চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং অপারেশন
ওরা ছুটছে। হায়নার তাড়া খাওয়া ভয়ার্ত মানুষ শহর থেকে গ্রামে। গ্রাম থেকে গ্রামান্তর। আরাে প্রত্যন্তের নিরাপদ আশ্রয়ে। যেখানে পাকসেনার হিংস্র নরঘাতের ভয় নেই, ধ্বংস নেই, নারীর সতীত্ব লুণ্ঠনের আশংকা নেই। কিন্তু এরা পালাবে কোথায়? কোথায় সেই নিরাপদ আশ্রয়? শ্যামল সুন্দর স্বদেশ এখন খা খা বিরানভূমি! বাঙালি নিধন যজ্ঞের নারকীয় উল্লাসে গােটা দেশ এখন ভয়ংকর নেকড়ে অরণ্য। ‘৭১-এর এমনি ভয়াবহ সময়ে ধুমকেতুর মতাে আবির্ভূত হল বাংলা মায়ের দামাল ছেলেরা মুক্তিযােদ্ধার বেশে। মরণপণ শপথে তারা বলীয়ান। শপথ, বাঙালি নিধন যজ্ঞে উন্মত্ত পাকসেনাদের। হাত থেকে ওদের বাঁচাতে হবে। প্রত্যাশা কালাে আঁধারের জঠর চিরে নতুন সূর্যোদয়। সবুজের বুকে লাল সূর্য আঁকা পতাকার সম্মান প্রতিষ্ঠা করতে হবে। বাংলা মায়ের সন্তানদের বাঁচাতে ৭১-এর সেই রক্তঝরা দিনগুলােতে মুক্তি যােদ্ধারা গেরিলা পদ্ধতিতে অপারেশন করে পাকসেনা ও তাদের দোসরদের নাভিশ্বাস তুলে দিয়েছিল এবং গেরিলাদের সাফল্যের খবরে সবার চোখে-মুখে ফুটে উঠেছিল আশার ঝিলিক। সেই অতন্দ্রপ্রহরী গেরিলা যােদ্ধাদের চোরাগুপ্তা হামলার বাস্তব চিত্র যা সময়ের প্রবাহমানতায় লােক চক্ষুর আড়ালে চলে যাচ্ছে—সেই বিস্মময়কর কাহিনীগুলাে আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসে মূল্যবান দলিল। সম্মানিত পাঠক, আসুন আগামী প্রজন্মের জন্য কাহিনীগুলাের স্মৃতি রােমন্থন করি। তাদের জানতে দিই ‘৭১-এর ইতিহাস। তারা সম্মান করতে শিখুক মুক্তির সৈনিকদের।
আগষ্টের মাঝামাঝি সময়। মুক্তিযােদ্ধারা এখন বেশ সংগঠিত। জনতার সমুদ্রে তাদের বিচরণ।
গ্রামবাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে তারা ঢুকে পড়েছে। বিভিন্ন সেক্টরে তাদের সাফল্য পাকহানাদারদের চঞ্চল করে তুলেছে। তারাও হিংস্রতায় আরাে উন্মত্ত। হত্যা, ধ্বংস আর নারী ধর্ষণে ওরা আরাে বেপরােয়া। কুলাঙ্গার রাজাকার, আলবদররা ওদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে। পাকসেনাদের হিংস্রতায় জ্বলছে গ্রাম, মানুষ ছুটছে। মৃত্যু, ধ্বংস এবং স্বজন হারানাের বিলাপ বাংলার শ্যামল প্রান্তর জুড়ে। করসেনট্রেশন ক্যাম্পে মা, বােনের আর্ত চিঙ্কার। একদিকে মুক্তিযােদ্ধাদের জীবন মরণ পণ, অন্যদিকে হানাদারদের রসনার উষ্ণতা। এমনি এক সময়ে পাকসরকার ঘােষণা দিল। অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়নের। শেষ তারিখ ঘােষিত হল ৮ই সেপ্টেম্বর ‘৭১ এ। নিকটস্থ কোর্ট বিল্ডিং-এ প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত অস্ত্রের লাইসেন্স নবায়ন করা যাবে। রেডিওর এ ঘােষণায় লাফিয়ে উঠল দু’জন। তারা মুক্তিযােদ্ধা। দুপুরে শেল্টার বসে পরবর্তী কর্মসূচি ঠিক করছিল। শেল্টারের গােপন কক্ষে বসেই খবরটা তারা শুনল। নিমেষেই তারা অস্থির হয়ে উঠল। এদিক ওদিক পায়চারী শুরু করল। মাথার চুল ছিড়তে লাগল। আপনমনে বলে উঠল, এ সুযােগ হাত ছাড়া করা যায় না। যে করেই হােক কিছু একটা করতেই হবে। চট্টগ্রামের কেন্দ্রমূলে আঘাত হানতে হবেই।’ দুপুর গড়িয়ে সাঁঝ হল। স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র শুনে দু’তরুণের রক্তে জোয়ার এল। আর তর সইছিল না। রাতের গভীরতা বাড়ল। বাড়ল তরুণ দুজনের কর্মের স্পৃহা।
পুরাে রাত জেগে প্ল্যান তৈরি করল। চট্টগ্রাম কোর্ট বিল্ডিং-এর চারদিকের খসড়া মানচিত্র তাদের কাগজে স্থান পেল। সকালের সূর্যোদয় হল। দু’জন আস্তানা ছেড়ে ছদ্মবেশে বেরিয়ে পড়ল। শহরের এ পথ ও পথ ঘুরে কাের্ট বিল্ডিং-এর মূল অংশে পৌঁছে গেল। পাকসেনাদের দোসর মিলিশিয়াদের চোখকে ফাঁকি দিয় উঠে গেল তিনতলায়। খুঁজে পেল সেই কক্ষটি যেখানে অস্ত্র লাইসেন্স নবায়নের প্রস্তুতি চলছে। কক্ষের বাইরে উর্দু ও বাংলায় নােটিশ টানানাে হয়েছে। নােটিশে রয়েছে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ। অল্প সময়ের মধ্যে সমস্ত রেকি শেষ করে দু’জন নেমে এল । বিস্তারিত প্ল্যান করতে করতে পেরিয়ে গেল ক’দিন। ইতিমধ্যে চূড়ান্ত প্ল্যান ঠিক হয়ে গেছে। অপারেশন প্রস্তুতিও শেষ । এল সেই কাঙ্খিত দিন। বাংলা মায়ের মাটি হাতে তুলে শপথ নিল। ক্ষণ এল বিদায়ের-সতীর্থদের নিকট থেকে। এ বিদায় একদিকে আনন্দের বেদনা বিধুরতায় সিক্ত। কারণ ওরা চলছে মৃত্যুর পথে মায়ের সম্ভ্রম রক্ষার্থে প্রাণ দিতে। মৃত্যু ওদের পদে পদে। দৃপ্ত শপথে বলীয়ান দু’তরুণ মৃত্যুঞ্জয়ী বীরের মতাে আলিঙ্গন করল সতীর্থদের। একজন বলে উঠল মরলে শহীদ- বাঁচলে গাজী’ এ ধ্বনির মাঝে দু’তরুণ হাত নেড়ে ঘােষণা দিলেন ‘জয় বাংলা’। প্রতিধ্বনিত হল সবার অন্তর জুড়ে।
সেপ্টেম্বর ৮:একাত্তর। শরতের সকাল। নির্মল আকাশ। সােনালী রােদুরের ঝরঝরে দিন। বেলা বাড়ছে। ঘড়ির কাঁটা দশটা ছুঁই ছুঁই। কোর্ট বিল্ডিং চত্বরে এসে থামল একটি টেক্সী। নেমে এলেন দু’জন। বয়স বুঝা না গেলেও একজন অত্যন্ত গাম্ভীর্য নিয়ে এগুচ্ছেন । সুন্দর সুঠাম দেহ। চুলগুল বেকব্রাসে পরিপাটি করে আঁচড়ানাে। পােষাক পরিচ্ছদে আভিজাত্যের ছাপ। গলায় সােনার চেইন, হাতে রােলগােল্ডের ঘড়ি, পকেটে দামী কলম, পায়ে দামী সেন্ডেল। হাতে অত্যন্ত দামী একটি ছাতা। পেছনের জন কিছুটা মলিন পােষাক পরিচ্ছদে জীর্ণ হতশ্রী। একগাদা নথিপত্র বগলদাবা করে অত্যন্ত বিনয়ে প্রথমজনকে অনুসরণ করছে। এরা দ্রুত কোর্ট বিল্ডিং-এর তিনতলায় উঠে গেল। বিরাট করিডাের পেরিয়ে এল সেইটির সামনে যেখানে অস্ত্র লাইসেন্স নবায়ন হচ্ছে। দাঁড়াল, এদিক-ওদিক বুদ্ধিমত্তার সাথে দেখে নিল। চোখ পড়ল একজন পাকসেনা অফিসারের দিকে। বসে আছেন উঁচু আসনে। তার সামনে ক’জন চামচা। অনেক লােকের সমাগম। বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে, ওদের সকলে প্রায় বিহারী ও স্থানীয় দোষর ক’জন রাজাকার। সেনা অফিসারটির সামনে অস্ত্র হাত দাঁড়িয়ে। সেনা অফিসার তরুণ রাজাকারটিকে খাঁটি উর্দুতে জিজ্ঞেস করছে, ‘তােমহারা রাইফেল কেতনা মুক্তি খতম কিয়া?’ তরুণটি আমতা আমতা করে কী যেন বলল বুঝা গেল না। একজন লােক কক্ষে প্রবেশ করল। সেনা অফিসারসহ সবাই দাঁড়িয়ে গেল। বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে উনি ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্তা। তার সাথে এসেছেন আরাে ক’জন স্থানীয় দালাল। সবার নজর এখন ওদের দিকে। বিহারী ক’জন দম্ভোক্তি করছে।
মুক্তির সেনা দু’জন রাগে-দুঃখে ফুলছে কিন্তু করার কিছুই নেই। কক্ষ মুখে এসে দাঁড়াল। হাতের দামী ছাতাটিকে যত্ন সহকারে দরজার পাশে রেখে দিল। চারদিকে তাকিয়ে ছাতার ভেতরে রাখা পেনসিল টাইমবােমের সুইস টিপে দিল। সবার অলক্ষ্যে আস্তে করে বের হয়ে এল। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে একেবারে নিচে। স্নায়ুর চাপ ও দুরু দুরু বক্ষ নিয়ে কোর্ট বিল্ডিং-এর পশ্চিম পাশের সিঁড়ি দিয়ে নেমে এল নিউমার্কেটের সামনে। ঘড়ির সময় অনুযায়ী আর মাত্র দু’মিনিট। অপেক্ষা করছে তারা। সমস্ত চিন্তার অবসান ঘটিয়ে প্রচন্ড বিস্ফোরণের শব্দ হল। আনন্দে নেচে উঠল তারা। লােকজনের ছুটোছুটি, বাঁশির শব্দ। পাকসেনাদের আতংকিত হুংকার। আড়াল থেকে তারা সবই দেখল। অল্পক্ষণে শােনা গেল এম্বুলেন্সের আগমন শব্দ। প্রায় ডজন খানেক এ্যাম্বুলেন্স আহতদের নিয়ে ছুটছে। এরা সবাই পাকসেনা ও তাদের অপকর্মের দোসর। যারা আমাদের সম্পদ হরণ করেছে, মা, বােনদের ইজ্জত লুণ্ঠন করছে এরা তারাই। অসম সাহসী দু’তরুণ মুক্তির সৈনিক ফিরে এসেছে বিজয়ীর বেশে। সফল অপারেশন সংবাদ ফলাও করে প্রচার করল। একই রাতে বিবিসি ও এ অপারেশন সংবাদ ফলাও করে প্রচার করল। পাকহানাদারদের চট্টগ্রামের মূলকেন্দ্র কোর্ট বিল্ডিং-এর আঘাত করে যে দু’জন তরুণ সৈনিক বিশ্ববাসীকে জাগ্রত করেছিলেন তাঁদের প্রথমজন বীরমুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদ সরদার এবং দ্বিতীয় জন বীর মুক্তিযোেদ্ধা নূর মােহাম্মদ মিন্টু। তারা দু’জন সময়ের সাহসী সন্তান।
আমরা তাদের শ্রদ্ধা করি। জাতি তাদের প্রতি কৃতজ্ঞ। স্বাধীনতার কুড়ি বছর পেরিয়ে গেল অথচ আমরা কী একবারও খোঁজ নিয়েছি এ অসম সাহসী বাংলা মায়ের শ্রেষ্ঠ সন্তানরা কেমন আছেন? কোথায় আছেন? এখানে উল্লেখযােগ্য যে, এ অপারেশন যে ছাতাটি ব্যবহার হয়েছিল সেটি ছিল মুক্তিযােদ্ধা জালাল উদ্দিন আহমদের পিতা জনাব আব্দুল মােনাফ সওদাগরের। এ বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধাদের অন্যতম একটি আশ্রয় ও যােগাযোেগ কেন্দ্র ছিল। এ বাড়ির ছকিনা খাতুন ছিলেন মুক্তিযােদ্ধাদের নিকট মাদাম তেরেসা। সালাহউদ্দিন, জসিম উদ্দিন সবাই ছিল মুক্তিযােদ্ধা। কোর্টবিল্ডিং অপারেশনের সময় জালাল উদ্দিন তার এক চাচাসহ কোর্ট বিল্ডিং-এর নিচে অবস্থান গ্রহণ করেছিলেন।
( সূত্র ঃ রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু )
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত