You dont have javascript enabled! Please enable it! তেরখাদায় মুক্তিযুদ্ধ - সংগ্রামের নোটবুক
তেরখাদায় মুক্তিযুদ্ধ
তেরখাদার নির্বাচনে নির্বাচিত এমপিএ ডাঃ মুনসুর আলীর নেতৃত্বে তেরখাদা থানায় মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়। তিনি খুলনার তৎকালীন এসপি জনাব আবদুর রকীব খােন্দকারের নিকট থেকে ৭০টি রাইফেল এবং প্রায় চল্লিশ হাজারের মতাে গুলি পান। এসব নিয়ে তেরখাদা থানার ওসি বাবু নিরঞ্জন সেন, ফোহাম উদ্দীন ও বােরহান উদ্দীনের নিকট দেন এবং তাদের দায়িত্বে তেরখাদা হাই স্কুল মাঠে শুরু হয় অস্ত্রের প্রশিক্ষণ। পরবর্তীকালে মােল্লা নূরুল হক; গােপালগঞ্জের নূরুল হক, সােহরাব, জলিল, মােহাম্মদ আলী পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয়ায় মুক্তিবাহিনীর শক্তি বহুলাংশে বৃদ্ধি পায়। এমপিএ ডাঃ মুনসুর আলীর পরামর্শ মােতাবেক তেরখাদা থানায় ফোহাম উদ্দীনের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ইতিমধ্যে ফোহাম উদ্দীন ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দীন নামে পরিচিত হন। 
১৫ই মে, তেরখাদা থানার কিছু দালাল খুলনায় এসে পাকমিলিটারীর সাথে যােগাযােগ করে তাদের নিয়ে তেরখাদায় আসে এবং তারা ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দীন, আব্দুল ওহাব মােল্লা, এম এ দাউদ, রতন, সুনীল কুমারসহ শাহপাড়া গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেয় এবং লুটপাট করে। ঐ একই দিনে হাঞ্চনগাতি গ্রামের নলিনী রঞ্চন সাহা ও প্রফুল্লকুমার সাহাসহ মােট ১৬২টা বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। খুলনা ফেরার পথে ছাচিয়াদহ ত্রাসের রাজত্ব কায়েম হয়। ক্যাপ্টেন ফোহাম উদ্দীনের নেতৃত্বে যখন গেরিলা প্রশিক্ষণের জন্য একদল যুবক ভারতে ডাঃ মুনসুরের সাথে যােগাযােগ করে এবং তাদের প্রশিক্ষণ, প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ ইত্যাদি দিয়ে তিনি পুনঃ তাদের তেরখাদায় পাঠান, তখন থেকে নতুন করে শুরু হয় যুদ্ধ। তেরখাদায় রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় মে মাসের প্রথম দিকে ক্যাপ্টেন ফোহাম, রতন, বােরহান মাস্টার প্রমুখের নেতৃত্বে শুরু হয় রাজাকার ক্যাম্পের উপর আক্রমণ। দুই পক্ষে বেশ গােলাগুলি চলে। মুক্তিযােদ্ধারা রাজাকার ক্যাম্প ঘেরাও করে ফেলে এবং ব্যাপক আক্রমণ চালায়।
এই যুদ্ধে ৩০/৩৫ জন রাজাকার নিহত হয়, মুক্তিবাহিনীর পক্ষে ১ জন শহীদ ও ৩ জন আহত হয়। শহীদ ছেলেটির বাড়ি ছিল কালিয়া থানার কুঞ্জপুর গ্রামে। ২৮শে মে তেরখাদা ক্যাম্প থেকে মােল্লাহাটে রাজাকারদের উপর এক প্রচন্ড আক্রমণ করা হয়। এই যুদ্ধ ৩/৪ ঘন্টা চলে। এই যুদ্ধে ৪ জন রাজাকার নিহত হয় এবং মুক্তিবাহিনীর পক্ষে কালিয়া থানার গাছবাড়ি গ্রামের আবুবকর নিহত হয়। নতুন করে সাজগােজ করে তেরখাদা থানায় পুনরায় রাজাকার ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা হয়। এবার রাজাকাররা নতুন করে অত্যাচার শুরু করে। ফলে মুক্তিবাহিনী ২৮শে আগস্ট পুন এই রাজাকার ঘাঁটি আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নেয়। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়ে ক্রলিং করে গিয়ে ক্যাম্পের ভিতর গ্রেনেড় ফেলে। প্রচন্ড বেগে গ্রেনেডের বিস্ফোরণ ঘটে। বেশ কয়েকঘন্টা ধরে যুদ্ধ চলে। এই যুদ্ধে প্রায় ৪০/৫০ জন নিহত হয় এবং অস্ত্রসহ ২ জন রাজাকার ধরে আনা হয়।
বিভিন্ন সময় তেরখাদা ক্যাম্প থেকে গিয়ে কালিয়া, বড়দিয়া ও মােল্লাহাট থানায় আক্রমণ চালান হয়। এমন কি মােল্লাহাটের প্রখ্যাত চরকুলিয়া যুদ্ধ পরিচালনা করা হয় তেরখাদা ক্যাম্প থেকে। তেরখাদায় মুক্তিবাহিনীর যুদ্ধ পরিচালনা ও মুক্তিযােদ্ধাদের সুবিধা-অসুবিধা তদারকী করার জন্য তিনি একমাত্র এমপিএ যিনি তিনবার মুজিব নগর থেকে তেরখাদায় আসেন। মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের প্রায় সময় তেরখাদা থানা মুক্তিবাহিনীর দখলে ছিল। ডাঃ মুনসুর আলীর নির্দেশে তেরখাদায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন দপ্তর চালু ছিল। এই সময় বিচার বিভাগের দায়িত্বে ছিলেন এ্যাডভােকেট জনাব মােঃ আলী। ডাঃ মুনসুরের প্রচেষ্টায় তেরখাদার মুক্তিবাহিনী নর্থ খুলনা মুক্তিবাহিনী হিসাবে স্বাধীনতা যুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেল এমএজি ওসমানীর নিকট থেকে স্বীকৃতি পায় এবং অস্ত্রশস্ত্র লাভ করে। (সূত্র ও স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)

সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত