You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

ভাষা শহীদ শফিউর রহমান
শফিকুর রহমান চৌধুরী

জীবন-কথা জন্ম ও পরিবার-পরিচিতি
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন বাঙালির ইতিহাসে এক নবজাগৃতিমূলক উদ্বোধনের সূচনা করে। আসলে হাজার বছরের বাঙালি জীবনে নব বিকাশ ও আত্মপ্রতিষ্ঠার উৎসমুখ খুলে দেয় ১৯৪৮ ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন । এই ভাষা আন্দোলনের ফলে বাঙালি একটি গােষ্ঠী (race) থেকে একটি জাতিতে উত্তীর্ণ হওয়ার প্রক্রিয়ায় স্থিত হয় । অতএব, ভাষা আন্দোলনের ঐতিহাসিক গুরুত্ব সর্ববাদিসম্পন্ন ও সুদূরপ্রসারী। এই আন্দোলন তৈরি হওয়ার সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং রাজনৈতিক উপাদানসমূহকে দাহ্য পদার্থের রূপ দিয়েছিল মহান ভাষা আন্দোলন এবং তার অবিস্মরণীয় শহীদেরা । এই শহীদদেরই অন্যতম ভাষাশহীদ শফিউর রহমান।
ভাষাশহীদ শফিউর রহমান ১৯১৮ সালের ২৪শে জানুয়ারি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার অন্তঃপাতি বিখ্যাত কোন্নগরে জন্মগ্রহণ করেন। শহীদ শফিউর রহমানের পারিবারিক ইতিহাস থেকে জানা যায় তাঁর পূর্বপুরুষ এলাহাবাদের রাজপরিবারের ব্যক্তিগত চিকিৎসক ছিলেন। সেকালে হেকিমি ইউনানি ইত্যাদি চিকিৎসাই ছিল রাজপরিবারসহ সকলেরই অসুখে বিসুখে ভরসার স্থল। শফিউর রহমানের দাদা হাবিবুর রহমানও পারিবারিক ঐতিহ্য অনুসরণ করে হেকিমি চিকিৎসায় নিজেকে নিয়ােজিত করেন । যতদূর জানা যায় তারা ছিলেন এলাহাবাদেরই অধিবাসী । কিন্তু তারা কলকাতার অদূরে চব্বিশ পরগনার কোন্নগরে বসতি স্থাপন করেন ।
– কোন্নগর কলকাতার অদূরে একটি শহরতলি, দূরত্ব মাত্র ২৪ মাইল । কোন্নগরে তাদের বাড়ির পেছন দিয়ে প্রবাহিত ভাগিরথী নদী। কলকাতা থেকে বাসে ও ট্রেনে খুব সহজেই কোন্নগরে যাতায়াত করা যায় । এলাকাটি বর্ধিষ্ণু। শফিউর রহমানের পরিবার মােটামুটি অবস্থা সম্পন্ন এবং এলাকার একটি প্রভাবশালী পরিবার। তাঁদের বাড়ির সীমানা প্রাচীরের মধ্যে একটি মসজিদ, একটি প্রাইমারি স্কুল/পাঠশালা এবং মাদ্রাসাও আছে। এই অবস্থা সম্পন্ন পরিবারটির অনেক জমিজমা, দুটি পুকুর এবং সাজানাে গােছানাে বসতবাড়ি ছিল। আগে তাদের অনেক চাষাবাদের জমি ছিল, সেগুলাে তারা বর্গা প্রথায় হালচাষ করাতেন । কিন্তু এখন যা হয়। পরিবার কিছুটা ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ায় বাড়িঘর দেখভালের লােকজন নেই। ফলে তাদের জমিজমা ধন সম্পত্তি অন্যান্যরা ভােগদখল করছে। অথচ একসময় তাদের নামি পরিবারটির খ্যাতির জন্যই ইংল্যান্ডের বিখ্যাত ডি ওয়ার্ল্ড কোম্পানি একটি ঔষধের ফ্যাক্টরিও তাদের সহযােগিতায় তাদের গ্রামে স্থাপন করে । ফ্যাক্টরিটি এখনাে চালু আছে।

কোন্নগরে গিয়ে হাকিম সাহেবের নাম বললে সকলেই একনামে তাদের বাড়িটি চিনে । কিন্তু ভাগ্যের নিষ্ঠুর পরিহাস ভােগদখলকারীরা নিজেদের নামেই এখন বাড়িটি পরিচিত করাতে শশব্যস্ত ।।
শফিউরদের পরিবারটি নানা কারণেই বিখ্যাত এবং প্রভাবশালী ছিল। নিজেদের উদ্যোগে তাদের বাড়ি সংলগ্ন জমিতে একটি প্রাইমারি স্কুলও প্রতিষ্ঠা করেন। তাতে বুঝা যায় পরিবারটি একটি বিদ্যোৎসাহী পরিবার হিসেবে এলাকায় বিশেষ খ্যাতি লাভ করেছিল। এছাড়া বাড়ি সংলগ্ন জমিতে একটি মসজিদ এবং মাদ্রাসাও করা হয়েছিল । কিন্তু এমন একটি সম্পন্ন পরিবারও এখন অনেকটাই জীর্ণদশায় পতিত হয়েছে । হাকিম হাবিবুর রহমান-এর কোনাে স্মৃতিচিহ্ন বাড়িতে গেলে বুঝে উঠার উপায় নেই। আর শহীদ শফিউরের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য কোনাে সাইনবাের্ড বা স্মৃতিলিপিও বাড়িতে প্রতিষ্ঠা করা হয়নি। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা দানের জন্য শফিউর রহমান নিজের জীবনকে উৎসর্গ করে গেছেন। তাঁর জন্মস্থানের ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিবেচনা করে বাড়িটি সংরক্ষণের জন্য পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সহযােগিতায় একটি স্মৃতি জাদুঘর বা পাঠাগার প্রতিষ্ঠা করা যায় ।
শফিউর রহমানের মা কানাইতাতুন নেসাও এক সম্ভ্রান্ত পরিবারের মেয়ে। তার বাবা মশিউদ্দিন আহমেদ বৃটিশ আমলে উচ্চপদে সরকারি চাকরি করতেন। শফিউরের মা বাবা দু’দিকের বংশধররাই শিক্ষিত এবং সরকারি চাকুরে হিসেবে নিজ এলাকায় প্রতিষ্ঠিত ছিলেন।
শফিউরের বাবা মাহবুবুর রহমান ঢাকায় এসেও তার পরিবারকে অল্পসময়ের মধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন। তাঁর জ্যেষ্ঠ সন্তান শফিউর রহমান চাকরিজীবী ছিলেন। সে কথা আগেই বলা হয়েছে। তার অন্য সন্তানদের মধ্যে আসজাদুর রহমান ১৯৫২ সালে মিডফোর্ড হাসপাতালের ছাত্র ছিলেন। তাঁর অন্য পুত্র সাইদুর রহমান ঠিক কী করতেন সে তথ্য আমরা উদ্ধার করতে পারিনি। তবে মাহবুবুর রহমানের অন্য পুত্র মফিজুর রহমান একটি মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করতেন এবং তৈয়বুর রহমান ছিলেন একজন স্টিল ফটোগ্রাফার । দুই কন্যা জামিলা খাতুন ও শাকিলা খাতুন ছিলেন গৃহিনী। বর্তমানে মাহবুবুর রহমানের পুত্র-কন্যাদের কেউ আর জীবিত নেই ।

শিক্ষা ও সংসার-জীবন
কোন্ননগর এইচ. ই স্কুল থেকে তিনি ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে পরিচালিত মেট্রিকুলেশন পরীক্ষায় দ্বিতীয় বিভাগে উত্তীর্ণ হন। ১৯৪০ সালে কলকাতা গভর্নমেন্ট ইনস্টিটিউট থেকে টাইপ রাইটিং-এ একটি সার্টিফিকেট কোর্স সম্পন্ন করেন।
মুরুব্বিরাই আলাপ আলােচনার মাধ্যমে আকিলা খাতুনের সঙ্গে শফিউর রহমানের বিয়ের ব্যবস্থা করেন। উল্লেখ্য শফিউর রহমানের মা কানাইতাতুন নেসা ছিলেন

আকিলা খাতুনের ফুফু । আকিলা খাতুনের বাবা মৌলভি তমিজউদ্দিন আহমদ ছিলেন কানাইতাতুন নেসার বড় ভাই। ফুফাত ভাই শফিউর রহমানের সঙ্গে মামাত বােন আকিলা খাতুনের বিয়ে হয় ১৯৪৪ সালের ২৮শে মে । আকিলা খাতুনের বয়স তখন ১৩ বছর।
আকিলা খাতুনের বাবা মৌলভি তমিজউদ্দিন আহমদ কলকাতা রাইটার্স বিল্ডিং-এ শিক্ষা বিভাগে একজন উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা ছিলেন । আকিলা খাতুনের নানা মৌলভি নূর মােহাম্মদ সরকারি চাকরি করতেন । বাসা হাওড়ায় ছিল। কিন্তু চাকরির সুবাদে তিনি বছরের ছয়মাস দিল্লি এবং ছয়মাস শিমলা থাকতেন। নানি ছিলেন গৃহিণী। তাঁর দাদার। পরিবারের লােকজন থেকে নানা বাড়ির লােকজন অধিকতর শিক্ষিত ছিল।
শফিউর রহমানের বাবা মাহবুবুর রহমান দেশ বিভাগের পর Service option দিয়ে পশ্চিমবঙ্গ থেকে ঢাকায় এসে পাকিস্তান পােস্ট গ্র্যান্ড টেলিগ্রাফ অফিসে সুপারিন্টেনডেন্ট পদে যােগ দেন। ছাত্র থাকাকালীন শফিউর রহমান চব্বিশ পরগনায় সিভিল সাপ্লাই অফিসে চাকরি করতেন। এই পদে চাকরিত থাকা অবস্থায় তিনি তার পিতার সঙ্গে ঢাকা আসেন। ঢাকায় এসে তিনি ঢাকা হাইকোর্টে হিসাবরক্ষণ শাখায় চাকরিতে যােগদান করেন।
১৯৫২ সালে তিনি তাঁর স্ত্রীসহ আজাদ সিনেমা হলের নিকট ৬নং রঘুনাথ দাস লেনে বসবাস করতেন। তাঁর একমাত্র মেয়ে শাহনাজের বয়স তখন তিনবছর ।

ভাষা আন্দোলনের সূচনা ও পরিণতি
ধর্ম তথা দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের দুইটি অংশের মধ্যে ভৌগােলিক, জাতিগত, ভাষাগত, নৃতাত্ত্বিক ও সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রেই মৌলিক পার্থক্য ছিল । ১৯৪৮ সালে সূচিত ভাষা আন্দোলন ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে এসে চূড়ান্ত রূপ লাভ করে । একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির হাজার বছরের ইতিহাসে ভাষাভিত্তিক একটি জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের মহান ঐতিহাসিক দিন। এই দিন থেকে বাঙালি নিজের জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিভিন্ন আন্দোলন ও সংগ্রামের মাধ্যমে অগ্রসর হয়েছে।
পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই রাষ্ট্রভাষা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৭ই মে দাক্ষিণাত্যের হায়দরাবাদে মজলিসে ইত্তেহাদুল মােসলেমিনের বার্ষিক সভা উপলক্ষে আয়ােজিত এক উর্দু সম্মেলনে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য চৌধুরী খালিকুজ্জামান ঘােষণা করেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা । খালিকুজ্জামান উল্লেখ করেছিলেন যে, কংগ্রেসিরা হিন্দিকে ভারতের জাতীয় ভাষা করতে চায় মুসলিম সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার জন্য । এজন্য তারা উর্দুভাষাকে নষ্ট করতে উদ্যত হয়েছে। ধর্মীয় সঙ্কীর্ণতা এবং সাম্প্রদায়িক অনেক পাকিস্তানি নেতাই উর্দুকে মুসলমানের ভাষা বলে অভিহিত করেছিলেন। তারা পূর্ব বাংলার মুসলমানের সমৃদ্ধ বাংলা ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের কথা বেমালুম ভুলে গিয়েছিলেন । এসব অজ্ঞ, প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ নেতাদের কারণেই দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আর এরাই পাকিস্তানের ঐক্য, সংহতি ও ধর্মীয় মূল্যবােধ বজায় রাখার জন্য উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার অবৈজ্ঞানিক ও খোঁড়া যুক্তি তুলে ধরেছিলেন।
এরপর ১৯৪৭-এর জুলাই মাসে আলিগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. জিয়াউদ্দিন আহমদ উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশ করেন । তাছাড়া তিনি আরাে একধাপ এগিয়ে গিয়ে পাকিস্তানের প্রদেশগুলির স্কুলগুলিতে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দুকে শিক্ষার মাধ্যম করারও সুপারিশ করেন । এর প্রতিবাদে ২৯শে জুলাই ১৯৪৭ দৈনিক আজাদে প্রকাশিত হয় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর ‘পাকিস্তানের ভাষা সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধ।
বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিকগণ বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লিখতে শুরু করেন ১৯৪৭ সালের আরও আগে কলকাতায়। ১৯৪৭ সালের ৩রা জুন মাউন্ট ব্যাটেনের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা ঘােষণার সময় ভবিষ্যৎ পূর্ববঙ্গ সরকারের বিভিন্ন

বিভাগে কর্মরত লেখক ও বুদ্ধিজীবী সম্প্রদায়ের একটি বিরাট অংশ ছিলেন কলকাতায়। বিভিন্ন দৈনিক, সাপ্তাহিক ও মাসিক পত্রিকায় কর্মরত লেখক ও সাংবাদিকরাও ছিলেন সেখানে। বামপন্থী মুসলিম তরুণ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের নেতৃস্থানীয় অনেকেই তখন কলকাতায় ছিলেন। সুতরাং কলকাতা হয়ে উঠেছিল কিছুকালের জন্য পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক রাজধানী। মাউন্ট ব্যাটেন পরিকল্পনা ঘােষণার পর ভবিষ্যৎ পাকিস্তানের নানা রকম সমস্যা নিয়ে তারা লেখালেখি শুরু করেন । তাদের আলােচনার একটি প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন । উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার চেষ্টা শুরু হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে সচেতন লেখকগণ এই হীন চেষ্টার বিরুদ্ধে লেখা শুরু করেন । দৈনিক ইত্তেহাদের সাহিত্য বিভাগে ১৯৪৭ সালের ২২শে জুন এবং ২৯শে জুন তারিখে দু’কিস্তিতে বাংলা ভাষাবিষয়ক প্রস্তাব’ নামে আবদুল হক রচিত একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়। বাঙালির ভাষাগত স্বাতন্ত্র ঘােষণাই ছিল এর লক্ষ্য । বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন প্রথম আলােচিত হওয়ার মুহুর্তেই বাঙালি জাতীয়তাবাদ ব্যক্ত হয়েছিল এই প্রবন্ধে। একে ভাষাগত জাতীয়তাবাদ বলা যেতে পারে । প্রবন্ধের কিছু অংশ উল্লেখ করা হলাে :
“প্রায় বাঙালী এটা মনে প্রাণে জানেন যে, হিন্দী-উর্দুভাষীর সঙ্গে কথা বলতে হলে তাকে হিন্দী-উর্দুতে বলতে হবে, কেননা অপর পক্ষ বাংলা জানেন না। স্বেচ্ছা প্রণােদিত হলেও এটা একটা বাধ্যবাধকতা। এরূপ বাংলা জানা এবং বলার বাধ্যবাধকতা ও গরজ এখন পর্যন্ত অবাঙালীদের নেই। এর প্রধান কারণ এই যে, বাঙালীর জাতীয়তাবােধ এখনাে পরিপূর্ণভাবে স্ফুরিত হয়নি। তার জাতীয় মর্যাদাবােধ এখনাে অত্যন্ত কাঁচা । তার পূর্ণ জাতীয় ব্যক্তিত্ববােধ এখনাে অপ্রতিষ্ঠিত। এই কারণেই বাঙালীরা সাধারণতঃ বুঝতে পারেন না যে, নিজ বাসভূমেও ইংরেজ তথা অবাঙালীদের সঙ্গে তাদেরই ভাষায় কথা বললে জাতীয়তাবােধের দিক থেকে নিজেকে ছােট করা হয় । নিজের অমর্যাদা করা হয়, নিজের ব্যক্তিত্ব বিসর্জন দেয়া হয় ।… আমার মনে একটা প্রশ্ন সব সময়েই উদ্যত হয়ে থাকে, আমরা কেন আমাদের দেশে ইংরেজী-উর্দুহিন্দী বলতে বাধ্য থাকব? আমাদের দেশে যারা বাস করে সেইসব ইংরেজ বা উর্দুহিন্দীভাষীরা কেন বাংলা শিখতে বাধ্য হবে না ?” [বাংলা ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব, ইত্তেহাদ’ (কলকাতা), ২৯শে জুন ১৯৪৭]
ঐ প্রবন্ধ প্রকাশিত হওয়ার একদিন পরে, ৩০শে জুন তারিখে দৈনিক আজাদ’ – এর সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় প্রকাশিত হয়েছিল একই লেখকের ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা শীর্ষক প্রবন্ধ। সূচনায় বলা হয়— “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কি হবে তা এখন স্থির করার সময় এসেছে। যে ভাষাকেই আমরা রাষ্ট্রভাষারূপে গ্রহণ করি, তার আগে আমাদের বিশেষভাবে ভেবে দেখতে হবে, … কোন ভাষায় পাকিস্তানের সবচেয়ে বেশী সংখ্যক লােক কথা বলে, পাকিস্তানের মধ্যে সব থেকে শ্রেষ্ঠ ভাষা কোনটি । কোন ভাষায় সব থেকে শ্রেষ্ঠ সাহিত্য সৃষ্টি হয়েছে এবং কোন ভাষা ভাবপ্রকাশের পক্ষে সব থেকে বেশী উপযােগী ।… যেদিক থেকেই বিবেচনা করা যাক না কেন, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলা ভাষার দাবীই সবচেয়ে বেশী।… এর মধ্যে দ্ব্যর্থক যদিও কিছু নেই, তবু এখানে স্পষ্ট করেই বলা প্রয়ােজন বােধ করছি যে, কেবল পূর্ব-পাকিস্তানের জন্যই নয়,

পশ্চিম-পাকিস্তানসহ সমগ্র পাকিস্তানেরই রাষ্ট্রভাষা হওয়ার দাবী এবং যােগ্যতা সবচেয়ে বেশী বাংলা ভাষার” । [পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা, আজাদ (কলকাতা), ৩০শে জুন, ১৯৪৭]।
প্রবন্ধে জনসংখ্যা, সাহিত্য ও প্রকাশক্ষমতার দিক থেকে বাংলা ভাষার আন্তর্জাতিক মর্যাদার কথা উল্লেখ করা হয় এবং বলা হয় “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবার যােগ্য একমাত্র বাংলা ভাষাই” । প্রবন্ধে আরও একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রশ্ন উপস্থাপন করা হয় : “আমরা স্বাধীনতা পেতে যাচ্ছি । স্বাধীনতা যদি সবদিক দিয়েই না পাওয়া যায় তবে সে স্বাধীনতাকে পূর্ণ স্বাধীনতা বলা যায় না। অন্যান্য স্বাধীনতার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ভাষাগত স্বাধীনতাও পাওয়া দরকার। যে ভাষাগত স্বাধীনতা পেলে আমরা আমাদের মনােভাব সুষ্ঠুরূপে প্রকাশ করতে পারবাে।
“যে স্বাধীনতা আসছে ভাষাগত স্বাধীনতা না পেলে তা হবে আংশিক এবং বদ্ধমুখ। স্বাধীনতা।” প্রবন্ধটিতে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়।
রাষ্ট্রভাষারূপে বাংলার পক্ষে তার যুক্তি ও বক্তব্য ছিল অত্যন্ত স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষ । মাহবুব জামাল জাহেদী ২০শে জুলাই তারিখের দৈনিক ইত্তেহাদ’-এ প্রকাশিত ‘রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক প্রস্তাব’ শীর্ষক প্রবন্ধে বলেন, সমগ্র পাকিস্তানের জন্য একমাত্র উর্দু এবং একমাত্র বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব উভয়ই অযৌক্তিক হবে। উর্দু বাঙালিদের কাছে। প্রায় বিদেশী ভাষা, এবং এ ভাষা বিশেষভাবে মুসলমান ভাষা তাও নয়। উর্দু অধিকন্তু তুলনামূলকভাবে জটিল অথচ অনুন্নত ভাষা। পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য বাংলা রাষ্ট্রভাষা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উর্দু রাষ্ট্রভাষা গ্রহণ করা হলেই সুবিচার হবে। কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে লেখক কোনাে সুস্পষ্ট সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারেন নি। ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ তাত্ত্বিকরূপে আবদুল হক ও মাহবুব জামাল জাহেদী স্মরণীয় হয়ে থাকবেন। সংক্ষিপ্ত পর্যালােচনা থেকে দেখা যায় যে উর্দু রাষ্ট্রভাষার বিরুদ্ধে সর্ব প্রথম লেখক-বুদ্ধিজীবীরাই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন এবং সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। প্রথমে কলকাতা এবং পরে ঢাকা থেকে। বাংলা রাষ্ট্রভাষা দাবির পেছনে ছিল বাঙালির ভাষাগত স্বাতন্ত্র্যচেতনা এবং পাকিস্তান রাষ্ট্রে বাঙালির সংখ্যাগরিষ্ঠতা সম্পর্কে চেতনাবােধ। ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসের প্রথম সক্রিয় ভাষা আন্দোলনে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ চেতনা এবং বাঙালি জাতি হিসেবে স্বাতন্ত্রবােধ বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল । এভাবেই রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের মানসিক প্রস্তুতি। এ আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল লেখকদের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক আলােচনায়। এই আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালি জাতীয়তাবাদের প্রথম সরব প্রকাশ ঘটে।
ভাষা আন্দোলন বিচ্ছিন্ন কোনাে ঘটনা নয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার অনেক আগেই বাংলাদেশে উর্দুকে প্রতিষ্ঠার ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গিয়েছিল । এই পরিপ্রেক্ষিতে ভাষা আন্দোলনের অনেক আগেই সাহিত্যিক ও সাংবাদিক সমাজের একটি প্রগতিশীল অংশ মাতৃভাষা বাংলার মর্যাদা ও অধিকার রক্ষার জন্য সংগ্রাম চালিয়েছেন ।

১৯৪৭ সালে দেশবিভাগ এবং ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্ভর পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর সেখানকার রাষ্ট্রভাষা নির্বাচনের ইস্যুতে উর্দু বাংলা বিতর্ক মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। পাকিস্তানি শাসকদের এই অপরিণামদর্শী পদক্ষেপের কারণে ভাষা-বিতর্ক ক্রমেই সামনে চলে আসে। রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত বিতর্ক লেখক-সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী মহলের সচেতন অংশে কিছুটা উত্তেজনা সৃষ্টি করে। বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় যেমন লেখালেখি শুরু হয় তেমনি ছাত্র-শিক্ষক-লেখক-সাংবাদিক মহলেও এ বিষয়ে ক্ষুদ্র আলােচনা উত্তাপ প্রকাশ পেতে থাকে ।
নারায়ণগঞ্জ থেকে প্রকাশিত কৃষ্টি’ নামক মাসিক পত্রিকার কার্তিক (১৩৫৪) সংখ্যায় পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার পরিপ্রেক্ষিতে উর্দু ও বাংলা’ শীর্ষক বিখ্যাত প্রবন্ধে ড. মুহম্মদ এনামুল হক উর্দুকে একটি অপরিচিত বিদেশি ভাষা বলে বর্ণনা করেন । এবং এই ভাষাকে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন। ‘উর্দুকে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষারূপে স্বীকার করিয়া লইলে, বাংলা ভাষার সমাধি রচনা করিতে হইবে এবং সঙ্গে সঙ্গে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীরও জাতি হিসাবে ‘গাের’ দেওয়ার আয়ােজন করিতে হইবে। রাষ্ট্রভাষার সঙ্গে জাতীয় মর্যাদা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্ন জড়িত। উর্দু ইসলামি সাহিত্যে সমৃদ্ধ। উত্তর ভারতীয় মুসলমানদের সঙ্গে যােগাযােগের জন্য উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করা দরকার । ড. এনামুল হক এসব যুক্তির অসারতা তুলে ধরেন, এবং পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য উর্দু ও পূর্ব-পাকিস্তানের জন্য বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রস্তাব করেন। এক রাষ্ট্রে একাধিক (রাষ্ট্র) ভাষা অচল এই শ্রেণীর ধারণা সাম্রাজ্যবাদের পরিপােষক। উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার মারাত্মক পরিণতি সম্পর্কে তিনি বলেন, ইহাতে পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় সর্বনাশ ঘটবে ।… উর্দু বাহিয়া আসিবে পূর্ব-পাকিস্তানবাসীর মরণ, রাজনৈতিক, রাষ্ট্রীয়, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক মৃত্যু। এই রাষ্ট্রীয় ভাষার সূত্র ধরিয়া শাসন, ব্যবসা-বাণিজ্য ইত্যাদি সর্ববিষয়ে পূর্বপাকিস্তান হইবে উত্তর-ভারতীয় এবং পশ্চিম-পাকিস্তানী উর্দুওয়ালাদের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র। যেমন ভারত ছিল ইংরেজী রাষ্ট্রভাষার সূত্রে ইংরেজের শাসন ও শােষণের ক্ষেত্র। [কৃষ্টি, কার্তিক ১৩৫৪ (নভেম্বর ১৯৪৭) যতদূর জানা যায় এই পত্রিকার একটি সংখ্যাই প্রকাশিত হয়েছিল ।
সওগাত-এর অগ্রহায়ণ (নভেম্বর-ডিসেম্বর) সংখ্যায় প্রকাশিত রাষ্ট্রভাষা ও পূর্বপাকিস্তানের ভাষা-সমস্যা’ শীর্ষক প্রবন্ধে কাজী মােতাহার হােসেন বলেছিলেন বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা উচিত। পশ্চিম পাকিস্তানে উর্দু (অথবা পশতু) এবং পূর্ব-পাকিস্তানে বাংলা। যদি তা না করা হয়, যদি উর্দুকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হয় তাহলে বাঙালি হিন্দু-মুসলমান ইংরেজ-রাজের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে পশ্চিম-পাকিস্তানিদের কবলে গিয়ে পড়বে। সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন:
বর্তমানে যদি গায়ের জোরে উর্দুকে বাঙালি হিন্দু-মুসলমানদের উপর রাষ্ট্রভাষারূপে চালাবার চেষ্টা হয়, তবে সে চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কারণ ধূমায়িত অসন্তোষ

বেশি দিন চাপা থাকতে পারে না । শীঘ্রই তাহলে পূর্ব-পশ্চিমের সম্বন্ধের অবসান হবার আশঙ্কা আছে (সওগাত, অগ্রহায়ণ ১৩৫৪]।
বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বাঙালি জাতীয়তাবাদ এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চিন্তা চেতনায় উদ্বুদ্ধ রাজনীতিসচেতন বুদ্ধিজীবীগণ তাদের লেখার মাধ্যমে বাংলা ভাষার পক্ষে প্রবল জনমত গড়ে তােলেন । তাই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত তমদুন মজলিসের হাতে শুরু হয়নি। অন্যদিকে ভাষা আন্দোলনের সাংগঠনিক তৎপরতা, বিক্ষোভ, আন্দোলন তমদুন মজলিস এককভাবে করেনি । তমদুন মজলিস গঠিত হয় ১৯৪৭-এর সেপ্টেম্বর মাসে, কিন্তু এর অনেক আগেই রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বিতর্ক ও লেখালেখির কাজ শুরু হয়ে যায় প্রগতিশীল বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক সচেতন লেখকদের হাত দিয়ে । ( প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়ােজন যে, সে সময় আমাদের লেখক-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ যেমন- কবি গােলাম মােস্তফা, সাংবাদিক মুজিবর রহমান খা, আকরাম খাঁ, লেখক, সাংবাদিক মােহাম্মদ ওয়াজেদ আলী প্রমুখ ব্যক্তি ছাড়াও আরাে অনেকে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও আন্তঃপ্রাদেশিক ভাষা হিসেবে গ্রহণের পক্ষপাতি ছিলেন। এর প্রধান কারণ তাদের মধ্যে বাঙালি জাতিসত্তা সম্পর্কে আধুনিক বিজ্ঞানভিত্তিক চিন্তার অভাব এবং সেই সঙ্গে প্রচণ্ড ধর্মীয় সংস্কৃতিপ্রীতি ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রভাব কাজ করেছে।
ভাষার ব্যবহার নিয়ে প্রথম প্রতিবাদ
শিক্ষিত বাঙালির একটি অংশ বিশেষ করে ঢাকায় সরকারি কর্মচারিদের একটি অংশ পাকিস্তানে প্রথম প্রকাশিত এনভেলাপ, পােস্টকার্ড, ডাকটিকিট, মানিঅর্ডার ফরম, রেলটিকিট ইত্যাদি এবং সদ্য ছাপানাে টাকায় বাংলার বদলে শুধু ইংরেজি ও উর্দু ভাষাই ব্যবহৃত হয়েছে দেখে বিস্মিত হয় এবং তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল কলেজের ছাত্র-শিক্ষকগণই নন, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসরত সরকারি কর্মচারিদের একটি বিশাল অংশ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অনুষ্ঠিত জামায়েত ও খণ্ড মিছিলে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের প্রথমদিকে । মিছিলে উচ্চারিত স্লোগান—সব কিছুতে বাংলা চাই’, ‘উর্দুর সঙ্গে বিরােধ নাই’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর বাংলা ভাষার দাবি ঘিরে ছাত্র শিক্ষক কর্মচারীদের প্রতিবাদ, বিক্ষোভ, জমায়েত ও ঘটনাবলি ছিল অনেকাংশেই বিচ্ছিন্ন ও অসংগঠিত। | কিন্তু এর আনুষ্ঠানিক প্রকাশ, সংঘবদ্ধ প্রতিক্রিয়া ও প্রতিবাদের সংগঠিত প্রতিফলন শুরু হয় ১৯৪৭ সালের ২৭শে নভেম্বর করাচিতে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান শিক্ষা। সম্মেলনের এক পর্যায়ে গৃহীত ভাষা বিষয়ক সিদ্ধান্তের ফলে । শিক্ষা সম্মেলনে পাকিস্ত ানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পক্ষে সুপারিশ করা হয়। শিক্ষা সম্মেলনে ভাষাসংক্রান্ত সুপারিশ সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ছাত্র শিক্ষক বুদ্ধিজীবী সমাজের সচেতন অংশ বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং ৫ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক মুসলিম লীগ

ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে উপস্থিত হয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। উর্দুর পক্ষে শিক্ষা সম্মেলনে গৃহীত সুপারিশের কথা প্রকাশ পাওয়ার পর ৬ই ডিসেম্বর সুসংগঠিত ছাত্র বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয় । এদিন দুপুরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আগত ছাত্রদের এক বিশাল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম । সভায় বক্তৃতা করেন মুনীর চৌধুরী, কল্যাণ দাশগুপ্ত, এ. কে. এম আহসান প্রমুখ। সভায় বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা এবং পূর্বপাকিস্তানের সরকারি ভাষা ও শিক্ষার মাধ্যমরূপে গ্রহণ করার দাবি জানানাে হয় । মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার বাংলা ও বাঙালি বিরােধী প্রচারণারও তীব্র নিন্দা জানানাে হয় ।।
সভাশেষে মিছিলে শ্লোগান উচ্চারিত হয়। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’, ‘উর্দুর জুলুম চলবে না। এভাবে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চার মাসের মধ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরাতন কলাভবন প্রাঙ্গণে আমতলায় ছাত্র-শিক্ষকদের সভায় প্রথম প্রত্যক্ষভাবে বাংলা ভাষা আন্দোলনের সূচনা হয়। পূর্ব বাংলার তদানীন্তন। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবন বর্ধমান হাউস এবং মুসলিম লীগের মুখপত্র ইংরেজি দৈনিক মর্নিং নিউজ পত্রিকা অফিসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয় । এটাই ছিল বাংলা ভাষার দাবিতে প্রথম সভা, শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ।
প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি (ডিসেম্বর, ১৯৪৭)
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বছরের সবটুকু সময়ই ভাষা সমস্যার তত্ত্বগত দিক নিয়ে লেখালেখিতে এবং নানা কর্মতৎপরতায় শেষ হয় । ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কামরুদ্দিন আহমদ গঠিত গণআজাদী লীগ, সেপ্টেম্বরে গঠিত তমদুন মজলিস বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টি শিক্ষিত শ্রেণীর সামনে তুলে ধরে এবং এক্ষেত্রে মজলিসের ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। ডিসেম্বর মাসের শেষদিকে তমদুন মজলিসের নূরুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক মনােনীত করে একটি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই-আগস্ট মাসে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লেখালেখি, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয় । এই বছরের শেষ কয়েকটি মাসে ভাষার প্রশ্নে ছাত্র বিক্ষোভ, ছাত্র ধর্মঘট এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভের মতাে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও ঘটে। কিন্তু রাষ্ট্রভাষা বিষয়টির রাজনৈতিক গুরুত্ব সংগ্রাম পরিষদ উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হয়। তারা বিষয়টিকে ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবীদের সঙ্কীর্ণ সীমার বাইরে নিয়ে গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক জনগােষ্ঠীর নিকট পৌছাতে সক্ষম হয়নি। অবশ্য তাদের সাংগঠনিক সীমাবদ্ধতা ছিল এবং প্রস্তুতিও তেমন ছিল না।
ভাষা আন্দোলনের সংগঠক ও ভাষাসংগ্রামী আবদুল মতিন এই কমিটি ও তাদের কর্মতৎপরতা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত মূল্যায়ন করেছেন তা প্রণিধানযােগ্য।
“সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির দুর্বলতা ও বিভ্রান্তির কারণে আন্দোলন ক্রমেই স্তিমিত হয়ে আসে…। এই নেতৃত্বের রাজনৈতিক ও মতাদর্শগত দুর্বলতার এবং দোদুল্যমানতার কারণে ছাত্র, বুদ্ধিজীবী ও জনগণের সমর্থন সত্ত্বেও

ভাষা আন্দোলনকে তারা জাতিসত্তার আন্দোলনের চেতনায় সমৃদ্ধ করে তুলে বেশিদূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন নি। এদের একাংশ বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাগত পরিধির মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখতে আগ্রহী ছিলেন। অন্যদিকে এ সময় নেতৃত্বে তমদুন মজলিসের প্রাধান্য আন্দোলন বিকাশের অন্তরায় হয়ে দেখা দিতে থাকে। কারণ তমুদুন মজলিসের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে একটি ইসলামী সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা এবং এই উদ্দেশ্য সামনে থাকার কারণে ভাষার মত তাৎপর্যপূর্ণ বিষয়কে এরা তাদের সঙ্কীর্ণ সাম্প্রদায়িক ধ্যান-ধারণার বাইরে নিয়ে যেতে পারেন নি।”
পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ঐতিহাসিক প্রস্তাব
১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশনে ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও গণপরিষদের ভাষা হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি তুলে একটি সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপন করেন। তাঁর যুগান্তকারী এই প্রস্তাব নানাদিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ। গণপরিষদের কার্যবিবরণীর ভাষা বাংলার দাবি উপস্থাপন করার সঙ্গে তিনি পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসাধারণের ভাষা বাংলাকে পাকিস্তানের Lingua franca হিসেবে প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। পাকিস্তানের ছয় কোটি মানুষের মধ্যে পূর্ব বাংলার চার কোটি চল্লিশ লাখ মানুষের ভাষা হচ্ছে বাংলা। কিন্তু পাকিস্তানের ধর্মান্ধ, অশিক্ষিত ও অপরিণামদর্শী প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনসহ পূর্ববঙ্গের সদস্য তমিজুদ্দিন খান এবং পশ্চিম পাকিস্তান সদস্য গজনফর আলী প্রমুখ এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে যে বক্তব্য উপস্থাপন করেন। তার মর্মার্থ হলাে পাকিস্তান একটি ইসলামি রাষ্ট্র। রাষ্ট্রের সংহতি রক্ষার জন্য পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে মাত্র একটি এবং তা হবে উর্দু। লীগ সদস্যদের তীব্র। বিরােধিতার মুখে সংশােধনী প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। এসব প্রতিক্রিয়াশীল, ধর্মান্ধ, অশিক্ষিত রাজনীতিবিদের একটি রাষ্ট্রের জনগণের ভাষা, সংস্কৃতি সম্পর্কে বিজ্ঞানসম্মত কোনাে ধারণাই ছিল না । ভাষা সম্পর্কে তাদের অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে অনৈক্য ও বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে, যা পরবর্তীকালে জনগণের জীবনে নেমে আসে ভয়াবহ বিপর্যয়।
সে সময় কলকাতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় যুব সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী এদেশীয় প্রতিনিধিদল, গণপরিষদে নাজিমউদ্দিনের ভূমিকার প্রতিবাদে এবং বাংলার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপনের জন্য ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে ধন্যবাদ জানিয়ে ২৮শে ফেব্রুয়ারি একটি বিবৃতি প্রচার করেন [দৈনিক আজাদ ২৯-২-৪৮]। শুধুমাত্র ঢাকা শহরেই নয়, গণপরিষদের এই অন্যায় ও অযৌক্তিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে সারাদেশে প্রতিবাদ বিক্ষোভ সংঘটিত হয়েছিল। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষক শ্রেণির একটি বিশাল অংশ তখনাে বাংলাকে পূর্বপাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার বাহন হিসেবে দাবি করেই সন্তুষ্ট ছিলেন । তখনাে পর্যন্ত রাষ্ট্রভাষা বিষয়ে এখানে কোনাে সুসংগঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্ব গড়ে উঠেনি। এই পরিপ্রেক্ষিতে গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা
১০

হিসেবে বাংলার দাবি উত্থাপন ছিল অত্যন্ত বৈপ্লবিক । বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন এই মহান ব্যক্তি সেদিন সুস্পষ্টভাবে বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের ভাষা এবং পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে যে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ এবং যুক্তি উপস্থাপন করেছেন তা ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখিত থাকবে। প্রকৃতপক্ষে এই দাবি উপস্থাপনের মাধ্যমে তিনি পাকিস্তানের কুচক্রি ও ধর্মান্ধ শাসকগােষ্ঠীর নিকট মূলত একটি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন।
দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
নেতৃত্বের দুর্বলতা এবং চিন্তা-চেতনার টানাপােড়েন এবং পরস্পর বিরােধী মতাদর্শের ফলে ভাষা বিষয়ক কর্মতৎপরতা সুশৃঙ্খল সাংগঠনিক কাঠামাের মাধ্যমে অগ্রসর হয় নি। প্রথম সংগ্রাম পরিষদ কোনাে সংগ্রামী ভূমিকা নিয়ে এগিয়ে যেতে পারে নি। অথচ প্রাথমিক পর্যায়ে সাতচল্লিশ সালের জুন-জুলাই-আগষ্ট মাসে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লেখালেখির পর ঐ বছরের অবশিষ্ট কয়েক মাসে ছাত্র বিক্ষোভ, ছাত্র ধর্মঘট, এমনকি সরকারি কর্মচারীদের বিক্ষোভের মতাে তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাও ঘটে গেছে। এসব ঘটনার সুদূরপ্রসারী রাজনৈতিক গুরুত্ব সংগ্রাম পরিষদ অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়।
১৯৪৭ সালের জুন-জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে লেখা প্রবন্ধ ভাষা আন্দোলনের পটভূমি তৈরি করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। দৈনিক পত্রিকা ইত্তেহাদ’, ‘আজাদ’, ‘মিল্লাত’ বিভাগ পূর্বকালে ও পরে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক নিবন্ধ, সম্পদকীয় প্রকাশ করে জনমত তৈরি করতে যথেষ্ট সাহায্য করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর মাসিকপত্র কৃষ্টি ও সওগাত-এ গুরুত্বপূর্ণ রচনা প্রকাশিত হয়। স্থানীয় ‘ঢাকা প্রকাশ’ এ বিষয়ে সংবাদ প্রকাশ ও সম্পাদকীয় মন্তব্যের মাধ্যমে ভূমিকা রাখে। তমদুন মজলিস প্রকাশিত পুস্তিকা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দুতে সংকলিত তিনটি প্রবন্ধ উল্লেখযােগ্য।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর গোঁড়া ও অপরিণামদর্শী পাকিস্তানি নেতারা উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বক্তব্য দিতে থাকেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে কামরুদ্দিন আহমদের উদ্যোগে গঠিত হয় গণ আজাদী লীগ। সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত হয় সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সংগঠন পাকিস্তান তমদুন মজলিস । অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে এই সংগঠন তৈরি হয়।
তবে ভাষার প্রশ্নে গণ আজাদী লীগ ও প্রগতিবাদী যুব সংগঠন গণতান্ত্রিক যুবলীগের তুলনায় প্রথমদিকে তমদুন মজলিশ বেশ সক্রিয় ছিল। তারা পরবর্তীকালে রাষ্ট্রভাষার দাবি নিয়ে বেশি অগ্রসর হতে পারেনি। তাদের কর্মতৎপরতা লেখালেখি ও আলাপ আলােচনায় সীমাবদ্ধ ছিল ।
ভাষা আন্দোলনের প্রাথমিক পর্বে তমদুন মজলিসের সক্রিয় ভূমিকা সত্ত্বেও মতাদর্শগত সঙ্কীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি, সাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার কারণে সম্মিলিত প্রয়াসের ক্ষেত্রে মজলিস পিছিয়ে পড়ে। বশীর আল হেলাল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থে
১১

লিখেছেন, ‘সংগঠন হিসেবে তমদুন মজলিস পরে আর ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে প্রথম পর্বের মতাে যুক্ত থাকতে পারেনি এ সম্পর্কে দেওয়ান মােহাম্মদ আজরফ বাংলা। একাডেমীকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ভাষা আন্দোলন ক্রমে বামপন্থী প্রগতিবাদী সমাজতন্ত্রী কর্মী, নেতা ও দলসমূহের হাতে চলে যায় । এইসব দল। নিয়ন্ত্রিত আন্দোলনকে সমর্থন জুগিয়ে সমাজতন্ত্রীদের স্বার্থকে পােষণ বা সাহায্য করা (তমদুন মজলিশের) আদর্শবিরােধী ছিল, তারা বিশ্বাস করতেন ইসলামের বিপ্লবী সম্ভাবনায় । [বশীর, পৃ. ১৮৩]
একই বিষয়ে বদরুদ্দীন উমর লিখেছেন, “তমদুন মজলিস আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে, বিশেষত যখন তা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল তখন একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে কিন্তু মার্চের প্রথম দিকে আন্দোলন রাজনৈতিক চরিত্র পরিগ্রহ করার সঙ্গে সঙ্গে তমদুন মজলিসের গুরুত্ব এবং তাদের নেতৃত্বের প্রভাব উল্লেখযােগ্যভাবে কমে আসে।” [প্রাগুক্তি, পৃ. ১২৬]
রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে সক্রিয় আন্দোলন শুরু হওয়ার পূর্বে প্রতিষ্ঠানগতভাবে তমদুন। মজলিস বাংলার দাবির সপক্ষে প্রচারকার্যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে গঠিত এই প্রতিষ্ঠান ঐ মাসে বাংলাভাষার দাবির সমর্থনে ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু নামে পুস্তিকা প্রকাশ করে। এতে কাজী মােতাহার হােসেন, আবুল মনসুর আহমদ এবং তমদুন মজলিসের প্রধান কর্মকর্তা আবুল কাসেমের রচনা। সংকলিত হয় । তমদুন মজলিসের ভাষা বিষয়ক প্রস্তাবের মূল কথা ছিল পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বাংলা এবং উর্দু এবং পূর্ব পাকিস্তানের অফিস ও আদালতের ভাষা, অর্থাৎ সরকারি ভাষা ও শিক্ষার বাহন হবে বাংলা।
দ্বিতীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও ১৯৪৮ সালের ১১ই মার্চের আন্দোলন
তমদুন মজলিসের প্রকাশিত পুস্তিকা এবং এর প্রতিষ্ঠাতা অধ্যাপক আবুল কাসেম-এর বক্তব্যে দেখা যায়, তাদের লক্ষ্য ছিল দেশে ইসলামি সমাজব্যবস্থা কায়েম করার চেষ্টা চালানাে । তারা প্রগতিশীল সমাজব্যবস্থার ঘাের বিরােধী ছিল। বাঙালি জাতিসত্তার সঙ্গে সমন্বয় করে তারা বাংলা রাষ্ট্রভাষার বিষয়টিকে দেখেনি । ভাষা আন্দোলনকে তারা একটি সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখেন। পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠীর সঙ্গে আপােসের মাধ্যমে আন্দোলন নিজেদের হাতে রাখার চেষ্টা এবং অন্যদিকে প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরােধী ভূমিকা পালন করে তারা আন্দোলনে অনৈক্য ও বিভাজন সৃষ্টি করে।
তমদুন মজলিস প্রভাবিত প্রথম সংগ্রাম পরিষদ ভাষা আন্দোলনকে ব্যাপক জনগােষ্ঠীর মধ্যে নিয়ে যেতে সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ছাত্রাবাস ও দলের উদ্যোগে ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ সর্বদলীয় চরিত্রের দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হয়। ১৯৪৮ সালের ২রা মার্চ ফজলুল হক হলে বিভিন্ন চিন্তার সাংস্কৃতিক রাজনৈতিক নেতা ও কর্মীদের এক সভায় কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, অলি
১২

আহাদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, কাজী গােলাম মাহবুবসহ অনেকের উপস্থিতিতে দ্বিতীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। এটি ছিল একটি বহুদলীয় চরিত্রের সংগ্রাম পরিষদ। তমদুন মজলিস, পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগ, ইনসাফ, জিন্দেগী, যুগের দাবি পত্রিকা এবং বিভিন্ন ছাত্রাবাস থেকে প্রতিনিধি নিয়ে এটি গঠিত হয় । মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব এবং মতপার্থক্যের কারণে এ সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বেও দুর্বলতা লক্ষ্য করা যায় । ১০ই মার্চ রাতে ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত পরিষদের বৈঠকে ১১ই মার্চের কর্মসূচি নিয়ে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় । মার্চের ভাষা আন্দোলনে ফজলুল হক হল, ঢাকা হল, মেডিকেল কলেজ ও ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ হােস্টেলের ছাত্ররাই প্রধান ভূমিকা পালন করে । গণপরিষদের বাংলা বিষয়ক বিতর্কের খবর পত্র-পত্রিকায় ছাপা হওয়ার পর থেকে ১১ মার্চের আন্দোলন শুরুর পূর্ব পর্যন্ত ছাত্রদের প্রতিবাদী বিক্ষোভ, সমাবেশ মিছিল নিত্যদিনের ঘটনা হয়ে ওঠে।
অবশ্য একটি কথা মনে রাখা প্রয়ােজন সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ তখনও পাকিস্তানের প্রতি অন্ধ মােহে মােহাচ্ছন্ন ছিল বলে মুষ্টিমেয় ব্যক্তির রাজনৈতিক বক্তব্য তেমন সাড়া জাগাতে পারে নি । এসব সীমাবদ্ধতার কথা বিবেচনায় রেখে আন্দোলনের সফলতা ও ব্যর্থতা নিরূপণ করতে হবে ।
১৯৪৮ সালের শেষ দিকে শিক্ষা সম্মেলন উপলক্ষে ঢাকায় সভা, বিক্ষোভ ও মিছিলের মাধ্যমে প্রতিবাদী আন্দোলন শুরু হয়। এসময় বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রশ্ন গুরুত্ব লাভ করে । কিন্তু সুসংগঠিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে এই আন্দোলন গতি লাভ করতে পারেনি। ১৯৪৮ সালের ২৫শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের সংশােধনী প্রস্তাব গণপরিষদের বাঙালি-অবাঙালি মুসলিম লীগ সদস্যদের বিরােধিতায় বাতিল হয়ে যায়। গণপরিষদের এই সিদ্ধান্তে ঢাকার ছাত্রসমাজে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । এরফলে বাংলা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে কিছুটা গতির সঞ্চার হয় । শুরু হয় বৈঠকের পর বৈঠক । ২৬শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্র সভায় সরকারি ভাষানীতির বিরুদ্ধে দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। সভাশেষে ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগানে শ্লোগানে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত হয়ে ওঠে। সাধারণ ছাত্রসভার সুপারিশ অনুযায়ী ২৮শে ফেব্রুয়ারি তমদুন মজলিস ও পূর্ব পাক মুসলিম ছাত্রলীগের এক যৌথ বৈঠকে ১১ই মার্চ দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবসের কর্মসূচি পালনের দিন ধার্য করা হয়।
আন্দোলনকে সফল করার জন্য আবদুল গনি রােডে অর্থাৎ সেক্রেটারিয়েটের প্রথম গেটের সামনে শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ এবং দ্বিতীয় গেটের সামনে কাজী গােলাম মাহবুব, শওকত আলী প্রমুখ নেতা অবরােধ কর্মসূচির দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাক, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, রমনা পােস্ট অফিস ইত্যাদি স্থানেও অবরােধের কর্মসূচি নেয়া হয়েছিল । ১১ই মার্চ সকাল থেকে ঢাকায় সচিবালয়ের বিভিন্ন গেটের সামনে, পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে, রেলওয়ে ওয়ার্কশপ, রমনা পােস্ট অফিসসহ বিভিন্ন স্থানে পিকেটিং কর্মসূচি শুরু করা হয়। এতে নেতৃত্বে দেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি
১৩

আহাদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ। পুলিশ। বেপরােয়া লাঠিচার্জ এবং ব্যাপক ধরপাকড়ের মাধ্যমে বিক্ষোভ দমনের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। বহু ছাত্র ও ছাত্রনেতা গ্রেফতার হন । গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ছাত্রনেতা শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, শওকত আলী, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখ । তীব্র ছাত্র বিক্ষোভ ও আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে খাজা নাজিমউদ্দিন রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সঙ্গে আটদফা চুক্তিপত্র স্বাক্ষরে বাধ্য হন ।
নিরস্ত্র ছাত্র জনতার বিক্ষোভের মুখে পুলিশের যথেচ্ছ লাঠিচার্জ এবং জুলুমের প্রতিবাদে বেলা আড়াইটার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে নঈমুদ্দিনের সভাপতিত্বে ছাত্রদের প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে ছাত্রমিছিল কার্জন হল, হাইকোর্ট এবং সেক্রেটারিয়েটের সামনের রাস্তায় প্রতিবাদ বিক্ষোভ জানাতে থাকলে পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ, বুট-ব্যাটন ব্যবহার করতে থাকে। সরকারি গুণ্ডাবাহিনী শুধু ছাত্র-যুব সমাবেশে হামলা চালিয়েই ক্ষান্ত হয় না, কমুনিস্ট পার্টির অফিস ও বইয়ের দোকান তছনছ করে পুড়িয়ে দেয় । এগারই মার্চের প্রতিবাদ দিবস রাজশাহী, বগুড়া, যশাের, চাঁদপুর, জামালপুর, ভৈরব, ময়মনসিংহ, পাবনা, খুলনা, দৌলতপুর, রংপুর, দিনাজপুর, নােয়াখালি, চট্টগ্রামসহ বহুস্থানে পালিত হয়।
এইদিন অনেক ছাত্র পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়। অনেকে গ্রেফতার হয় । পরদিন পুলিশি জুলুম, নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে শহরের বিভিন্ন ছাত্র এলাকায় সভা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৩ই মার্চ শহরের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভের বিস্তার ঘটে এবং ১৪ই মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ১৫ই মার্চ পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার দিন ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সর্বজনাব কামরুদ্দিন, মােহাম্মদ তােয়াহা, তাজউদ্দিন আহমদ, ডা. করিম আন্দোলনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা রাখেন।
পরিষদ ভবনের সামনে অব্যাহত তুমুল বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বলচিত্ত মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে আপােষ-মীমাংসার প্রস্তাব দেন। সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের মধ্যে আবুল কাসেম, কামরুদ্দিন আহমদ, নঈমুদ্দিন আহমদ, মােহাম্মদ তােয়াহা, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আলােচনায় বসেন। তুমুল বিতর্কের পর আটদফা চুক্তিনামা স্বাক্ষরিত হয়। অবশ্য জেলে আটক শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, কাজী গােলাম মাহবুব প্রমুখের সম্মতিক্রমে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর দেন কামরুদ্দিন আহমদ এবং সরকারপক্ষে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন।
স্বাক্ষরিত চুক্তির ধারাগুলাে ছিল : ভাষা আন্দোলনে গ্রেফতারকৃত বন্দিদের অবিলম্বে মুক্তি, পুলিশি অত্যাচার সম্পর্কে মুখ্যমন্ত্রী কর্তৃক তদন্ত অনুষ্ঠান, এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশনে কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা বাংলা সম্পর্কে প্রস্তাব উত্থাপন, প্রদেশে সর্বস্তরে ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে বাংলার পক্ষে প্রস্তাব উত্থাপন, আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের বিরুদ্ধে কোনােরূপ ব্যবস্থা না নেয়া, কলকাতা থেকে আসা ইত্তেহাদ, স্বাধীনতা এবং অন্যান্য সংবাদপত্রের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, জারিকৃত ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার এবং আন্দোলনকারিগণ রাষ্ট্রের দুশমন নন এই স্বীকৃতি।
১৪

নাজিমউদ্দিন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পর পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা আসেন। ১৯৪৮ সালের ২১শে মার্চ ঢাকা রমনার রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসভায় মােহাম্মদ আলি জিন্নাহ ঘােষণা করেন যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। অন্যকোনাে ভাষা নয় ।
রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঘােষণার পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ও মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের মধ্যে স্বাক্ষরিত চুক্তি কার্যত অর্থহীন হয়ে পড়ে।
১১ই মার্চের আন্দোলনে অনেক ছাত্র পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। অনেকে গ্রেফতার হন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র আলী আছগর, এম আই চৌধুরী, জসিমুদ্দিন, এস এ বারী, ফরিদুল হুদাসহ অনেকে গ্রেফতার হন । ১২ই মার্চ নির্যাতন ও গ্রেফতারের প্রতিবাদে শহরের বিভিন্ন এলাকায় সভা ও সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় এবং ১৩ই মার্চ শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। স্বতঃস্ফূর্তভাবে বিক্ষোভের বিস্তার ঘটে এবং ১৪ই মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। ঢাকায় মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবনে মুসলিম লীগ সংসদীয় দলের বৈঠক চলাকালে ছাত্রগণ সামনের রাস্তায় দীর্ঘ সময় বিক্ষোভ অব্যাহত রাখেন। ঐদিনই সংগ্রাম পরিষদের বৈঠকে ১৫ই মার্চ সাধারণ ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এইদিন পূর্ববঙ্গ আইনসভার অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা।
পরদিন পরিষদ ভনের সামনে অব্যাহত তুমুল বিক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে দুর্বলচিত্ত মুখ্যমন্ত্রী নাজিমউদ্দিন ছাত্রদের সঙ্গে আপােস-মীমাংসার প্রস্তাব পাঠান। সংগ্রাম পরিষদ সঙ্গে সঙ্গেই প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত তাদের সভায় কামরুদ্দিন আহমদের তৈরি খসড়া আলােচ্যসূচী কিছু পরিবর্তনসহ গৃহীত হয়।
মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে সম্পাদিত আটদফা চুক্তি তমদুন মজলিস প্রধান বিরাট সাফল্য হিসেবে বর্ণনা করেন । কিন্তু আন্দোলনের মূল লক্ষ্য রাষ্ট্রভাষা বাংলা অনুমােদনের ধারাটিই সেখানে ছিল অস্পষ্ট ও বিভ্রান্তিমূলক। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র তাদের রাজনৈতিক হীন স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে আটদফা চুক্তি সম্পাদন করেন । ভাষা আন্দোলনকে মাঝ পথে থামিয়ে দেয়া, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর সফর নির্বিঘ্ন ও নিরূপদ্রব করে তােলাই ছিল শাসকদের লক্ষ্য। সচেতন ছাত্র সমাজ চুক্তির দুর্বলতা বুঝতে পেরেছিলেন। আপােষবাদী চুক্তি সম্পাদনের জন্য তারা আবুল কাসেমকে অভিযুক্ত করতে থাকেন। তাদের দাবি ছিল বাংলা রাষ্ট্রভাষা ও সংশ্লিষ্ট বিষয়ে নাজিমউদ্দিনের কাছ থেকে সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি ও বিবৃতি। বামপন্থীরাও আন্দোলন অব্যাহত রাখার পক্ষপাতি ছিলেন । উদার গণতন্ত্রী হিসেবে পরিচিত কামরুদ্দিন সাহেবেরও দৃষ্টিভঙ্গি ছিল অনুরূপ।
ছাত্র জনসাধারণের ভাষা বিষয়ক আবেগ-অনুভূতি, প্রতিবাদী চেতনার কথা মনে রেখে মােহাম্মদ তােয়াহা আন্দোলন বন্ধ করে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আপােসে রাজী ছিলেন না। কামরুদ্দিন সাহেবের ভাষ্যে দেখা যায় তাজউদ্দিন আহমদও ঐ প্রস্তাবের খুব
১৫

একটা পক্ষপাতি ছিলেন না । চুক্তির ফলাফল যে বাংলা ভাষার পক্ষে যায়নি তা পরবর্তী ঘটনাসমূহের দ্বারা প্রমাণিত হয় । আন্দোলন অব্যাহত রাখার সমর্থক ছাত্রদের বক্তব্যই সঠিক প্রমাণিত হয়। তমদুন মজলিস আপােস-রফার চুক্তিকে ছাত্রদের ‘বিজয়’ বলে অভিহিত করে আন্দোলন প্রত্যাহারের দাবি জানায় ।
সংগ্রাম পরিষদ যখন এই চুক্তিপত্র মেনে নেয়ার জন্য ছাত্রদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে তখন সদ্য কারামুক্ত শেখ মুজিবুর রহমান ও শওকত আলী ছাত্রদের একাংশকে নিয়ে চুক্তির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করেন। ফলে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ছাত্রসভায় আট দফা চুক্তিনামায় কিছুটা সংশােধন করা হয় । সংশােধনীতে উল্লেখ করা হয় পূর্ববঙ্গ ব্যবস্থাপক পরিষদে রাষ্ট্রভাষা সংক্রান্ত প্রস্তাব গ্রহণের জন্য একটি নির্দিষ্ট দিন নির্ধারণ না করা হলে মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হবে ।
সংশােধিত প্রস্তাব ছাত্রসভায় অনুমােদিত হওয়ার পর অলি আহাদের মাধ্যমে। নাজিমউদ্দিনের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ইতােমধ্যে ঐ সভায় বক্তৃতা শেষে শেখ মুজিবুর রহমান কিছুসংখ্যক ছাত্রের একটি মিছিল নিয়ে সরকার বিরােধী ধ্বনি দিতে দিতে পরিষদ ভবনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকেন। তাদের শ্লোগানে আকৃষ্ট হয়ে আরাে বহু ছাত্র সেখানে সমবেত হন এবং তাদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেতে থাকে। পুলিশ ছাত্রদের ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস এবং ফাঁকা গুলি ছুড়তে থাকে। ছাত্রদের বিক্ষোভ সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে। পুলিশ ছাত্রদের সেখান থেকে তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হয় । পুলিশি নির্যাতনের প্রতিবাদে ১৭ই মার্চ সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। পরদিন (১৭ই মার্চ) দুপুরে বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত ছাত্র সভায় জিন্নাহ সাহেবের আসন্ন ঢাকা সফরের কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ধর্মঘট প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। বহুদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দের মতাদর্শগত অন্তর্দ্বন্দ্ব, বাঙালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে ভ্রান্ত ধারণা এবং পাকিস্তানের স্থপতি মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে চরম অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী উক্তি সম্পর্কে সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বের প্রধান অংশ তমদুন মজলিস নিরব থাকে। ফলে আন্দোলন। সামনের দিকে অগ্রসর হয় না । ছাত্র যুব নেতৃত্বের একটি অংশের এধরনের দুর্বলতা ও সংগ্রামে অনীহার কারণে লীগ শাসকদের পক্ষে বাংলাভাষার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রম। গ্রহণ করা সহজ হয় । যেমন— ভাষা সংস্কার, আরবি হরফে বাংলা প্রচলন ইত্যাদি। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ফজলুর রহমান ছিলেন এইসব ষড়যন্ত্রের হােতা। ১৯৪৯ সালে বর্ণমালা নিয়ে বিতর্ক, কেন্দ্রীয় শিক্ষা উপদেষ্টা বাের্ডের আরবি হরফে বাংলা লেখার সুপারিশ, বাবায়ে উর্দু’ ড. আবদুল হকের উর্দু শিক্ষার সর্বজনীন প্রয়ােজন সম্পর্কে বক্তৃতা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ড. সাদানির বাংলা সম্পর্কে আপত্তিকর বেতার বক্তৃতা উল্লেখযােগ্য। ফলে ১৯৪৭ সালের মতাে বাংলা উর্দু বিতর্ক পত্র পত্রিকায় এবং সভা সম্মেলনের বক্তৃতায় দেখা দিতে থাকে । এর সঙ্গে নতুন মাত্রা যুক্ত হয় বর্ণমালা বিতর্ক।
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান করাচিতে এক পাঠাগার উদ্বোধনকালে বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের জাতীয় ভাষা [দৈ. আজাদ ২২.৯.১৯৪৯] ।
১৬

ভাষা ও সংস্কৃতিকে ঘিরে ধর্মভিত্তিক চেতনা গড়ে তােলার চেষ্টা শুরু হয় গােলাম মােস্তফা, সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল কাসেম প্রমুখের মাধ্যমে। এমনি করে বাংলা বিরােধিতার কাজ এগিয়ে চলে । অন্যদিকে বাংলা ভাষায় আরবি হরফ প্রচলনের বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদের প্রস্তাব [দৈনিক আজাদ, ১২-১২-১৯৪৯]। লেখক-সাহিত্যিক, গবেষকদের লেখার মাধ্যমে ভাষাও হরফ ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায় ।।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফর : রাষ্ট্রভাষার দাবি নস্যাৎ এবং আন্দোলনকারীদের রাষ্ট্রবিরােধী হিসেবে চিহ্নিত করা :
মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৮ সালের ১৯শে মার্চ ঢাকা আসেন। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের জন্য তিনি ঢাকা আসেন। পূর্ব বাংলার বিপর্যস্ত লীগ শাসনকে উদ্ধার এবং তার ব্যক্তিত্ব ও বিশাল জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি নস্যাৎ করা। পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে তাঁর মতামত সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী পদ্ধতিতে পূর্ববাংলার জনগণের ওপর চাপিয়ে দেয়া।
পূর্ববাংলার মাটিতে পা রেখে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ তিনটি জনগুরুত্বপূর্ণ বক্তৃতা দেন । ঢাকা রেসকোর্সের বিশাল জনসভায় ২১শে মার্চ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানে ২৪শে মার্চ এবং ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে ২৮শে মার্চ পাকিস্তান বেতারে। প্রতিটি বক্তৃতায় তিনি একই সুরে কথা বলেন। তার মূল কথাগুলাে ছিল যুক্তিহীন রূঢ়তায় পরিপূর্ণ, অন্ধ আবেগ, রাষ্ট্রদ্রোহী শব্দের চমকপ্রদ ব্যবহার, আন্দোলনকারীদের কমিউনিস্ট ও বিদেশি চর হিসেবে আখ্যায়িত করা। তিনি অত্যন্ত নির্লজ্জভাবে পূর্ববাংলার ধর্মপ্রাণ ও সহজ সরল মানুষকে লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়ে পাকিস্তানের খেদমত করার পরামর্শ দেন। তাঁর চোখে সরকারের সমালােচকগণ হয়ে যান কুইসলিং’ পঞ্চমবাহিনী ইত্যাদি।
নাগরিক সংবর্ধনা উপলক্ষে ঢাকা রেসকোর্স ময়দানে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুতে বক্তৃতা দেন। পাকিস্তানের স্থপতি বাংলার বিরুদ্ধে এবং উর্দুর পক্ষে বেশ জোরালােভাবে কথা বলেন। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ঢাকায় ছাত্রদের আন্দোলন। সম্পর্কে নিশ্চয়ই তিনি অবহিত ছিলেন। তাঁর জনপ্রিয়তা ও ব্যক্তিত্বের প্রভাব দ্বারা তিনি পূর্ববাংলার সচেতন ছাত্রসমাজের মতামত ও আন্দোলন দমাতে চেয়েছিলেন।
রাষ্ট্রভাষা উর্দুর পক্ষে তার মতামত শােনার পর রেসকোর্সের জনসমুদ্রে অবশ্য তীব্র প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা যায়নি। প্রত্যক্ষদর্শী সাঈদ হায়দারের মতে প্রতিবাদ উচ্চারণের বদলে ছাত্রসমাজের একাংশ সভাস্থল ছেড়ে চলে যায়। যাওয়ার পথে সাজানাে তােরণে কিছু ভাঙচুরও করে।
এই জনসভায় উপস্থিত কমিউনিস্ট কর্মী সরদার ফজলুল করিম বলেন, “জিন্নাহ সাহেবের বক্তৃতার দিন আমি রেসকোর্স ময়দানে উপস্থিত ছিলাম ।… জিন্নাহ সাহেব উর্দুতে ভাষণ দেন। বক্তৃতা করতে করতে এক জায়গায় তিনি বললেন, তােমাদের
১৭

মধ্যে কমিউনিস্ট আছে, তােমাদের মধ্যে গুপ্তচর আছে, তােমাদের তারা বিভ্রান্ত করছে। আমি বলছি, ভাষার ক্ষেত্রে যে প্রশ্ন উঠেছে তাতে উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহ সাহেবের ভাষণ শােনার পর ছাত্ররা এতই মর্মাহত হয়েছিল যে, হলে ফেরার পথে সংবর্ধনার জন্য তৈরি তােরণ তারা ভেঙে ফেলে । অনেকে বলেছেন, জিন্নাহ সাহেব রেসকোর্সে ভাষণ দানকালে ভাষার প্রশ্নে যে বক্তব্য রেখেছিলেন, তার প্রতিবাদ সেখানেই হয়েছিল। কিন্তু এ কথা ঠিক নয়। আমি একজন সচেতন কর্মী হিসেবেই সেখানে গিয়েছিলাম… সেখানে কোনাে বিক্ষোভ বা প্রতিবাদ আমি লক্ষ্য করিনি।”
কিন্তু ২৪শে মার্চ কার্জন হলে বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বক্তৃতায় রাষ্ট্রভাষা প্রসঙ্গে জিন্নাহ সাহেব আবারও যখন উর্দু রাষ্ট্রভাষার পক্ষে কথা বলেন তখন উপস্থিত ছাত্রদের একাংশ থেকে প্রতিবাদ উচ্চারণ নাে নাে নাে’ সবাইকে বিস্মিত করে । এখানে উপস্থিত সরদার ফজলুল করিমও একই কথা বলেছেন । কার্জন হলে জিন্নাহ। সাহেব ইংরেজিতে বক্তৃতা করেছিলেন। কয়েক সেকেণ্ড চুপ থেকে তিনি শান্তভাবে তাঁর বক্তব্য শেষ করেন। কিন্তু পূর্ব বাংলা থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে প্রদত্ত বেতার ভাষণে তিনি পুনরায় উর্দুভাষার বিষয়টি বেশ জোরের সঙ্গেই উল্লেখ করেন। কার্জন হলে ঐ না না’ প্রতিবাদে অংশ নিয়েছিলেন আবদুল মতিন ও তাঁর সঙ্গী ছাত্রগণ। ঢাকার রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে কায়েদে আযমের অপরিণামদর্শী ও অগণতান্ত্রিক বক্তব্য-এর তেমন কোনাে প্রতিবাদ করেনি। একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন শেরেবাংলা এ.কে. ফজলুল হক । ২৩শে মার্চ তিনি জিন্নাহর স্বৈরতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির কঠোর সমালােচনা ও প্রতিবাদ করে এক বিবৃতি দেন। দৈনিক আজাদ তির্যক শিরােনামে (হক ছাহেবের হুঙ্কার/ কায়েদে আজমের প্রতি জঘন্য আক্রমণ) তা প্রকাশ করে। রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক বক্তৃতায় পূর্ববাংলার ছাত্রসমাজ এবং জনসাধারণের মধ্যে কিছু মাত্রায় হলেও জিন্নাহর জনপ্রিয়তা কমে যায় ।।
২৪শে মার্চ সন্ধ্যায় জিন্নাহ সাহেব সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যে বৈঠকে মিলিত হন তা উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ে শেষ হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন শামসুল হক, কামরুদ্দিন আহমদ, আবুল কাসেম, মােহাম্মদ তােয়াহা, অলি আহাদ প্রমুখ । তারা জিন্নাহের নিকট একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
এরপর জিন্নাহ সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাতের ইচ্ছা প্রকাশ করায় বিভিন্ন হল ও ঢাকসুর প্রতিনিধিসহ মােহাম্মদ তােয়াহা তাঁর সঙ্গে দেখা করতে যান। কিন্তু সেখানেও আলােচনার পরিবেশ ছিল শীতল। প্রকৃতপক্ষে তিনি শুধু মুসলমান ছাত্রদের সঙ্গে আলােচনা করতে চেয়েছিলেন। অমুসলমান ছাত্রনেতাদের উপস্থিতিতে তিনি মুখ খুলতে রাজি হননি। এই ঘটনা জিন্নাহর অগণতান্ত্রিক ও সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিভঙ্গি নগ্নভাবে উন্মােচিত করে। ১৯৪৭ সালের ১১ই আগস্ট পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালে তিনি বলেছিলেন এখন থেকে কেউ আর মুসলমান বা হিন্দু নন, সবাই পাকিস্তানি । এই বক্তব্য থেকে সরে এসে তিনি নবগঠিত রাষ্ট্র পাকিস্তানকে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক ও অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করেন।
১৮

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
বাংলা রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে অনিশ্চয়তা, দ্বিধা-দ্বন্দ্ব এবং চরম হতাশার মধ্যেই ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ উদযাপিত হয়। এই উপলক্ষে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আয়ােজিত ছাত্রসভায় আবদুল মতিনের প্রস্তাবের ওপর ভিত্তি করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ নতুন করে গঠিত হয়। সাধারণ ছাত্রদের উৎসাহ-উদ্দীপনায় রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক রাজনৈতিক বিষয়টি এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনের সুযােগ আসে। আবদুল মতিন সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক নিযুক্ত হন।
বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ মার্চে ধর্মঘট পালন করুন’ সংগ্রাম কমিটি কর্তৃক প্রচারিত একটি ইশতেহার পর্যালােচনা করে দেখা যায় যে সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালের মার্চ মাসে। এ সম্পর্কে আরাে একটি ইশতেহার এবং একটি স্মারকলিপির সাহায্য নিয়ে আবদুল মতিন বলেন, ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির এই তিনটি দলিল বিশ্লেষণ করলেই বােঝা যায় ঐ কমিটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৫০ সালের ১১ই মার্চ। …
ভাষা আন্দোলনের চেতনা এ সময় ছাত্র-জনতার মধ্যে ক্রমশ উজ্জীবিত হতে থাকে। ইশতেহার, পােস্টার, সভা, ছােটোখাটো মিছিল ইত্যাদির মাধ্যমে সংগ্রাম পরিষদ ভাষার দাবিতে কিছুটা গতি সঞ্চার করতে সক্ষম হয়। গােটা পঞ্চাশ সাল এই ধরনের কর্মতৎপরতার মাধ্যমে অতিবাহিত হয় এবং অপেক্ষাকৃত অধিক উৎসাহ ও উদ্দীপনা নিয়ে সংগ্রাম পরিষদ ও ছাত্রসমাজ ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ উদযাপনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। পঞ্চাশের কর্মতৎপরতার আরাে একটি দিক ছিল পাকিস্তান গণপরিষদ কর্তৃক গঠিত মূলনীতি কমিটির উর্দু রাষ্ট্রভাষা সুপারিশের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ। ব্যাপক প্রতিবাদের মুখে কেন্দ্রীয় সরকার শেষ পর্যন্ত মূলনীতি কমিটির সুপারিশ সংক্রান্ত আলােচনা স্থগিত রাখেন।
১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ সংগ্রাম পরিষদ নতুন করে কর্মসূচি ঘােষণা করে। এ বছরই প্রথম রাষ্ট্রভাষা দিবস উপলক্ষে ছাত্র-জনতার মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যায়। একটি ইশতেহার প্রকাশ করা হয়। এই ইশতেহারে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে ১১ই মার্চ ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানানাে হয়। এখানে আরাে বলা হয়, বন্ধুগণ, যতক্ষণ পর্যন্ত আমরা কর্তৃপক্ষের এই ফ্যাসিস্ট মনােভাবকে সমূলে বিনষ্ট করে আমাদের বাংলার দাবি প্রতিষ্ঠিত করতে না পরি ততক্ষণ পর্যন্ত আমাদের সংগ্রাম ক্ষান্ত হতে পারে না।
অতএব আসুন- আমরা ১১ই মার্চ নিজ নিজ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা করে আমাদের ঐতিহাসিক রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে স্মরণ করে পুনরায় লৌহদৃঢ় প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষারূপে ঘােষণা করতে কর্তৃপক্ষকে বাধ্য করি।
সে বছর, বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনার সঙ্গে ১১ই মার্চ পালিত হয়। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট ও সভা অনুষ্ঠিত হয়। নারায়ণগঞ্জের ছাত্ররাও হরতাল ও মিছিল করে
১৯

বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে বিশাল সভার আয়ােজন করে। অলি আহাদের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সেই সভায় মােহাম্মদ তােয়াহা, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন।
উর্দু সমর্থকদের ক্রমবর্ধমান ষড়যন্ত্র ও চাপের মুখে বাংলা রাষ্ট্রভাষা চেতনা বৃদ্ধি পেতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর মতাে ধীরস্থির ব্যক্তিত্ব ১৯৫১ সালের ১৬ই মার্চ কুমিল্লায় অনুষ্ঠিত শিক্ষক সম্মেলনে সভাপতির ভাষণে বলেন, বাংলা ভাষা অবহেলিত হইলে আমি ব্যক্তিগতভাবে বিদ্রোহ করিব।’ চট্টগ্রামে অনুষ্ঠিত সাংস্কৃতিক সম্মেলনে ঐতিহ্যবাহী লােকসংস্কৃতি এবং গণসংস্কৃতি ও প্রগতিবাদী সাংস্কৃতিক চেতনা রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে নতুন শক্তি ও প্রাণের সঞ্চার করে। বাংলা রাষ্ট্রভাষার প্রতি করাচির প্রখ্যাত ‘ডন পত্রিকার পরােক্ষ সমর্থনের পাশাপাশি পেশােয়ারের ‘খাইবার মেইল’ পত্রিকা সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখে ।
১৯৫১ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে নতুন করে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক মহলে যে তর্কবিতর্ক ও বাংলার পক্ষে যে জনমত তৈরি হয় তা ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ভিত্তি মজবুত করে। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ২১শে ফেব্রুয়ারির আন্দোলন বাঙালির জীবনে তাৎপর্যময় করে তুলতে দারুণভাবে সাহায্য করে।
দীর্ঘ এই স্মারকলিপি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে যথেষ্ট আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল। এর কিছু গুরুত্বপূর্ণ অংশের বাংলা অনুবাদ তুলে ধরা হলাে :
“সবশেষে আমরা সে কথারই পুনরাবৃত্তি করব যে কথা আমরা বারবার দ্ব্যর্থহীন। ভাষায় বলে আসছি। যদি পাকিস্তানে একটিমাত্র রাষ্ট্রভাষা হয় তাহলে সেটা অবশ্যই হবে বাংলা। আর যদি তা একাধিক হয় তাহলে বাংলাকে হতে হবে তার মধ্যে অন্যতম।…
আমরা কখনই উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে মেনে নেব না। আমরা পূর্ববাংলাকে উপনিবেশে পরিণত করার ষড়যন্ত্র উদঘাটন করে দিতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আমরা তাদের এবং রাষ্ট্র পরিচালনার শীর্ষে অধিষ্ঠিত জনপ্রতিনিধিদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, যতদিন বাংলা ভাষার ন্যায়সঙ্গত দাবি প্রদেশে এবং কেন্দ্রে। পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত না হচ্ছে ততদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ শান্ত হবে না।”
পেশােয়ার থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত সংবাদপত্র মহলে এই স্মরকলিপির প্রভাব লক্ষ্য করা যায় । সীমান্ত প্রদেশের প্রভাবশালী দৈনিক ‘খাইবার মেইল ২০শে এপ্রিল ১৯৫১ সম্পাদকীয় নিবন্ধে বাংলা রাষ্ট্রভাষার সমর্থনে সুনির্দিষ্ট বক্তব্য উপস্থাপন করে :
বাংলা ভাষার দাবি অবহেলা করা যায় না। পাকিস্তানের জনসংখ্যার অধিকাংশ পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসী এবং বাংলা ভাষার নিজস্ব ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাহিত্য রহিয়াছে। উর্দুকে কাহারও উপর চাপাইয়া দেওয়া চলে না।… অতএব আমরা মনে করি যে, বাংলা এবং উর্দু উভয় ভাষাকেই পাকিস্তানের সরকারি ভাষারূপে স্বীকার করা উচিত।
২০

ঢাকার দৈনিক পাকিস্তান অবজারভার পত্রিকায় ৫ই মে ১৯৫১ সালে এবং সিলেটের সাপ্তাহিক নওবেলাল’ পত্রিকায় ১০ই মে ১৯৫১ এই সম্পাদকীয় পুনরায় প্রকাশিত হয়। এছাড়া লাহােরের দৈনিক টাইমস’ পত্রিকায় এ বিষয়ে প্রতিবেদন ছাপানাে হয়।
বাঙালি সদস্যদের মধ্যে কেউ কেউ পুনরায় উর্দুর পক্ষে তৎপর হয়ে ওঠেন। ‘পাকিস্তান অবজারভার বাংলার পক্ষে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। মৌলানা। আকরম খাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে (১৫ই এপ্রিল ১৯৫১ সালে করাচিতে অনুষ্ঠিত নিখিল পাকিস্তান উর্দু সম্মেলনে বাংলা বিরােধী বক্তব্য) ১৮ই এপ্রিল ১৯৫১ এক জাতীয় ভাষা শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধ লেখেন ।।
‘রিপাের্ট অনুযায়ী মওলানা আকরম খাঁ উর্দু সম্মেলনে বলেছেন যে, পূর্ব বাংলায় যারা উর্দুর বিরােধিতা করে তারা ইসলামের শত্রু।
আমাদের একথা মনে করারও কোনাে দরকার নেই যে, উর্দু প্রেমিকদের সম্মেলনে উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে মওলানা আকরম খাঁ যা বলেছেন এ প্রদেশে ফিরে এসে তিনি তার পুনরুক্তি করবেন। উর্দু সম্মেলনে আকরম খাঁ প্রমুখ কয়েকজন রাজনীতিকের উর্দুর পক্ষে এবং বাংলার বিরুদ্ধে বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায় ছাত্র-বুদ্ধিজীবীদের একটি অংশ । সেই সূত্রে ‘অবজারভার’ ১৯৫১ সালের মে মাসের সাত এবং আট তারিখে দুই দফায় রাষ্ট্রভাষা’ শীর্ষক সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। প্রথমটিতে বলা হয় :
‘রাষ্ট্রভাষার ওপর এই দুঃখজনক বিতর্ক ইতােমধ্যেই যথেষ্ট তিক্ততার সৃষ্টি করেছে ।… যদি বাংলা এবং উর্দু উভয়কেই রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করা হয় তাহলে পাকিস্তানের দুই অংশের জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বােঝাবুঝি সহজতর অধিকতর স্বাস্থ্যকর ও সুখকর হবে।।
এসময় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ একটি ইশতেহার প্রকাশ করে। এতে বাঙালি জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংক্রান্ত দাবি প্রাধান্য পায় । ইশতেহারটির শিরােনাম ছিল: স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করুন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন।
এসম্পর্কে আবদুল মতিন বলেন, বছর দুই আগে আমার সে সময়কার ইকবাল হলের রুমমেট এবং বর্তমানের ছাত্র-শিক্ষক মিলনায়তনের পরিচালক জনাব আসাদুজ্জামান খান (সম্প্রতি প্রয়াত…) আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটির প্রকাশিত স্থানীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করুন এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করুন’ শীর্ষক একটি প্রচারপত্র দেন । আমি প্রচারপত্রটা ওমর সাহেবকে দেই। সেটা তার বইয়ের তৃতীয় খণ্ডে দ্রষ্টব্য । ইশতেহারটির তারিখ ছিল ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৫১ ।।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে প্রচারণা এবং জনমত গঠনে বিশেষ ভূমিকা রাখে। প্রকৃতপক্ষে এই সংগ্রাম কমিটি আন্দোলনে নতুন প্রাণের সঞ্চার করে। ভাষা সমস্যার সমাধান না হওয়ায় ছাত্রসমাজের মধ্যে হতাশা ও
২১

অস্থিরতা ক্রমশ বেড়ে ওঠে । ১৯৪৯ সালের ২৩শে জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম এবং যুবলীগের মতাে কয়েকটি সংগঠনের কর্মতৎপরতা রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন গতি সঞ্চারিত হয়। এসময় বিভিন্ন শ্রেণীর সরকারি কর্মচারীদের অসন্তোষ, ক্ষোভ এবং সার্বিকভাবে দেশের অর্থনৈতিক মন্দা এবং পূর্বাপর সরকারি নির্যাতন ও দমননীতির পটভূমিতে শুরু হয় বায়ান্ন সাল। বাঙালির জীবনে একটি ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী বছরের সূচনা ।।
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান গণপরিষদে ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের ভাষা বিষয়ক প্রস্তাব বাতিল হওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবিতে বিস্ফোরণের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নাজিমউদ্দিনের রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক মন্তব্য আন্দোলনের দাবানল তৈরি করে ।
রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবি, সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের দাবি ছাত্র-যুব সমাজের মধ্যে ব্যাপক সমর্থন এবং আলােড়ন সৃষ্টি করে। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবির পক্ষে ব্যাপক জনমত তৈরি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনসচেতনতাও তৈরি হতে থাকে। এই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৫১ সালের ১১ই মার্চ উদযাপনের প্রস্তুতি চলতে থাকে। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’ শ্লোগানে শ্লোগানে রাজপথ মুখরিত হয়। নতুন করে রাষ্ট্রভাষা বাংলার অধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়।
১৯৫১ সালে বাংলা রাষ্ট্রভাষার পক্ষে নতুন করে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মহলে তর্কবিতর্ক ও বাংলার পক্ষে যে জনমত সৃষ্টি ও কর্মতৎপরতা লক্ষ্য করা যায় তা ভবিষ্যৎ আন্দোলনের ভিত্তি সুদৃঢ় করে। দেশবাসীর অসন্তোষের প্রেক্ষাপটে আগুন জ্বলতে প্রয়ােজন ছিল একটি ফুলিঙ্গের। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন সে স্ফুলিঙ্গটির জোগান দিয়েছিলেন বায়ান্ন সালের ২৭শে জানুয়ারি তাঁর ভাষণে । এদিন পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, পাকিস্তানকে আমরা এছলামী রাষ্ট্ররূপে গঠন করিতে যাইতেছি ।… প্রাদেশিক ভাষা কি হইবে তাহা প্রদেশবাসীই ঠিক করিবেন, কিন্তু পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হইবে উর্দু (দৈনিক আজাদ, ২৮ জানুয়ারি ১৯৫২)।
তাঁর বক্তব্যের প্রতিবাদে ২৯শে জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৩০শে জানুয়ারি সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতীক ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । সিদ্ধান্ত অনুযায়ী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহে শুধু হরতালই পালিত হয়নি, সভাশেষে বিশাল মিছিল এলাকা ঘুরে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে এসে শেষ হয় । এই সভায় ৪ ফেব্রুয়ারি শহরের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় । জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্ত সমর্থন আন্দোলনে একটি নতুন মাত্রা যােগ করে।
সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ ১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত কর্মী সম্মেলনে সরকার বিরােধী সব দল ও সংগঠনের প্রতিনিধিত্ব নিয়ে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। মূল উদ্দেশ্য পাকিস্তানের অন্যতম
২২

রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে প্রতিষ্ঠিত করা। ৪০ সদস্যের এই পরিষদের আহবায়ক মনােনীত হন কাজী গােলাম মাহবুব ।
বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি, যুবলীগ এবং অন্যান্য কলেজ ইউনিয়নের মতাে একাধিক ছাত্র সংগঠন তাদের কর্মতৎপরতা শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ৪ জানুয়ারির ছাত্রসভা ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী প্রতিবাদ কর্মসূচি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কর্মসূচির মধ্যে ছিল দেশব্যাপী হরতাল, সভা, শােভাযাত্রা এবং ঢাকায় আইন পরিষদ ঘেরাও। আইন পরিষদের অধিবেশনে বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণের জন্য প্রস্তাব পাশ করানাে ।
৪ ফেব্রুয়ারি সভা শেষে দশ/বার হাজার ছাত্রছাত্রীর বিশাল মিছিল রাজপথ ঘুরে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের বাসভবন বর্ধমান হাউসের সামনে জড়াে হয়ে শ্লোগান তােলে রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবে না’, ‘ভাষা নিয়ে ষড়যন্ত্র চলবে না। এই মিছিলে বেশ কিছু সংখ্যক সরকারি কর্মচারী ও সাধারণ শ্রেণীর মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশ নেয়। ছাত্রসভার এই সিদ্ধান্ত সমর্থন করে এই দিনই সর্বদলীয় পরিষদের সভায় প্রস্তাব গৃহীত হয় এবং মওলানা ভাসানী কর্মসূচি সফল করে তােলার জন্য দেশবাসী ছাত্র-জনতার প্রতি আহ্বান জানান।
ঢাকার বাইরেও একাধিক শহরে এই কর্মসূচি বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে পালিত হয়। (সাপ্তাহিক ইত্তেফাক, ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২)। মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও তাঁর অবাঙালি প্রধান প্রশাসন গােটা পরিস্থিতি গুরুত্ব অনুধাবন করতে ব্যর্থ হয়। বাংলা ভাষার দাবি ছাত্র-জনতার প্রাণের দাবিতে পরিণত হয়েছিল। বাংলা রাষ্ট্রভাষার দাবি আদায়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে যুবলীগ, ছাত্রাবাসগুলাের নেতা-কর্মী এবং বামপন্থী ছাত্র-যুবনেতারা। এর সঙ্গে যুক্ত হয় রাজনীতি সচেতন ছাত্রসমাজ।
আন্দোলনের গুরুত্বপূর্ণ কিছু দিক
ঢাকার বাইরে বিভিন্ন শহরে একুশের কর্মসূচী সফল করে তােলার জন্য সভা, সমাবেশ, বক্তৃতা, ইশতেহার বিতরণ ও রাষ্ট্রভাষা বাংলার শ্লোগানসহ মিছিলের আয়ােজন করে ছাত্র-জনসাধারণের মধ্যে রাষ্ট্রভাষা বিষয়ক জনমত গঠন এবং সচেতনতা সৃষ্টি ।
ঢাকার এবং ঢাকার বাইরের প্রথমবারের মতাে ছাত্রদের পাশাপাশি ছাত্রীরাও অধিক সংখ্যক সভা সমাবেশে যােগ দেয়। মানুষজনকেও ছাত্র-ছাত্রীদের সঙ্গে মিছিল, সভা সমাবেশে যােগ দিতে দেখা যায় ।।
‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই” শ্লোগানে যুক্ত হয় রাজবন্দীদের মুক্তি চাই’। এসময় রাষ্ট্রদ্রোহের মিথ্যা অজুহাতে কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীরা ছাড়াও বিরােধীদলীয় গণতান্ত্রিক সংগঠনের নেতা-কর্মীরাও গ্রেপ্তার হয়ে দীর্ঘদিন ধরে বন্দীজীবন কাটাচ্ছিলেন। এসময় শেখ মুজুির রহমান ও মহিউদ্দিন আহমদের মতাে নেতাও কারাগারে আটক ছিলেন ।
২৩

এসময় পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির পূর্ববঙ্গ সাংগঠনিক কমিটি ভাষাসংক্রান্ত বিষয় নিয়ে কয়েকটি ইশতেহার প্রকাশ করে, তাদের সমর্থক ও কর্মীদের জন্য। ১১ই ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন’ শিরােনামের এইরূপ একটি ইশতেহারে। নাজিমউদ্দিনের বক্তৃতা এবং উদ্ভূত পরিস্থিতি ও ছাত্রদের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আলােচনা শেষে লেখা হয়, ‘১৯৪৮ সালের আন্দোলন হইতেও এবারের আন্দোলন অনেক বেশি শক্তিশালী হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাইতেছে ।…
একুশে ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ : ছাত্র জনতার অভূতপূর্ব বিস্ফোরণ
১৯৫২ সালে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা নিয়ে নতুনভাবে বিতর্ক সৃষ্টি করেন খাজা নাজিমউদ্দিন। ২৭শে জানুয়ারি পল্টন ময়দানের জনসভায় তিনি ঘােষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” । এই ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি পুনরুজ্জীবিত হয়ে উঠে। ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সভা, সমাবেশ, মিছিলে রাজপথ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ১৯৫২ সালের ৩১শে জানুয়ারি ঢাকা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ৪০ সদস্যের প্রতিনিধিত্বমূলক কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয় ।
দ্বিতীয় উল্লেখযােগ্য ঘটনা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ১৯৫২ সালের ৪ঠা ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয় । এই ছাত্রসভায় ২১শে ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী হরতাল, সভা, সমাবেশ, মিছিলের কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়। সেই সঙ্গে আইন পরিষদ ঘেরাও-এর কর্মসূচিও গৃহীত হয় ।
২১শে ফেব্রুয়ারি আইনসভার বাজেট অধিবেশনের প্রথম দিন রাষ্ট্রভাষা দিবস’ পালনের ঘােষণায় বিচলিত হয়ে নূরুল আমিন সরকার ২০শে ফেব্রুয়ারি অপরাহে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে ১৪৪ ধারা জারি এবং সভা, সমাবেশ, শােভাযাত্রা, বিক্ষোভ নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। এর ফলে ছাত্র সমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় । ২০শে ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদের এক জরুরি সভা বসে। ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার প্রশ্নে সভায় মতানৈক্য দেখা দেয়। অলি আহাদ, আবদুল মতিনএবং ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্র গােলাম মওলা ১৪৪ ধারা ভঙ্গের পক্ষে ভােট দেন।
১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি মূলত ছাত্র ছাত্রীদের অনমনীয় মনােভাব এবং ছাত্র জনতার অভূতপূর্ব দৃঢ় মনােভাব এবং অপরিসীম ত্যাগ তিতীক্ষার কারণেই বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে গৌরবান্বিত ও মহিমান্বিত দিন । এদিন সকাল থেকেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন, মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণ এবং নিকটবর্তী জগন্নাথ হল মিলনায়তন, যেখানে পূর্ববাংলার আইনসভার অধিবেশন বসে তা সশস্ত্র পুলিশ ও ই পি আর বাহিনী ঘেরাও করে রেখেছিল।
সকাল থেকেই বিভিন্ন হলের ছাত্র-ছাত্রীরা অসংখ্য প্রাকার্ড নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন প্রাঙ্গণে সমবেত হতে থাকে। শহরের বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরা কলাভবনের আমতলায় সমবেত হয় । কলাভবন প্রাঙ্গণ বিক্ষুব্ধ ছাত্র-ছাত্রীতে ভরে যায় ।
২৪

সকাল ১১টার দিকে ছাত্র নেতা গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ২১শে ফেব্রুয়ারি ঐতিহাসিক ছাত্রসভা শুরু হয়। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবায়ক আবদুল মতিন ১৪৪ ধারা অমান্য করে দেশব্যাপী দুর্বার আন্দোলন গড়ে তােলার আহ্বান জানান ।
বিপুল করতালি ও গগণবিদারী রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘১৪৪ ধারা মানি না’ শ্লোগানের মধ্যে দিয়ে সমবেত ছাত্র ছাত্রীরা আবদুল মতিনের প্রস্তাব সমর্থন করেন। এরপর ১৪৪ ধারা ভঙ্গের জন্য ১০ জন ছাত্রের ছােট ছােট দল বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবনের সিংহদ্বার পর্যন্ত সুশৃঙ্খল ও সারিবদ্ধভাবে অবস্থান গ্রহণ করে।
দুপুর ১২টার দিকে ছাত্রদের ১০ জনের এক একটি দল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শ্লোগান দিতে দিতে সিংহদ্বার অতিক্রম করে। কিন্তু রাজপথে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পুলিশ বাহিনী। ১৪৪ ধারা ভঙ্গকারীদের উপর লাঠিচার্জ ও কাদানে গ্যাস ছুঁড়তে থাকে। সমগ্র কলাভবন প্রাঙ্গণ এবং সামনের রাজপথ, মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণ ও বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠ রণাঙ্গনে পরিণত হয়। পুলিশের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতার অসম লড়াই চলে ।।
এরপর অপরাহ ৩টার পরেই কোনাে প্রকার সতর্ক না করে পুলিশ ছাত্রদের উপর গুলিবর্ষণ করতে শুরু করে। এর ফলে মানিকগঞ্জ রাজেন্দ্র কলেজের ছাত্র রফিকউদ্দিন হােস্টেল প্রাঙ্গণে নিহত হন। পুলিশের বুলেট সরাসরি তার মাথায় লাগে। তার মাথার খুলি উড়ে যায়। ২০ নং ব্যারাকের বারান্দায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত তার সহপাঠী শামসুল বারী ওরফে মিয়া মােহনকে দেখে এগিয়ে আসছিলেন। হঠাৎ আবুল বরকত পড়ে গেলেন মাটিতে। ২১শে ফেব্রুয়ারির দ্বিতীয় শহীদ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শেষ পর্বের ছাত্র আবুল বরকত। তলপেট এবং ঊরুতে বুলেটবিদ্ধ আবুল বরকত সে রাতেই অপারেশন থিয়েটারে মারা যান। অনেকে গুরুতররূপে আহত হন। এঁদের মধ্যে গুরুতরভাবে আহত শুল্ক বিভাগের পিয়ন আবদুস সালাম ৭ই এপ্রিল মারা যান।
একুশে ফেব্রুয়ারি বিকেলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে বাংলা ভাষার দাবিতে বিক্ষোভরত ছাত্রজনতার উপর পুলিশের ঠাণ্ডা মাথায় গুলি চালানাে এবং ছাত্রজনতা হত্যার খবর দাবানলের মতাে ঢাকা শহর এবং দেশের সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে । সঙ্গে সঙ্গে অফিস আদালত, দোকান পাট, কলকারখানা, এমনকি রেল চলাচল ও রেডিও স্টেশন বন্ধ হয়ে যায় । সব মানুষ পথে নেমে আসে। সারাদেশ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ছাত্র জনতার আত্মত্যাগের মুহূর্ত থেকে সমগ্র পূর্ব বাংলা এক নুতন দেশে পরিণত হয়। বাংলার পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বদলে যায়। ২২শে ফেব্রুয়ারি সকালে বিশ্ববিদ্যালয় কলাভবন এবং সমস্ত হলে ছাত্র ছাত্রীরা ভাষাশহীদদের শােকে কালাে পতাকা উত্তোলন এবং কালাে ব্যাজ পরিধান করেন। শহরের নিয়ন্ত্রণ ই পি আর ও সেনাবাহিনীর হাতে ছেড়ে দেয়া হয় ।।
ঢাকার রাস্তায় সকাল থেকেই জনসমাগম ক্রমশ বাড়তে থাকে। একুশে ফেব্রুয়ারি পুলিশী জুলুম ও নির্যাতনের এটি ছিল স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ।
২৫

রাতে মুহুর্তের অসতর্কতায় মেডিকেল ছাত্রদের প্রহরার ফাঁকে পুলিশ-ই.পি.আর. লাশ তুলে নিয়ে আজিমপুর গােরস্থানে দাফনের ব্যবস্থা করে, যেজন্য পূর্ব-ঘােষিত শহীদদের জানাজা গায়েবি জানাজায় রূপান্তরিত হয়।
গায়েবি জানাজায় ছাত্রের চেয়ে অছাত্রের সংখ্যাই ছিল বেশি। বেলা প্রায় দশটার দিকে মেডিকেল হােস্টেল প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত গায়েবি জানাজায় কয়েক হাজার লােক যােগ দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে প্রধানত ছিলেন পলাশী ও নীলক্ষেত ব্যারাকে বসবাসকারী সেক্রেটারিয়েটের কর্মচারীবৃন্দ এবং বেশ কিছুসংখ্যক স্থানীয় জনসাধারণ। এই সঙ্গে যােগ দেন মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ার্ডবয়, পুরুষ নার্স, পাশের হােটেলরেস্তোরার কর্মচারীগণ। হােস্টেল প্রাঙ্গণ জনসমাগমে স্পন্দিত হয়ে ওঠে। এই উপলক্ষে ২৩ ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ’-এর প্রতিবেদন উল্লেখযােগ্য :
‘গতকল্য (শুক্রবার) সকাল অনুমান দশ ঘটিকার সময় মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে পরশুর নিহত ছাত্রদের গায়েবানা জানাজা সমাপন করা হয় । এই অনুষ্ঠানে জনাব এ.কে. ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন । অতঃপর সেখান হইতে প্রায় পাঁচ হাজার ছাত্র ও স্থানীয় জনসাধারণের একটি মিলিত শােভাযাত্রা বাহির করা হয়।
উপস্থিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে একজন মওলবী গােছের বয়স্ক ব্যক্তিকে জানাজায় ইমামতির জন্য মনােনীত করা হয় এবং সেই অপরিচিত ব্যক্তিটিই মােনাজাত পাঠ করেন।
যাই হােক, মিছিলের গতিপথ সম্পর্কে আজাদ’-এর প্রতিবেদন মােটামুটি হিসেবে সঠিক ও প্রতিনিধি-স্থানীয় বলে মনে হয় । আজাদ’-এর বিবরণে প্রকাশ :
‘ছাত্র ও নাগরিকদের এই শােভাযাত্রাটি ক্রমশ কার্জন হলের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ধরিয়া অগ্রসর হইতে থাকে। এই সময় শােভাযাত্রাকারীদের মধ্যে কোনরূপ উদ্ধৃঙ্খলতা দেখা যায় নাই। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার দাবিতে এবং পুলিশের গুলিবর্ষণের বিরুদ্ধে নানারূপ ধ্বনি করিতে করিতে শােভাযাত্রাকারীগণ হাইকোর্টের সম্মুখে উপস্থিত হইলে সেখানকার প্রহরারত সৈন্যবাহিনী তাহাদিগকে বাধা প্রদান করে।
‘এই শােভাযাত্রার সহিত বহু সরকারী কর্মচারীকে অংশগ্রহণ করিতে দেখা যায় । হাইকোর্টের নিকট পুলিশ ও সামরিক বাহিনী শােভাযাত্রার ওপর লাঠি ও গুলী চালায় এবং তাড়া করিয়া হাইকোর্টের ভিতর লইয়া যায়। সেখানে কয়েকজন গুরুতরভাবে আঘাত পান। ইহা সত্ত্বেও শােভাযাত্রাটি শান্তিপূর্ণভাবে নওয়াবপুরের দিকে যাইবার চেষ্টা করে এবং শােভাযাত্রাটির সম্মুখভাগ ফজলুল হক হলের পার্শ্ববর্তী রাস্তা ধরিয়া বেশ কিছু অগ্রসর হয় । এই সময়ে পুলিশ বাহিনী দৃঢ়তার সহিত বাধা প্রদান করে। ‘শােভাযাত্রাটির সম্মুখভাবে নিহত ও আহতদের রক্তমাখা জামাকাপড় ইত্যাদি দেখানাে হইতেছিল। ‘গতকল্যকার ঘটনার বিশেষত্ব হইল এই যে, সৈন্যগণকে অনেক ক্ষেত্রে সঙ্গীনের খোঁচায় বিক্ষোভকারিগণকে ঘায়েল করিতেও দেখা যায়। পরিষদ ভবনের পূর্ব-দক্ষিণ কোণে সৈন্যগণকে দুইটি মেশিনগান পাতিয়া বসিয়া থাকিতে এবং অন্যান্য আগ্নেয়াস্ত্র লইয়া ঘােরাফেরা করিতে দেখা যায় । একদল সৈন্যকে একটি মেশিনগান, কতকগুলি
২৬

করিয়া টমিগান, ব্রেনগান ও বেয়নেটসহ রাইফেল লইয়া মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সম্মুখে টহল দিতে দেখা যায়। ‘শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনের নিদর্শনস্বরূপ শহরের প্রতিটি ছাত্রাবাসে এমন কি কোনাে কোনাে গৃহেও পতাকা অর্ধনমিত রাখা হয় এবং শহরবাসী কালাে ব্যাজ পরিধান করেন ।
আন্দোলনের প্রচার কাজের সুবিধার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারি মেডিকেল কলেজের ছাত্রদের উদ্যোগে প্রথম কন্ট্রোল রুম স্থাপিত হয়। তৎকালীন মেডিকেল কলেজ ছাত্র। ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক শরফুদ্দিন আহমদ ব্যক্তিগত সাক্ষাঙ্কারে জানিয়েছেন। যে, ‘বিশে ফেব্রুয়ারি গভীর রাত অবধি ব্যস্ততার কারণে পরদিন অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি সকালে ১৪৪ ধারা ভাঙা সংক্রান্ত প্রচারের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য ভি.পি গােলাম মাওলার সাথে তার আলােচনা হয় এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গে হােস্টেলে একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে। এই উদ্দেশ্যে সাঈদ হায়দার, আবুল হাশিম, আহমদ রফিক প্রমুখের সঙ্গে আলােচনার পর পরিষদ ভবনের নিকটতম বিশের এক নম্বর কক্ষে কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়। কলেজ ইউনিয়নের উদ্যোগে বেলা বারােটার মধ্যে বিশের এক নম্বর কক্ষে সব ব্যবস্থা করে ফেলেন আমাদেরই ছাত্রবন্ধু ইয়াহিয়া । স্পিকার লাগানাে হয় হােস্টেলের উত্তর-পশ্চিম কোণে অবস্থিত আমগাছের ডালে । একেবারে পরিষদ ভবনের নাকের ডকায় ।।
এ সম্পর্কে হুমায়ুন কবির হাইয়ের বক্তব্যও অনুরূপ :
‘দুপুরে বেলা প্রায় একটার দিকে মাইক লাগানাে হয়। মনে হয় ওটা আমাদের ‘স্টুডেন্টস ইউনিয়নের মাইক ছিল । ইয়াহিয়া নামে একজন ছাত্র কন্ট্রোল রুম ও মাইকের দায়িত্বে ছিল । তা হতে অনেক উদ্দীপনামূলক গান ও রেকর্ডেড বক্তৃতা
প্রচার করা হতে থাকে। মেডিকেল ছাত্র ফজলে রাব্বির মতে, কন্ট্রোল রুম খােলা হয় দুপুর বারােটার দিকে এবং মেডিকেল কলেজ ছাত্র ইউনিয়নের মাইক ব্যবহার করা হয়। বেলা একটা থেকে মাইকে ১৪৪ ধারা ভেঙে পরিষদ ভবন ঘেরাওয়ের পক্ষে প্রচার কাজ শুরু হয়ে যায়। এই প্রচারে লাগাতার কণ্ঠ দিয়ে যাচ্ছিলেন মেডিকেল কলেজের ছাত্র সরফুল আলম (ভয়েস অব আমেরিকা, ওয়াশিংটনে ঘােষক-পাঠক), আবুল হাশিম (দীর্ঘকাল যাবৎ সউদি আরববাসী চিকিৎসক) এবং আরাে দুই একজন । প্রচারের বক্তব্য লেখা হচ্ছিল নানা হাতে ।
এ সম্পর্কে ডা. সাঈদ হায়দার বলেন :
‘পরিষদ ভবন লক্ষ্য করে লাউড স্পীকার লাগানাে হয়েছিল। আবুল হাশিম, সরফুল ও আরাে অনেকে উচ্চকণ্ঠে প্রতিবাদ জানাচ্ছিল পুলিশী জুলুমের। বক্তব্যের স্ক্রিপ্ট তৈরি করছিল জিয়া, আহমদ রফিক, কবির, কাদের ও আরাে অনেকে। ওদিকে পরিষদ ভবনে গমনেচ্ছু সদস্যদের দেখা পেলেই ধরে নিয়ে আসা হচ্ছিল ব্যারাকে, বােঝানাে হচ্ছিল পরিস্থিতির গুরুত্ব। জাহেদ, মাওলা, আহমদ রফিক সবাইকে দেখেছি সক্রিয় ব্যস্ততায় ছােটাছুটি করতে । মেডিকেল কলেজ ছাত্ররা যেমন এদেিক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছিল, অপরদিকে আহতদের চিকিৎসা ও সেবাকার্যের তত্ত্বাবধান করছিল।
২৭

গুলিবর্ষণের পর কন্ট্রোল রুম’-এর প্রচারে গুণগত পরিবর্তন দেখা দেয় । এবার মাইকে প্রচারিত হতে থাকে সরকারের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী বক্তৃতা, প্রতিরােধ গ্রহণের শপথ ঘােষাণা, পরবর্তী কর্মসূচির বিবরণ (যেমন পরদিন জানাজা ও মিছিলে অংশগ্রহণের আহ্বান, ঘরে ঘরে কালাে পতাকা উত্তোলন, প্রতিটি মানুষের কালাে ব্যাজ ধারণ, শােকদিবস পালন ইত্যাদি)। সেই মুহুর্তের উদ্দীপক স্লোগান ছিল : রক্তের বদলে রক্ত চাই’, ‘খুনী নুরুল আমিনের বিচার চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা প্রতিষ্ঠিত কর, ‘ব্লাড ব্যাংকে অকাতরে রক্ত দিন এবং ‘খুনী নুরুল আমিনের কল্লা চাই’ ইত্যাদি। আহতদের চিকিৎসার জন্য রক্তদানের উদাত্ত আহ্বানে বেশ সাড়া পাওয়া যায় । এরি মধ্যে মেডিকেল ছাত্র ও তরুণ চিকিৎসকদের তত্ত্বাবধানে যে ব্লাড ব্যাংক স্থাপন করা হয়েছিল, সেখানে রক্ত দেয়ার জন্য দেখা গেল লম্বা লাইন।
মাইকের প্রচারে এই সুবিধা হলাে যে গুলি চালনার খবর মুখে মুখে অতি দ্রুত শহরময় ছড়িয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে শহরের দোকানপাট-হােটেল-রেস্তোরা সব বন্ধ হয়ে যায় । কাউকে বলতে হলাে না, আজ হরতাল । মানুষজন হাসপাতালের দিকে ছুটতে থাকে, উদ্দেশ্য শহীদদের একনজর দেখা। নানা শ্রেণীর, নানা পেশার মানুষ। হাসপাতালে জনতার ভিড় সামলাতে একতলায় এবং দোতলায় সিড়ির মুখে দাড়িয়ে গেল কয়েকজন বলিষ্ঠ দীর্ঘকায় মেডিকেল ছাত্র, দোতলায়-ইমাদুল্লাহ দাঁড়ালেন একপাশে। তবু কি তাদের ঠেকানাে যায়? অন্যদিকে ঢাকা বেতারের লেখক-শিল্পীগণ তাৎক্ষণিকভাবে কর্মবিরতি পালন করেন ।।
গুলির খবরের প্রাথমিক প্রতিক্রিয়ায় আইন পরিষদের অধিবেশনে সত্যিকার অর্থেই ঝড় ওঠে এবং এর প্রধান উদ্যোক্তা লীগ দলীয় সদস্য মৌলানা আবুদর রশিদ তর্কবাগীশ। তিনি মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের ওপর গুলিবর্ষণ সম্পর্কে সরেজমিন তদন্তের জন্য চাপ দিতে থাকেন, কিন্তু মুখ্যমন্ত্রী ঘটনাস্থল পরিদর্শন এবং তদন্ত দূরে থাক, এ সম্পর্কে পরিষদে বিবৃতি দিতেও অস্বীকার করেন। ফলে উত্তেজিত তর্কবাগীশ একটি আবেগপূর্ণ বক্তৃতা শেষ করে মুখ্যমন্ত্রীর আচরণের প্রতিবাদে পরিষদকক্ষ ছেড়ে বেরিয়ে আসেন । ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মনােরঞ্জন ধর প্রমুখ কংগ্রেস সদস্যও প্রতিবাদে পরিষদ বর্জন করেন। আর যেসব মুসলমান সদস্য অধিবেশন বর্জন করে বেরিয়ে আসেন তাদের মধ্যে আলী আহমদ খান, শামসুদ্দিন আহমদ, খয়রাত হােসেন ও আনােয়ারা খাতুন প্রমুখ উল্লেখযােগ্য। এরা সবাই মেডিকেল হােস্টেল ও হাসপাতালে হতাহতদের দেখতে যান।
এদিকে মৌলানা তর্কবাগীশ হােস্টেল প্রাঙ্গণে ঘুরে ঘুরে ইতস্তত রক্তের ছােপ, দেয়ালে বুলেটের আঘাত, টিয়ার গ্যাসের অবশিষ্ট গন্ধ এবং রক্তমাখা জামা-কাপড় (যা পতাকার মতাে উড়ছিল) দেখতে দেখতে আবেগে অভিভূত হয়ে পড়েন। তাকে কন্ট্রোল রুমের মাইকে কিছু বলতে অনুরােধ করার সাথে সাথে তিনি রাজি হয়ে যান ।
মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্য মৌলানা তর্কবাগীশ মাইকে কথা বলতে বলতে ক্রুদ্ধ, আবেগরুদ্ধ কণ্ঠে তার সহকর্মীদের পরিষদ বর্জনের আহ্বান জানান । দাবি
২৮

জানান, জালিম সরকারের উদ্দেশ্যে পদত্যাগের। বলতে বলতে আবেগে, উত্তেজনায়, কান্নায় ভেঙে পড়েন মৌলানা তর্কবাগীশ। কয়েকজন ছাত্র তাকে ধরে রাখে। সরকারি দলের বিশিষ্ট সদস্য মৌলানা তর্কবাগীশের সরকার-বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ এবং ভাষা আন্দোলনের সমর্থনে বিরােধী ক্যাম্পের মাইকে আবেগদৃপ্ত ভাষণদান নিঃসন্দেহে একটি তাৎপর্যময় ঐতিহাসিক ঘটনা। এর ফলে জনসাধারণের চোখে নুরুল আমিন সরকারের ভাবমূর্তি যে বেশ কিছুটা নষ্ট হয়েছিল তা ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না।
ঢাকার রাস্তাগুলােতে জনসমাগম সকাল থেকেই ক্রমশ বাড়তে থাকে । নওয়াবপুর রােডে ক্রমবর্ধমান জনতার জঙ্গি উপস্থিতি ছিল বিশেষভাবে লক্ষ্য করার মতাে। আজাদের বিবরণ মতে এই রাস্তায় সামরিক বাহিনীর অবস্থানও ছিল তাৎপর্যপূর্ণ। এ সম্পর্কে আজাদ’ সুন্দর একটি ছবি এঁকেছে :
তাহারা (সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র জওয়ান) অস্ত্রশস্ত্রসহ পায়ে হাঁটিয়া এবং ট্রাকে করিয়া রাস্তায় টহল দিতে থাকে। রথখােলার মােড়ে এক ট্রাক সশস্ত্র রক্ষীকে মােতায়েন করা হয়। এদিকে নওয়াবপুরের জনতা ছােট ছােট শােভাযাত্রা করিয়া ‘রক্তের বদলে রক্ত চাই’, ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ স্লোগান দিয়া উত্তরদিকে অগ্রসর হইতে থাকে। তাহারা কাপ্তান বাজারের মােড়ে পৌছিলে ঐ স্থানে অপেক্ষারত সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী তাহাদের লক্ষ্য করিয়া গুলি ছোড়ে। ঐ গুলীবর্ষণের ফলে কেউ হতাহত হয় নাই।
নওয়াবপুর রাস্তার উভয় দিকের সমস্ত দোকান সম্পূর্ণরূপে বন্ধ থাকে ।… বেলা প্রায় ১২টার সময় রথখােলা ও নিশাত’ সিনেমা হলের মােড়ের মধ্যবর্তী স্থানে একটি চলতি সামরিক ট্রাক হইতে অপেক্ষমাণ নিরীহ পথচারীদের ওপর বেপরােয়াভাবে গুলী চালান হয় বলিয়া জানা গিয়াছে। ফলে একজন যুবক। ঘটনাস্থলেই নিহত এবং দুইজন আহত হয়।
আহতদের মধ্যে একটি বালককে বেয়নেট দ্বারা মাথায় আঘাত করা হয় বলিয়া জানা গিয়াছে। আরও প্রকাশ, সামরিক ট্রাকে করিয়া তাহাদের লইয়া যাওয়া হয় । সকালের দিকে নওয়াবপুরের বিভিন্নস্থানে সামরিক লােকজন বিক্ষিপ্তভাবে গুলি চালায়।
‘গতকল্য (অর্থাৎ শুক্রবার) সমগ্র ঢাকা শহরে উত্তেজনাময় পরিস্থিতি বিরাজ করিতে থাকে | সারা শহরটি আপাতদৃষ্টিতে একটি সামরিক ছাউনি বলিয়া প্রতীয়মান হইতে থাকে । বিভিন্নস্থানে ছাত্র ও জনসাধারণের শােভাযাত্রার ওপর পুলিশ ও সৈন্যবাহিনী বারংবার লাঠিচার্জ ও গুলিবর্ষণ করে। সকাল হইতেই মৃত, আহত ও মুমূর্ষ ব্যক্তিগণকে লইয়া এম্বুলেন্স গাড়িগুলি মেডিকেল কলেজ ও মিটফোর্ড হাসপাতালে আসিতে থাকে।
কয়েকটি স্থান হইতে মৃত ও গুরুতররূপে আহত কয়েকজনকে পুলিশ ভ্যানে তুলিয়া লইতে দেখা যায় বলিয়া প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট হইতে জানা গিয়াছে ।
‘এইদিন সমগ্র শহরে সমস্ত দোকানপাট, বাজারঘাট সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। অফিস-আদালত এমন কি সেক্রেটারিয়েটের কৰ্ম্মচারিগণও স্বতঃস্ফূর্তভাবে কর্মে যােগদান হইতে বিরত থাকে এবং বিভিন্নস্থানে শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে।
২৯

দেখা যাচ্ছে, বাইশে ফেব্রুয়ারি সারা ঢাকা শহরে বিভিন্ন দিক থেকে মিছিল বেরিয়ে আসে এবং পথ চলার সাথে সাথে মিছিলের আয়তনও বেড়েছে। এমনি এক মিছিলের বিবরণ দিয়েছেন কলতাবাজার মহল্লার জনৈক সেরাজুদ্দিন ওরফে নান্না । তরুণ সেরাজুদ্দিন বাবুবাজার থেকে চলমান মিছিলে অংশ নিয়ে সরদঘাট পৌছান । একটু এগিয়ে জনসন রােডে মর্নিং নিউজ’-এর ছাপাখানার কাছাকাছি জমায়েত লােকজনকে দেখতে দেখতে এগিয়ে যান। তৎকালীন ভিক্টোরিয়া পার্ক (বাহাদুর শাহ পার্ক) পেরিয়ে পরিপুষ্ট চেহারা মিছিলের সাথে এগিয়ে যেতে যেতে দেখেন, রথখােলার সামনে দাঁড়ানাে সেনাবাহিনীর ট্রাক । ওদের চকচকে আগ্নেয়াস্ত্রগুলাের দিকে একনজর তাকিয়ে নির্ভয়ে মিছিল এগিয়ে যায় স্লোগানে স্লোগানে রাজপথ মুখরিত করে।
তিন চারজনের সারির বলিষ্ঠ মিছিল এগিয়ে চলে। দূরে দেখা যায় উত্তরদিক থেকে ছুটে আসা সৈন্য বােঝাই একটি ট্রাক ‘চৌধুরী সাইকেল মার্ট’ বরাবর এসে হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়ে। এদিকে মানসী’ সিনেমার গলি থেকে পুলিশ ও সৈন্যদের একটি অংশ দ্রুত হেঁটে গলির মুখে এসে দাঁড়ায়। আর তখনি এগিয়ে আসা ট্রাক থেকে গুলী ছুটে আসে । মিছিলের কয়েকজন পড়ে যায় । তার মধ্যে একটি তরুণ তার ঠিক পাশেই আহত হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে, ঠিক কোমরের উপর গুলি লেগেছে। শাদা সার্ট, প্যান্ট পরা সেই আহত ছেলেটি ছিল তাঁতিবাজারের (বাসাবাড়ি লেন), নাম সিরাজুদ্দিন। ছেলেটিকে কয়েকজন মিলে ধরাধরি করে নিয়ে যায়।
এর খানিক আগেই ‘স্টুডিয়াে-এইচ’-এর সামনে গুলি চলেছে, একজন মারা যায় সেখানে। রাস্তায় দাড়ানাে লাইটপােস্টে গুলির ক্ষতচিহ্ন বহুদিন ছিল। নওয়াবপুর দিয়ে পরে যাওয়া-আসার পথে বুলেটের সেই চিহ্ন তাকে বহুদিন বাইশে ফেব্রুয়ারির কথা মনে করিয়ে দিয়েছে। কয়েকবার গুলি ও পুলিশের লাঠিচার্জের ফলে ছত্রভঙ্গ মিছিলের একাংশের সাথে সেরাজুদ্দিন ‘মানসী’র গলিপথ ধরে বংশালের দিকে এগিয়ে যায়। দেখতে পায়, ‘সংবাদ পত্রিকা অফিস পুলিশ পাহারা দিচ্ছে।
এই মিছিল শেষ পর্যন্ত সাতরওজা, জেল গেট হয়ে উর্দু রােড ধরে আজাদ’ অফিস পাশে রেখে পলাশী ব্যারাক হয়ে সলিমুল্লাহ হলের সামনে এসে দাঁড়ায় । পথে কিছু ছেলে আজাদ’ অফিসে হামলা চালাতে চেষ্টা করে, কিন্তু অন্যদের তৎপরতায় পেরে উঠে না । সেরাজুদ্দিন হলের সামনের রাস্তায় উপস্থিত জনতার সাথে তাদের মিছিলে মিশে যায়। পরিষদ ভবনের সামনে এগিয়ে আসার সাথে সাথে পুলিশ বেপরােয়া লাঠিচার্জ করে; স্লোগানের মুখে মিছিল এদিক-ওদিক ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় । মনে হয় তেইশে ফেব্রুয়ারি ‘আজাদ’ এই মিছিলেরই বিবরণ দিয়েছে নিম্নোক্ত ভাষায় :
মুসলিম হল হইতে এক বিরাট জনতা পরিষদ ভবনের দিকে নানা প্রকার ধ্বনি সহকারে শান্তিপূর্ণভাবে অগ্রসর হয় । তাহারা পরিষদ ভবনের নিকটবর্তী হইলে পুলিশ তীব্রভাবে তাহাদের ওপর লাঠিচার্জ করে । তাহারা তখন ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ সীমানার মধ্যে প্রবেশ করে এবং তথা হইতে নুরুল আমিন মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করিতে থাকে।
৩০

জীবনের শেষ দিন ও শাহাদাত বরণ
১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমান দশটায় ঘর থেকে বের হন। সেদিন পাজামা, শার্ট, গেঞ্জি ও কোট পরেছিলেন । সাইকেলে চড়ে অফিসে যেতেন। চটের ছােট্ট একটি থলেতে টিফিন বাটিতে ডিমভাজি এবং পরটা ভরে নেন নাস্তার জন্য । থলেটা সাইকেলের হ্যাণ্ডেলে লাগিয়ে তিনি অফিসে রওয়ানা হন। তখন এক বিরাট মিছিল যাচ্ছিল নবাবপুর রােড দিয়ে। মরণর্চাদের মিষ্টির দোকানের সামনে যখন তিনি, তখন গােলাগুলি শুরু হয়। এ অবস্থায় একটি গুলি তাঁর পিঠে লাগে । তবুও সাইকেল চালিয়ে তিনি কিছুটা পথ যান । খােসমহল রেস্টুরেন্টের সামনে এসে পড়ে যান । গুরুতর আহত অবস্থায় তাকে এম্বুলেন্সে করে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানাে হয়। গুলি তাঁর হৃৎপিণ্ডের মধ্যে ঢুকে গিয়েছিল বলে ডাক্তারি রিপাের্টে জানা যায় । ডা. এলিনসন অস্ত্রোপাচার করেন । তিনি গুলি বের করতে পারেননি। সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শফিউর রহমান শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এদিন ঢাকা হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমানসহ অনেকেই শহীদ হন। কিন্তু কেবলমাত্র শফিউর রহমানের লাশ ঢাকা মেডিকেল কলেজ থেকে উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল। অন্যদের লাশ গুম করে ফেলা হয়।
শফিউর রহমানের বােনের দেবর (স্বামীর ভাই) কাজী এনামুল্লা ঢাকা মেডিকেল কলেজের স্টেরিলাইজ ডিপার্টমেন্টের তদানীন্তন চিফ ছিলেন। তিনি গােলাগুলির সময় ঢাকা মেডিকেল কলেজে কর্তব্যরত ছিলেন। তিনি শফিউর রহমানের মৃতদেহ দেখে চিনতে পারেন। সঙ্গে সঙ্গে শফিউর রহমানের বাসায় যান। রাত তখন আনুমানিক আটটা। রেডক্রসের একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে শফিউর রহমানের স্ত্রী আকিলা খাতুন, তাঁর শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর ও ননদসহ হাসপাতালে লাশ দেখাতে নিয়ে যান ।।
আকিলা খাতুন তার তিন বছরের মেয়ে শাহনাজকে কোলে নিয়ে লাশের দিকে। অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলেন বলে জানান। তিনি বলেন, “আমার মনে হয় তিনি ঘুমুচ্ছেন । কপালে একটু রক্তের দাগ । বুকে ব্যাণ্ডেজ বাঁধা ।”
তারা বাসায় যাবার পর শুরু হয় নিষ্ঠুর ও অমানবিক পাকিস্তানী সৈন্যদের হাত থেকে শফিউর রহমানের লাশ উদ্ধারের প্রচেষ্টা। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যরা হাসপাতালে ঢুকে অনেক লাশ গুম করে দেয় বলে জানা যায় । কাজী এনামুল্লা’র সহযােগিতায় শহীদ শফিউর রহমানের ছােট ভাই মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাত্র আসজাদুর রহমান, সাহিত্যিক হাবিবুর রহমানের ছেলে মাহবুবুর রহমান, খলিল এবং
৩১

আরাে কয়েকজন ছাত্র তার লাশ ট্রলিতে রেখে স্টেরিলাইজ ডিপার্টমেন্টের ভেতরে আলমারির পিছনে তিনদিন লুকিয়ে রাখেন। ওরা পালাক্রমে সারারাত লাশ পাহারা দিয়ে রাখে । ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের লাশ উদ্ধারে প্রত্যক্ষদর্শী কামাল উদ্দিন আহমেদ-এর নিকট থেকে প্রাপ্ত তথ্য।
কামালউদ্দিন আহমেদ তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান আদমশুমারি বিভাগের Additional Superintendent হিসেবে কাজ করতেন। তিনি শহীদ শফিউর রহমানের খালাত ভাই । কামাল উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে এই বিষয়ে আলাপের জন্য ১৪-০২২০১০ তারিখে তার ২২/১, আজিমপুর রােড, ফ্ল্যাট নং ৩/ডি বাসভবনে যাই। তিনি বলেন যে, ১৯৫২ সালের ২২শে ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমান, নবাবপুর রােডের নিশাত সিনেমা হলের পাশ দিয়ে হাইকোর্টে যাচ্ছিলেন। এসময় গােলাগুলি শুরু হয়ে যায় । গুলি তাঁর পিঠে লাগে। তাঁকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় । শফিউর রহমানের ভাই আসজাদুর রহমান মিটফোর্ড হাসপাতালের ছাত্র ছিল। সেও ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করেছে। কিন্তু bleeding বন্ধ করা যায়নি। আসজাদুর রহমান রক্ত দিয়ে ভাই শফিউর রহমানকে বাচানাের চেষ্টা করেছে। বাইরে থেকেও দুই ব্যাগ রক্ত নেয়া হয়েছিল । কিন্তু সন্ধ্যার পর সে মারা যায়।
কামালউদ্দিন আহমেদের বড় বােনের স্বামী ছিলেন হাইকোর্টের court keeper, তিনি ও কামাল উদ্দিন আহমেদ হাইকোর্টের কম্পাউণ্ডে থাকতেন। শহীদ শফিউরের লাশ উদ্ধারের জন্য অন্যদের সঙ্গে তিনিও চেষ্টা চালান। পূর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন গভর্নর ফিরােজ খান নুনের স্ত্রী ভিকারুনন্নেসা ছিলেন একজন সমাজসেবক মহিলা। তার সঙ্গে কামালউদ্দিন আহমেদের যােগাযােগ ও পরিচয় ছিল । স্মৃতিচারণ করে কামাল উদ্দিন বলেন, “এসময় কারফিউ হয়ে যায় । ভিকারুনন্নেসা ঢাকার তৎকালীন এস. পি মাসুদকে বলেছিলেন, ইস কো মদদ করাে। কারফিউ পাস দেয়া হয়েছিল আমাদেরকে যাতে আমরা লাশের খোজে মেডিকেল কলেজে যেতে পারি। আমাদেরকে বারটি কারফিউ পাস দেয়া হয়েছিল । So that we can move. পুলিশ ভ্যান-এ করে আমাদেরকে মেডিকেল কলেজে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাদের সামনে ও পেছনে আর্মড পুলিশ ভ্যান । মাঝখানে আমরা । রাত ১২টা/ ১টার সময় মেডিকেল কলেজ ঢুকলাম । চৌকির নীচে স্ট্রেচারে সংরক্ষিত শফিউর রহমানের লাশ । আজিমপুর কবরস্থানে লাশ নিয়ে গেলাম । গােসল দেওয়া হয়। আনুমানিক ভাের চারটার সময়, আমরা জানাজার নামাজ পড়লাম । ৯২/- টাকায় জমি কেনা হলাে এবং শফিউরের লাশ দাফন করা হয়। রঘুনাথ দাস লেনের মসজিদের মুয়াজ্জিন জানাজার নামাজ পড়েন।”
শফিউর রহমানের পিতা মাহবুবুর রহমান এবং অন্য কয়েকজন গােপনে লাশ নিয়ে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করবেন এই মর্মে মুচলেকা দেয়ার পর কর্তৃপক্ষ লাশ হস্তান্তরে সম্মত হয়। তাঁর স্ত্রীর জমানাে একশত টাকা দিয়ে কবরের জায়গা কেনা হয়েছিল। শফিউর রহমানের রক্তমাখা শার্ট, কোট, জুতা সংরক্ষণ করা হয়। বর্তমানে এগুলাে জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
৩২

স্মৃতিচারণ করে আকিলা খাতুন বলেন, “আমার শাশুড়ি বলেছিলেন ওর কবরের জায়গাটা কিনে দিস। ওর মেয়ে শাহনাজ এবং গর্ভজাত শিশু যাতে তাদের বাবার একটি স্মৃতিচিহ্ন খুঁজে পায় । আমি আমার জমানাে ১০০ (একশত) টাকা উনাদের হাতে দিলাম । এখন এই কবর বাঙালি জাতির অমর স্মৃতি হয়ে আছে। তিনি মারা গেছেন শুক্রবার সন্ধ্যা সাতটায়, রবিবার রাতে আজিমপুর কবরস্থানে কবর দেয়া হয় । আমার শ্বশুর ও দেবর ট্রলির ওপর শােয়ানাে আমার স্বামীকে মুমূর্ষ অবস্থায় দেখেন। তার তখনও জ্ঞান ছিল । হাতে ঘড়ি ও হিরার আংটি ছিল । পকেটে ছিল ২০ (কুড়ি) টাকা। কাজী এনামুল্লাহ হাত থেকে ঘড়ি ও আংটি খুলে নিয়ে তার ভাইয়ের হাতে দিয়ে দেন। তিনি তখন বারবার শাহনাজের কথা বলছিলেন। আমার শাহনাজ! আমার শাহনাজ! বলছিলেন। ভাইকে বলছিল, তুমি ওকে দেখবে । আগলে রাখবে । আসজাদুর রহমান বলছিল তােমাকে বাসায় নিয়ে যাব । তিনি বলছিলেন আমার বাসায় আর যাওয়া হবে না।”
বাইশে ফেব্রুয়ারি হতাহতের সংখ্যা
আমরা দেখেছি, একুশে ফেব্রুয়ারি একটি নির্দষ্ট এলাকায় গুলি চালনা সত্ত্বেও কমপক্ষে চারজন শহীদ হয়েছিলেন, এছাড়া অন্যদের সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না । কিন্তু বাইশে ফেব্রুয়ারি ছাত্র-জনতার ব্যাপক গণবিক্ষোভের মুখে টহলরত পুলিশই.পি.আর ও সেনাবাহিনী একাধিক স্থানে গুলি চালনাের ফলে ঠিক কতজন নিহত হয়েছেন তাও নিশ্চিত করে কেউ বলতে পারেন নি ।
বাইশে ফেব্রুয়ারি পুলিশ-সেনাবাহিনীর গুলিতে হতাহতের সংখ্যা যে একুশে ফেব্রুয়ারির তুলনায় বেশি হবে সেকথা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ সম্পর্কে ‘আজাদ’এর ভাষ্য নিম্নরূপ (২৩-২-৫২)।
বৃহস্পতিবারের শােচনীয় ও ভয়াবহ ঘটনা বিস্মৃত হইতে না হইতে গতকাল (শুক্রবার) জুম্মার দিন আর একবার ঢাকার মাটি শিশু ও ছাত্রদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে। সেদিনকার ঘটনায় নিহত ব্যক্তিদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জ্ঞাপনার্থে শান্তিপূর্ণ মিছিল বাহির করিয়া পুলিশ ও সৈন্যদের গুলির আঘাতে নাগরিকদের ৪ জনকে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয় এবং শতাধিক আহত ব্যক্তি হাসপাতালে নীত হয়। ইহাদের মধ্যে ৪৫ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তাদের ১৫ জনের অবস্থা আশঙ্কাজনক বলিয়া জানা গিয়াছে। এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক ‘সৈনিক’-এর তেইশে ফেব্রুয়ারি বিশেষ শহীদ-সংখ্যায় বলা হয় :
‘গতকল্য বেলা ১১টার সময় প্রায় ৩০ হাজার জনতার মিছিল কার্জন হলের পূর্বদিকে পৌছাইলে পুলিশ কাঁদুনে গ্যাস ও লাঠির সাহায্যে বাধা দেয়। জনতাকে সংযত করিতে না পারিয়া তাহারা বেপরােয়া গুলি ছুঁড়িতে থাকে। ইতিমধ্যে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, ইহাতে ৮ জন নিহত ও অসংখ্য আহত হইয়াছে। অনেকের অবস্থাই আশঙ্কাজনক।…
৩৩

‘গতকল্য নবাবপুরে ৪জন, কার্জন হলে ২জন এবং রেলওয়ে কলােনীর সামনে ১জন
পুলিশের গুলিতে নিহত হইয়াছেন। আমরা দেখেছি, কার্জন হলের সামনে গুলিতে কেউ নিহত হন নি বলে শুধু ‘আজাদ’ প্রতিবেদকই নন, সংশ্লিষ্ট অনেকেই বলেছেন। সেক্ষেত্রে সৈনিক’-এর বক্তব্য সঠিক নয় ।
দৈনিক বাংলার অনুসন্ধানী সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম বাহান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে বেশকিছু নতুন তথ্য সংগ্রহ করা সত্ত্বেও এ সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু বলতে পারেন নি । হতাহতের সংখ্যা সম্পর্কে তার সর্বশেষ প্রতিবেদনে তিনি বলেন :
‘৫২’র ভাষা আন্দোলনে কতজন শহীদ হয়েছিলেন? আহত হয়েছিলেন কতজন? কেউ ঠিক করে বলতে পারে না।… সে সময়ের একজন সংবাদপত্রসেবী বলেছেন, গুলিতে হতাহতের সংখ্যা কোন সংবাদপত্রেই ছিল না। আজাদের সে সময়ের সংখ্যাগুলাে থেকে জানা যায় ২১ ও ২২ তারিখের গুলিতে ৯ ব্যক্তির মৃত্যু হয়েছিল।
বহু লাশ গুম করে ফেলা হয়েছিল।’ প্রকৃতপক্ষে সেসময় সংবাদপত্রের সংখ্যা যেমন কম ছিল তেমনি সংবাদ সংগ্রাহক সাংবাদিকগণের সবাই আজকের মতাে পেশাগত উৎকর্ষে এতটা দক্ষ ছিলেন না বলেই বাইশ তারিখে শহীদদের মধ্যে নিশ্চিতভাবে একমাত্র শফিউর রহমান ছাড়া আর কারাে কথা সুস্পষ্টভাবে জানা যায় না। অথচ দেখা যাচ্ছে, নওয়াবপুরেই একাধিক স্থানে গুলি চলেছে, মারাও গেছেন কেউ কেউ; কিন্তু কোন সাংবাদিকই বাইশের শহীদদের নাম (একমাত্র শফিউর রহমান বাদে) এবং অন্যান্য তথ্য-সংগ্রহ করতে পারেন নি, এমনকি আজাদ সাংবাদিকও নন।
শহীদ শফিউর রহমান সম্পর্কে দীর্ঘদিন ধরে বলা হয়েছে যে তিনি হাইকোর্টের সামনে গুলিতে মারা গেছেন। হাইকোর্টের কর্মচারী বলেই সম্ভবত এমন ধারণার সূত্রপাত। এ সম্পর্কে সৈনিক’-এর বক্তব্য :
‘২২শে ফেব্রুয়ারি ।… রাজপথে পুলিশ ও মিলিটারী দিচ্ছিল টহল । যাচ্ছিলেন একটি সাইকেল চড়ে হাইকোর্টের দিকে ।… তখন সাড়ে দশ ঘটিকা ।… হঠাৎ একটি রাইফেলের গুলি তার পৃষ্ঠদেশ ভেদ করে চলে গেল। পড়ে গেলেন মাটিতে। এম্বুলেন্স এল । তুলে নিল হাসপাতালে। একই বিষয়ে সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম শহীদ শফিউর রহমানের ছােট ভাই তৈয়বুর রহমানের সাথে সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে নির্ভরযােগ্য তথ্য উপস্থিত করেছেন, যা শহীদের অন্য এক ভাই মফিজুর রহমানের বক্তব্যের সাথে মেলে। তৈয়বুর রহমানের প্রদত্ত বিবরণ :
সকাল ১১টা কি সােয়া ১১টার দিকে তিনি বেরিয়েছিলেন। তখন একটা বিরাট মিছিল যাচ্ছিল নবাবপুর রােড দিয়ে । মরণাদের দোকানের সামনে যখন তিনি, তখন গুলি হয়। গুলি লাগে তার পিঠে। তবু সাইকেল চালিয়ে কিছুটা এগিয়ে যান, কিন্তু খােশমহল রেষ্টুরেন্টের সামনে এসে পড়ে যান । তাকে ধরাধরি করে
৩৪

রেষ্টুরেন্টের মধ্যে নিয়ে যাওয়া হয়। এখান থেকেই তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে পাঠানাে হয় এ্যাম্বুলেন্স করে ।… পরে শুনেছিলাম, গুলিতে ভাইয়ের কলজে ছিড়ে গিয়েছিল। অপারেশন সফল হয় নি তাই ।… সেদিন রাত তিনটায় আজিমপুরে তাকে দাফন করা হয়।
এ সম্পর্কে একই প্রতিবেদনে আরাে বলা হয় :
‘আগের দিন (২১শে ফেব্রুয়ারি) পুলিশের গুলিতে মারা গেছে অনেকে। অফিসআদালত সব বন্ধ। সবাই তাকে নিষেধ করলেন বাইরে বেরােতে, এমনকি স্ত্রীও । বললেন, ‘অফিসে একটু দরকার আছে। তা সেরে শাহনাজের (মেয়ের) কাপড় নিয়ে ফিরবাে।’ একথা বলে সাইকেলে চড়ে তিনি সেই যে বেরুলেন আর কখনাে
ফিরলেন না। একই বিষয়ে অলি আহাদ লিখেছেন :
ছত্রভঙ্গ শােভাযাত্রীরা পুনরায় সদরঘাটের পথে রওয়ানা দিলে নওয়াবপুর রােডে অবস্থিত অধুনালুপ্ত ‘খােশমহল’ রেস্টুরেন্টের সন্নিকটে পুনরায় সশস্ত্র পুলিশ বাহিনীর সহিত সংঘর্ষ ঘটে। এই সংঘর্ষেই হাইকোর্ট কর্মচারী শফিউর রহমান পুলিশের গুলিতে গুরুতরভাবে আহত হন। এবং পরবর্তীকালে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
এছাড়া সাপ্তাহিক ‘নতুন দিন’-এ (১৩৬২ সাল, ১১ই ফাল্গুন) নওয়াবপুর রােডে ‘খােশমহল’ রেস্টুরেন্টের সামনে মাথায় রাইফেলের গুলি লেগে জনৈক কিশাের অহিউল্লাহর শহীদ হওয়ার কথা বলা হয়েছে। রাজমিস্ত্রি হাবীবুর রহমানের আট-নয় বছর বয়সের ছেলে অহিউল্লাহর লাশ সঙ্গে সঙ্গে অপসারিত হয়।
জনাব অলি আহাদ বাইশ তারিখে নওয়াবপুর রােডে সংবাদ অফিসের বিপরীত দিকে জনৈক রিকশাচালক আবদুস সালামের শাহাদাত বরণের কথা বলেলেন। এ সম্পর্কে অন্য কোন সূত্রের সংবাদ মেলে না। দৈনিক আজাদ’-এর সংবাদ মতে একুশে ফেব্রুয়ারি গুলিতে আহত জনৈক আবদুস সালাম ৭ এপ্রিল (১৯৫২) ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মারা যান। তিনি ছিলেন পূর্ববঙ্গ সরকারের শিল্প অধিদপ্তরের একজন আজ্ঞাবাহক (পিওন)। থাকতেন নীলক্ষেত ব্যারাকে । প্রসঙ্গত একটি কথা উল্লেখ করা দরকার যে শহীদ আবুল বরকত এবং শহীদ শফিউর রহমান বাদে আর কোন শহীদের কবরই সংরক্ষণ করা যায় নি বলে হারিয়ে গেছে। | একুশে ও বাইশে ফেব্রুয়ারি পুলিশ এবং সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহতদের সংখ্যা নিয়ে বিভিন্ন সূত্রে বিস্তর মতভেদ। এ সম্পর্কে আমরা যতদূর সম্ভব উপরে উল্লেখ করেছি; বিশেষ করে বাইশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে। এমনকি একুশ তারিখের ঘটনা সম্পর্কেও দৈনিক আজাদ’-এ সন্দেহ প্রকাশ করে বলা হয় :
বৃহস্পতিবারের ঘটনা সম্পর্কে শহরে প্রবল গুজব যে, ঐ দিন ৪ জনেরও বেশি লােক নিহত হয়, কিন্তু ঘটনার সঙ্গে সঙ্গেই তাহাদের মৃতদেহ সরাইয়া ফেলা হয় । একটি কিশাের বয়স্ক বালক সম্বন্ধে অনুরূপ গুজব শুনিয়া বিশেষ অনুসন্ধানের পর জনা যায় যে বালকটি মেডিকেল কলেজ ও পরিষদ ভবনের মধ্যে ফুলার রােডে
৩৫

গুলির আঘাতে নিহত হয় এবং তার লাশ তৎক্ষণাৎ অপসারিত হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের
কতিপয় পােস্টগ্রাজুয়েট ছাত্রীর নিকট হইতেও ইহার সমর্থন পাওয়া গিয়াছে। তা হলে দেখা যাচ্ছে, এই দুই দিনে অন্ততপক্ষে দুইজন কিশাের প্রাণ হারিয়েছেন। কিন্তু বাইশে ফেব্রুয়ারির হতাহত সম্পর্কে সরকারি প্রেসনােটে বলা হচ্ছে দুইজন নিহত এবং ৪৫ জনের হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার কথা। দৈনিক ‘আজাদ’ ও ‘মিল্লাত’-এ প্রকাশিত একটি বিজ্ঞাপন থেকে জানা যায় যে, বাইশ তারিখে রিকশাওয়ালা আবদুল আউয়াল (লাইসেন্স নং ৩৪২) গুলিতে নিহত হন।
শহীদদের সংখ্যা নিয়ে পরস্পরবিরােধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে স্বভাবতই প্রশ্ন ওঠে, রাস্তা থেকে নিহতদের তুলে নিয়ে কোথায় কবর দেয়া হয়েছিল, বিশেষ করে বাইশ তারিখে? একুশ তারিখে পুলিশ মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে লাশ সরিয়ে নিয়ে আজিমপুর কবরখানায় দাফন করেছিল, সে তথ্য আমরা জেনেছি; কিন্তু ঐদিনের বাকি সবাইকে এবং পরদিনের শহীদ সবাইকে ঐখানেই কি দাফন করেছিল পুলিশ?
এ বিষয়ে সাংবাদিক আহমদ নূরে আলম আজিমপুর গােরস্থানের তৎকালীন ড্রেসার সুরুজ্জামান এবং মৌলবী হাফেজ আবদুল গফুরের সাথে আলাপ করে একুশের এবং বাইশের শহীদদের লাশ দাফন সম্পর্কে কিছু তথ্য সংগ্রহ করেন । ভাষাসংগ্রামী ও গবেষক আহমদ রফিকও তার সঙ্গে উক্ত ড্রেসার সুরুজ্জামানের সাথে কবরস্থানের পশ্চিমধারে নতুন পল্টন লাইনে তার বাড়িতে বসে আলাপ করেন । দেখা যায়, এতকাল পরে তার স্মৃতি যথেষ্ট বিবর্ণ। তার বয়স তখন সত্তর বছর ।
তবু সুরুজ্জামানের বক্তব্যে একটি বিষয় স্পষ্ট যে, ওদের মাঝরাতে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কবর খুঁড়তে লাগানাে হয়েছিল। লাগানাে হয়েছিল লাশ থােয়ানাের কাজে এবং অবাঙালি অফিসারটি তাদের বারবার ধমক দিচ্ছিল এই বলে যে, জলদি লাশ দাফন করাে। সব মিলিয়ে ওরা আটজন দ্রুত কাজ সারতে চেষ্টা করেন। তার সঙ্গী রমজান, রেজ্জাক ওরা কেউ আর বেঁচে নেই। ঠিক কয়টি কবর দেয়া হয় তা ঠিক মনে নেই, তবে প্রথম রাতে অর্থাৎ একুশে ফেব্রুয়ারি রাতে মাথায় গুলি লাগা একজনকে তারা কবর দেয় এবং বুকে গুলি লাগা অন্য একজনকে। দুই দিনে সব মিলিয়ে ছয়সাতটি লাশ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে একটি কিশােরের লাশও ছিল। একই বক্তব্য রেখেছিলেন মৌলবী গফুর লাশের জানাজা পড়া সম্পর্কে।
এদের বিবরণ থেকে আরাে যে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বেরিয়ে আসে তা হলাে, একুশের পরদিন ভােরে কয়েকজন ছাত্র এসে এদিক-ওদিক ছড়িয়ে থাকা কিছু রক্তমাখা কাপড়চোপড় সংগ্রহ করে নিয়ে চলে যায়। এই ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে আমরাও জানি এই জন্য যে পরদিন কাকভােরে মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র আজিমপুর গােরস্থান থেকে কয়েকটি রক্তমাখা কাপড়-চোপড় হােস্টেলে এনেছিলেন এবং এগুলাে মিছিলের মুখে পতাকার মতাে ব্যবহার করা হয়েছিল । উক্ত ছাত্রদের মধ্যে মেডিকেল কলেজের তৎকালীন দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র খােন্দকার মােহাম্মদ আলমগীর (এখন আমেরিকাবাসী) অন্যতম। তাঁর সঙ্গে ছিলাে তার সহপাঠী আমীর আহসান ।
৩৬

একুশে ফেব্রুয়ারি ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার দৃশ্য, পুলিশের সঙ্গে ছাত্র-জনতার মুখােমুখি অবস্থান, জঙ্গীমিছিল এবং পরদিন বাইশে ফেব্রুয়ারি মিছিলের শহর ঢাকা সব মিলিয়ে বিক্ষুব্ধ, উত্তেজিত ছাত্র, শিক্ষক, জনতা সাহসী মানুষে পরিণত হয় ।
বাইশে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথে ছাত্র জনতার ব্যাপক অংশগ্রহণ এবং ভীত সন্ত্রস্ত মুসলিম লীগ শাসকদের নির্দেশ অনুযায়ী নির্বিচারে গুলি চালনার ফলে নিহতের সংখ্যা একুশ তারিখের তুলনায় স্বভাবতই বেশি হওয়ার কথা।
পূর্ববাংলার জনবিচ্ছিন্ন এবং অবাঙালি আমলা নির্ভর স্বৈরাচারী শাসকগােষ্ঠী মধ্যরাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে শহীদের লাশ চুরি করতে দ্বিধা করেনি। আহত-নিহতদের বিষয়ে যাবতীয় তথ্য এখনও সরকারি Classified তথ্য। ভাষা আন্দোলনের দীর্ঘ ৬০ বছর পরে এসব তথ্য জনসমক্ষে প্রকাশ করা প্রয়ােজন । এগুলাে সরকারি গুদাম ঘরে রাখার কোনাে প্রয়ােজন নেই। ভাষা আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ ও সুষ্ঠু ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে এসব ক্লাসিফায়েড তথ্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এসব তথ্য বর্তমানে আমাদের জাতীয় সম্পদ। National Archives হচ্ছে এসব তথ্য সংরক্ষণের উপযুক্ত স্থান ।
এলিস কমিশনের রিপাের্ট থেকে কিছু কিছু তথ্য জানা গেলেও একদেশদর্শিতা এবং পক্ষপাতিত্বের কারণে এই রিপাের্ট তার বিশ্বাসযােগ্যতা হারিয়েছে। ভাষা আন্দোলনের তথ্যগুলাে জনসমক্ষে প্রকাশিত হলে বর্তমান গণতান্ত্রিক সরকারের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে বলে আমরা মনে করি।
চরিত্র-বৈশিষ্ট্য
শফিউর রহমান বাল্যকাল থেকেই বিনয়ী ছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি খুব পরােপকারীও ছিলেন। হয়তাে এ কারণেই তাঁর মধ্যে সমাজ ভাবনা ও রাজনৈতিক সচেতনতা কাজ করতাে। পাকিস্তানি শাসকদের অত্যাচার-অনাচার দেখে তিনি বলেছিলেন পাকিস্তান রাষ্ট্র টিকবে না।।
২১শে ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ছাত্র-জনতার উপর পুলিশের গুলিবর্ষণের পর পাকিস্তান শাসকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে তিনি সেদিন তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। তিনি বলেছিলেন সভ্য দেশে পুলিশ সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে পায়ে গুলি মারে, হাতে গুলি মারে, কিন্তু আজ পুলিশ এলােপাতাড়ি গুলি চালিয়ে ছাত্রদের মাথার খুলি উড়িয়ে দিয়েছে। কী বর্বরতা! তাঁর স্ত্রী আকিলা খাতুন দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস ২২শে ফেব্রুয়ারি আমার স্বামী বর্বর পাকিস্তানিদের গুলিতে শাহাদাত বরণ করেন।
স্মৃতিচারণ করে আকিলা খাতুন বলেন, আমার স্বামীকে চিৎকার করে কথা বলতে শুনিনি । আমার শ্বশুর বেশ রাগী ছিলেন। কিন্তু আমার স্বামী একজন ব্যতিক্রমধর্মী
৩৭

মানুষ। মানুষের উপকার করতে পারলে খুশী হতেন । কার বাজার লাগবে, কার কি লাগবে, পিয়ন-চাপরাশি সবাইকে সাহায্য করতেন।
শহীদ শফিউর রহমান যখন শহীদ হন তখন তাঁর স্ত্রী আকিলা খাতুন ১৯ বছরের তরুণী। তখন তিনি অন্তঃসত্ত্বা । ২২শে ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমান শহীদ হওয়ার ৩ (তিন) মাস পর ১৮ই মে তার ছেলে জন্মগ্রহণ করেন । প্রতি বছর ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি স্বামীসহ ভাষা আন্দোলনের অন্যান্য বীর শহীদদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শন করে তিনি রােজা রাখেন। এখনাে মাঝে মাঝে রােজা রাখেন।
৩৮

সমকালীন প্রতিক্রিয়া
ভাষা শহীদের আত্মােৎসর্গ, মহিমা উচ্চারিত হয়েছে অসংখ্য কবিতায়। এই প্রসঙ্গে ১৯৫৩ সালে প্রকাশিত হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ সংকলনে সংকলিত কবিতাগুচ্ছের কথা উল্লেখ করা যায়। এই সংকলনে এগারােটি কবিতা লিখেছিলেন বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান, বােরহান উদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আবদুল গণি হাজারী, ফজলে লােহানী, আলাউদ্দিন আল আজাদ, আনিস চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, জামালুদ্দিন, আতাউর রহমান, সৈয়দ শামসুল হক এবং হাসান হাফিজুর রহমান।
একুশে ফেব্রুয়ারি ভাষা শহীদদের আত্মদান বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেছে । উন্মেষ ঘটিয়েছে বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা। এসব কবিতায় বাঙালির জাতিসত্তার নবজাগরণ, অত্যাচারী পাকিস্তানী শাসকচক্রের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ উচ্চারিত হয়েছে। পাকিস্তানি বর্বর সামরিক বাহিনী কর্তক ভাষা শহীদদের স্মরণে নির্মিত প্রথম স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার পর আলাউদ্দিন আল আজাদ তাঁর কালজয়ী কবিতায় তীব্র প্রতিবাদ উচ্চারণ করেন –
স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তােমার? ভয় কি বন্ধু, আমরা এখনাে
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তাে। যে-ভিৎ কখনাে কোনাে রাজন্য
পারেনি ভাঙতে
হীরার মুকুট নীল পরােয়ানা খােলা তলােয়ার
খুরের ঝটিকা ধূলায় চূর্ণ যে-পদপ্রান্তে
যারা বুনি ধান
গুণ টানি, আর তুলি হাতিয়ার হাপর চালাই
সরল নায়ক আমরা জনতা সেই অনন্য।
ইটের মিনার
ভেঙেছে, ভাঙুক । ভয় কি বন্ধু, দেখ একবার আমরা জাগরী
চারকোটি পরিবার ॥
(আলাউদ্দিন আল আজাদ/ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’)
ভাষাশহীদ বরকত, সালাম, রফিক, জব্বার, শফিউর-এর নাম বাঙালির হৃদয়ে চির অম্লান ও উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। হাসান হাফিজুর রহমানের অমর কবিতায় শহীদদের নামের গৌরব ও মহিমা উচ্চারিত হয়েছে :
আবুল বরকত নেই; সেই অস্বাভাবিক বেড়ে-ওঠা
৩৯

ভাষাশহীদ শফিউর রহমান
বিশাল শরীর বালক, মধুর স্টলের ছাদ ছুঁয়ে হাঁটতাে যে তাঁকে ডেকো না;
আর একবারও ডাকলে ঘৃণায় তুমি কুঁচকে উঠবে
সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বারকি বিষন্ন থােকা থােকা নাম;
এই এক সারি নাম তার বর্শার তীক্ষ্ণ ফলার মতাে এখন হৃদয়কে হানে;
…. ………… ………… ……… ………
যাদের হারালাম তাঁরা আমাদেরকে বিস্তৃত করে দিয়ে গেল
দেশের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত, কণা কণা করে ছড়িয়ে দিয়ে গেল
দেশের প্রাণের দীপ্তির ভেতর মৃত্যুর অন্ধকারে ডুবে যেতে যেতে।
আবুল বরকত, সালাম, রফিকউদ্দিন, জব্বার।
কি আশ্চর্য, কি বিষন্ন নাম । একসার জুলন্ত নাম ॥
(হাসান হাফিজুর রহমান/‘অমর একুশে’)
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ রচিত কোনাে এক মাকে’ কবিতায় ভাষা আন্দোলনে শহীদ যে ‘খােকা মুড়কি হাতে প্রতীক্ষারত মায়ের নিকট কোনােদিন ফিরে আসবে না, সে মায়ের স্নেহ, ভালবাসা, আবেগ, অনুভূতি সমস্ত বাঙালি হৃদয়ে নাড়া দেয়। শহীদ খােকার মা হয়ে যায় দেশজননী –
কুমড়াে ফুল
শুকিয়ে গেছে,
ঝরে পড়েছে উঁটা;
পুঁইলতাটা নেতানাে“-
খােকা এলি ?”
ঝাপসা চোখে মা তাকায়
উঠোনে, উঠোনে
যেখানে খােকার শব
শকুনিরা ব্যবচ্ছেদ করে ।
এখন,
মা’র চোখে চৈত্রের রােদ
পুড়িয়ে দেয় শকুনিদের।
তারপর,
দাওয়ায় বসে
মা আবার ধান ভানে,
বিন্নি ধানের খই ভাজে,
খােকা তার
কখন আসে! কখন আসে!
এখন, মার চোখে শিশির ভাের,
৪০

স্নেহের রােদে
ভিটে ভরেছে ।
(আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ/‘কোনাে এক মাকে)।

এভাবে ভাষা আন্দোলন ও ভাষা শহীদরা পরবর্তীকালে গণতান্ত্রিক সকল আন্দোলনে অবিনাশী শক্তি ও প্রেরণার উৎস হয়ে যায়। বাঙালিরা যখনই পাকিস্তানী স্বৈরশাসক-এর বিরুদ্ধে রাজপথে আন্দোলনে নেমেছে তখনই ভাষাশহীদ ও শহীদ মিনার তাদের বিদ্রোহ ও গণজাগরণের মূর্ত প্রতীক হয়ে যায় ।
মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী রচিত একুশের প্রথম কবিতা কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি কবিতায় ভাষা শহীদদের আত্মদানের মাধ্যমে বাঙালির আত্মজাগরণের যে অবিনাশী চেতনা সৃষ্টি হয়েছে তা সুন্দরভাবে প্রতিফলিত হয়েছে
এখানে যারা প্রাণ দিয়েছে
রমনার ঊর্ধ্বমুখী কৃষ্ণচূড়ার তলায়
যেখানে আগুনের ফুলকির মতাে
এখানে ওখানে জ্বলছে অসংখ্য রক্তের ছাপ
সেখানে আমি কাঁদতে আসিনি ।
আজ আমি শােকে বিহ্বল নই।
আজ আমি ক্রোধে উন্মত্ত নই
আজ আমি প্রতিজ্ঞায় অবিচল ।…

হে আমার মৃত ভায়েরা।
সেই নিস্তব্ধতার মধ্য থেকে
তােমাদের কণ্ঠস্বর
স্বাধীনতার বলিষ্ঠ চিৎকার
ভেসে আসবে
সেইদিন আমাদের দেশের জনতা
খুনি জালিমকে ফাঁসির কাষ্ঠে
ঝুলাবেই ঝুলাবে
তােমাদের আশা অগ্নি শিখার মতাে জ্বলবে
প্রতিশােধ আর বিজয়ের আনন্দে।
(মাহবুব-উল আলম চৌধুরী/ কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি)।
৪১

এভাবে বায়ান্ন-উত্তর একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলন, সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ ও বিজয়ে প্রতিদিনের পথচলার অফুরন্ত শক্তির প্রতীক ও উৎস হিসেবে আবির্ভূত হয় । মহাদেব সাহা ‘একুশে গান কবিতায় উচ্চারণ করেন :
একুশ মানেই আসছে, স্বপ্ন আসছে, ভবিষ্যৎ আসছে।
একুশ মানে অতীত নয়, আগামী
মৃত্যু নয়, জন্ম,
একুশ মানে শহীদদের পায়ের শব্দ
একুশ মানে অজর, অমর, অবিনশ্বর
ভাষা আন্দোলনের শহীদেরা বায়ান্ন-উত্তর বিভিন্ন গণআন্দোলন, পাকিস্তান। সামরিক জান্তার অবৈধ শাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও প্রতিবাদ জানানাের এক অবিনাশী শক্তি হিসেবে বাঙালি কবিদের অনুপ্রাণিত করে । বরেণ্য কবি শামসুর রাহমান তার ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯’ কবিতায় উচ্চারণ করেন-
বুঝি তাই উনিশশাে ঊনসত্তরেও
আবার সালাম নামে রাজপথে, শূন্যে তােলে ফ্ল্যাগ
বরকত বুক পাতে ঘাতকের থাবার সম্মুখে ।
সালামের বুক আজ উন্মথিত মেঘনা
সালামের চোখ আজ আলােকিত ঢাকা
সালামের মুখ আজ তরুণ শ্যামল পূর্ববাংলা ।
শামসুর রাহমান/ ‘ফেব্রুয়ারী, ১৯৬৯’)
ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগকে উপজীব্য করে মুনীর চৌধুরী রচনা করেছেন তার বিখ্যাত নাটক কবর (রচনাকাল ১৯৫৩, প্রকাশকাল ১৯৬৯)। ঐ একাঙ্কিকায় তিনি ধারণ করেছেন বাঙালি জাতিসত্তার জাগরণের চেতনা । কবরই বাংলা সাহিত্যে প্রথম। প্রতিবাদী নাটক। এই নাটকে তিনি মূর্তি-২ চরিত্রে হাইকোর্টের কেরানির যে চরিত্র রূপায়িত করেছেন তার সঙ্গে ২২শে ফেব্রুয়ারি শফিউর রহমানের শহীদ হওয়ার ঘটনা বিস্ময়করভাবে মিলে যায় । শফিউর রহমান ছিলেন হাইকোর্টের কর্মচারী। গুলি তাঁর ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল । ডাক্তার শত চেষ্টা করেও তাকে বাঁচাতে সক্ষম হয়নি। মুনীর চৌধুরী তার এই বিখ্যাত একাঙ্কিকায় মুর্দা ফকিরের আচরণ এবং শহীদদের কবরে না যাওয়ার প্রতীকী উপস্থাপনার মাধ্যমে ভাষা শহীদদের অনন্তকাল জীবিত থাকা এবং সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ধর্মান্ধতা, স্বৈরশাসন ও শােষণের বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রামে প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবেন।
হাইকোর্টের কেরানি হয়েও নাটকে মূর্তি-২ কেন ছাত্রদের মিছিলে এসেছে এবং কেনই বা সে কবরে যাচ্ছে না, নেতার এই প্রশ্নের উত্তরে হাইকোর্টের কেরানি যা বলে তাতে অত্যাচার আর নির্যাতন, শাসন ও শােষণ যে, জনতাকে ঐক্যবদ্ধ করে তা মূর্তি২ এর সংলাপেই প্রতিফলিত হয়েছে। শহীদদের মৃত্যু নেই। যুগে যুগে তারা জনগণকে অত্যাচারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও সংগ্রামে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করে ।
৪২

নেতা … কে, তুমি কে ? মূর্তি-২। নাম বললে চিনতে পারবেন না । হাইকোর্টের কেরানী ছিলাম। তখন টের পাইনি । ফুসফুসের ভেতর দিয়ে চলে গিয়েছিল । এপিঠওপিঠ। বােকা ডাক্তার খামােকা কেটেকুটে গুলিটা খুঁজে খুঁজে হয়রান হয়েছে । জমাট রক্তের মধ্যে ফুটো নজরেই পড়েনি প্রথমে ।
নেতা। তুমিও এই দলে এসে জুটেছাে নাকি ?
মূর্তি-২। গুলি দিয়ে গেঁথে দিয়েছেন । ইচ্ছে করলেও আলগা হতে পারবাে না।
মুর্দা ফকিরের সংলাপেও উচ্চারিত হয়েছে প্রতিবাদী চেতনা। যেমন- ‘বাসি মরার গন্ধ আমি চিনি না? এ লাশের গন্ধ অন্যরকম। ঔষধের, গ্যাসের, বারুদের গন্ধ । এ-মুর্দা কবরে থাকবে না। বিশ-পঁচিশ-ত্রিশ হাত যত নিচেই মাটি চাপা দাও না কেন— এ-মুর্দা থাকবে না। কবর ভেঙে বেরিয়ে চলে আসবে । উঠে আসবে।
ভাষা শহীদদের স্মরণে রচিত হয়েছে যুগান্তকারী কিছু কবিতা যা পরবর্তীকালে গান হয়ে বাঙালির কণ্ঠে কণ্ঠে হয়েছে ধ্বনিত-প্রতিধ্বনিত। এ প্রসঙ্গে আবদুল গাফফার চৌধুরীর বিখ্যাত রচনা একুশে ফেব্রুয়ারি’ উল্লেখযােগ্য। এগানের সুর বাঙালিকে উদ্বেলিত করে, অনুপ্রাণিত করে। গানের সুরের জাদুকরি ছোঁয়ায় বাঙালি আপুত হয় । শহীদদের আত্মত্যাগের স্মৃতি চির জাগরুক হয়ে আছে গাফফার চৌধুরীর অমর সৃষ্টি ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতায় ।
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানাে একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি
ছেলেহারা শত মায়ের অশ্রু-গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি
আমার সােনার দেশের রক্ত রাঙানাে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলতে পারি ॥
জাগাে নাগিনীরা জাগাে নাগিনীরা জাগাে কালবােশেখীরা
শিশু হত্যার বিক্ষোভে আজ কাঁপুক বসুন্ধরা,
দেশের সােনার ছেলে খুন করে রােখে মানুষের দাবী
দিন বদলের ক্রান্তি লগনে তবু তােরা পার পাবি?
না, না, না, না, খুন রাঙা ইতিহাসে শেষ রায় দেওয়া তারই
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি !!
সেদিনাে এমনি নীল গগনের বসনে শীতের শেষ
রাত জাগা চাদ চুমাে খেয়েছিল হেসে;
পথে পথে ফোটে রজনীগন্ধা অলকানন্দা যেনাে,
এমন সময় ঝড় এলাে এক, ঝড় এলাে ক্ষ্যাপা বুনাে ॥
৪৩

সেই আঁধারের পশুদের মুখ চেনা,
তাহাদের তরে মায়ের, বােনের, ভায়ের চরম ঘৃণা
ওরা গুলী ছােড়ে এদেশের প্রাণে দেশের দাবীকে রােখে
ওদের ঘৃণা পদাঘাত এই বাংলার বুকে
ওরা এদেশের নয়,
দেশের ভাগ্য ওরা করে বিক্রয়
ওরা মানুষের অন্ন, বস্ত্র, শান্তি নিয়েছে কাড়ি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি।
তুমি আজ জাগাে তুমি
আজ জাগাে একুশে ফেব্রুয়ারি
আজো জালিমের কারাগারে মরে বীর ছেলে বীর নারী
আমার শহীদ ভাইয়ের আত্মা ডাকে
জাগে মানুষের সুপ্ত শক্তি হাটে মাঠে ঘাটে বাঁকে।
দারুণ ক্রোধের আগুনে আবার জ্বালবাে ফেব্রুয়ারি
একুশে ফেব্রুয়ারি একুশে ফেব্রুয়ারি ॥
[সুর : আলতাফ মাহমুদ ॥ আদিসুর : আবদুল লতিফ]
আবদুল লতিফের একুশের গান’ একটি অবিস্মরণীয় সৃষ্টি। এই গানে বাঙালির প্রতিবাদী চেতনা, হাজার বছরের বাঙালির ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি দারুণভাবে প্রতিফলিত হয়েছে :

গায়রে আমার দেশের মাঝি
ভাটিয়ালি গান ।
তার ভাটিয়াল গানের সুরে
মনের দুস্কু যায় রে দূরে
বাজায় বাঁশী সেই না সুরে
রাখাল বনের ছায় ॥
ওরা যদি না দেয় মান।
আমার দেশের যতেক গান
আছে, তার সাথে মাের নাড়ীর যােগাযােগ
আপদ বিপদ দুঃখে-কষ্টে
এ গান আমায় ভুলায় শােক।
টুং টা টুং দোতারা আর
সারিন্দা বাজাইয়া।
গাঁয়ের যােগী ভিক্ষা করে
প্রেমের সারী গাইয়া ॥
৪৪

একতারা বাজায় বাউল
ঘুচায় মনের সকল আউশ
তারা মারফতি মুর্শিদী তত্ত্বে
পথের দিশা দিয়া যায় ।
ওরে আমার বাংলা রে
তাের এই সােনার ভাণ্ডারে
আরাে কত আছে যে রতন
মূল্য তাহার হয় না দিলেও
মণি মুক্তা আর কাঞ্চন ॥

আর এক কথা মনে কইরা
আঁখি ঝইরা যায়।
ঘুম পারাইনা গাইতাে যে গান
মাের দুখিনী মায় ।
ওমায়, সােনা মাণিক যাদু বলে
চুমা দিয়া লইতাে কোলে
আরাে আদর কইরা কইতাে মােরে
আয় চান আমার বুকে আয় ।
আরাে আদর কইরা কইতাে মােরে
আয় চান আমার বুকে আয় ।
আমার মায়ের মতন গান
আমার মায়ের মতন প্রাণ।
এই, বাংলা বিনে কারাের দেশে নাই।
সেই, মায়ের মুখের মধুর বুলি
কেমন কইরা ভুলুমরে ভাই।
মরা, গাঙে যাদের গানে।
আইজো ডাকে বান
কেমন কইরা ভুলুমরে ভাই
তারার এমন দান ॥
মুকুন্দ দাশ পাগল কানাই।
হাসন মদন আর লালন সাঁই
ওরা, এদের মুখেও মারে লাথি
এই দুঃখ কি সওয়া যায় ।
এই গুণীদের রাখতে মান
৪৫

জীবন কেবা দিবা দান
তােরা, দলে দলে আয়রে সবে ভাই
নইলে কিন্তু জন্মের মত
মুখে তােদের পরবে ছাই ॥
ভুলিস নারে ওদের কথায়
ভাইরে করি মানা
থাকতে জবান হইস না বােবা।
চোখ থাকিতে কানা।
তাের, পিঠ চাপড়াইয়া কইয়া দাদা
তােরে, চায় করিতে ধােপার গাধা
ওরা, এই বাসনায় সভায় সভায়
মিটা বুলি কইয়া যায় ॥

দুইশ বছর ঘুমাইলি
আর কেনরে বাংগালি
জাগরে এবার সময় যে আর নাই
আইজো কি তুই বুঝবি নারে।
বাংলা বিনে গতি নাই ॥
[সুর : আবদুল লতিফ]

ওরা আমার মুখের কথা
কাইরা নিতে চায় ।
ওরা, কথায় কথায় শিকল পরায়।
আমার হাতে পায় ॥
কইতাে যাহা আমার দাদায়
কইছে তাহা আমার বাবায়
এখন, কও দেখি ভাই মাের মুখে কি
অন্য কথা শােভা পায় ॥

সইমু না আর সইমু না
অন্য কথা কইমু না।
যায় যদি ভাই দিমু সাধের জান ॥
ঐ জানের বদলে রাখুম রে
বাপ দাদার জবানের মান ॥
৪৬

সে শুনাইছে আমার দেশের
গাঁও গেরামের গান।
নানান রঙের নানান রসে।
ভইরাছে তায় প্রাণ ।
ঢপ কীর্তন ভাসান জারী
গাজীর গীত আর কবি সারী
আমার এই, বাংলা দেশের বয়াতিরা
নাইচা নাইচা কেমন গায় ॥
তারই তালে তালে হে।
ঢােল করতাল বাজে ঐ
বাঁশী কাসি খঞ্জরি সানাই।
কও দেখি ভাই এমন শােভা
কোথায় গেলে দেখতে পাই ।
পূবাল বায়ে বাদাম দিয়া
লাগলে ভাটির টান
বাংলাদেশের লােককবিরা তাঁদের সৃষ্টিশীল রচনার মাধ্যমে ভাষা শহীদদের গৌরব ও মহিমা উপস্থাপন করেছেন। রচনা করেছেন লােকসঙ্গীত। গ্রাম, শহরে ভাষা শহীদদের স্মরণে রচিত এসব জারিগান গেয়ে তিনি জনগণকে অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত করেছেন। এই প্রসঙ্গে প্রয়াত মরমি কবি ও লােককবি আবদুল হালিম বয়াতির নাম উল্লেখ করা যায় । সমাজ সচেতন এই লােককবি তাঁর রচিত জারিগানে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অসারতা এবং ফলশ্রুতিতে বাঙালিদের ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস অত্যন্ত চমৎকারভাবে উপস্থাপন করেছেন। হালিম বয়াতি রচিত জারিগানটি ভাষা আন্দোলনের একটি মূল্যবান ঐতিহাসিক দলিল। তিনি শুধু ধর্মীয়, শাস্ত্রীয় কাহিনী নিয়ে জারিগান রচনা করেননি। রাজনৈতিকভাবে সচেতন এই লােককবি সমসাময়িক ঘটনা নিয়ে অসংখ্য জারিগান লিখেছেন । ভাষাআন্দোলনের জারি এগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য।
আমাদের লােককবি, বয়াতিরা ভাষাশহীদ, গণআন্দোলনে শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের গৌরব ও মহিমাকে তাদের সঙ্গীতের মাধ্যমে গ্রাম শহরের জনগণের নিকট উপস্থাপন করে বাঙালির গৌরবময় ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিকে তরুণ প্রজন্মের নিকট জীবন্ত ও প্রবহমান করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন।
বাংলাদেশের আর একজন লােককবি সাইদুর রহমান বয়াতি তাঁর রচিত জারিগানে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় রচনা করেছেন। রামায়ন, মহাভারত, কোরান, হাদিস ও শাস্ত্র গ্রন্থ পাঠ করে সাইদুর রহমান বয়াতি অসংখ্য
৪৭

জারিগান, কবিগান রচনা করেছেন । সমাজ সচেতন এই লােককবি ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, বঙ্গবন্ধু ঘােষিত ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তিনি অসংখ্য জারিগান, ধুইয়া গান রচনা করেছেন। এসব গান ‘জয় বাংলা’-র কবি হিসেবে তাকে পরিচিতি দিয়েছে।
এভাবেই আধুনিক কবিদের ন্যায় আমাদের লােককবিরাও রাজনৈতিক আন্দোলনএর ওপর ভিত্তি করে লােক সঙ্গীত রচনা করেছেন ।

হালিম বয়াতি রচিত ভাষা আন্দোলনের জারি
এদিক ওদিক বলতে আমার অনেক হবে দেরী
মন দিয়া শােনেন ভাষা-আন্দোলনের জারী… ॥

উনিশশাে সাতচল্লিশ সালে চৌদ্দই আগস্টেতে
দুই পাকিস্তান জন্ম হইয়াছিল তাতে… ॥

ঊনিশশাে আটচল্লিশ সালে উন্নিশে মার্চ দিনে
জিন্নাহ্ সাহেব এসেছিলেন পূর্ব-পাকিস্তানে… ॥

জিন্নাহ্ সাহেব ভাবেন মনে রাষ্ট্রভাষা নিয়া
উর্দুভাষা বাংলার বুকে দিব চাপাইয়া… ॥

রাষ্ট্রভাষা উর্দুভাষা করে নিব তাই
বাঙালীদের বাংলাভাষা পাবে না আর ঠাই… ।।

ওরা রাষ্ট্রভাষা বাংলাভাষা করতে দিবে না
বাংলা আমার মাতৃভাষা কইতে দিবে না… ।।

১৯৪৮ সনে ২১শে মার্চের দিনে
রেসকোর্স ময়দানে শুরু হল ঘটনা… ॥

ঐদিন কায়েদে আজম জিন্নাহ বলেছেন সেথায়
রেসকোর্সের ময়দানে প্রথম ভাষণ দেয়
জিন্নাহ্ বলেন রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষা হবে না…।’

উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা জিন্নাহ সাহেব কয়
ছাত্ররা সােচ্চার হয়ে প্রতিবাদ জানায়।
বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু আমরা মানি না… ॥
৪৮

জিন্নাহর সাথে নাজিমুদ্দিন মুসলিম লীগ আর নূরুল আমিন
উর্দুভাষা চাইল সেদিন বাংলাভাষা চাইল না… ॥

২৩শে মার্চ প্রতিবাদ করেন (জুনাব) এ. কে. ফজলুল হক
‘বাঙালীরে তােমরা বুঝি পাইয়াছাে আহাম্মক
বাংলা হবে রাষ্ট্রভাষা উর্দু হতে পারে না… ॥

২৪শে মার্চ জিন্নাহ সাহেব কার্জন হলে যায়
সেইখানেও ভাষণ দিয়া আগের কথাই কয়
‘উর্দু হবে রাষ্ট্রভাষা বাংলা হতে দিব না… ।

হক ভাসানী বলছেন—ওরা বড় বেঈমান।
কুলুর বলদ সাজাইতে চায় বাঙালীর সন্তান…।।

শহীদ সােহরাওয়ার্দি বলেন জোরালাে ভাষায়
রাষ্ট্রভাষা বাংলাভাষা হইবে নিশ্চয়…।

তােহা সাহেব, ওলি আহাদ, গাজীউল হক সাহেবে
আবদুস সামাদ, জিল্লুর রহমান একই প্রস্তাবে…।

ভাষা আন্দোলনের মহান শক্তিবান পুরুষ
শেখ মুজিবর রহমান লােহার মানুষ… ॥

১৯৪৮ সালে ১৬ই মার্চ রাতে।
শওকত আলী, শেখ মুজিবর গেলেন মিটিঙেতে
ফজলুল হক হলে তারা মিটিং করতে যায়।

রাত্র নয়টা বাজে মিটিং করেন সে জায়গায়… ॥
রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক।
হয়েছিল সেই রাত্রে বড়ই আঁক জমক…।।

১৯৫০ সালে নিরাপত্তা আইনে।
শেখ মুজিবকে বন্দী কইরা জেলে নেয় তখনে… ।

জুনাব মহিউদ্দিন সাহেব সেও জেলে যায়।
তাদের সাথে রাজবন্দী বহু মানুষ হয়… ॥

১৯৫২ সাল ২১শে ফেব্রুয়ারি
রাজবন্দী মুক্তি দিবস ধার্য ছিল তারি… ॥
৪৯
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে এই দাবি বড়
সবে মিলে প্রচার পােস্টার সারাদেশে ছাড়াে… ॥

ডাক্তার সাফিয়া আর নাদিরা বেগম।
পাঁচশত পােষ্টার লেখেন নিয়া ছাত্রগণ।
তখন হৃদরােগে আক্রান্ত শেখ মুজিবর
মেডিকেল হাসপাতালেতে পাঠায় তাহার পর… ।

হাসপাতালে রােগী হইয়া বড় সুযােগ পায়
ছাত্রনেতাদের সাথে গােপন আলাপ হয়
বলে— জেলখানায় তিলে তিলে মৃত্যু হয়ে যাব।
ভাল—তার চেয়ে আমরণ অনশন করিব।
মুজিব ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে (করেন) আমরণ অনশন
বাঙলা ও বাঙালীর জন্য দিব এ জীবন
তার সাথে ছাত্র নেতা মহিউদ্দিন ছিলাে
তাদের গােপন আলাপ সরকার জানিতে পারিলাে… ।

আবার তারে নিয়া গেলাে ফরিদপুর জেলে
মুজিব—১৮ই ফেব্রুয়ারি এক গােপন চিঠি দিলে।
নির্ধারিত কর্মসূচী সঠিক ভাবেতে
আমরা যেন চালাইয়া যাই লিখছে এ চিঠিতে
১৯৫২’র ২০শে ফেব্রুয়ারি থেকে
একমাস ১৪৪ ধারা সরকার দিয়া রাখে
১৪৪ ধারা ভাঙবাে’ সবার এক মন
ঢাকা হলের পুকুর পাড়ে সভা হয় তখন
ফজলুল হক হলে আর ঢাকা হলের মাঝে
পুকুর পাড়ে সিদ্ধান্ত হল সবার কাজে… ।

বর্তমান সেইখানে সলিমুল্লাহ হল।
২১শে ফেব্রুয়ারি রাত্রে মিশিল সকল
আবার—২১ তারিখ সকাল বেলা আমগাছের তলে
মিটিং হইবে তাহা সকলেই বলে।
গাজীউল হক আমতলার সভার সভাপতি
তিনি যদি গ্রেফতার হয় কি হইবে গতি
তখন— এম. আর. আখতার মুকুল সভাপতি হবে।
তিনিও গ্রেফতার হলে তখন কি দাঁড়াবে
৫০

তখন কমরুদ্দিন সাহেব সভাপতি হবে।
এইভাবে গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ তারা দিবে… ॥

সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মী পরিষদ
সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােটে করলেন তারা মত।
একশত চৌচল্লিশ (১৪৪) ধারা ভাঙ্গা হবে না।
পরিণামে তাদের কথা ঠিক রইল না ।
১৪৪ ধারা ভাঙতে যারা চায়।

তিন পক্ষ একমত হইয়া তারা যায়।
ছাত্ররা ও যুগলীগের নেতা কর্মীগণ
তাদের সাথে ছাত্রনেতা ছিল কয়েকজন… ॥
তিন সপ্তাহ ছাত্ররা যে প্রস্তুতি নেয়।
মাতৃভাষা উদ্ধার করতে জীবন দিতে চায়
প্রকাশ্য আওয়ামী লীগ ধারা ভাঙার পক্ষে।
গুপ্ত ক্যুনিস্ট পার্টি ছিল একই লক্ষ্যে
বাঙালীর অন্তরের মাঝে চাপা আগুন জ্বলে
বিস্ফোরণ ঘটাইবে একুশের সকালে
সরকারের দমননীতি রূঢ় ব্যবহার
ছাত্রদের অন্তর ভেঙে হইতেছে চুরমার… ।।

একুশে ফেব্রুয়ারি সুপ্রভাতের কালে
জীবন মরণ খেলা আজ বাঙালীর কপালে
বিশে ফেব্রুয়ারি রাত্রে থমথমে ভাব
কারাে চোখে ঘুম নাই একুশের খােয়াব
আহম্মদ রফিক বলেন কি হবে উপায়
সরকারের চৌচল্লিশ ধারায় নিষেধাজ্ঞা রয়।
আবার- সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের মতে
আপােষবাদী নীতি তারা চাইয়াছেন চালাতে… ॥

দু’য়ের প্রতিক্রিয়া কিছু এলােমেলাে হলাে
ছাত্রসমাজ গভীরভাবে নাড়া দিয়াছিল
তখন মেডিকেল কলেজ হােস্টেল কাঁটাতারে ঘেরা।
ব্যারাক ছিল ডাকনাম বলিত ছাত্ররা
আজ সেখানে আউটডাের সেবিকা নিবাস।
রাস্তার দুইপাশে চিকন পাতার গাছ ।
৫১

কাটা তারের দুর্গের মাঝে বার নম্বর ব্যারাকে
শহীদ ডা. আলিম চৌধুরী কিছু দিন থাকে… ।

তার কিছু আগে গেলে বিশ নম্বর ব্যারাকে
ছােট খাটো শান্ত মুখ একটি মানুষ থাকে
শহীদুল্লাহ কায়সারকে সকলেই চিনি।
কায়সার’ শব্দ তার নামে তখনও মিলেনি।
গােপনীয়তার জন্য তালেব ভাই নাম।
গােপন তথ্য দেখা শুনা ছিল তার কাম
রাজনৈতিক কেন্দ্রবিন্দু মেডিকেল ব্যারাক
রাজনৈতিক নেতারা সব আসতে ঝাঁকে ঝক… ॥

অবাক হবার কথা নয় তবু সত্য কথা।
একুশের সকাল বেলা খােলা মেলা রাস্তা
বিভিন্ন স্কুল কলেজের ছাত্ররা সব আসে
আগের বলা আমতলা সবাই এসে মিশে
আমতলায় ছাত্র ছাত্রী জমায়েত হয় ।
শুধুমাত্র নেতাদের হুকুমের আশায়
বেলা একটু বাড়ার সাথে পুলিশের গাড়ি
ব্যারাকের আশে পাশে এলাে সারি সারি … ॥

আমতলার ছায়ায় তখন ঠাণ্ডা হাওয়া বয়
পাশে মধুর রেস্তোরাতে উত্তেজনা হয়
কেউ বলে ‘চৌচল্লিশ ধারা ভেঙে ফেলব আজ
কেউ বলে ‘চৌচল্লিশ ভাঙা মস্ত বড় কাজ
গাজীউল হক দেখে আসছেন মােঃ সুলতান
বিশ্ববিদ্যালয় তিনি ঢুকছিলাে তখন।
দুইজনে মিলে তারা চিঠি লিখতে লয়।
সিগারেটের ভেঁড়া প্যাকেট হাতে যাহা পায়… ॥

বিভিন্ন স্কুল কলেজে সংক্ষিপ্ত চিঠি।
‘ছাত্ৰভাইয়েরা তােমরা জলদি এসাে ছুটি
রাষ্ট্রভাষা বাংলা ভাষায় রূপ দিয়া দিব
একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙার সিদ্ধান্ত নিব।
প্রতি-স্কুল কলেজের ছাত্র দুইজন করে এসাে
সত্য সত্য তােমরা ভাই দেশকে ভালবাসাে
৫২

এরই মধ্যে ডাক্তার মঞ্জুর আসিল।
চিঠিগুলি বিলি করতে কিছু ছাত্র সাথে নিল… ॥

জাহানারা লাইজু ছােট একটি মেয়ে
সাইকেল চালাতে জানে সামনে আসলাে ধেয়ে।
ছােট্ট একটি ছেলে আসলাে নিজাম নাম ধরে।
নিজাম এবং জাহানারা চিঠি বিলি করে ।
বেলা আটটার পর হতে বিভিন্ন হল থেকে।
আর—স্কুল কলেজ হতে ছাত্র আসতে থাকে
বেলা সাড়ে নয়টায় বহু ছাত্র জমায়েত হয়
জনাব শামসুল হক সেথা এসে হাজির তখন হয়… ॥

তার মাথায় ছিলাে জিন্নাহ টুপি গায়ে শেরওয়ানী
একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতে নিষেধ করেন তিনি
ছাত্ররা তখন তারে ঘিরিয়ে ফেলিল
নানা রকম প্রশ্ন তারে করিতে লাগিল।
তার কথা শােনার মত মন কারাে নাই
আরাে দুইজন লােক আসিল দেখিল সবাই
শহীদুল্লাহ কায়সার আর মােহাম্মদ তােহা
আধঘণ্টা পরে বলবেন মনে ছিল যাহা… ॥

ইহার আগে রাতভর পােস্টারিং করেছে।
একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবে লেখা তাতে আছে
জনাব ইমদাদ হােসেন, আমিনুল ইসলাম, মর্তুজা বশীর
পােস্টারে জোরালাে ভাষা করিলেন জাহির
শহীদুল্লাহ কায়সার তােহা সাহেব এলে।
একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙা ঠিক হবে না বলে
তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা একশ চুয়াল্লিশ ভাঙিলে
আমরা তাদের সাথে থাকবাে মিছিলে মিছিলে… ॥

দশজন করে গ্রুপ রাস্তায় নেমে যাবে
বিশৃঙ্খলা যেন কেহ না করিবে। ১৯৫২ সাল একুশে ফেব্রুয়ারি
বৃহস্পতিবার ছিল আটই ফাল্গুন ধরি
বিশ্ববিদ্যালয়ে তখন সভা একটি হয়।
তার আহ্বায়ক আঃ মতিনকে বানায়
৫৩

একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবার পক্ষে বলে ।
আবার—গাজীউল হক দাঁড়াইয়া ভাঙিবারে চলে… ।।

একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙিব নিশ্চয়।
চারিদিকে কামান বন্দুক নাহি করি ভয়
নূরুল আমিনের কাছে কত অস্ত্র আছে।
ধুলার মত উড়ে যাবে ছাত্রগণের কাছে।
এই কথা বলার সাথে শব্দ যাচ্ছে শুনা ‘
একশ চুয়াল্লিশ ধারা আমরা মানিনা মানিনা
সভাপতির ভাষণ যখন শেষ হয়ে গেল।
আবদুস সামাদ সাহেব তখন সরবে বলিল… ।।

দশজন দশজন করে ভাগে ভাগে যাও
একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙিয়া ফালাও’
বিশ হাজার ছাত্র ছাত্রী জমায়েত ছিল
তাদের শ্লোগানে চারদিক কম্পিত হইল
লােহার গেটের সামনে পিচ ঢালা পথে
সশস্ত্র পুলিশগণ পজিশন নেয় তাতে
সবার প্রথম মােয়াজ্জেম হােসেন ভাইস চ্যান্সেলার
ঝাঁপাইয়া পড়িল ওদের ধারা ভাঙিবার… ॥

সুলতান সাহেবের খাতায় তার প্রথম নাম উঠাইল
গলা ফাটাইয়া তিনি বলিতে লাগিল।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা হবে কোন চিন্তা নাই
জীবনবাজী রেখে এসাে রাস্তায় নেমে যাই’
এইভাবে কিছুদূর গেল আগাইয়া ।
পুলিশের গাড়িতে তাদের নিল উঠাইয়া।
তখন বেলা এগারটা শুরু আন্দোলন
দশে দশে মানুষ রাস্তায় বাহির হয় তখন… ॥

পুলিশের লাঠিচার্জ কাদানী গ্যাস ছাড়ে
জোর করে ছাত্র ধরে গাড়ির মধ্যে ভরে
গ্যাসের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাইবার।
পুকুরে ঝাঁপাইয়া পড়ে জান বাঁচাবার
কালাে অন্ধকারে ছাইল বিশ্ববিদ্যালয়।
মেডিকেল কলেজ পর্যন্ত আঁধার হইয়া যায়।
৫৪

কিছুক্ষণ পর শিক্ষকগণ নিচে নেমে এলাে
মধুর কেন্টিন প্রক্টর-বাড়ির মাঝে দাঁড়াইল… ॥

ঢাকা জেলা মেজিস্ট্রেট কোরায়শীকে পেলাে।
অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী কথা বলতেছিলাে
অধ্যাপক মুজাফফর আহাম্মদ চৌধুরী তার সাথে
সকল শিক্ষকমণ্ডলী এলাে প্রতিবাদ করিতে
বেলা সাড়ে বারােটার সময় বিশ্ববিদ্যালয়
উপাচার্য এম. হােসেন আসিলাে সেথায়
বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকিবে তিন দিন
পুলিশের অত্যাচার চলছে সীমাহীন… ।।

প্রায় দুই হাজার ছাত্রছাত্রী লাঠির আঘাতে
রাস্তায় পড়িয়া তারা লাগিল কাতরাতে
তবু তারা বলেছিলাে মরিব মরিব।
বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা আদায় করে নিব’
গাজীউল হকের বুকে গ্যাসের আঘাতে
মাটিতে পড়িয়াছিলেন বেহুঁশির সাথে
এই ভাবেতে কিছুক্ষণ চলিতে লাগিলাে
ঢাকা শহর প্রায় অচল হয়ে গেলা… ॥

পুলিশের নির্যাতন সবাই সইতে না পারিয়া
ইট পাটকেল মাইরা ছিলাে অধৈর্য হইয়া
তখন পুলিশের দিকবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়।
ছাত্রদের লক্ষ্য করে গুলি চালায়… ॥

গুলি চলে চলে রে আমার ভাইয়ের বুকে গুলি চলে
সােনার টুকরা ছেলেরা সব পড়ল ঢলে ঢলে রে… ॥
রফিক, শফিক, বরকত আরাে আবুল জব্বার
বুকেতে গুলি লাগিয়া পৃষ্ঠ হলাে পার
শহীদ হয়ে গেল তারা ঘটনাস্থলে চলে রে…. ॥

আরাে সতের জনের মত গুরুতর আহত
হাসপাতালে নেয়া হলে মৃত প্রায় সে তাে।
মেডিকেল কলেজে তখন মাইক লাগাইলাে।
৫৫

পুলিশের অত্যাচারের প্রতিবাদ করিলাে
গুলি চালানাে সংবাদ দাবানলের মত
শহরে ছড়াইয়া পড়ে দুঃখ বলব কত
অফিস আদালত আর সেক্রেটারিয়েট
বেতার কেন্দ্রের কর্মচারী দিকবিদিক ছুটে… ।।
শহরে সমস্ত লােক বিক্ষুব্ধ অস্থির
মেডিকেল হােস্টেলে সবাই হইল হাজির
শহীদের রক্তে রঞ্জিত বস্ত্রখণ্ড নিয়া
উড়াইয়া দিল তখন পতাকা বানাইয়া
মাইক দিয়া শহীদানদের নাম ঠিকানা বলে
মুহুর্মুহু এই ঘােষণা অতিবেগে চলে… ॥

মানুষের মনে তখন মৃত্যুভয় নাই
জঘন্য এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশােধ চাই
বেলা-তিনটা দশ মিনিটের সময় আকস্মিক সাজে
একদল পুলিশ ঢােকে মেডিকেল কলেজে
পুলিশ ঢুকিয়া তখন মেডিকেল হােস্টেলে।
গুলি তখন করতে লইলাে আথালে পাথালে… ॥

বরকত, সালাম, শফিউদ্দিন শহীদ হইয়া গেল
আরাে একজন রিকসা চালক বুকের রক্ত দিল
নাম না জানা আরাে কত মানুষ মরে
সেই লাশ নিয়া পুলিশ স্প্রিট (স্পিরিট) দিয়া পুড়ে
ঐখানে আহত হয় ছিয়ানব্বই জনে
আরাে হাজারাে আহত লােক ছিল মেডিকেলে… ॥

একশত চুয়াল্লিশ ধারা ভঙ্গ হইয়া যায়
শহীদের রক্ত দিয়া ধুইয়া মুইছা দেয়
সমস্ত অফিস আদালত কল কারখানা
রেলগাড়ির চাকা বন্ধ বলতে পারে না
রেডিও যায় বন্ধ হইয়া রিকসা চলে না
মানুষের ঢল ছুটে সেদিন আসে মেডিকেলে
আকাশ পাতাল কাঁপে তাদের ক্রন্দনের রােলে… ॥
শেখ মুজিবর ফরিদপুরের জেলখানায় ছিলাে।
(তারে) ছাত্র আন্দোলনের চাপে ছাড়তে বাধ্য হলাে
৫৬

ফরিদপুর হইতে গােপালগঞ্জ নেয়
ছাব্বিশ ফেব্রুয়ারি ছাইড়া তারে দেয়
মুজিব-একুশের ঘটনা শুনে কান্দে জারে জার
ছাইড়া গেলি সােনার টুকরা ভাইয়েরা আমার
অসুস্থতার কারণে সে দেশের বাড়ি চলে
শহীদদের জন্যে কাইন্দা বুক ভাসায় জলে… ॥
ভবে নাইরে নাই রফিক সফিক নাই
আবুল জব্বার, সালাম, বরকত
মায়ের মুখ আর দেখে নাই… ॥
কিছুক্ষণ পর সালাউদ্দিন।
লাশ হইয়া আসিল ভাই
তার মাথার খুলি উইড়া গেছে
প্রাণ পাখি ভিতরে নাই …
হৃদয় বিদারক দৃশ্য বুঝানাে না যায়
জব্বার, রফিক, সফিউর রহমান নাইরে দুনিয়ায়
বুকের রক্ত দিয়া সালাম রাজপথ রাঙাইল তাই
(তবু) মৃত্যুর আগে বলেছে তারা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’…

শহীদ হইয়া গেছেন যারা
তাদের কখন মরণ নাই
তাদের রক্তের বদলেতে
রাষ্ট্রভাষা বাংলা পাই… ॥

শহীদগণের পিতা মাতা
কানছে সেদিন বুক ফাটাই
হালিম বলে এমন দৃশ্য
জীবনে আর দেখি নাই… ।।

আমার বাংলা ভাষার লাইগারে
আমি কেনাে শহীদ হইলাম না
বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা করতে যারা চায়
বুকের রক্ত দান করিয়া শহীদ হইয়া যায় রে… ॥

বরকত, ছালাম, জব্বার, রফিক ভাষা চেয়েছিল
গুলির সামনে বুক পাতিয়া চির বিদায় নিল
দিয়া গেল পথের সন্ধান প্রতি ঘরে ঘরে
(এখন) বাংলা ভাষা রাষ্ট্রভাষা তাদের রক্তের জোরে রে… ॥
৫৭

পাইলাম ভাষা মিটল আশা ঘুচলাে মনের ধান্দা।
চির সত্য সবার প্রাণে, শহীদ ভাইরা জিন্দা রে…।
[আবদুল হালিম বয়াতি : জীবন ও সঙ্গীত]
একুশের রক্তাক্ত স্মৃতি নিয়ে ২২শে ফেব্রুয়ারি ঢাকার রাজপথ যখন ছাত্র-জনতার প্রতিবাদী উচ্চারণ ও উত্তাপ মিছিলে উত্তাপ ছড়াচ্ছিল তখন মিছিল থেকে একটি তাৎপর্যপূর্ণ স্লোগান উচ্চারিত হয় “শহীদ স্মৃতি অমর হােক” । এই শহীদ স্মৃতিকে অমর করে রাখতেই মেডিকেল কলেজের কয়েকজন ছাত্র একটি ছােটখাটো শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা করেন । আকারে ছােট হলেও এই শহীদ মিনারের প্রতীকী গুরুত্ব ছিল অপরিসীম । কালক্রমে এই প্রতীক বাঙালির তীর্থস্থানে পরিণত হয়।
২৩শে ফেব্রুয়ারি গােলাম মাওলাসহ আন্দোলনে সক্রিয় নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাত্র মেডিকেল কলেজ হােস্টেল প্রাঙ্গণে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির সিদ্ধান্ত নেন। যৌথ চিন্তা ও সম্মিলিত শ্রমের ফসল ছিল এই স্মৃতিস্তম্ভ। মেডিকেল ব্যারাকের ছাত্ররাই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছিলেন ।।
শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির নকশা আঁকার দায়িত্ব পালন করেন বদরুল আলম । তাঁর সঙ্গে যােগ দেন সাঈদ হায়দার। কলেজ সম্প্রসারণ কাজের জন্য কলেজ প্রাঙ্গণে জমা করা ইট-বালু ব্যবহারে কোনাে সমস্যা ছিল না। কিন্তু গুদামে সিমেন্ট ছিল তালাবদ্ধ। সাব কন্ট্রাক্টর পিয়ারু সরদার নির্দ্বিধায় গুদামের চাবি ছাত্রদের দিয়ে দেন। একুশে এবং ছাত্রসমাজ জনমনে কতটা স্থান করে নিয়েছিল তা এ ঘটনা থেকে বুঝা যায় ।
১২ নম্বর শেডের সামনে এবং হােস্টেলের হাঁটাচলার রাস্তার পাশে স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির স্থান ঠিক হয়। স্থানটি বরকতের গুলিবিদ্ধ হওয়ার স্থান থেকে সামান্য দূরে। স্মৃতিস্তম্ভের স্থাপত্যকর্মের দায়িত্বে ছিলেন কলেজ ইউনিয়নের তৎকালীন জিএস। শরফুদ্দিন আহমদ। যিনি ইঞ্জিনিয়ার নামে সুপরিচিত ছিলেন।
কারফিউর রাত। সাহসী ছাত্ররা খাওয়া-দাওয়া শেষে রাত ১০টায় কাজ শুরু করেন। হােস্টেলের বয় বাবুর্চিরাও উপস্থিত সকলের সঙ্গে এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরিতে হাত লাগিয়েছিলেন । ছাত্ররা জোগাল-শ্রমিকের কাজ করে । হাসপাতালের স্ট্রেচারে বালুসিমেন্ট বহন করে ছাত্ররা।
খুব ভােরে কাজ শেষ হয়ে যায়। স্মৃতিস্তম্ভের স্থাপত্য ছিল সাড়ে দশ ফুট উঁচু। ছয় ফুট চওড়া। নামফলকে লেখা ‘শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ’ ফলকের আঁকিয়ে বদরুল আলম । পলেস্তারার কাজ শেষ হলে কালাে কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হয় স্থাপত্যটি। ছােট ছােট খুঁটি পুঁতে দড়ি বেঁধে ঘিরে দেওয়ার পর দড়িতে ঝুলিয়ে দেওয়া হয় লাল অক্ষরে লেখা পােস্টার। তাতে লেখা ছিল রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’ শহীদ স্মৃতি অমর হােক’ । সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর’, ‘রাষ্ট্রভাষা তহবিলে মুক্তহস্তে দান করুন।
২৪শে ফেব্রুয়ারি রােববার। সাপ্তাহিক ছুটির দিন । স্মৃতিস্তম্ভের কারিগররা ভাবতেই পারেননি যে, এটি দেখতে নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ সবাই গভীর আবেগ নিয়ে
৫৮

ছুটে আসবে । বাস্তবে তাই ঘটেছিল । এই ঐতিহাসিক স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে দলে দলে মানুষ আসতে শুরু করে। স্মৃতিস্তম্ভের বেদিতলে ফুল, টাকা-পয়সা, এমনকি সােনার গহনা দিয়েও মানুষ তাদের হৃদয় উজাড় করা শ্রদ্ধা-ভালােবাসার প্রকাশ করে । দর্শনার্থীদের মধ্যে অধিকাংশই পুরান ঢাকার বাসিন্দা। এভাবে পাকিস্তানি শাসক দলের প্রতি ঘৃণা-বিদ্বেষ ও ক্ষোভ জানিয়ে তারা অতীতের ভুল শােধরাবার চেষ্টা করে।
শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ আন্দোলনে নতুন মাত্রা যােগ করে । জনমনে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি ঘৃণা, ক্রোধ ও ক্ষোভ ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে থাকে । ২৫শে ফেব্রুয়ারি দৈনিক আজাদ স্মৃতিস্তম্ভ তৈরির খবর এভাবে ছাপে, “শহীদ বীরের স্মৃতিতে” । রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের যেসব শহীদ বীর গত ২১ ফেব্রুয়ারি পুলিশের নিষ্ঠুর গুলিতে বুকের রক্তে ঢাকার মাটি রাঙাইয়া দিয়েছেন তাহদিগকে স্মরণীয় করিয়া রাখিবার উদ্দেশ্যে ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রগণ হােস্টেল প্রাঙ্গণে নিজ হস্তে এক রাত্রির মধ্যে একটি স্মৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করিয়াছেন।
মেডিকেল কলেজের দুই একজন ছাত্রের উদ্যোগে তড়িঘড়ি শহীদ শফিউর রহমানের বাবা মাহবুবুর রহমানকে দিয়ে স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করানাে হয়। পরে সর্বজনীন সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আইন পরিষদ থেকে ইস্তফা দেওয়া আবুল কালাম শামসুদ্দিন ২৬শে ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ উদ্বোধন করেন। এই শহীদ স্মৃতিস্তম্ভ হয়ে যায় সর্বত্র আলােচনার বিষয় এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ আন্দোলনের নতুন প্রেরণা।
শহীদ মিনারের প্রতি জনগণের এই স্বতঃস্ফূর্ত শ্রদ্ধা, ভালােবাসা দেখে পূর্ববাংলার গোড়া ধর্মান্ধ, প্রতিক্রিয়াশীল শাসকচক্র ভবিষ্যৎ আন্দোলনের অনুপ্রেরণার উৎস ও প্রতীক এই স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নেয় । ঠিক আড়াই দিনের মাথায় অর্থাৎ ২৫শে ফেব্রুয়ারি শেষ বিকেলে স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলে দেয় সশস্ত্র পুলিশ। স্মৃতিস্তম্ভটি ভেঙে টুকরাে টুকরাে করে ট্রাকে তুলে নিয়ে যায় পুলিশ। মাটি খুঁড়ে শেষ ইটটিও তুলে নেয় তারা। কিন্তু নুরুল আমিন সরকার বুঝতে পারেনি যে ইটের স্মৃতিস্তম্ভ ভেঙে ফেলা গেলেও একুশের প্রতীক, বাঙালির জাতিসত্তার প্রতীক এ স্মৃতিস্তম্ভ মানুষের মন থেকে কখনাে মুছে ফেলা যাবে না । শহীদ মিনার রূপান্তরিত হয়ে স্মৃতির মিনারে পরিণত হয়। এই প্রথম শহীদ স্মারক স্থাপত্যটি মানুষের মুখে মুখে শহীদ মিনার নামে পরিচিত পেয়ে যায়। সরকারি পরিকল্পনায় নতুন করে এই শহীদ মিনার তৈরি হয়। একাত্তরে পাকিস্তানি বর্বর হানাদার বাহিনীও একই কায়দায় শহীদ মিনারকে ধ্বংস করেছিল। কিন্তু মানুষের হৃদয়ে কালজয়ী হয়ে রয়েছে এই শহীদ মিনার, একুশের সংগ্রামী চেতনার প্রতীক শহীদ মিনার বাঙালি জাতীয় চেতরা ও জাতিসত্তার প্রতীক হয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে ।
আড়াইদিন স্থায়ী প্রথম শহীদ মিনার পথ তৈরি করেছিল জাতীয় পর্যায়ে শহীদ মিনার তৈরির পরিকল্পনা। মেডিকেল ছাত্রদের স্বতঃস্ফুর্ত প্রেরণা ও উদ্দীপনায় এই স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি হওয়ার ফলে একুশের শহীদদের স্মরণে কালজয়ী শহীদ মিনার তৈরির পথ প্রশস্ত করে দেয়।
৫৯

শহীদ মিনার বাঙালির রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের আদর্শিক কেন্দ্রবিন্দু । পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আক্রমণে শহীদ মিনারের ধ্বংসস্তুপেই স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম শহীদ দিবস উদযাপিত হয়। এরপর স্বাধীন বাংলাদেশেও শহীদ মিনারের কাজ শেষ হয় জোড়াতালি দিয়ে (১৯৭৩)। শিল্পী হামিদুর রহমানের নকশা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। প্রস্তাবিত পরিকল্পনাটি ছিল বিশাল নান্দনিক ও আকর্ষণীয়। সঙ্গে ছিল নভেরা আহমদের ভাস্কর্যের সংযােজন। প্রথম মনােনীত মূল নকশা-স্থাপত্য এখনাে বাস্তবায়নের অপেক্ষায়। বর্তমান শহীদ মিনার নির্বাক, কথা বলে না । হামিদুর রহমানের মূল পরিকল্পনা মডেলও নকশামাফিক শহীদ মিনার নতুন করে নান্দনিক স্থাপত্যে গড়ে তােলা হলে বর্তমান প্রজন্ম ও অনাগত কালের মানুষের নিকট শহীদ মিনার জীবন্ত হয়ে পুনরায় মাথা তুলে দাঁড়াবে। ধর্মীয় গোঁড়ামি, সাম্প্রদায়িকতা গণতন্ত্রের অতন্ত্র প্রহরী হয়ে শহীদ মিনার মুক্ত ও মানবিক মূল্যবােধে উজ্জীবিত বাঙালির আত্মপরিচয়ের প্রতীক হয়ে দেশ-বিদেশের মানুষের নিকট চিরদিন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকবে।
প্রথম শহীদ মিনারটি ২৪শে ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ শফিউর রহমানের পিতা এবং ২৬ শে ফেব্রুয়ারি সকালে আবুল কালাম শামসুদ্দীন উদ্বোধন করেছিলেন । প্রখ্যাত ভাষাবিদ ও শিক্ষাবিদ, ভাষাসংগ্রামী অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৬ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই মিনার হয়ে উঠেছিল বাঙালির তীর্থ কেন্দ্র। জাতি, ধর্ম পেশা শ্রেণী নির্বিশেষে বৃদ্ধ-বৃদ্ধা, তরুণ-তরুণী, কিশাের-কিশােরীর স্রোত ২৪ ফেব্রুয়ারির সকাল থেকে আসছিল শহীদ মিনারে । মাতৃভাষার দাবিতে যারা প্রাণ দিয়েছেন তাদের জন্য আবেগে, অনুভূতিতে, স্নেহে ঐসব মানুষের হৃদয় মন ছিল পরিপূর্ণ। তারা শহীদের স্মৃতির উদ্দেশে পুস্পস্তবক দিচ্ছিলেন শহীদ মিনারের ভিত্তিমূলে । ফুলে ফুলে শহীদ মিনার বারবার ঢেকে যেতে সময় লাগছিল না। কিন্তু প্রতিক্রিয়ার কারাে হাত এটা মেনে নিতে পারেনি। তাই ছাব্বিশে ফেব্রুয়ারি দুপুর ও অপরাহের মধ্যে নাজিমউদ্দিন-নূরুল-আমীন-মুসলিমলীগ সরকারের সশস্ত্র বাহিনী বাংলাদেশে বাঙালির প্রথম শহীদ মিনারটি আক্ষরিক অর্থে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল । কিন্তু তারা জানতাে না যে, ইতিমধ্যেই বাঙালির হৃদয়ে যে স্মৃতির মিনার গাঁথা হয়েছিল তা নিশ্চিহ্ন করার শক্তি কোনাে শাসকের নেই।
১৯৫৩ থেকে ১৯৬৩ পর্যন্ত প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামে বাঙালি শহীদ মিনারে শপথ নিয়েছে। বাঙালির জাতিসত্তা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের ধারাবাহিক আন্দোলনের অন্তহীন প্রেরণার উৎস এই শহীদ মিনার। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের ঐতিহাসিক বিজয় একুশে ফেব্রুয়ারিকে নতুন তাৎপর্য দেয় । একুশে ফেব্রুয়ারির প্রতীক একুশ দফায় শহীদ মিনার নির্মাণ, একুশে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস ঘােষণা, বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা ঘােষণা। নূরুল আমিনের সরকারি বাসভবন বর্ধমান হাউস’কে বাংলা একাডেমী করার শপথ নিয়ে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে।
১৯৫৬ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি আবু হােসেন সরকারের মুখ্যমন্ত্রিত্বের আমলে বর্তমান শহীদ মিনারের স্থান নির্বাচন এবং ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয় । আতাউর রহমান
৬০

খানের মুখ্য মন্ত্রিত্বের আমলে শহীদ মিনারের পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয় তদানীন্তন চিফ ইঞ্জিনিয়ার এ জব্বারের ওপর। ঐ বছর শিল্পী হামিদুর রহমান ইংল্যাণ্ডে শিল্পকলা বিষয়ে উচ্চশিক্ষা সমাপন করে দেশে আসেন। প্রধান প্রকৌশলী জব্বার এবং শিল্পী জয়নুল আবেদীনের অনুরােধে তিনি শহীদ মিনারের একটি মডেল ও বায়ান্নটি নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেন। তার পরিকল্পনা অনুসারে ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাসে শহীদ মিনারের নির্মাণ কাজ শুরু হয়। ১৯৫৮ সালের একুশে ফেব্রুয়ারির মধ্যে শহীদ মিনারের ভিত, মঞ্চ এবং তিনটি স্তম্ভ নির্মাণের কাজ শেষ হয়। এর মধ্যে শিল্পী হামিদুর রহমান ভাষা আন্দোলনের ওপর হাজার বর্গফুটের একটি মুরাল’ চিত্রের দুই স্তরের কাজ শহীদ মিনারের নিচের ঘরে সমাপ্ত করেন। একাত্তর সালের মার্চ মাসের শেষের দিকে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী শহীদ মিনার ধ্বংস করার সময় ঐ মূল্যবান স্যুরালটিও ধ্বংস করে দেয় ।
১৯৫৭ সালে শিল্পী হামিদুর রহমান শহীদ মিনার নির্মাণের যে পরিকল্পনা করেছিলেন সে সম্পর্কে একাত্তর সালে দৈনিক পাকিস্তান পত্রিকার শহীদ দিবস সংখ্যায় মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর কর্তক শিল্পীর সাক্ষাৎকার ভিত্তিক একটি সচিত্র প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছিল ।… সেখান থেকে উদ্ধৃত করছি
“শিল্পী জানেন, বাসায় থেকে তার পক্ষে মিনারের কাজ করা সম্ভব হবে না। ঠিক হলাে মিনারের পাশেই একটা ছােট জায়গায় তিনি থাকবেন । দুটো বেড়ার ঘর বানানাে হলাে। একটা কাজ-কর্ম করার কারখানা, আরেক খুপড়ীতে শিল্পী থাকতেন। শিল্পীর ইচ্ছে ছিলাে শহীদ মিনারের কাজ করতে যেন চব্বিশ ঘণ্টা এই পরিবেশে থাকা যায়।…এখন আমরা মিনারের চারটি স্তম্ভ দেখছি। প্রত্যেকটি স্ত ম্ভের ভিতরে লােহার শিক দেয়া রয়েছে। এটা শিল্পীর মূল পরিকল্পনায় ছিল না। পরিকল্পনায় ছিল এই স্তম্ভগুলাের মধ্যে অজস্র চোখের নকশা থাকবে। লেবু হলুদ আর গাঢ় নীল রং-এর স্টেইন্ট গ্লাস-এ তৈরি হবে চোখগুলাে… মিনারের সামনে প্রশস্ত জায়গাতে থাকার কথা ছিলাে মার্বেল পাথর। এই পাথরের স্টেইন্ট গ্লাসের বিভিন্ন রঙিন চোখের আলােকিত প্রতিফলন পড়লে সূর্যের সাতরঙা বর্ণালী মেঝেতে সৃষ্টি হতাে। পুরাে মিনারটির সামনে একটি রেলিং থাকার কথা ছিল। রেলিংটা আগাগােড়া বর্ণমালা দিয়ে তৈরি হবে। একুশে ফেব্রুয়ারি তােমায় কি ভুলিতে পারি—এই কথাটা বারবার রেলিং-এ লেখা থাকার কথা ছিল… যে প্রশস্ত জায়গাটি মিনারের সামনে রয়েছে সেখানে বেশকিছু রক্তমাখা পায়ের ছাপ শহীদের স্মরণে আর কিছু বিশাল কালাে পায়ের ছাপ দানবের প্রতীক হিসেবে থাকার কথা ছিল। …আর এই মিনারের পাশেই থাকবে একটা বাংলা সাহিত্যের পাঠাগার …সেই পাঠাগারের দেয়ালে তৈলচিত্র থাকার পরিকল্পনা ছিল। ..মিনারের সামনে …কথা ছিল সুন্দর এক ঝর্ণা।…অনবরত অশ্রুর মতাে ঝরবে। সেইপানি আবার জমা থাকবে । মনে হবে যেন মহাকাল থেকে ঝরছে এই অশ্রুধারা। এই ঝর্ণার পরপরই বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটির প্রায় পাঁচিল ঘেঁষে আবার মিনারের মতাে একটি উঁচু বেদী উঠে যাবার কথা। যাতে দুই দিকে ঢেউ-এর প্রতিক্রিয়া থাকে এবং একটা বিশাল এলাকা জুড়ে শহীদ মিনারের অস্তিত্বটা টের
৬১

পাওয়া যায় ।…মিনার গাত্রে স্টেইন্ট গ্লাসের চোখ থেকে মেঝের মার্বেল পাথরে যে বর্ণালির ছটা পড়বে তাতে রঙের একটা কাল্পনিক ঘড়ি খাড়া করা যেতে পারে । যেমন: আটটা বাজলে বেগুনী রঙ। বারােটাতে নীল। পাঁচটায় কমলা রঙ। এমনি । দেখতে দেখতে ঘড়িটার রঙ পরিচিত হয়ে যেতাে ।… আর একটা ঘড়ি থাকার কথা ছিল উঁচু টাওয়ার ঘড়ি … সময়গুলাে বাংলা সংখ্যায় লেখা হতাে। শহরের একটা প্রধান সময় দেখার কেন্দ্র … মিনারের ঘড়ি একটা দৈনন্দিন অভ্যাসে পরিণত হয়ে যেতাে। …এক হাজার স্কোয়ার ফুটের একটি ম্যুরাল পেইন্টিং যেটা মিনারের ভিতরের কুঠুরীতে থাকার কথা… যদি এই পেইন্টিংটা হতাে তাহলে এটা পৃথিবীর দীর্ঘতম পেইন্টিংগুলাের অন্যতম হতাে। …পেইন্টিংটার দুটো স্তরের কাজ মাত্র বাকী ছিল ।”..
পরিকল্পনা অনুযায়ী শিল্পীর তত্ত্বাবধানে শহীদ মিনারের কাজ চলছিল। ১৯৫৭ সালের মার্চ মাসে আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে শিল্পী হামিদুর রহমানকে শহীদ মিনার প্রাঙ্গণ থেকে বের করে দেয়া হয়। অক্টোবর মাসে সামরিক শাসন প্রবর্তিত হলে শহীদ মিনারের কাজ বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৫৮ থেকে ১৯৬২ সাল পর্যন্ত শহীদ মিনারের জন্য নির্মিত মঞ্চ এবং অসম্পূর্ণ কয়েকটি স্তম্ভই ছিল এ দেশের শহীদ মিনার। এখানেই মানুষ ফুল দিয়ে ভাষা শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করেছে।
১৯৬২ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তানের তদানিন্তন গভর্নর লে. জে. আজম খান শহীদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ শেষ করার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. মাহমুদ হােসেনকে সভাপতি করে চৌদ্দ সদস্যবিশিষ্ট একটি কমটি করেন । কমিটি শিল্পী হামিদুর রহমানের সাতান্ন সালের মডেলভিত্তিক সহজ ও সংক্ষিপ্ত আকারে শহীদ মিনারের অসমাপ্ত কাজ শেষ করা হয়। ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এই শহীদ মিনার দেশের প্রতিটি গণআন্দোলন ও সংগ্রামের শপথ গ্রহণের কেন্দ্র ও অনুপ্রেরণার উৎস। ১৯৬৬ সালের ঐতিহাসিক ছয়দফা আন্দোলন, ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও ১৯৭১ সালের অসহযােগ আন্দোলনে এই শহীদ মিনার ছিল বাঙালির স্বাধিকার ও গণতান্ত্রিক আন্দোলনের প্রতীক। শহীদ মিনারে শপথ গ্রহণের মাধ্যমে বাঙালি কঠিন থেকে কঠিনতর আন্দোলনের দিকে অগ্রসর হয়। বাঙালির স্বাধীনতা ও মুক্তি আন্দোলনের প্রতীক হিসেবে শহীদ মিনার বাঙালিকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রেরণা ও শক্তি দিয়েছে।
২৬শে মার্চ পাকিস্তান হানাদার বাহিনী বাঙালির তীর্থস্থান ও স্বাধীনতা, জাতিসত্তা ও সংস্কৃতির প্রতীক শহীদ মিনারে ভারী গােলাবর্ষণ করে মিনারের স্তম্ভগুলাে ধ্বংস করে দেয়। ১৬ই ডিসেম্বর রমনা রেসকোর্স ময়দানে বর্বর হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের মুহূর্তে শহীদ মিনারের ধ্বংসস্তুপ থেকে পুনরায় জেগে উঠে শহীদ মিনার। মুক্তিযােদ্ধা ও লাখাে বাঙালি শহীদ মিনারে গিয়ে ভাষা শহীদদের প্রতি তাদের গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করে। ভাষা থেকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ভাষা শহীদদের আত্মত্যাগ বাঙালিকে নতুন রাষ্ট্র পরিচালনার কাজে পুনরায় অনুপ্রাণিত ও উজ্জীবিত
৬২

করে। শহীদ মিনারকে মূল পরিকল্পনা অনুযায়ী নির্মাণের ক্ষেত্রে স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকারের ব্যর্থতা ও অবহেলা অত্যন্ত দুঃখজনক। শিল্পী হামিদুর রহমানের মূল পরিকল্পনা, মডেল ও নকশা অনুযায়ী শহীদ মিনারকে নান্দনিক স্থাপত্যে গড়ে তােলা হলে বাঙালি জাতির জাতিসত্তার প্রতীক হিসেবে এই মিনার অনাগত কালে বাঙালির শক্তি, সাহস ও প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।
তেষট্টি সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবসে সদ্য সমাপ্ত শহীদ মিনারের উদ্বোধন করেন শহীদ আবুল বরকতের বাহাত্তর বৎসর বয়স্ক মাতা হাসিনা বেগম। তেষট্টি থেকে একাত্তর- নয় বৎসর ঐ শহীদ মিনারই ছিল এ দেশের প্রতিটি আন্দোলন ও সংগ্রামের শপথ গ্রহণের কেন্দ্র, অনুপ্রেরণার উৎস। ছেষট্টি সালের ছয়দফাভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলন, ঊনসত্তরের আগরতলা মামলা-ভিত্তিক মহান গণঅভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন ও একাত্তরের অসহযােগ আন্দোলনে এ শহীদ মিনার বাঙালিকে দিয়েছে কঠিন থেকে কঠিনতর সংগ্রামের প্রেরণা। এই শহীদ মিনারেই সংগ্রামী বাঙালির উত্তরণ ঘটেছে স্বাধিকার আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রামে। পাকিস্ত নি সামরিক বাহিনী একাত্তরের পঁচিশে মার্চ বাংলাদেশে গণহত্যা-যুদ্ধ শুরু করে ছাব্বিশে মার্চ ভারী গােলাবর্ষণ করে এই শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলাে ধ্বংস করে দেয়। ১৯৭১ সালের ২৫ শে মার্চ রাত্রি থেকে ১৬ই ডিসম্বের অপরাহ সময়কাল অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে শহীদ মিনার ছিল একটি ধ্বংসস্তুপ, যা ছিল পাকিস্তান বাহিনীর বর্বরতার প্রতীক। ১৬ই ডিসেম্বর রমনা মাঠে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের মুহূর্তে শহীদ মিনারের ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠে স্মৃতির মিনার, দলে দলে রণাঙ্গন প্রত্যাগত মুক্তিযােদ্ধা শহীদ মিনারে এসে শ্রদ্ধা জানায় ।।
বাহাত্তর সালের একুশে ফেব্রুয়ারিতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের নাগরিকরা তাদের প্রথম শহীদ দিবস পালন করেছিলাে ভগ্ন শহীদ মিনারে। শিল্পী হামিদুর রহমান বিশিষ্ট স্থপতি এম এস জাফরের সঙ্গে মিলিতভাবে শহীদ মিনার পুনরায় নির্মাণের নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেন । নকশাটি হামিদুর রহমানের সাতান্ন সালের শহীদ মিনারের মূল পরিকল্পনাভিত্তিক ছিল ।
শহীদ মিনারের ব্যাখ্যা ও তাৎপর্য নিম্নরূপ : মিনার এবং তার স্তম্ভগুলি মাতৃভূমি মাতৃভাষা তথা মাতা এবং তার শহীদ সন্তানদের প্রতীক। মধ্যখানের স্তম্ভটি মায়ের এবং পাশের দুটি করে চারটি স্তম্ভ সন্তানের প্রতীক। সাতান্ন থেকে একাত্তর সাল চৌদ্দটি বছর ঐ চেতনাই ছিলাে শহীদ মিনারের রূপকল্প; যা হামিদুর রহমানের সাতান্ন সালের পরিকল্পনায় প্রথম প্রতিফলিত হয়েছিল, যা আংশিকভাবে হলেও তেষট্টি সালে সমাপ্ত শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিল। বাহাত্তর সালে নতুনভাবে নকশা করতে গিয়ে হামিদুর রহমান সে- চেতনাকে অক্ষুন্ন রেখেছিলেন। মাতা এবং সন্তানের প্রতীক, স্তম্ভ নিয়ে গড়ে ওঠা শহীদ মিনার এ দেশের মানুষের চেতনায় স্থায়ী আসন নিয়েছিল । হামিদুর রহমানের ছাপ্পান্ন সালের পরিকল্পনাতে শহীদ মিনারের স্তম্ভগুলি মাতা ও সন্ত বনের প্রতীক, অর্ধবৃত্তাকারে মাতা তার শহীদ সন্তানদের নিয়ে দণ্ডায়মান, যা অনন্তকাল
৬৩

ধরে সন্তানদের রক্ষা করছেন, যারা তার মর্যাদা রক্ষার জন্যে নিজেদের বিসর্জন দিয়েছে, আর সেইজন্যে গৌরবান্বিত মা তাদের দোয়া করছেন, সন্তানদের আত্মত্যাগের মহিমায় মা ঝুঁকে পড়েছেন একটু স্নেহে আর চারটি সন্তানের মধ্য দিয়ে তিনি তার লক্ষ কোটি সন্তানকে দেখতে পাচ্ছেন। বাহাত্তর সালের পরিকল্পনাতেও মায়ের দৃষ্টির প্রতীক স্তম্ভের চোখের নকশা ছিল । স্তম্ভগুলি বিশুদ্ধ শ্বেত মর্মরে চৌদ্দ ফুট উচ্চ মঞ্চের উপর স্থাপিত হবে, সিঁড়ি, রেলিং সবই সাদা মার্বেল পাথরের করা হবে, শ্বেতমর্মরে সম্পন্ন সমগ্র মিনারটিতে একটি স্বর্গীয় পবিত্রতা ফুটে উঠবে । স্তম্ভগুলির পাদদেশে পুষ্পস্তবক দেবার বিশেষ ব্যবস্থা এবং দু’পাশের বেষ্টনীতে শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবিদের অবিস্মরণীয় উদ্ধৃতি লৌহ লিপিতে উত্তীর্ণ হবে, বিশেষ আলাে-ব্যবস্থায় রাতেও মিনার এবং স্তবক পরিদৃশ্যমান থাকবে । মিনারের প্রবেশ পথে থাকবে দুটি ভাস্কর্য এবং দুটি সিঁড়ি ঘরে ছােট পদ্মপুকুর, ভাষ্কর্য দুটি থেকে অবিরাম পানি প্রবাহিত হবে ঐ পুকুর দুটিতে মিনার ছাড়াও পরিকল্পনায় সংশ্লিষ্ট ছিল ঘড়িঘর, পাঠাগারসহ জাদুঘর, ভাস্কর্যসহ মিনারের চুতর্দিকে প্রাকৃতিক পরিবেশ সৃজন মিলনায়তন, শিল্পকলা ইত্যাদি। মােটকথা শিল্পী হামিদুর রহমান এবং স্থপতি জাফর সাতান্ন সালের শহীদ মিনারের মূল পরিকল্পনাকে অক্ষুন্ন রেখে বাহাত্তর সালে নতুন করে বাংলাদেশ সরকারের কাছে শহীদ মিনারের পরিকল্পনা পেশ করেন। দেশের খ্যাতনামা আরাে অনেক স্থপতি শহীদ মিনারের জন্য তাদের নকশা ও পরিকল্পনা পেশ করেছিলেন।
বিশ শতকের শেষে শহীদ মিনারের যে পরিবেশ তা কাঙ্খিত নয়, ২০ শে ফেব্রুয়ারি রাত ১২টা থেকে ২১ শে ফেব্রুয়ারি দুপুর ১২টা পর্যন্ত শহীদ দিবসের আনুষ্ঠানিকতার জন্যে শহীদ মিনারে যে পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় বছরের বাকি ৩৬৩ দিন তা রক্ষিত থাকে না। ফলে বছরের অধিকাংশ দিন শহীদ মিনারের পবিত্রতা ও ভাবগাম্ভীর্য লংঘিত হয়।।
ভাষা আন্দোলনের প্রত্যক্ষ ফসল বাংলা একাডেমী দেরীতে হলেও ভাষা শহীদদের স্মৃতি সংরক্ষণ, ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাসের উপাদান ও দলিল সংরক্ষণের জন্য ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কাজ শুরু করেছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০১০ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি বর্ধমান হাউজের দোতলায় ভাষা আন্দোলন জাদুঘর উদ্বোধন করেছেন। দেশের বরেণ্য ফোকলােরবিদ, শিক্ষাবিদ ও গবেষক বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের দিক নির্দেশনায় ও পরামর্শক্রমে জাদুঘর বিশেষজ্ঞ ড. ফিরােজ মাহমুদের তত্ত্বাবধানে এই জাদুঘর অচিরেই পূর্ণাঙ্গরূপ লাভ করবে বলে আমরা আশা করি। নতুন প্রজন্মের নিকট ভাষা আন্দোলনের ধারাবাহিক ইতিহাস তুলে ধরার ক্ষেত্রে এই জাদুঘর যুগান্তকারী ভূমিকা রাখবে।
ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে ইতােমধ্যে ভাষা শহীদের স্মৃতি নিদর্শন সংগ্রহ করে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাদের সৌভাগ্য যে, শহীদ শফিউর রহমানের স্ত্রী আকিলা খাতুনের সঙ্গে সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে শফিউর রহমান সম্পর্কে অনেক
৬৪

অজানা তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হয়েছি। তার ব্যবহৃত কোট, চশমা, মেট্রিক সার্টিফিকেটের মূল কপি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রদত্ত একুশে পদকের সার্টিফিকেট ইত্যাদি সংগ্রহ করে জাদুঘরে সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে । নববধূ আকিলা খাতুন এবং নববিবাহিত শফিউর রহমানের একটি দুর্লভ ছবি আমরা সংগ্রহ করেছি। আকিলা খাতুন এই ছবিটি দীর্ঘকাল সযত্নে সংরক্ষণ করেছেন এবং বাংলা একাডেমী ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে প্রদর্শনের জন্য দিয়েছেন । শফিউর রহমান একজন সৌখিন ব্যক্তি ছিলেন । মাথায় হ্যাট পরতে দারুণ সখ ছিল তাঁর । বিচিত্র ধরনের হ্যাট তিনি ক্রয় করতেন। পাজামা, পাঞ্জাবি, শেরওয়ানি, কোট এবং টাই পরতেও তিনি ভীষণ পছন্দ করতেন । মাথায় হ্যাট পরিহিত তার একটি ছবিও ভাষা আন্দোলন জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে।
বাঙালির প্রাণপ্রিয় প্রতিষ্ঠান বাংলা একাডেমীতে স্থায়ীভাবে ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠার কথা শুনে তিনি ভীষণ খুশী। তিনি বলেন, আমার স্বামীর স্মৃতি নিদর্শনগুলাে বাংলা একাডেমীর জাদুঘরে দিতে পারায় আমি আনন্দিত । জাদুঘরে এগুলাে সংরক্ষণের মাধ্যমে শহীদ শফিউর রহমানের প্রতি যথাযথ মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শিত হবে ।
সব ভাষা শহীদদের জন্য তাদের নিজস্ব এলাকায় জন্মস্থানে অথবা অন্য কোথাও তাদের নামে পাঠাগার, জাদুঘর স্থাপন করা হলেও ভাষাশহীদ শফিউর রহমানের নামে এখন পর্যন্ত তাঁর অমর স্মৃতিকে ধরে রাখার জন্য কোনাে পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। তার একমাত্র ছেলে শফিকুর রহমান, মেয়ে শাহনাজ এবং স্ত্রী আকিলা খাতুন বর্তমানে উত্তরায় স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। শহীদ শফিউর রহমানের নামে একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠার দাবি করছেন তারা বর্তমান গণতান্ত্রিক এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের নিকট।
উত্তরা ১৩ নং সেক্টরে মাঠের মাঝখানে কিছু জায়গা আছে। ১৩ নং সেক্টরের কল্যাণ সমিতির তদানিন্তন সভাপতি উদ্যোগ নিয়েছিলেন পাঠাগার প্রতিষ্ঠায় । কিন্তু বাস্তবায়িত হয়নি। পাঠাগার প্রতিষ্ঠার জন্য স্থানীয় সরকার বিভাগের অনুমােদন ও অর্থ বরাদ্দ রয়েছে বলে তারা জানান। শহীদ শফিউরের নামে উত্তরায় একটি পাঠাগার প্রতিষ্ঠিত হলে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম অনেক কিছু জানতে পারবে এবং সরকারের প্রতিশ্রুতিও বাস্তবায়িত হবে ।
ভাষা আন্দোলন আকস্মিক বা বিচ্ছিন্ন কোনাে ঘটনা নয়। এ আন্দোলন একটি অবিচ্ছিন্ন প্রক্রিয়ার ধারাবাহিকতার প্রকাশ। এ প্রক্রিয়ায় ভাষা-চেতনা এবং পরবর্তী পর্যায়ে বাঙালি জাতীয়তাবােধের তাৎপর্যপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে । ভাষাচেতনা ও জাতীয়তাবােধ ক্রমশ বিকশিত হয়ে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ’ নামক স্বাধীন ভাষিক রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছে । ভাষা থেকে স্বাধীন একটি ভূখণ্ড এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হয় ।
৬৫

ভাষা আন্দোলন থেকেই বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ । বাংলা ভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠার জন্য ভাষা আন্দোলনের শহীদদের আত্মত্যাগ তাই এত গুরুত্বপূর্ণ । ভাষা আন্দোলন এদেশের প্রথম গণতান্ত্রিক আন্দোলন। যা আমাদের জাতীয় সত্তা নির্মাণ এবং জাতীয় আন্দোলনের ধারাকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছে। প্রকৃতপক্ষে ভাষা আন্দোলনের ঘটনাবলী আমাদের জাতীয় ইতিহাসে বহুমাত্রিক উপাদান যােগ করেছে। পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মাতৃভাষা বাংলার অধিকার আদায় করার জন্য শহীদরা অকাতরে নিজেদের জীবন উৎসর্গ করে বাঙালির জাতিসত্তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালির আত্মপরিচয় লাভের দিন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে সেদিন ঢাকার রাজপথ ছাত্র, শ্রমিক, কৃষকের রক্তে রঞ্জিত হয়, এ দাবির সঙ্গে যুক্ত হয় গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক মূল্যবােধ । যার উপর ভিত্তি করে বাঙালির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার আন্দোলন ধাপে ধাপে মুক্তিযুদ্ধের দিকে এগিয়ে যায় । সৃষ্টি হয় স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ।
৬৬

তথ্যনির্দেশ
১. ভাষা আন্দোলন ইতিহাস ও তাৎপর্য, আবদুল মতিন ও আহমদ রফিক, সাহিত্য প্রকাশ,
তৃতীয় সংস্করণ, ফেব্রুয়ারি ২০০৫
২. ভাষা আন্দোলনের পঞ্চাশ বছর, আহমদ রফিক ও বিশ্বজিৎ ঘােষ, প্রকাশক : মাওলা
ব্রাদার্স, ফেব্রুয়ারি ২০০৩
৩. সাক্ষাৎকার : আকিলা খাতুন, ভাষা শহীদ শফিউর রহমানের স্ত্রী।
৬৭