন এবং সাহায্য দিতে থাকি। আমাদের কাজ তাে একটাই— দেশ স্বাধীন করা। অতএব সশস্ত্রবাহিনী এবং মুক্তিবাহিনীকে শক্তিশালী করতে যা-কিছু প্রয়ােজন, একক এবং সম্মিলিতভাবে করে যাব। এই লক্ষ্যে আমরা এক, অভিন্ন ও অদম্য অটুট।
সামাদ বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের সহপাঠী, পুরনাে সহকর্মীও বটে। আমাদের সমঝােতায় কোনাে অসুবিধা হয়নি। সে যােগদানের পরেই মন্ত্রণালয়ে নতুন নতুন পদ সৃষ্টি ও কর্মকর্তা নিয়ােগ করা হলাে, অতি দ্রুত। সামাদ দীর্ঘদিন সিলেটের ডি.সি. থাকায় কর্নেল ওসমানী ও লে. কর্নেল রবের পূর্বপরিচিত। তাঁদের পারস্পরিক বােঝাপড়া চমৎকার ছিল। কর্নেল ওসমানীর মেজাজ সর্বজনবিদিত। কেউ তাঁকে ঘটতে চাইত না। সামাদ অত্যন্ত দৃঢ়চিত্তের, কিন্তু স্বল্পভাষী। ওকেও সবাই সমীহ করত। ওর বুদ্ধিমত্তা আর ধীশক্তি ছিল অসাধারণ। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার পাবনার ছেলে। ড. ফারুক আজিজও (প্রধানমন্ত্রীর পি.এস.) পাবনার। অতএব সুন্দর একটা দল (team) গড়ে উঠেছিল।
সচিব সামাদকে প্রতিরক্ষামন্ত্রণালয়ে সহায়তা করতেন উপসচিব আকবর আলী খান (সি.এস.পি., হবিগঞ্জের প্রাক্তন মহকুমা প্রশাসক), সহকারী সচিব নূরুল ইসলাম চৌধুরী এবং সহকারী সচিব এম.এইচ. সিদ্দিকী।
কর্নেল (অব.) ওসমানী প্রায় প্রতিটি মন্ত্রিসভা বৈঠকে উপস্থিত থাকতেন; অবশ্য যখন তিনি হেডকোয়ার্টার-এ অবস্থান করতেন সে-সময়। কখনাে কখনাে সীমান্তে অথবা রণাঙ্গনে চলে যেতেন সরেজমিনে তদারকিতে। তার উপস্থিতিতে মুক্তিবাহিনী অনুপ্রাণিত হতাে। তাঁর পুরনাে পরিচিত অনেক জে.সি.ও. (J.C.O.) ব্যক্তিগতভাবে সেনা-অফিসার এবং জওয়ানদের তিনি খবরাখবর নিতেন— খাওয়া, থাকা, চিকিৎসা, পরিবার এইসব— তাতে ফৌজের সাথে প্রধান সেনাপতির আত্মিক সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
প্রধান সেনাপতির সঙ্গে আমার পরিচয় হয় ১৯৬৫ সালে রাওয়ালপিণ্ডিতে। সে সময় আমরা তৎকালীন পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারে কর্মরত ছিলাম। কর্নেল ওসমানীর ভাই এম.আর. ওসমানীও তখন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে কর্মরত ছিলেন। তিনিই রাওয়ালপিন্ডি ক্লাবে কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে আমার পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন। তিনি সেদিন আমাদের বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের কৃতিত্বের কথা বলেছিলেন। মেজর জিয়াও তৎকালীন বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন। আমরা সেদিন আনন্দিত ও গর্বিত হয়েছিলাম। আমাদের সকলের পূর্বপরিচিত কর্নেল (অব.) ওসমানী ১৯৭১-এ গণপরিষদ সদস্য (এম.এন.এ.) নির্বাচিত হন। তিনি তখন অবসরপ্রাপ্ত। সেই কর্নেল ওসমানী আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি।
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সংক্ষিপ্ত সাংগঠনিক কাঠামাে ও অবস্থান নিম্নরূপ ছিল:
বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী
সশস্ত্র বাহিনী সদর দপ্তর: মুজিবনগর
প্রধান সেনাপতি: কর্নেল (অব) এম.এ.জি. ওসমানী
চিফ অব স্টাফ: লে. কর্নেল আবদুর রব- পূর্বাঞ্চলের দায়িত্বপ্রাপ্ত
ডেপুটি চিফ অব স্টাফ: গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার- অপারেশনের দায়িত্বপ্রাপ্ত
সামরিক বাহিনীর যে-সকল অবসরপ্রাপ্ত (বাঙালি) অফিসার ও সৈনিক অসহযােগ আন্দোলনের ধারাবাহিকতার সাথে যুক্ত ছিলেন, সশস্ত্র বাহিনীর সমন্বিত করণ প্রয়াসে তাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা ছিল। পাকিস্তান বিমান ও নৌবাহিনীর পক্ষত্যাগী সদস্যগণও বিচ্ছিন্নভাবে বাংলাদেশ সরকারে যােগদানের ফলে বিভিন্ন সেক্টর ও কার্যালয় সমন্বিত হয়।
১৯৭১ সালের জুন মাসের মাঝামাঝি সময় পর্যন্ত বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর অঞ্চলভিত্তিক যে-অবস্থান পাওয়া যায় তা নিম্নরূপ ছিল:
ক. পার্বত্য চট্টগ্রাম: ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম-ই.পি. আর ও অন্যান্য
খ. চট্টগ্রাম ও ফেনী: মেজর জিয়াউর রহমান— ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
গ. কুমিল্লা অঞ্চল: মেজর খালেদ মােশাররফ- ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
ঘ. সিলেট (পূর্ব): মেজর মেজর শফিউল্লাহ— ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট।
ঙ সিলেট (উত্তর): মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত– ই.পি.আর ও অন্যান্য।
চ. কুড়িগ্রাম লালমনিরহাট: ক্যাপ্টেন নােয়াজেস উদ্দিন ই.পি.আর ও অন্যান্য
ছ. ঠাকুরগাঁও-দিনাজপুর: মেজর নাজমুল হক ই.পি.আর ও অন্যান্য
জ. সৈয়দপুর-পার্বতীপুর: ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন– ৩ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট
ঝ. নবাবগঞ্জ-রাজশাহী: ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দিন আহমেদ চৌধুরী ই.পি.আর ও অন্যান্য
ঞ. কুষ্টিয়া-যশাের: মেজর আবু ওসমান চৌধুরী— ই.পি.আর. ও প্রথম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট
ট. খুলনা-বরিশাল: মেজর মাে: জলিল মিয়া
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অফিসার, যারা বিদ্রোহী হয়ে পক্ষত্যাগ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন, তাঁরা নিয়মিত ইউনিট ও আধা-সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তুলেছিলেন। নিম্নলিখিত সংগঠনগুলাের ভূমিকা ছিল উল্লেখযােগ্য:
ক. মানিকগঞ্জ এলাকা: ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল হালিম চৌধুরী
খ. টাঙ্গাইল এলাকা: আবদুল বাতেন
গ. ভালুকা-জয়দেবপুর এলাকা: সুবেদার মেজর আফসার উদ্দিন
ঘ. বরিশাল এলাকা: হাবিলদার হেমায়েত উদ্দিন।
ঙ. সুনামগঞ্জ এলাকা: ক্যাপ্টেন (অব.) আবদুল মােতালেব
বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রতিরক্ষামন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের সভাপতিত্বে জুন ‘৭১ মাসে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে যুদ্ধপরিস্থিতির সার্বিক বিশ্লেষণ করে সুষ্ঠু প্রশাসনিক ব্যবস্থার অধীন যুদ্ধ-অঞ্চল গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং এই লক্ষ্যে জরুরি ভিত্তিতে সমন্বয়সভা আয়ােজন করার জন্য বাংলাদেশ সরকারের মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল (অব.) এম.এ.জি. ওসমানীকে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ প্রদান করা হয়।
১৯৭১ সালের ১১ জুলাই মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত উচ্চপদস্থ ও বেসামরিক কর্মকর্তাদের বৈঠকে মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধাঞ্চল ও যুদ্ধ কৌশল সম্বন্ধে বিস্তারিত আলােচনা ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। উপস্থিত কর্মকর্তাগণ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নেন এবং কর্নেল (অব.) এম.এ.জি. ওসমানীর নেতৃত্বে অবিচল আস্থা ও আনুগত্য স্থাপন করেন। এই বৈঠকে কর্নেল আবদুর রব, চিফ অব স্টাফ ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিযুক্ত হন। বাংলাদেশের সমস্ত যুদ্ধাঞ্চলকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে অধিনায়ক নিযুক্ত করা হয়। সিনিয়র অফিসারগণের মধ্যে যে যেখানে যুদ্ধরত ছিলেন তাঁকে সেই অঞ্চলেরই দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং তার অধীনস্থ এলাকায় অবস্থিত সমস্ত দল বা উপদলকে তাঁর একক অধিনায়কত্বে আনার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুক্ত-এলাকায় কর্তৃত্ব গ্রহণ ও সমন্বিত পরিকল্পনা অনুযায়ী আক্রমণ-কৌশল নির্ধারণের জন্য এই নিয়মিত বাহিনী গঠনের প্রয়ােজনীয়তা সবচেয়ে বেশি ছিল। মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর., আনসার, মুজাহিদ, পুলিশ ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুব-স্বেচ্ছাসেবকদের সমন্বয়ে এই ব্রিগেড গঠনের প্রস্তাব পেশ করা হয়। প্রাথমিকভাবে তিনটি ব্রিগেড গঠন করে জেড-ফোর্স’, কে-ফোর্স’, ও এস-ফোর্স’ নামে নামকরণ করা হয়।
২১ নভেম্বর ‘৭১ বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের যৌথ সিদ্ধান্তে ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সমন্বয়ে যৌথকমান্ড গঠন করা হয় এবং সমগ্র যুদ্ধ-এলাকাকে পুনঃবিন্যাসের মাধ্যমে মােট ৪টি যুদ্ধাঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। মুক্তিবাহিনীর ১০টি সেক্টর ও নিয়মিত বাহিনীর ৩টি ব্রিগেডকে এই ৪টি অঞ্চলের যৌথকমান্ডে সমন্বিত করা হয়। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর চূড়ান্ত বিজয় অর্জন পর্যন্ত এই কমান্ড কার্যকর ছিল।
প্রতিটি রণাঙ্গন সফরের পরই প্রধান সেনাপতি তার রিপাের্ট পেশ করতেন। সমস্যাবলি তুলে ধরতেন। মন্ত্রিসভাও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাৎক্ষণিকভাবে সমস্যা-সমাধানে তৎপর হতেন। আর সেখানেই যােগসূত্র ছিলেন সচিব সামাদ। আমি এবং নূরুল কাদের খান সর্বতােভাবে সমর্থন দিতাম। আর্থিক প্রসঙ্গ থাকলে অর্থ-সচিব আসাদুজ্জামান। এরকম একটি সভার বর্ণনা করছি নিচে:
২৩ আগস্টের সভায় উপস্থিত ছিলেন:
১. অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ২, প্রধানমন্ত্রী ৩. পররাষ্ট্র মন্ত্রী ৪. অর্থমন্ত্রী ৫. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ৬. প্রধান সেনাপতি এবং মন্ত্রিপরিষদ সচিব (আমি) ও প্রতিরক্ষা সচিব (সামাদ)।
নিয়মিত আলােচ্যসূচি আরম্ভ করার আগে সভাপতি প্রধান সেনাপতিকে তাঁর প্রতিবেদন উপস্থাপন করতে অনুরােধ জানিয়েছিলেন। মুক্তিবাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে প্রধান সেনাপতি যে প্রতিবেদন পেশ করেন তার অংশবিশেষ নিম্নরূপ ছিল:
ক. মুক্তিবাহিনী শত্রুর বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি বীরত্বপূর্ণ সফলতা অর্জন করেছে। সার্বিক হতাহতের অনুপাত মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ৬:১০০। সম্প্রতি চট্টগ্রাম, চালনা এবং সুনামগঞ্জে আমাদের বীর মুক্তিবাহিনী শত্রুর বড় রকমের ক্ষতিসাধন করেছে। অস্ত্রশস্ত্র এবং অন্যান্য মূল্যবান জিনিসপত্র বােঝাই কয়েকটি জাহাজ ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। মােটর লঞ্চ এবং বার্জ দখল করে নিয়েছে আমাদের সৈন্যরা।
প্রধান সেনাপতি এতেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাঁর মতে আরও অনেক কিছু করণীয় আছে, আরও উন্নতি করতে হবে।
অবশ্য এর আগে আরও অনেক সভাতেই মুক্তিবাহিনীর সমস্যা ও সাফল্য নিয়ে আলােচনা হয়েছে। বিবিধ সিদ্ধান্তও গৃহীত হয়েছে। অক্টোবর ৭ তারিখের আলােচনা ও সিদ্ধান্ত ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এই সভায় স্বাস্থ্যসচিবকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তিনি তাঁর প্রকল্প মুক্তিবাহিনী সদস্যদের চিকিৎসা (Scheme for the Medical Care of the Mukti Bahini) পেশ করেন। প্রকল্পটি নীতিগতভাবে অনুমােদিত হয়।
এরপর স্বাস্থ্যসচিব প্রতিরক্ষা দপ্তরের স্বাস্থ্যখাতে বরাদ্দের প্রস্তাব করেন। সিদ্ধান্ত হয় যে, অবিলম্বে স্বাস্থ্য (প্রতিরক্ষা মেডিকেল সার্ভিস)’ এই নামে নতুন একটি খাত (Head of Account) খােলা হবে। ১০ লক্ষ রুপির একটি তাৎক্ষণিক বরাদ্দ এতে দেওয়া হলাে। আরও সিদ্ধান্ত হলাে যে প্রধানমন্ত্রী যুগপৎ প্রতিরক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বিধায় তাঁকেই প্রয়ােজনমতাে এই অর্থ উঠানাের ক্ষমতা দেওয়া হলাে। যেহেতু বন্ধুরাষ্ট্রের সহযােগী প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেই মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসা-ব্যবস্থা করার কথা, বরাদ্দকৃত অর্থ (বাংলাদেশ সরকারের অর্থ নিতান্ত জরুরি প্রয়ােজন নেই) প্রধানমন্ত্রী ব্যয় করবেন। চাহিদা (requisition) অনুযায়ী অর্থমন্ত্রী টাকা ছাড় করবেন।
বাংলাদেশের মানুষের সমর্থনে ও আত্মিক অংশগ্রহণে আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ ছিল পরিপূর্ণভাবে জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধে অবসরপ্রাপ্ত পাকিস্তানি সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর বাঙালি কর্মকর্তা ও সাধারণ যােদ্ধাসহ সেই সময় পাকিস্তানের সেনাবাহিনীতে নিয়মিত কর্মরত বাঙালি সেনা কর্মকর্তা ও সৈনিকরা অংশগ্রহণ করেছিলেন। তাঁদের দায়িত্ব দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অধীন যে যুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল তা বিশ্বের অন্যান্য যুদ্ধের সঙ্গে তুলনীয়। তবে আমাদের যুদ্ধের প্রধান বৈশিষ্ট্য— এই যুদ্ধ জনগণের যুদ্ধ, জনতার যুদ্ধ। দেশের কৃষক-শ্রমিক, ছাত্র-শিক্ষক, তরুণ-যুবক বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণ নিয়ে
পৃষ্ঠা: ১০০
হয়ে উঠেছিল এক-এক জন উন্নতশির বীর সৈনিক। ভাবতে অবাক হতে হয়— কী করে সম্ভব হলাে এমনটি! বাংলাদেশের মানুষ সাধারণভাবে নরম মনের ভাবাবেগপূর্ণ শিল্পীমনা। সমরাস্ত্র ব্যবহার বিষয়ে ছিল না সম্যক ধারণা। তবু, আমার মনে হয় দেশপ্রেমে বলীয়ান হয়ে দেশমাতৃকার মুক্তির ব্রতে আধুনিক স্বয়ংক্রিয়, সমরাস্ত্র হাতে মানুষ-মারার শক্তিতে দুর্ধর্ষ পাকিস্তান বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হয়েছে, বিজয়ী হয়েছে। তাদের বিক্রম ও সার্বিক যুদ্ধকৌশল এবং আত্মদানের মহান আদর্শের কথা বাঙালি জাতি স্মরণ করবে যুগযুগ ধরে শ্রদ্ধাবনত চিত্তে—কৃতজ্ঞতা ভরে।
চিকিৎসা, ফিল্ড হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ে প্রতিনিয়ত প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় এবং সেনাবাহিনী সদর দপ্তর (যার মূল সমন্বয়কারী ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার) বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতেন; কখনও মিত্রবাহিনীর সহায়তায়, কখনও নিজস্ব সম্পদ থেকে। প্রধান সেনাপতি ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় আরও যেসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত, সহযােগিতা এবং অর্থ বরাদ্দ লাভ করেন সেগুলাে হলাে:
১. যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বিশেষ পরিচর্যা ও দেখাশুনার ব্যবস্থা; ২. জরুরি ভিত্তিতে শীতবস্ত্র সংগ্রহ (যুবশিবির সংক্রান্ত অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণিত হয়েছে); ৩. যুবশিবির এবং অভ্যর্থনা শিবির-এর সদস্যদের জন্য তাঁবু এবং শীতবস্ত্র (যুবশিবির অধ্যায় দ্রষ্টব্য)।
মুক্তিবাহিনীকে সহায়তা করার উদ্দেশ্যে বিশেষ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন প্রকৌশলীদের, যারা ইতােপূর্বে প্রতিরােধযুদ্ধের সময়, বিশেষ করে চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, ফেনী-বেলােনিয়া, সিলেট ইত্যাদি অঞ্চলে, সড়ক ও সেতু-নির্মাণ (মুক্তিবাহিনীর জন্য) এবং শত্রু-চলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টির জন্য পাশাপাশি ধ্বংস (demolition) করতেন তাদের আমরা বিভিন্ন সেক্টরে নিয়ােগ করতাম। পাশাপাশি প্রচারমাধ্যমে প্রকাশ করার জন্য (যেমন, স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র) বিভিন্ন অপারেশনের খবর সংগ্রহ ও বিতরণ করার লক্ষ্যে প্রতিটি অঞ্চল (zone) এবং সেক্টরের অধীন তথ্য অফিসার নিয়ােগ করেছিলাম। অনেক ক্ষেত্রে সেক্টর-কমান্ডাররা আমাদের আঞ্চলিক প্রশাসককেও বিভিন্ন প্রয়ােজনে অনুরােধ জানাতেন। মেজর খালেদ মােশাররফ HQ Sub Sector D-3 থেকে ২১ জুলাই আমাকে একটি চিঠি লেখেন (পরিশিষ্ট ৬৯ দ্রষ্টব্য) চিঠির বিষয়বস্তু লক্ষণীয়।
আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Council), বিশেষ করে চেয়ারম্যান এবং প্রশাসকগণ সেক্টরকমান্ডারদের সবরকম সাহায্য ও সহযােগিতা দিতেন। মুক্তিবাহিনী ও যুদ্ধাঞ্চলের সুবিধার জন্যই আমাদের প্রশাসনিক অঞ্চলগুলি এমনভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছিল যেন সেখান থেকে দ্রুত সরবরাহ ও সাহায্য পাঠানাে যায়। যুদ্ধক্ষেত্র থেকে শহীদদের লাশ অপসারণ, দাফনকাফনের ব্যবস্থা, গুরুতর আহত যাদের ফিল্ড হাসপাতালে চিকিৎসা সম্ভব নয় তাদের বড় হাসপাতালে পাঠানাের ব্যবস্থা, অর্থসাহায্য দান প্রভৃতি ছিল দৈনন্দিন কর্মধারা।
মেজর জিয়াউর রহমান কর্তৃক লেখা অর্থবরাদ্দের জন্য আমাকে, পূর্বাঞ্চলের প্রশাসক, ৬ জুলাই; মেজর খালেদ মােশাররফ কর্তৃক বিভিন্ন স্থানে (১০টি) বিবিধ কাজে নিয়ােগের উদ্দেশ্যে বেসামরিক কর্মকর্তাদের তালিকা সরবরাহের অনুরােধ (জুলাই মাসে) এবং মেজর নূরুল আলমের ১৭।৭।৭১ তারিখে ফটোগ্রাফারের জন্য অনুরােধ-পত্র ইত্যাদি পরিশিষ্টে সংযােজন করা হয়েছে। এ থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ ভূমিকা ও গুরুত্ব সম্বন্ধে বােঝা যাবে (পরিশিষ্ট ৭০ এবং ৭১ দ্রষ্টব্য)।
মুক্তিযুদ্ধের ডেপুটি চিফ অব স্টাফ ও বিমানবাহিনী-প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ.কে. খন্দকার বীরউত্তম যুদ্ধের নীতি-নির্ধারকদের মাঝে অন্যতম। তিনি নৌ-কমান্ডােদের সাহসিকতা সম্পর্কে বলতেন— মুক্তিযুদ্ধে নৌ-কমান্ডােদের অভিযান কেবল যে যুদ্ধে বিজয় অর্জন ত্বরান্বিত করেছিল তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধকে ঐশ্বর্যমণ্ডিতও করেছে। বাংলার এ দামাল ছেলেরা শ্রেষ্ঠ বীরের মর্যাদার অধিকারী।
মুক্তিযুদ্ধে এক নম্বর সেক্টরে সেক্টর-কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর-উত্তম এবং মিত্রবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের ডেল্টা সেক্টরের কমান্ডিং অফিসার ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং নৌঅভিযানের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন। মেজর রফিকের বক্তব্যে জানা যায় তিনি এবং সাবেগ সিং ১৫ আগস্ট (৭১)-এর অপারেশন জ্যাকপটের পরিকল্পনাকারী ছিলেন। আগস্টের ১৩ অথবা ১৪ তারিখে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর ক্যাপ্টেন সামন্ত নৌ-কমান্ডাে বাহিনীর সার্বিক প্রস্তুতি এবং অভিষেক প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের জন্য আগরতলা সফর করেন।
এখানে একটি বিষয় উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, নৌ-কমান্ডােদের মাঝে অধিকাংশ সদস্য ছিলেন ছাত্র এবং যুবক, যারা দেশের সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত শ্রেণী থেকেই এসেছিল। তারা নির্ভীক যােদ্ধা ছিল সত্য কিন্তু যুদ্ধ-পরিকল্পনা গ্রহণ করার মতাে বয়স, মেধা কিংবা যােগ্যতা তাদের ছিল না। ফ্রান্স থেকে যে আটজন নাবিক মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করেন, তারা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে একটি নৌ-কমান্ডাে বাহিনী গঠনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন, কিন্তু তাদের মাঝেও মাত্র একজনই ছিলেন জুনিয়ার অফিসার। এত বৃহৎ নিপুণ এবং তাৎপর্যপূর্ণ যুদ্ধ-পরিকল্পনা গ্রহণ তাঁদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। একই কারণে নৌকমান্ডাে বাহিনীর সার্বিক দায়িত্ব প্রধান সেনাপতি নিজের অধীনেই রেখেছিলেন।
স্বাধীনতাযুদ্ধে তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম.এ.জি. ওসমানীর একান্ত আগ্রহ ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ সরকারের অনুকূলে স্থলবাহিনীর পাশাপাশি প্রথম একটি ক্ষুদ্র নৌবাহিনী প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান নৌবাহিনী, ১৯৬৯ সনে ৫৭ জন নৌ-কর্মকর্তা ও নাবিককে ফ্রান্স থেকে দুটি সাবমেরিন খরিদ এবং উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য প্রেরণ করে, এদের মাঝে ১৩ জন বাঙালি নাবিকও ছিলেন। ৭১-এর ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি হানাদাররা নিরস্ত্র বাঙালিদের গণহত্যা শুরু করলে ফ্রান্সে বসেই এই বাঙালি নাবিকবৃন্দ বি.বি.সি. ও ভয়েস অব আমেরিকার প্রচারমাধ্যমে গণহত্যার সংবাদ জানতে পারেন। ১৩ জন নাবিকের মধ্য থেকে ৯ জন গােপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত নেন বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারতে যাবেন। সেই মতাে তারা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৩১ মার্চ ফ্রান্সে অবস্থানরত পাকিস্তানি সাবমেরিন থেকে পাকিস্তানি পক্ষ ত্যাগ করে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে অসমসাহসিকতার সাথে স্পেনের ভারতীয় দূতাবাসে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করেন। অনেক প্রতিকূল অবস্থার মাঝেও ভারতীয় দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স মি. বেদীর সহযােগিতায় অকুতােভয় বাঙালি নাবিকগণ বিশেষ তত্ত্বাবধানে এপ্রিলের ১০ তারিখে ভারতে পৌছান, ফলে তাদের মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্ভব হয়।
১৯৭১ সালের ১৩ মে শপথ নিয়ে ভাগীরথীর তীরে আম্রকাননে, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম নৌ-কমান্ড গঠিত হয়। ক্যাম্প নামকরণের মাধ্যমে যাত্রা শুরু করে। তখন ক্যাম্পে প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা ছিল ১২০ জন।
দশ নম্বর সেক্টরে পদস্থ কর্মকর্তা না-থাকায় কোনাে অধিনায়ক ছিল না। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রী, এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান দশম সেক্টরে প্রথম নৌবাহিনীর শুভ উদ্বোধন করেন। মংলা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে নৌ-কমান্ডােরা হামলা চালিয়ে অনেক জাহাজ ডুবিয়ে দেয়। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম হয়। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আকাশযুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দেয়।
২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনরি জন্ম হয়। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আকাশযুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দেয়।
এপ্রিল মাসের প্রথম থেকে ১৫ মে পর্যন্ত কেবল ভারতীয় বি.এস.এফ, আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা দান করত, ১৫ মে থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ড মুক্তিযােদ্ধাদের সহযােগিতা ও সমন্বয়ের দায়িত্ব নেয়। তবে তারা সরাসরি সীমান্তযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেনি। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের তিনটি পর্যায় ছিল। পর্যায়গুলাে নিম্নরূপ:
প্রথম পর্যায়: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২০ জুন পর্যন্ত। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণায় উজ্জীবিত হয়ে ছাত্র-যুবক বিভিন্ন পেশাজীবী মানুষ, কৃষক-শ্রমিক, গ্রাম ও শহরবাসী সাধারণ জন, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর., পুলিশ, আনসার স্বতস্ফূর্তভাবে পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরােচিত আক্রমণ প্রতিহত করে। অবশ্য হানাদার পাকিস্তানি দস্যুদের প্রতিঘাত করার প্রস্তুতি ছিল, তবে এ-সময়ের যুদ্ধ ছিল অপরিকল্পিত জনযুদ্ধ। অস্ত্র, গােলাবারুদের অভাব ছিল। যার যা ছিল তাই নিয়ে মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশানুযায়ী বাংলার মানুষ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধুধ্বনি উচ্চারণ করে ঝাপিয়ে পড়েছিল পাকিস্তানি শত্রুদের প্রতিহত করার মরণপণ সমরে।
দ্বিতীয় পর্যায়: ১৯৭১ সালের জুনের তৃতীয় সপ্তাহ হতে সেপ্টেম্বর। এ সময় মুক্তিযােদ্ধাদের সুসংগঠিত করা হয় এবং সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, বিভিন্ন বয়সের সাধারণ মানুষ সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনী, রাজাকার ও দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়মিত বাহিনী প্রচলিত রীতি অনুযায়ী(Conventional) যুদ্ধ শুরু করে।
তৃতীয় পর্যায়: অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ থেকে ৩ ডিসেম্বর ‘৭১ পর্যন্ত। এ সময় বাংলাদেশে চলতে থাকে গেরিলাযুদ্ধ। সীমান্ত এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষিত নিয়মিত সৈন্যদের যুদ্ধ চলে এবং বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকা হানাদারমুক্ত হয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে এসে যায়।
চতুর্থ ও শেষ পর্যায়: ৩ ডিসেম্বর হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী মিত্রবাহিনীর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ।
মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে আমি ভিন্ন এক অধ্যায়ে বলেছি, এ ছিল প্রকৃত অর্থেই জনযুদ্ধ। দেশের সর্বস্তরের মানুষ স্বদেশভূমিকে শত্রুমুক্ত করার লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিল। ছাত্র-যুবক-তরুণ-কৃষক শ্রমিক-বুদ্ধিজীবী প্রমুখ যেমন মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়ে যায়, তেমনি নিয়মিতঅনিয়মিত বাহিনীর সদস্যগণও এতে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকল সদস্যকে সে সময় প্রধানত তিনটি শ্রেণীতে চিহ্নিত করা হয়েছিল সরকারি দৃষ্টিকোণ থেকে। ছাত্র-তরুণ অসামরিক ব্যক্তি সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধা (Freedom Fighters)। এসব মুক্তিযােদ্ধার মধ্যে রাজনৈতিক আবেগ প্রবল ছিল। তাদের ভিন্নতর নামে অভিহিত করা হয়। এদের বলা হত মুজিববাহিনী (Bangladesh Liberation Force)। এরা সরকারের মুক্তিযােদ্ধা ও মুক্তিবাহিনীর চেইন অব কমান্ড বহির্ভূত ছিলেন। মুক্তিবাহিনী (Mukti Fouz) গঠিত হয় নিয়মিত বাহিনীর সদস্য, বিশেষ বাহিনীর সদস্য ও ব্যাটালিয়ন সমন্বয়ে। মুক্তিবাহিনীকে ১১টি সেক্টরে মােতায়েন করা হয়। সরকার তিন সেনা অফিসারের নামের আদ্যক্ষর দিয়ে আরাে অতিরিক্ত বাহিনীর নামকরণ করেছিলেন। এই বাহিনী ৩টি জেড ফোর্স, কে ফোর্স এবং এস ফোর্স নামে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুরােধে ভারত-সরকার আমাদের ছাত্র-যুবক ও সাধারণ মানুষদের যুদ্ধ-প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করে। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিয়ে সহায়তা করেছে। আমাদের সেনা-কর্মকর্তারা যারা পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে বিদ্রোহ করে চলে এসেছিলেন তারাও আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। আমি দেখেছি আমাদের সৈনিকরা কী গভীর নিষ্ঠার সাথে আমাদের সাধারণ মানুষদের, যারা অনেকেই কোনাে আগ্নেয়াস্ত্রই চোখে দেখেনি তাদের সংক্ষিপ্ত প্রশিক্ষণের পর একেকজন বিচক্ষণ ও সাহসী যােদ্ধায় রূপান্তরিত করেছিলেন। সীমান্ত এলাকায় মুক্তিবাহিনীরা অপারেশনকালে ভারতীয় সেনাবাহিনী সহায়তা করত এবং শেষের দিকে বিমান সাহায্য দিত। মুক্তিবাহিনীর আঞ্চলিক অফিস ছিল সীমান্ত এলাকায় আর প্রধান দপ্তর ছিল কোলকাতায়। প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম.এ.জি. ওসমানী কোলকাতা অফিসে বসতেন। ভারতীয় বাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান অফিস ছিল কোলকাতা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিবাহিনী অস্ত্র নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে। আমাদের নিয়মিত বাহিনী ভারতীয় বাহিনীকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্তে যুদ্ধ করে বিস্তীর্ণ এলাকা মুক্ত করে। আমাদের মুক্তিবাহিনীর বীরত্বের প্রশংসা করে লে. জেনারেল জে.এফ.আর জ্যাকোব লিখেছেন: মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় সেনাবাহিনীর মেজর জেনারেল অনকার সিং কালকাট এবং পরে ছিলেন মেজর জেনারেল বি.এন. সরকার। ভারতের বেশ কয়েকটি স্থানে ও সেনা-প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছিল।
নৌ-কমান্ডাে
মন্ত্রিপরিষদের সচিব হিসেবে সরকারিভাবে নৌ-কমান্ডাে সম্পর্কে কিছু তথ্য পেয়েছিলাম। উক্ত বিবরণ থেকে যা জানতে পারি তা হলাে: ৬ জনের কমান্ডাে দলকে ৩টি উপদলে ভাগ করে এক-একজন কমান্ডাের উপর ২০ জন কমান্ডাের দায়িত্ব প্রদান করা হয়। দলের নেতা-কমান্ডাের দায়িত্ব লাভ করেন শাহ আলম, মাযহার উল্লাহ ও আবদুর রশীদ। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বে প্রয়ােজনীয় সংখ্যক স্থলবাহিনীর মুক্তিযােদ্ধাকে কমান্ডােদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে দেওয়া হয়। অভিযানের কৌশলটি ছিল যে, তারা অভিযানের স্থানে পৌছে যাবেন ১০ আগস্টের আগেই। পরিকল্পনা অনুসারে কমান্ডােরা অগ্রসর হয়। ৮ আগস্ট মধ্যাহ্ন ভােজের পর হরিনা ক্যাম্প থেকে মেজর রফিক ও ভারতীয় ব্রিগেডিয়ার সাবেগ সিং কমান্ডােদের সাফল্য কামনা করে বিদায় দিয়েছিলেন।
১৫ আগস্ট রাতে চট্টগ্রাম বন্দরে ১০টি টার্গেটের অভিযান পরিপূর্ণভাবে সফল হয়। চট্টগ্রাম বন্দরের এই দুঃসাহসিক নৌ-অপারেশনের খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এই অপারেশনের খবর প্রকাশিত ও প্রচারিত হয় গুরুত্ব সহকারে। ১৫ আগস্ট আমাদের নৌ-কমান্ডােদের এই অভিযান একই সময়ে চট্টগ্রাম, মংলা, চাঁদপুর ও নারায়ণগঞ্জ নৌবন্দরে পাকিস্তানি জাহাজসমূহ ধ্বংস করে দেয়।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর সাথে যুক্ত হয়েছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এই বাহিনীর অধিনায়ক ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। মুক্তাঞ্চলে ছােট একটি রানওয়ে ছিল। সেই রানওয়ের পাশে একটি বাঁশের ঘরে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর পাইলট এবং টেকনিশিয়ানরা থাকতেন। মুক্তাঞ্চলের এই জঙ্গলাকীর্ণ এলাকায় রাতের আঁধারে বিমান চালিয়ে প্রশিক্ষণ দিতেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার। উল্লেখ্য যে, ৩ ডিসেম্বর ‘৭১ তারিখের পর ভারতীয় বিমান বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর সাথে যােগ দেওয়ায় প্রথম তিন-চার দিনের মধ্যেই ভারতীয় বিমানবাহিনী পাকিস্তান বিমানবাহিনীকে পঙ্গু করে দিতে সমর্থ হয়েছিল।
তবে এই বিমান-আক্রমণের প্রথম কৃতিত্ব নিয়েছিল নবগঠিত বাংলাদেশ বিমানবাহিনী। এয়ার কমােডাের এ.কে. খন্দকারের পরিচালনাধীন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর বৈমানিকগণ বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর নিজস্ব বিমান নিয়েই ৪ ডিসেম্বর ‘৭১ তারিখে চট্টগ্রাম ও ঢাকায় প্রথম আক্রমণ চালিয়েছিলন। উল্লেখযােগ্য কোনাে প্রশিক্ষণ ছাড়াই তারা সেদিন বােমার আক্রমণের যে নৈপুণ্য দেখিয়েছিলেন তা ছিল বিস্ময়কর। এই বিমানের রক্ষণাবেক্ষণের সম্পূর্ণ দায়িত্বও নিয়েছিলেন বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর প্রকৌশলীগণ।
বােমা হামলায় ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় বিরাজমান পরিস্থিতি মােকাবিলা করার জন্য একটি কার্যকর পরিকল্পনা তৈরি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ বিষয়ে কর্নেল ওসমানীর তত্ত্বাবধানে একটি প্ল্যান তৈরি করা হয়। এই প্ল্যানে যুদ্ধ-পরিচালনায় দক্ষ একটা কমান্ড গঠন, মুক্তিযােদ্ধা নিয়ােগের ক্ষেত্রে সুষ্ঠু নীতি অবলম্বন, প্রশিক্ষণ ও পরিবেশের উন্নতি এবং সমন্বয় ও যােগাযােগের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয়েছিল। উল্লেখ্য, আগেই বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার এক সভায় ডি.পি. ধর সহ বহু শীর্ষস্থানীয় ভারতীয় কর্মকর্তাদের উপস্থিতিতে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অধিকতর প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং যুদ্ধোপকরণ সরবরাহের দাবি জানানাে হয়।
বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন ও বিমান বাহিনীর যুদ্ধতৎপরতা সম্পর্কে জেনারেল আতাউল গনি ওসমানী মন্ত্রিসভা-সভায় একটি প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। তিনি রণাঙ্গন ঘুরে এসে অথবা যুদ্ধনীতি সম্বন্ধে তার পরিকল্পনা মন্ত্রিসভা-সভায় আলােচনা ও বিবেচনার জন্য পেশ করতেন। বিমানবাহিনী গঠন সম্পর্কিত তার বিবরণ প্রণিধানযােগ্য। আমাদের নিজস্ব বিমান ছিল না। তবে যুদ্ধের শেষের দিকে কয়েকটি বিমান নিয়ে ছােটখাটো একটি বিমান বাহিনী গঠন করা হয়। এই বাহিনীর কৌশল ছিল গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি ঘাঁটিতে হামলা করা এবং ইন্টারডিকশন অর্থাৎ শত্রুর যােগাযােগের পথকে বন্ধ করে দেয়ার জন্যে লক্ষ্যবস্তুর উপর আঘাত হানা। শত্রুর উপর প্রথম যে বিমান-হামলা হয়েছে তা বাংলাদেশের বীর
পৃষ্ঠা: ১১৫
বৈমানিকরা করেছে। ২৬ মার্চ থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত যে যুদ্ধ হয়েছে তাতে আমাদের বিমান অপ্রতুল ছিল, কিন্তু আমাদের বৈমানিকগণ বিমানঘাঁটিগুলােতে আঘাত হেনেছিল।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুক্তিযুদ্ধে সার্বিক সহযােগিতা দানের পূর্বশর্ত হিসেবে মুক্তিযুদ্ধে জাতীয় চরিত্র আরাে এবং এর অর্থনৈতিক দিকগুলাে তুলে ধরার পরামর্শ দেন। বন্ধুরাষ্ট্রের কর্মকর্তাদের সাথে আলােচনা ও পরামর্শের আলােকে বাংলাদেশ সশস্ত্রবাহিনীর তিনটি ব্যাটালিয়ান গঠন করা হয়। তবে, বাংলাদেশ সরকার আগেই জনগণকে বিভিন্ন নির্দেশ দিয়ে শত্রুর মােকাবিলা কীভাবে করতে হবে তা প্রচার করেছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতার, প্রচারপত্র ইত্যাদির মাধ্যমে। একটি স্বাধীন দেশের পূর্ণাঙ্গ সশস্ত্রবাহিনী গঠনের প্রশ্নটিকে সামনে রেখে বাংলাদেশ সরকার তখন বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গড়ে তােলার কথাও চিন্তা করেন। বিমানবাহিনীর প্রয়ােজনীয়তা তখন অনুভূত হচ্ছিল। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার বিমানবাহিনী গঠনের ব্যাপার নিয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ও কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে নিবিড়ভাবে আলােচনা করেন। এ আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে পরে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের উপস্থিতিতে ভারতীয় প্রতিরক্ষা সচিব মি.কে. লাল এবং বিমানবাহিনীর এয়ার ভাইস মার্শাল দেওয়ানের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের আলােচনা হয়।
ভারতীয় কর্তৃপক্ষ বলেন যে, আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ বৈমানিকদের ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গেই অপারেট করতে হবে এবং স্বভাবতই ভারতীয় নিয়ম-কানুন আমাদের উপর প্রযােজ্য হবে। এ প্রস্তাবে অসম্মতি জ্ঞাপন করা হয় বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে এবং বিকল্প প্রস্তাব হিসেবে আমাদের বিমান ও আনুষঙ্গিক সুবিধা প্রদানের অনুরােধ জানানাে হয়। এটা এজন্য যে, বাংলাদেশ বিমান তার নিজস্ব নিয়ম ও নিজস্ব সত্তা নিয়ে অপারেট করতে পারলে ভারতীয় বিমানবাহিনীর অনেকটা দায়িত্ব কমে যাবে। এর কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয় যে, আমাদের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বৈমানিক ও টেকনিশিয়ানের কোনাে অভাব তখন ছিল না। তাছাড়া জাতীয় সার্বভৌমত্বের কথা আমাদের বিবেচনায় সবসময়ই ছিল। পাকিস্তানি সামরিক জান্তাদের অপপ্রচার সবসময়ই ছিল। বিশ্ব-বিবেকও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিকে সজাগ দৃষ্টি নিবদ্ধ রেখেছিল। এজন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ আমাদেরই পরিচালনা করতে হবে, এ আত্মসম্মানবােধ আমাদের প্রবল ছিল।
এর কিছুদিন পর কোলকাতায় ভারতীয় বিমানবাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পি.সি. লালের সঙ্গে আবার আমাদের এ ব্যাপারে আলাপ হয়। এবার তিনি সম্মত হন এবং আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা ভারতীয় বিমানবাহিনী থেকে কয়েকটি বিমান, একটি ডাকোটা, দুটো হেলিকপ্টারসহ যুদ্ধ-বিষয়ক সব ধরনের সহযােগিতা লাভ করি। আমাদের নিজস্ব পাইলট ও টেকনিশিয়ানগণ ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর এসব বিমান, হেলিকপ্টার নিয়ে ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরের বিমানঘাঁটিতে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী গঠন করেন। সে সময় উইং কমান্ডার বাশার ৬ নম্বর সেকটর-কমান্ডার ছিলেন এবং ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট লিয়াকত, ফ্লাইট লেফট্যানেন্ট লে.নূরুল কাদের তখনও যথাক্রমে ৪ নম্বর এবং ৫ নম্বর সেক্টরে সেনাবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে নিয়ােজিত ছিলেন। এ তিনজন বিমানবাহিনী সদস্য ছাড়া বাকী সকল বৈমানিক বিমান বাহিনীর সঙ্গে যুক্ত হন।
স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ তখন ১ নম্বর সেক্টরের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তাঁকে সেখান থেকে ডিমাপুরে নিয়ে আসা হয় এবং বিমানবাহিনীর প্রশাসনিক ও অপারেশনের দায়িত্ব তার উপর ন্যস্ত করা হয়। এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ.কে. খন্দকার বাংলাদেশ বিমানবাহিনী সৃষ্টির কৃতিত্ব দাবি করতে পারেন।
ক্র্যাক প্লাটুন
শিক্ষক, শিল্পী, ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষকসহ বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ মুক্তিযুদ্ধের জন্য যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছিলেন, ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলের প্রশিক্ষণ-কেন্দ্রসহ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে তাদের বিভিন্ন সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল নিয়মিত ও সম্মুখ যুদ্ধের জন্য। এঁদের মধ্য থেকে বিশিষ ছাত্র-যুবক-তরুণদের সমন্বয়ে গঠন করা হয়েছিল গেরিলাবাহিনী। এই গেরিলাবাহিনীর সদস্যদের বিশেষভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। কেননা এরা যুক্ত ছিল আড়ালে, আবডালে থেকে গােপন ও ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র আক্রমণ পরিচালনায়। শত্রুসেনা-দখলকৃত এলাকাগুলিতে পৌছে, বিস্ফোরক জ্বালিয়ে, গ্রেনেড ছুড়ে, হাতবােমা ফাটিয়ে, দেশীয় অস্ত্র নিয়ে এবং সুযােগমতাে পিস্তল দিয়ে গুলি ছুড়ে পাকিস্তানি সৈনিকদের ঘাঁটি ও ছাউনিগুলাে ধ্বংস করাসহ শহরের সরকারি বিভিন্ন স্থাপনায় অপারেশন চালিয়ে দখলদার পাকিস্তান সরকারের কাজে বিঘ্ন ঘটিয়ে অস্বাভাবিক অবস্থা সৃষ্টি করায় পাকিস্তানি সৈনিকদের অস্থির রাখার কৌশলযুদ্ধ, আমাদের মুক্তিযুদ্ধে গেরিলাবাহিনীর দুঃসাহসিক অভিযান ও বিস্ময় সৃষ্টিকারী অপারেশন— পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ক্ষতবিক্ষত করে দিয়েছিল। উল্লেখ করতে হয় যে, গেরিলা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত বীরযােদ্ধারা স্ব-স্ব এলাকায় এসে বিশ্বস্ত ও মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের তরুণদের সংগঠিত করে স্বল্প সময়ের মধ্যে তাদের অস্ত্রচালনা শিক্ষা দিয়ে বাঙালি-অবাঙালি পাকিস্তানি দালালদের বাড়ি ও দোকানে আক্রমণ চালিয়ে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর মেরুদণ্ড প্রায় ভেঙে দেয়। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত গেরিলাবাহিনীর মধ্যে ক্র্যাক প্লাটুনের কিছু বাহিনীর দুঃসাহসিক অপারেশন আজো ঢাকাবাসী কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে। ক্রাক প্লাটুনের উল্লেখযােগ্য অপরেশন:
১. হােটেল ইন্টারকন্টিন্যান্টালে হ্যান্ড-গ্রেনেড ও এক্সপ্লাসিভ চার্জ ২. ৫টি ১১ কেভি, পাওয়ার স্টেশন আক্রমণ ও এক্সপ্লোসিভ চার্জ ৩. যাত্রাবাড়ি ব্রিজে এক্সপ্লোসিভ চার্জ ৪. হামিদুল হক চৌধুরীর প্যাকেজিং ইন্ডাস্ট্রিজে এক্সপ্লোসিভ চার্জ; ৫. বিডিআর গেইট, ধানমণ্ডি আক্রমণ; ৬. ভােগ (Vogue) দোকান (ঢাকার তৎকালীন জিন্না অ্যাভিনিউ-তে অবস্থিত) ও কয়েকটি পেট্রল পাম্পসহ বিভিন্ন স্থানে গ্রেনেড চার্জ; ৭. ঢাকার সন্নিকটে মাদারটেক ও ত্রিমােহনীতে পাকিস্তান আর্মিকে হত্যা; ৮. বৈদ্যেরবাজার ও রূপগঞ্জ থানা দখল এবং থানায় অবস্থানরত সমস্ত ইপিকাফ ও রাজাকারসহ পুলিশদের হত্যা। ২৬ আগস্ট আড়াইহাজার থানা দখল এবং সাতজন পাকিস্তানি আর্মি ও ইপিকাফ হত্যা।
ঢাকা গেরিলা (দক্ষিণ)
ঢাকা শহরে গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ঢাকা দক্ষিণে অপর একটি গ্রুপ গড়ে-তােলা হয়। ‘৭১ সালের ২৫ মার্চ আজিমপুর এলাকার কিছু ছাত্র ও যুবক পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে আক্রমণের জন্য বিশেষ ট্রেনিং নিয়ে ঢাকায় তাদের যুদ্ধ কার্যক্রম শুরু করে। এই বাহিনীর অগ্রসেনা আদিলের নামে বাহিনীটি পরিচিতি পায়। আদিল গ্রুপের সফল ও উল্লেখযােগ্য অপারেশন: ১. ‘৭১-এর নভেম্বরের শেষের দিকে নিউমার্কেটের কোণায় অবস্থিত পেট্রোল-পাম্প উড়িয়ে দেয়া। ২. আর্মি রিক্রুটমেন্ট অফিসে গ্রেনেড চার্জ।
ঢাকা গেরিলা (উত্তর)
২৫ মার্চের পর সেই ভয়াবহ পরিস্থিতিতে স্বজাতির শবদেহ পাশ কাটিয়ে স্বজনের রক্তনদী পাড়ি দিয়ে ঢাকা শহরের কিছু ছাত্র-যুবক পশ্চিম-দিনাজপুরের বালুরঘাটে একত্রিত হয়। সেখানে তারা ৪৫ দিনের একটি প্রশিক্ষণ নেয়। ইতােমধ্যে ২ নম্বর সেক্টরের প্রধান মেজর খালেদ মােশাররফ এদের কথা জানতে পারেন। ঢাকা শহরের মানুষ বলে তিনি তাদের তার সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত করে আরাে কিছু ঢাকাবাসী ছাত্র-যুবককে তাদের সঙ্গে দলভুক্ত করেন এবং ১৫ দিনের একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ দেন। বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই গেরিলাবাহিনীকে ঢাকা উত্তরে যুদ্ধ-পরিচালনার জন্য পাঠানাে হয়। নাসিরউদ্দিন ইউসুফ-এর নেতৃত্বে এই বাহিনীটি ঢাকা ও ঢাকার পার্শ্ববর্তী এলাকায় উল্লেখযােগ্য বিভিন্ন অপারেশন করে ঢাকার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে ভীত-সন্ত্রস্ত করে দেয়। ঢাকা গেরিলা (উত্তর) দলের কয়েকটি উল্লেখযােগ্য অপারেশন:
১. কাকরাইল মােড়ের পেট্রোল-পাম্প ধ্বংস করে।
২. সিঙ্গাইর থানা এলাকার কাছাকাছি একটি গ্রামে অপারেশন চালিয়ে ১৪ জনের পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর খাদ্যবহনকারী দলকে হত্যা করে।
৩. নভেম্বরের দিকে পাকিস্তানি আর্মির দুই লরির মাঝখানে হাইজাককৃত একটি গাড়িতে বিস্ফোরক রেখে অগ্নিসংযােগের মাধ্যমে ১৬ জন পাকিস্তানি সৈনিককে হত্যা করে।
৪. শাহবাগস্থ রেডিও পাকিস্তানের দপ্তরে গ্রেনেড চার্জ করে এবং নভেম্বরে ডিআইটি ভবনের চূড়ায় এক্সপ্লোসিভ চার্জ করে।
৫. ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রেনেড চার্জ।
ঢাকা ছাড়াও দেশের বিভিন্ন এলাকায় গেরিলাবাহিনী বারবার অপারেশন চালিয়ে পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকার, আলবদর, আল-শামসের দস্যুগুলােকে হত্যা করে, এলাকা ছাড়া করে, আহত করে ভীষণভাবে। সরকারি বিভিন্ন স্থাপনা উড়িয়ে দেয়। ব্রিজ, কালভার্ট ভেঙে দিয়ে পাকিস্তানিদের চলাচল রােধ করে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়: তৎপরতা, সাফল্য
মুজিবনগরে ১৭ এপ্রিল ঐতিহাসিক শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানের পরদিন অর্থাৎ এপ্রিলের ১৮ তারিখে মন্ত্রিসভা-সদস্যদের আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। মন্ত্রিসভার বিশেষ বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয় যে খন্দকার মােশতাক আহমেদ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইন ও সংসদ বিষয়াবলি দেখাশুনা করবেন। এপ্রিলের ঐ দিনগুলি ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। দিনগুলাের মধ্যে অন্যতম ছিল ১৮ এপ্রিল, যেদিন কোলকাতাস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের অধিকাংশ কর্মকর্তা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। অবশ্য এর আগে দিকনির্দেশনা দেন তৎকালীন তরুণ পি.এফ.এস. (Pakistan Foreign Service) অফিসার কে.এম. শেহাবুদ্দীনদিল্লির পাকিস্তান-দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব। এ দূতাবাসের সহকারী প্রেস সেক্রেটারি আমজাদুল হক ও শেহাবুদ্দীন ৬ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করেন।
পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের প্রবীণ কূটনীতিবিদ ডেপুটি হাই কমিশনার, এম. হােসেন আলীর নেতৃত্বে বাঙালিরা কার্যত ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিস দখল করে নেন। ঐ ভবনেই আরম্ভ হয় আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম। প্রথম দিকে কোলকাতার কর্মকর্তাবৃন্দ বেশ দিধাগ্রস্ত ছিলেন। কিন্তু আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতা ঘােষণার পর তাঁরা আর পেছনে তাকাননি। পরিস্থিতি অনুকূল থাকায় পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাজের অনেক সুবিধা হয়। প্রধানমন্ত্রী, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং আমরা যে পরিবেশে কাজ করতাম সে তুলনায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক সুশৃঙ্খল ও সুসজ্জিত একটি ভবন পাওয়ায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনেক সুষ্ঠু কাজ করার সুযােগ পেয়েছিল। তবে, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এই মন্ত্রণালয়কে কাজ করতে হতাে।
সার্কাস অ্যাভিনিউস্থ ভবনটি আমাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিরও (অর্থাৎ হাই কমিশন) অফিস ছিল। পূর্বতন পাকিস্তান ডেপুটি হাইকমিশনে কর্মরত সকল বাঙালি চাকুরে বাংলাদেশ সরকারের চাকুরিতে যােগদান করায় তারা সকলেই স্ব স্ব পদে বহাল থাকেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন হােসেন আলী (ডেপুটি হাই কমিশনার), রফিকুল ইসলাম (প্রথম সচিব), আনােয়ারুল করিম চৌধুরী (তৃতীয় সচিব), কাজী নজরুল ইসলাম (তৃতীয় সচিব), মাকসুদ আলী (তৃতীয় সচিব), সাইদুর রহমান (সুপারিনটেন্ডেন্ট)। সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বলতে সেরকম বড় কিছু ছিল না। প্রথমত যে-সমস্ত কূটনীতিবিদ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেছিলেন তাঁদেরকে স্ব স্ব কর্মস্থলে থেকে দেশের পক্ষে কাজ করতে বলা হয়েছিল। বেশ কিছু কর্মকর্তাকে প্রকাশ্যে আনুগত্য ঘােষণা না করে গােপনে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ করে যেতে পরামর্শ দেওয়া হয কারণ, তাদের প্রেরিত গােপন তথ্য আমাদের প্রয়ােজন ছিল। এই উভয় কারণে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কাজ করার মতাে লােকবল ছিল না তেমন। অবশ্য এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন ঘটে অক্টোবরের দিকে। তখন বেশ কয়েকজন পদস্থ এবং প্রবীণ কূটনীতিবিদ মুজিবনগরে এসে যােগদান করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন রাষ্ট্রদূত এ.এফ.এম. আবুল ফতেহ এবং রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমিন।
আরেকটি কারণে মন্ত্রণালয় ছােট রাখা হয়। একই প্রাঙ্গণে হাইকমিশন অবস্থান করায় সেখানে কর্মরত অফিসাররাও নানাভাবে মন্ত্রণালয়ের সহায়তা করেন। এঁদের মধ্যে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল আনােয়ারুল করিম চৌধুরীর (জয়-এর)।
এখানে তৎকালীন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি ধারণা দিচ্ছি। মন্ত্রীর সাথে ছিলেন তার নিরাপত্তা অফিসার এবং একান্ত সচিব ছিলেন কামাল সিদ্দিকী। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একজন ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। তাকে প্রত্যক্ষভাবে সহায়তা করার জন্য পররাষ্ট্রসচিব ছিলেন। পররাষ্ট্রসচিবের অধীনে বহিঃপ্রচার বিভাগ ও মিশনের কাজকর্ম তদারকি ছাড়াও অন্যান্য কিছু দায়িত্ব ছিল। কিন্তু পররাষ্ট্রসচিব বেশিরভাগ সময় ভিন্ন-ধরনের কাজ নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। ফলে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রকৃত কাজকর্মে তাঁকে যথাযথভাবে পাওয়া যেত না।
এই মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা ও কর্মচারীর মােট সংখ্যা ছিল ১৫ জন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন সর্বজনাব মাহবুব আলম, কামালউদ্দীন সিদ্দিকী, রফিক আহমদ খান, এম.এ.রেজা, এন.আর.বড়য়া প্রশান্ত কে, ভট্টাচার্য। এঁরা ছাড়া ৪ জন সহকারী এবং ৫জন অন্যান্য কর্মচারী ছিলেন। (পরিশিষ্ট ৭২ দ্রষ্টব্য)। এই মন্ত্রণালয়ের একটি সাংগঠনিক কাঠামােও তৈরি করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট ৭৩ দ্রষ্টব্য)! উল্লেখ্য, মন্ত্রণালয়ের নিরাপত্তা কর্মকর্তা এম.এ.রেজার কাজকর্ম কারাে এমনকি কর্নেল ওসমানীরও দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেননি। সম্ভবত তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত হতে আপ্রাণ চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার পর ঢাকার জিগাতলায় তার ভূমিকা অনেককেই ব্যথিত করেছিল।
উপরে বর্ণিত কাঠামাে থেকে বােঝা যাবে যে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আকারে কেমন ছোট ছিল। এর একটা বড় কারণ এই যে, বিদেশে বাংলাদেশের পক্ষে যারা আনুগত্য ঘােষণা করে প্রকাশ্যে কাজ করেছিলেন তারা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এবং মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সাথেই যােগাযােগ রাখতেন। তাঁদের অনেকের ব্যক্তিত্ব এবং অবস্থান এমন ছিল যে প্রধানমন্ত্রী নিজে তাদের সাথে কথা বলবেন বা নির্দেশ দেবেন এটাই ছিল সমীচীন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এদের অন্যতম। বিদেশে, বিশেষ করে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরােপে অনেকেই স্বতস্ফূর্তভাবে জনমত সৃষ্টির কাজ করেছেন; সরকারের ভিতরে এবং বাইরে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে, সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষও উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্বকে তারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবির যৌক্তিকতা এবং পাকিস্তানিরা বাংলাদেশে কী নৃশংস হত্যা ও ধ্বংসতাণ্ডবে লিপ্ত সেটা বােঝাতে পেরেছিলেন। এর পাশাপাশি ছিল প্রচারমাধ্যম যেমন, সংবাদপত্র, রেডিও, টি.ভি., আলােচনা, জনসমাবেশ, দৈনন্দিন মিছিল ইত্যাদি। বস্তুত প্রবাসী বাঙালিরাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সবচাইতে বড় প্রচার আর দূতিয়লী করেছেন। এটা খুবই স্বাভাবিক যে ঐ সময় তারা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থাকলেও বৈদেশিক নীতি সংক্রান্ত যাবতীয় কাজকর্ম প্রধানমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হতাে। সকলপ্রকার বৈদেশিক নীতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই ঠিক করে দিতেন। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ এবং সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয় প্রয়ােজন অনুযায়ী সেসব বাস্তবায়নের ব্যবস্থা নিতেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রম ও নীতি বিষয়ক একটি রূপরেখা বহিঃপ্রচার বিভাগ থেকে পররাষ্ট্র সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব ও তথ্য সচিবের নিকট প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার জন্য প্রেরিত হয়। এই রূপরেখায় বাংলাদেশ সরকারের নির্ধারিত নীতি বর্ণিত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর অগােচরে বর্ণিত নীতির বাইরে কারাে কোনাে কিছু করার উপায় ছিল না। তবে,
পৃষ্ঠা: ১২০
সে সময় কিছু অপতৎপরতা যে হয়নি, তা নয়। এসব হয়েছিল পাকিস্তানি ষড়যন্ত্রের কারণে এবং আমেরিকা ও চীন সরকারের ভ্রান্ত নীতি অবলম্বনের ফলে। সে সময় পৃথিবীর রাজনৈতিক গতি-প্রকৃতির প্রতি প্রধানমন্ত্রী প্রখর দৃষ্টি রেখেছিলেন। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতসহ, রাশিয়া, ফ্রান্স, জার্মানি এইসব দেশ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র নীতিতে গভীর রেখাপাত করেছিল। বাংলাদেশ সরকার পররাষ্ট্র বিষয়ক যে নীতিমালা প্রণয়ন করে, তার বৈশিষ্ট্য ছিল। নিম্নরূপ (পরিশিষ্ট ৭৪ দ্রষ্টব্য):
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র নীতির মৌলিক বৈশিষ্ট্য
১. সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি বিদ্বেষ নয়। বৈদেশিক নীতির ব্যাপক বৈশিষ্ট্য হলাে সকল বাস্তব প্রয়ােজনে মৌলিক ধারণার ব্যাখ্যা।
২. রাজনৈতিক অবদমন, অর্থনৈতিক শােষণ ও বঞ্চনা এবং সাংস্কৃতিক আগ্রাসন অবসানে বিশ্বাসী।
৩. জোটনিরপেক্ষ, সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী এবং শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান- এই তিনটি আমাদের বৈদেশিক নীতির গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তিপ্রস্তর (corner stone).
৪. পৃথিবীত্রাসী ও আঞ্চলিক শান্তিবিনষ্টকারী সকলপ্রকার সামরিক চুক্তির আমরা বিরােধিতা করি। আমরা সেনটো (CENTO) এবং সিয়াটো (SEATO) -কে নিন্দা করি। অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি অস্থিতিশীলকারী অথবা কোনাে দেশের নিজেদের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলন দমনকারী সকলপ্রকার সামরিক চুক্তির বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিকভাবে আমরা বিরােধিতা করব।
৫. বাংলাদেশ নিন্দা জানায় সাম্রাজ্যবাদ এবং নব্য সাম্রাজ্যবাদ উপনিবেশবাদ এবং ছােট দেশগুলাের উপর অন্যান্য সর্বপ্রকার বহিঃশক্তির অশুভ প্রভাব বিস্তার।
৬. বাংলাদেশ পারস্পরিক সমঝােতার ভিত্তিতে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে এবং সংলাপ-প্রক্রিয়ার ভিত্তিতে বিভিন্ন দেশ বা জাতির মধ্যে বিরাজমান জটিলতার সমস্যা সমাধানে বিশ্বাসী।
পরাশক্তি
৭. আমরা মনে করি ক্ষমতাধর পরাশক্তিগুলি নিম্নরূপে বিন্যস্ত: ক) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র খ) সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত রাশিয়া গ) চীন
৮. আমরা সকল পরাশক্তির সমর্থন এবং তদনুযায়ী সার্বক্ষণিক সহযােগিতা প্রত্যাশা করি। আমরা এশিয়ার পুনজোটবদ্ধতার প্রভাবের বিরােধিতা করি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণের প্রতি সম্মান জানিয়ে বলি, ইসলামাবাদের সামরিক বাহিনীকে অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ এবং ভারত-বাংলাদেশের সীমান্ত জুড়ে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়ােগ সংক্রান্ত বিষয়ে চাপ সৃষ্টির কারণে আমরা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনের ভূমিকার নিন্দা জ্ঞাপন করি। বাংলাদেশ ইস্যুর প্রতি সহযােগিতা ও সহানুভূতির জন্য আমেরিকার বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর প্রতি আমরা কৃতজ্ঞ। আমরা অবশ্যই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারের অন্যান্য সংগঠন, যেমন কংগ্রেস ও সিনেটের প্রতিও কৃতজ্ঞ।
৯. সমাজতান্ত্রিক সােভিয়েত রাশিয়া প্রাথমিক পর্যায়েই আমাদের সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। পরবর্তী পর্যায়ে ভিন্নতর কৌশলের কারণে আমাদের সংগ্রামের প্রতি নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে। ভারত-সােভিয়েতের সাম্প্রতিক ইসতেহারও বাংলাদেশের জন্য ফলদায়ক নয়। কিন্তু সােভিয়েত রাশিয়ার সক্রিয় মদদ প্রাপ্তির ক্ষেত্রে খুবই সর্তকতার সাথে প্রয়াস চালাতে হবে।
১০. চীনের ব্যাপারে আমরা ইচ্ছাকৃতভাবে নীরবতা রক্ষা করছি এবং তা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে। কারণসমূহ খুবই স্পষ্টভাবে বলা যায়।
আফ্রো-এশীয় দেশসমূহ
১১. সমগ্র আফ্রো-এশীয় দেশসমূহের কল্যাণের জন্য আমরা অঙ্গীকারাবদ্ধ এবং সেই লক্ষ্যে আফ্রো-এশীয় সংহতির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রাখব। আফ্রো-এশীয় সকল দেশের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্বন্ধ লালন করব।
মধ্যপ্রাচ্য
১২. খুবই বেদনার সাথে উল্লেখ করতে হয় যে, আরবদেশসমূহ আমাদের স্বার্থের বিপক্ষে কাজ করেছে, কিন্তু আমরা এ ব্যাপারে অনানুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষতা বজায় রাখব এবং রাখতে হবে। আমরা মনে করি ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ব্যাপক প্রচারকারী সরকারসমূহের এটি একটি ভয়ংকর ব্যর্থতা। আমরা বাস্তব সত্যের প্রতি তাদের আকৃষ্ট করার প্রয়াস চালিয়ে যাব এবং সেই সঙ্গে তারা যে ভুল-বােঝাবুঝিতে ভুগছে তা দূর করার চেষ্টা করব।
১৩. আরব-ইসরাইল সম্পর্কের সূত্রে আমাদেরকে কোনাে পক্ষেই রাখিনি এবং তা অব্যাহত রাখব যতদিন না আমাদের নীতিমালা পরিবর্তিত হয়।
১৪. শুধুমাত্র লন্ডন ছাড়া সমগ্র স্বাধীন ইউরােপ কমবেশি নীরব। অতএব পাকিস্তান প্রায় ওয়াকওভার পেয়ে যাচ্ছে।
১৫. ইউরােপের সকল সমাজতান্ত্রিক দেশ আমাদের সংগ্রামের প্রতি সুস্পষ্ট সমর্থন জ্ঞাপন করেছে এবং আমরা সেইসব দেশের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের ক্রমাগত চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি।
১৬. উপযুক্ত নীতিমালা চলতি সময়ের জন্য। বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিমালা আরাে সংক্ষেপ করা হবে। বৈদেশিক নীতিমালা ধারাবাহিকভাবে পুনঃনিরীক্ষা করা হচ্ছে এবং যখনই যেখানে যে কোনাে ধরনের গুরুত্বপূর্ণ উন্নতি বা প্রয়ােজনীয়তা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা বিবেচনার জন্য গ্রহণ করা হচ্ছে, যথাযথভাবে সমন্বিত করা হচ্ছে।
মুজিবনগর সরকারের বহিঃপ্রচার বিভাগ থেকে প্রেরিত উপরে বর্ণিত সরকারের নীতিমালার রূপরেখা অনুযায়ী সংশ্লিষ্ট সচিবগণ (পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, তথ্য) ছাড়াও সরকারের অন্যান্য অঙ্গসংগঠন (মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, সাধারণ প্রশাসন বিভাগ ইতাদি) অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল।
মুক্তিযুদ্ধকালে বৈদেশিক সম্পর্ক বিভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে সংগঠিত বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্য ও প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গে বিদেশিরা যােগাযােগ করেছে মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে এসে দাঁড়াতে।
আমেরিকান কংগ্রেসের স্বনামধন্য অনেক সদস্য (যেমন এডওয়ার্ড কেনেডি, ফ্রাঙ্ক চার্চ প্রমুখ), যুক্তরাজ্য থেকে পার্লামেন্ট সদস্য (পিটার শাের, জন স্টোন হাউস, রেজিনাল প্রেনিটি, বিখ্যাত সাংবাদিক (New York Times, Washington Post, Time Magazine, News Week, Reader’s Digest ইত্যাদির প্রতিনিধি, Sunday Times এবং London Times, Guardian, La monde এদের বার্তা প্রতিনিধি এবং আরও অনেকে) ক্রমাগতই ভারতে আসছিলেন, মূলত সরেজমিনে অবস্থা পরিদর্শন করতে। তারা প্রধানমন্ত্রী এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতও করতেন। কোনাে কোনাে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকতেন, সবসময় উপস্থিত থাকতেন না। আমাদের কোলকাতার মিশন প্রায়শই সংশ্লিষ্ট থাকতেন। মন্ত্রিপরিষদ-সচিব হলেও আমি প্রধানমন্ত্রীর খুব ঘনিষ্ঠ থাকায় পররাষ্ট্র বিষয়ক প্রতিটি কাজের গতি-প্রকৃতি ও অগ্রগতি সম্বন্ধে অবহিত থাকতাম। কোনাে কোনাে সময় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে আমার বিভাগ থেকেও পররাষ্ট্র বিষয়ক কাজ সমন্বয় করতাম।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত ভারত-সরকারের সাথে যােগাযােগ দুভাবে হতাে। নীতি-নির্ধারণ বিষয় অথবা যুদ্ধের বিষয়ে ভারত-সরকারের সঙ্গে যােগাযােগের প্রয়ােজন হলে প্রদানমন্ত্রী বা প্রধান সেনাপতি; আর দৈনন্দিন হলে মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয়ের মাধ্যমে যােগাযােগ হতাে। কঠোর গােপনীয়তার মধ্যে ভারত-সরকারের প্রতিনিধি ও কর্মকর্তাবৃন্দের সঙ্গে বৈঠক হতাে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সন্দেহজনক কার্যকলাপের কারণে তাঁকে বৈঠকের বাইরেই রাখা হতাে। তবে এই ব্যবস্থার কথা তাঁকে কখনই জানতে দেওয়া হয়নি। এমনকি ভারতের তরফ থেকে কূটনৈতিক শিষ্টাচার রক্ষার্থে নিরাপত্তাজনিত কারণ প্রদর্শন করা হতাে। এ কথা সবাই বুঝতে না পারলেও আমি বিষয়টি ঠিকই অনুধাবন করতাম।
বস্তুত ভারত-সরকার বিভিন্ন পর্যায়ে যােগাযােগের কয়েকটি চ্যানেল প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। প্রতিরক্ষা-বিষয়ে প্রধান সেনাপতি ও চিফ অব স্টাফ (কর্নেল ওসমানী ও গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার) এবং প্রতিরক্ষা-সচিব (সামাদ); মন্ত্রিপরিষদ-সচিব (আমি); বৈদেশিক সম্পর্ক হলে বা অন্য কোনাে সরকার সংশ্লিষ্ট হলে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং; ত্রাণ ও স্বাস্থ্য সংক্রান্ত হলে মন্ত্রী এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান ও সচিব ড.টি. হােসেন। কলকাতা মিশন, বিশেষ করে এ.কে. চৌধুরী আরেকটি চ্যানেল ছিলেন। ভারতের পক্ষে তারা কোলকাতায় বিদেশমন্ত্রকের (Foreign Affairs) একটি আবাসিক অফিস স্থাপন করেন যার প্রধান ছিলেন মি.এ.কে. রায়, আর সহকারী মিস অরুন্ধতি ঘােষ। মিস ঘােষ ব্যক্তিগতভাবেও আমাদের সরকারি কাজে কত যে সাহায্য করেছেন তা বলে শেষ করা যাবে না। বাংলাদেশের মানুষকে তিনি গভীরভাবে ভালােবাসতেন। এই বােধ থেকেই তিনি আমাকে, বিশেষ করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অসংখ্য কাজে সহায়তা করেছেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তার বহু গুরুত্বপূর্ণ অবদান মুজবনগর সরকারের জন্য তথা বাংলাদেশের জন্য স্মরণীয় হয়ে থাকবে। প্রতিরক্ষা বিষয়ে পূর্বাঞ্চলীয় সেনা-কমান্ড (G.O.C.-in-C, Eastern Command)-এর পক্ষে যােগাযােগ রাখতেন মেজর জেনারেল সরকার, বি.এস.এফ-এর আই.জি গােলক মজুমদার। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভা ও প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিলেন মি. চ্যাটার্জি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাজকর্মের, বিশেষ করে পররাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক বিষয়াদি দেখার জন্য পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (Officer on Special Duty) মি. আনােয়ারুল করিম চৌধুরী কর্তৃক প্রদত্ত এক প্রজ্ঞাপন (circular) প্রসঙ্গত উল্লেখ করা হলাে। নিচে প্রদত্ত প্রজ্ঞাপনের ভাষান্তর ও বাংলাদেশ দূতাবাস এবং প্রতিনিধিদের তালিকা দেখলেই বােঝা যাবে সরকারের কর্মতৎপরতা। মূল প্রজ্ঞাপনের কপি এবং তালিকা নিচে বাংলায় ভাষান্তরিত করে দেওয়া হলাে। (পরিশিষ্ট ৭৫ দ্রষ্টব্য)।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার
মুজিবনগর
আর-ক্যাব ১১৬ তারিখ ২৫-১১-৭১
নং বি-৩/১৬/৭১
পররাষ্ট্র দফতর
নথি-২/৫/৭১
গােপনীয়
নভেম্বর ২২.১৯৭১
প্রজ্ঞাপন
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃত প্রতিনিধিদের বিস্তারিত তথ্য এবং তাদের ঠিকানাসহ একটি তালিকাপত্র অবগতি ও দিকনির্দেশনা লাভের জন্য সংশ্লিষ্ট সকলের নিকট প্রেরণ করা হলাে।
স্বাক্ষর
(আনােয়ারুল করিম চৌধুরী)
বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
বিতরণ
১. বিদেশে বাংলাদেশের সকল দূতাবাস
২. ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিসভার সকল মন্ত্রীর একান্ত সচিববৃন্দ
৩. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সকল মন্ত্রণালয়ের সচিববৃন্দ
৪. প্রধান সেনাপতি, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী
৫. উপ-অধিনায়ক, বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী
৬. পরিচালক, তথ্য ও প্রকাশনা, বাংলাদেশ সরকার
৭. বাংলাদেশ বেতারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা
৮. বহিঃপ্রচার বিভাগ
বিদেশে বাংলাদেশ দূতাবাস
কোলকাতা
জনাব এম. হােসেন আলী
ভারতে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত
৯, সার্কুলার এভিন্যু
কোলকাতা-১৭, ভারত
ফোন: ৪৪-৫২০৮
৪৪-০৯৪১
নতুন দিল্লি
জনাব এইচ.আর চৌধুরী
বাংলাদেশের প্রতিনিধি
বাংলাদেশ দূতাবাস
সি-১১৯, আনন্দনিকেতন
নতুন দিল্লি-২১, ভারত
ফোন: ৬২-৬৪০৫
লন্ডন
জনাব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী
বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ দূতাবাস
২৪, পেমব্রিজ গার্ডেনস
লন্ডন-ডাব্লু-২, ইউ, কে (যুক্তরাজ্য)
ফোন: ০১-২২৯-০২৮১
০১-২২৯-৫৪৩৫
কেবল: বাংলাদেশ লন্ডন ডাব্লু -২
স্টকহোম
জনাব এ. রাজ্জাক
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ দূতাবাস
ডুভােমিসগ্র্যান্ড ৩৮
১২৭ ৪১ শার্ক হােলমেন
স্টকহােম, সুইডেন
ফোন: ৭/০-৬৮-৫৭
নিউইয়র্ক
জনাব এস.এ. করিম
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ মিশন
কক্ষ নং ১০০২ এ,
১০ ইস্ট ৩৯তম স্ট্রিট নিউইয়র্ক ১০০১৬
নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র
ফোন: (২১২) ৬৮৫-৪৫৩০
(২১২) ৭৩৯-০৩৮৮
ওয়াশিংটন
জনাব এম.আর সিদ্দিকী
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ দূতাবাস
১২২৩ কানেকটিকাট এভিনিউ
ওয়াশিংটন, ডি.সি, নর্থ-ওয়েস্ট (৫ম তলা)
ওয়াশিংটন, ডি.সি. ২০০৩৬, যুক্তরাষ্ট্র
ফোন: ৭৩৭-৯৫৩৮,
৭৩৭-৯১৯৬
কেবল: বাংলাদূত
হংকং
জনাব মহিউদ্দিন আহমেদ
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ দূতাবাস
প্রথম তলা
৩৭, বাের্ড উড রােড
হ্যাপী ভ্যালী, হংকং
ফোন: ৭৬৯৬১০
ম্যানিলা
জনাব কে.কে পন্নী
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ দূতাবাস
১৯৩৯ কামিয়াস স্ট্রিট
ডাস ম্যারিনাস ভিলেজ
মাকাটি রিজাল
ম্যানিলা, ফিলিপাইনস
ফোন: ৮৯-৫৬-২৭
কাঠমুণ্ডু
জনাব এ.এম. মুস্তাফিজুর রহমান
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
বাংলাদেশ হাউস
মহারাজগঞ্জ, বাসা বাড়ি (ব্রাহ্ম কটেজের বিপরীতে)
জি.পি. ও বক্স নং ৭৮৯
কাঠমুণ্ডু, নেপাল
বার্ন
জনাব ওয়ালিউর রহমান
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
HELVETIASTR 21
৩০০৫ বার্ন, সুইজারল্যাণ্ড
ফোন: ৮৯-৫৬-২৭
টোকিও
জনাব এস.এম. মাসুদ
বাংলাদেশ প্রতিনিধি
১৭, ইচিবাঞ্চ, সিয়াডাে-কু
কোজিমাচি, টোকিও, জাপান
ফোন: ৪৪৮২৬৫
পৃষ্ঠা: ১২৫
উপরের তালিকাসহ বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তার এই চিঠি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাজকর্মের ধরন সম্বন্ধে ধারণা দেয়। চিঠির বক্তব্য এবং যাদের নিকট প্রজ্ঞাপন প্রেরিত হয় তাতে যে বৈশিষ্ট্য ফুটে ওঠে তা ছিল পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুসৃত প্রচলিত রীতিনীতির অনুরূপ। অর্থাৎ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধকালে একটি স্বাধীন দেশের মতােই তাদের কাজকর্ম চালিয়ে গেছে। প্রশাসনের সকল ক্ষেত্রে, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও বাণিজ্য বিষয়ে, এমনি জাতীয় আয়-ব্যয় সমন্বয়ের ক্ষেত্রে, যুদ্ধ পরিচালনায় সমানভাবে দক্ষতার সঙ্গে সরকার কাজ করেছে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আকারে ছছাট হলেও এর সাফল্য ছিল অনেক বড়, অনেক বিশাল। এটি মন্ত্রণালয়ের একক কৃতিত্ব নয়। এই কৃতিত্বের দাবিদার ছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মকর্তা, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণাকারী বিদেশে কর্মরত কর্মকর্তাদের (ফরেন সার্ভিস, সিভিল সার্ভিস ও অন্যান্য), দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ বিভিন্ন শ্রেণীর কর্মকর্তা, কর্মচারী, বুদ্ধিজীবী, প্রশিক্ষণার্থী ও অধ্যয়নরত ছাত্র-শিক্ষকদের অবদান।
শত্রু-আক্রান্ত মাতৃভূমির জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা অসংখ্য বাঙালি নারী-পুরুষ নির্বিশেষে তৎকালীন প্রবাসী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাজ সমর্থন করেছে। তাদের অকুণ্ঠ ও অকৃপণ সমর্থন সরকারের কাজকর্মের সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত কর্মকর্তা, কর্মচারীর মনে অফুরন্ত অনুপ্রেরণা সঞ্চার করত। এসব অনুভূতি ও চিত্রের বর্ণনা এখন ভাষায় দেওয়া সম্ভব নয়। এ শুধু উপলব্ধির বিষয়। পাকিস্তানি হায়েনাদের আক্রমণ থেকে বাঙালি জাতি এবং তাদের ভূখণ্ড বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে- এই প্রত্যয় তখন বিদেশে অবস্থানরত সকল বাঙালির মনেপ্রাণে। তাদের প্রত্যয়দীপ্ত শপথ। বাংলাদেশ সরকারকে প্রবলভাবে উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছে। তারই প্রতিফলন ঘটেছে সরকারের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে। এসব পরিকল্পনার রূপরেখা প্রণীত হতাে সরকারের বিভিন্ন। মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিয়ােজিত বাঙালি কর্মকর্তা ও কর্মচারীর দ্বারা। পরিকল্পনা তৈরি হতাে বটে, কিন্তু তা অনুমােদনের জন্যে উপস্থাপিত হতাে মন্ত্রিসভার বৈঠকগুলিতে। মন্ত্রিপরিষদের বৈঠক ঘন ঘন অনুষ্ঠিত হতাে। এমনকি কোনাে কোনাে দিন একাধিক সভাও অনুষ্ঠিত হতাে। আবার কোনাে কোনাে সভা আরম্ভ হয়ে তা দ্বিতীয় দিনে গড়াত। এরকম একাধিক মুলতবি সভার সিদ্ধান্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
সরকারের এসব সভা-অনুষ্ঠানের গতি-প্রকৃতি এবং আয়ােজনের ধরন দেখলে স্পষ্টতই প্রতীয়মান হবে যে, তৎকালে অর্থাৎ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব বিষয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানেই হওয়া উচিত ছিল, সেগুলিও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হস্ত ক্ষেপ ছাড়া হতাে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নিজেই পররাষ্ট্র-বিষয়ক সিদ্ধান্তসহ বিভাগের হস্ত ক্ষেপ ছাড়া হতাে না। অর্থাৎ প্রধানমন্ত্রী নিজেই পররাষ্ট্র-বিষয়ক সিদ্ধান্তসহ অন্যান্য বিষয়াদি সম্পর্কিত কোনাে সমস্যা সমাধানের জন্য মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে সরাসরি মৌখিকভাবে নির্দেশ দিতেন। আবার কখনও ছােট নােটের মাধ্যমে সভা-অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করতে বলতেন আমাকে। এমন অনেক সভার ব্যবস্থা আমি আমার অফিসের সহকর্মীদের নিয়ে করতাম। আমি এসব নােট আমার ডায়েরিতে, কোনাে-কোনাে সময় নােট-প্যাডেও লিখে রাখতাম। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আমার ডায়েরিশীর্ষক অধ্যায়ে এসব উল্লেখ করা হয়েছে।
আগস্ট মাসের শেষে ২৪ তারিখে এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পররাষ্ট্র-বিষয়ক একটি প্রতিবেদনের উপর আলােচনা হয়। এই প্রতিবেদন পররাষ্ট্রসচিব পাঠিয়েছিলেন। (পরিশিষ্ট ৭৬ দ্রষ্টব্য) মন্ত্রিসভার এই সভায় নিয়মিতভাবে প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সি-ইন-সি ছাড়াও পররাষ্ট্রসচিব এবং আমি (ক্যাবিনেট সেক্রেটারি) উপস্থিত ছিলাম। সভায় পররাষ্ট্রসচিবের পাঠানাে প্রতিবেদনের ইন্দো-মস্কো চুক্তি সম্পর্কিত একটি বিশ্লেষণ সম্বন্ধে আলােচনা হয়।
পররাষ্ট্রসচিব কর্তৃক উপস্থাপিত জুলাই ও আগস্ট (১৯৭১) মাসের প্রতিবেদন এবং শান্তি প্রতিষ্ঠা ও সহযােগিতা প্রদানের লক্ষ্যে সম্পাদিত ইন্দো-রাশিয়া চুক্তির বিশ্লেষণ সম্পর্কে মন্ত্রিসভার সভায় উল্লেখ হয়। আলােচনাকালে সােভিয়েত রাষ্ট্রদূত এবং মন্ত্রী মহােদয়ের মধ্যে সােভিয়েত দূতাবাসে চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার আগে এবং পরে একাধিক বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার বিষয় জানা যায়। পররাষ্ট্রসচিবের প্রতিবেদন থেকে একটা বিষয় ভালােভাবেই উল্লেখ হয় যে, চুক্তি সম্পাদনের দিন থেকে সােভিয়েত সরকারের আচরণ কিছু শীতল হয়ে পড়েছে এবং তাদের পক্ষ থেকে তাৎক্ষণিকভাবে কোনাে সমর্থন মিলছে না। পররাষ্ট্রসচিবের প্রতিবেদনে একথা বলা হলেও বাস্তবে কিন্তু এমনটি ছিল না। ভারতসােভিয়েত চুক্তি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য একটি মাইলফলক ছিল।
দিল্লিতে পররাষ্ট্রসচিবের অবস্থানকালে পূর্ব-ইউরােপের দেশ, বিশেষ করে চেকোস্লোভাকিয়া এবং কিউবা ও আফগানিস্তান সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের তৎকালীন সার্বিক পরিস্থিতির গতি-প্রকৃতি সম্বন্ধে তাঁর নিকট থেকে অবহিত হতে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। এসব দেশের প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশের যুদ্ধকালে প্রয়ােজনীয় সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে তাৎক্ষণিক আশ্বাস প্রদান করেন। ভারত-সরকারের কুণ্ঠাহীন সমর্থন অব্যাহত ছিল। বিভিন্ন সময়ে ভারত-সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনাকালে যেসব বিষয়ের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয় সেগুলি নিম্নরূপ ছিল:
ক. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক অবস্থান সুদৃঢ়করণ; এবং
খ. অঞ্চল দখলে রাখা।
এছাড়া, নিম্নলিখিত বিষয়ও ভারত-সরকারের প্রতিনিধির বিবেচনার জন্য পেশ করা হয়েছিল:
ক. বাংলাদেশ বাহিনীর (BDF) জন্য যুদ্ধাস্ত্র;
খ. যুবশিবিরের জন্য সরঞ্জামাদি; এবং
গ. পূর্বপ্রতিশ্রুত সরঞ্জাম ও অস্ত্রশস্ত্র হস্তান্তরকরণ।
পররাষ্ট্রসচিবের প্রতিবেদন থেকে আরাে জানা যায় যে, ভারত-সরকার বাংলাদেশের ঘটনাবলি সুসমন্বিতভাবে দেখার জন্য কিছু ব্যবস্থা নিয়েছেন। এসব ব্যবস্থার মধ্যে শ্রী পি.এন. হাকসারকে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি, মিস্টার ডি.পি. ধরকে স্পেশাল অ্যাসিসট্যান্ট ও পলিসি প্ল্যানিং ইউনিট চেয়ারম্যান হিসেবে নিয়ােগদান এবং ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের বহিঃপ্রচার বিভাগে পৃথকভাবে বাংলাদেশ ডেস্কের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক একজন ডাইরেক্টর ইনচার্জকে দায়িত্ব প্রদান বিশেষ উল্লেখযােগ্য ছিল।
যা হােক, ১৯৭১ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং তার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে আরাে যেসব উল্লেখযােগ্য তৎপরতা সংঘটিত হয়, তার পেছনে ছিল বাংলাদেশ সরকারের সকল কর্মকর্তা, কর্মচারী, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দের সম্মিলিত প্রয়াস। এমন সম্মিলিত প্রয়াসের মধ্য থেকে অন্তত একটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরলে বােঝা যাবে, কীভাবে পাকিস্তানি অপতৎপরতাকে বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি শিক্ষক-ছাত্র, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, ব্যবসায়ী, সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী প্রমুখ নস্যাৎ করে দেয়। এসব তৎপরতা পাকিস্তানি প্রশাসনকে বেশ অসুবিধায় ফেলে এবং তাদের যুদ্ধজয়ের স্বপ্ন ও বাঙালি জাতিকে গােলামির শেকল পরানাের সাধ-আহ্লাদ কল্পনার ফানুসে পারিণত হয়।
মুজিবনগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসার অন স্পেশাল ডিউটিতে কর্মরত মি. আনােয়ারুল করিম চৌধুরী কর্তৃক প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে প্রেরিত স্কা্যানডিনেভিয়ান দেশসমূহে দায়িত্বপালনরত বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিবের পক্ষে বিশেষ প্রতিনিধি মি.এ. রাজ্জাকের একটি চিঠির বিষয়বস্তু খুবই প্রণিধানযােগ্য। (পরিশিষ্ট ৭৭ দ্রষ্টব্য)। চিঠিতে মি.রাজ্জাক জানান যে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ত্রাণসামগ্রী আনা-নেওয়া এবং চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে খালাস করার নিমিত্ত ডেনমার্ক থেকে জলযান সংগ্রহের চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার অনুরােধ জানিয়ে তিনি ঐ পত্র লিখেছিলেন। পত্রে তিনি ডেনিস রফতানিকারককে বাধা প্রদানের বিষয়ে একটি প্রস্তাবও রেখেছিলেন এবং এ ব্যাপারে তিনি স্থানীয়ভাবে আমাদের বন্ধুদের কাজে লাগানাের প্রস্তাব দেন। তিনি আরাে জানিয়েছিলেন যে, ডেনিস সরকার বাংলাদেশে গণহত্যার বিষয়টি সেপ্টেম্বর (১৯৭১) মাসে নরডিক কাউন্সিলে উত্থাপন করবেন (পরিশিষ্ট ৭৮ দ্রষ্টব্য)। এভাবেই সারা পৃথিবীতে বাঙালি জনগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে এবং দেশের জন্য কাজ করে গেছেন একান্তই নিভৃতে, অন্তরালে। স্বাধীনতার ত্রিশ বৎসরাধিক পরেও (২০০৪ সালেও) কি এসবের কোনাে মূল্যায়ন হবে না!
ঠিক এমনই দেশপ্রেমের আর একটি দৃষ্টান্ত এখানে তুলে ধরছি। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রেরিত বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের দলনেতা মি. ফকির শাহাবুদ্দিনের নিকট থেকে প্রাপ্ত চিঠির কপি (পরিশিষ্ট ৭৯ দ্রষ্টব্য) মি. আনােয়ারুল করিম চৌধুরী প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে তাঁর অবলােকন ও অবগতির জন্য পাঠিয়েছিলেন। এই চিঠিতে দলনেতা বিস্তারিত এক বিবরণ পাঠান। বিবরণে তিনি জ্যোতিপাল মহাথেরাের সঙ্গে এবং স্থানীয় বাঙালি ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আলােচিত বিষয় সম্বন্ধে জানান। মহাথেরাের মতে জানা যায়, ধর্মীয় সম্প্রদায়ের লােকজন কোনাে ধরনের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্ত হতে উৎসাহ বােধ করে না। এরপর তিনি (ফকির শাহাবুদ্দিন) আশঙ্কা ব্যক্ত করে জানান যে, পাকিস্তান দূতাবাসের কড়া নজরদারির মধ্যে তথাকার ২/৩ জন বাঙালিকে কাজ করতে হচ্ছে। এজন্য তারা সতর্কতা অবলম্বন করেছে। এমন এক সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে মহাথেরােকে তার নিজস্ব ধ্যান-ধারণা ও পদ্ধতিতে আমাদের দেশে সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে কাজ করতে দেওয়ার প্রস্তাব দেন। ব্যাংককে পাকিস্তানি নৃশংসতার বিরুদ্ধে মহাথেরাের আবেদন যাতে ব্যাপক প্রচার পায় সে সম্বন্ধে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে বলে দলনেতা জানিয়েছিলেন।
তিনি আরাে জানান যে, থাই-সরকার নিরপেক্ষতার জন্য সর্বজনবিদিত। কিন্তু আমাদের নিজস্ব কিছু উৎস থেকে জানা গেছে যে, ইয়াহিয়া এখানকার বাজার থেকে গােপনে অস্ত্র ক্রয় করে পি.আই.এ. বিমানযােগে বহন করছে। দলনেতা আরাে জানিয়েছিলেন যে, পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত লাওসে গমন করে মার্কিন সহযােগিতায় হয়তাে অস্ত্র-সংগ্রহ করে থাকতে পারে। সেখানকার কালােবাজার থেকে বাংলাদেশের জন্যেও সস্তায় অস্ত্র ক্রয় করা যেতে পারে বলে তিনি মন্তব্য করেছিলেন এবং এর মূল্য অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ পাওয়ার পর পরিশােধ করার সুবিধা পাওয়া যাবে বলে তিনি জানান।
দলনেতার প্রেরিত বিবরণ থেকে এ কথাও জানা যায় যে, জ্যোতিপাল মহাথেরাে থাই সরকারের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে এমন কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি, বিশেষ করে ওয়ার্লর্ড বুদ্ধিস্ট ফেলােশিপনামক প্রতিষ্ঠানের প্রেসিডেন্ট রাজকুমারী পুনের সাথে দেখা করেছেন। তিনি সম্ভাব্য সকলের নিকট বাংলাদেশের পরিস্থিতি তুলে ধরেছিলেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের দলনেতা প্রস্তাব করে জানিয়েছিলেন যে, ৬/৭ জনের থাই ধর্মীয় ব্যক্তি এবং সাংবাদিককে বাংলাদেশের পরিস্থিতি, বিশেষ করে বৌদ্ধ-শরণার্থীদের দুর্দশা সরেজমিনে দেখার জন্য আমন্ত্রণ জানালে তা কার্যকর হবে ও সুফল বয়ে আনবে।
থাই প্রতিনিধিদলের প্রত্যবর্তনের পর আরেকটি বৃহৎ আকারের প্রতিনিধিদলকে সরকারিভাবে আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে বলে উক্ত প্রতিবেদনে বলা হয়। দলনেতা ফকির শাহাবুদ্দিন পরামর্শ দিয়ে জানান যে, বাংলাদেশ সরকারের প্রয়ােজন থাই-সরকারের নিকট স্বীকৃতির জন্য আবেদন জানানাে। তিনি উল্লেখ করেন যে, প্রাচ্যের প্রবেশপথ হচ্ছে থাইল্যান্ড। এ ছাড়াও, তিনি পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা ফারুক ও আলম সম্বন্ধে কিছু বিরূপ মন্তব্য করেন। তবে, পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের আহ্বানে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারী পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস অনুষ্ঠানে যােগদান করেননি। বন্ধুরা তাদের ক্ষতির আশঙ্কা থেকে প্রয়ােজনে সহযােগিতা দানের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।
দলনেতা ফকির শাহাবুদ্দিনের এই প্রতিবেদন থেকে বাংলাদেশ সরকারের কর্মতৎপরতার উজ্জ্বল স্বাক্ষর পাওয়া যায়। এসব প্রতিবেদনের ভিত্তিতে মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সভায় কার্যক্রম স্থির করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হতাে।
ভারত-সােভিয়েত বিবৃতির বিষয়েও ১৯৭১ সালের ১ অক্টোবর মন্ত্রিসভার যে সভা অনুষ্ঠিত হয়, তা ইতিহাসের বিচারে এক জ্বলন্ত উদাহরণ। মন্ত্রিসভার সকল সদস্য ছাড়াও ক্যাবিনেট সেক্রেটারিও এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। সভাপতিত্ব করেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সকল সদস্যের পর্যবেক্ষণসহ একটি প্রতিবেদন পূর্বেই সকলকে দেন। মন্ত্রিসভার সভায় আলােচনার পর বিষয়বস্তু সকলের নিকট দেওয়ার জন্য সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ভারত-সােভিয়েত বিবৃতির মূল বিষয় কূটনৈতিক ভাষায় নিম্নরূপ ছিল:
Political Solution in accordance with the just and inallenable rights of East Bengal.
উপযুক্ত অংশে East Bengal শব্দটি লক্ষণীয়। ভারত-সােভিয়েত বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার প্রাথমিক ক্ষেত্র এভাবেই প্রস্তুত করা হয়েছিল। এ দ্বারা মুজিবনগরের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের কর্মতৎপরতা দৃশ্যমান হয়ে ওঠে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত অতি জরুরি ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল পাকিস্তানের আনুগত্য পরিহারকৃত সদস্যদের চাকুরি এবং তাদের বেতন-ভাতার সংস্থান করা ও তাদের নিরাপত্তা বিধান করা। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরুর পর মুজিবনগরে অবস্থিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের দপ্তর থেকে ঘােষণা দেওয়া হয়: বাঙালি কর্মকর্তা, কর্মচারী যাঁরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান দূতাবাসসমূহে কর্মরত রয়েছেন তারা তাদের আনুগত্য পরিহার করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্যের শপথ নিলে তাদেরকে তাদের ভােগর সকল সুযােগ-সুবিধাসহ আর্থিক সহযােগিতা প্রদান করা হবে। এই ঘােষণায় বিপুল সাড়া পাওয়া যায়। অবস্থা এমন দাঁড়ায় যে, এত বিপুলসংখ্যক আনুগত্যপরিহারকৃত সদস্যদের প্রতিশ্রুত সুযােগ-সুবিধা প্রদানে কষ্টকর অবস্থার সৃষ্টি হয়। এতদ্সত্ত্বেও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই অবস্থা দৃঢ়ভাবে সামাল দেয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে সহযােগিতা প্রদান করেন। সকলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের ভয়াবহ ও অনিশ্চিত সময়ে পরিস্থিতি সামাল দেয়। তবে, বন্ধুরাষ্ট্র এবং পৃথিবীর মানবদরদী সরকারগুলােও আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে আমার সেইসব দিনের স্মৃতি ও তৎপরতা কখনই বিস্মৃত হওয়ার নয়।
বন্ধুরাষ্ট্রের পরামর্শে সুইস ব্যাংকে বাংলাদেশ সরকারের জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নামে হিসাব খােলা হয়। এ ছাড়াও অন্য আরাে বাঙালির ব্যক্তিগত নামে সরকারের পক্ষে হিসাব খােলার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়। কিন্তু কোনাে দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতিতে এসব হিসাব বন্ধ হয়ে গেলে তা বাংলাদেশের জনগণের ব্যবহারের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংক্রান্ত কর্মকাণ্ড শুরু করা ছিল এক বিশাল ধাপ। এই মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্যাপক কর্মতৎপরতা শুরু হয়। তার ফলে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ধ্বংস, অগ্নিসংযােগ, হত্যা, লুঠ ইত্যাদির সংবাদ সারা পৃথিবীতে জানাজানি হয়ে যায় সুপরিকল্পিতভাবে দেশের দায়িত্বশীল সরকার হিসেবে নিজেদের ভাবমূর্তি প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক অপরিহার্য উপজীব্য হিসেবে পরিগণিত। সরকারের অন্যান্য মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে সুসমন্বিত উপায়ে এই মন্ত্রণালয় কাজ করেছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিটি মুহূর্ত দেশের অবস্থা, যুদ্ধের সফলতাবিফলতা, রণনীতি প্রণয়ন ইত্যাদির প্রতি যেমন প্রখর দৃষ্টি রেখেছিলেন, তেমনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিটি কাজও তিনি নিজে প্রত্যক্ষভাবে খেয়াল রাখতেন; যদিও এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে একজন গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক নেতা মন্ত্রীপদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবেই তিনি সকল মন্ত্রীর খোঁজখবরও রাখতেন। তাদের কাজকর্মে আন্তরিক সহযােগিতা প্রদান করতেন।
তাঁর সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎকালে অসাধারণ সাফল্য অর্জন করে বিদেশে কূটনৈতিক দূতাবাস স্থাপন করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ-প্রাথমিকভাবে কোলকাতা, দিল্লি, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক ও স্টকহােমে মিশন স্থাপন ছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিশেষ সাফল্য। এ ছাড়াও বিদেশে কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করার বিষয়ে এই মন্ত্রণালয় বিশেষ অবদান রাখে।
জাতিসংঘে প্রতিনিধিদল (Delegation) প্রেরণ; আফগানিস্তান, সিরিয়া ও লেবাননে প্রতিনিধিদল প্রেরণ; নেপালে প্রতিনিধিদল প্রেরণ এবং সিংহল (শ্রীলঙ্কা), বার্মা ও অন্যান্য দক্ষিণ-পূর্ব দেশে প্রতিনিধিদল প্রেরণ এবং এই তৎপরতায় আশানুরূপ ফললাভ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সরকারের এক অভূতপূর্ব সাফল্য বললে অত্যুক্তি হবে না।
আন্তর্জাতিক ডাক-যােগাযােগের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা ছিল প্রশংসনীয়। বাংলাদেশ সরকারের অস্তিত্ব সুদৃঢ় করতে ডাক-যােগাযােগ স্থাপনে ডাকটিকেট প্রবর্তন ছিল ঐতিহাসিক ঘটনা। বাংলাদেশের ডাকটিকেট প্রকাশ এবং ডাক-ব্যবস্থা সম্পকে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ে আলােচনা, বৈঠক ইত্যাদি অনুষ্ঠিত হয়। অবশেষে ভারত-সরকার বাংলাদেশ-কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবে ইতিবাচক সাড়া দেয়। ভারত কর্তৃক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ডাক-ব্যবস্থা সম্বন্ধে বিবেচনা করা হয়। কোলকাতাস্থ ডাক ও টেলিগ্রাফ বিভাগের পােস্টমাস্টার জেনারেল শ্রী এম.আর. কৃষ্ণনের সাথে বাংলাদেশ মিশনের মি.এ.কে. চৌধুরীকে যােগাযােগ বজায়
পৃষ্ঠা: ১৩০
রাখার পরামর্শ দিয়ে ভারত-সরকারের বহির্বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আন্ডার-সেক্রেটারি (মিস) অরুন্ধতি ঘােষ এক পত্র দিয়েছিলেন (পরিশিষ্ট ৮০ দ্রষ্টব্য)। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মিশনের তৃতীয় সচিব আনােয়ারুল করিম চৌধুরী তাৎক্ষণিকভাবে পত্র দিয়ে সরকারের গৃহীত ব্যবস্থা আন্ডার-সেক্রেটারিকে জানিয়েছিলেন। (পরিশিষ্ট ৮১ দ্রষ্টব্য।)
সরকারের তৎপরতায় বিদেশে আরাে যেসব সাফল্য অর্জিত হয় সেগুলি নিম্নরূপভাবে বর্ণনা করা যায়:
ক. বাংলাদেশি নাগরিক এবং সহানুভূতিশীল ব্যক্তিদের উদ্বুদ্ধ করে যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, সুইডেন, জাপান ও অন্যান্য কয়েকটি দেশের সমর্থন আদায়ের চেষ্টা করা হয় এবং তাতে অনেক সফলতা অর্জিত হয়।
খ. উপরে উল্লেখিত দেশসমূহের পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের জনগণের উপর পাকিস্তানি শাসকবৃন্দের অকথ্য অত্যাচার, নির্যাতন আর হত্যাকাণ্ডের বিশদ খবর বড় বড় শিরােনামে প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়।
গ. পাকিস্তানি বর্বর বাহিনীর অত্যাচারে বাংলাদেশ থেকে পার্শ্ববর্তী বন্ধুরাষ্ট্র ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বিতাড়িত বাঙালি শরণার্থীদের জন্য তহবিল সংগ্রহে উল্লেখযােগ্য সাফল্য আসে।
ঘ. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসসমূহে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করে পাকিস্তানের প্রতি অনাস্থা জ্ঞাপন ছিল আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে সফলতার আর-এক নিদর্শন। বিদেশে কর্মরত যেসব দেশে কূটনীতিকগণ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন, সেসব দেশের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল ইরাক, ফিলিপাইন ও আর্জেন্টিনা। কোলকাতা, দিল্লী, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, কাঠমণ্ডু ও হংকং-এ কর্মরত উচ্চপদস্থ কূটনৈতিক কর্মকর্তাদের আনুগত্য লাভের বিষয়টিও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাফল্য হিসেবে আজ চিহ্নিত। এ সম্পর্কে আরও বিস্তারিত তথ্য মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিশীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।
ঙ. মুক্তিযুদ্ধে আহত ও অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানাে যােদ্ধাদের উপযুক্ত চিকিৎসার জন্য বিদেশে, যেমন পূর্ব জার্মানি, সােভিয়েত ইউনিয়ন, চেকোশ্লাভাকিয়া প্রেরণের ব্যবস্থা সরকারের পররাষ্ট্র তৎপরতারই স্বাক্ষর। যুদ্ধাহত ব্যক্তিদের কৃত্রিম অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সংযােজনের জন্য তাঁদের বিদেশে প্রেরণ অপরিহার্য ছিল।
চ. পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সঙ্গে বন্ধুত্বের ও সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও ছিল সরকারের সাফল্য। সােভিয়েত ইউনিয়নের নৌবাহিনী বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত নৌবন্দরগুলি (চট্টগ্রাম, খুলনা, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে) পুননির্মাণ করে মুজিবনগর সরকারের অনুরােধে।
ছ. বিদেশে প্রশিক্ষণ গ্রহণরত সরকারি কর্মকর্তাদের স্বতঃপ্রণােদিত আনুগত্য প্রকাশ ছিল সরকারের কর্মতৎপরতার এক জ্বলন্ত স্বাক্ষর। যুদ্ধ চলাকালে এঁদের আনুগত্য পাকিস্তানি সরকারের মনােবল যেমন দুর্বল করে দেয়, তেমনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মনােবলকে প্রবলভাবে আশান্বিত ও উজ্জীবিত করে। এসব প্রশিক্ষণার্থী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করেছিলেন।
জ. বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা জোরদার করার লক্ষ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন বহিঃপ্রচার ও প্রকাশনা বিভাগকে (External Publicity and Publication Division) জোরদার করা হয়েছিল।
ঝ. মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জাতিসংঘের প্রতিনিধি প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খান মুজিবনগরের মুক্তাঞ্চলে শরণার্থীদের দুর্দশা দেখতে এসেছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের আহবানে। যুদ্ধ পরবর্তীকালে বিপুল সায্যসামগ্রীসহ রেডক্রস দলের বাংলাদেশে আগমন পররাষ্ট্র বিষয়ক এক বিরাট সাফল্য।
বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সমুদ্রসীমা
পৃথিবীর যেসব দেশের আন্তর্জাতিক সীমারেখায় সমুদ্রের জলরাশি বিদ্যমান সেসব রাষ্ট্রের সমুদ্রসীমা আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত আইন দ্বারা চিহ্নিত হয়ে থাকে। মুজিবনগর সরকার অন্যান্য সকল বিষয়ের সঙ্গে এদিকেও তীক্ষ দৃষ্টি রেখেছিল। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে এক ঘােষণায় রাষ্ট্রের সমুদ্রসীমার কথা উল্লেখ করেছিলেন বাংলাদেশ শত্রুমুক্ত হওয়ার প্রাক্কালে ১৫ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে। গােষণায় বলা হয় যে:
যেহেতু আন্তর্জাতিক আইন সততই একটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব সেই দেশের উপকূল সংলগ্ন এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত; এবং যেহেতু রাষ্ট্রের জলসীমা হিসেবে পরিগণিত সমুদ্র অঞ্চলের বিস্তৃতি সম্বন্ধে আন্তর্জাতিক অনুশীলন সর্বক্ষেত্রে অভিন্ন নয় এবং বাংলাদেশের জলসীমার বিস্তৃতি সম্বন্ধে ঘােষণা প্রয়ােজন; তাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম বর্ষে, আমি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এই মর্মে ঘােষণা করছি যে উপযুক্ত ভূমিরেখা থেকে সমুদ্রে বাংলাদেশের জলসীমা বারাে নটিক্যাল মাইল পর্যন্ত বিস্তৃত। (পরিশিষ্ট ৮২ দ্রষ্টব্য)।
কুটনৈতিক সাফল্য
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে যুক্তরাজ্যে কূটনৈতিক তৎপরতা এবং প্রবাসী বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে আন্দোলন ও জনমত গঠন করা ছিল আমাদের সরকারের এক বিশেষ সাফল্য। এর সঙ্গে আরাে যারা সম্পৃক্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে কয়েকজনের নামের তালিকা নিচে সংযােজিত হলাে। এই তালিকায় আরাে অনেকের নামই সংযােজিত হতে পারে যারা নেপথ্যে থেকে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন।
পররাষ্ট্র এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতৃবৃন্দ
১. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি
২. আবদুস সামাদ আজাদ, এম.এন.এ.
পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা এবং ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত
৩. ব্যারিস্টর আমীর-উল ইসলাম, এম.এন.এ.- প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা
৪. এম.আর.সিদ্দিকী, এম.এন.এ. – শিল্প ও বাণিজ্য উপদেষ্টা
আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত প্রতিনিধি
৫. ফকির শাহাবুদ্দিন, দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় প্রেরিত প্রতিনিধিদলের (Delegation) দলনেতা (Leader of the delegation)
৬. এ. রাজ্জাক, স্ক্যানডিনেভিয়ান রাষ্ট্রসমূহে বাংলাদেশের প্রতিনিধি (নরওয়ে,
সুইডেন, ডেনমার্ক)।
৭. শাহ্ মুয়াজ্জম হােসেন, এম.পি.এ.- পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি
৮. শাহ এ.এম.এস. কিবরিয়া, কাউন্সেলর, যুক্তরাষ্ট্র
৯. এ.এম.এ. মুহিত, অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, যুক্তরাষ্ট্র
১০. এনায়েত করিম, মিনিস্টার, যুক্তরাষ্ট্র
১১. এস. আনােয়ারুল করিম, উপস্থায়ী প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক
১২. মহিউদ্দিন আহমেদ, অস্থায়ী ট্রেড কমিশনার, হংকং
১৩. হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী, কাউন্সেলর, দিল্লি
১৪. এ. রেজাউল করিম, প্রথম সচিব, লন্ডন।
১৫. এম. হােসেন আলী, ডেপুটি হাই কমিশনার, কোলকাতা
১৬. এ.এইচ. মাহমুদ আলী, ভাইস কন্সাল, নিউইয়র্ক।
১৭. এ.এফ.এম. আবুল ফতেহ, রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত
১৮. খুররম খান পন্নী, রাষ্ট্রদূত, বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত
১৯. আবদুল মােমিন, রাষ্টদূত, বিশেষ দায়িত্বপ্রাপ্ত
জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ (১৯৭১) বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল
১. বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী—দলনেতা
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ প্রতিনিধি, জাতিসংঘে বাংলাদেশ স্থায়ী প্রতিনিধি
২. এম.এ. সামাদ, সদস্য, জাতীয় পরিষদ (বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা)
৩. অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ (বাংলাদেশ সরকারর পরামর্শ কমিটি সদস্য)
৪. ফণিভূষণ মজুমদার, সদস্য, জাতীয় পরিষদ
৫. সিরাজুল হক, সদস্য, জাতীয় পরিষদ
৬. সৈয়দ আবদুস সুলতান (এডভােকেট), সদস্য, জাতীয় পরিষদ
৭. ফকির শাহাবুদ্দিন আহমদ (এডভােকেট), সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ
৮. ড. মফিজ চৌধুরী, সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ।
৯. ডা. আসহাবুল হক, সদস্য, প্রাদেশিক পরিষদ
১০. ড.এ.আর মল্লিক, উপাচার্য, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
১১. অধ্যাপক রেহমান সােবহান, অর্থনীতিবিদ (পূর্ব-ইউরােপীয় দেশসমূহে রাষ্ট্রদূত)
১২. . এম.আর. সিদ্দিকী, জাতীয় পরিষদ সদস্য এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ প্রতিনিধি
১৩. কে.কে. পন্নী, দূর-প্রাচ্য ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত
১৪. এ.এফ.এম. আবুল ফতেহ, রাষ্ট্রদূত এবং বাংলাদেশ রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা
১৫. এস.এ. করিম, উপস্থায়ী প্রতিনিধি জাতিসংঘ
১৬. এ.এম.এ. মুহিত, আমেরিকাস্থ বাংলাদেশ মিশনে কাউন্সেলর
১৭. আবুল হাসান মাহমুদ আলী, দলপতির সুপারিশে আমেরিকাস্থ বাংলাদেশ মিশনের ভাইস কনসালকে অতিরিক্ত সদস্য নিয়ােগ করা হয়।
* মুক্তিযুদ্ধকালে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে পাকিস্তান দূতাবাসে কর্মরত যেসব বাঙালি কূটনীতিবিদ আনুগত্য পরিবর্তন করেন
১. কে.এম. শেহাবুদ্দিন: দ্বিতীয় সচিব, দিল্লি: ৬ এপ্রিল
২. আমজাদুল হক: সহকারী প্রেস এটাশি, দিল্লি: ৬ এপ্রিল
৩. এম. হােসেন আলী: ডেপুটি হাই কমিশনার, কোলকাতা: ১৮ এপ্রিল
৪. রফিকুল ইসলাম: প্রথম সচিব, কোলকাতা: ১৮ এপ্রিল
৫. আনওয়ারুল করিম চৌধুরী: তৃতীয় সচিব, কোলকাতা: ১৮ এপ্রিল
৬. কাজী নজরুল ইসলাম: তৃতীয় সচিব, কোলকাতা: ১৮ এপ্রিল
৭. মাকসুদ আলী: তৃতীয় সচিব, কোলকাতা: ১৮ এপ্রিল।
৮. সাইদুর রহমান: সুপারিন্টেন্ডেন্ট, কোলকাতা: ১৮ এপ্রিল
৯. এ.এইচ. মাহমুদ আলী: ভাইস কনসাল, নিউইয়র্ক: ২৬ এপ্রিল
১০. হাবিবুর রহমান: শিক্ষা অফিসার, লন্ডন: ২৭ এপ্রিল
১১. আবদুর রাজ্জাক খান: সহকারী শিক্ষা এটাশি, ওয়াশিংটন: ১৭ মে
১২. আবুল মাল আবদুল মুহিত: অর্থনৈতিক কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন: ৩০ জুন
১৩. মহিউদ্দিন আহমেদ: দ্বিতীয় সচিব, লন্ডন: ১ আগস্ট
১৪. এস আনওয়ারুল করিম উপস্থায়ী প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক: ৪ আগস্ট
১৫. এনায়েত করিম: মিনিস্টার, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৬. শাহ এ.এম.শামসুল কিবরিয়া: কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৭. আবু রুশদ মতিন উদ্দিন: শিক্ষা কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৮. আতাউর রহমান চৌধুরী: তৃতীয় সচিব, হিসাব, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৯. সৈয়দ মােয়াজ্জেম: আলী তৃতীয় সচিব, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
২০. এ.এম শরফুল আলম: সহকারী প্রশাসন এটাশি, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
২১. শেখ রুস্তম আলী: সহকারী তথ্য এটাশি, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
২২. লুফুল মতিন: তৃতীয় সচিব, হিসাব, লন্ডন: ৫ আগস্ট
২৩. আবদুর রউফ: সহকারী তথ্য এটাশি, লন্ডন: ৮ আগস্ট
২৪. ফজলুল হক চৌধুরী: সহকমারী শ্ৰম এটাশি, লন্ডন: ১১ আগস্ট
২৫. মহিউদ্দিন আহমদ: অস্থায়ী ট্রেড কমিশনার, হংকং: ১৮ আগস্ট
২৬. এ.এফ.এম আবুল ফতেহ: রাষ্ট্রদূত, ইরাক: ২৯ আগস্ট
২৭. খুররম খান পন্নী: রাষ্ট্রদূত, ফিলিপাইনস: ১৩ সেপ্টেম্বর
২৮. মুহিউদ্দিন আহমদ জায়গীরদার: তৃতীয় সচিব, লেগােস: ১৩ সেপ্টেম্বর
২৯. এম.মুস্তাফিজুর রহমান: দ্বিতীয় সচিব, কাঠমণ্ডু: ৩ অক্টোবর
৩০. হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী: কাউন্সেলর, দিল্লি: ৪ অক্টোবর
৩১. এম.রেজাউল করিম: প্রথম সচিব, লন্ডন: ৭ অক্টোবর
৩২. আবদুল মােমিন: রাষ্ট্রদূত, বুয়েনস আইরেস: ১১ অক্টোবর
৩৩. ফজলুল করিম: তৃতীয় সচিব, কায়রাে: ২৬ অক্টোবর
৩৪. এস.এম. মাসুদ: তথ্য সচিব, টোকিও: ২ নভেম্বর
৩৫. কিউ.এ.এম.এ রহিম: তৃতীয় সচিব, টোকিও: ২ নভেম্বর
৩৬. ওয়ালিউর রহমান: দ্বিতীয় সচিব, জেনেভা: ২ নভেম্ব
৩৭. সৈয়দ আমিরুল ইসলাম: তৃতীয় সচিব, টিউনিস: ১১ নভেম্বর
৩৮. আজিজুল হক চৌধুরী: তৃতীয় সচিব, লন্ডন: ৭ ডিসেম্বর
* মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান বৈদেশিক মিশনে কর্মরত যেসব বাঙালি কূটনীতিবিদ বিজয়ের পর বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তন করেন।
১. খাজা মােহাম্মদ কায়সার: রাষ্ট্রদূত, চীন
২৷ মীর্জা রশীদ আহমদ: রাষ্ট্রদূত, লেবানন
৩. এম. আনওয়ারুল হক: রাষ্ট্রদূত, সেনেগাল
৪. এ.এফ.এম. বশিরুল আলম: রাষ্ট্রদূত, পােল্যাণ্ড
৫. মােস্তফা কামাল: রাষ্ট্রদূত, বুলগেরিয়া
৬. মনজুর আহমেদ চৌধুরী: কাউন্সেলর, ফ্রান্স
৭. এ.এইচ. আতাউল করিম: কাউন্সেলর, ইটালি
৮. এ.এইচ. কায়সার মুরশেদ: কাউন্সেলর, অস্ট্রেলিয়া
৯. ফারুক সােবহান: প্রথম সচিব, ফ্রান্স
১০. মাহবুবুল হক: প্রথম সচিব, ইরান
১১. খুরশীদ হামিদ: দ্বিতীয় সচিব, চীন
১২. এ.এস.এম.খায়রুর আনাম: দ্বিতীয় সচিব, বেলজিয়াম
১৩. এ.কে.এম. ফজলুর রহমান: দ্বিতীয় সচিব, সুদান
১৪. আবদুল কাইয়ুম: দ্বিতীয় সচিব, মালয়েশিয়া
১৫. কাজী আনওয়ারুল মাসুদ: দ্বিতীয় সচিব, বার্মা
১৬. মােস্তফা ফারুক মােহাম্মদ: দ্বিতীয় সচিব, ইন্দোনেশিয়া
১৭. আবদুল মমিন চৌধুরী: দ্বিতীয় সচিব, তানজানিয়া
১৮. এম. আনওয়ারুল হাশেম: দ্বিতীয় সচিব, যুগােস্লাভিয়া
১৯. এ.কে.এম. ফারুক: দ্বিতীয় সচিব, থাইল্যাণ্ড
২০. আহমদ তারেক করিম: দ্বিতীয় সচিব, ইরান
২১. জিয়াউস শামস চৌধুরী: দ্বিতীয় সচিব, অস্ট্রেলিয়া
২২. আমিনুল ইসলাম: দ্বিতীয় সচিব, মালয়েশিয়া
২৩. এস.এম. রাশেদ আহমদ: দ্বিতীয় সচিব, যুগােস্লাভিয়া
২৪. মােস্তাফা কামাল: দ্বিতীয় সচিব, জেনেভা
২৫. মােহাম্মদ জামির: তৃতীয় সচিব, ইজিপ্ট
২৬. মাহবুব আলম: তৃতীয় সচিব, থাইল্যাণ্ড
২৭. রেয়াজুল হাসান: তৃতীয় সচিব, সােভিয়েত রাশিয়া
২৮. মােহাম্মদ রুহুল আমিন: তৃতীয় সচিব, জর্ডান
২৯. সৈয়দ নুর হােসেন: তৃতীয় সচিব, চীন
৩০. মােহাম্মদ আফসারুল কাদের: তৃতীয় সচিব, তুর্কী
৩১. মােহাম্মদ হুমায়ুন কামাল: তৃতীয় সচিব, মালয়েশিয়া
৩২. এস. খাজা শারজিল: তৃতীয় সচিব, ইজিপ্ট
৩৩. নাসির আহমদ: তৃতীয় সচিব, জাপান
৩৪. আবদুল্লাহ আল আহসান: তৃতীয় সচিব, ইজিপ্ট
৩৫. কাজী আফজালুর রহমান: তৃতীয় সচিব, ইরান
৩৬. মােহাম্মদ মােতাহার হােসেন: তৃতীয় সচিব, ফ্রান্স
৩৭. তােফায়েল করিম হায়দার: তৃতীয় সচিব, পশ্চিম জার্মানি
পৃষ্ঠা: ১৩৫
* আমেরিকায় পাকিস্তান মিশন থেকে যেসব বাঙালি চাকুরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আনুগত্য পরিবর্তন করেন
১. গউসুদ্দিন আহমদ, হিসাব বিভাগ, ওয়াশিংটন: ১ এপ্রিল
২. আবুল হাসান মাহমুদ আলী, ভাইস কনসাল, নিউইয়র্ক: ২৬ এপ্রিল
৩. আবদুর রাজ্জাক খান, সহকারী শিক্ষা এটাশি, ওয়াশিংটন: ১৭ মে
৪. এ.কে. ফজলুল বারি, হিসাব বিভাগ, ওয়াশিংটন: ২৬ মে।
৫. মুহিদ আহমদ চৌধুরী, হিসাব বিভাগ, ওয়াশিংটন: ৬ জুন
৬. মােহাম্মদ এ. গােফরান, তথ্য বিভাগ, নিউইয়র্ক: জুন
৭. জাকিউল হক চৌধুরী, সাঁটলিপিকার, নিউইয়র্ক: জুন
৮. আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থনৈতিক কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন: ৩০ জুন
৯. সৈয়দ আনওয়ারুল করিম, উপস্থায়ী প্রতিনিধি, নিউইয়র্ক: ৪ আগস্ট
১০. এনায়েত করিম, মিনিস্টার, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১১. শাহ আবু মােহাম্মদ শামসুল কিবরিয়া, রাজনৈতিক কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১২. সৈয়দ আবু রুশদ মতিন উদ্দিন, শিক্ষা কাউন্সেলর, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৩. আতাউর রহমান চৌধুরী, তৃতীয় সচিব, হিসাব, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৪. সৈয়দ মােয়াজ্জেম আলী, তৃতীয় সচিব, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৫. এ.এম. শরফুল আলম, সহকারী প্রশাসন এটাশি, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৬. শেখ রুস্তম আলী, সহকারী তথ্য এটাশি, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৭. মােহাম্মদ আবু সােলায়মান, রাষ্ট্রদূতের দফতর, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৮. মােহাম্মদ মজিবুল হক, সেনা বিভাগ, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
১৯. নূরুল ইসলাম, হিসাব বিভাগ, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
২০. হাবিবুর রহমান, হিসাব বিভাগ, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
২১. আফতাবুদ্দিন আহমদ, সেনা বিভাগ, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট
২২. মােশতাক আহমদ, হিসাব বিভাগ, ওয়াশিংটন: ৪ আগস্ট।
সকলে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যুদ্ধের ভয়াবহ ও অনিশ্চিত সময়ে পরিস্থিতি সামাল দেন। তবে, বন্ধুরাষ্ট্র এবং পৃথিবীর মানবদরদী সরকারগুলােও আমাদের পাশে এসে দাঁড়ায়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের দায়িত্ব পালনকালে আমার সেইসব দিনের স্মৃতি ও তৎপরতা কখনই বিস্মৃত হওয়ার নয়।
…………………………………………………
উপরের * চিহ্নিত অংশগৃলি আবুল মাল আবদুল মুহিত রচিত স্মৃতি অম্লান ১৯৭১ (আগামী প্রকাশনী, ঢাকা, ১৯৯৬) নামক গ্রন্থ থেকে উদ্ধৃত
…………………………………………………
তথ্য মন্ত্রণালয়: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল তারিখে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলামকে বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলীকে অর্থমন্ত্রী, এ.এইচ.এম.কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খন্দকার মােশতাক আহমেদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী করা হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাৎক্ষণিকভাবে তথ্য ও বেতার এবং টেলিযােগাযােগ মন্ত্রণালয়েরও দায়িত্ব নিজে গ্রহণ করেন। মন্ত্রিসভার ১৮ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত সভায় মন্ত্রীদের দায়িত্বণ্টন সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। দায়িত্ববণ্টন সম্পর্কিত এই সিদ্ধান্তের কথা গ্রন্থের মন্ত্রিপরিষদ ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগশীর্ষক অধ্যায়ে লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।
এপ্রিলের গােড়ার দিকে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তাঁর ডায়েরিতে টেলিফোন, বেতার, প্রকাশনা, প্রচার, রেডিও (মিডিয়াম ওয়েভ) ইত্যাদি বিষয়ে গুরুত্বের সঙ্গে নােট লিখে রেখেছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি এসব বিষয়ে ব্যবস্থাও গ্রহণ করেন। ২৯ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার সভায় আবদুল মান্নান এম.এন.এ.-কে সভাপতি করে একটি ৩-সদস্যবিশিষ্ট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের কাজকর্ম পরিচালনায় প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্য ও সহযােগিতার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
সরকারের অধীন সর্বপ্রথম সংস্থাসমূহের অন্যতম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। প্রাথমিক অবস্থায় জনাব আবদুল মান্নান এম.এন.এ. সাহেবের সরাসরি তত্ত্বাবধানে রেডিও স্থাপন করা হয়। প্রাক্তন রেডিও পাকিস্তানের যেসব ব্যক্তি আমাদের সাথে যােগদান করেছিলেন, তাদের মধ্য থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রােগ্রামিং এবং সম্প্রচার (ব্রডকাস্টিং)-এর জন্য লােকজন নিয়ােগ করা হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে শিল্পী ও প্রকৌশলী আমাদের সাথে যােগ দেওয়ার ফলে বেতারের কার্যক্রমের (আউটপুট) উন্নতি সাধিত হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে শতাধিক লােক নিয়ােগ করা হয়েছিল। বেতার আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রচারমাধ্যম বিধায়, অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কেবল যুদ্ধ-পরিচালনার পরেই এর স্থান।
তথ্য ও বেতার (সম্প্রচার) মন্ত্রণালয়ের অধীনস্থ অন্যান্য সংস্থাগুলি হলাে:
ক. চলচ্চিত্র
খ. প্রকাশনা এবং
গ. চারুকলা ও ডিজাইন।
উপরে বর্ণিত সংস্থাগুলির প্রত্যেকটিতে একজন করে পরিচালক নিয়ােগ করা হয় তারা তাদের দায়িত্ব শত প্রতিকূলতার মধ্যেও নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন।
বাঙালির মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগ্রামী বাহিনী ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ও পৃথিবীর অন্যান্য জাতির মুক্তিযুদ্ধের এক তাৎপর্যপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। কেননা সমগ্র যুদ্ধই অসামরিক অর্থাৎ সাধারণ মানুষ ও রাজনৈতিক নেতাদের দ্বারা পরিচালিত এক জনযুদ্ধ। এই যুদ্ধের অন্যতম বাহিনী একটি বেতার-কেন্দ্র। দখলদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সম্পূর্ণরূপে প্রতিরােধ ও প্রতিহত করার ঘােষণা, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা এবং বাঙালি জাতিকে পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান এই বেতারের মাধ্যমেই হয়। আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন এগারােটি সেক্টর ও অন্যান্য বাহিনীর মাধ্যমে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রও তার বৈপ্লবিক ভূমিকার জন্য একটি পৃথক অসামরিক সেক্টরের মর্যাদা দাবি করতে পারে।
২৫ মার্চ ১৯৭১ রাতে ইতিহাসের মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ডের নৃশংস পরিস্থিতিতে ২৬ মার্চের সূর্য বয়ে এনেছিল বাংলার বুকে এক সাগর রক্ত, হাহাকার এবং শােকের ছায়া। এই অবস্থায় ২৬ মার্চ ‘৭১ অপরাহ্ন প্রায় দুটার সময় তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে বেরিয়ে এল একটি বিদ্রোহী কণ্ঠ। প্রায় পাঁচ মিনিট কাল স্থায়ী এই কণ্ঠে ছিল বাঙালির মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা ও বাংলার জনগণের প্রতি দখলদার বাহিনীকে সর্বশক্তি দিয়ে রুখে দাঁড়ানাের উদাত্ত আহবান। এই দুঃসাহসী বীরকন্ঠ ছিলেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক জনাব এম.এ. হান্নান। কিন্তু পাঁচ মিনিট পর থেমে গিয়েছিল সেই কণ্ঠ। এক হতাশার মুহূর্তে হঠাৎ প্রায় সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে আর একটি কণ্ঠ ইথার ভেদ করে বেরিয়ে এল। ঘােষিত হলাে: নাসরুম মিনাল্লাহে ওয়া ফাতহুন কারীব। (আল্লাহর সাহায্য ও বিজয় নিকটবর্তী)। চট্টগ্রাম বেতারের কালুরঘাট ট্রান্সমিটারে সদ্য সংগঠিত স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার থেকে ভেসে এসেছিল এই বিপ্লবী কণ্ঠ। ঘােষক ছিলেন চট্টগ্রাম ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস প্রিন্সিপ্যাল জনাব আবুল কাশেম সন্দ্বীপ। তার সাথে পর পর কয়েকবার বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বলছি, ঘােষণা শ্রোতা সাধারণের মধ্যে অসীম আগ্রহ সৃষ্টি করে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হান্নান সাহেব আঞ্চলিক প্রকৌশলী মির্জা। নাসিরউদ্দীনকে ট্রান্সমিটার চালু করার বিষয়ে সম্মত করান। এরপর অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার, গণসংগীত প্রচার ইত্যাদি সম্বন্ধে তারা পরিকল্পনা করেন এবং অধ্যাপক মমতাজউদ্দীন আহমেদ-এর পরামর্শ অনুযায়ী ই.পি.আর. কমান্ডার ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের সঙ্গে যােগাযােগ হয়। কমান্ডার রফিক নিরাপত্তার জন্য আগ্রাবাদে ২০ জন এবং কালুরঘাটে ১৫ জন জোয়ান প্রেরণের ব্যবস্থা করেন।
বেতার কেন্দ্রে একটি সাইক্লোস্টাইল করা প্রচার পত্র পৌঁছে যায়। এর শিরােনাম ছিল: জরুরি ঘােষণা। এই ঘােষণার নিচে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাক্ষর ছিল। প্রচারপত্রের বক্তব্য ছিল:
অদ্য রাত ১২টায় বর্বর পাক বাহিনী ঢাকার পিলখানা এবং রাজারবাগ পুলিশ লাইনে অতর্কিত হামলা চালায়। লক্ষ লক্ষ বাঙালি শহীদ হয়েছেন। যুদ্ধ চলছে। আমি এই পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করছি এবং সমস্ত বিশ্বের স্বাধীনতাকামী দেশসমূহের কাছ থেকে সাহায্য প্রার্থনা করছি। জয় বাংলা। এটি দিয়েই অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের জন্ম এভাবেই হয়। পরে সরকারিভাবে এই বেতারকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমেই বঙ্গবন্ধু কর্তৃক আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাটি বহির্বিশ্বে প্রচারিত হয়েছে। সেই সঙ্গে বিভিন্ন ঘােষণা গণসংগীত এবং খণ্ড খণ্ড সংবাদ-বুলেটিন প্রচারের ফলে বাঙালির মনােবল যেমন দৃঢ় হয়েছিল, রক্তপিপাসু হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে তেমনি প্রতিরােধযুদ্ধে বাঙালি জাতি অবতীর্ণ হওয়ার সাহস পেয়েছিল।
কালুরঘাট থেকে বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ২৬ মার্চে দুটি অধিবেশন প্রচার করেছিল। প্রথমটি সন্ধ্যা ৭-৪০ মিনিটে, দ্বিতীয়টি রাত ১০টায় এবং দুই অধিবেশনেই একাধিকবার পাঠ করা হয়েছিল বাঙালির মহান নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র।
২৭ মার্চ সান্ধ্য-অধিবেশনে আনুমানিক সন্ধ্যা ৭টা ৪০ মিনিটে মেজর জিয়াউর রহমান ইংরেজিতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি পাঠ করেছিলেন। মেজর জিয়ার কণ্ঠে প্রচারিত ঘােষণার ধারণকৃত টেপ সংরক্ষিত আছে।
মেজর জিয়ার এই ঘােষণা-পাঠ অনেকেই শুনেছিলেন এবং বাঙালি সৈনিকরা যে তাঁর এই ঘােষণা শুনেই আমাদের জনযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবেন সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া গিয়েছিল। এই ঘােষণাটি যুদ্ধরত বাঙালির মনে আশার সঞ্চার করেছিল। পার্বত্য চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক হিসেবেই শুধু নয়, বহুযুগের কাক্ষিত বাঙালির স্বাধীনতা অর্জনের এলাকার সাধারণ মানুষ, শিক্ষক-ছাত্র, পুলিশ-আনসার, ই.পি.আর. সহ সেনাবাহিনীর বাঙালি সদস্যদের সুসংগঠিত করতে ব্যস্ত ছিলাম। ব্যস্ততার মধ্যেও আমি বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বিভিন্ন ঘােষণা ও সংবাদ-বুলেটিন শুনেছিলাম।
চট্টগ্রামের কালুরঘাটে সর্বপ্রথম স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হয়। এই কেন্দ্র স্বল্পকালীন ছিল। ২৬-৩০ মার্চ তারিখ পর্যন্ত এই কেন্দ্র সরকারের পক্ষে প্রচার কাজ চালিয়ে যেতে সক্ষম হয়েছিল। এই স্বল্প সময়ের শেষদিনে পাকিস্তান বিমানবাহিনী বােমাবর্ষণ করে কেন্দ্র ক্ষতিগ্রস্ত করে। ফলে, প্রচার বন্ধ হয়ে যায়। স্বল্পসংখ্যক বেতারকর্মী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ট্রান্সমিটার যন্ত্রটি নিয়ে প্রথমে পটিয়া, পরে রামগড়,বাগাফা প্রভৃতি স্থানে যেতে বাধ্য হন।
ই.পি.আর. এবং বাঙালি জোয়ান, আওয়ামী লীগের কর্মীসহ সাধারণ মানুষের সহায়তায় বীর শব্দ সৈনিকরা রামগড়ে পৌঁছেছিল ৩ এপ্রিল ১৯৭১ সন্ধ্যায়। থানার সামনে তাদের সাথে আমার সাক্ষাৎ হয়। এদের দলনেতা ছিলেন বেলাল মােহাম্মদ। আমি বেলালকে উৎসাহিত করলাম কাছে ডেকে। ওদের জানিয়ে দিলাম যে আগের দিন ভারতীয় বি.এস.এফ. একটা ট্রান্সমিটার দিয়েছেন। কিন্তু এটি চালাবার লােক নেই। এখনই দুইজন সপ্রচারককে—একজন বাংলার, একজন ইংরেজির, নিয়ে নৌকায় ওঠো। আরাে জানিয়ে দিলাম অপারেটর লাগবে না, একজন শিখ অপারেটর আছে। ২০০ ওয়াট ক্ষুদ্র তরঙ্গে প্রচারযন্ত্রটি ছিল বি.এস.এফ.-এর ৯২ হেড কোয়ার্টাসে বাগাফায়। একটি বাঁশের ঘরে খুদে প্রচারযন্ত্রটি ছিল আলমারির মতাে দাঁড় করানাে। আর ছিল টেপরেকর্ডার ও মাইক্রোফোন, রেকর্ডপ্লেয়ার এবং গ্রামােফোন রেকর্ড।
আগরতলা বেতার কেন্দ্র থেকেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রনামে অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রের নিজস্ব সম্প্রচার-ভবনসহ পরিচালনা-অবকাঠামাে না থাকায় সুষ্ঠুভাবে আমাদের প্রয়ােজন মােতাবেক ঘােষণা, বুলেটিন অনুষ্ঠান ও সংবাদ প্রচার করা সম্ভব হচ্ছিল না। তবুও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে প্রচারণা ক্রমাগতভাবে চলতে থাকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার এই উদ্যোগ শুরু হয় বালু হক্কক লেনে জয় বাংলা পত্রিকার অফিসে এপ্রিল মাসে। টাঙ্গাইলের তৎকালীন এম.এন.এ বর্তমান (২০০৪) আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মান্নান বেতার-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে। এর আগে ভারত-সরকারের নিকট থেকে পঞ্চাশ কিলােওয়াটের একটি ট্রান্সমিটার যন্ত্র পাওয়া গিয়েছিল।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সম্প্রচার মুজিবনগরে আরম্ভ হয় ২৫ মে ১৯৭১। মন্ত্রিপরিষদের সচিব হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার প্রশাসনিক কিছু দায়িত্ব আমাকে পালন করতে হয়েছিল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর সরকারি নিয়ম অনুযায়ী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রম শুরু হয় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের অধীন একটি পরিদপ্তর হিসেবে বেতার-কেন্দ্রের কর্মধারা পরিচালিত হতাে। তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয় পরিচালনায় ছিলেন:
১. আনােয়ারুল হক খান- সচিব
২. কামরুল হাসান- পরিচালক (ডিজাইন)
৩. এম.আর. আখতার মুকুল- পরিচালক (তথ্য বিভাগ)
৪. আবদুল জব্বার খান- পরিচালক (চলচ্চিত্র বিভাগ)
৫. সিরাজুল ইসলাম- চিত্র প্রযােজক
৬. অজিত কুমার- প্রধান হিসাবরক্ষক
তৎকালীন ঢাকা বেতার কেন্দ্রের টি.এইচ. সিকদার জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদত্ত ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণের টেপসহ অসহযােগ-আন্দোলনকালে বেতার থেকে প্রচারিত বিভিন্ন অনুষ্ঠানের টেপ নিয়ে যান। আমাদের নিজস্ব বেতার-কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ভারতীয় তথ্য-প্রতিমন্ত্রী নন্দিনী সতপথি বিশেষভাবে সহযােগিতা করেছিলেন।
প্রাথমিক অবস্থায়, জনাব আবদুল মান্নান এম.এন.এ-র তত্ত্বাবধানে আমাদের বেতার কেন্দ্র স্থাপন করা হয় বালিগঞ্জের সার্কুলার রােডে অবস্থিত একটি দোতলা বাড়িতে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীন আনুষ্ঠানিকভাবে এই বাড়িতেই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের কার্যক্রমের সূচনা হয়।
রেডিও পাকিস্তানের কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা আমাদের সাথে যােগাযােগ করেছিলেন। তাদের মধ্য থেকে কর্মসূচি প্রণয়ন, প্রােগ্রামিং এবং সম্প্রচারসহ প্রয়ােজনীয় আনুষ্ঠানিক কাজের জন্য তাদের নিয়ােগ দেওয়া হয়েছিল। ক্রমে ক্রমে শিল্পী ও প্রকৌশলী আমাদের সাথে যােগ দেওয়ার ফলে বেতারের কার্যক্রমে গতির সঞ্চার হয়। স্বাধীন বাংলা বেতারে শতাধিক লােক নিয়ােগ করা হয়েছিল। এই বেতার কেন্দ্রের পরােক্ষ উপদেষ্টা ছিলেন সর্বজনাব জিল্লুর রহমান এম.এন.এ, মােহাম্মদ খালেদ এম.এন.এ এবং তাহেরউদ্দিন ঠাকুর এম.এন.এ.।
২৪ মে বালিগঞ্জের বাড়িতে প্রধানমন্ত্রীর কক্ষটিতে কয়েকটি অনুষ্ঠান রেকর্ড করা হয়েছিল ভারত-সরকারের কাছ থেকে পাওয়া টেপরেকর্ডার-এ। সাংবাদিক তােয়াব খান, কামাল লােহানী, এম.আর. আখতার মুকুল প্রমুখ অনুষ্ঠান-পরিকল্পনা দেন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রথম দিনের অনুষ্ঠানসূচি সকাল ৭টায় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াৎ ও তরজমা; ৭-১০ মিনিটে দৈনিক দুটি অধিবেশনের প্রচার সংক্রান্ত ঘােষণা; ৭-১৫ মিনিটে বাংলা সংবাদসহ মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষ অনুষ্ঠান অগ্নিশিখা; সাহিত্যের অনুষ্ঠান রক্ত স্বাক্ষর; বঙ্গবন্ধুর ভাষণভিত্তিক অনুষ্ঠান বজ্রকণ্ঠ; বাংলা ও ইংরেজি সংবাদ ও চরমপত্র।
পৃষ্ঠা: ১৪০
কামাল লােহানী সংবাদ সংগঠনের দায়িত্ব নেন। পবিত্র কোরআন তেলাওয়াৎ করেন জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদক মােহাম্মদউল্লাহ চৌধুরী। হাসান ইমাম সালেহ আহমদ ছদ্মনামে বাংলা খবর পড়েন। ইংরেজি খবর পড়েন পারভিন হােসেন। মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা টি. হােসেনের স্ত্রী। বাংলা সংবাদের ইংরেজি অনুবাদের পাণ্ডুলিপি তৈরি করেন এ.টি.এম. কামালউদ্দিন আহমেদ।
সর্বজনাব মােস্তফা আনােয়ার এবং আশরাফুল আলম পরবর্তীকালে অনুষ্ঠান পরিচালনার ভার নিয়েছিলেন। অল্প কয়েকদিনের জন্য বদরুল হাসানও অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছেন। বিশেষ সাহিত্যানুষ্ঠান রক্ত স্বাক্ষর-এর পরিকল্পনা ও প্রথম কিছুদিন প্রযােজনার দায়িত্বে ছিলেন জনাব টি.এইচ. সিকদার। অল্প কয়েকদিন পর সংযােজিত হয়েছিল বিশ্বজনমত এবং সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্য। এ দুটি অনুষ্ঠানের পাণ্ডুলিপি পড়তেন জনাব আমিনুল হক বাদশা। ‘বিশ্বজনমত’ লিখতেন জনাব সাদেকীন।
প্রথমদিন ২৫ মে বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিনে স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রে মাত্র একজন বেতার-কর্মী ও ৩/৪ জন সাংবাদিকের প্রচেষ্টায় একটি সফল পরিবেশনায় প্রবাসী সরকারের নেতৃবৃন্দসহ সবাই বিস্মিত ও মুগ্ধ হয়ে যান। এভাবেই সূচনা হয় ঐতিহাসিক স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দ্বিতীয় ও চূড়ান্ত পর্যায়ের যাত্রা। এর ৩/৪ দিনের মধ্যে ঢাকা বেতারের দ্বিতীয় দলটি শহীদুল ইসলামের নেতৃত্বে এসে যােগ দেন। চট্টগ্রাম থেকে আসেন কালুরঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার শুরুর প্রথম দলটি, যাদের মধ্যে ছিলেন বেলাল মােহাম্মদ, সৈয়দ শাকের, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ, মুস্তাফা আনােয়ার, আবদুল্লাহ আল-ফারুক, শরফুজ্জামান, রশিদুল হাসান, রেজাউল করিম চৌধুরী, আমিনুর রহমান ও হাবিবউদ্দিন মণি। রাজশাহী কেন্দ্র থেকে শামসুল হুদা চৌধুরী, মেসবাহউদ্দিন আহমেদ, মােহাম্মদ ফারুক ও অনু ইসলাম এবং খুলনা বেতার থেকে এলেন মমিনুল হক চৌধুরী প্রমুখ।
একটি সংঘবদ্ধ বেতার কর্মীদল স্বাধীন বাংলা বেতারকে শক্তিশালী একটি বেতারপ্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছিলেন। সমর দাস, আবদুল জব্বার, অনুপ ভট্টাচার্য, রফিকুল আলম, স্বপ্ন রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, অজিত রায়, সর্দার আলাউদ্দিন, সুজেয় শ্যাম, সুবল দত্ত, কল্যাণী ঘােষ, কল্যাণ মিত্র, রাজু আহমেদ, রণেন কুশারী, মাধুরী চ্যাটার্জী, নারায়ণ ঘােষ মিতাসহ বহু শিল্পী, সুরকার, নাট্যকারের উপস্থিতি উজ্জ্বল করে তােলে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কাজী রফিকসহ ঢাকায় অবস্থানরত সহকর্মীরা গােপনে ঢাকা কেন্দ্র থেকে বিভিন্ন লেখকের পাণ্ডুলিপি, গানসহ মুক্তিযুদ্ধের জন্য প্রয়ােজনীয় উপকরণসমূহ পাঠিয়েছিলেন।
বালিগঞ্জ সার্কুলার রােডের বাড়িটির একটি কক্ষে চাদর কাপড় ঝুলিয়ে সাউন্ড প্রুফ রেকর্ডিং-এর জন্য সম্বল ছিল দুটি ভাঙা টেপরেকর্ডার। বালিগঞ্জের সার্কুলার রােডের বাড়িতে অনুষ্ঠান ধারণ করা হলেও তা প্রক্ষেপণ করা হতাে ৩৯ সুন্দরীমােহন স্ট্রিটের আটতলা বাড়ির ছাদের ওপর থেকে।
নবপর্যায়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য প্রথম গান বাণীবদ্ধ করলেন রংপুর বেতারের পল্লীগীতি শিল্পী শাহ্ আলী সরকার। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান বাণীবদ্ধ করার জন্য স্টুডিও ছিল মাত্র একটি। পরে আরাে দুটি কক্ষ খালি করে অনুষ্ঠান রেকর্ডিং-এর ব্যবস্থা করা হয়েছিল। বাদ্যযন্ত্রের আংশিক অভাব পূরণ করতে ড্রাম, সাইডড্রাম, গিটার ইত্যাদি যন্ত্রপাতি কেনা হয়েছিল।
আগরতলায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও হিসেবে ব্যবহার করা হতাে সার্কিট হাউসের একটি কক্ষ। এর প্রচারণা ছিল বিক্ষিপ্ত, অর্থাৎ প্রত্যেকদিন অনুষ্ঠান প্রচার করা সম্ভব হতাে না— একদিন-দুইদিন বিরতি দিয়ে আগরতলা থেকে আমাদের অনুষ্ঠানমালা প্রচারিত হতাে। ৪০০ ওয়াট ক্ষুদ্র তরঙ্গ ট্রান্সমিটার। মিটার ব্যান্ড ছিল ৮৩.৫৬। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্রের (বালুরঘাট) দশজন সার্বক্ষণিক সংগঠক ছিলেন: বেলাল মােহাম্মদ (তৎকালীন চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নিজস্ব শিল্পী), আবুল কাশেম সন্দ্বীপ ( ফটিকছড়ি কলেজের তৎকালীন ভাইস-প্রিন্সিপ্যাল), সৈয়দ আবদুস শাকের (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন প্রকৌশলী), আবদুল্লাহ আল ফারুক (চট্টগ্রাম বেতারের তৎকালীন অনুষ্ঠান-প্রযােজক), মােস্তফা আনােয়ার (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের তৎকালীন অনুষ্ঠান প্রযােজক), রাশেদুল হাসান (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের তৎকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট), আমিনুর রহমান (চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের তকালীন টেকনিক্যাল অ্যাসিসট্যান্ট), শরফুজ্জামান (ঐ, টেকনিক্যাল অপারেটর), রেজাউল করিম চৌধুরী (ঐ, তৎকালীন টেকনিক্যাল অপারেটর) এবং কাজী হাবিবুদ্দিন (তিনি বেতারের কর্মী ছিলেন না)।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের নীতিনির্ধারণী সভায় উপস্থিত থাকতেন জনাব কামরুল হাসান (বিশিষ্ট চিত্রশিল্পী এবং মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শিল্প ও ডিজাইন বিভাগের পরিচালক), জনাব আবদুল জব্বার খান (চলচ্চিত্র পরিচালক-প্রযােজক এবং মুজিবনগরে গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের চলচ্চিত্র বিভাগের পরিচালক), জনাব এম.আর. আখতার মুকুল (চরমপত্রের লেখক ও পাঠক এবং মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রেস ও তথ্য বিভাগের পরিচালক), জনাব আলমগীর কবীর (বিশিষ্ট চলচ্চিত্র-পরিচালক ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি অনুষ্ঠানের সংগঠক) প্রমুখ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী কর্তৃক জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণ এবং বাণী সাড়ে-সাত কোটি বাঙালির মনকে করেছিল আশাদৃঢ়। মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গনি ওসমানীও দেশবাসীর উদ্দেশে ভাষণ দিয়েছিলেন। এছাড়া যেসব প্রতিনিধি বিভিন্ন সময়ে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অংশগ্রহণ করেছেন তাঁদের নামও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। জনাব আবদুল মান্নান এম.এন.এ. (ভারপ্রাপ্ত এম.এন.এ: প্রেস, তথ্য, বেতার ও চলচ্চিত্র), জনাব জিল্লুর রহমান (কার্যনির্বাহী সম্পাদক, সাপ্তাহিক জয়বাংলা পত্রিকা), জনাব আবদুল মালেক উকিল, জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী, জনাব ইউসুফ আলী, সৈয়দ আবদুস সুলতান, জনাব মােহাম্মদ খালেদ, বেগম বদরুন্নেসা আহমেদ, জনাব নূরুল হক, অধ্যাপক হুমায়ুন খালেদ, জনাব শামসুর রহমান (শাহজাহান), অধ্যাপক আবু সাইয়ীদ, জনাব শামসুদ্দিন মােল্লা, জনাব মুস্ত ফিজুর রহমান (চুনু মিঞা), জনাব মনসুর আহমেদ, জনাব সাখাওয়াতউল্লাহ, ডাক্তার সাইদুর রহমান ও জনাব নাজিমউদ্দিন প্রমুখের নাম স্মরণীয়।
সংগীত পরিচালনা ও সংগীত পরিবেশন করেছিলেন আবদুল জব্বার, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, মান্না হক, এম.এ মান্নান; পুঁথিপাঠে মােহাম্মদ শাহ বাঙালি; আবৃত্তিতে অতিথিশিল্পী বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের পুত্র ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আবৃত্তিকার কাজী সব্যসাচী, মুজিব বিন হক; ধারা-বর্ণনায় নিখিলরঞ্জন দাশ। একক বা সমবেত কণ্ঠে সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন শাহ আলী সরকার, সন্জীদা খাতুন, কল্যাণী ঘােষ, অনুপ কুমার ভট্টাচার্য, মনজুর আহমেদ, কাদেরী কিবরিয়া, সুবল দাশ, হরলাল রায়, এ.এস.এম. গণি বােখারী, শাহীন মাহমুদ, অনিল চন্দ্র দে, অরূপ রতন চৌধুরী, মােশাদ আলী, শেফালী ঘােষ, হেনা বেগম, মফিজ আঙ্গুর, লাকী আখন্দ, স্বপ্ন রায়, মালা খান, রূপা খান, মাধুরী আচার্য, নমিতা ঘােষ, ইন্দ্রমােহন রাজবংশী, আবু নওশের, রমা ভৌমিক, মনােয়ার হােসেন, অজয় কিশাের রায়, কামালউদ্দিন, ইকবাল আহমেদ, রঞ্জন। ঘটক, মনােরঞ্জন ঘােষাল, তােরাব আলী শাহ, নায়লা জামান, বুলবুল মহলানবীশ, এম.এ.খালেক, মনজুলা দাশগুপ্ত, সুব্রত সেনগুপ্ত, উমা চৌধুরী, মােশাররফ হােসেন, ঝর্না ব্যানার্জী, দীপা ব্যানার্জী, সুকুমার বিশ্বাস, তরুণ রায়, প্রবাল চৌধুরী, তােরাব আলী, রফিকুল আলম, কল্যাণী মিত্র, মঞ্জুশ্রী নিয়ােগী, লীনা দাশ, সকিনা বেগম, রেজওয়ানুল হক, অনীতা বসু, নীনা, কণা, মহিউদ্দিন খােকা, রিজিয়া সাইফুদ্দিন, রেহানা বেগম, মিহির নন্দী, অমিতা সেনগুপ্ত, ভক্তি রায়, অর্চনা বসু, মােস্তফা তানুজ ও আরাে অনেকে।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান-ধারণ-উপযােগী যথাযথ ব্যবস্থা না থাকলেও কারিগরি মানকে অতিক্রম করেছিল অংশগ্রহণকারী লেখক-শিল্পীদের দক্ষ নিবেদন। আমাদের বীরপ্রাণ মুক্তিযােদ্ধারা এসব অনুষ্ঠান শুনে বিক্রমশালী হয়েছিলেন।
প্রাত্যহিক অধিবেশনে ধর্মীয় অনুষ্ঠানে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াৎ ও তরজমায় অংশগ্রহণ করেছিলেন মওলানা নূরুল ইসলাম জেহাদী, মওলানা খায়রুল ইসলাম যশােরী ও মওলানা ওবায়দুল্লাহ বিন সাঈদ জালালাবাদী। পবিত্র কোরআনের আলােকে হাবিবুর রহমানের কয়েকটি আলােচনাও প্রচারিত হয়েছিল ইসলামের দৃষ্টিতে শিরােনামে। পবিত্র গীতা পাঠ করতেন বিনয় কুমার মণ্ডল ও জ্ঞানেন্দ্র বিশ্বাস। পবিত্র ত্রিপিটক পাঠে অংশ নিয়েছিলেন রণধীর বড়ুয়া। আর পবিত্র বাইবেল পাঠ করতেন ডেভিড প্রণব দাস।
বিপ্লবী স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রই দখলদার পাকিস্তানি নরপশু সেনাবাহিনীদের বিরুদ্ধে প্রতিহতকারী প্রথম সংগঠন। এই বেতার-কেন্দ্রই বাঙালির জনযুদ্ধের প্রথম বিক্রমবাহিনী। তাই স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের দুই পর্বেই অংশগ্রহণকারী সকলকেই আমরা শব্দসৈনিকঅভিধায় সম্বােধন করি।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অনুষ্ঠান প্রচার ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। কেন্দ্রের প্রারম্ভিক দিবসের অনুষ্ঠানসূচি দেখলে মনে হবে এক স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সরকারের পক্ষেই এই অনুষ্ঠানসূচি প্রণয়ন করা হয়েছে। তবে, এ-কাজে এই শিল্পের সঙ্গে যুক্ত কুশীলবদের অবদান অনস্বীকার্য। তারা তাদের দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা দিয়ে প্রারম্ভিক দিবসের অনুষ্ঠান তিনটি পর্যায়ে তৈরি করেছিলেন:
ক. প্রতিষ্ঠা পর্যায়: ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মার্চ ১৯৭১ দুপুর পর্যন্ত: কালুরঘাট ট্রান্সমিটার, চট্টগ্রাম।
১. জয় বাংলা বাংলার জয়: অধিবেশন প্রারম্ভ ও সমাপ্তিতে সূচকধ্বনি হিসেবে ব্যবহৃত
(কথা: গাজী মাজহারুল আনােয়ার। ‘জয়বাংলা’ সিনেমার গান … রেকর্ড।)
খ. দ্বিতীয় পর্যায়: ৩ এপ্রিল থেকে ২৫ মে সকাল বেলা পর্যন্ত: শর্টওয়েভ ট্রান্সমিটার, আগরতলা
২. আমার সােনার বাংলা
আমি তােমায় ভালােবাসি
(রবীন্দ্র সংগীত)
: ঢাকায় উৎপন্ন গ্রামােফোন রেকর্ড
৩. কারার ঐ লৌহ কপাট : ঢাকায় উৎপন্ন গ্রামােফোন রেকর্ড (নজরুল গীতি)
৪. দুর্গম গিরি কান্তার মরু: ঢাকায় উৎপন্ন গ্রামােফোন রেকর্ড (নজরুল গীতি)
৫. মােরা ঝঞার মতাে উদ্দাম: ঢাকায় উৎপন্ন গ্রামােফোন রেকর্ড
৬. কেঁদো না কেঁদো না মা গাে: চট্টগ্রাম বেতারের স্টুডিও রেকর্ড
গ. তৃতীয় পর্যায়: ২৫ মে ১৯৭১ বিকেল বেলা থেকে ২ জানুয়ারি ১৯৭২ পর্যন্ত: ৫০ কি.ও. মিডিয়াম ওয়েভ, কলিকাতা
৭. জনতার সংগ্রাম চলবেই: ঢাকা বেতারের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: সিকান্দার আবু জাফর)
৮. বিচারপতি তােমার বিচার: ঐ (কথা সলিল চৌধুরী)
৯. সােনা সােনা সােনা: ঐ (কথা: আবদুল লতিফ, শিল্পী: শাহনাজ বেগম (রহমতুল্লাহ)
১০. সালাম সালাম হাজার সালাম: ঐ (কথা: ফজল-এ-খােদা, শিল্পী: মােহাম্মদ আবদুল জব্বার)
১১. আমি শুনেছি শুনেছি আমার মায়ের কান্না: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: ফজল-এ-খােদা, শিল্পী: মান্না হক)
১২. নােঙর তােলাে তােলাে সময়: ঐ (কথা: নঈম গওহর)
১৩. শােনাে একটি মুজিবরের থেকে: কলকাতায় উৎপন্ন গ্রামােফোন
(কথা: গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার, শিল্পী: অংশুমান রায়)
১৪. একটি ফুলকে বাঁচাব বলে: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: গােবিন্দ হালদার, শিল্পী: আপেল মাহমুদ)
১৫. ও বাগিলা রে, কেন বা আলু: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: হরলাল রায়, শিল্পী: রথীন্দ্রনাথ রায়)
১৬. ব্যারিকেড বেয়নেট বেড়াজাল: ঢাকা বেতারের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: আবু বকর সিদ্দিক)
১৭. আমার নেতা শেখ মুজিব: ঐ
১৮. অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: টি এইচ শিকদার )
১৯. অত্যাচারের পাষাণ কারা জ্বালিয়ে দাও: ঐ (কথা: আল মুজাহিদী)
২০. সােনায় মােড়ানাে বাংলা মােদের: ঐ (কথা, সুর ও শিল্পী: মুকসুদ আলী সাই)
২১. সাত কোটি আজ প্রহরী প্রদীপ: ঐ (কথা: সারওয়ার জাহান)
২২. রক্তেই যদি ফোটে জীবনের ফুল: ঢাকা বেতারের স্টুডিও রেকর্ড (কথা: সৈয়দ শামসুল হুদা)
২৩. তীরহারা এই ঢেউ-এর সাগর: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্টুডিও রেকর্ড (শিল্পী: আপেল মাহমুদ ও সঙ্গীরা)
২৪. ছােটদের বড়দের সকলের: ঐ (শিল্পী: রথীন্দ্রনাথ রায়)
২৫. একসাগর রক্তের বিনিময়ে: ঐ (কথা: গােবিন্দ হালদার, শিল্পী: স্বপ্ন রায়)
২৬. সাড়ে সাত কোটি মানুষের আর একটি নাম: কলিকাতায় উৎপন্ন গ্রামােফোন রেকর্ড (কথা: শ্যামল মিত্র, শিল্পী: মাে. আবদুল জব্বার)
২৭. পূর্বদিগন্তে সূর্য উঠেছে: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের (কথা: গােবিন্দ হালদার, স্টুডিও রেকর্ড সুর: সমর দাস)
২৮. আমি এক বাঙলার মুক্তিসেনা: ঐ (কথা: নেওয়াজিস হােসেন)
২৯. মুক্তির একই পথ সংগ্রাম: ঐ (কথা: শহীদুল ইসলাম)
৩০. জগতবাসী বাংলাদেশকে যাও দেখিয়ে: ঐ (শিল্পী: সরদার আলাউদ্দীন)
৩১. রুখে দাঁড়াও: ঐ (শিল্পী: সরদার আলাউদ্দীন)
৩২. মানুষ হ, মানুষ হ, আবার: ঐ (কথা: গুরুসদয় দত্ত। কামরুল হাসান, বেলাল মােহাম্মদ, আমিনুল হক বাদশা, কামাল লােহানী ও শেখ কামালের সমবেত কণ্ঠে রেকর্ডকৃত এবং ৩/৪ টি অধিবেশনে প্রচারিত)
৩৩. আমার প্রতিবাদের ভাষা : ঐ
৩৪. আমার ভায়ের রক্তে রাঙানাে: ঐ (কথা: আবদুল গাফফার চৌধুরী, সুর: আলতাফ মাহমুদ)
৩৫. পুঁথিপাঠ: ঐ (রচনা ও পরিবেশনা: মােহাম্মদ শাহ বাঙালী)
পৃষ্ঠা: ১৪৫
প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের স্নায়ুযুদ্ধ কোষ (Warfare cell) তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রণালয়ের সাথে ঘনিষ্ঠ সহযােগিতায় কাজ করে। এই শাখা পুস্তিকা, প্রচারপত্র, ব্রশিউর ইত্যাদি বহুসংখ্যক প্রকাশনা বের করেছে। এগুলি আমাদের বৈদেশিক সম্প্রচারে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছে।
সকল দিকে আমাদের প্রচার জোরদার করার উদ্দেশ্যে মিত্র-সরকারের অধীনস্থ তথ্যসংস্থা-প্রধানদের সাথে পর্যায়ক্রমিক সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস বাংলাদেশের অনেক শিল্পী ও বুদ্ধিজীবী ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল এবং পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশন করেন। বাংলাদেশের সংগ্রাম ও আবহমান সংস্কৃতির পরিচয় এসব অনুষ্ঠানে ফুটে উঠত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গঠন ও শরণার্থীদের জন্য অর্থসংগ্রহের ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা ছিল এসব অনুষ্ঠানের। জনাব ওয়াহিদুল হক, সনজিদা খাতুন, মােস্তফা মনােয়ার, সৈয়দ হাসান ইমাম, লায়লা হাসান, মাে. মােশাদ আলীসহ আরাে কয়েকজন রূপান্তরের গান’ শীর্ষক একটি অনুষ্ঠান করেছিলেন। এ অনুষ্ঠান প্রচণ্ড আলােড়ন সৃষ্টি করে।
বিক্ষুদ্ধ বাংলা(পরিশিষ্ট ৮৩) নামক গীতিআলেখ্য আজো স্মরণীয় হয়ে আছে। শিল্পীরা দল বেধে যেতেন বিভিন্ন ক্যাম্পে, মুক্তাঞ্চলে। এই অধ্যায়ের পূর্বেই এসব শিল্পী ও গােষ্ঠীর পরিচিতি দেওয়া হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধকালে শরণার্থীদের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছিল (পরিশিষ্ট ৮৪)।
বাংলাদেশের সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ
আমাদের বুদ্ধিজীবী, শিল্পী ও সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব যারা মুজিবনগরে ছিলেন তারা স্বাধীন বাংলা বেতারের মাধ্যমে জনযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সকলকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ ও উজ্জীবিত করে রাখেন। একদিকে মুক্তিযোেদ্ধা ও যুদ্ধে-অংশগ্রহণকারী অন্যান্য সকলকে জয়ের আশায় দীপ্ত করে রাখে, অন্যদিকে শত্রুপক্ষকে পরাজয়ের ভীতি প্রদর্শন করে মনােবল ভেঙে দেয়। পশ্চিমবঙ্গে গঠিত সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদ সারা ভারতে সভা, সমিতি, সেমিনার ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ভারতের সর্বস্তরের জনগণ এইসব অনুষ্ঠানে উপস্থিত হয় এবং সংহতি প্রকাশ করে।
বাংলাদেশ সংগ্রামী বুদ্ধিজীবী পরিষদের মধ্যে ছিলেন চিত্রশিল্পী কামরুল হাসান। তার আঁকা দৈত্য ইয়াহিয়ার ভয়ংকর ছবি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় কর্ম। এ ছবির নামকথা ছিল: এই জানােয়ারদের হত্যা করুন। ওরা মানুষ হত্যা করছে। আসুন আমরা জানােয়ার হত্যা করি। এ ছাড়াও তিনি বিভিন্ন পােস্টার তৈরি করেছিলেন। শিল্পী কামরুল হাসান মুজিবনগরে অবস্থানকালে অনেকগুলি ছবি এঁকেছিলেন।
পােস্ট ও টেলিগ্রাফ
১. ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ
২. আবদুল আজিজ, ই.পি.সি.এস
মুজিবনগরে প্রতিষ্ঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ যুদ্ধবিষয়ক কাজকর্ম ছাড়াও সরকারি বহু কাজ করেন। এর মধ্যে ডাক-বিভাগ প্রতিষ্ঠা এবং বেশ কয়েকটি দৃষ্টিনন্দন ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিলেন যা বিশ্বব্যাপী সমাদৃত হয়েছিল। (পরিশিষ্ট ৮৫ দ্রষ্টব্য)। প্রায় প্রতিটি মুক্তাঞ্চলে স্থাপিত হয়েছিল নিজস্ব ডাকঘর। এই ডাকঘরগুলোতে পত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা সচল রাখা হয়।
বাংলাদেশ ফুটবল দল
আমাদের গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের সময় পূর্ববাংলার ক্রীড়াবিদদের মধ্যে অনেকেই মুজিবনগরে পৌঁছে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অধীন বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন অনেকেই রণাঙ্গনে চলে যান। মুক্তিযুদ্ধের সহযোগী সংগঠন হিসেবে মুজিবনগরে গড়ে ওঠে স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল। পূর্ব বাংলার বিশিষ্ট ফুটবল খেলোয়াড় প্রতাপ শংকর দারার নেতৃত্বে এই ফুটবল-দল সারা ভারতে প্রদর্শনী ও প্রীতি ফুটবল ম্যাচ খেলে বাংলাদেশের পক্ষে সমর্থন ও সহযোগিতার আবেদন জানান।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের আন্তরিক ইচ্ছা ও প্রচেষ্টায় বাংলাদেশ ক্রীড়া পরিষদের বিকাশ ঘটে। ক্রীড়া পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ৬ জুন ‘৭১-এ স্বাধীন বাংলা ফুটবল-দল প্রশিক্ষণ আরম্ভ করে। ২৪ জুলাই নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগরে আমাদের ফুটবল দল প্রথম প্রদর্শনী খেলা খেলে। বিদেশের মাটিতে এই প্রথম আমাদের দেশের পতাকার সঙ্গে আর একটি দেশের পতাকা উত্তোলিত হয় এবং বাজানো হয় জাতীয় সংগীত। প্রদর্শনী ও প্রীতি ফুটবল খেলা থেকে অর্জিত প্রায় ৩ লক্ষ টাকা মুক্তিযুদ্ধ তহবিলে দেওয়া হয়।
পত্র-পত্রিকা ও বুলেটিন
বাংলাদেশ সরকারের মুখপত্র জয় বাংলা পত্রিকা আমাদের মুক্তিসংগ্রাম, রণাঙ্গনের আগুনঝরা যুদ্ধ, দেশ থেকে চলে যাওয়া উদ্বাস্তুদের অবস্থা, বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে বিশ্ব জনসমর্থন আদায়, বাংলাদেশের স্বীকৃতির পক্ষে পৃথিবীবাসীর প্রতি আহ্বান, হানাদার পাকিস্তানি বর্বর সেনাবাহিনীর গণহত্যা ভাঙব আর গঠিত সরকারের ভূমিকা ও কর্মধারা দেশ-বিদেশের মানুষকে জানানোর জন্য পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়। এই উদ্যোগের ফল ১১ মে ‘৭১ জয় বাংলা পত্রিকার আত্মপ্রকাশ।
জাতীয় সংসদ সদস্য আবদুল মান্নানের নেতৃত্বে পত্রিকাটির প্রকাশনা ছিল প্রশংসনীয় এই পত্রিকার সংগ্রামী ভূমিকার কথা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। ২২/১, বালু হক্বক লেন থেকে প্রকাশিত এই সাপ্তাহিক পত্রিকার মুদ্রণ ও অন্যান্য কাজে সহযোগিতা করেন পশ্চিমবঙ্গের কয়েকজন বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি। বরেণ্য সাংবাদিক, কবি-সাহিত্যিক আবদুল গাফ্ফার চৌধুরীর সম্পাদনায় প্রকাশিত এই পত্রিকাটি দেশে-বিদেশে ব্যাপক সমাদর লাভ করেছিল। এ ছাড়া উল্লেখযোগ্য সংখ্যক প্রচার পুস্তিকা, বুলেটিন, বাংলাদেশ (ইংরেজি ও বাংলা ভাষায়) নামক পত্রিকা, প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ ইত্যাদি প্রকাশিত হয়েছিল। পরিশিষ্ট ৮৬-তে এগুলির ১১টি নমুনা দেওয়া হয়েছে।
জয় বাংলা পত্রিকায় কর্মরত ব্যক্তিবর্গের পরিচয়
জনাব আবদুল মান্নান, এম.এন.এ.: প্রকাশক
(ছদ্মনাম আহমেদ রফিক) (সার্বিক দায়িত্বপ্রাপ্ত)
মোহাম্মদউল্লাহ চৌধুরী: উপদেষ্টা, সম্পাদকমণ্ডলী
(আবদুল মতিন চৌধুরী)
মোহাম্মদ খালেদ (অধ্যক্ষ): উপদেষ্টা, সম্পাদকমণ্ডলী
জিল্লুর রহমান: উপদেষ্টা, সম্পাদকমণ্ডলী
আবদুল গাফফার চৌধুরী: সম্পাদক
আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, বার্তা বিভাগ
আসাদ চৌধুরী: সহকারী সম্পাদক, ফিচার বিভাগ
গাজীউল হক: লেখক, ফিচার বিভাগ
ড. এবনে গােলাম সামাদ: লেখক, বার্তা বিভাগ
এম.এ. মােহাইমেন: সহকারী, প্রকাশনা বিভাগ
আবদুল মঞ্জুর: লেখক, বার্তা বিভাগ
গােলাম সরওয়ার: লেখক, বার্তা বিভাগ
রবিউল আলম: আলােকচিত্র শিল্পী, আলােকচিত্র বিভাগ
অনু ইকবাল (নজরুল ইসলাম): লেখক, বার্তা বিভাগ
অজিত কুমার দত্ত: প্রধান হিসাবরক্ষক
পার্থ ঘােষ: হিসাবরক্ষক
রণজিৎ নিয়ােগী: সহ-সম্পাদক, বার্তা বিভাগ
রবীন্দ্র গােপ: সাংবাদিক, বার্তা বিভাগ
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে বহিঃপ্রচার বিভাগ থেকে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে প্রকাশিত হয়েছিল ‘বাংলাদেশ বুলেটিন’। এই বুলেটিনের উপদেষ্টা ছিলেন মওদুদ আহমেদ। ফেরদৌস মুরশিদের সম্পাদনায় প্রকাশিত এই বুলেটিন মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক সাড়া জাগিয়েছিল।
মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী নিম্নলিখিত কর্মকর্তাবৃন্দ তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের সকল কাজকর্ম প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে করতেন।
১. আবদুল মান্নান এম.এন.এ.: উপদেষ্টা
২. আনােয়ারুল হক খান: সচিব
৩. কামরুল হাসান: পরিচালক
৪. এম.আর আখতার মুকুল: পরিচালক
৫. আবদুল জব্বার খান: পরিচালক
বহিঃপ্রচার বিভাগ
১. তাহের উদ্দিন ঠাকুর এম.এন.এ.: উপদেষ্টা
২. আমিনুল হক বাদশা
উল্লেখযােগ্য পত্র-পত্রিকা
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশে-বিদেশে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলসহ অনেকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা প্রকাশ করেছিলেন— যেগুলি এক একটি সমরাস্ত্রের মতাে কার্যকরী হয়ে উঠেছিল। দেশে-বিদেশে প্রকাশিত এই সমস্ত পত্রিকার মধ্যে কয়েকটি নাম উল্লেখ করছি: বঙ্গবাণী: স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র।
স্বদেশ: জাতীয়তাবাদী বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র।
বাংলাদেশ: সাপ্তাহিক সংবাদপত্র
রণাঙ্গন: মুক্তিফৌজের সাপ্তাহিক মুখপত্র
স্বাধীন বাংলা (সােনার দেশ): স্বাধীন বাংলার সাপ্তাহিক মুখপত্র।
মুক্তিযুদ্ধ: সাপ্তাহিক। পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশ) কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র
সােনার বাংলা: সাপ্তাহিক। মুক্তিবাহিনীর মুখপত্র।
বিপ্লবী বাংলাদেশ: বরিশাল থেকে প্রকাশিত সাপ্তাহিক।
বাংলার মুখ: একটি সংবাদ নিবন্ধ সাপ্তাহিক।
মুক্ত বাংলা: সাপ্তাহিক। বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামে সিলেট জেলার নির্ভীক স্বাধীন মুখপত্র।
সাপ্তাহিক বাংলা: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কণ্ঠস্বর।
দাবানল: সাপ্তাহিক। মুক্তিযােদ্ধা ও সংগ্রামী জনতার মুখপত্র।
বিদেশ থেকে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা
পরিক্রমা: বাংলাদেশ স্টিয়ারিং কমিটির জনসংযােগ বিভাগ কর্তৃক ১১ নং গােরিং স্ট্রিট লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি অর্ধ-সাপ্তাহিক।
জনমত: সাপ্তাহিক
বাংলাদেশ পত্র : বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, কলেজ স্টেশন শাখা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রচারিত।
Bangladesh: সাপ্তাহিক
The Nation Bangladesh: পাক্ষিক। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের মুখপত্র।
Bangladesh Today: গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রচার বিভাগ কর্তৃক প্রকাশিত একটি পাক্ষিক।
বাংলাদেশ: বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকার শাখা সংগঠন কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রচারিত। সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি: কে.এম. আলমগীর।
শিখা: বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, নিউইয়র্ক শাখা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
বাংলাদেশ: বাংলাদেশ সমিতি, কানাডা, টরেন্টো শাখা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
স্ফুলিঙ্গ: বাংলাদেশ সমিতি, কুইবেক কর্তৃক প্রকাশিত।
বাংলাদেশ নিউজ লেটার: বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, শিকাগাে শাখা কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
Bangladesh West Coast News Bulletin: বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা, ক্যালিফোর্নিয়া শাখা, আমেরিকা লীগ অব বাংলাদেশ কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
(সূত্র: এ.এস.এম. সামছুল আরেফিন সম্পাদিত মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে ব্যক্তির অবস্থান)
স্বরাষ্ট্র, পুলিশ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়
পঁচিশে মার্চ (১৯৭১ সাল) মধ্যরাতে পাকিস্তান সামরিক জান্তা নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালি জাতির ওপর ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পৃথিবীর ইতিহাসের জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড শুরু করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দেওয়া হয় বাঙালি-নিধনে। আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী, সমর্থক ও নিরপেক্ষ বাঙালি-নিধনই ছিল পাকিস্তান বাহিনীর লক্ষ্য। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে সে রাতে এবং পরবর্তী নয় মাস বিহারী জনগােষ্ঠীও বাঙালি-নিধন-কাজে যােগ দিয়েছিল। এদের নির্মমতায় টিকতে না পেরে অসংখ্য বাঙালি পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত, বার্মা সীমান্তে চলে যায় এবং দীর্ঘ সীমান্ত-এলাকা জুড়ে মানবেতর জীবন কাটাতে থাকে। কিন্তু, নিজ জন্মভূমি বিদেশিদের করায়ত্ত হবে তা তারা মেনে নিতে পারেনি। পূর্ববাংলার অভ্যন্তরে যারা নির্যাতন এবং হত্যার শিকার হয়েছিল তারা মনেপ্রাণে হানাদার পাকিস্তান বাহিনী এবং তাদের দোসর বিহারী ও শান্তি কমিটির কিছু দালালকে ঘৃণা করতে শুরু করে। এই ঘৃণা পূর্ববাংলার আনাচে-কানাচে প্রতিটি ঘরে বিস্তৃত হয়। এসব শত্রুর বিরুদ্ধে স্বাধীনতাকামী বাঙালি জনগণ প্রতিরােধ গড়ে তুলতে শুরু করে।
পূর্ববাংলায় বিরাজমান এমন পরিস্থিতিতে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে সীমান্ত-সংলগ্ন এলাকায় নির্বাচিত জনপ্রতিনিধির কোনাে কোনাে সদস্য একত্রে মিলিত হন। প্রাথমিক পর্যায়ে সম্মিলন ঘটতে কিছু সময় লাগে। তবে বলা যায় তা অতি দ্রুতই সম্পন্ন হয়। প্রধানত ভারতের বিভিন্ন রাজ্যের সীমান্ত অঞ্চলে এসব নেতা অবস্থান নিয়েছিলেন। আওয়ামী লীগ নেতা দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব তাজউদ্দীন আহমদ যাদের খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁদের নিয়েই কয়েকদিন অবিশ্রান্তভাবে শলা-পরামর্শ করলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামান, খন্দকার মােশতাক আহমেদ, আবদুল মান্নান, আমীর-উল-ইসলাম প্রমুখের সঙ্গে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলাপ-আলােচনায় প্রাধান্য পায়। কারণ, পাকিস্তান তার শক্তিশালী প্রচারমাধ্যমের সহায়তায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এমন ধারণা দিতে শুরু করে যে, পূর্ববাংলায় যা ঘটেছে তা তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এ সম্বন্ধে বহির্বিশ্বের চিন্তার কোনাে কারণ নেই। পাকিস্তানের সঙ্গে যেসব দেশের আন্তরিকতা ছিল এবং রাজিৈতক স্বার্থ জড়িত ছিল সেসব দেশের, বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এবং চীনের সরকারগুলাে পূর্ববাংলার জনগণের বিপক্ষে মনােভাব পােষণ করতে থাকে। ফলে, পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তান-সরকারের অত্যাচারের মাত্রা অবর্ণনীয় আকার ধারণ করে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ, এমনকি যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জনগণ মানবতাবিরােধী কার্যকলাপের জন্য পাকিস্তান-সরকারকে দায়ী করতে থাকে। কিন্তু আন্তর্জাতিক রীতিনীতির অজুহাত তুলে এসব দেশ পূর্ববাংলার নির্যাতিত মানুষের সাহায্যে আসতে পারছিল না।
এই পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৫ মার্চ রাতের অতর্কিত আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদস্বরূপ তাৎক্ষণিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। রাত ১২টার পর অর্থাৎ ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরের এই স্বাধীনতা-ঘােষণার পটভূমিতে তাজউদ্দীন আহমদ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সিদ্ধান্ত নেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠনের।
পৃষ্ঠা: ১৫০
এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জাতীয় নির্বাচনে জয়ী সদস্যগণের সমম্বয়ে মন্ত্রিসভা গঠন, রাষ্ট্রপতি, উপরাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন করা হয়। অধ্যাপক ইউসুফ আলী এই মর্মে ঘোষণার বাণী পাঠ করেন এবং তা অনুমােদিত হয়। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় উপস্থিত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক ও স্বতস্ফূর্ত জনগণের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে এই ঘােষণা দেওয়া হয়। এই ঘােষণার কথা অন্য প্রসঙ্গেও বলা হয়েছে।
আনুষ্ঠানিকভাবে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ঘােষিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা-ঘােষণার অনুমােদন আন্তর্জাতিকভাবে বিপুল সাড়া জাগায়। একই সময় মন্ত্রিসভার সদস্যগণের নাম, রাষ্ট্রপতি ও উপরাষ্ট্রপতির ক্ষমতা ইত্যাদি সম্বন্ধে ঘােষণা করা হয়। রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পাকিস্তানের কারাগারে বন্দিত্বের কারণে উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিরূপে সকল দায়িত্ব পালনের ভার অর্পণ করা হয়।
এভাবে গঠিত মন্ত্রিসভার সদস্য এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর লুটতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞের কারণে সাধারণ মানুষের নিরাপত্তা দারুণভাবে বিঘ্নিত হয়। বাস্তুচ্যুত মানুষের ত্রাণসামগ্রীর প্রয়ােজন অনুভূত হয়। তাদের পুনর্বাসিত করার প্রয়ােজনীয়তা দেখা দেয়। সীমান্ত-অঞ্চলে শরণার্থী শিবিরে এবং দেশের অভ্যন্তরে বিরাজমান আইন-শৃঙ্খলার অবনতিতে এই মন্ত্রণালয়ের ভূমিকা বৃদ্ধি পায়। প্রাথমিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সব মন্ত্রণালয় একযােগে দেশের এই বৃহৎ সমস্যার সমাধানে আত্মনিয়ােগ করে। সকল মন্ত্রীই সরকারের সব কাজে অংশ নিলেও দপ্তর বণ্টন করে দেওয়ায় নির্ধারিত দায়িত্ব পালনে মন্ত্রিগণ তৎপর হন। মুক্তিযুদ্ধকালে যে মন্ত্রীর যে দায়িত্ব তিনি সেভাবেই তা করতে থাকেন। দেশি-বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে তারা দায়িত্ব অনুযায়ী কাজ করতে থাকেন।
প্রথমদিকে স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীর সঙ্গে একজন পূর্ণ সচিব দায়িত্ব পালন করেন। পুলিশের ডাইরেক্টর জেনারেল এই বিভাগের কার্যাবলি সম্পাদন করেন। তথ্য সংগ্রহ করে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন সংস্থার নিকট তা প্রেরণ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি প্রধান কাজ ছিল। মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিকে ৪টি রেঞ্জের জন্য ৪ জন ডি.আই.জি, এবং প্রতি জেলায় একজন এস.পি. নিয়ােগ করা হয়। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জনবল সম্বন্ধেও মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল। এতদসংক্রান্ত আলােচনায় খসড়া নােট তৈরি করে পরে সেগুলি সিদ্ধান্তাকারে লেখা হতাে (পরিশিষ্ট ৮৭ দ্রষ্টব্য)। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদগুলাের (Zonal Administrative Councils-এর) দায়িত্বও পালন করেন। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে নিম্নলিখিত কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ােগ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
ডি.এস.পি. ৫ জন
ইন্সপেক্টর ১০ জন
দারােগা (এস. আই.) ২০ জন
করণিক (ক্লার্ক) ১ জন
ইন্সপেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে বিশেষ গােয়েন্দা সংগঠন গড়ে-তােলার জন্য বিশেষ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। এজন্য তাঁকে ১২,৫০০ রুপি বিরাদ্দ দেওয়া হয়েছিল। তাছাড়া, তাঁর হাতে মাসিক ৭,৫০০ রুপি অতিরিক্ত প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। এই পরিমাণ অর্থ নিরাপত্তাজনিত কারণে ব্যয়-বরাদ্দ ধরা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের সুপারিশক্রমে পার্বত্য চট্টগ্রামে মং রাজাকে সরকারি উপদেষ্টা নিয়ােগ করা হয় এবং তাঁকে মাসিক ৫০০ রুপি ভাতা মঞ্জুর করা হয়। তবে, এসব ব্যয় ও মঞ্জুরির বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যােগাযােগ করে তা বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেওয়া হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অন্যান্য কাজের সাথে নিম্নবর্ণিত কার্যাবলি সম্পাদনের দায়িত্ব লাভ করে এবং তা পালন করে:
ক. অবমুক্ত এলাকার প্রশাসনিক কাঠামাে চালুকরণ; খ. ভ্রমণ ডকুমেন্ট ইস্যু করা; এবং গ. তদন্ত অনুষ্ঠান করা।
আগস্ট মাসের ১৬ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত সাংগঠনিক কাঠামাে অনুমােদিত হয়। কাঠামােতে (organogram-এ) বর্ণিত পদগুলির প্রত্যেকটির দায়িত্বের বিবরণও দেওয়া হয়। এই মাসেরই ১৩ তারিখে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জুলাই-সেপ্টেম্বর ১৯৭১ মাসের জন্য ৬০ হাজার রুপির এক বাজেট, সচিব কমিটিতে পেশ করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট-৮৮ দ্রষ্টব্য)। বাজেটের সঙ্গে প্রেরিত নােটে দেখা যায় সরকারের অর্থবিভাগ আগেই ২,৫০,০০০/-রুপির থােক বরাদ্দ বাজেটে দিয়ে রেখেছে। প্রস্তাবিত বাজেটের সঙ্গে কর্মকর্তা-কর্মচারীর সংখ্যা, তাদের বেতনের হার প্রয়ােজনীয় স্টেশনারি দ্রব্যের নাম ও পরিমাণ দেওয়া হয়।
বাংলাদেশ পুলিশ ব্যাজের নকশা প্রণয়ন
মুক্তিযুদ্ধের সফল পরিণতি যতই সুস্পষ্ট হতে থাকে ততই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মপরিধি বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশ পুলিশের পােশাক, পােশাকের রং, কাপড়ের মান, কাপড়ের সহজলভ্যতা, ব্যাজ, ক্যাপ (টুপি) ইত্যাদি সম্বন্ধে সরকার চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করে। বয়স্কাউট, রেডক্রস সােসাইটি, বাংলাদেশ ইভাকুরি বাের্ড (Bangladesh Evacuee Board) গঠন ইত্যাদি সম্বন্ধেও মন্ত্রিসভার সভায় আলােচনা হয় এবং সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে এসব বিষয়ে মন্ত্রিসভার সভা অনুষ্ঠিত হয়।
সুদূর অতীতকাল থেকে নদীমাতৃক পূর্ববাংলার মানুষ ভাটিয়ালি গান আর নৌকার সঙ্গে সুপরিচিত। গ্রাম-বাংলার কৃষকের অন্যতম ফসল ধান। শাশ্বত বাংলার ঐতিহ্যের ছাপ বাংলাদেশ পুলিশের ব্যাজে, ক্যাপে রাখার বিষয়ে ব্যাপক আলােচনা হয়। অতঃপর নৌকা প্রতীকযুক্ত পুলিশের ব্যাজের নমুনা তৈরির সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এর নক্শা (design) প্রণয়নের দায়িত্ব দেওয়া হয় শিল্পী কামরুল হাসানকে। মুক্তিযুদ্ধকালে তাকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ডাইরেক্টর অব আর্টস অ্যান্ড ডিজাইনস পদে নিয়ােগ করে।
বয়স্কাউট, রেডক্রস সােসাইটির জন্য এককালীন ৩০০০/- রুপি বরাদ্দ দেওয়া হলেও প্রতি মাসে ২,৫০০/-রুপি করে বরাদ্দ মঞ্জুর করা হয়েছিল।
যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশ মিশনকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ রেডক্রসকে তাদের অধিভুক্ত (affiliation) করার ব্যবস্থা করতে নির্দেশ দেওয়া হয়। এজন্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সহযােগিতা নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল।
বাংলাদেশ ইভ্যাকুইয়ি বাের্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয় শেখ আবদুল আজিজ, এম.এন.এ.-কে।
স্বরাষ্ট্র বিষয়ে ১ সেপ্টেম্বর তারিখে মন্ত্রিসভার বৈঠকে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় তাও বাংলাদেশ সরকারের জন্য সবিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ছিল। উক্ত সিদ্ধান্তে তিনটি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব প্রদান করা হয়। বিষয়গুলাে নিম্নরূপ:
ক. মুক্ত এলাকায় (বাংলাদেশের শত্রু কর্তৃক অধিকৃত এলাকা থেকে তাদের বিতাড়ন করার পর) আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা; খ. অত্যাবশ্যকীয় ত্রাণসামগ্রী বিতরণ; এবং। গ. মৌলিক চাহিদা (পানি, গ্যাস, বিদ্যুৎ, বাসস্থান) পূরণ।
উপযুক্ত বিষয়গুলাে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রিপরিষদ-সচিবকে একটি পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য বলা হয়েছিল। তিনি এ কাজটি করে দিয়েছিলেন মন্ত্রণালয়ের জন্য। মন্ত্রিসভার সভায় ১৫ সেপ্টেম্বর তারিখে জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, যেমন জাতীয় পতাকার আকৃতি-প্রকৃতি প্রমিতকরণ (standardize) করার বিষয় নির্ধারণ করার সিদ্ধান্ত হয়। এইসঙ্গে ভ্রমণ পারমিট ও পাসপাের্ট প্রদানের বিষয়েও আলােচনা ও সিদ্ধান্ত হয়। শুধু তাই নয়, শত্রুমুক্ত বাংলাদেশে পুলিশ-প্রশাসনকে সাজানাের বিষয়ে ব্যাপক কর্মপন্থা গ্রহণের সুপারিশ করা হয় মন্ত্রিসভার ২৬ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে। মন্ত্রিসভায় গৃহীত এই সিদ্ধান্ত সম্পর্কিত বিস্তারিত বিবরণ এই গ্রন্থের অন্যত্র উল্লেখ করা হয়েছে।
পাকিস্তান আমলের শত্রুসম্পত্তি আইনের সংশােধন, বাস্তুচ্যুত জনগণের সম্পত্তি উদ্ধার করার পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য আকবর আলী খানকে দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি যথাসময়ে এতদ্সংক্রান্ত কাগজপত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ত্রাণ ও পুনর্বাসন সংক্রান্ত কাজকর্ম দেখার জন্য ড. মমাশাররফ হােসেনকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিনি যথাসমযে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগকে পরিকল্পিতভাবে বিন্যাসকরণ সম্পর্কিত প্রতিবেদন পেশ করেছিলেন। তাঁর প্রতিবেদন ২৬ নভেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত হয়।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণাধীনে ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগের কাজকর্ম সম্পন্ন করা হতাে। একজন রিলিফ কমিশনারের অধীনে এই বিভাগ সংগঠিত ছিল। তিনি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে কাজ করতেন। ত্রাণসামগ্রী বিতরণের জন্য আবেদনপত্র গ্রহণ করা হতাে। আবেদনপত্র ছিল বিভিন্ন প্রকারের। এসব খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করে দেখা হতাে। শুধুমাত্র বাংলাদেশের নাগরিকদের ত্রাণসাহায্য দেওয়া হতাে। ত্রাণ ও পুনর্বাসন বিভাগ আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের (Zonal Administrative Council) কাঠামাের মধ্যেই আঞ্চলিক ত্রাণ অফিসেরও (Zonal Relief Offices) ব্যবস্থা করেছিল।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বাংলাদেশ শিক্ষকদের ত্রাণ দেওয়ার ব্যবস্থা করে। শরণার্থী হিসেবে আশ্রয় গ্রহণকারী অধিকাংশ শিক্ষককে উদ্বাস্তু-শিবিরের শিশুদের উপকারার্থে বাংলাদেশের শিশুদের সেবা-কাজে লাগানাে হয়েছিল। শিক্ষক সমিতির সভাপতি মি. কামরুজ্জামান এম.এন.এ. শিবিরের স্কুলগুলিতে সেবামূলক কাজ করার জন্য স্কিম প্রণয়ন করেছিলেন।
মুক্তিযুদ্ধের সময় ৩০ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে আলােচ্যসূচির অন্ত গত বিবিধ বিষয়ে আলােচনা হয়। বাংলাদেশের বাস্তুচ্যুত ও অবহেলিত মহিলাদের একটি তালিকা তৈরির বিষয়ে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যদি দেখা যায় যে, উক্ত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রস্ত তকৃত তালিকার অন্তর্ভুক্ত মহিলাদের সংখ্যা বেশ উল্লেখযােগ্য, তবে তাদের দেখাশুনা করতে কিছু বয়স্ক মহিলা নিয়ােগ করা হবে। এই সিদ্ধান্তের বিষয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও জানানাে হয় অবগতির জন্য।
সরকার ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটি ও উদ্বাস্তু কল্যাণ বোর্ড নামে দুটি সংগঠনকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে ন্যস্ত করেন। প্রথম কমিটির প্রধান ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং। তিনি উদ্বাস্তুদের দেখাশুনার দায়িত্বও পালন করেন। তবে কল্যাণ বাের্ডে একজন রাজনৈতিক নেতাকে চেয়ারম্যান নিয়ােগ করা হয়েছিল। মি.জে.জি. ভৌমিককে রিলিফ-কমিশনার নিযুক্ত করা হয়। সি.এস.পি. মামুনুর রশিদকে উপসচিব নিয়ােগ করা হয়েছিল।
পুলিশের ডাইরেক্টর জেনারেলকে (স্বরাষ্ট্র সচিবকে) সরকারের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ পদ হিসেবে বিবেচনা করা হতাে। কোনাে কোনাে সময় মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাকে বিশেষ আমন্ত্রণ জানিয়ে উপস্থিত থাকতে নির্দেশ দেওয়া হতাে। ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর তারিখে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে লেখা একটি পত্র ডাইরেক্টর জেনারেল অব পুলিশকে দেওয়া হয়। এতে ১০ ডিসেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁকেও উপস্থিত থাকতে বলেছিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ২ জন উপসচিব ছিলেন। এঁদের একজন ছিলেন খিশােরগঞ্জের তৎকালীন এস.ডি.ও. খসরুজ্জামান চৌধুরী। অপর উপসচিবের দায়িত্বে ছিলেন এস.কে. চৌধুরী। তৎকালীন পুলিশ সার্ভিসের এস.কে. চৌধুরী স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ও.এস.ডি. ছিলেন। সহসচিব পদে দুজন ছিলেন। এঁরা হলেন এস.এ. রশিদ এবং জ্ঞানরঞ্জন সাহা। আরাে ছিলেন চৌধুরী এম.এ. গাফফার, ভিমন ব্যাপারি-সহ অন্যান্য।
মুক্তিযুদ্ধের সময় আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পুলিশের ডাইরেক্টর জেনারেল আবদুল খালেক মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের নিকট একটি প্রস্তাব উপস্থাপন করেছিলেন। সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত কর্মচারী নিয়ােগ সংক্রান্ত এই প্রস্তাব বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সি.ইন.সি.-র নিকট প্রথমে উপস্থাপিত হলে তিনি তাঁর অভিমতসহ তা বিবেচনার জন্য সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ.এইচ.এম. কামারুজ্জামানের নিকট প্রেরণ করেন। মন্ত্রী প্রস্তাবের প্রয়ােজনীয়তা সম্বন্ধে একমত হয়েছিলেন (পরিশিষ্ট ৮৯ দ্রষ্টব্য)।
উপরে উল্লেখিত প্রস্তাবের বিষয়বস্তু ছিল সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। কারণ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান বাহিনী এবং সামরিক প্রশাসক বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে বিভিন্ন রকম অপতৎপরতা শুরু করে। যেমন গুপ্তচর পাঠিয়ে আমাদের সরকার সম্বন্ধে এবং তার পরিকল্পনা ইত্যাদির তথ্য সংগ্রহে লিপ্ত হয়। ভারতীয় এলাকায় পাকিস্তানি অনুপ্রবেশকারীর ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি উদ্বেগজনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। এরা গােয়েন্দা তৎপরতা ছাড়াও ধ্বংসাত্মক কাজকর্মে লিপ্ত হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হয়। এ কারণে, শত্রুর গতিবিধি সম্বন্ধে পূর্বাহেই তথ্য লাভের জন্য বাংলাদেশ সরকারেরও এক সংগঠন ব্যবস্থা গড়ে-তােলা প্রয়ােজন। এই সংগঠনের সদস্যগণের নিয়মিত টহল পাকিস্তানি অপতৎপরতা অনেকাংশে প্রতিহত করতে সক্ষম হবে বলে উক্ত প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়। আমাদের সীমান্তবর্তী ভারতের জেলাগুলােতে, বিশেষ করে ২৪-পরগনা, নদীয়া, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, গারাে পাহাড়, খাসিয়া ও জয়ন্তিয়া-সহ আসাম এবং ত্রিপুরায় এই টহল-কাজে ৯০ জন কর্মকর্তার প্রয়ােজন ছিল। প্রস্তাবে আরাে বলা হয় যে, শত্রুপক্ষের ধৃত চর (spies)-দের জিজ্ঞাসাবাদ করতে ছােট ছােট কিছু দল তৈরি করা প্রয়ােজন। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা রাজ্যের জন্য এসব জিজ্ঞাসাবাদকারী দলের আবশ্যকতা সম্বন্ধে গুরুত্ব দেওয়া হয়। এসব দলের প্রতিটিতে একজন ইনসপেক্টর এবং দুজন সাব-ইনসপেক্টর অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব রাখা হয়। এসব কর্মকর্তা সংশ্লিষ্ট এজেন্সিসমূহের সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করবেন বলে সুপারিশ করা হয়। প্রস্তাবিত এই বাহিনী গঠন সম্পর্কিত অনুমােদন অবিলম্বে দেওয়ার জন্য প্রস্তাবে বলা হয়।
ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ অক্টোবর মাসের শেষ সপ্তাহে আরাে দুটি গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাব বিবেচনার জন্য সরকারের নিকট পেশ করেছিলেন। এসব প্রস্তাবের একটি ছিল ১৬ জন এস.আই.অব পুলিশের প্রশিক্ষণ সম্পর্কে (পরিশিষ্ট ৯০ দ্রষ্টব্য) অপরটি ছিল বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীর সদস্যদের জন্য বিনামূল্যে পােশাক (uniforms) সরবরাহ সংক্রান্ত (পরিশিষ্ট ৯১ দ্রষ্টব্য)। প্রথম প্রস্তাবে ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে রাজশাহীর সরদহ পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণের জন্য যােগদানকারী ১৬ জন পুলিশের এস.আই. যােগদান করেছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী কর্তৃক অধিকৃত হওয়ায় এপ্রিল মাসে একাডেমি পরিত্যাগ করে তারা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এ বিষয় উল্লেখ করে তাদের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশসহ তাঁদের জীবনবৃত্তান্ত প্রদানের কথা এ প্রস্তাবে বলা হয়। এতে আরাে উল্লেখ করা হয় যে, যেহেতু তারা তাদের প্রশিক্ষণের প্রাথমিক পর্যায়ে ছিলেন, সেহেতু তাদের কোনাে কাজে লাগানাে হযনি, এমনকি এ অবস্থায় তাদের চাকুরিতে নিয়ােগ দেওয়ার সম্ভাবনাও নেই। এঁরা বিপর্যন্ত অবস্থায় আছেন। আমাদের শত্রুমুক্ত এলাকা সম্প্রসারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঐসব অঞ্চলে বাংলাদেশ পুলিশ-প্রশাসন গড়ে তুলতে হবে। তখন পুলিশ-কর্মকর্তার অভাব দেখা যাবে। নদীয়া জেলার করিমগঞ্জে একটি ট্রানজিট ক্যাম্প আছে। এই ক্যাম্পে পুলিশ একাডেমির আইন প্রশিক্ষক (Law Instructors) এবং শরীরচর্চা প্রশিক্ষক (Drill Instructors) কাজ করছেন। অধিকৃত সরদহ একাডেমি থেকে চলে আসা প্রশিক্ষণার্থী সাব-ইনসপেক্টরদের করিমগঞ্জ পুলিশ ট্রানজিট ক্যাম্পে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার প্রস্তাব করা হয়। এতে ক্যাডেট এস.আই-বৃন্দ তাঁদের প্রশিক্ষণ কোর্স সমাপ্ত করতে সমর্থ হবেন। সর্বোপরি তাদের একটি আশ্রয়স্থল হবে।
এই ১৬ জন এস.আই-এর ৬ মাস প্রশিক্ষণ দানে যে ব্যয় হতে পারে তার আনুমানিক ব্যয়ের হিসাব উক্ত প্রস্তাবের সঙ্গে পুলিশের ডি.জি. প্রদান করেছিলেন। (পরিশিষ্ট ৯২ দ্রষ্টব্য)।
পৃষ্ঠা: ১৫৫
স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ অন্য অর্থে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা প্রতিরােধে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তাদের নিকট যার যা ছিল তাই নিয়ে পথে-ঘাটে, মাঠে-ময়দানে সর্বত্র অবতীর্ণ হয়। আর এর অবশ্যম্ভাবী ফল ছিল রক্তক্ষয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ভারী অস্ত্রশস্ত্রের মােকাবিলা করা প্রথমদিকে একেবারেই অভাবনীয় ছিল। ফলে, নিরীহ জনসাধারণ রুখে দাঁড়ানাের আগেই বিপুল ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হয়। এই ক্ষয়ক্ষতি ছিল ধনে এবং প্রাণে। এসব ক্ষয়ক্ষতি এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার জন্য মুজিবনগর সরকার প্রশাসন, মন্ত্রিপরিষদ, মন্ত্রণালয় সংগঠিত করার সঙ্গে সঙ্গে আহত, নিহত ব্যক্তিদের জন্য সরকারিভাবে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এ উদ্দেশ্যে সরকার কতিপয় মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সংগঠিত করার সময় স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয় নামে একটি মন্ত্রণালয় গঠন করেন। ২ মে তারিখে সরকারের গৃহীত সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে ডা.টি. হােসেনকে স্বাস্থ্যসচিব হিসেবে নিয়ােগদানের মাধ্যমে এই মন্ত্রণালয়ের কর্মতৎপরতা শুরু হয় (পরিশিষ্ট ৯৩ দ্রষ্টব্য)। অনেক দুঃখ-কষ্ট, অভাব-অনটনের মধ্যেও এই মন্ত্রণালয় স্থাপনের মাধ্যমে সরকার এই খাতে সুনির্দিষ্ট কার্যক্রম শুরু করে। মন্ত্রণালয়ের সচিবকে দুই তরুণ ডাক্তার সহায়তা করতেন এরা হলেন, ডা. সৈয়দ মােদাচ্ছের আলী এবং ডা. নাসিমা রহমান।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের প্রথমদিকে যুদ্ধের প্রয়ােজনেই সীমান্তের কাছাকাছি অনেক জায়গায় হাসপাতাল গড়ে ওঠে। এর একটি উদাহরণ রামগড় হাসপাতাল। এপ্রিল-মে মাসে রামগড় বেসামরিক হাসপাতালকে সামরিক হাসপাতালে জরুরিভাবে রূপান্তর করা হয়। রামগড়ের মহকুমা মেডিকেল অফিসার ডা. সিরাজুল ইসলাম অক্লান্ত পরিশ্রম করে, ওষুধ এবং অস্ত্রোপচারের প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর অপ্রতুলতা সত্ত্বেও হাসপাতালে দিনরাত চিকিৎসা চালিয়ে গেছেন।
অন্যদিকে স্থানীয়ভাবে, বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে ত্রিপুরা-কুমিল্লা সীমান্ত বরাবর ফিল্ডহাসপাতাল স্থাপন করেন স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তার ও আওয়ামী লীগ কর্মীরা। এর মধ্যে মেলাঘর হাসপাতালটি প্রসিদ্ধি লাভ করে। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর অবদান ছিল অসামান্য। তাকে আমাদের আঞ্চলিক প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দীন আহমদ প্রচুর সাহায্য করেন। এখানে সেক্টর কমান্ডার ছিলেন মেজর খালেদ মােশাররফ। তিনি সালদা নদী সীমান্ত বরাবর পাকিস্তানিদের পর্যুদস্ত করছেন। ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বিলেত থেকে এসে এখানে কাজে লেগে যান। তার সাথে ছিলেন বেশ কয়েকজন তরুণ ছেলে-মেয়ে স্বেচ্ছাসেবী। এদের মধ্যে কয়েকজন ছিলেন ডাক্তার। এমনিভাবে অন্যান্য যুদ্ধক্ষেত্রের আশেপাশেও গড়ে উঠেছিল চিকিৎসার ব্যবস্থা। বাংলাদেশ সরকার ধীরে ধীরে এঁদের স্বাস্থ্যদপ্তরের অধীনে নিয়ে হাসপাতাল তৈরি, ওষুধ, চিকিৎসা-সরঞ্জাম সরবরাহ, বেতন প্রদান এবং অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা করে।
মুজিবনগরে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ের কাজ পরিচালনার জন্য কিছুসংখ্যক ব্যক্তিকে বাছাই করে নিযুক্ত করা হয়েছিল। দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের নির্দিষ্ট পদমর্যাদাও দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে এই অধিদপ্তরের একটি সাংগঠনিক কাঠামাে ছিল (পরিশিষ্ট ৯৪ দ্রষ্টব্য)। কাঠামাে ছিল নিম্নরূপ:
১. স্বাস্থ্যসেবার মহাপরিচালক (Director General of Health Services) —১ জন
২. উপমহাপরিচালক (প্রশাসন) (Dy. Director General, Administration) –১ জন
৩. অফিস তত্ত্বাবধায়ক (Office Superintendent) –১ জন
৪. করণিক (Clerks) ২ জন
৫. পিয়ন ১ জন
পূর্বাঞ্চল, পশ্চিমাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলের প্রত্যেক দপ্তরের জন্য নিম্নলিখিত পদমর্যাদার কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিযুক্ত হন। সাংগঠনিক কাঠামাের এসব পদ প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক অনুমােদিত ছিল। এ তিনটি আঞ্চলিক দপ্তরের প্রধান ছিলেন উপমহাপরিচারক (Dy. Director General)।
১. উপমহাপরিচালক (Dy. Director General) –১ জন।
২. অফিস তত্ত্বাবধায়ক (Office Superintendent) –১ জন
৩. হিসাবরক্ষক (Accountant) –১ জন।
৪. ভাণ্ডার-রক্ষক (Store Keeper) —১ জন।
৫. করণিক-কাম-মুদ্রাক্ষরিক (Clerk-Cum-Typist) –১ জন
৬. পিয়ন –১ জন
৭. গাড়িচালক (Driver) —১ জন
প্রাথমিকভাবে একজন মহাপরিচালকের (ডাইরেক্টর জেনারেলের) অধীনে স্বাস্থ্য ও কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরনামে একটি বিভাগ সৃষ্টি করা হয়। পরবর্তীকালে মহাপরিচালক পদকে সচিবের পদমর্যাদা প্রদান করা হয়েছিল। তার উপর ন্যস্ত বিভাগে প্রধানত দুইভাবে কাজকর্ম সম্পন্ন হতাে। প্রথমত, শত্রুর আক্রমণে যারা আহত হতেন তাদের সেবা প্রদানই এই বিভাগের মুখ্য কাজ হয়ে দাঁড়ায়। আহতদের দুটি শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। যারা সম্মুখযুদ্ধে অথবা প্রতিরােধযুদ্ধে আহত বা শহীদ হতেন তাদের এক শ্রেণীতে এবং অন্যান্য নিরীহ নিরস্ত্র মানুষ যারা সীমান্ত পাড়ি দিতে গিয়ে বিভিন্নভাবে আহত হতাে অথবা অসুস্থ হয়ে পড়ত তাদের অন্য এক শ্রেণীতে বিভক্ত করা হয়। সরকারিভাবে এই দুই শ্রেণীকে যথাক্রমে (ক) সামরিক চিকিৎসা, ও (খ) বেসামরিক চিকিৎসা নামে অভিহিত করা হয়।
সাধারণভাবে যুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ব্যক্তিদের সামরিক চিকিৎসার অধীনে এবং অন্যান্যভাবে আহত বা অসুস্থ ব্যক্তিদের বেসামরিক চিকিৎসার অধীনে সেবা প্রদান করা হতাে। সামরিক চিকিৎসাকে সরকার প্রতিরক্ষাবিভাগের চিকিৎসা হিসেবেও গণ্য করতেন। এই প্রতিরক্ষা বিভাগের চিকিৎসা সেবার জন্য বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও বিভাগ নিম্নলিখিত ব্যবস্থাগুলাে গ্রহণ করে:
ক. সার্জন ও চিকিৎসকগণকে সরকারিভাবে দায়িত্ব প্রদান;
খ. আহত ও শহীদ ব্যক্তিদের বহনের জন্য পরিবহণ সংগ্রহ;
গ. ঔষধের ব্যবস্থা;
ঘ. অস্ত্রোপচার সংক্রান্ত যন্ত্রপাতির ব্যবস্থা;
ঙ. মাঠ পর্যায়ে চিকিৎসকদল গঠন (যেমন ফিল্ড মেডিক্যাল ইউনিট), ক্ষতস্থান বাঁধার উন্নত ধরনের কেন্দ্রসমূহ (যেমন, এডভান্সড ড্রেসিং স্টেশনস), এবং ক্ষতস্থান পরিষ্কার করে পট্টি বাঁধার জন্য প্রধান কেন্দ্রসমূহ (যেমন, মেইন ড্রেসিং স্টেশনস) স্থাপন; এবং
চ. আরােগ্য লাভের পর বিশ্রামের উদ্দেশ্যে কক্ষ (যেমন, কনভ্যালেসেন্স হােমস) স্থাপন ইত্যাদি।
উপযুক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ ছাড়াও আরাে কিছু চিকিৎসাবিষয়ক ব্যবস্থা মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্যবিষয়ক বিভাগ গ্রহণ করেছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর সদস্য ও মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের সেবা ও শুশ্রুষার জন্য নিম্নলিখিত ব্যবস্থা নেওয়া হয়:
১. যুদ্ধে যেসব সৈনিক বা মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হতেন তাদের উপর নির্ভরশীল পােষ্যদের জন্য পরিবহণের ব্যবস্থা রাখ হয়;
২. মুক্তিযুদ্ধে সম্পূর্ণরূপে অক্ষম সেনাসদস্য বা মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধাদের জন্য পেনশন/ভরণ-পােষণের ব্যবস্থা; এবং
৩. উপযুক্ত শ্রেণীর সদস্যদের মধ্যে যারা আংশিকভাবে অক্ষম হয়ে পড়েছেন তাঁদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
উপরে বর্ণিত উপায়ে চিকিৎসা ও অন্যান্য সেবা প্রদান করতে বাংলাদেশ সরকারকে বিপুল ব্যয়ের ধাক্কা সামলাতে হয়েছিল। এসব কাজ করতে সরকার প্রয়ােজনীয় অর্থ-সংস্থানের ব্যবস্থা করেন। সেই সময়ের বাজারমূল্যে প্রায় দশ লক্ষ রুপি অর্থ-সংস্থান করা হয়েছিল।
এছাড়া বেসরকারি খাতে বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর নাগরিককে চিকিৎসা-সুবিধা দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং তা বাস্তবায়ন করা হয়। এ কাজের জন্য প্রাথমিকভাবে প্রায় ৯ লক্ষ ৫০ হাজার রুপি বরাদ্দ দেওয়া হয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশের যেসব চিকিৎসক সীমান্ত অতিক্রম করে শরণার্থী-শিবিরে অথবা আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধবদের নিকট আশ্রয় গ্রহণ করেন এবং যারা সীমান্তের অভ্যর্থনা শিবিরে তাঁদের নাম-ঠিকানা লিপিবদ্ধ করেন, তাঁদের প্রায় সকলকেই বাংলাদেশ সরকার কাজে নিযুক্ত করেন। চিকিৎসা-কাজ ছাড়াও তাদের অন্যান্য কাজেও লাগানাে হয়েছিল। আবার ভারতসরকারও উদ্বাস্তু শিবিরের তত্ত্বাবধান করার জন্য, বিশেষ করে চিকিৎসা-সেবা সংক্রান্ত কাজে এই ডাক্তারদের মধ্যে অনেককেই নিযুক্ত করেছিলেন। এঁরা সাধ্যমতাে অস্বাস্থ্যকর শিবিরগুলােয় সেবার ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। শরণার্থী-শিবিরে অবস্থানরত বৃদ্ধ, নারী ও শিশুরা স্বাস্থ্য বিপর্যয়ের শিকার ছিল। প্রায় এক কোটি শরণার্থীর প্রায় প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্য সেবার দরকার ছিল।
পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের বন্ধুসুলভ দাতাসংস্থা মানবকল্যাণের মহান ব্রতে উজ্জীবিত হয়ে অকৃপণভাবে স্বাস্থ্য সেবামূলক অনুদান নিয়ে এগিয়ে এসেছিল। এসব অনুদান, দান হিসেবে প্রাপ্ত ওষুধপত্র, যন্ত্রাদি ইত্যাদি গ্রহণ ও সংগ্রহ স্বাস্থ্যবিভাগের উপরই ন্যস্ত ছিল। সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ তার ওপর অর্পিত গুরু দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে সম্পাদন করেছিল। বন্ধুদেশগুলাের সাহায্য সংস্থাগুলাে থেকে প্রাপ্ত ওষুধপত্র ও চিকিৎসা-সরঞ্জাম ছাড়াও আরাে যেসব দ্রব্য যেমন অ্যামবুলেন্স, তবু, ব্যান্ডেজ ইত্যাদি তাদের নিকট থেকে পাওয়া না গেলে অন্য উপায়ে সংগ্রহের দায়িত্ব স্বাস্থ্যবিভাগের ওপরই ন্যস্ত ছিল। বাঙালি জাতির উপর নেমে আসা বিপর্যয়ে অসুস্থ, রােগাক্রান্ত, আহত মানুষকে অক্লান্তভাবে দিনরাত সেবাপ্রদানের ব্যবস্থা করেছিল সরকারের স্বাস্থ্যবিভাগ। স্বাস্থ্যক্ষেত্রে সেবামূলক কাজের গতিধারা স্বাধীনতার পর অটুট রয়েছে। বলা যায়, বর্তমান স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের গােড়াপত্তন করেছে মুজিবনগর সরকার। এ ছাড়াও বাংলাদেশ রেডক্রস সােসাইটি প্রতিষ্ঠাও ছিল এই সরকারের আর এক অবদান। সােসাইটির চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয় ডা. আসহাবুল হককে। সােসাইটির মাধ্যমে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ছাড়াও প্রয়ােজনীয় চিকিৎসাসেবা দেওয়া হতাে।
এই বিভাগ অতি নিষ্ঠার সঙ্গে সরকারের পক্ষে কাজগুলাে করত। ১৮ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে অন্যান্য দপ্তরের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ বিভাগের দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছিল। তিনি এই বিভাগকে সুসংহত ও গতিময় করার জন্য সংশ্লিষ্ট সচিবকে পরামর্শ দিতেন প্রতিনিয়ত। স্বাস্থ্যবিভাগের সচিব পদের সমমানের মহাপরিচালক পদে প্রথম অধিষ্ঠিত হন উপমহাদেশের বিশিষ্ট চিকিৎসক ডা.টি. হােসেন। ১৯৭১ সালের ২ মে তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার বৈঠকে তাঁকে নিয়ােগদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। (পরিশিষ্ট ৯৪ দ্রষ্টব্য)। সংশ্লিষ্ট সিদ্ধান্তের কথা পূর্বেই মন্ত্রিপরিষদ ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগশীর্ষক অধ্যায়ে উল্লেখ করা হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় চিকিৎসা-সংক্রান্ত সরকারি সকল ব্যাবস্থাপনায় ডা.টি. হােসেনের সুদক্ষ তদারকি অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে বাংলাদেশের জাতীয় ইতিহাসে।
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি
মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে। বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপদে দায়িত্ব পালনকালে সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী বাঙালি জনগােষ্ঠীর ত্যাগ, সাহায্য, সহযােগিতা সম্বন্ধে জানার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল। কোনাে কোনাে সময় সরকারের আদেশ-নির্দেশ অনুযায়ী প্রবাসী বাঙালিদের সহযােগিতা আমরা গ্রহণ করেছি। পরিচিত, অপরিচিত সব প্রবাসী বাঙালিই তকালে আমাদের অতি ঘনিষ্ঠজন হিসেবে কাজ করেছেন। আমার ব্যক্তিগত কোনাে-কোনাে বন্ধু মুক্তিযুদ্ধের অনিশ্চিত, দুঃখময় ও দুঃসময়ে আমাকে যে সাহায্য-সহযােগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়, তা কোনােদিন বিস্মৃত হবে না। তারা ব্যক্তিগতভাবে আমাকে যেমন, তেমনি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারকে সাধ্যানুযায়ী সহযােগিতা করেছেন। তাঁদের কথা প্রসঙ্গিকভাবে এ গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হওয়া প্রয়ােজন। তবে তার আগে এঁদের ভূমিকার পেছনের ইতিহাসের দিকে দৃষ্টি ফেরানাে উচিত। হঠাৎ করে তাে তারা মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশকে সমর্থন করতে আসেননি।
আমাদের মনে আছে, ষাটের দশকে পূর্ববাংলায় কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে যায়। রাজনীতি-সচেতন যুক্তরাজ্যের বাঙালি ছাত্ররাও পূর্ববাংলার দাবি-দাওয়ার বিষয়ে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে যােগ দেয়। আমার যদুর মনে পড়ে, ১৯৬৩-৬৪ সালে লন্ডনে পূর্বপাকিস্তান ভবনপ্রতিষ্ঠা ছিল এক তাৎপর্যময় ঘটনা। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬-দফাকে সকল প্রবাসী বাঙালি গুরুত্বপূর্ণ দাবি হিসেবে গ্রহণ করে এবং মনেপ্রাণে তারা পাকিস্তানি শাসকচক্রকে ঘৃণা করতে শুরু করে। এই মনােভাব শুধু যুক্তরাজ্যেই নয়, পৃথিবীর অন্যান্য দেশের বাঙালিদের মধ্যেও বিরাজ করতে থাকে। আমার বন্ধু-বান্ধব, সহকর্মী, কিছু আত্মীয়-স্বজন যারা যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য প্রভৃতি স্থানে প্রবাসজীবন যাপন করছিলেন তাঁদের কয়েক জনের নিকট থেকে আমি যেসব চিঠিপত্র পেয়েছিলাম সেগুলির গুরুত্ব ঐতিহাসিক। কারণ, এসব চিঠিতে ব্যক্তিগত কথা থাকলেও দেশ ও জাতি সম্বন্ধে তকালে তাঁদের আবেগ, উৎকণ্ঠা লক্ষণীয়। প্রবাসী বাঙালিদের এই মনােভাব মুক্তিযুদ্ধে আমাদের অফুরন্ত অনুপ্রেরণা যুগিছে। ইতিহসের উপাদানের প্রয়ােজনে হয়তাে এসব চিঠির মূল্যায়ন একদিন হবে। তাই, পরিশিষ্টে বাছাইকৃত কিছু চিঠি সংযােজন করা হয়েছে।
মার্চের প্রথম থেকেই, বিশেষ করে আমেরিকা ও ব্রিটেনে সাজ-সাজ রব পড়ে যায়। প্রথমদিকে তারা আশায়-আশায় ছিলেন, হয়তােবা ইয়াহিয়া খানের এবং পাঞ্জাবি সামরিক শাসকদের বােধােদয় হবে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহ্বান করবে; পাকিস্তানের ইতিহাসে প্রথমবারের মতাে উন্মুক্ত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচনে বিপুলভাবে বিজয়ী একটি দল বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করবে; প্রতিষ্ঠিত হবে সত্যিকার জন-গণতান্ত্রিক সরকার। তারা যে সংঘাতের পথ, বর্বরতার পথ বেছে নেবে এটা দেশে-বিদেশে কেউ আশা করেননি। বিদেশি পত্র-পত্রিকাগুলােও হয়তাে তাদের বিভিন্ন রিপাের্টে একটা আশাব্যাঞ্জক ছবি চিত্রিত করেছিলেন। ভুল ভাংতে সময় লাগেনি। ১ মার্চে ইয়াহিয়ার ভাষণের পরপরই স্বদেশের মতাে বিদেশের বাঙালিরাও বুঝতে পারেন একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। বিপদের অশনি সংকেত দেখা যেতে থেকে।
পৃষ্ঠা: ১৬০
প্রবাসী বাঙালি যারা আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রে স্বাধীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের পক্ষে সর্বতােভাবে কাজ করেছেন, দিবারাত্রি পরিশ্রম করেছেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন জনাব এস.এ. করিম, এনায়েত করিম, এস.এ.এম.এস. কিবরিয়া এবং এ.এইচ. মাহমুদ আলি। জ্যেষ্ঠতা হিসেবে নামগুলাে উল্লেখ করলাম, কিন্তু ত্যাগ এবং সাহসের দিক থেকে মাহমুদ আলির নাম সর্বাগ্রে উচ্চারণ করা প্রয়ােজন, যদিও তিনি ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। যুক্তরাষ্টে পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের যেসব অফিসার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন, এ.এইচ. মাহমুদ আলি তাঁদের অগ্রগণ্য। কোনাে হিসাব-নিকাশের ধার না-ধেরে তিনি ২৬ এপ্রিল, ১৯৭১ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘঘাষণা করেন। উল্লেখিত কর্মকর্তাদের সকলেই ছিলেন পি.এফ.এস.। তারা পাকিস্তান দূতাবাসের অন্যান্য বাঙালি কর্মকর্তাদের সাথে একযােগে ৪ আগস্ট আনুগত্য ঘােষণা ও একাত্মতা প্রকাশ করেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি। এই আনুগত্য পরিবর্তনের ব্যাপারে এ.এম.এ. মুহিত সাহেবের দান ছিল অপরিসীম। নেপথ্যে থেকে তিনি গণসংযােগ এবং জনমত সংগঠিত করেছেন। তিনিও মাহমুদ আলির মতাে অন্যদের থেকে অনেক আগে, অর্থাৎ ৩০ জুন আনুগত্য ঘােষণা করেন। বিভিন্ন তথ্য থেকে এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে মুহিত সাহেব এবং মাহমুদ আলি ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মুক্তি-আন্দোলনের পথিকৃৎ। এনায়েত করিম সাহেব একসময় অসুস্থ হয়ে পড়লে এস.এ. করিম সাহেব অন্য সব কর্মকর্তার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কথা বলে ৪ আগস্টে একযােগে আনুগত্য ঘােষণার ব্যবস্থা করেন। ঐ সময় সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে সাড়া পড়ে গিয়েছিল।
এ.এইচ. মাহমুদ আলি প্রথমদিকে (এপ্রিল-আগস্টে) নিদারুণ অর্থকষ্টে দিন কাটিয়েছেন। তার স্ত্রী তাঁদের ভরণপােষণের দায়িত্ব নেন চাকুরি করে। এক আত্মীয়ের বাড়িতে তারা আশ্রয় পান। ২২ এপ্রিল ‘৭১ মি. আলি নিউইয়র্কে নিয়ােজিত পাকিস্তানি ভাইস-কনসাল পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য ১৬-সদস্য বিশিষ্ট প্রতিনিধিদল পাঠানাে হয় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে। এ.এইচ. মাহমুদ আলি ছিলেন দলের অন্যতম সদস্য। প্রথম দিনের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশনে তাঁকে সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী তাকে সঙ্গে নিয়ে জাতিসংঘের মার্কিন প্রতিনিধিদলের নেতা জর্জ বুশের সঙ্গে দেখা করেন।
এস.এ.এম.এস. কিবরিয়া সাহেব ছিলেন বাংলাদেশ অফিসের দায়িত্বে। তিনি পণ্ডিত ব্যক্তি, সুলেখকও। কাজেই বাংলাদেশের পক্ষে অধিকাংশ পত্রালাপ, রিপাের্ট ও জনসংযােগ বুলেটিন ইত্যাদি লেখার ও প্রকাশের দায়িত্ব ছিল তাঁর। এ কাজ তিনি নিষ্ঠা ও যােগ্যতার সাথে পালন করেন। তিনি দপ্তর-পরিচালনার দায়িত্বেও ছিলেন।
আমেরিকার প্রাণকেন্দ্র নিউইয়র্ক শহরে ছিল পাকিস্তান লীগ, যার সভাপতি প্রবাসী বাঙালি ব্যবসায়ী কাজী শামসুদ্দীন। ১৯৭০ সালের নভেম্বরে (ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত লক্ষ লক্ষ বাঙালির প্রতি পাকিস্তান-সরকারের চরম উদাসীনতার পর) তিনি এটিকে পরিণত করেন East Pakistan League- এ। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতেই তিনি দূরদৃষ্টি দিয়ে দেখতে পান বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের আলামত। ইস্ট পাকিস্তান লীগকে (East Pakistan League-কে) পরিণত করেন বাংলাদেশ লীগে (Bangladesh League)।
এমনি আরও কত ব্যক্তি কত অবদান রেখেছেন, তার সব বিবরণ আমাদের জানা নেই। তবে মুক্তিযুদ্ধের সব বিবরণই জাতিকে সঠিকভাবে জানতে হবে। সেই সব প্রবাসী বাঙালি ভাই-বােনেরা যারা দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন তাদের সকলের কথা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করি আর জানাই সালাম।
আমাদের বন্ধুবান্ধব, সহকর্মী, সহপাঠী, অগ্রজপ্রতিম ব্যক্তি, আত্মীয়-স্বজন যারা মুক্তিযুদ্ধে, বাঙলার স্বাধীনতা সংগ্রামে অবদান রেখেছেন তাদের কথা আমরা মােটামুটি জানি। শ্রদ্ধেয় এ.এম.এ. মুহিত সাহেব তার ‘স্মৃতি অম্লান ১৯৭১’ এবং আবদুল মতিন সাহেব তার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসে বাঙালি: বাংলাদেশ ১৯৭১’ গ্রন্থে অনেক মহানুভব ব্যক্তির স্মৃতিচারণ করেছেন। দুজনেই অমূল্য তথ্য রেখেছেন জাতির জন্য, ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য আরও অনেক মূল্যবান তথ্য আছে বিভিন্ন বইতে। এসব বইতে অনেকের নাম উল্লেখ করা হয়েছে, তাদের অবদানের কথাও আমরা জানতে পারি। এঁদের অনেকেই নিঃস্বার্থভাবে কাজ করেছেন, তারা অর্থসাহায্যও পাঠিয়েছেন। আবার বিজয়ের পর নিজ কর্মস্থলে ফিরে গেছেন। আত্মপ্রচারে যেমন মেতে ওঠেননি, তেমনই সরকারের কাছেও কোনাে দাবি-দাওয়া বা প্রার্থনা নিয়ে আসেননি। এঁরা কেউ চাওয়া-পাওয়ার ধার ধারেননি।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ-সচিব এবং তার আগে পূর্বাঞ্চলের প্রশাসক থাকার সুবাদে প্রবাসী বাঙালি সহকর্মী, বন্ধু-বান্ধব আমার কথা জানতেন এবং আমাকে চিঠিপত্র লিখতেন সরাসরি। তাতে অনেক সময় গুরুত্বপূর্ণ অথবা তাৎপর্যপূর্ণ কথা থাকত। আমি সেগুলাে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে জানাতাম। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আমি নিজেও তাঁদের কাছে তথ্য সংগ্রহ করে পাঠানাের অনুরােধ করতাম। সৌভাগ্যক্রমে আমি যেসব চিঠির অধিকাংশ সংরক্ষণ করেছি। প্রায় সব চিঠি এত তথ্যসমৃদ্ধ এবং দরদ দিয়ে লেখা, যা না-পড়লে বােঝা যায় না। তার সাথে আরেকটু সংযােজন করব আমি সেটা হলাে এই চিঠিগুলাে ১৯৭১- এ মুক্তিযুদ্ধের চরম উত্তেজনাময় দিনগুলিতে লেখা। গভীর দরদ এবং সহমর্মিতার ছোঁয়া আছে প্রতিটিতে। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আবেগের প্রকাশ আছে তাই ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের ৯৫, ৯৬, ৯৭, ৯৮, ৯৯, ১০০, ১০১, ১০২, ১০৩, ১০৪, প্রেক্ষিত মনে রেখেই চিঠিগুলােকে বিচার করতে হবে। অবিকৃত অবস্থায় সেইসব চিঠি সংখ্যক পরিশিষ্টে দেখা যেতে পারে। চিঠিগুলাে নিজেরাই কথা বলবে। কোনাে ব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে আনুপূর্বিক ঘটনা অথবা পরিচিতি অথবা বর্তমান অবস্থান প্রয়ােজন হতে পারে।
প্রসঙ্গক্রমে এখানে একটি কথা বলে রাখা ভালাে। মুক্তিযুদ্ধকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে মাহবুব আলম পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে সকল বাঙালি অফিসারকে, যারা বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য ঘােষণা করবেন, আশ্বাস দেন যে তাঁদের নিজ নিজ বেতন-ভাতা ও অন্যান্য সুবিধা সরকার সংরক্ষণ করবে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিল। অন্যান্য সার্ভিসের বাঙালি (যেমন অর্থনৈতিক, বাণিজ্যিক, শিক্ষা, তথ্য ইত্যাদি) কর্মকর্তা সবাই কিন্তু এই আশ্বাস বা আহ্বান পাননি।
আবুল মাল আবদুল মুহিত ১৯৭১ সালে আমেরিকায় পাকিস্তান সরকারের অর্থনৈতিক কাউন্সিলার পদে ওয়াশিংটনে কর্মরত ছিলেন। তিনি সবসময় বাঙালি জাতীয়তাবাদের মহিমাকে মনে প্রাণে লালন করতেন। বাংলাভাষার প্রতি অগাধ শ্রদ্ধা আর বাঙালি জাতিসত্তার প্রতি প্রগাঢ় ভক্তি নিয়ে বাঙালিদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে কখানাে প্রত্যক্ষ, কখনাে বা পরােক্ষভাবে তিনি অংগ্রহণ করেছেন। বাঙালির নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে বাঙালিরা পূর্ববাংলাসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসরত সকলেই হয়েছিল উজ্জীবিত, অনুপ্রাণিত। ২৫ তারিখে (২৫ মার্চ, ১৯৭১) সামরিক আক্রমণের পর মার্চ মাসে যে খবর বেরােয় তাতে ছিল পাকিস্তানিদের ধ্বংসলীলা ও হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহ বিবরণ। বহিষ্কৃত সাংবাদিকরা যেসব বিবরণ দিতে শুরু করলেন তা ছিল যেমন হৃদয়বিদারক তেমনি উত্তেজনামূলক। জনাব আবুল মাল আবদুল মুহিত সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পূর্ববাংলার বাঙালিদের সংগঠিত করে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে প্রভূত গতি সঞ্চার করে আমাদের সংগ্রামকে করেছিলেন আরাে শক্তিদীপ্ত। সরকারের চাকুরিতে থেকে আমি তার দেশপ্রেমের পরিচয় আরাে একবার দেখলাম।
তিনি আমেরিকায় প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে মুজিবনগর সরকার ও শরণার্থীদের জন্য অর্থ ও ত্রাণসামগ্রীর ব্যবস্থা করেছিলেন। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় লিখে, বাংলাদেশের পক্ষে আমেরিকায় জনমত গঠন করেছেন। সভা-সমিতির আয়ােজন করে নিজে বক্তৃতা দিয়ে এবং অন্যান্যদের দ্বারা বক্তৃতার ব্যবস্থা করে আমেরিকায় জনমত সৃষ্টি করেন। আমেরিকায় অবস্থানরত বাঙালিদের আত্মবিশ্বাস ও মনােবল অক্ষুন্ন রাখার প্রয়াসে অনলস কাজ করেছেন। স্বাধীনতাযুদ্ধের পর বাংলাদেশের পুনর্গঠন ও উন্নয়নের কাজে ড. নূরল ইসলাম ও অন্যান্যদের সঙ্গে মিলিতভাবে কাজ করেছেন।
প্রকৃতপক্ষে এ.এম.এ. মুহিত ছিলেন পাকিস্তানের ক্ষুব্ধ ও বিদ্রোহী কূটনীতিবিদ এবং জুলাইতে পাকিস্তান-পরিত্যাগী বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে নিবেদিত লবিস্ট। তার পরেই উল্লেখ করতে হয় প্রকৌশলী রেজাউল হাসান ফিরােজের নাম। তিনি থাকতেন বােস্টনে। মে মাসে মুক্তিবাহিনীর জন্য ১০০টি ওয়াকিটকি, ৮টি শর্টওয়েভ রেডিও ট্রান্সমিটার ও রিসিভার, ব্যাটারি-প্রায় ১ লক্ষ ডলার মূল্যের জিনিশ মাত্র ২০ হাজার ডলারে বাক্সবন্দি করে মুহিত সাহেবের সহযােগিতায় ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে মুজিবনগরে পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। প্রায় ৪ টন ওজনের যন্ত্রপাতি ভারতীয় মিশনের সুশীতল ব্যানার্জীর সৌজন্যে মুজিবনগর পৌছায়। মুহিত সাহেবকে সাহায্য করেন রাজ্জাক খান এবং হারুন সাহেব। মুজিবনগরে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেন বােস্টনের প্রবাসী বাঙালি তৈয়ব মাহতাব। নিজ খরচে মুজিবনগরে পৌছান ২ জুলাই। অসাধারণ কৃতিত্ব আর অবদান জনাব এ.এম.এ. মুহিত, রেজাউল হাসান ফিরােজ, তৈয়বুদ্দিন মাহতাব এবং অন্যান্য প্রবাসী মুক্তিযােদ্ধাদের।
প্রাসঙ্গিকভাবে মুজিবনগরের তাৎপর্যপূর্ণ একটি পরিচয় তুলে ধরা দরকার। বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরে অবস্থিত। মুজিবনগর কিন্তু নির্দিষ্ট কোনাে একটি জায়গায় নয়। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভা যেখানে সমবেত হতাে সে-স্থানটিই হতাে তখনকার মুজিবনগর। এই ব্যবস্থা নেওয়া হয়, যাতে পাকিস্তানের বিমানবাহিনী মুজিবনগরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে না দিতে পারে। যতদিন পর্যন্ত-না বিমান-হামলা প্রতিহত করার ক্ষমতা হয় ততদিন ভ্রাম্যমাণ মুজিবনগরই ছিল সরকারের সদর-দপ্তর। এ দপ্তর যেখাইে অবস্থান করত সেখানেই অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সব ধরনের সরকারি-বেসরকারি যােগাযােগ হতাে।
এপ্রিল মাসে হারুন-উর-রশিদ মুজিবনগরে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর জন্য অতি প্রয়ােজনীয় বিভিন্ন জিনিসের একটি তালিকা নিয়ে এসেছিলেন। রেজাউল হাসান ফিরােজ তার কাছ থেকে যন্ত্রের প্রয়ােজন সম্পর্কে বেশ কিছুটা ধারণা লাভ করেছিলেন। নিউহ্যাম্পশায়ার স্টেটের কনকর্ডে ফ্র্যাংকলিন পিয়ার্সন সেন্টারের অধ্যক্ষ (ডিন) এবং অ্যাকাডেমি অব অ্যাপ্লাইড় সায়েন্সের প্রেসিডেন্ট ডা. রবার্ট রাইস যােগাযােগযন্ত্র প্রেরণের ব্যাপারে প্রভূত সাহায্য করেন।
শিকাগাে-প্রবাসী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বাঙালি স্থপতি ফজলুর রহমান খান মে মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে যান। ৬ মে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে দেখা করেন।
প্রস্তাবিত আমেরিকা-সফর সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরী মি. খানের সঙ্গে পরামর্শ করেন। সেসময় খান যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শহরে অবস্থানরত বাঙালিদের নিয়ে একটি অ্যাকশন কমিটি গঠনের কাজে নিয়ােজিত ছিলেন। শিকাগাে থেকে তিনি বিভিন্ন শহরে বাঙালিদের সঙ্গে যােগাযােগ করে তাদের প্রতিনিধি দল ওয়াশিংটনে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। ওয়াশিংটন পৌছে প্রতিনিধি দল তাদের এলাকার সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে শেখ জিবের মুক্তির জন্য এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে পাকাস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার করার জন্য পাকিস্তান-সরকারকে চাপ দেওয়ার অনুরােধ করেন। তাঁর তৎপরতায় বিভিন্ন এলাকা থেকে নির্বাচিত সিনেটর ও কংগ্রেসম্যান বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে বক্তৃতা ও বিবৃতি দেন। এ-সংবাদ আমরা মুজিবনগরে পেয়েছি।
বিশেষভাবে মনে পড়ে হারুন-উর-রশিদের কথা। আমেরিকাস্থ বাঙালিদের প্রতিনিধিরূপে ১৩ এপ্রিল মুজিবনগর গমন করেন হারুন-উর-রশিদ (সি.এস.পি.১৯৫৯ ব্যাচ)। তিনি তখন বিশ্বব্যাংকে কর্মরত। তিনি স্বাধীন বাংলার সব বড় নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাঁর সাথে অনেক পরামর্শ করেন। মার্কিন সরকার এবং বিশ্বব্যাংকে তাঁর অনেক জানাশুনা থাকায় আন্তর্জাতিক অনেক বিষয়েই আলােকপাত করতে পারেন হারুন। প্রাথমিক অবস্থা থেকেই বাংলাদেশ-আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১২ জুন উনি আমাকে প্রথম চিঠি লেখেন। তাঁর চিঠি থেকে জানতে পারি কারা কারা বাংলাদেশের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেছেন। (তাঁর ভাষায় Totally Committed)। বাংলাদেশ এবং আমাদের সরকার সম্পর্কে তাঁর অনেক প্রশ্ন এবং উৎকণ্ঠা চিঠিতে ফুটে উঠেছে। কিছুটা অভিমান করে ফরেন সার্ভিসের অনেকের সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তাঁর অনুযােগের কারণও ছিল নিজে World Bank-এর চাকুরিতে থেকে আমেরিকায় মুক্তিবাহিনীর জন্য যন্ত্রপাতি (বেতার) সংগ্রহ করে সেগুলাে দেশে নিয়ে এসেছেন এবং মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছেন। দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হারুন নিজ খরচে এসেছেন, ফিরে গেছেন। হারুনউর-রশিদ মুক্তিযুদ্ধের পর সরকারে যােগদান করেননি। কখনও নিজের কাহিনী কাউকে বলেননি। নিভৃতে রয়ে গেছেন।
হারুন সাহেবের ১৬-৬-৭১ তারিখে লেখা প্রথম চিঠি পাই আমি ১৮-৬-৭১ তারিখে। উনি বিভিন্ন সংবাদ দেওয়ার পর ১১টি প্রশ্ন করেছিলেন- সবই দেশ, সরকার ও আমাদের সরকারের কার্যক্রম সম্পর্কে। আমি সে-সময় আগরতলায়, পূর্ব-অঞ্চলের প্রশাসক। পরিশেষে উনি আমার নিকট থেকে দুটো বিষয়ে জানতে চেয়েছিলেন-এ দুটো নিতান্তই ব্যক্তিগত। একটি আমার আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে, দ্বিতীয়টি তাঁর ছােট ভাই মামুনুর রশিদের খবরাখবর জানতে চেয়ে। গােটা চিঠিতে ছিল দেশ, জাতি এবং আমরা যারা কাজ করেছিলাম তাদের কুশল সম্পর্কিত বিষয়।
তিনি ১৯-৭-৭১ তারিখে দ্বিতীয় চিঠিটি লেখেন। আমি পাই ২৬-৭-৭১ তারিখে। আমি এখন অবাক হচ্ছি সে-সময় এয়ারমেইল সার্ভিস কত দ্রুত ও দক্ষ ছিল। সুদূর ওয়াশিংটন থেকে দিল্লি/অথবা বােম্বাই, তারপর কোলকাতা হয়ে আগরতলা চাট্টিখানি কথা নয়। এতদিন পর, ঢাকার সাথে ওয়াশিংটনের কত সহজ পথ, তাও এখন ডাকযােগে চিঠি এক সপ্তাহের আগে পৌছে না কখনও। শরণাপন্ন হতে হয় দ্রুত সার্ভিসের জন্য কুরিয়ারের, না হয় ই-মেইলের।
হারুন সাহেবের দ্বিতীয় চিঠিও বেশ সুন্দর। খবরাখবর দেওয়া এবং সেই সাথে আমাদের সরকারের জন্য পরামর্শ। বেকার শিক্ষকদের ভাতা দেওয়ার জন্য সরকারকে ভারত থেকে প্রয়ােজনে ঋণগ্রহণের পরামর্শ। পাশাপাশি তখনকার পি.এফ,এস. (ফরেন সার্ভিসের) সদস্যদের সম্পর্কে তাঁর মন্তব্য খুবই প্রণিধানযােগ্য। তার প্রস্তাব গ্রহণ করা হলে আর্থিক দিক দিয়ে সরকার লাভবান যেমন হতেন,শরণার্থীদের দুঃখকষ্ট লাঘবে তা সহায়ক হতাে।
দেশপ্রেম কেনাবেচার বিষয় নয়। প্রাসঙ্গিকভাবে এখানে উল্লেখ্য যে, এত কিছু প্রতিশ্রুতি এবং লােভ দেখানাের পরেও অনেক বাঙালি পি.এফ.এস. অফিসার আনুগত্য পরিবর্তন করেননি। উপরন্তু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কাজ করেছেন। এমনকি বিজয়ের ১ বছর বা ২ বছর পর দেশে ফিরে চাকুরিতে বহাল হয়েছেন, উচ্চপদে (সচিব এবং রাষ্ট্রদূত মর্যাদায়) সমাসীন হয়েছেন। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাদের আদরে বুকে জড়িয়ে নিয়েছেন, ভালাে ভালাে পােস্টিং দিয়েছেন। বিনিময়ে এই প্রভুভক্ত কর্মকর্তারা পাকিস্তানেরই সেবা করেছেন, স্বাধীন বাংলার নুন খেয়ে।
১৯-৭-৭১ তারিখের চিঠিতে হারুন সাহেব জানতে চেয়েছিলেন যে, তাদের পাঠানাে রেডিও ট্রান্সমিটার, ওয়াকিটকি ও যন্ত্রপাতি আমাদের সেক্টরে পেয়েছিলাম কি না। আগেই বলেছি তিনি এই সংগ্রহ এবং মুজিবনগরে প্রেরণ ও মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণে প্রত্যক্ষভাবে। জড়িত ছিলেন। হারুন সাহেবের মারফত আমরা জানতে পারি মুহিত সাহেব ও তিনি ছাড়া আর কে কে বাংলাদেশের পক্ষে ছিলেন। এঁদের নাম আগেই উল্লেখ করেছি।
উপরে অনেকের ত্যাগ ও অবদানের কথা উল্লেখ করেছি- যেমন ফজলুর রহমান খান, হারুন-উর-রশিদ প্রমুখ। ১৯৭০-৭১ সালে কয়েকজন সিএসপি কর্মকর্তা বিভিন্ন স্কলারশিপ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন। তাঁদের মধ্যে ছিলেন খােরশেদ আলম (১৯৫৭), ফখরুদ্দিন আহমদ (১৯৬৩) ও রশিদুর রেজা ফারুকী (১৯৬২)। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে সাথেই পাকিস্তান-সরকার এদের আর্থিক অনুদান ও ভাতা বন্ধ করে দেন। ঐ কঠিন সময়ে বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল আমেরিকান নাগরিকবৃন্দ একটি ফান্ড গঠন করেন। এ। ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র সরকারের বিভিন্ন সংগঠনে কর্মরত আমেরিকানরাও সরকারি অর্থানুকূল্যের ব্যবস্থা করেন। আমাদের সহকর্মী ও অন্যান্য বাঙালি যাঁরা অসুবিধায় ছিলেন তাঁদের জন্য অর্থসাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়। ফলে সকলেই যুক্তরাষ্ট্রে থেকে যান এবং বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা এবং জনমত সংগঠন ও সমর্থন আদায়ের কাজ করতে থাকেন। এঁদের মধ্যে বড় ভূমিকা রাখেন খােরশেদ আলম সাহেব। তিনি প্রথমে ছিলেন Bangladesh League of America New England-শাখার সভাপতি। খােরশেদ আলম সাহেবকে বাংলাদেশ সরকার তথ্যসচিব নিযুক্ত করে মুজিবনগরে ডেকে পাঠান, কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রে আন্দোলনের স্বার্থে তাঁকে সেখানকার প্রবাসীরা আসতে দেয়নি।
যুক্তরাষ্ট্রে প্রবাসী বাঙালিদের ইতিহাস অসম্পূর্ণ থেকে যাবে যদি আরও কয়েকজন বাঙালির অবদানের কথা উল্লেখ না করি। তারা হলেন নিউইয়র্কের কাজী শামসুদ্দীন (ব্যবসায়ী) এবং ড. ইউনূস (গ্রামীণ ব্যাংক খ্যাত)। শামসুদ্দীন ছিলেন নিউইয়র্কে পাকিস্তান লীগের সভাপতি। ১৯৭১ সালের নভেম্বরে তিনি সেটিকে নামকরণ করেন East Pakistan League। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারিতে তিনি এটিকে বাংলাদেশ লীগ (Bangladesh League)-এ পরিণত করেন। তিনি ছিলেন রেস্টুরেন্টের মালিক। এটিই পরিণত হয় গােটা আমেরিকা থেকে আগত আন্দোলনে যােগদানকারী বাঙালিদের মিলনক্ষেত্র, বলা যায় rallying point। নিউইয়র্কের সমস্ত সভা-সমাবেশ, র্যালি, পথসভা, জনসভা ইত্যাদির উৎপত্তি হতে এখান থেকে।
ইউনূস সাহেব টেনিসি স্টেটের ন্যাশভিলের কাছেই থাকতেন। ২৬ মার্চ প্রথম পাকিস্তানিআক্রমণের কথা শুনেই তিনি মনস্থির করে ফেলেন। ২৭ মার্চ আশেপাশের বাঙালিদের
পৃষ্ঠা: ১৬৫
(মােট ৬ জন) সমবেত করে কর্মপন্থা নির্ধারণ করেন। বাংলাদেশের জন্য অর্থসংগ্রহ, স্থানীয় পত্র-পত্রিকা, রেডিও-টিভিতে বিবৃতি, সাক্ষাৎকার ইত্যাদির ব্যবস্থা করে ঐ ৬ জন রীতিমতাে আলােড়ন সৃষ্টি করেন টেনিসি-তে। পরবর্তীকালে ওয়াশিংটনে ক্যাপিট্যাল হিলের সামনে সমাবেশে, র্যালিতে যােগদান থেকে শুরু করে পরবর্তী নয় মাস ক্লান্তিহীনভাবে কাজ করে যান স্বাধীন বাংলাদেশ সৃষ্টির জন্য মুজিবনগরের বাংলাদেশ সরকারের ঘােষিত মুক্তিযুদ্ধে। কিছুদিন ড. ইউনূস Bangladesh Newsletter প্রকাশনার দায়িত্ব পালন করেন।
এমনকি আরেক ব্যক্তি ছিলেন শামসুল বারি। তিনি এ.আর.খান ও অন্যান্যদের সহযােগিতায় বাংলাদেশ ডিফেন্স লীগ গঠন ও পরিচালনা করেন। একই সাথে আরাে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেন সেটি হলাে Bangladesh Newsletter নিয়মিত প্রকাশ, প্রচার ও বিতরণ ব্যবস্থা করেন। এই নিউজ-বুলেটিনের মাধ্যমে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কংগ্রেসের সদস্য, সিনেটর ও সরকারি কর্মকর্তাদের মধ্যে, সংবাদপত্র ও অন্যান্য প্রচারমাধ্যমে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের ন্যায্যতা ও যৌক্তিকতা এবং তার মানবিক ও নৈতিক ভিত্তি তুলে ধরেন ও প্রতিষ্ঠিত করেন। একই সাথে আমেরিকানরা জানতে পারে পাকিস্তানি বর্বরতা ও ধ্বংসতাণ্ডব এবং গণহত্যার কাহিনী, আর সেইসঙ্গে বীর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতিরােধের খবর। এর ফলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন- সরকার যতই পাকিস্তান-প্রীতি দেখান-না কেন, সেখানকার জনগণ ও গণমাধ্যম আমাদের পক্ষে চলে আসে। পরিণামে পাকিস্তানও কোণঠাসা হয়ে পড়ে।
ওহাইও থেকে অধ্যাপক আমিনুল ইসলাম আগস্টে মুজিবনগরে এসে যােগাযােগ স্থাপন-সংক্রান্ত যন্ত্রপাতি ব্যবহারের প্রশিক্ষণ দেন। ১৯৭১ সালে তিনি কংগ্রেসে তদ্বির করতে কয়েকবার ওয়াশিংটনে যাতায়াত করেন। ওহাইও-র ডেটনে তিনি বাংলাদেশ লীগ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।
মার্চ মাসের মধ্যেই যুক্তরাষ্ট্রে খােরশেদ আলম ও মাহবুব আলম স্বাধীনতা-আন্দোলনের পক্ষে সংঘবদ্ধভাবে কাজ শুরু করেন। সি.এস.পি. খােরশেদ আলম বৃহত্তর বােস্টনের বাংলাদেশ সংগ্রাম পরিষদের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছিলেন রেজাউল করিম ভূঁইয়া। অর্থনীতিবিদ মতিলাল পাল এবং প্রকৌশলী আমিনুল ইসলামও সংগ্রাম পরিষদে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। বােস্টনে অধ্যয়নরত আরেক বাঙালি ছাত্র ড.এম. আলমগীর খুবই তৎপর ছিলেন ঐ সময়টাতে। প্রচুর লিখতেন তিনি বাংলাদেশের পক্ষে। আমেরিকার বুদ্ধিজীবীরা বাংলাদেশে পাকিস্তানি বর্বরতা ও নৃশংসতার নিন্দা করে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে যে-বিবৃতি দেন সেটির খসড়া করেছিলেন ড. আলমগীর। বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা শিখানামক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে।
যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে অনেক বাঙালি ছাত্র ও শিক্ষক অধ্যয়নরত ছিলেন ১৯৭১ সালে। অধিকাংশই ছিলেন Ford Foundation, USAID ও World Bank Project Funding- এর অধীনে। জাপান এবং ইউরােপেও বেশকিছু ছাত্র ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হওয়ার কিছুদিন পর পাকিস্তান সরকারের চাপে এইসব অর্থসাহায্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। কারণ, ছাত্ররা স্বাধীনতা-আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েছিল। এই পরিস্থিতিতে বাঙালি নেতৃবৃন্দ (মুহিত, কিবরিয়া, করিম প্রমুখ) সহানুভূতিশীল আমেরিকানদের সহযােগিতায় Displaced Scholars Assistance Fund চালু করে সেখান থেকে অর্থ বরাদ্দ দিতে থাকেন ছাত্র ও প্রশিক্ষণার্থীদের। মার্কিন সরকারের, বিশেষ করে USAID-এর কোনাে-কোনাে কর্মকর্তা সক্রিয়ভাবে সাহায্য করেন।
১৯৭১ সালে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে এম.পি.এ. ডিগ্রি করছিলেন Ford Foundation বৃত্তি নিয়ে খােরশেদ আলম, সিএসপি। যুদ্ধের সময় তিনি আমাকে চিঠি লিখেছিলেন। তাঁর চিঠিতে বাংলাদেশ ও বাংলার জনগণ এবং আমরা যারা কাজ করছিলাম তাদের সম্পর্কে উৎকণ্ঠা এবং দরদ ফুটে উঠেছে। একই সাথে মার্কিন জনগণ,কংগ্রেস ও সিনেট সম্পর্কে প্রতিবেদন আর সরকারের নীতি বিশ্লেষণ ও সমালােচনা তাঁর চিঠিতে ছিল।
শ্রদ্ধেয় প্রফেসর নূরুল ইসলাম (যিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার শিক্ষক ছিলেন এবং ১৯৭২-এ বাংলাদেশ প্ল্যানিং কমিশনের প্রথম ডেপুটি চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন) ২১-৬-১৯৭১ তারিখে আমাকে চিঠি লেখেন। উনি পাকিস্তানি আক্রমণের শুরুতেই ঢাকা থেকে বের হয়ে যান। পরে ভারত হয়ে যুক্তরাষ্ট্র। তাঁর সাথে মােটামুটি একই সময়ে, প্রফেসর রেহমান সােবহান, আনিসুর রহমান, স্বদেশ বােস, হাসান ইমাম, প্রফেসর মােশাররফ হােসেন, প্রফেসর মুজাফফর চৌধুরী, অধ্যাপক খান সরওয়ার মুরশিদ, এবং আরও অনেক নামকরা অর্থনীতিবিদ, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ভারতে আমাদের অবস্থানে পৌঁছেছিলেন। একটি বড় গ্রুপ বিদেশে চলে যান এবং প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচার চালাতে থাকেন। প্রকাশ করেন পাকিস্তানি বর্বরতা, প্রফেসর নূরুল ইসলামের ভাষায় Holocaust। বাংলাদেশের স্বাধীনতা কেন এবং তার যৌক্তিকতা, বিশেষ করে পাকিস্তানিদের তথাকথিত ইসলামী মুখােশ উম্মােচন এবং আমাদের যুদ্ধের নৈতিক দিক এঁরা সকলে তুলে ধরেন। প্রফেসর রেহমান সােবহান প্রথমে ইউরােপ এবং পরে আমেরিকায় অত্যন্ত দৃঢ়ভাবে এবং দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সভা, সমিতি, আলােচনায় বক্তৃতা, পত্র-পত্রিকা, জার্নালে লেখালেখি করেন, অবিশ্রান্তভাবে।
প্রফেসর নূরুল ইসলাম প্রকাশ্যে না-এসে আমেরিকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে এবং সরকারের বিভিন্ন মহলে লবি করতে থাকেন। এদের সকলের কাছে তাঁর বক্তব্যের গ্রহণযােগ্যতা ছিল।
আমাকে লেখা তাঁর একটি চিঠির কথা উল্লেখ করতে হয়। তিনি ২১-৬-৭১ তারিখে চিঠিটি লিখেছিলেন। প্রাক্তন ছাত্রদের কষ্ট তাকে পীড়িত করত। আমার কাছে সরকারের ও অন্যান্য সহকর্মীদের খোঁজখবর নেওয়া ছাড়াও তিনি একটি চমকপ্রদ তথ্য দিয়ে, একটা প্রশ্ন করেছিলেন। প্রশ্নটি বিশেষ গুরুত্ববহ বলে পরিশিষ্টে হুবহু চিঠি সংযােজন করেও এখানে তা তুলে ধরছি। তার প্রশ্ন: P.S. I understand that a political settlement will be announced on 28th June. What is the reaction? এটা পড়ে হাসব না কাঁদব ভেবে পাইনি। যাহােক, পাকিস্তানি প্রচারণার জোর ছিল বলতে হবে। দুনিয়ার সর্বত্রই পাকিস্তানিরা বিভ্রান্তিকর তথ্য প্রচার করে আমাদের আপনজনকে দ্বিধায় ফেলতে চেষ্টা করেছে।
ড. হাসান ইমাম সাহেব ২২-৬-৭১ তারিখে প্যারিস থেকে আমাকে চিঠি লেখেন। উনি রেহমান সােবহান সাহেবের সাথে ভারত (আগরতলা) হয়ে প্যারিসে যান। ঐসময় তাদের সেখানে উপস্থিতি আমাদের জন্য বিরাট তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আগের দিন, ২১ জুন ১৯৭১, প্যারিসে অনুষ্ঠিত হয় Aid to Pakistan World Bank Consortium বৈঠক। প্রতি বছর সেসময় প্যারিসে এই বৈঠক হতাে বিশ্বব্যাংকের উদ্যোগে। অন্যান্য সকল দাতা-সংস্থা ও দেশ এতে অংশগ্রহণ করে পরের অর্থ বছরে কী পরিমাণ সাহায্য কোন্ কোন্ খাতে বরাদ্দ করা হবে তা নির্ধারণ করত। পাকিস্তানের পক্ষে খুব শক্তিশালী টিম পাঠানাে হয়। তাদের কার্যপত্র ছিল পরিষ্কার। পূর্ব পাকিস্তান স্বাভাবিক, কোনাে যুদ্ধ বিগ্রহ হচ্ছে না। কিছু দুস্কৃতকারী গােলমাল করার চেষ্টা করছে, তবে তা বিশেষ উল্লেখযােগ্য কিছু নয়। এরকম একটা শক্ত প্রচারের বিরুদ্ধে পাশ্চাত্যের গণমাধ্যম এবং বিশ্বব্যাকের (World Bank) কতিপয় মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তা, যারা ঐ সময় তৎকালীন পূর্ববাংলায় ছিলেন, তাদের রিপাের্ট এবং নৈতিক সমর্থন আমাদের পক্ষে বিপুলভাবে কাজ করেছিল। এর সাথে রেহমান সােবহান এবং হাসান ইমামের গণসংযােগ- তৎপরতা, বিশেষ করে রেহমান সােবহান সাহেবের ক্ষুরধার যুক্তিপূর্ণ বক্তব্য পাকিস্তানের সমস্ত অপকৌশল নস্যাৎ করে দেয়।
এইড কনসাের্টিয়াম অপকৌশলী পাকিস্তানকে এক বছরের জন্য সাহায্য দান স্থগিত রাখে। ঠিক একইভাবে এ.এম.এ. মুহিত, রেহমান সােবহান (পরে আমেরিকায়), প্রফেসর ইসলাম প্রমুখ যুক্তরাষ্ট্র সিনেট এবং কংগ্রেসে একই রকম জোরালাে বক্তব্য রাখতে থাকেন আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে নিয়ে।
অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি হাসান ইমামকে একটা ফেলােশিপ দেওয়া সত্ত্বেও তিনি প্যারিসে বিখ্যাত সােরবােন (Sorbonne) বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি কোর্স নেবার দায়িত্ব নেন, যাতে করে প্যারিসে আমাদের গণসংযােগের কাজ চালিয়ে যেতে পারেন। তার চেষ্টায় বিখ্যাত চিন্তাবিদ জা পল সার্জে এবং রেম আরো (Jem Paul Sartre and Rymond Arou) পাকিস্তানকে ফরাসি সাহায্যের তীব্র সমালােচনা করেন। হাসান ইমাম আরও অনেক ব্যক্তিগত তথ্য দেন। পরবর্তীতে অক্সফোর্ড থেকে উনি আমেরিকা যান ও বিশ্বব্যাংকে যােগদান করেন। অক্সফোর্ডের নাফিল্ড কলেজ থেকে হাসান ইমাম আমাকে আরেকটি চিঠি লেখেন, যার খামটি (সিলমােহরযুক্ত) আমার কাছে আছে। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন।
যুক্তরাজ্যে বসবাসরত অনেক বাঙালি মুজিবনগর সরকারের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেছিলেন। এঁদের মধ্যে প্রথমেই যার কথা মনে পড়ছে, তিনি হলেন হাবিবুর রহমান। ১৯৭১ সালে লন্ডনে পাকিস্তান হাই কমিশনে শিক্ষা অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে বিচারপতির পুত্র কায়সারের সঙ্গে লন্ডন বিমান বন্দরে তিনি মুজিবনগর সরকারের পক্ষে অভ্যর্থনা জানান ২৬ মার্চের একদিন পর। বিচারপতি চৌধুরীকে পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়ে যাওয়ার অভিযােগে ২৭ এপ্রিল বিনা-ননাটিশে তাঁকে পদচ্যুত করা হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার তাকে পররাষ্ট্র দপ্তরে (ফরেন সার্ভিস) নিয়ােগ করেন। তিনি অত্যন্ত কৃতিত্বের সাথে এক দশকের বেশি সময় বিভিন্ন দূতাবাসে দায়িত্ব পালন করেন। জেনারেল এরশাদের সামরিক আইন জারির পর তৎকালীন (১৯৮২) পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ.আর.এস. দোহা স্বাধীনতার পর নিযুক্ত অন্যান্য মুক্তিযােদ্ধাদের মতাে তাকেও কর্মচ্যুত করেন। তৎকালীন স্বৈরাচারী সরকার তার কোনাে মূল্যায়ন করেনি।
মুক্তিযুদ্ধকালীন নয়টি মাস হাবিবুর রহমান আমার সাথে যােগাযােগ রক্ষা করেছেন। বিলেতে ও ইউরােপে স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে সমস্ত তথ্য আমার মাধ্যমে সরকারকে দিয়েছে। প্রত্যেকটি উল্লেখযােগ্য সংবাদপত্রের ক্লিপিং তিনি আমাকে পাঠাতেন। তিনি ও তাঁর স্ত্রী ফেরদৌস লন্ডনে ও শহরতলীতে বাংলাদেশের সমর্থনে অনুষ্ঠিত বাঙালিদের সকল সভায় অংশগ্রহণ করেছেন। তিনি ছিলেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সার্বক্ষণিক সহচর। আমার বিশেষ বন্ধু হাবিব ও তার স্ত্রী যুদ্ধের সময় তাদের বাড়ির দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের কাজে নিয়ােজিত বাঙালিদের জন্য। ১৯৮২ সালের পর যদিও বাংলাদেশ সরকার তাকে কোনাে চাকরি দেননি, ব্রিটিশ সরকার তাঁকে সিভিল সার্ভিসে নিয়ােগ করেন। সম্প্রতি তিনি চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে ব্রিটিশ সরকারের অবসর ভাতা পাচ্ছেন।
আমার স্কুলজীবনের বন্ধু (১৯৪৬-৪৭) সহপাঠী নাজেম আহমেদ চৌধুরী (প্রাক্তন সি.এস.পি. ১৯৬৩ ব্যাচ) নরওয়ের ওসলাে (Oslo, Norway) থেকে চিঠি লেখেন ৫-৭-৭১ তারিখে। পরে তিনি ও আজিজুল হক (সি.এস.পি. ১৯৬২) লন্ডনে চলে যান ও বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। দুজনই বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত।
আমার ঘনিষ্ঠতম বাল্যবন্ধু বেবু (পুরাে নাম সুফি আকবর হােসেন) বহুদিন থেকে লন্ডনে স্থায়ীভাবে বসবাস করে। পেশায় চাটার্ড অ্যাকাউন্টেন্ট, বেশ সুপ্রতিষ্ঠিত। আমার সাথে সবসময়েই যােগাযােগ আছে। যুদ্ধের একেবারে প্রথমদিকে আমি রামগড়ে পৌঁছেই ত্রিপুরার সাব্রুম ডাকঘর মারফত ওকে আমাদের সমস্ত খবর পাঠাই, সেইসাথে আমাদের ভবিষ্যতের কর্মপন্থা। বেবু আমার চিঠি পেয়ে দু-ঘণ্টার মধ্যে উত্তর পাঠায়। সেই চিঠিটি ব্যক্তিগত হলেও এইসাথে সংযােজন করলাম। দুটো কারণ: এক, এরােগ্রাম চিঠিতে আমাদের বাংলাদেশ সরকারের আঞ্চলিক প্রশাসন কর্তৃক স্থাপিত ডাকঘরের ছাপ। দুই, চিঠিটি আগাগােড়া এত গভীর মমত্বে ভরা, এত দরদ আর ভালােবাসা প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে। যা মর্মস্পর্শী। দেশের মানুষের জন্য, জনতার জন্য আমার ও আমার পরিবারের জন্য, যা কিছুতেই ভােলা যায় না। বেবু এখনও আমার ঘনিষ্ঠতম বন্ধু-৫৪ বছর পরেও। স্বাধীনতাযুদ্ধের পুরাে নয় মাস বেবু আমাকে নিয়মিত অর্থসাহায্য পাঠিয়েছে। রক্ত দিয়ে এই ঋণ শােধ হবে না। লন্ডনে বেবু আমাদের স্বাধীনতা-আন্দোলনে বিরাট অবদান রেখেছে।
আরেক বাল্যবন্ধু, লেবু, ভালাে নাম মােহাম্মদ হােসেন, যুদ্ধের সময় আমার খোঁজখবর নিত, চিঠি লিখত। এপ্রিল মাসে লেবু ভারতে আসে এবং তারপর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কয়েকবার নিজ-পরিবারের সন্ধানে। দিনাজপুর, ঈশ্বরদী (পাবনা), রাজশাহীর গ্রামাঞ্চলে ঘুরে-ঘুরে অনেক কিছু প্রত্যক্ষ করে। প্রত্যক্ষদর্শীর সেই বিবরণ আবার আমাকে জানায় লন্ডন থেকে তাঁর ২২-৬-৭১ তারিখে লেখা চিঠিতে। সবচাইতে কষ্ট লাগে কীভাবে আমাদেরই দেশে বহিরাগত বিহারীরা বিভিন্ন শহর থেকে আমাদের বিতাড়িত করেছিল। কী অত্যাচারই না ওরা করেছে। ঈশ্বরদী রেল জংশন-রেলের শহর। তখনকার দিনে রেলওয়ে মানেই বিহারী, ওদেরই রাজত্ব। তার ওপর পেয়েছে অস্ত্রশস্ত্র আর মিলিটারির সহযােগিতা। ঈশ্বরদীর ৪/৫ মাইলের মধ্যে বাঙালিরা যেতে পারত না-লেবুর খবর মতে। একই অবস্থা হয়েছিল শান্তাহার, পাকশি, পার্বতিপুর, সৈয়দপুর, ময়মনসিংহ (রেল জংশন), পাহাড়তলিএইসব জায়গায়। এগুলি পরিণত হয় বাঙালি নিধনের বধ্যভূমিতে।
আমার বন্ধু লুর রহমান, সিলেটে বাড়ি, লন্ডনে স্থায়ী বাসিন্দা। লন্ডনের উপকণ্ঠে টুইকেনহামে কয়েকটা রেস্টুরেন্টের মালিক। খুবই ভালাে অবস্থা। তিনিও চিঠি লিখতেন, খবর দিতেন। নিয়মিত টাকা পাঠাতেন আমাকে তার প্রেরিত ৫০০ টাকা মানে ৫০০ পাউন্ড, কয়েক হাজার ভারতীয় রুটি, আমাদের ঐ দুঃসময়ে যথেষ্ট উপকারে এসেছে। আমার বন্ধু রহমান আমার স্ত্রীকে ভাবী ডাকলেও বলতেন তার ছােট বােন। লুৎফর রহমানের ৮-৬-৭১ তারিখে লেখা চিঠিতে ফুটে উঠেছে বাংলাদেশ আর মুক্তিযােদ্ধাদের প্রতি দরদ।
যুদ্ধের একেবারে শেষদিকে আমাদের আরেক সহকর্মী শামসুল আলম (সি.এস.পি. ১৯৬৩) আমেরিকার Williamstown, Massachusetts থেকে চিঠি লেখেন। উনি তখন একটি কোর্স করছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের সাথে মােটামুটি সংশ্লিষ্ট ছিলেন, তবে তেমন সক্রিয়ভাবে নয়।
সবচেয়ে বেশি চিঠি লিখেছেন সেই সময় আমার সহপাঠী, বন্ধু ও আত্মীয় হাবিবুর রহমান। লন্ডন থেকে তার সব সময়েই লেখার অভ্যাস। তার অবদানের কথা বলে শেষ করা যাবে না। সস্ত্রীক অত্যন্ত তৎপর ছিলেন লন্ডনে। তার তৎপরতা সম্পর্কে আগেই লিখেছি। এখানে তার চিঠিগুলাের কথা উল্লেখ করব। প্রতিটি চিঠি তথ্যপূর্ণ। কে কী করছেন, কী বলছেন সেসব লিখেছিলেন চিঠিগুলােতে আর চিঠিগুলাের সাথে পাঠিয়েছিলেন পত্র-পত্রিকার ক্লিপিং (clipping) ব্রিটেনে প্রকাশিত সকল নামী-দামী পত্রিকার ক্লিপিং তিনি আমাকে নিয়মিত পাঠাতেন। The London Times, The Sunday Times, The Guardian, The Daily Telegraph এইসব বিশ্ববিখ্যাত পত্রিকা বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিয়ে খবর ছাপাত,যার অনেকাংশ হতাে বিশ্লেষণধর্মী। পূর্ববাংলায় হত্যাযজ্ঞ ও ধ্বংস প্রচুর গুরুত্ব পেত। সেইসাথে পাকিস্তান আর্মির সমালােচনা।
২ জুন তারিখে লেখা হাবিবের চিঠি আমার জন্য ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। এখানে আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি:
I also read a news given by the Spokesman of the Pakistan Government, published in the Times, stating that the documents discovered in the offfice of the Deputy Commissioner, Rangamati, proves that this official was in close touch with the Indian Government, in organizing an Army resistance.I immediately concluded that you must have crossed the border and was eagerly waiting for your news.
চিঠির মর্মার্থ দাঁড়ায়: “London Times” পত্রিকায় প্রকাশিত পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্রের একটি বিবৃতিতে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয়েছে। তাতে তিনি (পাকিস্তান সরকারের মুখপাত্র) বলেছেন যে, রাঙামাটির ডেপুটি কমিশনারের অফিসে প্রাপ্ত নথিপত্রে প্রমাণিত হয়। যে এই বিশেষ অফিসার (অর্থাৎ আমি) ভারতীয় সরকারের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ করে সেনাবাহিনীর প্রতিরােধযুদ্ধ সংগঠন করি।কথাটি তাে সত্য। আর আমি এজন্য গর্বিত!
উপরােক্ত চিঠিতে হাবিব আরও লিখেছিলেন কীভাবে ৯০ মিনিটের নােটিশে তাকে পাকিস্তান হাইকমিশন ছাড়তে হয়। কারণ, পূর্ববাংলা নিয়ে পাঞ্জাবি অফিসারের সাথে তর্ক। কোনাে-কোনাে জায়গায় তার বক্তব্য অত্যন্ত তীক্ষ। ব্রিটিশ সংবাদ মাধ্যম ১৯৭০ সালের নভেম্বর থেকেই পূর্ববাংলাকে তাদের ১ নম্বর সংবাদ বিবেচনা করছিল (ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পর)। ১ মার্চ থেকে সকল ব্রিটিশ সংবাদপত্র, বিবিসি এবং সি.ভি. বাংলাদেশকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়েছে। পাকিস্তান আর্মির অভিযান, হত্যা ও ধ্বংসলীলা বিশেষভাবে প্রকাশিত হয়। ফলে ব্রিটিশ জনগণ, পার্লামেন্ট সদস্যবৃন্দ, বুদ্ধিজীবী, ত্রাণসংস্থা সকলে একযােগে বাংলাদেশের সমর্থনে এগিয়ে আসে। হাবিবের মতে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম আমাদের স্বাধীনতার পক্ষে অপূর্বঅবদান রেখেছে। একই চিঠিতে হাবিব বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এবং অন্যান্য বাঙালিদের তৎপরতা, বিক্ষোভ ও সভা-সমাবেশের বিবরণ দেন। চিঠির সাথে অনেক পত্রিকার ক্লিপিং ছিল। অনেক ব্যক্তিগত কষ্ট এবং আলাপচারিতাও ছিল চিঠিতে।
২ জুনের পর হাবিব আরেকটি অ্যারােগ্রাম পাঠান ১৫-৬-৭১ তারিখে। সেটিও তথ্যপূর্ণ। ১ সেপ্টেম্বর আরেকটি চিঠি পাই যার সাথে দেশের অভ্যন্তর থেকে পাঠানাে আমার ভাগ্নের লেখা চিঠি ছিল, যাতে আমার মা ও অন্যান্যদের বিস্তারিত খবর ছিল। হাবিব আরও অনেক চিঠি লিখেছেন আমাকে যুদ্ধের ৯ মাস ও পরবর্তীকালে ১৯৭২-৭৩ সালে। সবই তথ্যপূর্ণ ও বিশ্লেষণধর্মী। তবে তার বক্তব্য অনেক সময় তীব্র সমালােচনা, এমনকি ঘৃণামিশ্রিত থাকত।
জাপানে ছিলেন আমাদের আরেক সুহৃদ, শেখ আহমেদ জালাল। বহুদিন জাপানে অবস্থানের কারণে জাপানি ভাষা চমৎকার রপ্ত করেছিলেন। জাপানি বন্ধুবান্ধবও ছিল।
পৃষ্ঠা: ১৭০
অনেক। মার্চের প্রথম থেকেই বাংলাদেশের পক্ষে নেমে পড়েন প্রচারণায়। জালাল ও কতিপয় বাঙালি জাপানে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গড়ে তােলেন, যার সুফল আমরা স্বাধীনতা-পরবর্তীকালেও দীর্ঘদিন ভােগ করছি। জালালকে বাংলাদেশ ফরেন সার্ভিসে নেওয়া হয়। অনেকদিন চাকুরিতে ছিলেন। সর্বশেষ কোলকাতায় ডেপুটি হাই কমিশনার। কিছুদিন আগে ইন্তেকাল করেছেন।
তৎকালীন পাকিস্তান ট্রেড সার্ভিসের কর্মকর্তা ছিলেন শামসুজ্জামান। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায়, জাকার্তায় ছিল তার কর্মস্থল। তিনি বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করে রিপাের্ট পাঠাতেন।
আরেক ব্যক্তি, পদার্থবিদ ড. মাহফুজুল হক ছিলেন সিঙ্গাপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করতেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে সরাসরি যােগাযােগ ছিল। ১১ আগস্টে লেখা তাঁর চিঠি প্রধানমন্ত্রী আমাকে দিয়েছিলেন। সংরক্ষণে থাকায় সেটিও সংযােজন করলাম। অনেক যুক্তি দিয়ে তিনি বলেছিলেন যে: সশস্ত্র সংগ্রামই একমাত্র পথ এবং অস্ত্রধারণের জন্য অনেক বাঙালি বিদেশেই প্রস্তুত ছিলেন। তার মূল বক্তব্য ছিল এই যে: পাকিস্তানিরা অস্ত্রের ভাষাই বােঝে, অতএব তাদের দুর্বলতম স্থানেই আঘাত হানতে হবে। খােদ পশ্চিম পাকিস্তানে এবং বিদেশে তাদের মিশনগুলােতে নাশকতামূলক তৎপরতা চালালেই ওরা দমে যাবে। তার ভাষায়: শত্রুর Soft targets এবং এমন স্থানে যেখানে তারা আঘাতের আশঙ্কা করে না।
সহকর্মী হারুন-উর-রশিদ, সহকর্মী খােরশেদ আলম, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, ড. হাসান ইমাম, বন্ধু সুফী আকবর হােসেন (বেবু), বন্ধু মাহমুদ হােসেন (লেবু), বন্ধু লুঙ্কর রহমান, সহকর্মী শামসুল আলম প্রমুখের লেখা পত্রগুলি গ্রন্থে দেওয়া হলাে।
আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ: গঠন, তৎপরতা, অবদান
আঞ্চলিক প্রশাসন স্থাপন ও পরিচালনা ছিল একটি সম্পূর্ণ নতুন চিন্তাধারার ফসল। পূর্ণাঙ্গ একটি সরকার প্রতিষ্ঠা, যার অধীনে আঞ্চলিক প্রশাসনসহ বিভিন্ন বিভাগীয় কার্যক্রম থাকবে, যার ভিত্তি হবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া এবং মূল লক্ষ্য হবে যুদ্ধে নিয়ােজিত সেক্টর কমান্ড এবং মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযােগিতা—এই ছিল আমাদের ভাবনা। এই লক্ষ্যে ১১টি সেক্টরের সাথে ১১টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ (Zonal Administrative Council) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এই পরিষদগুলােতে নির্দিষ্ট এলাকার নির্বাচিত এম.এন.এ/ এম.পি.এ.-রা এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদস্য ছিলেন। তাঁদের মধ্য থেকেই আবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করা হতাে। এই পরিষদকে প্রশাসনিক সাহায্য দেওয়ার জন্য একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়ােগ করা হয়। সেইসাথে নিযুক্ত হন বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তা। (পরিশিষ্ট ১০৫ দ্রষ্টব্য।)
আঞ্চলিক প্রশাসকগণ প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। প্রত্যেক আঞ্চলিক চেয়ারম্যান তার অধীনস্থ রাজনৈতিক এলাকার সুষ্ঠু সমন্বয়ের জন্য উপঅঞ্চলে বিভক্ত করে উপদেষ্টা বা উপ-আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নিয়ােগ করার অধিকারী ছিলেন। এটি সম্পূর্ণভাবে স্থানীয় ব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত ছিল। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামাে কার্যকর ছিল।
আঞ্চলিক পরিষদ এবং দপ্তরগুলাে থাকার ফলে দেশ সম্পূর্ণভাবে দখলদার মুক্ত হবার আগেই আমাদের নিজস্ব প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পূর্ণ প্রস্তুত ছিল। সে-কারণে ১৬ ডিসেম্বরেই (কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে তার আগেই, যেমন যশােরে ওয়ালিউল ইসলাম ও তার টিম দায়িত্ব গ্রহণ করেন) আমাদের নিয়ােজিত সকল জেলা প্রশাসক/পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা স্বস্ব পদে যােগদান করে কালবিলম্ব না করে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করেন।
মূল পরিকল্পনায় পাচটি অঞ্চল (Zone) সৃষ্টি করা হয়েছিল। পরে পরিকল্পনাটি পরিমার্জন করে আরও ছয়টি অঞ্চল সৃষ্টি করা হয়।
দেশব্যাপী সুষ্ঠু প্রশাসনব্যবস্থা গড়ে-তােলার জন্য জুলাই মাসে সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি প্রশাসনিক অঞ্চলে বিভক্ত করে সরকারের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণাকারী জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের প্রত্যক্ষ ভােটে আঞ্চলিক চেয়ারম্যান নির্বাচন করা হয়। প্রতিটি অঞ্চলে একজন করে আঞ্চলিক প্রশাসকও নিয়ােগ করা হয়। এই প্রশাসকগণ কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়ােগপ্রাপ্ত ও নিয়ন্ত্রিত ছিলেন। শরণার্থী সমস্যা, মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক সামরিক-বেসামরিক বিষয়াবলির সুষ্ঠু সমন্বয় ও নিয়ন্ত্রণভার এই প্রশাসনিক অঞ্চলগুলাের ওপর ন্যস্ত হয়। আঞ্চলিক চেয়ারম্যান তাদের অধীনস্থ অঞ্চলের (দেশের ভিতরে ও বাইরে) রাজনৈতিক আঞ্চলিক সমন্বয়কারী সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় নিম্নবর্ণিত কর্মকর্তাদের নিয়ােগদান করেন (পরিশিষ্ট ১০৬ দ্রষ্টব্য):
ক. আঞ্চলিক স্বাস্থ্য কর্মকর্তা
খ. আঞ্চলিক শিক্ষা কর্মকর্তা
গ. আঞ্চলিক ত্রাণ কর্মকর্তা
ঘ. আঞ্চলিক প্রকৌশল কর্মকর্তা
ঙ. আঞ্চলিক পুলিশ কর্মকর্তা
চ. আঞ্চলিক তথ্য কর্মকর্তা
ছ. আঞ্চলিক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা
উল্লিখিত কর্মকর্তাগণ স্ব-স্ব মন্ত্রণালয় কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হতেন। আঞ্চলিক প্রশাসকগণ প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের (Zonal Administration Council-এর) বিশেষ দায়িত্ব
১. মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন ও পূর্ণ সহযােগিতা করা।
২. মুক্তিযােদ্ধা ক্যাম্পগুলাে পরিচালনা এবং সতর্কতার সঙ্গে কাজের সমন্বয়, রিক্রুট ও ট্রেনিং-এ পাঠানাের ব্যবস্থা করা।
৩. শরণার্থীদের দেখাশােনা ও ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কাজের সমন্বয় সাধন করা।
৪. তথ্য দপ্তর থেকে প্রকাশিত হাজার হাজার পুস্তিকা, প্রচারপত্র ও পােস্টার শরণার্থী ক্যাম্পগুলাে ছাড়াও বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিতরণের ব্যবস্থা করা।
৫. হানাদার দখলীকৃত অঞ্চল থেকে কোনাে সরকারি কর্মচারী এসে হাজির হলে তার নাম, পরিচয় লিপিবদ্ধ করে যােগ্যতা অনুসারে কাজে লাগানাে ও বেতনের ব্যবস্থা করা।
৬. বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর শাসনভার গ্রহণ করার পূর্ব পর্যন্ত এই প্রশাসনিক কাঠামাে কার্যকর।
মুজিবনগরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং সরকারি কর্মকাণ্ড পরিচালনার পূর্ব থেকেই পার্বত্য চট্টগ্রামের রামগড়, ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের সাব্রুম (দক্ষিণ জেলা) এবং ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় আমরা সংগঠিত হয়েছিলাম। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী এবং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণা এবং নির্দেশ অনুযায়ী আমরা বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তা-কর্মচারী কাধে কাঁধে মিলিয়ে সম্মিলিতভাবে যুদ্ধ এবং তার সব আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পাদন করেছি। বেসামরিক প্রশাসন সামরিক কমান্ডের পরিপূরক হিসেবে কাজ করেছে। সামরিক ও বেসামরিক পর্যায়ের কর্মকর্তা-কর্মচারী সম্মিলিতভাবে এবং সুশৃঙ্খলভাবে হানাদার বাহিনীকে এবং ষড়যন্ত্রকারী রাজাকারদের মােকাবিলা করেছি। আমি নিজে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি থেকে সদর দপ্তর রামগড়ে স্থানান্তর করার পর একমাসেরও বেশি সময় সেখানে মেজর জিয়াউর রহমানের পাশাপাশি কাজ করেছি। তিনিও আমাকে সহযােগিতা করেছেন। আমাদের সমঝােতাও ছিল ভালাে।
রামগড়ে অবস্থানকালেই পূর্বাঞ্চলীয় জেলাসমূহের নেতৃবৃন্দ সেখানে জমায়েত হন। এঁদের মধ্যে ছিলেন এম.আর. সিদ্দিকী, জহুর আহমদ চৌধুরী, নূরুল হক, এ.এস.এম. শামসুজ্জোহা, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর, মােহাম্মদ ইলিয়াস, কাজী জহিরুল কাইউম, আবদুর রশিদ, অধ্যাপক খালেদ, খালেদ মাহমুদ আলী, আবদুল আউয়াল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, প্রফেসর মােজাফফর আহমেদ, প্রফেসর নূরুল ইসলাম চৌধুরী, মির্জা আবু মনসুর, ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ হােসেন। এই নেতৃবৃন্দের সাথে পরে এসে একত্রিত হন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দ, দেশের নামকরা শিল্পী, সাহিত্যিক, প্রকৌশলী এবং আরও অনেকেই। অবশ্য এঁরা মাসখানেকের মধ্যে চলে যান প্রথমে আগরতলা ও পরে মুজিবনগরে।
রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সম্মিলিতভাবে এবং সর্বসম্মতিক্রমে আমাকে পূর্বাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসক নিয়ােগ করেন। এভাবে প্রশাসনভার গ্রহণ করে দেশের পূর্বাঞ্চলের এক বিশাল এলাকায় মুক্তিযুদ্ধের কাজকর্মে প্রমাসনিক বিষয়াদি, বিশেষ করে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সংযােগস্থাপন করে সমন্বিত ব্যবস্থা গড়ে তুলি। এ-কথা অনস্বীকার্য যে, প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক সমর্থন ছাড়া ভারত-সীমান্তে কখনােই কোনাে অস্ত্রধারী ব্যক্তি প্রবেশাধিকার পেতেন না। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সমঝােতা হয়ে যাওয়ায় আমার পক্ষে এদিকে সামাল দেওয়া সহজ হয়ে যায়। পরবর্তীকালে মাহবুব আলম চাষী পররাষ্ট্রসচিব নিযুক্ত হয়ে মুজিবনগর চলে গেলে আগরতলায় সম্পূর্ণ দায়িত্ব আমি গ্রহণ করি। জুলাই মাস পর্যন্ত আমি আগরতলায় ছিলাম। এর মধ্যে জুন মাসে একবার মুজিবনগর গিয়ে মন্ত্রিপরিষদ-সচিবের পদে যােগদান সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলাপ করি। প্রাথমিক সাংগঠনিক কাজকর্ম সম্পন্ন করে প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি নিয়ে আবার আগরতলায় ফিরে যাই। আমার স্থলাভিষিক্ত হন ড.কে.এ. হাসান। পরবর্তীকালে পূর্বাঞ্চল তিনটি এলাকায় (Zone-এ) বিভক্ত হয়—একটিতে এস.এ.সামাদ, (দক্ষিণ-পূর্ব ১: সাব্রুম/উদয়পুর) দ্বিতীয় এলাকায় ড. হাসান (দক্ষিণ-পূর্ব ২: আগরতলা) ও তৃতীয় এলাকায় কাজী রকিবউদ্দীন (পূর্ব: ধর্মনগর)।
আঞ্চলিক পরিষদ কী কী কাজ করবে, দায়িত্ব কী হবে; রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক সংগঠন, সাব-কমিটি কয়টি ও কী বিষয়ে হবে; আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা, অর্থ (আয় ও ব্যয়) —এসব বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের স্বাক্ষরে সাধারণ প্রশাসন বিভাগ (General Administration Department) একটি আদেশ জারি করে ২৭ জুলাই ১৯৭১। পরবর্তীকালে এটি পরিমার্জিত ও সংশােধিত হয়েছে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে, কিন্তু মৌলিক কাঠামাে ও দায়িত্বাবলি একই ছিল।
জোনাল কাউন্সিল বা আঞ্চলিক পরিষদের উৎপত্তিও যুবশিবিরের মতাে পূর্বাঞ্চলে। ১০ মে, ১৯৭১ পূর্ব-অঞ্চলের উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন রাজনৈতিক কমিটি আগরতলায় একটি বিশেষ সভা করেন। তাতে অনেকগুলি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। কিছুটা আলােচনা করলেই বােঝা যাবে কীভাবে আঞ্চলিক পরিষদের উৎপত্তি।
উপরােক্ত সভায় ছিলেন জহুর আহমেদ চৌধুরী (এম.পি.এ.), নূরুল হক (এম.এন.এ., বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে) এবং আবদুল কুদুস মাখন (পর্যবেক্ষক)। সভায় ফজলুল হক মণি-কে সিলেট, কুমিল্লা, নােয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং ঢাকার ছাত্রবৃন্দের সাথে আলােচনা করে রাজনৈতিক কমিটিতে একজন প্রতিনিধি পাঠাতে অনুরােধ করা হয়। কমিটির প্রস্তাবনায় মন্ত্রিসভার অনুমােদন লাভের জন্য নূরুল হক ও তাহেরউদ্দীন ঠাকুরকে মুজিবনগরে প্রেরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একই সভায় যুব ত্রাণ শিবির পরিদপ্তর স্থাপন করে মাহবুব আলমকে তার পরিচালক এবং চার-সদস্যবিশিষ্ট একটি পরিচালনা কমিটিও গঠন করা হয়। এঁরা হলেন ড. আবু ইউসুফ, প্রফেসর নূরুল ইসলাম, মুজাফফর আহমেদ ও খালেদ মাহমুদ আলী।
যেহেতু একজন বর্ষীয়ান নেতার নেতৃত্বে, সর্বসম্মতিক্রমে একটি কমিটি সফলভাবেই প্রশাসন কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখছিল এবং কমিটির সদস্যদের সাথে প্রশাসনিক কর্মকর্তারাও পূর্ণ সহযােগিতা করছিলেন, সেহেতু মুজিবনগরে কেন্দ্রীয় সরকার তাদেরকেই স্বীকৃতি দেন।
অল্পদিনের মধ্যে একেই সারাদেশের আঞ্চলিক পরিষদের মডেলরূপে গ্রহণ ও কার্যকর রূপ দেওয়া হয়। সর্বপ্রথম পাঁচটি অঞ্চল (Zone) সৃষ্টি ও অনুমােদন করা হয়। ক্রমান্বয়ে তার সংখ্যা ৯টি, তারপর তা ১১-তে উন্নীত হয়। এই দ্রুত সম্প্রসারণ হয় মুক্তিযুদ্ধের নানাবিধ প্রয়ােজনের জন্যই। মুক্তিবাহিনী সেক্টরগুলােও এভাবে সম্প্রসারিত হয়েছে।
এই রাজনৈতিক কমিটিমন্ত্রিসভার ১০ লক্ষ রুপির একটি আপকালীন মঞ্জুরি এবং যুবশিবিরের রূপরেখাও প্রেরণ করেন। পূর্বাঞ্চলের ৬টি জেলার যুবকদের জন্য মােট ১৩টি শিবির পরিচালনার কথা বলা হয়। শিবির পরিচালনার দায়িত্ব ৭ জন কর্মকর্তা নিয়ােগের সুপারিশ করেন কমিটি। এদের দায়িত্ব বণ্টন করতেন যুবশিবিরের ডিরেক্টর। শিবিরে ভর্তি এবং শৃঙ্খলা বজায় রাখার বিষয়েও সিদ্ধান্ত হয়। রাজনৈতিক কমিটি মােট ৮টি বিষয় নির্বাচন করে ৭ জন জনপ্রতিনিধিকে (এম.এন.এ. ও এম.পি.এ.) সেগুলাের দায়িত্ব প্রদান করে। বিষয়গুলি ছিল নিম্নরূপ:
দপ্তর/বিষয় দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিবর্গ
১. ত্রাণ, পুনর্বাসন ও স্বাস্থ্য সেবা: শামসুজ্জোহা
২. তথ্য, প্রকাশনা ও বিতরণ: তাহেরউদ্দীন ঠাকুর
৩. প্রশাসন: দেওয়ান ফরিদ গাজী
৪. প্রশিক্ষণ ও কর্মসূচি (যুবশিবির): তাহেরউদ্দীন ঠাকুর
৫. অর্থ: এম. আর. সিদ্দিকী
৬. যুদ্ধ প্রচেষ্টা: নূরুল হক
৭. ছাত্র-বিষয়াবলি: শেখ ফজলুল হক মণি
৮. রাজনৈতিক বিষয়: জহুর আহমেদ চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ স্বাক্ষরিত আরেকটি সরকারি আদেশে (G.O.) পশ্চিমঅঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল দুটিতে দ্বিখণ্ডিত করে নতুন আরও দুটি অঞ্চল সৃষ্টি করা হয় (পরিশিষ্ট ১০৭ দ্রষ্টব্য)। এ দুটি হলাে পশ্চিম-অঞ্চল -২ ও দক্ষিণ-পশ্চিম-২। অতএব সেপ্টেম্বর মাস নাগাদ আঞ্চলিক পরিষদের সংখ্যা দাঁড়ায় ১১টিতে।
আঞ্চলিক পরিষদে চেয়ারম্যান নির্বাচনের বিধান থাকায় সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে ৯টি অঞ্চল থেকে আমাদের কাছে নির্বাচনের ফলাফল পাঠানাে হয়। কোথাও আবার নির্বাচন স্থগিত, কোথাও দ্বিমত পােষণ করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ—এই ধরনের প্রতিবেদন (report) আমরা পাই। নিচের প্রতিবেদন (১৩.১১.৭১) লক্ষণীয়।
অঞ্চল ফলাফল/চেয়ারম্যান
১. দক্ষিণ-পূর্ব -১ : নির্বাচন স্থগিত
২. দক্ষিণ-পূর্ব -২ : নির্বাচন স্থগিত
৩. পূর্ব-অঞ্চল : কর্নেল এম. এ. রব, এম.এন.এ, সভাপতি; মােস্তফা আলী, এম. এন. এ, সহ-সভাপতি
৪. উত্তর-পূর্ব অঞ্চল -১ : দেওয়ান ফরিদ গাজী, এম.এন.এ
৫. উত্তর-পূর্ব অঞ্চল -২ : শামসুর রহমান খান, এম.এন.এ
৬. উত্তর-অঞ্চল : মতিউর রহমান, এম.এন.এ
৭. পশ্চিম-অঞ্চল : স্থগিত। এই অঞ্চলকে বিভক্ত করে জেলা ভিত্তিতে তিনটি নতুন অঞ্চল গঠনের প্রস্তাব।
পৃষ্ঠা: ১৭৫
৮. দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল: একই সিদ্ধান্ত।
৯. দক্ষিণ-অঞ্চল : আঞ্চলিক পরিষদের দায়িত্ব ও কর্মপরিধি সম্পর্কে দ্বিমত পােষণ করেন
আঞ্চলিক পরিষদের (Zonal Council-এর) সভাপতি নির্বাচনের বিধান ছিল; সহসভাপতি বা Vice Chairman-এর নয়। নির্বাচনমণ্ডলী ছিলেন সংশ্লিষ্ট এলাকার এম.এন.এ. ও এম.পি.এ.-বৃন্দ। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নানারকম বিরােধ ও ভিন্নমত দেখা দেয়। উদাহরণস্বরূপ একটি দৃষ্টান্ত উল্লেখ করা হলাে। পূর্ব-অঞ্চলে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন কর্নেল রব; একই সাথে মােস্তফা আলী, এম.এন.এ. সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন। বিধান না-থাকায় আঞ্চলিক পরিষদ একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে মন্ত্রিসভার অনুমােদনের জন্য প্রেরণ করেন। (পরিশিষ্ট ১০৮ দ্রষ্টব্য)।
বিভিন্ন প্রস্তাবনা এবং পরামর্শের ভিত্তিতে মন্ত্রিসভা নতুন দুটি অঞ্চল সৃষ্টি করেন। মােট ১১টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ গঠন ও নির্বাচন সম্পন্ন হওয়ার পর সরকার একটি পূর্ণাঙ্গ সারণী (chart) প্রকাশ করেন সেপ্টেম্বর মাসের শেষে।
সারণী
এক নজরে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ
ক্রমিক অঞ্চলের নাম অন্তর্ভুক্ত জেলার নাম ১. চেয়ারম্যান
২. সচিব/প্রশাসনিক কর্মকর্তা
১ দক্ষিণ-পূর্ব (সাব্রুম)-১ অঞ্চল চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম,
ফেনী মহকুমা ১. নূরুল ইসলাম চৌধুরী
২. এস.এ. সামাদ
২ দক্ষিণ-পূর্ব (আগরতলা)-২ অঞ্চল ঢাকা, কুমিল্লা, নােয়াখালী
(ফেনী ব্যতীত) ১. জহুর আহমদ চৌধুরী
২. কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ
৩ পূর্ব-অঞ্চল (ধর্মনগর) হবিগঞ্জ ও মৌলভীবাজার
(সিলেট জেলা) ১. কর্নেল এম.এ.রব,
২. ড. কে.এ. হাসান
৪ উত্তর-পূর্ব-অঞ্চল-১ (ডাউকি শিলং) সদর এবং সুনামগঞ্জ
(সিলেট জেলা) ১. দেওয়ান ফরিদ গাজী
২. এস.এইচ. চৌধুরী
৫ উত্তর-পূর্ব-অঞ্চল-২ (তুরা) ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল ১. শামসুর রহমান খান
২. লুৎফর রহমান
৬ উত্তর-অঞ্চল (কুচবিহার) রংপুর ১. মতিউর রহমান
২. ফয়েজ উদ্দীন আহমদ
৭ পশ্চিম অঞ্চল-১ (বালুরঘাট) দিনাজপুর এবং বগুড়া ১. আবদুর রহিম
২. এম.এ.কাশেম খান
৮ পশ্চিম-অঞ্চল-২ (মালদহ) রাজশাহী ১. আশরাফুল ইসলাম
২. জেড. আই. ভূঁইয়া
৯ দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল-১ পাবনা-কুষ্টিয়া ১. এম.এ. রব চৌধুরী
২. শামসুল হক
১০ দক্ষিণ-পশ্চিম-অঞ্চল-২ (বনগাঁও) যশাের-ফরিদপুর ১. ফণিভূষণ মজুমদার
২. বি. বিশ্বাস
১১ দক্ষিণ অঞ্চল (বারাসাত) বরিশাল-পটুয়াখালী ১. এম. এ. মােমেন
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, উপযুক্ত প্রতিটি অঞ্চলে আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ (Zonal Administrative Council) গঠিত হয়। এসব আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের দায়িত্ব ও কাজের আওতা সুনির্দিষ্টভাবে নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। অধিকন্তু, আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের অর্থ, ত্রাণ, স্বাস্থ্য, প্রচারণা ও শিক্ষা সংশ্লিষ্ট কাজ সুচারুরূপে সম্পন্ন করতে উপকমিটি গঠন করা হয়। উপকমিটির সদস্যসংখ্যা ৩ জনের কম বা ৭ জনের অধিক ছিল না। এসব সদস্যের মধ্য থেকে একজন চেয়ারম্যান হতেন এবং আঞ্চলিক কর্মকর্তা (Zonal officer) উপকমিটির সদস্য-সচিব হিসেবে কাজ করতেন।
প্রতিটি প্রশাসনিক অঞ্চলে আঞ্চলিক কর্মকর্তাগণকে সরকারের সংশ্লিষ্ট ডিপার্টমেন্ট নিয়ােগ দিতেন। সকল অঞ্চলের (Zone-এর) অর্থ-সংক্রান্ত সকল বিষয় আঞ্চলিক অর্থবিষয়ক উপকমিটি দেখাশােনা করত। প্রতি অঞ্চলে এই কমিটির সদস্যসংখ্যা ছিল ৫ জন করে। আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদের চেয়ারম্যান ও আঞ্চলিক প্রশাসনিক কর্মকর্তা অর্থবিষয়ক উপকমিটির পদাধিকার বলে (ex-officio) সদস্য থাকতেন এবং অবশিষ্ট ৩ জনকে পরিষদের সদস্যদের মধ্য থেকে নির্বাচিত করা হতাে। মাসিক ভিত্তিতে সরকার খরচের খাতওয়ারি বরাদ্দ ছাড় (release) করতেন। কোনাে খাতের ব্যয় পূর্বানুমতি গ্রহণ ছাড়া বরাদ্দকৃত পরিমাণের অতিরিক্ত ব্যয় করার উপায় ছিল না। আঞ্চলিক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা সরকারের অর্থবিধি (Financial Rules) অনুসারে প্রতিটি হিসাবের যথাযথ বিবরণ রাখতেন। প্রত্যেক মাসে অন্তত একবার অর্থ-বিভাগ কর্তৃক নিযুক্ত অডিটর দ্বারা হিসাব নিরীক্ষিত করিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা ছিল। হিসাবের পাক্ষিক বিবরণী মন্ত্রীসভায় উপস্থাপনের জন্য অর্থ-বিভাগের নিকট প্রেরণ করতে হতাে।
২৭ জুলাই তারিখে প্রেরিত সরকারের একটি মেমােতে আঞ্চলিক পরিষদের কর্মপরিধি, দায়িত্ব, ক্ষমতা, আঞ্চলিক কর্মকর্তা নিয়ােগ- এই সমস্ত বিষয়ে নির্দেশ দেওয়া থাকলেও নবগঠিত পরিষদের অনেকেরই প্রশাসনিক রীতি-নীতি সম্পর্কে কোনাে ধারণা না-থাকায় তারা অনেক বিষয়েই মুজিবনগরে পত্রালাপ করতেন, না হয় নিজেরাই ক্ষমতা-বহির্ভূত আদেশ-নির্দেশ দিতেন।
২৯ অক্টোবর সাধারণ প্রশাসন বিভাগ (General Administration Department)-এর। সচিব মন্ত্রিসভায়, এ-বিষয়ে একটি সার-সংক্ষেপ পেশ করেন। এতে দেখা যায় যে, ঐ সময় পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদন ব্যতীত প্রথম শ্রেণীর পদে বিভাগীয় প্রধানরা নিয়ােগ দিয়েছেন; সাধারণ প্রশাসন বিভাগের অবগতি ছাড়াই দ্বিতীয় শ্রেণীতে নিয়ােগ দেওয়া হয়েছে। উপরন্তু এমন কিছু পদে নিয়ােগ প্রদান করা হয়েছে, যে পদের অনুমােদন আদৌ ছিল না।
আঞ্চলিক (Zonal) অফিসে মােট ৭ জন প্রথম শ্রেণীর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার নিয়ােগের কথা ছিল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রকৌশলী, ত্রাণ, তথ্য-এই ৭ জন জেলা-পর্যায়ের কর্মকর্তা মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে নিয়ােজিত হবেন। এই হিসেবে ১১টি আঞ্চলিক পরিষদে ৭৭ (১১X৭ =৭৭) জন অফিসার নিয়ােগের কথা। অক্টোবর ২৯ তারিখ পর্যন্ত নিয়ােজিত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদন-প্রাপ্ত, কিন্তু কাজে যােগ দিতে পারেননি, যেহেতু কয়েকটি পরিষদে পূর্ণাঙ্গরূপে কাজ বিলম্বিত হচ্ছিল; ৩০টি পদের নিয়ােগ প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন ছিল। সাধারণ প্রশাসন বিভাগের প্রতিবেদনে দেখা যায় যে, পরিষদসমূহ ২৫ জন বিভিন্ন পর্যায়ের অফিসার সরাসরি নিয়ােগ করেছিলেন যাদের জন্য সরকারি অনুমােদন বিবেচনাধীন ছিল।
সার-সংক্ষেপ আরও দেখা যায় যে, ৪ জন প্রথম শ্রেণীর ও ২৫ জন দ্বিতীয় শ্রেণীর কর্মকর্তা অনিয়মিতভাবে আঞ্চলিক পরিষদে নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। এদের নিয়মিত করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। বিভিন্ন অধিদপ্তরে উল্লেখযােগ্য সংখ্যক কর্মকর্তাকে অনুমােদন ব্যতীত পদোন্নতি দেওয়া হয়, যথা:
ক. পুলিশ – ৮ জন
খ. অর্থবিভাগ – ৮ জন
গ. প্রতিরক্ষা – ১ জন
ঘ. স্বাস্থ্য-প্রথম শ্রেণী ৩ জন ও দ্বিতীয় শ্রেণী ১ জন
এই সমস্ত নিয়ােগ ও পদোন্নতি নিয়মিতকরণের পর স্বভাবতই আমাদের আর্থিক সঙ্গতির ওপর চাপ পড়ে। তথাপি আঞ্চলিক প্রশাসনকে শক্তিশালী ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার স্বার্থে এই নিয়ােগগুলি সরকারি আদেশ দ্বারা নিয়মিত করা হয়। এতে প্রশাসনে শৃঙ্খলা প্রবর্তিত ও গতি সঞ্চারিত হয়। একটি কথা বলা অত্যন্ত প্রয়ােজন যে, আঞ্চলিক পরিষদ এবং প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণ বাংলাদেশ সরকার উদ্ভাবিত এবং সৃষ্ট। তাই এর ব্যয়ভার বহনও ছিল আমাদের নিজস্ব সম্পদ থেকে।
আঞ্চলিক পরিষদের সংগঠন এবং কার্যক্রম সম্বন্ধে একটি চিত্র এ-প্রসঙ্গে তুলে ধরা যায়। এজন্য একটি প্রতিনিধিত্বমূলক অঞ্চল বেছে নেওয়া যেতে পারে। এরকম বাছাইকৃত (বা মডেল) অঞ্চল ধরলে সকল বিবেচনায় পূর্বাঞ্চল অগ্রগণ্য, বিশেষ কয়েকটি কারণে:
ক. সামরিক তৎপরতা পূর্বাঞ্চলে সর্বাপেক্ষা বেশি ছিল। এই অঞ্চলের অন্তর্গত ছিল ৩টি সেক্টর এবং সামরিক বাহিনীর তিন বীর সেনানায়ক এসব সেক্টরে সক্রিয় ছিলেন। মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর সফিউল্লাহ এবং তাদের সাথে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ও মেজর মীর শওকত আলী ত্রিপুরা রাজ্যের (আমাদের পূর্বাঞ্চলে) বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে পাকিস্তানি বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছিলেন। প্রথম তিন সেনা-কর্মকর্তার নামের ইংরেজি আদ্যক্ষর নিয়ে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর তিনটি ফোর্স (জেড. কে এবং এস ফোর্স) গঠিত হয়।
খ. এককভাবে এই অঞ্চলে ২৭৬টি শিবির স্থাপিত হয় এবং এসব শিবিরে শরণার্থীর সংখ্যা ছিল ৮,৩৪,০৯৮ জন। এছাড়াও শিবিরের বাইরে এই এলাকায় আরাে ৫,৪৭,৫৫১ জন শরণার্থী ছিল। সর্বমােট শরণার্থীর সংখ্যা (১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত) দাঁড়ায় মােট ১৩,৮১,৬৪৯ জন। এই পরিসংখ্যান ‘বাংলাদেশ ফাউন্ডেশন ফর ডেভেলপমেন্ট রিচার্স’ কর্তৃক প্রকাশত থিমেটিক ম্যাপেও (মুক্তিযুদ্ধ; শরণার্থী শিবির) উল্লেখ করা হয়েছে। বলা যায় এলাকা এবং জনসংখ্যার তুলনায় সীমান্তবর্তী অন্যান্য এলাকার শরণার্থী অপেক্ষা এই অঞ্চলে শরণার্থী বেশি।
গ. পূর্বঞ্চলেই গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও সামাজিক নেতৃবৃন্দ এবং বুদ্ধিজীবীর সমাবেশ সর্বাধিক ছিল—ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম, নােয়াখালী জেলার।
ঘ. এই অঞ্চলই (zone-ই) মুক্তিযুদ্ধ সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ কাজ শুরু করে ঢাকায় পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের সঙ্গে সঙ্গে।
ঙ. এখানেই যুবশিবিরের উৎপত্তি ও ক্রমবিকাশ।
যুবশিবির: মুক্তিযুদ্ধে ভূমিকা
যুবশিবির সম্পর্কে প্রথম চিন্তাভাবনা করেন ড. আবু ইউসুফ (ওরফে ড. হাবিবুর রহমান) মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে, আগরতলায়। তার ধ্যানধারণা (concept) ছিল সহজ-সরল, কিন্তু তা ছিল যুক্তিপূর্ণ। ভারতে আগত শরণার্থীদের সে দেশের সরকার আশ্রয়, খাদ্য, চিকিৎসা দিচ্ছিলেন। সেজন্য প্রয়ােজন ছিল বিপুলসংখ্যক তাবু, খাবার, রেশন এবং সামান্য কিছু অর্থসাহায্য। আমাদের সরকারের তরফ থেকেও সাধ্যমতাে সবরকম সাহায্য করা হচ্ছিল। এই শরণার্থীদের মধ্যে বিরাট একটি অংশ ছিল ছাত্র, যুবক, শ্রমিক, কৃষক, বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক কর্মী (আওয়ামী লীগ/ছাত্রলীগের সংখ্যা ছিল সর্বাধিক)। এরা আশ্রয়ের জন্য ভারতে যায়নি, গিয়েছিল দেশমাতৃকার ডাকে, দেশকে মুক্ত করার লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করতে। তার জন্য প্রয়ােজন শৃঙ্খলাবােধ, প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র। প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র দিলেই শেষ নয়- তার চেয়ে বড় বিষয় শৃঙ্খলাবােধ থেকে নিয়ম-নীতির মধ্যে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ। আরেক কথায়, একটি শৃঙ্খলা-ক্রমে (Chain of Command) থেকে নির্ধারিত সমরকৌশল অবলম্বন করে যুদ্ধ।
যে-ধারণাটি ড. আবু ইউসুফ (প্রফেসর ইউসুফ আলী নন) উপস্থাপন করলেন তা ছিল নিম্নরূপ:
ক. আশ্রয় গ্রহণকারী জনসংখ্যার মধ্যে যারা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে ইচ্ছুক তাদের জন্য ভিন্ন শিবির স্থাপন;
খ. প্রথম স্তরে যে-শিবিরে তাদের নেওয়া হবে সেগুলাে হবে অভ্যর্থনা-শিবির (Reception Camp)। এখানে তাদের দেওয়া হবে শারীরিক শিক্ষা (Physical training)। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধকরণ প্রশিক্ষণ (motivstion) এবং শৃঙ্খলাবোেধ (discipline)।
গ. প্রশিক্ষণ শেষে বাছাই করে যে যে-রকম উপযুক্ত সেইভাবে নিয়ােগ করা হবে। একদল যাবে মূল বাহিনীতে (base training); আরেক দল যাবে নিয়মিত বাহিনীর (regular force) সাথে উপযুক্ত প্রশিক্ষণ নিতে; কোনাে দল যাবে তথ্য সংগ্রহ ও রেকি (intelligence reconaissance) করতে; অন্য আরেকটি বিশেষ দলকে, যারা ছাত্রলীগের সদস্য, তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ছাত্র-যুবনেতাদের কমান্ডে।
ঘ. ভারত-সরকারের জন্য এটি কোনাে অতিরিক্ত বােঝা হবে না, বাড়তি খরচও হবে না। যে তাবু আর রেশন ছেলেরা পেত শরণার্থী-শিবিরে, সেগুলােকেই অন্যত্র সরিয়ে পৃথক অভ্যর্থনা-শিবিরে সরবরাহ করলেই চলবে।
ঙ. উদ্বুদ্ধকরণ (movivation) এবং শৃঙ্খলা সম্বন্ধে জ্ঞানদান ও শিক্ষা দেওয়ার দায়িত্ব আমাদের।
চ. পরবর্তীকালে মিলিটারি প্রশিক্ষণ (অধিকাংশই গেরিলা) এবং অস্ত্র সরবরাহ করার দায়িত্ব থাকবে আমাদের ও ভারত-সরকারের উপর যৌথভাবে। সেক্টর কমান্ডাররা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করবেন।
১৯৭১ সালে আমরা আগরতলায় থাকার সময় (মে-জুন মাসেই) স্থানীয়ভাবে রাজ্যসরকারের সহায়তায় এবং আর্মি-কমান্ড ও বি. এস. এফ. (B.S.F)-এর সাহায্যে যুব অভ্যর্থনা শিবির স্থাপন ও পরিচালনা শুরু করি। মিসেস গান্ধীর আগরতলা সফরকালে তার সাথে সাক্ষাৎকারের সময় অন্যান্য অনুরােধের মধে এটি ছিল অন্যতম। আমাদের চিন্তাভাবনা সম্বন্ধে তাকে জানালে তিনি সানন্দে তাতে সম্মতি দেন। কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের সরকার (মুজিবনগরে) এটি অনুমােদন করেন এবং যুবশিবির দপ্তর স্থাপন করা হয়। এটি প্রফেসর ইউসুফ আলীর নেতৃত্বে একটি বাের্ডের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে সরকারের অঙ্গসংগঠনে পরিণত হয়। মন্ত্রিসভার বিভিন্ন বৈঠকে যুবশিবির সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যা নিচে ক্রমানুসারে উল্লেখ করলাম। এতে যুবশিবিরের ক্রমবিবর্তন ও সম্প্রসারণ কীভাবে ঘটেছে তা বােঝা যাবে।
মে মাসে যখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী আগরতলায় গিয়েছিলেন, অন্যান্য লােকজন নিয়ে তখন আমি, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর ও মাহবুব আলম চাষীও আমাদের যুবশিবির পরিদর্শনে গিয়েছিলাম। এ মাসে যুবশিবির প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে অত্যন্ত তাৎপর্যময় ঘটনা ঘটে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী আগরতলা সফরে এসে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলকে রাজভবনে (গভর্নর হাউসে) সাক্ষাৎকার প্রদান করেছিলেন। ড. এ. আর. মল্লিক, প্রফেসর আলী আহসান, কাজী জহিরুল কাইউম প্রমুখের সঙ্গে আমিও ছিলাম দলে। ড. মল্লিক এবং আমি বক্তব্য রাখি। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর নিকট আমরা দুটো প্রস্তাব রেখেছিলাম। প্রস্তাব দুটোর একটি: শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার স্থাপন করে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করা এবং দ্বিতীয়ত যুবশিবির স্থাপন সংক্রান্ত অপর একটি প্রস্তাব। অবশ্য এ দুটো প্রস্তাবের সঙ্গে অন্যান্য গঠনমূলক প্রস্তাবও আমরা রেখেছিলাম। মিসেস গান্ধী, উল্লেখিত প্রস্ত বি দুটোয় সম্মতি প্রদান করছিলেন। ফলে, যুবশিবির ব্যবস্থা সুসংগঠিত করা সম্ভব হয়েছিল।
প্রসঙ্গক্রমে আরেকটি বিষয় উল্লেখ করতে চাই। শরণার্থী শিবির থেকেই যুবশিবিরের উৎপত্তি। তাই স্বাভাবিক কারণে যুবশিবিরের নিয়ন্ত্রণ প্রথমে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের (শহীদ কামারুজ্জামান মন্ত্রীর) অধীন ছিল। প্রফেসর ইউসুফ আলী যুবশিবির বাের্ডের চেয়ারম্যান হলে এটি মােটামুটিভাবে একটি স্বাতন্ত্র লাভ করে। কিন্তু যেহেতু মূল উদ্দেশ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ, সেহেতু প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় যুবশিবিরের সাথে অত্যন্ত ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত ছিল। বিভিন্ন সিদ্ধান্ত, পত্রালাপ, দলিলপত্র পরিশিষ্ট দেওয়া আছে। তাতেই এর প্রমাণ মিলবে। প্রাসঙ্গিকভাবে আরাে একটি বিষয় উল্লেখ্য। স্থানীয় বা আঞ্চলিকভাবে (zone-এ) যুবশিবির স্থাপিত হওয়ায় এগুলাে ছিল মাঠপর্যায়ের সংগঠন (grassroot organization)। আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal council) চেয়ারম্যান এবং স্থানীয় বাংলাদেশ প্রশাসনের হাতে অনেক কর্তৃত্ব ছেড়ে দেওয়া হয়েছিল। প্রত্যেক জোনাল কাউন্সিল যুবশিবির পরিচালনায় একটি করে কমিটি থাকত। কেন্দ্রে যেভাবে যুবশিবির পরিচালনা বাের্ড ছিল, ঠিক ঐভাবে প্রতিটি জোনে যুবশিবির পরিচালনা বাের্ড ছিল, যার সদস্যদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা থাকত। এঁরা অধিকাংশই ছিলেন নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, এম. এন. এ., এম.পি.এ.। স্থানীয়ভাবে সেক্টর কমান্ডারগণ (sector commanders) ব্যাপকভাবে খোজ খবর নিতেন ও প্রয়ােজনে তদারকি করতেন তাঁদের নিজ প্রয়ােজনে। সামরিক বাহিনীর কমর্থনে বিশাল গেরিলা বাহিনীর প্রয়ােজনীয়তা ছিল অপরিসীম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে, আনাচে-কানাচে, বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনায় (key point installetion) অপারেশন করতে যেত গেরিলা বাহিনী। তাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ, কৌশলগত নির্দেশনা (tactical
পৃষ্ঠা: ১৮০
guidance) এবং কোনাে-কোনাে ক্ষেত্রে নেতৃত্ব দিতেন সেক্টর (sector) বা সাব-সেক্টর (subsector) কমান্ডার অথবা সামরিক বাহিনীর অফিসারগণ।
যুবশিবির সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত
মন্ত্রিসভায় যুবশিবির পরিকল্পনা সম্বন্ধে প্রথম আলােচনা হয় ২২ জুনের (১৯৭১) সভায়। প্রধানমন্ত্রী আলােচনার বিষয়বস্তু সংক্ষেপে স্বহস্তে এইভাবে সিদ্ধান্তটি লিপিবদ্ধ করেন:
৪। যুবশিবির সংস্থা মাত্র একটি মাধ্যমে সমন্বয় করা হবে; ব্যক্তিগত পর্যায়ে কেউ এই চেষ্টা করবেন না যাতে সঙ্গতি নষ্ট হয়। পােশাক এবং হেলমেটের সমস্যা।
ক. যুবশিবির পরিকল্পনা/ছক অনুমােদন করা হলাে।
খ. পরিবর্তিত আকারে যুবশিবির প্রকল্প চূড়ান্তভাবে অনুমােদিত।
২৯ জুলাই (প্রধানমন্ত্রীর নিজ হাতে লেখা নােট):
সকলেই উপস্থিত। প্রফেসর ইউসুফ আলী বিশেষভাবে আমন্ত্রিত। প্রফেসর ইউসুফ আলী ত্রাণ ও পুনর্বাসন এবং যুবশিবিরের উপর তার প্রতিবেদন উপস্থাপন করলেন।
পরের লাইনে লেখা:
১. যুবশিবির বিশেষ সময় (zero hour)
আমার যতদূর মনে পড়ে কয়েকটি শিবির বন্ধ এবং অপর কয়েকটি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, কিন্তু বিস্তারিত লেখা নেই কিছু।
মন্ত্রিসভায় যুবশিবির সংক্রন্ত আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত ৯ আগস্ট তারিখে গৃহীত হয়।
১. যুবশিবির: অভ্যর্থনা শিবিরগুলি বাংলাদেশ সরকার দেখাশুনা করবে।
যেহেতু পূর্বাঞ্চলেই যুবশিবিরের সূচনা এবং ঢাকা, কুমিল্লা, নােয়াখালি, চট্টগ্রাম এবং সিলেট থেকে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক যুবশ্রেণী সমবেত হচ্ছিলেন ত্রিপুরা রাজ্যে, সেজন্য প্রথম কটি মাস এখানকার শিবিরগুলি বেশি তৎপর ছিল। এর ওপর ত্রিপুরা-রাজ্যে বড় সমাবেশ ঘটেছিল উপরােক্ত জেলাগুলির নেতৃবৃন্দের। ঐ সময়কার কয়েকটি প্রতিবেদন, চিঠিপত্র ইত্যাদি দেখলেই বােঝা যাবে কত গুরুত্বের সাথে যুবশিবিরগুলি পরিচালিত হতাে।
প্রাথমিক পর্যায়ে পূর্বাঞ্চলে সংগঠিত যুবশিবিরগুলি কোথায় কিভাবে, কার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়েছিল তার একটি সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে তুলে ধরা হলাে:
২৩ আগস্ট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একটি সিদ্ধান্তে যুবশিবির সম্বন্ধে বলা হয় যে, দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিনিধিবৃন্দ সঠিকভাবে কাজ না-করায় শিবিরগুলিতে বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়েছে।
২৮ মে তারিখে মাহবুব আলম সাহেব (ডিরেক্টর, ইয়ুথ ক্যাম্প-এই পরিচয়ে) গান্ধী পিস ফাউন্ডেশন(Gandhi Peace Foundation)-এর সচিবকে একটি চিঠি লেখেন। বিষয়: গ্রাম পর্যায়ে কাজের জন্য যুবশ্রেণি নিয়ােগে সহায়তা(পরিশিষ্ট-১০৯ দ্রষ্টব্য। এতে দেখা যায় যে গ্রাম-ভিত্তিক সংগঠন করার জন্য পূর্বাঞ্চলে যুবশিবির স্থাপিত হচ্ছে। পশ্চিম-অঞ্চলে ইতােমধ্যেই গান্ধী শান্তি পরিষদএইরকম কাজে সাহায্য করছিলেন বিধায় একই পাঠ্যক্রম এবং যােগ্যতাসম্পন্ন প্রশিক্ষক দিয়ে স্থানীয়ভাবে শিবির পরিচালনা করে যাবার প্রস্তাব রাখা হয়। একমাসব্যাপী প্রশিক্ষণে মাথাপিছু ২০০ রুপি করে ১০০ জন প্রশিক্ষণার্থীর জন্য ২০,০০০ রুপি চাওয়া হয় (প্রতি শিবিরে ১০০ জন হিসেবে)।
এর পরের মেমােটি (memo) ছিল এম. আর. সিদ্দিকী সাহেবের দস্তখতে (Memberin-charge, Finance) বিষয়বস্তু দেখে অনুমান করা যায় এটি পূর্বাঞ্চলের যুবশিবির-প্রধানকে লেখা। এতে অনুরােধ করা হয়েছে যে শিবিরগুলি পরিদর্শনকালে ক্যাম্পের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা যেন নির্ধারিত ছকে কতকগুলি তথ্য সরবরাহ করেন। এতে আমরা পূর্বাঞ্চলের যুবশিবিরগুলির একটি সম্পূর্ণ চিত্র পাই (পরিশিষ্ট-১১০ দ্রষ্টব্য।)।
জুন মাসে মােট ১৭টি শিবিরে ভারপ্রাপ্ত সবাই ছিলেন জাতীয় অথবা প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য, দু-একজন ব্যতীত (একজন এম. এ. হান্নান, জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি এবং আরেকজন অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন)। শিবিরগুলিতে সদস্য ছিলেন ৪৮৫০ জন, ৮টি জেলা থেকে আগত। নির্ধারিত ছকে একটি শিবিরের কর্মকর্তাদের বিবরণ পাওয়া যায়। তারা শিবিরগুলিতে অবস্থান করতেন। ১৯.৬.১৯৭১ তারিখে পূরণকৃত একটি ছকে দেখা যায় যে সেখানকার শিবিরপ্রধান ছিলেন এম. এ. হান্নান এবং তাঁর সহকারী ছিলেন এম. এ. মান্নান, ক্যাম্প-সুপারভাইজার ছিলেন জি. এ. প্রসাদনাথ (মন্টো), রাজনৈতিক প্রশিক্ষক আজিজুল হক (অ্যাডভােকেট), প্রফেসর নূরুল আবসার ও প্রফেসর নূর মােহাম্মদ, ছাত্র প্রতিনিধি এম. এ. হাশেম আর ডাক্তার ছিলেন ডা. রেজা।
পূর্বাঞ্চলের প্রশাসক রূপে ২৫.৬.৭১ তারিখে আমি একটি মেমাে (পরিশিষ্ট-১১১ দ্রষ্টব্য) জারি করি। এতে দেখা যায় অর্থমন্ত্রী একটি প্রশাসনিক কাঠামাে অনুমােদন করেন। এতে আঞ্চলিক প্রশাসন ছাড়াও যুবশিবির ব্যবস্থাপনারও অনুমােদন দেওয়া হয়। যুবশিবির কমিটি কাউন্সিলের সাথেই কাজ করত এবং এদের ব্যবস্থাপনা ও কর্মকাণ্ড আঞ্চলিক পরিষদ (Zonal Council) সমন্বয় করত। এই সময়ে অর্থাৎ জুনে যুবশিবির পরিচালনায় ছিলেন নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ:
১. প্রফেসর নূরুল ইসলাম চৌধুরী এম. এন. এ., ডিরেক্টর, প্রশাসন;
২. ড. আবু ইউসুফ, ডিরেক্টর, সিলেবাস ও কর্মসূচি
৩. জনাব মির্জা আবু মনসুর, এম. পি. এ., উপ-পরিচালক, সরবরাহ;
৪. জনাব বজলুর রহমান, উপ-পরিচালক, চলাচল;
৫. জনাব ফারুকী, এম. পি. এ., উপ-পরিচালক, প্রশাসন।
এছাড়া আরও কর্মকর্তা ছিলেন। পূর্ব-অঞ্চলের (Eastern Sector-এর) প্রধান হিসাবরক্ষক (Chief Accountant), এ. কে. চৌধুরী। ২৭.৭.৭১ তারিখের প্রতিবেদন অনুযায়ী দেখা যায় যে, জুলাই মাসে ঐ অঞ্চলে যুবশিবিরের সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ৩৩-এ উপনীত হয়েছে। তালিকা নিচে দেওয়া হলাে:
যুবশিবিরের তালিকা: জুলাই ১৯৭১
১. বক্সনগর
২. বেদতলী
৩. চারিপাড়া
৪. কংগ্রেস ভবন
৫. চোটাখােলা
৬. ধর্মনগর
৭. দুর্গা চৌধুরীপাড়া-বিজনা
৮. ঐ – গুমতি
৯. ঐ – ইছামতি
১০. গােকুলনগর
১১. ঐ
১২. ঐ
১৩. হরিণা
১৪. হাতিমারা
১৫. হাপানিয়া।
১৬. ঐ – ব্রহ্মপুত্র
১৭. ঐ – গুমতি
১৮. ঐ – যমুনা
১৯. হাপানিয়া – তিতাস
২০. জয়নগর
২১. কাঁঠালিয়া (বড়মুরা)
২২. কৈলাশহর
২৩. খােয়াই
২৪. মেলাঘর
২৫. মােহনপুর
২৬. মােতিনগর
২৭. পালাটোনা
২৮. পাথরকান্দী
২৯. রাজনগর (রাধানগর)
৩০. শিলাছড়া
৩১. শ্রীনগর
৩২. উদয়পুর
ইতােমধ্যে এই অঞ্চলের যুবশিবির পরিচালনা বাের্ড-ও সম্প্রসারিত হয়েছিল নিম্নলিখিতভাবে:
১. কেন্দ্রীয় প্রশাসন: প্রফেসর নূরুল ইসলাম, এম. এন. এ.
২. প্রশিক্ষণ এবং সমন্বয়: ড. আবু ইউসুফ (Geology-Ph.D.)
৩. কেন্দ্রীয় সরবরাহ: জনাব মির্জা আবু মনসুর, এম. পি. এ.
৪. চলাচল/তৎপরতা: জনাব বজলুর রহমান
৫. মেডিকেল: ড. এম. এ. মান্নান, এম.পি.এ.
৬. নতুন ভর্তি (recruitment)
৭. ছাত্রদের বিষয়াবলি: জনাব আ.স.ম. আবদুর রব
৮. কর্নেল চৌমুহনী অফিস: জনাব আবদুল লতিফ খান
(আগরতলা শহর)
জুলাইয়ের শেষভাগে চার শ্রেণীর শিবির স্থাপিত ও পরিচালিত হচ্ছিল যেমন:
ক. অভ্যর্থনা (Reception), খ. উদ্বুদ্ধকরণ (Motivaton), গ. প্রশিক্ষণ (Training) ও ঘ. নিয়মিত বাহিনীর সাথে।
একাত্মকরণ (Induction)
একটি শিবিরে কী কী নির্মাণসামগ্রী, ব্যবহার্য জিনিসপত্র, আসবাব এবং অন্যান্য জিনিস প্রয়ােজন ও সরবরাহ করা হতাে তার বিস্তারিত তালিকা পাওয়া যাবে প্রধান হিসাবরক্ষক (Chief Accountant) এ. কে. চৌধুরীর দেওয়া শিডিউলে।
যুবশিবির হেডকোয়ার্টারে অবস্থিত পরিচালকের দফতর থেকে ২৪ আগস্ট ওয়াইসি/রিপাের্ট/৯/১৯(২) সংখ্যক অতিগােপনীয় স্মারক মারফত ১ সেপ্টেম্বর তারিখ থেকে যুবকদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার কর্মসূচির সিদ্ধান্ত জানানাে হয়। এই স্মারকের কপি প্রতিরক্ষামন্ত্রী ও বাংলাদেশ সরকারের ডেপুটি চিপ অব স্টাফের নিকটও পাঠানাে হয়। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী প্রতিমাসে ২০,০০০ যুবককে প্রশিক্ষণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা হবে বলে জানা যায়। প্রশিক্ষণের পূর্ববর্তী কর্মসূচিতে আংশিক সংশােধন করে এই কর্মসূচি প্রণীত হয়েছিল। (পরিশিষ্ট-১১২ দ্রষ্টব্য।)
ত্রিপুরা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীকে লিখিত ২৬.৭.৭১ তারিখের একটি চিঠিতে দেখা যায় যুবশিবির প্রশাসনের পক্ষে কতকগুলি আবেদন করা হয়েছে; যেমন: চিকিৎসার ব্যবস্থা, দুগরী প্রতাপঘর নামক স্থানে নতুন শিবির অনুমােদন, মেয়েদের অভ্যর্থনার জন্য পৃথক ব্যবস্থা এবং তাদের নার্সিং ইনস্টিটিউট-এ ভর্তির ব্যবস্থা, নতুন তিনটি শিবির (কমলপুর, কৈলা শহর এবং ধর্মনগর) উদ্বোধন, শিবিরে যাওয়ার রাস্তা মেরামত, প্রতি যুবককে রাজ্য-সরকার প্রতিশ্রুত ৪০০ গ্রাম চাল এবং নগদ অর্থ প্রদান ইত্যাদি। এতে একটি জিনিস বেশ পরিষ্কার যে, যুদ্ধপরিচালনা ও যুবশিবির ইত্যাদি বিষয়ে আমাদের কর্মকর্তাবৃন্দ অনেকেই কোনাে আচরণবিধি (protocol) মানতেন না। তার ফলে বেশ অসুবিধা হতাে কোনাে-কোনাে সময়।
যুবশিবিরের বাের্ড অব কন্ট্রোলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীর স্বাক্ষরিত ২০-৯-৭১ তারিখে ৬৩(১৮) সংখ্যক স্মারক থেকে দেখা যায় যে, বাের্ড অব কন্ট্রোল, যুবশিবির ও কেন্দ্রীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন কমিটির যৌথসভা অনুষ্ঠিত হতাে। এমন একটি মুলতবি সভা ১৫-৯-৭১ তারিখ বিকেল ৫টায় অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা থাকলেও তা ২১-৯-৭১ তারিখ বিকেল ৪টায় অনুষ্ঠিত হবে বলে উক্ত স্মারকে উল্লেখ করা হয় (পরিশিষ্ট-১১৩ দ্রষ্টব্য)।
প্রতিরক্ষা সচিব নভেম্বর মাসে মন্ত্রিসভার বিবেচনা ও জরুরি সিদ্ধান্তের জন্য একটি সার-সংক্ষেপ পেশ করেন। বিষয়বস্তু এইরকম:
১. ঐ সময় বিভিন্ন অভ্যর্থনা শিবিরে ১ লক্ষ এবং যুবশিবিরে ২০,০০০ হাজার যুবক অপেক্ষমাণ ছিল।
২. ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ১ লক্ষ কম্বল ও ১ লক্ষ জ্যাকেট সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এতে দেখা যায় প্রয়ােজনের তুলনায় একটু ঘাটতি থেকে যাচ্ছে।
৩. এই ঘাটতি মিটানাের জন্য আমরা ৫০,০০০ চাদর/হাফ হাতা সােয়েটার কিনতে চাই। খরচ হবে ৫০,০০০ X ৩০ = ১৫,০০,০০০/= ১৫ লক্ষ রুপি।
অতি দ্রুত অর্থবরাদ্দের জন্য অনুরােধ করা হলাে। যুবশিবির অধিদপ্তর সত্বর প্রতিটি শিবিরে উল্লেখিত দ্রব্যের সরবরাহ নিশ্চিত করবেন।
সেনাবাহিনী (প্রতিরক্ষা) ও যুবশিবির কত ওতপ্রােতভাবে জড়িত ছিল তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ ২৪ আগস্ট যুবশিবির দপ্তরের ডিরেক্টর (সদর দপ্তর) উইং কমান্ডার মির্জা কর্তৃক জারি-করা কর্মসূচি। এতে দেখানাে হয়েছে সেনাবাহিনীতে নেওয়ার জন্য কোন কোন সেনা-ট্রেনিং ক্যাম্পের জন্য কত যুবক প্রশিক্ষণার্থী বাছাই করা হবে। এর বিপরীতে বিস্তারিত দেওয়া আছে বিভিন্ন শিবিরে অপেক্ষমাণ যুবকদের তালিকা।
যুবশিবিরের বিভিন্ন ক্যাম্পে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং প্রদানের জন্য শিবিরে আগত হাজার হাজার তরুণকে প্রশিক্ষিত করার পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছিল। মুক্তিবাহিনীতে নিয়মিত প্রশিক্ষণ গ্রহণের পূর্বে চূড়ান্তভাবে এইসব তরুণকে নির্বাচিত করার জন্য সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয় (পরিশিষ্ট-১১৪ দ্রষ্টব্য)। যুবশিবিরে সমবেত তরুণদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের আকাক্ষা প্রবল ছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়ে সরকারের কিছু নিয়মনীতি ছিল। এজন্য এসব তরুণকে বহু সময় ধরে শিবিরেই অবস্থান করতে হতাে। এতে এদের মধ্যে এক ধরনের হতাশা দেখা দেয়। হতাশা যাতে তাদের গ্রাস করতে না পারে সেজন্য এই ট্রেনিং-এর পরিকল্পনা নেওয়া হয়। এই ট্রেনিং-এর আওতায় প্রাথমিক চিকিৎসাব্যবস্থা, অগ্নিনির্বাপণ, কিছু বােমা সম্পর্কে বাস্তব জ্ঞান প্রদান, এসব বােমার কার্যকারিতা ও এ থেকে আত্মরক্ষার উপায় ইত্যাদি সম্বন্ধে শিক্ষা দেওয়া হতাে (পরিশিষ্ট ১১৫ দ্রষ্টব্য)।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করা হয়। একজন পরিচালকের অধীন বিভিন্ন অঞ্চলে (Zone) সহপরিচালক ছাড়াও অন্যান্য কর্মচারী ছিলেন। এদের বেতন-ভাতা বাবদ ব্যয় বাংলাদেশ সরকারের তহবিল থেকে নির্বাহ করা হতাে। যুবশিবিরে আশ্রিত তরুণদের প্রাথমিকভাবে সিভিল ডিফেন্স ট্রেনিং-এর জন্য প্রয়ােজনীয় সিলেবাসও তৈরি করা হয়। ট্রেনিং-সংশ্লিষ্ট সরঞ্জামাদি, যেমন স্ট্রেচার, কম্বল, ব্যান্ডেজ, বস্ন্যাকবাের্ড, ডাস্টার, সুতলি, রশি ইত্যাদি ক্রয় করা হয়।
পূর্বাঞ্চলীয় যুদ্ধক্ষেত্রের যুবশিবির
বাংলাদেশ থেকে অবিরল স্রোতের মতাে আগত তরুণ যুবকদের সামগ্রিকভাবে রণক্ষেত্রের উপযােগী করে প্রস্তুত করাই ছিল যুবশিবিরের প্রধান পরিকল্পনা ও কাজ। আগেই উল্লেখ করেছি, যুবশিবিরের ধ্যান-ধারণা ডা. হাবিবুর রহমান (ওরফে আবু ইউসুফ) সর্বপ্রথমে বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট উপস্থাপন করেছিলেন। সরকার এই পরিকল্পনার বিভিন্ন দিক পরীক্ষা করে যুবশিবির প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সমগ্র বাংলাদেশের যুবকদের নিয়ে যুবশিবিরের যাত্রা শুরু হয়েছিল। যুবশিবিরের কর্মকাণ্ড সুসমন্বিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। এসব ব্যবস্থা একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকারের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল।
পাকিস্তান বাহিনীর গণহত্যার মুখে সীমান্ত অঞ্চলের যেসব স্থান দিয়ে সকল পর্যায়ের জনগণ, বিশেষত, যুব-কিশাের সম্প্রদায় সীমান্ত অতিক্রম করত, সেই সকল স্থানেই অধিকাংশ যুবশিবির স্থাপিত হয়। এসব শিবির অভ্যর্থনা-শিবির হিসেবেও গণ্য হতাে। কারণ, সীমান্ত পার হয়েই সকলে তাদের নাম লেখাত এইসব শিবিরে। অভ্যর্থনা-শিবির প্রকৃত অর্থে উদ্বাস্তুদের মাঝখানের একটি স্থান হিসেবে পরিগণিত হতাে। সীমান্ত এলাকায় অথবা মুজিবনগরের বিভিন্ন স্থানে দায়িত্ব পালনের জন্য যেতে হলে এসব অভ্যর্থনা-শিবিরের মাধ্যমে প্রাথমিকভাবে তা করতে হতাে। প্রথমদিকে যুবশিবিরের ব্যবস্থাপনা সঙ্গত কারণে অগােছালাে ছিল এবং যুদ্ধে লিপ্ত হতে আগ্রহী তরুণগণ খুবই ভেঙে পড়েছিল। এমনকি, অনেকেই তাদের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য যুদ্ধ করতে পারছে না বলে প্রকাশ্যেই অশ্রু বিসর্জন করত। তাদের আক্ষেপ ও ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখেছি এই বলে যে, পাকিস্তান বাহিনী তাদের স্বজনকে হত্যা করে চলেছে নির্বিবাদে, আর তারা ওই জানােয়ারদের নৃশংসতার জবাব দিতে পারছে না। তারা বলত: আমরা ওদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাই, আমাদের অস্ত্র দিন। কিন্তু প্রয়ােজনের তুলনায় শিবিরগুলাের কর্মপরিধি বেশ সীমিত ছিল। এই
পৃষ্ঠা: ১৮৫
সীমাবদ্ধতার মাঝেও যুবশিবিরের কাজ কিন্তু কখনও থেমে থাকেনি। কোনাে-না-কোনােভাবে যুবশিবিরের তরুণদের সচল রাখা হয়েছিল। প্রধানত যেসব যুবশিবিরে প্রাথমিকভাবে কাজকর্ম চালু রাখা হয় সেগুলাে হচ্ছে নিম্নরূপ:
ক. হরিণা শিবির: এখানে ১০০০ জন তরুণকে প্রশিক্ষিত করার ব্যবস্থা ছিল। এই শিবির ঠিক সীমান্ত বরাবর ছিল না, সীমান্ত থেকে কিছু দূরে ছিল এর অবস্থান। যুবশিবিরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেজর মেহতাকে শিবিরে অবস্থানরত তরুণদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে আমি একসময় অনুরােধ করি। কিন্তু, স্থানীয় সামরিক কর্তৃপক্ষের সম্মতি ছাড়া এ-ধরনের প্রশিক্ষণ দেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক এই শিবিরের প্রধান ছিলেন।
খ. ছােটখােলা শিবির (একিনপুর সংলগ্ন): এই শিবির সীমান্ত-সংলগ্ন হওয়ায় আরাে অভ্যন্তরে সরানাের কথা ভাবা হয়। এই শিবিরে ৪০০ জন তরুণকে প্রশিক্ষণ দেওয়ার সংস্থান ছিল। এই শিবিরের প্রধান ছিলেন মি. খাজা আহমেদ এম. এন. এ.।
গ. রাজানগর যুবশিবির: অধ্যাপক এ. হানিফ এম.এন.এ ছিলেন এর প্রধান। এই শিবিরে ১০০০ জন তরুণের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মতাে সুবিধা থাকা সত্ত্বেও এখানে প্রাথমিকভাবে মাত্র ৪০০ জন তরুণের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়। বহু প্রতিকূলতার মধ্যে এই শিবিরের কাজকর্ম পরিচালিত হয়।
ঘ. সােনামুড়া যুবশিবির: সােনামুড়া এলাকায় ৪টি শিবির স্থাপন করা হয়েছিল। এগুলাে হচ্ছে: (১) কাঠালিয়া, (২) হাতিমারা, (৩) বক্সনগর, (৪) মেলাঘর। মি. জালাল আহমেদ এমপিএ; মি.এম.এ. রশিদ, এমপিএ; অধ্যাপক এ. রৌফ প্রমুখ। যথাক্রমে কাঁঠালিয়া, হাতিমারা ও বক্সনগরের শিবিরগুলাের প্রধান ছিলেন। মেলাঘর যুবশিবির সেক্টর-২-এর সঙ্গে যুক্ত থাকায় প্রথমদিকে এই শিবিরের কোনাে প্রধান ছিলেন না।
ঙ. উদয়পুর যুবশিবির: স্থানীয় অ্যাডিশনাল ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট মি. ব্যানার্জির সহযােগিতায় এই শিবিরের কাজকর্ম খুবই দৃশ্যমান হয়ে ওঠে। ক্যাপ্টেন এম. আলী এম.এন,এ. এই শিবিরের প্রধান ছিলেন। মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী এই শিবির স্বয়ংসম্পূর্ণ ছিল:
চ. মােহনপুর যুবশিবির: এই শিবিরের প্রধান ছিলেন মি. শরীফুদ্দিন আহমেদ এম.পি.এ.। প্রাথমিক সমস্যা সমাধানে ক্যাপ্টেন চ্যাটার্জি বিশেষ অবদান রেখেছিলেন।
ছ. সিলেট যুবশিবির: সিলেট সেক্টরে ঐ সময় তিনটি অভ্যর্থনা-শিবির সক্রিয় ছিল। এগুলি পরিচিত ছিল: (১) পাথরকান্দি, (২) খােয়াই, (৩) কৈলাশহর শিবির নামে। এসব শিবিরে যথাক্রমে সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক মি. আবদুল মােমেন, মি. মুস্তফা শহীদ এম.পি.এ., মি. মানিক চৌধুরী এম.এন.এ. শিবিরপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
উপরােল্লিখিত শিবির ছাড়াও আরাে কিছু স্থানে শিবির প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। মি. তৈমুজ আলী এম.পি.এ.-র নেতৃত্বে ধর্মনগর; মি. দেওয়ান আবদুল আব্বাস এম.এন.এ.-র নেতৃত্বে নারসিনগর; মি. গাজী ফজলুর রহমান এম.পি.এ.-র নেতৃত্বে বেলতলি নামক স্থানে। এবং আগরতলার কংগ্রেস ভবনে অভ্যর্থনা-শিবির একই সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে। শরণার্থী হিসেবে আগত তরুণদের পাঠানাের কেন্দ্র (transit camp) গড়ে-তােলা হয়।
ভয়ানক সঙ্কটময় পরিবেশ ও আর্থিক অসচ্ছলতার মধ্যে যুবশিবিরের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র দেশপ্রেমের কারণে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশপ্রেমের মনােভাব প্রতিটি বাঙালি তথা শরণার্থীকে আপ্লুত করে রেখেছিল। দেশপ্রেমের মন্ত্রে আবিষ্ট তরুণেরা এইসব যুবশিবিরের কর্মে প্রাণসঞ্চার করে রেখেছিল। কোনাে বাধা, অসুবিধা যুবশিবিরকে কখনও হীনবল করেনি। প্রথমদিকে কিছু অসুবিধা থাকলেও তা দূর হতে বেশি সময় লাগেনি।
আবু ইউসুফ সাহেবের ব্যক্তিগত ব্যবহার যাই হােক, তিনি সত্যসত্যই অত্যন্ত মেধাবী এবং সুচিন্তার মানুষ ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধে তার অবদান অসীম। আমি বলব যুবশিবির (Youth Camp) ধারণাটাই তাঁর চিন্তা থেকে এসেছিল। আগরতলায় জহুর আহমেদ চৌধুরী যেবাড়িতে থাকতেন সেখানে অন্যান্যদের সাথে এক কামরায় বাস করতেন আর সারাদিন লিখতেন। একদিন তিনি তার পরিকল্পনাটি একটি সুন্দর লেখা এবং ছকের মাধ্যমে পেশ করলেন। বাংলাদেশের ভেতর থেকে যে অগণিত ছাত্র-জনতা-যুব সম্প্রদায় ভারতে প্রবেশ করছিল তাদের শরণার্থী-শিবিরে না-পাঠিয়ে ভিন্ন ক্যাম্পে আশ্রয় প্রদান এবং তারপর বাছাই করে প্রথমে সাধারণ প্রশিক্ষণ (ও শৃঙ্খলার মধ্যে আনয়ন) এবং পরে উন্নততর অস্ত্র প্রশিক্ষণ (শ্রেণীবিন্যাস করে) দিয়ে যুদ্ধে প্রেরণ—এই ছিল মূল চিন্তাধারা। সবাই এই পরিকল্পনা লুফে নেন। অতি শীঘ্রই কেন্দ্রীয়ভাবে একটি সংগঠন হিসেবে যুবশিবির (Youth Camp Organization) আত্মপ্রকাশ করে। এই সংগঠনের অবদান মুক্তিযুদ্ধে অপরিসীম। অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে এর চেয়ারম্যান এবং উইং কমান্ডার মির্জাকে করা হয় মুখ্য পরিচালক। ফ্লাইট লেফটেনান্ট রেজা-কে এর সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। পূর্বাঞ্চলের যুবশিবিরসমূহের প্রধান ছিলেন প্রফেসর নূরুল ইসলাম এম.এন.এ.। যুবশিবিরগুলাে যে এভাবে তাদের হাতছাড়া হয়ে যাবে মাহবুব আলম চাষী-তাহেরউদ্দিন ঠাকুর গয়রহ তা ভাবতেও পারেননি সে-সময়।
মে-জুন-জুলাই এই তিন মাসে আমি আগরতলা অফিসের দায়িত্বে নিয়ােজিত ছিলাম। আমার সঙ্গে ছিলেন বিশেষ দায়িত্বে কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ, আকবর আলী খান এবং ড, এম.এ. হাসান (শ্রীমঙ্গল চা-গবেষণা কেন্দ্রের ডিরেক্টর)। এছাড়াও এ অফিসের প্রশাসনিক অফিসার ছিলেন লতিফ খান (কুমিল্লার)। তিনি ছিলেন কঠোর পরিশ্রমী এবং কর্মঠ। পরে বাংলাদেশে ট্রেডিং করপােরেশন অব বাংলাদেশ (TCB)-র অফিসার হিসাবে নিয়ােগপ্রাপ্ত হন। ঐসময় খন্দকার মুশতাক বাণিজ্যমন্ত্রী। অ্যাকাউন্টস এবং ক্যাশ দেখাশুনার দায়িত্বে ছিলেন বজলুর রহমান (এম.আর. সিদ্দিকী কর্তৃক নিয়ােজিত)। এই তিনটি মাস ছিল অত্যন্ত ঘটনাবহুল এবং গুরুত্বপূর্ণ। সমগ্র বাংলাদেশ থেকে মুক্তিকামী ছাত্র, কৃষক-শ্রমিক, যুবক, শিক্ষক, পেশাজীবী, আবালবৃদ্ধবনিতা তখন স্রোতের মতাে ভারতে চলে আসছিলেন। উত্তর-দক্ষিণ বঙ্গ থেকে যাচ্ছিলেন পশ্চিমবঙ্গে। আর প্রায় ৩০ লক্ষের মতাে গিয়েছিলেন ত্রিপুরায়। এদের জন্য আশ্রয়-শিবিরের ব্যবস্থা, খাদ্যসংগ্রহ ছিল এক বিশাল ব্যাপার। তার চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ ছিল প্রচণ্ড-যুদ্ধ পরিচালনা এবং সেই যুদ্ধের যাবতীয় চাহিদা মিটানাে। জিয়াউর রহমান, খালেদ মােশাররফ, কে.এম. শফিউল্লাহ, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী-এরা সবাই বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধ করছেন। ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় চতুর্দিকে অবস্থানরত পাকবাহিনীর সঙ্গে ঘােরতর যুদ্ধ করতে হচ্ছিল। ওপারে সিলেট সীমান্ত, মাঝখানে কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া তার নিচে নােয়াখালী-ফেনী, দক্ষিণে রামগড়-পার্বত্য চট্রগ্রাম। বাংলাদেশ বাহিনীর নিত্যপ্রয়ােজন তখন খাদ্য, অস্ত্র, গােলাগুলি, যােগাযােগ ব্যবস্থা, বিভিন্ন মাধ্যম, দ্রুত চিকিৎসা, অন্যান্য রসদ, অতি প্রয়ােজনীয় খবরাখবর (intelligence) ইত্যাদি। আরও প্রয়ােজন ছিল ফিল্ড-হাসপাতাল, সীমান্তের অদূরে চিকিৎসাব্যবস্থা, অ্যামবুলেন্স (ambulance), পরিবহণ, ওয়্যারলেস (wireless), পােশাক, তাবু এবং আরও কত কী। ভারতীয় মিত্রবাহিনী পেছন থেকে বড়রকম সমর্থন (support) দিচ্ছিল ঠিকই, কিন্তু আমাদের নিজস্ব ব্যবস্থাও রাখতে হচ্ছিল।
মুক্তিবাহিনী গতানুগতিক প্রথার যুদ্ধে (conventional warfare) পাকিস্তানিদের বাধা দেওয়ার সাথে নতুন নতুন রণকৌশলে পাকিস্তান বাহিনীকে পর্যুদস্ত করছিল। গেরিলা কায়দায় ওত পাতা (ambush), পেছন থেকে অতর্কিত আক্রমণ, শত্রম্নর যােগাযােগব্যবস্থা বিচ্ছিন্নকরণ, গােয়েন্দা-তথ্য সংগ্রহ করা ইত্যাদি নানাবিধভাবে পাকিস্তানিদের হয়রান করা হচ্ছিল। এসব কারণে সবচাইতে বেশি প্রয়ােজন ছিল সক্ষম, সাহসী, দেশপ্রেমিক মানুষ। এককথায় জনবল সংগ্রহ। জনবলের কোনাে অভাব ছিল না। বিশেষ করে যুবসম্প্রদায় ঝাপিয়ে পড়তে চাচ্ছিলেন মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য। আমাদের সমস্যা ছিল বাছাই করা। বিভিন্ন পয়েন্ট এবং শরণার্থী শিবির থেকে স্বেচ্ছাসেবক আগ্রহী যুবকদের আনতে হতাে বিশেষ কাম্পে। সেখানে হতাে প্রাথমিক বাছাই এবং তারপর মৌলিক প্রশিক্ষণ। এই ক্যাম্পগুলােকে বলা হতাে মৌলিক শিবির (Basic Camp) এখানে এদের মনােবল চাঙা করতে বিশেষ উদ্বুদ্ধকরণ (motivation) প্রশিক্ষণ দেওয়া হতাে। এখান থেকে উপযুক্ত প্রশিক্ষণার্থীদের নিয়ে যেতেন সেক্টর কমান্ডাররা। তারা কোনাে গ্রুপকে অস্ত্র এবং সংক্ষিপ্ত ট্রেনিং দিয়ে পাঠাতেন নিয়মিত বাহিনীর পাশাপাশি বা তাদের সাথে থেকে এসব গ্রুপ যুদ্ধ করতেন; কোনাে দলকে শত্রম্নদের অবস্থান ও অন্যান্য খবরাখবর নিতে দেশের মধ্যে পাঠাতেন, আবার কোনাে গ্রুপকে বিশেষ গেরিলা ট্রেনিং দিয়ে পাঠাতেন হানা দিতে (action) দেশের অভ্যন্তরে। ঢাকা এবং পার্শ্ববর্তী এলাকায় যে-সমস্ত স্কোয়াড পাঠানাে হতাে ছােট স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র, গ্রেনেড এবং নিশ্চিহ্নকরণ (demolition) সরঞ্জাম দিয়ে তাদের অধিকাংশই ছিল খালেদ মােশাররফ এবং সফিউল্লাহর সেক্টরে ট্রেনিংপ্রাপ্ত। অত্যন্ত সাহসী ও বুদ্ধিমান, অস্ত্রশস্ত্র পরিচালনা এবং গেরিলাযুদ্ধে বিশেষ পারদর্শী যারা, শুধুমাত্র তাদেরই পাঠানাে হতাে দেশের অভ্যন্তরে এবং অত্যন্ত গভীর অঞ্চলে।
এদের পাশাপাশি ভারতীয় বাহিনীও যুবশিবির থেকে বাছাই করে নিয়ে গেরিলাদের নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করত। রাজনৈতিক ভাবধারায় বিশেষভাবে উদ্বুদ্ধ এবং ছাত্রলীগের সদস্যদের নিয়ে পৃথক বাহিনী গঠন করা হয়েছিল, যার নাম ছিল মুজিববাহিনী। এদের সংগঠক ছিলন শেখ ফজলুল হক মণি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমেদ, আ.স.ম. আবদুর রব, আবদুল কুদুস মাখন, শাহজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমুখ প্রখ্যাত এবং বিপ্লবী ছাত্রনেতা। মুজিববাহিনীর সাথে অনেক সময় নিয়মিত বাহিনীর সংযােগ এবং সমন্বয় থাকত না। এটি নিয়ে কর্নেল ওসমানীর অনেক অভিযােগ ছিল।
জাতীয় ঐকমত্য: সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ
স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রাক্কালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে সুপরিকল্পিত ও ব্যাপক গণহত্যা আরম্ভ করে তাতে দেশের সর্বস্তরের জনসাধারণ কোনােমতেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা তাে দূরের কথা, মান-সম্মান-মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকার ন্যূনতম গ্যারান্টিও পাচ্ছিলেন না। স্বভাবতই, আত্মরক্ষার জন্য প্রতিরােধসংগ্রাম গড়ে-তােলার জন্য সর্বোপরি স্বাধীন সত্তা বজায় রাখার জন্য মুক্তিযুদ্ধের প্রতি যাদের সমর্থন ছিল, দলমত নির্বিশেষে প্রথমে সীমান্ত অঞ্চলে, পরে ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। সীমান্ত অঞ্চলে এবং বাংলাদেশের অভ্যন্তরে অন্যান্য অঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন এবং বিভিন্ন সরকারি/আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত কর্মকর্তাকর্মচারীবৃন্দ, ছাত্র-শিক্ষক, রাজনৈতিক কর্মী যারা ২৫ মার্চ রাত থেকেই বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই.পি.আর., পুলিশবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ রেখে লড়াই করেছেন, পাকিস্তানিদের প্রতিরােধ করেছেন তারা নতুনভাবে, পুনর্গঠিত হয়ে নতুন অস্ত্রশস্ত্র ও প্রশিক্ষণ নিয়ে তাদের সুবধািমতাে স্থান থেকে শত্রু পর্যদস্ত না-হওয়া পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবেন এটাই স্বাভাবিক; এটাই সর্বকালে, সর্বদেশে হয়ে এসেছে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ফ্রান্স, পােলান্ড; পরবর্তীতে আলজিরিয়া, ফিলিস্তিন, আফগানিস্তান, কম্বােডিয়া সব দেশেই এরকম হয়েছে ও হচ্ছে। বাংলাদেশেও এর কোনাে ব্যতিক্রম নয়। সংখ্যালঘু হিন্দুদের যেভাবে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং তাদের এদেশীয় দোসররা নির্যাতন, নিধন করছিল তাতে তাদের চলে যাওয়া ছাড়া উপায় ছিল না। তিন দিকে ভারতবেষ্টিত, বন্ধুপ্রতিম ব্যবহার ও অভ্যর্থনা, একই ভাষা-সংস্কৃতি এসব কারণেই ভারতে আশ্রয় নিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করাই ছিল সর্বোত্তম পথ। তদুপরি চিরশত্রু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নতুন বন্ধু পাওয়া এবং একটি দ্বিতীয় ফ্রন্টের অস্তিত্ব নাগালে আসায় ভারতের কৌশলগত স্ট্রাটেজিতে এক বিরাট সুবিধা হয়ে ওঠে। আমাদের সর্বাত্মক সমর্থন ও সাহায্য দেওয়ার পেছনে সরকারি এই মনােভাব কাজ করে থাকলেও ভারতের সর্বস্ত রের জনসাধারণ, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলা, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয়ের বাংলা-ভাষাভাষী জনগণ বাংলাদেশ থেকে আগত সকল মানুষকে নিঃস্বার্থে বুকে টেনে নিয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যখন বিপুল বাংলাদেশি জনগােষ্ঠীকে ভারত খাদ্য, আশ্রয়, ওষুধ, চিকিৎসা প্রদান করতে বাধ্য হচ্ছিল; সেই সময় এদের বাংলাদেশে ফিরে যাওয়া ত্বরান্বিত করতে তাদের সরকার ব্যস্ত ও সচেষ্ট হয়ে পড়ে। সেটা সম্ভব ছিল বাংলাদেশ অল্পদিনের মধ্যে স্বাধীন হলেই। এক কোটিরও বেশি মানুষকে আশ্রয় দিতে ও ভরণ-পােষণ করতে কীরকম ব্যয় ও সম্পদ প্রয়ােজন তা সহজেই অনুমেয়। তার ওপর বাংলাদেশ থেকে যারা ভারতে গিয়েছে তার উল্লেখযােগ্য সংখ্যক প্রশিক্ষিত সশস্ত্র যােদ্ধা। আরেকটি বিরাট অংশ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়তে শুধু অস্ত্র আর প্রশিক্ষণ দাবি করছে। এদের সামলিয়ে রাখাও ভারতের জন্য বিরাট সমস্যা। এই অবস্থায় যদি আশ্রয়গ্রহণকারী জনসমষ্টির একটি বৈধ সরকার থাকে যাদের নেতৃত্বে যুদ্ধ পরিচালিত হতে পারে যাদের পেছনে বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর জনসাধারণের, শতকরা নব্বই ভাগেরও বেশি মানুষের সমর্থন থাকে তাহলে আশ্রয়দাতা দেশের আর কী করণীয় থাকতে পারে। এর পরেও যে-তারে বাংলাদেশে হানাদার বাহিনী কর্তৃক গণহত্যা ও ধবংসলীলার সংবাদ ভারতসহ সমগ্র দুনিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত ও নিন্দিত-ধিকৃত হচ্ছিল, তাতে ভারতের জনসাধারণও কিছু-একটা করার জন্য সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করছিল।
এরকম একটা পটভূমিতে বিশ্ব-জনমত ভারতের পক্ষে এবং বিপুলভাবে আমাদের পক্ষে থাকলেও বিশ্ব-রাজনীতি এবং কূটনীতির বাস্তবতা অন্যরকম ছিল।
আমেরিকার জনসাধারণ এবং কংগ্রেস আমাদের সমর্থন দিলেও নিক্সন-কিসিঞ্জার চক্র তখন অন্য খেলায় মেতেছিল। চীনের সাথে সােভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আঁতাত গড়ে তুলতে আমেরিকার সে-সময় পাকিস্তানকে প্রয়ােজন ছিল। সময়টা ছিল আমাদের জন্য প্রকিকূল (ভারতের জন্যও)। সেটা ছিল পিং পং ডিপ্লোমেসির যুগ। পাকিস্তান তখন খুলেছে চীনের সাথে সিল্ক রুট—উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত, গিলগিট হয়ে কারাকোরাম পর্বতমালা অতিক্রম করে সিনকিয়াং। পাকিস্তানকে তখন মার্কিন সরকারের খুব প্রয়ােজন। অতএব বাংলাদেশে গণহত্যার ব্যাপক প্রমাণ ও প্রচার থাকলেও স্বার্থের কাছে সেদিন মানবতা পরাজিত। আমেরিকার সাথে সাথে ন্যাটোভুক্ত দেশগুলােও; যদিও গ্রেট ব্রিটেনে বাংলাদেশের সমর্থন তখন তুঙ্গে, ফ্রান্সে, জার্মনিতে, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেনেও একই অবস্থা। সর্বত্র চলছে বাংলাদেশের পক্ষে যে অভূতপূর্ব গণজাগরণ, গণসমাবেশ, র্যালি, জনসভা, মিছিল ইত্যাদি। লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশের পক্ষে যে র্যালি অনুষ্ঠিত হয় তা ছিল বিংশ শতাব্দীর পৃথিবীর ইতিহাসে স্মরণীয় বৃহত্তম সমাবেশ। ইরাকে হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্রিটেনে ২০০৩ সালে ১০ লক্ষাধিক লােকের সমাবেশে ও প্রতিবাদ সভার সাথে তার তুলনা চলে। ট্রাফালগার স্কোয়ারের উল্লেখিত সমাবেশের পাশাপাশি সংগীতানুষ্ঠান/কনসার্ট করে বাংলাদেশের জন্য জনসমর্থন এবং অর্থ-সংগ্রহ অভিযান চলেছে। নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে পণ্ডিত রবিশঙ্কর আর জর্জ হ্যারিসনের মিউজিক কনসার্ট আজও সকলে মনে রেখেছেন। শহরে শহরে, বিশ্ববিদ্যালয়ে, বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, সংবাদপত্র, প্রচারমাধ্যম ইত্যাদিতে বাংলাদেশে গণহত্যার ঘটনা জানাতে, জনগণের প্রতিরােধ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বৈধ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের পক্ষে প্রবল জনমত সৃষ্টির চেষ্টা চলছিল মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে। জনসমর্থনের ফলে অনেক সরকারই তাদের মনােভাব নমনীয় করতে বাধ্য হয়েছিলেন। সাথে সাথে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করে ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য বিপুল পরিমাণ সাহায্যদ্রব্য পাঠাচ্ছিলেন। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, জার্মানি, ডেনমার্ক, নরওয়ে, সুইডেন ইত্যাদি রাষ্ট্রের সরকার এবং তার চাইতেও বেশি বেসরকারি সাহায্য সংস্থাগুলাে (NGO) বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য বিপুল অর্থ ও খাদ্ৰদ্রব্যাদি, তাঁবু, চিকিৎসার জন্য ওষুধ ও সরঞ্জাম, ডাক্তার, নার্স, অ্যাম্বুলেন্স, পরিবহণের জন্য গাড়ি ইত্যাদি সংগ্রহ করে পাঠাচ্ছিলেন। আমেরিকার সরকার যাই করুক, আমেরিকার অনেক স্বাধীনচেতা রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, সাংবাদিক, শিল্পী, প্রকৌশলী, চিকিৎসক আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। অথ্যসাহায্য পাঠিয়েছেন। সাহায্যদ্রব্য, ওষুধ ও সরঞ্জাম বিতরণ করেছেন বিভিন্ন এলাকায় এবং ক্যাম্পে। ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস (ICRC)-এর ভূমিকা ছিল অতুলনীয় (যেটা দেশ মুক্ত হওয়ার পরেও তারা অব্যাহত রেখেছিলেন দীর্ঘকাল)। বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সচিব হিসেবে এসব কিছুর সঙ্গে আমার অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষ সংযােগ ছিল। পরিশিষ্টে সংযােজিত বিষয়াবলি থেকে এ-কথার সত্যতা প্রমাণিত হবে।
পৃষ্ঠা: ১৯০
আন্তর্জাতিক বেসরকারি সংস্থাগুলাের মধ্যে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যাপক ভূমিকা রেখেছিলেন OXFAM, CARE, SAVE THE CHILDREN, CARITAS, MEDICINE SANS FRONTIERE ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান।
বিশ্বব্যাংকের মিশন তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান থেকে ফিরে গিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অবস্থার যে-চিত্র তুলে ধরেন তাতে আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলাে বিপুলভাবে আন্দোলিত হয়। সে-কারণে FAO (বিশ্ব খাদ্য সংস্থা) প্রমুখ বাঙালিদের জন্য সাহায্যের হাত প্রসারিত করে। UNHCR (United Nations High Commissioner for Relief) প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের সরেজমিনে পর্যবেক্ষণের পর একপর্যায়ে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সরকারদ্বয়ও অর্থ ও সাহায্যদ্রব্য বিপুলভাবে পাঠাতে থাকে, তবে তা শুধুমাত্র শরণার্থীদের জন্য। একইভাবে অন্যান্য সরকারও সাহায্য পাঠাতে থাকেন।
বাংলাদেশের প্রতি পশ্চিমাশক্তির নীতিতে বরফ গলতে শুরু করে আন্তর্জাতিকভাবে ভারত কর্তৃক ব্যাপক কূটনৈতিক তৎপরতা এবং তার পাশাপাশি প্রবাসী বাঙালি নাগরিকদের ঐসব দেশে অবিরাম জনসংযােগের ফলে।
যে-বিষয়টি আমরা এবং ভারত-সরকার কিছুতেই বাগে আনতে পারছিলাম না, তা হলাে বড় বড় দেশের কূটনৈতিক সমর্থন এবং সামরিক সাহায্য। এর সঙ্গে ছিল চীনের প্রচণ্ড বৈরী নীতি। চীন কর্তৃক পাকিস্তানকে সরাসরিভাবে অব্যাহত সামরিক সাহায্য, অন্যান্য দেশে পাকিস্তানের পক্ষে প্রচারণা ইত্যাদিও ভারতীয় নীতিনির্ধারকদের মস্তবড় সমস্যায় ফেলে দিয়েছিল।
চীনা কমিউনিস্ট পার্টির একটা দারুণ বিজাতীয় আক্রোশ ছিল আমাদের প্রতি, যার প্রতিফলন আমরা দীর্ঘকাল দেখেছি (দেশমুক্ত হবার আগে ও পরে) বাংলাদেশ, ভারত ও অন্যান্য দেশের চীনপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিগুলাের মধ্যে। পশ্চিমবঙ্গে নক্সালপন্থীরা তাে প্রকাশ্যে আমাদের বিরােধিতা করেছে। সে-কারণে নক্সাল-সমস্যার সমাধান না করে, মিসেস গান্ধী পশ্চিমবাংলায় গঠনমূলক কিছুই করতে পারেননি।
সবকিছুর ওপরে চীনা সরকার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে (অর্থাৎ বাংলাদেশে) ভারতকে হস্তক্ষেপ করার বিরুদ্ধে প্রচ্ছন্ন হুমকি দিয়ে রেখেছিল। সে-কারণে ভারত দীর্ঘদিন প্রকাশ্যে কোনাে সামরিক তৎপরতায় লিপ্ত হতে পারেনি।
চীনের কূটনৈতিক ও সামরিক অবস্থান, আমেরিকা সরকারের বৈরী নীতি, পশ্চিমইউরােপে সরকারিভাবে ভারত কর্তৃক সামরিক হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধাচরণ-এগুলাে সামনে রেখে ভারতের পক্ষে এককভাবে কোনাে বৃহৎ পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছিল না। ভারত মরিয়া হয়ে সন্ধান করছিল একটি শক্তিশালী পরাশক্তির, যে যুগপৎ মার্কিন/চীন অপশক্তির মােকাবেলা করতে পারে এবং যার প্রভাবে পূর্ব-ইউরােপ প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও সাহায্য দিতে পারে। সেই পরাশক্তি সােভিয়েত ইউনিয়ন। আওয়ামী লীগের মােটামুটিভাবে একটা কমিউনিস্ট-বিরােধী, পুঁজিবাদী- ঘেঁষা ভাবমূর্তি (image)ছিল। তার নেতৃত্বে পরিচালিত সরকারকে স্বীকৃতি এবং তার সাহায্যার্থে সরাসরি এগিয়ে আসতে সােভিয়েত-ব্লক বড় একটা দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ছিল।
এই প্রেক্ষাপটে আমাদের জাতীয় স্বার্থে প্রয়ােজন ছিল বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ার। সেটা কেবল সম্ভব ছিল বড় এবং প্রভাবশালী বামপন্থী দল এবং বৃহত্তম হিন্দু দলের সমর্থনে।
দেশে-বিদেশে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর মতাে এত পরিচিত এবং প্রভাবশালী ও গ্রহণযােগ্য বামপন্থী নেতা আর কেউ ছিলেন না। এক নামে সবার কাছে সুপরিচিত ছিলেন মওলানা ভাসানী। ১৯৫৭ সালে (ফেব্রুয়ারি) থেকে বিরামহীনভাবে শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানী পশ্চিম পাকিস্তানের শােষণ-কর্তৃত্বের নিন্দা ও প্রতিবাদ করে এসেছেন। ১৯৫৭ সালে কাগমারির বিখ্যাত সম্মেলনে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আগত ন্যাপনেতাদের উদ্দেশে বলেছিলেন: এভাবে চলতে থাকলে আমরা আস্সালামাে আলাইকুম বলতে বাধ্য হবাে। অর্থাৎ পাকিস্তানের পশ্চিম-অঞ্চলের সঙ্গে পূর্ববাংলার সম্পর্ক টিকে থাকবে না। আমার আজও (২০০৪ সালে) মনে আছে সেদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনে ও সম্মুখের প্রাঙ্গণে (মধুর ক্যান্টিনসহ) আজকের অনেক বড় নেতা, মন্ত্রী ও হােমরা-চোমরা ব্যক্তি কীভাবে মওলানা ভাসানীর অনুসারী এবং ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দকে আক্রমণ করে নির্দয়ভাবে প্রহার করেছিলেন। আমি তখন উপস্থিত ছিলাম ডাকসু অফিসে (আমি সে-সময় কমনরুম সেক্রেটারি)। মওলানা ভাসানীর আরেকটি বিরাট অবদান ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়। সেদিন ছাত্র-জনতার কাতারে শামিল হয়েছিলেন লক্ষ শ্রমিক মজুর মওলানা ভাসানীর সঠিক নেতৃত্বে।
কমরেড মণি সিংহ সােভিয়েত ইউনিয়েনের কাছে সবচাইতে গ্রহণযােগ্য পূর্বপাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির (মস্কোপন্থী) নেতা। প্রফেসর মুজাফফর আহমদও তাই। তিনি ছিলেন পাকিস্তান ন্যাপ (মস্কো)-এর প্রধান। শ্ৰী মনােরঞ্জন ধর ছিলেন তৎকালে হিন্দুসমাজের অবিসম্বাদিত নেতা, পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস পার্টির কর্ণধার, ভারতের কাছে গ্রহণযােগ্য। পাশাপাশি এ-কথাও বলতে হবে যে, এই দলগুলাে সকলেই আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সমর্থন করেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে বিপুলভাবে অংশগ্রহণ করেছিল।
প্রবাসে অবস্থান করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কাজকর্মের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার বিষয়াবলি আমাদের জাতীয় জীবনে এবং ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। এই ইতিহাস কখনও মুছে ফেলা সম্ভব নয়। যতদিন পৃথিবীর অস্তিত্ব থাকবে ততদিনই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস গৌরবােজ্জ্বল ও অক্ষুন্ন থাকবে। মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকারের কাজকর্মে প্রত্যক্ষ ও নিবিড় সম্পর্ক আমার ছিল। এই সুবাদে সরকারের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সিন্ধান্ত বাস্তবায়নে আমার সক্রিয় যােগসূত্র ছিল। সার্বিকভাবে সবকিছু এই গ্রন্থের পৃষ্ঠায় উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও এমন কিছু তথ্য ও উপাত্ত এখানে সংযুক্ত হলাে যেগুলাে সম্বন্ধে দেশবাসী আগে অবহিত হয়নি। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বার্থে নিচে একটি চমকপ্রদ তথ্য তুলে ধরার চেষ্টা করেছি। এই তথ্য সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন সম্পর্কিত। জাতির দুর্যোগ ও সংকটকালে জাতীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠেনের প্রয়ােজনীয়তা প্রকটভাবে অনুভূত হয়। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ এই পরিষদ গঠনে নিজেই উদ্যোগ গ্রহণ করেন। কোন্ প্রক্রিয়ায় এবং কীভাবে পরিষদ গঠিত হয়েছিল সে-সম্বন্ধে বিবরণ দেওয়া প্রয়ােজন। তবে, পরিষদ গঠনের ফলে মুক্তিযুদ্ধে যে-প্রভাব পড়ে সে-কথা আগে বলা দরকার।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ আমাদের বহু কাঙ্ক্ষিত জাতীয় ঐক্য এনে দিতে সমর্থ হয়েছিল। সেইসাথে এনেছিল সােভিয়েত-ব্লকের অকুণ্ঠ সমর্থন। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই স্বাক্ষরিত হলাে ভারত- সােভিয়েত মৈত্রীচুক্তি। চীন তার ভারত-বিরােধী অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াল, ভারতও নেমে পড়ল সমরে, আমাদের পাশাপাশি।
৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভা বৈঠকে সর্বদলীয় ঐক্য স্থাপনের বিষয়টি বিশদভাবে আলােচিত হয়। সিদ্ধান্ত হয় যে বুধবার ৮ সেপ্টেম্বর কোনাে একটি গােপন স্থানে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, শ্রী মণি সিংহ, শ্রী মনােরঞ্জন ধর ও প্রফেসর মুজাফফর আহদেম-এর সাথে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভা একটি জরুরি বৈঠকে মিলিত হবেন। এই লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে লিখে প্রত্যেক নেতাকে আমন্ত্রণপত্র পাঠান। (পরিশিষ্ট ১১৬ দ্রষ্টব্য)।
ঐ বৈঠকে যেসব ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় সেগুলি পরের দিন অর্থাৎ ১৯৭১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন মিশন অফিস থেকে সমগ্র পৃথিবীর সংবাদ মাধ্যমগুলােয় প্রচারের উদ্দেশ্যে প্রেস-বিজ্ঞপ্তি আকারে পাঠানাে হয়। (পরিশিষ্ট ১১৭ দ্রষ্টব্য)।
পৃথিবীর বহু খ্যাতনামা প্রিন্ট মিডিয়া এবং ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে বাংলাদেশ সরকারের এই প্রেস-বিজ্ঞপ্তির পূর্ণাঙ্গ বিবরণ হুবহু প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়। এতে সারা পৃথিবীর জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের গতিপ্রকৃতির প্রকৃত চিত্র পেয়ে যায়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের মুক্তিকামী জনগণ যুদ্ধরত বাংলাদেশের জনগণের দুঃখকষ্টে একাত্মতা প্রকাশ করতে থাকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও তার জনগণকে সাহায্য ও সহযােগিতার হাত প্রসারিত করে তারা এগিয়ে আসে। তৎকালীন পত্রপত্রিকা এবং ই-মিডিয়া এসব কাহিনী প্রচার করতে থাকে।
উল্লিখিত বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল তার মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিল আট সদস্যবিশিষ্ট এক উপদেষ্টা পরিষদ (An eight-member Consultative Committee) গঠন। এটি একটি সর্বদলীয় কমিটি ছিল। এর আট জন সদস্য বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধি স্থানীয় ছিলেন। তবে, যেহেতু আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যগণের নেতৃত্বে সমগ্র মুক্তিযুদ্ধ এবং সরকার পরিচালিত হচ্ছিল, সেহেতু এই দলে নেতৃবৃন্দের আধিক্য ছিল এই কমিটিতে। বলাবাহুল্য, নির্বাচিত প্রতিনিধি সমম্বয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ায় সারা পৃথিবীর অন্যান্য দেশের অধিকাংশ সরকারসহ ভারত-সরকারও বাংলাদেশ সরকারের গ্রহণযােগ্যতা মেনে নেয়।
আট-সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় পরামর্শক কমিটিতে যেসব রাজনৈতিক দল অন্তর্ভুক্ত ছিল সেগুলাে হচ্ছে: (ক) বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, (খ) ন্যাপ (ভাসানী), (গ) ন্যাপ (মুজাফফর), (ঘ) বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি এবং (ঙ) বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস। পর পর দুইদিন এই সভা চলে।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটি গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রিত সকলকে স্বাগত জানিয়ে সভার কাজ পরিচালনা করেছিলেন।
সভায় স্থির করা হয়, নবগঠিত কমিটি বাংলাদেশ সরকারকে মুক্তিযুদ্ধ-বিষয়ক কাজে প্রয়ােজনীয় সহযােগিতা প্রদানের জন্য সার্বক্ষণিকভাবে নাগালের মধ্যে অবস্থান করবেন।
কমিটিতে যারা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিলেন তাদের তালিকা নিম্নরূপ:
১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ, ভাসানী)
২. মি. মণি সিং (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি)
৩. মি. মনােরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস)
৪. প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ (ন্যাপ, মুজাফফর)
৫. মি. তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী
৬. মি. খন্দকার মুশতাক আহমেদ, বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
৭. আওয়ামী লীগের আরও দুজন সদস্য
মি. তাজউদ্দীন আহমদ কমিটির সভা আহ্বান ও পরিচালনা করবেন বলে স্থির হয়। মুজিবনগরে দুইদিন ব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভায় নিম্নলিখিত সদস্যগণ উপস্থিত ছিলেন:
১. মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ন্যাপ, ভাসানী)
২. মি. মণি সিং (বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি)
৩. মি. মনােরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস)
৪. প্রফেসর মুজাফফর আহমেদ (ন্যাপ, মুজাফফর)
৫. মি. তাজউদ্দীন আহমদ, বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী
৬. মি. খন্দকার মুশতাক আহমেদ, বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী
৭. মি. মনসুর আলী, বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী
৮. মি. এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান, বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী
৯. মি. এম. এ. সামাদ, রাজনৈতিক উপদেষ্টা
উপস্থিত নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের মুক্তি অর্জিত না-হওয়া পর্যন্ত জীবনপণ লড়াই করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন। সভায় নির্বাচিত প্রতিনিধি সমন্বয়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে দেশবাসীকে দৃঢ় মনােবল নিয়ে ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানানাে হয়। সভায় বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি* মানুষের মুক্তি সংগ্রামে সমগ্র পৃথিবীর স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণকে সক্রিয়ভাবে সমর্থন দেওয়ারও আহ্বান জানানাে হয়।
সর্বদলীয় কমিটি গঠনের মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণের অংশগ্রহণের মনােভাব ও প্রত্যয় ফুটে ওঠে। কমিটি গঠনের মধ্য দিয়ে সার্বিক জাতীয় ঐক্যের প্রতিশ্রুতি প্রকাশিত হয় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি বিশ্বাস, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বৈধতা সুদৃঢ় হয়। সর্বদলীয় পরামর্শক পরিষদ গঠন ও বাংলাদেশ সরকারকে এর অকুণ্ঠ সমর্থন আমাদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে ও স্বাধীনতাযুদ্ধে একটি উল্লেখযােগ্য মাইলফলক। কারণ, এই পরিষদ গঠিত হওয়ায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং সরকারের কার্যক্রম সম্বন্ধে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক দৃষ্টি বাংলাদেশের মুক্তিকামী মানুষের প্রতি এক বিশেষ মাত্রায় নিবদ্ধ হয়। যুদ্ধরত বাঙালি জাতিকে সাহায্য-সহযােগিতার পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পথ উন্মুক্ত হয়। সর্বদলীয় পরিষদ গঠিত হওয়ায় সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পূর্ব ইউরােপীয় দেশগুলাের সমর্থন লাভের দ্বিধার ভাব এবং প্রতিবন্ধকতা দূর হয়ে যায়। এসব দেশ মুক্তিযুদ্ধকালে, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিতে আর দেরি করেনি। উল্লেখ্য, সর্বপ্রথম ভুটান স্বীকৃতি দেয়। এরপরই স্বীকৃতি দান করতে শুরু করে ভারত, নেপাল, ইরাক, কিউবা, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ। সর্বদলীয় কমিটি কর্তৃক গৃহীত যুগান্তকারী সিদ্ধান্তসমূহের বিস্তারিত বিবরণ এই গ্রন্থে সন্নিবেশ করা হয়েছে।
……………….………………………
* মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশ (সাবেক পূর্ব পাকিস্তান)-এর জনসংখ্যা।
……………….………………………
অর্থ মন্ত্রণালয়
পাকিস্তান সেনাবহিনী ২৫ মার্চ তারিখে নির্বিচার গণহত্যা শুরু করলে ভীত-সন্ত্রস্ত সাধারণ মানুষ পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত-সীমান্তে আশ্রয় গ্রহণ করে। রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীও সীমান্ত-অঞ্চলে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ সীমান্ত এলাকায় একত্রিত হতে শুরু করেন তাজউদ্দীন আহমদের প্রচেষ্টায়। এভাবে কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুরে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিগণ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিক ঘােষণা দেন এপ্রিলের ১৭ তারিখে। গঠিত হয় মুজিবনগর সরকারের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়। পরের দিন ১৮ এপ্রিল তারিখে সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যগণকে দায়িত্ব বণ্টন করে দেওয়া হয়। দায়িত্ব বণ্টনের ফলে সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব লাভ করেন ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী। অর্থমন্ত্রণালয়ের অধীনে নিম্নলিখিত দপ্তরসমূহ অন্তর্ভুক্ত ছিল:
ক. অর্থ ও জাতীয় রাজস্ব
খ. বাণিজ্য ও শিল্প
গ. পরিবহণ
পরিকল্পনা সেল, বাের্ড ও কমিশনের কাজকর্ম এই মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখে সম্পন্ন হলেও প্রকৃত ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজেই পরিকল্পনা বিষয়ক কাজকর্মে প্রত্যক্ষভাবে হস্তক্ষেপ করতেন।
অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব বণ্টনের পর এ মন্ত্রণালয় গড়ে তুলতে কয়েকদিন সময় লেগে যায়। বাংলাদেশ সরকারের সর্বপ্রথম কাজ ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগকে (General Administrative Department) গড়ে তােলা। এই গড়েতােলার কাজ করতে এবং অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে সক্রিয় করে তুলতে কয়েকদিন বেশি সময় লেগে যায়। বলা যায়, এটি ছিল সরকারের তৃতীয় প্রচেষ্টা মন্ত্রণালয় গড়ে তুলতে। এরপর অন্যান্য মন্ত্রণালয় গঠন প্রক্রিয়া শুরু হয়।
অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামােয় মন্ত্রীর অধীনে ১ জন সচিব, ১ জন একান্ত সচিব, ১ জন স্টেনােগ্রাফার, ১ জন হিসাব সহকারী (Dispatch Asstt.) এবং ২ জন। পিয়ন দেওয়ার সাংগঠনিক কাঠামাে প্রণীত হয়। অর্থমন্ত্রীর একান্ত সচিব হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন তৎকালীন সি. এস. পি. কর্মকর্তা সাদত হুসেইন। তেমনি, অর্থসচিবের অধীনে ১জন স্টেনােগ্রাফার, ১ জন করণিক-কাম-সহকারী ও ১জন পিয়ন দেওয়ার প্রস্তাব ছিল। এছাড়া, অর্থ মন্ত্রণালয়ের সচিবের সঙ্গে ২জন উপসচিব দেওয়া হয়। এঁদের একজন অর্থ এবং অপরজন ব্যবসা-বাণিজ্য বিষয় দেখার দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিলেন। দুই উপসচিবের প্রত্যেকের জন্য ১জন করে স্টেনােগ্রাফার ও পিয়ন ছিল। উপসচিবের (অর্থ) অধীনে কাজ করার জন্য আরাে ১০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন এসব কর্মকর্তা ও কর্মচারী দায়িত্ব অনুযায়ী বিভিন্ন নামে অভিহিত হতেন। তাদের পদের নাম ছিল: ক. হিসাব কর্মকর্তা (৩ জন), খ. ট্রেজারি অফিসার, সহকারী অফিসার, গ. স্টাফ অফিসার (২জন), ঘ. অডিট অফিসার। ঙ. বাজেট অফিসার (২জন)।
পৃষ্ঠা: ১৯৫
উপসচিব (বাণিজ্য)-এর অধীনে পর্বে-উল্লেখিত স্টেনােগ্রাফার ও পিয়ন ছাড়া আরাে ৩ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী ছিলেন। এঁদের পদনাম ছিল: ক. স্টাফ অফিসার (২জন), খ. জনসংযােগ কর্মকর্তা।
উভয় উপসচিবকে সহায়তা করার জন্য আরাে ৪৮ জন কর্মচারী ছিলেন। টাইপিস্ট, ড্রাইভার, পুলিশের এস. আই., এ. এস. আই, কনস্টেবল ইত্যাদি শ্রেণীর কর্মচারী ছিলেন। তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তান সরকারের অর্থ বিভাগের যুগ্মসচিব খন্দকার আসাদুজ্জামানকে মুজিবনগর সরকারের অর্থসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়। তিনি অর্থ মন্ত্রণালয়কে সংগঠিত করেছিলেন। সচিব হিসেবে তিনি মন্ত্রণালয়ের উভয় শাখা অর্থাৎ অর্থ এবং বাণিজ্য বিভাগের সকল কাজকর্ম মন্ত্রণালয়ের নীতিমালা ও মন্ত্রীর নির্দেশ অনুযায়ী সম্পন্ন করতেন।
উপসচিব (অর্থ) অর্থ বিভাগের সকল কাজকর্ম, যেমন হিসাব, নিরীক্ষণ, বাজেট প্রণয়ন, ট্রেজারির বিষয়াদি দেখাশুনা করতেন। এছাড়া মন্ত্রণালয়ের সাধারণ প্রশাসনিক দিক দেখার দায়িত্বও তিনি পালন করতেন।
উপসচিব (বাণিজ্য) অর্থ মন্ত্রণালয়ের বাণিজ্য শাখার দায়িত্ব পালন করতেন। বাণিজ্য বাের্ডকে প্রয়ােজনে তিনি সাচিবিক সহায়তা দিতেন। তিনি বাণিজ্য বিষয়ক সকল প্রস্তাব সচিবের সামনে উপস্থাপন করার পর এর বিভিন্ন দিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতেন।
মন্ত্রীর একান্ত সচিব ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ এবং দর্শনার্থীর সমস্যা ও কথা শােনার সময় মন্ত্রীকে সাহায্য করতেন। অর্থ শাখার কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের উপর তাদের পদনাম অনুযায়ী দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এঁরা সকলেই তাদের স্ব-স্ব দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেন। এঁরা ছাড়া আরাে যারা এই মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে নিযুক্ত হয়েছিলেন তাদের মধ্যে নেফাউর রহমান, ক্ষিতীশ চন্দ্র কুণ্ডু, এ. কে. এম. হেদায়েতুল্লাহ প্রমুখের নাম উল্লেখযােগ্য।
অর্থ মন্ত্রণালয় নিজের দাপ্তরিক ও প্রশাসনিক কাজকর্ম, বেতন, ভাতা, দ্রব্য ইত্যাদির জন্য ব্যয়-বরাদ্দসহ তিন মাসের (জুলাই-সেপ্টেম্বর, ১৯৭১) একটি বাজেট প্রস্তুত করে। এই বাজেটে আনুমানিক ব্যয় ধরা হয় মােট ১,৭৪,৬১০/- রুপি। অর্থ মন্ত্রণালয়কে সচল ও সক্রিয় করতে প্রাথমিকভাবে এই ব্যয়-বরাদ্দ ধরা হয়েছিল। মন্ত্রণালয়ের কাজ শুরু হওয়ার পর কতিপয় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়ােজনীয় হয়ে পড়ে এবং এই ব্যবস্থা সরকারি চালিকাশক্তি হিসেবে পরিগণিত হয়। নিম্নলিখিত বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হয়:
১. বাজেট প্রণয়ন ও আয়-ব্যয়ের হিসাব;
২. বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ও অন্যান্য উৎস থেকে সংগৃহীত সম্পদের হিসাব প্রস্তুত;
৩. বিভিন্ন সংস্থা ও ব্যক্তিবর্গকে অর্থ প্রদানের দায়িত্ব পালন ও বিধিমালা প্রণয়ন;
৪. আর্থিক শৃঙ্খলা প্রবর্তন;
৫. রাজস্ব ও শুল্ক আদায়;
৬. আর্থিক অনিয়ম তদন্তের জন্য কমিটি গঠন।
পৃথিবীর সকল দেশের সরকারের অনুরূপ বাংলাদেশ সরকারেরও বাজেট ছিল। আয়ব্যয়ের হিসাব সম্পর্কিত এই বাজেটে শুধু সরকারের নয়; বিভিন্ন দপ্তর, অঙ্গপ্রতিষ্ঠান, আঞ্চলিক অফিস, যুবশিবির, শরণার্থী, বেতার-প্রচারণা ইত্যাদি ব্যয় নির্বাহের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এছাড়া সরকার অগ্রদত্ত অর্থের (imprest money) ব্যবস্থাও করেছিল। এই তহবিল ১৬ এপ্রিল তারিখেই গঠন করা হয়। তাৎক্ষণিক বিভিন্ন ব্যয় মেটানাের সুবিধার্থে অগ্রদত্ত (imprest) অর্থের সংস্থান রাখা হয়। মন্ত্রিসভার ১৮ এপ্রিল তারিখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মাসিক বেতন, ভাতা, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মাসিক ব্যয় নির্বাহের পরিমাণ (আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ, বিভিন্ন শিবির ইত্যাদির দায়িত্বপ্রাপ্ত) নির্ধারণ করা হয়। এর আলােকে অর্থ মন্ত্রণালয় সরকারের বাজেট তৈরি করেছিল।
বাংলাদেশ সরকারের প্রারম্ভিক তহবিলের অর্থের উৎস ছিল তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানে অবস্থিত ব্যাংক, ট্রেজারিতে সংরক্ষিত নগদ অর্থ। সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী এ-সকল স্থান থেকে সংগৃহীত অর্থ সীমান্তবর্তী নিরাপদ স্থানে রাখা হয়। এসব স্থান থেকে কীভাবে ত্বরিত অর্থসম্পদ সংগ্রহ করতে হবে তার একটি পরিকল্পনা কর্নেল (অব.) ওসমানী ১৬ এপ্রিল তারিখে মন্ত্রিসভার সভায় উপস্থাপন করেন। মুক্ত-অঞ্চলের ট্রেজারি, ব্যাংক প্রভৃতি স্থানের স্ট্রং রুম থেকে টাকা ভারতীয় কর্তৃপক্ষের নিকট যথাযথ রশিদ নিয়ে জমা রাখার পরামর্শ উক্ত প্রস্তাবে ছিল। সরকার কর্তৃক প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং তদনুযায়ী ব্যবস্থা গৃহীত হতে থাকে। এছাড়া, কিছু দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি এভাবে সংগৃহীত অর্থ নিরাপদ স্ট্রংরুম সৃষ্টি করে সরকারের পক্ষে তা সংরক্ষণ করতেন। এই অর্থের বিনিময়-মূল্য সংগ্রহ তিনি কখনও নিজে এককভাবে করতে পারতেন না। তৎকালীন পাকিস্তানি মুদ্রা ভাঙানাের ব্যবস্থা করতেন কমপক্ষে তিনজন। পাকিস্তানি মুদ্রা বদলানাে হতাে প্রধানত খােলা বাজারে। সরকারিভাবেও এই মুদ্রা বিনিময় করা হয়েছে। এই কাজে সর্বদা একাধিক ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকত। তবে যে দুই ব্যক্তি সর্বাধিকভাবে এই কাজে নিযুক্ত ছিলেন তাঁরা হলেন মহম্মদউল্লাহ (যিনি বঙ্গবন্ধুর সরকার আমলে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন) এবং মােহাম্মদ মােহসিন।(খুলনা জেলার আওয়ামী লীগ নেতা)। এ-সময় পাকিস্তান-সরকার তাদের উচ্চমান নােট বাতিল ঘােষণা করার উদ্যোগ নেয়। এ-খবর গােয়েন্দা-সূত্রে বাংলাদেশ সরকার জেনে ফেলে। বাংলাদেশ সরকার দ্রুততম সময়ে বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়তায় সরকারি-বেসরকারি উপায়ে এসব মুদ্রা ভাঙিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা নেয় এবং তাতে প্রভূত সফল হয়।
নতুন নােট অথবা মুদ্রা বাজারে ছাড়ার বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই সজাগ ছিলেন। ১৪ এপ্রিল তারিখে তিনি স্বহস্তে তার ডায়েরিতে যে নােট লেখেন তার ৩ নম্বর ক্রমিকে লিখেছিলেন: সরকার কর্তৃক নতুন নােট অথবা মুদ্রা না ছাড়া পর্যন্ত দ্বৈত মুদ্রাব্যবস্থা চালু থাকবে। বাংলাদেশে মুদ্রা প্রস্তুত ও ছাপানাের ব্যবস্থা করতে হবে। সেই সাথে পুরােনাে পাকিস্তানি নােটের ওপর বাংলাদেশের ছাপ দেওয়া হবে।
একই দিনের ৪ নম্বর ক্রমিকে বর্ণিত নােটে তিনি লিখেছিলেন: প্রাক্তন ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তান বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকরূপে কাজ করবে। নােটের ৫ নম্বর ক্রমিকে লিখেছিলেন, ভারত এবং অন্যান্য বন্ধুপ্রতিম দেশ থেকে সরকার পরিচালনার জরুরি এবং তাৎক্ষণিক ব্যয় নির্বাহে ঋণ পাওয়া যাবে। প্রাথমিকভাবে ১ কোটি টাকার মতাে প্রয়ােজন হবে।
সরকারের কাজকর্ম এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় অর্থের অনিবার্য প্রয়ােজনের কথা প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত সচেতন মনে নােট করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তা বাস্তবায়নের বিভিন্ন পদক্ষেপও গ্রহণ করেছিলেন।
যুদ্ধরত বাহিনীর বেতন, বেসামরিক কর্মচারীদের বেতন, দেশের অভ্যন্তরে বেসামরিক জনগণের জন্য নিত্য প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি। (যেমন লবণ, ভােজ্য তেল, চাল, দেয়াশলাই ইত্যাদি) সরবরাহ বিষয়েও প্রধানমন্ত্রী ১৬ এপ্রিল তাঁর নোেট বইয়ে লিখেছিলেন। মুক্তাঞ্চলে উৎপাদিত ফসল এবং দ্রব্য (যেমন, চা, পাট, মাছ, কাগজ, শুটকি মাছ, চামড়া ইত্যাদি) বিক্রয় করে তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ সরকারি তহবিলে জমা রাখার কথাও তিনি ভেবেছিলেন-এ বিষয় তাঁর ১৬ এপ্রিলে লেখা নােটে দেখা যায়। এসব নােট লিখে শুধু বসে থাকেননি তিনি, এগুলাে নিয়ম অনুসরণ করে কার্যকর করার ব্যবস্থাও নিয়েছিলেন। মন্ত্রিসভার বৈঠকে যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হতাে, তার অধিকাংশই প্রধানমন্ত্রীর চিন্তাপ্রসূত ছিল। মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যের প্রস্তাবও সিদ্ধান্ত আকারে গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের জমাকৃত অর্থের স্থানকেও ‘ট্রেজারি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। সরকারের কেন্দ্রীয় ট্রেজারির অবস্থান ছিল কোলকাতায় ৯ নম্বর পার্ক সার্কাসে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশন অফিসের একটি কক্ষে। কেন্দ্রীয় ট্রেজারির অফিসার ছিলেন শ্রী মাখন চন্দ্র মাঝি। তিনি সহকারী সচিবও ছিলেন।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থ সংস্থানের জন্য বাংলাদেশ ফান্ড(Bangladesh Fund) নামে একটি তহবিল খােলা হয়। এই ফান্ডে ভারত, পৃথিবীর অন্যান্য দেশ এবং বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে প্রাপ্ত অর্থ জমা হতাে। সরকার স্বাধীন বাংলাদেশের যে স্মারক ডাকটিকেট বের করেছিলেন তার বিক্রয়লব্ধ অর্থ সরকারি কোষাগারে জমা হয়। স্বাধীন বাংলা ফুটবল দলভারতে বিভিন্ন শহরে প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচে টিকেট থেকে প্রাপ্ত ৩ লক্ষ টাকা সরকারি ট্রেজারিতে জমা করে।
দেশের পূর্বাঞ্চলে, উত্তরাঞ্চলে এবং পশ্চিমাঞ্চলে আঞ্চলিকভাবে সরকারি ট্রেজারি চালু করা হয়েছিল। এসব ট্রেজারি তাৎক্ষণিকভাবে সক্রিয় করা হয়। পূর্বাঞ্চলের ট্রেজারির তত্ত্বাবধান করার ভার প্রথমে এম. আর. সিদ্দিকী নিয়েছিলেন। পরে কিছুকাল আমাকে এই দায়িত্ব পালন করতে হয়েছিল। জুন-জুলাই মাস থেকে আমি এই দায়িত্বমুক্ত হই, কারণ আমি তখন মুজিবনগর সরকারের ক্যাবিনেট সচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমার পর পূর্বাঞ্চলের এই ট্রেজারির দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন ড. কে. এ. হাসান। অন্যান্য অঞ্চলে স্থাপিত ট্রেজারি তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব ছিল প্রধানত আঞ্চলিক প্রশাসক অ্যাকাউন্টস অফিসারদের উপর। প্রতিটি অঞ্চলেই আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ গঠিত হয়। এভাবে গঠিত ট্রেজারিগুলাে আঞ্চলিক প্রশাসকগণ (Zonal Administrators) দেখতেন। তাঁকে সহায়তা করার জন্য ট্রেজারার, সহকারী সচিবসহ অন্যান্য কর্মচারী ছিলেন।
বাণিজ্য বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য-বিষয়াদি দেখার জন্য এম. আর. সিদ্দিকী, এম. এন. এ দায়িত্বপ্রাপ্ত হয়েছিলেন। তিনি তখন ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলার (কৃষ্ণনগরে) অবস্থান করছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে জুন মাসের শেষ সপ্তাহে ভারত-সরকারের আগরতলাস্থ কাস্টমস্ কর্মকর্তা বি. বি. রায় চা-আমদানি বিষয়ে একটি চিঠি এম. আর. সিদ্দিকীর নিকট লিখেছিলেন। চিঠিতে বলা হয় যে, পূর্ববাংলা থেকে আনীত চা বাংলাদেশ সরকারের তত্ত্বাবধানে রয়েছে যা কাস্টমসের ছাড়পত্র ছাড়াই খােলাবাজারে বিক্রি হচ্ছে। তিনি পদ্ধতিগত কিছু নিয়মের কথা উল্লেখ করে কাস্টমসের ছাড়পত্র গ্রহণের অনুরােধ জানান। চিঠিতে এতদসংক্রান্ত আরাে কতিপয় বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল (পরিশিষ্ট ১১৮ দ্রষ্টব্য)। বাংলাদেশ সরকার পরবর্তীতে ভারত-সরকারের সঙ্গে আলােচনা করে বন্ধুসুলভ চুক্তির মাধ্যমে আনীত চা সম্বন্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়।
বাংলাদেশ সরকার অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে একটি বাণিজ্য বাের্ড গঠন করে। এটি স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান হিসেবে কাজ শুরু করে। এই বাের্ড শুধুমাত্র আয়ের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়নি বরং বাংলাদেশের আর্থিক ভিত্তি কীভাবে দৃঢ় হতে পারে সেসব সম্ভাব্য দিক সন্ধানের দায়িত্বও পালন করে। বাংলাদেশে উৎপাদিত পাট, চা, চামড়া, রপ্তানির ব্যবস্থা করতে এই বাের্ড দায়িত্ব পালন করে। সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। এর মধ্যে দেশের ডাক-ব্যবস্থা ক্ষেত্রে ডাকটিকেট প্রবর্তনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। শুধু রাজস্বের জন্যই নয়, দেশের সার্বভৌমত্বের একটি পরিচয় প্রদানের লক্ষ্যে ডাকটিকেট প্রবর্তন করা হয়।
বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য-ব্যবস্থা চালুকরণের নিমিত্ত ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি আলাপ-আলােচনা করেছিলেন। এ-বিষয়ে বাংলাদেশ সরকারের অর্থ ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এবং বাণিজ্য বাের্ড যৌথভাবে ভারত-সরকারের রাষ্ট্রীয় ট্রেডিং কর্পোরেশন ও ভারত-সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দের সাথে আলােচনা করে। এই আলােচনায় পরিবহণ সংক্রান্ত সুবিধা-অসুবিধা নিয়ে কথা হয়। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দর ব্যবহারের অনুপযােগী করে দেওয়ায় তা নিয়ে উভয় পক্ষ চিন্তিত হয়। তবে এই বন্দরগুলাে ব্যবহারােপযােগী হওয়ার পূর্বে ভিন্ন কী উপায়ে রপ্তানি হতে পারে সেসব দিক নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা হয়।
বাজেট প্রণয়ন
সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন খাতের আয়-ব্যয় সম্পর্কিত গতানুগতিক বাজেটের অনুরূপ না হলেও ব্যয়-বরাদ্দের বাজেট অতি যত্নের সঙ্গে তৈরি করা হয়েছিল। প্রত্যেক মন্ত্রণালয়, বিভাগ বা অঙ্গসংগঠন তাদের ব্যয়ের যে-হিসাব (বাজেট) তৈরি করতেন। তাতে সতর্কতার ছাপ থাকত সর্বাধিক। ব্যয়াধিক্য বা বাহুল্য ব্যয়ের কোনাে সুযােগই বাজেটে থাকত না। এমনকি শরণার্থী শিবিরের রক্ষণাবেক্ষণ, ত্রাণসামগ্রী বিতরণ ইত্যাদিতে কোনাে বাহুল্য ব্যয়ের হিসাব থাকত না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, বিভিন্ন মন্ত্রণালয় বা বিভাগ বা সংগঠন থেকে যে ব্যয়-বরাদ্দের হিসাব-সম্বলিত বাজেট মন্ত্রিসভায় উপস্থাপিত হতাে তাতে দেখা যেত প্রকৃত ব্যয়ের অতিরিক্ত এক টাকাও ধরা হয়নি। সাধারণত সরকারের বাজেটে টাকা-আনা-পাইয়ের হিসাব প্রদর্শিত হয় না, পূর্ণ সংখ্যায় (round figure-এ) থােক বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে যেসব বাজেট তৈরি করেছিল সেগুলােতে প্রকৃত ব্যয়ের পরিমাণ প্রদর্শন করে বাজেট তৈরি হয়েছে। এ থেকে বােঝা যায়, সরকার রক্ষণশীল ও সংযমী মনােভাবের পরিচয় দিয়েছে। দু-একটি দৃষ্টান্ত থেকে এ-কথার সারবত্তা প্রমাণিত হবে।
সরকারের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টের এমন একটি বাজেটে দেখা যায় যে, বিভিন্ন খাতে ২,০০,৪০০/-রুপি ব্যয়ের হিসাব প্রদর্শিত হয়েছে। এই পরিমাণ অর্থ বরাদ্দের জন্য অনুরােধ জানানাে হয়েছিল (পরিশিষ্ট ১১৯ দ্রষ্টব্য)। আবার সরকারের বিভিন্ন বিভাগ, শাখা, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, শিক্ষকবৃন্দের বেতন-ভাতা ইত্যাদি বাবদ মাত্র ১০,৬৬,৫০০/- রুপি, ৩,৬২,৫০০/- রুপি, ৬,১৭,৫০০/-রুপি একুনে ২০,৪৬,৫০০/-রুপি বাজেট অনুমােদনের জন্য পেশ করা হয়েছিল।
অর্থ ব্যয়ে বাংলাদেশ সরকারের কৃচ্ছতা অবলম্বনের দৃষ্টান্ত অপূর্ব। বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক ব্যয়ের রাশ টেনে ধারার এই দৃষ্টান্ত অন্য কোন দেশে বিরল। বাজেট নিয়ন্ত্রণ-ব্যবস্থা (check and balance) একটি স্বীকৃত বিষয়। তৎকালীন মুজিবনগর সরকার এই পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলেন।
অনভিপ্রেত মন্তব্য
অর্থব্যয়ের ক্ষেত্রে সরকারের স্বচ্ছতা ও কৃচ্ছ মনােভাব সত্ত্বেও সরকারের অর্থ-ব্যয় নিয়ে অনেক কাল্পনিক, অসত্য কথা পাকিস্তানি এজেন্টরা প্রচার করে। তাদের অপপ্রচারে মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয়। কিন্তু আমি মনে করি, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব অত্যন্ত স্বচ্ছ ছিল। কোথাও কোনােপ্রকার অপচয়ের ঘটনা ঘটেনি। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশপ্রেমিক বাঙালির মনে লুটপাটের কথা মনেই আসেনি। আমি এমন অনেক দেশপ্রেমিককে জানি, যারা যুদ্ধের সময় হাতের নাগালের মধ্যে পেয়েও অস্বাভাবিক উপায়ে অর্থসম্পদ স্পর্শও করেননি। বরং, তারা অরক্ষিত সম্পদ লুটপাট হয়ে যাওয়া থেকে রক্ষা করেছেন এবং সেসব সরকারি কোষাগার, মহাফেজখানায় জমা করার ব্যবস্থা করেছিলেন।
তবে, চোর-বদমায়েশ দেশে ছিল না, তা বলব না। তৎকালীন রাজাকার, আলবদর, আল শামসদের সহায়তায় এসব চরিত্রহীন দস্যু, দেশের কিছু শত্রু অবৈধভাবে সম্পদ লুটে নিয়ে রাতারাতি ধনী হয়েছে। খুন করেও এরা সম্পদের মালিক হয়েছে। আজকের বাংলাদেশে এসব লােক আবার মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে লুটপাট, ডাকাতি, হত্যা, ভিটেমাটি ছাড়া করেছে নিরীহ মানুষজনকে। মনে রাখতে হবে, সন্ত্রাসীদের জন্য বাংলাদেশের সৃষ্টি হয়নি।
আয়-ব্যয় সম্পর্কে কল্পকাহিনী ও অসত্য মন্তব্যের বিরুদ্ধে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকার বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। অর্থ-কেলেঙ্কারির সঙ্গে যাদের নাম যুক্ত হয় তাদের সম্বন্ধে তদন্ত করতে কমিশন গঠিত হয়েছিল। মন্ত্রিসভার ১৬-৮-৭১ তারিখে অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি কমিশন গঠিত হয়। কমিটিতে নিম্নলিখিত ব্যক্তিবর্গ অন্তর্ভুক্ত ছিলেন:
১. মি. এ. হান্নান চৌধুরী চেয়ারম্যান
২. মি. জে. জি. ভৌমিক সদস্য
৩. মি. এস. বড়য়া সদস্য সচিব
কমিশনের দায়-দায়িত্ব ও কাজের বিষয়বস্তু নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। ঐ সিদ্ধান্তে বলা হয় যে, যত শীঘ্র সম্ভব কমিশনকে প্রতিবেদন পেশ করতে হবে। আমি (লেখক) ঐ সিন্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে একটি অফিস-আদেশ জারি করেছিলাম। [১৩৫ (২৫)/ক্যাব, ১৬-৯-৭১]। তাতে বলা হয়, বাংলাদেশের অধিকৃত অঞ্চল থেকে আনীত সম্পদ ও অর্থের পরিমাণ তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠিত হয়েছে। এই কমিটি যথাসময়ে তার প্রতিবেদন মন্ত্রিসভায় পেশ করেছিলেন।
পরিকল্পনা সেল, বাের্ড কমিশন
বাংলাদেশ সরকার যাবতীয় পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য একটি পরিকল্পনা সেল গঠন করেন। ক্রমবর্ধমান চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এই সেলকে একটি বাের্ডে রূপান্তরিত করা হয়। কিন্তু তাতেও প্রয়ােজনীয়তা পূরণ না-হওয়ায় এটিকে কমিশনে সংগঠিত করা হয়। ভারতীয় প্রানিং কমিশনের আদলে প্ল্যানিং বাের্ডকে সম্প্রসারিত করা হয়। এভাবে সরকারের গঠিত পরিকল্পনা কোষকে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা কমিশনে সংগঠিত করা হয়েছিল। ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে চেয়ারম্যান নিয়ােগ করে নিম্নলিখিত সদস্যবৃন্দ সমন্বয়ে পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল:
ক. ড. খান সরওয়ার মাের্শেদ
খ. ড. মুশাররফ হােসেন
গ. ড. এস. আর. বােস
ঘ. ড. আনিসুজ্জামান
পৃষ্ঠা: ২০০
কমিশন বুদ্ধিজীবী ও পেশাজীবীদের মধ্য থেকে এর নিজস্ব কর্মকর্তা-কর্মচারী নিয়ােগ করেছেন।
কমিশনের ওপর নিম্নোক্ত কার্যাবলির দায়িত্বভার অর্পণ করা হয়:
ক. বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ঘােষণাপত্র (ম্যানিফেস্টো) এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগের উর্ধ্বতন নেতৃবৃন্দ (হাই কমান্ড) কর্তৃক প্রণীত উদ্দেশ্যাবলির ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রণয়ন।
খ. দেশ ও অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন মধ্য-মেয়াদী পরিকল্পনা প্রণয়ন। এই পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
গ. যেহেতু পুনর্গঠন একটি অতি বৃহৎ কাজ সেহেতু সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে সরকারের পক্ষে কোনােরূপ কালক্ষেপণ করা ঠিক হবে না। যেহেতু সকল পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে আমাদেরকে এখনই প্রস্তুত থাকতে হবে, সেহেতু পরিকল্পনা-প্রণয়ন বাস্তব অর্থেই অতি জরুরি হিসেবে পরিগণিত হয়েছে।
দেশের তাৎক্ষণিক পুনর্গঠনের জন্য নিচের সমস্যাদির দিকে মনােযােগ দিতে হয়েছে:
ক. বাস্তুহারাদের পুনর্বাসনের সমস্যা
খ. উচ্ছেদকৃত লােকদের বাসস্থান সমস্যা
গ. খাদ্য সরবরাহ
ঘ. যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনঃস্থাপন
ঙ. সাধারণ সুবিধাদি, যেমন স্বাস্থ্য, বিদ্যুৎ, পানি, হাসপাতাল ইত্যাদির পুনর্বাসন
চ. ক্ষতিগ্রস্ত সকল বন্দর, কারখানা, শিল্পপ্রতিষ্ঠান ইত্যাদি পুনরায় চালু করা
ছ. আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা
জ. শিক্ষার সুযােগ-সুবিধাদি পুনঃস্থাপন
ঝ. যতটুকু সম্ভব মুক্তিবাহিনীতে যােগদানকারী যুবকদের শিক্ষার ব্যবস্থা করা
ঞ. সরকারের ঘােষিত নীতি অনুযায়ী ব্যাংক, ইনস্যুরেন্স ও অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানজাতীয়করণ আরম্ভ করা
ট. ব্যবসা ও বাণিজ্যের পুনর্বাসন
ঠ. দেশের ভবিষৎ বাণিজ্য; ইত্যাদি
পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সরকারকে বিশেষজ্ঞ পরামর্শ প্রদান করত। পরিকল্পনাকোষে (Planning Cell) কর্মচারীদের যােগদানের প্রতিবেদন (joining report) চেয়ারম্যান মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী সরকারের অর্থসচিবকে জানিয়ে ৩.১২.৭১ তারিখের পিসি-১৩০/৭১ সংখ্যক একটি স্মারক প্রেরণ করেছিলেন (পরিশিষ্ট ১২০ দ্রষ্টব্য)। এর কপি সাধারণ প্রশাসন বিভাগ, ক্যাবিনেট বিভাগ, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সচিবগণকে এবং ট্রেজারি অফিসারের নিকটও প্রেরিত হয়।
কিন্তু এর অনেক আগেই পরিকল্পনা কমিশন গঠিত হয়েছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ২৩ সেপ্টেম্বর তারিখে লেখা নােট থেকে এ-বিষয়টি সম্বন্ধে জানা যায়। সচিব এই নােটে বাংলাদেশের শত্রুমুক্ত এলাকায় নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদি, যেমন চাল, লবণ, সরিষার তেল ইত্যাদিসহ কিছু কেরােসিন তেল ও ওষুধ সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য একটি স্কিম তৈরি করতে প্ল্যানিং কমিশনকে অনুরােধ জানান। এই স্কিম তৈরি করতে যা-যা প্রয়ােজন সে সম্বন্ধে উল্লেখ করার জন্যেও কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মুজাফফর আহমদ চৌধুরীকে অনুরােধ করা হয়। বিষয়টি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর গােচরে রয়েছে জানিয়ে স্কিমটি অবিলম্বে তৈরি করে দিতে বলা হয়েছিল (পরিশিষ্ট ১২১ দ্রষ্টব্য)। কমিশনের অপর দুই সদস্য ড. মুশাররফ হােসেন এবং ড. এস. আর. বােসের নিকট ১৬২(৩)-ক্যাব সংখ্যক নােটটি পাঠানাে হয়।
স্কিম প্রসঙ্গে সরকার কমিশনকে অবশ্য একটি ধারণা দিয়েছিল। ঐ ধারণা অনুযায়ী স্কিমে দুইটি বিষয়ে স্পষ্ট পরিকল্পনা দিতে বলা হয়। প্রথম পরিকল্পনায় আপৎকালীন বিষয় এবং দ্বিতীয় পরিকল্পনায় দীর্ঘমেয়াদী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে বলা হয়। আপকালীন স্কিম পুনর্বাসন এবং দীর্ঘমেয়াদী স্কিম পুনর্গঠন ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন সংক্রান্ত হবে। সরকারের উপরে বর্ণিত নােটের পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ সেপ্টেম্বর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী কিছু তথ্য চেয়ে ক্যাবিনেট সচিবের নিকট পিবি/৬৩/৭১ সংখ্যক একটি পত্র দেন (পরিশিষ্ট ১২২ দ্রষ্টব্য)। এই চিঠিতে কমিশনের চেয়ারম্যান শত্রুমুক্ত এলাকার ভৌগােলিক অবস্থান, যােগাযােগ ব্যবস্থা, এলাকাগুলির মােটামুটি সংখ্যা, এসব এলাকা কীভাবে পরিচালিত হচ্ছে, বিতরণসামগ্রী কীভাবে দেওয়া হবে অর্থাৎ মূল্যের বিনিময়ে কিংবা বিনামূল্যে ইত্যাদি সম্বন্ধে জানাতে বলেছিলেন। বাংলাদেশ সরকারের সচল কর্মপদ্ধতির দৃষ্টান্ত এসব চিঠি ও মেমাে থেকে পাওয়া যায়।
প্ল্যানিং কমিশনের পত্র প্রাপ্তির পর যথাসম্ভব তথ্য তাদের সরবরাহ করা হলে কমিশনের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি হিসেবে টেকনিক্যাল ডিভিশনের প্রধান এম. এ. গাফফারসহ কয়েকজনকে উপদ্রুত এলাকায় গিয়ে সরেজমিনে পরিদর্শনের প্রস্তাব দেওয়া হয়। এজন্য একটি পরিবহণের ব্যবস্থা করতে অনুরােধ জানানাে হয়। সরকার এ-প্রস্তাবের পক্ষে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়।
বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে শত্রুমুক্ত হলে কীভাবে দেশের পুনর্গঠন, উন্নয়নমূলক কাজকর্ম এবং সরকারের বিভিন্ন বিভাগ পরিচালিত হবে, তার একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা তৈরি করে এই কমিশন। এই পরিকল্পনার পূর্ণ বিবরণ ইতােমধ্যে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ, দলিলপত্র গ্রন্থের ৩য় খণ্ডে সন্নিবেশিত হয়েছে। এ থেকে বােঝা যাবে বাংলাদেশ সরকার মুজিবনগরেই ভবিষ্যৎ কর্ম-পরিকল্পনা আগেই তৈরি করেছিল। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে সরকারের সকল কর্মকাণ্ডের রূপরেখা ও পরিকল্পনা আগেই তৈরি করা হয়েছিল। কত বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন ছিল তৎকালীন সরকার। বর্তমান কাল(২০০৪ সাল) পর্যন্ত তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার প্রবর্তিত ধারা অনুসৃত হচ্ছে। তৎকালীন বাংলাদেশ সরকার দেশের প্রশাসনযন্ত্র পরিচালনায় পথিকৃতের ভূমিকা পালন করেছে, বলা চলে।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আমার ডায়েরি
১৯৭১ সালের ১ মার্চ তারিখে সচিবালয়ে কাজ সেরে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ (তৎকালীন জিন্নাহ অ্যাভিনিউ)- এ আমার যাওয়ার কথা। দুপুর ১২টা-১টার দিকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রেডিওতে ভাষণ দেন। রাজধানীর পরিস্থিতি আচমকা পাল্টে যায় তাঁর ভাষণের পর পর। জাতীয় সংসদের অধিবেশন বাতিলের ঘােষণা পূর্ববাংলার জনগণ জুলফিকার আলী ভুট্টো এবং পাঞ্জাবী শাসকদের ষড়যন্ত্র বলে বুঝল। পূর্ববাংলার সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠল। ঢাকার মতিঝিলে অবস্থিত হােটেল পূর্বাণীর সামনে সমবেত জনতার উদ্দেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সংক্ষিপ্ত-ভাষণে ইয়াহিয়ার কঠোর সমালােচনা করেন এবং ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সতর্ক অবস্থান গ্রহণের জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। পরিস্থিতির অবনতি হওয়ায় আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যত শীঘ্র সম্ভব রাঙামাটি ফিরে যাব।
পার্বত্য চট্টগ্রামে
এ-সময় আমি পার্বত্য চট্টগ্রামের ডেপুটি কমিশনার। সরকারি কাজে ঢাকায় এসেছিলাম ২৮ ফেব্রুয়ারি তারিখে। চট্টগ্রাম হয়ে ১ মার্চ রাতেই যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম ট্রেনযােগে। রেলের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা আমার ভগ্নীপতি (মরহুম) হােসেন আহমেদ ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম মেলে ফিরছিলেন তার কর্মস্থলে। ট্রেনে তার সেলুনে আরাে কয়েকজন কর্মকর্তা ছিলেন। মনে পড়ছে, হামেদ সফিউল ইসলামের কথা। তিনিও আমাদের সঙ্গে ছিলেন। সারারাত ট্রেন ভালােভাবেই চলল। ভােরের দিকে ফৌজদারহাটে ট্রেন থেমে পড়ল। আর এগুতে পারেব না। সামনে লাইনের উপর বড় বড় গাছের গুঁড়ি। কিছুক্ষণ পর ঠিক করলাম হেঁটেই চট্টগ্রাম যাব, মাত্র ৬/৭মাইল পথ।
সকাল ৯টার দিকে রেলওয়ে কলােনিতে আমার বােনের বাসায় পৌঁছলাম। আমার অফিসের জিপগাড়ি আগে থেকেই সেখানে অপেক্ষা করছিল। ফোনে চট্টগ্রামের ডিসি এবং পুলিশ সুপারকে না পেয়ে এসপি শামসুল হকের বাসায় গেলাম। রেলওয়ে বিল্ডিঙের কাছেই তার বাসা। সেখান থেকে লালদীঘির ময়দান। ময়দানে তখনই জনতার ঢল নামতে শুরু করেছে-বিকেলে জনসভা। কন্ট্রোল-রুমে সেনাবাহিনী, ই. পি. আর. এবং পুলিশ গিজগিজ করছে তাদেরও প্রস্তুতি চলছে। বিশ্ববিদ্যালয়, রাওজান, হাটহাজারী হয়ে যেতে হয় বলে রাস্তায় দেহরক্ষী নেওয়া প্রয়ােজন। হাটহাজারীর পর আমার এলাকা- সেখানে আমি নির্ভয়ে এবং নিশ্চিন্তে চলাফেরা করি। খোঁজখবর নিয়ে এবং কয়েকজন পুলিশ সাথে নিয়ে চট্টগ্রাম থেকে রওনা হয়ে গেলাম।
আরেকজনকে আমাদের সঙ্গে নিলাম। সে আমার বড় মেয়ে মুনমুন। আমার বােনের কাছেই থাকত। চট্টগ্রামে সেন্ট মেরি স্কুলে পড়ত। সেদিন মেয়েকে না নিয়ে গেলে বাপ-মায়ের কাছ থেকে সে একেবারেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ত। পরবর্তী ১০ মাস কী দুঃসহনীয় অবস্থায় কাটত মেয়েকে ছাড়া, ভাবতেও খারাপ লাগে এখন। মেয়ে ফেলে যেতে পারতাম কিনা- স্বাধীনতাযুদ্ধে যােগদান করতে পারতাম কিনা তাও জানি না। আমার এক ভাগ্নেও (মাহফুজ) আমার সাথে রাঙামাটিতে আসে সেদিন। তাকে তার পিতামাতার কাছে পরবর্তীকালে ফেরত পাঠানাে এক দুঃসাহসিক ব্যাপার ছিল। সে আরেক ঘটনা।
২মার্চের পর ঘটনাবলি অত্যন্ত দ্রুত এগিয়ে চলে, প্রেক্ষপটও পরিবর্তিত হয় সেইসাথে। ৩ মার্চ চট্টগ্রামে যে-ঘটনা ঘটে পরবর্তীকালে ঘটনার মধ্যে তা হয়তাে অনেকটা চাপা পড়ে গিয়েছে। অনেকেই বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু আমার মনে গাঁথা আছে।
৩ মার্চ দুপুরের দিকে খবর পেলাম চট্টগ্রামে প্রচণ্ড গােলযােগ হচ্ছে। ২ মার্চ বিকেলে জনসভার পর অনেক মিছিল বের হয়। এসব মিছিলের উপর বিহারীরা সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় হামলা চালায়। শেরশাহ্ কলােনি, ফিরােজ শাহ্ কলােনি, পাহাড়তলি প্রভৃতি স্থানে হামলা চলে। লালদীঘি ময়দানে আগমনরত এবং প্রত্যাবর্তনের পথে মিছিলের উপরে সুপরিল্পিতভাবে আক্রমণ চালানাে হয়। এতে একটা জিনিস সুস্পষ্ট হয় যে, সেনাবাহিনী এবং অবাঙালিরা আগে থেকেই তৈরি ছিল এবং বাঙালিদের প্রতিরােধ করার জন্য যথেষ্ট প্রস্তুতি তারা নিয়েছিল।
চট্টগ্রাম থেকে খবর পাওয়া যায় যে, অবাঙালি ঘাঁটিগুলােতে সেনাবাহিনীর স্পেশাল গ্রুপ (কমান্ডাে) এবং গুপ্তচরেরা আগে থেকেই অবস্থান নিয়েছিল এবং এসব জায়গা থেকে নিরস্ত্র জনতার ওপর গুলি চালানাে হয়। শুধু তাই নয়, অনেক স্থানে মারাত্মক অস্ত্র নিয়ে সরাসরি আক্রমণও পরিচালনা করা হয়। এমনকি এদের মেয়েরা বাড়ির ছাদ থেকে গরম পানি ঢেলে দেয় জনতার ওপর।
সবচেয়ে মারাত্মক ঘটনা ঘটে চট্টগ্রামের কমিশনার সাহেবের উপস্থিতিতে। কমিশনার জামিলুর রহমান খান কট্টর উর্দুভাষী। বাংলাদেশের কোটায় সিভিল সার্ভিসে তিনি চাকুরি পেয়েছিলেন। তিনি মনেপ্রাণে ঘৃণা করেন এতদ্অঞ্চলের মানুষ, আচার, অনুষ্ঠান, ভাষা, কৃষ্টি সবকিছু। তিনি আগে থেকেই বাঙালি-বিদ্বেষী। যদিও আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখা তার দায়িত্ব নয়, তবুও একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলে তিনি আমাদের উপর কর্তৃত্ব করার চেষ্টা করেন। তদুপরি আমি তার অধীনে এস. ডি. ও. ছিলাম রাজশাহীতে। এই কমিশনার ভদ্রলােক চট্টগ্রামের ডি. এম. এল. এ. (জেলা সামরিক আইন প্রশাসক)-কে সাথে নিয়ে বাঙালিদের ওপর যথেষ্ট নির্যাতন চালায়।
রাঙামাটিতে
রাঙামাটিতে আমাদের পুলিশ সুপার ছিলেন জনাব বজলুর রহমান। শান্ত, সৌম্য ভদ্রলােক। বেশ বয়স হয়েছে, প্রমােশন পেয়ে উঠেছেন। অবসর নেবার সময়ও হয়ে এসেছে তখন তার। আমাদের দুই পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠতা। আইন-শৃঙ্খলা বিষয়ে আমাকে কোনাে কথা জিজ্ঞাসা না করে করেন না। পুলিশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারেও আমার সাথে পরামর্শ করেন। রাঙামাটিতে অফিসারের সংখ্যা কম- আমি সকলকে চিনি। পুলিশ লাইনেও আমার ঘন ঘন যাতায়াত। রাঙামাটিতে আমাদের খবর আদানপ্রদানের দুটি ভালাে ব্যবস্থা ছিল: একটি পুলিশের এবং আরেকটি ই. পি. আর. (আজকের বি.ডি.আর.) বেতার- সেট। জেলার সমস্ত থানা এবং ই. পি. আর. এবং বি. ও. পি. (বর্ডার আউট পােস্ট) উইংসমূহ রাঙামাটির সাথে সংযুক্ত ছিল ওয়্যারলেসের মাধ্যমে। ই.পি.আর.-এর ওয়্যারলেস ছিল কোর্টের পাশে। পুলিশেরটা ছিল তাদের লাইনে। নিজে সরাসরি কথা বলতে হলে আমাকে এই দুই জায়গায় যাতায়াত করতে হতাে।
আমি রাঙামাটিতে ফিরে আমার অফিসের সকল কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ডেকে নিলাম। আমার সহকর্মীদের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা ছিল সৈয়দ আবদুস সামাদের। তিনি ছিলেন অ্যাডিশনাল ডেপুটি কমিশনার এবং পুনর্বাসন অফিসার। ঐ সময় টগবগে তরুণ। প্রখর বাঙালি জাতীয়তাবাদী এবং স্পষ্টভাষী। দ্বিতীয় জন ছিলেন এম.ই. শরিফ, ম্যাজিস্ট্রেট এবং সহকারী পুনর্বাসন অফিসার। তিনিও ছিলেন খুব স্বাধীনচেতা এবং উদার মনের মানুষ।
রাঙামাটি সদরের এস. ডি. ও. আবদুল আলি ছিলেন আরেক মহৎপ্রাণ, বাংলাদেশের জন্য নিবেদিত। আবদুল আলি মুক্তিযুদ্ধে শহীদ। এপ্রিলে পাকিস্তানি সেনারা রাঙামাটি দখলের সাথে সাথে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। সে-সময় তিনি রামগড়ের পথে যাত্রার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা অমানুষিক অত্যাচার করে আলির ওপর, আমার গতিবিধি এবং কার্যকলাপ জানার জন্য। শহীদ আবদুল আলি নিজে প্রাণ দিয়ে আমাদের নিরাপত্তা রক্ষা করেছেন। তিনি শত অত্যাচারেও মুখ খােলেননি কিংবা আমাদের গতিবিধি ও কাজ সম্বন্ধে শত্রুদের কাছে কিছু ফাঁস করেননি।
এম.এ. শরিফ সাহেবকে বিজয়ের সাথে সাথে রাঙামাটিতে পাঠানাে হয় ডেপুটি কমিশনার করে। পরে অনেকদিন চাকুরিতে ছিলেন। বেশ কয়েক বছর আগে তিনি ইন্তেকাল করেছেন।
এস.এ. সামাদ এবং এম.ই. শরিফ রাঙামাটিতে আমাদের সাথে আলােচনার সাথে সাথে বের হয়ে পড়েন সমগ্র পার্বত্য এলাকায় ই.পি.আর. ও পুলিশবাহিনীকে মানসিক প্রস্তুতি ও সংগঠিত করতে। তাদের দায়িত্ব ছিল জেলার বিভিন্ন থানা, বড় বড় হাট-বাজার ও পুলিশ ক্যাম্পে জওয়ানদের সাথে কথা বলা ও তাদেরকে আসন্ন স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য অনুপ্রাণিত করা। আরও কঠিন গুরুদায়িত্ব ছিল সীমান্ত এলাকার সকল ই.পি.আর. বর্ডার আউট পােস্টে (BOP) গিয়ে বাঙালি অফিসারদের সাথে কথা বলা ও গােপন ইঙ্গিত দিয়ে আসা। এই সব বি.ও.পি. -তে কমিশনড় অফিসার ছিলেন না- ছিলেন জে.সি.ও. এবং এন.সি.ও. (যেমন সুবেদার. হাবিলদার, নায়েক এরা)। কয়েকজন সুবেদার মেজর নায়েক সুবেদার ছিলেন। এদেরকে বলা হলাে যে, তারা যেন কোনাে অবস্থাতেই পশ্চিমাদের কথামতাে হাতিয়ার সমৰ্পণ না করেন। সময় হলে সিগনাল দেওয়া হবে। তারা সাথে সাথে পশ্চিমাদের বন্দি করবে ও যুদ্ধের জন্য রাঙামাটিতে এসে জমায়েত হবে।
পাকিস্তানি মার্শাল-ল তখনও পুরােপুরি বহাল। কী সাংঘাতিক ও ঝুঁকিপূর্ণ কাজ ছিল সামাদ আর শরিফের। তারপর ঐ রকম দুর্গম এলাকা-বন-জঙ্গল, পাহাড় আর বন্যপশু চারদিকে। সামাদ আর শরিফের চমৎকার সচলতা এবং যােজনার (mobilization) ফল আমরা ২৫/২৬ মার্চে হাতে-হাতে পাই। কঠোর পরিশ্রম আর উদ্যমের সাথে তরুণ সামাদ আর প্রৌঢ় শরিফ সমগ্র পার্বত্য-অঞ্চল চষে বেড়িয়েছেন। অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক তরুণ সামাদকেই নেতৃত্ব দিতে হয়েছে। প্রথমে কাপ্তাই, চন্দ্রঘােনা তারপর একে একে মারিশ্যা, জালিয়ানপাড়া, মহালছড়ি, মানিকছড়ি, মাসালং, দিঘিনালা, খাগড়াছড়ি, বরকল ইত্যাদি জায়গা থেকে সিগন্যাল এল সামাদের: আমরা সফল, সকলে প্রস্তুত। এখন চূড়ান্ত আহ্বানের অপেক্ষা। ২৫ মার্চ রাতে ক্যাপ্টেন হারুনের সাফল্য ও তারপর একে একে যেভাবে সবগুলাে বি.ও.পি. থেকে ই.পি.আর, জওয়ানেরা রাঙামাটিতে সমবেত হলেন তা পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া কিছুতেই সম্ভব ছিল না।
এস.ডি.ও. আবদুল আলি নিজে লঞ্চ নিয়ে বরকল ও আশেপাশের জওয়ানদের রাঙামাটিতে নিয়ে এলেন। পার্বত্য চট্টগ্রামের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও ডাকলাম। সকলে মিলে পরামর্শ করা হলাে। পরিস্থিতির ভয়াবহতা আমাদের ভাবিয়ে তুলল। ঠিক
পৃষ্ঠা: ২০৫
হলাে, আমরা অবাঙালি আর পাঞ্জাবিদের অন্যায় আঘাত প্রতিহত করব। আমার কর্মস্থলের সীমান্ত এলাকা দীর্ঘ হওয়ায় বর্ডার আউট পােস্টের সংখ্যাও ছিল অনেকগুলাে। এগুলােতে বাঙালি জে.সি.ও., জমাদার, সুবেদার ছিল প্রচুর সংখ্যায়; কিন্তু কমিশনড কর্মকর্তা ছিল প্রায় সবাই পাঞ্জাবি এবং অবাঙালি।
যাহােক, বাঙালি জুনিয়র অফিসার, সুবেদার, জমাদারদের আমাদের সিদ্ধান্তের কথা জানিয়ে দেওয়া হলাে। এদের সঙ্গে ওয়্যারলেসে-সরঞ্জাম ছিল। এগুলাের নেটওয়ার্ক ভালাে কাজ করছিল। ঢাকার সব খবরই আমরা পাচ্ছিলাম। আমাদের এই অঞ্চলের লােকের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা লক্ষ্য করছিলাম। বঙ্গবন্ধু দেশকে বাঁচানাের জন্য নিজের জীবন বাজি রেখেছেন, এ-কথা দেশের পূর্বাঞ্চলে বসে বােঝার উপায় ছিল না।
এর মধ্যে ৭ মার্চের পর বিভিন্ন সময় ঢাকা থেকে আমাদের কাছে বুলেটিন আসতে শুরু করল। জাতীয় পতাকার নমুনা (পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র সােনালি রঙে), জাতীয় সংগীত (আমার সােনার বাংলা পুরােটাই), স্বাধীনতা ঘােষণা ইত্যাদি সম্বন্ধে আমরা অবহিত হতে থাকলাম। অবশ্য এর অনেক আগেই ছাত্ররা স্বাধীনতার কথা বলে ফেলেছে। ৭ মার্চের পরেই তাে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়েছে এরা। রব, তােফায়েল, মাখন এরা পতাকা উড়িয়েছে, তারপর জাতীয় সংগীত গাওয়া হয়েছে এবং সেগুলাে একেবারে রাঙামাটির মতাে জায়গাতেও বুলেটিনের আকারে এসে গেছে। কাজেই দেশের স্বাধীনতাযুদ্ধ অনানুষ্ঠানিকভাবে সেদিনই ঘােষিত হয়ে গেছে।
৭ মার্চে বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার পর রাঙামাটিতে সবকিছু বুঝে গােছাতে আমাদের কয়েকদিন সময় লেগেছিল। ১০-১১ তারিখের দিকে ছাত্রমহল থেকে সঠিক সংবাদ পাওয়া শুরু করলাম। ইতােমধ্যে একদিন আমার সি.এ. (Confidential Assistant) কাজী মাইনুদ্দীন স্বাধীনতা ঘােষণার খসড়া, বাংলাদেশের পতাকার নমুনা এবং আমার সােনার বাংলা জাতীয় সংগীত ঘােষণার কাগজপত্র এনে দেখাল। ঢাকার সাথে ছাত্রদের সরাসরি যােগাযােগ ছিল, সে-সুবিধা আমাদের ছিল না। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে অসহযােগ আন্দোলন আরম্ভ হওয়ার পর থেকেই তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার একেবারে অচল হয়ে যায়। তখন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেব যেসব নির্দেশ দিচ্ছিলেন তাই দেশবাসী পালন করছিল। পুলিশ বলতে গেলে একরকম নিষ্ক্রিয় আইন-শৃঙ্খলার কোনাে সমস্যাও ছিল না। ১০ মার্চ থেকে ১৭ মার্চ মােটামুটি এইভাবে কাটল। এর মধ্যে এমন কিছু খবর এল যা রীতিমতাে উদ্বেগজনক। একটি ঘটনা আমার স্পষ্ট মনে আছে। সন্ধ্যার সময় এস.পি. বজলুর রহমান কয়েকজন ছাত্রনেতা এবং ই.পি.আর. ওয়্যারলেস স্টেশনের অপারেটরকে আমার কাছে নিয়ে এলেন। সবাই বেশ উত্তেজিত। চট্টগ্রাম ই.পি.আর. সদর দপ্তর (সেক্টর অথবা উইং) থেকে নির্দেশ পাঠানাে হয়েছে সকল বর্ডার আউট পােস্টে (BOP) যে, তাদের কাছে যে-সমস্ত ভারী অস্ত্রশস্ত্র (হেভি মেশিনগান এবং মর্টার) আছে সেগুলাে নিয়ে যেন চট্টগ্রামে জমা করেন। বি.ও.পি.-গুলাে থেকে সাফ জবাব: অস্ত্রসমর্পণ কোনােভাবেই নয়। কথাটা বলা সহজ, কিন্তু করা নয়। তখন মার্শাল-ল চলছে, মিলিটারি রাজত্ব। নির্দেশ অমান্য করা মানে অবধারিত কোর্ট মার্শাল। আর মানতে গেলে প্রাণ যাবে। পাঞ্জাবিদের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। অস্ত্র কেড়ে নিয়ে হামলা চালাবে।
আমার কাছে ই.পি.আর.-এর প্রতিনিধি পরামর্শ চাইলেন। আমি উপায় বের করলাম একটা। চট্টগ্রাম নিতে হলে রাঙামাটিতে সব অস্ত্র আনতেই হবে। এখানে আনার পর সড়কপথে ট্রাকযােগে চট্টগ্রাম পাঠানাে হবে। বি.ও.পি. থেকে উইং-এ খবর যাবে এই মর্মে: অস্ত্র পাঠানাে হলাে। রাঙামাটি থেকে চট্টগ্রাম মেসেজ পাঠানাে হবে: ট্রাক রওনা হয়ে গেছে। এর পর পথিমধ্যে ছাত্ররা ট্রাক আটকে ফেললে ওরা কী করতে পারে। এমন এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হলে তা মােকাবিলা করা সহজ নয়। চট্টগ্রাম বসে অসহায় পাঞ্জাবি অফিসার কী করবে। তারজন্য সড়কপথে পরিদর্শন করা বিপজ্জনক ও ঝুঁকিপূর্ণ।
১৬ মার্চ রাতে চট্টগ্রাম থেকে সহকর্মী ডেপুটি কমিশনার মুস্তাফিজুর রহমান টেলিফোনে জানালেন যে, পরদিন (১৭ মার্চ) সকালে যেন তাঁর বাংলােয় উপস্থিত হই। জরুরি বার্তা আছে, টেলিফোনে বলা যাবে না।
১৭ মার্চ সকালে হাজির হলাম ডি, সি, মুক্তাফিজুর রহমানের বাংলােয়। সেখানে বসে আছে সহকর্মী মহিউদ্দীন খান আলমগীর। ঢাকা থেকে তাকে ব্যক্তিগত বার্তা দিয়ে পাঠিয়েছেন তৎকালীন সি.এস.পি. সমিতি (CSP-Civil Service of Pakistan), পূর্ব পাকিস্তান শাখা। সমিতির নিয়ম অনুযায়ী প্রেসিডেন্ট হলেন চিফ সেক্রেটারি নিজে। আর শফিউল আজম হলেন সেই ব্যক্তি আমাদের বার্তার সাথে তার কোনাে সংস্রব নেই। সেটার দায়িত্ব প্রাদেশিক সরকারের সচিব এবং সমিতির সাধারণ সম্পাদক মুজিবুল হক সাহেবের। বিষয়বস্তু হলাে এই যে, আমাদের সমিতির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা অসহযােগ আন্দোলনের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করছি এবং আওয়ামী লীগের পক্ষে তাজউদ্দীন আহমদ সাহেবের নির্দেশাবলি মেনে চলব।
পরবর্তী বার্তা হলাে ঢাকা থেকে কেন্দ্রীয় শীর্ষ নেতা ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং খন্দকার মােশতাক আহমদ চট্টগ্রাম গিয়েছেন, ২ ও ৩ মার্চের ঘটনাবলি তদন্তের জন্য। তাদের সাথে ঐদিন সকালে (১৭ মার্চ) এ. আর. সিদ্দিকী বাটালি হিলের বাংলােতে সাক্ষাৎ করতে হবে। ডি.সি. মুস্তাফিজ, আমি এবং মহিউদ্দীন খান আলমগীর পাহাড়ের ওপর সুদৃশ্য বাংলােতে ঢােকার পথেই লে. কর্নেল চৌধুরীর সাথে দেখা, শাদা পােশাকে। তার একটা হাতে কনুই ভাঙা, স্লিং-এ ঝােলানাে। তাঁর সাথে বেশি কথা হলাে না; তিনি তখন কথাবার্তা সেরে বের হয়ে যাচ্ছেন। ২৫/২৬ মার্চের প্রথম দিকেই তিনি চট্টগ্রাম সেনানিবাসের ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে (EBRC) শহীদ হন। তিনি সেখানেই প্রধান প্রশিক্ষক ছিলেন।
সদা হাস্যময় ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী সাহেব আমাকে দেখেই কী তওফিক, কী খবরবলে উঠলেন। খন্দকার মােশতাক- কে আমি এর আগে কখনও দেখিনি। মনসুর আলী সাহেবকে পেয়ে বেশ ক্ষোভের সাথে আমি কয়েকটি অনুযােগ করলাম: (ক) ২/৩ মার্চের এতদিন পর এসেছেন সরেজমিনে দেখতে? (খ) চট্টগ্রামের আশেপাশে, এমনকি ঢাকাতেও যুদ্ধপ্রস্তুতির সব আলামত দেখা যাচ্ছে, চারদিকে পাকিস্তানিদের সাজ-সাজ রব, আপনারা কিছুই বুঝতে পারছেন না? (গ) আপনাদের কি নির্দেশ আমাদের জন্য?
আমার সেনা ছাউনিতে বেশ যাতয়াত ছিল পার্বত্য চট্টগ্রামের পরিস্থিতির কারণে। ইতােপূর্বে বেশ কয়েকবার ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদের সাজেক মালভূমি এবং মাসালং এলাকায় কয়েকবার অনুপ্রবেশ করেছে মিজো-বিদ্রোহীদের পিছু ধাওয়া করে। পার্বত্য চট্টগ্রামের অনেক ভিতরে এসে তারা মিজো-ক্যাম্প ধ্বংস করেছে। এ সবগুলােই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডােরা পরিচালনা করত। রসদ যেত রাঙামাটি হয়ে। (এখানে বলে রাখি: একসময় প্রাক্তন মেজর নূরুল ইসলাম শিশু, পরে জেনারেল ও মন্ত্রী, এই মিজো-মিশনে ১৯৬৯-৭০ সালে নিয়ােজিত ছিলেন)। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট, এমনকি ঢাকা সেনা হেডকোয়ার্টারেও (Eastern Command) আমার ডাক পড়ত পরিস্থিতি জানানাের জন্য। আমার বক্তব্য ছিল সবসময় যে, মিজোদের আশ্রয় ও সাহায্য করার কারণে পার্বত্য চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ অঞ্চল ছারখার হয়ে যাচ্ছে। বনজঙ্গল শেষ, পশুহত্যা নির্বিবাদে চলছে। তার চেয়েও বড় কথা, বৃহত্তর জনগােষ্ঠী চাকমা উপজাতি বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে, মিজোদের ধ্বংস এবং ভারতীয় অনুপ্রবেশের কারণে। ক্ষতিগ্রস্ত চচ্ছে চাকমা এবং টিপরাসহ অন্যান্য উপজাতি।
১৯৭১ সালের মার্চে চট্টগ্রামে ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কমান্ডাে ইউনিট, যার অধিনায়ক লে. কর্নেল শামস্ (শামসুল হক)। দুর্ধর্ষ, নিষ্ঠুর ও নির্দয় প্রকৃতির ছিল বলে তার ব্যাপক কুখ্যাতি। বেলুচ রেজিমেন্টও ছিল চট্টগ্রামে, যার কমান্ডিং অফিসার (C.O.) ছিল লে. কর্নেল ফাতমি। এই লােকটি ছিল ডেপুটি সাব-মার্শাল-ল অ্যাডমিনিস্ট্রেটর (Deputy Sub Martial Law Administrator)। যথাক্রমে মিজো অপারেশন এবং মার্শাল-ল ডিউটির কারণে এই দুই কর্নেল এবং তাদের সহকারীদের রাঙামাটিতে ঘন ঘন যাতায়াত ছিল। আমাকেও মাঝে মাঝে যেতে হতাে ক্যান্টনমেন্টের নিষিদ্ধ এলাকায়। চোখকান খােলা থাকলে যে কেউ বুঝতে পারত ওদের রণপ্রস্তুতি।
আমি এসব কথা ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী সাহেবকে খুলে বললাম। তাঁর বক্তব্য ছিল: শীঘ্রই সব ঠিক হয়ে যাবে। আমরা যথাসময়ে নির্দেশ পাঠাব। সেই নির্দেশ আর কোনােদিন পাইনি। কিন্তু বুঝে নিয়েছিলাম, কী সেই নির্দেশ হতে পারে। বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চের ভাষণে যেসব নির্দেশ দিয়েছিলেন, তিনি সেসব নির্দেশের কথাই সেদিন ইঙ্গিত করেছিলেন।
এর কয়েকদিন পর (১৭ মার্চে) আরও নাটকীয় ঘটনা শুরু হলাে। দ্রুত পট পরিবর্তন এত দ্রুত যে তার সাথে তাল মেলানাে কঠিন ছিল। ঢাকাতে আলােচনা বৈঠক, কিন্তু সারা পূর্ববাংলায়, বিশেষ করে চট্টগ্রামে সৈন্যসমাবেশ ও শক্তিবৃদ্ধি, ঢাকায় পাকিস্তান এয়ারফোর্স ও.পি.আই.-এর বিমান অবতরণ বহুগুণ বৃদ্ধি, সন্দেহজনক লােকজনের বিপুল সংখ্যায় অবতরণ, সেনানিবাসে অতিরিক্ত সতর্কতা ও বেসামরিক লােকজনের ওপর নিষেধাজ্ঞা-এ সবই স্পষ্টত অন্য কোনাে কিছুই ইঙ্গিত দিচ্ছিল।
এদিকে পার্বত্য চট্টগ্রাম ও চট্টগ্রামে সদা-সচেতন ছাত্রসমাজ আমাদের নানাবিধ তথ্য সরবরাহ অব্যাহত রেখেছিল। চট্টগ্রামে সােয়াতজাহাজের আগমন, ডক-কর্মীদের ধর্মঘট, সােয়াত খালাসে অস্বীকৃতি, যুদ্ধজাহাজ বাবরের বহির্নোঙরে অবস্থান, চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্টে ঘন ঘন হেলিকপ্টার ওঠানামা, বাঙালি সৈন্যদের পাের্টে পাঠানাের চেষ্টা, নিরস্ত্র জনগণের ওপর বন্দর-এলাকায়-বালুচ সৈন্যদের নির্বিচার গুলিবর্ষণ, বহু হতাহত ইত্যাদি খবর ত্বরিত গতিতে আমাদের কাছে আসছিল। এ যেটুকু আশা ছিল, সব আস্তে আস্তে বিলীন হয়ে গেল। আমাদের দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেল অর্থাৎ আমরা পয়েন্ট অব নাে-রিটার্নে চলে গেলাম প্রায়। এই অবস্থায় প্রস্তুতি ছাড়া আমাদের কিছুই করার ছিল না। এই প্রস্তুতি যত-না সামরিক, তার চেয়ে ঢের বেশি মানসিক। সেই সাথে সাংগঠনিক। স্থানীয় কর্মকর্তাদের একত্র করা, নানাবিধ দায়িত্ব বণ্টন করার জন্য প্রয়ােজন ছিল একটি বিশেষ সংগঠনের-যার সিন্ধান্ত হবে দ্রুত, থাকবে সবরকম ক্ষমতা এবং সকলের কাছে তা গ্রহণযােগ্য হবে। সেটি সম্ভব ছিল রাজনৈতিক নেতাদের সমর্থনে।
রাঙামাটিতে আওয়ামী লীগ সংগঠন ছিল অতি দুর্বল। পৌর-অধিকর্তা ছিলেন মুসলিম লীগের। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা দ্বিধাবিভক্ত। চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় প্রথম থেকেই নির্লিপ্ত এবং গােপনে পাকিস্তানিদের সাথে যােগাযােগ রাখছেন। চাকমারা প্রকাশ্যে যােগদান করতে চাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে আমাদের কাপ্তাই-চন্দ্রঘােনার দিকে তাকাতে হয়েছিল। শিল্প-এলাকা এবং বিরাট সংখ্যক শ্রমিকের সমাবেশ। শ্রমিকদের সবাই বাঙালি এবং অত্যন্ত রাজনীতিসচেতন; শক্ত ট্রেড ইউনিয়ন কাপ্তাই পানি-বিদ্যুৎ প্রকল্পে, চন্দ্রঘােনা কাগজ-কলে ও বনশিল্প প্রতিষ্ঠানে; চট্টগ্রাম এবং নােয়াখালীর স্বাধীনচেতা মানুষ সবাই। অতএব এটা হলাে আমাদের শক্ত ঘাঁটি। এখানে সৈয়দ আবদুস সামাদ বিরাট সহয়তা পেলেন।
আমাদের আরেক শক্ত ঘাঁটি রামগড়। নােয়াখালীর অধিকাংশ অধিবাসী এবং সচেতন কর্মী। মাঝখানে খাগড়াছড়ি। সবে মহকুমা সদর দপ্তর সেখানে স্থানান্তর করা হয়েছে, আমিই দায়িত্ব নিয়ে এই কাজ করেছিলাম। সরকারি নতুন শহর, কেবল গড়ে উঠছে। চতুর্দিকে পার্বত্য উপজাতির বসবাস। সেখানে সংগঠন করার কিছুই ছিল না। মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমা সবে পরিচিত হয়ে উঠেছেন।
আমরা সকলে যারা সদর রাঙামাটিতে কর্মরত, তাদেরই এগিয়ে যেতে হবে, নিতে হবে অগ্রগণ্য ভূমিকা-এই উপলব্ধি থেকে আমরা একটি সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠনের সিদ্ধান্ত নিলাম। সরকারি কর্মকর্তা, কর্পোরেশন কর্মকর্তা, শিক্ষক, ছাত্রনেতা, ব্যবসায়ী, পেশাজীবী, আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ-এদের সকলের সমম্বয়ে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলাে। সংগ্রাম পরিষদ গঠনের বিষয়ে তার ছােট একটি স্মৃতিকথামূলক লেখায় লিখেছিলেন। সেলেখার অংশবিশেষ এই গ্রন্থে সংযােজিত হলাে। ব্যবসায়ীদের মধ্যে দুজনের কথা আমার বিশেষ মনে পড়ে, একজন ইউসুফ আলি, আরেকজন মােহসিন। দুই ভাই। এদের অনেক লঞ্চ ছিল। এগুলাে চলাচল করত কাপ্তাই লেকের বিভিন্ন রুটে (যেমন মহালছড়ি, বিলাইছড়ি, মাইনিমুখম মারিশ্যা, বরকল, কাপ্তাই ইত্যাদি)। এই লঞ্চগুলাে ই.পি.আর. জওয়ান ও জে.সি.ও.-দের বহন করে নিয়ে আসে রাঙামাটিতে। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৬ মার্চ দিনের মধ্যেই প্রায় সবাই চলে আসেন। নবগঠিত সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব ছিল নিম্নরূপ:
* তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তান রাইফেল (EPR) বাহিনীর জোয়ান ভাইদের স্বাগত সংবর্ধনা জানিয়ে রণক্ষেত্রের দিকে পাঠিয়ে দেওয়া ও তাদের খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা করা।
* যানবাহন ঠিক রাখা ও উপযুক্ত সময়ে যথাস্থানে তা সরবরাহ করা।
* সামরিক রসদপত্র সরবরাহ করা।
* সরবরাহ লাই (Supply line) অক্ষুন্ন রাখা।
* জনসাধারণের মনে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করা।
* রাঙামাটি স্টেশন ক্লাবে যুবকদের সংক্ষিপ্ত রাইফেল চালনা শিক্ষা।
* নিয়ন্ত্রণ কক্ষ পরিচালনা করা।
সংগ্রাম পরিষদের দায়িত্ব ছাড়াও অন্যান্য দায়িত্ব নিম্নরূপভাবে প্রদান করি:
* রাঙামাটিতে নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: এস.পি. বজলুর রহমান।
* উপ-নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্র: আবদুল আলী, এস.ডি.ও., সদর। চট্টগ্রাম এবং অগ্রবর্তী ঘটির সাথে যােগাযােগ।
বিশিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদের নিম্নলিখিতভাবে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়:
ড. আলতাফ আলী: খাদ্য সংগ্রহ, বণ্টন, সম্মুখে প্রেরণ, ছাত্রদের ট্রেনিং
আবদুল আলী/ রুহুল আমিন/ এম.ই. শরিফ: গােলাগুলি ফ্রন্টে পাঠানাের দায়িত্বপ্রাপ্ত।
গণসংযোগ
মারিশ্যায় ম্যাজিস্ট্রেট: খান আমির আলী
যােগাযােগ ও পরিবহণ: জেলা পরিষদের প্রকৌশলী তাজুল ইসলাম এবং সড়ক ও যােগাযােগ বিভাগের বাবু জ্যোতি বিকাশ চাকমা।
কয়েক বছর আগে রাঙামাটিতে প্রাক্তন কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা আমার সাথে দেখা করেন। তাদের কাছ থেকে রাঙামাটির প্রথম মুক্তিযােদ্ধা ব্যাচের তথ্য সংগ্রহ করি। সকলের নাম আমার মনে ছিল না, তবে নিম্নোক্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সম্বন্ধে যা জানতে পারি তা নিচে দেওয়া হলাে।
রাঙামাটির প্রথম মুক্তিযােদ্ধা ব্যাচ
১. ইফতেখার (হেডমাস্টার সাহেবের ছেলে)
২. আবদুস শুকুর (দেলওয়ারের ছেলে)
৩. মােহাম্মদ শফি (প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক মুজিবুল হক সাহেবের ভাইপাে) শহীদ
৪. মামুন-শহীদ
৫. এস.এম. কামাল, পিতা-মুজিবুল হক
৬. মাহবুবুর রহমান (ব্যবসায়ী)
৭. আবুল কালাম আজাদ
৮. সুনীল (বর্তমানে প্রখ্যাত সাংবাদিক)
৯. দিদারুল আলম (বর্তমানে পুলিশের পদস্থ কর্মকর্তা)
১০. রণবিক্রম কিশাের ত্রিপুরা (খাগড়াছড়ি জেলা পরিষদ সদস্য)
১১. প্রভুদাস চৌধুরী (মার্মা)
১২. গৌতম দেওয়ান
১৩. মােহাম্মদ ইয়াছিন (বনবিভাগ, খাগড়াছড়ি)
১৪. অনিল চন্দ্র দাস (পশুসম্পদ বিভাগ)
১৫. কানু বিশ্বাস, পিতা-যতীন্দ্র লাল বিশ্বাস
১৬. বাবুল বিশ্বাস, পিতা-যতীন্দ্র লাল বিশ্বাস
১৭. আলমগীর, কনিষ্ঠতম মুক্তিযােদ্ধা, পিতা-খলিল
১৮. জাহাঙ্গীর, কনিষ্ঠতম মুক্তিযােদ্ধা, পিতা-খলিল
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে এই প্রথম ব্যাচ মাত্র কয়েকদিনের ট্রেনিং নিয়েই কালুরঘাট পতনের পূর্বে চট্টগ্রাম রণাঙ্গনে যােগদান করে।
১৯৭১ সালে ২৬/২৭ মার্চে যেসব ই.পি.আর. ইউনিট রাঙামাটিতে সমবেত হয়েছিলেন এবং যারা কাপ্তাই, বান্দরবন, রামগড়ে ছিলেন তাদের কয়েকজনের সাথে আমার ১৯৭২ সালে আবার দেখা হয়। প্রশ্ন করে জানতে পারে রাঙামাটি থেকে গিয়ে তারা কে কোথায় যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং বিজয়ের পর কোথায় আছেন, কেমন আছেন। তাদের বিষয়ে কিছু তথ্য এখানে সংযুক্ত করলাম।
* সুবেদার আবদুল গনি: কমান্ডার, দ্বিতীয় কোম্পানি, বরকল। একে এস.ডি.ও আবদুল আলী লঞ্চে করে ২৬ মার্চ তারিখেই নিয়ে আসেন রাঙামাটিতে। ইনি চট্টগ্রাম যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। পরে সুবেদার মেজর হয়ে জামালপুরে চলে যান।
* নায়েব সুবেদার নাজির আহমদ: জালিয়াপাড়া বি.ও.পি. থেকে এসেছিলেন। চট্টগ্রামে নতুনপাড়ায় যুদ্ধে শহীদ ২৮ মার্চ।
পৃষ্ঠা: ২১০
* সুবেদার মেজর নজরুল: কাপ্তাইয়ে ক্যাপ্টেন হারুনের সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। পরে যশােরে ২ নম্বর কোম্পানির সেকেন্ড-ইন-কমান্ড।
* সুবেদার নজরুল ইসলাম: ই.পি.আর.ডি. কোম্পানি বান্দরবান। ক্যাপ্টেন ফারুকের সাথে চলে যান যুদ্ধে। পরে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় সুবেদার মেজর ফারুকের সাথে চলে যান যুদ্ধে। পরে পদোন্নতি পেয়ে ঢাকায় সুবেদার মেজর হন।
* সুবেদার আজিজুর রহমান: মাসালং (পার্বত্য চট্টগ্রাম) ই.পি.আর. কোম্পানি, যুদ্ধ করেন কালুরঘাট, শুভপুর ও রামগড়ে। বিজয়ের কয়েক মুহূর্ত আগে ফৌজদারহাটে (চট্টগ্রাম) যুদ্ধে শহীদ হন-১৬ ডিসেম্বরে।
* নায়েব সুবেদার নাজির আহমদ: শহীদ
* আবদুর রব: রাঙামাটি। ঢাকা বি.ডি.আর.-এ অ্যাডজুটেন্ট হন।
মানসিকভাবে সকলেই তৈরি। কিছু-একটা ঘটতে যাচ্ছে। ২৫ মার্চ রাত্রে প্রথম খবর এল। আমরা তাে তখন সবসময় ওয়্যারলেস শুনছি। আমাদের দুটো নেটওয়ার্ক ছিল। আমি পুলিশলাইনে আর.ই.পি.আর.-এর কাছে বসতাম, খবর নিতাম। আমার সাথে এস.পি. বজলুর রহমান থাকতেন, মারা গেছেন কিছুদিন আগে। ঢাকায় বাড়ি। ২৫ মার্চ রাত দশটার পরে উনি আমাকে টেলিফোন করলেন খুব উত্তেজিতভাবে। কী হয়েছে? ছুটে গেলাম। ওয়্যারলেস-সেটের কাছে। একেবারে পরিষ্কার শুনতে পাচ্ছি, ওরা রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে, আগুন দিচ্ছে, রাইফেলের এবং গােলাগুলির আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে। পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল।
ঐ রাত্রে কিছুক্ষণ পরেই কাপ্তাইয়ের সঙ্গে যােগাযােগ করলাম। পাওয়ার-স্টেশনের ম্যানেজার শামসুদ্দিন এবং আমার ভাই ফারুক আজিজ খান বললেন, এখানে প্রচণ্ড গােলাগুলি শুরু হয়ে গেছে। ই.পি.আর.-এর পাঞ্জাবি সামরিক অফিসার বাধা দিচ্ছে, হারুন (ক্যাপ্টেন হারুন, ই.পি.আর.) এগিয়ে গেছে, ওদেরকে আক্রমণ করে বন্দি করবে, ওদের কাছ থেকে চাবি নেবে অস্ত্রাগারের। আমি তখনই তাড়াতাড়ি সমস্ত জায়গায় খবর পাঠালাম: তােমরা এখুনি অস্ত্রশস্ত্র দখলে নিয়ে তােমাদের পাঞ্জাবি অফিসারদের বন্দি করে রাঙামাটিতে চলে এসাে।মধ্যরাতের দিকে কাপ্তাই থেকে ক্যাপ্টেন হারুন টেলিফোন করে বললেন: আমরা ওদেরকে আটকে ফেলেছি এবং অস্ত্রাগার আমাদের হাতে এসে গেছে। অস্ত্রশস্ত্র এখন আমাদের হাতে। আমরা এখনি চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হচ্ছি, কালুরঘাটে গিয়ে আমি ক্যাপ্টেন রফিকের সঙ্গে যােগ দেব।
২৬ মার্চ সকালের মধ্যে আমাদের বার্তা পেয়ে রাঙামাটি থেকে পাঠানাে লঞ্চে করে দলে-দলে ই.পি.আর. আর পুলিশের বাঙালি জোয়ানরা তাদের জে.সি.ও.- দের নেতৃত্বে সুদূর বরকল, দীঘিনালা, মারিশ্যা, মহালছড়ি-এইসব জায়গা থেকে জমায়েত হলেন কোর্টপ্রাঙ্গণে। সেখানে তাদের অভ্যর্থনা, খাওয়া আর ব্রিফিং-এর ব্যবস্থা। এরা সবাই পরে চট্টগ্রামের দিকে রওনা হলেন। পরে জেনেছি যে, ফরিদপুরের ডি.সি. ইউসুফ এবং গােয়ালন্দের এস.ডি.ও. রেজাউল হায়াত আমার সমস্ত নির্দেশ এবং ওয়্যারলেসে ই.পি.আর. এবং পুলিশের কথােপকথন শুনেছেন।
চট্টগ্রামের সাথে আমাদের যােগাযােগ ভালাে নয়, ঢাকার সাথে তাে যােগাযােগ একেবারেই বিচ্ছিন্ন। এই পরিস্থিতিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কঠিন ছিল। রাঙামাটি থেকে দুদিক দিয়েই যাওয়া যায় চট্টগ্রাম, একটা হচ্ছে রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়ক, যেটা রাউজান-হাটহাজারী হয়ে চট্টগ্রাম সােজা চলে গেছে। আর একটা হলাে রাঙামাটি থেকে লঞ্চে কাপ্তাই যাওয়ার
পথ। ভিতরে রাস্তাও আছে। হাটহাজারীতে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে যাদের পাঠিয়েছি তারা গিয়েছে রাঙামাটি সড়কপথে। আবার ঐদিকে কালুরঘাটে জড়াে হয়েছে কাপ্তাই, ঘাগড়া এই সমস্ত জায়গা থেকে।
ওখানে যাওয়ার পরে কতজন যে যােগদান করেছে যুদ্ধে আর কতজন রাস্তা থেকে সরে গিয়েছে তার কোনাে হিসেব আমরা পাইনি। অনেকে রাস্তা থেকে চলে গেছে, অনেকে মারাও গেছে, অনেকে যােগদান করে সেনাবাহিনীর সঙ্গে। চট্টগ্রামে তখন অনিশ্চিত অবস্থা। মেজর জিয়াউর রহমান ও মেজর মীর শওকত তখন ওখানে সিনিয়র অফিসার।
আমাদের মুক্তিবাহিনীর বাধার মুখে পাকিস্তান বাহিনীর সদস্যরা প্রথমে এগিয়ে আসতে পারেনি। ক্যাপ্টেন রফিক রেলওয়ে ভবনের আশেপাশে অবস্থান নিয়ে প্রচণ্ড প্রতিরােধ করছেন। পরবর্তীকালে খাইবার যুদ্ধজাহাজ চিটাগাং পাের্ট-এর উপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ করে এগিয়ে এলে ওরা ওখানে নামে। নতুন পাকিস্তানি সৈন্য এলে ক্যান্টনমেন্টে অবরুদ্ধ সৈন্যরা শক্তি পেল। তারা একত্রিত হয়ে চট্টগ্রাম শহর দখল করে ফেলল।
আমাদের তখন প্রচণ্ড ভয় যে পাকিস্তানিরা বােধহয় হেলিকপ্টার রাঙামাটি আক্রমণ করবে। কাজেই রাঙামাটির খালি জায়গায় যাতে হেলিকপ্টারে তারা নামতে না পারে সেজন্য বড় বড় খুঁটি ধারালাে করে পুতে রাখা হলাে। আর রাঙামাটি-চট্টগ্রাম সড়কে ঘাগড়া নামক জায়গায় বিরাট গর্ত করে রাখা হলাে যাতে ঐ পথে আকস্মিকভাবে না আসতে পারে। গাছ কেটে সেগুলাে ফেলে রাস্তা আটকানাে হলাে। অস্ত্রশস্ত্র যেখানে যা ছিল আনা হলাে। ওপরের পাহাড়ে রাস্তার দিকে তাক করে বসানাে হলাে মেশিনগান। ই.পি.আর.-এর একটি ছােট দল সেখানে সার্বক্ষণিক পাহারায় নিযুক্ত।
রামগড়ে
যুদ্ধের ২য় দিন অর্থাৎ ২৬ তারিখ সন্ধ্যায় আমি বাইরে থেকে ফিরেছি। এসে দেখি আমার বারান্দায় ভদ্রলােক বসা। লম্বা দীর্ঘদেহী, মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। রুক্ষ, শুষ্ক চেহারা। আমি জিজ্ঞাসা করলাম: কে আপনি? বললেন: আমি ক্যাপ্টেন রফিক। আমি চট্টগ্রাম থেকে এসেছি। আপনি আমাকে ভারতীয় সীমান্তে পাঠানাের ব্যবস্থা করুন। আমি রামগড় হয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সাথে যােগাযােগ করতে চাই। ওদের সাহায্য না পেলে আমাদের চলবে না। আমাদের অস্ত্রশস্ত্রের দরকার। আমি তখনই এস.পি. কে ডাকলাম। এস.পি. এলেন। রামগড়ে আমাদের এস.ডি.ও.-কে টেলিফোনে বললাম: “ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম যাচ্ছেন আপনার কাছে। তাঁকে তাড়াতাড়ি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে যােগাযােগ করিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করুন।” একটা জিপে উনি চলে গেলেন রামগড়ে।
তার পরের দিনই সংবাদ এল যে ক্যাপ্টেন রফিক পৌঁছে গেছেন, কিন্তু ভারতীয়রা ওঁর সাথে কথা বলতে রাজি নন। তারা বলেছেন, ডি.সি. সাহেব অথবা সিনিয়র অফিসার কেউ না হলে কথা বলব না। আপনি যদি আসেন তাহলে কথা বলতে পারে।
রাঙামাটি থেকে রামগড়। প্রবল বৃষ্টি। পাহাড়িয়া নদী বন্যার পানিতে খরস্রোতা হয়ে গেছে। কাঠের পুল বানিয়ে কোনােরকমে রাস্তা অতিক্রম করেছি। আমি আমার পরিবার নিয়েই গেছি। লােকজন নিয়ে আমি মহালছড়ি এবং খাগড়াছড়ি হয়ে রামগড়ে গেলাম ২৭ মার্চ। রামগড়ে ভারতীয় বি.এস.এফ.-এর ক্যাপ্টেন মাহেক সিং এসে আমাকে নিয়ে গেলেন নদীর ওপারে।
রামগড়ের ওপারেই সাব্রুম। সাব্রুমের এস.ডি.ও. আমাকে নিয়ে গেলেন। আগরতলা থেকে দক্ষিণের ত্রিপুরার ডি.সি. অশােকনাথ এলেন। তার সাথে ডাকবাংলােতে বসে বৈঠক করলাম। বললেন, আমি তাে সিভিল সাইডে, আমার কোনাে এক্তিয়ার নেই কিছু করার। এখানে মেজর জেনারেল গঞ্জালভেস আসছেন, মাউনটেইন ডিভিশনের জি.ও.সি.। উনি আপনাদের সাথে কথা বলতে চান, আলাপ করে বুঝতে চান কী করা দরকার। তারপর আমাদের বি.এস.এফ.-এর কর্নেল ঘােষ আসবেন। ওরা সবাই আপনার সাথে কথা বলতে চান।ওঁদের সঙ্গে ওখানেই দেখা হলাে। বুঝতে অসুবিধা হলাে না তারা কী চাইছেন। তারা জানতে চাইলেন যে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গতিবিধির খবর রাখি কি না। আমি বললাম, এটা আমাদের সেনা-অফিসাররা ভালাে জানেন।
আমি ভারতীয়দের সাহায্য করলাম মিজো-বিদ্রোহীদের খবরাখবর দিয়ে। আর দিলাম পার্বত্য চট্টগ্রামের ভৌগােলিক বর্ণনা। আমার সাথে কিছু বিস্তারিত ম্যাপ ছিল। সেগুলােও সেনাদের খুবই প্রয়ােজন যে-কোনাে আর্মি-চলাচলে (army movement)। আমি বললাম, দেখুন আমাদের তাে এই অবস্থা, আমরা বাধা দিচ্ছি, কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র না-থাকাতে কিছুই করতে পারছি না। তারা সাহায্য সহযােগিতা করতে চাইলেন। আমাকেই প্রথম চালান (consignment) গ্রহণ করতে বললেন। ওঁরা আমাকে প্রথম বাক্সভর্তি অস্ত্রশস্ত্র দিলেন। প্রথম চালানটি ফেনী নদীর উত্তর তীরে বি.এস.এফ.-এর ক্যাপ্টেন মাহেক সিং আমাকে হস্তান্তর করলেন। আমি আবার সেগুলাে ই.পি.আর. রামগড় উইং-এর জে.সি.ও.-কে বুঝিয়ে দিলাম। রামগড় থেকে চট্টগ্রাম কীভাবে অস্ত্রের চালান পাঠানাে যায় সেটাই হলাে বড় সমস্যা। সমাধান হলাে পার্বত্য এলাকায় চলাচলকারী পুরােনাে জিপগাড়ির বহর। অনেকগুলাে গাড়ি সংগ্রহ করে আমরা একটি গাড়িবহর পার্বত্যপথে গহিন জঙ্গলের মধ্য দিয়ে পাঠিয়েছিলাম চট্টগ্রাম। গন্তব্য স্থলে পৌছাল কিনা জানতে পারিনি।
এর মধ্যে দুই-তিন দিন ওখানে থাকার পরে যখন মােটামুটি একটা ব্যবস্থা হলাে, রামগড়ে আমরা স্থির করলাম যে, এখানেই আমাদের লােকজন থাকবে। সেখানে সকলের সাথে পরামর্শ করে মােটামুটি একটা ব্যবস্থা করা হলাে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পাকিস্তান সেনাবাহিনী এসে আমাদের যাতে আক্রমণ করতে না পারে সেজন্য ধুমের পরে ফেনী ব্রিজের কাছে শুভপুর রেলওয়ে ব্রিজে আমাদের সৈনিকেরা পজিশন নেয়। রামগড়ের ই.পি.আর.-এর উইং কমান্ডার মেজর শামসুদ্দিনকে শুভপুর ব্রিজের দায়িত্ব নিতে অনুরােধ জানালে তিনি সম্মত হন। খুব সম্ভবত ক্যাপ্টেন রফিক ওখানে ছিলেন।
এই এলাকায় একটা চা-বাগান (tea. estate) ছিল। এর ম্যানেজার ছিলেন আউয়াল সাহেব। পুলিশের সি.আই ছিলেন একজন। কোথায় যেন উধাও হলেন। সমস্ত দায়িত্ব নিলেন ও.সি., পরে তিনি থানায় বসে মেজর জিয়াউর রহমানের সাথেও সার্বক্ষণিকভাবে কাজ করেন। সিরাজুল ইসলাম ছিলেন রামগড় হাসপাতালের দায়িত্বে। এঁরা সকলেই দিনরাত পরিশ্রম করতে থাকেন।
রামগড়ে মুক্তিযুদ্ধ-সংক্রান্ত কাজকর্ম সংগঠিত করে মার্চের শেষে আমি আবার ফিরে চলে গেলাম রাঙামাটিতে। রাঙামাটিতে গিয়ে দেখি অবস্থা খুব খারাপ। সরকারি সব বাঙালি কর্মকর্তা, পুলিশ, ই.পি.আর. কেউ নেই। শুনতে পেলাম, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা রাঙামাটি অভিমুখে এগিয়ে আসছে। চট্টগ্রাম ক্যান্টনমেন্ট তারা দখল করেছে।
আগরতলায়
মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক পর্যায়ে রামগড়ের পরই আগরতলা এবং সাব্রুম হয়ে ওঠে আমাদের প্রধান কর্মস্থল। চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নােয়াখালী, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ, এমনকি ঢাকার নেতারাও তখন অধিকাংশই ত্রিপুরা রাজ্যে। প্রফেসর নূরুল ইসলাম এম.এন.এ, জহুর আহমেদ চৌধুরী এম.পি.এ, এম.আর. সিদ্দিকী এম.এন.এ., এ ফরিদ গাজী এম.এন.এ, মােশাররফ হােসেন এম.পি.এ., আবদুল মান্নান, ড. মান্নান, এম.এ. হান্নান, মিজানুর রহমান চৌধুরী এম.এন.এ., রশিদ আহমেদ এম.পি.এ., সিরাজুল হক (অ্যাডভােকেট) এম.এন.এ., শামসুদ্দোহা (নারায়ণগঞ্জ) এম.এন.এ., নূরুল হক (নােয়াখালী), এম.এন.এ., ফটিকছড়ি থানার মির্জা আবু মনসুর এম.পি.এ., হাটবাজারি থানার আবদুল ওয়াহাব, এম.এ. খালেদ (সাংবাদিক) – এম.এন.এ. আরও অনেকেই ছিলেন ত্রিপুরায়, বিশেষ করে আগরতলাতে।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসেই জহুর আহমেদ চৌধুরীর নেতৃত্বে আগরতলার কর্নেল চৌমুহনিতে বাংলাদেশ অফিস চালু হয়ে গিয়েছে। একদিকে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, অন্যদিকে সামরিক অফিসাররা এবং তাদেরই সাথে বেসামরিক কর্মকর্তা সবাই কাজ করে চলেছেন। প্রাণপণে লড়াই চালাচ্ছেন ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ এবং আনসার ও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত যুবকেরা। পাশাপাশি আসছে শরণার্থীর ঢল। এইরকম একটা অবস্থায় বিদেশে, ভিন্ন সরকারের আশ্রয়ে আমাদের একটা অফিস চালানাে যে কী কঠিন আর দুরূহ কাজ, তা আজ কেউ অনুমানও করতে পারবেন না। অবশ্য রামগড়ে (২ মে পর্যন্ত) এবং সাব্রুমে রাজনৈতিক বড় মাপের কোনাে নেতা থাকতেন না। মাঝে মাঝে আসতেন।
এমন কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে কাজ শুরু হয়। এই অঞ্চলে প্রথমে আমাদের বেসামরিক প্রশাসক হলেন মাহবুব আলম চাষী। তার সাথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার এস.ডি.ও. কাজী রকিবউদ্দীন, হবিগঞ্জের এস.ডি.ও. আকবর আলী খান। আমি (পার্বত্য চট্টগ্রামের ডি.সি.) রামগড়ে, ঠিক ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্তে (কয়েকশ গজের মধ্যেই ফেনী নদীর অপর পাড়ে সাব্রুম শহর)। ওখানে ছিলেন মেজর জিয়াউর রহমান, মেজর শামসুদ্দীন, ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূইঞা প্রমুখ। ফেনী-শুভপুর অঞ্চলে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম প্রতিরােধ করেছেন পাকিস্তানি বাহিনীকে। আর মহালছড়ি-মানিকছড়ি-খাগড়াছড়ি অঞ্চলে প্রাণপণ যুদ্ধ করেছেন মেজর মীর শওকত আলী পাকিস্তান সেনাবাহিনী এবং মিজোদের বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের পূর্বাঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়া সার্বিক তত্ত্বাবধান করেছেন, শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছেন। যুদ্ধ-পাগল যুবকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করেছেন। রামগড় থানায় আমরা একসাথে অফিস করি। আমার সাথে ছিলেন পার্বত্য চট্টগ্রামের এস.পি. বজলুর রহমান, কাপ্তাইয়ের ডি.এস.পি. তালুকদার এবং আরও অনেকে। ওপরের দিকে ত্রিপুরা রাজ্যের উত্তর, পশ্চিম এবং দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলে তখন তুমুল লড়াই করেছেন মেজর খালেদ মােশাররফ, মেজর কে.এম. সফিউল্লাহ প্রমুখ।
এপ্রিলের শেষ দিকে কোনাে-একদিন কর্নেল (অব.) ওসমানী, মিজানুর রহমান চৌধুরী এবং আরও কয়েকজন আমাদের অবস্থান-স্থলে এলেন। তখনই বিস্তারিত জানলাম বাংলাদেশ সরকার গঠন সম্পর্কে। আওয়ামী লীগ নেতা ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী। কর্নেল ওসমানী ওয়ারফ্রন্ট দেখতে এসেছেন। সম্ভবত এম.আর. সিদ্দিকী সাহেবও ছিলেন তাঁর সাথে। আগরতলা অফিস এবং মুজিবনগর সম্পর্কে মােটামুটি তথ্য তাঁরা দিলেন। আমাদেরকে উৎসাহিতও করলেন।
আমার সন্তানসম্ভবা স্ত্রী এবং ছেলে ও দুই মেয়ে রাঙামাটি থেকে আগত আমার সহকর্মীদের সাথে রামগড়ে অবস্থান করছিল। সীমানার অপরপ্রান্তে সাব্রুম শহরে সেখানকার এস.ডি.ও. আমাদের থাকার জন্য দুটো বাড়ির ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। আমাদের রামগড় ত্যাগ করতে হলে যাতে আমরা সেখানে আশ্রয় নিতে পারি।
মুক্তিযােদ্ধাদের প্রবল প্রতিরােধের মুখে পাকিস্তান বাহিনী কিছুতেই শুভপুর রেলসেতু অতিক্রম করতে পারছিল না। অবশেষে এপ্রিলের শেষদিকে ওরা বিমানবাহিনী নিয়ােগ করে। প্রবল বােমাবর্ষণের ফলে শুভপুরের দক্ষিণপ্রান্তে ট্রেঞ্চে আর বাঙ্কারে অবস্থানরত মুক্তিযােদ্ধারা পশ্চাদপসরণ করে অবস্থান নেয়। পরে কুমিল্লা এবং চট্টগ্রাম থেকে পাকিস্তানি সাজোয়া বাহিনী দ্রুত রামগড়ের দিকে অগ্রসর হয়। এরা রামগড় চা-বাগানের কাছাকাছি এলে ২ মে, ১৯৭১ আমরা সদলবলে রামগড় ত্যাগ করি।
এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে আমি যাই আগরতলায় ওখানকার নেতৃবৃন্দ এবং ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে পরিচিত হতে। অবশ্য এর মধ্যে বেশ কয়েকবার ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারবৃন্দ (জেনারেল গনজালভেসের কথা এখনও মনে আছে), বি.এস.এফ.-এর কর্নেল ঘােষ ও মাহেক সিং এবং ত্রিপুরার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অশােক নাথ সাব্রুমে এসেছেন এবং আমাদের মধ্যে আলােচনাও হয়েছে যুদ্ধ-পরিচালনা, সামরিক সাহায্য ও শরণার্থী সমস্যা সম্পর্কে।
আগরতলায় দেখা হয় মাহবুব আলম চাষীর সাথে। তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী তাহেরউদ্দীন ঠাকুরের সাথে তখনই আমার পরিচয়। এদের খুব ঘনিষ্ঠ ছিলেন ত্রিপুরা সরকারের কর্মকর্তা কে.পি. দত্ত। তাঁর পরিবারের সাথে আমাদেরও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক হতে দেরি হয়নি। চাষী সাহেবকে পূর্বাঞ্চলের বেসামরিক প্রশাসক নিয়ােগ করেন এম.আর. সিদ্দিকী সাহেব। মাহবুব আলম চাষী ১৯৪৯ ব্যাচের পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসের সদস্য। চট্টগ্রামে বাড়ি। যুদ্ধের প্রাক্কালে তিনি ছিলেন নােয়াখালীর চর-অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়-দুর্গতদের পুনর্বাসনের কাজে। তিনি চাকুরি থেকে পদত্যাগ করে সমবায়-আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন চট্টগ্রামের পূর্বাঞ্চলে রাওজান। থানার গুমাই বিল এলাকায়। তখনই তিনি তাঁর নামের শেষে চাষীযুক্ত করেন। এটি ছিল সম্ভবত ১৯৬৫ সাল, তখন তিনি ফরেন অফিসে ডিরেক্টর। ১৯৭১ সালে নােয়াখালীর চরঅঞ্চল থেকে সরাসরি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে আগরতলায় পৌঁছেন। তাহের ঠাকুরের সাথে তার পূর্ব- যােগাযােগ ছিল বলেই আমার মনে হয়েছে। সে প্রসঙ্গ পরে। আগরতলায় এম.আর. সিদ্দিকী, মাহবুব আলম চাষী আমাকে নিয়ে যান ত্রিপুরার মহাকরণ ভবনে মুখ্যমন্ত্রী, চিফ সেক্রেটারি এবং অন্যান্যদের সাথে পরিচয় করাতে।
এর মাত্র কয়েকদিন পরে আমাকে জানানাে হলাে যে, মাহবুব আলম চাষীকে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রসচিব নিয়ােগ করা হয়েছে। অতএব আমাকে আগরতলা অফিসের প্রশাসক নিয়ােগ করা হলাে।
সে সময়টাতে মাহবুব আলম চাষী মােটামুটিভাবে রাজনৈতিক যােগাযােগেই বেশি সময় কাটাতেন। কার মাধ্যমে তাদের পরিচয় জানতাম না, কিন্তু ইন্দিরা মন্ত্রিসভার প্রাক্তন মন্ত্রী ড. ত্রিগুণা সেন এবং কোলকাতার বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির মণি ভাই ভিমানি প্রমুখের সঙ্গে আলম সাহেবের বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। বলা বাহুল্য তাহেরউদ্দীন ঠাকুর সর্বত্রই সদা বিরাজমান থাকতেন। একদিনের কথা মনে পড়ে- সেটা আলম চাষীর কোলকাতা
পৃষ্ঠা: ২১৫
যাওয়ার প্রাক্কালে। তাহের ঠাকুর বললেন যে, আলম সাহেবকে কয়েকটা শার্ট-প্যান্ট কিনে দিতে হবে, কেননা তিনি বলতে গেলে এক বস্ত্রে সীমান্ত অতিক্রম করে এসেছেন। তখন আবু ইউসুফ সাহেবের সাথেও আলাপ হলাে। অত্যন্ত মৃদুভাষী, কিছুটা আন্তরিকতাহীন বলে মনে হয়েছে আমার তাঁকে দেখে। পরে জানলাম তার প্রকৃত পরিচয়; তিনি আসলে ড. হাবিবুর রহমান, জিওলজিক্যাল সার্ভের বৈজ্ঞানিক। চাষী সাহেব টীকা যােগ করলেন যে উনি (আবু ইউসুফ) তিন অক্ষরদের (অর্থাৎ আমাদের CSP-দের) দেখতে পারেন না। তাহের ঠাকুর আমাকে কানে কানে বললেন যে, চাষী সাহেবেরও আমাদের প্রতি (সি.এস.পি.- দের) একই মনােভাব। কথাগুলাে যে কত সত্য, তা পরে হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছি।
যুদ্ধরত নিয়মিত এবং গেরিলা বাহিনীকে সাহায্য, সহযােগিতা, সংবাদ সরবরাহ, যােগাযােগ রক্ষা করা, যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের ফ্রন্ট থেকে পেছনে বহন করে আনা এবং চিকিৎসা ও ওষুধের ব্যবস্থাকরণ, যুদ্ধে শহীদদের কাফন-দাফনের ব্যবস্থা, অমুসলিমদের তাদের ধর্মমতে সৎকার করা ইত্যাদি কত রকম- যে কাজ ছিল তখন, তা তালিকা দিয়ে শেষ করা যাবে না। প্রত্যক্ষ (সম্মুখ সমর) এবং গেরিলাযুদ্ধের পাশাপাশি চলছিল আরেক যুদ্ধ-স্নায়ুযুদ্ধ এবং প্রচারণাযুদ্ধ। এতেও প্রচুর দক্ষ জনবল প্রয়ােজন হতাে, যাদের সরবরাহ করত যুবশিবির এবং বিভিন্ন সংগঠন। এইসঙ্গে ছিল স্বাধীন বাংলা সাহিত্য সংস্কৃতি সমিতি, স্বাধীন বাংলা ফুটবল দল এবং আরও অনেক সংঘ/সমিতি।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় ওপরের যেসব কর্মকাণ্ডের বিবরণ দিলাম তার সবকিছু সমন্বয় করত জোনাল কাউন্সিল বা আঞ্চলিক পরিষদ। যুদ্ধের প্রথম কয়েক মাস আগরতলাতে সমগ্র পূর্বাঞ্চলের জন্য একটি মাত্র অঞ্চল (zone) ছিল যার প্রশাসক ছিলাম আমি। রাজনৈতিক কর্তৃত্ব ছিল জহুর আহমেদ চৌধুরীর হাতে। অন্যান্য নেতারাও বিভিন্ন কাজে সাহায্য-সহযােগিতা করতেন। আবার কখনও কখনও সমস্যাও সৃষ্টি করতেন। সরকারি কর্মকর্তাদের আমার সাথে কাজ করতেন কাজী রকিবউদ্দীন, ড. কে. এ. হাসান, আকবর আলী খান প্রমুখ। এছাড়া আরও অনেকে ছিলেন।
আগেই বলেছি আমাদের আগরতলা আঞ্চলিক অফিসে প্রচণ্ড কাজের চাপ ছিল। প্রধানতম কাজ মুক্তিবাহিনীকে সর্বতােভাবে সাহায্য করা। দ্বিতীয় কাজ পূর্ব-বাংলা তথা পূর্বপাকিস্তান থেকে আগত শরণার্থীদের খাদ্য-বাসস্থান-চিকিৎসার ব্যবস্থা করা। কিছুদিনের মধ্যেই এদের মােটামুটি ব্যবস্থা হয়ে গেলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়াল যুবশিবির সংগঠন এবং পরিচালনা। তৃতীয়ত, পাকিস্তানি আক্রমণ-অত্যাচারের মুখে বিপুল পরিমাণ সরকারিআধাসরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী যারা দেশত্যাগ করেছিলেন, তাদের দেখাশুনা করা। সেই সাথে দক্ষতা-অভিজ্ঞতা দেখে শ্রেণীবিন্যাস করে যে যে-কাজে উপযুক্ত তাকে সেই কাজে নিয়ােগ করা।
আমাদের কাছে সকলেই এসে তাদের আগমনের কথা লিপিবদ্ধ করতেন। তাদের নাম তালিকাভুক্ত করতে হতাে। তাদের যতদূর সম্ভব কাজে লাগানাের পরেও বিপুল সংখ্যক ব্যক্তিদের আমরা কোনাে কাজেই লাগাতে পারিনি। ডাক্তারদের আমরা যােগদানের সাথে সাথেই যুদ্ধক্ষেত্রে ফিল্ড হাসপাতালে অথবা যুবশিবিরে পাঠিয়ে দিতাম। প্রকৌশলী এবং নানাবিধ কারিগরি বিদ্যায় পারদর্শী যারা ছিলেন তাদের আমরা কাজে লাগাতে পেরেছি বিভিন্ন রণক্ষেত্রে এবং শিবিরে।
মুক্তিযুদ্ধের সেই প্রথম দিকেই আমরা আরেকটি কাজ শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে তখন নির্বিচারে গণহত্যা চালাচ্ছে পাকিস্তান বাহিনী আর তাদের এদেশীয় সঙ্গীরা। খুন, হত্যা, ধর্ষণ, বাড়ি-ঘর ধ্বংস, জ্বালানাে, লুটতরাজ চালাচ্ছিল সর্বত্র। যেখানে ওরা যাচ্ছে সেখানেই তারা এই কাজ করছিল। এইসব ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ এবং শহীদ, আহত, এবং নির্যাতিতদের তালিকা, তাদেরই দেওয়া বর্ণনা লিপিবদ্ধ করা হচ্ছিল বিভিন্ন আশ্রয় শিবিরে অবস্থানরত সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারী এবং স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে। বিশাল আয়ােজন ছিল এটি। সাথে সাথে আমাদের দেশপ্রেমিক কর্মকর্তাদেরও কাজে নিয়ােগ করা সম্ভব হয়েছিল। অত্যন্ত পরিতাপ এবং ক্ষোভের বিষয় এই যে, এত তথ্য/প্রমাণ সংগ্রহ করেও যুদ্ধাপরাধীদের এবং তাদের দোসরদের বিচার কবে হবে বাংলাদেশে!
এই সময়ে দেশ থেকে অনেক কলাকুশলী, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক, সাংবাদিক গিয়েছিলেন মুক্তাঞ্চল ও সীমান্ত অঞ্চলে স্থাপিত শরণার্থী শিবিরে। এদের অনেকেই সুপরিচিত এবং জনপ্রিয় ব্যক্তি ছিলেন। তৎকালীন রেডিও পাকিস্তানের অনেক প্রখ্যাত শিল্পী তাে বটেই, কলাকুশলীরাও এসেছিলেন। চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে মেজর জিয়াউর রহমানের কণ্ঠে বঙ্গবন্ধুর বরাত দিয়ে ঘােষণার পরেই ওখানকার ট্রান্সমিটারটি ঐ কেন্দ্রের প্রযােজক এবং কুশলীবৃন্দ কাধে করে পার্বত্য চট্টগ্রামের গহিন অরণ্য এবং পাহাড় অতিক্রম করে প্রথমে রামগড়ে ও তারপর ত্রিপুরার বাগাফা নামক স্থানে স্থাপন করে অনুষ্ঠান চালাতে থাকে। এঁদের নেতৃত্বে ছিলেন বেলাল মােহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দীপ ও অন্যান্য। জয় বাংলা, বাংলার জয়’ গানটির গায়ক আবদুল জব্বার, সমর দাস, আপেল মাহমুদ, নমিতা ঘােষ পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গায়ক-গায়িকা, সংবাদ-পাঠক, পর্যালােচক আগরতলা হয়েই মুজিবনগর গেছেন। এদের প্রায় প্রত্যেকের প্লেনের টিকিটসহ হাতখরচের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল আমাদের। আবদুল গাফফার চৌধুরী, এম.আর. আখতার মুকুল,কামাল লােহানী, আল-মাহমুদ, নির্মলেন্দু গুণ এবং আরও অনেকে প্রথমে আমাদের দপ্তরেই গিয়েছিলেন। আল-মাহমুদ আমার স্ত্রীর খালাতাে ভাই। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে ৯ মাস আমাদের সাথে ছিলেন।
মার্চের শেষে/এপ্রিলের প্রথমদিকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড.এ.আর. মল্লিক, অধ্যাপক সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক আনিসুজ্জামান এবং আরও অনেকে রামগড়ে পৌছেন। পরবর্তীতে এঁরা কোলকাতায় যান। তেমনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরও অনেক অধ্যাপক, যেমন মােজাফফর আহমেদ, মুশাররফ হােসেন, স্বদেশ বােস প্রমুখ আগরতলায় গিয়েছিলেন প্রথম। বিমানবাহিনীর গ্রুপ ক্যাপ্টেন আর. কে. খন্দকার, উইং কমান্ডার মির্জা, উইং কমান্ডার বাশার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান মাহমুদ এবং পি.আই.এ.-র বেশ কয়েকজন বৈমানিক (নাসির হায়দার প্রমুখ) আগরতলায় পৌঁছেন। আমার সাথে তাদের আলােচনা হয়। পরে তারা বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীতে বিভিন্ন দায়িত্ব পালন করেন অসীম সাহস এবং শৌর্যবীর্যের সাথে।
রামগড়ের পতনের পরেই ২ মে ১৯৭১, আমরা সাব্রুম থেকে আগরতলা যাত্রা করি। আমরা বলতে আমার পরিবার, রাঙামাটি থেকে আগত আমার সহকর্মীবৃন্দ, ড্রাইভার, পাচক, সহকারী। সঙ্গে আমাদের বেশকিছু দিনের জন্য রসদ (চাল-ডাল- তেল, আটা ইত্যাদি) যাতে করে বিদেশ-বিভুঁইয়ে অভুক্ত থাকতে না হয়। সারাটা পথ জনস্রোতের সাথে-সাথে গিয়েছি। সাব্রুম থেকে আগরতলা পর্যন্ত কেউ পায়ে হেঁটে, কেউ গরুর গাড়িতে, কেউ বাসে-ট্রাকে, যে যেভাবে পারে শত্রু-অধ্যুষিত এলাকা থেকে দূরে চলে যেতে চাইছে। এর ওপর চট্টগ্রামের রাউজান, হাটবাজারী, ফটিকছড়ি, পটিয়া এইসব এলাকায় ফজলুল কাদের চৌধুরী এবং তার বাহিনীর নারকীয় অত্যাচার আর নির্বিচার হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পেতে সংখ্যালঘুদের যেভাবে সম্ভব নিরাপদ আশ্রয়ের জন্য সীমান্ত অতিক্রম করেছে। এত বছর পরেও আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই মানুষের ঢল-কেউ খুঁড়িয়ে চলছে, কেউ চলতে পারছে না, তবুও বাঁচার তাগিদে চলছে কেউ বাঁশের দুপ্রান্তে বাঁধা চাদরে বা কাপড়ে অন্যের কাঁধে সওয়ার হয়ে, কেউ কাদছে, কেউ বেদনায় কাতরাচ্ছে। সে যে কী দৃশ্য নাদেখলে বিশ্বাস করা যায় না!
আগরতলার কাছাকাছি পৌঁছেই প্রবল ঝড় আর বৃষ্টির মধ্যে পড়েছিলাম। এমন অন্ধকার আর বৃষ্টি যে বাধ্য হয়ে গাড়ি থামতে হলাে। সন্ধ্যার পর আগরতলা পৌছুলাম। কোনাে বিশেষ গন্তব্যস্থান জানা ছিল না- সেটাই ছিল স্বাভাবিক, স্থির করলাম লােকজনকে জিজ্ঞেস করে বাংলাদেশ হােস্টেলখুঁজে বের করব। তাই করলাম এবং সেখানে পৌছে দেখি তিল ধারণের স্থান নেই। ওখানেই একটা কামরায় থাকতেন জহুর আহমেদ চৌধুরী। তিনি তার নিজের ঘরটি ছেড়ে দিলেন। উল্লেখ করা প্রয়ােজন আগরতলার কৃষ্ণনগরে অবস্থিত বাংলাদেশ হােস্টেলটি।
তখন আবার আরেক বিপদ। আমার স্ত্রী ছিলেন সন্তানসম্ভবা। রাস্তার ধকলে তার এসে গেল প্রবল জ্বর। কোথায় ডাক্তার, কোথায় ওষুধ। কোনােরকমে ঐ হােস্টেলে যারা থাকতেন তাঁরা কী যেন একটা ব্যবস্থা করলেন। পরদিন সকালে আবার বের হলাম আমাদের অফিস দেখতে এবং বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে।
ঐ অঞ্চলে অবস্থানরত আমি তখন পূর্ববাংলার একমাত্র সিনিয়র অফিসার এবং ডেপুটি কমিশনার পদের। অপরাপর সার্ভিসের অনেকে। তাঁদের মধ্যে দু-একজন বেশ সিনিয়র কর্মকর্তা গেছেন; যেমন হাবিবুর রহমান ওরফে আবু ইউসুফ, রেলওয়ের চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেব। যেহেতু আমি চট্টম ও পার্বত্য চট্টগ্রামে প্রতিরােধ-সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়ে এসেছি, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করেছি, শত্রুকে প্রতিহত করতে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছি – তাই আমাকে সকলে (রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ, কর্মীবাহিনী, অন্যান্য কর্মকর্তা/কর্মচারী) তাদের আঞ্চলিক প্রশাসক হিসেবে স্বাভাবিক ও সহজভাবেই মেনে নিয়েছিলেন। তাতে আমার কাজে অনেক সুবিধা হয়েছিল।
কাজী রকিবউদ্দীন ও আমাদের অন্যান্য সহকর্মী আমাকে ও আমার পরিবারকে ৩ মে বিকেলেই তাদের আশ্রয়স্থলে নিয়ে গেলেন। সেটি একটি বাগানবাড়ি-ওপরে টিনের চাল দিয়ে একটি বড় বাংলাে, ছােট বােধহয় ৪টি কামরা। বাথরুম বেশ খানিকটা দূরে। বাগানের মাঝখানে পুকুর এবং বাইরে একটা চালাঘর। আগরতলা শহর থেকে এয়ারপাের্ট রােডের ধারেই বাগানবাড়ি। রাস্তা থেকে বাড়িটি দেখা যায় না। কাজী রকিব, আকবর আলী খান ও ড. কে. এ. হাসান একটি বড় কামরায় থাকতেন। তাঁদের গাড়ি ছিল এবং কজন কাজের লােক ছিল। ওরা আমাদের জন্য দেড়খানা কামরা ছেড়ে দিলেন। একটিতে আমার ছেলে ও মেয়েরা, আরেকটি ছােট একটি খুপরির মতাে, সেখানে আমি ও আমার স্ত্রী। কাজের লােকদের, ড্রাইভারদের থাকার জায়গায় অভাব নেই। খাওয়াদাওয়া সকলের একসাথে। আমার সাথে তিনজন ড্রাইভার (ইদ্রিস, হিমাংশু, আরেকটি চাকমা ছেলে), বাবুর্চি ডালু বড়ুয়া, আমার বহুদিনের পুরােনাে আর্দালি আবুল বশর, বডিগার্ড সাত্তার (তার সাথে একটা বেটা সাব- মেশিনগান) এবং আরেক ছেলে লতিফ। বাগানবাড়ির মালিক ছিলেন চক্রবর্তী বাবু। আদি নিবাস ব্রাহ্মণবাড়িয়া। সেখানে প্রতিরােধ সংগ্রামে কাজী রকিবউদ্দীন প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন। মেজর খালেদ মােশাররফ এ অঞ্চলে এস.ডি.ও. রকিবের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। ব্রাহ্মণবাড়িয়া থেকে গাড়ি নিয়ে সরাসরি ত্রিপুরা যাওয়া যেত ঐ সময়। ত্রিপুরা রাজ্যের আদি বাসিন্দা টিপরা এবং অন্যান্য উপজাতি সংখ্যায় যা ছিলেন তার দ্বিগুণ ছিলেন কুমিল্লা আর সিলেট থেকে বিশেষ করে সীমান্ত-সংলগ্ন ব্রাহ্মণবাড়িয়া আর হবিগঞ্জ থেকে পাড়ি দেওয়া হিন্দু-অধিবাসীবৃন্দ। মাতৃভূমির প্রতি এঁদের প্রবল আকর্ষণ ছিল বিধায় এই এস.ডি.ও রকিবউদ্দীনের আর আকবর আলী খান বিশেষ সমাদর পেতেন আগরতলায়। রকিব তাে খুব জনপ্রিয় ছিলেন। এঁরা দুজন এবং চক্রবর্তী বাবু আমার পরিবারের যথেষ্ট যত্ন নিয়েছেন ঐ সময়। আমার ছেলেমেয়েদের স্নেহ করতেন, দেখাশুনাও করতেন। উভয়েই ছিলেন অবিবাহিত।
এখানে শ্রীমঙ্গলের চা গবেষণা কেন্দ্রের (Tea Research Centre-এর) ডিরেক্টর এবং তাঁর সহকর্মীদের কথা না-বললেই নয়। এই কেন্দ্রটি পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারের অধীনে ছিল বাণিজ্য মন্ত্রণালয় (Commerce Ministry), যেমন ছিল চা (Tea) বাের্ড। এখানকার গবেষক, বৈজ্ঞানিক সবাই ছিলেন রাজনীতি ও সামাজসচেতন এবং দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ। দেশপ্রেম তাদের মধ্যে প্রবল। আমার ব্যক্তিগত ধারণা হলাে যে, পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকারে যাদের কাজ করার অভিজ্ঞতা রয়েছে তারা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানিদের আসল রূপ জানতে ও বুঝতে পারেন। নিজে থেকেই তারা পাঞ্জাবিদের ঘৃণা করতে আরম্ভ করেন, নিজের বাঙালি জাতিসত্তাবােধ তখন জাগ্রত হয়। ড. হাসান, তাঁর সহকর্মী ড. চৌধুরী ও অন্যান্য বৈজ্ঞানিকদের বেলাতেও তাই। ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণ শুরু হতেই এরা সকলে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করতে থাকেন। খালেদ মােশাররফ যখন ঐ এলাকায় যান এবং পরে ত্রিপুরার দিকে চলে আসেন, সেই সময় শ্রীমঙ্গল, মৌলভিবাজার, হবিগঞ্জ-এই বিস্তীর্ণ এলাকার চা-বাগানের বাঙালি অফিসারবৃন্দ এবং চা গবেষণা কেন্দ্রের (Tea Research Centre-এর) সমস্ত গবেষক/ বৈজ্ঞানিক চলে আসেন ত্রিপুরায়। ড. হাসান সম্ভবত আকবর আলী খানের সাথে আসেন চক্রবর্তী বাবুর বাগানবাড়িতে। পরে আমার সাথে দেখা হয়। তার পুরাে দল নিয়ে তিনি সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন আমাদের তৎপরতার সাথে। পরে তিনি ঐ আঞ্চলিক প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
মে মাসের কোনাে এক সময় কিশােরগঞ্জের এস.ডি.ও. খসরুজ্জামান চৌধুরী সপরিবারে উপস্থিত হলেন আগরতলায়। তিনিও আশ্রয় নিলেন আমাদের চক্রবর্তীর বাগানবাড়িতে। আমাদের আরেক সি.এস.পি সহকর্মী মামুনুর রশিদ যােগ দিয়েছিলেন আমাদের সাথে। মামুনের বড়ভাই হারুনুর রশিদ (সি.এস.পি) আমেরিকায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। তার চাচা মােমেন সাহেব তখন বিদেশে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। তিনিও আমাদের সাথে মুজিবনগরে যােগ দেন পরবর্তী কালে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমার কোনাে বর্ণনা সম্পূর্ণ হবে না যদি-না। একজন মহানুভব ব্যক্তির কথা বলি। তার নাম বাচ্চু চক্রবর্তী (এইচ.এন.চক্রবর্তী)। আগরতলায় বসবাস-পরিবারের চা-বাগান আছে। যথেষ্ট প্রতিপত্তিশালী। ভারি সুন্দর দেখতে- যেন রূপকথার রাজপুত্র। আমরা আগরতলায় যাবার পরেই রকিবের মাধ্যমে পরিচয় হলাে। তারপর থেকেই আমার পরিবারে নিত্যসঙ্গী। সকলের বাচ্চুদাছেলেমেয়েদের বাচ্চুকাকা অত্যন্ত বিনয়ী এবং মৃদুভাষী, বাংলাদেশের জন্য নিবেদিতপ্রাণ। আদিবাড়ি ব্রাহ্মণবাড়িয়া। ভাষায় এবং চালচলনেও বাঙ্গাল। কোলকাতার আলীপুরে বাড়ি ছিল। শ্বশুরবাড়ি উত্তরপ্রদেশের আগ্রা (অবশ্য প্রবাসী বাঙালি পরিবারে)।
মে মাসে (অথবা জুনে) আরাে দুটি অত্যন্ত উল্লেখযােগ্য এবং স্মরণীয় ঘটনা ঘটল। পারিবারিক দিক দিয়েই খুবই গুরুত্বপূর্ণ তখন পর্যন্ত। আগরতলায় অবস্থানকালে আমরা দেশের ভিতরের অনেক খবরই পেতাম। কোনাে বিশেষ ব্যক্তি বা গ্রুপ (যেমন পাকিস্তান বিমানবাহিনীর অফিসারবৃন্দ, পি.আই.এ.-র কর্মকর্তা, রেডিও পাকিস্তানের কলাকুশলীবৃন্দ প্রমুখ) ত্রিপুরা সীমান্তে পৌঁছেই প্রথমে কৃষ্ণনগর হােস্টেল অথবা কর্নেল চৌমুহনি আমাদের দপ্তরের ঠিকানা নিতেন, পরে যােগাযােগ করতেন। তাদের কাছ থেকে আমরা নানাবিধ তথ্য পেতাম। সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে গুরুত্বপূর্ণ হলে বা কোনাে তাৎপর্য থাকলে সেক্টরকমান্ডারদের জানাতাম। এইরকম একটা ব্যস্ততা আর ডামাডােলের মধ্যে নিজেদের মা-ভাইবােনদের জন্যও উদ্বিগ্ন থাকতাম। ভাবতাম আর কখনও দেখা হবে কিনা! আমার মা সিরাজগঞ্জের উল্লাপাড়ায় আমাদের নিজ গ্রামের বাড়িতে থাকতেন। আমাদের বাড়ি যেতে করতােয়া নদী পার হতে হয়। সে-সময় বেশ কঠিন ছিল রাস্তা। অতএব মা নিরাপদেই ছিলেন মােটামুটি। আমার শাশুড়ি তার ছােট ছেলে ও মেয়েকে (বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ-পড়য়া) নিয়ে বেশ অসুবিধায় ছিলেন। গ্রামের বাড়ি টাঙ্গাইলের গােপালপুরে। ঢাকা-টাঙ্গাইল-ময়মনসিংহ মহাসড়কের খুব কাছেই। ঐ এলাকায় কাদের সিদ্দিকীর ঘন ঘন আনাগােনা ছিল। কাদেরিয়া বাহিনী গােপালপুর থানা আক্রমণ করে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে যায় ও থানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। ফলে গােপালপুর থানা অঞ্চল পাকিস্তান বাহিনীর রােষানলে পড়ে। আমার শাশুড়ির জন্য এলাকাটি হয়ে ওঠে বিপজ্জনক। পাকিস্তানিরা প্রায়ই ঐদিকে আসার চেষ্টা করত। প্রসঙ্গত এখানে একটা মজার ঘটনা বর্ণনা করতে হয়।
মার্চ মাসে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিন আগে আমার শাশুড়ি এবং ছােট শ্যালক রাঙামাটি এসেছিলেন বেড়াতে। আমাদের (ডি.সি.র) বাংলােতে একটা ছােটখাটো চিড়িয়াখানা ছিল। তার মধ্যে ছিল খাঁচায় রাখা একটা কুচকুচে কালাে ময়না। ওটা মানুষের অনেক কথাই অনুকরণ করত। কেমন করে জানি না ও শুনে-শুনে শিখে ফেলেছিল: জয় বাংলা। মানুষ। দেখলেই বলত: জয় বাংলা। আমার শাশুড়ি ময়নাটা নিয়ে যান গ্রামের বাড়ি গােপালপুর। ওখানে সারাক্ষণ ওর বুলি ছিল: জয় বাংলা, জয় বাংলা। এপ্রিল-মে মাসে কে যেন পাকিস্তানিদের এই পাখিটির অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানিয়ে দেয়। একদিন পাকিস্তান সেনাবাহিনী গ্রামে এসে হাজির। এসেই হুকুম: ইধার কোই তােতা হায়? উর্দুতে পাখিকে বলে তােতাআর গ্রামের মানুষ মনে করেছে বােধহয় মানুষ-তােতাকে ওরা খুঁজছে। গ্রামে সত্যি সত্যি এক যুবকের নাম ছিল তােতা। আর যায় কোথায়? তােতাকে হাজির করা হলাে। সে তাে ভয়ে কাঠ। তাকে মারধােরও করা হলাে। এদিকে এই চৈ চৈ-এর মধ্যে আমার শাশুড়ি তার মেয়ে শিরীন এবং খাঁচার ময়না (তােতা) নিয়ে অন্য গ্রামে চলে গেছেন। পাকিস্তান বাহিনী ঐ এলাকায় অতর্কিত আক্রমণের (ambush) ভয়ে সহজে নদী পারাপার করতে চাইত না। গােপালপুরে থাকাকালীন আমাদের মুরুব্বি (ফুফাজান) পাখিকে শেখাতে অনেক চেষ্টা করেছেন প্রতিদিন ভােরবেলায় পাকিস্তান জিন্দাবাদ আর আল্লাহু আকবর। কিন্তু পাখি একই বুলি বলত। রেডিওতে শুনে বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠস্বর নকল করে হুবহু বলত ‘জয় বাংলা’। আর বলত: ঢেউ দিও না জলে ওগাে, ঢেউ লাগে যে মনে, রানা ওঠো(আমার স্ত্রীর ভাইপাে)। গ্রামের লােকেরা বিশ্বাস করতে আরম্ভ করেছিল যে পাখি যখন কিছুতেই জয় বাংলা বুলি ছাড়ছে না, বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। বিজয়ের কয়েকদিন আগে কাদেরবাহিনীর সদস্যরা ঐ বাড়িতে এসে পাখিটি নিয়ে যায়, টানাহেঁচড়াতে ওটা বেশ জখমও হয়।
পূর্বের কথায় ফিরে যাই। আগরতলায় আমাদের আপনজনের খবরাখবরের জন্য আমরা যখন ব্যাকুল, সেই সময়ে হঠাৎ একদিন সকালে আমার স্ত্রীর বড়ভাই জনাব লুৎফর রহমান (যিনি পাকশিতে রেলওয়ের ডিভিশনাল কমার্শিয়াল অফিসার ছিলেন), তার স্ত্রী এবং
পৃষ্ঠা: ২২০
মেজোভাই পাকিস্তান এয়ারফোর্সের ফ্লাইট লেফটেনান্ট ফজলুর রহমান আমাদের বাগানবাড়িতে উপস্থিত। তাঁদের আকস্মিক উপস্থিতিতে যত-না অবাক তার চেয়ে ঢের বেশি উল্লসিত আমরা, বিশেষ করে আমার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা। সুদূর পাকশি থেকে পাবনা হয়ে ঢাকা; সেখান থেকে ভৈরববাজার-আশুগঞ্জ-ব্রাহ্মণবাড়িয়া-সালদানদী-আগরতলা—এই লম্বা বিপজ্জনক এবং ঘটনাবহুল যাত্রা একটি উপাখ্যান হতে পারে।
লুৎফর রহমান সাহেবকে আমি পরে মুজিবনগর পাঠাই। তাঁকে পাঠানাে হয় মেঘালয়ের (ভারত) তুরা নামক স্থানে আঞ্চলিক প্রশাসক করে। মেঘালয়ের তুরাতে ছিল আমাদের উত্তরাঞ্জলের এলাকা, যার চেয়ারম্যান ছিলেন জনাব শামসুর রহমান খান (টাঙ্গাইলের এম.এন.এ.)। এই এলাকাটি আরেকটি কারণে পরিচিত হয়ে আছে। মেজর জিয়াউর রহমান এখানেই তার জেড-ফোর্স (ZForce)-এর হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন। লুৎফর রহমান সাহেবের প্রধান কাজ ছিল জেড-ফোর্স-কে সহযােগিতা করা। অন্যথায় তুরার মতাে অত দুর্গম এলাকায় কারাে যাবার কথা নয়। মনেপ্রাণে খাটি বাঙালি, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বুদ্ধ জনাব লুৎফর রহমান সানন্দে তুরায় যােগদান করেন। এখান থেকেই ডিসেম্বর মাসে তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার উত্তরাঞ্চলে (অর্থাৎ বর্তমান শেরপুর, নেত্রকোণা, কিশােরগঞ্জ এলাকা) মেজর জিয়াউর রহমান সাহেব অভিযান শুরু করেন স্বাধীনতার পর লুৎফর রহমান। সাহেবকে বাংলাদেশ রেলওয়ে বাের্ডের সেক্রেটারি নিযুক্ত করা হয়। ক্রমান্বয়ে তিনি পশ্চিমঅঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার এবং পূর্বাঞ্চলের জেনারেল ম্যানেজার হয়েছিলেন (রেলওয়ের সর্বোচ্চ পদ)। সাবেক পাকিস্তান রেলওয়ে (প্রশাসন) ক্যাডারের এই মেধাবী অফিসার চমৎকার ইংরেজি ও বাংলা লিখতে পারতেন। আমাকে কতবার বলেছেন, ‘আপনার রয়েছে। অমূল্য তথ্য আর অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার। আপনার মতাে প্রত্যক্ষভাবে আর কয়জন ইতিহাস সৃষ্টি হতে দেখেছে। আপনি লিখুন। নিজের সময় না হলে আমাকে ডিকটেশন দিন আমি লিখব।’ তাঁর সে-সাধ পূর্ণ হয়নি। প্রায় দশ বৎসর হলাে তিনি আমাদের ছেড়ে গিয়েছেন। রেখে গেছেন তাঁর স্মৃতি। আজ (২০০৪ সাল) আমার লেখা দেখলে কী যে খুশি হতেন!
আমার স্ত্রীর দ্বিতীয় ভাই ফ্লাইট লে. ফজলুর রহমান ‘৭১-এ ছুটিতে এসেছিলেন ঢাকায়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথেই তিনি স্থির করেন এই যুদ্ধে লড়তে হবে, যেভাবেই হােক স্বাধীন বাংলার কোনাে অফিসে যােগদান করতে হবে। আগরতলায় আমার কাছে রিপাের্ট করাই উনি শ্রেয় মনে করলেন। বড় ভাইয়ের সাথে যােগাযােগ হলাে দুজনে একসাথে রওনা হবেন স্থির করলেন। ছােট ভাইয়েরও বড় জনের মতাে এক ছেলে, এক মেয়ে। স্ত্রী ছেলেমেয়েসহ বড় ভাইয়ের মতাে পরিবার নিয়ে দুর্গম পথের ঝুঁকি তিনি নিলেন না। এয়ারফোর্সের অফিসার চলে যাওয়া মানেই ডেজার্টার। ধরা পড়লে সাথে সাথে কোর্ট মার্শাল (মানেই গুলি করে হত্যা)। তার পরিবারকে পাঠালেন রাজশাহী শহরে পৈতৃক বাড়িতে। সেখান থেকে চাঁপাইনওয়াবগঞ্জ হয়ে মালদহ, যেখানে তাদের পূর্বপুরুষের ভিটা এবং আত্মীয়স্বজনের বসবাস। এমনিতে সব ভালােই ছিল, কিন্তু এই লম্বা বিপদসঙ্কুল পথে লুকিয়ে লুকিয়ে যাওয়ার যে-ধকল তাতে মিসেস ফজলুর রহমান অসুস্থ হয়ে পড়েন। কোলে দুগ্ধপােষ্য শিশু। মিসেস রহমানকে দুরারােগ্য ডায়াবেটিসে ধরে বসে। আজও তিনি ভুগছেন।
ফজলুর রহমান সাহেব মুজিবনগরে যান আমার তত্ত্বাবধানে। স্ত্রী সেখানে তার সাথে যােগদান করেন। রহমান সাহেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন আর, কে, খন্দকার সাহেবের কাছে পাঠাই (তিনি তখন ডিপুটি চিফ অব স্টাফ)। খন্দকার সাহেব কল্যাণীতে (পশ্চিমবঙ্গের রানাঘাটের নিকটে) থাকার ব্যবস্থা করেন। কয়েকদিন ওরিয়েন্টেশনের পর তাঁকে পাঠানাে হয় সিলেটে ডাওকীতে (সেক্টর ছয়) মেজর মীর শওকত আলীর অধীনে সাব-সেক্টর কমান্ডার পদে। মুক্তিযুদ্ধের শেষ কয়েক মাস তিনি রণক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পর বস্ত্রশিল্প কর্পোরেশনে (BTMC) দীর্ঘদিন জেনারেল ম্যানেজার পদে থাকার পর অবসর নেন। অতি সম্প্রতি নানারকম প্রতিকূল অবস্থায় দীর্ঘ রােগভােগের পর ইন্তেকাল করেছেন। আমার এই দুই আত্মীয় এবং আরেক আপন বড় ভাইকে শুধুমাত্র মুক্তিযােদ্ধা হওয়ার কারণে চাকুরি জীবনে অবিরাম সংগ্রাম করতে হয়েছে। তারই ফলে কঠিন সব ব্যাধি আর অকাল মৃত্যুবরণ। কী লজ্জা আর পরিতাপের কথা স্বাধীন বাংলাদেশে!
আমার অগ্রজ জনাব হােসেন তফাজ্জল ইমাম (আমি ডাকতাম ছােট ভাই বলে) রাজশাহীর গােপালপুর সুগার মিলে (তৎকালীন ই. পি. আই. ডি. সি-র অন্তর্ভুক্ত) চিফ অ্যাকাউন্টস অফিসার পদে কর্মরত ছিলেন ‘৭১-এর মার্চ মাসে। ওখানকার জেনারেল ম্যানেজার আনােয়ারুল আজিম ছিলেন সাবেক বিমানবাহিনী অফিসার। অত্যন্ত স্বাধীনচেতা এবং সাহসী এই ভদ্রলােক ছিলেন দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযােদ্ধা। তিনি গােপালপুর এলাকায় কর্মরত লােকজন এবং আশেপাশের গ্রামের জনগণকে নিয়ে শক্ত প্রতিরােধ গড়ে তােলেন। নাটোর থেকে রাজশাহীর দিকে অগ্রসরমান পাকিস্তান বাহিনীকে এরা বেশ কিছুদিন আটকে রাখেন। কিন্তু অস্ত্রশস্ত্রের সামনে লাঠি-বল্লম-বর্শা দিয়ে কতদিন? গােপালপুরের পতন ঘটে এবং ঐ জি. এম. আনােয়ারুল আজিমকে পাকিস্তানিরা হত্যা করে। শহীদ হন আজিম এবং তার সাথে আরও প্রায় একশত জন। এই গণহত্যার স্থানটি এখন চিহ্নিত।
আমার ভাই তফাজ্জল ইমাম তাঁর স্ত্রী এবং তিন সন্তানকে নিয়ে গােপালপুর থেকে চলে যান রাজশাহী-মুর্শিদাবাদের চর-অঞ্চলে পদ্মানদীর সীমান্ত এলাকায়। পথে তাদের সর্বস্ব কেড়ে নেয় পাকিস্তানিদের দোসর রাজাকারেরা। রাজশাহী মুর্শিদাবাদের সীমান্তে কোনােএক গ্রামে এক গৃহস্থের গােয়ালঘরে তাদের জায়গা দেওয়া হয়। ওখানে ঐ অবস্থায় জন্ম হয় ভাই-ভাবীর চতুর্থ সন্তানের (দ্বিতীয় কন্যা, নাম কুহু)। কোলে নবজাত শিশু নিয়ে কখনও হেঁটে, কখনও গরুর গাড়িতে যান মুর্শিদাবাদ জেলার বহরমপুরে। ভাবীর আত্মীয়স্বজন ছিলেন ওখানে মায়ের দিকের। মুর্শিদাবাদের মুসলমানেরা বাংলাদেশের বিহারীদের মতাে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ঘাের বিরােধী ছিল। ঐ বৈরী পরিবেশে না-থেকে তারা চলে যান প্রথমে বর্ধমান, তারপর চুচুড়া (চিনশুরা)। ভাবীদের আদি বাসস্থান বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর (সিল্কের জন্য বিখ্যাত) আর মায়ের মুর্শিদাবাদ। আমরা ঘটিবলে ঠাট্টা করতাম। যাই হােক, এই প্রতিকূল অবস্থায় অভাব আর অনটনে বড় ভাইয়ের ডায়াবেটিস দেখা দেয় ঐ অল্পবয়সে। ওঁরা লােকমুখে জানতে পারেন বাংলাদেশ সরকারের কথা। তারপর আরও খোজখবর নিয়ে তারা আমার ঠিকানা পান শুধু বাংলাদেশ অফিস, কৃষ্ণনগর, আগরতলা। ভারতের ডাক ও তার যােগাযােগ সেই বৃটিশ আমল থেকেই নির্ভরযােগ্য। চুঁচুড়া থেকে আমার কাছে টেলিগ্রাম এল: আমরা চুঁচুড়ায় আছি। যত শিগগির পারাে যােগাযােগ করাে এবং সাহায্য পাঠাও।
আমাদের সব সমস্যার সমাধান বাচ্চুদা-কে বললাম। উনি বললেন: কুচ পরওয়া নেই। এখনই যাচ্ছি, খুঁজে বের করব। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনস-এ টিকিট করে সঙ্গে কিছু টাকা দিয়ে। পাঠালাম। বাচ্চুদা ঠিকই ভাইকে বের করলেন। ওখান থেকে খবর পাঠালেন যে, সব ব্যবস্থা (আহার-বাসস্থান করে ফিরে আসছেন। আমি মুজিবনগরে পৌছে ভাইকে ডেকে পাঠালাম। উনি পেশায় অ্যাকাউনটেন্ট এবং উঁচুপদে সমাসীন ছিলেন। ওঁকে বারাসাতে আমাদের দক্ষিণ আঞ্চলিক হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা (Zonal Accounts Officer) করে পাঠানাে হলাে। সেখানে মােমেন সহেব ছিলেন আঞ্চলিক প্রশাসক।
মে মাসের কোনাে-একসময় ড. ত্রিগুণা সেন আগরতলায় এসেছিলেন অন্যান্য লােকজন নিয়ে। মাহবুব আলম চাষী, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর এবং আমি গিয়েছিলাম আমাদের একটা যুবশিবির পরিদর্শনে। আমি তখনও জানতাম না যে ড. সেন ভারত-সরকারে নেই এবং বাইরের কোনাে বৃহৎ শক্তির সাথে তার বিশেষ সখ্য আছে। কোলকাতায় যাবার পর খন্দকার মােশতাকের নানাবিধ কর্মকাণ্ড এবং সবসময় সরকারকে (বিশেষ করে তাজউদ্দীন সাহেবকে) অসুবিধায় ফেলা এবং হেয় করার প্রচেষ্টা লক্ষ্য করলাম। তার (মােশতাকের) ঘনিষ্ঠজন কারা এবং কাদের সাথে ওঠাবসা করেন এটা লক্ষ্য করে মােটামুটি দুয়ে দুয়ে চার করা যেত। তাজউদ্দীন সাহেব কিছু জানতে পারলেও বাইরে প্রকাশ করতেন না। হয়তাে উপযুক্ত সময় এবং যথেষ্ট প্রমাণের অপেক্ষায় ছিলেন। কত রকমের গােয়েন্দা-সংস্থা আর কত ধরনের প্রভাব-বলয় চারদিকে কাজ করছিল নিজ নিজ স্বার্থসিদ্ধির জন্য তা চাক্ষুষ না করলে কোনাে ধারণা করা সম্ভব নয়।
মে মাসে আরেকটি বড় এবং আমাদের জন্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা ঘটে। সেটি ছিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর আগরতলা সফর এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলকে রাজভবনে (গভর্নর হাউসে) সাক্ষাৎকার প্রদান। ঐ দলে ড. এ. আর. মল্লিক, প্রফেসর আলী আহসান, কুমিল্লার অ্যাডভােকেট সিরাজুল হক, গণপরিষদ সদস্য কাজী জহিরুল কাইউম, প্রফেসর নুরুল ইসলাম, সাংবাদিক খালেদ, বেশ কয়েকজন বুদ্ধিজীবী, শিল্পী, কবি, সাহিত্যিক ছিলেন। আমিও ছিলাম দলের একজন। ড. মল্লিক এবং আমি বক্তব্য রেখেছিলাম। মিসেস গান্ধী যাকে বলে একটা রীতিমতাে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন প্রতিনিধি দল (High Powered Team) নিয়ে এসেছিলেন সরেজমিনে দেখতে এবং বাংলাদেশের জন্য কী করা যায় তার সিদ্ধান্ত নিতে। তার সাথে ছিলেন কেন্দ্রীয় তথ্যমন্ত্রী নন্দিনী সৎপতি, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধার্থ শংকর রায়, ত্রিপুরার লে. গভর্নর ডিয়াজ, অল ইন্ডিয়া রেডিওর মহাপরিচালক মি. এ. কে. সেন। মিসেস গান্ধী আমাদের সাথে খােলামেলা আলােচনা করলেন। আমরা তাকে বােঝালাম যে বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য সবরকম ত্যাগ স্বীকার করবে। আমাদের পেছনে সারা জাতি জেগে গিয়েছে। মুক্তিপাগল বাঙালি লড়াইয়ে প্রস্তুত। তখন আমাদের প্রয়ােজন প্রশিক্ষণ আর অস্ত্র। আমরা (অর্থাৎ পূর্বাঞ্চলের নেতৃবৃন্দ) বুঝতে পারিনি যে, ইতােমধ্যেই আমাদের প্রবাসী সরকারের সাথে ভারত-সরকারের একটা সমঝােতা হয়ে গিয়েছে সামরিক সাহায্যের বিষয়ে। এর পাশাপাশি আর দুটো দাবি ছিল আমাদের। আমাদের শক্তিশালী রেডিও ট্রান্সমিটার এবং তার সাথে স্টুডিও, যাতে করে আমরা স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনা করে আমাদের নিজস্ব অনুষ্ঠান জনগণকে শােনাতে পারি, নিজেদের প্রচার চালাতে পারি, দেশের অভ্যন্তরে জনগণকে যুদ্ধের সঠিক খবর দিয়ে উদ্বুদ্ধ করতে পারি। এক কথায় স্নায়ুযুদ্ধ জেতার অন্য বিশেষ হাতিয়ার রেডিও (টেলিভিশন তখন অত্যন্ত সীমিত) নেটওয়ার্ক খুবই আবশ্যক।
আমাদের দ্বিতীয় প্রস্তাব ছিল যুবশিবির সংক্রান্ত। যেহেতু ভারত-সরকার শরণার্থীদের জন্য বিপুল ব্যয় বহন করে শিবির চালাচ্ছেন এবং রেশন দিচ্ছেন, সেহেতু আমাদের যুবকদের প্রশিক্ষণের জন্য পৃথক শিবির করে সেখানে শরণার্থীদের জন্য বরাদ্দকৃত তাবু আর রেশনের একটা অংশ ঐ যুবশিবিরে দিলে অতিরিক্ত ব্যয় তাে হবেই না উপরন্তু অত্যন্ত অল্প খরচে আমরা বিশাল একটি বাহিনী পাব যারা উপযুক্ত প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র পেলে দেশের মুক্তি সহজ ও ত্বরান্বিত করতে পারবে। শরণার্থী শিবিরসমূহের পরিচালনা, স্থানীয় প্রশাসনিক এবং প্রতিরক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলির সর্বাত্মক সহযােগিতা, আমাদের যােগাযােগ ও যাতায়াতের ব্যবস্থা উন্নতকরণ ইত্যাদি নানাবিধ গঠনমূলক প্রস্তাবও আমরা সেদিন রেখেছিলাম।
মিসেস গান্ধী প্রায় সব বিষয়েই সম্মত হয়েছিলেন, ফলে অতি শীঘ্রই শুরু হলাে স্বাধীন বাংলা বেতার, আর আমরা পেলাম একটা সুসংগঠিত যুবশিবির ব্যবস্থা। এই দুটোই আমাদের মহামূল্যবান সম্পদ ছিল সে-সময়। এই হাতিয়ার ছাড়া যুদ্ধ-পরিচালনা কোনােক্রমেই সম্ভব হতাে না। মিসেস গান্ধীর সাথে সভার জন্য আমরা মােটামুটি প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। মােট ৪টি বিষয়ের ওপরে আমরা একটা কার্যপত্র (working paper) তৈরি করেছিলাম। বিষয়গুলাে হলাে:
ক. বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিকা এবং আমাদের স্বাধিকার অর্জনের ইতিহাস ও সংগ্রাম;
খ. মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, মূল্যবােধ ও আদর্শ;
গ. সংগ্রামের ধর্মনিরপেক্ষ বৈশিষ্ট্য;
ঘ. সংগ্রামের তৎকালীন অবস্থা/পর্যায়।
তিনজন বিশিষ্ট ব্যক্তিকে কার্যপত্র প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। এঁরা হলেন প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান, জনাব ওসমান জামাল এবং শ্রী শান্তিরঞ্জন ভৌমিক। মােট এক হাজার শব্দের মধ্যে তাদের প্রতিবেদন লেখা সীমিত করতে অনুরােধ করা হয়েছিল।
মিসেস গান্ধী আমাদের আলােচনা ওখানেই সীমিত রাখলেন না। কয়েকদিন পর তিনি দিল্লি থেকে আগরতলা পাঠালেন তাঁর সরকারের প্রবীণতম সচিব, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের ভারপ্রাপ্ত শ্রী স্বামীনাথনকে। ভারতীয় মন্ত্রিপরিষদ-সচিবের সাথে আমাদের আরও বিস্তারিত আলােচনা হয়। বিভিন্ন বিষয়ে, যাতে ভারতীয় সরকার অনেক দ্রুত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করতে পারেন। বৈঠকের স্থান ছিল আগরতলা বিমানবন্দরের কাছাকাছি নরসিংঘর কারিগরি বিদ্যালয়ে।
যুবশিবিরের নিয়ন্ত্রণ ও কর্তৃত্ব একবার কজা করতে পারলে মাহবুব আলম চাষী অনায়াসেই একে ভিন্ন ধারায় নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা করতেন। কোমলমনা যুবকদের উদ্বুদ্ধ (motivate) ও মগজধােলাই করে চাষী গয়রহ খন্দকার মােশতাকের পক্ষে অন্য প্রচারণা চালাতেন। আল্লাহ আমাদের বাঁচিয়েছিলেন মােনাফেকদের হাত থেকে ঐ চরম দুঃসময়ে।
মে মাসের শেষে অথবা জুনের প্রথমে জনাব এম. আর. সিদ্দিকী আগরতলায় পৌঁছেন। তখন আলম চাষী সাহেব কোলকাতা চলে গেছেন। তার সাথে তাহেরউদ্দীন ঠাকুর। সিদ্দিকী সাহেব বার্তা নিয়ে এসেছেন তাজউদ্দীন সাহেবের পক্ষ থেকে। আমাকে মুজিবনগর গিয়ে নতুন মন্ত্রিপরিষদ সচিবালয় গড়তে হবে এবং মন্ত্রিপরিষদ-সচিবের দায়িত্ব পালন করতে হবে। আমাকে পছন্দ করার কারণ পূর্বাঞ্চলের নেতৃবৃন্দের সুপারিশ এবং পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের কাজ করার অভিজ্ঞতা। স্বাধীন, সার্বভৌম সরকারে মন্ত্রিসভা কীভাবে পরিচালিত হয়, নিয়ম-কানুন কী ধরনের, মন্ত্রিসভার জন্য সার-সংক্ষেপ তৈরি ইত্যাদি নিত্যনৈমিত্তিক প্রয়ােজনগুলােতে প্রধানমন্ত্রীকে সাহায্যে করার কেউ ছিলেন না। এসব কারণে আমাকে ডেকে পাঠানাে হলাে।
মুজিবনগরে
আগরতলা থেকে দূরে যাওয়ার বড় একটা উৎসাহ তখন ছিল না আমার। আমার স্ত্রী ইসমাৎ তখন আসন্ন সন্তানসম্ভবা (জুলাই মাসে নতুন অতিথির আগমন আশা করছিলাম)। ওখানে ডাক্তারদের সাথে পরিচয় হয়েছে। বাংলাদেশের একজন দাই (রাঙামাটির এবং আমাদের পূর্বপরিচিত) সংগ্রহ করা হয়েছে। চক্রবর্তী বাবুর বাগানবাড়িতে দেখাশুনার লােকজনও আছেন। সব মিলিয়ে একটা অজানা পরিবেশে যাওয়ার ইচ্ছা বা আগ্রহ কোনােটাই ছিল না।
এতদ্সত্ত্বেও সিদ্দিকী সাহেব আমাকে শেষপর্যন্ত প্রভাবিত করলেন। তখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে সাময়িকভাবে একা যাব, মােটামুটিভাবে দপ্তর গােছগাছ করে ফিরে আসব। জুলাই মাসে সন্তানের জন্ম হলে কয়েকদিন পর সপরিবারে এবং রাঙামাটি থেকে আগত অত্যন্ত প্রয়ােজনীয় এবং সেখান থেকে আসা বিশ্বাসী কর্মচারীদের নিয়ে যাব।
মুজিবনগর যাবার প্রস্তুতি যখন সম্পন্ন করেছি সেই সময় একটা মজার ঘটনা ঘটল। কোলকাতার ছাপে একটা টেলিগ্রাম পাঠিয়েছেন আমার সহকর্মী (১৯৬১ ব্যাচেরই সি.এস.পি.) নূরুল কাদের। নামের সাথে পৈতৃক পদবি ‘খান’ থাকলেও সেটা তিনি বর্জন করেছেন খানসেনাদের বর্বরােচিত হামলার প্রতিবাদে। টেলিগ্রামের সারমর্ম: ‘এখন কোলকাতা এসাে না।’ সিদ্দিকী সাহেব ওটাকে গুরুত্ব দিতে নিষেধ করলেন ব্যক্তিগত পরামর্শ হিসেবে। বিষয়টি পরে বুঝতে পেরেছিলাম। কোলকাতা গিয়ে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের হাল ধরি, এটা আমার কোনাে-কোনাে বন্ধু পছন্দ করেননি।
তবু যাওয়াটাই ঠিক করলাম। স্থির হলাে বাচ্চু বাবু আমার সাথে যাবেন। কোলকাতায় আলিপুরে তাঁদের বাড়ি আছে। ঘন ঘন যাতায়াত। তাই উনি সাথে থাকলে আমাকে ব্যক্তিগত ঝক্কি-ঝামেলা তেমন সইতে হবে না। আমার স্ত্রী-ও আমাকে একা ছাড়তে চাইলেন না। ইন্ডিয়ান এয়ারলাইনসের দুটো টিকিট (রিটার্ন) সংগ্রহ করা হলাে।
কোলকাতায় আমরা উঠলাম কেনিলওয়ার্থ হােটেলে (বর্তমানেরটা নয়)। আসলে পুরােনাে এক আর্মেনিয়ান খ্রিস্টান মহিলার গেস্ট হাউস। পৌঁছে খবরাখবর নিলাম কে কোথায় আছেন, নেতারা কোথায় থাকেন, নিরাপত্তার কী ব্যবস্থা, যােগাযােগ কীভাবে, এইসব মামুলি তথ্য।
যেদিন পৌঁছলাম (তারিখটা মনে করতে পারছি না) তার পরদিন সকালে ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের (এটি এখন শেক্সপিয়ার সরণী) অফিসে উপস্থিত হলাম। এটা বি. এস, এফ.-এর পুরােনাে কোনাে বাড়ি ছিল। চারিদিকে উঁচু দেয়াল দিয়ে ঘেরা। পেছন দিকে সেকেলে দালান। বড় বড় সব ঘর। দালানে ঢুকেই প্রশস্ত বারান্দা। সামনে মাঠ। বড় দালানের চারদিকে আবার ছােট ছােট বেশ কয়েকটি দালান। থিয়েটার রােডের এই বাড়ির। একটি কক্ষে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ থাকতেন। কক্ষ-সংলগ্ন একটি বাথরুমও ছিল। আমাদের অফিস পাহারার জন্য বি. এস. এফ.-এর ইউনিট থাকত পাশের ছােট বিল্ডিং-এ।
তখনকার মতাে আর-কোনাে আলােচনা তার সঙ্গে হলাে না। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বলতে কিছুই ছিল না। অতএব শূন্য থেকেই আমাকে গড়তে হবে। সকলের সহযােগিতা প্রয়ােজন। ওখানকার নেতৃবৃন্দের অনেককেই চিনি না। ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী আমার আত্মীয় এবং ১৯৫২ সাল থেকে পরিচিত। এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান সাহেবকে রাজশাহী থেকে চিনতাম। আবদুস সামাদ আজাদ, সাহেবকে তার পাবনার বৈবাহিক সূত্রে চিনতাম। জিল্লুর রহমান সাহেবকে জানতাম আমার ভৈরববাজারের আত্মীয়ের মাধ্যমে। ঐ ভবনে, অর্থাৎ আমাদের অফিসের ওপরতলায় আরও বেশ কয়েকজন থাকতেন। তাদের মধ্যে ছিলেন। খুলনার মােহসিন সাহেব আর ঢাকার আওয়ামী লীগ অফিসের সেক্রেটারি মােহাম্মদউল্লাহ (পরে রাষ্ট্রপতি)। টাঙ্গাইলের মান্নান সাহেবও ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রীর তখনকার একান্ত সচিব ছিলেন ড. ফারুক আজিজ খান, আমার মামাতাে ভাই। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব ছিলেন জনাব লুৎফুল হক (ই. পি. সি. এস.)। আমাদের অফিস-ভবনের দোতলায় বসতেন দুটি পৃথক কক্ষে ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান। ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী ছিলেন অর্থ, বাণিজ্য,
পৃষ্ঠা: ২২৫
যােগাযােগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে। তাঁর মন্ত্রণালয়ের সচিব জনাব খন্দকার আসাদুজ্জামান (আমাদের সি. এস. পি. সহকর্মী, ১৯৬০ ব্যাচ)। উনি আমার সহপাঠী—ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ১৯৫৮ সালের অর্থনীতির ছাত্র। তার ওপর টাঙ্গাইল বাড়ি, এবং আমার মতােই টাঙ্গাইলে বিয়ে করেছেন ছাত্রাবস্থায়।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের খুব ঘনিষ্ঠ কয়েক ব্যক্তি ঐসময় প্রচণ্ড পরিশ্রম করেছেন। নিঃস্বার্থভাবে দেশসেবায় নিয়ােজিত রেখেছেন নিজেদের। এঁরা হলেন পুরােনাে ঢাকার এম.পি. এ. জনাব মােহাম্মদ সিরাজুল ইসলাম, জনাব আরহাম সিদ্দিকী, গাজীপুরের এম. এন, এ. জনাব শামসুল হক প্রমুখ। তিনজনেই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতা-ঢাকা শহর ও শহরতলীর পার্টি-কর্মকাণ্ডে বিশেষভাবে জড়িত। সিরাজুল ইসলামের আরও একটি পরিচিতি ছিল। তিনি আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ইয়ার মােহাম্মদ খান সাহেবের ছােটভাই। পুরােনাে ঢাকার কারকুনবাড়ি লেনে তাঁদের পৈতৃিক বাড়িতেই আওয়ামী লীগের জন্ম। উনি যে-এলাকার এম.পি.এ. সেটি বঙ্গবন্ধুর নিজের আসন এবং বঙ্গবন্ধুই তাঁকে মনেনীত করেন পুরােনাে ঢাকার জনপ্রতিনিধি হিসেবে। সফল ব্যবসা এবং বিত্তের জন্য যেমন পরিচিতি, তেমনই সবাই তাঁকে জানেন দানশীল (philanthropist) ও চিন্তাবিদ বলে। ঢাকার ন্যাশনাল মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল, লায়ন্স চক্ষু হাসপাতাল এবং আরও অনেক দাতব্য প্রতিষ্ঠানের প্রধান পৃষ্ঠপােষক ইসলাম সাহেব। এই প্রসঙ্গে আরও স্মর্তব্য, বঙ্গবন্ধু ২২-২৩ মার্চের দিকে তাজউদ্দীন আহমদ ও ড. কামাল হােসেনকে পাকিস্তানিরা আক্রমণ করলে যে-স্থান নির্বাচন করতে বলেছিলেন সেটি পুরােনাে ঢাকাতেই সিরাজুল ইসলাম সাহেবদের একটি গােপন আস্তানা।
শামসুল হক সাহেব ১৯৫২ সালে সলিমুল্লাহ মুসলিম হলের ছাত্র ইউনিয়নের ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন। ১৯৭২ সালে বঙ্গবন্ধু-মন্ত্রিসভার মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
আরও দুই বিশিষ্ট নেতার নাম এখানে উল্লেখযােগ্য। উভয়েই ঢাকা জেলার এবং তাজউদ্দীন সাহেবের ঘনিষ্ঠ। এরা হলেন প্রয়াত ময়েজউদ্দীন আহমেদ ও ফকির শাহাবুদ্দীন। দুজনেই জনপ্রিয় এবং মুক্তিযুদ্ধকালে অনেক অবদান রেখেছেন। বিশেষ করে সরকারের বিশেষ প্রতিনিধিরূপে ফকির শাহাবুদ্দীন দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার দেশগুলিতে সরকারি এবং বেসরকারি পর্যায়ে বাংলাদেশের পক্ষে সফল দূতিয়ালি করেন। বিজয়ের পর বাংলাদেশের প্রথম এটর্নি জেনারেল নিযুক্ত হন। ময়েজউদ্দীন আহমেদ কয়েকবার সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হন। এরশাদ আমলে দুবৃত্তের গুলিতে তিনি নিহত হন।
আসাদুজ্জামান সাহেব ১৯৭১ সালের মার্চে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান সরকারের অর্থদপ্তরের (প্রাদেশিক সরকারে মন্ত্রণালয় ছিল না, বলা হতাে ডিপার্টমেন্ট, তার দায়িত্বে) নিয়ােজিত ছিলেন। মার্চের শেষে টাঙ্গাইল চলে যান সপরিবারে। প্রত্যক্ষভাবে প্রতিরােধ সংগ্রামে জড়িয়ে পড়েন। মুক্তিবাহিনী টাঙ্গাইল থেকে পিছু হটলে তিনি তাদের সাথে যমুনা নদীর অপর পাড়ে সিরাজগঞ্জ চলে যান। ওখানকার বীর এস.ডি. ও. শামসুদ্দীন ১৯৬৯ ব্যাচের সি. এস.পি. তৎকালীন চিফ সেক্রেটারি শফিউল আজমের আপন ভায়রা ভাই। তাকে নানাভাবে প্রভাবিত তরে ঢাকায় আনা হয়। পরে পাকিস্তানি সেনারা শামসুদ্দীনকে একটা বস্তাবন্দি করে ফেরত পাঠায়। প্রচণ্ড প্রহারে তিনি তখন একটা কাগজের মণ্ড (paper pulp)-র মতাে। শহীদ শামসুদ্দীন আমাদের গর্ব।
আসাদুজ্জামান সাহেব সিরাজগঞ্জ থেকে পিছু হটে মুজিবনগরে যান এবং ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে অংশ নেন। আর ছিলেন পাবনার সাবেক ডেপুটি কমিশনার নূরুল কাদের, মেহেরপুরের বীর মুক্তিযােদ্ধা এস.ডি.ও. তৌফিক এলাহী চৌধুরী (পরে যুদ্ধে বীরত্বের জন্য ক্যাপ্টেন এবং বীরবিক্রম)। ঝিনাইদহের এস. ডি.পি.ও. মাহবুবউদ্দীন আহমেদ (পি. এস. পি.), নড়াইলের এস. ডি.ও কামাল সিদ্দিকী, সি. এস. পি. মাগুরার এস. ডি. ও. ওয়ালিউল ইসলাম সি. এস. পি. (যিনি পরে ছাত্র-নেত্রী রাফিয়া আক্তার ডলিকে বিয়ে করেন) এবং যশােরের সহকারী কমিশনার (প্রবেশনার), জনাব সাদত হুসেন সি. এস. পি.। এঁরা সকলেই পরে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করে পি.এইচ. ডি ডিগ্রিপ্রাপ্ত হন এবং সরকারের সর্বোচ্চ পদে আসীন হয়েছেন নিজ নিজ গুণে। সবাই দেশে অতি পরিচিত। আরাে ছিলেন রাজশাহীর কমিশনার শামসুদ্দীন সাহেব, ই.পি.সি.এস.; নাটোরের এস.ডি.ও. কামালউদ্দীন।
মুজিবনগরের বর্ণনা দেওয়া অবশ্য আমার মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। আমাদের সরকারে কে কী ভূমিকা পালন করছিলেন সেটি বর্ণনাই মূল কথা। যথাস্থানে আরও বিস্তারিত, যেমন কে কী দায়িত্বে ছিলেন, কী কাজ করতেন, কী ভূমিকা ছিল এগুলাে উল্লেখ করা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর মিলিটারি-সচিব ছিলেন একজন। তিনি মেজর নূরুল ইসলাম শিশু। স্বাধীন বাংলাদেশে বিভিন্ন সময়ে অনেক বিতর্কিত ভূমিকা রেখেছেন। মেজর জেনারেল নূরুল ইসলাম প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মন্ত্রিসভায় মন্ত্রীও হয়েছিলেন।
প্রয়াত নূরুল কাদের সরকারের জি.এ. অর্থাৎ জেনারেল অ্যাডমিনিস্ট্রেশন বিভাগ গঠন করে এটিকে একটা কার্যকর সংস্থায় পরিণত করেছিলেন। এই দপ্তরের কাজ ছিল সরকারের সব সিভিল কর্মকর্তা, কর্মচারীর নিয়ােগ, বদলি, শৃঙ্খলা দেখা। শুধু আমাদের সচিবালয়েই নয়, সারাদেশে, মুক্তাঞ্চলে এবং সবগুলাে অঞ্চলে (Zone-এ) সবাইকে নিয়ােগ ও দেখাশুনা করার দায়িত্ব ছিল। আমি যােগদানের পূর্বে নুরুল কাদের মন্ত্রিপরিষদ-বিভাগও দেখাশুনা করতেন। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তার বেশ ভালাে সমঝােতা ছিল। উনি প্রধানমন্ত্রীর কথা বুঝতে পারতেন ভালাে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনকে জানতে-বুঝতে আমারও বেশি দেরি হয়নি। কখন কী চাইতেন তা বুঝতাম। ভাবে আভাসে অনেক কথাই আমাদের বলে দিতেন—চারিদিকে শত্রু-পরিবেষ্টিত অবস্থায় সব কথা খুলে বলার অবকাশ ছিল না। ওয়ালিউল ইসলাম এবং নাটোরের এস.ডি.ও. কামালউদ্দীন ছিলেন জি.এ. বিভাগে।
সিলেটের ডেপুটি কমিশনার আমাদের সতীর্থ আবদুস সামাদ (সি.এস. পি. ১৯৬৯ ব্যাচ) বেশ পরে এসে যােগদান করেন মুজিবনগর-সরকারে। উনি আসার পরেই (আগস্টসেপ্টেম্বরের কোনাে সময়) প্রতিরক্ষা-সচিব নিযুক্ত হন। স্বল্পভাষী আমাদের এই বন্ধু আজ আর নেই।
গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খন্দকার, (ডেপুটি চিফ অব স্টাফ) ও সামাদ চমৎকার সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে কাজ করতেন। ঘটনাচক্রে আমরা চার পাবনাবাসী প্রধানমন্ত্রীর আশেপাশে—গ্রুপ ক্যাপ্টেন আর. কে. খন্দকার, সামাদ, ড. ফারুক আজিজ ও আমি। নূরুল কাদের ছিলেন পাবনার প্রাক্তন ডিসি। মন্ত্রী এম. ক্যাপ্টেন মনসুর আলীও ছিলেন। অবশ্য আমাদের মধ্যে আঞ্চলিকতার কোনাে প্রভাব ছিল না কখনও। কোথায় কার বাড়ি সেচিন্তা মনে আসেনি কখনও।
থিয়েটার রােডের ৮ নম্বরে অবস্থিত অফিসে আরাে যারা বসতেন তাঁদের অন্যতম ছিলেন ডা. টি. হােসেন, শামসুদ্দীন আহমেদ, মি. ভৌমিক, এম. এ. খালেক, নূরুদ্দীন আহমেদ, শীলুব্রত বড়ুয়া, ড. আহমেদ আলী প্রমুখ। ডা. টি. হােসেন ছিলেন স্বস্থ্যসচিব, খালেক সাহেব পুলিশের ডিরেক্টর জেনারেল; ভৌমিক মহাশয় রিলিফ কমিশনার; নূরুদ্দীন আহমেদ সাহেব বন ও পরিবেশ সচিব। ডা. টি. হােসেনের স্ত্রী মিসেস হােসেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি খবর পড়তেন। তাঁর কণ্ঠস্বর সবাই শুনেছে ঐ সময়। ওঁদের মেয়েও আমাদের সাথে কাজ করত। আমার পাশের কামরায় আরেক জন বসতেন, নাম শীত বড়য়া, জেলা জজ। আইন ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় দেখাশুনা করতেন তিনি। ড. আহমেদ আলী ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের নেতৃস্থানীয় দলীয় কর্মী।
যুবশিবিরের সদর দপ্তরও ছিল আমাদের সচিবালয়ের অন্তর্গত। চেয়ারম্যান প্রফেসর ইউসুফ আলী, মহাপরিচালক উইং কমান্ডার মির্জা; পরিচালক ফ্লাইট লেঠটেনান্ট রেজা, এরা। সকলে বসতেন আমাদের ঐ ভবনেই।
মুজিবনগর সরকারের সংগঠন, কর্মকাণ্ড, দপ্তর বণ্টন, কার্যপ্রণালী ইত্যাদি বিষয়ে পৃথক আলােচনা অন্য অধ্যায়ে করেছি। এখানে মন্ত্রিসভার কিছু স্মৃতির কথা উল্লেখ করব। তার আগে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীবর্গ অন্যান্য ব্যক্তিগণ কে কোথায় থাকতেন, কীভাবে থাকতেন সে সম্পর্কে আলােকপাত করা যাক।
কোলকাতার সি. আই. টি. অ্যাভিনিউয়ে আশুবাবুর বাড়িতে বিভিন্ন ফ্ল্যাটে থাকতেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মােশতাক, অর্থমন্ত্রী এম. মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পরিবার। সকলেই পরিবারের সাথে থাকতেন, প্রধানমন্ত্রী ব্যতীত। তিনি প্রতিজ্ঞা করেছিলেন দেশ স্বাধীন না-হওয়া পর্যন্ত পরিবারের সাথে থাকবেন না। কর্নেল ওসমানী এবং প্রধানমন্ত্রী একই জায়গায় অর্থাৎ ৮ থিয়েটার রােডে অফিসের সাথেই থাকতেন। খন্দকার মােশতাক তার দপ্তর স্থাপন করেছিলেন বাংলাদেশ মিশনেসার্কাস অ্যাভিনিউযেখানে এখনও আমাদের মিশন, ডেপুটি হাই কমিশনারের দপ্তর এবং বাসস্থান। ঐ একই জায়গায় অফিস করতেন পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলম চাষী; ডেপুটি হাই কমিশনার হােসেন আলী এবং অন্যান্য। আমাদের স্নায়ুযুদ্ধ (Psy warfare)-এর কিছু কাজ ওখানে করা হতাে। বাংলাদেশে গণহত্যার (genocide) ওপর তথ্য সংগ্রহ এবং প্রচার-চালানাের দায়িত্ব ছিল ব্যরিস্টার মওদুদ আহমদের ওপর। তাকেও একটি কক্ষ বরাদ্দ করা হয়েছিল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে।
স্বভাবতই মন্ত্রিসভা এবং অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধান সেনাপতি প্রমুখের নিরাপত্তা একটি বড় চিন্তার কারণ ছিল। কিন্তু আমাদের তেমন কিছুই করার ছিল না। আমাদের অফিসে সারাক্ষণ যে-পরিমাণ মানুষের ভিড় লেগে থাকত তাতে যে-কোনাে বড় দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারত। শত্রু গুপ্তচর যে আশেপাশেই ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। একমাত্র মন্ত্রিসভার আলােচনা এবং সিদ্ধান্ত আমরা গােপন করতে পারতাম পরবর্তীকালে মুক্ত বাংলাদেশে যা আমাদের জন্য খুবই কঠিন ছিল (এখনও তাই মনে হয়)। মন্ত্রিসভা অত্যন্ত ছােট ছিল আকারে; মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য, প্রচারযন্ত্র এবং শরণার্থীদের দেখাশুনা ও দেশবাসীর মনােবল সমুন্নত রাখা—এই তাে ছিল প্রধানতম কাজ। ইতিহাস সাক্ষ্য দেবে এই মহান ব্রতে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রথম সরকার প্রবাসী হয়েও নানা প্রতিকূলতার মধ্যে কতখানি অটল ছিল এবং সফল হয়েছিল। ১৬ ডিসেম্বরের মহান বিজয়ই তার প্রধানতম প্রমাণ।
স্বাধীন বাংলাদেশের আইনগত ভিত্তি ১০ এপ্রিল, ১৯৭১-এর স্বাধীনতার ঘােষণা (Proclmation of Independence)। এটিই সারা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে স্বীকৃতি পেয়েছে। আমাদের সংবিধান রচিত হয়েছে Proclamation of Independence-কে কেন্দ্র করে। দেশে যে-সমস্ত আইন বলবৎ করা হয়েছিল ১৯৭১-৭২ সালে আইনের ধারাবাহিকতা ও প্রয়ােগ আদেশ, (Laws Continuance Enforcement Order), স্বাধীনতার ঘােষণার মাধ্যমে প্রাপ্ত ক্ষমতা দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশের পূর্ণাঙ্গ সংবিধান প্রণীত ও বহাল হওয়ার পূর্বাবধি যে-সমস্ত কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা হয়েছিল, এই ধারাবাহিকতায় সাময়িক সংবিধান আদেশ (Provisional Constitution Order) দ্বারা সেইসবের উৎস আমাদের স্বাধীনতার ঘোষণা (Proclamation of Independence)’।
বাংলাদেশের বর্তমান এবং আগামী প্রজন্মের এসব ইতিহাস-সৃজনকারী তথ্যের ধারাবাহিককা সম্পর্কে জ্ঞান থাকা অত্যন্ত প্রয়ােজন। ইতিহাস হঠাৎ করে একদিনে হয় না। বাংলাদেশের ইতিহাসও তাই। এজন্যই প্রয়ােজন পেছনে ফিরে তাকানাে এবং বুঝতে চেষ্টা করা আমরা কী জাতি, কীভাবে আমরা স্বাধীনতা পেলাম। পূর্বাপর ঘটনাক্রমে এবং ঐতিহাসিক বিবর্তন সম্পর্কে জ্ঞান না-থাকলে ইতিহাসও রচনা করা যায় না। আজকের স্বাধীন বাংলাদেশকে জানতে হলে অবশ্যই ১৯৪০ সালের লাহাের ঘােষণা থেকে কীভাবে দ্বিজাতি তত্ত্বের (Two Nation Theory-র) যুক্তিতে ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তান সৃষ্টি হলাে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট, তারপর কীভাবে স্বাধীন পাকিস্তান ধর্মের নামে সংখ্যাগুরু জনগােষ্ঠীর জনপদ পূর্ববাংলাকে শােষণ আর বঞ্চনা করা হলাে, বাঙালির চিরন্তন ভাষাসংস্কৃতিকে ধ্বংস করে ইসলামের নামে উর্দু চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা হলাে, বাঙালি রুখে দাঁড়াল মহান ২১ ফেব্রুয়ােিত (১৯৫২); স্বাধিকার আন্দোলন দানা বাঁধতে শুরু হলাে, ১৯৬৬ সালে এসে পূর্ণতা লাভ করল, আন্দোলন; এল ৬-দফা আদায়ের আন্দোলন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে; তার পাশাপাশি নির্যাতন-কারাগারে নিক্ষেপ; কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা; মাওলানা ভাসানী আর ছাত্র-নেতৃবৃন্দের পরিচালনায় ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান; আইয়ুব খানের পতন এবং মার্শাল-ল; ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয় এবং ঐ বছরেই সাইক্লোন আর জলােচ্ছ্বাসে উপকূলবর্তী লাখ লাখ মানুষ প্রাণ হারাল, বিপুল ক্ষয়ক্ষতি হলেও পাকিস্তান সরকার করল সম্পূর্ণ অবজ্ঞা আর অবহেলা; নির্বাচনে মুসলিম লীগসহ অন্যান্য দলকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে অধিকাংশ আসনে নিরঙ্কুশ জয়লাভ করে আওয়ামী লীগ সরকার গঠনে প্রস্তুত তখনই ইয়াহিয়া খান কর্তৃক জাতীয় সংসদ অধিবেশন স্থগিত ঘােঘণা; ৭ মার্চে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আর স্বাধীনতার ডাক; ৭ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত সফলতম অসহযােগ আন্দোলন; ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানবাহিনীর নিরস্ত্র বাঙালির ওপর জঘন্যতম হামলা এবং সেইসাথে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা; ২৫ মার্চ রাত থেকে বীর ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং সেইসাথে বেসামরিক প্রশাসন এবং সর্বস্তরের জনসাধারণের বীরত্বপূর্ণ প্রতিরােধ; ২৭ মার্চ কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ আমাদের সকলকে সেদিন অনুপ্রাণিত করেছিল; ১০ এপ্রিলের আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘােষণা (Proclamation of Independence); ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার ঐতিহাসিক মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ; ১৬ ডিসেম্বরে চূড়ান্ত বিজয়; ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন; ১১ জানুয়ারি সাময়িক সংবিধান আদেশ(Provisional Constitution Order) এবং ১২ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু কর্তৃক সরকারের দায়িত্ব গ্রহণ; ১৯৭৩ সালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সংবিধান প্রণয়ন ও প্রবর্তন—এইসব ঐতিহাসিক ঘটনা ওতপ্রােতভাবে জড়িত। আজকের বাংলাদেশকে এই ধারাবাহিকতায় পর্যালােচনা এবং বিশ্লেষণ করতে হবে।
১৭ এপ্রিল, ১৯৭১ মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে, যে-স্থানে ১৯৫৭ সালের ১৫ জুন বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল, ঠিক সেই স্থানেই দুশাে বছরেরও বেশি কাল পরে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সূর্যোদয় হলাে—এর চাইতে আনন্দের আর গর্বের আর কী হতে পারে! অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ এবং প্রধান সেনাপতি পতাকা উত্তোলন করলেন। সশস্ত্র বাহিনীর অভিবাদন (গার্ড অব অনার) গ্রহণ করলেন। দেশি-বিদেশি সাংবাদিকবৃন্দ, বিপুলসংখ্যক জনতা আর নেতৃবৃন্দ দেখে অভিভূত হলেন। এই আনন্দ আর গর্বের মুহূর্তে আমি সেখানে উপস্থিত থাকতে নাপারলেও যারা ছিলেন তাঁদের কাছে বর্ণনা শুনেছি—সে কী উত্তেজনা, উৎসাহ আর উদ্দীপনা, শরীরে বিদ্যুৎপ্রবাহের মতাে মুহূর্ত (electrifying moment)।
আমার ডায়েরি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন কাজকর্ম সম্পন্ন করতে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে আমাদের যােগাযােগ করতে হতাে। তাদের ঠিকানা অথবা টেলিফোন নম্বর আমি মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আমার ডায়েরিতে লিখে রাখতাম। আজ এই গ্রন্থ লিখতে বসে সেসব টেলিফোন নম্বর এবং ঠিকানা আমার নিকট খুবই গুরুত্ববহ মনে হচ্ছে। এসব ফোনে কত গােপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রীয় কাজ করেছি তা ভেবে এখন অবাক হই। এসব স্মৃতিময় ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর মুক্তিযুদ্ধ ও তৎকালে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকরের বহু কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিল বলে সেসব এখন ইতিহাসের উপাদান ও সাক্ষী। তাই, এগুলাে নিচে উল্লেখ করা হলাে।
কোলকাতা অবস্থানকালে ১৯৭১ সালের এপ্রিল-মে মাসে গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন ও ঠিকানা
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি: ৪৪-৭০২২
প্রধানমন্ত্রী: ৪৪-৪৮১৮/১৬
পররাষ্ট্রমন্ত্রী: ৪৪-৬৭৪০
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী: ৪৪-৭৯৪৭
অর্থমন্ত্রী: ৪৪-৯৩২৮
প্রধান সেনাপতি: ৪৪-৭৩৩৮
প্রিন্সেপ স্ট্রিটের দপ্তর: ২৪-৮০১৮
মাইদুল হাসান: ৪৬-৩৪৩১-৮
ড. ত্রিগুণা সেন: ৩৫০০৯৩
মি. আর.এন. স্যানাল: ৪৭-৬৮১৭/৪৪-১২৪৫
মি. অরুণ মুখার্জি: ৪৪-৪৬২৬
(ডেপুটি কমিশনার, এস.বি.)
মি. গােলক মজুমদার: ৪৪-৪৮১৮
(ডি. আই. জি., বি. এস. এফ),
২ বি লর্ড সিনহা রােড, কলিকাতা
মেজর জেনারেল সরকার: ২৩২৩২১-৩৯৯
ইস্টার্ন কমান্ড
মি. এ. কে. রায়: ২২১৬৮১/৪৬০২৩৩/৪৪-৯৭০২
(বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রক)
পৃষ্ঠা: ২৩০
মি. এস. চট্টোপাধ্যায় (চ্যাটার্জী): ৪৪-৭১৯১/৪৪-৪৮১৮
(বি.এস. এফ.)
২ বি লর্ড সিনহা রােড, কলি ৭০০০১৬
মিস, অরুন্ধতি ঘােষ: ৪৫০১৪২
(বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রক, আমাদের সাথে দৈনন্দিন যােগাযােগ রাখতেন)
মি. ডি. কে. ভট্টাচার্য, জয়েন্ট সেক্রেটারি: ৩৭৫৮৪৬
ক্যাবিনেট সচিবালয়, নতুন দিল্লি
CII/100. Motibagh
ড. ফারুক আজিজ খান: ৪৪-৬০৮২
প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত সচিব
২১৫/১/৫ লােয়ার সার্কুলার রােড
কোলকাতা-১৭
(এটি আমাদেরও নিবাস ছিল)
মি. এইচ. ডি. পেনহা.: ২৩-২০১১/৪৪-৮৬৮৪
প্রধান তথ্য অফিসার (P.I.O.)
ভারত সরকার
প্রযত্নে মি. রথি
মি. এ. কে. সেন
ডিরেক্টর জেনারেল,
আল ইন্ডিয়া রেডিও
মি. এস. কে. সিংহ
ডিরেক্টর, বহির্বিশ্ব প্রচারণা (Director, External Publicity)
আমাদের নেতৃবৃন্দ/কর্মকর্তাদের ঠিকানা/টেলিফোন
মি. ফণিভূষণ মজুমদার: ৪৪-২৩১৩/৪৭-৫৩৫৯
(প্রযত্নে মি. এস. কে. সেনগুপ্ত)
PRO, Indian Tube Co.
মি. এ. খালেক
ডি.জি. পুলিশ
৭/ই গােবরা রােড,
ফ্ল্যাট ৮, কোলকাতা-৭০০০১৪
উপরের গােবরা রােডের ঠিকানায় আরাে যারা থাকতেন তাঁরা হলেন
ক. প্রফেসর সৈয়দ আলী আহসান
ফ্ল্যাট-২
খ. ড. মুশাররফ হােসেন
(সদস্য প্ল্যানিং সেল), ফ্ল্যাট-৬
গ. মি. লুফুল হক (অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির একান্ত সচিব) ফ্ল্যাট-১
ঘ. ড. স্বদেশ বােস: ৪৬-২৯১৪
ঙ. মি. আমিনুর রহমান
চিফ পাইলট
২৬ মারকুইস স্ট্রিট
কোলকাতা-৭০০০১৬
(ফ্রি স্কুল স্ট্রিটে ফায়ার ব্রিগেড হেডকোয়ার্টারের পেছনে)
চ. ড. এ.আর.মল্লিক
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গঠিত তৎকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের একটি প্ল্যানিং সেল ছিল। এই সেলের সদস্যবৃন্দের সঙ্গে আমার নিবিড় সম্পর্ক স্বাভাবিক নিয়মানুযায়ী রাখতে হয়েছিল। কিন্তু এই সেলের সদস্যবৃন্দ কোলকাতার বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলেন। অথচ তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখার বিষয়টি অপরিহার্য ছিল। যুদ্ধকালীন জরুরি অবস্থায় তাদের সকলের সঙ্গে প্রতিনিয়তই সংযােগস্থাপন করতে হতাে। এদের তৎকালীন অবস্থানের ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর আমার ডায়েরিতে লিখে রেখেছিলাম। কারণ, সরকারিভাবে কোনাে টেলিফোন-গাইড যুদ্ধাবস্থায় প্রকাশ করা সম্ভব ছিল না। তাই মন্ত্রিপরিষদ-সচিব হিসেবে তাদের ঠিকানা এবং টেলিফোন নম্বর আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলাম। আমি মনে করি, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আমার ব্যক্তিগত ডায়েরিতে সংরক্ষিত তথ্যগুলােও বিশেষ অবদান রাখবে। গবেষকদের এসব তথ্য কাজে লাগতে পারে। নিচে তথ্যগুলাে উল্লেখ করা হলাে:
সদস্যবৃন্দ এবং তাদের ঠিকানা/টেলিফোন
ড. মােজাফফর আহমেদ চৌধুরী
হােটেল পূর্বরাগ
৩৫-৬৮০৬
ড. খান সারওয়ার মুরশিদ
৩৭, আমির আলি অ্যাভিনিউ
ড. মুশাররফ হােসেন
৭-ই গােবরা রােড
ড. স্বদেশ বােস
৩/৫ যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় টিচার্স ব্লক
ড. আনিসুজ্জামান
৪৪-৯৯১৯
৪০-এ দিলকুশা স্ট্রিট
প্ল্যানিং সেলের অফিস
৪৬/৮ বালিগঞ্জ প্রেস, বালিগঞ্জ
কোলকাতা-৭০০০১৯
জনাব আমিরুল ইসলাম (রহমত আলী)
কোহিনূর, তৃতীয় তলা (১৩)
ত্রিপুরা হাউস
কে. পি. দত্ত
(আগরতলা)
৪৬-৩৫২৩
৪৬-৯৬৬৯
নূরুল কাদের
সংস্থাপন সচিব
স্বাধীন বাংলা বেতার
৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রােড
৪৭-১০৯৬
৪৪-৩০৪০ (বিশেষ প্রয়ােজনে)
বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ
(যারা নানাভাবে সাহায্য করেছেন, পরামর্শ দিয়েছেন, আশ্রয় দিয়েছেন)
ড. অশােক কুমার বাগচি: ৪৪-২৮৪১
১৬ কংগ্রেস একজিবিশন রােড
কোলকাতা-৭০০০১৭
মি. রণেন আয়ন দত্ত: ৪৬-৬৩১৭
২৫, কেয়াতলা লেন
মি. আবদুস সালাম১, ব্যারিস্টার
৪-এ পাম অ্যাভিনিউ
কোলকাতা-৭০০০১৯
বাসা: ৪৪-৯৬২৬
চেম্বার: ২৩-৮৭৮০/২৩-০০৮৩
জনাব আখতারুজ্জামান, এম.পি.এ.
৪৪-৮২০৫
৬/বি মিডলটন স্ট্রিট
কোলকাতা-৭০০০১৬
মি. এ. কে. দত্ত. চৌধুরী২
৪৪, আয়রন সাইড রােড,
ব্লক এফ ৪৪-৪৬৫৭
অফিস: ২২-৪১৯২
…………………………………………
১. মি. সালাম আমার শৈশবের বন্ধু, ঢাকা কলেজিয়েট স্কুলের সহপাঠী আবদুল কুদুসের বড় ভাই। ঢাকার জিঞ্জিরার মরহুম খান বাহাদুর হাজি হাফেজ মােহাম্মদ হােসেনের (বড় কাটরা) নাতি। জিঞ্জিরা, মৌলভীবাজার, ছােট কাটারায় তাঁর ছিল বিশাল সম্পত্তি। ব্যবসা করে কোলকাতাতেও অগাধ সম্পত্তি করেছিলেন। সেগুলি ওয়াকফ করে দেন। ব্যারিস্টার সালাম ছিলেন এর মােতাওয়ালী। থাকতেন অভিজাত বালিগঞ্জের পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িতে।
মুক্তিযুদ্ধে সালাম সাহেবের অবদান অপরিসীম। তাঁর পাম অ্যাভিনিউয়ের বাড়িটি ছিল একটা রিফিউজি ক্যাম্প। ঢাকার মানুষ, তার ওপর মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল, অতএব যিনি এসেছেন, তাঁরই স্থান হয়েছে। উপরন্তু খাওয়া-থাকার সুব্যবস্থা। বিছানায় জায়গা না হলে মেঝেতে অথবা খাটিয়ায়। তাঁর ফ্ল্যাটও বিশাল।
সালাম ভাইয়ের বাড়িতে প্রায় পুরাে সময়টা থেকেছেন মওদুদ আহমেদ, সৈয়দ আলী আহসান, ভিখারুল ইসলাম, সাদেক খান প্রমুখ। সাময়িকভাবে আরও অনেকে। আমার ব্যক্তিগত বা সরকারি আইনী সহায়তা প্রয়ােজন হলে সেটিও সালাম ভাইয়ের কাছে পেতাম। তাঁর তখন প্রচুর জানাশুনাও ছিল। নিজে ব্যারিস্টার, পার্টনার জ্যোতি বসুর ভাগ্নে। আবার ওয়াকফএস্টেটের লােকজনও ছিল। তার সহকারীর নাম ছিল সাব্বির-উর্দুভাষী। বড় মনােযাতনা নিয়ে বেচারা আমাদের হুকুম তামিল করত।
২. মি. এ. কে. দত্ত চৌধুরী ছিলেন পূর্ববাংলার প্রাক্তন সি.এস.পি. ১৯৪৯ ব্যাচ। বরিশালে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালীন ভারতে চলে যান এবং সেখানে ছােটখাটো সরকারি চাকুরিতে যােগদান করেন। রাইটার্স বিল্ডিং-এ অফিস ছিল। একাত্তরে আমাদের সাথে যােগাযােগ করেন।
…………………………………………
মি. ফণি. মজুমদার, এম.পি. এ.
১৭। ডি। ১এ রানি ব্রাঞ্চ রােড
কোলকাতা-৭০০০০২
শ্রী অলােক সেন
৪৭-৭৬১০/৪৬-৬৪৭৮
শেখ ফজলুল হক মণি
পি. ২৯৪, সি, আই.টি.রােড
বেলেঘাটা
তােফায়েল আহমেদ, এম. এন. এ.
৪৭-১০৩২
২১, রাজেন্দ্র রােড, ভবানিপুর
সুলতান শরিফ
(ইংল্যান্ড থেকে এসেছিলেন)
শ্রী নিকেতন হােটেল
৩৭, মহাত্মা গান্ধী রােড
কোলকাতা
মি. বি. আর. গুপ্ত, অতিরিক্ত সচিব,
পশ্চিমবঙ্গ সরকার,
রাজভবন এনেক্স, ২৩-৭৬৫৫
ডা. সৈয়দ মােদাচ্ছের আলী
৭-বি একডালিয়া রােড
গড়িয়াহাট
৪৪-বি শামসুল হুদা রােড
কোলকাতা- ৭০০০০১৭
পার্ক সার্কাস এলাকায় অবস্থিত এই ঠিকানা। এখানে একটি বাড়িতে নিচে বর্ণিত বেশ কয়েকজন আশ্রয় নিয়েছিলেন।
মি. এ.এইচ. খান
৩ নম্বর ফ্ল্যাট
মি. নূরুদ্দিন আহমেদ
সরকারের কৃষি ও বন সচিব
(বেগম বদরুননেসার স্বামী)
নিচ তলা
মি. মান্নান, এম. এন. এ.
(তথ্য মন্ত্রণালয় ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত)
তিন তলা
মি. মতিউর রহমান, এম.এন.এ.
নীচ তলা
মি. জিল্লুর রহমান, এম.এন.এ.
তিন তলা
মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে মরহুম রুহুল কুদ্স (সি.এস.পি. ১৯৪৯ ব্যাচ) আমাদের সাথে যােগ দেন। উনি বঙ্গবন্ধুর সাথে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আসামী ছিলেন। চাকুরি থেকে বরখাস্ত হন ১৯৬৯ সালে। মুজিবনগরে তাঁকে মুখ্য সচিব নিয়ােগ করা হয়। দেশ হানাদারমুক্ত হবার পর তিনি প্রধানমন্ত্রীর অস্থায়ী প্রধান সচিব নিযুক্ত হন। তাঁর তৎকালীন ঠিকানা২৬/বি আহিরি পুকুর রােড, কোলকাতা।
অন্যান্য নেতৃবৃন্দ
মি. আবদুস সামাদ আজাদ, এম.এন.এ. ৪৪-৩৯৪৩
৪/৩/সি ওরিয়েন্ট রােড
মি. মনােরঞ্জন ধর
৩৫-০৩০৪
মওলানা ভাসানী
প্রযত্নে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
প্রফেসর মােজাফফর আহমেদ
বিদেশি অতিথি যারা তথ্য সংগ্রহে এসেছেন অথবা সরেজমিনে তদন্ত করতে এসেছেন
মি. কেভিন মেনসেল, প্রযত্নে ললিত রায়
৮, রাউডেন স্ট্রিট, কোলকাতা-১৭
প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন নভেম্বর ১১ তারিখ বিকেল ৫টায়, তাকে অনেক তথ্য/দলিল দেওয়া হয়।
মি. ইয়েন মার্টিন ফোর্ড
ফাউন্ডেশন গেস্ট হাউজ
৪৪-৯৮৫১
বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির নাম, ঠিকানা, টেলিফোন নম্বর ছাড়াও ডায়েরিতে কোনাে কোনাে সময় গুরুত্বপূর্ণ সভার সংক্ষেপ কথা লিখে রাখতাম। এ সবই করতাম যখন প্রধানমন্ত্রী অন্য কোনাে কাজের ফাঁকে এমন মৌখিক নির্দেশ দিতেন, তখন। তারই একটি দৃষ্টান্ত আমার ডায়েরিতে আছে। নিচের সংক্ষিপ্ত বাক্যটি লিখেছিলাম এভাবে:
‘অর্থনৈতিক পরিকল্পনার জন্য বিশেষ কাউন্সিল’
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাংগঠনিক কাঠামাে কেমন ছিল, তার একটি খসড়াও আমার ডায়েরিতে টুকে রেখেছিলাম। মন্ত্রিপরিষদ-সচিব হিসেবে আমার চিন্তা-ভাবনার মধ্যে এসব বিষয় অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ ও নির্দেশ পালনের অংশ হিসেবে এভাবে কাজ করতাম।
আমার ডায়রিতে ভারতীয় পররাষ্ট্র বিষয়ক মন্ত্রক এবং অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক কমিটির একটি বর্ণনা আছে। তারই ওপর ভিত্তি করে পরবর্তী টেবিলটি দেওয়া হলাে:
পৃষ্ঠা: ২৩৫
ভারতীয় বৈদেশিক বিষয়ক মন্ত্রণালয়
নীতি নির্ধারণ
মি. ডি. পি. ধর, চেয়ারম্যান, বিদেশ
মন্ত্রকের বহিঃবিভাগে প্ল্যানিং কমিটি
(আগস্ট মাস থেকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায়)
টি. এন. কাউল (পররাষ্ট্র সচিব)
এস. কে. ব্যানার্জি, সচিব (পূর্ব)
পি. এস. মেনন (সচিব)
কে. পি. এস. মেনন
যুগ্ম-সচিব (বাংলাদেশ ডেস্ক)
এ. ডব্লিউ.বি. ভাজ
ডিরেক্টর, বাংলাদেশ (১)
পি. এল. সিরাইন,
ডিরেক্টর, বাংলাদেশ (২)
এন.সি. ব্যানার্জি (উপসচিব)
এ.আর. মুখার্জী, আন্ডার সেক্রেটারি
নীতি-নির্ধারণ বিভাগ, চেয়ারম্যান
জে.এস. ভট্টাচারিয়া
যুগ্ম-সচিব, ক্যাবিনেট
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক কমিটি
ড. এস. চক্রবর্তী
(সদস্য পরিকল্পনা কমিশন) চেয়ারম্যান,
অর্থনৈতিক পরিকল্পনা বিষয়ক কমিটি
ড. অশােক মিত্র
মি. আর. ডি. সাথে
যুগ্ম-সচিব, বৈদেশিক বিষয়ক
মন্ত্রণালয়
আমার ডায়রিতে আরাে কয়েকটি এন্ট্রি আছে যার ঐতিহাসিক মূল্য রয়েছে। এজন্য এসব এন্ট্রির তথ্যাদি এখানে উল্লেখ করা হলাে:
৯ আগস্ট, ১৯৭১
সিদ্ধান্ত ১। তিন-সদস্যবিশিষ্ট একটি এনকোয়ারি কমিশন গঠন করা হলাে:
ক. জনাব হান্নান খ. মি. ভৌমিক গ. মি. বড়য়া
এই কমিশনের দায়িত্ব ও কাজ (Terms of reference) প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করে নির্ধারিত হবে। তিনজনের মধ্যে জ্যেষ্ঠতম ব্যক্তি (চাকুরিতে সিনিয়র) চেয়ারম্যান হবেন।
২. সচিবালয় বাইরে স্থানান্তর করা হবে:
ক. প্রতিরক্ষা ব্যতীত অন্য কোনাে দপ্তর এখানে থাকবে না। খ. এখানে কোনাে বাসস্থান থাকবে না। গ. এখানে রান্না-খাবার কোনাে ব্যবস্থা থাকবে না। ঘ. সচিবালয় এক বা একাধিক ভবনে স্থানান্তরিত হবে।
থিয়েটার রােডে আমাদের সদরদপ্তরে গােপনীয়তা এবং শৃঙ্খলা বজায় রেখে কোনােক্রমেই কাজ করা যাচ্ছিল না। দোতলায় অনেকেই বসবাস করতেন। তাদের জন্য রান্না-খাবার ব্যবস্থা ছিল। পরিণামে কাজের পরিবেশটাই নষ্ট হয়ে যায়। বহিরাগতদের প্রচণ্ড ভিড়ে নিরপত্তাও বিঘ্নিত হয়। এইসব কারণে সচিবালয় স্থানান্তরের বিষয়টি বারবার আলােচিত হয়।
আগস্ট মাসে সর্বদলীয় ঐক্য স্থাপন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে পড়ে। মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত মােতাবেক সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের প্রস্তাব করা হয়। মন্ত্রিসভার ৮ আগস্টের সভায় বিস্তারিত আলােচনা হয় এই বিষয়ে। প্রস্তাবিত পরিষদের সদস্য ছিলেন:
ক. শ্রদ্ধেয় মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী খ. শ্রী মণি সিংহ গ. শ্রী মনােরঞ্জন ধর ঘ. প্রফেসর মােজাফফর আহমেদ
এই সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ সভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং মন্ত্রিসভার সকল সদস্য অংশগ্রহণ করবেন বলে সিদ্ধান্ত হয়। প্ল্যানিং সেলের সদসদেরও আমন্ত্রণ জানানাে হয়। মি. মণি সিংহের সাথে যােগাযােগের দায়িত্ব দেওয়া হয় মি. মইদুল হাসানকে।
৮ আগস্টে সম্ভবত ঐ একই সভায় আরও কতকগুলি বিষয় আলােচিত হয়, যেমন: বাংলাদেশ সরকারের গঠন এবং মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় নানাবিধ সমস্যা। ভারত এবং অন্যান্য বিদেশি সরকারের সাথে যােগাযােগ এবং আলােচনা কীভাবে হওয়া উচিত এ-বিষয়টি প্রাধান্য পায়। কয়েকটি নির্দেশও জারি করা হয়:
ক. সরকারি কর্মকর্তাদের বিনয় এবং বিচক্ষণতার সাথে কথা বলা উচিত।
খ. জনাব সামাদের মারফত জনাব ওবায়দুর রহমানকে সংবাদ দেওয়া হয় তিনি যেন প্রতিরক্ষা ব্যবস্থায় নিয়ােগের জন্য জনশক্তি সংগ্রহ করেন।
গ. আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের যারা একই সাথে এম.এন.এ. বা এম.পি.-এর দ্বৈত ভূমিকা ও দায়িত্ব আছে এ-কথা স্মরণ রেখে তাদের কাজে লাগানাে এবং তাদের সাথে পরামর্শ করা উচিত।
ঘ. সচিবালয় স্থানান্তর: বর্তমান ভবনে আবাসনের ব্যবস্থা পর্যালােচনা করে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নােট প্রণয়ন এবং পরবর্তী সভায় আলােচনা।
বেশ কয়েকটি অভিযােগের পরিপ্রেক্ষিতে বিনয় এবং বিচক্ষণতার সাথে কথা বলার বিষয়টি আলােচনায় আসে। দেখা যায়, অনেক সময় সরাসরি যােগাযােগ না-করে যুদ্ধরত নেতৃবৃন্দের সাথে পরােক্ষে যােগাযােগ করা হতাে।
১০ সেপ্টেম্বর বিকেল ৪টায় নিউ কেনিলওয়ার্থ হােটেলের ১০৯ নম্বর কক্ষে একটি বৈঠক হয়। প্রধানমন্ত্রী বিশেষ সাক্ষাৎকার দান করেন ভিখারুল ইসলাম (ব্যারিস্টার) ও আবেদকে।
বিদেশি অতিথিদের সাথে সাক্ষাৎকারের সময় নিরাপত্তার বিষয়টি জড়িত থাকায় ভারতসরকারের নিরাপত্তা অধিকর্তা এ.কে. রায়কে বিশেষ ব্যবস্থা নিতে বলা হয়। সাক্ষাৎকারের রাজনৈতিক দিকগুলাে দেখার দায়িত্ব ছিল ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের। অন্যান্য বিষয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিবের দায়িত্বে ছিল।
১২ সেপ্টেম্বর ৩:৩০ টায় বৈঠক
আবদুস সামাদ, তাহের ঠাকুর এবং হােসেন আলীর সমন্বয়ে তথ্য এবং বেতারে স্নায়ুযুদ্ধ পরিচালনায় একটি টিম গঠন করা হয়।
এই আবদুস সামাদ কি আজাদ সাহেব, নাকি প্রতিরক্ষা-সচিব মনে নেই। তবে প্রতিরক্ষা-সচিবই হবেন, কারণ উল্লিখিত টিমের প্রকৃতি বিদেশ-নীতি সংশ্লিষ্ট নয়। পররাষ্ট্রবিষয়ক হলে আবদুস সামাদ আজাদই হতেন। তাহের ঠাকুর এবং হােসেন আলীকে কেন অন্তর্ভুক্ত করা হলাে এর কোনাে ব্যাখ্যা নেই। তথ্য ও বেতার দেখার দায়িত্ব ছিল মান্নান সাহেবের। হােসেন আলী সাহেবের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন ছাড়া আর কোনাে গুণ বা ভূমিকা আমার চোখে পড়েনি। তাহের ঠাকুরের নানাবিধ তৎপরতার কথা এখন যেমন শােনা যায়, তখনও শােনা যেত।
সেপ্টেম্বর ১২ তারিখে সচিব-পর্যায়ে দুটো টিম গঠন করা হয়: তথ্যের জন্য প্রতিরক্ষাসচিব; পরিকল্পনার জন্য মন্ত্রিপরিষদ-সচিব। ঐ দিন আরাে কয়েকটি বিষয় আলােচনা করা হয়:
ক. অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদন খ. বিদেশে মিশনগুলি উন্নীতকরণ গ. শেহাবুদ্দীনের বিবৃতি
মি. কে. এম. শেহাবুদ্দীন দিল্লিস্থ পাকিস্তান মিশনে দ্বিতীয় সচিব ছিলেন। উনি পাকিস্তান সরকারের কূটনৈতিক চাকুরি ছেড়ে বের হয়ে আসেন এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেন এপ্রিলের প্রথমেই। ঐদিন মন্ত্রিসভার বৈঠক নির্ধারিত ছিল। তার আলােচ্যসূচি ছিল:
ক. পাটের বৈদেশিক বাণিজ্যের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা খ. আঞ্চলিক পরিষদে (Zonal Council-এ) ভাইস-চেয়ারম্যান নিয়ােগ।
সেপ্টেম্বর ১৪
মন্ত্রিসভার আলােচনা: প্রধানমন্ত্রী
বিভিন্ন সমস্যাবলি। প্রকাশ্যে সবরকম তৎপরতা সম্ভব নয়। বিদেশি সংবাদদাতাদের সাথে মেলামেশা এবং কথাবার্তা বলায় সতর্কতা। যুদ্ধের জন্য কার্যকরভাবে সকল শক্তি সমবেত করা বা নিয়ােগে নানাভাবে বাধাগ্রস্ত—বিশেষ করে গােপনীয়তা রক্ষার জন্য।
যুদ্ধের সঙ্গে যারা সরাসরি সম্পৃক্ত নন অথবা সংগ্রামের গভীরতা ও ব্যাপকতা (perspective) যারা অনুধাবন করতে পাছেন না তাদের কোনাে বিবৃতি দান করা উচিত নয়, উদ্দেশ্য যতই সৎ এবং মহৎ হােক-না কেন। ভারতীয় কর্মকর্তাদের সাথে সকল স্তরে সহযােগিতা করা প্রয়ােজন।
তথ্য ও প্রচারণা অবশ্যই সমন্বিত হতে হবে। একজন মাত্র মুখপাত্র থাকবেন, একটি মুখপত্র। সমন্বিতভাবে প্রচার চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে সমঝােতা হয়েছে। এজন্য আরও ভালাে/উন্নত লােকবল প্রয়ােজন।
বিভিন্ন প্রস্তাব
ক. বাংলাদেশ শিল্পীদের সংগঠন গড়ে তােলা। খ. প্রচুর সংখ্যক সরকারিভাবে স্বীকৃত (accreditated) সংবাদদাতা নিয়ােগ ও ব্যবহার। গ. বুদ্ধিজীবীদের মেধা কাজে লাগানাে। সাহিত্য, সংগীত, শিল্পকলা ইত্যাদি ক্ষেত্রে যেসব ব্যক্তিত্ব আছেন তাদের প্রচারণায় নিয়ােগ করা।
এখানে দুটো বিশেষ সুপারিশ রাখা হয়:
১. তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ে সংস্কৃতি বিষয়ক ইউনিট (Cultural unit)
২. প্রচারের ক্ষেত্রে সম্পদের (আর্থিক এবং মানসিক) সম্পূর্ণ ও যথার্থ ব্যবহার করার জন্য একটি কমিটি গঠন।
ভারত-সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাবৃন্দ যেমন: বহিঃপ্রচারণার ডিরেক্টর (Extemal Publicity) মি.এ.কে. রায়; রেডিও’র মহাধ্যক্ষ (D. G., Radio), প্রধান তথ্য কর্মকর্তা (Principal Information Officer), টি.ভি.-র অধ্যক্ষ (Director, TV); অভ্যন্তরীণ প্রচারের ডিরেক্টর (Director, Field Publicity), মি. ভট্টাচার্য—এদের সাথে আমাদের তৎপরতা সমন্বয় করলে প্রভূত ফল পাওয়া যাবে।
সেপ্টেম্বর ২২
এইদিন মি. এ. কে. রায় প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করেন। দুটি বিষয় অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ ছিল:
১. ভারতীয় সংবাদপত্রে এমন ব্যাপকভাবে বাংলাদেশের খবর ছাপা হচ্ছিল যাতে করে আমাদের পরিকল্পনা বিঘ্নিত হবার প্রভূত আশঙ্কা ছিল। সংবাদ সংস্থাসমূহ এবং সংবাদপত্র মালিকদের একটি আলােচনাসভা (confrerence) আয়ােজন করার প্রয়ােজনীয়তা উল্লেখ করে তাতে সংবাদমাধ্যমকে একটি নীতিমালা (guidelines) দেওয়া যেতে পারে।
২. মন্ত্রিপরিষদ-সচিব নিজে বিমানবন্দরে ভারতীয় প্ল্যানিং কমিশন সদস্যকে অভ্যর্থনা জানাবেন। প্রথম বৈঠকটি হবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সকাল ৯ টায়। বাংলাদেশ প্ল্যানিং সেলের সাথে ভারতীয় প্ল্যানিং কমিশন সদস্য মি. এস, চক্রবর্তী এবং তার সহকর্মীদের যৌথসভা নির্ধারণ করা হয়।
প্রফেসর মােজাফফর চৌধুরী এবং অন্যান্য সদস্যদের একটি কার্যপত্র তৈরি করতে অনুরােধ জানানাে হয়। এটি তারা প্রধামন্ত্রীর সাথে আলােচনা করবেন। এই প্রসঙ্গে প্ল্যানিং সেল তাঁদের কয়েকটি সমস্যার কথা বলেন। (১) আর্থিক, (২) স্থানাভাব, (৩) টেলিফোন।
যৌথসভার পূর্বেই দুটি সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল সেলের সদস্যদের সম্পর্কে: বিনাখরচে আবাস এবং বেতন পর্যাপ্ত।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে ভারতীয় অর্থনীতিবিদদের মধ্যে ড. চক্রবর্তী অত্যন্ত মেধাবী এবং উজ্জ্বল নক্ষত্র বলে বিবেচিত হতেন। বয়স নিতান্তই কম, তিরিশের কোঠায়; দেখতে অত্যন্ত সুশ্রী এবং ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। প্রবাসী বাঙালি। সব বিবেচনা করেই মিসেস গান্ধী একে পাঠিয়েছিলেন বাংলাদেশ দলের সাথে বৈঠক করতে। চক্রবর্তীর প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদা ছিল। ভারতীয় দলে আরও ছিলেন মি. ডি. কে. ভট্টাচার্য এবং এস. রামচন্দ্রন (প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যুগ্ম-সচিব)। এই যৌথসভায় থাকার কথা ছিল প্রফেসর নূরুল ইসলাম, ড. আনিসুর রহমান, ড. মাহমুদ, ড. ওয়াহিদুল হক, ড. এম. জি. মােস্তফা।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথে ড. এস. চক্রবর্তীর বৈঠকের বিবরণ ছিল নিম্নরূপ:
২৪।৯।৭১
প্রধানমন্ত্রী
সাহায্যের পরিসীমা (ব্যাপ্তি) সবক্ষেত্রেই পারস্পরিক সহযােগিতা। আমাদের দীর্ঘকালীন পরিকল্পনা (Perspective Plan) প্রস্তুত করার সময় ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব এবং পারস্পরিক সহযােগিতার বিষয়টি বিবেচনায় নিতে হবে।
পৃষ্ঠা: ২৪০
বর্তমান বঞ্চনার পূর্বাপর ব্যাখ্যা-ইতিহাস। সুপরিকল্পিত এবং সুসংবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে শােষণ ও বঞ্চনা করা হয়েছে ১৯৪৭ সাল থেকে।
ড. এস. সি.
বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, স্কুলশিক্ষকের কাজে নিয়ােগ-দেশসেবায় তাদের অবদান।
রাজনৈতিক শিক্ষা।
শিশুদের মৌলিক শিক্ষা (3-R’s)-বাংলার ইতিহাস; শিক্ষকদের জন্য রাজনৈতিক চেতনা। প্রথম আধা-খেচড়া কোনাে পরিকল্পনা নয়-স্বল্পকালীনও নয়। দীর্ঘস্থায়ী স্বাবলম্বী (self-sustaining), যার থাকবে নিজস্ব জীবনীশক্তি ও গতি।
এটি বাস্তববায়ন করতে প্রয়ােজন নিজস্ব কর্মীবাহিনী। জনশক্তি উন্নয়ন পরিকল্পনা প্রয়ােজন।
প্রধানমন্ত্রী
রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠানগুলি পরিচালনার জন্য প্রয়ােজন দক্ষ ও সচেতন কর্মীবাহিনী। এর ব্যবস্থা দীর্ঘকালীন পরিকল্পনায় থাকতে হবে।
জরুরি সমস্যা চিহ্নিতকরণ: যেমন বাসস্থান, খাদ্য, অন্যান্য নিত্য প্রয়ােজনীয় সরবরাহ। যৌথ শুল্ক ব্যবস্থা-কী ভবিষ্যৎ? প্রধানমন্ত্রী নির্দেশাবলি জারি করবেন। শিক্ষকদের ভারতীয় কর্তৃপক্ষ শরণার্থী শিবিরে নিয়ােগ করবেন। আমাদের বুদ্ধিজীবীরা গণসচেতনতামূলক সাহিত্য রচনা করবেন।
২৪।৯।৭১ যৌথসভা
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের পক্ষে ড. এস. চক্রবর্তী, মি. ডি. কে. ভট্টাচার্য, মি. এ. কে. রায়। বাংলাদেশ পরিকল্পনা সেলের সকল সদস্য।
১. প্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির তালিকা
২. বিভিন্ন তথ্য ও উপাত্ত: কীভাবে সংগ্রহ করা যায়।
– পাকিস্তান সরকারের প্রকাশিত সকল দলিল, প্রকাশনা
– পরিকল্পনা দলিল।
– Delhi School of Economics
– ও
– Indian Institute of Statistics
– এই দুই জায়গায় রক্ষিত দলিলপত্র/বই
– বিভিন্ন Census ড়েপরত
আমাদের প্রয়ােজন
ক. অর্থব্যবস্থা পরিকল্পনা ও পরিকল্পনা প্রণয়নে দক্ষ ও অভিজ্ঞ ব্যক্তি। খ. ভারতের এমন লােকবল যারা বাংলাদেশের সমস্যাবলি সম্পর্কে ভালাে জ্ঞান রাখে। গ. কর প্রশাসন (Taxation) ও সরকারি ব্যবস্থাপনা (Public Finance): কর প্রশাসনের সঙ্গে সম্পৃক্ত এইরকম ব্যক্তি। ঘ. পানিসম্পদ ব্যবহার: পানি নিয়ন্ত্রণ ও নদীশাসন-গঙ্গা/ব্রহ্মপুত্র। যৌথ এবং পারস্পরিক সহযােগিতামূলক নিরীক্ষা (এইজন্য এই বিষয়ে অভিজ্ঞ ও সম্পৃক্ত ব্যক্তি নিয়ােগ)। ঙ. যানবাহন ও যােগাযােগ-পরিবহণ অর্থনীতিবিদ। চ. মানব-সম্পদ উন্নয়ন পরিকল্পনা। এক্ষেত্রে শুধুমাত্র পরামর্শক (Consultants) পাওয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশি দক্ষ ব্যক্তি ও শিক্ষকদের তালিকা ড. চক্রবর্তীকে সরবরাহ করা যেতে পারে। পরবর্তীকালে এই যৌথসভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছিল উভয় পক্ষ থেকে।
অক্টোবর ০২ (কিছু সিদ্ধান্ত মন্ত্রিসভায় নয়)
১. আঞ্চলিক পরিষদের (zonal Council-এর) দায়িত্ব ও কার্যপরিধি সম্পর্কে নতুন খসড়া নির্দেশ।
২. নিয়ােগ ও বদলি সংক্রান্ত কতিপয় সিদ্ধান্ত।
৩. ক) Ms. Anna Taylor, Dr. David Nablin, Mr. Richard Levine এদের সাক্ষাৎকার দেবার পূর্বে খোজ-খবর। মি. এ. কে. রায়-কে অনুরােধ। মানবাধিকার সম্পর্কিত কমিশন গঠন। (খ) বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী (Volunteer Corps) (গ) আমাদের জন্য অবস্থানের পারমিট (Residential Permit) (ঘ) যানবাহন বিষয়। ৪. উপরের (১) নম্বর বিষয় সম্পর্কে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা করবেন। বিষয়টি জনাব জহুর আহমদ চৌধুরী এবং জনাব নূরুল কাদেরের সাথেও আলােচনা করতে হবে।
৫. আগরতলায় কাজী রকিবকে নির্দেশ দিতে হবে শান্তির বাজারে সভা আয়ােজনের জন্য।
২৮ অক্টোবর, ১৯৭১
পরবর্তী মন্ত্রিসভার আয়ােজন করতে হবে।
আলােচ্যসূচি:
(ক) অঞ্চল (zone) গুলিতে ব্যয় নিয়ন্ত্রণ। (খ) এম.এন.এ./এম.পি.এ-দের জন্য TA/DA (গ) দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল-১ ও দক্ষিণ-পূর্ব অঞ্চল-২ যােদ্ধাদের অভিষেকের (induction) জন্য ভাতা।
(১) বাংলাদেশ মিশন, কোলকাতা স্মারক-ডাকটিকিট বিক্রয়লব্ধ সমুদয় অর্থ এবং অবিক্রীত ডাকটিকিট অর্থ মন্ত্রণালয়ে জমা করবেন। (২) শ্রী জয়প্রকাশ নারায়ণ প্রদত্ত ২ লক্ষ রুপি মিশনে জমা আছে। (৩) জয়প্রকাশ ৭/৮ নভেম্বর কোলকাতা আগমন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন।
তার টেলিফোন নম্বর ৪৪-৭৭৫৮।
নভেম্বর ৫
সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদের সভা সকাল ১০টায়।
দুপুরে খাবারের ব্যবস্থা।
সন্ধ্যায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির সাথে ইফতার।
নভেম্বর ১৫, মন্ত্রিসভার সভা
H.C এবং সামাদ সাহেবের প্রত্যাবর্তন।
[H.C. বােধ হয় হুমায়ুন রশিদ চৌধুরী এবং সামাদ হচ্ছেন আবদুস সামাদ আজাদ]
১৬ নভেম্বর: পুনরায় সভা নির্ধারিত
১৭ নভেম্বর: New York Times-এর Sydney Schandler পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করবেন। Visnews TV-3 থাকবে। NewSweek-এর Borchgrave-আসছেন।
২৫ নভেম্বর
প্ল্যানিং সেল ৪৬-এ বালিগঞ্জ প্লেস-এ স্থানান্তরিত। আসবাব ও সরঞ্জাম ব্যবস্থা।
এইদিন জানা গেল আমেরিকান সিনেটর ফ্রাঙ্ক চার্চ (Senator Frank Church) আসছেন শনি অথবা রবিবার (২৭ অথবা ২৮ নভেম্বর) মন্ত্রিসভার সদস্যের সাথে সাক্ষাতের জন্য। এরা আমাদের বুদ্ধিজীবীদের সাথেও আলােচনা করবেন। সঙ্গে রয়েছেন Saxbe, Roth, Tom Dyne সিনেটরদের aide বা সহকারী)।
২৬ নভেম্বর
রাজনৈতিক উদ্বুদ্ধকরণের (motivation) কাজে প্রতিটি ক্যাম্পে ৭/৮ জনের দল (যারা আওয়ামী লীগের হবে)। এদেরকে বাংলাদেশ সরকার পরিচয়পত্র দেবে। ভারত-সরকারের পক্ষ থেকেও শনাক্তকরণ কাগজ থাকবে। যুদ্ধের খবর সংগ্রহকারী সাংবাদিকরা (War Correspondents) চাক্ষুষ দেখা ও তথ্যসংগ্রহের জন্য শিলং, আগরতলা ও তুরা এই কয়টি স্থান হয়ে যাবেন। মেঘালয়ের শিলং-এ (তুরা-র জন্য) যােগাযােগ করতে হবে ডেপুটি আই. জি. পি. সি.আই.ডি. (Deputy IGP, CID-কে। তিনি পরিচয়পত্র ইস্যু করবেন। আসাম সরকারের সাথে কথা হয়েছে।
ডিসেম্বর ১১
প্রধানমন্ত্রী যশাের ফ্রন্ট পরিদর্শনে গেছেন।
[এ পর্যন্ত আমার ডায়েরি-তে শেষ লেখা, ডিসেম্বর ১১ তারিখের পর ডায়েরি লেখার সময় পাইনি।]
ঘটনাবহুল সেপ্টেম্বর-ডিসেম্বর ১৯৭১
সেপ্টেম্বর মাস থেকেই ভারত-বাংলাদেশ সর্বোচ্চ পর্যায়ে আনুষ্ঠানিক আলাপ-আলােচনা শুরু হয়। এর আগে উভয় দেশের প্রধানমন্ত্রী একান্ত বৈঠক করেছেন, মন্ত্রী পর্যায়েও দিল্লিতে আলােচনা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ও প্রধান সেনাপতি নিজ নিজ চ্যানেলে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেছেন। বেসামরিক প্রশাসনে সরকারের যা-কিছু করণীয় তা আমরা (বিভিন্ন সচিব ও সংস্থাপ্রধান) কার্যকর করেছি। অপরদিকে ভারত-সরকারের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ তাদের নিজ নিজ চ্যানেলে জানিয়ে দিয়েছেন কে কী, কখন করবেন। আমাদের জানা ছিল ভারতীয় কোন কর্তৃপক্ষ বা কর্মকর্তা কোন্ কাজটির জন্য দায়িত্ব এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত। আমার মনে হয় ক্ষমতার এরকম বিকেন্দ্রীকরণের কারণেই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন দ্রুত হত। অস্বাভাবিক পরিস্থিতি ও সময়ে অস্বাভাবিক পন্থাতেই কাজ করা উত্তম।
আমাদের জন্য আরেকটি বিরাট ইতিবাচক বিষয় হল ভারতের কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক সরকারগুলির (এক্ষেত্রে পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরা রাজ্য দুটির) সর্বাত্মক সমর্থন। অত্যন্ত আন্ত রিক ছিল প্রতিটি পদক্ষেপ যেমন সরকারের, তেমনি জনগণের। কখনও কোনাে অসুবিধায় পড়তে হয়নি। ভারতীয় যে-সমস্ত কর্মকর্তা আমাদের সাথে পাশাপাশি কাজ করতেন (যেমন সামরিক-আধা-সামরিক বাহিনীর সদস্য, প্রশাসনিক কর্মকর্তা, পররাষ্ট্র ও বৈদেশিক সম্পর্ক বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা) তাদের বেশির ভাগ ছিলেন বাঙালি। মনে হতাে মিসেস গান্ধী এঁদের কর্মক্ষমতা, উৎসাহ ও দক্ষতার সাথে সাথে মােটিভেশনও বিবেচনা করতেন। ড. সুখময় চক্রবর্তী, মি. ডি. কে. ভট্টাচার্য, মি. এ. কে. রায়, মিস অরুন্ধতি ঘােষ, জেনারেল বি.এন. সরকার, মি. গােলক মজুমদার, মি. এ. কে. চ্যাটার্জি প্রমুখ যেভাবে আমাদের সার্বক্ষণিক সাহায্য ও সহযােগিতা করেছেন তা এক কথায় অতুলনীয়।
সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনাবলিতে ফিরে আসা যাক। ১৬ সেপ্টেম্বর একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক হয় ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত, মন্ত্রীর পদমর্যাদায় পলিসি প্ল্যানিং কমিটির সদ্য-নিযুক্ত চেয়ারম্যান মি. ডি.পি. ধর-এর সাথে। উচ্চশিক্ষিত, প্রাজ্ঞ, বিচক্ষণ মি. ধরের কথাবার্তাতে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পাওয়া যেত। দীর্ঘ কূটনৈতিক অভিজ্ঞতা, সবে ফিরেছেন মস্কো থেকে ভারত-সােভিয়েত মৈত্রীচুক্তি সফলভাবে সম্পাদন করে (তিনি মস্কোতে রাষ্ট্রদূত ছিলেন)। তাঁর আলাপ-আলােচনায় কূটনৈতিক ছাপ যেমন ছিল, তেমনই ছিল দৃঢ়তা (যার উৎস ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর আস্থা)। বাংলাদেশের সামগ্রিক বিষয়সমূহে ভারতীয় পক্ষে তিনিই ছিলেন ভারপ্রাপ্ত। ইতিপূর্বে আগস্টের ২৯ তারিখে ডি. পি. ধর কোলকাতায় আসেন নতুন দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রথম ও বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের মিশনে (Fact-finding mission)। ঐ সময়ে শুধুমাত্র রাজনৈতিক পর্যায়ে, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের সাথেই বৈঠক করেন দীর্ঘসময়। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভা এবং প্রধান সেনাপতির সাথেও আলােচনা হয়।
রাজনৈতিক পর্যায়ে নানাবিধ সমস্যা ও সমাধানের প্রক্রিয়া জানাতেই তাঁর এই আগমন। তার সাথে কথাবার্তায় বােঝা গেছে ভারত-সরকারের নিকট বাস্তবসম্মত একটি নীতি ও কর্মপন্থা (policy-package) সুপারিশ করার আগে বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধান সেনাপতি ওসমানী ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে মতবিনিময়, আলাপ-আলােচনা করে সর্বসম্মত কিছু পথ বের করার চেষ্টা করছিলেন যাতে মুক্তিযুদ্ধ জোরদার এবং আমাদের বিজয় ত্বরান্বিত হয়। স্মরণ করা যেতে পারে যে বন্ধুবর মাঈদুল হাসান ঐ সময় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিনিধিরূপে শ্রী ধরের সাথে বেশ কয়েকবার অনানুষ্ঠানিক আলােচনায় বসেন। তার দুতিয়ালি যথেষ্ট কার্যকর ছিল এইজন্য যে, কোনাে পক্ষেই আনুষ্ঠানিকতার বালাই ছিল না এবং কেউই অপরের কাছে দায়বদ্ধ ছিলেন না। মাঈদুল হাসানের মারফত ডি.পি. ধর আমাদের প্রধানমন্ত্রীকে ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থা, সরকারের ওপর নানাবিধ চাপ, সর্বোপরি আন্তর্জাতিক ভূ-রাজনৈতিক অবস্থান ও তাৎপর্য সম্পর্কে বিস্তারিত বিশ্লেষণ তুলে ধরেন। এতে আমাদের সরকার অপর পক্ষের অর্থাৎ ভারতের সীমাবদ্ধতা, তৎকালীন সমস্যা ও দ্রুত সমাধানের উপায় হিসেবে কী করণীয় তার উপায় উদ্ভাবনে সচেষ্ট হতে পেরেছিলেন।
ইতােমধ্যে ভারত-সােভিয়েত চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। উভয় সরকারের যৌথ ইস্তাহার সম্পর্কিত প্রতিবেদন ও বিশ্লেষণ মন্ত্রিসভায় উপস্থাপন করেছেন আমাদের পররাষ্ট্রসচিব। এটি পর্যালােচনা করতে গিয়ে দেখা গেল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশ্লেষণ বেশ নেতিবাচক এবং তা ডি. পি. ধরের পর্যালােচনার সাথে বড় একটা সঙ্গতিপূর্ণ নয়। চুক্তির নেপথ্যে সােভিয়েত নেতৃবৃন্দ যেসব কথাবার্তা বলেছেন এবং যেসব আশ্বাস দিয়েছেন তা আমাদের প্রধানমন্ত্রী আগেই জানতেন। অতএব তার এবং আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনেক বেশি ইতিবাচক। প্রকৃতপক্ষে এই চুক্তি সম্পাদনের পর-পরই ভারতকে সােভিয়েত কর্তৃপক্ষ বড়একটা সামরিক চালান সরবরাহ করেন। তারা এটাও জানতেন যে, এই অস্ত্রশস্ত্র বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতেই পড়বে। ১৯৭১ সালের আগস্টে মুক্তিবাহিনীকে সংগঠিত এবং সজ্জিত করতে এই অস্ত্র-সরবরাহ নিতান্ত প্রয়ােজন ছিল। প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখা ভালাে যে, আমাদের পররাষ্ট্রসচিব তখন মাহবুব আলম চাষী, যার পাশ্চাত্য-ঘেঁষা মনােভাব কারও অবিদিত ছিল না।
আগস্টের মাঝামাঝি সময়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী দিল্লি সফর করেন মিসেস গান্ধীর আমন্ত্রণে। এই সময় মুজিববাহিনীর কার্যকলাপে কর্নেল ওসমানী অধৈর্য হয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অভিযােগগুলাে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তুলে ধরেন। ভারতীয় প্রতিষ্ঠান RAW (অর্থাৎ Research and Analysis Wing) হলাে একটি গােয়েন্দা-প্রতিষ্ঠান। অনেকে একে পাকিস্তানের ISI (অর্থাৎ Inter-Services Intelligence)এর আদলে পরিচালিত বলে উল্লেখ করেন। প্রকৃত প্রস্তাবে অনেক পার্থক্য আছে। RAW ছিল সরাসরি ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের অধীন। আই.এস.আই. (ISI) যেমন সরাসরি সামরিক গােয়েন্দা প্রতিষ্ঠান, পাকিস্তানের মিলিটারি শাসক এবং তাদের আন্তর্জাতিক মনিবদের স্বার্থে পরিচালিত; RAW তেমনটা নয়। দ্বিতীয়ত একটি গণতান্ত্রিক সরকারের অঙ্গসংগঠন বলে এর দায়বদ্ধতা এবং জবাবদিহিতাও ছিল। এতদ্সত্ত্বেও কোনাে-কোনাে বিষয়ে RAW এত গােপনীয়তা বজায় রাখত যে তাতে যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ ছিল।
তাজউদ্দীন আহমদ এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব মি. পি.এন. হাকসার এবং RAW-এর প্রধান মি. রামনাথ কাও-এর সাথে মুজিববাহিনীপ্রসঙ্গ তুলে ধরেন এবং বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর শৃঙ্খলাজনিত সমস্যা আলােচনা করেন। আগস্টে দিল্লিসফরটি ছিল অত্রন্ত ফলপ্রসূ। সংক্ষেপে তিনটি দৃশ্যমান ফল পাওয়া যায়:
ক. বাংলাদেশ বাহিনীর জন্য সমরাস্ত্র;
খ. RAW কর্তৃক মুজিববাহিনীর পূর্বাঞ্চল কমান্ড (Eastern Command) আমাদের মুক্তিবাহিনীকে সরাসরি সাহায্য ও সমর্থন দিতে আরম্ভ করে। RAW মুজিববাহিনীর
পৃষ্ঠা: ২৪৫
ভারতীয় ব্যবস্থাপক মেজর জেনারেল উবানকে কর্নেল ওসমানীর সাথে সহযােগিতার সুস্পষ্ট নির্দেশ দেয়।
ভারত-সরকার কর্তৃক এইসব পদক্ষেপ নেওয়ার পর দৃশ্যতই অবস্থার অনেক উন্নতি হয় এবং আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বেগবান হয়।
উপরে বর্ণিত পটভূমিতে মি.ডি.পি ধর-এর কোলকাতা আগমন এবং বিভিন্ন আলােচনা ও সাক্ষাৎকার খুবই তাৎপর্যপূর্ণ ছিল। আগস্টের মাঝামাঝি অস্ত্রের চালান বৃদ্ধি পাওয়ায় আমাদের নিজস্ব গােপন সংস্থাগুলাের মাধ্যমে টাঙ্গাইল, ফরিদপুর, বরিশাল, নােয়াখালী ইত্যাদি অঞ্চলের গেরিলা বাহিনীগুলােকেও (বিশেষ করে কাদের সিদ্দিকী ও হেমায়েতকে) অস্ত্র সরবরাহ করা সম্ভব হয়।
শ্ৰী ডি. পি. ধর আনুষ্ঠানিকভাবে কার্যভার গ্রহণ করেন ৬ সেপ্টেম্বর। তিনি দায়িত্ব। নেওয়ার পরই, যাকে আমরা তার কোলকাতা-সফরের ফল বলতে পারি, কয়েকটি সুনির্দিষ্ট গঠনমূলক তৎপরতা লক্ষ্য করি; যেমন:
১. যুবশিবিরের ধারণ ও প্রশিক্ষণ ক্ষমতা সম্প্রসারিত হয় (expansion);
২. মুক্তিফৌজের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্রসরবরাহ অনেক সমন্বিত হয় (coordinated);
৩. মুক্তিবাহিনীর লােকবল অনেক বৃদ্ধি পায়;
৪. একটি সর্বদলীয় প্ল্যাটফর্ম বা ফোরাম গঠিত হয় যাতে করে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সর্বাত্মক রাজনৈতিক সমর্থন বৃদ্ধি পায় (জনযুদ্ধের উপাদান)।
সেপ্টেম্বরের ১৬ তারিখে মি. ডি. পি. ধর ও তাঁর দলের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলােচনা হয়—কোলকাতাতেই একটি গােপন ও সুরক্ষিত স্থানে। ভারতীয় দলে প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা, নীতি-নির্ধারণ কমিটি, পরিকল্পনা কমিশন, ত্রাণ ও পুনর্বাসন প্রভৃতি সংস্থার প্রতিনিধি ছিলেন। এতে সুবিধা ছিল এই যে, মি. ধর প্রায় সময়ে তাঁদের প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিয়ে বাস্তবায়নের নির্দেশ দিতেন। বাংলাদেশ ও ভারত-সরকারের মাঝে এটি ছিল আনুষ্ঠানিক বৈঠক। বাংলাদেশ দলের নেতৃত্ব দেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। আমি সেই সভায় উপস্থিত থেকে আলােচনা ও সিদ্ধান্ত লিপিবদ্ধ করি। আমার লেখা সেই নােটবই এখনও অক্ষত অবস্থায় আছে। সেই নােটগুলি এখানে বর্ণনা করছি।
১৬-৯-১৯৭১
মি. ডি. পি. ধরের সাথে আলােচনা
আলােচনার প্রারম্ভে মি. ধর উল্লেখ করেন যে এখন থেকে উভয়পক্ষ নিয়মিত বৈঠক করবেন। ভবিষ্যতে পরিস্থিতি যাচাই এবং মত বিনিময়ের জন্য আরও আলােচনা হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
পররাষ্ট্র সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব ও জনাব ফতেহ্ দিল্লি সফর করেছেন আলােচিত বিষয়গুলাে বাস্তাবয়নের জন্য। বিভিন্ন সমস্যা আলােচনা করা হয়। সব সমস্যা একসাথে সমাধান সম্ভব নয়। কিছু যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন এখনও রয়ে গেছে।
যুদ্ধপ্রচেষ্টা কীভাবে ত্বরান্বিত করা হবে সেটাই চিন্তার কারণ। এই বিষয়টি উভয়ের জন্য সাধারণ সমস্যা। একযােগে কাজ করতে হবে। প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার প্রক্রিয়াটি গত সভার পরও মন্থর গতিতে চলছে। (এখানে মি. ধরের সাথে পূর্বের অর্থাৎ ২৯-৩০ আগস্টে অনুষ্ঠিত বৈঠকের কথা বলা হয়েছে। ধীর গতিবলতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের দিকে ইঙ্গিত করা হয়েছে।) আমাদের প্রতিরক্ষা সদর দপ্তর অপর পক্ষের সাথে ঘনিষ্ঠ সংযােগ রাখছেন। কিন্তু কাজ খুব একটা এগুচ্ছে না। কিছু নতুন সম্ভাবনা পরিলক্ষিত হচ্ছে।
বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে সমর্থন ও সাহায্য (মুক্তিযুদ্ধের জন্য) অটুট। আমরা সন্তুষ্ট। অন্যান্য দলসমূহ যারা এতদিন সমর্থন করছিলেন এবং সাহায্য দিচ্ছিলেন, তাঁরা এখন আনুষ্ঠানিকবাবে প্রকাশ্যে চলে এসেছেন। এখন তারা আমাদের যুদ্ধের সাথে একাত্মতা ঘােষণা করেছেন। তাঁদের এই সমর্থন একটি বিরাট পদক্ষেপ (সাফল্য)।
কোনাে সমস্যাই অনতিক্রম্য নয় যদি আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার থাকে এবং প্রচেষ্টা হয় একনিষ্ঠ। বন্ধুদেশ থেকে আমরা সর্বদা সহযােগিতা কামনা এবং আশা করি। পারস্পরিক সমর্থন ও সহযােগিতা প্রয়ােজন। আমাদের থাকতে হবে এক কর্মসূচি, এক উদ্দেশ্য এবং অভিন্ন পথ। বর্তমান বৈঠকের পর আমরা স্পষ্ট ও দৃশ্যমান ফলাফল আশা করি।
এই পর্যায়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আমাদের যুদ্ধপ্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করার বিষয়ে মি. ধরের চিন্তাধারা এবং পরামর্শ আহ্বান করেন; কীভাবে আরও দ্রুত আমরা এগুতে পারি সেটা জানতে চান। যুদ্ধ এবং চূড়ান্ত বিজয়ের প্রচেষ্টা ত্বরান্বিত করতে প্রধানমন্ত্রী একটি পদ্ধতি বের করার কথা বলেন। এই বৈঠকের দিন ছিল বৃহস্পতিবার। মি. ধর জানান যে, তিনি শনিবার পর্যন্ত থাকবেন যাতে আমাদের সরকারের সাথে আলােচনা ফলপ্রসূ হয়। (উল্লেখ্য, এসব বিষয়ে আলােচনা ও বক্তব্য ১৬ সেপ্টেম্বর তারিখে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পরিপ্রেক্ষিতে গণ্য করতে হবে।)
মি. ডি. পি. ধর (আমার নােটে DPD)
বর্তমান যুদ্ধপ্রচেষ্টাকে ত্বরান্বিত এবং ব্যাপকতর করার বিষয়ে চিন্তাভাবনা করে আগামী দেড় মাসে (অর্থাৎ নভেম্বর মাস নাগাদ) বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। বিষয়টি সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার পাচ্ছে, অন্য সব বিষয়কে অতিক্রম করে। আরােও কার্যকর প্রচেষ্টা। (প্রতিরক্ষা সচিব সামাদের দিল্লি যাত্রা উল্লেখ করা হয় এখানে)।
এখন তিনটি বিষয়ে সম্পূর্ণ মতৈক্য প্রয়ােজন: (ক) সমঝােতা; (খ) যুদ্ধ বিষয়ে বাস্তবায়ন পরিকল্পনা (operational plan), (গ) যুদ্ধ-পরিকল্পনায় কর্তৃত্ব (command)।
মি. ধর জানালেন যে তিনি, ভারতীয় সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল মানেকশ এবং মি. রামজি (শ্রী জগজীবন রাম, প্রতিরক্ষা মন্ত্রী কিনা ঠিক মনে নেই)— অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতির (কর্নেল ওসমানীর) সাথে সৌজন্যমূরক সাক্ষাৎ করবেন। তিনি আরও বললেন যে, তাদের (ভারতীয়) পক্ষ থেকে কোনাে বিষয়ে ঘাটতি থাকলে সে বিষয়ে সমালােচনা তারা সানন্দে গ্রহণ করবেন। তারা অবশ্যই তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করবেন।
দ্বিতীয় বৈঠক: বিকেল ৪.৩০ মি. স্থান: হােটেল হিন্দুস্থান ইন্টারন্যাশনাল
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধান সেনাপতির উপস্থিতিতে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় দল বাংরাদেশের সর্বদলীয় ঐক্য পরিষদ গঠনের সংবাদকে উৎসাহের সাথে স্বাগত জানান। তারা একে গঠনমূলক পদক্ষেপ বলে বর্ণনা করেন। এতে অনেক সুবিধা ও সুফল পাওয়া যাবে। ঐক্য পরিষদকে বিভিন্ন বিষয়ে সংশ্লিষ্ট করার বিষয়ে তারা পরামর্শ দেন। এতে আমাদের যুদ্ধ যে জাতীয় জনযুদ্ধ, তা সপ্রমাণিত হবে। কাজের পরিধি বিশাল। সময় সংক্ষিপ্ত – এই ছিল মি. ধরের অনুভূতি। যুদ্ধ-পরিচালনা বিষয়ে তাঁর অভিমত হলাে: মুক্তিসেনা নির্বাচন ও নিয়ােগ, প্রশিক্ষণ গেরিলা বাহিনীকে ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়গুলি স্বতন্ত্রভাবে নিলে অগ্রগতি ব্যাহত হবে। একই সঙ্গে দায়িত্ব-বণ্টনে বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়ােজন কিছুসংখ্যক তরুণকে ভিন্নভাবে ভর্তি ও প্রশিক্ষণের বিষয়ে তদন্ত চলছে পরে এ বিষয়ে জানানাে হবে।
বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিদেশে প্রতিনিধিদল পাঠানাের বিষয়ে আলােচনা করা হয়। কী উদ্দেশ্য সাধনে তাঁরা যাবেন তা জানা দরকার। বিদেশে প্রতিনিধি দল পাঠানাের বিষয়ে নীতিগতভাবে তাঁরা একমত, তবে কয়েকটি সংশয় আছে:
ক. কার্যকর হতে হলে বড় দল পাঠানাে উচিত নয়।
খ. দলের আকার বড় হলে বিদেশে দেখাশুনা করা একটি সমস্যা;
গ. আমাদের (বাংলাদেশ সরকারকে) সকলেই ঘনিষ্ঠভাবে পর্যবেক্ষণ করছেন একটি বড় দল বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশে পাঠালে জনগণ তা ভালােভাবে নেবে না সরকার সমালােচিত হবে।
ঘ. বিদেশে ভারতের বিভিন্ন কূটনৈতিক প্রতিনিধি এবং ভারতে অবস্থিত বিদেশি মিশনগুলাের সাথে যােগাযােগ করা হয়েছে। তাঁদের অভিমত হলাে এই যে, বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী যথাযােগ্যভাবে আপ্যায়িত হবেন না। তাতে করে তিনি কার্যকর ভূমিকাও পালন করতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বিধান একটি বাস্তব সমস্যা। সংশ্লিষ্ট কোনাে সরকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নিরাপত্তা প্রদানে নিশ্চয়তা দান করতে সম্মত নয়। (কূটনৈতিক শিষ্টাচার খুবই স্পর্শকাতর বিষয়, তাই এমন প্রশ্ন দেখা দেয় মনে হয়।)
একটি ছােট প্রতিনিধি দল এখন পাঠানাে যেতে পারে। মি. ধর নিজে যাবেন না। পরবর্তী দুই মাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ব্যাপক আঘাত হানার প্রস্তুতি নিতে হবে। (এই বক্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ এবং ভারতের পক্ষে পরবর্তী পদক্ষেপ গ্রহণের সুস্পষ্ট ইঙ্গিত। আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী উভয়েই পরে মন্তব্য করলেন: ‘He means business)
পরবর্তী আলােচ্য বিষয়গুলাে হলাে: অর্থনৈতিক ও বাণিজ্য সংক্রান্ত। এই দুটো বিষয়ে কার্যপত্র (working paper) প্রয়ােজন।
ব্যাংকিং, বীমা, সমবায়, ভারী শিল্প ও কলকারখানা পরিচালনা ইত্যাদি বিষয়ে ভারত আমাদের জনবলকে প্রশিক্ষণ দিতে পারে। তার সুযােগ-সুবিধা করে দেওয়া হবে। মি.এ.কে. রায়কে তালিকা দিলে তিনি ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। প্রচারের জন্য একটি দল গঠন করা হবে। তারা আমাদের সাহায্য করবেন। বাংলাদেশের পক্ষে যথেষ্ট প্রচার হচ্ছে না। একটি যৌথ সংগঠন প্রয়ােজন— যার সাথে থাকবে প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ভারত এতেও সাহায্য করতে পারে। বুদ্ধিজীবীদের যথাযথ সংগঠিত করা হচ্ছে না। যুদ্ধের প্রয়ােজনে এই ক্ষেত্রে যথেষ্ট করণীয় আছে। বামপন্থী বুদ্ধিজীবীদের আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সম্পৃক্ত করতে হবে।
সেপ্টেম্বরের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলি
সেপ্টেম্বর ৬
মওলানা ভাসানী, শ্রী মনােরঞ্জন ধর, প্রফেসর মােজাফফর আহমদ, শ্রী মণি সিংহ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ সর্বদলীয় ঐক্যের জন্য এগিয়ে এলেন। বিভিন্ন পর্যায়ে তাদের সাথে আলাপআলােচনা অব্যাহত থাকে।
সেপ্টেম্বর ১২
প্রতিরক্ষা-সচিব সামাদ, তাহেরউদ্দীন ঠাকুর এম.এন.এ. ও রাষ্ট্রদূত হােসেন আলীকে নিয়ে স্নায়ুযুদ্ধের (Psy-warfare) ব্যাপারে কমিটি গঠন করা হলাে।
পরিকল্পনা ও তথ্য বিষয়ে সাহায্য করার জন্য দুটো টিম গঠন করা হলাে: একটি মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও অন্যটি প্রতিরক্ষা-সচিবের নেতৃত্বে। বিদেশে বাংলাদেশ প্রতিনিধি (মিশন) দলকে শক্তিশালী করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে।
সেপ্টেম্বর ১৫
একটি উঁচু পর্যায়ের ভারতীয় প্রতিনিধি দল দেশে-বিদেশে প্রচার শক্তিশালী করার লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। দলে ছিলেন মি.এ.কে. রায় (যুগ্ম সচিব), ডিরেক্টর (জাতিসংঘ ডেস্ক), ডিরেক্টর (বৈদেশিক প্রচার), মহা-পরিচালক (রেডিও), মুখ্য প্রচারকর্ত (পি.আই.ও.) ডিরেক্টর (টিভি), ডিরেক্টর (মাঠ পর্যায়ে প্রচার), মি. ভট্টাচার্য (প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর থেকে)। এঁরা পরামর্শ দিলেন:
ক. আমাদের শিল্পীদের সংগঠিত করতে হবে;
খ. পরিচয়পত্র বহনকারী সাংবাদিক নিয়ােগ করতে হবে;
গ. বুদ্ধিজীবীদের মেধা কাজে লাগাতে হবে।
এই কাজগুলাে সম্পন্ন করার জন্য আমাদের পক্ষে একটি কমিটি গঠন করা হলাে। এই কমিটির উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল প্রচারের ক্ষেত্রে বিদ্যমান সকল সম্পদের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করা।
সেপ্টেম্বর ২৪
সেপ্টেম্বর মাসের এটি আরেকটি মাইলফলক। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী এবং ভারতীয় প্রতিনিধি মি. ডি. পি. ধররে মধ্যেকার বিস্তারিত আলােচনার পরিপ্রেক্ষিতে সেপ্টেম্বর মাসেই বিভিন্ন পর্যায়ে অনেকগুলি বৈঠক হয়। বৈঠকের আলােচনায় শুধু যুদ্ধজয়ই নয়, যুদ্ধপরবর্তী পুনর্গঠন ও আনুষঙ্গিক বিষয়সমূহ প্রাধান্য পায়। ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ড. সুখময় চক্রবর্তীর সদলবলে কোলকাতা আগমন এবং আমাদের পরিকল্পনা বাের্ডের সদস্য ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে তাদের বৈঠক কোনাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছিল না। এটা ছিল সামগ্রিক পরিকল্পনার একটি অংশ। মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি, ভারতীয় বাহিনীর সমর্থন, যৌথ সামগ্রিক পরিকল্পনার একটি অংশ। মুক্তিবাহিনীর শক্তি বৃদ্ধি, ভারতীয় বাহিনীর সমর্থন, যৌথ কমান্ড স্থাপন, সমর পরিকল্পনা প্রণয়ন ইত্যাদি ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব। প্রধানমন্ত্রী নিজে, প্রধান সেনাপতি এম.এ.জি. ওসমানী এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার এইসব বিষয় তত্ত্বাবধান করতেন। গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে. খন্দকার এবং ভারতীয় ইস্টার্ন কমান্ডের মেজর জেনারেল বি.এন, সরকার বিস্তারিত অপারেশন পরিকল্পনা প্রণয়ন এবং পর্যালােচনায় সার্বক্ষণিকভাবে ব্যস্ত থাকতেন।
অপরদিকে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃস্থাপন, আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা, শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন, ভৌত-অবকাঠামাে পুননির্মাণ, অর্থনীতি সচল করা, সর্বোপরি জাতীয় উন্নয়ন ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে চিন্তাভাবনা করে সুচিন্তিত অভিমতের ভিত্তিতে পরিকল্পনা প্রণয়নের দায়িত্ব ছিল সচিবদের ও পরিকল্পনা বাের্ডের। মিসেস গান্ধী কর্তৃক সর্বাত্মক সাহায্য দানের প্রতিশ্রুতির অংশবিশেষ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পুনর্গঠন। এই উদ্দেশ্যে ড. সুখময় চক্রবর্তীর নেতৃত্বে ভারতীয় দল আমাদের অর্থাৎ বাংলাদেশ পক্ষের সাথে আলােচনায় বসেন ২৪ সেপ্টেম্বর। আমাদের পক্ষে প্ল্যানিং বাের্ডের চেয়ারম্যান প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, প্রফেসর খান সরওয়ার মাের্শেদ, ড. মুশাররফ হােসেন, ড. এস.আর.বােস ও ড. আনিসুজ্জামান আলােচনায় অংশগ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে আমি ছিলাম বৈঠকে। পরে ভারতীয় দল প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সাথেও সাক্ষাৎ করেন। ‘মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের তৎপরতা’ ও ‘মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি এবং আমার ডায়েরি’ অধ্যায়ে এই সব আলােচনার বিষয় উল্লেখ করেছি।
সেপ্টেম্বরের আরাে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা হলাে: ভারতীয় প্রতিরক্ষা-সচিবের কোলকাতা আগমন ও বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলােচনা।
সেপ্টেম্বরে মন্ত্রিসভা
মন্ত্রিসভা এই মাসে অনেক গুরুত্বপূর্ণ এবং সুদূরপ্রসারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। প্রতিটি বৈঠকেই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়/বিভাগ তাদের কার্যপত্র পেশ করে; সেগুলাে যথারীতি সংশ্লিষ্ট সদস্যগণের মধ্যে বিতরণের পর মন্ত্রিসভায় আলােচনা হয়। সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য দ্রুত গতিতে ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেওয়া হতাে যথাযথ কর্তৃপক্ষকে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে আমি সিদ্ধান্ত দ্রুত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মনিটরিং করতাম।
এই মাসে যে-সকল বৈঠক হয় তার মধ্যে ৬, ১০, ১২, ১৪ ও ২০ সেপ্টেম্বর তারিখগুলােতে সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ অনেক সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৪ তারিখের বৈঠকটি উল্লেখযােগ্য। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বৈঠকটি আহ্বান করেছিলেন, অনুষ্ঠিত হয় তার বাসভবনে। উদ্ভূত রাজনৈতিক ও সামরিক সমস্যাবলি নিয়ে আলােচনা করা হয় এই বৈঠকে।
৬ সেপ্টেম্বর মন্ত্রিসভার সভায় পরিকল্পনা বাের্ডের চেয়ারম্যান ও সকল সদস্য এবং বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে ড. এ.আর. মল্লিক উপস্থিত ছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশের দীর্ঘমেয়াদী অর্থনৈতিক পরিকল্পনা এবং ভারত-সরকারের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দের সাথে অন্যান্য আলােচ্য বিষয় নির্ধারণ করাই ছিল এই বৈঠকের মূল উদ্দেশ্য এই অধ্যায়ের শুরুতেই উল্লেখ করেছি যে, মি. ডি.পি. ধরের সাথে বৈঠকের কথা, যার সবচাইতে উল্লেখযােগ্য দিক ছিল যুদ্ধপ্রস্তুতি সম্পর্কিত। এই বৈঠকে সামরিক প্রস্তুতির সাথে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বেসামরিক ও রাজনৈতিক আলেচনাও হয়। সেগুলাে যথাস্থানে উল্লেখ করেছি।
ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন এবং তথ্য ও বেতার কর্মকর্তাদের সাথে আলােচনার পূর্বে আমাদের প্রস্তুতি গ্রহণ জরুরি ছিল। ৬ সেপ্টেম্বরের মন্ত্রিসভার বৈঠকে ড. এ.আর.মল্লিক, ড. মুজাফফর আহমেদ চৌধুরী, ড. মুশাররফ হােসেন, ড. এস.আর. বােস ও ড. আনিসুজ্জামান বিশেষ আমন্ত্রণে যােগদান করেন। তিনটি উদ্দেশ্য ছিল এই আলােচনা-বৈঠকে: (১) ড. মল্লিককে শিক্ষা উপদেষ্টা নিয়ােগ ও পরিকল্পনা সেলের সাথে সম্পৃক্তকরণ; (২) সরকার ও বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে সহযােগিতা-সম্পর্ক আরও নিবিড়করণ; (৩) দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনার রূপরেখা নির্ধারণ।
ঐ একই দিনের বৈঠকে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাজকর্ম ও উন্নয়ন তৎপরতা জোরদার এবং গতিশীল করতে উপযােগী প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলার লক্ষ্যে বেসামরিক প্রশাসন, পুলিশ ইত্যাদি নতুনভাবে ঢেলে সাজানােরও চিন্তাভাবনা করা হয়। বাংলাদেশ প্রশাসনিক সার্ভিস, বাংলাদেশ পুলিশ সার্ভিস ইত্যাদির রূপরেখা কী হবে তার জন্য আরম্ভ হয় চিন্তা-ভাবনা। বাংলাদেশ পুলিশের তকমা নৌকাচিহ্ন সম্বলিত করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হল। শিল্পী কামরুল হাসানকে এর ডিজাইন তৈরি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। একই সময় প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্যও নতুন আঙ্গিকে ব্যাজ, তকমা ইত্যাদি ডিজাইন তৈরির
পৃষ্ঠা: ২৫০
কথা চিন্তা করা হয়। পুলিশের পােশাক, বাংলাদেশ রেডক্রস সােসাইটি, বয় স্কাউটস, গােয়েন্দা সংস্থা পুনর্গঠন এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা বিধানের ব্যবস্থাকল্পে বাহিনী গঠন ইত্যাদি কোনাে চিন্তাই বাদ যায়নি সে-সময়।
সেপ্টেম্বরের ১০ ও ১১ তারিখের বৈঠকে মুক্ত এলাকায় প্রশাসন স্থাপন, বিদেশে প্রচার কাজ, আঞ্চলিক প্রশাসন, দেশের অভ্যন্তরে আইন-শৃঙ্খলা এবং নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রীর সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
২০ তারিখের সভায় আঞ্চলিক প্রশাসনগুলােকে আরও সম্প্রসারণ এবং পুনর্বিন্যাস করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের টাইপ-করা খসড়ার ওপর প্রধানন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ নিজ হাতে নতুন সৃষ্ট অঞ্চলগুলির নাম লিখে দেন। সরকারি কর্মকর্তা নিয়ােগের বিষয়ে সুস্পষ্ট আদেশ জারি করা হয়। ঐদিন তৎকালীন পাকিস্তান সরকার কর্তৃক নতুন মনােনীত কর্মকর্তাদের বাংলাদেশ সরকারের চাকুরিতে নিয়ােগ সম্পর্কে নির্দেশ দেওয়া হয় যে, যারা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করবেন শুধু তাদের আবেদন বিবেচনা করা হবে। অবশ্য শর্ত দেওয়া হয় যে, তাদের বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কমপক্ষে ৬ (ছয়) সপ্তাহের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। (বাংলাদেশে ১৯৭১ সালের পর এই বিষয়টি নিয়ে অনর্থক বিতর্ক সৃষ্টি করা হয় এবং অনেক নবীন কর্মকর্তাকে চাকুরির সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হয়।)
বিদেশে প্রশিক্ষণরত বাঙালি কর্মকর্তাদের মধ্যে যারা বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােঘণা করেছিলেন তাদের সেবা যাতে সরকার গ্রহণ করতে পারে সে-বিষয়েও সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় বাংলাদেশ সরকার এ-কথাও সহানুভূতির সাথে বিবেচনা করে যে, দেশের অভ্যন্তরে পাকিস্তানের পক্ষে তৎপরতার অভিযােগে কর্মকর্তাদের বরখাস্ত করা হলে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে বিদেশে প্রশিক্ষণরত, বিশেষ করে যারা স্বাধীন বাংলাদেশের পক্ষে আন্দোলন করেছেন, তাদের দেশে ফিরে এসে কাজে যােগদান করতে বলা হয়।
দেশে-বিদেশে কর্মকাণ্ড বহুগুণে বৃদ্ধি পাওয়ায় নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনার জন্য এবং বাংলাদেশের মুক্ত-অঞ্চল সফর করতে আসা বিদেশি অতিথিদের সংখ্যাও বাড়তে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে: (ক) কোলকাতায় গণসংযােগ (liaison) দপ্তর এবং (খ) একটি প্রটোকল অফিস খােলা হবে। যুদ্ধ-সম্পর্কিত প্রচারের ক্রমবর্ধমান গুরুত্ব ও প্রয়ােজনের তাগিদে তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়কে শক্তিশালী ও পুনর্বিন্যাস করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। একটি তথ্যনীতির প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয়। সমস্ত প্রচার কর্মকাণ্ড অনতিবিলম্বে সমন্বয় করার নির্দেশ দেওয়া হয়। নতুন কেউ তথ্যসচিবের পদে যােগদান নাকরা পর্যন্ত প্রতিরক্ষা সচিব সামাদ এই দায়িত্ব পালন করবেন এবং প্রতিরক্ষার কাজে অর্থাৎ মুক্তিবাহিনীর তৎপরতায় যাতে তথ্য মাধ্যমগুলাে একযােগে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে। স্মরণ করা যেতে পারে যে, যুক্তরাষ্ট্রে অধ্যয়নরত জনাব খােরশেদ আলমকে এই পদে নিয়ােগ দিয়ে কাজে যােগদান করতে বলা হয়েছিল।
সেপ্টেম্বরের শেষেই উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জন্য শীতবস্ত্র ও কম্বল সরবরাহের জন্য সরকার সচেষ্ট হন। এজন্য অতিরিক্ত অর্থও বরাদ্দ করা হয়েছিল। একই সাথে প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে যুবশিবিরের যেসব সদস্য কার্যকরভাবে গেরিলা বাহিনীতে যােগদান করবে তাদের জন্য পূর্ণ চিকিৎসা নিশ্চিত করারও নির্দেশ দেওয়া হয়। ঐ সময় লক্ষ্য করা যায় যে, পূর্বদিকে আগরতলায় এবং উত্তরদিকে মানকারচরে যুবশিবিরগুলি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত যুবক নিতে বাধ্য হচ্ছিলেন। এই কারণে যানবাহনের ব্যবস্থা করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর তত্ত্বাবধানে এই অতিরিক্ত যুবকদের অন্যত্র স্থানান্তর করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়।
সেপ্টেম্বর মাসের ঘটনাবলি আমাদের জন্য খুবই আশাব্যঞ্জক ছিল। আগস্টের শেষে ডি. পি. ধর-এর আগমন, তারপর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর দিল্লি সফর, পরিকল্পনা কমিশনের ড. চক্রবর্তীর সাথে আমাদের বিস্তারিত আলােচনা, ডি.পি. ধরের দ্বিতীয় দফা আগমন ও আমাদের সাথে আনুষ্ঠানিক আলােচনা, তারপর তথ্য ও বেতার প্রচার মাধ্যমের হােমরাচোমরা কর্তাব্যক্তিদের কোলকাতায় আমাদের সাথে বিস্তারিত আলােচনা—এইসব ঘটনা এত দ্রুত ঘটে গেল যে, আমরা অদূর ভবিষ্যতে বড় কিছু একটার উজ্জ্বল সম্ভাবনা দেখছিলাম। এখানে আমরা বলতে প্রধানমন্ত্রী, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, মন্ত্রিসভা ও আমাদের ছােট দলকে বুঝাতে চেয়েছি।
অক্টোবর, ১৯৭১ অক্টোবর মাস ছিল সেপ্টেম্বরের মতােই ঘটনাবহুল কিন্তু আরও গুরুত্বপূর্ণ। বিজয়ের সূর্য আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। মাসের সূচনাতেই হলাে মন্ত্রিসভার বৈঠক ১ তারিখে। জরুরি বিষয় ছিল ভারত-সােভিয়েত যৌথ-ঘােষণা। বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে এর তাৎপর্য বিশ্লেষণ করা হলাে, চুলচেরা আলােচনাও হলাে। আমরা তখনও জানতাম না (তবে অনুমান করছিলাম), মিসেস গান্ধী রুশ-নেতাদের সাথে কী গােপন আলােচনা করছেন। যৌথ-ঘােষণায় এ-বিষয় সঙ্গত কারণে প্রচারিত হয়নি। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঠিকই জানতেন নেপথ্যে কী ঘটছে।
এই সময় মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ ঘন ঘন মুক্ত-অঞ্চল এবং সীমান্ত এলাকা পরিদর্শন শুরু করেন। সফর থেকে ফিরেই তাঁরা তাঁদের বর্ণনা দিতেন। বিশেষ করে যেসব সমস্যা তারা প্রত্যক্ষ করতেন, কেন্দ্রীয় পর্যায়ে সেসব সমস্যার আশু সমাধানের সুপারিশ রাখতেন। কোনাে কোনাে সময় তারা স্থানীয়ভাবে সেক্টর-কমান্ডার অথবা আঞ্চলিক প্রশাসনের সাহায্যে এলাকা বিশেষের সমস্যার সমাধান করে আসতেন। মন্ত্রিদের এই সফর ও পরিদর্শন মুক্তিযােদ্ধাদের মনােবল আরও অনেক উজ্জীবিত করত।
মন্ত্রিসভার ১ অক্টোবরের বৈঠকে স্বরাষ্ট্র এবং অর্থমন্ত্রী উভয়েই তাদের প্রতিবেদন পেশ করেন। আমার এখনও মনে আছে সেদিনের তরুণ অফিসার সাদত হুসেইন (আজকের প্রবীণ মন্ত্রিপরিষদ-সচিব) উত্তরবঙ্গ থেকে ফিরে এসে সে কী উত্তেজিত! রৌমারি থেকে মানকেরচর পর্যন্ত বিস্তৃত এলাকা আমাদের দখলে। মুক্ত-অঞ্চলে সর্বত্র স্বাধীন বাংলার সবুজলাল পতাকা উড়ছে, ছেলেরা কুচকাওয়াজ করছে; থানা, স্কুল, সব সরকারি প্রতিষ্ঠান দৈনন্দিন কাজ করে চলেছে; আঞ্চলিক প্রশাসন তাদের কর্মকাণ্ড সম্প্রসারিত করছে; সেক্টর কমান্ডের অফিসারগণ নতুন অপারেশনের পরিকল্পনা করছেন। সবকিছু মিলিয়ে রােমাঞ্চ। সৃষ্টিকারী এক পরিস্থিতি। স্বাধীনতা আর বিজয়ের নেশায় সকলেই আচ্ছন্ন ও বিমুগ্ধ। আমার ব্যক্তিগত অনুভূতিতে এই অবস্থা বুঝতে পারি।
মন্ত্রী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী, মন্ত্রী এ.এইচ. এম. কামারুজ্জামান ধীর, স্থির, কিন্তু গর্বিতভাবেই বর্ণনা করলেন তাঁদের অভিজ্ঞতা। বিভিন্ন সমস্যা আলােচিত হওয়ার পর দ্রুত অনেকগুলাে সিদ্ধান্ত দেওয়া হলাে।
পরবর্তী বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ৪ অক্টোবর। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর রণাঙ্গনে যৌথ পরিদর্শন এবং উত্তর ও পূর্বাঞ্চল সফর ছিল প্রধান আলােচ্য বিষয়। এই সফর ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। ব্যক্তিগতভাবে এই বৈঠকে উপস্থিত থাকতে পারা আমার জন্য অত্যন্ত মূল্যবান অভিজ্ঞতা ছিল। এই দুই মহান নেতার সফরসঙ্গী হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল সেদিন। খুবই ঘটনাবহুল ছিল এই সফর।
কোলকাতা থেকে শিলিগুড়ি এবং তারপর পুরাে উত্তরবঙ্গ ঘুরে আসামের গৌহাটি হয়ে দীর্ঘ বিমানপথের যাত্রাশেষে আগরতলা পৌঁছি। শিলিগুড়ি ছিল প্রথম যাত্রাবিরতি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী এক বিমানে, আমি ও শেখ নাসের (বঙ্গবন্ধুর ছােটভাই) আরেকটিতে। তখনকার উড়ােজাহাজও বিশেষ প্রকৃতির।
কোলকাতা থেকে যাত্রা শুরুর কিছুক্ষণের মধ্যেই শুরু হলাে ঝড় আর বৃষ্টি। অদূরে হিমালয় পর্বতমালা ও নিচে গভীর জঙ্গল এক ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করেছিল। আমাদের বিমানটি ছিল ভারতীয় বিমানবাহিনীর একটি ক্যারিবু (Caribou)—ক্যানাডার তৈরি এবং বেশ পুরােনাে। ঝাকুনির চোটে ভয় পেয়েছিলাম সবাই।
ছােটবেলায়, ব্রিটিশ আমলে ও পাকিস্তান সৃষ্টির পর পর আমাদের শিলিগুড়ির সাথে একটা যােগসূত্র ছিল। শিলিগুড়ি দার্জিলিং-এর পথে ব্রডগেজ রেলের শেষ স্টেশন। এখান থেকে দার্জিলিং-এর সরু (narrow guage) রেল আর সড়কপথ শুরু। কোলকাতার শিয়ালদহ রেলস্টেশন থেকে প্রথমে রানাঘাট, তারপর পর্যায়ক্রমে পােড়াদহ, ঈশ্বরদী, শান্ত হার, পার্বতীপুর হয়ে শিলিগুড়ি—এই রেলপথে চালু ছিল বিখ্যাত দার্জিলিং মেল, আসাম মেল, নর্থ বেঙ্গল এক্সপ্রেস ইত্যাদি। কী চমৎকার সেসব গাড়ি! কয়লা আর বাষ্পচালিত সেইসব রেলগাড়ির গতি ছিল ঘণ্টায় ৬০ (ষাট) মাইলেরও বেশি। আমাদের স্বপ্নের সেসব গাড়ি সবগুলােতে ডাইনিং কার, শাদা পােশাকপরা বেয়ারা আর ফার্স্ট ক্লাস-সেকেন্ড ক্লাস এক গাড়ি থেকে অন্য গাড়িতে ভেতরে যােগাযােগ-করিডাের।
যাই হােক, শিলিগুড়িতে পৌঁছে আমাদের ছােটবেলার সেই শহর আর পাইনবৃক্ষের সারি খুঁজে পাইনি। চারদিকে বিস্তৃত বিশাল শহর। আসাম এবং ভারতের পূর্বাঞ্চলের সকল রাজ্য (প্রদেশ) এবং পশ্চিমবঙ্গের সাথে উত্তর-ভারতের রেল ও সড়ক যােগাযােগের সঙ্গমস্থল হল শিলিগুড়ি। তার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভারতের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার জন্য। উত্তর-পূর্বের অরুণাচল রাজ্য দিয়ে একবার ঢুকে পড়তে পারলে পর পর মণিপুর, নাগাল্যাণ্ড, আসামের সমতল হয়ে সােজা পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি আর দার্জিলিং। এখান থেকে সহজেই বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া যায় উত্তরের সিকিম আর ভুটানকে। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধের সময় চীনাবাহিনী অরুণাচলের পার্বত্য গিরিপথ দিয়েই একরকম বিনা বাধায় ভারতে ঢুকে পড়েছিল। সেই অভিজ্ঞতা থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী ভালােভাবেই শিক্ষা গ্রহণ করেছিল।
১৯৬২ সালের পর বেশ কয়েক বছর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে ভারতের ঘনিষ্ঠ সামরিক আঁতাত ছিল। সময়টা ছিল আমেরিকা-চীনের চরম বৈরী-সম্পর্কের। ভারতের সাহায্য আমেরিকার গােপনভাবে এগিয়ে আসে। সৃষ্টি হয় বড় বড় সামরিক স্থাপনা, সেনা-ছাউনি, বিমানঘাটি। আসতে থাকে আমেরিকান উপদেষ্টা, প্রকৌশল, সামরিক সাজ-সরঞ্জাম। এরই ফলশ্রুতি ছিল ভারতের মাউন্টেন ডিভিশনের সৃষ্টি। চীনের পশ্চিম-দক্ষিণাঞ্চলে, বিশেষ করে তিব্বত এবং সিংকিয়াং প্রদেশগুলিতে গণবাহিনীর ঘাটি, তৎপরতা, আণবিক গবেষণা স্থাপনাগার ইত্যাদি সম্পর্কে গােপনে তথ্য সংগ্রহের জন্য ভারত সে-সময় আমেরিকানদের ভালাে বন্ধু ছিল। সামরিক সহযােগিতা তারই ফল।
১৯৭১ সালে অবশ্য চিত্রটি একেবারে পাল্টে যায়। চীন এগিয়ে আসে আমেরিকার দিকে, বন্ধুত্বের হাত সম্প্রসারণ করে; অপরপক্ষও তাই। উদ্দেশ্য: সাধারণ শত্রু সােভিয়েত ইউনিয়নের বিনাশ। আমাদের বাংলাদেশের তখন ত্রিশঙ্কু অবস্থা। এই প্রেক্ষিতে ১৯৭১ সালে ভারত-সােভিয়েত বন্ধুত্ব এবং আঁতাত অনিবার্য ছিল। যার সুফল আমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ও পরবর্তীকালে পুরােপুরি পেয়েছি।
আগের কথায় ফিরে যাই। শিলিগুড়ি বিমানবন্দরের নাম বাগডােগরা। এখানে ভারতীয় বিমান ও স্থলবাহিনীর বিশাল ঘাঁটি: ভারতের পূর্বাঞ্চলে প্রহরীর মতাে। সদা-সচেতন, যুদ্ধাবস্থার জন্য প্রস্তুত বিভিন্ন সামরিক বিন্যাস (formation) সেখানে পৌঁছে সেনাবহরের বিশাল আয়ােজন দেখে বিস্মিত হই। শিলিগুড়ি-বাগডােগরা এবং আশেপাশের অঞ্চল ঘিরে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর বিশাল কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবহিত হই। এখানে সেনাবাহিনীর পুরাে একটি কোর (Corps), যার মানে অন্তত তিনটি ডিভিশন এবং তার সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য প্রতিষ্ঠান (যেমন মেডিক্যাল, সরবরাহ, গােলন্দাজ, যােগাযােগ ইত্যাদি) সবই ছিল ঐ কোরের অধীনে। ডিভিশনগুলি ছিল জলপাইগুড়ি, দার্জিলিং এবং আসামের বিভিন্ন সামরিক গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে। শিলিগুড়ি ছিল বিশাল সামরিক বিমানঘাঁটি ও উত্তরাঞ্চলের কমান্ড। শিলিগুড়ির কোর এবং ডিভিশনগুলি স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় উত্তরদিক থেকে বাংলাদেশে ঢুকে পড়ে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, প্রধান সেনাপতি এবং আমরা, সফরসঙ্গীরা বাগডােগরা সামরিক বিমানঘাঁটিতে অবতরণ করলাম।
বিশিষ্ট মেহমানদের ক্যান্টনমেন্টের অভ্যন্তরে অতিথিশালায় থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল। আমি, শেখ নাসের ও ক্যাপ্টেন নূর (কর্নেল ওসমানীর এ.ডি.সি.) সার্কিট হাউসে। এই নূরের কথাই এখন মনে পড়ছে; ও তাে একটি নরঘাতক। মুখে দাড়িগোঁফ ছিল না, খুব গাট্টাগােট্টা, পেশিবহুল শরীর। ভারতীয় অফিসাররা ওকে দেখে ঠাট্টা করেছিল, ও কি কুস্তি গীর? নরঘাতক বললাম এইজন্য যে, সে বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের অন্যতম। এই ক্যাপ্টেন নূর, প্রধান সেনাপতি ওসমানী সম্পর্কে নানারকম মন্তব্য করতেন সুযােগ পেলেই। যেমন তিনি প্রায়ই বলতেন: কর্নেল ওসমানী খুব ভিতু ছিলেন, ঘরে কোনাে শব্দ শুনলে তখনই বিছানা ছেড়ে টর্চ দিয়ে দেখতেন খাটের তলায় কেউ আছে কিনা, ইত্যাদি। এ.ডি.সি.-র দায়িত্বে থেকে এসব মন্তব্য তার মুখে বেমানান ছিল।
বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানালেন সেক্টর কমান্ডার উইং কমান্ডার বশর ও তার সাথে স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন। এরা দুজনেই পর পর বাংলাদেশ বিমানবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হয়েছিলেন। বিমানবন্দরের ভারতীয় সেনা ও বিমানবাহিনী কর্মকর্তাও ছিলেন।
আমরা দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে নির্ধারিত জায়গায় চলে গেলাম। সেদিন রাতেই কোর কমান্ডার (নামটা মনে নেই) আমাদের জন্য অভ্যর্থনার আয়ােজন করেছিলেন অফিসার্স মেসে। আমি এর আগে এক সাথে এত আর্মি-অফিসার দেখিনি; পাকিস্তান সেনাবাহিনীতেও না। লেফটেন্যান্ট জেনারেল মনে হল দুজন; মেজর জেনারেল এক ডজনের মতাে; ব্রিগেডিয়ার কয়েক ডজন; কর্নেল, লে. কর্নেল আর মেজর গুণে শেষ করতে পারিনি। বিমানবহিনীর পদস্থ কর্মকর্তা, যেমন এয়ার ভাইস মার্শাল, এয়ার কমােডাের, গ্রুপ ক্যাপ্টেন অনেক। সামরিক অফিসারদের এত বড় সমাবেশ দেখে মনে হয়েছে নিশ্চয়ই তাদের ডেকে পাঠানাে হয়েছিল বিশেষ কোনাে উদ্দেশ্যে। তখনও বােঝা যায়নি যে আর মাত্র দুই মাসের মধ্যেই তারা বড় কোনাে অপারেশনের প্ল্যান করছেন।
পরদিন সকালবেলা আমরা গেলাম মূর্তি ক্যাম্পে, যেখানে আমাদের প্রথম অফিসার ব্যাচের ট্রেনিং সমাপ্ত হবার কথা। সমাপনী উপলক্ষে চিরাচরিত পাসিং আউট প্যারেডে (Passing out parade)-এ স্যালুট নিলেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কমিশন পাওয়া সেনা-অফিসারদের সার্টিফিকেটে দস্তখত করলাম আমি। এই অফিসারদের সকলেই বিভিন্ন সেক্টরে অন্তর্ভুক্ত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেছেন। বেশ কয়েকজন শহীদ হয়েছেন, অনেকেই বীরত্বের জন্য পদকে ভূষিত হয়েছেন। আমাদের গর্ব এঁরা। এখন বােধ হয় এঁরা অবসরে চলে যাচ্ছেন। তিন দশকের বেশি সময় অতিক্রান্ত হয়ে গেল, কিন্তু আমার স্মৃতির মণিকোঠায় ঘটনাগুলি গেঁথে আছে।
শিলিগুড়ি থেকে আগরতলা। আগরতলাতে আমাদের বিরাট আস্তানা। পূর্বাঞ্চলের সব বড় বড় নেতা, রাজনৈতিক, যুব-ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, কয়েকজন সেক্টর কমান্ডার ও অন্যান্য অফিসার। প্রশাসনের লােকজনও অনেক। প্রচুর উৎসাহ-উদ্দীপনা তাদের মধ্যে। স্বাধীন বাংলার অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আর প্রধানমন্ত্রীকে তারা যথাযােগ্য মর্যাদা এবং আড়ম্বরের সাথে গ্রহণ করলেন। দেখে মনে হলাে না যে আমরা বিদেশের মাটিতে।
রাতে আগরতলা সার্কিট হাউসে একটি অনভিপ্রেত ঘটনা ঘটল। শেখ ফজলুল হক মণি তার কয়েকজন সাথী নিয়ে এলেন সার্কিট হাউসে। প্রধানমন্ত্রীর সাথে তার কামরায় একান্ত বৈঠক করতে করতে হঠাৎ উত্তেজিত হয়ে চিৎকার করতে আরম্ভ করলেন। অনেকেই সমবেত হলেন। রাগের কারণ প্রধানমন্ত্রী ও কর্নেল ওসমানী সম্পর্কে তার (শেখ মণির) নানা অভিযােগ। ওসমানী কেন মুজিববাহিনীর কার্যকলাপ সম্পর্কে অভিযােগ করলেন, আর প্রধানমন্ত্রী কেন ভারতীয় কর্তৃপক্ষের কাছে তা প্রকাশ করলেন। এছাড়া সরকার গঠনের বিষয়ে শেখ মণির ক্ষোভ তাে ছিলই। সব ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ একটি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। বলাবাহুল্য প্রধানমন্ত্রীর সাথে প্রকাশ্যে এরকম উচুগলায় এবং রাগতস্বরে কথা বলা মােটেই আমাদের মান-সম্মান বৃদ্ধি করেনি। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন কিন্তু তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে ধীরস্থিরভাবেই ঘটনাটি গ্রহণ করলেন। বিষয়টিতে সেরকম কোনাে গুরুত্ব দিলেন বলে আপাতদৃষ্টিতে মনে হলাে না।
পরদিন বেশ কয়েকটি জনসভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বক্তৃতা করলেন। সবগুলাে স্থানের পাশেই আমাদের যুবশিবির। নিকটেই সেক্টরদের আস্তানা। প্রচুর জনসমাবেশ হয়েছিল। ব্যবস্থাপনায় ছিলেন কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নােয়াখালীর নেতৃবৃন্দ আর আমাদের পূর্বাঞ্চলের জোনাল প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ। বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা জনগণের মাঝে। মনে করার কোনাে উপায়ই ছিল না যে আমরা তখনও বিদেশের মাটিতে।
খুব সম্ভবত ঐদিন অথবা পরের দিন আমরা গেলাম মেজর রফিকের সেক্টরে, বেলােনিয়ায়। সামনেই যুদ্ধ চলছে; কামান আর মর্টারের গােলাবর্ষণের আওয়াজ। সেনাকর্মকর্তা এবং মুক্তিযােদ্ধারাও খুবই অনুপ্রাণিত আর উল্লসিত হলেন। মাঝে মাঝে একদল বের হয়ে যাচ্ছেন, আরেক দল ক্লান্ত পরিশ্রান্ত হয়ে ফিরছেন, হয়তাে কোনাে মিশন। অথবা পেট্রোল শেষ করে। যুদ্ধসীমান্ত খুবই কাছে, কিন্তু মেজর রফিকের ঘাঁটিটি খুবই সুরক্ষিত; পাহাড়ের ওপর, গাছপালায় আবৃত; নিচে চারদিকে বাঙ্কার। রফিক আমাদের দূরবীন দিয়ে দেখালেন নিচে; অদূরেই পাকিস্তানিদের আনাগােনা লক্ষ্য করা গেল। আমার পূর্বপরিচিত বেশ কয়েকজন সেনা-অফিসারের সাথেও দেখা হলাে। মুক্তিযুদ্ধের সাত মাসের মাথায় এসে এই প্রথম দারুণ উল্লসিতবােধ করলাম। মনে হলাে এতদিনের পরিশ্রম আর ত্যাগ বােধহয় সার্থক হতে চলেছে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর এই গুরুত্বপূর্ণ সফরের পরেই মুজিবনগরে ক্রমান্বয়ে অনেকগুলাে সুদূরপ্রসারী ঘটনা ঘটল। ২০-২১ অক্টোবর আওয়ামী লীগের কার্যকরী কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হলাে। এই সভায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী অন্যান্য নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত করেন। নেতৃবৃন্দও এই দুই ব্যক্তির প্রতি অবিচল আস্থা প্রকাশ করেন। ইতােমধ্যে বেশ কয়েকটি মন্ত্রিসভা বৈঠকও অনুষ্ঠিত হলাে (অক্টোবর ১, ৫, ৭, ২০ ও ৩০)। প্রত্যেকটির মূল লক্ষ্য (thrust) মুক্তিযুদ্ধে বিজয়। সেজন্য যা-যা করণীয় আমাদের তাই করতে হবে। মুক্তিবাহিনী, যুবশিবির, গেরিলাবাহিনী এবং দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধরত
পৃষ্ঠা: ২৫৫
অন্যান্য বাহিনীর (যেমন কাদের সিদ্দিকী, হেমায়েত) শক্তিবৃদ্ধি, অস্ত্র ও সরবরাহ নিশ্চিতকরণ যেমন হয়েছে অক্টোবরের শেষ নাগাদ; তেমনই সাংগঠনিক দিক থেকেও মুক্তিবাহিনী যথেষ্ট সুগঠিত, সুশৃঙ্খল ও তৎপর হয়েছে। শত্রুর দুর্গে ঘন ঘন আঘাত হেনে একদিকে যেমন দুর্বল করা হয়েছে, অপরদিকে তাদের মানােবলও ক্রমেই নিম্নগামী হয়েছে। রণক্ষেত্রের পাশাপাশি তথ্যমাধ্যমগুলির সাহায্যে স্নায়ুযুদ্ধেও আমরা অগ্রগামী। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শ্রোতা বাংলার ঘরে-ঘরে তখন।
অক্টোবরের ২২ তারিখে রাষ্ট্রের দুই কর্ণধার, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি গমন করেন আলােচনার জন্য। মিসেস গান্ধী ও তার মন্ত্রিসভার অন্যান্য সদস্যদের সাথে তাদের আলােচনা হয়। শ্রী ডি.পি. ধর-এর সাথে তাদের তিন দফা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। RAW-এর ওপর আরও চাপ সৃষ্টির জন্য মি. ধরকে বিশেষভাবে বলা হয়, যাতে আমাদের সেনাবাহিনীর কর্নেল ওসমানীর নেতৃত্বে চেইন অব কমান্ড কোনােক্রমেই বিঘ্নিত না হয়। এই সময়ে ভারতীয় পূর্বাঞ্চল কমান্ডে মেজর জেনারেল বি.এন. সরকারকে বাংলাদেশ বাহিনীর সাথে সরাসরি সমন্বয়কারী নিয়ােগ করা হয়। পূর্ব কমান্ড (Eastern Command) ও বাংলাদেশ বাহিনী ও মুক্তিফৌজ যাতে একযােগে সমন্বিতভাবে শত্রুর বিরুদ্ধে নামতে পারে সেইজন্যই জেনারেল সরকারের নিয়ােগ।
অক্টোবর মাসেই দুই দেশের যৌথ–কমান্ড সৃষ্টির চিন্তাভাবনা শুরু হয়। নেপর্যায়ে প্রাথমিক আলােচনা চলে। সেনাপ্রধানদের স্তরে বিস্তারিত আলােচনা হতে থাকে।
অক্টোবরে আরেকটি সুদূরপ্রসারী ঘটনা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের বিজয়কে আরেক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যায়। ২৪ অক্টোবরে মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ১৯ দিনের জন্য পশ্চিমা দেশগুলি সফরের উদ্দেশ্যে ভারত ত্যাগ করেন। লক্ষ্য: বাংলাদেশ ও ভারতের পক্ষে ঐসব দেশের সরকারি দৃষ্টিভঙ্গি জেনে নেওয়া এবং আমাদের পক্ষে দোদুল্যমনা সরকারগুলােকে টেনে আনা। একই সাথে ইউরােপ ও আমেরিকার বিভিন্ন গণমাধ্যম (পত্র-পত্রিকা, রেডিও ও টিভি) এবং রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের (যেমন পার্লামেন্ট, কংগ্রেস) নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনার ভিত্তিতে তাদেরকে প্রভাবিত করা। এই সফরের মাত্র দুইদিন আগে, অর্থাৎ ২২ তারিখে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি যান আলােচনা ও পরামর্শের জন্য। মিসেস গান্ধী বিদেশ যাত্রার পূর্বেই বাংলাদেশ সরকারের সাথে আরেকবার পরামর্শ করে নেন। খুব সম্ভবত তিনি ইতিমধ্যেই তার পরবর্তী কর্মপন্থা স্থির করে নিয়েছিলেন। সােভিয়েত ইউনিয়নের নেতৃবৃন্দের সাথেও হয়তাে তার পূর্বাহ্নেই মােটামুটি ছক কাটা হয়ে গিয়েছিল। পশ্চিম-ইউরােপের দেশগুলিকে পক্ষে না আনা গেলেও অন্তত যাতে নিরপেক্ষ রাখা যায় তার হয়তাে একটা শেষ প্রচেষ্টা। আমেরিকার সরকারের মনােবল তার ভালােই জানা ছিল। তবু চেষ্টা করছিলেন যাতে তারা (মার্কিন সরকার) পাক-ভারত সংঘর্ষ বাধলে সরাসরিভাবে ডুড়িয়ে না পড়ে। এছাড়া মার্কিন কংগ্রেস, বিশেষত সিনেটকে যদি কিছুটা হলেও প্রভাবিক করা যায় তাহলে আমেরিকা প্রত্যক্ষ কোনাে সামরিক হস্তক্ষেপে যাবে না, কেননা আমেরিকার সংবিধান অনুযায়ী যে-কোনাে সামরিক সংঘর্ষে যেতে সিনেটের অনুমােদন প্রয়ােজন। সামরিক মহড়া এবং শক্তি প্রদর্শন এক জিনিস, আর প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ আরেক কথা। পরবর্তী ঘটনা প্রমাণ করে যে, মিসেস গান্ধীর হিসেবে-নিকেশ সঠিত ছিল।
অক্টোবর ও নভেম্বর মাসে অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রীচুক্তি সম্পাদনের সম্ভাবনা সম্পর্কে মি. ডি.পি.ধর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীনের কাছে বিষয়টি উত্থাপন করেন। এই সময়ে সম্ভবত একটা খসড়া নিয়ে আলােচনা হয়ে থাকতে পারে।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী দিল্লি থেকে প্রত্যাবর্তনের পর আমাদের কর্মকাণ্ড বহুগুণ বেড়ে গেল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ তার মাত্র কয়েকজন কর্মকর্তা-কর্মচারীকে নিয়ে হিমশিম খাওয়ার অবস্থা। আমার নিজের ওপর চাপ তথন প্রচণ্ড। একদিকে মন্ত্রিসভা বৈঠক, তার কার্যপত্র দেখা, আলােচনাসূচি সকলকে যথাসময়ে জানানাে; অপরদিকে প্রধানমন্ত্রীর নানা নির্দেশ যথাযথভাবে পালনের ব্যবস্থা। এর পাশাপাশি ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে প্রতিদিন বৈঠক এবং বিভিন্ন বিষয়ে আলােচনা ও সমঝােতার ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের দায়িত্ব। একই সাথে পরিকল্পনা বাের্ড (সেল থেকে উন্নীত)-কে সবরকম সহায়তা প্রদান—এত কাজ সেদিন কীভাবে করেছি এখন চিন্তা করে অবাক হই।
আমাদের তখনকার দিনের তৎপরতার একটি উদাহরণ ৩০ অক্টোবর তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভা বৈঠক।
প্রথম দফায় আলােচ্যসূচিতে স্থান পেল ৬টি বিষয়। এই ৬টি বিষয় বৃদ্ধি পেয়ে পরে দাঁড়াল ১৩টিতে। সেগুলাে নিচে উল্লেখ করলাম:
১. শহীদ এবং যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধাদের পরিবারের দেখাশুনা/ভরণপােষণ প্রতিরক্ষা
মন্ত্রণালয়;
২. মুক্তিবাহিনী সদস্যদের জন্য শীতবস্ত্র—প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়;
৩. যুবশিবির এবং যুব অভ্যর্থনা শিবিরে অবস্থানরত যুবকদের জন্য শীতবস্ত্র প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়;
৪. মুক্ত এলাকায় প্রশাসনব্যবস্থা— সাধারণ প্রশাসন বিভাগ।
৫. মুক্ত-অঞ্চলে প্রশাসন, স্থানীয় প্রশাসন কাউন্সিল কর্তৃক নিয়ােগ—সাধারণ প্রশাসন;
৬. বিভিন্ন পর্যায়ে নিয়ােগ: কেন্দ্রীয় ও আঞ্চলিক প্রশাসনে সাধারণ প্রশাসন;
৭. সীমান্ত এলাকায় অতিরিক্ত পুলিশ নিয়ােগ—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়;
৮. ১৬ জন প্রশিক্ষণার্থী দারােগার চাকুরি—স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়;
৯. পুলিশবাহিনীর সদস্যদের বিনাখরচায় পােশাক সরবরাহ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়;
১০. বাংলাদেশ পুলিশবাহিনীতে নিয়ােগ ও প্রশিক্ষণ—স্বরাষ্ট্র;
১১. আঞ্চলিক প্রশাসনে ব্যয় সঙ্কোচন—অর্থ মন্ত্রণালয়;
১২. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের চলাচল ভাতা—অর্থ মন্ত্রণালয;
১৩. কৃষি মন্ত্রণালয় গঠন—স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী।
উপরের বিষয়বস্তুর তালিকা দেখলেই মনে হবে যে প্রায় প্রতিটি বিষয় ছিল অত্যন্ত জরুরি। মুক্তিবাহিনী, পুলিশ, যুবশিবির, আঞ্চলিক প্রশাসন, মুক্ত-অঞ্চলে আমাদের নিজস্ব প্রশাসন স্থাপন —এইসব বিষয়ের কোনােটি মুলতবি বা স্থগিত করার উপায় ছিল না। বিষয়গুলি সম্পর্কে গৃহীত সিদ্ধান্তগুলি ত্বরিত গতিতে সকলকে জানানাে এবং বাস্তবায়নের ব্যবস্থা করাও ছিল আমাদের কাজ। দায়িত্ব এবং কর্মপরিধি ঐ সময় বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। আমাদের ভাবার কোনাে অবকাশ ছিল না অত কাজ করতে পারব কি না।
আলােচ্য বিষয় থেকে যেমন বােঝা যায়, সিদ্ধান্তের ব্যাপারেও তাই; অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযােদ্ধা, শহীদ, যুদ্ধাহত, যুবশিবির, শীতবস্ত্র সরবরাহ ইত্যাদি বিষয়ই মন্ত্রিসভায় প্রাধান্য পায়। এই সভায় প্রধান সেনাপতি ও প্রতিরক্ষা-সচিব উপস্থিত ছিলেন। বিশেষ আমন্ত্রণে এসেছিলেন রাষ্ট্রদূত ফতেহ। তাঁকে তখন যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন পুনপ্রতিষ্ঠার ওপর কাজ করতে বলা হয়েছিল। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের সবগুলাে প্রস্তাব অনুমােদিত হয়। প্রয়ােজনীয় অর্থও বরাদ্দ করা হয়। যুবশিবিরে অবস্থানরত যুবকদের শীতবস্ত্রের জন্য বরাদ্দ দেওয়ার সাথে সাথে বলা হয়েছিল যে ভারত-সরকারের ত্রাণমন্ত্রণালয় কর্তৃক এদের জন্য পােশাক সরবরাহের কথা। সেটি পাওয়া গেলে আমাদের বাজেট সঙ্কুলানে সুবিধা হবে।
অক্টোবর ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিসভার এই বৈঠকের ৯ নম্বর বিষয়বস্তু খুবই প্রণিধানযােগ্য বিশেষ করে ২০০৪ সালের বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে। মাত্র কয়েকদিন আগে আমরা জানতে পারলাম যে বাংলাদেশ পুলিশের বহুদিনের পুরােনাে পােশাক। (uniform) পাল্টানাে হয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ এবং অর্থবহ হলাে পুলিশের ব্যাজের পরিবর্তন। এটার পেছনে রাজনৈতিক চিন্তাভাবনা কাজ করেছে বলে অধিকাংশ ব্যক্তি মনে করেন। কোনাে বিতর্কে না গিয়ে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভায় ১৯৭১ সালে এই উভয় বিষয়ে কী ধরনের আলােচনা হয়েছিল এবং কী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিল তা এই গ্রন্থের স্বরাষ্ট্র, পুলিশ, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়শীর্ষক অধ্যায়ে বর্ণিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ যখন চুড়ান্ত পরিণতির দিকে এগিয়ে যাচ্ছে সেই সময় তিন যুগেরও বেশি আগে কী প্রতিকূল অবস্থা আর পরিস্থিহির মধ্যে এমন সুদূরপ্রসারী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত নিয়েছিল আমাদের মন্ত্রিসভা, তা সত্যই বিস্ময়কর। এই সিদ্ধান্ত বর্তমান (২০০৪ সালে) অর্থাৎ স্বাধীনতার ৩২ বছর পর পরিবর্তিত হওয়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরােধী চক্রের অপতৎপরতার কথাই মনে আসছে।
নিয়মিত বিষয়সূচির বাইরে ৩০ অক্টোবর সভায় কয়েকটি বিধির বিষয় জরুরি ভিত্তিতে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়:
ক. বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর জুনিয়র কমিশনড অফিসার (JCO) এবং অন্যান্যদের (other ranks) তৎকালীন বেতনের (যথাক্রমে ১৫০/- রুপি ও ৭৫/- রুপি) অতিরিক্ত ৫০/- রুপি ভাতা দেওয়া হবে ১ নভেম্বর থেকেই।
খ. পুলিশ এবং বেমাসরিক প্রশাসনকে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার্থে সাহায্য করার জন্য আঞ্চলিক প্রশাসন স্থানীয় গ্রামীণ স্বেচ্ছাসেবক নিয়ােগ করতে পারে।
গ. জনাব আবদুস সামাদ আজাদ তার সাম্প্রতিক যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য সফরের রিপাের্ট উপস্থাপন করেন। তার প্রস্তাব-মতে মন্ত্রিসভা যুক্তরাজ্যে (ব্রিটেন) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের জন্য সংগৃহীত সকল অর্থের হিসাব নিরীক্ষণ করার নিমিত্তে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘােষণাকারী সাবেক পাকিস্তান অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের জনাব লুৎফুল মতিনকে নিয়ােগ করা হয়।
ঘ. বাংলাদেশ থেকে আগত সকল পরিবারে মহিলা, বিশেষ করে বয়স্কাদের তালিকা প্রণয়নের জন্য স্বাস্থ্যসচিবকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
নভেম্বর, ১৯৭১
ইউরােপ ও আমেরিকা সফরের প্রাক্কালে যেমন মিসেস গান্ধী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর সাথে পরামর্শ করেছিলেন, ঠিক তেমনই দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তিনি পুনরায় তাঁদের সাথে আলােচনায় বসেন। বিদেশ যাত্রার পূর্বে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় ২২ অক্টোবর, ফিরে এসে আবার আলােচনায় বসেন ১৬ নভেম্বর। এই বৈঠকটি বলা যায় বাংলাদেশের নেতৃদ্বয়কে বিদেশ-সফরের বিষয়বস্তু সম্পর্কে অবহিত করার জন্য- যাকে ইংরেজিতে বলা যেতে পারে debriefing। দ্বিতীয় আলােচ্য বিষয় ছিল: পরবর্তী কর্মপন্থা নির্ধারণ। বাংলাদেশ-ভারত সামরিক যৌথকমান্ডের নেতৃত্বে পাকিস্তান বাহিনীকে প্রতিহত ও পরাজিত করার নীল নকশা এই সময়ে প্রণয়ন করা হয়।
এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে যে, ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম সেপ্টেম্বর মাস থেকে প্রত্যক্ষভাবে আলাপ-আলােচনায় সম্পৃক্ত হয়ে পড়েন। এর আগে, বিশেষ করে আগস্ট মাসে ভারত-সােভিয়েত চুক্তি সম্পন্ন হওয়ার পূর্বপর্যন্ত বাংলাদেশ সম্পর্কে তার ধারণা অস্বচ্ছ ছিল। মিসেস গান্ধী যেমন প্রথম থেকেই বাংলাদেশ সমস্যার নৈতিক ও মানবিক দিকটাই মুখ্য করে দেখেছেন, ভারতের সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ অতটা বিবেচনায় নেননি, অন্যদের বেলায় তা ছিল না। শ্ৰী রামের মতাে অনেকেই এটাকে বৃহত্তর ভারত-পাকিস্তান সমস্যার অংশবিশেষরূপে দেখেছেন। মিসেস গান্ধী পাকিস্তানিদের বর্বর আক্রমণ ও নৃশংস অত্যাচার এবং শরণার্থীদের কষ্ট ও যন্ত্রণাকে অনেক বড় করে দেখেছেন নিজে আপুত হয়েছেন; যাকে বলা যেতে পারে emotionally and morally involved—অন্যদের বেলায় তা ছিল না। ভারতীয় প্রতিরক্ষামন্ত্রী অত্যন্ত প্রবীণ প্রথম সারির কংগ্রেস-নেতা হয়েও, বাংলাদেশ সম্পর্কে দায়িত্বজ্ঞানহীন মন্তব্য করেছেন বেশ কয়েকবার। এটি আমাদের অনেক সময় বিবেচনায় নিতে হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আমাদের বলেছেন সে-কথা।
সেপ্টেম্বর-অক্টোবরে যখন গােটা উপমহাদেশ উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে, চারদিকে একটা সাজসাজ রব, তখন সেই সমস্যার সম্মুখীন হন মিসেস গান্ধী। বাংলাদেশ সমস্যা ও সমাধানে তিনি নিজে, ব্যক্তিগতভাবে, সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছিলেন আগেই। কিন্তু তাঁকে তাঁর মন্ত্রিসভা ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ এবং পার্লামেন্টকে সঙ্গে নিয়েই এগুতে হয়েছে। অনেক মতামত ছিল। মােটামুটিভাবে একটা জাতীয় ঐকমত্যে পৌঁছানাের পরই যুদ্ধের মতাে বিরাট একটা সিদ্ধান্ত ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নিতে সক্ষম হয়েছিলেন।
তিনটি মূল সমস্যা ছিল প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধীর। প্রথম সমস্যা, কট্টরপন্থী একদল ছিলেন যারা চাচ্ছিলেন এই সুযােগ (অর্থাৎ বাংলাদেশে সংঘাতের সময়) পাকিস্তানকে শেষ করতে। তাদের ভাষায়, Final settlement with Pakistan’। দ্বিতীয় সমস্যাটির সাথে আমরাও জড়িয়ে পড়েছিলাম বাধ্য হয়ে। সেটি হলাে ভারতের দক্ষিণপন্থী কিছু নেতা (যেমন ত্রিগুনা সেন) আমেরিকার সাথে গােপন আঁতাত করে বাংলাদেশি দক্ষিণপন্থী নেতাদের (যার নেতা ছিলেন খন্দকার মােশতাক আহমেদ) সাথে একাযােগে এমন একটা কিছু করার—যাতে আমেরিকা ও পাকিস্তানের স্বার্থ রক্ষা হয়, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় থাকে। এই উদ্দেশ্যেই খন্দকার মােশতাক জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যােগদান করার জন্য এত উদগ্রীব ছিলেন: নিউইয়র্কে কীভাবে সত্বর যেতে পারেন সেজন্য ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে বারবার অনুরােধ করছিলেন। মিসেস গান্ধীর তৃতীয় সমস্যাটি আমাদেরও প্রভাবিত করেছিল। সেটা পশ্চিমবাংলার নক্সাল-আন্দোলন। চারু মজুমদার পরিচালিত এই আন্দোলন যেভাবে শ্রেণিশত্রু খতমের নামে বেপরােয়া হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছিল তাতে গােটা পশ্চিমবাংলার আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিরি মারাত্মক অবনতি ঘটে। কংগ্রেসী নেতৃবৃন্দ এদের বিশেষ টার্গেট ছিল। চীনপন্থী হওয়ার কারণে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি এরা বৈরী ছিল বিধায় বিভিন্ন জেলাতে শরণার্থীদের ভীতির কারণও হয়ে উঠেছিল নক্সালীরা। মিসেস গান্ধী। অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে নক্সাল সমস্যার সমাধান করেন। পশ্চিমবঙ্গ প্রশাসন এবং পুলিশ সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হওয়ায়, নক্সালদের দমন করতে কেন্দ্রীয় পুলিশ বাহিনী (CRP বা Central Reserve Police) নিয়ােগ করা হয়।
১৬ নভেম্বর মিসেস গান্ধীর সাথে বৈঠকের পরপরই প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বিস্ত রিত আলােচনার জন্য শ্রী ডি.পি. ধরের সাথে বৈঠকে বসেন। আলােচনা আরও ফলপ্রসূ করার জন্য শ্রী ধর কোলকাতায় চলে আসেন ১৯ তারিখে। ১৯-২০ তারিখে বিভিন্ন পর্যায়ে আলােচনা হয় তার সাথে কখনও প্রধানমন্ত্রীর সাথে, কখনও আমাদের সাথে। এই সময়ে আলােচনা আর নীতি-নির্ধারণে সীমাবদ্ধ ছিল না। মূল বিষয়ে সমঝােতা হয়ে যাবার পর বিস্তারিত আলােচনা, যাতে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন ত্বরান্বিত হবে, সেটাই ছিল তখনকার করণীয়। পরিকল্পনার মুখ্য উদ্দেশ্য: বিজয় এবং বাংলাদেশকে শত্রুকবলমুক্ত করা; তার সাথে আনুষঙ্গিক বিষয়াদি। যৌথ কমান্ড স্থাপন; সামরিক সমঝােতার চুক্তি প্রধান কার্যালয় স্থাপন; বিভিন্ন পর্যায়ে দায়িত্ব বণ্টন; শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন; যােগাযােগ ব্যবস্থা (রেল, সড়ক, সেতু, নৌপথ) মেরামত ও পুননির্মাণ; খাদ্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যাদির সরবরাহ এবং বণ্টন নিশ্চিতকরণ; চিকিৎসাব্যবস্থা চালুকরণ এগুলাে ছিল আমাদের যৌথ আলােচনার বিষয়বস্তু। সাথে সাথে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের খুঁটিনাটি (Operational Details) দেবারও দায়িত্ব ছিল উভয় পক্ষের।
কতকগুলি বিষয় ছিল নিতান্তই আমাদের সরকারের আওতাধীন—যেমন আইন ও শৃঙ্খলা পুনরুদ্ধার; বেসামরিক প্রশাসন পুনঃস্থাপন; সরকারি কর্মচারী নিয়ােগ; সরকারি, আধাসরকারি, শিল্প ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্তৃত্বগ্রহণ এবং সেগুলােকে চালু করার ব্যবস্থা; পরিত্যক্ত বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং বন্ধ হয়ে যাওয়া স্কুল ও হাসপাতাল সচল করা ইত্যাদি বিষয় ছিল অত্যন্ত জরুরি।
নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপযুক্ত বিষয়ে কালবিলম্ব না করে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সচিবদের নির্দেশ দেন। স্বাধীন বাংলাদেশের পুরাে প্রশাসনযন্ত্রকে দেশে ফিরে অদম্য উৎসাহ নিয়ে দেশগঠনে আত্মনিয়ােগের আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। এই লক্ষ্যে সচিবদের কয়েকটি কমিটি গঠন করা হয়। একই সাথে প্ল্যানিং বোের্ড (পূর্বের সেল)-কে সহায়তা দিয়ে যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশ পুনর্গঠনের জন্য সবরকম পরিকল্পনা প্রণয়নে সাহায্য করতে বলা হয়। আগেই বলেছি আমাদের ছােট মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বহুমুখী কর্মতৎপরতার কথা। এর সাথে পরিকল্পনা বাের্ডকে সহায়তা প্রদান এবং সচিবালয় এবং ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সাথে সমন্বয় সাধন আরেক মাত্রা যােগ করে। বিষয়ভিত্তিক বেশ কয়েকটি সচিব-কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তার মধ্যে কয়েকটি ছিল যেমন গুরুত্বপূর্ণ, তেমনই গােপনীয় ও স্পর্শকাতর। অগ্রাধিকার অনুসারে নিম্নোক্ত বিষয়গুলি আমাদের আলােচনা ও রিপাের্টে প্রাধান্য পায়:
ক. বেসামরিক প্রশাসন;
খ. আইন ও শৃঙ্খলা;
গ. শরণার্থী প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন;
ঘ. যােগাযােগব্যবস্থা পুনস্থাপন ও পুনর্নির্মাণ;
ঙ. বিজয়ােত্তর বাংলাদেশে সার্বিক পুনর্গঠন;
চ. বিচার ব্যবস্থা: বিশেষ করে দালালদের বিচার;
ছ. স্বাস্থ্যসেবা;
জ. শিক্ষাব্যবস্থা।
পরিকল্পনা বাের্ড এবং সচিব-কমিটি এইসব বিষয়ে জরুরি ভিত্তিতে নানাবিধ সুপারিশসহ তাদের রিপাের্ট পেশ করেন, যা পর্যায়ক্রমে মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করা হয়। সিদ্ধান্ত গৃহীত
পৃষ্ঠা: ২৬০
হবার পর সেগুলােকে বিতরণ এবং তার বাস্তবায়ন নিরীক্ষণ আমাদের করতে হবে। আমার সহকর্মী শরিফ, রহমতউল্লাহ আর আসাদুজ্জামান ঐদিনগুলিতে (এবং বিজয়ের পরে) উদয়াস্ত পরিশ্রম করেছেন। কেমন অজ্ঞাত, অখ্যাত রয়ে গেলেন মুক্তিযুদ্ধের এই বেসামরিক বীর সেনানীরা।
নভেম্বর মাসে ভারত-সরকার বেশ কয়েকটি জরুরি সংস্থা এবং তাদের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাকে কোলকাতায় নিযুক্ত করেন। তাঁদের কাজ ছিল আমাদের বিভিন্ন সংস্থার সাথে একযােগে পরিকল্পিতভাবে কাজ করা। যুদ্ধজয়ের পাশাপাশি অন্যান্য বিশাল সমস্যাগুলির দদ্রুত সমাধান না করতে পারলে স্বাধীনতা নিরর্থক হয়ে যাবে—এই উপলব্ধি সারাক্ষণ আমাদের মাঝে কাজ করেছে।
নভেম্বরের ১৩ তারিখে তৎকালীন স্বাস্থ্যদপ্তরের সচিব ড. টি. হােসেন একটি নােট প্রেরণ করেন যার বিষয়বস্তু ছিল ভারতীয় ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব কর্নেল লুথরার সাথে তার বৈঠকের বিবরণ। এটি পড়লে আমাদের সচিবদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে একটা ধারণা হবে। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, ড. টি. হােসেন তার গােটা পরিবার নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। তাঁর অদম্য উৎসাহ আর তৎপরতা অন্যদেরও অনুপ্রেরণা যােগাত। সংশ্লিষ্ট ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে তিনি সবসময় যােগাযােগ রাখতেন এবং মুক্তিযােদ্ধা, যুবশিবির ও ত্রাণশিবিরের জন্য কিছু-না-কিছু প্রয়ােজনীয় জিনিস সংগ্রহ করতেন। মুক্ত-অঞ্চলেও ছিল তার অবাধ যাতায়াত। তার স্ত্রী মিসেস পারভিন হােসেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে ইংরেজি সংবাদ পাঠিকা ছিলেন। মেয়ে কাজ করত আমাদের সচিবালয়ে। ১৩ নভেম্বরের নােটের প্রধান বিষয় ছিল:
ক. মুক্তিবাহিনীর জন্য অ্যাম্বুলেন্স (Ambulance);
খ. মুক্ত-অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর জন্য ওষুধ সরবরাহ;
গ. রােগমুক্তি আশ্রয়ের জন্য বাসস্থান;
ঘ. মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ কর্তৃক প্রদত্ত বিশেষ দায়িত্ব।
স্বাস্থ্যসচিবের প্রতিবেদনে দেখা যায় মােট ১৯টি অ্যাম্বুলেন্স ভারতীয় স্বাস্থ্যদপ্তর দিয়েছিলেন এবং সেগুলাে আমাদের সেক্টর-কমান্ডারদের দ্বারা নির্ধারিত স্থানসমূহে বিতরণ করা হয়েছে। সেইসাথ এইসব গাড়িতে ওষুধও পাঠানাে হয়েছে। ভালাে ব্যবস্থা করেছিলেন ড. হােসেন। ভারত-সরকারের গৌহাটি, শিলং এবং আগরতলা কেন্দ্রীয় সরবরাহ কেন্দ্র থেকে আমাদের বিভিন্ন সেক্টরের মেডিকেল অফিসারদের কাছে প্রতিমাসে নিয়মিত ওষুধ সরবরাহ করা হবে। রৌমারিতে আমাদের হাসপাতাল ও চিকিৎসাকেন্দ্রে এক সপ্তাহের মধ্যে পর্যাপ্ত ওষুধ পাঠানাে হবে। অন্যান্য মুক্ত-অঞ্চলে প্রতি ২৫০০০ জনসংখ্যা অনুপাতে একটি চিকিৎসাকেন্দ্র হিসেব করে আমাদের স্থানীয় ডাক্তারের কাছে ওষুধ পৌঁছানাে হবে।
রােগমুক্তি কেন্দ্র স্থাপনের জন্য পশ্চিমবাংলার এক বা একাধিক স্থানে আবাস, যাতে ৩০০ রােগী একসাথে রাখা যায় এরকম একটা ব্যবস্থা নেওয়া হয়। এর সম্পূর্ণ ব্যয় বহন করে হরিয়ানা-বাংলাদেশ মুক্তি সহায়ক সমিতি, যার সভাপতি শ্রী গুলজারিলাল নন্দা এবং কোষাধ্যক্ষ হলেন শ্রী এম. কে. ভিমানি।
বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন স্থান থেকে পাকিস্তান বাহিনী দ্বারা নির্যাতিত বেশকিছু মহিলা ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। এদের জন্য চিকিৎসা, রােগমুক্তি, আশ্রয়, খাদ্য ও বস্ত্রের ব্যবস্থা জরুরি বিধায় আমি স্বাস্থ্যসচিবকে বিশেষ অনুরােধ করেছিলাম কর্নেল লুথরার সাহায্যে একটা বন্দোবস্ত করার। বিশেষ পরিবহণের ব্যবস্থা, সমাজসেবা কর্মীদের সাহায্যে এদের পরিচর্যা করে কোনাে নির্দিষ্ট স্থানে আশ্রয়-এসসব বিষয়বস্তু ড. টি. হােসেন আলােচনা করেছিলেন কর্নেল লুথরার সাথে। একই সঙ্গে পূর্ব-সীমান্ত অঞ্চল সফরের ব্যবস্থাও করেন তিনি।
নভেম্বর মাসে মন্ত্রিসভার বেশ কয়েকটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। প্রধানমন্ত্রীর সাথে সচিবদের সাপ্তাহিক সভাও নিয়মিত ব্যবস্থা করা হয়। প্রতিটি সভাতেই পূর্বের সপ্তাহে অনুষ্ঠিত সভার সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ওপর প্রতিবেদন এবং ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে অনুষ্ঠিত সমন্বয়সভার বিষয়বস্তু আলােচনা করা হয়। নভেম্বরের ১,৮,১৫,২২, ২৯, ও ৩০ তারিখে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এছাড়া বেশ কয়েকটি জরুরি বৈঠক হয় দ্রুত পরিবর্তনশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সামরিক অগ্রগতির বিষয়ে। এর সবগুলির বিবরণ আমি লিপিবদ্ধ করিনি। কোনাে কোনাে বৈঠক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির বাসভবনে অনুষ্ঠিত হয়, কিন্তু স্পর্শকাতর বিষয় বিধায় ঐগুলির সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে রাখিনি।
নভেম্বর ১৫ তারিখে অনুষ্ঠিত সভার তিনটি বিষয় ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আমাদের জাতীয় জীবনে সুদূরপ্রসারী ছাপ রেখেছে; ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্যও তা একই রকম তাৎপর্যপূর্ণ। সেটি হল আমাদের জাতীয় পতাকার সঠিক রং, আকার ও আকৃতি সংক্রান্ত। শ্রদ্ধেয় শিল্পী কামরুল হাসানকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তার প্রস্তাবটি মন্ত্রিসভা গ্রহণ করে। তখনও অমাদের পতাকার মাঝে বাংলাদেশের মানচিত্র শােভা পেত। (বঙ্গবন্ধু স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের কিছুদিন পর পতাকা আরও সহজভাবে আঁকা ও রক্ষণাবেক্ষণের সুবিধার জন্য মানচিত্রটি বাদ দেওয়া হয়। সেই সাথে জাতীয় সংগীত বিধিমালার সাথে সংগতি রেখে জাতীয় পতাকা-বিধি প্রণয়ন করা হয় পতাকার সঠিক রং, আকৃতি ও আকার বর্ণনা করে। জাতীয় সংগীত ও পকাকাকে সম্মান দেখানাের জন্য বিস্তারিত বিধি জারি করা হয়। আমাদের সৌভাগ্যই বলতে হবে যে, জাতীয় পরিচিতির এই দুই বিশেষ প্রতীক এখনও অক্ষত আছে। দুঃখ এবং ক্ষোভ হলাে এই যে, স্বাধীনতা-বিরােধী ব্যক্তিরা আজকাল এগুলাে ব্যবহার করছে যত্রতত্র।
১৫ নভেম্বর সভায় বাংলাদেশের নাগরিকদের বিদেশভ্রমণে পরিচিতিপত্র দেওয়ার জন্য (তখনও আমাদের পাসপাের্ট হয়নি) ফি আদায়ের প্রস্তাব করা হয়। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর স্বল্পকালীন সময়ের জন্য ত্রৈমাসিক আয়-ব্যয় (বাজেট) পেশ ও অনুমােদন। ১৮ নভেম্বর তারিখে প্রাপ্ত সংবাদের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর অনুমােদনক্রমে পাকিস্তান-সরকারের ছাপানাে রুপি নােট যেগুলাে মুদ্রামূল্যরহিত (demonetized) করা হয়েছে সেগুলাে ছেড়ে দেওয়ার বিষয়ে আমি একটি নােট পাঠাই অর্থসচিবকে। দ্বিতীয়ত, যে-সকল নােটের মুদ্রামূল্য তখনও বহাল ছিল সেগুলাে চলতি সরকারি হারে আমরা বাজারে ছাড়ব, এরকম সিদ্ধান্ত হয়।
নভেম্বর ১৯ তারিখে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের কর্মকর্তা শ্রী ডি.কে, ভট্টাচার্য, কোলকাতায় আসেন আলােচনার জন্য। আমার সাথে বৈঠক হয় ঐদিন। আমাদের দিক থেকে যে যে বিষয়ে গুরুত্ব আরােপ করা হয় তা হলাে:
ক. আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি পুনরুদ্ধার;
খ. নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের সরবরাহ;
গ. বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের পুনর্বাসন;
ঘ. স্বাস্থ্য এবং মহামারী নিরােধক ব্যবস্থা এবং সামরিক-বেসামরিক যােগাযােগ।
অন্যান্য বিষয়
বেতার
আমাদের কর্তৃত্বাধীনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একজন বিশেষজ্ঞ নিয়ােগ।
রেলওয়ে
আমাদের পক্ষে পরিকল্পনা কমিশনে নিয়ােজিত প্রকৌশল উপদেষ্টা (জনাব এ. গফুর, পূর্ব রেলের প্রধান প্রকৌশলী) রেল-সংযােগ পুনঃস্থাপনের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়নে ব্যস্ত। তাকে সহায়তা করার জন্য রেলওয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা প্রয়ােজন। রেলের ম্যাপও চেয়েছেন তিনি।
বিদ্যুৎ ও সেচ-ব্যবস্থা
এই ক্ষেত্রেও কয়েকজন উপদেষ্টা প্রয়ােজন।
পরিকল্পনা
কমিশনের জন্য দাপ্তরিক স্থান সঙ্কুলান, বই-পত্র, অফিস-সরঞ্জাম, আসবাবপত্র ইত্যাদির ব্যবস্থা।
মুদ্রা
ভারত-সরকারের সাহায্যে আমাদের কাছে গচ্ছিত পাকিস্তানি নােট পরিবর্তনের ব্যবস্থা।
নভেম্বর ২২ তারিখের বৈঠকের আলােচ্য বিষয় ছিল অক্টোবর ১৯৭১ থেকে মার্চ ১৯৭২ পর্যন্ত সময়ের জন্য ষান্মাসিক বাজেট অনুমােদন। কিন্তু বিবিধ বিষয়ে আলােচনাকালে মুক্ত বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠার বিষয়টি বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। স্বাধীন বাংলাদেশে পরবর্তীকালে এই বিষয়টির সুদূরপ্রবাসী প্রভাবের কথা মনে রেখে মূল আলােচনা এখানে তুলে দিলাম:
ক. খণ্ডকালীন কোনাে সমাধান দিয়ে এই সমস্যার সমাধান হবে না। বেসামরিক প্রশাসন সামগ্রিকভাবে আমাদের বিবেচনায় নিতে হবে।
খ. আইন-শৃঙ্খলা, পুনর্বাসন, খাদ্য ও নিত্যপ্রয়ােজনীয় সামগ্রী সরবরাহ, বাসস্থান, অতি জরুরি সেবা (যেমন, চিকিৎসা ও ওষুধ সরবরাহ) এইসব সমস্যা এমন প্রকটহবে যা অকল্পনীয়।
গ. কোনাে পরিকল্পনা প্রণয়নের পূর্বে আমাদের অবশ্যই সমস্ত তথ্য জানতে হবে।
ঘ. যেসব সচিব বেসামরিক প্রশাসনে দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসম্পন্ন, তাদের দ্বারা মন্ত্রিপরিষদ প্রদত্ত নীতিমালা অনুসারে একটি কার্যপত্র প্রস্তুত করানাে যেতে পারে।
ঙ. আইন-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে প্রথমেই যে-সমস্যাটি দেখা দেবে তা হলাে শত্রুর সহযােগী দালালদের (collaborators) যাচাই-বাছাই করা। কেউ কেউ মত প্রকাশ করেন যে, এ-ধরনের অনেকেই শত্রুর ভয়ে আতঙ্কিত হয়ে তাদের সহযােগিতা করেছে। জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের তথ্য অনুযায়ী অধিকাংশ সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী যারা দেশের অভ্যন্তরে কাজ করছিলেন তাঁরা মনেপ্রাণে দেশপ্রেমিক।
চ. বিরাট আকারে সরকারি কর্মচারীদের বাছাই করে বাদ দিলে প্রশাসনে শূন্যতা দেখা দেবে। তার ওপর আমাদের সামাজিক অবস্থান বিবেচনা করে এ-কথা নিঃসন্দেহে বলা চলে যে রাজনীতিবিদরা এ-ব্যাপারে সরকারের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করবে। (পরবর্তীকালে বাস্তবে এ রকমটাই ঘটেছে।)
ছ, রাজনৈতিক কর্মিবৃন্দ প্রশাসনে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণ করতে পারেন।
জ. সমস্যা যত বড়ই হােক-না কেন, দেশকে গড়তে হলে আমাদের বিপ্লবকে সফলতার পথে নিয়ে যেতেই হবে।
দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর কয়েকজন সচিবকে নিয়ে একটি সাব-কমিটি গঠন করা হয়: মন্ত্রিপরিষদ সচিব, অর্থ সচিব, প্রতিরক্ষা সচিব, সাধারণ প্রশাসন সচিব, স্বরাষ্ট্র সচিবএদের সমন্বয়ে। সভাপতি জনাব ফতেহ। যত দ্রুত সম্ভব রিপাের্ট দাখিল করতে হবে।
শিলং, আগরতলা এবং তুরাগে যুদ্ধ প্রতিবেদন (রণাঙ্গন সাংবাদিক) নিয়ােগ বিষয় ২৭ নভেম্বর ১৯৭১ মন্ত্রিপরিষদ-সচিব (লেখক)-স্বাক্ষরিত প্রজ্ঞাপনে অপরপক্ষ ছবি (Photo) সংযুক্ত পরিচয়পত্র বহন করতে হবে।
ক. যুদ্ধ প্রতিবেদক (রণাঙ্গন সাংবাদিক)-দের অবশ্যই প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের অথবা তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের প্রদত্ত নিজ নিজ পরিচিত-চিত্র পরিচয়পত্র ছবি (ফোটো সংযুক্ত) বহন করতে হবে।
খ. আসাম ও মেঘালয় রাজ্যে অবাধ চলাচল সুবিধা ও দ্রুত যুদ্ধ-প্রতিবেদন প্রেরণের প্রয়ােজনে শিলং-এর পুলিশের (গােয়েন্দা) পরিদর্শকের সঙ্গে যােগাযােগ করার পরামর্শ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় স্থানীয় পুলিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যােগাযােগের সহজ সুবিধার জন্য আসাম-সরকারের টেলিপ্রিন্টার বার্তা নং পি.এল.বি ৩৫৯/৭১-এর সূত্রে যুদ্ধ প্রতিবেদকদের পরিচিতিপত্র প্রেরণ করা হয়।
ইউ.ও. নম্বর- ৩৯৬(২)/ক্যাব তারিখ ২৭.১১.৭১-পত্রটির অনুলিপি প্রতিরক্ষা সচিব ও তথ্য ও বেতার সচিবের দপ্তরে প্রেরণ করা হয়।
২৯ নভেম্বরের সভা মুলতবি করে ৩০ তারিখে অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রধান আলােচ্য বিষয় ছিল: নভেম্বর মাসে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কার্যাবলি। এছাড়া বাংলাদেশ সরকারের দপ্তরসমূহ ও উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিরাপত্তা সম্পর্কে ব্যবস্থা নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। মুক্তাঞ্চলে বেসামরিক প্রশাসন-ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। ৩০ তারিখের বৈঠকে পূর্বে আলােচিত এবং গৃহীত ষান্মাষিক বাজেটের (অক্টোবর ৭১-মার্চ ৭২) ব্যয়-বরাদ্দ অনুমােদন করা হয়।
নভেম্বর মাসের শেষদিকে দুইটি গুরুত্বপূর্ণ সমীক্ষা পরিচালনার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে সরকার। প্রথমটি সামরিক দায়িত্ব থেকে অব্যাহতিপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ও বিস্তারিত তথ্য-সংক্রান্ত। দ্বিতীয়টি নির্যাতিত মহিলাদের তথ্য সংগ্রহের জন্য। পরিকল্পনা বাের্ডকে এই দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধের শেষপ্রান্তে পৌছে আমার ব্যক্তিগত নােটবইতে আরও কিছু তথ্য লিপিবদ্ধ করেছিলাম, যা নিচে উল্লেখ করলাম:
৪/১১/১৯৭১
১. আমীর-উল-ইসলাম এ.জি.র (অরুন্ধতি ঘােষ) সাথে যােগাযােগ করেন Ian Martin-এর সাক্ষাৎকার স্থির করবেন।
২. তথ্যসচিব আনােয়ারুল হক খান ভারতীয় বিদেশমন্ত্রকের যুগ্ম-সচিব এ. কে. রায়.-এর মাধ্যমে যােগাযােগ করবেন প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের যুগ্ম-সচিব ডি.কে. ভট্টাচার্যের সাথে।
৩.মন্ত্রিসভা বৈঠকের জন্য: পরিকল্পনার ওপর নােট।
৪. স্বাস্থ্য-সচিবকে স্বাস্থ্য-সচিবকে সচিব কমিটির বৈঠকে আহ্বান।
৫. পরিকল্পনা বাের্ডের সাথে আলােচনা।
৬. পরিবহণের ওপর নােট: ক. এ.কে. রায়- কে (ভারতীয় বিদেশ মন্ত্রক) প্রয়ােজন জানাতে হবে। খ. নিরাপত্তা বিষয়েও। গ. মনােরঞ্জন বাবুর লেখা নােট। ঘ. প্রশাসনিক ব্যবস্থা। ঙ. Ian Martin-এর দিল্লি যাত্রা।
এছাড়া মন্ত্রিসভার সভায় যেসব সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তা বিস্তারিতভাবে লেখার জন্য আমি টুকে রাখতাম। সেই নিদর্শন আমার লেখা নােট থেকে এখানে উদ্ধৃত করা হলাে। ঘটনাবহুল দিনগুলিতে কীভাবে কাজ করতাম, এতদিন পর সেসব কাগজপত্র ও লেখা দেখে আমি নিজেই আবেগাপ্লুত হই।
৮/১১/৭১
মন্ত্রিসভা বৈঠক
প্রতিরক্ষা-উলের বস্ত্র
সকল আঞ্চলিক প্রশাসনকে নির্দেশ: এম.এন.এ./এম.পি.-দের শীতবস্ত্র ক্রয়কল্পে ৪০০/-রুপি ভাতা: ১০টি কিস্তিতে কর্তন।
lan Martin প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎকার ৯/১১/৭১ বিকেল ৩.৩০ মিনিটে। আমীর-উল-ইসলাম থাকবেন।
মন্ত্রিসভার সভায় বসে উপরে লিখিত কায়দায় নােট করতাম। কিন্তু পরে সিদ্ধান্ত (minutes) লিখতাম।
১৯/১১/৭১
কাশ্মিরী নেতৃবৃন্দ কর্তৃক আমাদের ক্যাম্প পরিদর্শন।
অন্যান্য বিষয়: যানবাহন; টেলিফোন অস্ত্র ব্যক্তিগত অস্ত্রের লাইসেন্স; নিরাপত্তা।
২২/১১/৭১
মন্ত্রিসভা বৈঠক
উপরে উল্লেখ করেছি।
একইভাবে উপরের তারিখগুলােতেও নােট লিখেছিলাম। পরে এসব নােট থেকে সিদ্ধান্ত লেখা হয়। এসব সিদ্ধান্তের কথা মন্ত্রিপরিষদ ও সাধারণ প্রশাসন বিভাগশীর্ষক অধ্যায়ে বলা হয়েছে। জাতীয় জীবনে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাস ছিল ‘৭১ সালের ডিসেম্বর মাস। এ মাসে আমার কাজকর্ম ছিল অভূতপূর্ব উন্মাদনা। কীভাবে, কিসের প্রেরণায় বিজয়ের প্রাক্কালে কাজ করেছি, এখন স্মৃতি হাতড়িয়ে তা পেতে বেশ কষ্টকর মনে হচ্ছে।
ডিসেম্বর,১৯৭১: বিজয়ের মাস
ডিসেম্বরের প্রথম তারিখে আমার প্রধান কাজ হল সচিবদের কমিটিকে তাদের কাজ শেষ করে দ্রুত বিভিন্ন বিষয়ের উপর প্রতিবেদন পেশ করার তাগিদ দেওয়া। বিষয়গুলি সবই
পৃষ্ঠা: ২৬৫
বিজয়ােত্তর বাংলাদেশের প্রশাসনের জন্য। বিজয় আমাদের নিশ্চিত এবং অতি সন্নিকট। স্বাধীন, সার্বভৌম বাংলার মাটিতে আমাদের বিপ্লবী সরকারের প্রশাসন চালু করে সমস্ত দায়িত্ব সুষ্ঠু ও সুচারুরূপে সম্পন্ন করাই আমাদের লক্ষ্য।
সচিবদের কমিটি মােট ১০টি বিষয়ে প্রতিবেদন পেশ করার জন্য নিজেদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করেছিলেন:
১. রাজনৈতিক শৃঙ্খলা ও ব্যবস্থাপনা: জনাব এ.এফ.এম. ফতেহ্ (সভাপতি)।
২. পুলিশ প্রশাসন পুনঃস্থাপন: স্বরাষ্ট্র সচিব।
৩. শত্রু-সম্পত্তি ব্যবস্থাপনা এবং বাস্তুচ্যুত ব্যক্তিদের সম্পত্তি পুনরুদ্ধারকল্পে আইন প্রণয়ন: জনাব আকবর আলী খান।
৪. সেনাবাহিনীর বেসামরিক গণসংযােগ, গণবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের অন্তর্ভুক্তি: প্রতিরক্ষা-সচিব।
৫. দালালদের প্রতি আচরণ এবং বেসামরিক কর্মকর্তাদের যাচাই-বাছাই: মন্ত্রিপরিষদ ও প্রতিরক্ষা-সচিব।
৬. পাবলিক সার্ভিস কমিশন, নিয়ােগ, বদলি, ইত্যাদি (সরকারি কর্মকর্তাদের জন্য): সচিব, সাধারণ প্রশাসন।
৭. বাস্তুচ্যুত ও ছিন্নমূল ব্যক্তিদের জন্য ত্রাণব্যবস্থা ও পুনর্বাসন: ড. মুশাররফ হােসেন, সদস্য, পরিকল্পনা বাের্ড।
৮. অর্থনৈতিক পুনর্গঠন এবং সংশ্লিষ্ট বিষয়াবলি: ড. মুশাররফ হােসেন, সদস্য, পরিকল্পনা বাের্ড।
৯. আয় ও আমদানি: অর্থ সচিব
১০. বেসামরিক প্রশাসন সংগঠন: অর্থ-সচিব।
সচিব-কমিটির এতদসংক্রান্ত বৈঠকে ও আলােচনায় অন্যান্য সচিবদের (যেমন কৃষি, স্বাস্থ্য, তথ্য) আমন্ত্রণ জানানাে হয়। বিশেষ আমন্ত্রণে আরও উপস্থিত থাকেন সামরিক বাহিনীর ডেপুটি চিফ-অব-স্টাফ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ.কে.খন্দকার।
২ ডিসেম্বর আমার কাছে এই মর্মে একটি বার্তা পৌছে যে, সিলেট এবং ময়মনসিংহ জেলার মুক্ত-অঞ্চলে পাকা ধান কাটার অপেক্ষায় আছে। কোনাে কোনাে ব্যবসায়ী এই ধান। অল্পদামে ক্রয় করে সীমান্তের ওপারে ভারতে চালান করছে। বিনিময়ে লবণ, কেরােসিন তেল ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে চড়া দামে বিক্রি করছে। সংবাদটি পেয়েই আমি অর্থ ও বাণিজ্য সচিবকে ব্যবস্থা নিতে অনুরােধ করি।
ডিসেম্বরের ৩ তারিখে আমরা খবর পেলাম যে, মিসেস গান্ধী কোলকাতায় আসছেন এবং ঐদিন বিকেলে ময়দানে জনসমাবেশে ভাষণ দেবেন। তিনি শুধুমাত্র জনসভায় ভাষণ দিতে কোলকাতায় আসছেন, এরকম মনে করার কোনাে কারণ ছিল না। তিনি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠকে মিলিত হবেন, এরকম মনে করাটা খুবই যুক্তিসঙ্গত ছিল।
এখন সব পথ পরিষ্কার। মিসেস গান্ধী জনসভায় বলে দিয়েছেন যে, ভারত আর চুপ করে দর্শকের ভূমিকায় বসে থাকতে পারে না। রাতেই খবর এল যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী আন্তর্জাতিক যুদ্ধ-বিরতি সীমানা (Line of Control) লংঘন করে কাশ্মীরের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়েছে।
পরদিন সকালে (৪ ডিসেম্বর) পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করল। বাংলাদেশ ও ভারত যৌথ-কমান্ড গঠন করল। সম্মিলিত বাহিনীর নামকরণ হল মিত্রবাহিনী। নিরাপত্তা পরিষদে পাক-ভারত যুদ্ধ-বিরতি প্রস্তাবে সােভিয়েত ইউনিয়ন ভেটো প্রদান করল। ভারত ও বাংলাদেশের দক্ষিণপন্থীদের মুখ বন্ধ হলাে (যারা এতদিন বাংলাদেশের সর্বদলীয় ঐকমত্যের এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের সাথে ভারতের সখ্যের বিরােধিতা করে আসছিল)।
আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতির অনুরােধ জানিয়ে ৪ ডিসেম্বর আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে একটি বিশেষ চিঠি পাঠালেন (পরিশিষ্ট ১২৩ দ্রষ্টব্য)। প্রত্যুত্তরে প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে তার চিঠিতে সেই সুসংবাদটি সম্পর্কে অবহিত করেন, যে-সংবাদের জন্য আমরা গভীর আগ্রহ আর উৎকণ্ঠার সাথে এতদিন অপেক্ষা করছিলাম। ভারত-সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দিয়েছে। সেদিন আমাদের কী আনন্দ! সংবাদটি আমরা আগেই পেয়েছি। মিসেস গান্ধীর চিঠির বার্তা আনুষ্ঠানিক। প্রধানমন্ত্রী এটি গ্রহণ করেন ৭/১২/৭১ অপরাহ্নে ৩টা ২৫ মিনিটে। মিসেস গান্ধীর চিঠি ছিল এক কথায় অপূর্ব (পরিশিষ্ট ১২৪ দ্রষ্টব্য)।
৬ ডিসেম্বর সকালে আমরা কয়েকজন সচিব ও কর্মকর্তা ভারতীয় উচ্চপর্যায়ের সফরকারী দলের সাথে বৈঠকে মিলিত হই। ভারতীয় দলে ছিলেন প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়, মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, পরিকল্পনা কমিশন, অর্থ এবং ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা। বৈঠক চলার সময়েই লক্ষ্য করলাম চারিদিকে একটা চাঞ্চল্য। পাশের ঘরে রেডিও শােনা যাচ্ছে। গভীর আগ্রহের সাথে ভারতীয় কয়েকজন কর্মকর্তা রেডিও শুনছেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী পার্লামেন্টে ভাষণ দিচ্ছেন।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস গান্ধীর দৃঢ় এবং সুস্পষ্ট কণ্ঠ ভেসে এল। ভারত-সরকার বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। ভারতীয় পার্লামেন্টে তুমুল হর্ষধ্বনি আর করতালি দিয়ে সকলে সংবাদটিকে স্বাগত জানালেন।
এদিকে আমাদের বৈঠকের উপস্থিত ভারতীয় কর্মকর্তারা একযােগে উঠে দাঁড়িয়ে আমাকে উদ্দেশ্য করে বললেন: Congratulations! Excellency! Now we can address you properly. [এখন থেকে আপনাকে আমরা যথাযােগ্য সম্মানের সাথে একসেলেন্সিবলতে পারব।
৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪টায় অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি অফিসকক্ষে মন্ত্রিসভার জরুরি বৈঠক আহ্বান করা হলাে কয়েক ঘণ্টার নােটিশে। আলােচ্য বিষয়: ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ এবং রণক্ষেত্রে অগ্রগতি।
ডিসেম্বর ৮ তারিখে সচিব-কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সভা অনুষ্ঠিত হলাে। বিষয়: স্বাধীন বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা। এতে বিশেষ কয়েকটি বিষয় সংশ্লিষ্ট ছিল বিধায় সচিবরা নিজেদের মধ্যে কার্যপত্র প্রস্তুতের দায়িত্ব বণ্টন করে নিয়েছিলেন।
বেসামরিক প্রশাসন কীভাবে পুনর্বাসন করা যায়, প্রয়ােজনীয় রদবদল করে পুনর্গঠন করা সম্ভব কি না, বিপ্লবী সরকারের নীতি এবং কর্মসূচির সাথে তাল মিলিয়ে যুগােপযােগী করে গড়ে তােলা যায় কিনা-এ-সমস্ত চিন্তাভাবনা আমরা অক্টোবর-নভেম্বর মাসেই করতে থাকি। মন্ত্রিসভা আমাদের মতামত জানতে চান এবং প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত এ.এফ.এম. ফাতেহ সাহেবকে সভাপতি করে সচিব-কমিটি গঠন করেন।
দায়িত্বপ্রাপ্ত সচিবগণ তাদের কার্যপত্রগুলাে দাখিল করার পর ৮ ডিসেম্বর জনাব আবুল ফতেহর অফিসে (বাংলাদেশ মিশণে অবস্থিত) সমন্বয়কারী হিসেবে আমি সভা আহ্বান করি। আমরা ৬ জন সচিব উপস্থিত ছিলাম।
বিষয় ১: বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা
বিষয় ২: পাকিস্তানি দালালদের বিচার/সরকারি কর্মচারীদের বাছাই পদ্ধতি
আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতি, অপরাধীদের বিচার, বিচারপদ্ধতি, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা, সরকারি কাজকর্মের প্রয়ােজন, রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিচার-বিবেচনা, দেশ পুনর্গঠন, বিপ্লবী সরকারের বিভিন্ন প্রতিশ্রুতি এবং ঘােষিত নীতিমালা-এই সমস্ত বিষয় উল্লেখ করা হয়েছিল আমাদের কার্যপত্রে। আমি অবাক হচ্ছি-আজ থেকে ৩২/৩৩ বছর আগে, আমরা যখন সকলেই প্রায় (দুয়েক জন ছাড়া) ত্রিশের কোঠায়, কেমন করে শত ব্যস্ততার মধ্যে এত চুলচেরা বিশ্লেষণ করে একটা স্বাধীন সরকারের আইনানুগ কাঠামাে তৈরি করে দিয়েছি!
সমস্যার বিভিন্ন দিক পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে বিশ্লেষণ করে আমি যে আইনের খসড়া করেছিলাম তাতে নিচের বিষয়গুলি ছিল:
ক. আইনের পরিধি; খ. সংজ্ঞা; গ. বিচারপদ্ধতি; ঘ. ট্রাইবুনাল; ঙ. শাস্তি; চ. প্রদত্ত শাস্তি সরকার কর্তৃক অনুমােদন; বিশেষ ক্ষেত্রে সুপ্রিমকোর্ট; ছ. দালালদের (collaborators) তালিকা প্রণয়ন (সংজ্ঞা অনুসরণ করে); জ. এই বিষয়ে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রীর ঘােষণা (বিশেষ করে আইনানুগ ব্যবস্থা সম্পর্কে); ঝ. আইন প্রণয়নের জন্য বিশেষজ্ঞ কমিটি নিয়ােগ।
এই বিষয়টি সচিব-কমিটিতে আলােচনার পর প্রয়ােজনীয় সংশােধনসহ মন্ত্রিসভায় পেশ করা হয়।
পাকিস্তান সরকারের সাথে সহযােগিতা করেছেন এমন কর্মচারীদের বাছাই
এই বিষয়েও আরেকটি কার্যপত্র তৈরি করা হয় সচিব-কমিটির পর্যালােচনার জন্য।
বর্ণিত পরিস্থিতির আলােকে বেশ কয়েকটি বাছাই-কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়, যেমন কমিটি এ, বি, সি, ডিও ই। অভিযুক্তদের বেতনের স্তর বিবেচনায় নিয়ে পাঁচটি কমিটি গঠন করা হয়। গঠনও ছিল উচ্চপর্যায়ের: কমিটি এ-র জন্য হাইকোর্ট সুপ্রিমকোর্ট জজ; বিএর জন্য জেলা জজ, সিও ডি-এর জন্য সাব-জজ এবং ই-এর জন্য মুন্সিফ।
বেসরকারি প্রশাসন সম্পর্কিত অন্যান্য কার্যপত্র মন্ত্রিসভায় বিস্তারিত আলােচনা ও সিদ্ধান্তের জন্য পেশ করা হয়। মন্ত্রিসভা মােটামুটিভাবে সচিব-কমিটির প্রস্তাব গ্রহণ করেন।
১০ তারিখে মন্ত্রিসভার একটি বিশেষ বৈঠকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপস্থাপিত প্রস্তাব, ভারতে বাংলাদেশের হাইকমিশনার নিয়ােগ বিবেচনা করা হলাে। দিল্লিস্থ বাংলাদেশ প্রতিনিধি হুমায়ুন রশিদ চৌধুরীকে ভারতে বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত করা হলাে।
মিত্রবাহিনী একযােগে সব কয়টি রণক্ষেত্রে সম্মুখসমরে অবতীর্ণ হওয়ার সামগ্রিকভাবে পূর্ববাংলার চিত্র বদলাতে শুরু করল। সরাসরি এবং সম্মুখ সমরে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতিরক্ষা বৃহ্যগুলি ভেঙে পড়ছিল। যে মনােবলের (morale) এত বড়াই তাদের, তা বাতাসে উড়ে গেল। একে একে তছনছ হয়ে যেতে লাগল পাকিস্তানের তথাকথিত শক্ত ঘাঁটিগুলি। প্রতিটি জেলাশহরে পতনে সাথে সাথে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সহযােগিতায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পূর্ব-নিযুক্ত জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার এবং কর্মকর্তাবৃন্দ প্রশাসনিক ব্যবস্থা পুনরুদ্ধার করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে সবাইকে জানিয়ে দিলেন তাদের উপস্থিতি এবং কর্তৃত্ব। এই পরিস্থিতিতে মুক্ত-অঞ্চলের জেলা প্রশাসকগণ সরকারের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করে সামগ্রিক পরিস্থিতির এবং প্রয়ােজনীয় সাহায্যের ওপর রিপাের্ট পাঠাতে আরম্ভ করলেন।
যশাের মুক্ত হলাে সকলের আগে। নবনিযুক্ত জেলা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম তার বাংলাে আর জেলা প্রশাসকের দপ্তরে সবুজ আর রক্তলাল রঙের স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা ওড়ালেন। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রিবর্গ আমরা সকলে উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছি কখন আমরা যশাের পরিদর্শন করব। মিত্রবাহিনী দপ্তর থেকে বলা হলাে যে বিচ্ছিন্ন বিভিন্ন পয়েন্টে পাকিস্তানি এবং তাদের দোসর তাঁবেদার দস্যুদের সম্পূর্ণ পরিষ্কার করার পরেই নেতৃবৃন্দের স্থলপথে যাওয়া নিরাপদ হবে। তাছাড়া অনেক জায়গায় শত্রুবাহিনী মাইন পুঁতে রেখেছিল। সেগুলাে নিষ্ক্রিয় করা আবশ্যক।
জেলা প্রশাসক ওয়ালিউল ইসলাম যশাের পৌছেই বার্তা পাঠাতে আরম্ভ করলেন। মূল বিষয়বস্তু: নিত্যপ্রয়ােজনীয় জিনিসের সরবরাহ নিশ্চিতকরণ। চাল, আটা, ডাল, লবণ, খাবার তেল, কেরােসিন এইগুলি ছিল অত্যাবশ্যকীয়। তালিকা পাওয়ার সাথে সাথে আমাদের পূর্বনির্ধারিত চ্যানেলের মাধ্যমে প্রয়ােজনীয় সরবরাহের ব্যবস্থা করা হলাে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন ডিসেম্বরের ১১ তারিখে যশাের গেলেন সরেজমিনে পরিদর্শন করতে। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে সদলবলে প্রধানমন্ত্রীর সফর এই প্রথম। আর আগেও গেছেন মুক্ত-অঞ্চল, কিন্তু নিরাপত্তার স্বার্থে সন্তর্পণে এবং যথেষ্ট ব্যবস্থা নিয়ে। এবারের পরিদর্শন বিজয়ীর বেশে এবং প্রকাশ্যে। ফিরে আসার পর প্রধানমন্ত্রীর অভিব্যক্তি দেখার মতাে! আমরা সকলেই উল্লসিত।
পূর্ব-রণক্ষেত্রেও মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি ঝড়ের মতাে, ঠিক যেমন পশ্চিম-রণক্ষেত্রে। ১০ ডিসেম্বর দক্ষিণ-পূর্ব-২ অঞ্চলের আঞ্চলিক প্রশাসক কাজী রকিবউদ্দীন আহমেদ জরুরি বার্তা পাঠালেন। তার সারমর্ম হলাে: বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত। অধিকাংশ ক্ষেত্রে সরকারি কর্মকর্তারা বহাল তবিয়তে আছেন এবং তারা বাংলাদেশের প্রতি অনুগত। প্রয়ােজনীয় নির্দেশ পেলে এদের কাজে যােগদান করতে দেওয়া যায়। ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সাথে কী বন্দোবস্ত হয়েছে জানালে সংগ্রহ করতে পারি। অনেক স্থানে শত্রুরা পালানাের আগে ব্যাংক থেকে টাকাপয়সা লুট করে নিয়ে গেছে। জরুরি ভিত্তিতে ৬ লক্ষ রুপি পাঠানাে হােক।
কাজী রকিব বার্তা পাঠিয়েছিলেন কুমিল্লা অঞ্চল থেকে। এর পরপরই তিনি আমার নির্দেশে পূর্বনির্ধারিত ছক অনুযায়ী কুমিল্লার জেলা প্রশাসকের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ডিসেম্বর মাসের সব ঘটনাই আমাদের জন্য এক-একটি ঐতিহাসিক মাইলফলক। পাঠককে একবার প্রাসঙ্গিক তথ্য এবং ঘটনাপঞ্জিতে চোখ বুলিয়ে নিতে অনুরােধ করি।
কতিপয় প্রাসঙ্গিক তথ্য-ঘটনাপঞ্জি
ডিসেম্বর ৩: বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কোলকাতার ময়দানে বক্তৃতা। ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ আই.এন.এস. রাজপুতকর্তৃক পাকিস্তানি ডুবােজাহাজ পি.এন.এস. গাজীধ্বংস।
ডিসেম্বর ৪: আনুষ্ঠানিকভাবে ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ-ঘােষণা। বাংলাদেশ ও ভারতীয় বাহিনীর সমন্বয়ে যৌথ-কমান্ড গঠন ও মিত্রবাহিনীনাম গ্রহণ। নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতি-প্রস্তাবে রাশিয়ার ভেটো প্রদান। ভারতীয় নৌবাহিনীর হামলায় পাকিস্তানি ডেস্ট্রয়ার ‘খাইবার’ ও ‘শাহজাহান’ করাচির অদূরে ধ্বংস।
ডিসেম্বর ৬: (ক) ভারতের পার্লামেন্টে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কর্তৃক গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের ঘােষণা। ভারত-পাকিস্তান কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন।
(খ) ঢাকা বিমানবন্দর অকেজো হওয়ায় পাকিস্তান বিমানবাহিনীর পাইলটগণের তৃতীয় দেশের সাহায্যে পূর্ব-পাকিস্তান ত্যাগ।
ডিসেম্বর ৭: যশাের বিমানবন্দরের পতন। মিত্র বাহিনীর একযােগে যশাের শহরে প্রবেশ ও পাকিস্তানি বাহিনীর পলায়ন।
ডিসেম্বর ৮: বিভিন্ন সেক্টরে প্রচণ্ড যুদ্ধ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রীর যশােরে অবস্থান, ভারতের চিফ-অব-স্টাফ জেনারেল মানেক-শ কর্তৃক পূর্ববাংলায় পাকিস্তানি সৈন্যদের আত্মসমর্পণের আহ্বান। জাতির উদ্দেশে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দিলেন।
ডিসেম্বর ৯: চাদপুর ও দাউকান্দিকে মুক্ত-এলাকা ঘােষণা। পূর্ব-রণাঙ্গনে ভয়াবহ লড়াই।
ডিসেম্বর ১০: যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ।
ডিসেম্বর ১১: (ক) পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী কর্তৃক জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টের কাছে আত্মসমর্পণের জন্যে তারবার্তা প্রেরণ। ইয়াহিয়া খান কর্তৃক এই সংবাদের অস্বীকৃতি জ্ঞাপন এবং জাতিসংঘে অবস্থানকারী প্রতিনিধিদলের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো কর্তৃক এই আবেদনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ।
(খ) বগুড়া ও ময়মনসিংহ এলাকা মুক্ত ঘােষণা।
(গ) ঢাকার অদূরে ভারতীয় কমান্ডাে বাহিনীর প্যারাস্যুটের মাধ্যমে অবতরণ। রাজশাহী, জামালপুর ও সিরাজগঞ্জ মুক্ত ঘােষণা।
(ঘ) মার্কিন সপ্তম নৌ-বহরের ভারত মহাসাগরে প্রবেশের গুজব প্রচার।
ডিসেম্বর ১৩: মিত্রবাহিনী কর্তৃক পূর্ব-পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকা চতুর্দিক দিয়ে অবরুদ্ধ। আত্মসমর্পণ বাঞ্ছনীয় হবে- এই মর্মে জেনারেল মানেকশ কর্তৃক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর কাছে বার্তা প্রেরণ।
ডিসেম্বর ১৪: ঢাকার গভর্নর ডা.আবদুল মালিক-সহ উচ্চপদস্থ বেসামরিক কর্মচারীদের পদত্যাগ ও হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থিত আন্তর্জাতিক রেডক্রসের কাছে নিরাপত্তা দাবি। পাকিস্তান বাহিনীর ৯৩ ইনফেন্ট্রি ব্রিগেড কমান্ডার ব্রিগেডিয়ার কাদেরের ঢাকার অদূরে আত্মসমর্পণ।
পৃষ্ঠা: ২৭০
ডিসেম্বর ১৫: হানাদার বাহিনী প্রধান লে. জে. নিয়াজী কর্তৃক জেনারেল মানেকশ-এর নিকট আত্মসমর্পণের স্বীকৃতি জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ এবং জেনারেল মানেক-শ কর্তৃক ১৬ ডিসেম্বর আত্মসমর্পণের সময় নির্ধারণ।
ডিসেম্বর ১৬: বিকেল ৪.৩১ মিনিটে মিত্রবাহিনীর কাছে লে. জেনারেল নিয়াজির আনুষ্ঠানিক আত্মসমর্পণ।
ডিসেম্বর ১৭: প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ভাষণ দিলেন স্বাধীনতার সূর্যোদয়ে।
এই আনন্দ আর গর্বের সাথে মিশে আছে আমাদের একটি বিষাদের দিন, শােকের দিন। চূড়ান্ত বিজয়ের মাত্র ২ দিন আগে দেশের শত্রু, কতিপয় নরপিশাচ জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ঘটায়। ১৪ ডিসেম্বর দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবীরা প্রাণ হারান এই দুবৃত্তদের হাতে। কী করুণ আর মর্মান্তিক সেই হত্যাকাণ্ড!
আমাদের কাজের চাপ অত্যধিক বৃদ্ধি পাওয়ায় এবং প্রতি ঘণ্টায় পট পরিবর্তন আর নতুন নতুন খবর আসতে থাকায় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে আমরা ২৪ ঘণ্টায় কাজ করার জন্য পর্যায়-তালিকা (Duty Roster) করেছিলাম (পরিশিষ্ট ১২৫ দ্রষ্টব্য)।
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহ থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনীর ইস্টার্ন কমান্ডের সাথে আমাদের প্রত্যক্ষ যােগাযােগ স্থাপন করতে হলাে। থিয়েটার রােডের অফিস-প্রাঙ্গণে লম্বা একটি ব্যারাকে যৌথ কমান্ডের শাখা অফিস স্থাপন করা হয়েছিল। এখান থেকে মিত্র বাহিনীর সমস্ত অগ্রযাত্রা পর্যবেক্ষণ করা হতাে। বাংলাদেশ এবং ভারতীয় বাহিনীর কোন্ ইউনিট কোথায় যুদ্ধরত, কোন কোন শহর দখল করছে, ইত্যাদি তথ্য ঘণ্টায় ঘণ্টায় মনিটর করা হতাে। প্রতিরক্ষা-সচিব সামাদ, সচিব নূরুল কাদের ও আমি ঘন ঘন গিয়ে খবর নিতাম। অনেক সময় গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার সাথে থাকতেন। এর মধ্যে প্রতিদিনই আমাদের একবার করে ইস্টার্ন কমান্ডের হেডকোয়ার্টার ফোর্ট উইলিয়ামে যেতে হত। ওখানে বিশেষ স্থাপনাগুলি এবং গােপন অফিস সবই মাটির নিচে; বাইরে থেকে বােঝার উপায় ছিল না। অপরপক্ষে আমাদের যােগাযােগের মূলকেন্দ্র বাঙালি মেজর জেনারেল বি.এন. সরকার, যাকে ঐ সময় বেসরকারি বিষয়দি তদারক কর্মকর্তা (Civil Affairs Liaison Officer) নিয়ােগ করা হয়েছিল, তিনি ছিলেন ইস্টার্ন কমান্ডের কর্ম-বাস্তবায়ন পরিচালক (Director of Operations). অত্যন্ত অমায়িক ছিলেন ভদ্রলােক। বাংলাদেশে ভারতীয় দূতাবাস প্রতিষ্ঠিত হলে জেনারেল সরকার প্রথম ভারতীয় মিলিটারি অ্যাটাশে নিযুক্ত হয়েছিলেন। আমাদের অন্যান্য অফিসাররা যােগাযােগ করতেন কর্নেল মরিস লে. কর্নেল বাত্রা প্রমুখের সঙ্গে। ফোর্ট উইলিয়াম থেকে আমাদের সামরিক পরিচয়পত্র (Military Identity Card) দেওয়া হয়েছিল যাতে আমাদের চলাচলে কোনাে বিঘ্ন সৃষ্টি না হয়। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল মুক্ত হবার সাথে সাথে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির দ্রুত অবনতি সম্পর্কে নানারকম সংবাদ আসতে থাকে। অনেক জায়গাতেই অগ্রসরমান মুক্তিবাহিনীর স্থানীয় সদস্যরা রাজাকার/আলবদরদের নিজেরাই শাস্তি প্রদান শুরু করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে শাস্তি মানেই মৃত্যুদণ্ড। ব্যক্তিগত আক্রোশ এবং প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছিল কেউ কেউ। এটাই আমরা আশঙ্কা করছিলাম এতদিন। এরকম অবস্থা চলতে থাকলে চরম অরাজকতা এবং নৈরাজ্য দেখা দিতে পারে, এই আশঙ্কায় মন্ত্রিসভা ১০ ডিসেম্বর জরুরি। বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্তের বিষয়বস্তু জানিয়ে আমি তাৎক্ষণিকভাবে তথ্যসচিব আনােয়ারুল হক খান সাহেবকে তা ব্যাপক প্রচার করতে অনুরােধ জানাই। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকেও এটি ঘন ঘন প্রচার হতে থাকে।
আমরা ক্রমশই বুঝতে পারছি যে চূড়ান্ত বিজয় ঘনিয়ে আসছে; এখন সময় আর প্রতীক্ষার ব্যাপার। ১৩ অথবা ১৪ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের জন্য এলেন কয়েকজন ভারতীয় উর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও জেনারেল। ঢাকা শহরে পাকিস্তানিদের বিভিন্ন স্থাপনায় ব্যাপক বােমাবর্ষণের পর তাঁরা তৎকালীন গভর্নমেন্ট হাউসে বােমাবর্ষণের অনুমতি চাইলেন। এই শেষ আঘাত হানলে শত্রুপক্ষ একেবারেই হতােদ্যম হয়ে পড়বে।
একটির-পর-একটি শহর আর অঞ্চল মিত্রবাহিনী দ্বারা মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তান বাহিনীর মনােবল বলতে কিছু ছিল না। তাদের শেষ ভরসা মার্কিন-চীন হস্তক্ষেপ। মার্কিন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করায় তারা একটা আশার ক্ষীণ আলাে দেখতে পেল।
১৩ ডিসেম্বর থেকে বেতারে ঘন ঘন প্রচারিত হচ্ছে মিত্রবাহিনীর সর্বাধিনায়ক জেনারেল মানেক-শ-র শত্রুর প্রতি নির্দেশ: সম্মানজনকভাবে আত্মসমর্পণ করাে।
১৬ ডিসেম্বর সকালে খবর এল জেনারেল নিয়াজি ঐদিনই আত্মসমর্পণ করবেন। জেনারেল মানেকশ ১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৪-৩১ মিনিটে আত্মসমপর্ণের দিন-ক্ষণ নির্ধারণ করলেন।
তখন আরম্ভ হলাে আমাদের নানাবিধ প্রস্তুতি। প্রথমটি হলাে; আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে আমাদের পক্ষে কে থাকবেন। মিত্রবাহিনীর যৌথ-কমান্ডে আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী আর জেনারেল অরােরা (ভারতীয় পূর্ব-কমান্ডের প্রধান সেনাপতি) একযােগে কাজ করতেন। কিন্তু কোথায় কর্নেল ওসমানী? তিনি তাে প্রধান কার্যালয়ে নেই। তার সাথে অতি দ্রুত সংযােগ স্থাপন তখন আশু প্রয়ােজন। দ্বিতীয় প্রস্তাবটি হলাে: শক্র আত্মসমর্পণ করলে আমরা কত দ্রুত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থানান্তর করব ঢাকায়। এই স্থানান্তরের বিষয়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রথম প্রশ্ন: নেতৃবৃন্দের নিরাপত্তা। সেটি নিশ্চিত না-করা পর্যন্ত আমরা কোনাে ঝুঁকি নিতে পারি না। অতএব সমরনায়কদের পরে প্রথম ব্যাচে যাবেন সচিববৃন্দ। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিবর্গ ঢাকা থেকে সিগন্যাল পাওয়ার পর যাবেন। অগ্রবর্তী দলে কারা থাকবেন সেটা পূর্বেই নির্ধারিত ছিল। তৃতীয় বিষয়টি একই রকম গুরুত্বপূর্ণ: স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের জন্য অপেক্ষমাণ বিশাল জনতা, যারা বিভিন্ন ক্যাম্পে অবস্থান করছেন। তাদের জন্য যানবাহন, খাদ্যদ্রব্য, অন্যান্য সরবরাহ ইত্যাদি। তার সাথে সাথেই কালবিলম্ব না করে পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠনের কাজ আরম্ভ করা।
ইতিপূর্বে আমি উল্লেখ করেছি কিভাবে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেই আগস্ট মাস থেকে আমাদের পরিকল্পনা বাের্ড ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশনের সহায়তায় ব্যাপক পুনর্গঠনপরিকল্পনা প্রস্তুতে ব্যস্ত ছিল। একই সাথে দেশে কী কী অত্যাবশ্যকীয় জিনিস কত পরিমাণে পাঠানাের ব্যবস্থা করতে হবে তার তালিকা তৈরিও করতে হয়েছে বাের্ড এবং কমিশনকে। বেসামরিক প্রশাসন পুনস্থাপন সংক্রান্ত সচিব-কমিটির সাথেও আমরা আমাদের শ্রদ্ধেয় অধ্যাপকদের সংশ্লিষ্ট করেছিলাম। যাই হােক, এই পরিস্থিতিতে ১৪ ডিসেম্বর ড. সুখময় চক্রবর্তী (ভারতীয় পরিকল্পনা কমিশন সদস্য) কোলকাতা এলেন আমাদের প্ল্যানিং বাের্ডের সাথে বসে সরবরাহ ব্যবস্থা, শরণার্থী ও বাস্তুহারা মানুষের প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন এবং পুনর্গঠনের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করার জন্য।
ইতােমধ্যে আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটি জেলায় আমাদের নিজস্ব ডেপুটি কমিশনার এবং পুলিশ সুপার নিয়ােগ করে তাদের নিজ নিজ কর্তব্যস্থলে যােগদানের নির্দেশ দিয়েছি। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পদের জন্যও সম্ভাব্য ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যাতে তারা কয়েক ঘণ্টার নােটিশে কার্যভার গ্রহণ করতে পারেন। এদের মধ্যে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল বেসামরিক বিমান পরিবহণ দপ্তর (Civil Aviation Director)। এই কর্মকর্তা ঢাকা বিমানবন্দরের যাবতীয় বিষয় দেখাশুনা করেন। সমস্ত দামি যন্ত্রপাতি (রাডার ইত্যাদি) তার নিয়ন্ত্রণে। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার সাহেব আমাদের আগেই সতর্ক করে দিয়েছেন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা বিমানবন্দর স্থাপনা সম্পর্কে। আমাদের হাতের কাছেই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি উইং কমান্ডার মির্জা (অব.) উপস্থিত ছিলেন। বিগত ৮ মাস দক্ষতার সাথে তিনি যুবশিবির দপ্তর পরিচালনা করেছেন। আমাদের অগ্রবর্তী প্রথম দলে অবশ্যই উইং কমাণ্ডার মির্জা যাবেন। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকায় পৌঁছেই বিমানবন্দরের দায়িত্ব নিয়ে সমস্ত জাতীয় সম্পদের রক্ষণাবেক্ষণের কাজটি তিনি সুচারুরূপে সম্পন্ন করেছিলেন। মির্জা তাৎক্ষণিকভাবে একটি জরুরি বার্তায় খন্দকার সাহেবকে জানান যে ঢাকা বিমানবন্দরে বিমানবাহিনীর প্রচুর সরঞ্জাম তখনও অরক্ষিত আছে। গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার ১৭ তারিখে কোলকাতায় ফিরে এসে মির্জার বার্তা পেয়ে ১৯ ডিসেম্বর আবার ঢাকায় যান এবং বিমানবাহিনীর মূল্যবান সরঞ্জাম রক্ষা করেন।
উইং কমান্ডার মির্জার সাথে আমাদের অগ্রবর্তী দলে আর যে দুজন বিশিষ্ট ব্যক্তি অন্ত র্ভুক্ত হয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন স্বাধীন বাংলা বেতারের ভাষ্যকার ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক, সাংবাদিক ও শিশুসাহিত্যিক (বর্তমানে সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট এবং ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির একনিষ্ঠ কর্মী, স্বাধীন বাংলার জন্য নিবেদিতপ্রাণ) ফয়েজ আহমেদ এবং চরমপত্র’ খ্যাত ও সরকারের প্রধান তথ্য কর্মকর্তা এম.আর. আখতার মুকুল। (পরিশিষ্ট ১২৬ এবং ১২৭ দ্রষ্টব্য)।
বিজয় দিবস: ডিসেম্বর ১৬, ১৯৭১
স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর আমি এবং আমার সহকর্মীরা প্রায়ই একটি প্রশ্নের সম্মুখীন হতাম। সেটি কর্নেল ওসমানী প্রসঙ্গে। উনি কেন নিয়াজীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন না। সাথে সাথেই আরেকটি প্রশ্ন উত্থাপিত হতাে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার সম্পর্কে: উনি কেন প্রথম সারিতে চেয়ারে বসলেন না। বেশ যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন এবং সেই সাথে স্পর্শকাতর। অনেকেই ধরে নিয়েছেন, বিষয়টি ভারতীয়রা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছিলেন। আমি এই প্রশ্নের উত্তর অনেকের কাছে খুঁজেছি। সবচাইতে গ্রহণযােগ্য মনে হয়েছে গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকারের (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল) মুখের ভাষ্য। (খন্দকার সাহেব স্বাধীন বাংলাদেশ এয়ারফোর্সের প্রথম চিফ অব স্টাফ এবং এর স্থপতিও। পরবর্তীকালে অস্ট্রেলিয়া ও ভারতে বাংলাদেশের হাই কমিশনার এবং বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা মন্ত্রী।) আমি ভারতীয় মেজর জেনারেল বি.এন. সরকারের মুখে তাঁদের কথাও শুনেছি।
খন্দকার সাহেবের ভাষ্য
ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহে, বিশেষ করে ৩ ডিসেম্বর ভারত তথা মিত্রবাহিনী প্রত্যক্ষ যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার সাথে সাথে যুদ্ধক্ষেত্র অত্যন্ত দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছিল। আজ যেখানে যুদ্ধ হচ্ছে, কাল সেটা মুক্ত হয়ে নতুন আরেকটা ফ্রন্ট খুলে গেছে। যুদ্ধের পরিচালনা সংক্রান্ত (operational) বিষয়াদির দায়িত্বে ছিলেন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার। তার ওপর সদরদপ্তরের দায়িত্ব দিয়ে কর্নেল ওসমানী চলে যান শত্রুমুক্ত সিলেটে। ১৩/১৪ ডিসেম্বর কর্নেল ওসমানী সিলেটের উদ্দেশে যাত্রা করেন। তাঁর পরিবহণ ছিল বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি হেলিকপ্টার। ১৬ ডিসেম্বর সকালে যখন সংবাদ এল যে এদিনই বিকেলে পাকিস্তান সেনাবাহিনী আত্মসমর্পণ করবে, সেই সময় কর্নেল ওসমানীর সাথে অনকে চেষ্টা করেও মন্ত্রিসভার যােগাযােগ করা সম্ভব হয়নি। এই পরিস্থিতিতে মন্ত্রিসভা ১৬ তারিখ সকালে জরুরি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, গ্রুপ ক্যাপ্টেন খন্দকার বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করবেন।
ঢাকায় পৌছার পর খন্দকার সাহেব দেখেন যে, তৎকালীন রেসকোর্স ময়দানে বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে চরম বিশৃঙ্খলা। এত লােকের সমাবেশে কিছুই নিয়ন্ত্রণে আনা যাচ্ছিল না; শৃঙ্খলা তাে দূরের কথা। তার ওপর ছিল আত্মসমর্পণকারী পাকিস্তানিদের নিরাপত্তার প্রশ্ন। ঐ পরিস্থিতিতে যত দ্রুত সম্ভব দলিলে দস্তখত করে ওখান থেকে চলে যাওয়াই ছিল শ্রেয়।
বিজয়ের অব্যবহিত পরে
ডিসেম্বর ১৭
নবনিযুক্ত ডেপুটি কমিশনার ও এস.পি.-দের স্বাধীন বাংলা বেতার এবং টেলিগ্রাম মারফত সরাসরি নির্দেশ দিতে আরম্ভ করি। টাইপ করার সময় না থাকায় এই সময় সরাসরি হাতে লিখে নির্দেশ দিতে থাকি। ১৭ ডিসেম্বর তারিখে প্রদত্ত এমন একটি হাতে লেখা নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এই নির্দেশপত্রে এম.ই. শরিফ (উপসচিব)-কে ভারতীয় অফিসারদের সাথে যােগাযােগ এবং আমাদের বিভিন্ন অঞ্চলে কর্মরত অফিসারদের সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়।
১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর সারাদেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠিত করতে আরও কায়েকদিন সময় প্রয়ােজন ছিল। আমাদের প্রধানতম কাজ ছিল রাজধানী ঢাকা, বন্দরনগরী চট্টগ্রাম, বিভাগীয় শহরগুলি এবং গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও বেসামরিক স্থাপনাগুলি কালবিলম্ব না করে প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেওয়া। একই সাথে সচিবালয় ও সারাদেশে বিভিন্ন দপ্তরে বেসামরিক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করে স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সরকারের নিয়ন্ত্রণ সুদৃঢ় করা।
ঢাকা বিমানবন্দর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিরাপত্তা বিধান করার পর সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা ছােট ছােট দলে ঢাকা যেতে থাকেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ এবং আমাদের বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ ও কর্মকর্তার সাথে এই বিষয়টি সমন্বয়ের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর।
ডিসেম্বর ১৮
১৮ তারিখে যে উচ্চপর্যায়ের অগ্রবর্তি দলকে ঢাকায় পাঠানাে হলাে তাতে ছিলেন (পরিশিষ্ট ১২৮):
১. মুখ্য-সচিব: রুহুল কুদুস
২. রাষ্ট্রপতির উপদেষ্টা: এ.এফ.এম.এ. ফতেহ
৩. সংস্থাপন সচিব: নূরুল কাদের
৪. পুলিশের মহাপরিচালক: এম.এ. খালেক
৫. সচিব, তথ্য মন্ত্রণালয়: আনােয়ারুল হক খান
৬. সচিব, অর্থ মন্ত্রণালয়: কে.এ. জামান
৭. নৌপরিবহণের পরিচালক: কিউ.এ.বি.এম. রহমান
৮. বেসামরিক বিমান চলাচলের পরিচালক: উইং কমান্ডার (অব.) মির্জা
১৮ ডিসেম্বর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির নির্দেশে মন্ত্রিসভার বিশেষ জরুরি-সভা আহবান করা হল। আলােচ্য বিষয়বস্তু পর্যালােচনা করলেই অনুমান করা যাবে কী রকম চাপের মুখে আমরা ছিলাম।
১৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ মন্ত্রিসভা বৈঠকের কার্যসূচি:
১. সামরিক ও পুলিশ বাহিনীর জন্য পােশাক;
২. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের নামে একাউন্ট
৩. গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রসাশনিক কাঠামাে;
৪. কৃষি মন্ত্রণালয়ের বাজেট;
৫. ঢাকা বেতার কেন্দ্র নতুনভাবে চালু করা;
৬. গণবাহিনীর সদস্যদের প্রস্তাবিত জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্তি;
৭. সরকারি কর্মচারীদের পুনর্বিন্যাস।
এরপর ২০ ডিসেম্বর আমরা তথ্য ও বেতারের একটি দল পাঠাই (পরিশিষ্ট ১২৯ দ্রষ্টব্য)। এই দলে ছিলেন:
১. এ.জে. খান: পরিচালক
২. আসিফ আলী: প্রযােজক ও ক্যামেরাম্যান
৩. আলম: যুদ্ধক্ষেত্রের ফটোগ্রাফার
৪. ফেরদৌস: সহকারী ক্যামেরাম্যান
২০ তারিখে ঢাকা গমনের জন্য একটি বড় দলের তালিকা আমি পূর্বাহ্বে ইস্টার্ন কমান্ডের ব্রিগেডিয়ার সিন্হাকে পাঠিয়েছিলাম (পরিশিষ্ট ১৩০ দ্রষ্টব্য।
২১ ডিসেম্বর ভারতীয় বৈদেশিক বিষয় মন্ত্রকের যুগ্মসচিব মি. এ. কে. রায়-কে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ১৫ দিনের অতি প্রয়ােজনীয় সামগ্রীর একটি তালিকা পাঠাই। ভারতীয় পক্ষে তিনি তখন সমন্বয় করছিলেন। ব্যবস্থাটি ছিল পূর্বে স্থিরীকৃত। (পরিশিষ্ট ১৩১ দ্রষ্টব্য)।
এই সময় ঢাকায় প্রশাসনের কর্তৃত্ব নেওয়া এবং পাশাপাশি আমাদের অস্থায়ী সদর দপ্তর মুজিবনগর থেকে স্থায়ী রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তর ছিল আমাদের প্রধানতম উদ্যোগ। এদিকে নেতৃবৃন্দকে (প্রথমত জনপ্রতিনিধি এবং উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের) ঢাকায় পাঠানাের ব্যবস্থা করা; অন্যদিকে নথিপত্র, অত্যাবশ্যকীয় দাপ্তরিক সরঞ্জাম স্থানান্তর ছিল আমার অন্যতম দায়িত্ব। বেসামরিক বিমান চলাচল তখন বন্ধ। স্থলপথে যােগাযােগও বিচ্ছিন্ন। সড়ক ও রেলসেতু অধিকাংশ বিধ্বস্ত। এগুলাে মেরামত করে পুনঃস্থাপন এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা পুনর্বাসন স্বাভাবিক অবস্থায় সময়সাপেক্ষ হলেও ভারতীয় সামরিক কর্তৃপক্ষ অত্যন্ত দ্রুত কাজ করে যাচ্ছিলেন। তা হলেও ২/৩ সপ্তাহের আগে সড়ক যােগাযােগ সম্ভব ছিল না। এই পরিস্থিতিতে ভারতীয় সামরিক বিমান পরিবহণের ওপরেই আমাদের প্রধানত নির্ভর করতে হয়েছে। আকারে ছােট হলেও আমাদের নবসৃষ্ট বিমানবাহিনী বিমান পরিবহণে যথাসাধ্য তাদের দায়িত্ব পালন করছিল।
ডিসেম্বর মাসে মহান বিজয়ের পরও দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হতে যথেষ্ট সময় নিয়েছিল। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানেন দেশ কী রকম বিধ্বস্ত ছিল। ৯ মাসের যুদ্ধ কী রকম তীব্র ছিল, কী পরিমাণ ধ্বংস সাধিত হয়েছিল সেটি যারা জানেন, তাঁদেরকে নতুন করে বলার
পৃষ্ঠা: ২৭৫
প্রয়ােজন নেই। এই ধ্বংসস্তুপ থেকে দেশকে উদ্ধার করে পুনর্গঠনের কাজ কত ব্যাপক হতে পারে তা সহজেই অনুমেয়। অবশ্য যারা জেনেও না জানার ভান করেন অথবা বুঝেও না বােঝেন তাদেরকে বলে লাভ নেই। এটা আমার বিষয়বস্তু নয় এখানে। আমার বক্তব্য: ঐ পরিস্থিতিতে কি কোলকাতা, কি ঢাকা, কোনাে স্থানেই আমাদের স্বস্তি ছিল না। একদিকে ঢাকায় কর্মস্থল স্থানান্তর, অন্যদিকে কোলকাতায় মন্ত্রিসভার সবরকমের কাজকর্ম চালিয়ে যাওয়া— সে যে কী প্রচণ্ড চাপ তা বুঝিয়ে বলা যাবে না।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ও অন্যান্য মন্ত্রিবর্গ ডিসেম্বর মাসের ২২ তারিখে একত্রে ঢাকা ফিরে আসেন। তখন ঢাকা শহর উৎসবমুখর। আমি এবং আমার অন্যান্য সহকর্মী যারা মান্ত্রিসভাকে সহায়তাসহ অন্যান্য দাপ্তরিক কাজে মুজিবনগরে অবস্থান করছিলাম, তাদের অধিকাংশ ঐদিন ঢাকায় যাই। কয়েকজন কর্মকর্তাকে রেখে আসা হয় নথিপত্র এবং অফিসসরঞ্জাম গুটিয়ে নিয়ে আসার জন্য।
ঢাকা প্রত্যাবর্তনের পর নেতৃবৃন্দের প্রথম কাজ ছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করে আনা। এই লক্ষ্যেই তারা সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। ভারত এবং অন্যান্য সকল বন্ধুরাষ্টের মাধ্যমে এবং জাতিসংঘের মধ্যস্থতায়, বিশেষ করে মহাসচিব উ থান্টের ব্যক্তিগত প্রচেষ্টায় বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনা উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ঘন ঘন ছুটে যান উদ্বেগাকুল বেগম ফজিলাতুন নেসা, ছেলে মেয়ে এবং বঙ্গবন্ধুর পিতা-মাতার কাছে।
আমরা কয়েকজন কর্মকর্তা তখন নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে সরকারি কাজকর্ম চালু করতে ব্যস্ত। অধিকাংশ সহকর্মী, যাদের আনুগত্য সম্পর্কে আমাদের কোনাে সংশয় ছিল না তাদেরকে কালবিলম্ব না করে প্রশাসনের বিভিন্ন পদে নিয়ােগ করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের যে সমস্ত সহকর্মীকে শেরে বাংলানগরস্থিত তথাকথিত বন্দিশিবিরে (POw camp) আটক করে রেখেছিল তাদেরকে মুক্ত করে যথাযথ সম্মানের সাথে সরকারি বিভিন্ন পদে নিয়ােগ করা আমাদের অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল। এদের মধ্যে ছিলেন বন্ধুবর আইয়ুবুর রহমান (সি.এস.পি, ১৯৫৯), আ.ন.ম. ইউসুফ (সি.এস.পি. ১৯৬১), সৈয়দ রেজাউল হায়াত (সি.এস.পি. ১৯৬৭), নূরুল মােমেন খান (পি.এস.পি. ১৯৬১), লােকমান হােসেন (ডিরেক্টর, ডাক ও তার বিভাগ), শাহ্ মােহাম্মদ ফরিদ (সি.এস.পি. ১৯৬৮) এবং আরও অনেকে। এঁদের যেগদানের ফলে সরকারি কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চারিত হয়।
বিজয়ের প্রাক্কালে আমরা যেসব জেলা প্রশাসক, পুলিশ সুপার ও অন্যান্য কর্মকর্তা নিয়ােগ করেছিলাম তারা বিপুল উৎসাহের সাথে প্রশাসনকে সচল করার দায়িত্ব পালন করতে থাকেন। ফলে কোনােখানে প্রশাসনিক শূন্যতা দেখা দেয়নি।
১৯৯১ সালের ২৩ ডিসেম্বর ঢাকায় প্রথম মন্ত্রিসভা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সাবেক পূর্বপাকিস্তান সরকারের ক্যাবিনেট রুমে। এই বৈঠকের প্রধান সিদ্ধান্ত ছিল বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি প্রদান, প্রাক্তন স্টেট ব্যাংককে ‘বাংলাদেশ ব্যাংক’ নামকরণ। জাতীয় স্মৃতিসৌধ নির্মাণেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। মুজিবনগরে মুক্তিযােদ্ধাদের একটি জাতীয় মিলিশিয়ায় অন্তর্ভুক্ত করার যে-সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল সেটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ১১ – সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় মিলিশিয়া বাের্ডগঠিত হয়। একই সাথে সকল পাটকল রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। এই সিদ্ধান্ত আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোর প্রতিফলন ছিল।
২৭ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ করে শেখ আবদুল আজিজ, ফণীভূষণ মজুমদার, আবদুস সামাদ আজাদ এবং জহুর আহমেদ চৌধুরীকে মন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। পরদিন অধ্যাপক ইউসুফ আলীকেও মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। খন্দকার মােশতাক আহমদকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে দিয়ে আবদুস সামাদ আজাদকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিয়ােগ করা হয়। মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় বৈঠকটি হয় বঙ্গভবনের ক্যাবিনেট রুমে।
এই প্রসঙ্গে দুটো সুদূরপ্রসারী এবং ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তের কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমটি হল সাবেক গভর্নমেন্ট হাউস এবং স্টেট গেস্ট হাউস-এই দুটো ভবনের নামকরণ সংক্রান্ত। ১৮ ডিসেম্বর তারিখে আমাদের অগ্রবর্তী যে-দলটি জনাব রুহুল কুদ্দুসের নেতৃত্বে ঢাকায় পৌঁছেন তারা বােমাবর্ষণে বিধ্বস্ত গভর্নমেন্ট হাউস পরিদর্শনে গিয়ে তাৎক্ষণিকভাবে ওটির নতুন নাম ‘বঙ্গভবন’ প্রস্তাব করেন। যতদূর মনে পড়ে প্রস্তাবটি ছিল আসাদুজ্জামান এবং নূরুল কাদেরের। ‘বঙ্গভবন’ এজন্য যে, সেটি রাষ্ট্রের প্রতীক।
অপর ভবনটি ছিল স্টেট গেস্ট হাউস(মিন্টো রােড এবং হেয়ার রােডের সংযােগস্থলে অবস্থিত, বর্তমান রজনীগন্ধা’) যেটাকে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রূপান্তরের প্রস্তাব করা হয়। যেহেতু প্রধানমন্ত্রী জনগণের প্রতিনিধি এবং তার বাসভবন জনগণের জন্য উন্মুক্ত থাকবে, তাই এর নামকরণের প্রস্তাব করা হয় গণভবন। ঐ দুটি নাম সৌভাগ্যবশত এখনও অক্ষুন্ন আছে। পরবর্তীকালে বঙ্গবন্ধু শেরে বাংলানগরে বাসভবন স্থানান্তর করলে সেটির নামকরণ হয় গণভবন’।
দ্বিতীয় ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত ছিল রাষ্ট্রীয় কাজে বাংলার প্রচলন। ২৩ ডিসেম্বর মন্ত্রিসভার বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রস্তাব করলেন যে আমাদের কার্যবিবরণী এবং সিদ্ধান্ত বাংলায় লেখা হােক। আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন পারব কিনা। আমার উত্তর: অবশ্যই। সেদিন থেকেই বাংলায় লেখা আরম্ভ করলাম। নবসৃষ্ট বাংলাদেশ ব্যাংক এবং আরও কয়েকটি বিষয়ে সরকারি প্রজ্ঞাপন জারি করা প্রয়ােজন ছিল। সে-সময় সবকিছুই ছিল ইংরেজিতে। গেজেট নােটিফিকেশন সর্বস্তরে প্রচলিত। আমি প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে যােগাযােগ করলাম বি.জি.প্রেস বা সরকারি প্রেসের সাথে। সেখানে ছিলেন কয়েকজন উৎসাহী কর্মকর্তা।
সরকারের আগ্রহে আর বি.জি. প্রেসের দক্ষতার ফসল হলাে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে রাষ্ট্রভাষা বাংলায় প্রজ্ঞাপন লেখা। মন্ত্রিসভার জন্য সারসংক্ষেপ, আলােচনা এবং মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত সবই আমরা বাংলায় আরম্ভ করলাম। কোনাে অসুবিধা হয়নি ইংরেজি থেকে বাংলায় রূপান্তরে। কাজ আরও দ্রম্নত করার জন্য তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বাের্ড থেকে আনা হলাে বাংলা সাটলিপিকার খন্দকার আবদুর রশিদকে। আমি আরও দুজন বাংলা সাঁটলিপিকার পেয়ে গেলাম- একজন ওয়াজেদ, আরেকজন রায়হান।
ইতােমধ্যে বােমার আঘাতে ক্ষতিগ্রস্ত বঙ্গভবনের যথাসাধ্য সংস্কার করে সেটাকে কাজের উপযােগী করা হলাে। দরবার হলটি ভেঙে পড়েছিল, কিন্তু অন্যান্য অংশ অক্ষত থাকায় ওখানে অফিস চালানাে যেত। মন্ত্রিসভার বৈঠক হলাে একটি কি দুটি।
ডিসেম্বর ২৭ তারিখে সম্প্রসারিত মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন হল বঙ্গভবনে। এই প্রথমবার আনুষ্ঠানিকতার সাথে শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করলাম আমি: মন্ত্রিদের নিয়ােগের ঘােষণা, এক-এক করে তাদের শপথবাক্য পাঠ করার অনুরােধ ইত্যাদি আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করলাম আমন্ত্রিত ব্যক্তিবর্গ, নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিবৃন্দ, বিদেশি মেহমান, সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা, সংবাদপত্র, রেডিও আর টেলিভিশনের উপস্থিতিতে। যেমন গর্বিত প্রধানমন্ত্রী, তেমনই আমি আর সহকর্মীরা। সে কী দারুণ এক অনুভূতি!
পৃষ্ঠা: ২৭৭
স্বাধীন, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে-তােলার জন্য আমি এবং আমার সহকর্মীবৃন্দ ধন্য এবং গৌরবান্বিত বােধ করি। একটি স্বাধীন দেশের এবং তার সরকারের সার্বভৌমত্বের কিছু প্রতীক থাকে যেগুলাে ঐ দেশের নাগরিকদের গর্বের বিষয়, যেমন জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত ইত্যাদি। এর সাথে সাথে আরও কিছু বিষয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নেয় যেগুলােকে সম্মান প্রদর্শন করা হয়। ভয়াবহ এবং রক্তক্ষয়ী একটি যুদ্ধের পর বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সমস্যা ছিল অপরিসীম, পর্বতপ্রমাণ। সেগুলাে সমাধানের প্রচেষ্টার পাশাপাশি দেশ ও সরকারের প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়গুলাের দিকেও আমাদের সমান দৃষ্টি এবং মনােযােগ দিতে হয়েছে।
এমনি একটি জরুরি বিষয় ছিল রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিবর্গ (প্রতি- এবং উপমন্ত্রীসহ), সুপ্রিমকোর্টের প্রধান ও অন্যান্য বিচারপতিদের শপথ। সরকারে কারও এ-সম্পর্কে তেমন ধারণা ছিল না। মন্ত্রিপরিষদ-সচিবের ওপরই এই গুরুদায়িত্ব বর্তায়। আমার এখনও মনে আছে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে বঙ্গভবনে শপথবাক্যের খসড়া প্রণয়নের কথা। আমার সাথে তখন ছিলেন মুক্তিযােদ্ধা উপসচিব আকবর আলী খান। শরণাপন্ন হলাম সহকর্মী মহিউদ্দীন খান আলমগীরের। আরেক সহকর্মী প্রাদেশিক গভর্নরের সাবেক উপসচিব নূরুল ইসলাম (অনু) বঙ্গভবনের উপসচিবের দায়িত্ব পালন করছিলেন।
আমরা চার সহকর্মী মিলে ৩৩ বছর আগে সরকারের সকল পদ ও দায়িত্বের সবগুলাে শপথবাক্যের (পদের এবং গােপনীয়তা রক্ষার) যে-মুসাবিদা সেদিন করেছিলাম, মন্ত্রিসভা সেগুলাে শুধু অনুমােদনই করেনি, আমাদের বাংলাভাষায় লিখিত মুসাবিদা দেখে অনেক সাধুবাদও দিয়েছিলেন। আমি এখনও গর্বের সাথে বলি: সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে তিন দশকেরও আগে আমরা শপথবাক্যের যে-মুসাবিদা করেছিলাম এখনও তা চালু আছে, বিন্দুমাত্র কোনাে পরিবর্তন তাতে করার প্রয়ােজন হয়নি। আমাদের জন্য এর চেয়ে বড় আনন্দের আর পরিতৃপ্তির আর কী থাকতে পারে!
———X———