This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা
শারমিন আহমদ
যাত্রা হলাে শুরু
প্রখ্যাত মনােবিজ্ঞানী এরিক এরিকসন তার গুরু ফ্রয়েডের কিছু বিতর্কিত মতবাদ খণ্ডন করেন। এরিকসনের এই নতুন মতবাদ তাকে নিওয়েডিয়ান পণ্ডিতদের মাঝে শীর্ষ আসনে পৌছে দেয়। এরিকসনের মতে, মানবজাতির মন-মানসিকতা যৌন প্রবৃত্তি নয়, বরং সমাজ থেকে পাওয়া অভিজ্ঞতার মাধ্যমেই তা গড়ে ওঠে। তিনি তার এই যুগান্তকারী মতবাদটিকে বিশদ ব্যাখ্যা ও পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে উপস্থাপন করতে গিয়ে বলেন, প্রতিটি মানুষই জীবনের আটটি স্তরে বিশেষ সংঘর্ষপূর্ণ পরিস্থিতির মুখােমুখি হয়ে থাকে। জীবনের শুরু থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত মানুষকে অগ্রগতির একেকটি স্তর পার হতে যেয়ে সংঘর্ষের মুখােমুখি হতে হয়। প্রতিটি স্তরে সে যেভাবে এই সংঘর্ষকে মােকাবিলা করে তার উপরই নির্ভর করে তার পরবর্তী সময়ের অগ্রগতি ও ব্যক্তিত্বের বিকাশ। এরিকসন বলেন, জন্মের পর থেকে প্রায় ৬ বছর বয়স পর্যন্ত একটি শিশুর পৃথিবীকে চেনার প্রধান মাধ্যম হলাে তার মা, বাবা ও পরিবার। এই সময়টিতে শিশু তার মা এবং বাবাকে অনুকরণ করার চেষ্টা করে; পরিবার তাকে প্রভাবিত করে। তাদের চালচলন, কথাবার্তা, ভিন্নতা ও সাদৃশ্যতার মাপকাঠিতে সে চেষ্টা করে পৃথিবীকে জানার। বিভিন্ন সামাজিক ও মানসিক সংঘাতকে সে কীভাবে মােকাবিলা করবে তার প্রস্তুতি শুরু হয় ঐ বয়স থেকেই। সৌভাগ্যবান শিশু, যারা দারিদ্রতা, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও প্রতিকূল অবস্থার কারণে বাবা-মাকে হারায়নি অথবা বঞ্চিত হয়নি তাদের স্নেহছায়া থেকে তাদেরই একজন হয়ে ষাটের দশকের শুরুতে আমার পৃথিবীতে যাত্রা শুরু। এর ফলে বাবা-মায়ের চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে পৃথিবীকে আমার জানার চেষ্টাও ধীরে ধীরে হতে থাকে বিস্তৃত। আমার আন্ধু ও আম্মা দুজনেই ছিলেন আত্মনিবেদিত, সংগ্রামী নারী ও পুরুষ। তাদের চিন্তা আবর্তিত হতাে দেশ ও দশকে কেন্দ্র করে। মানুষের প্রতি তাদের নিঃস্বার্থ মমত্ববােধ এবং অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের অবিচল প্রতিরােধ আমার মতাে অগণিত সাধারণ মানুষের দৃষ্টিতে তাঁদের করে তােলে। অসাধারণ। শৈশবে আব্বকে ঘিরে আমার স্মৃতি উজ্জ্বল নীলাকাশে খণ্ড খণ্ড শারদ মেঘের মতােই ভাসমান। তিনি ছিলেন এক ব্যতিক্রমধর্মী জীবন ও সময়ের অগ্রপথিক। তাকে ভালােভাবে জানার আগেই তিনি চলে গেলেন পৃথিবী ছেড়ে। তিনি চলে গেলেন আমার কৈশাের ও যৌবনের সন্ধিক্ষণে। তারপরও তাকে আবিষ্কার করার চেষ্টা করি প্রতিনিয়ত ঐ শৈশবের স্মৃতির মেঘমালার সাথি হয়ে। তার মধ্য দিয়েই বিশ্বকে খুঁজে দেখার চেষ্টা করি, কখনাে বিশ্বের অসীম রহস্যর মধ্যে খুঁজি তাকে।
আমার এই স্মৃতিচারণা মূলত আন্ধুকে নিয়েই। তবে এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে প্রাসঙ্গিকভাবে আরও নানা ঘটনা। যে প্রিয়জন চলে যায় অনন্তলােকে তার স্মৃতি হৃদয়ে ভরপুর হয়ে থাকে বেশি। মাত্রায়। ষাটের দশকের পৃথিবীতে যখন হাঁটি-হাঁটি পা-পা করে পথ চলা শুরু করলাম তখন সারা পৃথিবীতেই ব্যতিক্রমধর্মী নানা চিন্তাচেতনার আলােড়ন দেখা দিয়েছে। যারা ছিল এত কাল বাকরুদ্ধ ও নিপীড়িত তারা সবে সাড়া জাগাতে শুরু করেছে পৃথিবীর আনাচে-কানাচে। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলাের মাঝে বৃদ্ধি পেয়েছে ক্ষয়রােগ, তারা জায়গা করে দিচ্ছে পৃথিবীর দুই পারমাণবিক শক্তিতে। ধনতত্ববাদী, গণতান্ত্রিক যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচিত নেতা তারুণ্য শক্তির প্রতীকরূপে জয়যুক্ত হলেন জন এফ কেনেডি। আর ওদিকে ফ্লোরিডার মাত্র ৯০ মাইল দক্ষিণে কিউবার আর এক তরুণ ফিদেল ক্যাস্ট্রো মাত্র ৩২ বছর বয়সে গেরিলা যুদ্ধের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের মিত্র অত্যাচারী শােষক বাতিস্তা সরকারকে হটিয়ে পুরাে লাতিন আমেরিকায় ছড়িয়ে দিলেন স্ত্র বিপ্লবের ঢেউ। ষাট দশকের রােমান্টিক বিপ্লবের নায়ক ফিদেলের গেরিলা সংগ্রামের সাথি চেগুয়েভারা বিপ্লব ছড়াতে গিয়ে সিআইএ’র নির্দেশে নিহত হলেন বলিভিয়ায়। প্রিয় ‘চে’র প্রতিকৃতি অঙ্কিত লকেট তখন উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকায় মুক্তিকামী প্রতিটি তরুণের গলায় ঝুলছে। সর্বত্র মুক্তির সংগ্রাম চলছে সে সময় এবং আদর্শবাদী সৃষ্টিশীল মুক্তচিন্তার জোয়ার বইছে ভিন্ন ধারায়, ভিন্ন পরিবেশে। গণআন্দোলন, রাজনীতি, চিত্রকলা, শিল্পকলা, কাব্য, সাহিত্য, সংগীত এমনকি ক্রীড়া জগৎও মুখর বৈষম্যহীন নতুন সমাজ গড়ার স্বপ্ন ও অঙ্গীকারে বিভাের তরুণ নক্ষত্রদের উদ্ভাসিত উপস্থিতিতে। যুক্তরাষ্ট্রের রােসাপার্ক নামের এক নারী বাসে কৃষাঙ্গদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় বসতে অস্বীকার করে বর্ণবাদ-বিরােধী মুক্তি আন্দোলনের স্ফুলিঙ্গ হুড়িয়ে দিলেন সারা দেশে; মার্টিন লুথার কিং ও ম্যালকম এক্স (আলহাজ মালিক শাবাজ) পরিণত হলেন আফ্রিকান-আমেরিকান মুক্তি আন্দোলনের অগ্নিপুরুষে। বিশ্বকাপ বিজয়ী মুষ্ঠিযােদ্ধা মােহাম্মদ আলী, অভিনেত্রী জেন ফন্ডা, সংগীতশিল্পী জোন বায়েজ প্রমুখ সােচ্চার হলেন বর্ণবাদ ও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে। এদিকে বেটি ফ্রিডানের ফেমিনিন মিস্টিক বইটি যুক্তরাষ্ট্রের নারী মুক্তি আন্দোলনে এনে দিল নতুন মাত্রা। ওদিকে বিশ্বনন্দিত বিটলস গ্রুপের সংগীত পেছাল কালােত্তীর্ণ মার্গে-তাদের আধ্যাত্মিক বাণী সমৃদ্ধ হৃদয় পরিশুদ্ধির আহ্বানে। | রবিশংকরের অন্তর আলােড়িত সেতারের বিমুগ্ধ আলাপে মিলিত হলাে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের হৃদয়। মধ্যপ্রাচ্যে, ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়াসহ ষাটের দশকের পৃথিবীর নেতৃত্ব তখন তরুণদের হাতে। আমার মতাে যারা সেই সময়টিতে জম্মেছিল তারা পৃথিবীকে কীভাবে দেখছিল এই চিন্তা জন্মাত আমার অভিবাসী হৃদয়ে। চিন্তার সূত্র ধরে আগ্রহ ভরে আলাপ জমাতাম আমার মার্কিনি বন্ধুদের সঙ্গে। দুটি ভিন্ন মহাদেশ, প্রায় দশ-হাজার মাইলের ব্যবধানে আমাদের জন্ম। আমাদের ধর্ম, বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি ও সমাজব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। অথচ শৈশবের বেশ কিছু অভিজ্ঞতাকে প্রায় একই সঙ্গে আমরা সঞ্চয় করেছিলাম গােলার্ধের দুটি ভিন্ন স্থানে অবস্থান করেও। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান, আজকের বাংলাদেশের গুটিকতক মানুষের ঘরে তখন সাদাকালাে টেলিভিশন পৌছেছে। আমাদের ঘরে টেলিভিশন ছিল না। আমি ও আমার দেড় বছরের পিঠাপিঠি ছােট বােন রিমি (সিমিন হােসেন) কুতকুত, হাডুডু ইত্যাদি খেলতে যেতাম ধানমণ্ডির পুরাতন ১৯ নম্বর রােডে আমাদের বন্ধু রাখীদের বাড়িতে। খেলার পর ওদের বাড়িতে মাঝে মাঝে টেলিভিশন দেখতাম রাখী, ওর বড় দুই বােন কাজল আপা ও আঁখি আপার সঙ্গে। কখনাে, আমাদের দোতলা বাড়ির ভাড়াটিয়া শহীদ সাহেবের দুই ভাতিজি আঁখী আপা | (ভিন্নজন) ও ইলা আপার সাথে। মাসুমা খাতুনের (বর্তমানে ভয়েস অব আমেরিকা হতে অবসরপ্রাপ্ত) মিষ্টি মুখ ও শ্রুতিমধুর। ঘােষণার মধ্য দিয়েই টেলিভিশনের অনুষ্ঠানগুলাের সঙ্গে আমার পরিচয়। ষাটের দশকের মধ্যভাগে পূর্ব পাকিস্তানে যে সাদাকালাে টেলিভিশনের আবির্ভাব ঘটে, তার তখন একটি মাত্রই চ্যানেল। অনুষ্ঠানও হাতেগােনা। টেলিভিশনও চালু থাকত মাত্র কয়েক ঘণ্টার জন্য। চ্যানেল ও সময়ের সীমাবদ্ধতার কারণে আমাদের পছন্দ ও অপছন্দের গণ্ডিও হতাে সীমিত। তারপরও ঐ একটি মাত্র চ্যানেল ঘিরে ছােট-বড় সকলেই যারা একই অনুষ্ঠান দেখতাম, মনে হতাে আমরা যেন হৃদয়ের কাছাকাছি পৌছে গিয়েছি। একই গৃহে বসবাস করেও ছােট-বড় সকলেই যেমন আজ ভিন্ন ভিন্ন বিশ্বে বিভক্ত, চারদিকে মাত্রাহীন পছন্দ ও বিনােদনের আতিশয্য, সে যুগে তেমনটি ছিল না। এ যুগে প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি হয়েছে অথচ আমাদের মানসিক অগ্রগতি প্রযুক্তির অগ্রগতির সঙ্গে তাল মেলাতে পারেনি। সে কারণেই আমরা পরিণত হয়েছি নয়া প্রযুক্তির দসে। প্রযুক্তির অভিনব কলাকৌশলকে আমরা যতখানি না শাস্তি সৃষ্টির কাজে লাগিয়েছি তার চেয়ে অশান্তির । এর জন্য প্রযুক্তি দায়ী নয়, দায়ী আমাদের অবিবেচক মন ও মানসিকতা। ফলে আমরা ব্যাপকভাবে সৃষ্টি করছি যুদ্ধের নিষ্ঠুরতম প্রক্রিয়া। বিশ্বব্যাপী দ্রুততার সঙ্গে ছড়িয়ে দিয়েছি আরও হিংস্রতা ও বন্যতা। একটিমাত্র বােতাম টিপেই নিমেষেই পৌছে যাচ্ছি ভিন্ন। মহাদেশে, অথচ পারছি না নিজগৃহের অতি আপনজনদের হৃদয়ে পেীছাতে। | সারা দিনের খেলার পর শ্রান্ত রিমি ও আমি বন্ধু পরিবেষ্টিত হয়ে সেকালের সাদাকালাে টেলিভিশনের। অনুষ্ঠানগুলাে দেখতাম মুগ্ধ বিস্ময়ে, আজকের পরিণত বয়সের রং-বেরঙের জটিল ভাবনা ছাড়াই। আমাদের প্রিয় বাংলা হাসির সিটকম ছিল হিরা, চুনি, পান্না।’ মূল অভিনেতা আশীষ কুমার লৌহ, খান জয়নুল প্রমুখ। ইংরেজি সিরিজ শাের মধ্যে আই লাভ লুসি’, ‘বিউইচড’ ও ‘ফিউজিটিভ’ আমাদের মন কেড়ে নিয়েছিল। ঢাকা ও মার্কিন টেলিভিশনের এই জনপ্রিয় সিরিজগুলাে ষাটের দশকে বেড়ে ওঠা আমার সমবয়সী মার্কিনি বন্ধু ও আমার শৈশবের উষ্ণ স্মৃতির একটি অংশ হয়ে দাঁড়ায়। সেই একই সময় তারা যখন মার্টিন লুথার কিংয়ের নাম ঘন ঘন শুনছিল এবং প্রত্যক্ষ করছিল কৃষ্ণাঙ্গদের সমঅধিকার আন্দোলনের উত্তাপময় অভিযাত্রা, আমি তখন ঢাকার রাজপথে শেখ মুজিবুর রহমানের নাম উচ্চারিত হতে শুনেছিলাম। দেখেছিলাম সড়কজুড়ে ব্যারিকেড, বিক্ষোভ ও উত্তাল মিছিলের স্রোতধারা। ভিন্ননাম, ভিন্নদেশ অথচ লক্ষ্য একই সামাজিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার প্রতিজ্ঞা ও সংগ্রাম। ১৯৬০ সালে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তরুণ জন এফ কেনেডি নির্বাচিত হলেন বিশ্বশক্তি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি পদে। পাকিস্ত েিন তখন আইয়ুব খানের সামরিক শাসন চলছে প্রচণ্ড দাপটের সঙ্গে। স্বৈরাচারী ও শােষক সেই সামরিক সরকারের পক্ষে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের গণতান্ত্রিক সরকার। বিশ্ব রাজনীতির এই পর্যায়টিতে এসেই কিন্তু আমার মার্কিন বন্ধু ও আমার অভিজ্ঞতার মধ্যে দেখা দেয় বিরাট অমিল। তারা তাদের রাষ্ট্রের মুক্ত নীতির যে রূপ দেখেছে, আমি আমার রাষ্ট্রে তার প্রতিফলন ঘটতে দেখিনি। আমি যখন তাদের বলি যে তৃতীয় বিশ্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পরিচয় হলাে দুর্নীতিপরায়ণ, সামরিক বা রাজতান্ত্রিক সরকারের বন্ধু ও মানুষের মুক্তি আন্দোলনের বিরুদ্ধে এক আগ্রাসী ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে, অনেকেই তখন তাদের নীল, খয়েরি, কালাে বা হিজল বুজ চোখগুলােতে বিস্ময়ের বিচ্ছুরণ ছড়িয়ে বলে, “তা কেন হবে? আমাদের। সরকার তাে শুধু বর্বর কমিউনিস্টদের খেদাচ্ছিল ! | যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ মানুষই মূলধারার কর্পোরেট নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যমগুলাের ব্যাপক প্রচারণার প্রভাবে ঐ চিন্তাধারার অনুসারী। তাদের কারাে কারাে সঙ্গে যখন ঘনিষ্ঠতা ও বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে শিক্ষাঙ্গনে, কর্মক্ষেত্রে ও প্রতিবেশী হওয়ার সুবাদে তখন ভাব-বিনিময় হয় এই প্রসঙ্গে। আমি তখন স্মৃতির গভীর থেকে তুলে আনি মণিমুক্তাসম ঘটনার সম্পদরাশি যা বিশ্বের প্রাচুর্যশীল শক্তিশালী রাষ্ট্রের মুক্তিকামী রাজনৈতিক ও সৃজনশীল আন্দোলনের চেয়ে কোনাে অংশেই কম নয়। আমার ছেলেবেলার স্মৃতির মধ্যেও মূর্ত হয়ে ওঠে মানুষের জন্মগত অধিকার; আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে স্বাধিকার প্রচেষ্টার গণতান্ত্রিক আন্দোলন। আমার শৈশবের ক্ষুদ্র পৃথিবীটি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায় নিপীড়িত মানুষের দুর্বার সংগ্রামের অবিস্মরণীয় স্মৃতিতে; স্বৈরাচার ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে রক্তক্ষয়ী স্বাধীনতাযুদ্ধের গৌরবগাথাতে। আমার আজকের এই বিশ্ব দৃষ্টিভঙ্গিটির শিকড় যে এই মহাদেশের অন্যপ্রান্তে, তা-ও হয় ব্যক্ত। স্বাধিকারের লক্ষ্যে সংগ্রামরত, ক্ষুদ্র ভৌগােলিক সীমারেখায় বেষ্টিত বিশাল জনসমুদ্রের দেশ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) রাজধানী ঢাকার ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকার এক সুবিশাল হৃদয় ও চিন্তাধারার রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণের যােগসূত্র ধরেই আমি আবিষ্কার করি মহাবিশ্বকে।
সেই যুগে ঢাকা শহরে যারা আমার মতাে বড় হয়েছে তাদের এক অতি ক্ষুদ্র অংশ ছিল রাজনৈতিক পরিবারের সঙ্গে যুক্ত। আমার বন্ধুদের অধিকাংশই ছিল অরাজনৈতিক পরিবারের সদস্য। রাজনীতি সচেতন হওয়ার বয়স তখনাে আমার হয়নি, কিন্তু চারদিকের অন্যায় ও অবিচারের জঞ্জাল সরিয়ে যে নতুন কিছু গড়ার উদ্যোগ চলছে তা বুঝতে পারতাম। ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময় তখন। এই সময়ের সকল গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ঘটনার কেন্দ্রে ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান (তখনাে তিনি বঙ্গবন্ধু উপাধি লাভ করেননি) ও আব্দু তাজউদ্দীন আহমদ। শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা মুজিব কাকু বলে সম্বােধন করতাম। মুজিব কাকুর সম্মােহনী ব্যক্তিত্ব, জ্বালাময়ী ভাষণ দেওয়ার ক্ষমতা ও বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রতীক ভাবমূর্তির সঙ্গে আব্দুর সাংগঠনিক দক্ষতা, রাজনৈতিক দূরদর্শিতা ও পরিশুদ্ধ চিন্তাবােধ যুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগকে তকালীন পূর্ব পাকিস্তানের এক নম্বর রাজনৈতিক দলে পরিণত করেছিল। আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে ২১শে ফেব্রুয়ারি এই অমর গানটির রচয়িতা সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরীর ভাষায় শহীদ সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগে শেখ মুজিবের পেছনে প্রকৃত বুদ্ধিদাতা ও কর্মী পুরুষ ছিলেন তাজউদ্দীন … ফর্সা গােলগাল চেহারা, বুদ্ধিদীপ্ত চোখমুখ, বেশি মানুষের ভীড়ে লাজুক এই শিক্ষিত ও মার্জিত রুচির মানুষটি প্রখর ব্যক্তিত্বশালী নেতা ছিলেন না। কিন্তু তার শিক্ষা, বুদ্ধি ও সংগঠন শক্তির সঙ্গে শেখ মুজিবের ব্যক্তিত্ব, সাহস ও জনপ্রিয়তার মিশ্রণে আওয়ামী লীগ। বাংলাদেশের একমাত্র জাতীয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। মেধাবী ও কৃতীছাত্র আব্দু হতে পারতেন সরকারের কোনাে উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা অথবা বেছে নিতে পারতেন নিরাপদ, স্বাচ্ছন্দ্য কোনাে জীবন। কিন্তু নিপীড়িত মানুষের কল্যাণের লক্ষ্যে ও আর্থ-সামাজিক বৈষম্য রােধের জন্য তিনি বেছে নেন দুর্গম গিরি কান্তার মরু সমান এক ঝঞাতাড়িত জীবন। নেতা তাজউদ্দীনের বিশাল ব্যক্তিত্বের মধ্য থেকেই তাই খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করি পিতা তাজউদ্দীনকে। | কুয়াশা ঢাকা শীতের ভােরে আব্দুর হাত ধরে আমার ছােট বােন রিমিসহ আমরা বের হতাম বকুল ফুল কুড়াতে। সঙ্গে হাঁটতে বের হতেন আম্মা ও আমাদের অতি শ্রদ্ধেয় ফুফাতাে বােন। আনার আপা (আনােয়ারা খাতুন)। আমাদের ৭৫১ সাত মসজিদ রােডের দোতলা বাড়ির উল্টো দিকের পুরাতন ২১ নম্বর সড়কে ছিল সারিবদ্ধ বকুল ফুলের গাছ। আমরা সবাই মনের আনন্দে সেই ফুল কুড়াতাম। ছেলেবেলায় আন্ধু বয়স্কাউটের সদস্য হিসেবে নানারকম জনসেবামূলক কাজ করেছিলেন। আমাদের তা থেকে বিভিন্ন উদাহরণ দিতেন। রাস্তায় যদি কোনাে আবর্জনা, ফলমূলের খােসা, ভাঙা টিন, কাচ ইত্যাদি পড়ে থাকত আন্ধু সেগুলাে নিজ হাতে কুড়িয়ে রাস্ত টিকে জঞ্জালমুক্ত ও নিরাপদ করে তুলতেন। জনহিতকর কোনাে কাজই তাঁর কাছে ক্ষুদ্র ছিল । আব্দুর সঙ্গে আমরা ঘরে ফিরতাম সৈনিকের মতাে লেফট-রাইট মার্চ করে। কখনাে সাঁঝের আলােতে জানালায় বেয়ে ওঠা লতাবেলির মিষ্টি সুবাসের মাঝে বসে আন্ধুর কাছ থেকে আমরা গল্প শুনতাম হরেক রকমের। তাঁর বলা একটি গল্প বিশেষ করে আমার মন ছুঁয়ে যায়—এক বুড়িও তার দুই বিশ্বস্ত কুকুর রঙ্গা ও ভঙ্গার গল্প। সাধারণত এই লােক-কাহিনিগুলাে স্থানভেদে একটু ভিন্নভাবে বর্ণিত হতে দেখা যায় । আৰু বিছানায় বালিশে মাথা হেলান দিয়ে শুতেন আর আমরা দুই বােন আব্দুর দুই কাঁধে মাথা দিয়ে গােগ্রাসে গিলতাম সব গল্প । আন্ধু বলতেন, “এক বুড়ি, সে যাবে তার নাতনিকে দেখতে। লাঠি হাতে ঠুকঠুকিয়ে চলল সেই বুড়ি এক বিজন বনের ভেতর দিয়ে। হঠাৎ করেই তার সামনে এসে দাঁড়াল এক সুচতুর শেয়াল। সে দাঁত মুখ খিচিয়ে বলল, এই বুড়ি তােকে আমি খাব।’ বুড়ি ছিল দারুণ বুদ্ধিমতী। সে উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে বলল, ‘আমাকে খেয়ে তুমি মােটেও স্বাদ পাবে না।’ সে তার হাড় জিরজিরে শরীর দেখিয়ে বলল, ‘আমার শরীরে নেই একরত্তি মাংস, একটু সবুর করাে। নাতনির বাড়ি বেড়াতে যাচ্ছি, সেখান থেকে ভালাে খাওয়া-দাওয়া করে গায়ে যখন মাংস লাগিয়ে ফিরব তখন খেয়াে।’ শেয়াল একটু চিন্তা করে দেখল যে বুড়ির যুক্তিই সঠিক। তখন সে বলে “ঠিক আছে। আমি এই পথেই তাের জন্য অপেক্ষা করব।’ বুড়ি হাঁফ ছেড়ে চলতে শুরু করল। পথিমধ্যে সে দেখা পেল একটি বাঘ ও ভালুকের। তাদের তর্জন-গর্জনের সামনেও বুড়ি তাঁর সাহস হারাল না। শেয়ালকে যে কথা বলেছিল সেই একই কথা বলে সে তার জীবন রক্ষা করল। নাতনির বাড়ি পৌহে বুড়ি মহাখুশি। নাতনির সেবাযত্নে ও মজার মজার হরেক-রকমের খাবারের বদৌলতে সে বেশ নাদুসনুদুস হয়ে। উঠল। আনন্দ, আহাদে, হাসি গল্পে কটি মাস কেটে গেল স্বপ্নের মতো। এবার বুড়ির ঘরে ফেরার পালা। ফিরতে হবে, সেই একই পথ দিয়ে। অন্য কোনাে পথ নেই। বুড়ি মনে মনে এক বুদ্ধি বের করল। নাতনির সহায়তায় সে ঢুকে পড়ল বাগানের মস্তবড় এক মিষ্টি কুমড়াের ভেতরে। সঙ্গে নিল গুড়, মুড়ি, খই ও তিলের নাড়ু। এবার মিষ্টি কুমড়ােটিকে নাতনি দিল এক বিরাট ধাক্কা। সে ধাক্কায় কুমড়ােটি এসে পৌছল ভালুক-ভায়ার সামনে। ভালুক কুমড়ােটি উল্টে-পাল্টে দেখল। নাহ ! নেহাতই এক কুমড়াে ! সে হতাশ হয়ে কুমড়োটিকে দিল এক ধাক্কা। এবার কুমড়ােটি গিয়ে পড়ল ঐ বাঘ মামার সামনে। বাঘও কুমড়ােটিকে এপাশ-ওপাশ পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে রাগে দিল এক মস্ত ধাক্কা। সেই ধাক্কায় কুমড়ােটি হড়বড়িয়ে পড়ল শেয়াল পণ্ডিতের সামনে। শেয়াল তাে শুধু নেহাতই শেয়াল নয়, সে পণ্ডিতও বটে, তাকে ফাঁকি দেওয়া কঠিন। এই বিজন বনে গড়িয়ে চলা কুমড়ােটির রহস্য উঘাটনের জন্য সে তার ধারালাে দাঁত দিয়ে কুমড়ােটিকে করল খণ্ড-বিখণ্ড। আর যায় কোথায় ! বুড়ি বের হয়ে এল, তার নাদুসনুদুস নতুন শরীর নিয়ে। শেয়ালের চোখ খুশিতে হয়ে উঠল চকচকে। তাকে ফাঁকি দেওয়া সহজ কাজ নয়। বুড়ি যখন দেখল তার মৃত্যু আসন্ন। তখন জীবন। রক্ষার জন্য সে শেষ চেষ্টা করল। শেয়ালকে অনুনয় করে বলে, ‘আমার মরতে আপত্তি নেই। শুধু মরার আগে আমার একটি ছােট্ট অনুরােধ তােমাকে রাখতে হবে।’ শেয়াল তার নাক-মুখ খিচিয়ে বিরক্তিভরে বলে উঠল, বলে ফ্যাল তাের কী অনুরােধ।’ বুড়ি বলল, ‘আমি খুব গান গাইতে ভালােবাসি। মরবার আগে আমার শেষ গানটি গাইতে চাই।’ ‘তথাস্ত’, শেয়াল বলে উঠল। বুড়ি তখন বনের প্রান্তে একটি ফাঁকা জায়গায় গিয়ে দাঁড়াল। সেই জায়গাটিতে ছিল একটি উঁচু মাটির টিলা, সেই টিলার ওপর দাঁড়িয়ে সে গাইল তার শেষ গান ‘আয়রে আমার রঙ্গা, ভঙ্গা, আয়রে। আমার রঙ্গা, ভঙ্গা।’ বুড়ির করুণ ডাক পৌছল তার দুই কুকুর রঙ্গা ও ভঙ্গার কানে। তারা তুমুল। ঘেউ ঘেউ করতে করতে ছুটে এল বুড়িকে রক্ষা করতে। ঐ দুই বাঘ-কুকুরের তাড়া খেয়ে শেয়াল পণ্ডিত উধ্বশ্বাসে দৌড়ে পালাল। বুড়িও উপস্থিত বুদ্ধির বলে তার প্রাণ বাঁচাল।” গল্প শুনতে শুনতে আমরা দুইবােন আব্দুর কাঁধে মাথা রেখে ঘুমিয়ে পড়তাম। স্বপ্নের রাজ্যে দেখা দিত অত্যাশ্চর্য কল্পকাহিনির জগৎ, যেখানে পশুপাখি কথা বলে, জ্যোৎস্নার প্লাবনে সিক্ত আকাশে পরীরা ওড়ে, মৎস্যকন্যারা নির্ভয়ে গায় গান। গল্পের জগৎ পৃথিবীকে চেনার ক্ষেত্রে যুক্ত করে বিশেষ মাত্রা। ধূর্ত শেয়াল ও হিংস্র বাঘভালুক-সমান মানুষের অরণ্যে প্রকৃত বন্ধুর সাহায্যের হাত মুক্তির সংগ্রামকে করে তােলে জয়যুক্ত। (অনেক মানুষ এতই নিকৃষ্ট যে পশুর সঙ্গে তুলনা করলে বরং পশুরই অপমান হয়)। ১৫ নম্বর পুরানা পল্টনে ছিল আওয়ামী লীগের অফিস। মুজিব কাকু ও আব্দুর যৌথ নেতৃত্বে এই নবীন রাজনৈতিক দলটিতে তখন অসামান্য গতি সঞ্চার হয়েছে। দলের কাজে নিবেদিত আর নাওয়া-খাওয়ার কোনাে সময় ছিল না। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে কিছু সুযােগ-সন্ধানী মানুষের হীন চক্রান্ত ও পাকিস্তান। সরকারের উসকানিতে শুরু হয় হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা। আনার আপা তখন বাংলাবাজার স্কুলের দশম শ্রেণীর ছাত্রী। সহপাঠী অধিকাংশই হিন্দু। মুসলিম মেয়েরা তখনাে শিক্ষার ক্ষেত্রে পিছিয়ে রয়েছে। দাঙ্গার সময় স্কুল বন্ধ হয়ে গেল। স্কুল যখন খুলল আনার আপা অবাক হয়ে দেখলেন তার ক্লাস প্রায় ফাকা। তাঁর প্রিয় ফুটফুটে সুন্দরী সহপাঠী অরুণাসহ অধিকাংশ হিন্দু ছাত্রীই নিরাপত্তার অভাবে পরিবারসহ দেশ ত্যাগ করেছে। আব্দু, মুজিব কাকু ও অসাম্প্রদায়িক প্রগতিশীল নেতৃবৃন্দ দাঙ্গা রুখতে ও জনজীবনে নিরাপত্তা ফিরিয়ে আনার জন্য দাঙ্গাক্রান্ত এলাকায় স্বেচ্ছাসেবকের দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিলেন। পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সামরিক সরকার। দমন আইন প্রয়ােগ করে মুজিব কাকু, আব্দুসহ অনেকের বিরুদ্ধেই মিথ্যা মামলা ঠুকে দিল। ঢাকার প্রচণ্ড শীতের মধ্যে ছড়িয়ে পড়া দাঙ্গার রূপটি ছিল মৃত্যুর মতাে হিমশীতল। সেই দুঃসময়ে রায়ের বাজার এলাকার কাঠমিস্ত্রি নিতাই দাস ও এক হিন্দু গোয়ালা আমাদের বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করে। পাড়ায় দুধ বিলি করার সময় দুবৃত্তরা গােয়ালার মাথা ফাটিয়ে দেয়। ঘটনাটি আমাদের বাড়ির সামনের রাস্তায় ঘটে। দাঙ্গাবিরােধী স্বেচ্ছাসেবকরা ধরাধরি করে গােয়ালাকে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসে। আন্ধু নিজ হাতে গােয়ালার মাথা ধুইয়ে রক্ত পরিষ্কার করে তার মাথায় যত্ন করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দেন। শুশ্রষারত আব্দুর পাশে বসে সেই প্রথম জানলাম মানুষের আর একটি ভিন্ন পরিচয়ও আছে। আরও বুঝলাম বিশ্বাস ও মতের ভিন্নতার কারণে মানুষের মানুষ পরিচয়টি হতে পারে মূল্যহীন ও ক্ষত-বিক্ষত এক নিমেষেই।
১৯৬৪ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি আমার প্রথম জম্মদিনে আনার আপা ও খালাতাে বােন নীলু আপা বেলুন ও কাগজের ফুল দিয়ে ঘর সাজালেন। বন্ধু মিথ্যে ও রিমিকে পাশে নিয়ে আমি কেক কাটলাম। আম্মা আমার বেশ কটি ছবি তুললেন। ছােট কাকু, দলিল ভাই, ভুলু ভাই, হাসান ভাই ও অন্যরাও জম্মদিনের আনন্দে যােগ দিলেন। আতাউর রহমান খান (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্ত েিনর মুখ্যমন্ত্রী) এলেন তাঁর স্নেহভাজন তাজউদ্দীন-কন্যার চতুর্থ (লিপইয়ারে জন্মাবার কারণে প্রতি চার বছরে ঐ দিনটি আসে) বছরে পদাপর্ণের প্রথম জন্মদিনে যােগ দিতে। তিনি আমার। জন্য নিয়ে এলেন মনকাড়া এক পুতুল। আল্লু নিয়ে এলেন মনােমুগ্ধকর একরাশ ফুল। ১৯৬৪ সালের ডিসেম্বর মাসের শুরুতে, পাকিস্তানের জনক মহাম্মদ আলী জিন্নাহর বােন। ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে আমাদের বাসায় বসেছিল নির্বাচনী প্রচারণা ক্যাম্প। তিনি স্বৈরাচারী জেনারেল ও স্বঘােষিত রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে নির্বাচনে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তার প্রতীক ছিল হারিকেন। রিমি ও আমি সারাদিন ঘুরঘুর করতাম সদাব্যস্ত নিবেদিত কর্মীদের আশপাশে। আমাদের বাড়ির ফোন ঝনঝন করে সর্বক্ষণ বাজত। কেউ যখন আমাদের ফোন নাম্বার জানতে চাইতেন আমি উৎসাহ ভরে বলতাম 83532। পিতল রঙের হােট হারিকেনের পিন জামায় গেঁথে আমরা মুগ্ধ বিস্ময়ে দেখতাম কর্মীদের কাজকর্ম। আমাদের বাসার সামনের লম্বা বাগানের একপ্রান্তে বাতাবি লেবু গাছের পাশে বসানাে হয়েছিল লাকড়ির চুলা। তাতে বিরাট বড় ডেকচি বসিয়ে কর্মীদের জন্য রান্না হতাে। রান্নার খুশবু, লাকড়ির চুলার ধোঁয়া, কর্মীদের সদাব্যস্ত কোলাহল, নিধুম রাতের সৃষ্টি হাজারাে ইশতেহার। ও বিবৃতির মাঝ দিয়ে আমার সামনে ধীরে ধীরে উন্মােচিত হয় রাজনীতির বিশাল জগৎটি। উল্লেখ্য ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল করে, সংসদকে অবলুপ্ত করে ও সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ করে দুর্বল প্রশাসক, প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে হঠিয়ে, পাকিস্তানের ইতিহাসের প্রথম মার্শাল ল প্রবর্তনকারী যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করেন ও নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করেন। | ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ঐ লােক দেখানাে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে, প্রতিদ্বন্দ্বী ফাতেমা জিন্নাহর বিরুদ্ধে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে এবং জোর জুলুম ও নিষ্পেষণের মাধ্যমে নির্বাচনে জেতেন। | ১৯৬৫ সালে আমার নানি সৈয়দা ফাতেমা খাতুন পা পিছলে পড়ে গিয়ে মাথায় আঘাত পান। খবরটি শােনামাত্রই আব্ব আওয়ামী লীগ অফিস থেকে ফিরে এসে নিজ হাতে নানির শুশ্রুষায় লেগে যান। সেকালের নামকরা ডাক্তার নন্দী নানিকে দেখতে আসেন। ডায়াবেটিসের রােগী নানিকে তিনি অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেন। ডাক্তার নন্দী রােগ নির্ণয়ে এবং রােগীর চিকিৎসায় ছিলেন সিদ্ধহস্ত। সেকালে তাে আর এ যুগের মতাে প্রযুক্তিনির্ভর ও উন্নত চিকিৎসা সম্ভবপর ছিল না। কিন্তু চিকিৎসকের স্বতঃলব্ধ জ্ঞান, যা ব্যতীত কোনাে চিকিৎসাই। সফল হয় না এবং সম্পূর্ণতা লাভ করে না, তা পুরােটাই ডাক্তার নন্দীর আয়ত্তে ছিল। সেই সময় ঢাকার চিকিৎসক মহলে বহুল পরিচিত একটি নাম ছিল ডা. নন্দী। তাঁর মতাে একজন মহৎ সেবাপরায়ণ প্রসিদ্ধ চিকিৎসকও সাম্প্রদায়িক পাকিস্তান সরকারের রােষানলে পড়ে দেশ ত্যাগে বাধ্য হন। আব্দুর পাশে বসে আমি সে সময় ইতিহাসের এমন ধারাকেই পর্যবেক্ষণ করছি শিশুর দৃষ্টি দিয়ে, যেন স্বপ্নের মাঝে আলাে ও আঁধারের সঙ্গে লুকোচুরি খেলা। ১৯৬৫ সালের ৩০ ডিসেম্বর আমাদের তৃতীয় বােন মিমি জম্মগ্রহণ করে। সে সময় বাজারে। মিমি চকলেট সদ্য এসেছে। আমার মিমি চকলেটপ্রীতির কারণে সদ্য জন্ম নেওয়া পুতুলের মতাে ফুটফুটে বােনটিকে আমি মিমি নামেই ডাকা শুরু করলাম; ওর মিমি নামটি এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়। মিমি তার দুই বড় বােনের মতােই জম্মেছিল ভােরবেলায়। সেই ভােরে ঘুম ভেঙে দেখি আম্মা পাশে নেই। আব্দুও নেই। আমি ভঁা করে কেঁদে ফেলে রিমির হাত ধরে ঘরের বাইরে বের হলাম। দেখি পাশের ঘরের বন্ধ দরজার সামনে আন্ধু উদগ্রীব হয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছেন। উষার আগমনের কিছু আগে ঘরের ভেতর নবজাত শিশু সরবে ভূমিষ্ঠ হলাে। আম্মা হাসপাতালের যান্ত্রিক পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়ার চেয়ে নিজ গৃহের পরিচিত ও স্বাভাবিক পরিবেশে সন্তান জন্ম দেওয়ার পক্ষপাতী ছিলেন। সে যুগে এই প্রথাটি প্রচলিত ছিল। (বর্তমানে পাশ্চাত্যের কোনাে কোনাে রাষ্ট্রে নিজগৃহে সন্তান জন্ম দেওয়ার এই প্রথাটির পুনর্জাগরণ দেখা। দিয়েছে, অথচ আমাদের দেশে আমরা ক্রমশই হারিয়ে ফেলছি সন্তান জন্ম দেবার স্বাভাবিক পরিবেশ ও প্রক্রিয়াকে।) আমাদের তৃতীয় বােন নিয়মানুসারে ডাক্তার খােদেজা সরকারের হাতেই জন্ম নেয়। সে ভূমিষ্ঠ হওয়ার কিছুক্ষণ পর আমাদের পুরনাে দাইমা—যাকে সবাই সুলতানের মা বলে সম্বােধন করত বের হয়ে এলেন আতুড় ঘর থেকে। তাকে দেখে আন্ধু ব্যাকুলভাবে জিজ্ঞেস করলেন, কী হয়েছে ?’ দাইমার বহু আশা ছিল যে এবার ছেলেই হবে এবং সেই সুবাদে সে মােটা বকশিশেরও প্রত্যাশা করছিল। তাই প্রশ্নের উত্তরে মুখ ব্যাজার করে অনেকটা তাতানাে স্বরেই জবাব দিল, কী আবার হইব, মাইয়াই হইছে !’ বাড়িরও সবার আশা ছিল এবার ছেলেই হবে। কিন্তু তারা সবাই নিরাশ হওয়াতে আল্লু নবজাতক শিশুকে গভীর স্নেহে আদর করে তার নামকরণ করলেন আদুরী। আদুরী বােন মিমিকে পৃথিবীতে স্বাগতম জানাতে আল্লু কিনে আনলেন রাশি রাশি মিঠাই-মণ্ডা। আমি ও রিমি খাটের চারপাশ ঘিরে নেচেগেয়ে নতুন বােনকে স্বাগত জানালাম। নতুন বইয়ের ছড়া গানটিই আমরা গাইলাম—
‘খুকুমণি জনম নিল যেদিন মােদের ঘরে,
পরীরা সব দেখতে এল কতই খুশি ভরে।
আদর করে দুধ খাওয়াল সােনার পেয়ালাতে,
দোলা দিয়ে ঘুম পাড়াল জ্যোৎস্না মাখা রাতে।
নেচে গেয়ে হেলে দুলে হাত ধরে সব তায়,
কতই খেলা খেলল তারা ফুলের বিছানায়।
মিমির জন্মের মাস খানেক পরই বােধকরি রােজার ঈদ এল। আব্দু সেই ঈদের | ভােরবেলায় হুলস্থুল লাগিয়ে দিলেন। তিনি আমাকে ও রিমিকে ঘুম থেকে উঠিয়ে দিলেন। | তারপর আমাদের সঙ্গে নিয়ে আমাদের পেছনের বাড়ির প্রতিবেশী ও পারিবারিক বন্ধু রাজু খালা ও তার স্বামী হাজি মহসিন খালুকেও ডেকে তুললেন। সে সময় ঢাকা শহরে বেশ শীত পড়ত। শীতের সকালেই আম্মা ও আনার আপা আমাদের গরম পানি দিয়ে গােসল করিয়ে দিলেন। আলু, ছােট কাকু (আফসারউদ্দীন আহমদ), আমার নানা সৈয়দ সেরাজুল হক এবং পাড়ার অনেকেই গেলেন ঈদের নামাজ পড়তে। এদিকে আমি ও রিমি আম্মার হাতে তৈরি করা নতুন ডিজাইনের ঈদের ফ্রক পরে মাথায় লাল ফিতার বাহারি ঝুটি বেঁধে পাড়া বেড়ানাের জন্য প্রস্তুত। সে সময় কৃষ্ণচূড়া, বকুল ও নারকেল গাছে ঘেরা ধানমণ্ডি ছিল প্রায় ফাকা, যানজট ও কোলাহলমুক্ত মনােরম এক আবাসিক এলাকা। অতটুকু বয়সেই আমরা পাড়ার মেয়েরা দল বেঁধে এ-বাড়ি ও-বাড়ি বেড়াতে ও খেলতে যেতাম নিশ্চিন্ত নির্ভাবনায়। সন্ত্রাস, ছিনতাই, রাহাজানি, অপহরণ ইত্যাদি শব্দগুলাে আমাদের মনের অভিধানে তখনাে যুক্ত হয়নি। রােজার ঈদের পরপরই আব্ব ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বাঙালির মুক্তির সনদ ছয় দফার আন্দোলন নিয়ে। ছয় দফার অন্যতম রূপকার আব্ব লাহােরে বিরােধী দলীয় সম্মেলনে যােগদান
করেন মুজিব কাকুসহ । ১৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬; এই দিনে, এই সম্মেলনে মুজিব কাকু স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির দাবি হিসেবে ছয় দফাকে আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেন। আইয়ুব খানের বৈদেশিক মন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো তখন ছয় দফাকে অযৌক্তিক প্রমাণ করার জন্য মুজিব। কাকুকে ঢাকার পল্টনের জনসভায় তর্কযুদ্ধের আহ্বান জানালেন। মুজিব কাকু আন্ধুর সঙ্গে পরামর্শ করে ভুট্টোর চ্যালেঞ্জটি গ্রহণ করলেন। বাকর্লে-অক্সফোর্ডের তুখােড় ছাত্র ভুট্টো ঢাকায়। এলেন এক বিরাট উপদেষ্টার দল সঙ্গে নিয়ে। তিনি নিশ্চিন্ত যে এই তর্কযুদ্ধে তিনি মুজিব। কাকুকে হারিয়ে দেবেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে আল্লু ইতােমধ্যেই ছয় দফার যৌক্তিকতা প্রমাণের জন্য প্রস্তুত করেছেন এক বিশদ প্রমাণপত্র। আল্লু ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করে মুজিব কাকুর চ্যালেঞ্জ গ্রহণের সংবাদটি আনুষ্ঠানিকভাবে জ্ঞাপন করলেন। আব্দুর সঙ্গে কথা বলার পরপরই ভুট্টো বুঝতে পারলেন ছয় দফার যৌক্তিকতা আন্ধু এমন নিপুণ ও তথ্যবহুল যুক্তিতে দাড় করিয়েছেন যে, মুজিব কাকু ও তার দলকে তর্কে হারানাে মুশকিল। আন্ধুর সঙ্গে কথা শেষ করার পর ভুট্টো মুসলিম লীগের নেতাদের কাছে মন্তব্য করেছিলেন, হি ইজ ভেরি থরাে। শেখের। যােগ্য লেফটেন্যান্ট আছে দেখছি ! তর্কযুদ্ধের দিন পল্টনের জনসভায় শরিক হওয়ার জন্য যখন বিভিন্ন জায়গা থেকে ঢাকায় মানুষের সমাগম হতে শুরু করেছে ঠিক সেই দিন। সকালবেলাতেই ভুট্টো তার উপদেষ্টার দলসহ চুপিসারে ঢাকা ত্যাগ করলেন। ঢাকার বহু কাগজ ঐ ঘটনার উপর বিশদ আলােকপাত করে। একটি কাগজের শিরােনাম ছিল ভুট্টোর পলায়ন।” ভুট্টো ও পল্টন ময়দান নাম দুটি আমার শৈশবের ক্ষুদ্র স্মৃতির ভাণ্ডারে সে সময় প্রথমবারের মতাে যুক্ত হয়। এই দুটি নামের ভেতরে লুকিয়ে থাকা ঐতিহাসিক ঘটনাটি সম্বন্ধে জানতে পারি অবশ্য অনেক পরে। তখন আমি বানান করে পড়তে শিখেছি এবং ভীষণ ব্যস্ত খেলাধুলা ও নতুন কুকুর পিপিকে নিয়ে। আমাদের জাপানি প্রতিবেশী রিমি ও আমার সমবয়সী খেলার সাথি শিওমি ও নিশিও-র বাবা-মা ঢাকায় জাপান মিশনের দায়িত্ব পালনের পর দেশে ফেরার আগে তাদের কুকুর পিপিকে। উপহার হিসেবে আমাদের কাছে রেখে যান। কালাে ও বাদামি রঙে মিশানাে পিপিকে পেয়ে আমি মহাখুশি। আব্দুও যােগ দিলেন আমার খুশিতে। রিমি ছােটবেলা থেকেই কুকুর-বেড়ালকে ভয় করত। সে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে পিপির সঙ্গে আৰু ও আমার হই-হুল্লোড় করে খেলা দেখত । একদিন পিপির সঙ্গে আল্লু ও আমি বাগানে বল ছােড়াছুড়ি করে খেলছি। হঠাৎ দেখি, গেটের বাইরে এক কালাে কুচকুচে কুকুর আকুতি ভরা নয়নে আমাদের খেলা দেখছে, যেন সে-ও যােগ। দিতে চায় আমাদের খেলায়। আব্ব খেলা থামিয়ে গেট খুলে কুকুরটিকে ভেতরে ঢোকালেন। নতুন কুকুরটিও যােগ দিল আমাদের খেলায়। আল্লু প্রস্তাব দিলেন এই কুকুরটির নামকরণের। আমরা দুজন মিলে ভেবেচিন্তে ওর নাম দিলাম শিপি। আর সঙ্গে খেলাধুলা, গল্প ও নির্মল আনন্দঘন সময় কাটানাের মধ্যেই আব্বকে জানছি। ঠিক এই সময়ই আন্ধুর সঙ্গে আমার পরিচয়ের পর্বটিতে হঠাৎ করেই ছেদ পড়ল। বাবা তাজউদ্দীনের একদিন ডাক এল জননেতা তাজউদ্দীনের কাছ থেকে। জননেতা আমার বাবাকে কেড়ে নিল সুদীর্ঘ দিনের জন্য।
১৯৬৬ সালের ৮ মে ছয় দফা আন্দোলনের কারণে মুজিব কাকু ও আব্দুসহ বন্দী হলেন আওয়ামী লীগের জহুর আহমদ চৌধুরী, নূরুল ইসলাম ও রাজশাহীর মুজিবর রহমান; ধীরে ধীরে দলের আরও নেতা ও কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হলাে। সেই ৮ মের গভীর রাত দেড়টার সময় আম্মার হাতের ধাক্কায় আমার ঘুম ভেঙে যায়। চোখ মেলে দেখি যে ঘরের সব বাতি জ্বলছে। ঘরের মেঝেতে রাখা ভােলা একটি সুটকেসে আব্দুর লুঙ্গি, গেঞ্জি, শার্ট ও প্যান্ট ভাজ করে রাখা। আম্মা আরও কিছু কাপড়চোপড় ও দাড়ি কামানাের সরঞ্জাম গুছিয়ে রাখছেন। আমাদের বড় খাটটি যেখানে আলু, আম্মা, রিমি ও আমি ঘুমাতাম, সেখানে দেখি আব্ব নেই। খাটের পাশের
দোলনায় আমাদের চারমাস বয়সী ছােট্ট বােন মিমি নিশ্চিন্তে ঘুমাচ্ছে। রিমি আমার মতােই অবাক বিস্ময়ে চারদিকে তাকাচ্ছে। আমি আম্মাকে জিজ্ঞেস করলাম, “আম্মা, আলু কোথায় ? আম্মা বললেন, “তােমার আব্ব ড্রইংরুমে আছেন। এই সুটকেসটা তােমার আন্ধুকে দিয়ে এসাে।’ সুটকেসের ঢাকনা বন্ধ করে আম্মা সেটা আব্দুর কাছে পৌছানাের দায়িত্ব আমার কাছে। তুলে দিলেন। আমি খুশি মনে লাফাতে লাফাতে সুটকেসটাকে দুই হাতে ধরে টানতে টানতে ঘরের ঠিক পাশের ড্রইংরুমটিতে নিয়ে গেলাম। দেখি ড্রইংরুমে আন্ধু বসে আছেন। পাশে খাকি পােশাক পরা দুজন মানুষ। একজনের চেহারা বেশ হাসিমাখা। তিনি আমার নাম জিজ্ঞেস করে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন। সুটকেসটা আল্লুকে দেওয়ার পর আব্ব আমাকে কোলে তুলে আদর। করলেন। রিমি ও আমাকে আদর করে আমাদের হাত ধরে বাড়ির সামনের বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন। আমাদের পাশে আম্মা, ছােট কাকু ও আব্দুর অতি আদরের ভাগনি আনার আপা। দুচোখ ভরা বিষন্নতা নিয়ে বিদায় জানাতে এলেন। আমি বিস্ময়ভরা চোখে দেখি আমাদের পুরাে বাড়ি ঘিরে দাঁড়িয়ে রয়েছে অস্ত্রধারী আরও কিছু পুলিশ। আমাদের হাত ছেড়ে সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জিপের মধ্যে আৰু উঠে গেলেন, জিপটা চলতে শুরু করল। আমি আন্ধু আন্ধু বলে হাত নাড়লাম। আব্ব আমাদের দিকে হাত নেড়ে হাসলেন। পুলিশ ভরা আরও চার-পাঁচটা জিপ আব্দুর জিপের সঙ্গে চলা শুরু করল ধানমণ্ডির ২ নম্বর সড়কের দিকে।
আন্ধুকে প্রথমে অন্তরীণ করা হলাে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। তাঁকে রাজবন্দিদের জন্য নির্দিষ্ট শ্রেণীতে না রেখে সাধারণ শ্রেণীভুক্ত করা হলাে। আম্মা ও আনার আপার সঙ্গে কারাগারে সাক্ষাৎ হওয়ার পর আব্ব তাদের জানালেন যে, প্রচণ্ড গরমে একদিন তিনি ঘুমাতে পারেননি। কিছুদিন পর তাকে ঢাকা কারাগার থেকে হঠাৎ করেই স্থানান্তরিত করা হলাে ময়মনসিংহ কারাগারে। | আব্দুকে যে সময় গ্রেপ্তার করা হয়, সে সময় ছয় দফা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আন্দোলন তীব্রভাবে দানা বাঁধতে শুরু করেছে। গ্রেপ্তারের আগে আম্মার প্রশ্নের জবাবে আল্লু অভয় দিয়ে বলেছিলেন, আব্দুসহ আওয়ামী লীগের মূল নেতৃবৃন্দকে আটক করা হলেও সংগ্রাম থেমে থাকবে না। কারণ, তৃণমূল পর্যায়ে তারা রেখে যাচ্ছেন এমন একটি শক্তিশালী সংগঠন যা সংগ্রামকে অব্যাহত রাখবে। পরে আব্দুর কথাই সঠিক প্রমাণিত হলাে। ৭ জুন দেশব্যাপী পূর্ণ হরতাল পালিত হলাে। রাজবন্দিদের মুক্তি ও ছয় দফা বাস্তবায়নের দাবিতে স্কুল, কলেজ, কলকারখানা, গাড়িঘােড়া সব বন্ধ হয়ে গেল বিক্ষুব্ধ জাতির ঐকান্তিক সমর্থনে। স্বৈরাচারী সেনা-রাষ্ট্রপতি আইয়ুব খান ও তার দুষ্কর্মের সঙ্গী গভর্নর মােনায়েম খান ১৪৪ ধারা জারি করলেন। ১৪৪ ধারা অমান্যকারী বিদ্রোহী শ্রমিক ও জনতার ওপর চলল কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলিবর্ষণ । শ্রমিক। মনুমিয়াসহ এগারােজন অকুতভয় ত্যাগী বীর সেদিন শহীদ হলেন। ৭ জুন এমন করেই অমরত্ব লাভ করল। ঐ ঐতিহাসিক দিনটির স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে আব্ব বলেছিলেন, জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম এগােয় সর্পিল গতিতে আঁকাবাঁকা পথ ধরে। রক্ত-পিচ্ছিল এই পথ। বাধা এখানে অসংখ্য। পার হতে হয় অনেক চড়াই-উতরাই। সংগ্রামের এক একটা মােড় পরিবর্তনে ইতিহাসে সংযােজিত হয় নতুন অধ্যায়। ৭ জুন আমাদের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাসে এমনি একটি যুগান্ত কারী মােড় পরিবর্তন। … ৭ জুনকে এক অর্থে বলা যায় ছয় দফার দিবস। এই দিনে ছয় দফার দাবিতে বাঙালি রক্ত দিতে শুরু করে। স্বাধিকারের এই আন্দোলনই ধাপে ধাপে রক্তনদী পেরিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধে গিয়ে শেষ হয়েছে। কাজেই বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে ৭ জুন অমর ।। | আব্দুসহ মূল নেতৃবৃন্দ যখন কারান্তরীণ তখন আওয়ামী লীগের হাল ধরেছিলেন ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক আমেনা বেগম ও মিজানুর রহমান চৌধুরী। দলের চরম দুর্দিনে তারা প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সাংগঠনিক তৎপরতা অব্যাহত রেখেছিলেন এবং ছয় দফার বক্তব্যকে উজ্জীবিত করেছিলেন। তাদের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের কর্মিসভা অনুষ্ঠিত হতাে আমাদের বাড়ির
নিচতলার বৈঠকখানায়। আমেনা বেগম তার ছেলেকেও সঙ্গে নিয়ে আসতেন। সে ছিল আমাদের বয়সী। আমরা একসঙ্গে নানারকম খেলা খেলতাম। একদিন আমেনা বেগম আমাদের বললেন, ‘তােমরা এই বইগুলাে নিয়ে গেটের সামনে দাড়িয়ে থাকো। যারাই সভায় আসবে, তাদের হাতে একটি করে বই দেবে।’ বই বিলি করার দায়িত্ব পেয়ে আমরা ভীষণ খুশি। সবুজ রঙের বইটির মলাটে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল সেই যুগান্তকারী বৈপ্লবিক বাণী পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসন চাই’। | সেদিন সন্ধ্যায় আমি অতি উৎসাহে আল্লুকে ময়মনসিংহ কারাগারে চিঠি লিখলাম, “আব্দু আজ আমি অনেকগুলি বই মিটিংয়ে বিলি করেছি। বইয়ের নাম পূর্ব বাংলায় স্বায়ত্তশাসন চাই’।” আন্ধু তাঁর অতি সুন্দর মুক্তার মতাে হস্তাক্ষরে চিঠির উত্তর দিলেন। তিনি জানালেন আমার বই বিলি করার সংবাদে তিনি খুশি হয়েছেন। (কারাগার থেকে লেখা আব্দুর সব চিঠি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমাদের বাসা থেকে বিনষ্ট হয়ে যায়।) তারপর দেখতে দেখতে ১৯৬৭ সাল চলে এল। রােজার ঈদের আগের দিন আম্মা রাত। জেগে মুরগির রােস্ট, কাবাব, পরােটা, জর্দা ইত্যাদি রান্না করলেন। এ ধরনের মজার খাবার রান্না হলেই বুঝতাম যে কারাগারে আলুর সঙ্গে দেখা করার দিন ঘনিয়ে এসেছে। আম্মার হাতের অতুলনীয় খাবারে টিফিন কেরিয়ার বােঝাই করে কাক ডাকা ভােরে আমরা ছুটতাম ঢাকার ফুলবাড়িয়া স্টেশনে যেখান থেকে গ্রিনঅ্যারাে রেলে চড়ে রওনা হতাম ময়মনসিংহের পথে। আমাদের ঈদের নতুন জামাকাপড় হয়নি, অথচ মনজুড়ে খুশির লক্ষ ফানুস উড়ছে। আমরা ঢাকার ভৌগােলিক সীমানা পেরিয়ে যাচ্ছি ময়মনসিংহে, যেন সাতসমুদ্র তেরাে নদী পেরিয়ে যাচ্ছি আশ্চর্য সুন্দর অজানা এক রাজ্যে যেখানে আল্লু পথ চেয়ে রয়েছেন আমাদের অপেক্ষায়। আম্মা রেলগাড়ির জানালা দিয়ে উদাস নয়নে তাকিয়ে থাকতেন কোন সুদূরে। তাঁর কাঁধে তখন ঘর ও বাইরের সব দায়িত্ব এসে পড়েছে। তিনি সবকিছুই একাকী সামলাচ্ছিলেন তেজস্বী মনােভাব নিয়ে। একদিকে অর্থনৈতিক সংগ্রাম, তিনটি শিশুর লালনপালন, রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের সাহায্য-সমর্থন, রাজবন্দিদের পরিবারের খোঁজখবর, তাঁদের মুক্তির দাবিতে মিটিং, মিছিল, সমাজসেবা আবার লেখাপড়াও চালিয়ে যাচ্ছিলেন পূর্ণোদ্যমে। | আম্মার সংগ্রামী জীবনে বইছে যে কত ঝড়ের তাণ্ডব তা বােঝার বয়স তখনাে আমাদের হয়নি। আমরা রেলগাড়ির জানালা দিয়ে বাইরে তাকাতাম উঞ্ছন্ন নয়নে। রিমি ও আমি রেলগাড়ির ঝমাঝম শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছড়া আবৃত্তি করতাম।
রেলগাড়ি ঝমাঝম,
পা পিছলে আলুর দম,
ইস্টিশনের মিষ্টি কুল,
শখের গােলাপ পারুল ফুল।
ময়মনসিংহে গিয়ে আমরা উঠতাম অ্যাডভােকেট জুলমত আলী খানের বাসায়। (পরবর্তী। সময়ে বিএনপির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা, ভুটান ও থাইল্যান্ডে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত এবং সামরিক প্রশাসক, রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদেশে অন্যায়ভাবে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কর্নেল তাহেরের তিনি আইনজীবী ছিলেন।) তিনি ও তাঁর স্ত্রী আমাদের যথেষ্ট আদর করতেন। তাদের মেয়ে নীতার সঙ্গে আমরা খেলাধুলা করতাম। নীতার পােষা কালাে ময়না পাখিটির ঠোট ছিল কমলালেবুর মতাে উজ্জ্বল বর্ণের । আমাদের দেখলেই সেই ঠোট দুটি নেড়ে খনখনে গলায় শুধাত, কী গাে কেমন আছ ?’ ছােয় শান্ত মনােরম শহর ময়মনসিংহ। তার চেয়েও আমাদের দৃষ্টিতে মনােরম ছিল ময়মনসিংহ কারাগারটি। কারাগারের সামনে ছিল বিশাল গাছপালায় ঘেরা বিরাট দিঘি এবং ভেতরে আন্ধুর হাতে গড়া সূর্যমুখী ও গােলাপের বাগান। কারাগারের জেলার ছিলেন অমায়িক মানুষ। নিয়মের ব্যতিক্রম করে ঈদের দিন কারাগারের ভেতরের বিশাল লােহার গেটটি খুলে দিলেন আমার আর রিমির জন্য। আম্মা ওয়েটিংরুমে বসে রইলেন আর আমরা উড়ন্ত প্রজাপতির মতাে আনন্দের পাখায় ভর করে ছুটে গেলাম রাজবন্দিদের জন্য সংরক্ষিত গৃহটির সামনে। একটি টানা লম্বা টিনের চালা দেওয়া পাকা ঘরের মেঝেতে সারি সারি লােহার খাট পাতা, যার একটি আব্দুর শয্যা। সেখানে দেখা হলাে মহারাজ ত্রৈলােক্য চক্রবর্তী, অজয় রায়, রফিকউদ্দীন ভূঁইয়া, মনােরঞ্জন ধরসহ বহু রাজবন্দির সঙ্গে। মুক্ত পৃথিবীর প্রতীক দুটো বাচ্চা মেয়েকে দেখে তারা ভীষণ উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। তাঁদের কোল থেকে কোলে আমরা দুবােন ঘুরতে থাকলাম। দুজন সিপাই আমাদের নিয়ে গেল আব্দুর কাছে তার প্রিয় বাগানে। তিনি সে সময় একটি সাদা হাফহাতা গেঞ্জি ও লুঙ্গি পরে বাগানের কাজ শেষ করছিলেন। জেলার সাহেব চমক দেওয়ার জন্য আমাদের ভেতরে আসার সংবাদটি আন্ধুকে জানাননি। আব্ব আমাদের দুই বােনকে দেখে আনন্দে বিহ্বল হয়ে গেলেন। রাজবন্দিরা। আমাদের জানালেন যে আব্ব একটি ভােলা নর্দমাকে ভরাট করে এই সূর্যমুখী, গােলাপ ও চন্দ্রমল্লিকার বাগানটি করেছেন। সেই কত কাল আগের কথা ! আজ মনে হয় বাগানটি ছিল আলুর নির্মল চরিত্রেরই একটি সমুজ্জ্বল প্রতীক। তাঁর জীবনের আরাধনাই ছিল মাটির কাছাকাছি হয়ে সব জঞ্জাল সাফ করে সৌন্দর্যের বীজ বুনে যাওয়া, দেশ ও দশকে অসত্য, অবিচার ও অন্যায়ের হাত থেকে মুক্ত করা। | শীতের রৌদ্রালােকিত নরম উষ্ণ অপরাকে হাওয়ায় ভেসে আসা গােলাপের মিষ্টি সুবাসে মন মাতিয়ে স্বপ্নের বাগানের রচয়িতা আব্দুকে সেদিন যেন নতুন করে আবিষ্কার করলাম। আম্মার কাছে ফিরে যাওয়ার আগে আমরা দু’বােন রবি ঠাকুর রচিত ‘আজি ধানের খেতে রৌদ্র ছায়ায় লুকোচুরির খেলা যে ভাই লুকোচুরির খেলা’ গানটির সঙ্গে ঘুরে ঘুরে নাচলাম। আল্লু ও বাকি সব রাজবন্দি মন্ত্রমুগ্ধের মতাে আমাদের নাচ দেখলেন, গান শুনলেন। নাচ, গান ও পাখির মতাে আমাদের কথাবার্তার কলকাকলি শেষ হওয়ার পর আব্বর হাত ধরে আমরা দু’বােন ফিরে এলাম অপেক্ষাকক্ষে যেখানে আম্মা আমাদের জন্য অধীর আগ্রহে পথ চেয়ে রয়েছেন। ঈদের ছুটির পর স্কুল খুলল। আমাদের শিক্ষয়িত্ৰী আপা ছাত্রীরা কে কেমন করে ঈদ পালন। করেছে সে সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলেন। প্রায় সবাই বলল, তারা ঈদের ভােরবেলায় ঘুম থেকে উঠে গােসল করে অতি সযত্নে লুকিয়ে রাখা নতুন জামাকাপড়-জুতাে পরেছে। তাদের বাড়িতে রান্না হয়েছে পােলাও, কোর্মা, জর্দা, সেমাই ইত্যাদি। বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়স্বজন সেদিন ভিড় করেছে তাদের বাড়িতে। তারাও বেড়াতে গিয়েছে বাবা-মা’র সঙ্গে। শুধু একটি মেয়ে বলল, সে ঈদের আনন্দ করতে পারেনি কারণ তার সেদিন খুব জ্বর ছিল। আমার বলার পালা এলে আমি দাঁড়িয়ে বেশ গর্বের সঙ্গে বললাম, আমরা নতুন জামাকাপড় পরিনি। আমাদের বাসায় বন্ধুবান্ধবও আসেনি। কিন্তু আমরা সেদিন খুব মজা করে ঈদ পালন করেছি আন্ধুর সঙ্গে জেলখানার ভেতর।’ আমাদের ব্যতিক্রমধর্মী বাবার কারণে আমাদের জীবনের একটি বিরাট অংশ যে ব্যতিক্রমধর্মী হয়ে পড়ছিল তা আমি উপলব্ধি করতাম। আমার উত্তর শুনে আমার এক সহপাঠী জিজ্ঞেস করল, ‘তােমার আব্ব কি চুরি করেছে ?’ রাজনীতি কী ? তার সঠিক সংজ্ঞা আমার জানা ছিল না। মনে মনে দুঃখ পেলেও যথাসাধ্য তাকে এবং কৌতূহলী অন্য সহপাঠীদের বােঝাবার চেষ্টা করলাম আব্ব আমাদের সবার মঙ্গলের জন্য কাজ করছেন। যারা দেশের জন্য কাজ করেন। তাদেরকে সরকার জেলে পুরে দেয়। | সেই ঘটনার কিছুদিন পর আমাদের শিক্ষয়ত্ৰী আপা জানালেন যে, অভাবী ছাত্রীরা আর্থিক সহায়তার জন্য পুয়াের ফান্ডের আবেদনপত্রে আবেদন করতে পারে। এ জন্য অভিভাবকের স্বাক্ষরসহ ফরম পূরণ করে স্কুলে জমা দিতে হবে। ক্লাসে ফরম বিতরণ করা হলাে। আমিও একটি ফরম নিয়ে বাসায় ফিরলাম। ফরমটায় চোখ বুলিয়ে আম্মা বেশ হাসলেন। কৌতুক ভরা চোখে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, “তােমার কি মনে হয়, আমরা গরিব ?’ আমি বললাম, ‘ঈদে আমরা নতুন জামা-কাপড় পাইনি, আন্ধু জেলে, তাহলে তাে আমরা গরিব ! আমার ক্লাসে ক’জন মেয়ে আমাকে সে কথাই বলেছে।’ আম্মা বললেন, ‘শােননা নতুন কাপড় পরলেই কেউ ধনী হয়ে যায় না। যার যতটুকু রয়েছে তার থেকে যে অকাতরে দান করতে পারে, সেই ধনী। তােমার আব্দু নিজের জীবনকে দান করেছেন দেশের জন্য। ক’জনের আল্লু অমন করে দান করতে পারে?’ আম্মার সেদিনের আত্মপ্রত্যয় ভরা গর্বিত উক্তিটি আমার শিশুমনে গভীরভাবে রেখাপাত করে। অন্তরের ঐশ্বর্য যে বস্তু ও বিলাসসামগ্রী থেকে শ্রেষ্ঠ তা তিনি বুঝিয়ে দিলেন এবং নিজেকে বিলিয়ে দেওয়ার সংগ্রামে আব্দুর অসাধারণ অবস্থানটিও তিনি তুলে ধরলেন আমার পৃথিবীর পথে পথ চলার উষালগ্নে । নিঃস্বার্থ দেশসেবার মন্ত্রে দীক্ষিত আব্দুর যথার্থ জীবন-সঙ্গিনী ছিলেন। তিনি। এমন সবল চরিত্রের অনন্য সাধারণ বাবা-মায়ের সন্তান হতে পারার বিরল সৌভাগ্যই তাে জীবনের এক অতুলনীয় প্রাপ্তি। বাবা ও মায়ের জীবনসংগ্রামের মধ্যে দিয়ে ঢাকার উত্তপ্ত রাজপথকে আমি আবিষ্কার করি। একদল খুদে বন্ধুর সঙ্গে হাডুডু ও লুকোচুরি খেলার ফাঁকে ফাঁকে ভেসে আসে রাজপথের বিদ্রোহী শ্লোগান, ‘জেলের তালা ভাঙবাে, শেখ মুজিবকে আনবাে’। রাজবন্দিদের মুক্তি চাই…’। আতাউর রহমান খান তখন ছিলেন রাজবন্দি সাহায্য কমিটির চেয়ারম্যান এবং আম্মা সেই কমিটির আহ্বায়ক। একই সঙ্গে তিনি বিভিন্ন সামাজিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও যুক্ত। নারী অধিকার আন্দোলনের সংগ্রামী ও নিবেদিত নারীনেত্রী কবি সুফিয়া কামাল, ডক্টর নীলিমা ইব্রাহীম, মালেকা বেগম, আয়েশা খানম, নূরজাহান মুরশিদ, নূরুন্নাহার সামাদ প্রমুখের সঙ্গে আম্মার আদর্শিক সখ্যতা গড়ে ওঠে নারীর অধিকার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। মহিলা পরিষদের সঙ্গে এভাবেই যুক্ত হয়ে যান তিনি। বাল্য ও কৈশােরে ঘােড়ার দৌড়, সাঁতার, সাইকেল প্রভৃতি খেলার প্রতিযােগিতায় চ্যাম্পিয়ন হতেন। রান্না, সূচিশিল্প ও বুননে পারদর্শী আম্মা আমাদের জন্য নিজ হাতে তৈরি করতেন চমৎকার পােশাক। হাওয়াই গিটারে তুলতেন মনােরম সুরের আলাপ। ছবি তুলতেন চমৎকার। হােমিওপ্যাথির ওপর ডিপ্লোমা নিয়ে তিনি বিনা মূল্যে চিকিৎসা ও সেবা প্রদান করতেন। কুরআন তেলাওয়াতও করতেন অতি বিশুদ্ধ উচ্চারণসহ। আত্মিক ও জাগতিক গুণাবলির সমন্বয়ে আম্মার মধ্যে আত্মনির্ভরশীল, মমতালব্ধ, ত্যাগী ও সাহসী চেতনার এক বলিষ্ঠ বহিঃপ্রকাশ ঘটে। আল্লু কারারুদ্ধ হওয়ার পর আম্মার সৃজনশীলতা আত্মপ্রকাশ করে ভিন্ন পথে, রাজপথের সংগ্রামে। (পরবর্তী সময়ে ১৯৭৫ সালে জাতীয় নেতৃবৃন্দর নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পর এই আম্মাই জাতির চরম দুর্দিনে, নেতৃত্বের মহা সংকটপূর্ণ সময়ে আহ্বায়িকা হিসেবে তাঁর জীবনসাখির প্রাণপ্রিয় দলটির হাল ধরেন। ত্যাগ ও সাহসিকতার সঙ্গে মৃত আওয়ামী লীগের পুনরুত্থানে এক অনন্য ভূমিকা পালন করেন। এমনকি যে সময় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করতে মানুষ ভয় পেত, সেই দুঃসময় আম্মার নিঃস্বার্থ নির্ভিক নেতৃত্বেই সর্ব প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে আর্মি পুলিশের বাধা সত্ত্বেও ৩২ নাম্বার রােডের সামনে প্রকাশ্য সভা করে ১৫ আগস্ট ১৯৭৭, বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের দিনটি শােক দিবস হিসেবে পালিত হয়।) | অম্লান সেই অতীতের এক গনগনে উত্তপ্ত উত্তাল সময়ে আমার কানে ভেসে আসে আগরতলা শব্দটি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাক্যটির সঙ্গে আগরবাতির কেমন একটা সম্পর্ক যেন খুঁজে পেতাম। মুজিব কাকু আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এক নম্বর আসামি, ব্যাপারটি সে সময় জানা হয়ে যায়। রাজনীতির অশান্ত জগৎটি তখনাে আমার ভাবনার রাজ্য থেকে অনেক দূরে। সে সময় দস্যু বনহুর সিরিজের বইগুলাে লােভনীয় চকলেটের মতাে আমি সমবয়সী। বন্ধুদের সঙ্গে গোগ্রাসে গিলছি। সহজ, সরল ভাষায় লেখা সিরিজগুলাে আমাদের আট-নয় বছর বয়সী ছেলেমেয়েদের দ্রুত পঠনের দক্ষতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে চলছিল। যদিও সিরিজগুলাে আমাদের মতাে ছােট বয়সের ছেলেমেয়েদের উদ্দেশ্য করে লেখা হয়নি। সে যুগে শিশু-সাহিত্যের সংখ্যা হাতেগােনা হলেও অবসরে বই পড়ার মতাে সংস্কৃতিটি মধ্যবিত্ত সমাজে ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল। দস্যু বনহুরও এমনি করেই আমাদের হাতে এসে পড়ে। দুৰ্বত্তের যম বনহর। নামের একজন মহৎ হৃদয় ও নির্মল চরিত্রের দস্যুর প্রতিকৃতি সহজেই আমাদের শিশুমনে আসন গেড়ে নেয়। একই সময়ে শিশু-সাহিত্যের মধ্যে হাশেম খান রচিত পরীর দেশে ফুলের বেশে, সাজেদুল করিমের চিংড়ি ফড়িং-এর জন্মদিনে, নাসির আহমেদের লেবু মামার সপ্তকাণ্ড ও মেঘমল্লার সংকলনের ভেতর রাহাত খান রচিত ‘হাজার বছর আগে’ গল্পটি আমাকে দারুণ মুগ্ধ
রাহাত খান তার এই মনােমুগ্ধকর রূপকথার গল্পটির মধ্য দিয়ে এক অপরূপ লাবণ্যময়ী শান্তি ও সমৃদ্ধিপূর্ণ শ্যামল বাংলাকে মূর্ত করে তােলেন। সেই কাঙ্ক্ষিত স্বপ্নের বাংলায় তাঁতি, মাঝি ও চাষিরা তাদের শ্রমের ফসল উপভােগ করে নির্ভয়ে। নারী ও পুরুষ পরস্পরের সঙ্গী হয়ে জীবনের ঐশ্বর্যকে বরণ করে নেয়। তারা গান গায়,
যখন আকাশে জ্বলন্ত বৃত্তিকারা পাক খায়
হরিণশিশু স্বপ্ন দেখে
সবুজ ঘাস।
আমরা তখন এক, দুই, তিন, চার ফিরছি
কী সুন্দর জীবনের এই
অপরূপ অবকাশ।
ঐ অপরূপ জীবনেও ঝড় আসে। আগ্রাসী সম্পদ লুণ্ঠনকারী ভিনদেশি রাজা স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা। সবুজ বাংলাকে গ্রাস করে নেয়। শুরু হয় সংগ্রাম। জিৎ হয় শােষিতের। বাংলা হয় মুক্ত।
১৭-৩০
অন্তদৃষ্টি
রাজপথের সংগ্রামকে আমি আবিষ্কার করি গল্পে। আন্ধুর কাছে লেখা আমার পরবর্তী সময়ে চিঠিতে ঐ বইগুলাের একটি তালিকাও দিই। আব্দুর উত্তরের অপেক্ষায় আমি দিন গুনতে থাকি। কারাগার থেকে চিঠি পৌছাতে সময় লাগে। নানা বিধিনিষেধ পেরিয়ে আব্দুর চিঠিটি একদিন। আমাদের কাছে পৌছায়। খুব ছােট, মুক্তার মতাে অক্ষরে সাজানাে পরিপাটি চিঠিতে তিনি ব্যক্ত করলেন নিজেকে। আমার বইয়ের তালিকা পড়ে খুব খুশি হয়েছেন জানালেন। ছােটবেলায় তিনি ক্লাসে প্রথম স্থান লাভ করায় আরব্য উপন্যাসের আলীবাবা ও চল্লিশ চোর’ বইটি পুরস্কার হিসেবে পেয়েছিলেন তাও লিখলেন। বাড়িতে অনেক পুঁথি ছিল। ছােটবেলায় তিনি সেই পুঁথি সুর করে পড়তেন—সােনাভানের গল্প, সয়ফুলমুলুক বদিউজ্জামাল এবং গাজী-কালু ও চম্পাবতীর কাহিনি। কলেজে উঠে মীর মােশাররফ হােসেনের বিষাদসিন্ধু ও শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের বিভিন্ন উপন্যাসও তিনি পড়েছেন, সেগুলােরও নাম লিখলেন। কন্যার সঙ্গে বই পড়ার তালিকা বিনিময়। করার পর জানালেন তার উদ্বেগের কথা। তিনি স্বপ্নে দেখেছেন যে পিপি এক অন্ধগলির মধ্যে। দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে ফেরার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। এর একটি চোখ যেন নষ্ট হয়ে গিয়েছে। সে। চোখের নীরব ভাষায় কাকুতিমিনতি করে বলছে ওকে যেন একলা সেই অন্ধগলিতে ফেলে আমরা চলে না যাই। বাড়ির ভেতরের টানা খােলা বারান্দায় বসে আম্মা ও আমি যখন সেই চিঠি পড়ছি। ঠিক সে সময় রাস্তা থেকে হাঁপাতে হাঁপাতে পিপি বারান্দার সামনে এসে দাঁড়াল। তার একটি চোখ রক্তাক্ত ও অন্য চোখটিতে ভয় ও বেদনামিশ্রিত আকুতি।
| ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় তখন বিক্ষোভ ও হরতাল চলছে। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। প্রত্যাহার, শেখ মুজিবসহ রাজবন্দিদের মুক্তি দাবি, ছাত্রনেতা আসাদ হত্যার (২০ জানুয়ারি ‘৬৯) বিচার দাবি এবং পাকিস্তানের সামরিক শাসন ও আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের চূড়ান্ত সময় সেই উনসত্তর। ঢাকার রাজপথে সারি বাধা কৃষ্ণচূড়ার মতাে লাল রঙের রক্ত বহানাের বছর সেটি। জোট বাঁধা মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত হরতাল ভাঙার প্রচেষ্টায় যানবাহনশূন্য রাস্তায় বিকট শব্দে এদিক থেকে সেদিক ছুটে যেত পাকিস্তানি সেনাদের জিপ। সেই জিপগুলাের গতি নিশ্চল করার জন্য সংগ্রামী জনতা ব্যারিকেড ফেলে রাখত। আবার অদৃশ্য থেকে ঢিল-পাটকেলও ছুটে যেত ঐ জিপ গাড়ি লক্ষ্য করে। ঐরকম কোনাে ঢিলই বােধহয় পিপির চোখে লেগেছিল। কারাগারের অন্তরাল থেকে আন্ধু কেমন করে দেখলেন এই ভবিষ্যৎকে, কে জানে! তবে ভালোবাসার চোখ যে অন্ত র্ভেদী এবং স্রষ্টার সকল সৃষ্টির সঙ্গেই যে হতে পারে আত্মিক যােগাযােগ, এই ধারণাটি ঐ ঘটনা থেকে আমার মনে গেঁথে যায়। পিপি তার কিছুদিন পরই মারাত্মক রােগাক্রান্ত হয়ে পশু। হাসপাতালে মারা যায়। | ঊনসত্তর সালের বারােই ফেব্রুয়ারি, পড়ন্ত বিকেলে বাগানের উড়ন্ত প্রজাপতির পেছনে ছুটে চলেছি। ঠিক এমনি সময়ই আমাদের বাড়ির সামনের পাের্চের নিচে একটি বেবিট্যাক্সি এসে থামল। বেবিট্যাক্সি থেকে যিনি নামলেন তিনি আমাদের সেই আশ্চর্য রহস্যময় আব্দু। শেষ বিকেলের সােনালি রােদের অভিবাদন সারা শরীরে জড়িয়ে আলু ঘরে ফিরে এলেন। এর পরের অধ্যায় এক সুদীর্ঘ বন্ধুর পথ অতিক্রমের ইতিহাস। এই ইতিহাসের এক উজ্জ্বল চরিত্র। এবং শঙ্কাকুল মুক্তিযুদ্ধের নায়ক আমার আব্দু। তার কাহিনিতে ভরা গল্পের ঝুলি। উনসত্তরের এই নতুন অধ্যায়ে এসে আমার পিতা তাজউদ্দীন হারিয়ে গেলেন নেতা তাজউদ্দীনের বলিষ্ঠ আবির্ভাবে। অজস্র জনতার ভিড়ের মাঝে হঠাই আর দেখা পেতাম কোনাে বিশেষ ঘটনাকে কেন্দ্র করে। আব্ব মুক্তি পাওয়ার কিছুদিন পরই আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হন কেরামত আলী নামের লম্বা চওড়া ও মস্ত গোঁফওয়ালা মিশমিশে কালাে বর্ণের এক ব্যক্তি। জমিজমাকে কেন্দ্র করে গ্রামীণ কৃষক কেরামত আলীর সঙ্গে তার প্রতিবেশীর তুমুল বাগবিতণ্ডা গড়ায় হাতাহাতিতে এবং প্রতিবেশীর দা-এর কোপ এড়াতে গিয়ে নিজের অজান্তেই কোপ দিয়ে হত্যা করে বসে সে প্রতিবেশীকে। তারপর কারাবাস। দীর্ঘ এক যুগ শ্রম কারাদণ্ড ভােগের পর সে সদ্য খালাস পেয়ে সােজা চলে এসেছে আমাদের বাড়িতে। কারাগারে সে রাজবন্দিদের দেখাশােনা করত। আন্ধু মুক্তি লাভের সময় তাকে আমাদের বাড়ির ঠিকানা দিয়েছিলেন। গ্রামে সরাসরি ফেরত যেতে কুণ্ঠিত, অনুতপ্ত কেরামত আলীর আশ্রয় মিলল আমাদের বাড়িতে। আৰু তাকে নিজ হাতে ধরে শেখালেন বাগানের কাজ। দাগি আসামি কেরামত আলী রূপান্তরিত হলাে আমাদের ফুলবাগানের মালিতে। খুরপি দিয়ে জমি নিড়াতে নিড়াতে সে তার গল্পের ঝুলি থেকে আমাকে ও রিমিকে উপহার দিত হরেক রকমের গল্প। তিন বছরের ছােট্ট মিমিকে কোলে করে আমি আর রিমি গােগ্রাসে গিলতাম সেই সব আজগুবি কল্পকাহিনি। কেরামত আলীর আগমনের মধ্য দিয়েই আব্দুর জীবনদর্শন সম্বন্ধে আরও একটি পরিচয় ঘটে। তিনি মানুষের অন্তর্নিহিত অপার সম্ভাবনার প্রতি প্রচণ্ডভাবেই আস্থাশীল ছিলেন। একজন অপরাধী তার আন্তরিক অনুতাপের মধ্যে দিয়েই বিবর্তিত হতে পারে মানব উন্নতির উচ্চসােপানে। এবং সে জন্য প্রয়ােজন। মানুষ ও সমাজের সার্বিক সহায়তা। আব্ব তার ব্যক্তিজীবনের নিভৃত কর্মকাণ্ডে সেই বিশ্বাসকেই প্রতিফলিত করেছিলেন।
আব্বু কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর আমাদের বাড়ি আবারাে সরগরম হয়ে উঠল। এরই মধ্যে কারাগার হতে মুক্তি পাওয়ার মাত্র ৬দিন পরেই, ১৮ ফেব্রুয়ারি আব্দু রওয়ানা দিলেন তকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের রাওয়ালপিণ্ডির পথে। রাওয়ালপিণ্ডিতে অনুষ্ঠিত আসন্ন গােলটেবিল বৈঠকের প্রস্তুতি কমিটির সভায় যােগ দিতে । গােলটেবিল বৈঠকে পাকিস্তানের রাজনীতিবিদরা ভবিষ্যৎ নির্বাচনের পরিকল্পনা ও শাসনতন্ত্রের রূপরেখা নিয়ে আলােচনা করবেন। রাওয়ালপিণ্ডির পথে রওয়ানা দেবার আগে আন্ধু ঢাকায় কুর্মিটোলার সেনানিবাসে কারাবন্দী, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামি মুজিব কাকুর সাথে সাক্ষাৎ করলেন। তিনি প্রস্তুতি কমিটির সভায় যােগ দিতে যাচ্ছেন মুজিব কাকুর ইচ্ছানুযায়ী ও তার প্রতিনিধি হয়ে। এই সভায় যােগদানের নেপথ্য ইতিহাস হলাে যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রসঙ্গে মুজিব কাকুর সাথে যখন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কারাগারে সাক্ষাৎ হয়, তখন আমীর-উল ইসলাম বলেছিলেন যে নিঃশর্তে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা তুলে না নিলে গােলটেবিল বৈঠকে আওয়ামী লীগ যােগদান করবে না, এই প্রস্ত বিটি প্রস্তুতি কমিটিতে উত্থাপন করা যায়। পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট ও গােলটেবিল বৈঠকের সমস্বয়কারী নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানও বলেছেন যে ঐ প্রস্তাব কমিটিতে আনতে বাধা নেই। (উল্লেখ্য তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগই ছিল মূল ও পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃত্ব দানকারী সে সময়ের রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে সব চাইতে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন। সে তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের ভূমিকা ছিল খুবই সীমিত) কথাটি শুনে মুজিব কাকু বললেন, “যে দলের প্রেসিডেন্ট ও জেনারেল সেক্রেটারি দুজনেই জেলে, তাদেরকে বাদ দিয়ে কী করে গােলটেবিল বৈঠক হতে পারে ?’ তিনি এই প্রশ্নটি উথাপন ও আওয়ামী লীগের প্রতিনিধিত্ব বাদে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের গােলটেবিলে যােগদানের অযৌক্তিকতা ও অসারতা যুক্তি ও প্রজ্ঞার সাথে তুলে ধরার জন্য একজন প্রতিনিধি পাঠাবার কথা বললেন। তারপর একটু চিন্তা করে বললেন দলের মধ্যে একজনই রয়েছে যে রাওয়ালপিণ্ডিতে দলের সুযােগ্য প্রতিনিধিত্ব করতে পারবে। সে হলাে তাজউদ্দীন। যদি তাজউদ্দীন জেল থেকে ছাড়া পায়, সেই এই কাজটি করতে পারবে।’ আমীর-উল ইসলাম লক্ষ করলেন যে আব্দুর মেধা, যােগ্যতা ও বিশ্বস্ততার প্রতি মুজিব কাকুর রয়েছে পরম আস্থা। তারপর মুজিব কাকুর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানের সাথে দেখা করলেন। তিনি তখন ঢাকা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের পথে রওয়ানা দেবেন। আমীর-উল ইসলাম তাকে মুজিব কাকুর মেসেজটি পৌছে দিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রভাবশালী এই রাজনীতিবিদ (আইয়ুব খানের সামরিক সরকার বিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানকারী রাজনীতিবিদদের অন্যতম, পাঠান বংশদ্ভূত নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালের জুন মাসে পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন। সাথে সাথেই কয়েক জায়গায় ফোন সেরে আমীর-উল ইসলামকে বললেন, আপনি এক ঘণ্টা পরে তাজউদ্দীন সাহেবের সাথে তার বাসায় সাক্ষাৎ করুন।’ প্রস্তুতি কমিটির মিটিং এ impressive ও convincing ভাবে’ (ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলামের ভাষায়) আন্ধু তার দল ও মুজিব কাকুর প্রতিনিধিত্ব করলেন। তিনি প্রশ্ন তুললেন আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান বাদে গােলটেবিল বৈঠকের যৌক্তিকতা প্রসঙ্গে। তিনি নিঃশর্তে তার মুক্তি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবি উত্থাপন করলেন। মুজিব কাকু অবশেষে, আব্দুর কারা মুক্তির দশ দিন পর ২২ ফেব্রুয়ারি মুক্তি পেলেন। রাস্তায় জনতার উৎফুল্ল শ্লোগান, জেলের তালা ভেঙেছি, শেখ মুজিবকে এনেছি’। গণআন্দোলনের চাপে ও সঠিক রাজনৈতিক চিন্তা ও পদক্ষেপের কারণে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বিনা শর্তে প্রত্যাহার হওয়ার পর রাজনৈতিক মঞ্চে মুজিব কাকুর পুনরায় আবির্ভাব বাঙালির মুক্তিসংগ্রামের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু হিসেবে। এই সময়টিতে তিনি আমাদের বাড়িতে ঘন ঘন আসতেন। আধুর সঙ্গে আলাপ-পরামর্শ করেই তিনি দলীয় প্রধান হিসেবে বিভিন্ন কর্মসূচি ঘােষণা করতেন। আব্দুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতার ওপর মুজিব কাকুর গভীর আস্থা ছিল। আম্মাকে তিনি ছােট বােনের মতােই স্নেহভরে লিলি (আম্মার ডাক নাম) বলে সম্বােধন করতেন। আব্লু ঘুমাতেন খুব কম এবং প্রায়ই রাত জেগে দলীয় বিবৃতি এবং সূক্ষ্ম রাজনৈতিক পরিকল্পনাগুলাে প্রণয়ন করে প্রাঞ্জল ভাষায় ঢেলে সাজাতেন। আব্দুর খাটুনির মাত্রা বেশি হলেই মুজিব কাকু গভীর উদ্বেগের সঙ্গে আম্মাকে বলতেন, ‘লিলি, তাজউদ্দীনের দিকে খেয়াল রেখাে, ওকে ছাড়া কিন্তু সব অচল।’ তিনি যখন আব্দুর সঙ্গে দেখা করতে আসতেন আমি ও রিমি মুজিব কাকু বলে দৌড়ে তার কাছে ছুটে যেতাম। মুজিব কাকু আমাদের সঙ্গে টুকিটাকি কথা বলতেন এমন উষ্ণ স্বরে যে ওনাকে ভালাে না বেসে পারা যায় না। নিজ দলের নেতা ও কর্মীবৃন্দ ছাড়াও আমাদের বাড়িতে অন্যান্য দলের নেতা ও কর্মীদেরও সমাগম হতাে। আম্মা ট্রেতে চা-নাশতা সাজিয়ে দিতেন আর রিমি ও আমি উৎসাহভরে সেগুলাে পরিবেশন করতাম। কাজের লােকের বদলে প্রায় সময়ই এই দায়িত্বটি আম্মা আমাদের ওপরই তুলে দিতেন। চা-নাশতা পরিবেশনের ফাঁকে ফাঁকেই আমাদের পরিচয় ঘটে কমিউনিস্ট পার্টির নেতা মণি সিংহ, মােজাফফর আহমদ, নেজামি ইসলামী পার্টির নেতা মৌলবি ফরিদ আহমেদ প্রমুখের সঙ্গে। ফরিদ আহমেদের মেয়ে জাকিয়া ছিল আমাদের খেলার সাথি। আব্দুর যুগের অধিকাংশ নেতৃবৃন্দের মধ্যে রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে ব্যক্তিগত সৌজন্য সম্পর্ক ও শ্রদ্ধাপূর্ণ আচরণে কখনােই ছেদ পড়েনি। | কোরবানির ঈদ বােধ হয় এল ফেব্রুয়ারির শেষ বা মার্চের শুরুতে। নানা কোরবানি ঈদ। উপলক্ষে একটা খাসি কিনে আনলেন। জামাতার জেল মুক্তির আনন্দে তিনি উৎফুল্ল। আন্ধুকে নিয়েই খাসিটি কোরবানি দেবেন ঠিক করলেন। কিন্তু খাসি জবাইয়ের সময় আর আন্ধুকে খুঁজে পেলেন না। আমাকে বললেন আব্দুকে খুঁজতে। আমি সারা ঘর খুঁজেও আন্ধুকে পেলাম না। তারপর ছাদে গেলাম। সেখানেও আৰু নেই। তারপর কী মনে করে ছাদের পানির ট্যাংকের পেছনে উঁকি দিয়ে দেখি আব্দু সেখানে দেওয়ালে পিঠ দিয়ে মাটিতে বসে রয়েছেন। যেন লুকোচুরি খেলা খেলতে গিয়ে ধরা পড়েছেন, এমনি সকাতর নয়নে আমার দিকে তাকালেন। তারপর ব্যথিত স্বরে বললেন, আমি ছােটবেলা থেকেই পশু-পাখির জবাই দেখতে পারি না।’ নানা শেষ পর্যন্ত জামাতাকে না পেয়ে অন্যদের নিয়ে খাসিটি কোরবানি দিলেন। | ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ। আমাদের দোতলা বাড়ির ভাড়াটিয়া শহীদ সাহেব টিভিতে খবর দেখছিলেন। খবর দেখে দোতলার বারান্দা হতে নিচতলায় আম্মার উদ্দেশে উত্তেজিত কণ্ঠে বললেন ‘ভাবি জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাওয়ার নিয়ে নিয়েছে। প্রচণ্ড গণ-আন্দোলনের তােড়ে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাধ্য হলেন পদত্যাগ করতে। অশুভতর আরও ভয়াবহ জঙ্গিবাদী জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছেই তিনি ক্ষমতা হস্তান্তর করলেন। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই, আইয়ুব খানের মতােই, ইয়াহিয়া খানও নিজেকে প্রেসিডেন্ট ঘােষণা করলেন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণের পর, উনসত্তরের কোনাে একদিন (যতদূর মনে পড়ে মধাফের সময়) আমাদের ধানমণ্ডি স্কুলে এলেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী, ছাত্রলীগের উদ্যমী অ্যাকটিভিস্ট রাফিয়া আখতার ডলি (১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে মাত্র ২৬ বছর বয়সে, আওয়ামী লীগ দল হতে সাংসদ নির্বাচিত হন), তার সাথে আরও অনেক বিক্ষুদ্ধ ছাত্রছাত্রীর দল। স্কুলের বড় আপা ও ছােট আপার নিষেধে কাজ হলাে না। স্কুলের বাইরে তরুণদের উত্তপ্ত শ্লোগান চলতে থাকল। মার্শাল ল’র বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তান সরকারের জোর জুলুমের প্রতিবাদে স্কুল বন্ধের আহ্বান জানান হলাে। কেউ কেউ শ্লোগান দিল, ‘প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ১ নম্বরের বেহাইয়া।’ শেষপর্যন্ত নাছােড়বান্দা রাফিয়া আখতার ডলি ও আরও কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী স্কুলের ভেতরে ঢুকলেন। তিনি আমাদের স্কুলের পেছনের মাঠে জ্বালাময়ী ভাষণ দিলেন। পুরাে স্কুল ভেঙে পড়ল তাঁর ভাষণ শুনতে। তিনি বললেন যে, পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার মাত্র। পূর্ব পাকিস্তানে চালের মণ ৪০ টাকা কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে বিশ টাকা। অথচ পূর্ব পাকিস্ত েিনর সম্পদ লুণ্ঠন করেই পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবি শাষকগােষ্ঠী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। এই দুঃশাসনের অবসান ঘটাতে হবে। তিনি সেদিন বটতলার সভায় যােগ দেওয়ার জন্য ছাত্র ও শিক্ষকদের আহ্বান জানালেন। আমি মাঠের পাশের লাগােয়া নিচতলার ক্লাসের খােলা জানালায় বসে মুগ্ধ চিত্তে তার ভাষণ শুনছি। ভাষণ শেষ হবার পর তিনি বললেন স্কুলে গণআন্দোলনের পক্ষে প্রতিনিধি থাকতে হবে। উৎসাহী অনেকের সাথে আমিও হাত তুললাম। প্রাইমারি ক্লাসগুলাের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি আমাকে বানালেন ভাইস প্রেসিডেন্ট, অপর এক ছাত্রীকে বানালেন প্রেসিডেন্ট। উচু ক্লাসগুলাে হতেও প্রতিনিধি মনােনীত করা হলাে। তিনি বা তাঁর সাথের কেউ একজন এবার ঘােষণা দিলেন, ‘তােমাদের মধ্যে সাহসী কে যে স্কুল ছুটির ঘণ্টা বাজাবে।’ ব্যাস আর যায় কোথায় । দুঃশাসনের প্রতিবাদে ঘন্টা বাজাবার চাইতে স্কুল তাড়াতাড়ি ছুটি হবে এই আনন্দে আমার সাথে ছুট দিল আরও কয়েকজন। যতদূর মনে পড়ে, উচু ক্লাসের এক ছাত্রী ঘণ্টা বাজিয়ে দিল। দপ্তরি হা হা করে তেড়ে এল। কিন্তু ততক্ষণে স্কুলের বিশেষত উচু ক্লাসের অনেক ছাত্রীই বটতলার সভায় যােগদানের জন্য প্রস্তুত। উনসত্তরের ১৮ আগস্ট সন্ধ্যায় আমাদের গ্রামের বাড়ি দরদরিয়া থেকে সংবাদবাহক বয়ে আনল এক মর্মান্তিক সংবাদ—দাদি মেহেরুননেসা খানম ইহলােক ত্যাগ করেছেন। পরদিন ১৯ আগস্ট রিমির জম্মদিন উপলক্ষে আমরা বেলুন দিয়ে ঘর সাজাচ্ছিলাম। দাদির মৃত্যু সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সারা বাড়িতে নেমে এল শােকের ছায়া। আন্ধু সেদিন ঢাকার বাইরে রাজনৈতিক কাজে ব্যস্ত ছিলেন। খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি ঢাকায় ফিরে দরদরিয়া যাওয়ার জন্য রেলস্টেশনের পথে রওনা হলেন। তার সঙ্গে আমি। রেলস্টেশনে আনার আপা ও ছােট কাকুও আমাদের সঙ্গে যােগ দিলেন। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঝড়বৃষ্টি চলছে। যেন আমাদের শােকাহত মনের সঙ্গে প্রকৃতিও তাল মিলিয়েছে। গভীর রাতে আমরা পৌছলাম শ্রীপুর রেলস্টেশনে। চারদিকে ঝড়ের শোঁ শোঁ শব্দ এবং প্রায় জনমানবশূন্য অন্ধকারাচ্ছন্ন আশপাশ মিলে এক ভৌতিক পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। সেই ঝড়ঝঞাপূর্ণ গভীর রাতে কোনাে রিকশা বা গরু-মহিষের গাড়ি পাওয়া গেল না। যানবাহনের জন্য ভােররাত পর্যন্ত। অপেক্ষা করতে হবে। আল্লু এক মুহূর্তও অপেক্ষা করতে নারাজ। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন যে, পাঁচ মাইল পথ আমরা হেঁটেই পাড়ি দেব। ঝড়বৃষ্টিতে কর্দমাক্ত লালমাটির পিচ্ছিল পথটি পাড়ি দেওয়া সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। আমি বারবারই পিছলে পড়ে যাচ্ছিলাম। আব্ব আমার হাতটি শক্ত করে ধরে শেখালেন কী করে পায়ের আঙুলগুলাে সামান্য মুড়ে মাটিকে খামচে পিচ্ছিল মেঠো পথে হাঁটতে হয়। আন্ধুর হাতে হাত রেখে তারই দেখিয়ে দেওয়া পদ্ধতি মতাে জুতাে খুলে খালি পায়ে একটু একটু করে সম্মুখে এগােতে থাকলাম। শাল গজারি বনের ওপর যখন ভােরের প্রথম আলাে পৌছাল শীতলক্ষ্যার জল প্রভাতী সূর্যের কিরণে ঝলমল করে উঠল, আমাদের ক্ষুদ্র কাফেলাটিও তখন পৌছল তার। গন্তব্য স্থলে দাদিকে শেষ বিদায় জানাতে। লাল মাটি ও টিনের চাল দিয়ে তৈরি দক্ষিণ ও পশ্চিমের দুটি কোঠাবাড়ি। পশ্চিমের কোঠাবাড়িতে আব্দুর জম্ম। এবং দক্ষিণের কোঠাবাড়ির ঘরে দাদির শেষ শয্যা। মাত্র নয় মাস আগেই দাদির প্রিয় সঙ্গী নানির পরলােক যাত্রা ঘটে। নানি অসুস্থ হওয়ার আগের রাতে আমাকে সন্ধ্যাতারা নামের এক রাজকন্যার গল্প বলেছিলেন। এক সন্ন্যাসীর উপদেশ অনুযায়ী সন্ধ্যাতারার রাজ্যের উত্তরে যাওয়া নিষেধ ছিল। সেই নিষেধ উপেক্ষা করে কৌতূহলী কিশােরী রাজকন্যা গােপনে পথ পাড়ি দেয় উত্তরের দিকে। এইটুকু বলে নানি থামেন। তারপর ?’ নানির পাশ ঘেঁষে আগ্রহে আমি প্রশ্ন করি। নানি বলেন, ‘আজ রাতটুকু এই পর্যন্ত থাক, বাকিটুকু কাল শােনাব।’ আগামীকালের স্বপ্ন দেখতে দেখতেই ঘুমের রাজ্য পাড়ি দিই। সেই প্রতীক্ষিত আগামীকালটি আর কোনাে দিনও আসে না। পরদিন নানি অসুস্থ হয়ে । পড়েন। অসুস্থতা মারাত্মক আকার ধারণ করলে আল্লুকে কারাগার থেকে দুই ঘণ্টার জন্য। প্যারােলে মুক্তি প্রদান করা হয় নানিকে দেখার জন্য। বাড়িভর্তি মানুষজন ও অস্ত্রধারী পুলিশ। পরিবেষ্টিত আব্দু নানির শয্যার পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন যৌন তাপসের মতাে। | নভেম্বর মাসের চার তারিখে মধ্যাহ্ন বেলায় নানি পরলােকে পাড়ি জমান। নানি মারা যাওয়ার পর তার বলা সেই অর্ধসমাপ্ত গল্পটিকে আমি সম্পূর্ণ করার চেষ্টা করি বিভিন্ন রকম। উপসংহার টেনে। কোনােটাই মনঃপূত হয় না। বড় হওয়ার পর এই উপলব্ধি হয় যে, জীবনটাই। যেন কোনাে এক অর্ধসমাপ্ত গল্প, যার শেষ কোনাে দিনও জানা হবে না। জীবনের শেষ প্রান্তে পেীছেও না। দাদির শেষ শয্যার পাশে দাড়িয়ে বিস্ময় ও বেদনায় হতবাক আমি বারবারই খুঁটিয়ে দেখছিলাম চিরঘুমন্ত দাদিকে। এক ফুৎকারেই কী করে এই তেজোদীপ্ত প্রাণ নিভে যেতে পারে ! নানির মৃত্যুর পর দাদি প্রায়ই বলতেন তারও বিদায় নেওয়ার সময় ঘনিয়ে এসেছে। তার কথার মর্ম তখনাে আমরা বুঝিনি। দাদিকে ধরে আবু কাঁদলেন ছেলেমানুষের মতাে। কিন্তু কর্তব্যপালনে থাকলেন সজাগ। দাদির জন্য কবর খোড়া, তাঁর জানাজা থেকে শুরু করে সমাধিস্থ করা পর্যন্ত সবকাজেই তিনি অগ্রণী ভূমিকা পালন করলেন। আমবাগানে হাওয়া বৃষ্টিতে স্নাত দূর্বাঘাসের আচ্ছাদনে ঢাকা পারিবারিক গােরস্তানে দাদা মৌলবি মুহাম্মদ ইয়াসিন খানের কবরের পাশেই দাদির শেষ শয্যা। রচিত হলাে। আমার জীবনের প্রথম দেখা এই কবর খোড়া ও কবরের গহিনে প্রিয়জনের হাতে প্রিয়জনকে শায়িত করার দৃশ্যটি মনে গেঁথে রইল নানির রেখে যাওয়া অসমাপ্ত সন্ধ্যাতারার গল্পটির মতাে। দাদিকে কবর দেওয়ার পর আন্ধু দাদির ঘরটির সামনে বসে অঝােরে কাঁদলেন। এই ঘরটিতেই ডাকাতরা যখন দাদার মাথা লক্ষ্য করে কুড়ালের কোপ বসাতে যায় তখন দাদি হাত বাড়িয়ে কুড়ালটি ধরে ফেলেছিলেন। এর ফলে তার হাতের মাঝখানের আঙুলটি টুকরা হয়ে পড়ে যায়। দাদা প্রাণে বেঁচে যান। ঘােট ঘােট লাল মাটির টিলা, বিশাল গড়, শাল ও গজারির বনে ঘেরা এই এলাকায় সেকালে বাঘের উপদ্রব হতাে। আব্দুর দাদা ইব্রাহীম খাঁ ছিলেন বাঘ শিকারি। একবার বাঘ শিকারের সময় ঘাপটি মেরে থাকা আহত বাঘ হঠাৎই তার গায়ে ঝাঁপ দিয়ে ১৭টি কামড় দেয় । বাঘের কামড়ের বিষক্রিয়া তার সারা শরীরের ছড়িয়ে পড়ে। মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে সাতদিন পর তিনি অকালে প্রাণত্যাগ করেন। এই মর্মান্তিক ঘটনার পরও বাঘের সম্পর্কে আমার দাদির কোনাে ভয়ডর ছিল না। তিনি মশাল জ্বেলে বাঘ তাড়াতেন। একবার গভীর রাতে গরু-ছাগলের খোঁয়াড়ে বাঘ হামলা চালায়। দাদি সবার আগে ছুটে যান বাঘের হাত থেকে গরু-ছাগল বাঁচাতে। শুকনা পাটখড়ি ও ডাল পালার জ্বলন্ত মশাল হাতে দাদিকে ধেয়ে আসতে দেখে বাঘ চম্পট দেয়। আন্ধু ছিলেন এমন দুর্দান্ত সাহসী মায়েরই সন্ত নি। দাদির স্মৃতিচারণা করে আল্লু সেদিন বললেন, মায়ের প্রচণ্ড উৎসাহ ছাড়া আমার লেখাপড়া সম্ভব ছিল না।’ আরবি ও ফারসি শিক্ষায় শিক্ষিত দাদা ছিলেন ঔপনিবেশিক ইংরেজ সরকারের ইংরেজি শিক্ষার ঘােরতর বিরােধী। গৃহে প্রতিষ্ঠিত মক্তবে দাদার কাছে আরবি ও ধর্মীয় শিক্ষা। সমাপ্ত করার পর দাদির ঐকান্তিক প্রয়াস ও ইচ্ছায় আব্দুকে ভর্তি করা হয় ডুলেশ্বরের প্রাইমারি স্কুলে। জন্মস্থান দরদরিয়া গ্রাম থেকে পাঁচ মাইল দূরের কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি (এম.ই) স্কুলে পড়ার সময় তিনজন ব্রিটিশ সরকার বিরােধী বিপ্লবী নেতার সান্নিধ্যে তিনি আসেন। এই তিন বিপ্লবী বীরেশ্বর ব্যানার্জি, মণীন্দ্র শ্রীমানী ও রাজেন্দ্র নারায়ণ চ্যাটার্জি আব্দুর মেধা ও চারিত্রিক গুণাবলিতে অত্যন্ত মুগ্ধ হন। তাদের সুপারিশে তিনি কালীগঞ্জের সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউশনে ভর্তি হন। উল্লেখ্য, আৰু কিশাের বয়সেই ধূমপান ও নেশা পানের অপকারিতা সম্বন্ধে সচেতনতা সৃষ্টির প্রয়াস নেন ও সমাজসেবার দায়িত্ব নিজ কাঁধে তুলে নেন। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি আন্ধু কুরআন চর্চাও অব্যাহত রাখেন এবং কুরআনে হাফেজ হন। একসময় গ্রামের স্কুলের পাঠ শেষ করে ভর্তি হন ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ হাইস্কুলে। ১৯৪৪ সালে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় প্রথম বিভাগে দ্বাদশ স্থান লাভ করা সত্ত্বেও সমাজসেবা ও প্রগতিশীল রাজনৈতিক আন্দোলনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জড়িত থাকার কারণে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা সময় মতাে দিতে পারেননি। মেধাবী পুত্রের নিয়মিত লেখাপড়ায় ছেদ পড়েছে দেখে দাদি ভীষণ মনঃক্ষুন্ন হলেন। দলের কাজে নিবেদিত আব্দু সে বছরও পরীক্ষা। দেবেন না বলে মনঃস্থির করেছিলেন। কিন্তু দাদির দৃঢ় ইচ্ছার কাছে তিনি হার মানলেন। পুত্রের লেখাপড়ার বিষয়টি যে তার কাছে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ তা ব্যক্ত করলেন এভাবে। আব্বর হাতে একটি রামদা ধরিয়ে দিয়ে দাদি বললেন, আল্লু যদি সে বহর পরীক্ষা না দেন তবে এই দা দিয়ে দাদিই নিজেকে কতল করবেন। মাতৃভক্ত আব্দুর এরপর পরীক্ষা দেওয়া ছাড়া আর কোনাে উপায় রইল না। ১৯৪৮ সালে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণীতে চতুর্থ স্থান লাভ করে তিনি দাদির মুখে হাসি ফুটিয়ে তুলেছিলেন। | নেপােলিয়ন বলেছিলেন, “তােমরা আমাকে ভালাে মা দাও, আমি তােমাদের ভালাে জাতি উপহার দেব’। একজন ভালাে মা পেতে হলে প্রয়ােজন পরিবার ও সমাজের সহায়তা। নারীর আত্মনির্ভরশীল চিন্তা ও চেতনার বিকাশে সহায়ক সমাজেই সৃষ্টি হতে পারে মানুষ গড়ার কারিগর সুদক্ষ মা ও সুন্দর সন্তান। শাল-গজারির বনে ঘেরা গ্রামে বড় হওয়া দাদির মতাে অগ্রগামী চিন্তা-চেতনাসম্পন্ন দৃঢ়চেতা সাহসী মায়ের দেওয়া অনন্য উপহার ছিল আন্ধুর মতাে বিশাল হৃদয়ের অকুতােভয় সংগ্রামী, ত্যাগী ও দেশপ্রেমিক রাষ্ট্রনায়ক। দাদি মারা যাওয়ার কয়েক মাস পর আমাদের একমাত্র ভাই জন্ম নিল ১৯৭০ সালের ৫ জানুয়ারি। সেদিন বেলা দুটায় আমাদের ধানমণ্ডির বাড়ির নিচতলার বন্ধ ঘরটি থেকে ভেসে আসে নবজাতকের চিৎকার। ওই ঘরটির জানালা ছিল আমাদের ফুল বাগানের দিকে মুখ করা। সেই জানালার নিচের বাগানে বসে সাদা হাফহাতা গেঞ্জি ও চেক লুঙ্গি পরিহিত আন্ধু খুরপি দিয়ে মাটি নিড়াচ্ছিলেন। গােলাপ, কসমস, জিনিয়া, সুইটপি, ডালিয়া প্রভৃতি রংবেরঙের মৌসুমি ফুলে ভরা বাগানের পরিচর্যারত আন্ধুকে তার একমাত্র পুত্র জন্মাবার সংবাদটি আমিই সর্বপ্রথম পৌছে দিই। তিনি খুরপি মাটিতে রেখে ঝলমলে হাসিভরা মুখ নিয়ে। নবজাতককে দেখতে ঘরে প্রবেশ করলেন। আব্দুর ছেলে হওয়ার খুশিতে মুজিব কাকু সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ অফিসে উপস্থিত সব নেতা ও কর্মীকে মিষ্টি কিনে খাওয়ালেন। এদিকে বাড়িভর্তি আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুবান্ধব আব্দুকে অনুরােধ করলেন মিষ্টি খাওয়ানাের জন্য। তিনি অভিমান ভরা স্বরে বললেন, তাঁর তিন নম্বর মেয়ে যেদিন হলাে সেদিন কেউ কেউ হতাশ হয়েছিল। তিনি সেদিন মিষ্টি কিনে সবাইকে খাইয়েছিলেন। আজ যখন ছেলে হওয়াতে তারা এতই খুশি তখন তারাই যেন মিষ্টি কিনে খাওয়ায়। আবু যখন সত্যিই কোনাে মিষ্টি কিনলেন না তখন আমাদের ছােট মামা সৈয়দ গােলাম মাওলা মিষ্টি কিনে আমাদের আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও প্রতিবেশীদের মধ্যে বিতরণ করলেন। নবজাতকের ডাক নাম কী রাখা হবে তা নিয়ে আমাদের বাসায় জল্পনা-কল্পনা চলছে। তখন বাংলা নামের প্রতি সকলের আকর্ষণ বেড়েছে। আমি কারাে কারাে প্রস্তাবিত নাম নিয়ে নামের বিভ্রাট’ একটি মজার ছড়া লিখে ইত্তেফাকের কচিকাঁচার আসরে পাঠিয়ে দিলাম।
আমার একটি ভাই হলাে
রাখব কী তার নাম
ভাবছি বসে তাই।
ভালাে যদি নাম পেয়ে যাই
আর ভাবনা নাই।
আম্মা বলেন, রাখব আমি তাপস
আমি বলি, যদি হয়ে যায় সে।
জুতা মােছার পাপােশ!
আনার আপা বলেন
রাখব আমি অমি।
আমি বলি যদি হয়ে যায় সে।
পাশের বাড়ির টমি।
(অংশবিশেষ) আমার কাঁচা হাতের ছড়াটি নিয়ে যখন বাড়িতে হাসির হুল্লোড় চলছে, সেই সময়ই আমার গল্পভাণ্ডারের ভেতর থেকে প্রতিভাদীপ্ত কিশাের গােয়েন্দা সােহেলের নামের সঙ্গে নাম মিলিয়ে ছােট ভাইটিকে সােহেল নামে ডাকা শুরু করলাম। রিমি আর মিমিও আমার সঙ্গে তাল মেলাল। বড়দের ভেটো দিয়ে আমার ভাইয়ের সােহেল নামটি চালু হয়ে গেল। | ছােট ভাই সােহেলকে নিয়ে আমরা তিন বােন বেশ মেতে থাকলাম। কিছুদিন পর নির্বাচনের তারিখ ঘােষণা হলাে। আলু ব্যস্ত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিয়ে, আর আমরা ব্যস্ত সােহেলকে নিয়ে। এই সময় এক দুর্ঘটনা ঘটল। অক্টোবর মাসের কোনাে একদিন আম্মা বারান্দা থেকে তাড়াহুড়ো করে নিচের লনে নামার সময় পড়ে গিয়ে পা ভেঙে ফেলেন। আব্দুর কলেজ জীবনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডাক্তার এম.এ করিম, আমাদের প্রিয় পারিবারিক চিকিৎসক সদা হাস্যময় করিম কাকু আম্মার পায়ে দক্ষতার সাথে এবং সুন্দর করে প্লাস্টার করে দিলেন। | নির্বাচনী প্রস্তুতির শত ব্যস্ততার মধ্যেও আবু আম্মার পরিচর্যার দিকে খেয়াল রাখতেন। আব্দুর সাথে আমি প্রায়ই চলে যেতাম ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর রােডে হাড় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ওমর জামিলের বাসভবনস্থ চেম্বারে । আব্ব তাকে আমার অবস্থা সম্বন্ধে অবহিত করতেন এবং আমার ব্যাপারে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতেন। আম্মাকে দেখানাের জন্য ডাক্তার ওমর জামিলকে সাথে করে অনেক সময় আমরা বাড়ি ফিরতাম। এরই মধ্যে নির্বাচনের তারিখ এগিয়ে এল। চারদিকে আনন্দমুখর পরিবেশ। ঠিক তখনই জাতীয় দুর্যোগ। ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে দশ লক্ষাধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের চরম অবহেলা ও বাঙালির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ প্রকট হয়ে ওঠে এই মর্মান্তিক প্রাকৃতিক দুর্যোগের মধ্যে। আব্দু ও মুজিব কাকু তখন চরকির মতাে দুর্গত এলাকায় ঘুরে ঘুরে মানুষকে সাহায্য করছেন। সঙ্গে গােটা আওয়ামী লীগই তখন পালন করছে বিকল্প সরকারের ভূমিকা, যােগ্যতা ও আন্তরিকতা সহকারে । তখন কিছু মানুষ আমাদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নেয়। আম্মা তার পায়ে বাঁধা অতিকায়। প্লাস্টারটি নিয়েই ক্রাচে ভর দিয়ে সহায়-সম্বলহীন উদ্বাস্তুদের তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। হাঁটুর নিচের (টিবিয়া বােন) দুই টুকরাে হয়ে যাওয়া হাড়টি জোড়া লাগতে অনেক সময় নেয়।
ঘূর্ণিঝড়ের কারণে নির্বাচনের তারিখ কিছুদিন পিছিয়ে যায়। নির্বাচন আদৌ অনুষ্ঠিত হবে কি না তা নিয়ে দেখা যায় সংশয়। শেষ পর্যন্ত সেই নির্বাচন পুনর্নির্ধারিত সময়ে অনুষ্ঠিত হয়। ৭ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত প্রথম সাধারণ নির্বাচনের পরিবেশটি ছিল আনন্দমুখর। উৎসবমুখর এই নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে আপামর মানুষ তখন প্রচণ্ড আশা ও উদ্দীপনা নিয়ে নতুন ভবিষ্যতের স্বপ্নকে লালন করেছে। নির্বাচনে ৬ দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভের পরও পাকিস্তানের সামরিক সরকার প্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান তার পূর্ব-প্রতিশ্রুতির ওপর। কুঠারাঘাত করে বেছে নিল গণহত্যার পথকে। এরপর তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টি প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো শরিক হলাে ষড়যন্ত্রে । পাকিস্তানের সামরিক সরকার একাত্তরের ৩ মার্চ পূর্বনির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করল ভুট্টোর সঙ্গে হাত মিলিয়ে। এতে সারা দেশ ফেটে পড়ল স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভে। অথচ তখন পর্যন্ত জনগণের আশা ছিল ছয় দফার ভিত্তিতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য একটি গ্রহণযােগ্য শাসনতন্ত্র গড়ে তােলা সম্ভবপর হবে। | সে সময় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে অসাধারণ কার্যকারিতার সঙ্গে সুশৃঙ্খলভাবে দেশব্যাপী। অসহযােগ আন্দোলন পালিত হয়। বাঙালির প্রাণের দাবি মেটাতে এই ঐতিহাসিক অসহযােগ আন্দোলনের মূল নীতি-নির্ধারক ও সংগঠক হিসেবে আলু গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। এদিকে ৬ মার্চে জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত রেডিও ও টেলিভিশনের ভাষণে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে গােলযােগ ও অখণ্ডতা ধ্বংসের অভিযােগ আনেন। সেই সন্ধ্যায় আওয়ামী লীগের মূল নেতৃবৃন্দ যারা হাইকম্যান্ড’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন তারা মুজিব কাকুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে এক সভায় মিলিত হন। ৭ মার্চের জনসভা, যা ইয়াহিয়া খানের ভাষণের আগেই নির্ধারিত হয়েছিল সেটিকে অপরিবর্তিত রেখে ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নিয়ে আলােচনা হয়। মুজিব কাকুর নিজস্ব ভাষা ও বাচনভঙ্গির মধ্য দিয়েই আব্বর লিখে দেওয়া মূল পয়েন্টগুলাে ৭ মার্চের ভাষণের মধ্যে প্রতিফলিত হয়। আম্মা ও রিমির সঙ্গে রেসকোর্সের ময়দানে শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই ঐতিহাসিক ভাষণটি শােনার সৌভাগ্য আমারও হয়। মুজিব কাকু তাঁর তেজোদীপ্ত আবেগময় ভরাট গলায় আসন্ন স্বাধীনতাযুদ্ধে প্রস্তুতির সুস্পষ্ট ইঙ্গিত দেন। এই ভাষণে সরাসরি স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়নি। পাকিস্তান সরকার যাতে তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী ও দেশদ্রোহী আখ্যা দেওয়ার সুযােগ না পায় এবং বিশ্ববাসী যাতে বুঝতে পারে যে গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়া সরকারের প্রচণ্ড অসহযােগিতা ও নির্যাতন সত্ত্বেও শেষ অবধি চেষ্টা করেছে শান্তিপূর্ণভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় স্বৈরাচারী সরকার পদ্ধতির পরিবর্তন ঘটাতে। বিষয়গুলাের প্রতি লক্ষ রেখেই অত্যন্ত ভারসাম্যের সঙ্গে জনগণের কাছে স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য প্রস্তুতির বার্তা প্রেরণ করা হয়। ৭ মার্চের ভাষণটি পরবর্তী সময়ে লাখ লাখ মুক্তিকামী মানুষকে স্বাধীনতার জন্য চরম আত্মত্যাগে অনুপ্রেরণা জোগায়। অসহযােগ আন্দোলন চলাকালে ১৫ মার্চ আওয়ামী লীগের তরফ থেকে আন্ধু দেশ পরিচালনার জন্য ৩৫টি নির্দেশ জারি করেন। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে নির্দেশগুলাে পালন করে প্রমাণ করে আওয়ামী লীগই প্রকৃত সরকার। | মার্চের এই অস্থির ও অনিশ্চিত সময়টিতে আমাদের ডান ও বাম পাশের বাড়ির প্রতিবেশী ও খেলার সাথিরা দেশ ত্যাগ করে। আমাদের ডান পাশের বাড়িতে থাকতেন, যুগােশ্লাভিয়া দূতাবাসের ঢাকা শাখার কর্মকর্তা। আমার সমবয়সী তার বড় মেয়ে সাকিবা ও ছােট ছেলে সামির ছিল আমাদের খেলার সাথি। সাকিবার কুতকুত খেলায় হাতেখড়ি হয় আমার হাতে। মার্চের এক অপরাহে সে তার সােনালি বাদামি ঝাঁকড়া চুল উড়িয়ে দৌড়ে এল আমাদের বাড়িতে। জানাল যে তারা ভাইবােন মায়ের সাথে যুগােশ্লাভিয়ায় চলে যাচ্ছে। তাদের বাবা অফিসের কাজ গুটিয়ে কিছুদিন পর ওদের সঙ্গে স্বদেশে মিলিত হবেন। আমাদের জলছাদের নিচে মাধবীলতার ঝােপের পাশে দাড়িয়ে সাকিবা নীলাভ রঙের কাগজে তার বাবার নাম ও বাড়ির ঠিকানা লিখে দিল। বাবার নাম আবদাল্লা। ঠিকানা : সারাএভাে, যুগােশ্লাভিয়া। সাকিবার সঙ্গে সেই শেষ সাক্ষাতের দুই যুগ পরে সারায়েভাে যুগোশ্লাভিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। সদ্য স্বাধীনতাপ্রাপ্ত সেই গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বসনিয়ায় (সারাভাে যার রাজধানী) মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা ও গণহত্যা বন্ধের আন্দোলনে আমি জড়িয়ে পড়ি একসময়। ভবিতব্য একেই বলে ! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেস ও রাজপথে চলে আমাদের আন্দোলন। হােয়াইট হাউসে উইমেনস। ব্যুরাের ৭৫তম (১৯৯৫) প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আমন্ত্রিত হওয়ার সুযােগে রাষ্ট্রপতি বিল ক্লিনটন ও ফার্স্টলেডি হিলারি ক্লিনটনের কাছে সরাসরিই দাবি উত্থাপন করি। যুগােশ্লাভিয়ার সার্ব-সরকার ও সাবাহিনী, যারা বসনিয়ায় নির্বিচারে গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ করি। বিল ক্লিনটন আশ্বাস দিয়ে বলেন ন্যাটোর মাধ্যমে শিগগিরই সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। বসনিয়ার নারীদের ওপর সার্ব-সৈন্যদের পাশবিক নির্যাতন প্রসঙ্গে আমার মন্তব্যের প্রেক্ষিতে হিলারি বলেন, বসনিয়ার নারীদের লাঞ্ছনা ও কষ্ট তার হৃদয়েও গেঁথে রয়েছে। | আমার সহকর্মী ও বন্ধু বসনিয়ায় মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রামরত এক দুরন্ত সাহসী নেত্রী বেভারলি ব্রিটন। যিনি নিজের জীবন বাজি রেখে অতি সন্তর্পণে বসনিয়ার রাজধানী সারাভাের বুকেই চালিয়েছেন মানবাধিকারের কাজকর্ম। বসনিয়া প্রসঙ্গে আমার বিশেষ আগ্রহের কারণ জানতে চাইলে আমি তার কাছে ব্যক্ত করি ১৯৭১-এ পাকিস্তান বাহিনী কর্তৃক বাঙালিদের ওপর নৃশংস গণহত্যার কাহিনি। সেদিনের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে বিজয়ী বাঙালিদের চরম মাসুল দিতে হয়েছিল। আজ যেমন গণতান্ত্রিক নির্বাচনে বিজয়ী স্বাধীন সার্বভৌম বসনিয়ার ওপর নেমে এসেছে তার প্রাক্তন প্রভু যুগােশ্লাভিয়ার খড়গহস্ত । নীল কাগজে সাকিবার হাতে লেখা ঠিকানাটি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে হারিয়ে যায়। সেদিনের বিক্ষুব্ধ অস্থির এবং রক্তাক্ত পটভূমিতে দাঁড়িয়ে কখনাে ভাবিনি যে আমি একদিন স্মৃতিতে অঙ্কিত সারাভাের পথ ধরে খুঁজে ফিরব ছেলেবেলার খেলার সাথি সাকিবকে ! অথবা স্বাধীনতাকামী ভিন্ন কোনাে জাতির মধ্যেই খুঁজব বাংলাদেশের হৃদয়। | আমাদের বাঁ পাশের প্রতিবেশী মরহুম হারুন-উর-রশিদ সাহেবের বাড়ির পরের বাড়িটাতে থাকত আমাদের খেলার টিমের বন্ধু ফাতেমা, খাদিজা ও হােসেন। অবাঙালি হওয়ার সূত্রে তারা ঢাকার বিক্ষুদ্ধ মাস্তান যুবকদের রােষদৃষ্টিতে পড়ে। অসহযােগ আন্দোলনের উত্তাপদন্ধ একদিনে তাদের বাড়ি লুটপাট হয়ে যায়। আন্ধু তাদের নিরাপত্তার জন্য তড়িৎ ব্যবস্থা গ্রহণ করলেও ফাতেমার বাবা, যিনি ছিলেন অতি সজ্জন ব্যক্তি, তিনি পরিবারসহ করাচির পথে ঢাকা ত্যাগ করেন। সন্ত্রাস, রক্তপাত ও যুদ্ধের একটি নির্মম দিক হলাে প্রিয়জনের সঙ্গে বিচেছদ; প্রিয় বন্ধুকে চিরতরে হারানাে।
৩৩-৪২
দুর্বার প্রতিরােধ
ইয়াহিয়া সরকার যে আওয়ামী লীগের কাছে পাকিস্তানের রাষ্ট্র পরিচালনার ভার কখনােই হস্তান্তর করবে না তা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠছিল। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী যেকোনাে মুহূর্তে আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও বাঙালি জনগণের ওপর হামলা চালাতে পারে এই আশঙ্কা উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছিল। তখন সামনে খােলা থাকবে একটাই পথ—সেটা স্বাধীনতার পথ। আলুকে আম্মা প্রশ্ন করেছিলেন যে মুজিব ইয়াহিয়া বৈঠক যদি ব্যর্থ হয় তাহলে বিকল্প ব্যবস্থা কী হবে? আ উত্তর দিয়েছিলেন আমরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে যাব তারপর স্বাধীনতা ঘােষণা করে দেব।’ ( ২৩ মার্চে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রােডে, মুজিব কাকুর বাড়িতে ছাত্ররা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করল। ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ইয়াহিয়া খান গােপনে ঢাকা ত্যাগ করলেন। আলােচনার আবরণে অপারেশন সার্চলাইট গণহত্যার নীল নকশা তখন সম্পন্ন। দুবছর আগে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা গ্রহণের দিনকে বেছে নেওয়া হলাে বাঙালির ওপর মরণ আঘাত হানার জন্য। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৫ মার্চের ভয়াল কালাে রাতে আল্লু গেলেন মুজিব কাকুকে নিতে মুজিব কাকু আব্দুর সঙ্গে আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবেন সেই ব্যাপারে আব্বু মুজিব। কাকুর সাথে আলােচনা করেছিলেন। মুজিব কাকু সে ব্যাপারে সম্মতিও দিয়েছিলেন। সেই অনুযায়ী আত্মগােপনের জন্য পুরান ঢাকায় একটি বাসাও ঠিক করে রাখা হয়েছিল। বড় কোনাে সিদ্ধান্ত সম্পর্কে আব্দুর উপদেশ গ্রহণে মুজিব কাকু এর আগে দ্বিধা করেননি। আব্দুর, সে কারণে বিশ্বাস ছিল যে, ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণে মুজিব কাকু কথা রাখবেন। মুজিব কাকু, আব্দুর সাথেই যাবেন। অথচ শেষ মুহূর্তে মুজিব কাকু অনড় রয়ে গেলেন। তিনি আল্লুকে বললেন, বাড়ি গিয়ে নাকে তেল দিয়ে ঘুমিয়ে থাকো, পরশুদিন (২৭ মার্চ) হরতাল ডেকেছি।’ মুজিব কাকুর তাৎক্ষণিক এই উক্তিতে আব্দু বিস্ময় ও বেদনায় বিমূঢ় হয়ে পড়লেন। এদিকে বেগম মুজিব ঐ শােবার ঘরেই সুটকেসে মুজিব কাকুর জামাকাপড় ভাঁজ করে রাখতে শুরু করলেন। ঢােলা পায়জামায় ফিতা ভরলেন।
পাকিস্তানি সেনার হাতে মুজিব কাকুর স্বেচ্ছাবন্দি হওয়ার এইসব প্রস্তুতি দেখার পরও আল্লু হাল না ছেড়ে প্রায় দেড় ঘণ্টা ধরে বিভিন্ন ঐতিহাসিক উদাহরণ টেনে মুজিব কাকুকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন। তিনি কিংবদন্তি সমতুল্য বিভিন্ন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের উদাহরণ তুলে ধরলেন, যারা আত্মগােপন করে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন। কিন্তু মুজিব কাকু তাঁর এই সিদ্ধান্তে অনড় হয়ে রইলেন। আল্লু বললেন যে, পাকিস্ত নি সেনাবাহিনীর মূল লক্ষ্য হলাে পূর্ব বাংলাকে সম্পূর্ণ রূপেই নেতৃত্বশূন্য করে দেওয়া। এই অবস্থায় মুজিব কাকুর ধরা দেওয়ার অর্থ হলাে আত্মহত্যার শামিল। তিনি বললেন, ‘মুজিব ভাই, বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা হলেন আপনি আপনার নেতৃত্বের ওপরই তারা সম্পূর্ণ ভরসা করে রয়েছে।’ মুজিব কাকু বললেন, তােমরা যা করবার কর। আমি কোথাও যাব না।’ আন্ধু বললেন, “আপনার অবর্তমানে দ্বিতীয় কে নেতৃত্ব দেবে এমন ঘােষণা তাে আপনি দিয়ে যাননি। নেতার অনুপস্থিতিতে দ্বিতীয় ব্যক্তি কে হবে, দলকে তাে তা জানানাে হয়নি। ফলে দ্বিতীয় কারাে নেতৃত্ব প্রদান দুরূহ হবে এবং মুক্তিযুদ্ধকে এক অনিশ্চিত ও জটিল পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দেওয়া হবে। আর সেদিনের এই উক্তিটি ছিল এক নির্মম সত্য ভবিষ্যদ্বাণী। পূর্ব-পরিকল্পনা অনুযায়ী আন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা লিখে নিয়ে এসেছিলেন এবং টেপ রেকর্ডারও নিয়ে এসেছিলেন। টেপে বিবৃতি দিতে বা স্বাধীনতার ঘােষণায় স্বাক্ষর প্রদানে মুজিব কাকু অস্বীকৃতি জানান। কথা ছিল যে, মুজিব কাকুর স্বাক্ষরকৃত স্বাধীনতার ঘোষণা হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (বর্তমানে শেরাটন) অবস্থিত বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌছে দেওয়া হবে এবং তারা আন্ডারগ্রাউন্ডে গিয়ে স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা করবেন। আব্ব বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই, এটা আপনাকে বলে যেতেই হবে, কারণ কালকে কী হবে, আমাদের সবাইকে যদি গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়, তাহলে কেউ জানবে না, কী তাদের করতে হবে। এই ঘােষণা কোনাে-নাকোনাে জায়গা থেকে কপি করে আমরা জানাব। যদি বেতার মারফত কিছু করা যায়, তাহলে সেটাই করা হবে।” মুজিব কাকু তখন উত্তর দিয়েছিলেন, ‘এটা আমার বিরুদ্ধে দলিল হয়ে থাকবে।
এর জন্য পাকিস্তানিরা আমাকে দেশদ্রোহের জন্য বিচার করতে পারবে। আলুর লেখা ঐ স্বাধীনতা ঘােষণারই প্রায় হুবহু কপি পরদিন আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রচারিত হয়। ধারণা করা যায় যে ২৫ মার্চের কয়দিন আগে রচিত এই ঘােষণাটি আন্ধু তার আস্থাভাজন কোনাে ছাত্রকে দেখিয়ে থাকতে পারেন। স্বাধীনতার সমর্থক সেই ছাত্র হয়তাে স্বউদ্যোগে বা আব্দুর নির্দেশেই স্বাধীনতার ঘােষণাটিকে বহির্বিশ্বের মিডিয়ায় পৌঁছে দেন। মুজিব কাকুকে আত্মগােপন বা স্বাধীনতা ঘােষণায় রাজি করাতে না পেরে রাত নয়টার কিছু পরে আব্দু ঘরে ফিরলেন বিক্ষুদ্ধ চিত্তে আম্মাকে সব ঘটনা জানালেন। মুজিব কাকুর সঙ্গে পুরান ঢাকার পূর্ব নির্ধারিত গােপন স্থানে আব্দুর আত্মগােপন করার কথা ছিল। মুজিব কাকু না যাওয়াতে পূর্ব-পরিকল্পনা ভেস্তে যায়। সেই রাতে আম্মারও ঘরে থাকার কথা ছিল না। শিশু সােহেল ও ছােট মিমিকে সঙ্গে করে তারও বাসা ত্যাগ করার কথাই ছিল। আমাকে ও রিমিকে। বুদ্ধি করে আম্মা তাঁতিবাজারে খালার বাড়িতে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন মাত্র দু’দিন পূর্বেই। আব্দুর বন্ধু আওয়ামী লীগের এমএনএ ও কোষাধ্যক্ষ আবদুল হামিদ সেই সন্ধ্যায় এসেছিলেন আম্মাকে ফরাশগঞ্জে তার বাড়িতে নিয়ে যেতে। আম্মার ইচ্ছে ছিল যে আন্ধুকে বিদায় জানিয়ে তারপর বাসা থেকে যাবেন। আলুর ফেরার কথা ছিল অনেক আগেই কিন্তু মুজিব কাকু বাসা না ত্যাগ করার ফলে তাকে বুঝাতে আব্বর অনেক সময় লেগে যায়। এদিকে হামিদ কাকুও আমাদের বাড়িতে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে ফিরে যান। সে সময় রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য হয়ে পড়েছে। স্বেচ্ছাসেবক ও জনতা গাছপালা কেটে রাস্তায় রাস্তায় ব্যারিকেড দিয়ে রেখেছে। নেতৃবৃন্দের কাছেও খবর পৌঁছে গিয়েছে যে ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করার পরপরই সামরিক বাহিনী আক্রমণ ও ধরপাকড়ও শুরু করবে। আওয়ামী লীগের নেতা, কর্মী ও ছাত্রদের ওপর আঘাত আসবে এই ধারণাটি বদ্ধমূল থাকলেও নিরস্ত্র ও নিরীহ জনসাধারণের ওপরও যে ঢালাওভাবে আঘাত হানা হবে এই কথাটি অনেকেই ভাবতে পারেননি।
সেদিন আব্ব বাসায় ফিরে খুব রাগান্বিত হয়ে আম্মাকে বললেন, ‘মুজিব ভাই কিছুতেই বাসা থেকে যাবেন না। আমিও কোথাও যাব না।’ বাইরের পােশাক বদলে আব্দু ভগ্নচিত্তে সটান হয়ে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পরই প্রচণ্ড অস্থিরতা নিয়ে উঠে পড়লেন। বাসায় তখনাে লােকজন আসা যাওয়া করছে। সবার মধ্যেই উল্কণ্ঠা ও উত্তেজনা বিরাজমান। এরই মধ্যেও নূরজাহান খালা (বেগম নূরজাহান মুরশিদ।স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী ও অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদের স্ত্রী) আমাদের বাসায় এলেন তিনি দেখেন আব্দুর মন খুব খারাপ। বাসায় ক্রমাগত ফোন আসছে। আন্ধু বললেন যে দেশের কী হবে ঠিক নেই আর এখন মহিলারা ফোন করছেন মহিলাদের আসনে নমিনেশনের ব্যাপারে তদবির নিয়ে। নূরজাহান খালা নিজে বেশ কিছু ফোন রিসিভ করলেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও এলেন আব্দুর খোঁজে। এসে দেখেন যে বেগম মুরশিদ বাইরের ঘরে বসা। ভেতরের ঘরে আব্দুর গলা তিনি শুনতে পেলেন। আন্ধু জোরে জোরে আম্মার সাথে কথা বলছিলেন। সে সময় আর আন্ধুর সাথে তার দেখা হলাে। তিনি, বেগম মুরশিদকে তার ইউনিভার্সিটির কোয়ার্টারে নামাতে চলে গেলেন। (পরিশিষ্টে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সাক্ষাৎকারে উল্লেখিত। পৃ. ১৯১) আম্মার কাছে রাখা রাইফেলের ব্যাগটি না পাওয়ায়, আব্দু রেগে বলছিলেন যে রােগীকে মাত্র পনেরাে মিনিটের জন্য অজ্ঞান করা হয়েছে, অপারেশনের জন্য। ঐ পনেরাে মিনিটের বাইরে এক মিনিট অধিক সময়ও রােগীর জন্য ক্ষতিকর হতে পারে। যাই হােক, আম্মা শেষ পর্যন্ত ব্যাগটি খুঁজে পেলেন। চটের ব্যাগ ও তার মধ্যে রাখা রাইফেলটি তাড়াহুড়ায় শােবার ঘরের আলমারির মাথায় রেখে ভুলে গিয়েছিলেন। ব্যাগটি খুঁজে পাবার পরও আব্দুর অস্থিরতা কমল না। মুজিব কাকু বাসা থেকে বের হলেন না, কোনাে নির্দেশও দিলেন না এই ব্যাপারটি তাকে গভীরভাবে মর্মাহত ও বিচলিত করে। রাত প্রায় এগারােটার দিকে, মুজিব কাকুর বাসা থেকে ড. কামাল হােসেনকে সাথে করে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম আবারও ফিরে আসেন আমাদের বাসায়। আন্ধু তখন সামনের ফুল বাগানে ঘেরা লনে অস্থিরভাবে পায়চারি করছিলেন।
তার পরনে লুঙ্গি ও হাফ হাতা গেঞ্জি। গেটের সামনে গাড়ি থামিয়ে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কথা বললেন আব্দুর সাথে। তিনি বললেন, ‘Military has taken over আপনাকে যেতে হবে আমাদের সাথে।’ আব্দু প্রচণ্ড অভিমানের স্বরে বললেন, ‘কী করব? কোথায় যাব?’ আমীর-উল ইসলাম যখন আল্লুকে তাদের সাথে যাবার জন্য জোর তাগাদা দিচ্ছেন, তখনিই আমাদের বাসার দক্ষিণে ইপিআর অর্থাৎ ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস (পরে বিডিআর- বাংলাদেশ রাইফেলস; এখন বিজিবি- বর্ডার গার্ড অব বাংলাদেশ) এলাকা থেকে আওয়ামী লীগের কুমিল্লা হতে নির্বাচিত এম, এন, এ (মেম্বার অব ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি) মােজাফফর সাহেব দৌড়াতে দৌড়াতে গেটের কাছে এসে বলেন যে, পাকিস্তান সেনাবাহিনী ইপিআরকে নিরস্ত্র করছে। কথাটি শােনার পর আব্দুর মনে পরিবর্তন এল। তিনি মুজিব কাকুর কাছ হতে নির্দেশ না পাওয়া জনিত দ্বিধা দ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেললেন। দ্রুত গতিতে ঘরের ভেতর গেলেন। যখন ফিরে এলেন, কাঁধে তার রাইফেল ঝুলছে, কোমরে পিস্তল গোজী। লুঙ্গির ওপর সাদা ফতুয়া স্টাইলের হাফ হাতা শার্ট। সহচরদের সাথে আল্লু বেরিয়ে পড়লেন অজানার পথে। আম্মাকে তড়িঘড়ি করে বলে গেলেন ‘তােমরা কী করবে কর। আমি চলে গেলাম। আম্মা ঝােপের আড়ালে দাঁড়িয়ে দেখলেন যে গাড়িটি ঝিগাতলার দিকে ছুটে গেল এবং একটু পর আবার ঘুরে এসে লালমাটিয়ার পথে সাঁ করে মিলিয়ে গেল। এই সময় আম্মাও দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন যে সােহেল ও মিমিকে নিয়ে তিনি বাড়ি ত্যাগ করবেন আমাদের গাড়িতে করে। কিন্তু তার আগেই গুলি ও ফ্লেয়ার ছুড়তে ছুড়তে পাকিস্তানি বাহিনীর জিপ গাড়িগুলাে আমাদের বাড়ির দিকে আসতে থাকল। ফ্লেয়ার ছােড়ার ফলে নিকষ কালাে রাত্রি প্রভাতের মতাে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। কোনাে ক্ষুদ্র প্রাণীরও লুকিয়ে রাস্তা পার হবার উপায় নেই, গাড়ি করে পালানাে তাে দূরের কথা। টেলিফোন ও বিদ্যুতের লাইনগুলাে ঝমঝম শব্দে খুলে পড়ল।
আম্মা উপস্থিত বুদ্ধি খাটিয়ে সােহেল ও মিমিকে নিয়ে চলে গেলেন দোতলায়, যেখানে মাত্র বছর খানেক আগেই নতুন। ভাড়াটে হয়ে এসেছিলেন কালীগঞ্জ ছাত্রলীগের একসময়ের সহ-সভাপতি বিলেত-ফেরত তরুণ ব্যারিস্টার আবদুল আজিজ বাগমার ও তার প্রাণবন্ত, সদালাপী নবপরিণীতা স্ত্রী আতিয়া বাগমার আমাদের প্রিয় আতিয়া কাকি। আম্মা ও আতিয়া কাকি উর্দুভাষী ভাড়াটে সাজলেন। আতিয়া কাকির পরনে শেলােয়ার-কামিজ। আম্মা শাড়ি বদলে শেলােয়ার-কামিজ পরার সময়
পাননি। তারা দুজনেই গৌরবর্ণের, সাধারণ বাঙালি নারীর তুলনায় লম্বা চওড়া এবং উর্দুভাষায় দুজনেই পারদর্শী ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনী শেল ও গুলি ছুড়তে ছুড়তে আমাদের বাড়িতে উপস্থিত হলাে। তারপর দোতলার শােবার ঘরে প্রবেশ করে আম্মা ও আতিয়া কাকির বুকের ওপর স্টেনগান ধরে রুক্ষ স্বরে উর্দুতে জিজ্ঞাসা করল, ‘তাজউদ্দীন কোথায় ? মিসেস তাজউদ্দীন এখানে কোন জন? তুমি না তুমি ?’ আতিয়া কাকি খুব দৃঢ় স্বরে উর্দুতে প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আপনারা ভুল করছেন। এখানে মিসেস তাজউদ্দীন নেই। আমরা সকলে ভাড়াটিয়া। আমাদের বাড়িওয়ালা তাজউদ্দীন সাহেব। নিচতলায় থাকেন। আম্মার দারুণ আশঙ্কা হচ্ছিল যদি নিচের তলায় ফ্রেমে বাঁধানাে ছবিগুলাে দেখে আম্মাকে চিনে ফেলে! তিনি কোলে করা সােহেলকে নিয়ে নিজের মুখটা খানিক আড়াল করে কপট ধমকের স্বরে আতিয়া কাকিকে উর্দুতে বললেন, “আমি তােমাকে প্রথমেই মানা করেছিলাম। রাজনীতিবিদের বাড়ি ভাড়া না নিতে। হায় আল্লাহ! এখন ছেলেমেয়ে নিয়ে এই ভােগান্তি আমার নসিবে ছিল! আমি কালই করাচির টিকিট কেটে এই দেশ ছাড়ব।’ আতিয়া কাকি ও আম্মার অভিনয়টি দারুণ হয়েছিল। তাদের দিকে তাক করা স্টেন।
গানগুলাে সরে গেল। তাঁরা সেযাত্রা রক্ষা পেলেন। পরবর্তী সময়ে আম্মা ও আতিয়া কাকির মুখে এই ঘটনাটি এতবার আমরা শুনেছিলাম যে পুরাে সংলাপ আমাদের মুখস্থ হয়ে গিয়েছিল। আতিয়া কাকি ও আম্মা রক্ষা পেলেও অন্য ঘর ও নিচতলা থেকে আজিজ কাকু, তাদের বাবুর্চি আব্দুল, আমাদের ফুফাতাে ভাই তফাজ্জল হােসেন, মামাতাে ভাই হাসান মাহমুদ, আমাদের বাড়ির যিনি দেখাশােনা করতেন সেই বারেক মিয়াকে পাকিস্তানি সৈন্যরা বন্দী করে। আটক থাকা অবস্থায় তাদের ওপর চলে প্রচণ্ড নির্যাতন। সেদিন, অর্থাৎ ২৫ মার্চ রাতে নিচতলায় কাজের ছেলে কিশাের দিদারের ওপর আসে আক্রমণের প্রথম ঝাপটা। তাঁকে আল্লু ও আম্মার সন্ধান জিজ্ঞেস করা হয়। তখন সেই কিশাের উপস্থিত বুদ্ধি না হারিয়ে বলে ওঠে যে দুপুরের মধ্যাহ্ন ভোেজ সেরে তারা কোথায় চলে গিয়েছেন সে জানে না। দিদার সে যাত্রায় পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছ থেকে রক্ষা পেয়ে পালিয়ে যায়। সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর সে চুপি চুপি আবার ফিরে আসে নানার কাছে। সৈন্যরা নিচতলায় আমাদের ৭৮ বছরের বর্ষীয়ান নানা সৈয়দ সেরাজুল হকের বুকেও স্টেনগান ঠেকিয়ে কর্কশ স্বরে আল্লু ও আম্মার খবর জানতে চায়। অসুস্থ নানা উঠে বসে ইংরেজি ও উর্দুতে কথা বলার চেষ্টা করেন। দুজন অপেক্ষাকৃত ভদ্ৰ গােছের অফিসার নানাকে শুয়ে পড়তে বলে। নানা সেই আদেশকে মৃত্যুর সংকেত মনে করে ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ কলমা পড়তে পড়তে পুনরায় শুয়ে পড়েন। এরপর কিছুদিনের মধ্যে পুরাে বাড়িটিই পরিণত হয় পাকিস্তানি বাহিনীর ছােটখাটো ক্যাম্পে। নানা কিছুতেই বাড়ি না ছাড়ার সংকল্প নেওয়ায় দিদারসহ গৃহবন্দি হন। প্রথম যে দল ক্যাম্পের দায়িত্ব গ্রহণ করে তাদের উর্ধ্বতন অফিসার বিভিন্ন অছিলায় নানার কাছ থেকে আম্মা ও আব্দুর সন্ধান জানার চেষ্টা করে বিফল হয়। প্রথম ব্যাচের অফিসারটি ছিল আচরণে শ্রদ্ধাশীল। নানা তার জ্ঞানের ঝুলি থেকে তাকে নানারকম মূল্যবান উপদেশ দিতেন। শেখ সাদির নীতি উপদেশগুলাের মধ্যে দিয়ে তিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার অমানবিক নীতি ও কার্যকলাপের সমালােচনা করতেন।
পাকিস্তান বাহিনীর ঐ অফিসার আব্দুর কথা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বারান্দায় পাকারে রাখা খবরের কাগজের সামনে তাকে নিয়ে বলেন যে, এই খবরের কাগজগুলাে পড়লেই আপনি তাজউদ্দীন সম্বন্ধে জানতে পারবেন। কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নানার আরবি, ফারসি এবং ইংরেজি জ্ঞান ও ধর্মীয় বিষয়ে অগাধ পাণ্ডিত্য দেখে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর এই অফিসার একসময় বিস্ময় প্রকাশ করে বলেন, সৈয়দ সাহেব, আপনি ছিলেন আরবির প্রফেসার এবং ইসলাম ধর্ম সম্বন্ধেও আপনার অগাধ জ্ঞান রয়েছে। অথচ আপনার মেয়ের কি না বিয়ে দিলেন এক হিন্দুর সঙ্গে নানা প্রতিবাদ করে বললেন, ‘আমার জামাতা হিন্দু নয়। ওর নাম তাজউদ্দীন আহমদ। ঢাকা কলেজে সে আমার আরবি ক্লাসের সেরা ছাত্র ছিল।’ কিন্তু সেই অফিসার পূর্ণ আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে প্রতিবাদ করে নানাকে বললেন, ‘ওর নাম তাজউদ্দীন নয়। ওর আসল নাম হলাে তেজারাম। সে এক ভারতীয় হিন্দু। পাকিস্তানে অনুপ্রবেশ করেছে পাকিস্তান ভাঙার জন্য পুরাে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর মস্তিষ্কে ঐ বিদ্বেষপূর্ণ সাম্প্রদায়িক ও বানােয়াট তথ্যগুলাে সুপরিকল্পিতভাবে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুজিব কাকু পাকিস্তান কারাগারে বন্দী। তার পরও স্বাধীনতার যুদ্ধ থেমে থাকেনি। হুঁশিয়ার কাণ্ডারির মতােই আব্দু ধরেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের হল। সে কারণেই পাকিস্তান সরকার আব্দুকে তাদের এক নম্বর শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করেছিল। আম্মা ও আতিয়া কাকি তাদের উপস্থিত বুদ্ধি ও সাহস দিয়ে সেদিন পাকিস্তানি সৈন্যদের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার পর আম্মা আবারও দ্রুত সিদ্ধান্ত নেন দ্বিতীয় কোনাে বাহিনী চলে আসার আগেই গৃহ ত্যাগ করার। ২৬ মার্চ চারদিকে কারফিউ চলছে, বাড়ির সামনে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনীর আনাগােনা। পাশের বাড়ির ছাদে নিজেকে আড়াল করে সাকিবার বাবা ইশারায় আম্মাকে বললেন, তাঁর বাড়িতে আশ্রয় নেওয়ার জন্য। কিন্তু তাঁর বাড়িটি আমাদের বাড়ির মতােই বড় রাস্তার ওপরে হওয়াতে পাকিস্তানি সৈন্যদের নজর এড়িয়ে সেখানে আশ্রয় নেওয়া দুরূহ।
আতিয়া কাকির সহায়তায় আম্মা অতি সন্তর্পণে দোতলা থেকে নিচ তলায় নেমে এলেন। কোলে সােহেল এবং মিমির হাতে হাত ধরা। সঙ্গে কাজের মেয়ে আমেনা বেগম। নিচতলায় ভেতরের বারান্দায় নানা বসা। তার দৃষ্টিতে যেন সব-হারাবার ব্যথা। আম্মা নানার পা ছুঁয়ে সালাম করে দোয়া চাইলেন। বললেন, তিনি পেছনের বাড়ির দেওয়াল টপকিয়ে পালাতে যাচ্ছেন। নানা ব্যাকুল কণ্ঠে আম্মাকে রুখতে চাইলেন বললেন, ‘লিলি, তুই যাসনে, মিলিটারির হাতে ধরা পড়ে যাবি। চারদিকে তখনাে কারফিউ চলছে। ধরা পড়ার ভয় প্রতিপদে। আম্মা আর পিছু ফিরে নানার দিকে চাইলেন না। ভয় হলাে কী জানি যদি মায়ার টানে দুর্বল হয়ে পড়েন। পেছনের বাড়ির লােক ছিলেন অতি সজ্জন এক ব্যক্তি সিলেটে তাঁর বাড়ি, নাম আবদুল মুবিন চৌধুরী। (মুক্তিযােদ্ধা : বীরবিক্রম মেজর (অব.) শমসের মবিন চৌধুরীর পিতা)। তিনি ও তার স্ত্রী তাহমিদুন নাহারসহ পুরাে পরিবার ছুটে এল আম্মা ও শিশু ভাইবােনকে দেওয়াল পার করানাের জন্য সহযােগিতা করতে। ভদ্রলােক আম্মাকে তাঁর মেয়ে’ সম্বােধন করে অতি সমাদরে বরণ করলেন। অথচ নতুন এই প্রতিবেশীদের সঙ্গে আম্মার আগে কোনাে আলাপ-পরিচয় হওয়ার সুযােগ হয়নি। ২৭ মার্চ সকাল আটটায় কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। তখন আমাদের অসম সাহসী বড় মামু ক্যাপ্টেন সৈয়দ গােলাম কিবরিয়া আম্মাকে তাঁর আশ্রয়দাতার বাড়ি থেকে নিয়ে যান শঙ্কা ছিল আম্মার খোজে সামরিক বাহিনী আশপাশের বাড়িতেও হামলা চালাতে পারে। আতিয়া কাকিও সেদিন চলে গেলেন শান্তিনগরে তাঁর মায়ের বাড়িতে। যাওয়ার সময় নানার কাছে তিনি কিছু টাকা রেখে গেলেন। যদি আজিজ কাকু ফিরে আসেন তখন এই টাকা কাজে লাগবে।
সেদিন বেলা ১১টায় বড় মামুর ধানমণ্ডির ১৩/২-এর বাড়িতে মুসা সাহেব নিয়ে আসেন সেই ঐতিহাসিক চিরকুট। আম্মা রুদ্ধশ্বাসে বারবার করে পড়লেন আব্দুর পরিপাটি মুক্তার মতাে হাতে লেখা ছােট্ট কটি অসামান্য বাক্য। লিলি আমি চলে গেলাম। যাবার সময় কিছুই বলে আসতে পারিনি। মাফ করে দিও।
আবার কবে দেখা হবে জানি না মুক্তির পর। তুমি ছেলেমেয়ে নিয়ে সাড়ে-সাত-কোটি মানুষের সঙ্গে মিশে যেও। দোলন চাঁপা।’ (দোলনচাপা আর ছদ্ম নাম)। আব্দুর চিরকুটটি পড়ার পর আম্মা তার হৃদয়ের অনুভূতিকে ব্যক্ত করেছিলেন এভাবে কতক্ষণ যে কাগজখানা হাতে নিয়ে স্তব্ধ হয়ে বসেছিলাম জানি না। সেদিনের সেই মুহূর্তে এ কথা কয়টি শুধু কথার কথাই ছিল না। জীবনের পরবর্তী অধ্যায় শুরু করার জন্য সেই লেখাগুলাে ছিল এক পবিত্র প্রেরণার উৎস। সাড়ে-সাত-কোটি মানুষের সঙ্গে নিজেকে নতুনভাবে নতুন রূপে আবিষ্কার করেছিলাম সেদিন। তারপর ফিরে পেলাম এক নতুন সত্তা। শুরু হলাে এক অবিস্মরণীয় মহান যাত্রা। এরপর তিনি প্রস্তুতি নিলেন বন্ধুর যাত্রাপথ অতিক্রমের জন্য। আব্দুর চিঠিটি আম্মার মধ্যে অসামান্য প্রেরণার সঞ্চার ঘটাল। বড় মামুর বাড়ির ওপরও পাকিস্তানি সেনাদের চোখ পড়তে পারে এই আশঙ্কায় আম্মা বড় মামুর প্রবল ইচ্ছার বিরুদ্ধে আশপাশের কিছু বাড়িতে ক্ষণস্থায়ী অবস্থানের ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। এক বাড়ির দরজাই খুলল না এবং অপর বাড়ির সরকারি কর্মকর্তা তাকে গৃহে আশ্রয় দেওয়ার কিছু পরে রাতের আঁধারে বের হয়ে যেতে বাধ্য করলেন। আম্মা ফিরে এলেন বড় মামু ও মামির উষ্ণস্নেহ ছায়াতলে। তারপর সতর্কতা অবলম্বনের জন্য আবারাে স্থান পরিবর্তন। ৩০ মার্চ সকালে মগবাজারের রাস্তায় আমার সঙ্গে রিমি ও আমার দেখা হলাে। খালাতাে ভাই সাঈদ ভাই আম্মার কাছে আমাদের পৌছে দিলেন। ২৫ মার্চের ভয়াল রাত্রির পর আমাদের প্রতিটি দিন যেন এক এক যুগের মতাে কেটেছে। মনে হলাে কত যুগ পর আমার দেখা পেলাম ।
ছােট্ট ভাই সােহেল ও আদুরী মিমিকে আমরা দুই বােন জাপটে ধরে বড় মামুর লাল হিলম্যান গাড়িতে আম্মার ও আমেনার পাশে চড়ে বসলাম। বড় মামু গাড়ি চালাচ্ছেন, পাশে আওয়ামী লীগের একনিষ্ঠ সমর্থক ও পৃষ্ঠপােষক আফতাবউদ্দীন মিয়া, আজিজ কাকুর দূর সম্পর্কের ভগ্নিপতি ও ব্যবসায়ী। আমরা ডেমরা ঘাট দিয়ে লঞ্চে করে আফতাবউদ্দীন সাহেবের কালীগঞ্জের বাড়ি জামালপুরে যাব। নিরাপত্তার খাতিরে শহর আমাদের ছাড়তেই হলাে। গাড়িতে বসে আম্মার কাছে উজাড় করে দিলাম আমাদের এক সপ্তাহের রােমহর্ষক ট্র্যাজিক অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনি। ২৫ মার্চের সন্ধ্যা পর্যন্ত রিমি ও আমি তাঁতিবাজারে খালাতাে ভাইবােনদের সঙ্গে ভােলা ছাদে যারপরনাই আনন্দে খেলে বেড়িয়েছিলাম। স্কুলে যেতে হচ্ছিল না তাই মনে একটু বেশিই আনন্দ। দু’দিনের মধ্যেই আমরা মাঞ্জা দিয়ে ঘুড়ি উড়াতে শিখে গেলাম। পাশের বাড়ির ছেলেমেয়েদের সঙ্গে ছাদে রং-বেরঙের ঘুড়ি ওড়ানাের প্রতিযােগিতা শুরু হলাে। ঘুড়ি ওড়ানাের। ফাকে ফাকে আমি মহা উদ্যমে খালার বাড়ির পুরাে দেওয়াল, আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার ছবি সাদা চকে একে ভরে ফেললাম। পাশে বড় বড় করে লিখলাম ‘জয় বাংলা’। খালার বাড়ির চারপাশে, বাদরের উপদ্রব। খাবারদাবার সামলে রাখতে হতাে। আমাদের চোখের সামনেই রান্নাঘর থেকে কলা তুলে বাঁদর চম্পট। সবচেয়ে মজা লাগত মা-বাঁদর যখন সন্তানকে পিঠে নিয়ে ঘেঁষাঘেঁষি পুরনাে বাড়ির এক কার্নিশ থেকে অপর কার্নিশে নির্ভয়ে লাফিয়ে পার হয়ে যেত। সেই ভয়াল কালােরাতের সন্ধ্যায় আমাদের খেলা অনিচ্ছাকৃতভাবে বন্ধ হলাে খালার তাগাদায়। হাতমুখ ধুয়ে খালার হাতের মজাদার খাবার খেয়ে সারা দিনের খেলাধুলায় শ্রান্ত আমরা গল্প করতে করতে ঘুমিয়ে পড়লাম। প্রায় মধ্যরাতে আমাদের ঘুম ভেঙে গেল ভয়ানক গােলাগুলি ও অগণিত মানুষের চিল্কারের শব্দে হিন্দু-অধ্যুষিত তাতিবাজার ও পার্শ্ববর্তী শাঁখারিবাজারে আগুন জ্বলছে। চারদিকে শুধু মরণ চিৎকার ও বাতাসে পােড়া গন্ধ। বিস্ময়, আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা মিশ্রিত রাতটি দেখতে দেখতে পার হয়ে গেল।
পরদিন সারাদিন কারফিউ। তার মধ্যেই দিনদুপুরে খালার বাড়ির পেছনের নাগরমহল সিনেমা হলের কাছ থেকে ভেসে এল অসহায় মানুষের মরণ আর্তনাদ ও প্রচণ্ড ব্রাশ ফায়ারের শব্দ। খালার বাড়ির পেছনের বারান্দা দিয়ে নাগরমহল সিনেমা হলের একাংশ দেখা যেত। আমাদের চোখের সামনেই সিনেমা হলটিকে জ্বলতে দেখলাম। আগুনের সঙ্গে বিশ্রী কালাে ধোঁয়া চারপাশের বাড়ির দিকে ধেয়ে এল। খালার বাড়ির ভেতরও ভরে গেল ধোঁয়ায়। মনে হলাে মৃত্যু বুঝি আসন্ন। আমরা সকলেই আল্লাহর নাম স্মরণ করতে থাকলাম। আগুনের হাত থেকে খালার বাড়ি রক্ষা পেলেও আতঙ্ক ও অনিশ্চয়তা বড়দের ঘিরে ধরল। ছােট হওয়ার একটি বিশেষ সুবিধা ছিল এই যে, আমরা বিচরণ করতাম বর্তমানে। অপরিবর্তনীয় অতীত ও অজানা ভবিষ্যৎ নিয়ে খুব বেশি ভাববার চেয়ে আমরা সহজেই মানিয়ে নিতাম বিরামহীন বর্তমানের প্রতিটি মুহূর্তের সঙ্গে। তাৎক্ষণিক স্বস্তি সঞ্চয়ের জন্য ধ্যানাভ্যাসের প্রথম পর্যায়ে সদা ভ্রাম্যমাণ মনটিকে, অতীত ও ভবিষ্যৎ থেকে মুক্ত করে যেমন সন্নিবিষ্ট করা হয় শ্বাস-প্রশ্বাসের উত্থান ও পতনের সঙ্গে, আমরা ছােটরাও তেমনি মগ্ন হয়ে যেতাম সদা বিরাজমান বর্তমানের হৃৎস্পন্দনের সঙ্গে। এ কারণেই দুশ্চিন্তা যেমন আঁকড়ে ধরত তেমনি স্মৃতির পটে যা আঁকা হয়ে যেত তা হতাে নিখাদ ও পক্ষপাত দোষমুক্ত অভিজ্ঞতার এক অনুপম চিত্রলিপি। ২৬ মার্চ সারা দিন ও রাত্রির কারফিউয়ের মধ্যে দিয়েই সন্তর্পণে অলিগলি পেরিয়ে ও পাঁচিল টপকিয়ে খালার বাড়িতে আশ্রয় নিল বহু মানুষজন। অকুতােভয় খালা সকলকে সাদরে বরণ করলেন। আশ্রিতদের কাছেই শােনা গেল নাগরমহল সিনেমা হল-এ আগুন লাগার কাহিনি। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনারা আশপাশের বস্তিতে গুলি চালিয়ে ও আগুন জ্বালিয়ে বহু নিরীহ মানুষকে হত্যা করে। অনেকে প্রাণ বাঁচাতে নাগরমহল সিনেমা হলে আশ্রয়গ্রহণ করার পর বর্বর সেনারা সেই হলটিতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আগুন থেকে বাঁচবার জন্য দলে দলে মানুষ রাস্তায় বের হওয়ার পর তাদের ওপর ঢালাওভাবে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। শতাব্দীর জঘন্যতম, সুপরিকল্পিত এই হত্যাকাণ্ডগুলাের অন্যতম কারণটি ছিল জাতিভিত্তিক। হিন্দু ও মুসলিম নির্বিশেষে, বাঙালি হওয়ার কারণেই নিরীহ ও নিরপরাধ মানুষগুলােকে হত্যা করা হয়।
ঘটনার ভয়াবহতা প্রত্যক্ষ করে আমাদের পরিচয় গােপন করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারফিউয়ের মধ্যে বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি ও হত্যাকাণ্ডের খবরটিও ইতােমধ্যে জানা হয়ে গিয়েছে। রিমি ও আমাকে বলা হলাে যদি সৈন্যরা আমাদের বাড়িতে ঢুকে আমাদের পরিচয় জানতে চায় আমরা যেন আব্দুর নাম গােপন করি, খালু সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকেই যেন বাবা। হিসেবে পরিচয় দিই। চারপাশের এই নৃশংসতা দেখে আমার মনটি বিদ্রোহ করতে চাইল। আমি বললাম, ‘যদি মরতে হয় আব্দুর পরিচয় দিয়েই মরব।’ আমার সেদিনের উক্তিটি ছিল মর্মান্তিক অভিজ্ঞতার আলিঙ্গনে পিষ্ট এক বালিকার অবােধ আস্ফালন মাত্র। বাড়ির সকলে ইতােমধ্যেই আমার চক দিয়ে আঁকা নৌকার ছবি ও জয়বাংলা শব্দমালা মুছে ফেলেছে। এতটুকু অসতর্ক হলেই বাড়িভর্তি সকল মানুষই মৃত্যুমুখে পতিত হবে এই রূঢ় সত্যটি দিবালােকের মতােই স্পষ্ট হয়ে উঠল। ২৭ মার্চ সকালে কয়েক ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হলাে। সেই সময়ই বড় মামু মামাতাে ভাই মাসুদকে সঙ্গে নিয়ে উপস্থিত হলেন মুক্তির দিশারী রূপে। আমাদের দুই বােনকে সঙ্গে নিয়ে তিনি রওনা হলেন মগবাজারের পথে। চারদিকে ছড়িয়ে থাকা অগণিত লাশের সারি ও রক্তাক্ত রাজপথের মধ্যে দিয়ে পথ করে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলল বড় মামুর লাল হিলম্যান গাড়িটি।আব্বু ও আম্মার খবর জানবার জন্য আমাদের মন অধীর হয়ে উঠল। আমাদের ব্যাকুল। প্রশ্নের উত্তর বড় মামু দিলেন খুব সংক্ষেপে। আব্ব দুর্গম পথ পাড়ি দিয়েছেন বাঙালি জাতিকে মুক্ত করবার প্রতিজ্ঞা নিয়ে। আম্মা আত্মগােপন করে রয়েছেন ঢাকা শহরের মধ্যেই। বড় মামু আমাদের নিয়ে গেলেন মগবাজারের ছােট মামুর (সৈয়দ গোলাম মওলা) বাড়িতে। সেখানে আমরা একরাত কাটালাম। পরদিন খুব ভােরে তিনি পরিবারসহ বরিশালের উলানিয়া অঞ্চলে মামির বাবার বাড়িতে চলে গেলেন। রিমি ও আমি এরপর আশ্রয় নিলাম মগবাজারেই সদ্য বিবাহিত দম্পতি আমাদের খালাতাে ভাই সাঈদ (সামসুল আলম চৌধুরী) ও ফুফাতাে বােন আনার আপার স্নেহাশ্রয়ে। ৩০ মার্চ সকালে বড় মামু আবারাে এলেন আমাদের নিতে।
শিশুকাল থেকেই বড় বােনের ভালােবাসা দিয়ে যে আনার আপা আমাদের আগলে রেখেছিলেন তাঁকে ছেড়ে আসতে আমাদের যারপরনাই কষ্ট হচ্ছিল। আমরা ব্যথিত চিত্তে পরস্পরের কাছ থেকে বিদায় নিলাম। দুরন্ত সাহসী সাঈদ ভাই ও বড় মামু আমাদের নিয়ে গেলেন মগবাজারের রাস্তার এক পাশে রাখা পরিচিত হিলম্যান গাড়িটির কাছে। গাড়ির ভেতর আবিষ্কার করলাম আম্মাকে। শুরু হলাে উজাড় করে হৃদয়ের কথা বলা বন্ধুর অজানা পথে পাড়ি দেওয়ার প্রারম্ভে। সতর্কতা অবলম্বনের জন্য টিকাটুলি মােড়ে আমরা গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম। দুটা বেবিট্যাক্সি আমাদের পৌছে দিল ডেমরা ঘাট পর্যন্ত। কৌতূহলী মানুষের নানা জিজ্ঞাসাবাদ এড়িয়ে লঞ্চে করে আমরা পৌছলাম কালীগঞ্জে আফতাবউদ্দীন মিয়ার বাড়িতে। এই এলাকায় তিনি ‘পাগলা’ আফতাব নামেই বেশি পরিচিত। সাদা পাঞ্জাবি ও পায়জামা পরিহিত কুচকুচে কালাে ও লম্বা দাড়িওয়ালা সদাহাস্য আফতাব মিয়া নাকি এককালে মানসিক রােগাক্রান্ত ছিলেন। ভালাে হয়ে যাওয়ার পর তাঁর ‘পাগলা’ উপাধিটি রয়ে যায়। তাঁর বাড়িতে পৌছানাের সঙ্গে সঙ্গেই শুরু হলাে আসন্ন বৈশাখের কালবৈশাখী ঝড়। পড়ন্ত বিকেলের রক্তিম আভা ঢাকা পড়ে গেল ঘন কালাে মেঘে। পাড়ার মেয়েদের আমন্ত্রণে রিমি ও আমি ঝড়াে হাওয়ার মতােই মিলিয়ে গেলাম আমের বনে আম কুড়াতে। মহা ফুর্তিতে কচি আমে কোচড় ভরে ফিরে এলাম আম্মার কাছে। ঘরে কুপিবাতি টিমটিম করে জ্বলছে। আম্মা আশঙ্কা করছিলেন যে এই বিজলিবাতিহীন জঙ্গলের পরিবেশে আমরা হয়তাে ভয় পাব। কিন্তু আম্মার আশঙ্কাকে খণ্ডন করে আমি উৎসাহভরে বলে উঠলাম, ‘আম্মা, আমরা আর ঢাকায় যাব এখানে দিনের বেলায় গাছের নিচে নিচে ঘুরে বেড়াব আর রাতে পড়ব। কী মজা হবে না আম্মা!’ এগারাে বছরের জ্যেষ্ঠ কন্যার এই অভাবনীয় প্রস্তাবটি শুনে আম্মার ভাবনার রাজ্যে যে কথাগুলাে সেই মুহূর্তে জড়াে হয়েছিল, তা পরবর্তী সময়ে তিনি প্রকাশ করেছিলেন এইভাবে“আমি ঐ জঙ্গলের মধ্যে ঘনায়মান সন্ধ্যার অন্ধকারে দাড়িয়ে রাগের পরিবর্তে সশব্দে হেসে উঠলাম। আমার সঙ্গে মেয়েরাও হাসছে। ওরা ভেবেছে আমি আনন্দের সঙ্গে সম্মতি দিয়েছি, তারই জন্য এই হাসি। যেন শিশু-প্রাণের ভয়লেশহীন এক অবাধ গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে ওরাও চলেছে। সেখানে কোনাে ভয়, দুশ্চিন্তা ও পরবর্তী মুহূর্তের নিদারুণ অনিশ্চয়তার বিন্দুমাত্র নেই কোনাে চিহ্ন ও লেশ।* আফতাবউদ্দীন মিয়া ও তাঁর পরিবার-পরিজন আমাদের সাদরে বরণ করে আশ্রয় দেওয়ার পরেও পরদিন গভীর রাতেই সেই স্থানও ত্যাগ করতে হলাে। আমাদের আসার খবর চারদিকে রটে গিয়েছে। এরপর আমরা সােজা রওনা দিলাম আব্দুর জন্মভূমি আমাদের গ্রামের বাড়ি দরদরিয়ার পথে।
এবারে আর রেলগাড়িতে যাত্রা নয়, শীতলক্ষ্যা নদী পথে রৌদ্রালােকিত ভােরের মিষ্টি বাতাসে আমাদের ছইওয়ালা নৌকা তরতর করে এগিয়ে চলল। মাঝির কাছে আমাদের পরিচয় গােপন রাখা হলাে। আম্মা তার সর্বক্ষণের সঙ্গী রেডিওতে কান পেতে বিবিসি, ভয়েস অব আমেরিকা ও কোলকাতার আকাশবাণী বেতার কেন্দ্রের সংবাদ শােনার চেষ্টায় রত। আকাশবাণীর সংবাদে ভেসে এল জনপ্রিয় সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সােনালি কণ্ঠ : ‘এপার বাংলায় নতুন মন্ত্রিসভা, ওপার বাংলায় গণহত্যা ও যুদ্ধের দামামা। আন্ধুর সহােদর মেজ ভাই, আমাদের মফিজ কাকু (মফিজউদ্দীন আহমদ) আমাদের আশ্রয় দিলেন তার পরম আদর ও স্নেহের ডানাতলে। ওখানে আমাদের সমবয়সী চাচাতাে বােন ইপি ও দিপির সঙ্গে শুরু হলাে খেলা আর খেলা। জ্যোৎস্না ভরা রাতে উঠোনের পাশে রাখা খড়ের গাদার পেছনে ও দক্ষিণের কোঠাবাড়ির কাঠের মাচায় উঠে আমরা লুকোচুরি খেলতাম। আমাদের খেলায় যােগ দিত ওহিদুল, পেয়ারা, খােকন, সােমত্ত, হােরেসা এইসব আত্মীয় ও গ্রামের ছেলেমেয়েরা। বাড়ির সামনের পুকুরের ঢেউয়ে চাঁদের আলাে থিরথির করে কাঁপত। শাল ও গজারির বন চৈতি হাওয়ার দোলায় দুলত শনশন শব্দ করে। ঝিঝি পােকার অবিশ্রান্ত ডাক, হাজার জোনাকির নক্ষত্র মালায় ঘেরা বন ও হারিকেনের ফিকে আলােয় আমাদের লুকোচুরি। খেলা দারুণ জমে উঠত আলাে ও আঁধারের রহস্য কেটে কেটে আমরা খুঁজে বেড়াতাম একে অন্যকে। ১০ এপ্রিল রাতটি ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের আকাশবাণী কোলকাতার বেতার কেন্দ্র থেকে। বারবারই প্রচার করা হচ্ছিল যে রাত ১০টার পর একটি বিশেষ সংবাদ প্রচারিত হবে। রান্নাঘরে ব্যস্ত কাকিকে (হােসনে আরা বেগম) আম্মা পশ্চিমের কোঠার দোতলায় আমাদের শােবার ঘরে ডেকে নিলেন। আমার নির্দেশে খেলা ফেলে ইপি ও দিপিসহ রিমি ও আমি জড়াে হলাম আম্মার খাটের ওপর।
বাইরের বাংলা ঘরের বারান্দায় গ্রামের লােকজনসহ রেডিও ঘিরে মফিজ কাকুও অপেক্ষা করছেন সেই বিশেষ সংবাদের রাত ১০টায় দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের সতেজ ও মসৃণ কণ্ঠে উচ্চারিত হলাে শতাব্দীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবাদটি। তিনি বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামের নতুন এই রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান। উপ-রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। আর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ। এখন বাংলাদেশের বিপ্লবী সরকারের প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ প্রচারিত হবে। তারপর শুরু হলাে আন্ধুর ভাষণ। আব্দুর কণ্ঠ শুনে বিপুল বিস্ময় ও আনন্দে আমরা বাকরুদ্ধ যেন স্বর্গলােক থেকে ভেসে আসছে কোনাে দৈবকন্ঠ, ইথার তরঙ্গের মধ্য দিয়ে ভেসে আসা আব্দুর কণ্ঠস্বর আমরা শুনলাম এমনই। একাগ্রতার সঙ্গে আব্বু বললেন, স্বাধীন বাংলাদেশের বীর ভাইবােনেরা, বাংলাদেশের সাড়ে-সাত-কোটি মুক্তি পাগল গণমানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সরকারের পক্ষ থেকে আমি আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি আমরা শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করছি তাদের, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করতে গিয়ে তাদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছেন যত দিন বাংলার আকাশে চন্দ্র-সূর্য-গ্রহ-তারা রইবে, যত দিন বাংলার মাটিতে মানুষ থাকবে, তত দিন মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামের বীর শহীদদের অমরস্মৃতি বাঙালির মানসপটে চির অম্লান থাকবে। পুরাতন পূর্ব পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষের ওপর নতুন বাংলাদেশ গড়ে তুলবার সঙ্কয়ে আমাদের সবাইকে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হতে হবে। আমাদের এই পবিত্র দায়িত্ব পালনে এক মুহূর্তের জন্যেও ভুলে গেলে চলবে না যে এ যুদ্ধ গণযুদ্ধ এবং সত্যিকারের অর্থে এক কথাই বলতে হয় যে এ যুদ্ধ বাংলাদেশের দুঃখী মানুষের যুদ্ধ খেটে খাওয়া সাধারণ কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, জনতা, তাদের সাহস, তাদের দেশপ্রেম, তাদের বিশ্বাস, স্বাধীন বাংলাদেশের চিন্তায় তাদের নিমগ্নপ্রাণ, তাদের আত্মাহুতি, তাদের ত্যাগ ও তিতিক্ষায় জন্ম নিল এই নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ। সাড়েসাত-কোটি মানুষের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় ফলপ্রসূ হয়ে উঠুক আমাদের স্বাধীনতার সম্পদ। বাংলাদেশের নিরন্ন দুঃখী মানুষের জন্য রচিত হােক এক নতুন পৃথিবী, যেখানে মানুষ মানুষকে শােষণ করবে না।
আমাদের প্রতিজ্ঞা হােক ক্ষুধা, রােগ, বেকারত্ব আর অজ্ঞানতার অভিশাপ থেকে মুক্তি। এই পবিত্র দায়িত্বে নিয়ােজিত হােক সাড়ে-সাত-কোটি বীর বাঙালি ভাইবােনের সম্মিলিত মনােবল ও অসীম শক্তি। যারা আজ রক্ত দিয়ে উর্বর করছে বাংলাদেশের মাটি, যেখানে উৎকর্ষিত হচ্ছে স্বাধীন বাংলাদেশের নতুন মানুষ, তাদের রক্ত আর ঘামে ভেজা মাটি থেকে গড়ে উঠুক নতুন গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা গণ-মানুষের কল্যাণে সাম্য আর সুবিচারের ভিত্তিপ্রস্তরে লেখা হােক ‘জয় বাংলা জয় স্বাধীন বাংলাদেশ। আব্বুর সুদীর্ঘ বক্তৃতাটি সমাজের সর্বস্তরের মানুষকে উদ্দেশ্য করে রচিত হয়েছিল। তাঁর। বক্তব্যের প্রতিটি ছত্রেই ছিল সুচিন্তিত দিক-নির্দেশনা স্বাধীনতার লক্ষ্যে ও স্বাধীনতা-উত্তর। বাংলাদেশের জন্য। সামরিক বাহিনী ও বেসামরিক প্রশাসনকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে ভাতা ও নিয়ােগপত্র প্রদান করে তাদের মধ্যে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়েছিল অত্যন্ত সুচারুভাবে রক্তঝরা গণহত্যার শিকার একটি জাতির চরম সংকটপূর্ণ সময়ের দূরদর্শী নেতা আব্দুর সজাগ দৃষ্টি ছিল সার্বভেীমত্ব রক্ষার ব্যাপারে। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে সেদিন বলেছিলেন, বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্রসমূহের কাছে যে অস্ত্র সাহায্য আমরা চাইছি। তা আমরা চাইছি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে একটি স্বাধীন দেশের মানুষ আর একটি স্বাধীন দেশের মানুষের জন্য এই সাহায্য আমরা চাই শর্তহীনভাবে এবং আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি তাদের শুভেচ্ছা ও সহানুভূতির প্রতীক হিসেবে, হানাদারদের রুখে দাঁড়াবার এবং আত্মরক্ষার অধিকার হিসেবে, যে অধিকার মানব-জাতির শাশ্বত অধিকার বহু বছরের সংগ্রাম ত্যাগ ও তিতিক্ষার বিনিময়ে আমরা আজ স্বাধীন বাংলাদেশের পত্তন করেছি। স্বাধীনতার জন্য যে মূল্য আমরা দিয়েছি তা কোনাে বিদেশি রাষ্ট্রের উপরাষ্ট্র হওয়ার জন্য নয়। পৃথিবীর বুকে স্বাধীন সার্বভৌম একটি শান্তিকামী দেশ হিসেবে রাষ্ট্র পরিবার গােষ্ঠীতে উপযুক্ত স্থান আমাদের প্রাপ্য। এ অধিকার বাংলাদেশের সাড়ে-সাত-কোটি মানুষের জন্মগত অধিকার।’ আব্দুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, পাণ্ডিত্য, বিনয়, নিষ্ঠা, দেশপ্রেম, সততা ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন চারিত্রিক গুণাবলির কারণেই তিনি ভারত সরকার ও ইন্দিরা গান্ধী প্রশাসনের শ্রদ্ধা, সম্মান ও আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
১০ এপ্রিলের সেই নিশীথ রাতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শােনা আব্দুর ঐতিহাসিক বক্তৃতাটি বিশ্লেষণ করার মতাে বয়স আমার তখন ছিল না। কিন্তু তাঁর বক্তব্য থেকে একটি ব্যাপারই সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছিল যে স্বাধীনতাযুদ্ধে জয় আমাদের সুনিশ্চিত। আম্মা গভীর আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে বললেন, আর চিন্তা নেই। তােমাদের আব্ব রয়েছেন স্বাধীনতাযুদ্ধের নেতৃত্বে। জয় আমাদের হবেই।’ মফিজ কাকু বাংলা ঘর থেকে ফিরে এসে উল্লসিত কণ্ঠে আম্মাকে অভিনন্দন জানালেন। ২৬ মার্চ দুপুরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র থেকে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল হান্নান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। কালুরঘাটে চট্টগ্রাম বেতারের শিল্পী বেলাল মােহাম্মদ প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে মেজর জিয়াউর রহমানের (পরবর্তী সময়ে জেনারেল ও প্রেসিডেন্ট) ২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঘােষণাটি অধিকাংশ মানুষের কাছে পৌছে যায়। তিনিও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষ থেকেই স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন। জিয়াউর রহমানের ঘোষণাটি সে সময় বাঙালি সৈনিকদের মধ্যে বিশেষ উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি করেছিল। স্বাধীনতার এই ঘােষণাগুলাে ছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতারই একটি অংশ। ৫২-এর ভাষা আন্দোলন, আত্মদান, ৬-দফার জন্য সংগ্রাম, রক্তক্ষরণ, প্রথম জাতীয় সাধারণ নির্বাচন, অসহযােগ আন্দোলন, ৭ মার্চের যুগান্তকারী ভাষণ ইত্যাদি বাঙালির আত্মাধিকারের মােড় পরিবর্তনকারী ঘটনাবলির মধ্য দিয়েই পুরাে জাতি ধাপে ধাপে মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিয়েছিল চূড়ান্ত স্বাধীনতার জন্য স্বাধীনতার ঘােষণাগুলাে ছিল দুই দশকের সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে অর্জিত মানসিক প্রস্তুতিরই একটি সফল উত্তরণ কিন্তু তারপর ? স্বাধীনতার জন্য আত্মত্যাগে প্রস্তুত এই দামাল জাতিকে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দেওয়ার জন্য।
প্রয়ােজন ছিল একটি আইনানুগ জাতীয় সরকারের। সারা বিশ্বের সমর্থন লাভ ও মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলাের সাহায্য ও সহযােগিতা আদায় এবং নবজাতক রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি অর্জনের জন্যও জরুরি ছিল আইনগত ও আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনাকারী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের। ১০ এপ্রিল গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিষ্ঠা সম্ভবপর করেছিল বিচ্ছিন্ন সংগ্রামকে একটি ঐক্যবদ্ধ জাতীয় কাঠামাের মধ্য দিয়ে মূলধারায় প্রবাহিত করতে। ১০ এপ্রিলের পর থেকেই আমাদের পৃথিবীটি ভিন্ন রূপে দেখা দেয়। পূর্ব দিগন্তে স্বাধীনতার যেই সূর্যটি উদীয়মান, সেই উদয়ের পথের নেতৃত্বে রয়েছেন আব্দু, আমাদের আর ভয় নেই। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে প্রথম বাংলাদেশের সরকারের মন্ত্রিপরিষদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান হয়। দেশবিদেশের সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে অনাড়ম্বর পরিবেশে আত্মপ্রকাশ করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। আব্দুর সুযােগ্য সহযােদ্ধা সৈয়দ নজরুল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আল্লু প্রধানমন্ত্রী, তাঁর তিন সহকর্মী ক্যাপ্টেন এম. মনসুর আলী—অর্থমন্ত্রী; আবু হেনা এম, কামরুজ্জামান স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসনমন্ত্রী; এবং খন্দকার মােশতাক পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। খন্দকার মােশতাক আসলে প্রধানমন্ত্রী পদের প্রত্যাশী ছিলেন। শেষ পর্যন্ত তা হতে না পেরে তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়া হবে এই শর্তে তিনি সরকারে যােগ দেন।’ ১৭ এপ্রিল ইথারে আবারাে ভেসে এল আব্দুর কণ্ঠস্বর, ‘আমি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাংলাদেশের সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের সাংবাদিক বন্ধুদের আন্তরিক ধন্যবাদ জানাচ্ছি এই জন্য যে তারা আমাদের আমন্ত্রণে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটি দেখে যাওয়ার জন্য বহু কষ্ট করে, বহু দূর-দূরান্ত থেকে এখানে উপস্থিত হয়েছেন। পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছােট-বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোনাে শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না আমরা আশা করি শুধু শুভেচ্ছার মনােভাব নিয়ে সবাই নিঃসঙ্কোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন। কারাে তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।” স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগর নামকরণ আব্দুরই করা। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেছিলেন যে যুদ্ধাবস্থায় সরকার যেখানে যাবে সেই স্থানের নাম হবে মুজিবনগর। পরবর্তীতে কোলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের ভবনটি মুজিবনগর নামে পরিচিত হয়। মেহেরপুরের স্বাধীন বাংলাদেশের সেই প্রথম রাজধানীতেই কুরআন তেলাওয়াতের মাধ্যমে ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটির সূচনা হয়। কুরআন তেলাওয়াত করেন পাশের গ্রামের দশম শ্রেণীর ছাত্র মােহাম্মদ বাকের আলী। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন টাঙ্গাইল থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান। মেহেরপুরের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ (পরবর্তী সময়ে ঢাকার পুলিশ প্রধান) এবং মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-এ-এলাহী চৌধুরী, রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি আতাউল গণি ওসমানী ও চিফ অব স্টাফ কর্নেল (অব.) আবদুর রবের নামও তিনি ঘােষণা করেন। আইনানুগ সরকারের মূলভিত্তি ও বাংলাদেশের সংবিধানের মূল উৎস স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রটি, যা ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম রচনা করেন, তা পাঠ করেন দিনাজপুর থেকে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ সদস্য ও আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি দলের চিফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রে আমাদের এই স্বাধীনতার ঘােষণা ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে’ উল্লিখিত হয়। প্রতিবছর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস পালনের প্রথম আনুষ্ঠানিক স্বীকৃতি ঐ শপথ গ্রহণ দিবসেই প্রদান করা হয়। বিশ্বের আর একটি রাষ্ট্র স্বাধীনতা ঘােষণাপত্রের মাধ্যমে আইনানুগ সরকারের প্রতিষ্ঠা করে, সে দেশ হলাে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
২১ এপ্রিল কাঁধে ল্যাকটোজেন দুধের টিনের বােঝা বয়ে আমাদের গ্রামের বাড়িতে প্রবেশ করা মাত্রই বমি করে জ্ঞান হারালেন আমাদের হাসান ভাই (আবু আহসান)। চোখে-মুখে পানি ছিটিয়ে সেবা-শুশ্রুষা করে হাসান ভাইয়ের জ্ঞান ফিরিয়ে আনা হলাে। যশােরের ছেলে, পুরনাে ঢাকার যশাের বাের্ডিংয়ের মালিক, হাসান ভাই থাকতেন ১৭ নম্বর কারকুনবাড়ি লেনের খুব কাছেই ১৪ নম্বর কারকুন বাড়ি লেনে। আব্দু, ছােট কাকু, আমাদের চাচাতাে ভাই দলিলউদ্দীন। আহমদ (দলিল ভাই) ও আনার আপা ঐ ১৭ নম্বর বাড়িতে থাকতেন। ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল আল্লু ও আম্মার বিয়ের পর আম্মা ঐ বাড়িতে প্রথম ওঠেন। প্রতিবেশী ও পারিবারিক বন্ধু হাসান। ভাই আম্মাকে ‘মামি’ সম্বােধন করে এক মস্ত কেক দিয়ে বরণ করেন। সেই থেকে হাসান ভাই আমাদেরও বড় ভাই সমান। আমাদের শৈশবকাল থেকেই তাঁর সঙ্গে আমাদের আত্মার সম্পর্ক সেই হাসান ভাইকেই আম্মা গােপনে চিঠি পাঠিয়েছিলেন এক বছর তিন মাসের শিশু সােহেলের জন্য দুধ, ফ্যারেক্স, তালমিছরি ও ওষুধপত্র জোগাড় করে আনতে। গ্রামে এই প্রয়ােজনীয় খাদ্যদ্রব্য ও ওষুধপত্রের প্রচণ্ড সংকট। নিরাপত্তার জন্য আম্মা তাঁকে রেলগাড়িতে আসতে নিষেধ করায় তিনি নদীপথে ও হাঁটাপথে ঐসব জিনিসপত্রের বােঝা নিয়ে বহু কষ্টে আমাদের মাঝে উপস্থিত হন। পথ অচেনা থাকায় ঐ ভারী বােঝা নিয়ে তাঁকে বাড়তি বেশ কয় মাইল ঘুরতেও হয়েছিল। হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে শহরের খবরাখবর জানা হলাে। এরই মধ্যে ২৭ এপ্রিল দরদরিয়া পার্শ্ববর্তী শ্রীপুর বাজারে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যরা আক্রমণ শুরু করে। আর কাপাসিয়া মাইনর ইংরেজি স্কুলের শিক্ষক আব্দুল কুদুস আকন্দের পুত্র, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক রুহুল আমিন ভাই (বর্তমানে ডক্টর রুহুল আমিন যুক্তরাষ্ট্রের জনস হপকিনস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসরপ্রাপ্ত) ও তাঁর নবপরিণীতা স্ত্রী রুবী।
ভাবিও (উম্মে কুলসুম) সেদিন বিকেলেই তার বড় ভাই ফারুক ভাই (বদরুজ্জামান)সহ কাপাসিয়া থেকে আমাদের কাছে উপস্থিত হলেন। রুহুল আমিন ভাইয়ের বিয়েতে আমি তার গাড়িতে চড়ে বরযাত্রী রূপে বিয়ের অনুষ্ঠানে গিয়েছিলাম। রুবী ভাবি তার মিষ্টি স্বভাব দিয়ে আমাদের সবার মন জয় করে নিয়েছিলেন। তাঁরা আসার পর আমরা একত্রে সিদ্ধান্ত নিলাম যে আমরা সকলে সে রাতেই গ্রাম ত্যাগ করব কালব্যাধি লিভার সিরােসিস রােগাক্রান্ত মফিজ কাকু পার্শ্ববর্তী দেওনা গ্রামে আত্মীয়ের বাড়িতে আশ্রয় নেবেন, কাকি ছেলেমেয়েসহ তার বাবার বাড়ি হাতিরদিয়া রওনা হবেন এবং আমরা আপাতত ঢাকায় ফিরে যাব রুহুল আমিন ও হাসান ভাইদের সঙ্গে গভীর রাতে চুপিসারে আমরা আমাদের প্রিয় দরদরিয়া গ্রাম ত্যাগ করলাম। নদীপথে ঢাকা শহরে ফিরে আম্মা প্রথমে গেলেন হাসান ভাইয়ের স্ত্রী জাহানারা ভাবির বাবার বাড়ি জোড়পুল লেনে। সেখানকার প্রতিবেশীদের মধ্যে আমাদের হঠাৎ উপস্থিতি সম্পর্কে কৌতূহলের উদ্রেক হওয়ায় রুহুল আমিন ভাই আমাদের নিয়ে গেলেন তাঁর শ্বশুরবাড়ি বাসাবােতে। ইতােমধ্যে আম্মা আওয়ামী লীগ নেতা হামিদ কাকুর সঙ্গে হাসান ভাইয়ের মাধ্যমে যােগাযােগ করেন। হামিদ কাকু খবর পাঠালেন যে আম্মা যেন আমাদের সঙ্গে নিয়ে মুন্সিগঞ্জে তার শ্বশুরবাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। সেখানে গেলে হামিদ কাকুর লঞ্চ আমাদের নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে। মুন্সিগঞ্জে যাওয়ার প্রস্তুতি নেওয়ার ফাঁকেই আমি রুবী ভাবির বাবা লুৎফুর রহমান কাকুকে জিজ্ঞাসা করলাম পথে পড়ার জন্য তার লাইব্রেরি থেকে কোনাে বই নিতে পারি কি না। জনাব লুৎফুর রহমান, যিনি নিজে ছিলেন বিদ্যান ও পণ্ডিত মানুষ, আমার বই পড়ার আগ্রহ দেখে খুশি ভরেই সম্মতি দিলেন। তার লাইব্রেরি থেকে যে বইটা সেদিন তুলেছিলাম সেটির নাম ছিল টলস্টয়ের সেরা গল্প। খবর পেয়ে আম্মা আমাদের সঙ্গে নিয়ে হামিদ কাকুর শ্বশুর বাড়িতে গেলেন।
সেখানে একরাত কাটানাের পর তার শ্যালক অনু মামা ও রুহুল আমিন ভাইসহ ছােট্ট একটি লঞ্চ আমাদের নিয়ে রওনা হলাে পদ্মা নদীর তীরবর্তী বানরী গ্রামের উদ্দেশে। প্রাইভেট লঞ্চে একসঙ্গে এতগুলাে তরুণের উপস্থিতিতে সন্দেহের সৃষ্টি হতে পারে এ কারণে আম্মার পরামর্শ অনুযায়ী হাসান ভাই ও ফারুক ভাই শহরে ফিরে গেলেন। অনু মামা লঞ্চ চালাচ্ছেন ও রুহুল আমিন ভাই তাকে সহায়তা করছেন। চারদিকে দিগন্তবিস্তারী পদ্মা নদী ও আকাশে পুঞ্জীভূত মেঘ ও রৌদ্রের লুকোচুরি খেলা। এরই মাঝে আমাদের লঞ্চ এগিয়ে চলছে আমি ব্যাগ থেকে রাশিয়ার অমর কথাশিল্পী লিও টলস্টয়ের সেরাগল্পের বইটি খুলে ডুবে গেলাম অন্য জগতে। ‘মানুষ বাঁচে কিসে’ এই গল্পটির নায়ক দেবদূত মাইকেলকে পৃথিবীতে পাঠানাে হয়েছিল তিনটি মহা সত্যকে আবিষ্কার করার জন্য। এক অতি দরিদ্র মুচি সাইমনের গৃহে আশ্রয় নেবার প্রথম দিনটিতেই শীতার্ত ও ক্ষুধার্ত মাইকেল আবিষ্কার করেন প্রথম মহা সত্যকে। মানুষের মাঝে কী রয়েছে? মানুষের মাঝে রয়েছে ভালােবাসা অতি স্বার্থপর ও আত্মকেন্দ্রিক মানুষও তার ভেতরে লুকায়িত ভালােবাসার স্পর্শে সােনার মানুষে পরিণত হতে পারে দ্বিতীয় মহা সত্যটি তিনি আবিষ্কার করেন ছােট দুটি যমজ বালিকার সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাতের মাধ্যমে স্রষ্টার আদেশে তিনি পৃথিবীতে গিয়েছিলেন সদ্য জন্ম দেওয়া ঐ শিশু দুটির মায়ের জান কবচ করার জন্য মাতৃহারা শিশু দুটিকে কে লালন-পালন করবে এই চিন্তার উদ্রেক হওয়ায় তিনি মায়ের জান কবচ না করেই স্বর্গে প্রত্যাবর্তন করেন। স্রষ্টা তাকে দেখান যে যিনি অতি ক্ষুদ্র কীটপতঙ্গেরও লালন-পালন করে থাকেন। তার পক্ষে এই দুটি শিশুর প্রতিপালনের ব্যবস্থা করাও অসম্ভব নয়। মাইকেল ফিরে আসেন পৃথিবীতে সদ্য জন্ম দেওয়া যমজ কন্যার মার প্রাণ হরণ করে যখন স্বর্গের পথে রওনা হন তখন তাঁর বিশাল ডানা দুটি খসে পড়ে। আপনা-আপনিই আত্মা স্বর্গে চলে যায়।
স্রষ্টার প্রথম আদেশ লঙ্ঘন করার জন্য এবং তাঁর মহাপরিকল্পনার অংশ হিসেবে মাইকেলকে পৃথিবীতেই রয়ে যেতে হয় তিনটি মহা সত্যকে খুঁজে বের করার জন্য। ঐ সত্যগুলােকে জানার মধ্যেই তার প্রায়শ্চিত্ত হবে। দ্বিতীয় মহা সত্যটিকে খুঁজে পান ঐ যমজ বাচ্চা দুটিকে দেখে। মাতৃহারা বাচ্চা দুটির হাত ধরে তাদের জন্য নতুন জুতার অর্ডার দিতে এসেছিল তাদের পালক মা। তাঁর নিজ সন্তানের মৃত্যুতে ব্যাকুল ঐ মা গভীর স্নেহে বরণ করেন দুই শিশুকে। মেয়েদের প্রতি তাঁর গভীর ভালােবাসা দেখে মাইকেল অনুধাবন করেন দ্বিতীয় মহা সত্যকে। মানুষ বাঁচে কিসে ? মানুষ বাঁচে ভালােবাসার স্পর্শে। তৃতীয় মহা সত্যটি তিনি খুঁজে পান এক আত্মগর্বে গর্বিত ধনী ব্যক্তির আচরণের মধ্য দিয়ে ঐ ব্যক্তি পার্টিতে যাওয়ার জন্য মূল্যবান চামড়ার এক জোড়া জুতার অর্ডার দিতে সাইমনের কাছে এসেছিলেন। মাইকেল সেই মুহূর্তে ঐ ধনী খদ্দেরের পেছনে দেখতে পেয়েছিলেন মৃত্যু-দূতের ছায়া। তৃতীয় মহা সত্যটির দ্বার এ ভাবেই উম্মােচিত হয়। মানুষ কী জানে না ? মানুষ জানে না তার মৃত্যু কখন হবে। অথচ সেই ক্ষণস্থায়ী জীবন নিয়ে কত পরিকল্পনা কত আস্ফালন। তিনটি মহা সত্যের আলােকে আলােকিত মাইকেলের প্রায়শ্চিত্ত সম্পন্ন হয়। তিনি ফিরে যান স্বর্গে টলস্টয়ের অন্য গল্পটিও আমার মনকে নাড়া দেয়। গল্পটির নাম ‘একজন মানুষের জন্য কতটুকু জমির প্রয়ােজন। গল্পটি এক ধনী, সম্পদ-লােভী মানুষকে কেন্দ্র করে। এই মানুষটির মধ্যে জমি-ক্রয়ের নেশা প্রবল ছিল। সূর্যোদয় হতে, সূর্যাস্ত পর্যন্ত পায়ে হেঁটে সে যতটুকু জমি ভ্রমণ করবে তার সবটুকুই সে পাবে, বিক্রেতাদের এই প্রস্তাবে সে রাজি হয়ে যায় মহা পূর্তিতে। অল্প জমি ভ্রমণ করে তার আশ মেটে না। আরও জমি লাভের আশায় সে ব্যগ্র পদচারণে, ঘর্মাক্ত কলেবরে, জমির সীমানাকে বৃদ্ধি করে। সূর্যাস্তের সময় সে বিশাল জমির মালিক বনে যায়। কিন্তু সম্পদ আর ভােগ করা হয়ে ওঠে না। জমির লােভে শরীরের সব শক্তি নিঃশেষিত এই মানুষটি হঠাৎই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। বাস্তবিক, তার জন্য ততটুকু জমিরই প্রয়ােজন ছিল যতটুকু দিয়ে তার শেষ শয্যা রচিত হয়েছিল। গল্পের জগৎ থেকে বাস্তবে ফিরে আসি বৃষ্টির প্রচণ্ড ঝাপটায় একাকার হয়ে।
আকাশ আঁধার হয়ে প্রচণ্ড ঝড় বৃষ্টি নেমেছে। ঝড়বৃষ্টির দাপটে আমাদের লঞ্চ টলমল করে দুলছে। লঞ্চের খােলা জানালা দিয়ে বৃষ্টির পানি ঢুকছে অবিরাম। কূল-কিনারাহীন পদ্মার ঢেউ ফুসে ফুসে উঠছে। মনে হলাে এই যাত্রায় পদ্মা নদীতেই আমাদের সলিল সমাধি ঘটবে আমাদের লঞ্চটি একসময় দুলতে দুলতে জনমানবহীন পদ্মর এক চরে আটকে গেল। ঝড় থেমে যাওয়ার পর রুহুল আমিন ভাই এবার স্টিয়ারিং হইল ধরে লঞ্চ চালকের আসন গ্রহণ করলেন। আর অনু মামা লাফ দিয়ে নেমে গেলেন পানিতে রশির অভাবে আম্মার কিছু শাড়ি পেঁচিয়ে তা লঞ্চের সঙ্গে বেঁধে অনু মামা টানতে থাকলেন। উদ্দেশ্য, চরা থেকে লঞ্চকে পানিতে নামানাে আমরা সকলেই সাধ্য মতাে সহায়তা করলাম লঞ্চটিকে চরামুক্ত করার জন্য। শেষ অবধি লঞ্চটি আবারাে পানিতে ভাসল বিজন সন্ধ্যায় আমরা উপস্থিত হলাম বানরী নামের অজানা গ্রামে আমাদের আশ্রয়দাতা আওয়ামী লীগের সমর্থক এক অতি সজ্জন গৃহস্থ সেই বাড়িতেই হামিদ কাকুও রয়েছেন পরিবারসহ তাঁর দুই ছােট ছেলে বিপু ও অপু।একমাত্র কন্যা আমাদের সমবয়সী বন্ধু ইভাকে পেয়ে আমরা খুব খুশি হলাম। হামিদ কাকু অতি উৎসাহে মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ সরকারের বলিষ্ঠ ভূমিকা সম্বন্ধে আমাদের অবহিত করলেন।
দিনের বেলা ইভা, রিমি ও আমি চলে যেতাম পদ্মার তীরে। জোয়ারে সিক্ত নরম বালির। মধ্যে আমরা লিখতাম ‘জয় স্বাধীন বাংলাদেশ। সারাদিন নদীর তীর ও ধানখেত, পাটখেত ও বনবাদাড়ে ঘুরে আমরা ঘরে ফিরতাম সাঁঝবেলা। চারদিকে তখন তক্ষক সাপের তক্কে তকে ডাক শােনা যেত। বিশাল লেজওয়ালা কুমিরের মতাে দেখতে একটি-দুটি তক্ষক সাপের সঙ্গে। প্রথম সাক্ষাৎ এই বানরী গ্রামেই। বানরী গ্রামে কয়েক দিন থাকার পর আমাদের ক্ষণস্থায়ী এই ঠিকানা আবারাে বদল হলাে। এবার ঐ একই লঞ্চে মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার রসুনিয়া গ্রামের উদ্দেশে। সেখানে আমাদের আশ্রয় দিলেন এক অতি সাহসী হিন্দু বিধবা। নাম রেণুকণা দে তার একমাত্র পুত্র অজয় ও কন্যা সবিতাসহ তিনি এক দালান বাড়িতে থাকেন। আমরা সেখানে পৌছবার পূর্বদিন। তাদের প্রতিবেশী বাড়ির ১১ জনকে পাকিস্তানি বাহিনী দড়ি দিয়ে বেঁধে গুলি করে হত্যা করে। ওখানে যাওয়ার পর সন্ধ্যায় খবর এল সিরাজদিখান থানার প্রধান বাজারে পাকিস্তানি সৈন্যরা ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এই খবর শােনার পর আমাদের আশ্রয়দাতারা তাদের ধর্মীয় বইপত্র ও সকল নিদর্শন মাটির নিচে পুঁতে ফেললেন। আমাদের নিরাপত্তার জন্য ঐ সাহসী নারী তার পুত্রসহ গােয়াল ঘরে সারা রাত জেগে পাহারা দিলেন। এই আশঙ্কা ও উদ্বেগপূর্ণ রাতে আমাদের মনে পড়ল গৃহশিক্ষক ভবেশ (ভবেশ পাল) স্যারের কথা তিনি বেঁচে আছেন তাে ? লক্ষ্মীপূজার সময় তিনি রিমি ও আমাকে তার বাড়িতে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ফেরার সময় তাঁর বাবা, মা আমাদের সঙ্গে দিয়েছিলেন একরাশ তিল ও নারকেলের নাড়ু। পরদিন সকালে একটি দুঃখজনক সংবাদে আমাদের মনটা ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়ল। পদ্মা নদীর পাড়ের সেই ছায়াঘেরা শান্ত সবুজ বানরী গ্রামকে পাকিস্তানি বাহিনী পুড়িয়ে ভস্ম করে দিয়েছে। আমাদের আশ্রয়দাতা সেই অতি সজ্জন গৃহকর্তাকে গুলি করে হত্যা করেছে রক্তলােভী হায়েনার দল। রসুনিয়া গ্রাম থেকে পালানাের মুহূর্তে শুনলাম এক অসম-সাহসী দেশপ্রেমিক তরুণের করুণ মৃত্যুর কাহিনি। সিরাজদিখান থানার বাজারে আগুন লাগিয়ে দিয়ে সৈন্যরা নিরীহ মানুষদের গুলি করে হত্যা করছিল। এই তরুণ মৃত্যুভয় উপেক্ষা করে জয় বাংলা’ বলে প্রতিবাদ করেছিলেন। পাকিস্তানি সেনারা তাকে নদীর ঘাটে কোমর পর্যন্ত পানিতে নামিয়ে ব্যঙ্গ করে বলেছে ‘জয় বাংলা না, বল জয় পাকিস্তান’। বেয়ােনেটের আঘাতে তার শরীর লাল হয়ে উঠেছিল।
পদ্মার পানিতে ধরেছিল আবিরের রং মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ তার শেষ উত্তর জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে পদ্মার বুকে লুটিয়ে পড়েছিল। টলস্টয়ের গল্পটি চকিতেই মনে উদয় হলাে। মানুষের মাঝে কী আছে ? ভালােবাসা। দেশপ্রেম তাে ভালােবাসারই এক অমর প্রতীক। যার হৃদয়ে নেই ভালােবাসা সে তাে অমানুষ মাত্র! পরদিন রসুনিয়া গ্রাম থেকেও আমাদের পালাতে হলাে। এরপর আরও কত গ্রাম যে আমাদের ঘুরতে হলাে তার হিসাব নেই। মনে পড়ে, আমরা অজান্তেই আশ্রয় নিয়েছিলাম এক পাকিস্তান-সমর্থক দালালের বাড়িতে। ভােররাতে আম্মার ঘুম ভেঙে যায় পাশের ঘরে ফিসফিস শব্দে। সেই দালাল তার সাঙ্গপাঙ্গদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করছিল হিন্দু-অধ্যুষিত বিভিন্ন এলাকায় আগুন ধরানাের তার কথাবার্তা আম্মা শুনে ফেলেন। সকাল হওয়ামাত্র আম্মা এক নৌকা ভাড়া করে আমাদের নিয়ে অন্যত্র চলে যান পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণে গ্রামে অবস্থানও বিপজ্জনক হয়ে দাঁড়াল এই অবস্থায় আম্মা আমাদের সঙ্গে করে বুড়িগঙ্গা নদীপথে রওনা দিলেন ঢাকা শহরের পথে। পদ্ম থেকে বুড়িগঙ্গা জুড়ে ভেসে চলেছে কত শত মানুষের লাশ! অধিকাংশ লাশই একসঙ্গে দড়িতে বাঁধা এবং অনেক লাশের স্তুপের ওপর চিল-শকুন বসে রয়েছে। গানবােটে থাকা পাকিস্তানি সেনাদের সুতীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে আপাদমস্তক বােরখার আড়ালে লুক্কায়িত আম্মার হাত ধরে আমরা লঞ্চঘাটে নামলাম। লঞ্চঘাট থেকে বেবিট্যাক্সি করে সােজা বড় মামুর ধানমণ্ডির ১৩/২-এর বাড়িতে। আমাদের অপ্রত্যাশিত আগমনে সকলে যারপর নাই খুশি হলাে। সমবয়সী মামাতাে বােন শিরিন, নাসরিন ও ইয়াসমিনের কাছে আমরা উজাড় করে দিলাম গত দুইমাসের কাহিনি। আমাদের বড় মামাতাে বােন, কলেজ ছাত্রী লাইলী আপা সংগােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করছেন জেনে পুলকিত হলাম। কিন্তু সেখানে থাকা সম্ভব হলাে না। বড় মামুর বাড়ির আশপাশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আস্তানা থাকায় সেখান থেকে আম্মা চলে গেলেন মগবাজারে আনার আপা ও সাঈদ ভাইয়ের বাড়িতে। তখন শহরজুড়ে সেনাবাহিনীর তৎপরতা। তার মধ্যেই সাঈদ ভাই তার প্রতিরােধযুদ্ধ অব্যাহত রেখেছেন। তার শােবার ঘরের খাটের নিচে লুক্কায়িত অস্ত্রশস্ত্র, ঔষধপত্র এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের নানাবিধ প্রচারপত্র তিনি সংগােপনে বিলি করেন মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝে। পরবর্তী সময়ে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে ধরা পড়েন এবং অলৌকিকভাবে রক্ষা পান।
ছােট মামুর দুই মেয়ে মুন্নী আপা ও এরফানা আপাও দেশরক্ষার্থে সংগ্রাম পরিষদ থেকে ট্রেনিং নেন। উলানিয়ায় নানা বাড়ি থেকে মগবাজারে ফিরে আসার পর এরফানা আপা হন তাঁর এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য এক যােগাযােগ মাধ্যম। ছােট মামু ও মামির অজান্তে তিনি বুকশেলফের বইয়ের পেছনে অস্ত্র লুকিয়ে রাখতেন। অপারেশনে যাবার আগে মুক্তিযােন্ধারা তাঁর কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে যেত। দেশ মুক্তির জন্য বাঙালি হৃদয় সেদিন একাত্ম। ঘরে ঘরেই চলছে প্রতিরােধ সংগ্রাম। সাঈদ ভাইয়ের বাড়িতেই শ্রীপুরের আওয়ামী লীগ নেতা রহমত আলীর সঙ্গে আম্মার যােগাযােগ হলাে হাসান ভাইয়ের মারফত। তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতায় গিয়েছিলেন। আব্দুর সঙ্গে দেখা করে এসেছেন। ২৫ মার্চ রাতে বাড়ি ছাড়ার পর থেকে আব্দু আমাদের কোনাে সংবাদই জানতেন না। রহমত আলীকে তিনি বলেছিলেন যশাের বাের্ডিংয়ে হাসান ভাইয়ের সঙ্গে যােগাযােগ করলেই আমাদের সংবাদ জানা যাবে যদি আমরা বেঁচে থাকি তা হবে সুখের বিষয় এবং যদি আমাদের মৃত্যু ঘটে তাহলে আব্দু সান্ত্বনা খুঁজবেন মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে রহমত আলী ভাই আমাদের কাছে এলেন মুক্তির দূত হয়ে। ২১ মে তাঁর সঙ্গে আমরা রওনা দিলাম সীমান্তের পথে সঙ্গে তার শ্যালক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকম অনার্স বর্ষের ছাত্র রতন ভাই (শফিকুল ইসলাম তালুকদার)। পাঁচ মাসের অন্তঃসত্ত্বা আনার আপা চোখের পানি ফেলতে ফেলতে আমাদের বিদায় দিলেন। আবার কবে দেখা হবে কেউই জানে না। রহমত আলী ভাইয়ের সঙ্গে এবারের যাত্রার অভিজ্ঞতা ছিল অন্যরকম। এবারে আর ঘূর্ণিপাকের মতাে এ-গ্রাম ও-গ্রাম, এ-বাড়ি ও-বাড়ি আশ্রয়ের সন্ধানে ঘুরে বেড়ানাে নয়, এবার আমাদের স্থির লক্ষ্য যে করেই হােক সীমান্ত পার হওয়া। রহমত আলী ভাই তার চেনা পথেই আমাদের আগরতলায় নিয়ে গেলেন। পথে যেতে যেতে নানার কথা খুব মনে পড়ছিল। আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের ক্যাম্প বসেছে।
সেখানেই নানা গৃহবন্দি হিসেবে দিনযাপন করছেন। খুব ইচ্ছে করছিল এক নজর নানাকে দেখে যাই, কিন্তু মিলিটারির হাতে ধরা পড়ার আশঙ্কা পদে পদে। নানা ও আমাদের সবারই জীবনের ঝুঁকি, যদি একবার আমাদের পরিচয় ফাস হয়ে যায়। ফারসি দর্শন ও কাব্যের রাজ্যে আমার প্রথম প্রবেশ নানার হাত ধরে। আমার ছয় বছর বয়সে তিনি আমার সামনে মেলে ধরেছিলেন শেখ সাদি, হাফিজ ও মওলানা জালালউদ্দীন রুমীর জগৎকে। যেন অতলান্তিকের গভীর হৃদয় থেকে কুড়িয়ে পেয়েছেন কোনাে সমুজ্জ্বল মুক্তা, এমনি আনন্দে বিভাের হয়ে তিনি আমাকে আবৃত্তি শেখাতেন। আমার কচি কন্ঠে উচ্চারিত হতাে সাদির জীবনদর্শন কাফেলা রাফত হাস্ত
মা হাম মিরাভিম।
মলি দো রুম।
ইন হাম বাস আস্ত
কাফেলা চলে গিয়েছে। আমাদেরও যেতে হবে। দু’দিনের এই ঘরে, এইটুকুই যথেষ্ট। মৃত্যুর আশঙ্কা ও সব অনিশ্চয়তাই বিলীন হয়ে যায় ঐ ব্যাপক জীবনদর্শনের সান্নিধ্যে এসে। গভীর প্রত্যয় নিয়ে শুরু হয় পথ চলা দু’দিনের এক ক্ষণস্থায়ী আবাসের সন্ধানে।
ডেমরা ঘাট, কাঁচপুর, বৈদ্যের বাজার হয়ে আমাদের লঞ্চ একসময় ছেড়ে এক নিটোল সুন্দর গ্রামে। কুমিল্লা জেলায় অবস্থিত এই গ্রামটির নাম রামচন্দ্রপুর। নদীর তীরবর্তী এক তরুণ ওয়্যারলেস অফিসারের গৃহে আনার আপার রান্না করা খাবার আমরা ভাগাভাগি করে খেলাম। এই তরুণ অফিসার তার ছােষ্ট্র কেরােসিনের চুলায় বড়দের জন্য চায়ের পানি বসালেন। চা-পর্ব শেষ হতেই আমরা আবারাে ছুটলাম। যাত্রাপথে দেখা হলাে সিরাজউদ্দীন ওরফে তেজগাঁও থানার শিলু দারােগার সঙ্গে। তিনি ছিলেন অসহযােগ আন্দোলনের এক সক্রিয় কর্মী এবং গােপনে আন্ধুর কাছে নিয়ে আসতেন পাকিস্তান প্রশাসনের ভেতরের খবর। আমাদের দুই বােনকে তিনি চিনতেন। গ্রামের আঁকাবাকা মেঠো পথের মধ্যে তিনি আমাদের আবিষ্কার করলেন এবং সানন্দে আমাদের গাইড রূপে দুর্গম যাত্রাপথের সঙ্গী হলেন। ঐ এলাকার এক আওয়ামী লীগের এমএনএ’র বাড়িতে সন্ধ্যায় আশ্রয় নিলাম। কিন্তু মাঝরাতেই আম্মার ডাকে ঘুম ভেঙে গেল তক্ষুনি ঐ গ্রাম ছাড়তে হবে। খবর এসেছে যে মিলিটারিরা খুব শিগগির আক্রমণ চালাবে। গাঢ় আঁধারে আমরা পথ পাড়ি দিলাম। আম্মার ভাঙা পা-জোড়া লাগলেও দ্রুত হাঁটার মতাে শক্তি সেই পায়ে তখনাে ফিরে আসেনি। তার পরও তিনি খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে যত দ্রুত হাঁটা সম্ভব হেঁটে চললেন। হাঁটতে হাঁটতে অন্ধকারে আমার হাতে হাত রেখে বললেন, ‘ভয় কোরাে না, একমনে হামিম, হামিম পড়ে শরীরের চারপাশে ফুঁ দিয়ে দাও। কারাে সাধ্যি নেই ক্ষতি করার।’ আম্মা এত দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে কথাটি বললেন যে আমি নির্ভয়ে কুরআনের এই রহস্যাবৃত শব্দটি পড়তে পড়তে সম্মুখে এগােতে থাকলাম। ঐ বাড়ির দুই মুক্তিযােদ্ধা তরুণ মােস্তফা ও মােশারফ ভাই সােহেল ও মিমিকে কাঁধে করে আমাদের নিয়ে গেলেন নদীর ঘাটে। এরপর নৌকা করে ভিন্ন এক গ্রামের বাজারে পৌছলাম খাবার কেনার জন্য। তক্ষুনি আমরা জানতে পারলাম যে রামচন্দ্রপুর গ্রামটি পদ্মাতীরের বানরী গ্রামের মতােই ভস্মীভূত হয়ে গিয়েছে। আরও পরে জানতে পেরেছিলাম যে রামচন্দ্রপুর গ্রামের অতিথিপরায়ণ সেই তরুণ ওয়্যারলেস অফিসারকেও পাকিস্ত নি সেনা গুলি করে হত্যা করেছে।
সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার পথে আমাদের প্রথম বাধা ছিল সিঅ্যান্ডবি পুল। ঐ পুলের ওপর দিয়েই মিলিটারির জিপ যাতায়াত করে এবং অস্ত্রধারী সেনারা টহল দিতে থাকে। সেই পুলের নিচ দিয়েই আমাদের পার হতে হবে অতি সন্তর্পণে। কোনাে কোনাে কৃষক ডিঙি করে চলছে, আবার কোনাে কৃষক প্রাণ হাতে করে কোমরপানিতে নেমে পুলের চারধার জুড়ে বাড়ন্ত সবুজ ধান ও পাটখেতের পরিচর্যা করছে। মাঝে মাঝে পুলের ওপর থেকে এলােপাতাড়ি গুলি চালানাে হয়। তখন কৃষকরা পানির মধ্যে মাথা গুঁজে লুকানাের চেষ্টা করে। আমাদের কিছু দূরেই খেতের পাশ দিয়ে বেশ কয়টি লাশ ডেসে যেতে দেখলাম। এরই মধ্যে আমাদের ডিঙি ছেড়ে আমরা দুই দলে ভাগ হয়ে কোমরপানিতে নেমে পড়লাম। সামনের দলে মাঝির সঙ্গে রিমি, আমি ও রতন ভাই আম্মা, সােহেল, মিমিসহ পেছনের দলে। একসঙ্গে সবাই যাতে মারা না যাই সেই জন্য আম্মা এই ব্যবস্থা করেছেন। পুলের ঠিক নিচেই এক গর্তের মধ্যে রতন ভাই ও আমি পড়ে গেলাম। আমরা কেউই সঁতার জানি না, এবং গর্তের কারণে ওই জায়গায় পানি ছিল বেশ গভীর। ঢকঢক করে পানি গিলতে গিলতে আমরা ডুবতে লাগলাম। ক্ষণিকের মধ্যেই মনে হলাে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নয় এই পুলের নিচের পানির মধ্যেই আমাদের সলিল সমাধি ঘটবে। মাঝি আমাদের একটু পেছনে ছিল সে এসে এই দুই অসাতারু শহুরুকে রক্ষা করল। সিঅ্যান্ডবি পুল পার হওয়ার সময় আম্মা এক অলৌকিক দৃশ্য দেখতে পা এক সাদা। দাড়িওয়ালা ও সাদা পােশাক পরিহিত জোতির্ময় বৃদ্ধ আম্মার মাথার ওপর হাত রেখে অভয় দিচ্ছেন। মুহূর্তের মধ্যেই আমার মনের ভেতরে জমে থাকা সব আশঙ্কা দূর হয়ে যায়। এই একই বৃদ্ধকে তিনি। দেখেছিলেন ২৫ মার্চের রাতে। পাকিস্তানি সৈন্যরা যখন তাণ্ডবলীলা করে ধানমণ্ডির বাসা আক্রমণ করে তক্ষুনি আতিয়া কাকির পাশে দাঁড়ানাে আম্মা ঐ জ্যোতির্ময় বৃদ্ধকে তার মাথার ওপর ডান হাত রেখে অভয় দিতে দেখেন। দৃশ্যটি মাত্র কয়েক সেকেন্ডের। তারপরই আম্বা গভীর প্রত্যয়ে আতিয়া কাকিকে বলেন, ‘ভয় নেই আতিয়া, মিলিটারিরা আমাদের ক্ষতি করতে পারবে না।’
জীবনের বাঁকে বাঁকে সঞ্চিত এমন অলৌকিক ঘটনার পসরা নিয়ে আমরা এগিয়ে চলি সমুখে। আরও কিছু গ্রাম, আরও কিছু প্রতিরােধ ও প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করে আমরা ধাবমান হই রেললাইনের দিকে রেললাইনটি হলাে আমাদের সর্বশেষ প্রতিবন্ধক। এই বিভীষিকাময় রেললাইনের একটু দূরেই পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্প ও সেখানে প্রচণ্ড রকমের যুদ্ধ চলছে। রেললাইনের দিকে ধাবমান রিমি ও আমি হঠাৎই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লাম আমাদের দল থেকে। আমাদের সঙ্গে পোঁটলাপুটলি কাঁধে নিয়ে দৌড়াচ্ছে হাজার হাজার সহায়-সম্বলহীন, ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষ। সন্তান-সম্ভবা এক কিশােরী প্রসব যাতনায় লুটিয়ে পড়ল পথের ধারে। আর্তনাদরত সেই কিশােরীর পাশে এসে দাঁড়াল আরেক নারী কোলে তার ক্রন্দনরত শিশু। তার মধ্যেও সে সন্ত নি সম্ভবা কিশােরীটিকে সাহায্য করার চেষ্টা করছে। স্রোতের মতাে মানুষের ধাক্কায় আমি এগিয়ে চললাম সামনের দিকে। ঐ দুই নারী পেছনে মিলিয়ে গেল আমার আশপাশের মানুষের কষ্ঠ। থেকে একটি চিৎকারই বারবার শুনতে পাচ্ছিলাম, ‘বর্ডার, বর্ডার। মাথার ওপরে গনগনে সূর্য, নিচে হাজারাে শরণার্থীর ভিড়ে আমরা ছুটছি বর্ডারের সন্ধানে। যেন বর্ডার পেরােলেই আমরা পৌছে যাব কোনাে অলৌকিক শান্তির রাজ্যে তৃষ্ণায় রিমি ও আমার গলা শুকিয়ে কাঠ। দৌড়াতে দৌড়াতে পা যখন আর চলে না, মাথা ঝিমঝিম করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে কে যেন বলল, ‘ঐ দেখা যায় বর্ডার।’ বিস্ময়ে বিমূঢ় হয়ে আমরা তাকালাম সবুজ ঘাসের জমিনে রাখা এক থও সাদা পাথরের দিকে। ঐ পাথরখণ্ডটির ওদিকে ভারতের শুরু। আমরা তখনাে বাংলাদেশের সীমানায় দাঁড়িয়ে রয়েছি হতভম্বের মতাে। বর্ডার বলতে উঁচু লােহার বিশাল কোনাে গেট বা দেওয়ালের ছবি আমার মনে অঙ্কিত ছিল। তার বদলে কি না এই ছােট্ট পাথরখণ্ড ! ভারত ও বাংলাদেশের সীমানার চিহ্নরূপী এই ছােট্ট পাথরখণ্ডটি অতিক্রম করলেই আমরা পৌছে যাব ভারতে নিরাপদ স্থানে। অথচ মনের মধ্যে স্ফীত হওয়া একরাশ অনুভূতির জোয়ারে প্লাবিত, আমার হৃদয়ের দৃষ্টিতে, সীমানার ঐ ক্ষুদ্র চিহ্নটিই ছিল এক অসীম প্রতিবন্ধক প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে হবে। স্বেচ্ছায় নয়, প্রাণ রক্ষার্থে !
সেজন্যই বাংলাদেশের সীমানার শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে মনে হলাে আমার জীবন-প্রাণ সবই যেন রেখে গেলাম বাংলাদেশের মাটিতে। রিমি ও আমি অশ্রুর প্রাবনে সিক্ত হয়ে পার হলাম সীমানা। মনে মনে বললাম, “বিদায়, প্রিয় বাংলাদেশ’। আবার কবে দেখা হবে কে জানে। দিনটি ছিল ২৫ মে, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জন্মদিন। আগরতলা সীমান্তবর্তী এই জায়গাটির নাম বক্সনগর। এই বক্সনগরের প্রাইমারি স্কুলের সামনের এক বিশাল দিঘি থেকে রিমি ও আমি আঁজলা ভরে পানি খেলাম। আর একটু হেঁটে দেখি পােস্ট অফিসের পাশে একটি টিউবওয়েল সেখান থেকে আবারাে পানি খেলাম। পিপাসা যেন মিটতেই চায় না। আরও কিছুদূর হাঁটার পর দেখি আম্মা এক বিশাল কাঠালগাছের নিচে বসে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। আমরা দৌড়ে আম্মা, আমেনা, মিমি ও সােহেলের সঙ্গে মিলিত হলাম। আম্মার মাথাভর্তি জটা। ডানহাতের মুঠোয় তিনি বাংলাদেশের মাটি ধরে রেখেছেন। আমাদের সবার পরনে ছিন্নভিন্ন ময়লা কাপড় এবং সবাই দারুণ ক্ষুধার্ত। এক সদয় গৃহিণী আমাদের খৈ, গুড় ও ছাতু দিয়ে ভারতের মাটিতে আপ্যায়ন করলেন। আমাদের দলের কে একজন সােৎসাহে বলল, “আর ভয় নেই। এখন আমরা ইন্ডিয়াতে পৌছে গেছি। আমি আম্মার কানের কাছে মুখ নিয়ে বিস্ময় ভরা কণ্ঠে প্রশ্ন করলাম, আম্মা, ইন্ডিয়াতেও কি কাঁঠাল গাছ হয় ? ভৌগােলিক অবস্থা সম্বন্ধে নিদারুণ অজ্ঞ মেয়েটির কথা শুনে আম্মা ঐ অবস্থার মধ্যেও হেসে উঠলেন ইন্ডিয়া বলতে নানা, মামা ও আম্মার মুখে কোলকাতার ছাত্রাবাস, বেকার হােস্টেল, ইসলামিয়া হােস্টেল, মানুষ-টানা রিকশা, গড়ের মাঠ, রাইটার্স বিল্ডিং ও ভীমনাগের সন্দেশের কথা বুঝতাম। তার মধ্যে আম ও কাঁঠালগাছের কোনাে বিবরণ ছিল না। বিস্ময় কাটিয়ে উঠে দেখি মাটি ও প্রকৃতির মধ্যে কী নিবিড় মিল! অমনটি যদি মানুষের মধ্যে পাওয়া যেত! বক্সনগরের শরণার্থী শিবিরটি আম্মা আমাদের নিয়ে ঘুরে দেখলেন। কঙ্কালসার শিশুদের দুর্দশা দেখে চোখ বেয়ে পানি আপনিই ঝরতে লাগল। সহায়-সম্বলহীন ভিটে-মাটি-ছাড়া মানুষদের আম্মা আশ্বাস দিলেন। তাদের দুঃখের দিন অবসানের আর দেরি নেই। দেশ হানাদারমুক্ত হবেই।
আগরতলা সার্কিট হাউসে দেখা হলাে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের এমএনএ সামসুজ্জোহা কাকু ও তাঁর পরিবারের সঙ্গে। তাঁর দুই মেয়ে নিগার আপা (নিগার সুলতানা) ও নার্গিসের (নার্গিস আক্তার) সঙ্গে ভাব হয়ে গেল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই সীমান্ত পার হওয়ার দুদিন পর ২৭শে মে আমরা মালবাহী কার্গো বিমানে চড়ে কোলকাতার দমদম এয়ারপাের্টে পৌছলাম। সেখান থেকে বাংলাদেশ মিশনের হাইকমিশনার হােসেন আলী সাহেবের পার্ক-সার্কাসের বাসভবনে পৌছলাম পড়ন্ত বিকেলে। বাসভবনটির সঙ্গেই বাংলাদেশ মিশন। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিপরিষদের সদস্যদের শপথ গ্রহণের পরদিন ১৮ এপ্রিলে কোলকাতায় নিযুক্ত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হােসেন আলী তার মিশনের সকল কর্মচারীসহ আনুষ্ঠানিকভাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন। এর আগে ১৫ এপ্রিলে আন্ধু গােপনে হােসেন আলীর সাথে দেখা করে তাঁকে বাংলাদেশের পক্ষে থাকতে রাজি করান। এ বিষয়ে মঈদুল হাসান লেখেন, ‘হােসেন আলী এবং ডেপুটি হাইকমিশনে নিযুক্ত সব বাঙালি যাতে ১৮ এপ্রিল একযােগে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করেন তার ব্যবস্থাদি সম্পন্ন হয় দু’দফা বৈঠকে। হােসেন আলী সাহেব, তাঁর স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে আমাদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। কার্গো বিমানে করে কোলকাতা পৌছাতে আমাদের প্রায় নয় ঘন্টা সময় লেগেছিল। সারা দিনের ভ্রমণের ধকলে ও অনাহারে বিধ্বস্ত আমরা গােসল ও খাওয়া-দাওয়া সারার সঙ্গে সঙ্গেই বিছানায় ঘুমিয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ ঘুমানাের পর ঘুম ভেঙে গেল। মনে হলাে আম্মা যেন ধাক্কা দিচ্ছেন। ধড়মড় করে উঠে বসলাম। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলাে মিলিটারি বােধহয় আক্রমণ করতে আসছে । এক্ষুনি পালাতে হবে। কিন্তু না, এ তাে বাংলাদেশ মিশন! ভাইবােনরা নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে রয়েছে। আম্মা এপাশ-ওপাশ করছেন। আমি গ টিপে টিপে বারান্দায় বেরিয়ে পড়লাম। কেমন এক অস্থিরতায় ঘুম আর এল না। হােসেন আলী সাহেবের তরুণী কন্যা ও আমার সমবয়সী ছেলে জ্যাক জিজ্ঞেস করল ‘গান শুনবে?’ আমি মাথা নেড়ে সায় দিলাম। তারা উৎসাহভরে রেকর্ডে শিল্পী অংশুমান রায়ের সেই হৃদয় আলােড়িত করা গানটি ছেড়ে দিল ।
শােননা একটি মুজিবরের কণ্ঠস্বরের ধ্বনি
প্রতিধ্বনি আকাশে বাতাসে ওঠে রনি…
বাংলাদেশ আমার বাংলাদেশ।
বিশ্বকবির সােনার বাংলা, নজরুলের বাংলাদেশ
জীবনানন্দের রূপসী বাংলা, রূপের যে তার নেই কো শেষ
বাংলাদেশ।
গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও সমর দাসের সুরে, অংশুমান রায়ের এই গানটি প্রথম শুনি। আমাদের দরদরিয়া গ্রামে মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে। আকাশবাণী থেকে এই গানটি প্রচারিত হয়েছিল। পরদিন সন্ধ্যায় রিমির সঙ্গে বাংলাদেশ মিশনে ৭ মার্চের অগ্নিঝরা বক্তৃতা, এই গানটি আবারও শােনার ও শিল্পী অংশুমান রায়কে দেখার সৌভাগ্য হয়। | গান শেষ হওয়ার পর রাতে আমি মিশনের বারান্দার সােফায় বসে ম্যাগাজিন পড়ছিলাম। একটি পত্রিকায় বেগম হােসেন আলীর সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। বগুড়া জেলার এই নম্রভাষী। মহিলা স্বাধীনতাযুদ্ধের সপক্ষে বাংলাদেশ মিশনের সকলকে যেভাবে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন ও তাঁর স্বামীকে সহায়তা করেছেন সেই বিষয়ের ওপর সাক্ষাৎকারটি। সেটা পড়ার সময় হঠাৎ দেখি বারান্দার দরজা দিয়ে হােসেন আলী সাহেবের সঙ্গে আন্ধু প্রবেশ করছেন। আমি বিস্ময়ে ও আনন্দে সােফা ছেড়ে উঠে দাঁড়ালাম। আব্রু এগিয়ে এসে আমার মাথায় হাত বুলালেন। হােসেন আলী সাহেব নিজেই গেলেন আম্মাকে আব্দুর আসার সংবাদটি জানাতে। এদিকে আন্ধু আমাকে নিয়ে সােফায় বসে প্রথমেই জানতে চাইলেন আমাদের কাপাসিয়া এলাকার মানুষের তৎপরতা সম্বন্ধে। আব্দুর প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে মনে হলাে এক নিমেষেই আমি যেন এগারাে থেকে একুশে পদার্পণ করেছি। আব্দুর সঙ্গে আমার জীবনের বিরল কয়েকটি মিনিটের একান্ত আলাপের বিষয়বস্তু ছিল তাঁর ধ্যান, জ্ঞান, প্রাণ, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য ও বীর মুক্তিযােদ্ধাদের কেন্দ্র করে। আমি সােৎসাহে এক নিঃশ্বাসে গড়গড় করে বলে গেলাম আমাদের কাপাসিয়া থানা থেকে অসীম সাহসী তরুণ মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র নেওয়ার কাহিনি। ১০ এপ্রিল আব্ব তার প্রথম বেতার ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘােষণা।
দিয়ে জাতীয় ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেন। ঠিক সেদিনই আমাদের এলাকার যুব-তরুণরা লড়াই করার জন্য কাপাসিয়া থানা থেকে অস্ত্র লুট করে আমাদের এলাকায় চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেন। একই দিনে ঘটে যাওয়া দুটো ঘটনা কাকতালীয় হলেও এই অস্ত্র লুটের ঘটনাটির মধ্যে দিয়ে এলাকাভিত্তিক নতুন ইতিহাসের সৃষ্টি হয়। তরুণদের মধ্যে ব্যাপক আশা ও উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটে। ইংরেজ আমলে বিপ্লবী মাস্টারদা সূর্য সেনের নেতৃত্বে চট্টগ্রাম পুলিশ। লাইনের অস্ত্রাগার লুণ্ঠনের (১৮ এপ্রিল ১৯৩০) বিপুল সাড়া জাগানাে কাহিনিটি শুনে মনে হতাে যে স্বদেশ মুক্ত করার সংগ্রামে লুষ্ঠিত অস্ত্র তাে বাস্তবিক উদ্ধারকৃত অস্ত্রই। একচল্লিশ বছর পর ঐ একই এপ্রিল মাসের এক ঘন সন্ধ্যায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাত থেকে স্বদেশ মুক্ত করার লক্ষ্যে কাপাসিয়া থানা থেকে অস্ত্র লুণ্ঠনকারী দুঃসাহসী যুব-তরুণদের মধ্যে ছিলেন ফজলুর রহমান, মাহমুদুল আলম খান বেনু, কামালউদ্দীন নাননু, কামাল মিয়া, নূরুল ইসলাম, শহীদুল্লাহ, ওবায়দুল্লাহ, নুরুন্নবী খসরু, বজলুর রশীদ মােল্লা, আব্দুল আউয়াল প্রমুখ। (মুক্তিযােদ্ধা ফজলুর রহমানের কাছ থেকে নামের তালিকা ও বাকি বিবরণ সংগ্রহ করা হয়েছে)। অস্ত্র লুণ্ঠন করার পর তারা শীতলক্ষ্যা নদী পার হয়ে চরখামের স্কুলে অস্ত্র প্রশিক্ষণ ক্যাম্প স্থাপন করেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হামলা এড়াতে গিয়ে তারা পরে ঐ স্থান ছেড়ে উত্তরখামেরে ক্যাম্পটি স্থাপন করেন। কিন্তু সেখানেও বেশিদিন থাকা সম্ভবপর না হওয়ায় তারা রায়দ ইউনিয়নের কপালেশ্বর হাইস্কুলে ক্যাম্প স্থাপন করেন। এই ক্যাম্পটিতে প্রচুর মুক্তিপাগল তরুণের সমাগম ঘটে এবং এখান থেকেই এমএনএ ফকির শাহাবুদ্দীনের (বাংলাদেশের প্রথম অ্যাটর্নি জেনারেল) নেতৃত্বে তারা উচ্চ প্রশিক্ষণের জন্য মে মাসের শেষে ভারত গমন করেন। একই সময়ে আমরাও সীমান্ত পার হই। আব্বু খুব মনােযােগের সঙ্গে আমার কথা শুনছিলেন।
সেদিন আমার খবরের ঝুলি থেকে শুধু ১০ এপ্রিলের অস্ত্র লুণ্ঠনের সংবাদটিই আব্দুকে বলতে পেরেছিলাম। একটু পর লম্বা বারান্দার ওপাশের গেস্টরুমের দরজা খুলে গেল হােসেন আলীর টোকায়। আব্বু তক্ষুনি সােফা ছেড়ে গেস্টরুমের দরজার দিকে হাঁটা শুরু করলেন। তিনি রিমি এবং আমার মাথায় আবারও হাত বুলালেন। ঘুমন্ত মিমি ও সােহেলকে একনজর দেখলেন, তারপর আধাখােলা দরজার সামনে দাড়িয়েই আম্মার সঙ্গে সামান্য সময় কথা বললেন। যে আল্লুকে দেখার জন্য, তার কথা শােনার এবং আমাদের এই দুই মাসের শিহরণ জাগানাে অভিজ্ঞতাগুলাে তাকে বলার জন্য আমরা অধীর, সেই আন্ধু এলেন ‘ক্ষণিকের অতিথি হয়ে। কথাও বললেন, খুব সংক্ষিপ্ত আকারে। আম্মা সেই গভীর রাতের অভিজ্ঞতাকে আমার কাছে দেওয়া লিখিত এক সাক্ষাৎকারে (৩১ ডিসেম্বর, ১৯৯৩) প্রকাশ করেছিলেন বহুকাল পর গভীর আবেগভরা হৃদয় দিয়ে। তার ভাষায় আমার জীবন ও ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে মিলনের মুহূর্তে তাজউদ্দীনের নির্ভুল সিদ্ধান্তের অমােঘ ঘােষণা। গাঢ় ক্লান্তির ঘােরে প্রায় অসচেতন অবস্থায় প্রতিটা মুহূর্ত যেন কেটে যাচ্ছে। এই বুঝি এসে পড়লেন। রাত্রি ১টা ২০ মিনিটের সময় তিনি এসে পৌছালেন ঐ বাড়িতে। দরজায় টকটক টোকা দেওয়ার শব্দে ধড়মড়িয়ে দরজা খুলতেই দেখি হােসেন আলী। উদ্বিগ্ন স্বরে তাকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি আসেন নাই ? কথা শেষ হওয়ার আগেই তিনি জবাব দিলেন, স্যার এসে গেছেন’। করিডােরের ওপাশে দৃষ্টি ফেলতেই দেখি তাজউদ্দীন আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। প্রায় এক ফিট দূরে থাকতেই দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি যেন হতভম্ব। অবাক দৃষ্টি নিয়ে তার মুখের দিকে তাকিয়ে আছি। তিনি থমকে গেলেন। সেই মুখে কী দেখেছিলাম অমন গভীর রাতে! ফেলে আসা দু’মাসের ভয়ংকর ঘটনাবলির যে মর্মান্তিক বর্ণনা নিজ মুখে তাঁকে শােনাব বলে যে ছক প্রায় নিশ্চিতভাবে সজ্জিত ছিল মনে, বাস্তবতার অসাধারণ শক্তি দিয়ে নিমিষে তা যেন আড়াল করে দিল। যাকে ছোঁয়া যায় না। সে যে তখন মানুষ রূপের এক অসাধারণ মহামানব।
দুজনার দৃষ্টি বিনিময়ের সময়কালটা ছিল ১০-১৫ সেকেন্ড। অতি দ্রুত আর একটু কাছে। সরে এসে বললেন, ‘শােননা, আমি ৬-৭ মিনিট সময় হাতে নিয়ে এসেছি। এখন আমাদের মুক্তিযুদ্ধ চলছে। আমরা ‘এক্সাইলে’ (নির্বাসনে) সরকার গঠন করেছি। আমি এবং কেবিনেটের অন্য চারজন মন্ত্রী শপথ গ্রহণ করেছি যে দেশ পাকিস্তানি-সেনমুক্ত করে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ প্রতিষ্ঠা না করা পর্যন্ত আমরা কেউ ফ্যামিলির সঙ্গে থাকব না। আর একটা কথা, কালকেই এখান থেকে তােমাদের অন্য বাড়িতে সরিয়ে ফেলা হবে, কারণ এটা (সরকারি) অফিসারের বাসা বলেই তিনি ঘড়ির দিকে দেখলেন। এই সময়কালটা ছিল ৫ থেকে ৬ মিনিট। সেই মুহূর্তগুলােতে এমন গৌরবমণ্ডিত ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তকে আমি প্রাণভরে অভিনন্দন জানিয়েছিলাম। প্রত্যুত্তরের মাধ্যমে নয়, দারুণ শিহরণ জাগানাে ঐকমত্য পােষণ করেছিলাম উদ্ভাসিত গভীর দৃষ্টি বিনিময়ের মাধ্যমে। তিনি বুঝেছিলেন। তারপর তিনি চলে গেলেন। সেই সময়কার ঐ মহান সিদ্ধান্ত হাজার বছরের যেন এক অমূল্য উপাদান। চলন্ত জীবনের কত ঐতিহাসিক ঘটনার উথানপতনের সঙ্গে বারংবার তাকে নতুনভাবে আবিষ্কার করেছি, ক্ষুদ্র থেকে বৃহত্তর পরিসরে। এ যে কত বড় অমূল্য সাধনার প্রাপ্তি।
ক্ষুদ্র চাওয়া-পাওয়া ও ব্যক্তি স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে দেশ ও দশকে ভালােবাসার কী অমূল্য আদর্শ রেখে গেলেন আব্দু। আর আম্মাই বা কত নিঃস্বার্থভাবে নিজেকে একাত্ম করে দিলেন তার জীবনসাথির মহৎ সংগ্রামের অনুচ্চারিত প্রেরণা হয়ে। | তারপর আমরা হােসেন আলী সাহেবের সরকারি বাসভবন ত্যাগ করে পার্ক স্ট্রিটে কোহিনুর ম্যানসনের চারতলা ফ্ল্যাটে উঠলাম। এই ফ্ল্যাটটিতে আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা এবং পরবর্তীতে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির প্রতিষ্ঠাতা, আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনের অগ্রণী ও মজলুমদের নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী সাহেব থাকতেন। তার একটি অংশে আমাদের থাকার ব্যবস্থা হলাে। তাকে দাদু সম্বােধনের মাধ্যমে আমাদের ছােটদের সঙ্গে তার পরিচয়পর্ব শুরু হলাে। তিনি আম্মার হাতের রান্নার খুবই ভক্ত হয়ে পড়লেন। আমাদের সঙ্গে মজার মজার গল্প করা ও ঝাল খাওয়ায় তার জুড়ি ছিল না। আব্দুর নিবেদিত ও দূরদর্শী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করতেন। এই ফ্ল্যাটেই মিমি ও আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর স্টাফ মধুসূদন দত্ত আমাদের ঐ বিল্ডিংয়ের একজন ভালাে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যান। আমাদের নিরাপত্তার জন্য সে সময় সুকুমার চান্দ ও মােহন সিংহ নামে আরও দুজন নিরাপত্তা স্টাফ নিযুক্ত ছিল। সুকুমার চান্দ ছােট্ট সােহেলকে খুবই আদর করত এবং মােহন সিংহ নেপালের গুদের দুর্ধর্ষ লড়াইয়ের গল্প বলত। এক সপ্তাহ পরে আমরা সিআইটি রােডের (৩৯ ড. সুন্দরী মােহন অ্যাভিনিউ) আটতলায় স্থানান্তরিত হই। বিন্ডিংঙের নাম চম্পা কোর্ট। মালিক আশু ঘােষ। মওলানা ভাসানীও একই দিন শিলংয়ে চলে যান। আমাদের ২৫ নম্বর ফ্ল্যাটের ঠিক উল্টো দিকের ২৭ নম্বর ফ্ল্যাটে খন্দকার মােশতাক আহমেদ তার স্ত্রী ও পরিবারসহ থাকতেন। তার পাশের ২৮ নম্বর ফ্লাটে থাকতেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তার পরিবার। ছয়তলায় পরিবারসহ থাকতেন এএইচএম কামরুজ্জামান।
পাঁচতলায় ক্যাপ্টেন (অব.) এম. মনসুর আলী ও তার পরিবার। কামরুজ্জামান সাহেবের মেয়ে রিয়া আপা ও মনসুর আলী সাহেবের একমাত্র মেয়ে সমবয়সী শিরিনের সঙ্গে আমার বেশ বন্ধুত্ব হয়ে যায়। রিমি খেলত কামরুজ্জামান সাহেবের সবচেয়ে ছােট মেয়ে চুমকি ও নজরুল ইসলাম সাহেবের দুই মেয়ে রুপা ও লিপির সঙ্গে। আমাদের এই ছােট্ট দুই রুমওয়ালা ফ্ল্যাটের পেছনের ব্যালকনিতে একদিন দাড়াতেই পাশের ফ্ল্যাটের এক ববকাটা ঝাকড়া চুলওয়ালা মিষ্টি মেয়ের সঙ্গে বেশ আলাপ হয়ে যায়। ওর ব্যালকনি থেকে মাথা ঝুকিয়ে সে তার নামটি জানায়। তার ডাকনাম মিঠু। ভালাে নাম নিবেদিতা পাল। ক্লাস থ্রির ছাত্রী সে। আমার চেয়ে প্রায় আড়াই বছরের ছােট মিঠুর সঙ্গে খুব তাড়াতাড়ি গভীর বন্ধুত্ব হয়ে যায় বই বিনিময়ের মাধ্যমে। সেও বই পড়ার দারুণ ভক্ত। কদিন আগেই আম্মা, রতন ভাই ও রিমিসহ কলেজ স্ট্রিট থেকে একরাশ বই কিনে এনেছিলাম। সেই বইগুলাের মধ্যে ছিল দেব সাহিত্য কুটির প্রকাশিত বিশ্বের শ্রেষ্ঠ গল্প, বিদেশি গল্প চয়ন, ভূত পেত্নী-দৈত্য দানব, রাক্ষস-খােক্কস, শিবরাম চক্রবর্তীর হাসির গল্প প্রভৃতি। ঐ বইগুলাের সঙ্গে যুক্ত হয় প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার সত্যজিৎ রায়ের দাদা উপেন্দ্রকিশাের রায়চৌধুরীর সহজ ভাষায় লেখা ‘ছেলেদের মহাভারত’, অবনীনন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা ‘নালক’। রংচঙা ছবিওয়ালা চটি বইয়ের মধ্যে ছিল ‘ভক্ত ধ্রুবের গল্প’ ও ‘ভক্ত প্রহল্লাদের গল্প’ বড় পরিসরের জীবনীর মধ্যে ছিল হজরত আব্দুল কাদির জিলানী, তাপসী রাবেয়া বসরী, রামকৃষ্ণ পরমহংস ও স্বামী বিবেকানন্দের জীবনী আম্মা কিনলেন শৈলেশ দে রচিত ‘আমি সুভাষ বলছি’। ঐ বইগুলাে আমার ক্ষুদ্র জগতের দুয়ার উন্মােচিত করে ও মনকে নাড়া দেয় বিপুলভাবে। নালক’ বইটির মনােমুগ্ধকর ভাষা ও বিবরণ আমাকে এতই আপুত করে যে আমি নিজে নিজেই ধ্যান অভ্যাস করার প্রচেষ্টা করি। পাঁচ বছরের মিমিকে বেছে নিই আমার ধ্যানের সহযােগী হিসেবে। চোখ বন্ধ করে মনে মনে ভাবার চেষ্টা করি, যে আমিও যেন সাধক ভিক্ষু নালকের মতাে গৃহ ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়েছি কোনাে অজানায় ।
অথবা নালকের গুরু ধ্যানস্থ দেল ঋষি, যিনি দিব্যদৃষ্টি মেলে সিদ্ধার্থ গেীতমবুদ্ধ জন্মগ্রহণ করবেন এই ঘটনা দেখতে পেয়েছিলেন, তারই মতাে যেন দেখার চেষ্টা করি আমাদের মুক্তিযােদ্ধা বীরদের বিজয়; অথবা গৌতম বুদ্ধের মতােই যিনি ভরা পূর্ণিমার রাতে খুঁজে পেয়েছিলেন মানব মুক্তির পথ ধ্যানের গভীরে পৌছে, তাকেও অনুকরণের চেষ্টা করি। পদ্মাসনের ভঙ্গিতে বসে। তৃতীয় শ্রেণীতে হজরত মুহম্মদ (সা.)-এর জীবনী পড়া হয়েছিল। তিনি হেরা পর্বতের নির্জন গুহায় দিনের পর দিন কাটাতেন ধ্যান করে। ধ্যানমগ্ন অবস্থায় থাকাকালীন তিনি জিবরাঈল (আ.) ফেরেশতার সাক্ষাৎ লাভ করেন এবং প্রথম দৈববাণী ‘ইকরা’ বা ‘পড়’র মাধ্যমে পশ্চাৎপদ আরব সমাজে সাম্য, সুবিচার ও শিক্ষার বৈপ্লবিক বার্তা ছড়িয়ে দেন। তাপসী রাবেয়া তার ধ্যান ও একাগ্র প্রার্থনার বলে জয় করেছিলেন পার্থিব কামনা ও বাসনা। ক্ষমা করেছিলেন মানুষের নির্দয়তাকে। নৈকট্য লাভ করেছিলেন বিশ্ব প্রতিপালকের। ভক্ত প্রহল্লাদ তার প্রার্থনা ও প্রেমের বলে বশীভূত করেছিলেন বিষধর সাপকে। ভক্ত ধ্রুব খুঁজে পেয়েছিলেন তাঁর পরম আরাধনার হরিকে। নরেন্দ্র তার ধ্যান ও গভীর আত্মিক অনুসন্ধানের মধ্যে দিয়ে রূপান্তরিত হয়েছিলেন সেবক ও সাধক স্বামী বিবেকানন্দতে। আমি ঐ বইগুলাে পড়ে এতই অনুপ্রাণিত বােধ করি যে আমার দৃঢ় বিশ্বাস জন্মায় গভীরভাবে প্রার্থনা ও নিয়মিত ধ্যান অভ্যাস দেশের স্বাধীনতা অর্জনে সহায়ক হবে। কলেজ স্ট্রিট থেকে কেনা নামাজ শিক্ষার বই থেকে আরও কিছু সুরা আম্মার সহায়তায় মুখস্থ করে আমি নামাজ পড়া শুরু করলাম এই প্রবাসের মাটিতেই পাকিস্তান সরকার যে রাষ্ট্রকে মালাউন ও কাফেরের দেশ হিসেবে অভিহিত করত সেই ভারতের মাটিতেই এই শরণার্থী বাঙালি মুসলিম বালিকার ইসলামি তরিকায় শুরু হলাে প্রার্থনা। চোখ বুজে বলতাম, ‘হে আল্লাহ, আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের বিজয়ী করাে। আমাদের দেশকে স্বাধীন করাে’। স্বদেশ। মুক্তির সঙ্গে আধ্যাত্মিক অনুসন্ধিৎসার এক গভীর যােগসূত্র গড়ে ওঠে এভাবেই।
সদা প্রবাহমান জীবনের বাঁকে বাঁকে যে বিশেষ ঘটনাবলির সমাহার ঘটে থাকে তার পেছনেও থাকে সুনির্দিষ্ট কারণ। প্রতিটি ঘটনাই, তা যত দুঃখজনকই হােক না কেন, জীবনকে করে থাকে সমৃদ্ধ; চিন্তার রাজ্যকে করে বিস্তৃত। মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতার পাদপিঠেই জন্ম নিয়ে থাকে বিবর্তিত নতুন মানুষ। পরিত্যক্ত হয় পুরনাে দৃষ্টিভঙ্গি। ‘৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক সরকারের লেলিয়ে দেওয়া তথাকথিত ‘মুসলিম’ হানাদার বাহিনীর পৈশাচিক কার্যকলাপ প্রত্যক্ষ করে অল্প বয়সেই ঐ ধারণাটি মনে গভীরভাবে শিকড় গেড়ে বসে যে ধর্ম নিছক কোনাে লেবেল নয়। কোনাে বিশেষ ধর্মের লেবেল পরিধান করলেই সে ঐ ধর্মের প্রতিনিধি হয়ে যায় না। ধর্মের ভিত্তি হলাে সুকর্মের ওপর প্রতিষ্ঠিত। এক ধর্মের সঙ্গে অন্য ধর্মের আচার-অনুষ্ঠানে (rituals) বিভেদ হতে পারে; স্রষ্টা, পরকাল, পুনর্জন্ম প্রভৃতি সম্পর্কে তত্ত্বগত (Theological) মতভেদ থাকতে পারে এবং সে বিষয়ে কে সঠিক সে বিচারের ভার একমাত্র স্রষ্টার। কিন্তু প্রতিটি ধর্মেই মানুষের সঙ্গে মানুষের সম্পর্কের অন্তর্নিহিত মৌলিক (Core values) মূল্যবােধগুলাে অভিন্ন। প্রতিটি ধর্মেই দয়া, দান, ক্ষমা, বিনয় ও ন্যায়পরায়ণতা চর্চার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করা হয়েছে এবং হিংসা, লােভ, অহঙ্কার, পরনিন্দা ও মিথ্যাকে পরিহার করতে বলা হয়েছে। এই মূল্যবােধগুলাের আন্তরিক চর্চার ওপরই নির্ভর করে ব্যক্তি ও সমাজের আত্মিক ও জাগতিক অগ্রগতি। এক অর্থে এই মানবিক মূল্যবােধগুলােই হলাে ধর্মের হৃদয়। পাকিস্তান সরকার ও তাদের পাপকর্মের সঙ্গী তথাকথিত ইসলামপন্থী জামাতে ইসলামী, আলবদর, আল শামস প্রভৃতি দলগুলাে নিরীহ নারী, পুরুষ ও শিশু হত্যা করে ইসলামসহ সকল ধর্মের মৌলিক ভিত্তির ওপরই প্রবল আঘাত হানে। লাঞ্ছিতা ও ধর্ষিতা লক্ষাধিক বধূ, মাতা ও কন্যার মর্মভেদী আর্তনাদের মধ্যেই রচিত হয় ইসলামের মুখােশ পরিহিতদের কবর।
ভারী অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে পথের ভিখারি, অসহায় শিশু, রাস্তার ফেরিওয়ালা, রিকশাওয়ালা, কৃষক, • মজুর, শিক্ষক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবী পেশাজীবী কেউই সেদিন রক্ষা পায়নি। তথাকথিত একদল মুসলিমের হাতে আর একদল অসহায় ও নিরপরাধ মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নাগরিক প্রাণ হারায়। প্রাণ বাঁচাতে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় পায় পার্শ্ববর্তী সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দুঅধ্যুষিত রাষ্ট্রে। সকল ধর্মের নির্যাস মানবতা জয়যুক্ত হয়। সমগ্র বিশ্বের ইতিহাসও এই সাক্ষ্য দেয় যে মানুষের মানবতা কখনাে একটি বিশেষ ধর্ম বা সংস্কৃতির মধ্যে আবদ্ধ থাকেনি। প্রাচীনকালে মক্কার নির্যাতিত মুসলিমদের সাদরে আশ্রয় দিয়েছিল আবিসিনিয়ার (ইথিওপিয়া) ন্যায়পরায়ণ খ্রিষ্টান রাজা নেগাস। মধ্যযুগে তুরস্কের মুসলিম সুলতান দ্বিতীয় বাইয়াজিদ রাজকীয় নৌবহর পাঠিয়ে স্পেনের বহু সংখ্যক ইহুদির প্রাণ রক্ষা করেছিল খ্রিষ্টীয় ক্যাথলিক শাসকদের ইনকুইজিশন থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে (১৯১৫-১৭) তুর্কি সরকারের (Young Turks) গণহত্যা থেকে প্রাণ রক্ষার জন্য বহু আর্মেনীয় খ্রিষ্টান আশ্রয় পেয়েছিল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র মিশর ও সিরিয়ায়। এমআইটির বিরল প্রতিভাবান, অসামান্য পাণ্ডিত্যের অধিকারী ইহুদি বংশদ্ভূত নােম চমস্কি যিনি নিজেকে কোনাে বিশেষ ধর্মের সঙ্গে সম্পৃক্ত করেন না তার কলম অবিরাম চলেছে সত্যের পক্ষে। সমগ্র লাতিন আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের বাস্তব চিত্রকে অকাট্য যুক্তির বলে তুলে ধরায় সাম্রাজ্যবাদ চালিত মূলধারার গণমাধ্যমে তার স্থান না হওয়ার পরও তার কলম বা বক্তব্য থেমে থাকেনি। তিনি ক্রমশই প্রিয় হয়ে উঠেছেন সত্য-সন্ধানী মানুষের কাছে।
এ ধরনের বরেণ্য ব্যক্তিদের কার্যকলাপ প্রমাণ করে যে এই পৃথিবীতে জ্ঞানের সাধনা, জাতি, ধর্ম ও বর্ণনির্বিশেষে ন্যায়ের পক্ষে সংগ্রাম ও মমতার উষ্ণতায় আত্মচরিত্র গড়ার প্রচেষ্টাই হতে পারে স্রষ্টার অন্যতম আরাধনা। এভাবেই আমার জীবনে ১৯৭১ উদয় হয় মহাশিক্ষক রূপে। আমার সঞ্চয়ে সেদিন যে। নানা-ধর্ম-জাতি ও সংস্কৃতির বইগুলাে যুক্ত হয়েছিল তারও বােধহয় কোনাে নির্দিষ্ট কারণ ছিল। বহুযুগ পরে, আমার সুদীর্ঘ অভিবাসী জীবনে ও কর্মক্ষেত্রে শাস্তি শিক্ষা, আন্তঃধর্মীয় সংলাপ (Interfaith dialogue) নারী উন্নয়ন ও মানবাধিকারের বিষয়গুলােই হয়ে উঠবে আমার প্রধান কার্যক্রম। আমাদের পাশের ফ্ল্যাটের প্রতিবেশী মিঠুর বাবা প্রশান্ত কুমার পাল, মা রাধা পাল, ছােট বােন সােমা ও দাদু আশুতােষ পাল নিয়ে তাদের ছিমছাম সংসার। সমবয়সী সােমার সঙ্গে মিমির বেশ ভাব হয়ে যায়। মিঠু হয় রিমি ও আমার বন্ধু রাধা মাসিমার বাড়ি বিক্রমপুরের ভাগ্যকুলে। তিনি তাঁর দেশের মানুষদের সঙ্গে বিক্রমপুরের আঞ্চলিক ভাষাতেই কথা বলতেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি তাদের গভীর সমর্থন ও আমাদের প্রতি তাদের আন্তরিকতা ও সহমর্মিতার ফলে আমরা প্রায় একই পরিবারের মতাে হয়ে যাই। সােহেলের জন্য মিঠুর বাবা-মেসােমশাই প্রতিদিনই তাজা সন্দেশ নিয়ে আসতেন। যেদিনই আমি একটা নতুন বই পড়ে শেষ করতাম দৌড়ে চলে। যেতাম দাদুর কাছে সেই বই সম্বন্ধে আলােচনা করতে। দাদুর মধ্য দিয়ে নানার অভাব যেন, অনেকটা পূরণ করতাম। ছেলেদের মহাভারত বইটি ছিল বেশ বড় আকারের। বইটি আমি দিন-রাত পড়ে তাড়াতাড়ি শেষ করে ফেললাম। পুরাে বইটা সত্যিই শেষ করেছি কি না পরীক্ষা করার জন্য দাদু মহাভারতের মাঝখান থেকে একটি অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র চরিত্রকে বের করে তার নাম জানতে চাইলেন, ‘ঝলাে তাে ঘটৎকোচের (পাণ্ডব রাজপুত্র ভীমের বীরপুত্র) মায়ের নাম কী ? আমি সঙ্গে সঙ্গেই উত্তর দিলাম ‘হিড়িম্বা। দাদু খুব খুশি হয়ে আশীর্বাদ করলেন। বই পড়া ছাড়াও আমাদের সেই দিনগুলাের প্রধান আকর্ষণ ছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান এম, আর, আখতার মুকুলের কণ্ঠে তাঁর রচিত ব্যঙ্গাত্মক খবর ‘চরমপত্র’ শােনার জন্য আমরা অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতাম। ভীষণ মজার মজার শব্দ ব্যবহার করে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে ইয়াহিয়া সরকারের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার চিত্র খবরে তুলে ধরতেন। প্রিয় দেশাত্মবােধক গানগুলাের মধ্যে ছিল,
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে রক্ত লাল –কোরাস
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে বাংলার স্বাধীনতা আনলে যারা শিল্পী স্বপ্না রায়
একটি ফুলকে বাঁচাব বলে যুদ্ধ করি কণ্ঠ ও সুর শিল্পী আপেল মাহমুদ
তীর হারা এই ঢেউয়ের সাগর পারি দেবরে আপেল মাহমুদ কোরাস
সােনায় মােড়ান বাংলা মােদের শুশান করেছে কে শিল্পী মুকসুদ আলী সাই
সালাম সালাম হাজার সালাম সকল শহীদ স্মরণে শিল্পী মােহাম্মদ আবদুল জব্বার
হায়রে কৃষাণ তােদের এ ছিন্ন দেহ দেখে যে মন মানে না স্বপ্ন রায়।
কোলকাতার বরেণ্য গীতিকার গােবিন্দ হালদার প্রথম তিনটি গান রচনা করেন। প্রথম দুটি গানে সুরারােপ করেন বাংলাদেশের নন্দিত সুরকার সমর দাস। নানাবিধ প্রতিকূলতা ও সীমাবদ্ধতার মধ্যেও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের অনুষ্ঠান মুক্তিযুদ্ধের প্রাণশক্তিতে পরিণত হয় ঐ বেতার কেন্দ্রের সঙ্গে জড়িত অসংখ্য নিবেদিত শিল্পী, কর্মী ও পরিচালকের কারণে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও বেতার মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠানে প্রতিফলিত হতাে প্রথম বাংলাদেশ সরকারের চিন্তাধারা। একটি স্বাধীন সার্বভৌম, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের সংজ্ঞা কী হতে পারে তা নিপুণভাবে উপস্থাপিত হতাে আকর্ষণীয় এবং শিক্ষণীয় অনুষ্ঠানসূচির মধ্যে দিয়ে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ২৬ মার্চ থেকে বেলাল মােহাম্মদ, আবুল কাশেম সন্দ্বীপ প্রমুখের উদ্যোগে অনিয়মিতভাবে প্রচারিত হয়ে আসছিল। বাংলাদেশ সরকার গঠিত হওয়ার পর বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের জম্মবার্ষিকীর দিনে, ২৫ মে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ২য় পর্বের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হয় বালিগঞ্জ সার্কুলার রােডে অবস্থিত তার নিজস্ব ভবনে, অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী ট্রান্সমিটার ও আনুষঙ্গিক অবকাঠামোেসহ। প্রবাসে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। প্রতিষ্ঠার উদ্যোক্তা ছিলেন আব্দু। টাঙ্গাইলের তৎকালীন এমএনএ বর্তমান আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আব্দুল মান্নান বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার জন্য একটি বৈঠক ডাকেন প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শে পাকিস্তান সরকার সমানেই তখন প্রচার করে চলেছে যে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত সকলেই দেশদ্রোহী, ধর্মদ্রোহী, কাফের, হিন্দু প্রভৃতি। বাঙালি মুসলিমদের সংগ্রাম যে পাকিস্তান সরকারের শশাষণ ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং ইসলামের বিরুদ্ধে নয় তার প্রমাণ হিসেবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সর্বপ্রথম নিয়মিত কুরআন তেলাওয়াত ও তার অনুবাদ প্রচারিত হয় আব্দুর পরামর্শে।
ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ যে ধর্মহীনতা নয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রে সকল ধর্মের প্রতিই সমান আচরণ ও শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করা হবে তার সহজ নিদর্শনকে জনগণের কাছে তুলে ধরা হয় কুরআন, পীতা, ত্রিপিটক ও বাইবেল পাঠ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সম্প্রচারিত করে। এর মধ্যে একদিন কামাল ভাই (শেখ কামাল) আম্মার সঙ্গে দেখা করতে আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন। তিনি তাদের ধানমণ্ডির বাড়ি থেকে পালিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করেছেন। তিনি আম্মাকে জানালেন যে গৃহবন্দি থাকাকালে পাকিস্তানি অফিসারদের আলাপচারিতায় শুনেছেন যে আম্মাসহ আমাদের তিন ভাইবােনের নাম হত্যার তালিকায় রয়েছে। শুধু মিমির নামটি সেই তালিকায় নেই সেনাবাহিনী আমাদের পরিবারের সদস্য সংখ্যা সম্বন্ধে ভুল তথ্য পেয়ে থাকলেও এটাই সুস্পষ্ট হয়ে উঠে যে আল্লু ও তার পরিবারকে হত্যার মধ্যে দিয়ে তারা স্বাধীনতা যুদ্ধকেই বিনষ্ট করতে চেয়েছিল। কামাল ভাই দেখা করার পরে একদিন জামাল ভাইও (শেখ জামাল) তার এক আত্মীয়র সাথে আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন দেখা করতে কিশাের জামাল ভাই পালিয়েছিলেন, কামাল ভাইয়ের আরও পরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী মুজিব কাকুর পরিবারকে ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর রােডের বাসা থেকে স্থানান্তরিত করে ধানমণ্ডির পুরাতন ১৮ নম্বর রােডের যে ৬১৩ নম্বর বাড়িতে গৃহবন্দি করে রেখেছিল সেই বাসস্থান হতে। আলুর মিলিটারি কর্মকর্তা মেজর নূরুল ইসলাম শিশুর (পরে মেজর জেনারেল) স্ত্রীও আম্মার সঙ্গে দেখা করতে এলেন তাঁর দুই ফুটফুটে সুন্দর শিশুকন্যাকে সঙ্গে নিয়ে। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাকে আটক করেছিল। তিনি কৌশলে মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় পাকিস্ত নি সেনাবাহিনীকে ফাকি দিয়ে পালিয়ে ভারতে চলে আসেন। মুরশিদ খালু (অধ্যাপক খান সারওয়ার মুরশিদ), নূরজাহান খালা (নূরজাহান মুরশিদ) ও তাঁদের দুই মেয়ে রুমা আপা (তাজিন মুরশিদ) ও নাইনু আপা (শারমিন মুরশিদ) প্রায়ই আম্মার কাছে আসতেন যুদ্ধের বিভিন্ন খবরাখবর নিয়ে। নাইনু আপা স্বাধীন বাংলা শিল্পী দলের সদস্য ছিলেন। তারা দেশাত্মবোেধক গান গেয়ে মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণকে অনুপ্রাণিত করতেন। (তারেক। মাসুদ পরিচালিত মুক্তির গান’ প্রামাণ্যচিত্রে স্বাধীন বাংলা শিল্পী গােষ্ঠীর সঙ্গে নাইনু আপাও রয়েছেন।) নাইনু আপাকে মনে হতাে কত সৌভাগ্যবান। তিনি বাংলাদেশে ফিরে যেতে পারছেন। তাঁর সাহসিকতায় আমরা মুগ্ধ হতাম। মনে হতাে, আমিও তাদের সংগীত দলে যােগ দিয়ে ফিরে যাই বাংলাদেশের বুকে। আমাদের ফ্ল্যাটটি প্রায় দিনই নানা মানুষের আনাগােনায় মুখরিত থাকত শুধু আব্দুরই দেখা পেতাম না।
ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও মন্ত্রিপরিষদের অন্য সদস্যদের পক্ষে তাদের প্রতিজ্ঞা পালন সম্ভবপর হলেও আল্লু তার প্রতিজ্ঞা অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিলেন। দেশ মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত তিনি। পারিবারিক জীবন যাপন করেননি। তিনি বলতেন ‘যুদ্ধরত অবস্থায় যােদ্ধারা যদি পরিবারবিহীন অবস্থায় থাকতে পারে আমি সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তা পারব না কেন? আব্বু মাঝে মাঝে আমাদের আটতলায় আসতেন এবং সােজা চলে যেতেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের ফ্ল্যাটে। তার সঙ্গে মিটিং করতেন। একবার আন্ধুর সঙ্গে হঠাৎ দেখা হয়ে গেল আমাদের ৮-তলার এলিভেটরের সামনে। তিনি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে নিবিষ্ট মনে আলাপ করতে করতে এলিভেটরের দিকে এগােলেন। আমি ও রিমি তখন অধীর আগ্রহে কাছাকাছি দাঁড়ানাে। তিনি আনমনে আমাদের দিকে একটুখানি হাত নেড়ে এলিভেটরে উঠলেন। ঘটাং ঘটাং শব্দ করে লােহার শিকওয়ালা পুরনাে আমলের এলিভেটর নিচে নেমে গেল। উত্তরবঙ্গ থেকে আগত একদল মুক্তিযােদ্ধার খাবার পরিবেশনের সময় তাদের একজন মারফত আম্মা একদিন জানলেন যে আল্লু অসুস্থ। আমরা আগাম খবর না দিয়ে ট্যাক্সি করে পরদিনই রওনা হলাম ৮ নম্বর থিয়েটার রােডের উদ্দেশে সাথে অধ্যাপিকা বদরুননেসা আহমেদ ও রতন ভাই। দৈবক্রমে সে দিনটি ছিল ১৯ আগস্ট। আমার ছােট বােন রিমির জম্মদিন। ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে (বর্তমানে সেক্সপিয়র সরণি) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মূল কার্যালয়। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী মুজিবনগর’। মুক্তিযুদ্ধের প্রাণকেন্দ্র। বিশাল গাছের আড়ালে আংশিক ঢাকা পুরনাে আমলের ভবনটিতে আমরা প্রবেশ করলাম প্রবল উৎসুক ভরা হৃদয়ে। সেখানে জানা-অজানা বহু মানুষের ভিড়। আমার সঙ্গে বারান্দা, হলঘর ও করিডাের অতিক্রম করে আব্দুর ঘরটিতে উঁকি দিয়ে দেখি তিনি ঘরে নেই। ঘরটি একাধারে আব্দুর অফিস, শয়নকক্ষ ও খাবারঘর হিসেবে ব্যবহৃত হতাে। ঘরের মধ্যে নামমাত্র আসবাবপত্র। ঘরের একধারে একটি চিকন খাট বিছানাে।
অপর পাশে একটি টেবিলভর্তি একরাশ কাগজপত্র ও দুটি চেয়ার পাতা। ঘরের সঙ্গে লাগােয়া বাথরুমের আধখােলা দরজার ফাক দিয়ে খুচখুচ’ ফিকে শব্দ ভেসে আসছে। আম্মা উদ্বিগ্ন হয়ে উঁকি দিতেই দেখেন যে আব্বু বাথরুমের মেঝেতে বসে একটি শার্ট কাচছেন। আব্দুর পরনে লুঙ্গি ও সাদা হাফহাতা গেঞ্জি। আমাদের সাড়া পেয়ে আব্বু ফিরে তাকাতেই দেখা গেল যে তার সাদা গেঞ্জির একাংশ রক্তে লাল হয়ে উঠেছে। ডায়বেটিসের রুগী। আলুর বুকে একটি ফোড়া উঠেছে এবং তা ফেটে যাওয়ায় এই অবস্থা তার শরীরেও বেশ জ্বর। আম্মার উদ্বিগ্ন ও দুঃখকাতর চেহারার দিকে তিনি ছুড়ে দিলেন তার স্বভাবসিদ্ধ স্মিত হাসি। যেন এমন কোনাে ব্যাপারই নয় এমনি হালকা স্বরে বললেন, যে সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডির সঙ্গে তাঁর আগামীকাল একটা কর্মসূচি রয়েছে। তাঁর আর শার্ট নেই। সে জন্য বাদামি রঙের ফুলহাতা একমাত্র শার্টটিকে তিনি কেচে দিচ্ছেন যাতে শুকিয়ে পরদিন পরতে পারেন। আমরা সকলেই মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলাম আব্বর মুখের দিকে। মনে মনে ভাবলাম এ কোন বাবা ? এ বাবা যে আমার ধরা-ছোঁয়ার বাইরে অনেক উর্ধ্ব জগতের এক মানুষ বাদামি রঙের ফুলহাতা ঐ একমাত্র শার্টটি পরেই তিনি রণাঙ্গন, মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প ও শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন এরপর আম্মা আব্দুর জন্য দুটি শার্ট কেনার ব্যবস্থা করলেন। আলুর সাথে মার্কিন সিনেটর কেনেডি ও ব্রিটিশ এম, পি ডগলাসম্যানসহ বেশ কিছু বিদেশি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের সাক্ষাৎ হয়। সাক্ষাতের জায়গাটি ছিল, যশােরের বেনাপােল সীমান্তের নিকটবর্তী, পশ্চিম বঙ্গের বনগা-হরিদাশপুর সীমান্তে। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা মাটিতে পুঁতে, বিদেশি প্রতিনিধিদের সাথে সাক্ষাৎকারগুলাে হতাে। আন্ধুর সাথে যেতেন বিএসএফের ইনসপেক্টর সৌমেন চ্যাটার্জি ও সাব ইনসপেক্টর বীর নারায়ণ বােস।” এই সাক্ষাৎগুলাের মাধ্যমে আন্ধু মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বিদেশি রাষ্ট্রগুলাের সমর্থন ও সহযােগিতা আদায়ের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখেন। এম. পি ডগলাসম্যান যুক্তরাজ্যর হাউস অব কমনসে বাংলাদেশের পক্ষে যে জোরালাে বক্তব্য রাখেন, তার অসাধারণ দিকটি ছিল এই যে বক্তব্যর যুক্তি ও তথ্যগুলােতে আব্দুর দেওয়া যুক্তি ও তথ্যরই প্রতিধ্বনি ছিল।
যুদ্ধের ঐ প্রতিকূল পরিবেশেও কোনাে লিখিত নােটস ছাড়াই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পয়েন্টগুলাে অত্যন্ত গুছিয়ে ও প্রাঞ্জল করে ডগলাসম্যানের কাছে আব্ব উপস্থাপিত করেছিলেন। যার ফলে বাংলাদেশের পক্ষে এই ব্রিটিশ এমপির আন্তরিক সমর্থন ও সহযােগিতা অর্জন সম্ভবপর হয়।” ২৫ মার্চ রাতে আমাদের বাড়ি থেকে যাদের পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তাঁদের সকলের ছাড়া পাওয়ার সংবাদ পেয়ে উৎফুল্ল হই। সেপ্টেম্বরে তারা মুক্তি পান অনেকটা অপ্রত্যাশিতভাবেই। পাকিস্তানি বাহিনীর শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় তাঁরা বন্দিদশা থেকে মুক্তি পান। ২৫ মার্চ রাতে যে দলটি তাদের বন্দী করে নিয়েছিল তারা যখন বদল হয়, তখন কোথা থেকে তাদের ধরে আনা হয়েছিল এই তথ্যটি নতুন দলের কাছে আর পৌছায়নি। যার ফলে তারা ছাড়া পান। আজিজ বাগমার প্রচণ্ড নির্যাতন ও দুর্দশা ভােগ করে মুক্তি পেলেন আরও পরে। সে অন্য এক ইতিহাস অক্টোবর মাস। এ মাসে মুক্তিযােদ্ধাদের অগ্রগতি পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্রতর হয়। এ মাসেই ঐ অবিস্মরণীয় মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতেই আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ সাম্যের কবি, বিদ্রোহের কবি, নারী জাগরণ ও মানব মুক্তির সংগ্রামে নিবেদিত কবি কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে তার স্বপ্ন ও আদর্শেরই এক জ্বলন্ত নিদর্শন ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। কবির জ্যেষ্ঠ পুত্র আবৃত্তিকার কাজী সব্যসাচী ও কনিষ্ঠ পুত্র গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ আসতেন আম্মার সঙ্গে দেখা করতে। একদিন সন্ধ্যায় আম্মাসহ আমাদের সব্যসাচী নিয়ে গেলেন তাঁদের বাড়িতে কবির সাথে সাক্ষাৎ করাতে। যে কবির রচনা, কাব্য আমাদের প্রেরণা জুগিয়েছে, রক্তে দোলা দিয়েছে, নিঃশ্বাসে এনেছে মুক্তির ঝঙ্কার সেই কবির সঙ্গে দেখা হবে! আনন্দে আমরা আত্মহারা। বাহুল্যবর্জিত এক সাধারণ সরকারি ফ্ল্যাটে কবি তার পুত্র, পুত্রবধূ, নাতি ও নাতনিসহ থাকেন। তার ঘরে ঢুকে দেখি খাটের ওপর তিনি বসা নির্বাক হয়ে। শুনেছি কবি মানসিকভাবে অসুস্থ। কিন্তু এতখানি! আম্মা একরাশ ফুল নিয়ে গিয়েছিলেন, কবির হাতে তিনি তুলে দিলেন সেই ফুল। কিছু পাপড়ি ছড়িয়ে পড়ল তাঁর খাটের ওপর কবি ফ্যালফ্যাল করে আম্মার দিকে চেয়ে রইলেন।
তাঁর টানা টানা উৎসুক চোখ দুটি যেন কিছু বলতে চাইছে। কিন্তু বলা হলাে না। আমাদের নিয়ে আসা একরাশ ফুলের মাঝে তিনি বসে রইলেন নির্বাক হয়ে। পরাধীনতা, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, নারী নিষ্পেষণ ও সকল প্রকার অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে যার অগ্নিঝরা কবিতা ও গান জুগিয়েছে বৈপ্লবিক প্রেরণা, সেই কবি ফুলের শয্যায় নীরব রইলেন। এবারে কবির পাশে আম্মা বসে তার দুটি হাত ধরে আমন্ত্রণ জানালেন স্বাধীন বাংলাদেশে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য। আম্মা বললেন যে, মুক্তির কবি তার পরিবারসহ আমন্ত্রিত মুক্ত বাংলাদেশে। আম্মার কথা শুনে কবি হঠাৎ হুম করে হুঙ্কার দিলেন। যেন তিনি গ্রহণ করেছেন সেই আমন্ত্রণ ভেবে দেখুন, দেশ তখনাে শত্রুমুক্ত হয়নি। তার পরও কতখানি প্রত্যয়ের সঙ্গে আম্মা আমন্ত্রণটি দিয়েছিলেন। ভারতের বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ছবিসহ আম্মার সঙ্গে কবির সাক্ষাতের সংবাদটি প্রকাশিত হয়েছিল। আম্মার আমন্ত্রণটি একদিন বাস্তব রূপ লাভ করে। বঙ্গবন্ধু, মােস্তফা সারােয়ার প্রমুখের উদ্যোগে কবি তার পরিবারসহ ১৯৭২-এর ২৫ মে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। কবির সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের দিনটিতেই রিমি ও আমার সমবয়সী কবির দুই নাতনি মিষ্টি ও খিলখিলের সঙ্গে ভাব হয়ে যায়। ‘৭১-এর প্রবাসজীবনের সেই দিনগুলাে আমাদের অধিকাংশ সময় ঘরেই কাটত এরই মধ্যে কবির সঙ্গে সাক্ষাতের পর তার বাড়িতে আমাদের দুজনের যাতায়াত শুরু হয়। সব্যসাচী মাঝে মাঝে মিষ্টি ও খিলখিলকে নিয়ে আসতেন আমাদের ফ্ল্যাটে ফ্ল্যাটের সামনে লম্বা টানা করিডােরে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম কখনাে আমাদের রিকশায় করে নিয়ে যেতেন তাদের ক্রিস্টোফার রােডের সিআইটি বিল্ডিংয়ের ৪ নম্বর ফ্ল্যাটে। কবির পাশে বসে ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’ গানটি গাইতাম। তিনি সুদূরে দৃষ্টি মেলে, তন্ময় হতেন। কখনাে বা হুঙ্কার দিয়ে উঠতেন। তাঁর হাতে কাগজ দিলে তিনি আনমনাভাবে তা ছিড়ে কুটিকুটি করতেন। মিষ্টি ও খিলখিলের মা কবির সার্বক্ষণিক সেবা-যত্ন করতেন। তাঁর জন্য নিজ হাতে খাবার রাঁধতেন।
আমরা বেড়াতে গেলে খুব আপ্যায়ন করতেন। কাজের ফাকে ফাকে তিনি জিজ্ঞেস করতেন বাংলাদেশের কথা। ঘরে ফিরে আমাদের সময় কাটত গতানুগতিকভাবে। কখনাে স্কুলের বই-খাতা, যা আম্মা কলেজ স্ট্রিট থেকে কিনে দিয়েছিলেন, সেগুলােকে নিরুৎসাহ ভরে নাড়াচাড়া করে, গােগ্রাসে গল্পের বই পড়ে এবং বিপুল আগ্রহভরে স্বাধীন বাংলা বেতারের অনুষ্ঠান শুনে। আগেই উল্লেখ করেছি যে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখা নালক’ গল্পটি আমাকে ধ্যানভ্যাসে অনুপ্রাণিত করে। দেবল ঋষির বালক শিষ্য নালকের জীবনের মধ্যে দিয়েই গৌতম বুদ্ধের জীবনকাহিনি বর্ণিত হয়। গ্রাম্য কিশােরী সুজাতার হাতে করা পায়েশ খেয়ে সিদ্ধার্থ গৌতম বুদ্ধ ধ্যানে বসলেন। পাশে নদী। ভরা পূর্ণিমার রাত প্রাচীন মহীরুহের নিচে ধ্যানমগ্ন তিনি। অসত্য অন্ধকারের অধিবাসী মার, মরিয়া হয়ে আক্রমণ করল সিদ্ধার্থকে। ভয়, ছলনা ও প্রলােভন দিয়ে সে সিদ্ধার্থের ব্রত ভাঙাবার চেষ্টা করল, কিন্তু সিদ্ধার্থ অনঢ়, অটল। সে ব্রত নিয়েছে সিদ্ধ না হয়ে, বুদ্ধ না হয়ে, সে তার ধ্যানাসন ত্যাগ করবে না। জয় হলাে দৃঢ় সংকল্পের সত্যের কাছে মার পরাজিত হয়ে পলায়ন করল। সিদ্ধার্থ গৌতম বােধিপ্রাপ্ত হলেন। তিনি হলেন বুদ্ধ। সজাগ ও আলােকপ্রাপ্ত। পাঁচ বছরের ছােট বােন মিমি, যে ছিল আমার ধ্যানের সাথি, তার ওপর চলত আমার পরীক্ষানিরীক্ষা। মাঝে মাঝে ওকে ঘরে রেখে, বাইরের জানালা দিয়ে লক্ষ রাখতাম। ঠিক মতাে ধ্যান করছে, না ফাকি দিচ্ছে তারই পরীক্ষা। ছােট মিমি একটু পরপরই চোখ পিটপিট করে তাকাত, একনাগাড়ে পাঁচ মিনিট সে যদি চোখ বন্ধ করত, তাকে তখন পুরস্কৃত করতাম মজার কোনাে গল্প বলে। একমাত্র ছােট ভাই সােহেলকে নিয়ে চলত আমাদের নানা খেলা। সােহেলের দুই হাত ধরে পায়ের ওপর দাঁড় করিয়ে ছড়া বলে নাচালে সে ভীষণ মজা পেত। ঘােড়া সেজে তাকে পিঠে। চড়িয়ে ঘরময় ঘুরে বেড়াতাম, বাইরের কোনাে মানুষ দেখলেই সে আধাে স্বরে মিষ্টি করে বলত, ‘জয় বাংলা’।
৪৫-৭৪
সেতুবন্ধন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন প্রশাসন ছিল সম্পূর্ণভাবেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরােধী এবং পাকিস্ত গনের স্বৈরাচার সামরিক সরকারের বর্বর কর্মকাণ্ডের অন্ধ সমর্থক ও সহায়তাকারী। কিন্তু মার্কিন ডেমােক্র্যাট মেজরিটি কংগ্রেস ছিল মুক্তিযুদ্ধের প্রতি সহানুভূতিশীল। কংগ্রেসম্যান কর্নেলিয়াস গ্যালাঘের (Gallagher) কংগ্রেসে প্রদত্ত তার বস্তুনিষ্ঠ রিপাের্টে (৩ আগস্ট, ‘৭১) বলেন,
সন্ত্রাস সকল সময় মানুষকে দাবিয়ে রাখতে পারে না। তা কখনােই তাদের বিশ্বস্ততা ও • সহানুভূতিকে জয় করে না। তা শুধু স্বৈরাচার যার অধীনস্ত তাদের করা হয়েছে, তা বন্ধ করার জন্য এবং তাদের জীবন, তাদের সম্মান ও স্বাধীনতার জন্য সংকল্পকে জোরদারই করে থাকে। সন্ত্রাস যতখানি পাশবিক হবে প্রতিরােধও ততখানি দৃঢ় হবে। পূর্ব পাকিস্তানে আজ সে ধরনেরই যুদ্ধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। আমাদের সামনে একটা নতুন ভিয়েতনাম ঘটতে যাচ্ছে; …পাকিস্তান তার বর্তমান আকারে টিকতে পারবে না। তার কারণ আমরা পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র ভারতকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। আমরা পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি মানুষকে দূরে সরিয়ে দিচ্ছি। একটি বেপরােয়া সরকারের বর্বর কর্মকাণ্ডের সঙ্গে নিজেদের সংযুক্ত করে আমরা মানুষ হিসেবে আমাদের মানবতাবাদী, মুক্ত এবং মুক্তিপ্রিয় ভাবমূর্তিকে কলঙ্কিত করছি।” | ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভার সদস্যদের শপথ গ্রহণ দিবসে প্রদত্ত ভাষণে আন্ধু দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছিলেন, পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনােবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রকে লালিতপালিত করছেন। দুনিয়ার কোনাে জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হােক কাল হােক দুনিয়ার ছােট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে। স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে। আব্দুর সেদিনের আত্মপ্রত্যয়ী ও স্বাধীনতার প্রশ্নে আপসহীন বক্তব্যের যেন। সুস্পষ্ট আভাস দেখতে পাওয়া যায় কংগ্রেসে গ্যালাঘেরের প্রদত্ত উপরােক্ত রিপাের্টের ৫ অনুচ্ছেদে।
The war of East Pakistani’s Liberation and Independence may already be too far gone for a settlement short of independence through the processes of political conciliation and negotiation. সিনেটের শরণার্থীবিষয়ক সাব-কমিটির সভাপতি সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি একাত্তরের ২৬ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রদত্ত এক মর্মস্পর্শী ভাষণে অকাট্য তথ্য ও যুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন। তার এই আন্তরিক ভাষণে তিনি নিজ সরকারেরও কড়া সমালােচনা করেন যেটি ৮ সেপ্টেম্বর ‘৭১-এ কংগ্রেসের রেকর্ডভুক্ত হয়। পাকিস্তানের সামরিক সরকারের নির্দেশে নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালিদের ওপর যে ভয়াবহ গণহত্যা শুরু হয়েছিল তার স্মৃতিকে সুপরিকল্পিতভাবেই বাংলাদেশের তরুণ মানস থেকে মুছে ফেলার প্রয়াস নিয়েছে স্বাধীনতা বিরােধী গােষ্ঠী। বর্তমান বিশ্বরাজনীতিতে অপ্রতিদ্বন্দ্বী পরাশক্তি, স্বৈরাচারী, সামরিক ও একনায়কবাদী সরকার, ধর্মীয় ও কর্পোরেট মৌলবাদী শক্তির সহায়তাকারী যুক্তরাষ্ট্র সরকারের উত্তরােত্তর বৃদ্ধি পাওয়া দপূর্ণ আচরণ, অমানবিক ও সাম্রাজ্যবাদী ভূমিকার প্রেক্ষিতে ও গণহত্যার দলিলরূপে কেনেডির সুদীর্ঘ বক্তব্যের কিছু অংশ এখানে প্রাসঙ্গিক। (অনুবাদ লেখকের) : ‘আমি জাতীয় প্রেসক্লাবের সদস্যদের কাছে কৃতজ্ঞ, আমার এক সপ্তাহব্যাপী ভারতের। শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের অভিজ্ঞতা যার দৃশ্যকে আধুনিক কালের সবচেয়ে মর্মান্তিক মানষ দুর্দশার ঢেউ হিসেবে বর্ণনা করা যায়, সে সম্বন্ধে বলার সুযােগ দেওয়ার জন্য। [ওয়াশিংটন পােস্টের ২৯ জুলাই ‘৭১-এর রিপাের্টে আন্তর্জাতিক ত্রাণকমিটির প্রধান অ্যানজিয়ার বিডল ডিউকের (Angier Biddle Duke) ভবিষ্যদ্বাণী যাতে তিনি ঐ বছরের শেষ নাগাদ শরণার্থীদের সংখ্যা ১ কোটিতে পৌছবে বলে উল্লেখ করেন। – লেখক। এই পুরাে দুঃখজনক ঘটনা পৃথিবী এখনাে অনুধাবন করেনি। আমি আপনাদের বলতে পারি যে আপনারা নিজেরা সরাসরি ঘটনাটি না দেখা পর্যন্ত এর বিশালতাকে অনুধাবন করতে পারবেন না। ভারতে, পূর্ব বাংলার সীমান্তবর্তী পুরাে এলাকা – পশ্চিমে কোলকাতা এবং পশ্চিম বাংলা থেকে উত্তরে জলপাইগুড়ি ও দার্জিলিং ডিস্ট্রিক্ট এবং পূর্বে ত্রিপুরা প্রদেশের আগরতলার শরণার্থীদের এলাকাগুলাে আমি পরিদর্শন করেছি। আমি ক্যাম্পে জড়াে হওয়া অগণিত শরণার্থীদের কথা শুনেছি। এরা খােলা মাঠ বা গণদালানের পেছনের অস্থায়ী আশ্রয়স্থলে বেঁচে থাকার সংগ্রাম করছিল অথবা মরিয়া হয়ে পালানাের জন্য দিনের পর দিন এমনকি সপ্তাহের পর সপ্তাহ তারা পশ্চিম বঙ্গের রাস্তার পথে হাঁটছিল। তাদের চেহারা ও তাদের কাহিনি এক লজ্জাজনক লােকগাথার মধ্যে খােদিত, যার ফলে বিশ্বজোড়া মানুষের নৈতিক চেতনাবােধ আপ্লুত হওয়াই উচিত। .আপনারা শিশুদের দেখতে পাবেন, যাদের ছােট্ট হাড়গােড়ের ওপর তাদের চামড়া ঝুলে রয়েছে-তাদের মাথা তোলারও শক্তি নেই। এই সব শিশু আর কখনােই সুস্থ হবে না এই ভাবনায় তাদের অভিভাবকদের চোখে আপনারা হতাশাগ্রস্ত দৃষ্টি দেখবেন। সবচেয়ে কঠিন হলাে মাত্র পূর্বরাতেই মৃত্যুবরণ করা শিশুর লাশ অবলােকন করা। …তদুপরি সীমান্তবর্তী বহু ভারতীয় নাগরিকের গ্রামও পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর শেলের আক্রমণের মধ্যে পড়ে। ভারত সরকার যখন এই মানব দুর্দশার স্রেতি তার সীমান্ত অতিক্রম করতে দেখল সে তখন তার এলাকায় বেষ্টনী দিয়ে শরণার্থীদের প্রবেশ প্রত্যাখ্যান করতে পারত। কিন্তু ভারতের চিরস্থায়ী কৃতিত্ব যে সে করুণার পথ বেছে নিয়েছে। শরণার্থীদের সাহায্য ও বান্দোবস্তের জন্য ভারত সরকার বিরাট প্রচেষ্টা নিয়েছে-যা ইতিহাস লিপিবদ্ধ করবে এবং স্মরণ করবে।…৩৫ বছরের অভিজ্ঞতাসম্পন্ন এক ৫৫ বছর বয়সী বেসামরিক রেলওয়ে কর্মচারী এবং সে মুসলিম, ভরদুপুরে তার রেলরােডের স্টেশনের ওপর পাকিস্কানি সেনাদের অর্থহীন আক্রমণের কথা আমাকে জানাল। সে বলল, আমি জানি না তারা কেন আমাকে গুলি করল। আমি কোনাে রাজনৈতিক দলভুক্ত নই। আমি একজন রেলওয়ে ক্লার্ক মাত্র।’ .আরও দুঃখজনক হলাে নির্দোষ ও অশিক্ষিত গ্রাম্য অধিবাসীদের অভিজ্ঞতার বর্ণনা। দুর্ভাগ্যক্রমে দক্ষিণ এশিয়ায় আমেরিকার বর্তমান চেহারা, অতীতের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া থেকে তেমন ভিন্ন নয়। এই ভাবমূর্তিটি সেই আমেরিকার যে সামরিক নিষ্পেষণকে সমর্থন করে এবং সামরিক সন্ত্রাসে ইন্ধন জোগায়। এই ভাবমূর্তিটি সেই আমেরিকার যে স্বাচ্ছন্দ্যে স্বেচ্ছাচারী সরকারের সঙ্গে মিল স্থাপন করে। .আমেরিকানদের জন্য এই বিশাল মানব দুর্দশার কারণ জানার এখুনি সময়…পূর্ববাংলার জন্য ইস প্রথম হতেই ছিল আত্মনির্ধারণ এবং গণতান্ত্রিক নীতিমালা। পশ্চিম পাকিস্তানের বহু বছরের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্য,-দীর্ঘ সামরিক শাসন এবং নির্বাচনের অপূর্ণ প্রতিজ্ঞার পর-শেষ পর্যন্ত গত ৭ ডিসেম্বর অবাধ নির্বাচন পূর্ব পাকিস্ত। েিন অনুষ্ঠিত হয় ।…এই নির্বাচনে পূর্ব বাংলার আওয়ামী লীগ দল এবং তার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি ভােট পেয়ে ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। এভাবেই জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে বেসামরিক গণতান্ত্রিক শাসন পদ্ধতিতে প্রত্যাবর্তন করার জন্য নতুন সংবিধানের খসড়া প্রণয়নের দায়িত্ব পায়। কিন্তু তারপর যা ঘটল, তা বিল ও ধোকাবাজিরই নমুনা এবং সামরিক শাসনকে পুনরায় আহ্বান করা হলাে। স্বায়ত্তশাসনের লক্ষ্যে ছয় দফার প্রস্তাবটি নিয়ে শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার মধ্যে আপস-মীমাংসা মন্থর গতিতে চলতে থাকল এবং তার অবনতিও ঘটল-২৫ মার্চ রাতে সন্ত্রাস ও রক্তপাতের মধ্য দিয়ে যার হঠাৎ বিস্ফোরণ ঘটল। পূর্ব বাংলার এই অবস্থায় আমেরিকানদের বিশেষ করে মর্মপীড়া হওয়া উচিত। কারণ আমাদের সামরিক যন্ত্রপাতি আমাদের বন্দুক ও ট্যাংক এবং প্লেন, যা এক যুগের বেশি সময় ধরে প্রেরণ করা হচ্ছে তা নিদারুণ দুর্দশাকে লক্ষণীয়ভাবে বৃদ্ধি পেতেই সহায়তা করছে। আরও বেদনাদায়ক ব্যাপার হলাে যে আমাদের দেশের উচ্চতম স্থানে অধিষ্ঠিত কর্মকর্তাদের নির্দেশেই সামরিক রসদগুলাে চালান দেওয়া হচ্ছে বলে প্রতীয়মান হয়। আমেরিকার সামরিক রসদ নিয়ে পাকিস্তানি জাহাজ পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে অবিরত আমেরিকার বন্দর ত্যাগ করছে। এই ব্যাপারগুলাে খুবই লজ্জাকর ও দুঃখজনক। কেননা, এগুলােকে কলমের একটি সহজ খোচায় নিবৃত্ত করা যেত। আপনারা হয়তাে বলবেন যে এটি আমাদের কোনাে বিষয় নয় যে জড়াতে হবে। বিশ্বের দারােগাগিরি আমরা করতে পারি না। তা হয়তাে সঠিক। কিন্তু শীতল সত্য হলাে যে আমরা পূর্ব বাংলায় ইতােমধ্যেই জড়িয়ে গিয়েছি। আমাদের অস্ত্র জড়িয়ে গিয়েছে। আমাদের অর্থ – যা বিগত দুই দশক যাবৎ অর্থনৈতিক সাহায্য হিসেবে বিনিয়ােগ করা হয়েছে, তাও বিজড়িত। প্রশ্ন এটি নয় যে আমরা জড়াব কি না বরং কীভাবে জড়াব। এটি প্রশ্ন নয় যে, আমরা তহবিল হতে অর্থ ব্যয় করব কিনা, বরং আমরা কীভাবে ব্যয় করছি। আমরা কি আরও অন্ত্রের জোগান দিচ্ছি নাকি জনহিতকর কর্মসূচি যা শান্তি এবং প্রচণ্ড বিপদগ্রস্ত এলাকায় উপশম আনতে পারে তাতে বিনিয়ােগ করছি।” স্বাধীনতার জন্য পূর্ব বাংলার বাঙালিদের ব্যাকুল বাসনাকে লক্ষ করে সত্য ও সমবেদনার দীপ্তিতে উদ্ভাসিত এই অনন্য বক্তব্যটির ইতি কেনেডি টেনেছিলেন বাঙালির গর্ব বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গীতিকাব্য হতে উদ্ধৃতি দিয়ে : চিত্ত যেথা ভয়শূন্য, উচ্চ যেথা শির,
জ্ঞান যেথা মুক্ত, যেথা গৃহের প্রাচীর।’ জাতীয় প্রেসক্লাবে প্রদত্ত কেনেডির এই ভাষণটি দীর্ঘ ৩৯ বছর পরও তার প্রাসঙ্গিকতা। হারায়নি। তাঁর বক্তব্যের একটি বিশেষ অনুচ্ছেদে আমার চোখ বারবারই ঠেকে গিয়েছে। কোনাে ব্যক্তির নাম না উল্লেখ করলেও বাংলাদেশের দুর্যোগে মার্কিন সরকারের করণীয় কী, এ প্রসঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি আওয়ামী লীগের এক কর্মকর্তার মন্তব্য তার মনে এতখানিই রেখাপাত করে যে তিনি মন্তব্যটিকে তার বক্তব্যের মধ্যে তুলে ধরেন। কেনেডি বলেন, পূর্ব বাংলার নেতৃবৃন্দ যাদের সঙ্গে আমি আলাপ করেছি এবং যারা বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের অঙ্গ তাদের কষ্ঠে পরিহাস ব্যক্ত হয়েছে, এই নেতৃবৃন্দ আমেরিকায় আসবেন না সাহায্য চাওয়ার জন্য। একজন আওয়ামী লীগ কর্মকর্তা এভাবে বললেন, বহু রাষ্ট্র এবং বহু মানুষ আমেরিকায় আসে বিলিয়ন ডলার চাওয়ার জন্য, যা দিয়ে আরও অস্ত্র, আরও রসদ সংগ্রহ করবে। আমরা বাঙালিরা শুধু এটুকুই চাই যে তােমরা কোনাে কিছুই জোগান দিয়াে না। না অস্ত্র, অর্থ, কোনাে পক্ষকেই নয় তােমরা যেন শুধু নিরপেক্ষতা অবলম্বন করাে।’ ১৯৭১ সালে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, মুস্তফা সারওয়ার, ড. স্বদেশ বােস ও ড. এ. আর, মল্লিকসহ আরও কয়েকজন কেনেডির সঙ্গে কোলকাতায় সাক্ষাৎ করেছিলেন। কেনেডির। বক্তৃতায় উল্লিখিত উক্তিটি বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কে করেছিলেন জানার জন্য আমি। যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফোনে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের সঙ্গে ঢাকায় কথা বলি (২৫ ডিসেম্বর, ২০০৬)। তিনি জানালেন যে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রিন্সিপাল এড হিসেবে কেনেডির কাছে তিনিই এ উক্তিটি করেন। আমীর-উল ইসলাম বললেন, ওই উক্তিটি তাজউদ্দীন ভাইয়ের চিন্তাধারার সঙ্গে একাত্ম ছিল।’ | একটি জাতির সবচেয়ে বড় সম্পদ হলাে আত্মমর্যাদা যার বিকাশ সম্ভবপর হতে পারে। আত্মমর্যাদাশীল ন্যায়পরায়ণ সবল নেতৃত্বের গুণে। গণহত্যার শিকার যুদ্ধরত, হতদরিদ্র, সমস্যার ভারে জর্জরিত ‘৭১-এর বাংলাদেশ আশ্চর্য প্রত্যয়ে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের প্রতিনিধির কাছে তুলে ধরেছিল বাংলাদেশের হৃদয়, যার পুরােটাই গৌরবমণ্ডিত আলাের আভায় ভরপুর। . যুক্তরাষ্ট্র সরকারের এক প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর ও শাণিত বিবেকের প্রতিমূর্তি ঢাকার কনসাল। জেনারেল আর্চার ব্লাড, যিনি বাংলাদেশে নিযুক্ত বিশজন মার্কিন কূটনীতিকের স্বাক্ষরসহ পাকিস্ত। েিনর প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের অনৈতিক সমর্থনের তীব্র প্রতিবাদ করেন ও বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধের। জন্য মার্কিন প্রশাসনের কর্মপন্থার পরিবর্তন দাবি করে কড়া চিঠি পাঠিয়েছিলেন (৬ এপ্রিল। ১৯৭১-এ আর্চার ব্লাডের পাঠানাে টেলিগ্রামটি স্টেট ডিপার্টমেন্টে পৌছলে আরও নয় জন। উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা তাতে স্বাক্ষর করেন। এরপর তাকে নিক্সন ও কিসিঞ্জার শাস্তিস্বরূপ অবিলম্বে ওয়াশিংটনে ডেকে পাঠান। শুধু তাই নয় গণহত্যার এক পর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার, গণহত্যাকারী জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পাঠানাে বার্তায় ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন তার তথাকথিত কৌশলপূর্ণ ও কোমল আচরণের জন্য। | একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে দাঁড়িয়ে আমি যুক্তরাষ্ট্রকে আবিষ্কার করি নানা রঙে। অমানবিক আমেরিকা ও মানবিক আমেরিকা; উৎপীড়কের সহায়ক আমেরিকা ও আর্তের দুঃখে । দরদি আমেরিকা। যুক্তরাষ্ট্রের পরস্পর-বিরােধী আচরণের মধ্যে দিয়েই যেন মানব-প্রকৃতি। সম্বন্ধেও ধারণা গড়ে উঠতে শুরু করে। সাদা ও কালাের সরল বিভাজন অতিক্রম করে শুরু হয় বর্ণালি রং খোঁজার পালা। | বাঙালির ন্যায়ভিত্তিক মুক্তি সংগ্রামের পক্ষে যুক্তরাষ্ট্রের অরাজনৈতিক সংগঠনগুলােও অনন্য। ভূমিকা রাখে। জগৎবিখ্যাত সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশংকরের অনুরােধের প্রতি সম্মান ও সমর্থন জানিয়ে বিটলস-এর বিশ্ব নন্দিত শিল্পী জর্জ হ্যারিসন বাংলাদেশের জন্য কনসার্টের আয়ােজন। করেন। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্কের ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনের জনসমুদ্রে The Concert for Bangladesh নামের এই অভূতপূর্ব সংগীত অনুষ্ঠানটি ছিল আমেরিকার । ইতিহাসের সর্ববৃহৎ চ্যারিটি কনসার্ট। নামীদামি সেলিব্রেটির সমন্বয়ে অনুষ্ঠিত এই বিশাল কনসার্টটি ছিল পরবর্তীকালের ইথিওপিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা প্রভৃতি খ্যাতনামা চ্যারিটি। কনসার্টগুলাের পথিকৃৎ। জর্জ হ্যারিসনের উপস্থাপনায় পণ্ডিত রবিশংকর, ওস্তাদ আলী আকবর। খান, ওস্তাদ আল্লারাখা, শ্রীমতি কমলা চক্রবর্তী, বব ডিলান, বিলি প্রেস্টন, লিয়ন রাসেল, রিংগােস্টার, এরিক ক্ল্যাপটন প্রমুখ নিবেদিত শিল্পী এই কনসার্টে যন্ত্র ও কণ্ঠসংগীত পরিবেশন। করে শ্রোতাদের বিমােহিত করেন। জর্জ হ্যারিসন তাঁর স্বপ্নিল চোখ মেলে আবেগ ভরা কণ্ঠে। বাংলাদেশের জন্য গান গেয়ে লক্ষ-কোটি মুক্তিকামী বাঙালির হৃদয়ে চিরস্থায়ী আসন গড়ে নেন। জর্জ হ্যারিসনের কথা ও সুরে গাওয়া, বাংলাদেশ’ গানটির মাধ্যমে মুক্তি সংগ্রামরত বাংলাদেশ সারা বিশ্বে নিমেষেই ব্যাপক পরিচিতি লাভ করে। শিল্পীরা যখন তাদের জনপ্রিয়তাকে মানবাধিকার ও মানবিক কর্মকাণ্ডে নিবেদন করেন, তা কতখানি সার্থকতা লাভ করতে পারে তার প্রমাণ এই বাংলাদেশ কনসার্ট। এই কনসার্ট থেকে উপার্জিত আড়াই লাখ ডলার দান করা হয় জাতিসংঘের (UNICEF) শিশু তহবিলে – ভারতীয় শরণার্থী শিবিরে মরণাপন্ন ও রােগাক্রান্ত বাংলাদেশি শিশুদের কল্যাণে। বাংলাদেশ কনসার্টের সাফল্যে অণুপ্রাণিত হয়ে ‘জর্জ হ্যারিসন ফান্ড ফর ইউনিসেফ’ প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশি শিশুসহ বিশ্বের সকল শিশুদের সাহায্যার্থে। | ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ জোরগতিতে এগিয়ে চলছে অধিকাংশ মানুষের প্রাণঢালা সাহায্য, সমর্থন ও সহযােগিতার মধ্য দিয়ে। আমাদের ছােট ফ্ল্যাটটিতে মানুষ অবিরত আসছে নিত্যনতুন খবর নিয়ে। শুধু আন্ধুর কাছ থেকেই কোনাে খবর নেই। তাঁর সঙ্গে আবার কবে দেখা হবে সে সম্বন্ধেও আমরা অনিশ্চিত। এর মধ্যেই হঠাৎ আমাদের অবাক করে দিয়ে আৰু উপস্থিত হলেন আমাদের দুই রুমের ছােট ফ্ল্যাটটিতে। উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে সৈয়দ নজরুলের সঙ্গে সভা শুরু হওয়ার বেশ আগেই তিনি চলে এলেন আমাদের কাছে। আমাদের শশাবার খাটের ওপর জড়াে হয়ে বসে আমরা মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে শুনলাম আব্দুর সীমান্ত পাড়ি দেওয়ার কাহিনি। আমার ও রিমির কৌতুহলী প্রশ্নেরও তিনি উত্তর দিলেন তার স্বভাবসিদ্ধ নম্রতা ভরা কষ্ঠে। শৈশবের প্রারম্ভে তার কাছে শােনা রূপকথা ও লােককাহিনির চেয়েও আকর্ষণীয় মনে হলাে তাঁর বিজয়ের পথে যাত্রার শিহরণ জাগানাে কাহিনি। (এই বিবরণের কিছু অংশে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের বর্ণনা ও প্রাসঙ্গিক রেফারেন্স যােগ করা হয়েছে।) ২৫ মার্চ রাতে আম্মা বাগানের ঝােপের আড়াল থেকে দেখেছিলেন যে আন্ধুকে নিয়ে গাড়িটি আমাদের বাড়ির সামনের সাতমসজিদ সড়কের ডানদিকে জিগাতলার দিকে ছুটে যায় এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই আর একটা গাড়ি ঘুরে এসে আবার আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে বাঁ দিকে লালমাটিয়ার দিকে সাঁ করে মিলিয়ে যায়। জিগাতলার কাছাকাছি ১৩ নম্বর সড়কে ড. কামাল হােসেন তার এক আত্মীয়ের বাড়িতে নেমে পড়েছিলেন। পরে তিনি পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দী হয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তরিত হন সুদীর্ঘ নয় মাস বন্দি থাকা অবস্থায় তার ওপর পাকসেনারা প্রচণ্ড মানসিক নির্যাতন চালায়। আল্লু ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লালমাটিয়ায় রেলওয়ের সাবেক চিফ ইঞ্জিনিয়ার গফুর সাহেবের বাড়িতে আশ্রয়গ্রহণ করেন। তারা সেখানে আশ্রয় নেওয়ার ৫/৭ মিনিটের মধ্যেই পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয়। চারদিকে ব্রাশফায়ারের শব্দ এবং মানুষের মরণ আর্তনাদে কেঁপে কেঁপে ওঠে। মধ্যরাতের আকাশ ভরে যায় আগুন ও কালাে ধোঁয়াতে। এইসময় আন্ধু কেঁদে ফেলেন মুজিব কাকুর কথা ভেবে। তিনি বলেন, ‘এবার দস্যুরা ৩২ নম্বর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে হামলা করছে। | গফুর সাহেবের বাড়িতে যদি তল্লাশি শুরু হয় তখন আল্লু নিজেকে পরিচয় দেবেন গফুর সাহেবের ঠিকাদার মহম্মদ আলী হিসেবে। আমীর-উল ইসলাম হবেন গফুর সাহেবের ভাতিজা। নাম রহমত আলী। এই তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তটি নিয়ে তারা প্রস্তুত হলেন বিপদের মােকাবিলায় । গফুর সাহেবের বাড়ির ছাদের ওপরে নিজেদের আড়াল করে তারা দেখলেন তাণ্ডবলীলা। পরে তারা অন্য বাড়িতে আত্মগােপন করার প্রাক্কালে পাকিস্তানি সৈন্যের হাতে লালমাটিয়ার পানির। ট্যাংকের নিরাপত্তা প্রহরীকে প্রহৃত হতে দেখলেন। ট্যাংকের পানি সরবরাহ করানাের জন্য এই প্রহার। আব্বদের আত্মগােপনের স্থানটি ছিল মােহাম্মদপুরের অবাঙালি বিহারি-অধ্যুষিত এলাকার কাছেই। তারা মুখে রুমাল বাঁধা ও মাথায় উর্দি পরা বিহারিদের পার্শ্ববর্তী বস্তিতে আগুন ধরিয়ে দিতে দেখলেন। আগুন থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বস্তির নারী-পুরুষ ও শিশুরা তাদের ঝুপড়ি থেকে বেরিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গেই তাদের ওপর চলল পাকিস্তানি সেনাদের অবিরাম ব্রাশফায়ার। অসহায় ও নিরপরাধ মানুষের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের বর্বরতা প্রত্যক্ষ করে (পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে উদ্দেশ করে আন্ধু সেদিন মন্তব্য করেছিলেন এরা হারবে।’ ২৭ মার্চ সকালে কারফিউ তুলে নেওয়া হয় দেড় ঘন্টার জন্য। এই সময় আন্ধু দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলেন যে সাতমসজিদ রােড পার হয়ে রায়ের বাজারের পথ দিয়ে শহর ত্যাগ করবেন। লুঙ্গি, পাঞ্জাবি, মাথায় সাদা টুপি পরিহিত ও হাতে লোেক দেখানাে বাজারের থলির আড়ালে কোমরে গোঁজা পিস্তল আড়াল করে আন্ধু চললেন গ্রামের উদ্দেশে। গফুর সাহেবের বাসায় অতিকায় রাইফেলটিকে ফেলে যেতে হয়। তিনি সেটি প্লাস্টিক মুড়ে মাটিতে পুঁতে রাখেন। আমাদের বাড়ির কাছাকাছি এসে তার ভীষণ ইচ্ছা হচ্ছিল আম্মাসহ ৰাড়ির সকলের খবর নেওয়ার। তারা। কি বেঁচে রয়েছেন না সেনাবাহিনীর হাতে মৃত্যুবরণ করেছেন! এই চিন্তাটা ব্যক্ত করার পর দুর্গম পথের সাথি আমীর-উল ইসলাম প্রচণ্ড আপত্তি জানালেন। এই কাজটায় রয়েছে প্রচণ্ড ঝুঁকি। আন্ধুও সিদ্ধান্ত পাল্টালেন। এই মানবিক দুর্বলতাকে তিনি ঝেড়ে ফেললেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির স্বার্থে। বাংলার গ্রামেগঞ্জে ও পথের প্রতি বাঁকেই তারা পেলেন মানুষের প্রাণঢালা ভালােবাসা, আদর ও আপ্যায়ন। এরই মধ্যে বাবুবাজার পুলিশ ফাঁড়ির কনস্টেবল রুস্তমের সঙ্গে তাঁদের দৈবাৎ দেখা হয়ে যায়। ঐ ফাঁড়িতে পাকিস্তানি সেনারা আক্রমণ চালিয়ে ঘুমন্ত পুলিশ কনস্টেবলদের গুলি করে হত্যা করেছে। সে কোনাে মতে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছে। রুস্তম আন্ধুদের কাছে সে ঘটনা বর্ণনা করে।
ঢাকা ছেড়ে বিভিন্ন গ্রামগঞ্জের ভেতর দিয়ে যাওয়ার পথে ২৮ মার্চ রাতে পদ্মার তীরবর্তী। এম আওরঙ্গবাদে শুকুর মিয়া নামের আওয়ামী লীগের এক কর্মীর বাড়িতে তারা আশ্রয় নেন। এই বাড়ির সকলেই তাঁতের ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেখানে তারা গােসল করে রাতের খাবার খেতে বসবেন তখুনি রেডিওতে শুনতে পান সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধুর পক্ষ থেকে মেজর জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতা ঘােষণা। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জিয়াউর রহমানের ইংরেজিতে এবং পরদিন বাংলায় সম্প্রচারিত ঘােষণাটি আব্দুসহ সামরিক ও বেসামরিক সকল বাঙালিকে অনুপ্রাণিত করে। পরদিন ভােরেই তারা সেই স্থান ত্যাগ করেন। কখনাে হেঁটে, কখনাে খেয়া, নৌকা ও রিকশায় চড়ে তারা পথ পাড়ি দিতে থাকেন। ফরিদপুর শহরে পৌছবার পূর্বে কিছু সময়ের জন্য তাঁদের ঘােড়াতেও চড়তে হয়। শহরের উপকণ্ঠে পেীছে তারা ঘােড় ছেড়ে দেন। যাতে চিহ্নিত না হয়ে পড়েন এ জন্যই তারা এই ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। এবারে রিকশাযােগে তারা পৌছান আওয়ামী লীগের নেতা ও এমপি ইমামউদ্দিনের বাড়িতে। এমপি ইমামউদ্দিন সে সময় বাড়ি ছিলেন না। ঢাকার মর্মান্তিক হত্যাযজ্ঞের কথা শুনে তিনি বাড়ি থেকে দূরে সরে স্থানীয় সংগ্রাম পরিষদের সদস্য বাঙালি পুলিশ ও ইপিআরের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করে চলেছিলেন। বহু মানুষ সে সময় ফরিদপুর শহর ছেড়ে গ্রামে আশ্রয়গ্রহণ করে। চারদিকের আতঙ্কপূর্ণ থমথমে পরিবেশের মধ্যে বাড়িতে একাকী অবস্থানকারী ইমামউদ্দিনের স্ত্রী হাসি তাঁদের সাদরে অভ্যর্থনা জানালেন। তাঁর সাহসিকতা, আতিথেয়তা ও তেজস্বী মনােভাব আবারাে প্রমাণ করল যে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে নারীর
————————————
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লেখককে জানান যে (১৭, ২০ ও ২২ মে, ২০১৪) ওনার লেখা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি বইটিতে (১৯৯১, পৃ. ২২) গ্রামটির নাম আগারগাঁও উল্লেখিত হলেও নামটি হবে। আওরঙ্গবাদ। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম লেখককে জানান যে (১৭, ২০ ও ২২ মে, ২০১৪) তাজউদ্দীন আহমদ ও তিনি ২৮ মার্চ রাতে মেজর জিয়াউর রহমানের ঘোষণা বাংলায় শুনতে পান। ২৯ মার্চ কামারখালি ঘাটে তারা আবারও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে অন্য ঘােষকের ঘােষণা শুনতে পান। ঘােষণায় শত্রুর দিকে নজর রাখতে বলা হচ্ছিল। পাকিস্তানি কমান্ডােরা এলাকায় ঢুকতে পারে এই সতর্কবাণী এবং তাদেরকে ধরিয়ে দেবার ঘােষণাও দেওয়া হচ্ছিল।
ভূমিকা অনন্য। ৩০ মার্চ সকাল ১০:৩০ এ তারা ঝিনাইদহে পৌছলেন। স্থানীয় আওয়ামী লীগ। সম্পাদক ও সংসদ সদস্য আবদুল আজিজের বাড়িতে তাঁরা আশ্রয়গ্রহণ করলেন। এখানেই দেখা হলাে মহকুমা পুলিশ কর্মকর্তা (স্বাধীনতার পরে ঢাকার পুলিশ সুপার) মাহবুবউদ্দিন আহমদের সঙ্গে। তিনি অত্যন্ত দক্ষতা ও নিষ্ঠার সঙ্গে ঐ এলাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। তাঁর স্থাপিত কন্ট্রোল রুমের মাধ্যমে তখন যশাের ও কুষ্টিয়ার গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলােতে সংবাদ বিনিময় হচ্ছিল। নড়াইলের এস.ডি.ও কামাল সিদ্দিকীও অত্যন্ত বীরত্বের সঙ্গে মুক্তিসংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছিলেন। আবদুল আজিজ আল্লুকে তার একটি লুঙ্গি ব্যবহার করতে দেন। আব্দুর মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। তিনি দাড়ি না কামাতে মনস্থির করেন। ভারতের মনােভাব সম্বন্ধে তখন তিনি নিশ্চিত নন। যদি ভারত মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন না করে তবে বাংলাদেশের মাটিতেই আত্মগােপন করে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। সেই চিন্তা করে খোঁচা খোঁচা দাড়িসহ কৃষকের বেশভূষায় তিনি রওনা দেন চুয়াডাঙ্গায়। চুয়াডাঙ্গায় পৌছে দেখা হয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য ডা. আসহাবুল হক, জাতীয় পরিষদের সদস্য আফজালুর রশীদ বাজ প্রমুখের সঙ্গে। চুয়াডাঙ্গায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস ইপিআর-এর অসম সাহসী কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর নেতৃত্বে তখন প্রবল প্রতিরােধ গড়ে উঠেছে। মেহেরপুরের মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-এ-ইলাহী চৌধুরীও সর্বতােভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তা করছেন। সাধারণ। মানুষরা অকাতরে তাদের খাবারদাবার ভাগ করছে প্রতিরােধ যােদ্ধাদের সঙ্গে। যশাের ও কুষ্টিয়ায় প্রতিরােধযােদ্ধাদের বিজয় ও পাকিস্তানি সেনাদের পলায়নে আপামর জনসাধারণের মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সঞ্চার ঘটেছে। এরই মধ্যে আন্ধু ভেবে চলেছেন—তার পরবর্তী পথের সন্ধান যেন একটু একটু করে উন্মােচিত হচ্ছে। উন্নত অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এই বিশাল পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীকে খণ্ড যুদ্ধে বিজয়ের মাধ্যমে সাময়িকভাবে প্রতিহত করা সম্ভব। কিন্তু তাদের সম্পূর্ণরূপে পরাজিত করার জন্য দরকার প্রয়ােজনীয় অস্ত্র, পর্যাপ্ত রসদ ও উন্নত প্রশিক্ষণের। এই দুরূহ কাজটিকে বাস্তবায়নের পথ কী ? প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত কতখানি সহায়তা করবে ? ২৫ মার্চের গণহত্যার ক’দিন আগেই চল্লিশটি দেশের দূতাবাসের প্রতিনিধিরা আন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। ৭ মার্চে মুজিব কাকুর ভাষণে স্বাধীনতা ও গেরিলাযুদ্ধের যে সুস্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল তারই প্রেক্ষাপটে ভাবের আদান-প্রদান হয়েছিল। ৭ মার্চের দুই-একদিন পূর্বে মুজিব কাকুর নির্দেশে আন্ধু ঢাকাস্থ ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে, সি, সেনগুপ্তের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছিলেন। উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তানের শাসকেরা যদি সত্যি সত্যি পূর্ব বাংলায় ধ্বংস তাণ্ডব শুরু করে তবে সে অবস্থায় ভারত সরকার আক্রান্ত কর্মীদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান বা সম্ভাব্য প্রতিরােধ সংগ্রামে কোনাে সাহায্য সহযােগিতা করবে কি না জানতে চাওয়া।’ এ বিষয়ে দিল্লির মনােভাব জানতে সেনগুপ্ত দিল্লিতে যান। ভারতের সাধারণ নির্বাচনে ব্যস্ততার কারণে উচ্চপর্যায় থেকে সংবাদ আনতে তার কিছুটা সময় লেগে যায়। ঢাকায় আন্ধুর সঙ্গে সেনগুপ্তের সাক্ষাৎ হয় ১৭ মার্চ। ঐ সাক্ষাতে সেনগুপ্ত সুস্পষ্ট উত্তর না দিলেও আশ্বাস দিয়েছিলেন ভারতের সহযােগিতার। লেখক মঈদুল হাসান এ সমন্ধে উল্লেখ করেন, ‘এই বৈঠকে স্থির হয় তাজউদ্দীন শেখ মুজিবের সঙ্গে পরামর্শের পর সেনগুপ্তর সঙ্গে আবার মিলিত হবেন এবং সম্ভবত তখন তাজউদ্দীন সর্বশেষ পরিস্থিতির আলােকে প্রয়ােজনীয় সাহায্য-সহযােগিতার প্রকার ও ধরন সম্পর্কে নির্দিষ্ট আলােচনা চালাতে সক্ষম হবেন। ২৪ মার্চে এই বৈঠকের কথা ছিল। কিন্তু শেখ মুজিব এ বিষয়ে কোনাে আলােকপাত করতে না পারায় এবং নির্ধারিত সময়ে তাজউদ্দীনকে অসহযােগ আন্দোলনসংক্রান্ত নির্দেশাবলি সংশােধনের মুসাবিদায় ব্যস্ত রাখায় সেনগুপ্তের সঙ্গে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে পারেনি।
৩০ মার্চ বেলা প্রায় ৩টা। সীমান্তের উদ্দেশে চলতে চলতে আলুর মাথায় জড়াে হচ্ছিল। অজস্র চিন্তা। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা প্রসঙ্গে ভারতের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপনের জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তৌফিক-এ-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদকে ওপারে পাঠানােই যুক্তিযুক্ত মনে হলাে। আমরা দুই বােন সােৎসাহে প্রশ্ন করি, তারপর ? গৌরবদীপ্ত সময়ের যে ইতিহাস গল্পচ্ছলে আব্দু সেদিন বলে গিয়েছিলেন তার দুই নাবালিকা কন্যার কাছে তারই বিবরণ পরে অনুরণিত হয় আমীর-উল ইসলামের মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি-কথায়। তিনি লিখলেন সেই ঐতিহাসিক সিদ্ধান্তটির কথা এভাবে ‘পলায়নী মনােবৃত্তি নিয়ে সীমান্ত পার হব না বলে আমরা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। স্বাধীন দেশের স্বাধীন সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে যােগ্য মর্যাদা নিয়েই আমরা ভারতে যাব। স্বাধীন দেশের প্রতিনিধি হিসেবে আমাদের গ্রহণ করলেই প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে আমাদের আলােচনা সম্ভব। তৌফিক-এ-ইলাহী চৌধুরী ও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ চলে গেলেন ওপারে। বলা যেতে পারে যে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম প্রতিনিধি ছিলেন এই দুই দেশপ্রেমিক তরুণ। তারা দায়িত্ব সহকারে আব্দুর সেই ঐতিহাসিক বার্তাটি পৌছে দিয়েছিলেন ভারতের সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তাদের কাছে। কুষ্টিয়া জেলার জীবননগরের কাছে এবং পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া জেলার সীমান্ত। বর্তী ওই স্থানটির নাম টুঙ্গি। জায়গাটি প্রায় জনমানবহীন। সীমান্তের পাশে ঝােপ-জঙ্গল ও বড় বড় অশ্বথ, দেবদারুগাছ। তার পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে শীর্ণকায় এক খাল। খালের ওপর একটি সেতু গােছের কালভার্ট। তার ওপরই বসার একটুখানি জায়গা। সেখানেই বসে অপেক্ষারত আব্দু ও তার সঙ্গী। পড়ন্ত বেলা, সূর্য ডুবি ডুবি করছে। আব্দুর মনটায় নেমেছে বিষাদের ছায়া। আমীর-উল ইসলাম জিজ্ঞেস করলেন তার বিষন্নতার কারণ। তিনি বললেন, যে তার বাল্যকালের। একটি ঘটনা মনে পড়ছে। তার হিন্দু সহপাঠীরা বলতেন, “ততাদের পাকিস্তান টিকবে না। তিনি পাল্টা যুক্তি খাটিয়ে জোর দিয়ে বলতেন, অবশ্যই টিকবে’।” তিনি আজ সেই তর্কে হেরে গেলেন। কিন্তু তাতে কী ? যে আকাশে সূর্যাস্ত হয়, সে আকাশেই তাে উদিত হয় নতুন সূর্য। আন্ধু মনে মনে আঁকলেন ভবিষ্যতের রূপরেখা। তিনি বললেন, ‘পালিয়ে যাওয়ার পথে এ দেশের মানুষের স্বাধীনতা লাভের যে চেতনার উন্মেষ দেখে গিয়েছিলাম সেটাই আমাকে আমার ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্ত নেওয়ার পথে অনিবার্য সুযােগ দিয়েছিল। জীবননগরের কাছে সীমান্তবর্তী টুঙ্গি নামক স্থানে একটি সেতুর নিচে ক্লান্ত দেহ এলিয়ে আমি সেদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বার্থে যে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম তা হলাে, একটি স্বাধীন সরকার প্রতিষ্ঠা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম পরিচালনার জন্য কাজ শুরু করা।” বাংলাদেশের ভাগ্যাকাশে স্বাধীনতার সূর্যোদয় হবে বলেই আন্ধুর কাছে ন্যস্ত হলাে মুক্তিযুদ্ধের নেতৃত্বভার। এর পরের ঘটনাগুলাে ঘটল এমনভাবে যেন রােমহর্ষক উপন্যাসের নতুন কোনাে পর্ব। তৌফিক ও মাহবুবের সঙ্গে দেখা হলাে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তা। ক্যাপ্টেন মহাপাত্রর। তৌফিক ও মাহবুবের কাছ থেকে পুরাে ঘটনা জেনে ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর কর্মকর্তারা তখনি সংবাদ প্রেরণ করেন তাদের বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান আইজি গােলক মজুমদারকে। এরপর সম্পূর্ণ সামরিক কায়দায় স্বাধীন রাষ্ট্রের এই দুই প্রতিনিধিকে পূর্ণ। সম্মান সহকারে গার্ড অব অনার প্রদান করে নিয়ে যাওয়া হয় ভারতীয় সীমান্ত চৌকিতে। সন্ধ্যা আটটার কাছাকাছি সময় গােলক মজুমদার গাড়ি করে কোলকাতা থেকে টুঙ্গিতে উপস্থিত হন। গােলক মজুমদার দুস্তর-মরুকান্তার পাড়ি দেওয়া স্বাধীনতার পথের দুই যাত্রীর সাথে তার প্রথম সাক্ষাতের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেন, তাঁদের পরনে ছিল ময়লা গেঞ্জি ও লুঙ্গি। ক্লান্ত মুখে চার-পাঁচ দিনের দাড়িগোঁফ ও পায়ে রাবারের ছেড়া চটি। একেবারে কৃষকের সাজ। অনাহারেঅর্ধাহারে শরীর দুর্বল। কণ্ঠস্বর ক্ষীণ। প্রথম সাক্ষাতেই আব্ব জানালেন যে, দেশের ভেতরে প্রতিমুহূর্তে বিশ্বাসঘাতকতা ও বিপদের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও তিনি ভারতে আশ্রয় নিতে অনাগ্রহী। কেননা শেখ সাহেবের সুস্পষ্ট নির্দেশ যে ভারতই বাঙালির শেষ সম্বল। সুতরাং এমন কিছু যেন করা হয় যাতে ভারত বিব্রত বােধ করে।” গােলক মজুমদার বললেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানে থাকা। তার পক্ষে নিরাপদ নয়। যােগ্য নেতার অভাবে গণবিক্ষোভ স্তিমিত হয়ে যাবে এবং তিনি এলে ভারত কোনােভাবেই বিব্রত হবে না। তখন আব্ব আরও আলাপ-আলােচনা করে আমীর-উল ইসলামসহ জিপে করে তার সঙ্গে কোলকাতা রওনা হন। তৌফিক ও মাহবুব ফিরে গেলেন কুষ্টিয়ায়, পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে আরও একটি বড় অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে। গেলিক মজুমদারের সঙ্গে আলাপের প্রাথমিক পর্যায়েই আল্লু ও আমীর-উল ইসলাম শরণার্থীদের আশ্রয়, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য পর্যাপ্ত অস্ত্র ও প্রশিক্ষণের জন্য ভারত সরকারের সাহায্য ও সহযােগিতার আবেদন জানান। গােলক মজুমদার জানান যে তাঁর পক্ষে ছােটখাটো কিছু অস্ত্র জোগাড় করা সম্ভবপর হলেও বড় পর্যায়ের সাহায্যের জন্য ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাতের প্রয়ােজন রয়েছে। জিপ গাড়িটি সােজা গিয়ে থামল দমদম বিমানবন্দরে। প্রায় এইসময় ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী প্রধান কে. এফ. রুস্তামজি দিল্লি থেকে বিমানে করে সেখানে এসে পেীছলেন। গােলক মজুমদার কোলকাতা রওনা হওয়ার পূর্বেই রুস্তামজির সঙ্গে যােগাযােগ করে আব্দুদের বর্তমান অবস্থা ও আবেদন সম্পর্কে তাকে অবহিত করেছিলেন। এরপর রুস্তামজিসহ তারা উঠলেন কালাে অ্যাম্বাসেডর গাড়িতে। তাঁদের নেওয়া হলাে একটা ছিমছাম সুন্দর বাড়িতে। ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীর অফিসারদের জন্য সংরক্ষিত এই বাড়িটির নাম ‘আসাম ভবন’। তাদের কোনাে পরিধেয় বস্ত্র না থাকায় রুস্তামজি সুটকেস খুলে তার নিজের পােশাক তাদের পরতে দিলেন। গােসল করার পর ছয় ফুট লম্বা রুস্তামজির পায়জামা-পাঞ্জাবিতে তাঁদের বেমানান লাগলেও করার কিছুই ছিল না। প্রায় শেষরাতে সামান্য কিছু খেয়ে তারা আলােচনায় বসলেন। পরদিন সকালে নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় সেখানে উপস্থিত হলেন। (মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়টিতে শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায় অত্যন্ত নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কাজ করেন।) পরিচয়পর্বের পর তার সহায়তায় আব্দু ও আমীরউল ইসলামের জন্য প্রয়ােজনীয় শার্ট-প্যান্ট, ব্যক্তিগত ব্যবহার সামগ্রী ও আব্দুর ডায়াবেটিসের ওষুধের ব্যবস্থা করা হয়। এর মধ্যে রুস্তামজি দিল্লিতে যােগাযােগ করে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আব্দুর সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেন। তিনি ইন্দিরা গান্ধীর আস্থাভাজন ছিলেন। এদিকে সেদিন আব্বরা আবার ফিরে যান টুঙ্গির সীমান্তে। সেখানে বিএসএফ-এর সহায়তায় কিছু অস্ত্র মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর কাছে তুলে দেওয়া হয়। গােলক মজুমদার একটি এলএমজি আন্ধুকে দেন। সেই এলএমজিটি আব্ব মেজর আবু ওসমান চৌধুরীর হাতে তুলে দিয়ে বলেন, ‘আপনি সামলাবেন এটা। তখুনি ইপিআর-এর সুবেদার মুজিবুর রহমানকে এলএমজি ব্যবহার সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই সময় গােলক মজুমদার আব্বকে উদ্দেশ করে ইংরেজিতে বলেন, ‘you will win’ (আবদুল আজিজ বাগমার, ‘চিরবিজয়ের মহাপ্রস্থান, অনুলিখন)। ১ এপ্রিল রাত ১০টায় একটি মালবাহী সামরিক বিমানে আন্ধু ও আমীর-উল ইসলাম , গােলক মজুমদার ও শরদিন্দু চট্টোপাধ্যয় সংগােপনে সকলের চোখ এড়িয়ে দিল্লির পথে রওনা হলেন। পুরনাে AN12 রাশিয়ান বিমানটি প্রচণ্ড আওয়াজ ও কাঁপুনি তুলে ধীরগতিতে যখন দিল্লিতে পেীছল তখন ভাের হয় হয়। সেখানে গিয়ে তাঁদের দেখা হয় বাংলাদেশ থেকে আগত কয়েকজন বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিবিদ রেহমান সােবহান, আনিসুর রহমান, আবদুর রউফ, এম, আর, সিদ্দিকী, সিরাজুল হক প্রমুখের সঙ্গে। ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা (RAW) তাঁদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ থেকে আগত রাজনীতিবিদদের জিজ্ঞাসাবাদ করেন এবং গােপনে আন্ধুকে দেখিয়ে নিশ্চিত হন যে তিনিই মূল ব্যক্তি। ৩ এপ্রিল রাত ১০টায় ১০ নম্বর সফদার জং রােডে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আন্ধুর প্রথম সাক্ষাৎ হয়। ইন্দিরা গান্ধী সে সময়টিতে আব্দুর অপেক্ষায় বারান্দায় পায়চারি করছিলেন। বাহুল্যবর্জিত স্টাডিরুমে তাদের আলাপচারিতা শুরু হয় এভাবে। ইন্দিরা গান্ধী প্রথমেই আন্ধুকে প্রশ্ন করেন, শেখ মুজিব কেমন আছেন?’ আব্দু উত্তর দেন, “আমার যখন তাঁর সঙ্গে শেষ দেখা হয় তখন তিনি সব বিষয় পরিচালনা করছিলেন। তার যে পরিকল্পনা ছিল সে মতােই আমাদের কাজ চলছে এবং হাইকমান্ড হিসেবে আমরা কাজ চালিয়ে যাচ্ছি। যার যেটা দায়িত্ব সেভাবে কাজ করছি এবং আমি আমার দায়িত্ব হিসেবে এখানে এসেছি। আল্লু এই আলােচনায় খুব পরিষ্কারভাবে ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, ‘এটা আমাদের যুদ্ধ। আমরা চাই ভারত এতে জড়াবে । আমরা চাই না ভারত তার সৈন্য দিয়ে, অস্ত্র দিয়ে আমাদের স্বাধীন করে দিক। এই স্বাধীনতার লড়াই আমাদের নিজেদের এবং আমরা এটা নিজেরাই করতে চাই। এই ক্ষেত্রে আমাদের যা দরকার হবে তা হচ্ছে, আমাদের মুক্তিবাহিনী গড়ে তােলার জন্য আপনার দেশের আশ্রয়, ট্রেনিংয়ের সবরকম সুবিধা এবং সে ব্যাপারে আপনাদের সাহায্য-সহযােগিতা ও অস্ত্র সরবরাহ। এ সব আমাদের জরুরি প্রয়ােজন হবে। আর আমরা যে রকম পরিস্থিতি দেশে দেখে এসেছি তাতে মনে হয় যে দুই-এক সপ্তাহের মধ্যেই প্রচুর শরণার্থী এ দেশে ঠাই নেবে। তাদের আশ্রয় এবং আহারের ব্যবস্থা ভারত সরকারকে করতে হবে। বহির্বিশ্বে আমাদের স্বাধীনতার কথা প্রচারের জন্য ব্যবস্থা করতে হবে। কূটনৈতিক ক্ষেত্রেও বিশেষ অবদান রাখবেন এটা আমরা। আশা করি।” ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলােচনায় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের আন্তর্জাতিকীকরণ যাতে ঘটে সে বিষয়ে আন্ধু জোর দেন। নতুন রাষ্ট্রের পররাষ্ট্র নীতিমালাও ব্যাখ্যা করেন। সাবলীলভাবে। তিনি জানান, আমাদের পররাষ্ট্রনীতি হবে জোটনিরপেক্ষ। সকলের প্রতি বন্ধুত্ব, কারাে প্রতি শত্রুতা নয়। বাংলার মানুষের সংগ্রাম মানবতার পক্ষে ও হিংস্র ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে। সকল গণতন্ত্রকামী মানুষ ও সরকারের সহায়তা আমরা চাই। আল্লু ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে কথা বলেছিলেন একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের ধীশক্তি ও আত্মমর্যাদাসম্পন্ন এবং বিশ্বরাজনীতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল রাষ্ট্রনায়কের মতােই। এ কারণেই আল্লু ও ইন্দিরা গান্ধীর প্রশাসনের মধ্যে শ্রদ্ধা ও হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। ভারত সরকার সর্বাত্মকভাবে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সাহায্য ও সমর্থনের প্রতিশ্রুতি প্রদান করে। দ্বিতীয় দফা বৈঠকে ইন্দিরা গান্ধী আব্দুকে জানান। মুজিব কাকুর গ্রেপ্তার হওয়ার সংবাদ, যা পাকিস্তান সরকার তখনাে প্রচার করেনি। এই সংবাদ পেয়ে আব্দু বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য যা কিছু করণীয় তা করতে শ্রীমতি গান্ধীকে অনুরােধ জানান। ইন্দিরা গান্ধী আশ্বাস দেন, তিনি সর্বাত্মক চেষ্টা করবেন। ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাফল্যজনক সাক্ষাতের আলােকে ভারতসহ বহির্বিশ্বের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলার এবং মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় কাঠামাের অন্তর্ভুক্ত করে তাকে পরিচালনার জন্য অবিলম্বে সরকার গঠনের প্রয়ােজনীয়তা দেখা যায়। এই চিন্তাটি কুষ্টিয়ার সীমান্তে অপেক্ষারত আব্দুর মাথায় প্রথমেই উদয় হয়েছিল। এখন প্রয়ােজন যথাশীঘ্র তা বাস্তবে রূপ দেওয়া। সরকার গঠনের লক্ষ্যে আন্ধু ও আমীর-উল ইসলাম আলােচনা করেন এম, আর, সিদ্দিকী, আব্দুর রউফ প্রমুখের সঙ্গে। ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ভাষাসৈনিক রফিকউদ্দিন ভূঁইয়াসহ আরও অনেকে চিঠির মাধ্যমে সরকার গঠনের পক্ষে ঐকমত্য প্রকাশ করলেন। তাঁরা লিখলেন, ‘যেন অবিলম্বে সরকার গঠন করা হয় এবং তাজউদ্দীন আহমদ যেন সেই সরকারের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আলাপ-আলােচনার পর সিদ্ধান্ত নেওয়া হলাে অসহযােগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু ও তার সহকর্মী শীর্ষস্থানীয় পাঁচজন নেতাসহ যে হাইকমান্ড গঠন করা হয়েছিল এবং যারা ছায়া। সরকারের কাজ করছিলেন, তাঁদের নিয়েই প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হবে। হাইকমান্ড নিয়ে সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর প্রথম কাজ হয় ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামসহ মন্ত্রিসভার বাকি সদস্যদের খুঁজে বের করা। দিল্লি থেকে কোলকাতায় পৌছে দেখা। হয় মন্ত্রিসভার সদস্য এম. মনসুর আলী ও আবু হেনা কামরুজ্জামানের সঙ্গে। তারাসহ আওয়ামী লীগের প্রায় অর্ধশত এমএলএ, এমপি ও রাজনীতিক যারা সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতায় আশ্রয়গ্রহণ করেছিলেন, তাঁদের সঙ্গে সরকার গঠন ও মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করার ব্যাপারে সরকারের ভূমিকা ও প্রয়ােজনীয়তা সম্পর্কে আলােচনা হয়। এম, মনসুর আলী ও আবু হেনা কামরুজ্জামান স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন। সরকার গঠনের ব্যাপারে আন্ধুর বক্তব্যকে সকলেই মেনে নেন। বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর প্রথম ভাষণটির খসড়া আন্ধু, রেহমান সােবহান ও আমীর-উল ইসলাম মিলে তৈরি করেছিলেন। দিল্লিতে রেকর্ড করা আল্লুর বক্তৃতাটি শিলিগুড়ির কোনাে এক জঙ্গলের গােপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয় ১০ এপ্রিল, বাংলাদেশ সময় রাত দশটায়। সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্ত নি হানাদার বাহিনীর বর্বরতার বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের অকুতােভয় সংগ্রাম এবং বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে স্বাধীন বাংলা সরকার গঠনের কথা। সীমান্ত এলাকায় তারা যাতে সহজে যাতায়াত করতে পারেন সে জন্য ইন্দিরা গান্ধী তাঁদের একটি ছােট ডাকোটা প্লেনের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। সেই প্লেনে করেই ১১ এপ্রিল সকালে ময়মনসিংহের তুরা পাহাড়ের কাছে আন্ধু, এম. মনসুর আলী ও আমীর-উল ইসলাম অবতরণ করলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সন্ধানে। বিএসএফ-এর সহায়তায় তারা সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আবদুল মান্নানের খোঁজ পেলেন। আব্দু ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম একান্তে আলাপ করলেন। আবু তাঁকে জানালেন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনসহ সব ঘটনা। সব শুনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম আব্দুসহ সকলকে অভিনন্দন জানালেন এবং সরকার গঠনের পক্ষে সম্পূর্ণ মত দিলেন। ডাকোটা প্লেনটি এবার উড়াল দিল আগরতলার পথে। সেখানে পৌছে খুঁজে পেলেন মন্ত্রিসভার অপর সদস্য খন্দকার মােশতাক আহমদকে। ইতােমধ্যে কর্নেল ওসমানীসহ অনেক রাজনীতিবিদই সেখানে পৌঁছেছেন। আল্লু আলাপ করলেন কর্নেল ওসমানীর সঙ্গেও। প্রথাগত যুদ্ধের বিপরীতে জনযুদ্ধকে গেরিলা যুদ্ধের মধ্যে সংগঠিত করার আহ্বান জানিয়ে তার ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব অর্পণ করা হলাে। সেক্টর কমান্ডারদের নাম আব্দু ১০ এপ্রিলের ভাষণেই উল্লেখ করেছিলেন। সরকার গঠনের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হলাে ১৭ এপ্রিল মেহেরপুর জেলার বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে, মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ ও স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠের মধ্যে দিয়ে। বাংলাদেশের মাটিতেই হবে শপথগ্রহণ এই ছিল আব্দুর সিদ্ধান্ত। এভাবেই সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাধে ন্যস্ত হলাে মুক্তিসংগ্রাম পরিচালনার গুরু দায়িত্ব। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উড়ল মুক্ত আকাশে। আন্ধু বললেন, ‘পলাশীর এক আম্রকাননে বাংলা ও ভারতের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত হয় ইংরেজদের হাতে, অপর এক আম্রকাননে উদিত হলাে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সূর্য।’ আব্দুর গল্প বলা শেষ হলাে। তিনি চলে গেলেন উল্টো দিকের ফ্ল্যাটে। সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে সভা শুরু করলেন ঘড়ির কাঁটা ধরে। স্বাধীনতাযুদ্ধের গৌরবােজ্জ্বল অনন্য ঘটনাবলির প্রদীপরাশি গল্পের মধ্যে দিয়ে তিনি প্রজ্বলিত করেছিলেন আমাদের কচি মন। তাঁর বলায় ছিল আশা ও নিশ্চিত বিজয়ের অনুরণন। তাঁর গল্পে অনুচ্চারিত ছিল স্বাধীনতাবিরােধীদের ভয়াবহ ষড়যন্ত্র এবং ক্ষমতালিন্দু স্বার্থান্বেষীদের অন্তর্কলহ ও কুটিলতার বিরুদ্ধে তাঁর অবিশ্রান্ত সংগ্রামের কথা। আপসহীন, চূড়ান্ত স্বাধীনতার স্বপ্নকে বাস্ত বায়িত করার জন্য তাকে পাড়ি দিতে হয়েছিল বহু চড়াই-উতরাই। | খন্দকার মােশতাক আহমেদ বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে কৌশলে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন পাকিস্তান ও মার্কিন সরকারের স্বার্থ রক্ষার কাজে। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটির প্রতি তার বিশেষ আগ্রহের কারণ এই কার্যকলাপ থেকেই অনুমান করা যায়। মুক্তিসংগ্রামকে ধ্বংস করে কনফেডারেশন গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত করার জন্য তিনি সুচতুর চাল চালেন। মুক্তিযুদ্ধকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য তিনি একটি ভাবাবেগপূর্ণ প্রশ্ন উথাপন করেন। স্বাধীনতা চাও, না মুজিবকে চাও?’ যদি স্বাধীনতা পেতে হয় তাহলে মুজিবকে পাবে না এবং মুজিবকে পেতে হলে স্বাধীনতাসংগ্রামকে বিসর্জন দিতে হবে। এই ছিল পৃষ্ঠপােষক মার্কিন সরকারের তরফ থেকে পেশ করা তার যুক্তি। এর জবাবে আব্ব বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতাও চাই, মুজিবকেও চাই। স্বাধীনতা এলেই মুজিবকে পেতে পারি।” মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে মােশতাকের গােপন আদান-প্রদান সম্পর্কে আল্লু অবহিত হওয়ার পর ষড়যন্ত্রের দোসর পররাষ্ট্রসচিব মাহবুব আলম চাষীসহ মােশতাককে নিষ্ক্রিয় করে দেওয়া হয়। সাংবাদিক লরেন্স 17981976 (Lawrence Lifschultz) Bangladesh: The Unfinished Revolution’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন :
The (U.S.) contacts were highly sensitive because…they bypassed the dominent leadership of the provisional government in person of the Prime Minister Tajuddin Ahmad. Tajuddin like nearly the entire rank and file of the Bangladesh Movement, was irrevocably commited to full independence of the country, after the massacre of 25th March and would breach no compromise on this issue. Therefore absolute descretion and secrecy was the key to splitting the Bengali leadership and supporting that faction which would compromise with Pakistan and not demand full independence. Some sources have suggested that the moment chosen was to be October, 1971, when Mustak, as Foreign Minister, was expected to arrive in New York to present the Bangladesh Case before the UN general assembly. Had he suddenly in New York, Unilaterally and without warning announced a compromise solution short of independence-a position that constituted a sell out and betrayal in the view of Tajuddin and the rest of the leadership Mustak might at that stage have pulled off a full coup against the rest of Awami leadership back in Calcutta and the history of Bangladesh might have been very different.
লরেন্স লিফশুলজ মার্কিন প্রশাসনের সঙ্গে মােশতাকের গােপন যােগসাজশের কথা এবং কোনাে পূর্বাভাস ছাড়াই জাতিসংঘে যােগদান করে স্বাধীনতার বিপক্ষে পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝােতা ঘােষণার গােপন চক্রান্ত এবং তাঁর ঐ বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ কার্যকলাপের বিপরীতে আলুর নেতৃত্বে প্রায় সকল বাঙালির পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষে আপসহীন মনােভাবের কথা উল্লেখ করেছিলেন। আব্দুর ওই আপসহীন মনােভাবেরই বাস্তব রূপ দেখতে পাই যখন মার্কিন প্রশাসনের সহায়তায় পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের লক্ষ্যে মােশতাকের জাতিসংঘে যােগদানের পরিকল্পনা বানচাল হয়ে যায় আব্দুর তড়িৎ ও দৃঢ় পদক্ষেপের ফলে।“ মােশতাকের পরিবর্তে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের আট সদস্যের প্রতিনিধি দলটি নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যােগদানের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেন।”
স্বাধীনতার পর অব্যাহতিপ্রাপ্ত মাহবুব আলম চাষীর বদলে ২১ ডিসেম্বর আবুল ফতেহ পররাষ্ট্রসচিবের দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মােশতাককেও ছাড়তে হয় পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদটি। এর প্রতিশােধ মােশতাক পরবর্তী সময়ে নিয়েছিল বড় নির্মমভাবে। মােশতাকের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার পর গােপনীয়তা ও নিরাপত্তার স্বার্থে দেশরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে অধিকাংশ সামরিক সিদ্ধান্ত আব্দু একক দায়িত্বে গ্রহণ করেন। মােশতাকের ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ঘটনাটি স্বাধীনতাযুদ্ধের নাজুক পরিস্থিতিতে যাতে বিভাজন ও সংশয়ের কারণ না হয়ে দাঁড়ায় সে জন্য। বিষয়টিকে সতর্কতার সঙ্গে গােপন রাখা হয়। একদিকে আব্দুকে যেমন প্রতিহত করতে হয়েছিল আন্তর্জাতিক চক্রান্ত তেমনি যুবনেতাদের অনাস্থা ও ষড়যন্ত্র এবং আওয়ামী লীগের একাংশের অন্ত কলহ ও কোন্দল। বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে যুবনেতারা স্বাধীন বাংলাদেশ তথা মুজিবনগর সরকারের প্রতি অনাস্থা প্রদর্শন করে। তারা বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের পক্ষে জোর দেয় । আব্ব বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন জনের মতামত গ্রহণ করেন। এমনকি যােদ্ধাদেরও মতামত নেন। আলােচনার মাধ্যমে কোন্দলকারী ও অনাস্থা প্রদর্শনকারী দলটি ব্যতীত অধিকাংশ সকলের কাছেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে ওঠে যে আইনগত সরকার প্রতিষ্ঠা ব্যতীত ভারত সরকারের কাছ থেকে অস্ত্রগ্রহণকারী মুক্তিযােদ্ধারা পরিচিত হবে সন্ত্রাসী ও বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে। সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিগত স্বার্থে বিভিন্ন বিপ্লবী কাউন্সিল গড়ে ওঠাও অস্বাভাবিক কিছু নয়, যা স্বাধীনতাযুদ্ধকে করবে শতধা বিভক্ত। গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনগত সরকারের পক্ষেই সম্ভব স্বাধীনতার পক্ষ সমর্থনকারী সকলকেই দল মতনির্বিশেষে এক কাতারভুক্ত করে পূর্ণ স্বাধীনতার পথে পরিচালনা করা এবং স্বীকৃতি ও সমর্থনের জন্যে বিদেশি রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে কূটনৈতিক তৎপরতা চালিয়ে যাওয়া। সরকার গঠনের পক্ষে উথাপিত যুক্তির বলে যখন বিপ্লবী কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবটি ভেস্তে যায় তখন বিএসএফ-এর প্রতিষ্ঠাতা ও মহাপরিচালক রুস্তামজির প্রবল বিরােধিতা সত্ত্বেও ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ (Research and Analytical Wing)-এর সহায়তায় শেখ মনির নেতৃত্বে গঠিত হয় মুজিব বাহিনী। মেজর জেনারেল সুজান সিং উবান নিয়ােজিত হন মােটা ভাতা ও সুবিধাপ্রাপ্ত মুজিব বাহিনীকে প্রশিক্ষণের দায়িত্বে। অন্যদিকে অপর্যাপ্ত অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান ও ভাতার সংকটের মধ্যে দিয়ে নিয়মিত ও অনিয়মিত বাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত বৃহত্তর মুক্তিবাহিনীর যােদ্ধারা দেশ মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত হন। মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ ভারতীয় প্রশাসনকে বােঝানাের চেষ্টা করে যে তারা সরাসরি বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে বিশেষ ক্ষমতাপ্রাপ্ত এবং একমাত্র তাদেরই অধিকার রয়েছে মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার। এক বাক্সে সকল ডিম না-রাখার পক্ষপাতী ভারত সরকারও মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে গােপন রাখে। ব্যাপারটি বেশিদিন গােপন থাকে না। অগাস্টে আন্ধু যখন দিল্লি সফর করেন, সেখানে তিনি ‘র’-এর সাহায্যপুষ্ট মুজিব বাহিনীর ক্রমবর্ধমান উজ্জ্বল কার্যকলাপ ও সরকার-বিরােধী ভূমিকা সম্পর্কে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং এই স্বাধীনতাযুদ্ধকে বিভক্তকারী মারাত্মক সমস্যা সমাধানের জন্য পি.এন হাসার (ইন্দিরা গান্ধীর মুখ্য সচিব) এবং ‘র প্রধান রামনাথ কাওয়ের সাহায্য চান। কিন্তু দুজনেই নীরব থাকেন। তাদের এই নীরবতায় আল্লু মনােবল না হারিয়ে দ্বিগুণ উদ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম’ হিসেবে বিশ্বের দরবারে উপস্থাপন এবং সােভিয়েত ইউনিয়নসহ সহানুভূতিশীল রাষ্ট্রগুলাের সমর্থন আদায়ের জন্য আপ্রাণ প্রয়াস চালিয়ে যেতে থাকেন। সমগ্র জাতির মুক্তি ও কল্যাণের লক্ষ্যে আব্দুর নিবেদিত কর্মপ্রয়াসের বিপরীতে অনুগত তরুণদের ক্ষুদ্র অংশকে নিয়ে সঙ্কীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থে গঠিত মুজিব বাহিনীর প্রতিষ্ঠা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করছিল। তাদের আত্মঘাতী কর্মকাণ্ড ও ভিত্তিহীন অপপ্রচারণা তাদের ক্রমশই অপ্রিয় করে তােলে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নয়, বরং মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন ইউনিট হয় মুজিববাহিনীর আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু।* জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের কাতার থেকে তারা এভাবেই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ভারত সরকারও তাদের প্রশিক্ষণ বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। একপর্যায়ে মুজিববাহিনীর শীর্ষস্থানীয় এক নেতা এতটাই হিংসাত্মক ও মরিয়া হয়ে ওঠে যে সে আন্ধুকে হত্যারও প্রচেষ্টা চালায়। মােশতাক, মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ নেতাদের গঠিত উপদলগুলােও আব্দুর কর্মকাণ্ডে প্রচণ্ড বাধার সৃষ্টি করতে থাকে। তাদের সৃষ্ট অবিশ্বাস, অনাস্থা ও অপপ্রচারণা বালুর দুর্গের মতােই ধসে পড়তে থাকে আব্দুর সবল নেতৃত্বের কারণে। মাত্র। নয়টি মাস তিনি ছিলেন জাতির নেতৃত্বে। অথচ ঐ নয়টি মাসেই তিনি সম্পন্ন করেছিলেন যেন এক যুগের কর্ম। সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচাইতে সফল সরকার ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের এই প্রথম বাংলাদেশ সরকার। নেতৃত্বকে যদি এক কথায় সংজ্ঞায়িত করা যায় তাহলে বলা যেতে পারে সুযােগ্য নেতা তিনিই, যিনি সবার মেধা ও দক্ষতাকে সুপরিকল্পিতভাবে দেশ ও দশের কাজে লাগাতে পারেন। নেতৃত্বের এই বিরল গুণটি আব্দুর ছিল। জাতির চরম দুর্দিনে ও জাতির পরিত্রাণে তাঁর প্রতিটি কর্মেই ছিল দেশপ্রেম, দূরদর্শিতা, ন্যায় ও সততার স্বাক্ষর। নিপুণ কৌশল ও দক্ষতার সঙ্গে স্বাধীন রাষ্ট্রের উপযােগী খাদ্য, বাসস্থান, শিক্ষা, পুনর্বাসন প্রভৃতি অঙ্গসংগঠনগুলাে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন। তাঁর সুতীক্ষ দৃষ্টি থেকে কোনাে সমস্যাই বাদ পড়েনি। স্বহস্তে লিখিত ১৩ এপ্রিলের মেমােতে উল্লেখ করেছেন। সামরিক ও রাজনৈতিক সংগঠনকে শক্তিশালী করার কথা, যুবক্যাম্প সৃষ্টির কথা। নির্যাতিত বেসামরিক নাগরিকদের জন্য ত্রাণের ব্যবস্থার পাশাপাশি বাংলাদেশের মুদ্রা ছাপানাের মতাে। গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক বিষয়টিও তাঁর চোখ এড়ায়নি।” | ঐ একই মাসের নােটে তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টিতে যেমন জোর দিয়েছেন, পরবর্তী ২ মে’র নােটে জাতির পিতার মুক্তি দাবি উল্লেখ করেছেন। যেন তিনি জানতেন যে বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও স্বাধীনতাযুদ্ধের সাফল্যের ওপরই নির্ভর করবে তার মুক্তি। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক বিরােধী দলগুলাের ভূমিকাকেও তিনি খাটো করে দেখেননি। সরকার পরিচালনা ও দেশ মুক্তির সংগ্রামে তাদের পরামর্শ ও সহায়তা লাভের জন্য তাঁর নিজস্ব দলের একাংশের প্রচণ্ড বাধা সত্ত্বেও আহ্বায়ক হিসেবে গঠন করেন মুক্তিযুদ্ধের মাইলফলক জাতীয় উপদেষ্টা কমিটি। মওলানা ভাসানী হন এই কমিটির সভাপতি। দেশের কল্যাণে, ভিন্ন জন ও মতকে ঐক্যবদ্ধ করে, একত্রে কাজ করার গণতান্ত্রিক মানসিকতা তার মাঝে পরিলক্ষিত হয় চরম প্রতিকূল অবস্থাতেও। ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাপ (মােজাফফর), বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি, বাংলাদেশ ন্যাশনাল কংগ্রেস ও আওয়ামী লীগকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে ৮ সেপ্টেম্বর আমন্ত্রণ। জানিয়ে স্বহস্তে যে পত্রটি তিনি লেখেন তার অপর বিশেষত্ব হলাে তাতে সকাল ১০টার পাশে ব্র্যাকেটে বাংলাদেশ সময়ের উল্লেখ।
প্রবাসের মাটি থেকে পুরাে মুক্তিযুদ্ধকে তিনি পরিচালনা করেছিলেন তাঁর ঘড়ির কাঁটায় বাংলাদেশের সময়কে অনুসরণ করে। বাংলাদেশ তার অস্তিত্বে ছিল সদা বিরাজমান। বাংলাদেশকে তিনি ভালােবেসেছিলেন এক বিশাল হৃদয়ের মানবসত্তা হিসেবে। এই ভালােবাসা তার রাষ্ট্রনায়কোচিত দূরদৃষ্টিকে ম্লান করেনি। সে কারণে স্বাধীন রাষ্ট্রে অবাঙালিদের—যেমন বিহারি সম্প্রদায় যারা পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল তাদের সমস্যা ভার লাঘবের কথাও উল্লিখিত হয় তার ২৮ অক্টোবরের নােটে। ওদিকে ১৩ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের আগেই মন্ত্রিসভার সভায় রাষ্ট্রীয় আইনের মাধ্যমে দালালদের বিচারের বিষয়টি গৃহীত হয়।”
ইন্দিরা গান্ধীর অত্যন্ত আস্থাভাজন কূটনীতিক বাংলাদেশ-ভারত বিষয়ক সমন্বয়কারী দুর্গা প্রসাদ ধর (ডি.পি ধর) বাংলাদেশ সরকার বিরােধী মুজিব বাহিনীর তৎপরতা রােধে ব্যাপক অবদান রাখেন।
রাজনৈতিক মতাদর্শের ভিন্নতার কারণে কাউকে শাস্তি দেওয়া আব্দু সমর্থন করেননি। কিন্তু যারা মুক্তিযুদ্ধের সময় অমানবিক ও বর্বরােচিত কার্যকলাপের মাধ্যমে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে সহায়তা করেছে তাদের সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘সরকার কোনাে পাইকারি ব্যবস্থা নেবে তবে যে সব দালাল স্বাধীনতা সংগ্রামে বিঘ্ন সৃষ্টি করেছে এবং বাঙালি হত্যায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহায়তা করেছে তাদের বিচার করা হবে এবং শাস্তি দেওয়া হবে। দালাল-গােষ্ঠী বাঙালি বা অবাঙালি’ যেই হােক না কেন, রেহাই পাবে না।” ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী জন্মলাভ করে। পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনীর সঙ্গে এর আদর্শগত ও আচরণগত পার্থক্য ব্যাপক। বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর জন্ম একটি রক্তক্ষয়ী ও বৈপ্লবিক মুক্তিযুদ্ধের অগ্নিগর্ভ থেকে। এই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মূল কর্মকাণ্ড ও নীতিনির্ধারণী ক্ষমতা পাকিস্তানি কায়দায় কোনাে সামরিক প্রশাসকের হাতে কেন্দ্রীভূত নয়। বরং আইনানুগভাবে এবং স্বাধীনতার ঘােষণাপত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত এক বেসামরিক এবং গণপ্রজাতন্ত্রী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের হাতে ন্যস্ত। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন, সামরিক ও বেসামরিক উভয় অংশের মধ্যেই এনেছিলেন উদ্দীপনা ও বিরল ভারসাম্য। | ঐ নভেম্বর মাসেই এল রােজার ঈদ। আব্ব রণাঙ্গনে মুক্তিযােদ্ধাদের মাঝে তাদের ক্যাম্পে মিলিত হলেন। আমাদের ফ্ল্যাটে ঈদের দিন কোনাে বিশেষ খাবারের আয়ােজন হলাে না। নতুন কাপড়ও জুটল না। শাক, ডাল, আলুভর্তা, ভাত খেয়ে ঈদ উদযাপিত হলাে। আম্মা আমাদের বললেন যে, লাখ লাখ শরণার্থী ও মুক্তিযােদ্ধার ভাগ্যে জোটেনি কোনাে ঈদের আনন্দ। তাদের বেদনার ভাগীদার আমাদেরও হতে হবে।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ঐতিহাসিক ভারত-সােভিয়েত মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিটির ফলে বাংলাদেশের পক্ষে ভারতের স্বীকৃতি লাভের পথটি উন্মুক্ত হয়। ভারতের পাশে দাঁড়িয়েছে সােভিয়েত ইউনিয়নের মতাে শক্তিশালী মিত্র। যে কারণে পাকিস্তান ও মার্কিন শক্তির বিরুদ্ধে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের পথটি সহজতর হয়। আন্ধু স্বীকৃতি প্রসঙ্গে উল্লেখ করেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের অনুরােধ জানিয়ে ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর প্রথম শ্রীমতি ইন্দিরাকে চিঠি লিখি। এরপর ২৩ নভেম্বর আর একখানা চিঠি দিই। ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের ঘােষিত যুদ্ধের ঠিক আগের দিন ২রা ডিসেম্বর ও পরের দিন ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীকে চিঠি দিয়েছি। ৬ ডিসেম্বর বেলা ১১টায় ভারতীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের কথা ঘােষণা করার পর শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী আমাকে একখানা আনুষ্ঠানিক চিঠি। দেন। ৭ ডিসেম্বর মঙ্গলবার বিকেল সােয়া তিনটায় মুজিবনগরে সে চিঠি আমার হাতে এসে পেীছায়। ৪০
আব্বুর সুদক্ষ নেতৃত্বের একটি বড় অর্জন হলাে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের ভারতের স্বীকৃতি লাভ। বাংলাদেশের ইতিহাসের সবচেয়ে মর্যাদাশীল চুক্তিটিও কিন্তু সম্পাদিত হয় ঐ একই সময়। আল্লু এ সম্পর্কে বলেন, বাংলাদেশ কারাে ঘাঁটি হবে না। এমনকি যুদ্ধের দিনে সবচেয়ে বিপর্যয়ের সময়ে ভারতীয় বাহিনীকে বলেছি, শ্রীমতি গান্ধীকে বলেছি, বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে তুমি আমাদের দেশে যাবে। বন্ধু তখনি হবে যখন তুমি আমাদের স্বীকৃতি দেবে। তার আগে সার্বভৌমত্বের বন্ধুত্ব হয় না। ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিয়ে ভারতীয় বাহিনী, আমাদের সঙ্গে এসেছিল। সেদিন–শুনে রাখুন আমার বন্ধুরা কোনাে গােপন চুক্তি ভারতের সঙ্গে হয়নি। একটাই চুক্তি হয়েছে, সেই চুক্তি প্রকাশ্য এবং কিছুটা লিখিত, কিছুটা অলিখিত। সেই নয় মাসে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং আমি যুক্তভাবে স্বাক্ষর করেছিলাম। সেখানে লেখা ছিল আমাদের। স্বীকৃতি দিয়ে সহায়ক বাহিনী- Supporting force হিসেবে তােমরা বাংলাদেশে প্রবেশ করবে। এবং যেদিন আমরা মনে করব আমাদের দেশে আর তােমাদের থাকার দরকার নেই সেদিন তােমরা চলে যাবে। সেই চুক্তি অনুসারে বঙ্গবন্ধু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীকে বললেন, ৩০ মার্চের মধ্যে তােমাদের বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে যাবে, তখনই মিসেস গান্ধী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চের মধ্যে সহায়ক বাহিনী উঠিয়ে নিয়ে গেলেন। | ৬ ডিসেম্বর যেদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিল সেদিন আমাদের সবার হৃদয়ে বয়ে গেল বিপুল আনন্দের জোয়ার। আমাদের ছােট ফ্ল্যাটটি ভরে গেল ফুলে আর ফুলে। আব্ব আমাদের উল্টো দিকের কোনাকুনি ফ্ল্যাটে গেলেন সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে মন্ত্রিসভার সভা করতে। আন্ধুর সঙ্গে আনন্দে উল্লসিত আরও অনেকে। সভা সেরে মাত্র আধঘণ্টার জন্যে আমাদের ফ্ল্যাটে এলেন। সােহেলকে তিনি কোলে তুলে নিলেন। আনন্দে বিহ্বল আমরা দাঁড়ালাম আব্দু, আম্মার পাশে।। আমাদের সবার হাতে ধরা ফুলের তােড়া। আব্দুর চেহারায় বিষন্নতার ছাপ। তিনি ফ্ল্যাট ভরা উল্লসিত। মানুষজনের মধ্যে থেকে হঠাৎ করে ঢুকলেন আমাদের শােবার ঘরে। তার কিছুক্ষণ পরই ঝড়ের গতিতে বের হয়ে চলে গেলেন। বহু যুগ পর আম্মা আমার কাছে সেই বিশেষ দিনের একটি অজানা গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেন। আব্দু ঘরে ঢােকার কিছুক্ষণ পরই আম্মা ঘরে প্রবেশ করেন। তিনি দেখেন আব্দু ঘরের জানালার সামনে দাঁড়িয়ে অঝােরে কাঁদছেন। আম্মা, যিনি আব্বকে গভীরভাবেই জানতেন, বুঝলেন যে তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য কাঁদছেন। বাংলাদেশের জন্য এত বড় অর্জন, এই স্বীকৃতির দিন, অথচ তিনি পাশে নেই। আম্মাকে দেখে আন্ধু কান্না থামালেন। তারপর কোনাে এক গভীর চিন্তায় মগ্ন হয়ে আন্ধু জানালার গরাদে হাত রাখলেন। তারপর আম্মা দেখলেন যে আন্ধু আম্মার দিকে অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছেন। তারপর হঠাৎই আম্মাকে বললেন, শ্রীমাভাে বন্দরনায়েক কি তুমি হবে?’ দু’বার কথাটি তিনি উচ্চারণ করলেন। আব্দুর হঠাৎ ঐ উক্তিটি সম্পর্কে আম্মা তার মনের অবস্থা আমার কাছে এভাবে ব্যক্ত করলেন, ‘ঐ মুহূর্তে আমি তাজউদ্দীনের ঐ তাল, লয়, পৃথিবীর বাস্তবতা বিচ্যুত, পৃথিবীর লাখাে ঘটনার সঙ্গে সম্পর্কহীন মন্তব্যের কোনাে কারণ খুঁজে পেলাম না। কথাটি বলেই তাজউদ্দীন দ্রুত গতিতে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আমি বেশ কয় মুহূর্ত নিঃসাড় হয়ে আকাশ-পাতাল ভাবনার রাজ্যে ডুবে গেলাম। ঐ কথাটির অর্থ কী ? | ১৯৫৯ সালে শ্রীলঙ্কার প্রধানমন্ত্রী সলােমান বন্দরনায়েক বৌদ্ধধর্মাবলম্বী এক চরমপন্থী ভিক্ষু-ধর্মযাজকের গুলিতে প্রাণ হারান। ১৯৬০ সালে তার বিধবা স্ত্রী শ্রীমাভাে বন্দরনায়েক তার স্বামীর শ্রীলঙ্কা ফ্রিডম দলের নেতৃত্ব দেন এবং বিশ্বের প্রথম নারী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নির্বাচিত হন। শ্রীলঙ্কার ঐ রাজনৈতিক ঘটনা ও পরিবেশের সঙ্গে আব্দুর ঐ মন্তব্যটির কী কোনাে সম্পর্ক ছিল? স্বীকৃতির ঐ আনন্দঘন পরিবেশ ছাড়িয়ে আব্ব কী দিব্যদৃষ্টি মেলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দুর্যোগ ও তার জীবনের মর্মান্তিক পরিণতিকেই দেখতে পেয়েছিলেন ? আব্দুও চরমপন্থী ঘাতকদের গুলিতে মৃত্যুবরণ করেন। দেশের চরম নৈরাশ্যজনক পরিস্থিতির মধ্যে আম্মা তার স্বামীর তিলতিল করে গড়া দল আওয়ামী লীগের নেতৃত্বভার গ্রহণ করেন দুর্দান্ত সাহসিকতা, আন্তরিকতা ও দক্ষতার সঙ্গে। আমাদের বিদ্যুৎ সমাজ সেই অনালােকিত ও জাতীয় জীবনের গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টিকে একদিন তথ্য ও গবেষণার মাধ্যমে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরবেন এই আশা রাখি। ৭ ডিসেম্বর যশাের মুক্ত হলাে। ১১ ডিসেম্বর মুক্ত স্বদেশের মাটিতে অনুষ্ঠিত প্রথম জনসভায় যােগ দিতে আব্ব, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, এম আর আখতার মুকুল, ফণীভূষণ মজুমদার, জহির রায়হান, রওশন আলী, মােশাররফ হােসেন, তবিবুর রহমান
সরদার প্রমুখ নেতৃবৃন্দ মুক্ত যশােরে গেলেন। বিজয়ের আনন্দে উদ্বেলিত জনতা, দেশি ও বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে যশােরের টাউন হল ময়দানের জনসভায় আন্ধু বাংলাদেশে | ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দৃঢ় সংকল্প উল্লেখ করেন। ধর্মের প্রতি গভীর শ্রদ্ধাশীল আব্দুর ঐ বক্তব্য ধর্মের বিরুদ্ধে ছিল না বরং তথাকথিত ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলগুলাের হাতে ধর্মের অপব্যবহারকে রােধ করার জন্যই তিনি ঐ ঘােষণা দেন। তাঁর ঐ ঘােষণার প্রতিফলন দেখতে পাওয়া যায় ১৯৭২ এর সংবিধানে যেখানে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়। তাঁর দূরদর্শী। | সেই চিন্তাধারার যৌক্তিকতা বর্তমান বাংলাদেশ ও বর্তমান বিশ্বের প্রেক্ষিতে আরও প্রাসঙ্গিক। আলুর বন্ধুপ্রতিম ঘনিষ্ঠ সহকর্মী যশোের আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা মশিউর রহমানকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করেছিল। আন্ধু উম্রান্তের মতাে ছুটে গেলেন ক্যান্টনমেন্টের সেই ঘরটিতে যেখানে তাকে পাশবিকভাবে হত্যা করা হয়। ঘরটিতে প্রবেশ করে তিনি ডুকরে কেঁদে ওঠেন। আব্দুর সাদা পাঞ্জাবি সিক্ত হয়ে যায় চোখের জলে । শত্ৰু-মুক্ত এই নবীন দেশটিকে শহীদের রক্তের উপযুক্ত দেশ হিসেবে গড়ে তুলতে হবে, সে কথা তিনি বারবার স্মরণ করিয়ে দিলেন। বিজয়ের আনন্দঘন পরিবেশের মধ্যেও আব্দুর অবয়বে বিরাজমান কোনাে গভীর চিন্তা। পাকিস্তানি বাহিনীর পরাজয় ঘটেছে। কিন্তু আনাচে-কানাচে তাে ছড়িয়ে রয়েছে তাদেরই চর, নতুন মুখােশ পরে। সেই চিন্তাই কি আব্ব করছিলেন, একই সঙ্গে তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ার হাজারাে পরিকল্পনা ? সেই দিনটির প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর টেক্সাস প্রবাসী | মুক্তিযােদ্ধা মাহবুব-উর-রহমান জালাল ই-মেইলে অ্যাটাচ করে আমার কাছে পাঠালেন ১৮ ডিসেম্বর ১৯৭১-ফারইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউয়ের প্রচ্ছদ। প্রচ্ছদে মুক্ত যশােরের এক প্রাঙ্গণে সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি পরিহিত গভীর চিন্তায় মগ্ন আব্দুর ছবি। তার সুগভীর দৃষ্টি সম্মুখে প্রসারিত। যেন তিনি দেখছেন ভবিষ্যৎকে। তার পাশেই কালাে আচকান, কালাে পায়জামা ও
কালাে টুপি পরিহিত খন্দকার মােশতাক। সে ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখছে। মুক্তিযােদ্ধা সৈনিকরা | পেছনে দাঁড়ানাে। সাদা ও কালাে, ভবিষ্যৎ ও অতীত। খুবই অর্থবহ ঐ প্রচ্ছদটি, প্রচ্ছদটির | শিরােনামটিও অর্থবহ। Bangladesh No Looking Back, (বাংলাদেশ পেছনে তাকিয়ে নেই) শুরু হয়েছে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রা। মােশতাকের ষড়যন্ত্র ধরা পড়ার পর আব্ব তাকে চোখে চোখে রাখতেন। যশোেরেও তিনি | তাকে সতর্কতার সঙ্গে কাছে রেখেছিলেন যাতে সে নতুন ষড়যন্ত্র পাকাতে না পারে।
| দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে আব্দুর দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষণীয়। ১০ ডিসেম্বর তার নেতৃত্বে যে সকল সরকারি কর্মচারী ও কর্মকর্তারা যুদ্ধাপরাধ করেছেন, তাদেরকে বিচারের অধীনে আনার সিদ্ধান্তটি গৃহীত হয়। ১৩ ডিসেম্বর, রাষ্ট্রীয় আইনের | মাধ্যমে দালালদের বিচারের বিষয়টি মন্ত্রিসভায় আলুর উদ্যোগে গৃহীত হয় যা আগেই উল্লেখ করেছি। যেন তিনি জানতেন যে স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে এই বিষবৃক্ষদের সমূলে উৎপাটিত করলে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ এক অসাম্প্রদায়িক, বৈষম্য মুক্ত ও সবল সুন্দর বাংলাদেশ গড়ে | তােলা সম্ভব নয়।
১১ ডিসেম্বর ভাের রাতে রিমিও রওয়ানা দিল মুক্ত যশােরের পথে। আম্মা আমাকে কয়েকবার ডাকলেন। আমি তখনাে গভীর ঘুমে। আমার ঘুম না ভাঙায় তিনি আর ডাকলেন না।
হয়তাে তিনি আমাদের দু’বােনকে এক সঙ্গে ছাড়তে চাননি। রাস্তাটি তখনাে নিরাপদ নয়। রিমি। ছােট হলে কী হবে, ছােটবেলা থেকেই সে ধীরস্থির, কর্তব্যপরায়ণ ও প্রচণ্ড দায়িত্বশীল । দেশ, সমাজ ও রাজনীতি সম্পর্কে তার প্রচণ্ড আগ্রহ ছােটবেলা থেকেই। মুক্ত যশাের যাওয়ার উৎসাহে সেই রাতে সে ভালাে মতাে ঘুমাতেই পারেনি। ভােরবেলা রিমি মিঠু-সােমাদের সঙ্গে যশােরের পথে রওনা দিল। মিঠুর বাবা, মেলােমশাই গাড়ি চালাচ্ছেন। সেই গাড়িতে মাসিমা, হাসান ভাইও আছেন। ওরা যশােরে গিয়ে দেখল চারদিকে বিপুল আনন্দ উচ্ছাস। যুদ্ধবন্দি পাকিস্তানি সৈন্য নিয়ে ধীরগতিতে সারি সারি ট্রাক এগিয়ে চলেছে। শােকাহত এক বৃদ্ধা, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর হাতে যার পুত্র সন্তানের মৃত্যু ঘটেছে, পাকিস্তানি সেনাদের লক্ষ করে কেঁদে কেঁদে যশােরের আঞ্চলিক ভাষায় বলছে – বাজান, একটারে নামায়ে দে, মেরে জান ঠান্ডা করি।’ রাস্ত রি দু’পাশে দাড়ানাে সারিবদ্ধ জনতা বন্দী পাকিস্তানি সেনাদের জুতাে তুলে দেখাচ্ছে। বিজয়ের আনন্দ ও উল্লাসের মধ্যেও স্বজন ও বন্ধু হারানাের অপরিসীম বেদনার চিহ্ন মুক্ত যশােরের আনাচে-কানাচে। যশাের মুক্ত হয়েছে। চারদিকে রব উঠেছে, ‘চলাে চলাে ঢাকা চলাে’—ঢাকাকে মুক্ত করতে হবে। ভারতীয় মিত্রবাহিনীর সঙ্গে মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে ঢাকার দিকে। উৎফুল্ল জনতা তাদের জানাচ্ছে প্রাণঢালা অভিনন্দন ও স্বাগতম । ঢাকায় পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পতন আসন্ন। আবু জেনারেল ওসমানীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি যেন প্রস্তুত থাকেন যেকোনাে সময় ঢাকায় যাওয়ার জন্য। কিন্তু তিনি বিভিন্ন রণাঙ্গন সফর করার জন্য ১১ ডিসেম্বর হতে কোলকাতার বাইরে ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর যেদিন ঢাকা মুক্ত হলাে সেদিন তিনি সিলেটে ছিলেন। পাকিস্তান বাহিনী তার হেলিকপ্টারকে আক্রমণ করে ভূপাতিত করে। তিনি ও তার সহযাত্রীরা অলৌকিকভাবে রক্ষা পান। জেনারেল ওসমানী উপস্থিত না থাকতে পারার কারণে ওসমানীর পরিবর্তে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার (পরবর্তী সময়ে এয়ার ভাইস মার্শাল) গেলেন মুক্ত ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে যেখানে সূচিত হতে যাচ্ছে শতাব্দীর এক ঐতিহাসিক আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান। তিরানব্বই হাজার সেনাবাহিনীসহ পাকিস্তানি জেনারেল এ. কে. নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন। | ঢাকা মুক্ত হয়েছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশ বিজয় লাভ করেছে। আমরা আনন্দে দিশেহারা। মুক্ত স্বদেশে ফিরে যাব সেই খুশিতে আমরা বিভাের। ২২ ডিসেম্বর আব্দু ও মন্ত্রিসভার সদস্যগণ ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করলেন। বিমানবন্দরে তাদের বিদায় দিতে এসেছিলেন ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনীপ্রধান খসরু রুস্তামজি, একই বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার আই.জি গােলােক মজুমদারসহ ভারতীয় প্রশাসনের অনেকে। বিমানবন্দরে আব্দুর সঙ্গে বিদায় করমর্দন করে রুস্তামজি বললেন, আশা করি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে বন্ধুত্ব চিরকাল অক্ষুন্ন থাকবে।’ আব্দু সামান্য রূঢ় স্বরে উত্তর দিলেন ‘হ্যা, সমতা সহকারেই বন্ধুত্ব হতে পারে। গােলক মজুমদার নম্রভাষী আব্দুর কাছ থেকে এই কঠোর উত্তর শুনে অবাক হয়ে গেলেন। স্বাধীনতার মােলাে বছর পর বন্ধু মিঘােকে নিয়ে যখন তার সাথে কোলকাতায় তাঁর সল্টলেক সিটির বাসভবনে দেখা করতে যাই তখন মুক্তিযুদ্ধকে ঘিরে আলাপচারিতার সময় আব্দুর ঐ উক্তি সম্বন্ধে তিনি মন্তব্য করেন, দেশের স্বার্থে তিনি রুস্তামজির মতাে মহৎ-প্রাণ মানুষ যিনি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে নানাভাবে সহায়তা করেছিলেন—তাঁকেও ছেড়ে কথা বলেননি।’৪৭ নেতা, কর্মী ও জনসাধারণের প্রাণঢালা সংবর্ধনার মধ্যে দিয়ে মন্ত্রিসভার সদস্যরা স্বদেশে প্রত্যাবর্তন করলেন। ঢাকার সচিবালয় প্রাঙ্গণে আন্ধু যে বক্তব্য রাখলেন তার মধ্যে ব্যক্ত হলাে বৈপ্লবিক বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন ও আহ্বান। তিনি বললেন, ‘শহীদের রক্তে বাংলাদেশের সবুজ মাটি লাল হয়েছে। শহীদের রক্তে উর্বর মাটিতে উৎপন্ন ফসল ভােগ করবে গরিব চাষি, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ। কোনাে শােষক জালেম ও সাম্রাজ্যবাদী শক্তি বাংলাদেশকে শােষণ করতে পারবে না। বাংলাদেশ একটি বিপ্লবী জাতি, যারা প্রশাসনিক কাজে নিয়ােজিত রয়েছেন তাদের বৈপ্লবিক চেতনা নিয়ে কাজ করে যেতে হবে এবং পুরনাে দৃষ্টিভঙ্গি ত্যাগ করে সাম্যবাদী অর্থনীতি, গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ কায়েম করা যখন সম্ভব হবে তখনই বিপ্লব সম্পূর্ণ হবে। | তিনি আরও বললেন, ‘আমরা যেন এমন কোনাে কাজ না করি যাতে মানুষ বলতে পারে পাকিস্তান ভালাে ছিল।’ প্রধানমন্ত্রী হিসেবে স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের পর মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ ছিল তার প্রথম সরকারি কার্যক্রম। তিনি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে গেলেন আহত মুক্তিযােদ্ধাদের দেখতে। ২১ নম্বর ওয়ার্ডটি সংরক্ষিত ছিল আহত মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য। তিনি প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধার কাছে গিয়ে তাদের খোঁজখবর নিলেন। ২৪ নম্বর বেডে শায়িত শ্রীপুর থানা ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক আবুল মনসুর খান, প্লাস্টারে বাঁধা তার ডান পা উঁচু করে রাখা। আব্দুর আত্মীয়, ময়মনসিংহের নিগুয়রীর আদি বাসিন্দা, কলেজের ২য় বর্ষের ছাত্র মনসুর শ্রীপুরে পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেন। ১৮ এপ্রিল পাকিস্তান বাহিনীর গুলি তার ডান পায়ের মাংস ভেদ করে চলে যায়। অধিক রক্তক্ষরণে মরণাপন্ন তিনি, গ্রামবাসী ও আত্মীয়স্বজনের সহায়তায় প্রাণে বেঁচে যান। ক্ষত না শুকাতেই আবারও যােগ দেন মুক্তিযুদ্ধে। তিনি কসবা বর্ডার দিয়ে ভারতের আগরতলায় যান এবং সেখান থেকে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে আসেন। শ্রীপুরে। অব্যাহত রাখেন প্রতিরােধ সংগ্রাম। ১৩ ডিসেম্বর তিনি ও তার সহযােদ্ধারা শ্রীপুর মুক্ত করেন। সেদিনই পাকিস্তানি বােমারু বিমানের হামলায় তিনি আবারাে আহত হন ঐ একই পায়ে। বােমার শলাকা তাঁর পায়ের হাড়ের গভীরে ঢুকে যায়। শেষ পর্যন্ত টিবিয়া বােনের চার ইঞ্চি কেটে ফেলতে হয়। দ্বিতীয়বারও তিনি প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু হাসপাতালে চিকিৎসাধীন থাকতে হয় এগারাে মাস। এরই মধ্যে সদ্য স্বদেশ প্রত্যাবর্তিত বিজয়ী প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার পুনরায় সাক্ষাৎ হাসপাতালের বেডে। আত্মীয়তার বাইরে তাজউদ্দীন তার এলাকার এই তরুণ মুক্তিযােদ্ধাকে স্নেহ করতেন। মনসুর প্রথমবার গুলিবিদ্ধ হওয়ার পর আব্দুর কাছে সংবাদ পেীছায় যে তিনি গুলিতে নিহত হয়েছেন। তাই এতদিন পর হঠাৎ করেই তাকে হাসপাতালে দেখে আল্লু অভিভূত হয়ে পড়েন। আন্ধু বলে ওঠেন, “আমি শুনেছিলাম…’ তারপরই বাকরুদ্ধ হয়ে পড়েন। | আব্দুর স্নেহভাজন আত্মীয় মনসুর; আমাদের মনসুর ভাই। আব্ব তার জন্য হাসপাতালে বিশেষ কোনাে সুবিধার ব্যবস্থা করলেন না। মুক্তিযােদ্ধা সকলেই তার সন্তান। সকলেরই প্রাপ্য একই সুযােগ ও সুবিধা, এই চিন্তার স্নিগ্ধতা তিনি ছড়িয়ে দিলেন সকল আহতের মধ্যে। | ৩১ ডিসেম্বরে আম্মা, আমরা চার ভাইবােন, বন্ধু মিঠু, হাসান ভাই ও রতন ভাই ভারতীয় বিমানে করে ঢাকার তেজগা বিমানবন্দরে পৌঁছলাম। আমাদের বরণ করতে চেনা ও অচেনা বহু মানুষ বিমানবন্দরে উপস্থিত। অনেকেই আম্মা ও আমাদের গলায় পরিয়ে দিলেন ফুলের মালা। | ধানমণ্ডির ২ নম্বর রােডের বাংলাদেশ রাইফেলসের হেডকোয়ার্টারের পাশেই বড় মামুর ভাড়া বাড়ি। ২৭ মার্চ সেই ঐতিহাসিক চিরকুট বহনকারী মুসা সাহেবের বাসার দোতলায় তিনি (১৩/২ এর বাসা ছেড়ে) ভাড়া নিয়েছেন। আমাদের দেখতে আত্মীয়স্বজন মানুষজনে সেই বাড়ি ভরপুর। আমরা সকলেই আদান-প্রদান করছি মুক্তিযুদ্ধের নয়টি মাসের স্মৃতি ও অভিজ্ঞতা। বড় মামু তার বাসায় আশ্রয় দিয়েছেন পাদ্যাবের অধিবাসী দুই সজ্জন অবাঙালি ব্যবসায়ীকে। ফারুক চাচা ও মহম্মদ আলী ভাই এই নামেই ছােটরা তাদের সম্বােধন করত। বড় মামুর সঙ্গে তাদের পরিচয় যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছু আগে । যুদ্ধের সময় পাঞ্জাবি সেনা, অধিকাংশ অবাঙালি বিহারি, জামায়াতে ইসলামী, আল বদর, রাজাকার, আল শামস ইত্যাদি উগ্রপন্থী দলগুলাে লাখ লাখ নিরীহ বাঙালিকে হত্যা করে ও মা-বােনকে ধর্ষণ করে। তাদের প্রতি তখন জনসাধারণের তুমুল ঘৃণা ও ক্ষোভ। বাংলাদেশ সরকার সে সময় বারবার নির্দেশ দিচ্ছে জনসাধারণ যেন প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ড থেকে বিরত থাকে। তারা যেন নিজ হাতে আইন না তুলে নেয়। অধিকাংশ বাঙালিই সেই নির্দেশ মান্য করে এবং ব্যক্তিগত ও দলীয়ভাবে মানবিকতা ও সংযমের পরিচয় দেয়। তা সত্ত্বেও অনেক অবাঙালি ও পাকিস্তানপন্থী জনসাধারণের রােষানলে পড়ে জানমাল হারায়। গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল চক্রান্তকারীরা অবশ্য আত্মগােপন করে এবং জামায়াতে ইসলামীর আমির গােলাম আযমসহ ঐ দলের নেতারা পাকিস্তান বা অন্য কোনাে দেশে পালিয়ে যায়। ঐ অস্থিরতার মধ্যেই ভীত-সন্ত্রস্ত ফারুক চাচা ও মহম্মদ আলী ভাইকে বড় মামু নিজ গৃহে সাদরে আশ্রয় দেন। ওদিকে বিজয়ের মাত্র ক’দিন আগেই বড় মামু ও তাঁর। পরিবার প্রাণে বেঁচে যান এক পাকিস্তানি সেনা অফিসারের বদান্যতায়। বিজয়ের চার মাস আগে বড় মামুর পাশের হিন্দু প্রতিবেশীর বাড়িটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী দখল করে নেয় এবং সেখানে ক্যাম্প স্থাপন করে। বাড়ির মালিক তার আগেই পরিবারসহ আত্মগােপন করেছেন। ক্যাম্প স্থাপনের পর ক্যাম্পের মেজর বোখারী নামের এই অফিসার বড় মামুর বাড়িতে যাতায়াত শুরু করেন। তার ব্যবহার খুব ভালাে। তিনি জানান যে পরিবার থেকে এতদিন বিচ্ছিন্ন হয়ে তার আর ভালাে লাগছে না। ঘরের খাবার, ঘরােয়া পরিবেশ ইত্যাদি তিনি খুব মিস করছেন। অতিথিপরায়ণ, উদারচিত্ত বড় মামু তাকে প্রায়ই মধ্যাহ্নভােজ বা নৈশভােজে ডেকে নিতেন। অফিসার বড় মামির রান্নার খুব প্রশংসা করতেন এবং বড় মামুকে সম্বােধন করতেন ‘ভাই’ বলে। ১৩ ডিসেম্বর সকালে কারফিউ ওঠার পর বড় মামু বাজার নিয়ে ঘরে ফেরেন। তার কিছুক্ষণ পরই সেই অফিসার ঘরে ঢুকে বড় মামুকে নিভৃতে কিছু কথা বলে বেরিয়ে যান। বড় মামু মামিকে বলেন যে অতিসত্বর ছেলেমেয়ে নিয়ে তিনি যেন গাড়িতে ওঠেন। গােটা বাজার রান্নাঘরে যেখানে আছে তেমনই থাকুক। ঘটনা গুরুতর। গাড়িতে উঠে বড় মামু ঘটনা খুলে বলেন। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী থেকে ঐ অফিসারকে নিয়ােগ করা হয়েছিল বড় মামুর ওপর নজর রাখতে। তারা জানত যে জোহরা তাজউদ্দীন তার বােন। বােনের সঙ্গে তার কোনাে যােগাযােগ রয়েছে কি না সে সম্বন্ধে তথ্য আদায়ের জন্য তিনি বড় মামুর সঙ্গে ভাব করেন। ক’মাস মেলামেশার পর বুঝতে পারেন যে বােনের সঙ্গে তার যােগাযােগ নেই। ঘর-সংসারের দায়িত্ব পালনেই এই ব্যক্তি ব্যস্ত। এরই মধ্যে ব্যক্তিগতভাবেও বড় মামুকে তাঁর ভালাে লেগে যায়। সেইদিন তিনি খবর পেয়েছেন যে আজ কিবরিয়া সাহেবের (বড় মামু) বাড়ির প্রতি বিশেষ নজর দেওয়া হবে। সংকেতটি গুরুতর। তিনি যেহেতু তাঁকে ভাই সম্বােধন করেছেন সেই কারণে ভাই হিসেবে তিনি এসেছেন তাকে সতর্ক করতে। অবিলম্বে কিবরিয়া ভাই যেন পরিবারসহ গৃহ ত্যাগ করেন।
অফিসারের সতর্কবাণী অনুসারে বড় মামু তার পরিবারকে নিয়ে আশ্রয় গ্রহণ করলেন ধানমণ্ডি থেকে অনেক দূরে গােপীবাগে তাঁর বন্ধুর বাড়িতে। ১৬ ডিসেম্বর ঢাকা মুক্ত হওয়ার পর বিজয়ের আনন্দমুখর পরিবেশে ফিরে এলেন নিজ গৃহে। ফিরে এসে বাড়ির কেয়ারটেকারের কাছে শুনলেন যে তিনি গৃহত্যাগ করার পর অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত অবাঙালি, বাঙালি রাজাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের বাড়ি ঘেরাও করে তল্লাশি চালায়। তারা যে ট্রাকে করে এসেছিল সেই। ট্রাকের মধ্যে কালাে কাপড়ে চোখ ও মুখ বাঁধা বেশ কিছু তরুণ ও মধ্যবয়সীকেও সে দেখতে পায়। তাদের কারাে কারাে আচরণে মনে হয় যে তারা যেন পিতা ও পুত্র বা নিকট আত্মীয়। কুখ্যাত বদরবাহিনী বুদ্ধিজীবীদের অনেককে তাে এভাবেই কালাে কাপড়ে চোখমুখ বেঁধে হত্যা করে বিজয়ের পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত।
বড় মামু ও তার পরিবারকে যে অফিসার বাঁচিয়েছিলেন তার খোঁজ বড় মামু স্বাধীনতার পর পান বহু কষ্টে। ঢাকা সেনানিবাসে তিনি ছিলেন অন্য যুদ্ধবন্দিদের সঙ্গে। বড় মামুকে দেখে তিনি হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। ভারতে এ P.o,w ক্যাম্পে না যাওয়া পর্যন্ত বড় মামু এই যুদ্ধবন্দির খোঁজখবর নিতেন। কখনাে তিনি তাঁর জন্য নিয়ে যেতেন শীতের কাপড়, খাবারদাবার ও অন্যান্য। প্রয়ােজনীয় সামগ্রী। | সীমা লঙ্ন, নিষ্ঠুরতা ও নিমর্মতার মধ্যেও মানবিকতার স্পর্শ যেন নতুন করে বেঁচে থাকার প্রেরণা জোগায়। আবার একই মানবজাতির মধ্যে দানবীয় আচার ও আচরণ প্রত্যক্ষ করে আমার ঐ নবীন বয়সেই মনে প্রশ্ন উদিত হয় নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, হত্যা, গণহত্যা ও যুদ্ধের প্রকৃত কারণ কী ! প্রশ্নটি নিয়ে নাড়াচাড়া করতেই পার হয়ে যায় জীবনের অনেকগুলাে অধ্যায়। পৃথিবীর যাবতীয় আধ্যাত্মিক দর্শন বলে যে অন্যায়, অবিচার, নিষ্ঠুরতা, হত্যা, গণহত্যা, যুদ্ধ প্রভৃতি মানবতাবিরােধী আচরণের মূল কারণ হলাে অহংবােধ (ego বা নাফস আল-আম্মারা) যা মানুষকে অজ্ঞ করে রাখে তার মানবজীবনের প্রকৃত লক্ষ্য সম্বন্ধে। অহংবােধে আচ্ছন্ন মানুষ বিস্মৃত হয় যে তার পৃথিবীতে জন্মানাের মূল কারণ ও লক্ষ্য হলাে উচ্চ-সত্যের (উচ্চ-সত্যকে অভিহিত করা হয় আল্লাহ, ভগবান, ঈশ্বর, গড় এবং আদি আমেরিকানদের ভাষায় ‘গ্রেট স্পিরিট” ইত্যাদি নানা নামে) সঙ্গে সংযােগ স্থাপন করা। সংযােগ স্থাপনের মূল দুটি উপাদান হলাে প্রেম ও জ্ঞান। যেকোনাে সভ্য সমাজের প্রাণশক্তি হিসেবে ঐ দুটি উপাদানের প্রয়ােগ যখন ব্যাপকভাবে ব্যাহত হয় তখনই সমাজের ভারসাম্য নষ্ট হয় এবং বৃদ্ধি পায় অন্যায়-অবিচার, নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, লােভ ও লালসা। (পরিশিষ্টে ‘শান্তির সন্ধানে’ প্রবন্ধে উল্লেখিত। পৃ. ২৫৭)।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সংঘটিত গণহত্যার কারণ খুঁজতে ও বিশ্লেষণ করতে গিয়ে পার হয়ে যায় কয়েক যুগ। বসন্তের প্রভাত অজান্তেই মিলে যায় হেমন্তের সন্ধ্যায় ।
৭৭-৯৯
সূর্য-বার্তা
এবারে ফিরে আসি আমার নবীন কৈশােরের সিংহদ্বারে। ১ জানুয়ারি ১৯৭২-এর দোরগােড়ায় ৩৫ নম্বর হেয়ার রােডের সরকারি বাসভবনে সেইদিন আমরা উঠলাম। প্রাচীন অশ্বথ ও ছায়াঘেরা গাছপালায় ঢাকা হালকা হলুদ রঙের এই বাসভবন। স্পেন ও মরদেশের ঐতিহ্যবাহী হালকা হলুদ এটেল মাটির রঙে রাঙানাে ব্রিটিশ যুগের এই বাসভবনটির এক ও দোতলাজুড়ে রয়েছে খােলা বারান্দা। নিচতলায় দোতলায় ওঠার সিড়ির বাঁ পাশে বসার ঘর, ডান পাশে খাবারঘর ও রান্নাঘর। এ ছাড়া পুরুষ আত্মীয়স্বজনের থাকার ঘর ও আব্দুর ব্যক্তিগত সহযােগীদের অফিস কক্ষ জলছাদে ঢাকা গাড়ি বারান্দা ছাড়িয়ে দক্ষিণ-পূর্ব দিকজুড়ে রয়েছে ফুলের বাগান, দূর্বাঘাসের গালিচায় টাকা প্রাঙ্গণ, দোলনা ও স্লাইড। পশ্চিমে বাড়ির সামনের প্রধান গেটের পাশে নিরাপত্তা পুলিশদের থাকার ব্যবস্থা। দোতলায় বারান্দার মুখােমুখি যেখানে সিঁড়ি শেষ হলাে ও তার বাঁ পাশের বড় ঘরটিকে প্রায়ই ব্যবহার করা হতাে পরিবারের কমনরুম হিসেবে ছােট্ট সােহেল উত্তরে আব্দুর গাড়ির চালক ও তার পরিবার, অন্যান্য কর্মচারী যেমন সুইপার, পাচক, মালি ও তাঁদের পরিবারের বাসগৃ ও মিমি ঐ ঘরে থাকত। কখনাে কখনাে আমরা চার ভাই-বােন একত্রে ঘুমাতাম। ঘরটির একপাশে বসার কিছু চেয়ার ও ছােট টেবিল পাতা। আম্মার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব কখনাে এই রুমটিতে বসে চা-নাস্তা খেতেন, কথাবার্তা বলতেন। আম্মার রেকর্ড প্লেয়ার, শাড়ি-কাপড় ও ব্যক্তিগত সামগ্রী এই ঘরটিতে থাকত। ঐ ঘরটির পাশে ছােট আরেকটি ঘর। কমনরুমের সঙ্গে লাগােয়া দরজা দিয়ে ঐ ছােট ঘরে প্রবেশ করা যেত। ওই ঘরটিতে আব্বু ও আম্মা থাকতেন। ঘরটিতে ছিল একটি মাঝারি আকারের আয়নাওয়ালা ড্রেসিং টেবিল, শশাবার খাট, বুকশেলফ ও পড়ার টেবিল-চেয়ার। ঘরটির দ্বিতীয় দরজাটি দক্ষিণের বারান্দার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল। দোতলার সিঁড়ির ডান পাশে কমনরুমের উল্টো দিকে ছিল আরও একটি বড় ঘর যার বেশ কিছু নামকরণ আমি করেছিলাম যেমন এমার্জেন্সি রুম, নিরাময় কেন্দ্র, সালিশ কেন্দ্র ইত্যাদি।
এই রুমটির দুই পাশে বড় খাট পাতা। চেয়ারটেবিলও রয়েছে। গ্রাম ও দূর-দূরান্ত থেকে আসা রােগী, দুস্থ অভাবী ও নানাবিধ সমস্যায় আক্রান্ত পরিবারের জন্য এই ঘরটি সংরক্ষিত ছিল। রিমিও এই ঘরটিতে থাকত। ঐ ছােটবেলা থেকেই দুর্দশাগ্রস্ত মানুষের সমস্যা লাঘবের জন্য রিমির কর্মদ্যোগ ও অস্তিরিকতা ছিল অতুলনীয়। নিরাময় কেন্দ্র—যার অপর নাম ছিল মধ্যের ঘর—তার সঙ্গের লাগােয়া দরজা দিয়ে পশ্চিমের ঘরটিতে প্রবেশ করা যেত। আব্দু-আম্মার ঘরের সমান আকারের এই ছােট ঘরটিতে থাকতেন আমাদের নানা বিষয়-সম্পত্তির প্রতি সদা নির্মোহ দার্শনিক অন্তর্দৃষ্টির এই বর্ষীয়ান শিক্ষাবিদ, তার জমিজমা যা ছিল তার সবটুকুই ভাগ করে দেন পাঁচ ছেলেমেয়ের মধ্যে। অবসর জীবনের অধিকাংশ সময় তিনি অতিবাহিত করেন তার ছােট ছেলে আমাদের ছােট মামুসৈয়দ গােলাম মাওলা ও ছােট মেয়ে লিলি, আমাদের আম্মার সঙ্গে নিরাময় কেন্দ্র মধ্যের ঘরের উত্তর দিকের ঘরটিতে আমি থাকতাম। ঐ ঘরটিও ছিল নিরাময় কেন্দ্র বা এমার্জেন্সি রুমেরই অপর এক্সটেনশন, অর্থাৎ রােগশােক তাপে ক্লিষ্ট অতিথিদের স্থান সঙ্কুলান না হলে তারা এ ঘরটিও ব্যবহার করতেন। আমার ঘরের জানালা দিয়ে দেখা যেত বাড়ির পেছনের একাংশ কর্মচারীদের বাসগৃহ ও প্রাচীন মহীরুহের ছায়াঘন সুগম্ভীর উপস্থিতি। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে আমাদের স্কুল খুলল। প্রায় দশ-মাস পর সহপাঠীদের সঙ্গে দেখা। সবার মধ্যে সে কী আনন্দ ও উল্লাস! সকলেই আমরা সােৎসাহে মুক্তিযুদ্ধের নয়-মাসের স্মৃতিচারণা করছি। আমার কিছু সহপাঠী ভারত-পাকিস্তান বিমানযুদ্ধের বর্ণনা দিল। ছাদের ওপর দাড়িয়ে হাত নেড়ে নিজ হাতে গড়া বাংলাদেশের পতাকা উড়িয়ে তারা বাংলাদেশের মিত্রবাহিনী ভারতীয় মিগের অন্তরীক্ষ অভিযানকে জানিয়েছে সাদর অভ্যর্থনা। পাকিস্তানি বিমান ভূপতিত হওয়ায় তারা উল্লসিত হয়ে চারদিক সরগরম করেছে। বিমানযুদ্ধের বর্ণনা শুনে মনে হলাে—ইশ আমিও যদি সেদিন ওদের সঙ্গে থাকতাম! ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারি জনগণ-মন-নন্দিত বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন করলেন।
আনন্দে আত্মহারা লক্ষ লক্ষ মানুষের ঢল চারদিকে তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে একনজর দেখার জন্য তারা ব্যাকুল। নেতা-কর্মী পরিবৃত বঙ্গবন্ধু উঠলেন খােলা ট্রাকে। লক্ষ লক্ষ জনতার প্রাণঢালা অভিনন্দনের মাঝ দিয়ে ট্রাকটি ধীর গতিতে চলল রেসকোর্স ময়দানের (বর্তমানে যার নাম সােহরাওয়ার্দী উদ্যান। ভবিষ্যতে এর সাথে হয়তাে স্বাধীনতা পার্ক নামকরণ যুক্ত হবে) উদ্দেশে। সেখানে তিনি ভাষণ দেবেন। মুজিব কাকুর পাশেই আনন্দে উদ্বেলিত আব্বু দাড়িয়ে রয়েছেন। হঠাৎ মুজিব কাকু আন্ধুর কানের কাছে মুখ নামিয়ে বললেন, তাজউদ্দীন, আমি কিন্তু প্রধানমন্ত্রী হব !”
১২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আম্মাসহ আমরা বঙ্গভবনে গেলাম। নতুন মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে আন্ধু মুজিব কাকুর কাছে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার সমর্পণ করলেন। উদ্দীপ্ত ঝলমলে হাসিভরা মুখে আবু বললেন, ‘আজ আমার জীবনের সবচেয়ে আনন্দের দিন। নেতার অনুপস্থিতিতে মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে জড়িত থেকে দেশকে স্বাধীন করেছি। আবার নেতাকে মুক্ত করে তাঁরই হাতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বভার তুলে দিয়ে আমি নিজেকে ধন্য মনে করছি। অন্তত ইতিহাসের পাতার এককোনায় আমার নামটা লেখা থাকবে। আম্মার পাশে বসে আব্দুর হাসিডরা গৌরবদীপ্ত মুখ, মুজিব কাকুর আত্মপ্রত্যয়ী অভিব্যক্তি ও চারদিকের আনন্দঘন পরিবেশ দেখে সেদিন মনে হয়েছিল আর শঙ্কা নেই। বাংলাদেশের সুদিন বুঝি ফিরে এল স্কুল থেকে ফিরে আমাদের সময় কেটে যেত খেলা আর খেলায় আমাদের বাড়ির পেছনের কর্মচারীদের ছেলেমেয়েদের অনেকে আমাদের সঙ্গে খেলায় যােগ দিত। খেলার সঙ্গীদের মধ্যে সবচেয়ে তুখােড় ছিল শাহনাজ, আমারই সমবয়সী। ওর বাবা দিনাজপুরের সাঁওতাল অঞ্চলের অধিবাসী ছিলেন, নাম মংলু। আমরা ডাকতাম মংলু ভাই বলে। দোহারা গড়ন, এক মাথা কোঁকড়া চুল, নিকষ কালাে রঙের, পেশিবহুল, পেটানাে শরীর, মুখ ভরা বিস্ত্র হাসি—এই হলাে মংলু ভাই। আমার নানিবাড়ি দিনাজপুরের ফুলবাড়িতে কাটিয়েছেন জীবনের বেশ কিছু বছর। পরবর্তী সময়ে বিআরটিসি বাসের মেকানিক হিসেবে চাকরি নেন ঢাকা শহরে মুক্তিযুদ্ধের সময় সর্বস্বান্ত মংলু ভাই আব্দুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর তাঁর শরণাপন্ন হন। মগবাজারে মেজ মামু ও ছােট মামুর পাশাপাশি বাড়ি নানা তখন ছােট মামুর বাড়িতে অবস্থান করছেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অপেক্ষাকৃত ভদ্র প্রথম দলটি চলে যাওয়ার পর দ্বিতীয় যে দলটি আসে তারা নানার সাথে রুক্ষ আচরণ শুরু করে, এরই মধ্যে নানা অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং হাসপাতালে ভর্তি কারণ দেখিয়ে আমাদের বাসা ত্যাগ করেন। পিজি হাসপাতালে চিকিৎসা গ্রহণের পর তিনি ছােট মামুর বাসায় চলে যান।
আব্বু, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও আরও জনাপাঁচেক সহকর্মীসহ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের সন্ধ্যায় তাদের সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। ছােট মামু পরিবারসহ মামির বাড়ি বরিশালের উলানিয়া থেকে ঢাকায় ফেরত এসেছেন মাস খানেক আগে ঘরের সব আসবাবপত্র, এমনকি সিলিং ফ্যান পর্যন্ত, তাদের অবর্তমানে লুটপাট হয়ে যায়। আব্দুদের জন্য বারান্দায় পাটি পেতে দেওয়া হলাে। ছােট মামি মুড়ি ও চা দিয়ে আপ্যায়ন করলেন। সেখানেই মংলু ভাই দেখা করলেন আব্দুর সঙ্গে চার নাবালক সন্তান, এক অন্তঃসত্ত্বা কন্যা, নাতনি ও স্ত্রীর ভরণপােষণের দায়িত্ব মংলু ভাইয়ের কাঁধে অথচ তিনি তখন সর্বস্বান্ত । মেয়ের জামাইও নিখোঁজ পাড়ার মাস্ত নিরা বিজয় দিনের সন্ধ্যায় তাকে ধরে নিয়ে যায়। দিশেহারা মংলু ভাইকে আন্ধু সান্ত্বনা দিলেন। আল্লুর উদ্যোগে পরিবারসহ তাদের জন্য হেয়ার রােডের বাসভবনে কর্মচারীদের এলাকায় বসবাসের ব্যবস্থা করা হয়। অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়া পর্যন্ত দুই বছরের বেশি মংলু ভাই ও তার পরিবার সেখানেই বসবাস করতেন। খেলতে খেলতে প্রায়ই চলে যেতাম কর্মচারীদের এলাকায়। আব্দুর সরকারি গাড়ির ড্রাইভারের বউটি ছিল ফুটফুটে সুন্দরী, কিন্তু দারুণ মুখরা। আমাকে দেখলেই গলার স্বর নামিয়ে ফেলত এবং গুনগুন করে সুইপারের বউয়ের সঙ্গে ঝগড়া চালিয়ে যেত। মংলু ভাইয়ের বেড়া দিয়ে ঘেরা দুটি ঘর পরিপাটি করে রাখা, ছােট উঠানে লাকড়ির চুলা। শাহনাজের মা মরিয়ম বিবি মুর্শিদাবাদের মেয়ে, আমরা সম্বােধন করতাম ভাবি বলে।
ভুনা পছন্দ করতাম বলে প্রায়ই তিনি সেটা আমার জন্য বেঁধে রাখতেন। ওখানে গেলে দেখা হয়ে যেত হুসনা আপার সঙ্গে, শাহনাজের বড় বােন। ছিপছিপে গড়ন, দুধে-আলতাবরণ, টানা টানা চোখ কোমরে তার লুটিয়ে পড়ত মেঘবর্ণের একরাশ ঘন চুল, বয়স বড়জোর একুশ ঘরের জানালা দিয়ে উদাস নয়নে তিনি বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকতেন। ঝরনাধারার মতাে তার চোখ বেয়ে পড়ত জল ফকরে আলমকে তিনি তখনাে খুঁজছেন। ১৯৬৯ সালের নভেম্বর মাসে হুসনা আপার সঙ্গে ইস্পাহানি কোম্পানির গাড়ির ড্রাইভার। অবাঙালি ফকরে আলমের বিয়ে হয়। সােহেলকে নিয়ে সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা আম্মা ও আমরা তিন বােন সেই বিয়ের অনুষ্ঠানে যােগ দিয়েছিলাম। সে সময়ের জনপ্রিয় ছায়াছবি ‘সাতভাই চম্পায়’ নায়িকা কবরীর এক সখীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়ে হুসনা আপা অনেকের নজর কেড়েছিলেন। বিয়ের পর তার অভিনয়ে ছেদ পড়ে। ঘর-সংসার নিয়ে হুসনা আপা ব্যস্ত হয়ে পড়েন। প্রথম কন্যাসন্তান সাহানার জম্মের পর শিশু সাহানা ও ফকরে আলমসহ আমাদের বাসায় বেড়াতে আসেন। সঙ্গে বাক্সভড়া মিষ্টি। সেই নম্রভাষী, নির্বিরােধী ফকরে আলমকে তাঁদের মগবাজারের ইস্পাহানির কোয়ার্টার থেকে বিজয় দিবসের দিন সন্ধ্যা ৬টায় মুক্তিযােদ্ধা নামধারী পাড়ার কিছু মাস্তান যুবক অস্ত্রের মুখে ধরে নিয়ে যায়। তার অপরাধ, তিনি অবাঙালিবিহারি। পুত্র-সন্তান শাহ আলমকে (বাফিল) নিয়ে অন্তঃসত্ত্বা হসনা আপা অনুনয় করে বলে, ‘আমি বাঙালি। ফকরে আলম নির্বিরােধী মানুষ তাকে মারবেন না। অস্ত্রধারীরা আশ্বাস দেয়, ‘আমরা আলমকে মারব না ছেড়ে দেব। রাত ২টায় ঐ মাস্তান দলের একজন ফোন করে জানায় তারা ফকরে আলমকে মধ্যরাতে ছেড়ে দিয়েছে। কিন্তু বাড়ি ফেরার পথে মগবাজার শাহ সাহেব বাড়ির মাজারের কাছ থেকে অন্য দল তাকে তুলে নিয়ে গিয়েছে। পরদিন দ্বিতীয় দলের অপর এক ব্যক্তি ফোন করে জানাল যে ফকরে আলমকে হত্যা করে তার লাশ খালে ফেলা দেওয়া হয়েছে। ফকরে আলমের মা কেঁদে। বললেন, ‘অন্তত লাশটিকে তাে ফেরত দিতে পারত।’ উড়াে খবর, বিশ্বাস করতে হুসনা আপার মন চাইল না। আশা নিরাশার মধ্যে দিন পার হতে লাগল।
ফকরে আলম আর ফিরে এল না। হুসনা আপারও অপেক্ষার শেষ হলাে না। ১৭ জানুয়ারি ১৯৭২ বহু দর্শনার্থীর ভিড় ঠেলে হসনা আপা হেয়ার রােডের বাড়ির নিচতলার ঘরে ঢুকলেন। আবু তখন অর্থসচিব মতিউল ইসলামের সঙ্গে যুদ্ধ-বিধ্বস্ত নবজাত রাষ্ট্রের অর্থনীতি বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনায় বসেছেন। এরই মধ্যে হুসনা আপার বিলাপে আলােচনা বন্ধ করতে হলাে। তিনি কাঁদতে কাঁদতে আন্ধুকে অনুরােধ করলেন ফকরে আলমকে উদ্ধারের জন্য আব্বু সেই মুহূর্তেই আইজি-কে ফোন করে বিষয়টি অবহিত করলেন ফকরে আলমের ছবি দিয়ে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন জেলখানায় খোঁজ লাগালেন। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার পরিদর্শনের সময় ব্যক্তিগতভাবে আব্বু নিজেও ফকরে আলমের খোঁজ করলেন সবই বৃথা। আন্ধু একদিন ডেকে পাঠালেন হুসনা আপাকে তার মাথায় হাত বুলিয়ে ব্যথিত কণ্ঠে বললেন, মা, ধৈর্য ধরাে। ও বেঁচে নেই।’ ঐ ঘটনার বছর খানেক পর ফকরে আলমের মা শামসুন্নিসা এলেন আম্মার সঙ্গে দেখা করতে, সঙ্গে হুসনা আপা। দোতলার পারিবারিক কমনরুমে আমি তাদের বসালাম বিধবা মায়ের একমাত্র সন্তান ছিল ফকরে আলম শৈশবে পিতৃহারা শিশুপুত্রকে এই মা বহু কষ্টে বড় করেছিলেন আম্মা তাঁর হাত ধরে সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করলেন। শােকাহত মা এক হৃদয় নিংড়ানাে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘আমার ছেলে অসময়ে চলে গেল সেটি আল্লাহর ইচ্ছা। বাংলাদেশের বুকে তাঁকে রেখে গেলাম।’ ১৯৭৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি, হুসনা আপা ও দুই নাতিনাতনিসহ করাচিতে আত্মীয়স্বজনের কাছে চলে যান।
স্বাধীন দেশের মাটিতে ২৯ ফেব্রুয়ারি আমার ১২তম জন্মদিন পালিত হলাে। লিপ-ইয়ারে ভূমিষ্ঠ হওয়ার কারণে ঐ দিনটিকে আমার তৃতীয় জম্মদিন হিসেবেও ধরা যেতে পারে।
জম্মদিন, ভরা পূর্ণিমার রাতে গানের জলসা, গহিন বনে চড়ুইভাতি, দৌড় ও সাঁতার প্রতিযােগিতা, এ ধরনের আনন্দময় উৎসবগুলাে পালিত ও আয়ােজিত হতাে আম্মার উৎসাহে। আম্মার উৎসাহে আব্দু বাধা দিতেন না, কিন্তু নিজেকে সযতনে আড়াল করে রাখতেন লাজুক কিশােরের মতাে। আব্দুর প্রতিটা মুহূর্তই যেন নিবেদিত ছিল দেশের কল্যাণে কখনাে কখনাে যখন তিনি উপস্থিত হতেন আমাদের আনন্দ উৎসবে, তার ঠোটের কোণে লেগে থাকত এক চিলতে লাজুক হাসি তার চোখের দ্যুতিতে সামান্য বিস্ময়। আমার জম্মদিনের সন্ধ্যায় তিনি সারাদিনের কাজ সেরে বাড়ি ফিরলেন। বাড়ি তখন আত্মীয়স্বজন, বন্ধু-বান্ধবের সরব উপস্থিতিতে গমগম করছে। অতি উৎসাহী কিছু তরুণ আত্মীয় দক্ষিণের বারান্দায় ব্যান্ডের তালে তালে সােৎসাহে গাইছে ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু। আযম খানের এই গানটি তখন খুবই জনপ্রিয়। এরই মধ্যে শাড়ি পরা খােপা বাঁধা আমাকে দেখে আল্লু অবাক হয়ে গেলেন। মাথায় হাত বুলিয়ে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালেন। তারপর নিভৃতে ঘরে ডেকে নিয়ে স্মরণ করিয়ে দিলেন তার প্রিয়তমা যুদ্ধ-বিধ্বস্ত বাংলাদেশের দুরবস্থা। বললেন, সংবরণ-সংযমের কথা এমনভাবে যেন আমাকে একাকী লক্ষ্য করে নয়, তার মধ্যে শরিক তিনি নিজেও। তার কিশােরী কন্যাকে বিনম্রভাবে উপদেশ দিলেন উপদেশ না দেওয়ার ছলে। একটু পর আমি ফিরে গেলাম ব্যান্ডের কাছে। আমার অনুরােধে ব্যান্ডের বাজনা থেমে গেল। আমাদের যুগে জন্মদিনের প্রধান উপহার ছিল বই। তরুণ রাজনীতিক আ, স, ম, আবদুর রব তার উপহার দেওয়া সুকান্ত সমগ্রের পাতায় লিখলেন, রিপি, আমি বাংলাদেশে পৃথিবী দেখতে চাই। তােমরা তা বাস্তবে দেখ।’ রবিঠাকুরের গল্পগুচ্ছের পাতায় লিখলেন, “রিপি, আজ তােমার জম্মদিন।
কারাে মৃত্যু দিন। বড় হয়ে মনে রেখাে’ উপহার-স্বরূপ আরও পেলাম রবিঠাকুরের ‘সঞ্চয়িতা’। উপহারদাতা অপর তরুণ নেতা নূর-এ-আলম সিদ্দিকী। কাজী নজরুল ইসলামের ‘সঞ্চিতা’, মীর মােশাররফ হােসেনের ঐতিহাসিক উপন্যাস ‘কারবালার প্রান্তর’ বইগুলােও ছিল উপহারের সারিতে। সুকান্তের বিদ্রোহের কবিতা এতই ভালাে লেগে গেল যে তাকে ধন্যবাদ জানিয়ে জন্মদিনের রাতেই লিখে ফেললাম এক চিঠি। অনন্ত লােকের অধিবাসীর কাছে লেখা সেই আমার প্রথম চিঠি। তার ঠিকানা খুঁজতে গিয়ে যখন জানলাম যে মাত্র একুশ বছর বয়সেই বাংলা কাব্যের এই প্রতিভাবান তরুণের মহাপ্রয়াণ ঘটেছে, তখন আমি কেঁদেই খুন। জ্বরের কারণে স্কুল কামাইয়ের দিনগুলােতে একনাগাড়ে পড়ে শেষ করলাম ‘কারবালার প্রান্তরে’। উপন্যাসের গাঁথুনি ও সাবলীলতা মন ছুঁয়ে গেল। নানার ঘরে ইমাম গাজ্জালি ও শেখ সাদির দর্শন ও কাব্য শােনার ফাকে ফাকে শুরু করলাম রবিঠাকুরের গল্পগুচ্ছ পড়া। এক ঝড়ের রাতে বিদ্যুৎ চলে গেল। আমি দৌড়ে গেলাম নানার ঘরে। মােমবাতির মৃদু আলাের কম্পন শরীরে মেখে শেষ করলাম রবিঠাকুরের ‘নষ্টনীড়’ প্রেমের গল্পটি। আব্দুর ঘরের সামনের অপেক্ষাকৃত নিরিবিলি বারান্দাটি বেছে নিলাম কবিতা পড়ার জন্য। সঞ্চয়িতার বধূ’ কবিতাটি পড়লাম বারবার। অজান্তেই মুখস্থ হয়ে গেল পুরাে কবিতা।
বেলা যে পড়ে এল জলকে চল।
পুরানাে সেই সুরে কে যেন ডাকে দূরে
কোথা সে ছায়া সখী, কোথা সে জল।
কোথা সে বাধা ঘাট অশ্বথ তল
এরই মধ্যে পুনরায় গান শেখা শুরু হলাে মূলত আম্মার উৎসাহে।
১৯৭০ সালে রিমি ও আমার হারমােনিয়ামে হাতেখড়ি। আমাদের গানের প্রথম শিক্ষক ছিলেন আবু সাঈদ স্যার ও নাচের প্রথম শিক্ষক আসাদ স্যার ও শারমিন আপা ১৯৬৭ সালে আম্মা, রিমি ও আমাকে নাচের স্কুলে ভর্তি করে দেন। ১৯৬৮-তে রিমি, আমি, সীমা ও পপি টিভিতে ছােটদের দলীয় কথক নৃত্যে প্রথম পুরস্কার পাই। গওহর জামিল ছিলেন বিচারক। শিল্পী নাশিদ কামাল (ইভু) আমাদের নাম ঘােষণা করেছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান টেলিভিশনের একমাত্র মহিলা স্টাফ, অনুষ্ঠান উপস্থাপিকা মাসুমা খাতুন ছিলেন ছােটদের অনুষ্ঠানের হােস্ট। স্টুডিও থেকে বেরিয়ে আসতেই তিনি আমাদের জড়িয়ে ধরে প্রাণঢালা অভিনন্দন জানিয়েছিলেন। ছােটদের প্রতি তার আন্তরিক স্নেহ, সহানুভূতি ও প্রেরণার কারণে তিনি ছােটদের মধ্যেও ছিলেন বিশেষ জনপ্রিয়। এবারে আবু সাঈদ স্যারের উৎসাহে তার অন্যান্য ছাত্রছাত্রীর সঙ্গে স্বাধীন বাংলাদেশের টিভিতে রিমি ও আমি গাইলাম বসন্তবরণের গান। সাকিনা সারওয়ার ছিলেন সেই অনুষ্ঠানের প্রযােজক। ছুটির দিনে পালা করে আমরা হারমােনিয়ামে তুলতাম ভৈরবী-পূরবী রাগের ঝঙ্কার পরবর্তী শিক্ষক পি. সি গােমেজ শেখালেন আরও কিছু হিন্দুস্থানি রাগ-রাগিণী এবং আমাদের প্রিয় বেশ কিছু রবীন্দ্রসংগীত। আব্দুর ঘরের সামনের বারান্দাটি আমার খুব পছন্দের ছিল। ঐ বারান্দা থেকে দেখা যেত প্রাচীন গাছপালায় ঘেরা আমাদের খেলার মাঠ, দোলনা, স্লাইড, ব্যাডমিন্টনের কোর্ট ও অজস্র ফুলের সমারােহ। আগ্রহ ভরে আম্মাকে একদিন হারমােনিয়ামে সদ্য তােলা ‘চাঁদের হাসির বাঁধ ভেঙেছে’ গানটি গেয়ে শােনালাম। আম্মা তন্ময় হয়ে গানটি শুনলেন। তখন ঘন সন্ধ্যা, আল্লু অফিস থেকে বাড়ি ফিরেছেন। আম্মার নির্দেশে আবারও আল্লুকে গানটি গেয়ে শােনালাম। আবু দাঁড়িয়ে গানটি শুনলেন। তারপর মিষ্টি হেসে বললেন, মনে হয় সেদিনের কথা রিপি মাত্র কথা বলতে শিখেছে, অন্ধকারকে বলত বন্ধকার’ আর সে কি না আজ গান গেয়ে শােনাচ্ছে !’ আব্দুর স্মৃতিচারণ আর বেশি দূর এগুলাে না। পিএ খবর দিল, নিচে বেশ কিছু দর্শনার্থী আব্দুর সাক্ষাৎপ্রার্থী আব্দুর সবচেয়ে ছােট বােন, আমাদের বুলবুল ফুফুর বড় মেয়ে রেখা আপা প্রায় সবধরনের খেলাতেই ছিলেন সমান পারদর্শী।
সাইকেল চালানােতে ছিলেন বিশেষ পটু। তিনি যত্নের সঙ্গে রিমি ও আমাকে সাইকেল চালানাে শেখালেন। ছােট কোনাে লেডিজ বাইক নয়, একেবারে বড়দের উচু কালো রডওয়ালা সাইকেল বারবার আছাড় খেতে খেতে যখন সাইকেল চালানাে অভ্যাস করছি তখন হঠাৎই আন্ধু আমাকে দেখে ফেললেন। সঙ্গে কালীগঞ্জ থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের সাংসদ ময়েজউদ্দিন আহমেদ (১৯৮৫ সালে রাজনৈতিক মিছিলে এরশাদ দলের সন্ত্রাসীর ছুরিকাঘাতে নিহত) ও সাভারের সাংসদ আনােয়ার জং সাহেব। তাদের বিদায় দিতে আলু নিচতলার অফিসকক্ষ থেকে গাড়ি বারান্দায় এসেছেন। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। আমাকে সাইকেল চালাতে দেখে ময়েজউদ্দিন সাহেব আগ্রহ ভরে এগিয়ে এসে বললেন, ‘মা, তােমার সাইকেলটা একটু চালাতে পারি ?’ আমি সােৎসাহে মাথা নাড়তেই তিনি সাইকেল চালানাে শুরু করলেন। বললেন, বর্তমানে প্র্যাকটিস নেই কিন্তু একসময় খুব চালাতেন। এরপর আনােয়ার জং সাহেবের সাইকেল চালানাের পালা। নিমেষেই তারা যেন ফিরে গেলেন তাদের কৈশােরে। রােমন্থন করতে লাগলেন তাঁদের নবীন বয়সের স্মৃতি আব্বু বললেন, কলেজ জীবনে সাইকেল চালিয়ে তিনি বিভিন্ন অঞ্চলে যেতেন রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা চালাতে এর কিছুদিন পর আলু সত্যি সত্যিই নিজের জন্য একটি সাইকেল কিনে ফেললেন এবং নিরাপত্তা অফিসারদের চোখ এড়িয়ে বেরিয়ে যেতেন বিভিন্ন জায়গায়, এমনকি তাঁতিবাজারে আমার খালার বাড়ি পর্যন্ত আব্বু কোনাে কৃত্রিম জীবনব্যবস্থা পছন্দ করতেন না। সহজ-সরল অনাড়ম্বর জীবনের মধ্যে তিনি খুঁজে পেতেন মুক্তির স্বাদ। ব্যাডমিন্টন কোর্টে আম্মার সঙ্গে আমরা ব্যাডমিন্টন খেলতাম। সময় পেলে আব্দুও খেলায় যােগ দিতেন। আম্মা মাঝে মাঝে আমাদের সঙ্গে দৌড়ের প্রতিযােগিতা করতেন।
আম্মার দ্রুতগতির সঙ্গে আমরা তাল মেলাতে পারতাম না। আমাকে সাত মাসের পেটে নিয়ে আম্মা দরদরিয়া গ্রামে আত্মীয়স্বজনকে দৌড়ের প্রতিযােগিতায় চ্যালেঞ্জ করেছিলেন। সেই প্রতিযােগিতায় সবার আগে ফিনিশ লাইন অতিক্রম করে জিতলেন বটে কিন্তু গতি রােধ করতে পেরে সামনের খাড়া পুকুরপাড় থেকে সােজা নিচে পড়ে গেলেন। পড়তে পড়তে আম্মা তাৎক্ষণিকভাবে দুটো হাঁটু একত্র করে বুকের কাছে নিয়ে ঝুপ করে পড়লেন পুকুরপাড়ের নরম কাদার ওপর। সেখান থেকে এক সাঁতারে গিয়ে উঠলেন পুকুরের অপর পাড়ে। এই হলেন আম্মা দুরন্ত দুঃসাহসী। আর আমি যে অলৌকিকভাবে পরম করুণাময়ের কৃপায় বেঁচে গেলাম সেটিও মহাভাগ্য। আম্মা শত ব্যস্ততার মধ্যেও শুরু করলেন লেখা। মুক্তিযুদ্ধের জানা-অজানা বহু ঐতিহাসিক ঘটনার বুনন দিয়ে সৃষ্ট এই স্মৃতিকথার নাম ছিল ‘উদয়ের পথে’। ধারাবাহিকভাবে লেখাটি দৈনিক বাংলা পত্রিকায় প্রকাশিত হতাে। আম্মার চমৎকার লেখার হাত এবং স্মৃতিকথার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও প্রাসঙ্গিকতার কারণে ‘উদয়ের পথে’ জনপ্রিয়তা লাভ করে। আমার সহপাঠীরাও লেখাটি মনােযােগের সঙ্গে পড়ত। এক বছরের ঊর্ধ্ব সময় পর্যন্ত লেখাটি প্রকাশ হওয়ায় আম্মা পত্রিকার জন্য লেখা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হন। স্মৃতিকথায় মুজিব কাকুকে কেন্দ্র করে কিছু ঘটনা ব্যক্ত করায় মুজিব কাকু অসম্ভষ্টি প্রকাশ করেন। পত্রিকার সম্পাদককেও তিনি তার অসন্তুষ্টির কথা জানান। আলু সে সময় একটি মন্তব্য করেন যে সমকালীন সময়ে ইতিহাস -লেখাই শ্রেয়, তাতে জীবিত ব্যক্তিদের সঙ্গে সংঘর্ষ হতে পারে। ১৯৭১-এ ভারত ও বাংলাদেশের চুক্তি অনুযায়ী ১৯৭২-এর ১৫ মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রত্যাহার হয়। আব্দুর উদ্যোগে সূচিত দূরদৃষ্টিসম্পন্ন চুক্তি এবং সৈন্য প্রত্যাহারের মাধ্যমে এ চুক্তির প্রতি ভারতীয় সরকারের শ্রদ্ধা প্রদর্শন সারা বিশ্বের জন্যই ছিল গৌরববাজ্জ্বল এক বিরল দৃষ্টান্ত।
কাঁচা আমের মৌসুমে আমরা দরদরিয়া গ্রামে গেলাম আন্ধু ও আম্মার সঙ্গে। আমাদের নিয়ে হেলিকপ্টারটি অবতরণ করল দরদরিয়া প্রাইমারি স্কুলের খেলার মাঠে। আমাদের বরণ করতে এসেছে অগণিত মানুষ। হেলিকপ্টার থেকে নামতেই রিমি, আমি দৌড়ে গেলাম বাড়ির দিকে। পশ্চিমের কোঠাবাড়ি, যেখানে আল্লুর জন্ম, হানাদার বাহিনী সেটা পুড়িয়ে দিয়েছে। আমাদের প্রপিতামহের সময়ের গজারি কাঠ ও এটেল লাল মাটির মিলনে গঠিত কাঠের বারন্দা দিয়ে ঘেরা এই দোতলা বাড়িটির জায়গায় দাঁড়িয়ে রয়েছে কঙ্কাল পােড়ামাটি। মানুষজন আগ্রহভরে বললেন যে, দেশ স্বাধীন হয়েছে এখন আর চিন্তা নেই। ঐ পােড়া-ভিটায় আবারাে বাড়ি উঠবে। আব্বু উত্তর দিলেন, যত দিন বাংলাদেশের ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের বসবাসের ব্যবস্থা না হবে তত দিন ঐ ভিটায় বাড়ি উঠবে না। (আন্ধু বেঁচে থাকতে ঐ ভিটায় বাড়ি ওঠেনি। মফিজ কাকুর পরিবার বহু পরে একটি সাধারণ ঘর তুলেছিলেন।) এলাকার উন্নয়ন প্রসঙ্গে আন্ধু বললেন যে, তিনি তাে শুধু তার এলাকার মন্ত্রী নন, তিনি সারা বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী উন্নয়ন শুরু করতে হবে সারা বাংলাদেশেই, সমানভাবে তার এলাকাকে প্রাধান্য দিলে তা হবে স্বার্থপরের মতাে কাজ। এ প্রসঙ্গে আব্বু এক সহজ সুন্দর উদাহরণ টানলেন। বললেন, আমাদের দেশের রীতি হলাে মেহমানকে আদর-যত্ন করে ভালাে ভালাে খাবার খাইয়ে তারপর যা থাকে নিজেরা ভাগ করে খাওয়া। সুতরাং এলাকাবাসীকেও চিন্তা করতে হবে সামগ্রিকভাবে। সারা বাংলাদেশকে আদর-যত্ন করে গড়ার কথা ভাবনায় রাখতে হবে। আমরা একনিষ্ঠভাবে আলুর কথা শুনছি, হৃদয়ে গেঁথে নিচ্ছি তাঁর প্রতিটি কথা। প্রত্যক্ষ করছি তার কাজের মাঝে কথার অসামান্য প্রতিফলনকে।
আব্বু দরদরিয়ার আশপাশের বিভিন্ন ইউনিয়ন পরিদর্শনে গেলেন। তিনি হেঁটে রওনা দিয়েছেন। আমি আন্ধুকে বললাম, আমিও যেতে চাই।’ আল্লু খুশি মনে সায় দিয়ে বললেন, ‘অনেক দূর হাঁটতে হবে, পারবি হাঁটতে ? আমি আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে বললাম, ‘পারব’। আমার জামার পেছনের বােতাম ছেড়া ছিল। আমি দৌড়ে দক্ষিণের কোঠায় বসা আম্মার কাছে একটা সেফটিপিন চাইলাম। আম্মা ব্যাগ থেকে সেফটিপিন বের করে আমার এই অতি ব্যবহৃত জামায় গেঁথে বললেন, ‘আন্ধুর মেয়ে হয়েছ আন্ধুর মতােই। জামাকাপড়ের দিকে খেয়াল নেই।’ আম্মার কথা শেষ না হতেই আমি দৌড়ে গেলাম আব্দুর দলটিকে ধরতে। আল্লু তখন ঘন গজারিবনের পাশে বিস্তীর্ণ ধানক্ষেতের আইলের ওপর দিয়ে রওনা দিয়েছেন এলাকা পরিদর্শনে। আব্দুর স্মরণশক্তি ছিল অতুলনীয়। তিনি এলাকাবাসীর প্রায় সকলের নাম-ধাম এবং হাঁড়ির খবর রাখতেন। প্রতিটি গাছপালা, লতাগুল্মের সাথেও ছিল তাঁর নিবিড় পরিচয় এরপর আব্দুর সফরসঙ্গী হলাম ময়মনসিংহের কিশােরগঞ্জে। নভেম্বরে আম্মা ও সব ভাইবােনসহ আন্ধুর সঙ্গে চট্টগ্রামের কক্সবাজার, রাঙামাটিসহ আশপাশের এলাকাগুলাে ঘুরলাম। এটি ছিল আব্দুর সাংগঠনিক সফরসহ প্রাথমিক শিক্ষকদের সম্মেলনে যােগদান এবং আমাদের (সব ভাইবােনের) প্রথম সমুদ্র দেখার অভিজ্ঞতা। আবু কাজে চলে যেতেন এবং আমরা সারাদিন ও সন্ধ্যা পর্যন্ত সমুদ্র সৈকতে ঝিনুক কুড়াতাম। সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে লুটোপুটি খেলতাম। দু’বছর দশ মাসের ছােট্ট সােহেলকে নিয়ে একদিন বেরিয়ে পড়লাম সার্কিট হাউসের (যেখানে আমরা অবস্থান করছিলাম) আশপাশের টিলাময় অঞ্চলগুলাে ঘুরে দেখার জন্য। ছােট ছােট টিলায় গড়া পাহাড়ি অঞ্চল, তার মধ্যে দিয়ে মেঠো পথ।
সােহেলের হাত ধরে আঁকাবাঁকা মেঠো পথ দিয়ে একটু একটু করে উঁচুতে উঠছি। নিচু হয়ে উড়ে যাওয়া বিশাল ডানার গাংচিল। দেখে সােহেল উৎফুল্ল। জনশূন্য এই পাহাড়ি পথে মাঝে মাঝে ঘাসফড়িংয়ের আনাগােনায় মৃদু গুঞ্জন উঠছে। এরই মধ্য উল্টো দিক থেকে হেঁটে আসা এক ব্যক্তি আমাদের দুই ভাই-বােনকে দেখে থমকে দাঁড়ালেন। পরনে লুঙ্গি, মাথায় টুপি, গাল ভরা কাঁচাপাকা দাড়ি। আমাদের নামধাম জিজ্ঞেস করলেন। বাংলাদেশের রীতি অনুযায়ী তার জিজ্ঞাসা কার ছেলেমেয়ে, কোথায় বাড়ি, কেন এখানে এসেছি পর্যন্ত গড়াল। আব্বু নাম শুনতেই তিনি যেন আনন্দে দিশেহারা হয়ে গেলেন। অনুনয় করলেন তার বাড়িতে যেন দু’দণ্ড বসে যাই। বেশি দূরে না, এই কাছেই বাড়ি গ্রামের মানুষের কাছে কম করেও মাইল খানেকের হাঁটাপথ। সূর্য তখন একটু একটু করে মধ্যগগনে প্রবেশ করেছে। সােহেলকে তিনি কোলে তুলতে চাইলেন। কিন্তু সােহেল কিছুতেই যাবে না। অগত্যা সােহেলকে কাঁধে নিয়ে আমি রওনা দিলাম আগম্ভকের সঙ্গে। সােহেল ও আমি যেদিকে হাঁটা দিয়েছিলাম তিনি তার গন্তব্য বদলে সেদিকেই হাঁটা দিলেন। চড়াই-উতরাই পেরিয়ে তার বাড়িতে পৌছলাম। অতি সাধারণ শন ও মাটির বাড়ি। আমাদের যত্ন করে বারান্দায় রাখা পিড়িতে বসতে দিলেন। এরপর চিৎকার করে সারা বাড়ি ও আশপাশের বাড়ির লােকজনকে একত্র করে ফেললেন। সকলেই উৎসুক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। যেন আমরা সদ্য মঙ্গলগ্রহ থেকে আবির্ভূত হয়েছি। গাছের ডালপালা দিয়ে বানানাে বেড়ার সঙ্গে বাঁধা এক দুধেলা ছাগল। সেও ফ্যালফ্যাল করে আমাদের দিকে তাকিয়ে রয়েছে। ওকে দেখে শিমির’ কথা মনে হলাে। গত বছর আমাদের দরদরিয়ার বাসস্থান পুড়িয়ে দেওয়ার পর আমার পালিত ‘শিমি’ নামের ছাগলটি জবাই করে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ভূরিভােজন সারে।
নিমন্ত্রণকর্তা লাকড়ির চুলায় জ্বাল দেওয়া ছাগলের গরম দুধ ও মুড়ি দিয়ে আমাদের। আপ্যায়ন করলেন। ছাগলের দুধ সােহেলের মুখের কাছে ধরতেই সে ভ্যা করে কেঁদে ফেলল। ছাগলের দুধের কড়া গন্ধের সঙ্গে সে অভ্যস্ত নয়। গৃহকর্তা দু’চুমুক দিয়ে মুড়ি খাওয়া শুরু করলাম। তিনি হাসির দীপ্তি ছড়িয়ে আমাদের দেখিয়ে আশপাশে জড়াে হওয়া লােকজনকে আঞ্চলিক ভাষায় বললেন, এনারা আমাদের মেজবান হয়েছেন। আমার বড় ভাগ্য।’ বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের কত কম চাহিদা, কত অল্পতেই তারা সন্তুষ্ট। অতিথিপরায়ণতাতেও তাঁদের তুলনা হয় না। সেই সময়টাও অপেক্ষাকৃতভাবে কত সহজ স্বাভাবিক ছিল! অনায়াসেই কেমন বিশ্বাস করে আমরা ছােট দুটি ভাইবােন চলে গেলাম এক অপরিচিতের সঙ্গে!
কক্সবাজারে আব্দুর কাজ শেষ হওয়ার পর আমরা হেলিকপ্টারে করে রাঙামাটিতে পেীছলাম। খরস্রোতা নদী ও উঁচু উঁচু পাহাড়ের আলিঙ্গনে ঘেরা রাঙামাটির অপূর্ব সৌন্দর্যে আমরা মুগ্ধ হয়ে গেলাম। পার্বত্য চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের সেক্রেটারি শামসুল আলমের মেয়ে ইয়াসমিনের সঙ্গে আমাদের খুব ভাব হয়ে গেল। তার মাধ্যমে উপজাতি মেয়েদের সঙ্গেও ভাব হলাে। পূরবী মুৎসুদ্দী নামের এক উপজাতি মেয়ের সাথে বেশ ক’বছর চিঠিপত্রের মাধ্যমে যােগাযােগ ছিল। রাঙামাটি গার্লস স্কুলের ছাত্রীরা আব্দুকে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সংবর্ধনা দিল। উপজাতিদের বাশ-নৃত্য দেখার সেই প্রথম অভিজ্ঞতা। প্রতিটি সভাতেই আব্দুর মূল বক্তব্য ছিল একতাবদ্ধ হয়ে দেশ গড়ার আহ্বান। লক্ষ করতাম শিশু ও কিশােরদের জন্য তাঁর বিশেষ মমতা। কচিকাঁচার মেলা, স্কাউট সম্মেলন, শিশুদের চিত্রকলার প্রতিযােগিতা ইত্যাদি। অনুষ্ঠানগুলােতে তিনি যেতেন বিশেষ আগ্রহ সহকারে। অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের গুরুদায়িত্ব পালনের মধ্যেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি ছিল তারুণ্যের সুষ্ঠু বিকাশে। তিনি বলতেন, ‘স্বাধীন দেশের মানুষের মতােই এ দেশের শিশুরাও চিন্তার স্বাধীনতা পাবে। আমাদের বড়দেরই শিশুদের সুপ্ত প্রতিভা বিকাশের অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। কেবল ছােটরাই যে বড়দের কাছ থেকে। শিক্ষা গ্রহণ করবে তা নয়, ছােটদের কাছ থেকেও বড়দের অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। প্রাথমিক শিক্ষকদের জাতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথির ভাষণ দিতে গিয়ে আব্ব বলেন, ‘রাষ্ট্রের জাতি গঠনে প্রাথমিক শিক্ষকদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে। সন্তানের পিতাই কেবল একক পিতৃত্বের দাবীদার হতে পারেন না। একটি শিশুকে যিনি প্রাথমিক জ্ঞান, শিক্ষা দিয়ে মানুষ করে তােলেন তাঁর দান কোনাে অংশেই কম নয়।
কক্সবাজার, ঢাকা মুন্সিগঞ্জসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে তিনি জোর গলায় বক্তব্য রেখেছিলেন গণমুখী শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের জন্য। শিক্ষা কী তা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলতেন, ‘পারিপার্শ্বিকতাকে উপলব্ধি করার নামই হলাে শিক্ষা।’ শিক্ষার অবিচ্ছিন্ন অংশ হিসেবে নৈতিক চরিত্র গঠনের বিষয়টিও তিনি ছাত্রছাত্রীদের মনে করিয়ে দিতেন।” আন্ধুর সঙ্গে আমরা যাচ্ছি বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। আমাদের ক্ষুদ্র পৃথিবী দ্রুত প্রসারিত হচ্ছে নিত্যনতুন অভিজ্ঞতা ও শিক্ষার সংস্পর্শে এসে। ১৯৭২ সালে আমি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার কচিকাঁচার আসরের সদস্য হলাম সদস্য সংখ্যা ৪০২৭৪। বিজয় দিবস সংখ্যার জন্য একটি লেখা পাঠালাম। নাম ‘মা’। সত্য ঘটনা অবলম্বনে রচিত এক শহীদ মুক্তিযােদ্ধা ও তার মা’র কাহিনি। লেখাটি কোনাে কপি ছাড়াই সরাসরি পােস্টে পাঠিয়ে দিলাম কচিকাঁচার আসরের শ্রদ্ধাভাজন পরিচালক রােকনুজ্জামান খান ওরফে দাদাভাই বরাবর। লেখাটি ছাপা হবে কি না সে বিষয়ে ছিল সংশয়। একদিন মা’ যখন প্রকাশিত হলাে তখন আমার আনন্দ দেখে কে! পত্রিকায় প্রকাশিত আমার জীবনের প্রথম গল্প সেটি আব্বু অফিস থেকে ঘরে ফেরার পর আম্মা লেখাটি দেখালেন আব্বু খুব খুশি হয়ে তাঁর অস্যেস মতাে মাথায় হাত বুলিয়ে দিলেন, বললেন, এই সেদিনের রিপি, কবে লেখিকা হয়ে গেল! আব্দুর বন্ধু আরহাম সিদ্দিকী কাকু সে সময় উপস্থিত ছিলেন। তিনি আম্মাকে লক্ষ্য করে হেসে বললেন হবে না কেন। মা-ও যে লেখিকা! আম্মার লেখা উদয়ের পথে তখন ধারাবাহিকভাবে দৈনিক বাংলায় বের হচ্ছে।
ঐ একই বছর আমার সহপাঠী সুলতানা বেগম (মুন্নী) পরিবারসহ সিলেটে চলে যায়। ক্লাসের সবাই মিলে আমরা ওর জন্যে এক ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করি। কোনাে কারণে অনুষ্ঠানের দিন ধার্য হয় স্কুলের দিন। স্থান আমাদের হেয়ার রােডের বাসভবন। গাছের নিচে পিকনিক, গান, কবিতার মধ্য দিয়ে পুরােদিন আমাদের আনন্দে কেটে যায়। ওদিকে ক্লাস নিতে গিয়ে খালেক স্যার ও মণীষাদির চক্ষু স্থির। প্রায় চল্লিশজন ছাত্রীর মধ্যে থেকে হাতেগােনা দুইতিনজন মাত্র উপস্থিত। বাকি সবাই মুন্নীর ফেয়ারওয়েল অনুষ্ঠানে প্রথম বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঠিক একবছর পূর্তির দিন (১০ এপ্রিল, ১৯৭২) জাতীয় সংসদে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার সদস্য, সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী প্রয়াত বেগম নূরজাহান মুরশিদ প্রশ্ন করেন, মাননীয় সভাপতি সাহেব, গত ২৬ মার্চ ১৯৭১ তারিখে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন সে-সম্বন্ধে আমি জানতে চাই।’ বঙ্গবন্ধু তার দীর্ঘ বক্তব্যের এক অংশে স্বাধীনতা ঘােষণা প্রসঙ্গে সেদিন বলেন, আমি ওয়ারলেসে চট্টগ্রামে জানালাম বাংলাদেশ আজ থেকে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র এই খবর প্রত্যেককে পৌছিয়ে দেওয়া হােক যাতে প্রতিটি থানায়, মহকুমায়, জেলায় প্রতিরােধ সংগ্রাম গড়ে উঠতে পারে। সেজন্য প্রয়ােজনীয় নির্দেশও দিয়েছিলাম। এ ব্যাপারে আত্মসচেতন হতে হবে। দেশবাসী জানে একই তারিখে দেশের বিভিন্ন জায়গায় প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু হয়েছিল। এটা হাওয়ার ওপর থেকে হয় নাই। যদি কোনাে নির্দেশ না থাকত তবে কেমন করে একই সময়ে, একই মুহূর্তে সব জায়গায় সগ্রাম শুরু হলাে ?” বন্ধবন্ধু ২৫ মার্চ গত ২৬ মার্চের শুরুতে স্বাধীনতা ঘােষণা করলেও পরবর্তীতে স্বাধীনতার প্রথম ঘােষক কে তা নিয়ে বহু বিতর্কের সৃষ্টি হয়। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণাটি তার দলের নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে যারা তার ঘনিষ্ঠ সহযােগী তাদেরকে দিয়ে না যাওয়াতে যে ফাক সৃষ্টি হয়। তারই ফলে এই বিতর্কের সৃষ্টি হয়। এই বিতর্কে অধিকাংশ ক্ষেত্রে সত্যর অন্বেষার চাইতে, ব্যক্তি স্বার্থ প্রাধান্য পায়।
বিএনপি সরকার প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার প্রথম ঘােষক হিসেবে ইতিহাসে প্রতিষ্ঠিত করতে সচেষ্ট হয়। যদিও জিয়াউর রহমান বেঁচে থাকতে এই দাবি করেননি। ২০০৯ সালে, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের প্রদত্ত রায়ে (রিট পিটিশন নং ২৫৭৭/২০০৯/ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে মন্ত্রী পরিষদ সচিব ও অন্যান্য) স্বীকৃত হয় যে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘােষণা দেন যা তৎকালীন ইপিআরের ট্রান্সমিটার, টেলিগ্রাম ও টেলি প্রিন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশের সব জায়গায় প্রচারিত হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে জড়িত বা সে সম্পর্কে যারা আলােকপাত করতে পারবেন তাদের অনেকে বেঁচে নেই বা ইতিহাসে তাদের স্থান হয়নি। তার দলের নেতৃবৃন্দ ওনাকে স্বাধীনতা ঘােষণায় রাজি করাতে না পারলেও বঙ্গবন্ধু যে গােপনে স্বাধীনতার ঘােষণায় প্রস্তুতি নিয়েছিলেন তার প্রমাণ হলাে শহীদ ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হককে তিনি ট্রান্সমিটার যােগাড় করতে বলেছিলেন। (ট্রান্সমিটার বানানােয় পারদর্শিতার জন্য পাকিস্তান সরকার ওনাকে তমঘাএ-ইমতিয়াজ খেতাবে ভূষিত করে।) বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ অনুযায়ী তিনি খুলনা থেকে ট্রান্সমিটার এনেছিলেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের কাছে সে বিষয়টি উল্লেখ করেছিলেন ২৫ মার্চ, মধ্যাহ্নে। পাকিস্তান আর্মি ২৯ মার্চ সকালে নূরুল হককে তার মহাখালির ওয়্যারলেস কলােনির বাস ভবন হতে চিরতরে তুলে নিয়ে যায়। তারা তার পুরাে বাড়ি সার্চ করে ট্রান্সমিটারের সন্ধানে।” ওদিকে ২৫ মার্চ রাত ১২ টার দিকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে একটি গুরুত্বপূর্ণ টেলিফোন আসে। ফোন কলটি রিসিভ করেন তাঁর পার্সনাল এইড হাজী গােলাম মােরশেদ। (বঙ্গবন্ধুর সাথে সে রাতে তিনিও গ্রেফতার হন এবং পাকিস্তান আর্মি ঢাকা। ক্যান্টনমেন্টে তাঁর ওপর অমানুষিক নির্যাতন চালায়। ফোন কলটি ছিল এরূপ ‘আমি বলদা।
গার্ডেন থেকে বলছি। মেসেজ পাঠানাে হয়ে গিয়েছে, মেশিন নিয়ে কী করব ?’ বঙ্গবন্ধু হাজী। গােলাম মােরশেদের মাধ্যমে উত্তর দিলেন ‘মেশিনটা ভেঙে পালিয়ে যেতে বল। সে রাতে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণাটি সম্পর্কে প্রথম বইয়ে প্রকাশ করেন লন্ডনভিত্তিক দ্য ডেইলি টেলিগ্রাফ ও সানডে টেলিগ্রাফের সাউথ এশিয়ান করেসপনডেন্ট, নিবেদিত সাংবাদিক ডেভিড লােসাক। সে সময়ের বহুল প্রশংসিত তথ্য বহুল Pakistan Crisis বইটি তিনি সমাপ্ত করেন মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময় ১৯৭১ এ। তিনি উল্লেখ করেন যে “শেখ মুজিবুর রহমানের ক্ষীণ কণ্ঠ কোন এক গুপ্ত রেডিও হতে ইথার তরঙ্গে পাকিস্তান রেডিওর কাছাকাছি প্রচারিত হয়েছিল। স্বাধীনতার ঘােষণাটি, যাতে তিনি বাংলাদেশকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রূপে উল্লেখ করেন, তা আগেই রেকর্ড করা ছিল বলে সাংবাদিক লােক মনে করেন। ব্যারিস্টার আমীরউল ইসলাম আমার কাছে উল্লেখ করেছিলেন (২৫ ও ২৬ এপ্রিল, ২০১৪) যে বঙ্গবন্ধুর মতােই ভরাট গলার অধিকারী ইঞ্জিনিয়ার নূরুল হক হয়তাে বঙ্গবন্ধুর হয়ে রেডিওতে স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন, যা অসম্ভব নয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর তৎকালীন জনসংযােগ অফিসার মেজর সিদ্দিক সালিক তার বহুল আলােচিত Witness to Surrender বই এ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণা প্রচারণা সম্পর্কে উল্লেখিত ডেভিড লােসাকের বইটি হতে উদ্ধৃতি দেন। প্রচারণাটি তিনি নিজে শােনেননি বলে উল্লেখ করেন।” (যদিও বাংলাদেশের কোনাে কোনাে সূত্রে তিনি নিজে প্রচারণাটি শুনেছেন বলে উল্লেখ করা হয়।) টেলিগ্রাম ও টেলিপ্রিন্টরের মাধ্যমে ইংরেজিতে রচিত ঘােষণাটি বিভিন্ন জায়গায় চলে যায়।
(ওয়্যারলেসে ব্রডকাস্ট ঐ লিখিত ঘােষণায় গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ উল্লেখিত ছিল না।) টেলি প্রিন্টারের পাওয়া ঘােষণার ভিত্তিতে, বাংলায় অনুবাদ করে চট্টগ্রাম বেতার হতে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের নেতা আবদুল হান্নান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন ২৬ মার্চ দুপুরে। দুপুরের প্রথম ঘােষণার পর চট্টগ্রামের কালুরঘাটে বেলাল মােহাম্মদের উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে আবুল কাসেম সন্দ্বীপ সন্ধ্যা ৭.৪০ মিনিটে প্রথম ঘােষণাটি করেন “স্বাধীন বাংলা বিপ্লবী বেতার কেন্দ্র হতে বলছি।” তারপর ঐ একই সন্ধ্যায় আবদুল হান্নান কালুর ঘাটের স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র হতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বহস্তে লিখিত স্বাধীনতার ঘােষণাপত্র পাঠ করেন। ২৭ মার্চ বেলাল মােহাম্মদের অনুরােধে তৎকালীন মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠ করেন।” সকলেই বঙ্গবন্ধুর পক্ষ হতেই স্বাধীনতা ঘােষণা করেছিলেন কারণ বঙ্গবন্ধু ছিলেন। অবিসংবাদিত নেতা ও স্বাধীনতার প্রেরণা ওয়্যারলেস মারফত যে তিনি সর্বপ্রথম স্বাধীনতা ঘঘাষণা বার্তা পাঠান তাও উল্লেখিত তথ্য হতে জানা যায়। কিন্তু প্রশ্ন হলাে তিনি কেন দলের নেতৃবৃন্দের শত অনুরােধ সত্ত্বেও তাদের কাছে স্বাধীনতার ঘােষণা দিতে রাজি হননি। তিনি ওয়্যারলেসে চট্টগ্রামে জানালেন যে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র অথচ তার পরেই তার দলের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে ঘােষণা সম্পর্কে পূর্বাভাস পর্যন্ত দিলেন না, তাকে এ সম্পর্কে কোনাে কিছু জানালেন না। টেপ রেকর্ডারেও। কোনাে নির্দেশ দিতে রাজি হলেন না। আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার আগে স্বাধীনতার ঘােষণা দেশবাসী। ও বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌছে দেবার কথা ছিল এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার সে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল তাতে তিনি সাড়া দিলেন না। ২৫ মার্চ রাতে তার বাসভবনে তাজউদ্দীন আহমদ যে লিখিত স্বাধীনতা ঘােষণার খসড়াটি নিয়ে আসেন তাতেও স্বাক্ষর দানে অপরাগতা জানালেন রাষ্ট্রদ্রোহিতা এড়ানাের জন্য। ব্যাপারটি বিস্ময়কর। অথচ সে রাতে পাকিস্তান বাহিনী যে ক্র্যাক ডাউন করবে তা তিনি জানতেন। চারদিক থেকেই তখন সে সম্পর্কে খবর আসছিল।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গােপনে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলে পরে এই আশঙ্কা প্রায় সকলেই করছিল ওনাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যেতে বা স্বাধীনতা ঘােষণায় রাজি করাতে না পেরে তাজউদ্দীন আহমদ অত্যন্ত বিক্ষুদ্ধ চিত্তে ও ভগ্ন মনে বাড়ি ফিরেন। মুজিব ভাই ছাড়া তিনিও ঘর থেকে বের হবেন না একথা বলে তিনি সে রাতে বাসায় থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম জোর না করলে এবং তাকে সে রাতে উঠিয়ে না নিলে তাজউদ্দীন আহমদ বন্দী হতেন বা খুব সম্ভব তার প্রাণনাশ হতাে এবং সুযােগ্য নেতৃত্বর অভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধকে ঠেলে দেওয়া হতাে এক অনিশ্চিত, দীর্ঘস্থায়ী ও ভয়াবহ পরিণতির দিকে। সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে বাংলাদেশের অভ্যুদয় এক কঠিন ব্যাপার হয়ে দাঁড়াত উল্লেখ্য, গণহত্যা ও বুদ্ধিজীবী হত্যার মূল পরিকল্পক মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর লেখা বই How Pakistan Got Divided-এর উদ্ধৃতি দিয়ে ওয়েব সূত্রে উল্লেখিত হয়েছে যে এই চরম বাঙালি ও হিন্দু বিদ্বেষী যুদ্ধাপরাধী জেনারেল বঙ্গবন্ধুর যতটা না সমালােচক ছিলেন, তার চাইতেও কঠোর মনােভাব পােষণ করতেন তাজউদ্দীন আহমদ সম্পর্কে তিনি ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদের প্রধান শত্রু।” তাজউদ্দীন আহমদ সে রাতে ধরা পড়লে, তাকে যে বঙ্গবন্ধুর মতাে বাঁচিয়ে রাখা হতাে না, তা বলা বাহুল্য। বঙ্গবন্ধু কেন তার সহকর্মীদের প্রবল অনুরােধ সত্ত্বেও সে রাতে বাড়িতে থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নিলেন তার কারণ হতে পারে যে তিনি নিজেকে একটা অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে ফেলতে চাননি। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতে তাজউদ্দীন আহমদ ও তাঁরা আন্ডারগ্রাউন্ডে চলে গিয়ে যে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের পথ বেছে নিতে যাচ্ছিলেন তার ফলাফল ছিল অনিশ্চিত। তিনি পলায়ন করলে ওনাকে দেশদ্রোহিতার আখ্যা দেওয়া হতাে যা তিনি এড়াতে চাচ্ছিলেন। অন্য দিকে তিনি জানতেন যে তিনি বন্দী হবার পরেও স্বাধীনতার জন্য নেগশিয়েটেড সেটেলমেন্ট করা সম্ভব এমন কথা তিনি হয়তাে চিন্তা করছিলেন। ১৯৬২ সালে তিনি বাংলাদেশকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টা নিয়ে গােপনে ভারতে গিয়েছিলেন জানা যায় (পরিশিষ্টে হাজী গােলাম মােরশেদের বঙ্গবন্ধুকে দেওয়া পদত্যাগপত্রের একটি অংশের ব্যাখ্যায় উল্লেখিত পৃ. ২২১) কিন্তু তদানীন্তন ভারত সরকারের থেকে সাড়া না পাওয়াতে তিনি হয়তাে নিজে ও পথে আর যেতে চাননি। যদিও ১৯৬২-র প্রেক্ষিত ও ১৯৭১-এর প্রেক্ষিত ছিল। সম্পূর্ণ ভিন্ন। সে সময় ভারত সরকারের সহযােগিতা গ্রহণ প্রতীয়মান হতাে বিছিন্নতাবাদী ও দেশদ্রোহীতামূলক কর্মকাণ্ড রূপে। স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সময়টা পরিপক্ক তখনাে হয়নি। কিন্তু ১৯৭১ এ গণভােটে ল্যান্ড স্লাইড বিজয়ী আওয়ামী লীগ ও বাঙালির একছত্র নেতা বঙ্গবন্ধু বিপুল জনপ্রিয়তার শিখরে।
পাকিস্তান সরকারের বৈষম্য, নির্যাতন, ও গণরায়ের প্রতি অবজ্ঞা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করে স্বাধিকার হতে স্বাধীনতার আন্দোলনে। ঐ প্রেক্ষিতে ভারতের সহায়তা কামনা হতাে এক স্বাধীনতাকামী জাতির প্রতিনিধি হিসেবে। তারপরও তিনি হয়তাে নিজেকে কোনাে অনিশ্চিত সম্ভাবনার দিকে নিতে চাননি। তিনি হয়তাে কোনাে বিকল্প দুয়ার খােলা রাখতে চেয়েছিলেন। আর একটা ব্যাপার অনেকে বলে থাকেন, তা হলাে পাকিস্তান সরকার তাঁকে বন্দী করার পর তিনি যতবারই মুক্তি পেয়েছেন তাঁর জনপ্রিয়তা ততই বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ব্যাপারটাও ফ্যাক্টর হতে পারে। বঙ্গবন্ধু কেন গােপনে দলের বাইরে এবং তাঁর নিকটতম এবং আস্থাভাজন সহকর্মীদের এড়িয়ে ভিন্ন মাধ্যম দিয়ে স্বাধীনতার ঘােষণা পাঠালেন তার অন্য কারণ হতে পারে যে তিনি স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে সরাসরি কোনাে সংযােগ রাখতে চাননি। ২৫ মার্চের পাঁচ-ছয় দিন আগে ঢাকাস্থ মার্কিন কনস্যুলেটের কর্মকর্তা মিস্টার ব্রুট (পদ মর্যাদায় তৃতীয়) ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে লাঙ্কে আমন্ত্রণ করে জানান যে বাংলাদেশের সংগ্রামের প্রতি তার।
ব্যক্তিগত সহানুভূতি থাকলেও স্টেট ডিপার্টমেন্ট বা সিআইএ’র মানচিত্রে বাংলাদেশ বলে কিছু নেই। ধারণা করা যেতে পারে যে একই মেসেজ উচ্চ পর্যায় হতে বঙ্গবন্ধুকে জানান হয়েছিল। ৭ মার্চ সকালে তার সাথে মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড দেখা করে ওয়াশিংটনের বার্তা পৌছে দেন যে তারা কোনাে প্রকার বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সমর্থন করবে না।” তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ১৪ ডিভিশনের জিওসি মেজর জেনারেল প্রয়াত খাদিম হুসাইন রাজা বঙ্গবন্ধুকে হুঁশিয়ারি বার্তা পাঠিয়েছিলেন যে তিনি যদি ৭ মার্চে স্বাধীনতা ঘােষণা করেন, রাজা আর্মি নিয়ে শক্ত হাতে তা দমন করবেন এবং প্রয়ােজন হলে ঢাকা শহর গুড়িয়ে দেবেন। বঙ্গবন্ধুকে সেসব বিষয়ও বিবেচনা করতে হচ্ছিল। তিনি যদি ধরা না দেন তাঁকে খুঁজতে যেয়ে আরও হত্যাযজ্ঞ হবে সে কথাও তিনি তার সহকর্মীদের বলেছিলেন। আবার ওনাকে হয়তাে এই আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল যে তিনি ধরা দিলে ওনাকে এবং তার পরিবারকে হত্যা করা হবে না। ১৮ মার্চে যখন মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী ও মেজর জেনারেল খাদিম হুসাইন রাজা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্দেশে গণহত্যার নীল নকশা অপারেশন সার্চ লাইটের পরিকল্পনা তৈরি করেন তখন তাতে উল্লেখ ছিল ‘শেখ মুজিবকে জীবন্ত গ্রেফতার করার। উদ্ভূত এসকল জটিল পরিস্থিতির আলােকে ধরা যেতে পারে যে স্বাধীনতা ঘােষণার সাথে বঙ্গবন্ধু সরাসরি সংযােগ না রেখে ভিন্ন মাধ্যমে স্বাধীনতার বার্তা প্রেরণ ও ধরা দেওয়া শ্রেয় মনে করেছিলেন। (স্বাধীনতা ঘােষণা যথেষ্ট নয় যদি না তার সাথে যুক্ত হয় দেশ স্বাধীন করার সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনা।) কিন্তু তার ঘনিষ্ঠ সহচর, দূরদর্শী তাজউদ্দীন আহমদ যেন ভবিষ্যৎ দেখতে পাচ্ছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাবার পক্ষে বিভিন্ন যুক্তি উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন যে বঙ্গবন্ধু তার অবর্তমানে কার ওপর নেতৃত্বভার পড়বে এবং কে হবে সেকেন্ড ইন কমান্ড’ একথা যেহেতু আগে ভাগে কাউকে বলেননি এবং এ ব্যাপারে তার দলকে নির্দেশ দেননি, সেহেতু মুজিববিহীন স্বাধীনতাযুদ্ধে অন্য কারাে নেতৃত্ব দানে আসবে প্রচণ্ড বাধা। সকলেই যার যার নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করবে।
এর ফলে জাতীয় ঐক্য হবে বিনষ্ট এবং স্বাধীনতার যুদ্ধ ধাবিত হবে জটিলতর পরিস্থিতির দিকে। দেশকে স্বাধীনতাযুদ্ধের মুখে ঠেলে দিয়ে নেতা ধরা দিয়েছেন এমন নজির ইতিহাসে নেই সে কথাও তিনি সেই ২৫ মার্চ রাতে স্মরণ করিয়ে দিয়েছিলেন। রাজনীতি ও মানব মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে সুগভীর ওয়াকিবহাল তাজউদ্দীন আহমদের যুক্তি ও আশঙ্কাই সত্যে পরিণত হয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর ভগ্নী পুত্র শেখ ফজলুল হক মনি ও তার সহযােগী যুব দলটি ক্ষুদ্র গােষ্ঠী স্বার্থে গড়ে তােলে মুজিব বাহিনী। (লক্ষণীয় ব্যাপার হলাে যে বঙ্গবন্ধু পুত্র শেখ কামাল কিন্তু মুজিব বাহিনীতে যােগদান করেননি। তিনি প্রথম বাংলাদেশ সরকার পরিচালিত মুক্তিবাহিনীতে যােগ দান করে ট্রেনিং নিয়েছিলেন।) শুরু হয় আত্মঘাতী সংঘর্ষ। বঙ্গবন্ধুর ধরা দেওয়া, অনুপস্থিতি ও দিক নির্দেশনা না দিয়ে যাবার কারণে যে বিভাজন ঘটে তা হতেই কোলকাতায় সৃষ্টি হয় নিজ নিজ স্বার্থরক্ষাকারী ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র উপদল এবং মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ধ্বংস করার নানা ষড়যন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধর হালধারী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদকে হত্যা করারও উদ্যোগ নেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু যুব দলকে বিশেষ কিছু নির্দেশ গােপনে দিয়েছিলেন কিন্তু সে সমন্ধে হাই কমান্ড নামে পরিচিত তার দলের ছায়া সরকারের সাথে আলােচনা করেননি; বা তার ঘনিষ্ঠ সহকর্মীদের জানাননি।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এ সম্বন্ধে বলেন যে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তারা যখন কোলকাতায় পৌছলেন তখন তাজউদ্দীন আহমদ ওনাকে বলেছিলেন যে ১৯৭১ এর মার্চ মাসে তাজউদ্দীন আহমদ যখন বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য তার ঘরে ঢুকছেন তখন তিনি শুনতে পান যে বঙ্গবন্ধু যুব-ছাত্র নেতা শেখ মনি, সিরাজুল আলম খান, তােফায়েল আহমদ প্রমুখকে (আব্দুর রাজ্জাকও এই প্ল্যানের সাথে জড়িত ছিলেন) বিভিন্ন নির্দেশ দিচ্ছেন। সে সময় তার কানে আসে যে বঙ্গবন্ধু বলছেন, ‘১০ নম্বর রাজেন্দ্র প্রসাদ রােডে গেলে খোঁজ পাওয়া যাবে’ আর একজনের নাম উল্লেখ করা হয় চিত্ত সুতার। কোলকাতায় পৌছে তারা ভবানীপুরে ঐ বাড়ি খুঁজে পেলেও চিত্ত সুতার নামে কোনাে ব্যক্তি ওখানে থাকেন না বলে জানানাে হয়। ঐ ব্যক্তি ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যম হিসেবে কোলকাতায় কাজ করতেন। ১৯৮৭ সালে যখন কোলকাতায় ভারতীয় নিরাপত্তা অফিসার শরদিন্দু চট্টপাধ্যায়ের সাথে আমার দেখা হয় তখন তিনি জানান যে উনিও তাজউদ্দীন আহমদের সাথে ঐ বাসায় চিত্ত সুতারের খোঁজ করেছিলেন। পরে তারা জানতে পারেন যে ছদ্মনাম ধারণ করে চিত্ত সুতার ঐ বাসায় থাকতেন। বাংলাদেশের বরিশাল জেলার বিতর্কিত রাজনীতিবিদ চিত্তরঞ্জন সুতার যুদ্ধের প্রারম্ভে কোলকাতায় চলে যান। ভারতীয় গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর মাধ্যম হিসেবে পরিচিত চিত্ত সুতার ও শেখ মনি পরিচালিত যুব দলটি সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় একতার প্রতীক গণপ্রজাতন্ত্রী প্রথম বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধ ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়। ‘র’ এর সহায়তায় এবং বাংলাদেশ সরকারের অজান্তে গড়ে তােলা হয় ‘মুজিব বাহিনী’। মঈদুল হাসান এ সম্পর্কে লেখেন বস্তুত এই বাহিনীর সদস্য ভুক্তির জন্য সর্বাধিনায়ক হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার অনুপস্থিতিতে শেখ ফজলুল হক মনি’র প্রতি আনুগত্যের অঙ্গীকার। করেই শপথনামা পাঠ করা হতাে। শেখ মনির দাবি ছিল যে একমাত্র তারাই সশস্ত্র বাহিনী। গঠনের ব্যাপারে শেখ মুজিব কর্তৃক মনােনীত প্রতিনিধি।
‘র’ এর চ্যানেল ব্যবহার করে গােপনে যুব দলটিকে সশস্ত্র বাহিনী গঠনের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশনা হতে বুঝা যায় যে তিনি পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করে সমঝােতার কোনাে বিকল্প রাস্তা খােলা রাখতে চেয়েছিলেন। এ প্রসঙ্গে ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু হয়ত চেয়েছিলেন একটা সাে কলড স্ট্রাগল হবে এবং তার ভিত্তিতে নেগশিয়েশন হবে।” সরকার। গঠন হলে তাে আর সেই রাস্তা খােলা থাকে না। বিপরীতে আপসহীন ও পূর্ণ স্বাধীনতার প্রশ্নে সুদৃঢ় তাজউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকার গঠন করে স্বাধীনতাকামী জাতির প্রত্যাশা পূর্ণ করেছিলেন। তিনি পাকিস্তান ও যুক্তরাষ্ট্র সমর্থিত খন্দকার মােশতাকের কনফেডারেশন গঠনের ষড়যন্ত্রও বানচাল করে দিয়েছিলেন। তিনি জানতেন যে কোনাে রাষ্ট্র বা দলের নীতি নির্ধারণ বা কার্য পরিচালনায় অন্য রাষ্ট্রের গােয়েন্দা সংস্থার হস্তক্ষেপ অশুভ। তাজউদ্দীন আহমদ সে বিষয়টি নিয়ে অত্যন্ত সচেতন ছিলেন এবং তার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতাযুদ্ধে শারীরিকভাবে উপস্থিত না থাকায় এবং গণতান্ত্রিক নীতি অনুসারে দলকে স্বাধীনতা ঘােষণা, সরকার গঠন, স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালনা ও তাঁর অবর্তমানে নেতৃত্ব সম্বন্ধে কোনাে নির্দেশ দিয়ে যাওয়ায় যে মারাত্মক ফাক ও অস্পষ্ট পরিস্থিতির সৃষ্টি হয় তার অশুভ জের চলতে থাকে। স্বাধীনতাযুদ্ধে জয় লাভ ও তাঁর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পরও। ১৯৭২ এর প্রারম্ভে, বিজিত বাংলাদেশের নতুন লগ্নে, ভবিষ্যতের অশনি সংকেত খুব কম মানুষই সেদিন শুনতে পেয়েছিল। আমার স্মৃতিতে ১৯৭২ সালের একটি স্মরণীয় দিন ছিল কবি কাজী নজরুল ইসলামের বাংলাদেশে আগমনের দিনটি। বাংলাদেশ সরকারের আমন্ত্রণে কবি সপরিবারে ২৫ মে স্বাধীন। বাংলাদেশের মাটিতে পদার্পণ করেন। মিষ্টি ও খিলখিল ভর্তি হয় আমাদের ধানমণ্ডি সরকারি স্কুলে ওদের পরিবারের জন্য সরকার থেকে ধানমণ্ডিতে বরাদ্দ করা হয় সুন্দর খােলামেলা দোতলা বাড়ি। স্কুল ছুটির পর আমরা ওদের মাঝে মাঝে গাড়ি করে পৌছে দিতাম। কবিকে দেখবার জন্য ওদের বাড়ি সর্বদাই থাকত লােকে লােকারণ্য। কবি-পরিবারকে আম্মা এক সন্ধ্যায় দাওয়াত করলেন।
কবির জ্যেষ্ঠপুত্র কাজী সব্যসাচী, কনিষ্ঠপুত্র গিটারবাদক কাজী অনিরুদ্ধ, দুই পুত্রবধূ এবং কবির নাতি-নাতনিরা আমাদের বাড়ি বেড়াতে এলেন। কবি অসুস্থতার কারণে। আসতে পারলেন না। কবি’র পরিবারের সাথে আমন্ত্রিত ছিল পশ্চিমবঙ্গের বিশিষ্ট লেখক প্রবােধ কুমার স্যানাল ও মনােজ বসু। তাঁদের লেখা বই উপহারস্বরূপ আমাদের হাতে তুলে দিলেন। মনােজ বসু আমাকে উপহার দেওয়া বইটিতে সুন্দর গােটা গােটা অক্ষরে লিখলেন, হাতের লেখার দাম কতটুকু, মনের মাঝে সব লেখাই রয়ে গেল।’ আমার গল্প, গান, কবিতার রাজ্যে নানা সংযােজন করলেন নাটক। সেক্সপিয়ারের রিচার্ড দ্য সেকেন্ড ড্রামার একটি অংশ আমাকে দিয়ে মুখস্থ করালেন। ব্রিটিশ রাজের আমলে ছাত্রাবস্থায় কোলকাতার বেকার হােস্টেলে থাকার সময় রিচার্ড দ্য সেকেন্ড ড্রামায় বলিং ফ্রক চরিত্রে নানা অভিনয় করেন। আমি মুখস্থ করলাম বলিং ফ্রক ও জন অফ গষ্টের কথােপকথনের অংশটি। রাজার আদেশে বলিং ফ্রক নির্বাসনে যাওয়ার প্রাক্কালে জন অফ গন্টের সঙ্গে দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের সংলাপ ঊনআশি বছরের বর্ষীয়ান নানা আমার সঙ্গে নাটকের সংলাপ বলতে বলতে যেন ফিরে যেতেন তার তারুণ্যে হয়ে যেতেন বলিং ফ্রক বা তেজস্বী কোনাে যােদ্ধা। আমার নবীন কৈশােরে যখন উম্মেলিত হচ্ছে নতুন স্বপ্ন, নতুন জগৎ ও জিজ্ঞাসা, আন্ধু তখন মহাব্যস্ত স্বাধীনতার জ্যোতির্ময় স্বপ্ন, সাম্যবাদী ন্যায়বিচারভিত্তিক গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তােলার সংগ্রামে। ঐ সংগ্রামে আন্ধু ক্রমশই একা হয়ে পড়েছিলেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর মুজিব কাকু কখনােই আন্ধুর কাছে জানতে চাননি মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের ঘটনাবলি। আব্ব বেশ কয়েকবার বলার চেষ্টা করলেও মুজিব কাকু কখনই শুনতে চাননি যে তার অবর্তমানে আৰু কীভাবে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন; তাকে কী ধরনের প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়েছিল; কারা ছিল স্বাধীনতার শত্রু, কারা মিত্র।
রহস্যজনক ভাবেই বিষয়টি জানতে চাওয়া সম্পর্কে তিনি নীরবতা পালন করেছেন। মুজিব কাকুর উদাসীনতায় আব্লু হয়েছেন আহত, মর্মাহত তবু হাল ছাড়েননি। অবিরাম চেষ্টা করেছেন মুজিব কাকুকে সামনে রেখেই নবজাত বাংলাদেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌছে দিতে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাসের মতােই হানাদারমুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশেও আব্ব সৃষ্টি করেছেন ন্যায়বিচার, ত্যাগ, সততা, সংযম ও সুদক্ষ নেতৃত্বের অপূর্ব দৃষ্টান্ত দেশ ও জাতির কল্যাণে তিনি বিলীন করেছেন ব্যক্তিস্বার্থ বা অন্ধ ক্ষোভ ‘৭১-এর মার্চ মাসের এক কালাে রাতে আশ্রয়প্রার্থী আম্মাকে, তার শিশুপুত্র ও কন্যাসহ কারফিউয়ের মধ্যে ঘর থেকে বিতাড়িত করেছিলেন যে আয়কর কর্মকর্তা তার পদোন্নতির অনুমােদন আব্দু করেছেন হাসিমুখে। আম্মাকেও বিষয়টি অবহিত করেছেন নির্দ্বিধায়। যােগ্য জীবনসঙ্গীর মতােই আম্মাও সেই সিদ্ধান্তে সহমত জ্ঞাপন করেছেন। অনুমােদনের ফাইলে আন্ধু তার শিশিরবিন্দুর মতাে হস্তাক্ষরে লিখেছেন, ‘আমি তার এসিআর-গুলাে দেখলাম। চাকরিজীবনের রেকর্ড অনুযায়ী তার পদোন্নতি পাওয়া উচিত। আর মুক্তিযুদ্ধের সময় তার বিতর্কিত ভূমিকা ছিল বলে উল্লেখ করা হয়েছে কিন্তু বিষয়টি সম্পর্কে স্পষ্ট করে কিছু বলা হয়নি। কারাে প্রতি সন্দেহবশত কোনাে সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ঠিক হবে বলে আমি মনে করি না। যদি তার বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোনাে অভিযােগ থাকে তবে তা আলাদাভাবে উপস্থাপন করা যেতে পারে। যেহেতু নির্দিষ্ট কোনাে অভিযোেগ এখানে দেখানাে হয়নি বা কোনাে প্রমাণও নেই, তাই আমি বিষয়টিকে বিবেচনার মধ্যে না এনে তার এই পদোন্নতি অনুমােদন করলাম।
আইনের শাসনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল আবু চেয়েছিলেন যে যুদ্ধাপরাধী পাকিস্তান সেনাদের বিচার হােক আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে। যুদ্ধাপরাধী যদি বাঙালি হয়ে থাকে তাহলে তাকে নাগরিকত্ব থেকে বিচ্যুত না করে তার বিচার যেন হয় দেশের মাটিতে ও বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী। পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বনকারী এ. জেড. এম শামসুল আলম যিনি ছয় দফা ও মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রচুর লেখালেখি করেছিলেন ওয়াশিংটনে ট্রেনিংয়ে থাকার সময় তাঁর নাগরিকত্ব বাতিল হয়ে যায়। অনুতপ্ত ঐ ব্যক্তি দেশে তার পরিবার-পরিজনের কাছে ফিরে যেতে ইচ্ছুক ছিলেন এবং বিচারের সম্মুখীন হওয়ার জন্য প্রস্তুত এই মর্মে আবেদন করেছিলেন। শামসুল আলমের বাংলাদেশ-বিরােধী কার্যকলাপে প্রচণ্ড ক্ষোভ থাকা সত্ত্বেও আন্তু তার নাগরিকত্ব বহাল রেখে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ করেন। তারপর রাষ্ট্র যদি মনে করে তার বিচার করা উচিত তাহলে তার বিচার হবে এই মত প্রকাশ করেন। বিষয়টিকে তিনি সরাসরি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুল মান্নানের বরাত দিয়ে মুজিব কাকুর কাছে উত্থাপন করেন। ক’দিন পর মুজিব কাকু আব্দুকে তাঁর অফিসে ফোন করেন বিষয়, শামসুল আলমের নাগরিকত্ব বাতিল সম্পর্কে আব্দুর মতামত। আব্ব মুজিব কাকুকে বলেন, ‘মুজিব ভাই, এই বিষয়ে আপনার সঙ্গে আমার কিছু কথা বলার ছিল। আজকে শামসুল আলমের দরখাস্তের কারণে বলার সুযােগ হলাে। প্রথম কথা, আমাদের কোনাে অধিকার নেই যে মানুষটা বাংলাদেশে জন্মেছে তাকে দেশের নাগরিকত্ব থেকে বহিষ্কার করার। এটা অন্যায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এই অন্যায় সিদ্ধান্তকে পরিবর্তন করা উচিত। দ্বিতীয় কথা, আমি শামসুল আলমের দরখাস্ত পাঠিয়েছি যেটা এখন আপনার কাছে আছে। সেটা দেখেন এবং সে যে অন্যায় করেছে এই কারণে তাকে বাংলাদেশে নিয়ে এসে দেশের আইন অনুযায়ী বিচার করার ব্যবস্থা করেন। আব্দুর যুক্তি ছিল যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান যুদ্ধাপরাধীদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়নি। জার্মান নাগরিক হিসেবেই তাদের সমুচিত বিচার হয়েছে।
মুজিব কাকুকে তিনি বললেন, ‘গােলাম আযমকে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে। এইসব লােক বিদেশে থাকলে তাদের শাস্তি তাে হলাে না, এই দেশের মানুষ তাে জানতেই পারল না যে তারা কী জঘন্য অপরাধ করেছিল আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময়। সুতরাং দেশে তাদের আসতে হবে। দেশে ফিরে আসার পর তাদের বিচার করতে হবে। এবং বিচারে যে শাস্তি হবে সেই শাস্তি তাদের দেওয়া হবে। যদি কেউ বেকসুর খালাস পায় সেটা সে পাবে। ব্যক্তিগত ক্ষোভ, ঘৃণা ও বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে আইনের শাসনের প্রতি আব্দুর গভীর শ্রদ্ধা এবং নিজ জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের প্রয়ােগ বাংলাদেশের রাজনীতিতে আব্দুকে এক অনন্য ব্যক্তিত্বে পরিণত করেছিল। ঐ একই কারণে তাঁকে পদে পদে প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীনও হতে হয়েছিল। বাধা এসেছিল মূলত তার নিজ দলের উচ্চপর্যায়ের ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের কাছ থেকেই। তাদের সামন্ততান্ত্রিক চিন্তাধারা ও স্বৈরাচারী কার্যকলাপ নবজাত বাংলাদেশের প্রগতির পথে হয়ে দাঁড়িয়েছিল পর্বতসমান অন্তরায়। | ১৯৭২ সালের শুরুতে সারা বাংলাদেশে শিশু-খাদ্যের সংকট দেখা দেয়। আম্মা তখন মহিলা পরিষদের ভাইস প্রেসিডেন্ট, বেগম সুফিয়া কামাল প্রেসিডেন্ট। নারীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের লক্ষ্যে গঠিত অরাজনৈতিক বেসরকারি সংগঠন মহিলা পরিষদ ঐ জাতীয় সংকট উত্তরণের জন্য বলিষ্ঠ ভূমিকা নেয়। আম্মার নেতৃত্বে নারীদের মিছিল সরাসরি মিন্টু রােডে অবস্থিত গণভবনে মুজিব কাকুর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে। শিশুখাদ্যের সংকট সমাধানের জন্য তাঁর হাতে তুলে দেওয়া হয় স্মারকলিপি। আম্মাকে ঐ ভূমিকায় দেখে মুজিব কাকু মােটেও প্রীত হলেন না। আম্মা আশ্বাস দিলেন যে তিনি ও তাঁর সংগঠন সরকারকে ব্ৰিত করার জন্য আসেনি বরং সংকট নিরসনের জন্য সরকারকে সহায়তা করতেই প্রস্তুত। ঐ ঘটনার পর মুজিব কাকু আম্মাকে মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য হওয়ার জন্য প্রস্তাব পাঠান। প্রস্তাব পাবার পর আম্মা আব্দুকে বললেন ‘মুজিব ভাই আমাকে মহিলা আওয়ামী লীগে যােগ দিতে বলছেন, তুমি কী বল ?
আন্ধু বললেন, ‘এটা তােমার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। এ বিষয়ে তুমি যা ভালাে মনে করবে সেটাই কর।’ আম্মা চিন্তা ভাবনা করে শেষ পর্যন্ত মহিলা আওয়ামী লীগে যােগ দিলেন। আম্মাকে মহিলা আওয়ামী লীগে যােগদানের নির্দেশ দিয়ে মুজিব কাকু অজান্তেই তার দলকে এক ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সহায়তা করেছিলেন। ১৯৭৫ সালে মুজিব কাকু, তার পরিবার এবং আব্দুসহ চার জাতীয় নেতৃবৃন্দের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর আওয়ামী লীগে যখন চরম নেতৃত্বশূন্যতা দেখা দেয় তখন আওয়ামী লীগের আহ্বায়িকা হিসেবে নেতৃত্বদানের জন্য দল সর্বসম্মতিক্রমে (এপ্রিল, ১৯৭৭) আম্মাকে মনােনীত করে। মহিলা আওয়ামী লীগের সদস্য হওয়ার কারণেই দলীয় বিধি অনুযায়ী আম্মার ওপর নেতৃত্বভার অর্পণ করা দলের পক্ষে সম্ভবপর হয়। ১৯৭২-এর আগস্ট মাসে আম্মা ও ড. ফওজিয়া মােসলেম মহিলা পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে মঙ্গোলিয়া গেলেন আফ্রিকা ও এশিয়ার সংহতি ও উন্নয়নের লক্ষ্যে প্রতিষ্ঠিত Afro Asian Peoples’ Solidarity Organization (AAPSO)-47 westfo সম্মেলনে যােগদান করতে। ব্যক্তিগত উদ্যোগে এবং মহিলা পরিষদের মতাে বেসরকারি ও অরাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে আম্মা অব্যাহত রেখেছিলেন সমাজকল্যাণমূলক কর্মকাণ্ড। একই বছরে মহিলা পরিষদের উদ্যোগে এক বিশাল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলাে। তিন দিনব্যাপী এই সম্মেলনকে সার্থক করতে আম্মা, সুফিয়া খালা (কবি সুফিয়া কামাল, মহিলা পরিষদের সভানেত্রী), মালেকা খালা (মালেকা বেগম, একসময় তিনি মহিলা পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন), আয়েশা খালা (আয়েশা খানম, বর্তমানে মহিলা পরিষদের সভানেত্রী) প্রমুখ মহা ব্যস্ত। সে সময় মালেকা খালা ও আয়েশা খালার সঙ্গে প্রায়ই দেখা হতাে আমাদের বাড়িতে। সম্মেলনে যােগদানের জন্য বিদেশ থেকেও বহু নারীনেত্রী বাংলাদেশে আসেন। তাদের অনেকের জন্য থাকার বন্দোবস্ত করা হয় হােটেল পূর্বাণীতে।
মালেকা খালা আমাকে সঙ্গে নিয়ে হােটেলে যেতেন অতিথিদের খোঁজ-খবর নিতে, তাদের সুবিধা-অসুবিধার কথা জানতে। সম্মেলন শেষে বিদেশি অতিথিদের জন্য লঞ্চে নদী ভ্রমণের ব্যবস্থা করা হয়। আমাদের অবাক করে দিয়ে এলেনা নামের এক বিদেশি অতিথি চমৎকার বাংলায় আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা শুরু করলেন। অধ্যাপিকা এলেনা ব্ৰজালিনা জানালেন শান্তিনিকেতনে তিনি বেশ ক’বছর ছিলেন এবং বিশ্বভারতী থেকে বাংলা সাহিত্যে ডিগ্রি করেছেন। তিনি বললেন, যে বাংলাদেশের জন্ম বাংলা সাহিত্য ও শিল্পকে আরও সমৃদ্ধ করবে। নারীর ভাগ্য উন্নয়ন, মুক্তি প্রসঙ্গেও আলােচনা অব্যাহত রইল। সম্মেলনে দেশি-বিদেশি অভ্যাগতদের কথা শুনে মনে হলাে যে নারী, সে যে রাষ্ট্রেরই হােক না কেন, শুধু নারী হয়ে জন্মানাের কারণেই তারা কোনাে-না-কোনােভাবে বৈষম্যের শিকার। দেখতে দেখতে ১৯৭৩ এসে গেল। স্বাধীনতা লাভের পরপরই যে সংবিধান রচনার কাজ শুরু হয়েছিল তা এত দিনে সমাপ্ত হয়েছে। সংবিধান রচনা কমিটির সদস্য হিসেবে আন্ধু ও তাঁর সহকর্মীরা জনগণের কাছে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে ছিলেন বদ্ধপরিকর। এ কারণেই মাত্র এক বছরের মধ্যেই জাতিকে একটি সংবিধান দেওয়া আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে সম্ভবপর হয়। নতুন সংবিধানের আলােকে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় মার্চ মাসে। স্বাধীনতাযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী আওয়ামী লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা তখনাে ব্যাপক। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করলেও দলের কিছু নেতা নির্বাচনে কারচুপি করে জিতেছে এ খবর কিছু পত্রিকায় প্রকাশিত হয় এবং বড়দের আলােচনা থেকেও সে খবর শুনতে পাই। সিলেটের কয়েকটি আসনে কারচুপি এবং কুমিল্লায় খন্দকার মােশতাক চুরি করে জিতেছে এই খবরগুলাে রাজনৈতিক মহলে তখন অজানা ছিল না। দলীয় নেতাদের কিছু অংশের এ ধরনের অনৈতিক আচরণ আব্দুর পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভবপর ছিল না। আত্মসমালােচনার মাধ্যমেই আসতে পারে আত্মশুদ্ধি এই নীতিতে বিশ্বাসী আব্লু ক্রমশই একাকী হয়ে পড়েন।
১৯৭৩-এর একটি স্মরণীয় দিন ছিল ১৭ এপ্রিল। বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে আলু ও আম্মার সঙ্গে আমরা চার ভাইবােন হেলিকপ্টার যােগে ১৬ এপ্রিল কুষ্টিয়ায় পৌছাই। সেদিন বিকেলেই আব্ব কুষ্টিয়ার বাড়াদিতে মহিলা কল্যাণ সমিতির নিজস্ব গৃহের ভিত্তি স্থাপন করেন। মহিলা সমিতিটি তিল তিল করে গড়ে উঠেছিল নিবেদিত সমাজকর্মী এবং মুক্তিযােদ্ধা সেলিনা হামিদ ও তাঁর স্বামী হামিদ সাহেবের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়।
১৭ এপ্রিল আমরা জিপ ও মাইক্রোবাস করে রওনা দিই ঐতিহাসিক মুজিবনগরের উদ্দেশে। মেহেরপুর থেকে প্রায় ১২ মাইল দূরে ভবেরপাড়া গ্রামের বৈদ্যনাথতলায় অবস্থিত ছায়া-স্নিগ্ধ ঘন সবুজ আম্রকানন। ওই স্থানটির নামকরণ আব্ব করেছিলেন “মুজিবনগর’—বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী। আব্দুর মুখে শােনা সেই মুজিবনগর আমার মানসপটে যেন এক রূপকথার রাজপুরী যেখানে উদিত হয়েছিল স্বাধীনতার সূর্য। তার দেখা পাব ভেবে আমার মন আনন্দে বিহ্বল। রিমি ও আমি কিচিরমিচির করে আমাদের আনন্দ প্রকাশ। করছি। আমাদের সফরসঙ্গী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম সংস্থাপন সচিব নুরুল কাদের খানের হাতে একটি মােটা ইংরেজি বই। সকলের উচ্ছ্বসিত কথাবার্তার মধ্যেও নিবিষ্টভাবে তিনি বই পড়ছেন। দেখে ভালাে লাগল। তাঁর স্ত্রী তারিন কাকির সঙ্গে আমাদের বেশ ভাব হয়ে গেল। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও তার স্ত্রী জাহানারা আমীরও (লীলা কাকি) আমাদের সঙ্গে এসেছেন। তারাও গল্প করছেন। স্মৃতিচারণা করছেন ‘৭১-এর। ঘন সবুজ আম্রকাননের অব্যক্ত সম্ভাষণ যেন সাদরে অভ্যর্থনা জানাচ্ছে আজকের এই বিশেষ দিনটিতে এমনি কথা মনে উদিত হলাে মুজিবনগরে পেীছে। শত মানুষের সরব। উপস্থিতিতে মুখরিত আম্রকাননে মঞ্চ করা হয়েছে। আল্লু ও সৈয়দ নজরুল ইসলাম (তখন তিনি শিল্পমন্ত্রী) মঞ্চের পাটাতনে পাশাপাশি বসেছেন।
সভায় উপস্থিত প্রথম মন্ত্রিসভার প্রায় সকল সদস্য। যার নামে মুজিবনগর সেই মুজিব কাকুই অনুপস্থিত এমন এক গুরুত্বপূর্ণ সভায়। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের ঘটনাবলি জানতে চাওয়া সম্বন্ধে তিনি যেমন রহস্যজনকভাবে নীরবতা পালন করেছেন, তেমনই দুঃখজনকভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন মুজিবনগরকে। তার জীবদ্দশায় তিনি। কখনােই স্বাধীনতার ঐ গৌরবদীপ্ত স্থানটিতে যাননি। যেন তার মনের অভিধানে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম রাজধানী মুজিবনগরের কোনাে অস্তিত্বই নেই। পাকিস্তানি জঙ্গি হামলা ও বােমা বর্ষণ থেকে দূরে এবং নিরাপত্তার খাতিরে কোলকাতার তকালীন ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে স্থানান্তরিত হয়েছিল প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসনিক কার্যালয় এবং রাজধানী মুজিবনগর । আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য কূটনৈতিক আদান-প্রদান, মুক্তিযােদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, দেশরক্ষার নীতি প্রণয়ন, প্রয়ােগ, স্বাধীন বাংলাদেশের উপযােগী অর্থনৈতিক, বাণিজ্য, সমাজকল্যাণ প্রভৃতি অঙ্গসংগঠনগুলাে গড়ে তােলাসহ সমগ্র স্বাধীনতাযুদ্ধ পরিচালিত হয়েছিল এই ৮ নম্বর থিয়েটার রােড থেকেই। আৰু এই কার্যালয়েই দিবানিশি যাপন করেছেন এবং একাগ্র সাধনায় মুক্তিযুদ্ধকে সাফল্যমণ্ডিত করেছেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ভারতীয় সরকার বেশ। ক’বারই জানতে চেয়েছিল যে বাংলাদেশ সরকার ৮ নম্বর থিয়েটার রােডকে সংরক্ষণ করবে কি। (ভবনটি তখনাে ভারতীয় সরকারের মালিকানায় ছিল ।) কিন্তু এ বিষয়ে মুজিব কাকুর অনাগ্রহ, অনীহা ও নিরুত্তাপ মনােভাবের কারণে বাংলাদেশের গৌরবময় সেই ঐতিহাসিক স্থানটি আর সংরক্ষিত হয়নি। বহুকাল পরে ১৯৮৭ সালে শিশুপুত্র তাজ ও মিম্মাকে সঙ্গে করে আবারাে প্রবেশ করেছি ৮ নম্বর থিয়েটার রােডে, তথা মুজিবনগরে। প্রাচীন গাছের প্রহরায় আংশিকভাবে ঢাকা প্রথম বাংলাদেশ সরকারের প্রাণকেন্দ্র এই পুরাতন ভবনটি তত দিনে পরিণত হয়েছে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান অরবিন্দ আশ্রমে।
সড়কটির নামও বদলে গিয়েছে। নতুন নাম সেক্সপিয়ার সরণি। অরবিন্দ আশ্রমের একজন বর্ষীয়ান পরিচালক আমার পরিচয় পেয়ে অতি সমাদরে পুরাে ভবনটিই আমাদের ঘুরে দেখালেন। আব্দুর ব্যবহৃত অফিসকক্ষে প্রবেশ করে অপরিচিত জিনিসপত্র, ফার্নিচারের ভেতরেই যেন আমি খুঁজতে থাকলাম এক পরম পরিচিত মানুষের স্পর্শ। যেন সময়কে বন্দী করে আমি প্রবেশ করলাম এক অনন্য ইতিহাসের মর্মস্থলে।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই ৮ নম্বর থিয়েটার রােডকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা যেত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফরাসি রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতা চার্লস দ্যাগল (পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট) পার্শ্ববর্তী দেশ ইংল্যান্ডে আশ্রয়গ্রহণ করে নাৎসি জার্মানির অবরােধের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। লন্ডন থেকে প্রায় ছত্রিশ। মাইল দূরবর্তী ঐতিহ্যবাহী শহর বার্ক হ্যামস্টেড, যেখানে তিনি ফরাসি মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত। করেছিলেন, তা এখনাে দ্যাগলের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিপ্লবী চিন্ত বিদ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির সুগভীর বিশ্লেষক কার্ল মার্কস তার নির্বাসনকালীন সময়ে লন্ডনে যে বাড়িটিতে সপরিবারে কিছুকাল ছিলেন সেই ২৮ নম্বর ডিন স্ট্রিটের বাড়ির দোরগােড়ার ফলকে উল্লিখিত রয়েছে যে কার্ল মার্কস ১৮৫১-৫৬ সাল পর্যন্ত এই বাড়িটিতে বসবাস করতেন। নিজ দেশের স্বর্ণসন্তানদের প্রাপ্য মর্যাদা না দিয়ে এবং নিজ জাতির স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসকে অবহেলা ও খণ্ডিত করে আমরা বহির্বিশ্বের সামনেও হয়ে গেছি স্নান ও সঙ্কুচিত। ৮ নম্বর থিয়েটার রােড সংরক্ষিত যেমন হয়নি আমাদের নেতৃত্বের মানসিক দৈন্যতার কারণে, তেমনি স্বাধীনতার পরপরই আব্দুর পরিকল্পনা অনুযায়ী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানেও গড়ে ওঠেনি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর। মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে যদি স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপরই বিজয়ী বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত করা হতাে তাহলে আজ দেশে স্বাধীনতা-বিরােধী ও যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত না।
বাংলাদেশের মতাে অনুন্নত দেশের সরকারের পক্ষে যতখানি সম্ভব আমাদের ইতিহাসকে জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত করা, বেসরকারিভাবে জাতীয় পর্যায়ে তা করা কঠিন কাজ। (বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ)। দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ সরকার জাতির প্রতিনিধিত্ব করেনি, প্রতিনিধিত্ব করেছে দলের এবং সেই দলেরই ব্যক্তিবিশেষকে। পছন্দ না হলে নিজ দলের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এবং ঐতিহাসিক প্রয়ােজনেই ৮ নম্বর থিয়েটার রােডকে জাদুঘর হিসেবে সংরক্ষণ করা যেত। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফরাসি রাজনীতিবিদ ও সামরিক নেতা চার্লস দ্যাগল (পরবর্তী সময়ে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট) পার্শ্ববর্তী দেশ ইংল্যান্ডে আশ্রয়গ্রহণ করে নাৎসি জার্মানির অবরােধের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামে নেতৃত্ব দেন। লন্ডন থেকে প্রায় ছত্রিশ। মাইল দূরবর্তী ঐতিহ্যবাহী শহর বার্ক হ্যামস্টেড, যেখানে তিনি ফরাসি মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত। করেছিলেন, তা এখনাে দ্যাগলের স্মৃতিকে ধরে রেখেছে। সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতির বিপ্লবী চিন্ত বিদ ও পুঁজিবাদী অর্থনীতির সুগভীর বিশ্লেষক কার্ল মার্কস তার নির্বাসনকালীন সময়ে লন্ডনে যে বাড়িটিতে সপরিবারে কিছুকাল ছিলেন সেই ২৮ নম্বর ডিন স্ট্রিটের বাড়ির দোরগােড়ার ফলকে উল্লিখিত রয়েছে যে কার্ল মার্কস ১৮৫১-৫৬ সাল পর্যন্ত এই বাড়িটিতে বসবাস করতেন। নিজ দেশের স্বর্ণসন্তানদের প্রাপ্য মর্যাদা না দিয়ে এবং নিজ জাতির স্বর্ণোজ্জ্বল ইতিহাসকে অবহেলা ও খণ্ডিত করে আমরা বহির্বিশ্বের সামনেও হয়ে গেছি স্নান ও সঙ্কুচিত। ৮ নম্বর থিয়েটার রােড সংরক্ষিত যেমন হয়নি আমাদের নেতৃত্বের মানসিক দৈন্যতার কারণে, তেমনি স্বাধীনতার পরপরই আব্দুর পরিকল্পনা অনুযায়ী সােহরাওয়ার্দী উদ্যানেও গড়ে ওঠেনি মুক্তিযুদ্ধের জাদুঘর।
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিকে যদি স্বাধীনতাযুদ্ধের পরপরই বিজয়ী বাংলাদেশে জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত করা হতাে তাহলে আজ দেশে স্বাধীনতা-বিরােধী ও যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমতা বৃদ্ধি পেত না। বাংলাদেশের মতাে অনুন্নত দেশের সরকারের পক্ষে যতখানি সম্ভব আমাদের ইতিহাসকে জাতীয় পর্যায়ে সংরক্ষিত করা, বেসরকারিভাবে জাতীয় পর্যায়ে তা করা কঠিন কাজ। (বেসরকারি উদ্যোগে ঢাকা শহরে প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ)। দুর্ভাগ্য যে, ইতিহাসকে সংরক্ষণ করতে বাংলাদেশ সরকার জাতির প্রতিনিধিত্ব করেনি, প্রতিনিধিত্ব করেছে দলের এবং সেই দলেরই ব্যক্তিবিশেষকে। পছন্দ না হলে নিজ দলের ইতিহাস-চিহ্নিত মানুষদের বিসর্জন দিতেও দ্বিধাবােধ করেননি। এ ভাবেই আমরা একসময় পরিণত হয়েছি ইতিহাস বিস্মৃত ও পথভ্রষ্ট জাতিতে। (দেরিতে হলেও ২০১১-র ৭ মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের অংশবিশেষের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ও ভূগর্ভস্থ জাদুঘরের প্রতিষ্ঠা বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ। আশা করি এই জাদুঘর ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে অখণ্ডিত, অবিকৃত ও বস্তুনিষ্ট ইতিহাসকে সংরক্ষণ করবে)। | সেদিন সেই ১৯৭৩-এর বৈশাখের অপরাত্নে মুজিবনগর আম্রকাননের মঞ্চের সামনে উপবিষ্ট আমার কিশাের হৃদয়ে স্থান পায়নি হৃদয়বিদারক কোনাে ভাবনা। আমি সেই স্বর্ণালি সময়ে ইতিহাসকে স্পর্শ করেছি ইতিহাস-প্রমাণ মানুষদের সান্নিধ্যে এসে। ইতিহাসকে সংরক্ষিত করেছি হৃদয়ের মণিকোঠায়। সেদিনের ভাষণে আব্ব বলেছিলেন যে স্বাধীনতা অর্জনের চেয়ে স্বাধীনতা। রক্ষা করা আরও কঠিন কাজ। বিদেশি সাহায্য-মুক্ত, স্বনির্ভর অর্থনীতির মাধ্যমেই সত্যিকারের স্বাধীনতা অর্জন সম্ভব।
সেই ১৭ এপ্রিল রাতের স্মৃতিটি ছিল বড় মনােমুগ্ধকর। লােক-কবি লালন শাহর ১৯৯তম জম্মবার্ষিকী উপলক্ষে এক স্মরণসভা ও গানের অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয় ছেউরিয়া গ্রামে। লালন লােক-সাহিত্য একাডেমির উদ্যোগে আয়ােজিত এই অনুষ্ঠানে আব্ব প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন এবং বলেন যে লালন শাহ ছিলেন বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ লােক-কবি। আলােচনা ও বক্তব্য শেষ হওয়ার পর শুরু হলাে লােকগীতির অনুষ্ঠান। একতারা ও দোতারা বাজিয়ে শিল্পীরা। লােকগীতি পরিবেশন করলেন। মঞ্চের পাটাতনে আন্ধু পরিবারসহ বসে তস্ময় হয়ে গান শুনছেন। আব্দুর কাছাকাছি আমি বসে রয়েছি। পুরাে পরিবার একত্র হয়ে ‘নিশিরাত এমন মরমিয়া’ গান শােনার বিরল সৌভাগ্যে মন আত্মহারা। জাতি, ধর্ম, শ্রেণী ও গােত্রের গণ্ডি পেরিয়ে যে লালন আলিঙ্গন করেছেন বিশ্বমানবতাকে, তারই সংগীতের মূৰ্ছনায় হৃদয় উদ্ভাসিত। একতারার মৃদু স্পন্দন তুলে বাউল-গায়ক চোখ বুজে লালন শাহর গান গাইছেন ‘সব লােকে কয় লালন কি জাত সংসারে লালন কয় জাতের মাথা বিকাইছি সাধ বাজারে। মন্ত্রিপরিষদের সদস্যবৃন্দ মুজিবনগর সরকারের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর পরপরই চলে গিয়েছিলেন। আল্লু বাড়তি একদিন থেকে গিয়েছিলেন কিছু আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করার জন্য। ১৮ এপ্রিল। সকালে আন্তু লােকসাহিত্য, একাডেমির উদ্বোধন করেন। গতকালের মতাে এই সকালেও লােকে লােকারণ্য। দূর-দূরান্ত থেকে কত মানুষজন এসেছে। পরম আগ্রহে তারা অনুষ্ঠান উপভােগ করছেন। দর্শকের সারিতে আন্ধু ও আমার পাশে বসে আমরা জানছি নতুন তথ্য। বাঙালি সংস্কৃতির বলিষ্ঠ বিকাশে লােক-সাহিত্যের অবদান সম্পর্কে আমরা শুনছি বক্তাদের বিভিন্ন আলােচনায়। বক্তব্যের ফাকে এক গায়ক হারমােনিয়ামে স্বাধীন বাংলা বেতারের গান ধরলেন—
সােনায় মােড়ানাে বাংলা মােদের শ্মশান করেছে কে?
কে, কে কে… ইয়াহিয়া তােমায় আসামির মতাে জবাব দিতে হবে।
ভুঠো তােমায় আসামির মতাে জবাব দিতে হবে ..
. রবিঠাকুরের অমর কাব্য ‘সােনার তরীর জন্মস্থান শিলাইদহ ছিল আমাদের সফরের অন্যতম এবং শেষ আকর্ষণ। ফারুনের মৃদুমন্দ হাওয়ায় দোল-খাওয়া তরণীর মধ্যে বসে বিশ্বকবি রচনা করেছিলেন এমন এক কবিতা, এমনি ভাবনায় আমরা যেন কিছু মুহূর্তের জন্য হারিয়ে গেলাম। তার পরই সফর শেষে ফিরে গেলাম ঢাকা শহরে। আল্লু আবারাে যেন হারিয়ে গেলেন আকাশ-প্রমাণ কর্মব্যস্ততার মাঝে।
লিভার সিরােসিস রােগাক্রান্ত মফিজ কাকুর শরীর দিনে দিনে খারাপ হচ্ছিল। পিজি হাসপাতালে ওনাকে ভর্তি করে চিকিৎসা চালানাে হলাে অনেক দিন পর্যন্ত কিন্তু শারীরিক অবস্থার কোনাে উন্নতি হলাে না। ঢাকার বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের পরামর্শ অনুযায়ী মফিজ কাকুকে নিয়ে আগস্টে আম্মা লন্ডনে গেলেন চিকিৎসার জন্য। সাথে ছােট মিমি ও সােহেলকে নিলেন। আব্দুর সাথে বাসায় তখন শুধু রিমি আর আমি। সে সময় আমি ম্যাক্সিম গাের্কির ‘মা’ গল্প পড়া শেষ করে স্কুলের বন্ধুর কাছ থেকে ধার করা ‘দিল্লীর বুকে দস্যু বনহুর’ পড়া শুরু করলাম। একদিন অফিস থেকে ফিরে আন্ধু আমার খোঁজ নিতে ঘরে ঢুকলেন। পড়ার টেবিলে আমি দস্যু বনহুর পড়ায় মগ্ন। আন্ধু আমাকে পড়ার বই ফেলে এই বই পড়তে দেখে ফেলেছেন ! আমার তখন ধরণী দ্বিধা হও’ এই অবস্থা। আব্ব বইটির শিরােনামে এক ঝলক চোখ বুলালেন। স্মিত। হাসলেন। কিন্তু কিছু বললেন না। আমি হাফ ছেড়ে বাঁচলাম।
সূত্র: তাজউদ্দীন আহমদ নেতা ও পিতা – শারমিন আহমদ
১০৩-১২৪
ঘরে ফেরা
সত্যই শক্তি। সত্য তার আপন বলেই বলীয়ান। এই নীতির একনিষ্ঠ অনুসারী আব্দু লড়ছেন একাকী। ১৯৭৩ সালও শেষ হতে চলল। এরই মধ্যে আমার খুব আগ্রহ জন্মাল শান্তিনিকেতনে লেখাপড়া করার। বাংলাদেশের বেশকিছু শিল্পী তখন শান্তিনিকেতনে গিয়েছেন সংগীতের ওপর লেখাপড়ার জন্য। অনেকের কাছেই তখন শান্তিনিকেতনের কথা শুনি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর শান্তিনিকেতনে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করেছিলেন। তাঁর স্বপ্ন ছিল যে বিশ্বভারতী বিশ্বদৃষ্টি ও উদার চেতনাসম্পন্ন সৃষ্টিশীল মানুষের জন্ম দেবে। প্রকৃতির সাথে একাত্ম হয়ে শিক্ষার্থীরা সৃষ্টি করবে নতুন তাল, লয়, ছন্দ; রচনা করবে যুগান্তকারী দর্শন, শিল্প ও কাব্য। সেই শান্তিনিকেতনের স্কুলে ভর্তি হব এই ইচ্ছার কথা আম্মাকে জানালাম। আম্মা আমাকে উৎসাহ দিলেন। শান্তিনিকেতন থেকে ভর্তির ফরমও আনা হলাে। আম্মা শান্তিনিকেতনে আমার ভর্তির ব্যাপারে আন্ধুকে জানালেন। একদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিনে সকালে আন্ধু আমাকে ডাকলেন আব্দুর ঘরের সামনের বারান্দায় রাখা চেয়ারে পিতা ও কন্যা মুখােমুখি বসলাম। আম্মাও আলুর পাশে বসা। আব্বু স্মিত হেসে বললেন, ‘আমি শুনলাম তুমি শান্তিনিকেতনে পড়তে যেতে চাও?’ আমি বললাম, হ্যা, আব্বু ।’ আব্বু বললেন, “খুব ভালাে কথা। শান্তি নিকেতনে তাে অনেক নামকরা মানুষেরা লেখাপড়া করেছেন। এমন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে লেখাপড়া করা তাে সৌভাগ্যের ব্যাপার।’ আব্বুর কথা শুনে আমি মনে মনে আশ্বস্ত হলাম। এবার আব্বু সেই মিষ্টি হাসিমাখা কণ্ঠে বললেন, কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলাে আমি তাে তােমাকে শান্তি নিকেতনে পাঠাতে পারব না। দেশে এখন দুরাবস্থা চলছে। দেশের রাজনৈতিক অবস্থা ভালাে এই সময় আমার মেয়ে ভারতে পড়তে যাবে, ব্যাপারটা ঠিক হবে না।’ আব্বুর কথা শুনে আমি মনে মনে আহত হলেও আমি জানতাম যে তার কথার পেছনে যুক্তি রয়েছে। আমার শান্তি নিকেতনে পড়তে যাওয়ার বিষয়টা সেখানেই ইতি হলাে।
আম্মা খুব সুন্দর সেলাই করতে পারতেন। আমার আবদার অনুযায়ী তিনি একদিন আমার ইংরেজি রূপকথার বইয়ের ‘Beauty and the Beast’ গল্পের বিউটির পােশাকের আদলে একটি লম্বা সুতির ফুল-ফুল ছাপওয়ালা ম্যাক্সি বানিয়ে দিলেন। সে সময় ঢাকায় ম্যাক্সি পরার চল হয়নি। আন্ধু আমাকে ম্যাক্সি পরা দেখে হেসে ফেললেন, বললেন, ‘এ যে দেখি পাগলনি বুবুর আলখাল্লা।’ আব্দুর সবচেয়ে বড় বােন গােলাবুন্নেসা আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতেন। খুব অল্প বয়সে তিনি স্বামীকে হারান এবং শিশুকন্যা রাবেয়া খাতুন ও শিশুপুত্র রকিবউদ্দীনকে একাকী মানুষ করেন। কন্যা ও পুত্রের বিয়ের পর তাঁদের নামে সব বিষয়-সম্পত্তি লিখে দিয়ে তিনি সম্পূর্ণভাবেই আধ্যাত্মিক জগতে চলে যান। গজারিনের মধ্যে লতাপাতার আচ্ছাদনে ঘেরা একটি স্থানে মাটির ঘর বানিয়ে তিনি সেখানে জিকির ও ধ্যানে নিমগ্ন থাকতেন। পরনে লম্বা আলখাল্লা ও হাতে তসবি। মাঝে-মাঝে মাসের পর মাস কারাে সঙ্গে কথা না বলে তিনি ধ্যানমগ্ন থাকতেন খাবারও খেতেন যৎসামান্য—দুধ, ফল বা পানি। তার ভাইবােনেরা ও গ্রামের মানুষজন তাকে ডাকত পাগলনি বুবু বলে। আম্মা আমাদের শিখিয়েছিলেন ‘দরবেশ ফুফু’ বলে। সম্বােধন করতে। ছােটবেলায় দরদরিয়ায় বেড়াতে গেলে কখনাে-সখনাে গহিন বনের ভেতরে দরবেশ ফুফুর সাক্ষাৎ পেতাম। তিনি মাটির চুলায় গুড়ের ক্ষীর বেঁধে আমাদের আপ্যায়ন করতেন। একবার আমাদের ধানমণ্ডির বাড়িতে বেড়াতে এসেছিলেন। ফজরের নামাজ পড়ে তিনি। আমাদের বাগানে পায়চারি করতেন। বাগানের ফুল তুলে মালা গেঁথে আমাদেরকে উপহার দিতেন। তার চোখের দৃষ্টি ছিল তীক্ষ সজাগ, যেন আমাদের অন্তরটা দেখতে পাচ্ছেন। আমরা জিজ্ঞেস করতাম, দরবেশ ফুফু, আপনার একা থাকতে ভয় করে না? তিনি বলতেন, ‘একা কোথায় ? আল্লাহ সর্বদা সব জায়গায় বিরাজমান।’ আমি একবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, দরবেশ ফুফু, আপনার জঙ্গলে থাকতে ভয় করে না, যদি সাপ বা বাঘ আপনাকে কামড় দেয় ?’
তিনি উত্তর দিয়েছিলেন, ‘আল্লাহর জীবকে ভালােবাসলে ওরা ক্ষতি করে না।’ প্রকৃতি ও জীবজগতের সঙ্গে মানুষের যে একটি নিবিড় যােগসূত্র রয়েছে, জীবপ্রেম যে আরাধনার অংশ, সেই চিন্তার বীজ তিনি আমার মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। আলখাল্লাধারী দরবেশ ফুফু ছিলেন আমাদের জন্য রহস্য ও বিস্ময়। ১৯৭০ সালে তিনি পরলােকগমন করেন। |যা-ই হােক, আমার ম্যাক্সি সম্বন্ধে আব্দুর মন্তব্য শুনে বুঝলাম যে এই পােশাক আব্দুর পছন্দ হয়েছে। নানার কাছে ম্যাক্সি পরে যেতে তিনি খুব প্রীত হয়ে বললেন, এ যে দেখি বাগদাদি জিলবাব !’ (লম্বা আরবি পােশাক)। নানার পূর্বপুরুষ সুফি সাধক সৈয়দ আহমেদ তানুরি বাগদাদ থেকে এই উপমহাদেশে আসেন দিল্লির সুলতান ফিরােজ শাহর আমলে সুতরাং দেখা গেল যে রূপকথার রাজ্য পেরিয়ে আমার ফুলছাপা ম্যাক্সি ধারণ করেছে আমার পিতৃ ও মাতৃকুল উভয় বংশেরই ঐতিহ্যকে। আর একদিন শাড়ি পরে আব্দুর সামনে দিয়ে হেঁটে যাওয়ার সময় দোতলার বারান্দায় বসা। আলু চমকে গিয়ে আম্মাকে বললেন, “এই মেয়েটি কে? ও রিপি নাকি?’ আম্মা হেসে বললেন, ও আমাদের রিপি।’ আব্ব দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ও কবে বড় হয়ে গেল? ওর সঙ্গে যে আমার পরিচয়ই হলাে না!’
কাকে কী ধরনের দায়িত্ব দিতে হবে এবং কে কোন কাজটি ভালাে পারবে সে ব্যাপারে আন্ধু ছিলেন পারদর্শী। অনেক কাজ, যা ছােটদের কাছে দিতে অনেকেই ভরসা করবে না, আব্দু তা অনায়াসেই আমাদের মতাে ছােটদের করতে দিতেন। ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি আওয়ামী লীগের দ্বি-বার্ষিক কাউন্সিলের সমাপনী অধিবেশনে আন্ধু আড়াই ঘণ্টা এক অসাধারণ বক্তব্য রাখেন। আওয়ামী লীগেরই কোনাে এক সদস্য বক্তব্যটি টেপ রেকর্ডারে ধারণ করেন। ধারণকৃত সেই টেপ থেকে কপি করার দায়িত্ব আব্বু দিলেন আমার দেড়-বছরের ছােট বােন বারাে বছরের রিমিকে রিমি তার নিজস্ব খালি ক্যাসেট ও আব্দুর দেওয়া টেপ রেকর্ডার নিয়ে প্রথমে সার্কিট হাউস রােডের (কাকরাইলের পাশে) আওয়ামী লীগ অফিসে যায়। যিনি টেপ করেছিলেন সেই ভদ্রলােককে রিমি খুঁজে বের করে। তিনি রিমিকে জানান, কে যেন টেপটি নিয়ে গিয়েছে, তাঁর কাছে আর কোনাে কপি নেই। এরপর রিমি বাসায় ফেরার পর আব্দু কয়েক জায়গায় ফোন করে জানতে পারলেন যে বাংলাদেশ বেতারও আব্বুর ভাষণটি টেপ করেছে। আব্দুর নির্দেশ মতাে রিমি এবার গেল বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্রে তখন বেতার কেন্দ্র ছিল শাহবাগে। সেখানে প্রায় তিন ঘণ্টা বসে আব্দুর পুরাে বক্তব্যটি সে টেপে ধারণ করে বাড়ি ফেরে। রিমি আন্ধুর বক্তৃতাটা সম্পর্কে আমাদের সঙ্গে বেশ উৎসাহ ভরে আলােচনা করে। এরপর অনুলিখনের দায়িত্বে আব্বু এবার আমাকে জড়ালেন। আজিজ কাকু, তার এক সহকর্মী ও আমি একত্রে শুরু করলাম অনুলিখনের কাজ।
আব্বুর ভাষণ আমরা তন্ময় হয়ে শুনছি আর লিখছি। সেই পঁয়ত্রিশ বছর আগেকার ভাষণ আজও কত অকাট্য সত্য। এক জায়গায় তিনি বলেছেন, “সকলেই বলে চোর, চোর, চোর; তবে চুরিটা করে কে ? কে তারা ? আমি তাে এ পর্যন্ত শুনলাম না বিগত দু’বছরে যে, কোনাে কর্মী এসে খাস করে বলেছে যে আমার চাচা ঐ রিলিফের চাল চুরি করে। এমন তাে কেউ বলেনি। ঐ পল্টন ময়দানে বক্তৃতা করে দুর্নীতি ধরে ফেলতে হবে আর ধরা পড়লে বাড়িতে এসে বলে তাজউদ্দীন ভাই আমার খালু ধরা পড়েছে, ওরে ছেড়ে দেন। আমি বলি, তুমি না বক্তৃতা করে এলে ? তখন সে উত্তর দেয় বক্তৃতা করেছি সংগঠনের জন্য, আমার খালুকে বাঁচান। এই হলাে বাংলাদেশের অবস্থা। সামাজিক বয়কটই বা কোথায় ? দুর্নীতি যারা করে তাদের বিরুদ্ধে সামাজিক বয়কট করতে হবে।’ অন্যত্র তিনি বলেছেন, ‘যুবকদের সম্বন্ধে বঙ্গবন্ধুকে কিছু বলে যাই। কৈশাের থেকে যৌবনে। যে পা দেয় তার জন্য কী ব্যবস্থা? আগের লােকসংখ্যার জন্য ঢাকায় যে স্কুল-কলেজ ছিল, ব্যায়ামাগার ছিল, বর্তমানে তা কি বাড়ছে না কমছে? মতিঝিল, দিলকুশা এলাকায় জিপিও হয়েছে। ঐ পুরাে এলাকা তাে খালি ছিল। ছােটবেলায় আমরা ওখানে খেলাধুলা করেছি। এক একটা স্কুলের জন্য এক-একটা খেলার মাঠ ছিল। কলেজগুলােরও নিজস্ব মাঠ ছিল। বর্তমানে লােক বেড়েছে, সন্তান-সন্ততি বেড়েছে, খালি জায়গায় ইমারত হয়েছে, বাড়িঘর হয়েছে, মানুষের তুলনায় যেখানে মাঠঘাট বৃদ্ধি পাওয়ার কথা সেখানে কমে গেছে। আগে কলেজগুলােতে যে বিন্ডিং ছিল সেখানে ৫০ জনের বসার স্থান ছিল। এখনাে ঐ ৫০ জনেরই স্থান আছে অথচ ছাত্রসংখ্যা ৫০ জনের জায়গায় এক হাজার হয়েছে। যুবকদের পড়াশােনার সঙ্গে মন ও মননশীলতা বিকাশের সুযােগ করে দিতে হবে। পাঠাগারের সংখ্যা ও আয়তন বাড়াতে হবে। খেলাধুলার ব্যবস্থা করতে হবে। আমি ঢাকা শহরের কথা বলছি, সঙ্গে সঙ্গে সব জেলা ও মহকুমা সদর দপ্তর এবং অন্যান্য ঘনবসতি এলাকায় পাঠাগার ও খেলার মাঠ গড়ে তুলতে হবে। বঙ্গবন্ধু আপনি হুকুম দিয়ে দিন, ঢাকায় এক মাইল লম্বা আধমাইল প্রশস্ত একটা জায়গা নিয়ে ছেলেদের খেলাধুলার ব্যবস্থা করে দিন।
নিষ্কলুষ আনন্দ লাভের সুযােগ করে দিন। তা নাহলে এরা ফুটপাতে ঘুরে বেড়াবে। ঘুরে বেড়ালে সাধারণত কী হতে পারে ? চিন্তা করে দেখুন। হাত শুধু পকেটেই যাবে না, নানান দিকে যাবে কাজেই যুবকদের এমনভাবে গড়ে তুলতে হবে যেন ভবিষ্যতে সােনার বাংলার যুবক হিসেবে তারা গড়ে ওঠে। ১৯৭৪ সালে আমার মনের একটি আশা পূর্ণ হলাে। বছরের শুরুতে, ফেব্রুয়ারি মাসে, আইজি গােলক মজুমদারের ছােট মেয়ে বাসন্তীদির বিয়ে উপলক্ষে আমাদের শান্তিনিকেতনও দেখা হয়ে গেল। তার বিয়ে হয়েছিল কোলকাতায় এবং বউভাত হয় আসানসােলে। আম্মা এবং আমরা চার ভাইবােন সেই বিয়ে ও বউভাত দুটো অনুষ্ঠানেই উপস্থিত ছিলাম। ১৯৭২ সালের ২৭ মে গােলক বাবুর বড় মেয়ে জয়ন্তীদির বিয়েতেও আমরা শরিক হয়েছিলাম। সে সময় তার স্ত্রী অঞ্জলী মজুমদার জীবিত ছিলেন এবং তিনি আমাদের খুব যত্ন-আত্তি করেছিলেন। এবারও যত্নের কমতি হলাে না কিন্তু তার স্নেহমাখা উপস্থিতির অভাব আমরা সকলেই বােধ করলাম। গােলকবাবু ও আম্মা অনেকক্ষণ তার স্ত্রীর স্মৃতিচারণা করলেন। বউভাতের পর গােলক মজুমদার আমাদের শান্তিনিকেতনে নিয়ে যান। বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেই প্রথম দেখলাম যে শাড়ি পরেই অনেক ছাত্রী স্বচ্ছন্দে সাইকেল চালিয়ে যাতায়াত করছে এবং গাছের নিচে ক্লাস দেওয়া হচ্ছে। আর্কাইভে সংরক্ষিত রবিঠাকুরের চিঠিপত্র পড়ার সৌভাগ্য, লাল সুরকি-ঢালা পথ এবং শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধ মনােরম পরিবেশ দেখে আমরা মুগ্ধ। রিমি ও আমি কৌতূহলভরে নানারকম প্রশ্ন করলাম। আমরা একদিন নিজেরাই শান্তিনিকেতনে আবারাে বেড়াতে আসব এমন কথাও আমরা দুই বােন বলাবলি করলাম। দুর্গাপুর ও আসানসােলের রেস্ট হাউসে থাকাকালে ওখাকার তেল শােধনাগার ও কয়লাখনিতে কর্মরত কিছু রাশিয়ান/রুশ পরিবারের সঙ্গেও আমাদের পরিচয় হলাে।
আমি আমার প্রাথমিক রুশ ভাষা প্রয়ােগ করে দুই-তিনজন রাশিয়ান মহিলার সঙ্গেও বন্ধুত্ব করে ফেললাম। কবি পুশকিনের রুশ লােকগাথার প্রেম নিয়ে রচিত তেজোদীপ্ত কবিতা ও লেখক টলস্টয়ের হৃদয়-জাগরণকারী সাহিত্যসম্ভার আমাকে রুশ ভাষা শিখতে অনুপ্রাণিত করে। বাড়িতেই স্বচেষ্টয় শুরু হয় অক্ষরজ্ঞান লাভ ও রুশ ভাষায় লেখাপড়া। ছােটদের টলস্টয়’ নামে আমার একটি প্রবন্ধ দৈনিক পূর্বদেশের চাদের হাট’-এর পাতায় সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল। ১৯৭৪ সালের ১৯ মে আব্দুর প্রয়াত বড় ভাই ওয়াজিউদ্দীন আহমদের পুত্র আমাদের চাচাতাে ভাই দলিলউদ্দীন আহমদের বিয়ে হলাে। প্রকৌশলী দলিল ভাই চাকরির সুবাদে থাকতেন টঙ্গিতে। আমাদের বাড়িতেই গায়ে হলুদসহ তাঁর বিয়ের বিভিন্ন আয়ােজন হলাে। বিয়েতে বাহুল্য একেবারেই ছিল না, ছিল অফুরন্ত আনন্দ। আব্দুর স্নেহছায়ায় যার ছাত্রজীবনের অনেকগুলাে সময় কেটেছে, সেই দলিল ভাইয়ের বউভাতের অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলাে ব্যতিক্রমধর্মী। চা-চক্রের মধ্য দিয়ে। আৰু অনাড়ম্বর সাধারণ জীবনযাপন করতেন। আজকাল রাজনীতিবিদের মধ্যে কেউ কেউ ঘটা করে বিশালাকার কেক কেটে জন্মোৎসব পালন করেন, অথচ আন্তু তার জম্মদিন পালন তাে দূরের কথা সে বিষয় কোনাে দিন আভাস-ইঙ্গিতও দেননি তিনি চাইতেন। তার পরিবারও যেন পরিমিতির মাত্রা কখনাে অতিক্রম না করে। আনন্দের বহিঃপ্রকাশ ঘটুক আন্তরিকতা, সংযম ও সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে এবং এর মধ্যেই ফুটে উঠবে সৌন্দর্য আব্দুর আদর্শের প্রতিফলন যেন ঘটল দলিল ভাইয়ের বিয়েতে। চা-চক্রে উপস্থিত মুজিব কাকু বর, কনে, আব্বু ও আম্মাকে সাথে নিয়ে ছবি তুললেন। তার প্রাণ খােলা হাসি, গমগমে কণ্ঠের রসালাপ ও দ্যুতিময় উপস্থিতি বিয়ের অনুষ্ঠানের আনন্দে নতুন মাত্রা যােগ করল। আমাদের কিশােরজীবন ছন্দময় হয়ে উঠছে সুন্দর সুন্দর অভিজ্ঞতার স্পন্দনে আর এরই মধ্যে আমরা লক্ষ করলাম যে আৰু যেন ক্রমেই ম্রিয়মাণ হয়ে পড়ছেন। যে স্বপ্ন নিয়ে আন্ধু মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন সেই স্বপ্ন যেন ভস্ম হতে শুরু হয়েছে। দলের ভেতরেই শুরু হয়েছে দুর্নীতি এবং সেগুলাে প্রশ্রয় পাচ্ছে ব্যাপকভাবে। সরকার সেনাবাহিনীকে মােতায়েন করল দুর্নীতি উচ্ছেদের জন্য। আওয়ামী লীগের এক এমপির বাসা থেকে রিলিফের জিনিসপত্র সেনাবাহিনী উদ্ধার করল।
ঐ এমপি এবং তার মতাে দুর্নীতিবাজ অনেকেরই কোনাে বিচার হলাে না। আল্লু ঘটনা জেনে হেয়ার রােডের বাড়ি থেকেই মুজিব কাকুকে ফোন করে বললেন, সেনাবাহিনী যখন দেশের সম্মানিত আইন প্রণয়নকারীর বাসা থেকে রিলিফ চুরির মাল উদ্ধার করে এবং সেই ব্যক্তি অনায়াসে পার পেয়ে যায় তখন সরকারের সম্মান কোথায় থাকে ? এর ফলে সরকারের ওপর জনগণের আস্থা তাে আর থাকে না! তারপর তিনি বললেন যে, সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল শফিউল্লার নির্দেশে সেনাবাহিনী হাতে-নাতে ধরেছে এই দুর্নীতিপরায়ণদের। তারা যখন ছাড়া পেল, তার অর্থ কি তারা নির্দোষ ? যদি তাই হয়ে থাকে তাহলে সম্মানিত এমপিকে হেয় করার জন্য সেনাপ্রধানের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া উচিত, কারণ একই সঙ্গে দুজন তাে নির্দোষ হতে পারে না ! নিশ্চয়ই একজন দোষী। বাস্তব যখন প্রমাণ করছে যে এমপি দোষী তখন তার এবং তার মতাে সকলের দৃষ্টান্তমূলক বিচার করতে হবে। নতুবা আইনের শাসন বলতে দেশে কিছু থাকবে না। মুজিব কাকু বললেন, তিনি ব্যাপারটা সুরাহা করবেন। কিন্তু পরে কিছুই হলাে না। আব্বু দুঃখভরে মন্তব্য করলেন, ‘মুজিব ভাই শেষ পর্যন্ত আর্মিকেও ক্ষেপিয়ে দিলেন। সেই অস্থির দিনগুলােতে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি, সর্বহারা পার্টি, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল এসব সরকার বিরােধী দলগুলাে দেশের অর্থনৈতিক দুরাবস্থা ও মানুষের হতাশাকে ব্যবহার করে শ্রেণী শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সশস্ত্র বিপ্লবের ডাক দেয়। সরকারি প্রতিষ্ঠান যেমন ব্যাংক ও পুলিশ দফতরসহ সরকার দলীয় সদস্যদের ওপর হামলা শুরু হয়। তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড দেশকে আরও সংকট ও অস্থিতিশীলতার দিকে ঠেলে দেয়। সেসময় সরকার যদি শক্ত হাতে আইনের শাসন ও দল মতের উর্ধ্বে ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠা করত, তাহলে সরকারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরে আসত। কিন্তু দেখা গেল যে নিজ দলের অনুগত ক্যাডাররা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড ও শত অপরাধ করেও পার পেয়ে যাচ্ছে এবং সন্ত্রাস দমননীতি প্রযােজ্য হচ্ছে শুধু বিপক্ষ দলের বেলায়।
ওদিকে ১৯৭৩-এ আরব ইসরায়েল যুদ্ধের পর তেলের মূল্য বৃদ্ধি পাওয়ায় বিশ্বব্যাপী তখন খাদ্য সংকট চলছে। উন্নত রাষ্ট্রগুলােতেও অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা দেখা দিয়েছে। সে প্রেক্ষিতে যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে রাতারাতি পরিবর্তন আনা সম্ভবপর ছিল না। দেশের মানুষ সে ক্ষেত্রে কষ্ট সহ্য করার জন্য রাজি ছিল। কিন্তু জনগণ যখন দেখল যে সরকারি দলের অনেক লােকজন সব রকমের সুবিধা গ্রহণ করছে এবং আপামর জনগণ বঞ্চিত হচ্ছে তাতে করে সরকারের জনপ্রিয়তায় ব্যাপক ধ্বস নামে।’ (পরিশিষ্টে ইস্টার্ন নিউজ এজেন্সির প্রাক্তন ডিপ্লোম্যাটিক করেসপন্ডেট সাংবাদিক সৈয়দ মােহাম্মদ উল্লার সাক্ষাৎকারে উল্লেখিত। পৃ. ২০০।) মুজিব কাকুর মন্ত্রিসভা থেকে ক’জন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রী তাঁদের অজান্তে হঠাৎই বাদ পড়ে গেলেন। সমাজকল্যাণ প্রতিমন্ত্রী বেগম নূরজাহান মুরশিদের মতাে সৎ, যােগ্য ও স্পষ্টবাদী মানুষদের মন্ত্রিসভায় বেশিদিন ঠাই হলাে না। নূরজাহান মুরশিদ, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, শামসুল হক, জেনারেল ওসমানী ও শেখ আবদুল আজীজসহ বেশ কজন মন্ত্রী ও প্রতিমন্ত্রীকে ‘৭৪ সালের মে মাসে আকস্মিকভাবে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেওয়া হয়। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এ প্রসঙ্গে বলেন, বঙ্গবন্ধু একটি রেজিগনেশন লেটার ড্রাফট করে সব ক্যাবিনেট মিনিস্টারদের স্বাক্ষরসহ কপি নিজের কাছে রাখেন। পরে সেই রেজিগনেশন লেটার ব্যবহার করলেন আমাদেরকে বাদ দেওয়ার জন্য। তার ধারণা ছিল যে আমরা তাজউদ্দীন আহমদের অনুসারী সেজন্য আমাদের অনেকেই বাদ পড়ে যান। মুজিব কাকুকে যারা ঘিরে ধরেছিলেন এবং তাঁর ওপর প্রভাব বিস্তার করছিলেন, তাদের মধ্যে ন্যায়নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত সবল ও সমৃদ্ধশালী নতুন বাংলাদেশকে গড়ে তােলার মতাে সততা ও যােগ্যতা সম্পন্ন নিবেদিত মানুষের অভাব পরিলক্ষিত হয়। সেসময়ের কেবিনেট সচিব (‘৭১-‘৭৫) তওফিক ইমাম এ প্রসঙ্গে তাঁর বইয়ে লিখেছেন, বঙ্গবন্ধুর প্রত্যাবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই তার (খন্দকার মােশতাক তৎপরতা শুরু হয়। অনুপ্রবেশ ঘটে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠজনদের ভিতর। অত্যন্ত দ্রুত বিভিন্ন ছল-চাতুরির মাধ্যমে তিনি বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠতা লাভ করেন। দিনেরাতে তাদের কান ভারী করতে থাকেন তাজউদ্দীন এটা করেছে, তাজউদ্দীন সেটা করেছে- ইত্যাদি পাশাপাশি তােষামােদ।
এই দুটি কাজে নির্লজ্জ বেহায়া ছিলেন খন্দকার মােশতাক আর ঠিক তার বিপরীত ছিলেন তাজউদ্দীন। তােমােদ, পরনিন্দা, পরচর্চা এ সব তিনি কখনাে করতেন না, পারতেনও না। নীতিগতভাবে চরম ঘৃণা করতেন এ সব। অন্যদিকে সুচতুর মােশতাক শুধু নিজে নয়, তার পক্ষের নেতৃবৃন্দ যারা বঙ্গবন্ধুর আস্থাভাজন ছিলেন, তাদেরকে দিয়ে, চরম মিথ্যাচার করিয়ে বঙ্গবন্ধু-তাজউদ্দীন দুজনের দূরত্ব সৃষ্টি করেছিলেন। এর ফল হয়েছিল সুদূরপ্রসারী। আমি অবশ্যই বলব খন্দকার মােশতাক এবং অনুগামীদের মূল লক্ষ্য ছিল বঙ্গবন্ধুকে অপসারণ এবং ক্ষমতা গ্রহণ এর সাথে কাজ করেছে তার প্রতিহিংসা পরায়ণতা এবং নীচ স্বভাব বেছে বেছেই পাকিস্তান এবং সহযােগী শক্তিরা একে নিয়ােগ করে তাদের বাহন রূপে। খন্দকার মােশতাক একাধিকবার দীর্ঘদিনের জন্য আওয়ামী লীগ থেকে বহিস্কৃত হয়েছিলেন দলবিরােধী অপতৎপরতা এবং শৃংখলাভঙ্গের অপরাধে এহেন দুকৃতকারীকে কীভাবে বঙ্গবন্ধু গ্রহণ করলেন এবং স্বাধীনতা-উত্তরকালে এতখানি বিশ্বাসে নিলেন তা আমার বােধগম্য হলাে না। বাকশালের গঠনতন্ত্র ও রূপরেখা প্রণয়নে তার ছিল সক্রিয় ভূমিকা এই বিভেদ আর অবিশ্বাস মােশতাক একা করেননি। তিনি তার তাবেদারদের নিয়েই করেছেন। দু একজনের কথা বলা যাক। তাহেরউদ্দিন ঠাকুরকে বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত স্নেহ করতেন, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, তুখােড় ছাত্রনেতা; বঙ্গবন্ধুর কাছের লােক, নূরুল ইসলাম মজুর প্রমুখ পৃথক। পৃথকভাবে একই বক্তব্য রাখতেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এভাবে এরা একজনের বক্তব্য এবং পরিবেশিত খবর আরেকজন সমর্থন করতেন। পাশাপাশি সুযােগসন্ধানী এবং উচ্চাভিলাষী কিছু আমলা এবং গােয়েন্দা বাহিনীর কর্তাব্যক্তি (যারা পাকিস্তান সরকারকে ভালােভাবেই খেদমত করেছেন এক সময়) বঙ্গবন্ধুকে অনেক কথাই পরিবেশন করতেন নেতৃত্বে ফাটল ধরানাের জন্য। বঙ্গবন্ধুর আপনজনের মধ্যে শেখ ফজলুল হক মনিরও একটা ভূমিকা ছিল মনে হয়, নাবুঝে, মুজিবনগর সরকারের প্রতি মনির একটা প্রচণ্ড বিদ্বেষ ছিল, যার বহিঃপ্রকাশ আমি কয়েকবার দেখেছি (একবার প্রকাশ্যে আগরতলায়)। মনি ছিলেন উচ্চাভিলাষী এবং প্রচণ্ড রাগী মানুষ।
তাকে খেপানাে খন্দকার মােশতাক গয়রহের বাম হাতের কাজ। ভিডিওতে ধারণকৃত এক সাক্ষাৎকারে (১৯ এপ্রিল, ২০১১) ড. কামাল হােসেন (বঙ্গবন্ধুর প্রশাসনে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন) আমার কাছে, মুজিব কাকুর পরিবারের নিকটতম ব্যক্তিবর্গের কাছে, খন্দকার মােশতাকের, আব্দুর বিরুদ্ধে মিথ্যাচারের একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। ১৯৭৫ সালের মার্চ মাসে ড. কামাল হােসেন যখন মুজিব কাকুর ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাসভবনের দোতলায় তার শয়নকক্ষে প্রবেশ করেন, তিনি দেখেন বেগম মুজিব পান বানাচ্ছেন এবং মােশতাক মােড়ায় বসা। তিনি ঘরে ঢােকার সাথে সাথে মােশতাক বলে উঠলেন, ‘এই তাে ভাবিকে বলছিলাম তাজউদ্দীনই তাে চায় নাই বঙ্গবন্ধু ও আপনারা ফিরে আসেন পাকিস্তান থেকে।’ কামাল হােসেন তাকে সরাসরি বললেন, ‘আমি একটা কাজে এসেছি, আমাকে এ সব বলবেন না।’ মােশতাকের এই উক্তি সম্বন্ধে তিনি সাক্ষাৎকারে বললেন, ‘First of all এটা totally মিথ্যা কথা—তারপর ভাবিকে (বেগম মুজিব শুনিয়ে বলা, within her hearing-এটা তাে খুব একটা অশুভ কাজ করলেন।
নেতা যখন অসৎ, অযােগ্য, দুনীতিপরায়ণ ও সুবিধাবাদীদের কাছে টেনে নেন এবং তাদের প্রশ্রয় দেন তখন তার ভয়াবহ পরিণাম শুধু তার ভাগ্যেই ঘটে না, পুরাে জাতিকেই তার মাসুল দিতে হয়। জাতি পিছিয়ে যায় শত বছর। আন্ধু ‘৭৪ সাল থেকেই বলা শুরু করেছিলেন লিলি তুমি বিধবা হতে চলেছ। মুজিব ভাই বাঁচবে না, আমরাও কেউ বাঁচব না। দেশ চলে যাবে স্বাধীনতা বিরােধীদের হাতে। আলু, যিনি মুক্তিযুদ্ধ সাফল্যর সাথে পরিচালনা করলেন, যুদ্ধাপরাধী ও দালালদের বিচার প্রসঙ্গে বিজয়ের আগেই মন্ত্রিসভায় বৈঠকের মাধ্যমে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিলেন (২৪ জানুয়ারি ১৯৭২ বাংলাদেশ দালাল আদেশ, ১৯৭২ নামে সরকারিভাবে প্রবর্তিত আইনটি ছিল বহুলাংশে তাঁর দৃঢ় ইচ্ছার ফসল) সেই তাকে ও এই বিষয়ের সাথে সম্পৃক্ত বিজ্ঞজনদের সাথে পরামর্শ না করেই মুজিব কাকু একক সিদ্ধান্তে ও আকস্মিকভাবে ১৯৭৩ সালে, যুদ্ধাপরাধ ও মানবতা বিরােধী নৃশংস অপকাণ্ডে লিপ্ত রাজাকার-আল বদরদের সাধারণ ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। সাধারণ ক্ষমার মতাে অতি গুরুত্বপূর্ণ এবং স্পর্শকাতর বিষয়টি জাতীয়ভাবে এবং সংসদীয় সিদ্ধান্তের মধ্যে দিয়ে আসেনি। এই ক্ষমাপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের অধিকাংশই তাদের বিরুদ্ধে মামলা নিষ্পত্তির আগেই ছাড়া পেয়ে যায়। তথ্য অনুসারে ৩০ নভেম্বর ১৯৭৩ তারিখে তথাকথিত সাধারণ ক্ষমা ঘোষণার আগে ৩১ অক্টোবর ১৯৭৩ পর্যন্ত দালাল অধ্যাদেশে অভিযুক্ত মােট ৩৭ হাজার ৩৭১ (নতুন সূত্র ৩৭ হাজার ৪৭১ জন) জনের মধ্যে ২ হাজার ৮৪৮ জনের মামলা নিষ্পত্তি হয়েছিল। সাধারণ ক্ষমার ফলে বাংলাদেশ দালাল আদেশ, ১৯৭২ এর অধীনে অভিযুক্ত প্রায় ২৬ হাজার আসামি মুক্তিলাভ করে ।
যাদের বিরুদ্ধে খুন, খুনের প্রচেষ্টা, ধর্ষণ, বাড়িঘরে অগ্নিসংযােগ ইত্যাদি সুনির্দিষ্ট অভিযােগ ছিল তারা সাধারণ ক্ষমা পায়নি বলা হয় । সুনির্দিষ্ট অভিযােগে আটক ১১ হাজার আসামির বিচার তখনাে চলছিল। আন্ধু চেয়েছিলেন যে দালাল আদেশে আটক সকলের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পরই যাদের বিরুদ্ধে বড় অপরাধ প্রমাণিত হয়নি তারা বিবেচনা সাপেক্ষে সাধারণ ক্ষমা পেতে পারে কিন্তু মামলা নিষ্পত্তির আগেই হাজার হাজার অভিযুক্তদের মুক্তির ফলে মানুষের তাে জানারই সুযােগ রইল না যে কারা ছিল দালাল, কারা সত্যই নির্দোষ এবং কে কী ধরনের অপরাধ করেছিল। সুনির্দিষ্ট বড় অপরাধে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের সাধারণ ক্ষমা প্রদান করা হয়নি। বলা হলেও দেখা যায় যে অনেক বড় অপরাধী ও খুনি এই সাধারণ ক্ষমার বদৌলতে মুক্তি লাভ করে। যেমন শহীদ বুদ্ধিজীবী-সাহিত্যিক শহীদুল্লাহ কায়সারের অপহরণকারী ও তাঁর হত্যাকাণ্ডর সাথে জড়িত দশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত (এই ব্যক্তির তাে আরও কঠোর সাজা হওয়া উচিত ছিল) আল বদরের সদস্য খালেক মজুমদারের মুক্তিলাভ। ওদিকে শহীদ বুদ্ধিজীবী ও চিকিৎসক ভ. আলীম চৌধুরীর হত্যার সাথে আল বদরের অন্যতম সংগঠক মওলানা আবদুল মান্নান জড়িত দাবি করেছেন শহীদের পরিবার, সেই পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর দুষ্কৃতিতে সহায়তাকারী মওলানা মান্নান সাধারণ ক্ষমার ফলে মুক্তি লাভ করেন এবং আশির দশকে জেনারেল এরশাদের শাসনামলে ধর্মমন্ত্রী হন। সাধারণ ক্ষমা প্রাপ্তদের অন্যতম কুখ্যাত দালাল শাহ আজিজুর রহমান প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটে প্রধানমন্ত্রী হন। (জেনারেল জিয়াউর রহমান ও বিচারপতি সায়েম সরকারের আমলে ৩১ ডিসেম্বর, ১৯৭৫ দালাল আইন বাতিল হবার পরে ১১ হাজার বা তারও ঊর্ধ্ব যুদ্ধাপরাধী ও গণহত্যাকারী যারা সাধারণ ক্ষমা প্রাপ্ত হয়নি তারাও বেরিয়ে এসে সসম্মানে পুনর্বাসিত হয়। অপর সাধারণ ক্ষমাপ্রাপ্ত দালাল গভর্নর মালিক, তার কতিপয় সহযােগী, যার মধ্যে তার ক্যাবিনেটের মন্ত্রী মওলানা মােহাম্মদ ইসহাক অন্যতম মুক্তি লাভ করেন। এ ছাড়াও পাকিস্তানিদের সহায়তাকারী শর্ষিনার পীর বিএনপির, খালেদা জিয়ার সরকারের আমলে স্বাধীনতা পদক লাভ করেন।
২০০১ সালে খালেদা জিয়া দ্বিতীয় বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী নৃশংস আলবদর দল প্রধান ও উপ-প্রধান মতিউর রহমান নিজামী এবং আলী আহসান মুজাহিনকে মন্ত্রী বানান। বাংলাদেশ বিজয় অর্জনের পর পলাতক এই দুই ঘাতক পরবর্তীতে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের দালাল আইন বাতিলের বদৌলতে পুনর্বাসিত হয়। ‘৭৩ এ সাধারণ ক্ষমায় মুক্তি প্রাপ্ত উচ্চপদস্থ, তথাকথিত শিক্ষিত দালালরা ছিল পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর অত্যন্ত আস্থাভাজন। নৃশংস গণহত্যায় তারা পাকিস্তান রক্ষার নামে সেনা বাহিনীকে যে সমর্থন যুগিয়েছিল তা প্রত্যক্ষ খুনের চাইতে কোনাে অংশে কম নয়, অনেক ক্ষেত্রে বেশিই ছিল। স্বভাবতই তাদেরকে এভাবে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন আব্বকে গভীরভাবে ব্যথিত করেছিল। কোষাগার ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শূন্য, যুদ্ধ বিধ্বস্ত স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও জটিল অর্থনৈতিক সেক্টরের হাল ধরা অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের তখন অন্য দিকে খুব বেশি মনােযােগ দেবার সময় ও সুযােগ না থাকলেও, দালালদের এমনি করে বিচার বাদে ছেড়ে দেবার বিষয়টি তিনি কোনমতেই মেনে নিতে পারেননি। তিনি “দালাল আইনে অভিযুক্তদের ছেড়ে দেওয়ার ব্যাপারে প্রবল আপত্তি জানান।” তিনি এ প্রসঙ্গে বলেন, “যুদ্ধাপরাধীদের কোন দেশেই এভাবে ক্ষমা করা হয় না। এ ক্ষেত্রে যে কারণেই তাদেরকে ক্ষমা করা হােক না কেন, সেটা ন্যূনতম বিচারের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করে। জাতির পিতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান দণ্ড মওকুফ করে দিতে পারেন। এটা করা হলে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের আত্মীয়স্বজন ও সভ্য জগৎকে বুঝান যাবে ন্যূনপক্ষে অপরাধীদের বিচার করা গেছে; ইতিহাসে অন্তত লেখা থাকবে যে মানবতাবিরােধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের চেষ্টা করা হয়েছে।”
সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার প্রায় বছরখানেক আগে দালালদের প্রসঙ্গে আন্ধু যে কথাগুলাে বলেছিলেন তার সবই আজ চল্লিশ বছর পর নতুন করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করায় ঐতিহাসিক সত্যে পরিণত হয়েছে। তিনি বলেছিলেন, তাদের প্রতি সরকার যে ক্ষমা সুলভ দৃষ্টিভঙ্গী নিয়েছেন ইতিহাসে তার নজীর নেই। নিজেদেরকে শুধরে নেওয়ার জন্য সরকার তাদেরকে সময় দিয়েছেন। জনগণ যদি তাদেরকে ক্ষমা করে দেন সরকারের বলার কিছুই থাকবে না। কিন্তু অন্যথায় তাদেরকে বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। দেশের বাইরে পলাতক গােলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল না করে তাকে দেশে ফিরিয়ে এনে দেশের মাটিতেই স্বচ্ছ ও নিরপেক্ষ বিচার করার পরামর্শ তিনি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিলেন এবং পাকিস্তান যুদ্ধাপরাধী সেনাদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনাল আইনে বিচারের কথা বলেছিলেন যা পূর্বে উল্লেখিত। আব্বু জানতেন যে গণহত্যার মূল অপরাধী পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে রয়েছে অনেক চ্যালেঞ্জ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিরুদ্ধে নানাবিধ চাপ সৃষ্টির কথা তিনি ২২ ডিসেম্বর, ১৯৭১ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দুদিন আগে অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামানের কাছে বলেছিলেন। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান তাঁর প্রবন্ধে ড. আনিসুজ্জামানের বরাত দিয়ে আব্দুর উদ্ধৃতি দেন। আন্ধু আনিসুজ্জামানের কাছে যুদ্ধাপরাধীদের শাস্তি দেওয়া প্রসঙ্গে বলেন, “চেষ্টার ত্রুটি হবে না, তবে কাজটি সহজ হবে না। আমি [আনিসুজ্জামান জানতে চাই, কেন? তিনি বলেন, যুদ্ধবন্দী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কাউকে বিচার করা সম্ভবপর হবে বলে তিনি মনে করেন না। আমি আবার জানতে চাই, কেন ? তিনি বলেন, মার্কিনিদের চাপ আছে। তারা পাকিস্তানকে চাপ দিচ্ছে বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে, ভারতকে চাপ দিচ্ছে যুদ্ধবন্দীদের ছেড়ে দিয়ে উপমহাদেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক করে তুলতে। তিনি আরও বলেন, যুদ্ধবন্দীদের বিচারে সােভিয়েত ইউনিয়ন ইচ্ছুক নয়, ভারতও উৎসাহী নয়। এ অবস্থায় কার জোরে আপনি বিচার করবেন ?
আর মূল অপরাধীদের বিচার না করতে পারলে। তাদের সাঙ্গপাঙ্গদের বিচারের প্রক্রিয়া দুর্বল হয়ে যেতে বাধ্য।” জটিল বাস্তবতার নিরিখে অনেকটা ভবিষ্যদ্বাণীর মতােই কথাগুলাে বললেও, তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গে ছিলেন অনমনীয়। দেশে ফিরে বঙ্গভবনে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক আইন অনুসারে গত নয় মাসে যেসব যুদ্ধবন্দী গণ-হত্যা ও অন্য অপরাধের জন্য দায়ী হবে তাদের বিচার হবে।” ঠান্ডা যুদ্ধে জড়িত দুই প্রতিদ্বন্দ্বী বিশ্ব শক্তিসহ আন্তর্জাতিক চাপ এবং পাকিস্তানে আটক সাড়ে তিন লক্ষের অধিক বাঙালিকে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে ভারতে আটক ৯৩ হাজার যুদ্ধ বন্দীর প্রায় সকলের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়া বাস্তব হলেও, মূল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা বাংলাদেশের পক্ষে সম্ভবপর ছিল। ভারতও পাকিস্তানকে জানিয়ে দিয়েছিল যে যেহেতু পাকিস্তান সেনা বাহিনী ভারত ও বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে, সেহেতু বাংলাদেশের সম্মতি ব্যতীত তাদেরকে ছাড়া হবে না।” প্রথমে এই যুদ্ধাপরাধীর সংখ্যা ১৫০০ হতে ৪০০ এবং সর্বশেষ ১৯৫ জনে এসে চূড়ান্ত হয়। ভারত হতে ১৯৫ জন পাকিস্তান যুদ্ধবন্দিকে বাংলাদেশের রাজধানীতে এনে গণহত্যা ও অন্যান্য যুদ্ধাপরাধের জন্য বিচার করা হবে, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন এই ঘােষণা দেন ১৯৭৩ সালের এপ্রিল মাসে।” ১১ মে ১৯৭৩, পাকিস্তান সরকার আন্তর্জাতিক আদালতে পিটিশনের মাধ্যমে অনুরােধ করে যাতে করে ভারত বাংলাদেশের কাছে কোনাে পাকিস্তান যুদ্ধবন্দিদের হস্তান্তর না করে।