অপারেশন পাকিস্তান শিপিং কোম্পানী
( আগ্রাবাদ বাণিজ্যিক এলাকা বর্তমান বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন)
আমরা পড়েছি কিউবার মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস, জেনেছি ভিয়েতনামের বীর মুক্তিযােদ্ধাদের কার্যক্রম আর দেখেছি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের ঐতিহাসিক গেরিলা যুদ্ধ কৌশল। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গেরিলা কৌশলের পাশাপাশি আমাদের গেরিলা যােদ্ধাদের কৌশল উপস্থাপন করলে একটি সত্য বেরিয়ে আসবে। তা হল বাংলার গেরিলা যােদ্ধারা প্রকৃতির সন্তান। তাদের কৌশল আধুনিক সমর বিজ্ঞানের ধারাকে রুখে দিয়েছে। তা না হলে বর্বর পাকবাহিনী এ ভাবে মার খাবে কেন? সংবাদ-৫ আগষ্ট সভা। পাকিস্তান শিপিং কোম্পানীর আগ্রাবাদ অফিসে বসছে ওরা। সুন্দর দোতলা পাইনভিউতে শিপিং কোম্পানী সজ্জিত অফিস। পাকিস্তান শিপিং কোম্পানীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও পাকিস্তান নৌবাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের যৌথ সভা। সাথে থাকছেন জাপানী একদল প্রতিনিধি। নৌবাণিজ্য বৃদ্ধি সংক্রান্ত একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। সবাই এসেছেন পাকিস্তানের রাওয়ালপিন্ডি থেকে। পাইনভিউকে সাজানাে হয়েছে সুন্দর করে। জিন্নাহ রােড (বর্তমান শেখ মুজিব সড়ক) থেকে পাইনভিউ পর্যন্ত রাস্তায় কার্পেটিং করা হয়েছে। অফিসের ভিতরের অবস্থাও রুচিসম্মত করে সাজানাে। বড় বড় ফুলের টব ভেতরে-বাইরে। দারােয়ান পিওনদের দেয়া হয়েছে নতুন পােষাক। আগ্রাবাদ অফিসের বড় কর্তা, মেঝ কর্তা ও ছােট কর্তাদের বিশ্রাম নেই। সবাই যখন কাজে ব্যস্ত দূর থেকে মুচকি হেসেছেন একজন।
তিনি মনে মনে প্রতিজ্ঞা করলেন তােমরা সব বাড়িঘর পুড়ে ছাই করে দিচ্ছ আর এখানে বসে বিদেশের সাথে বাণিজ্য চুক্তি করবে— এ হতে দেব না। ঊনসত্তরের গণ আন্দোলনে গড়ে ওঠা যুবক আব্দুল হক। তার সাথে রাজপথে সখ্যতা গড়ে ওঠে প্রত্যয়ী ছাত্র নেতা তােহা গাজীর। তিনি সেই তখন থেকে মনে প্রাণে বাংলার স্বাধিকারের পক্ষে। মাঝে মাঝে তােহা গাজী তার অফিসে আসতেন, কথা হত। তিনিও বিভিন্ন সভা সমিতিতে যেতেন। এভাবে এক সময় জড়িয়ে পড়েন শ্রমিক রাজনীতির সাথে। তবে প্রত্যক্ষ ভাবে ছিলেন না—গােপনে কাজ করতেন। তিনি একদিন এলেন কবির তােরণে। দেখেন পরিচিত অনেকে। যুদ্ধ তখন চলছে। গােপনে সংবাদ পাঠালেন পাইনভিউতে পাক বাণিজ্যিক সভা বসবে। এ সংবাদ যথাসময়ে আলােচিত হল। দলীয় নেতা ডাঃ মাহফুজুর রহমান অনেক ভেবে চিন্তে ঠিক করলেন অপারেশন প্রক্রিয়া।
পুরাে দায়িত্ব দেয়া হল রইসুল হক বাহারকে। তিনি পূর্বেই প্রয়ােজনীয় প্রশিক্ষণ সমাপ্ত করে এসেছেন ভারত থেকে। বিশেষ করে তিনি একজন এক্সপ্লোসিভ বিশেষজ্ঞ হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। এ অপারেশনের দায়িত্ব গ্রহণ করে তিনি ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। প্রাথমিক অবস্থায় নিজে শিপিং কোম্পানীর সার্বিক অবস্থা সচক্ষে দেখে এলেন। দুদিন পর্যবেক্ষণ করে তিনি বুঝলেন অফিসের ভিতর অপারেশন করা সমূহ বিপদজনক। লােক ক্ষয়ের সম্ভাবনা রয়েছে। তাই তিনি বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণের চিন্তা শুরু করলেন। পরামর্শ করলেন সতীর্থদের সাথে। পাইনভিউর চারপাশের অবস্থার প্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত হল অফিস সংলগ্ন বিদ্যুৎ সাব স্টেশনে। সােজা ভিতরে প্রবেশ করলেন। একজন লােক অন্য কক্ষ থেকে বেরিয়ে এলেন। ভদ্রলােক বাঙালি এ অফিসের দায়িত্বে। একটু দূরে আছে দু’জন পাকসৈনিক। ট্রান্সফরমার পাহারা দিচ্ছেন। লােকটি গরীব উল্লাহকে প্রশ্ন করলেন, আপনি কেন এসেছেন? আমার একটি আটার কল আছে মতিয়ার পুলে। আজ সকাল থেকে সে লাইনে কারেন্ট নেই। কোন কাজ করতে পারছি না। যদি একটু ঠিক করার ব্যবস্থা করতেন।
মিলের নাম কি ? খাতুন আটার কল। ঠিক আছে, আপনি খাতায় লিখে দিয়ে যান। আমাদের লােক এলে যাবে। | গরীবউল্লাহ অভিযােগ লিখে দিলেন খাতায়। ফরিদউদ্দিন নামে নাম দস্তখত করলেন। লােকটির সাথে কথা বলতে বলতে দেখে নিলেন সাব ষ্টেশন ও ট্রান্সফরমারের অবস্থান। বেরিয়ে এলেন। এসেই তিনি রিপাের্ট করলেন রইসুল হক বাহারকে। সব শুনে বাহার পুনরায় রেকি করে এলেন। সিদ্ধান্ত হল সাব ষ্টেশন ও ট্রান্সফরমার উড়িয়ে দিতে হবে। তাহলে একঢিলে দু’পাখি মারা সম্ভব হবে। দলীয় নির্দেশ হল কোন অবস্থাতেই যেন প্রাণহানি না ঘটে। রাতে বসেছে আলােচনা। পরদিন পাঁচই আগস্ট পাকিস্তান শিপিং অফিসে পাকিস্তান ও জাপানের মধ্যেকার নৌবাণিজ্য মিশনের বৈঠক বসবে। সময় বেশি নেই। কবীর। তােরণের গােপন আশ্রয়ে তৈরি হল বিস্ফোরক। আনা হল জুতার ক’টি নতুন প্যাকেট। প্যাকেটে ভরা হল বিস্ফোরক। প্রয়ােজনীয় অস্ত্র প্রস্তুত করা হল। ভােরে ক’জন মিলে। নামাজ পড়ল মুগলটুলীস্থ আবদুর রহমান মাতবর মসজিদে। নামাজ শেষ করে এল বাণিজ্যিক এলাকায় পাইনভিউর সামনে। উদ্দেশ্য প্রাতঃভ্রমণের পাশাপাশি অপারেশন। স্থলের সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষন করা। অবস্থা স্বাভাবিক। প্রতিদিনের মতাে ক’জন পাকসৈনিকের পাহারা চলছে। ফিরে এলেন আশ্রয় কেন্দ্রে। পাঁচই আগস্ট। সকাল ৯.৩০ মিনিটে সংগ্রহ করা হল একটি টেক্সী। মুগলটুলীর কালু সওদাগরের টেক্সীটিকে নেয়া হল। চলেছেন রইসুল হক বাহার, ফয়েজুর রহমান, গরীবউল্লাহ, মােঃ শফি, মুন্সী, মােফাজ্জল হােসেন অথবা জাফর (সঠিক নাম কেউ বলতে পারেনি) প্রমুখ মুক্তিযােদ্ধারা। টেক্সীটি থামল পাইনভিউর নিকটে বিদ্যুৎ সাব ষ্টেশনের পাশে। নেমেই সবাই স্তম্বিত।
প্রায় ডজন খানেক পাকআর্মি ও নৌসেনা। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে দাঁড়িয়ে। রাস্তায় চিন্তা করা সুযােগ নেই। তাই দ্রুত চলে গেলেন বিদ্যুৎ সাব ষ্টেশনের ভেতরে। আল্লাহর বিশেষ রহমত— ডিউটিরত পাকসৈনিকটি বাথরুমে ঢুকে গােসল সারছিল। তাদের দেখে বাঙালি কর্মচারীটি এগিয়ে এল। গরীব উল্লাহ তখন পূর্বের সূত্র ধরে বলতে শুরু করল, কিরে ভাই, দু’দিন আগে আপনাকে বলে গেলাম আমার মিলের বিদ্যুৎ লাইন ঠিক করে দিতে। এখনও ঠিক করলেন না। লােকটি খাতা আনতে ভেতরে গেল। অমনি ফয়েজুর রহমান আচমকা রিভালবার লােকটির বুকে চেপে ধরল। মৃদু আর্তনাদ করে উঠল। একজন বাথরুমের বাইরে থেকে দরজার খিল আটকে দিল। ইতিমধ্যে রইসুল হক বাহার ট্রান্সফরমারে প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরকে বসানাের কাজে লেগে গেলেন। বাকীরা দরজার আড়াল থেকে অস্ত্র নিয়ে পাহারায় বসেছে। এদিকে পাইনভিউর সামনে চলছে তােড়জোড়। দু’একজন উর্ধ্বতন কর্মকর্তা এসে গেছেন। বিদেশী অতিথি ও ঊর্ধ্বতন নৌকর্মকর্তাদের অভ্যর্থনা জানাতে বাইরে এসে দাঁড়িয়েছেন। পাহারারত পাকসৈনিকরা সবাই অতিথিদের আগমনের প্রতীক্ষায় ব্যস্ত। অন্যদিকে তাদের খেয়াল নেই। রইসুল হক বাহার সব কাজ শেষ করলেন। সমস্যা দেখা দিল বাঙালি কর্মচারীটিকে নিয়ে। বিস্ফোরণ ঘটলে লােকটি মারা যাবে। পাকসৈনিকটির কিছুই হবে না কারণ বাথরুম অনেক দূরে। লােকটিকে ভয় দেখিয়ে পেছনে ঢেবার পাড়ের দিকে বের করে দেয়া হল।
ঠিক তখনই বাহার কর্ডে আগুন দিলেন। সবাই সুকৌশলে বেরিয়ে এল। সবার মনে ভয়। ভাগ্য খুবই ভাল পাকসৈনিকরা তখন পাইনভিউর সামনে ভীষণ ব্যস্ত। তাই অন্যদিকে তাদের খেয়াল নেই। সােজা চলে এলেন টেক্সীর সামনে। টেক্সীতে উঠে সােজা কায়েদে আজম রােডে (বর্তমান শেখ মুজিব সড়ক)। কিছু দূর গিয়ে নেমে গেলেন রইসুল হক বাহার। বাকীরা মগপাড়ায় চলে এলেন। অবশ্য কায়দে আজম রােডে উঠে শুনতে পেলেন প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ। আনন্দে নেচে উঠল সবাই। পাইনভিউর কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা ভয়ে এদিক-ওদিক ছুটতে শুরু করলেন। সাধের সভা পন্ড হল। বিদ্যুৎ পাওয়ার ষ্টেশনের আশেপাশের সব ভবনের কাচ ভেঙ্গে খান খান হয়ে পড়ল। জাপানী প্রতিনিধিদের সামনে পাকসরকার ও তাদের দোসরদের মুখে চুনকালি লেপে দিল মুক্তির সাহসী সন্তানরা। (সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত