কামালপুর যুদ্ধ
একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম নিয়মিত ব্রিগেড ‘জেড ফোর্স’ ৭ই জুলাই গঠিত হয়। লেঃ কর্নেল জিয়াউর রহমান এই নব গঠিত ব্রিগেডের অধিনায়ক নিযুক্ত হন এবং তাঁর নামের ইংরেজী প্রথম অক্ষর দিয়ে এই ব্রিগেডের নাম— করণ করা হয় ‘জেড ফোর্স। প্রথম ইস্ট বেঙ্গল, তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল এবং অষ্টম ইস্ট বেঙ্গল এই ব্রিগেডের অন্তর্ভুক্ত হয়। মেজর মইনুল হােসেন চৌধুরী, মেজর জিয়াউদ্দিন (পাকিস্তান থেকে এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন), ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটোয়ারী, ফ্লাঃ লেঃ লিয়াকত আলী খান, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন আব্দুল হাফিজ, ক্যাপ্টেন আব্দুল কাইয়ুম চৌধুরী, মেজর সাফায়াত জামিল, ক্যাপ্টেন মহসিন, ক্যাপ্টেন আনােয়ার হােসেন, ক্যাপ্টেন আকবর হােসেন, লেঃ নুরুন্নবী চৌধুরী, ক্যাপ্টেন সাদেক হােসেন, লেঃ আনিসুর রহমান, লেঃ এমদাদুল হক, লেঃ ওয়াকার হাসান, লেঃ মােদাসের হােসেন, লেঃ মাহবুবুর রহমান, লেঃ এমদাদুল হক, লেঃ মুনিবুর রহমান, লেঃ ওয়ালিউল ইসলাম ও লেঃ বাকের ‘জেড ফোর্সের অধীনে যুদ্ধ পরিচালনা করেন। জামালপুর-ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কের প্রবশেপথ কামালপুর বিওপিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর শক্তিশালী ঘাঁটি ছিল। বাংকারগুলাের দেয়াল পর্যায়ক্রমে মাটি, টিন, লােহার বীম ও সিমেন্ট দিয়ে সূদৃঢ় করা হয়েছিল। প্রতিটি বাংকারের ছাদ সমূহ অনুরূপভাবে সুদৃঢ়ভাবে নির্মিত হয়েছিল।
টানেল তৈরি করে সমস্ত প্রতিরক্ষাবৃহ্যের বাংকারের মধ্যে যাতায়াত করার ব্যবস্থা ছিল। পাকিস্তানীরা বুবিট্রাপ, বাঁশের কাঞ্চি ও প্রতিরক্ষা ব্যুহ্যের সম্মুখে মাইন ফিল্ড দিয়ে সম্পূর্ণ এলাকাকে দুর্ভেদ্য দুর্গের মতাে তৈরি করেছিল। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মমতাজ ও লেঃ মান্নানকে কামালপুর পাক অবস্থান রেডি করার দায়িত্ব দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও লেঃ মান্নান রেকি করার সময় দু’জন পাকসেনার সম্মুখে পড়ে যায়। একজন পাকসেনার সাথে সালাউদ্দিনের ধস্তাধস্তি শুরু হয়। লেঃ মান্নান একটি গাছের নিচে অবস্থান নিলেন। সুবেদার হাই রাইফেলের বাট দিয়ে আঘাত করে পাকসেনার রাইফেল কেড়ে নিলেন। নায়েক শফি পলায়নপর পাকসেনাকে লক্ষ্য করে গুলি বর্ষণ করল। পাকসেনারা বাংকার থেকেও গুলি বর্ষণ করল । সুবেদার হাই শত্রুর অবস্থান লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ করতে করতে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের দিকে অগ্রসর হল। হাই সালাউদ্দিনের বুকের ওপরে চড়ে থাকা পাকসেনাকে স্টেনগান দিয়ে আঘাত করলে পাকসেনা তার রাইফেল ফেলেই পালিয়ে যায়। তারপর সালাউদ্দিন ও মান্নান শত্রুর কাছ থেকে ছিনিয়ে নেয়া রাইফেল দু’টিসহ অন্যান্যদেরকে নিয়ে নিজ অবস্থানে ফিরে আসেন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন এভাবেই অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেলেন। কামালপুর যুদ্ধের বর্ণনা দিতে গিয়ে ব্রিগেডিয়ার আমিন আহমেদ চৌধুরী লিখেছেন : ‘৩০-৩১শে জুলাই প্রথম ইস্ট বেঙ্গল (সিনিয়র টাইগার) রাতের আঁধারে রওনা হল। প্রথমে সালাউদ্দিনের ডেল্টা কোম্পানী, ফলােআপ কোম্পানী হল ক্যাপ্টেন হাফিজের ব্রেভাে, যার পিছনে হল ব্যাটালিয়ন আর গ্রুপ এবং এইচ আর’ গ্রুপে ছিলেন মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল) মইন এবং সাথে ছিলেন কর্নেল জিয়াউর রহমান। সম্ভবতঃ ব্রিগেডের প্রথম এ্যটাক সরেজমিনে তদারক করার জন্য কর্নেল জিয়া নিজেও এটাকিং ট্রপসের সাথে রওনা হন।
আক্রমণের ‘এইচ আওয়ার ছিল ৩০/৩১শে জুলাই-এর রাত ৩-৩০ মিঃ । কিন্তু বেঙ্গল এফইউপিতে (Gorming up place) সময় মতাে পৌছাতে পারেনি। ফলে ৩৫০ মিঃ সময়ে প্রােগ্রাম অনুযায়ী আমাদের নিজস্ব আর্টিলারী ফায়ার যখন শুরু হয় (ফায়ারের সংকেত ধ্বনি ছিল হিপ’ করে ওয়ারলেসের উপর শব্দ করা) তখনও আমাদের ছেলেরা এফইউপিতে পৌছানাের জন্য প্রাণপণ দৌড়াচ্ছে। কাদামাটিতে এতগুলাে লােকের এই দৌড়াদৌড়ির ফলে যথেষ্ট শব্দ হয়, তাতে করে দুশমনের পক্ষে আক্রমণের দিক নির্ধারণ করা একেবারে সহজ পর্যায়ে ডেপথ (টু আপ) হওয়ার ফলে আগে-পিছে হয়ে যায়। ফলে কমাণ্ড ও কন্ট্রোল কায়েম করা ভয়ানক মুশকিল হয়ে পড়ে। অন্যদিকে এসেম্বলী এরিয়া থেকে পূর্বনির্ধারিত এফইউপিতে আসার মাঝ পথে আমাদের নিজস্ব আর্টিলারী ফায়ার শুরু হওয়াতে প্রথম ইষ্টবেঙ্গল তৎক্ষণাৎ সে অবস্থাতেই কোনক্রমে ফর্মআপ হতে থাকে। ফলে সে কি চিৎকার আর হট্টগােল! আবার ডাইরেকশানের অভাবে এডভ্যান্স করাকালীন একে অন্যের উপর পড়ে বসে। আর অপেক্ষাকৃত নিচু কর্দমাক্ত জমির উপর আসার সাথে সাথে পাকিস্তানী ও আমাদের যুগা আর্টিলারীর ক্রস ফায়ারিং এর নিচে আসার ফলে আমাদের বেশ কিছু ছেলে হতাহত হয়ে পড়ে। অন্যদিকে অয়্যারলেস সেট জাম হওয়াতে সংযােগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন হয়, তাতে বিশৃঙ্খলা চরমে পৌছায়। এ অবস্থায় প্রথম ইষ্টবেঙ্গলের পক্ষে আক্রমণের ব্যুহ রচনা করা আদৌ সম্ভব ছিল না। বরং সৈন্য দলের পক্ষে পালিয়ে আসাটাই অত্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। কারণ এটাকিং ট্রপস যদি ঠিক মতাে ফর্ম আপ না হত তাদের পক্ষে আক্রমণ করার প্রশ্নই ওঠে না। মেজর (বর্তমানে মেজর জেনারেল) মইন অয়্যারলেস ছেড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছিলেন।
আর ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও হাফিজ একপ্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে ছুটে বেড়াচ্ছেন। সে এক অদ্ভুত দৃশ্য। এক দিকে প্রথম ইষ্টবেঙ্গল ব্যাটল প্রসিডিউরের চামড়া পর্যন্ত তুলে ফেলছে, অন্যদিকে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন মেগাফোনে বাংলা-ইংরেজী- উর্দুতে মিশিয়ে অকথ্য ভাষায় গালি দিচ্ছিল তার সৈন্যদলকে। কারাে বা কলার ধরে লাইন সােজা করে আগের দিকে (টারগেট মুখী) মুখ করে দিচ্ছে আর কাউকে বা হিফিজ ষ্টেনের বাট দিয়ে মারছে। চরম বিশৃঙ্খলার মাঝে শুধুমাত্র মনের জোর ও অদম্য সাহসে বলীয়ান হয়ে সালাউদ্দিন ও হাফিজ সর্বপ্রকার প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিকূলতা অতিক্রম করে নিজ নিজ কোম্পানীকে অভিষ্ট লক্ষ্যে উপনীত করতে সক্ষম হন এবং নিঃসন্দেহে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে উল্লেখযােগ্য আক্রমণ সুচারুরূপে সম্পন্ন করেন।”
মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণের মুখে পাকসেনারা তাদের প্রথম সারির প্রতিরক্ষা অবস্থান ছেড়ে পেছনে সরে যায়। মুক্তিবাহিনীর সাহসী সৈনিকরা শত্রুর বাংকার অতিক্রম করে কমিউনিটি সেন্টারে ঢুকে পড়ে এবং হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। সুবেদার হাইয়ের নেতত্বে যে প্লাটুনটি যুদ্ধ করছিল তারা মাইন ফিডের সামনে পড়ে যায়। এই প্লাটুনের ডানে ছিলেন ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন ও তার সহযােগীগণ। পাকসেনারা তখন পাল্টা আক্রমণের জন্যে তৈরি হচ্ছে। সালাউদ্দিন সুবেদার হাইকে ডানে যেতে নির্দেশ দিলেন। নায়েক হাই-এর হাত বােমার আঘাতে উড়ে গেল। সালাউদ্দিনের ঠিক সামনে এসে পড়ে এবং সালাউদ্দিন শহীদ হন। ক্যাপ্টেন হাফিজ নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে গেলেন । তার স্টেনগানটি শত্রুর গুলির আঘাতে উড়ে গেল এবং তিনি সামান্য আহত হলেন। মেজর প্রচণ্ড গুলিবর্ষণের মধ্যে একটি গাছের আড়াল থেকে নির্দেশ দিচ্ছিলেন। লেঃ মান্নান মেজর মঈনের দিকে আসতে শত্রুর গুলি তার উরু ভেদ করে চলে যায়। ফ্লাইট লেফটেনেন্ট লিয়াকত শত্রুর কামানে গােলার আঘাত থেকে অল্পের জন্যে বেঁচে গেলেন। আহত ক্যাপ্টেন হাফিজকে উদ্ধারের জন্য লেঞ্চ নায়েক রবিউল অগ্রসর হলে তার বুকে গুলি লাগে। প্রচণ্ড যুদ্ধের পরে সকাল সাড়ে সাতটায় মুক্তিবাহিনী পেছনে সরে আসে। কামালপুরের এই ভয়াবহ যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর ১ জন অফিসার ও ৩০ জন সৈনিক নিহত এবং ২ জন অফিসার ও ৬৬ জন সৈনিক আহত হয়। পাকসেনাদের তিন ট্রাক মৃত দেহ সরিয়ে ফেলতে গ্রামবাসীরা দেখেছে।
কামালপুরের যুদ্ধ সম্পর্কে মেজর হাফিজ তার ডায়রীতে লিখেছেন —৩১শে জুলাই ১৯৭১। আজ ভাের তিনটায় কামালপুর বিওপি-এর ওপর মেজর মঈনের নেতৃত্বে আমরা কোম্পানী নিয়ে আক্রমণ করলাম। আমি B কোম্পানী এবং ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন D কোম্পানী নিয়ে প্রচণ্ড হামলা চালালাম। কয়েকজনের কাপুরুষতার জন্যে আমাদের আক্রমণ সফল হল না। আমাদের ৩০ জন শহীদ এবং ৭০ জন মারাত্মকভাবে আহত হয়। মাত্র চল্লিশ গজের ব্যবধান ছিল আমাদের এবং শত্রু পক্ষের প্রধান ঘাঁটির মধ্যে। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন, আমার প্রিয় বন্ধু বীরত্ব ও সাহসিকতার এক অপূর্ব দৃষ্টান্ত স্থাপন করে শত্রুর মর্টারের শেলের আঘাতে শহীদ হলেন। আমার নিজের শরীরে ছয় জায়গায় মর্টারের গােলার টুকরার আঘাত লাগে। আমাকে তুরা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হল। লেঃ মান্নানের ডান উরুতে গুলি লাগায় সেও হাসপাতালে ভর্তি হল। আমার প্রিয় ড্রাইভার সিরাজও শহীদ হল। শত্রু পক্ষের চল্লিশজন নিহত হয়। আমাদের পল্টনের অফিসারদের মধ্যে ওই সব চাইতে প্রিয় ছিল। ট্রপস-এর কাছে। সালাউদ্দিনের পবিত্র কোরান শরীফ খানা আমার কাছে রয়ে গেল। ওর কথা মনে হলেই আর চোখের পানি রাখতে পারি না, মনে হয় ও মরেনি। আবার হাসতে-হাসতে ফিরে আসবে আমাদের মাঝে। দু’বার ও মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছিল। বুঝলাম, ওর মতাে দুঃসাহসী সৈনিকের পক্ষে বাঁচা সম্ভব নয়, ছিল না। He was too brave to live. আমাদের কমাণ্ডার মেজর জিয়াউর রহমান প্রস্তাব করলে সালাউদ্দিনের নামানুসারে আমাদের পল্টনের নামকরণ করার জন্য। ওকে সর্বোচ্চ সাহসিকতার পুরস্কারের জন্য recommend করা হবে।
সূত্র : মুক্তিযুদ্ধের দু’শো রণাঙ্গন – মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি সম্পাদিত