You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

কিন্তু তা সত্ত্বেও পাকিস্তানে সামরিক বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই প্রণীত হয় ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস (ট্রাইব্যুনালস) অ্যাক্ট। তার কিছুদিন পরেই জুলাই মাসের শেষে আল্লু ওয়াশিংটন সফরে যান আন্তর্জাতিক অর্থ ব্যবস্থা সংস্কার কমিটির সভায় যােগ দিতে। সেই সফরে মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটস উইলিয়াম রজারসের সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে যে আলােচনা হয় তা সে সময়ের ওয়াশিংটনে কর্মরত অর্থনীতিবিদ ও কূটনীতিক আবুল মাল আব্দুল মুহিত, বােন রিমিকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে তুলে ধরেন। তিনি বলেন, “সেক্রেটারি অফ স্টেটস উইলিয়াম রজারস যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি উত্থাপন করে বাংলাদেশকে নমনীয় হতে অনুরােধ করলেন এবং বললেন যে, নাইজেরিয়া বায়াফ্রার যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দিয়েছে। তাজউদ্দীন সাহেব এই বক্তব্যকে গ্রহণ করলেন না। তিনি বললেন যে, বায়ায় সংখ্যালঘু গােষ্ঠী ফেডারেশনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ব্যর্থ হয়। বাংলাদেশে। কিন্তু সংখ্যালঘুরা সংখ্যাগরিষ্ঠের অধিকার হরণে পাশবিক অত্যাচার করে পরাস্ত হয়। এ ক্ষেত্রে সংখ্যালঘু ছিল ক্ষমতাশালী এবং তারা যে অপরাধ করেছে তার বীভৎস বিবরণ খােদ আমেরিকার সাংবাদিকরাও লিপিবদ্ধ করেছেন। তবুও বাংলাদেশ সমস্ত সেনাবাহিনীকে ছেড়ে দিয়ে মাত্র ১৯৫ জনের বিচারের দাবী করেছে। এই বিচার মানব জাতির কল্যাণের জন্য প্রয়ােজনীয়। তাজউদ্দীন আহমদের সেই আদর্শিক স্বপ্ন আর বাস্তব হয় না। পরবর্তী বছর, ১৯৭৪ সালের ৯ এপ্রিল, দিল্লিতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের ত্রিপক্ষীয় সমঝােতায় ঐ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ও মানবতা বিরােধী পাকিস্তান সেনাকেও বঙ্গবন্ধু ক্ষমা করে দেন। আন্তর্জাতিক চাপের বিরুদ্ধে এবং সাড়ে তিন লক্ষের উর্ধ্ব বাঙালিকে পাকিস্তান হতে ফিরিয়ে আনার জন্য, ৯৩ হাজার যুদ্ধ বন্দীর বিচার যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পক্ষে একাকী করা সম্ভবপর না হলেও, মাত্র ১৯৫ জনের বিচারের ব্যাপারে সেই বাধা ছিল না। ২৮ অগাস্ট ১৯৭৩, বাংলাদেশের সহায়তায় ভারত ও পাকিস্তানের চুক্তিতেও উল্লেখিত ছিল যে ১৯৫ জন অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী ব্যতীত বাকি সকল যুদ্ধবন্দির প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা হবে। শতাব্দীর জঘন্যতম গণহত্যার মূল পরিকল্পক ও বাস্তবায়কদের অন্যতম, ১৯৫ জনের তালিকাভুক্ত এই সকল যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান সেনারা অট্টহাসি দিয়ে শেষপর্যন্ত ফিরে যায় পাকিস্তানে ইস্টার্ন কমান্ড প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজি, যিনি ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ইস্টার্ন কমান্ড হেড কোয়ার্টারের সেনাবাহিনীর মিটিঙে পাকিস্তানি সৈন্যদেরকে বাঙালি নারীদের ওপর লেলিয়ে দেবার এবং বাংলাদেশকে জারজ জাতি উল্লেখ করে তার চেহারা। পরিবর্তনের সদম্ভ ঘােষণা দেন (ঐ মিটিঙে উপস্থিত মেজর জেনারেল খাদিম হুসেইন রাজা তার। বইতে এ বিষয়ে উল্লেখ করেন) সেই নিয়াজির গায়ে তার নৃশংস পাপ কর্মের জন্য আঁচড়টুকুও লাগে না।

‘৭১ এর গণহত্যার মাস্টার মাইন্ড, বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডর নীল নকশা প্রণয়ণকারী ও তার বাস্তবায়ক, আল বদর, আল শামস প্রভৃতি সন্ত্রাসী দলগুলাের প্রশিক্ষণদাতা, হিটলারি বর্বরতার । আর এক প্রতীক, মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীও অবলীলায় রেহাই পেয়ে যান। প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ঐ ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিনা বিচারে কেন ছেড়ে দিলেন সে সম্পর্কে বিচারপতি হাবিবুর রহমান জে, এন দীক্ষিতের উল্লেখ করে বলেন “জে, এন দীক্ষিত তার লিবারেশন অ্যান্ড বিয়ন্ড-এ বলছেন, এমনকি এই স্বল্পসংখ্যক যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষেত্রেও বাংলাদেশ সরকার সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহ কিংবা মামলার নথিপত্র প্রস্তুতির ব্যাপারে তেমন তৎপর ছিল না।’ তিনি আরও বলেন, ‘মুজিবুর রহমান এ ব্যাপারে হাকসারকে (ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত) বলেছিলেন যে সাক্ষ্য-প্রমাণ সংগ্রহে অসুবিধার কারণে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিষয়ে শক্তি ও সময় নষ্ট করতে চান না। হয়তাে কোনাে দীর্ঘমেয়াদি কৌশলের কথা ভেবেই মুজিব এ ধরনের একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে চালিত হয়েছিলেন। তিনি এমন কিছু করতে চাননি, যাতে পাকিস্তানসহ অন্যান্য মুসলিম দেশের বাংলাদেশকে স্বীকৃতিপ্রদান বাধাপ্রাপ্ত হয়। পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি এবং তার পরপরই আব্দুর নিষেধ সত্ত্বেও মুজিবকাকু তড়িঘড়ি করে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ভুট্টোর আমন্ত্রণে লাহােরে। গেলেন অর্গানাইজেশন অব দ্য ইসলামিক কনফারেন্সে (২২-২৪ ফেব্রুয়ারি) যােগ দিতে। সেখানে নিশ্চয়ই ভুট্টো-মুজিবের মধ্যে এমন কোনাে সমঝােতা হয়েছিল যার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় তার মাত্র দুই মাস পরের ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মধ্যে। ঐ চুক্তির ১৪ প্যারাগ্রাফে উল্লেখিত
“The Prime Minister of Pakistan declared that he would visit Bangladesh in response to the invitation of the Prime Minister of Bangladesh and appealed to the people of Bangladesh to forgive and forget the mistakes of the past in order to promote reconciliation Similarly, the Prime Minister of Bangladesh had declared with regard to the atrocities and destruction committed in Bangladesh in 1971 that he wanted the people to forget the past and to make a fresh start, stating that the people of Bangladesh knew how to forgive.

পরবর্তী ১৫ প্যারাগ্রাফে উল্লেখিত ‘Having regard to the appeal of the Prime Minister of Pakistan to forgive and forget the mistakes of the past the “Foreign Minister of Bangladesh stated that the government of Bangladesh had decided not to proceed with the trial as acts of clemency. It was agreed that the 195 prisoners of war may be repatriated to Pakistan along with the other prisoners of war now in the process of repatriation under the Delhi Agreement of 25th August 1973, ১৮ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে বাংলাদেশে সফরের ঘােষণা, অতীতের ভুলভ্রান্তি ভুলে যাওয়া ও ক্ষমা করে দেবার জন্য পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর বাংলাদেশের কাছে আবেদন এবং বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর তার জনগণকে অতীত ভুলে নতুন যাত্রা শুরু করার আহ্বান, বাংলাদেশের জনগণ ক্ষমা করতে জানে এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানিকে অনুকম্পার নিদর্শন হিসেবে বিচার না করে অন্য যুদ্ধবন্দিদের সাথে পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে প্রভৃতি এই সকল বাক্যবলি চুক্তিতে উল্লেখিত বিধায় মনে হয় যে বাংলার মাটিতে হয়নি কোনাে নৃশংস গণহত্যা এবং বাংলাদেশের জনগণের সম্মতি রয়েছে বিচার বহির্ভূত এই নজিরবিহীন ক্ষমায়। ক্ষমা পরম ধর্ম অবশ্যই। কিন্তু ব্যক্তিগত অপরাধের ব্যাপারে ক্ষমা এক বিষয় এবং একটি জাতির বিরুদ্ধে সঙ্গবদ্ধ গণহত্যা, ধর্ষণ ও অমানবিক অপরাধের ব্যাপারে ক্ষমা। অন্য বিষয় এখানে ক্ষমা হতে পারে, তবে তা বিচারের পূর্বে এবং জনগণের সম্মতি ব্যতীত নয়। নতুবা যে জনসাধারণ হয়েছিল নারকীয় হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞর শিকার তাদের প্রতিই করা হয়। অবিচার। ইতিহাসের অধ্যাপক ড. কামাল হােসেন এ প্রসঙ্গে বলেন, অর্থাৎ ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পৃথিবীর ইতিহাসের যে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ সংঘটিত হয়, তার জন্য একজন অপরাধীকেও শাস্তি পেতে হয়নি। ব্যক্তি পর্যায়ে ক্ষমা মহৎ গুণ হলেও কোন রাষ্ট্র, সম্প্রদায় বা জাতির প্রশ্নে অপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়া কোনভাবেই মহত্তের পরিচায়ক হতে পারে না। কেননা এ ধরনের ক্ষমার কারণে একটি জাতির আত্মত্যাগ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার বিষয়টি হয়ে পড়তে পারে বিপন্ন, কিংবা দেশ মানবতাবিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের আবর্তে তলিয়ে যেতে পারে।

বিচারপতি হাবিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য বক্তব্যর সাথে ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ ও ২৬ মার্চ ১৯৭৫ এর দুটি বক্তব্য ক্ষমা ঘােষণার প্রেক্ষিতে তুলে ধরেন। ২৫ জানুয়ারি ১৯৭৫ সংবিধানের চতুর্থ সংশােধনী বিল পাস হওয়ার পর নতুন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার বক্তব্যে বলেন, কোনাে দেশের ইতিহাসে নাই বিপ্লবের পর বিপ্লবকে বাধা দিয়েছে যারা, শত্রুর সঙ্গে সহযােগিতা করেছে যারা, যারা এ দেশের মানুষকে হত্যা করেছে, তাদের কোনাে দেশে, কোনাে যুগে ক্ষমা করে নাই। কিন্তু আমরা করেছিলাম সবাইকে ক্ষমা করেছিলাম। ২৬ মার্চ ১৯৭৫ স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে আয়ােজিত সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের এক জনসভায় রাষ্ট্রপতি বললেন, ‘ভায়েরা, বােনেরা আমার, আমরা চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু একটা ওয়াদা আমি রাখতে পারি নাই। জীবনে যে ওয়াদা আমি করেছি জীবন দিয়ে হলেও সে ওয়াদা আমি পালন করেছি। আমি ওয়াদা করেছিলাম তাদের বিচার করব। এই ওয়াদা আপনাদের পক্ষ থেকে খেলাপ করেছি, তাদের আমি বিচার করিনি। আমি ছেড়ে দিয়েছি এ জন্য যে এশিয়ায়, দুনিয়ায় আমি বন্ধুত্ব চেয়েছিলাম।

‘বাংলাদেশের মানুষ জানে কী করে ক্ষমা করতে হয়, ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকের ছেড়ে দেওয়ার প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধুর উক্তি সমন্ধে বিচারপতি হাবিবুর রহমান বলেন, ‘যারা বিচার করতে পারেননি, তাদের মুখে ক্ষমা করার অহংকার মানায় না।” বলা বাহুল্য যে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিনা বিচারে ছেড়ে দেবার পরেও বাংলাদেশের। প্রতি ভুট্টো ও পাকিস্তান সরকারের যে বিন্দুমাত্র কৃতজ্ঞতা বােধ জাগেনি যার প্রমাণ তাদের পরবর্তী বাংলাদেশ বিরােধী কার্যকলাপ। তারা যে তাদের পাপাচারের জন্য অনুতপ্ত নয়, তার প্রমাণ পাকিস্তান সরকার আজও বাংলাদেশে নৃশংস গণহত্যার সম্পূর্ণ দায়ভার গ্রহণ করে, কোনাে চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে, নিঃশর্তে এবং রাষ্ট্রীয়ভাবে ক্ষমা প্রার্থনা এবং গণহত্যার জন্য ক্ষতিপূরণ প্রদান করেনি। উপরন্দ্র জামায়েত ইসলামী দলের নেতা গণহত্যাকারী, ধর্ষণকারী ও যুদ্ধাপরাধী কাদের মােল্লার সাম্প্রতিক ফাসির পরে বাংলাদেশের বিজয় দিবস এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর আত্মসমর্থনের দিনটিকেই বেছে নিয়ে (১৬ ডিসেম্বর, ২০১৩) পাকিস্তান জাতীয় এসেম্বলিতে পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু ঐ নৃশংস নরঘাতকের জন্য সমবেদনা প্রস্তাব গৃহীত হয়। ‘৭১ এ পাকিস্তান সেনা বাহিনীর গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষণ ও অপহরণের প্রধান দোসর জামায়াতে ইসলামীর আমির গােলাম আযম চার যুগ পরে বাংলা ভিশন টিভির কাছে দেওয়া সাক্ষাঙ্কারে যে কথাগুলাে বলেছেন তাতে বােঝা যায় যে দালালদের সাধারণ ক্ষমা ও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচার না করে রেহাই দেওয়াটা কত বড় মারাত্মক ভুল রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ছিল। গােলাম আযম বলেন যে স্বাধীনতার ৪০ বছর পর্যন্ত কেউ তাদের যুদ্ধাপরাধী বলেনি। ১৯৫ জন পাকিস্তান সেনার নাম যুদ্ধাপরাধীর তালিকাভুক্ত ছিল। কিন্তু কোনাে বেসামরিক ব্যক্তির নাম ছিল না। ঐ ১৯৫ জনকেও ভুট্টোর সাথে মিটিং করে মুজিব কাকুর মাফ করে দেওয়ার কথা তিনি উল্লেখ করেন। তিনি এ প্রসঙ্গে আরও বলেন, ‘শেখ মুজিব সাহেব নিজেই এই ইস্যুর মীমাংসা করে দিয়ে গেছেন।… তখন সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে সবাইকে মাফ করলেন- তাে তিনি তাে এটার মীমাংসা করে দিয়ে গেলেন- যুদ্ধাপরাধী ইস্যুটার মীমাংসা করে দিয়ে গেলেন।

এখন ৪০ বছর পর এই ইস্যুটাকে খাড়া করা হলাে কেন ? মীমাংসা আসলে হয়নি বলেই শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ২৬ মার্চ, ১৯৯২ সালে ঐতিহাসিক রেসকোর্স তথা সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে, গোলাম আযমসহ ঘাতক দালালদের বিচারের দাবিতে শুরু হয় গণআদালত। ২০০৮ এ জনগণের কাছে দেওয়া নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে সাহসিকতার সাথে সম্পাদন করছে যুদ্ধাপরাধী ঘাতক দালালদের বিচারের গুরুদায়িত্ব। আশাকরি অচিরেই পাকিস্তানে যুদ্ধাপরাধী সেনাদের যে কজনও বেঁচে রয়েছে তাদেরও বিচার শুরু হবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে। বিচার করতে হলে সকল অপরাধীরই করতে হবে। বিশেষত সেই সকল মূল যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তানি সেনাদের বিচারের উদ্দেশ্যে আন্তরিক প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। তাছাড়া শুধু জামায়াতে ইসলামীই নয়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তাকারী সকল যুদ্ধাপরাধী তারা যে দলেরই হােক না কেন তাদেরও বিচার করতে হবে। বলা বাহুল্য যে শুধু যুদ্ধাপরাধীই নয় মহান মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক চেতনা ও জনকল্যাণমুখী রাষ্ট্র গড়ার অঙ্গীকারের বিপরীত আচরণকারী কোন দল বা নেতার স্থান বাংলাদেশের মাটিতে হতে পারে না। ইসলাম ধর্মের কলঙ্ক, গণহত্যাকারী, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী, নারী ধর্ষণকারী ও মানবতা বিরােধী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত ঘাতক দালালরা যারা সেদিন ১৯৭৩ সালের সাধারণ ক্ষমার ফলে মুক্তিলাভ করেছিল তারা নির্দোষিতার মুখােশ পরে মিশে গিয়েছিল সাধারণ মানুষের ভিড়ে। তারা (এবং পরবর্তীতে জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত বিবেকহীন দালাল পুনর্বাসনের মধ্য দিয়ে যারা পুনঃ জাগরিত হয়েছিল) সঙ্গবদ্ধ হয়ে সংগােপনে শুরু করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিরােধী, পাকিস্তানপন্থী তৎপরতা ও নানাপ্রকার অপপ্রচারণা ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠায় তল্কালীন মুজিব সরকারের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির কারণে দেশি ও বিদেশি শক্রদের হাত ক্রমশই শক্তিশালী হয়ে ওঠে। | ১৯৭৪ সালের ৮ আগস্ট আন্ধু দুই সপ্তাহের জন্য মধ্যপ্রাচ্য সফরে গেলেন।

মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক জোরদার, পারস্পরিক উন্নয়ন ও অর্থনৈতিক সহযােগিতার জন্য আর এই সফর বাংলাদেশের জন্য ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তেলের মূল্যবৃদ্ধিতে বিশ্বের অর্থনীতির নকশা বদলে যায়। তেলসম্পদের ওপর ভিত্তি করে বাণিজ্য, ব্যাংকিং এবং মধ্যপ্রাচ্যে জনশক্তির চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই প্রেক্ষিতে মধ্যপ্রাচ্যের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তােলা বাংলাদেশের জন্য ছিল প্রয়ােজনীয়। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের দুর্দিনে মধ্যপ্রাচ্য পাশে এসে দাঁড়ায়নি, তার পরও বাস্তব অবস্থার প্রেক্ষিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত, খরা, বন্যাতাড়িত বাংলাদেশের স্বার্থে তিনি ইরাক, কুয়েত, সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফর করেন। এই সফরের প্রধান চ্যালেঞ্জ ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের বিরূপ। মনােভাবের পরিবর্তন ঘটানাে। পাকিস্তান ও পরাজিত পাকিস্তানপন্থীরা ঢালাওভাবে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচারণা করে। তাদের অপপ্রচারণা এতদূর পর্যন্ত গড়ায় যে বাংলাদেশের মানুষেরা মুসলমান নয়, তারা কাফের, তারা হিন্দু ইত্যাদি; সুতরাং তারা কোনাে সহানুভূতি বা সহমর্মিতা পেতে পারে না। যদিও অপপ্রচারণ, তা সত্ত্বেও হিন্দু, মুসলমান—সে যে ধর্মেরই হােক না। কেন—তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলাে সে মানুষ তার ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে তার প্রতি বৈষম্যমূলক, অমানবিক ও অপমানজনক আচরণের নামই অধর্ম। এই মহাসত্যটি স্বার্থলােভী। মানুষ ভুলে যেতে পারদর্শী। মধ্যপ্রাচ্যে আল্লুকে কী ধরনের চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছিল তার বিশদ বর্ণনা আব্দুর ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীর সাক্ষাৎকারে উল্লিখিত হয়েছে। কুয়েতের অর্থমন্ত্রী আবদুর রহমান সেলিম-আল আতিকি আন্ধুর সঙ্গে দেখা করে প্রথম যে কথা জিজ্ঞেস করলেন, ‘তােমরা কেন পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়েছ ? আল্লু খুব সহজভাবে উত্তর দিলেন, ‘দেখ, আমাদের। সমস্যাটি মূলত অর্থনৈতিক। তুমিও অর্থমন্ত্রী আমিও অর্থমন্ত্রী, তাই বিষয়টি তােমাকে বললে, তুমি বুঝবে ভালাে। তারপর তিনি পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশ পৃথক হওয়ার কারণগুলাে সংক্ষেপে তুলে ধরে বলেন, এর মধ্যে ধর্মের কোনাে ভূমিকা নেই। আমরাও মুসলমান, তারাও মুসলমান।

সত্যি বলতে পাকিস্তান আমরাই এনেছিলাম। বাঙালি না হলে পাকিস্তান আসত না। পাকিস্তানের পক্ষে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি মুসলিমদের ভােটের কারণেই পাকিস্তান রাষ্ট্রের সৃষ্টি সম্ভবপর হয়।” কুয়েতের অর্থমন্ত্রী, যিনি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ও তার সফরসঙ্গীদের প্রথমে শীতল অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন, আন্ধুর সঙ্গে আলাপের পর তার ব্যবহার পাল্টে যায়। এরপর তিনি স্বতঃস্ফূর্তভাবে অফিসিয়াল ডিনারের প্রস্তাব দেন। পরদিন বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর সম্মানে। কুয়েতের অর্থমন্ত্রী এক বিশাল নৈশভােজের আয়ােজন করেন। কুয়েত অর্থ মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে উচ্চপর্যায়ের গণ্যমান্য ব্যক্তি আমন্ত্রিত হন। এভাবে বরফ গলতে শুরু করে। বাংলাদেশকে অর্থনৈতিক সাহায্য ও সহযােগিতার জন্য কুয়েত প্রতিশ্রুতি দেয়। সৌদি আরব তখনাে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। ১৯৭৫-এ বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। | মালয়েশিয়ার জাতির জনক ও প্রথম প্রধানমন্ত্রী (১৯৬৩-১৯৭০) টুংকু আব্দুর রহমান আইনগতভাবে আলু ও তার সফরসঙ্গীদের সৌদি আরব সফরের ব্যাপারে ঐকান্তিক সহযােগিতা করেন। সৌদি অর্থমন্ত্রী শেখ মােহাম্মদ আব্দুল খেল ও বাদশাহ ফয়সলের সঙ্গে আব্বুর সাক্ষাৎকার সাফল্যমণ্ডিত হয়। সৌদি আরব প্রথম থেকেই উষ্ণ সংবর্ধনা জানালেও এখানেও কুয়েতের মতােই ধর্মের বিষয়টি ওঠে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নীতি ধর্মনিরপেক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। আন্ধু কুরআন থেকে উদ্ধৃতি দেন, ‘লা কুম, দীনুকুম ওয়ালিয়া দীন।’ (তােমার জন্য তােমার ধর্ম, আমার জন্য আমার ধর্ম)। (সুরা : ১০৯ : আয়াত : ৬) লা ইকরা হাফিদীন। (ধর্মে জোর জবরদস্তি নেই)। (সুরা ২: আয়াত ২৫৬)।

ইসলামের সঙ্গে বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষতার সংঘাত নেই এই উত্তরের পর তাদের বলার কিছু ছিল না। ঢাকায় ফেরার পর আব্দুর সফরের ঘটনা ও উত্তর শুনে নানা খুশি হয়ে বললেন, ‘আমার যােগ্য ছাত্রের যােগ্য উত্তর। (ঢাকা কলেজে নানা আব্দুর আরবির শিক্ষক ছিলেন)। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপপ্রচারণা খণ্ডনের জন্য আল্লুর যুক্তি, ধৈর্য, আচরণ, উপস্থাপনা ও বাচনভঙ্গি, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক, কূটনীতি, শান্তি ও উন্নয়নের সঙ্গে জড়িত সকলের জন্যই শিক্ষণীয় উদাহরণ হতে পারে। কার কাছে কোন বিষয়টি কীভাবে উপস্থাপন করতে হবে। তা তিনি ভালাে বুঝতেন এবং তা প্রয়ােগ করতেন সত্যের অপলাপ না ঘটিয়ে ও তােষামােদের আশ্রয় না নিয়ে। বাংলাদেশ সম্পর্কে মধ্যপ্রাচ্যের নেতিবাচক মনােভাব বহুলাংশে পরিবর্তিত হয় আব্দুর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায়। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে নতুন দুয়ার খুলে যায়। আব্দুর উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকের সদস্যভুক্ত হয় বাংলাদেশ। ১২ আগস্ট জেন্দায় ইসলামিক উন্নয়ন ব্যাংকের সম্মেলনে ভাষণদানকালে তিনি আশা প্রকাশ করেন যে এর ফলে উন্নয়নে অর্থ সরবরাহের ক্ষেত্রে এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মােচিত করবে। শুধু মুনাফা অর্জনের লক্ষ্যের দ্বারাই ইসলামিক ব্যাংক পরিচালিত হবে না। … অন্যান্য উন্নয়ন ব্যাংকের সঙ্গে ইসলামিক ব্যাংকের মৌলিক পার্থক্য এখানেই। এই বৈশিষ্ট্যগুলােতে ইসলামের মহান নীতিই প্রতিফলিত হয়েছে। ইরাক ও কুয়েত বাংলাদেশকে পর্যাপ্ত পরিমাণে অপরিশােধিত তেল সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দেয় এবং তা দিয়ে চট্টগ্রামে তেল শােধনাগার সারা বছর চালু রাখা যাবে এই আশা তিনি পােষণ করেন। ইরাক সফরকালে আব্দুর মাধ্যমে ইরাক বাংলাদেশের জন্য বড় অঙ্কের আর্থিক অনুদান মধ্যপ্রাচ্যে বাংলাদেশের জনশক্তির যে বিপুল চাহিদা রয়েছে সেই বিষয়টির ওপর রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে জোর দেওয়া হয়। বাংলাদেশকে সহযােগিতার জন্য আব্দুর আমন্ত্রণে কুয়েত থেকে অর্থনৈতিক প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। সব মিলিয়ে আব্বুর মধ্যপ্রাচ্য সফর সাফল্যমণ্ডিত হয়। প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যে যে রাষ্ট্র সফরেই আল্লু গিয়েছেন বা উচ্চপর্যায়ের বিদেশি ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে আলােচনা করেছেন, তারা সকলেই বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য তাকে সাহায্য ও সহযােগিতা দিয়েছিলেন। অনেক ক্ষেত্রে তিনি বাংলাদেশের জন্য ভাবাবেগ প্রকাশ করেছেন খুব তীক্ষভাবেই। তারপর সেই ভাবাবেগ পৃথক করেছেন যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশ ও বাস্তবতার প্রেক্ষিতে। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসনের বাংলাদেশ-বিরােধী ভূমিকায় তিনি প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ ছিলেন। তিনি মার্কিন সাহায্য গ্রহণেরও বিরুদ্ধে ছিলেন।

কিন্তু যখন তিনি দেখলেন খরা বন্যাতাড়িত বাংলাদেশের অর্থকোষের ভাণ্ডার শূন্য, সদ্য স্বাধীন এই দেশটির মঙ্গলের জন্য তাঁকে। কাজ করতে হবে এইধরনের রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে, তখন তিনি তাঁর ব্যক্তিগত অনুভূতি ও ভাবাবেগকে আলাদা করেছেন বাস্তবতা থেকে কিন্তু বাংলাদেশের স্বার্থ ও মর্যাদা এতটুকু ক্ষুন্ন হতে দেননি। তাঁর হৃদয় ও চিন্তার বিশালতা মুক্তিযুদ্ধ ও বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তার আত্মমর্যাদাপূর্ণ অভিব্যক্তি বহির্বিশ্বের মানুষকে চমকে দিয়েছে, থমকে দিয়েছে, সাধারণের ভিড়ে তাকে করেছে অনন্য, বাংলাদেশের মর্যাদাকে করেছে সমুন্নত। এই অধ্যায়ে তার কিছু উদাহরণ দেওয়া যাক। ১৯৭২ সালের ২৬ জানুয়ারি ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবস উপলক্ষে আন্ধু দিল্লিতে আমন্ত্রিত হয়েছিলেন। সেখানে সাউন্ড অ্যান্ড লাইট শাে’র আয়ােজন করা হয়। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট ও যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী (সেক্রেটারি অব ডিফেন্স) রবার্ট ম্যাকনামারা ও আলুকে সেই অনুষ্ঠানে পাশাপাশি বসানাের ব্যবস্থা করেছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রের সরকার পাকিস্তানকে সম্পূর্ণ সহযােগিতা করেছিল; বাংলাদেশকে ধ্বংস করার জন্য সপ্তম নৌবহর পাঠিয়েছিল, এজন্য যুক্তরাষ্ট্রের সরকারের প্রতি আন্ধু ছিলেন প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ। (অবশ্য যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ যারা বাংলাদেশকে সমর্থন করেছিলেন তাদের প্রতি তিনি বরবারই কৃতজ্ঞ ছিলেন)। শ্রীমতি গান্ধী যুক্তরাষ্ট্র সরকার সম্পর্কে আব্দুর মনােভাব জানতেন সে জন্যই এমনভাবে বসার আয়ােজন করেছিলেন যাতে করে তাদের মধ্যে কথাবার্তা হতে পারে। ম্যাকনামারা বেশ কয়বার পাশে বসা আব্বুর দিকে তাকিয়েছিলেন। যেন আব্বু সাড়া দিলেই তারা কথা বলতে পারেন কিন্তু অনুষ্ঠানের পুরাে সময়টা আন্ধু পাশে বসে থাকলেও একবারও তার দিকে ঘুরেও তাকাননি, কথা বলা তাে দূরের কথা। ব্যাপারটা ভারতীয় কর্তৃপক্ষসহ অনেকেরই চোখে পড়েছিল। আব্বু ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরী (যিনি নিজেও ঐ অনুষ্ঠানে আব্বুর পেছনে বসেছিলেন) ব্যাপারটি লক্ষ করেছিলেন। রাতে হােটেলে ফিরে তিনি এ প্রসঙ্গে আল্লুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘স্যার, ম্যাকনামারার পাশে বসে অন্য দেশের প্রধানমন্ত্রীরা ম্যাকনামারার সঙ্গে কথা বলতে উদগ্রীব হয়ে থাকে, আর সে আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাইছে আর আপনি কথা বললেন,।’ এ কথা শুনে আবু হঠাৎ সেন্টিমেন্টাল হয়ে পড়েন। আব্বু উত্তর দিলেন, চৌধুরী সাহেব, বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের সময় এদের ভূমিকা কী আপনি জানেন ?’ আবু সাঈদ চৌধুরী বললেন, “উনি তাে ওয়ার্ল্ড ব্যাংকে ছিলেন, তিনি তাে আমেরিকান গভর্নমেন্ট না।’ আলু উত্তর দিলেন, He is a super government, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক হচ্ছে আমেরিকান গভর্নমেন্টের সুপার গভর্নমেন্ট। এদের রােল ছিল আমাদের মেরে ফেলার। আমি কী করে তার সঙ্গে কথা বলি ?”

ম্যাকনামারার কাহিনি এখানেই শেষ হলাে না। তিনি ভারত সফর শেষে বাংলাদেশে আসলেন। বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারাকে বিমানবন্দরে অভ্যর্থনা জানাতে কে যাবেন এই নিয়ে কথা উঠল প্ল্যানিং কমিশনের চেয়ারম্যান অধ্যাপক নূরুল ইসলাম তার সাক্ষাৎকারে ঘটনাটির বিবরণ দিয়েছেন। নূরুল ইসলাম বললেন, “আমি প্রস্তাব করলাম ‘ম্যাকনামারাকে রিসিভ করবেন বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তাজউদ্দীন, তুমি কী বলাে?’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, ‘মুজিব ভাই আপনার এয়ারপাের্টে যাওয়ার কোনাে প্রশ্নই ওঠে না। আমি বললাম, ‘আপনি আপত্তি করছেন কিন্তু অন্য অনেক জায়গায় তাে এমনই হয়।’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, অন্য জায়গায় যা হয় এখানে সেটা চলবে না, চিফ অব প্রােটোকল যাবে। আমি বললাম, ‘বিশ্বব্যাংক প্রেসিডেন্ট যখন পাকিস্ত নি যেতেন তখন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী কিংবা যিনি পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান থাকতেন তিনি যেতেন। আর আপনি চিফ অব প্রটোকল পাঠিয়ে দেবেন?’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “ঠিক আছে, আপনি যখন বলছেন তখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর যাবেন। আপনিও যাবেন
না।’ বঙ্গবন্ধু সব শুনছিলেন, বললেন, ঠিক আছে, তাজউদ্দীন যা বলছে তাই করেন।’ শেষ পর্যন্ত তাই হলাে। ম্যাকনামারাকে রিসিভ করলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর হামিদুল্লাহ সাহেব।”

পরদিন আব্দুর সঙ্গে বৈঠকে বসলেন ম্যাকনামারা। সঙ্গে প্রফেসর নূরুল ইসলাম। (বৈঠকের এই বিশেষ অংশটি প্রফেসর নূরুল ইসলামের উপরে উল্লেখিত সাক্ষাৎকার থেকে তুলে ধরা হলাে।) ম্যাকনামারা জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের জন্য কোথায় কী ধরনের সাহায্য দরকার।’ তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “আমাদের যা দরকার, তা আপনি দিতে পারবেন কি না। আমার সন্দেহ আছে।’ ম্যাকনামারা বললেন, ‘মিস্টার মিনিস্টার, আপনি বলুন, আমরা চেষ্টা করব দিতে।’ তখন তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, মিস্টার ম্যাকনামারা, আমাদের গরু এবং দড়ি দরকার। যুদ্ধের সময় গরু সব হারিয়ে গেছে। এখানে-ওখানে চলে গেছে, মরে গেছে। পাকিস্তান যুব্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। চাষিরা এদিক-সেদিক পালিয়ে গেছে। তখন গরু হারিয়ে গেছে। এখন যুদ্ধ শেষ, চাষি ফিরেছে, কিন্তু গরু নেই, তাই চাষ করবে কীভাবে? কাজেই আমাদের অগ্রাধিকার হলাে গরু।’ ম্যাকনামারার চোখ-মুখ লাল হয়ে যাচ্ছে। তাজউদ্দীন সাহেব বললেন, “আর আমাদের সব দড়ি তাে পাকিস্তানিরা নষ্ট করে ফেলেছে। এখন গরু পেলে গরু বাঁধতে দড়ি প্রয়ােজন। গরু এবং দড়ির প্রয়ােজন খুব তাড়াতাড়ি, না হলে সামনে জমিতে চাষ হবে না।’ ম্যাকনামারা বুদ্ধিমান মানুষ। আব্দুর উপহাস বুঝতে তার অসুবিধা হলাে না। পরবর্তী সময়ে আন্ধুর সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে ম্যাকানামারা মন্তব্য করেছিলেন, ‘He probably is the best Finance Minister at present in the world.” আব্বুর সঙ্গে কাজ করে শুধু ম্যাকনামারাই নন, সব বিদেশি কর্মকর্তাই মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর কাজের মধ্যে দিয়েই তিনি বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করেছেন। প্রফেসর নুরুল ইসলামের ভাষায় : তাজউদ্দীন সাহেব অত্যন্ত নির্ভুলভাবে খুব অল্প কথায় সব বিষয় তুলে আনতে পারতেন। তাঁর এই বিশেষত্বটি ছিল। তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমান ছিলেন এবং রাজনীতিবিদরা সাধারণত যে ধরনের কথাবার্তা বলেন তিনি তেমন বলতেন না। তার এই পরিষ্কার এবং স্ট্রেট কথার ফলে সবাই তার প্রতি আকৃষ্ট হতেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে সহজেই বিষয়গুলােকে নিয়ে আসা সম্ভব হতাে। এটা ঠিক, শুধু ম্যাকনামারাই নয়, যে কোনাে বিদেশি যারাই তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে কথা বলেছেন তারা প্রত্যেকেই তার সম্পর্কে অগাধ শ্রদ্ধা পােষণ করেছেন। তার ক্যাপাসিটি সম্পর্কে কারাে কোনাে সন্দেহ ছিল না। আর একটা জিনিস ছিল তার, যেখানে কোনাে ভুল হচ্ছে তিনি সেই ভুলটা স্বীকার করতেন, বুঝতে পারতেন সঙ্গে সঙ্গে।

১৯৭৪ সালে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (এভিবি) সভায় যােগ দিতে আব্দু কুয়ালালামপুরে যান, সেখানেও বাংলাদেশের পক্ষে তাঁর ব্যতিক্রমধর্মী সবল উপস্থাপনা ব্যাংকের বাের্ড অব ডাইরেক্টরদের শ্রদ্ধা কুড়ায় এবং তিনি অভূতপূর্ব সহযােগিতা লাভ করেন। সে সময় মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জমিরউদ্দিন আহমেদ, যিনি আল্লুকে ছােট ভাইয়ের মতােই স্নেহ করতেন, তাঁর স্মৃতিচারণায় এ ঘটনাটির উল্লেখ করেছেন : ‘মনে পড়ে, ১৯৭৪ সালের ২৪ এপ্রিল এডিবি’র মিটিংয়ের জন্য তাজউদ্দীন কুয়ালালামপুরে এলেন। আমি তখন সেখানে বাংলাদেশের পতাকাবাহী। আমাদের অনেকগুলাে ঋণ সম্পর্কে আবেদন ছিল। মিটিং-এর জন্য আমাদের উৎকণ্ঠার কোনাে শেষ নেই। অনেক মেমাে, অনেক ফাইলপত্র নিয়ে অর্থসচিব কফিলউদ্দিন মাহমুদ প্রস্তুত। আমি ও কফিলউদ্দিন মাহমুদ ঠিক তাজউদ্দীনের পেছনের সারিতে বসা। দেখলাম তাজউদ্দীন ফাইলটি গুছিয়ে ফিতা বেঁধে ফেললেন। বললেন, “Excellencies, how many times I will repeat that Bangladesh needs soft loans. Do you want me on my knees ?’ (এক্সেলেনসিজ, আমি কতবার পুনরাবৃত্তি করব যে বাংলাদেশের সহজ ঋণের প্রয়ােজন। আপনারা কি চান আমি হাঁটু গাড়ি ?] সব মিটিং স্তব্ধ হয়ে গেল। বাংলাদেশের সব কয়টি অনুরােধ গৃহীত হলাে। যেখানে তিন ঘন্টা মিটিং চলার কথা ছিল সেখানে মাত্র পনেরাে মিনিটেই মিটিং শেষ হলাে। কী আত্মপ্রত্যয় ! কী বাচনভঙ্গী ! সবাই মুগ্ধ হয়ে গেলেন।’ আবু বিদেশ থেকে যে ধরনের সাহায্য ও সহযােগিতা পেয়েছিলেন নিজ দেশ থেকে যদি । তেমনটি পেতেন তাহলে বাংলাদেশের ভাগ্য খুলে যেত। সহযােগিতার তুলনায় নিজ দেশে তাকে প্রায় প্রতি ক্ষেত্রেই প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হতে হয়েছে। একটি বিষয় খুব জোরেসােরেই তাঁর। বিরুদ্ধে প্রচার করা হতাে যে তিনি ভারতপন্থী, ভারতের এজেন্ট। নিজ দলের ভেতর এবং বাইরের স্বাধীনতা-বিরােধী শক্তিরা এই প্রচারণা অব্যাহত রেখেছিল। পাকিস্তান সরকার প্রচার করেছিল যে, তিনি আসলে হিন্দু। নাম তেজারাম।

ভারত থেকে তিনি বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন পাকিস্তান ভাঙার জন্য। পাকিস্তান সরকারের এই ভিত্তিহীন অপপ্রচারণা ছিল হাস্যকর এবং বাংলাদেশে তা কোনাে কূল পায়নি। ভারতপন্থী এই অপপ্রচারণাও বিলুপ্ত হয়ে যায় তার। নিজ কর্মজীবনের আলােকেই। আন্ধু ছিলেন মনে-প্রাণেই স্বাধীনচেতা এবং দেশপ্রেমিক। বাংলাদেশের কল্যাণে তিনি সারা জীবন উৎসর্গ করেছেন। সে কারণে তিনি বাংলাদেশপন্থী। ন্যায়-নীতির মধ্যে দিয়ে তিনি বাংলাদেশের সেবা করেছেন, সেজন্য তিনি ন্যায়পন্থীও বটে। ভারত সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদাশীল চুক্তিটি সম্পাদিত হয়েছিল। আব্দুর আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নেতৃত্বের কারণেই। স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে ভারতের স্বীকৃতি লাভ, স্বীকৃতির পরই মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে মিত্রবাহিনী হিসেবে ভারতীয় সৈন্য বাংলাদেশে প্রবেশ করার। অনুমতি পাবে এবং যখনই বাংলাদেশ সরকার চাইবে তক্ষুনি বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার হবে, এমন চুক্তি যা আন্ধুর নেতৃত্বাধীন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারতের মাটিতে সম্পাদন করে, তা তাে ছিল বাংলাদেশের জন্য এক বিশাল অর্জন ও সম্মানের ব্যাপার। তিন মাসের মধ্যে বিদেশি সৈন্যবাহিনীর প্রত্যাহার তাে বিশ্বে আজও নজিরবিহীন। বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের প্রতি আব্দুর কৃতজ্ঞতাবােধ ছিল। বাংলাদেশের চরম দুর্দিনে ভারত বাংলাদেশের পাশে এসে দাড়িয়েছিল। এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছিল সেজন্য কৃতজ্ঞতাবােধ থাকা স্বাভাবিক। কৃতজ্ঞতাবােধ মনুষ্যত্বেরই অংশ। কিন্তু সেই কৃতজ্ঞতাবােধ বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষায় তার জন্য অন্তরায় হয়নি। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তিনি যেমন বাংলাদেশের স্বার্থরক্ষা করেছেন এবং মর্যাদা বৃদ্ধি করেছেন, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও তেমনি।

অধ্যাপক নূরুল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, “তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে এই ভারতঘেঁষা। কথাটি যারা বলেছে তারা সম্পূর্ণ বাজে কথা বলেছে। তিনি কোনদিনই কারাে প্রতি নতজানু ছিলেন না। তার কোনরকম দুর্বলতা ছিল না। কোন দেশের প্রতি তার যা কিছু দুর্বলতা ছিল তা ছিল তাঁর নিজের দেশ বাংলাদেশের জন্য। তিনি ছিলেন প্রাে-বাংলাদেশ। আমি তার সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে এমন প্রমাণ পাইনি যে তিনি ভারতের সঙ্গে খাতির করে সমঝােতা করেছেন। আমি প্রায় তিন বছর তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। আমার অভিজ্ঞতায় এটি নেই যে ভারত আমার বন্ধু দেশ কাজেই ছেড়ে দাও। অথবা ভারতের সঙ্গে আলােচনার সময় শক্ত না থেকে নরম থাকতে হবে। এমন তিনি কখনােই করেননি বা বলেননি। তাজউদ্দীন সাহেবের মধ্যে কৃতজ্ঞতাৰােধ ছিল। যুদ্ধের দিনে ভারত আমাদের আশ্রয় দিয়েছে, সাহায্য কবে, সেজন্য তিনি কৃতজ্ঞ। কিন্তু দেশের স্বার্থে পাট বিক্রি করতে হবে, ফার্টিলাইজার লাগবে এ সব কথাবার্তার ক্ষেত্রে অনেক সময় আমরা ভারতীয়দের সঙ্গে ঝগড়া পর্যন্ত করেছি। তাজউদ্দীন সাহেব কোনদিন নরম হতে বলেননি। আমাদের মনােভাব ছিল আমরা স্বাধীন দেশ, কথাবার্তা-আলােচনায় আমরা স্বাধীনভাবে কথা বলবাে। আমাদের দেশের স্বার্থের বিষয় কোনাে খাতির নেই। যেমন পাট নিয়ে আলােচনার সময় আমরা সরাসরি ভারতকে বলেছি, তােমাদের পাট উৎপাদন বন্ধ করতে হবে। তােমাদের খরচ বেশি তােমরা উৎপাদন কেন করছাে ? আমরা তােমাদের কাছে পাট বিক্রি করবাে। আমি রীতিমত ফাইট করেছি তাদের সঙ্গে। আগে ভারত কিছু কিছু পাট উৎপাদন করতাে, বাকিটা নিতাে বাংলাদেশ অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তান থেকে। কিন্তু পাক-ভারত (১৯৬৫) যুদ্ধের পর পাকিস্তান পরবর্তী সময়ে ভারতে পাট বিক্রি বন্ধ করে দেওয়ার ফলে ভারত বেশ জোরেসােরে পাট উৎপাদন শুরু করে। আমরা চেয়েছিলাম ওরা বাড়তি পাট উৎপাদন বন্ধ করে আবার আগের মতাে আমাদের কাছ থেকে পাট ক্রয় করুক। তাজউদ্দীন সাহেবের কথা ছিল, বিপদে সাহায্য করেছে ভালাে কথা, আমরা বন্ধু থাকবাে। কিন্তু তাই বলে আমার দেশের স্বার্থের ক্ষতি হয় এমন কোনাে সুবিধা আমি তােমাকে দেবাে না।”

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান আন্ধুর স্বাধীন চিন্তা ও কার্যক্রমের উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, মনে আছে ওআইসি (Organization of the Islamic Conference) সম্মেলনে লাহাের যাওয়ার আগে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘ভারত হয়ে যাই, ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটু দেখা করে তারপর যাবাে।’ তাজউদ্দীন বলেন, ‘কেন ? আপনি কেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে একটু দেখা করে যাবেন ? আপনি স্বাধীন দেশের প্রধানমন্ত্রী, আপনি কেন কাউকে জিজ্ঞেস করবেন ? আপনি কেন অন্যের কাছে মাথা নিচু করবেন?’ তখন মুজিবুর বলেন, “ঠিক আছে। আমি সরাসরিই চলে যাবাে।’ তাজউদ্দীন বলেন, ‘মুজিব ভাই, আপনি তাই করেন। এতে আপনার মান-সম্মান থাকবে।’ লাহােরে ওআইসি সম্মেলনে মুজিব কাকুর যােগদান প্রসঙ্গে আল্লু দ্বিমত প্রকাশ এবং যেতে নিষেধ করলেও দেশের মর্যাদার প্রশ্নে বন্ধুরাষ্ট্রের প্রতিও তার মনােভাব ছিল অবিচল। আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে যায়। বিশ্বের পণ্যবাজারে নিত্যপ্রয়ােজনীয় দ্রব্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পায়, আন্তর্জাতিক খাদ্যসংকট দেখা দেয়। বাংলাদেশের তখন হিমশিম অবস্থা বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক ও কারিগরি সহযােগিতা লাভ, দেশের উন্নয়ন প্রকল্পগুলােকে চালু করার জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশে সাহায্যে কনসাের্টিয়াম গঠন, বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সম্পদের যথাযােগ্য ব্যবহার করে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি ও বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের মতাে অতি প্রয়ােজনীয় বিষয়গুলােকে কেন্দ্র করে আল্লু ‘৭৪-এর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে ক্যানাডা, যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, বুলগেরিয়া, চেকোশ্লোভাকিয়া, জাপানসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ সফর করেন।

আব্বু যখন বিশ্বব্যাংক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের গভর্নরদের সভায় যােগদান ও আলােচনার জন্য ওয়াশিংটনে পৌছেন তখন মুজিব কাকু জাতিসংঘের সভায় যােগদানের জন্য তার আগেই নিউইয়র্কে পৌছেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলায় বক্তব্য প্রদান করে ইতিহাস সৃষ্টি করেন। শিশু বাংলাদেশ সে বছর জাতিসংঘের সদস্য হয়। ওয়াশিংটনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ডের সঙ্গে মুজিব কাকুর মাত্র ১৫ মিনিটের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। আব্দু আগে থেকেই মুজিব কাকুকে নিষেধ করেছিলেন যে, যথাযােগ্য মর্যাদার সঙ্গে রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ ব্যতীত তিনি যাতে ফোর্ডের সঙ্গে দেখা না করেন। মুজিব কাকুর সঙ্গে ফোর্ডের বৈঠক ফলপ্রসূ হলাে না। আৰু খুব মর্মাহত হলেন। ১৩ অক্টোবর, এক মাস সাত দিন পর দেশে ফিরলেন আব্বু আম্মাসহ আমরা আন্ধুকে রিসিভ করতে বিমানবন্দরে (তেজগাও পুরাতন বিমানবন্দর) গেলাম। বিমানবন্দরে উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে আন্ধু জোরালাে বক্তব্য রাখলেন। তিনি বললেন, ‘বর্তমান জাতীয় দুর্যোগকালে উটপাখির মতাে বালিতে মাথা গুজে যদি ভাবা হয় যে ঝড় থেমে গেছে তা হবে মারাত্মক ভুল।’ তিনি অবিলম্বে দল-মত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে সঙ্গে নিয়ে জাতীয়ভাবে খাদ্যসংকটের বাস্তব সমাধানের আহ্বান জানালেন। আব্বু দেশে ফেরার পর ঘটনা একের পর এক খুব দ্রুত ঘটতে শুরু করল। আমরা একদিন স্কুল থেকে ফেরার পর মংলু ভাইয়ের মেয়ে শাহনাজ দৌড়ে এসে উত্তেজিত কষ্ঠে খবর দিল ‘শেখ সাহেব আজকে বাসায় এসেছিলেন। দাদার সঙ্গে ভীষণ তর্কাতর্কি হয়েছে।’ আম্মা নিচতলার রান্নাঘরে পিঠা ভাজছিলেন। তিনি আল্লুকে পিঠা খেতে বলার জন্য শাহনাজকে ওপরতলায় পাঠিয়েছিলেন। চঞ্চল শাহনাজ যখন দ্রুতগতিতে আব্দুর ঘরে ঢুকছে তখন শেখ সাহেব চুরুটের পাইপ হাতে নিয়ে ঘর থেকে বের হচ্ছেন। শাহনাজ তাঁর সঙ্গে খেল এক ধাক্কা। ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে তাকিয়ে দেখে শেখ সাহেব, তিনি মাত্র এসেছেন। আন্ধু সে সময় গােসল করছিলেন এবং শেখ সাহেব আল্লুকে ঘরে না পেয়ে বারান্দায় বসলেন। শাহনাজ দৌড়ে নিচে নেমে রান্নাঘরে আম্মাকে শেখ সাহেবের হঠাৎ আগমনের সংবাদ জানায়।

আমাদের শৈশবকাল থেকেই আমাদের বাড়িতে শেখ সাহেব তথা মুজিব কাকুর উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক ব্যাপার। আব্বু ও মুজিব কাকু একে অন্যের গৃহে যাতায়াত করতেন অবাধে। তাঁরা একত্রে বুদ্ধিপরামর্শ ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতেন। রাতের পর রাত জেগে দুজনে মিলে দেশ ও দশের জন্য কাজ করতেন। তারা ছিলেন একে অন্যের পরিপূরক। কিন্তু স্বাধীনতার পর তাদের দুজনের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশই বাড়তে থাকল এবারে মুজিব কাকুর আগমনের প্রেক্ষিত সম্পূর্ণ ভিন্ন। নীতিগত ও আদর্শিক ব্যাপারে দুজন তখন সম্পূর্ণ ভিন্ন মেরুতে অবস্থান করছেন। আব্বু ততদিনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন যে তিনি আর মন্ত্রিসভায় থাকবেন না, মুজিব কাকু যেদিন ইস্তফা দিতে বলবেন সেদিনই তিনি ইস্তফা দেবেন। নিজে থেকে ইস্তফা দিয়ে মুজিব কাকুকে বিব্রত করবেন না, আবার তাঁর আজীবনের নীতি ও আদর্শের সঙ্গেও আপস করবেন না। তিনি রাগ করে কদিন অফিসে যাননি। মুজিব কাকুর আসার খবর পেয়ে আম্মা ওপরে গেলেন। আব্দুর সঙ্গে মুজিব কাকুর তখন ভীষণ তর্ক চলছে। আব্ব ওনাকে বলছেন, মুজিব ভাই আজকে আমি আপনাকে যে কথাগুলাে বলব, আমি জানি আপনি সে কথাগুলাে যুক্তি দিয়ে খণ্ডাতে পারবেন না।’ আব্বু গণতন্ত্রকে হত্যা করে সব রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করে একমাত্র রাজনৈতিক দল বাকশাল (বাংলাদেশ কৃষকশ্রমিক লীগ) যা তিনি গঠন করতে যাচ্ছেন তার ভয়াবহ পরিণাম সম্পর্কে বললেন। প্রশ্ন তুললেন দলের হাতে অস্ত্র, দলীয় ক্যাডারদের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় বাধার সৃষ্টি ও সাধারণ মানুষদের তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করে আত্মীয়স্বজন ও দলের প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গের অন্যায় সুবিধা গ্রহণ সম্পর্কে আব্বু বললেন, ‘মুজিব ভাই, এই জন্যেই কি আমরা ২৪ বছর সংগ্রাম করেছিলাম। যেভাবে দেশ চলছে, আপনিও থাকবেন না, আমরাও থাকব না, দেশ চলে যাবে রাজাকার আল বদরদের হাতে।’

বাকশাল গঠনের মাধ্যমে একদলীয় শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে আন্ধু তার চূড়ান্ত মতামত মুজিব কাকুকে জানিয়েছিলেন। ব্যক্তিগত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীকে সাক্ষী রেখে তিনি মুজিব কাকুকে ফোন করে বলেছিলেন, আপনি একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন, কিন্তু আপনাকে আমি অনেকবারই বলেছি আমার দ্বিমতের কথা। আর আজ আমার চূড়ান্ত মতামত দিচ্ছি। আমি আপনার এই একদলীয় শাসনের সঙ্গে একমত নই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার হাতে এতই ক্ষমতা দেওয়া আছে যে সেই ক্ষমতাবলে দেশে একদলীয় ব্যবস্থা বা আর কোনাে পরিবর্তনের প্রয়ােজন আছে বলে আমি মনে করি না। আমরা বক্তৃতায় সব সময় বলেছি একটি সুখী সমৃদ্ধশালী দেশের কথা, যার ভিত্তি হবে গণতন্ত্র। যে গণতন্ত্রের গুণগান করেছি আমরা সব সময়, আজকে আপনি একটি কলমের খোঁচায় সেই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়ে দেশে একদলীয় শাসনব্যবস্থা করতে যাচ্ছেন। … বাই টেকিং দিস। স্টেপ ইউ আর ক্লোজিং অল দ্য ডােরস টু রিমুভ ইউ পিসফুলি ফ্রম ইউর পােজিশন।” ২৬ অক্টোবর দুপুর ১২:২২ মিনিটে আব্রু পদত্যাগ করলেন। পদত্যাগপত্রে স্বাক্ষর দিয়ে। অফিস থেকে ফোন করে আম্মাকে জানালেন, লিলি, আমি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেছি। ১২টা বেজে ২২ মিনিটে আমি পদত্যাগপত্রে সই করেছি।’ ফোনের মধ্যেই আম্মা আব্বুকে অভিনন্দন জানালেন। আম্মার Intuitive sense (অন্তান) ছিল প্রখর। ‘৭২ সাল থেকেই তিনি আন্ধুকে বলতেন যে আব্ব মন্ত্রিসভায় বেশিদিন টিকতে পারবেন না, তাঁকে কাজ করতে দেওয়া হবে না। দুপুর একটার কিছু পরে আব্দু সরকারি বাসায় ফিরে এলেন বন্ধু আরহাম সিদ্দিকীর গাড়ি। করে। নিজের জন্য সরকারি গাড়ি ব্যবহার বন্ধ করলেন পদত্যাগের সঙ্গে সঙ্গেই। আল্লু ফিরে। আসার পরপরই আমাদের বাড়ি লােকে লোকারণ্য হয়ে গেল। সকলেরই প্রশ্ন তার পদত্যাগ সম্পর্কে। আব্ব হাসিভরা মুখে পদত্যাগ সম্পর্কিত প্রশ্ন সযত্নে এড়িয়ে গেলেন। মুজিব কাকুর। বিরুদ্ধে একটি বাক্যও উচ্চারণ করলেন না।

আম্মা আমাদের বললেন, “তােমাদের আন্ধু পদত্যাগ করে মহাসম্মানের কাজ করেছেন।’ পরদিন সব পত্রিকার শিরােনামে আব্দুর পদত্যাগের বিষয়টি প্রকাশিত হলাে তাজউদ্দীনের পদত্যাগ। সরকার-প্রভাবিত কিছু কাগজে লেখা হলাে বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তাজউদ্দীন আহমদকে পদত্যাগ করানাে হলাে।’ বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থটা কী ? এই প্রশ্নের কোনাে উত্তরই খুঁজে পেলাম না। পত্রিকার কোনাে বিবরণে না। নিজের হৃদয়েও না। ঐতিহাসিক চরমপত্রের রচয়িতা ও পাঠক এম, আর আখতার মুকুল আব্দুর পদত্যাগ সম্পর্কে লিখেছেন, ‘মন্ত্রিসভা থেকে তাজউদ্দীন বিদায় নিলেন। মনে হলাে বঙ্গবন্ধুর কোমর থেকে শাণিত তরবারি অদৃশ্য হয়ে গেল। ছায়ার মতাে যে নির্লোভ ব্যক্তি অসাধারণ নিষ্ঠার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে অনুসরণ করেছেন এবং নিঃস্বার্থভাবে পরামর্শ দিয়ে বহু বিপদ থেকে উদ্ধার করেছেন এক গােপন চক্রান্তের ফাঁদে পা দিয়ে শেখ সাহেব সেই মহৎপ্রাণ ব্যক্তিকে ক্ষমতাচ্যুত করলেন। চক্রান্তকারীদের প্ররােচনায় মুজিব কাকু আব্দুকে এমনই অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। যে আব্বু মন্ত্রী থাকাকালীন সময় সরকারি সচিবকেও নির্দেশ দিয়েছিলেন আব্দুর কাছে কে আসে, কী কথাবার্তা হয় এসব খবর ওনাকে জানাতে বহির্বিশ্বেও আব্দুর পদত্যাগ নিয়ে প্রতিক্রিয়া হলাে। মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত জমিরউদ্দিন আহমেদকে ডেকে পাঠালেন সে দেশের জাতির জনক টুংকু আব্দুর রহমান। তিনি জানালেন যে, তাজউদ্দীনের এই সরিয়ে দেওয়াটাকে তারা ভালাে মনে করছেন না। মুক্তিযুদ্ধের প্রধানমন্ত্রী, বর্তমান অর্থমন্ত্রী যাকে সবাই চেনে, যিনি বাংলাদেশের জন্য সবদিকে জোর প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন তাকে কেন হঠাৎ সরিয়ে দেওয়া হলাে ? জমিরউদ্দিন আহমেদ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেনকে চিঠির মাধ্যমে এবং ঢাকায় এসে মুজিব কাকুকে সরাসরি মালয়েশিয়া সরকারের প্রতিক্রিয়া জানালেন। মুজিব কাকু উত্তর দিলেন, ‘আমি কাকে মন্ত্রী রাখি রাখি তাতে ওদের কী রে?’ রাষ্ট্রদূত জবাব দিলেন, এটা অন্য কেউ নয়, তাজউদ্দীন। আমাদের মতাে গরিব দেশে তাজউদ্দীন যে কয়দিন অর্থমন্ত্রী ছিলেন, শুধু ভিক্ষা করেই বেড়িয়েছেন। কিন্তু ভিক্ষুকেরও যে ডিগনিটি, আত্মমর্যাদা থাকতে পারে তা তাজউদ্দীনের ছিল। তাই তিনি সবার মনে দাগ কেটেছেন। কাজেই তারা তাদের প্রতিক্রিয়া জানাবেই।”

‘৭১ এ বাংলাদেশে গণহত্যার অন্যতম মদদদাতা মার্কিন সেক্রেটারি অব স্টেটস (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) হেনরি কিসিঞ্জারের নভেম্বর মাসে বাংলাদেশে আগমনের প্রাক্কালে, মার্কিন আগ্রাসী পররাষ্ট্রনীতির কঠোর সমালােচক আব্দুর পদত্যাগ লক্ষণীয় বিষয়।
পদত্যাগের ক’ঘন্টা আগে থেকেই সাদা পােশাকে গােয়েন্দা সংস্থার লােকরা সচিবালয় ঘিরে রেখেছিল। পদত্যাগ করার পরও আব্দুর যেন মুক্তি মিলল না। আব্দুর ওপর কড়া নজর রাখা হলাে। আব্দুর গতিবিধির ওপর রিপাের্ট করার জন্য সরকারি গােয়েন্দা সংস্থাগুলােকে নিযুক্ত করা হলাে। প্রথমে সরকারি বাসভবন, সেটা ছাড়ার পর আমাদের নিজস্ব বাসভবনের ওপর নজর রাখা শুরু হলাে। আন্ধু দুঃখ করে বলতেন যে পাকিস্তান আমলেও যেমন পেছনে গােয়েন্দা লেগে থাকত, স্বাধীন বাংলাদেশেও ঠিক একই অবস্থা। বাস্তবে পাকিস্তান থেকে ভৌগলিক ও রাজনৈতিক স্বাধীনতা অর্জন করলেও বাংলাদেশের রাজনীতি ও প্রশাসন পাকিস্তানের স্বৈরতান্ত্রিক মন ও মানসিকতা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। সে কারণেই ন্যায়নীতি ও প্রগতিশীল চিন্তাচেতনার ধারক আব্দুর মন্ত্রিসভা থেকে বিদায় অবশ্যম্ভাবী ছিল। ঐ বাস্তবতা সত্ত্বেও সেদিন বহু মানুষই কল্পনা করতে পারেননি যে আন্ধু ও মুজিব কাকুর পথ স্বাধীন দেশের মাটিতেই চিরতরে। আলাদা হয়ে যাবে। ষাটের দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক স্বর্ণালি লগ্নে মুজিব-তাজউদ্দীন এই নবীন জুটির আবির্ভাব বাংলাদেশের রাজনৈতিক মঞ্চে। তারা আওয়ামী লীগে প্রগতিশীল নতুন ধারার সূচনা করেন। তারা গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক সিদ্ধান্তগুলাে নিতেন একত্রে। বাস্তবায়ন করতেন কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। তাদের কাজ দেখে মনে হতাে তারা এক অভিন্ন সত্তা। তাঁদের টিমওয়ার্কের সবল ভিত্তির ওপর ১৯৭০ সালে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় অর্জন ও জনগণের আস্থা অর্জন সম্ভবপর হয়েছিল। তারা ছিলেন একে অন্যর পরিপূরক। মুজিব বাদে তাজউদ্দীনের ইতিহাস যেমন অসম্পূর্ণ তেমনি তাজউদ্দীন বাদে মুজিবের। বাংলাদেশকে তার অভীষ্ট সুশাসন ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় কাঠামােয় দাঁড় করানাের জন্য বড় প্রয়ােজন ছিল তাদের। সে কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি ছিল আব্বু ও মুজিব কাকুর বিচ্ছেদ। জাতির দুর্ভাগ্য যে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতেই ঘটে তাদের আদর্শিক ও নীতিগত বিচ্ছেদ।

আব্বু ও মুজিব কাকু সারাজীবন যে নীতি ও আদর্শকে লালন করেছিলেন তারই সার্থক প্রতিফলন ঘটানাের সুযােগ এসেছিল স্বাধীন বাংলাদেশে। আন্ধু তার নীতি হতে দূরে সরে। যাননি। কিন্তু মুজিব কাকু ষড়যন্ত্রকারীদের প্ররােচনায় সরে গিয়েছিলেন বহু দূরে। সে কারণেই ঐ বিচ্ছেদ ঘটে। আব্দুর পদত্যাগের মধ্যে দিয়ে ১৯৭১ এর স্বাধীনতাবিরােধী ও মুজিবনগর সরকারবিরােধী এই দুই দলের বিজয় সূচিত হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন আব্দু স্বাধীনতা বিরােধী যে দলটির ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করে তাদেরকে নিষ্ক্রিয় করে দেন তারাই মুজিব কাকুর প্রত্যাবর্তনের পর তার কাছে চলে আসে। যেহেতু মুজিব কাকু কখনই আব্দুর কাছে। জানতে চাননি নয় মাসের মুক্তিযুদ্ধের কথা, কে ছিল শত্রু কে মিত্র এবং কার কী ভূমিকা সেহেতু তাজউদ্দীন বিরােধী ঐ দুই দলের পক্ষে সম্ভবপর হয় মুজিব কাকুকে বিপথে পরিচালিত করা। শেখ মনির দাবি অনুযায়ী মুজিব কাকু গােপনে ও দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে শেখ মনিকে যদি তাঁর। প্রতিনিধি করে ভারতে পাঠিয়েও থাকেন ও তার অনুগত সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তােলার নির্দেশ দিয়েও থাকেন, তিনি কি জানতেন না যে যারাই স্বাধীনতায় বিশ্বাসী তারাই তার অনুগত ? অপর দিকে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল জাতীয় ঐক্যের বাইরে কিছু ব্যক্তির কর্তৃত্ব ও ক্ষুদ্র গােষ্ঠী। স্বার্থ প্রতিষ্ঠার জন্য। মুজিব কাকু কি জানতেন না যে জাতীয়ভাবে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম ও সুদক্ষ নেতৃত্ব ব্যতীত পাকিস্তানকে ঠেকিয়ে বাংলাদেশের পক্ষে স্বাধীনতা অর্জন অসম্ভব ? শেখ মনি ও তার দলটির কি সেই যােগ্যতা ছিল ? এই প্রশ্নগুলাে স্বাভাবিকভাবেই চলে আসে। তাজউদ্দীনের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে এই সত্যটিকে যেন তিনি কখনােই মেনে নিতে পারেননি। অথচ আলু নিজেকে আড়াল করে রেখে সব কৃতিত্বই দিয়েছেন তার প্রিয় ‘মুজিব ভাইকে’ মুজিব কাকুর নামেই স্বাধীনতা যুদ্ধকে তিনি পরিচালনা করেছেন।

মুজিব কাকুর ভাবমুর্তিকে স্বাধীনতার প্রেরণারূপে মুক্তি পাগল মানুষের কাছে আৰু উপস্থাপন করেছেন কি নিঃস্বার্থভাবে! দুর্ভাগ্য যে মুজিব কাকু তা যেন বুঝেও বুঝতে চাননি। মুক্তিযুদ্ধে চেতনায় উপস্থিত থাকলেও তিনি শারীরিকভাবে অনুপস্থিত ছিলেন এই ব্যাপারটাও তাকে খুব সম্ভব মনস্তাত্ত্বিকভাবে প্রভাবিত করেছিল। স্বাধীনতা যুদ্ধে বাংলাদেশ-ভারত যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা এ সম্পর্কে এক ভিডিও সাক্ষাৎকারে বলেন- “আমি মুজিবুর রহমানকে ছােট করার জন্য বলছি না, তাকে অশ্রদ্ধা করছি না। কিন্তু শেখ মুজিব যখন পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে ছিলেন তখন অস্থায়ী সরকার ভারতের সহায়তায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করে ফেলেছে; এবং যখন তিনি ফিরে আসেন তখন তিনি আবিষ্কার করেন যে স্বাধীনতার বড় অংশটি তাকে বাদ দিয়ে অর্জন করা হয়ে গেছে। ঐ সাক্ষাৎকারে লে. জে অরােরা মুক্ত কণ্ঠে আব্দুর সুনির্মল হৃদয়’ ও ‘দক্ষ প্রশাসক গুণাবলির প্রশংসা করেন। তিনি অকপটে বলেন মুজিব বাহিনীর, মুক্তিবাহিনীর সাথে অসহযােগিতা করার কথা এবং বাংলাদেশ সরকারের অগােচরে সৃষ্ট মুজিব বাহিনী সম্বন্ধে তিনি যখন জানতে পারেন এটা করা ঠিক হচ্ছে না বলে চিফ অব স্টাফকে জানানাের বিষয়টি। মুক্ত বাংলাদেশে মুজিব বাহিনীর অস্তিত্ব যে শুভ হয়নি, সে সম্বন্ধে তিনি বলেন, ‘যুদ্ধের পর আমরা মুজিব বাহিনী ভেঙে দিতে চেয়েছিলাম যেন এ বাহিনীর সবাই আবার তাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে ফিরে যেতে পারে। এর জন্য পরিকল্পনাও নেওয়া হয়েছিল কিন্তু যখন শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে এলাে তখন তিনি মুজিব বাহিনী না ডেঙে একে গড়ে তুলতে চাইলেন। এর জন্য আমার কাছে যন্ত্রপাতি, গাড়ি ইত্যাদি ভারতীয় সহায়তা চাইলেন। ব্যক্তিগতভাবে এতে আমি অসন্তুষ্টই হই। এর ফল হলাে যে মুজিব বাহিনী দিয়ে তেমন কোনাে কাজই হয়নি বরং মুজিব বাহিনীর কারণে বাংলাদেশ আর্মিই খােদ শেখ মুজিবের ওপর খেপেছিল। মুজিব কাকুর সাথে প্রশাসনিক বিষয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতা সম্বন্ধে অরােরা বলেন, ‘পরবর্তীতে আমি যখন তার সঙ্গে আরাে ঘনিষ্ঠভাবে মেলামেশার সুযোেগ পেলাম, তখন আমি উপলব্ধি করলাম যে তিনি প্রশাসনিক বিষয়ে যত না দক্ষ, জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে, তাদেরকে ক্ষেপিয়ে তুলতে তিনি তার চেয়ে অনেক বেশি দক্ষ ছিলেন।

তিনি কথা বলে লােকজনকে নাচাতে পারতেন। কিন্তু প্রশাসন চালানাের ব্যাপারে তিনি তেমন দক্ষ ছিলেন না। | প্রশাসনিক বিষয়ে মুজিব কাকুর অদক্ষতা এবং নতুন দেশ গড়ার জন্য যে দূরদর্শিতা, মানসিকতা ও নেতৃত্বের প্রয়ােজন ছিল তার ব্যাপক অভাবের ফলে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বিতর্কিত যে রক্ষী বাহিনী গড়ে ওঠে তা ছিল মুজিব বাহিনীরই নব সংস্করণ। এর সাথে মুক্তিযােদ্ধাদের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের পরিকল্পনা যা মুজিব কাকু বাতিল করে দেন তার সাথে ছিল আকাশ পাতাল তফাৎ। সংক্ষেপে দেশ পুনর্গঠন, নিরাপত্তা রক্ষা ও সবল অর্থনৈতিক কাঠামাে গড়ে তােলার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদেরকে উপযুক্ত ট্রেনিং ও শিক্ষা দেবার যে পরিকল্পনা আক্ম নিয়েছিলেন (পরিশিষ্টে জাতীয় মিলিশিয়া সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের ঘােষণায় বিস্তারিত উল্লেখিত। পৃ ৩৪১) তার বিপরীতে ক্ষুদ্র ব্যক্তি ও গােষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষাকারী মুজিব বাহিনীর নতুন রূপ রক্ষী বাহিনী জাতীয় ঐক্যে ফাটল ধরায়। ওদিকে স্বাধীন দেশের মাটিতে, মুজিব বাহিনীর ছাত্র নেতাদের মধ্যেও শুরু হয় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার রক্তক্ষয়ী লড়াই। সংঘর্ষের জের ধরে ‘৭২ সালের অক্টোবর মাসে গঠিত হয় জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। ‘৭৪ এ নিজ নিজ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠাকে কেন্দ্র করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতি পক্ষের হাতে সাতজন ছাত্র প্রাণ হারায়। এদিকে স্বাধীনতা বিরােধী পাকিস্তান ও সি.আই.এর প্রতিনিধি মােশতাক ও তার অনুচরদের লক্ষ্য ছিল ত্রিমাত্রিক। এক, আব্বু ও মুজিব কাকুর মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করা; দুই, মুজিব কাকুর ভুল প্লান পলিসিকে সমর্থন করা; তিন, মুজিব কাকুসহ স্বাধীনতা যুদ্ধের মূল নেতৃবৃন্দকে হত্যা করা। আন্ধুর সাথে মুজিব কাকুর ভাঙন ধরানােটি ছিল খুব সম্ভবত মােশতাকের প্রথম লক্ষ্য। কারণ মােশতাক জানতেন যে আন্ধু ছিলেন মুজিব কাকুর বর্মস্বরূপ।

তারা এক থাকলে বাকি দুই লক্ষ্য বাস্তবায়ন সম্ভবপর নয়। মুজিব কাকুকে আব্দুর থেকে দূরে সরিয়ে নেওয়ার কাজে তিনি ব্যবহার করেছিলেন শেখ মনিসহ মুজিব কাকুর কিছু নিকট আত্মীয়স্বজনদের। এই আত্মীয়দের ধারণাও ছিল না যে মুজিব-তাজউদ্দীন জুটির ভাঙন শুধু মাত্র দুটি ব্যক্তির সম্পর্কের ভাঙন নয়; ঐ ভাঙনের ফলে একদিকে দেশের যেমন ব্যাপক ক্ষতি সাধন হবে তেমন তাঁরা। নিজেরাও হয়তাে বেঁচে থাকবেন না। আব্দুর স্পষ্টবাদিতা ও অপ্রিয় সত্যকে তুলে ধরার সৎ সাহসকে তারা অন্তরায় গণ্য করেছিলেন। যদিও ঐ গুণাবলি ছিল দেশ রক্ষার বর্মস্বরূপ। এ প্রসঙ্গে মনে পড়ছে গােলােক মজুমদারের কথা। ১৯৭১ সালে বি,এস,এফ-এর পূর্বাঞ্চলীয় ইনসূপেক্টর জেনারেল (অবসরপ্রাপ্ত) এই পরম শ্রদ্ধাভাজন মানুষটি তার কর্মক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের বাইরেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে সমর্থন করেছিলেন নিঃস্বার্থভাবে। সুশাসনভিত্তিক, গণতান্ত্রিক ও সবল কাঠামাের ওপর স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশ গড়ে উঠুক এই ছিল তার একান্ত কামনা। কথা প্রসঙ্গে ‘৮৭-এর সেই সাক্ষাতে তিনি আমাকে বলেছিলেন, ‘তাজউদ্দীন সাহেব ছিলেন শেখ সাহেবের মহৎ ও বিশ্বস্ত বন্ধু, কিন্তু কঠোর সমালােচক। তিনি শেখ সাহেবকে সাথে নিয়েই বাংলাদেশের জন্য পরিবর্তন আনতে চেয়েছিলেন।” | (উপরােক্ত বিষয়গুলাে নিয়ে, বস্তুনিষ্ঠভাবে, দল ও মতের পক্ষপাতিত্বের উর্ধে আরও গবেষণা ও আলােচনা হওয়া দরকার ছিল কিন্তু তা হয়নি। একটি জাতির জন্ম ও তার রাজনৈতিক ইতিহাস জানবার জন্য দরকার উন্মুক্ত মানসিকতা ও সত্যকে জানবার অঙ্গীকার। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, “ইতিহাস দেশের গৌরব ঘােষণার জন্য নহে, সত্য প্রকাশের জন্য।’ ইতিহাস যত সুস্পষ্ট হবে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য সঠিক পথ বেছে নেওয়া ততই সহজ হবে।) আব্বুর পদত্যাগের পর শুরু হলাে আমাদের জীবনের আর এক নতুন অধ্যায়। আব্দু বললেন যত তাড়াতাড়ি পারা যায় সরকারি বাসভবন ছেড়ে আমাদের নিজেদের বাসায় উঠতে হবে। ধানমণ্ডির বাসার ভাড়াটেদের নােটিশ দেওয়া হলাে।

পূর্ণোদ্যমে শুরু হলাে বাঁধাহঁাদার কাজ। বাসা বদলাবার তােড়জোড়ের মধ্য দিয়েই আন্ধুকে হঠাৎ করেই যেন কাছে পেলাম। তার সঙ্গে যেন নতুন করে পরিচয় শুরু হলাে। দেখা গেল যে গােছগাছ, বাঁধাছাদা ও মেরামতের কাজে আব্দুর জুড়ি নেই। আম্মার সঙ্গে সঙ্গে আব্দুও কাজ করে যাচ্ছেন সুচারুভাবে। ছােষ্ট রিমি, যে ছােটবেলা থেকেই খুৰ দায়িত্বশীল ও সংসারী, সে-ও আলু ও আম্মাকে বাসা বদলানােতে খুবই সহায়তা করছিল। সরকারি বাড়ির সব আসবাবপত্র যা আমাদের দায়িত্বে ছিল, তার তালিকা আন্ধু তৈরি করলেন। কর্তৃপক্ষকে তালিকা অনুযায়ী সবকিছু বুঝিয়ে দিয়ে আব্দু আম্মা ও আমাদের নিয়ে রওনা দিলেন হাতে-গড়া জীবনের প্রথম বাড়ি ধানমণ্ডির ৭৫১ সাতমসজিদ রােডের উদ্দেশে। ২৮ নভেম্বরের ঘন সন্ধ্যায় আমরা ফিরে এলাম নিজ গৃহে। আব্দু ও আম্মার কোলে চড়ে পুরান ঢাকার ১৭ কারকুন বাড়ি লেন থেকে রিমি ও আমি এই বাড়িতে প্রথম গৃহ প্রবেশ করি ১৯৬৩ সালের ৫ এপ্রিল। মিমি ও সােহেল তখনাে জম্মগ্রহণ করেনি। চিকিৎসক ও রাজনীতিবিদ বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বাবা কফিলউদ্দিন চৌধুরী (১৯৫৭ সালে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্তমন্ত্রী ছিলেন) আব্দুকে খুব স্নেহ করতেন। তিনিই ধানমণ্ডির সরকারি প্লট কেনার জন্য আন্ধুকে জোর দেন। সে সময় ধানমণ্ডি প্রায় বিরান ভূমি। সেই এলাকার প্রতি মানুষের তখনাে আকর্ষণ গড়ে ওঠেনি। জমি জমারও চাহিদা নেই। পুরান ঢাকার র্যাঙ্কিং স্ট্রিট, ওয়ারি, সেগুনবাগিচা প্রভৃতি এলাকাই তখন অভিজাত ও আবাসিক এলাকা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। আব্বু সে সময় তিন হাজার টাকায় ধানমণ্ডিতে দশ কাঠা জমি কেনেন। বিয়ের পর ‘৬১ সালে হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন থেকে চল্লিশ হাজার টাকা ঋণ নেন বাড়ি করার জন্য। প্রতি মাসে ৩৪৪ টাকা কিস্তিতে হাউস বিল্ডিংয়ের ধার শােধ করতেন। ভবিষ্যৎ চিন্তা করে বাড়ি তৈরি করলেন দোতলা। আম্মা তখন আপত্তি জানিয়েছিলেন দোতলা বাড়ির কী দরকার?

একতলাই যথেষ্ট। আল্লু কিছু বলতেন না। মিটিমিটি হাসতেন। তারপর দীর্ঘ সময়ের জন্য যখন কারাবাসে গেলেন, তখন ঐ দোতলার ভাড়া দিয়েই আম্মাকে চলতে হতাে। সাতশাে টাকা ভাড়ার প্রায় অর্ধেকই চলে যেত হাউজ বিল্ডিং-এর দেনা শশাধ করতে। বাকি টাকা দিয়ে আম্মা কোনাে মতে সংসার চালাতেন। রাজনৈতিক কর্মী ও দুস্থ আত্মীয়স্বজনকেও আম্মা সাহায্য করতেন। এই বাড়িটি ছিল আমাদের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ। আব্বু পরিবারের ভূমি ও কৃষি সম্পদের অভাব ছিল না। সারা জীবন চাকরি বা পরিশ্রম না করে জমির আয় দিয়েই আন্ধু চলতে পারতেন। কিন্তু আদর্শগত কারণে তিনি স্বইচ্ছায় বেছে নিয়েছিলেন সাধারণ জীবন। সেন্ট গ্রেগরি স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করার পর প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়েছিলেন যে বৃত্তির টাকা বা নিজ উপার্জনের টাকা দিয়ে তিনি লেখাপড়া করবেন। নিজেকে স্বাবলম্বী করে তােলার ব্যাপারে ছাত্রাবস্থা থেকেই তিনি ছিলেন অত্যন্ত সজাগ।

ধানমণ্ডির বাড়িতে ওঠার পর আব্লু পূর্ণোদ্যমে লেগে গেলেন বাগান করা ও খুঁটিনাটি মেরামতের কাজে। আব্দুর একটি টিনের টুলবক্স ছিল। সেটার ভেতর থেকে ক্রু ড্রাইভার, পেরেক, তারকাটা ইত্যাদি বের করে বিভিন্ন কাজ সারতেন। আব্দুর ডিজাইন করা (বাংলার ঐতিহ্যবাহী কলসের ডিজাইন) জানালার গ্রিলগুলাে আম্মা ধুয়ে-মুছে নতুন করে রং করালেন। আম্মা বললেন, ‘৬৩ সালে প্রথম যেদিন এই বাড়িতে আনার আপা, ছােট কাকু দলিল ভাইসহ উঠলেন, তখনাে বাড়ি তৈরির কাজ চলছে। ঘরে ঢুকে দেখেন যে অতি প্রয়ােজনীয় টয়লেট তখনাে বানানাে হয়নি। আবু সঙ্গে সঙ্গে টয়লেট বানানাের কাজে লেগে গেলেন। হাইয়ের বাবাকে সঙ্গে নিয়ে (বারেক মিয়া) সারা রাত জেগে কোদাল নিয়ে গভীর গর্ত করে মাটির চাড়ি বসিয়ে কাঁচা টয়লেট বানালেন। আম্মা বললেন, এই হলাে তােমাদের আব্বু কোনাে কাজকেই ও ছােট মনে করে না। সব কাজ নিজে করতে পারলেই তার আনন্দ। ‘৭৪-এর ডিসেম্বর মাসে ঢাকার ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউট মিলনায়তনে ঠাকুরমার ঝুলি অবলম্বনে ‘বুদ্ধভূতুম’ নৃত্যনাট্য দুই দিনের জন্য মঞ্চস্থ হয়। সাবেক তথ্যমন্ত্রী শেখ আবদুল আজিজের স্ত্রীর উদ্যোগে ৩৫ জন শিশু ও কিশােরদের একটি দল এই নৃত্যনাট্যে অংশগ্রহণ করে। নাটকে রিমি হয়েছিল রাজা। আমি দুটু পাঁচ রানির এক রানি এবং শেষ দৃশ্যে বেশভূষা বদলে হয়েছিলাম রাজপুত্র বুধকুমার। শাপমুক্তি পেয়ে বাঁদর বুদ্ধ, কলাবতী রাজকন্যার স্বামী রাজপুত্র বুধকুমারে রূপান্তরিত হয়। নাটকের মধ্য দিয়েই আমাদের দলটি হয়ে যায় এক পরিবারের মতাে। নাটকটি প্রথমে মােস্তফা মনােয়ারের সুদক্ষ তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ টিভিতে প্রদর্শিত হয়। তারপর এই মঞ্চ নৃত্যনাট্য। দু’দিনই ছিল হাউস ফুল। টিকিট বিক্রি থেকে অর্জিত সব অর্থ মিসেস আজিজ বন্যাদুর্গতদের সাহায্যার্থে মুজিব কাকুর হাতে তুলে দেন। আল্লু ও আম্মা ব্যস্ত থাকায় আমরা বাসাতেই ওনাদের কিছুটা নাচ ও অভিনয় করে দেখাই।

‘৭৫-এর ২৪ জানুয়ারি একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দল বাকশাল গঠনের জন্য সংবিধানে। চতুর্থ সংশােধনী আনা হলাে। মুজিব কাকু রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। বিগত ২৪ বছরের গণতান্ত্রিক আন্দোলন যে লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য ধাপে ধাপে গড়ে উঠেছিল সেদিন তার যেন সমাধি ঘটল। আব্দুর আজীবনের চিন্তা-চেতনা, সংগ্রাম ও মূল্যবােধের অংশ ছিল যে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক, নিরপেক্ষ ন্যায়বিচার ব্যবস্থার প্রবর্তন, সবই তখন বিলুপ্তির পথে। বাকশালের ১৫ সদস্যর কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভাপতি হলেন মুজিব কাকু। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলীর পরেই চার নম্বরে খন্দকার মােশতাকের স্থান হলাে। জিল্লুর রহমান, শেখ ফজলুল হক মনি ও আব্দুর রাজ্জাক হলেন সাধারণ সম্পাদক। ১১৫ সদস্যর কেন্দ্রীয় কমিটিতে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর পরে পাঁচ নম্বরের স্থানটি নিলেন মােশতাক। এছাড়াও গঠিত হলাে জাতীয় কৃষক, শ্রমিক, যুব, ছাত্র, মহিলা লীগ প্রভৃতির জন্য এবং জেলা ভিত্তিক কমিটি। আব্ব কোনাে কমিটিতেই যােগ না দিয়ে সাধারণ সদস্য হিসেবে বাকশালে রইলেন। বাকশাল ত্যাগ করলে তার তিলতিল করে হাতে গড়া দল আওয়ামী লীগ ত্যাগ করতে হয় সেই কারণে তিনি নামে মাত্র সদস্য পদে রইলেন। আন্ধু তখনাে আশার বিপরীতে আশা করছিলেন যে মুজিব। কাকু একদিন তার ভুল বুঝতে পারবেন। মনে পড়ে বহু দলের বিপরীতে যখন ত্রিদলীয় ঐক্যজোট করা হলাে, আব্ব কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহকে বলেছিলেন, ‘মণিদা, আপনারা ত্রি-দলীয় ঐক্যজোট করেননি, ত্রিশূল করেছেন। এক শূলে মুজিব ভাই মারা যাবেন, অপর শূলে আপনারা ও আমরা, এবং তৃতীয় শূলে দেশপ্রেমিক শক্তিকে মারা হবে। আমরা হেয়ার রােডের বাসায় থাকার সময় আব্দু মণি সিংহের কাছে এই উক্তি করেছিলেন। মুজিব। কাকুকেও বাকশাল গঠনের ভয়াবহ পরিণামের কথা বারবার স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন কিন্তু কোনাে ফলই হলাে না। আৰু যেন উল্কা বেগে ছােটা ট্রেনের সম্মুখের সারিতে বসা এক যাত্রী। তিনি দেখছেন ট্রেনটি লাইনচ্যুত হয়ে গভীর খাদের দিকে ধাবমান।

তার আশপাশের অন্যান্য। যাত্রীরা কেউ ঘুমন্ত, কেউ বা গালগল্পে মশগুল। ট্রেন চালকেরও কোনাে হুশ নেই। ট্রেনটি এগিয়ে চলেছে অবশ্যম্ভাবী পরিণতির দিকে। ফেব্রুয়ারি মাসে আম্মা একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্বপ্ন দেখলেন। আব্লু যেন মহাশূন্য থেকে দড়ি ধরে নিচে নেমে আসছেন। অগণিত জনতা তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে দণ্ডায়মান আব্বু যেই মাটিতে পা রাখবেন এবং মানুষও হাততালি দিতে যাবে সেই মুহুর্তেই অদৃশ্য টানে কে যেন তাকে মহাশূন্যে তুলে নিল। তিনি হারিয়ে গেলেন মেঘের আড়ালে। মহাশূন্যের গভীরে। স্বপ্নটি দেখার পর আম্মার মনে গভীর আশঙ্কা জম্মাল যে আব্বু আর বেশিদিন বাঁচবেন না। আব্বু তখন ব্যস্ত, কিন্তু ভিন্নভাবে। তিনি বাগান করেন, আমাদের জন্য মােটা সুই-সুতা দিয়ে সেলাই করে রাফ খাতা বানান। শরৎচন্দ্রের রচনাবলি কিনে দেন, পাচ বছরের একমাত্র পুত্র সােহেলকে তাঁর প্রথম স্কুলে ভর্তি করেন। মিমি ও সােহেলের হাত ধরে ধানমণ্ডি লেকের পাড় ও আবাহনী মাঠে বেড়াতে যান। খাবার টেবিলে তাঁর ছাত্রজীবন, রাজনৈতিক জীবন ও ‘৭১-এর স্মৃতিচারণা করেন। ধর্ম, দর্শন, শিল্প ও সাহিত্য নিয়ে আলােচনা করেন। ‘৪৪ সালে ম্যাট্রিক পরীক্ষার একদিন আগে আন্ধু শের-এ-বাংলা এ কে ফজলুল হকের বক্তৃতা শুনতে সভায় গিয়েছিলেন। পরীক্ষার দিন আরেকজনের কাছ থেকে লেখার জন্য ভালাে কলম ধার করে পরীক্ষা দেন। ফলাফল যেদিন বের হলাে হােস্টেল সুপারিন্টেন্ডেন্ট ডুল রােল নম্বর দেখে রাজনীতির কাজে ব্যস্ত আব্বকে খবর দিয়েছিলেন যে তিনি সেকেন্ড ডিভিশন পেয়েছেন। নিয়মিত বৃত্তি পাওয়া আব্ব ভাবলেন যে এবারে আর স্কলারশিপের অর্থে কলেজে। পড়া হবে না। এরপর আব্বু রাজনৈতিক সহকর্মী শামসুল হক ও মুজিব কাকুর সঙ্গে তার দেখা হয়, তারা মেধা তালিকায় ১২তম স্থান লাভের জন্য আন্ধুকে অভিনন্দন জানান। তাদের। মাধ্যমেই আব্ব প্রথম সঠিক ফল জানতে পারেন। আব্ব ইন্টারমিডিয়েট পাস করেন মেধা তালিকায় চতুর্থ স্থান লাভ করে। কিন্তু মাঝখানে লেখাপড়ায় ছেদ পড়ে। ব্রিটিশ শিক্ষাবর্জন আন্দোলনের সাথে একাত্ব হয়ে তিনি এক বছর লেখাপড়া করেননি। পরে দাদির চাপে ১৯৪৮ সালে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেন এবং অর্থনীতিতে অনার্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হন।

আব্বুর ছাত্রজীবনের স্মৃতিচারণায় চলে আসত অসংখ্য মানুষের নাম। সকলের সঙ্গেই তার সম্পর্কের মূল যােগসূত্র ছিল দেশসেবা। স্মৃতিচারণায় যখন মুজিব কাকুর প্রসঙ্গ উঠত লক্ষ্য করতাম আন্ধু কেমন ভালােবাসার সঙ্গে তার কথা বলছেন, তাঁর প্রতি আব্দুর অভিমান ছিল, কিন্তু ভালােবাসায় ছিল না এতটুকু খাদ। মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী রাজনীতিক আব্দু যখন দেখলেন যে মুসলিম লীগ সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিষ্ঠান না হয়ে পরিণত হয়েছে মুষ্টিমেয় বিত্তশালী ক্ষমতাসীনদের প্রতিনিধি ও স্বৈরাচারী সরকারের তল্পিবাহকে, তখন তিনি হলেন আওয়ামী লীগের অন্যতম উদ্যোক্তা ও সংগঠক। ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আবু ১৯৫৪ সালের প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ থেকে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন পান। নির্বাচনে মুসলিম লীগের বিপক্ষে যুক্তফ্রন্ট জোট গঠিত হয়। এই নির্বাচনে আব্ব পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক প্রভাবশালী ও প্রবীণ রাজনীতিবিদ ফকির আবদুল মান্নানকে ১৩,০৬৭ ভােটের ব্যবধানে পরাজিত করে প্রাদেশিক পরিষদের কনিষ্ঠতম সদস্য (এমএলএ) নির্বাচিত হন। আন্ধু বলতেন যে, যুক্তফ্রন্টের বিজয় ছিল অসাম্প্রদায়িকতা ও প্রগতিশীল চিন্ত ধারার পক্ষে জয় ১৯৫৮ সালে প্রাদেশিক পরিষদের তরুণ সদস্য আব্দু রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রসহ পাশ্চাত্যের বেশ কিছু দেশ সফর করেন। জনগণ নির্বাচিত সেই রাষ্ট্রগুলাের গণমুখী। সরকার ও রাষ্ট্র ব্যবস্থায় আইনের শাসন প্রয়ােগের মতাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলাে তাকে অনুপ্রাণিত করে। | ধর্মের প্রসঙ্গ উঠলে আল্লু বলতেন নিঃস্বার্থভাবে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জীবসেবার নামই ধর্ম সত্য ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার মধ্যেই স্রষ্টাকে পাওয়া সম্ভব আব্বু বরাবরই ধর্মান্ধতা ও ধর্ম বিরােধিতার মাঝামাঝি স্থানকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করবে না এবং রাষ্ট্রে সব ধর্মের সমান অধিকার থাকবে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে তিনি এভাবেই সংজ্ঞায়িত করেছিলেন। পাকিস্তান আমলের মতাে রাষ্ট্রের হাতে যাতে ধর্মের অপব্যবহার না হতে পারে সে জন্যই ধর্মনিরপেক্ষতা স্বাধীন বাংলাদেশে গৃহীত হয়।

এ ক্ষেত্রে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিল অব রাইটসের ভিত্তিতে গড়া সংবিধানের প্রথম সংশােধনীতে উল্লিখিত ধর্মীয় অধিকারের সাথে আব্দুর চিন্তাধারার মিল লক্ষ করা যায়। আল্লু বলতেন যে আমাদের দেশে ধর্মকে আমরা আচার ও আনুষ্ঠানিকতার মধ্যে সীমাবদ্ধ করে রেখেছি। আমাদের ধর্মীয় শিক্ষাব্যবস্থায় রয়েছে বিরাট গলদ। সে কারণেই ধর্মের মূল বার্তা নির্যাতিত ও অসহায়ের পক্ষে। সংগ্রামের সময় অধিকাংশ ধর্মজ্ঞ ও ধর্মীয় নেতাকে খুঁজে পাওয়া যায় না। আব্দুর তরুণ বয়সের ডায়েরিগুলাে পড়লে দেখা যায় যে তিনি মিশেছেন সব ধর্মমত ও শ্রেণীর মানুষের সঙ্গে। জড়িত থেকেছেন বিভিন্ন মানবকল্যাণমূলক ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে। চরিত্রকে পরিশুদ্ধ করেছেন। আত্মসমালােচনার মাধ্যমে। ধর্মীয় কর্মকাণ্ডকে যুক্ত করেছেন জনকল্যাণে। কলেজছাত্র তাজউদ্দীন জোহরের নামাজ পড়ছেন এবং বেরিয়ে যাচ্ছেন নগর ছাত্রদের জন্য সাংগঠনিক কমিটি গঠনের কাজে। তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি, ৬ আগস্ট, ১৯৪৬ (বি. দ্র. ১৯৪৭-১৯৫০ সনের ডায়েরির উদ্ধৃতিগুলাে প্রতিভাস থেকে প্রকাশিত তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি থেকে নেওয়া।) কুরআন শরিফ কিনছেন (২৯ জানুয়ারি ১৯৪৮), জমিয়াতুল উলেমা প্রসঙ্গে মাওলানা সাহেবের জন্য বিবৃতি তৈরি করছেন (১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০), জুম্মার নামাজ পড়েছেন (১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০), মাদ্রাসার সভায় যােগ দিচ্ছেন (৫ এপ্রিল ১৯৫০), মাদ্রাসার সভায় সভাপতিত্ব করছেন (১২ মে ১৯৫০)। আবার পাশাপাশি তিনি রেলস্টেশনে পড়ে থাকা অচেনা এক মৃতসম যাত্রী। বৃদ্ধার জন্য উদাসীন রেল কর্তৃপক্ষের কাছে ও হাসপাতালে করছেন ছােটাছুটি (২৫ আগস্ট ১৯৪৭)। তিনি লড়ছেন অন্যায়ের শিকার এতিমখানার ছাত্রদের অধিকার নিয়ে (২৮ নভেম্বর ১৯৪৭)। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বিরুদ্ধে ও নির্যাতিত সংখ্যালঘুদের পক্ষে সােচ্চার হচ্ছেন (১০, ১১, ১২, ১৮ ফেব্রুয়ারি) বন বিভাগের কর্মচারীদের ঘুষ ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে হাজত খাটছেন (৭ জুলাই ১৯৫০)। আব্বু বলতেন ব্যক্তি ও রাজনৈতিক স্বার্থসিদ্ধির জন্য যারা ধর্মের লেবেল পরে অপকর্ম করে তারা ধর্মেরই অবমাননা করে। তাদের অপকর্মের ফলে সহিংসতা, দাঙ্গা প্রভৃতি ছড়িয়ে পড়ে দাবানলের মতাে, দুর্নাম হয় ধর্মের। আব্দু ধর্মের লেবেল-ভিত্তিক রাজনীতি সমর্থন করতেন না।

তিনি সকল ধর্মের নির্যাস ও বিশ্বজনীন মূল্যবােধ, ন্যায়, সমতা ও সততার ওপর প্রতিষ্ঠিত সমাজ গড়ার জন্যই আজীবন সংগ্রাম করেছিলেন। সেই কত যুগ আগে থেকেই আলু এমন ধরনের চিন্তা – ভাবনা করতেন যার যৌক্তিকতা ও প্রাসঙ্গিকতা দিনে দিনেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। বর্তমানে ধর্মের লেবেলধারী অধিকাংশ রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলাে হয়ে দাঁড়িয়েছে দুর্নীতি, স্বৈরাচার, নারী নিষ্পেষণ, অসহিষ্ণুতা, অজ্ঞতা ও হিংসার প্রতীক। যেসব ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাে রাষ্ট্রের গায়ে ইসলামি লেবেল পরানাের চেষ্টা করে বা ইসলামি রাষ্ট্র গড়ার কথা বলে তারা ভুলে যায় রাষ্ট্রের ধারণাটি ইসলাম থেকে আসেনি, এসেছিল হাজার বছর পরে ইয়ােরােপ থেকে এবং তা ছিল জাতিসত্ত্বা ও ভৌগােলিক সীমারেখাভিত্তিক। নবী করিম (স.) ইসলামি রাষ্ট্র গড়েননি, তিনি গড়েছিলেন তার সময়ের চেয়ে প্রগতিশীল উম্মাহ বা এমন এক জাতি যার কোনাে ভৌগলিক সীমারেখা ছিল না বা বিশেষ কোনাে বংশ বা বর্ণ ভিত্তিক জাতি সত্ত্বার সাথে সম্পৃক্ত ছিল না। এই উম্মাহ বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ, শ্রেণী-গােত্রে গঠিত এবং উচ্চ আদর্শ ও মূল্যবােধের সংমিশ্রণে সৃষ্ট ছিল। ইসলাম ধর্ম ইয়ােরােপে বেঁনেসার পথিকৃত হতে পেরেছিল ঐসব উচ্চতর মানবিক মূল্যবােধের জন্য। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের প্রাক্তন ডেপুটি ডাইরেক্টর, এবং হার্ভার্ড ইন্টারন্যাশনাল ল’ জার্নালের প্রতিষ্ঠাতা ড. রবার্ট ডিকসন ক্রেইনের মতে নবী করিম (স.) বিভিন্ন ধর্ম, বর্ণ ও গােত্রকে একত্র করে যে উন্নত মডেল গঠন করেছিলেন পরবর্তী সময়ে তা আদি আমেরিকান চেরােকি গােত্র সৃষ্ট কনফেডারেশন ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কনফেডারেশন প্রণয়নে প্রভাবিত করে।

আব্বু ছিলেন একজন যথার্থ রাষ্ট্রনায়ক। তার চিন্তাধারা ছিল স্বাধীন, উদার ও সুদূরপ্রসারী। তিনি বিশ্বের বিভিন্ন দর্শন ও মতবাদ যা বাংলাদেশের জন্য কল্যাণকর হবে মনে করতেন তা থেকে গ্রহণের পক্ষপাতী ছিলেন। সাম্য ও সম্পদের ন্যায়ভিত্তিক সুষম বণ্টনের বিষয়টি ছিল তার চেতনার একটি অংশ। তার উদ্যোগে ইসলামী ব্যাংকের সদস্যভুক্ত হয় বাংলাদেশ। তিনি মনে করতেন যে এই ব্যাংকের একমাত্র লক্ষ্য ইসলামের আদর্শ অনুযায়ী মুনাফা হবে না, বরং পুঁজি বিনিয়ােগ হবে সাধারণ মানুষের কল্যাণে।” তিনি সমাজতন্ত্র সম্বন্ধে বলতেন, ‘আমরা বাংলাদেশে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব যা সােভিয়েত রাশিয়া কিংবা চীনের ধরনের হবে না, বরঞ্চ তা হবে আমাদের নিজেদের মতাে। আমরা গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যে সুষম সমন্বয় ঘটাব যা বিশ্বে একটি অসাধারণ ব্যাপার হবে’। আব্বুকে কাজ করার সুযােগ দিলে এবং তিনি বেঁচে থাকলে আমার বিশ্বাস, তিনি যেমন মাত্র নয় মাসে দেশকে মুক্ত করেছিলেন তার প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও আন্তরিকতা দিয়ে তেমনি আত্মিক ও জাগতিক দিকগুলাের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে বাংলাদেশকেও গড়ে তুলতে পারতেন সারা বিশ্বের জন্যই এক অনুকরণীয় মডেল হিসেবে। আব্বু বলতেন যে শুধু রাজনৈতিকভাবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্মৃতিকে টিকিয়ে রাখা সম্ভবপর নয়। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ছড়িয়ে দিতে হবে তৃণমূলে। শিল্পী, কবি ও সাহিত্যিকদের এ ক্ষেত্রে বড় দায়িত্ব পালন করতে হবে, ১৯৭১-এ যেমন তারা করেছিলেন। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে আব্দু চলচ্চিত্র সেন্সর বাের্ডের সদস্য ছিলেন। সে সময় ছবি দেখে ভাবতেন যে খরা, বন্যা, অভাব-তাড়িত এই দেশে গণমানুষের সংগ্রামের কাহিনি যেন চলচ্চিত্রের মধ্যে ফুটে ওঠে। সুস্থ রুচিশীল ছবির চাহিদা যেন গড়ে ওঠে সেই জন্য পরিবেশ ও মানসিকতা তৈরি করার কথা তিনি ভাবতেন। তিনি সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর গড়ার পরিকল্পনা করেছিলেন ১৯৭১ সালেই। সেই অপূর্ণ ইচ্ছার কথা আমাদের কাছে ব্যক্ত করতেন সেই জাদুঘরে প্রদর্শিত হবে মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক আলােকচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণ, বিগত ২৪ বছরের সংগ্রামের ইতিহাস, তথ্য ও নিদর্শন। জাদুঘরের সঙ্গেই থাকবে গবেষণাগার যেখানে বসে নতুন প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের ওপর গবেষণা করবে।

আব্বু বলতেন বাংলাদেশের জন্মের ইতিহাস সংরক্ষণের মধ্যেই প্রতিক্রিয়াশীলদের ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করা সম্ভব। সাধারণত খাবার টেবিলেই চলত এসব আলােচনা। আলু খাবার খেতেন খুব পরিপাটি করে। এতটুকু খাবার নষ্ট করতেন না। আমাদের বলতেন, ‘যতটুকু খাবার খেতে পারবে ততটুকুই প্লেটে নাও। কিন্তু বেশি নিয়ে নষ্ট করবে না। একদিন ছােট্ট সােহেল মাছ দেখে মুখ ব্যাজার করে বলে, মাছ খাব না।’ আম্মা বললেন, তাহলে ডিম ভেজে দিই।’ আব্দু সেই মুহূর্তে সােহেলকে খাবার টেবিল থেকে উঠিয়ে বারান্দায় নিয়ে গেলেন। খুব আস্তে করে ছেলেকে বললেন, ‘এই দেশ স্বাধীন করার জন্য লাখ লাখ মানুষ প্রাণ দিয়েছে, দেশের বহুলােক না খেয়ে মারা যাচ্ছে, আর তুমি মাছ খেতে চাও না ? শিশু সােহেলের ঐ কথাগুলাে বােঝার বয়স হয়নি। তারপরও ঐ মাছ না-খেতে চাওয়ার মতাে ছােট্ট ঘটনার মধ্যে দিয়েই দেশপ্রেমের শিক্ষা দিতে আন্ধু দ্বিধা করলেন। অন্যকে যা করতে বলতেন তিনি নিজেও তা পালন করতেন অক্ষরে অক্ষরে। নিজেকে নিয়ে গর্ব করা বা অহমিকার মতাে ব্যাপারটা তার মধ্যে ছিল একেবারই অনুপস্থিত। নিজের কাজ নিজে করতে ভালােবাসতেন। থাকতেন সাধাসিধাভাবে, কিন্তু পরিষ্কার-পরিপাটি। পড়ালেখা করতেন প্রচুর। সুরাপান ও ধুমপান বর্জন করেছেন আজীবন অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন বিদেশ সফরে উঠতেন সস্তা হােটেলে এবং গরিব দেশের পয়সা বাঁচুক এ জন্য সস্ত্রীক তিনি কখনােই বিদেশে যাননি। সত্য ও ন্যায় ছিল তার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অসত্য ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন অবিশ্রান্ত যােদ্ধা। তিনি যেন এক ক্ষণজন্মা সাধকেরই গুণাবলিতে ভূষিত ছিলেন। আমাদের বিয়ে প্রসঙ্গ উঠলে আৰু বলতেন, ‘বিয়ে হবে সাধারণভাবে। ডাল, ভাত, করল্লা ভাজি দিয়ে বিয়েতে মেহমান আপ্যায়ন করা হবে। মেয়েদের বিয়েতে গয়নাগাটি দেব না। আমাদের সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ আমাদের মেয়ে দিয়ে দিচ্ছি তারপর আর কোনাে কথা থাকে না।

যাদের ঘরে ওরা যাবে তারাই হবে ভাগ্যবান।’ আলু ও আম্মার বিয়ের সময় আম্মা আন্ধুকে বলেছিলেন যে তিনি সােনার অলংকার চান না, আব্দু যেন বিয়ের দিন বেলি ফুলের মালা নিয়ে আসেন। আম্মার ইচ্ছে অনুযায়ী তাদের বিয়ে হয়েছিল বেলি ফুলের মালা বদল করে। তারা একত্রে নতুন জীবন শুরু করেছিলেন আষ্টেপৃষ্ঠে বাধা মেকি ও অর্থহীন সামাজিক সংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ উদাহরণ সৃষ্টি করে। আমার জন্মের দিন আল্লু প্রথা ভেঙে আতুরঘরে আম্মা ও আমার সঙ্গে সারারাত জেগে আমাদের পরিচর্যা করেছিলেন। আমার জন্ম উপলক্ষে সাইকেলে বেঁধে নিয়ে এসেছিলেন একটা সাদা বেতের দোলনা। দোলনায় দোল দিয়ে আমাকে শােনাতেন কত রকমের ছড়া। দীর্ঘ কারাবাসের আগে আমাদের বুকে নিয়ে বলতেন হরেক রকমের গল্প। ছােট্ট মেয়ের হাত ধরে পড়ে-যাওয়া পাখির নীড় বাঁধতেন মাধবীলতার ঝাড়ে। বাগান আলােকিত করতেন মৌসুমি ফুলের সারে। ১৯৭৫-এর ঐ দিনগুলােতে মনে হতাে ছেলেবেলার সেই হারানাে দিনগুলােই বুঝি আবার ফিরে এল। যেন যুদ্ধে পরিশ্রান্ত আব্দু বহুকাল পর ঘরে ফিরে এলেন। ১৯৭৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি, ভাষা আন্দোলন দিবসে শহীদ মিনারে কে বা কারা ছড়িয়ে দিল অসংখ্য হ্যান্ডবিল। হ্যান্ডবিলের শিরােনাম ছিল, ‘ফ্যাসিস্ট খুনি মুজিব ধ্বংস হােক।’ হ্যান্ডবিলের কথাগুলাে এমনভাবে লেখা ছিল যে পড়লে গা কেঁপে ওঠে। মুজিব প্রশাসনের দুর্নীতি, হত্যাকাণ্ড ইত্যাদিকে কেন্দ্র করে হ্যান্ডবিলের লেখাগুলাে যেন কী এক অশুভ সময়ের দিকে ইঙ্গিত করছিল। চারদিকে গুঞ্জন ভয়াবহ কিছু একটা ঘটতে চলল বলে। ১৭ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের চতুর্থ প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উদযাপন করতে খন্দকার মােশতাকসহ মুজিবনগর মন্ত্রিসভার সদস্যরা মেহেরপুরে গেলেন। আন্ধুকে আমন্ত্রণ বা খবর জানাবার প্রয়ােজন কেউ বােধ করলেন না। পদত্যাগের পর থেকে দলের উচ্চপদস্থ নেতা ও সহকর্মীদের প্রায় সকলেই তাকে এড়িয়ে চলেন। ১৭ এপ্রিলের মতাে বিশেষ দিনটিতেও আব্দু যেন নির্বাসিত। ঐদিন আলু কেমন যেন আনমনা হয়ে রইলেন। কারাে সঙ্গে তেমন কথাবার্তা বললেন না। কী যেন ভাবতে ভাবতেই অতর্কিতে আমাদের ‘৬৫ মডেলের সবুজ ফক্সওয়াগন গাড়িটি উঠিয়ে দিলেন রাস্তার আইলের ওপর। আব্দু একাই গাড়ি চালাচ্ছিলেন এবং ভাগ্য ভালাে বড় কোনাে দুর্ঘটনা থেকে সেদিন বেঁচে গেলেন। দেশ স্বাধীন করার কী নির্মম প্রতিদান পেলেন আব্বু !

১৯৭১ এর সেই রক্তঝরা দিনগুলােতে, নাওয়া-খাওয়া প্রায় বিসর্জন দিয়ে, এক বস্ত্রে তিনি স্বাধীনতার যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত পারিবারিক জীবনযাপন করবেন না এই শপথ গ্রহণকারী মন্ত্রী সভার সদস্যদের মধ্যে তিনিই একমাত্র সেই শপথ রক্ষা করেছিলেন অক্ষরে অক্ষরে। ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের অফিস কক্ষ হয়েছিল তার কর্মস্থল ও বাসস্থান। স্বাধীনতা অর্জন ছিল তার ধ্যান ও লক্ষ্য প্রসঙ্গে উল্লেখযােগ্য। তিনি গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ‘আল্লাহ-তায়ালা আমাদের স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ২৫ মার্চ ১৯৭১-এর রাতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে বন্দি হতে সাহায্য করে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন সময়ে বাংলাদেশের একচ্ছত্র নেতা বানিয়েছিলেন। তাজউদ্দীন আহমদের জায়গায় অন্য কেউ এমনকি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান থাকলেও অত সুষ্ঠুভাবে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনা করতে হয়তাে-বা পারতেন না। কারণ স্বাধীনতাযুদ্ধের বিভিন্ন স্তরে যে-সকল কঠিন পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছিল সেই-সকল পরিস্থিতি তথ্য ও প্রামাণ্যবহুল ‘২৬৬ দিনে স্বাধীনতা গ্রন্থের রচয়িতা মুক্তিযােদ্ধা অ্যাডভােকেট মুহাম্মদ নুরুল কাদিরের উক্তিটি এর সঠিক মূল্যায়ন করে সবকিছু ঠান্ডা মাথায় বিচার বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করে সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তা বাস্তবায়নের জন্য নেতৃত্বের যে দৃঢ়তা ও কঠোরতার প্রয়ােজন ছিল তা একমাত্র প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দেখাতে পেরেছিলেন।

বিশ্বে মেধাবী মানুষের অভাব নেই, বাগ্মী ও বাকপটু মানুষেরও কমতি নেই। অভাব। পূর্ণাঙ্গভাবেই সৎ (Integrity) মানুষের, যাঁর চিন্তা, চেতনা ও কর্মধারা সত্যের জ্যোতিতে আলােকিত লােকচক্ষুর অন্তরালে যিনি নিজেকে যাচাই করেন নৈর্ব্যক্তিকভাবে এবং উত্তাল সাগরে দিক হারা নাবিকের জন্য পরিণত হন অনির্বাণ লাইট হাউসে। নিভৃতে ও জনারণ্যে তিনি ধারণ করেন একই রূপ, মুখােশহীন খাঁটি রূপ, জাগরিত বিবেকের দ্যুতিময় স্পর্শে তা সদা ঝলমল। পৃথিবীর বিচিত্র বাজারে যারা নিজ বিবেক ও উচ্চ আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে সওদা করেন স্কুল প্রবৃত্তি, ক্ষমতা, বিষয়-বৈভবের, তাদের দৃষ্টিতে ঐ দ্যুতিময় মানুষগুলাে পথের কাঁটাস্বরূপ। সাধারণের চোখে তারা যেন মহা বিস্ময়। আন্ধু তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন উচ্চ আদর্শে দীক্ষিত, মেধা, যুক্তি ও বিবেচনাবােবাধে শাণিত এমনই এক বিরল ধারার পূর্ণাঙ্গ মানুষ ও আলাের পথের অভিযাত্রী । অতি ক্ষমতাধর মানুষও দুর্বল ও নিস্প্রভ হয়ে যেত তার উন্নত নীতিবােধ ও যুক্তির সংস্পর্শে এসে তাজউদ্দীন সম্পর্কে পাকিস্তান পিপলস পার্টি-প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টোর উক্তিটি খেয়াল করুন। সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর বরাত দিয়ে ঘটনাটি তুলে ধরা হলাে—‘তাজউদ্দীনকে পাকিস্তানিরা বিশেষ করে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও তার সহকর্মীরা কি ভয় করতেন তার একটা ঘটনা বলি। ১৯৭১ সালে মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের সেই রুদ্ধশ্বাস দিনগুলাের কথা। ভুট্টো এসেছেন ঢাকায়। আছেন ইন্টারকন্টিনেন্টাল হােটেলে কড়া মিলিটারি পাহারায়। আমরা ক’জন বাঙালি সাংবাদিক তার সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পেয়েছি। মুজিবইয়াহিয়া আলােচনার অগ্রগতি সম্পর্কে তিনি বেশি কিছু বলতে চাইলেন না। দুজন সহকর্মীর সঙ্গে তিনি উত্তেজিত কণ্ঠে আলাপ করছিলেন। একসময় আমাদের উপস্থিতি ভুলে গিয়ে উর্দুতে বলে উঠলেন—আলােচনা বৈঠকে মুজিবকে আমি ভয় পাই না। ইমােশনাল অ্যাপ্রােচে মুজিবকে কাবু করা যায় কিন্তু তার পেছনে ফাইল বগলে চুপচাপ যে নটোরিয়াস লােকটি বসে থাকে তাকে কাবু করা শক্ত।

দিস তাজউদ্দীন, আই টেল ইউ, উইল বি ইউর মেন প্রবলেম’ (আমি তােমাদের বলছি এই তাজউদ্দীনই হবে তােমাদের জন্য বড় সমস্যা)। ভুট্টোর উক্তি ও আশঙ্কাই ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছিল। পাকিস্তানের জন্য তাজউদ্দীন হয়ে দাঁড়িয়ে ছিলেন এক বিশাল সমস্যা। তিনি আপস করেননি, দৃঢ় হাতে মুক্তিযুদ্ধের হাল ধরে মুক্তিকামী জনগণের জন্য পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে এনেছিলেন পূর্ণ স্বাধীনতা। ভুট্টোর ঐ উক্তির একত্রিশ বছর পর তাঁর কন্যা, পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেনজির ভুট্টো, যুক্তরাষ্ট্রের ট্রিনিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে (স্যানঅ্যান্টোনিও, টেক্সাসে) আসেন ঐ বিশ্ববিদ্যালয় আয়ােজিত Distinguished Lecture Series-এ প্রধান বক্তা হিসেবে বক্তব্য রাখার জন্য। সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে (১ অক্টোবর, ২০০২) আমাদের পারিবারিক বন্ধু ট্রিনিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত অধ্যাপক ও প্রকৌশল বিভাগের তকালীন চেয়ারম্যান ড. মাহবুবউদ্দিনের সঙ্গে তার পরিচয় হয়। বেনজির যখন জানতে পারেন যে তিনি বাংলাদেশের এবং আন্ধুর সঙ্গে তাঁর পারিবারিক সূত্রে পরিচয় রয়েছে তখন তিনি মন্তব্য করেন, ‘I heard a lot about Tajuddin Ahmad from my father. He was the reason Bangladesh was formed’ cauf তাজউদ্দীন আহমদ সম্বন্ধে আমার বাবার কাছে অনেক শুনেছি। তার কারণেই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।) ২৬ মার্চ, ২০০৯-এ ড. মাহবুবউদ্দিন আমার কাছে বেনজির ভুট্টোর সাথে সাক্ষাতের ঘটনা ও তার মন্তব্যটি উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পেছনে আব্দুর ভূমিকা সম্বন্ধে পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের কোনাে সংশয় ছিল না। ক্ষুদ্র ব্যক্তিস্বার্থে নিজ দেশে যারা এই ঐতিহাসিক সত্যকে আড়াল করার চেষ্টা করেছেন, তারা হয়তাে বিস্মৃত হয়েছিলেন যে সত্যকে কেউ আড়াল করতে পারে না। সত্যর আলাে বড় তীব্র। নির্মম। সুন্দর আশা-হতাশা, দুঃখ-বেদনার ঢেউ এপ্রিল পেরিয়ে পদার্পণ করল মে মাসে। মুক্তিযােদ্ধা। আবুল মনসুর খানের সঙ্গে সাঈদা রওশন আরার বিয়ে হলাে ১১ মে। বরযাত্রী হিসেবে মনসুর ভাইয়ের সঙ্গে আন্ধু তার শান্তিবাগের বাড়ি থেকে খিলগাঁয়ে বিয়ের অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছিলেন। বউভাতে যেতে পারেননি বলে মনসুর ভাই পরের মাসে তার বাড়িতে আব্দুসহ আমাদের সবাইকে দাওয়াত করেন। নবপরিণীতা সাঈদা ভাবির শিক্ষক আবুল কালাম আজাদও (সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক ও প্রাথমিক শিক্ষক অ্যাসােসিয়েশনের সভাপতি) আমাদের সঙ্গে যােগ দেন।

নতুন ভাবি অনেক উপাদেয় পদ রান্না করে আমাদের আপ্যায়ন করলেন। মনসুর ডাই ও ভাবির আতিথেয়তা ও ছিমছাম নতুন সংসার দেখে সবাই খুব খুশি। এই দাওয়াতটিই ছিল। আমাদের সাথে করে কোনাে পারিবারিক দাওয়াতে আলুর শেষ যােগদান। খাবার শেষে আম খেতে খেতে আমরা বড়দের আলাপ শুনছি। আল্লু কথা প্রসঙ্গে মনসুর ভাইকে দেখিয়ে বললেন, ‘আমার আত্মীয় হিসেবে, যুদ্ধাহত মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে এদের অবদান ও প্রাপ্য থাকা সত্ত্বেও এদের রেকমেন্ড করিনি, যাতে মানুষ বলতে না পারে আমি স্বজনপ্রীতি করেছি। তারপরেও আমি রেহাই পাইনি। আব্বুর স্মিত হাসিভরা মুখে কেমন এক চাপা বেদনা খেলে গেল। মনে পড়ে আমার ছোেট ফুফা মােহাম্মদ নূরুল ইসলাম খান (সােনামিয়া) যিনি সৎ, দানশীল ও নিবেদিত সমাজসেবক হিসেবে তার এলাকায় পরিচিত ছিলেন, তিনি যখন ১৯৭৩-এর নির্বাচনের সময় তার এলাকা ময়মনসিংহের ভালুকা থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন চান, আব্বু তখন তার নীতি, অর্থাৎ আত্মীয়স্বজনকে সুবিধা বা অনুগ্রহ না দেওয়ার ব্যাপারটি উল্লেখ করেন। আব্দু ফুফাকে বলেন “আপনি একজন সৎ ও ভালাে মানুষ। কিন্তু যখনই আপনি আমার মাধ্যমে নমিনেশন পাবেন, অন্য নিকট লােকেরা অসঙ্গত সুবিধা নেবে। এই লােকেরা ন্যায় বিচারে বাধার সৃষ্টি করবে। অন্যায় হলেও, এদের পেছনে আমি রয়েছি, এই ভেবে সাধারণ মানুষ ভয়ে চুপ করে থাকবে।’ | ন্যায়নীতি, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এই শব্দগুলাের সঠিক অর্থ যেন আব্দুর সমগ্র জীবনেই বিদ্যমান। আব্দুর মামা আওয়ামী লীগ নেতা ও সমাজসেবক হেকিম মােল্লাকে আব্দু খুব শ্রদ্ধা করতেন। হেকিম নানাও আব্বকে স্নেহ করতেন। গৌরবর্ণের বলিষ্ঠ গড়নের এই প্রাণচঞ্চল মানুষটিকে যখন সন্ত্রাসীরা হত্যা করে আন্ধু তখন অর্থমন্ত্রী। ঐ হত্যাকাণ্ডে আন্ধু গভীরভাবে মর্মাহত হয়েছিলেন। ১৯৭৩-এর নির্বাচনের সময় আন্ধু যখন কাপাসিয়ায় গেলেন তখন পুলিশ সুপার আব্দুকে বলেছিলেন, হত্যার ব্যাপারে কাউকে যদি আব্দু সন্দেহ করে থাকেন তিনি তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। অথবা এ বিষয়ে আব্দুর কোনাে নির্দেশ থাকলে তা তিনি পালন করবেন। আল্লু পুলিশ সুপারকে একটি নির্দেশই দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন। “আইনকে তার নিজ গতিতে চলতে দিন।

আইনকে কারাে হাতের মুঠোয় বন্দী রাখবেন না।’ এই হলাে আব্বু এক স্মরণীয়, বরণীয় ও অনুকরণীয় চরিত্র ও আদর্শের অধিকারী। মানুষের চরিত্রের আসল পরিচয় ফুটে ওঠে মূলত দুটি সময়ে। এক দুঃসময়ে এবং দুই ক্ষমতা প্রাপ্তির পর। জাতির চরম দুঃসময়ে একজন খাঁটি সেবকের মতােই আন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দিয়েছিলেন এবং ক্ষমতার শিখরে পৌঁছেও তিনি এক মুহুর্তের জন্যও ভােলেননি জনগণের কাছে তার দায়বদ্ধতার কথা; সততা, সংযম ও সুনীতির আদর্শকে। তারপরও তাে তিনি রেহাই পাননি। অজ্ঞানতার পরিমণ্ডলে তার সততা ও ন্যায়-নীতি বােধই যেন হয়ে দাঁড়িয়েছিল এক বিরাট অপরাধস্বরূপ। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করার পর লিভার সিরােসিস রােগাক্রান্ত মফিজ কাকুর শারীরিক অবস্থা অবনতির দিকে যাওয়ায় আব্বু ঠিক করলেন চিকিৎসার জন্য তাঁকে রাশিয়ায় নিয়ে। যাবেন। ভিসার জন্য আন্ধু তৎকালীন সােভিয়েত রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। রাষ্ট্রদূত জানালেন যে, বাংলাদেশের বাইরে যাওয়ার জন্য ভিসা পেতে হলে আল্লুকে প্রথমেই রাষ্ট্রপতির অনুমতি গ্রহণ করতে হবে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সেরকম নির্দেশই তাদের দেওয়া। হয়েছে। এ কথা শুনে আন্ধু বললেন, তাহলে তিনি দেশের বাইরে যাবেন না। যে দেশ তিনি স্বাধীন করলেন সেই দেশের বাইরে যেতে হলে তাকে অনুমতি নিতে হবে এর চেয়ে দুঃখজনক। আর কী হতে পারে ! (১৯৭৭ সালের ২৮ জুলাই লিভার সিরােসিস ব্যাধিতে মফিজ কাকু ইন্তে কাল করেন)। আমাদের বাড়ির সামনে সরকারি গােয়েন্দা সংস্থার লােকজনের তখনাে কড়া নজর। মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা আর প্রাণনাশের উদ্যোগ নিয়েছিল তাদের হুমকির কারণে আমাদের দোতলার সিড়ির গােড়ায় লােহার গ্রিলের দরজা বসেছে। দেশ স্বাধীন করার কী অভিনব প্রতিদান !

আব্বু বলতেন, যুগান্তকারী বৈপ্লবিক কাজ করার সুযােগ মানুষের জীবনে খুব কমই আসে। সেই কাজ সারা জীবনে মানুষ একবারই করতে পারে। তার কাঁধে এসে পড়েছিল মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব তিনি সফলভাবে পালন করেছেন। বিজয়ের পর বেঁচে থাকাটাই তার জন্য বাড়তি পাওনা। বিজয়ের পরবর্তী দু’বছর দশ মাস দশ দিন সময় পর্যন্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। তাতে এটাই প্রমাণিত হয় মুক্তিযুদ্ধের সফল কাণ্ডারী হিসেবেই আব্দুর ভূমিকা অনন্য। ছিল না বরং দেশ গড়ার কাজেও বাংলাদেশে বড় প্রয়ােজন ছিল তাঁকে। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তাজউদ্দীন ভাই বাংলাদেশের রাজনীতিতে একমাত্র ব্যক্তি যিনি রাজনীতির সঙ্গে সুশাসনের সংযােজন ঘটানাের ব্যাপারে খুবই সচেতন ছিলেন। ক্ষমতার মাধ্যমে সুশাসন নিশ্চিত করার যে দায়িত্ব সে ব্যাপারে বেশিরভাগ রাজনীতিবিদই সচেতন নন। তাঁরা মনে করেন ক্ষমতায় যাওয়াই রাজনীতির সফলতা। কিন্তু রাজনীতির সফলতা নির্ভর করে ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেশে সুশাসন নিশ্চিত করা। সুশাসন নিশ্চিত করার মূল তিনটি উপাদান। রয়েছে : (১) রাজনৈতিক, (২) সামাজিক, (৩) অর্থনৈতিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা। রাজনীতিবিদ যখন জনগণের প্রতিনিধি হওয়ার বদলে নিজেকে সার্বভৌম মনে করেন তখনই ঘটে ঋলন। আমরা সংবিধানের প্রস্তাবনায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য ঐ তিনটি বিষয়ের প্রতি খুবই গুরুত্ব দিয়েছিলাম। এই উপাদানগুলােকে প্রতিষ্ঠার জন্য একজন রাজনীতিবিদের সবচেয়ে প্রয়ােজন নিজেকে আইনের কাজে অনুগত করা। তাজউদ্দীন ভাইই ঐ তিনটি বিষয়কে যা ছিল আমাদের স্বাধীনতার অঙ্গীকার প্রতিষ্ঠিত করার বলিষ্ঠ উদাহরণ সৃষ্টি করেছিলেন। আত্মপ্রচার বিমুখ আন্ধু তার সারাজীবনের চিন্তায় ও কাজে যে মহৎ উদাহরণগুলাে সৃষ্টি করেছিলেন, তা নতুন, সুন্দর বাংলাদেশ গড়ার জন্য সমুজ্জ্বল দিক নির্দেশক হতে পারে এখনাে তারপর দেখতে দেখতে জুলাই মাসও প্রায় এসে গেল। আমাদের দিন চলছে নিত্য দিনের মতােই।

এই সময় আম্মা লক্ষ করলেন দুপুরের খাবারের পর আল্লু কাউকে কিছু না বলে নিভৃতে কোথাও যেন উধাও হয়ে যাচ্ছেন। বেশ কয়েক দিন ধরেই এই অবস্থা চলছে। আম্মা একদিন ঠিক করলেন তিনি আল্লুকে অনুসরণ করবেন। দুপুরের খাবারের পর আন্ধু আস্তে করে দোতলা থেকে নিচতলায় নেমে এলেন। পেছনেই আম্মা। আন্ধু নিচতলার লনের ওপর দিয়ে হেঁটে বাড়ির পেছনের গ্যারেজে ঢুকলেন। গ্যারেজে জাল দিয়ে ঘেরা কাঠের খাঁচায় রাখা ধবধবে সাদা খরগােশ দুটি আন্ধুকে দেখে যেন প্রাণচঞ্চল হয়ে উঠল। সােহেল খরগােশ পছন্দ করে বলে মুজিব কাকু ১৯৭৫-এর জানুয়ারি মাসে ওর জন্য খরগােশ দুটি উপহার হিসেবে পাঠিয়েছিলেন। সেই খরগােশ সেখানে রাখা ছিল। আব্বু মাটিতে উবু হয়ে বসে খাঁচার দরজা খুলে সেই খরগােশ দুটিকে পরম যত্নে কচি ঘাস খাওয়াতে থাকলেন। হঠাৎ আম্মার উপস্থিতি টের পেয়ে তিনি পেছনে ফিরে তাকালেন। আম্মা হতাশা ভরা নম্র কণ্ঠে বললেন, “তােমাকে দিয়ে দেশের কাজ আর হবে না। আল্লু গভীর দৃষ্টিতে আম্মার দিকে তাকিয়ে স্মিত হাসলেন। সেই হাসিতে মিশে ছিল এক অপরূপ নির্মলতা ও গোপন গভীর বেদনা জুলাই মাসে কামাল ভাইয়ের (শেখ কামাল) বিয়ে ঠিক হলাে ক্রীড়া নক্ষত্র সুলতানা (খুকী) আপার সঙ্গে তিনি একবার আমাদের ধানমণ্ডি স্কুলে অনুষ্ঠিত ক্রীড়া অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছিলেন। বিয়ে উপলক্ষে মুজিব কাকুর ৩২ নং রােডের বাড়িতে খুব শােরগােল। আম্মা আমাকে সঙ্গে নিয়ে একদিন সন্ধ্যা রাতে মুজিব কাকুর বাসায় গেলেন। সবাই তখন আসন্ন বিয়ের আয়ােজন নিয়ে। আলােচনা করছেন। মুজিব-কাকি ঘরের সামনের বারান্দায় বসে পান খেতে খেতে গল্প করছেন। আমি মুজিব কাকুর ঘরের সামনে দিয়ে হেঁটে যেতেই ভেতর থেকে মুজিব কাকু আমাকে ডাকলেন, ‘এই রিপি নাকি? ভেতরে আয়।’ ঘরের খােলা দরজা দিয়ে দেখা যায় মুজিব কাকু বালিশে মাথা রেখে বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। তার মাথার কাছে চেয়ারে শেখ ফজলুল হক মনি বসা। তিনি মুখ নিচু করে নিম্নস্বরে মুজিব কাকুকে কিছু বলছিলেন।

মুজিব কাকুর ডাকে আমি ঘরে ঢুকতেই শেখ মনি মুখ তুলে আমার দিকে তাকালেন। তাঁর দৃষ্টি শীতল ও সতর্ক। মুজিব কাকু তার স্বভাবজাত উষ্ণতা ভরা কণ্ঠে আমাদের কুশল জিজ্ঞেস করলেন। এরপর দরাজ গলায় বললেন, ‘শােন, আমি তােকে লেখাপড়া করতে রাশিয়ায় পাঠাব।’ আমার সঙ্গে মুজিব কাকুর সেই শেষ কথা। মনে পড়ে ১৯৬৮ সালে মুজিব কাকু ও আব্লু যখন জেলে, তখন এই বাড়িতেই অনাড়ম্বর পরিবেশে অল্প কিছু আত্মীয়স্বজন ও বন্ধু-বান্ধবের উপস্থিতিতে মুজিব কাকুর জ্যৈষ্ঠ কন্যা হাসিনা আপার (শেখ হাসিনা) সাথে বিজ্ঞানী এম এ ওয়াজেদ মিয়ার বিয়ের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। আম্মার সাথে সেই অনুষ্ঠানে আমি যােগ দিয়েছিলাম। ঘােমটা পরা নববধূ হাসিনা। আপাকে এই সামনের বারান্দায় বসানাে হয়েছিল। বেণী বাধা রেহানা আপা (শেখ রেহানা) বড় বােনের বিয়েতে খুব উৎফুল্ল ছিলেন। সে সময় সংগ্রামী রাজনৈতিক পরিবারের সদস্য হিসেবে আমরা সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতাম। বিশেষ করে আব্বু ও মুজিব কাকুর হৃদ্যতার কারণে মুজিব কাকু ও আমাদের পরিবারের মধ্যেও সুন্দর সম্পর্ক গড়ে উঠে। মুজিব-কাকি ও হাসিনা আপা আম্মার হাতের রান্না খুব পছন্দ করতেন। বিশেষ করে শুটকি, নানারকম ভর্তা ও মাছের তরকারি। আম্মা সেগুলাে বেঁধে টিফিন ক্যারিয়ারে করে পাঠিয়ে দিতেন। হাসিনা আপা আমাদের বাড়িতে বেড়াতে আসতেন। কখনাে তার সাথে থাকত তার খালাতাে বােন জেলী আপা । আনার আপার সহপাঠী । ইডেন কলেজে হাসিনা আপা, আনার আপার এক ক্লাস ওপরে পড়তেন। তিনি যখন ছাত্রলীগের নির্বাচনে সভাপতি পদপ্রার্থী হন, আনার আপা তখন সাধারণ সম্পাদকের পদপ্রার্থী হয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর মুজিব কাকু ও আব্দুর মধ্যে আদর্শিক দূরত্ব বাড়তে থাকলেও আম দের দুই পরিবারের মধ্যে সৌজন্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় ছিল। কয়েকদিন পর ক্রিসেন্ট লেকের পাড়ে নতুন গণভবনে কামাল ভাইয়ের গায়ে হলুদের অনুষ্ঠান হলাে।

আজকাল যেমন বিয়ের অনুষ্ঠানগুলােতে বলিউড ও হিন্দি সংস্কৃতির ছড়াছড়ি ও বাড়াবাড়ি, বাংলা গানের বদলে হিন্দি গানের প্রাধান্য লক্ষ করা যায় সে সময়ের অনুষ্ঠানগুলাে তেমন ছিল না। কামাল ভাইয়ের গায়ে হলুদ ও বিয়ের অনুষ্ঠানের আয়ােজন হয়েছিল বাঙালি। সংস্কৃতিকে ঘিরে। অনুষ্ঠানে অনেকেই রং খেলেছিলেন। রং খেলার পর রঙে রাঙানাে অনেকেই নেমে পড়লেন লেকের পানিতে। লেকের পানি লাল রঙে রক্তিম বর্ণ ধারণ করল। মুজিব-কাকি ভালাে সাঁতার জানতেন। গায়ে হলুদের অনুষ্ঠানের পর তিনি ও অন্য অতিথিরা লেকে সাঁতার কাটলেন। জ্বর থাকায় রিমি গায়ে হলুদে যেতে পারেনি। বাসায় ফিরে আমি ওকে এই আনন্দপূর্ণ অনুষ্ঠানের বর্ণনা দিলাম। কামাল ভাইয়ের বিয়ের দিন আমরা মুজিব কাকুর বাসা থেকে বরযাত্রী হয়ে বেইলি রােডের অফিসার্স ক্লাবে বিয়ের অনুষ্ঠানে যােগ দিলাম। রেহানা আপা বন্ধুদের নিয়ে নতুন ভাবিকে লক্ষ্য করে মজার গান গাইলেন। ঐ বিয়ের কিছুদিন পরই মুজিব কাকু আন্ধুকে ফোন করে জানালেন জামাল ভাইয়ের বিয়েও ঠিক হয়েছে তার বােনের মেয়ে রােজীর সঙ্গে ঘরােয়া পরিবেশে অনুষ্ঠিত জামাল ভাইয়ের বিয়েতে আল্লু ও আম্মা যােগ দিলেন। দুই ছেলে ও নতুন দুই বউসহ মুজিব কাকু ও কাকির ছবি সব দৈনিকের প্রথম পাতায় ছাপা হলাে। কোনাে কোনাে পত্রিকায় বিয়ের ছবির নিচেই স্থান পেল দুর্ভিক্ষের শিকার ক্ষুধার্ত, মরণাপন্ন মানুষের ছবি। জুলাই মাসের শেষে আব্দুর কাছে খবর এল বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মধ্যে কেউ কেউ মুজিব কাকুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে। তারা যে কোনাে সময় মুজিব কাকু ও তাঁর সরকারের ওপর আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত। এই খবর পেয়ে একদিন রাত ১১টায় গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরেই আব্লু হেঁটে সােজা চলে যান মুজিব কাকুর বাসায় । মুজিব কাকু তখন শােবার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। আন্ধু মুজিব কাকুকে ষড়যন্ত্রের খবর জানিয়ে বলেন তিনি যেন অবিলম্বে সেনাবাহিনী, বিশেষ করে তাঁর গােয়েন্দা বাহিনীর ওপর নজর দেন। তিনি যেন এই খবরকে কোনাে মতেই হাল্কাভাবে না নেন। কিন্তু মুজিব কাকু আব্দুর এই সতর্কবাণীকে কোনাে আমল দিলেন না। সেদিন আব্দু খুব চিন্তিতভাবেই ঘরে ফিরে এলেন।

১৫ আগস্ট সকালে আব্দুর কাপাসিয়া এবং আমাদের দরদরিয়া গ্রামে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অভাবনীয়ভাবে ঘটনা মােড় নিল অন্যদিকে। খুব ভােরে প্রচণ্ড গােলাগুলির শব্দে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল। আমার সমবয়সী খালাতাে বােন ইরিনা আগের রাতে আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে থেকে গিয়েছিল। সে চিৎকার করে রিমিকে জড়িয়ে ধরল। রাজশাহীর এসপি (আমাদের এক মামা ও আম্মার মামাতাে ভাই) সৈয়দ আবু তালেব দুদিন আগে সরকারি কাজে ঢাকায় আমাদের বাসায় উঠেছিলেন। তিনি হতভম্বের মতাে ঘর থেকে বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। তার পাশে আলু ও কাজের ছেলে ইলিয়াস দাঁড়ানাে। আমরাও একে একে বারান্দায় জড়াে হলাম। রিমি ও আমিও গেলাম আব্দুর পেছনে পেছনে। দু-একটা গুলির শব্দ আবারাে শােনা গেল। তারপর সব নিঃশব্দ হয়ে গেল। আৰু নিচে নেমে বারান্দায় ইস্ত্রির টেবিলের পাশে রাখা ফোনে বিভিন্নজনকে যােগাযােগের চেষ্টা করলেন। কিন্তু সেই ভােরে ফোনে কাউকেই পেলেন না। এরপর আব্দুর নির্দেশ মতাে রিমিও ফোনে যােগাযােগের চেষ্টা করল। মিন্টো রােডে অধ্যাপক ইউসুফ আলীর সরকারি বাড়ির ফোন ধরল তাঁর মেয়ে বেবি। বেবি জানাল যে ওর বাবা নামাজ পড়তে গিয়েছেন এবং তাঁদের বাড়ির কাছেও অনেক গােলাগুলি হয়েছে। বেবি তখনাে জানত না মুজিব কাকুর ভগ্নিপতি খাদ্যমন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের মিন্টো রােডের বাসাতেও অভুথানকারীরা আক্রমণ করে তাকেসহ তার পরিবারের পাঁচ সদস্যকে হত্যা করেছে। আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ছােট মেয়ে বেবী সেরনিয়াবাত রিমির সহপাঠী ছিল। সেও নিহতদের মধ্যে ছিল। তার বড় মেয়ে শেখ ফজলুল হক মনির স্ত্রী আরজু মনি তার স্বামীসহ তাদের ধানমণ্ডির বাসায় ১৫ আগস্ট ভােরে একই দলের গুলিতে নিহত হন। মুজিব কাকু ও তার পরিবারের নিকটতম অত্যন্ত ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গরা একই দিনে, কাছাকাছি একই সময়ে অকালেই জীবন হারালেন। একটু সকাল হতেই আব্দু ফোনে খন্দকার মােশতাককে পেলেন।

তিনি আন্ধুর কাছে এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বিস্ময় প্রকাশ করলেন। অর্থ মন্ত্রণালয়ের এক পিয়ন আনােয়ার আগের রাতে আব্বর সঙ্গে দেখা করতে এসে বেশি রাত হওয়ায় আমাদের বাসায় থেকে গিয়েছিলেন, তিনি চলে গেলেন। আমাদের বাড়ি যিনি দেখাশােনা করতেন সেই বারেক মিয়া (হাইয়ের বাবা) এবং ইলিয়াস বাইরে বেরিয়ে পড়লেন। একটু পর বারেক মিয়া রাস্তা থেকে প্রায় ছুটতে ছুটতে ঘরের কাছে এসে চিৎকার করে রেডিও অন করতে বলেন। রাস্তTয় অনেক মানুষ জড়াে হয়েছে। তারা রেডিওতে কী এক ভাষণের কথা যেন বলাবলি করছে। আব্বু রেডিও অন করলেন। ইথারে ভেসে এল মেজর ডালিমের উত্তেজিত কণ্ঠ- ‘খুনি মুজিবকে। হত্যা করা হইয়াছে।’ আমরা সবাই বাক্যহারা হয়ে গেলাম। বেদনায় বিমূঢ় আব্দু গভীর দীর্ঘশ্বাস | ফেলে বললেন, ‘মুজিব ভাই জেনে গেলেন না কে ছিল তার প্রকৃত বন্ধু আর কে শক্র। মৃত্যুর আগে যদি চিন্তার সময় পেয়ে থাকেন তাহলে হয়তাে ভেবেছেন আমিই তাকে হত্যা করিয়েছি। আমি যদি মন্ত্রিসভায় থাকতাম কারাে সাধ্য ছিল না মুজিব ভাইয়ের শরীরে কেউ সামান্য আঁচড় কাটে।’ সপরিবারে স্ত্রী ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, তিনপুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, দশ বছরের বালক শেখ রাসেল, ছােট ভাই শেখ নাসের, দুই পুত্র বধূ সুলতানা কামাল খুকী ও পারভীন জামাল রােজীসহ মুজিব কাকু নিহত হন। দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা সে সময় পশ্চিম জার্মানিতে থাকায় তারা প্রাণে বেঁচে যান। শিশু রাসেলকেও ছাড়েনি বর্বর ঘাতকের দল। ১৯৬৪ সালে যখন রাসেলের জন্ম হয়, আম্মার সাথে আমি নবজাতক শিশুকে দেখতে গিয়েছিলাম । মুজিব কাকির কোল আলাে করে রয়েছে ফুটফুটে রাসেল। আজ সে নেই ! তারা। কেউ নেই। কী এক নির্মম ও অবিশ্বাস্য সত্যের মুখােমুখি আমরা সেদিন দাঁড়ানাে ! মুজিব কাকুকে হত্যার খবর রেডিও মারফত চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল। ইলিয়াস রাস্তা থেকে আরও খবর নিয়ে এল। অনেক মানুষ এই হত্যাকাণ্ডে উল্লাস প্রকাশ করেছে। হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করে কেউ কেউ শ্লোগানও দিচ্ছে। পঁচাত্তরে মুজিব কাকুর জনপ্রিয়তা ছিল শূন্যের কোঠায়। তার নেতৃত্ব সম্পর্কে হতাশাগ্রস্ত জনগণ তার স্বৈরশাসনের অবসান কামনা করছিল। যদিও তারা হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করেনি (অতীতে একই জনগণ তার জন্য প্রাণ আহুতি দিতে পর্যন্ত প্রস্তুত ছিল) তা সত্ত্বেও ধারণা করা যায় যে দেশের অধিকাংশ মানুষ এই নির্মম হত্যাকাণ্ডকে সমর্থন করেনি। দুর্ভাগ্য যে সেদিনের নির্মম হত্যাকাণ্ডকে রুখতে বা সেই হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদ করতে মুজিব কাকুর অনুগত রক্ষী বাহিনী চরমভাবেই ব্যর্থ হয়।

একমাত্র বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে জাতির জনকের হত্যার সশস্ত্র প্রতিবাদ করেন ও জেনারেল জিয়াউর রহমান নিয়ন্ত্রিত আর্মির সাথে সংঘর্ষের ফলে দেশান্তরী হতে বাধ্য হন। মুজিব কাকুকে হত্যা করা হয়েছে- এই ঘােষণা শােনার পর আব্ব বলেছিলেন, মুজিব কাকু জেনে গেলেন না কে ছিল তাঁর প্রকৃত বন্ধু আর কে শত্রু। রাষ্ট্রপতি হিসেবে খন্দকার মােশতাকের নাম ঘােষিত হওয়ার পর মনে হলাে নিয়তির কী নির্মম পরিহাস, মুজিব কাকুর অতি কাছের আস্থাভাজন এই ব্যক্তিটি নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। সে ও তার মতাে ষড়যন্ত্রকারীরা ঠিকই জানত যে আন্ধু মুজিব কাকুর পাশে থাকলে তারা আঘাত হানতে পারবে না। সে কারণেই কুমন্ত্রণা ও ভুল পরামর্শ দিয়ে তারা মুজিব কাকুকে আব্দুর কাছ থেকে দূরে সরিয়ে নেয়। মুজিব কাকুর আত্মীয়দের মধ্যে কেউ কেউ আব্দুর প্রতি তাদের ব্যক্তিগত আক্রোশের কারণে আব্দু ও মুজিব কাকুর সম্পর্কে ফাটল ধরায় এবং হত্যাকারীদের ষড়যন্ত্র বাস্তবায়নের পথকে সহজ করে দেয়। আব্বু নিঃস্বার্থ উপদেশ, সতর্কবাণী সব অগ্রাহ্য করে মুজিব কাকু স্বাধীনতার শত্রুদের বরণ করেন পরম বন্ধু হিসেবে।

পঁচাত্তরের ১৫ আগস্টের সকালবেলাটা ছিল উকণ্ঠা, উত্তেজনা ও বেদনাসিক্ত। আশপাশের অনেকেই আব্দুর সঙ্গে দেখা করতে এলেন। আব্দুর সাবেক একান্ত সচিব আবু সাঈদ চৌধুরীসহ অনেকে সকাল থেকেই আমাদের বাসায় ফোন করা শুরু করলেন। কেউ কেউ আব্বুকে বাসা ছেড়ে যাওয়ার উপদেশ দিলেন। আম্মা বারবার আল্লুকে অনুরােধ করলেন, “তুমি বাসায় থেকো, আশপাশে কোথাও চলে যাও। নিরাপদ জায়গায় গিয়ে দেখাে পরিস্থিতি কী হয়।’ আন্ধু বাসা ছেড়ে যাওয়ার ব্যাপারে বিন্দুমাত্র আগ্রহ দেখালেন না। আব্দুর মুখমণ্ডলজুড়ে কী নিদারুণ বেদনার ছাপ। আব্দুর এক সতীর্থ উপদেশ দিলেন ভারতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। আবু বললেন, ‘যে পথে একবার গিয়েছি সে পথে আর যাব না।’ একাত্তরের সেই সময় ও আজকের সময়ের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাৎ। সেদিন বঙ্গবন্ধু জীবিত ছিলেন। তারই প্রতিনিধি হিসেবে তাজউদ্দীন এক স্বাধীনতা-পাগল জাতির মুক্তির সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে ভারতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। কিন্তু আজ তিনি যদি পালিয়ে যান তাহলে হত্যাকারী ও ষড়যন্ত্রকারীরা অপপ্রচারণার সুযােগ পাবে যে তিনিই মুজিবকে হত্যা করিয়ে পালিয়ে গিয়েছেন। আন্ধু বললেন, “বিশ্বাসঘাতক অপবাদ নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে মরে যাওয়াই ভালাে।’ সকাল সাড়ে নয়টার দিকে সেনাবাহিনীর কিছু সদস্য আমাদের বাসা ঘিরে ফেলল। সামনের বড় রাস্তাজুড়ে সেনাবাহিনীর অতিকায় ট্রাকগুলাে মূর্তিমান আতঙ্কের মতাে একে একে বাসার সামনে জড়াে হলাে। আব্বুর সঙ্গে আমরা বাসার টেলিফোনের পাশে দাঁড়াননা। সেই মুহুর্তে একজন অফিসার দ্রুতগতিতে আমাদের দোতলার বারান্দায় উঠে এলেন। ক্যাপ্টেন শহীদ হিসেবে পরিচয়দানকারী এই অফিসার আম্মাকে বললেন, এই মুহূর্ত থেকে আপনারা কেউ বাসার বাইরে যেতে পারবেন না এবং বাইরের কেউ ভেতরে আসতে পারবে না।’

আব্বু প্রত্যুত্তর দিলেন, বলুন হাউস অ্যারেস্ট। আমাদের গৃহবন্দি করলেন। ক্যাপ্টেন শহীদ আমাদের কাছে একটা চাকু চাইলেন। তাঁর হাতে চাকু দেওয়া মাত্রই তিনি টেলিফোনের তারটি দ্বিখণ্ডিত করলেন। তারপর ফোন-সেট সহকারে নিচে নেমে গেলেন। আমাদের নিচতলাটি একটি স্কুলকে ভাড়া দেওয়ার সময় আব্দু সামনের রুমটি ব্যক্তিগত অফিস হিসেবে ব্যবহারের জন্য খালি রেখেছিলেন (ষাটের দশকেও ঐ রুমটি তিনি অফিস, পড়ার ঘর ও বৈঠকখানা হিসেবে ব্যবহার করতেন)। সেই রুমটিকেই তারা তাদের থাকার জন্য বেছে নিল এবং বাসায় ছাদের ওপর অ্যান্টি-এয়ারক্র্যাফট-গান স্থাপন করল। তাদের ব্যাপার-স্যাপার দেখে মনে হচ্ছিল তারা যেন অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বিশাল কোনাে বাহিনীর মােকাবিলা করতে যাচ্ছে। হােট সােহেল আমার কোলে চড়ে দোতলার জানালা দিয়ে নিচের রাস্তায় জমায়েত আর্মির ট্রাকগুলাে দেখে উত্তেজিত কণ্ঠে বলে উঠল ব’পা, মিলিটারি বন্দুক’! এর পর থেকে আমরা সবাই বাসায়, সবার কাছ থেকে একেবারে বিচ্ছিন্ন। সময় যেন আর কাটছে না। প্রতিটি মুহূর্ত মনে হচ্ছে যেন একটি দিন। তারপর গভীর রাতে আমাদের দোতলার দরজার কলিংবেল আচমকা বেজে উঠল। দরজা খুলতেই দেখা গেল যে হত্যাকারীদের অন্যতম মেজর ডালিম ও তার সঙ্গে অন্য একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। মেজর ডালিম জানাল যে আব্দুর নিরাপত্তার জন্য বাসায় আর্মির পাহারা বসেছে। নিরাপত্তা ঠিক আছে কি না সেটা দেখতেই তার আগমন। আব্ব তাকে ধমক দিয়ে বললেন যে তাদের আসার উদ্দেশ্য আসলে তিনি বন্দী। হয়েছেন কি না সে ব্যাপারে নিশ্চিত হওয়া। আমাদের বাসায় বেড়াতে এসে আটকে পড়া সেই মামা চলে গেলেন পরদিন। আব্ব বলেকয়ে তার চলে যাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ইরিনা গেল কয়েক দিন পর। তাদের চলে যাওয়ার অনুমতি মিললেও আমাদের কারাে বাইরে যাওয়ার উপায় ছিল না। আব্বু বহু কষ্টে নিচের তলা থেকে সেনাবাহিনীর কন্ট্রোল রুমের সঙ্গে যােগাযােগ করে ১৮ আগস্ট থেকে রিমি ও মিমির স্কুলে যাওয়ার অনুমতি জোগাড় করলেন। অন্তত বাইরের পরিস্থিতি রিমি স্বচক্ষে দেখে আমাদের জানাতে পারবে, যেটা আৰু চিন্তা করেছিলেন। তাদের স্কুলে যাওয়ার সময় প্রচণ্ড ঝামেলা পােহাতে হতাে। তাদের ব্যাগ, বই, খাতাপত্র ইত্যাদি পরীক্ষা করা হতাে। স্কুল থেকে ফেরার পর আবারাে একইভাবে আসতে হতাে। রিমির স্কুলের সহপাঠীদের ধারণা ছিল ১৫ আগস্টে আমাদেরও মেরে ফেলেছে।

ওকে ক্লাসে প্রবেশ করতে দেখে তারা সবাই খুব চমকে গিয়েছিল। স্কুল থেকে রিমি শুনে এল যে আর্মির পাহারায় মুজিব কাকুকে টুঙ্গিপাড়ায় কবর দেওয়া হয়েছে। রাস্তায় বিভিন্ন জায়গায় সে আর্মির পাহারা দেখল। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের সামনে একটি ট্যাংক রাখা হয়েছে দেখতে পেল। ১৯ আগস্ট রিমি ১৪ বছরে পা দিল। আমার জমানাে অনেক স্ট্যাম্প ও কার্ডের মধ্যে একটি কার্ড রিমির খুব পছন্দের ছিল। সেই কার্ডটি ওকে জন্মদিনের উপহার হিসেবে দিতেই সে খুশিতে আপুত হয়ে উঠল। আব্দুও মাথায় হাত রেখে আশীর্বাদ করলেন, তিনি সচরাচর যা করেন না, কয়েক লােক খাবারও তার মুখে তুলে দিলেন। ২২ আগস্ট শুক্রবার সকালে আমাদের বাড়ির সামনে পুলিশের দুটি জিপ এসে থামল। এক পুলিশ অফিসার এসে আব্বুকে বললেন, স্যার আমাদের সঙ্গে আপনাকে যেতে হবে।’ আন্ধুকে কোথায় নিয়ে যাওয়া হবে তা তিনি প্রকাশ করলেন না। আব্লু গােসল করে নাশতা খেয়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেন। জিজ্ঞেস করলেন জামা-কাপড় নিতে হবে কি না। অফিসার বললেন, ‘নিলে ভালাে হয়। আন্ধু একটা ছােট সুটকেসে কিছু জামা-কাপড় গুছিয়ে নিলেন। সঙ্গে নিলেন কুরআন শরিফ ও কালাে মলাটের ওপর সােনালি বর্ডার দেওয়া একটা ডায়েরি, যাতে তিনি। লিখেছিলেন মুক্তিযুদ্ধকালের কথা ও ভবিষ্যতে বাংলাদেশ কীভাবে চলবে তার নির্দেশনা। আব্দুর ঘরের সামনের বারান্দায় আমরা চার ভাইবােন দাড়িয়ে রয়েছি বিদায় দিতে। আব্ব আমাদের সবার মাথায় হাত বুলালেন। আম্মা জিজ্ঞেস করলেন, কী মনে হয়, কবে তােমাকে ছাড়বে ? আল্লু সিড়ির দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই এক হাত নেড়ে বললেন, Take it forever, ধরে নাও চিরদিনের জন্যই যাচ্ছি।’ আমরা দৌড়ে লতাগুলা ও ফুলে হাওয়া দোতলার জলছাদে এসে দাঁড়ালাম। গৃহবন্দি থাকা অবস্থায় আল্লু গাড়ি বারান্দার ওপরের এই জলছাদে দাঁড়িয়ে বাইরে অপেক্ষমাণ তাঁর ভক্ত ও শুভানুধ্যায়ীদের উদ্দেশে হাত নাড়তেন। আজ আমরা আন্ধুকে বিদায় দিতে তার উদ্দেশে হাত নাড়ছি। আব্বু জিপে উঠতেই রাস্তার উল্টো দিকের মুদি দোকানের সামনে দাঁড়ানাে নীল বর্ণের জিনসের ট্রাউজার পরিহিত এক বিদেশি আব্দুর জিপের জানালার সামনে এসে দাঁড়ালেন।

তিনি আব্বুকে কী যেন বললেন, আব্দুও তাকে কী যেন উত্তর দিলেন। পুলিশ এবার তাকে বাধা দিল এবং আন্ধুকে বহনকারী জিপটি শী করে চোখের আড়াল হয়ে গেল। আমাদের মনে প্রশ্ন ছিল কে এই বিদেশি, তার সঙ্গে আব্দুর কী কথা হয়েছিল। প্রায় এগারাে বছর পর আলােড়ন সৃষ্টিকারী Bangladesh: The Unfinished Revolution গ্রন্থের রচয়িতা মার্কিন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুল্টজ সেই প্রশ্নের উত্তর দিলেন। ওয়াশিংটন ডিসির উপকণ্ঠে আমাদের ডেমােক্রাসি বুলেভার্ডের বাসায় বেড়াতে এসে জানালেন যে তিনিই ছিলেন সেই বিদেশি যার সঙ্গে আন্ধুর কথা হয়েছিল। লিফসুল্টজ আব্দুকে জিজ্ঞেস করেছিলেন ‘আপনাকে কী মন্ত্রিসভায় যােগদানের জন্য নিয়ে যাওয়া হচ্ছে ? “আন্ধু উত্তর দিয়েছিলেন ‘আমার তা মনে হয় না। আব্বু যেন ধরেই নিয়েছিলেন যে ঐ যাওয়াই তাঁর শেষ যাওয়া।

১৬৯-১৮০
সাক্ষাৎকার
আম্মা ও ভাইবােনদের সাক্ষাৎকার
আ্ব্বুকে যখন হত্যা করা হয় তখন ছােট বােন সিমিন হােসেন রিমি (লেখক, সমাজকর্মী ও সাংসদ) ও আমি কিশােরী। কনিষ্ঠতম বােন মাহজাবিন আহমদ মিমির (লেখক, কবি ও সমাজকর্মী) বয়স সে সময় নয় বছর ও একমাত্র ছােট ভাই তানজিম আহমদ সােহেল (প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী ও সাংসদ) পাঁচ বছরের শিশুমাত্র। আব্দু সম্বন্ধে রিমি তার বহুল প্রশংসিত বই আমার ছােটবেলা : ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ (২০০১)-এ বহু মূল্যবান তথ্যের জোগান দিয়েছে এবং স্মৃতিচারণ করেছে। সে লিখে চলেছে অবিরাম। আব্ব সম্বন্ধে আমার প্রথম স্মৃতিচারণামূলক প্রবন্ধ ‘তাজউদ্দীন নেতা না পিতা’র (সচিত্র সন্ধানী/বিজয় দিবস সংখ্যা ১৯৭৯) মধ্য দিয়ে আমি আবিষ্কার করার চেষ্টা করেছি একজন অসাধারণ মানুষকে। সেই প্রচেষ্টা বিবর্তিত হয়েছে আরও নানা লেখার মধ্য দিয়ে।
এবারে আ্ব্বুকে ঘিরে আম্মা, রিমি, মিমি ও সােহেলের শৈশবের স্মৃতিভিত্তিক সাক্ষাৎকারের মধ্য দিয়ে এক মহৎ প্রাণ অনন্য মানুষের চরিত্রের অপ্রকাশিত দিকগুলাে ও তাঁকে হারানাের অন্ত হীন বেদনার স্মৃতিমালা ঊনীলিত হলাে।
(যুক্তরাষ্ট্র হতে ঢাকায় টেলিফোনে ধারণ করা এই সাক্ষাঙ্কারগুলাে তারিখ অনুযায়ী। উল্লেখিত হলাে।)
মিমির সাক্ষাৎকার
রিপি : মিমি তােমার ছােটবেলায় আলুকে তুমি যেভাবে দেখেছ এবং তাঁকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলাে তােমার মনে দাগ কেটেছে, সে সম্বন্ধে তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই। মিমি : আমি একটি মজার ঘটনা দিয়েই আব্দুর স্মৃতিচারণা করব। ১৯৭৪-এর শেষের | দিকের ঘটনা সেটি। আন্ধু তখন মন্ত্রিসভা থেকে রিজাইন দিয়ে আমাদের নিয়ে ধানমণ্ডির বাসার দোতলায় উঠেছেন। আম্মা সবেমাত্র পুরাে বাসার দেওয়ালে সুন্দর করে সাদা রং করিয়েছেন। আমি তখন ক্লাস ফাইভে উঠি। নতুন ক্লাসের জন্য আমি সদ্য লসাগু বা লঘিষ্ঠ সাধারণ গুণিতক। শিখেছি। মনের আনন্দে আমি সেই লসাগু নতুন রং করা সাদা দেওয়াল জুড়ে লিখে চললাম। আম্মা, আমার ওই দেওয়াল অঙ্কন দেখে মােটেও প্রীত হলেন না। তিনি আমার কান মলে বললেন, ‘দাঁড়াও, তােমার আব্বকে দেখাচ্ছি। আম্মার নালিশ শুনে আব্ব এলেন সরেজমিনে দেখতে। রাগ করার বদলে তিনি মুগ্ধ নয়নে সাদা দেওয়াল ভরা আমার লসাগু দেখে আম্মাকে বললেন, “দেখাে লিলি, কী পাকা হাতের লেখা !’
আর একবার আমি ও সােহেল বাথরুমের ঝরনার নিচে হাফপ্যান্ট পরে মহানন্দে গােসল করছিলাম। একবার আমি সােহেলকে ধাক্কা দিয়ে ঝরনার নিচে দাঁড়াচ্ছিলাম। আর একবার সােহেল। বেশ মজা করে আমরা দুই ভাইবােন গােসল করছিলাম। অনেকক্ষণ হয়ে যাওয়াতে আম্মা তাড়া দিলেন এই তােমরা শিগগির গােসল শেষ কর। এরই মধ্যে আন্ধু আমার ভূগােল খাতা নিয়ে বাথরুমের সামনে দাড়িয়ে আমাকে বললেন, ‘এই ভূগােল খাতা কি তােমার ?’ আমি বললাম হ্যা আমার।’ আৰু খুব খুশি হয়ে খাতা খুলে আম্মাকে আমার লেখা ও আঁকা আহ্নিক গতি, বার্ষিক গতি, সৌর জগতের ছবি দেখিয়ে বললেন, “দেখাে কী সুন্দর ওর হাতের লেখা ? আমার মনে আছে যে আমাদের একটি সাদা-কালাে জাপানি এনইসি টিভি ছিল। সেই টিভিতে Anna and the King সিরিয়ালটি প্রত্যেক রােববার সকালে আমরা দেখতাম। তারপর আলু আমাকে ও সােহেলকে ধানমণ্ডির দোতলার সিঁড়ির কাছের বাথটাবটিতে নামিয়ে দিতেন। ঐটিই একমাত্র বাথটাবওয়ালা বাথরুম ছিল। আমরা মহাফুর্তিতে বাথটাবে ঝাপাঝাপি করতাম। আল্লু বাথরুমের পাশের ঘরের ইজি চেয়ারে বসে পড়তেন। রিপি : আলু, বাচ্চাদের সঙ্গে খেলাধুলা খুব পছন্দ করতেন। ১৯৬৬-তে জেলে যাওয়ার আগে, নিচতলার বাথটাবওয়ালা বাথরুমে তিনি রিমি ও আমার সঙ্গে গােসল করতেন। বাথটাব ভর্তি পানির মধ্যে রিমি ও আমি ঝাপাঝাপি করতাম। গেঞ্জি-লুঙ্গি পরিহিত আলু বাথটাবে শরীর ডুবিয়ে ঘুমের ভান করতেন। তারপর হঠাৎ হাউ’ শব্দ করে আমাদের চমকে দিতেন। শুধু রাজনৈতিক জীবনই নয়, আলুর চরিত্রের এই কোমল ও উষ্ণদিকগুলাে থেকেও মানুষের জানার ও শিক্ষা নেওয়ার অনেক কিছু রয়েছে। বাংলাদেশে ও ট্রাডিশনাল অনেক সমাজেই বাবারা সাধারণত ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খুব একটা ইনভলভড় থাকেন না। রাজনীতিতে জড়িত থাকার। কারণে আল্লুকে আমরা খুব একটা কাছে পাইনি। তা সত্ত্বেও যতটুকু পেয়েছি, তা যেন পরম পাওয়া। মিমি : হা, তাই। আলু যখনই সময় পেয়েছেন, আমাদের সঙ্গে সময় কাটানাের চেষ্টা করেছেন। রিজাইন দেওয়ার পর তাঁর হাতে অনেক বেশি সময় ছিল। সেই সময় তিনি ব্যয় করতেন খুব সুন্দরভাবে। মনে পড়ে, তিনি বিকেল ৩টার দিকে ঘরে বিশ্রাম নিতেন। বিকেল ৪টায় দিবান্দ্রিা থেকে উঠে সােহেল ও আমাকে ওনার দুই হাতের দুই কড়ে আঙুলের মাথায় ধরে বৈকালিক ভ্রমণে বের হতেন। আমাদের দৌড়াদৌড়ি, খেলাধুলা তিনি মনােযােগের সঙ্গে দেখতেন। উপভােগ করতেন। রিপি : এবারে তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই ৪ ও ৫ নভেম্বরের দিনটির কথা।
মিমি ! ৪ তারিখে মফিজ কাকুর বাসার ঘরের মাটিতে বাবুল ভাইকে রােলিংপিনের মতাে এ-মাথা থেকে ও-মাথা গড়াগড়ি খেতে দেখেছিলাম। উনি ও মামাগাে, ও মামাগাে আর্তনাদ করে কাঁদছিলেন। ৫ তারিখ সকাল থেকে বাসার উত্তর দিকে আবাহনীর মাঠ থেকে আমাদের বাসার সামনে ছিল বিশাল লাইন। বাসার দক্ষিণে বিডিআর-এর গেট থেকেও আমাদের বাসা পর্যন্ত বিরাট লাইন ছিল। সকলেই লাইন করে নিচতলার সামনের ঘরে রাখা আল্লুকে দেখতে আসছিল। ধানমণ্ডি আওয়ামী লীগের তরুণ নেতা রেজা ভাইকে মিছিল নিয়ে আসতে দেখলাম। আমি বারবার ওপর-নিচ করছিলাম। একবার আম্মাকে দেখছিলাম, আর একবার আন্ধুকে। দোতলার বারান্দায় বসা আম্মা কেঁদে কেঁদে আক্ষেপ করছিলেন ‘আমি রিট পিটিশন করেছিলাম। পেরােলটা হয়ে গেলেই ও জেল থেকে ছাড়া পেয়ে যেত।’ গ্যারেজের কাছে, পিছনের বাগানে আন্ধুকে গােসল করানাের সময় সাঈদ ভাই ও হাসান ভাইয়ের গােসল সংক্রান্ত কথাবার্তা ভেসে আসছিল। তুমি, আমাকে ও সােহেলকে দোতলার বারান্দার জানালার সামনে দাঁড় করালে।
জানালার বাইরে, আম গাছের নিচে ট্রাকে আব্দুকে রাখা হয়েছিল। সােহেল খুব কাঁদছিল। তুমি সােহেলকে বললে, ‘সােহেল কেঁদো না। আমরা বড় হয়ে এর বদলা নেব।’ রিপি : সামগ্রিকভাবে আলুকে কীভাবে তুমি মূল্যায়ন কর ? মিমি : ব্যক্তি হিসেবে আব্দুর সঙ্গে কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অভিন্নতা আমি লক্ষ করি। একাধারে তিনি এ জগতের হয়েও এ জগতের নন। রবিঠাকুর ব্যবসা সংক্রান্ত ব্যাপারে যেভাবে মনােনিবেশ করেছেন, নিজ ভাই ও আত্মীয়স্বজনকে উপদেশ দিয়েছেন, তেমনি অপূর্ব দক্ষতার সঙ্গে রচনা করেছেন সােনার তরী’র মতাে মহাকাব্য। আব্ব জাগতিক সূক্ষ্ম থেকে সূক্ষ্মতর ও ছােটখাটো বিষয়গুলাে যেমন দক্ষতা ও নিপুণতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করেছেন ও সুরাহা করেছেন, তেমনি জাগতিক বিষয়াবলির বাইরের মানবিক, আত্মিক ও বিমূর্ত দিকগুলাের সঙ্গেও সমানভাবেই সম্পৃক্ত থেকেছেন। রবিঠাকুরের পরই উনি হাতেগােনা বাঙালির মধ্যে একজন, যিনি যতটুকু স্পৃহা ও উদ্দীপনা নিয়ে জাগতিক বিষয়গুলােকে দেখেছেন তেমনি একই স্পৃহা ও উদ্দীপনায় তিনি মানবিক ব্যাপারগুলােকেও উপলব্ধি করেছেন। রিপি : আম্মার মধ্যেও কিন্তু একই ধরনের আত্মিক, জাগতিক ও মানবিক গুণাবলির সমন্বয় দেখা যায়। | মিমি : হ্যা, সে জন্যেই ওনাদের মধ্যে এত মিল ছিল। ওনারা ছিলেন পরস্পরের যােগ্য জীবনসঙ্গী।
(রবি ও বুধবার, ৪ ও ২১ জুলাই, ২০১০) সােহেলের সাক্ষাৎকার। রিপি: আলুকে যখন হত্যা করা হলাে, তখন তােমার বয়স মাত্র পাঁচ বছর। সেই সময় আল্লুকে ঘিরে তােমার স্মৃতির পটে যে ঘটনাগুলাে আজও জাগ্রত, সে সম্পর্কে তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই। সােহেল : আমার অল্প বয়সে আলু চলে যাওয়াতে ওনার সঙ্গে আমার স্মৃতির সংখ্যা হয়তাে কম কিন্তু প্রতিটি স্মৃতিই খুব মূল্যবান ও দিকনির্দেশনাকারী। বর্তমান রাজনীতিবিদদের সঙ্গে তুলনা করলে দেখা যায় যে আন্ধু ছিলেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একজন অনন্য ব্যক্তিত্ব। রাজনীতিবিদেরা অধিকাংশ সময়ই মানুষের হাততালি নেওয়ার জন্য বা প্রশংসা পাওয়ার জন্য মানুষের সামনে এক রূপ ধারণ করেন কিন্তু পেছনে অন্য রূপ। কিন্তু লােকচক্ষুর বাইরে মানুষ যে কাজটি করে থাকে তার মধ্যেই তাে প্রকাশ পায় তার আসল রূপ। ব্যক্তি আলু ছিলেন একজন অসাধারণ দেশপ্রেমিক ও দুর্ধর্ষ ধরনের সৎ মানুষ। ঘরে ও বাইরে তিনি দেশপ্রেম বােধ ও সৎ জীবনযাপনের এক বিরল নিদর্শন স্থাপন করেছিলেন। মনে পড়ে, রাতে টেলিভিশনের অনুষ্ঠান শেষ হওয়ার পর যখন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা দেখানাে হতাে ও জাতীয় সংগীত বেজে উঠত, আলু সঙ্গে সঙ্গেই দাড়িয়ে পড়তেন এবং আমাকেও অ্যাটেনশনের ভঙ্গিতে দাঁড়াতে বলতেন। আমি হাত টান টান করে আলুর সঙ্গে দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত ও জাতীয় পতাকার প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করতাম। এই ঘটনাটির স্মৃতি আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িতে। আব্ব তখন অর্থমন্ত্রীর পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। ওই ধানমণ্ডির বাড়িতেই একবার খাবার সময় যখন আম্মা আমাকে মাছ দিলেন তখন আমি ঘ্যানঘ্যান শুরু করলাম যে মাছ খাব না। আল্লু তখন আমাকে বারান্দায় নিয়ে গিয়ে বললেন, ‘দেশের মানুষ খাবার পায় না। লাখ লাখ মানুষ না খেয়ে মারা যাচ্ছে। আর তুমি মাছ খেতে চাও ?’ আব্দু যে কথাগুলাে আমাকে বললেন, সেগুলাে বােঝার বয়স তাে তখনাে হয়নি তারপরও আন্ধু তাে বিরত থাকেননি দেশ প্রেমের শিক্ষা দিতে। সে সময় ঐ কথা বুঝিনি কিন্তু আজ তা মনকে ভীষণ নাড়া দেয়। ছােটবেলায় আমি খুব চঞ্চল ছিলাম। সবার ছােট বলে বড়দের কাছ থেকে অতি আদর পেয়ে বেশ আহ্লাদিপনা করতাম ও জেদও ধরতাম। আব্ব কিন্তু ছােট বলে বা একমাত্র ছেলে বলে প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি যেমন ভালােবাসা দেখাতেন তেমনি অযথা আবদার করছি দেখলে শাসনও করতেন, যাকে বলে ‘tough love’। আম্মাকেও সতর্ক করতেন, বলতেন ‘বেশি আদর দিয়ে ছেলেটাকে নষ্ট করে দিয়াে না। সে সময় আব্দুর কথা শুনে আম্মাকেই সমর্থন করতাম। কিন্তু আজ বুঝি আব্ব কত সঠিক ছিলেন। অতি শৈশব থেকেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে ন্যায়নীতি বােধের শিক্ষা তিনি দিতেন তার নিজের আচার, আচরণ ও উদাহরণ সৃষ্টির মাধ্যমে। আবার অজস্র ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি আমার শিশুসুলভ কৌতূহলকে নিবৃত্ত করতেন এবং অনেক সময় আমার সঙ্গে এমন আচরণ করতেন যেন মনে হতাে আমিও বড় কোনাে ব্যক্তি। আন্ধু তখন। অর্থমন্ত্রী। আলু ও আম্মাসহ আমি গাড়ি করে কাকরাইলের পাশ দিয়ে আসছি। হঠাৎ দেখি এক বিশাল হাতি সেই পথ দিয়ে চলছে। আমি বায়না ধরলাম যে হাতিতে চড়ব। আম্মা আমার মনােযােগ অন্যদিকে সরাবার চেষ্টা করলেন, ভাবলেন, আলু বিরক্ত হবেন। কিন্তু আন্ধু সঙ্গে সঙ্গেই গাড়ি থামিয়ে আমাকে হাতিতে চড়ালেন। সেদিন হাতিতে চড়ে আমার মনে মহা আনন্দ। আমার চার বছরের জীবনের সেটি এক অমূল্য স্মৃতি। | আর একবার আন্ধু আমাকে সঙ্গে করে চিড়িয়াখানায় গেলেন। চিড়িয়াখানার কর্মকর্তারা আন্ধুকে খুশিতে ঘিরে ধরেছে। ঐ ভিড়ের মধ্যেও আব্দু একটি জীবজন্তর ছবিওয়ালা ব্যাজ নিজ হাতে আমার শার্টে গেঁথে দিলেন। আন্ধু আমাকে মনে করে নিজ হাতে আমাকে ব্যাজ পরিয়ে দিয়েছেন এটা ভেবে সেদিন আমি খুব গর্বিত বােধ করেছিলাম। | আল্লু অর্থমন্ত্রী থাকাকালীন আমাদের হেয়ার রােডের সরকারি বাসভবনের আর একটি স্মৃতি মনে পড়ে। বিশাল গাছপালায় ঘেরা সেই বাসভবনের আশপাশে রাতের বেলা কোনো হায়েনা বা শেয়াল-জাতীয় জন্ত এসেছিল। আব্দু ওনার রাইফেলটি নিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার সময় আমাকে বললেন সােহেল, এসাে। আমি কৌতূহল ও উৎকণ্ঠা নিয়ে আব্দুর পিছে পিছে গেলাম। সামনে পেছনের মাঠ ও গাছপালার আশপাশ ঘুরে আমরা ঘরে ফিরে এলাম। ঘরে ফিরে আমি বললাম, ‘আল্লু ভয় লাগছে। আব্ব ওনার পিস্তলটি আমার বালিশের নিচে রেখে বললেন, ‘ভয় নেই। এখন ঘুমাও।’ আশ্চর্য ব্যাপার হলাে যে, আব্বু জীবনে কোনাে প্রাণী এমনকি একটি পাখিও হত্যা করেননি এবং কোনাে পশুপাখি জবাইয়ের দৃশ্য সহ্য করতে পারতেন না। কিন্তু তিনি অস্ত্র সংগ্রহ পছন্দ করতেন। রাইফেল ও পিস্তল-জাতীয় কিছু অস্ত্র শখ করে কিনেছিলেন। | আব্বু আমাকে দায়িত্ব দিতে পছন্দ করতেন। আমার মতামত বিবেচনা করতেন। আমার পাচ বছর বয়সে আমাদের ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে আন্ধু আমাকে নিয়ে গেলেন স্কুলে ভর্তি করাতে। আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পূর্ব দিকে কাকলী স্কুল ছিল। সে সময় ঐ স্কুলের সামনে গাছের নিচে কোনাে ক্লাস চলছিল। মনে হয় কোনাে আর্টের ক্লাস। আমি স্কুলটা দেখে বললাম। “আব্ব, এই স্কুলে ভর্তি হব না। আমি গাছের নিচে পড়ব না।’ এরপর কাছেই গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলটি দেখে খুব পছন্দ হলাে। স্কুলের সামনের খেলার মাঠে দোলনা ও স্লাইডে ছেলেমেয়েদের খেলাধুলা দেখে মনে হলাে যে এটাই আমার স্কুল হবে। আল্লুকে মনের কথাটি জানাতেই আলু ঐ স্কুলে আমাকে ভর্তি করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিলেন। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আব্বকে জানালেন যে তারা স্কুলে শুধু বিদেশিদের ভর্তি করেন। আল্লু যুক্তি উত্থাপন করে বললেন যে স্কুলটি চলছে বাংলাদেশের মাটিতে অথচ বাংলাদেশিদের ভর্তি করা হবে না সেটা কেমন কথা! আব্দুর কথার পরই স্কুলের পলিসি পরিবর্তন করা হয়। তারা বাংলাদেশিদের জন্য, যতদূর মনে পড়ে, পাঁচ পার্সেন্টের একটি কোটা নির্ধারণ করে। আমি গ্রিন হেরাল্ড ইন্টারন্যাশনাল স্কুলে ভর্তি হই। জীবজন্তুর প্রতি আব্দুর খুব মায়া ছিল। মুজিব কাকু আমাকে যে খরগােশ দুটি উপহার দিয়েছিলেন তাদেরকে আল্লু নিজ হাতে খাওয়াতে ভালােবাসতেন। আমাকে সঙ্গে নিয়ে খরগােশদের পরিচর্যা করতেন। আবাহনী মাঠে যখনই খেলা হতাে আব্দুর কড়ে আঙুল ধরে আব্বর সঙ্গে খেলা দেখতে যেতাম। জেলে আলুকে হত্যা করার পর যখন আব্দুর লাশ আমাদের ধানমণ্ডির বাসায় নিয়ে আসা। হলাে, তখনকার খণ্ড খণ্ড স্মৃতিগুলাে কেমন আলাে-ছায়ার মতাে মনে এখনাে ভাসে। আলােছায়ার উপমাটি দিলাম এ কারণে যে তখনাে মৃত্যু সম্বন্ধে ধারণা স্পষ্ট হয়নি। আমি অগণিত মানুষের কোলাহল ও হাহাকার শুনতে পাচ্ছিলাম, কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছিলাম না ঘটনার গভীরতা। আমি শুনতে পারছিলাম যে আন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে, বুঝতে পারছিলাম যে আব্দু আর নেই। কিন্তু আবারও মনে হচ্ছিল আৰু আসলেই বেঁচে আছে। মনের মধ্যেই চিন্তার সংঘর্ষ চলছিল। আমাদের বাসার পেছনে গ্যারেজের সামনের উঠোন মতাে জায়গায় আব্দুকে যখন গােসল করানাে হচ্ছিল, আমি তখন সেখানে ঘােরাফেরা করছিলাম। বােঝার চেষ্টা করছিলাম কী হচ্ছে। আলুর মাথার কাছে অনেকক্ষণ বসে আলুকে দেখছিলাম। তারপর আবার ভিড়ের মধ্যে দোতলায় আম্মার কাছে যাচ্ছিলাম। দেখি আম্মা কাঁদছেন। কিছু বিদেশি সাংবাদিক ও দূতাবাস থেকে আগত বিদেশিদের দেখতে পেলাম তারা আম্মাকে সমবেদনা জানিয়ে চলে যাচ্ছে। আমি একটু ওপর-নিচ ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। আমার ভেতরে অনুভূতিগুলাে কেমন জট পাকিয়ে বিবশ হয়ে যাচ্ছিল। একসময় আমি অঝােরে কান্না শুরু করলাম। মনে হয় তুমি আমাকে কোলে তুলে নিয়ে সান্ত্বনা দিয়ে কিছু বলেছিলে। | রিপি : আমি বলেছিলাম, ‘সােহেল কেঁদো না, আমরা বড় হয়ে এর বদলা নেব’। এই স্মৃতিটি আমি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলাম, মিমির সাক্ষাৎকার থেকে জানলাম।। সােহেল : এ রকম মর্মান্তিক পরিস্থিতিতে একটি শিশুর মনে কী আলােড়ন চলছে সে সম্পর্কে ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আমাদের সামাজিক পরিবেশে অনুভূতিকে প্রায় সময়ই প্রকাশ করার বদলে ভেতরে চেপে রাখতে হয়। বিশেষ করে, একজন শিশু, যে এ রকম একটা নিষ্ঠুরতা প্রত্যক্ষ করেছে, সে জানছে না যে কীভাবে সে তার বেদনাময় অনুভূতিকে প্রকাশ করবে। তার কাছ থেকে কেউ জানতে চাইছে না। সবার মাঝেও সে ভীষণ একা। আব্বুকে যখন আব্দুরই হাতে লাগানাে আমগাছের নিচে রাখা হলাে আমি তখন আবারও আব্দুর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। ট্রাকে করে সবার সঙ্গে আমিও গেলাম বনানি কবরস্থানে। মনে পড়ে, একটা গাছের নিচে আব্দুর কবর খোঁড়া হয়েছিল। রিপি : ওটা ছিল বকুলগাছ। ছােটবেলায় খুব ভােরে আব্দুর সাথে ধানমণ্ডির ২১ নাম্বার রাস্ত Tয় চলে যেতাম বকুল ফুল কুড়াতে। মালা গেথে উপহার দিতাম আব্দু ও আম্মাকে।
আমাকে বােঝানাে হলাে যে আব্দু বিদেশে। আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। আমার মনে হলাে যে আন্ধু হয়তাে মাটির নিচ দিয়েই বিদেশে চলে গিয়েছেন। আমার ছয়-সাত বছর বয়স পর্যন্ত আমি বিশ্বাস করতাম যে আবু আমেরিকায় চলে গিয়েছেন। যদিও আমার মনের এক অংশ জানত যে আন্ধু মৃত। কিন্তু আল্লু বিদেশে চলে গিয়েছেন, এই কথাটি বিশ্বাসের মধ্যে মনে এক প্রকার স্বস্তি পেতাম। আমার সাত বছর বয়সে আমার আদরের পােষা কুকুর হাইডি রাস্তায় দুর্ঘটনায় মারা যায়। | আমি আমার সে বছরের ডায়েরিতে লিখেছিলাম যে আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা হলাে আমার বাবার মৃত্যু ও আমার কুকুর হাইডির মৃত্যু। শিশুমন জীবজন্তু ও মানুষকে ভালােবাসার মধ্যে পার্থক্য করে না। সে শুধু বােঝে যে প্রিয়জন, সে যে প্রজাতিরই হােক না কেন, তাকে হারানাের দুঃখ অপরিসীম। শিশুর ভালােবাসা খাটি ও অকৃত্রিম। | জীবনে অনেক দুঃখ-বেদনাকেই আমি অতিক্রম করেছি। কিন্তু আল্লুকে হারানাের বেদনা এখনাে যেন জাগ্রত। রিপি : আব্বুর সমস্ত জীবনটাই ছিল একটা পরিষ্কার আয়নার মতাে। সােহেল : হ্যা, তাই। আব্দুর চালচলন ও চিন্তাধারা ছিল far advanced । তার জীবনের মধ্যে দিয়েই তিনি আমাদের জন্য monumental message রেখে গিয়েছেন। (সসামবার, ৫ জুলাই, ২০১০)
রিমির সাক্ষাৎকার
রিপি : মেয়ে হিসেবে তুমি আল্লুকে কীভাবে মূল্যায়ন কর ?| রিমি : আব্দুর কথা আমি মেয়ে হিসেবে আলাদা করে চিন্তা করতে পারি না। উনি এমন একজন আলােকিত মানুষ যে তিনি যদি শারীরিকভাবে বেঁচে না-ও থাকেন, ওনার কাজের মধ্যেই | তিনি চিরজীবী। খুব কষ্ট হয় যে এই মানুষটির অনেক কিছু দেবার ছিল, তার অকালমৃত্যু নির্মম হত্যাকাণ্ড হওয়াতে তিনি সেটা দিতে পারলেন না। তার পরও যেটা মনে করে ভালাে লাগে যে তার কাজ যদি তুলে ধরা হয়, তাহলে তাঁর রােল মডেল ও আদর্শের অনুকরণে একটা রাষ্ট্রকে পরিপূর্ণভাবে গঠন করা যায়। | রিপি : তুমি তাে আব্দুর ছেলেবেলার সঙ্গীসাথিদের অনেকেরই সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেছ, | তাঁদের স্মৃতিচারণার মধ্য দিয়ে আব্দু সম্বন্ধে যে তথ্যগুলাে বের হয়ে এসেছে তা তােমার কাছ | থেকে শুনতে চাই। রিমি : আব্দুর ডায়েরিতে কালুর বাপের (সাবু শেখ) অনেক উল্লেখ পাই। তাকে যখন নব্বই। | সালে ইন্টারভিউ করি উনি বললেন যে বালক তাজউদ্দীন যখন পাড়ার ছেলেদের সঙ্গে খেলত সে কখনাে ঝগড়া-বিবাদে শরিক হতাে না। বরং সে সব সময় ঝগড়া মিটিয়ে দিত। সাধারণত অল্পবয়সীরা ঝগড়া, মারামারিতে সহজেই জড়িয়ে পড়ে, সে কখনােই ওসবে জড়ত না। ছােটবেলার ঐ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তাঁর রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ডেও পরিলক্ষিত হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের নির্বাচনে এমএলএ (প্রাদেশিক সদস্য) নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি তাঁর
এলাকার থানায় চলে গিয়েছিলেন যে দরদরিয়া গ্রামের কোনাে লােকের মামলা যেন থানা গ্রহণ না করে। উনি বলতেন যে যত ব্যস্তই আমি থাকি না কেন তােমাদের বিভেদ হলে আমি সালিশ করে দেব। তিনি মামলা-মােকদ্দমার বিরােধী ছিলেন। মামলা-মােকদ্দমা করে অযথা অপচয়, মনকষাকষি ইত্যাদির বাইরে সুসম্পর্ককে তিনি দাম দিতেন। কালুর বাপ আরও বলেছিলেন যে অন্যের যে কোনাে কাজ, তা যত ছােটই হােক না কেন, আব্দু তা এত আন্তরিকতার সঙ্গে করতেন যেন তার নিজের কাজ। সাধারণত মানুষ অন্যের কাজ কখনােই এত যত্ন নিয়ে করে না। রিপি : মানুষকে যিনি সত্যিকারের ভালােবাসেন, তিনি তাঁর কাজটিও নিজের মনে করেই করেন। আপন পর ভেদাভেদ করেন না। ভালােবাসার সঙ্গে নিখুঁতভাবে কাজ সম্পন্ন করার অভ্যাসটিও তাঁর চরিত্রের এক অঙ্গ ছিল। কাজ কাজই, সে ব্যাপারে তিনি আপন-পর ভেদাভেদ করতেন না। | রিমি : পরস্পরের সঙ্গে আর সুসম্পর্ক গড়ে তােলার একটা সুন্দর নিদর্শন শফিউদ্দীন দফাদারের ছেলে আজিজের মৃত্যুর ঘটনার মধ্য দিয়ে পাওয়া যায়। প্রতিবেশী ফজর আলীর গুলিতে বালক আজিজ মারা যায়। বন্য শূকর শিকারের সময় এই বালক খেলতে খেলতে বন্দুকের সামনে চলে আসে এবং গুলিবিদ্ধ হয়। আল্লু তাকে হাসপাতালে নিয়ে যান এবং তার প্রাণরক্ষার জন্য রক্তদান করেন। কিস্তু তারপরও তার মৃত্যু ঘটে। তখন আজিজের পরিবার ফজর আলীর বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলাও আব্দু সালিশের মাধ্যমে মিটিয়ে দেন। আলু বলেন যে এই দুঃখজনক ঘটনা অনিচ্ছাকৃত। আৰু ঐ শােকসন্তপ্ত ও অনিচ্ছাকৃত মৃত্যুর জন্য অনুতপ্ত। দুই পরিবারের মধ্যে মিল করিয়ে দেন। আজও ঐ দুই পরিবারের মধ্যে মিল বিদ্যমান। রিপি : নবী করিম (স.) বলেছিলেন যে পরস্পরের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপন ও মিলমিশ করে দেওয়া অতিরিক্ত নামাজ ও দানের চেয়েও উত্তম। আদি (ইয়ােরােপীয় আগ্রাসনের পূর্বে উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় বসবাসকারী উন্নত সভ্যতার ধারক-বাহক) আমেরিকানদের জীবনধারা পর্যালােচনা করলেও দেখা যায় যে তাদের সমাজে সেই ব্যক্তিকেই সবচেয়ে মর্যাদাশীল ও শক্তিশালী হিসেবে গণ্য করা হতাে, যিনি পরস্পরের মধ্যে শান্তি রক্ষা ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় সর্বদা নিয়ােজিত থাকতেন। আব্দুর চারিত্রিক গুণাবলির আলােকে বলা যেতে পারে যে তিনি ছিলেন তার সময়ের চেয়ে অনেক এগিয়ে। বর্তমানে শাস্তি শিক্ষা, সংঘর্ষ সমাধান” (conflict resolution) মধ্যস্থতা, সালিশ ইত্যাদির ক্রমবর্ধমান ব্যবহার বিশ্বের বিভিন্ন শিক্ষা ও আইন প্রতিষ্ঠানগুলােতে পরিলক্ষিত হয়। আন্ধু সেই কাজগুলাে ছেলেবেলা থেকেই করে আসছিলেন। | রিমি : হ্যা, তাই। এখন খাদ্যনিরাপত্তার কথা বলা হয়। আন্তু সেই কতকাল আগে ছাত্রাবস্থায় পল্লি মঙ্গল সমিতি করে তাতে ধর্মগােলা প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। বাৎসরিক ফসল ওঠার পর যারা ধনী, তারা সেই ধর্মগােলাতে আধা মণ করে ধান জমা দিত যাতে আকালের সময় দুস্থ, অভাবী ও গরিব কৃষকেরা সেই মজুদকৃত ফসল থেকে উপকৃত হতে পারে। আব্দুর এ ধরনের সমাজ সচেতনতা ও দায়িত্ববােধ আমাকে মুগ্ধ করে। তিনি নীরবে এই কাজগুলাে নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতেন।| বিপি : ভবিষ্যতের দিকনির্দেশক হিসেবে, তার আদর্শকে কীভাবে সামনে নিয়ে আসা যায়। মনে কর?
রিমি : আলাপ, আলােচনা ও গবেষণার মাধ্যমে জানাতে হবে এতে তিনি লাভবান হবেন না। মানুষ ও সমাজ উপকৃত হবে।
রিপি : আব্বকে ঘিরে ছােটবেলার বিশেষ স্মৃতি, যা তােমার মনে পড়ছে, তা তােমার কাছ থেকে শুনতে চাই।
রিমি : আব্দুর গাছ নিড়ানাের স্মৃতি খুব মনে পড়ে। কী অসীম যত্নের সঙ্গে তিনি চারাগাছের মাটি নিড়াতেন। শক্ত মাটিকে দুই হাত দিয়ে ভেঙে গুঁড়া গুড়া করতেন। তারপর কত যত্নের সঙ্গে চারা গাছের শিকড় মাটির ভেতরে বসাতেন। মাটি দিয়ে শিকড় ঢেকে দিয়ে তাতে পানি ঢালতেন। তখন আমি দেখে ভাবতাম গাছটা সত্যিই জীবিত। সে একদিন বড় হবে। আব্বুর খুব প্রশংসা করার উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা দেওয়ার ক্ষমতা ছিল। আমি তাে ছােটবেলা থেকেই রান্নাবান্না পছন্দ করতাম। আন্ধু তাঁর বন্ধু ও সহকর্মীদের বলতেন, দেখ আমার মেয়ে বেঁধেছে।’ আব্লু ছােটদেরও দায়িত্ব দিতেন। উনি বিশ্বাস করতেন যে আমরা দায়িত্ব পালন করতে পারব। আন্ধু একবাক্যে ছিলেন অনন্য মানুষ।
(সাক্ষাৎকার। বুধবার (১ রমজান ১১ অগাস্ট, ২০১০)

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের দুর্দিনের কাণ্ডারী, আহ্বায়িকা ও দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য আম্মা সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের সাক্ষাৎকার
আম্মার শারীরিক অবস্থা বর্তমানে ওঠানামা করছে। সে কারণে এই সাক্ষাৎকার সংক্ষিপ্ত আকারে গৃহীত হলাে। ২০০৭ ও ২০০৮-এ ভিডিওতে আম্মার দীর্ঘ যে সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করি, তা ভবিষ্যতে প্রকাশের আশা রাখি। রিপি : আম্মা, আব্দুকে একজন মানুষ ও স্বামী হিসেবে কীভাবে মূল্যায়ন করেন? আম্মা : এমন ব্যক্তিত্ব, এমন স্বচ্ছ মানুষ আমি জীবনে দেখিনি। খুবই মানসম্পন্ন। পরের জন্য অনুভূতি ও বিশ্লেষণমূখী চেতনা খুব প্রখর ও সুদক্ষ ছিল। ওনার কোনাে কথাতে জটিলতা ছিল না। কোনাে জটিল প্যাচের কথা বলতেন না। মানুষ যেটা সহজে বুঝতে পারে, সেভাবেই বলতেন। আমার জীবনে তিনি এক অনন্য-অসাধারণ ব্যক্তিত্ব ছিলেন। আমার জীবনে আমি দেখি যে উনি এক অভাবনীয় ও আলােকিত মানুষ হিসেবে জন্ম নিয়েছিলেন। আমার বিয়ের পর দেখি যে উনি খুব সাধারণভাবে থাকতে পছন্দ করেন। দেশে প্রচুর বৈষয়িক সম্পত্তি থাকা সত্ত্বেও নিজে অতি সাধারণভাবে জীবন যাপন করতেন। উনি একটা চৌকিতে থাকতেন। আমাদের বিয়ের সময় ওনার বন্ধুরা নতুন তােশক, বালিশ ও চাদর দিয়ে ঘর সাজিয়ে দেয়। ওনার উপার্জন হতে তিনি দুস্থ, অসহায়, বিধবা ও এতিমদের মধ্যে বিলিয়ে দিতেন। নিজের জন্য কিছু রাখতেন না।
| ওনার চিন্তাচেতনা ও ব্যবহারের কারণে উনি আমার জীবনে এক আলােড়ন সৃষ্টিকারী মানুষ ছিলেন। (বৃহস্পতিবার, ১২ আগস্ট, ২০১০)

১৮৩—১৯০

সাংবাদিক সৈয়দ মােহাম্মদ উল্লাহর সাক্ষাৎকার
প্রাক্তন নিউজ এডিটর ও ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট, ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি (এনা), ঢাকা, বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্র হতে প্রকাশিত প্রথম নিয়মিত সাপ্তাহিক বাংলা পত্রিকা প্রবাসী’র প্রতিষ্ঠাতা (১৯৮৫) ও সম্পাদক। | আমি সে সময় (১৯৭২-৭৫) ঢাকার এনা’র ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেন্ট এবং গণভবনের সঙ্গেও অ্যাটাচড ছিলাম। এনার চিফ এডিটর গােলাম রসুল মল্লিক আমাকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বঙ্গবন্ধুর স্মৃতিশক্তি খুব প্রখর ছিল। উনি একবার কাউকে দেখলে পরে চিনতে ভুল করতেন না। প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বিভিন্ন সফর, মিটিং ও অনুষ্ঠানে আমি যেতাম । সে সময় আমি সাংবাদিক হিসেবে অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন সাহেবের ৩৫ হেয়ার রােডের সরকারি বাসভবনেও যেতাম। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে খুব স্নেহ করতেন। ‘৭৩-এর সাধারণ নির্বাচনের প্রার্থী মনােনয়নের সময় একদিন তার হেয়ার রােডের বাসায় পৌছে দেখি যে নমিনেশন পাওয়ার আশায় ওই বাসার নিচতলায় বহু প্রার্থীর ভিড়। এক লোেক সঙ্গে এক সুন্দরী মহিলাকে নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেবের অফিস রুমে ঢুকে নমিনেশন চাইতে যান। তাজউদ্দীন সাহেব ভীষণ ব্রেগে তাদের ঘর থেকে বের করে দেন। ওই নির্বাচনে আতাউর রহমান খান (পূর্বতন পূর্ব পাকিস্তানের এককালীন মুখ্যমন্ত্রী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। ভােটের দিন উনি তাজউদ্দীন সাহেবকে ফোন করলেন। বললেন যে, আওয়ামী লীগের লােকজন তার এলাকার বিভিন্ন ভােটকেন্দ্রে গােলমাল করছে। তারা তার সমর্থকদের ভােট দিতে দিচ্ছে না। তাজউদ্দীন সাহেব তখন ওই অঞ্চলের পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ফোন করে এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে বললেন এবং ঢাকা থেকে একজন বিদেশি সাংবাদিকসহ কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিককে সে এলাকায় পাঠালেন। এর ফলে ওই এলাকায় গােলমাল প্রশমিত হয় এবং আতাউর রহমান খান ইলেকশনে জিতলেন। আমার সাংবাদিক জীবনের অনেক ঘটনা, স্মৃতি ও তথ্যের মধ্যে একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযােগ্য এবং যা জানানাে দরকার মনে করি। ‘৭৩-এর নির্বাচনের দিন সন্ধ্যায় আমরা চারজন সাংবাদিক রমনার পুরনাে গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে যাই। উনি তখন নিচতলার পূর্ব দিকের ওয়েটিং রুমে ইজিচেয়ারে বসেছিলেন। আমরা রুমে ঢুকতেই উনি আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। উনি আমার সঙ্গের সিনিয়র সাংবাদিকদের স্নেহ করে ‘তুই’ সম্বােধন করতেন। তাদেরকে চিনতেন বহুদিন ধরে। আমি জুনিয়র সাংবাদিক, নতুন পরিচয়। আমাকে তুমি সম্বােধন করতেন। আমার সঙ্গের সিনিয়র সাংবাদিকরা ছিলেন ইংরেজি দৈনিক বাংলাদেশ অবজারভারের সিটি এডিটর আব্দুর রহিম ও সিনিয়র স্টাফ করেসপন্ডেন্ট জোয়াদুর রহীম এবং বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) চিফ,
যিনি ১৯৯৬ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রেস সেক্রেটারি হয়েছিলেন, জাওয়াদুল করিম। বঙ্গবন্ধু আমাদের বসতে বললেন এবং আমাদের বললেন, “দেখাে নির্বাচন দিলাম, আমার । একটা প্ল্যান আছে। তাজউদ্দীনদের হাতে দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি কিন্তু ক্ষমতার বাইরে থাকব। এরা যদি ঠিক মতাে চালাতে না পারে, বা অন্যায় করে, লােকে তখন আমার কাছে আসবে। আমি আল্টিমেট আদালতের মতাে থাকৰ। এ কথা শুনে আমি বলতে চেয়েছিলাম, ‘স্যার, খুব ভালাে হবে। কিন্তু আমার সম্পূর্ণ বাক্য বলা হলাে না, ‘স্যার’ পর্যন্ত বলতে পেরেছিলাম। আমার তিন বড় ভাই সাংবাদিক সেই মুহূর্তেই বসা থেকে লাফিয়ে উঠে প্রবলভাবে বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যে। আপত্তি জানালেন। তারা বললেন যে বঙ্গবন্ধুর এই সিদ্ধান্ত দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে, এই সিদ্ধান্ত ঠিক হবে না, ইত্যাদি। ঠিক সেই মুহূর্তেই প্রতিমন্ত্রী কে এম ওবায়েদুর রহমানের স্ত্রী। অধ্যাপিকা শাহেদা ওবায়েদ মিষ্টির ভাণ্ড নিয়ে ঘরে ঢুকলেন। ওবায়েদ জিতেছেন। তার এলাকায় ফলাফল তাড়াতাড়ি ঘােষিত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু উনার হাত থেকে মিষ্টি নিয়ে আমাদের নিজ হাতে তুলে দিলেন। তাঁর সেই ঐতিহাসিক বক্তব্য তখন চাপা পড়ে গেল এবং অন্যান্য প্রসঙ্গ এসে গেল। খালেদা জিয়া দ্বিতীয় মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী থাকার সময়, সম্ভবত ২০০২ সালে, সে সময় আমি। ঢাকায় একদিন জাতীয় প্রেসক্লাবে গিয়েছি বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ করতে। নিয়তির কী। পরিহাস, ‘৭৩-এ বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যের ওই প্রতিবাদকারীদের একজন, আব্দুর রহীম, এদিন। প্রেসক্লাবে কথা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধুকে ভঙ্গবন্ধু’ বলে উপহাস করছিলেন !
সাল-তারিখ মনে নেই। আমি লালবাহিনীর জনসভা কাভার করি ঢাকার সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে। বঙ্গবন্ধু লালবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করেন। লালবাহিনীকে বলা যেতে পারে দলীয় সমর্থনপুষ্ট ও তরুণদের নিয়ে গঠিত বাহিনী। শ্রমিক লীগের আবদুল মান্নান ছিলেন লালবাহিনীর প্রধান। জনসভায় শেখ সাহেব দেশে গােলযােগ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে উক্তি করেন, ‘লাল ঘােড়া দাবড়ায়ে দেব।’ উক্তিটির যদিও পরিপ্রেক্ষিত ছিল, কিন্তু সমালােচকদের কাছে তা ছিল শ্রুতিকটু। সে সময় সিরাজ শিকদারের সর্বহারা পার্টি ও আরও বেশ কিছু দল ও গ্রুপ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ইত্যাদি নাম দিয়ে দেশব্যাপী সন্ত্রাসী তৎপরতা চালাচ্ছিল। শেখ সাহেব ওই মিটিং থেকেই দ্বিতীয় বিপ্লবেরও ডাক দেন। শেখ সাহেব যেদিন সােহরাওয়ার্দী ময়দানে লালবাহিনীর সালাম নিচ্ছেন, ঠিক তখন তাজউদ্দীন সাহেব জিঞ্জিরায় এক জনসভায় দেওয়া বক্তব্যে বলেন, ‘প্রাইভেট বাহিনী রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। আমার সহকর্মী সাংবাদিক যিনি জিঞ্জিরায় তাজউদ্দীন সাহেবের মিটিং কাভার করছিলেন, তিনি এ কথা আমাকে জানান। শেখ সাহেবের লালবাহিনীর জনসভায় সব মন্ত্রী এবং দলের উচ্চপর্যায়ের সকলেই উপস্থিত ছিলেন। তাজউদ্দীন সাহেবই একমাত্র মিনিস্টার যিনি ওই অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকেননি। | কাজী ফজলুর রহমান ছিলেন সিএসপি অফিসার। ইয়াহিয়া খান তাঁকেসহ বেশকিছু বাঙালি। অফিসারের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ এনে পদচ্যুত করে। তাকে ‘৭৪ অথবা ‘৭৫ সালে একদিন লালবাহিনীর সভাপতি শ্রমিক লীগের আবদুল মান্নান তার পুরানা পল্টনের অফিসে বন্দী করে রাখেন। তাজউদ্দীন সাহেব খবর পেয়ে সােজা সেখানে গিয়ে তাকে মুক্ত করে নিয়ে আসেন। ১৯৭৪ সালে হিমাগার সমিতি হােটেল পূর্বাণীতে তাদের বাৎসরিক মিটিং ও ডিনারের ব্যবস্থা করে। সেই মিটিংয়ে তারা বিদ্যুতের নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহ দাবি করে। সেখানে আমার সঙ্গে আরও অনেক সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন। সে সময় সরকারি সিদ্ধান্তহীনতায় কয়লা আমদানির অভাবে। বিদ্যুতের তীব্র সংকট সৃষ্টি হয়। খুলনার নিউজপ্রিন্ট কারখানাসহ অনেক মিল ও ইন্ডাস্ট্রির
প্রডাকশন স্থবির হয়ে যায়। ইন্দিরা গান্ধী তখন বঙ্গবন্ধুর বার্তা পেয়ে জরুরিভিত্তিতে ভারত থেকে | কয়লা সরবরাহ করেন। সে বছর বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট চলছিল। রাশিয়া (তৎকালীন সােভিয়েত ইউনিয়ন) আমেরিকা ও অন্যান্য দেশ থেকে খাদ্য সংগ্রহ করেছিল এবং সেই সংগ্রহ হতে কয়েক জাহাজ খাদ্যশস্য ধার হিসেবে ভারতে পাঠানাের নির্দেশ দেয়। ওই জাহাজগুলাে গভীর সমুদ্রে থাকাকালীন বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে ভারত একটি বা দুটি জাহাজ ডাইভার্ট করে বাংলাদেশে পাঠায়। তাজউদ্দীন সাহেব হিমাগার সমিতির উক্ত অনুষ্ঠানে এসব বিষয়ে অনেক কথা বলেছিলেন। একপর্যায়ে তিনি বেশ ইমােশনাল হয়ে গেলেন। বললেন, ‘সার্বভৌমত্ব অটুট রাখতে হলে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে সচেষ্ট হতে হবে, নিজের পায়ে দাঁড়ানাের চেষ্টা করতে এবং আত্মমর্যাদা বজায় রাখতে হবে।’ তিনি আরও বললেন, রাষ্ট্র তার সার্বভৌমত্বের বিনিময়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে না। যেমন একজন নারী তার সতীত্ব বিসর্জন দিয়ে কৃতজ্ঞতার প্রতিদান দিতে পারে না।’ | তাঁর সেদিনের ওই উক্তিটি আমার মনে খুব দাগ কেটেছিল।
| ১৯৭৪-এর সেপ্টেম্বর মাসে আমি জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সেশন এবং বঙ্গবন্ধুর | নিউইয়র্ক ও ওয়াশিংটন সফর কাভার করি। বাংলাদেশ সে বছরই জাতিসংঘের সদস্যভুক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু নিউইয়র্কে পৌছানাের পরপরই তাজউদ্দীন সাহেব আইএমএফ ও ওয়ার্ড ব্যাংকের সম্মেলনে যােগ দিতে ওয়াশিংটনে আসলেন। সেটিও আমি কাভার করি। মুহিত সাহেব (বর্তমান। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আব্দুল মুহিত) তখন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ অ্যাম্বেসিতে ইকোনমিক মিনিস্টার হিসেবে কাজ করছেন। তাজউদ্দীন সাহেবের সম্মানে তিনি তার বাসায় ডিনারের আয়ােজন করেন। ওয়াশিংটন ডিসির ডুপন্ট সার্কেলের হােটেল থেকে অনু ভাই (নুরুল ইসলাম অনু, তখন বাংলাদেশ দূতাবাসে কাউন্সিলর হিসেবে কর্মরত) আমাকে ও আরও ক’জন সাংবাদিককে উঠিয়ে নিজে ড্রাইভ করে মুহিত সাহেবের বাসায় নিয়ে যান। তাজউদ্দীন সাহেব সেই ডিনারে দুঃখ প্রকাশ করে অনেক কথাই বলেছিলেন। আভাসও দিয়েছিলেন যে তিনি আর বেশিদিন মন্ত্রিসভায় থাকবেন না। তিনি একটা কথা শুনে খুব আপসেট ও শকড হয়েছিলেন। বাংলাদেশ সরকার এক মার্কিন পাবলিক রিলেশন্স কোম্পানিকে বঙ্গবন্ধুর যুক্তরাষ্ট্রের সফর কাভার করতে ২০ থেকে ৪০ হাজার ডলার দিয়েছে, এ তথ্য তিনি সেদিনই জানতে পারেন। তাজউদ্দীন সাহেব অর্থমন্ত্রী, অথচ এ ব্যাপারে তাকে আগে জানানাে হয়নি। তিনি মর্মাহত হয়েছিলেন যে গরিব দেশের এতগুলাে টাকার অপচয় হলাে, অথচ পাবলিসিটিও হলাে না। এখানে উল্লেখ্য, কয়েক বছর আগে জাতিসংঘের ৫০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে যােগ দেওয়ার জন্য আফ্রিকার কোনাে এক রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিউইয়র্কে এসে এখানকার এক ছােট্ট মােটেলে ওঠেন। তিনি বলেন যে তার রাষ্ট্রের সামর্থ্য নেই যে তাকে দামি হােটেলে রাখবে। শুধু এই কারণে ওই প্রেসিডেন্ট বিশাল মিডিয়া কাভারেজ পান। তার কোনাে পাবলিসিটি কোম্পানির সহায়তার প্রয়ােজন হয়নি। | তাজউদ্দীন সাহেব পার্লামেন্টে সকল সদস্যের বক্তব্যের প্রতি খুব শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি সবার আলােচনার নােট নিতেন। পার্লামেন্টে ছােষ্ট্র বিরােধী দলের সদস্যদের সব প্রশ্নের উত্তর দিতেন খুব গুছিয়ে, যুক্তি ও তথ্যের মাধ্যমে। এর বিপরীত চিত্রও উল্লেখ করা যায়। একবার স্পিকার মােহম্মদ উল্লাহর (পরবর্তীকালে স্বল্পকালীন রাষ্ট্রপতি) তিনবার অনুরােধের পর মন্ত্রী। খন্দকার মােশতাক বিরােধী দলের এক সদস্যের প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য হন। তিনি অর্ধেক দাঁড়িয়ে, অনিচ্ছভাবে বলেন যে তার আরও সময়ের দরকার। স্বাধীনতা ঘােষণা সম্বন্ধে আমার হাইপােথিসিস হলাে যে ; বঙ্গবন্ধুর নামে স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে অনেক দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। সে সময় আমি চট্টগ্রামে ছিলাম এবং অনেক ঘটনা কাছ থেকে দেখার ও জানার সুযােগ
আমার হয়। বেলাল মােহাম্মদ ছিলেন চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী। তিনি ‘৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় হৃদয়গ্রাহী কথিকা পাঠ করে অনেকের প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন। তিনি ছিলেন অত্যন্ত দেশপ্রেমিক। তিনি, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ এবং আরও কজন ইঞ্জিনিয়ার চট্টগ্রামের কালুরঘাটে। ২৬ মার্চ, ১৯৭১ এক কিলােওয়াটের রেডিও স্টেশন স্থাপন করেন। সেখান থেকেই আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা আব্দুল হান্নান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন [২৫ মার্চ গত ২৬ শে। মার্চের শুরুতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। তারপর ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার হতে আব্দুল হান্নান স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ২য় বার কালুরঘাট ট্রান্সমিটার হতে ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় তিনি। বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। বেলাল মােহাম্মদ চট্টগ্রামের পটিয়া অঞ্চল হতে মেজর জিয়াকে কালুর ঘাটে নিয়ে আসেন। উদ্দেশ্য একজন সিনিয়র মিলিটারি অফিসারকে দিয়ে স্বাধীনতা ঘােষণা করা। বেলাল মােহাম্মদের অনুরােধে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর পক্ষে কালুরঘাট ট্রান্সমিটার হতে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস ২৬ মার্চ, একারণেই যে ঐ দিনেই প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষিত হয়। লেখক)। এই দেশপ্রেমিকেরা নিজেরাই বঙ্গবন্ধুর নাম দিয়ে ওয়্যারলেসে বিভিন্ন স্থানে মেসেজ পাঠান। ফোনেও তারা নিজেদের গ্রুপের মধ্যে একই বার্তা বিনিময় করেন। আর একটা ব্যাপার হলাে বেলাল মােহাম্মদরা জানতে পারেন যে কয়েকজন বাঙালি আর্মি অফিসার কালুরঘাট থেকে কয়েক মাইল দূরে পাহাড়ি এলাকায় অবস্থান করছেন। তারা ২৭ মার্চ সেখানে গিয়ে ওই অফিসারদের বেতার কেন্দ্রে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে সিনিয়র অফিসার হিসেবে মেজর জিয়াউর রহমানকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য বাংলায় লেখা একটি বিবৃতি দিয়ে সেটি পাঠ করতে বলেন। জিয়া বিবৃতিটি পড়ে নিজে কাগজ কলম নিয়ে ইংরেজিতে একটি বিবৃতি তৈরি করেন এবং সেটি পাঠ করে শােনান। সেই ইংরেজি বিবৃতিতে তিনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা করেন, যা আমি চাটগা থাকাকালীন নিজ কানে শুনি। আধঘণ্টা পর তিনি আরেকটি সংশােধিত ঘােষণা পাঠ করে শােনান। তাতে তিনি নিজেকে আর অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেননি, শুধু বঙ্গবন্ধুর নামে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। পরবর্তী সময়ে আমি সেখানে উপস্থিত কয়েকজনের বরাতে শুনেছি যে জিয়া নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ঘােষণা করায় উপস্থিতদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং তাদের প্রতিবাদের মুখে জিয়া নিজের ওই রাষ্ট্রপতিত্বের দাবি বাদ দিয়ে সংশােধিত ঘােষণা পাঠ করতে বাধ্য হন। আমার মতে, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকেই স্বাধীনতার ঘােষণা হিসেবে ধরা যেতে পারে। | দেশ যখন স্বাধীন হলাে তখন সবকিছু বিধ্বস্ত ছিল। ব্রিজ, ফ্যাক্টরি, রাস্তাঘাট সবই বিনষ্ট ছিল। খরা, বন্যা লেগে ছিল। তারপর ‘৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের পর তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী সকল পণ্যের দাম বিপুল পরিমাণে বেড়ে যায়। সে সময় বিশ্বের সর্বত্র তীব্র খাদ্যসংকট ছিল, ফলে মূল্য আকাশচুম্বী হয়ে পড়ে। বাংলাদেশেও প্রচণ্ড খাদ্যসংকট দেখা দেয়। কিন্তু ওই সংকট ও অন্যান্য দ্রব্যের অত্যধিক মূল্যবৃদ্ধির জন্য সরকার দায়ী ছিল না। কারণ যুদ্ধের ফলে দেশের প্রায় এক কোটি মানুষ শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী ও তাদের দেশীয় দোসররা লাখ লাখ ঘরবাড়ি, দোকানপাট পুড়িয়ে দিয়েছিল। পর পর দুটি শস্য মৌসুমে আবাদের সুযােগ পায়নি মানুষ। তা ছাড়া যুদ্ধের শেষ পর্যায়ে পাকিস্তানিরা কলকারখানা, ব্রিজ, কালভার্ট, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ইত্যাদি ধ্বংস করে দিয়েছিল। ফলে দেশের সার্বিক অবস্থা একটা প্রচণ্ড বিপর্যয়ের কবলে নিপতিত হয়েছিল। দেশের মানুষ এসব দেখেছে এবং বুঝতে পেরেছে। তাই তারা কষ্ট সহ্য করতে রাজি ছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। মিরাকল ঘটানােও সম্ভব ছিল না। সে হিসেবে সরকার ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু জনগণ যখন দেখল যে অনেক আওয়ামী লীগার রাতারাতি ধনী বনে যাচ্ছে, সব সুবিধা নিচ্ছে এবং আপামর জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে তাতে করে সরকারের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। এ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হতে ফেনীর জয়নাল হাজারীর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। হাজারী মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন বটে, কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর তিনি অধিকাংশ অস্ত্র সমর্পণ করেননি, সন্ত্রাস করেছেন এবং অনেক লুটপাট করেছেন। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যাপক অভিযােগ ছিল। তিনি। অবৈধভাবে ফেনীর দুটি আবাসিক হােটেল দখল করেন। জেলখানার পাশে কলেজ রােডের ওপর। ওই হােটেল দুটি ছিল। একটির নাম হােটেল ডিনােফা, অন্যটির নাম মনে নেই। হাজারী একটি হােটলে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন এবং অন্য হােটেলকে জেলখানা ও টর্চার চেম্বার করে পাকিস্তানপন্থীদের ওপর নির্যাতন চালান। তাদের স্বজনদের কাছ থেকে অনেক অর্থ আদায় করতেন। ফেনীর আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি খাজা আহমেদ (তিনি ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামের একজন বীর সেনানী ছিলেন এবং কিছুকাল নৈনিতাল জেলে জওহরলাল নেহেরুর পাশের সেলে বন্দী ছিলেন)। তিনি হাজারীর অত্যাচার হতে পাকিস্তানি দালালদের বাঁচানাের। এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের সরকারি জেলে পাঠিয়ে দেন। জয়নাল হাজারীর অত্যাচার এতই বৃদ্ধি পায় যে বঙ্গবন্ধুর সরকার তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনী। পাঠাতে বাধ্য হয়। একদিন পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে হাজারীর সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয়। হাজারীর ওই দখল করা হােটেল থেকেই পুলিশ বাহিনী তাকে আটক করে। পরে তিনি উচ্চ কানেকশনের বলে ছাড়া পান। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি পল্টন ময়দানে যুবলীগের বিশাল এক সমাবেশ করেন। সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি ছিলেন। সেদিন হাজারীর হাত দিয়ে শেখ মনি বঙ্গবন্ধুকে হরিণ উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে ফেনী এলাকার জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। এর কয়েক দিন পর। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে আমার সঙ্গে এ নিয়ে শেখ মনির প্রচণ্ড তর্ক হয়। আমি মনিকে বলেছিলাম যে তিনি হাজারীর মতাে সন্ত্রাসীর হাত দিয়ে শেখ সাহেবকে হরিণ উপহার দিয়ে ঠিক কাজ করেননি। আমার সহকর্মী সাংবাদিক সৈয়দ নাজিম উদ্দিন মানিক (প্রয়াত) আমাকে সমানে চিমটি কাটছিলেন যাতে মনির সঙ্গে তর্কে ক্ষান্ত দেই। সেদিন মনি আমাকে বলেছিলেন যে জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে সব অভিযােগ অপপ্রচারণা। তিনি আরও বলেছিলেন, যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, তাদের অস্ত্রের প্রতি আকর্ষণ থাকবেই। অস্ত্র তারা নিজেদের কাছে। রাখলেও সেটা অপরাধের পর্যায়ের পড়ে না। যারা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেয়নি, তাদের পক্ষে এসব বােঝা মুশকিল। | আরেকটি ঘটনা। ১৯৭৩ বা ‘৭৪ সালের কথা। বাংলা একাডেমীতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমানের স্মরণসভার আয়ােজন করেন তাঁর আত্মীয় অধ্যাপক আলাউদ্দীন আল-আজাদ। তৎকালীন বিমানমন্ত্রী জেনারেল ওসমানী ছিলেন প্রধান অতিথি । তার উপস্থিতিতেই একজন সার্ভিং আর্মি অফিসার বললেন যে মতিউর বেঁচে থাকলে আজ তিনি ‘৭১ এর মতােই যুদ্ধবিমান নিয়ে বিদ্রোহ করতেন। তিনি সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার সমালােচনা করে এ কথা বলেছিলেন। ওসমানী কোনাে প্রতিবাদ করলেন না। আমি সেই মিটিং কভার। করেছিলাম।প্রচণ্ড বিপর্যয়ের কবলে নিপতিত হয়েছিল। দেশের মানুষ এসব দেখেছে এবং বুঝতে পেরেছে। তাই তারা কষ্ট সহ্য করতে রাজি ছিল। মাত্র সাড়ে তিন বছরে দেশের অবস্থার ব্যাপক পরিবর্তন আনা সম্ভব ছিল না। মিরাকল ঘটানােও সম্ভব ছিল না। সে হিসেবে সরকার ব্যর্থ হয়নি। কিন্তু জনগণ যখন দেখল যে অনেক আওয়ামী লীগার রাতারাতি ধনী বনে যাচ্ছে, সব সুবিধা নিচ্ছে এবং আপামর জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে তাতে করে সরকারের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধস নামে। এ ক্ষেত্রে আমার অভিজ্ঞতা হতে ফেনীর জয়নাল হাজারীর ঘটনা উল্লেখ করা যেতে পারে। হাজারী মুক্তিযােদ্ধা ছিলেন বটে, কিন্তু দেশ স্বাধীনের পর তিনি অধিকাংশ অস্ত্র সমর্পণ করেননি, সন্ত্রাস করেছেন এবং অনেক লুটপাট করেছেন। তার বিরুদ্ধে এ ধরনের ব্যাপক অভিযােগ ছিল। তিনি। অবৈধভাবে ফেনীর দুটি আবাসিক হােটেল দখল করেন। জেলখানার পাশে কলেজ রােডের ওপর। ওই হােটেল দুটি ছিল। একটির নাম হােটেল ডিনােফা, অন্যটির নাম মনে নেই। হাজারী একটি হােটলে তার হেডকোয়ার্টার স্থাপন করেন এবং অন্য হােটেলকে জেলখানা ও টর্চার চেম্বার করে পাকিস্তানপন্থীদের ওপর নির্যাতন চালান। তাদের স্বজনদের কাছ থেকে অনেক অর্থ আদায় করতেন। ফেনীর আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি খাজা আহমেদ (তিনি ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় মুক্তিসংগ্রামের একজন বীর সেনানী ছিলেন এবং কিছুকাল নৈনিতাল জেলে জওহরলাল নেহেরুর পাশের সেলে বন্দী ছিলেন)। তিনি হাজারীর অত্যাচার হতে পাকিস্তানি দালালদের বাঁচানাের। এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য তাদের সরকারি জেলে পাঠিয়ে দেন। জয়নাল হাজারীর অত্যাচার এতই বৃদ্ধি পায় যে বঙ্গবন্ধুর সরকার তার বিরুদ্ধে পুলিশ বাহিনী। পাঠাতে বাধ্য হয়। একদিন পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে হাজারীর সশস্ত্র বাহিনীর কয়েক ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষ হয়। হাজারীর ওই দখল করা হােটেল থেকেই পুলিশ বাহিনী তাকে আটক করে। পরে তিনি উচ্চ কানেকশনের বলে ছাড়া পান। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে যুবলীগ প্রধান শেখ ফজলুল হক মনি পল্টন ময়দানে যুবলীগের বিশাল এক সমাবেশ করেন। সেই সমাবেশে বঙ্গবন্ধু প্রধান অতিথি ছিলেন। সেদিন হাজারীর হাত দিয়ে শেখ মনি বঙ্গবন্ধুকে হরিণ উপহার দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। এতে ফেনী এলাকার জনগণের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয়। এর কয়েক দিন পর। ঢাকার জাতীয় প্রেসক্লাবে আমার সঙ্গে এ নিয়ে শেখ মনির প্রচণ্ড তর্ক হয়। আমি মনিকে বলেছিলাম যে তিনি হাজারীর মতাে সন্ত্রাসীর হাত দিয়ে শেখ সাহেবকে হরিণ উপহার দিয়ে ঠিক কাজ করেননি। আমার সহকর্মী সাংবাদিক সৈয়দ নাজিম উদ্দিন মানিক (প্রয়াত) আমাকে সমানে চিমটি কাটছিলেন যাতে মনির সঙ্গে তর্কে ক্ষান্ত দেই। সেদিন মনি আমাকে বলেছিলেন যে জয়নাল হাজারীর বিরুদ্ধে সব অভিযােগ অপপ্রচারণা। তিনি আরও বলেছিলেন, যারা অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশ স্বাধীন করেছে, তাদের অস্ত্রের প্রতি আকর্ষণ থাকবেই। অস্ত্র তারা নিজেদের কাছে। রাখলেও সেটা অপরাধের পর্যায়ের পড়ে না। যারা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নেয়নি, তাদের পক্ষে এসব বােঝা মুশকিল। | আরেকটি ঘটনা। ১৯৭৩ বা ‘৭৪ সালের কথা। বাংলা একাডেমীতে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট বীরশ্রেষ্ঠ শহীদ মতিউর রহমানের স্মরণসভার আয়ােজন করেন তাঁর আত্মীয় অধ্যাপক আলাউদ্দীন আল-আজাদ। তৎকালীন বিমানমন্ত্রী জেনারেল ওসমানী ছিলেন প্রধান অতিথি । তার উপস্থিতিতেই একজন সার্ভিং আর্মি অফিসার বললেন যে মতিউর বেঁচে থাকলে আজ তিনি ‘৭১ এর মতােই যুদ্ধবিমান নিয়ে বিদ্রোহ করতেন। তিনি সরকারের দুর্নীতি ও ব্যর্থতার সমালােচনা করে এ কথা বলেছিলেন। ওসমানী কোনাে প্রতিবাদ করলেন না। আমি সেই মিটিং কভার। করেছিলাম।
২১ অক্টোবর, ২০০১ লেখকের ডায়েরি থেকে। (ডায়েরির অধিকাংশই ইংরেজিতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। সঙ্গতি রাখার জন্য ইংরেজিতে লেখা ঘটনা ও তথ্যাবলি বাংলা অনুবাদ করা হলাে। কিছু কিছু ইংরেজি শব্দ অনুবাদ ব্যতীত ব্যবহার করা হলাে।)
মুজিব হত্যা সম্পর্কে তথ্য
ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সি-এনার তৎকালীন সাংবাদিক ও নিউইয়র্কের বাংলা সাপ্তাহিক প্রবাসীর প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক সৈয়দ মােহাম্মদ উল্লাহর সঙ্গে কথা হলাে। মােহাম্মদ উল্লাহ ভাই আমার জানামতে অত্যন্ত সৎ ও বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতা করেছেন। তার কাছ থেকে কতগুলাে তথ্য পেলাম যা লিখে রাখলাম ভবিষ্যতের জন্য। (নিম্নে উল্লিখিত ৪ ও ৫ নম্বর-এ মােহাম্মদ উল্লাহ সাহেব আরও কিছু তথ্য যােগ করেছেন)। মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের প্রধান ব্যক্তিবর্গের কার্যকলাপ
১) ১৯৭৪ বা ‘৭৫ সালে খন্দকার মােশতাক তার তেহরান সফরের সময় চীনের উপ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে এক অনির্ধারিত মিটিং করেন।
২) মােশতাকের ডান হাত বলে পরিচিত তথ্য প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দীন ঠাকুর দুই সপ্তাহ ধরে ভারত সফর করেন। তাকে ভারতের তথ্যমন্ত্রী (পূর্ণ মন্ত্রী) অভ্যর্থনা জানান যা প্রােটোকলের বাইরে।
৩) যখন লাহাের কনফারেন্সের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের প্রতিনিধিদল বঙ্গবন্ধুকে সেখানে যােগদানে রাজি করাতে আসেন তখন প্রতিমন্ত্রী তাহেরউদ্দীন ঠাকুর তাদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন।
৪) মােহাম্মদ উল্লাহ ভাই আরও জানান “পূর্ব এশিয়ায় নিউজ উইকের ব্যুরাে চিফ আর্নল্ড জেটলিন, তিনি বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের কয়েক দিন পর কোলকাতা হয়ে বাংলাদেশে আসেন। এ সময় একদিন তিনি আমাদের এনার কার্যালয়ে এসেছিলেন। আমাদের এক্সিকিউটিভ এডিটর হাসান সাঈদের টেবিলের ওপর বসে সামনের একটি চেয়ারে পা রেখে (অনেক পশ্চিমা তৃতীয় বিশ্বের লােকদের সঙ্গে আচরণে এখনাে যে ধৃষ্ঠতার পরিচয় দিয়ে থাকে। তারই প্রকৃষ্ট উদাহরণ।- সাক্ষাকারদাতার উক্তি) আমাদের সঙ্গে কথা বলছিলেন। হাসান সাঈদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন, “তােমরা কি আগে থেকে এসব ব্যাপারে কোনাে কিছু
জানতে না বা আঁচ করতে পারােনি? উত্তরে তিনি জানান যে ম্যানিলায় তিনি বেনজির ভুট্টোর চাচা মমতাজ আলী ভুট্টোর সঙ্গে ডিনার করেছিলেন। সে সময় তাঁর কাছে একটি ফোন আসে এবং তাঁকে জানানাে হয় যে মুজিব নিহত হয়েছেন। তিনি এই তথ্যটি মমতাজ ভুট্টোকে জানান। তখন ভুট্টো স্মিত হাসি হাসেন [knowing smile] কিন্তু কিছুই বলেননি। তাতে ধারণা করা যেতে পারে-এ বিষয়ে তারা আগে থেকে কিছু জানত।
৫) জেটলিন আরেক ঘটনা উল্লেখ করলেন। তিনি বললেন, মাস দেড়েক আগে আমি ঢাকা
এসেছিলাম। বিমানবন্দর থেকে আমি সােজা তােমাদের সচিবালয়ে খন্দকার মােশতাকের অফিসে যাই। কিছুক্ষণ সেখানে কথা বলার পর তিনি আমাকে তার গাড়িতে করে তার সরকারি বাসভবনে নিয়ে যান। সেখানে আমরা বেশ কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলি এবং খাওয়াদাওয়া করি। এরপর ওইদিনই সন্ধ্যায় আমি ঢাকা থেকে কোলকাতা চলে যাই। হাসান সাঈদ তার এই দুই বক্তব্যের ব্যাখ্যা জানতে চাইলেও জেটলিন আর কিছু বলতে রাজি হননি।” ব্যক্তিগত, টেলিফোন ও ভিডিও সাক্ষাৎকার ১১ নভেম্বর ও ৩০ নভেম্বর, ২০০৯ এবং ১২ জানুয়ারি ২০১০ ওয়াশিংটন-নিউইয়র্ক, যুক্তরাষ্ট্র। তথ্যসূত্র
১) বেলাল মােহাম্মদ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। ঢাকা : অনুপম প্রকাশনী, ১৯৯৩ সংস্করণ,
পৃ. ৩৩-৩৪, ৪০
২) চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অর্থনীতিবিদ ড: মইনুল ইসলামের সাথে এ প্রসঙ্গে কথা
বললে (৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৪) তিনিও অনুরূপ মত প্রকাশ করেন। তিনি উল্লেখ করেন সে ২৭ মার্চ, ১৯৭১ মেজর জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘােষণাটি যাতে তিনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি উল্লেখ করে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, তা চট্টগ্রাম থেকে তিনি শােনেন। তিনি আরও জানান যে, তারপর সেই সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্রে উপস্থিত, ড: মমতাজউদ্দীন (নাট্যকার) বেলাল মােহাম্মদ প্রমুখের প্রতিবাদের মুখে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধুর নামে ঐ সন্ধ্যাতেই আবার স্বাধীনতা ঘােষণা করেন।
৩) কালুর ঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের স্থপতি বেলাল মােহাম্মদ পূর্বে উল্লেখিত বইয়ে (পু, ৪০, ৪৪-৪৫) উল্লেখ করেন যে ২৭ মার্চ মেজর জিয়া নিজের নামে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণার কথাটি লিখেছিলেন। পরে বেলাল মােহাম্মদের অনুরােধে তিনি নিজের নামের শেষে বঙ্গবন্ধুর নাম উল্লেখ করে, তার নামে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। ২৮ মার্চ তিনি নতুন একটি লিখিত ঘােষণা নিয়ে এসেছিলেন যাতে তিনি নিজেকে Provisional Head of Bangladesh ও স্বাধীন বাংলা লিবারেশন আর্মির প্রধান হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। এই দ্বিতীয় ঘােষণায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে অনুল্লেখিত থাকে যা ছিল শ্রোতাদের কাছে আপত্তিকর। ঐ আপত্তির কারণে, মেজর জিয়া তৃতীয় ঘােষণায় মহান নেতা বঙ্গবন্ধুর নাম বারবার উল্লেখ করেন। সৈয়দ মােহাম্মদ উল্লাহ এবং ড: মইনুল ইসলাম উল্লেখ করেন যে ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় তারা মেজর জিয়াউর রহমানের প্রথম ঘােষণাটি শােনেন, যাতে তিনি নিজেকে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে উল্লেখ করেন। বেলাল মােহাম্মদ এ প্রসঙ্গে তার বইতে ২৮ মার্চ উল্লেখ করেন।

বঙ্গবন্ধুর পার্সনাল এইড হাজী গােলাম মােরশেদের সাক্ষাৎকার
হাজী গােলাম মােরশেদ। নামটি আমি প্রথম শুনি ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকার নেওয়ার সময়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুর নিষেধ সত্ত্বেও তিনি নিজ জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তার সাথে থেকে যান। ঐ কালাে রাতে বঙ্গবন্ধুর সাথে তিনিও ৩২ নং রােডের বাসগৃহ হতে কারাবন্দি হন। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আটকাধীন মােরশেদ সাহেবের ওপর চলে পাশবিক নির্যাতন। মুমূর্ষ অবস্থায় তিনি মুক্তি লাভ করেন ২৫ নভেম্বর, ১৯৭১। ওনার উদ্যোগে ও অনুরােধে, ভারতীয় সেনার বঙ্গবন্ধুর গৃহবন্দি পরিবারকে ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রােডের বাড়ি থেকে মুক্ত করে, ১৭ ডিসেম্বর, ১৯৭১। কিশাের বয়স হতে রাজনীতির সাথে জড়িত হাজী গােলাম মােরশেদের জীবন বর্ণাঢ্য ঘটনামালায় ভরপুর। বরেণ্য ও শক্তিধর রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বদের তিনি খুব কাছে থেকে দেখেছেন; সাক্ষী হয়েছেন এমন সব ঘটনাবলির যা ইতিহাসের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে ভবিষ্যতের সত্যান্বেষী-বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস রচয়িতাদের ইতিহাসকে আলােকিত করতে পারে। | ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছ থেকে ওনার নাম ও ফোন নাম্বার সংগ্রহ করে, পরদিন ওনাকে ফোন করি। উনি সাথে সাথেই ওনার বাড়িতে আমন্ত্রণ জানান। পুত্রবধূ প্রিয়াংকার ভিডিও ক্যামেরাটি নিয়ে ওনার ঢাকার আসাদগেটের বাড়িতে যখন পৌছি তখন বিকেল তিনটা। পেরিয়ে গিয়েছে। উনি খাটের ওপর আধশােয়া অবস্থায় স্ত্রী, কন্যা, জামাতা ও পরিবারবর্গ পরিবৃত অবস্থায় সাপ্তাহিক ছুটির দিনটি উপভােগ করছিলেন। আমাকে সাদরে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন, যেন বহুদিনের চেনা। এক নিমিষে আপন করে নেওয়ার মতাে গুণাবলি সমৃদ্ধ এই অশীতিপর মানুষটির অভিব্যক্তি ও আচরণে তারুণ্যর উদ্দীপনা স্পষ্ট। রসিকতা করেন স্বাচ্ছন্দ্যে। রসালাপে যে কোনাে আলােচনাকে করে তােলেন প্রাণবন্ত। স্মৃতিশক্তি অসাধারণ। কালের গর্ভে নিমজ্জিত ইতিহাসকে বর্ণনা করেন এমনভাবে, যেন মাত্র সেদিনের ঘটনা। সত্য বলেন নির্দ্বিধায়, কোনােরকম রাখ ঢাক ছাড়াই। ভিডিওতে ধারণকৃত ওনার দীর্ঘ সাক্ষাৎকারের প্রাসঙ্গিক অংশবিশেষ তুলে ধরা হলাে : আসসালামু আলাইকুম। চাচা আপনার পুরাে নামটি বলবেন? আমার নাম মহম্মদ গােলাম মােরশেদ। আমাকে হাজী মােরশেদ নামেই সবাই চেনে। চাচা আপনি যদি একটু শুরু করেন সেই সময়ের ঘটনা থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বলছিলেন যে রাত সাড়ে দশটার দিকে উনি এবং ড. কামাল হােসেন, ২৫ মার্চ, ১৯৭১, বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে গেলেন। যেয়ে দেখলেন যে ডাইনিং টেবিলে বঙ্গবন্ধুর সাথে আপনি বসা। ওখান থেকে আপনি কি স্মৃতিচারণ করবেন ? যখন আমীর-উল আসল, তখন বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যাবার চেষ্টাই সে করল। কিন্তু বঙ্গবন্ধু বললেন যে তিনি ডিসিশন নিয়ে ফেলেছেন আগেই। তার আগেই উনি বলে দিয়েছেন, “If they don’t get me, they will massacre all the people and destroy the city.” Wala RCA হয়েছে যে এটা তার ও আমার জীবনের শেষ রাত্রি। স্বাধীনতার Key লগ্ন যাকে বলে। লগ্ন শুরু হলাে। বঙ্গবন্ধু আমাকে অনেক দিন আগে একটা নির্দেশ দিয়েছিলেন যখন কোনাে ডিসিশন নিয়ে ফেলব, তুমি কখনাে আমাকে ইনফ্লুয়েন্স করবার চেষ্টা করবে না। তার আগে তিনি বলেছেন, “তুমি আমার সবচেয়ে কাছে থাক, তার ফলে আমি বিভ্রান্ত হয়ে যেতে পারি।’ ২৫ মার্চ রাতে তাহলে আমি সকাল থেকে বলি। প্রতিদিন সকালে আমি চলে আসতাম। সারাদিন আমি বঙ্গবন্ধুর সাথে থাকতাম। অনেক রাত হলে চলে যেতাম। এটা আমার রুটিন ছিল। আপনার বাসা কোথায় ছিল? কাকরাইলে বাসা ছিল। আমার একটা গাড়ি ছিল ঢাকা গ, ওয়ান। ঐ গাড়িতে করে বঙ্গবন্ধু আমার সাথে যেতেন। বঙ্গবন্ধু প্রেফার করতেন আমার সাথে যাতায়াত।
কী গাড়ি ছিল ? টয়ােটা সেমি ডিলাক্স। এটা কিনেছিলাম হীলু ভাইয়ের কাছ থেকে। উনি ঢাকার মােত্তালিব কলােনির মালিক ছিলেন। ইস্টার্ন হার্ডওয়ারের মালিক। সিক্সটি নাইনে হজ থেকে ফিরে আসার পর গাড়িটা কিনি। বঙ্গবন্ধু মাঝে মাঝে আপনার সাথে ঐ গাড়িতে যেতেন? মাঝে মাঝে না ডেইলি। কোথায় যেতেন। আওয়ামী লীগ অফিসে। আর বিভিন্ন জায়গায় ট্যুরে যেতাম। একবার নড়াইলে গেলাম। তখন তাজউদ্দীন ভাই, মনসুর ভাই আমাদের সাথে। গাড়ির কী রং ছিল ? সাদা। আচ্ছা ! এখন মনে পড়ে সাদা টয়ােটা গাড়ি ! হ্যা। তােমাদের বাড়িতেও ঐ গাড়ি গিয়েছিল। মুজিব কাকু এ গাড়ি করে আসতেন আমাদের বাসায়। হ্যা, ঐ গাড়িতেই উনি আসতেন। তােমার মা কাবাব বানিয়ে আমাদেরকে খাওয়াতেন। তখন ২৫ মার্চ সকাল বেলায় কী হলাে?
আমি আসলাম নয়টার দিকে। এরপর ওসমানী সাহেব আসলেন (জেনারেল মােহাম্মদ আতাউল গনি ওসমানী), শেখ আব্দুল আজীজ ভাই আসলেন। তারপর তাজউদ্দীন ভাই তাে এসে এক দুঘন্টা করে থাকতেন ডেইলি। পেপার তৈরি করা, স্টেটমেন্ট তৈরি করা, ইভ্যালুয়েট করা এ সমস্ত ওনাকেই করতে হতাে। He was one dynamo behind শেখ মুজিবুর রহমান। আনসার ডাইরেক্টর আব্দুল আউয়াল সাহেব বললেন যে আনসার বাহিনীর আর্মস-অ্যামুনেশন আছে। এটা প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্টের পুলিশ লাইনে মালখানায় জমা আছে। উনি একসময় যশােরের এসপি ছিলেন। আমার সাথে সেই জন্যে ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। আমি তখন যশাের মহকুমা আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি। উনি এই অ্যাডভাইসটা দিলেন। আমি এই ব্যাপারটা সিরাজুল আলম খানের সাথে আলােচনা করলাম যে আমাদের তাে অ্যামুনেশন দরকার। প্রত্যেক আনসারের জন্য যে একটা বিরাট আর্মস, বিরাট অ্যামুনেশন, প্রত্যেক ডিস্ট্রিক্ট হেডকোয়ার্টারে আছে, আউয়াল সাহেব ত্যাডভাইজ করেছেন যে ওটা আমাদের লােকজনদের ভেতর যেন ডিস্ট্রিবিউট করে দেই। সিরাজুল আলম খান সাহেব হেসে উড়িয়ে দিলেন কথাটা। এরপরে আমি
বঙ্গবন্ধুকে বললাম। বঙ্গবন্ধু ওসমানী সাহেবকে বললেন মুরশেদ কী বলছে, আপনি শােনেন।’ ওনাকে মুরশেদ নামেও অনেকে সম্বােধন করে থাকেন।] আমি ওসমানী সাহেবকে বললাম। উনি বললেন ‘দেখি চিন্তা করে। এরপর দুপুর হয়ে গেল। বাসায় ফিরব খাওয়ার জন্য। ওসমানী সাহেব আমাকে বললেন, ‘আমাকে একটা লিফট দেন।’ ওসমানী সাহেবকে নিয়ে ধানমণ্ডির ৬ কি। ৫ নম্বর রােডে সামাদ সাহেবের (আবদুস সামাদ আজাদ) বাড়িতে নামালাম। ওসমানী সাহেব আমার হাত ধরে টেনে নিয়ে গেলেন ভিতরে। ওখানে দুপুরে খেলাম। নামাজ পড়লাম। তারপর। তিনটা চারটার দিকে চলে আসলাম বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে। এক বালুচ নবাব এসেছিলেন। বঙ্গবন্ধু ওনার সাথে কথা বললেন। পাঁচটার দিকে আমি ঘরে ঢুকলাম। বঙ্গবন্ধু ও আমীর-উল (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম) বসে আছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে তােমাকে একটু ঢাকার এসপির কাছে যেতে হবে।’ আউয়াল সাহেব সাথে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘তােমরা দুজন ঢাকার এসপিকে বল আর্মস ও অ্যামুনেশন যেন ফোর্সের ভেতর ডিস্ট্রিবিউট করে।’ রাজারবাগে (পুলিশ লাইন) সব আর্মস ও অ্যামুনেশন। রাজারবাগ তখন ডিস্ট্রিক্ট পুলিশ হেড কোয়ার্টার ছিল। আমরা তখন সার্কিট হাউসের সামনে ঢাকার এস.পির বাড়িতে গেলাম। উনি একটু অসুস্থ ছিলেন। উনি আসলেন। আসলে আমি বললাম । আউয়াল সাহেব ডিটেলস বললেন। তারপর মাগরিবের নামাজ পড়ে বঙ্গবন্ধুর কাছে এসে রিপাের্ট করলাম। তখন আমীর-উল বলল, মুরশেদ ভাই যশােরে খবর দেওয়া দরকার। মশিয়ুর রহমান সাহেবকে একটু খবর দেন। আমি তখন বঙ্গবন্ধুর দিকে তাকালাম। বঙ্গবন্ধু বললেন যা’। তখন আমি বাসায় চলে আসলাম। বাসায় চলে এসে যশােরের মশিয়ুর মামাকে (যশাের আওয়ামী লীগের সভাপতি, শহীদ মশিয়ুর রহমান) ফোন করলাম। সেখানে রওশন আলী সাহেব, তবীবুর রহমান সাহেব এম, এল, এ, এম.পি সবাই ছিলেন। তাে বলে দিলাম যে বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে পুলিশ লাইনে যত আর্মস ও অ্যামুনেশন আছে সেগুলাে ফোর্সের ভেতর ডিস্ট্রিবিউট করে দেওয়ার জন্য। আমাদের স্বাধীনতার সমর্থকদের মধ্যে ডিস্ট্রিবিউট করার কথা বলেছিলেন ?
, পুলিশ ফোর্সের ভেতর ডিস্ট্রিবিউট করার কথা বলেছিলাম। বাঙালি পুলিশের মধ্যে। পুলিশ লাইনের প্রায় সমস্তই বাঙালি। দু-একজন হাবিলদার বাদে। ওদের কাছে অস্ত্র থাকত না । , ওরা রেস্টে থাকে। পুলিশ লাইনে সাধারণত আন-আর্মড থাকে। আচ্ছা, তাই, মালখানা থেকে তুলে তাদের হাতে যেন অস্ত্র তুলে দেওয়া হয় ? হ্যা, ডিস্ট্রিবিউট যেন করা হয়। আমীর-উলই বলল, “মুরশেদ ভাই এখান থেকে ফোন করা তাে অসুবিধা, আপনি আপনার বাসায় যেয়ে ফোন করেন। কারণ এটা গােপন ব্যাপার
হ্যা। তখন আমি আমীর-উলের অ্যাডভাইজ মতাে বাসায় চলে গেলাম। বাসায় চলে গিয়ে ফোন করলাম। তখন আটটা সাড়ে আটটা বাজে। এটা ২৫ মার্চ রাতে ? হ্যা ২৫ মার্চ রাতেমাই গুডনেস, এটা তাে সাংঘাতিক! এরপর আমার মা আবার মারা গিয়েছেন ৩ ফেব্রুয়ারি সে বছরেই। মার জানাজায় মুজিব ভাই, তাজউদ্দীন ভাই সবাই এটেন্ড করেছিলেন। আমার বড়ভাই (আতিউর রহমান) তখন চিফ ইঞ্জিনিয়ার, পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বাের্ডের। হাতিরপুলের বাসায় থাকতেন। (সেখানে জানাজা হয়) যখন আমি বের হলাম তখন (রাত) সাড়ে নয়টা বাজে। মার কবর জিয়ারত করার জন্য। বেরিয়েছি, তারপর মুজিব ভাইয়ের বাসায় যাব। এসে আমি দেখি শাহবাগের মোড়ে ব্যারিকেড। ফেলা হচ্ছে। তখনাে দশটা বাজেনি, দশ বাজে বাজে করছে।
ব্যারিকেড ফেলছে আমাদের ছেলেরা ? হ্যা। আমাদের ছেলেরা ব্যারিকেড দিচ্ছে। তখন আজিমপুর গােরস্থানে যাওয়া অ্যাবানডান করে, এয়ারপাের্ট রােডটা খালি পেলাম সেই এয়ারপাের্ট রােড দিয়ে সােজা চলে আসলাম। চলে এসে দেখি সামনে আবার ব্যারিকেড। তখন বাঁয়ে গ্রিন রােডে ঢুকলাম। ঢুকে যেয়ে একটা গলি। দিয়ে কলাবাগানের ভেতর দিয়ে আমি মিরপুর রােডে উঠলাম। আমার সামনে ধড়াস করে একটা গাছ পড়ল। দেখি কুড়াল হাতে রাশেদ মােশাররফ (মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফের ভাই)। আমরা রাস্তায় আটকে গেলাম। রাস্তায় আটকে গেলে রাশেদ মােশাররফ ছুটে আসল। আমাকে আবার নানা বলে। বলে নানা এ দিকে তাে রাস্তা বন্ধ। তাে এদিক দিয়ে যান।’ আমাকে আট নাম্বার (ধানমণ্ডি) রােড দিয়ে যেতে অ্যাডভাইস করল। তাে আমি আট নাম্বার রােডে ঢুকে, ঐ ব্রিজটা পার হয়ে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির সামনে গাড়িটা রেখে সােজা ছুটে গেলাম। নিচে কেউ নেই। (হাজী মুরশেদ সাহেব জানান যে, সে রাতে বাড়িতে বঙ্গবন্ধুর সাথে শিশু রাসেল ও বেগম মুজিব ছিলেন। বাকি চার ছেলেমেয়ে বাসার বাইরে ছিল)। শুনসান ? শুনসান। শুধু পুলিশের একটা দারােগা ছিল, সেই দাড়িয়ে ছিল। ভেতরের বারান্দার সামনে। আমি সােজা ওপরে উঠে গেলাম। ওপরে উঠে দেখি বঙ্গবন্ধু পাইপ হাতে বসে আছেন। আমি ঢােকার সাথে সাথে বললেন, ‘আমরা স্বাধীন হয়ে গেলাম। They are coming to arrest me. I have decided to stay.’ ঠিক এই তিনটা কথা উচ্চারণ করলেন। তখন রাত সাড়ে দশটা বাজে? হা। এ রকমই। ড. কামাল ও আমীর-উল কাকু তােওরা একটু পরেই আসল। বঙ্গবন্ধু কোথায় বসা ? ওপরে বেডরুমে বসাছিলেন। আমীর-উল কাকু ও ড. কামাল হােসেন কি বেডরুমে গেলেন ? , ওনারা নিচের বারান্দায় আসলেন। তারপরে নিচের টেবিলে বসলেন। আপনারা কি তখন নিচে নেমে এসেছিলেন ? হ্যা, আমি তখন ওপর নিচ করছি। প্রচুর টেলিফোন আসছে। মওদুদ (ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ) ফোন করে বলল যে হাজী ভাই পালান। তারপর সিরাজুল হক সাহেবের (অ্যাডভােকেট, এম,সি,এ) স্ত্রী বললেন যে, মুজিব ভাইকে বলেন যে পালিয়ে যেতে, ওরা মেরে। ফেলবে। তারপর সুবােধ মিত্র ছিলেন যশােরের এম.সি,এ তিনি বললেন আপনারা পালান। আপনি উপর নিচ করছিলেন ? উপরেও টেলিফোন, নিচেও টেলিফোন। দুইটা লাইন? ২টা টেলিফোন। মুজিব ভাই কোনাে টেলিফোন ধরছিলেন না। তারপর এই সময় আমীর-উল আসল। কামাল হােসেন তাে অ্যাগ্রেসিভ টাইপের না। খুব নরম সরম। মানুষের ভিড়ের বাইরে থাকতেই পছন্দ করতেন। আমীর-উল ছুটে আসল। ছুটে এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে কথা বলল। ঐ সময়টায় আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারলাম না। আমার যেন কেন। আবারও ছুটতে হলাে। তাে ওর সাথে কী কী কথা হলাে এটি আমি শুনিনি। আর তখন শুনবার মতাে মনের অবস্থাও না। এরপরে বীবুর রহমান আসল। তবীবুর রহমান হচ্ছে বঙ্গবন্ধুর মতাে লম্বা সাইজ। পরে ডাইরেক্টর অব পাবলিক কমিশন হয়। সে এসে বঙ্গবন্ধুকে জড়িয়ে ধরল, বলল, “মুজিব ভাই, পালান। ওরা মেরে ফেলবে আপনাকে।’ তখন কী বলল সেটা শােন ‘if they don’t get me, they will massacre all the people, all my people and destroy the city’. এরপরে রাত এগারােটা বেজে গেল, বারােটা প্রায় বাজে বাজে, এমন সময় একটা টেলিফোন আসল। বলে ‘আমি বলদা গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব?’ আমি মুজিব ভাইয়ের কাছে দৌড়ে গেলাম, বললাম যে ফোন এসেছে- ‘মেসেজ পাঠান হয়ে গিয়েছে। মেশিন নিয়ে আমি কী করব? উনি বললেন, ‘মেশিনটা ভেঙে ফেলে পালিয়ে যেতে বল।’ বঙ্গবন্ধু বললেন মেশিন ভেঙে পালিয়ে যেতে। আমি তাকে (বার্তা প্রেরক) সে কথা বললাম। রাত কটায় এ কলটা আসে? Around Twelve (am). আমার হাতে একটা ঘড়ি ছিল। ঘড়িতে দেখলাম একটা দশ-পনেরাে হবে, সে সময় চারদিক আলােকিত হয়ে গেল। পরে শুনলাম ট্রেসার বুলেট বলে ওকে। আমি তখন নিচ ওপর করছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, “কোনদিক দিয়ে এই গুলিগুলাে আসল?’ আমি একটি দিক দেখিয়ে দিলাম। আমারও তখন হিতাহিত জ্ঞান নেই। তারপর বঙ্গবন্ধু আবার ওপরে চলে গেলেন। এরপর আমি ফোন ধরে কথা বলছি- তখন একটা কথা শুনলাম হ্যান্ডস আপ’। তারপর আমি হাত উচু করে ফেললাম। তারপর আর একজন আওয়াজ করল ‘মাত মার। কিন্তু তার আগেই আমার মাথায় আঘাত লাগল। আমি অজ্ঞান হয়ে গেলাম।
Oh, My God! এরপর যেটা শুনেছি। স্বাধীনতার পরে পাশেই এ.কে মােশাররফ হােসেন সাহেব থাকতেন, পরে খালেদা জিয়া বা জিয়াউর রহমানের মিনিস্টার হন- কেমিক্যাল কর্পোরেশনের ডাইরেক্টর ছিলেন। বঙ্গবন্ধুর পশ্চিমের বাড়িতে থাকতেন। উনি ব্যালকনিতে শুয়ে সব দেখছেন। আমাকে যখন রক্তাক্ত অজ্ঞান অবস্থায় উঠিয়ে নিয়ে যাচ্ছে- তখন বঙ্গবন্ধু নিচের বারান্দায় এসে গিয়েছেন এবং আমাকে এই অবস্থায় দেখে বলেছেন, ‘How dare you hit him ? I want him alive.’ এই শব্দটা উনি এমনভাবে আওয়াজ করেছিলেন যে উনি পাশের দোতলার ভেতর। থেকে শুনতে পেয়েছিলেন। আপনি জ্ঞান ফিরে কী অবস্থায় নিজেকে দেখতে পেলেন? তখন আমি গােঙাচ্ছি। দেখি- মাটিতে শুয়ে আছি। পরে রমার কাছে শুনেছি ওটা সংসদ ভবনের সামনের মাঠ। রমা ও বুড়িকেও ওখান থেকে উঠিয়ে নিয়েছিল। ও, সেই বুড়ি! শেখ সাহেবের বাসায় যে কাজ করত আমাদের বাসায় মাঝে মাঝে আসত। হ্যা। আর রমা মানে রহমান নামে যে ছেলেটা কাজ করত। এই আমাদের তিনজনকে একটা ট্রাকে নিল। আর বঙ্গবন্ধুকে আলাদা কীভাবে নিয়ে গেল আমি জানতে পারিনি। এরপর সংসদ ভবনে রাখল। রেখে আর একটা গাড়িতে সূর্য ওঠার আগেই আমাকে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিয়ে গেল। আমি তখন শীতে কাঁপছি। দাঁত কটকট করছে। মাথায় ব্যান্ডেজ বাঁধা। তখন আমার জ্ঞান এসেছে। আমাকে বসিয়ে রেখেছে। তারপর আমাকে বলছে নজর নিচে রাখি।’ চোখ নিচে রাখ। আমাকে দেখতে দেবে না। এই সময় আজান হলাে। আদমজি পাবলিক স্কুলের সামনে ছােট ট্রাকে আমাকে রেখে দিল। তারপর অফিসে কিছুক্ষণ রাখল। তারপর সিএমএইচে (Combined Military Hispital) আমাকে ভর্তি করে দিল। সি.এম.এইচে দুদিন থাকার পর, মেজর এসবি রহিম তিনি ডাক্তার ছিলেন, ব্রিগেডিয়ার মজিদুল হকের সূত্র ধরে ওনাদের সাথে আমাদের অ্যাকুয়েনন্টেনস ছিলসিলেটের জায়গির বাড়ির জামাই- উনি আমাকে দেখতে আসলেন। দেখে বললেন, ভাবিকে খবর নিয়ে দেব।’ উনি চলে যাচ্ছেন। এমন সময় এক সিপাই তাকে চ্যালেঞ্জ করল- “কিউ উসকা সাৎ বাৎ কিয়া ? মানা হ্যায়।’ কেন ওর সাথে কথা বললে ? কথা বলা নিষেধ। উনি কী জবাব দিয়ে চলে গেলেন। একটা সিপাই একটি মেজরকে থ্রেট করল।
যেহেতু তিনি বাঙালি। হ্যা তিনি বাঙালি। এরপর দুই তিনদিন ওরা আমাকে হাসপাতালে রাখল। এরপর একটা কাঠের শেডে নিয়ে গেল। সেখানে আরও তিরিশ-চল্লিশ জন বন্দী ছিল। সেখানে মেঝের ওপর আমাকে শুইয়ে রাখল। এপ্রিল মাস পর্যন্ত আমরা সেখানে থাকলাম। একটা ঝড় হলাে কাঠের শেড ভেঙে গেল। পাশের একটা গােডাউনে নিয়ে গেল। এই সময় আমাদের পায়খানা পেশাবে কোনাে পানি দিত না। একটা থালার মধ্যে ভাত আর কিছু ডাল দিয়ে দিত- দশজন খেত এক থালার ভাত। ক্ষুধার যন্ত্রণা সে সময় উপলব্ধি করলাম। তখন থেকেই নিয়ত করলাম যে ক্ষুধার্ত মানুষ আমার কাছ থেকে না খেয়ে যেন ফেরত না যায়। আহ্।। এরপরে একই কাপড় একই জামা। যখন রক্তাক্ত অবস্থায় সি.এম.এইচে ভর্তি হলাম, তখন পায়জামা-পাঞ্জাবি রক্তাক্ত হয়ে গিয়েছে। একটা সিপাই যে পাহারা দিচ্ছিল, সে তার সালওয়ার কামিজ আমাকে দিল। ওটা বদলে ফেললাম। এই সালওয়ার কামিজ দিয়েই আটমাস চলে গেল। (স্ত্রীকে লক্ষ করে) আছে না সেই সালওয়ার কামিজ ? স্ত্রী, হাজজা রােকেয়া মােরশেদ : হ্যা আছে। আর যেটার মধ্যে খেতে দিত। ও রকম সেইম আমরা একটা কিনে রেখেছি। যদি থাকে আমাকে একটু দেখিয়েন। তারপর কী হলাে চাচা ? তারপরে যে আসে সেই বলে “মুজিব কা সেক্রেটারি,মুজিব কা ড্রাইভার’ এই বলে পিটায় আর চলে যায়। এর পরে ইন্টারােগেশনের জন্য নিয়ে গেল আর একটা ব্যারাকে সেখানে নীল গ্লাস ওয়ালা ঘর- সেখানে পুরাে উলঙ্গ করে পেটাতে লাগল,তারপর জুন মাস পর্যন্ত এ ভাবেই চলল। মারে। যতক্ষণ না অজ্ঞান হই ততক্ষণে মারে। ঠিক মনে হয় যে সময় জান বেরিয়ে যাচ্ছে,সে সময় মার বন্ধ করে দেয়। তারা এত ট্রেনড। তারপরে বলে, বাতাও’। আমি বলি কেয়া বাতায়গা ? আমাদের তাে গােপন করার কিছু ছিল । আমরা তাে কিছু গােপন করিনি। আমাদের তাে কোনাে প্রিপারেশন ছিল না। আবেগ ছাড়া। কয়েকটা লগি আর চায়নিজ কুড়াল ছাড়া আমাদের আর কিছু ছিল না। অবশ্য সিরাজুল আলম খানদের একটা প্রিপারেশন ছিল। জুন মাসে আমাকে অর্ধমৃত অবস্থায় ৬ দিন হাসপাতালে রেখে দিল। এর মধ্যে আগস্টের দিকে কিছু মানুষ ছাড়া আরম্ভ করল। তখন খালেক ভাই বলে টি.এন্ড.টির এক পিয়ন বাসায় খবর দিল। সে আমার জন্য একটা লুঙ্গি ও একটা গেঞ্জি বাসা হতে নিয়ে আসল। তারা সেটা রাখতে দিল। আগস্ট মাসের ছয় তারিখে মেজর ফারুকী আসল আমাকে দেখতে। বলল কাল সুভা তােমাকো লে যায়েগে, তোমকো গাওয়াই দেনা পরেগা’। বললাম কেয়া গাওয়াই দেগে ? বলল ‘যাে জানতা হ্যায়।’ আমি বললাম, “যাে জানতা হ্যায়- আপলেগ যাে বলেগা, ওহি বলনা পরেগা’। (মেজরের উত্তর) ‘নেহি যাে জানতা হ্যায়, ওহি বলেগা’। (রােকেয়া মােরশেদ সেই নমুনা টিনের পাত্র নিয়ে আসলেন। এরকম পাত্রে বন্দী অবস্থায় খাবার দেওয়া হতাে।).
এটার মধ্যেই খাবার দিত?
হা। শেষের দিকে। এটার অর্ধেকের কম ভাত দিত। আর সন্ধ্যায় যেটা দিত সেটা আধা সেদ্ধ কুমড়াের তরকারি বা কিছু টেস্টলেস।
কোনমতে বাঁচিয়ে রাখা সেই আরকি আবার যদি পেশাব লাগত। রাত্রে এটাতেই পেশাব করতে হতাে। তারপর পানিও খেতে ভয় পেতাম। তারপর কোন পর্যন্ত বললাম ? অগাস্টে আমাকে গাওয়াই (সাক্ষী) দিতে হবে। তখন আমি মনে মনে ঠিক করলাম- প্লেনে তাে আমাকে নিয়ে যাবে। তখন বাথরুমের ভেতর দিয়ে ইন্ডিয়ান ওশানে ঝাঁপ দিয়ে পড়ব। এ ছাড়া আমার আর কোনাে উপায় নেই। যখন মনে মনে ঠিক করলাম তখন মনটা শান্ত হয়ে গেল। ডেসপারেশন থেকে এই চিন্তাটা আসল।
হা। স্বাক্ষী দিতে যাওয়া মানে- কী সাক্ষী ? মুজিবের বিরদ্ধে সাক্ষী দিতে বলবে। তারপর যে টর্চার করবে,সেই টর্চারের ফলে যা বলবে, তাই বলতে হবে। হ্যা সেটাই। এরপরে ওরা আর নিয়ে গেল না। আর আসল না। আমাকে একটা বড় ডায়েরি লেখার মতাে বই দিল। বলল তােম যাে জানতা হ্যায় বােল- লেখ । তােমাৱা যিন্দেগিক শুরু সে লেখ। পেনসিল দিল। তাে- শুরুতেই লিখতে থাকলাম। আপনার কোন ইয়ারে জন্ম ? সাটিফিকেটে ও পাসপাের্টে থারটি টু। অ্যাকচুয়ালি থারটি ওয়ান। 10th December, 1931. আমাদের দেশে তাে বয়স চুরি করা হয়। তারপর কী হলাে? ২৫ সেপ্টেম্বর আমাকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ট্রান্সফার করল। আমাদের ঐ ক্যাম্পটাই খালি করে জেলখানায় পাঠিয়ে দিল। জেলখানায় যেয়ে পেট ভরে ভাত খেলাম ছয় মাস পর। মনে হলাে যে বেহেশতে আসলাম। তখন আমার চল্লিশ পাউন্ড ওজন কমে গিয়েছে। জেলখানায় থাকতে থাকতে এখন যেখানে নির্বাচন কমিশন সেখানে আমাকে নিয়ে আসল। মেজর ও তিনচার জন আমাকে বলল কী কী জান আমাদেরকে বল। ওরা কথা বলত তুমি করে।’ আমি বললাম যা জানি তা তাে বলেছি। তারপর আবারও কিছু কিছু বললাম। কয়েক মিনিট পরে বলে যাও’। জেলখানায় ফেরত পাঠিয়ে দিল। ২৫ নভেম্বর আমাকে ছেড়ে দিল। আপনার পরিবার পরিজন- যখন জেলে ছিলেন ? আমার বড় বােন, আমার স্ত্রী দুই তিনবার ঢাকা জেলে আমার সাথে দেখা করে এসেছে। (স্ত্রী রােকেয়া মােরশেদকে লক্ষ করে) তখন আপনার মনােভাব কী ছিল? উনি ছাড়া পাবেন কি না ? উনি ছাড়া পাবেন,এই আশা নিয়েই তাে বেঁচে ছিলাম। তারপর কাশেম সাহেব একটা চিঠি দিলেন যে হয় ওনার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন না হয় ছেড়ে দেন। উনি এসব (রাজনৈতিক) ব্যাপারে জড়িত না। মিস্টার কাশেম, মালেক (গর্ভনর) কেবিনেটের মিনিস্টার ছিলেন। তিনি ব্রিগেডিয়ার বশীরকে চিঠি দিলেন। বিগ্রেডিয়ার বশীর ঢাকার ইনচার্জ ছিলেন। আবুল কাশেম সাহেব Former Deputy Speaker of Pakistan- ময়দুল ইসলামের বাবা। উনি একটা চিঠি দিলেন যে He is a deeply religious man.He has no conncetion with politics, রিলেশনশিপের কারণে সে শেখ মুজিবের বাড়িতে যেত। পরে সেই চিঠির কপি ওর থেকে (স্ত্রীকে লক্ষ করে) পেয়েছিলাম।
কাশেম সাহেব ব্রিগেডিয়ার বশীরকে চিঠিটি দিলেন এবং ওটার ভিত্তিতে আপনাকে ছেড়ে দিল ?
সম্ভবত। প্লাস গভর্নর মালেকের ছােট ভাই আমাদের কাজিন। তিনি আমাদের ভগ্নীপতিমুজিবর রহমান মালেক- টিপু মালেকের আব্বা। আপনি যখন ছাড়া পেলেন তখন তাে আপনার অবস্থা খুবই শােচনীয়। তখন কী ট্রিটমেন্ট চলল? রােকেয়া মােরশেদ ; না তখন তাে ট্রিটমেন্ট সম্ভব ছিল না। যুদ্ধ চলছে। আমরা কাকরাইলে বাসা ভাড়া দিলাম। যখন উনি বাড়িতে এসেছিলেন- বাসায় বসে থাকতেন। বের হবার ক্ষমতা ছিল না। উনি থরথর করে কাঁপতেন। পা দুটো কাঁপত। দাঁড়াবার ক্ষমতা ছিল না। খেতেও খুব কষ্ট হতাে। ডিসেম্বরে যখন যুদ্ধ শুরু হয়, তখন উনি মােনাজাত শুরু করলেন যাতে দেশটা স্বাধীন হয়। তারপর কীভাবে আপনার সাথে বেগম মুজিবের দেখা হলাে ? ১৭ ডিসেম্বর সকাল বেলা ফজরের নামাজ পড়ে আমার মামাতাে ভাই আবুল ইলিয়াস মজিদ,উনি তখন ব্রিটিশ কোম্পানি এভারি স্কেলের চিফ ইঞ্জিনিয়ার। এখন আটলান্টায় থাকেন। ওনার গাড়ি করে ভাবি যেখানে বন্দী আছে সেটা খুঁজে খুঁজে সেখানে গেলাম। ধানমণ্ডির ১৮ নাম্বার রােডে। তাে আমার মাথায় টুপি,মুখে দাড়ি গাড়ি থেকেই নেমে গেটের কাছে যেতেই [আর্মির গার্ড বলে মাত আও’। ১৭ ডিসেম্বর ? হ্যা ১৭ ডিসেম্বর। তখনও পাকিস্তান আর্মি ওনাদেরকে অবরুদ্ধ করে রেখেছে। Oh My God, ১৭ ডিসেম্বর! হ্যা বিজয়ের পরের দিন। তাে আমি ভয়ে পিছিয়ে আসলাম। খানিক দূরে আসলে দেখি এম.ই চৌধুরী সি.এস.পি আর হাতেম আলী খান চিফ ইঞ্জিনিয়ার ওনারা হেঁটে যাচ্ছেন মনিং ওয়ার্ক করে। ওনাদের দুজনকে আমি চিনতাম। আমাকে দেখে বলেন করছেন কী, কাল বিকালে এখানে দুজনকে গুলি করে মেরেছে।’ তখন আমি চলে আসলাম। ভাইকে সাথে করে সাকিট হাউসে ঢুকলাম। সেখানে দেখি একজন মেজর জেনারেল (নাম) গনজালভেস। ওনাকে বললাম মুজিব ভাই এর Family in serious conditionarmy may kill her at any time’ তথন উনি একজন শিখ জেনারেলের সাথে কথা বললেন। Two star, না three star জেনারেল মনে নেই। দুজন আলােচনা করে,জেনারেল গনজেলভেস আমাকে বললেন, “তােমার গাড়ি আছে ?’ আমি বললাম, ‘আছে, আমার ভাই গাড়ি নিয়ে নিচে বসে আছে।’ তিনি বললেন, ‘আমাকে এয়ারপাের্টে নিয়ে চল।’ ওনাকে নিয়ে এয়ারপাের্টে আসলাম। এয়ারপাের্টে এসে উনি মেজর রাজা বলে একজনের সাথে কথা বললেন। তার সাথে তিনজন সিপাই দিয়ে আমার সাথে ওনাকে আসতে বললেন। মেজর রাজাকে আমার সাথে পাঠালেন, বেগম মুজিবকে রেসকিউ করার জন্য। আর এক ভদ্রলােক ওনাকে গাড়ি অফার করল। দুই গাড়িতে আমরা আসলাম। আপনি কি পেছনের গাড়িতে ছিলেন ? মেজর রাজা আমাদের গাড়িতে ছিলেন। আমার মামাতাে ভাইয়ের গাড়ি। তাহলে আপনার ইনিশিয়েটিভেই বেগম মুজিব ছাড়া পেলেন। আপনিই মেজর জেনারেল গনজালভেসের সাথে সার্কিট হাউসে দেখা করলেন এবং উনি মেজর রাজাকে বললেন আপনার সাথে যেয়ে মুক্ত করতে। | হ্যা মেজর রাজা। অথচ সেদিনই পেপারে দেখলাম লিখেছে মেজর অশােক তারা। (বাংলাদেশ প্রতিদিন, ২ জুলাই, ২০১২। হতে পারে মেজর রাজার অন্য নাম ছিল অশােক তারা। পত্রিকাটিতে হাজী গােলাম মােরশেদের নাম ও অবদান অনুল্লেখিত)। মেজর রাজাকে নিয়ে আপনি ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর রােডে গেলেন ? হা। ওনার কোমরে একটা মাত্র গ্রেনেড, হাতে কোনাে অন্ত্র নেই। ওনার সিপাইদের হাতে অন্ত্র আছে। সিপাইদের পেছনের গাড়িতে রাখলেন। উনি একাই হেঁটে গেটের কাছে গেলেন। যেয়ে ওদের সাথে কথা বললেন। তখন ওরা টার্ম দিল যে আমাদের আর্মস-অ্যামুনেশন নিয়ে | যদি চলে যেতে দাও। তাহলে আমরা কিছু করব না। না হলে সব ম্যাসাকার করে দিয়ে যাব।’
ওদের কাছে ছােট মাইক্রোবাস ছিল- মেজর রাজা বললেন, ঠিক আছে, তােমরা আর্মসঅ্যামুনেশন নিয়ে চলে যাও।’ তখন ওরা আমস-অ্যামুনেশন নিয়ে পাঁচ-সাতজন ছিল, চলে | গেল। [পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্দেশপ্রাপ্ত ছিল যে তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের কোনাে ক্ষতি করবে কিন্তু বিজয়ের পর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে দ্রুত গৃহবন্দি দশা হতে মুক্তির উদ্যোগ ও মুক্ত করার ব্যাপারে হাজী গােলাম মােরশেদের অবদান অনস্বীকার্য। তারপর ভেতরে ঢুকে কী দেখলেন ? দেখলাম সবাই বসে আছে। হাসু বসে আছে, রেহানা বসে আছে, তারপর রাসেল বসে আছে। | বড় দুই পুত্র শেখ কামাল ও শেখ জামাল পালিয়ে ভারতে চলে গিয়েছিলেন থােকা ভাই আছেন খােকা ভাই কে ? খােকা ভাই হচ্ছেন হাসুর মামা। থােকা ভাইকে বললাম- (যে অফিসার বঙ্গবন্ধু পরিবারকে মুক্ত করল তাকে যেন সম্মান দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়)। হাসু হচ্ছেন শেখ হাসিনা ? হ্যা। ভাবিকে আমি সালাম করলাম। এরপর সম্ভবত শমসের মুবিন চৌধুরীর মা বাড়িতে | ঢুকলেন। তিনি দেখা করে চলে গেলেন আমি চলে আসলাম। চাচা, মুজিব কাকু যখন ফিরে আসলেন- মুক্ত হলেন পাকিস্তান কারাগার থেকে তখন আপনি | আবার ফিরে গেলেন ওনার সাথে কাজ করতে ? | হ্যা। ১০ জানুয়ারি ওনাকে যে ট্রাকে আনা হলাে, সে ট্রাকের পেছনে আমি পা ঝুলিয়ে আসলাম। পথে উনি পিপাসায় কাতর হলেন। তখন রেডিও অফিসের সামনে দৌড়ে- সাইফুল বারী বােধহয় ওখানের স্টেশন ম্যানেজার, তার কাছ থেকে একটা জা ও পানি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে খাওয়ালাম। এরপরে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে মিটিং করে, বক্তৃতা করে বঙ্গবন্ধু সামনে বসলেন, আমি পিছনে বসলাম। ঐ একই গাড়িতে ধানমণ্ডির বাসায় আসলাম। এরপরে ডেইলি আমি যেতাম। বঙ্গবন্ধু Oath (প্রধানমন্ত্রী পদে) নিলেন, সেখানেও গেলাম। তারপর একুশে জানুয়ারি আমি বার্লিনে চিকিৎসার জন্য গেলাম। সেই জাহাজে ক্যাপ্টেন ডালিম, মেজর আমিন আহমেদ চৌধুরী, মেজর হারুর অর রশীদ, লেফটেনেন্ট শমসের মবিন চৌধুরী (তাদের সাথে একই জাহাজে বার্লিনে চিকিৎসার জন্য | গেলাম। আমার চিকিৎসা হয়ে গেল, ওরা বলল, তােমার এখানে তিনমাস থাকতে হবে। রেস্ট নিতে হবে।’ তখন আমার মন আর টানে না। আমি শুনলাম বঙ্গবন্ধু রাশিয়ায় আসছেন। তাে ওদেরকে বলে মস্কোতে চলে আসলাম বাই ট্রেন। থার্ড অথবা ফোর্থ মার্চে আমি মস্কোতে পেীছলাম। শামসুর রহমান (খান) তখন ওখানে অ্যাম্বাসেডর। এয়ারপাের্ট থেকে আমাকে রিসিভ করে ওনার ওখানে নিয়ে গেলেন। তারপর বঙ্গবন্ধুর সাথে টুর করলাম। লেনিগ্রাদ-স্ট্যালিাদ এসব জায়গায় গেলাম। বঙ্গবন্ধু ও আমি একই কমপ্লেক্সে থাকতাম। আমরা তখন বােধহয় লেনিন্যাদে, ঐ সময় বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে এন্টারপ্রাইজ (ইউ,এস,এস) থেকে সামান্য দূরে (সােভিয়েত) সাবমেরিন ছিল— যদি কোনােভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ইন্টারফেয়ার করত (মার্কিন যুদ্ধ নৌবহর) এন্টারপ্রাইজ ডুবিয়ে দিত (সােভিয়েত সাবমেরিন)। ইউ.এস.এস এন্টারপ্রাইজের কথা বলছিলেন উনি। হ্যা সে বিষয়ে রাশিয়ার তাে একটা প্রস্তুতি ছিল। তারপর আপনি যখন ফিরে আসলেন দেশে। তখন কবে থেকে কাজে লাগলেন ? আমি যখন ফিরে আসলাম তখন প্রতিদিন গণভবনে যেতে থাকলাম। বঙ্গবন্ধুর সাথে ওঠা বসা করতাম। এরপরে বােধহয় মার্চের লাস্ট উইকে Honorary Aide to the Prime Minister এই একটা গেজেট নােটিফিকেশন করে অ্যাপয়েনমেন্ট দিল। তৌফিক ইমাম তখন কেবিনেট সেক্রেটারি । তারপর ঐ যেতাম, কাজ করতাম, লােকের সুখ-দুঃখের কথা শুনতাম। তখন প্রত্যেক শহীদ ফ্যামিলিকে দু হাজার টাকা দেওয়া হতাে। সেটার চেক লেখা হতাে, সই হতাে। বঙ্গবন্ধু সই করার সময় পেতেন না। আমি রাত এগারােটা-বারােটার সময় বাসায় যেয়ে ওগুলাে সই করে নিয়ে আসতাম। এরপরে রেডক্রসের মাধ্যমে চিঠিপত্র আসত, পাকিস্তানে যারা আটকে আছে তাদের। সাহায্যের জন্য আবেদন আসত। তাদের চিঠিপত্র নিয়ে আমি ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারিকে দিতাম। বাংলাদেশ রেডক্রস থেকে Disabled freedorn fighters rehabilitation institute করেছিল, এখন সেটা রেডক্রসের হেডকোয়ার্টার, ঐ বিল্ডিংটাতে আমার অফিস ছিল। আপনার প্রত্যাশা কী ? আপনার স্বপ্ন কী ?
আমার স্বপ্ন Justice and Fairness. আর আমার একটা ফর্মুলা আছে, যে ফর্মুলার। প্রথম ইনস্ট্রাকশনটি বঙ্গবন্ধু সই করেছিলেন। একটা গেজেট নােটিফিকেশন হয়েছিল, Order number one one four, dated 24th May, 1972 সেটা এই সি,এস,পি- সেক্রেটারিরা। স্যাবােটাজ করেছে সেটা হারিয়েই ফেলেছে। তার প্রথম লাইনটা হচ্ছে : সকল পত্রের ও আবেদনের প্রাপ্তি স্বীকার করিতে হইবে। অফিসে কোনাে ফাইল পিয়ন-চাপরাশি বহন করিবে না। Relevant officials will take and give it to the relevant officers within seventy two hours. Section officer- (and) Assistant Secretary within forty eight hours, the Deputy Secretary- (and) Joint Secretary within twenty four hours and the Secretary will dispose all the files.
সেটা পাস হয়েছিল ? অর্ডার ইস্য হয়েছিল কিন্তু ইমপ্লিমেন্ট হয়নি- এক্সিকিউট হয়নি। কিন্তু স্যাবােটাজড হয়েছে নু ঃযবংব নর্ধপৎধঃং আমরা কারাে রেসপেক্ট নষ্ট করতে চাইনি, আমরা কারাে পজিশন নষ্ট করতে চাইনি। আমরা সাধারণ মানুষ। এখন প্রত্যেক গর্ভমেন্ট অফিসের সামনে লিখে দেওয়া উচিত মানুষকে হয়রান, অপমান ও ঘুষ সংগ্রহ কেন্দ্র। রিঃযবৎ ভব িবীপবঢ়ঃরড়হং এইসব ঘটনা ঘটছে। শাসন করবে কে? পলিটিশিয়ান কি আর পলিটিশিয়ান আছে- সে ট্রেডার হয়ে গিয়েছে। আমার কিছু পজিটিভ প্রােপােজাল ছিল বঙ্গবন্ধুর কাছে- ঐড়ঃড় হু ঃযব মড়াবৎহসবহঃ- যড়ঃড় ঃধপশষব ঃযব ঢড়ষরঃরপধষ ঢ়ড়পবংং, একজন মেম্বার অব পার্লামেন্ট কী করবে আর কী করবে না। ডেভেলপমেন্টের সাথে একজন পলিটিক্যাল লিডারের কানেকশন থাকা উচিত। কিন্তু সবাই আশা করে। যে এম. পি সাহেব রাস্তা করে দেবে। কিন্তু রাস্তা করা তাে এম.পি সাহেবের কাজ না। এম.পি সাহেবের কাজ হচ্ছে এড় মরাব ংড়পরধষ ংঃরপব ধহফ ধরহবংং সে তাে আইন প্রণেতামড়ড়ফ মড়াবৎহধহপব রহঃড়পব করার জন্য তার সৃষ্টি।
পঁচাত্তরে বাকশাল গঠনের আগেই আপনি কাজ ছাড়লেন ?
তার আগেই আমি কাজ ছেড়ে দেই। আমি চুয়াত্তরের শেষের দিকে গণভবনে যাতায়াত বন্ধ করে দিলাম। রিজাইন করেছিলাম আমি ২৫শে জুন, তিয়াত্তরে। কিন্তু উনি (বঙ্গবন্ধু সেটা একসেপ্ট করেননি। আমি তখন টঙ্গি চলে গিয়েছিলাম। উনি ফোন করে বললেন “তুই যদি না আসিস, আমি ডি.আই.জি দিয়ে তােকে অ্যারেস্ট করিয়ে নিয়ে আনব। তাে আমি চলে আসলাম।
তারপর বললাম, ‘আমি এসে কী করব ? আপনি তাে আমার কোনাে কথা শুনবেন না। আমার কথা শুনতেন কিন্তু করতেন না এবং যাদের দিয়ে করাতেন, তারা করতে চাইত না।
তাদের দিয়ে করাতে পারতেনও না। বুরােক্র্যাসি ওনাকে টোট্যালি ঘিরেছিল। এই বুরােক্রাসির ভেতরে আমি Total anti people force পেয়েছি। মানুষের প্রতি কোনাে রেসপেক্ট নেই, লাড [ভালােবাসা নেই, মর্যাদা দেওয়ার ইচ্ছাও নেই এবং অন্যকে মর্যাদাহীন করতে পারলেই তারা এনজয় করে। ফরাসউদ্দীনও (ড. মােহাম্মদ ফরাসউদ্দীন- বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ১৯৭৩-১৯৭৫) পি.এস ছিলেন। কিন্তু তিনি দ্র ও সােবার ছিলেন। He was not an anti people force. কিন্তু কিছু করতে পারতেন না। পরে পুলিশ সার্ভিস থেকে আই.জি আব্দুর রহীম সাহেব আসলেন সেক্রেটারি হয়ে। He was a good man. তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে কি দেখা হতাে ? হ্যা, দেখা হতাে- তাজউদ্দীন ভাই ছিলেন Behind the scene real কারিগর of our liberations. But for Tajuddin- বঙ্গবন্ধু কখনােই দেশকে এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে নিয়ে যেতে পারতেন না। তাজউদ্দীন ভাইয়ের ধীরতা এবং গঠন করবার শক্তি এবং বঙ্গবন্ধুর আইডিয়াকে সেইপে নিয়ে আসার যে প্রক্রিয়া- তাজউদ্দীন ছিলেন এক্সট্রা অর্ডিনারি। এক্সটা অর্ডিনারি। আল্লাহ বঙ্গবন্ধুকে তাজউদ্দীন দিয়েছিলেন। লিবারেশন ওয়ারের সময় তাজউদ্দীনকে আমীর-উল ইসলাম দিয়েছিলেন।
আমীর কাকুই তাে সে রাতে আল্লুকে জোর করে বাড়ি থেকে বের করেন- আব্ব যদি বাসায় থাকতেন আব্বকে তাে মেরেই ফেলত- আব্ব ছিলেন ডেথ লিস্টে। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে বলেছিলেন হাজী সাহেব, আবুল হাশিম সাহেব যদি বেঙ্গল মুসলিম লীগের সেক্রেটারি না থাকতেন, আবুল হাশিম সাহেবের কাজ, ফিলসফি, মিশন যদি আমাদের সামনে না থাকত, তাহলে আমরা সবাই কমিউনিস্ট হয়ে যেতাম।’ ব্রিটিশ আমলের কথা তিনি বলছিলেন। আমার লাইফে ছােট ছােট টুকরাে ঘটনার সাথে আমি জড়িত আমি অনেক কিছু জেনেছি- শুনেছি কিন্তু তার কোনাে সাক্ষী নেই। কিন্তু আপনি ইতিহাসের কত বড় সাক্ষী।
কিন্তু আমি যে সর্বনাশও করেছি। জিয়াউর রহমানের জন্য পােস্ট ক্রিয়েট করেছি। করে তাকে প্রমােশন দিয়েছি। That post was created on my Insistency, on my request. Deputy Chief of Staff OCHI কোন সালে? সেভেন্টি টু। আমাকে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বলল, ‘নানা আমাকে বঞ্চিত করেছে (জেনারেল) ওসমানী সাহেব আমাকে দেখতে পারেন না বলে।’ জিয়াউর রহমান বললেন? | হ্যা। বললেন, ‘আপনি বিচার করে দেন। আমি বিচার করতে গেলাম- বঙ্গবন্ধুকে যেয়ে বললাম যে এই হয়েছে- এই হয়েছে জিয়াউর রহমানকে বঞ্চিত করা হয়েছে- ওনার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘দাঁড়া, দাঁড়া- থাম-থাম। তারপর ডেপুটি চিফ অব স্টাফের পােস্ট ক্রিয়েট করে বঙ্গবন্ধু ওনাকে বসিয়ে দিলেন। আমাকে বললেন, “তুই নাছােড়বান্দা যা ধৰি ছাড়বি না।’ জিয়াউর রহমান পরে আপনাকে দেখতে এসেছিলেন ? জিয়াউর রহমান- আমি সেভেন্টি সিক্সে কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলাম, আমাকে অ্যারেস্ট করেছে। কার কবর জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন?
বঙ্গবন্ধুর মাজার। টুঙ্গিপাড়ায়। তখন জিয়াউর রহমানের গভর্নমেন্ট। সেভেন্টি সিক্সের ১৫ আগস্ট সকালে আমাকে ধরে নিয়ে ফরিদপুরের জেলে পুরে পনেরাে দিন পচাল। রােকেয়া মােরশেদ : পনেরাে দিন নয়- আঠারাে দিন। আমি ওদেরকে (পুলিশ) জিজ্ঞেস করেছিলাম কেন ধরেছেন? ওনার কি কোনাে দোষ ছিল ? বলল, না। উনি জিয়ারত করতে গিয়েছিলেন। আমরা না করায় উনি জিয়ারত করেননি। কিন্তু আমরা। ওনাকে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য ধরেছি।’ বিনা অপরাধে- জিজ্ঞাসা করার জন্য ওনাকে ধরল। আঠারাে দিন ফরিদপুরের জেলে ! এই হচ্ছে জিয়াউর রহমানের প্রতিদান ! এই হচ্ছে জাতির জনকের মাজার জিয়ারত করার অপরাধ ! বলদা গার্ডেন থেকে যে ফোনটা এসেছিল ওটার মানে কী ছিল? মেসেজ, মানে ওয়্যারলেস পাঠানাে হয়ে গিয়েছে ! কী মেসেজ পাঠানাে হয়েছিল ? সেটা তাে জানি না। কিন্তু সে মেসেজ লিবারেশন ছাড়া আর কী হতে পারে ? আপনার লাইফের সিগনিফিক্যান্ট মুহুর্ত কী ? ডিউরিং সােহরাওয়ার্দী টাইম। তার সাথে যখন আমি থেকেছি তিনি একটা কথা বলেছিলেন যে এমন একটা সময় আসে যখন সব স্ট্রিট লেবারার টু দ্য টপ অব দ্য কান্ট্রি একই সময়ে। একই কথা ভাবে, একই চিন্তা করে ঠিক রেডিও ওয়েভ লেন্থের মতাে, তখুনি দেশ মুক্ত হয়।’ বাহ! কোন সালে একথা বলেছিলেন ? এটা বলেছিলেন ফিফটি থ্রি-ফিফটি ফোরে। সে সময় আমি একজন কর্মী ছিলাম। চৌদ্দ বছর বয়স থেকে আমি রাজনীতির সাথে জড়িত। উনিশশাে পঁয়তাল্লিশ সালে রশীদ আলী ডে অ্যাটেনড করেছি কোলকাতায়। (নেতাজি সুভাষ বােসের আজাদ হিন্দ ফৌজের ক্যাপ্টেন রশীদ আলী পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পক্ষে সমর্থন দেন। আজাদ হিন্দ ফৌজে যুক্ত থাকার অভিযােগে ব্রিটিশ সরকার তাকে বন্দী করলে ওনার মুক্তির দাবিতে ভারত ব্যাপী আন্দোলন হয়।) উনিশশাে ছেচল্লিশ সালে পাকিস্তান ইস্যুর ওপর ইলেকশনে আমরা কাজ করেছি। উনিশশাে সাতচল্লিশ, আটচল্লিশ, ঊনপঞ্চাশ, পঞ্চাশে আমি মুসলিম ছাত্রলীগের সাথে জড়িত ছিলাম। উনিশশাে আটচল্লিশ সালে ঢাকার রাস্তায় রাষ্ট্র ভাষার পক্ষে প্রসেশন করেছি। যশাের ডিসট্রিক্ট মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের সেক্রেটারি ছিলাম। বায়ান্নতে রাষ্ট্র ভাষা সংগঠনের কনভেনর ছিলাম। তিপান্নতে যশাের ডিস্ট্রিক্ট বাের্ডের মেম্বার ইলেক্টেড হই এবং ইস্ট পাকিস্তানে I was the youngest member elected to the district board. এর পর ফিফটি থ্রিতে আমরা মুসলিম লীগের সংস্পর্শ ত্যাগ করি। যুক্রন্ট ইলেকশনে ঝাপিয়ে পড়ি। এই যুক্তফ্রন্ট ইলেকশনের সময় আমি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর খুব নিকট সান্নিধ্যে আসি। তিনি আমাকে নিয়ে সব টুর করতেন। তিনি ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিশন করেছিলেন ক্যান্ডিডেটদের পপুলারিটি যাচাই করার জন্য। প্রফেসর
——————-
পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন ও বাংলা ভাষাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতির দাবীতে ঐক্যবদ্ধ। প্রগতিশীল ও অসামপ্রদায়িক যুন্টের নেতৃত্বে ছিলেন কৃষক শ্রমিক পার্টির নেতা শেরে বাংলা এ. কে ফজলুল হক, আওয়ামী মুসলিম লীগের (অসাম্প্রদায়িক চেতনার প্রতিক হিসেবে ১৯৫৫ সালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ নাম করণ হয়) নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, নিজাম-এ-ইসলাম পার্টির নেতা মাওলানা আতহার আলী এবং গণতন্ত্রীদলের নেতা হাজী মহম্মদ দানেশ এবং মাহমুদ আলী সিলেটি। ঐ নির্বাচনে (৮ মার্চ, ১৯৫৪) পূর্ব পাকিস্তানের চিফ মিনিস্টার মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমিন হেরে যান এবং পূর্ব পাকিস্তানে। মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। যুজফ্রন্ট হয় জয়যুক্ত।
নূরুর রহমানও ছিলেন। পরে তিনি সােহরাওয়ার্দী ক্যাবিনেটের স্টেট মিনিস্টার (অর্থ প্রতিমন্ত্রী ) হন। তাকে আর আমাকে নিয়ে উনি একটা ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং কমিটি করে দেন। আমরা ঈশ্বরদী, নাটোর, বগুড়া, এসব বিভিন্ন জায়গায় ফ্যাক্টস ফাইন্ডিং করতাম। অনেক সময় আওয়ামী লীগের সাপাের্টার বাদ পড়ে যেত। কে,এস,পির (শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক প্রতিষ্ঠিত কৃষক শ্রমিক পাটি) সাপাের্টার নমিনেশন পেয়ে যেত। (উদাহরণস্বরূপ পাবনায় আওয়ামী লীগের প্রফেসার হামিদ বাদ পড়ে যান এবং কেএসপির মাওলানা গফুর নমিনেশন পান।) এর জন্য কেউ কেউ আমাদের ওপর অসন্তুষ্ট হতেন। সােহরাওয়ার্দী সাহেব খুব জাস্ট মানুষ ছিলেন। অথচ একটা কলংক আছে যে হি ওয়াজ অ্যা কমিউনাল। ফিফটি থ্রি থেকে সিক্সটি থ্রি পর্যন্ত আমি তার সাথে কাজ করেছি। হি ওয়াজ অ্যা টোটালি সেকুলার ম্যান। অথচ ওনাকে কলঙ্কিত হতে হলাে- বড় দুর্ভাগ্য। এখন যে বাংলাদেশ দেখছেন- আপনার কী প্রত্যাশা ? কিছু বলার আছে ? আমার বক্তব্য হচ্ছে I am a born politician but I do not do politics. আমি মনে করি politics is a trust and politicians are trustees.আজকে সাধারণ মানুষ সকাল থেকে পিয়নের হাত থেকে শুরু করে সেক্রেটারি পর্যন্ত প্রত্যেকের হাতে লাঞ্ছিত, অপমানিত,শােষিত এবং অত্যাচারিত। তাদের কারাে কোনাে স্বাধীনতা নেই। যে কোনাে পর্যায়ের আমলা, পিয়ন, চাপরাশি, তফসিলদার, যুগ্ম সচিব, সচিব, চেয়ারম্যান, সরকারি কর্মচারী প্রথমে সাধারণ মানুষকে হয়রানি করে, তারপর অপমান করে, তারপর ঘুষ খায়, with very few exceptions, তা হলে মানুষ স্বাধীন হলাে কী করে? এখন Government of the servant, for the servant and by the servant চলছে। আমি সেখানে নিজের নাম লিখতে পারব না। আমার একাশি বছর বয়স। My days are numbered- যেখানে বিবেকের দংশন আর এত অসম্মান সেখানে পলিটিকস করা যায় না। সেদিনের সুদীর্ঘ সাক্ষাঙ্কারটি হাজী গােলাম মোেরশেদ শেষ করলেন আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে- “তুমি আসলে যে আমার মনে হচ্ছে এই গত সাইত্রিশ বছরের মধ্যে আজকের দিনটা আমার জন্য সবচেয়ে বড়দিন।। হাজী গােলাম মােরশেদের সাক্ষাৎকাটি গ্রহণ করতে গিয়ে আমিও হয়ে উঠছিলাম আবেগ আপুত। ওনারা যে বাংলাদেশের জন্য আজীবন সংগ্রাম করেছেন সেই লক্ষ্য থেকে আমরা আজও কত দূরে! বাংলাদেশের রাজনীতিতে ও প্রশাসনে সৎ মানুষের নেতৃত্ব খোজা যেন মরুভূমিতে মরীচিকার পেছনে ছুটে বেড়ানাের মতােই। ওনার স্মৃতিচারণার মধ্যে দিয়ে আমি ফিরে দেখছিলাম অদেখা যুগকে অবিস্মরণীয় কালের সকাল সন্ধ্যাকে। আজকের যুগে বিরল এমন নিবেদিত রাজনৈতিক কর্মী ও ব্যক্তিত্বকে হয়তাে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করবে ও তাদের আদর্শকে অনুসরণ করবে। ভিডিও সাক্ষাৎকার। শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২। আনুষঙ্গিক তথ্য যা পরে হাজী গােলাম মােরশেদের কাছ থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে (কোস্তারিকা হতে ঢাকায় টেলিফোন সাক্ষাঙ্কার। বৃহস্পতিবার, ১৬ আগস্ট, ২০১২) তার কিছু অংশ সাক্ষাঙ্কারের মধ্যে ব্র্যাকেটে উল্লেখিত হলাে।

সাংবাদিক জহিরুল হকের সাক্ষাৎকার
সাবেক রিপাের্টার মার্নিং নিউজ
আদি নিবাস খুলনা, বাংলাদেশ
১৯৭৩ অথবা ‘৭৪ সালে বাজারে ২টাকা স্ট্যাম্পের তীব্র সংকট দেখা দেয়। কালােবাজারিরা স্ট্যাম্পের কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে। ২ টাকার স্ট্যাম্প ৫০ থেকে ১০০ টাকায় বিক্রি করত। এরকম সময়ে তাজউদ্দীন সাহেবের পিআরও (পাবলিক রিলেশনস অফিসার) আব্দুল আউয়াল সাহেব আমাকে মর্নিং নিউজ অফিসে ফোন করে বলেন যে মন্ত্রী সাহেব এক জায়গায় যাবে। উনি আপনাকে সঙ্গে নিতে চান। আমি রিপাের্টার হিসেবে তাজউদ্দীন সাহেবের অনেক অনুষ্ঠান কভার করতাম। সেজন্য আউয়াল সাহেব আমাকে ভালাে জানতেন। তাজউদ্দীন সাহেবও আমাকে পছন্দ করতেন। আমি নিউজ এডিটরকে জানালাম যে মন্ত্রী সাহেবের সঙ্গে এক জায়গায় যেতে হবে। উনি সঙ্গে সঙ্গেই অনুমতি দিলেন। তাজউদ্দীন সাহেব, ওনার প্রাইভেট সেক্রেটারি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব, এসপি ও ডিসিসহ আমরা ঢাকা কেটে গেলাম। প্রথমে আমরা সচিবালয়ে গিয়েছিলাম। আমার সঙ্গে বাসস ও বিসিআই-এর সাংবাদিকরাও ছিলেন। সচিবালয় থেকে। তাজউদ্দীন সাহেবসহ ঢাকা কোর্টের চত্বরে। সেখানে মহুরিরা বসে দলিল লেখে ও স্ট্যাম্প বিক্রি করে। তাজউদ্দীন সাহেব সরেজমিনে দেখতে এসেছিলেন যে সত্যি স্ট্যাম্পের সংকট রয়েছে। কিনা। উনি আড়ালে দাড়িয়ে আমাকে বললেন যে আপনি বিক্রেতার কাছে যেয়ে ২ টাকার স্ট্যাম্প চান। আমি ওনার কথা অনুযায়ী বিক্রেতার কাছে ২টাকার স্ট্যাম্প ঢাইতেই সে বলল যে স্ট্যাম্প নেই। সেই মুহূর্তেই তাজউদ্দীন সাহেব সেখানে উপস্থিত হয়ে বিক্রেতাকে বললেন। স্ট্যাম্পের বাক্স খুলুন দেখি।’ বিক্রেতা ঘাবড়িয়ে বাক্স খুলতেই দেখা গেল যে বাক্স ভর্তি ২ টাকার স্ট্যাম্প। তাজউদ্দীন সাহেব তখন আমাকে বাদী করে বিক্রেতার বিরুদ্ধে কেইস করলেন। কিন্তু পরে জানতে পারি যে তৎকালীন পাট প্রতিমন্ত্রী মানিকগঞ্জের মােসলেহউদ্দীন সাহেবের হস্ত। ক্ষেপে তার আত্মীয় বিক্রেতা রেহাই পেয়ে যায়।
(ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার, ১৪ এপ্রিল, ২০১০। ১লা বৈশাখ, বাংলা নববর্ষ Polo India Club Restaurant, Dupont Cincle Washington DC, U.S.A) মনে হয় ‘৭৩ সাল সেটি। কালিয়াকৈরে, তাজউদ্দীন সাহেব কৃষি ব্যাংকের শাখা উদ্বােধন। করলেন। শামসুল হক সাহেবও সেখানে ছিলেন। উনি তখন প্রথম সারির একজন নেতা। যতদূর মনে পড়ে তিনি সমবায় মন্ত্রীও ছিলেন। শাখা উদ্বোধনের পর খবর এল যে কে বা কারা দুইজনকে গাছের সঙ্গে বেঁধে গুলি করে হত্যা করেছে। তাজউদ্দীন সাহেব তৎক্ষণাৎ আমাকে, প্রেস ইনফর্মেশন ডিপার্টমেন্টের একজন ফটোগ্রাফার ও কয়েকজন সাংবাদিকসহ ঢাকায় ফিরে
আসার পথে নিহতদের দেখতে যান। গুলিবিদ্ধ লােক দুটি তখনাে গাছের সঙ্গেই বাঁধা। তাদের ফটোসহ হত্যাকাণ্ডের খবর মর্নিং নিউজে ছাপা হয়েছিল। শ্রমিক লীগের অন্তদ্বন্দ্বের কারণেই ওই দুটি নির্মম হত্যাকাণ্ড ঘটে। | ২৬ অক্টোবর ১৯৭৪ সালে তাজউদ্দীন সাহেব রিজাইন করেন। ওইদিন দুপুরে, আমি কাজ থেকে বাসায় এসে বিশ্রাম করে প্রেসক্লাবের দিকে রওয়ানা হই। আমি শান্তিবাগ থেকে প্রেসক্লাবে যাওয়ার পথে তাজউদ্দীন সাহেবের পিয়নের সঙ্গে দেখা হয়। পিয়ন বলে যে আমার স্যার আজকে রিজাইন করেছেন।’ কথাটি শুনে আমি প্রেসক্লাবে না গিয়ে বিকেল চারটার দিকে, ওনার হেয়ার রােডের সরকারি বাসায় পেীছি। সেখানে যেয়ে দেখি তাজউদ্দীন সাহেব খুব ভালাে মুডে সবার সঙ্গে কথাবার্তা বলছেন। ওনার পাশে রাশিয়ার সাবেক রাষ্ট্রদূত, কালিয়াকৈরের শামসুল হক সাহেব, ড. কামাল হােসেন ও আরও ক’জন বসা। কিছুক্ষণ পর ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ ও বাসস-এর এক সাংবাদিক আসলেন। মওদুদ আহমেদ হেসে বললেন তাজউদ্দীন সাহেব, চলেন আমরা একসঙ্গে ল ফার্মে ল প্র্যাকটিস করি।’ সেদিন তাজউদ্দীন সাহেবের খুশিভরা চেহারা দেখে মনে হয়নি যে উনি এতবড় পদ থেকে সদ্য রিজাইন করেছেন। (১৪ এপ্রিল, ২০১০। ওয়াশিংটন ডিসি) কুখ্যাত চারাচালানদার ম্যানসেরু মিয়া (কোড নাম] সম্পর্কে সরেজমিনে তদন্ত করার জন্য তাজউদ্দীন সাহেব চিটাগাং এ যান। তাজউদ্দীন সাহেব আমাকে সঙ্গে আসতে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। কিন্তু আমি যেতে পারিনি, কারণ আমাকে গণপূর্তায়ন মন্ত্রী মতিউর রহমানের দুটি মিটিং কাভার করতে হয়েছিল। একই হেলিকপ্টারে তাজউদ্দীন সাহেব ও মতিউর রহমানসহ আমরা প্রথমে নােয়াখালীর রায়পুরায় যাই। আমাদেরকে সেখানে নামিয়ে দিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব চিটাগাং-এ চলে যান।
(১৩ জুলাই, ২০১০)
—————
* কাস্টমসের সহকারী কালেক্টর আব্দুল লতিফ সিকদার তার নথিপত্র যুক্ত রিপাের্টে উল্লেখ করেন যে তাজউদ্দীন আহমদের সরেজমিনে পরিদর্শনের ফলে চোরাচালানীর বিরুদ্ধে কেসটা গুরুত্ব পায় এবং বিশেষ তদন্তের মাধ্যমে অসাধারণ কেসের প্রেক্ষিত তৈরি করে ও পরিণতি লাভ করে। ঐ কেসে নেপথ্য ব্যক্তিবর্গ জড়িত থাকার সত্য উদঘাটিত হয়। উল্লেখিত বিষয়ে ওনার বিস্তারিত বিবরণ হতে পৃ. ৪০-৪৩ সিমিন হােসেন রিমির লেখা ‘আমার ছােটবেলা ১৯৭১ এবং বাবা তাজউদ্দীন আহমদ’ গ্রন্থে (প্রতিভাস, ২০০১, ছয় পরিশিষ্ট) অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।

সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের বংশাবলি ও পারিবারিক ইতিহাস
আম্মার পিতৃকুল সম্বন্ধে তথ্য নানা বেঁচে থাকতে ওনার কাছ থেকে শুনে লিপিবদ্ধ করি। নানার সব ভাইয়ের ও একমাত্র বােনের পুরা নাম ও বাড়ির ঠিকানা নানার কনিষ্ঠ ভাইয়ের পুত্র সৈয়দ আনওয়ার হােসেনের কাছ থেকে সংগ্রহ করি। নানার পুরা নাম সৈয়দ সেরাজুল হক। জন্ম ইংরেজি ১৮৯৩ সাল, বাংলার বৈশাখ (মে-জুন) মাসে। জন্মস্থান : কুমিল্লা (বর্তমান চাদপুর)। ঠিকানা : সৈয়দ বাড়ি; গ্রাম : আজাগড়া; পােস্ট অফিস : ওয়ারুক; থানা : হাজীগঞ্জ (বর্তমান : শাহারাস্তি)। নানা কোলকাতার ইসলামিয়া কলেজ থেকে স্বর্ণপদকসহ আরবিতে বিএ অনার্স পাস করেন। জ্ঞানের সাধক নানা ইংরেজি ও ফারসি ভাষা এবং সাহিত্যেও কৃতিত্বের স্বাক্ষর রাখেন। বিএ পাস করার পর তিনি কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাস্টার্স ক্লাসে ভর্তি হন এবং কিছুদিন ইসলামিয়া কলেজে অধ্যাপনা করেন। পরবর্তী সময়ে ঢাকা কলেজ থেকে অধ্যাপক হিসেবে অবসর গ্রহণ করেন। নানার সবচাইতে বড় ভাইয়ের নাম সৈয়দ আবদুল হক। খুব সম্ভবত ওনার পরেই এক বােন জন্মগ্রহণ করেন। নাম সৈয়দা রাবেয়া খাতুন। উনি অত্যন্ত পরহেজগার ছিলেন এবং তরুণ বয়সে। মৃত্যুবরণ করেন। নানা তৃতীয় সন্তান, ভাইদের মধ্যে দ্বিতীয়। তৃতীয় ভাই সৈয়দ ফজলুল হক। চতুর্থ ভাই সৈয়দ তাহেরুল হক। পঞ্চম ভাই সৈয়দ শামসুল হক (শামু), এবং যষ্ঠ ভাই সৈয়দ মাহফুজুল হক (মাফু)। আমাদের শামু নানা সৈয়দ শামসুল হক ওনার এলাকায় ব্রিটিশবিরােধী প্রতিরােধ আন্দোলনের একজন অগ্রণী নেতা ছিলেন। ব্রিটিশবিরােধী তৎপরতার জন্য তাঁকে। বহুদিন পলাতক জীবন যাপন করতে হয়। যত দূর মনে পড়ে, ওনার সাথে আমার প্রথম সাক্ষাৎ ১৯৭০ সালে। উনি নানাকে দেখতে আমাদের সাতমসজিদ রােডের বাসায় এসেছিলেন। নানার মতােই উনি ৬ফিট লম্বা ছিলেন। ওনার মেদহীন পেটানাে শরীর, বাবরি চুল, ও তারুণ্যের দীপ্তিময় চোখ দেখে মনেই হতাে না উনি একজন বর্ষীয়ান মানুষ।
আমার প্রপিতামহ, নানার পিতার নাম সৈয়দ মওলানা আব্দুল মজিদ। ওনার ভাইয়ের নাম হাফেজ সৈয়দ মহম্মদ।
ওনাদের পিতার নাম : হাজি সৈয়দ মওলানা জালালউদ্দীন। প্রপিতামহ : হাজি সৈয়দ মওলানা ফোরকান। প্র-প্রপিতামহ : হাজি সৈয়দ মওলানা আব্দুল করিম। উনি তৎকালীন কুমিল্লা জেলার ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন। প্রবাদ আছে যে চালের একটি দানার মধ্যে তিনি সুরা ইখলাসের আয়াত লিখতে পারতেন। মওলানা আব্দুল করিমের (ওনার পিতা ও পিতামহর নাম জানা যায়নি), প্রপিতামহের নাম মওলানা হাজি সৈয়দ আহমেদ তানুরী। ওনার জন্ম ও আদি বাসস্থান বাগদাদে। হজরত বড় পীর সাহেব, সৈয়দ আব্দুল কাদের জিলানী (রহ.) বংশধর। নানার কাছ থেকে উপরােক্ত তথ্য সংগ্রহ করার পর বাকি তথ্য ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মওলার কাছ থেকে সগ্রহ করি। ওনার পূর্বপুরুষ সম্বন্ধে ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত একটি খবরের কাটিং উনি ফাইল করে রেখেছিলেন। সেখান থেকে আমি হাতে কপি করি। ছােট মামার সূত্রমতে নােয়াখালির কাঞ্চনপুরে ওনাদের পূর্বপুরুষ সুফি সাধক সৈয়দ আহমেদ তানুরীর মাজার রয়েছে। উনি দিল্লির সুলতান ফিরােজ শাহ্র আমলে ইরাক থেকে ভারত উপমহাদেশে আসেন। সাধারণের মধ্যে তিনি মীরান শাহ নামে পরিচিত ছিলেন। ইত্তেফাক পত্রিকার খবরে (তারিখবিহীন) প্রকাশিত হয়েছিল যে নােয়াখালি জেলার রামগঞ্জ থানাধীন কাঞ্চনপুরের মাজার শরিফে হজরত শাহ সৈয়দ আহমদ তনুরীর (সামান্য ভিন্ন বানান) এবং তদীয় ভগ্নি সৈয়দা সালেহা মধুমা খাতুনের ওরশ মােবারক আগামী ১১ অগ্রহায়ণে অনুষ্ঠিত হবে। আম্মার মাতৃকুল সম্বন্ধে প্রায় সব তথ্য ও ইতিহাস আম্মার মামাতাে বোেন সৈয়দা রােকেয়া বেগমের কাছ থেকে সংগ্রহ করি আশির দশকের প্রথমার্ধে। পরবর্তী সময়ে আম্মা ও পরিবারের অন্যান্যরা আরও কিছু তথ্য যােগ করেন। আম্মার মামাতাে ভাই সৈয়দ আবু তাহেরের পুত্র সৈয়দ মাসহুদ বাদশাহ, ও মামাতাে বােন সৈয়দা রােকেয়া বেগমের পুত্র সৈয়দ আবু সালেহ মহম্মদ মুজতবা (রনি), আম্মার খালাতাে বােন মােসাম্মাৎ তালে আফরােজের (পেয়ারা) পুত্র কাজী ওবায়দুল কবীর (ম), আমার ছােট বােন সিমিন হােসেন রিমি এবং ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মাওলার জ্যেষ্ঠা ও কনিষ্ঠা কন্যা রােকসানা ওয়াদুদ (মুন্নী) ও সৈয়দা রেজওয়ানা হকের (সীমা) কাছ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। আমার নানি সৈয়দা ফাতেমা খাতুন ছিলেন পিতামাতার সর্বকনিষ্ঠ সন্তান। জন্ম ১৯০৪। (পরিবারের ইতিহাস লেখার সময় যাদের জন্মসাল জানা গিয়েছে বা কাছাকাছি অনুমান করা গিয়েছে শুধু তাদেরটাই তাদের নামের পর উল্লেখ করা হলাে।) জন্মস্থান : ফুলবাড়ি, দিনাজপুর। নানির পিতা সৈয়দ গােলাম মােস্তফার জন্ম আনুমানিক ১৮৬২ সালে, হুগলির ইমামবাড়ার জমিদার পরিবারে। তিনি ছিলেন সে যুগের প্রথম বাঙালি মুসলিম MBBs ডাক্তারদের একজন। কোলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে তিনি ডাক্তারি পাস করেন। এই উপমহাদেশে সেকালে হাতেগােনা যে কজন ডাক্তার সার্জারিতে স্পেশালিস্ট ছিলেন তিনি তার মধ্যে একজন। শুধু চিকিৎসক হিসেবেই তিনি প্রসিদ্ধ ছিলেন না, শিক্ষানুরাগী ও দানশীল হিসেবেও তিনি জনসমাজের শ্রদ্ধা ও ভালােবাসা অর্জন করেন। উনি ২০০ বিঘার ওপরে জমি স্কুলের জন্য দান করেন। দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে প্রতিষ্ঠিত এস. জি. মােস্তফা স্কুল (১৯২০) এখনাে তার স্মৃতি বহন করছে। | ওনার ছােট আরও দুই ভাই ছিলেন। মধ্যম ভাই লন্ডন থেকে ব্যারিস্টারি (Bar-at-Law) ডিগ্রি অর্জন করে রংপুরের মুন্সি পাড়ায় স্থায়ী হন। কনিষ্ঠ ভাই ব্যারিস্টার হয়ে লন্ডনে স্থায়ী হন, দেশে আর ফেরেননি। সৈয়দ গােলাম মােস্তফার প্রথম বিয়ে হয় রংপুরে কামারকাছনার জমিদার কন্যার সাথে । বিয়ের পর একটি কন্যা জন্মগ্রহণ করে এবং স্ত্রী মৃত্যুবরণ করেন। কন্যার নাম ছিল সৈয়দা খাতুন। প্রথম স্ত্রীর মৃত্যুর পর তিনি দ্বিতীয় বিয়ে করেন সম্রান্ত পরিবারের কন্যা বদরুননেসাকে। এই ঘরে তাদের প্রথম পুত্র জন্মগ্রহণ করেন, নাম সৈয়দ আবদুর রব (১৮৯০) দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ আব্দুর রউফ (১৮৯১) তৃতীয় পুত্র সৈয়দ আব্দুল লতিফ চতুর্থ পুত্র সৈয়দ আব্দুল সামাদ
পঞ্চম পুত্র সৈয়দ আব্দুল কাশেম
ষষ্ঠ সন্তান কন্যা সৈয়দা রাবেয়া খাতুন (১৯০২)
সপ্তম ও কনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা ফাতেমা খাতুন (১৯০৪)
আমার নানি ছিলেন সকলের নয়নের মণি। সবচেয়ে ছােট বলে বাবা, মা, বড় ভাই ও বােনেরা অত্যন্ত আদর ও আহ্লাদ করতেন। আদর করে সকলে তাকে ফাতু বলে ডাকতেন। ওনার বড় দুই ভাই সৈয়দ আব্দুর রব ও রউফ পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলায় দুই বােনকে বিয়ে করেন। বিয়ের পর আব্দুর রব সন্ন্যাসী হয়ে গৃহত্যাগ করে বিহারে চলে যান। বহু যুগ পর তিনি সংসারে প্রত্যাবর্তন করেন এবং জীবনের শেষ সাত বছর নানির কাছে অবস্থান করেন। ওনার ঘরে ফিরে আসার নেপথ্য কাহিনি হলাে যে তিনি ৩৭ বছর স্রষ্টার উপাসনা ও ধ্যানে মগ্ন থাকার পর গায়েবি আওয়াজ আসে, ‘তুমি পেছনে কী ফেলে এসেছ?’ উনি স্ত্রী ও মা’কে পেছনে ফেলে এসেছিলেন। গায়েবি প্রশ্নটির কারণে তিনি গৃহে প্রত্যাবর্তন করেন। প্রবাদ আছে যে তিনি অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন। প্রবাদগুলাে এমন তিনি বাঘের পিঠে করে ফুলবাড়িতে ফিরে আসেন। ঝড় তুফানের সময় নদীর ওপর জায়নামাজ বিছিয়ে মানুষজনের পারাপারের ব্যবস্থা করেন। নানি ওনার আরও কিছু অলৌকিক ক্ষমতা প্রত্যক্ষ করেন কিন্তু উনি কারাে কাছে বলতে মানা করায় উনি বেঁচে থাকা পর্যন্ত নানি কারাে কাছে প্রকাশ করেননি। আব্দুর রব প্রয়ােজন না হলে কথা বলতেন না। অধিকাংশ সময় ইশারায় ভাবের আদান-প্রদান করতেন। নানির হাতের সুজির হালুয়া ও চা ওনার প্রিয় খাবার ছিল। নানির দ্বিতীয় ভাইয়ের নাম সৈয়দ আব্দুর রউফ। ওনার পুত্রের নাম সৈয়দ আবু তাহের (১৯১৫)। পুত্রবধূ (পঞ্চম ভাইয়ের জ্যেষ্ঠ কন্যা) সৈয়দা জাহানারা বেগম। | তৃতীয় ভাই সৈয়দ আব্দুল লতিফের একমাত্র পুত্রের নাম সৈয়দ আব্দুল মােত্তালিব। পুত্রবধূ সৈয়দা রােকেয়া বেগম (পঞ্চম ভাইয়ের তৃতীয় কন্যা)। আব্দুল মােত্তালিব শিশু অবস্থায় মাতৃহারা হন। আমার নানি ওনাকে স্তন্য পান করান এবং নিজ সন্তানের ন্যায় লালন-পালন করেন। আব্দুল মােত্তালিব কোলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে বিএ পাস করেন। তিনি District Controller of Food পদে কর্মজীবন অতিবাহিত করেন। নানির চতুর্থ ভাইয়ের নাম সৈয়দ আব্দুস সামাদ। উনি দিনাজপুরে বিয়ে করেন। ওনার একমাত্র পুত্রের নাম সৈয়দ শাহ আলম। পঞ্চম ভাই সৈয়দ আব্দুল কাশেম বিয়ে করেন গাইবান্ধার মেয়ে আকলিমা খাতুনকে। ঐ ঘরে ছয় সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জ্যৈষ্ঠ পুত্রের নাম সৈয়দ আবু তালেব (জন্ম : ১৯১৭) দ্বিতীয় সন্তান জ্যেষ্ঠ কন্যা সৈয়দা জাহানারা বেগম (জন্ম : ১৯১৯)। তৃতীয় সন্তান মেজ কন্যা সৈয়দা হােসনে আরা বেগম (জন্ম : ১৯২২) চতুর্থ সন্তান তৃতীয় কন্যা সৈয়দা রােকেয়া বেগম (জন্ম: ১৯২৬) পঞ্চম সন্তান চতুর্থ কন্যা সৈয়দা দেলওয়ারা বেগম (জন্ম : ১৯৩৬) ষষ্ঠ সন্তান কনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা রওশন আরা বেগম (রুশু) (জন্ম: ১৯৩৮) প্রথম
আবুল কাশেম দ্বিতীয় বিয়ে করেন বারকনা ফুলবাড়ি, দিনাজপুরে। স্ত্রীর নাম ঘােষ। এই ঘরে তিন সন্তান জন্মগ্রহণ করে :
পুত্র সৈয়দ গিয়াসুদ্দীন আবু কালাম (বাবু) সৈয়দ জালালউদ্দীন আবু জামাল (সেলিম) ও সর্বকনিষ্ঠ সন্তান কন্যা সৈয়দা আঞ্জুমান আরা (রেবা)। নানির বড় বােন সৈয়দা রাবেয়া খাতুনের বিয়ে হয় বগুড়ায় মুন্সেফ সৈয়দ আব্দুল লতিফের সাথে।
ওনাদের জ্যেষ্ঠ পুত্রের নাম সৈয়দ আব্দুল মােজাফর; দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ আবদুর রাজ্জাক। ও সর্বকনিষ্ঠ কন্যা সৈয়দা মােসাম্মৎ তালে আফরােজ (পেয়ারা ১৯১৮)। ওনার স্বামীর নাম কাজী মজিদুন নবী (১৯১০)। নানি সৈয়দা ফাতেমা খাতুন ও নানা সৈয়দ সেরাজুল হকের পাঁচ সন্তান জন্মগ্রহণ করে। জ্যেষ্ঠ পুত্র সৈয়দ গােলাম কিবরিয়া (২০ এপ্রিল ১৯২০)। উনি ব্রিটিশ সরকারের Kings Commission থেকে Captain পদ লাভ করেন। কবি, লেখক ও নাট্যকার হিসেবে সুপরিচিত ছিলেন। চট্টগ্রাম বেতারে উনি ছােটদের আসর পরিচালনা করতেন এবং বেতারে শিল্পকলা ও সাহিত্য আসরেও যােগ দিতেন। দ্বিতীয় সন্তান জ্যেষ্ঠ কন্যা সৈয়দা হাসিনা খাতুন, গৃহবধূ (১৯২২)। তৃতীয় সন্তান দ্বিতীয় পুত্র সৈয়দ গােলাম মর্তুজা (১৯২৪)। ব্যবসায়ী। ইনিও সাহিত্য অনুরাগী ছিলেন ও নিভৃতে কাব্যচর্চা করতেন। চতুর্থ সন্তান তৃতীয় পুত্র সৈয়দ গােলাম মাওলা (১ অক্টোবর ১৯২৯)। ব্যবসায়ী। সাহিত্য অনুরাগী এবং চিত্রাঙ্কনে পটু ছিলেন। ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মাওলার সাথে ছােট মামি (বরিশালের উলানিয়া জমিদার পরিবারের কন্যা) সৈয়দা কামরুন নেসার বিয়ে হয় ১৯৫৩ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি। বিয়ের সময় ছােট মামুর বয়স ২৪ বছর এবং সদ্য চাকরিতে যােগ দিয়েছেন। পঞ্চম সন্তান, সর্বকনিষ্ঠ কন্যা আমার আম্মা সৈয়দা জোহরা খাতুন (২৪ ডিসেম্বর ১৯৩২, জন্মস্থান : পুরাতন ঢাকা)। মহিলা পরিষদের প্রাক্তন ভাইস প্রেসিডেন্ট, জাতীয় নেতৃত্বের চরম সংকটের সময় তিনি আহ্বায়িকা (এপ্রিল, ১৯৭৭) হিসেবে আওয়ামী লীগের হাল ধরেন এবং এই দলকে পুনরুজ্জীবিত করেন। আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়ামের সদস্য। আব্বু ও আম্মার বিয়ে ১৯৯২ সালে আম্মা যখন যুক্তরাষ্ট্রে আমার কাছে বেড়াতে আসেন তখন আমি আম্মার সাক্ষাৎকারের (১০ নভেম্বর ১৯৯২ বেলা ৩-৩০ ঘটিকা) মাধ্যমে আলু-আম্মার বিয়ের কাহিনি লিপিবদ্ধ করি। এই লেখাতে প্রায় দুই যুগ আগে লিপিবদ্ধ করা আম্মার বিশদ সাক্ষাৎকার থেকে আল্লু ও আম্মার প্রথম পরিচয়ের দিন এবং বিয়ের দিনটি সম্পর্কে কিছু তথ্য সংক্ষিপ্ত আকারে উল্লেখ করা হলাে। আমার জন্ম হবার দিনটি ঘিরে আম্মা যে স্মৃতিচারণা করেছিলেন তা-ও সংক্ষেপে উল্লেখ করা হলাে। আম্মার ঘনিষ্ঠ বন্ধু অনু খালা ও ওনার স্বামী ইসলাম সাহেব ছিলেন আল্লু ও আম্মার বিয়ের ঘটক। ১১ এপ্রিল অনু খালা আম্মার একটি খোঁপা করা সাইড থেকে তােলা ছবি আন্ধুকে দেখিয়েছিলেন। আম্মার সাথে আব্দুর প্রথম দেখা ১৯৫৯ সালের ১৪ এপ্রিল। ১ বৈশাখ, বাংলার নববর্ষের দিনটিতে। সাক্ষাতের স্থান, বংশালে অনু খালা ও ইসলাম সাহেবের বাসায়। আম্মা যখন ঐ বাড়িতে প্রবেশ করেন, আন্ধু তখন বাইরের উঠানে চেয়ারে বসে ইসলাম সাহেবের সাথে টেবিলে রাখা ভাত ও ড়ামাছের চচ্চড়ি খাচ্ছিলেন। আব্দুর পরনে ছিল হাওয়াই শার্ট। আম্মা হাতে কাজ করা একটি থ্রিকোয়ার্টার ব্লাউজের সাথে সাদা সুতির শাড়ি পরেছিলেন। আব্বু ও আম্মার যখন বিয়ের কথা চলছে তখন বড় মামু আব্দুর গ্রামের এক প্রভাবশালী ব্যক্তির কাছে আব্দুর সম্বন্ধে খোঁজ করেন। সেই ব্যক্তি আব্দুর স্বভাব-চরিত্র সম্বন্ধে ভূয়সী প্রশংসা করেন। পরে জানা যায় যে সেই ব্যক্তি ছিলেন আব্দুর বিরােধী দলের। আব্বর সাথে তার সম্পর্কও ভালাে ছিল না। তা সত্ত্বেও ঐ ব্যক্তি তার রাজনৈতিক ও ব্যক্তিগত বিরােধকে পাশে হটিয়ে আব্দু সম্বন্ধে সত্য বলতে দ্বিধা করেননি। | ২৬ এপ্রিল, রােববার, রাত ৮টায় আলু ও আম্মার বিয়ে পড়ানাে হয়। আম্মার ইচ্ছা অনুযায়ী আম্মার জন্য একরাশ বেলী ফুলের গয়না আব্দু বিয়ের দিন এনেছিলেন। সেই বেশী ফুলের গয়না পরেই আম্মার বিয়ে হয়। বিয়ের আগে আম্মা আব্বকে বলেছিলেন, ‘আমার সােনার গয়নার দরকার নেই। আমি বেলী ফুল ভালোবাসি। তা দিয়েই আমার বিয়ে হােক।’ সমাজের কিছু আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা রীতি ও সংস্কারকে ওনারা সেদিন চূর্ণ করে দেন, হৃদয়ের মিলনকে প্রাধান্য দিয়ে। | বিয়ের স্থান : কাজি বাড়ি, মগবাজার। ১৯৫৬ সালে ঢাকা কলেজের অধ্যাপনা থেকে অবসর গ্রহণের পর নানা পরিবারসহ মগবাজার বিলের উল্টো দিকের বিশাল গাছপালায় হাওয়া এই বাড়িটি ভাড়া করেন। খালাতাে ভাই সাঈদ ভাই এই বাড়ির নতুন নামকরণ করেন স্বপ্নদ্বীপ। এই বাড়িতেই আমার জন্ম।
মেহমান : ৫০-৬০ জন। অধিকাংশই আত্মীয়স্বজন। আব্দুর সাথে এসেছিলেন ছােট কাকু, দলিল ভাই ও আনার আপা।
আব্দুর বন্ধুদের মধ্যে ডাক্তার করিম কাকু বরযাত্রী হয়ে এসেছিলেন। বিয়ে খুব অল্প সময়ের মধ্যে ঠিক হওয়ায় বেশি মানুষকে দাওয়াত দেওয়া সম্ভব হয়নি। বিয়ের খাবার : খাসির বিরিয়ানি, মুরগির রােস্ট, কাবাব ও মিষ্টি। নানি যেমন রান্নায় পারদর্শী ছিলেন, নানাও কোনাে অংশে কম ছিলেন না। বিয়ের খাবার রাঁধা হয়েছিল নানার রেসিপি অনুযায়ী ও নানার তত্ত্বাবধানে।
২৮ জুলাই ২০১১: আমার জন্মদিনটির স্মৃতিচারণা। আমি যুক্তরাষ্ট্র থেকে বাংলাদেশে আম্মাকে টেলিফোন করি। আম্মা বললেন, “এই কদিনের মধ্যেই রােজার মাস শুরু হবে। তােমার কথা খুব মনে পড়ছে। তােমার জন্ম হয়েছিল। ১ রােজার দিন। তুমি জন্মাবার পর তােমাকে দেখে তােমার আব্দুর সে কী আনন্দ! আঁতুড়ঘরে তােমাকে নিয়ে সারারাত কাটালেন।’ নানা-নানির ইচ্ছা ছিল যে ওনাদের বাড়িতে আমি জন্মগ্রহণ করি। আমি জন্মাবার ৫/৬ দিন আগে আম্মা কারকুন বাড়ি লেন থেকে মগবাজারে নানা-নানির কাছে চলে যান। কাজের পর আব্ব প্রতিদিন আম্মাকে দেখতে মগবাজারে চলে আসতেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় আম্মাকে দেখতে এসে আব্দু সে রাতে থেকে গেলেন।
ডা, খােদেজা সরকারের তত্ত্বাবধানে পরদিন ১ রমজান ২৯ ফেব্রুয়ারি (১৯৬০) সােমবার ভাের ৬টায় আমি ভূমিষ্ঠ হই। সপ্তাহ খানেক পর নবজাতককে নিয়ে আম্মা কারকুন বাড়ি লেনে ফিরে আসেন। আম্মা যেন সেই সময়ে ফিরে গিয়েছেন এমনি এক আবেগ ভরা কণ্ঠে বললেন, “তােমার আব্দু সাইকেলে বেঁধে একটি সাদা দোলনা তােমার জন্য নিয়ে এসেছিল। তােমার জন্য সেই সাদা দোলনা কিনে তােমার আব্দুর খুব গর্ব। আমি ঠাট্টা করে বলতাম, ভারি তাে এক দোলনা এনেছ মেয়ের জন্য, তাই নিয়ে এত ! আমার ঠাট্টা শুনে তােমার আব্ব খুব অভিমান করলেন। সেই দোলনায় তুমি শুতে আমরা দুজনে দোলা দিতাম। তােমার মুখে যখন একটি দুটি বুলি ফুটছে তােমার আব্দুর সে কী আনন্দ!’
জেল হত্যাকাণ্ড এক দুঃসহ সময়ের স্মৃতিচারণ
১৯৭৫ সালের ৪ নভেম্বর সন্ধ্যায়- জেল কর্তৃপক্ষ, ৩ নভেম্বরে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার অভ্যন্তরে নিহত, তাজউদ্দীন আহমদের লাশ, ভাগ্নে (বড় বােন সুফিয়া খাতুনের পুত্র) মুক্তিযােদ্ধা আবু সাঈদের (শাহিদ) কাছে হস্তান্তর করেন। সেই দুঃসহ সময়ের স্মৃতি ও তথ্য যুক্তরাষ্ট্র হতে, বাংলাদেশে শাহিদ ভাইয়ের সাথে টেলিফোন সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে লিপিবদ্ধ করি । নিজ পিতার নির্মম হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কোনাে সাক্ষাৎকার, তথ্য ও বিবরণ লিপিবদ্ধ ও সংগ্রহ করা সুকঠিন কাজ। তার পরও এক রক্তঝরা ইতিহাসের বেদনাদায়ক পর্বটিকে উম্মুক্ত করতে হয়েছে ভবিষ্যতের কথা ভেবে। জাতীয় ইতিহাসের এক কলঙ্কিত অধ্যায়, এই জেল হত্যাকাণ্ড ও আরও ঘটে যাওয়া নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের যাতে পুনরাবৃত্তি না হয়, সে জন্য দরকার সত্য ইতিহাস জানা। অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার মতাে শক্তি অর্জন করা। জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে সম্মিলিতভাবে সহায়তা করা। আমি শুধু একজন পিতাকেই হারায়নি, হারিয়েছি এক অনন্য মানুষকে। জাতি হারিয়েছে ভবিষ্যতের দিক-দিশারী, সত্য ও ন্যায়ের প্রতীক, বিশ্ব দৃষ্টিসম্পন্ন এক বিশাল নেতাকে। ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক মহান নেতার আবির্ভাব তখনই সম্ভবপর হবে, যখন আমরা আন্তরিকভাবেই প্রচেষ্টা নেব অতীতকে জানার ও সুযােগ্য মানুষ ও নেতার জীবনাদর্শ হতে শিক্ষা নেওয়ার। আবু সাঈদ : আমি সে সময় মিরপুর ৬ নম্বরে জনতা ব্যাংকে চাকরি করি। নভেম্বরের ৪ তারিখ, দুপুর ১২টার দিকে আমার ম্যানেজার আমাকে বললেন যে জেলখানায় পাগলা ঘণ্টি বেজেছে। বড় মামার (তাজউদ্দীন আহমদ) কাছে শুনেছিলাম যে জেলে পাগলা ঘণ্টি বাজা বিপদের সংকেত। তখন আমি ওখান থেকে সােজা ধানমণ্ডিতে মামির কাছে যাই। ওনাকে পাগলা ঘন্টি বাজার কথা বলি। মামি আমার কথা শুনে চুপ করে থাকলেন। এরপর আমি ওই ধানমণ্ডির সেন্ট্রাল রােডে রহমত আলী (শ্রীপুর আওয়ামী লীগের নেতা) সাহেবের বাসায় গেলাম ঘটনা জানতে। ওনাকে বাসায় পেলাম না। ওনার ওয়াইফকে জিজ্ঞেস করলাম, উনি কোথায় ? উনি বললেন যে রহমত আলী সাহেব মাহবুব আলম চাষীর বাসায় গিয়েছেন। (চারতলা বাসা) নিচতলায় বন্ধু মিজানের সঙ্গে দেখা। সে-ও জানতে এসেছে। তার হােভায় চড়ে, তাকে নিয়ে গেলাম নাজিমউদ্দীন রােডে, জেলের ডাক্তার মায়েনুদ্দীন সাহেবের বাসায়। উনি আমাদের গাজীপুর এলাকার লােক। আমার সঙ্গে আগে থেকেই পরিচয় ছিল।
উনি তখন বাজারে গিয়েছেন। আমরা ওনার জন্য অপেক্ষা করতে থাকলাম। উনি বাজার থেকে ফিরে, আমরা অপেক্ষা করছি দেখা সত্ত্বেও বাজারের ব্যাগ নিয়ে সােজা ভেতরে ঢুকে গেলেন। অন্যদিন হলে উনি আপ্যায়ন করাতেন, কুশলাদি জিজ্ঞেস করতেন। যাই হােক, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর উনি দেখা করলেন। আমি গত রাতে জেলে পাগলা ঘন্টি বাজার
ব্যাপারে ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম। উনি বললেন, ‘আমিও শুনেছি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “আপনি গতকাল জেলে ডিউটিতে যাননি? উনি বললেন, ‘না, যাইনি।’ আমি জিজ্ঞেস করলাম, “কেন যাননি?’ উনি অনিচ্ছাসহকারে জবাব দিলেন, “আমি ছুটিতে ছিলাম।’ ওনার উত্তর দেওয়ার ধরন শুনে মনে হলাে উনি কিছু লুকাচ্ছেন। আমরা চলে আসার সময় উনি গম্ভীরভাবে বললেন, ‘জেলে একটা কিছু ঘটেছে, পরে জানতে পারবেন। ওনার কাছ থেকে সঠিক কোনাে উত্তর না পেয়ে আমি খুব রাগান্বিত হয়ে চলে এলাম। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। বড় মামার বাসায় এসে শুনি। জেলহত্যার খবর জানাজানি হয়ে গিয়েছে। এরই মধ্যে মােহাম্মদপুর থানার ওসি বড় মামার বাসায় এসে খবর দিলেন যে, জেলখানায় আত্মীয় গেলে কর্তৃপক্ষ তার কাছে লাশ হস্তান্তর করবে। তখন আমি ওসির গাড়িতেই জেলে গেলাম। আমার সঙ্গে অন্য কেউ ছিল না। সন্ধ্যা ৭টার দিকে জেলখানায় পৌছি। সেখানে কামরুজ্জামান সাহেবের ভাই ইতি সাহেবের সঙ্গে দেখা হয়। উনি জানালেন যে উনি সম্মতি দিয়ে এসেছেন যে ওনার (কামরুজ্জামান) লাশ রাজশাহীতে দাফন করা হবে। সেই অনুযায়ী হেলিকপ্টার দিয়ে লাশ রাজশাহীতে নেওয়া হয়।
মামার লাশ হস্তান্তরের আগে জেল কর্তৃপক্ষ আমাকে জিজ্ঞেস করে যে জানাজা কোথায় হবে ? আমি বললাম যে, লাশ প্রথমে বাসায় নেব, তারপর ঠিক হবে কোথায় জানাজা হবে। তারা তখন বঙ্গভবনে ফোন করে। তাদের বহুক্ষণ সময় লাগে অনুমতি পেতে। একসময় কর্তৃপক্ষ আমাকে বলে যে আপনি চলে যান। আর বলে যান কোথায় দাফন হবে, আমরা সেখানেই লাশ পাঠিয়ে দেব।’ কিন্তু আমি নাছােড়বান্দা। বললাম যে, আগে লাশ হস্তান্তর করেন। তারপর কোথায় দাফন হবে সে বিষয়ে আমরা সিদ্ধান্ত নেব।’ সন্ধ্যা ৭টা হতে প্রায় মধ্যরাত পর্যন্ত আমি জেলগেটের সামনে বসা। ওই রাতের পরিবেশ ছিল যুদ্ধের সময়ের মহড়ার মতাে জনমানবশূন্য, নীরব, নিস্তব্ধ। রাত ১১টার দিকে জেলগেটের সামনে বিডিআর-এর মেজর আতাউর রহমানের সঙ্গে দেখা হয়। উনি আমার দিকে এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি তাজউদ্দীন সাহেবের কী হন?’ আমি বললাম, ‘ভাগ্নে হই। উনি বললেন, আমাকে চিনতে পারছেন? আমি ইপির (তাজউদ্দীন আহমদের সহােদর মফিজউদ্দীন আহমদের কন্যা) মামা। আমি জেলগেটে পাহারায় আছি।’ আমি বললাম যে জেল কর্তৃপক্ষ বঙ্গভবনে ফোন করছে। লাশ হস্তান্তরের জন্য ক্লিয়ারেন্স নিচ্ছে। আমার ভয় হচ্ছে মাঝপথে কেউ আবার লাশ নিয়ে যায় কি না। মেজর আতা আশ্বস্ত। করলেন। বললেন, ‘অসুবিধা হবে না। আপনি লাশ নিয়ে যেতে পারবেন। শেষ পর্যন্ত বহু দেরি করে, গভীর রাতে আমার স্বাক্ষর নিয়ে মামার লাশ হস্তান্তর করে ঢাকার সদর নর্থের এসডিওর পক্ষের একজন। ডিআইজি প্রিজনও সেখানে উপস্থিত ছিলেন। পুলিশসহ পুলিশের ট্রাকে লাশ নিয়ে যখন বাসায় ফিরি তখন গভীর রাত। বাসায় এসে কাউকে পাইনি। সে সময় লাশ নামানাের লােক পাইনি। হাই-এর বাবা (বারেক মিয়া) পাশের বাসায় লুকিয়ে ছিল। তাকে ডাকাডাকির পর সে আসে। লাশের পাশে আমি একা বসা। ফকির শাহাবুদ্দীনকে (এটর্নি জেনারেল) ফোন করলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গেই চলে আসলেন। উনি বললেন, “তুমি একা এখানে? আমি বললাম, “জি। উনি লাশ সংরক্ষণের জন্য বরফ ও চা-পাতার ব্যবস্থা করলেন। একজন লােক পাঠিয়ে দিলেন বরফ ও চা-পাতাসহ। প্রতিবেশীর বাসায় মামানি ছিলেন। ওনাকে খবর দিলাম। উনি সঙ্গে সঙ্গেই আসলেন। উনি যেন এক নিস্তব্ধ পাথরের মূর্তি। মামানির সেদিনের শােকাহত চেহারার বর্ণনা করা কঠিন। | ৫ তারিখ সকালে ডাক্তার করিম সাহেব আমার সামনেই মামার শরীরের গুলির ক্ষত দেখেন। আমি তাকাতে পারিনি। ময়েজউদ্দীন সাহেব এসে বললেন যে আমি বাধা দিচ্ছে। সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে তারা মামা ও জেলে নিহত নেতাদের লাশ দাফন করতে দেবে না। আব্দুল মালেক উকিল মামাকে শেষ দেখা দেখতে আসেন। তারপর ওনার সঙ্গে আমিও কাছেই মনসুর আলী
সাহেবের আত্মীয়ের বাসায় যাই। সেখানে মনসুর আলী সাহেবের লাশ রাখা হয়েছিল। মালেক উকিল সাহেব ওই আত্মীয়ের বেডরুম থেকে বঙ্গভবনে ফোন করেন। আমি শুনলাম যে উনি ফোনে বলছেন যে ‘খালেদ মােশাররফের কাছে আমাদের অনুরােধ, সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে আমরা একটু মাটি চাই এমন একজন মানুষের জন্য, যিনি দেশটাকে স্বাধীন করেছেন। তাজউদ্দীন সাহেবকে দাফনের জন্য একটু মাটি চাই।’ মালেক উকিল মামার কথাটি বিশেষভাবে উল্লেখ করলেন। বঙ্গভবন থেকে বলা হলাে ওনার ফোন নাম্বার দিতে। বলা হলাে যে ওনাকে কল ব্যাক করা হবে। মালেক উকিল বঙ্গভবন থেকে ফোনের অপেক্ষায় সেখানে রইলেন। আমি ওই সময় বড় মামার বাসায় চলে আসি। বাসায় পৌছে দেখি জানাজা বাদেই মামাকে বনানিতে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। আমি তখন দৌড়ে পুলিশের আইজি ও ডিআইজিকে বললাম যে মালেক উকিল বঙ্গভবনে কথা বলছেন, যাতে ওনাকে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে দাফন করা হয়। আমার কথা শুনে ওনারা ওয়্যারলেস হাতে করে পুলিশের জিপে উঠে আবাহনী মাঠের দিকে গেলেন । সে সময় ট্রাক থেকে মামার লাশ আমরা নিচে নামাই। আমগাছের নিচে মামাকে রাখার পর সেখানেই মেজ মামা বড় মামার জানাজা পড়ান। পুলিশের বাধায় ও ভয়ে বহু লোেকই বনানি গােরস্তানে যায়নি। আমরা বনানিতে পৌঁছার পর দেখি যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও মনসুর আলী সাহেবদের লাশ দাফন হয়ে গিয়েছে। এত বছর পরও যখন ওই ভয়াবহ দিনগুলাের কথা মনে হয়, তখন আমি নিজেকে সামলাতে পারি না। আমি ব্যক্তিগতভাবে শুধু একজন মামাকেই হারায়নি, আমি হারিয়েছি একজন মহান নেতাকে। মামা ছিলেন মুক্তিযুদ্ধের একক নায়ক। ওনার নেতৃত্বেই দেশ স্বাধীন হয়। ওনার দৃঢ় মনােবল ও নেতৃত্ব না থাকলে এত সহজে দেশ স্বাধীন হতাে না। তিরানব্বই হাজার পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীও আত্মসমর্পণ করত না। অথচ ওনার কোনাে মূল্যায়ন হয়নি। আওয়ামী লীগ। সরকার মুক্তিযুদ্ধের কথা বলতেই চায় না। আওয়ামী লীগ বলে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঘােষণায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। আর ওদিকে বিএনপি মনে করে জিয়াউর রহমানের ঘােষণায় দেশ স্বাধীন হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বলে যে একটি রাষ্ট্র গঠনের জন্য চারটি মৌলিক উপাদানের প্রয়ােজন। এক, হলাে ভূখণ্ড দুই. সার্বভৌমত্ব তিন, জনগণ ও চার, সরকার। বঙ্গবন্ধু বা জিয়াউর রহমান সরকার গঠন করে রাষ্ট্রকে পরিচালিত করেননি। বা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠন করেননি। সেই কৃতিত্ব তাজউদ্দীন আহমদের। তিনি ওই চারটি মৌলিক উপাদানের মধ্যে সমন্বয় ঘটিয়ে আমাদের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র উপহার দিয়েছিলেন। (সাক্ষাৎকার জুন ২৮, ৩০ ও ১৩ জুলাই, ২০১০)

তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি
উল্লেখিত আয়েরিগুলাে, সিমিন হােসেন রিমি সম্পাদিত, তাজউদ্দীন আহমদের ডায়েরি (প্রতিভাস। প্রকাশনা) হতে উল্লেখিত হলাে। বাংলায় অনূদিত ডায়েরির পাশে, তরুণ রাজনৈতিক কর্মী ও হাত্র আব্দুর স্বহস্তে ইংরেজিতে লেখা ডায়েরি উল্লেখ করা হলাে। ২৮ নভেম্বর ‘৪৭, শুক্রবার। ৬-১৫ মিনিটে উঠেছি। সকাল সােয়া ৭টা থেকে সাড়ে ৮টা পর্যন্ত পড়াশােনা করেছি। রাতে পড়াশােনা হলাে না। | সকালে নাঈমউদ্দিন সাহেব এলেন। তিনি কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করবেন। সাড়ে ১১টার দিকে শওকত সাহেব আমার কাছে এসে সাইকেলের দাম বাবদ নগদ ১০/- টাকা নিলেন। | বিকেল ৪টায় বলিয়াদি প্রেসে গিয়ে প্রুফ নিলাম। ৫টার দিকে কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। ওয়াদুদ সেখানে ছিল। শামসুল হুদা সন্ধ্যা পর্যন্ত এলেন না। আমি তার কাছে গেলাম এবং ৭টা নাগাদ তাকে নিয়ে এলাম। | কামরুদ্দিন সাহেব সরদার বাড়িতে গিয়ে কাদের সরদারকে আনলেন। আউয়াল ও সামসুজ্জোহাও তার সাথে এলেন। একজন ভদ্রলােকসহ ক্যাপ্টেন শাহজাহানও এলেন। এতিম ছাত্র ও এতিমখানার জন্য সবকিছু শামসুল হুদাকে করতে হবে। কামরুদ্দিন সাহেব আউয়াল সাহেব ও সামসুজ্জোহাকে সঙ্গে নিয়ে তফাজ্জল আলীর কাছে গেলেন। আমি রাত সাড়ে ৮টার। দিকে ফিরলাম। আজ থেকে খুব ঠান্ডায় ভুগছি। শরীর খারাপ সত্ত্বেও রাত ১২টা পর্যন্ত প্রুফ দেখলাম। ১২টার দিকে বিছানায় গেলাম। আবহাওয়া কিছুটা খারাপ।
বি. দ্র. আমি মনে প্রচণ্ড আঘাত পেলাম। হয়তবা প্রচণ্ডতর একটি, যখন দেখলাম কামরুদ্দিন সাহেবসহ কেউই এতিমখানার ছাত্রদের ব্যাপারে আগ্রহ দেখাচ্ছেন না। সামান্য একটু চেষ্টার পরিবর্তে ছেলেগুলােকে তাদের ভাগ্যের উপর ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। পঞ্চম শ্রেণীর প্রথম ও তৃতীয়, চতুর্থ শ্রেণীর প্রথম, অষ্টম শ্রেণীর ফার্স্টবয় এবং সপ্তম শ্রেণীর মেধাবী এবং কুশলী কারিগরি ছাত্রগুলাে, তাদের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনাকে হারাবে। এসব দরিদ্র এতিম ছেলেদের জন্য কেউ এতিমখানার ক্ষমতাধর দ্রলােকদের সঙ্গে ঝগড়া করতে এগিয়ে আসবে বলে মনে হচ্ছে যদিও অতীতে এমন দেখা গেছে আমরা কালু, নূরুল হুদা ও আফতাবউদ্দিন ভূইয়া এবং অন্যদের জন্য গুরুত্বহীন বিষয়ে কত চেষ্টাই না করেছি। আমরা সংসদীয় রাজনীতির জন্য সময় দিতে পারি। কিন্তু যখন এসব ছেলেদের জন্য কিছু করতে চাই তখন সময়ের প্রশ্ন আসে। এ
ক্ষেত্রে আমরা আমাদের বিবেক ও স্বার্থের সাথে প্রতারণা করছি। আমাদের সব ভালাে ভালাে কথা জনগণকে ধোঁকা দেওয়ার জন্য। নির্দোষ ছেলেরা ! আমরা ভালােভাবেই জানি তাদের জন্য কিছুই করতে পারব না। ২৯ জানুয়ারি ‘৪৮, বৃহস্পতিবার সকাল সাড়ে ৬টায় ঘুম থেকে উঠেছি। সাড়ে ৭টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত পড়াশােনা করেছি। তারপর আর পড়াশােনা হলাে না। মখদুমী লাইব্রেরির হিসাব মেটানাের জন্যে সকাল সাড়ে ৭টার দিকে নাঈমউদ্দিন সাহেব। এলেন। তিনি কিছুক্ষণ পরে চলে গেলেন। | বিকেল সাড়ে ৩টায় নাজির লাইব্রেরিতে গিয়ে মহিউদ্দিনকে পেলাম না। সাড়ে ৫টা পর্যন্ত সেখানে অপেক্ষা করলাম।
৬টায় বসিরউদ্দিনের কাছে গেলাম, তারপর টাইম হলাে। ঘড়ি তখনাে মেরামত হয়নি। শনিবার যেতে হবে। সন্ধ্যে ৭টায় পুনরায় নাজির লাইব্রেরিতে এলাম, কিন্তু মহিউদ্দিনকে পাওয়া গেল না। সাড়ে ৭টায় মেসে ফিরলাম। ৯টায় বিছানায় ঘুমাতে গেলাম। আবহাওয়া স্বাভাবিক। ৩০ জানুয়ারি, ৪৮, শুক্রবার সকাল ৭টায় ঘুম থেকে উঠে ১০টা পর্যন্ত পড়াশােনা করলাম। তারপর আর কোনাে পড়াশােনা হয়নি। ১টার সময়ে নাঈমউদ্দিন সাহেবের একটি স্লিপ পেলাম। তিনি ২০টি টাকা চেয়েছেন। তাঁর জন্য ২০ টাকার একটি চেক দিয়েছি। পৌনে পাঁচটায় ফজলুর রহমান এবং হাবিবুল্লাহকে সঙ্গে করে বের হলেন। লীগ অফিসে কিছুক্ষণ থেমেছি। মুজিব, শওকত, কালু, নুরুল হুদা সেখানে উপস্থিত ছিলেন। ৫-৩০ মিনিটে সেখান থেকে বেরিয়ে এলাম। ফজলুর রহমান এবং হাবিবুল্লাহ চলে গেল। হজরত আলীকে সঙ্গে করে ডা, করিমের কাছে এলাম। সেখানে ৭টা পর্যন্ত ছিলাম। সেখান থেকে সন্ধ্যে ৭টা ১৯ মিনিটে বসিরউদ্দিনের কাছে গেলাম। তার কাছ থেকে লেখার কপি নিলাম না। সন্ধ্যা ৭-৪৫ মিনিটে কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে ক্যাপ্টেন শাহজাহান সাহেবের বাসায় এলাম। সেখানে জলিলকেও দেখলাম। আহা কি দুঃখের দিন। (শুক্রবার) : স্যাড নিউজ : বিষাদের বার্তা। ঠিক রাত ৮টার সময়ে জলিল আমায় বলল : গান্ধীজীকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। আমি এ কথা কোনােভাবেই বিশ্বাস করতে পারলাম না। কিন্তু শাহজাহান সাহেবও এই খবর ঠিক বলে বললেন। আমি হতবুদ্ধি হয়ে গেলাম। প্রায় ৩ মিনিট আমার স্নায়ুগুলাে যেন বিবশ হয়ে রইল। খবরটা শুনে আমার কণ্ঠ থেকে কেবল একটা চীৎকার-ধ্বনি বেরিয়ে এল। ৮-২০ মিনিটে কামরুদ্দিন সাহেব নীচে নেমে এলেন। তিনি ভয়ানকভাবে বিমূঢ় হয়ে গেছেন। | রাত সাড়ে ৮টায় নূরজাহন বিল্ডিং থেকে বেরিয়ে এলাম। বেচারাম দেউরীতে রেডিওতে নিজের কানে সেই খবর শুনলাম। রাত ৯টায় ফজলুল হক হলে এলাম। সেখান থেকে ঢাকা হলে গেলাম। সেখানে ৯-৩০ মিনিট থেকে ১০টা পর্যন্ত রেডিওতে পণ্ডিত নেহেরু এবং সর্দার প্যাটেলের ভাষণ শুনলাম। বাসায় ফিরলাম রাত ১১টায়। বিছানায় যখন গেলাম, তখন রাত ১২টা।
আবহাওয়া স্বাভাবিক।
মৃত্যু : আমি জীবনে এই প্রথম মৃত্যুর আঘাত পেলাম। মানুষের মৃত্যুর আঘাত। অথচ মানুষের মৃত্যুকে আমি খুবই স্বাভাবিক ঘটনা বলে মনে করি। | মহাত্মা গান্ধী। কাথিওয়ারের পােড় বন্দরে জনুগ্রহণ। অক্টোবরের ২ তারিখ : ১৮৬৯ সাল। মৃত্যু : বিরলা ভবন : নয়াদিল্লী। ৩০ জানুয়ারি ১৯৪৮ সাল। সময় ৫-৪০ মিনিট, অপরাহ (আই.এস.টি)। হত্যাকারীর বুলেট বর্ষণে মৃত্যু। তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮ বছর ৩ মাস ২৮দিন। | গান্ধীজী অন্যান্য দিনের মতাে ৫-১০ মিনিটে (আই.এস.টি.) তাঁর প্রার্থনা মঞ্চের দিকে অগ্রসর হচ্ছিলেন। একটি লোেক উঠে দাঁড়াল। সে পিস্তলের ৩টা গুলি করল। একটা গুলি মহাত্মার বুক ভেদ করে গেল। আর দুটো তার তল পেটে বিদ্ধ হয়েছে। তাঁর নিদারুণ রক্তপাত ঘটেছে। ৩০ মিনিট পরেই মহাত্মা গান্ধী বিরলা ভবনে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন। হত্যাকারীকে জনতা সাথে সাথেই ধরে ফেলেছে। তার নাম নাথুরাম গডসে। সে বম্বের লােক। একজন মারাঠী। হিন্দু রাষ্ট্র’ পত্রিকার সম্পাদক। | একথা স্মরণ করতে হয় যে, মাত্র ১০ দিন আগে ২০ জানুয়ারি একটা লােক গান্ধীজী যখন তাঁর সান্ধ্য প্রার্থনায় ভাষণ দিচ্ছিলেন, তখন তাকে লক্ষ্য করে গুলি করেছিল। কিন্তু সে লােকটা গুলি করেও পালিয়ে যেতে পেরেছিল। | আমার কাছে মৃত্যু একটা সাধারণ ব্যাপার, স্বাভাবিক ব্যাপার। আমি কারুর মৃত্যুতে কোনােদিন শােক প্রকাশ করিনি। আমার বড় ভাইয়ের মৃত্যুর কথা আমার এখনাে স্মরণ আছে। ১৯৪৪ সালে তার মৃত্যু হয়। তার মৃত্যুর সময়ে আমি উপস্থিত ছিলাম না। কিন্তু তার মৃত্যুর জন্য আমার মনে কোনাে দুঃখবােধ জাগেনি। তেমন দুঃখবােধের কোনাে কারণ আমি খুঁজে পাইনি।
| আমার বাবার মৃত্যুর কথাও আমার মনে আছে। মাত্র এক বছর আগে তার মৃত্যু হয়েছে। বছরটা শেষ হতে আর কয়েকটা দিন মাত্র বাকি। তাঁর মৃত্যুর সময়ে আমি কোলকাতায় ছিলামতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে। তার মৃত্যুতেও আমার মনের মধ্যে কোনাে দুঃখ জাগেনি। তার মৃত্যুতে কেবল কাঁধের উপর পারিবারিক বােঝার ভারটা যেন জীবনে প্রথমবারের জন্য বােধ করলাম।
| আমার মনে আছে, বাবার মৃত্যুর খবর শােনার মাত্র ১৫ মিনিট পরেই আমি ৪টা পরাটা | এবং এক বাটি মাংস খেয়েছিলাম। আমার তাে একথাও মনে আছে, তার পরের রাতে, যে বিছানাতে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেছিলেন সেই বিছানাতে আমি গভীর দ্রিায় নিদ্রিত হয়েছিলাম।

৩১ জানুয়ারি ‘৪৮, শনিবার সকাল ৮টায় ঘুম থেকে উঠলাম। কোনাে পড়াশােনা হলাে না। | ইউনিভার্সিটি চত্বরে শােক সঞ্জয় গেলাম। ১৯৩০ মিনিটে ড, এম, হাসানের সভাপতিত্বে সভা শুরু হলাে। শেষ হলাে ২টা। যাঁরা বল করলেন তাদের মধ্যে ছিলেন : ড. এম. হােসেন, ড. এস, এম, হােসেন, কাজী মােতাহার হােসেন, প্রফেসর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, বি, এ, সিদ্দিকী। এ ছাড়াও অন্যান্য বক্তা ছিলেন। | ২-৩০ মিনিটে রেল স্টেশনে গেলাম খবরের কাগজের জন্য। লােকে খবরের কাগজের জন্য এমনভাবে দৌড়াচ্ছে, ভিড় করছে যে, সে ভিড় ঢাকার সিনেমা হলের থার্ড ক্লাসের কাউন্টারের ভিড়কে। ছাড়িয়ে গেছে। মানুষের উপর মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। একজন আর একজনকে চেপে ধরছে। স্বাস রুদ্ধ হয়ে আসছে। একের পায়ের নিচে অপরের চাপা পড়ছে। একজনকে মাড়িয়ে আর একজন চেষ্টা করছে খবরের কাগজের একটু টুকরাও পেতে পারে কিনা। সেখানে যদি পাওয়া যায় এই লােকটির খবর। লােকটিকে এতদিন কি তারা এমনভাবে সত্যই ভালােবেসেছিল ? কোনাে কিছু পাওয়ার জন্য মানুষের এমন ভিড় আমি জীবনে আর দেখিনি। কী নিদারুণ চাহিদা কাগজের। আর কাগজের কী দাম!
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের মহাপ্রয়াণের দিনের সংবাদপত্রের চাহিদা আর মূল্যের স্মৃতি আমার আছে। যে কাগজে সে দিনের মর্মান্তিক খবরটি প্রকাশিত হয়েছিল, তখন পয়সা দিয়ে তার একটা পুরাে কাগজ আমরা কিনতে পেরেছিলাম। কিন্তু আজ পুরাে কাগজ নয়। একজন আর একজনের সঙ্গে ভাগ করে কিনেছে খবরের কাগজ। এমনি তার চাহিদা। এক ঘন্টার মধ্যে কাগজ সব শেষ হয়ে গেল। কোনাে কাগজ আর পাওয়া গেল না। তবু লােকের ভিড় কমল না। তারা অপেক্ষা। করতে লাগল যেন আবার ট্রেনে কাগজ আসবে। তারই জন্য অপেক্ষা। | ৩-৩০ মিনিটে নাজির লাইব্রেরিতে গেলাম।’অল ইন্ডিয়া রেডিওতে প্রয়াত মহর্ষির শেষকৃত্যের ধারা। বিবরণী ৬-১৫ মিনিট পর্যন্ত শুনলাম। সাড়ে সাতটায় মেসে ফিরে এলাম। ১০টায় বিছানায় গেলাম।
সমস্ত শহরে হরতাল হয়েছে। ঢাকার জন্য এ দৃশ্য অভাবিত। ভিক্টোরিয়া পার্ক থেকে শােক মিছিল বেরুল। ৫টায় শ্রীশ, চাটার্জীর সভাপতিত্বে করােনেশন পার্কে শােক সভা এবং মৌন প্রার্থনা হলাে। কোনাে বক্তৃত নয় । | সূর্য অস্তমিত হলাে। এবং অস্তমিত হলাে মানবতার পথের দিশারী আলােকবর্তিকা। তাহলে কি অন্ধকার নেমে এল। আলাে এবং অন্ধকার। অন্ধকার এবং আলাে। দিনের পরে তাে রাত্রির আগমন এবং দিনের আগমনে নিশার অপসারণ। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ। তার পরে তাে সূর্যের কিরণ। ক্ষীণতনু নতুন চন্দ্র। কিন্তু তারপরো তাে আনন্দময় পূর্ণ চন্দ্রের আবির্ভাব। হতাশার শেষ তাে আশাতে। সংকটময় মুহূর্ত শ্রে, তিরােহিত হয় বিস্মৃত অতীতে। অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ তাে বর্তমানের সৃষ্টিতে রূপায়িত হয়। জগৎ তাে থেমে থাকে না। অনিবার তার এই চক্র। | যে মানুষটির শােকে আজ আমরা মুহামান, সে লােকটি তাে অন্ধকারের দীর্ঘপথ অতিক্রম করে আলােতে পেীছেছিলেন। তাকেও সে অন্ধকারে আলাের অন্বেষণে উদ্বিগ্ন হতে হয়েছে। অথচ কী বিস্ময় ! তিনি নিজেই তাে ছিলেন একটি আলােকবর্তিকা। আলােককে কি তুমি ধ্বংস করতে পার ? আলাের কণিকা আমাদের কাছ থেকে বহু দূরে অবস্থিত হতে পারে। কিম তাতে। কী ? ধ্রুবতারার দূরত্ব অকল্পনীয়। কিন্তু বিজন মেরুতে অভিযানকারীর সেইই তাে একমাত্র দিক নির্ধারক। যুগ থেকে যুগ। তার চোখের ক্ষুদ্র কল্পনাটিও আমাদের পথের দিশা প্রদান করে। তাহলে বেদনা কেন? বহু যুগের এই ধ্রুবতারার কাছ থেকে আমরা নির্দেশ গ্রহণ করব। তাঁর ফেলে যাওয়া পায়ের চিহ্ন ধরে আমরা অগ্রসর হয়। তিনি শান্তি লাভ করুন। আমিন। | ১১টা ৪৫ মিনিটে, সকালে (আই, এস, টি,) মহাত্মার মরদেহকে বিরলা ভবন থেকে শশাভাযাত্রা করে বহন করে আনা হলো। শবাধারটি বহন করেছে সামরিক বাহিনীর অধিনায়কবৃন্দ। কারণ ভারত মহাত্মার শেষকৃত্যকে রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠান বলে ঘােষণা করেছে।
৪-২০ মিনিটে শবাধার যমুনার তীরে রাজঘাটে এসে পৌছল। ৪-৩০-এ দেহটিকে চিতায় শায়িত করা হলাে। উত্তর দিকে রক্ষিত হলাে তার শিরদেশ। দেবদাস গান্ধী দেহটির ওপর চন্দন কাঠের একটি স্বপকে স্থাপন করলেন। বিকেল ৪-৫৫ মিনিটে (আই.এস,টি,) রামদাস গান্ধী চিতায় অগ্নি সংযােগ করলেন। ৫টার মধ্যে মহাত্মার দেহ জন্মে রূপান্তরিত হয়ে গেল। মহাত্মার শিয়রে পণ্ডিত রামদাস শর্মা মন্ত্র পাঠ করলেন। মহাত্মার চিতায় ১৫ মণ চন্দন কাঠ, ৪ মণ ঘি, ২ মণ সুগন্ধী, ১ মণ নারকেল এবং ১৫ সের কপূরের সমাহার ঘটেছিল। আমার আর কিছু না থাক চুল আঁচড়াবার বিলাস আছে। তােক সামান্য। তবু তাে বিলাস। আজ কি সেটুকুও আর রইল না। আজ আর আমার গােসল হলাে না। ৪৮ ঘণ্টা ধরে আমার। কেশবিন্যাসও ঘটল না। আমার মনে আছে, একবার ১০ মহররমে মুখে মাে মেখেছিলাম বলে, ওয়াসেফ সাহেব মুসলিম লীগ অফিসে আমাকে তিরস্কার করেছিলেন। সে দিন আমি জবাব দিয়ে বলেছিলাম ; দুঃখের এমন প্রকাশে আমি বিশ্বাসী নই। কিন্তু সেই আমিই গত দুদিন ধরে আমার কেশ বিন্যাসকে পরিত্যাগ করেছি। অন্তরের এক তাগিদে, বিস্মৃতির এক অপরিহার্যতায় ।

২১ মার্চ ‘৪৮, রবিবার সকাল সাড়ে ৭টায় ঘুম থেকে উঠেছি। পড়াশােনা হলাে না। | বিকেল সােয়া ৩টায় আসগর সাহেবের সঙ্গে বেরিয়ে এফ. এইচ. এম. হলে গেলাম সেখানে নাঈমউদ্দিন সাহবের সঙ্গে দেখা হলাে। | বিকেল সাড়ে ৪টায় রেসকোর্স ময়দানে কায়দে আযমের জনসভায় গেলাম। কায়দে আযম এলেন সােয়া ৫টায়। অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি হিসেবে নবাবের বক্তৃতার পর কায়দে আযম পৌনে ৬টায় তার বক্তৃতা শুরু করলেন। পৌনে ৭টা পর্যন্ত ১ ঘন্টা বক্তৃতা করলেন। তিনি মন্ত্রিসভা ও মুসলিম লীগের পক্ষে প্রচার চালালেন এবং সাম্প্রতিক ভাষা আন্দোলনের নিন্দা করলেন। তিনি ঘােষণা করলেন যে, উর্দুই হবে রাষ্ট্র ভাষা। পূর্ব বাংলার সরকারি ভাষা বাংলা হবে কি না সে ব্যাপারে চূড়ান্তরূপে সিদ্ধান্ত নিতে বললেন। ছাত্রদেরকে সাবধান করে দিলেন এবং প্রায় সরাসরি তাদেরকে রাষ্ট্রের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় এফ, এইচ, এম, হলে ফিরে এলাম। তােয়াহা সাহেব অ্যাসেমরি হলের। সামনে ন্যাশনাল গার্ডদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করলেন। তারপর জনাব মােহাজের ও জহিরউদ্দিনও বক্তৃতা করলেন। রাত ৯টার দিকে মেসে ফিরে এলাম। ১১টায় ঘুমাতে গেলাম। আবহাওয়া স্বাভাবিক। আজ সকাল থেকে ঠান্ডায় ভুগছি। বি: দ্র: কায়দে আযমের ভাষণ এ প্রদেশের সবাইকে আহত করেছে। প্রত্যেকেই নিদারুণ বিরুক্ত- তিনি দলের ওপরে উঠবেন সবাই সে আশাই করেছিল। ২৪ মার্চ ‘৪৮, বুধবার। সকাল সাড়ে ৭টায় ঘুম থেকে উঠেছি। পড়াশােনা হলাে না। ১০টার দিকে শওকত সাহেব এসে নারায়ণগঞ্জে দলের জনসভার কথা জানালেন। সাড়ে ১১টায় তােয়াহা সাহেব এলে তাকে নিয়ে কামরুদ্দিন সাহেবের কাছে গেলাম। তিনি বেরিয়ে গেছেন। আমরা একটা ট্যাক্সি নিয়ে ১২-৪৫ মিনিটে নারায়ণগঞ্জ রওনা হয়ে সােয়া ১টায় সেখানে পৌছলাম। ২টায় কামরুদ্দিন সাহেব ছাড়া সবাই হাজির। তােয়াহা সাহেব সভা মুলতবির প্রস্তাব দিলে সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলাে। সভা আগামীকাল সকাল সাড়ে ৮টায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। বিকেল সাড়ে ৩টায় আমরা ঢাকায় ফিরে কামরুদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সেখানে কাসেম ও অলি আহাদ উপস্থিত ছিলেন।
ছাত্র লীগের ব্যাপারে আলােচনার জন্য আব্দুর রহমান চৌধুরীকে সাথে নিয়ে তােয়াহা সাহেব বিকেল সাড়ে ৫টায় কায়দে আযমের সঙ্গে দেখা করলেন। শাহ আজিজের উপস্থিতিতে তাদের আলােচনা প্রায় ঘণ্টাধিককাল স্থায়ী হলাে। কায়দে আযম ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম স্টুডেন্ট লীগের ব্যাপারে একমত হলেন এবং একটা গঠনতন্ত্র তৈরি করে নতুন করে শুরু করতে। বললেন। তিনি অল বেঙ্গল মুসলিম স্টুডেন্ট লীগকে বিলুপ্ত ঘােষণা করলেন। সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় কায়েদে আযম রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম কমিটিকে একটা সাক্ষাৎকার দিলেন। আমরা তার সামনে একটা স্মারকলিপি দিলাম। কি কায়দে আযম আমাদের বক্তব্য উপস্থাপন। করতে দিলেন না। তিনি উর্দুর পক্ষে তাঁর নিজস্ব মতামত দিতে লাগলেন যা চরমভাবে যুক্তিহীন। তিনি আমাদেরকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন যে, আমরা যেন উর্দুকে আমাদের মাতৃভাষা হিসেবে গ্রহণ করি। তিনি যা বললেন, “তােমাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য হওয়া উচিত উর্দু। আমরা হয়ত কিছুটা হলেও আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি জানাতে পারতাম, যদি না শামসুল হক সাহেব তাঁকে উত্তেজিত
করতেন। সােয়া সাতটা পর্যন্ত আলােচনা হলাে। কায়দে আযম অনেক ঘটনা অস্বীকার করলেন। হয় এসব ব্যাপারে তিনি জানেন না, না হয় ইচ্ছাকৃতভাবেই তিনি এটা করছিলেন। এফ, এইচ, হল হয়ে মেসে ফিরলাম। হলে প্রায় রাত ৯টা পর্যন্ত দেড়টা ধরে আলােচনা করলাম। ১১টায় ঘুমাতে গেলাম। আজ বেশ ভালাে লাগছে। আবহাওয়া স্বাভাবিক। ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, শুক্রবার সকাল ৭টায় উঠেছি। পড়শােনা হয়নি। | বেলা ১২টায় ডি,এফ,ওর অফিসে গেলাম। কিন্তু তিনি তার অফিস রুমে ছিলেন না। ছিলেন উপর তলায়। বেলা সােয়া ১২টায় স্টেশনে ফজলুর সঙ্গে দেখা করলাম এবং আজিজ মিয়ার কাছে কিছু নির্দেশ পৌছে দেয়ার জন্য তাকে বললাম। জালালও বাড়ি যাচ্ছে। বেলা ১টা থেকে ৬টা পর্যন্ত নবাবপুর, সদরঘাট, পাটুয়াটুলি, ইসলামপুর, দিগবাজার, ইংলিশ রােড, চক প্রভৃতি এলাকা ঘুরে বেড়ালাম। হিন্দুদের ওপর কিছু মুসলমানদের ধ্বংসযজ্ঞ প্রত্যক্ষ করতে করতে। রাত কাটালাম কামরুদ্দিন সাহেবের বাসায়। আবহাওয়া : মধ্যদিন পর্যন্ত স্বাভাবিক ছিল। দিনের তিন-চতুর্থাংশ সময় এক পশলা বৃষ্টি হলাে। রাত থেকে জোরে বাতাস বইছে। | বি. দ্র. স্বাধীনতার পর প্রথমবারের মতাে ঢাকা আজ দুপুর ১২টা থেকে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা প্রত্যক্ষ করল। গত তিন/চার দিন ধরে কোলকাতায় যে দাঙ্গা চলছিল এটা তারই ধারাবাহিকতার ফল। শরণার্থীরা বিশেষ করে বিহারিরা এই গােলযােগের জন্য দায়ী। স্থানীয় জনগণ যদিও এসবের বিপক্ষে নয়, তবে তারা উদাসীন। সন্ধ্যা পর্যন্ত অবিরাম লুট, হত্যা আর অগ্নিসংযোেগ চলল। পুলিশ এসব বন্ধ করার কোনাে চেষ্টাই করল না। অবাঙালি পুলিশেরা বরং উৎসাহ যােগাচ্ছিল। পুরাে প্রশাসন নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করল। সরকারের পক্ষ থেকে ১৪৪ ধারা এবং সন্ধ্যা ৬টা থেকে ভাের ৬টা পর্যন্ত কারফিউয়ের ঘােষণা দেয়া হলেও তা কার্যকর করা হলাে না। বর্তমান গােলযােগের উৎপত্তি নিহিত আছে ভারত ইউনিয়নের বিশেষ করে পশ্চিম বাংলার প্রতিপক্ষদের মধ্যে। মূলত গত সপ্তাহে কোলকাতায় মুসলমানদের উপর যা ঘটেছে এটা নিঃসন্দেহে তারই বহিঃপ্রকাশ। উদ্দেশ্যমূলক না হলেও পূর্ব বাংলা অ্যাসেমব্লির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি এম, এল,এ দের একটি অবিবেচক পদক্ষেপ এই ঘটনাকে গুরুতর করে তােলে। সংসদের কার্যক্রমে তাদের অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত এবং পূর্ব-বাংলার সংখ্যালঘুদের রক্ষা করার জন্য জাতিসংঘের কাছে আবেদন, এই প্রদেশের মুসলমানদের অসন্তুষ্ট করার জন্য যথেষ্ট ছিল। এম,এল,এ দের এই পদক্ষেপগুলাে যতই সরল বিশ্বাস ও বিদ্ধ নাগরিক অধিকার বােধ থেকেই উৎসারিত হােক না কেন এর বিরুদ্ধে অতি উদারপন্থীদের ঠিক সন্দেহ না হলেও অসন্তোষ ছিলই। | এছাড়াও সচিবালয়ের কেরানিদের আরাে একটি অপরিকল্পিত পদক্ষেপের ফলে বিস্ফোরণ উনখ এক বারুদের স্কুপে আগুনের স্ফুলিঙ্গ ছড়িয়ে দেয়া হলাে। যখন কেরানিরা ভারতীয় | দূতাবাসের সামনে মিছিল করে এসে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্য সচিব সি, এম, সেনের কাছে তাদের অনুভূতি বর্ণনা করে ভারত প্রজাতন্ত্রের কাছ থেকে প্রশংসিত হয়। সি, এম, সেন আমাদের মুখ্য সচিবের সঙ্গে বৈঠক করছিলেন। শরণার্থীরা, বিশেষত বিহারিরা যারা প্রতিশােধ নেয়ার জন্য সুযােগের অপেক্ষায় ছিল, তারা পরিস্থিতির অবনতি ঘটায়। বেচারা কেরানিদের সাংবিধানিকভাবে পদক্ষেপ নেয়ার আন্তরিক ইচ্ছা মারমুখী জনতাকে নিয়ন্ত্রণ করতে সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়। এইজনতা কেরানিদের চারপাশে জড়াে হয়েছিল এবং যাদের অধিকাংশই ছিল শরণার্থী। দাঙ্গাকারীদের এই আক্রমণের ফলে প্রথমে আক্রান্ত হয় সংখ্যালঘুদের বিষয়-সম্পত্তি এবং তারপর ব্যক্তি। ক্রমবর্ধমানভাবে পূর্ণোদ্যমে হত্যাকাণ্ড চলতেই থাকল। দোকানপাট ইতােমধ্যেই লুষ্ঠিত হয়েছে। হিন্দুদের জীবনটাই দুষ্কৃতিকারীদের মনােযােগের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত হয়েছে। কিন্তু পরিবার সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে এমন খবর পাওয়া যাচ্ছে। ব্যাপকসংখ্যক বিচ্ছিন্ন সহিংসতার ঘটনাও ঘটছে। চলন্ত ট্রেনের কামরায় নৃশংসভাবে হত্যার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। সরকার বিচ্ছিন্ন হিন্দু পরিবারগুলাের জন্য আশ্রয় কেন্দ্র খুলেছে। প্রধান প্রধান সড়কগুলাে সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে। সান্ধ্য আইনের মেয়াদ বিকেল ৫টা থেকে বাড়িয়ে সকাল ৮টা পর্যন্ত করা হয়েছে। এত কিছু সত্ত্বেও ডানে বামে চতুর্দিকে মানুষ নিধন চলছে। সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের পক্ষে এবং দুষ্কৃতিকারীদের বিরুদ্ধে কেউ টু শব্দটি করছে না। ১০ তারিখ থেকে জীবনের উপর হামলা চলছে। দাঙ্গাকারী জনতার রােষ কমে এলে ঘটনা শান্ত হবার কোনাে চিহ্ন নেই। ১৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৫০, শনিবার খুব ভােরে ঘুম থেকে উঠেছি। ৯টায় রায়েদের কাচারি ঘরে গিয়েছিলাম। সেখানে আসিরুদ্দিন মােল্লার সুপারিশ করা দরখাস্ত পেলাম। কাচারি ঘরে অনানুষ্ঠানিক মিটিং হলাে। স্থানীয় গণ্যমান্য মুসলিম ব্যক্তিবর্গ, আবিদ বেপারি, হাসেন মৃধা, নবাব পালান প্রমুখ প্রায় ৪০ জন হিন্দু ও মুসলিম ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। বর্তমানে গােলযােগ বিষয়ে পাকিস্তান সরকারের অবস্থান এবং ঘটনার প্রকৃত অবস্থা ব্যাখ্যা করলাম। তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছিল। এখানে উপস্থিত সবাই সরকারের পাশে থাকা এবং গােলযােগ বন্ধের শপথ করল। বেলা আড়াইটায় বরামার উদ্দেশে রওনা হলাম।
বরামাতে হেডমাস্টার মফিজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। সেই সময় কাপাসিয়া থানার সেকেন্ড অফিসার একজন সশস্ত্র পুলিশ নিয়ে সেখানে ঝেয়াদিতে ২টি ভৌমিক পরিবার। এবং ৩টি শুক্লাদাস পরিবারকে অশেষ দুর্গতির মধ্যে দেখলাম। বাড়ি ঘর আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। ব্রজেন্দ চন্দ্র ভৌমিক সেকেন্ড অফিসারের কাছে এজাহার দিলেন। স্থানীয় মুসলমানরা তাদেরকে রক্ষা করেছে। মীর মােহাম্মদ নামে একজন গুন্ডাদের কার্যকলাপের প্রতিবাদ করতে গেলে গুন্ডাদের হাতে আহত হন। ঠিক সন্ধ্যায় সেকেন্ড অফিসার ও আমি মীর মােহাম্মদের বাড়িতে গেলাম। এরপর সঞ্জীব রায়ের বাড়ি হয়ে বরামাতে ফিরে এলাম। সঞ্জীব রায়ের বাড়ির পাশে ৪টি অগ্নিদগ্ধ বাড়ি দেখলাম। সেখানে কোনাে বাসিন্দা ছিল না। আমরা রাত সাড়ে ৮টায় বরামাতে সভা করলাম। সভায় অনেক লােক জড়াে হয়েছিল। শাহেদ আলি বেপারি, হুসেইন আলি খাসহ আরাে অনেকে সেখানে উপস্থিত ছিলেন। দাঙ্গার কারণে সর্বস্তরে যে ক্ষতিকর কার্যকলাপ সংঘটিত হয়েছে আমি তার উপর জোর দিয়ে দীর্ঘসময় ধরে বক্তব্য রাখলাম এবং শান্তির জন্য আবেদন জানালাম। উপস্থিত সবাই সমস্বরে তাদের সাধ্যমত চেষ্টা করবেন বলে শপথ উচ্চারণ করলেন।
স্কুলের হেডমাস্টার, ইউনিয়ন বাের্ডের প্রেসিডেন্ট এবং স্থানীয় মুসলমানরা বরামার হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকদের রক্ষা করেছে। রাতের খাবার শেষে পুলিশের সেকেন্ড অফিসার হুসেইন খানের বাড়িতে গেলেন এবং আমরা রাতে বরামাতে থেকে গেলাম।
রাত প্রায় ১২টার দিকে ঘুমাতে গেলাম। আবহাওয়া : স্বাভাবিক। প্রায় শীতহীন রাত।

২১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৫২, বৃহস্পতিবার ভাের সাড়ে ৫টায় উঠেছি। সকালে আমি যখন পুকুরে গােসল করতে গিয়েছিলাম তখন রফিক আমার বিছানার বালিশের নিচ থেকে টাকা হাতিয়ে নেয়। নাশ মিয়া, জয়তুনের বাপ প্রমুখের সহায়তায় ১৪৭ টাকা আট আনার মতাে তার কাছ থেকে উদ্ধার করা গেল। এই ঝামেলার কারণে আমি সকালের ট্রেন ধরতে পারলাম না।
বেলা ১২টা ১৪ মিনিটের ট্রেনে ঢাকার উদ্দেশে রওনা হলাম। একই কামরায় আমার সহযাত্রী ছিলেন এফ করিম ও ডা, আহসানউদ্দিন। রাজেন্দ্রপুর থেকে উঠলেন হাসান মােড়ল। স্কুল সম্পর্কিত বিষয়াবলি, তার দায়িত্ব ও ২৪.০২.৫২ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ম্যানেজিং কমিটির সভা নিয়ে আমি তার সঙ্গে কথাবার্তা বললাম। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে ট্রেন থামতেই আমি এবং এফ করিম সেখানে নেমে গেলাম। পুরাে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিশাল জনসমাবেশ। মেডিক্যাল কলেজ ও অ্যাসেমব্লি হলের কাছে এইমাত্র পুলিশের টিয়ার গ্যাস ছােড়ার বিষয়ে লােকজন বলাবলি করছিল। | বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে প্রায় ২০ মিনিটের মতাে থেমে ডিপিআই অফিসে গেলাম। মুসলিম এডুকেশন ফান্ডের গ্রান্ট-ইন-এইডস সম্পর্কিত সহকারীর সঙ্গে দেখা করলাম। তিনি আমাকে জানালেন এক সপ্তাহের মধ্যে তিনি স্মারক পাঠিয়ে দেবেন। বেলা ৩টার দিকে আমি ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম।
| ইডেন ভবনের দ্বিতীয় গেটের কাছে আকবর আলী বেপারির সঙ্গে রেনুকে পেলাম। তিনি। আমাকে বললেন, তারক সাহার বাড়ি ও বমি বাজারের দোকানটি তিনি কিনে নেবেন। এটি কিনতে টাকার জন্য তিনি জমি বিক্রি করবেন। তার সঙ্গে কথা বলে বাসে উঠলাম এবং বেলা সাড়ে ৩টায় এসডিও (উত্তর)-এর আদালতে উপস্থিত হলাম। এসডিওর সঙ্গে তার খাস কামরায় দেখা করলাম বিকেল ৪টা ৫ মিনিটে। আমাদের স্কুল ও ২৪,২.৫২ তারিখে অনুষ্ঠিতব্য ম্যানেজিং কমিটির সভা নিয়ে তার সঙ্গে আলােচনা করলাম। প্রধান শিক্ষকের বিষয়াবলি ও অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি কীভাবে সুরাহা করা যায় সে ব্যাপারে আমার পরামর্শের সঙ্গে তিনি একমত হলেন। তিনি আমাকে ৩,৩.৫২ তারিখে ম্যানেজিং কমিটির একটি সভা আয়ােজন করার জন্য বললেন। তখন তিনি শ্রীপুর থাকবেন। এরই মধ্যে তিনি আমার অনুরােধে শ্রীপুরের উদ্বাস্তু মিস্ত্রিদের ত্রাণের আবেদন অনুমােদন করলেন। তার চেম্বার ছাড়লাম বিকেল ৪টা ২৫ মিনিটে। আদালতের রেস্তোরাঁয় সিআইবির অ্যাসিস্ট্যান্ট মহিউদ্দিন ও আমাকে সাদির মােক্তার নাস্তা খাওয়ালেন। বিকেল পাঁচটার দিকে। আদালত ছেড়ে এলাম। কামরুদ্দীন সাহেবের সঙ্গে তাঁর বাড়িতে দেখা করলাম এবং দেরি না করে তার সঙ্গে ৯৪ নবাবপুর এএমএল অফিসে এলাম। মিনিট পাঁচেকের জন্য সেখানে থেমে কেমব্রিজ ফার্মেসিতে গেলাম। জহির ভাই-এস এম জহিরউদ্দীনও আমাদের চা দিলেন। | ডা, করিম ও আমি মেডিক্যাল কলেজে গেলাম। পুলিশের গুলিতে আহত ও নিহতদের মৃতদেহ দেখার চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। ডা, করিম চলে গেলেন। আমি মেডিক্যাল কলেজ হােস্টেলে ইতস্তত ঘােরাফেরা করে রাত ১১টায় যােগীনগরে ফিরে গেলাম।
রাতের খাবারের পর ভাবির সঙ্গে কথা বললাম রাত সাড়ে ১২টা পর্যন্ত। বিছানায় গেলাম রাত ১টায়। আবহাওয়া : স্বাভাবিক। অপেক্ষাকৃত কম ঠান্ডা। বি. দ্র. আজ দুপুরে খেতে পারিনি।
গভীর রাতে সাড়ে ৩টায় পুলিশ বাহিনী আমাদের বাড়ি ঘেরাও করল এবং যুবলীগের অফিসে তল্লাশি চালাল। তারা ক্ষতিকর বা অবৈধ কিছু খুঁজে পেল না। যুবলীগের অফিস লাগােয়া আমার শােবার ঘর, তাই আমি ঘর থেকে সরে পড়ায় তারা আমার উপস্থিতি টের পায়নি। ভাের ৪টায় তারা চলে গেল। এরপর আর ঘুমাইনি। বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সাধারণ ধর্মঘট চলছে। গতকাল থেকে এক মাসের জন্য সিআর, পিসি, ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছে। আজ বিকেলে অ্যাসেমব্লি বসেছে। ধর্মঘট পালনকারী ছাত্ররা শান্তিপূর্ণভাবে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে অ্যাসেমব্লি হাউসের কাছে জড়ো হয়; যাতে তাদের কষ্ঠ অধিবেশনে উপস্থিত এমএলএরা শুনতে পান। প্রথমে শুরু হলাে গ্রেফতার করা। এরপর কাঁদননা গ্যাস ছােড়া হলাে। তারপর গুলি। চালানাে হলাে মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে। গুলিতে চারজন ঘটনাস্থলেই নিহত হচ্ছে। আহত হলাে ৩০ জন। জানা যায় ৬২ জনকে জেলে পােরা হয়েছে। আরও শােনা যায় পুলিশ কয়েকটি মৃতদেহ সরিয়ে ফেলেছে। বেসরকারি সূত্রের দাবি, মৃতের সংখ্যা ১০ থেকে ১১ জন। অক্টোবর ১৪, ১৯৭৪ সােমবার : দৈনিক সংবাদ ও দৈনিক পূর্বদেশ খাদ্য সংকটকে রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে; নিরন্ন মানুষকে বাঁচাতে দলমত নির্বিশেষে এগিয়ে আসুন : অর্থমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বর্তমান জাতীয় দুর্যোগকালে উট পাখির মতাে বালিতে মাথা গুঁজে থাকলে চলবে না। বাংলাদেশের মানুষকে বাঁচাতে হবে। অবিলম্বে দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের মানুষকে সাথে নিয়ে জাতীয়ভাবে খাদ্য সংকটের বাস্তব সমাধানের পথে এগিয়ে আসতে হবে। তিনি গতকাল ঢাকা বিমানবন্দরে এই অভিমত ব্যক্ত করেন। | তিনি বলেন, সকল দল ও মতের নেতৃবৃন্দ এবং বিশেষজ্ঞদের একত্রিত করে বর্তমান খাদ্য সংকট মােকাবেলায় সুনির্দিষ্ট ও কার্যকরী পন্থা গ্রহণের জন্য তিনি প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অনুরােধ করবেন। তিনি তার বক্তব্য দ্বারা কোনাে সর্বদলীয় বা জাতীয় সরকার গঠনের কথা বলছেন কিনা এই প্রশ্নের জবাবে মন্ত্রী বলেছেন যে, সে প্রশ্নই ওঠে না, কারণ বর্তমান সরকার জনগণের দ্বারা নির্বাচিত। কদিন আগের উপ-নির্বাচনেও আওয়ামী লীগ জয়ী হয়েছে। তিনি বলেন, খাদ্য সমস্যাকে অবশ্যই রাজনীতির উর্ধ্বে রাখতে হবে। এ কথা মনে রাখতে হবে যে, শুধুমাত্র বক্তৃতা, বিবৃতি, স্লোগান দিয়ে সংকটের সমাধান হবে না। এই প্রসঙ্গে তিনি ১৯৫৬ সালের সর্বদলীয় খাদ্য কমিটির কথা উল্লেখ করেন। | অর্থমন্ত্রী আবেগরুদ্ধকণ্ঠে বলেন, মানুষ না খেয়ে মরছে- এ অবস্থা চলতে দেয়া যায় না। এর অবসান ঘটাতে হবে। তিনি বলেন, মাটি আর মানুষ নিয়ে দেশ- বাংলাদেশ এখন সার্বভৌম, তার মাটি কেউ কেড়ে নিতে পারবে না। কিন্তু মানুষ না থাকলে কাকে নিয়ে রাজনীতি, কার। জন্যই বা রাজনীতি। মানুষ যখন মরে যাচ্ছে তখন নীরব দর্শক হয়ে বসে থাকা যায় না। এ পরিস্থিতি মােকাবেলা করতে যারা ব্যর্থ হবে তাদের ব্যক্তি নির্বিশেষে ছাঁটাই করা দরকার। এমনকি আমি যদি হই আমাকেও বাদ দেয়া উচিত। মােটকথা যে কোনাে মূল্যে যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মতাে বর্তমান সঙ্কট মােকাবেলা করে মানুষ বাঁচাতে হবে।
| জনৈক সাংবাদিক বর্তমান গণঐক্য জোটের পরিপ্রেক্ষিতে তার দলমত নির্বিশেষে খাদ্য সঙ্কট মােকাবেলার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দাবি করলে অর্থমন্ত্রী বলেন, আমি গণঐক্য জোটকে আরাে ব্যাপকভিত্তিক (ব্রড বেজড) করার কথা বলেছি। তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, আমি মনে করি। কিছুসংখ্যক (মাইক্রোস্কপিক মাইনরিটি-) লােক যারা বিদেশের এজেন্ট, তারা ছাড়া এ দেশের
সকল মানুষ দেশপ্রেমিক। তাছাড়া বিরােধী দল করলেই মানুষ অ-দেশ প্রেমিক হয় না। দুঃখ। ভারাক্রান্ত কণ্ঠে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, কেউ অভিজাত বিপণী কেন্দ্রে মার্কেটিং করবে আর কেউ না খেয়ে রাস্তায় মরে পড়ে থাকবে এ অবস্থা চলতে দেয়া যেতে পারে না। তিনি। আরাে বলেন, যারা আজ না খেয়ে ধুকে ধুকে পথে-ঘাটে পড়ছে-মরছে, তারা আমাদের। মানবতাবােধের প্রতি বিদ্রুপ করে বিদায় নিচ্ছে। তিনি জানান যে, বিদেশ সফরকালে তিনি। বিদেশি সংবাদপত্রে বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যুর সচিত্র খবর পাঠ করে ব্যথিত হয়েছেন। লন্ডনে ব্রিটিশ টেলিভিশনে তিনি বাংলাদেশে অনাহারে মৃত্যু এবং এরই পাশাপাশি এক শ্রেণীর মানুষের বিলাসবহুল জীবনযাত্রার দুই বিপরীত মর্মান্তিক ছবি দেখেছেন। তিনি দেখেছেন ঢাকার রাজপথে
খেয়ে মরে যাওয়া মানুষের লাশ আর তারই পাশাপাশি নাইট ক্লাবে এক শ্রেণীর মানুষ বেআইনীভাবে আমদানিকৃত দামি বিদেশি মদ এবং আস্ত মুরগি খাচ্ছে। তিনি জানান যে, লন্ডনে বসে নিজ দেশের দুই বিপরীত ও অমানবিক দৃশ্য দেখে তিনি মর্মাহত ও লজ্জিত হয়েছেন। | তিনি দুঃখ করে বলেন, দেশের মানুষ যখন না খেতে পেয়ে মরছে, তখন কালাে টাকার মালিকরা তাদের সম্পদ আরাে বাড়ানাের জন্য অবৈধ প্রতিযােগিতায় মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, ভিক্ষাবৃত্তি সকল অধঃপতন ও দুর্নীতির মূল কারণ। আমরা স্থায়ীভাবে বৈদেশিক সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল হতে পারি না। আমাদের দেশে প্রচুর সম্পদ রয়েছে। সেই সম্পদ। আহরণ করে গণ-মানুষের মধ্যে সুষম বন্টনের মাধ্যমে আমাদের সুষম জাতীয় অর্থনীতি গড়ে তােলার কাজ করে যেতে হবে। যদিও অনেক আগে থেকেই আমাদের তা করা উচিত ছিল। অর্থমন্ত্রী দেশের বিত্তবান লােকদের কৃচ্ছুতা সাধনের জন্যেও আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাদের নাই তাদেরকে কৃচ্ছতা সাধনের কথা বলে মরতে বলতে পারি না। আমরা সবাই সহানুভূতিশীল হলে এ পরিস্থিতির বেদনা কিছুটা প্রশমিত হতাে। | জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আরাে বলেন, সরকারি দলই হােক আর বিরােধী দলই হােক। কারাে হাতে অস্ত্র থাকা উচিত নয়। এতে আইন শৃঙ্খলা রক্ষায় নিয়ােজিত সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক ও উপদলের মধ্যে অনাস্থার মনােভাব সৃষ্টি হয়। সাংবাদিকদের উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনারা কেন সরকারের ভালােমন্দ তুলে ধরছেন না? কেন বাস্তব। অবস্থা তুলে না ধরে জনগণকে শুধু আশার বাণীই শােনাচ্ছেন ? অমুক দেশ থেকে চাল আসছে, গম আসছে, সাহায্য পাওয়া যাবে- এইটুকু লিখলেই চলবে না। কীভাবে উৎপাদন বাড়ানাে যেতে পারে, কীভাবে সকল মানুষকে একত্রিত করে সমস্যার সমাধান করা যেতে পারে তার প্রচেষ্টা চালাতে হবে।’
পরিশেষে তিনি বলেন যে, একটি স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তােলার ব্যাপারে আমাদেরকে কঠোর পরিশ্রম করতে হবে।

সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ
৩০৪
তাজউদ্দীন আহমদের ভাষণ
বাংলাদেশবাসীর উদ্দেশ্যে : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদের বেতার। ভাষণ। (স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে ১০ এপ্রিল, ১৯৭১ তারিখে প্রচারিত)
স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাই-বােনেরা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিপাগল গণ-মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তার সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদেরকে আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান। জীবন আহুতি দিয়েছেন। যতদিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যতদিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, ততদিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমর স্মৃতি। বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে। ২৫ মার্চ মাঝরাতে ইয়াহিয়া খান তার রক্তলােলুপ সাঁজোয়া বাহিনীকে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের ওপর লেলিয়ে দিয়ে যে নর-হত্যাযজ্ঞের শুরু করেন তা প্রতিরােধ করবার আহ্বান জানিয়ে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। আপনারা সব কালের সব দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামী মানুষের সাথে আজ একাত্ম। পশ্চিম-পাকিস্তানী হানাদার দস্যুবাহিনীর বিরুদ্ধে যে প্রতিরােধ আপনারা গড়ে তুলেছেন তা এমন এক ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন যে, পৃথিবীর সমস্ত স্বাধীনতাকামী মানুষের কাছে আপনাদের এ অভূতপূর্ব সংগ্রাম সর্বকালের প্রেরণার উৎস হয়ে রইল। প্রত্যেকদিনের সংগ্রামের দিনপঞ্জি আমাদের মুক্তিসংগ্রামের ইতিহাসকে সমৃদ্ধ করছে, বিশ্বের কাছে আমাদের গৌরব বৃদ্ধি করছে। আপনাদের অদম্য সাহস ও মনােবল, যা দিয়ে আপনারা রুখে দাড়িয়েছেন ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুদের বিরুদ্ধে, তার মধ্য দিয়ে আপনারা এইটেই প্রমাণ করেছেন যে, যুদ্ধক্ষেত্ৰস্তীর্ণ ধ্বংসাবশেষের মধ্যে দিয়ে ধূলি-কাদা আর রক্তের ছাপ মুছে এক নতুন বাঙালি জাতি জন্ম নিল। পৃথিবীর কাছে আমরা ছিলাম শান্তিপ্রিয় মানুষ। বন্ধু-বাৎসল্যে, মায়া ও হাসিকান্নায়, গান, সংস্কৃতি আর সৌন্দর্যের ছায়ায় গড়ে ওঠা আমরা ছিলাম পল্লী-বাংলার মানুষ। পৃথিবী ভাবত, আমরাও ভাবতাম, যুদ্ধ রণডংকা আমাদের থেকে অনেক দূরে। কিন্তু আজ ? | আমাদের মানবিক মূল্যবোেধ ও আদর্শের পতাকা সমুন্নত রেখে আমরা আবার প্রমাণ করেছি। যে, আমরা তিতুমীর-সূর্য সেনের বংশধর। স্বাধীনতার জন্যে যেমন আমরা জীবন দিতে পারি, তেমনি আমাদের দেশ থেকে বিদেশি শত্রু-সৈন্যদের চিরতরে হটিয়ে দিতেও আমরা সক্ষম। আমাদের অদম্য সাহস ও মনােবলের কাছে শক্র যত প্রবল পরাক্রম হােক না কেন, পরাজয়
বরণ করতে বাধ্য। আমরা যদি প্রথম আঘাত প্রতিহত করতে ব্যর্থ হতাম তাহলে নতুন স্বাধীন প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হয়ত কিছুদিনের জন্যে হলেও পিছিয়ে যেত। আপনারা শত্রুসেনাদের ট্যাঙ্ক ও বােমারু বিমানের মােকাবেলা করেছেন এবং তাদেরকে পিছু হটে গিয়ে নিজ শিবিরে আশ্রয় নিতে বাধ্য করেছেন। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ মুক্ত। বৈদেশিক সাংবাদিকরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের যে কোনাে জায়গায় বিনা বাধায় ঘুরে বেড়াতে পারেন এবং আপনাদের এ বিজয়ের কথা তারা বাইরের জগৎকে জানাচ্ছেন। | আজ প্রতিরােধ আন্দোলনের কথা গ্রাম-বাংলার প্রতিটি ঘরে পৌঁছে গেছে। হাজার হাজার মানুষ আজকের এই স্বাধীনতা সংগ্রামে যােগ দিয়েছেন। বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও ই.পি.আর,এর বীর বাঙালি যােদ্ধারা এই স্বাধীনতা সগ্রামের যে যুদ্ধ তার পুরােভাগে রয়েছেন এবং তাদেরকে কেন্দ্র করে পুলিশ, আনসার, মােজাহিদ, আওয়ামী লীগ, স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী, ছাত্র, শ্রমিক ও অন্যান্য হাজার হাজার সংগ্রামী মানুষ এই যুদ্ধে যােগ দিয়েছেন। অতি অল্প সময়ের মধ্যে এদেরকে সমর কৌশলে পারদর্শী করা হয়েছে ও শত্রুদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নেওয়া অস্ত্র ও গােলা-বারুদ দিয়ে বাংলার ও মুক্তিবাহিনীকে শত্রুদের মােকাবেলা করার জন্যে প্রস্তুত করা। হয়েছে। সাগরপারের বাঙালি ভাইয়েরা যে যেখানে আছেন আমাদেরকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য পাঠাচ্ছেন। | সিলেট ও কুমিল্লা অঞ্চলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর খালেদ মােশাররফকে আমরা সমর পরিচালনার দায়িত্ব দিয়েছি। খালেদ মােশাররফের নেতৃত্বে আমাদের মুক্তিবাহিনী অসীম সাহস ও কৃতিত্বের সাথে শত্রুর সঙ্গে মােকাবেলা করেছেন এবং শত্রু সেনাদেরকে সিলেট ও কুমিল্লার ক্যান্টনমেন্টের ছাউনিতে ফিরে যেতে বাধ্য করেছেন। আমাদের মুক্তিবাহিনী শীঘই শক্রকে। নিঃশেষ করে দেবার সংকল্প গ্রহণ করেছে। চট্টগ্রাম ও নােয়াখালি অঞ্চলে সমর পরিচালনার ভার পড়েছে মেজর জিয়াউর রহমানের ওপর। নৌ, স্থল ও বিমান বাহিনীর আক্রমণের মুখে চট্টগ্রাম শহরে যে প্রতিরােধব্যুহ গড়ে উঠেছে এবং আমাদের মুক্তিবাহিনী ও বীর চট্টলার ভাইবােনেরা যে সাহসিকতার সাথে শক্রকে মােকাবেলা করেছেন, স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এই প্রতিরােধ স্ট্যালিনাডের পাশে স্থান পাবে। এই সাহসিকতাপূর্ণ প্রতিরােধের জন্য চট্টগ্রাম আজ শক্রর কবলমুক্ত হয়েছে। চট্টগ্রাম শহরের কিছু অংশ ছাড়া চট্টগ্রাম ও সম্পূর্ণ নােয়াখালি জেলাকে মুক্ত এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল অঞ্চলের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে মেজর শফিউল্লাহর ওপর। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল এলাকা সম্পূর্ণভাবে মুক্ত করে আমাদের মুক্তিবাহিনী ঢাকার দিকে অগ্রসর হবার প্রস্তুতি নিচ্ছে। পূর্বাঞ্চলের এই তিনজন বীর সমর পরিচালক ইতােমধ্যে বৈঠকে মিলিত হয়েছেন এবং একযােগে ঢাকা রওনা হবার পূর্বেই পূর্বাঞ্চলের শত্রুদের ছােট ছােট শিবিরগুলােকে সমূলে নিপাত করবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চলে ই.পি.আর-এর বীর সেনানী মেজর ওসমানের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয়েছে কুষ্টিয়া ও যশাের জেলার । কুষ্টিয়ার ঐতিহাসিক বিয়ের পর আমাদের মুক্তিবাহিনী সমস্ত এলাকা থেকে শত্রুবাহিনীকে বিতাড়িত করেছে এবং শত্রুসেনা এখন যশাের ক্যান্টনমেন্টে ও খুলনা শহরের একাংশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মেজর জলিলের ওপর ভার দেওয়া হয়েছে ফরিদপুর-খুলনা-বরিশাল-পটুয়াখালির। উত্তরবঙ্গে আমাদের মুক্তিবাহিনী মেজর আহমদের নেতৃত্বে রাজশাহীকে শত্রুর কবল থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করেছেন। মেজর নজরুল হক সৈয়দপুরে ও মেজর নওয়াজেশ রংপুরে শত্রুবাহিনীকে সম্পূর্ণ অবরােধ করে বিব্রত করে তুলেছেন। দিনাজপুর, পাবনা ও বগুড়া জেলাকে সম্পূর্ণ মুক্ত করা হয়েছে। রংপুর ও সৈয়দপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকা ছাড়া জেলার বাকি অংশ এখন মুক্ত। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের এ অভূতপূর্ব সাফল্য ভবিষ্যতে আরও নতুন সাফল্যের দিশারী। প্রতিদিন আমাদের মুক্তিবাহিনীর শক্তি বেড়ে চলেছে। একদিকে যেমন হাজার হাজার মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যােগ দিচ্ছে তেমনি শক্রর আত্মসমর্পণের সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। আর একই সঙ্গে আমাদের নিয়ন্ত্রণে আসছে শক্রর কেড়ে নেয়া হাতিয়ার। এই প্রাথমিক বিজয়ের সাথে সাথে মেজর জিয়াউর রহমান একটি বেতার কেন্দ্র গড়ে তােলেন এবং সেখান থেকে আপনারা শুনতে পান স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম কন্ঠস্বর । এখানেই প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের কথা ঘােষণা করা হয়। আপাতত আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়েছে দক্ষিণপশ্চিম অঞ্চলের মুক্ত এলাকায়। পূর্বাঞ্চলের সরকারি কাজ পরিচালনার জন্যে সিলেট-কুমিল্লা এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের আর একটি কার্যালয় স্থাপন করা হয়েছে। আমরা এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রের প্রতিনিধি, কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি, তারা যেন স্বচক্ষে এবং সরেজমিনে দেখে যান যে স্বাধীন বাংলাদেশ আজ সত্যে পরিণত হয়েছে। সাথে সাথে আমরা সমস্ত বন্ধু রাষ্ট্র ও পৃথিবীর সমস্ত সহানুভূতিশীল ও মুক্তিকামী মানুষের কাছে ও ‘রেডক্রস’ ও অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার কাছে সাহায্যের আহ্বান জানাচ্ছি। যারা আমাদের সাহায্য করতে ইচ্ছুক অথচ বর্বর ইসলামবাদ শক্তি যাদের এই মানবিক কাজটুকু করবার বিরুদ্ধে নিষেধ উঁচিয়ে দাড়িয়েছে তারা এখন স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সাথে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করতে পারেন। | আমরা যদিও বিদেশ থেকে পাঠানাে ত্রাণ-সামগ্রীর জন্যে কৃতজ্ঞ, কিন্তু এটা ভুলে গেলে চলবে না যে, আজকের দিনে বাংলাদেশের জন্যে সবচেয়ে বড় ত্রাণের বাণী বয়ে আনতে পারে উপযুক্ত এবং পর্যাপ্ত হাতিয়ার, যা দিয়ে বাংলাদেশের মানুষ হানাদারদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে পারে এবং রক্ষা করতে পারে তার ও তার প্রিয় পরিজনের জান, মান আর সম্রম। বৃহৎ শক্তিবর্গের অস্ত্রাগারের আধুনিক সরঞ্জামে সজ্জিত জেনারেল ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী আজ আমাদের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র বাঙালির কণ্ঠ স্তব্ধ করে দেওয়ার এক পৈশাচিক উত্ততায় মত্ত। আমরা সেইসব বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে মানবতার নামে আবেদন জানাচ্ছি, যেন এই হত্যাকারীদের হাতে আর অস্ত্র সরবরাহ করা না হয়। এ সমস্ত অস্ত্র দেয়া হয়েছিল বিদেশি শত্রুর আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্যে বাংলার নিস্পাপ শিশুদেরকে ও নিরপরাধ নরনারীকে নির্বিচারে হত্যা করার জন্যে নিশ্চয়ই এ অত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের কৃষক-শ্রমিকের মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কষ্টার্জিত বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে যে অস্ত্র কেনা হয়েছে এবং যাদের টাকায় ইয়াহিয়া খানের এই দস্যুবাহিনী পুষ্ট, আজ তাদেরকেই নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। আমরা অস্ত্র সরবরাহকারী শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানাচ্ছি যে, শুধু অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করলেই চলবে না, যে অস্ত্র তাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে সে অস্ত্র দিয়ে সাড়ে সাত কোটি বাঙালিকে স্তব্ধ করে দেওয়ার প্রয়াস বন্ধ করতে হবে।
পৃথিবীর জনমতকে উপেক্ষা করে আজও ইয়াহিয়ার ভাড়াটে দস্যুরা বাংলাদেশের বুকে নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। তাই আমরা সমস্ত দেশের কাছে অস্ত্র সাহায্য চাচ্ছি এবং যারা জাতীয় জীবনে স্বাধীনতাকে সর্বোচ্চ মূল্য দিয়ে এসেছেন ও নিজেদের দেশেও হানাদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন তারা আমাদের এ ডাকে সাড়া না দিয়ে পারবে না, এ বিশ্বাস আমরা রাখি।
বিদেশি বন্ধু রাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের কাছে। এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানবজাতির শাশ্বত অধিকার। বহু বছরের সংগ্রাম, ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্যে যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোনাে বিদেশি রাষ্ট্রের উপ-রাষ্ট্র হবার জন্যে নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তি কামী দেশ হিসাবে রাষ্ট্র পরিবারগােষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার। আমাদের বাঙালি ভাইয়েরা, আপনারা পৃথিবীর যে কোনাে প্রান্তে থাকুন না কেন, আজকে মাতৃভূমির এই দুর্দিনে সকল প্রকার সাহায্য নিয়ে আপনাদেরকে এগিয়ে আসতে হবে। বিদেশ থেকে অর্থসংগ্রহ করে অস্ত্র কিনে আমাদের মুক্ত এলাকায় পাঠিয়ে দিন, যাতে করে আমাদের মুক্তিবাহিনীর সৈনিকরা অতি সত্বর সে অস্ত্র ব্যবহার করতে পারে তার মাতৃভূমিকে রক্ষা করবার কাজে। ইতােমধ্যেই আমাদের বাংলাদেশের ঘরে ঘরে প্রত্যেকেই নিজেদের হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছেন। যাদের হাতে আজও আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারিনি তাদের আহ্বান জানাচ্ছি, যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে লড়াইয়ে অংশ নিন। আমাদের স্থির বিশ্বাস যে, শীঘ্রই আপনাদের হাতে আমরা আধুনিক অস্ত্র তুলে দিতে পারব। ইতােমধ্যে প্রত্যেক আধুনিক অস্ত্র ব্যবহারের ট্রেনিং নেবার জন্যে নিকটবর্তী সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যােগাযােগ করুন। যাদের হাতে আধুনিক অস্ত্র নেই তাদেরও এই জনযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব এবং ক্ষমতা রয়েছে। শত্রুর ছত্রী ও গুপ্তবাহিনীকে অকেজো করে দেবার কাজে আপনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারেন। সম্মুখসমরের কাজ না করতে পারলেও আপনি রাস্তা কেটে, পুল উড়িয়ে দিয়ে এবং আরাে নানাভাবে আপনার উপস্থিত বুদ্ধি দিয়ে শত্রুকে হয়রান ও কাবু করতে পারেন। নদীপথে শত্রু যাতে না আসতে পারে তার সম্ভাব্য সমস্ত ব্যবস্থা আপনাকেই গ্রহণ করতে হবে ও সবদিকে কড়া দৃষ্টি রাখতে হবে। নদীপথে সমস্ত ফেরি, লঞ্চ ও ফ্ল্যাট অকেজো করে দিতে হবে। এ সমস্ত দায়িত্ব পালন করার জন্যে স্থানীয় এলাকার সমর পরিচালকের সাথে সংগ্রাম পরিষদের মাধ্যমে যােগাযােগ করতে হবে এবং তার আদেশ ও নির্দেশাবলি মেনে চলতে হবে। যুদ্ধে অংশ নেয়া ছাড়াও বাংলাদেশকে সব দিক দিয়ে বাঁচিয়ে রাখবার দায়িত্বকেও অবহেলা করলে চলবে না। শাসনকার্যে অভিজ্ঞ ও সংশ্লিষ্ট বাঙালি অফিসারদের মধ্যে যারা এখনাে আমাদের সাথে যােগ দিতে পারেননি, তারা যে যেখানেই থাকুন না কেন, আমরা তাদেরকে মুক্ত এলাকায় চলে আসতে আহ্বান জানাচ্ছি। অনুরূপভাবে আমরা আহ্বান জানাচ্ছি সমস্ত বুদ্ধিজীবী, টেকিনিশিয়ান, ইনজিনিয়ার, সংবাদপত্রসেবী, বেতার শিল্পী, গায়ক ও চারুশিল্পীদের, তারা যেন অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। আমাদের সামনে বহুবিধ কাজতার জন্যে বহু পারদর্শীর প্রয়ােজন এবং আপনারা প্রত্যেকেই স্বাধীন বাংলাদেশের সেবায় আত্মনিয়ােগ করবার সুযােগ পাবেন। আমরা বিশেষ করে সমস্ত রাজনৈতিক দলের নেতাদেরকে বাংলাদেশের এই সংঘবদ্ধ জনযুদ্ধে সামিল হতে আহ্বান জানাচ্ছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে সাড়ে সাত কোটি মানুষের এই ঐতিহাসিক প্রতিরােধ ও প্রতিরক্ষা আন্দোলনকে চিরাচরিত রাজনৈতিক গণ্ডির উর্ধ্বে রাখবার জন্যে আমরা আবেদন জানাচ্ছি। হানাদার শত্রুবাহিনীর সাথে কোনাে প্রকার সহযােগিতা করা বা সংস্রব রাখা চলবে না। বাংলাদেশে আজ কোনাে মীরজাফরের স্থান নেই। যদি কেউ হঠাৎ করে নেতা সেজে শত্রু সৈন্যের ছত্রছায়ায় রাজনৈতিক গাের থেকে গাত্রোত্থান করতে চায়, যাদেরকে গত সাধারণ নির্বাচনে বাংলার মানুষ ঘৃণ্যভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে, তারা যদি এই সুযােগে বাংলাদেশের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে, বাংলাদেশের স্বার্থবিরােধী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়, তবে বাংলাদেশের মানুষ তাদেরকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, তারা সাড়ে সাত কোটি বাংলাদেশবাসীর রােষবহ্নিতে জ্বলে খাক হয়ে যাবে। আমাদের মনে রাখতে হবে যে, আমাদের দেশের উপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। কাজেই স্বাধীন জীবনযাত্রা ব্যাহত হতে বাধ্য। হয়ত কোথাও নিত্য প্রয়ােজনীয় জিনিসের ঘাটতি দেখা যেতে পারে। আমাদের উচিত হবে যতদূর সম্ভব ব্যয়সংকোচ করা এবং জিনিসপত্র কম ব্যবহার করা। দোকানদার ও ব্যবসায়ীদের কাছে বিশেষ অনুরােধ তারা যেন মজুতদারি ও কালােবাজারির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন এবং জিনিসপত্রের দাম যাতে সাধারণ লােকের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে যায় তার দিকে দৃষ্টি রাখেন। । এ যুদ্ধে যে আমাদের জয় অবশ্যম্ভাবী তাতে সন্দেহের কারণ নেই। আপনারা ইতােমধ্যে সাহস ও ত্যাগের বিনিময়ে যে বিজয় অর্জন করেছেন শত্রুপক্ষ আজকে তা স্পষ্টই বুঝতে পেরেছে। তারা ভেবেছিল যে, আধুনিক সমর সজ্জায় এবং কামানের গর্জনের নিচে স্তব্ধ করে দেবে বাঙালির ভবিষ্যৎ আশা-ভরসা। আর চোখ রাঙিয়ে ভয় দেখিয়ে বাঙালিকে তারা বুটের নিচে নিষ্পেষণ করবে। কিন্তু তাদের সে আশা আজ ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আমরা তাদের মারমুখী আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে আছি এবং তাদেরকে যে প্রতিনিয়ত হটিয়ে দিচ্ছি এতে তাদের সমস্ত যড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়ে গেছে। তাদের খাদ্য সরবরাহের সকল পথ আজ বন্ধ ঢাকার সাথে আজ তাদের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। উড়োজাহাজ থেকে খাবার ফেলে এদেরকে ইয়াহিয়া খান আর বেশি দিন টিকিয়ে রাখতে পারবে না। ওদের জ্বালানি সরবরাহের লাইন আমাদের মুক্তিবাহিনী বন্ধ করে দিয়েছে। ইয়াহিয়ার উড়ােজাহাজ আর বেশি দিন বাংলাদেশের আকাশে দেখা যাবে না। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি উত্তাল জনসমুদ্রের মাঝখানে ওরা আজকে বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতাে। বাংলাদেশের আকাশে শীঘই ঝড়ের মাতম শুরু হচ্ছে। ওরা জানে ওরা হানাদার। ওরা জানে ওদের বিরুদ্ধে পৃথিবীর সমস্ত মানুষের দ্রুকুটি ও ঘৃণা। ওরা আঁত,- ওরা সন্ত্রস্ত,- মৃত্যু ওদের সামনে পরাজয়ের পরােয়ানা নিয়ে হাজির। তাই ওরা উন্মাদের মতাে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছে। পৃথিবী আজ সজাগ হয়েছে। পৃথিবীর এই অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র বাংলাদেশের দিকে তাকিয়ে আছে বিশ্বের মানুষ যেখানে ওরা এ ধ্বংসের খেলায় মেতে উঠেছে। বিশ্বের মানুষ আজ আর ইসলামাবাদ সরকারের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার মিথ্যা যুক্তি আর অজুহাত স্বীকার করে নিতে রাজি নয়। যে সমস্ত সাংবাদিক বাংলাদেশের এই যুদ্ধের ভয়াবহতা ও নৃশংসতা থেকে অব্যাহতি পেয়েছেন তারা ইয়াহিয়ার এই অন্যায় ও অমানবিক যুদ্ধ আর ধ্বংসলীলার বিরুদ্ধে নিন্দা জানাচ্ছেন। অপরপক্ষে যে সমস্ত সাংবাদিক আমাদের মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করছেন তারা বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন বাংলাদেশের মানুষের এই বীর প্রতিরােধ যুদ্ধের খবর আর বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন ইয়াহিয়া সরকারের ধ্বংস ও তাণ্ডবলীলার চাক্ষুষ প্রমাণ।
‘ ইতােমধ্যে সােভিয়েট রাশিয়া এবং ভারতবর্ষ এই নির্বিচার গণহত্যার বিরুদ্ধে তাদের হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে এবং সােভিয়েট রাশিয়া অবিলম্বে এই হত্যাযজ্ঞ ও নিপীড়ন বন্ধ করবার আহ্বান জানিয়েছে। গ্রেট বৃটেনও বাংলাদেশের এ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছে। যে সমস্ত পাকিস্তানি বিমান মৃত্যুর সরঞ্জাম নিয়ে ঢাকা আসার পথে জ্বালানি সংগ্রহ করছিল, তাদেরকে জ্বালানি সরবরাহ করতে অস্বীকৃতি জানিয়েছে আমাদের প্রতিবেশী রাষ্ট্র সিংহল ও ব্রহ্মদেশ। যদিও কোন কোন দেশ বাংলাদেশের ঘটনাবলিকে পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে। অভিহিত করেছেন, তবু এ কথা এখন দিব্যলােকের মতাে সত্য হয়ে গেছে যে, সাড়ে সাত কোটি
মানুষকে পিষে মারার চেষ্টা, তাদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতাকে ব্যর্থ করে দেবার ষড়যন্ত্র একটি আন্ত জাতিক ব্যাপারে পরিগণিত হয়েছে এবং এই সমস্যা আজ পৃথিবীর সমস্ত মানুষের বিবেককে। নাড়া দিচ্ছে। বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমরা বিদেশে অবস্থানরত বাঙালি ভাইদের বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও পৃথিবীর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে অনুরােধ জানিয়েছি। পৃথিবীর বিভিন্ন রাজধানীতে আমরা আমাদের স্বাধীনতা ও আত্মরক্ষার সংগ্রামে সাহায্য ও সহানুভূতি চেয়ে পাঠাচ্ছি।
| আমাদের যে সমস্ত ভাইবােন শক্রকবলিত শহরগুলােতে মৃত্যু ও অসম্মানের নাগপাশে আবদ্ধ, আদিম নৃশংসতার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সাহস ও বিশ্বাসের সাথে মুক্তির পথ চেয়ে আছেন তাদেরকে আমরা এক মুহূর্তের জন্যে ভুলতে পারি না। যারা আমাদের সংগ্রামে শরিক হতে চান তাদের জন্যে রইল আমাদের আমন্ত্রণ। যাদের পক্ষে নেহাৎই মুক্ত এলাকায় আসা সম্ভব নয় তাদেরকে আমরা আশ্বাস এবং প্রেরণা দিচ্ছি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, শহীদ ভাইবােনদের বিদেহী আত্মার পক্ষ থেকে। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে পারে না। ইনশাআল্লাহ, জয় আমাদের সুনিশ্চিত। | আমাদের যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে না বলে আমাদের স্থির বিশ্বাস; কারণ প্রতিদিনই আমাদের। শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে এবং আমাদের এ সংগ্রাম পৃথিবীর স্বীকৃতি পাচ্ছে। কিন্তু আমাদের মুক্তিবাহিনীর হাতে শেষ পরাজয় মেনে নেয়ার আগে শত্রুরা আরাে অনেক রক্তক্ষয় আর ধ্বংসলীলা সৃষ্টি করবে। তাই পুরাতন পূর্ব-পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার। সংকল্পে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহুর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকার অর্থে এ কথাই বলতে হয় যে, এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ। খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, ছাত্র-জনতা তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্নপ্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়ে সাত কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্যে রচিত হােক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শশাষণ করবে না। আমাদের প্রতিজ্ঞা হােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত হােক সাড়ে সাত কোটি বীর বাঙালি ভাইবােনের সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা; গণ-মানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হােক ‘জয় বাংলা’, ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ’। TAJUDDIN CALLS FOR ARMS AID Text of Mr. Tajuddin Ahmad’s broadcast on April 14, 1971.
The Bangladesh Prime Minister, Mr. Tajuddin Ahmad, today invited the world Press and diplomatic and political observers to tour the liberated areas and see for themselves the realities in his free country.
In a broadcast over the Swadhin Bangla Betar Kendra Mr. Ahmad, also asked friendly Governments and people as well as international agencies like the Red Cross to establish direct contact with the Bangladesh Government and render help.
Laying special emphasis on arms help which was “a permanent need for Bangladesh today”, the Prime Minister said arms were immediately needed to repel the aggressors. He also appealed to countries supplying arms and ammunition to Pakistan to suspend forth with their supplies to an “army of murderers who were killing innocent men, women and children”. (THE TIMES OF INDIA, New Delhi-April 15, 1971)
এপ্রিল ১৭, ১৯৭১ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের ভাষণ : | আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদেরকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে, তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাবার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। আমি কিছু বলবার আগে প্রথমেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি আমাদের সংবাদপত্রসেবী এবং নিউজ এজেন্সির প্রতিনিধিদের যে, তারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে আগাগােড়া সমর্থন দিয়ে গিয়েছেন এবং সত্য কথা প্রকাশ করতে চেষ্টা করেছেন। যদিও ইয়াহিয়া সরকার তাদেরকে এবং তার সেই দস্যু বাহিনী বিদেশি সাংবাদিকদের ভেতরে আসতে দেয়নি, যারা ভেতরে ছিলেন তাদেরও জবরদস্তি করে ২৫ তারিখ রাতেই বের করে দিয়েছেন। আমি আপনাদের আরাে ধন্যবাদ দিচ্ছি, আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি এই জন্য যে, আমার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে সংগ্রাম, স্বাধীনতা সংগ্রাম, সেই সংগ্রাম কোনাে অবস্থাতেই যাতে ব্যাহত না হয় এবং কোনাে অবস্থাতেই সে সংগ্রামকে ভুল ব্যাখ্যা না দেয়া হয় সে জন্য আপনারা আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন, সঠিক পথ দেখিয়েছেন। | আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে আবেদন জানাব ভবিষ্যতেও আপনারা দয়া করে চেষ্টা করবেন যাতে সঠিক সংবাদ পরিবেশিত হয়, যাতে কোনাে দুষ্কৃতকারী বা কোনাে শক্র বা এজেন্ট ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে আমাদের আন্দোলনের কোনাে রকম ভুল ব্যাখ্যা করতে না পারে, ভুল বােঝাতে না পারে। সেই সাথে আমি আপনাদের আরাে অনুরােধ জানাৰ আমাদের বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে হ্যান্ড আউট যাবে সেটাকেই বাংলাদেশ সরকারের সঠিক ভাষ্য বলে ধরে নেবেন, সেটাকেই ভিত্তি হিসেবে ধরে নেবেন। আর আমি আপনাদের আরাে একটি অনুরােধ জানাব, জানি না কীভাবে সেটা সম্ভব হবে, আমাদের বাংলাদেশের মাটি থেকে আপনারা কীভাবে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন, কীভাবে বাংলাদেশ সরকারের সাথে লিয়াজো করতে পারেন সেই ব্যাপার আপনারা চিন্তা করে দেখবেন এবং সেই ব্যাপারে আপনাদের পরামর্শ আমরা অত্যন্ত সাদরে, আনন্দের সাথে গ্রহণ করব।
এখন আমি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমার ভাষ্য তুলে ধরব। বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের ঔপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্ম-নিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনাে বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে গণ-হত্যার আসল ঘটনাকে ধামাচাপা দেয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে কীভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা আকাঙ্ক্ষাকে সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন। | পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ৬-দফার আলােকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ৬-দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মােট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের মধ্যে মােট ১৬৭টি আসন লাভ করেছিল। নির্বাচনী বিজয় এতই চূড়ান্ত ছিল যে, আওয়ামী লীগ মােট শতকরা আশিটি ভােট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চূড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। | স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক অশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চূড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ৬-দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযােগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু এবং পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ৬-দফাকে এগিয়ে গিয়েছিল। কাজেই ৬-দফাকে গ্রহণ বা প্রত্যাখ্যান করার জন্য জনগণের কাছে এই দলের জবাবদিহি ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি ছিল ৬-দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ৬-দফার আলােকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল। আশা করা গিয়েছিল যে, জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলাে আলােচনায় বসবে। এমনি আলােচনার প্রস্তাব এবং পাল্টা প্রস্তাবের ওপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সব সময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে, যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবােধকে জাগ্রত রাখার জন্য গােপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদেই গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্বর জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের লক্ষ্যে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে গেল এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষা করে দেখল। | পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলােচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ‘৭১-এর মাঝামাঝি সময়ে। এই বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ৬-দফা ভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন। এবং ফল কী হতে পারে তারও নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্ত বিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে, ৬-দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি। তবে পাকিস্তান পিপলস পার্টির সাথে একটি সমঝােতায় আসার পর তিনি জোর দিলেন। পরবর্তী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে ঢাকায় ২৭ জানুয়ারি ‘৭১। জনাব ভুট্টো এবং তার দল আওয়ামী লীগের সাথে গঠনতন্ত্রের ওপর আলােচনার জন্য এ সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হন।
ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামাে সম্পর্কে কোনাে সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তার দল ৬-দফার বাস্তব ফল কী হতে পারে সে সম্পর্কে আলােচনার প্রতিই অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না সূচক, এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোনাে তৈরি বক্তব্যও ছিল না, সেহেতু, এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপস ফরমুলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সব সময়ই ভােলা ছিল। এই আলােচনা বৈঠক থেকে এটাও স্পষ্ট হয়ে গেল। যে, কোন পর্যায় থেকে আপস ফরমুলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোনাে বক্তব্য ছিল না। | এখানে একটি কথা আরাে পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার যে, আওয়ামী লীগের সাথে আলােচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোনাে আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলােচনার জন্য সব দরজাই খােলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলােচনার পর পাকিস্তান পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরাে অধিক ফলপ্রসূ আলােচনায় বসবেন, অথবা জাতীয় পরিষদে তারা ভিন্নভাবে আলােচনায় বসার জন্য অনেক সুযােগ পাবেন। পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এই সিদ্ধান্ত এ জন্যই সবাইকে আরাে বেশি বিস্মিত করে যে, শেখ মুজিবের দাবি মােতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে | প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জুঠোর কথা মতােই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘােষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদের পরিষদের | অধিবেশনে যােগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হস্তকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যান ও ইয়াহিয়ার ঘনিষ্ঠ সহচর লে. জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দেখা করে তাদের ওপর পরিষদের অধিবেশনে যােগদান না। করার জন্য চাপ দিতে থাকেন। জবাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্ত্বেও পি.পি.পি, ও | কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩ মার্চ জাতীয় পরিষদের
অধিবেশনে যােগদানের জন্য বিমানে পূর্ব-বাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমনকি কাইয়ুম | লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে, পি.পি.পি-র বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোনাে কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ১ মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মুলতবি ঘােষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশি করার জন্য। শুধু তাই নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব-বাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে মধ্যপন্থী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে মন্ত্রিসভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারি জান্তার হাতে তুলে দেয়া হলাে। এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোনক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণ-রায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল। * একমাত্র স্থান যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকরী করতে পারত এবং রাজনৈতিক শক্তি | প্রদর্শন করতে পারত। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় | পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে একটা ইটো জগন্নাথে পরিণত করার। জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশঙ্কা করা হয়েছিল। তা-ই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে, ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনাে ইচ্ছাই ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারি রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিল যে, এক পাকিস্তানের কাঠামােতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোনাে সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহ্বান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা এক বাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘােষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন। | শেখ মুজিব এতদসত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩ মার্চ অসহযােগ কর্মসূচির আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মােকাবিলার জন্য। শান্তির অন্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনাে তিনি আশা করছিলেন যে, সামরিক চক্র তাদের জ্ঞানবুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২ ও ৩০ মার্চ ঠান্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র ও নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। শেখ সাহেবের অসহযােগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযােগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযােগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরী অসহযােগ আন্দোলন কোথায় সাফল্য লাভ করেনি ! পূর্ণ অসহযােগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ। অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেল না হাইকোর্টের কোনাে বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণ-প্রশাসন বিভাগের কর্মচারীগণ কাজে যােগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিল। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারীগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যােগদান থেকে বিরত থেকে তারা ক্ষান্ত হলেন না, অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লােকেরাও সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন শেখ সাহেবের প্রতি। তারা স্পষ্টভাবে ঘােষণা করলেন যে, আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারাে নির্দেশ মেনে চলবেন না। | এ অবস্থার মুখােমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহযােগের মধ্যে। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হলাে । এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসন ও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্ব্যর্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলি সর্বান্তকরণে মাথা পেতে মেনে নিলেন এবং সমস্যাবলির সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযােগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরূহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলির মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের কোনাে আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযােগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইন শৃঙ্খলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগ ও ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ ইয়াহিয়াকে একটা কন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলাে। কেননা তার ঐ দিনের প্ররােচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সঙ্কটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপালেন আওয়ামী লীগের ওপর। অথচ যিনি ছিলেন সঙ্কটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকার সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লে. জেনারেল ইয়াকুব খানের স্থলে পাঠানাে হলাে লে. জেনারেল টিক্কা খানকে। এই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনােভাবের পরিচয়। কিন্তু ইতােমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যােগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪-দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানাের জন্য ইয়াহিয়াকে দেয়া হয় তার শেষ সুযােগ। বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্ত েিনর রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণ-হত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করা। এটা আজ। পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে যে, অনুরূপ একটি সঙ্কট সৃষ্টির পরিকল্পনা বেশ আগেভাগেই নেয়া হয়েছিল। | ১ মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়ােজিত ট্যাঙ্কগুলাে ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানি কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লােকদের পরিবার পরিজনদেরও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানাে হতে থাকে। | ১ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তােলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পি.আই.এ-এর কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পােশাকে সশস্ত্র বাহিনীর লােকদের বাংলাদেশে আনা হলাে। সি ১৩০ পরিবহন বিমানগুলাের সাহায্যে অস্ত্র এবং রসদ এনে বাংলাদেশে স্থূপীকৃত করা হয়। হিসাব নিয়ে জানা গেছে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে প্রয়ােজনীয় সাজ সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমান বন্দর এলাকায় আর্টিলারি ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন-নির্গমনের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড সংগঠনে ট্রেনিংপ্রাপ্ত একদল এস. জি. কমান্ডাে গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেয়া হয়। ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যেসব কুকাণ্ড ঘটে এরাই সেগুলাে সংঘটন করেছিল। সামরিক হস্ত ক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এ সবের উদ্দেশ্য। | প্রতারণা বা ভণ্ডামির এই স্ট্রাটেজি গােপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলােচনায় আপসমূলক মনােভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ মার্চ আলােচনা শুরু হলে ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলােচনার এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪-দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনােভাব কী ? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোনাে আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে, ৪-দফা শর্ত পূরণের ভিত্তিতে উভয় পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন। আলােচনাকালে যে সব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলাে হলাে : ১। মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘােষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ২। প্রদেশগুলােতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর। ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন। ৪। জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন। আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভূট্টোর মনােনয়নের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬-দফা হলাে বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযােগ্য নীলনকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়ােগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করবে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এম,এন,এ. দের পৃথকভাবে বসে ৬-দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলােপের আলােকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তােলার সুযােগ অবশ্যই দিতে হবে। | শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এই নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় এবং তা হলাে অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন। এক্ষেত্রেও উভয় পক্ষ এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬-দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মােটামুটি তার আলােকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে। | অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম, এম, আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের সাথে আলাপ-আলােচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ কথা বলেন যে, রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬-দফা কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লভ কোনাে সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না। আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিনটি সংশােধনী পেশ করেছিলেন তাতে এ কথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে, সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোন শব্দ বসবে তা নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষার সামান্য রদবদলসহ সংশােধনীগুলাে আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্তকরণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোনাে বাধাই ছিল না। | এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয়, কোনাে পর্যায়েই আলােচনা অচলাবস্থায় সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তার উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোনাে কথা বলেননি যে, তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণ-হত্যাকে ধামাচাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোছুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলােচনায় তিনি এবং তার দলবল একমত হয়েছিলেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘােষণার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকড় তুলেছেন ইয়াহিয়া তা-ই অনুমােদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘুণাক্ষরেও মুজিবকে এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার ইয়াহিয়া যদি আভাস-ইঙ্গিতেও এ কথা বলতেন তাহলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করত না। কেননা এমন একটা
সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলােচনা বানচাল করতে দেয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশি করার জন্যই করা হয়েছিল। এটা কোনাে সময়ই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না। | ২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম, এম, আহমদ তার সংশােধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোনাে চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং জবাব এম, এম, আহমদ। আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ মার্চ করাচি চলে গেলেন। ২৫ মার্চ রাত ১১টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে পজিশন’ গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হলাে। গণ-হত্যার এক পূর্ব নির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোনাে চরমপত্র। অথবা মেশিন গান, আর্টিলারি সুসজ্জিত ট্যাঙ্কসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাপিয়ে পড়ল ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি কোনাে কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লােক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরােধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুণ্ডে, প্রতিটি অলিগলি ও আনাচেকানাচে চলতে লাগল নির্বিচারে গুলি। সামরিক বাহিনীর লােকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযােগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যেসব মানুষ। বের হওয়ার চেষ্টা করল তাদের নির্বিচারে হত্যা করা হয় মেশিনগানের গুলিতে। আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ইপিআর বীরের মতাে লড়ে গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোনাে প্রতিরােধ দিতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযােগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শীঘই তা প্রকাশ করব। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে, সব বর্বরতা ও নিষ্টতার কাহিনি আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সবকিছুকে ম্লান করে দিয়েছে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদের দিয়ে গেলেন বাঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন, পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানান হলাে এর কৈফিয়ত। এই বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পর বিরােধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘণ্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ-আলােচনা চালাচ্ছিলেন সে দলের লােকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘােষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ-আলােচনায় কোনাে সঙ্গতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘােষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির। অবাধ মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তার বক্তব্য থেকে এ কথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলাে যে, ইয়াহিয়া আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব-পাকিস্তানের মধ্যে একটা দুর্লজ্জ প্রাচীর হিসেবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার। লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোনােমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লম্বন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মতাে। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোেগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথারই আভাস মেলে যে, ইয়াহিয়া খান। ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রােথিত হয়ে গেছে। যদি না হতাে। তাহলে তারা একই দেশের মানুষের ওপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারত না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচারে গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানের বিয়ােগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন বাঙালির রক্ত দিয়ে। বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নিমূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পােড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হলাে আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা। প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলােকে ধূলিস্যাৎ করা, যাতে একটি জাতি হিসেবে কোনােদিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি। | ইতােমধ্যে এ লক্ষ্য পথে সেনাবাহিনী অনেকদূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শশাষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসেবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল। অসহযােগের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ। বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উট পাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে, এতদ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তাহলে তারা ভুল করেছেন। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যত সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মােহমুক্ত। তাদের বােঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনাে জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হােক কাল হােক দুনিয়ার ছােট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে। | সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার ওপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাঁচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সােভিয়েট ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করব। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সে জন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাব। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের ওপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়।
জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভস্ম ও ধ্বংসস্তৃপের ওপর একটা নতুন দেশ গড়ে তােলা। এ একটা দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা। প্রাণপণে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যৎকে উজ্জ্বল করতেই হবে। | আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে, সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোনাে। বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছােট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোনাে শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না। আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনােভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারাে তাঁবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্ম-নিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না। আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন। | বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোনাে জাতি। আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনাে জাতি আমাদের। চেয়ে কঠোরতর সগ্রাম করেনি, অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি। জয়বাংলা।”
সূত্র : তাজউদ্দীন আহমদ- নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ
৩২০
এপ্রিল, ১৯৭১
যুদ্ধাবস্থায় দরদরিয়া গ্রাম থেকে আবু আহসান (হাসান) কে লেখা
সৈয়দা জোহরা তাজউদ্দীনের চিঠি

এপ্রিল, ১৯৭১
স্নেহের হাসান
আশা করি ভাল আছ। বাসা থেকে কিভাবে সে রাতে বিভীষিকাময় মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে পরদিন কারফিউর মধ্যে দেওয়াল টপকিয়ে অন্য বাসায় যেয়ে তারপর পর পর ৭ দিন কোথায় কিভাবে কাটিয়ে তারপর এখানে কিভাবে এসেছি সে ইতিহাস কোন একদিন শুনতে পারবে, ৭ কোটি মানুষের সাথে ছেলেমেয়ে নিয়ে মিশে আছি-এটাই মহা সান্ত্বনা। ভাল আছি। | নদী পথে তুমি এখানে আসতে পার, রাস্তায় বা ট্রেনে সম্ভবই নয়। তুমি যদি ঢাকায় থাক, বাসার দিকে খেয়াল রেখ, সেখানে শুধু আব্বা আছেন। ঢাকার পরিস্থিতি খারাপের দিকেই যেতে পারে, শহরে কারােই থাকাটা সেফ নয়, বুদ্ধি বিবেচনা মত চলিও।
বাসার কিছু মূল্যবান জিনিষপত্র সুযােগ মত অন্য কোথাও সরিয়ে ফেলতে পারলে লুটের হাত থেকে হয়ত রক্ষা পেত। উপরতলায় রুমে আমার পেডেস্টাইল পাখাটা আছে। নিচে ঘরের পাখাগুলােও খুলে সরিয়ে ফেলা দরকার। | ফতুল্লায় ‘গ্রীনওয়েজ কোল্ড স্টোরেজ আছে ফতুল্লার পথে হাতের ডানে পড়বে। সেখানে গিয়ে হামিদ সাহেবের ভাই আছে, তার সাথে দেখা করে আমার কথা বলবে কিছু টাকা দেবার জন্য, দরকার হলে এই চিঠির এই অংশ দেখিও। পাচশত টাকা দিতে বলিও। বাচ্চার জন্য বড় তিন টিন ল্যাকটোজেন’, দুই টিন ফ্যারেক্স’, দেড় সের তালমিস্ত্রি দিও। আর ঔষধের মধ্যে, কাশির ঔষধ, একটা ‘বিনাড্রিল’, একটা ‘ফেনসিডিল এসকারবন tablet 100 mg এক শিশি। | বাসায় যেয়ে দিদারকে বলে অথবা তুমি নিজে মধ্যের ঘরে কোনায় ছােট আলমারির ড্রয়ারে বাচ্চার সব কাপড় আছে- খুব অসুবিধা হচ্ছে- গরম কাপড়ও বাচ্চার সেখানেই আছে ওগুলাে দিয়ে দিও, আর বেবিখাটের ড্রয়ারেও সার্ট প্যান্ট আছে। সব বুদ্ধি মত ব্যবস্থা করিও। বৌ, কনক কেমন আছে। সবার জন্য দোয়া রইল।
মামি।
—————–
আমাদের দরদরিয়া গ্রাম থেকে হাসান ভাইকে লেখা আম্মার চিঠি। এ চিঠি লেখার সময় আম্মা জানতেন
যে পাকিস্তান আর্মি আমাদের বাসায় ক্যাম্প স্থাপন করেছে। চিঠি পেয়ে আমাদের বাসার সামনে এসে হাসান ভাই দেখেন আমাদের পুরাে বাড়ি আর্মিরা ঘেরাও করে রেখেছে। আর্মির প্রশ্নের উত্তরে নানাকে দেখতে এসেছেন একথা বলে ভেতরে ঢুকে নানাকে দেখেই কোনমতে প্রাণ নিয়ে বের হয়ে আসেন।

Previous