You dont have javascript enabled! Please enable it! বিস্ফোরণের মুখে হােটেল ইন্টারকন - সংগ্রামের নোটবুক
বিস্ফোরণের মুখে হােটেল ইন্টারকন
ঢাকার হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল। সংক্ষেপে কেউ বলে ডাকা ইন্টারকন। আন্তজাতিক মানসম্পন্ন হােটেল। অঙ্গে আন্তঃমহাদেশীয় আভরণ, অবয়বে পাশ্চাত্যের জৌলুস। কখনাে মনে হয়, যেন প্রাচ্যের সোঁদা গন্ধময় ঢাকা নগরীর বুকে পাশ্চাত্য কালচারের একটি মিনি গ্রাফটিং। এই পান্থশালায় রাষ্ট্রীয় সম্মানিত অতিথির যেমন পদরেনু পড়ে তেমনি তাবৎ পৃথিবীর পর্যটন, সফরকারী সরকারী-বেসরকারী প্রতিনিধি, সাংবাদিকশিল্পীর লাগে পদস্পর্শ। শুধু স্পর্শ কেন, বলা যায় মুখর হয় হরেক রমক নামী-দামী অতিথির গুঞ্জনে। পঁচিশে মার্চের সেই বিভীষিকাময় রাত এবং তার পরের দিনগুলােতে। এই হোটেল অবলােকন করেছে নানা ঘটনার নেপথ্য ছায়াবাজী, হয়ত বা শ্রবণ করেছে সংগােপন সংলাপ। যদি বলি অধিকৃত ঢাকা নগরীতে এই হােটেলটি ছিল এই আর্ন্তজাতিক কর্ম প্রবাহের অন্যতম প্রাণকেন্দ্র, তাও বােধহয় ভুল বলা হবে না। আর এই হােটেলই পর পর দু’বার কেঁপে উঠেছিল প্রচণ্ড বিস্ফোরণের শব্দের ঝাকুনি লেগেছিল বিদেশেও। পাশ্চাত্যের সভ্যতাগবী স্বার্থান্বেষী দেশগুলােতে গিয়ে লেগেছিল ঢাকার ইন্টারকনের কাঁপন। প্রথমবার জুন মাসে। বিশ্বব্যাংকের একটি দল এবং পাকিস্তানকে সাহায্যদানকারী কনসর্টিয়ামের চেয়ারম্যান মিঃ কারগিল তখন ঢাকায় উদ্দেশ্য অর্থনৈতিক পরিস্থিতি নিরূপণ, পাকিস্তানের বৈদেশিক সাহায্যের চাহিদা যাচাই । জুন মাসের প্রথমার্ধে হয় গ্রেনেড চার্জ। পর পর তিনটি গ্রেনেড হােটেলের অতিথির পিলে চমকে দিল।
গ্রেনেড তিনটি ছোড়া হয়েছিল রাতের বেলা হােটেলের সামনের ট্যাক্সি ষ্ট্যান্ডের পাশের ফুটপাত থেকে। ওখানে চারটি বড় গাছ ছিল। প্রথম গ্রেনেডটি ছােড়া হয়। হােটেলের পাের্চ দাড়ানাে বিশ্বব্যাংকের গাড়ির উপর । দুটি হােটেলেরই সামনের টানা বারান্দার দুপাশে। এই অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বব্যাংক তথা বিশ্ববাসীকে মুক্তিবাহিনীর বলিষ্ঠ অস্তিত্ব জানিয়ে দেয়া।  একটি হাইজ্যাক করা নীল রঙের ডাটসুন কারে এসে মুক্তিবাহিনীর চারজন তরুণ এই অপারেশনটি করে। এছাড়া আরেকজন ছিলেন গাড়ির চালক। তিনি পেশায় টেলিভিশনের একজন ক্যামেরাম্যান। গাড়িটি হাইজ্যাক করা হয় সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে সাতটায় গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশনের সামনের রাস্তা থেকে। ভবনটিতে তখন রয়েছে। প্রায় এক কোম্পানী হানাদার সৈন্যের ক্যাম্প। _ গেরিলারা একটি টয়ােটা এবং একটি ট্রাম্প গাড়িতে চেপে গাডি হাইজ্যাক করতে বেরিয়েছিল। এয়ারপাের্ট রােড়ে এসে তারা এই ডাটসুটিকে দেখতে পায়। গাড়িতে ড্রাইভার ছাড়া অন্য কোন আরােহী নেই। অনুসরণ শুরু হল। তারপর গুলশানে ভারতীয় হাইকমিশন ভবন বরাবর এসে দুটি গাড়ির একটি ডাটসুনকে ওভারটেক করে ওর পথরােধ করে দাড়াল। ড্রাইভারকে রিভলভারের নল ঠেকিয়ে বলা হল গাড়ি দাও। -পাড়ি নিয়ে তারা এল সিদ্বেশ্বরীর এক বাসায়। সেখানে থেকে নেয়া হল ৮টা গ্রেনেড। _ হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে গ্রেনেড় নিক্ষেপের পর তারা এল রমনা থানার পাশ দিয়ে মগবাজারে কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা ও শান্তি কমিটির কর্মকর্তা এডভােকেট এ কিউ এম শফিকুল ইসলামের বাসায়। চলন্ত গাড়ি থেকে শফিকুল ইসলামের বাসায় ছাড়া হয় দুটো গ্রেনেড। সেখান থেকে তাদের গাড়ি ছুটল মতিঝিল এলাকায় একটি সিনেমা হলের দিকে। কিন্তু পথিমধ্যে একটি পত্রিকা অফিসের কাছে এসে পরিকল্পনা বদল হল। তারা। দেখতে পেল, রােজকার মতাে সে রাতেও পত্রিকা অফিসের গেটের কয়েকজন পাঞ্জাবী। দারােয়ান বসে বসে আড্ডা মারছে। সাথে রয়েছে মিলিশিয়া জওয়ান।
গাড়ি থেকে সেই গেট লক্ষ্য করে ছোঁড়া হল গ্রেনেড। কিন্তু যে গেরিলাটি এই কাজ করেছিল তার জামার আস্তিন আটকে গিয়েছিল গাড়ির দরজার লকে গ্রেনেড নিক্ষেপের সময়। ফলে এটি লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়।  হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে দ্বিতীয় ঝাকুনি লেগেছিল ১১ই আগষ্ট বিকেলে। হােটেলের বাথরুমে রক্ষিত ২৮ পাউন্ডের পিকে বা পুষ্টিক এক্সপ্রেসিভ বিস্ফোরণে হােটেল ভবন এবং আসবাবপত্রের ক্ষতি হয়েছিল। এই অপারেশনের মূল দুই নায়ক ছিল সামাদ ও বাকের (পরে শহীদ)। অন্যান্য সহযােগীদের মধ্যে ছিল উলফত, মায়া ও গাজী।  হােটেল ইন্টারকনকে এই দ্বিতীয় ঝাঁকুনি দেয়ার ইচ্ছে বেশ কিছু দিন থেকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা মনের মধ্যে পােষণ করছিল। সেই জুনের ঘটনার পর হােটেলে বসেছিল কড়া পাহারা। মােতায়েন হয়েছিল হানাদার খানসেনা, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ। হােটেলের তিন কোণে ছিল বালির বস্তার প্রতিরােধ দেয়াল। সেখানে সর্বক্ষণ লাইট মেশিনগান, এসএলআর, বা জি-৩ এর নল উঁচু হয়ে রয়েছে। এছাড়া রয়েছে নিজস্ব গার্ড। হানাদার খানসেনা ও পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ হােটেলকে বলতে গেলে রীতিমতাে বাসাবাড়ি বানিয়ে ফেলেছিল।
একদিন বৈঠক বসল। ঠিক হল শীগগীরই এই অপারেশনটি করতে হবে। সামাদ ভাই এই অপারেশনের জন্যে আগে থেকেই খোঁজ-খবর ও মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। তিনি তার পরিকল্পনা বৈঠকে বসলেন। গৃহীত হল পরিকল্পনাটি। হােটেল ইন্টারকনে অকারণে বা মােটামুটি প্রয়ােজনে তখন প্রবেশ করা দুঃসাধ্য ব্যাপার। অথচ অপারেশনের জন্যে কয়েকবার হােটেলে যেতে হবে। তােফা এক ফন্দী বের করলেন সামাদ ভাই। তিনি নিওন সাইন’এবং ‘গ্লো-সাইন’-এর ব্যবসা করতেন। কন্ট্রাক্টের কাজ। ঐ হােটেলের বিভিন্ন দোকানের নিওন’ এবং ‘গ্লো-সাইনের কাজ আগে করেছেন। এই সূত্র ধরেই অপারেশনের কার্যক্রমের ধারা তৈরি করা হল। থাই ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি প্রশস্ত অফিস ছিল হােটেলের শপিং আর্কেডের পূর্ব পশ্চিম দিকের সারিতে। বিমান সংস্থাটি ওখান থেকে অফিসটি হােটেলের আর্কেডের পূর্ব কোণে একটি ছােট কক্ষে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নিল। উদ্দেশ্য ব্যয় সংকোচ করা। ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার ভেতরে যেমন যােগাযােগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়েছিল তেমনি বহির্জগতের সাথেও বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল যােগাযােগ বন্ধন। বিদেশী বিমান কোম্পানী দূরে থাক, পাকিস্তান আন্তর্জাতিক এয়ারলাইন্সও হালে পানি পাচ্ছিল না। এ অবস্থায় প্রকাণ্ড অফিস সাজিয়ে রেখে বসে মাছিমারা থাই এয়ার লাইন্স কর্তৃপক্ষ সমীচীন মনে করল না। এ জন্যেই অফিস স্থানান্তরের ব্যবস্থা।
সামাদ সাহেব এই অফিস স্থানান্তরের সুযােগ নিলেন। গায়ে পড়ে তিনি কর্তৃপক্ষের সাথে আলাপ করলেন। নতুন অফিস কক্ষের ‘গ্লো-সাইন’ লাগানাের অর্ডার নিলেন বাজারের চলতি রেটের চেয়েও কম পয়সায় যাতে কোন কমপিটিশনই না হয়। এর উদ্দেশ্য হােটেলে যেন সহজে আসা-যাওয়া করা যায়।  কয়েক দিন ‘রেকি করার পর ঠিক হল ‘সাকী বার’-এর বিপরীত দিকে পুরুষদের টয়লেট রুমের একটেরে কোণায় ল্যাট্রিনের মধ্যে বিস্ফোরক বস্তুটি রাখা হবে। দশই আগষ্ট সামাদ সাহেবের গ্লো-সাইনের কাজ শেষ হল। তারপর হােটেলের ‘ডি ডে’র জন্যে চলল চূড়ান্ত পর্যায়ের কাজ। এগারােই আগষ্ট সকালে বায়তুল মােকাররম থেকে ৫৩ টাকা দিয়ে কেনা হল একটি ব্রিফ কেস। তারপর ওর ভেতরে সাজান হল বিস্ফারক-২৮ পাউণ্ড পিকে এবং ৫৫ মিনিট মেয়াদী ‘টাইম পেন্সিল’। তারপর বিকেলে গাড়িতে চেপে অপারেশনে রওয়ানা হল সামাদ, বারেক, মায়া ও গাজী। এদের মধ্যে শেষের দু’জন গাড়িতে স্টেনগান নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।  হােটেলের লাউঞ্জে প্রবেশের জন্যে মূল দরজা দিয়ে না ঢুকে ‘সুইস এয়ার’-এর অফিস কক্ষের দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকল সামাদ ও বারেক। এ ব্যাপারে সহায়তা করলে। ঐ অফিসেরই এক বন্ধু। প্রথমে সামাদ টয়লেট রুমে ঢুকলেন। খানিকপরে বাকের। বাক্স খুলে ‘টাইম পেন্সিল প্রেস করল। এর আগেই ল্যাট্রিনের দরজায় দাঁড়িয়ে কভার হিসেবে বাকের ব্রীফকেসটি রাখল কমােডের পেছনে। তারপর দরজা তেমনি বন্ধ রেখে বিস্ফোরণটি ঘটায় তাদের নাম হল ফেরদৌসী ও জন। এরা দু’জনেই ছিল ম্যাট্রিক পরীক্ষার্থী। ফেরদৌসের বাড়ি বড় মগবাজার। এবং জনের বাসা নারিন্দা। এদের সহায়তা করেন ডিআইটির একজন কর্মচারী।  মূল পরিকল্পনা ছিল ডিআইটি টাওয়ারের উপর টেলিভিশনের এন্টেনা টাওয়ারটি কাটিং চার্জ করে ফেলে দেয়া। ফেরদৌস ও জনের কাজ ঠিক সেভাবেই চলছিল। কিন্তু মাঝপথে এসে বাধ্য হয়ে তাদের পরিকল্পনা পাল্টাতে হয়।
ডিআইটি জোনারেল সেকশনের সেই সহায়ক বন্ধুটি নিজে গেরিলা বা বিচ্ছু ছিলেন না। কিন্তু তাঁর বুকেও ছিল বিচ্ছুদের মতাে প্রাণবহ্নি। জনের সাথে প্রথম আলাপ হল তাঁর। জন জিজ্ঞেস করল, তিনি সহায়তা করতে রাজী আছেন কিনা? তিনি সম্মত হলেন। ডিআইটি ভবনে ঢােকার জন্যে তিনি ফেরদৌস ও জনকে দুটি পাশ জোগাড় করে দিলেন। সেই পাশ দিয়ে ডিআইটি ভবনে প্রবেশ করে তারা চলে গেল ‘এন্টেনা টাওয়ারের কাছে। পাঁচ থেকে সাত মিনিট সেখানে তারা থাকল। এ সময়ের মধ্যে তারা রেকি ওয়ার্ক অর্থাৎ জরীপ কাজ করে নিল। জায়গাটিকে মাপা হল। ঘনত্ব নিরূপণ করা হল। কাটিং চার্জ বসবার জায়গা ঠিক করা হল। তারপর তারা ফিরে এল। ঠিক হল, বিস্ফোরণের জন্যে দরকার ১৬ পাউণ্ড পিকে; ২০ ফুট কর্ড-এক্স (সাধারণত একই সময়কালে বাড়তি বিস্ফোরণ ঘটানাের জন্যে এই বিস্ফোরক কর্ডটি ব্যবহার করা হয়; পােড়ার গতি হল প্রতি সেকেণ্ড ২১ হাজার মিটার); ১টা ডেটোনেটর এবং ৬ ফুট ফিউজ ওয়্যার। সেদিন বিকেলেই রমনা পার্কে একটি গাছের নিচে বসে ডিআইটির সেই বন্ধুর সাথে আলাপ হল। কিভাবে মাল পাচার করা হবে তা বুঝিয়ে বলা হল। ঠিক হল, জুততার মধ্যে পায়ের পাতার নিচে এবং পায়ে নকল ব্যাণ্ডেজের আড়ালে এগুলাে নেয়া হবে। পরদিন থেকেই মাল পাচার শুরু হল।
অফিসে যাওয়ার আগে বন্ধুটির বাসায় গিয়ে দুই পায়ে প্যান্টের নিচে ফার্স্ট এইড’ ব্যাণ্ডেজ বেঁধে দিল জন। এই ব্যাণ্ডেজের নিচে রাখা হল প্যাকেট ছাড়ানাে ৪ আউন্স করে মােট আট আউন্স পিকে। এই বিস্ফোরকটি দেখতে ঘরের চালে লাগাবার পুডিং-এর মতাে। দুই পায়ে জুতাের ভেতরে পায়ের পাতার নিচে এমনি করে দেয়া হল আরাে ৮ আউন্স পিকে। বন্ধুটি এভাবে ১২ দিনে মােট ১২ পাউণ্ড পিকে বহন করলেন। এই জিনিসগুলাে তিনি রাখতেন সাততলার কক্ষে। ওখানে রাজ্যের পুরনাে ফাইলপত্র স্তুপাকৃতি অবস্থায় ছিল। তার মধ্যে জিনিসগুলাে তিনি লুকিয়ে রাখলেন। বারােদিনের মাথায় ইপিআইডিসি’র পাশে হাবিব ব্যাংকের সামনে ট্যাক্সিতে রক্ষিত বােমার বিস্ফোরণ ঢাকা নগরীকে বেশ নাড়া দিয়ে গেছে। এর ফলে ডিআইটি ভবনে চেকপােষ্টসমূহে তল্লাশী আরাে বেড়ে গেল। দমেও গেলেন ভদ্রলােক। কিন্তু জন ও ফেরদৌস তাকে আবার চাঙ্গা করে তুলল। হাবিব ব্যাংকের বিস্ফোরণের ঘটনার পরদিন বন্ধুর পায়ে নকল ব্যাণ্ডেজের নিচে বেঁধে দেয়া হল ৬ ফুট গজ ফিউজ ওয়্যার’। ফাউন্টেন পেনের মধ্যকার অংশগুলাে ফেলে দিয়ে খােলের মধ্যে ভরে দেয়া হল একটি ডেটোনেটর। (সূত্র : ঢাকায় গেরিলা অপারেশন, হেদায়েত হােসেন মােরশেদ)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত