প্রায় বেলা ১২টার দিকে পাকসেনাদের কনভয়ের ৩/৪ টা গাড়ি গােয়াল খালি অতিক্রম করলে, নগর আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রধান মীর্জা খায়বার হােসেন খবর পেয়ে সকলকে প্রস্তুতি নেয়ার নির্দেশ দেন। এক দল আশ্রয় নেয় বৈকালী সিনেমা হলের ভেতর, অন্যদল খুলনা বিভাগীয় পাবলিক লাইব্রেরীর ভেতর। মীর্জা খায়বার হােসেন, এ্যাডভােকেট মঞ্জুরুল আলম, শেখ দবিরুল ইসলাম, মীর্জা আফজাল হােসেন, তবারক মােল্লা, আবু জাফর জফা, শেখ হিসাম উদ্দীন, শেখ কুতুব উদ্দীন, শেখ সালাম উদ্দীন, শেখ সারােয়ারু উদ্দীন, মুজাম্মির, খিজির আলী, দুলু কাজী, হাবিবর রহমান, খবীর জিন্না, বাবু খােকন, শেখ নূর মােহাম্মদ, ওয়াদুদ, মােহাম্মদ আলম , শেখ আব্দুল গাফফার, কালিপদ, মাে: নুরুল হক, পুলিশের সিপাহী মুফাজ্জল মুন্সি, পুলিশ ও আর্মির প্রাক্তন সদস্যসহ ৫০/৬০ জন মিলিত ভাবে বিভিন্ন স্থান থেকে পাককনভয়কে বাধা দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়। ইতিমধ্যে পাকসেনাদের তিন চারটি গাড়ি এসে যায়। সাথে সাথে শুরু হয় রাইফেল ও বন্দুকের গুলি। পাকসেনারা বিপদ দেখে যশাের রােডের পূর্ব দিকে দ্রুত নেমে পড়ে পজিশন নেয় এবং বৈকালী সিনেমা হল লক্ষ্য করে শুরু করে ব্যাপক গােলাবর্ষণ। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীও কম যায় না, তারাও বেপরােয়া হয়ে গােলাগুলি আব্যাহত রাখে। অবস্থা বেগতিক দেখে পাকসেনারা মর্টারের শেল নিক্ষেপ করতে থাকে। ফলে বৈকালী সিনেমা হলের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পাকসেনাদের একমাত্র টার্গেট তখন বৈকালী সিনেমা হল। কারণ, ওখান থেকেই বেশি গােলাগুলি তাদের দিকে আসছিল। পাকসেনারা বৃষ্টির মতাে গুলি করতে থাকে। ফলে সিনেমা হলে স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর পক্ষে আর কোন মতে টিকে থাকা সম্ভব ছিল না। তারা পিছু হটে নিরাপদ স্থানে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। পাবলিক লাইব্রেরী ও বয়রা গার্লস কলেজের ভিতর থেকে তখন শুরু হয় আক্রমণ।
খানসেনারা তখন পাবলিক লাইব্রেরী ও মহিলা কলেজের দিকে আক্রমণ শুরু করে, খানসেনাদের লক্ষ্যে অনেক বােমা ও ককটেল নিক্ষেপ করা হয়। কিন্তু সেগুলাে তেমন কাজে আসেনি। ঐ সময় একজন স্বেচ্ছাসেবক এক ঝুড়ি বােমা মাথায় করে বিড়ি খেতে খেতে দ্রুত এ্যাডভােকেট মঞ্জুরুল আলমের নিকট আসে। মঞ্জুরুল আলম তাকে বিড়ি খেতে দেখে ধমক দিলেন, কারণ আগুনে নিজেদেরই বিপদ হতে পারে। এলােপাথাড়ী বােমার লক্ষ্যহীন আক্রমণ চলে। বয়রা মহিলা কলেজের সামনে ছিল প্রচুর ইটের গাদা, সি এন্ড বির এই ইটের ঢিবির পিছন থেকে একদল তরুণ কয়েকটা আক্রমণ চালায়। খানসেনাদের একজন নিহত হয় এবং কয়েকজন আহত হয়। এই সময় পুলিশের সিপাহী মুন্সি মুজাম্মেল হক এক ইটের গাদা থেকে অন্য এক ইটের গাদায় যাওয়ার সময় পাকসেনাদের এক জোয়ান তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। নিশানা ছিল অব্যর্থ, তাই সাথে সাথে লুটিয়ে পড়ে এই অকুতােভয় যােদ্ধা। বিকেল ৪টা পর্যন্ত দু’পক্ষ ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত থাকে। খানসেনাদের আরাে ২০/২৫ টি গাড়ি চলে আসে। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা পিছু হটে যায় আর খানসেনারা চলে যায় খুলনা শহরে। এই যুদ্ধে এইচ এন্ড পুদ্দার কোম্পানীর একজন শ্রমিকও মারা যায়। তার নাম মুন্সি রাঙ্গা মিঞা। যুদ্ধ শেষে আজকের যুদ্ধের বীর শহীদ বয়রা রিজার্ভ ক্যাম্পের সিপাহী পি আর এফ নাম্বার ১৩৪, মুন্সি মােফাজ্জল হককে যথারীতি বাজারে দাফন করা হয়। এই শহীদের বাড়ি ছিল ফরিদপুর জেলার মুকছেদপুর থানার বাহাড়া গ্রামে। তার আত্মত্যাগ যুগ যুগ ধরে বয়রাবাসী স্মরণ করবে।
বয়রা যুদ্ধের পরদিন ২৮শে মার্চ খুলনা থেকে কয়েক গাড়ি মিলিটারী এসে বয়রা এলাকায় ব্যাপক জ্বালানাে-পেড়ানাে শুরু করে। স্থানীয় জনসাধারণের অনুরােধে এলাকার ক্ষয়ক্ষতি ও জানমালের নিরাপত্তার জন্য আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী প্রতিরােধ না করে পিছু হটে যায়। তারা ফুলতলায় যায় এবং আবু কাজী ও খােকন কাজীর বাড়ি লুট করে, পুড়িয়ে দেয়। এই সময় পাকসেনাদের পথ চিনিয়ে নিয়ে যায় সরাে মােল্লা, হাবিবুর রহমান। (পরবর্তীতে রাজাকার কমান্ডার), সৈয়দ মােল্লা, ওহাব মহলদার প্রমুখ। বয়রা যুদ্ধের ফলাফল যা-ই হােক না কেন, এই যুদ্ধ এতদ্বঞ্চলের লােকজনের দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। সামান্য ক’টা বােমা, রাইফেল, বন্দুক নিয়ে দুর্ধর্ষ খানসেনাদের গতিরােধ করা ছিল এক ঐতিহাসিক ঘটনা। বৈকালীর যুদ্ধ তাই খুলনার স্বাধীনতার ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। মীর্জা খায়বার, এ্যাডভােকেট মঞ্জুরুল আলম, মল্লিক সুলতান আহমেদ, শেখ দবিরুল ইসলাম, নূর মােহাম্মদ সহ অন্যান্য যযাদ্ধারা সেদিন যে সাহসিকতার নজির স্থাপন করেছে গােটাজাতির জন্য তা গর্বের বস্তু।
(সূত্র ঃ স্বাধীনতার দুর্জয় অভিযান, স ম বাবর আলী)