You dont have javascript enabled! Please enable it! রাজিব-যুদ্ধশিশু - সংগ্রামের নোটবুক
রাজিব

রাজিবের আগমন সিমসন পরিবারে এমন ঘটনার মধ্য দিয়ে যা সিমসনেরা বোধহয় কখনাে ভুলবেন না। সিমসনেরা নয়াদিল্লির কানাডীয় হাই কমিশনারের অফিস থেকে যে তার বার্তা পেয়েছিলেন তাতে লেখা ছিল তারা রাজিব নামে একটি ছেলে পাচ্ছেন, যাকে সুনিল-এর বদলে পাঠানাে হচ্ছে। আরও লেখা ছিল, সুনীল ডঃ রবার্ট ফেরির বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্য পরীক্ষায় টেকেনি। তার পর পর সিমসনেরা এও জানলেন যে, সুনীল ছেলেটি কে? সে শিশুটি (সুনীল) তখনই শিশু ভবনে মৃত্যুবরণ করেন। সুনীলকে আগে পছন্দ করা হয়েছিল তাদের জন্য এবং তাকে আলাদা করে হাসপাতালে রাখা হয়েছিল। কিন্তু দুর্বল স্বাস্থ্যের শিশুটি বাঁচেনি।রাজিবের জন্ম ১৯৭২ সালে ১ জুলাই ঢাকার শিশু ভবনে। তার জন্মের সময় ওজন ছিল ৩ কেজি। ফ্রেড ও বনি কাপুচিনােরা তখন ঢাকায় । ওকে তারা সিমসনদের জন্য পছন্দ করেন। যেহেতু সিমসনেরা তখন কানাডাতে অন্যান্য দায়িত্বে ছিলেন। রাজিবকে প্রথম দলের ১৫ জন যুদ্ধশিশুর অংশরূপে সিমসনদের জন্য পছন্দ করা হয়েছিল। যখন ১৯ দিন বয়সের রাজিব কানাডাতে পেীছল, তখন সিমসনদের কাছে মনে হয়েছিল শিশুটির যেন জন্মের পর আর কোনাে ওজন বাড়েনি। আনুষ্ঠানিক দত্তক নেবার সময় সিমসনেরা তার শিশু ভবনে দেয়া নামটি রাখেন প্রথম নাম হিসেবে, মাঝের নামের জায়গায় সংযুক্ত করেন ক্যাপুচিনাে এবং পরিবারের নাম সংযুক্ত করা হলে ছেলেটির নাম দাঁড়ায় রাজিব ক্যাপুচিনাে সিমসন।

রাজিব অন্য ছেলেমেয়েদের মতােই বড় হচ্ছিল। সে ব্রাউন এলিমেন্টারি স্কুল, টরন্টো, অন্টেরিওতে পড়াশােনা শুরু করে। তারপর সে নদান সেকেন্ডারি স্কুলে যায় ১৯৮৮-১৯৮৯। ১৯৮৯ সালে রােগ নির্ণয়ে ধরা পরে যে, একধরনের মানসিক রােগে (সিজোফ্রেনিয়া) আক্রান্ত, যে রােগের জন্য চিন্তা, অনুভূতি ও কাজের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব, অর্থাৎ ভগ্নমনষ্কতা পরিলক্ষিত হয়। আমরা সপ্তম অধ্যায়ে দেখতে পাবাে যুদ্ধশিশুদের প্রথম সফরে তাদের জন্মদেশে যাওয়ার পর তাদের প্রতিক্রিয়া। রাজিব তখন এক সপ্তাহের জন্য ক্যানাডপ্টের সংগঠিত ১৯৮৯ সালের সফরে গিয়েছিল। তখন রাজিব ১৬ বছর বয়সের বালক। তবে সে খুব কম কথা বলত। দেখা গেল, যারা বাংলাদেশে য়েছিল বাংলাদেশকে যেভাবে দেখেছিল, রাজিব ঠিক সেভাবে দেখেনি। সিমসনেরা বিশ্বাস করেন যে, যেহেতু রাজিব বাংলাদেশ সম্পর্কে বেশি কিছু জানত না, তার কোনাে পরিষ্কার ধারণা ছিল না সে কী দেখবে সে দেশে। স্যাড্রা বলেন, বিষয়টি এরকমও হতে পারে যে, রাজিব যখন দেখল দেশের দরিদ্ররা কী কষ্ট করে এক মুঠো ভাতের জন্য, বয়স নির্বিশেষে ছােট থেকে বুড়াে বয়সেও কাজ করতে হচ্ছে শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য, সে দেখে স্তম্ভিত।
স্যান্ড্রার ভাষ্যমতে, কানাডাতে বড় হওয়ার আগে জীবনে প্রথম দারিদ্রতার এমন বাস্তব রূপ দেখে সম্ভবত মানসিকভাবে আঘাতপ্রাপ্ত হয়। ঢাকার রাস্তায় সাধারণ মানুষদের দুর্বিপাক অবস্থা দেখেনিশ্চয়ই অন্যান্য যুদ্ধশিশুদের মতাে ভাবে – যে তাকে দত্তক না নিলে হয়তাে তার অবস্থাও ওরকম হতে পারত। পরিবারের ভাষ্যমতে, মানসিকভাবে বিপর্যস্ত রাজিব ভয়ঙ্কর দারিদ্র, শিশু শ্রম, অনাহার ও মানবিক দুর্দশা দেখে তার মানসিক ভারসাম্য ও স্থিতিশীলতা হয়তাে হারিয়ে ফেলে। স্যান্ড্রা বলেন যে, রাজিব যখন বাংলাদেশে গিয়েছিল, তার কানাডীয় জীবনে তার কোনাে অভিজ্ঞতা হয়নি । রাজিব ভাষাটা বলতে পারত না বলে সে তখনকার মানুষের সঙ্গে নিজেকে মেলাতে পারেনি। তিনি আরও বলেন, “১৯৮৯ সালে রাজিব বুঝতে পারেনি দারিদ্রতার আসল রূপ কী, বাংলাদেশে দারিদ্র দেখার পর সে আরও বুঝেছে যে সে অন্যদের মতাে দেখতে একরকম হলেও সে কানাডীয় । রাজিবের করুণাবস্থার বিশদ করতে গিয়ে স্যান্ড্রা বলেন যে, অর্থনৈতিক জীবনের এহেন চিত্র দেখে সম্ভবত ঘাবড়ে যাওয়া রাজিব তার জন্মদেশের সঙ্গে যােগসূত্র কেটে দিয়ে নিজেকে সম্পর্কহীন করে তােলে । অন্যভাবে বলা যায় সেজন্যই হয়তাে রাজিব কানাডার সঙ্গে আরও বেশি নিজেকে সংশ্লিষ্ট করতে থাকে । এ ধরনের সমস্যার সাথে পরিচিত সিমসন পরিতাপের সাথে বুঝতে পারেন যে, রাজিব তার দুটি পরিচিতিকে সমন্বিত করার ক্ষমতা রাখে না। ফলে তার অপারগতা তাকে আরও দ্বিধাগ্রস্ত করে ফেলে। কানাডা ও বাংলাদেশের মাঝে যে বিশাল পার্থক্য তাতে ওর সব মাপজোক গুলিয়ে যায়, সে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়ে।
রাজিবের দত্তক অবস্থান বিষয়ে প্রতিক্রিয়া এবং তার স্কুল ও বাড়ির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নেয়া এবং লেখাপড়া ও অন্যান্য কাজকর্মে সে যেমন করছিল, এদের সম্পর্কের পারস্পরিকতা। খোজার অবকাশ এখানে নেই। যেমনটি ইঙ্গিত করা হয়েছে, এর সঙ্গে বরং তার মায়ের গর্ভধারণের শর্তাদি অর্থাৎ যে পরিস্থিতিতে তার মা তাকে গর্ভে ধারণ করেছিলেন এবং যতদিনের জন্য করেছিলেন তার সম্পর্ক বেশি ছিল মনে হয় । স্যাভ্রা আরাে বলেন, এটা খুবই সম্ভব যে রাজিব বাংলাদেশে যা দেখেছিল তার জন্য সে প্রস্তুত ছিল না মােটেই। বাংলাদেশে সে হয়তাে তখন আচমকা কোনাে আঘাত পেয়েছে, উত্তষ্ঠিত স্যান্ড্রা অনুমানে বলেন । সে যে ঐ রকম ভয়ঙ্কর দরিদ্র সমাজের মানুষ তেমন কোনাে নগ্ন সত্যের মুখােমুখি হবার জন্য সে কখনাে তৈরি ছিল না। তার অভিজ্ঞ অভিমত। ব্যক্ত করে স্যান্ড্রা আবারাে বলেন যে, এ কথাটি তাে সত্যি । আগে সে কখনাে এমন অনুভব করেনি যে সে দু’বিশ্বের মাঝে – কানাডা ও বাংলাদেশের মধ্যে ঝুলে রয়েছে নিঃসন্দেহে। ঢাকায় অনাথ আশ্রমে যাওয়ার অভিজ্ঞতা তাকে আমূল কাঁপিয়ে দেয়। আবার নৃতাত্ত্বিক বিচারে সে কোথাকার, কোনাে সমাজের দাবিদার সদস্য সেটা তার নিজের কাছে অত্যন্ত প্রকট হয়ে ধরা দেয়ায় সে ঠিক বুঝতে পারেনি সে কোথা থেকে এসেছে।
সিমসনরা এটা জানতে ও বুঝতে পেরেছিলেন যে, সাধারণত সব পােষ্য শিশুদের মধ্যেই। তাদের অতীত খোজার এবং নিজের উৎস এবং পূর্বপুরুষ সম্পর্কে জানার আগ্রহ লক্ষ্য করা যায় । রাজিবের মধ্যে এর কোনাে লক্ষণ দেখা যায়নি। পরিবারের সদস্যরা বলেন, প্রথম থেকেই রাজিব কখনাে তার জন্মদেশ, সমাজ বা বাড়ি ঘর সম্পর্কে কোনাে আগ্রহ দেখায়নি, তাই গােড়া অনুসন্ধানের জন্য কেমন করে কী হলাে, কীভাবে তার জন্ম ইত্যাদি বিষয়ে সে একদমই উৎসুক ছিল না। কিন্তু একই সাথে স্যান্ড্রা বলেন, রাজিবের পথও নেহাৎ মসৃণ ছিল; বরং সে পথ ছিল অনিশ্চয়তায় ভরা । কিন্তু রাজিব কখনাে রায়ানের (আরেক যুদ্ধ শিশু যার সম্পর্কে আমরা ইতােমধ্যে জেনেছি) মতাে তার অতীত জানতে চায়নি। মায়ের কথা যদি বলেন, ওটা রাজিবের জন্য এমন কোনাে অতীত ইতিহাস ছিল না যে সে বিষয়ে জানতেই হবে।
“দত্তক বিষয়ে এমন কোনাে গভীর আবেগী ইস্যুও ছিল না যার নিষ্পত্তি প্রয়ােজন,” স্যাভ্রা রাজিবের মানসিক ও আচার ব্যবহারের পরিবর্তন সম্পর্কে এভাবে মন্তব্য করেন। বড় হওয়ার কালে রাজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ এবং “অধিকৃত বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্তানে” পাকিস্তানি সেনাদের অনাচারের বিষয়ে তেমন কিছু জানতে চায়নি এবং শােনেওনি । স্যাজ্জ্বার। মনে পড়ে, রাজিব কেবল জানত যে তাকে বাংলাদেশের এক অনাথ আশ্রম থেকে দত্তক নিয়ে। কানাডায় আসা হয়েছিল । সিমসনরা জানতেন, তাদের সব ছেলেমেয়েরই নিজ নিজ উৎস ও জন্মদেশ সম্পর্কে জানার অধিকার রয়েছে। তাদের নিজ জন্মদেশগুলােতে মানুষেরা কী কষ্টে জীবনধারণ করে সেটাও তাদের জানার দরকার। সেখানে জীবনযাপন যে অত্যন্ত কষ্টের এবং তাদের দত্তক নিয়ে আসা যে এক অলৌকিক ঘটনা সে বিষয়ে তাদের অবগত হওয়া উচিত। কিন্তু সিমসনরা এ বিষয়ে কখনাে কোনাে জোর দেননি। এ ব্যাপারে তারা মােটামুটিভাবে তাদের সন্তানদের ব্যক্তিগত পছন্দের উপরে ছেড়ে দিয়েছিলেন।
দুর্ভাগ্যবশত ১৯৯০ সালের পর থেকে দীর্ঘ অসুস্থতার কারণে রাজিব পিছিয়ে পড়তে থাকে। যখন তার বয়স ১৬ থেকে ১৮। তখন রাজিব স্কুলে যাবার উৎসাহ হারিয়ে ফেলে। লেখাপড়ায় মন বসাতে পারেনি, তার সখের ব্যাপারগুলিও (hobby) অবহেলিত হতে থাকে। বয়স ১৮ বছর হওয়া পর্যন্ত সে ছিল তাজা কিশাের, প্রাণচাঞ্চল্যে ভরপুর। ১৯ বছর হতে না হতে সে পরিবারের সবার চোখের সামনে ভেঙে পড়তে লাগে। তার আগে পর্যন্ত স্যাভ্রার। ভাষ্যমতে: “সে ছিল বুদ্ধিমান এবং ভালাে ব্যবহারে অভ্যস্ত একটি ছেলে যাকে মানুষ করাটা দুঃসাধ্য ছিল না” । রাজিবের বােন মেলানির (সিমসনদের মেয়ে) ভাষ্যমতে “মাঝে মাঝে খুব সামান্য ব্যাপারে রাজিব উত্তেজিত ও মারমুখী হয়ে উঠত”। সত্যি কথা বলতে কি, সে সময়গুলােতে রাজিব প্রায়ই নিজেকে আহত করার প্রবণতায় ভুগত; স্নায়ুবৈকল্য ও মুর্হারােগে। আক্রান্ত রােগীর মতাে চেঁচামেচি করত । ফলে তার কথাবার্তা জড়িয়ে যেত যেটা অন্যদের কাছে দুর্বোধ্য হয়ে পড়ত। এত সত্ত্বেও মেলানির মতে, রাজিব সবসময় উষ্ণ হৃদয় মানুষের মতাে আচরণ করত যা তার চারপাশের সবাই বুঝতে পারত ।
রাজিবের বয়স ২০ বছর হতে না হতেই দেখা গেল তার সার্বক্ষণিক তত্ত্বাবধানের প্রয়ােজন হয়ে দাড়াল । নইলে তার আচার অনেকাংশে ভীতিপ্রদ এবং অনিশ্চিত আচার ব্যবহার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। এ অবস্থার আলােকে এবং সময়ের চাকা যেভাবে গড়ায় তাতে রাজিব আগের তুলনায় আরও বিদ্রোহী ধরনের হয়ে ওঠে। তার সঙ্গী-সাথীরাও তাকে বশ মানাতে ব্যর্থ হয় । ওর পরিবার সবসময় ওকে ভালােবাসার কথা বলে বন্ধুত্বের আদর দিয়ে এবং পরিবারের সবার সমর্থন দিয়ে তাকে ইতিবাচক পরিবেশ সৃষ্টির কথা বলে সান্তনা দেয়ার চেষ্টা করেন । ডাঃ ফেরি বাংলাদেশে যুদ্ধশিশুদের বাছাই করার পর প্রথমবারের মতাে রাজিব ও অন্য সকল যুদ্ধশিশুর ডাক্তারি পরীক্ষা করেছিলেন। সে স্বাস্থ্য পরীক্ষায় রাজিবের ফাইলে নেতিবাচক কিছু পাওয়া যায়নি। পরবর্তী বছরগুলিতে সিমসনরা বুঝতে পারেন রাজিবের যেসব শারীরিক ও মানসিক সমস্যাগুলি আগে চিহ্নিত করা যায়নি, পরে সমস্যাগুলি তাকে আচমকা তীব্রভাবে আক্রান্ত করে।
রাজিব যে পর্যায়ের বৈকল্যে ভুগছিল, দেখা গেল তার মা-বাবা এটুকু জ্ঞান লাভ করেন যে, যে কোনাে শিশুর জীবনের প্রথম ভাগে মানসিক অসুবিধাগুলি সঠিকভাবে সনাক্ত করা প্রয়ােজন। ছােটখাটো অকার্যকারিতা দেখা দিলে সেগুলি বিশদভাবে চিহ্নিতকরণ ও চিকিৎসার মাধ্যমে কার্যকর করে তােলা অবশ্য কর্তব্য। সেটা তারা পরে বুঝতে পারলেন । ঐ সময়ে পুরাে পরিবার রাজিবকে নানাভাবে আশ্বস্ত করার চেষ্টা চালায়। মােটামুটিভাবে তাকে বলার চেষ্টা করা হয়েছিল যে, সে যতই কষ্ট সহ্য করুক আর যত বিপদের মধ্য দিয়ে যাক সে পরিবারের সকলের ভালােবাসা পেতে থাকবে আগের মতাে । রাজিবও তার মা-বাবা ও ভাইবােনদের বিশ্বাস করে যে, প্রয়ােজনবােধে তারা ওকে যখন তখন সাহায্য করবে। এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না সিমসনদের সবচেয়ে বড় শক্তি ছিল যে, পরিবারের কোনাে ছেলেমেয়েরা মােটেই অবহেলিতবােধ করেনি, যখন মা-বাবা এরকম একের পর এক সমস্যার সমাধান করেছিলেন।
গােটা পরিবার যখন চাপের মুখে, সকল পারিবারিক সদস্য পরিস্থিতির টানটান অবস্থা হৃদয়ঙ্গম করেন এবং যার যার সুবিধেমতাে একে অন্যের শুশ্রুষা করেছেন । টুকরাে টুকরাে সাফল্য একত্রিত করে জুড়ে নিয়ে বড় সাফল্য তৈরি করে। পরিবারের সবাই রাজিবের অবস্থা যাতে আরও খারাপ না হয় সেদিকে লক্ষ্য রাখেন। আচার ব্যবহারের বিচারে, “রাজিবকে সামলানাে আসলেই বেশ কষ্টের ছিল, অল্প বললে এটুকুই বলা যায়,” ওর বােন মেলানি সিমসন বলে। শেষ পর্যন্ত দেখা গেল রাজিবের অসুস্থতা যতই বাড়তে থাকে, সে ততই তার মা-বাবার আবেগী কথাবার্তাকেও তুচ্ছ করত । পরিবারের সদস্যরা তখন এটা বুঝতে পেরেছিলেন যে রাজিব ওরকম আচরণ কেন মা-বাবার সাথে করছিল। তারা জানতে পেরেছিলেন যে, ওটা তার ব্যক্তিগত প্রত্যাখ্যান নয়! সিমসনরা তখন পরিষ্কারভাবে বুঝতে পারেন রাজিব তার পারিবারিক সদস্যদের কী আপনভাবে জীবনের প্রথম থেকে দেখে আসছে! এতে সন্দেহের কোনাে অবকাশ নেই। অতএব মা-বাবা বিশ্বাস করেন সিমসন পরিবারে দত্তক নেবার জন্য রাজিবের অসুস্থতা দেখা দেয়নি। অসুস্থতার উৎস তার জন্মলগ্ন থেকে, এমনকি গর্ভধারণের কাল থেকে। যতবার লেখকের সাথে স্যাভ্রার আলাপ হয়েছে ততবারই স্যান্ড্রা বলার চেষ্টা করেছেন যে: রাজিব নিজেকে কানাডীয় হিসাবে দেখে । কারণ সে অন্য আর কিছু জানে না, দেখেওনি।
কথাটি বলার পর স্যান্ড্রা তার বক্তব্যে আরও জোর দিয়ে বলেন, ১৯৮০ এবং ১৯৯০ এর দশক জুড়ে তারা ভয় পাচ্ছিলেন রাজিবের শরীর ও মনের স্বাস্থ্য আরও খারাপ হতে পারে । সিমসনরা রাজিবের চিকিৎসার সুফল পাবার আশায় ব্যতিব্যস্ত হয়ে অনুসন্ধান করেন অন্য কোনাে চিকিৎসা পদ্ধতি, যেমন অন্য কোনাে হাসপাতাল কিংবা চিকিৎসা পদ্ধতির পরিবর্তন। প্রথমবার হাসপাতালে যখন নেয়া হলাে তখন চিকিৎসকেরা রাজিবের ভগ্নমনষ্কতার কথা বলেছিলেন, যার জন্য তার নিয়মিতাে চিকিৎসার প্রয়ােজন । ঐ অসুখটা এক বিচিত্র ধরনের নৈর্ব্যক্তিকীকরণ ও ক্রমবর্ধমান উৎকণ্ঠা সংশ্লিষ্ট অসুখ। পারিবারিক সদস্যদের জন্যও ওটা হঠাৎ এক ভীতিকর অভিজ্ঞতা ছিল।
রাজিবের স্বাস্থ্যের অবস্থা বর্ণনা করতে গিয়ে স্যাভ্রা তাকে “ভ্ৰমগ্রস্ত ভগ্নমনষ্ক ছেলে যে ক্ষিপ্ত হলে নিজের এবং পারিবারিক সদস্যের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে। বাড়িতে যখন রাজিবের নানা ধরনের চিকিৎসা হয়েছে, তখন পরিবারকে মারাত্মক ভীতিকর অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হয়েছে সন্দেহ নেই। যখন চিকিৎসকেরা রােগ নির্ণয় করে ভগ্নমনষ্কতার বিষয়ে উপযুক্ত চিকিৎসার ছকে পরিকল্পনা তৈরি করে দিলেন, সিমসন পরিবার সাহস ও আশার সঙ্গে পরবর্তী সময়ে রােগের সঙ্গে লড়াইয়ে নামেন। ক্রমে ক্রমে পুরাে পরিবারের জন্য রাজিবের অসুস্থতা তাদের জীবনের এক পরম সত্য হয়ে দাঁড়ায় – ভালােবাসা, আদর, বিনােদন ও শিক্ষার দ্বারা ভারসাম্য বজায় রাখার পালা।
১৯ জন ছেলেমেয়ে মানুষ করে তােলা মা-বাবা হিসাবে সিমসনরা তাদের মনের গহনে অনুভব করতেন রাজিবের সমস্যা ও ইস্যুগুলি । কিন্তু ওর আবেগী উন্নয়নে একটা গােলমেলে ব্যাপার রয়ে গিয়েছিল। সঙ্কটের পুরাে সময় সিমসন প্রশংসনীয়ভাবে পরিবারের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য প্রদর্শন করেছেন। সকল ঝড় ঝাপটা ও বাধা বিপত্তি মােকাবিলা করার জন্য পরিবারের সবাই পারস্পরিকভাবে অনুগত এবং বিশ্বস্ত থেকেছেন শুধু রাজিবের জন্য। তারা। এমনভাবে তাদের ভালােবাসা একে অন্যকে যুগিয়েছে যা প্রতিফলিত হয়েছে তাদের বলার ভঙ্গিতে, শারীরিক ভঙ্গিতে অনুভূতির ছোঁয়া প্রকাশে একে অপরকে প্রদর্শনের মাধ্যমে । আরেকটি বিচক্ষণীয় দিক যে, সঙ্কটকালে পারিবারিক সদস্যরা বৃত্তাকারে একত্রিত হতেন যেটা শীঘ্রই সিমসন পরিবারে সাধারণ ঐতিহ্য হয়ে দাঁড়ায় । দুর্ভাগ্যক্রমে, বহু বছর যাবত ওষুধ চলার পরও রাজিবের কোনাে পরিবর্তন হয়নি। সময়ের সাথে সাথে বরং অনেকটা খারাপই হয়েছিল।
একদিকে বলা হয় যে, গর্ভবকালের সময় মেয়াদি দুশ্চিন্তায় তীব্র মােড় এবং টান আর মাতৃত্বের উভয়লতা অনেক সময় গর্ভস্থ সন্তানের ব্যক্তিত্বে গভীর ক্ষত রেখে দিতে পারে। অন্যদিকে জীবন সম্প্রসারিত করে এমন সব আবেগ, যেমন- আনন্দ, উত্যুল্লতা এবং উচ্চাশা স্বাস্থ্যবান শিশুর আবেগীয় উন্নয়নকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে উল্লেখযােগ্যভাবে । বর্তমান অধ্যায়ে প্রতিটি শিশুর সংক্ষিপ্ত জীবনালেখ্য আমরা দেখতে পাবাে কেমন করে তাদের নিজের ধারণার উপর ভিত্তি করে এবং পরিবার ও পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে এ জটিল বিষয় সম্পর্কে আমাদের গােচরীভূত করে । রাজিবের ক্ষেত্রে আমরা হয়তাে কখনাে জানতে পারব না তার বিভিন্ন ধরনের ব্যক্তিত্ব ও ভাবভঙ্গির কোনটির কতখানি অংশ সে মাতৃগর্ভে অবস্থানকালে পেয়েছে বিশেষ করে যে পরিস্থিতে তার মা ধর্ষনের শিকার হয়ে তাকে নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়েছিলেন।
“অধিকৃত বাংলাদেশে” এক গর্ভধারিণী জন্মদাত্রী মায়ের উদ্বেগ, পীড়ণ এবং মানসিক চাপের মাত্রা বিবেচনা করলে এটা স্বীকার্য যে, এ ধরনের চাপ সবচেয়ে অনাকাক্ষিত পরিবেশে গর্ভধারণ করা শিশুর ক্ষেত্রে খুব সম্ভবত নেতিবাচক ফলাফলই হবে। চিকিৎসকদের মতে, নেতিবাচক ফলাফলের মধ্যে অল্প ওজন, খিটখিটে মেজাজ এবং (মাতৃত্বের চাপে শিশুর অস্বাভাবিক মস্তিষ্ক) ইত্যাদি উল্লেখযােগ্য। প্রজনন বিষয়ে গর্ভস্থ শিশুদের ভেতরে যেসব প্রবণতা বিরাজ করে তার মধ্যে আগ্রাসিকতা, আপত্তিকর মনমর্জি, মনের গতির উঠানামা, ভ্ৰমগ্ৰস্থতা, মনােবৈকল্যতা এবং ভগ্নমনস্কতা রাজিবের ক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হয়। রাজিবের ক্ষেত্রে আমারদের মনে রাখতে হবে যে, তার জন্মদাত্রী মা এবং অন্যান্যরা অধিকৃত বাংলাদেশে কীভাবে সন্তান ধারণ করেছিলেন । ডাক্তারি বিদ্যায় বলা হয়ে থাকে যে, আপন মাতৃত্বের প্রতি মায়ের যে প্রতিক্রিয়া বা মনােভাব, সেটাই গর্ভস্থ সন্তানের মস্তিষ্কের পূর্ণতা প্রাপ্তি ও ভবিষ্যৎ আত্মমর্যাদাবােধের নিয়ামক। রাজিবকে যদি ‘aborted’ (অর্থাৎ অকালে হঠাৎ জীবন শেষ করে দেয়া) শিশু যে কোনােক্রমে প্রাণে বেঁচে’ ছিল ধরে নেয়া হয়, তবে তাকে স্থিতিস্থাপকতার জীবিত উদাহরণ হিসাবে দেখা যেতে পারে (The Gazette, 13 October, 1972)। আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই, মানসিকভাবে অস্থির এবং মারাত্মকভাবে সমস্যায় আক্রান্ত হলেও রাজিবের বাঁচবার শক্তি অদম্য। সাধারণ মানুষের ভাষায় রাজিবের জন্মদাত্রী মায়ের গর্ভধারণকে ঘিরে অস্বাভাবিক ঘটনাবলির প্রভাবই রাজিবের বর্তমান মানসিক অবস্থার জন্য দায়ী।
সিমসনরা অবগত আছেন যে, অনেকে যুক্তি তুলে ধরেন যে শিশু তার মায়ের এবং মায়ের সঙ্গীদের দ্বারা মানসিকভাবে প্রভাবান্বিত হন। তদানুসারে রাজিব যেখানেই বাস করুক না কেন সারা জীবন তাকে সহিংসতা ও ক্ষতচিহ্ন বয়ে বেড়াতে হবে। যে সহিংসতা “অধিকৃত। বাংলাদেশে তার মায়ের ওপর ঘটেছিল, তার স্মৃতি তাকে সারা জীবন তাড়া করে ফিরবে । কাউকে দোষ না দিয়ে সিমসনরা রাজিবের বাস্তবতাকে মেনে নিয়েছিলেন একথা জেনেই যে, একজন মানুষ প্রজনন বিষয়ে উত্তরাধিকারী তার নিয়ন্ত্রণ অন্য কেউ করতে পারে না। বাবামায়েদের মতে এর অর্থ হলাে, রাজিব যে চ্যালেঞ্জের মুখােমুখি দাঁড়িয়েছিল সেটা সাধ্যমতাে বােঝার চেষ্টা করা । রাজিব অথবা সিমসন দম্পতি কেউই প্রজননের অংশীদার হতে পারেন । তার গুণাগুণ সম্যক বুঝে নিয়ে তার মােকাবেলা করা সেই উত্তরাধিকারীর পক্ষেই সম্ভব ।
উপসংহারে এ কথা বলা নিরাপদ যে, রাজিবের বর্তমান নৈরাশ্যজনক বিশ্ব প্রাথমিকভাবে। মারাত্মক কতগুলাে সমস্যার একটি সিরিজ মাত্র। কয়েকদিন সে চুপচাপ পড়ে থাকত কিন্ত হঠাৎ উদ্দীপনায় ফেটে পড়ত। পরিবারের এ ধরনের হঠাৎ হৈ চৈ যথেষ্ট সংঘাতের জন্ম। দিয়েছে ইতােমধ্যে। তার মা-বাবা জানেন, রাজিব অন্য ভগ্নমনষ্ক অসুস্থ মানুষের মতাে। আচার আচরণে, রুষ্ট ও অবাধ্য হয়ে ওঠে। তবুও রাজিবের বিপন্ন অবস্থা দেখে তার মা-বাবা এবং ভাইবােনেরা সবসময় তাকে বােঝার চেষ্টা করেছে। শেষ পর্যন্ত রাজিবের উত্তরােত্তর খারাপ অবস্থা দেখে মা-বাবা উপলব্ধি করেন যে, বাইরে কোথাও স্থানান্তরিত করা প্রয়ােজন। তারা আরও বুঝলেন যে, যদিও সে এত বড়টি হয়েছে। বাড়িতে থাকলে সুনির্দিষ্ট ঝুঁকি বাড়তে পারে। তারা উপলব্ধি করেন যে, যে সংস্থায় সে থাকবে বা তার চিকিৎসা করা হবে সেখানে লােকদের উপরও অহেতুক নির্ভরতা বাড়বে। ফলে ওকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা সমস্যাবহুল হবে। ডাক্তার, বিশেষজ্ঞ, কাউন্সেলরদের সঙ্গে পরামর্শ করে সিমসনরা রাজিবের জন্য যেটা সবচেয়ে ভালাে, ওকে একটি প্রতিষ্ঠানে রাখার সিদ্ধান্ত নেন। আশ্চর্যের কিছু নেই, রাজিবের মানসিক স্বাস্থ্যের দ্রুত অবনতি ঘটতে দেখে পরিবার রাজিবকে নিরাপদে রাখা এবং পারিবারিক সদস্যদের নিরাপত্তার কথা ভেবে ওকে একটি উপযুক্ত ও যথােচিত প্রতিষ্ঠানে রাখতে বাধ্য হলেন। সালটা ছিল জানুয়ারি ২০১০।
রাজিব বর্তমানে Ontario Shores Centre for Mental Health Sciences নামক এক প্রতিষ্ঠানে থাকে। এটি অন্টেরিওর হুইটবি শহরে অবস্থিত। সংক্ষেপে প্রতিষ্ঠানটিকে ‘Ontario Shores’ বলা হয়। এটি একটি সরকারি হাসপাতাল যেখানে নানা ধরনের রােগীর বিশেষ পরীক্ষা করা হয়, চিকিৎসা সেবা দেয়া হয় এবং জটিল ও কঠিন মানসিক রােগীদের দীর্ঘ চিকিৎসা দেয়া হয়। মাই লেইনের ভাষ্যমতে, হতাশা ও ক্রোধে বিপর্যস্ত হলেও রাজিব Ontario Shores-এ থাকাটা মােটামুটিভাবে মানিয়ে নিয়েছে। সিমসনর পরিবারের সদস্যদের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী রাজিব সেখানে নিরাপদবােধ করে, যেমনটি আশা করা হয়েছিল। এমনকি প্রথম দুবছর তার বােন মাই লিয়েনের অফিসে যখন তখন যেত এবং তার সাথে সংলাপ করত । কিন্তু ২০১২ থেকে সে আস্তে আস্তে সেখানে যাওয়া কমিয়ে দেয়। একসময়ে দেখা গেল যে সে সেখানে যাওয়া একদম বন্ধ করে দেয় । পরিবার তাকে প্রায়ই স্বাস্থ্যকর খাবার পাঠান । তাছাড়া শরীরের যত্ন নেবার বিষয়ে একটি ব্যায়ামের প্যাকেজ” তাকে পাঠিয়েছেন দুবছর আগে। মাই লিয়েন এও জানায় যে, রাজিবকে ভারি মাত্রায় ওষুধ খাইয়ে রাখা হয়। পরিবার এতেই খুশি যে রাজিব Ontario Shores-এ পেশাজীবীদের তত্ত্বাবধানে আছে। এটা যে রাজিব কোনাে রকমে বেঁচে আছে সেরকম অবস্থা নয়। পরিবার এখনও রাজিবের প্রতি অনুরক্ত। “সবাই তার অনুপস্থিতি উপলব্ধি করে। অবশ্য কেউ তার মানসিক স্বাস্থ্যের ব্যাপারে কিছু করতে পারে না। তাকে ভালাে রাখার অন্য কোনাে উপায়ও কারাে জানা নেই,” দুঃখের সাথে বলে মাই লিয়েন । পরিবার জানে আজ রাজিব বিষন্নতায় উদাসীনভাবে বেঁচে আছে এক ভীতিকর অবস্থার মধ্য দিয়ে । যখন মাঝে মাঝে তার উদ্দীপনা বাড়ে, তখন তাকে আবার ওষুধ দেওয়া হয়। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত রাজিবের জীবনের পাওয়া না পাওয়ার কথা বলতে গিয়ে রাজিবের মা তার ছেলের বর্তমান অবস্থা খুব সংক্ষেপে বর্ণনা করেন এভাবে, “সবচেয়ে সুন্দর ভদ্রলােক ছেলে আমার যখন সুস্থ, এবং ঠিক এর উল্টো যখন অসুস্থ হয়।

সূত্র : ৭১-এর-যুদ্ধশিশু-অবিদিত-ইতিহাস-মুস্তফা-চৌধুরী