This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
মতিউর রহমান নিজামী আলবদর থেকে মন্ত্রী
আলী আকবর টাবী
নান্দীপাঠ
একজন স্বাধীনতাবিরােধী, মানবতার শত্রু, ভণ্ড ধার্মিক, প্রতারক ও ঘাতকের নাম নিজামী। কূপমণ্ডুক ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনীতির প্রতিভূ নিজামী। এই গ্রন্থে নিজামীর অতীত ও বর্তমান নিয়ে আলােচনার পাশাপাশি নিজামীর প্রতিক্রিয়াশীল দর্শনে বিশ্বাসী সকল ব্যক্তি, গােষ্ঠী ও রাজনৈতিক দলের চেহারা উন্মােচনের চেষ্টা করা হয়েছে।
‘৭১-এ স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজিত হয়ে নিজামী গা ঢাকা দেন। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট এক প্রতিবিপ্লবের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু স্বপরিবারে নিহত হলে ক্ষমতার হাত বদলের মধ্য দিয়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা দখল করে সামরিক শাসন জারি করেন। সবাইকে তাক লাগিয়ে জিয়াউর রহমান দালাল আইনে অভিযুক্ত শাহ আজিজের মতাে কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরােধীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করেন। জিয়ার সামরিক সরকার বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবিধান থেকে ‘দালাল আইন বাতিল করেন। ফলে নিজামীসহ সকল পাকি দালাল জানে বেঁচে যায়। এখানেই জিয়াউর রহমান থামলেন না। তিনি সংবিধান থেকে ‘ধর্মভিত্তিক রাজনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা’টি তুলে নেন। ফলে স্বাধীনতাবিরােধীরা বাংলাদেশকে সাম্প্রদায়িক ও ধর্মীয় জঙ্গি রাজনীতির স্বর্গরাজ্যে পরিণত করে। নিজামীরা ধর্ম প্রচারের নাম করে প্রতিক্রিয়াশীল মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাে থেকে কাড়িকাড়ি পেট্রোডলার নিয়ে আসে। অচিরেই তারা বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক হয়ে যায়। অর্থ বিত্তের দাপটে এসব স্বাধীনতাবিরােধীরা সমাজপতি বনে যান। অপরদিকে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতির পালা। ফলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে ক্রমশ ঝাপসা হয়ে আসে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা থেকে নতুন প্রজন্ম বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। এই সুযােগকে কাজে লাগিয়ে নিজামী আস্তে আস্তে রাজনৈতিক দৃশ্যপটে শক্তিধর নেতা রূপে আবির্ভূত হন। এখন তিনি জামায়াতের আমির। বিএনপি-র সাথে জোট বেঁধে তিনি রাষ্ট্র ক্ষমতার অংশীদার হয়েছেন। তিনি ২০২০ সালের মধ্যে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের মহাষড়যন্ত্র আঁটছেন। এসব গণ দুশমনদের অতীত ইতিহাস ও চরিত্র নতুন প্রজন্মের কাছে আমরা তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছি বলেই আজ জাতির ভাগ্যের এই নির্মম পরিণতি। তাই পেশাদার লেখক না হওয়া সত্ত্বেও শত সীমাবদ্ধতা নিয়ে জাতীয় ও সামাজিক দায়িত্ব মনে করে বিবেকের তাড়নায় ঘাতক নিজামীর অতীত ও বর্তমান নতুন প্রজন্মের কাছে
৬
তুলে ধরার জন্য গ্রন্থটি রচনা করেছি। নিজামীর কার্যকলাপ ও চরিত্র চিত্রিত করতে যেয়ে আমি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক বিভিন্ন গ্রন্থ ও পত্র পত্রিকার সাহায্য নিয়েছি। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নিজামীর কর্মকাণ্ড, বক্তৃতা-বিবৃতি উপস্থাপন। করতে যেয়ে সিংহভাগ সাহায্য নিয়েছি তাদেরই দলীয় মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম’ পত্রিকার । ফলে নিজামী কখনও বলতে পারবে না তার বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযােগগুলাে মনগড়া, মিথ্যা ও কাল্পনিক।
এই গ্রন্থ রচনায় আমাকে সর্বাত্মকভাবে সহযােগিতা করেছেন শ্রদ্ধেয় জনাব ওয়াকিল মুজাহিদ, বন্ধুপ্রতীম বাসুদেব বসু, মিনার আহমেদ বুলবুল ও ভােরের । কাগজের ডেপুটি জেনারেল ম্যানেজার জনাব মােঃ সিদ্দিকুর রহমান চৌধুরী। আমার স্নেহাস্পদ ভাগ্নে মােঃ মােজাম্মেল হক ওয়েব সাইট থেকে নানা তথ্য সংগ্রহ করে দিয়ে আমার কাজকে সমৃদ্ধ করেছে। বইটির প্রুফ দেখার কাজে সহায়তা করেছেন জনাব সাইফুদ্দিন আহমেদ কাজল ও জনাব মােঃ মাসুদুল ইসলাম (মাসুদ)। তাদের সকলের কাছে আমি ঋণী ও কৃতজ্ঞ।
আলী আকবর টাবী
২৮ অক্টোবর ২০০৬
৭
ধর্মীয় লেবাসের অন্তরালে
ভােরবেলা, ১৩ অক্টোবর ২০০১ সাল ।
বাংলাদেশের নবনির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া তার মন্ত্রীদের গাড়ি বহর নিয়ে এসে থামলেন সাভার জাতীয় স্মৃতিসৌধের সামনে, উদ্দেশ্য স্মৃতিসৌধের বেদিতে ফুল দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের মহান শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করা। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর গাড়ির পেছনে মন্ত্রী মহােদয়দের পতাকাবাহী গাড়ির বহর সারিবদ্ধভাবে থামানাে। এরূপ একটি জাতীয় পতাকাবাহী শকট থেকে নেমে আসলেন শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত একজন মন্ত্রী, মাথায় কেতা দুরস্ত টুপি। আপাদমস্তক ধর্মীয় আলখেল্লায় আবৃত। এই পুত ও পবিত্র পােশাক-আশাক এবং নুরানী চেহারার আড়ালে লুকিয়ে আছে একটি কদর্য বীভৎস অতীত। মানুষ হত্যা ও নৃশংসতায় তিনি হিটলার মুসােলিনীকেও হার মানিয়েছেন। হিটলার মুসােলিনী। অন্য জাতির ওপর হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছিল আর এই ব্যক্তিটি ধর্মীয় লেবাসের আবরণে নিজ জাতিসত্ত্বাকে ধ্বংস করে দেবার জন্য আদিম হিংস্রতায় স্বজাতির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
এই ব্যক্তিটির নাম নিজামী।
পুরাে নাম মওলানা মতিউর রহমান নিজামী।
সাভার স্মৃতিসৌধটি ‘৭১-এর শহীদদের স্মরণে নির্মিত। ‘৭১-এর শহীদদের রক্তে রঞ্জিত যে ঘাতকের হাত, সেই ঘাতক নিজামী ত্রিশ বছর পর আজ এসেছে ফুলের অর্ঘ্য নিয়ে সাভারের শহীদ বেদিতে। কেবলমাত্র নিজামীর মত ভণ্ড প্রতারকের পক্ষে এমন নিখুঁত অভিনয় করা সম্ভব। ফিল্মের বিশ্বসেরা ভিলেনও। নিজামীর কপটতার কাছে নস্যি। বিড়ালতপস্বী, বকধার্মিক কোনাে উপমাই নিজামীর জন্য প্রযােজ্য নয়। নিজামীর তুলনা কেবল নিজামীই।
নিজামী নিশ্চয় ঘাতক কিংবা প্রতারক হিসাবে জন্মগ্রহণ করেননি। তাহলে জন্মের পর কীভাবে তিনি ধীরে ধীরে একজন ঘাতক এবং প্রতারকে পরিণত হলেন তা জানতে হলে তার গুরু মওলানা আবুল আলা মওদুদীর চিন্তাধারা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে সংক্ষেপে কিছু আলােচনা করা দরকার। এই ব্যক্তিটি মগজ ধােলাইয়ের মধ্য দিয়ে নিজামীকে ক্রমশ একজন প্রতারক ও জল্লাদে পরিণত করেছিলেন। কাজেই নিজামীকে জানতে হলে প্রথমে তার দীক্ষাগুরু মওদুদী সম্পর্কে সম্যক জানা প্রয়ােজন।
১১
মওদুদী ছিলেন নিজামীর নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের দীক্ষাগুরু
নিজামী আপনা-আপনি হিটলার ও মুসােলিনীর মত নৃশংস হয়ে ওঠেননি । নিজামীর নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদের দীক্ষাগুরু ছিলেন আবুল আলা মওদুদী। মওদুদী তার ভাবশিষ্যদের কাছে প্রচার করেছিলেন, আজ আপনাদের সামনে জার্মানি ইটালির দৃষ্টান্ত মজুদ রয়েছে। হিটলার ও মুসােলিনী যে বিরাট শক্তি অর্জন করেছেন, সমগ্র বিশ্বে তা স্বীকৃত। কিন্তু এই সফলতার কারণ জানা আছে কি? সেই দুটো বস্তু অর্থাৎ বিশ্বাস ও নির্দেশের প্রতি আনুগত্য। নাজি ও ফ্যাসি দল কখনও এত শক্তি অর্জন করতে পারত না, যদি না তারা নিজেদের নীতির প্রতি অটল বিশ্বাস রাখতাে এবং নিজেদের নেতৃবৃন্দের কঠোর অনুগত হতাে।১
এভাবেই মওদুদী নাৎসিবাদ ও ফ্যাসিবাদী ধ্যান-ধারণায় নিজামীদের উজ্জীবিত করে নিষ্ঠুর ও অমানবিক পথে ঠেলে দিয়েছিলেন। মওদুদী ইসলাম সম্পর্কে অসত্য ও মনগড়া তত্ত্ব হাজির করতে গিয়ে বলেন- ‘রসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহ আলাইহে ওয়াসাল্লাম তের বৎসর পর্যন্ত আরবকে ইসলামের আহ্বান জানাইতে থাকেন, মানুষকে বুঝাইবার যত প্রকার উৎকৃষ্ট পন্থা আছে তাহা অবলম্বন করেন, যুক্তিপ্রমাণ দেন।… তিনি সত্য প্রকাশ ও সংস্থাপনের জন্য উপযােগী কোনাে উপায় বাদ দেন নাই।… কিন্তু ওয়াজ-নসিয়ত ব্যর্থ হওয়ার পর ইসলামের আহ্বায়ক তলােয়ার হাতে লইলেন।… তিনি তলােয়ার হাতে লওয়ার পর মানুষের মন হইতে ক্রমে ক্রমে পাপ ও দুষ্কৃতির কালিমা দূর হইতে লাগিল।২
এভাবেই মওদুদী তার অনুসারী নিজামীদের মধ্যে এক ধরণের ধর্মীয় উন্মাদনার সৃষ্টি করে খুন ও হত্যাযজ্ঞে উৎসাহিত করেছিলেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে আমাদের দেশের নিরীহ লক্ষ লক্ষ মানুষ তাদের এই উন্মাদনার শিকার হয়েছে। অথচ আমরা জানি সত্য, ন্যায়, শান্তি ও সাম্যের ললিত বাণীতে আকৃষ্ট হয়েই দেশে দেশে কালে কালে দলে দলে মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছে। কিন্তু চতুর মওদুদী সুকৌশলে তার অনুসারীদের ইসলামের আধ্যাত্মিক পথ থেকে সরিয়ে এনে ঘাতকে পরিণত করেছিলেন। সেজন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই মওদুদীর অনুসারী নিজামীরা অস্ত্র হাতে স্বজাতি নিধন করার জন্য নেমে পড়েছিল। ইসলামের ইতিহাস থেকে আমরা জানি মুসলমানদের ওপরে আঘাত আসলে কেবলমাত্র তখনই তারা অস্ত্র ধারণ করে আত্মরক্ষা করেছে। শান্তিপূর্ণ অবস্থায় ইসলাম কখনও অস্ত্র ধারণে সমর্থন করেনি।
স্বাধীনতা সংগ্রাম হারাম-মওদুদীর তত্ত্ব
মওদুদী ছিলেন ইসলামী ভাবাদর্শের আড়ালে মূলত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের একজন খাটি সেবাদাস। এদেশের ধর্মভীরু মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে সাম্রাজ্যবাদের
———————————-
১. একাত্তরের ঘাতক জামায়াতে ইসলামী অতীত ও বর্তমান, পৃষ্ঠা-৩৯।
২. ড. মােহাম্মদ হাননান, বাঙালির ইতিহাস, পৃষ্ঠা-৩৮২।
———————————-
১২
স্বার্থ রক্ষা করাই ছিল তার মূল লক্ষ্য। তাই পাকিস্তানের প্রখ্যাত আলেমরা মওদুদীর ইসলাম ও রসুলের (সাঃ) ইসলাম এক নয় বলে অভিমত ব্যক্ত করেন। ইসলামে মনগড়া ব্যাখ্যা দেবার জন্য অনেক আলেম মওদুদীকে কাফের বলেও ঘােষণা দেন। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যখন ব্রিটিশ উপনিবেশের জোয়াল থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ মুক্ত করার আন্দোলন তীব্র করে তুলেছিল মওদুদী তখন ইংরেজদের উপনিবেশ রক্ষার জন্য নানাভাবে দালালী করেন। তিনি জামায়েতে ইসলামী, হিন্দ’ নামে একটি মৌলবাদী সংগঠনের জন্ম দেন। এই দল গঠনের পর মওদুদী ধর্মভীরু মুসলমানদের ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন তথা স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার জন্য উদ্দেশ্য প্রণােদিতভাবে ইসলাম সম্পর্কে বিতর্কিত ব্যাখ্যা দিয়ে বলেন- মুসলমানদের পক্ষে দেশের এরূপ স্বাধীনতা সংগ্রাম করা হারাম যার পরিণামে ইউরােপীয় অমুসলিমদের হাত থেকে ক্ষমতা ভারতীয় অমুসলিমদের নিকট হস্তান্তরিত হবে’।৩
এই ভেক ধার্মিক ব্যক্তিটির মুখােশ তখনই খুলে যায় যখন লাহাের প্রস্তাবের মাধ্যমে শুধুমাত্র মুসলমানদের সংখ্যাগরিষ্ঠ অঞ্চল নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের সৃষ্টির কথা বলা হয়। ইউরােপীয় অমুসলিমদের হাত থেকে ভারতীয় অমুসলিমদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে বিতর্কটি মওদুদী জন্ম দিয়েছিলেন তার আর কার্যকারিতা থাকে না যদি মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠদের নিয়ে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠা লাভ করে। কিন্তু মওদুদী তারপরও পাকিস্তান আন্দোলনকে সমর্থন দেননি বরঞ্চ পাকিস্তান আন্দোলনকে কখনও ‘খোঁড়া পাকিস্তান কখনও না পাকিস্তান’ গালিতে ভূষিত করেছেন। তিনি পাকিস্তান আন্দোলনকে হারাম আন্দোলন এবং পাকিস্তানের জন্য যারা জীবন বিসর্জন দিয়েছেন তাদের হারাম মউত বলে ফতােয়া দিয়েছেন।৪
মওদুদীর জাতীয়তাবাদ বিরােধী তত্ত্ব
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর বিশ্বব্যাপী জাতীয়তাবাদী আন্দোলন তীব্র হয়ে উঠে। সাম্রাজ্যবাদ ক্রমশ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। বিশ্বে নতুন নতুন স্বাধীন রাষ্ট্রের উদ্ভব ঘটে। তাই সাম্রাজ্যবাদ জাতীয়তাবাদকে শত্রু হিসাবে চিহ্নিত করে। মওদুদীও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে মুসলমানদের বিভ্রান্ত করার জন্য ইসলামের নয়া তত্ত্ব হাজির করে বলেন, ‘…ইসলাম সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের শত্রু। সেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদই হােক কিংবা মনগড়া মুসলিম জাতীয়তাবাদই হােক।৫
———————————————-
৩. মওলানা মওদুদী, সিয়াম কাশমকাশ, ১ম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৪৮।
৪. হালিম দাদ খান, মুক্তিযুদ্ধ ও গােলাম আযম, পৃষ্ঠা-১১।
৫. দৈনিক পাকিস্তান, ২১ অক্টোবর, ১৯৬৯।
———————————————-
১৩
গণতন্ত্রের শত্রু মওদুদী
গণতন্ত্র সাম্রাজ্যবাদের অপছন্দ। কারণ গণতন্ত্র থাকলে কোনাে দেশকে ইচ্ছামত শােষণ করা যায় না। তাই সাম্রাজ্যবাদের লালিত মওদুদী সাম্রাজ্যবাদ রক্ষা করার জন্য গণতন্ত্রের বিরােধিতা করেছেন। আর এই গণতন্ত্রের বিরােধিতা করতে গিয়ে। তিনি ইসলামের অপব্যাখ্যা দিতে দ্বিধা করেননি। ইসলামের দোহাই দিয়ে তিনি বলেন- ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য মুসলমান হিসাবে আমি এই নীতির সমর্থক নই।৬ তিনি আরাে বলেন- ‘আইন পরিষদে একাধিক দল গঠন করা শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।৭ এইভাবে মওদুদীর গণতন্ত্র ও জাতীয়তাবাদ বিরােধী তত্ত্বে পুরিপুষ্ট হয়ে এবং ফ্যাসিবাদ ও নাৎসিবাদ দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে নিজামীরা ক্রমশ প্রতিক্রিয়াশীল ও অন্ধকারের শক্তিতে পরিণত হন।
ভােল পাল্টানােতে মওদুদীর জুড়ি মেলা ভার
এতকিছুর পরও যখন পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলাে তখন এই ভণ্ড ধার্মিক ও তার অনুসারীরা রাতারাতি সাচ্চা পাকিস্তানি বনে গেলেন। শুধু তাই নয় । পাকিস্তানের একমাত্র ইসলামের এজেন্ট হিসাবে নিজেদের দাবি করলেন। ইসলাম প্রতিষ্ঠার নামে সাম্রাজ্যবাদীদের মদদে মুসলমানদের ভিতর এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা বাধিয়ে দিলেন। অসংখ্য কাদিয়ানীর রক্তে হােলি খেলে নিজেকে ‘সাচ্চা মুসলমান’ হিসাবে জাহির করলেন। কিন্তু এই সাচ্চা মুসলমান’ মওদুদীকে মানুষ হত্যার দায়ে আইয়ুবের আমলে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন বিচারপতি মনির ও বিচারপতি কায়ানির আদালতে ফাঁসির আদেশ দেওয়া হয়। পরে সৌদি বাদশাহর অনুরােধে ও মুচলেকা দিয়ে মওদুদী প্রাণ ভিক্ষা পান।
কাদিয়ানী হত্যার নেপথ্য রহস্য
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ভারতবর্ষসহ এশিয়া ও আফ্রিকার বহু উপনিবেশ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের হাতছাড়া হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিপুল ব্যয়ভার এবং উপনিবেশ হাতছাড়া হওয়ার ফলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ দুর্বল হয়ে পড়ে পক্ষান্তরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের উত্থান ঘটে। এসময় মওদুদী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের তাবেদার রাষ্ট্র সৌদি আরবের মাধ্যমে মার্কিন কানেকশন পাকাপােক্ত করেন এবং তখন থেকেই জামায়াতের ফান্ডে সৌদি ডলার আসতে শুরু করে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর জিন্নাহর আমল থেকেই সরকারি প্রশাসনে উচ্চ শিক্ষিত কাদিয়ানী অফিসারের প্রভাব ছিল। এমনকি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীও ছিলেন কাদিয়ানী । তাঁর নাম ছিল স্যার জাফরুল্লাহ। এরা ছিলেন মার্কিনবিরােধী। ফলে পাকিস্তানের
————————————–
৬. মওলানা আবুল আলা মওদুদী, সিয়াসী কাশমকাশ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৪।
৭. দৈনিক জং, ৩০ অক্টোবর, ১৯৫২।
————————————–
১৪
ওপর থেকে কাদিয়ানীদের প্রভাবমুক্ত করার জন্য সিআইএ-র চক্রান্তে মওদুদী কাদিয়ানীবিরােধী দাঙ্গা বাধিয়েছিলেন। এখন তাে মার্কিন দলিলপত্র থেকেই ফাঁস হয়ে গেছে যে, এই দাঙ্গা বাধানাের কাজে মওদুদীর পেছনে প্রকৃত মদদদাতা ছিল সৌদি আরব ও আমেরিকা।৮ কাজেই ইসলামের নামে মওদুদী দাঙ্গা বাধিয়ে কাদিয়ানী হত্যা করলেও প্রকৃত রহস্য হলাে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের গােয়েন্দা বিভাগের মদদে এই অমানবিক কাজটি তিনি করেছিলেন। তথ্য প্রমাণাদি দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয় যে, ইসলাম প্রচারের জন্য মওদুদী জামায়াতে ইসলামী নামক সংগঠনটি সৃষ্টি করেননি। মূলত তিনি ধর্মের আড়ালে প্রথমে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও পরে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য সংগঠনটির জন্ম দিয়েছিলেন।
১৯৭১ সালে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থে মওদুদী, গােলাম আযম ও নিজামী গংরা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করেছিলেন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় পাকিস্তান সামরিক জান্তার মাধ্যমে যে প্রভাব বলয় গড়ে তুলেছিল। বাংলাদেশ নামক স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রটি প্রতিষ্ঠিত হলে তা ক্ষুন্ন হবার আশঙ্কা ছিল। তাই তারা জাতিসংঘে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ৫ বার ভেটো প্রয়ােগ করেছিল এবং আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম নস্যাৎ করে দেবার জন্য সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করেছিল। কাজেই মওদুদী, গােলাম আযম এবং নিজামী গংরা ইসলামের দোহাই দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করেছিল ইসলাম প্রতিষ্ঠার জন্য নয়, মার্কিন প্রভুর স্বার্থ রক্ষাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এখনও জামায়াতে ইসলামী এদেশে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ক্রীড়নক হিসাবে কাজ করছে তার প্রমাণ হলাে কিছুদিন আগে মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রােকা বাংলাদেশে ২০০৬ সালের ২৬ জানুয়ারি তিন দিনের সফরে এসেছিলেন। তাঁর। সফরসূচিতে জামায়াতে ইসলামের সাথে কোনাে বৈঠক পূর্ব নির্ধারিত না থাকলেও পরদিন খুব ভােরে প্রেসকে না জানিয়েই ক্রিস্টিনা রােকা জামায়াতে ইসলামের আমির মতিউর রহমান নিজামীসহ জামায়াতের উর্ধ্বতন কয়েকজন নেতৃবৃন্দের সাথে গােপন বৈঠক করেন। বৈঠকের খবরটি প্রকাশ হয়ে পড়লে সাংবাদিকরা ক্রিস্টিনা রােকার কাছে বৈঠকটি সম্পর্কে সরাসরি জানতে চাইলে ক্রিস্টিনা রােকা তা অস্বীকার করেননি। শুধু তাই নয় জামায়াতের জঙ্গি কানেকশন বারবার প্রমাণিত হওয়া সত্ত্বেও ক্রিস্টিনা রােকা এবং প্রাক্তন মার্কিন রাষ্ট্রদূত হেরি কে, টমাসসহ মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তর জামায়াতে ইসলামীকে ‘মডারেট মুসলিম গণতান্ত্রিক দল হিসাবে একাধিকবার সার্টিফিকেট দিয়েছে।
মার্কিনীদের দ্বারা জামায়াতকে সার্টিফিকেট দেবার কারণ হচ্ছে জন্মলগ্ন থেকেই জামায়াত সাম্রাজ্যবাদের এজেন্ট হিসেবে কাজ করে আসছে। বিশেষ করে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করে নিজামী ও তার সংগঠন
————————————————-
৮. আব্দুল গাফফার চৌধুরী, কালের আয়নায়, সমকাল, ১৭ জুন ২০০৬।
————————————————-
১৫
জামায়াতে ইসলামী পরীক্ষিত তল্পিবাহক হিসাবে মার্কিনীদের বিশ্বস্ততা অর্জন করে। চলতি ঘটনাবলি থেকেও নিজামীদের মার্কিন প্রীতির আরাে প্রমাণ মেলে । সাম্প্রতিক ইরাকে নির্লজ্জ মার্কিন আগ্রাসন এবং মার্কিন সৈন্যদের দ্বারা ইরাকি নারী, পুরুষ ও শিশুদের ওপর পাশবিক অত্যাচার ও নারকীয় হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে নিজামীরা টু শব্দটি পর্যন্ত করেননি। এছাড়া মার্কিন মদদে ইসরাইল কর্তৃক লেবাননে বর্বরােচিত গণহত্যার প্রতিবাদে নিজামী ও তার দল জামায়াতে ইসলামী নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করেছে।
ইসলামী ছাত্র সংঘ ও নিজামী
মওলানা মওদুদী ১৯৪১ সালে লাহােরে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মৌলবাদী ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামী, হিন্দ’। পরবর্তীকালে এই রাজনৈতিক দলটি তার অঙ্গসংগঠন রূপে ইসলামী ছাত্র সংঘ’ গঠন করে। মূলত ইসলামের নামে ছাত্রদের মওদুদীবাদের বটিকা গেলানােই ছিল ইসলামী ছাত্র সংঘের আসল উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য।
নিজামী মওদুদীবাদে আকৃষ্ট হয়ে ইসলামী ছাত্র সংঘে যােগদান করেন। অল্প সময়ের ভিতর মওদুদীর অন্ধ অনুসারী হিসাবে আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হন। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৬৬ সালে তিনি ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি নির্বাচিত হন। মওদুদীর বিশ্বাসভাজন ভাবশিষ্য হওয়ার কারণে ১৯৬৬ সাল থেকে একটানা পাঁচ বছর অর্থাৎ মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত হয়ে সংগঠনটি বিলুপ্ত না হওয়া পর্যন্ত নিজামী সংগঠনটির সভাপতির পদটি আকড়ে থাকতে সক্ষম হন। এত দীর্ঘ সময় আর কেউ এই সংগঠনটির কেন্দ্রীয় সভাপতির দায়িত্ব পালন করতে পারেননি। শুধু তাই নয় নিজামীই একমাত্র ছাত্রনেতা যিনি ছাত্র সংঘের সারা পাকিস্তানের প্রধান ছিলেন। ইতিপূর্বে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে পৃথক পৃথক সভাপতি নির্বাচিত হতাে।
এই ছাত্র সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা লগ্ন থেকে আমাদের দেশের সকল প্রগতিশীল আন্দোলনের বিরােধিতা করেছে। আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের শুধু মৌখিক বিরােধিতা করেই ক্ষান্ত হয়নি, নানা ঘাতকবাহিনী সৃষ্টি করে নিজামীর ছাত্র সংগঠনটি পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে বাঙালি নিধনে মেতে উঠেছিল। সর্বোপরি কুখ্যাত আলবদরবাহিনী গড়ে তুলে এদেশের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবী, দার্শনিক, শিক্ষক, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীদের হত্যা করে নিজামীরা কলঙ্কজনক ইতিহাস সৃষ্টি করেছিলেন ।
ভাষা আন্দোলন ও নিজামীদের ভূমিকা
নিজামীরা ছিলেন ভাষা আন্দোলনের ঘোরতর বিরােধী, তারা শহীদদের স্মরণে নির্মিত মিনারকে অনৈসলামিক বলে ফতােয়া দেন। শহীদ মিনারে ফুল
১৬
দেওয়াকেও ইসলাম বিরােধী বলে অপপ্রচার করেন। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ট্যাংক দিয়ে আমাদের অহংকার জাতীয় শহীদ মিনারটি গুড়িয়ে দিলে নিজামীদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম’ উল্লাস প্রকাশ করে ইতিহাস কথা কও শিরােনাম দিয়ে সম্পাদকীয়তে লেখে- “… গভর্নর আজম খান ছাত্রদের খুশি করার জন্য যে শহীদ মিনার তৈরি করলেন তাকে পুজা মণ্ডপ বলা যেতে পারে । কিন্তু মিনার কিছুতেই না। যাহােক সেনাবাহিনী এই কুখ্যাত শহীদ মিনারটি ধ্বংস। করে সেখানে মসজিদ গড়ে শহীদদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শনের চেষ্টা করেছেন জেনে দেশবাসী খুশি হয়েছে।”৯
২১শের প্রভাতে ভাষা শহীদদের স্মরণে বাঙালিরা যে শ্রদ্ধা নিবেদন করে তার বিরুদ্ধে নিজামীরা ফতােয়া দিয়ে বলেন, নগ্নপদে চলা, প্রভাতফেরী, শহীদ। মিনারে আল্পনা আঁকা ও চন্দ্রবেদির মূর্তি স্থাপন ও যুবক-যুবতী মিলে নাচগান করা অনৈসলামিক’।১০ তবে আমাদের ভাষা আন্দোলন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত হওয়ার পর বর্ণচোরা জ্ঞানপাপী নিজামী গংরা তাদের আরেক গুরু গােলাম আযমকে মাঝে মধ্যে রংচং লাগিয়ে ভাষা সৈনিক হিসাবে দাবি করেন। কিন্তু প্রকৃত ঘটনা বিশ্লেষণ। করলে তাদের এই দাবিটি অসার প্রমাণিত হবে। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন বলতে আমরা মূলত ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির আন্দোলনকে বুঝি। অথচ ১৯৫২ সালে গােলাম আযম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ছিলেন না। তখন তিনি ছিলেন রংপুর কারমাইকেল কলেজের শিক্ষক। তাহলে কিসের জোরে নিজামীরা গােলাম আযমকে ভাষা সৈনিক দাবি করেন? প্রকৃত ঘটনা হলাে ভাষা আন্দোলনের কয়েক বছর আগে লিয়াকত আলী খান তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সফরে আসলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি সংবর্ধনা সভার আয়ােজন করা হয়। এই সংবর্ধনায় লিয়াকত আলী খানের সম্মানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের পক্ষে একটি মানপত্র পাঠ করার কথা ছিল ডাকসুর তৎকালীন ভি.পি. অরবিন্দ বােসের। মানপত্রটি রচনা করেছিলেন তৎকালীন ছাত্রনেতা মুহাম্মদ কামরুজ্জামান। মানপত্রে উর্দুর সাথে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আবেদন ছিল। এ বিষয়ে মুহাম্মদ কামরুজ্জামান ঢাকা ডাইজেস্টে সাক্ষাৎকারে বলেন, ভি.পি. অরবিন্দ বােস ছিলেন হিন্দু। তাই তাকে দিয়ে রাষ্ট্রভাষা বাংলা করার আবেদন সংবলিত মানপত্র পাঠ করালে তা ভিন্নভাবে চিত্রিত হতে পারে। সেজন্য তৎকালীন ডাকসুর ভি.পি, অরবিন্দ বােসের পরিবর্তে জি.এস. গােলাম আযমকে দিয়ে মানপত্র পাঠ করানাের সিদ্ধান্ত হয়।১১
“১৯৪৮ সালে গােলাম আযম জামায়াতে ইসলামী অথবা অন্য কোনাে রাজনৈতিক সংগঠনের সাথে জড়িত ছিলেন না। প্রকৃতপক্ষে ১৯৫৪ সালের ভাষা
——————————————–
৯. দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ জুলাই, ১৯৭১।
১০. সাংস্কৃতিক অনুপ্রবেশের ইতি হােক, দৈনিক সংগ্রাম, ২২ মে, ১৯৭১।
১১. হালিম দাদ খান, মুক্তিযুদ্ধ ও গােলাম আযম, পৃষ্ঠা-৪১। মতিউর রহমান নিজামী আলবদর থেকে মন্ত্রী -২
——————————————–
১৭
আন্দোলনের পরে এপ্রিল মাসে জামায়াতে ইসলামীর মুত্তাফিক (সহযােগী) হিসাবে যােগ দেন”।১২
কাকতালীয়ভাবে যদিও ভাষা আন্দোলনে যুক্ত হওয়ার সামান্য সুযােগ গােলাম আযমের হয়েছিল তথাপিও ১৯৫৪ সালে জামায়াতে ইসলামীতে যােগ দেবার পর তিনি বলেন, ভাষা আন্দোলনে তার অংশগ্রহণ ভুল হয়েছিল।১৩ তার এই ভুল স্বীকারােক্তির পর ভাষা সৈনিকের দাবিটি আর ধােপে টেকে না।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও মওদুদীবাদী নিজামী
ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে সমগ্র বাঙালি সমাজে ভাষা ভিত্তিক বাঙালি। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের উন্মেষ ঘটে এবং অতি দ্রুত এই আন্দোলন বিকশিত হতে থাকে। কিন্তু নিজামী ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ সর্বক্ষেত্রে এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরােধিতা করেছিল। নিজামীর গুরু মওদুদী ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদকে শয়তানের সার্থক হাতিয়ারের সাথে তুলনা করে বলেছেন- ‘বংশ, জন্মভূমি, ভাষা ও বর্ণ এসবের ভিত্তিতে তৈরি জাতীয়তা মানব জাতির জন্য এক বিরাট বিপদ।… এসবই হচ্ছে অশান্তি, বিশৃঙ্খলা, নিরাপত্তাহীনতা ও হানাহানির চির উৎস, খােদার সবচেয়ে বড় অভিশাপ ও শয়তানের সার্থক হাতিয়ার।১৪ মওদুদীর এই মন্ত্রে বলিয়ান হয়ে নিজামীরা ইসলাম রক্ষার নামে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করেন। প্রগতিশীল বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের গতি রােধ করার জন্য নিজামীরা উগ্র সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করে ধর্মের অপব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম সম্পাদকীয়তে লেখে- ‘এ নূতন জাতির নাম হলাে ‘জয়বাংলা জাত। তাদের কালেমা ও সালাম-কালাম হলাে ‘জয়বাংলা তাদের দেশের নাম বাংলাদেশ; তাদের ধর্মের নাম বাংগালী ধর্ম, এ ধর্মের প্রবর্তকের নাম দিয়েছে তারা বঙ্গবন্ধু’।১৫ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি সুস্থ বাঙালি সাংস্কৃতিক চর্চা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পায়। ঐতিহ্যবাহী বাংলা নববর্ষ, বৈশাখী মেলা, রবীন্দ্রসঙ্গীত চর্চা দেশব্যাপী ব্যাপকভাবে প্রসারিত হয়। বাঙালিদের এসব সাংস্কৃতিক চর্চা নিজামীদের চক্ষুশূল ছিল। সুস্থ ধারার এসব বাঙালি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে তারা ইসলাম বিরােধী বলে অপপ্রচার করতে লাগল। বাঙালির গর্ব। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথকে মুসলিম জনগােষ্ঠী থেকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে নিজামীদের
——————————————————-
১২. মুহাম্মদ কামরুজ্জামান, অধ্যাপক গােলাম আযমের সগ্রামী জীবন, পৃষ্ঠা-৪২।
১৩. দৈনিক পাকিস্তান, ১৯ জুন, ১৯৭০ সাল।
১৪. আব্বাস আলী খান, জামায়াতে ইসলামীর ইতিহাস, পৃষ্ঠাঃ ৫৪-৫৫, ৬৫-৬৬, ৬৯, ২১৫-১৬,
২৩০-৩১, ২৫৩ ও ২৫০।
১৫. দৈনিক সংগ্রাম, জয়বাংলা ধর্মমত, ১৩ মে ১৯৭১।
——————————————————-
১৮
পত্রিকা সাম্প্রদায়িক উস্কানী দিয়ে লিখলাে, রবীন্দ্রনাথের সবচেয়ে বড় পরিচয়। তিনি হিন্দু, গত কয়েক সপ্তাহ আগে জিন্নাহ হল যখন সূর্যসেন হলে পরিণত হলাে এবং রবীন্দ্রনাথের গান জাতীয় সঙ্গীত হিসাবে প্রস্তাবিত হলাে তখন ভারতের | হিন্দুরা তাদের সাফল্যের আনন্দে ডুগডুগি বাজাতে শুরু করলাে।১৬
শুধু তাই নয় নজরুলের গজল ও ইসলামী গানগুলাে ছাড়া বাকিগুলাে বর্জনের পক্ষে ছিলেন নিজামী ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। কারণ এগুলাে সবই ছিল বাঙালি জাতির স্বতন্ত্র অস্তিত্ব ও জাতীয়তাবােধের পরিচায়ক।
বাঙালি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে নিজামীরা শুধু অপপ্রচার করেই ক্ষান্ত হননি সুযােগ-সুবিধা বুঝে এসব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে সন্ত্রাসী হামলাও চালিয়েছিলেন।
১৯৬০ সালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের উদ্যোগে ঢাকা মেডিকেল কলেজে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হচ্ছিল। অনুষ্ঠানে প্রখ্যাত রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী জাহেদুর রহিম। ‘আমার সােনার বাংলা’ গানটি পরিবেশন করেছিলেন। স্রোতারা ছিল বিমুগ্ধ ও মােহাবিষ্ট। এ সময় দুদিক থেকে ইসলামী ছাত্রসংঘ ও সামরিক জান্তা আইয়ুবের। সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ যৌথভাবে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে হামলা চালায়।
জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পাশাপাশি ধর্মনিরপেক্ষতা, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের আন্দোলনও বেগবান হতে থাকে। কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীল নিজামী গংরা সাম্রাজ্যবাদ ও পাকিস্তানের সামরিক প্রভুদের রক্ষা করার জন্য ইসলামের নামাবলি গায়ে দিয়ে এসব আন্দোলনের বিরুদ্ধে মারমুখী অবস্থান নেন। ফলে শিক্ষা। প্রতিষ্ঠানে ও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রগতিশীলদের সাথে নিজামীর ইসলামী ছাত্র সংঘ ও তাদের মূল রাজনৈতিক সংগঠন জামায়াতে ইসলামের সংঘর্ষ বাধে।
বাঙলা সাহিত্য বনাম নিজামীর কার্যকলাপ
বাঙালি জাতীয়তাবাদ অসাম্প্রদায়িক হওয়াতে হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সকল ধর্মের বাঙালি এই আন্দোলনে শামিল হয়। সকল ধর্মের বাঙালি ঐক্যবদ্ধ হওয়ায় এই আন্দোলন অমিত শক্তি অর্জন করে এবং পাকিস্তানের সামরিক জান্তা আইয়ুবের তখতে তাউশ কাঁপিয়ে তােলে। আইয়ুবকে এই আন্দোলন থেকে রক্ষা করার জন্য নিজামীরা আইয়ুবের পাশে দাঁড়ায়। জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে দুর্বল ও বিপথগামী করার জন্য তারা নানা রকম ছল চাতুরীর আশ্রয় নেয়। প্রথমে তারা
ঐক্যের ফাটল ধরানাের জন্য সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াতে থাকে। নিজামীর ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আইয়ুবের সন্ত্রাসী ছাত্র সংগঠন এনএসএফ একজোট হয়ে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অমুসলিমদের সাহিত্য বর্জনের পক্ষে ব্যাপক প্রচার। অভিযান চালায়। এ বিষয়ে আব্দুল গাফফার চৌধুরী বলেন, ১৯৬৫ সালে
————————————-
১৬. দৈনিক সংগ্রাম, মায়াকান্না, ১০ এপ্রিল, ১৯৭১।
————————————-
১৯
পাকিস্তান ভারত যুদ্ধের পর পূর্ব পাকিস্তানের স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্রসহ সকল অমুসলিম সাহিত্যিকের লেখা পঠন-পাঠন নিষিদ্ধ করার জন্য উগ্র মৌলবাদী ও জামায়াত পন্থীদের দ্বারা দাবি তােলা হয়।১৭
ঐতিহাসিক ৬ দফা ও ১১ দফা আন্দোলন বানচালে নিজামীদের ষড়যন্ত্র
১৯৬৬ সালের ৫ ও ৬ ফেব্রুয়ারি লাহােরে পাকিস্তানের সম্মিলিত বিরােধী দলের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পেশ করেন। নিজামীর তাত্ত্বিক গুরু আবুল আলা মওদুদী ও গােলাম আযম ৬ দফার বিরুদ্ধে সর্বাত্মক জেহাদ ঘােষণা করেন। গােলাম আযম ৬ দফার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে যেয়ে বলেন, “আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচির উদ্দেশ্য ছিল পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া। যেসব দল খােলাখুলিভাবে বিচ্ছিন্নতার আন্দোলন শুরু করেছিল এবং স্বাধীন বাংলা গঠনের জন্য জনতাকে উত্তেজিত করেছিল সেসব দলকে নিষিদ্ধ ঘােষণার জন্য তিনি সরকারের প্রতি আহ্বান জানান”।১৮
পরবর্তীতে এদেশের প্রগতিশীল ছাত্রসমাজ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৯৬৯ সালের ৪ জানুয়ারি ঐতিহাসিক ১১ দফা ঘােষণা করে। ছাত্র সমাজের ১১ দফা এবং বঙ্গবন্ধুর ৬ দফার আন্দোলন একীভূত হয়ে ‘৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের সৃষ্টি করে যা পরবর্তীতে স্বাধীনতা সংগ্রামে রূপ নেয়।
ছাত্র সমাজের মহান ১১ দফা আন্দোলন যখন গণ-অভ্যুত্থানে মােড় নিচ্ছিল তখন নিজামী ছিলেন ইসলামী ছাত্র সংঘের সারা পাকিস্তানের সভাপতি। তিনি এবং তার ছাত্র সংগঠনটি ১১ দফা আন্দোলনে যােগ দেয়নি বরং এই আন্দোলনে কুঠারাঘাত করার জন্য নানা কূটচাল ও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন। তারা আইয়ুবের স্বৈরশাসনকে স্থায়ী করার লক্ষ্যে ১১ দফার ভিত্তিতে রচিত ঐক্যবদ্ধ ছাত্র আন্দোলনকে দ্বিধা বিভক্ত করতে চান। তাই তারা ১১ দফার বিপরীতে ৮ দফা পেশ করেছিল। এ প্রসঙ্গে ড. মােহাম্মদ হান্নান বলেন, ‘৬৯ সালে আইয়ুববিরােধী তীব্র আন্দোলনে ছাত্রদের ১১ দফার বিপরীতে ইসলামী ছাত্রসংঘ হাজির করে ৮ দফা। কাজেই চলমান আন্দোলনের সঙ্গে এদের বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ বেধে যায়। কোথাও কোথাও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ মারাত্মক আকার ধারণ করতে থাকে।১৯ এভাবে নিজামী ও তার ইসলামী ছাত্রসংঘ আইয়ুব খানকে গণরােষ থেকে উদ্ধারের ঘৃণ্য কলাকৌশলের আশ্রয় নেয়।
নিজামী ১৯৭০ সালের ২১ জানুয়ারি ঢাকায় ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক সম্মেলনে মওলানা মওদুদীকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসেন। মওদুদী ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক পরিষদের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে যােগদানের
——————————————————-
১৭. আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আমরা বাঙালি না বাঙলাদেশী? পৃষ্ঠা-১১।
১৮. দৈনিক সংগ্রাম ২৩ জুন, ১৯৭১।
১৯. ড. মােহাম্মদ হান্নান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস।
——————————————————-
২০
পূর্বে ১৮ জানুয়ারি পল্টন ময়দানে জামায়াতে ইসলামীর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত আরেকটি জনসভায় যােগদান করেন। সভায় মওদুদীর ভাষণের পূর্বে চট্টগ্রাম জেলার জামায়াতের আমির অধ্যাপক ওসমান রমিজ বক্তৃতা শুরু করেন। ভাষণে তিনি তীব্র ও শ্লেষাত্মক ভাষায় ৬ দফা ও ১১ দফার বিরুদ্ধে বিষােদগার করতে থাকলে উপস্থিত জনতা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এক পর্যায়ে উত্তেজিত জনতা। দাঁড়িয়ে অধ্যাপক ওসমান রমিজের বক্তব্যের প্রতিবাদ করতে থাকলে জামায়াত ও ছাত্র সংঘের কর্মীরা লাঠিসোটা নিয়ে জনতার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। মুহূর্তের মধ্যে পল্টন ময়দান রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। জনতা মঞ্চে ও প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। জামায়াতের জনসভা পণ্ড হয়ে যায়। মওলানা মওদুদী আর বক্তৃতা দিতে পারেননি। ঢাকায় তখনও ৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের ধাক্কার টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছিল। অবস্থা বেগতিক দেখে মওলানা মওদুদী ২১ জানুয়ারি ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক পরিষদের সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে যােগদান করতে সাহস পাননি। প্রধান অতিথির অনুপস্থিতিতেই তকালীন ছাত্র সংঘের প্রধান মতিউর রহমান নিজামীর সভাপতিত্বে ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রাদেশিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের উপস্থিত প্রতিনিধিদের সভায় বক্তব্য রাখতে গিয়ে নিজামী ১৭ জানুয়ারি পল্টনের জামায়াতের জনসভা পণ্ড হয়ে যাওয়ার জন্য ৬ দফা ও ১১ দফার সমর্থকদের দায়ী করে কঠোর ভাষায় সমালােচনা করেন।
২১
মুক্তিযুদ্ধে নিজামীর অপতৎপরতা
বাঙালি জাতির যত অর্জন, তার মধ্যে স্বাধীনতা সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ অর্জন। কারণ এই মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতি নিজস্ব পরিচয় নিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে। তাই আমাদের অহংকার আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। অথচ এই মহান মুক্তিযুদ্ধের সরাসরি বিরােধিতা করেছিল নিজামীর ছাত্র সংঘ। প্রথমে তারা স্বীকারই করেনি যে, মুক্তিযুদ্ধ বলে কোনাে কিছু ঘটেছে। বলেছে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা গােলযােগ সৃষ্টি করছে। তাদের কথা যখন কেউ বিশ্বাস করল না। তখন তারা বললাে মুক্তিবাহিনী আছে বটে তবে তথাকথিত মুক্তিবাহিনীর শতকরা নব্বই জনই হিন্দু’।২০
বাঙালি গণহত্যা সম্পর্কে নিজামীর রাজনৈতিক গুরু মওদুদী বলেই বসলেন যে, বাংলাদেশের গণহত্যা ইন্দো-ইসরাইলি মিথ্যা প্রচারণা।২১ কিন্তু যখন ব্রিটিশ টেলিভিশন কর্তৃক বাঙালি গণহত্যার সচিত্র প্রতিবেদন প্রচারিত হলাে তখন তারা বললাে, ‘ব্রিটিশ টেলিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের তথাকথিত মর্মস্পর্শী অবস্থা সম্পর্কে ভুয়া ছবি প্রদর্শন করছে। ব্রিটিশ টেলিভিশনে যেসব ছবি দেখানাে হচ্ছে সেগুলাে সাম্প্রতিককালের নয় বরং সেগুলাে ঘূর্ণিঝড়ের সময়কার ছবি’।২২
তেমনিভাবে প্রথমে তারা স্বীকারই করেনি যে, ভারতে শরণার্থী গেছে। তার। বলেছে, “হিন্দুস্থান এখন নিজ দেশের তালাবদ্ধ মিল কারখানার বিপুল সংখ্যক শ্রমিক ও বেকার নাগরিকদের একত্র করে শরণার্থী বলে প্রচার করছে এবং বিশ্ববাসীর দরবারে মানবতার দোহাই দিয়ে তাদের নামে সাহায্য হাসিলের চেষ্টা চালাচ্ছে।২৩ পরে স্বয়ং ইয়াহিয়া যখন স্বীকার করলেন কিছু লােক ওপারে গেছে। এবং তাদের ফিরে আসার জন্য আহ্বান জানিয়ে রীতিমত সংবর্ধনা শিবির খুলে। বসলেন তখন নিজামীদের সুর বদলে গেল। তাদের পত্রিকায় ইয়াহিয়া খানের। সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়ে ‘ওরে আয় ফিরে আয়শিরােনামে প্রকাশিত সম্পাদকীয়তে লিখলাে, ভারত ও তার চরদের প্ররােচনা ও প্রচারণায় বিভ্রান্ত হয়ে যেসব আইনানুগ নাগরিক সীমান্তের ওপারে গিয়ে অশেষ কষ্টে ভুগছেন প্রেসিডেন্ট
———————————————
২০. দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ অক্টোবর, ১৯৭১ সাল।
২১. দৈনিক সংগ্রাম, ৩ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
২২. দৈনিক সংগ্রাম, ১৯ জুলাই, ১৯৭১ সাল।
২৩. দৈনিক সংগ্রাম, ৬ নে, ১৯৭১ সাল।
———————————————
২২
আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তাদের স্বদেশে ফিরে আসার আহ্বান জানিয়েছেন। এ আহ্বান সময়ােপযােগী হয়েছে। এ আহ্বান আমাদের বিভ্রান্ত ও বিপথগামী ভাই-বােনদের প্রাণে আশার সঞ্চার করবে। একতরফা ও একটানা প্ররােচনা ও প্রচারণায় স্বদেশ ছেড়ে বিদেশে গিয়ে তারা যে অমানুষিক দুর্ভোগের শিকার হয়েছিলেন আশা করি এবার তার অবসান ঘটবে।২৪
ভণ্ডামি আর কাকে বলে? ক’দিন আগে নিজামীরা বললাে ভারতে শরণার্থী যায়নি আবার ক’দিন পরেই ‘ওরে আয় ফিরে আয়’ বলে শরণার্থীদের ফিরে আসার জন্য মায়াকান্না জুড়ে দিল। তাদের এই মায়াকান্নার পরও যখন শরণার্থীরা ফিরলাে না, তখন তারা আবার ভারতকে অভিযুক্ত করে বললাে, ভারত সরকার আন্তর্জাতিক যে সাহায্য সহযােগিতা পাচ্ছে তা বন্ধ হয়ে যাবে দেখেই শরণার্থী ফিরিয়ে দিতে গড়িমসি করছে।২৫ স্ববিরােধিতা আর কাকে বলে! একমাত্র নিজামীদের মতাে নির্লজ্জ বেহায়ারাই পারে এমন জলজ্যান্ত স্ববিরােধী কথাবার্তা বলতে।
এভাবেই মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় ইসলামের ভেকধারী নিজামী ও তার মুরুব্বী ও সাঙ্গপাঙ্গদের ধর্মের মুখােশটি খসে পড়ে জনসমক্ষে। বেরিয়ে পড়ে তাদের স্বজাতি বিদ্বেষী কুৎসিৎ এবং হিংস্র রূপটি যা মীরজাফরের চরিত্রকেও হার মানায় ।
মুক্তিযুদ্ধের মৌখিক বিরােধিতা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। বাঙালি নিধনে পাক বাহিনীকে তারা সর্বতােভাবে সহযােগিতা করেছিল। এছাড়াও পাক বাহিনীর সহায়তায় নিজামীরা গড়ে তুলেছিল নানা ঘাতক বাহিনী। নিজামীদের এসব ঘাতকবাহিনী আদিম হিংস্রতায় ঝাঁপিয়ে পড়েছিল মুক্তিকামী বাঙালিদের ওপর। গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও অগ্নিসংযােগ করে বাঙালিদের স্বাধীনতার সাধ তারা চিরতরে মিটিয়ে দিতে চেয়েছিল।
২৫ মার্চ কালােরাত ও নিজামী গংদের কর্মকাণ্ড
আমাদের স্বাধীনতার সাধ চিরতরে স্তব্ধ করে দেবার জন্য ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালাে রাত্রে পাক হানাদার বাহিনী ঝাপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত ঢাকাবাসীর ওপর। রাতের নিস্তব্ধতা ভেঙে খান খান হয়ে পড়ল জল্লাদ বাহিনীর রাইফেল, কামান ও মর্টারের হিংস্র গর্জনে। হাহাকার, আর্তচিৎকার ও ক্রন্দনে ২৫ মার্চের রাত ভয়ংকর হয়ে উঠল। স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রের নল উদ্গীরণ করছিল মৃত্যু আর মৃত্যু। ফুটপাত, রাজপথ ও রিকশায় জমে উঠল মৃত মানুষের লাশ।।
পাকবাহিনীর উদগ্র বর্বরতায় ভুলুণ্ঠিত হলাে শহীদ মিনার। আক্রান্ত হলাে রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানার তৎকালীন ইপিআর ক্যাম্প, জগন্নাথ হল ও রােকেয়া হল। অগ্নিসংযােগ করা হলাে ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদের অফিস।
————————————-
২৪ দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ মে, ১৯৭১ সাল।
২৫ দৈনিক সংগ্রাম, ২ জুন, ১৯৭১ সাল।
————————————-
২৩
এমনি শ্বাসরুদ্ধ পরিবেশে কোনাে সংবাদপত্র ছাপা হলাে না। এমনকি সরকারি সংবাদপত্রও নয়। এরূপ একটা ভয়ার্ত পরিবেশে নিজামীরা শঙ্কাহীনভাবে ও নিরানন্দমনে তাদের দলীয় মুখপত্র “দৈনিক সংগ্রাম’ অফিসে কাজ করে চলেছিল। মনে হয় এরূপ একটা অস্বাভাবিক পরিবেশের কথা আগে থেকেই তাদের জানা। ছিল। পরদিন ভােরে অন্য কোনাে পত্রিকা বের না হলেও নিজামীদের দৈনিক সংগ্রাম’ ঠিকই বের হলাে। সবচেয়ে অবাক ব্যাপার পত্রিকাটিতে গতরাতের গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগের কোনাে খবরই ছাপা হলাে না। পক্ষান্তরে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার বাঙালির মুক্তি সংগ্রামবিরােধী কঠোর নির্দেশসমূহ ও প্রেসনােট গুরুত্ব সহকারে প্রথম পাতায় ছাপানাে হয়েছিল।
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে দীর্ঘ নয় মাস নিজামী যেসব বক্তৃতা, বিবৃতি, হুমকি, সেমিনার, সিম্পােজিয়াম করেছে এবং বিভিন্ন ধর্মীয় দিবস উদ্যাপনের নামে মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধাচারণ করেছে তা এ অধ্যায়ে তুলে ধরা হলাে।
তথাকথিত স্বাধীন বাংলা আন্দোলন গােলামে পরিণত করার ষড়যন্ত্র– নিজামী
পাকবাহিনী বাংলাদেশে নির্বিচারে গণহত্যা শুরু করলে ভারতে এক কোটি শরণার্থী আশ্রয় নেয়। মানবিক কারণে ভারত এসব বাঙালিকে আশ্রয় দিলেও তাদের অর্থনীতিতে মারাত্মক চাপ পড়ে। ভারতীয় পার্লামেন্টে তাই এই গণহত্যার বিরুদ্ধে উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বাঙালিদের জীবন রক্ষার আবেদন জানিয়ে একটি প্রস্তাব পাস করা হয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এই প্রস্তাবে নিজামী তেলে-বেগুনে জ্বলে ওঠে। নিজামী ক্ষিপ্ত হয়ে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধকে ‘তথাকথিত স্বাধীন বাংলা’ বলে কটাক্ষ করে একটি বিবৃতি দেন। ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রধান হিসাবে মতিউর রহমান নিজামী স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে উল্লেখ করা হয়- আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি যে, ভারতীয় পার্লামেন্টে পাকিস্তানের সাত কোটি দেশপ্রেমিকের জীবন দুর্বিসহ করার হীন মানসে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে উত্তেজনা সৃষ্টির ঘৃণ্য ভূমিকা পালনে মেতে উঠেছে। একদিকে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলার সমস্যার সৃষ্টি করছে। অন্যদিকে সীমান্ত এলাকায় যুদ্ধ প্রস্তুতি ও উত্তেজনা সৃষ্টি করে পাকিস্তানকে একটি আন্তর্জাতিক যুদ্ধে জড়াতে বাধ্য করার চেষ্টা করছে।
… ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত পূর্ব পাকিস্তানের তথাকথিত বন্ধু সেজে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করার পুরাতন দুঃস্বপ্নে বিভাের হয়েছে।
… পূর্ব পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী প্রেরণ, সীমান্ত বরাবর সৈন্য মােতায়েন ও পাকিস্তানের ভৌগলিক অখণ্ডের বিরুদ্ধে ভারতীয় বেতারের দূরভিসন্ধিমূলক প্রচারণার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি নাগরিকের কাছে এটা অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, তথাকথিত স্বাধীন বাংলা’ আন্দোলন পূর্ব
২৪
পাকিস্তানের জনগণকে চিরতরে গােলামে পরিণত করার জঘন্য ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়’।২৬
গণহত্যার জন্য কিছু সংখ্যক অপরিণামদর্শী নেতাই দায়ী- নিজামী
‘৭১-এর ২৫ মার্চ রাত থেকে খুনি ইয়াহিয়ার নির্দেশে বর্বর পাক সেনারা বাঙালি নিধনযজ্ঞ শুরু করে। কিন্তু নিজামী পাক সামরিক জান্তাদের নির্মমতার নিন্দা না করে এই হত্যাকাণ্ডের দায়-দায়িত্ব মুক্তি সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী বাঙালি নেতাদের ওপর চাপিয়েছিলেন। তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা ভাসানী প্রমুখ বরেণ্য নেতাদের ‘অপরিণামদর্শী নেতা হিসাবে আখ্যায়িত করে যশােহর ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের উদ্দেশ্যে ধৃষ্টতাপূর্ণ বক্তৃতা দেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন পূর্ব পাকিস্তানে সম্প্রতি যা ঘটেছে তা নিঃসন্দেহে দুঃখজনক। কিন্তু সবকিছুই অপ্রত্যাশিত নয়। কারণ কিছু সংখ্যক অপরিণামদর্শী নেতার বল্গাহীন রাজনীতি এজন্য দায়ী। বিগত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আঞ্চলিক দল ও সারা পাকিস্তান ভিত্তিক দলগুলাের মধ্যে চিন্তাধারার মৌলিক পার্থক্য ছিল।২৭
এখানে আঞ্চলিক দল বলতে নিজামী আওয়ামী লীগকে বুঝিয়েছেন। আর তার মতে বাঙালিরা ‘৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়ে নিরঙ্কুশ বিজয়ী করে মহাপাপ করেছিল। তাই পাকিস্তানি সৈন্যরা নারকীয় হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে বাঙালিদের উচিত শিক্ষা দিয়ে ভালাে করেছে। এরূপ শাস্তি বাঙালিদের প্রাপ্য ছিল। এভাবেই নিজামী পাক সৈন্য দ্বারা বাঙালি গণহত্যাকে জায়েজ করেছিলেন।
কোলকাতার আর আগরতলার মহাশ্মশানই যথেষ্ট- নিজামী
‘৭০-এর নির্বাচনে এদেশের মানুষ ৬-দফা ও ১১-দফার পক্ষে রায় দেয়। কিন্তু পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খান জনগণের এই রায়ের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী। প্রদর্শন করেন। তিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে বাঙালি সমাজ গর্জে ওঠে। শুরু হয় ঐতিহাসিক ও অভূতপূর্ব অসহযােগ আন্দোলন। রাজপথ হয় স্লোগানে স্লোগানে প্রকম্পিত। সেই আন্দোলনে রাজপথের মিছিলে একটি জনপ্রিয় স্লোগান ছিল, ‘জিন্না শাহির পাকিস্তান, আজিমপুরের গােরস্থান’। এই স্লোগান নিজামীদের যারপর নাই ক্ষিপ্ত ও প্রতিহিংসা পরায়ন করে তােলে। কিন্তু গণজোয়ারের মুখে তাদের করার কিছুই থাকে না। গণবিচ্ছিন্ন নিজামী ভিতরে ভিতরে প্রতিশােধ স্পৃহায় জ্বলতে থাকে। সুযােগও এসে যায় একাত্তর সালে। ‘৭১-এর ২৫ মার্চ কালােরাত থেকে শুরু হয়। বাঙালিদের ওপর বিরামহীন নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। পাক বাহিনীর এই নৃশংসতা
———————————————-
২৬ দৈনিক সংগ্রাম, ১১ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
২৭ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
———————————————-
২৫
থেকে বাঁচার জন্য এক কোটির ওপর বাঙালি তাদের ঘরবাড়ি সহায়-সম্বল ছেড়ে পায়ে হেঁটে এক অবর্ণনীয় দুঃখ-যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে শরণার্থী হিসাবে ভারতের। কোলকাতা ও আগরতলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে আশ্রয় নেয়। বাঙালি শরণার্থী এসব আবালবৃদ্ধবণিতা ও শিশুদের এই দুঃখ-যন্ত্রণায় নিজামী এক ধরনের বিকৃত সুখ। অনুভব করেন। তাই তিনি পুলকিত হয়ে যশােহর ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় বলেন, সম্প্রতি (মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়ে- লেখক) যারা পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিল আল্লাহ্ তাদের প্রত্যেককে লাঞ্ছিত করেছেন।… পাকিস্তানকে যারা আজিমপুরের গােরস্থান বলে স্লোগান দিয়েছিল তাদেরকে পাকিস্তানের মাটি গ্রহণ করেনি। তাদের জন্য কোলকাতার আর আগরতলার মহাশ্মশানই যথেষ্ট।২৮
নিজামী এই বক্তব্যের মাধ্যমে বাঙালিদের অসহায়ত্বকে শুধু কটাক্ষ করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি স্বাধীনতাকামী লাঞ্ছিত বাঙালিদের ষড়যন্ত্রকারী হিসাবেও উল্লেখ করেছেন।
‘৬৫ সালে এদেশের জনগণ সরকারিভাবে কালেমা পড়ে- নিজামী
নিজামীরা মনে করেন, তারাই হচ্ছে এদেশের ইসলামের একমাত্র সােল এজেন্ট। ইচ্ছামত যখন তখন যে কাউকে মােনাফেক, কাফের ও মুরতাদ বলে ফতােয়া দেওয়া হলাে তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে যশােহর। ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় বক্তৃতাদানকালে নিজামী বললেন যে, ‘৬৫ সালের আগে আমাদের দেশের জনগণ কিংবা শাসক কেউই মুসলমান ছিল না। ‘৬৫ সালে কাশ্মির নিয়ে পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে বাধ্য হয়ে সরকার ও জনগণ কালেমা পড়ে নওমুসলিমে পরিণত হয়। ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় নিজামী বলেন, ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত আমরা ভুলে গিয়েছিলাম আমরা কোন জাতি। কিন্তু ‘৬৫-এর ৬ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণ্যবাদী ভারত যেদিন পাকিস্তানের পাক ভূ-খণ্ডে হামলা চালিয়েছিল সেদিন প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে রেডিও, টেলিভিশন ও জনগণ সরকারিভাবে কালেমা পড়ে মুসলমানিত্বের স্বকীয় ঐতিহ্য স্বীকার করলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় মাত্র ৬ বৎসরের মধ্যে এতবড় দুর্ঘটনা ভুলে গিয়ে ১৯৭১ সালে ডেকে আনলাম নিজেদের সর্বনাশ। এদেশের মুসলমানরা হিন্দু দাদাদের ধোকায় পড়ে গেল। এতে শুধু দেশে নয় বিদেশেও তারা খ্যাতি হারিয়েছে।২৮
মুক্তিযুদ্ধ হচ্ছে আমাদের অহংকার আর নিজামী আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বনাশ বলেছেন। এরূপ সর্বনাশা কথা যারা বলতে পারে, তারা কখনই স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হতে পারে না।
—————————————–
২৮ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
২৯ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
—————————————–
২৬
আমাদের সশস্ত্র করা হউক-নিজামী
নিজামী তার বক্তৃতা ও বিবৃতিতে বারবার বােঝাতে চেয়েছেন কেবলমাত্র পাকিস্তানি সৈন্যদের দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবিলা করা সম্ভব নয়। মুক্তিযােদ্ধাদের মােকাবিলা করতে হলে নিজামীদের মত এদেশের স্বাধীনতাবিরােধীদের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে। যশােহর ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় ভাষণদানকালে নিজামী আবারও খুনি পাক সামরিক জান্তার কাছে অস্ত্র চেয়ে বলেন- “দেশের সংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে এগিয়ে এসেছি তেমনি সরকারের (পকিস্তান সামরিক জান্তা- লেখক) উচিত হবে আমাদের খাটি সৈনিকরূপে গড়ে তােলা।৩০
মুক্তিযােদ্ধারা ‘দুষ্কৃতিকারী’ ও ‘ভারতীয় অনুচর’-নিজামী
পৃথিবীর সকল জাতিই মুক্তিযােদ্ধাদের শ্রেষ্ঠতম সন্তান হিসাবে গণ্য করে। আমরাও মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে গর্ব করি। আমাদের দেশেও মুক্তিযােদ্ধারা ‘সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ সন্তান হিসাবে জাতীয়ভাবে স্বীকৃত। কিন্তু স্বাধীনতাবিরােধী নিজামী কখনই মুক্তিযােদ্ধাদের সম্মান করে কথা বলেননি বরং তাদেরকে কখনও ইসলামের শত্রু, ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী, দুষ্কৃতিকারী, বিচ্ছিন্নতাবাদী, ইহুদিদের দালাল ও ব্রাহ্মণ্যবাদী বলে গালিগালাজ করেছেন। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে চট্টগ্রামে ইসলামী ছাত্র সংঘ কর্তৃক আয়ােজিত মুক্তিযুদ্ধবিরােধী ছাত্র সভায় মুক্তিযােদ্ধাদের কটাক্ষ করে বলেন- … মার্চ থেকে দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় অনুচররা যে ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল, তাতে কোনাে মানুষ আশা করতে পারেনি যে, পাকিস্তান ও পাকিস্তানি মুসলমানরা স্বাধীন সত্ত্বা নিয়ে টিকে থাকবে, দুষ্কৃতিকারীরা দেশের বুকে যে রক্তের প্রবাহ বইয়েছে তার নজির দুনিয়ার ইতিহাসে নাই’।৩১
পাকিস্তান আল্লাহর ঘর-নিজামী
সাধারণত আমরা মসজিদকেই আল্লাহর ঘর বলে থাকি। এমনকি সেই মসজিদ ইহুদি-নাসারাদের দেশে প্রতিষ্ঠিত হলেও সেটা আল্লাহর ঘর। কিন্তু পাকিস্তান আল্লাহর ঘর এরূপ হাস্যকর বানােয়াট কথা কুরআন হাদিসের কোথাও লেখা নাই। অথচ বর্ণচোরা বক-ধার্মিক নিজামী কৃত্রিম রাষ্ট্র পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য ধর্মীয় জিগির তুলে চট্টগ্রামে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভায় বললেন, ‘পাকিস্তান আল্লাহর ঘর । আল্লাহ একে রক্ষা করেছেন, ভবিষ্যতেও রক্ষা করবেন, দুনিয়ার কোনাে শক্তিই পাকিস্তানকে নিশ্চিহ্ন করতে পারবে না’।৩২
—————————————————-
৩০ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল ।
৩১ দৈনিক সংগ্রাম, ৫ আগস্ট, ১৯৭১ সাল ।
৩২ দৈনিক সংগ্রাম, ৫ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
—————————————————-
২৭
একদিন ব্রিটিশের দালালি করতে যেয়ে এই নিজামীরাই ফতােয়া দিয়েছিলেন, পাকিস্তান আন্দোলন হারাম এবং পাকিস্তান আন্দোলন করতে যেয়ে যারা জীবন দিয়েছেন তাদের জীবনদান ‘হারাম মউত। আবার এখন। বলছেন পাকিস্তান আল্লাহর ঘর’। নিজ হীনস্বার্থ উদ্ধারের জন্য ফতােয়া পরিবর্তন করতে এসব ধর্মব্যবসায়ীরা সিদ্ধহস্ত।
মুসলমানরা টিকে থাকতে পারে-নিজামী
নিজামী আমাদের দেশের ধর্মভীরু জনগণকে বােকা বানিয়ে মুক্তিযুদ্ধ থেকে বিরত রাখার জন্য নানা প্রকার ছলচাতুরী ও অপপ্রচারের আশ্রয় নিয়েছিলেন। তিনি অপপ্রচার করেছিলেন বাংলাদেশ স্বাধীন হলে মুসলমানরা ধর্মকর্ম করতে পারবে না। তাদের অস্তিত্বই বিলীন হয়ে যাবে। এমনকি টুপি, দাড়ি পর্যন্ত রাখতে পারবে না। ৩ আগস্ট ইসলামী ছাত্র সংঘ আয়ােজিত সভায় নিজামী বলেন- ‘পাকিস্তান টিকে থাকলেই কেবল এখানকার মুসলমানরা টিকে থাকতে পারে।৩৩
স্বাধীনতা সংগ্রামে ইহুদি, ভারত ও রাশিয়ার ষড়যন্ত্র-নিজামী
স্বাধীনতা সংগ্রামে এদেশবাসী এক মরণপণ ও রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়। সমগ্র জাতি যখন বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়ে যাচ্ছে, সেই সময় পাকিস্তান রক্ষার জন্য ১৯৭১ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘আজাদি দিবস’ অতি জাঁকজমক সহকারে পালনের জন্য তৎকালীন পাকিস্তান ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ছাত্র সংঘের প্রতিটি ইউনিটকে নির্দেশ দেন। কিন্তু বেশির ভাগ ইউনিটই মুক্তিযােদ্ধা ও জনগণের ভয়ে দিবসটি পালন করতে সাহস পায়নি। কেবলমাত্র শহরাঞ্চলের দু’একটি ইউনিট পাক সেনাবাহিনীর কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিবসটি পালন করে। নিজামী স্ব-উদ্যোগে অনেক ঢাকঢােল পিটিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এক ছাত্র সভার আয়ােজন করে। এই সভায় নিজামী তার গুরু গােলাম আযমকে প্রধান অতিথি করে নিয়ে আসেন। মুক্তিযােদ্ধাদের ভয়ে পাকিস্তানি সেনা, আলবদর ও রাজাকার পরিবেষ্টিত হয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সভাটি অনুষ্ঠিত হয়। নিজামী নিজেই এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। সভাপতির ভাষণে তিনি বলেন, পাকিস্তানের শত্রু ইহুদি, | ভারত ও রাশিয়া পাকিস্তানবিরােধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। তিনি বলেন, শুধু রাশিয়া। নয় সারা দুনিয়ার ইসলামবিরােধী শক্তিগুলাে ভারতের পেছনে দাঁড়ালেও পাকিস্তানের এক ইঞ্চি জায়গাও দখল করতে পারবে না’।৩৪
—————————————-
৩৩ দৈনিক সংগ্রাম, ৫ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
৩৪ দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
—————————————-
২৮
পাকিস্তান কোনাে ভূ-খণ্ডের নাম নয়-একটি আদর্শের নাম-নিজামী
পাকিস্তানের ‘আজাদি দিবস উপলক্ষে ১৪ আগস্ট ১৯৭১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র সংঘ আয়ােজিত সভাতে নিজামী আরাে বলেন, ‘পাকিস্তান কোনাে ভূ-খণ্ডের নাম নয়, একটি আদর্শের নাম। এই ইসলামী আদর্শের প্রেরণাই পাকিস্তান সৃষ্টি করেছে এবং এই আদর্শই পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে সক্ষম। ইসলাম প্রিয় ছাত্রসমাজ বেঁচে থাকলে পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকে থাকবে।৩৫ বর্ণচোরা আর কাকে বলে। একদিন যারা পাকিস্তান আন্দোলনকে অনৈসলামিক বলে প্রচার করেছে এখন তারাই আবার পাকিস্তান একটি আদর্শেন নাম বলে দাবি করছে। এই স্ববিরােধী বক্তব্য থেকে প্রমাণিত হয় নিজামীরা পবিত্র ইসলাম ধর্ম নিয়ে ব্যবসা করছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়ে প্রস্তাব পাস
পাকিস্তান সামরিক জান্তা কর্তৃক ৭১ সালে বাঙালিদের ওপর পরিচালিত গণহত্যার বিরুদ্ধে সারাবিশ্বে ধিক্কার ও নিন্দার ঝড় ওঠে, প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে বিশ্ববিবেক। তৎকালীন জাতিসংঘের মহাসচিব উ-থান্ট, সােভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিসহ পৃথিবীর বিভিন্ন বিবৃতি দেন। অথচ মানবসভ্যতা ধ্বংসকারী পশুর চেয়েও নিকৃষ্ট পাক সেনাবাহিনীকে নিজামী বাঙালি নিধনের জন্য অভিনন্দিত করেছিলেন। ১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর যশােহরে ইসলামী ছাত্র সংঘের সভার প্রধান অতিথি নিজামীর স্বাক্ষরিত পাস করা প্রস্তাবটিতে বলা হয়- … ভারতীয় দালাল ও তার এজেন্টদের পাকিস্তান ধ্বংসের পরিকল্পনা নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর প্রতি অভিনন্দন রইল।৩৬ অপর একটি প্রস্তাবে বলা হয়, সরকারি অফিস আদালত থেকে ইসলাম ও পাকিস্তানবিরােধী সকল কর্মচারীদের বরখাস্ত করে খাটি দেশপ্রেমিক মুসলমানদের নিয়ােগ করার দাবি জানানাে হয়’ ।৩৭
ছাত্রসংঘের কর্মীরা পাকিস্তানের প্রতি ইঞ্চি জায়গা রক্ষা করবে-নিজামী
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে পাকবাহিনীর ওপর মুক্তিযােদ্ধাদের আঘাত তীব্রতর। হয়ে ওঠে। এরই মাঝে ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবস’ চলে আসে। পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবসে আমাদের মুক্তিযােদ্ধারা যখন পাকসেনাদের ওপর সর্বাত্বক আঘাত হানার এক মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করে, তখন পাকিস্তান সামরিক জান্তার সেবাদাস নিজামী এই দিবসটি মহাসমারােহে উদ্যাপনের উদ্যোগ গ্রহণ
—————————————–
৩৫ দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ আগস্ট, ১৯৭১ সাল ।
৩৬ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
৩৭ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
—————————————–
২৯
করে। নিজামী তার প্রতিক্রিয়াশীল ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের মাধ্যমে এবং পাকিস্তানি দখলদার সামরিক বাহিনীর অর্থে ও সহায়তায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা দিবস উপলক্ষে এক ছাত্র গণজমায়েতের আয়ােজন করে। প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন দিয়ে নানা বর্ণে কার্জন হলের। সভাস্থলটি সাজানাে হয়। সভাস্থলে ঢােকার প্রবেশ পথগুলােতে কয়েকটি সুদৃশ্য তােরণও নির্মাণ করা হয়। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি ছাড়াও বাঙালিদের কাছে ‘জল্লাদ হিসেবে নিন্দিত ইয়াহিয়া খান এবং বালুচদের কাছে ‘কসাই’ হিসেবে ধিকৃত টিক্কা খানের বড় বড় কয়েকটি ছবি দিয়ে সভাস্থলটি সুসজ্জিত করা হয়। শুধু তাই নয় এই সমাবেশেও নিজামী তার গুরু যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমকে প্রধান অতিথি হিসাবে নিয়ে আসেন। এছাড়া স্বাধীনতাবিরােধী বিভিন্ন গােষ্ঠী ও ব্যক্তিবর্গকে নিজামী এই সমাবেশে দাওয়াত দিয়ে নিয়ে আসেন। এক কথায় নিজামী এই সমাবেশকে স্বাধীনতা বিরােধীদের এক মহামিলন মেলায় পরিণত করেন। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধাদের ভয় সবসময় তাদের তাড়া করে ফিরত। খােলামেলাভাবে এই সমাবেশ করার সাহস তাদের ছিল না। তাই সভা চলাকালে কার্জন হলের সকল প্রবেশ পথে সেদিন সশস্ত্র পাক সেনাদের পাহারা বসিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে সভাটি সম্পন্ন করেন। এই সমাবেশে গােলাম আযমসহ স্বাধীনতাবিরােধী সকল ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে নর্তন-কুর্দন করে বক্তৃতা দেন। পাক সশস্ত্র বাহিনী দ্বারা পরিবেষ্টিত হয়ে নিজামী এই সভায় হুংকার দিয়ে বলেন- ইসলামী ছাত্র সংঘের প্রতিটি কর্মী দেশের প্রতি ইঞ্চি ভূমি। রক্ষা করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এমনকি তা পাকিস্তানের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য হিন্দুস্তানের মূল ভূখণ্ডে আঘাত হানতেও প্রস্তুত।৩৮
মুক্তিযােদ্ধারা খােদাদ্রোহী-নিজামী
মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য নিজামী ইসলামের পবিত্র দিবসগুলােকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে দ্বিধা করেনি। ধর্মীয় দিবস উপলক্ষে তিনি যেসব প্রবন্ধ রচনা করতেন তাতে সেই পবিত্র দিবসের তাৎপর্য ও আধ্যাত্মিক দিকটির ব্যাখ্যা অনুপস্থিত থাকত। পক্ষান্তরে নিজেদের হীন ও ক্ষুদ্র রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের। জন্য ধর্মের অপব্যাখ্যায় ঠাসা থাকত। নিজামী ১৯৭১ সালে শব-এ-কদর। উপলক্ষে যে প্রবন্ধ রচনা করেছেন, সেখানেও তিনি শব-এ-কদরের তাৎপর্য ও আধ্যাত্মিক বিষয় ব্যাখ্যা না করে মুক্তিযােদ্ধাদের খােদাদ্রোহী বলে অপবাদ দিয়েছেন। ‘শব-এ-কদর একটি অনুভূতি’ শীর্ষক প্রবন্ধে নিজামী তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে লেখেন- “খােদায়ি বিধান বাস্তবায়নের সেই পবিত্র ভূমি পাকিস্তান আল্লাহর ঘর। আল্লাহর এই পুতপবিত্র ঘরে আঘাত হেনেছে খােদদ্রোহী
——————————————
৩৮ দৈনিক সংগ্রাম, ৮ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
——————————————
৩০
কাপুরুষের দল। এবারের শব-এ-কদরে সামগ্রিকভাবে ইসলাম ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পরিচালিত উল্লেখিত যাবতীয় হামলা প্রতিহত করে সত্যিকারের শান্তি ও কল্যাণ প্রতিষ্ঠার এই তীব্র অনুভূতি আমাদের মনে সত্যিই জাগাবে কি?৩৯
আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তার প্রিয়ভূমি হেফাজত করেছেন -নিজাম
যে পাক সেনারা বাঙালির রক্তে হােলি খেললাে, নারী ধর্ষণ করলাে, শিশু হত্যা করলাে সেই সেনাবাহিনীকে নাকি আল্লাহ্ পাকিস্তান রক্ষার দায়িত্ব দিয়েছেন। এমন একটা হাস্যকর উদ্ভট কথা বললেন নিজামী চট্টগ্রামের ছাত্র-সুধী সমাবেশে। তিনি বললেন- ‘আল্লাহ তার প্রিয় ভূমি পাকিস্তানকে রক্ষার জন্য ঈমানদার মুসলমানরা যখন রাজনৈতিক সমস্যার মােকাবিলা রাজনৈতিক পন্থায় করতে ব্যর্থ হলাে, তখন আল্লাহ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে তার প্রিয় ভূমি হেফাজত করেছেন।৪০ আল্লাহ যে খুনি পাকসেনাদের পাকিস্তান হেফাজতের দায়িত্ব দিয়েছেন এ তথ্য নিজামী কোন্ আসমানি কেতাব থেকে পেয়েছেন? ধর্মের আবরণে ভণ্ডামীই ছিল নিজামীর রাজনীতির মূল ভিত্তি সেটা আবারও প্রমাণিত হলাে।
পাকসেনারা আমাদের ভাই-নিজামী
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে বিমানযােগে পাকিস্তান পালিয়ে যান। যাবার আগে তার দু’জন বিশ্বস্ত অনুচর বালুচদের কাছে কসাই হিসেবে খ্যাত লে. জেনারেল টিক্কা খান ও জেনারেল রাও ফরমান আলীকে বাঙালি হত্যার নির্দেশ দিয়ে যান। প্রভুর নির্দেশে এই দুজন মনুষ্যরূপী নরঘাতক অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছিল। কী উন্মত্ততা আর পৈশাচিকতা নিয়ে পাক সৈন্যরা সেদিন নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল তা এ দু’জন রক্তপিপাসু জেনারেলের সেদিনকার কথােপকথন ও কার্যকলাপ থেকে কিছুটা অনুধাবন করা যায়।
২৫ মার্চ রাতেই রাও ফরমান আলী বলেছিলেন, বাঙালিদের আমি ২৪ ঘণ্টার মধ্যে শেষ করে ফেলব। … তার আদেশ প্রচার করার জন্য সামনে ছিল একটা টেপ রেকর্ডার। তার অর্ডারগুলাে তিনি ইংরেজিতে দিয়েছিলেন। সেই টেপ পরে পাওয়া গেছে। … আত্মসমর্পণের পর তার ড্রয়ার থেকে উদ্ধারকৃত কাগজপত্রে তার হাতেই লেখা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের সবুজকে লাল রঙে রাঙিয়ে দিতে হবে । আর টিক্কা খানকে বাঙালি হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তিনি নির্বিকারে বলেছিলেন, মানুষ নিয়ে ভাবছি না, আমি ভাবছি দেশ নিয়ে।৪১
বিবেকবর্জিত এই দুই জেনারেলের পরিকল্পনা অনুসারে পাক সেনারা বাঙালি
————————————————–
৩৯ দৈনিক সংগ্রাম, ১৬ নভেম্বর, ১৯৭১ সাল।
৪০ দৈনিক সংগ্রাম, ৫ আগস্ট, ১৯৭১ সাল ।
৪১ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, পৃষ্ঠাঃ ৩৫-৩৬।
————————————————–
৩১
নিধনযজ্ঞে মেতে ওঠে। পাকসেনাদের নৃশংসতায় বিশ্ববাসী সেদিন শিহরিত হলেও স্বাধীনতাবিরােধী নিজামী এক ধরনের বিকৃত জিহাদী পুলক অনুভব করেছিলেন। বাঙালি হত্যাযজ্ঞে উল্লাস প্রকাশ করে নিজামী পাকসেনাদের ‘ভাই’ বলে সম্বােধন করে বিবৃতিতে বলেন- ‘পাকসেনারা আমাদের ভাই। দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী ও সাধারণ নাগরিক একাত্ম হয়ে আজ শত্রুর মােকাবিলা করবে’।৪২
————————————————–
৪২ দৈনিক সংগ্রাম, ৩ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
————————————————–
৩২
ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান ভারতীয় এজেন্ট!
—নিজামী
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে যেমন দলে দলে মানুষ মুক্তিবাহিনীতে যােগদান করে তেমনি বাংলাদেশের বাইরে নানা দেশে বসবাসরত বাঙালিরাও মুক্তিযুদ্ধে নানাভাবে সম্পৃক্ত হয়। এমনকি তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দিশিবির থেকে পালিয়ে এসেও অনেক বাঙালি সামরিক বাহিনীর লােকজন স্বাধীনতা যুদ্ধে শামিল হন।
মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পাকিস্তানে অবস্থানরত বেশিরভাগ বাঙালি সামরিক অফিসার ও সৈনিকদের নিরস্ত্র করে একরকম নজরবন্দি করে রাখা হয়েছিল। এরকম নজরবন্দি অবস্থায় ছিলেন ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান। দেশমাতাকে শৃঙ্খলমুক্ত করার জন্য বিমান বাহিনীর এই অকুতােভয় বাঙালি তরুণ অফিসারের হৃদয়কেও দারুণভাবে নাড়া দিয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের জন্য তিনি পথ খুঁজতে থাকেন। সুযােগও এসে যায় একদিন।
মতিউর রহমানকে নজরবন্দি অবস্থায় মাশরুর বিমান ঘাটিতে পাকিস্তানিরা একটি ভিন্নধর্মী কাজে নিয়ােজিত করেছিল। ২০ আগস্ট, ১৯৭১ মাসরুর বিমান ঘাটির অফিস থেকে হঠাৎ তিনি লক্ষ্য করেন, মিনহাজ নামক একজন পাকিস্তানি পাইলট অনুশীলনের জন্য একটি যুদ্ধ বিমান নিয়ে উড়তে যাচ্ছে। সুযােগ বুঝে মতিউর রহমান তার নিজ গাড়ি চালিয়ে Taxi Track-এর এক কোণায় গিয়ে পজিশন নেন।… রশিদ মিনহাজের প্লেন যখন Taxi Track-এর কাছে আসে, তখন মতিউর রহমান তার দৃষ্টি আকর্ষণ করে হাত দিয়ে সংকেত দেন প্লেন থামানাের জন্য।… প্লেন থামামাত্র মতিউর রহমান লাফ দিয়ে পাখার ওপর ওঠে রশিদের সাথে কথা বলার চেষ্টা করেন। রশিদ তার অক্সিজেন মাস্ক খােলার সঙ্গে সঙ্গে সম্ভবত ক্লোরােফর্ম ভেজানাে কাপড় দিয়ে তার মুখে চেপে রশিদকে পরাস্ত করেই মতিউর দ্রুতগতিতে প্লেনের পিছনের ককপিটে বসে পড়েন।৪৩ বিমানটি সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার পর মতিউর রাডারে ধরা না পড়ার জন্য অত্যন্ত নিচু দিয়ে বিমানটি নিয়ে উড়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু হঠাৎ করে বিমানটি বিধ্বস্ত হয়ে উভয়ে মারা যান। পরে বিধ্বস্ত বিমানটির টেপ রেকর্ডারটি উদ্ধার করা হলে ‘মিনহাজের শেষ
—————————————————-
৪৩ গ্রুপ ক্যাপ্টেন (অবঃ) মােঃ আব্দুল কুদুস পিএসসি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর স্মারকগ্রন্থ। মতিউর রহমান নিজামী আলবদর থেকে মন্ত্রী -৩
—————————————————-
৩৩
যে কথাটি টেপ রেকর্ডে ধরা পড়েছিল, সেটি ছিল, আমাকে হাইজ্যাক করা
হচ্ছে’।৪৪
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা সারা বিশ্বে অপপ্রচার করে আসছিল তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে স্বাধীন বাংলা সরকার বলে কোনাে কিছুর অস্তিত্ব নাই। সামরিক জান্তা আরাে বােঝাতে চাইতাে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীন বাংলা সরকার এসবই হচ্ছে ভারতীয়। ও ইহুদিদের অপপ্রচার এবং পাকিস্তানের সর্বত্র স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। অথচ যখন খােদ পাকিস্তানের করাচির সামরিক বিমান ঘাটিতেই ঘটে গেল যুদ্ধ বিমান ছিনতাইয়ের মত চাঞ্চল্যকর ঘটনা, তখন পাকসামরিক সরকার মহাব্রিতকর অবস্থায় পড়ে গেল। তাদের মিথ্যাচার বিশ্ববাসীর কাছে প্রকাশ হয়ে পড়বে এই ভয়ে দীর্ঘ ১০ দিন বিমান ছিনতাইয়ের ঘটনাটি গােপন রাখল । কিন্তু যখন নানা ফাঁকফোকর দিয়ে বিভিন্ন সংবাদ সংস্থার মাধ্যমে বিশ্ববাসীর কাছে ঘটনাটি ফাঁস হয়ে যায় তখন এক রকম বাধ্য হয়েই পাকসামরিক জান্তা ছিনতাইয়ের ঘটনাটি সরকারি প্রেসনােটের মাধ্যমে জনসমক্ষে প্রকাশ করে। ঘটনাটি ঘটেছিল ২০ আগস্ট অথচ সরকার প্রেসনােটটি দিয়েছিল ৩০ আগস্ট।
পরবর্তীতে পাকসামরিক সরকার মিনহাজকে পাকিস্তানের সর্বোচ্চ খেতাব। ‘নিশানে হায়দার’ দেন অপরদিকে বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ সরকার ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানের বীরত্বপূর্ণ আত্নাহুতির জন্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ খেতাব বীরশ্রেষ্ঠ উপাধিতে ভূষিত করেন। যুদ্ধ বিমান ছিনতাই ও মিনহাজের মৃত্যুতে পাকিস্তানে শােক ও হতাশা নেমে আসে। আর পাকিস্তানি দখলদার সামরিক জান্তার তাবেদার ঘাতক মতিউর রহমান নিজামী ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানের আত্নাহুতিতে শােকাহত না হয়ে বরঞ্চ মিনহাজের মৃত্যুতে শােক বিহ্বল হয়ে মিনহাজের পিতার নিকট একটি তারবার্তা প্রেরণ করেন। তারবার্তায় নিজামী বাঙালির গর্ব ‘বীরশ্রেষ্ঠ ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমানকে ভারতীয় এজেন্ট’ পক্ষান্তরে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর পাইলট মিনহাজকে ‘মহান শহীদ’ বলে উল্লেখ করেছেন। ৪ সেপ্টেম্বর নিজামীদের পত্রিকা দৈনিক সংগ্রামে ‘মিনহাজের পিতার নিকট ছাত্রসংঘ প্রধানের তারবার্তা’ এই হেড লাইনে পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়, ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী শহীদ মিনহাজের পিতার নিকট এক তারবার্তা প্রেরণ করেছেন বলে সংগঠনের প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে প্রকাশ, তারবার্তায় জনাব নিজামী বলেন যে, পকিস্তানি ছাত্র সমাজ তার পুত্রের মহান আত্মত্যাগে গর্বিত। ভারতীয় হানাদার ও এজেন্টদের মােকাবিলায় মহান শহীদ মিনহাজের গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা অক্ষুন্ন রাখতে তারা (নিজামীরা- লেখক) বদ্ধপরিকর।৪৫
—————————————
৪৪ দৈনিক সংগ্রাম, ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৭২ সাল। ৪৫ দৈনিক সংগ্রাম, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১ সাল।
—————————————
৩৪
ফ্লাইট লেফটেনেন্ট মতিউর রহমান ভারতীয় এজেন্ট!—নিজামী ৩৫ ‘৭১-এর ঘাতক মতিউর রহমান নিজামী আমাদের বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরকে ভারতীয় এজেন্ট’ এবং করাচিতে মতিউরের কবরকে পাকিস্তানিরা ‘গাদ্দারের কবর’ বলে অসম্মান করলেও বীরশ্রেষ্ঠ মতিউরের স্ত্রী মিলি রহমান স্বগর্বে বলেন, ‘আমার মতি কোনাে বিশেষ সময় বা হঠাৎ বিশেষ আবেগের তাড়নায় কোনাে ঘটনা ঘটিয়ে নিজের জীবন বিসর্জন দেয়নি। বরং বহু বছরের লালিত এক ঘৃণা বা আক্রোশের তাড়নায় তিনি এই পদক্ষেপটি নিয়েছিলেন।… ১৯৭১ সালে তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তানের সমস্ত বাঙালি যখন প্রায় গৃহবন্দি অবস্থায় জীবন কাটাচ্ছিল, তখন সুদূর পশ্চিম পাকিস্তানের বাঙালিরা একরকম নজরবন্দি অবস্থায় মৃত্যুকূপে অসহায়ভাবে দিন কাটাচ্ছিল। সেই অবস্থায় মৃত্যুর মধ্য দিয়ে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করে আমার মতি হয়ে রইলেন চিরভাস্বর। কাঁপিয়ে গেলেন পাকিস্তানের ভিত, জানিয়ে গেলেন বিশ্ববাসীকে- বাঙালি সত্যের জন্য যেমন লড়তে জানে, তেমনি হাসিমুখে মরতেও পারে।৪৬ এ অনুভূতি বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমানের সহধর্মিনী মিলি রহমানের একার নয়, এটা এখন চৌদ্দ কোটি বাঙালির অনুভূতি।
——————————————-
৪৬. মিলি রহমান, বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান স্মারকগ্রন্থ।
——————————————-
৩৫
দালাল মাদানী নিহত ও নিজামীর আস্ফালন
মওলানা মুস্তফা আল মাদানী ছিলেন পাকিস্তানি ঘাতক বাহিনীর একজন নির্ভরযােগ্য দোসর। শান্তি কমিটির প্রভাবশালী একজন সংগঠক ছিলেন তিনি। এছাড়াও রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনী গঠনেও তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন। তার ইঙ্গিতে পাকবাহিনী বহু গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছিল এবং হত্যা করেছিল বহু স্বাধীনতা পিপাসু বাঙালিদের। বাঙালি নিধনের নীলনকশা তৈরিতে তিনি ছিলেন সিদ্ধপুরুষ। এক কথায় মাদানী ছিলেন বাঙালিদের একটি আতঙ্ক। অথচ নিজামীদের কাছে এসব কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরােধী পাকিস্তানি। দালালরাই ছিল আলেম, বুজর্গ পীর এবং মােকলেছ। সারা দেশে ওয়াজ মাহফিলের নামে এই ব্যক্তিটি মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করে বেড়িয়েছেন দিনের পর দিন। পাকিস্তানি সৈনিক ও রাজাকার পরিবেষ্টিত হয়ে বিক্রমপুরের আব্দুল্লাপুর গ্রামে ওয়াজ মাহফিলের নামে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে এক প্রচার অভিযান চালানাের সময় মুক্তিযােদ্ধাদের এক দুঃসাহসিক গেরিলা হামলায় তিনি নিহত হন। মুক্তিযােদ্ধাদের এই সফল অভিযানে বাঙালিদের ভিতর খুশির বন্যা বয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এই কুখ্যাত দালালের নিহত হওয়ার সংবাদটি পরিবেশিত হওয়ার পর গ্রামে গ্রামে মিষ্টি বিতরণ শুরু হয়। অপরদিকে পাকিস্তানি তাবেদার নিজামীদের মহলে ক্ষোভ, হতাশা ও ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। দালাল মাদানীর অপঘাত মৃত্যুতে নিজামী ক্ষিপ্ত হয়ে পত্র পত্রিকায় মুক্তিযােদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী হিসেবে অভিহিত করে ন্যাক্কারজনক একটি বিবৃতি প্রদান করেন। বিবৃতিতে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে আস্ফালন করে বলেন, ইসলামী আন্দোলনের দুই একজন নেতাকে হত্যা করে পাকিস্তানে ইসলামী জীবন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার আন্দোলন স্তব্ধ করা যাবে না এবং দুষ্কৃতিকারীদের এর পরিণাম ফল ভােগ করতেই হবে।৪৭
উপরােক্ত জ্বালাময়ী বিবৃতি দিয়েই নিজামী ক্ষান্ত হননি। তিনি দালাল মাদানীর স্মরণে এক শােকসভার আয়ােজন করেন। এই শােকসভায় বক্তৃতাকালে নিজামী মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যাকারী’ বলে তিরস্কার করেন আর স্বাধীনতাবিরােধী
——————————————–
৪৭ দৈনিক সংগ্রাম, ১২ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
——————————————–
৩৬
৩৭ আল মাদানীকে ‘শহীদ’ বলে আখ্যায়িত করেন। বক্তৃতায় নিজামী বলেন- ‘পূর্ব পাকিস্তানের মাটি শহীদ আল মাদানীর মত এমন পুত পবিত্র রক্তে রঞ্জিত হওয়াই প্রমাণ করে যে, হত্যাকারীরা একটি ভূখণ্ডকে কারাে শাসন থেকে মুক্ত করার জন্য সংগ্রাম করছে না বরং একটি আদর্শকে উৎখাত করে অপর একটি আদর্শ কায়েম করতে চায়।… পাকিস্তানকে যারা বিচ্ছিন্ন করতে চায় তারা ইসলামকে উৎখাত করতে চায়’ ৪৮
মাদানী নিহত হওয়াতে স্বাধীনতাবিরােধী শক্তির অপূরণীয় ক্ষতি সাধিত হয়। তার মৃত্যুতে স্বাধীনতাবিরােধী মহলকে এতাে বিচলিত ও ক্রোধের অনলে দগ্ধ করেছিল যে নিজামীর গুরু মওদুদী ও গােলাম আযম তাৎক্ষণিকভাবে তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিলেন। মওদুদী ও গােলাম আযম কঠোর ভাষায় বিবৃতি দিয়েছিলেন। গােলাম আযম বিবৃতিতে মুক্তিযােদ্ধাদের ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলমানের দুশমন’ এবং বাংলাদেশকে তথাকথিত বাংলাদেশ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। গােলাম আযম প্রতিশােধ স্পৃহায় মুক্তিযােদ্ধাদের তন্ন তন্ন করে তালাশ করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। গােলাম বিবৃতিতে বলেছিলেন, “ইসলাম, পাকিস্তান ও মুসলমানদের দুশমন তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা। আর যাই হােক দেশের ভালাে, সৎ লােক, ঈমানদার লােক, পাকিস্তানের প্রতি অনুগত ও আস্থাভাজন লােকদের বহুসংখ্যক ইতােমধ্যে শহীদ করেই ছাড়েনি তারা মওলানা মাদানী সাহেবের মত একজন সর্বজন শ্রদ্ধেয় আলেম, বুজর্গ পীর এবং মােখলেছ পাকিস্তানিকেও শহীদ করতে সাহসী হয়েছে যার সমগ্র জীবন ইসলাম ও পাকিস্তানের জন্য ওয়াকফ। তার শাহাদতে গােটা পাকিস্তানের মুসলিম মানস চরমভাবে বিক্ষুব্ধ। তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের উচিত তাদের ঈমানকে দুরস্ত করা। মওলানা মাদানীর এ শাহাদতের সত্যিকার মর্যাদা তখনই সম্ভব যখন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি মুসলমান নিজ নিজ এলাকার দুষ্কৃতিকারীদের তন্ন তন্ন করে তালাশ করে তাদের থেকে দেশকে মুক্ত করার জন্য রাতদিন চেষ্টা করবে। পাকিস্তান ও ইসলামকে দুশমনের হাত থেকে রক্ষার জন্য জেহাদের আন্তরিক প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করবে। মওলানা মাদানীর এ শাহাদত পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের বুকে ঈমানের আগুন প্রজ্জ্বলিত করবে এ আমার পূর্ণ বিশ্বাস।৪৯
——————————————-
৪৮ দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
৪৯ দৈনিক সংগ্রাম, ১২ আগস্ট, ১৯৭১ সাল।
——————————————-
৩৭
নিজামী ও আলবদর
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজামী শুধু বক্তৃতা, বিবৃতি ও প্রবন্ধ, নিবন্ধ লিখেই ক্ষান্ত। হননি। মুক্তিযুদ্ধকে প্রতিহত করার জন্য তিনি রীতিমত কয়েকটি সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছিলেন। এসব বাহিনীর মধ্যে সবচেয়ে সংগঠিত ও ভয়ঙ্কর ছিল আলবদর বাহিনী। তিনি নিজেই এই বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত হন। নিজামীর নেতৃত্বাধীন ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের বাছা বাছা কর্মীদের সমন্বয়ে এই ঘাতক বাহিনীর সৃষ্টি হয়েছিল।
আলবদর বাহিনী যে পাকিস্তানের খুনি সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় এবং ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত হয়েছিল তা নিজামী কখনও অস্বীকার করতে পারবেন না। কারণ জামায়াতীদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের ১৯৭১ সালের ১৪ নভেম্বর নিজামীর রচিত প্রবন্ধেই এই সত্যটি জ্বলজ্বল করছে। বদর দিবসঃ পাকিস্তান ও আলবদর’ এই শিরােনামে প্রকাশিত প্রবন্ধে নিজামী বলেন- ‘বিগত দু’বছর থেকে পাকিস্তানের একটি তরুণ কাফেলার ইসলামী পুনর্জাগরণ আন্দোলনের ছাত্র প্রতিষ্ঠান পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘ এই ঐতিহাসিক বদর দিবস পালনের সূচনা করেছে।… আমাদের পরম সৌভাগ্যই বলতে হবে পাক সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় এদেশের ইসলাম প্রিয় তরুণ সমাজ বদর যুদ্ধের স্মৃতিকে সামনে রেখে আলবদর বাহিনী গঠন করেছে।৫০
নিজামীর এই প্রবন্ধ থেকে আরাে জানা যায় যে, নিজামী আলবদর বাহিনীর এক একটি ইউনিট ৩১৩ জনের সমন্বয়ে গঠন করেছিলেন। তার এই প্রবন্ধে তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের হিন্দুবাহিনী বলে মন্তব্য করেন এবং খুনি পাকবাহিনীর সাথে ঐক্যবদ্ধভাবে যুদ্ধ করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে বলেন- ‘…. আমাদের বিশ্বাস। সেদিন আর বেশি দূরে নয় যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দুবাহিনীকে পরাস্ত করে হিন্দুস্তানের অস্তিত্বকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উডডীন করবে।৫১
——————————————-
৫০. মতিউর রহমান নিজামী, বদর দিবসঃ পাকিস্তান ও আলবদর, দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১। ৫১. মতিউর রহমান নিজামী, বদর দিবসঃ পাকিস্তান ও আলবদর, দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ নভেম্বর, ১৯৭১।
——————————————-
৩৮
২৩ নভেম্বর পাকিস্তান সরকার জরুরি অবস্থা জারি করলে তার সমর্থনে নিজামী ২৫ নভেম্বর ঢাকা শহরে আলবদরদের নিয়ে একটি মিছিল বের করেন। এই মিছিলের পুরােভাগে থেকে নিজামী মিছিলের নেতৃত্ব দেন। পরদিন ২৬ নভেম্বর আলবদরের এই মিছিলের সংবাদ ফলাও করে দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশ করা হয়। প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানের পাক ভূমিতে সাম্রাজ্যবাদী ভারতের ঘৃণ্য হামলার প্রতিবাদে নিন্দা জ্ঞাপন করে ঢাকা শহরে আলবদরের উদ্যোগে গতকাল বৃহস্পতিবার ঢাকায় এক বিরাট বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলটি বায়তুল মােকাররম থেকে শুরু হয়ে শহরের প্রধান প্রধান সড়কগুলি প্রদক্ষিণ করে।৫২
২৩ সেপ্টেম্বর নিজামী আলিয়া মাদ্রাসায় বদর বাহিনীর ক্যাম্পে বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ভৎসনা করে যে বক্তৃতা দেন তাতেই বুদ্ধিজীবী হত্যার প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তার বক্তব্যে তিনি আলবদরদের বলেন- যারা ইসলামকে ভালােবাসে শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালােবাসে। এবারের সংঘটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।৫৩
নিজামীর বুদ্ধিজীবী হত্যার নীলনকশা কার্যকর করার জন্য আলবদর বাহিনী। দিয়ে ‘শয়তান নির্মূল অভিযান’ নামে একটি অভিযান চালিয়েছিলেন। এই অভিযানে আলবদররা ‘শনি’ নামে বুদ্ধিজীবীদের কাছে চিঠি পাঠায়। বুদ্ধিজীবী হত্যার হুমকি দিয়ে চিঠিতে লেখা হয়, তােমার মনােভাব চালচলন ও কাজকর্ম কোনােটাই আমাদের অজানা নেই।… এই চিঠি পাওয়ার সাথে সাথে নির্মূল হওয়ার জন্য প্রস্তুত হও।৫৪
| আলবদর বাহিনী গঠিত হওয়ার পর উল্লসিত হয়ে নিজামীদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম’ এই বাহিনীর আদর্শ ও উদ্দেশ্য বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছেন, ‘আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রত্যাশা! যেখানে তথাকথিত মুক্তি বাহিনী আলবদর সেখানেই ভারতীয় চর কিংবা দুষ্কৃতিকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল’।৫৫
হা নিজামীদের পত্রিকাটি বদর বাহিনীর চরিত্র যথার্থই ফুটিয়ে তুলেছিল। আলবদর শুধু মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য সাক্ষাৎ আজরাইলই ছিল না, তারা সমস্ত মুক্তিকামী বাঙালির জন্য ছিল মূর্তিমান জল্লাদ। এক কথায় আলবদর নামক এই দানব বাহিনী ১৯৭১ সালে বাঙালি হত্যার মহােৎসবে মেতে উঠেছিল। এদের। পরিকল্পনা ছিল সুদূর প্রসারী ও ভয়ঙ্কর। তারা চেয়েছিল গােটা বাঙালি জাতিকেই
—————————————————
৫২. দৈনিক সংগ্রাম, ২৬ নভেম্বর, ১৯৭১।
৫৩. জামায়াতে ইসলামের অতীত বর্তমান, পৃষ্ঠা-৭৫।
৫৪. একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১৪১।
৫৫. দৈনিক সংগ্রাম, ১৪ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
—————————————————
৩৯
চিরতরে মেধাশূন্য করে দিতে, যাতে বাঙালি জাতি পৃথিবীতে কোনােদিন মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারে। তাদের এই মহাপরিকল্পনার অংশ হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রখ্যাত অধ্যাপক, স্বনামধন্য চিকিৎসক, প্রকৌশলী, প্রথিতযশা সাহিত্যিক, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের নাম লিস্ট করে খুব ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করেছিল। বিখ্যাত মার্কিন সাংবাদিক রবার্ট পেইন তাঁর সাড়া জাগানাে ম্যাসাকার। নামক গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, বুদ্ধিজীবী হত্যার দীর্ঘ তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছিল আলবদর নামে ধর্মোন্মত্ত দলকে দিয়ে।৫৬ এই গ্রন্থের আরেক জায়গায় রবার্ট পেইন বলেন, এরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রদের গােপনে হত্যার চক্রান্ত করে। শুধু গােপন চক্রান্তই নয় আলবদররা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল লােক চক্ষুর আড়ালে’।৫৭
মুক্তিযুদ্ধের বিশিষ্ট গবেষক ড. হান্নান বলেন- নভেম্বর মাসের শেষ থেকে। ডিসেম্বর মাসের মাঝ পর্যন্ত ঢাকাসহ সারা দেশে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে যে হত্যাকাণ্ড চালানাে হয়, তা করে একমাত্র জামাতে ইসলামী ও ইসলামী ছাত্র সংঘের বাহিনী- আলবদর গােষ্ঠী। পাকিস্তানের সেনারা এসময় ছিল এদের সহযােগী মাত্র।৫৮
বুদ্ধিজীবী নিধনযজ্ঞে আলবদরের বর্বরতা
নিজামী তার গঠিত আলবদর বাহিনীকে হিটলারের গেস্টাপাে ও মুসােলিনীর নাজি বাহিনীর আদলে গড়ে তুলেছিলেন। নৃশংসতা ও পৈশাচিকতার দিক থেকে এরা অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করেছিল। হত্যা, গুপ্তহত্যা, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতনসহ এমন কোনাে অপরাধ নেই যা তারা করেনি। এদের হাতে সেদিন পরাজিত হয়েছিল সভ্যতা। বিকৃত উল্লাস ও আদিম হিংস্রতায় আমাদের বুদ্ধিজীবীদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এই শকুনের দল। মানুষ হত্যা ও নির্যাতনের নানা কলা-কৌশল উদ্ভাবন করেছিল ঘাতক দলটি। ঢাকাসহ সারা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল পর্যন্ত তারা অসংখ্য বন্দিশিবির গড়ে তুলেছিল। ঢাকার প্রধান বন্দিশিবিরটি ছিল মােহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজে। ঢাকা শহরে কারফিউ ও ব্ল্যাক আউটের মধ্যে কাদা মাখানাে একটি বাসে করে বুদ্ধিজীবীদের। ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের বন্দিশিবিরে আনা হতাে। কাউকে দুপুর, কাউকে গভীর রাতে আবার কাউকে খাবার টেবিল থেকে তুলে আনা হতাে। প্রথমে চোখ বেঁধে বুদ্ধিজীবী ও স্বাধীনতা পক্ষের নেতাকর্মীদের বন্দিশিবিরে নেওয়া হতাে। বন্দিশিবিরে নেবার পর বন্দিদের সরাসরি গুলি করে হত্যার পক্ষপাতী ছিল না এই হায়নার দল। দীর্ঘতম অত্যাচারের পর একজন মানুষকে মৃত্যুর শেষ সীমানায়
——————————————-
৫৬ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার।
৫৭ রবার্ট পেইন, ম্যাসাকার, পৃষ্ঠা-৩৫।
৫৮ মােহাম্মদ হাননান, বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের ইতিহাস, মুক্তিযুদ্ধ পর্ব, পৃষ্ঠা-৩৮০।
——————————————-
৪০
ছিল। ১৪ ডিসেম্বর এই তালিকার ৮ জন শিক্ষক ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল।৬০ এরা হচ্ছেন- মুনীর চৌধুরী (বাংলা), ড. আবুল খায়ের (ইতিহাস), গিয়াসউদ্দিন আহমেদ (ইতিহাস), রশিদুল হাসান (ইংরেজি), ড. ফয়জুল মহী (শিক্ষা গবেষণা) এবং ড. মর্তুজা (চিকিৎসা)।
ড্রাইভার মফিজুদ্দিনের স্বীকারােক্তির ভিত্তিতে রায়ের বাজারের বিল ও মিরপুরের শিয়ালবাড়ির বধ্যভূমি থেকে অধ্যাপকদের গলিত বিকৃত মৃতদেহ উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছিল।
এই জল্লাদের ডায়েরিতে আরাে যাদের নাম ছিল অথচ হত্যা করার সময় পায়নি তারা হচ্ছেন- ওয়াকীল আহমদ (বাংলা), ড. নীলিমা ইব্রাহীম (বাংলা), ড. লতিফ (শিক্ষা গবেষণা), ড. মনিরুজ্জামান (ভূগােল), ড. কে.এম. সফিউদ্দিন (সমাজতত্ত্ব), এ.এম.এম. শহীদুল্লা (গণিত), ড. সিরাজুল ইসলাম (ইসলামের ইতিহাস), ড. আখতার আহমেদ (শিক্ষা), জহিরুল হক (মনােবিজ্ঞান), আহসানুল হক (ইংরেজি) সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী (ইংরেজি) এবং কবীর চৌধুরী।
নিজামীর আরেকজন বিশ্বস্ত সহকর্মী ছিলেন এ.বি.এম. খালেক মজুমদার। ১৯৭১ সালে তিনি ছিলেন ঢাকা শহরের জামায়াতে ইসলামীর দপ্তর সম্পাদক। নিজ হাতকে শক্তিশালী করার জন্য নিজামী খালেক মজুমদারকে আলবদর বাহিনীতে নিয়ে আসেন। অচিরেই খালেক মজুমদার বুদ্ধিজীবীদের জন্য এক মূর্তিমান দানবে পরিণত হন। কারফিউ আর ব্লাক আউটের মধ্যে এ.বি.এম. খালেক মজুমদার আরাে ছ’সাত জন আলবদরকে নিয়ে দরজা ভেঙে শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়িতে ঢােকেন। তাদের পরনে ছিল ছাই রংয়ের পােশাক, সাদা কাপড়ে মুখ বাঁধা ছিল। হাতে ছিল রিভলবার, রাইফেল এবং মেশিনগান। দলের তিনজন দোতলা থেকে শহীদুল্লাহ কায়সারকে ধরে নিয়ে আসে।
১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলে কয়েতটুলী মসজিদের ইমাম হাফেজ মােহাম্মদ আশরাফুদ্দিন শহীদুল্লাহ কায়সারের বাড়িতে গিয়ে জানান, স্থানীয় খালেক মজুমদার কয়েকদিন আগে তার কাছে শহীদুল্লাহ কায়সারের ঠিকানা এবং তিনি রাত্রে কোথায় থাকেন জানতে চেয়েছিলেন। তার তথ্যের ওপর ভিত্তি করে ছােট কাটরার মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা বাহিনী রামপুরার টেলিভিশন কেন্দ্রের। কাছাকাছি একটি গােপন আড্ডা থেকে খালেককে গ্রেফতার করে। খালেক আটক হবার পর ইমাম সাহেব তাকে শনাক্ত করেন। শহীদুল্লাহ কায়সার হত্যা মামলায়। খালেক মজুমদারের বিরুদ্ধে সমস্ত অভিযােগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছিল।
‘গ্রেফতার হওয়ার সময় খালেক মজুমদারের বাড়িতে তল্লাশি চালিয়ে ১টি পিস্তল, ৪০ রাউন্ড গুলি, বদর বাহিনীর ট্রেনিং সংক্রান্ত কাগজপত্র এবং বুদ্ধিজীবীদের হত্যার ব্যাপারে জামায়াতের সর্বশেষ সার্কুলার পাওয়া গিয়েছিল।৬১
—————————————–
৬০ একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১৫২।
৬১ একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১৪৭।
—————————————–
৪২
আলবদর হেড কোয়ার্টারে বাঙালিদের এক বস্তা চোখ
নিজামীরা মুক্তিপাগল বাঙালিদের ইসলামের নামে মওদুদীবাদে দীক্ষিত করে স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিরত রাখতে চায়। কিন্তু ব্যর্থ হয়ে এসব গােড়া ধর্মান্ধরা ক্রোধান্বিত হয়ে বাঙালি জাতির ওপর কাপুরুষােচিত হত্যাকাণ্ড চালিয়ে প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেছিল। সেদিন বাঙালি হত্যায় কি পাশবিক উল্লাসে মেতেছিল এসব। হায়েনার দল তা ৭২ সালে ১৯ জানুয়ারি দৈনিক পূর্বদেশে প্রকাশিত প্রতিবেদনে। জানা যায়। দৈনিক পূর্বদেশ তৎকালীন বর্ষিয়ান নেতা মওলানা আব্দুর রশিদ তর্কবাগিশের উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবেদনে উল্লেখ করে, ‘হানাদার পাকবাহিনীর সহযােগী আলবদরেরা পাক সেনাদের আত্মসমর্পনের পর যখন পালিয়ে যায় তখন তাদের হেড কোয়ার্টারে পাওয়া গেল এক বস্তা বোেঝাই চোখ। এদেশের মানুষের চোখ। আলবদরের খুনিরা তাদের হত্যা করে চোখ তুলে বস্তা বােঝাই করে। রেখেছিল।
বৃদ্ধ মওলানা খেদোক্তি করে আরাে বলেন- খুনিদের এই বাহিনীর নাম দেওয়া হলাে আলবদর বাহিনী। একি কোনাে মনঃপুত নাম? যে বদর যুদ্ধ ছিল আদর্শের জন্য, ইসলামের প্রথম লড়াই, সেই যুদ্ধের সাথে কি কোনাে সংযােগ এই নৃশংসতার মধ্যে ছিল? মওলানা বলেন, হানাদারদের সহযােগী এই বদর বাহিনী শুধু ইসলামের শত্রু নয়, এরা হলাে জালেম।
আলবদরের এই নৃশংসতার সাথে চীনের অত্যাচারী সম্রাট চেংসিয়েন চুং-এর হিংস্রতার সাথে মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বিদ্রোহী গ্রামবাসীদের তিনি নির্বিচারে হত্যা করেই শান্তি পাননি। তিনি সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছিলেন নিহত গ্রামবাসীদের কান এবং পায়ের পাতা কেটে আনার জন্য, প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে মৃতদেহগুলাে রাজধানীতে আনা অসুবিধা মনে করে তিনি এই নির্দেশ দিয়েছিলেন। এই কান ও পায়ের পাতা নাকি পিরামিডের মত উঁচু হয়েছিল আর তাই দেখে নাকি প্রতিহিংসাপরায়ণ রাজা পরম তৃপ্তি অনুভব করেছিলেন। তেমনিভাবে নিজামীরাও বুদ্ধিজীবীদের মৃতদেহ আলবদরের হেড কোয়ার্টারে আনা অসুবিধা বিধায় শুধু চোখ উপড়ে এনে জমা করে পৈশাচিক উল্লাসে মেতেছিল।
বধ্যভূমি নিজামীর আলবদর বাহিনীর নৃশংসতার একটি জ্বলন্ত স্বাক্ষর
নিজামীর আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালে ইতিহাসের নিকৃষ্টতম বর্বরােচিত যে। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছিল তার জাজ্বল্যমান সাক্ষ্য বহন করে চলেছে, তাদেরই । সৃষ্ট বধ্যভূমিগুলাে। এসব বধ্যভূমির নৃশংসতার ছবি দেখলে কিংবা সেই সময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রত্যক্ষদর্শী স্বনামধন্য লেখক কিংবা সাংবাদিকদের প্রবন্ধ। পাঠ করলে যে কোনাে সুস্থ মানুষও স্থির থাকতে পারবে না। হত্যাকে উৎসব ভেবে সেদিন এদেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান বুদ্ধিজীবী ও মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছিল পশু শক্তিতে বলিয়ান এসব নর পিশাচের দল।
৪৩
আমরা শিয়ালবাড়ির যে বিস্তীর্ণ বন-বাদাড়পূর্ণ এলাকা ঘুরেছি তার সর্বত্রই। দেখেছি শুধু নরকঙ্কাল আর নরকঙ্কাল। পা বাঁচিয়েও হাড়হীন মাটির ওপর পা ফেলতে পারিনি। (ক্ষমা কর শহীদ ভাই বােনেরা, দেশের জন্য আত্মদান করার পরও তােমাদের হাড় মাড়িয়ে চলতে হচ্ছে আমাদের।) দেখেছি কুয়ায় কুয়ায় মানুষের হাড়।৬৩
শুধু ঢাকার শিয়ালবাড়ি, রায়ের বাজার, কাটাসুর নয় সারা বাংলাদেশেই নিজামীর আলবদর বাহিনী শত শত বধ্যভূমির সৃষ্টি করেছিল। আর সেসব এলাকার ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষকসহ শত শত স্বাধীনতাকামী মানুষকে নির্মম নির্যাতনের মধ্য দিয়ে হত্যা করেছিল। দৈনিক আজাদ ২৭ ডিসেম্বর ১৯৭১-এর সংখ্যা গ্রেফতারকৃত কতিপয় আলবদর সদস্যের স্বীকারােক্তি উদ্ধৃত করে লেখে- ‘আর এক সপ্তাহ সময় পেলেই আলবদর বাহিনী। সকল বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে ফেলতাে।
আলবদর বাহিনীর নারী নির্যাতন ও হত্যা
বাঙালি নিধনে নিজামী ও তার আলবদর বাহিনীর কাছে নারী পুরুষ বলে কোনাে বাছ বিচার ছিল না। নারী নির্যাতন ও হত্যার ক্ষেত্রে নিজামী ও তার আলবদর। বাহিনীর জুড়ি মেলা ভার। এসব ধর্মাশ্রয়ী ও পাপাচারদের হাতে সেদিন নারীর মর্যাদা ও সম্ভ্রম হয়েছিল, কলুষিত। নারী নির্যাতন ও হত্যার ক্ষেত্রে ইসলামের। কোনাে মূল্যবােধই তাদের রুখতে পারেনি। তাদের এই নারী নির্যাতনের বীভৎসতা ইসলামসহ সভ্য জগতের কোনাে বিবেকবান মানুষই অনুমােদন করতে পারেনি। ঢাকার গ্রিনল্যান্ড মার্কেন্টাইল কোম্পানি লিমিটেডের চিফ একাউন্টেন্ট মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন আলবদরদের চোখ ফাঁকি দিয়ে রায়ের বাজার বধ্যভূমি থেকে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর দৈনিক বাংলায় তার জবানিতে ঢাকার আলবদরদের প্রধান বন্দিশিবির মােহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজের লােমহর্ষক বন্দি জীবনের বর্ণনা দেন। তার বর্ণনায় নারী নির্যাতন ও লাঞ্ছিত হওয়ার করুণ চিত্র ফুটে ওঠে। জবানিতে মােহাম্মদ দেলােয়ার হােসেন বলেন- “রাত দশটা থেকে অনুমান একটা পর্যন্ত বেশ কয়েকবার বদর বাহিনীর জল্লাদেরা এসে আমাদের খানিক পর পর দেখে গেল। রাত প্রায় ১২টায় আমাদের উপরতলা থেকে কয়েকজন মহিলার আর্তনাদ ভেসে এলাে। সেই আর্তনাদের বর্ণনা দেওয়া আমার পক্ষে দুঃসাধ্য।… কোনাে এক মহিলা চিৎকার করে বলে উঠলেন- আপনারা আমার বাপ, ভাই। আমাকে মারবেন না। চারিদিকে মাতম, আহাজারি, তা বর্ণনার ভাষা আমার নেই।৬৪
——————————————
৬৩. দৈনিক পূর্বদেশ, ৮ জানুয়ারি, ১৯৭২।
৬৪. একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-৫২, ৫৩।
——————————————
৪৫
শিলালিপির এডিটর সেলিনা পারভীনকে তার বাসা থেকে আলবদর বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। নিজামীর আলবদর বাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও নিহত সেলিনা পারভীনের লাশের যে বর্ণনা সেদিন দৈনিক পত্রিকায় অধ্যাপিকা হামিদা রহমান দিয়েছিলেন তা পড়ে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়েছিল এবং নারীর মর্যাদার প্রতি | নিজামীদের কুৎসিত দৃষ্টিভঙ্গী ও বিকৃত মূল্যবােধ ধরা পড়েছিল। এই প্রতিবেদনে আরাে ফুটে ওঠে ধর্মাশ্রয়ী পাপিষ্ঠ নিজামীদের নারী নির্যাতনের বীভৎস রূপ। শুধু তাই নয় নারী নির্যাতন ও হত্যার সময় ইসলামের ভেকধারী এসব নরপশুরা নারীর মর্যাদা ও আব্রুকে ভূলুণ্ঠিত করতে কোনােরূপ দ্বিধা সংকোচ করেনি। কাঁটাসুরের বধ্যভূমি পরিদর্শন করে অধ্যাপিকা হামিদা রহমান ১৯৭২ সালের ২ জানুয়ারি দৈনিক আজাদে সেলিনা পারভীনের লাশের এক করুণ ও হৃদয় বিদারক বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন, আর একটু এগিয়ে যেতেই বাঁ হাতের যে মাটির ঢিবিটা ছিল তারই পাদদেশে একটি মেয়ের লাশ। মেয়েটির চোখ বাঁধা। গামছা দুটো আজও ওখানে পড়ে আছে। পরনে কালাে ঢাকাই শাড়ি ছিল। এক পায়ে মােজা ছিল। মুখ ও নাকের আকৃতি নেই। কে যেন অস্ত্র দিয়ে তা কেটে খামচিয়ে তুলে নিয়েছে। যেন চেনা যায় না।… স্তনের একটা অংশ কাটা। লাশটা চিৎ হয়ে পড়ে আছে। বীভৎস চেহারার দৃশ্য বেশিক্ষণ দেখা যায় না। তাকে আমি চিনতে পারিনি। পরে অবশ্য শনাক্ত হয়েছে যে, মেয়েটি সেলিনা পারভীন, ‘শিলালিপি’র এডিটর।৬৫
এই প্রতিবেদনে অধ্যাপিকা হামিদা রহমান আরাে একটি মেয়ের নারী কঙ্কালের মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়েছিলেন এভাবে, আর একটু দূরে যেতেই দেখতে পেলাম, একটি কঙ্কাল, শুধু পা দুটো আর বুকের পাঁজরটিতে তখনও অল্প মাংস আছে। বােধ হয় চিল শকুনে খেয়ে গেছে। কিন্তু মাথার খুলিটিতে লম্বা লম্বা চুল। চুলগুলাে ধুলাে কাদায় মিশে যেয়ে নারী দেহের সাক্ষ্য বহন করছে।৬৬
বদর যুদ্ধ ছিল ইসলামের ইতিহাসের প্রথম যুদ্ধ। যুদ্ধে মুসলমানদের সহজ বিজয় অর্জিত হয়। তাই বদরের যুদ্ধে মুসলিম ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা স্মরণীয় যুদ্ধের অন্যতম। বদর যুদ্ধের বিজয়ে ইসলাম বেঁচে থাকার অবকাশ পায়। মহান বদর যুদ্ধে জয়লাভের পর ইসলামের জয়যাত্রা শুরু হয়।
মক্কার বিধর্মীদের দ্বারা অত্যাচারিত হয়ে এবং মহান আল্লাহপাকের আদেশে নবীজী (সাঃ) বিচলিত হয়ে ওঠেন। তখন আল্লাহর তরফ হতে নবীজীর (সাঃ) কাছে ওহি নাজিল হলাে, আল্লাহ্র পথে তাদের সাথে যুদ্ধ করাে, যারা তােমাদের সাথে যুদ্ধ করে, তবে সীমা লঙ্ন করাে না। কারণ আল্লাহ্ সীমা লঙ্ঘনকারীকে পছন্দ করেন না।৬৭
——————————————
৬৫. একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১১০।
৬৬. একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১১০।
৬৭. সুরা বাকারা, ১৯০।
——————————————
৪৬
তাহলে মওলানা মতিউর রহমান নিজামী আলবদর বাহিনী গঠন করে হাজার হাজার বধ্যভূমি সৃষ্টি করে, নারী নির্যাতন ও সম্ভ্রম লুণ্ঠন করে এবং নিরপরাধ, নিরস্ত্র ও নিরীহ বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের ওপর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ চালিয়ে কি ‘সীমা লজ্জন’ করেননি? আবার নিজামী দ্বারা নির্যাতিত বাঙালিদের শতকরা ৮৫ ভাগই ছিল মুসলমান। ইতিহাস থেকে আমরা আরাে জানতে পারি যে, মহান বদরযুদ্ধে জয়লাভের পরও নবীজী (সাঃ) কোনাে বিধর্মীর ওপর অন্যায় অত্যাচার করেননি। তাহলে ইসলামের ভেকধারী, যিনি নামের আগে মওলানা ব্যবহার করেন এবং বেশভূষা ও চেহারায় ‘পাক্কা’ ঈমানদার তিনি ইসলামের কোন শিক্ষা থেকে স্বজাতি এবং নিজ ধর্মের নারী-পুরুষের ওপর নিষ্ঠুর অন্যায় অত্যাচারের খড়গ চালিয়েছিলেন? নবীজীর (সাঃ) মহান ধর্মযুদ্ধের নামে নিজামী তার ঘাতক বাহিনী নামকরণ করে কি মহাপাপ করেননি? নবীজীকে (সাঃ) এভাবে অপমানিত করার জন্য নিজামীকে ইতিহাস কখনই ক্ষমা করবে না।
বুদ্ধিজীবী নিধনঃ নিজামী, সি.আই.এ. এবং রাও ফরমান আলীর একটি সম্মিলিত মিশন
যে কোনাে দেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম কিংবা জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল আন্দোলনে বুদ্ধিজীবীদের বিরাট ভূমিকা থাকে। তাদের ক্ষুরধার লেখনী ও যুক্তিবাদী বক্তব্যের মাধ্যমে জাতির ঘুমন্ত বিবেক জাগিয়ে তােলে। বাঁচার লড়াইয়ে মানুষকে উদ্বুদ্ধ করে। তাই সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রকারীরা মনে করে যেকোনাে দেশের মানব মুক্তির লড়াইকে দমাতে হলে বুদ্ধিজীবীদের নির্মূল করা প্রয়ােজন। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ তাদের ঔপনিবেশিক শাসন ও শােষণ টিকিয়ে রাখার জন্য সেদেশে তাদের প্রতিষ্ঠিত পুতুল সরকারের মাধ্যমে বুদ্ধিজীবী হত্যার ন্যাক্কারজনক এই পথটি বেছে নিয়েছে। আর এই বুদ্ধিজীবী হত্যার কাজ নিখুঁতভাবে করার জন্য মার্কিন গােয়েন্দা সংস্থা সিআইএ তাদের কর্মীদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। হেলেন হেইট ও ডুসপিক এই দুজন ছিলেন সিআইএ-র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ঘাতক, যারা বিভিন্ন দেশে বুদ্ধিজীবী হত্যা করে বিশেষ কুখ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
ইন্দোনেশিয়ায় বুদ্ধিজীবী হত্যা করে হাত পাকিয়ে এ দু’জন ঘাতক ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন। ইন্দোনেশিয়াতে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ড পরিচালনা করার অপরাধে এই দুই ব্যক্তির অনুপস্থিতিতেই সে দেশের সরকার তাদের বিচারের সম্মুখীন করেছিলেন।
বাঙালি জাতিকে নিঃশেষ করে দিতে হলে কিভাবে বেছে বেছে বুদ্ধিজীবী হত্যা করতে হবে তার পরিকল্পনা করেছিলেন সিআইএ-র প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এই দুই এজেন্ট ও পাকিস্তানি জেনারেল রাও ফরমান আলী। এরা মিলে তিন হাজার বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের তালিকা প্রস্তুত করেছিলেন। তারপর তাদের এই হত্যা পরিকল্পনাটি বাস্তবায়নের জন্য তুলে দেওয়া হয়েছিল খুনি নিজামীর হাতে।
৪৭
নিজামীও এই তালিকা মােতাবেক সমস্ত বুদ্ধিজীবী হত্যার নির্দেশ দিয়েছিলেন তার ঘাতক আলবদর বাহিনীকে। বুদ্ধিজীবী অপহরণ ও হত্যার ক্ষেত্রে এই তালিকাটি। যে নিজামীরা বিশেষ গুরুত্বসহকারে অনুসরণ করেছিলেন তার যথেষ্ট প্রমাণ পরবর্তীতে পাওয়া গিয়েছিল। পাকবাহিনী আত্মসমর্পণের পর নিয়াজীর শােবার ঘরে প্রাপ্ত এই তালিকার সাথে নিজামীর বিশ্বস্ত অনুচর আলবদর বাহিনীর প্রধান জল্লাদ আশরাফুজ্জামান খানের প্রাপ্ত ডায়েরিতে বুদ্ধিজীবীদের যে তালিকা রয়েছে, তাতে রয়েছে অদ্ভুত মিল। এই তালিকা অনুসারে অনেককেই নিজামীরা ডিসেম্বরের পূর্বেই হত্যা করেছিল।
হেইট ও ডুসপিক যে রাও ফরমান আলীর সাথে বাঙালি বুদ্ধিজীবী হত্যা পরিকল্পনার সাথে যুক্ত ছিলেন তার প্রমাণও মুক্তিযুদ্ধের পর ফরমান আলীর ডায়েরিতেই পাওয়া যায়, ফরমান আলীর ডায়েরিতে এই দুজনের নামের পাশে ছােট ছােট অক্ষরে লেখা U.S.A ও D.G.I.S অর্থাৎ ডিরেক্টর জেনারেল অব। ইন্টারন্যাশনাল সার্ভিস লেখা ছিল। আর লেখা আছে রাজনৈতিক ৬০-৬২, ৭০’। অপর এক জায়গায় লেখা আছে- এ দুজন আমেরিকান পিআইএ-র একটি বিশেষ বিমানে ব্যাংককের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করে।৬৮
—————————————
৬৮ একাত্তরের ঘাতক কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১২১।
—————————————
৪৮
নিজামী ও শান্তি কমিটি
১৯৭১ সালে বাঙালি গণহত্যার নায়ক লে. জে. নিয়াজীর গণসংযােগ অফিসার ছিলেন কর্নেল সিদ্দিক সালেক। নিয়াজীর গণসংযােগ অফিসার থাকার সুবাদে কর্নেল সিদ্দিক সালেকের পক্ষে সামরিক জান্তা এবং এদেশীয় স্বাধীনতাবিরােধী মােনাফেকদের চক্রান্ত ও কর্মকাণ্ড খুব কাছে থেকে দেখার সুযােগ হয়েছিল । বাংলাদেশের স্বাধীনতার ওপর স্মৃতিচারণ করে তিনি একটি গ্রন্থ রচনা করেন। তার গ্রন্থটির নাম ‘উইটনেস টু সারেন্ডার’। এই বইতে তিনি শান্তি কমিটির গঠন প্রক্রিয়া সম্পর্কে বর্ণনা দিতে গিয়ে বলেন- বয়স্ক ও নামীদের নিয়ে শান্তি কমিটি গঠিত হলাে, আর যারা তরুণ ও কর্মক্ষম দেহের অধিকারী তাদের রাজাকার বাহিনীতে রিক্রুট করা হলাে।
১৯৭১ সালে বাঙালিদের ওপর বর্বর হত্যাকাণ্ড চালানাের জন্য সারা বিশ্বে পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যখন নিন্দার ঝড় বইছিল, ঠিক তখনই নিজামীর। গুরু গােলাম আযম ১২ জন বিশ্বাসঘাতক সাথে নিয়ে খুনি লে. জে. টিক্কা খানের সাথে বৈঠক করেন। বৈঠকের তারিখটি ছিল ৪ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল। পরদিন ভােরে সব জাতীয় দৈনিকে বৈঠকের ছবিসহ সংবাদটি গুরুত্ব সহকারে পরিবেশিত হয়। এই বৈঠকে গােলাম আযমরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধ দমনের জন্য টিক্কা খানকে সর্বাত্মক সহযােগিতা করার আশ্বাস প্রদান করেন।
৬ এপ্রিল গােলাম আযম পুনরায় আরেক দল মীরজাফর নিয়ে টিক্কা খানের সহিত দেখা করেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে কিভাবে বানচাল করা যায় সে বিষয়ে টিক্কা খানকে শলা পরামর্শ দেন। গােলাম আযমের সাথে শলা পরামর্শের ভিত্তিতেই ৯ এপ্রিল টিক্কা খান ১৪০ সদস্য বিশিষ্ট শান্তি কমিটি ঘােষণা করেন। ঘােষণাটি টিক্কা খানের হলেও এর মূল রূপকার ছিলেন গােলাম আযম স্বয়ং। যেহেতু শান্তি কমিটির রূপকার ছিলেন নিজামীর গুরু, তাই শান্তি কমিটির প্রতিটি কর্মসূচি সফল করার জন্য নিজামীর দায়িত্ব এসে পড়ে। শান্তি কমিটির প্রতিটি সভা, সমাবেশ ও মিছিল সফল করার জন্য নিজামী তার ছাত্র সংঘের কর্মীদের নিয়ে উপস্থিত থাকতেন। শান্তি কমিটির বিভিন্ন সমাবেশে নিজামীর উপস্থিতি প্রমাণ করে যে, তিনি শান্তি কমিটির একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন।
শান্তি কমিটি গঠিত হবার পর গােলাম আযমরা ১২ এপ্রিল যােহরের নামাজের পর বায়তুল মােকাররম থেকে প্রথম মিছিল বের করেন। নিজামী ছাত্র
৪৯
সংঘের কর্মীদের নিয়ে মিছিলে যােগদান করেন এবং মিছিলের পুরােভাগে থেকে গােলাম আযমের সাথে নেতৃত্ব দেন। নিজামীর ছাত্র সংঘের কর্মীরা মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান ও পাক সামরিক জান্তা ইয়াহিয়ার বৃহৎ ছবি মিছিলে নিয়ে আসে। বাঙালি গণহত্যার নায়ক ইয়াহিয়ার ছবি নিয়ে নিজামীরা। সেদিন মিছিলে নির্লজ্জভাবে নর্তন-কুর্দন করেছিল। মিছিলের জমায়েত বাড়ানাের জন্য গােলাম আযম ও নিজামীরা বিহারী মােহাজেরদেরকে মিছিলে শরিক করে। নিজামীর চ্যালা চামুণ্ডা ও বিহারীরা মিছিলে ব্যান্ড পার্টি বাজিয়ে উৎসবে মেতে ওঠে। ইসলামে জায়েজ না হওয়া সত্ত্বেও, নামাজের পর বাদ্যযন্ত্রের ব্যবহার এটাই প্রমাণ করে যে, ইসলাম ছিল নিজামীদের মুখােশ মাত্র।
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই বাঙালিরা পাকিস্তানি পতাকা ঘৃণাভরে ছুড়ে ফেলে দিয়েছিল অথচ নিজামীর এক অনুসারী পাকিস্তানের একটি বিরাট পতাকা নিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে উপস্থিত হয়ে শােভা বর্ধন করেছিল। ধর্মীয় স্লোগানের আড়ালে তারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামকে বিপথগামী করতে চেয়েছিল। তাই তারা উর্দু এবং বাংলায় ধর্মের নামে স্লোগান দিয়েছিল। সেদিন মিছিলের স্লোগান ছিল, ‘পাকিস্তানের উৎস কি – লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ, কায়দে আজম জিন্দাবাদ, ইয়াহিয়া খান জিন্দাবাদ, টিক্কা খান জিন্দাবাদ, আল্লাহ্ তা’আলার মেহেরবান ধ্বংস করবে হিন্দুস্তান, ব্রাহ্মণ্যবাদ সাম্রাজ্যবাদ মুর্দাবাদ, ওয়াতনকে গাদ্দারােসে হুঁশিয়ার। ইত্যাদি।৬৯
মিছিলটি শেষ হলে গােলাম আযম ও নিজামীরা পাকিস্তান রক্ষার জন্য লম্বা মােনাজাত করেন। মােনাজাত পরিচালনা করেন নিজামীর গুরু গােলাম আযম। পরদিন গােলাম আযমের মােনাজাতের খবরটি দৈনিক সংগ্রাম পরিবেশন করতে যেয়ে লেখে- ‘গােলাম আযম পাকিস্তান সেনা বাহিনীকে সত্যিকারের মুসলিম সৈনিক হিসাবে দেশ রক্ষার যােগ্যতা অর্জনের জন্য আল্লাহ্র দরগাহে দোয়া করেন। সত্যিকারের মুসলমান ও পাকিস্তানি হিসাবে বেঁচে থাকার ও পাকিস্তানকে চিরদিন ইসলামের আবাসভূমি হিসেবে টিকিয়ে রাখার জন্য তিনি সর্বশক্তিমানের নিকট দোয়া করেন।৭০
মােনাজাত শেষ হলে নিজামীর লােকজন আজিমপুর কলােনী, শান্তিনগর, শাখারী বাজার প্রভৃতি স্থানে বাঙালিদের বাড়িঘর ও দোকানপাটে আগুন ধরিয়ে দেয়, বেশ কিছু বাঙালিকে হত্যা করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখে।৭১ পরবর্তীতে আক্রান্ত ব্যক্তিরা জানায়’ নিজামীর ইসলামী ছাত্র সংঘের কর্মীরা এই হামলা
—————————————–
৬৯ দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
৭০ দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ এপ্রিল, ১৯৭১ সাল।
৭১ একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-৩০।
—————————————–
৫০
সংঘটিত করেছিল। এভাবেই শান্তি কমিটি তাদের বাঙালি নিধনের কাজ শুরু করেছিল।
১৯৭১ সালে ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘আযাদি দিবস উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি আয়ােজিত সভায় গােলাম আযমের সাথে উপস্থিত ছিলেন নিজামী। এ সভা সফল করার জন্য গােলাম আযম নিজামীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। নিজামীও গুরুর আদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন। করেছিলেন। সেদিন পাক সেনাদের পাশাপাশি গােলাম আযম সভাটির নিরাপত্তার দায়িত্ব দিয়েছিলেন নিজামীকে। সেদিনও সভাটির মূল জমায়াতের দায়িত্ব ছিল নিজামীর ওপর। কিন্তু এসব সভায় সিল মারা দু’একজন দালাল ছাড়া কোনাে বাঙালিকে উপস্থিত করা যেতাে না। তাই নিজামী সেদিনের সভা সফল করার জন্য মােহাম্মদপুর ও মিরপুর থেকে বাস ভর্তি করে বিহারীদের উপস্থিত করেছিলেন। এই সভায় ভাষণ দানকালে গােলাম আযম বলেন- “আল্লাহ্ না। করুক, যদি পাকিস্তান না থাকে তাহলে বাঙালি মুসলমানদের অপমানে মৃত্যুবরণ করতে হবে। এই সভায় তিনি পাকিস্তানের দুশমনদের মহল্লায় মহল্লায় তন্ন তন্ন করে খুঁজে তাদের অস্তিত্ব বিলােপ করার জন্য দেশপ্রেমিক নাগরিকদের শান্তি কমিটির সাথে সহায়তা করার জন্য উদাত্ত আহ্বান জানান।৭২
মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস গােলাম আযমের শিষ্য নিজামী তার সহচরদের নিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের তন্ন তন্ন করে খুঁজে বের করার কাজটি নিষ্ঠার সাথে করেছিলেন।
——————————————-
৭২ একাত্তরের ঘাতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-৩৮।
——————————————-
৫১
নিজামী ও রাজাকার
১৯৪৮ সালে পাকিস্তান সরকার আনসার এ্যাক্ট ঘােষণা করেন। এই এ্যাক্ট অনুসারে আনসার বাহিনীকে সেনাবাহিনীর সহযােগী শক্তি হিসাবে গড়ে তােলা হয়েছিল। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে আনসার বাহিনীর সদস্যরা পাক বাহিনীকে সহযােগিতা তাে করে নাই বরং এই বাহিনীর সদস্যরা দলে দলে মুক্তি বাহিনীতে যােগদান করতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে সামরিক শাসক টিক্কা খান। ‘আনসার এ্যাক্ট’ বাতিল করে আনসার বাহিনীকে বিলুপ্ত ঘােষণা করেন। অপরদিকে আনসার বাহিনীর স্থলে নিজামীদের গড়ে তােলা অপশক্তি ‘রাজাকার বাহিনী’কে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সহযােগী সংগঠন হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। যে অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রাজাকার বাহিনীকে সেনাবাহিনীর সহযােগী বাহিনী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া হয় সেই অর্ডিন্যান্সটি পূর্ব পাকিস্তান রাজাকারস অর্ডিন্যান্স, ১৯৭১’ নামে পরিচিত।৭৩
প্রথমে জামায়াতে ইসলামী নিজামীর আরেক গুরু এ.কে.এম. ইউসুফ খুলনায় রাজাকারদের একটি বাহিনী পরীক্ষামূলকভাবে গড়ে তােলেন। এ.কে.এম. ইউসুফ। ছিলেন তৎকালীন জামায়াতে ইসলামীর মজলিসে সুরার একজন সদস্য। নিজামীর ইসলামী ছাত্র সংঘের ৯৬ জন কর্মীর সমন্বয়ে খুলনার প্রথম ‘রাজাকার’ ইউনিটটি গঠন করেন। প্রথম দলটি গঠনের পরই সারা দেশে রাজাকার বাহিনী গড়ে তােলার কাজ শুরু হয়। রাজাকার বাহিনী গঠনের পর থেকেই নিজামীরা এই বাহিনীকে সরকারি স্বীকৃতির জন্য আবেদন নিবেদন করতে থাকে। | রাজাকার বাহিনীর স্বীকৃতি লাভের জন্য সামরিক সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করে নিজামীরা তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামে নানা প্রবন্ধ, নিবন্ধ ও সম্পাদকীয় লিখতে থাকে। তারা বিভিন্নভাবে সরকারকে বােঝাতে চায় শুধুমাত্র একটি সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনী দ্বারা পাকিস্তান রক্ষা করা যাবে না। পাকিস্তান রক্ষা করতে হলে পাকিস্তানিমনা বেসামরিক ব্যক্তিদেরকেও সশস্ত্র করতে হবে। বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড’- এই শিরােনাম দিয়ে সম্পাদকীয়তে লেখে- আমাদের পাকিস্তান ও জাতীয় আদর্শে বিশ্বাসী নির্ভরযােগ্য লােকদের সমন্বয়ে একটি বেসামরিক
———————————————
৭৩ দৈনিক ইত্তেফাক, ২২ আগস্ট, ১৯৭১।
———————————————
৫২
পােশাকধারী বাহিনী গঠন করে তাদের হাতে আগ্নেয়াস্ত্র দেবার ব্যবস্থা করা হলে অতি তাড়াতাড়ি দুষ্কৃতিকারীদের নির্মূল করা সম্ভব হবে।৭৪
১৯৭১ সালের জুন মাসে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তান সফরকালে লাহােরে সাংবাদিক সম্মেলনে নিজামীর গুরু গােলাম আযম সরকারের কাছে দাবি করেন যে, দেশ প্রেমিকদের (স্বাধীনতাবিরােধী-লেখক) সশস্ত্র করা হউক অন্যথায় পরিস্থিতি মারাত্মক অবনতি ঘটবে।৭৫
অবশেষে পাক সামরিক সরকার রাজাকার অর্ডিন্যান্স, ১৯৭১ জারি করে। রাজাকারদের স্বীকৃতি দিলে নিজামীদের দীর্ঘ দিনের খায়েশ পূরণ হয়। তাই তারা তাদের মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম’-এ গদগদ হয়ে রাজাকার অর্ডিন্যান্স’ শীর্ষক সম্পাদকীয়তে উল্লেখ করেন “… রাজাকার বাহিনীর কর্মতৎপরতাকে অধিকতর ফলপ্রসূ করে তােলার ব্যবস্থা গ্রহণ করে সরকার প্রতিটি সফলকাম মানুষের প্রশংসাভাজন হয়েছেন। বর্তমান সংকট মুহূর্তে দেশের অভ্যন্তরীণ বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে শান্তি রক্ষা ও দুষ্কৃতিকারীদের’ (মুক্তিযােদ্ধাদের – লেখক) দমনের জন্য রাজাকারদের মত একটি ত্যাগী ও নিষ্ঠাবান স্বেচ্ছাসেবী বাহিনীর অত্যন্ত প্রয়ােজন ছিল”।৭৬
পাক সামরিক সরকারের স্বীকৃতি লাভের পর নিজামী জেহাদি জোশে। রাজাকার বাহিনী সুসংগঠিত ও শক্তিশালী করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। নিজামী তার বিশ্বস্ত অনুচর ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা মােহাম্মদ ইউসুফকে রাজাকার বাহিনীর সর্বাধিনায়ক নিযুক্ত করেন এবং প্রতিটি জেলায় ছাত্র সংঘের জেলা নেতৃবৃন্দকে স্ব-স্ব জেলার রাজাকার বাহিনীর প্রধান করা হয়।৭৭
রাজাকারদের প্রাথমিক ইউনিটের নাম ছিল কোম্পানি। যে কোনাে ব্যক্তিই রাজাকারদের প্রাথমিক ইউনিট কোম্পানির কমান্ডার হতে পারত। তবে এর। উপরের পদে ছাত্র সংঘ’ কিংবা জামাতের কর্মী’ ছাড়া কেউ আসতে পারত না। এরা একসাথে ছিল রাজাকার ও আলবদর।
রাজাকার বাহিনী স্বীকৃতি লাভের পর স্বাধীনতা প্রিয় বাঙালিদের ওপর অত্যাচারের মাত্রা বেড়ে যায়। এরা শত শত লােক হত্যা করে এবং বাঙালি মেয়েদের নির্যাতন করে পাক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। অগ্নিসংযােগ ও পাক সেনাদের লুটপাটের এরা ছিল প্রত্যক্ষ সহযােগী। গ্রামগঞ্জ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে যেখানে পাক সেনারা প্রাণের ভয়ে যেতে স্বাচ্ছন্দ্যবােধ করতাে না সেখানে রাজাকারদের পাঠানাে হতাে। ব্রিজ, কালভার্ট ও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা পাহারাতে রাজাকারদের ব্যবহার করা হতাে।
————————————————-
৭৪ দৈনিক সংগ্রাম, ২৮ মে, ১৯৭১
৭৫ দৈনিক সংগ্রাম, ২১ জুন, ১৯৭১।
৭৬ দৈনিক সংগ্রাম, ২৩ অগস্ট, ১৯৭১।
৭৭ একাত্তরের ঘতক দালাল কে কোথায়, পৃষ্ঠা-১০১।
————————————————-
৫৩
রাজাকারদের ইসলামী জোশে উজ্জীবিত করার জন্য নিজামী জেলায় জেলায় ঘুরে রাজাকারদের সমাবেশে বক্তব্য দেন।
রাজাকারদের উদ্দেশ্যে নিজামীর কোরআনের আয়াত পাঠ
নিজামীদের প্ররােচনায় ও নির্দেশে রাজাকাররা হত্যা, ধর্ষণ, লুট ও অগ্নিসংযােগসহ নানা প্রকার পাপাচারে লিপ্ত হয়েছিল। এসব নিষ্ঠুর ও পাপাচার কাজের সাথে শান্তির ধর্ম ইসলামের কোনাে সম্পর্ক নাই। অথচ এসব পাপ কাজে রাজাকারদের আরাে উস্কে দেবার লক্ষ্যে নিজামী পবিত্র কোরআনের আয়াতের অপব্যবহার করতে কখনও দ্বিধান্বিত হননি। নিজামী ১৪ সেপ্টেম্বর রাজাকার সদর দফতরে সমবেত রাজাকারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেবার সময় আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কোরআনের আয়াত উচ্চারণ করে অপব্যাখ্যায় বলেন- সুরায়ে তওবার ১১১ ও ১১২ আয়াতের আলােকে জাতির এই সংকটময় মুহূর্তে প্রত্যেক রাজাকারকে ঈমানদারীর সাথে তাদের ওপর অর্পিত এই জাতীয় কর্তব্যে সচেতন হওয়া উচিত।৭৮
মুক্তিযযাদ্ধাদের হত্যার নির্দেশ
মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যার নির্দেশ দেবার সময়ও নিজামী ইসলামের দোহাই দিতে ভুলে যাননি। নিজামী বারবারই বক্তৃতা, বিবৃতিতে বােঝাতে চেয়েছিলেন পাকিস্তানের সামরিক জান্তার আরােপিত অন্যায় যুদ্ধের বিরুদ্ধে লড়াই করা আর ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই করা সমার্থক। তিনি যশােহরে রাজাকারদের সমাবেশে মুক্তিযােদ্ধাদের হত্যার নির্দেশ দিয়ে বলেন- আমাদের প্রত্যেককে একটি ইসলামী রাষ্ট্রের মুসলমান সৈনিক হিসেবে পরিচিত হওয়া উচিত এবং প্রত্যেক মজলুমকে আমাদের প্রতি আস্থা রাখার মত ব্যবহার করে তাদের সহযােগিতার মাধ্যমে ঐ সকল ব্যক্তিকে খতম করতে হবে যারা সশস্ত্র (মুক্তিযােদ্ধা-লেখক) অবস্থায় পাকিস্তান ও ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে।”৭৯
একজন মইত্যা রাজাকারের কাহিনী
১৯৭১ সালে পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় মইত্যা রাজাকার নামে এক দুর্ধর্ষ ঘাতকের আবির্ভাব ঘটে। তার নির্মমতা ও নিষ্ঠুরতার জন্য প্রতিটি মানুষের কাছে সে ছিল এক মূর্তিমান যমদূত। তার নির্মম অত্যাচারে অতিষ্ঠ ছিল বেড়া ও সাঁথিয়ার প্রতিটি মানুষ। মইত্যা রাজাকার ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলায় চালিয়েছিল নারকীয় তাণ্ডব। এই বিশ্বাসঘাতক পাকসেনাদের পথ দেখিয়ে গ্রাম-গঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চলে নিয়ে যেত।
———————————————
৭৮ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
৭৯ দৈনিক সংগ্রাম, ১৫ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১।
———————————————
৫৪
তার নির্দেশ ও প্ররােচনায় তার ঘাতক বাহিনী ও পাকসেনারা স্বাধীনতার সংগঠক ও সমর্থকদের নির্বিচারে হত্যা করত এবং তাদের বাড়ি-ঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দিত। এই রক্ত পিপাসু শকুনের তাণ্ডবের দুঃসহ স্মৃতি নিয়ে আজও বয়ে বেড়াচ্ছে স্বজন হারানাে অসংখ্য পরিবার। পাবনার বেড়া ও সাঁথিয়া উপজেলার বয়স্ক ব্যক্তিরা মইত্যা রাজাকারের সৃষ্ট বধ্যভূমির হৃদয়বিদারক যে ঘটনার বিবরণ দেন, তাতে বুঝা যায় এসব হায়নার দল সেদিন বেড়া-সাঁথিয়া উপজেলায় বাঙালিদের রক্তে হোলি খেলেছিল।
২০০০ সালের ডিসেম্বর মাসে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়ােজিত নাগরিক সমাবেশে ‘৭১-এর স্মৃতিচারণ করতে এসেছিলেন মইত্যা রাজাকারের এলাকা বেড়া উপজেলার বিশালিখার গ্রামের এক যুবক। ৭১ সালে সে ছিল কিশাের মুক্তিযােদ্ধা। মইত্যা রাজাকার বাহিনীর বর্বরতার শিকার ও মৃত্যুর দুয়ার থেকে বেঁচে যাওয়া যুবকের নাম আব্দুল লতিফ। তার বাবাও ছিলেন একজন অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধা। মইত্যা রাজাকারের নির্দেশে নির্মম নির্যাতনের শিকার হয়ে তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করেছিলেন।
নাগরিক সমাবেশে ‘৭১-র স্মৃতিচারণ করতে আসলে দৈনিক জনকণ্ঠ’ আব্দুল লতিফের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। সাক্ষাৎকারটি ২০০০ সালের ৮ ডিসেম্বর দৈনিক জনকণ্ঠের প্রথম পাতায় ছাপা হয়। সাক্ষাৎকারে আব্দুল লতিফ মইত্যা রাজাকারের গণহত্যা, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের যে বিবরণ দেন তা পাঠ করে যে কোনাে সুস্থ মানুষ শিহরিত না হয়ে পারে না। সাক্ষাৎকারে আব্দুল লতিফ বলেন, ‘আপনারা আজ যাকে মওলানা মতিউর রহমান নিজামী’ নামে চেনেন তাকে আমরা চিনি মইত্যা রাজাকার’ নামে। পাবনার বয়স্ক লােকদের কাছে নিজামী এখনও মইত্যা রাজাকার নামে পরিচিত। আমার বাবা শহীদ সােহরাব আলী প্রামানিককে এই ‘মইত্যা রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় পাক বাহিনী হত্যা করেছিল। আমার বাবা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে নভেম্বর মাসের শেষ দিকে তিনি আত্নীয়-স্বজনদের খোঁজখবর করতে নিজ গ্রাম বিশালিখায় এসেছিলেন। মইত্যা রাজাকার তথা নিজামী বাহিনীর লােকজন আমার বাবার খোঁজ পেয়ে যায়। ‘৭১-র ৩ ডিসেম্বর পাকবাহিনী রাজাকার আলবদরদের সহায়তায় আমাদের গ্রাম ঘিরে ফেলে এবং ফজরের নামাজের সময় আমার বাবাকে ধরে ফেলে। তারা এই সময় গ্রামবাসীর ওপর চালায় পাশবিক ও বর্বর নির্যাতন। আমার বাবার ওপরও নিষ্ঠুরভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে হায়নার দল। রাইফেলের বাট দিয়ে পেটাতে থাকে এবং বেয়নট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যুর শেষ সীমানায় নিয়ে এক পর্যায়ে গুলি করে মেরে ফেলে। আমি তখন ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে। ঘটনার সাত আটদিন পর বাবার হত্যাকাণ্ডের এই নৃশংস বিবরণ। জানতে পারি।
বাবার হত্যাকাণ্ডের আগে নিজামী বাহিনীর সহায়তায় আমিও একবার পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়েছিলাম। আগস্ট মাসের ১৩ কিংবা ১৪ তারিখ হবে।
লতিফ মির্জার (আওয়ামী লীগের সাবেক এমপি) সঙ্গে শাহজাদপুর মুক্তিযােদ্ধা। ক্যাম্পে ছিলাম। আমাকে সংবাদ সংগ্রহের জন্য বেড়ায় পাঠানাে হয়। বাড়িতে আসার পর ৫/৬ ঘণ্টা অবস্থান করেছিলাম। তখন মইত্যা রাজাকার সেখানে ছিল। তার নির্দেশে বেড়া সাঁথিয়া এলাকার আলবদর বাহিনীর প্রধান রফিকুন্নবীর (বাবলু) নেতৃত্বে আলবদররা আমাকে বেড়া বাজারের পেছনের বাড়ি থেকে ঘেরাও করে ধরে ফেলে। তারা আমাকে নিয়ে যায় বেড়া থানার পাক আর্মির ক্যাম্পে। রাতে আমার ওপর চালানাে হয় অকথ্য নির্যাতন। জ্বলন্ত সিগারেট দিয়ে আমার গায়ে ছ্যাকা দেয়া হয়। বেয়নেট চার্জ করা হয় এবং মারধর করা হয়। ক্যাম্পে অবস্থান করছিল মইত্যা রাজাকার’ নিজামী। আমি তার কাছে প্রাণ ভিক্ষা চাই। নিজামীকে বলি আমি গরিব মানুষের ছেলে, আমি কোনাে কিছুর সাথে জড়িত নই। কিন্তু নিজামী তাতে কর্ণপাত না করে আমি কি বলেছি তা উর্দুতে পাক বাহিনীকে জানায়। নির্যাতনের এক পর্যায়ে আমার হাত পা বেঁধে ফেলা হয় এবং আমাকে বস্তায় ভরে ফেরির ওপর থেকে যমুনা নদীতে ফেলে দেয়া হয়। কিন্তু আল্লাহর রহমতে আমি পানি খেতে খেতে এবং টানা-হাচড়ার এক পর্যায়ে বস্তার মুখ ও আমার হাত খুলে যায়। তারপর সাঁতার কেটে নদী পার হয়ে এক বাড়িতে আশ্রয় নেই এবং মুক্তিযুদ্ধে ফিরে যাই।
মইত্যা রাজাকার নামে মতিউর রহমান নিজামী নরঘাতক। সাঁথিয়ার করমজা গ্রামে যে বধ্যভূমি পাওয়া গেছে তাও নিজামীর নৃশংসতার স্বাক্ষর দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার বধ্যভূমিটি খনন করা হচ্ছে। তাই গণহত্যা নারী নির্যাতন যাবতীয় দুষ্কর্মের জন্য আমি নরঘাতক নিজামীর শাস্তি চাই।
করমজা গ্রামের বধ্যভূমি ও পার্বতীর বুকফাটা আর্তনাদ
মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাস নিজামী পাবনার সাঁথিয়া উপজেলায় অসংখ্য বধ্যভূমির সৃষ্টি করেছিল। এসব বধ্যভূমিগুলাে নিজামীর নৃশংসতার সাক্ষ্য আজও ধারণ করে। আছে। মাটি খননের সময় যেভাবে লক্ষ বছরের পুরাকীর্তি বের হয়ে আসে তেমনিভাবে স্বাধীনতার ৩৫ বছর পরও বধ্যভূমিগুলাের মাটি খননের সময় নিজামী ও তার বশংবধদের পাষণ্ডতার সাক্ষী বহন করছে। এই সেদিন ২০০০ সালে করমজা গ্রামের মাটি খননের সময় আরাে একটি বধ্যভূমির সন্ধান পাওয়ার পর ঐ বছরেরই ৭ ডিসেম্বর তৎকালীন তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদের তত্ত্বাবধানে। এবং স্বজন হারানাে হাজার হাজার শােকার্ত মানুষের উপস্থিতিতে বধ্যভূমিটির মাটি খননের কাজ শুরু হয়। সারাদিন খননের পর প্রায় চারহাত মাটির নিচ থেকে খুলিসহ দেহাবশেষ বের হয়ে আসে। এতে এলাকাবাসী নিশ্চিত হয় ১৯৭১ সালে ৮ মে নিজামীর ঘাতক বাহিনীর সহায়তায় পাকবাহিনী ষষ্ঠী হালদারসহ যে আটজনকে লাইন করে দাঁড় করিয়ে নির্বিচারে হত্যা করেছিল এই কঙ্কালগুলাে।
৫৬
তাদেরই। এসময় শহীদদের আত্নীয়-স্বজনদের আহাজারিতে এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়।
ষষ্ঠী হালদারের মেয়ে পার্বতী চিৎকার করে বলতে থাকে বাবা তুমি কোথায়। কতদিন বাবা বলে তােমাকে ডাকিনি। আমার খুব কষ্ট হয় বাবা। পার্বতীর এই আহাজারিতে দর্শনার্থীদের চোখ অশ্রুসজল হয়ে ওঠে। পার্বতী জানান ১৯৭১ সালের ৮ মে তার বয়স ছিল মাত্র ১২ বছর। ঐ দিন ভােরে পাকবাহিনী স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় তার নিরপরাধ বাবাকে জোরপূর্বক বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে যায়। সেদিন পার্বতী তার মা ও নিরীহ বাবা সেই পাষাণদের হাত-পা ধরে প্রাণ ভিক্ষা চেয়েছিল। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় নাই। পার্বতী আজও ভােলেনি তার বাবার অশ্রুসিক্ত চোখ।৮০
নিজামীর পলায়ন
এখন ১৯৭১ নয়, ২০০৬। পাবনার ইছামতি নদী দিয়ে অনেক পানি গড়িয়েছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশে ঘটে গেছে প্রতিবিপ্লব। জাতির জনক সপরিবারে নিহত হয়েছেন। ক্যান্টনমেন্ট থেকে পায়ে বুট হাতে রাইফেল নিয়ে বেরিয়ে এসে ক্ষমতা দখল করেছেন জিয়াউর রহমান। তার বেয়ােনেটের খোচায় ছিন্নভিন্ন হয়েছে। শহীদের রক্তের বিনিময়ে পাওয়া পবিত্র সংবিধানটি। সেখান থেকে খসে পড়েছে। | ‘দালাল আইন ও নিষিদ্ধ ঘােষিত ধর্মের নামে রাজনীতি করার বিধানটি। জিয়ার বদৌলতে নিজামীরা প্রাণে বেঁচে গেছেন। পেয়েছেন ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করার সুযােগ। নিজ স্বার্থে ধর্মকে স্বার্থক ব্যবহার করেছেন নিজামী। নারী নেতৃত্ব না মানলেও ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার জন্য এখন মানছেন। নিজামীর শিষ্য আলী আহসান মুজাহিদের ভাষায় খালেদা জিয়া এখন তাদের “নয়নমণি”।
জিয়ার সহধর্মিনী বেগম খালেদা জিয়াকে ব্যবহার করে হয়েছেন ক্ষমতার অংশীদার। এখন তিনি আর মইত্যা রাজাকার’ নন, এখন তিনি মাননীয় শিল্পমন্ত্রী এবং মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি। বাংলাদেশের পুলিশ এখন তাকে দিন রাত পাহারা দেয়। শুধু পুলিশ কেন প্রয়ােজন হলে র্যাব, চিতা, কোবরা, বিডিআর এমন কি সেনাবাহিনীও তাকে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে।
নিজামী ভাবলেন ৩৫ বছর কম তাে সময় নয়। আমার হাতে এখন আর বাঙালির রক্তের দাগ নেই। আমি তাে জাতীয় স্মৃতিসৌধেও গেছি। কই কেউ তাে আমাকে কিছু বলেনি। সবাই আমার ‘৭১-এর কীর্তি’ ভুলে গেছে। আমি যাব বিশালিখায় যাব। যেখানে একদিন আমি পাকিস্তান রক্ষার জন্য বধ্যভূমি সৃষ্টি করেছিলাম। সেখানেই একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভিত্তিপ্রস্তর উন্মােচন করে বিশালিখার মানুষকে দেখিয়ে দেব আমি কেমন শক্তিধর।
————————————-
৮০. জনকণ্ঠ, ৮ মে, ২০০০
————————————-
৫৭
কিন্তু বিধি বাম। নিজামীর আগমন বার্তা পেয়েই স্বজন হারানাে শহীদ পরিবার বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। গর্জে ওঠে গ্রামবাসী। তারা নিজামীকে গ্রামে ঢুকতে না দেয়ার ব্যাপারে ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করে। ক্ষুব্ধ গ্রামবাসী শুক্রবার রাতেই নিজামীর নামফলক ভিত্তিপ্রস্তর স্তম্ভটি গুড়িয়ে দেয়। গ্রামের সকল রাস্তাঘাট, হাটবাজারসহ বাড়ি বাড়ি কয়েকশ কালাে পতাকা উড়িয়ে দেয়। গ্রামে প্রবেশের মুখে গাছের গুড়ি ফেলে বেরিকেড সৃষ্টি করে। শনিবার দুপুরে ভিত্তিপ্রস্তর উদ্বোধনের নির্দিষ্ট সময়ের আগে গ্রামবাসী বিশাল বিক্ষোভ মিছিল বের করে অনুষ্ঠান স্থানসহ গােটা গ্রাম প্রদক্ষিণ করে। এ সময়ে গ্রামে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়লে শিল্পমন্ত্রী নিজামী খবর পেয়ে পরিস্থিতি সামলাতে নির্ধারিত কর্মসূচি বাতিল করে সটকে পড়েন।৮১ এই ঘটনার সংবাদ পরিবেশন করতে যেয়ে প্রথম আলাে লেখে, একাত্তরে এ গ্রামের মানুষের ওপর অত্যাচার-নির্যাতন মওলানা মতিউর রহমানের প্রত্যক্ষ মদদে হয়েছে বলে গ্রামবাসী মনে করেন। তারা বিশ্বাস করেন, নিজামী এ গ্রামে ঢুকলে শহীদের আত্মা কষ্ট পাবে। তাই শহীদদের পরিবার ও মুক্তিযােদ্ধারাসহ গ্রামের সর্বস্তরের লােকজন নিজামীকে গ্রামে ঢুকতে না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।৮২
নিজামীর কথায় টিএনও ডিসি পুলিশ অফিসার উঠবস করে। কিন্তু সেদিন নিজামীকে কেউ রক্ষা করতে পারেনি। একটি অজ পাড়াগাঁয়ের স্বজন হারানাে সাহসী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরােধে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় সম্মানিত’ শিল্পমন্ত্রী। ২০০৬ সালে নিজামীর লেজ গুটিয়ে পলায়নের দৃশ্য আবার প্রমাণ করে ভােল পাল্টালেও আসলেই তিনি মইত্যা রাজাকার’। ছােট গ্রাম বিশালিখার বীর জনতা। সারা বাংলাদেশের মানুষকে শিখিয়ে দিলাে কিভাবে রুখতে হয় স্বাধীনতাবিরােধী ও যুদ্ধাপরাধী নিজামীদের। সাবাস বিশালিখার গ্রামবাসী! সাবাস শহীদ পরিবার!
————————————-
৮১ জনকণ্ঠ, ১ অক্টোবর, ২০০৬।
৮২ প্রথম আলাে, ১ অক্টোবর, ২০০৬।
————————————-
৫৮
নিজামীরা কখনও বদলায় না
স্বাধীনতা উত্তরকালে মওলানা ভাসানী, অধ্যাপক আবুল ফজল, মনসুর আহম্মদ প্রমুখ মানবতাবাদী ব্যক্তিত্বের মানবিক আহ্বানে সাড়া দিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান স্বাধীনতা বিরােধীদের সাধারণ ক্ষমা করে মহানুভবতার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। বঙ্গবন্ধু ও মানবতাবাদী ব্যক্তিবর্গ ধারণা করেছিলেন এসব স্বাধীনতাবিরােধীরা ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ভুল সংশােধন করে। সঠিক পথে পরিচালিত হবে। অবশ্য বঙ্গবন্ধু কেবলমাত্র তাদেরকেই সাধারণ ক্ষমা করেছিলেন, যারা শুধু নীতিগতভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিলেন এবং যারা দেশ স্বাধীন হলে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে ক্ষমা প্রার্থনা করেছিলেন। যারা আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করতে যেয়ে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগে লিপ্ত ছিল তারা এই সাধারণ ক্ষমার আওতাভুক্ত ছিল না। রাজাকার কমান্ডার, শান্তি কমিটির নেতা, আলবদর ও আল শামসের সদস্যরা সাধারণ ক্ষমার বহির্ভূত ছিল। সে কারণেই স্বাভাবিকভাবে গােলাম আযম, শাহ আজিজ, মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মুজাহিদদের। মতাে দাগী স্বাধীনতাবিরােধীরা সাধারণ ক্ষমার অযােগ্য ছিল।
বঙ্গবন্ধু ‘দালাল আইন এবং সংবিধানে ধর্ম নিয়ে রাজনীতির ওপর যে বিধিনিষেধ ছিল সেটি উঠিয়ে নেননি। কিন্তু ১৫ আগস্ট প্রতিবিপ্লবে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হওয়ার পর জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়েই সামরিক শাসন জারি করেন। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনের অধীনে বিশেষ অর্ডিন্যান্স জারি করে ‘দালাল আইন তুলে নেন। ফলে কুখ্যাত স্বাধীনতা বিরােধীরা আইনের ফাঁকফোকর গলে জেল থেকে বেরিয়ে আসে। সামরিক সরকার জিয়ার অসাংবিধানিক অর্ডিন্যান্সের বদৌলতে চল্লিশ বছরের সাজাপ্রাপ্ত আলবদর কমান্ডার আমিনুল হক, যাবজ্জীবন কারাদণ্ড প্রাপ্ত চিকন আলীর মত ঘৃণিত হাজার হাজার আলবদর রাজাকার ও স্বাধীনতাবিরােধীরা জেল থেকে বেড়িয়ে এসে শহীদ পরিবারগুলােকে উপহাস করে। অনেক স্বাধীনতাবিরােধী আত্মগােপন করে ছিল। তারাও বেরিয়ে আসতে শুরু করে। নিজামীও তার সাঙ্গপাঙ্গ নিয়ে গােপন অবস্থা থেকে জনসমক্ষে চলে আসেন।
৫৯
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় বিরােধিতা করার কারণে ১৯৭৩ সালের ১৮ এপ্রিল তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার কর্তৃক গােলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল হয়। কিন্তু জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধান সংশােধনের সুযােগে মায়ের অসুস্থতার অজুহাত দেখিয়ে গােলাম আযম ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই পাকিস্তানের পাসপাের্ট নিয়ে বিমানে চড়ে উড়াল দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন।
আমাদের সংবিধানে ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ছিল। ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্মান্ধ ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয়‘রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুযায়ী কোনাে সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্মভিত্তিক অন্য কোনাে সমিতি বা সংঘ গঠন বা তাহার সদস্য হবার বা অন্য কোনাে প্রকারে তার তৎপরতায় অংশগ্রহণ করবার অধিকার কোনাে ব্যক্তির থাকবে না।
কিন্তু জিয়াউর রহমান অসাংবিধানিকভাবে অর্ডিন্যান্স জারি করে সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদটি বাতিল করলে আমাদের দেশের স্বাধীনতাবিরোধী ধর্মান্ধরা রাজনীতি করার সুযােগ পায়। এসব ধর্ম ব্যবসায়ীরা রাতারাতি রাজনৈতিক দল খুলে বসে। নিজামীরা ১৯৭৯ সালে মওলানা আব্বাস আলী খানকে আমির এবং ইয়াহিয়া খানের তত্ত্বালীন পূর্ব পাকিস্তানের পুতুল সরকার মালেকের মন্ত্রীসভার সদস্য মওলানা ইউসূফকে সেক্রেটারি জেনারেল নির্বাচিত করে জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’ নামক দল গঠন করে তাদের কার্যক্রম শুরু করে। প্রথমে নিজামী জাময়াতে ইসলামীর আমির কিংবা সেক্রেটারি জেনারেল না হলেও তিনি ছিলেন জামায়াতের একজন শক্তিধর নিয়ন্ত্রক নেতা। বাংলাদেশে জামায়াতকে পুনর্গঠনে তিনি নিয়ামক ভূমিকা পালন করেন। জামায়াত মূলত তারই মস্তিষ্কে পরিচালিত হতাে।
জামায়াতের আত্মপ্রকাশের পর স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় তাদের অপকর্মের জন্য অনুশােচনা তাে দূরের কথা, তারা পুরােনাে খেলায় নব উদ্যমে মেতে ওঠে। মুক্তিযুদ্ধের প্রতিশােধ নেওয়ার জন্য আরাে সুপরিকল্পিত এবং সুসংগঠিতভাবে তাদের ফ্যাসিবাদী কার্যক্রম শুরু করে।
কিছুদিন পর আব্বাস আলী খানকে সরিয়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব না থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানি পাসপাের্টধারী গােলাম আযমকে ১৯৯১ সালের ২৯ ডিসেম্বর ‘জামায়াতে ইসলামী, বাংলাদেশ’-এর আমির বানানাে হয়। বাংলাদেশের সংবিধানে কোনাে বিদেশী নাগরিককে কোনাে পার্টির প্রধান করার বিধান না থাকলেও নিজামীরা আমাদের সংবিধানকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমকে পার্টি প্রধান করে দুঃসাহসের চরম পরাকাষ্ঠা প্রদর্শন করেন। সে সময় ক্ষমতাসীন ছিলেন বেগম খালেদা জিয়ার বিএনপি সরকার। তবে এটাও। সত্য যে, খালেদা সরকারের গােপন সায় না থাকলে নিজামী ও গােলাম আযমদের পক্ষে সংবিধানবিরােধী কাজ করার দুঃসাহস হতাে না।
৬০
গােলাম আযমকে জামায়াতের আমির করার সাথে সাথে দেশ জুড়ে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শুরু হয়ে যায় স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলন। অবশেষে ১১ ফেব্রুয়ারি যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযম ও তার সহকর্মীদের বিচারের লক্ষ্যে শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে আহ্বায়ক করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গােলাম আযমের বিরুদ্ধে তীব্র গণআন্দোলন শুরু হয়ে যায়। অবশেষে ১৯৯২ সালের ২৬ মার্চ সােহরাওয়ার্দী উদ্যানের যেখানে বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ দেন সেখানে জাহানারা ইমামের সভাপতিত্বে লাখাে মানুষের উপস্থিতিতে গণআদালত বসে। এই গণআদালতের রায়ে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম গােলাম আযমকে যুদ্ধাপরাধী সাব্যস্ত করে ফাঁসির রায় ঘােষণা করেন।
গােলাম আযম বিরােধী তীব্র গণআন্দোলনের মুখে জনগণকে ধােকা দেওয়ার জন্য ২০০০ সালের ৭ ডিসেম্বর গােলাম আযমকে সরিয়ে নিজামীকে জামায়াতের আমির করা হয়। এভাবেই ৭১-এর শহীদ বুদ্ধিজীবীদের ঘাতক আলবদর বাহিনীর প্রধান মওলানা মতিউর রহমান নিজামী স্বাধীনতার পরাজিত শক্তি জামায়াতে ইসলামীর সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী হলেন। এক যুদ্ধাপরাধীর বদলে আরেক যুদ্ধাপরাধী জামায়াতের আমির হলাে।
নিজামীর ছাত্র সংঘের পুনর্জন্ম
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নিজামী: ও তার ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘ কলঙ্কজনক কর্মকাণ্ড সংঘটিত করেছিল। সে কারণেই স্বাধীনতা যুদ্ধে পরাজয়ের পর। নিজামীসহ ছাত্র সংঘের সমস্ত নেতাকর্মী জনরােষ থেকে বাঁচার জন্য আত্মগােপনে চলে যান। কেউ কেউ পাকিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে পালিয়ে যান। আবার জনতা অনেককে ধরে পুলিশের হাতে সােপর্দ করে। কিন্তু জিয়ার সামরিক সরকারের স্বাধীনতাবিরােধীদের পুনর্বাসন নীতির সুযােগে ১৯৭৭ সালে ৬ ফেব্রুয়ারি প্রাক্তন ছাত্র সংঘের নেতাদের নিয়ে সিদ্দিক বাজারের কমিউনিটি সেন্টারে একত্রিত হন। সেখানে সকলেই আলােচনার মধ্য দিয়ে একমত হন যে, মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করার জন্য স্বাধীন বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র সংঘ’ নামে আর কাজ করা সম্ভব নয়। তাই তারা তাদের কালাে অতীত আড়াল করার জন্য ইসলামী ছাত্র সংঘের নাম পরিবর্তন করে ইসলামী ছাত্র শিবির’ নামকরণ করেন। তারা শুধু ইসলামী ছাত্র সংঘের সংঘ’ পরিবর্তন করে ‘শিবির’ রাখে আর বাদবাকি সবই অপরিবর্তিত থাকে। তারা দলীয় পতাকা ও মনােগ্রাম পরিবর্তন করেনি। শুধু তাই নয় ছাত্র সংঘের কর্মীদের যে পাঠ্যক্রমে রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া হতাে হুবহু সেই একই পাঠ্যক্রম অনুসরণ করা হচ্ছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কর্মীদের প্রশিক্ষিত করার জন্য। এমনকি নিজামীরা মূল নামটি পরিবর্তন করলেও সংক্ষিপ্ত নাম ‘I.C.S.’ পরিবর্তন করেনি। তাদের সংক্ষিপ্ত নামটি যাতে পরিবর্তন করতে না
৬১
হয়, সেজন্য সংক্ষিপ্ত নামের সাথে মিলিয়ে পুরাতন নামটির সংস্করণ করে ইসলামী ছাত্র শিবির রাখে। I.C.S. দিয়ে ইসলামী ছাত্র সংঘ এবং ইসলামী ছাত্র শিবির দু’টি বােঝানােই সম্ভব।
ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠালগ্নে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রায় সকলেই ছিলেন। প্রাক্তন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা এবং খুনি আলবদর কমান্ডার অথবা সদস্য। ইসলামী ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আলবদর কমান্ডার মীর কাসেম আলী। এরপর সভাপতি নির্বাচিত হন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক মােঃ কামরুজ্জামান। পরবর্তীতে আবু তাহের নামক আরাে একজন ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন, যিনি ১৯৭১ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান শাখার ইসলামি ছাত্র সংঘের সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন। প্রতিষ্ঠালগ্নে ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির মত জেলা পর্যায়ের কমিটিগুলােতেও সাবেক ইসলামি ছাত্র সংঘের নেতাকর্মী এবং আলবদর বাহিনীর কমান্ডার অথবা সদস্যদের সমন্বয়ে পুনর্গঠিত হয়েছিল।
রগকাটা, কজিকাটা ও গলাকাটা রাজনীতির শুরু
মুক্তিযুদ্ধে পরাজয়ের আগুনে জ্বলছিল নিজামী। তাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের ছাত্র ও রাজনৈতিক সংগঠনের নেতা ও কর্মী এবং প্রগতিবাদী মুক্তচিন্তার মনীষীদের ওপর পরিকল্পিতভাবে প্রতিশােধ স্পৃহায় ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য তার হাতে পুনর্গঠিত ইসলামি ছাত্র সংঘের বাংলাদেশী সংস্করণ ইসলামী ছাত্র শিবিরকে নির্দেশ দেন। ছাত্র শিবির নিজামীর নির্দেশিত পথে ‘৭১-এর বদলা নিতে মরিয়া হয়ে ওঠে এবং অতীতের মত রগকাটা, কজিকাটা ও গলাকাটার রাজনীতি শুরু করে। প্রকাশ্য রাজনীতি করার সুযােগ পেয়ে শিবির ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্রসমাজ কর্মী সাজ্জাতকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ছাত্রলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে ঈদের নামাজ পড়ে ফেরার পথে ১৯৮৮ সালের ১৮ মে কুপিয়ে হত্যা করে। নাজিরহাট কলেজের ভিপি আমিনুলকে ছুরিকাঘাতে ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসে হত্যা করে। সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের এজিএস ছাত্রলীগ নেতা তােরাবকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। চট্টগ্রাম কলেজের বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতা শাহাদতকে ১৯৮২ সালে ঘুমন্ত অবস্থায় তারই রুমমেট ছাত্র শিবিরের কর্মী জবাই করে হত্যা করে। নাজিরহাট কলেজের ছাত্রলীগ নেতাও শিবিরের সন্ত্রাসীদের হাতে গুলিবিদ্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে। বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ শাখার সভাপতি জামিল আখতার রতনকে শিবির প্রকাশ্যে ইট দিয়ে মাথা থেলে দেয় এবং পরে চাইনিজ কুড়াল ও চাপাতি দিয়ে কুপিয়ে মর্মান্তিকভাবে হত্যা করে। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্রলীগ নেতা বেলাল চৌধুরীকে ১৯৮৮ সালে শিবিরের ক্যাডাররা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে। চাপাই নবাবগঞ্জের বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধা আমিরুল ইসলাম জালালকে শিবির খুনিরা ১৯৮৮ সালের ১০ জুলাই পৈশাচিকভাবে খুন।
৬২
করে। ১৯৮৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর শিবির ছাত্রলীগ মিছিলে হামলা করে ছাত্রলীগ নেতা মুনির ও তপনকে নির্মমভাবে খুন করে। নিজামীর সুযােগ্য উত্তরসূরীরা মুক্তিযােদ্ধা জালালের লাশ ছিনিয়ে নেওয়ার সময় চাপাই নবাবগঞ্জ শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। জালালের লাশ রক্ষা করতে যেয়ে তার ছােট ভাই টিপু, জাসদের (ইনু) ছাত্রনেতা মাহমুদ ও বারকী নামের অপর একজনকে ঘাতক শিবিরের হাতে জীবন বলি দিতে হয়। শিবির কর্মীরা এতটাই উন্মত্ত ও বেপরােয়া হয়ে ওঠে যে, ১৯৯২ সালের ১৮ মার্চ একই রাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসের ১৫ জন ছাত্রের হাত পায়ের রগ কেটে ফেলে।৮৩ ১৯৯২ সালের ২০ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজে ছাত্র শিবির হামলা করে ছাত্র লীগের মেধাবী ছাত্র মাহবুবুল আলমকে হত্যা করে।৮৪
রক্তপিপাসু শিবিরের পাষণ্ড কর্মীরা ১৯৮৬ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একটি নারকীয় ঘটনার অবতারণা করে। তারা জাতীয় ছাত্র সমাজের চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আব্দুল হামিদের ডান হাতের কজি নির্মমভাবে কেটে নেয় এবং ছুরির মাথায় এই কজি গেঁথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় চত্বর প্রদর্শন। করে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীর ভিতর ভীতির সঞ্চার করে।
——————————————-
৮৩. মােহাম্মদ হান্নান, বাংলাদেশ ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৭৬।
৮৪ মােহাম্মদ হান্নান, বাংলাদেশ ১৯৯২, পৃষ্ঠা-৭৮।
——————————————-
৬৩
শিবিরের সাথে সখ্যতা থাকা সত্ত্বেও ছাত্রদলের কর্মীরাও শিবিরের হাত থেকে রেহাই পায়নি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদল নেতা নূতনকেও তারা ১৯৯২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি হাত পায়ের রগ কেটে নির্মমভাবে খুন করে। ২০০৪ সালের ১ ডিসেম্বর সিলেটে শিবিরের সন্ত্রাসীদের হাতে ছাত্রদল নেতা রফিকুল হাসান খুন হন। জামায়াত শিবির নাখােশ হবে ভেবে ক্ষমতাসীন ছাত্র সংগঠন ছাত্রদলের কেন্দ্রীয় নেতারা এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে তেমন উচ্চবাচ্য করেনি।
ধর্মীয় সংগঠনগুলােও ইসলামী ছাত্র শিবিরের হিংস্রতা থেকে রক্ষা পায়নি। ১৯৭৮ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রনেতা মওলানা আব্দুস সােবাহানকে শিবির কর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। মওলানা আব্দুস সােবাহান সে সময় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১০ জানুয়ারি চন্দ্রঘােনা তৈয়বিয়া ওয়াদুদিয়া মাদ্রাসার মাত্র ১১ বছর বয়সের ছাত্র আব্দুল হালিমকে ঘুমন্ত অবস্থায় শিবির কর্মীরা দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। ইসলামী ছাত্রসেনার নেতা লিয়াকত আলীও শিবিরের হাতে মর্মান্তিকভাবে খুন হন। ১৯৮৬ সালে শিবির ক্যাডাররা হাটহাজারি মাদ্রাসায় হামলা চালিয়ে দু’জন মাদ্রাসার ছাত্রকে হত্যা করে।
ইসলাম শান্তির ধর্ম। এই পবিত্র ধর্মকে নিজামীরা তাদের হীন স্বার্থে ব্যবহার করতে যেয়ে তাদের অনুসারীদের কীরূপ ধর্মান্ধ ও পাষণ্ড করে তুলেছিল তার প্রমাণ পাওয়া যায় মুক্তিযােদ্ধা জালালের নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার সময়। শিবির সন্ত্রাসীদের হাত থেকে জালালকে রক্ষা করার জন্য তার মা চিৎকার করে বলে, “দোহাই আল্লাহ্র, এরকম করে আমার বাবাকে মেরাে না, দোহাই আল্লাহ্র, দোহাই আল্লাহর। উন্মত্তদের একজন হাতের হাসুয়া দ্বারা জালালকে আঘাত করতে থাকে এবং বলে, আল্লাহর নামেই চালাচ্ছি। আমাদের একাজ থেকে ফেরানাের কোনাে আল্লাহ্ নেই, কোনাে আল্লাহ নেই।৮৫
২০০১ সালের ২৮ অক্টোবর নিজামীরা বিএনপি সরকারের অংশীদার হয়েই আরাে হিংস্র হয়ে ওঠে এবং কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, সাংবাদিক, স্বাধীনতা পক্ষের শক্তি ও সংখ্যালঘুদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। শিবির ক্যাডার নাসির তার দলবল নিয়ে ২০০১ সালের ১৬ ডিসেম্বর নাজিরহাট কলেজের অধ্যক্ষ গােপাল কৃষ্ণ মূহুরীকে তার নিজ বাড়িতে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করে। ২০০৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের স্বনামধন্য শিক্ষক অর্থনীতি সমিতির সাবেক সভাপতি ড. মােহাম্মদ ইউনূসকে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সভাপতি মাহবুব সালেহী নৃশংসভাবে হত্যা করে। শুধু তাই নয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জুয়ােলজী ও মাইনিং বিভাগের ছাত্র হওয়া সত্ত্বেও তারই বিভাগীয় প্রধান অধ্যাপক ড. আবু তাহেরকেও সালেহী ২০০৬ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তারিখে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে ম্যানহােলের ভিতর ঢুকিয়ে
——————————————–
৮৫ মওলানা আব্দুল আউয়াল, জামাতের আসল চেহারা, পৃষ্ঠা-১২৫।
——————————————–
৬৪
রাখে। কতটুকু পাষাণ আর বিবেকবর্জিত হলে একজন ছাত্র তারই বিভাগীয় প্রধান সম্মানিত শিক্ষকের লাশ পুঁতিগন্ধময় ম্যানহােলের ভিতর ঢুকিয়ে রাখতে পারে? ‘৭১-এর আল বদরদের কায়দায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের হত্যা এবং নিষ্ঠুরতা প্রদর্শন করে ইতিমধ্যে সালেহী নিজেকে নিজামীর যােগ্য উত্তরসূরী হিসাবে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে।
রাজশাহীতে ড. তাহের হত্যা মামলায় এ যাবত যে তিনজন গ্রেপ্তার হয়েছে, তারা সবাই ১৬৪ ধারায় ম্যাজিস্ট্রেটের স্বীকারােক্তি দিয়েছে যে তারা সরাসরি এই খুনের সাথে জড়িত ছিল। তারা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে আরাে বলেছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবির সভাপতি মাহবুব সালেহী তাদের সাথে এই হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করেছে এবং নেতৃত্ব দিয়েছে। নিজামীরা বি.এন.পি. সরকারের শরিক হওয়ায় এসব ঘাতকের হাত এত লম্বা হয়েছে যে, অধ্যাপক ড. আবু তাহের বিএনপি-র শিক্ষক সংগঠনের একজন নেতা হওয়া সত্ত্বেও সরকার সালেহীর কেশাগ্রও স্পর্শ করতে পারেনি। সালেহী বীরদর্পে বুক চিতিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় চতুর দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। নিজামীর উত্তরসূরীরা হুমকি দিচ্ছে সালেহীর কিছু হলে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জ্বালিয়ে দেবে। জ্বালিয়ে দেবার বিষয়টি যে তারা কথায় কথায় বলছে তা নয়। ইতিপূর্বে তারা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নবাব আব্দুল লতিফ হল গান পাউডার দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল। মাস্টার্স পরীক্ষা দেবার জন্য ৭৫%। হাজিরার প্রয়ােজন। কিন্তু সালেহীর মাত্র ১৬% হাজিরা থাকা সত্ত্বেও মাস্টার্স পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রচলিত আইনকে উপহাস করছে। তবে তার চেয়ে পরিতাপের বিষয় অধ্যাপক ড. তাহের যে বিভাগের প্রধান ছিলেন সেই বিভাগেই নিয়ম বহির্ভূতভাবে তারই ঘাতক ছাত্র পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পেরেছে। অথচ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিও বিএনপি শিক্ষক সংগঠনের সদস্য। তাহলে বিএনপি নিজামীদের কাছে এতটা অসহায় কেন? তাহলে ভিতরে ভিতরে জামায়াত কি বিএনপি-কে গ্রাস করে ফেলেছে?
জঙ্গি সংগঠনগুলাে আলবদরের বাংলাদেশী সংস্করণ
নিজামীরা ‘৭১ সালে আলবদর, আলশামস ও রাজাকার এই তিনটি প্রধান ঘাতক বাহিনী গঠন করেছিল। কিন্তু এখন নিজামী তার জামায়াতের অধীনে এরূপ ১৬টি ঘাতক বাহিনী গড়ে তুলেছে। এই ১৬টি ঘাতক বাহিনী হচ্ছে আলবদর বাহিনীর নূতন সংস্করণ। এই বাহিনীগুলাে আরাে সুসংগঠিত, দুর্ধর্ষ এবং আধুনিক মারণাস্ত্রে সুসজ্জিত। ‘৭১ সালে নিজামীদের ঘাতক দলে কোনাে আত্মঘাতী সদস্য ছিল না। বর্তমানে নিজামী তার ঘাতক বাহিনীগুলােতে হাজার হাজার আত্মঘাতী সদস্য গড়ে তুলেছে। ‘৭১ সালে নিজামী শুধু জামায়াতের ছাত্র শাখার সভাপতি এবং আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিল। এখন নিজামী জামায়াতের প্রধান হওয়াতে জামায়াত ও ছাত্র শিবিরসহ অন্যান্য সংগঠন এবং ১৬টি ঘাতক বাহিনীর সবগুলােই তার অঙুলি
৬৫
হেলনে পরিচালিত হচ্ছে। সে কারণে ‘৭১-এর চেয়ে নিজামী এখন শতগুণে ক্ষমতাশালী ও ভয়ঙ্কর। খালেদা সরকারের কাঁধে চড়ে তিনি এখন শিল্পমন্ত্রী। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া ও মধ্য এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রােকা কিংবা রিচার্ড বাউচার থেকে আরম্ভ করে ইউরােপীয় ইউনিয়নের নীতি নির্ধারক সকল প্রতিনিধিই বাংলাদেশে এসে নিজামীর সাথে সাক্ষাৎ না করে যেতে পারেন না। যুদ্ধাপরাধী হয়েও নিজামী রাষ্ট্রীয় শকটে জাতীয় পতাকা উড়িয়ে চলেছেন। জাতীয় সংসদে তার নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা দাবিদার’ ও মুক্তিযুদ্ধের পতাকা উত্তোলক শাহজাহান সিরাজরা মােনাজাত করছেন। স্বাধীনতা উত্তর বুদ্ধিজীবী হত্যা তদন্তের জন্য ১৯৭১ সালের ২১ ডিসেম্বর জহির রায়হানকে আহ্বায়ক করে একটি কমিটি গঠন করা হয়েছিল। এই তদন্ত কমিটিতে বর্তমান আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহম্মদ’ সদস্য ছিলেন। ভাগ্যের কি নির্মম পরিহাস আজ বুদ্ধিজীবী হত্যার নায়ক নিজামী ও মওদুদ আহম্মদ একই মন্ত্রিসভার সদস্য। রাজনৈতিক দুবৃত্তায়নের ফলে এরূপ অসম্ভব কার্যটি সম্ভব হয়েছে।
‘৭১-এর আলবদরের অনুকরণে নিজামী যে ১৬টি ঘাতক উগ্র জঙ্গিবাহিনী প্রকাশ্যে ও অপ্রকাশ্যে গড়ে তুলেছেন, সেগুলাে হলাে- ‘শাহাদত-ই-আল হিমা হরকাতুল জিহাদ, হিযবুল তাওহিদ, আল মুজাহিদ, জামায়াতি ইয়াহিয়া আল তুরাগ, আল হারাকাত আল ইসলামিয়া, আল মাহফুজ আল ইসলামী, জামাআতুল ফালাইয়া, তাওহিদি জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জুমাতুল আল সাজাদ, শাহাদাতই-নব্যুয়্যত, আল তুরাত, ইসলামী বিপ্লবী পরিষদ, জয়শে মােস্তফা, জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশ।৮৬
তবে ১৬টি জঙ্গি সংগঠনের বাইরেও তাদের আরাে গােপন সংগঠন কাজ করে যাচ্ছে বলে শােনা যায় । দিন দিন তারা জঙ্গিদের নতুন নতুন ফ্রন্ট খুলছে। জামা’আতুল মুজাহিদীন, জাগ্রত মুসলিম জনতা ও হরকাতুল জেহাদ ভিন্ন ভিন্ন। নাম হলেও এগুলাে আলাদা কোনাে সংগঠন নয়। এদের সবার গােড়া জামায়াত নেতা নিজামী। কাজের সুবিধার জন্য এরা আলাদা আলাদা এলাকা ভাগ করে। নিয়েছে। এদের পরস্পরের মধ্যে সুপরিকল্পিত নেটওয়ার্ক আছে। একাধিক সংগঠনের নেতাও দেখা যায় একই ব্যক্তি, বক্তব্যও প্রায় অভিন্ন। দিনে এক সংগঠন রাতে আর এক সংগঠন। দিনে জামায়াত রাতে জামায়াতুল মুজাহিদীন, কিংবা হরকাতুল জেহাদ। মনে হয় তারা একই নেটওয়ার্কের সদস্য। এদের অর্থের উৎস এক। পর্যালােচনা করলে দেখা যায় এদের বিদেশী কানেকশনও। এক।
জঙ্গি গ্রুপগুলাে বহুধা বিভক্ত হয়ে কাজ করার পেছনে একটি সুপরিকল্পিত উদ্দেশ্য আছে। আর তা হলাে, কোনাে একটি গ্রুপ রাষ্ট্রবিরােধী কাজ করতে যেয়ে ধরা পড়ে নিষিদ্ধ ঘােষিত হলে অন্য গ্রুপগুলাে যেন কাজ চালিয়ে যেতে পারে।
———————————————-
৮৬ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অঘােষিত যুদ্ধের ব্লু প্রিন্ট, পৃষ্ঠা-১৯২।
———————————————-
৬৬
প্রথমে স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামি ছাত্র শিবিরের কর্মী বানানাে হয়। এদের ভিতর জামায়াতের দৃষ্টিতে যারা অগ্রসর তাদের পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মধ্য প্রাচ্যের বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল দেশে প্রশিক্ষণের পর উপরােক্ত উগ্র সংগঠনের সাথে সম্পৃক্ত করা হয়। সে কারণেই উগ্ৰজঙ্গি শায়খ আব্দুর সহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানী, আব্দুল আউয়াল, খালেদ সাইফুল্লাহ ও ইফতেখার হােসেন ওরফে আল মামুনসহ সকল জঙ্গির অতীত ইতিহাস পর্যালােচনা করলে জানা যায় যে, এরা সকলেই ছাত্র জীবনে ইসলামি ছাত্র শিবির ও পরবর্তীতে জামায়াতে ইসলামের সদস্যপদ লাভের। পর জামায়াতের জঙ্গি গ্রুপগুলােতে সংগঠিত হয়েছে। এছাড়া পুলিশ যখনই এদের আস্তানায় হানা দিয়েছে, তখনই তাদের কক্ষে আবুল আলা মওদুদীর ও গােলাম। আযমের পুস্তিকা, দেলােয়ার হােসেন সাঈদির সিডি এবং জামায়াতে ইসলামীর পত্র-পত্রিকা ও প্রকাশনী পেয়েছে।
জামায়াতে ইসলাম নিয়ন্ত্রিত হরকাতুল জেহাদ খুবই দুর্ধর্ষ একটি জঙ্গি গ্রুপ। আফগানিস্তানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুফতি হান্নান এই বাহিনীর প্রধান। ১৯৯৯ সালের ১৮ জানুয়ারি কবি শামসুর রাহমানের বাসায় যারা হামলা চালিয়েছিল, তারা ছিল হরকাতুল জিহাদের সদস্য। ওই ঘটনায় যারা গ্রেপ্তার হয়েছিল তাদের মধ্যে একজন পাকিস্তানি ও একজন দক্ষিণ আফ্রিকার নাগরিকও ছিল। তারা স্বীকার করেছিল ওসামা বিন লাদেন তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়েছিল। তাদের দেয়া হয়েছিল ৩ লাখ ডলার (প্রায় ২ কোটি টাকা)। এ অর্থ তারা ৪২৯টি মাদ্রাসায়। বিতরণ করে। সৌদি আরবের দাতব্য প্রতিষ্ঠানগুলাে বাংলাদেশের ৬৪ হাজার মাদ্রাসায় যে অনুদান দেয়, ওসামার দেয়া অর্থ তারই অংশ।৮৭
বিরােধী দলের নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ২০০০ সালের ২৪ জুলাই গােপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় ৩০ কেজি ওজনের বিস্ফোরক পুঁতে রাখা, ২০০৪ সালের ২১শে মে হযরত শাহজালাল (রাঃ) মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনােয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সাবেক অর্থমন্ত্রী শাহ এম.এস. কিবরিয়ার হত্যাকাণ্ড ও ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাসহ আওয়ামী লীগের প্রথম সারির সব নেতাকে সুপরিকল্পিতভাবে একসাথে হত্যার উদ্দেশ্যে পরপর ২১টি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটিয়ে যে নারকীয় হত্যাকাণ্ড ঘটায়, তাতে ঘটনাস্থলেই মহিলা আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদিকা আইভী রহমানসহ ২১ জন মারা যায়। উপরের সকল ঘটনার সাথে মুফতি হান্নান ও তার হরকাতুল জেহাদ যে জড়িত তা গ্রেপ্তারকৃত মুফতি হান্নান এবং তার আটক অনুসারীরা ইতিমধ্যে গােয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে।
মুফতি হান্নানের সাথে বিএনপি সরকারের একটি প্রভাবশালী অংশের যােগসূত্র সম্প্রতি দেশের প্রভাবশালী দৈনিক পত্রিকাগুলােতে ফাঁস হয়ে গেছে।
————————————–
৮৭ সােহরাব হাসান, গণতন্ত্র না জঙ্গিতন্ত্রের সাথে থাকবেন, মৃদুভাষণ, ২৫ জানুয়ারি, ২০০৬।
————————————–
৬৭
পত্রিকাগুলাে গােয়েন্দা সংস্থাগুলাের বরাত দিয়ে জানাচ্ছে- মুফতি হান্নান ‘আ’ আদ্যাক্ষরের একজন মন্ত্রী এবং ‘ল’ ও ‘গ’ আদ্যাক্ষরের দু’জন প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে চলতাে।৮৮ মুফতি হান্নানের স্বীকারােক্তি থেকে গােয়েন্দা সূত্র জানায়, ২০০০ সালের ২৪ জুলাই কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার সভাস্থলে বােমা পুঁতে রাখার পর শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এরপর হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি হান্নান, তার গুরু মওলানা আবু জাফরসহ অন্যরা গা ঢাকা দিলেও তাদের ষড়যন্ত্র থেমে থাকেনি। বিদেশে বৈঠকের আগে পাকিস্তানি মওলানা ফজলুর রহমান খলিল (পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর এজেন্ট- লেখক) বাংলাদেশে এসে মুফতি হান্নানের গুরু আবু জাফরের সঙ্গে বৈঠক করে পরবর্তী হামলার প্রস্তুতি নিতে বলে।৮৯ পরবর্তী হামলার প্রস্তুতি নিতেই ২০০৪ সালের প্রথম দিকে সিসিলি ও উত্তর আফ্রিকার মধ্যে ভূমধ্যসাগরের একটি দ্বীপরাষ্ট্রে আব্দুর রশিদের সঙ্গে পাকিস্তানের হরকাতুল । মুজাহিদীন নেতা মওলানা ফজলুর রহমান খলিল বৈঠক করেন। একটি বিদেশী গােয়েন্দা সংস্থা ওই বৈঠকের আয়ােজন করে। বৈঠকে হরকাতুল জিহাদের পক্ষ হয়ে বাংলাদেশের একজন রাজনৈতিক নেতার প্রতিনিধিও উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে আব্দুর রশিদ ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার জন্য অর্থ ও অন্যান্য সব। ধরনের সহায়তার প্রতিশ্রুতি দেন।৯০
ইদানীংকালে মুফতি হান্নান গােয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে যে, তিনি সিলেটের মেয়র বদরুদ্দিন কামরানকে হত্যার উদ্দেশ্যে দুইবার গ্রেনেড হামলা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি আরাে স্বীকার করেন সিলেটের মহিলা ওয়ার্ড কমিশনার জেবুন্নেসাকেও হত্যার উদ্দেশ্যে তার বাহিনী গ্রেনেড হামলা করেছিল।
নিজামীর আরেক ঘাতক বাহিনীর নাম জেএমবি অর্থাৎ জামা’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ। শায়খ আব্দুর রহমান এই বাহিনীর প্রধান। তার পিতা ছিলেন ‘৭১ সালে নিজামীর একজন ঘনিষ্ঠ সহচর এবং কুখ্যাত রাজাকার আব্দুল্লাহ্ ইবনে ফজল । জেএমবি-র সেকেন্ড ইন কমান্ড হচ্ছেন সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই। প্রথমদিকে জেএমবি-র কর্ম তৎপরতা উত্তরবঙ্গ ও বৃহত্তর ময়মনসিংহে পরিলক্ষিত হলেও পরবর্তীতে সারা বাংলাদেশে তাদের নেটওয়ার্ক বিস্তৃতি লাভ করে। জে.এম.বি. ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট একযােগে ৬৩টি জেলায় ৩৫০টি স্থানে ৫ শতাধিক বােমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে প্রশাসনের প্রতি। চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়। এই হামলা তারা প্রকাশ্য ঘােষণা দিয়েই করে। এই হামলাগুলাের লক্ষ্যবস্তু ছিল হাইকোর্ট, জজকোর্ট, বার কাউন্সিল, ডিসি অফিস ও । প্রেস ক্লাব ইত্যাদি। একসাথে ৬৩টি জেলায় প্রকাশ্য প্রথম হামলাটি ছিল মূলত
———————————————
৮৮. সংবাদ, ১৫ সেপ্টেম্বর, ২০০৬।
৮৯ .সমকাল, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৬।
৯০. সমকাল, ২০ সেপ্টেম্বর, ২০০৬।
———————————————
৬৮
প্রতীকী। এই হামলার ভিতর দিয়ে দেশবাসীকে তারা একটি মেসেজ দিতে চায়। আর তা হলাে আমাদের আধুনিক বিচার ব্যবস্থা, প্রশাসন, মিডিয়াসহ আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের কোনাে ব্যবস্থাকেই তারা মানে না অর্থাৎ আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রের তারা উচ্ছেদ চায়। তাদের এই প্রকাশ্য আবির্ভাবের সাথে দেশবাসী আরাে দু’টি শব্দের সাথে পরিচিত হয়। এই দু’টি শব্দের একটি হলাে ‘তাগুদি আইন এবং অপরটি হলাে ‘এহসার। তাদের ভাষায় তাগুদি অর্থ ‘মানব রচিত আইন’ আর এহসার হলাে ‘আত্মঘাতী’ অর্থাৎ আমরা যাকে ‘সুইসাইড স্কোয়াড’ বলি। তাগুদি আইন মানি না বলে তারা আমাদের নিরীহ নিরস্ত্র বিচারপতিদের ওপর হামলা শুরু করে দেয়। নানারকম অভিনব পদ্ধতিতে তারা আত্মঘাতী বােমা হামলা চালাতে শুরু করে। ৩ অক্টোবর একযােগে চাঁদপুর, লক্ষীপুর ও চট্টগ্রামে আদালতে বিচারকার্য চলার সময় বিচারপতিদের ওপর বইবােমা হামলা চালায়। ফলে একজন নিহত হয়। ২০০৫ সালের ২৯ নভেম্বর গাজীপুর বার কাউন্সিলে এবং ২০০৫ সালের ১ ডিসেম্বর গাজীপুর ডিসি অফিস প্রাঙ্গণে ফ্লাস্ক বােমা হামলা চালায়। এই হামলায় ৬ জন নিহত ও ১০০ জন আহত হয়। ২০০৫ সালের ৮ ডিসেম্বর নেত্রকোনায় বােমা হামলা চালিয়ে ৮ জনকে নিহত ও ৩ শতাধিক আহত করে।
তাদের এই সন্ত্রাসী অপতৎপরতা শুধু দেশের ভিতরেই তােলপাড় সৃষ্টি করেনি, বহির্বিশ্বেও চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করেছিল। তাদের সরব আত্নপ্রকাশের পর প্রতিদিনই তারা আদালত প্রাঙ্গণ, বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল, কলেজসহ আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলসমূহে হুমকি সম্বলিত লিফলেটসহ বােমা পেতে রেখে এক ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে। পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, এক পর্যায়ে এসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-ছাত্রীর উপস্থিতির হার শূন্যের কোঠায় নেমে আসে এবং আধুনিক বিপণি বিতানগুলাে ক্রেতাশূন্য হয়ে পড়ে। জেএমবি-র গুরু নিজামী বিএনপি-র চার দলীয় জোট সরকারের অংশীদার হওয়াতে তারা। (জেএমবি) বেপরােয়া হয়ে ওঠে। তাগুদি আইন মানি না বলে তারা বিচারপতিদের ওপর হামলা করে জঘন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করে। প্রথমে তারা। সিলেটের বিচারপতি বিজয় বিহারী কুণ্ডুকে বােমা হামলা করে মারাত্মক আহত। করে। এসব শ্বাপদদের হাত থেকে ঝালকাঠির আদালতের বিচারক জগন্নাথ পাড়ে ও সােহেল আহম্মদ বাঁচতে পারেননি। ২০০৫ সালের ১৪ নভেম্বর আদালতে যাবার সময় জেএমবি-র জঙ্গি সদস্য তাদের গাড়িতে শক্তিশালী বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করে।
জেএমবি-র সেকেন্ড ইন কমান্ড সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলা ভাই উত্তরবঙ্গ বিশেষ করে বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। উত্তরবঙ্গে তিনি সন্ত্রাসের জনপদ গড়ে তােলেন। তার এই বেপরােয়া সন্ত্রাসের কাছে প্রশাসন অসহায় ও নির্বিকার ছিল। প্রশাসনের ওপর মহলে যােগাযােগ থাকার কারণে তার। সাথে মাঝে মধ্যে রাজশাহীর পুলিশ সুপার মাসুদ মিঞা বৈঠক করে তার
৬৯
অসামাজিক কাজের সহায়তা দিত। পুলিশ সুপারের কক্ষে তার এবং পুলিশ সুপার। মাসুদ মিঞার বৈঠকের ছবি দেশের বিভিন্ন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়। | আরেক পুলিশ কর্মকর্তা নওগাঁর তৎকালীন পুলিশ সুপার ফজলুর রহমান। আত্রাই ও রাণীনগরে বাংলা ভাইকে পুলিশি পূর্ণ নিরাপত্তা (প্রটোকল) দিতেন। এ বিষয়ে এসপি ফজলুর রহমানকে সাংবাদিকরা জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, উপরের নির্দেশেই তিনি এসব করেছেন। বাংলা ভাইয়ের অত্যাচার ও হত্যাকাণ্ড সমর্থন করে তার আধ্যাত্মিক পুরুষ শায়খ আব্দুর রহমান রাজশাহীর বাগমারা মহিলা কলেজের মিলনায়তনে বলেন, সারাদেশে আমরা জঙ্গি তৎপরতা চালাচ্ছি। সশস্ত্র ইসলামী বিপ্লবই আমাদের লক্ষ্য।৯১
২০০৪ সালের শুরুতে বাংলা ভাইয়ের লােমহর্ষক অত্যাচারের কাহিনী জাতীয় দৈনিকগুলােতে প্রকাশ পেতে শুরু করে। বগুড়ার নন্দীগাম থানার বামন গ্রামে আব্দুল কাইয়ুম ওরফে বাদশাকে বাংলা ভাই হত্যা করে উল্টো করে গাছের সাথে ঝুলিয়ে রাখার হৃদয় বিদারক ছবি যখন জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত হয়, তখনই সংসদে দাঁড়িয়ে নিজামী বাংলা ভাইকে রক্ষা করার জন্য মিথ্যা ভাষণে বলেন, বাংলা ভাই বলে কিছু নেই, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি। মানুষের ভিতর। ত্রাস সৃষ্টির জন্য বাংলা ভাই মাইকে মৃত্যুপথ যাত্রীর (যাকে তারা খুন করতে চলেছে- লেখক) চিৎকার প্রচার করতাে।
২৬ জুন ঢাকা ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে বিএইচআইআর-এর নির্যাতনবিরােধী আলােচনা সভায় বাংলা ভাইয়ের নির্মমতার বলি বাদশার সহােদর ভাই মাহবুবুল ইসলাম যখন ভ্রাতৃ হত্যার কথা স্মরণ করে বিরােধীদলীয় নেত্রীকে উদ্দেশ্য করে বলেন, আপনার স্বজন হারানাের চোখের জলের ধারার সাথে আমাদের স্বজন হারানাের বেদনার জল একাকার হয়ে গেছে তখন দর্শক সারিতে বসা অনেকের পক্ষেই অশ্রু ধরে রাখা সম্ভব হয়নি।৯২
| নিজামীদের নিয়ন্ত্রিত জঙ্গি সংগঠনগুলাের টার্গেট হলাে বাঙালি সংস্কৃতির ওপর আঘাত পরিচালনা করা। এ লক্ষ্যেই তারা বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, পহেলা বৈশাখের অনুষ্ঠান, বাণিজ্যিক মেলা, ঐতিহ্যবাহী মেলা, সিনেমা হল, যাত্রা, নাটক, গানের আসর প্রভৃতি স্থানে হামলা চালিয়ে প্রাণহানি ঘটায়। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৯৯ সালের ৬ মার্চ যশােহর টাউন হলে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বােমা মেরে ১০জনকে হত্যা করা হয় এবং ১৫০জনকে চিরদিনের মত পঙ্গু করে দেওয়া হয়। ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল রমনার বটমূলে ১লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে বােমা হামলা করলে এখানে ১০জন মারা যায় এবং ২০জন আহত হয়। ২০০১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর সাতক্ষীরা রুক্সি সিনেমা হলে ও সার্কাস প্যান্ডেলে বােমার আঘাতে প্রাণ হারায় ৩ জন, আহত হয় ১০০ জন। ২০০৩ সালের ১৭ জানুয়ারি টাঙ্গাইলের শফিপুরের পাগলার মেলায় বােমা ফাটিয়ে মারা হয় ৮জন
—————————————–
৯১ অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অঘােষিত যুদ্ধের ব্লু প্রিন্ট, পৃষ্ঠা-১৯৪।
৯২ জনকণ্ঠ, ২৭ জুন, ২০০৬।
—————————————–
৭০
এবং আহত করা হয় ১৫জনকে। ২০০৫ সালের ১৫ জানুয়ারি বগুড়ার নাট্যানুষ্ঠানে বােমা মেরে হত্যা করা হয় ২জনকে এবং এই হামলায় আহত হয়। ৩৫জন।
সুফিসাধকদের মাজারও তাদের প্রতিহিংসার টার্গেটে পরিণত হয়। সিলেটে হযরত শাহজালালের মাজারে ওরস অনুষ্ঠানে ৫জন মুসুল্লিকে হত্যা করা হয় এবং আহত করা হয় ৫০ জনকে। এসব ধর্মান্ধরা মাছ এবং কাছিমকেও ইসলামের শত্রু ভাবতে থাকে। তাই তারা খুলনার খান জাহান আলীর মাজারের ঐতিহ্যবাহী কাছিম এবং সিলেটের হযরত শাহজালাল (রঃ)-এর মাজারের গজার মাছ বিষ। প্রয়ােগে হত্যা করে। কথিত আছে সাধক পুরুষরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে এদেশে আসার সময় এসব কাছিম এবং মাছ সাথে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাই এসব সাধক পুরুষদের ভক্তরা এসব মাছের বিশেষ যত্ন নিত বলে এদেশের স্বঘােষিত ইসলামের ঠিকাদারদের পছন্দ হয়নি।
সংখ্যালঘুদের উপাসনালয় তাদের আক্রমণের বাইরে ছিল না। ১৯৯৯ সালের ৮ অক্টোবর খুলনার আহমদিয়া মসজিদে বােমা মেরে ৮জনকে হত্যা করা হয়। ২০০১ সালের ৩ জুন গােপালগঞ্জের বালিয়াচর গির্জায় বােমার বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ১০জনকে নিহত ও ২৬ জনকে আহত করা হয়।
গ্রামীণ ব্যাংক, ব্র্যাক, প্রশিকাসহ বিভিন্ন এনজিও অফিসেও তারা হামলা চালাতে থাকে। এসব আন্তর্জাতিক খ্যতিসম্পন্ন এনজিওগুলাের অপরাধ হলাে তারা নারীর ক্ষমতায়নকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়। আর এসব ধর্মান্ধরা নারী মুক্তিতে বিশ্বাস করে না।
মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের রাজনৈতিক প্রগতিশীল দলকে তারা বহু আগে থেকে শত্রু বলে বিবেচনা করে আসছে। বিশেষ করে ‘৭১-এর পরাজয়ের গ্লানি কখনই তারা। ভুলতে পারেনি। তাই ২০০১ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকার পল্টন ময়দানে সিপিবি-র বিশাল জনসভায় হামলা চালিয়ে ৫ জনকে নিহত ও ৫০ জনকে আহত করা হয়। ২০০১ সালের ২৬ জুন নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগ অফিসে বােমার আঘাতে ২১ জনকে হত্যা এবং শতাধিক কর্মীকে আহত করা হয়। সুরঞ্জিত সেন গুপ্তকে হত্যার উদ্দেশ্যে সিলেট জনসভায় মঞ্চের কাছে শক্তিশালী বােমা ফাটালে মঞ্চের একাংশ উড়ে যায়। সুরঞ্জিত সেন গুপ্ত মারাত্নক আহত হন। এই বিস্ফোরণের ফলে ৩ জন নিহত হয় এবং বহু মানুষ আহত হয়।
জামায়াতের শক্তিশালী তহবিল এবং জঙ্গিবাদের অর্থের যােগান
জামায়াতের অর্থের যােগান আসে সৌদি আরব, কুয়েত লিবিয়াসহ কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম দেশ থেকে। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত তহবিল দেশে ব্যাংকিং, চিকিৎসা, বীমা, শিক্ষা, ক্ষুদ্র, মাঝারী ও ভারী শিল্পে বিনিয়ােগ করে তারা পাঁচশত কোটি টাকা মুনাফা বছরে হাতিয়ে নিচ্ছে। জামায়াতীরা তালেবানি রাষ্ট্র কায়েমের
৭১
জন্য অত্যন্ত কৌশলে অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা অর্জনের চেষ্টা করছে। তহবিল সংগ্রহের জন্য জামায়াত বৈধ এবং অবৈধ সকল পথেই ব্যবসা করছে। সাম্প্রতিককালে হেরােইন পাচারের সাথে জামায়াতের সংশ্লিষ্টতার চাঞ্চল্যকর তথ্য পাওয়া গেছে। একে তাে হেরােইন তার ওপর পাচার। এসব কপট ধর্ম ব্যবসায়ী জামায়াতীরাই এদেশে ইসলামের একমাত্র খাদেম হিসেবে নিজেদের দাবি করে। যুক্তরাজ্যে হেরােইন পাচারের অভিযােগে গ্রেপ্তারকৃত বিডি ফুডের চেয়ারম্যান। বদরুদ্দোজা চৌধুরী মােমিন স্বীকার করেছেন অপ্রচলিত পণ্য রপ্তানির আড়ালে। তিনি দীর্ঘদিন ধরে যুক্তরাজ্যে হেরােইন পাচার করে আসছেন। তার স্বীকারােক্তিতে জানা যায়, ব্রিটেনে পৃথক ৩টি চালানে সাড়ে ৭৫ কেজি হেরােইন তিনি পাচার করেছেন।
বিডি ফুডের গ্রেপ্তারকৃত চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা চৌধুরী মােমিন গােয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে জামায়াতের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতার কথা স্বীকার করেছেন। ‘জামায়াতের শীর্ষ নেতাদের দহরম মহরমের কথা তিনি লুকানাের চেষ্টা না করেই বলেছেন, জামায়াতের চট্টগ্রাম থেকে নির্বাচিত এক এমপি তার ঘনিষ্ঠ জনদের একজন। জামায়াতের ওই এমপি শিপিং ব্যবসার সাথে জড়িত। বৃহত্তর নােয়াখালীতে তার অর্থায়নেই জামায়াত পরিচালিত।… বিডি ফুডের হেরােইন পাচারের টাকা জামায়াতের তহবিলে গেছে- এ তথ্য অস্বীকার করছে না। জামায়াত। বলছে না যে বিডি ফুডের মালিকের সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক নেই।৯৩ এছাড়াও জামায়াতের নিয়ন্ত্রিত শত শত মাদ্রাসার মাধ্যমে এতিম ও হতদরিদ্র ছাত্রদের দেখিয়ে প্রতি বৎসর কয়েক কোটি টাকার কোরবানির চামড়া সংগ্রহ করে, যার মাধ্যমে তাদের তহবিল আরাে শক্তিশালী ও মজবুত হচ্ছে। ২০০৫ সালের ১৭ আগস্ট সিরিজ বােমা বিস্ফোরণের পর জঙ্গিদের অর্থের উৎস খোজ করতে গিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক জামায়াতে ইসলামের নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংকের সম্পৃক্ততা পায়। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংক দেশের প্রচলিত আইনানুসারে ইসলামী ব্যাংকে জরিমানা করতে বাধ্য হয়। ইসলামী ব্যাংক কর্তৃক জঙ্গিদের অর্থ যােগানের বিষয়টি এমন নগ্নভাবে দেশ-বিদেশে প্রকাশ পায় যে, নিজামী বিএনপির জোট সরকারের শিল্পমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও ইসলামী ব্যাংককে জরিমানা থেকে রক্ষা। করতে পারেনি। শুধু তাই নয় জবাবদিহিমূলক প্রশ্নোত্তরে ‘গত ২৭ জুন অর্থমন্ত্রী জাতীয় সংসদে ইসলামি ব্যাংকটির সঙ্গে জঙ্গি গােষ্ঠীর সম্পৃক্ততার কথা। জানান।৯৪
অস্ত্রের উৎস
জামায়াত ও তাদের প্রতিষ্ঠিত জঙ্গিবাদী গ্রুপগুলাে পাকিস্তান আফগানিস্তান ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে অস্ত্র ও নানারকম বিস্ফোরক দ্রব্যাদি ও সরঞ্জাম
————————————
৯৩. সংবাদ, ১৮ মে, ২০০৬।
৯৪. সমকাল, ৫ জুলাই, ২০০৬।
————————————
৭৩
নানা পথে বেআইনিভাবে নিয়ে আসে। এরকম বেশ কিছু চালান দেশের বিভিন্ন স্থানে ধরা পড়েছে। তবে চট্টগ্রাম ও বগুড়ার চালান দু’টি ছিল সবচেয়ে বড় ও উল্লেখ করার মত। এছাড়াও রাজধানীর কুড়িলে আধুনিক অস্ত্রের বড় ধরনের একটি চালান ধরা পড়ে। কূটনৈতিক জোনের কাছে এত বড় অবৈধ অস্ত্রের চালান সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয়। আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকেও প্রশ্নবিদ্ধ করে তােলে। বান্দরবান ও হবিগঞ্জ থেকে বিডিআর মারাত্নক সব অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেছে। এসব অস্ত্রের ভিতর ট্যাংক বিধ্বংসী মাইন, রকেট লাঞ্চার, রাইফেল, পিস্তল ও গােলাবারুদসহ মারাত্মক ধরনের মারণাস্ত্র ছিল। ২০০৪ সালের ২৫ নভেম্বর বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি থেকে ২৫টি ভারী অস্ত্রশস্ত্রসহ বিপুল পরিমাণ গ্রেনেড ও বােমা উদ্ধার করা হয়। ২০০৪ সালের ২৪ ডিসেম্বর বান্দরবানে আবারও মর্টারসহ বিপুল পরিমাণ ভারী অস্ত্র ধরা পড়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে।
বগুড়ার কাহালুতে ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালানের সাথে নিজামীর ইসলামী ছাত্র শিবিরের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। দেশের দুটি প্রাইভেট চ্যানেল এই গােলাবারুদের সাথে ছাত্র শিবিরের যােগসূত্র আছে এ খবর প্রচার করলে সরকার চ্যানেল দু’টির ওপর সেন্সরশিপ চালু করে।৯৫ ২০০৪ সালের ১ এপ্রিল হাজার কোটি টাকা মূল্যের স্মরণকালের বৃহত্তর চালানটি ধরা পড়ে চট্টগ্রামে। ১০ ট্রাক ভর্তি অস্ত্রের চালানের ভিতর ছিল ১০ হাজার আগ্নেয়াস্ত্র, রকেট শেল, রকেট লাঞ্চার, ২ হাজার গ্রেনেড, তিন লাখ বুলেট। চট্টগ্রামের সি.ইউ.এফ.এল. জেটিতে অস্ত্র খালাসের সময় চালানটি ধরা পড়ে। সি.ইউ.এফ.এল, ঘাটটি মতিউর রহমান নিজামীর নিয়ন্ত্রিত ঘাট বলে সর্বজনবিদিত। চট্টগ্রামের এই অস্ত্রের চোরাচালানের সাথে পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সাথে চোরাচালান সিন্ডিকেট নেতা হাফিজুর রহমানের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পাওয়া গেছে। আন্তর্জাতিক চোরাচালান সিন্ডিকেট হাফিজ ও বার্মা জহির এই চোরাচালান নিয়ন্ত্রণের মূল দায়িত্বে ছিল। এ বিষয়ে অধ্যাপক আবু সাইয়িদ তাঁর ‘অঘােষিত যুদ্ধের ব্লু প্রিন্ট গ্রন্থে উল্লেখ করেন, “গত ১ এপ্রিল ‘০৪ শিল্পমন্ত্রী জামায়াত আমির মওলানা মতিউর রহমান নিজামীর নিয়ন্ত্রণাধীন সি.ইউ.এফ.এল. জেটি ঘাটে অস্ত্রের চালান আটকের আনুমানিক ১৫ দিন আগে নগরীর স্টেশন রােড এলাকায় একটি হােটেলে বৈঠক করেছে হাফিজ ও বার্মা জহির। গােয়েন্দাদের ধারণা, দুজন এ কয়েকদিন চট্টগ্রামে অবস্থান করে অস্ত্রের চালান খালাসের বিষয়ে নানা আয়ােজন করেছে’।৯৬
এ যাবৎ অস্ত্রের বড় ধরনের যত চালান এসেছে তা সাধারণ সন্ত্রাসের কাজে ব্যবহার হয় না। এসব অস্ত্র কেবল যুদ্ধকালীন সময়ে ব্যবহার হয়। ২০২০ সালের
—————————————————–
৯৫. সােহেল ইমরান, মারাত্নক সব অস্ত্রশস্ত্র কারা আনছে, কাদের জন্য আনছে, মৃদুভাষণ, ০৫ জানুয়ারি, ২০০৪।
৯৬. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অঘােষিত মুক্তিযুদ্ধের ব্লুপ্রিন্ট, পৃষ্ঠা-২০০।
—————————————————–
৭৪
মধ্যে যারা রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করে ইসলামী হুকুমতের নামে তালেবানি রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়, তাদের পক্ষেই এত বড় ধরণের অস্ত্র আমদানির যৌক্তিকতা আছে।
বিদেশ থেকে অস্ত্র চালান অবৈধভাবে আমদানি করা ছাড়াও নিজামীর জামায়াত শিবির ও তাদের নিয়ন্ত্রিত জঙ্গিরা স্থানীয়ভাবে হাল্কা অস্ত্র, শক্তিশালী রিমােট কন্ট্রোল টাইম বােমা বানানাের অনেক বিশেষজ্ঞ বিদেশ থেকে ট্রেনিং দিয়ে নিয়ে এসেছে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢাকার বাসাবাে, দিনাজপুর, গাজীপুরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিপুল পরিমাণ মারাত্মক বিস্ফোরক ও বােমা তৈরির সরঞ্জামাদি জঙ্গিদের কাছ থেকে উদ্ধার করেছে।
জঙ্গিবাদ প্রশিক্ষণ
জামায়াত শিবির ও তাদের জঙ্গিবাদী সংগঠনগুলাে দেশের ভিতর ও বাইরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। দেশের বাইরে পাকিস্তান, আফগানিস্তান, লিবিয়াসহ মধ্য প্রাচ্যের কয়েকটি প্রতিক্রিয়াশীল দেশে তারা প্রশিক্ষণ নিয়ে থাকে। দেশের অভ্যন্তরে চট্টগ্রামের গভীর অরণ্যে রয়েছে জঙ্গিদের একাধিক ঘাঁটি। বাংলাদেশের আড়াই হাজার মাইল ভারতীয় সীমান্তবর্তী এলাকায় জঙ্গিদের প্রশিক্ষণ দিতে পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সম্পৃক্ততা রয়েছে।৯৭ জামায়াত ও তাদের নিয়ন্ত্রিত জঙ্গি গ্রুপগুলাের অসংখ্য মাদ্রাসা ও কওমি মাদ্রাসাগুলােতেও নিয়মিত জঙ্গি প্রশিক্ষণ চলছে। সারা দেশে তারা শত শত মাদ্রাসা গড়ে তুলেছে। তবে বেশ কিছু মাদ্রাসা তারা লােক চক্ষুর আড়ালে চট্টগ্রাম, সিলেট ও ময়মনসিংহের। গভীর অরণ্যে গড়ে তুলেছে। ময়মনসিংহের ভালুকার গভীর জঙ্গলে এরূপ একটি মাদ্রাসায় গভীর রাতে প্রশিক্ষণরত অবস্থায় জেএমবি-র সুরা সদস্য ও মােস্ট ওয়ান্টেড মওলানা আব্দুর রউফসহ ২৫ জনকে ২০০৬ সালের ৩ আগস্ট গ্রেফতার করা হয়। গ্রেপ্তার কৃতদের মধ্যে সুইসাইড স্কোয়াডের সদস্য কামরুজ্জামান কামাল ও মােঃ সাইফুল ইসলাম রয়েছে।৯৮ কবি শামসুর রাহমানের ওপর। হামলাকারীদের ভিতর যেসব হরকাতুল জেহাদের জঙ্গি গ্রেফতার হয়েছিল তাদের স্বীকারােক্তিতে জানা যায়, ওসামা বিল লাদেনের প্রেরিত বিরাট অংকের অর্থ আমাদের মাদ্রাসা শিক্ষায় ব্যয় হচ্ছে। লাদেনের অর্থে যেসব মাদ্রাসা পরিচালিত হচ্ছে সেখানে স্বাভাবিকভাবেই তালেবানি রাষ্ট্র তৈরির জন্য জঙ্গিবাদ শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, দেশে অন্তত ৩২৫টি কওমি মাদ্রাসায় ইসলামি জঙ্গিদের সামরিক প্রশিক্ষণ দেয়া হয়ে থাকে। প্রায় এক হাজার বিদেশী সামরিক প্রশিক্ষকের ভূমিকা পালন করছে বলেও তথ্য বেরিয়েছে গােয়েন্দা তদন্তে ।… একটি হিসাব মতে দেশে কওমি মাদ্রাসার সংখ্যা ২৫ হাজার। শিক্ষার্থী।
——————————————-
৯৭ জনকণ্ঠ, ৩ আগস্ট, ২০০৬। ৯৮ দৈনিক সংবাদ, ৪ আগস্ট, ২০০৬।
——————————————-
৭৫
ও শিক্ষকের সংখ্যা যথাক্রমে ২৫ লাখ ও ২ লাখ’।৯৯ এসব কওমি মাদ্রাসার। বেশির ভাগই জামায়াত ও জঙ্গি সংগঠনগুলাে দ্বারা পরিচালিত। এসব কওমী মাদ্রাসায় সিলেবাস তৈরিতে সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ না থাকাতে নিজামীরা ইসলামের নামে মওদুদীবাদ শিক্ষা দিয়ে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধ তৈরি করে। কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-ছাত্রীদের বেশির ভাগই হতদরিদ্র ও পিতৃমাতৃহীন হওয়াতে এদের পারিবারিক বন্ধন শিথিল হয়। পরিবারের প্রতি পিছুটান না থাকাতে খুব সহজেই নিজামীরা এদের ধর্মের ভুল ব্যাখ্যা দিয়ে বেহেশতের লােভ দেখিয়ে এহসার সদস্য অর্থাৎ আত্নঘাতী জঙ্গি হিসাবে তৈরি করে। এভাবে জামায়াত ও জঙ্গি গ্রুপগুলাে তাদের নিয়ন্ত্রিত মাদ্রাসা থেকে প্রতি বছর হাজার হাজার আত্নঘাতী। সদস্য জঙ্গি করছে। এসব জঙ্গি দেশে অস্বস্তিকর ও ভীতিকর পরিবেশের সৃষ্টি করে আমাদের দেশের শান্তি ও অগ্রগতির পথ রুদ্ধ করেছে এবং বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও তালেবানি রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস চালিয়ে বহির্বিশ্বে আমাদের দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করছে।
নিজামীর জামায়াতের সহিত জঙ্গিদের কানেকশন
বাংলাদেশে মুসলিম জঙ্গিবাদী এবং জঙ্গিবাদীদের সাথে জামায়াতের কানেকশন নিয়ে অভিজ্ঞ রাজনৈতিক মহল, বােদ্ধা সমাজ বিশ্লেষক, গবেষক এবং দেশী ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন মিডিয়াগুলাে বহু আগে থেকেই সতর্ক করে আসছিল। কিন্তু নিজামী অভিযােগগুলাে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করার ষড়যন্ত্র, ‘বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত’ বলে খণ্ডন করে আসছিল।
শুধু তাই নয় জঙ্গিদের আড়াল করার জন্য নিজামী বলে, বাংলা ভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’ ‘মাহফুজ আনামকে জিজ্ঞেস করলে বাংলা ভাইয়ের খবর জানা
———————————————
৯৯ মাহবুব কামাল, সংগঠিত হচ্ছে তালেবান শক্তি, মৃদুভাষণ, ২৮ আগস্ট, ২০০৬।
———————————————
৭৬
যাবে’ ‘বােমা হামলার সাথে ভারতের গােয়েন্দা সংস্থা ‘র’ এবং ইসরাইলের গােয়েন্দা সংস্থা মােশাদ জড়িত।
১৭ আগস্টের ৬৩ জেলায় একযােগে বােমা বিস্ফোরণের পর জঙ্গিদের আড়াল করার জন্য নিজামী ২০০৫ সালের ডিসেম্বর মাসে পল্টনে জামায়াতের সমাবেশে বলেন, জঙ্গি তৎপরতা বােমাবাজিবিরােধী দল ও প্রতিবেশী রাষ্ট্রের কাজ।১০০ পল্টন ময়দানে নিজামী আরাে বলেন, দেশে জাতীয়তাবাদী শক্তি ও ইসলামি শক্তির মধ্যে ঐক্য যাতে অটুট না থাকে এবং বিভেদ সৃষ্টির জন্যই তথাকথিত জঙ্গিদের সৃষ্টি। জঙ্গিবাদ আওয়ামী লীগের সৃষ্টি।১০১ জঙ্গিদের আড়াল করার নিজামীর এই অপচেষ্টা এটাই প্রমাণ করে নিজামীর সঙ্গে জঙ্গিদের কানেকশন আছে।
জঙ্গিদের বীভৎস হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণ যখন ফুসে ওঠে এবং বিশ্ব জনমত জঙ্গিবাদ দমনের জন্য চাপ সৃষ্টি করে, তখন বাধ্য হয়ে বিএনপি সরকার ‘আইওয়াশ করার জন্য সীমিত আকারে কয়েকজন নিচু স্তরের জঙ্গি গ্রেপ্তার করে, আর তখনই বাধে বিপত্তি। যখনই কোনাে জঙ্গি ধরা পড়েছে বলেছে সে জামায়াত কর্মী। এভাবে থলের বিড়াল বের হতে থাকে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা যায় আটক পঞ্চাশ শতাংশ জঙ্গিই জামায়াতের সাথে তাদের সম্পর্কের কথা স্বীকার করেছে। এ পর্যন্ত পত্রিকায় যে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যায় বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, রংপুরের এনামুল হক – এরা প্রত্যেকেই জামায়াতের সাথে যুক্ত ছিল নয়তাে এখনও জামায়াতের সঙ্গেই রয়েছে। রংপুরের এনামুল হক, বৃহত্তর সিলেটের সাবেক জামায়াত নেতার পুত্র শামীম (জেএমবি-র আইটি বিভাগের প্রধান) এবং সানীর আস্তানা থেকে সাঈদীর ক্যাসেট পাওয়া গেছে। আটক আরাে জঙ্গির কাছ থেকে জামায়াতের রাজনৈতিক লিটারেচার পাওয়া গেছে। রাজশাহীর তানােরে জামায়াতের এক প্রভাবশালী নেতার বাড়িতে পুলিশ বােমা তৈরির বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক ও সরঞ্জাম উদ্ধার করেছে। সেখান থেকে বােমা তৈরি রত অবস্থায় বাংলা ভাইয়ের দুই কর্মীকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। জামায়াত কানেকশন না থাকলে বােমা তৈরির সরঞ্জামসহ জেএমবি-র সদস্যরা জামায়াত নেতার বাড়িতে আশ্রয় পেল কিভাবে? কিন্তু পুলিশ বিএনপি সরকারের অংশীদার জামায়াতের মন্ত্রী নিজামীর চাপে শেষ পর্যন্ত তানােরের জামায়াত নেতাকে গ্রেপ্তার করতে পারেনি।
সংসদ ভবন থেকে জঙ্গি সন্দেহে দু’জন আটক করার পরও জামায়াতের চাপে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তাতেও কি জামায়াতের সাথে জঙ্গি কানেকশন প্রমাণিত হয় না?
——————————————-
১০০ জনকণ্ঠ, ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৫।
১০১ ইত্তেফাক, ২৯ ডিসেম্বর, ২০০৫।
——————————————-
৭৭
জঙ্গিদের সাথে নিজামীদের সম্পর্কের আরাে একটি জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে, জঙ্গিদের একজন আধ্যাত্মিক নেতা শায়খ আব্দুর রহমান মওলানা মতিউর রহমান নিজামীর সুপারিশে মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা করার সুযােগ পান। শুধু তাই নয় মদিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশােনা শেষ করার পর নিজামীর সুপারিশেই তিনি। বাংলাদেশস্থ সৌদি দূতাবাসে চাকুরী পেয়েছিলেন। শায়খ রহমানের অতীত ইতিহাস পর্যালােচনা করলে জানা যায় তিনি জামায়াত শিবিরের সাথে যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও শায়খ রহমান সিলেটের জামায়াত অধ্যুষিত এলাকায় টিলাগড়ার ‘সূর্য দীঘল’বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার সময় তার রুমে আবুল আলা মওদুদী, গােলাম আযম রচিত পুস্তিকা ও দেলােয়ার হােসেন সাঈদীর বক্তৃতার ক্যাসেট পাওয়া যায়। জঙ্গিদের সঙ্গে কোনাে সম্পর্ক নেই- নিজামীর এই বক্তব্য। আরাে অসার প্রমাণিত হয় যখন, শায়খ আব্দুর রহমান নিজেই তথ্য দিয়েছেন,
৭৮
‘জামায়াতের সঙ্গে বৈঠকের পরই সে দেশব্যাপী বােমা হামলা পরিচালনা করে।১০২
শায়খ রহমান টিএফআই-এর কাছে নিজামী ও বিএনপি-র কয়েকজন মন্ত্রীর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের কথা স্বীকার করেন। জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য গােয়েন্দা সংস্থা ও র্যাবের সমন্বয়ে গঠিত কমিটিকে টাস্কফোর্স ইন্টেলিজেন্স সংক্ষেপে টিএফআই বলে। এই টিএফআই-এর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন শায়খ আব্দুর রহমান ধরা পড়ার পর দেশের অনেকগুলাে বােমা হামলা, কয়েকটি হত্যাকাণ্ড এবং লুটপাটের কথা স্বীকার করেছে। তার এসব কর্মকাণ্ডে সরকারের দু’জন মন্ত্রীর সহযােগিতার কথাও তিনি স্বীকার করেন। এ দু’জন মন্ত্রী হলেন জামায়াতে ইসলামীর মতিউর রহমান নিজামী এবং বিএনপি-র ব্যারিস্টার আমিনুল হক।
টিএফআই-এর ওই কর্মকর্তা আরাে বলেন, শায়খ রহমান ১৭ আগস্ট ও তৎপরবর্তী বােমা হামলার কথা স্বীকার করেছে। তার আগে যেমন ময়মনসিংহের চারটি সিনেমা হলে বােমা হামলা, সিলেটে মেয়র কামরানের ওপর দু’দফা হামলা ও উত্তরবঙ্গের বেশ কয়েকটি হামলার কথা স্বীকার করেছে। তাছাড়া বৃহত্তর রাজশাহী অঞ্চলে বাংলা ভাই কর্তৃক অত্যাচার, নির্যাতন ও কয়েকটি হত্যাকাণ্ডের কথাও স্বীকার করেছে। এসব ঘটনায় ওই অঞ্চলে দুই মন্ত্রী ব্যারিস্টার আমিনুল হক, মতিউর রহমান নিজামী, প্রতিমন্ত্রী আলমগীর কবির, রাজশাহীর মেয়র মিজানুর রহমান মিনু, নাটোরের উপমন্ত্রী রহুল কুদুস তালুকদার, এমপি নাদিম মােস্তফার সরাসরি সহযােগিতার কথাও সে বলেছে’।১০৩
জঙ্গিবাদের জন্মদাতা যে জামায়াত তার প্রমাণ আরাে মেলে নিজামীর আরেক দোসর মওলানা আব্দুস সুবহানের সঙ্গে আফগান জঙ্গি নেতা গুলবুদ্দিন হেকমতিয়ারের বৈঠকের ছবিটি যখন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়ে পড়ে। মওলানা ছােবাহান ও হেকমতিয়ারের বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল পাকিস্তানের পেশােয়ারে। মওলানা আব্দুস সুবহান ‘৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর পক্ষে পাবনা শহরে কুড়াল মিছিল করেছিলেন। বর্তমানে তিনি পাবনার জামায়াত নেতা এবং এমপি। মওলানা আব্দুস সুবহান ও হেকমতিয়ারের বৈঠকের পথ ধরেই শায়খ আব্দুর রহমান, মুফতি হান্নান ও বাংলা ভাইসহ যারা জামায়াত শিবিরের সদস্য ছিলেন, তারা আফগানিস্তান গিয়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ নিয়ে দেশে ফিরেছিলেন।
নিজামীর সঙ্গে জঙ্গীবাদীদের সম্পর্ক আরাে নগ্নভাবে প্রকাশ পায় যখন নিজামী ক্রিস্টিনা রােকার সঙ্গে বৈঠকে উগ্রবাদীদের পক্ষে ওকালতি করেন। রােকা। ও নিজামীর বৈঠকের খবরটি ২০০৬ সালের ২৮ জানুয়ারি দেশের সকল জাতীয়
——————————————-
১০২. সুজন সরকার, জোট সরকারের প্রশ্রয়ে অব্যাহত মৌলবাদী আস্ফালন, মৃদুভাষণ, ২৮ আগস্ট, ২০০৬।
১০৩. যুগান্তর, ১৩ মার্চ, ২০০৬।
——————————————-
৭৯
দৈনিকে ফলাও করে প্রকাশিত হয়। রােকার সঙ্গে বৈঠকে জঙ্গিদের হয়ে কথা বললেন নিজামী’ শীর্ষক শিরােনামে ২৮ জানুয়ারি দৈনিক ভােরের কাগজে উল্লেখ করা হয়, দেশজুড়ে বােমা হামলাকারী উগ্র মৌলবাদী জঙ্গি সংগঠন জেএমবির (জামা’আতুল মুজাহিদীন, বাংলাদেশ) পক্ষে উপযাচক হয়ে কথা বললেন জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী। দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্রিস্টিনা রােকার সঙ্গে গতকাল শুক্রবার সকালে সাক্ষাৎকালে মতিউর রহমান নিজামী বলেছেন, জে.এম.বি তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। ইসলামের নামে মানুষকে ভুল পথে পরিচালিত করা এবং সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করার জন্য তারা ক্ষমাও চেয়েছে। এসব কথা জানা গেছে খােদ ক্রিস্টিয়ানা রােকার কাছ থেকে।… রােকা জানান নিজামী তাকে বলেছে, জে.এম.বি তাদের কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত, ক্ষমাও চেয়েছে তারা।
নিজামীদের সঙ্গে জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার বিষয়টি আর গােপন থাকে না, যখন জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে জঙ্গিদের অর্থায়নের বিষয়টি জনসম্মুখে প্রকাশিত হয়ে পড়ে। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক থেকে ঋণ নিয়ে ৭৬ কেজি ওজনের বােমা বসানাের ব্যবস্থা করেছিল মুফতি হান্নান’্১০৪ শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইয়ের গােপন একাউন্ট খুঁজে পাওয়া যায় ইসলামী ব্যাংকে। ইসলামী ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থায়নের বিষয়টি প্রকাশ হয়ে পড়লে দেশ-বিদেশে হৈচৈ পড়ে যায়। রাতারাতি ব্যাংকটির শেয়ারের বাজার পড়ে যায়। গ্রাহকদের টাকা তােলার হিড়িক লেগে যায়। যারা না বুঝে ব্যাংকটির শেয়ার হােল্ডার হয়েছিলেন তারাও তাদের শেয়ার তুলে নেওয়ার প্রস্তুতি নেন। জঙ্গিদের অর্থায়নের অপরাধে বাংলাদেশ ব্যাংক ব্যাংকটিকে জরিমানা করতে বাধ্য হয়। জনসম্মুখে বিষয়টির এত নগ্ন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছিল যে, নিজামী বিএনপি সরকারের প্রভাবশালী মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশ ব্যাংকের জরিমানা থেকে ব্যাংকটিকে রক্ষা করতে পারেনি। শেষ পর্যন্ত খােদ অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমানও পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে তাদের জোটের বড় শরিক জামায়াতে ইসলামের ইসলামী ব্যাংকের জঙ্গি অর্থায়নের বিষয়টি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হন। এরপরও কি আর প্রমাণ করতে হবে নিজামী ও তার দল জামায়াতে ইসলামী জঙ্গিদের সাথে জড়িত নয়? তবে এটাই কি নিজামীদের সৎলােকের শাসন প্রতিষ্ঠার নমুনা?
নিজামী ও জামায়াতের সাথে জঙ্গি কানেকশনের বিষয়টি আজ শুধু প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল কিংবা মিডিয়ার দাবি নয়, অনেক ইসলামিক সংগঠনও এমনকি তাদের শরিক জোটের ভিতর থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি জামায়াতের জঙ্গি সম্পৃক্ততার বিরুদ্ধে কথা বলছেন। ইসলামী ঐক্যজোটের একাংশের মহাসচিব আলহাজ্জ্ব মিছবাহুর রহমান চৌধুরী বলেছেন, দেশের ৬৩টি জেলার। ৫০০ স্থানে একসঙ্গে বােমা বিস্ফোরণের আর্থিক ও সাংগঠনিক শক্তি জামায়াত
———————————————-
১০৪. মৃদুল হক, পর্যবেক্ষক, মৃদুভাষণ, ১০ অক্টোবর, ২০০৫।
———————————————-
৮০
ছাড়া অন্য কোনাে ইসলামিক দলের নেই। তাছাড়া দেশের প্রতিটি ইসলামিক দলের কার্যকলাপ মনিটর করে জামায়াত। তাই জামায়াতের চোখ ফাঁকি দিয়ে । অন্য কেউ এ ধরনের ঘটনা ঘটাতে পারে – এটা আমি বিশ্বাস করি না।১০৫
ইসলামিক ফাউন্ডেশনের সাবেক পরিচালক মওলানা ফরিদ উদ্দীন মাসউদ দাবি করেন, নিজামী বােমা হামলার সাথে জড়িত। তাকে রিমান্ডে নিয়ে। জিজ্ঞাসাবাদ করলেই হামলার রহস্য বেরিয়ে আসবে।
নিজামী-খালেদার শরিক জোটের একটি দলের প্রধান মওলানা ফজলুল হক আমিনী বলেন, জামায়াত শিবিরের অফিসে অভিযান চালালে অবৈধ অস্ত্র পাওয়া যাবে।১০৬
নিজামী-খালেদার চারদলীয় জোটের আরেকটি শরিক দলের প্রধান নাজিউর রহমান মঞ্জু বলেছেন, সরকার মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ কার্যক্রম দমনে ব্যর্থ হয়েছে। জামায়াতকে জোটে রেখে মৌলবাদ ঠেকানাে যাবে না, কেননা তাদের সঙ্গে জঙ্গিদের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রয়েছে।১০৭
প্রাক্তন স্বরাষ্ট্র সচিব ওমর ফারুক জামায়াতের সমর্থক হিসাবে সর্বজনবিদিত। নিজামী-খালেদা জোট সরকারের সময় দীর্ঘদিন ধরে তিনি স্বরাষ্ট্র সচিব হিসাবে কর্মরত ছিলেন। স্বরাষ্ট্র সচিব হিসাবে কর্মরত থাকা অবস্থায় তিনি প্রগতিশীল ও মুক্ত চিন্তার ব্যক্তিবর্গকে নানাভাবে হয়রানি করেছেন, তেমনি জঙ্গি প্রশ্রয়দাতা হিসেবেও ব্যাপকভাবে সমালােচিত হয়েছেন। বিএনপি-র ধামরাইয়ের সাংসদ ব্যারিস্টার জিয়া জামায়াত সমর্থক ওমর ফারুকের জঙ্গি কানেকশন সম্পর্কে অভিযােগ করে বলেন, ওমর ফারুক স্বরাষ্ট্র সচিব থাকা অবস্থায় দেশে জঙ্গিদের উত্থান ঘটে। তার প্রত্যক্ষ মদদে বাংলা ভাই ও শায়খ আব্দুর রহমানের মতাে শীর্ষ স্থানীয় জঙ্গি নেতারা ধামরাই ঘুরে গেছেন।১০৮
এছাড়াও সুফিবাদের সংগঠক তরিকত ফেডারেশনের চেয়ারম্যান আলহাজ্ব সৈয়দ নজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারী, জাকের পার্টির প্রধান পীরজাদা মােস্তফা আমির ফয়সাল, চরমােনাইয়ের পীর, বিএনপি-র প্রভাবশালী এমপি সাবেক ডাকসাইটে সচিব আবু হেনা – এরা প্রত্যেকেই বিভিন্ন সময়ে জামায়াতের জঙ্গি কানেকশনের বিরুদ্ধে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়েছেন।
আন্তর্জাতিক গােয়েন্দাসংস্থা ও আন্তর্জাতিক সন্ত্রাসবাদের সাথে জামায়াতের কানেকশন
পাকিস্তান গােয়েন্দা সংস্থা আইএসআই-এর সাথে জামায়াতের সম্পর্ক পাকিস্তান। আমল থেকেই। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি গােয়েন্দা সংস্থার
—————————————–
১০৫. যুগান্তর, ২০০৫।
১০৬ .সােহরাব হাসান, ক্ষমতাসীন জোটে ফাটল, মৃদু ভাষণ, ১৮ এপ্রিল, ২০০৫।
১০৭ .সােহরাব হাসান, ক্ষমতাসীন জোটে ফাটল, মৃদু ভাষণ, ১৮ এপ্রিল, ২০০৫।
১০৮. প্রথম আলাে, ১ অক্টোবর, ২০০৬।
—————————————–
৮১
নীলনকশা অনুসারে নিজামীরা আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে নাশকতামূলক কার্যে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছিল এবং বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছিল। স্বাধীনতা উত্তর আফগানিস্তানের লাদেনের জঙ্গি সংগঠন আল কায়দার সঙ্গেও তাদের যােগাযােগ স্থাপিত হয়। এছাড়াও মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, কুয়েত ও লিবিয়ার বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল গােষ্ঠীর সাথেও তাদের সখ্যতা গড়ে উঠে। চেচনিয়া, কাশ্মির ও মিয়ানমারের ৪টি জঙ্গি সংগঠনের সাথে তাদের আঁতাত গড়ে উঠে। মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্টের বরাত দিয়ে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, জামায়াতের সঙ্গে হরকাতুল জিহাদ (পাকিস্তান), আল কায়দা (আফগানিস্তান)-র সঙ্গে সম্পর্ক রয়েছে। বাংলাদেশের হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি হান্নানের আধ্যাত্মিক গুরু মওলানা আবু জাফর ওসামা বিন লাদেনের মার্কিন বিরােধী যুদ্ধ ঘােষণার সঙ্গীদের ছয় জনের মধ্যে অন্যতম। ১৯৯৮ সালের ২৩ এপ্রিল মার্কিন স্টেট ডিপার্টমেন্ট এই রিপাের্ট প্রকাশ করে।১০৯
ঘাতকের স্বীকারােক্তি
নৃশংস ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকাণ্ড এবং সর্বোপরি ৬৪টি জেলার ভিতর ৬৩টি জেলায়। একযােগে বােমা হামলার পর বিশ্ব নেতৃবৃন্দের চাপে এবং দেশের গণমানুষের গণ অসন্তোষ অবদমনের জন্য সরকার বাধ্য হয়ে এক নাটকের মাধ্যমে শায়খ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাই, মুফতি হান্নানকে গ্রেপ্তার করতে বাধ্য হয়। গ্রেপ্তারের পর অতীতে এদের দ্বারা সংগঠিত বিভিন্ন সন্ত্রাসী হত্যাকাণ্ডের সত্যতা এদের মুখ থেকেই একে একে প্রকাশ পেতে থাকে। শায়খ আব্দুর রহমান নিজের মুখেই আদালতে স্বীকার করেছেন আদালতের বিচারপতিদের ওপর হামলা এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথাবিরােধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক ড. মােহাম্মদ ইউনূস, ময়মনসিংহের সিনেমা হলের বােমা হামলা এসবই তার নির্দেশে সংঘটিত হয়েছে। হরকাতুল জিহাদের মুফতি হান্নান গােয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছেন শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে কোটালীপাড়ায় ৩০ কেজি বিস্ফোরক, ২১ আগস্ট শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড হামলা, সিলেটের মেয়র কামরানকে হত্যার উদ্দেশ্যে দু’বার গ্রেনেড হামলা, সিলেটের মহিলা কমিশনার জেবুন্নেসার ওপর গ্রেনেড হামলার কথাও গােয়েন্দাদের কাছে স্বীকার করেছে মুফতি হান্নান।
জঙ্গিদের আড়াল করার নিজামী ও চারদলীয় জোটের কুটচাল
দিন যতই গড়াচ্ছে দিবালােকের মত পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে, দেশের কল গ্রেনেড ও বােমা হামলা নিজামীদের সামরিক শাখা জেএমবি হরকাতুল জেহাদ ও জামা’আতুল মুজাহিদীনসহ প্রায় ১৬/১৭টি প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য জঙ্গি গ্রুপ দ্বারা
—————————-
১০৯ জনকণ্ঠ, ৩ আগস্ট, ২০০৬।
—————————-
৮২
সংগঠিত। এসব দুর্ধর্ষ জঙ্গিরা তাদের নিজেদের মুখে মিডিয়া, গােয়েন্দা এবং আদালতের কাছে তাদের সকল বােমাবাজির কথা একে একে স্বীকার করছে। অথচ এতদিন এসব জঙ্গিদের আড়াল করার জন্য নিজামী-খালেদার চারদলীয় জোট সরকার বিরােধী দলের ওপর দোষ চাপাচ্ছিল।
যশােহর উদীচীর অনুষ্ঠান, সিপিবি-র জনসভা ও রমনার বটমূলে ছায়ানটের বৈশাখী অনুষ্ঠানের বােমা হামলার জন্য নিজামী ও দেলােয়ার হােসেন সাঈদী খ্যাতনামা সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমামকে দায়ী করে বক্তৃতা বিবৃতি দিতে থাকেন। এসব প্রতিটি অনুষ্ঠানেই হাসান ইমাম অতিথি হিসাবে উপস্থিত ছিলেন। তাই নিজামী ও সাঈদীরা অপপ্রচার করতে থাকে যেখানেই হাসান ইমাম সেখানেই বােমাবাজি। এভাবে নিজামীদের বানােয়াট বক্তব্যের সূত্র ধরে যশােহর উদীচী অনুষ্ঠানে ও রমনা বটমূল অনুষ্ঠানে গ্রেনেড হামলা মামলার দায়ভার চাপানাে হয় প্রখ্যাত সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমামের কাঁধে।১১০
ময়মনসিংহের ৪টি সিনেমা হলের হামলায় আওয়ামী লীগ নেতা সাবের হােসেন চৌধুরী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্মানিত শিক্ষক বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, প্রথিতযশা সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির ময়মনসিংহ জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বর্ষিয়ান নেতা অধ্যাপক মতিউর রহমান ও রয়টারের সাংবাদিক এনামুল হককে গ্রেপ্তার করে বরাবার রিমান্ডে নিয়ে নির্মম অত্যাচার করা হয়েছে। এসব সম্মানিত ব্যক্তিদের হাতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরিয়ে আদালতে হাজির করে বীরত্ব জাহির করেছে নিজামী-খালেদার পাষণ্ড সরকার।
হযরত শাহজালাল (রঃ) মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনােয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলার জন্য কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সদস্য আলম খান মুক্তি, সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের আহ্বায়ক হাবিবুর রহমান সেলিম, জেলা ছাত্রলীগের যুগ্ম সম্পাদক সেলিম আহম্মদ ও হারুনুর রশিদ – এই চার ছাত্রলীগ নেতাকে গ্রেপ্তার করে এবং রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করে মিথ্যা স্বীকারােক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। নিজামী-খালেদার সরকার।
২০০৪ সালের ৭ আগস্ট গুলশান কমিউনিটি সেন্টারে সিলেটের মেয়র আওয়ামী লীগ নেতা বদরুদ্দিন কামরানকে হত্যার উদ্দেশ্যে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালে মেয়র আহত হলেও প্রাণে বেঁচে যান। কিন্তু আওয়ামী লীগের জনপ্রিয় নেতা ইব্রাহীম আলী মারা যান। গ্রেনেডের আঘাতে ক্ষত্রিস্থ একটি গাড়ির মালিক এস.এম. নুনু মিয়াকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। এস.এম. নূনু মিয়া বাংলাদেশ বংশােদ্ভূত একজন ব্রিটিশ নাগরিক ছিলেন। তিনি সদ্য আওয়ামী লীগে যােগদান করেছিলেন। গ্রেপ্তারের পর নূনু মিয়ার ওপর অত্যাচারের স্টিম রােলার চালানাে হয়। তাকেও হাতে পায়ে ডাণ্ডাবেড়ি পরানাে হয়। দেয়া হয় ইলেক্ট্রিক শক। ঢাকায় এনে জয়েন্ট ইন্টারােগেশন সেলে অকথ্য নির্যাতন করা হয়। নূনূ মিয়া নিম্ন
—————————————
১১০ দৈনিক জনকণ্ঠ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৬।
—————————————
৮৩
আদালত চত্বরে সাংবাদিকদের কাছে বলেন, পুলিশ নিষ্ঠুর নির্যাতন করে তাকে এরকম মিথ্যা জবানবন্দি দিতে বলে যে, তিনি এবং নিহত আওয়ামী লীগ নেতাসহ কয়েকজন ওইদিন হােটেল চত্বরে হামলা চালিয়েছিলেন।১১১ নিজামীদের জোট সরকারে জিঘাংসার স্বীকার ব্রিটিশ নাগরিক নূনূ মিয়া যখন মৃতপ্রায়, সে সময় ব্রিটিশ সরকারের হস্তক্ষেপে তিনি মুক্তি পান।
অনুরূপভাবে চার যুবলীগ নেতাকে মিথ্যা আসামি করে ফাসাতে যেয়ে নিজামীর জোট সরকারের ষড়যন্ত্র ফাঁস হয়ে গেলে সরকার নিজেই ফেঁসে যায়। সম্প্রতি হরতালের আগের রাত্রে ঢাকার রাস্তায় একটি দোতলা বাসে কে বা কারা গান পাউডার দিয়ে আগুন লাগিয়ে পুড়িয়ে দেয়। পুলিশ উদ্দেশ্যমূলকভাবে দুই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করে নির্যাতনের মুখে মিথ্যা স্বীকারােক্তি দিতে বাধ্য করে। নিজামী খালেদা সরকারের পুলিশের তৈরি করা মিথ্যা স্বীকারােক্তিতে বলা হয় যে, চার যুবলীগ নেতার পরামর্শে তারা যাত্রীদের পুড়িয়ে মারার জন্য বাসটিতে গান পাউডার দিয়ে আগুন দিয়েছিল। কিন্তু পরে আদালতে হাজির হয়ে দুই ব্যক্তি। প্রকৃত ঘটনা ফাঁস করে দেয়। তারা জানায় পুলিশ নির্যাতন করে তাদের দিয়ে মিথ্যা স্বীকারােক্তি আদায় করেছে। প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে বাস পােড়ানাের দিন ঐ দুই ব্যক্তির একজন অন্য মামলায় জেলে আটক ছিল। ঐ ব্যক্তি যে ঘটনার দিন সত্যিই জেলে আটক ছিল বিষয়টি আদালতে প্রমাণিত হলে চার যুবলীগ নেতা ‘মিথ্যা মামলা হতে অব্যাহতি পান।
এবার আসা যাক ড. হুমায়ুন আজাদের হামলা নিয়ে নিজামী-খালেদার নির্দেশনায় মামলার নাটকটির বিষয়ে। ২০০৪ সালের ২৭ অক্টোবর ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদেশ্যে ঘাতকরা চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত করে, ঘটনাচক্রে ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগের পূর্ব নির্ধারিত একটি হরতাল ছিল। খালেদা জিয়া প্রকৃত হামলাকারীদের আড়াল করার জন্য হরতালের বিষয়টি টেনে এনে একটু মুচকি হেসে বললেন, হরতালের সাফল্যের জন্য আওয়ামী লীগ পরিকল্পিতভাবে এই কাণ্ডটি ঘটিয়েছে। খালেদার এই মন্তব্যে পুলকিত হয়ে জেহাদি জোশে জামায়াত ও জঙ্গি কানেকশন খ্যাত স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতাফ হােসেন। চৌধুরী ছাত্রলীগের এক কর্মীকে গ্রেপ্তার করে কারাগারে পাঠায়। অথচ শায়খ আব্দুর রহমান গােয়েন্দাদের কাছে ও আদালতে স্বীকার করেন যে, ‘পাক সার জমিন বাদ সাদ’ বইটি লেখার কারণে তারই নির্দেশে ড. হুমায়ুন আজাদকে হত্যার উদ্দেশ্যে হামলা করা হয়েছিল। এই স্বীকারােক্তির পর খালেদা নিজামী। সরকারের নির্দেশিত নাটকটির যবনিকাপাত ঘটে এবং দীর্ঘ কারাভােগের পর ছাত্রলীগের সেই কর্মী মুক্তি পায়।
নিজামী ও বিএনপি-র সরকার সবচেয়ে নিন্দিত, বেদনাদায়ক ও অমানবিক কাজটি করেছিল ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার নারকীয় হত্যাযজ্ঞ নিয়ে। গ্রেনেড
————————————————
১১১ মৃদুল হক, একের পর এক বােমা হামলা, মৃদুভাষণ, ১৬ আগস্ট, ২০০৪।
————————————————
হামলার নিষ্ঠুরতায় দেশবাসী যখন শােকে হতবিহ্বলিত ও বিশ্ব বিবেক স্তম্ভিত, তখন খালেদা- নিজামী গংরা তাদের তৈরি হরকাতুল জেহাদের জঙ্গিদের রক্ষা করার জন্য স্বজন হারানাে শােকাহত এই আওয়ামী লীগ নেতাদের হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত করে বক্তৃতা এবং সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে অসত্য ভাষণ দিয়ে চরম অমানবিক ও বিকৃত মানসিকতার পরিচয় দেন।
২১শে আগস্টের হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের একদিন পরই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের এক সমাবেশে ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল বলেন, শেখ হাসিনা এবং সাবের হােসেন চৌধুরীকে রিমান্ডে নিলেই নাকি প্রকৃত রহস্য উদ্ঘাটন হবে। প্রায় একই সময় স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর তার সেই ঐতিহাসিক বাংরেজী (ইংরেজি বাংলা মেশানাে) উক্তিতে বলেন, ‘উই আর লুকিং ফর শত্রুস।’ এরপর ৩০ আগস্ট বিএনপির প্রতিবাদ সমাবেশে দেখা গেল তারা লুকিং করে শত্রু খুঁজে পেয়েছেন। আব্দুল মান্নান ভুইয়াসহ বেশ কিছু মন্ত্রী আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলার জন্য আওয়ামী লীগকেই দায়ী করেন। শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী আমানুল্লাহ আমান সমাবেশে রীতিমত আগাম একটি তদন্ত রিপাের্ট দিয়েই দিলেন। তিনি বললেন খুব তাড়াতাড়িই তদন্ত রিপাের্ট দিব। ওই রিপাের্টে গ্রেনেড হামলার জন্য ‘আব্দুস সামাদ আজাদ, মােহাম্মদ নাসিম, সাবের হােসেন চৌধুরী, তােফায়েল আহম্মদ এবং মতিয়া চৌধুরীকে দায়ী করা হবে।১১২ এরপর ২ সেপ্টেম্বর বিএনপির প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়ােজিত এক সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া গ্রেনেড হামলার ঘটনাকে ষড়যন্ত্র হিসেবে অভিহিত করে বলেছেন, সরকারের সাফল্যকে আড়াল করতে এ বােমা হামলার ঘটনা ঘটানাে হয়েছে।
খালেদা জিয়ার ২ সেপ্টেম্বরের বক্তৃতার পর সাহস সঞ্চয় করে ৭১-এর আলবদর প্রধান নিজামী উজ্জীবিত হয়ে জামায়াতের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে রীতিমত সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে বলেন, ‘বাংলাদেশ নিয়ে মারাত্নক ষড়যন্ত্র হচ্ছে। নৈরাজ্যের মাধ্যমে বাংলাদেশকে অকার্যকর রাষ্ট্রে পরিণত করে এদেশে বিদেশী শক্তির আগ্রাসনের প্রেক্ষাপট তৈরির চক্রান্তের অংশ হিসেবেই গ্রেনেড হামলার মত নাশকতামূলক কর্মকাণ্ড ঘটানাে হচ্ছে।১১৩
এরপর নিজামী-খালেদা সরকার ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ওপর আরাে একটি আষাঢ়ে গল্প ফেঁদে বসেন পরে ধরা খেয়ে হাস্য কৌতুকের সৃষ্টি হয়। জজ মিয়া নামের নােয়াখালীর এক ছিচকে অপরাধীকে ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলার আসামি হিসেবে ধরা হয়। শুধু তাই নয় তার কাছ থেকে স্বীকারােক্তিও নাকি আদায় করা হয় যে, সে ২১ আগষ্ট গ্রেনেড হামলার সাথে জড়িত ছিল। কিন্তু হাটে হাঁড়ি ভেঙে দেয় জজ মিয়ার ছােট বােন খােরশেদা বেগম। ২০০৬ সালের ২০
———————————————
১১২. মােজাম্মেল হােসেন, যেমন রিপাের্ট চেয়েছিল সরকার, মৃদুভাষণ, ১১ অক্টোবর, ২০০৪।
১১৩. বিভুরঞ্জন সরকার, মৃদুভাষণ, ১৩ সেপ্টেম্বর, ২০০৪।
———————————————
৮৫
আগষ্ট জজ মিয়ার গ্রামের বাড়িতে সাংবাদিকরা গেলে খােরশেদা বেগম বলেন যে, তার ভাইকে গ্রেনেড হামলার আসামি হিসেবে ধরা হয়েছে ঠিকই তবে তার ভাইয়ের কোনাে কিছু হবে না। পুলিশ বলেছে তাদের কথামত চললে তার ভাইকে। রাজসাক্ষী করা হবে। ফলে তাকে আর মরতে হবে না। এখন তাদের সংসার। চালানাের জন্য আপাতত সি. আই. ডি-র বিশেষ সুপার রুহুল আমিন প্রতি মাসে দুই থেকে আড়াই হাজার টাকা দেয় এবং আজই তার মা কিছুক্ষণ আগে রুহুল আমিনের কাছ থেকে খবর পেয়ে ঢাকা গেছেন টাকা আনতে। এভাবে আমাদের রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে মিথ্যাচার ও বিকৃত ইতিহাস সৃষ্টির হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করছে। নিজামী-খালেদার সরকার।
২০২০ সালের ভিতর নিজামীদের রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র
নিজামী ও ফজলুল হক আমিনীরা নারী নেতৃত্বে বিশ্বাসী না হলেও ক্ষমতার মােহে খালেদা জিয়ার নেতৃত্ব মানতে এখন তাদের ইসলামে বাধে না। শুধু তাই নয় ‘৭১-এর নিজামীর আলবদর বাহিনীর কমান্ডার, বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল, সরকারের সমাজকল্যাণমন্ত্রী আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ খালেদা জিয়ার মুসাহেবী করতে যেয়ে বাইতুল মােকাররমের উত্তর গেটে জামায়াতে ইসলামের জনসভায় বলেন, খালেদা জিয়া আমাদের নয়নমনি।১১৪
আরেকজন কুখ্যাত স্বাধীনতাবিরােধী দেলােয়ার হােসেন সাঈদী আরাে এক কদম এগিয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের সভায় বলেন, ছাত্রদল ও ছাত্র শিবির এক মায়ের পেটের দুই ভাই’।১১৫ এসব মিষ্টি মিষ্টি কথার বােলচালে ‘৭১-এর ঘাতক প্রতারকরা বি.এন.পি-র কাঁধে চড়ে বসেছে। বি.এন.পি.-র কাঁধে চড়ে প্রশাসন যন্ত্রের সর্বত্র দখল করে নিয়েছে এসব স্বাধীনতাবিরােধী চক্র। পাবলিক সার্ভিস কমিশন, সচিবালয়, বিচার বিভাগ, পুলিশ প্রশাসন এবং বিভিন্ন গােয়েন্দা সংস্থাসহ সর্বত্র তারা একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করেছে। নিজামী সরকারের শিল্পমন্ত্রী হয়ে সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্য হাতিয়ে নিয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, কুষ্টিয়ার ইসলামিক বিশ্ববিদ্যালয়, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়সহ সকল বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপি শিক্ষক সংগঠনের সহায়তায় যােগ্যতা না থাকা সত্ত্বেও জামায়াত শিবিরের ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসাবে নিয়ােগ পাচ্ছে এবং এভাবেই তারা আধুনিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােকেও প্রতিক্রিয়াশীলদের আখড়ায় পরিণত করছে।
এখন তারা আর্থিক ও প্রশাসনিকভাবে এতই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে, বিএনপি-কে এখন তারা থােড়াই কেয়ার করে বরং বিএনপি উল্টো নিজামীদের
———————————–
১১৪. দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ জুলাই, ২০০৬।
১১৫. সমকাল, ২৮ এপ্রিল, ২০০৬।
———————————–
৮৬
তােয়াজ করছে। জামাত শিবিরের ওপর বিএনপির নির্ভরতা এতই বৃদ্ধি পেয়েছে। যে, ২০০৬ সালের ৩ জুন তারিখের পল্টন ময়দানে জামায়াতের রুকন সম্মেলনে তারেক জিয়া হাওয়া ভবনের একদল সাগরেদ নিয়ে ছুটে গিয়েছিলেন জামাতের আশির্বাদের জন্য। সেখানে তিনি যুদ্ধাপরাধী গােলাম আযমের সাথে করমর্দনের। পর নিজামীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় রুকনদের উদ্দেশ্যে বলেন, একটি পরিবারের বিভিন্ন সদস্যের মধ্যে ছােটখাটো বিষয়ে মতবিরােধ থাকা সত্ত্বেও পরিবার হিসেবে তাদের ঐক্য অটুট থাকে। তেমনি জামায়াত ও বিএনপির মধ্যেও যে কোনাে মূল্যে ঐক্য টিকিয়ে রাখতে হবে।১১৬
তারেক রহমানসহ বিএনপি-র মন্ত্রী ও এমপি-রা অবৈধভাবে যে অর্থ বৈভবের পাহাড় গড়ে তুলেছে তা রক্ষার জন্য জামায়াতকে এত সুযােগ-সুবিধা ও প্রশ্রয় দিয়েছে যে, আজ বিএনপি-র অস্তিত্বই বিপন্ন। এখন পুরাে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের জন্য নিজামীরা মহাষড়যন্ত্র করছে। জামায়াতের এই ষড়যন্ত্র ফাঁস করছে মার্কিন প্রভাবশালী দৈনিক ওয়াশিংটন পোেস্ট। ২ আগস্ট ওয়াশিংটন পােস্ট বাংলাদেশের সন্ত্রাসবাদের ওপর একটি চাঞ্চল্যকর দীর্ঘ রিপাের্ট করেছে। এই প্রতিবেদনটি তৈরি করেছেন ওয়াশিংটন পােস্টের প্রবীণ সাংবাদিক সেলিগ এস. হ্যারিসন। ১৯৫১ সাল থেকে তিনি বাংলাদেশকে জানেন। তখন থেকেই তিনি এই পত্রিকার দক্ষিণ এশিয়া অঞ্চলের প্রতিনিধি ছিলেন। ২ আগস্ট হ্যারিসন ওয়াশিংটন পােস্টের প্রতিবেদনে উল্লেখ করেছেন যে, ‘পনের হাজার সশস্ত্র যােদ্ধা ১৯ ক্যাম্প থেকে গেরিলা প্রশিক্ষণ দিয়ে বাংলাদেশকে অচল করতে পরীক্ষামূলকভাবে ১৭
——————————————
১১৬ দৈনিক ভােরের কাগজ, ৪ জুন, ২০০৬।
——————————————
৮৭
আগস্টের সিরিজ বােমা হামলা করিয়েছে জোট সরকারের অংশীদার যুদ্ধাপরাধী জামায়াত। ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলাও তাদের পরিকল্পনায় হয়েছে।১১৭
জামায়াত ২০২০ সালের ভিতর রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে তালেবানি রাষ্ট্র গঠনের মহাপরিকল্পনা করেছে। আর এই ক্ষমতা দখল তারা গণতান্ত্রিক উপায়ে। করবে না। তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করবে সশস্ত্র জেহাদের নামে। নিজামীরা গণতন্ত্র মানে না। গণতন্ত্র সম্বন্ধে নিজামীদের আধ্যাত্মিক গুরু মওদুদীর তত্ত্ব হলাে, ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য Goveranment of the people by the people for the people মুসলমান হিসাবে আমি এই নীতির সমর্থক নই।১১৮ গণতন্ত্রের বিষয়ে তিনি আরাে বলেন, ‘আইন পরিষদে একাধিক দল গঠন করা শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত।১১৯ এখন নিজামীরা গণতন্ত্রের সুযােগ নিচ্ছে দলকে শক্তিশালী ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের পূর্ব প্রস্তুতি হিসেবে। নিজামী রাষ্ট্র ক্ষমতা দখল করতে চায় সশস্ত্র লড়াইয়ের মাধ্যমে। তাই নিজামী তার জামায়াত-শিবির ও ১৬টি জঙ্গি সংগঠনের সমন্বয়ে প্রায় ৭০ হাজার। সুপ্রশিক্ষিত ক্যাডার গড়ে তুলেছে ২০২০ সালের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত লক্ষ্য নিয়ে। এই ৭০ হাজার ক্যাডারের মধ্যে জামায়াত শিবিরের ‘পনের হাজার ‘জাগ্রত মুসলিম বাংলার ৩০ হাজার’ হরকাতুল জেহাদের ১৫ হাজার ১২০ এবং অন্যান্য গ্রুপের ১০ হাজার।
আর এই সশস্ত্র পথে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলকে নিজামীরা বলেছে ‘ইসলামী বিপ্লব’। তারা আরাে বলেছে রাষ্ট্র ক্ষমতা দখলের পর ইসলামী হুকুমত কায়েম করবে। প্রকৃতপক্ষে তারা ইসলামী হুকুমতের আড়ালে ‘মওদুদীবাদ’ ও তালেবানি। রাষ্ট্র কায়েম করবে। আফগানিস্তানের তালেবানি রাষ্ট্রের নমুনা আমরা দেখেছি। সেখানে ইসলামী হুকুমতে’র ধ্বজাধারীরা গণতন্ত্রকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছিল। তারা এতটাই পরমত অসহিষ্ণু যে, শুধু ভিন্ন ধর্মাবলম্বীই নয়, নিজ ধর্মের ভিন্ন মতালম্বীরাও এদের জিঘাংসার স্বীকার হয়েছে। আমাদের দেশেও ক্ষমতায় যাওয়ার আগেই নিজামীরা অর্থাৎ ইসলামী হুকুমতের মুখােশধারীরা ভিন্ন। ধর্মের উপাসনালয়গুলােতে গ্রেনেড ও বােমা হামলা করছে, এমনকি ইসলাম ধর্মের ভিন্ন মতালম্বীদের মসজিদেও গ্রেনেড হামলা করে মুসল্লিদের হত্যা করছে। হযরত শাহজালালের (রঃ) মাজারে, ওরসে ও পীর মাশায়েখদের পবিত্র দরবার শরীফেও তারা হামলা করে মুসলমানদের হত্যা করতে দ্বিধা করছে না। তাগুদি আইন মানি ’ বলে আদালত প্রাঙ্গনে নিরীহ বিচারপতিদের ওপর এবং প্রশাসনিক ভবনে
——————————————————–
১১৭. দৈনিক জনকণ্ঠ, ৩ আগস্ট, ২০০৬।
১১৮. আবুল আলা মওদুদী, সিয়াসী কাসমকাশ, ৩য় খণ্ড, পৃষ্ঠা-৯৪।
১১৯. দৈনিক জং, ৩০ অক্টোবর, ২৯৫২।
১২০. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, অঘােষিত যুদ্ধের ব্ল প্রিন্ট, পৃষ্ঠা-২০১।
——————————————————–
৮৮
ভয়াবহ হামলা করে নিরীহ মানুষদের একের পর এক হত্যা করে চলেছে। আর তারা যদি সত্যিই ২০২০ সালের ভিতর ক্ষমতা দখল করতে পারে, তবে আমাদের বিচার ব্যবস্থা, শিক্ষা ব্যবস্থা, প্রশাসনযন্ত্রসহ রাষ্ট্রের সকল স্তম্ভগুলাে ধ্বংস করে দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রযন্ত্রটিই ভেঙে ফেলবে – এ ব্যাপারে কোনাে সন্দেহ। নাই। আফগানিস্তানের মতােই আধুনিক স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দেবে। নারীকে করবে তারা গৃহবন্দি, মেয়েদের বােরকা পরতে এবং ছেলেদের দাড়ি রাখতে বাধ্য করবে। সকল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ড, বাঙালির ঐতিহ্যবাহী অনুষ্ঠান, পহেলা বৈশাখ, বৈশাখী মেলা, নাটক, সঙ্গীতানুষ্ঠান, শিল্প মেলা, বাণিজ্য মেলা, এনজিও কার্যক্রম (বিশেষ করে যারা নারী ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী), ২১শের। প্রভাত ফেরী, এমনকি বিজ্ঞান চর্চা সবই বন্ধ করে দেবে। ভাষা শহীদদের স্মৃতিতে নির্মিত শহীদ মিনার, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিসৌধ- যা বাঙালিদের অহংকার সবই ধুলায় গুড়িয়ে দেবে। জাতীয় পতাকা ও জাতীয় সঙ্গীত বদলে ফেলবে। এক কথায় বাঙালির হাজার বছরের সংগ্রামের অর্জনগুলােকে তারা ধ্বংস করে দেবে।
মুক্তমনের বুদ্ধিজীবীদের অবস্থা কেমন হবে তা এখনই অনুমেয়। ‘৭১-এর থেকে এখন পর্যন্ত ড. মুনির চৌধুরী, শহীদুল্লা কায়সার, ডা. ফজলে রাব্বি, ড. হুমায়ুন আজাদ, ড. ইউনূস ও ড. আবু তাহেরদের মত করুণ পরিণতি সবাইকে ভােগ করতে হবে। ইতিমধ্যে অধ্যাপক হাসান আজিজুল হক, ড. আবুল বারাকাত, ড. আরেফিন সিদ্দিকী, ড. জাফর ইকবাল ও ড. এম.এম. আকাশসহ অসংখ্য অধ্যাপক, লেখক, কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী জামায়াতীদের মৃত্যু পরােয়ানা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। নিজামীরা নীলনকশার মাধ্যমে ২০২০ সালে ক্ষমতা দখলের আগেই পরিকল্পিতভাবে কখনও নিজেরা আবার কখনও তাদের সম্প্রসারিত প্রকাশ্য ও অপ্রকাশ্য সামরিক জঙ্গি শাখাগুলাের মাধ্যমে উদীচীর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, ছায়ানটের বটমূলের বৈশাখী অনুষ্ঠান, বগুড়ার নাট্যানুষ্ঠান, শফিপুরের পাগলার মেলা, ময়মনসিংহ ও সাতক্ষীরার সিনেমা হলে, সুফি সাধকদের মাজারে এবং ওরস অনুষ্ঠানে, ১৬ ডিসেম্বরের বিজয় মেলায় এবং এনজিও অফিসে, আহম্মদিয়া সম্প্রদায়ের মসজিদে এবং সংখ্যালঘুদের উপাসনালয়সহ আরাে বহু অনুষ্ঠানে বােমা ও গ্রেনেড হামলা চালিয়ে অগণিত মানুষ হত্যা করেছে। এসব হামলার মাধ্যমে ভীতির সঞ্চার করে তাদের ধর্মান্ধ আদর্শের পরিপন্থী ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলােকে বল প্রয়ােগের মাধ্যমে বন্ধ করে দেবার ষড়যন্ত্র করছে। ইতিমধ্যে নিজামী জোট সরকারের মন্ত্রী হওয়ার সুবাদে খালেদার সরকারকে ব্যবহার করে যাত্রানুষ্ঠানের ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করাতে সমর্থ হয়েছেন।
এছাড়াও প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা জামায়াতীদের লােকজন সারাদেশে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে, বিজয় মেলা, বাঙালিদের ঐতিহ্যবাহী মেলাসমূহ, কনসার্ট এবং যেসব ইসলামী ধর্মীয় আচার অনুষ্ঠান নিজামীদের পছন্দনীয় নয়, সেগুলাে
৮৯
আইনশৃঙ্খলার দোহাই দিয়ে বন্ধ করে দিচ্ছে। আর এসব কাজ নিজামীরা করছে যাতে ২০২০ সালে তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী সশস্ত্র বল প্রয়ােগের মাধ্যমে ক্ষমতা দখলের পর মওদুদীবাদ তথা তালেবানি শাসন চালু করতে বেগ পেতে না হয়। এভাবেই আমাদের শিক্ষা, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক বিকাশের পথ রুদ্ধ করে দিয়ে মধ্যযুগীয় অন্ধকারের দিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছে নিজামী গংরা।
আল্লাহর আইন চাই, সৎ লােকের শাসন চাই
আল্লাহর আইন চাই, সৎ লােকের শাসন চাই- এই স্লোগানের প্রবক্তা নিজামীরা চারদলীয় জোটের অংশীদার হওয়াতে জোটের মন্ত্রী-এমপিদের অবাধ লুটপাট ও দুর্নীতির দায়িত্ব তাদেরকেও নিতে হবে। ইতােমধ্যে পরপর চারবার চারদলীয় জোট সরকার দুর্নীতিতে সারাবিশ্বে প্রথম হয়েছে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য কর্নেল অলি প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, চারদলীয় জোটের মন্ত্রী এবং এমপিরা মিলে দুই হাজার কোটি টাকা লুট করেছে। এসব টাকা তারা ডলারে রূপান্তর করে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার ফলে টাকার। অবমূল্যায়ন হয়েছে। তারই ফলশ্রুতিতে দ্রব্যমূল্য আকাশচুম্বী হয়েছে। বিএনপি মনােনীত প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডা. বদরুদ্দোজা চৌধুরী বলেছেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার পরিবার দুই হাজার কোটি টাকা বেআইনিভাবে হাতিয়ে নিয়েছে এবং দেশের বাইরে পাচার করেছে। এসব সকল লুটপাটের দায়-দায়িত্ব নিজামীকেও নিতে হবে। কেননা নিজামীও চারদলীয় জোট সরকারের অংশীদার। শুধু বিএনপি-র মন্ত্রী-এমপিরাই দুর্নীতিতে জড়িত তা নয়, জামায়াতের এমপিরাও অবাধ লুটপাটে অংশ নিয়েছে-যা বিভিন্ন সময়ে পত্রপত্রিকাগুলাে ফলাও করে প্রকাশ করেছে। এমনকি নিজামী নিজেও দুর্নীতির জালে আবদ্ধ হয়ে গেছেন। সম্প্রতি নিয়ম বহির্ভূতভাবে তিনি রাজউকের একটি প্লট নিয়ে পত্রপত্রিকাগুলােতে ব্যাপকভাবে সমালােচিত হয়েছেন। নিজামীর দুর্নীতির মাধ্যমে রাজউকের প্লট প্রাপ্তির ব্যাপারে দৈনিক প্রথম আলাের পরিবেশিত সংবাদে বলা হয়, সরকারের শেষ সময়ে এসে শিল্পমন্ত্রী ও জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামীকে ‘বিশেষ বিবেচনায় প্লট দেওয়া হয়েছে। নিজামীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে মে মাসে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বিশেষ বিবেচনায় তাকে প্লট দিয়েছে বলে রাজউক ও মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়। তবে এই বিবেচনায় প্লট দেওয়া যায় শুধু বরাদ্দ বিধিমালার ১৩-এ ধারা অনুযায়ী। এই ধারা অনুযায়ী শুধু জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে অবদান রাখার জন্য প্লট পাওয়া যায়। মে মাসে মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনায় বিশেষ বিবেচনার কথা বলা হলেও ১৩-এ ধারার কথা সরাসরি না লিখে প্রয়ােজনীয়। ব্যবস্থা নিন’ লেখা হয়েছে। এ জন্য রাজউক বিপাকে পড়ে। কারণ তার আবেদন নির্ধারিত ছকে, নির্ধারিত ফি দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে আসেনি। যাচাই-বাছাই
৯০
কমিটিরও কোনাে ভূমিকা ছিল না। শুধু মন্ত্রণালয়ের চাপ আছে। বরাদ্দ বিধিমালা অনুযায়ী সাধারণভাবে প্লট পেতে হলে পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিতে হয়। পরে বিষয়টিকে বৈধতা দেওয়ার জন্য ৩ অক্টোবর সরাসরি ১৩-এ ধারার উল্লেখ করার জন্য রাজউক থেকে মন্ত্রণালয়ে চিঠি পাঠানাে হয়। এর জবাবে মন্ত্রণালয়ের সম্মতিপত্র পেয়ে নিজামীকে ১৩-এ ধারায় প্লট দেওয়া হয়।
আশির দশকে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি এইচ.এম. এরশাদ ১৩-এ ধারায় বিশেষ বিবেচনায় ৪৯ জনকে প্লট দেওয়ায় ‘৯১ সালে বিএনপি সরকার মামলা করেছিল। এমনকি আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ সময়ে ১০টি প্লট বিশেষ বিবেচনায় দেওয়ায় বিএনপি সরকার ২০০১ সালে ক্ষমতা গ্রহণ করে দুর্নীতি দমন ব্যুরােয় অভিযােগ দাখিল করে।১২১
এ বিষয়ে মতিউর রহমান নিজামীর বক্তব্য জানতে একাধিকবার যােগাযােগ করা হলেও তিনি কথা বলবেন না বলে জানানাে হয়। গতকাল যােগাযােগের চেষ্টা করা হলে তার একান্ত সহকারী মােঃ খােরশেদ আলম ফোন ধরে বলেন, মন্ত্রী সাহেব ঢাকার বাইরে। তাকে পাওয়া যাবে না।১২২
যে ১৩-এ ধারায় প্লট নেওয়ার জন্য ‘৯১ সালে বিএনপি সরকার এরশাদের বিরুদ্ধে মামলা করলাে এবং ২০০১ সালে খালেদা-নিজামী সরকার আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে মামলা করলাে সেই একই ধারায় নিজামী কি করে প্লট নিলাে। সেটাই দেশবাসীর কাছে বড় প্রশ্ন।
আল্লাহর আইন চাই, সৎলােকের শাসন চাই বলে যারা চিৎকার করে মুখে। ফেনা তােলে তারা একটি সামান্য প্লটের লােভ সংবরণ করতে পারে না। এই সমস্ত তথাকথিত সৎলােক দিয়ে ইসলামের কি খেদমত হবে, তা দেশবাসী হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে।
নিজামীর আরেক সহচর ৭১-এর ঘাতক জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুজাহিদ জোট সরকারের সমাজকল্যাণ বিভাগের টেকনােক্র্যাট মন্ত্রী থাকাকালীন দেশের ভেতরে ও বিদেশে সাড়ে ৯শ’ দিন সরকারি সফর করেছেন। তার এই ভ্রমণ বিলাসিতাকে সরকারি সফর হিসাবে দেখালেও এর মূল উদ্দেশ্য ছিল দলীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম। এতে সরকারের প্রায় ১১ কোটি টাকা ব্যয় হয়েছে। প্রভাব খাটিয়ে সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে দেড় হাজারেরও বেশি জামায়াত শিবির কর্মীকে চাকরি দিয়েছেন। এছাড়াও আওয়ামী লীগ মন্ত্রী ও এমপিদের নামে যেসব প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল সেগুলাে উদ্বোধনের সময় নিজের নামে নতুন করে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেছেন। তিনি ৫ বছরে মাত্র ৫৮৭ দিন ঢাকায় ছিলেন। মন্ত্রী থাকা অবস্থায় ৫ বছরে তিনি ২৮৪টি ইসলামী জঙ্গি এনজিও’র রেজিস্ট্রেশন দিয়ে রেকর্ড করেছেন। তার মন্ত্রণালয় পল্লী ঋণ
————————————-
১২১. প্রথম আলাে, ১৮ অক্টোবর, ২০০৬।
১২২. প্রথম আলাে, ১৮ অক্টোবর, ২০০৬।
————————————-
৯১
কর্মসূচির আদায়কৃত অন্তত ৩০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছে। ২০০৬ সালের জুন মাসে সমাজসেবা অধিদপ্তরই এই হিসাব করেছে। তবে সমাজসেবা। অধিদপ্তরের অন্য এক সূত্র বলেছে, ঋণের অন্তত ৭০ কোটি টাকা আত্মসাৎ হয়েছে।
সূত্রটি আরাে বলেছে সমাজসেবা অধিদপ্তরের মাধ্যমে বয়স্কভাতা বিতরণ, ঋণ বিতরণ, অক্ষম প্রতিবন্ধীদের মাঝে ঋণ বিতরণ, শিশু পরিবার, এতিমখানা, সেফ হােম পরিদর্শনের নামে সরকারি বিরাট অঙ্কের অর্থ হরিলুট করা হয়েছে।১২৩
সরকারি অর্থ ও সম্পদ অপব্যবহার করে মুজাহিদ যে অন্যায় ও দুর্নীতি করেছেন তার জবাবদিহি কে করবে?
বি.এন.পি-র সাথে জোট বেঁধে নিজামীর নেতৃত্বাধীন জামায়াতের যে ১৭ জন ২০০১ সালের নির্বাচনে আল্লাহর আইন চাই, সৎ লােকের শাসন চাই’ স্লোগান তুলে সংসদ নির্বাচিত হয়েছিলেন তারা সকলেই ব্যাপক দুর্নীতি করে আঙুল ফুলে। জোড়া বটগাছে পরিণত হয়েছেন। কাজের বিনিময়ে খাদ্য, কাজের বিনিময়ে টাকা প্রভৃতি প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি ও এলাকার উন্নয়ন খাতে টেন্ডারবাজিতে লক্ষ লক্ষ টাকা কমিশন নিয়ে আজ তারা বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক।
পিরােজপুর-১ আসনের সাংসদ দেলােয়ার হােসাইন সাঈদী ‘৭১ সালে ছিলেন একজন মুদি দোকানদার। মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যাপক লুটপাট করে তিনি প্রথম দফায় ভাগ্য পরিবর্তন করতে সমর্থ হন। পাঁচ তহবিল’ নামে মুক্তিযুদ্ধের সময় তারা একটি লুটেরা কমিটি গঠন করেন। সকল লুটের মাল একত্রে জমা হওয়ার পর এই কমিটির মাধ্যমে সাঈদীরা ভাগবাটোয়ারা করে নিত। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, তিনি সাউথখালী চরে গড়ে তােলেন রামরাজত্ব; সাউথখালী গ্রামের আনসার আলী জমাদ্দারের স্ত্রী জাহানারা বেগমকে তুলে নিয়ে বিয়ে করেন (দৈনিক জনকণ্ঠ, ১ ফেব্রুয়ারি, ২০০৭)। দ্বিতীয় দফায় ২০০১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তার ভাগ্য দ্বিতীয় দফায় রাতারাতি খুলে যায়। পাঁচ বছরে সাঈদী ফাউন্ডেশনসহ ১৪টি প্রতিষ্ঠান সাঈদী গড়ে তুলেছেন। শুধু তাই নয় সাঈদী ফাউন্ডেশন নামে তিনি রীতিমত একটি চরও দখল করে নিয়েছেন। সাঈদী ফাউন্ডেশনের আওতায় সরকারি অর্থ ও সম্পদ লুটপাট করে প্রতিষ্ঠা করেছেন। পিরােজপুর ইসলামিয়া টেকনিক্যাল এন্ড বিজনেজ কলেজ, তাহফিমুল কোরআন মাদ্রাসা, দারুল কোরআন মহিলা দাখিল মাদ্রাসা, খলিশাখালী মহিলা দাখিল ও নাজিরপুর দাখিল মাদ্রাসা। অবাধ লুটপাট ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে ‘৭১-এর মুদি দোকানদার সাঈদী এখন ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি চিটাগাং (IIUC)’-এর একজন মালিক বনে গেছেন। সাংসদ নির্বাচিত হয়ে শুধু সাঈদী
—————————————
১২৩. জনকণ্ঠ ২১ জানুয়ারি ২০০৭
—————————————
৯২
কোটি কোটি টাকা ও জায়গা সম্পত্তির মালিক হয়েছেন তাই নয়, আলাদিনের চেরাগের পরশে তার পরিবার ও জামায়াত নেতারা রাতারাতি বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছেন।
২০০১ সালে যশােহর-২ আসনের সাংসদ নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াত নেতা মুহাদ্দিস আবু সাঈদ। নির্বাচিত হওয়ার পর আল্লাহর আইন ও সৎ লােকের শাসন বাদ দিয়ে নিজের আখের গুছিয়ে নিয়েছেন অত্যন্ত চাতুর্যতার সঙ্গে। এমপি হওয়ার আগে পদ্মবিলা সিনিয়র মাদ্রাসার অধ্যক্ষ ছিলেন। তখন তিনি ৩০ কিলােমিটার দূরের কর্মস্থলে যাতায়াত করতেন পুরনাে বাইসাইকেল বা লােকাল বাসে চড়ে। এখন তিনি যাতায়াত করেন দামী এসি মাইক্রোবাসে চড়ে। এমপি হওয়ার আগে ঝিকরগাছা শহরে সাধারণ বাড়িতে বাস করলেও বর্তমানে তিনি রাজধানী ঢাকার মােহাম্মদপুরে আসাদগেট এলাকায় স্ত্রীর নামে ৩৫ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি ফ্লাট কিনেছেন। শুধু তাই নয়, তার নিজ নির্বাচনী এলাকায় শহীদ মুক্তিযােদ্ধা স্মৃতি সড়ক’ এর নাম পরিবর্তন করে নিজের নামে নামকরণ করেছেন।
সাতক্ষীরা-৫ আসনে গাজী নজরুল ইসলাম বিজয়ী হয়ে লুটপাটের নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। এমপি হওয়ার আগে পৈতৃক সূত্রে প্রাপ্ত ৮ বিঘা জমি ছাড়া আর কিছুই ছিল না। অথচ তিনি এখন গাড়ি, বাড়ি, ব্যাংকবীমাসহ কয়েক কোটি টাকার মালিক। শ্যামনগর উপজেলায় জমি কিনে বিলাসবহুল বাড়ি নির্মাণ করেছেন। প্রভাব খাটিয়ে টেংরাখালী এলাকায় স্ত্রীর নামে ১২০ একর জমি বরাদ্দ নিয়েছেন। উপজেলা সদরে মসজিদ মার্কেটে প্রভাব খাটিয়ে দুই ছেলের নামে জমি হাতিয়ে নিয়েছেন। শ্যামনগর উপজেলা সদরে সাতক্ষীরা জেলা পরিষদের মালিকানাধীন মুক্তিযােদ্ধা সুপার মার্কেটের প্রায় ৪০টি দোকানের ২টি নিজেই বেনামে বরাদ্দ নিয়েছেন এবং বাকিগুলাে পরিবার ও নিজের লােকজনের নামে বণ্টন করেছেন। সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার আগে নৌকা ও বাইসাইকেলে যাতায়াত করতেন। এখন চড়েন বিলাসবহুল প্রাইভেট কারে ।
পাবনা সদর থেকে মওলানা ছােবাহান সাংসদ নির্বাচিত হয়ে লুটপাটের মহােৎসবে মেতে উঠেছেন। গত পাঁচ বছরে কাবিখা, কাবিটা, টিআর, আর গ্রামীণ আবকাঠামাে, এডিপি প্রভৃতি প্রকল্পে ৪৮০ কোটি টাকা বরাদ্দ হয়েছে। এসব প্রকল্পে ব্যাপক দুর্নীতি করে তিনি কয়েক কোটি টাকা দু হাতে কামিয়ে নিয়েছেন। উপমহাদেশের প্রখ্যাত নায়িকা সুচিত্রা সেনের পৈতৃক ভিটা দখল করে ইমাম গাযালী স্কুল এন্ড কলেজ গড়ে তুলে চুটিয়ে ব্যবসা করছেন। ইমাম গাযযালীর মত আধ্যাত্মিক মহাপুরুষের নামে জমি দখল করে আবার আওয়াজ তােলেন ‘সৎ লােকের শাসন চাই, আল্লাহর আইন চাই’।
এখানেই শেষ নয়, তিনি ইমাম গাযযালী স্কুল এন্ড কলেজের নামে অনন্ত বাজারের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের কোয়ার্টারের জন্য বরাদ্দকৃত ৫ কোটি টাকার জমি গণপূর্ত বিভাগকে চাপ দিয়ে নামমাত্র মূল্যে হাতিয়ে নিয়েছেন। তার দু’জন
৯৩
সাগরেদ জামায়াত কর্মী আনছার আলী ও মুস্তাক আহমেদকে তিনি পাবনা মানসিক হাসপাতালে ঔষধ সরবরাহের সুযােগ করে দেন। কিন্তু এরা নকল ঔষধ সরবরাহ করতে যেয়ে ধরা পড়ে।
চট্টগ্রাম-১ আসনে ২০০১ সালে নির্বাচিত হয়েছেন জামায়াত নেতা শাহজাহান চৌধুরী। এক সময় তিনি ছিলেন ক্ষুদ্র মােটরপার্টস ব্যবসায়ী। এখন তিনি নামে-বেনামে কোটি কোটি টাকার মালিক। তিনি কালুরঘাটে প্রাইম সল্ট নামে একটি লবণের কারখানা গড়ে তুলেছেন। তিনি এখন পঞ্চাশ লক্ষ টাকা দামি বিলাসবহুল গাড়িতে চড়েন। কদমতলীতে একটি ফিলিং স্টেশনের মালিকও হয়েছেন। প্রতিষ্ঠা করেছেন একটি বিশাল শিপিং কোম্পানি। সম্প্রতি বিদেশে হেরােইন পাচারের অভিযােগে শিপিং কোম্পানিটি বহুল সমালােচিত হয়েছিল। সাতকানিয়া থানায় সরকারি জায়গা দখল করে মােজাদ্দেদ-ই-আল ফেসানি একাডেমি নামে একটি কিন্ডারগার্টেন গড়ে তুলেছেন। যেখানে নির্মাণ করেছেন একটি তিনতলা ভবন। তিনি সিন্ডিকেট গঠন করে ডলু ও টংকাবর্তী বালিমহাল দখল করে নিয়েছেন। প্রতিদিন এই দুটি মহাল থেকে অর্ধশত ট্রাক বালি বেআইনিভাবে বিক্রী হয়। প্রতি ট্রাক বালির দাম ৪০০/৫০০ টাকা।
খুলনা-৬ আসনের সাংসদ রুহুল কুদুস বিভিন্ন চিংড়ি ঘেরে জোর করে বিনা পুঁজিতে অংশীদার হয়ে কোটি কোটি টাকা কামিয়েছেন। কয়রার জায়গীরমহল শাহবাড়ীর জামে মসজিদের ৫০ বিঘা ওয়াকফ জমি দেখাশােনার নামে তার পরিবারের লােকজন ভােগদখল করছে। কাবিখা, কাবিটাসহ সরকারি সকল উন্নয়নমূলক কাজে তিন ভাগের একভাগ টাকা শাহ জুবায়ের এবং তার পার্টি জামায়াতে ইসলামীর ফান্ডে জমা দিতে হয় বলে এলাকায় প্রচার আছে।
বাগেরহাট-৪ আসনে মুফতি আব্দুস সাত্তার আকন ২০০১ সালে সাংসদ নির্বাচিত হন। সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর আকন পরিবারের ভাগ্যের ছিকে খুলে যায়। গাড়ি-বাড়ি আর লাখ লাখ টাকার জমি করলেন হুজুরের পরিবার। মূলত সুন্দরবনের বদৌলতে হুজুরের পরিবার শনৈ শনৈ অর্থনৈতিক উন্নয়নের শিখরে পৌঁছে যান। তবে বৈধ পথে এই বিশাল বিত্ত বৈভবের মালিক হুজুরের পরিবার হননি। হুজুরের বড় ছেলে ফয়সাল আকনের নেতৃত্বে একটি কাঠচোর চক্র গড়ে উঠে। হুজুর এই কাজে ছেলেকে বাধা দেননি। বরঞ্চ তার প্রশ্রয়ে সুন্দরবনের গােলপাতা ও কাঠ অবৈধভাবে পাচার করে লাখ লাখ টাকা কামিয়ে নিয়েছেন সাংসদ মুফতি সাত্তার আকনের পরিবার।
আলবদর স্টাইলে বুদ্ধিজীবী হত্যা শুরু
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক সামরিক জান্তা বাঙালিদের ওপর চূড়ান্ত আঘাত হানার পর নিজামীকে দিয়ে আলবদর গঠন করে বুদ্ধিজীবী নিধন শুরু করেছিল। কিন্তু নিজামীদের রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের চূড়ান্ত লক্ষ্য ২০২০ সালে হলেও বুদ্ধিজীবী হত্যার ঘৃণ্য কাজটি অনেক আগে থেকেই শুরু করে দিয়েছে।
৯৪
‘৭১ সালে যেমন লিস্ট করে বেছে বেছে আমাদের দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তান শহীদুল্লা কায়সার, মুনির চৌধুরী, ড. ফজলে রাব্বীদের মত বরেণ্য ব্যক্তিদের হত্যা করেছে, স্বাধীনতা উত্তর তারা ড. হুমায়ুন আজাদ, ড. ইউনূস, ড. আবু । তাহেরের মত সম্মানিত জ্ঞানী ব্যক্তিদের ইতিমধ্যে নির্মমভাবে হত্যা করে। ফেলেছে। তাদের হিট লিস্টে এখনও আছে ড. জাফর ইকবাল, হাসান আজিজুল। হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমিতির, সভাপতি ড. আরেফিন সিদ্দিকী, অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. আবুল বারাকাত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। অর্থনীতি বিভাগের জনপ্রিয় শিক্ষক ও গবেষক অধ্যাপক ড. এম.এম. আকাশসহ অসংখ্য বরেণ্য ব্যক্তিত্ব।
তাদের এই হিট লিস্টের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ‘৭১ সালে নিজামীর আলবদররা যেভাবে শনি’ নাম দিয়ে গােপনে বুদ্ধিজীবী হত্যার পরােয়ানা দিয়ে চিঠি পাঠাতাে এখনও একই কায়দায় আমাদের সম্মানিত কবি, সাহিত্যিক, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের হুমকি দিয়ে গােপনে চিঠি পাঠাচ্ছে।
তবে চারদলীয় জোট সরকারের অংশীদার হওয়ার সুবাদে তাদের দুঃসাহস এতই বৃদ্ধি পেয়েছে যে, এখন শুধু গােপনে চিঠি দিয়ে নয়, প্রকাশ্যে আমাদের সম্মানিত গুণী ব্যক্তিদের হুমকি দিচ্ছে এবং লাঞ্ছিত করছে। গত ২০০৬ সালের ২৩ আগস্ট জনপ্রিয় লেখক ও শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের প্রধান ড. জাফর ইকবাল তার অফিস কক্ষে বসে ছিলেন, তখন ছাত্র শিবিরের সভাপতি এ.টি.এম. শরীফুল আমিন সুমনের নেতৃত্বে প্রায় ২০জন ক্যাডার সেখানে যায়। তারা কক্ষের ভিতর ঢুকেই ড. জাফর ইকবালকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ শুরু করে। এক পর্যায়ে তারা তাঁর (ড. জাফর ইকবাল) জিহ্বা কেটে নেবার হুমকি দেয় এবং তাকে তার কক্ষ থেকে বের করে দেবার চেষ্টা চালায়।১২৪
এর একদিন পরই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের অধ্যাপক বাংলা সাহিত্যের খ্যাতিমান কথা সাহিত্যিক, গল্পকার ও দার্শনিক হাসান আজিজুল হকের। কুশপুত্তলিকা দাহ করেছে ইসলামী ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা। তারা হাসান আজিজুল হককে বলেছে, ‘নাস্তিক’, ‘জীবন্ত শয়তান’, ‘ইসলামের শত্রু। বলেছে এদেশে তােমার ঠাই হবে না। হাসান আজিজুল হক ভূতস্বরূপ। এই ভূতকে বিদায় করতে না পারলে ইসলামের ভীষণ ক্ষতি হবে।’ বলেছে- তােমাকে কেটে টুকরাে টুকরাে করে বঙ্গোপসাগরে ভাসিয়ে দেব। তােমার পরিণতি হুমায়ুন আজাদের মতাে হবে। ১২৫
ড. হুমায়ুন আজাদকে জামাত শিবিরের এসব ঘাতকরা গােপন চিঠির মাধ্যমে হুমকি দিয়েছিল। এই হুমকির পরিপ্রেক্ষিতে দৈনিক পত্রিকার মাধ্যমে সরকারের
—————————————
১২৪ সমকাল, ২৫ আগস্ট, ২০০৬। ১২৫ সমকাল, ২৫ আগস্ট, ২০০৬।
—————————————
৯৫
কাছে নিরাপত্তা চেয়ে হুমায়ুন আজাদ চিঠি লিখেছিলেন। কিন্তু বিএনপি সরকার তার আবেদনে কর্ণপাত করেনি। ফলে ঘাতকের চাপাতির আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছিলেন ড. হুমায়ুন আজাদ। আজ বিএনপি-র প্রশ্রয়ে, জামাত শিবির এতটাই বেপরােয়া যে, এই দেশবরেণ্য আন্তর্জাতিকভাবে সুপরিচিত এই দুই শিক্ষককে প্রকাশ্যে হত্যার হুমকি দিচ্ছে। শিবিরের এই ঔদ্ধত্যপূর্ণ আচরণে ক্ষোভ প্রকাশ করে এবং মহান এই দুই শিক্ষকের বিপন্ন জীবনের প্রতি শঙ্কিত হয়ে প্রখ্যাত ছড়াকার লুৎফর রহমান রিটন লিখেছেন, ‘গ্রিসের তরুণ ছাত্ররা তাদের শিক্ষক সক্রেটিসকে রক্ষা করতে পারেনি বাংলাদেশের তরুণ ছাত্ররাও কি পারবে না। তাদের শিক্ষক মুহাম্মদ জাফর ইকবাল এবং হাসান আজিজুল হককে হিংস্র শ্বাপদদের ছােবল থেকে রক্ষা করতে?
হ্যাঁ, এখন থেকেই যদি আমরা আমাদের নূতন প্রজন্মকে নিজামীর জামায়াত শিবিরের সর্বনাশা ধর্মান্ধ রাজনীতি সম্পর্কে সচেতন না করি এবং নিজামীদের ধর্মচারী মুখােশটি তাদের (নূতন প্রজন্ম) সামনে খুলে দিতে না পারি, তাহলে এই হায়নার দল এই দুজন মহান শিক্ষককেই শুধু নয়, আমাদের গােটা দেশ ও জাতিকেই গিলে খাবে।
৯৬
——————————-