অপারেশন হােটেল আগ্রাবাদ
পাকিস্তানের সামরিক সরকারের মিথ্যাচার সভ্য দুনিয়াকে থমকে দিয়েছে। বাংলা মায়ের দামাল ছেলেদের দুষ্কৃতিকারী বলে অপবাদ দিয়ে বিশ্ব বিবেককে প্রতারিত করেছিল। মুক্তিযােদ্ধারা তাই জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দলকে দুর্জয় প্রাণের আনন্দ নিয়ে প্রমাণ করিয়ে দিয়েছে মুক্তিযােদ্ধারা দুষ্কৃতিকারী নয়। তারা স্বাধীনতা প্রত্যাশী সূর্যসৈনিক। আর পাকবাহিনী বর্বর ইতিহাসের জঘন্যতম নিষ্ঠুর অত্যাচারী। প্রয়ােজনীয় রেকি শেষ করেছে। ওরা বসেছে দলীয় অধিনায়কের সামনে। সুবােধ বালকের মতাে। একান্ত মনােযােগী হয়ে শুনছে অধিনায়কের আদেশ-নির্দেশ। হারিকেনের মিট মিট আলােয় ওরা ক’জন বিপ্লবী। সামেন আধা ভাঙ্গা একটি টেবিল। বর্ণনা দিচ্ছেন একজন কি করে গত তিনদিন হানাদার বাহিনীকে ফাকি দিয়ে হােটেল আগ্রাবাদের সব গােপন তথ্য ও পাকসৈনিকদের অবস্থান বের করে আনলেন। কখনও মৌলভীর বেশে, কখনাে পত্রিকার হকার হয়ে আবার কখনাে বিদ্যুৎ বিভাগের কর্মীর বেশে। ডাঃ জাফর উল্লাহ বােরহান, ডাঃ সাইফুদ্দিন, ফয়েজুর রহমান, গরীব উল্লাহ, শফি (মুন্সী)সহ মুক্তির সৈনিকেরা একান্ত অনুগত শীষ্যের মতাে দল নেতাকে হােটেল আগ্রাবাদের অবস্থান জানালেন। দলীয় অধিনায়ক ভাবছেন কি করে এ অপারেশন সফল করা যায়। পাকসৈনিকরা হােটেল আগ্রাবাদকে কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থার মধ্যে নিয়ে এসেছে। তাদের রক্ষা ব্যুহ ভেদ করে ভিতরে আঘাত হানা অসম্ভব। চিন্তার রেখা সকলের মাঝে। সময় বেশি নেই। হাই কমান্ড থেকে নির্দেশ এসেছে হােটেল আগ্রাবাদ অপারেশন করতেই হবে। কারণ পাকসরকার রেডিও-টেলিভিশনে প্রচার করছে পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক।
বিশেষ করে জাতিসংঘে তাদের দূত পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক বলে প্রচার করছে। পাকপ্রতিনিধির কথার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য এসেছে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক বাহিনী। তাদের একটি দল এসেছে চট্টগ্রামে। উঠেছে হােটেল আগ্রাবাদে। তাদের আগমনে পাকসৈনিক ও তাদের দোসররা হােটেল আগ্রাবাদসহ পুরাে চট্টগ্রামের নিরাপত্তা জোরদার করেছে। অধিনায়ক টেবিলের উপর রাখা কাগজে রেকির বিবরণ চিত্র দেখছেন। অবশেষে আগ্রাবাদ হােটেলের উত্তর পূর্ব কোণের একটি স্থানে কলম ঠেকালেন। তিনি সামনে উপবিষ্ট অন্যান্য সতীর্থদের বললেন, ‘পুরাে এলাকায় পাকসৈনিকদের কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনী রয়েছে কিন্তু ঐ অংশে তুলনামূলকভাবে কম। কারণ এই অংশে রয়েছে একটি বিদ্যুৎ ট্রান্সফরমার। এ ট্রান্সফরমারই হচ্ছে হােটেল আগ্রাবাদের প্রাণ। এটার উপর হােটেল আগ্রাবাদের বিদ্যুৎ নির্ভর করছে। এ ছাড়াও এ-পথ দিয়ে তেমন কেউ চলাচল করে না। তাই কর্তৃপক্ষ ও পাকসৈনিকরা এ-পথের তেমন গুরুত্ব দেয়নি। তবুও প্রতিদিন একজন পাকসেনা ও স্থানীয় একজন ট্রান্সফরমারটি পাহারা দিয়ে থাকে। হােটেল আগ্রাবাদের অন্যান্য অংশের তুলনায় নিরাপত্তা বেষ্টনী এ অংশে একেবারে দুর্বল। মুক্তিযােদ্ধারা ভাবলেন এ স্থানটিই হবে অপারেশনের জন্য উত্তম। সিদ্ধান্ত হল শুধুমাত্র ঐ ট্রান্সফরমারটিকে উড়িয়ে দিতে হবে এবং রক্তপাত পরিহারে সচেষ্ট থাকতে হবে। একদিন কেটে গেল। সংগ্রহ করা হল প্রয়ােজনীয় বিস্ফোরক ও অস্ত্র ।
বিভিন্নভাবে গােলাবারুদ পৌছে গেল মােগলটুলী কবির তােরণ মাতব্বর বাড়ির মুক্তিযােদ্ধাদের গােপন আশ্রয়ে। বাড়িটির বৈশিষ্ট্য ভিন্ন। বাড়িটির মুখে রয়েছে কবির তােরণ নামের একটি বিরাট গেইট। দু’পাশে বড় বড় দুটি কবরস্থান। দু’কবরস্থানের মাঝ দিয়ে চলে গেছে একটি রাস্তা। গেইট পেরিয়ে ভিতরে ঢুকলে অনেকগুলাে আঁকাবাঁকা গলি। ভিতরে অনেকগুলাে ঘর। সেখানের একটি ঘরে মুক্তিযােদ্ধাদের আশ্রয়কেন্দ্র। আশ্রয়কেন্দ্রের পেছনে রয়েছে একটি পানা ভর্তি ডােবা ও পাড় জংলায় ভরা। এমনি একটি বাড়িতে মুক্তিযােদ্ধারা গােপন ঘাঁটি স্থাপন করেছে। কোন অপরিচিত ব্যক্তির পক্ষে এ শেল্টারের খোঁজ পাওয়া কষ্টকর। বিশেষ করে এ বাড়ির মহিলা-পুরুষ সবাই মুক্তির সৈনিক। তাদের মনােবল, সাহস ও স্বাধীনতার প্রতি অকৃত্রিম একাগ্রতা ছিল বিস্ময়ের ব্যাপার। অর্থাৎ নিরাপত্তার ব্যাপারে এ আস্তানা বেশ ভাল। ইতিমধ্যে পবিত্র মাহে রমজান এসে গেছে। ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা শত দুঃখ কষ্টের মধ্যেও সিয়াম সাধনায় নিজেদের নিয়ােজিত রেখেছেন। এরি মধ্যে অপারেশনের ক্ষণ ঠিক হয়ে গেল। বুদ্ধিবিবেক ও বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে অপারেশন সম্পন্ন করতে হবে। অপারেশন শেষ করে সবাই চলে যাবে পূর্ব মাদারবাড়ি শেল্টারে। দ্বিতীয় রমজান। এ মাসের পবিত্রতায় ধর্মপ্রাণ মানুষ মসজিদে তারাবির নামাজ পড়তে যায়। মসজিদে মানুষ যা হওয়া দরকার তা হয়নি। পাকবাহিনীর ভয়ে। মােগলটুলীর গােপন শেল্টারে তখনও মুক্তির সৈনিকরা অপারেশন আয়ােজনে ব্যস্ত। দলীয় অধিনায়ক ডাঃ মাহফুজুর রহমানসহ অপারেশনে অংশগ্রহণকারী সকল যােদ্ধা এসে গেছে। প্রত্যেকের সাথে দলীয় অধিনায়ক আলিঙ্গন করলেন। ক্ষীণ স্বরে জয় বাংলা’ বলে মাটি তুলে নিলেন হাতে। ঘড়ির কাঁটা ঠিক আটটার ঘর ছুঁয়েছে।
বাঙলা মায়ের দামাল সন্তানরা বেরিয়েছেন। মােগলটুলী শেল্টার থেকে হােটেল আগ্রাবাদের দূরত্ব অতি অল্প। পাড়ার অলিগলি দিয়ে তারা এসে গেল হােটেল আগ্রাবাদের উত্তর পূর্ব কোণের ট্রান্সফরমারের প্রায় নিকটে সামনের বাড়িটি সমস্যা হয়ে দাঁড়াল। এ বাড়ির উপর দিয়ে যেতে হবে। বাড়ীর মালিক ঈশা খান। তিনি গরীব উল্লাহ ও সফিকে চেনেন। দেখে ফেললে সমস্যা হতে পারে। সুকৌশলে দেয়াল ঘেঁষে ঘেঁষে একে একে পার হয়ে বাড়ির পেছনে এলেন। সেখান থেকে বাড়ির অংশ পরিস্কার দেখা যাচ্ছে। জায়গাটি ভীষণ মন্ধকার। তাই মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য বিশেষ সুবিধে হল। উত্তর পূর্বকোণের ট্রান্সরমারটিও দেখা যাচ্ছে। ট্রান্সফরমারের পাশে একটি ছােট গেইট। গেইটের ভিতরে দু’জন প্রহরী বসে বসে কথা বলছে। তাদের স্টেন ও রাইফেল একপাশে রেখে দিয়েছে। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে মুক্তিযােদ্ধারা তাদের কাজ ঠিক করে ফেলল। কে কি করবে । দ্রুত নিঃশব্দে পা চালিয়ে ওরা এলেন ট্রান্সফরমারের গেইটে । নিরাপত্তা প্রহরী দু’জন তখনও গভীর আলােচনায় ব্যস্ত। আচমকা মুক্তির সৈনিকরা লাফিয়ে পড়ল তাদের সামনে। কেউ কিছু বুঝার আগেই তাদের বুকে রিভলবার চেপে ধরল। নিরাপত্তা প্রহরীদ্বয় ঘটন। আকস্মিকতায় বিহ্বল। তাদের নিয়ে আসা হল গেইটের বাইরে অন্ধকার স্থানে। রক্তপাত পরিহার করতে হবে। তাই তাদের না মেরে পিছমােড়া দিয়ে গাছের সাথে বেঁধে রাখা হল। একজন পাকসৈনিক অন্যজন স্থানীয় অবাঙালি রাজাকার। ট্রান্সফরমারের বিস্ফোরক স্থাপন করতে গিয়ে প্রথমত ফয়েজুর রহমানের হাত পুড়ে গেল। একই অবস্থা হল গরীব উল্লাহর (তার হাতে এখনাে দাগ রয়েছে)। তারপরও উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক বসানাে হল। জাফর উল্লাহ বােরহান ও ডাঃ সাইফুদ্দিন পুরো অপারেশন স্থলের নিরাপত্তা নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন। তারা দু’জনে পাকবাহিনীর অস্ত্রগুলাে নিয়ে চলে এলেন। অবশ্য পূর্বেই প্রহরীদ্বয়কে নিরাপদ স্থানে নিয়ে আসা হয়েছে। তারা বার বার মিনতি জানাচ্ছে যেন তাদের হত্যা করা না হয়। ধমকের সুরে বলা হল আওয়াজ করলেই গুলি করে দেব।
তাদের মুখ বেঁধে দেয়া হল। তারা মৃত্যুর ভয়ে চুপসে গেল। ইঙ্গিত এল। সবাই একে একে নিরাপত্তা প্রহরীদের নিকট সরে এল । নিরাপত্তা প্রহরীরা বুঝতে পারেনি মুক্তিযােদ্ধারা প্রস্থান করেছে। প্রহরীদ্বয় মনে করেছিল মুক্তিরা অস্ত্র হাতে পেছনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। অন্ধকারের মধ্যেই তারা সবই ঈশা খানের বাড়ির ভিতর দিয়ে সকলের চক্ষুকে ফাকি দিয়ে চলে এলেন কমার্স কলেজ রােড পেরিয়ে অন্য এলাকায়। রাত ৯.১২ মিনিটে প্রচন্ড শব্দ করে বিস্ফোরণ হল। অন্ধকার হয়ে গেল হােটেল আগ্রাবাদ। মানুষজন ভয়ে দৌড়াচ্ছে। হােটেল আগ্রাবাদের ভিতর শুরু হয়েছে চেচামেচি হােটেল কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসেছে স্বদেশী-বিদেশী সবাই। হােটেল চত্বরে অবস্থানকারী পাকসৈনিকরা এদিক-ওদিক ছুটছে আর এলােপাথাড়ী গুলি ছুড়ছে। মােগলটুলী আবদুর রহমান মাতব্বর মসজিদে তখনও তারাবির নামাজ চলছিল। পথচারীরা ভয়ে মসজিদে ঢুকে গেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের অপারেশনের সময় দলীয় অধিনায়ক ডাঃ মাহফুজুর রহমান মাথায় টুপি দিয়ে মােগলটুলীস্থ হাসান নামক এক বন্ধুর বাসায় বসেছিলেন। তারা প্রথমে বুঝতে পারেনি কেন মাহফুজ সাহেব এসেছেন। বিস্ফোরণের শব্দ হওয়ার পর হাসান ও তার স্ত্রী ব্যাপার বুঝতে পারলেন। আকারে ইঙ্গিতে অপারেশনের সফলতার জন্য ধন্যবাদ জানালেন। মুক্তিযুদ্ধের স্থানীয় কর্মী আবদুল মমি। তাকে নভেম্বরের ২৩ তারিখ আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায় নির্যাতন ক্যাম্প ডালিম হােটেলে। নির্যাতন করেছে। অমানবিক পদ্ধতিতে। তাদের অত্যাচার ভােগ করার চেয়ে মৃত্যু শতগুণে শ্রেয়। অবশ্য তিনি অলৌকিকভাবে তাদের নির্যাতন শিবির থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছিলেন। হােটেল আগ্রাবাদ অপারেশন প্রসঙ্গে মতিন বলেন, আমি সেদিন মসজিদে ছিলাম। নামাজ তখন দশ কি বারাে রাকাত শেষ হয়েছে। শুনলাম প্রচন্ড আওয়াজের শব্দ। বুঝতে পারিনি। পুরাে এলাকাকে কাঁপিয়ে দিয়েছে।
মুক্তিযুদ্ধে সময় অনেক আওয়াজ শুনেছি। তবে এতাে প্রচন্ড আওয়াজ শুনিনি।’ অপারেশন শেষ করে মুক্তিযােদ্ধারা মােগলটুলী বাজারে এসে বিস্ফোরণের আওয়াজ পেলেন। আনন্দে আত্মহারা হয়ে দ্রুত পা ফেলে চলে এলেন পূর্ব মাদারবাড়ির তৎকালীন ছাত্রনেতা মুক্তির সৈনিক আবদুল আহাদ চৌধুরীর বাড়িতে। হােটেল আগ্রাবাদের অপারেশন সবাইকে বিস্মিত করেছে। পাকসরকারের গর্ব চূর্ণ হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে বলে জাতিসংঘে পাকিস্তানের দূত যে প্রচার করেছে তা মিথ্যা প্রমাণিত হল। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল মুক্তিযােদ্ধাদের সম্পর্কে নতুন ধারণা নিয়ে ফিরে গেল। পাকসরকারের মিথ্যাচার সম্বন্ধে তারা সুস্পষ্ট ধারণা পেল। হােটেল আগ্রাবাদ অপারেশনের পরদিন স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতারকেন্দ্র থেকে অপারেশনের সংবাদ প্রচার হল। বিবিসি’ও এ সংবাদ পরিবেশন করেছে। বিশেষ করে এম আর আক্তার মুকুল রসালাে করে চরমপত্রের মাধ্যমে হােটেল আগ্রাবাদ অপারেশনের বিবরণ দিয়েছেন।
(সূত্র : রণাঙ্গনে সূর্য সৈনিক, সাখাওয়াত হােসেন মজনু)
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত