You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

মুক্তিযুদ্ধে প্রবাসী বাঙালি: যুক্তরাজ্য
আবদুল মতিন

১৯৭১ সালে লন্ডন বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রধান কেন্দ্রে। পরিণত হয়। যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিরা ‘মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত সংগ্রামকে নিঃসঙ্কোচে পূর্ণ সমর্থন জানায়। এই সংগ্রামের কাহিনী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গৌরবজনক ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা অনুধাবন করতে হলে উনিশ শ’ পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার কথা মনে রাখা প্রয়ােজন। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ করে পাকিস্তান সৃষ্টির পর ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ। সরকার পূর্ব বাংলার জনসাধারণের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত হয়েও তারা নিজ দেশে পরাধীনতার জীবন বরণ। করতে বাধ্য হয়। মুসলিম লীগের স্বৈরাচারী শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য ১৯৪৯ সালের জুন মাসে আওয়ামী মুসলিম লীগের জন্ম হয়। পরবর্তীকালে মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে আওয়ামী লীগ অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে। পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের তৎকালীন নেতাদের মধ্যে ছিলেন হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। উনিশ শ’ পঞ্চাশের দশকে তারা যখন লন্ডনে আসেন তখন প্রবাসী বাঙালিরা তাদের সঙ্গে পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক দাবিদাওয়া সম্পর্কে আলােচনা করেন। এই প্রসঙ্গে আবদুল মান্নান (ছানু মিয়া), মিনহাজ উদ্দিন, হরমুজ আলী ও আইয়ুব আলীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। প্রয়ােজনমতাে তারা বাঙালি নেতাদের সঙ্গে সহযােগিতা করেছেন এবং সর্বপ্রকার সাহায্য দিয়েছেন। লন্ডন সফরকালে মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্য বাঙালি নেতারা আর্লস কোর্ট এলাকায় ২৭৫ নম্বর ব্রমটন রােডে অবস্থিত আবদুল মান্নানের রেস্তরা ‘গ্রিন মাস্ক’ এবং কেনসিংটন এলাকায় ২৯ নম্বর সেন্ট মেরী এ্যাবটস্ টেরাসে (বর্তমানে অন্য নামে পরিচিত) তার নিজস্ব বাড়িতে সাদর অভ্যর্থনা লাভ করেন। উনিশ শ’ পঞ্চাশের দশকের প্রথম দিকে লন্ডনে বাঙালি ছাত্রদের সংখ্যা নগণ্য ছিল। উল্লিখিত দশকের শেষ ভাগ থেকে ষাটের দশকের প্রথমদিকে বহু বাঙালি ছাত্র লন্ডনে আসতে সমর্থ হয়।
বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল ছাত্রদের সম্মিলিত প্রচেষ্টার ফলে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট হওয়া বাঙালিদের পক্ষে সম্ভব হয়। মাহমুদুর রহমান, আমিরুল ইসলাম, শরফুল ইসলাম খান, সুবিদ আলী টিপু, একরামুল হক প্রমুখ বাঙালি ছাত্ররা পর্যায়ক্রমে ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট পদ দখল করতে সমর্থ হন। রাজনীতি-সচেতন বাঙালি ছাত্ররা পূর্ব বাংলার দাবিদাওয়ার ব্যাপারে প্রবাসী বাঙালিদের সঙ্গে যােগ দেন। ইতােমধ্যে লন্ডন-প্রবাসী বাঙালিরা পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশন দখল করে বাঙালিদের দাবিদাওয়া আদায়ের আন্দোলনে শরিক হন। ১৯৬৪ সালে উত্তর লন্ডনের ৯১ নম্বর হাইবারি হিলে পূর্ব পাকিস্তান ভবন (East Pakistan House) প্রতিষ্ঠা নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। এই প্রতিষ্ঠানটি যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের দায়িত্ব গ্রহণ করে। পূর্ব বঙ্গের জনগণকে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বঞ্চনার বিরুদ্ধে এবং পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতার সপক্ষে গণআন্দোলন গড়ে তােলার ব্যাপারে সহায়তা করাই ছিল প্রতিষ্ঠাতাদের মূল উদ্দেশ্য। প্রতিষ্ঠানটি স্থাপনের ব্যাপারে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন মিনহাজউদ্দিন, আবদুল মান্নান (ছানু মিয়া) ও হাফেজ মজির উদ্দিন। তেরচৌদ্দটি রুমবিশিষ্ট দোতলা বাড়িটির মূল্য ছিল দশ হাজার পাউন্ড। এর মধ্যে পাঁচ হাজার পাউন্ড অগ্রিম জমা দিতে হয়। এর একটা অংশ মিনহাজউদ্দিন নিজ পকেট থেকে এবং বাকি অংশ ব্যাঙ্ক থেকে ধার নিয়ে জমা দেন। পূর্ব বাংলার দাবিদাওয়া সম্পর্কে সবাইকে সচেতন করার জন্য প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে এশিয়ান টাইড’, (Asian Tide) শীর্ষক একটি ইংরেজি পত্রিকা এবং পূর্ব বাংলা শীর্ষক একটি বাংলা। পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ইংরেজি পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন ফজলে আলী ও নিজামউদ্দিন ইউসুফ। বাংলা পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন আলমগীর কবীর ও মেসবাহ উদ্দিন।
কয়েক মাস পর আমীর আলী পত্রিকা দুটির সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের উভয় অংশের মধ্যে বিদ্যমান অর্থনৈতিক বৈষম্য সম্পর্কে ‘আনহ্যাপি ইস্ট পাকিস্তান (Unihappy East Pakistan) শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকা প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রকাশ করা হয়। কবীর উদ্দিন আহমদ (পরবর্তীকালে ডক্টর এবং ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনিয়র লেকচারার) সম্পাদিত পুস্তিকাটি রচনার ব্যাপারে জাকারিয়া খান চৌধুরী সহায়তা করেন। ১৯৬৬ সালে যুক্তরাজ্যে জেনারেল আঁ$’র রাষ্ট্রীয় সফরকালে ‘আইয়ুব এক্সপােজড় শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকাও প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে প্রচারিত হয়। ১৯৬৬ সালে প্রবাসী বাঙালিরা ঐতিহাসিক ছ’দফাকে তাদের মুক্তি-সনদ হিসেবে গণ্য করেন। পাকিস্তান যুব ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট সুলতান মােহাম্মদ শরীফ এবং ছাত্রলীগের নেতা ও কর্মীরা যুক্তভাবে ছ’দফা সম্পর্কিত দলিল ছাপিয়ে সমগ্র যুক্তরাজ্যে প্রচারের ব্যবস্থা করেন। এ ব্যাপারে পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের তৎকালীন সভাপতি সুবিদ আলী টিপু ও পাকিস্তান যুব ফেডারেশনের প্রাক্তন। প্রেসিডেন্ট আফতাবউদ্দিন শাহ্ সহযােগিতা করেন। ১৯৬৮ সালে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা কেন্দ্র করে প্রবাসী বাঙালিরা শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করে আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলন গড়ে তােলেন। মামলার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর পাকিস্তান ছাত্র ফেডারেশনের উদ্যোগে প্রধানত বাঙালি ছাত্ররা লাউড স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশন দখল করেন। বিক্ষোভকারী ছাত্ররা শেখ মুজিবের নেতৃত্বের প্রতি আস্থা ঘােষণা করেন এবং অবিলম্বে তার মুক্তির দাবি জানান। প্রবাসী বাঙালিরা পিছিয়ে থাকেন নি। যুব ফেডারেশনের উদ্যোগে আয়ােজিত একটি প্রতিবাদ মিছিলে যােগ দিয়ে ৭/৮ হাজার বাঙালি হাইড পার্ক থেকে পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়ে একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এই প্রতিবাদ মিছিলে যােগ দেয়া ও হাই কমিশন দখল করার ব্যাপারে অংশগ্রহণের জন্য আনিস আহমদকে জুলাই মাসের প্রথমদিকে (সম্ভবত ৮ জুলাই) পাকিস্তান হাই কমিশনের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তখন পর্যন্ত এটাই ছিল সবচেয়ে বড় প্রতিবাদ মিছিল। এরপর আরাে কয়েকটি মিছিলের আয়ােজন করা হয়। মিছিলে অংশগ্রহণকারী নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন এম এ রকীব, হাফিজ মজিরউদ্দিন, শামসুর রহমান, মতিউর রহমান, মিম্বর আলী ও সুলতান মাহমুদ শরীফ। একটি মিছিলের পর সুলতান শরীফ হাই কমিশন থেকে পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে ফেলে কালাে পতাকা উত্তোলন করেন।
এই কালাে পতাকার ফটো ও প্রতিবাদ মিছিলের সংবাদ ১৯৬৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দি টাইমস পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়। ছাত্র ও বাঙালি জনসাধারণের প্রতিবাদ মিছিলের পর আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সম্পর্কে আলােচনা করে কর্তব্য নির্ধারণ করার জন্য পরপর দুটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রিটে হাফিজ মজিরউদ্দিনের দোকানে প্রথম সভা এবং দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনে আবদুল মান্নানের ‘গ্রিন মাস্ক’ রেস্তোরায় দ্বিতীয় সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিস্তারিত আলােচনার পর পাকিস্তানি শাসকদের বিরুদ্ধে আন্দোলন ও মামলা | পরিচালনার ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য একটি ডিফেন্স কমিটি গঠন করা হয়। মিনহাজ উদ্দিন কমিটির কনভেনার মনােনীত হন। শেখ মুজিবের পক্ষ । সমর্থন করার জন্য কমিটি ব্রিটেন থেকে একজন কৌসুলি পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ‘তাজমহল’ রেস্তোরাঁর মালিক আইয়ুব আলীর সৌজন্যে কেনসিংটন হাই। স্ট্রিট এলাকায় ১ নম্বর এডিংটন রােডে ডিফেন্স কমিটির অফিস স্থাপন করা হয় । সুলতান মাহমুদ শরীফ এই অফিস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ডিফেন্স কমিটির পক্ষ থেকে লন্ডনের সংবাদপত্র এবং পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়। প্রবাসী বাঙালিরা ডিফেন্স কমিটির তহবিলে মুক্তহস্তে দান করেন। যথাসময়ে কুইন্স কাউন্সেল ও শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামসকে মামলা পরিচালনার জন্য পাঠানাে হয়। মিনহাজ উদ্দিন এক সাক্ষাৎকারে বলেন : “এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল’-এর মাধ্যমে আমরা ব্যারিস্টার নিযুক্ত করলাম। (এজন্য) অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। আমি বারাে শ’ পাউন্ড যােগাড় করলাম। মিসেস মুজিব জায়গাজমি বিক্রি করে সেই সময় বিশ হাজার টাকা যােগাড় করলেন এবং সেই টাকা আমার কথামতাে চিটাগাং-এর একটি নির্দিষ্ট ব্যাঙ্ক একাউন্টে জমা দেয়া হলাে। সেই রিসিট আমার কাছে পাঠিয়ে দেয়া হলাে। আগরতলা কেসে আমার নিজের পকেট থেকে পাঁচ হাজার পাউন্ড খরচ হয়েছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর শেখ মুজিব সে টাকা ফিরিয়ে দিয়েছেন আমাকে।
ইতােমধ্যে লন্ডনে এক রেস্তোরায় ছােটখাটো একটা প্রেস কনফারেন্স করা হলাে। আগরতলা কেস সম্পর্কে এবং আমরা যে শেখ মুজিবকে ডিফেন্ড করার জন্য ব্যারিস্টার পাঠিয়েছি লন্ডন থেকে তাও বলা হলাে। পরের দিনই খবরের কাগজে আমাদের ছবিসহ খবর প্রকাশিত হয়। | আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার পর শেখ মুজিবুর রহমান জেল। থেকে মুক্তিলাভ করেন। ২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ রমনা রেসকোর্সে (বর্তমান সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) তাকে গণসংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। এই উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের তত্ত্বালীন সহ-সভাপতি তােফায়েল আহমদ তাঁকে ‘বঙ্গবন্ধু’ খেতাবে ভূষিত করেন। সমবেত জনসাধারণ বিপুল করতালিসহকারে তােফায়েল আহমদের প্রস্তাব সমর্থন করেন। যুক্তরাজ্যে আইয়ুব-বিরােধী আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীদের ব্যক্তিগতভাবে ধন্যবাদ জানানাের উদ্দেশ্যে ১৯৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন সফরে আসেন। তাকে অভ্যর্থনা জানানাের জন্য প্রবাসী বাঙালিরা। একটি কমিটি গঠন করেন। গাউস খান এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ছিলেন। | লন্ডনে অবস্থানকালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাসাদুক আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার জন্য জেরার্ড স্ট্রিটে তার রেস্তোরায় (“দি গ্যাঞ্জেস’) যান। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। সাক্ষাতের পর তাসাঙ্গুক আহমদ তার সহকর্মী আব্দুল মতিনকে বলেন, পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামের কথা চিন্তা করছেন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) স্পষ্ট অভিমত-রক্তাক্ত সংগ্রাম এড়ানাে যাবে না। এই সংগ্রামে কার সাহায্য পাওয়া যাবে জিগ্যেস করা হলে তিনি তাসাদুক আহমদকে বলেন : “যে কেউ সাহায্য করবে তারই সাহায্য নেব।’ ৬ নভেম্বর (১৯৬৯) বঙ্গবন্ধু লন্ডন ত্যাগ করেন। তার কিছুকাল পর যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। গাউস খান এই নবগঠিত প্রতিষ্ঠানের সভাপতি মনােনীত হন। দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের কুলাউড়া রেস্তোরার মালিক বি এইচ তালুকদার সাধারণ সম্পাদক পদে নিয়ােজিত হন। পরবর্তীকালে লন্ডন আওয়ামী লীগ গঠিত হয়। মিনহাজউদ্দিন ও সুলতান মাহমুদ শরীফ এই শাখার যথাক্রমে প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৭০ সালের আগস্ট (কিংবা সেপ্টেম্বর) মাসে পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান আমেরিকা যাওয়ার পথে লন্ডনের ক্ল্যারিজেস হােটেলে অবস্থান করেন। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে লন্ডন আওয়ামী লীগ হােটেলের সামনে এক বিক্ষোভের আয়ােজন করে। হােটেলের নিকটবর্তী রাস্তার কোণে পুলিশ-বেষ্টনীর বাইরে কালাে পতাকাধারী প্রবাসী-বাঙালিরা ইয়াহিয়া খানের সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে ও গণতন্ত্রের সপক্ষে শ্লোগান দেয়। বিক্ষোভের এক পর্যায়ে স্বয়ং ইয়াহিয়া খান রাস্তা পার হয়ে বিক্ষোভকারীদের সঙ্গে কথা বলার জন্য আসেন। তাদের সঙ্গে কথাকাটাকাটির সময় সুলতান মাহমুদ শরীফ জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে সরাসরি জিগ্যেস করেন, আসন্ন নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমান যদি পার্লামেন্টে সর্ববৃহৎ রাজনৈতিক দলের মর্যাদা লাভ করেন, তা হলে তাকে সরকার গঠনের সুযােগ দেয়া হবে কি না? এই প্রশ্নের সরাসরি উত্তর না দিয়ে ইয়াহিয়া খান কিছুটা অসংলগ্নভাবে বলেন : “আমি যে-কোনাে মূল্যে পাকিস্তানকে রক্ষা করবাে। পাকিস্তানকে ধ্বংস করার সুযােগ আমি কাউকে দেবাে না। পাকিস্তানের জন্য আমি প্রাণ দিতে রাজি আছি।’ ১৯৮৯ সালে লন্ডনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে আহমদ হােসেন জোয়ারদার (এ এইচ জোয়ারদার) বলেন, তিনি ও তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মীরা ইয়াহিয়া খানবিরােধী বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। আসন্ন নির্বাচনে (১৯৭০) সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মর্যাদা অর্জন করলে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে কিনা- এই প্রশ্নের জবাবে ইয়াহিয়া খান বলেন : “এটা প্রেসিডেন্টের ইচ্ছার ওপর নির্ভরশীল। এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে মি. জোয়ারদার বলেন : ‘তখন আমাদের কাছে পাকিস্তানি শাসকদের চিন্তাধারা এবং ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা দিনের মতাে পরিষ্কার হয়ে গেল। তারা ধরে নিয়েছিলেন, বাঙালিরা তাে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবেই ; আর যদি ঘটনাক্রমে তেমন কিছু ঘটেই যায়, তবুও তাদের ক্ষমতায় যেতে দেয়া হবে না। এটা তারা নির্বাচনের আগেই নির্ধারণ করে রেখেছিল।১০
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭ ডিসেম্বর। সর্বগ্রাসী। ঝড়ের জন্য কিছুসংখ্যক আসনে নির্বাচন ১০ জানুয়ারি (১৯৭১) পর্যন্ত স্থগিত রাখা হয়। মােট ২২টি দলও উপদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। জাতীয় পরিষদে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য নির্ধারিত ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আওয়ামী লীগ দখল করে। এর ফলে আওয়ামী লীগ সমগ্র পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারি দলের মর্যাদা লাভ করে। নির্বাচনের পর পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার জন্য ১৫ ডিসেম্বর লন্ডনের বাঙালি ছাত্র ও যুবকরা নাইটসব্রিজ এলাকার চেশাম প্লেসে অবস্থিত ছাত্রাবাসে মিলিত হন। প্রস্তাবিত গণপরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ দেবে না বলে সভায় অংশগ্রহণকারীরা আশঙ্কা প্রকাশ করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ পর্যন্ত এ ধরনের আরাে কয়েকটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সদস্য ও সমর্থকরা এসব সভায় অংশগহণ করেন। আন্দোলনের মূল উদ্দেশ্য ও কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে একমত না হওয়ায় তখনও পর্যন্ত ‘অ্যাকশন কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় নি। সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভের পর। জুলফিকার আলী ভুট্টো নির্বাচনের ফলাফল মেনে নিতে অস্বীকার করেন। রাজনৈতিক সঙ্কট নিরসনের জন্য ১২ জানুয়ারি (১৯৭১) ঢাকায় শেখ মুজিবের সঙ্গে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলােচনায় কোনাে অগ্রগতি না হওয়ায় ইয়াহিয়া খান ১৪ জানুয়ারি ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৭ জানুয়ারি তিনি সিন্ধু প্রদেশের লারকানা জেলায় ভুট্টোর বাড়িতে এক গােপন বৈঠকে সলাপরামর্শ। করেন। মি. ভুট্টো গণপরিষদের প্রস্তাবিত অধিবেশন বয়কট’ করবেন বলে ঘােষণা করেন। ২১ ফেব্রুয়ারি (১৯৭১) লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সভায় লন্ডন আওয়ামী লীগ মি. ভুট্টোর সিদ্ধান্তকে অগণতান্ত্রিক বলে ঘােষণা করে। মিনহাজউদ্দিন এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে সুলতান মাহমুদ শরীফ বলেন, পার্লামেন্টের প্রস্তাবিত অধিবেশন স্থগিত রাখার সম্ভাবনা আঁচ করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব পার্লামেন্টের অধিবেশন নির্ধারিত তারিখে অনুষ্ঠানের দাবিতে লন্ডনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের নির্দেশ দেন।
এই নির্দেশ অনুযায়ী ২৮ ফেব্রুয়ারি লন্ডন আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে এক প্রচণ্ড বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় তিন হাজার প্রবাসী-বাঙালি এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। বিক্ষোভকারীরা। পার্লামেন্টের আসন্ন অধিবেশন স্থগিত রাখার বিরুদ্ধে সাবধানবাণী উচ্চারণ করেন। সেদিন সন্ধ্যায় লন্ডনের ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকা ও রেডিও মারফত গণপিরষদের অধিবেশন স্থগিত রাখার সংবা পাওয়ায় প্রকালীবাঙালিরা বেশন স্থগিত রাখার সংরঃ ‘বা গত অবিলম্বে মশাল মিছিল ও পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে ২৪-ঘণ্টাব্যাপী ‘ভিজিল’ অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। রাজনৈতিক পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে এই ‘ভিজিল’ ২৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ক্রমাগত চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ২ মার্চ বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভুইয়ার নেতৃত্বে একদল বাঙালি রাজনৈতিক-কর্মী লন্ডনে এসে ‘ভিজিল’-এ অংশগ্রহণকারীদের সঙ্গে যােগ দেন। ৩ মার্চ বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তানের রাজনৈতিক মৃত্যু ঘােষণা করে আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানি পতাকায় অগ্নিসংযােগ করেন। বাঙালি রেস্তোরার মালিকরা। বিক্ষোভকারীদের জন্য খাবার সরবরাহের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৫ মার্চের পর বিক্ষোভকারীরা পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে থেকে সরে গিয়ে নিকটবর্তী হাইড পার্কে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিছুসংখ্যক বিক্ষোভকারী ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে সাহায্যের আবেদন জানান। | ৩ মার্চ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ইসলাম ও ভূগােলের মধ্যে বিরােধের ফলে সৃষ্ট বিপরীতমুখী শক্তি পাকিস্তানকে দু’ভাগে ভেঙে ফেলবে বলে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। এই নিবন্ধে পাকিস্তানকে কৃত্রিম উপায়ে সৃষ্ট মুসলিম রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা হয়। | উল্লিখিত তারিখে (৩ মার্চ, বৃহস্পতিবার) শেখ মুজিব বলেন, পরবর্তী রােববার তিনি ছ’দফার ভিত্তিতে রচিত পাকিস্তানের সংবিধান ঘােষণা করবেন। পরদিন ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানে কার্যত স্বায়ত্তশাসন কায়েম হবে। ৫ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে সংঘর্ষের ফলে ৩০০ জন নিহত হয়েছে। এই তথ্য প্রকাশ করে শেখ মুজিব পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী দখলকারী-শক্তির মতাে ব্যবহার করছে বলে অভিযােগ | করেন। সৈন্যবাহিনী নির্বিচারে মেশিনগানের গুলি চালিয়ে অসহায় জনসাধারণকে হত্যা করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
৫ মার্চ ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে পল মার্টিন শেখ মুজিবকে কার্যত । বিদ্রোহী পূর্ব বাংলার শাসক বলে উল্লেখ করেন। পরদিন ‘দি টাইমস’-এ এই। সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ৬ মার্চ ‘দি টাইমস’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, প্রতিবাদমুখর পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার দাবি ঘণ্টায় ঘণ্টায় তীব্রতর হচ্ছে।… শেখ মুজিব নিশ্চয় পাকিস্তানকে দু’ভাগ করতে চান না। কিন্তু ভুট্টো তাকে সেদিকে ঠেলে নিয়ে যাচ্ছেন। ৬ মার্চ করাচি থেকে পিটার হ্যাজেলহাস্ট প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবের সামনে দুটি পথ খেলা রয়েছে : তিনি একতরফাভাবে স্বাধীনতা ঘােষণা করতে পারেন অথবা গণপরিষদের অধিবেশন ডেকে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের অধিবেশনে যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানাতে পারেন। ৭ মার্চ ‘দি সানডে টাইমস-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৭ মার্চ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবকরা চেশাম প্লেসে অবস্থিত পাকিস্তানি ছাত্রাবাসের দেয়াল থেকে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর ছবি নামিয়ে পায়ের তলায় ফেলে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে পাকিস্তানি শাসকদের প্রতি তাদের ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করেন। ছাত্রাবাসে অনুষ্ঠিত সভায় গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে অবস্থিত লাইভ স্কোয়ারে অবিরাম বিক্ষোভ প্রদর্শন করার জন্য বহু ছাত্র ও যুবক জমায়েত হন। পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের যুক্তরাজ্য শাখার সদস্যরা এবং যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সদস্য ও সমর্থকরা এই বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করেন। শেখ আবদুল মান্নান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের সদস্যদের নেতৃত্বদান করেন। একই তারিখে (৭ মার্চ) বাঙালি ছাত্রদের সর্বদলীয় এক সভায় বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন (বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) গঠিত হয়। সেদিন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়ােজিত এক প্রতিবাদ মিছিলেও ছাত্ররা যােগ দেন। উল্লিখিত তারিখে পূর্ব পাকিস্তান ভবনে অনুষ্ঠিত এক সমাবেশে পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা ঘােষণার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সেদিন সন্ধ্যায় পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে ছাত্র ও যুবকদের উদ্যোগে বিক্ষোভ অনুষ্ঠানকালে ঘােষণাটি ইংরেজি ও বাংলা প্রচারপত্র হিসেবে বিলি করা হয়।১৩
৭ মার্চ ঢাকার রেসকোর্সে (পরবর্তীকালে সােহরাওয়ার্দী উদ্যান) অনুষ্ঠিত এক । বিশাল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু তাঁর জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষণে বলেন : ‘প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায় আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলুন এবং আমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরাে দেবাে। এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বাে, ইনশাআল্লাহ। এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ বঙ্গবন্ধুর এই ঐতিহাসিক ঘােষণার খবর পরদিন লন্ডনের সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয় নি। যুক্তরাজ্য প্রবাসী বাঙালিরা তার ভাষণের বিবরণ জানার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছিল। ৮ মার্চ ঢাকা থেকে মার্টিন এ্যাডিনি প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, নতুন । সামরিক শাসনকর্তা জেনারেল ইয়াকুব খান সম্ভবত পদচ্যুত হয়েছেন। পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস বি এ সিদ্দিকী নতুন গভর্নর হিসেবে জেনারেল টিক্কা খানের শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে অস্বীকার করেছেন। পরদিন ‘দি গার্ডিয়ান’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ৯ মার্চ (মঙ্গলবার) ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত অপর এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিবের অগ্নিগর্ভ বক্তৃতার পরদিন (সােমবার) ঢাকার জীবনযাত্রা মােটামুটিভাবে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসে। তবে এটা পরিষ্কার বােঝা যায়, তার (শেখ মুজিব) নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় পরিপূর্ণ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। তার অনুমতি ছাড়া কোনাে সরকারি কার্য পরিচালিত হবে না। গত রােববার (৭ মার্চ) তাঁর বক্তৃতা ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে সরাসরিভাবে প্রচারিত হওয়ার ফলে বেতার কর্মচারীরা অনুষ্ঠান সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করে দেন। পরদিন (৮ মার্চ) বক্তৃতাটি প্রচারিত হওয়ার পর রেডিও স্টেশনে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসে। উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ধর্মঘট পালনের জন্য শেখ মুজিবের নির্দেশ অনুযায়ী সব সরকারি ও বেসরকারি অফিস, উচ্চ ও নিম্ন আদালত, স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে বন্ধ থাকবে। তাছাড়া ট্যাক্স ও খাজনা দেয়া হবে না, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আর্থিক লেনদেন বন্ধ থাকবে এবং পূর্ব পাকিস্তানের ব্যাঙ্কে পশ্চিম পাকিস্তানের একাউন্টগুলাে পরবর্তী নির্দেশ জারি না হওয়া পর্যন্ত বন্ধ বলে গণ্য করা হবে। | ৯ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক গণসমাবেশে বক্তৃতাদানকালে চীনপন্থী মওলানা ভাসানী বলেন, পাকিস্তানি সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবুর রহমানের সগ্রামকে তিনি সমর্থন করেন।
এর ফলে শেখ মুজিবের নীতির প্রতি বামপন্থীদের প্রকাশ্য সমর্থন সূচিত হয় বলে ‘দি টাইমস্’-এর সংবাদদাতা পল্ মার্টিন মন্তব্য করেন। ১০ মার্চ ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের বক্তৃতার সারমর্ম উল্লেখ করা হয়। ১২ মার্চ ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, জনগণের পূর্ণ আস্থাভাজন শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত শাসনকর্তা বলে মনে হয়। ইতােমধ্যে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর (বর্তমান ১০ নম্বর) রাস্তায় অবস্থিত তার বাড়িকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের অনুকরণে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট বলে উল্লেখ করা হচ্ছে। সরকারি অফিসার, রাজনীতিবিদ, ব্যাঙ্কার, শিল্পপতি এবং অন্যান্য মহলের লােকজন তার সঙ্গে দেখা করার জন্য ৩২ নম্বরের বাড়িতে গিয়ে ভিড় জমাচ্ছেন। এই পরিস্থিতিতে শুধু মিলিটারি ব্যারাক ও সৈন্যবেষ্টিত বিমানবন্দরের ওপর। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের কর্তৃত্ব রয়েছে বলে এই সংবাদে উল্লেখ করা হয়। বিভিন্ন দেশের সরকার কিংবা তাদের কূটনৈতিক প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ করে পূর্ব বঙ্গের আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের অনুরােধ জানানাের জন্য বঙ্গবন্ধুর পূর্ব নির্দেশ অনুযায়ী মার্চ মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে (১০ থেকে ১২ তারিখের মধ্যে) সুলতান মাহমুদ শরীফ, মিনহাজউদ্দিন ও মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু লন্ডনে নিয়ােজিত ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন, ভারত সরকার এ ব্যাপারে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশন প্রবাসী বাঙালিদের সর্বপ্রকার সাহায্য দান করবে বলে বিদেশে ভারতের প্রত্যেকটি দূতাবাসকে জানিয়ে দেয়া হয়েছে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে ১৪ মার্চ (রােববার) লন্ডনে একটি গণসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। মফস্বলের বহু শহর থেকে দশ হাজারের বেশি বাঙালি হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে যােগদান করেন। হাইড পার্ক থেকে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানের নেতৃত্বে লাউডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এর আগে লন্ডনে বাঙালিদের এত বড় সমাবেশ আর দেখা যায় নি।১৪ এই সমাবেশের পর ব্রিটেনে বাঙালিদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কয়েক দিনের মধ্যে তারা প্রায় ১৫টি শহরে অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন। এই শহরগুলাের মধ্যে ছিল লন্ডন, বার্মিংহাম, লিড়স, ব্র্যাফোর্ড ও ম্যাঞ্চেস্টার।
১৫ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঢাকায় পৌঁছাবার কয়েক ঘণ্টার মধ্যে চার হাজারেরও বেশি ছাত্র তাঁর বিরুদ্ধে তুমুল বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৬ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এই রিপাের্টে বলা হয়, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার মধ্যে আসন্ন আলােচনার ফলাফল সম্পর্কে কোনাে কোনাে মহল আশাবাদী ছিল। কিন্তু ছাত্র ও ট্রেড ইউনিয়ন কর্মীরা পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে কথা শুনতে রাজি নয়।। | এই অনিশ্চিত পরিস্থিতিতে বিদেশি সামরিক ও বেসামরিক বিমান ভারতের ওপর দিয়ে সরাসরি পূর্ব পাকিস্তানে উড়ে যাওয়া নিষিদ্ধ বলে ঘােষণা করা হয়। | ১৭ মার্চ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ। মুজিবের নির্দেশে চট্টগ্রাম বন্দরে ডক-শ্রমিকরা জাহাজ থেকে চীনা অস্ত্রশস্ত্র নামাতে অস্বীকার করেছে। এ সংবাদে আরও বলা হয়, গত সপ্তাহে দু’হাজারেরও বেশি। পাকিস্তানি সৈন্য গােপনে চট্টগ্রাম বন্দরের নিকটবর্তী এলাকায় জাহাজ থেকে । নেমেছে বলে শেখ মুজিব ঘােষণা করেছেন। এই ঘটনা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, পাশব-শক্তি প্রয়ােগ করে পূর্ব পাকিস্তানকে দমনের জন্য সামরিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণ করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খান। গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার তারিখ ৩ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত পিছিয়ে দেন বলে দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর স্টাফ রিপাের্টার মন্তব্য করেন। ইতঃপূর্বে পাকিস্তানের অখণ্ডত্ব বজায় রাখার জন্য প্রয়ােজন হলে বল প্রয়ােগ করা হবে বলে ইয়াহিয়া খান প্রকাশ্যে হুঙ্কার দেন। ১৯ মার্চ ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে দু’দিনব্যাপী আলােচনার পর পুলিশ ও সৈন্যবাহিনীর। সাম্প্রতিক গুলিচালনার ব্যাপারে তদন্ত অনুষ্ঠানের জন্য ইয়াহিয়া খান প্রদত্ত ১৭ মার্চের প্রস্তাব শেখ মুজিব প্রত্যাখ্যান করেন। তিনি বলেন, তদন্ত অনুষ্ঠানের ঘােষণা থেকেই বােঝা যায়, কমিশন গঠনের প্রস্তাব অর্থহীন। জনগণকে প্রতারণা করাই এর উদ্দেশ্য। এই কমিশনের সঙ্গে কেউই সহযােগিতা করবে না বলে তিনি ঘােষণা করেন। ২০ মার্চ ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে ‘দি অবজারভার -এর সংবাদদাতা বলেন, শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলােচনার ফলে পাকিস্তানের পাঁচটি প্রদেশ নিয়ে একটা কনফেডারেশন গঠনের সম্ভাবনা রয়েছে। শেখ মুজিব সম্ভবত অন্তর্বর্তীকালীন জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােজিত হবেন।
ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে ২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টোর ঢাকা আগমন রাজনৈতিক মহলে, বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানে আশার সঞ্চার করে। কিন্তু বিদ্রোহী বাঙালিরা অমঙ্গল আশঙ্কা করে মি. ভুট্টোর বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ২২ মার্চ শেখ মুজিব ও মি, ভুট্টো এক বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠক চলাকালে ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে বলা হয়, গণপরিষদের প্রারম্ভিক অধিবেশনের তারিখ ২৫ মার্চ থেকে পিছিয়ে দেয়া হবে। | যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালি ছাত্রদের প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি’ ও তাদের সমর্থকরা ২৩ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে বাংলার জনগণের সঙ্গে তাদের সংহতি ঘােষণা করে। ( ২৩ মার্চ আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান প্রজাতন্ত্র দিবসের পরিবর্তে। প্রতিরােধ দিবস পালন করে। ঢাকার সরকারি অফিস-আদালত, স্কুল-কলেজ এবং শেখ মুজিবের বাড়িসহ শত শত বাড়ির ওপর সবুজ পটভূমিতে বাংলাদেশের সােনালি মানচিত্রখচিত নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়। এ সম্পর্কে ২৪ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিব তাঁর বাড়ির সামনে কয়েকশ’ আওয়ামী লীগ কর্মীর এক সমাবেশে গুরুত্বপূর্ণ। ভাষণ দেন। তিনি বলেন, ২২ দিন আগে তার নেতৃত্বে যে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়, তার ফলে পাকিস্তানি কায়েমি স্বার্থের মেরুদণ্ড ভেঙে গেছে। শান্তিপূর্ণভাবে এই আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য তিনি তাঁর দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। রক্তপাত ছাড়া যিনি যুদ্ধে জয়লাভ করেন তিনিই সবচেয়ে বড় সেনাপতি’ বলে শেখ মুজিব মন্তব্য করেন।
মওলানা ভাসানী ও তাঁর সহকর্মীরা প্রতিরােধ দিবসের পরিবর্তে ২৩ মার্চ স্বাধীনতা দিবস পালন করেন। এই উপলক্ষে আয়ােজিত এক জনসভায় ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির জেনারেল সেক্রেটারি মশিউর রহমান (যাদু মিয়া) স্বীকার করেন, তার প্রতিপক্ষ সাড়ে সাত কোটি বাঙালির পূর্ণ আস্থা অর্জন করেছে। তিনি আরও বলেন : “জনগণ সামরিক বাহিনী ও আওয়ামী লীগের কাছ থেকে নির্দেশ পেয়েছে। এবং তারা সেনাবাহিনীর নির্দেশ উপেক্ষা করেছে।১৬ | ২৫ মার্চ সন্ধ্যার আগে করাচি থেকে প্রেরিত ‘দি টাইমস্ ও ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সংবাদদাতাদের খবরে বলা হয়, ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের আলােচনা ব্যর্থ। হয়েছে। শেখ মুজিব এক ঘােষণা জারি করে বিদেশি কোম্পানিদের মাল রপ্তানি সম্পর্কিত আর্থিক লেনদেন পূর্ব বাংলার দুটি ব্যাঙ্কের মারফত করার নির্দেশ দেন। করাচির পরিবর্তে ম্যানিলা ও লন্ডনের মাধ্যমে ঢাকার সঙ্গে বহির্বিশ্বের টেলি-যােগাযােগ রক্ষার জন্য তিনি বিদেশি ডাক ও টেলিগ্রাফ কোম্পানিদের অনুরােধ জানান। | প্রেস ট্রাস্ট অব ইন্ডিয়ার এক খবরে প্রকাশ, পূর্ব বঙ্গের ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশের অসহযােগিতার ফলে পাকিস্তানি সৈন্যরা পুলিশ বাহিনীকে অস্ত্র পরিত্যাগে বাধ্য করতে পারে নি। তা ছাড়া ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস, অস্ত্রধারী রিজার্ভ পুলিশ ও বেসামরিক পুলিশ বাহিনীর বাঙালি সদস্যরা একযােগে শেখ মুজিবের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২৬ মার্চ লন্ডনের। সংবাদপত্রে এসব খবর ফলাও করে প্রকাশিত হয়। ২৬ মার্চ লন্ডনের প্রভাতকালীন সংবাদপত্রে বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর প্রকাশিত হয় নি। সেদিন সান্ধ্য-পত্রিকাগুলােতে (‘ইভিনিং নিউজ’ ও ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড) পূর্ব বাংলার বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত সংবাদ প্রকাশিত হয়। পরবর্তী খবরে প্রকাশ, ২৫ মার্চ মধ্যরাত্রির পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চ) জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রক্ত-পিপাসু বর্বর সৈন্যবাহিনী বাংলাদেশের অসহায় পুরুষমহিলা-শিশুদের নির্বিচারে হত্যা করে রক্তবন্যার সূচনা করে।
মার্চ, ১৯৭১
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশন উপলক্ষে জেনেভায় ছিলেন।১৭ সেদিন সকালবেলা বি বি সি’র খবর শুনে তিনি অনুমান করলেন, বাংলাদেশে গুরুতর একটা কিছু ঘটেছে। ঢাকার সঙ্গে বাইরের জগতের যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক-শিক্ষিকাদের কথা তার মনে পড়লাে। তিনি অত্যন্ত অস্বস্তি বােধ করলেন। সেদিনের অধিবেশনে গিয়ে তিনি কমিশনের চেয়ারম্যান মি. এগুইলার অনুমতি নিয়ে বি বি সি’র খবরের কথা উল্লেখ করে সেদিনই লন্ডনে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত প্রকাশ করেন। | লন্ডন বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীর বড় ছেলে আবুল হাসান চৌধুরী । (কায়সার) ও হাবিবুর রহমান তাকে অভ্যর্থনা জানান। হাবিবুর রহমান তখন পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করার তিন সপ্তাহ পরে তিনি চাকরিচ্যুত হন। দক্ষিণ লন্ডনের বাসায় পৌঁছাবার কিছুক্ষণ পর সুলতান মাহমুদ শরীফ কয়েকজন বাঙালি সহকর্মীসহ বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাঁরা সবাই ঢাকার সঙ্গে যােগাযােগ করতে না পেরে বিচারপতি চৌধুরীর মতাে শঙ্কিত বােধ করেন। তিনি তখনই ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ-এশিয়া বিভাগের প্রধান ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগের চেষ্টা করেন। সন্ধ্যার পর তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করা সম্ভব হয়। পরদিন (শনিবার) ছুটির দিন হওয়া সত্ত্বেও তিনি সকাল ১১টার সময় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে রাজি হন। তার (বিচারপতি। চৌধুরী) অনুরােধক্রমে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর একান্ত সচিব মি. ব্যারিংটনও পরদিন পররাষ্ট্র দপ্তরে আসতে রাজি হন। ২৬ মার্চ সকালবেলা থেকে বাঙালি ছাত্র শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও । আফরােজ আফগান ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের নিকটবতী হােয়াইটহলে অনশন ধর্মঘট শুরু করেন। লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারকালে শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশ ‘মর্মান্তিক কিছু একটা হতে যাচ্ছে আশঙ্কা করে ২৫ মার্চ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ অনশন পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবির প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে অনশনকারীদের আশপাশে ‘হ্যাঙ্গ ইয়াহিয়া’, ‘রেকগনাইজ বাংলাদেশ’, ‘স্টপ। জেনােসাইড’ ইত্যাদি শ্লোগান লেখা প্ল্যাকার্ড ও পােস্টার রাখা হয়।
প্রচণ্ড শীতের মধ্যে রাতের বেলাও ৫০ থেকে ১০০ জন বাঙালি পর্যায়ক্রমে অনশনকারীদের সঙ্গে ছিলেন। ব্রিটিশ পুলিশ তাঁদের সঙ্গে সহযােগিতা করে। পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ থেকে অনশনকারীদের রক্ষা করাই তাদের উদ্দেশ্য ছিল বলে অনুমান করা হয়। পুলিশের ডাক্তার প্রতিদিন অনশনকারীদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। তৃতীয় দিন তারা বলেন, অনশনকারীদের শরীর দুর্বল হয়ে পড়েছে। অবিলম্বে অনশন ত্যাগ না করা হলে তাদের জোর করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হবে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী বাংলাদেশ ছেড়ে না যাওয়া পর্যন্ত তারা অনশন অব্যাহত রাখবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ইতােমধ্যে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিতর্ক শুরু হয়েছিল এবং প্রতিদিনই এম পি-দের মধ্যে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন বৃদ্ধি পাচ্ছিল। অবশেষে শ্রমিকদলীয় এম পি পিটার শােরের অনুরােধক্রমে ২৮ মার্চ। বিকেল ৩/৪ টার দিকে তারা অনশন ভঙ্গ করেন। ব্রিটিশ টেলিভিশন ও পত্র-পত্রিকায় অনশনকারীদের ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ২৬ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতা গাউস খানের উদ্যোগে লন্ডনের বেরিক স্ট্রিটে অবস্থিত তার এলাহাবাদ’ রেস্তোরার উপরের তলার অফিসে এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনার পর পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে অবিলম্বে বিক্ষোভ প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।১৯ | সেদিন সন্ধ্যার দিকে পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে প্রায় ৩০০ বাঙালি ছাত্র ও জনসাধারণ তুমুল বিক্ষোভ শুরু করেন। এক পর্যায়ে তারা হাই কমিশন দখলের চেষ্টা করেন। রাত প্রায় নয়টার দিকে উত্তেজিত ছাত্র ও যুবক এবং পুলিশের মধ্যে এক সংঘর্ষের ফলে মােহাম্মদ ইসহাক, শফিকুল হকসহ মােট আটজনকে গ্রেফতার করা হয়। মােহাম্মদ ইসহাক তখন যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উৎসাহী সদস্য ছিলেন। পরদিন তিনজনের বিরুদ্ধে পুলিশ মামলা দায়ের করে। ১ জুন মাল্বারা স্ট্রিট কোর্টে উত্থাপিত মামলায় মােহাম্মদ ইসহাককে দু’সপ্তাহের কারাদণ্ড দেয়া। হয়। গাউস খান এই মামলার ব্যয়ভার বহন করেন। লন্ডন আওয়ামী লীগের সভাপতি মিনহাজউদ্দিনও উল্লিখিত বিক্ষোভে যােগ দেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, পাকিস্তান হাই কমিশনার বাংলাদেশের স্বাধীনতা।
মেনে না নেয়া পর্যন্ত তিনি হাই কমিশনের বাইরে অবস্থান করবেন। ২৭ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের পার্টি আওয়ামী লীগ এই বিক্ষোভের আয়ােজন করে। প্রায় একশ’জন ছাত্র ও জনসাধারণ সারা রাত হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা শেখ আবদুল মান্নান এবং ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু। পুলিশ কর্তৃপক্ষ হাই কমিশনকে পাহারা দেয়ার জন্য প্রায় ৫০ জন পুলিশ অফিসার নিয়ােগ করেন। পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রমণের খবর পাওয়ার পর আহমদ হােসেন জোয়ারদার তার সহকর্মীদের সহায়তায় ২৬ মার্চ সন্ধ্যায় পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ হস্টেলে এক জরুরি সভার আয়ােজন করেন। এই সভায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মী, ছাত্র ও যুবকরা যােগদান করেন। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, আজ বাংলাদেশের জন্মদিন এবং এখন থেকে পূর্ব পাকিস্তান বলে কিছু নেই। তকালীন পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফেডারেশনের বাঙালি সভাপতি ইকরামুল হক এই প্রস্তাব সম্পর্কে আপত্তি জানান। | ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস হাউসের প্রেসিডেন্ট আনিস রহমান এবং আরাে কয়েকজন বাঙালি ছাত্র পাকিস্তান স্টুডেন্টস হস্টেলের সভায় যোেগ দেন। শামসুল আবেদীন, আনিস রহমান, মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু এবং আরাে কয়েকজন সভায়। বক্তৃতা করেন। শামসুল আবেদিন পাকিস্তানিদের বিভিন্ন অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু বলেন, আমরা অনেক চেষ্টা করেছি এক সঙ্গে থাকার জন্য, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিদের অত্যাচার-অবিচারের ফলে আর এক সঙ্গে থাকা সম্ভব নয়। আনিস রহমান বলেন : ‘পাকিস্তান ইজ ডেড। কাজেই এখন। আমাদের সেইভাবে তৈরি হতে হবে।
লন্ডনে বিভিন্ন এলাকায় অ্যাকশন কমিটি গঠনের একটি প্রস্তাবও উল্লিখিত সভায় গৃহীত হয়। এই প্রস্তাব অনুযায়ী মি. জোয়ারদার ও তাঁর ১৫/২০ জন সহকর্মী সেই রাতেই দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের স্ট্রেথাম এলাকায় কুলাউড়া’ তন্দুরি রেস্তোরার উপরতলায় সমবেত হয়ে একটি অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন। এই কমিটির কর্মকর্তাদের মধ্যে ছিলেন বি এইচ তালুকদার (সভাপতি), আহমদ। হােসেন জোয়ারদার (সিনিয়র ভাইস-প্রেসিডেন্ট) এবং সােহেল ইবনে আজিজ (জেনারেল সেক্রেটারি)। মি. জোয়ারদার সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবে এই কমিটির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ( ২৭ মার্চ ‘দি টাইমস্ ও ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠায় তিন-কলাম শিরােনাম দিয়ে স্বাধীনতা ঘােষণার সংবাদ এবং এ সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ‘দি টাইমস’-এর সংবাদে বলা হয়, ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলে একটি স্বাধীন প্রজাতন্ত্র গঠন সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের ঘােষণার পর গৃহযুদ্ধ শুরু হয়। এক বেতার ভাষণে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে বেআইনি প্রতিষ্ঠান এবং শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলে ঘােষণা করে শাস্তিদানের সঞ্চয় প্রকাশ করেন। ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী এবং শেখ মুজিবের সমর্থক ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের মধ্যে ঘােরতর সংগ্রাম অব্যাহত রয়েছে। ‘পাকিস্তানের আকাশে যুদ্ধের মেঘ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় মন্তব্য উপলক্ষে ‘দি টাইমস্-এ বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যদের আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধের ডাক দিয়ে এবং স্বাধীনতা ঘােষণা করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের সর্বজনস্বীকৃত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সাহসের পরিচয় দিয়েছেন। বাঙালি রেজিমেন্টের সৈন্যরা শেখ মুজিবের নির্দেশ মেনে নেবে বলে বিশ্বাস করার কারণ রয়েছে।২২. ট্র্যাজেডি ইন পাকিস্তান’ শিরােনাম দিয়ে ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, যে-কোনাে মূল্যে পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের একগুয়ে মনােভাব শেখ মুজিবকে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা ঘােষণা করতে বাধ্য করে।… বাংলাদেশ পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ফলে অখণ্ড পাকিস্তানের চিন্তাধারা অযৌক্তিক বলে আবার প্রমাণিত হয়েছে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানিয়ে বেঙ্গল স্টুডেন্টস অ্যাকশন। কমিটি ২৭ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ একটি বিজ্ঞাপন দেয়। বাংলাদেশ আক্রমণকারী পাকিস্তানি সৈন্যদের অপসারণের ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যও এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে আবেদন জানানাে হয়। | ২৭ মার্চ হাবিবুর রহমান বিচারপতি চৌধুরীকে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে নিয়ে যান। তিনি মি, সাদারল্যান্ডের রুমে পৌছানাের পর মি. ব্যারিংটন এসে তাদের সঙ্গে যােগ দেন। কিছুক্ষণ পর মি. সাদারল্যান্ডের সেক্রেটারি ঢাকা থেকে টেলেক্সযােগে সংবাদ আসছে বলে খবর দিলেন।
টেলেক্সের লম্বা সংবাদ পড়ার মাঝখানেই বেদনা ও সহানুভূতিভরা মুখ তুলে মি, সাদারল্যান্ড বিচারপতি চৌধুরীর দিকে তাকালেন। ধীরে ধীরে তিনি বললেন : ‘খবর খুব খারাপ। বহু লােক প্রাণ হারিয়েছে। আপনার বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু ছাত্রছাত্রী হতাহত হয়েছে।’ এই কথা বলে তিনি আবার পড়তে শুরু করলেন। পড়া শেষ হলে তিনি বললেন : ‘পঁচিশে মার্চ দিবাগত রাত্রে ঢাকায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার একটি ভয়াবহ রাত যাপন করেন। পরের দিনই তিনি গুলশান থেকে শহরের দিকে আসার চেষ্টা করে রাস্তায় অনেক মৃতদেহ দেখে ফিরে যান। সান্ধ্য-আইন শিথিল করার পর জনৈক ফার্স্ট সেক্রেটারি অল্পক্ষণের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি দেখেন, | ইকবাল হল-এর (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সিড়ি বেয়ে রক্ত গড়িয়ে পড়ছে। তিনি জানতে পারেন, জগন্নাথ হলের সামনে গণকবর খুঁড়ে সেখানে নিহত ছাত্র ও শিক্ষকদের মৃতদেহ ছুঁড়ে ফেলা হয়। আর যেসব ছাত্রকে গুলির ভয় দেখিয়ে মৃতদেহগুলাে গণকবরের সামনে আনতে বাধ্য করা হয়, তাদেরও পরে গুলি করে সেই কবরেই ফেলা হয়। ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার ফ্রাঙ্ক সার্জেন্ট আরাে লিখেছেন, পাকিস্তান রেডিও শেখ মুজিবকে বন্দি করা হয়েছে বলে দাবি করেছে। এ দাবির সত্যতা সম্পর্কে তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। মি. সাদারল্যান্ড আরও বলেন, পাকিস্তান সরকার বিদেশি দূতাবাসের টেলেক্স ব্যবহার নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছে। এর ফলে ঢাকা থেকে আরও সংবাদ পাঠানাে যাবে না বলে তাকে জানানাে হয়েছে। , বিচারপতি চৌধুরী মি. সাদারল্যান্ডকে বলেন : “এই মুহূর্ত থেকে পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আমার আর কোনাে সম্পর্ক রইলাে না। আমি দেশ থেকে দেশান্তরে যাবাে, আর পাকিস্তানি সৈন্যদের এই নিষ্ঠুরতা-নির্মমতা কথা বিশ্ববাসীকে জানাবাে। তারা আমার ছেলে-মেয়েদের হত্যা করেছে। এর প্রতিবিধান চাই।” বিদায় নেয়ার আগে বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাসহিউমের সঙ্গে তাঁর সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার জন্য মি. সাদারল্যান্ডকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক (পরবর্তীকালে লর্ড হিউম) তখন স্কটল্যান্ডে ছিলেন। লন্ডনে ফিরে আসার পর তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেবেন বলে তিনি কথা দেন। তা ছাড়া বৈদেশিক সাহায্য দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উডের সঙ্গেও সাক্ষাৎ করার ব্যবস্থা। করবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের আগে সংবাদপত্রে কোনাে বিবৃতি না দেয়ার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ করেন। কারণ, সংবাদপত্রে বিবৃতি দেয়ার পর তাঁকে বিদ্রোহী ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে। এর ফলে তার সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যাপারে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পক্ষে প্রটোকল’ ভঙ্গের অভিযােগ উঠতে পারে।
বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞের খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলনের কয়েকজন উৎসাহী সমর্থক নিজেদের মধ্যে প্রাথমিক আলাপ-আলােচনার পর ২৭ মার্চ (শনিবার) একটি ইংরেজি ‘নিউজলেটার প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ মার্চ (মঙ্গলবার) নিউজলেটার’-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। এই সংখ্যায় ব্রিটিশ সােশ্যালিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দের উদ্দেশে একটি। ‘খােলা চিঠি’ এবং মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত। অ্যাকশন কমিটির কার্যকলাপ সম্পর্কে একটি রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। ‘খােলা চিঠি’-তে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আসল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করে অবিলম্বে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ প্রত্যাহার করে তাকে মুক্তিদান, আওয়ামী লীগের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবি এবং হত্যা ও অমানুষিক নির্যাতন সম্পর্কে তদন্ত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের দাবি সমর্থন করার জন্য আকুল আবেদন জানানাে হয়। | ২৭ মার্চ বিকেলবেলা শিল্পী আবদুর রউফ ও মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুসহ। কয়েকজন ছাত্র ও যুবনেতা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তাছাড়া। ব্রিটেনস্থ বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের ড. জাফরউল্লাহ চৌধুরী, ড, মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার এবং আবদুল হাকিমও তার সঙ্গে দেখা করেন। তাঁদের সবাইকে তিনি সংঘবদ্ধ কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব গঠনের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন তাঁর নিজের ভূমিকা সম্পর্কে তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় । কমিটি গঠিত না হওয়া পর্যন্ত তিনি ব্যক্তিগতভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের। পক্ষে কাজ করে যাবেন। তাছাড়া বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর, শিক্ষাবিদ ও পার্লামেন্ট সদস্যের সঙ্গে দেখা করে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করবেন উত্তর লন্ডনের পূর্ব পাকিস্তান ভবনে সেদিন (২৭ মার্চ) বিকেলবেলা ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীদের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্পর্কে ২৯ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, প্রায় আটশ’ লােক এই সভায় যােগদান করেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ, লন্ডন আওয়ামী লীগ এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির মস্কো ও চীনপন্থী গ্রুপসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা সভায় হাজির ছিলেন। ছাত্রদের প্রস্তাবিত কর্মপন্থার প্রতি সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা তাদের সঙ্গে একযােগে কাজ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিরত থাকেন। পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে একটি ট্রাভেল এজেন্সির অফিসে আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সদস্যরা তাদের কর্মপন্থা নির্ধারণের জন্য পৃথক সভার আয়ােজন করেন। এই সভায় পূর্ব পাকিস্তান ভবনের বক্তব্য পেশ করার জন্য পাঁচ-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাে হয়। শেখ আবদুল মান্নান এই প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্য ছিলেন।
পূর্ব পাকিস্তান ভবনে অনুষ্ঠিত সভার শেষে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। পূর্ব লন্ডনের সভায় যােগদানের জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন শহর থেকে প্রতিনিধিরা আসেন। পূর্ব পাকিস্তান ভবন থেকে সরাসরি পূর্ব লন্ডনে গিয়ে শেখ আবদুল মান্নান, আমীর আলী, মােহাম্মদ আইয়ুব, সাখাওয়াত হােসেন এবং আরাে কয়েকজন এই সভায় যােগদান করেন। গাউস খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই সভায় কাউন্সিল। ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ নামের একটি প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে দীর্ঘ আলােচনার পর এ সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত পরবর্তী সভায় গ্রহণের প্রস্তাব। অনুযায়ী ২৯ মার্চ (সসামবার) পর্যন্ত সভার কাজ স্থগিত রাখা হয়। শনিবার (২৭ মার্চ) বিকেলবেলা পূর্ব লন্ডনের ফুরনিয়ার স্ট্রিটে অবস্থিত পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশনের অফিসে অনুষ্ঠিত অপর এক সভায় কয়েকশ’ বাঙালি যােগদান করেন। এদের মধ্যে অনেকেই মুক্তিযুদ্ধে যােগদানের উদ্দেশ্যে নিজেদের নাম-ঠিকানা তালিকাভুক্ত করান। পরবর্তীকালে মিনহাজউদ্দিন এক সাক্ষাঙ্কার উপলক্ষে মজনু-নুল হককে বলেন, মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ যুবকদের ৩/৪ শ পাসপাের্ট তার। কাছে জমা দেয়া হয়েছিল। ২৯ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৮ মার্চ (রােববার) প্রায় সাত হাজার পতাকা ও প্ল্যাকার্ডধারী বাঙালি বার্মিংহামের স্মল হিথ পার্কে সমবেত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানায়। তাদের ব্যানারে ‘পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ শব্দগুলাে বড় বড় অক্ষরে লেখা ছিল। | ২৮ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারেও একটি বিশাল প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়। অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সমর্থকরাও এই সভায় যােগদান করেন। বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার, কভেন্ট্রি, লুটন ও অন্যান্য শহর থেকে কোম্ ও ট্রেনযােগে কয়েক হাজার বাঙালি এই সভায় যােগদানের জন্য আসেন। সভায় বিভিন্ন বক্তা বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেন এবং বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশগুলাের প্রতি আহ্বান জানান। গাউস খান ট্রাফালগার স্কোয়ারে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় না থাকলে এশিয়ার এই অশান্ত অঞ্চলে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ব্যাহত হবে। কিন্তু সামরিক-বল প্রয়ােগ করে পাকিস্তানের অখণ্ডতা । রক্ষা করা যাবে না। এই পন্থা অবলম্বন করলে গৃহযুদ্ধ অবশ্যম্ভাবী। সম্পাদকীয় নিবন্ধে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবকে রাষ্ট্রদ্রোহী’ ঘােষণা করে জেনারেল ইয়াহিয়া তার জীবনের সবচেয়ে মারাত্মক ভুল করেছেন।
২৮ মার্চ কার্ডিফ থেকে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি ফর ওয়েলস্-এর। নেতৃস্থানীয় সদস্যরা লন্ডনে এসে বেঙ্গল স্টুডেন্টস্ অ্যাকশান কমিটির সদস্যদের। সঙ্গে ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, শ্রীলঙ্কা ও সােভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আবেদন জানান। ২৭ মার্চ তারিখে গঠিত ওয়েলস্ কমিটির সদস্যরা। কার্ডিফের এ্যাঞ্জেল হােটেলের সামনে জমায়েত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সম্পর্কে প্রচারপত্র বিলি করেন। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এওয়ার্ড হিথ তখন এ্যাঞ্জেল হােটেলে অবস্থান করছিলেন। ( ২৯ মার্চ প্রকাশিত এক সংবাদে ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সংবাদদাতা সাইমন। ড্রিংগ বলেন, বৃহস্পতিবার রাত ১২টার পর (অর্থাৎ ২৬ মার্চ শুক্রবার) পাকিস্তান সেন্যবাহিনী বিনা প্ররােচনায় ঢাকায় তিন ঘণ্টা যাবৎ অবিরাম গােলাগুলি চালায়। ২৮ মার্চ (রােববার) তাকে ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। কলকাতা থেকে পিটার হ্যাজেলহাস্ট প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানে বল প্রয়ােগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করার জন্য সামরিক বাহিনীকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন : ‘আল্লাহকে অশেষ ধন্যবাদ, পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত রক্ষা পেয়েছে। ২৫ ২৯ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতির জন্য পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্পূর্ণভাবে দায়ী করা চলে না। ২৯ মার্চ (সােমবার) লন্ডনের পােল্যান্ড স্ট্রিটে অবস্থিত ‘মহাঋষি’ রেস্তোরায় গাউস খানের সভাপতিত্বে পূর্ব লন্ডনের অসমাপ্ত কাজ শুরু হয়। সভায় বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার পর কাউন্সিল ফর দি পিপল্স্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’ নামের প্রতিষ্ঠান গঠন সম্পর্কে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটিগুলােকে অনুমােদন-দানের দায়িত্ব কাউন্সিলকে দেয়া হয়। কার্যনির্বাহি পরিষদ হিসেবে ১১জন নির্বাচিত সদস্য এবং ব্রাডফোর্ড, শেফিল্ড, গ্লাসগাে, বার্মিংহাম প্রভৃতি শহরে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটির ১০ জন প্রতিনিধি নিয়ে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। গাউস খান, শেখ আবদুল মান্নান, আতাউর রহমান ও কোহিনুর রেস্তোরার মালিক আবদুল হামিদ যথাক্রমে কমিটির প্রেসিডেন্ট, জেনারেল সেক্রেটারি, সাংগঠনিক সেক্রেটারি ও কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্’-এর সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকার প্রসঙ্গে গাউস খান বলেন, নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল তার নেতৃত্বে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে চার-দফা পরিকল্পনা পেশ করে। এই পরিকল্পনায় বাংলাদেশকে ব্রিটেনের স্বীকৃতিদান, অনুরূপ পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘকে ব্রিটেনের অনুরােধ জ্ঞাপন, ব্রিটেনে তৈরি অস্ত্রশস্ত্র পশ্চিম পাকিস্তানে চালান নিষিদ্ধকরণ এবং অসহায় ও নিরস্ত্র জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার নীতি পরিহার করার জন্য রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণের প্রস্তাব করা হয়। পররাষ্ট্র দপ্তর তাদের পরিকল্পনা সহানুভূতির সঙ্গে বিবেচনার আশ্বাস দেয় বলে মি. খান প্রকাশ করেন। মি. খান আরও বলেন, তাঁর নেতৃত্বাধীন কাউন্সিল বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অর্থ, খাদ্য-সামগ্রী এবং প্রয়ােজনমতাে অস্ত্র সরবরাহের পন্থা বিবেচনা করে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতােমধ্যে বিপুলসংখ্যক প্রবাসী-বাঙালি দেশে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করার ব্যাপারে সাহায্যের অনুরােধ জানিয়ে তাকে টেলিফোন করেছে। ৩০ মার্চ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ৩০ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৯ মার্চ ভারতের। প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের জনসাধারণের সঙ্গে ভারতীয় পার্লামেন্টের সংহতি ঘােষণার জন্য বিরােধী দলগুলাের দাবি মেনে নেন। ব্রিটিশ পার্লামেন্টেও বাংলাদেশের কথা উত্থাপন করা হয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য পিটার শাের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের) বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর বর্বরােচিত অত্যাচার ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ জনসাধারণের তীব্র ঘৃণার কথা পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দেয়ার জন্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস্-হিউমকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক পূর্ব পাকিস্তানে প্রাণহানির জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ব্যাপারে মন্তব্য করা তাঁর পক্ষে উচিত হবে না। ৩০ মার্চ ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর ‘লিড স্টোরি’তে ঢাকায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রথম বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সংবাদদাতা সাইমন ড্রিংগ প্রেরিত সংবাদে বলা হয়, ২৫ মার্চ রাত্রে তিনি অন্যান্য বিদেশী সাংবাদিকদের সঙ্গে হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীকালে শেরাটন হােটেল) ছিলেন। বিদেশী সাংবাদিকদের যখন বহিষ্কার করা হয় তখন তিনি হােটেলের ছাদে লুকিয়ে। ছিলেন। পরে সুযােগমতাে হােটেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে সারা শহর ঘুরে তিনি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর হত্যা ও ধ্বংসলীলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহ করেন। ২৭ মার্চ তাকে করাচি পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সেখান থেকে ২৯ মার্চ ব্যাঙ্কক পৌছেই তিনি উক্ত তারবার্তা পাঠান। দু’বার মালপত্র ও দেহ তল্লাশি সত্ত্বেও তিনি তাঁর নােটগুলাে বাঁচাতে সক্ষম হন। ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর তিন কলামব্যাপী সংবাদে বলা হয়, আল্লাহ ও অখণ্ড পাকিস্তানের নামে ঢাকাকে একটি বিধ্বস্ত ও ভীত-সন্ত্রস্ত নগরীতে পরিণত করা হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর চব্বিশ-ঘণ্টাব্যাপী নিষ্ঠুর ও নির্মম গােলাগুলি বর্ষণের ফলে অন্তত সাত হাজার লােক নিহত এবং বিস্তীর্ণ এলাকা ধূলিসাৎ হয়েছে। ‘দেশের অবস্থা শান্ত’ বলে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের দাবি সত্ত্বেও হাজার হাজার লােক শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে। এই দীর্ঘ রিপাের্টে। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস, রাজারবাগ পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স, পুরনাে শহরের বিভিন্ন এলাকা এবং নারায়ণগঞ্জে গণহত্যার বিস্তারিত ও হৃদয়বিদারক বিবরণ দেয়া হয়। সাইমন ড্রিংগ আরও বলেন, শেখ মুজিবকে টেলিফোনে সতর্ক করে আসন্ন। বিপদ সম্পর্কে অবহিত করা হয়। তিনি তাঁর বাড়ি ছেড়ে যেতে অস্বীকার করেন। জনৈক আস্থাভাজন ব্যক্তিকে তিনি বলেন : ‘আমি যদি পালিয়ে থাকি, তা হলে তারা (পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী) আমাকে খুঁজে বের করার জন্য সমগ্র ঢাকা শহরকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দেবে। জনৈক পাঞ্জাবি অফিসার সাইমন ড্রিংগকে বলেন : ‘আমরা আল্লাহ ও অখণ্ড । পাকিস্তানের নামে যুদ্ধ করছি।’ | সাইমন ড্রিংগ-এর এই রিপাের্ট প্রবাসী বাঙালিদের সংঘবদ্ধ করার ব্যাপারে যথেষ্ট সাহায্য করে। স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণকারীরা এই রিপাের্টটি অমূল্য দলিল হিসেবে ব্যবহার করেন। বিচারপতি চৌধুরী এই রিপাের্টের ‘ক্লিপিং’ তাঁর ব্রিফকেসে রাখেন এবং যখনই কোনাে বিশিষ্ট ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছেন। তাকে একটি ফটোকপি দিয়ে এসেছেন। “ইনার টেম্পল’-এ অধ্যয়নরত আইনের ছাত্র শামসুল আলম চৌধুরী বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে ৩০ মার্চ লন্ডনে পৌছান। তিনি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর হত্যাকাণ্ডকে গণহত্যা আখ্যা দিয়ে কয়েকটি হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দেন। ঢাকার ধানমন্ডি এলাকায় বঙ্গবন্ধুর বাড়ির কাছে তার এক বন্ধুর বাড়িতে তিনি। লুকিয়ে ছিলেন। তার সঙ্গে সাক্ষাঙ্কারের বিবরণ ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড ও ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়।
৩০ মার্চ বিচারপতি চৌধুরী অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর এবং সেন্ট ক্যাথরিন কলেজের অধ্যক্ষ লর্ড এ্যালেন বুলকের সঙ্গে দেখা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের হতাহত শিক্ষক ও ছাত্রদের কথা জানান। তার পরামর্শ অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটিজ অ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারিজেনারেল স্যার হিউ প্রিন্সারের সঙ্গে দেখা করেন। স্যার হিউ ইতােমধ্যে সংবাদপত্রের মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়েছিলেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরােধ অনুযায়ী তিনি হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে এক তারবার্তা পাঠান। অবিলম্বে রক্তক্ষয় বন্ধ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে শান্তি স্থাপন করার জন্য তিনি ইয়াহিয়া খানকে অনুরােধ জানান। ৩১ মার্চ ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক পত্রে তারিক আলী, হামজা আলাভী, মােহাম্মদ আখতার ও নাসিম বাজওয়া পশ্চিম পাকিস্তানের সােশ্যালিস্টদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে অভিনন্দন জানান। সাধারণ নির্বাচনে বাঙালিদের শতকরা ৯৮ ভাগ ভােটপ্রাপ্ত আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করে পূর্ব বাংলার ৭ কোটি অধিবাসীকে দেশদ্রোহিতার অপবাদ দেয়ার জন্য তারা ইয়াহিয়া খানকে নিন্দা করেন। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম শুরু করা ছাড়া বাঙালি জনসাধারণের আর কোন উপায় ছিল না বলে পত্ৰলেখকরা মনে করেন। তারা পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য মি. ভুট্টোকে দায়ী করেন। | উল্লিখিত তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত আরও একটি পত্রে অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমােডর মােহাম্মদ খান জানজুয়া (এম কে জানজুয়া), কর্নেল ইনায়েত হােসেন ও ফরিদ এস্ জাফরী পূর্ব বাংলার জনসাধারণের ইচ্ছা অনুযায়ী। নিজেদের ভাগ্য নির্ধারণের অধিকার মেনে নেয়ার দাবি জানান। শতকরা ৯৮ ভাগ ভােটপ্রাপ্ত পার্টি ও তার নেতার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোেগ চূড়ান্ত । অবমাননাকর বলে তারা মনে করেন।

এপ্রিল, ১৯৭১
১ এপ্রিল ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে ঢাকা থেকে বিমানযােগে করাচিতে নিয়ে আসা হয়েছে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। তিনি কোথায় ও কিভাবে রয়েছেন সে সম্পর্কে পাকিস্তান সরকার নীরব থাকার নীতি গ্রহণ করেছে। | একই তারিখে ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ৩১ মার্চ ভারতীয় পার্লামেন্টে গৃহীত এক প্রস্তাবে পূর্ব বাংলার সাড়ে সাত কোটি জনগণের ঐতিহাসিক অভ্যুত্থান সফল হবে বলে আশা প্রকাশ করা হয়। মিসেস গান্ধী নিজে এই প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন, পূর্ব বাংলার জনগণের প্রতি ভারতীয় জনগণের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এবং তারা সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য প্রস্তুত। | ১৯৮৯ সালে লন্ডনে প্রদত্ত এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ উইমেনস্ এ্যাসােসিয়েশন ইন্ গ্রেট ব্রিটেন’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা মিসেস জেবুন্নেসা বখস্ বলেন : ‘পঁচিশে মার্চ আর্মি ক্র্যাডাউনের আগে থেকেই আমরা বুঝতে পারছিলাম, দেশে ভয়ঙ্কর একটা কিছু হতে যাচ্ছে। এ দেশের খবরের কাগজে কিছু কিছু সংবাদ আসছে। আমরা তাই মহিলাদের পক্ষ থেকে কিছু করার কথা ভাবছিলাম। এরপর এলাে পচিশে মার্চের ভয়াল রাত। আমরা বুঝলাম, আর নয়, অপেক্ষা করার দিন শেষ হয়ে গেছে। এবার রাস্তায় নামতে হবে। এর জন্য চাই একটা সংগঠন। আমরা কয়েকজন আলাপ-আলােচনা করতে থাকলাম। অবশেষে ২ এপ্রিল লোরি রােডে আমার বাড়িতে মিসেস ফেরদৌস রহমান, উর্মি রহমান, লুলু বিলকিস বানু এবং আরাে দু’একজন একত্র হলাম এবং সেদিনই আমাকে কনভেনার করে বাংলাদেশ উইমেনস্ অ্যাসােসিয়েশন ইন্ গ্রেট ব্রিটেন’ (বাংলাদেশ মহিলা সমিতি) প্রতিষ্ঠিত হয়।২৯ ৩ এপ্রিল (শনিবার) বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করা হয়। এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে মিসেস আনােয়ারা জাহান বলেন, সকালবেলা প্রায় তিনশ’ শাড়ি-পরিহিতা বাঙালি মহিলা টেমস্ নদীর উত্তর তীরবর্তী ভিক্টোরিয়া এ্যামব্যাঙ্কমেন্ট এলাকায় সারিবদ্ধ হয়ে বিক্ষোভমিছিলের জন্য তৈরি হন। অনেকের হাতে ছিল প্ল্যাকার্ড। তার একদিকে বড় বড় অক্ষরে ইংরেজিতে লেখা ছিল ‘স্টপ জেনােসাইড’, ‘রেকগনাইজ বাংলাদেশ’, “ইয়াহিয়া’স আর্মি-আউট আউট’ এবং অন্যদিকে বাংলায় লেখা ছিল ‘গণহত্যা বন্ধ কর,’ ‘বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দাও,’ ‘আমার নেতা তােমার নেতা-শেখ মুজিব। শেখ মুজিব, ‘ইয়াহিয়ার আর্মি-ভাগাে ভাগাে।’
কেউ কেউ শিশুদেরও সঙ্গে নিয়ে। এসেছিলেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা শ্লোগানগুলাের সঙ্গে তােমার দেশ আমার দেশ-বাংলাদেশ’ শ্লোগান দিয়ে আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে মহিলারা সুশৃঙ্খলভাবে হােয়াইটহল হয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাড়ির দিকে। এগিয়ে যান। প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে একটি স্মারকলিপি হস্তান্তর করে মিছিল বাকিংহাম প্রাসাদে গিয়ে হাজির হয়। প্রাসাদে কর্মরত অফিসারদের হাতে স্মারকলিপি প্রদান করে মিছিল হাইড পার্কের দিকে এগিয়ে যায়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের চোখেমুখে ছিল দৃঢ় প্রত্যয়ের ছাপ। তারা শপথ নিয়েছেনদেশকে শত্রুমুক্ত করতে হবে এবং প্রয়ােজন হলে ব্যক্তিগত সুখ ও আরাম বিসর্জন দিতে হবে। হাইড পার্কে স্পিকার্স কর্নারের কাছে সমবেত হওয়ার পর নেত্রীস্থানীয় মহিলারা দেশের দুর্দিনে বাঙালি মহিলাদের নিজ নিজ কর্তব্য সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। মহিলাদের এই মিছিল বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লন্ডনে এটাই ছিল বাঙালি মহিলাদের প্রথম মিছিল। উল্লিখিত তারিখে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে ‘দি টাইমস’ ও ‘দি গার্ডিয়ান নিরপরাধ বাঙালিদের নির্বিচারে হত্যার জন্য দায়ী পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর নৃশংসতার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। দি গার্ডিয়ান পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়, পাকিস্তানের তথাকথিত জাতীয় সংহতির মৃত্যু হয়েছে; নির্বিচারে হত্যার মাধ্যমে দুই অংশকে এক করা সম্ভব নয়। ৪ এপ্রিল লন্ডন থেকে প্রকাশিত ‘দি অবজারভার’-এর মস্কো সংবাদদাতা দেব । মুরারকা প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, সােভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগরনি। পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে নিপীড়নমূলক ব্যবস্থা অবিলম্বে প্রত্যাহার ও হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। ৩ এপ্রিল প্রেরিত এক কূটনৈতিক বার্তায় তিনি বলেন, সাম্প্রতিক সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে অধিকাংশ ভােটদাতার সমর্থন লাভের পর বাঙালি নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার সহকর্মীদের গ্রেফতার ও নির্যাতন সােভিয়েত ইউনিয়নের পক্ষে উদ্বেগজনক। শক্তি প্রয়ােগের ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা জটিলতর হবে বলে ।
তিনি বিশ্বাস করেন। এই সমস্যার শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করার জন্য তিনি অনুরােধ জানান। সােভিয়েত প্রেসিডেন্টের আবেদন সম্পর্কিত খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী এনামুল হকসহ (পরবর্তীকালে ডক্টর) লন্ডনস্থ সােভিয়েত দূতাবাসে গিয়ে জনৈক উর্ধ্বতন কূটনীতিবিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।৩২ ৪ এপ্রিল (রােববার) দুপুরবেলা বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে হাইড পার্কে বাংলাদেশের সমর্থনে একটি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশের পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান এই জনসমাবেশে বক্তৃতা করেন। হাইড পার্ক থেকে একটি বিক্ষোভ-মিছিল ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে গিয়ে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ এবং স্ট্রাথাম এলাকার অ্যাকশন কমিটির যৌথ ব্যবস্থাপনায় অনুষ্ঠিত একটি বিরাট জনসভায় যােগ দেয়। এই সভায়। সভাপতিত্ব করেন গাউস খান। সভার কার্য পরিচালনা করেন বি এইচ তালুকদার। কাউন্সিলের জেনারেল সেক্রেটারি হিসেবে শেখ আবদুল মান্নান এবং ঐথাম অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে আহমদ হােসেন জোয়ারদার সভায় বক্তৃতা করেন। অপর বক্তাদের মধ্যে ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ, হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার) ও সাখাওয়াত হােসেন। সভার পর একটি বিক্ষোভ মিছিল ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করে। উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যায় লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড টাউন হলে শ্রমিক দলের প্রভাবশালী সদস্য জন এ্যানালসের সভাপতিত্বে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাের জন্য আহুত এই সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন লর্ড (ফেনার) ব্রকওয়ে, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের, পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস্, শেখ আবদুল মান্নান, লুলু বিলকিস বানু, লন্ডন আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি সুলতান মাহমুদ শরীফ ও বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর সম্পাদক ফরিদ এস, জাফরী। লর্ড ব্রকওয়ে পূর্ব বঙ্গের ব্যাপারে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ দাবি করেন এবং পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীকে কোনাে প্রকার সাহায্য না দেয়ার জন্য শ্রীলঙ্কার । প্রতি আবেদন জানান। পিটার শাের পূর্ব বঙ্গের হত্যাকাণ্ডকে পাকিস্তানের। অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে মেনে নিতে অস্বীকার করেন এবং বিধ্বস্ত এলাকায়। জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক দল পাঠাবার ব্যাপারে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান।
মাইকেল বার্নস শরণার্থীদের সাহায্যদানের ব্যাপারে আলােচনা উপলক্ষে সময় অপচয় না করে পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করা বাঞ্ছনীয় বলে মন্তব্য। করেন। সুলতান শরীফ স্বাধীনতা সগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা বিশ্লেষণ করে বলেন, বাংলাদেশ সম্পূর্ণ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত বাঙালিরা শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে হলেও সংগ্রাম চালিয়ে যাবে। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’ সম্পাদক ফরিদ এস, জাফরী এবং পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী পূর্ব বঙ্গের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেন।৩৪ এই সভায় কোনাে কোনাে বক্তা বাংলাদেশ সংগ্রামকে ভিয়েতনামের সগ্রামের সঙ্গে তুলনা করেন। তাদের বক্তৃতা থেকে বােঝা যায়, বাংলাদেশের জীবনমরণ সংগ্রামে প্রতিবেশী ভারত ও অন্যান্য বন্ধু দেশের সাহায্য তারা প্রত্যাশা করেন। অধিকাংশ শ্রোতা তাঁদের সঙ্গে একমত হন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ মিনিস্টার ফর ওভারসিজ ডেভেলাপমেন্ট রিচার্ড উডের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ইয়ান সাদারল্যান্ড এই সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তিনিও এই সাক্ষাৎকালে উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী মি. উড়কে পূর্ব বঙ্গে রক্তক্ষয় বন্ধ এবং শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য যথাযােগ্য চেষ্টা করার অনুরােধ জানান। মি. উড বলেন, ব্রিটিশ সরকার ইতােমধ্যে পাকিস্তানে নিয়ােজিত ব্রিটিশ হাই কমিশনারের সঙ্গে এই ব্যাপারে যােগাযােগ করেছেন এবং একটি বন্ধু রাষ্ট্রের ওপর যতটা চাপ দেয়া সম্ভব তা তারা নিশ্চয় দেবেন। ৬ এপ্রিল স্যার আলেক পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলীর সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টাব্যাপী আলােচনাকালে পূর্ব বাংলা সম্পর্কে ব্রিটিশ মনােভাব জ্ঞাপন করেন। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ফ্রাঙ্ক জাডের এক চিঠির উত্তরে পাকিস্তান হাই কমিশনার জানান : পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবকে কয়েক দিন আগে গ্রেফতার করেছেন এবং বর্তমানে তিনি আটক রয়েছেন।’ ৬ এপ্রিল ‘দি গার্ডিয়ান ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ৬ এপ্রিল (সােমবার) সকালবেলা জানা যায়, পূর্বদিন রাতে বেশ কিছুসংখ্যক পার্লামেন্ট সদস্য পূর্ব বঙ্গে ‘গৃহযুদ্ধ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ সরকারকে। প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরােধ জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেছেন। এদের মধ্যে ক্রস ডগলাসম্যান, ফ্রাঙ্ক জাড়, নাইজেল ফিসার, এরিক হেফার এবং জন পার্ডোর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
সেদিন বিকেলবেলা পররাষ্ট্রমন্ত্রী আলেক ডগলাস-হিউম পার্লামেন্টে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করেন। ৬ এপ্রিলের মধ্যে ১৬০ জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাব সমর্থন করেন। স্যার আলেকের বক্তব্য বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনকারীদের কিছুটা নিরাশ করে। তিনি বলেন, রাজনৈতিক মতবিরােধ আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে দূর করা বাঞ্চনীয় বলে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ইতঃপূর্বে ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন। আলােচনা ভেঙে যাওয়ার পর সামরিক বল প্রয়ােগ করার জন্য তিনি দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সংঘাত বন্ধ করে পুনরায় আলােচনা শুরু করার জন্য পাকিস্তানের কাছে আবেদন জানান। পার্লামেন্টে স্যার আলেক প্রদত্ত বক্তৃতার সমালােচনা প্রসঙ্গে ৬ এপ্রিল ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, গতকাল স্যার আলেক ডগলাস-হিউম। পূর্ব পাকিস্তানে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার দাবির প্রতি সমর্থন ঘােষণার সুযােগ পেয়েছিলেন। তিনি সে সুযােগের অপচয় করেছেন। তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভিন্ন দলীয় সদস্যরা যে প্রশ্ন তুলেছেন সে সম্পর্কে অবাক হওয়া তার পক্ষে উচিত হবে না। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ভােটের মাধ্যমে শেখ মুজিবকে ক্ষমতা গ্রহণের অধিকার। দিয়েছিল। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবকে সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত করার জন্যই সামরিক অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক নির্যাতন অসঙ্গত—একথা খােলাখুলিভাবে বলতে না পারলে স্যার আলেকের পক্ষে বিবৃতিদান স্থগিত রাখা উচিত ছিল।৩৫ ইতঃপূর্বে টেলিফোন করে বিচারপতি চৌধুরী ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলর ও সম্মানিত শিক্ষাবিদ লর্ড জেমসের সঙ্গে ৬ এপ্রিল সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে মধ্যাহ্নভােজে আমন্ত্রণ জানান। অতিথি হিসেবে প্রায় পনেরােজন অধ্যাপক তাদের সঙ্গে যােগ দেন। লর্ড জেমস্ ও অন্যান্য অধ্যাপকদের সঙ্গে আলােচনাকালে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ আন্দোলনের পটভূমি এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত গণহত্যা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। তিনি বলেন : ‘আমাদের সম-অধিকারের দাবি আজ স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত হয়েছে। আজ আমরা স্বাধীনতা অর্জনের জন্য দৃঢ়সঙ্কল্প। জীবনে কখনাে। রাজনীতির সঙ্গে আমার সম্পর্ক ছিল না। কিন্তু একজন আত্মসম্মানবােধসম্পন্ন বাঙালি হিসেবে আমিও সেই সংগ্রামে যােগদান করেছি। লর্ড জেমস্ বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা শিগগিরই বুঝতে পারবে তারা কি ভুল করেছে।
ছ’ মাসের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন বাংলাদেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হবে বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন।৬ আওয়ামী লীগ পরিচালিত স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে প্রবাসী বাঙালিদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সংযােগ স্থাপন এবং তার ব্যাপকতা সম্পর্কে তাজউদ্দিন আহমদ ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে ৭ এপ্রিল সুলতান মাহমুদ শরীফ, মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু ও মাহমুদ হােসেন লন্ডন থেকে কলকাতা রওনা হন। ব্রিটেনে দূতাবাস স্থাপনের ব্যাপারে সহায়তা করার জন্য তারা প্রায় তিন মাস পর লন্ডনে ফিরে আসেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, পাকিস্তানি নির্যাতন ও মুক্তিযােদ্ধাদের অসীম সাহস সম্পর্কে তিনটি প্রামাণ্য চলচ্চিত্র তারা সঙ্গে নিয়ে এসেছিলেন। এই চলচ্চিত্রগুলাে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটিগুলাের উদ্যোগে প্রদর্শিত হয়। ১০ এপ্রিল বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তি এবং পূর্ব বাংলায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য অনুরােধ জানান। এ ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার যতদূর সম্ভব কূটনৈতিক চাপ দেবেন বলে স্যার আলেক আশ্বাস দেন। তার সঙ্গে প্রায় দেড় ঘণ্টাকাল আলাপের সময় মি, সাদারল্যান্ড ও মি. ব্যারিংটন উপস্থিত ছিলেন। আলােচনাকালে স্যার আলেক জানতে চান, বিচারপতি চৌধুরী কোথায় থাকবেন। বলে স্থির করেছেন। উত্তরে তিনি বলেন : ‘আমি ঠিক করেছি আমার দেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত ব্রিটেনে অবস্থান করবাে, আর স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যাবাে।’ এর উত্তরে স্যার আলেক অনেক কিছু না বলে একটি প্রীতিপূর্ণ হাসি উপহার দিলেন বলে বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন, স্যার আলেক বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল।৩৭ হােয়াইটহলে অবস্থিত পররাষ্ট্র দফতর থেকে বেরিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরী একটি ট্যাক্সি নিয়ে অন্ডউই এলাকায় অবস্থিত বুশ হাউসে বি বি সি’র ওভারসিজ সার্ভিসের বাংলা বিভাগে যান। সিরাজুর রহমান ও শ্যামল লােধ তৈরি হয়েই ছিলেন। তারা বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। এই সাক্ষাৎকারকালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ছাত্রছাত্রী হত্যার কাহিনী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বর্ণনা করে বলেন, বিশ্ববাসীকে এই নৃশংস হত্যার কথা তিনি জানাবেন এবং বাংলাদেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত তিনি দেশে ফিরবেন না। বি বি সি সেদিনই এই সাক্ষাৎকার প্রচার করে। কলকাতার সংবাদপত্রে এই সাক্ষাৎকারের রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। বি বি সির সঙ্গে সাক্ষাঙ্কারের পর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর পক্ষ থেকে পিটার গিল বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন।
উল্লিখিত সাক্ষাৎকারের পর বুশ হাউস ত্যাগ করার সময় স্থানীয় পাকিস্তান দূতাবাসে নিয়ােজিত সেকেন্ড সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমদকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। মহিউদ্দিন বলেন : ‘স্যার, আমি আপনার নির্দেশের অপেক্ষায় রয়েছি। আপনি ডাকলেই আমাকে পাবেন। তখনাে পর্যন্ত প্রবাসী সরকার গঠিত হয় নি। কাজেই বিচারপতি চৌধুরী তাকে তখনই চাকরি ছেড়ে দিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনে যােগ দেয়ার কথা বলেন নি। ১১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত এক সভায় বেঙ্গল স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশ আন্দোলনে জড়িত অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও দলের সঙ্গে সহযােগিতার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে কমিটির সদস্য-সংখ্যা ৩১-এ দাঁড়ায়। কমিটির পক্ষ থেকে এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ দেয়ার জন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্যদের কাছে আবেদন জানানাে হয়। তাছাড়া বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকার করে নিয়ে ইয়াহিয়া সরকারের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার জন্য চেয়ারম্যান মাও সে-তুং-এর কাছে একটি তারবার্তা পাঠানাে হয়। ১২ এপ্রিল অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধি হিসেবে বহুসংখ্যক বাঙালি ছাত্র নিজেদের পতাকা ও স্বাধীনতার দাবি সংবলিত প্ল্যাকার্ড নিয়ে কমিটি ফর নিউক্লিয়ার ডিআরমামেন্ট আয়ােজিত প্রতিবাদ মিছিলে অংশগ্রহণ করে ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসমাবেশে যােগ দেয়। উল্লিখিত তারিখে লন্ডনের জেরার্ড স্ট্রিটে অবস্থিত ‘দি গ্যাঞ্জেস’ রেস্তোরার মালিক তাসাদুক আহমদ বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘মুজিবনগর’-এ অবস্থান গ্রহণকারী ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনযােগে আলাপ করেন। আলাপকালে আমীরুল ইসলাম বলেন, ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত বিচারপতি চৌধুরীর বেতার সাক্ষাৎকারের বিবরণ পড়ে তাজউদ্দিন আহমদ ও তাঁর সহকর্মীরা অত্যন্ত খুশি হয়েছেন। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের মধ্যে যারা ভারতে এসেছেন, তাঁরা শিগগির প্রবাসী সরকার গঠন করবেন এবং তাজউদ্দিন আহমদ হবেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বিদেশে প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি নিয়ােগ করতে চান। তার সম্মতি নেয়ার জন্য আমীরুল ইসলামকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে।
বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করিয়ে দেয়ার জন্য আমীরুল ইসলাম তাসাদুক আহমদকে অনুরােধ করেন। | ১২ এপ্রিল আমীরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার সময় বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘আপনাদের সঙ্গে কোনরূপ যােগাযােগ না হলেও আমি স্বাধীনতা। আন্দোলনে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করে যাচ্ছি। আমি ধন্যবাদের সঙ্গে বিশেষ প্রতিনিধিরূপে কাজ করার সম্মতি জানাচ্ছি। আপনি নেতৃবৃন্দকে আমার সালাম | জানাবেন এবং বলবেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে আমার সাধ্যমতাে সাহায্য করবাে।’ | আমীরুল ইসলাম বললেন : “শিগগিরই শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে এবং তার পরেই। আপনার নিয়ােগপত্র পাঠিয়ে দেয়া হবে। | আমিরুল ইসলামের সঙ্গে কথা বলার পর বিচারপতি চৌধুরী ব্যালহাম এলাকার বাড়ি থেকে উত্তর লন্ডনের ফিঞ্চলি এলাকার একটি বাড়িতে উঠে যান। পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী ব্যালহামের বাড়ির টেলিফোন নম্বর যােগাড় করে। বিচারপতি চৌধুরীকে ডিনারে আমন্ত্রণ জানান। আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করা সত্ত্বেও বারবার তাকে টেলিফোন করা হয়। নিরাপত্তার খাতিরে তিনি বাড়ি বদলাতে বাধ্য হন। ফিঞ্চলির ফ্ল্যাটে এক সপ্তাহ থাকার পর তিনি পশ্চিম লন্ডনের এ্যাকটন এলাকায় একটি ছােট বাড়ি ভাড়া নিয়ে চলে যান। ফিঞ্চলির ফ্ল্যাটে থাকার সময় স্কটল্যান্ড ইয়ার্ড নামে পরিচিত লন্ডন মেট্রোপলিটন পুলিশের হেডকোয়ার্টার্স থেকে পুলিশ অফিসার মি, ল্যাঙ্গলি ও তার সহকর্মী মি, ওয়াকার বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেন। তারা পাকিস্তান সরকারের এক গােপন পরিকল্পনার কথা ফাস করে বলেন, সুযােগ পেলেই পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সাদা পােশাকধারী গুপ্তচররা তাকে অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে যাবে। কাজেই তিনি যেন সাবধানে চলাফেরা করেন। অফিসাররা তাকে ভরসা দিয়ে বলেন, যুক্তরাজ্য সরকার তার নিরাপত্তা সম্পর্কে সাধ্যানুযায়ী সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা। বিচারপতি চৌধুরীর গতিবিধির ওপর নজর রাখবেন। তার টেলিফোন নম্বরের গােপনীয়তা রক্ষা, অপরিচিত লােকের সঙ্গে সাক্ষাৎ এবং বেসরকারি যানবাহনযােগে চলাফেরা সম্পর্কে নানা ধরনের সাবধানতা অবলম্বনের পরামর্শ। দিয়ে বিদায় নেয়ার আগে প্রয়ােজনমতাে ব্যবহার করার জন্য একটি টেলিফোন নম্বর দিয়ে যান। এই নম্বরে টেলিফোন করার কয়েক মিনিটের মধ্যেই তিনি প্রয়ােজনীয় সাহায্য পাবেন। | ১৩ এপ্রিল লন্ডনের ‘দি ওয়াকার্স প্রেস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, গাউস খানের নেতৃত্বে কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশের কয়েকশ’ বাঙালি সমর্থক ১২ এপ্রিল লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীনের সমর্থন প্রত্যাহার করার আবেদন জানায়। কাউন্সিলের পক্ষ থেকে দূতাবাসের কর্মচারীদের হাতে প্রদত্ত এক স্মারকলিপিতে বলা হয়, বাঙালিরা অতীতে তাদের সংগ্রামে চীনকে সমর্থক বলে বিবেচনা করেছে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তাদের বর্তমান নীতির ফলে বাঙালি জনসাধারণ চীনের প্রতি শ্রদ্ধা হারাতে শুরু করেছে। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে বিচারপতি চৌধুরী কমনওয়েলথ সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ এবং অধ্যাপক জিনকিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর মি. স্মিথ জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে একটি ব্যক্তিগত চিঠি লিখে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি ও পূর্ব বঙ্গে রক্তপাত বন্ধ করার জন্য অনুরােধ জানাবেন বলে কথা দেন। | অধ্যাপক জিনকি ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের সদস্য ছিলেন। ১৯৭১ সালে তিনি রক্ষণশীল দলের কমনওয়েলথ গ্রুপের সেক্রেটারি ছিলেন। তার আমন্ত্রণক্রমে বিচারপতি চৌধুরী রক্ষণশীল দলভুক্ত পার্লামেন্ট সদস্যদের এক সভায় বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বক্তৃতা দেন। লর্ড সেলকার্ক এই সভায়। সভাপতিত্ব করেন। মূল বক্তৃতার পর লর্ড সেলকার্ক একটি সহানুভূতিমূলক বক্তৃতা দেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের প্রশ্নের ধারা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থন করেন। ১৩ এপ্রিল ‘দি টাইমস পত্রিকায় যুক্তরাজ্য প্রবাসী ভারতীয় লেখক নীরদ চন্দ্র চৌধুরীর একটি চিঠি প্রকাশিত হয়। চিঠির শুরুতে তিনি বলেন, ব্রিটিশ সংবাদপত্র এবং বেতার ও টিভিতে পূর্ব বঙ্গের ঘটনাবলিকে যেভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, তার বিরুদ্ধে বাঙালি হিসেবে তিনি তীব্র প্রতিবাদ জানাতে বাধ্য হয়েছেন। | ১৯৭০ সালের ৩১ ডিসেম্বর কলকাতার হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় (বর্তমানে অবলুপ্ত) প্রকাশিত তার এক নিবন্ধের উল্লেখ করে মি. চৌধুরী বলেন, তিনি যা আশঙ্কা করেছিলেন তা ঘটেছে। সামরিক শক্তির ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের অচিন্তনীয় শ্রেষ্ঠতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিলে এই শক্তি সাফল্যের সঙ্গে প্রয়ােগ করা হবে। তিনি পূর্ব বাংলার মুসলমানদের এ ব্যাপারে সংযত হওয়ার পরামর্শ দেন। পাকিস্তানের সামরিক আক্রমণ শুরু হওয়ার আগে ঢাকায় সমবেত ব্রিটিশ সাংবাদিকরা যে ধরনের সংবাদ পাঠিয়েছেন, তার ফলে বাঙালি মুসলমানরা চরম পন্থা গ্রহণে উৎসাহিত হয়েছে বলে তিনি দাবি করেন। | মি. চৌধুরী মনে করেন, পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ও সুষ্ঠু শাসনব্যবস্থা। ফিরিয়ে আনা পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর উদ্দেশ্য নয়। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার সম্ভাবনা দূর করে তারা পূর্ব বাংলায় শত্রু-দেশ দখলকারী সৈন্যবাহিনী হিসেবে থাকার চেষ্টা করছে। তাদের এই চেষ্টা সফল হবে এবং অনির্দিষ্টকাল তারা পূর্ব বাংলা দখলে রাখতে সক্ষম হবে। দি টাইমস্’কে উপদেশ দিয়ে তিনি বলেন, আপনাদের উদ্দেশ্য সৎ বলে স্বীকার করে বলতে হচ্ছে, উভয় পক্ষের মধ্যে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের জন্য আপনারা যে পরামর্শ দিয়েছেন তা বাস্তবায়ন অসম্ভব। উপসংহারে তিনি বলেন, বাঙালিদের প্রতিরােধ বৃদ্ধির সহায়ক কোনাে কিছু না করাই হবে দয়ালু মনােভাবের পরিচায়ক। উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত অপর এক চিঠিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. রমেশ চন্দ্র মজুমদার ও কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এস এন সেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে যে হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় তার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন।
১৪ এপ্রিল ‘দি ওয়ার্কার্স প্রেস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানের সংহতি বজায় রাখার জন্য ইয়াহিয়া খানের প্রচেষ্টাকে অভিনন্দন জানিয়ে চৌ এন-লাই এক বাণী পাঠিয়েছেন। বাণীতে বলা হয়, পাকিস্তানে এখন যা ঘটছে তা মূলত তাদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে চীন সরকার মনে করে। ভারতের সম্প্রসারণবাদীরা যদি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক অভিযান শুরু করে তা হলে চীনের জনসাধারণ ও সরকার পাকিস্তান সরকারের পক্ষ সমর্থন করবে। ইতােমধ্যে পাকিস্তান থেকে লন্ডনে প্রাপ্ত এক সংবাদে জানা যায়, জুলফিকার আলী ভুট্টো ও মওলানা মওদুদী বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থনদানের জন্য। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার কমােডর এম কে জানজুয়া, তারিক আলী, ফরিদ জাফরী, হামজা আলভী ও অন্য পাকিস্তানিদের রাষ্ট্রদ্রোহী বলে প্রকাশ্যে নিন্দা করেন। উগ্রপন্থী পাকিস্তানি মােল্লারা তারিক আলী ও ফরিদ জাফরীকে কাফের বলে বর্ণনা করে। এপ্রিল মাসের প্রথমদিকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পৃথকভাবে দেখা করে তাদের দলের নেতৃত্ব গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ জানান। তার স্মৃতিকথায় তিনি বলেন, ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলামের সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলার পর তিনি দৃঢ়ভাবে অনুভব করেন, তাঁর পক্ষে কোনাে দল বা সমিতির কর্মকাণ্ডে যােগ দেয়া উচিত হবে না। বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি বিভিন্ন দলের সংগ্রামী স্পৃহা ও প্রচেষ্টাকে সমন্বিত করার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। অতএব, তিনি নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীনতার জন্য কাজ করবেন। গাউস খানের অনুরােধক্রমে শেখ আবদুল মান্নান বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে তাকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের নেতৃত্ব গ্রহণ করার অনুরােধ জানান। কাউন্সিলের সাফল্য কামনা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, তিনি কোনাে বিশেষ দল বা প্রতিষ্ঠানে যােগ দেবেন না। নির্দলীয় ব্যক্তি হিসেবে স্বাধীনতার জন্য তিনি কাজ করবেন বলে স্থির করেছেন। স্মৃতিচারণ উপলক্ষে ইন্টারন্যাশনাল স্টুডেন্টস্ হাউসের প্রেসিডেন্ট আনিস রহমান বলেন, এপ্রিল মাসের গােড়ার দিকের এক সন্ধ্যায় তিনি এবং তার কয়েকজন বন্ধু-বান্ধব ফজলে রাব্বি মাহমুদ হাসানের আর্লস্ কোর্টের বাড়িতে বসে বাংলাদেশ পরিস্থিতি নিয়ে আলাপ-আলােচনা করছিলেন। কিছুদিন যাবৎ তারা বিভিন্ন দল-উপদলগুলাের কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের জন্য নির্দলীয় কোনাে ব্যক্তিত্বের শরণাপন্ন হওয়ার কথা ভাবছিলেন। স্বভাবতই তারা বিচারপতি চৌধুরীর কথা চিন্তা করেন। ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের নির্বিচারে হত্যার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে বিচারপতি চৌধুরীকে তারা উপযুক্ত ব্যক্তিত্ব বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আনিস রহমান তখনই তাকে টেলিফোন করে স্বাধীনতা আন্দোলনে নেতৃত্বদানের জন্য অনুরােধ জানান। বিচারপতি চৌধুরী একটু ইতস্তত করে বললেন : ‘আমার কি কোনাে রাজনৈতিক দলে যােগ দেয়া উচিত হবে?” আনিস রহমান বললেন : স্যার, এটা এখন আর রাজনীতি পর্যায়ে নেই; এটা। বাংলাদেশের জনগণের অস্তিত্বের প্রশ্ন। বিচারপতি চৌধুরী কথাটা মেনে নিয়ে আধঘণ্টার মধ্যেই আর্লস্ কোর্টে এসে হাজির হন। সেদিন যে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়, তার ভিত্তিতে কিছুকাল পর অ্যাকশন কমিটিগুলােকে নেতৃত্বদানের উদ্দেশ্যে – একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হয়। ১৬ এপ্রিল লন্ডনের হলওয়ে এলাকায় ব্যারিস্টার রুহুল আমিনের বাড়িতে একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটি ও রাজনৈতিক দলের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সপক্ষে তাদের কার্যকলাপের বিবরণ দেন।৫ এই বৈঠকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট গাউস খান বলেন, আন্দোলনের স্বার্থে প্রয়ােজন হলে তিনি পদত্যাগ করবেন। বিচারপতি চৌধুরী প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজি হলে তিনি বিনা দ্বিধায় তার সঙ্গে কাজ করবেন। বিচারপতি চৌধুরীর পক্ষে কোনাে প্রতিষ্ঠানে যােগদান করা কেন সম্ভব নয় তা তিনি ব্যাখ্যা করেন এবং স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যাবলির সমন্বয় সাধনের উদ্দেশ্যে একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের আবেদন জানান। রাত দুটো পর্যন্ত আলােচনার পরও কমিটির কাঠামাে তৈরি করা সম্ভব হয় নি। পরদিন আবার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের ব্যাপারে একমত না হলে তিনি আর ঘরােয়া বৈঠকে। যযাগদান করবেন না। তা সত্ত্বেও সেদিন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। ১৬ এপ্রিল (শুক্রবার) ব্রিটেনের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউ স্টেটসম্যান’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত ‘দি ব্লাড অব বাংলাদেশ’ শীর্ষক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, রক্তের বিনিময়ে যদি স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়, তা হলে বাংলাদেশ অত্যধিক রক্ত দিয়েছে। জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সরকারের পতন এবং দেশের সীমান্ত পরিবর্তনের উদ্দেশ্যে যেসব সংগ্রাম পরিচালিত হয়েছে, তাদের মধ্যে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সবচেয়ে বেশি রক্তক্ষয়ী ও স্বল্পকাল স্থায়ী বলে প্রমাণিত হতে পারে। পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রাম সাময়িকভাবে পরাজিত হতে পারে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম ন্যায়সঙ্গত বলে স্বীকৃতি পাবে।৪৬ উল্লিখিত তারিখে ব্রিটেনের বামপন্থী রাজনৈতিক দল ‘দি সােস্যালিস্ট লেবার লীগ”-এর উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনের টয়েনবি হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। আশাতীত জনসমাগমের ফলে বহু বাঙালি শ্রোতা হলের বাইরে দাঁড়িয়ে থাকতে বাধ্য হন।
সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার এবং শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করা হয়। তাছাড়া বাংলাদেশে গণহত্যা সংগঠনের জন্য রক্তপিপাসু ইয়াহিয়া চক্র ও তার সমর্থক চীনের তীব্র নিন্দা করা হয়। ১৮ এপ্রিল ‘দি অবজারভার পত্রিকায় ‘মুজিবনগর সরকার গঠনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার বৈদ্যনাথতলায় আয়ােজিত এক বিশেষ অনুষ্ঠানে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ শপথ গ্রহণ করেন। প্রায় পাঁচ হাজার বাঙালি এই অনুষ্ঠান উপলক্ষে সমবেত হন। মুক্তিবাহিনীর রাইফেলধারী তরুণরা বাংলাদেশ সরকারের সদস্য, বিদেশী সাংবাদিক ও অতিথিদের নিরাপত্তার দায়িত্ব গ্রহণ করে। | ১৮ এপ্রিল ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারের বিবরণ প্রকাশিত হয়। পূর্ববর্তী সপ্তাহে ‘ম্যানড্রেক গৃহীত এক। সাক্ষাঙ্কারকালে বিচারপতি চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের হৃদয়বিদারক বিবরণ দিয়ে বলেন, এরপর অখণ্ড পাকিস্তানের আদর্শ মরীচিকা মাত্র। তিনি আরও বলেন, দু’সপ্তাহ যাবৎ ক্রমাগত বােমা ও গােলাগুলির সাহায্যে জনসাধারণকে নির্বিচারে হত্যার পর পূর্ব বাংলার ভয়াবহ পরিস্থিতিকে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার বলে গণ্য করা চলবে না।। উল্লিখিত তারিখে ঔপনিবেশিক স্বাধীনতা আন্দোলনের (মুভমেন্ট ফর। কলােনিয়াল ফ্রিডম) উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ হিটলার আমলের পর দুনিয়ার ইতিহাসে সবচেয়ে অনুভূতিহীন ও বর্বরতম আক্রমণ বলে পরিগণিত হবে। সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশকে স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের দাবি জানানাে হয়। পরাধীনতার বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তীকালে “লিবারেশন নামে পরিচিত হয়। ১৮ এপ্রিল (রােববার) পূর্ব লন্ডনে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রায় পাঁচশ’ বাঙালি শ্রমিক এই সভায় যােগদান করেন। সেদিন বিকেলবেলা লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত এক জনসমাবেশেও প্রায় পাঁচ হাজার লােক যােগদান করেন। বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট তােজাম্মেল হক (টনি) তাঁর বক্তৃতায় বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে “জনযুদ্ধ’ বলে ঘােষণা করেন। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই। জনসমাবেশের পর একটি বিক্ষোভ মিছিল ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। উল্লিখিত তারিখে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যানের নেতৃত্বে “জাস্টিস ফর ইস্ট বেঙ্গল’ শীর্ষক একটি কমিটি গঠন করা হয়।
১৯ এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ হতে আগত শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য কলকাতা রওনা হন। ইতােমধ্যে বিচারপতি চৌধুরী কয়েকজন সমমনা বাঙালিসহ পার্লামেন্ট হাউসে গিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। এদের মধ্যে ছিলেন পিটার শাের, ব্রুস ডগলাসম্যান, মাইকেল বার্নস্ ও জন স্টোনহাউস। তারা প্রবাসী বাঙালিদের সম্মিলিতভাবে আন্দোলন গড়ে তােলার ওপর জোর দেন। তৃতীয় সপ্তাহের গােড়ার দিকে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস্ পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের যুক্তরাজ্য সফর বাতিল করার দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। তার প্রস্তাবের সমর্থনে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর গণহত্যামূলক অভিযানের পর পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের সফর ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’র সঙ্গে তুলনীয়। ১৯ এপ্রিলের মধ্যে বিভিন্ন দলভুক্ত ত্রিশজন পার্লামেন্ট সদস্য এই প্রস্তাবের পক্ষে স্বাক্ষরদান করেন। ২০ এপ্রিল ব্রিটিশ হাউস অব কমন্সের বিরােধীদলের নেতা হ্যারল্ড উইলসনের এক প্রশ্নের উত্তরে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেন, যথাসময়ে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তিনি পূর্ণ বিবৃতি পার্লামেন্টে পেশ করবেন। মি. উইলসন পূর্ব বাংলায় গণহত্যা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ পরিদর্শক টিম পাঠানাের জন্য প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ করেন। উদারনৈতিক দলের সদস্য ডেভিড স্টিলের এক প্রশ্নের উত্তরে মি. হিথ বলেন, ব্রিটিশ সরকার সংঘর্ষের অবসান এবং সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অনুসন্ধানের জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের স্বাধীনতা থাকা বাঞ্ছনীয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য উইলিয়াম হ্যামিলটন বলেন, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে অবিলম্বে ব্রিটিশ সরকারের তীব্র নিন্দা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা উচিত। শ্রমিকদলের নেতৃস্থানীয় সদস্য পিটার শাের পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী অনুসৃত নিষ্ঠুর দমননীতি পরিহারের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের নীতি-নির্ধারণের উদ্দেশ্যে পার্লামেন্টে জরুরি আলােচনা অনুষ্ঠানের দাবি জানান। ২০ এপ্রিল ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ‘বিচ্ছেদপন্থী নেতা শেখ মুজিব ও পাকিস্তান-বিরােধী ষড়যন্ত্রে জড়িত তাঁর সহকর্মীদের বিচারের জন্য ইসলামাবাদে একটি বিশেষ ট্রাইবুনাল গঠনের উদ্যোগ। নেয়া হয়েছে। করাচি থেকে প্রেরিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশ নামের একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গঠনের উদ্দেশ্যে বেআইনি ঘােষিত আওয়ামী লীগের নেতাদের ভারতের সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার নিশ্চিত প্রমাণ পাকিস্তান সরকারের হাতে রয়েছে বলে একটি আধাসরকারি সূত্র দাবি করে।
১৯৬০-এর দশকে ব্রিটেনের বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী বামপন্থী পাক্ষিক ‘দি রেড মৌল’-এ প্রকাশিত এক নিবন্ধে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্র ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে দায়ী বলে ঘােষণা করেন। এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে সমর্থনদানের জন্য তিনি মাওপন্থী চীনের কঠোর সমালােচনা করেন। ‘ এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের কর্মসূচি তৈরি করার উদ্দেশ্যে পাক্ষিক ‘পিস নিউজ পত্রিকার অফিসে একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মিস মারিয়েটা প্রকোপে ও পত্রিকাটির সম্পাদক। যুক্তরাজ্যস্থ বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুদ্দিন চৌধুরী (মানিক) ও খােন্দকার মােশাররফ এই বৈঠকে যােগ দেন। কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার পর ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ শীর্ষক একটি প্রতিষ্ঠান গঠনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২০ এপ্রিল আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা আনুষ্ঠানিকভাবে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ প্রতিষ্ঠা করেন। পূর্ব বাংলা থেকে অবিলম্বে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহারের দাবির ভিত্তিতে শক্তিশালী আন্দোলন গড়ে তােলা এবং বাস্তুহারা বাঙালিদের সাহায্যদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ। প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য বলে ঘােষণা করা হয়। পল কনেটের নেতৃত্বে তরুণ শিক্ষয়িত্রী মিস মারিয়েটা প্রকোপে ক্লিয়ারিং হাউস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় তার বাড়িতে প্রতিষ্ঠানটির অফিস স্থাপন করা হয়। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মাইকেল বার্নস এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। ২৩ এপ্রিল কলকাতায় এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রক্স ডগলাসম্যান বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের অর্থনৈতিক বিধিনিষেধ প্রয়ােগ করা উচিত। তিনি আরও বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে সংঘটিত মার্কিন সৈন্যবাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের মতাে বহু ঘটনা পূর্ব বাংলায় প্রতিনিয়ত ঘটছে। কয়েক দিন আগে মি, ডগলাসম্যান তার পার্লামেন্টারি সহকর্মী মি. স্টোনহাউসসহ পূর্ব বাংলা থেকে আগত শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য কলকাতায় পৌঁছান। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কিত কার্যকলাপের সমন্বয় সাধনের ব্যাপারে যুক্তরাজ্যের অ্যাকশন কমিটিগুলাের কর্তব্য নির্ধারণের জন্য এপ্রিল মাসের তৃতীয় সপ্তাহে পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে নেতৃস্থানীয় বাঙালিদের একটি বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা মতিউর রহমান চৌধুরী (‘দিলশাদ’ রেস্তোরাঁর মালিক) হলের ব্যয়ভার বহন করেন। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা এই। বৈঠকে যােগ দেন। পরপর তিন রাত আলােচনার পর ২৩ এপ্রিলের বৈঠকে। কভেন্ট্রি শহরে পরদিন (২৪ এপ্রিল) অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই সম্মেলনে অ্যাকশন কমিটিগুলােকে নেতৃত্বদানের জন্য একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা হবে বলে ঘােষণা দেয়া হয়।
উল্লিখিত বৈঠকে কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’র সভাপতি গাউস খানসহ কেন্দ্রীয় কমিটির ১১জন সদস্য পদত্যাগ করবেন বলে ঘােষণা করেন। যুক্তরাজ্যের প্রত্যেকটি অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের কভেন্ট্রি সম্মেলনে যােগদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়। সভার উদ্যোক্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে সম্মেলনে উপস্থিত থাকার জন্য সনির্বন্ধ অনুরােধ জানান। কভেন্ট্রি সম্মেলন অনুষ্ঠানের আয়ােজন করার দায়িত্ব যারা নিয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), দবীরউদ্দিন (লুটন), শামসুর রহমান (পূর্ব লন্ডন), আজিজুল হক ভূঁইয়া (বার্মিংহাম), মনােয়ার হােসেন (ইয়র্কশায়ার), এ এম তরফদার (ব্র্যাডফোর্ড) এবং শেখ আবদুল মান্নান (লন্ডন)। | ২৪ এপ্রিল ‘দি টাইমস্-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিম বঙ্গের নকশালপন্থীরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরােধিতা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। নকশালপন্থীদের দেয়ালপত্রে দাবি করা হয়, পূর্ব বাংলায় তথাকথিত বিপ্লব চীনের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদীদের ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয়। উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, উগ্র মাওপন্থী নেতা মােহাম্মদ তােয়াহা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরােধিতার পথ পরিত্যাগ করেছেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাক্ষরিত নিয়ােগপত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে বহির্বিশ্বে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনার দায়িত্ব অর্পণ করা হয়। ২৩ এপ্রিল লন্ডনে বসবাসরত বাঙালি ব্যবসায়ী রকিবউদ্দিন তাকে টেলিফোনে জানান, কলকাতা থেকে তার নিয়ােগপত্র তিনি সঙ্গে নিয়ে ফিরে এসেছেন। সেদিন দুপুরবেলা বিচারপতি চৌধুরী এনামুল হকসহ রকিবউদ্দিনের রেস্তোরায় যান। মধ্যাহ্নভােজনের সময় নিয়ােগপত্রখানি তার হাতে দেয়া হয়। বিচারপতি চৌধুরী তাকে নিয়ােগপত্রখানি কভেন্ট্রি সম্মেলনে পড়ে শােনানাের জন্য অনুরােধ করেন। কারণ, এই নিয়ােগপত্র থেকে পরিষ্কার বােঝা যাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তাঁর পক্ষে কোনাে বিশেষ দল বা প্রতিষ্ঠানে যােগদান করার প্রশ্ন অবান্তর।৫০ বৃহত্তর লন্ডনের ১৪টি কমিটির ১৪ জন প্রতিনিধি এবং নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন, তৈয়েবুর রহমান, আজিজুর রহমান, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন, জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, জাকারিয়া খান চৌধুরী, মতিউর রহমান চৌধুরী এবং শেখ আবদুল মান্নান একটি কোচযােগে ২৪ এপ্রিল (শনিবার) কভেন্ট্রি শহরে পৌঁছান। স্থানীয় একটি মিলনায়তনে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১২৫ জন প্রতিনিধি ও ২৫ জন পর্যবেক্ষক যােগদান করেন। সকল দলের পক্ষ থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে | সম্মেলনে সভাপতিত্ব করার অনুরােধ জানানাে হয়। তিনি তাতে রাজি না হয়ে সভানেত্রী হিসেবে লুলু বিলকিস বানুর নাম প্রস্তাব করেন। মিসেস বানু বাংলাদেশ। মহিলা সমিতির প্রতিনিধি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন।
এ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘সভার শুরুতেই সকল দলের পক্ষ থেকে আমাকে সভাপতিত্ব করতে বলা হয়। আমি চিন্তা করে দেখলাম, যদি এই সভা কোনাে কারণে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনে ব্যর্থ হয়, অথবা গঠিত হলেও যদি ভেঙে যায় তবে ইউরােপীয় বা অন্যদের কাছে বাঙালিদের হয়ে কথা বলার অধিকার কিছুটা বাধা পাবে। আমি অসম্মতি জ্ঞাপন করে বেগম লুলু বিলকিস বানুর নাম সভানেত্রী হিসেবে উল্লেখ করি ।… আমার কথায় তিনি রাজি হয়ে গেলেন। সভার কাজ শুরু হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরীর জন্য ‘মুজিবনগর সরকার প্রদত্ত নিয়ােগপত্র পড়ে শােনানাে হয়। মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে বিশিষ্ট ব্যবসায়ী রকিব উদ্দিন পত্রখানি আনুষ্ঠানিকভাবে তার হাতে তুলে দেন। বিচারপতি চৌধুরী তার উদ্বোধনী বক্তৃতায় সকল দলের সমর্থনপুষ্ট ও সকলের বিশ্বাসভাজন একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের জন্য আবেদন জানান। প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির সদস্যদের নামের তালিকা তৈরি করার ব্যাপারে অচলাবস্থা দেখা দেয়। বহু আলাপ-আলােচনা পর ‘অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে’ নামের একটি সংগঠন। প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব গৃহীত হয়। সংগঠনের কার্য পরিচালনার জন্য পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হিসেবে ১. আজিজুল হক ভুইয়া, ২. কবীর চৌধুরী, ৩. মনােয়ার হােসেন, ৪. শেখ আবদুল মান্নান, ৫. শামসুর রহমানের নাম ঘােষণা করা হয়। এই পাঁচজনের ওপর আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং বৃহত্তর কমিটি গঠনের দায়িত্ব দেয়া হয় । তাছাড়া স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম বৈঠকে একজন আহ্বায়ক নিয়ােগ করা হবে। বলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। অপর এক প্রস্তাবে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায়। সংগঠিত অ্যাকশন কমিটিগুলােকে কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির শাখার মর্যাদা দেয়া হয়। | কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানানাে হয়। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে নিয়ােজিত থাকাকালে অন্য কোনাে পদ গ্রহণ করা তাঁর পক্ষে অনুচিত হবে বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। তার ফলে সম্মেলনে স্থির করা হয়, কেন্দ্রীয় কমিটি তার সঙ্গে পরামর্শ করে কাজ করবে। কভেন্ট্রি সম্মেলনে রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে শুধু আওয়ামী লীগ ও ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের নেতা ও কর্মীরা যােগ দিয়েছিলেন তা নয়। সাধারণত বামপন্থী হিসেবে পরিচিত রাজনৈতিক কর্মীরাও সম্মেলনে যােগ দেন। এদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, জগলুল হােসেন, ব্যারিস্টার লুৎফুর রহমান শাজাহান, আবু মুসা, মেসবাহউদ্দিন ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন। বামপন্থীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন মাওপন্থী। এদের মধ্যে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ। ছিলেন স্পষ্টভাষী।৫২
কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডনে ফিরে আসার পথে শেখ আবদুল মান্নান ‘কাউন্সিল ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে ভেঙে দিয়ে লন্ডন এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির একটি শাখা গঠনের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রিটে হাফেজ মনির হােসেনের দোকানে একটি সভার আয়ােজন করা হয়। এই সভায় উপস্থিত ছিলেন শামসুর রহমান (সভাপতি), জিল্লুর রহমান, আমীর আলী, ড. নুরুল হােসেন, মিনহাজউদ্দিন এবং আরাে অনেকে। নেতৃস্থানীয় একজন প্রস্তাবিত লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট হিসেবে মিনহাজউদ্দিনকে নির্বাচনের অনুরােধ জানান। শেখ মান্নান। প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারি হিসেবে যথাক্রমে গাউস খান ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেনের নাম প্রস্তাব করেন। তারা দুজনেই অনুপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলােচনার পরও শেখ মান্নানের প্রস্তাব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সম্ভব হয় নি। তখন মিনহাজউদ্দিন আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়ে গাউস খান সম্পর্কিত প্রস্তাব মেনে নেন। সাখাওয়াত হােসেন সম্পর্কিত প্রস্তাব সবাই মেনে নেন। গাউস খান খুশি হন নি। তিনি আশা করেছিলেন কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটিতে তার স্থান হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজি হন। কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য তিনি ৫৮ নম্বর বেরিক স্ট্রিটে তার রেস্তোরার উপরতলায় একটি রুমও দিয়েছিলেন। এই শাখা কমিটি ‘লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’ নাম গ্রহণ করে। আমীর আলীর সম্পাদনায় কমিটির মুখপত্র হিসেবে ‘জয় বাংলা শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকার ৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পর লন্ডন কমিটি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে ‘গ্রেটার লন্ডন কমিটি’ নাম গ্রহণ করে। সংবিধান প্রণয়নের পর বিভিন্ন কারণে কমিটির সদস্যদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা দেয়। সাখাওয়াত হােসেন সেক্রেটারি পদ থেকে ইস্তফা দেন। আমীর আলীও কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। অনতিবিলম্বে স্টিয়ারিং কমিটির প্রথম সভা ২১ নম্বর রােমিলি স্ট্রিটে অবস্থিত একটি রেস্তোরার বেসমেন্টে অনুষ্ঠিত হয়। লুলু বিলকিস বানু সভাপতিত্ব করেন। ম্যাঞ্চেস্টার থেকে কবীর চৌধুরী (পরবর্তীকালে ড. কবীর চৌধুরী), ব্র্যাডফোর্ড থেকে মনােয়ার হােসেন, বার্মিংহাম থেকে আজিজুল হক ভুইয়া এবং লন্ডন থেকে। শামসুর রহমান ও শেখ আবদুল মান্নান সভায় যােগদান করেন। বিচারপতি। চৌধুরীর উপস্থিতিতে সভার কাজ শুরু হয়। আলাপ-আলােচনার বিষয়বস্তু ও সিদ্ধান্ত গােপন রাখা সম্ভব হবে না আশঙ্কা করে বিচারপতি চৌধুরী অবিলম্বে একটি অফিস স্থাপনের প্রস্তাব করেন।
২৬ এপ্রিল মার্কিন সাপ্তাহিক ‘নিউজউইক পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি। হত্যাযজ্ঞের পুরাে পৃষ্ঠাব্যাপী বিবরণের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাম্প্রতিক ফটোগ্রাফ। প্রকাশিত হয়। করাচি বিমানবন্দরের লাউঞ্জে বন্দি অবস্থায় তার ফটোগ্রাফ গ্রহণ করা হয়। গম্ভীরভাবে তিনি একটি সােফায় বসে রয়েছেন; দু’পাশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর দু’জন জোয়ান তাঁকে পাহারা দিচ্ছে। ২৭ এপ্রিল স্থানীয় পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত প্রবীণ অফিসার হাবিবুর রহমানকে বিনা নােটিশে পদচ্যুত করা হয়। তিনি সাত বছর যাবৎ উক্ত পদে নিয়ােজিত ছিলেন। ২৮ এপ্রিল সন্ধ্যায় এক হাজারেরও বেশি প্রবাসী বাঙালি লন্ডনের মে ফেয়ারে অবস্থিত ইংলিশ স্পিকিং ইউনিয়নের হেডকোয়ার্টার্সে আয়ােজিত এক সংবর্ধনায় যুক্তরাজ্য সফররত পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের সদস্যদের যােগদানে বাধা সৃষ্টি করেন। স্টিয়ারিং কমিটি এবং কয়েকটি স্থানীয় অ্যাকশন কমিটি এই বিক্ষোভের আয়ােজন করে। প্রায় ৫০জন পুলিশের সহায়তায় ক্রিকেটারদের হলের ভেতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হয়। চব্বিশজন বাঙালি বিক্ষোভকারীকে এই উপলক্ষে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ এপ্রিল শেখ আবদুল মান্নানের বাড়িতে স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে কমিটির কর্তব্য, কর্মপদ্ধতি ও কৌশল সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। কবীর চৌধুরী কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে শেখ মান্নানের নাম প্রস্তাব করেন। বাকি সদস্যরা তাকে সমর্থন করেন। শেখ মান্নান পরবর্তীকালে বলেন, নিজের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে সচেতন ছিলেন বলে তিনি তার চেয়ে কম বয়স্ক কাউকে আহ্বায়ক নিয়ােগ করার অনুরােধ জানান। বিচারপতি চৌধুরী তাকে বলেন : আপনি অভিজ্ঞ, আপনি রাজনীতি করেছেন, বাকি চারজন রাজনীতি করেন নি। অতএব, আপনার এই দায়িত্ব নেয়া উচিত।’ শেখ মান্নান তাকে বুঝিয়ে বলেন : কাজটা যদি আমি করি, নামটা আমি নিতে চাই না। আমি অঙ্গীকার করছি, কাজ আমি করবাে।’ তখন আজিজুল হক ভূঁইয়াকে আহ্বায়ক নিয়ােগ করা হয়। | তিন সপ্তাহের মধ্যে আজিজুল হক ভূঁইয়া মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে প্রত্যক্ষ আলােচনার জন্য কলকাতা চলে যান। তিন মাস পর তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। তার অনুপস্থিতিতে শেখ মান্নান কমিটির আহ্বায়ক ও অফিস পরিচালকের দায়িত্ব। | পালন করেন।
কিছুকাল পর ইয়র্কশায়ার অঞ্চলের প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ব্র্যাডফোর্ডের মনােয়ার হােসেন সম্পর্কে জটিলতা দেখা দেয়। শেফিল্ড, ব্র্যাডফোর্ড ও লিডস থেকে দলে দলে লােকজন এসে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, মনােয়ার হােসেন নাকি জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে এক তারবার্তায় পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন। তাকে অবিলম্বে সরিয়ে দিতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী প্রথমে এই দাবি উপেক্ষা করেন। পরপর। বিভিন্ন প্রতিনিধিদল লন্ডনে এসে একই দাবি পেশ করার ফলে বিচারপতি চৌধুরী বিভ্রান্ত হন। মনােয়ার হােসেন ছিলেন ইয়র্কশায়ারের প্রথম নির্বাচিত বাঙালি কাউন্টি কাউন্সিলার। পাকিস্তানিদের ভােট নিয়ে তিনি নির্বাচিত হয়েছেন বলেই তাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। কিন্তু তিনি উল্লিখিত তারবার্তা পাঠান নি বলে। শেখ মান্নান মনে করেন। তার (শেখ মান্নান) আপত্তি থাকা সত্ত্বেও বিচারপতি চৌধুরী সঙ্কট এড়ানাের জন্য স্টিয়ারিং কমিটির বৈঠকে নিম্নে বর্ণিত সিদ্ধান্ত গ্রহণের পরামর্শ দেন। এরপর থেকে মনোেয়ার হােসেন কমিটির বৈঠকে যােগদান করবেন। , শুধু টেলিফোনে শেখ মান্নানের সঙ্গে যােগাযােগ করবেন, লন্ডনে এসে কমিটির কাগজপত্র নিয়ে যাবেন এবং কোচভর্তি লােকজন নিয়ে এসে বিক্ষোভ-মিছিল ও জনসভায় যােগ দেবেন। যেভাবে তিনি স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য হয়েছেন সেভাবেই থাকবেন। মনােয়ার হােসেন ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন।৫৫
মে, ১৯৭১
১ মে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের কাছে লিখিত এক পত্রে বিরােধীদলীয় নেতা হ্যারল্ড উইলসনের অন্যতম পার্লামেন্টারি প্রাইভেট সেক্রেটারি ফ্র্যাঙ্ক জাড পাকিস্তানকে সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানান। পশ্চিম বঙ্গ সফর শেষে লন্ডনে ফিরে এসে ব্রুস ডগলাসম্যান ১ মে দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতাকে বলেন, শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার পর মুক্তাঞ্চলে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সে সম্পর্কে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারি মি. রয়ালের সঙ্গে আলােচনা করেছেন। লন্ডনের কোনাে কোনাে পত্রিকায় প্রকাশিত বিভ্রান্তিমূলক সংবাদের প্রতিবাদ করে তিনি বলেন, যশাের জেলায় মুক্তিযােদ্ধারা তাদের আক্রমণ অব্যাহত রেখেছে। পূর্ব বঙ্গের সঙ্কট পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার নয় বলে তিনি স্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করেন। মি. রয়ালের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে জন। স্টোনহাউসও উপস্থিত ছিলেন। | ব্রিটেন সফরকারী পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে প্রবাসী বাঙালিদের বিক্ষোভের ফলে ক্রীড়ামােদীরা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি হারাতে পারে বলে ১ মে দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় নিবন্ধে আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। বাঙালিদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার পদদলিত করার বিরুদ্ধে আমেরিকা ও ব্রিটেনসহ গণতন্ত্রের আন্তর্জাতিক সমর্থকরা প্রতিবাদ করবে বলে আশা করা স্বাভাবিক। কিন্তু তারা প্রকাশ্যে উচ্চবাচ্য করেনি। কাজেই বাঙালিদের পক্ষে বিক্ষোভ প্রদর্শন করা ছাড়া আর কোনাে উপায় নেই বলে উক্ত নিবন্ধে মন্তব্য করা হয়। ১ মে উরস্টার শহরে পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের প্রথম ম্যাচের বিরুদ্ধে প্রায় ছ’শ বাঙালি পুরুষ ও মহিলা শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির বার্মিংহাম শাখার প্রেসিডেন্ট জগলুল পাশার নেতৃত্বে এই বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে কোচযােগে আগত প্রায় একশ’ বাঙালি ছাত্র ও যুবক এই বিক্ষোভে যােগদান করে। নিরাপদ পরিবেশে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস স্থাপনের জন্য শেখ আবদুল মান্নান ও তার সহকর্মীরা চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। মে মাসের গােড়ার দিকে। ড, মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার ও হারুন-অর-রশীদ শেখ মান্নানের সঙ্গে দেখা করতে আসেন। ড. জোয়ারদার বলেন, বহির্বিশ্বের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গের রফতানি বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে হেন্ডন অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট হারুন-অররশীদের পাট-রফতানি ব্যবসাও বন্ধ হয়ে গেছে। পূর্ব লন্ডনের ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রিটে অবস্থিত দোতলা দালানে তার অফিস তিনি আর চালাতে পারছেন না।
তার অফিসে তিনটি টেলিফোন, টেবিল, টাইপ-রাইটার এবং অফিসের জন্য প্রয়ােজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র রয়েছে। স্টিয়ারিং কমিটির জন্য নেয়া হলে তিনি অফিসটির জন্য যে ভাড়া দিচ্ছেন, তাই দিতে হবে। ভাড়া নেয়া সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর সম্মতি পাওয়ার পর ৩ মে গােরিং স্ট্রিটে স্টিয়ারিং কমিটির অফিস খােলা হয়।৫৬ নতুন অফিসে বিচারপতি চৌধুরীর উপস্থিতিতে স্টিয়ারিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। শামসুল আলম চৌধুরী অফিস সেক্রেটারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। | নতুন অফিসের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন উপলক্ষে সমবেত বাঙালিদের উদ্দেশে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : “মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান মৃত্যুবরণ করেছে। বাংলাদেশ আজ একটি স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। বাংলাদেশের নিপীড়িত জনগণ আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার প্রতিষ্ঠার দাবিতে সংগ্রাম করছে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীকে খতম না করা পর্যন্ত এই সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর অতর্কিত আক্রমণের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলায় সংঘটিত গণহত্যা কিছুতেই পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার হতে পারে না। জাতিসংঘ ও ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস এই গণহত্যা সম্পর্কে তদন্ত করে অপরাধীদের উপযুক্ত শাস্তিদানের ব্যবস্থা করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। | স্টিয়ারিং কমিটির অফিস ভাড়া নেয়ার কিছুকাল পর হারুন-অর-রশীদ একখানি চিঠি নিয়ে দেখা করতে আসেন। চিঠিখানি খুলনা থেকে তার স্ত্রীর নামে লেখা। হয়েছে। শেখ মান্নান ও তাঁর সহকর্মীদের সামনে এসে তিনি কান্নায় ভেঙে পড়েন। চিঠিতে বলা হয়েছে, তাঁর ১৪ বছর-বয়সী ভাইকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গিয়ে প্রথমে নির্মমভাবে মারধর করেছে, তারপর কান দুটো কেটে ফেলেছে এবং সব শেষে গাছে ঝুলিয়ে তার চোখ দুটো উপড়ে ফেলেছে। অবিলম্বে এই চিঠির ইংরেজি অনুবাদ করে শেখ মান্নান জাকারিয়া খান চৌধুরীসহ কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে যান। শ্রমিকদলীয় সদস্য জন স্টোনহাউসের সঙ্গে দেখা করে তাঁরা চিঠিখানি অবিলম্বে স্পিকারের হাতে পৌঁছে দেয়ার জন্য অনুরােধ করেন। বাংলাদেশের নিরপরাধ মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করার এই জঘন্য চিত্র পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে পৌছে দেয়ার ফলে প্রবাসী বাঙালিরা তাদের অকুণ্ঠ। সাহায্য ও সহানুভূতি পেয়েছিলেন।৮
৬ মে ‘দি মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বার্মিংহামের নিকটবর্তী এজবাস্টন ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দু’হাজার বাঙালি পুরুষ ও মহিলা যুক্তরাজ্য সফররত পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। জগলুল পাশা বিক্ষোভকারীদের নেতৃত্ব দেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি ইভিনিং স্টার’-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, ১৯৪৭ সালে জোড়াতালি দিয়ে যে দুটি দেশকে এক দেশ বলে ঘােষণা করা হয়েছিল, তাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত যুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বলা চলে না। এই দুটি দেশের মধ্যে একটি। যে অপরটির সম্পূরক নয়, তা এখন দিনের আলাের মতাে স্পষ্ট। | ইতােমধ্যে ‘মুজিবনগর সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে আমেরিকায় গিয়ে জাতিসংঘে নিয়ােজিত বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদল ও মার্কিন জনসাধারণকে বাংলাদেশের আন্দোলন সম্পর্কে অবহিত করার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি অবিলম্বে মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে তিন মাসের ভিসার জন্য আবেদন করেন। কিন্তু কন্সাল-জেনারেল তাকে ১৯৭১ সালের ৬ মে থেকে ১৯৭৫ সালের ৬ মে পর্যন্ত চার বছরের ভিসা মঞ্জুর করেন। চার বছরের মধ্যে যতবার খুশি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার অনুমতি ভুলক্রমে দেয়া হয়েছে কিনা জানতে চাইলে কন্সাল-জেনারেল বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন : ‘না, ভুল নয়, ইচ্ছা করেই দিয়েছি। একবার গেলেই আপনার দেশ স্বাধীন হয়ে যাবে সেটা ভাবি নি।… দেখুন, মি, জাস্টিস চৌধুরী, ব্যাপারটা হচ্ছে এই—আপনি আমাদের দেশে যাচ্ছেন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে [ প্রচারকার্য চালাতে। পাকিস্তান আমাদের বন্ধুরাষ্ট্র। তাদের আমরা অসন্তুষ্ট করতে পারি না। সে রকম চিঠি পেলে আমরা পাকিস্তানিদের জানিয়ে দেব যে আর আপনাকে ভিসা দেয়া হবে না। অল্প দিনের ভিসা দিলে আপনি ভিসার জন্য আবার | আসতেন; তাই আমরা ঠিক করলাম যে আপনাকে আমরা চার বছরের ভিসা দেব। | তা হলে পাকিস্তান ও আপনারা দু’পক্ষই আমাদের শান্তিতে থাকতে দেবেন।” ৮ মে গােরিং স্ট্রিটের অফিসে সমগ্র যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রায় একশ’জন প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয়। স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর এই সভা সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য বলে বিবেচিত হয়। সভায় সর্বসম্মতিক্রমে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাহায্যার্থে বাংলাদেশ ফান্ড’ নামের একটি তহবিল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তহবিল পরিচালনার জন্য বাের্ড। অব ট্রাস্টি’র বাঙালি সদস্য নির্বাচনের ব্যাপারে জটিলতা দেখা দেয়। বিচারপতি। চৌধুরী প্রথমে ‘বাের্ড অব ট্রাস্টি’-র সদস্য হতে রাজি হন নি। বহু আলাপআলােচনার পর বিচারপতি চৌধুরী, বিশিষ্ট সমাজকর্মী ডােনাল্ড চেসওয়ার্থ ও শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউসকে সদস্য মনােনীত করে ‘বাের্ড অব ট্রাস্টি’ গঠন করা হয়। বাংলাদেশ তখনাে পর্যন্ত স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি না পাওয়ার ফলে কোনাে ব্যাঙ্কই ‘বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একাউন্ট খুলতে রাজি হচ্ছিল। অনেক চেষ্টার পর হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক নামের একটি মার্চেন্ট ব্যাঙ্ক একাউন্ট। খুলতে রাজি হয়। কিছুকাল পর হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক হঠাৎ একাউন্টটি বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। বহু চেষ্টার পর ‘বাের্ড অব ট্রাস্টি’-র সদস্যগণ ন্যাশনাল ওয়েস্টমিস্টার ব্যাঙ্কে নতুন একাউন্ট খুলতে সক্ষম হন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন, পাকিস্তান দূতাবাসের প্রতিবাদের ফলেই হ্যামরােজ ব্যাঙ্ক উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিল বলে তিনি পরবর্তীকালে জানতে পেরেছিলেন। ‘বাংলাদেশ ফান্ড থেকে স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য ও ট্রাস্টিবৃন্দ এবং বিচারপতি চৌধুরী নিজে কোনাে অর্থ গ্রহণ করেন নি।৬০
৮ মে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত নর্থহ্যাম্পটন শহরের ক্রিকেট গ্রাউন্ডের বাইরে প্রায় দু’শ বাঙালি পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। বিক্ষোভকারীরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান এবং পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমকে দেশে ফিরে যাওয়ার দাবি সংবলিত ‘স্লোগান দেয়। | স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে জনসভায় বক্তৃতাদানের জন্য যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানানাে হয়। এই অনুরােধের পরিপ্রেক্ষিতে ৯ মে সকালবেলা ব্র্যাডফোর্ড এবং বিকেলবেলা বার্মিংহামে জনসভার আয়ােজন করা হয়। ব্র্যাডফোর্ডে অনুষ্ঠিত জনসভা স্টিয়ারিং কমিটির পরিকল্পনা অনুযায়ী জনসংযােগের প্রথম প্রচেষ্টা। একটি আহ্বায়ক কমিটি এই জনসভার আয়ােজন করে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে মুসাব্বির তরফদার এবং এ কে এম এনায়েতউল্লাহর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। মি. খান এই কমিটির সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ব্র্যাডফোর্ডে একটি জনাকীর্ণ হলে জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সােনার বাংলা, আমি তােমায় ভালবাসি’ দিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। তার বক্তৃতায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘বন্দি হওয়ার পূর্ব মুহূর্তে বাংলার নেতা (শেখ মুজিবুর রহমান) স্বাধীনতা ঘােষণা করে সমগ্র বাঙালি জাতির আশা ও আকাক্ষারই প্রতিধ্বনি করেছেন। শেখ মুজিবকে বন্দি করে পাকিস্তান বাঙালি জাতির অনুভূতির প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করেছে বলে তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘােষণা করেন। দীর্ঘ বক্তৃতায় মুজিবনগর সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে তিনি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় আদর্শ ব্যাখ্যা করেন। সমবেত জনসাধারণ ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হােক’ ইত্যাদি স্লোগান দিয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন ঘােষণা করে। ব্র্যাডফোর্ড থেকে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের সদস্য ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার ও স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নানসহ বার্মিংহাম যান। বার্মিংহাম অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে জগলুল পাশা এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ মান্নানের বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী প্রধান বক্তা হিসেবে তার বক্তব্য পেশ করেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘পচিশে মার্চের স্তব্ধ অন্ধকারের নির্মম হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে এক নবজাগ্রত জাতির জয়যাত্রা শুরু হয়েছে। সেই ন্যায়যুদ্ধে আপনারা সকলেই যােগদান করেছেন। আপনাদের সঙ্গে একজন নগণ্য বাঙালি হিসেবে আমিও এসে দাড়িয়েছি। আমরা চেয়েছিলাম সমান অধিকার, এগিয়ে চলেছিলাম নিয়মতান্ত্রিক পথে। সেই সময় প্রতারণার দ্বারা সময় হরণ করে পাকিস্তান থেকে সৈন্য এনে তাদের ছেড়ে দেয়া হয়েছে শ্যামল বাংলার বুকে মা-বােনের ইজ্জত হরণ, লুণ্ঠন আর গণহত্যার জন্য। এই সভার কথা উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী তাঁর স্মৃতিকথায় বলেন : ‘বাঙালির সংগ্রাম ছিল আদর্শ প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। সে আদর্শ এমন এক অনুপ্রেরণা, উদ্দীপনা ও উৎসাহের সৃষ্টি করেছিল, যা ভাষায় বর্ণনা করা অসম্ভব।”৬১
১০ মে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করার জন্য ব্রিটেনের শ্রমিক ও বিভিন্ন প্রগতিশীল শক্তির প্রতি আহ্বান জানায়। | ১২ মে ল্যাঙ্কাশায়ার ও পার্শ্ববর্তী এলাকার বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে পাচ-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল ৬৩০-সদস্যবিশিষ্ট পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যের হাতে পৌঁছে দেয়ার উদ্দেশ্যে ৬৩০ খানি চিঠি নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে এসে হাজির হন। প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন এম রহমান, জাহির চৌধুরী, নজরুল ইসলাম, এ কে কামালউদ্দিন এবং লতিফ আহমদ। প্রতিনিধিদলের ছবি পরদিন ‘ইভিনিং স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। | ১৩ মে দি টাইমস্ -এর প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ব বাংলায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সৈন্যবাহিনী অপসারণ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদানে বিরত থাকার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। ব্রিটেনের ২০৬জন বুদ্ধিজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও প্রখ্যাত নাগরিকদের দস্তখত সংবলিত বিজ্ঞাপনে হাজার হাজার নিরপরাধ ব্যক্তি-হত্যার ঘটনাকে পাকিস্তানের ঘরােয়া ব্যাপার বলে উল্লেখ করার জন্য ব্রিটিশ সরকারের সমালােচনা করা হয়। ২৫ মার্চ রাত্রিবেলা ঢাকায় সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের আভাস দেয়ার উদ্দেশ্যে বন্ধ-করা দোকানপাটের সামনে পড়ে থাকা একটি বিকৃত মৃতদেহের ভীতিপ্রদ ছবি বিজ্ঞাপনে ব্যবহার করা হয়। বিজ্ঞাপনটির শিরােনাম ছিল এই মুহূর্ত আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়, মানুষ অভ্যন্তরীণ সমস্যার চেয়ে অনেক বড়।’ অ্যাসােসিয়েটেড প্রেস গৃহীত এই ছবিতে পাকিস্তানের প্রকৃত উদ্দেশ্য পরিষ্কার বােঝা যায়।
বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক ‘অ্যাকশান বাংলাদেশ’ বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার বহন করে। বিজ্ঞাপনটি কেটে নিজের নাম ও ঠিকানা যােগ করে নিজ নিজ এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যদের কাছে ডাকযােগে পাঠাবার জন্য পাঠক-পাঠিকাদের অনুরােধ জানানাে হয়। ১৩ মে ‘দি গার্ডিয়ান-এ নীরব বিবেক’ শীর্ষক এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়। আগামী কাল (১৪ মে) পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনাকালে ইয়াহিয়া খান ও অখণ্ড পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত টিকে থাকবে বলে ভান করা সরকার কিংবা বিরােধীদলের সদস্যদের পক্ষে উচিত হবে না। পাকিস্তান ভেঙে যাবে; কবে। পর্যন্ত ভাঙবে সেটাই এখন লক্ষণীয়। পাকিস্তান ভেঙে যাওয়ার পন্থা তদারক করার জন্য শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া সম্ভব হলে ব্যাপারটা সহজতর এবং রক্তপাতের পরিমাণ স্বল্পতর হবে। কারণ, মুজিব নিজেকে শান্তিপ্রিয় বলে প্রমাণ করেছেন।’ | কার্ডিফে সংগঠিত দক্ষিণ ওয়েলসের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পাঁচজন সদস্য বাংলাদেশ সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে পার্লামেন্ট ভবনের বাইরে ১৩ মে দুপুরবেলা থেকে পরদিন বিকেলবেলা পর্যন্ত মােট ২৬ ঘণ্টা অনশন পালন করেন। অনশনকারীদের মধ্যে ছিলেন আবদুল হান্নান, এম জেড মিয়া, মােহাম্মদ ফিরােজ, আবদুল হালিম ও আবদুস শহীদ। অ্যাকশন কমিটির এক বিবৃতিতে বলা হয়, দক্ষিণ ওয়েলস্ থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্যরা বাংলাদেশের আত্মনিয়ন্ত্রণ দাবির সমর্থক। | মে মাসের প্রথম দিকে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যান বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে হাউস অব কমন্সে যে ব্যক্তিগত প্রস্তাব পেশ করেন, সে সম্পর্কে ১৪ মে সরকার ও বিরােধীদলের সম্মতিক্রমে বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। এর আগেই বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে স্যার আলেক বলেন, শেখ মুজিবের স্বাস্থ্য। সম্পর্কে উদ্বেগের কারণ নেই বলে পাকিস্তান সরকার ব্রিটিশ সরকারকে জানিয়েছে। পাকিস্তান সরকারের এই উক্তি বিশ্বাস না করে ইসলামাবাদে অবস্থিত ব্রিটিশ হাই। কমিশনের মাধ্যমে প্রকৃত খবর সংগ্রহ করার জন্য বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে অনুরােধ করেন। স্যার আলেক বলেন, শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকারকে রাজি করানাের জন্য ব্রিটিশ সরকার চেষ্টা চালিয়ে যাবে। প্রায় তিনশ’ পার্লামেন্ট সদস্য মি, ডগলাসম্যানের প্রস্তাবটি সমর্থন করেন। সমর্থনকারীদের মধ্যে পিটার শাের, মাইকেল বার্নস্, ফ্র্যাঙ্ক এলান, হিট ফ্রেজার, ফ্রেড এভান্স, এন্ড্রু ফাউন্ড, রেজ ফ্রিসন, হিউ জেনকিন্স, জন সিলকিন, রবার্ট প্যারি, জন স্টোনহাউস, ইয়ান মিকার্ডো, স্যার জেরাল্ড নেবারাে প্রমুখের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
প্রস্তাবের পক্ষে বক্তৃতাদানকালে মি. ডগলাসম্যান বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের ব্যাপকতা এবং তার প্রতিক্রিয়া হিসেবে যে প্রচণ্ড ঘৃণার উদ্রেক হয়েছে তার ফলে পাকিস্তান আজ এক রাষ্ট্র হিসেবে মৃত। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সর্বপ্রথম বাঙালিদের হত্যা করতে শুরু করে বলে বিভিন্ন মহল থেকে। তাঁকে বলা হয়েছে। সংঘর্ষ চলাকালে পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্য না দেয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার স্বীকৃতির ভিত্তিতে পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। তিনি আরও বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীকে বের করে না দেয়া পর্যন্ত সংঘর্ষ অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ও আওয়ামী লীগের পক্ষে ক্রমাগত গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সামর্থ্য রয়েছে। অবিলম্বে শান্তি স্থাপন করার ব্যবস্থা করা হলে বর্তমান পরিস্থিতি দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে পর্যবসিত হবে। এর ফলে লক্ষ লক্ষ লােক খাদ্যাভাবে, মহামারী ও বুলেটের আঘাতে মৃত্যুবরণ করবে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ব্রিটেনের যে প্রভাব রয়েছে তা প্রয়ােগ করে পাকিস্তানকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য। | তিনি আশা করেন, পাকিস্তানকে বিশ্ব ব্যাঙ্ক ও আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল থেকে সাহায্যদান বন্ধ রাখার জন্য ব্রিটিশ সরকার ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। ইতােমধ্যে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় গুরুতর সঙ্কট দেখা দিয়েছে। যুদ্ধ বাবদ পাকিস্তানকে দৈনিক দশ লক্ষ পাউন্ড খরচ করতে হচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে যুদ্ধের অবসান ঘােষণা না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্য না দেয়ার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের কাছে দাবি জানান। | বৈদেশিক উন্নয়ন দফতরের মন্ত্রী রিচার্ড উড় বলেন, পূর্ব বঙ্গে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। কিন্তু বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ রেখে সমস্যার সমাধান সম্ভব নয় বলে তিনি মনে করেন। তিনি আরও বলেন, আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবকে পূর্ব বঙ্গে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে, তা যাচাই করা সম্ভব হয় নি। সর্বশেষ সংবাদে প্রকাশ, তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি করে রাখা হয়েছে এবং সম্ভবত তার বিচারের ব্যবস্থা করা হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এডওয়ার্ড হিথ ব্যক্তিগত ভিত্তিতে গােপন আলােচনা করেছেন বলে মি. উত্ প্রকাশ করেন। আলােচনাকালে মি. হিথ পূর্ববাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পরামর্শ দেন।
শ্রমিক দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য ডেনিস হিলি বলেন, পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবের বিচারের ব্যবস্থা করবে না বলে তিনি আশা করেন। যদি তা করা হয় তা হলে বর্তমান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে। জনগণের আশা-আকাক্ষা অনুযায়ী শিগগিরই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্যোগ যদি গ্রহণ না করা হয়, তা হলে ভারত ও পাকিস্তান প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। ইতােমধ্যে রাশিয়া ও চীন যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। এই পরিস্থিতিতে সমগ্র দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তি ব্যাহত হওয়ার বাস্তব সম্ভাবনা রয়েছে। | উদারনৈতিক দলের সদস্য জন পার্ডো বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে ব্রিটেন, কমনওয়েলথ এবং জাতিসংঘ নিজেদের হীনবল বলে প্রমাণ করেছে। মনােবলের অভাবে তারা নৈতিক চাপ প্রয়ােগ করতে ব্যর্থ হয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য জন স্টোনহাউস বলেন, পূর্ব বঙ্গের জনগণ পূর্ণ স্বাধীনতা চায় কিনা তা যাচাই করার জন্য জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে একটি গণভােট গ্রহণ করা উচিত। এক হাজার মাইল দূরে অবস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানের পক্ষে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির ইচ্ছার বিরুদ্ধে পূর্ব বঙ্গে তাদের শাসন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব বলে তিনি মন্তব্য করেন। আলােচনার উপসংহারে মি. উড় বলেন, পূর্ব বঙ্গে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করবে। কিন্তু উন্নয়ন বন্ধ করে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তানের ওপর চাপ প্রয়ােগ করার ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকার রাজি নয়। তা সত্ত্বেও তিনি মি. ডগলাসম্যানের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভােট দেয়ার জন্য পরামর্শ দিচ্ছেন না। কারণ, তা অন্যায় হবে বলে তিনি মনে করেন। শেষ পর্যন্ত সর্বসম্মতিক্রমে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কিত বিতর্কের রিপাের্ট পরদিন ফলাও করে বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। এর ফলে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে উৎসাহ ও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়। মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ভারতীয় সােশ্যালিস্ট পার্টির নেত্রী মিসেস অরুণা আসফ আলী মস্কো থেকে ফেরার পথে লন্ডনে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা। আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক হিসেবে তিনি সুপরিচিত। মুজিবনগর সরকারের পক্ষে ভারতে ও বিদেশে জনমত গড়ে তােলার জন্য তিনি সর্বশক্তি নিয়ােগ করেন। লন্ডনে অবস্থানকালে তিনি কয়েকটি ব্রিটিশ ও বাঙালি গ্রুপের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন।
লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে লিঙ্ক ফোরাম’ গ্রুপের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস আসফ আলী বলেন, ভারতের জনগণ বাংলাদেশের সংগ্রামকে জাতীয় বিপ্লব বলে মনে করে। কারণ, বাংলাদেশের জনগণ একযােগে বিদ্রোহ ঘােষণা করেছে। দল ও মত নির্বিশেষে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন কি করে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত হয়, তা ব্যাখ্যা করেন। সন্ধ্যায় বিমানযােগে তারা লন্ডনে ফিরে আসেন। | মে মাসের শেষদিকে আফগানিস্তানে অবস্থানরত প্রবীণ জননেতা খান আবদুল গাফফার খান বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে এক দীর্ঘ বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারির খবর তিনি বেতারযােগে পেয়েছেন। এর ফলে বাঙালিদের ওপর ভীতির রাজত্ব কায়েম হয়েছে। তাদের দুর্দশার জন্য তিনি অত্যন্ত বেদনাবােধ করেন। প্রকৃত পরিস্থিতির সংবাদ ধামাচাপা দেয়ার উদ্দেশ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সীমান্ত প্রদেশের কাইয়ুম খানের মিথ্যা প্রচারণার সমালােচনা করে গাফফার খান বলেন, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা বর্তমান যুদ্ধের উদ্দেশ্য নয়; ক্ষমতা দখল করাই এর প্রধান উদ্দেশ্য। পাঞ্জাবের ধনিক শ্রেণী এবং উর্ধ্বতন সামরিক নেতৃবৃন্দ নিজেদের স্বার্থে ক্ষমতা দখল করেছে। হতভাগ্য বাংলার আর কোনাে অপরাধ নেই; তারা নির্বাচনে জয়লাভ করেছে, এটাই তাদের অপরাধ। বাঙালিদের সঙ্গে আজ যে খেলা অনুষ্ঠিত হচ্ছে, সেই একই খেলা পসতুনদের সঙ্গে পাকিস্তান গঠনের সময় অনুষ্ঠিত হয়। | পাকিস্তানি ভাইবােনদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গাফফার খান বলেন : ‘পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ সব সময়ে ধর্মের নামে আমাদের প্রতারিত করেছে। তারা পাকিস্তান ও ধর্মের নামে কথা বলার অধিকার দাবি করে। বাংলায় যা ঘটেছে তা কি ইসলামের জন্য ঘটেছে? আমরা একটানা সামরিক শাসনের আওতায় রয়েছি, একথা দয়া করে আপনারা মনে রাখবেন। গাফফার খান আরাে বলেন, জালালাবাদে নিয়ােজিত পাকিস্তানি কন্সাল তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে বাঙালিরা পাকিস্তান ধ্বংস করেছে বলে উল্লেখ করেন। এর উত্তরে তিনি বলেন, ট্যাঙ্ক, মেশিনগান ও বােমা দিয়ে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করা যাবে না। পাকিস্তান সরকার বাস্তবিকই যদি পাকিস্তানের সংহতি রক্ষা করতে চায়, তা হলে তিনি শেখ মুজিব ও পাকিস্তান সরকারের মধ্যে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার জন্য মধ্যস্থতা করতে রাজি হবেন। পাকিস্তান সরকার যদি শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় তাহলে তিনি বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত থাকবেন।
কিছুকাল পর পাকিস্তানি কন্সল গাফফার খানের সঙ্গে পুনরায় সাক্ষাৎ করে। বলেন, তিনি এ সম্পর্কে তার একটি বিবৃতি প্রচার করবেন বলে পাকিস্তান সরকার আশা করে। গাফফার খান বলেন, বিবৃতি দেয়ার কোনাে প্রয়ােজন নেই; তবে তিনি বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন। ২৪ মে বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরে রওনা হন। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন এনামুল হক। তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণায় নিয়ােজিত ছিলেন। ২৭ মে ‘দি গার্ডিয়ান বাংলাদেশে পাকিস্তানি নৃশংসতা সম্পর্কে দু’জন খ্রিষ্টান ধর্মীয় নেতা রেভারেন্ড জন হ্যাস্টিংস ও রেভারেন্ড জন ক্ল্যাপহাম প্রদত্ত প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ প্রকাশ করে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর এই নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী অ্যাকশন বাংলাদেশ পুস্তিকাকারে পুনর্মুদ্রণ করে। পুস্তিকার শেষে বাংলাদেশের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য অ্যাকশন বাংলাদেশ বিশ্বসমাজকে আহবান জানায়। ২৯ মে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডনে ফিরে আসেন। পরদিন তিনি ম্যাঞ্চেস্টারে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা করেন। ম্যাঞ্চেস্টার রওনা হওয়ার আগে তিনি গােরিং স্ট্রিটের অফিসে গিয়ে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে বিদেশ থেকে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে একখানি চিঠি লিখে স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূঁইয়ার মারফত পাঠাবার। ব্যবস্থা করেন। মি. ভুইয়া তিন মাস পর লন্ডনে ফিরে আসেন। তার অনুপস্থিতিতে শেখ আবদুল মান্নান স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক ও অফিস পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন। ম্যাঞ্চেস্টারের অধিবাসী প্রবীণ বাঙালি হাজী আবদুল মতিন উল্লিখিত সভার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য কবির চৌধুরী এবং স্থানীয় বাঙালি ছাত্রদের নেতা মহিউদ্দিন আহমদ তাকে সাহায্য করেন। বিরাট হলটিতে তিল ধারণেরও স্থান ছিল না। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চ তারিখের বক্তৃতার ক্যাসেট বাজিয়ে সভার কাজ শুরু হয়। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় ২৫ মার্চের রাত থেকে শুরু করে ৩০ মে পর্যন্ত সংঘটিত ঘটনাবলির বিবরণ দেন। তিনি আমেরিকায় বাঙালিদের সংগঠন এবং কর্মতৎপরতার কথাও উল্লেখ করেন। শ্রোতারা জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’ ইত্যাদি শ্লোগান দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সঙ্গে একাত্মতা ঘােষণা করেন। হাজী আবদুল মতিন, শেখ আবদুল মান্নান, এনামুল হক এবং আরাে কয়েকজন এই সভায় বক্তৃতা করেন।
জুন, ১৯৭১
১ জুন লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের মুখপত্র পাকিস্তান নিউজ-এ পূর্ব বঙ্গের ৫৫জন বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবীর নামে প্রচারিত একটি বিবৃতি প্রকাশিত হয়। মে মাসে নিউইয়র্কের ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব ইউনিভার্সিটি এমেরিটাস্ পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এক বিবৃতি প্রচার করে। মার্কিন শিক্ষাবিদদের বিবৃতির অসারতা প্রমাণ করার জন্য পাকিস্তানের সামরিকচক্র মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করে। পূর্ব বঙ্গের বুদ্ধিজীবীদের নামে ১৬ মে ঢাকা থেকে প্রচারিত এই বিবৃতিতে বলা হয়, সাধারণ নির্বাচনের পর থেকে তথাকথিত চরমপন্থীরা স্বায়ত্তশাসনের দাবিকে একতরফাভাবে স্বাধীনতার দাবিতে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করছে এবং যারা এর বিরােধিতা করে তারা শারীরিক নির্যাতনের শিকার হয়। এই বিবৃতিতে আরও বলা হয়, মেশিনগান ও মর্টার সংগ্রহ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম ছাত্রাবাস জগন্নাথ হলকে গােপন অস্ত্রাগারে পরিণত করে হলের প্রাঙ্গণ মুক্তিবাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা হয়। পাকিস্তান সামরিক বাহিনী এই সশস্ত্র প্রচেষ্টা বানচাল করে দিয়ে শান্তি ও শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনেছে বলে বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানকারীরা সন্তোষ প্রকাশ করেন। স্বাক্ষরদানকারীদের মধ্যে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, কাজী দীন মােহাম্মদ, শামসুল হুদা চৌধুরী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তানপন্থীর নাম দেখে প্রবাসী বাঙালিরা এই বিবৃতি পাকিস্তানি অপপ্রচারের উদাহরণ বলে নিশ্চিত হন। ভারতীয় সর্বোদয় নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে কায়রাে, রােম, হেলসিংকি, পারী ও মস্কো সফরের পর ২ জুন লন্ডনে পৌঁছান। পল কনেট ও মারিয়েটা প্রকোপের উদ্যোগে অ্যাকশন বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অনুষ্ঠিত এক সভায় মি, নারায়ণ বলেন : বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হবে এবং বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া খান কিংবা বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে ব্যক্তির সঙ্গে বাক্যবিনিময় কিংবা করমর্দন করতে রাজি নন।… আমি শান্তিবাদী; কিন্তু ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালিদের সশস্ত্র প্রতিরােধের নিন্দা করতে আমি রাজি নই। যুদ্ধের জন্য ভারতের তৈরি হওয়া উচিত।’ এই সভায় তিনজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যজন স্টোনহাউস, পিটার শাের ও মাইকেল বার্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন জানিয়ে বক্তৃতা করেন। তাদের বক্তৃতার পর বিচারপতি চৌধুরী সবাইকে ধন্যবাদ জানান এবং মি, নারায়ণের বিদেশ সফরের সাফল্য কামনা করেন। ৪ জুন জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানার্থে লন্ডন অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে একটি চা-চক্রের আয়ােজন করা হয়। এই সমাবেশে লন্ডন কমিটির পক্ষ থেকে গাউস খান এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বক্তৃতা করেন। বিচারপতি চৌধুরী মি. নারায়ণের জীবন-দর্শনের ওপর আলােকপাত করেন।
৪ জুন (শুক্রবার) বাংলাদেশ মহিলা সমিতি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে একটি মিছিলের আয়ােজন করে। সমিতির সভানেত্রী মিসেস জেবুন্নেসা বসের নেতৃত্বে প্রায় দু’শ মহিলা ও শিশু সেন্ট জেমস পার্ক থেকে মিছিল করে। ডাউনিং স্ট্রিটে যান। অবিলম্বে গণহত্যার অবসান ও স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত পােস্টার ও প্ল্যাকার্ড-ধারিণী শাড়ি পরিহিতা মহিলারা সহজেই পথচারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। দু’বােন সমিতির ব্যানার বহন করেন। এঁদের মধ্যে একজন তার স্বামী ও তিন সন্তান নিয়ে দু’সপ্তাহ আগে লন্ডনে পৌছাতে সক্ষম হন। মিসেস জাহানারা রহমান ও মিসেস আনােয়ার জাহান মিছিল পরিচালনার ব্যাপারে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। | মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদলের নেত্রী হিসেবে মিসেস বস্ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্যদান অব্যাহত রাখার সিদ্ধান্ত। পুনর্বিবেচনা করার জন্য ব্রিটিশ সরকারকে অনুরােধ জানানাে হয়। বর্তমান। পরিস্থিতিতে পাকিস্তান সরকারকে সাহায্যদান অব্যাহত রাখা হলে বাংলাদেশে বহু পরিবারের দুর্ভোগ বৃদ্ধি পাবে এবং বহু লােকের মৃত্যু ঘটবে বলে স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয়। | ৫ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে ‘সেইভ দি চিলড্রেন ফান্ড’, দি ব্রিটিশ রেডক্রস সােসাইটি’ এবং ক্রিস্টিয়ান এইড’ প্রভৃতি প্রতিষ্ঠানের কাছে অবিলম্বে ত্রাণকার্য শুরু করার জন্য একটি আবেদন। পেশ করা হয়। ৫ জুন শেফিল্ড অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে স্থানীয় টাউন হলে একটি জনসভার আয়ােজন করা হয়। শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত প্রীতিশ মজুমদার এ ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। বাঙালি, ভারতীয় ও ইংরেজ শ্রোতারা সভায় উপস্থিত ছিলেন। শেখ আবদুল মান্নান, ড, জোয়ারদার এবং অপর কয়েকজন সহকর্মীকে নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় যােগদানের জন্য লন্ডন থেকে শেফিল্ড যান। হলে ঢােকার আগে প্রীতিশ মজুমদার ভেতর থেকে বেরিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, স্যার, আপনাকে একটা দুঃসংবাদ দিতে হচ্ছে। আমরা তাে সভা করতে পারছি না। পাকিস্তানিরা হলের মধ্যে ঢুকে পড়েছে।
হলঘরটিও তারা চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। বিচারপতি চৌধুরীর সহকর্মীরা বললেন, হলে আমরা ঢুকবাে এবং সভা হবেই। যে-কোনাে পরিস্থিতির মােকাবিলা করার জন্য আমরা তৈরি রয়েছি। হলে ঢােকার সময় বিরােধী পক্ষ গােলমাল সৃষ্টির চেষ্টা করে। তারা দু’তিন টুকরাে পাথর ছুঁড়ে মারে এবং ব্যারিকেড তৈরি করে বাধা সৃষ্টির চেষ্টা করে। বিচারপতি চৌধুরী ও তার সহকর্মীরা ‘ব্যারিকেড ভেঙে হলে ঢুকে পড়েন। পুলিশ দক্ষতার সঙ্গে শৃঙ্খলা বজায় রাখে। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : ‘আমরা একটি পবিত্র সাধনায় লিপ্ত। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করে সেখানে সংসদীয় গণতন্ত্র স্থাপনে আমরা দৃঢ়সঙ্কল্প। ব্রিটেনের মতাে নির্বাচিত প্রতিনিধিবৃন্দ জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী দেশ শাসন করবেন। মানুষের মৌলিক অধিকার স্বীকৃত হবে; সংবাদপত্র ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা নিশ্চিত করে মানুষের মনে নিরাপত্তাবােধ স্থায়ী করতে হবে। সেই মহৎ জীবনের লক্ষ্যে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে দৃপ্ত পদক্ষেপে।” সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন শেফিল্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ফ্র্যাঙ্ক গার্লিং, আফরােজ চৌধুরী, কবীর চৌধুরী ও শেখ আবদুল মান্নান। হলের। বাইরে একদল পাকিস্তানি জমায়েত হয়। অপ্রীতিকর পরিস্থিতি সৃষ্টির আশঙ্কা থাকায় দু’শ ইউনিফর্ম পরিহিত পুলিশ তাদের প্রতি নজর রাখে। | ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের রিডার ও শেখ মুজিবের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সােবহান মে মাসে কলকাতা থেকে লন্ডন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে তিনি এইড কন্সর্শিয়াম’-এর সদস্য দেশগুলাের প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ করার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন। জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে লন্ডনে ফিরে এসে অধ্যাপক সােবহান কয়েকটি প্রভাবশালী ব্রিটিশ সংবাদপত্রের সম্পাদক ও প্রতিনিধিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এর ফলে ৪ ও ৫ জুন ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় তার দুটি নিবন্ধ প্রকাশিত হয়। প্রথম নিবন্ধে তিনি পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান বন্ধ রাখার পক্ষে যুক্তি প্রদর্শন করেন।
দ্বিতীয় নিবন্ধে তিনি মুজিব-ইয়াহিয়া আলােচনার পটভূমি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেন, পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের পরিকল্পনা সম্পর্কে সম্ভবত ১ ও ৬ মার্চের মধ্যে চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ৪ জুন সাপ্তাহিক ‘নিউ স্টেটসম্যান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সম্পাদকীয় নিবন্ধ ছিল মূলত তারই বক্তব্য। নিবন্ধের উপসংহারে বলা হয়, অতঃপর ইয়াহিয়া ও তার অনুচরদের বৈদেশিক সাহায্যদানকারী দেশগুলাে পূর্ব বঙ্গে গণহত্যার দায় এড়াতে পারবে না। “দি কপূসেজ ইন দি সান” (সূর্যালােকে মৃতদেহ) শীর্ষক এই নিবন্ধ পাঠকদের অভিভূত করে। ৫ জুন মি. সােবহান স্থানীয় ‘দি গ্যাঞ্জেস’ রেস্তোরায় বাংলাদেশ নিউজলেটার ও বাংলাদেশ ফ্রিডম মুভমেন্ট ওভারসিজ’-এর কর্মী ও সমর্থকদের এক ঘরােয়া সভায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। ৬ জুন লন্ডন অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী বাঙালিরা এবং বেশ কিছুসংখ্যক ইংরেজ যােগদান করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার বক্তৃতায় প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে একতার প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা করেন। সংগ্রামের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি অপপ্রচারের তীব্র সমালােচনা করে তিনি বলেন : ‘জয় আমাদের সুনিশ্চিত। | পাকিস্তানের আর্থিক সাহায্যপুষ্ট কয়েকজন বাঙালি মুক্তি’ নামের একটি বাংলা সাপ্তাহিকের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে হীন প্রচারণা চালায়। এদের মধ্যে মুক্তি পত্রিকার সম্পাদক আবুল হায়াতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সে ভারতীয় হিন্দুদের মুসলমানবিরােধী ষড়যন্ত্র বলে দাবি করে। বিচারপতি চৌধুরীর বিরুদ্ধে সে মিথ্যা ও মানহানিকর প্রচারণা অব্যাহত রাখে। উক্ত পত্রিকাটির কয়েকটি কপি সংগ্রহ করে দেশপ্রেমিক বাঙালিরা সভামঞ্চের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে অগ্নিসংযােগ করেন। ৬ জুন ব্রিটিশ সরকার ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের সাহায্যার্থে দশ লক্ষ পাউন্ড মঞ্জুর করে। বি বি সি প্রচারিত ‘দি ওয়ার্ল্ড দিস উইকয়েন্ড’ এই সাহায্য প্রয়ােজনের তুলনায় নগণ্য বলে উল্লেখ করে। এ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বৈদেশিক উন্নয়ন দপ্তরের মন্ত্রী রিচার্ড উড় কিছুটা আত্মপক্ষ সমর্থনের সুরে বলেন, অযথা বিলম্ব না করে তারা এই মজুরির কথা ঘােষণা করেছেন। তাছাড়া খাদ্য-দ্রব্য সরবরাহের সিদ্ধান্তও তারা নিয়েছেন। এই উভয় প্রকার সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ২০ লক্ষ পাউন্ড।
অপর এক প্রশ্নের উত্তরে মি. উড় বলেন, ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে রাজনৈতিক মীমাংসার মাধ্যমে শান্তি স্থাপনের জন্য ব্যক্তিগত চিঠি লিখেছেন। | ৭ জুন ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে প্রকাশ, বৈদেশিক সাহায্য সম্পর্কে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্টারি মুখপাত্র জুডিথ হার্ট ব্রিটিশ সরকার ঘােষিত সাহায্যের পরিমাণ ‘হাস্যকর’ বলে উল্লেখ করেন। পূর্ব বঙ্গে সামরিক অভিযান সম্পূর্ণ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদান অনুচিত হবে। বলে তিনি মন্তব্য করেন। মে মাসের গােড়ার দিকে করাচির ইংরেজি দৈনিক দি ডন পত্রিকার লন্ডন সংবাদদাতা নাসিম আহমদ “দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির এক সভায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রাম শুরু হওয়ার আগে তাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। সভায় উপস্থিত বাঙালি শ্রোতারা নাসিম আহমদের অশালীন উক্তির বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ জানায়। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার জন্য সােসাইটির কর্তৃপক্ষ বিচারপতি চৌধুরীকে হাইকোর্টের জজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা সম্পর্কে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী এই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করার জন্য দাবি জানান। সােসাইটির কর্তৃপক্ষ এই দাবি উপেক্ষা করেন। এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য সালমান আলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ৮ জুন ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে সরকারি হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে স্যার আলেক মন্তব্য করেন। পাকিস্তানপন্থী বাঙালি ডেপুটি হাই কমিশনার সেলিমুজ্জামান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে সােসাইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ১২ জুন ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে পাকিস্তানের হাই কমিশনারের মনােভাব উদ্ধত বলে উল্লেখ করা হয়। ৮ জুন ‘দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির হলরুমে অনুষ্ঠিত বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের জন্য পাকিস্তানের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক হত্যা সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন, তখন শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই শােকে অভিভূত হন। সভার কাজ শেষ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. ডবলিউ এ জেঙ্কিন্সের স্ত্রী লেডি জেঙ্কিন্স সভামঞ্চে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে নিহতদের জন্য শােক প্রকাশ করেন।
তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন জ্ঞাপন করেন। বিচারপতি চৌধুরী প্রত্যেকবার পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর পাকিস্তান হাই কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে স্যার আলেক বিচারপতি চৌধুরীকে তাঁর সরকারি বাসভবনে গিয়ে দেখা করার পরামর্শ দেন। বাসভবনে সামাজিক সাক্ষাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাে কূটনৈতিক রীতি-বিরুদ্ধ বলে তিনি উক্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সামাজিক সাক্ষাতের সময় রাজনৈতিক আলােচনা নিষিদ্ধ নয়। ৮ জুন ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত এক পত্রে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন সম্পূর্ণ বন্ধ না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদান অনুচিত হবে। বলে তিনি মন্তব্য করেন। মে মাসের গােড়ার দিকে করাচির ইংরেজি দৈনিক দি ডন পত্রিকার লন্ডন সংবাদদাতা নাসিম আহমদ “দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির এক সভায় বঙ্গবন্ধু ও তাঁর সহকর্মীদের তীব্র ভাষায় আক্রমণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সগ্রাম শুরু হওয়ার আগে তাকে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। সভায় উপস্থিত বাঙালি শ্রোতারা নাসিম আহমদের অশালীন উক্তির বিরুদ্ধে তুমুল প্রতিবাদ জানায়। রাজনৈতিক নিরপেক্ষতা প্রমাণ করার জন্য সােসাইটির কর্তৃপক্ষ বিচারপতি চৌধুরীকে হাইকোর্টের জজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য হিসেবে আওয়ামী লীগের ছয়-দফা সম্পর্কে বক্তৃতাদানের আমন্ত্রণ জানান। পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী এই আমন্ত্রণ প্রত্যাহার করার জন্য দাবি জানান। সােসাইটির কর্তৃপক্ষ এই দাবি উপেক্ষা করেন। এই ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার জন্য সালমান আলী পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। ৮ জুন ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কার্যকলাপে সরকারি হস্তক্ষেপ অনুচিত বলে স্যার আলেক মন্তব্য করেন। পাকিস্তানপন্থী বাঙালি ডেপুটি হাই কমিশনার সেলিমুজ্জামান ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে সােসাইটির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। ১২ জুন ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে পাকিস্তানের হাই কমিশনারের মনােভাব উদ্ধত বলে উল্লেখ করা হয়। ৮ জুন ‘দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটির হলরুমে অনুষ্ঠিত বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের জন্য পাকিস্তানের তীব্র সমালােচনা করেন। তিনি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বিচারে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষক হত্যা সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বর্ণনা দেন, তখন শ্রোতাদের মধ্যে অনেকেই শােকে অভিভূত হন। সভার কাজ শেষ হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন উপাচার্য ড. ডবলিউ এ জেঙ্কিন্সের স্ত্রী লেডি জেঙ্কিন্স সভামঞ্চে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরীকে জড়িয়ে ধরে নিহতদের জন্য শােক প্রকাশ করেন। তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের প্রতিও সমর্থন জ্ঞাপন করেন।
বিচারপতি চৌধুরী প্রত্যেকবার পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পর পাকিস্তান হাই কমিশন আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিবাদ জানায়। এর ফলে স্যার আলেক বিচারপতি চৌধুরীকে তাঁর সরকারি বাসভবনে গিয়ে দেখা করার পরামর্শ দেন। বাসভবনে সামাজিক সাক্ষাতের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানাে কূটনৈতিক রীতি-বিরুদ্ধ বলে তিনি উক্ত পরামর্শ দিয়েছিলেন। বলা বাহুল্য, সামাজিক সাক্ষাতের সময় রাজনৈতিক আলােচনা নিষিদ্ধ নয়। ৮ জুন ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত এক পত্রে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত গণহত্যার উল্লেখ করে নিম্নে বর্ণিত দুটি প্রস্তাব পেশ করেন : ১. পূর্ব বঙ্গের বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা এবং পাকিস্তান সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্দেশ্যে অবিলম্বে সিকিউরিটি কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা উচিত; ২. পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ পূর্ব বঙ্গে শাসন চালিয়ে যাওয়ার অধিকারী কিনা সে সম্পর্কে জাতিসংঘের সদস্য দেশগুলাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত। বাংলাদেশ সরকারকে পূর্ব বঙ্গের জনগণের প্রতিনিধিমূলক সরকার হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার যৌক্তিকতাও তাদের বিচার করে দেখা উচিত। তিনি মনে করেন, বাংলাদেশকে যতাে তাড়াতাড়ি স্বীকৃতি দেয়া হবে, ততাে তাড়াতাড়ি পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করা সম্ভব হবে। অবরুদ্ধ ঢাকা নগরী থেকে লন্ডনে ফিরে এসে শফিক রেহমান (চার্টার্ড এ্যাকাউন্টেন্ট) দি গার্ডিয়ান ও দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকার সংবাদদাতাদের। সঙ্গে ৯ জুন এক সাক্ষাৎকারকালে বলেন, পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযােদ্ধাদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। তারা মাইনের সাহায্যে রাস্তাঘাট ও রেলওয়ে লাইনের বিপুল ক্ষতিসাধন করেছে এবং খুলনাগামী স্টিমার সার্ভিস বন্ধ করতে সক্ষম হয়েছে। মুক্তিযােদ্ধারা ওঁৎ পেতে থেকে সামরিক যানবাহনের ক্ষতিসাধন এবং পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযােগিতাকারী দেশদ্রোহীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করেছে। মি. রেহমান আরও বলেন, ঢাকায় যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের খোজখবর পাওয়া যাচ্ছে না। এই প্রসঙ্গে তিনি কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম উল্লেখ করেন। এদের জেরা করার জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। তারা ফিরে আসেন নি। যারা দেশ ত্যাগ করতে পারবেন না বলে নির্দেশ দেয়া হয়েছে, তাদের নাম ৩৬। পৃষ্ঠাব্যাপী একটি তালিকায় লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। তিনি নিজে সৌভাগ্যবান বলেই বেরিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তিনি বলেন : আমরা যুদ্ধ করার মতাে মনােবলের অধিকারী। কিনা এ প্রশ্ন অবান্তর; প্রাণের দায়ে এখন আমাদের যুদ্ধ করতে হবে।’ মুক্তিবাহিনীর উদ্যোগে রাস্তাঘাটের ব্যাপক ক্ষতিসাধনের ফলে ঢাকার বাইরে যাওয়া এক রকম অসম্ভব বলে তিনি প্রকাশ করেন।
টেলিফোন যােগাযােগ ব্যবস্থার গুরুতর অবনতি ঘটেছে। কেবল বিমানযােগে চট্টগ্রাম যাওয়া সম্ভব। টিকেট কেনার জন্য কয়েক দিন অপেক্ষা করতে হয়। স্বাধীন বাংলা বেতার নামের একটি। শক্তিশালী বেতার কেন্দ্র থেকে সকাল ও সন্ধ্যায় ৭টা থেকে ৮টা পর্যন্ত প্রােগ্রাম প্রচার করা হচ্ছে। ১৭ মে ঢাকায় স্টেট ব্যাঙ্ক, দুটি সিনেমা হল এবং একটি আধুনিক শপিং এলাকায় একযােগে ৮টি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়। মে মাসে মুক্তিবাহিনীর একটি দল সরাসরি আক্রমণ চালিয়ে নরসিংদী এলাকার একটি তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান মিয়া আবদুল হামিদ ও তার দু’জন। সহযােগীকে হত্যার কাহিনীও তিনি সবিস্তারে বর্ণনা করেন। ৯ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনকালে মিসেস জুডিথ হার্ট বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ২০ লক্ষ পাউন্ড অপ্রতুল বলে মন্তব্য করেন। শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে তিনি আর্থিক সাহায্যের পরিমাণ বৃদ্ধি করার জন্য দাবি জানান। বিরােধী দলের নেতা হ্যারল্ড উইলসন বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব বিবেচনা করে অবিলম্বে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানান। তিনি বাংলাদেশের হত্যাযজ্ঞকে গত মহাযুদ্ধের পর সবচেয়ে মর্মান্তিক ঘটনা বলে উল্লেখ করেন। | বিরােধীদলের দাবি মেনে নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম ১০ জুন পার্লামেন্টে পাকিস্তান সম্পর্কে বিশেষ বিতর্ক অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। চার ঘণ্টাব্যাপী বিতর্ককালে স্যার আলেক বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেন। শেষ পর্যন্ত তিনি শরণার্থীদের সাহায্য বাবদ ব্রিটিশ সরকারের দান সীমাবদ্ধ থাকবে না বলে আশ্বাস দেন। ১১ জুন লন্ডনের উইকয়েন্ড টেলিভিশন বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে একটি অনুষ্ঠান প্রচার করে। এই অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনে তার বক্তব্য পেশ করেন। অনুষ্ঠানের প্রারম্ভে তাকে সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী বাঙালির প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে বিরােধী মত প্রকাশ করার জন্য অনুষ্ঠান কর্তৃপক্ষ টোরি দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন বিগস্-ডেভিডসনকে আমন্ত্রণ জানান। তিনি পাকিস্তানের গোঁড়া সমর্থক হিসেবে পরিচিত ছিলেন। এই অনুষ্ঠানে মি. বিগস-ডেভিডসন এবং আরাে কয়েকজন বিচারপতি চৌধুরীকে বহু প্রশ্ন করেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে সবগুলাে প্রশ্নের উত্তর দেন। | ১২ জুন ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী হিন্দুদের নির্বিচারে হত্যা করছে। পূর্ব বাংলা থেকে জনৈক ব্রিটিশ নাগরিক হাতে হাতে পাঠানাে এক চিঠিতে হত্যাকাণ্ডের চাক্ষুষ বিবরণ দিয়ে বলেন, পুরুষদের নির্মমভাবে হত্যা করে মহিলা ও শিশুদের ভারতে পালিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। হিন্দুদের শুধু হিন্দু বলেই হত্যা করা হচ্ছে।
৩০ থেকে ৪০ জন বাস্তুচ্যুত হিন্দুকে ছােট ছােট দলে ভাগ করে গণকবরের সামনে দাঁড় করিয়ে সরাসরি গুলি করা হচ্ছে। উল্লিখিত তারিখে লন্ডনের উত্তরে অবস্থিত সেন্ট আলবান্স শহরে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় বক্তৃতা করেন। পরদিন (১৩ জুন) বিচারপতি চৌধুরী তার সহকর্মীদের নিয়ে লিড়সে পৌঁছান। স্থানীয় একটি বিরাট হলে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, দেশকে। শত্রুমুক্ত করে এবং স্বাধীনতার পতাকা উচ্চে তুলে ধরে বাংলাদেশের বীর শহীদদের প্রতি সত্যিকারের শ্রদ্ধা নিবেদন করতে হবে। সভায় শেখ মান্নান, অধ্যাপক কবীরউদ্দিন আহমদ এবং আরাে কয়েকজন বক্তৃতা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রামে লিড়সের বাংলাদেশ অ্যাসােসিয়েশন ও লিস্ লিবারেশন ফ্রন্ট উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। মিয়া মােহাম্মদ মােস্তাফিজুর রহমান। (পরবর্তীকালে ড. রহমান) ও মির্জা মােজাম্মেল হক যথাক্রমে প্রতিষ্ঠান দুটির। প্রেসিডেন্ট ছিলেন। লিড়সের বাঙালি কর্মীরা ‘জয় বাংলা নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। মােহাম্মদ নুরুল দোহা এই পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লিড়সের মহিলারাও আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ১৩ জুন বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকরা পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের বিরুদ্ধে জনমত গঠনের উদ্দেশ্যে একটি প্রতিবাদ মিছিলের আয়ােজন করেন। মিছিলটি লন্ডনের হাইড পার্ক থেকে পার্ক লেন, পিকাডিলি ও ডাউনিং স্ট্রিট হয়ে ট্রাফালগার স্কোয়ারে পৌঁছায়। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ব্রিটিশ ওভারসিজ ডেভেলপমেন্ট দপ্তর, কানাডার হাই কমিশন এবং ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, অস্ট্রিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, হল্যান্ড ও ইতালির দূতাবাসগুলাের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ১৩ জুন (রােববার) লন্ডনের বহুল প্রচারিত ও প্রভাবশালী দি সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে এক বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। করাচির ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকার সহ-সম্পাদক ও “দি সানডে টাইমস্ -এর পাকিস্তান সংবাদদাতা এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের চাক্ষুষ বিবরণ ‘গণহত্যা’ (জেনােসাইড) শিরােনাম দিয়ে ফলাও করে ছাপানাে হয়। পত্রিকাটির প্রথম পৃষ্ঠায় সংবাদদাতার পরিচয় এবং রিপাের্টের সারমর্ম প্রকাশিত হয়। প্রায় দশ হাজার শব্দ সংবলিত মূল রিপাের্টটি পাঁচ কলামব্যাপী শিরােনাম দিয়ে ১২ থেকে ১৪ পৃষ্ঠায় ছাপানাে হয়।
প্রথম পৃষ্ঠায় প্রকাশিত রিপাের্টে বলা হয়, মার্চ মাসের শেষদিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের হাজার হাজার বেসামরিক অধিবাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করেছে। ইয়াহিয়ার সামরিক সরকারের পক্ষে এই ভয়ঙ্কর সংবাদ চাপা দেয়া সম্ভব হয় নি। কলেরা ও দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা উপেক্ষা করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৫০ লক্ষেরও বেশি বাঙালি ভারতে গিয়ে আশ্রয়প্রার্থী হওয়ার কারণ এই হত্যাযজ্ঞ। দি সানডে টাইমস্ -এর সংবাদদাতা এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের চাক্ষুষ বিবরণ বহির্বিশ্বকে অবহিত করার জন্য পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসেছেন। সৈন্যবাহিনী শুধু বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের হত্যা করে নি, হিন্দু ও মুসলমানদের তারা নির্বিচারে হত্যা করেছে। ১৮ মে (মঙ্গলবার) ম্যাসকারেনহাস লন্ডনে ‘দি সানডে টাইমস্ -এর অফিসে এসে হাজির হন। পত্রিকার কর্তৃপক্ষকে তিনি বলেন, পূর্ব বাংলা থেকে ৫০ লক্ষেরও বেশি অধিবাসী কেন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে, তার প্রকৃত কারণ সংবলিত কাহিনী তিনি লিখবেন। এই কাহিনী ছাপানাে হলে তিনি করাচিতে ফিরতে পারবেন না। তাই করাচি ফিরে গিয়ে সপরিবারে লন্ডনে ফিরে আসার আগে তাঁর রিপাের্ট ছাপানাে হবে না বলে পত্রিকার কর্তৃপক্ষ প্রতিশ্রুতি দেন। ম্যাসকারেনহাস করাচিতে ফিরে গিয়ে দশ দিন পর পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে দেশত্যাগ করতে সমর্থ হন। | ‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত মূল রিপাের্টে ঢাকা, কুমিল্লা, চাঁদপুর, হাজিগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর নবম ও ঘােড়শ ডিভিশনের অফিসারদের অমানুষিক কার্যকলাপ সম্পর্কে হৃদয়বিদারক বিবরণ দেয়া হয়। বিভিন্ন ঘটনার সঙ্গে জড়িত অফিসারদের মধ্যে নবম ডিভিশনের মেজর রাঠোর, মেজর বশীর, কর্নেল নঈম, লে. কর্নেল আসলাম, বালুচ রেজিমেন্টের ক্যাপ্টেন আজমত, লে. জাওয়াদ, কুমিল্লার সামরিক শাসক মেজর আগা এবং জেনারেল রেজা, মেজর ইফতিখার ও ক্যাপ্টেন দুররানীর নাম উল্লেখ করা হয়। কুমিল্লা সার্কিট হাউস প্রাঙ্গণে ১৯ এপ্রিল মেজর আগার নির্দেশে সন্ধ্যা ছয়টার পর লাঠি দিয়ে পিটিয়ে দু’জন হিন্দু, একজন ছাত্র, একজন আওয়ামী লীগ সংগঠক এবং একজন খ্রিষ্টান বন্দিকে হত্যার বিবরণ পড়ে কারাে পক্ষে বিচলিত না হওয়া অসম্ভব।
ঢাকায় অবস্থিত ইস্টার্ন কমান্ডের সদর দপ্তরে আলােচনাকালে ম্যাসকারেনহাসের কাছে পূর্ব বঙ্গে প্রযােজ্য সরকারি নীতি ব্যাখ্যা করা হয়। এই নীতির সপক্ষে বলা হয় : ১. বাঙালিরা বিশ্বাসযােগ্য নয়; ২. বাঙালিদের মধ্যে পৃথক হওয়ার মনােভাব দূর করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে তাদের ইসলামিক ভ্রাতৃত্ববােধ দৃঢ় করার উদ্দেশ্যে জনসাধারণকে নতুন করে ইসলামিক দীক্ষাদানের ব্যবস্থা করতে হবে; ৩. মৃত্যু ও দেশত্যাগের ফলে হিন্দুদের নাম-নিশানা মুছে যাওয়ার পর তাদের বিষয়-সম্পত্তির লােভ দেখিয়ে সুবিধাভােগ থেকে বঞ্চিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর মুসলমানদের সমর্থন আদায় করতে হবে। ভবিষ্যতে এদের ওপর। ভিত্তি করে শাসনব্যবস্থা ও রাজনৈতিক কাঠামাে গড়ে তুলতে হবে। বাঙালিদের সমর্থন লাভের জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও লে. জেনারেল টিক্কা। খানের চেষ্টা মােটামুটিভাবে ব্যর্থ হয়। কিছুসংখ্যক পাকিস্তানপন্থী বাঙালি স্বেচ্ছায় রক্তপিপাসু পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে সহযােগিতা করে। এদের মধ্যে নেজামে ইসলামের মৌলবী ফরিদ আহমদ, মুসলিম লীগের ফজলুল কাদের চৌধুরী ও জামাতে ইসলামীর গােলাম আযমের নাম ম্যাসকারেনহাসের রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়। উল্লিখিত রিপাের্ট সম্পর্কে ‘দি সানডে টাইমস্ -এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয় : ‘১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের সময় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে মতের অমিল ও অনৈক্যের বীজ বপন করা হয়। তখন থেকে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিরা ন্যায়সঙ্গতভাবে নিজেদের অসম-অংশীদার বলে অনুভব করে। দেশের আর্থিক সম্পদ সৃষ্টির ক্ষেত্রে অর্ধেকেরও বেশি অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদের প্রতি দরিদ্র আত্মীয়ের মতাে ব্যবহার করা হয়। দি সানডে টাইমস’-এর এই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী রিপাের্ট বিশ্বের বিভিন্ন সংবাদপত্র, টিভি ও রেডিওর মাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এর ফলে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি গণহত্যা সম্পর্কিত সংবাদ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
সারা বিশ্বের অসংখ্য গণতন্ত্রকামী কর্মী ও জনসাধারণ এবং বহু গণতান্ত্রিক দেশ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি প্রকাশ্যে সমর্থন জ্ঞাপন করে। ১৩ জুন সন্ধ্যায় আই টি.ভি. ‘র ‘ম্যান ইন দি নিউজ প্রােগ্রামে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারের বিবরণ প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাঙ্কারে তিনি বলেন, পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের খবর চেপে যাওয়ার চেষ্টা করছে। তিনি আরও বলেন : সৈন্যবাহিনী পাকিস্তানকে খতম করেছে। বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়া হলেই হত্যাযজ্ঞ বন্ধ হবে। বাংলাদেশের বড় বড় শহর ছাড়া আর কোথাও পাকিস্তান সরকারের অস্তিত্ব নেই বলে তিনি উল্লেখ করেন। ১৪ জুন ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ উল্লিখিত সাক্ষাৎকারের বিবরণ প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য লাভের উদ্দেশ্যে বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে ১৪ জুন একটি শােভাযাত্রার আয়ােজন করা হয়।
জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণক্রমে আল্‌স্টারের ইউনিয়নপন্থী পার্লামেন্ট সদস্য জেমস্ কিফেডার, শ্রমিকদলীয় সদস্য জেমস্ টিন এবং টোরি দলীয় সদস্য মিসেস জিল নাইট (পরবর্তীকালে ডেইম্ নাইট) পাকিস্তান সফরে যান। দি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রেরিত একাধিক তারবার্তায় মিসেস নাইট নিজেকে পাকিস্তান ও ইয়াহিয়া খানের অন্ধভক্ত বলে প্রমাণ করেন। ১৪ জুন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক তারবার্তায় মিসেস নাইট | ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারের কথা উল্লেখ করেন। এই সাক্ষাৎকারকালে শেখ মুজিবকে পূর্ব বঙ্গ পরিস্থিতির জন্য দায়ী করে ইয়াহিয়া খান বলেন, নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন করার চেষ্টা করেন। তিনি ও তার সহকর্মীরা বহু লােককে হত্যা করেন। এই তারবার্তায় আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের সৈন্যবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং পূর্ব বঙ্গে নিয়ােজিত প্রত্যেক পাকিস্তানি সৈন্যকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেছিল বলে পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ বিশ্বাস করেন। এই পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী তড়িৎগতিতে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। ১৫ জুন ১২০ জন শ্রমিকদলীয় সদস্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে। একটি প্রস্তাব পেশ করেন। এই প্রস্তাবে পূর্ব বঙ্গে গণহত্যার জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও সামরিক নেতৃবৃন্দকে দায়ী করা হয়। ডাক ও তার-যােগাযােগ দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী জন স্টোনহাউস উত্থাপিত এই প্রস্তাব সমর্থন করে যারা দস্তখত দেন তাঁদের মধ্যে ছয়জন প্রিভি কাউন্সেলর, শ্রমিক দলের চেয়ারম্যান ইয়ান মিকাডো এবং কার্যনির্বাহী পরিষদের তিনজন সদস্য ছিলেন। কয়েকদিনের মধ্যে প্রস্তাবটি তিনশ’র বেশি পার্লামেন্ট সদস্যের সমর্থন লাভ করে। পার্লামেন্টে উত্থাপিত অপর একটি প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে উপযুক্ত রাজনৈতিক কাঠামাে গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখা বাঞ্ছনীয়। দু’শ পঞ্চাশজনের বেশি পার্লামেন্ট সদস্য প্রস্তাবটি সমর্থন করেন।
১৬ জুন ‘ডেইলি মিরর পত্রিকায় খ্যাতনামা সাংবাদিক জন পিলজার প্রদত্ত রিপাের্টে পূর্ব বঙ্গে নির্বিচারে বাঙালিদের হত্যা ও নির্যাতনের ভীতিজনক এক বিবরণ দেয়া হয়। পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি এড়িয়ে মি. পিজার বাংলাদেশের যুদ্ধবিধ্বস্ত এলাকা সফর করেন। একটি জাতির মৃত্যু’ শীর্ষক রিপাের্টে জনৈক বৃদ্ধের পেটে বেয়নেট দিয়ে এলােপাতাড়ি কাটার চিহ্ন, সরাসরি গুলির আঘাতে একটি শিশুর ক্ষতবিক্ষত কানে জমাট রক্ত এবং জীবন্ত কবর দেয়া স্বামীর কবরের পাশে জনৈক মহিলার শােক প্রকাশের করুণ কাহিনী দিয়ে তিনি তার রিপাের্ট শুরু করেন। উপসংহারে তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসীর বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান পরিচালনা করছে। গ্রামের পর গ্রাম আক্রমণ করে শেখ মুজিবের সমর্থক এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের হত্যা করাই তাদের মূল উদ্দেশ্য। হাজার হাজার, সম্ভবত লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ পুরুষ, মহিলা ও শিশুকে পাঞ্জাবি ও পাঠান সৈন্যরা নির্মমভাবে হত্যা করেছে। এই রিপাের্ট প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী জন পিলজারকে টেলিফোন করে ধন্যবাদ জানান। এর দু’একদিন পর মি. পিলজার বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের সর্বশেষ পরিস্থিতি সম্পর্কে মৌখিক বিবরণ দেন। মি. পিজার বলেন, বাংলাদেশ নিজস্ব শক্তিতে জয়ী হবে বলে তিনি বিশ্বাস করেন। ১৬ জুন ‘দি টাইমস্ পত্রিকায় একটি সন্দেহজনক সংবাদ প্রকাশিত হয়। রাতারাতি গজিয়ে ওঠা এশিয়ান নিউজ সার্ভিস’ নামের একটি প্রতিষ্ঠানের সংবাদদাতা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে শৃঙ্খলা ফিরে এসেছে বলে নিশ্চিত হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেসামরিক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তনের উদ্যোগ নিয়েছেন। ঢাকার অধিবাসীদের মধ্যে যারা পালিয়ে গিয়েছিলেন তারা ফিরে আসতে শুরু করেছেন। ঢাকার ধ্বংসপ্রাপ্ত বাজারগুলােতে আবার বেচাকেনা শুরু হয়েছে।
বেসামরিক কর্তৃপক্ষ চট্টগ্রাম, খুলনা, ময়মনসিংহ, কুমিল্লা ও ছােট শহরগুলাের শাসনভার গ্রহণ করেছেন।… পূর্ব পাকিস্তান থেকে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলভুক্ত ১৬৭ জন সদস্যের মধ্যে ২৫ জন ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সহযােগিতা করবেন বলে বিশ্বাসযােগ্য সূত্রে জানা গেছে। ব্যাপক ক্ষমা প্রদর্শন সম্পর্কে সামরিক সরকারের ঘােষণা প্রচারিত হওয়ার পর আরও বহু সদস্য এদের সঙ্গে যােগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।… প্রাক্তন চিফ জাস্টিস ও আইনমন্ত্রী কর্নেলিয়াস এবং প্রাক্তন এটর্নি জেনারেল মঞ্জুর কাদির একটি নতুন সংবিধান প্রণয়নে ব্যস্ত রয়েছেন।… ঢাকার জনৈক মধ্যবিত্ত বাঙালি কেরানির মন্তব্য থেকে পরিস্থিতি আঁচ করা যায়। এই কল্পলােকনিবাসী কেরানি বলেন : ‘আমরা চাই শান্তি; বাংলাদেশ না পাকিস্তান তা আমরা জানতে চাই না।৭২ বাংলাদেশ মহিলা সমিতি, অ্যাকশন বাংলাদেশ এবং আরাে কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যােগ দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধের দাবি জানিয়ে সপ্তাহব্যাপী ব্যাপক কর্মসূচি পালন উপলক্ষে ১৬ জুন পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।। পাকিস্তানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জ্ঞাপন উপলক্ষে মহিলা সমিতির কর্মীরা অন্যদের সঙ্গে যােগ দিয়ে লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের সামনে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় অংশগ্রহণ করেন। এই উপলক্ষে স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটির কর্মী আবদুল হাই খান ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী দূতাবাসের সামনে অনশন পালন করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন, এ দুজনের অনশন শুরু হওয়ার পর তিনি প্রতিদিনই তাদের দেখতে যান। কয়েকদিন পর তাদের অবস্থা দেখে তিনি। তার অফিসে বসে ভাবছিলেন, এ ব্যাপারে কী করা যায়। এমন সময় মার্কিন দূতাবাসের রাজনৈতিক সচিব মি. কিং তাকে টেলিফোন করেন। তিনিই বিচারপতি চৌধুরীর জন্য মার্কিন ভিসার ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মি. কিং বলেন, রাষ্ট্রদূত থেকে সবাই অনশনের ব্যাপারে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। বিচারপতি চৌধুরী ও অনশনকারীদের মনােভাব রাষ্ট্রদূত ও মার্কিন সরকারকে যথাযথভাবে জানাবার প্রতিশ্রুতি দিয়ে মি. কিং অনশন প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে সনির্বন্ধ অনুরােধ জানান। মি. কিং-এর অনুরােধ সম্পর্কে স্টিয়ারিং কমিটি এবং স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটির নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করে বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন দূতাবাসের সামনে গিয়ে ছাত্রদের অনশন ভাঙার অনুরােধ জানান। অনশনকারীরা তার অনুরােধ রক্ষা করেন।
১৭ জুন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম বিচারপতি চৌধুরীর কূটনৈতিক পরিচয়পত্র স্বাক্ষর করেন। এই পরিচয়পত্রে বিচারপতি চৌধুরীকে যুক্তরাজ্যে হাই কমিশনার হিসেবে নিয়ােগের কথা আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা করা হয়। এই পরিচয়পত্র রানী দ্বিতীয় এলিজাবেথের সরকারি বাসভবন বাকিংহাম প্যালেসে পেশ করা হয়। যথাসময়ে পরিচয়পত্র প্রাপ্তিস্বীকার করে বাকিংহাম প্যালেস থেকে বিচারপতি চৌধুরীর কাছে একটি পত্র পাঠানাে হয়। এই পত্রের মাধ্যমে প্রকারান্তরে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়া হয় বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। | ১৯ জুন ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক তারবার্তায় মিসেস জিল নাইট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে ব্যাপক সফরকালে তিনি পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত গণহত্যার কোনাে প্রমাণ পান নি। বরং আওয়ামী লীগের ‘চরমপন্থী সদস্যদের নৃশংসতার প্রমাণ পেয়ে তিনি বিচলিত হয়েছেন। ঢাকার নতুন শহর থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সংসদ সদস্য জহিরুদ্দিন তাকে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলন তিনি সমর্থন করেন না। পাকিস্তান সরকার শান্তি ফিরিয়ে আনবে বলে তিনি (জহিরুদ্দিন) বিশ্বাস করেন। করাচি থেকে প্রেরিত মিসেস নাইটের এই তারবার্তায় পাকিস্তান সামরিক চক্রের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন সহানুভূতি পাঠকদের দৃষ্টি এড়ায় নি। ( ১৯ জুন হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এক প্রতিবাদ সভায় শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের বলেন, পাকিস্তানের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে ব্রিটিশ সরকারের অগ্রণী হওয়া উচিত। বেসামরিক ও প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দেয়া হবে না বলে পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দেয়ার জন্য তিনি আন্তর্জাতিক সাহায্যদানকারী সংস্থার প্রতি আবেদন জানান। জুন মাসের মাঝামাঝি জাতীয় শ্রমিক লীগের সভাপতি মােহাম্মদ শাজাহান ও সাধারণ সম্পাদক আবদুল মান্নান লন্ডন সফরে আসেন। স্টিয়ারিং কমিটি। আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে তারা বক্তৃতা করেন। মার্চ মাসের গৌরবজনক। সগ্রাম সম্পর্কে তারা আবেগপূর্ণ ভাষায় তাদের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার সপক্ষে ব্রিটিশ শ্রমিক আন্দোলনের সমর্থন লাভের জন্য জাতীয় শ্রমিক লীগের নেতৃদ্বয় ব্রিটেন আসেন।
মি. মান্নান ইঞ্জিনিয়ারিং শ্রমিকদের নেতা হিউ স্ক্যানলন, রাসায়নিক শ্রমিকদের নেতা বল্ এডওয়ার্ডস, সিনেমা শিল্পে নিয়ােজিত কারিগরদের নেতা এ্যালান স্যাপার, খনি শ্রমিকদের নেতা লরেন্স ড্যালি এবং ছাপাখানার শ্রমিকদের নেতা রিচার্ড ব্রিগিনশ’র সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সমর্থনের আবেদন জানান। ব্রিটিশ শ্রমিক। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ তার আবেদনে সাড়া দিয়ে পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। _ ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির মুখপত্র ‘দি মনিং স্টার’-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা ক্রিস্ মায়ান্টের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মি. মান্নান বলেন, বাংলাদেশের শ্রমিকশ্রেণী শেখ মুজিবুর রহমানের ছয়-দফা দাবির মধ্যে অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতিশ্রুতি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার ফলে তাঁর নেতৃত্বে গণসংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করে। ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী সশস্ত্র আক্রমণ শুরু করার পর নিপীড়িত শ্রমিকশ্রেণী সর্বাগ্রে স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈনিক ও স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে যােগদান করে। এই সাক্ষাৎকারের বিবরণ ২৮ জুলাই ‘দি মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ২০ জুন এক জনসভায় বক্তৃতা করার জন্য বিচারপতি চৌধুরী ওয়েলসের প্রধান শহর কার্ডিফে যান। মি, মান্নানও তার সঙ্গে যান। সভায় বক্তৃতাদানকালে তিনি স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে তাঁর ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং বাঙালি শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর নির্যাতনমূলক কার্যকলাপের ভয়াবহতা বর্ণনা করেন। কার্ডিফের জনসভায় বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, এবারের স্বাধীনতা হবে গণমানুষের স্বাধীনতা এবং তাদের প্রতিনিধিরা দেশ শাসন করবেন। পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের আপােসের সম্ভাবনা রয়েছে বলে যে গুজব ছড়ানাে হয়েছে, তা ভিত্তিহীন বলে তিনি ঘােষণা করেন। অন্য বক্তাদের মধ্যে ছিলেন শেখ আবদুল মান্নান ও সুলতান মাহমুদ শরীফ।
২১ জুন বিচারপতি চৌধুরী শ্রমিক নেতা মি. মান্নানসহ হল্যান্ড সফরে যান। সফরে যাওয়ার দু’দিন আগে হল্যান্ড থেকে একটি টেলিভিশন টিম লন্ডনে এসে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। ২০ জুন সন্ধ্যায় এই সাক্ষাঙ্কার। প্রচারিত হয়। পরদিন বিকেলবেলা বিমানযােগে তিনি আমস্টারডামে পৌঁছান। বিমানবন্দরের ভি আই পি রুমে সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের সাংবাদিকরা তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিমানবন্দর থেকে হােটেলে পৌঁছানাের পর দু’জন পার্লামেন্ট সদস্য তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাঁদের সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। পরদিন (২২ জুন) বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে পার্লামেন্ট ভবনে যান। কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্যের সহায়তায় তিনি স্পিকারের সঙ্গে সৌজন্যমূলক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বিকেলবেলা পার্লামেন্টের একটি কমিটি রুমে তিনি বৈদেশিক ব্যাপার সম্পর্কিত সাব-কমিটির সদস্যদের সঙ্গে মিলিত হন। তারা দু’ঘণ্টারও বেশি সময় ধরে বিচারপতি চৌধুরীকে নানা প্রশ্ন করেন। প্রশ্নোত্তরের পর সাব-কমিটির চেয়ারম্যান বলেন, বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে। আলােচনার পর তারা বুঝতে পেরেছেন, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের পর বাংলাদেশ পাকিস্তানের সঙ্গে থাকতে পারে না। তারা আরও বলেন, বাংলাদেশের সংগ্রামকে তারা আদর্শগতভাবে সমর্থন জানাবেন। সাব-কমিটির সদস্যদের সঙ্গে আলােচনাকালে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন। সুনীল কুমার লাহিড়ী, জহীরুদ্দিন এবং রাজিউল হাসান রঞ্জু। পরদিন লন্ডনে ফিরে আসার আগে বিচারপতি চৌধুরী একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। এই সম্মেলনের রিপাের্ট এবং অন্যান্য কার্যকলাপের সংবাদ হল্যান্ডের বিভিন্ন সংবাদপত্রের প্রথম পৃষ্ঠায় দু’তিন কলামব্যাপী শিরােনাম দিয়ে প্রকাশিত হয়। স্বল্পসংখ্যক প্রবাসী বাঙালির সাহায্য ও সহায়তা এবং আদর্শের প্রতি বিচারপতি চৌধুরীর দৃঢ়প্রত্যয়ের ফলে ডাচ সরকারি ও বেসরকারি মহল তাকে একটি স্বাধীন, সার্বভৌম এবং সর্বজন স্বীকৃতরাষ্ট্রের বিশেষ প্রতিনিধির মর্যাদা ও সম্মান প্রদর্শন করেন।৭৫
২১ জুন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী সরদার শরণ সিং ও ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রায় এক ঘণ্টাকাল আলাপ-আলােচনা করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরে অনুষ্ঠিত এই ঘরােয়া বৈঠকের পর প্রচারিত এক যুক্ত বিবৃতিতে বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের অধিবাসীরা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সংজ্ঞা নির্ধারণ করবেন। এই বিবৃতির মাধ্যমে গ্রহণযােগ্য। সমাধানের শর্ত সম্পর্কে ব্রিটিশ সরকারের মনােভাব পরিষ্কারভাবে প্রকাশ করা হয়। বাঙালিদের স্বাধীনতা দাবির এই পরােক্ষ স্বীকৃতি প্রবাসী বাঙালিদের উৎসাহিত করে।৬ পররাষ্ট্র দপ্তরে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি. শরণ সিং বলেন, ভারতের জন্য বৈদেশিক সাহায্য চাওয়ার উদ্দেশ্যে তিনি লন্ডনে আসেন নি। পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার অনুরােধ জানানাে তার সফরের মূল উদ্দেশ্য। সােভিয়েত ইউনিয়ন ও পশ্চিম ইউরােপের কয়েকটি দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে আলােচনার পর মি. শরণ সিং লন্ডনে আসেন। তিনি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এওয়ার্ড হিথের সঙ্গেও এক সাক্ষাৎকারে মিলিত হন। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের নির্দেশ অনুযায়ী বিচারপতি চৌধুরী শরণ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে ভারতীয় রাষ্ট্রদূত আপা পন্থ উপস্থিত ছিলেন। মি. শরণ সিং বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বিভিন্ন দেশ সফরকালে যদি বিপদের সম্মুখীন হন, তা হলে তিনি (বিচারপতি চৌধুরী) ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে যােগাযােগ করতে যেন দ্বিধাবােধ না করেন। কথা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র পাঠাবার ব্যাপারে ভারত সরকারের অনুমতি চেয়েছেন। অনুমতি না । পাওয়ার জন্য অস্ত্র পাঠানাে সম্ভব হচ্ছে না বলে প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে হতাশা। দেখা দিয়েছে। মি, শরণ সিং বলেন, বিদেশ থেকে অস্ত্র না পাঠালেও মুক্তিযােদ্ধারা প্রয়ােজনীয় অস্ত্র পাচ্ছে। তবে লন্ডন থেকে অস্ত্র পাঠাবার অনুমতি ।
দেয়ার আগে কয়েকটি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে সেজন্য অনুমতিদানে বিলম্ব হচ্ছে। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন, শেখ মান্নান ও আজিজুল হক ভুইয়া ভারতীয় দূতাবাসের বাঙালি কূটনীতিবিদ শশাঙ্ক শেখর ব্যানার্জির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। মুজিবনগর সরকারের কোনাে জরুরি বার্তা ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে পাঠানাে হলে মি. ব্যানার্জি তা শেখ মান্নান অথবা মি. ভুইয়ার কাছে পৌছানাের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ৭৭ পারী থেকে ২১ জুন প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে গঠিত ১১ সদস্যবিশিষ্ট আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান (এই পাকিস্তান কন্সরসিয়াম) পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত নতুন সাহায্যদানের প্রস্তাব সম্পর্কিত আলােচনা স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সাহায্যদানকারী দেশগুলাের প্রতিনিধিদের সভায় ‘বি’ করার জন্য লন্ডন থেকে অ্যাকশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও বাংলাদেশ মহিলা সমিতির প্রতিনিধিরা পারী সফর করেন। ২৪ জুন ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম পার্লামেন্টে বলেন, পূর্ব বাংলা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের নিশ্চিত প্রমাণ না পাওয়া পর্যন্ত ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানকে নতুন কোনাে বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুর করবে না। এই ঘােষণার মাধ্যমে কয়েকদিন আগে পারীতে অনুষ্ঠিত এই পাকিস্তান কন্সরসিয়াম’-এর সিদ্ধান্তের প্রতি ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন সূচিত হয়। | ২৬ জুন লন্ডনের বেওয়াটার এলাকায় সংগঠিত বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে একটি প্রকাণ্ড হলে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বহু ইংরেজ এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। শ্রমিক দলের পক্ষ থেকে পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। শেখ মান্নান স্টিয়ারিং কমিটির কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ দেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন : বাঙালির জয়যাত্রা সফল হবেই। এই তিন মাসে যে একতা গড়ে উঠেছে তা সকল বাধা অতিক্রম করে সাফল্য বয়ে আনবে।
স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর ২৭ জুন বার্মিংহামে দ্বিতীয় জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ডিগবেথ হলে অনুষ্ঠিত এই সভায় বক্তৃতাদান উপলক্ষে বিচারপতি চৌধুরী। স্বাধীনতা সংগ্রামের যৌক্তিকতা এবং ২৫ মার্চের পর সংঘটিত তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনাগুলাে বর্ণনা করেন। তাছাড়া বাংলাদেশ সংগ্রামের ঐতিহাসিক ও আদর্শগত দিক সম্পর্কেও তিনি বিশদ ব্যাখ্যা দেন। শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জুলিয়াস সিলভারম্যান এবং ক্রস ডগলাসম্যানও সভায় বক্তৃতা করেন। | বিরাট জনসমাবেশের সুযোেগ নিয়ে চীনপন্থী বাঙালি মেসবাহউদ্দিন হলের বাইরে দাঁড়িয়ে তার দলের মুখপত্র ‘গণযুদ্ধ বিক্রির চেষ্টা করেন। এই খবর পাওয়ার পর স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য আজিজুল হক ভূঁইয়া মাইক্রোফোনের সামনে দাঁড়িয়ে বলেন : ভাই সব, এই হলের বাইরে চীনের এক চর আমাদের সভা ‘স্যাৰােটাজ করার জন্য দাঁড়িয়ে আছে। সে পত্রিকা বিক্রি করছে। তার ঘােষণা শােনার পর জনতা মেসবাহউদ্দিনকে ঘিরে ফেলে উত্তম-মধ্যম দেয়ার উপক্রম করে। শেখ মান্নান ছুটে গিয়ে তাকে জনতার হাত থেকে মুক্ত করে হলের মধ্যে নিয়ে এসে বিচারপতি চৌধুরীর পাশে চুপচাপ বসে থাকার জন্য বলেন। সভা শেষ না হওয়া পর্যন্ত তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা হয়। হলের একদিকে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটি কয়েকটি ছােট ছােট দোকান খােলে। এই দোকানগুলােতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মনােগ্রাম সংবলিত নেক-টাই, কাফ-লিঙ্ক ইত্যাদি বিক্রি করা হয়। সভার উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন জগলুল পাশা, মােহাম্মদ আবদুল গনি ও তােজাম্মেল হক (টনি)। ২৭ জুন ‘দি সানডে টাইমস্ -এর রাজনৈতিক ভাষ্যকার হুগাে ইয়াং এক নিবন্ধে বলেন, ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি নেতৃবৃন্দের হাস্যকর নির্বুদ্ধিতার জন্য রক্ষণশীল দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য মিসেস জি নাইটের নেতৃত্বে প্রেরিত পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সফরকে সামরিক সরকার অন্তত পাকিস্তানের অভ্যন্তরে তাদের অপপ্রচারের স্বপক্ষে ব্যবহার করতে সক্ষম হয়েছে। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব বাংলায় হিন্দু ও মুসলমানদের ব্যাপক হারে হত্যা করেছে বলে মিসেস নাইট এখন স্বীকার করছেন। এর জন্য পাকিস্তানকে ভুল বােঝা উচিত হবে না বলে তিনি (মিসেস নাইট) মনে করেন।
এ প্রসঙ্গে মি, ইয়াং ১৪ জুন থেকে ২৩ জুন পর্যন্ত ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত তাঁর তারবার্তার উল্লেখ করেন। উক্ত তারবার্তায় মিসেস নাইট বলেন, সামরিক বাহিনী সংঘটিত ব্যাপক হারে হত্যার কোনাে প্রমাণ তিনি পান নি। হত্যা সম্পর্কিত খবরগুলাে পাকিস্তান-বিরােধী প্রচারণা ছাড়া আর কিছুই নয়। ভারতের প্রতি সহানুভূতিশীল বিদেশী সংবাদপত্রগুলাে পূর্ব বাংলার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসার জন্য দায়ী বলে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর প্রতি সহানুভূতিসম্পন্ন মিসেস নাইট ইঙ্গিত করেন। বিগত সপ্তাহে মিসেস নাইট ‘দি সানডে টাইমস’-এর সংবাদদাতাকে বলেন : জরুরি অবস্থার চরম পর্যায়ে নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ড অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে আমি নিশ্চিত কিন্তু এখনও তা ঘটছে বলে আমি মানতে রাজি নই।’ মি, ইয়াং প্রকাশ করেন, ব্রিটেন ও পাকিস্তান প্রায় একই সঙ্গে পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের পাকিস্তান সফরের প্রস্তাব করে। ১৪ মে পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনাকালে পররাষ্ট্র ব্যাপারে শ্রমিকদলীয় মুখপাত্র ডেনিস্ হিলি এ সম্পর্কে প্রথম উল্লেখ করেন। সরকার ও বিরােধীদল একমত হওয়ার পর আশা করা হয়েছিল, পররাষ্ট্র দপ্তর, পার্লামেন্টের কর্মসূচি নির্ধারণের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী উইলিয়াম হােয়াইটুল’ এবং রক্ষণশীল ও শ্রমিকদলের চিফ হুইপ যথাক্রমে ফ্রান্সিস পিম ও ব মেলিস্ এ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা অবলম্বন করবেন। ১৪ মে পাকিস্তান হাই কমিশন একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের প্রতিনিধিদল পাকিস্তানে পাঠাবার উদ্যোগে গ্রহণ করে। ব্রিটিশ পরিকল্পনা অনুযায়ী উভয় সরকারের সম্মতি নিয়ে পার্লামেন্টের প্রবীণ সদস্যদের পাঠানাে হবে এবং ব্রিটিশ সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করবে বলে আশা করা হয়েছিল। পাকিস্তানিরা প্রবীণ সদস্যদের পরিবর্তে তাদের মনােনীত সদস্যের আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করে। এই পরিকল্পনা অনুযায়ী পার্লামেন্টের হুইটসান’ ছুটি শেষ হওয়ার আগেই পাকিস্তান মিসেস নাইট ও তার সঙ্গীদের আমন্ত্রণ জানায়। পার্লামেন্টের ৬৩০জন সদস্যের মধ্যে এই তিনজনকে কেন আমন্ত্রণ জানানাে হয়, সে সম্পর্কে পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত কাউন্সেলার সন্তোষজনক উত্তর দিতে পারেন নি বলে মি. ইয়াং উল্লেখ করেন। | উল্লিখিত প্রতিনিধিদলের সদস্য মনােনয়নের ব্যাপারে রক্ষণশীল দলীয় সদস্য স্যার ফ্রেডারিক বেনেট গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি পার্লামেন্ট সদস্যদের সমবায়ে গঠিত এ্যাংলাে-পাকিস্তান গ্রুপের চেয়ারম্যান। তিনি ‘স্টার অব পাকিস্তান’ পদক ধারণ করে গর্ব বােধ করেন। তার পিতা মি. জিন্নাহর বন্ধু ছিলেন বলে তিনি পার্লামেন্টে বক্তৃতাদানকালে প্রকাশ করেন। সর্বদলীয় পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল পাঠানাের দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি ও | বিরােধীদলের সদস্যরা ছুটির শেষে ৮ জুন পার্লামেন্টের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর | মিসেস নাইটের নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধিদল ১১ জুন পাকিস্তান রওনা হবেন বলে জানতে পারেন।
এই খবর প্রকাশিত হওয়ার পর প্রতিনিধি পাঠানাের দায়িত্বপ্রাপ্ত। সদস্যরা মিসেস নাইট ও তাঁর সঙ্গীদের সফর বাতিল করার চেষ্টা করেন। প্রাক্তন যুদ্ধমন্ত্রী জেমস্ র্যামডেন ও মি. হিলির যুক্ত নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে তাদের তিনজনকে গ্রহণ করা হবে বলে আশ্বাস দেয়া হয়। ১০ জুন এই নবগঠিত প্রতিনিধিদলের সদস্যদের নাম যখন ঘােষণা করা হয়, তখন পর্যন্ত কয়েকটি জরুরি কাজ সমাধা করা হয় নি। প্রতিনিধিদল ভারত অথবা পাকিস্তানে | যাবে, নাকি উভয় দেশে যাবে, তা স্থির করা হয় নি। ঘােষণা প্রকাশিত হওয়ার আগে বিদেশ সফররত মি. হিলির সঙ্গে আলােচনা করা হয় নি। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সুযােগ গ্রহণ করে মিসেস নাইট ও তার সঙ্গীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী পাকিস্তানের পথে রওনা হন। | পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলাে মিসেস নাইটের পাকিস্তান-প্রীতি সম্বল করে | অনতিবিলম্বে বাংলাদেশ ও ভারতবিদ্বেষী প্রচারণায় মনােনিবেশ করে। রেডিও পাকিস্তানের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মিসেস নাইট বলেন, ব্রিটিশ সংবাদপত্রে অত্যধিক পরিমাণে ‘উড়াে-খবর ও একতরফা ভারতীয় প্রচারণা’ ছাপানাে হচ্ছে। বলে তিনি মনে করেন। জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে ব্রিটিশ টেলিভিশনের সংবাদ পরিক্রমায় জিল নাইটের পূর্ব বাংলা সফর সম্পর্কিত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এই চলচ্চিত্রে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে এক জনসমাবেশে আলােচনারত মিসেস নাইটকে দেখানাে হয়। এই সমাবেশে মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান দেশে কোনাে গােলযােগ কিংবা অশান্তি আছে কি না জিগ্যেস করার জন্য মিসেস নাইটকে অনুরােধ করেন। তার প্রশ্নের উত্তরে সমাবেশের মধ্য থেকে বলা হয়, দেশের অবস্থা সম্পূর্ণ শান্ত ও স্বাভাবিক। বলা বাহুল্য, পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষের সহায়তায় এই সমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছিল। পূর্ব লন্ডনের প্রবীণ সমাজকর্মী আবদুল মালেক ১৯৮৪ সালের মে মাসে এক সাক্ষাঙ্কারে বলেন, উল্লিখিত সংবাদ-পরিক্রমা দেখার পর তিনি গভীর রাতে শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শশারের সঙ্গে টেলিফোনযােগে আলাপ করেন। মি, শােরকে তিনি বলেন, অবিলম্বে এই মিথ্যা প্রচারণার জোরালাে প্রতিবাদ না করা হলে বাংলাদেশ সম্পর্কে পার্লামেন্টে উত্থাপিত প্রস্তাবের প্রতি ইতােমধ্যে যাঁরা সমর্থন জ্ঞাপন করেছেন, তাঁদের কেউ কেউ হয়তাে সমর্থন প্রত্যাহার করবেন। তিনি মি, মালেককে প্রবাসী বাঙালিদের পক্ষ থেকে একটি প্রতিবাদপত্র নিয়ে পরদিন পার্লামেন্টে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করার পরামর্শ দেন। মি. মালিক তার কন্যার সাহায্যে একটি প্রতিবাদপত্র টাইপ করে পরদিন মি. শশারের হাতে পৌঁছে দেন। মি. শাের এই প্রতিবাদপত্র নিয়ে শ্রমিকদলীয় নেতা মি. হ্যারল্ড উইলসনের সঙ্গে আলাপ করেন। পার্লামেন্ট-বহির্ভূত বাংলাদেশ সমর্থক মহলও পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা বন্ধের দাবি জানায়।
বিচারপতি চৌধুরীও এ ব্যাপারে কর্মতৎপরতার পরিচয় দেন। তিনি তাঁর স্মৃতিকথায় লিখেছেন, বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদানকারী পার্লামেন্ট সদস্যদের সহায়তায় আরও চারজন সুপরিচিত সদস্যকে বাংলাদেশ ও ভারত পরিদর্শনের জন্য তিনি রাজি করান। এঁদের মধ্যে ছিলেন রক্ষণশীল দলভুক্ত জেমস্ র্যামডেন ও টোবি জ্যাসেল এবং শ্রমিক দলভুক্ত আর্থার বটলি ও রেজ প্রেন্টিস্। ২১ জুন তারা লন্ডন ত্যাগ করেন। ৭৯ | বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর সম্পাদকমণ্ডলীর চেয়ারম্যান ফরিদ এস জাফরী জুন মাসে লিখিত এক খােলা-চিঠিতে মিসেস জিল্ নাইটের পাকিস্তান-প্রীতির তীব্র সমালােচনা করেন। এই চিঠিতে বলা হয়, আপনি যদি “দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাসের ‘গণহত্যা’ শীর্ষক বিস্তারিত রিপাের্ট পড়ে থাকেন, তা হলে আপনি নিশ্চয় হত্যাযজ্ঞের স্থান ও কাল এবং নিহতদের নাম-ঠিকানা লক্ষ্য করেছেন। এসব প্রামাণ্য তথ্য আপনি কি অস্বীকার করতে চান? হিন্দু ও মুসলমানদের জ্বালিয়ে দেয়া বাড়িঘর কি আপনি দেখেছেন? পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রে হিন্দুদের সমূলে উৎখাত করে দেশত্যাগে বাধ্য করার দাবি সম্পর্কিত খবর কি আপনি পড়েছেন? পাকিস্তান সরকারের আমন্ত্রণে
ইসলামাবাদে গিয়ে বন্ধুত্বপূর্ণ আলাপ-আলােচনার পর বাস্তুত্যাগীদের দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানের আন্তরিকতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হওয়া আপনার নিরপেক্ষতার অভাব প্রমাণ করে। আপনি স্বেচ্ছায় নিতান্ত বােকার মতাে পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা প্রচারণার শিকার হয়েছেন বলে আমরা অবাক হচ্ছি। মানবাধিকারের সমর্থক না হয়ে আপনি নিজেকে খুনি সরকারের অন্ধ-সমর্থক বলে প্রমাণ করেছেন। ব্যাপারটি অত্যন্ত দুঃখজনক ও আপাতবিরােধী সত্য, এ সম্বন্ধে কোনাে সন্দেহ নেই। মহান মুক্তিযােদ্ধাদের চরম আত্মত্যাগ ও কষ্টভােগ সম্পর্কে আপনার অযৌক্তিক মন্তব্যের বিরুদ্ধে আমাদের ঘৃণা ও ক্ষোভ ভাষায় প্রকাশ করা কঠিন। পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে। আপনার লজ্জাকর ভূমিকা সম্পর্কে রায় দেয়ার ভার আমরা ব্রিটেনের জনগণের ওপর ছেড়ে দিচ্ছি। ২৮ জুন লন্ডনের রেড় লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে গ্রেটার লন্ডন ও পার্শ্ববর্তী এলাকার অ্যাকশন কমিটিগুলাের প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী কেন্দ্রীয় এ্যাকশন কমিটির নির্বাচন স্থগিত রাখার কারণ বিশ্লেষণ করেন এবং একতা বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন, কেন্দ্রীয় এ্যাকশন কমিটির কাজ স্টিয়ারিং কমিটি চালিয়ে যাচ্ছে এবং তা সুষ্ঠুভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। যুদ্ধকালীন পরিস্থিতির মধ্যে সবার দৃষ্টি যদি নির্বাচনের দিকে চলে যায়, তা হলে সাংগঠনিক কাজ পিছিয়ে যাবে বলে তিনি মনে করেন। জাতীয় স্বার্থে আরও কিছুদিন নির্বাচন স্থগিত রাখার জন্য তিনি অনুরােধ করেন। প্রতিনিধিরা তার আবেদনে সাড়া দেয়ার ফলে দলাদলির বিপদ থেকে আন্দোলন রক্ষা পায় বলে তিনি পরবর্তীকালে মন্তব্য করেন। ২৯ জুন পনেরজন বাঙালি খালাসি ও অফিসার ওয়েলসের কার্ডিফ বন্দরে নােঙর করা পাকিস্তানি জাহাজ এম ভি কর্ণফুলি’ থেকে পালিয়ে ট্রেনযােগে লন্ডনে এসে স্বরাষ্ট্র দফতরে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেন।
তারা বলেন, করাচি থেকে রওনা হওয়ার পর নানাভাবে তাদের হয়রান, অপমান, এমনকি শারীরিক নির্যাতন করা হয়। অফিসারদের মুখপাত্র এ কে এম নুরুল হুদা (ইঞ্জিনিয়ার) বলেন, পাকিস্তানে ফিরে গেলে তাদের শারীরিক নির্যাতন কিংবা হত্যা করা হবে বলে তারা আশঙ্কা করেন। তিনি আরও বলেন, চট্টগ্রাম বন্দরে অস্ত্রবাহী জাহাজ থেকে ডক শ্রমিকরা মাল খালাস করতে অস্বীকার করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা জাহাজে উঠে বাঙালি খালাসিদের প্রত্যেককে হত্যা করে নদীতে ফেলে দেয়। | কার্ডিফ থেকে নির্বাচিত পার্লামেন্ট সদস্য এ্যালফ্রেড এভান্সের সহায়তায় বিচারপতি চৌধুরী বাঙালি খালাসি ও অফিসারদের রাজনৈতিক আশ্রয়ের প্রার্থনা। মঞ্জুর করাতে সক্ষম হন। এ কে এম নুরুল হুদাকে স্টিয়ারিং কমিটির একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করা হয়। ৩০ জুন (বুধবার) দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক পূর্ণ-পৃষ্ঠা বিজ্ঞাপনে বাংলাদেশে সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানানাে হয়। ১৫ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ সমর্থক সদস্যরা যে প্রস্তাব পেশ করেন, তা বড় বড় অক্ষরে ছাপিয়ে তার নিচে দু’শ’জনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্যের নাম প্রকাশ করা হয়। এদের মধ্যে ১১ জন প্রিভি কাউন্সিলর এবং ৩০ জনেরও বেশি প্রাক্তন মন্ত্রীর নাম রয়েছে। বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে এই বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। জুন মাসে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি প্রায় ছ’শ পত্রের মাধ্যমে ব্রিটেনের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র ইউনিয়নের কাছে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন এবং মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যদানের জন্য অনুরােধ জানান।
জুলাই, ১৯৭১
১ জুলাই ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে পাকিস্তান সফরকারী তথাকথিত পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের নেত্রী হিসেবে মিসেস জিল্ নাইটের যােগ্যতা সম্পর্কে খ্যাতনামা সাংবাদিক বার্নার্ড লেভিন সন্দেহ প্রকাশ করেন। ইয়াহিয়া খানের আমন্ত্রণে পাকিস্তান সফর করে নিরপেক্ষ মতামত দেয়া মিসেস নাইটের পক্ষে সম্ভব নয় বলে তিনি মন্তব্য করেন। | শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য আর্থার বটলির নেতৃত্বে প্রেরিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সদস্য টোবি জ্যাসেল কলকাতায় প্রদত্ত এক | বিবৃতিতে বলেন, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী পূর্ব বঙ্গে হিন্দু-অধ্যুষিত বহু গ্রাম নির্বিচারে ধ্বংস করেছে। দি ডেইলি টেলিগ্রাফ পত্রিকায় ১ জুলাই প্রকাশিত এই রিপাের্টে বলা হয়, গত দশ দিন যাবৎ মি. জ্যাসেল ও তার সঙ্গীরা পূর্ব বঙ্গের বহু এলাকা এবং ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবির ঘুরে দেখেছেন। উল্লিখিত তারিখে দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, ঢাকা জেলার উত্তর-পশ্চিম কোণে প্রায় ৪০ মাইল দূরবর্তী সিন্দুরী নামের একটি গ্রামের বাড়িঘর লুটপাট করার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা গ্রামটি আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। গত পাঁচ দিনে এই এলাকায় আরও ৭টি গ্রাম ধ্বংস করা হয়। অধিকাংশ অধিবাসী হিন্দু বলেই গ্রামগুলাে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সৈন্যবাহিনী সিন্দুরী গ্রামের স্বর্ণকার রাধাবিনােদ কর্মকার এবং সাতজন পুরুষ ও একজন বৃদ্ধাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। চারজন মহিলাকেও তারা ধর্ষণ করে। . মি. বটমূলির নেতৃত্বে প্রেরিত ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি দলের সদস্য রেজ প্রেন্টিস দিল্লিতে সাংবাদিকদের সঙ্গে পূর্ব বঙ্গ সমস্যা সম্পর্কে আলােচনাকালে বলেন, কেবল রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমেই শান্তি ফিরিয়ে আনা সম্ভব বলে তিনি মনে করেন। ২ জুলাই ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এই রিপাের্টে আরও বলা হয়, পূর্ব বঙ্গ থেকে নির্বাচিত প্রতিনিধিদলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনা করে। এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে।
মি, বটমূলি ভারতীয় পার্লমেন্ট সদস্য ও সাংবাদিকদের এক সভায় বক্তৃতাদানকালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে সাবধান করে দিয়ে বলেন, পূর্ব বঙ্গে ‘আরাে একটি ভিয়েতনাম’ সৃষ্টির আশঙ্কা রয়েছে। পূর্ব বঙ্গ সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধানের জন্য উদ্যোগী না হলে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট তার ফলাফলের জন্য। দায়ী থাকবেন বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। ৩ জুলাই লন্ডনের কনওয়ে হলে সমগ্র গ্রেট ব্রিটেনের শাখা কমিটিগুলাের (অ্যাকশন কমিটি) প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী প্রতিনিধিবৃন্দকে একতা বজায় রাখার জন্য আবেদন জানান এবং কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির নির্বাচন স্থগিত রাখার যুক্তি বিশ্লেষণ করেন। প্রতিনিধিবৃন্দ তার যুক্তি মেনে নিয়ে নির্বাচন স্থগিত রাখার ব্যাপারে সম্মতি প্রদান করেন। উল্লিখিত সম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে মােহাম্মদ শাজাহান ও আবদুল মান্নান মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রবাসী বাঙালিদের দেশপ্রেম ও কর্মতৎপরতার জন্য ধন্যবাদ জানান। জেনারেল ফরমান আলী খান ব্রিটিশ সাংবাদিক মিস্ ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থের সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারকালে স্বীকার করেন, গত সপ্তাহে (জুন মাসের শেষ সপ্তাহে) পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী টাঙ্গাইল জেলার ছ’টি গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। ৩ জুলাই ‘দি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা হিসেবে এই গ্রামগুলাে ধ্বংস করা হয়েছে। | ৩ জুলাই পাকিস্তান সরকার লন্ডনস্থ হাই কমিশনার সালমান আলীকে “দি রয়াল কমনওয়েলথ সােসাইটি’র ভাইস-প্রেসিডেন্ট পদ থেকে ইস্তফা দেয়ার নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানের প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিচারপতি চৌধুরীকে বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তব্য পেশ করার জন্য সােসাইটির আমন্ত্রণ প্রত্যাহার না করার ফলে এই নির্দেশ দেয়া হয়। পূর্ব বাংলা ও ভারত সফরের পর লন্ডনে ফিরে এসে ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের সদস্যরা বলেন, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর হত্যা ও নির্যাতন অভিযান অব্যাহত রয়েছে। শিশুরাও তা থেকে রেহাই পায় নি। পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের বক্তব্য রেডিও, টিভি ও সংবাদপত্রের মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ার পর মিসেস জিল নাইট ৫ জুলাই ইয়াহিয়া খানের কাছে লিখিত এক পত্রে তার উল্লেখ করে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি হত্যা ও নির্যাতনের অভিযােগ সম্পর্কে তদন্ত করে অপরাধী সৈন্যদের শাস্তিদানের পরামর্শ দেন। ৬ জুলাই ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।
স্কটল্যান্ডের এবারডিনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ খনি শ্রমিক ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে ইউনিয়নের কার্যকর কমিটি পূর্ব বঙ্গ পরিস্থিতি সম্পর্কে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করে। এই প্রস্তাবে রাজনৈতিক বন্দিদের, বিশেষ করে শেখ মুজিবের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে আলােচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরােপ করা হয়। প্রস্তাবটি সমর্থন করে ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি লরেন্স ড্যালি বলেন, পূর্ব বঙ্গের শতকরা ৯৯জনের সমর্থনপুষ্ট আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্যই পাকিস্তান সরকার সামরিক অভিযান শুরু করে। ৫ জুলাই তারিখের অধিবেশনে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। | পূর্ব বাংলার পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রসঙ্গে ৭ জুলাই ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’ পত্রিকায় বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে সামরিক অত্যাচার ও নির্যাতনের গ্রহণযােগ্য ভবিষ্যৎ নেই।… কেবল শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানকে নিশ্চিত ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারেন। এই কঠোর বাস্তবতাকে পাকিস্তান অস্বীকার করার চেষ্টা করছে। তাকে মুক্তি দিয়ে পূর্ব বঙ্গের নেতৃত্বে পুনপ্রতিষ্ঠিত করার মাধ্যমে শান্তি স্থাপিত হতে পারে। এছাড়া অন্য কোনাে পথ নেই। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের রিডার ড. মােহর আলীর যুক্তভাবে স্বাক্ষরিত একটি দীর্ঘ চিঠি ৭ জুলাই ‘দি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। লন্ডনের রয়াল গার্ডেন হােটেল থেকে লিখিত এই চিঠির মাধ্যমে তারা উভয়েই বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এবং পাকিস্তানের সামরিক চক্রের সমর্থনের নির্জলা মিথ্যা তথ্য পরিবেশন করেন। বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালাবার জন্য পাকিস্তানের সামরিক সরকার সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও মােহর আলীর ব্যয়বহুল সফরের ব্যবস্থা করে। | উল্লিখিত চিঠিতে তারা বলেন, গ্রেট ব্রিটেনের বহু লােক মনে করেন, বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকসহ বহুসংখ্যক বাঙালিকে মার্চ মাসের ২৫/২৬ তারিখে এবং পরবর্তকিালে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করেছে একথা জানতে পেরে তারা (সাজ্জাদ হুসাইন ও মােহর আলী) বিস্মিত হয়েছেন। তারা জোর দিয়ে বলেন, বুদ্ধিজীবীদের বেপরােয়াভাবে হত্যা করা হয় নি। ২৫ মার্চ। কিংবা তারপর চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে অধ্যাপককে হত্যা করা হয় নি। ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক। হল) ও জগন্নাথ হলের আশপাশে সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে নয়জন অধ্যাপক মারা। গিয়েছেন। আওয়ামী লীগের সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী এই ছাত্রাবাসগুলােকে ঘাটি। করে সৈন্যবাহিনীকে আক্রমণ না করলে এই প্রাণহানি এড়ানাে যেতাে। তাদের ব্যক্তিগত বন্ধু’ অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা গুলির আঘাতে আহত হয়ে হাসপাতালে গিয়ে তিন দিন পর মারা যাওয়ার আগে তার বন্ধুদের কাছে নাকি।
বলেছেন, আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা তাঁর বাড়িতে না ঢুকলে তিনি সৈন্যবাহিনীর আক্রমণ এড়াতে পারতেন। তারা দাবি করেন, ২৫ মার্চ ঢাকা ও রাজশাহীর ছাত্রাবাসে খুব অল্পসংখ্যক ছাত্র ছিল। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে পরিচালিত অসহযােগ আন্দোলনের কর্মসূচি অনুযায়ী ৩ মার্চ থেকে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়গুলাে বন্ধ করার নির্দেশ দেয়ার ফলে অধিকাংশ ছাত্র ছাত্রাবাস ত্যাগ করে। এই সুযােগে আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবকরা ইকবাল হল ও জগন্নাথ হলকে অস্ত্রাগারে পরিণত করে। মার্চ মাসে সামরিক আক্রমণের আগে পূর্ণ অরাজকতা বিরাজ করছিল বলে তারা মনে করেন। তখন নাকি জনসাধারণের বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যাদের মতভেদ ছিল তাদের জীবনের কোনাে নিরাপত্তা ছিল না। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে এবং ১৩ এপ্রিল সৈন্যবাহিনীর রাজশাহী দখল করার আগে, আওয়ামী লীগের আদর্শের প্রতি আস্থাহীন অধ্যাপকদের হত্যা করার জন্য বারবার চেষ্টা করা হয় বলে তারা দাবি করেন। অবাঙালি অধ্যাপকদের তখন ঘরবন্দি করে রাখা হয়। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী এই অরাকজতা দমন না করলে বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু অবাঙালি অধ্যাপকের মৃত্যু অবধারিত ছিল বলে তারা বিশ্বাস করেন।২ | ১০ জুলাই বাঙালিদের উদ্যোগে বেডফোর্ড শহরের একটি পাবলিক হলে বিচারপতি চৌধুরীর সভাপতিত্বে এক জনসভার আয়ােজন করা হয়। স্থানীয় পাকিস্তানিরা হলটি চারদিক থেকে ঘিরে রেখে বাধা দেয়ার চেষ্টা করে। প্রত্যেকটি গেটের সামনে তাদের লােক দাড়িয়ে ছিল। পাকিস্তানিদের প্রতি দ্রুক্ষেপ না করে বিচারপতি চৌধুরী দৃঢ় মনােভাব নিয়ে সভার কাজ চালিয়ে যান। তিনি কঠোর ভাষায় পাকিস্তানিদের হীন মনােভাবের নিন্দা করেন। পাকিস্তানিদের এই হঠকারিতায় বাংলাদেশ আন্দোলন লাভবান হয়েছে বলে ওয়াকিবহাল মহল মনে করেন। অধ্যাপক কবীরউদ্দিন আহমদ ও শেখ আবদুল মান্নান এই সভায় বক্তৃতা করেন। | ১১ জুলাই ‘দি সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে পূর্ব বঙ্গের পরিস্থিতি সম্পর্কে বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি গােপন রিপাের্টের কথা উল্লেখ করা হয়। জুন মাসে পূর্ব বঙ্গ সফরের পর বিশ্ব ব্যাঙ্ক প্রেরিত একটি মিশনের নেতা পিটার কারগিল উল্লিখিত রিপাের্ট পেশ করেন। এই রিপাের্টে যশাের, খুলনা, মংলা, ফুলতলা ও কুষ্টিয়ায় পাকিস্তানি ধ্বংসলীলার চাক্ষুষ বিবরণ দিয়ে অদূর ভবিষ্যতে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা প্রকাশ করা হয়। পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদানকারী দেশগুলাের এক ঘরােয়া বৈঠকে উল্লিখিত রিপাের্টের সারমর্ম পেশ করা হয়। এর ফলে ২১ জুন অনুষ্ঠিত এক সভায় পাকিস্তানকে সাহায্যদান স্থগিত রাখার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। সাহায্যদানকারী দেশগুলাের মধ্যে রয়েছে ব্রিটেন, কানাডা, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, জাপান, ইতালি ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। ৬ জুলাই বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট রবার্ট ম্যাকনামারা রিপাের্টটি প্রত্যাহার করে ব্যাঙ্কের নথিপত্র থেকে বেমালুম গায়েব করার নির্দেশ দেন। রিপাের্টের নকল সংবাদপত্রের প্রতিনিধিদের হস্তগত হয়েছে বলে টের পাওয়ার পর ৯ জুলাই তিনি তার নির্দেশ প্রত্যাহার করেন। ১৩ জুলাই ‘নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকায় এ সম্পর্কে বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। | ১৮ জুলাই (রােববার) স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে লন্ডনস্থ চীনা দূতাবাসের সামনে একটি বিক্ষোভ এবং দূতাবাস থেকে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন পর্যন্ত মিছিলের আয়ােজন করা হয়।
বিক্ষোভ ও মিছিলে যােগদান করার জন্য ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে বিপুলসংখ্যক বাঙালি কোচযােগে লন্ডনে আসেন। জগলুল পাশার নেতৃত্বে বিরাট একটি দল বার্মিংহাম থেকে এসে বিক্ষোভ ও মিছিলে যােগ দেয়। তােজাম্মেল (টনি) হকও কয়েকটি কোচ-ভর্তি বাঙালিদের নিয়ে এদের সঙ্গে যােগ দেন। বিক্ষোভ শেষে দূতাবাসে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। স্মারকলিপিতে বলা হয়, চীনের মহান নেতা মাও জে-ডুং এবং প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাইয়ের প্রতি বাঙালিদের মধ্যে গভীর শ্রদ্ধাবােধ রয়েছে। পাকিস্তান তাদের বন্ধু-রাষ্ট্র-এই অজুহাতে তারা যদি পাকিস্তানকে সমর্থন করেন, তা হলে ইতিহাসের চোখে তারা দোষী বলে সাব্যস্ত হবেন। | জুলাই মাসের মাঝামাঝি আমেরিকার কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট লন্ডনে আসেন। তাদের সম্মানার্থে কমনওয়েলথ ইউনিভারসিটিজ অ্যাসােসিয়েশনের সেক্রেটারি জেনারেল স্যার হিউ প্রিঙ্গার একটি ভােজসভার আয়ােজন করেন। ব্রিটেনের বেশ কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরও এই ভােজসভায় যােগদান করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সংঘটিত হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আলােচনার সুযােগ দেয়ার উদ্দেশ্যে স্যার হিউ বিচারপতি চৌধুরীকে ভােজসভায় যােগদানের জন্য বিশেষভাবে আমন্ত্রণ জানান। বলা বাহুল্য, বিচারপতি চৌধুরী এই। সুযােগের সদ্ব্যবহার করেন। | ১৯ জুলাই ফাইনান্সিয়াল টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শিগগিরই সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন বিচার অনুষ্ঠিত হবে। ইসলামাবাদে ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারকালে ইয়াহিয়া খান এই তথ্য প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযোেগ আনা হবে তার মধ্যে মৃত্যুদণ্ডযােগ্য অভিযােগ রয়েছে। তার পক্ষ সমর্থন করার জন্য পাকিস্তানি আইনজীবী নিয়ােগ করা হবে। বিদেশী আইনজীবী নিয়ােগের অনুরােধ প্রত্যাখ্যান করা হয়েছে। মি. ম্যাক্সওয়েল বলেন, ইয়াহিয়ার পরামর্শদাতাদের মধ্যে কেউ কেউ | রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে শেখ মুজিবকে প্রাণদণ্ড দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের ওপর চাপ সৃষ্টি করছে বলে তিনি বিভিন্ন সূত্রে জানতে পেরেছেন। জুলাই মাসের তৃতীয় সপ্তাহে আমেরিকান বার অ্যাসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলন লন্ডনে অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে যােগদানকারী প্রতিনিধিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি ইন গ্রেট ব্রিটেন একটি *খােলা চিঠি’ ২০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রকাশের ব্যবস্থা করে। এই খােলা চিঠি’-তে বার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যদের লক্ষ্য করে বলা হয়, আইনজীবী হিসেবে আইন ভঙ্গ করা সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হচ্ছে। তাছাড়া আমেরিকান নাগরিক হিসেবে তারা বাঙালিদের দুঃখ-দুর্দশা ও নির্যাতনের খবর সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অবহিত করে এই অমানিশার অবসান ঘটাতে পারেন।
পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যা, ধর্ষণ ও অন্যান্য নির্যাতনের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, বহির্বিশ্ব গণহত্যা শব্দটির কথা ভুলে গিয়েছে বলে মনে হয়। আইনজীবী হিসেবে বার এ্যাসােসিয়েশনের সদস্যরা নিশ্চয় স্বীকার করবেন, পাকিস্তান জাতিসংঘের ‘জেনােসাইড কনভেনশন’-এর দ্বিতীয় ধারার ক, খ এবং গ উপধারা ভঙ্গ করেছে। | উপসংহারে বলা হয়, বার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যরা নিম্নে বর্ণিত দাবিগুলাের প্রতি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের দৃষ্টি আকর্ষণ করবেন বলে বাঙালি ছাত্রছাত্রী ও তাদের সমর্থকরা আশা করেন :১. পাকিস্তানকে আমেরিকার সামরিক সাহায্যদান অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে; ২. বাংলাদেশ থেকে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধ রাখতে হবে; ৩. গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে; ৪. জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে স্বীকৃতি দিতে হবে; ৫. পাকিস্তান জেনােসাইড কনভেনশন ভঙ্গ করে বিশ্ব শান্তি বিপন্ন করার জন্য সমগ্র ব্যাপারটি সিকিউরিটি কাউন্সিলে আলােচনার জন্য উত্থাপন করতে হবে। বিজ্ঞাপনটির অর্ধেক জায়গা জুড়ে জনগণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানের একটি হাস্যোজ্জ্বল ছবি ছাপানাে হয়। ২৫ জুলাই ‘দি অবজারভার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পশ্চিম বঙ্গের মাও-সমর্থক নক্সালপন্থীরা পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর বর্বর অত্যাচার সমর্থন করে বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে। কলকাতা থেকে পত্রিকাটির সংবাদদাতা সুনন্দ দত্ত রায় এই সংবাদ প্রেরণ করেন। ২৬ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন প্রগতিশীল রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী লন্ডনে এক সভায় মিলিত হয়ে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে যুক্ত কর্মপন্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে একটি কমিটি গঠন করেন। পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীরের স্বাধীনতা ও পশ্চিম পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক অধিকার প্রতিষ্ঠার সমর্থক এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থকদের কর্মপ্রচেষ্টার সমন্বয় সাধন কমিটির প্রধান লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হয়। সদস্যদের প্রত্যেকেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন। পাকিস্তানের প্রাক্তন এয়ার কমােডর এম কে জানজুয়া কমিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। ৮৫ ২৬ জুলাই হাউস অব কমন্সের হারকোট রুমে স্বাধীন বাংলাদেশের ৮টি ডাকটিকেট সংবলিত একটি “সেট’ এবং ‘ফাস্ট ডে কভার’ প্রকাশ উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সকল দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য এবং দেশ-বিদেশের প্রায় চল্লিশজন সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ডাকটিকেটগুলাে ও “ফাস্ট ডে কভার’ প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নান (ছানু মিয়া) এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাজ্যে প্রবাসী বাঙালি নেতৃবৃন্দও এই অনুষ্ঠানে যােগদান করেন।
ডাকটিকেটগুলােতে বাংলাদেশের মানচিত্র, পতাকা, শিকল ভাঙার ছবি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাত ইত্যাদি প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফটো সংবলিত পাঁচ টাকা মূল্যের টিকেটে সােনালি-সদৃশ, কমলা, গাঢ় বাদামি ও হাফ-টোন কালাে রঙ ব্যবহার করা হয়। প্রতি ‘সেট’ ডাকটিকেটের মূল্য নির্ধারণ করা হয় ২১ টাকা ৮০ পয়সা (তল্কালীন পাউন্ডের মূল্য ২০ টাকা হিসেবে ব্রিটিশ মুদ্রায় ডাকটিকেটগুলাের মূল্য ছিল ১ পাউন্ড ৯ পেনি)। মুজিবনগর সরকারের সম্মতিক্রমে শ্রমিকদলীয় প্রাক্তন ডাক ও টেলিযােগাযােগ মন্ত্রী জন স্টোনহাউসের উদ্যোগে ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কভার প্রকাশিত হয় । লন্ডন প্রবাসী বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিক ডাকটিকেটগুলাের নকশা তৈরি করেন। তিনি বলেন, ডাকটিকেটগুলােতে ব্যবহৃত প্রতিকৃতিগুলাের মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাপূর্ণ এবং প্রগতিশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল তাঁর মুখ্য উদ্দেশ্য। বিদেশে চিঠিপত্র পাঠাবার জন্য ভারত সরকার ডাকটিকেটগুলাে ব্যবহার করার অনুমতি দিয়েছেন বলে উদ্যোক্তারা প্রকাশ করেন। পরদিন (২৭ জুলাই) লন্ডনের বিভিন্ন পত্রিকায় ডাকটিকেটগুলাের ‘ফ্যাক্সিমিলি’সহ সংবাদ প্রকাশিত হয়। | ২৯ জুলাই (১৯৭১) বাংলাদেশ ডাকটিকেট ও ফাস্ট ডে কভার’ বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, ভারত, যুক্তরাজ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইজরায়েল, ইউরােপ, অস্ট্রেলিয়া ও দূরপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। মুজিবনগর সরকারও কলকাতায় ডাকটিকেট’ ও ‘ফার্স্ট ডে কভার’ প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ডাকটিকেট প্রদর্শন উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, আগস্ট মাস শেষ হওয়ার আগেই ব্রিটেনে বাংলাদেশের দূতাবাস স্থাপন করা হবে। বাংলাদেশ এখন একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ। হানাদার বাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়ে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়াই বর্তমানে বাঙালিদের একমাত্র কর্তব্য।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক ঘােষণার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এই ঘােষণা অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে বাঙালি জাতি স্বৈরাচারীদের বিরুদ্ধে অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হবে। এই হীন উদ্যোগের বিরােধিতা করার জন্য তিনি বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ ও বিভিন্ন দেশের সরকারের কাছে আকুল আবেদন জানান। পাকিস্তান কমনওয়েলথ ত্যাগ করতে পারে বলে যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে তার উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, কমনওয়েলথের বাকি দেশগুলাে সানন্দে তা মেনে নিয়ে বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রকে সাদর অভ্যর্থনা জানাতে পারে। উল্লিখিত সাংবাদিক সম্মেলনের বিবরণ ২৭ জুলাই ‘দি মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। আগস্ট মাসের প্রথমদিকে পাকিস্তানের সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন্ ম্যাকব্রাইডকে ইসলামাবাদে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন। লন্ডনের বার্নার্ড শেরিডান সলিসিটার্স-এর পক্ষ থেকে একজন অভিজ্ঞ সলিসিটারও তাঁর সঙ্গে যান।৭ ২৪ জুলাই (শনিবার) মি. ম্যাক্ৰাইড ইসলামাবাদে পৌঁছানাের পর কয়েকজন উচ্চপদস্থ অফিসারের সঙ্গে দেখা করেন। ইয়াহিয়া খান নিজে দেখা করতে অস্বীকার করেন। কাজেই বাধ্য হয়ে তিনি ইয়াহিয়ার আইন বিষয়ক উপদেষ্টা বিচারপতি কর্নেলিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি (কর্নেলিয়াস) বলেন, কোনাে বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ কিংবা তার পক্ষ সমর্থন করতে দেয়া হবে না। ইয়াহিয়া খানের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী রুদ্ধদ্বার কক্ষে শেখ মুজিবের বিচার অনুষ্ঠিত হবে এবং তার পক্ষ সমর্থন করার জন্য একজন পাকিস্তানি আইনজীবী নিয়ােগ করা হবে। | ২৭ জুলাই ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, শেখ মুজিবের সঙ্গে এই প্রথমবার মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে দেখা করার চেষ্টা করা হয়। গ্রেফতারের পর থেকে তাঁকে নির্জন কারাকক্ষে বন্দি করে রাখা হয়।
কয়েক দিন পর লন্ডনে ফিরে এসে মি, ম্যাব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার সুযােগ না পাওয়ার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেন। | ২৬ জুলাই পাকিস্তান হাই কমিশনার সালমান আলী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার। আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুর করার জন্য এইড পাকিস্তান কনসরসিয়াম’কে রাজি করানাের ব্যাপারে ব্রিটেনের সাহায্য প্রার্থনা করেন। ২৭ জুলাই রাত্রিবেলা ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে প্রকাশিত এক বিবৃতিতে স্যার আলেকের সঙ্গে সালমান আলীর সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, আরও বৈদেশিক সাহায্য মঞ্জুর করার আগে পূর্ব বাংলায় একটি রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক কাঠামাে প্রতিষ্ঠার প্রয়ােজন অত্যন্ত স্পষ্ট। ২৮ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, কূটনৈতিক মধ্যস্থতার মাধ্যমে শরণার্থীদের পূর্ব বঙ্গে ফেরত পাঠানাে কিংবা ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা পরিহার করা যাবে না। কিন্তু কয়েকটি নাটকীয় পদক্ষেপ সমস্যা। সমাধানে সহায়ক হতে পারে। প্রথমত, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় তাঁকে রাজনৈতিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার সুযােগ দিতে হবে। দ্বিতীয়ত, সিকিউরিটি কাউন্সিলের সঙ্গে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠা করে ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। তৃতীয়ত, পাঞ্জাবি সৈন্যদের পাঞ্জাবে ফিরিয়ে না নেয়া পর্যন্ত নৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যাপারে ইয়াহিয়া খানকে বিরক্তিজনক ব্যক্তি হিসেবে গণ্য করা হবে বলে পরিষ্কার ভাষায় সাবধান করে দিতে হবে। উল্লিখিত সম্পাদকীয় নিবন্ধে শরণার্থীদের তদারকের জন্য জাতিসংঘ নিয়ােজিত হাই কমিশনার প্রিন্স সদরউদ্দিন আগা খানকে গোঁড়া মুসলমান এবং ইয়াহিয়ার প্রতি তার মনােভাব দ্ব্যর্থব্যঞ্জক বলে উল্লেখ করা হয়। বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রতিনিধিদল পূর্ব বঙ্গ সফরকালে অত্যাচার ও নির্যাতন সম্পর্কে যে তথ্য সংগ্রহ করেছেন সে তুলনায়। তিনি বেশি কিছু দেখেছেন বলে মনে হয় না। শরণার্থীদের কাছে তিনি রক্ষাকারী হিসেবে বিবেচিত হবেন বলে আশা করা বৃথা। আগামী ১ আগস্ট (রােববার) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে যে গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়েছে, সে সম্পর্কে জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বিভিন্ন পত্রিকায় ২৯ জুলাই অগ্রিম সংবাদ প্রকাশিত হয়।
উল্লিখিত সংবাদে বলা হয়, ‘বিটস্ গ্রুপের অন্যতম সদস্য জর্জ হ্যারিসনের উদ্যোগে বাংলাদেশ’ নামের যে নতুন রেকর্ড তৈরি করা হয়েছে তা বেলা দুইটার সময় ট্রাফালগার স্কোয়ারের গণসমাবেশে বাজিয়ে শােনানাে হবে। ঠিক তখন নিউইয়র্কের মেডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে রেকর্ডটির উদ্বোধন উপলক্ষে এক অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়েছে। রেকর্ড বিক্রি করে সংগৃহীত অর্থ শরণার্থী সাহায্য তহবিলে দান করা হবে। এই সংবাদে আরও বলা হয়, আগামী রােববার (১ আগস্ট) ব্রিটেনের সর্বত্র বাঙালি রেস্তোরাগুলাে বন্ধ রেখে মালিক ও কর্মচারীরা দলে দলে ট্রেন ও কোচযােগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে এসে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রতি সমর্থন জানাবেন। গণসমাবেশের আয়ােজনকারী অ্যাকশন বাংলাদেশের জনৈক মুখপাত্র ‘দি মর্নিং স্টার পত্রিকার প্রতিনিধিকে বলেন, বার্মিংহাম থেকে ৭০টি কোচভর্তি বাঙালি গণসমাবেশে যােগ দেয়ার জন্য লন্ডনে আসবেন। পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা’ শীর্ষক অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী একটি বিজ্ঞাপন ৩০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। ঢাকা শহরের রাস্তায় পরিত্যক্ত তিনজন তরুণের মৃতদেহের একটি ছবির নিচে লেখা রয়েছে : “এই ছবিটি আপনার ছেলে-মেয়েদের দেখান এবং তাদের সঙ্গে নিয়ে জনসমাবেশে যােগ দিন। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১ আগস্ট (রােববার) ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যাকশান বাংলাদেশ আহূত এক সমাবেশে যােগদানের জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানানাে হয়। পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে এই গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়। অ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে প্রকাশিত এই বিজ্ঞাপনে বিচারপতি চৌধুরীসহ বিভিন্ন বক্তার নাম এবং বার্মিংহাম, ব্র্যাডফোর্ড, কেমব্রিজ, কার্ডিফ, কভেন্ট্রি, গ্লাসগাে, লিড়স, লিভারপুল, লুটন, ম্যাঞ্চেস্টার, পাের্টস্মাথ ও শেফিল্ড থেকে যাতায়াতের ব্যবস্থা সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার জন্য বিভিন্ন টেলিফোন নাম্বার উল্লেখ করা হয়। যারা গণসমাবেশে যােগ দিতে অক্ষম, তাদের কাছে বাংলাদেশ আন্দোলনের কাজ চালিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থ সাহায্যের আবেদন জানানাে হয়। ৩০ জুলাই ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সিনেটর ইউজিন ম্যাকার্থি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে সমর্থন করেন।
৩০ জুলাই অ্যাকশান বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলােচনাকালে তিনি উল্লিখিত মন্তব্য করেন। | ৩১ জুলাই অ্যাকশান বাংলাদেশের উদ্যোগে লন্ডনের ডরচেস্টার হােটেলে আয়ােজিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি. ম্যাককার্থি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাঁর মতামত ব্যাখ্যা করেন। তিনি বলেন, নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় তিনি স্বাধীন বায়ার দাবি সমর্থন করেন। ভৌগােলিক কারণে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি। অধিকতর যুক্তিসঙ্গত বলে তিনি মনে করেন। | জুলাই মাসের শেষদিকে ব্রিটেন পূর্ব বঙ্গে ব্যবহারের জন্য কয়েকটি মােটরবােট সরবরাহ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। এই সংবাদ পাওয়া মাত্র বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে ইয়ান সাদারল্যান্ডের সঙ্গে দেখা করেন। মি. সাদারল্যান্ড সংবাদের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, মােটরববাটগুলাে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কাজে ব্যবহার না করার শর্ত আরােপ করা হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মােটরববাটগুলাে পাওয়ার পর পাকিস্তান। সৈন্যবাহিনী পূর্ব বাংলার নদীপথ দিয়ে অভ্যন্তরের গ্রামাঞ্চলে গিয়ে হত্যা ও লুণ্ঠনের জন্য নিশ্চয় ব্যবহার করবে। এই আশঙ্কার প্রতি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার। জন্য তিনি স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার অনুরােধ জানান।
ইতােমধ্যে জন স্টোনহাউস, পিটার শাের ও আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য ব্রিটিশ সরকারের উপরােক্ত সিদ্ধান্ত প্রত্যাহার করার দাবি জানিয়ে পার্লামেন্টে একটি প্রস্তাব পেশ করেন। পররাষ্ট্র দপ্তরের সঙ্গেও এ ব্যাপারে তারা আলােচনা করেন। স্যার আলেকের সঙ্গে সাক্ষাকালে বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি বলেন, পূর্ব বঙ্গের পক্ষে গ্রহণযােগ্য রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে না পাওয়া পর্যন্ত কোনাে মােটরবােট পাকিস্তানকে সরবরাহ করা হবে না। জুলাই মাসের শেষদিকের আরও একটি ঘটনা বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। পাকিস্তানের সামরিক সরকার কিছুসংখ্যক পাকিস্তান-ভক্ত বাঙালিকে সরকারি খরচে বিদেশে পাঠায়। নেজামে ইসলামের নেতা মৌলবী ফরিদ আহমেদ এদের অন্যতম। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ সফরকালে বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞকে তিনি ইসলামি জেহাদ’ বলে দাবি করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নাকি ভারতের কারসাজি ছাড়া আর কিছুই নয়। ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পরিচালিত ইসলামি জেহাদকে সমর্থন করা মুসলিম দেশগুলাের পক্ষে অবশ্য কর্তব্য বলে তিনি উল্লেখ করেন। মধ্যপ্রাচ্য থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, ফরিদ আহমদের এই প্রচার অভিযান ফলপ্রসূ হয় নি। তাই তিনি মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হন। করাচি ফিরে গিয়ে তিনি এক গাঁজাখুরি কাহিনী সংবাদ হিসেবে পরিবেশন করেন। সাংবাদিকদের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন রিডার রেহমান সােবহান এবং লন্ডন প্রবাসী কমিউনিস্টপন্থী’ পাকিস্তানি ছাত্রনেতা তারিক আলী ভারত সরকারের উদ্যোগে গঠিত এক প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে বৈরুতে পৌঁছান। বৈরুতের আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়ােজিত এক সভায় তাঁরা বক্তৃতাদানের চেষ্টা করেন। কর্তৃপক্ষ এই সভা অনুষ্ঠানের অনুমতি দিতে অস্বীকার করেন। ভারতীয় দূতাবাসগুলাের উদ্যোগে তাঁদের জন্য অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টা আরব দেশগুলাের অনুমতির অভাবে পরিহার করা হয়। এই প্রতিনিধিদলের সব খরচ ভারত সরকার বহন করে এবং ভারতীয় অফিসারগণ সর্বদা তাদের সঙ্গে ছিলেন। পাকিস্তানি সংবাদপত্রে উপরােক্ত মিথ্যা ও বিদ্বেষমূলক কাহিনী ফলাও করে প্রকাশ করা হয়।
আগস্ট, ১৯৭১
১ আগস্ট ‘দি সানডে টাইমস্ -এ প্রকাশিত একটি বিশ্লেষণমূলক নিবন্ধে পত্রিকাটির বিশেষ সংবাদদাতা মারে সেইল বলেন, পূর্ব বাংলা পরিস্থিতি সম্পর্কে পাকিস্তানের মস্তিষ্ক-বিকৃতির লক্ষণসূচক প্রচারণার ফলে তাদের সৈন্যবাহিনী ভিয়েতনামের যুদ্ধের মতাে এক ভয়াবহ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। এই মিথ্যা প্রচার অভিযানে সামরিক সরকার নিয়ন্ত্রিত পাকিস্তানি সংবাদপত্রগুলােকে ব্যবহার করা হচ্ছে। সবাই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে এক ষড়যন্ত্রে যােগ দিয়েছে বলে দাবি করে বলা হচ্ছে, ভারত ব্রিটেনের সঙ্গে, বি বি সি জায়নিস্ট’ নামে পরিচিত চরমপন্থী ইহুদিদের সঙ্গে এবং রাশিয়া ইজরায়েলের সঙ্গে হাত মিলিয়ে পাকিস্তান-বিরােধী। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। শুধু চীন ইসলামকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে অনুগত বন্ধু হিসেবে পাকিস্তানের সঙ্গে রয়েছে। ‘মারে সেইল তার নিবন্ধে আরাে বলেন, পূর্ব বাংলার অধিবাসীদের দাবি হলাে, বিদেশী জালিমদের খতম করাে। এই মনােভাবের মধ্যে ভারত-বিরােধিতার কোনাে স্থান নেই; পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর উদ্যোগে পরিচালিত ‘ভারতকে ধ্বংস করার অভিযান’ সম্পর্কে তাদের (বাঙালিদের) কোনাে উৎসাহ নেই। তাদের চোখে পশ্চিম পাকিস্তানিরাই বিদেশী জালিম। উভয়পক্ষের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে মারে সেইল বলেন, বাংলাদেশের সমর্থক ও পাকিস্তানিদের মধ্যে কোনাে প্রকার আপস হওয়া সম্ভব নয়। | পাকিস্তানের অত্যাচারী সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্ব-জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে ১ আগস্ট (রােববার) লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
পল কনেটের নেতৃত্বে গঠিত অ্যাকশন বাংলাদেশের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই জনসমাবেশে ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে ২০ হাজারেরও বেশি বাঙালি যােগ দেন। শতাধিক বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সদস্যদের লন্ডনে নিয়ে আসার জন্য বিভিন্ন কমিটি বহু কোচ ভাড়া করে। একমাত্র বার্মিংহাম থেকে ৭০টি কোচ বাঙালিদের নিয়ে লন্ডনে আসে। [ সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বিচারপতি চৌধুরী, লর্ড ব্রকওয়ে, লর্ড গিফোড, অশােক সেন (পরবর্তীকালে ভারতের আইন দপ্তরের মন্ত্রী), পিটার শাের, [ রেজু প্রেন্টিস, ক্রস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস, পল কনেট, বেগম লুলু বিলকিস | বানু ও গাউস খান। | বক্তৃতাদানকালে বিচারপতি চৌধুরী ঘােষণা করেন, বাংলাদেশ কখনও তার স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ থেকে বিচ্যুত হবে না। বাংলাদেশের পূত-পবিত্র ভূমি। থেকে হানাদার বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমাদের আপসহীন, বিরামহীন সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সংগ্রাম।’ | হাজার হাজার কণ্ঠে ‘জয় বাংলা’ স্লোগানের মাধ্যমে বিচারপতি চৌধুরীর উদ্দীপনাময় ঘােষণাকে সমর্থন জানানাে হয়। বাঙালিদের আত্মবিশ্বাসের প্রমাণ। | পেয়ে তিনি অভিভূত হন বলে তার স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, ‘মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের সঙ্গে আপােসরফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে বলে মিথ্যা প্রচারণা চালানাে হচ্ছে। | বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে বানচাল করার জন্য শত্রুপক্ষ এই গুজব ছড়াচ্ছে। তিনি এই ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে আলাপ করেছেন। উপরােক্ত গুজব ভিত্তিহীন বলে প্রধানমন্ত্রী তাকে জানিয়েছেন। শত্রুপক্ষের মিথ্যা প্রচারণা দ্বারা বিভ্রান্ত না হওয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরী আহ্বান জানান। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন্ ম্যাব্রাইড বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন | করার উদ্দেশ্যে তাঁর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে পাকিস্তান থেকে ব্যর্থ মনােরথ হয়ে ফিরে এসেছেন বলে বিচারপতি চৌধুরী প্রকাশ করেন। সমবেত জনতা ‘শেম ‘শেম’ বলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র নিন্দা প্রকাশ করে। বিচারপতি চৌধুরী অবিলম্বে বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করেন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশসমূহের প্রতি আহ্বান জানান। তাছাড়া পূর্ব বঙ্গে নির্বিচারে ব্যাপক হত্যার মাধ্যমে গণহত্যা সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক কনভেনশন ভঙ্গের জন্য পাকিস্তানের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা জাতিসংঘের অধীনস্থ সিকিউরিটি কাউন্সিলের কর্তব্য বলে তিনি দাবি করেন। _ বক্তৃতা প্রসঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী মুজিবনগর সরকারের তিনটি নির্দেশের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম নির্দেশ অনুযায়ী শিগগিরই লন্ডনে একটি দূতাবাস স্থাপন করা হবে বলে তিনি ঘােষণা করেন।
দ্বিতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের বিমানযােগে ভ্রমণ না করার জন্য বাংলাদেশের নাগরিকদের প্রতি তিনি আহ্বান জানান। তৃতীয় নির্দেশ অনুযায়ী পাকিস্তানি সরকারি কর্মচারী হিসেবে। পাকিস্তান ও বিদেশে নিয়ােজিত বাঙালিদের অবিলম্বে পদত্যাগ করে মুজিবনগর সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানান। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তৃতার পর অপ্রত্যাশিতভাবে লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত দ্বিতীয় সেক্রেটারি মহিউদ্দিন আহমদ বক্তৃতা দেয়ার জন্য । এগিয়ে আসেন। জনতার বিপুল হর্ষধ্বনির মধ্যে মি. আহমদ ঘােষণা করেন, পাকিস্তানের চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবিকে তিনি অস্বীকার করতে পারেননি। একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে তিনি বেঁচে থাকতে চান। তাঁর। বক্তৃতা সমবেত জনতার মধ্যে বিপুল উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। ইউরােপে কর্মরত পাকিস্তানি কূটনীতিবিদদের মধ্যে মহিউদ্দিন আহমদই সর্বপ্রথম পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করেন। ১০ এপ্রিল বি বি সি’র বুশ হাউসে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিনি বাংলাদেশের প্রতি তার সমর্থনের কথা। প্রকাশ করেন। ট্রাফালগার স্কোয়ারের জনসভায় যােগদানের জন্য রওনা হওয়ার কিছুক্ষণ আগে মি, আহমদ টেলিফোনযােগে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, তিনি বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে প্রস্তুত। বিচারপতি চৌধুরী তাকে সপরিবারে তাঁর বাড়িতে আসার জন্য বলেন। সেখান থেকে তাঁরা দুজন। সরাসরি ট্রাফালগার স্কোয়ারে যান। জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে জন স্টোনহাউস এম পি বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তান সংঘটিত হত্যাকাণ্ড ও অরাজকতা হিটলারের আমলে সংঘটিত ঘটনাবলির মতােই ভয়াবহ। কিছুদিন আগে তিনি কলকাতা ও পশ্চিম বঙ্গের বিভিন্ন এলাকায় অবস্থিত শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে দুর্গতদের অবস্থা নিজ চোখে দেখে এসেছেন।
মি. স্টোনহাউস আরও বলেন, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থন করার জন্য পাকিস্তান সরকার বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন বলে তিনি জানতে পেরেছেন। এই আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানিয়েছেন। পাকিস্তানে তার শারীরিক নিরাপত্তা বিপন্ন হবে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন। পঞ্চাশ বছর যাবৎ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকারী লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের উদ্দেশ্যে সিকিউরিটি কাউন্সিলের জরুরি সভা অনুষ্ঠানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের আহ্বান জানানাে উচিত। ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা করে তিনি বলেন, অবিলম্বে আলােচনার মাধ্যমে এই সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের নিষ্ক্রিয়তার সমালােচনা করেন। রেজ প্রেন্টিস্ এম পি বলেন, বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়া উচিত । জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবাই বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করবে বলে আশা প্রকাশ করেন। অপর বক্তাদের সঙ্গে একমত হয়ে তিনি গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত ৭ কোটি ৫০ লক্ষ লােকের নেতা শেখ মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তিদানের দাবি জানান। পল কনেট তার বক্তৃতায় বলেন : ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পাশে রয়েছে। বিশ্বের সকল দেশের, সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মুক্তিকামী মানুষ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ স্বাধীনতা হরণকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের যুদ্ধ। আপনাদের এই আদর্শবাদী সংগ্রামের সঙ্গে আমরা একাত্মতা প্রকাশ করছি। জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে অশােক সেন (পরবর্তীকালে ভারতের আইন দপ্তরের মন্ত্রী) বাঙালির সগ্রাম ও একনিষ্ঠ দেশপ্রেমের কথা গর্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। | প্রবাসী বাঙালি মহিলাদের পক্ষ থেকে বক্তৃতাদানকালে বেগম লুলু বিলকিস বানু মুক্তিযুদ্ধের সূচনা থেকে লন্ডনস্থ বাঙালি মহিলা সমিতির কার্যকলাপের সংক্ষিপ্ত বিবরণ পেশ করেন। সভার শেষে আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ একটি শােভাযাত্রা সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই লিপিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান, শেখ মুজিবের মুক্তির জন্য পাকিস্তান সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি এবং পাকিস্তানে অস্ত্র চালান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে মার্কিন সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আবেদন জানানাে হয়।
প্রধানমন্ত্রীর বাসস্থানের সামনে অপেক্ষমাণ সাংবাদিকদের উদ্দেশে প্রদত্ত এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ জনগণ, রাজনীতিবিদ ও। সংবাদপত্রগুলােকে তাদের সহযােগিতার জন্য ধন্যবাদ জানান। হাইড পার্কের উত্তর-পূর্ব কোণে অবস্থিত স্পিকার্স কর্নারের কাছে গিয়ে শােভাযাত্রার অবসান হয়। | ট্রাফালগার স্কোয়ারে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘অপারেশন ওমেগা’র উদ্যোগে গঠিত ইন্টারন্যাশনাল পিস্ টিম’ ও তার কর্মসূচির বাস্তবায়ন। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে পল কনেটের স্ত্রী এলেন কনেট এবং আরও একজন মহিলা একটি মােটরযানযােগে ট্র্যাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হন। উপস্থিত বাঙালিরা তাদের আন্তরিক অভিনন্দন জানান। বাংলাদেশে প্রবেশের পর পাকিস্তান সামরিক কর্তৃপক্ষ তাদের বন্দি করে যশাের কারাগারে আটক রাখে । | ২ আগস্ট শ্রমিক ও রক্ষণশীল দলভুক্ত বেশ কয়েকজন প্রাক্তন মন্ত্রী ও বহু। পার্লামেন্ট সদস্য শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব পার্লামেন্টে পেশ করেন। এই প্রস্তাবে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত ভয়াবহ বিপর্যয়ের ফলে উদ্ভূত সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য অবশ্য প্রয়ােজনীয় পূর্বশর্ত হিসেবে শেখ মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। এই প্রস্তাবটি বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে গত ১৫ জুলাই যে প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে, তার পরবর্তী পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হয়। প্রস্তাবের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন, জন স্টোনহাউস, আর্নেস্ট মারপল্স, মাইকেল স্টুয়ার্ট, পিটার শাের ও এডওয়ার্ড দুক্যান। এ সম্পর্কে ৩ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, কমপক্ষে ৩৫০জন পার্লামেন্ট সদস্য প্রস্তাবটি সমর্থন করবেন বলে উদ্যোক্তারা আশা করেন।। ২ আগস্ট লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনারের ‘চ্যান্সেরি বিভাগের অফিসার বখতিয়ার আলী স্বাক্ষরিত এক দলিলে প্রকাশ, ইয়াহিয়া খানের পক্ষে প্রচারণা চালাবার জন্য যুক্তরাজ্য সফরকারী বেগম আখতার সােলায়মান (হােসেন শহীদ। সােহরাওয়ার্দীর কন্যা) ও তার স্বামী এস এ সােলায়মানকে ভাতা বাবদ নগদ অর্থ। দেয়া হয়। ২০ জুলাই থেকে ৪ সপ্তাহের জন্য দৈনিক সাড়ে সাত পাউন্ড হিসেবে স্বামী-স্ত্রী দু’জনে মােট ৪২০ পাউন্ড গ্রহণ করেন। সফরে রওনা হওয়ার আগে বেগম সােলায়মান পেশােয়ারে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, বিদেশ সফরকালে তিনি পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে কোনাে টাকা নেবেন না। বি বি সি’র উর্দু সার্ভিস প্রচারিত এক সাক্ষাৎকারকালেও তিনি জোর গলায় বলেন, পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে তিনি কোনাে টাকা গ্রহণ করেন নি।
লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকায় ভাতাদান সম্পর্কিত সরকারি দলিলটির। ফ্যাক্সিমিলি ১৯৭১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় ছাপানাে হয়। উক্ত দলিল সম্পর্কিত সংবাদ বাংলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের নগ্নরূপ’ শিরােনাম দিয়ে । প্রকাশিত হয়। ৫ আগস্ট পাকিস্তানের সামরিক সরকার বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে। একটি শ্বেতপত্র প্রকাশ করে। বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বাঙালিরা সবকিছুর জন্য দায়ী। বলে এই তথাকথিত দলিলে অভিযােগ করা হয়। ৬ আগস্ট ‘দি টাইমস্ ও ‘দি গার্ডিয়ান’-এ দলিলটির সারমর্ম প্রকাশিত হয়। | উল্লিখিত দলিলে বলা হয়, সংবিধান প্রণয়ন সম্পর্কে আলােচনাকালে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার জন্য প্রকারান্তরে স্বাধীনতা আদায়ের চেষ্টা করেন। তাদের এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর তারা সশস্ত্র বিদ্রোহের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জনের পরিকল্পনা করেন। রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রকাশিত এই দলিলে বিভিন্ন বিষয়ের মধ্যে নিম্নে বর্ণিত তিনটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করা হয় : ১. ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে পূর্ব বঙ্গের। জাতীয়তাবাদী আওয়ামী লীগ এক লক্ষ পুরুষ, মহিলা ও শিশুদের হত্যা করে; ২. ২৬ মার্চ সকালবেলা সশস্ত্র অভূত্থানের জন্য আওয়ামী লীগ একটি পরিকল্পনা তৈরি করে; ৩, ভারতের সঙ্গে গােপন পরামর্শ করে আওয়ামী লীগ তাদের। পরিকল্পনা তৈরি করে এবং ভারত অস্ত্র ও সৈন্য দিয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেয়। | দলিলটির পরিশিষ্টে বলা হয়, চট্টগ্রাম এলাকা পাঁচ দিন যাবৎ বিদ্রোহীদের দখলে থাকাকালে ১০ থেকে ১২ হাজার লােককে হত্যা করা হয়। তাছাড়া বগুড়া। ও খুলনায় যথাক্রমে ২০ হাজার ও ৮ হাজার বিহারিকে হত্যা করা হয়। | এই মিথ্যা ও অতিরঞ্জিত ‘শ্বেতপত্র প্রকাশ করে পাকিস্তান সরকার পূর্ব বঙ্গে তাদের সামরিক বাহিনী সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের জন্য আওয়ামী লীগ ও ভারতের ঘাড়ে দোষ চাপানাের ব্যর্থ চেষ্টা করে। ইউরােপ ও আমেরিকার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সংবাদপত্রগুলাে শ্বেতপত্রে’র বিশ্বাসযােগ্যতা সম্পর্কে সন্দেহ। প্রকাশ করে। | ৫ আগস্ট লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে ডাইরেক্টর অব অডিট এ্যান্ড একাউন্টস পদে নিয়ােজিত লুৎফুল মতিন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। বিচারপতি চৌধুরীকে লিখিত এক পত্রে তিনি তার সিদ্ধান্তের কথা জানান। মি. মতিনের পদত্যাগকালে চারজন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে কর্মরত ছিলেন।
জুলাই মাসের শেষদিকে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানি কারাগারে দুর্বিষহ জীবনযাপন করতে বাধ্য হচ্ছেন বলে খবর পাওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি-জেনারেল মাটিন এ্যানালসের সঙ্গে দেখা করে এই ব্যাপারে তাকে সাহায্য করার অনুরােধ জানান। মি, এ্যানালসের সঙ্গে আলােচনার পর বিচারপতি চৌধুরী এ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির (আই সি আর সি) কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে দরখাস্ত পেশ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মি. এ্যানালসের পরামর্শ অনুযায়ী তিনি সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের প্রধান ও “ডিন এবং রেডক্রস সংক্রান্ত জেনেভা কনভেনশন ও আনুষঙ্গিক আইন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ড্রেপারকে ‘মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে আন্তর্জাতিক রেডক্রস কমিটির কাছে দরখাস্ত পেশ করার জন্য ব্যারিস্টার হিসেবে নিয়ােগ করেন। ৫ আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক ড্রেপারসহ জেনেভায় পৌঁছান। অধ্যাপক ড্রেপার আনুষ্ঠানিকভাবে রেডক্রসের উচ্চপদস্থ অফিসারদের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর শারীরিক নিরাপত্তার ব্যাপারে আলােচনা করেন এবং তার সম্পর্কে সঠিক সংবাদ সংগ্রহের জন্য অনুরােধ জানান। রেডক্রসের কর্তৃপক্ষ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা। করার চেষ্টা করবেন এবং ফলাফল যথাসময়ে তাকে (অধ্যাপক ড্রেপার) জানাবেন। বলে আশ্বাস দেন। | অধ্যাপক ড্রেপারকে বিমানবন্দরে বিদায় দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী জেনেভায় ফিরে এসে ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস-এর অফিসে গিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল নিয়াল ম্যাকডারমেটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রাক্তন মন্ত্রী মি. ম্যাকডারমেট অত্যন্ত মনােযােগ দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস ও বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিচারপতি চৌধুরীর বক্তব্য – শােনেন। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে উদ্বেগ প্রকাশ করে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছিলেন। | মি. ম্যাকডারমেটের অফিস থেকে বিচারপতি চৌধুরী ওয়ার্ল্ড ইউনিভারসিটি সার্ভিসেস-এর অফিসে গিয়ে সেক্রেটারি জেনারেল চিদামবরা নাথানের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। ৬ আগস্ট লন্ডনে ফিরে আসার আগে বিচারপতি চৌধুরী সুইস পার্লামেন্টের প্রভাবশালী সদস্য জা জিগলার এবং কয়েকজন সাংবাদিকের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া ১৭ আগস্ট তিনি জেনেভায় একটি সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতাদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। জা জিগলার ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
৭ আগস্ট লন্ডনের ‘মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে বাংলাদেশের রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রহসন অবিলম্বে বন্ধ করার দাবি জানিয়ে ভারতীয় পার্লামেন্টের ৪৬৭ জন সদস্য ৬ আগস্ট জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল উ থান্টের কাছে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তিদানের দাবিও এই। স্মারকলিপিতে জানানাে হয়। | উল্লিখিত তারিখে ‘দি সানডে টাইমস’-এর প্রতিনিধি রালফ শ’র সঙ্গে একান্ত সাক্ষাৎকার উপলক্ষে জেনারেল ইয়াহিয়া খান বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে সর্বোচ্চ শ্রেণীভুক্ত বন্দি হিসেবে শেখ মুজিব সুস্থ শরীরে বেঁচে আছেন। কিন্তু আগামীকাল তিনি বেঁচে থাকবেন কিনা তা বলা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। | ইয়াহিয়া খান আরও বলেন, দেশের আইন অনুযায়ী তার বিচার হবে। তার মানে এই নয় যে আমি তাকে আগামীকাল গুলি করে হত্যা করবাে। তার স্বাভাবিক মৃত্যু হতে পারে। জেলখানায় তাকে সর্বোচ্চ শ্রেণীর বন্দি হিসেবে রাখা হয়েছে। তাকে শারীরিক পরিশ্রম করতে হয় না। একটি বিছানা, বৈদ্যুতিক পাখা, গরম পানির ব্যবস্থাসহ ছােট একটি কামরা তাঁকে দেয়া হয়েছে এবং একজন ডাক্তার তাকে দেখাশােনা করছেন।’ ৮ আগস্ট ভারত ও সােভিয়েত ইউনিয়ন একটি ২০-বছর মেয়াদি ‘শান্তি, বন্ধুত্ব ও সহযােগিতার চুক্তি স্বাক্ষর করে। এর ফলে ভারতের প্রতিরক্ষার ব্যাপারে সসাভিয়েত ইউনিয়নের সামরিক সাহায্যের নিশ্চয়তা প্রতিষ্ঠিত হয় বলে দিল্লির কূটনৈতিক মহল মনে করেন। ৯ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে ওয়াশিংটনের বেয়াড়া নীতি এবং চীনের সঙ্গে পুনরায় কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের ফলে সােভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করা ছাড়া মিসেস গান্ধীর পক্ষে আর কোনাে উপায় ছিল না। ভারত-সােভিয়েত চুক্তিকে পাকিস্তান আক্রমণাত্মক চুক্তি’ বলে অভিহিত করে। ১১ আগস্ট ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস্’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এই চুক্তিকে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় হিটলারের সঙ্গে রাশিয়ার চুক্তি স্বাক্ষরের সঙ্গে তুলনা করেন। | আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের প্রথমদিকে পাকিস্তান অবজারভার (বর্তমানে ‘বাংলাদেশ অবজারভার) পত্রিকার মালিক হামিদুল হক চৌধুরী পশ্চিম ইউরােপের কয়েকটি দেশ সফর করে লন্ডনে পৌঁছান। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানাের জন্য তাঁকে এবং গণতন্ত্রী দলের নেতা মাহমুদ আলীকে (বর্তমানে পাকিস্তানের নাগরিক) বিদেশে পাঠানাে হয়। লন্ডনে তাঁরা বিখ্যাত রয়াল ল্যাঙ্কাস্টার হােটেলে অবস্থান করেন। পাকিস্তান সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করে। ভাতাদান সম্পর্কিত সরকারি দলিলের ফ্যাক্সিমিলি’ লন্ডনের সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘জনমত’-এর ৫ সেপ্টেম্বর (১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়।৯৫
ল্যাঙ্কাস্টার হােটেল থেকে টেলিফোন করে হামিদুল হক চৌধুরী লন্ডন প্রবাসী সাংবাদিক আবদুল মতিনের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আলােচনাকালে মি. চৌধুরী বলেন, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ। পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়। অথচ পূর্ব পাকিস্তানের জনসাধারণ তা চায় না। বিগত নির্বাচনে যারা আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছে তারা পাকিস্তানকে ধ্বংস করার ম্যান্ডেট’ তাকে দেয় নি। | মি. মতিন বলেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যবাহিনী বাঙালিদের মুক্তিযুদ্ধের পথ বেছে নিতে বাধ্য করেছে। | মি. চৌধুরী বলেন, মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ক্ষমতা ও সাহস আওয়ামী লীগের নেই। বাঙালিদের সাহসের অভাব সম্পর্কে তিনি ফেনিয়ে-ফাপিয়ে গল্প বললেন। পতেঙ্গায় বিমানবন্দরের কন্ট্রোল টাওয়ার’ দখলকারী বাঙালি সৈন্যরা নাকি পাঠান সৈন্যদের দেখেই হাতের বন্দুক ছুঁড়ে ফেলে ‘সেলুট’ দিয়ে দাঁড়ায়। ব্যঙ্গ করে তিনি বলেন, এদের নিয়ে শেখ মুজিব যুদ্ধ করবে! মি. মতিন বলেন, মুক্তিযুদ্ধ ছাড়া বাঙালিদের আর কোনাে উপায় নেই। মি, চৌধুরী বললেন, শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগ ভারতের হাতের-পুতুল। মাত্র। ভারত যদি পূর্ব পাকিস্তান দখল করে তাহলে মুসলমানরা এক হাজার বছর। ধরে হিন্দুদের গােলাম হয়ে থাকবে। আবদুল মতিন তার যুক্তি খণ্ডনের চেষ্টা করেন। মি. চৌধুরী শেষ পর্যন্ত হাল। ছেড়ে দিয়ে বললেন, তুমি এ ব্যাপারে মাহমুদ আলীর সঙ্গে কথা বলাে। সে। তােমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলবে। | মি, মতিনের অনিচ্ছা সত্ত্বেও মি. চৌধুরী তাঁকে মাহমুদ আলীর রুমে নিয়ে যান। তার মুখেও একই যুক্তি শােনা গেল। হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী কয়েক দিন লন্ডনে ছিলেন। কয়েকটি বাঙালি রেস্তোরায় গিয়ে তারা ঘরােয়া আলােচনাকালে ভারতের তথাকথিত । দুরভিসন্ধির কথা উল্লেখ করেন। তারা বলেন, ভারত ১৯৪৭ সালে দেশ-বিভাগ। মেনে নেয় নি। তাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগকে তারা সমর্থন করছে। ব্যারিস্টার আব্বাস আলীসহ মাত্র অল্প কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী। বাঙালি মাহমুদ আলী ও হামিদুল হক চৌধুরীর সঙ্গে যােগাযােগ করেন। গােলযােগের আশঙ্কায় তারা প্রবাসী বাঙালিদের নিয়ে জনসভা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা ত্যাগ করেন।৯৭ আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে পারীতে বসবাসকারী খ্যাতনামা লেখক সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহর সঙ্গে লন্ডনভিত্তিক বাংলাদেশ নিউজলেটার গ্রুপ’-এর সরাসরি। যােগাযােগ স্থাপিত হয়।
১৯৬৭ সালের ৮ আগস্ট তিনি ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক দপ্তরে প্রােগ্রাম স্পেশালিস্ট হিসেবে যােগ দেন। পরবর্তীকালে তিনি ডেপুটি ডাইরেক্টর পদে উন্নীত হন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর প্রতিটি সংখ্যা এবং ব্রিটিশ ও আমেরিকান। সংবাদপত্রের বহু ক্লিপিং ডাকযােগে সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে পাঠানাে হয়েছিল। আগস্ট মাসে পারী সফরকালে আবদুল মতিনের সঙ্গে তার যােগাযােগ হওয়ার পর তিনি জানান, বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি সম্পন্ন ফরাসি সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ ও বুদ্ধিজীবীদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত খবর সরবরাহ করার ব্যাপারে ইতােপূর্বে লন্ডন থেকে পাঠানাে বুলেটিন ও ক্লিপিংগুলাে তার খুব কাজে লেগেছে। তখন থেকে তার। স্ত্রী এ্যানমেরী ওয়ালীউল্লাহ ফরাসি সংবাদপত্রসমূহে বাংলাদেশ সম্পর্কে প্রকাশিত সংবাদ-বিশ্লেষণ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য ইংরেজিতে অনুবাদ করে বাংলাদেশ। নিউজলেটার’-এ প্রকাশের জন্য নিয়মিতভাবে পাঠান। সেপ্টেম্বর মাসের (১৯৭১) শেষের দিকে তিনি লন্ডনে আসেন। মুক্তিযুদ্ধের সমর্থক কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করা তার সফরের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। বিচারপতি চৌধুরী তখন লন্ডনের বাইরে ছিলেন বলে তার সঙ্গে দেখা করা সম্ভব হয় নি। বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্ব-জনমত গড়ে তােলার জন্য সর্বোদয় আন্দোলনের নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের উদ্যোগে দিল্লিতে যে আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়ােজন করা হয়েছিল, তাতে যােগ দেয়ার জন্য সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও নিতান্ত ব্যক্তিগত কারণে তিনি এই সম্মেলনে যােগ দিতে পারেন নি। ১০ অক্টোবর (১৯৭১) তিনি পারীতে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’ ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পরদিন (বুধবার) একটি সামরিক আদালতে রাষ্ট্রদ্রোহিতা ও অন্যান্য গুরুতর অভিযােগে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সামরিক শাসন দপ্তর থেকে ৯ আগস্ট প্রকাশিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এই তথ্য প্রকাশ করা হয়। এই বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার জন্য কৌসুলি নিয়ােগের সুযােগ দেয়া হবে। তবে পাকিস্তানের নাগরিক ছাড়া অন্য কাউকে কৌসুলি নিয়ােগ করা যাবে না। সামরিক আদালতের সদস্যদের নাম এবং কোথায় এই গােপন-বিচার প্রহসন অনুষ্ঠিত হবে তা সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ হয়নি। সামরিক আদালতে বিচারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিভিন্ন মহল থেকে শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি ও ব্যক্তিগত পত্র লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনে পাঠানাে হয়। বিভিন্ন সংবাদপত্রের সম্পাদকীয় মন্তব্যে শেখ মুজিবের বিচার অপরিণামদর্শীর সিদ্ধান্ত বলে উল্লেখ করে তা পরিহার করার পরামর্শ দেয়া হয়।
১০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবের গােপন-বিচার সম্পর্কে ইয়াহিয়া খানের অকল্পনীয় সিদ্ধান্ত ভারত উপমহাদেশের জন্য অধিকতর তিক্ততা, যুদ্ধ ও ধ্বংস ডেকে আনবে। ভারত ও পাকিস্তানের পক্ষে প্রকাশ্য সংঘর্ষ ছাড়া আর কোনাে পথ খােলা আছে বলে মনে হয় না। | ১০ আগস্ট জেনেভা থেকে “দি ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস’ শেখ মুজিবের গােপন বিচার অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের কাছে এক জরুরি তারবার্তা প্রেরণ করে। কমিশনের ব্রিটিশ সেক্রেটারি-জেনারেল নিয়াল ম্যাকডারমেটের উদ্যোগে এই তারবার্তা প্রেরণ করা হয়। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন-বিচার সম্পর্কে ১০ আগস্ট ‘দি মর্নিং স্টার’-এর প্রতিনিধির সঙ্গে আলােচনাকালে বিচারপতি চৌধুরী বলেন, এর ফলে বাংলাদেশের জনগণ অধিকতর ঐক্যবদ্ধ হবে। শেখ মুজিব বাঙালিদের হৃদয়ে এক বিশিষ্ট স্থান দখল করতে সক্ষম হয়েছেন। কোনাে নেতাই তাঁর মতাে নির্ভীক নন। ২৫ মার্চ ঢাকা থেকে চলে যাওয়ার জন্য তার বন্ধুরা তাকে অনুরােধ করেন। তাঁকে খুঁজে বের করার অজুহাতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনী সমগ্র শহরকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করবে আশঙ্কা করে তিনি ঢাকা থেকে চলে যেতে অস্বীকার করেন। তিনি অবশ্য জানতেন না, সৈন্যবাহিনী ইতােমধ্যে গণহত্যার পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। জনগণকে বাঁচার জন্য তিনি আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি অধিবাসী স্বাধীনতা অর্জনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। এটি একটি বাস্তব সত্য। এ সত্যকে মেনে নেয়ার জন্য পার্লামেন্ট সদস্যরা ব্রিটিশ সরকারকে রাজি করানাের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। | শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের দাবি জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সম্প্রতি উত্থাপিত প্রস্তাবটি ইতােমধ্যে দু’শজনেরও বেশি পার্লামেন্ট সদস্য সমর্থন করেছেন জেনে বিচারপতি চৌধুরী কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। তিনি ব্রিটিশ সরকার ও জনগণের কাছে শেখ মুজিবের মুক্তি অর্জনের ব্যাপারে কার্যকর সমর্থনদানের জন্য আবেদন জানান। উপসংহারে তিনি বলেন : ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই। আমরা বিজয় অর্জন করবাে, এ সম্বন্ধে আমার মনে কোনাে সন্দেহ নেই। সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করার জন্য বাংলাদেশ মিশন লন্ডনের বিখ্যাত সলিসিটারদের প্রতিষ্ঠান বার্নার্ড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানিকে নিয়ােগ করে। ১১ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক পত্রে তারা বলেন, শেখ মুজিবকে আইনগত পরামর্শ গ্রহণের সুযােগ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। পাকিস্তানের সরকারি মহলের মাধ্যমে তাঁর সঙ্গে যােগাযােগের চেষ্টা করে তারা ব্যর্থ হয়েছেন।
এ সম্পর্কে তারা পাকিস্তান হাই কমিশনারের মারফত যে পত্র প্রেরণ করেন, তার কোনাে উত্তর পাওয়া যায় নি। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী সন্ ম্যাকব্রাইডের সঙ্গে বার্নার্ড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানির জনৈক সলিসিটার রাওয়ালপিন্ডি যান। শেখ মুজিবকে তার পছন্দ। অনুযায়ী আইনজীবীর সঙ্গে আলােচনার সুযােগদান, বেসামরিক আদালতে তাঁর প্রকাশ্য বিচার অনুষ্ঠান এবং তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাে অবিলম্বে তাকে অবহিত করার দাবি সরাসরি পাকিস্তান সরকারের কাছে পেশ করার জন্য তাঁরা পাকিস্তান সফর করেন। এই সফর ফলপ্রসূ হয় নি। | পাকিস্তানের বেসামরিক কর্তৃপক্ষ ২৬ জুলাই মি. ম্যাকব্রাইডকে বলেন, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে যেসব অভিযােগ আনা হবে তা লিপিবদ্ধ করা হয় নি এবং দেশি কিংবা বিদেশি আইনজীবীর সঙ্গে আলােচনার সুযােগ তাকে দেয়া হয় নি। এমনকি তাকে কোন জেলে বন্দি রাখা হয়েছে তাও তিনি জানতে পারেন নি। পত্রের উপসংহারে বলা হয়, স্বাভাবিক ন্যায়নীতির সর্বনিম্ন মান অনুযায়ী শে। মুজিবের ন্যায্য বিচার লাভের কোনাে সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া খান সন ম্যাকব্রাইড় ও বার্নার্ড শেরিডান এ্যান্ড কোম্পানির। সলিসিটারের সঙ্গে দেখা করতে অস্বীকার করেন। তারা অগত্যা ইয়াহিয়া খানের আইন বিষয়ক উপদেষ্টা বিচারপতি কর্নেলিয়াসের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বলেন, কোনাে বিদেশী আইনজীবীকে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ অথবা তার পক্ষ সমর্থন করতে দেয়া হবে না । বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে ১১ আগস্ট লন্ডনের হাইড পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোচযােগে বাঙালিরা দলে দলে হাইড পার্কে এসে জমায়েত হন। সভায় বক্তৃতাদানকালে বিচারপতি চৌধুরী বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবি করে ঘােষণা করেন : বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তাহানি কিংবা কোনাে প্রকার ক্ষতি হলে বাঙালি জাতি কোনাে দিন পাকিস্তানকে ক্ষমা করতে পারবে না। ক্ষমা শব্দটি বাঙালি চিরদিনের মতাে ভুলে যাবে।’ আঞ্চলিক কমিটিগুলাের কয়েকজন নেতা এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নানও বক্তৃতা করেন। তারা পাকিস্তান সরকারকে সতর্ক করে দিয়ে বলেন, বঙ্গবন্ধুর কোনাে ক্ষতি হলে সমগ্র বাঙালি জাতি অপরাধীর সমুচিত শাস্তির ব্যবস্থা করবে। এই সভায় পাকিস্তান হাই কমিশনে ডাইরেক্টর অব অডিট এ্যান্ড একাউন্টস পদে নিয়ােজিত লুফুল মতিন, ফজলুল হক চৌধুরী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করেন।
সভার শেষে এক বিরাট শশাভাযাত্রা পিকাডিলি সার্কাসসহ বিভিন্ন রাস্তা। পরিক্রমণের পর ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌঁছায়। শশাভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা ‘শেখ মুজিবের মুক্তি চাই’, ‘বিচার প্রহসন বন্ধ কর’, ‘গণহত্যা বন্ধ করা ইত্যাদি শ্লোগান দেয়। দি মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, পাঁচ হাজারেরও বেশি লােক এই শােভাযাত্রায় অংশগ্রহণ করে। পিটার শাের, মাইকেল বার্নর্স, ক্রস ডগলাসম্যান, জন স্টোনহাউস এবং আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য শােভাযাত্রার প্রথম সারিতে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে ছিলেন। | প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সরকারি দপ্তরে নিয়ােজিত জনৈক অফিসারের হাতে একটি স্মারকলিপি দিয়ে বিচারপতি চৌধুরী বলেন : “শেখ মুজিব একটি। স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশের রাষ্ট্রপতি। তার বিচার করার অধিকার কারাে নেই। গােপন-বিচার একেবারেই সভ্যতা-বহির্ভূত। এই প্রহসনের অবসান এবং শেখ মুজিবের অবিলম্বে মুক্তির জন্য ব্রিটিশ সরকার পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের ওপর প্রভাব বিস্তার করবে, এটাই আমাদের আশা।১০০
১২ আগস্ট ‘দি টাইমস্ -এর প্রধান সম্পাদকীয় নিবন্ধে সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন-বিচারের তীব্র নিন্দা করা হয়। পাকিস্তানের এই সিদ্ধান্তকে শােকাবহ বলে উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবের যুদ্ধ ঘােষণা করার অভিযােগ উদ্ভট বলে বর্ণনা করা হয়। তাছাড়া গােপন-বিচারকে লজ্জাকর বলে অভিহিত করে বলা হয়, এর ফলাফল অন্যায্য হওয়ার গুরুতর আশঙ্কা থাকে। উপসংহারে বলা হয়, শেখ মুজিবের জীবন রক্ষার জন্য সবাইকে জোরালাে আবেদন জানাতে হবে। | সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের গােপন-বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দু’জন শ্রমিক দলীয় সদস্যের পৃথক চিঠি ১৩ আগস্ট ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত হয়। ১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনকারী কৌসুলি টমাস উইলিয়ামস তার পত্রে বলেন, সামরিক আদালতে। গােপন-বিচারের ভয়াবহ ফলাফল এড়ানাের জন্য ব্রিটিশ সরকার ও জাতিসংঘ যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে বলে তিনি আশা করেন। অপর পত্রে পিটার শাের বলেন, গােপনে শেখ মুজিবের বিচার অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত থেকে মনে হয়, পাকিস্তানি প্রেসিডেন্ট পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন এবং সশস্ত্র সংঘর্ষের আশঙ্কা সম্পর্কে নিরুদ্বেগ। এটা অত্যন্ত দুঃখজনক ব্যাপার। নিজেদের মঙ্গলের কথা বিবেচনা করে পাকিস্তানের শাসকচক্র এই। পরিস্থিতিতে তাদের মত পরিবর্তন করবে বলে তিনি কি আশা করতে পারেন? আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে ভারতের প্রাক্তন দেশরক্ষামন্ত্রী এবং যুক্তরাজ্যে তাদের প্রাক্তন হাই কমিশনার মি. কৃষ্ণমেনন ৪/৫ দিনের জন্য লন্ডনে আসেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতীয় মনােভাব দৃঢ়তার সঙ্গে ব্যাখ্যা করাই তার। সফরের প্রধান উদ্দেশ্য ছিল। তার বয়স তখন প্রায় ৭৫ বছর। তিনি তখন ভারতীয় লােকসভার স্বতন্ত্র সদস্য। বিচারপতি চৌধুরী স্যাভয় হােটেলে গিয়ে মি, কৃষ্ণমেননের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। প্রবাসী ভারতীয় সাংবাদিক ড. তারাপদ বসু তাঁকে দেখাশােনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। লন্ডন অবস্থানের প্রথম দিন পুরাে বিকেলবেলা তিনি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ও বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন সম্পর্কে আলােচনা। করে কাটান।
১৩ আগস্ট মি. কৃষ্ণমেনন কমনওয়েলথ ইনস্টিটিউটের প্রেক্ষাগৃহে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতা করেন। সভার শেষে ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙালি বাস্তুত্যাগীদের অবস্থা সম্পর্কে গৃহীত চলচ্চিত্র প্রদর্শন করা হয়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, নিজের চোখে যা দেখেছেন তা আরও করুণ ও হৃদয়বিদারক। ১৪ আগস্ট তিনি ভারতীয় ছাত্রাবাস মহাত্মা গান্ধী হল এবং রেড লায়ন। স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে অনুষ্ঠিত দুটি পৃথক সভায় বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। বিচারপতি চৌধুরী উভয় সভায় উপস্থিত ছিলেন। কনওয়ে হলের সভায় তিনি মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে মি, কৃষ্ণমেননকে ধন্যবাদ জানান। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খান মি, কৃষ্ণমেননের সম্মানার্থে একটি ঘরােয়া ভােজসভার আয়ােজন করেন। বিচারপতি চৌধুরী, স্টিয়ারিং কমিটির নেতৃবৃন্দ এবং কয়েকজন বিশিষ্ট কর্মীকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়েছিল। তিনি ধৈর্য সহকারে সবার বক্তব্য শােনেন এবং যথাসম্ভব সাহায্যের আশ্বাস দেন। লন্ডনের কর্মসূচি পালনের পর তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পথে রওনা হয়ে যান। | ১৪ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ব্রিটিশ শ্রমিক দলের জাতীয় কার্যনির্বাহক সংস্থার পক্ষ থেকে পাকিস্তান হাই কমিশনারের কাছে সম্প্রতি লিখিত এক পত্রে শেখ মুজিব ও তার সহকর্মীদের অবিলম্বে মুক্তিদানের আবেদন জানানাে হয়। শ্রমিক দলের সহকারী সেক্রেটারি গুইন মর্গান লিখিত চিঠিতে বলা হয়, সামরিক আদালতে গােপন বিচারের সিদ্ধান্ত পরিত্যাগ করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমে বিদ্যমান সমস্যার স্থায়ী সমাধান সম্ভব বলে শ্রমিক দল মনে করে। | ১৫ আগস্ট (রােববার) ‘দি অবজারভার পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি নির্যাতন ও তাদের নীতির যৌক্তিকতা প্রমাণ করা ছাড়া | শেখ মুজিবের গােপন বিচারের আর কোনাে উদ্দেশ্য থাকতে পারে না। পত্রিকাটি ইয়াহিয়া সরকারকে সাবধান করে দিয়ে বলে, শেখ মুজিবকে যদি শুধুমাত্র আনুষ্ঠানিকভাবেও মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়, তাহলে এর ফলাফল সুদূরপ্রসারী হবে। এর ফলে, পূর্ব বঙ্গে নিরবচ্ছিন্নভাবে রাজনৈতিক ও সামাজিক দমনকার্য পরিচালনাই জেনারেল ইয়াহিয়ার একমাত্র নীতি বলে যে সন্দেহ রয়েছে, তা সত্য বলে প্রমাণিত হবে।
এই নীতি সফল হতে পারে না এবং এর ফলে ভারতপাকিস্তান যুদ্ধের আশঙ্কা বৃদ্ধি পাবে। উল্লিখিত তারিখে ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, গত বুধবার (১১ আগস্ট) লাহাের থেকে ৮০ মাইল দূরবর্তী শহর লায়ালপুরের একটি সার্কিট হাউসে পূর্ব বঙ্গের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হয়। জনৈক ব্রিগেডিয়ার তিন-সদস্যবিশিষ্ট একটি বিশেষ সামরিক আদালতের প্রধান কার্যনির্বাহক পদে নিয়ােজিত হয়েছেন। পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে ১৫ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশ-বিরােধী একটি জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত বাংলাদেশ নিউজলেটার এই জনসমাবেশকে ‘অদ্ভুত সার্কাস’ বলে। অভিহিত করে। লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে কয়েকজন বাঙালি কুইসলিং’ যােগদান করে। এদের নেতা মােহাম্মদ আবুল হায়াত পাকিস্ত নি অর্থ সাহায্য গ্রহণ করে বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণার জন্য মুক্তি নামের একটি। সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করে। টোরিদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য এবং লন্ডনস্থ পাকিস্তান সােসাইটির প্রতিষ্ঠাতা জন। বিগ ডেভিডসন এমপি তার বক্তৃতায় পাকিস্তানি গণতন্ত্রের প্রশংসা করেন। অন্যান্য বক্তা মিসেস ইন্দিরা গান্ধী, বি বি সি এবং ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করেন। ১৬ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, দু’সপ্তাহ আগে। ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশের সমর্থক বাঙালিদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের পাল্টা জবাব হিসেবে পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট’ ১৫ আগস্ট অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের আয়ােজন করে। এপ্রিল মাসে আবুল হায়াতের নেতৃত্বে। বার্মিংহামে এই প্রতিষ্ঠানটি জন্মলাভ করে। পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের অভিযােগ অস্বীকার করে পাকিস্তান হাই কমিশন প্রকাশিত একটি প্রচারপত্র ট্রাফালগার স্কোয়ারের জনসমাবেশে বিলি । করা হয়। কয়েকটি প্ল্যাকার্ডে ইয়াহিয়া খানের ছবি দেখা যায়। এই ছবিগুলাে। পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে সরবরাহ করা হয় বলে দি গার্ডিয়ান’-এর রিপাের্টে। উল্লেখ করা হয়।
১৬ আগস্ট রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক এম, হােসেন এবং বাংলা বিভাগের অধ্যাপক এম. ইসলাম লিখিত একখানি চিঠি ‘দি। টাইমস’-এ প্রকাশিত হয়। এই চিঠিতে তারা গত ৭ জুলাই প্রকাশিত ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও ড. মােহর আলীর চিঠির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। ড. সাজ্জাদ হুসাইন ও ড. মােহর আলী তাদের চিঠিতে বলেন, চট্টগ্রাম কিংবা । রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে বাঙালি অধ্যাপককে হত্যা করা হয় নি। এর। উত্তরে অধ্যাপক এম, হােসেন ও অধ্যাপক এম. ইসলাম বলেন, ১৩ এপ্রিল। রাজশাহী দখল করার পর পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী গণিতশাস্ত্র বিভাগের হাবিবুর রহমান ও ভাষাতত্ত্ব বিভাগের এস আর সমাদ্দারকে তাদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে। গিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করে। ড. সাজ্জাদ হুসাইন তখনও পর্যন্ত রাজশাহী। বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় অবস্থিত উপাচার্যের বাসভবনে বসবাস করছিলেন। এই হত্যাকাণ্ডের খবর তার অজানা থাকার কথা নয়। ১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করার জন্য । বিশ্ব জনমতের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। তার একটি প্রতিকৃতির নিচে পাকিস্তান। জাতীয় সংসদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ, পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর সশস্ত্র আক্রমণ ও গণহত্যা এবং সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুর গােপন-বিচার সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত তথ্য দেয়া হয়। এই বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তাদের তালিকায় ৬৮টি প্রতিষ্ঠানের নামােল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি এ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লন্ডনের ওয়ালডর্ফ হােটেলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রীতিঅনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ অ্যাসােসিয়েশন’ এই অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। প্রতিষ্ঠানটির পক্ষ থেকে পুলিন বিহারী শীল ও ড. গিয়াস উদ্দিন বিচারপতি চৌধুরীকে প্রধান অতিথি হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। তারা উভয়েই বাঙালি। মি, শীল ত্রিশের দশকে চট্টগ্রাম থেকে লেখাপড়ার জন্য ব্রিটেনে আসেন এবং তখন থেকেই এ দেশে বসবাস করছেন। ইউরােপে ভারতের স্বাধানতা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য মি, শীল ও ড. গিয়াসউদ্দিন এই অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেন। এই প্রীতি-অনুষ্ঠানে মুসলিম দেশগুলাে ছাড়া অন্যান্য দেশের রাষ্ট্রদূতগণ যােগদান করেন। পূর্ব ইউরােপের প্রায় প্রত্যেকটি দেশ এবং সাইপ্রাস, কিউবা, মরিশাস প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রদূত, ভারতের ডেপুটি হাই কমিশনার, ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্য এবং বহু সাংবাদিক এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থনদানের জন্য সবাইকে ধন্যবাদ জানান। ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য। স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে বক্তৃতা দেন। | এই অনুষ্ঠানে মি. শীল গভর্নমেন্ট বাই মার্ডার’ (হত্যার মাধ্যমে শাসন) শীর্ষক একটি প্রচারপত্র বিলি করেন।১০১ | বিশ্ব জনমতকে প্রভাবিত করার উদ্দেশ্যে বিচারপতি চৌধুরী ১৭ আগস্ট সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় একটি আন্তর্জাতিক সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠানের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। ৫ আগস্ট জেনেভায় অবস্থানকালে এই সম্মেলন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করে তিনি লন্ডনে ফিরে এসেছিলেন। তার পরামর্শ অনুযায়ী স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি সম্মেলন অনুষ্ঠানের কথা ঘােষণা করে। সুইজারল্যান্ডের সমাজতান্ত্রিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জা জিগলার এ সম্পর্কে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ফেডারেল পার্লামেন্টের স্থানীয় সদস্যদের ব্যবহারের জন্য জেনেভা শহরে একটি ভবন রয়েছে। এই ভবনের প্রেস রুমে মি.। জিগলার সম্মেলনের ব্যবস্থা করেন। ১৭ আগস্ট সকাল সাড়ে দশটায় বিচারপতি চৌধুরী জেনেভা বিমানবন্দরে পোঁছান। সুইজারল্যান্ডের বিশিষ্ট নাগরিক মাদাম ক্যাথলিন লা প্য তাকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, তাঁকে ভিসা মধুর করা হয়নি বিধায় তার সাংবাদিক সম্মেলন বাতিল করা হয়েছে বলে পাকিস্তানি দূতাবাসের উদ্যোগে। জেনেভায় অবস্থিত জাতিসংঘের প্রেস রুমে একটি বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয়েছিল। এই খবর পেয়ে মাদাম লা প্য ও তাঁর সহকর্মীরা পাল্টা বিজ্ঞাপনে ঘােষণা করেন, পাকিস্তানি দূতাবাসের মিথ্যা ও বিভ্রান্তিমূলক বিজ্ঞপ্তি উপেক্ষা করে সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করার জন্য তারা বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন এবং সম্মেলন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে। প্রবেশ-ভিসা থাকা সত্ত্বেও বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীর পাসপাের্টে এন্ট্রি সিল’ সঙ্গে সঙ্গে দেয়া হয় নি। এ ব্যাপারে পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের হাত রয়েছে বলে। মাদাম লা প মনে করেন। বিকেলবেলা সাংবাদিক সম্মেলনের আগে দু’জন সুইস ফেডারেল পুলিশ। অফিসার বিচারপতি চৌধুরীর হােটেলে গিয়ে তাকে বলেন, তার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার প্রতি লক্ষ্য রাখার জন্য রাজধানী বার্ন থেকে তারা এসেছেন। পাকিস্তানিদের দুরভিসন্ধি রয়েছে বলে তারা খবর পেয়েছেন।
ফেডারেল পার্লামেন্টের জেনেভা অফিসে পৌঁছে বিচারপতি চৌধুরী মি.। জিগলারের রুমে যান। মাদাম লা প্য প্রেস রুম থেকে ঘুরে এসে বললেন, পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূতের বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপ্তির ফলে সাংবাদিকদের আগ্রহ বেড়ে গেছে। তার ফলে বহু সাংবাদিক প্রেস রুমে তার জন্য অপেক্ষা করছেন। | সাংবাদিকদের ভিড়ের মধ্যে পাকিস্তানি দূতাবাসের একজন সেকেন্ড সেক্রেটারি। ছিলেন। বিচারপতি প্রেস রুম থেকে মি, জিগলারের রুমে ফিরে এসে মাদাম লা । প্য, সম্মেলনের কয়েকজন আয়ােজনকারী এবং বার্ন থেকে আগত পুলিশ। অফিসারদের বলেন : “এই সম্মেলন সাংবাদিকদের জন্য, পাকিস্তানি কূটনীতিবিদ এখানে আসতে পারেন না।’ তারা বলেন, এ প্রশ্ন তাঁকে করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছেন, দূতাবাসের জনসংযােগ অফিসার পদে তিনি নিয়ােজিত। অতএব, তাকেও সাংবাদিক হিসেবে। গণ্য করতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী বলেন : “তিনি দূতাবাসের অফিসার, কিন্তু পেশাগতভাবে সাংবাদিক নন অথবা কোনাে সংবাদপত্র বা সংবাদ সংস্থার প্রতিনিধি নন। অতএব, তার প্রবেশাধিকার নেই, একথা তাকে বুঝিয়ে বলুন।’ শেষ পর্যন্ত পাকিস্তানি দূতাবাসের অফিসার প্রেস রুম থেকে চলে যান। সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস ও যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসন সম্পর্কেও সাংবাদিকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। পরদিন ‘লা সুইস’, ‘ট্রিবিউন দ্য জেনিডসহ সুইজারল্যান্ডের বিভিন্ন পত্রিকায় পুরাে পৃষ্ঠাব্যাপী সম্মেলনের খবর ও বাংলাদেশ আন্দোলনের ইতিহাস প্রকাশিত। হয়। পত্রিকাগুলাে বড় বড় হরফে পাকিস্তানিদের বিভ্রান্তিকর বিজ্ঞপ্তির কথা উল্লেখ করে। কয়েকটি পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তির ছবিও প্রকাশিত হয়।১০২ ১৭ আগস্ট আন্তর্জাতিক ওমেগা পিস টিমের আটজন ব্রিটিশ ও তিনজন আমেরিকান কর্মী পাকিস্তানি আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র এবং অন্যান্য সাহায্য-সামগ্রী নিয়ে পেত্রাপােল পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ইয়াহিয়ার সৈন্যরা তাদের গ্রেফতার করে জেলখানায় আটক রাখে। ১৮ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে বলা হয়, গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন ওমেগার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতার স্ত্রী এলেন কনেট এবং আরাে কয়েকজন মহিলা। তারা পিস টিমের অগ্রগামী দল হিসেবে একটি ভ্যানযােগে ১ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ওমেগার কর্মীরা যশাের জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৮ আগস্ট বিচারপতি চৌধুরী জেনেভায় লীগ অব রেডক্রস এবং ইন্টারন্যাশনাল কমিটি অব রেডক্রসের কর্মকর্তাদের সঙ্গে দেখা করে বঙ্গবন্ধুর জীবনের নিরাপত্তার জন্য তাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখার অনুরােধ জানান। সেদিন বিকেলবেলা তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন।
২১ আগস্ট লন্ডনে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, পাকিস্তানি আইনজীবী এ কে ব্রোহি সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের পক্ষ সমর্থন করবেন। সামরিক শাসনকর্তার প্রধান কার্যালয় থেকে জারি করা এক বিবৃতিতে এই সংবাদ প্রকাশ করা হয়। ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, মি. ব্রোহি এই দায়িত্ব। গ্রহণে রাজি ছিলেন না। শেষ পর্যন্ত আইন দপ্তরের অনুরােধে তিনি রাজি হন। ২১ আগস্ট (শনিবার) সকালবেলা ইরাকে নিয়ােজিত পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ টেলিফোনযােগে বিচারপতি চৌধুরীর প্রতি আনুগত্য ঘােষণা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে জানান। | সেদিন বিকেলবেলা গােরিং স্ট্রিটের অফিসে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে মি, ফতেহ তার সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেন। তার এই সিদ্ধান্তের কথা বিচারপতি চৌধুরী তারবার্তা পাঠিয়ে মুজিবনগর সরকারকে জানিয়ে দেন। সাংবাদিক সম্মেলনে মি, ফতেহ বলেন, সামরিক আদালতে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হওয়ার পর তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ইরাকের রাজধানী বাগদাদ ত্যাগ করার দিন তিনি দূতাবাস থেকে বেরিয়ে সরাসরি ব্যাঙ্কে গিয়ে দূতাবাসের একাউন্ট থেকে ২৫ হাজার পাউন্ড তুলে নেন। ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের সহায়তায় উক্ত অর্থ ‘মুজিবনগর’ | সরকারের কাছে পাঠানাের ব্যবস্থা করে তিনি সপরিবারে ইরাক থেকে ট্যাক্সিযােগে দশ মাইল পার হয়ে কুয়েত বিমানবন্দর থেকে লন্ডনের পথে রওনা হন। আগস্ট

মাসের মাঝামাঝি পর্যন্ত প্রায় বিশজন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দেন। তাদের মধ্যে মি, ফতেহ ছিলেন সবচেয়ে উচ্চপদস্থ অফিসার। তার লন্ডনে আগমন সংবাদ বিভিন্ন পত্রিকায় বিশেষ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। | কিছুকাল পর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে বিচারপতি চৌধুরীকে বলা হয়, আবুল। ফতেহুর বিরুদ্ধে পাকিস্তান হাই কমিশন এক অভিযােগ পেশ করেছে। ইরাকের ব্যাঙ্ক থেকে পাকিস্তান সরকারের অর্থ তুলে নিয়ে আসার অভিযােগে মি. ফতেহকে পাকিস্তান সরকারের হস্তে অর্পণ করার সরাসরি অনুরােধ আসার সম্ভাবনা রয়েছে বলে তাকে জানানাে হয়। মি, ফতেহ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃবৃন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের জন্য ‘মুজিবনগর’-এ যাওয়ার কথা ভাবছিলেন। পাকিস্তান সরকারের মতলব টের পাওয়ার পর অবিলম্বে তার ‘মুজিবনগর’-এ চলে যাওয়া বাঞ্ছনীয় বলে বিবেচিত হয়। যাওয়ার আগে তিনি ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মকর্তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।১০৩ | ২৩ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বার্মিংহামের বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট জগলুল পাশা ছ’ হাজার পাঁচশ’ পাউন্ডের একখানি চেক পশ্চিম বঙ্গে আশ্রয়গ্রহণকারী দুস্থ বাঙালিদের সাহায্যার্থে লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের হস্তে অর্পণ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম-বিরােধী পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্টের কনভেনার মােহাম্মদ আবুল হায়াতের দস্তখতে প্রেরিত একখানি চিঠি ২৩ আগস্ট “দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত হয়। এই চিঠিতে ১৯ আগস্ট প্রকাশিত এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ভিক্টর কিয়েরনানের চিঠির বালকসুলভ প্রতিবাদ করা। হয়। অধ্যাপক কিয়েরনান ১৫ আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে ইয়াহিয়ার সমর্থনে অনুষ্ঠিত জনসমাবেশের উল্লেখ করে বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিরা এই সমাবেশে অংশগ্রহণ করে। আবুল হায়াত নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দিয়ে বলে, জনসমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই পূর্ব বঙ্গের নাগরিক। অধ্যাপক কিয়েরনান তাঁর চিঠিতে বলেন, পাকিস্তানে জনজীবন সভ্যতার মাপকাঠি দিয়ে বিচার করা চলে না এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের মান অত্যন্ত নিচু। আবুল হায়াত তার প্রতিবাদ করে বলেন, “ব্রিটিশ শাসন শুরু হওয়ার আগে আমরা। (অর্থাৎ মুসলমানরা) ৮শ’ বছর যাবৎ শাসন করেছি। তিনশ’ বছরব্যাপী মােগল শাসনের পূর্বে এবং পরবর্তীকালে দেশে অধিকতর শান্তি, সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি, সামাজিক ন্যায়বিচার ও নিরাপত্তা বজায় ছিল। ব্রিটিশ রাজের অ্যুদয়ের ফলে আমাদের (অর্থাৎ মুসলমানদের) দুর্দশা শুরু হয়।’ চিঠির উপসংহারে আবুল হায়াত বলেন, পাকিস্তানের ‘নিচু মানের রাজনৈতিক নেতৃত্ব’ সমাজের সবচেয়ে বেশি পাশ্চাত্যমুখী অংশ থেকে এসেছে।
২৪ আগস্ট ‘দি মনিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি এবং জাতিসংঘের মানবিক অধিকার কমিশনের সদস্য বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশে ইয়াহিয়া সরকারের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে কমিশনের জরুরি সভা আহ্বান করার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টকে অনুরােধ জানিয়ে এক তারবার্তা প্রেরণ করেন। এই তারবার্তায় তিনি আরও বলেন, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নেতা শেখ মুজিবকে বিচার করার আইনগত অধিকার পাকিস্তানের নেই। ২৭ আগস্ট বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনের বেজওয়াটার এলাকার নটিংহিল গেইট টিউব স্টেশনের কাছে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে প্রায় ৩শ’ বাঙালি, কয়েকজন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য এবং বহু বিদেশী সাংবাদিকের উপস্থিতিতে বাংলাদেশ মিশনের দ্বারােদঘাটন করেন। ভারতের বাইরে লন্ডনেই বাংলাদেশের প্রথম কূটনৈতিক মিশন প্রতিষ্ঠিত হয়। দূতাবাসের সামনে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করার পর বিচারপতি চৌধুরী বলেন, লন্ডন থেকেই বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশ মুক্তি আন্দোলনের সঙ্গে সংযােগ রক্ষা করা হবে এবং লন্ডনই হবে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রধান কেন্দ্র। | পরবর্তীকালে লন্ডনে এক সাক্ষাৎকার উপলক্ষে স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত কনভেনার শেখ আবদুল মান্নান বলেন, জাকারিয়া খান চৌধুরী খবর নিয়ে এলেন, বেজওয়াটার এলাকায় ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেনের বাড়িটি কূটনৈতিক মিশনের জন্য পাওয়া যেতে পারে। এই বাড়িতে তখন টক-এই নামের প্রতিষ্ঠান পরিচালিত একটি আন্তর্জাতিক হােস্টেল ছিল। ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর চেয়ারম্যান ডােনাল্ড চেস্ওয়ার্থ এই হােস্টেলের ওয়ার্ডেন পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। মি. চেসওয়ার্থ প্রথম থেকেই বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক ছিলেন। “ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর পক্ষ থেকে তিনি ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারীদের সাহায্যের ব্যবস্থা করার জন্য কয়েকবার কলকাতা যান। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে তখন তার পরিচয় হয়। মে মাসে মি, চেস্ওয়ার্থ বাংলাদেশ ফান্ডের অন্যতম ট্রাস্টি পদে নিয়ােজিত হন।
বিচারপতি চৌধুরী, শেখ আবদুল মান্নান ও জাকারিয়া খান চৌধুরী ডােনাল্ড চেস্ওয়ার্থের সঙ্গে দেখা করেন। মি, চেসওয়ার্থ হােস্টেলের গ্রাউন্ড ফ্লোরের রুমগুলাে নামমাত্র ভাড়ায় বাংলাদেশ মিশনকে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। উদ্বােধনী বক্তৃতায় বিচারপতি চৌধুরী বলেন, ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী পূর্ব বঙ্গে গণহত্যা শুরু করার পর বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করা হয়। ১৭ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়। উপরােক্ত ঘােষণা অনুযায়ী বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের জন্য বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। হয়, জলে। গ্রেট ব্রিটেন-প্রবাসী বাঙালিরা একটি স্বাধীন দেশের নাগরিক। এই স্বাধীন দেশের সরকারি প্রতীক হিসেবে একটি মিশন স্থাপনের জন্য তাদের আগ্রহ ও বাসনা বিচার করে গত ১ আগস্ট বাংলাদেশ মিশন স্থাপনের কথা ঘােষণা করা হয়। ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রিটে মিশনের কাজ অবিলম্বে শুরু করা হয়। এখন থেকে ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে মিশনের কাজ যথারীতি পরিচালিত হবে। গত ২৩ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব বঙ্গকে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে উপনিবেশ এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শােষণের শিকার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আইনসঙ্গতভাবে আমাদের ন্যায্য দাবি আদায়ের চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে। সত্য ও ন্যায়পরায়ণতা বিসর্জন দিয়ে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনী ধ্বংসযজ্ঞে আত্মনিয়ােগ। করেছে। তারা এখনও গণহত্যায় নিয়ােজিত রয়েছে। ইতােমধ্যে তারা নিশ্চয় বুঝতে পেরেছে, যে জাতি মৃত্যুকে জয় করেছে তাকে সামরিক বলপ্রয়ােগের মাধ্যমে পরাজিত করা সম্ভব নয়। * আমাদের প্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের নির্ভীক ও দৃঢ় প্রতিজ্ঞ নেতাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁকে বেআইনিভাবে বন্দি করে রাখা হয়েছে। তাঁর বিচার-অনুষ্ঠান বর্বরােচিত কাজ। তার যদি কোনাে ক্ষতি হয়, তাহলে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি কখনও তা ক্ষমা করবে না। শেখ মুজিব একটি স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্ট। তার বিচার করার অধিকার অন্য কোনাে দেশের নেই। আমরা অবিলম্বে তাঁর মুক্তি দাবি করি।
সবচেয়ে জরুরি যে-কথাটি মনে রাখা দরকার তা হলাে পাকিস্তানের মৃত্যু হয়েছে। এর ফলে দুটি নতুন দেশের জন্ম হয়েছে। ইতঃপূর্বে পূর্ব পাকিস্তান নামে পরিচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশটি এখন স্বাধীন বাংলাদেশে পরিণত হয়েছে। পূর্ববর্তী অবস্থায় আর ফিরে যাওয়া সম্ভব নয়— একথা কখনও ভুলে যাওয়া চলবে না। ইয়াহিয়া খানের হানাদার সৈন্যদের তাড়িয়ে দিয়ে আমরা একটি সুখী ও সমৃদ্ধশালী দেশ গড়ে তুলবাে। এ দেশে হিন্দু, মুসলমান, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ ও অন্যান্য। ধর্মাবলম্বীরা সাম্য ও মৈত্রীর ভিত্তিতে সমান মানবাধিকার ভােগ করবে। উপসংহারে বিচারপতি চৌধুরী শেখ মুজিবের মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন দেশের জনগণ ও সরকারের কাছে আবেদন জানান।১০৪ দূতাবাস উদ্বোধনের পর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন সদস্য বাংলাদেশের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করে বক্তৃতা করেন। | উদ্বোধনের দিন দূতাবাসের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমদ, লুৎফুল মতিন, শিল্পী আবদুর রউফ, মহিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, আবদুস সালাম, এ কে এম নূরুল হুদা ও ফজলুল হক চৌধুরী। মুজিবনগর সরকার ইতঃপূর্বে বিচারপতি চৌধুরীকে হাই কমিশনার পদে নিয়ােগ করে ‘লেটার অব ক্রিডেন্স’ (কূটনৈতিক পরিচয়পত্র) প্রেরণ করে। অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামের দস্তখত সংবলিত এই পরিচয়পত্র আবার ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠানাে হয়। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের পর বিচারপতি চৌধুরী হলু-ঘরে উদ্বোধনী ভাষণ দেয়ার সময় একটি অপ্রত্যাশিত ঘটনা সংঘটিত হয়। বিনা আমন্ত্রণে কয়েকটি কোচবােঝাই পুলিশ অফিসার মিশনের সামনে এসে পাহারার দায়িত্ব গ্রহণ করে। অনুষ্ঠানের শেষে তাদের সবাইকে প্রতি অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য আমন্ত্রণ জানানাে হয়।
পরদিন সংবাদপত্র পড়ে বােঝা গেল, পুলিশ কেন পাহারাদানের দায়িত্ব গ্রহণ করেছিল। বাংলাদেশ মিশনে অনুষ্ঠান চলার সময় পাকিস্তানি হাই কমিশনার সালমান আলী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে গিয়ে মিশন স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। প্রতিমন্ত্রী জোসেফ গডবারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে মি. আলী বলেন, তাঁর দেশের এক অংশের নাম পূর্ব পাকিস্তান। এই অংশের নাম বদল করে বাংলাদেশ নাম নিয়ে লন্ডনে দূতাবাস স্থাপন পাকিস্তানের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবমাননাকর। ব্রিটেন পাকিস্তানের বন্ধু-রাষ্ট্র। অতএব, উদ্বোধনী অনুষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া ব্রিটিশ সরকারে কর্তব্য। মি, গড়বার মনােযােগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনে বলেন, এ ধরনের নাম ব্যবহার ব্রিটেন সমর্থন করে না। পাকিস্তান সরকারকে ব্রিটেন প্রদত্ত স্বীকৃতি অব্যাহত রয়েছে। অতএব, বাংলাদেশ মিশনকে কূটনৈতিক মর্যাদা দেয়ার প্রশ্ন অবান্তর। প্রায় এক ঘণ্টাকাল আলােচনার পর মি, আলী তার কূটনৈতিক চাল সফল হয়েছে বলে অনুমান করে পররাষ্ট্র দপ্তর ত্যাগ করেন। | পাকিস্তানের প্রতিবাদ সম্পর্কে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর ও স্বরাষ্ট্র দপ্তরের মধ্যে। আলােচনার মর্ম অপ্রকাশিত থাকা সত্ত্বেও পরিষ্কার বােঝা যায়, পাকিস্তানিদের সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্যই বাংলাদেশ মিশনের বাইরে পুলিশ পাহারার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।১০৫ – দূতাবাস স্থাপিত হওয়ার পর সরকারি অফিসারগণ ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন্সে। এবং বেসরকারি কর্মকর্তারা ১১ নম্বর গােরিং স্ট্রিটে অফিসের কাজ করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। গােরিং স্ট্রিটের কর্মকর্তারা সাংগঠনিক ও প্রচারকার্য এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের অফিসাররা কূটনৈতিক কার্য-পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। বিচারপতি চৌধুরী সকালবেলা গােরিং স্ট্রিটে এবং বিকেলবেলা পেমব্রিজ গার্ডেন্সে উপস্থিত থেকে বাংলাদেশ আন্দোলন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কয়েক মাস পর বিশিষ্ট বাঙালি শিল্পপতি জহুরুল ইসলাম তার এক পাঞ্জাবি বন্ধুর সহায়তায় চিকিৎসার অজুহাতে লন্ডনে আসার অনুমতি নিয়ে দেশত্যাগ করেন। জুলাই মাসের শেষের দিকে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যাসােসিয়েশনের কর্মকর্তা ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, মি. ইসলাম তার সঙ্গে দেখা করতে চান। চিকিৎসার অজুহাতে তিনি লন্ডনের লুইসাম হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন।
ড. জোয়ারদারের গাড়িতে হাসপাতালে গিয়ে বিচারপতি চৌধুরী তার সঙ্গে দেখা করেন। মি. ইসলাম বলেন, স্বাধীনতা আন্দোলনের জন্য অর্থ সাহায্য করার অনুরােধ তিনি তাজউদ্দিন আহমদের কাছ থেকে পেয়েছেন। তিনি নিজেও স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করতে চান। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র ক্রয় এবং স্টিয়ারিং কমিটির ব্যয়ভার বহনের জন্য বাংলাদেশ ফান্ড’ নামে একটি তহবিল। খােলা হয়েছে। চাদাদানকারীরা এই তহবিলের অর্থ অন্য কোনাে খাতে খরচ করার পক্ষপাতী নন। প্রস্তাবিত দূতাবাসের জন্য প্রতি মাসে দু’ থেকে আড়াই হাজার পাউন্ড প্রয়ােজন হবে। মি. ইসলাম যদি দূতাবাসের খরচ চালিয়ে নেন, তাহলে বিচারপতি চৌধুরী নিশ্চিন্ত মনে কূটনৈতিক দায়িত্ব পালন করতে পারবেন। মি. ইসলাম এক কথায় রাজি হয়ে বললেন, প্রতি মাসে তিনি ড. জোয়ারদারের মারফত দু’হাজার পাউন্ড পাঠাবেন। ঢাকায় অবস্থানরত মি. ইসলামের পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার খাতিরে উল্লিখিত অর্থ অন্য কারাে নামে জমা করে নিতে হবে। তারা তিনজনে মিলে ঠিক করলেন, প্রতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ড. জোয়ারদার উল্লিখিত পরিমাণ অর্থ মি, ইসলামের কাছ থেকে নিয়ে আসবেন। অর্থ প্রদানকারীর নিরাপত্তার খাতিরে জনৈক সুবিদ আলীর নামে তা জমা দেয়া হবে। দূতাবাসের ফিনান্স ডাইরেক্টর লুৎফুল মতিন এই অর্থ গ্রহণ করে প্রতি মাসে সুবিদ আলীর নামে যথারীতি রসিদ প্রদান করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত মি. ইসলাম বাংলাদেশ মিশনের ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পালন করেন।১০৬ ৩০ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত ওয়াশিংটন ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক। সম্পাদকীয় মন্তব্যে ইয়াহিয়া খানকে বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিণতির জন্য দায়ী। করা হয়। নির্বাচনে শেখ মুজিবের জয়লাভের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, জেনারেল ইয়াহিয়াকে কয়েকজন সহকর্মী জেনারেল ছাড়া আর কেউ ভােট দেন নি। শেখ মুজিব সম্ভবত জীবিত রয়েছেন এবং সামরিক আদালতে তার গােপন বিচার অনুষ্ঠিত হচ্ছে। তার বহু সমর্থককে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে এবং বাকিদের দেশত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়েছে। গত বছর যেখানে শান্তিপূর্ণভাবে নির্বাচন। অনুষ্ঠিত হয় আজ সেখানে ক্রমবর্ধমান গেরিলা-সংঘর্ষ, অনশন ও ভীতি বিরাজমান। অর্থবহ সত্তা হিসেবে পাকিস্তানের কোনাে অস্তিত্ব নেই। | উপসংহারে বলা হয়, ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম গত কয়েক মাস যাবৎ ঘৃণাসূচক বক্তৃতাদান ছাড়া আর কিছুই করেন নি। তিনি অন্তত একটা প্রয়ােজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। ওয়াশিংটন সফর করে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে কিছু অকাট্য যুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে ব্রিটেনের মনােভাব জ্ঞাপন করতে পারেন। এতে হয় তাে কোনাে ফল হবে না। তা সত্ত্বেও এই প্রচেষ্টা ন্যায্য পদক্ষেপ হিসেবে বিবেচিত হবে। আগস্ট মাসের শেষ দিকে রুমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব-শান্তি’ শীর্ষক একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছাত্রনেতা মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুকে সম্মেলনে যােগদানকারী প্রতিনিধিদের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে তাদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে রুমানিয়ায় যাওয়ার জন্য অনুরােধ করেন। বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কিত প্রচার-পুস্তিকা নিয়ে তিনি। ৩০ আগস্ট রুমানিয়ায় পৌঁছান। | ভারতীয় প্রতিনিধিদলের নেতা সারাভাইয়ের সঙ্গে দেখা করে মােহাম্মদ হােসেন মন্তু তাঁর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। ভারতীয় দলে অন্য দু’জন সদস্য শিশির গুপ্ত ও হােসেন জাহির তাকে অন্যান্য দেশের কয়েকজন প্রতিনিধির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। তিনি মার্কিন প্রতিনিধিদলের সদস্য জেরি স্মিথের সঙ্গে দেখা করে পাকিস্তানে সমরাস্ত্র প্রেরণ বন্ধ করার জন্য অনুরােধ জানান। এরপর তিনি সােভিয়েত প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে দেখা করেন। তারা বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে যথাসাধ্য সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দেন।১০৭
সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
১ সেপ্টেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের গভর্নর ও সামরিক প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খানকে সরিয়ে দিয়ে ড. আবদুল মােত্তালিব মালিককে গভর্নর এবং লে. জে. আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজীকে সামরিক প্রশাসক পদে নিয়ােগ করা হয়েছে। ৩১ আগস্ট করাচি থেকে প্রেরিত এই সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের প্রশাসনিক দায়িত্ব ড. মালিক ও তার মন্ত্রীদের হাতে দেয়া হবে। ইয়াহিয়ার এই অসাধু চাল ব্যর্থ হবে বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন। ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর বিশেষ সংবাদদাতা মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে বলা হয়, টিক্কা খানের অপসারণের ফলে জনসাধারণ উহূল্প বােধ করবে। ৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এই বিশ্লেষণে আরও বলা হয়, ড. মালিক বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও বহু বাঙালি তাকে ‘কুইসলিং’ বলে মনে করে। | ১ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে নরওয়ের রাজধানী অসলাে। | পৌঁছান। তাঁর সফরসঙ্গী ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জু। বিমানবন্দরে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হামিদুল ইসলাম এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রফিকুজ্জামানসহ ৬/৭জন বাঙালি তাদের অভ্যর্থনা জানান। মাত্র ৬/৭জন অসলােবাসী বাঙালির কর্মতৎপরতার ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন নরওয়ের বিভিন্ন মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। তাদের প্রচেষ্টার ফলে স্থানীয় টিভি বিচারপতি চৌধুরীর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তিনি নরওয়ের অধিবাসীদের কাছে স্বাধীনতা আন্দোলনের সারমর্ম ব্যাখ্যা করার সুযােগ লাভ করেন। সেদিন বিকেলবেলা এই সাক্ষাৎকার প্রচারিত হয়। পরদিন (২৭ সেপ্টেম্বর) বিচারপতি চৌধুরী বেলা ১১টার সময় নরওয়ের প্রধান বিচারপতি পিয়ের অল্ডের সঙ্গে কফি পানের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেন। তিনি সুপ্রিম কোর্টের সব বিচারপতিকে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে মিলিত হওয়ার উদ্দেশ্যে তাঁর কক্ষে আসার জন্য অনুরােধ জানিয়েছিলেন। তারা জানতে চাইলেন, বাংলাদেশ কেন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করতে চায় । বিচারপতি চৌধুরী সংক্ষেপে বাঙালির স্বাধীনতা কামনার মূল কারণগুলাে বিশ্লেষণ করেন। তারা বাঙালিদের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্দোলনের সাফল্য কামনা করেন। | সেদিন দুপুরবেলা বিচারপতি চৌধুরী অসূলাে রােটারি ক্লাবের সভায় অতিথি হিসেবে যােগদান করেন। সভা শুরু হওয়ার আগে তিনি এক সংক্ষিপ্ত ভাষণে সংগ্রামী বাংলার দৃঢ় প্রত্যয়ের বাণী’ সদস্যদের কাছে পৌঁছে দেন। রােটারি ক্লাবের সভার পর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ের পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে পার্লামেন্টের আন্তর্জাতিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনাকালে বাঙালিদের দাবির যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করেন।
এরপর বিচারপতি চৌধুরী অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগের ডিন’-এর সঙ্গে দেখা করেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অধ্যাপক। | কিছুকাল আগে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশে গণহত্যা সংঘটনের অপরাধে পাকিস্তানের বিচার অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যে একটি আন্তর্জাতিক ট্রাইবুনাল গঠন সম্পর্কে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে অনুরােধ জানায়। এই ট্রাইবুনালের প্রধান কাজ হবে গণহত্যা সম্পর্কে একটি প্রামাণ্য রিপাের্ট প্রণয়ন করা। এ সম্পর্কে। আলােচনার পর আইন বিভাগের ডিন প্রস্তাবিত ট্রাইবুনালের সদস্যপদগ্রহণ করতে রাজি হন। (এই ট্রাইবুনাল গঠিত হওয়ার আগেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা | অর্জন করে।) ৩ সেপ্টেম্বর সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী অসলাের মেয়রের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন জানান। বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি অসলাে শহরের বিভিন্ন আলােকচিত্র সংবলিত একটি বই উপহার দেন। বইটির প্রথম পৃষ্ঠায় তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বলে উল্লেখ করেন। নরওয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার আগেই অসলাের মেয়র বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে স্বীকৃতি দেন। সেদিন বিকেলবেলা নরওয়ের পররাষ্ট্র দপ্তরের প্রতিমন্ত্রী স্টলটেনবার্গ বিচারপতি চৌধুরীকে আনুষ্ঠানিকভাবে সাদর অভ্যর্থনা জানান। প্রায় দেড় ঘণ্টা যাবৎ আলােচনার পর মি, স্টলটেনবার্গ বলেন, স্ক্যান্ডিনেভিয়ার দেশসমূহের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের আসন্ন সম্মেলনে নরওয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে বিবৃতি পেশ করবে। সম্মেলনের সরকারি বিবরণীতে বাংলাদেশের প্রতি সমর্থনের কথা প্রকাশ করা হবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
৬ সেপ্টেম্বর (সােমবার) সকালবেলা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ সংগ্রামের উদ্দেশ্য, বিদ্যমান পরিস্থিতি এবং সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পেশ করেন। পরদিন নরওয়ের সবগুলাে সংবাদপত্রে তার বক্তব্য গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হয়। উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যা সাতটার সময় অসলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের মিলনায়তনে এক বিরাট ছাত্র সমাবেশের আয়ােজন করা হয়। ছাত্র ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট মি. বুল বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক। তার উদ্যোগে ছাত্র-সমাবেশে বক্তৃতা দেয়ার জন্য বিচারপতি চৌধুরীকে আমন্ত্রণ জানানাে হয়। | নির্দিষ্ট সময়ের কয়েক মিনিট আগে হামিদুল ইসলাম, আলী ইউসুফ, রফিকুজ্জামান এবং আরাে কয়েকজন বাঙালি ছাত্রের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরী মিলনায়তনে উপস্থিত হয়ে নরওয়ের ছাত্রদের মধ্যে উত্তেজনা ও চাঞ্চল্য লক্ষ্য করেন। | নরওয়ের একজন বিখ্যাত শিল্পীর আঁকা একটি ব্যঙ্গচিত্র ছাত্র ইউনিয়ন পােস্টার হিসেবে ব্যবহার করে। এই ব্যঙ্গচিত্রে ইয়াহিয়া খানকে নরহত্যাকারী দৈত্যরূপে দেখানাে হয়। পােস্টারের পাশে ছিল সভার বিজ্ঞপ্তি। ছাত্র ইউনিয়নের কর্মকর্তারা বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, কয়েকজন পাকিস্তানি ছাত্র মিলনায়তনের প্রবেশদ্বারের কাছে কয়েকটি পােস্টার ছিড়ে ফেলেছে। এর ফলে উত্তেজিত ছাত্ররা দলে দলে মিলনায়তনে এসে সমাবেশে যােগ দেন। বিচারপতি চৌধুরীর বক্তৃতার আগেই দু’তিনজন ছাত্রনেতা বাংলাদেশে ছাত্র নিপীড়নের জন্য পাকিস্তানি বাহিনীর তীব্র নিন্দা করেন। তারা বলেন, নরওয়ে বাক-স্বাধীনতার দেশ। এ দেশে এসে পাকিস্তানি ছাত্ররা যদি পােস্টার ছিড়ে ফেলতে সাহস করে তা হলে নিজেদের দেশে তাদের এবং তাদের সরকারের ব্যবহার সহজেই অনুমেয়। | পাকিস্তানি ছাত্রদের অগণতান্ত্রিক ও উস্কানিমূলক কাজের ফলে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে তীব্র জনমত সৃষ্টি হয়। এই সুযােগ গ্রহণ করে বিচারপতি চৌধুরী রাজনৈতিক বক্তৃতার ধরন ত্যাগ করে মর্যাদাব্যঞ্জক ভাষায় নিপীড়িত জনগণের মুক্তির কামনা ব্যক্ত করেন। সমবেত ছাত্ররা তাকে অভিনন্দন জানিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করেন।১০৮ ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী অসলাে থেকে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোেম। রওনা হন। ইতােমধ্যে পাকিস্তান সরকার তাদের দূতাবাসে নিয়ােজিত কূটনৈতিক অফিসার ও অন্যান্য কর্মচারী এবং তাদের পরিবারবর্গের পাসপাের্ট ৭ সেপ্টেম্বরের মধ্যে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়ার নির্দেশ জারি করে। বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার এবং কর্মচারীদের বাংলাদেশের পক্ষে যােগদান বন্ধ করার উদ্দেশ্যে এই নজিরবিহীন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
৩ সেপ্টেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, এ যাবৎ বিশজন বাঙালি কূটনৈতিক অফিসার পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন। এঁদের মধ্যে দু’জন লন্ডন এবং চৌদ্দজন ওয়াশিংটন দূতাবাসে নিয়ােজিত ছিলেন। পাকিস্তানের কূটনৈতিক পাসপাের্ট ব্যবহার করে তারা নির্বিঘ্নে দেশ-দেশান্তরে সফর করেছেন। ৪ সেপ্টেম্বর ‘মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশ আন্দোলনকে সাহায্য ও সমর্থনদানের উদ্দেশ্যে ওয়েলসের রাজধানী কার্ডিফ শহরে। একটি ‘সলিডারিটি’ কমিটি গঠন করা হয়েছে। কমিটির সদস্যদের মধ্যে কমিউনিস্ট পাটি, শ্রমিক দল, ওয়েলস্ জাতীয়তাবাদী দল, ক্রিশ্চিয়ান এইড (আন্তর্জাতিক সাহায্য সংস্থা) এবং ইয়াং কনজারভেটিভদের প্রতিনিধি রয়েছেন। গত বৃহস্পতিবার (২ সেপ্টেম্বর) অনুষ্ঠিত উদ্বোধনী সভায় কমিটির সদস্যগণ বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ, অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তিদান এবং পাকিস্তানে অস্ত্র চালান নিষিদ্ধ করার দাবি জানান। ‘অপারেশন ওমেগা’ প্রেরিত পিস টিমের চারজন সদস্য দুর্গতদের জন্য সাহায্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে ৫ সেপ্টেম্বর পায়ে হেঁটে পেত্রাপােল পার হয়ে দ্বিতীয়বার পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করেন। পাকিস্তানি সৈন্যরা অবিলম্বে তাদের গ্রেফতার করে। আরও তিনজন সদস্য অন্য এক পথ দিয়ে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করেন। তারাও গ্রেফতার হন বলে অনুমান করা হয়। পিস টিমের সদস্যরা ১৭ আগস্ট প্রথমবার সাহায্যসামগ্রী সঙ্গে নিয়ে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করেন। ২৬ ঘণ্টা আটক রাখার পর পাকিস্তানি সৈন্যরা তাদের পশ্চিম বঙ্গে ফেরত পাঠায়। | ১০ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দফতরে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, ৫ সেপ্টেম্বর পূর্ব বঙ্গে প্রবেশকারী পিস টিমের প্রথম দলের চারজন সদস্যকে কারাদণ্ড দিয়ে যশাের জেলে পাঠানাে হয়েছে। ঢাকায় অবস্থিত ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনারের অফিস থেকে এই সংবাদ পাঠানাে হয়। | ১৮ সেপ্টেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ১৭ সেপ্টেম্বর পিস টিমের সাজাপ্রাপ্ত সদস্যদের জেল থেকে মুক্তি দিয়ে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া হয়।
শিগগিরই তারা লন্ডনে ফিরে আসবেন বলে আশা করা হচ্ছে। | ৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী নরওয়ে থেকে সুইডেনে পৌঁছান। সুইডেনে। নিয়ােজিত পাকিস্তানের প্রাক্তন কূটনৈতিক অফিসার আবদুর রাজ্জাক বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। | স্টকহােমে পৌঁছার দু’ঘণ্টা পর বিচারপতি চৌধুরী নােবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক গুনার মীয়ারডালের সঙ্গে দেখা করেন। আবদুর রাজ্জাক। এই সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের আদর্শ ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করার পর বিচারপতি চৌধুরী অধ্যাপক মীয়ারডালকে স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যান পদ গ্রহণ করার জন্য অনুরােধ করেন। তিনি সানন্দে রাজি হন। | সেদিন বিকেলবেলা আবদুর রাজ্জাক ও রাজিউল হক রঞ্জুকে সঙ্গে নিয়ে বিচারপতি চৌধুরী সুইডিস সােস্যালিস্ট ডেমােক্রেটিক পার্টির সেক্রেটারি-জেনারেল স্টেন এ্যান্ডারসনের সঙ্গে দেখা করেন। তার পার্টি তখন ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করার পর মি. এ্যান্ডারসন বলেন, তার পার্টির সমর্থন জানিয়ে শুধু একটা প্রস্তাব পাশ করিয়ে তিনি সন্তুষ্ট হতে পারেন বাংলাদেশকে সত্যিকারের সাহায্য করতে হলে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য অস্ত্র সরবরাহ করতে হবে। তাদের পার্টির মাধ্যমে অস্ত্র সরবরাহ করার চেষ্টা করবেন বলে তিনি আশ্বাস দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ক্যালবার্গ এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি পিয়ের শশারির সঙ্গে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রী তখন সুইডেনে ছিলেন না। ৮ সেপ্টেম্বর সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী সুপ্রিম কোর্টের অস্থায়ী প্রধান বিচারপতি মিসেস ইনগ্রিড গার্ডেওয়াইডেমারের সঙ্গে দেখা করেন। বিকেলবেলা তিনি সুইডিস পার্লামেন্ট হাউসে গিয়ে লিবারেল পার্টির চিফ হুইপ ইয়ান স্টিফেনসনের সঙ্গে বাংলাদেশ সংগ্রাম সম্পর্কে আলােচনা করেন। তার পার্টি বাংলাদেশকে সমর্থন করবে বলে তিনি আশ্বাস দেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী সুইডেনের খ্যাতনামা সাংবাদিক এবং এক্সপ্রেসেন ইভনিং ডেইলি পত্রিকার সম্পাদক টমাস হ্যামেনবার্গের সঙ্গে দেখা করে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি বাংলাদেশ আন্দোলন সমর্থন করবেন বলে আশ্বাস দেন। | ৯ সেপ্টেম্বর সকালবেলা সাভেনস্কা ডাগ ব্লাডেট পত্রিকার পক্ষ থেকে সাংবাদিক বাে কার্লসন বিচারপতি চৌধুরীর একান্ত সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। বিকেলবেলা একটি জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। সুইডেনের প্রত্যেকটি উল্লেখযােগ্য পত্রিকার প্রতিনিধি এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। প্রশ্নের ধারা থেকে বােঝা যায়, সাংবাদিকরা বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল। | ১০ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী এফটেন ব্লাডেট পত্রিকার খ্যাতনামা। সাংবাদিক ফ্রেডারিকসেনের সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে আলােচনা করেন। তিনি স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে একযােগে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন।
১৩ সেপ্টেম্বর বিমানযােগে সুইডেন ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী আবদুর রাজ্জাককে সুইডেনে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার দায়িত্ব অর্পণের জন্য মুজিবনগর সরকারকে পত্রযােগে অনুরােধ জানান।১০৯। বিচারপতি চৌধুরীর স্ক্যান্ডিনেভিয়া সফরকালে বাংলাদেশ আন্দোলনের শত্রুরা গভীর রাতে লন্ডনের গােরিং স্ট্রিটে অবস্থিত স্টিয়ারিং কমিটির অফিসের নিচের তলার প্রবেশদ্বারে একটি বােমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এর ফলে দরজা-জানালার ক্ষতি হয়, কিন্তু কেউ আহত হননি। পাকিস্তানপন্থীরাই এর জন্য দায়ী বলে সবাই মনে করেন। ১০ সেপ্টেম্বর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের (মেট্রোপলিটন পুলিশ হেডকোয়ার্টার্স) অফিসার পিটার ল্যাঙ্গলি অফিসে এসে স্টিয়ারিং কমিটির কর্মকর্তাদের সঙ্গে তাঁদের ব্যক্তিগত নিরাপত্তা সম্পর্কে আলােচনা করেন। তাছাড়া তিনি অফিসের সামনে পুলিশের ঘনঘন টহলের ব্যবস্থা করেন। ১ থেকে ১০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত পারীতে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এই সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের প্রায় ৭শ’ প্রতিনিধি যােগদান করেন। সংশ্লিষ্ট দেশের স্পিকার তার প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেন। সম্মেলনে যােগদানকারী পার্লামেন্ট সদস্যদের বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি বর্বরতা সম্পর্কে অবহিত করার জন্য ব্রিটেন থেকে বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করে। ১ সেপ্টেম্বর পারী পৌঁছে ছাত্র প্রতিনিধিরা সম্মেলনের সভাপতি আঁদ্রে সেনারনাগারের সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করেন। পরদিন অনুষ্ঠিত সাক্ষাৎকারকালে ছাত্র-প্রতিনিধিরা বিচারপতি চৌধুরীর চিঠি তার হাতে দেন। এই চিঠিতে তিনি মুজিবনগর সরকারের পার্লামেন্টকে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ জানান। | ছাত্র-প্রতিনিধিরা সুযােগমতাে প্রত্যেক প্রতিনিধিদলের নেতার কাছে বিচারপতি চৌধুরীর চিঠি পৌঁছে দেন। এই চিঠির সঙ্গে ছিল বাংলাদেশ সম্পর্কে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতিবিদদের লেখা একটি নিবন্ধ, বিশ্ব ব্যাঙ্কের একটি রিপাের্ট, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ভাষণ এবং বিদেশী সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত সংবাদ।। নরওয়ে, ইতালি, আয়ারল্যান্ড, শ্রীলঙ্কা এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়া ও ল্যাটিন আমেরিকার প্রতিনিধিবৃন্দ বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানান। লাইবেরিয়ার প্রতিনিধিদলের নেতা বাংলাদেশ সরকারকে আফ্রিকায় একটি কূটনৈতিক প্রতিনিধিদল পাঠাবার পরামর্শ দেন। প্রতিনিধিদল পাঠানাে হলে তাদের সর্বপ্রকার সাহায্যদানের আশ্বাসও তিনি দেন।
জর্ডানের প্রতিনিধিদলের নেতা আল হােসেইনি পাকিস্তানি অত্যাচার ও নিপীড়নের কাহিনী শুনে অভিভূত হন এবং দেশে ফিরে গিয়ে জর্ডানের বাদশাকে এ সম্পর্কে অবহিত করবেন বলে আশ্বাস দেন। মার্কিন প্রতিনিধিদলের জনৈক সদস্য পাক হানাদার বাহিনী সংঘটিত অমানুষিক অত্যাচারের বিবরণ শুনে বলেন, দেশে ফিরে গিয়ে এসব কথা তিনি ব্যক্তিগতভাবে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে জানাবেন। মিশরীয় প্রতিনিধিদলের নেতা প্রথমে ছাত্র প্রতিনিধিদের বলেন, মিশর থেকে রওনা হওয়ার আগে তিনি পাকিস্তানি দূতাবাস থেকে জানতে পেরেছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন একটি মুসলিম রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করার অপচেষ্টা মাত্র। কিন্তু পারীতে আলােচনার পর তিনি বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই বলে মন্তব্য করেন। বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়ে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের সম্মেলনে একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়। ছাত্র-প্রতিনিধিগণ ফ্রান্সের জাতীয় ছাত্র সমিতির সঙ্গেও বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। বাংলাদেশের নির্যাতিত ছাত্রদের সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশের জন্য। তারা একটি বিরাট শশাভাযাত্রার আয়ােজন করেন। ছাত্র-প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নজরুল ইসলাম, এ এইচ প্রামাণিক, ওয়ালী আশরাফ, খােন্দকার মােশাররফ হােসেন এবং মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু।১০ কমিটি ফর ক্রিশ্চিয়ান অ্যাকশন’-এর চেয়ারম্যান ক্যানন কলিলের উদ্যোগে লন্ডনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রদর্শনী এবং চারটি আলােচনা-সভার আয়ােজন করা হয়। ট্র্যাফালগার স্কোয়ারের কাছে সেন্ট মার্টিনস্-ইন-দি-ফিল্ড নামের বিখ্যাত গির্জার বেসমেন্টে ১৩ থেকে ১৮ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত এই প্রদর্শনী স্থায়ী হয়। আলােচনা-সভার মূল বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ক্যানন কলিন্স (১০ সেপ্টেম্বর), জন গ্রিগ (১৪ সেপ্টেম্বর), মর্টিন এ্যাডেনি (১৫ সেপ্টেম্বর) এবং ফরিদ জাফরী (১৬ সেপ্টেম্বর)।১১১ | ১৩ সেপ্টেম্বর (সােমবার) সকালে বিমানযােগে বিচারপতি চৌধুরী সুইডেন থেকে ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকি পৌঁছান। তাঁর সঙ্গে ছিলেন রাজিউল হাসান রঞ্জু। হেলসিংকিতে নিয়ােজিত ব্রিটিশ কাল-জেনারেল রয় ফক্স। বিমানবন্দরে বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। ঢাকায় ব্রিটিশ ডেপুটি হাই কমিশনার পদে নিয়ােজিত থাকাকালে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপিত হয়। মি. ফক্স তাদের দু’জনকে নিজের বাড়িতে নিয়ে যান।
বিকেলবেলা মি. ফক্স বিচারপতি চৌধুরীকে রেলওয়ে স্টেশনের কাছে তার হােটেলে পৌঁছে দেন। হােটেলে জিনিসপত্র রেখে তিনি সরাসরি বিশ্ব শান্তি পরিষদের সেক্রেটারি-জেনারেল রমেশচন্দ্রের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। রমেশচন্দ্র বলেন, হেলসিংকিতে অবস্থানকালে বিচারপতি চৌধুরী তার অফিস এবং টেলিফোন ও টেলেক্স ব্যবহার করলে তিনি খুশি হবেন। বিচারপতি চৌধুরী সানন্দে এই উদার প্রস্তাব গ্রহণ করেন। রমেশচন্দ্র তার সহকর্মীদের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর পরিচয় করিয়ে দেয়ার পর সেখানে বসেই তার হেলসিংকির কর্মসূচি তৈরি করেন। |পরদিন বিচারপতি চৌধুরী অত্যন্ত কর্মব্যস্ত থাকেন। সকালবেলা হােটলে এসে ফিনিশ টেলিভিশন তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তরদানকালে তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ও বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করেন। বিকেলবেলা ছাত্রদের এক সভায় তিনি বক্তৃতা করেন। তারপর পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। এঁদের মধ্যে একজন কয়েক দিনের মধ্যে ফিনল্যান্ডের প্রতিনিধি হিসেবে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবেন। তিনি ফিনিশ সরকারকে বাংলাদেশ সংগ্রাম সম্পর্কে অবহিত করা এবং জাতিসংঘে বাংলাদেশকে সমর্থন করার আশ্বাস দেন। এরপর পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা বিচারপতি চৌধুরীকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, বাংলাদেশ আন্দোলনের ব্যাপকতা এবং গুরুত্ব সম্পর্কে ফিনিশ সরকার সজাগ রয়েছে। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে ফিনল্যান্ডের সহায়তা আশা করতে পারে। সন্ধ্যাবেলা হেলসিংকি ত্যাগ করার আগে বিচারপতি চৌধুরী ফিনল্যান্ডের বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘সুয়ােম্যান সােসিয়লি ডেমােক্রাত’-এর সম্পাদক এবং সুপ্রিম কোর্টের জজ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার কমিশনের সদস্য ভ্যাটিওসারিওর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তারা বাংলাদেশ আন্দোলনকে যথাসম্ভব সাহায্যদানের আশ্বাস দেন। | ১৪ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের কোপেনহাগেন পৌঁছান। বিমানবন্দরে মতিউর রহমান এবং লিয়াকত হুসেনসহ কয়েকজন বাঙালি কর্মী তাকে অভ্যর্থনা জানান। বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক মিমি ক্রিশ্চিয়ানসেন নামের একজন বয়ােবৃদ্ধা ডেনিশ মহিলার বাড়িতে বিচারপতি চৌধুরী ও রাজিউল হাসান রঞ্জুর থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। |
পরদিন সকালবেলা বিচারপতি চৌধুরী ডেনমার্কের বহুল প্রচারিত সংবাদপত্র “ইনফরমেশন অফিসে গিয়ে সম্পাদক নিয়েলসেনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইতােমধ্যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে কয়েকটি সম্পাদকীয় নিবন্ধ লিখেছেন। বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণ পাকিস্তানকে প্রত্যাখ্যান করেছে—একথা ডেনমার্ক উপলব্ধি করে। মুক্তিযােদ্ধারা। ঢাকা দখল না করা পর্যন্ত কোনাে বিদেশী সরকারের পক্ষে বাংলাদেশকে। স্বীকৃতিদান সহজ হবে না বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। বিচারপতি চৌধুরী। বলেন, ঢাকার বুকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত না হওয়া পর্যন্ত। বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের জয়যাত্রা থামবে না।। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করেন। তারা বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি প্রকাশ করেন এবং সম্ভবত সাহায্য করবেন বলে। আশ্বাস দেন। পার্লামেন্ট ভবন থেকে বিচারপতি চৌধুরী টিভি স্টেশনে যান। সাক্ষাৎকার যিনি পরিচালনা করছিলেন তিনি রেকর্ডিং শুরু হওয়ার আগে বিচারপতি চৌধুরীকে বলেন, পাকিস্তান সরকার ডেনমার্কের একজন অ-ব্যবসায়ীকে অস্ত্র সরবরাহের অনুরােধ জানিয়েছে। সাক্ষাৎকার গ্রহণকালে এ সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার উদ্দেশ্যে ডেনিশ সরকারের কাছে আবেদন জানার জন্য তিনি বিচারপতি চৌধুরীকে পরামর্শ দেন। সাক্ষাৎকারকালে অস্ত্র সরবরাহ সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে বিচারপতি চৌধুরী। বলেন, গণতন্ত্রে অটল বিশ্বাসী ডেনমার্ক কখনও পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর স্বৈরশাসন চিরস্থায়ী করার উদ্দেশ্যে অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে তিনি আশা করেন। পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করা হলে নারী-নির্যাতন, শিশু-হত্যা এবং যেসব নিরপরাধ মানুষের প্রাণহানি হবে, তার জন্য দায়ী থাকবে অস্ত্র সরবরাহকারী দেশ। | স্থানীয় বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি টিভি সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করেছিলেন। কমিটির আহ্বায়িকা কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড একজন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ তিনি ঢাকায় উপস্থিত ছিলেন। তার কয়েক দিন আগে তিনি কুমিল্লার পল্লী উন্নয়ন একাডেমীতে অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে যােগদান করেন। সেদিনের হত্যাকাণ্ড তিনি নিজের চোখে দেখেছিলেন বলে দেশে ফিরে এসেও তা। ভুলতে পারেন নি। কোপেনহাগেনে তার অফিসে বঙ্গবন্ধুর ছবি ঝােলানাে রয়েছে। গণ্যমান্য লােকজনের সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার জন্য তিনি সেদিন রাতে তাঁর বাড়িতে একটি সান্ধ্য-অনুষ্ঠানের আয়ােজন করেছিলেন।
টিভি স্টেশন থেকে বিচারপতি চৌধুরী পুনরায় পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে স্পিকারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বাংলাদেশ সংগ্রামের সাফল্য কামনা করেন। এরপর বিচারপতি চৌধুরী পার্লামেন্টে বৈদেশিক কমিটির সদস্যদের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা হরণ, নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সংসদে সমবেত হওয়ার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা এবং পাকিস্তানের বৈষম্যমূলক নীতি সম্পর্কে অবহিত হওয়ার পর বৈদেশিক কমিটির সদস্যরা স্বভাবতই ক্ষুব্ধ হন। কমিটির সভাপতি কিয়েল অলসেন বাংলাদেশকে সর্বপ্রকার সাহায্যদানের আশ্বাস দেন। বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকারের প্রায় দু’মাস পর তিনি ডেনমার্কের দেশরক্ষা মন্ত্রী পদে নিয়ােজিত হন। এঁদের সমবেত প্রচেষ্টার ফলে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করার জন্য যে কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান চুক্তি সম্পাদন করেছিল, তারা যুদ্ধকালীন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করতে অসম্মতি জ্ঞাপন করে। ১৬ সেপ্টেম্বর বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে যােগদানের জন্য মনােনীত ডেনিশ প্রতিনিধিদলের নেতার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তিনি
জাতিসংঘে অন্যান্য দেশের প্রতিনিধিদের কাছে বাংলাদেশ পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করবেন এবং বাংলাদেশের পক্ষে জনমত গঠনে সহায়তা করবেন বলে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন। | বেলা প্রায় ১১টার সময় ডেনমার্কের প্রভাবশালী পত্রিকা ‘পলিটিকেন’-এর খ্যাতনামা সম্পাদক জন ডানস্ট্র্যাপ বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। তার কথাবার্তা থেকে পরিষ্কার বােঝা যায়, তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনের একজন উৎসাহী সমর্থক। সেদিন বিকেলবেলা স্থানীয় অ্যাকশন কমিটি ও কয়েকজন উৎসাহী বাঙালির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ আন্দোলন সম্পর্কে বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। কোপেনহাগেনের প্রায় প্রত্যেকটি দৈনিক ও সাপ্তাহিক সংবাদপত্র এবং সংবাদ-সংস্থার প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। প্রারম্ভিক ভাষণে বাংলাদেশ সংগ্রামের পশ্চাৎপট ব্যাখ্যা করে বিচারপতি চৌধুরী। বলেন, আদর্শগতভাবে এই সংগ্রাম ভৌগােলিক সীমারেখা অতিক্রম করে সকল দেশের ও সকল মানুষের সংগ্রামে পরিণত হয়েছে। এই সংগ্রামে ডেনিশ জনগণ সক্রিয় সাহায্যদান করবে বলে তিনি আশা করেন। প্রশ্নোত্তরকালে জনৈক সাংবাদিক বলেন, বাংলাদেশ সরকার ইসরাইলের কাছ থেকে সাহায্য গ্রহণ করছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এ সম্পর্কে তিনি বিচারপতি চৌধুরীর অভিমত জানতে চান। তিনি বলেন, এই মিথ্যা প্রচারণার জন্য পাকিস্তান দায়ী। বাংলাদেশ সরকারকে মুসলিম দেশগুলাের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করাই তাদের উদ্দেশ্য। তাদের এই হীন কারসাজি ব্যর্থ হবে। সত্য চিরকালই। জয়লাভ করে। | বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে ডেনিশ ভাষায় একটি সংবাদ বুলেটিন নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হচ্ছিল। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম থেকে তথ্য সংগ্রহ করে কিস্টেন ওয়েস্টগার্ড ও তার সহযােগীরা এই বুলেটিন প্রকাশের ব্যবস্থা করেন। এদের কর্মচাঞ্চল্য ও একাগ্রতা লক্ষ্য করে বিচারপতি চৌধুরী বিস্মিত হন বলে তাঁর স্মৃতিকথায় উল্লেখ করেছেন। ১৬ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যাবেলা বিচারপতি চৌধুরী কোপেনহাগেন থেকে বিমানযােগে লন্ডনের পথে রওনা হন।১১২ | উল্লিখিত তারিখে সন্ধ্যাবেলা দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের লিঙ্কস প্রাইমারি স্কুলে ব্রিটিশ কমিউনিস্ট পার্টির উদ্যোগে বাংলাদেশের সমর্থনে একটি জনসভার আয়ােজন করা হয়। সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ আবদুল মান্নান বলেন, ভারত বিভাগের পর থেকে পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানি নির্যাতন ও বঞ্চনার বিরুদ্ধে পরিচালিত সংগ্রাম এবং মুক্তিবাহিনার বর্তমান সংগ্রাম একই সংগ্রামের অংশ বলে তিনি মনে করেন।
কমিউনিস্ট পার্টির স্থানীয় শাখার সভাপতি সিড ফেঞ্চ বলেন, স্থানীয় অধিবাসীদের মধ্যে রাজনীতি-সচেতন ব্যক্তিরা বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ এবং জনসমাবেশের মাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগের উদ্যোগ গ্রহণ করবেন বলে তিনি আশা করেন।১৩ ১৬ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের স্কারবারা শহরে অনুষ্ঠিত উদারনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলনে পার্লামেন্ট সদস্য জন পার্ডো উত্থাপিত এক প্রস্তাবে অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তিদান এবং পূর্ব বঙ্গ থেকে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি জানানাে হয়। ১৭ আগস্ট ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, আগামী ৬০ দিনের মধ্যে এই দাবি পূরণ না করা হলে একটি কমনওয়েলথ সম্মেলন আহ্বান করে বাংলাদেশকে স্বাধীন ও সার্বভৌম দেশ হিসেবে স্বীকৃতিদানের প্রস্তাব পেশ করা ব্রিটিশ সরকারের কর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। ১৭ সেপ্টেম্বর ফরাসি সাহিত্যিক, মুক্তিযােদ্ধা ও আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন কূটনীতিবিদ আঁদ্রে মালরাে পারীতে প্রকাশিত এক বিবৃতি প্রসঙ্গে বলেন, পূর্ব বঙ্গে গিয়ে তিনি বাঙালি মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সংগ্রামে যােগ দেয়ার জন্য তৈরি রয়েছেন। ১৮ সেপ্টেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, তাঁর রওনা হওয়ার তারিখ শিগগিরই ঘােষণা করা হবে। এই চাঞ্চল্য সৃষ্টিকারী বিবৃতি বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রে গুরুত্ব সহকারে প্রকাশ করা হয়। এর ফলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি গণতান্ত্রিক বিশ্বের দৃষ্টি বিশেষভাবে আকৃষ্ট হয়। মসিয়ে মালরাের বিবৃতি সংবাদপত্রে প্রকাশিত হওয়ার পর বিচারপতি চৌধুরী তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।১১৪ ১৮ সেপ্টেম্বর লন্ডনের ওভাল এলাকায় ক্রিকেট খেলার ময়দানে বাস্তুচ্যুত বাঙালিদের সাহায্যার্থে একটি বিরাট ‘পপ সঙ্গীতের উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে প্রায় ৩৩ হাজার তরুণ-তরুণী এই উৎসবে যােগদান করে। এ সম্পর্কে ২০ সেপ্টেম্বর ‘দি মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, টিকেট বিক্রির আয় থেকে ১৫ হাজার ২ শ পাউন্ড ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের জন্য পাঠানাে হবে।
১৮ সেপ্টেম্বর ব্রিটিশ লিবারেল পার্টির বার্ষিক সম্মেলনে বক্তৃতাদানকালে দলের নেতা জেরেমি থর্প বাংলাদেশের সংগ্রামকে সমর্থনদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের কাছে জোরালাে আবেদন জানান। বাংলাদেশের জনগণের দুর্ভোগ উপশমের জন্য ব্রিটেনের কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যাপারে তার দল সরকারি কর্তৃপক্ষকে রাজি করাতে সক্ষম হবে বলে তিনি আশা করেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর অক্টোবর (১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, মি, থর্প বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করেন এবং আন্দোলনকারীদের সর্বপ্রকার সাহায্যদানের জন্য তার দলের সদস্যদের প্রতি আহবান জানান। | ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের কনওয়ে হলে বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে বিচারপতি চৌধুরী উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন। সংসদের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি এনামুল হক (পরবর্তীকালে ড, এনামুল হক) নৃত্যনাট্যটি রচনা করেন। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের এই বিপ্লবী-আলেখ্য দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। এই নৃত্যনাট্যটি ব্রিটেনের অন্যান্য শহরেও মঞ্চস্থ করা হয়। গণসংস্কৃতি সংসদের সম্পাদিকা ছিলেন মুন্নি রহমান। ফাহমিদা হাফিজও এই সংগঠনে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।১১৫ ২১ সেপ্টেম্বর মুজিবনগর সরকার প্রেরিত এক তারবার্তায় বলা হয়, জাতিসংঘের আসন্ন অধিবেশনে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করার জন্য ১৬-সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। বিচারপতি চৌধুরী। এই প্রতিনিধিদলের নেতা মনােনীত হয়েছেন। অবিলম্বে তাকে নিউইয়র্ক রওনা হওয়ার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। | বিচারপতি চৌধুরী গােরিং স্ট্রিটের অফিস এবং পেমব্রিজ গার্ডেন্সের দূতাবাসে তার অনুপস্থিতিতে কার্য পরিচালনার জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করে ২৩ সেপ্টেম্বর লন্ডন থেকে নিউইয়র্কের পথে রওনা হন। ২৯ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ সম্পর্কে বক্তৃতা প্রসঙ্গে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম বলেন, নিজের দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়ার প্রয়ােজন হয় না, এ ধরনের শান্তিপূর্ণ পরিস্থিতিতে জনগণের আস্থাপূর্ণ বেসামরিক সরকার গঠনের মাধ্যমে যুদ্ধের আশঙ্কা এড়ানাে সম্ভব। ৩০ সেপ্টেম্বর ‘দি টাইমস্ -এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে উপরােক্ত বক্তৃতার উল্লেখ করে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের হিন্দু ও মুসলমান অধিবাসীদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে এমন একটি সরকার গঠন করা অবশ্য প্রয়ােজন। এই নিবন্ধে আরও বলা হয়, আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমেই লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগী দেশে ফিরে গিয়ে শান্তিপূর্ণ পরিবেশে শালীনতাপূর্ণ জীবনযাপনের আশা পােষণ করতে পারে। আওয়ামী লীগ জনগণের স্বাভাবিক মুখপাত্র বলে পাকিস্তানের বিগত নির্বাচন প্রমাণ করেছে। গত মার্চ মাসের তুলনায় ভিন্ন পরিবেশে আওয়ামী লীগ নতুনভাবে আলাপ-আলােচনা করতে পারে। এই আলাপ-আলােচনায় শেখ মুজিবকে কারামুক্ত হয়ে অংশগ্রহণ করার সুযােগ দিতে হবে।
অক্টোবর, ১৯৭১
১ অক্টোবর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীর কর্মতৎপরতার বিশদ বিবরণ দেয়া হয়। পত্রিকাটির সংবাদদাতা ডেভিড লােশাক প্রেরিত এই বিবরণে বলা হয়, বাঙালি গেরিলারা আমেরিকা, ব্রিটেন, রাশিয়া, চীন, ফ্রান্স প্রভৃতি দেশে তৈরি রাইফেল, মেশিনগান ও মর্টার ব্যবহার করছে। পাকিস্তানি সৈন্যদের অতর্কিতে আক্রমণ করে তারা কিছুসংখ্যক চীনদেশে-তৈরি অস্ত্র যােগাড় করতে সক্ষম হয়। এই সংবাদ স্বভাবতই প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে উৎসাহের সঞ্চার করে। ৬ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে পশ্চিম বঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলােকে পাকিস্তানের ধ্বংসাবশেষ বলে উল্লেখ করে ইয়াহিয়া খানের সৈন্যবাহিনীকে তার জন্য দায়ী করা হয়। এই নিবন্ধে আমেরিকা থেকে পাকিস্তানকে সামরিক অস্ত্র সরবরাহ অব্যাহত রাখারও নিন্দা করা হয়। | ৭ অক্টোবর ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত ব্রিটিশ শ্রমিক দলের বার্ষিক সম্মেলনে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের শােকাবহ পরিস্থিতির জন্য পাকিস্তান সরকারকে দায়ী করা। হয়। কার্যনির্বাহী পরিষদের পক্ষ থেকে পার্লামেন্ট সদস্য ও শ্রমিক দলের চেয়ারম্যান ইয়ান মিকার্ডো এই প্রস্তাব পেশ করেন। ৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান ও ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবিলম্বে আলােচনা অনুষ্ঠানের ব্যাপারে উদ্যোগী হওয়ার জন্য শ্রমিক দল ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানায়। প্রস্তাবের সমর্থনে জুডিথ হার্ট, ক্ৰস্ ডগলাসম্যান, জন্ স্টোনহাউস এবং আরও কয়েকজন সদস্য বক্তৃতা করেন। | মি, ডগলাসম্যান বলেন, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দেয়ার জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর শ্রমিক দলের নিরবচ্ছিন্নভাবে চাপ দেয়া অবশ্য কর্তব্য। মি, স্টোনহাউস বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ হিটলারের জার্মানিতে যাট লক্ষ ইহুদি নিধনের পরবর্তীকালের সবচেয়ে বড় শােকাবহ ঘটনা বলে অভিহিত করেন। মিসেস হার্ট বলেন, বাংলাদেশে দুস্থদের জন্য খাদ্য বিতরণের দায়িত্ব পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর পরিবর্তে জাতিসংঘের ওপর ন্যস্ত করতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যার স্থায়ী সমাধানের জন্য রাজনৈতিক সমাধান অপরিহার্য। তিনি আরও বলেন, শেখ মুজিব ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতাদের মুক্তি দিয়ে তাদের সঙ্গে আলােচনার মাধ্যমেই বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব।
৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান-এর কূটনৈতিক সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিলার’ রেজাউল করিম পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদান করেছেন। এ পর্যন্ত যেসব বাঙালি অফিসার হাই কমিশন থেকে পদত্যাগ করেছেন, তাঁদের মধ্যে মি, করিম সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। পত্রিকাটির সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে মি, করিম বলেন, পাকিস্তান সরকারের ভয়ানক নির্বুদ্ধিতা ও অপকর্মের প্রতিবাদে তিনি পদত্যাগ করেছেন। ৫ মার্চ দিবাগত রাতে পূর্ব বঙ্গে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের পর বিদেশে নিয়ােজিত অন্যান্য বাঙালি অফিসারদের মতাে তিনিও নিদারুণ মানসিক যাতনা ভােগ করেন। পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞকে তিনি বিংশ শতাব্দীর নিষ্ঠুরতম ঘটনা বলে উল্লেখ করেন।১১৬ ৮ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান-এ প্রকাশিত অপর এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সরকারের বিনা অনুমতিতে বাংলাদেশে ঢুকে দুস্থদের মধ্যে কাপড়-চোপড় বিতরণ করার জন্য ‘অপারেশন ওমেগা’র আরও দুজন কর্মীকে গ্রেফতার করে যশাের জেলে পাঠানাে হয়। গত আগস্ট মাস থেকে এ যাবৎ ‘ওমেগা’র কর্মীরা মােট ছ’বার বাংলাদেশে গিয়ে সাহায্যসামগ্রী বিতরণের চেষ্টা করেন। ইতঃপূর্বে ১২জন কর্মীকে গ্রেফতার করে কিছু দিন জেলে আটক রাখার পর বাংলাদেশ থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১০ অক্টোবর “দি সানডে টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে লন্ডনস্থ পাকিস্তান। হাইকমিশনের একটি গােপন দলিলের উদ্ধৃতি দিয়ে বলা হয়, ৩ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত বাংলাদেশ-বিরােধী একটি বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার পাকিস্তান। সরকার বহন করে। দি টাইমস’-এ প্রকাশিত বিজ্ঞাপনের উদ্যোক্তা হিসেবে তথাকথিত ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট’-এর নাম উল্লেখ করা হয়। পাকিস্তানপন্থী। ‘বাঙালি’ আবুল হায়াত ফ্রন্ট-এর প্রতিষ্ঠাতা। পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত প্রেস কাউন্সিলর আবদুল কাইয়ুম সরকারি তহবিল থেকে ২,৬৪০ পাউন্ড ব্যক্তিগত নামে গ্রহণ করে সলিডারিটি ফ্রন্ট’-এর প্রতিনিধির হাতে দেন। ‘দি সানডে টাইমস-এ গােপন দলিলটির ফ্যাক্সিমিলি’ প্রকাশিত হয়।
আর্জেন্টিনায় পাকিস্তান দূতাবাসে নিয়ােজিত বাঙালি রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমিন। ১১ অক্টোবর পদত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগদানের কথা ঘােষণা করেন। ১৩ অক্টোবর তিনি লন্ডনে পৌছেই বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ১৪ অক্টোবর ‘দি মর্নিং স্টার’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। | সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে মি. মােমিন বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্র বেআইনিভাবে ক্ষমতাসীন হয়েছে। তারা পূর্ব বঙ্গে হত্যা, অত্যাচার ও নিপীড়নের জন্য দায়ী। যাদের আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করা হয়েছে তারা জনসাধারণের আস্থাভাজন ব্যক্তিদের হাতে ক্ষমতা অর্পণ করে সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত আশ্বস্ত বােধ করবে না। ১২ অক্টোবর ব্রিটিশ উদারনৈতিক দলের যুব প্রতিষ্ঠান ইয়াং লিবারেলস্ বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানায়। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর কাছে লিখিত এক পত্রে তারা বলেন, ইয়াহিয়া খান হাজার হাজার নিরপরাধ বাঙালিকে হত্যা করার জন্য সুপরিকল্পিতভাবে তার সৈন্যবাহিনী নিয়ােগ করেন। ১৩ অক্টোবর ‘দি। মর্নিং স্টার’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়।
জেনেভা থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, বাংলাদেশে পাকিস্তান সামরিক চক্রের মানবাধিকার লঙ্ঘন সম্পর্কে তদন্ত করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব । জুরিস্ট’-এর একটি প্রতিনিধিদল আগামী ডিসেম্বর মাসে ভারত সফর করবে। কমিশনের সদস্যরা পাকিস্তান সফরেও যাবেন বলে আশা করেন। ১৪ অক্টোবর। লন্ডনের ‘ইন্ডিয়া উইকলি পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, আগামী জানুয়ারি মাসের শেষে তদন্তকারী কমিশন তাদের রিপাের্ট পেশ করবে। ১৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনে ভারতে। আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুর্গতির প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান নির্ধারণ করে অবিলম্বে তা কার্যকর করতে হবে। | বিশ্বের দুর্গত জনগণকে সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’। ও অক্সফ্যাম’ নামে পরিচিত দুটি বিখ্যাত দাতব্য প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগে উপরােক্ত । বিজ্ঞাপনটি প্রকাশিত হয়। বিজ্ঞাপনটির শেষে একটি কুপন সংযােজিত হয়। এই কুপনটি পূরণ করে নিজ নিজ এলাকার পার্লামেন্ট সদস্যের কাছে পাঠানাের জন্য। পাঠকদের অনুরােধ জানানাে হয়। এই কুপনে বলা হয়, জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী। প্রাপ্ত অধিকারবলে পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং দুর্গতদের সাহায্যদানের পরিকল্পনা অবিলম্বে কার্যকর করার জন্য দস্তখতকারী জাতিসংঘের কাছে আবেদন জানাচ্ছে।৯৮। ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের দুর্দশা সম্পর্কে বিশ্ববাসীকে অবহিত করার। জন্য ২১ অক্টোবর ‘অক্সফ্যাম ৬০জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ সংবলিত একটি পুস্তিকা প্রকাশ করে। এই পুস্তিকায় যাদের বিবৃতি, লিখিত বিবরণ ও সাক্ষাৎকারের রিপাের্ট প্রকাশ করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন সিনেটার এওয়ার্ড কেনেডি, মাদার তেরেসা, ড, ট্রেভর হাডলস্টোন, জেরাল্ড স্কার্ফ (কার্টুনিস্ট) এবং কিছুসংখ্যক সাংবাদিক ও ব্রিটিশ পার্লামেন্টের কয়েকজন প্রভাবশালী সদস্য। ২১ অক্টোবর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ‘অক্সফ্যাম’-এর ডাইরেক্টর লেজলি কার্কলি বলেন, এই পুস্তিকাটি প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল উ থান্টের হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্ট, আমেরিকান কংগ্রেস ও জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যােগদানকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদলের সদস্যদের মধ্যে পুস্তিকাটি বিতরণ করা হবে।
ভারত উপমহাদেশের বিদ্যমান পরিস্থিতি সম্পর্কে বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দকে অবহিত করার উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর নয়া দিল্লি ত্যাগ করেন। তিন সপ্তাহ বিদেশে অবস্থানকালে তিনি ব্রাসেলস্, ভিয়েনা, লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, পারী ও বন (তৎকালীন পশ্চিম জার্মানির রাজধানী) সফর করবেন। | ২৫ অক্টোবর বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রয়াল ইনস্টিটিউট অব ইন্টান্যাশনাল রিলেশন্স ভবনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীদের বিরুদ্ধে গণহত্যামূলক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। এই অভিযানকে গৃহযুদ্ধ বলা যায় না। গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া অনুযায়ী ভােটদানের ফলে নিরপরাধ জনগণকে তারা নির্বিচারে হত্যা করছে। বিপুলসংখ্যক বাস্তুত্যাগীকে তারা ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করতে বাধ্য করে। এর ফলে ভারতীয় জনসাধারণের জীবনযাত্রা এবং ভবিষ্যৎ উন্নয়ন পরিকল্পনা ব্যাহত হচ্ছে। ভারত এ যাবৎ ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে। বর্তমানে ভারতের নিরাপত্তার প্রশ্ন বড় হয়ে দেখা দিয়েছে। | ২৬ অক্টোবর ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন পত্রিকায় প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, মিসেস গান্ধী বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে উপমহাদেশের সঙ্কটজনক পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। | ২৬ অক্টোবর মিসেস গান্ধী বেলজিয়াম থেকে অস্ট্রিয়ার রাজধানী ভিয়েনা পৌঁছান। ২৮ অক্টোবর ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, ২৭ অক্টোবর মিসেস গান্ধী অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ব্রুনাে ক্রাইস্কির সঙ্গে উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে দেড় ঘণ্টাকাল আলাপ করেন। এরপর এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, ভারতপাকিস্তান সীমান্তে আসন্ন সঙ্কট এড়াতে হলে পূর্ব বঙ্গের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযােগ্য একটি রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ভিয়েনা সফররত ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে। আলােচনাকালে মি, ক্রাইস্কি বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিয়ে রাজনৈতিক জীবনে ফিরে যাওয়ার সুযােগ দেয়া উচিত বলে তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন। ৬ নভেম্বর লন্ডনের ইন্ডিয়া উইকলি’-তে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৯ অক্টোবর (শুক্রবার) মিসেস গান্ধী ভিয়েনা থেকে লন্ডনে পৌঁছান। ব্রিটেনে দু’দিনব্যাপী সফরকালে তিনি প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তাছাড়া ইনস্টিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল এ্যাফেয়ার্স-এর সদস্যদের এক সভায় তিনি বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে বক্তৃতা করেন। সােভিয়েত-ভারত মৈত্রী-চুক্তি সম্পর্কেও তিনি বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেন।
২৯ অক্টোবর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সম্পাদকীয় নিবন্ধে মিসেস গান্ধীর সফরের কথা উল্লেখ করে বলা হয়, ৯০ লক্ষ বাস্তুত্যাগীকে আশ্রয় দিতে বাধ্য হওয়ার ফলে ভারত এক অসহনীয় অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক দায়িত্ব। বহন করছে। | মিসেস গান্ধী মনে করেন, বাস্তুত্যাগীদের জন্য সাহায্য বরাদ্দ করে কেবল সাময়িকভাবে সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। তাঁর অভিমত সমর্থন করে সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের মাধ্যমে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করে বাস্তুত্যাগীদের পূর্ব বঙ্গে ফিরে যাওয়ার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। সম্পাদকীয় নিবন্ধের উপসংহারে বলা হয়, উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর যুক্তিগুলাে গ্রহণযােগ্য। মিসেস গান্ধী লন্ডনে পৌঁছানাের কয়েক ঘণ্টা পর বাংলাদেশ মিশনের প্রধান ও মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ক্ল্যারিজেস হােটেলে গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনের উদ্যোগে এই সাক্ষাতের আয়ােজন করা হয়। মিসেস গান্ধীর সঙ্গে ইতঃপূর্বে বিচারপতি চৌধুরীর সাক্ষাৎ হয়নি। তিনি বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে পুরনাে বন্ধুর মতাে কথা বলতে শুরু করেন। ফ্রান্স, হল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, ফিনল্যান্ড ও সুইজারল্যান্ডে বিচারপতি চৌধুরীর সফরের অভিজ্ঞতা সম্পর্কে তিনি জানতে চান। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এওয়ার্ড হিথের সঙ্গে সাক্ষাৎ করার আগে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে যথেষ্ট সময় না দিয়ে তিনি এই সাক্ষাতের অনুরােধ জানিয়েছেন বলে মিসেস গান্ধী উল্লেখ করেন। বিচারপতি চৌধুরী বলেন, বিভিন্ন দেশের সরকার ও জনগণ বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীল। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে তারা বলেন, ভারতের স্বীকৃতিদানের ওপর তাদের সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে। আবেগপূর্ণ স্বরে তিনি আরও বলেন, মিসেস গান্ধীর পিতা বেঁচে থাকলে তিনি শুধুমাত্র বাস্তুত্যাগীদের আশ্রয় দিয়েই ক্ষান্ত থাকতেন না। অবশ্য এর প্রতিদানে দেয়ার মতাে কিছুই বিচারপতি চৌধুরীর নেই। বাংলাদেশ কখনও ভারতের করদরাজ্যে পরিণত হবে না। তবে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিবেশী ভারতের বন্ধু-রাষ্ট্রের ভূমিকা গ্রহণ করবে। এই বন্ধুত্ব ভারতের কাম্য কিনা, ভারত তা বিবেচনা করবে। মিসেস গান্ধী ধৈর্য ধরে তাঁর বক্তব্য শােনার পর বিনীতভাবে বলেন, বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করে বিচারপতি চৌধুরী সৌজন্য প্রকাশ করেছেন। এ সম্পর্কে বাংলাদেশের জনগণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা পর্যন্ত অপেক্ষা করা বাঞ্ছনীয় বলে তিনি মনে করেন।
বিচারপতি চৌধুরীর উল্লিখিত প্রতিদান সম্পর্কে মিসেস গান্ধী বলেন, স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে তিনি একটিমাত্র প্রতিদান আশা করেন—তা হলাে গণতন্ত্র । তিনি সামরিক শাসন দেখতে চান না। উল্লিখিত সাক্ষাৎকালে বিচারপতি চৌধুরী মিসেস গান্ধীকে বলেন, লন্ডনের এক সভায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে জয়প্রকাশ নারায়ণকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, তাঁকে প্রশ্ন করে লাভ নেই। স্বীকৃতিদানের অধিকারী হলে তিনি বহু পূর্বে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করতেন। | মিসেস গান্ধী হাসিমুখে বলেন, মি. নারায়ণের মতাে সরকারি-দায়িত্বমুক্ত নাগরিকের অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত। মানবতার খাতিরে তিনি বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে সর্বপ্রকার সাহায্য দিচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ভারতের জনগণের স্বার্থের প্রতি নজর রাখা তাঁর প্রাথমিক কর্তব্য। তিনি ভারতের ওপর একটা যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে পারেন না। ভারতকে বিনা প্ররােচনায় যদি আক্রমণ করা হয়, তা হলে কি করে তার জবাব দিতে হবে, ভারত তা জানে। | উপযুক্ত সময়ে বিনা দ্বিধায় বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করবেন বলে মিসেস গান্ধী উপরােক্ত সাক্ষাৎকারকালে বিচারপতি চৌধুরীকে আশ্বাস দেন।১৯। ৩০ অক্টোবর (শনিবার) লন্ডনের হেনরি থর্নটন স্কুলে বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি এই সম্মেলনের আয়ােজন করে। ম্যাঞ্চেস্টার, লিড়, বার্মিংহাম, এক্সেটার, কেমব্রিজ, অক্সফোর্ড এবং অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ছাত্র প্রতিনিধিদল সম্মেলনে। যােগদান করেন। [ সকালবেলা ঘরােয়া অধিবেশনে কমিটির কার্যবিবরণী পেশ করা হয়। মধ্যাহ্নভােজনের পর বাংলাদেশ সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী আনুষ্ঠানিকভাবে সম্মেলন উদ্বোধন করেন। শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য। পিটার শাের এবং ব্রিটেন ও ফ্রান্সের ছাত্র প্রতিষ্ঠানের নেতৃবৃন্দ প্রকাশ্য অধিবেশনে বক্তৃতা করেন। বিকেলবেলার অধিবেশনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে।
সুদূরপ্রসারী আলােচনা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী আলােচনা-অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। অধ্যাপক রেহমান সােবহান স্বাধীনতা সংগ্রামের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। আলােচনায় অংশগ্রহণ করে ড. আজিজুর রহমান খান স্বাধীনতা সংগ্রামের অর্থনৈতিক পটভূমি ব্যাখ্যা করেন। সম্মেলনে ছাত্ররা ঘােষণা করেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে সমাধান তাদের কাছে গ্রহণযােগ্য নয়। কোনাে রকম আপস-আলােচনায় তাদের আস্থা নেই। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের গৌরবজনক পরিণতি তাদের কাম্য। সম্মেলনের পর বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ-এর (পিপল’স কালচারাল সােসাইটি) উদ্যোগে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়।১২০ ৩১ অক্টোবর ‘দি অবজারভার পত্রিকার কমনওয়েলথ সংবাদদাতা প্রদত্ত এক সংবাদে বলা হয়, আজ (রােববার) প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে মিসেস ইন্দিরা গান্ধীর অসমাপ্ত আলােচনা পুনরায় শুরু হয়। মিসেস গান্ধী ব্রিটেনকে উপমহাদেশের ব্যাপারে জড়াতে চান না। তিনি আশা করেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি এবং এ সম্পর্কে ভারতের নীতির প্রতি ব্রিটেন সমর্থন জানাবে। | বর্তমান সঙ্কটের রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে কারারুদ্ধ বাংলাদেশ নেতা শেখ মুজিব কিংবা তার সহকর্মীদের সঙ্গে অবিলম্বে আলােচনা শুরু করার ব্যাপারে পাকিস্তানকে রাজি করানাের জন্য ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন বলে মিসেস গান্ধী তার সঙ্গে আলােচনাকালে আশ্বস্ত হতে চান। _ অক্টোবর মাসের শেষদিকে বিচারপতি চৌধুরী পাকিস্তানের প্রাক্তন-রাষ্ট্রদূত আবদুল মােমেনকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডনের একটি হােটেলে মরিশাসের কৃষিমন্ত্রী স্যার আবদুর রাজ্জাকের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎ করেন। কয়েক মাস আগে লন্ডনে তাঁর সঙ্গে বিচারপতি চৌধুরীর প্রথমবার সাক্ষাৎ হয়। তখন তিনি বলেন, পাকিস্তানের। অঙ্গচ্ছেদের ব্যাপারে তিনি সম্মতি দিতে পারেন না। দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালে বিচারপতি চৌধুরী মি, আবদুল মােমেনকে কথা বলার সুযােগ দেন। তিনি বাংলাদেশকে মরিশাসের স্বীকৃতিদানের ব্যাপারে সমর্থনদানের জন্য স্যার আবদুর রাজ্জাককে অনুরােধ করেন। মােমেনের বক্তব্য শােনার পর তিনি বলেন : পাকিস্তান ভেঙে দেয়া ঠিক হবে না। অতীতের অন্যায় ক্ষমা করে নতুন পরিবেশ সৃষ্টি করার জন্য এগিয়ে যেতে হবে। মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউসাগর রামগােলাম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের পক্ষপাতী ছিলেন। তার দলের মুসলমান সদস্যদের বিরােধিতার ফলে তা সম্ভব হয়নি।১২১
নভেম্বর, ১৯৭১
১ নভেম্বর (সােমবার) লন্ডনের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে মিসেস গান্ধীর আনুষ্ঠানিক আলােচনা গতকাল (রােববার) দুপুরবেলা সমাপ্ত হয়। সােমবার লন্ডনের ‘ফরেন প্রেস অ্যাসােসিয়েশন আয়ােজিত মধ্যাহ্নভােজসভায় বক্তৃতাদানকালে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধ করার জন্য ভারত সম্পূর্ণভাবে তৈরি না থাকলে দেশের জনগণ তার সরকারকে ক্ষমা করবে। তিনি আরও বলেন, ভারত পাকিস্তানকে কখনও আক্রমণ করে নি এবং বর্তমানেও সেই ইচ্ছা নেই। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান সম্পর্কে এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি পাল্টা প্রশ্ন করেন, স্বীকৃতিদানের ফলে কি লাভ হবে? তিনি বলেন, স্বীকৃতিদানের উপযুক্ত মুহূর্ত সম্পর্কিত প্রশ্ন তাঁর সরকারের বিবেচনাধীন রয়েছে। | ভারতীয় মুখপাত্ররা বলেন, ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র পাকিস্তান ভেঙে গিয়েছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে মিসেস গান্ধী পাশ্চাত্যের দেশগুলাের বিরুদ্ধে অনুযােগের সুরে। বলেন, পাকিস্তানের কার্যকলাপ উপেক্ষা করে ভারত ও পাকিস্তানকে সমপর্যায়ের রাষ্ট্র বলে উল্লেখ করা বিরক্তিকর। ২ নভেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, ভারত ও পাকিস্তান সমপর্যায়ভুক্ত নয় এবং তা মেনে নিতে তিনি রাজি নন। একই তারিখে ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, সভাগৃহের দরজায় জনৈক প্ল্যাকার্ডধারী বিক্ষোভকারী মিসেস গান্ধীর কাছে বাস্তুত্যাগীদের দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে ভারতের বাধা সৃষ্টির কারণ জানতে চায়। তিনি । বলেন, এ প্রশ্নটি এ বছরের সবচেয়ে বড় রসিকতা বলে গণ্য হওয়া উচিত। বাস্তুত্যাগীদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করার জন্য ভারত অত্যন্ত সচেষ্ট রয়েছে। তা সত্ত্বেও দৈনিক প্রায় ৩০ হাজার বান্ধুত্যাগী ভারতে আশ্রয়গ্রহণ করছে। ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে চীন পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ করবে বলে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতি সম্পর্কে তার অভিমত জানতে চাইলে মিসেস গান্ধী বলেন, অন্যান্য প্ররােচনামূলক বিবৃতির সঙ্গে এর মিল রয়েছে। পাকিস্তানকে আক্রমণ করার ইচ্ছা ভারতের নেই। ইতঃপূর্বে পাকিস্তান দু’বার আক্রমণ করেছে বলে ভারতকে সম্পূর্ণভাবে তৈরি থাকতে হবে। ১ নভেম্বর স্থানীয় কলােসিয়াম থিয়েটারে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত এক সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিসেস গান্ধী উপমহাদেশের সমগ্র পরিস্থিতির ভয়াবহতা বর্ণনা করে বলেন, তিনি একটি আগ্নেয়গিরির চূড়ায় অবস্থান করছেন বলে মনে করেন। কখন বিস্ফোরণ ঘটবে তা তিনি জানেন না।
উল্লিখিত তারিখে ফাইনান্সিয়াল টাইমস’-এর সংবাদদাতা কেভিন র্যাফাটি এক সংবাদ-বিশ্লেষণে বলেন, শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের আবেদন জানাবার উদ্দেশ্যে মিসেস গান্ধী ব্রিটেন ও পাশ্চাত্যের অন্যান্য দেশ সফর করছেন বলে মনে করা হয়। কিন্তু অগ্নিগর্ভ ভাষায় প্রদত্ত তার বক্তব্য থেকে মনে হয়, শরণার্থীদের জন্য সাহায্যের প্রশ্ন জরুরি নয়। পাকিস্তান প্রেসিডেন্টের উদ্যোগে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানই তাঁর কাম্য। | পত্রিকাটির সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, মিসেস গান্ধীর যুক্তি বােধগম্য এবং যুক্তিসঙ্গত। তিনি মনে করেন, আলােচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পূর্বশর্ত হিসেবে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিতে হবে। পত্রিকাটি মনে করে, মিসেস গান্ধীর যুক্তি মেনে নেয়া ছাড়া অন্য কোনাে উপায় নেই। | ১ নভেম্বর ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস-হিউম ক্ল্যারিজেস হােটেলে গিয়ে মিসেস গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে ৪০ মিনিট যাবৎ বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন। উল্লিখিত তারিখে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর বিশেষ সংবাদদাতা ডেভিড লােশাক এক সংবাদ-বিশ্লেষণে বলেন, পাকিস্তান বর্তমান একটি চরম সঙ্কটের মুখােমুখি হয়েছে। গত দশ মাসে একের পর এক হঠকারী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। তা সত্ত্বেও হঠকারিতার জন্য অনুতাপ না করে সাধুতার ভান করা হয়। সরকারি প্রচারণামূলক চলচ্চিত্রের মাধ্যমে পূর্ব বঙ্গের গণহত্যার জন্য বাঙালিদের দায়ী করা। হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া মাত্রাজ্ঞান হারিয়ে পাকিস্তান-সৃষ্ট পরিস্থিতির জন্য । ভারতকে দায়ী করে। | শেখ মুজিবকে কারারুদ্ধ করে পাকিস্তানের সামরিক চক্র বিপদমুক্ত হয়েছে বলে মনে করা ভুল হবে। শেখ মুজিবই একমাত্র ব্যক্তিত্ব যিনি পাকিস্তানকে ভরাডুবি থেকে রক্ষা করতে পারেন। তাকে কারাগারে আটক রাখা হলে তিনি একটি প্রতীক এবং ইয়াহিয়ার বিকল্প হিসেবে পরিগণিত হবেন ৩ নভেম্বর ‘দি টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, সুইজারল্যান্ডের রাজধানী বার্ন-এ অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসে সেকেন্ড সেক্রেটারি হিসেবে নিয়ােজিত ওয়ালিউর রহমান পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন। তিনি সুইজারল্যান্ডে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন। ৭ নভেম্বর বৃহত্তর লন্ডন এলাকার বাঙালিদের উদ্যোগে গঠিত ১৪টি এ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিবৃন্দ এক সভায় মিলিত হয়ে গ্রেটার লন্ডন কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করেন।
এস এম আইউব এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। ত্রিশজন প্রতিনিধি ও দর্শক এই সভায় যােগদান করেন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর নভেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা। হয়, বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির কর্মসূচির সমন্বয় সাধন এবং প্রস্তাবিত জাতীয় সম্মেলন সাফল্যমণ্ডিত করার জন্য কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্দেশ্যে উল্লিখিত কো-অর্ডিনেটিং কমিটি গঠন করা হয়। মি. আইউব কমিটির আহ্বায়ক মনােনীত ৪ নভেম্বর মিসেস গান্ধী লন্ডন থেকে ওয়াশিংটন পৌঁছান। সেখান থেকে ৭ নভেম্বর তিনি পারীতে যান। পারীতে দু’দিন কাটিয়ে ৯ নভেম্বর তিনি পশ্চিম জার্মানি পৌঁছান। ৯ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য নতুন প্রচেষ্টা গ্রহণ না করা পর্যন্ত ইয়াহিয়া খান বহির্বিশ্বে ক্রমেই অধিকতর সমর্থনহীন হয়ে পড়বেন। এর ফলে মরিয়া হয়ে তিনি কাশ্মির কিংবা পাঞ্জাবে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে অসহনীয় অবস্থা থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করতে পারেন। সৌভাগ্যক্রমে, ভুট্টোর চীন। সফরের উদ্দেশ্য সফল হয় নি বলে মনে হয়। | উল্লিখিত তারিখে ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, ঘটনাস্রোত ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল (৮ নভেম্বর) আমেরিকা পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করেছে। পাকিস্তানের বিশ্বস্ত বন্ধু বলে প্রচারিত চীন থেকে ভুট্টো ‘আন্তরিক বন্ধুত্ব’ ও ‘সমর্থনের দৃঢ় সঙ্কল্প’ সম্পর্কিত মৌখিক আশ্বাস নিয়ে ফিরে এসেছেন। এর ফলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী অপার স্বস্তি বােধ করবেন।। সম্পাদকীয় মন্তব্যে আরও বলা হয়, পাকিস্তানের জেনারেলগণ নিজেদের দুর্বুদ্ধির ফলে সৃষ্ট নিপীড়নমূলক পথের শেষ প্রান্তে উপনীত হয়েছেন। তারা যুদ্ধ করে পরাজয় স্বীকার করতে পারেন, কিংবা আলােচনার মাধ্যমে বিদায় গ্রহণ করতে পারেন। এরপর তাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব নয়; প্রতারণামূলক গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাও সম্ভব নয়। ১০ নভেম্বর ঢাকা থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর গেরিলা
যােদ্ধারা বিগত দু’ সপ্তাহের মধ্যে বাংলাদেশের ৭টি এলাকা দখল করে মুজিবনগর সরকারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে। ১১ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, ঢাকার নিকটবর্তী মধুপুর জঙ্গল এবং সুন্দরবন এলাকা মুক্তিযােদ্ধাদের দখলে রয়েছে। ১১ নভেম্বর বন্ থেকে ‘দি গার্ডিয়ান’-এর সংবাদদাতা নরম্যান ক্রসল্যান্ড প্রেরিত সংবাদে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান সমস্যা সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর অনমনীয় মনােভাব থেকে বােঝা যায়, উভয় দেশের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হওয়ার স্পষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন, সীমান্ত এলাকায় এবং ওপারের ঘটনার ওপর যুদ্ধ শুরু হবে কিনা তা নির্ভর করছে। পূর্ব বঙ্গের অধিবাসীরাই পাকিস্তানের অখণ্ডতার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। কিন্তু পূর্ব বঙ্গে যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে জনসাধারণ পাকিস্তানের অখণ্ডতা বজায় রাখার পক্ষপাতী কিনা সে সম্বন্ধে সন্দেহ রয়েছে। সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থী দেশে ফিরে যেতে সক্ষম না হওয়া পর্যন্ত পরিস্থিতি বিপজ্জনক বলে বিবেচিত হবে। | ইয়াহিয়া খানের এক পত্রের জবাবে পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সলর উইলি ব্রান্ড উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। তিনি মধ্যস্থতা করতে রাজি নন বলে জার্মানির সরকারি মুখপাত্র প্রকাশ করেন। মিসেস গান্ধী মধ্যস্থতার প্রস্তাব সম্পর্কে উৎসাহী নন। বিশ্ব-জনমত ইয়াহিয়া খানকে সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করতে বাধ্য করবে বলে তিনি আশা করেন। পাকিস্তান ভারতকে আক্রমণ করলে ভারত পাল্টা আক্রমণ করবে এবং দখলিকৃত এলাকা ফিরিয়ে দেয়ার জন্য কেউ ভারতকে বাধ্য করতে পারবে না বলে সম্প্রতি ভারতের দেশরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম যে মন্তব্য করেন, সে সম্পর্কে মিসেস গান্ধী একমত বলে উল্লেখ করেন। তিন দিনব্যাপী পশ্চিম জার্মানি সফরের পর মিসেস গান্ধী ১১ নভেম্বর বন্ থেকে দিল্লি রওনা হন। বন্ অবস্থানকালে তিনি ফেডারেল চ্যান্সলর উইলি ব্রান্ডের সঙ্গে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলােচনা করেন। ভারত-বিরােধী প্রচারে চীনপন্থীরা মওলানা ভাসানীর নাম ব্যবহার করতে দ্বিধাবােধ করে নি।
ভারত ও বিদেশে প্রচারিত বিবৃতিতে বলা হয়, মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি ব্যাহত করার জন্য ভারত সরকার মওলানা ভাসানীকে কার্যত গৃহবন্দি। অবস্থায় দিনযাপন করতে বাধ্য করেছে। শেষ পর্যন্ত তিনি তার ভক্তদের এই মিথ্যা প্রচারণার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ১১ নভেম্বর। বিচারপতি চৌধুরীর কাছে লিখিত এক পত্রে তিনি গৃহবন্দি থাকার সংবাদ ১৮ নভেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, শেখ মুজিবকে মুক্তিদানের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব। পাকিস্তানের মঙ্গলকামী বিদেশী নেতৃবৃন্দের মধ্যে অনেকেই ইয়াহিয়া খানকে জানিয়েছেন, শেখ মুজিবের মুক্তির মাধ্যমে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ এড়ানাে সম্ভব বলে তারা মনে করেন। অথচ ইয়াহিয়া খান এই পরামর্শ গ্রহণ করতে রাজি নন। শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হলে পূর্ব বঙ্গ পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করবে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। ১৮ নভেম্বর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা দর্শনা শহর দখল করতে সক্ষম হয়েছে। এখান থেকে পূর্ব দিকে আক্রমণ চালিয়ে এই সেক্টরের প্রধান রাস্তাগুলাে দখল করাই মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য বলে মনে হয়। পূর্ব বঙ্গের দেবহাটা থেকে ২৩ নভেম্বর অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসের সংবাদদাতা সন্তোষ বসাক প্রেরিত এক সংবাদে মুক্তিযােদ্ধাদের বিবৃতি উল্লেখ করে বলা হয়, পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীকে উচ্ছেদ করার সংগ্রাম গতকাল (২২ নভেম্বর) শুরু। হয়েছে। ২৪ নভেম্বর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, মুক্তিযােদ্ধারা এই যুদ্ধকে ‘জীবন-মরণ সংগ্রাম’ বলে উল্লেখ করেন। | ২৪ নভেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে বলা হয়, জাতিসংঘের মতামতকে উপেক্ষা করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে সংগ্রামরত মুক্তিযােদ্ধারা এগিয়ে যাবে। যুদ্ধের অবসান ঘটাতে হলে শেখ মুজিবের মুক্তি এবং বাঙালিদের স্বায়ত্তশাসন লাভের অধিকার সংবলিত প্রস্তাব পেশ করতে হবে। এ ধরনের উদ্যোগ ছাড়া রক্তপাত বন্ধ হওয়ার কোনাে সম্ভাবনা নেই। উল্লিখিত তারিখে ‘দি টাইমস্ -এর সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, পাকিস্তানের দু’অংশকে একত্র করে পূর্বাবস্থায় ফিরে যাওয়ার সম্ভাবনা নেই। বর্তমান উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান মন্থর গতিতে স্বাভাবিক রাজনৈতিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবেন কিংবা শেষ পর্যন্ত শুভেচ্ছার প্রতীক হিসেবে শেখ মুজিবকে মুক্তিদান করবেন, এই আশায় ভারত ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করবে বলে আশা করা যায় না। অপরপক্ষে ভারত বিভাগের নীতির প্রতি আস্থাশীল প্রবীণ পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দের কাছে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা অচিন্ত্যনীয়।
এ ব্যাপারে নবীনদের সহানুভূতি থাকা অসম্ভব নয়। ভারতের সঙ্গে অন্তহীন ঝগড়ার অবসান হলে পাকিস্তান অতি সহজেই তার ভৌগােলিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক সত্তা খুঁজে পাবে। | ২৯ নভেম্বর করাচি থেকে ফাইনান্সিয়াল টাইমস’-এর সংবাদদাতা প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম ও যশাের এলাকায় ভারতীয় আক্রমণ অব্যাহত রয়েছে। উল্লিখিত তারিখে জেনেভা থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ, শেখ মুজিবের গােপন-বিচার ও তার ফলাফল সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করার জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্টস’ পাকিস্তান সরকারের কাছে দাবি জানিয়েছে। ৩০ নভেম্বর “ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন’ পত্রিকায় প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, যদি শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়ে থাকে, তাহলে তাকে দয়া প্রদর্শনের জন্য। কমিশন অনুরােধ জানিয়েছে। ২৯ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডি থেকে “দি টাইমস্’-এর সংবাদদাতা ডেভিড। হাউসগাে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ২৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের অধিবেশন শুরু হওয়ার পর একটি জাতীয় সরকার গঠন সম্পর্কে আলােচনার জন্য পূর্ব বঙ্গের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ও মুসলিম লীগ নেতা নূরুল আমিনকে ইয়াহিয়া খান আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। পিপলস্ পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো এ ব্যাপারে ইয়াহিয়া। খানের সঙ্গে দু’বার আলােচনা করেছেন। ভারত ও পূর্ব বঙ্গের ‘দুষ্কৃতকারীদের ব্যাপারে ইয়াহিয়া খান অত্যন্ত আপসপন্থী মনােভাব প্রকাশ করেছেন বলে নূরুল আমিন ক্ষোভ প্রকাশ করেন। সামরিক বাহিনীর একটি প্রভাবশালী অংশ তার মতামত সমর্থন করে, এ সম্বন্ধে কোননা সন্দেহ নেই। ৩০ নভেম্বর প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, পূর্ব বাংলার প্রতি। পাকিস্তানের বর্তমান নীতির মৌলিক পরিবর্তনের কোনাে প্রয়ােজন নেই বলে নূরুল আমিন দাবি করেন। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে বিচারপতি চৌধুরী লন্ডন থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রত্যাবর্তন করেন। পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামের উদ্দেশ্য বর্ণনা করার জন্য হার্ভার্ড, নিউইয়র্ক সিটি, কলম্বিয়া, হােফস্ট্রা ও ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয় এবং ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনােলজি (এম আই টি) ও হার্ভার্ড স্কুল অব ল’ সফর করেন। উপরােক্ত প্রতিষ্ঠানগুলােতে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থকদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনাকীর্ণ সভায় তিনি বক্তৃতা করেন।
ডিসেম্বর, ১৯৭১
১ ডিসেম্বর লন্ডনের বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য পূর্ণ স্বাধীনতা অবশ্যপ্রয়ােজন বলে ভারত সরকার মনে করে। ৩০ নভেম্বর রাজ্য পরিষদে বক্তৃতাদানকালে মিসেস গান্ধী ভারত সরকারের উপরােক্ত মনােভাব দ্ব্যর্থহীন ভাষায় প্রকাশ করেন। দি টাইমস্ ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, উচ্চ পরিষদে অনুষ্ঠিত এক বিতর্কে অংশগ্রহণ করে মিসেস গান্ধী বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর উপস্থিতি ভারতের নিরাপত্তার প্রতি হুমকি বলে তিনি মনে করেন। প্রতিবেশী দেশে গণহত্যা ভারতের জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী। নিরস্ত্র জনগণকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে তারা নিষ্ক্রিয় থাকতে পারেন না। তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান যদি ভারতের প্রতি শান্তির হস্ত প্রসারিত করতে চায়, তাহলে সদিচ্ছার প্রমাণ হিসেবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে বাংলাদেশ থেকে তার সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করতে হবে। | ১ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্’-এ প্রকাশিত অন্য একটি সংবাদে বলা হয়, ৩০ নভেম্বর রাত্রিবেলা এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে ভারতের দেশরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, আত্মরক্ষার জন্য প্রয়ােজন হলে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে সীমান্ত অতিক্রম করে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করার অনুমতি দেয়া হবে। | ২ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পুত্র শেখ জামালের একটি আলােকচিত্র প্রকাশিত হয়। চিত্র-পরিচিতি উপলক্ষে বলা হয়, শেখ জামাল বাংলাদেশ গেরিলা বাহিনীতে যােগ দিয়েছেন। তার ইউনিট পূর্ব বঙ্গ সীমান্ত পার হয়ে দশ মাইল ভেতরে গিয়ে যুদ্ধে নিয়ােজিত রয়েছে। ৩ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারতকে বিব্রত করার উদ্দেশ্যে পাকিস্তান সরকার ভারতের পাঞ্জাব এলাকায় একটি স্বাধীন শিখ রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে চরমপন্থী শিখদের সমর্থনদান করবে বলে আশ্বাস দিয়েছে। গতকাল (২ ডিসেম্বর) লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে চরমপন্থী শিখদের নেতা ড, জগজিত সিং চৌহান উপরােক্ত তথ্য প্রকাশ করে বলেন, পাকিস্তানের অন্তর্গত নানকানা সাহেব থেকে একটি বেতার কেন্দ্র এবং লাহাের ও রাওয়ালপিন্ডি থেকে নতুন একটি যাত্রীবাহী বিমান প্রতিষ্ঠান পরিচালনার জন্য ইয়াহিয়া খান অনুমতি দেবেন। এর ফলে পাক-ভারত সীমান্ত বিরােধে মিসেস গান্ধী অনুসৃত নীতি ব্যাহত হবে বলে ড. চৌহান মনে করেন।
৩ ডিসেম্বর করাচি থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, জুলফিকার আলী ভুট্টো। নুরুল আমিনের নেতৃত্বে গঠিত ‘কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় যােগদানের প্রস্তাব সংবলিত একটি পত্র ইয়াহিয়া খানের কাছে পাঠিয়েছেন। রাওয়ালপিন্ডিতে অনুষ্ঠিত এক বিরাট জনসমাবেশে মি. ভুট্টো তার সিদ্ধান্তের কথা ঘােষণা করেন। | ৪ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, সঙ্কটের ক্রমবর্ধমান অবনতি এবং ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার ব্যাপারে ব্যর্থতার কথা বিবেচনা করে তিনি উল্লিখিত পত্র পাঠিয়েছেন। কিন্তু তার কাছে। ‘পূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে বলে তিনি দাবি করেন। | মি. ভুট্টো আরও বলেন, তিনি নিজে এবং তার পার্টি যুদ্ধক্ষেত্রে শত্রুর মুখােমুখি হওয়ার জন্য প্রস্তুত। ইয়াহিয়া খান যদি তার প্রস্তাব মেনে নেন, তাহলে আগামীকাল তিনি ‘কোয়ালিশন মন্ত্রিসভায় যােগদান করে ভারতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। | ৩ ডিসেম্বর মধ্যরাত্রির অব্যবহিত পর এক বেতার ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তান ভারতের বিরুদ্ধে পূর্ণোদ্যমে যুদ্ধ করছে এবং দেশে যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছে। সারা দেশে জরুরি অবস্থা ঘােষণা করার পর জাতির উদ্দেশে এই বেতার ভাষণ প্রচার করা হয়। | ৪ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্ ও ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত সংবাদ অনুযায়ী মিসেস গান্ধী আরও বলেন, পাকিস্তানি স্যার জেট বিমান উত্তর-পশ্চিম ভারত ও কাশ্মিরের আটটি বিমান ঘাঁটির ওপর আক্রমণ চালায়। পরবর্তী খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানি বিমান আগরতলার বিমান ঘাঁটিও আক্রমণ করে। প্রথম সপ্তাহের শেষে লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বাংলাদেশ ও ভারতের বিরুদ্ধে সামরিক আক্রমণ পরিচালনার জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্রের তীব্র নিন্দা করা হয়। ওয়ালি খান ও মুজাফফর আহমদ পরিচালিত ন্যাশনাল আওয়ামী পাটি ও পিপলস্ ডেমােক্রেটিক ফ্রন্ট অব বাংলাদেশের উদ্যোগে এই সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৬ ডিসেম্বর মর্নিং স্টার পত্রিকায় এই সভার বিস্তারিত রিপাের্ট প্রকাশিত হয়।
উল্লিখিত সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, এই যুদ্ধের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়ন ছাড়া অন্যান্য বৃহৎ শক্তিবর্গ বিশেষভাবে দায়ী। পূর্ব বঙ্গে সামরিক আক্রমণ চালিয়ে গণহত্যা শুরু করার পর তারা নিষ্ক্রিয় থাকার নীতি গ্রহণ করে। বৃহৎ শক্তিবর্গ ও জাতিসংঘ কর্তৃক পূর্ব বঙ্গ সমস্যার গণতন্ত্রসম্মত রাজনৈতিক সমাধানের দাবি উত্থাপন এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের অধিকার স্বীকারের মাধ্যমে সর্বাত্মক যুদ্ধজনিত বিপর্যয় এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল। ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির যুক্তরাজ্য শাখার ভাইস-প্রেসিডেন্ট ড. নূরুল আলম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী জনগণকে সমর্থনদানের জন্য সােভিয়েত ইউনিয়নসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশসমূহ ও ভারতকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। যারা পাকিস্তান টিকে থাকবে বলে বিশ্বাস করে তারা মূর্খের স্বর্গে বাস করছে বলে তিনি মন্তব্য করেন। | সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে সুদান কমিউনিস্ট পার্টির পলিটিক্যাল ব্যুরাের সদস্য এসেলেইন এল-আমীর বলেন, তার পার্টির পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সমর্থনসূচক একটি বাণী নিয়ে তিনি এসেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী প্রত্যাহার করার দাবি সংবলিত একটি প্রস্তাব সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। পিপলস্ ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টের সেক্রেটারি হাবিবুর রহমান প্রস্তাবটি উত্থাপন করেন। | ৫ ডিসেম্বর ‘দি সানডে টাইমস’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারত-পাকিস্তান বিরােধে চীন পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করবে বলে প্রধানমন্ত্রী চৌ এন-লাই ঘােষণা করেছেন। ব্রিটিশ সাংবাদিক নেভিল ম্যাক্সওয়েলের সঙ্গে এক সাক্ষাঙ্কারকালে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অনুষ্ঠিত হলে উভয় দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ধ্বংসাত্মক ও আক্রমণমূলক কার্যকলাপের ব্যাপারে চীন দৃঢ়ভাবে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। শেষ পর্যন্ত ভারত তার ফলাফল ভােগ করবে। এরপর উপমহাদেশে অশান্তি বিরাজ করবে।
৬ ডিসেম্বর ভারত সরকার স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে। ৭ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস ও ‘মনিং স্টার’-এ এই সংবাদ প্রকাশিত হয়। ভারতীয় পার্লামেন্টে তুমুল হর্ষধ্বনির মধ্যে উপরােক্ত সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বলেন, পাকিস্তানের বর্তমান সঙ্কটের শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে ক্ষতিকর হওয়ার আশঙ্কা থাকা সত্ত্বেও এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ঘটনাবলির স্বাভাবিক পরিণতির সম্ভাবনা থাকলে এই পদক্ষেপ গ্রহণের পূর্বে তিনি ইতস্তত করতেন। কিন্তু ঘটনাপ্রবাহের মােড় পরিবর্তিত হয়েছে। জীবন-মরণ সংগ্রামে নিয়ােজিত বাংলাদেশের জনগণ এবং আক্রমণকারীদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ সংগ্রামে নিয়ােজিত ভারতীয় জনগণ বর্তমানে একই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য পরস্পরের সহযােগীতে পরিণত হয়েছে বলে মিসেস গান্ধী। বলেন।১২৩ মিসেস গান্ধী বাংলাদেশ সরকারের কাছ থেকে প্রাপ্ত কয়েকটি পত্রের কপি পার্লামেন্ট সদস্যদের অবগতির জন্য পেশ করেন। ২৪ এপ্রিল (১৯৭১) লিখিত পত্রে সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ জানানাে হয়। ৪ ডিসেম্বর লিখিত সর্বশেষ পত্রে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমদ দস্তখত করেন। ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, গণতান্ত্রিক নীতিতে বিশ্বাসী বাংলাদেশ সরকার ভবিষ্যতে সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি অনুসরণ করবে বলে ঘােষণা করেছে। ৬ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী কৌশলগত কারণে পশ্চাদপসারণ করছে বলে ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে জেনারেল রাও ফরমান আলী স্বীকার করেন। ৭ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চাদপসারণ আত্মরক্ষার সর্বোত্তম উপায় বলে ফরমান আলী দাবি করেন। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর ৭টি ডিভিশন আক্রমণ শুরু করেছে বলে তিনি প্রকাশ করেন। ৬ ডিসেম্বর ব্রিটিশ পার্লামেন্টের অধিবেশনে টোরিদলীয় সদস্য ডাকান স্যান্ডস সিকিউরিটি কাউন্সিলে সােভিয়েত ইউনিয়নের ‘ভিটো প্রয়ােগের সমালােচনা করেন। ৭ ডিসেম্বর মর্নিং স্টার’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, শ্রমিকলীয় সদস্যগণ তার সােভিয়েত-বিরােধী মন্তব্যের তীব্র সমালােচনা করেন। এদের মধ্যে জন স্টোনহাউসের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য।
সিকিউরিটি কাউন্সিলে উত্থাপিত মার্কিন প্রস্তাব সমর্থন করতে অস্বীকার করার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের প্রশংসা করেন। বৃহত্তর লন্ডন এলাকার ১৪টি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির পক্ষ থেকে ১০ জন সদস্যবিশিষ্ট একটি প্রতিনিধিদল ৬ ডিসেম্বর লন্ডনস্থ ভারতীয় হাই কমিশনে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ভারত সরকারকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করে। ৭ ডিসেম্বর ‘মর্নিং স্টার -এ প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, প্রতিনিধিরা জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়ে ইন্ডিয়া হাউসে প্রবেশ করেন। ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থের সঙ্গে সাক্ষাঙ্কালে তিনি বলেন, ভারত আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের মাধ্যমে ঐতিহাসিক সত্যকে মেনে নিয়েছে। বাংলাদেশ গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের পথ অনুসরণ করবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। ৭ ডিসেম্বর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করে। নয়া দিল্লিতে ভারত সরকারের জনৈক মুখপাত্র এই সংবাদ প্রকাশ করেন। ভারতের পর ভুটানই সর্বপ্রথম বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদান করে। ৮ ডিসেম্বর জেনারেল ইয়াহিয়া খান নুরুল আমিনকে প্রধানমন্ত্রী এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোকে উপ-প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়ােগ করে একটি কোয়ালিশন’ সরকার গঠন করা হয়েছে বলে ঘােষণা করেন। ৯ ডিসেম্বর ‘ফাইনান্সিয়াল টাইমস্ -এ প্রকাশিত উক্ত সংবাদে বলা হয়, জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের পক্ষ সমর্থন করার জন্য ভুট্টো অবিলম্বে রাওয়ালপিন্ডি থেকে নিউইয়র্ক রওনা হন। ১০ ডিসেম্বর বাংলাদেশ মহিলা সমিতির উদ্যোগে হাইড পার্ক এলাকার স্পিকার্স কর্নারের কাছে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। দলে দলে মহিলারা এই সভায় যােগ দেন। সভার পর মহিলারা মিছিল সহকারে বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। | ১১ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে মিস ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বঙ্গের গভর্নর ড. আবদুল মােত্তালেব মালিক আত্মসমর্পণের শর্তাবলি নির্ধারণের উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের মাধ্যমে ভারতের সঙ্গে আলােচনার জন্য যে প্রস্তাব পেশ করেন, তার বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খান ভিটো’ প্রয়ােগ করেন। | ১২ ডিসেম্বর ‘দি সানডে টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, গত শুক্রবার (১০ ডিসেম্বর) মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর মারফত ড. মালিকের প্রস্তাব ঢাকায় নিয়ােজিত জাতিসংঘের প্রতিনিধির কাছে পেশ করা হয়। উল্লিখিত সংবাদে আরও বলা হয়, ১১ ডিসেম্বর জেনারেল এ এ কে নিয়াজি হঠাৎ ঢাকা বিমানবন্দরে হাজির হয়ে দম্ভভরে ঘােষণা করেন, তিনি পালিয়ে যাননি। তার মৃত্যুর পূর্বে ঢাকার পতন হবে না।
উল্লিখিত তারিখে “দি সানডে টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত আর একটি সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সহকর্মীদের নিয়ে সদ্যমুক্ত যশাের পরিদর্শন করেন। বিপুল জনসমুদ্র ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি সহকারে তাদের অভ্যর্থনা জানায়। | ১২ ডিসেম্বর বিকেলবেলা লন্ডনের হাইড পার্ক এলাকার স্পিকার্স কর্নারের কাছে প্রায় ১৫ হাজার প্রবাসী বাঙালির এক গণসমাবেশে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবি করা হয়। ১৯ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক জনমত’-এ প্রকাশিত উপরােক্ত সংবাদে আরও বলা হয়, ব্রিটেনের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে দলে দলে প্রবাসী বাঙালিরা কোচযােগে লন্ডনে এসে এই সমাবেশে যােগদান করেন। সমবেত জনগণের উদ্দেশ্যে বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন বাংলাদেশ মিশনের ভারপ্রাপ্ত প্রধান কর্মকর্তা
রেজাউল করিম, শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শাের ও জন স্টোনহাউস এবং বাংলাদেশ থেকে আগত আওয়ামী লীগের নেতা ড, আসাবুল হক। ১৩ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, হাইড পার্ক থেকে বাঙালিরা বিরাট মিছিল সহকারে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে অবস্থিত ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পৌছায়। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট গাউস খানের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল প্রধানমন্ত্রীর কাছে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের অনুবােধ সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে সাহায্য করার জন্যও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীকে অনুরােধ জানানাে হয়। ডাউনিং স্ট্রিট থেকে প্রবাসী-বাঙালিরা অন্ডউইচে অবস্থিত ভারতীয় হাই। কমিশনে গিয়ে একটি ধন্যবাদজ্ঞাপক পত্র পেশ করেন। ১২ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় লন্ডনের মহাত্মা গান্ধী হলে ইন্ডিয়া লীগ আয়ােজিত এক সভায় শ্রমিক দলীয় প্রাক্তন মন্ত্রী পিটার শাের বলেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটেনের তৈরি থাকা উচিত। ১৩ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এই সংবাদে আরও বলা হয়, নবগঠিত বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে যথেষ্ট পরিমাণে ব্যবহারিক সাহায্যদানের জন্যও ব্রিটেনের তৈরি থাকা কর্তব্য। | ১৪ ডিসেম্বর বিকেলবেলা পূর্ববঙ্গের গভর্নর ড. এ এম মালিক ও তার মন্ত্রিপরিষদ একযােগে পদত্যাগ করেন। একটি ব-পয়েন্ট কলম দিয়ে এক টুকরাে ছেড়া কাগজে নিজ হাতে পদত্যাগপত্র লিখে ড. মালিক তা জাতিসংঘের অফিসার জন কেলি ও ‘দি অবজারভার’-এর সংবাদদাতা গেভিন ইয়াংকে দেখান। ইয়াহিয়া খানের কাছে লেখা পদত্যাগপত্রখানি ঢাকায় নিয়ােজিত আন্তর্জাতিক রেডক্রস সােসাইটির প্রতিনিধির কাছে হস্তান্তর করা হয়। [ সকালবেলা থেকে ড. মালিক ও তার মন্ত্রীর পদত্যাগের কথা বিবেচনা করছিলেন। ভারতীয় বিমান আক্রমণের ফলে গভর্নরের বাসভবন ধ্বংস হওয়ার পর তারা পদত্যাগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। পূর্ববঙ্গের উচ্চপদস্থ সরকারি অফিসারগণ ড, মালিকের নির্দেশ অনুযায়ী নিরপেক্ষ-এলাকা হিসেবে ঘােষিত হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে (পরবর্তীকালে শেরাটন) আশ্রয়গ্রহণ করেন। | ১৬ ডিসেম্বর ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এ প্রকাশিত এক পত্রে বাংলাদেশ আন্দোলনের উৎসাহী সমর্থক লর্ড ব্রকওয়ে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অস্তিত্ব নেই; এই সত্য ইয়াহিয়া খানকে মেনে নিতে হবে।
গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে নির্বাচিত বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়া তার পক্ষে অবশ্যকর্তব্য বলে তিনি মনে করেন। ১৬ ডিসেম্বর ‘দি গার্ডিয়ান-এর সম্পাদকীয় নিবন্ধে ভারতের বিরুদ্ধে ভুট্টোর এক হাজার বছর যাবৎ যুদ্ধ করার প্রতিজ্ঞা সম্পর্কে বলা হয়, বর্তমান পরিস্থিতিতে এ ধরনের হাস্যকর কথা বলার কোনাে মানে হয় না। ১৫ ডিসেম্বর ঢাকা থেকে ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’-এর সংবাদদাতা মিস্ ক্লেয়ার হােলিংওয়ার্থ প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, জেনারেল নিয়াজি নীতিগতভাবে যুদ্ধবিরতি ঘােষণা করতে রাজি হয়েছেন। অনিচ্ছা সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার নির্দেশ অনুযায়ী নিয়াজি আত্মসমর্পণের শর্ত সম্পর্কে আলােচনা করতে রাজি হন বলে মিস হােলিংওয়ার্থ বলেন। ১৬ ডিসেম্বর লন্ডনের সান্ধ্য-দৈনিক দি ইভনিং স্ট্যান্ডার্ড-এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী আজ পূর্ববঙ্গে আত্মসমর্পণ করেছে। জেনারেল নিয়াজির পক্ষে এ ছাড়া অন্য কোনাে পথ খােলা ছিল না। তার আত্মসমর্পণের ফলে বহু নিরীহ লােকের প্রাণহানির আশঙ্কা দূর হয়েছে। | পত্রিকাটির সম্পাদকীয় মন্তব্যে বলা হয়, স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা এবং লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিশ্চিত করার জন্য ভারতের যুদ্ধ-প্রচেষ্টা অনেকেই সমর্থন করবে। সবকিছু বিবেচনা করে বলা চলে, দুনিয়ার ইতিহাসে অযােগ্য নেতাদের মধ্যে অন্যতম বলে বিবেচিত ইয়াহিয়া খান মিসেস গান্ধীকে অস্ত্র ব্যবহার করতে বাধ্য করেন। পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কে ১৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্টে প্রদত্ত ভাষণে মিসেস গান্ধী বলেন, পাকিস্তান বিনাশর্তে আত্মসমর্পণ করেছে। ঢাকা এখন একটি স্বাধীন দেশের রাজধানী। ১৭ ডিসেম্বর ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত উল্লিখিত সংবাদে আরও বলা হয়, নতুন জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান তার দেশের জনগণের মধ্যে ন্যায্য আসন গ্রহণ করে বাংলাদেশকে উত্তরােত্তর সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাবেন বলে মিসেস গান্ধী আশা। প্রকাশ করেন। সােনার বাংলার স্বপ্ন সফল করার সুযোেগ উপস্থিত হয়েছে। এ । ব্যাপারে ভারতের শুভেচ্ছা থাকবে বলে তিনি আশ্বাস দেন।
মিসেস গান্ধী আরও বলেন, এ বিজয় শুধুমাত্র বাংলাদেশের বিজয় নয়। মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতি যেসব জাতি শ্রদ্ধাশীল তারা এই বিজয়কে মানব স্বাধীনতার ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য পথ-নির্দেশক বলে গণ্য করবে।১২৪ ১৬ ডিসেম্বর নিউইয়র্কে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও তাঁর সহকর্মীরা ভারত ও বাংলাদেশ বাহিনীর যুক্ত কমান্ডের কাছে পাকিস্তান বাহিনীর আত্মসমর্পণের সংবাদ পান। যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি। সমর্থনদানকারী বিভিন্ন প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করার জন্য আরও কয়েক দিন অবস্থানের পর তিনি এবং বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের অপর সদস্যগণ ২২ ডিসেম্বর লন্ডনে ফিরে আসেন। | লন্ডনে ফিরে আসার পর বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের কাছ থেকে একটি তারবার্তা পান। এই তারবার্তায় তাকে। অবিলম্বে দেশে ফেরার জন্য অনুরােধ জানানাে হয়। বিচারপতি চৌধুরী টেলিফোনযােগে সৈয়দ নজরুল ইসলামের সঙ্গে আলােচনাকালে বলেন, ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকায় বসবাসকারী বাঙালিরা বাংলাদেশের জন্য আপ্রাণ পরিশ্রম করেছেন; তাদের ধন্যবাদ না জানিয়ে তিনি দেশে ফিরতে পারবেন না। তাছাড়া সাংগঠনিক কয়েকটা কাজ সমাধা না করে ব্রিটেন থেকে তিনি ফিরে যেতে পারেন না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেন, বিদেশের বিভিন্ন সরকারের স্বীকৃতি লাভের ব্যাপারে বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে আলােচনা করা দরকার। তাছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যাপারেও তার সঙ্গে আলােচনা করা প্রয়ােজন। তিনি ইচ্ছা করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সলর থাকতে পারেন। তা যদি না চান, তাহলে নতুন ভাইস-চ্যান্সলর নিয়ােগ সম্পর্কে তাঁর পরামর্শ প্রয়ােজন। তিনি যদি ভাইস-চ্যান্সলর পদে নিয়ােজিত থেকে লন্ডনে ফিরে যেতে চান, তাহলে একজন অস্থায়ী ভাইস-চ্যান্সলর নিয়ােগ করতে হবে। বিচারপতি চৌধুরী শিগগিরই দেশে ফিরবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।১২৫ | ২০ ডিসেম্বর লন্ডনে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে ইকোনমিক মিনিস্টার’ পদে নিয়ােজিত এ এফ এম এহসানুল কবীর বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন বলে ঘােষণা করেন। ২১ ডিসেম্বর পারী থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, স্থানীয় পাকিস্তানি দূতাবাসে কমার্শিয়াল কাউন্সেলার’ পদে নিয়ােজিত মােসলেউদ্দিন আহমদ এবং ব্রাসেলসে অবস্থিত পাকিস্তান দূতাবাসে ‘সেকেন্ড সেক্রেটারি’ পদে নিয়ােজিত খায়রুল আনাম বাংলাদেশের পক্ষে যােগ দিয়েছেন। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বাগত জানানাের জন্য লন্ডনের হাইড পার্কে স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। বিচারপতি চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে টেলিফোনে শেখ আবদুল মান্নানকে বলেন, সভার তারিখ ২ জানুয়ারি (১৯৭২) ঠিক করা হলে তিনি তার আগেই লন্ডনে পৌঁছে যাবেন। তিনি আরও বলেন, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্যদের নামে সব অ্যাকশন কমিটির। পক্ষ থেকে এই সভা আহ্বান করতে হবে। তিনি নির্দেশ দিলেন, জন স্টোনহাউস ও পিটার শােরসহ ব্রিটিশ পার্লামেন্টের যেসব সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করেছেন, তাদের সবাইকে সাদর আমন্ত্রণ জানাতে হবে।
২ জানুয়ারি (১৯৭২) লন্ডনের আবহাওয়া দুর্যোগপূর্ণ ছিল। তা সত্ত্বেও ব্রিটেনের বিভিন্ন এলাকা থেকে কোচযােগে ৭/৮ হাজার উৎসাহী বাঙালি বিজয়ের আনন্দে শরিক হওয়ার উদ্দেশ্যে হাইড পার্কে জমায়েত হয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাড়িয়ে থেকে সভার কাজ শুরু হওয়ার জন্য অপেক্ষা করেন। জন স্টোনহাউস, পিটার শাের এবং অ্যাকশন বাংলাদেশের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা পল কনেটের প্রতিনিধি হিসেবে মিস মারিয়েটা প্রকোপে এবং আরও কয়েকজন ব্রিটিশ নাগরিক সভায় উপস্থিত ছিলেন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার -এর পক্ষ থেকে তাসাঙ্গুক আহমদ, বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের প্রতিষ্ঠাতা এনামুল হক ও বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিরাও সভায় উপস্থিত ছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত কনভেনার শেখ আবদুল মান্নান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। বিচারপতি চৌধুরী জাতিসংঘে কিভাবে কাজ করেছেন, কিভাবে বাঙালির স্বপ্ন। সফল হলাে, কিভাবে তারা ত্যাগ স্বীকার করেছে, বাঙালির ভবিষ্যৎ কেন উজ্জ্বল হবে ইত্যাদি বিষয় সম্পর্কে আবেগপূর্ণ ভাষায় বক্তৃতা করেন। তিনি আরও বলেন : ‘সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে গঠিত নতুন বাংলাদেশে হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ ও খ্রিষ্টান ধর্মাবলম্বী এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত ব্যক্তিরা শান্তিতে বসবাস করবে। বাংলাদেশের বাঙালিরা সভ্য জাতি হিসেবে গর্ববােধ করে। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর মতাে বর্বর অত্যাচারের নীতি অনুসরণ করবে না। গণহত্যা সম্পর্কিত জেনেভা কনভেনশন যারা লঙ্ঘন করেছে, তাদের বিচার করা হবে।’ বিচারপতি চৌধুরী দৃঢ় কণ্ঠে বলেন : স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ফিরে না আসা পর্যন্ত বাঙালিরা তার মুক্তির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবে।১২৬ | বিচারপতি চৌধুরী স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণকারী প্রবাসী বাঙালি এবং সমর্থনদানকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের অশেষ ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন। ব্রিটিশ সরকারের প্রতিও তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। | এই উপলক্ষে বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশ ফান্ড’-এর জন্য সংগৃহীত অর্থের সংক্ষিপ্ত হিসাব পেশ করেন। ব্যক্তি-বিশেষ ও বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটি সংগৃহীত অর্থের একটি বিরাট অংশ ‘বাংলাদেশ ফান্ড’-এ জমা দেয়া হয় নি বলে তিনি প্রকাশ করেন। শিগগিরই তা জমা দেয়ার জন্য তিনি অনুরােধ জানান।১২৭ অতঃপর স্থানীয় নেতৃবৃন্দ বক্তৃতা করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন শ্রমিকদলীয় প্রাক্তন মন্ত্রী জন স্টোনহাউস, মহিলা সমিতির বেগম আনােয়ারা জাহান, ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জু, জাকারিয়া খান চৌধুরী, অ্যাকশন বাংলাদেশের মারিয়েটা প্রকোপে, স্টিয়ারিং কমিটির সদস্য শামসুর রহমান এবং বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড, হাকিম। | ৬ জানুয়ারি (১৯৭২) সন্ধ্যায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের অনুরােধ অনুযায়ী লন্ডন থেকে বিমানযােগে ঢাকার পথে রওনা হন। কলকাতা হয়ে ৮ জানুয়ারি তিনি ঢাকায় পৌঁছান। ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
লন্ডন, ১৮ মে, ২০০০
বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি
১৯৭১ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের নবনির্বাচিত গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হওয়ার কথা ছিল। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে বঞ্চিত করার উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রস্তাবিত অধিবেশন স্থগিত রাখার ঘােষণা জারি করেন। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিরা ইয়াহিয়া খানের অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপনের উদ্দেশ্যে ১৪ মার্চ লন্ডনে এক গণসমাবেশের আয়ােজন করে। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত এই সমাবেশে ১০ হাজারেরও বেশি বাঙালি যােগদান করে। হাইড পার্ক থেকে বিক্ষোভকারীরা যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সভাপতি গাউস খানের নেতৃত্বে লাউডস স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনে গিয়ে পূর্ব বাংলার দাবি সংবলিত একটি স্মারকলিপি পেশ করে। এই সমাবেশের পর প্রবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতা বৃদ্ধি পায়। কয়েক দিনের মধ্যে তারা প্রায় ১৫টি শহরে ‘অ্যাকশন কমিটি গঠন করে। এই শহরগুলাের মধ্যে ছিল লন্ডন, বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার, লিডস ও ব্র্যাডফোর্ড। ইতঃপূর্বে বার্মিংহামে সংগঠিত পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট নাম পরিবর্তন করে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি নাম গ্রহণ করে। এই কমিটি বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যদের বীভৎস হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য কর্মসূচি গ্রহণ করে। এই কমিটির উদ্যোগে ২১ মার্চ বার্মিংহামে একটি গণসমাবেশের আয়ােজন করা হয়। এই । সমাবেশে ৭ হাজারেরও বেশি বাঙালি ও তাদের দাবির সমর্থকরা যােগদান করেন। ২৬ মার্চের পর বিভিন্ন পেশাজীবী এবং বাংলাদেশ সম্পর্কে উৎসাহী ব্যক্তিরাও নিজস্ব প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলেন। এদের মধ্যে ছিল বাংলাদেশ স্টুডেন্টস্ অ্যাকশন কমিটি (ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ), বাংলাদেশ উইমেন্স অ্যাসােসিয়েশন (মহিলা সমিতি), বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশন, অ্যাকশন বাংলাদেশ, বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ এবং ওমেগা।১২৮
২৬ মার্চ সন্ধ্যার পর পাকিস্তান স্টুডেন্টস্ হােস্টেলে অনুষ্ঠিত এক জরুরি সভার পর আহমদ হােসেন জোয়ারদার (এ এইচ জোয়ারদার) কয়েকজন সঙ্গীসহ দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ২৪ নম্বর থােম হাই স্ট্রিটে বি এইচ তালুকদারের কুলাউড়া’ তন্দুরি রেস্তোরার উপরতলায় অনুষ্ঠিত এক সভায় যােগ দেন। পূর্ব বঙ্গ পরিস্থিতি সম্পর্কে সভায় আলাপআলােচনার পর মি, তালুকদারের নেতৃত্বে স্ট্রেথম অ্যাকশন কমিটি গঠিত হয়। কমিটির উৎসাহী সদস্যদের মধ্যে ছিলেন নুরুল হক চৌধুরী, এ এইচ জোয়ারদার, সােহেল ইবনে আজিজ, নৃপেন্দ্রনাথ ঘােষ, মােহাম্মদ রফিক এবং এ ইসলাম। মি, তালুকদার রেস্তোরার ওপরতলা বিনা ভাড়ায় অ্যাকশন কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি স্রেথাম কমিটির নেতৃবৃন্দ বার্মিংহাম, ম্যাঞ্চেস্টার ইত্যাদি অঞ্চলে গিয়েও অন্য বাঙালিদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। এই কমিটির একটি নিজস্ব ফান্ড ছিল। ফান্ডের। ট্রাস্টিদের মধ্যে ছিলেন রিচার্ড ক্রসম্যান (পরবর্তীকালে শ্রমিকদলীয় মন্ত্রী), লর্ড গিফোর্ড ও বিশপ ট্রেভর হাড়লস্টোনের মতাে বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ। এই ফান্ড থেকে তারা ৫০০ পাউন্ড মুজিবনগর সরকারের মাধ্যমে বাঙালি শরণার্থীদের জন্য পাঠিয়েছেন বলে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে জানিয়েছেন। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে কুলাউড়া’ তন্দুরি রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত বাঙালিদের বৈঠকে বিচারপতি চৌধুরী যােগদান করেন।
| ১৯৭১ সালের শেষদিকে স্ট্রেথাম কমিটির উদ্যোগে লন্ডনের কনওয়ে হলে একটি বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী এই সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে যােগ দেন। বক্তাদের মধ্যে ছিলেন পিটার শাের (এম পি), ক্রস ডগলাসম্যান (এম পি), লর্ড গিফোর্ড, লর্ড ব্রকওয়ে এবং অধ্যাপক রেহমান সােবহান। | স্ট্রেথাম কমিটির প্রচার সম্পাদক নুরুল হক চৌধুরী রচিত “বাংলাদেশ ফাইটস ফর ফ্রিডম’ (Bangladesh Fights for Freedom) শীর্ষক একটি ইংরেজি পুস্তিকা কমিটির উদ্যোগে প্রকাশিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী তার ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন। | লন্ডনে স্মৃতিচারণ উপলক্ষে এ এইচ জোয়ারদার বলেন, মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে প্রচারিত হােয়াই বাংলাদেশ (Why Bangladesh?) শীর্ষক একটি পুস্তিকার হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে স্ট্রেথম অ্যাকশন কমিটি যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় বিতরণের ব্যবস্থা করে। তিনি আরও বলেন, বিলেতে কর্মরত সাধারণ বাঙালিরা ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের জন্য মুক্তহস্তে দান করেন। রেস্তোরাঁর কর্মীরা অনেকেই তাঁদের সাপ্তাহিক বেতনের প্যাকেট দান করেন। কমিটির উদ্যোগে হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার এবং আরাে কয়েকটি জায়গায় জনসভার আয়ােজন করা হয়। আসন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মপন্থা নির্ধারণের উদ্দেশ্যে ৭ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে লন্ডনের বিভিন্ন এলাকায় অনেকগুলাে সভা অনুষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধি এবং উৎসাহী ব্যক্তিরা এসব সভায় যােগ দেন। হাইবারি হিলে অবস্থিত পূর্ব পাকিস্তান হাউস, গাউস খানের ‘এলাহাবাদ’ রেস্তোরাঁ, মতিউর রহমান চৌধুরীর ‘দিলশাদ’ রেস্তোরাঁ, ফোর্ডহাম স্ট্রিটে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশনের অফিস এবং ছাত্রদের বিভিন্ন আস্তানায় সভাগুলাে অনুষ্ঠিত হয়।
২৬ মার্চ হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার পর বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন এ করে যৌথ নেতৃত্বদানের প্রয়ােজন তীব্রভাবে অনুভূত হয়। এই উদ্দেশ্যে একটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠান গঠনের জন্য ২৯ মার্চ (সােমবার) লন্ডনের পােল্যান্ড স্ট্রিটে অবস্থিত মহাঋষি রেস্তোরায় একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। দীর্ঘ আলাপ-আলােচনার পর বিভিন্ন এলাকার প্রতিনিধিদের নিয়ে কাউন্সিল ফল দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে’ শীর্ষক একটি কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হয়। গাউস খান এই কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন। উইন্ডমিল স্ট্রিটে অবস্থিত ‘লাক্ষী রেস্তোরার মালিক শওকত আলী তার রেস্তোরার দুটি রুম বিনা ভাড়ায় কমিটির অফিস হিসেবে ব্যবহার করার জন্য দেন। তাছাড়া অফিসের কাজে বিনা খরচে একটি টেলিফোন ব্যবহার করার অনুমতি দেন। | কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা লন্ডনের বাইরের কমিটিগুলাের সঙ্গে যােগাযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন কভেন্ট্রি ও বার্মিংহামসহ মিডল্যান্ডের বিভিন্ন শহরে যান। শেখ আবদুল মান্নান ইংল্যান্ডের দক্ষিণ-পূর্ব এলাকা এবং লন্ডনের চারপাশের শহরে যেসব কমিটি ছিল তাদের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। গাউস খান নিজে ল্যাঙ্কাশায়ার ও ইয়র্কশায়ারসহ উত্তরাঞ্চলের কমিটিগুলাের সঙ্গে যােগাযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।১৩৩ যুক্তরাজ্যের প্রায় প্রত্যেকটি অ্যাকশন কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব মেনে নিয়ে অনুমােদন গ্রহণ করে। কিন্তু দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনে বি এইচ তালুকদারের নেতৃত্বে গঠিত কমিটি অনুমােদন গ্রহণের বিরােধিতা করে। মি. তালুকদার গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হন নি। আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে তার মত পরিবর্তন করার জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির পাঁচজন সদস্যসহ শেখ আবদুল মান্নান মি. তালুকদারের বাড়িতে গিয়ে রাত ১২টা পর্যন্ত তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। আলােচনাকালে তাঁর সহকর্মী নুরুল হক চৌধুরী, সােহেল ইবনে আজিজ এবং আরও কয়েকজন উপস্থিত ছিলেন। তিনি তার সিদ্ধান্তে অনড় থাকেন। কিছুতেই তিনি গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হন নি। | বার্মিংহামের দুটি কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্ব মেনে নেয়া সত্ত্বেও গাউস খানের নেতৃত্ব মেনে নিতে রাজি হয় নি এবং প্রতিষ্ঠান হিসেবে তাদের স্বাতন্ত্র্য বজায় রাখে। এই দুটি কমিটির মধ্যে জগলুল পাশা ও আজিজুল হক ভূঁইয়ার নেতৃত্বে পরিচালিত কমিটি সদস্য-সংখ্যার বিচারে লন্ডনের পর দ্বিতীয় স্থান দখল করে। মি. পাশা ও মি. ভূঁইয়া যথাক্রমে এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি ছিলেন। তােজাম্মেল হক অপর কমিটির নেতা ছিলেন।
স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কিত কার্যকলাপে উভয় কমিটি কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে পূর্ণ সহযােগিতা করে। | লন্ডনের অন্যান্য কমিটি কোনাে কোনাে ব্যাপারে কেন্দ্রীয় কমিটির সঙ্গে দ্বিমত পােষণ করে। গাউস খান ও শেখ মান্নান পূর্ব লন্ডনে গিয়ে মতিউর রহমান চৌধুরী, মিম্বর আলী, শামসুর রহমান ও অন্য স্থানীয় নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে এক সঙ্গে কাজ করার আবেদন জানান। তারা বলেন, আপনারা কাজ চালিয়ে যান। যখনই ডাক আসবে তখনই তারা বৃহত্তর কমিটির সঙ্গে কাজ করবেন। তারা আশা করেন, কেন্দ্রীয় কমিটিতে যাদের প্রতিনিধিত্ব নেই, তাদের প্রতিনিধি নেয়া হবে। আপাতত বৃহত্তর কমিটির ডাকে যতাে শশাভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল ও জনসভা হবে তাতে তাঁরা যােগ দেবেন এবং কেন্দ্রীয় কমিটির প্রচারপত্র, দেয়ালপত্র ও পুস্তিকা বিলি করার ব্যাপারেও তারা সাহায্য করবেন। ইতােমধ্যে বৃহত্তর কমিটির পক্ষ থেকে একটি নির্দেশনামার মাধ্যমে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটিগুলােকে জানিয়ে দেয়া হয়, তারা যেন অবিলম্বে স্থানীয় অধিবাসী এবং এমপিদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবির প্রতি তাদের সমর্থন আদায় ও প্রয়ােজনবােধে শােভাযাত্রা ও বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করে।৩৪। ২৩ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের আর্টিলারি প্যাসেজে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিরা একটি কেন্দ্রীয় প্রতিষ্ঠান গঠনের উদ্দেশ্যে পরদিন (২৪ এপ্রিল) কভেন্ট্রি শহরে একটি প্রতিনিধি সম্মেলনের আয়ােজন করেন। এই সম্মেলনে গঠিত অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে নামের প্রতিষ্ঠানের কার্য পরিচালনা জন্য ৫-সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। স্টিয়ারিং কমিটির দ্বিতীয় বৈঠকে আজিজুল হক ভূঁইয়া কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত হন। তাঁর পক্ষে যথেষ্ট সময় দেয়া সম্ভব না হওয়ায় কিছুকাল পর শেখ আবদুল মান্নান কমিটির আহবায়ক এবং অফিস পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডনে ফিরে আসার পথে শেখ আবদুল মান্নান কাউন্সিল ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে ভেঙে দিয়ে বৃহত্তর লন্ডন এলাকার জন্য কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটির একটি শাখা গঠনের প্রস্তাব করেন।
এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনের হ্যাসেল স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক সভায় ‘লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ” গঠিত হয়। গাউস খান ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন যথাক্রমে এই কমিটির প্রেসিডেন্ট ও সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। কিছুকাল পর লন্ডন অ্যাকশন কমিটি একটি সংবিধান প্রণয়ন করে গ্রেটার লন্ডন নাম গ্রহণ করে। সংবিধান প্রণয়ন করার পর বিভিন্ন কারণে কমিটির সদস্যদের মধ্যে উৎসাহের অভাব দেখা দেয়। সাখাওয়াত হােসেন সেক্রেটারি পদ থেকে ইস্তফা দেন। আমীর আলীও কমিটির সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।১৩৫ স্টিয়ারিং কমিটির প্রধান দুটি দায়িত্ব ছিল : ক. প্রবাসে স্বাধীনতা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া এবং খ, বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটিকে সংঘবদ্ধ করার উদ্দেশ্যে একটি প্রতিনিধিমূলক কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা। স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নান বলেন : “আমাদের প্রথম দায়িত্ব সাফল্যজনকভাবে আমরা পালন করেছি। কিন্তু দ্বিতীয় দায়িত্ব পালনে আমরা সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হয়েছি। এজন্য বিচারপতি চৌধুরী বিরূপ সমালােচনার সম্মুখীন হন। তিনি ছিলেন আমাদের উপদেষ্টা। স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়কের দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আমিও ব্যক্তিগতভাবে সমালােচিত হয়েছি। কেউ কেউ এজন্য আমাকে দায়ীও করেছেন। কেন আমরা ব্যর্থ হয়েছি, সে সম্পর্কে একটি ব্যাখ্যা দেয়া প্রয়ােজন। বিভিন্ন দল ও মতের সমর্থকরা বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে বারবার দেখা করে অবিলম্বে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করার জন্য দাবি জানাচ্ছিলেন। তাদের চিন্তাধারা এবং উদ্দেশ্যের বিভিন্নতা সম্মিলিত আন্দোলনের পরিপন্থী হবে বলে বিচারপতি চৌধুরী আশঙ্কা করেন। কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে অবশ্যম্ভাবী আত্মকলহের ফলে আন্দোলন দুর্বল হয়ে পড়বে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন। তিনি যেন দিব্যদৃষ্টিতে দেখেন, বিভিন্ন মতাবলম্বী নিয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি গঠিত হলে আমরা যে এক জাতি, আমাদের একটাই দাৰি-স্বাধীনতা, তা থাকবে না।’
শেখ আবদুল মান্নান প্রদত্ত তথ্য থেকে জানা যায়, স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচজন সদস্য কাজের সুবিধার জন্য আঞ্চলিক নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। এই অঞ্চলগুলাে ছিল : ক, ইয়র্কশায়ার ও ব্রিটেনের উত্তরাঞ্চল, খ, ল্যাঙ্কাশায়ার, গ, মিডল্যান্ডস এবং ঘ, লন্ডন ও দক্ষিণ-পূর্ব ইংল্যান্ড। এই চার অঞ্চলের চারজন নেতা এবং তাদের প্রত্যেকের একজন সহকর্মী স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে অনুষ্ঠিত একাধিক বৈঠকে যােগ দিয়েছেন। আঞ্চলিক নেতাদের মধ্যে ছিলেন এ এম তরফদার, হাজী আবদুল মতিন, জগলুল পাশা ও গাউস খান। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে তাঁরা একমত হতে পারেননি। লন্ডন এলাকার নেতৃবৃন্দ আরও দু’জন আঞ্চলিক প্রতিনিধি নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটি পুনর্গঠনের পক্ষে ছিলেন। কিন্তু অন্যান্য অঞ্চলের নেতৃবৃন্দ বিভিন্ন অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের সম্মেলন। আহ্বান করে নতুন কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের পক্ষপাতী ছিলেন। স্টিয়ারিং কমিটির উপদেষ্টা পদে অধিষ্ঠিত বিচারপতি চৌধুরীর কাছে শেখ মান্নান কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন সম্পর্কে একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। এই স্মারকলিপিতে তিনি দুটি প্রস্তাবের কথা উল্লেখ করেন। প্রথম প্রস্তাবে বলা হলাে : গােরিং স্ট্রিটে আঞ্চলিক কমিটির পরবর্তী বৈঠকে কেন্দ্রীয় কমিটির নির্বাচন অনুষ্ঠিত হােক। দ্বিতীয় প্রস্তাবে বলা হলাে, স্টিয়ারিং কমিটির পাঁচজন সদস্য এবং আরাে ছয়জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিদের নিয়ে বর্ধিত স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হােক। ছয়জন নেতৃস্থানীয় ব্যক্তির নামও তিনি উল্লেখ করেছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী শেখ মান্নানের কোনাে প্রস্তাব গ্রহণ করতে রাজি হলেন না। তিনি বলেন : ‘আমি দিব্য-দৃষ্টিতে দেখছি, আপনি যাদের নামের তালিকা দিয়েছেন, তাদের “কো-অপ্ট’ করার সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে অসুবিধার সৃষ্টি হবে এবং কিছুইতে আপনাদের একতা আর থাকবে না। আর আমি কোনাে কাজেই লাগবে না।… ‘প্যাভােরার বাক্স একবার খুলে দেয়া হলে আর বন্ধ করা যাবে না। আপনারা প্যান্ডােরার বাক্স খুলে দেবেন, এটা হবে না।১৩৬ | বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, ইউরােপ ও আমেরিকার যেসব দেশে তিনি গিয়েছেন, সেখানে দেখেছেন বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাঙালি একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তিনি বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ এবং বহু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস-চ্যান্সেলরদের সঙ্গে দেখা করেছেন। আন্দোলনের একটা ইমেজ’ (ভাবমূর্তি) তিনি গড়ে তুলেছেন এবং এই । আন্দোলন চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব বলে তিনি মনে করেন।
বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠন করে যারা স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন হাজী আবদুল মতিন (ম্যাঞ্চেস্টার), ড. মােজাম্মেল হক (গ্লাসগাে), বােরহান উদ্দিন (লুটন), দবীর উদ্দিন (সেন্ট অলবান্স), নূর। মােহাম্মদ খান (লেস্টার), আজিজুল হক ভুইয়া, জগলুল পাশা, আফরােজ মিয়া, ইজরাইল। মিয়া ও তােজাম্মেল (টনি) হক (বার্মিংহাম), ড. মাের্শেদ তালুকদার, কাজী মুজিবুর রহমান, ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন ও আতাউর রহমান খান (পশ্চিম লন্ডনের বেজওয়াটার কমিটি), এস এম আইউব (উত্তর লন্ডন), সৈয়দ আবু আহসান ও কায়সারুল ইসলাম (দক্ষিণ-পশ্চিম লন্ডনের ব্যালহাম কমিটি), বি এইচ তালুকদার, সােহেল ইবনে আজিজ, এ এইচ জোয়ারদার ও নূরুল হক চৌধুরী (দক্ষিণ পশ্চিম লন্ডনের স্রেথম কমিটি), তাসাদুক আহমদ (ওয়েস্টমিনস্টার কমিটি) এবং মিম্বর আলী, শামসুর রহমান, মতিউর রহমান চৌধুরী, ফখরুদ্দিন আহমদ, সিরাজুল হক, জিলুল হক ও তৈয়বুর রহমান (পূর্ব লন্ডনের বিভিন্ন কমিটি)।১৩৭ স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার কিছুকাল পর যুক্তরাজ্যের বাঙালিরা স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থনসূচক ব্যাজ, নেকটাই ও টি-শার্ট, বাংলাদেশের পতাকা এবং বিভিন্ন বকম প্রতীক সংবলিত জিনিসপত্র বিক্রি করতে শুরু করে। এদের মধ্যে কেউ কেউ ব্যক্তিগত স্বার্থে কিংবা পকেট ভারি করার জন্য স্বাধীনতা আন্দোলনের সুযােগ গ্রহণ করে। তাছাড়া কোনো কোনাে জিনিসের ডিজাইন ছিল নিম্নমানের এবং দাম রাখা হয়েছিল অত্যধিক। এই বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি স্টিয়ারিং কমিটির দৃষ্টি আকর্ষণ করে। বিচারপতি চৌধুরীর সঙ্গে দীর্ঘ আলােচনার পর প্রবাসী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলন সম্পর্কে। সচেতন করার জন্য রুচিসম্মত ব্যাজ, নেকটাইপতাকা ও টি-শার্ট ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় ।
স্টিয়ারিং কমিটির অনুমােদন ছাড়া কোনাে জিনিস বাজারে ছাড়া হলে তা না কেনার জন্য কমিটির পক্ষ থেকে জনসাধারণকে অনুরােধ জানানাে হয়। ইতােমধ্যে বাজারে যেসব জিনিস পাওয়া যাচ্ছিল, তার মধ্যে কয়েকটি ব্যাজ ও নেকটাই বিক্রি করার অনুমােদন দেয়া হয়। অন্য কয়েকটি ব্যাজ এবং রিকগনাইজ বাংলাদেশ লেখা টি-শার্ট বিক্রি বন্ধ করার নির্দেশ দেয়া হয়। ২৫ মার্চের দিবাগত রাত্রের (অর্থাৎ ২৬ মার্চের) হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রবাসী বাঙালি ডাক্তাররা মুক্তিযােদ্ধাদের সরাসরি সাহায্যদানের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশন’ গঠন করেন। এ ব্যাপারে যারা উদ্যোগ গ্রহণ করেন তাঁদের মধ্যে ছিলেন ড. আবদুল হাকিম (সভাপতি), ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী, ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার, ড. আহমদ, ড. কাজী ও ড. সাইদুর রহমান। জাফরুল্লাহ চৌধুরী মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের অত্যন্ত উৎসাহী সদস্য ছিলেন।। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুকাল পর তিনি মুজিবনগর’-এ চলে যান। নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। আলাপ-আলােচনার পর তিনি মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করে তিনি আহত মুক্তিযােদ্ধাদের চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। অধিকাংশ সময় বিভিন্ন রণাঙ্গনে সেবারত চিকিৎসক হিসেবে কাজ করলেও তিনি দু’একবার খুব অল্প সময়ের জন্য হলেও লন্ডনে আসেন। স্মৃতিচারণ উপলক্ষে শেখ আবদুল মান্নান বলেন : ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী ও ড. মােশাররফ হােসেন জোয়ারদার এবং তাদের আরাে কয়েকজন সহকর্মী গােরিং স্ট্রিটে। স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে এসে জানতে চান, আমাদের কোনাে আর্থিক সঙ্কট আছে কিনা। আমরা বললাম, আর্থিক সঙ্কটের জন্য আমরা বিচারপতি চৌধুরীকে আমেরিকা পাঠাতে পারছি না। তারা বললেন, বিচারপতির বিমান-ভাড়া তারাই দেবেন। মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের সৌজন্যে বিচারপতি চৌধুরীর প্রথম আমেরিকা সফরের ব্যবস্থা করা সম্ভব হয়। স্বাধীনতা আন্দোলনকালে বিচারপতি চৌধুরীর বিদেশ সফরের খরচ স্টিয়ারিং কমিটির তহবিল থেকে নেয়ার প্রয়ােজন হয় নি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাঙালিরা প্রয়ােজনীয় অর্থের ব্যবস্থা করেছেন।৩৯
মুক্তিযুদ্ধকালে সংস্কৃতি ক্ষেত্রে প্রবাসী বাঙালিদের কর্মতৎপরতা অব্যাহত ছিল। যুক্তরাজ্যে তখন দুটি নতুন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান গঠিত হয়। তার মধ্যে একটি ছিল মােহাম্মদ আলীর উদ্যোগে গঠিত ‘বাংলাদেশ কালচারাল অ্যাসােসিয়েশন’। এরা রাজনৈতিকভাবে স্টিয়ারিং কমিটিকে সাহায্য করেছেন। স্বাধীন বাংলাদেশের শিল্প ও সাহিত্যের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তারা চিন্তা-ভাবনা করেছেন। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদ’ নামের অপর প্রতিষ্ঠানটির প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট ছিলেন এনামুল হক (পরবর্তীকালে ড, এনামুল হক)। তিনি তখন ফোর্ড ফাউন্ডেশনের বৃত্তি নিয়ে ডক্টরেট ডিগ্রির জন্য অক্সফোর্ডে গবেষণারত ছিলেন। মুন্নি রহমান ও জেবুন্নেসা খায়ের যথাক্রমে গণসংস্কৃতি সংসদের সম্পাদিকা ও ট্রেজারারের দায়িত্ব পালন করেন। ফাহমিদা হাফিজ এই প্রতিষ্ঠানের উৎসাহী সদস্যা হিসেবে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। | ১৮ ও ১৯ সেপ্টেম্বর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে ‘গণসংস্কৃতি সংসদ’-এর প্রতিষ্ঠাতা প্রেসিডেন্ট এনামুল হক রচিত ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ শীর্ষক একটি নৃত্যনাট্য মঞ্চস্থ হয়। বিচারপতি চৌধুরী, এই অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী ভাষণ প্রদান করেন। মুক্তিযুদ্ধের এই বিপ্লবী-আলেখ্য দর্শকদের হৃদয় স্পর্শ করে। | ১৬ অক্টোবর ম্যাঞ্চেস্টারের ফ্রি ট্রেড হলে স্থানীয় অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে নৃত্যনাট্যটি মঞ্চস্থ হয়। অক্টোবর মাসের শেষদিকে মিসেস গান্ধীর লন্ডন সফরকালে তাকে সংবর্ধনা জানাবার জন্য আয়ােজিত একটি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপলক্ষেও নৃত্যনাট্যটি। মঞ্চস্থ করা হয়। নৃত্য ও গানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিল শেলী খায়ের, স্বাতী খায়ের, মধু হাফিজ ও সুরাইয়া ইসলাম।১৪০ ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে তরুণ শিক্ষক পল কনেট, তার স্ত্রী এলেন কনেট এবং অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচ.ডি কোর্সের ছাত্রী মারিয়েটা প্রকোপে বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। কিছুকাল পর (সম্ভবত ২০ এপ্রিল) বাংলাদেশ আন্দোলনকে প্রত্যক্ষ সাহায্যদানের কর্মসূচি তৈরি করার জন্য ক্যালিডােনিয়ান স্ট্রিটে অবস্থিত পিস নিউজ পত্রিকার অফিসে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
এই বৈঠকের উদ্যোক্তাদের মধ্যে ছিলেন পল কনেট, মারিয়েটা প্রকোপে ও পত্রিকাটির সম্পাদক। মােট আটটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিরা এই বৈঠকে অংশগ্রহণ করেন। বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধি হিসেবে শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) ও খােন্দকার মােশাররফ এই বৈঠকে যােগ দেন। কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনার পর অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ নামের একটি সংস্থা গঠন করা হয়। পূর্ব বাংলা থেকে অবিলম্বে পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার এবং বাস্তুহারা বাঙালিদের সাহায্যদানের জন্য প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ প্রতিষ্ঠানটির মূল উদ্দেশ্য বলে ঘােষণা করা হয়। মারিয়েটা প্রকোপে এই সংস্থার সচিবের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। আরও কিছুকাল পর পল কনেট ও মারিয়েটার উদ্যোগে অধিকৃত বাংলাদেশে খাদ্যসামগ্রী ও ওষুধপত্র পৌঁছে দেয়ার জন্য ‘অপারেশন ওমেগা’ নামের একটি সংস্থা প্রতিষ্ঠা করা হয়। লন্ডনের ক্যামডেন এলাকায় মারিয়েটার বাড়িতে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর অফিস স্থাপিত হয়। এখান থেকেই অ্যাকশন বাংলাদেশ ক্লিয়ারিং হাউস’ এবং ‘অপারেশন ওমেগা’র কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি তার উৎসাহের কারণ সম্পর্কে শামসুদ্দীন চৌধুরীর এক প্রশ্নের উত্তরে মারিয়েটা বলেন : “যেখানে একটা পশুশক্তি এভাবে ঝাপিয়ে পড়েছে নিঃসহায় মানুষগুলাের ওপর, সেখানে কি করে অন্য দেশের মানুষ বসে থাকতে পারে। মানুষকে তার দেশ-গােত্রের ভিত্তিতে আলাদা করে দেখাটা মস্ত বড় অন্যায় নয় কি?’
১৯৭১ সালে বাংলাদেশে আন্দোলনের সমর্থনে অনুষ্ঠিত জনসভা ও মিছিলে পল কনেট ও মারিয়েটা প্রকোপের উপস্থিতি অবধারিত ছিল। পার্লামেন্টে লবি,’ মার্কিন দূতাবাস কিংবা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ মিছিল এবং অন্যান্য অনুষ্ঠানে হাজির থাকার ব্যাপারে তারা কর্তব্যনিষ্ঠার পরিচয় দেন। অদম্য কর্মপ্রেরণা, মানবিক চেতনাবােধ ও কর্তব্যনিষ্ঠার ফলে তারা প্রবাসী বাঙালিদের শ্রদ্ধা অর্জন করে তাদের আপনজনে পরিণত হন।১৪২ ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ‘দি টাইমস্ -এ দুটি বড় আকারের বিজ্ঞাপন প্রকাশিত হয়। পরবর্তীকালে শেখ আবদুল মান্নান বলেন, স্টিয়ারিং কমিটি এই বিজ্ঞাপনের ব্যয়ভার বহন করে। | ১৩ মে ‘দি টাইমস্ -এর প্রায় এক পৃষ্ঠাব্যাপী বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পূর্ববঙ্গে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে সৈন্যবাহিনী অপসারণ না করা পর্যন্ত পাকিস্তানকে কোনাে প্রকার সাহায্যদানে বিরত থাকার জন্য ব্রিটিশ সরকারের প্রতি আহ্বান জানানাে হয়। এই বিজ্ঞাপনে ব্রিটেনের ১০৬ জন বুদ্ধিজীবী, পার্লামেন্ট সদস্য ও অন্যান্য প্রখ্যাত নাগরিকদের দস্তখত সংযােজিত হয়। উল্লিখিত তারিখে রাত্রিবেলা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ ও বার্মিংহাম রিলিফ এন্ড অ্যাকশন কমিটি’ একযােগে হাউস অব কমন্সের পার্শ্ববর্তী টেমস নদীর দক্ষিণ তীরবর্তী আলবার্ট এ্যামব্যাঙ্কমেন্টে ক্যান্ডল-লাইট ভিজিল’-এর (Candle-light Vigil) আয়ােজন করে। ২০ মে থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছানাের ব্যাপারে “অ্যাকশন বাংলাদেশ সারা বিশ্বের সহযােগিতা লাভের জন্য কার্যক্রম শুরু করে। ‘অপারেশন ওমেগা ঔষধ ও খাদ্যসামগ্রী পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ( ২৭ মে পূর্ববঙ্গে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে দু’জন প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দি গাডিয়ান।
পত্রিকায় প্রকাশিত হয় । ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ উক্ত বিবরণ পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করে ব্যাপকভাবে বিতরণের ব্যবস্থা করে। | ১১ জুন ‘দি গার্ডিয়ান’-এ ‘অপারেশন ওমেগার নামে প্রকাশিত এক বিজ্ঞাপনে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের সাহায্যদানের আবেদন জানিয়ে বলা হয়, বাংলাদেশের দুর্ভোগ কারাে ‘অভ্যন্তরীণ সমস্যা নয়। এ সমস্যা আমাদের সকলের।
১৪ থেকে ১৮ জুনের মধ্যে অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর উদ্যোগে দশটি বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনে অবস্থিত দশটি দেশের দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শনের পর পূর্ববঙ্গ পরিস্থিতি সম্পর্কে সংশ্লিষ্ট দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে একটি স্মারকলিপি পেশ করা হয়। এই স্মারকলিপিতে বলা হয়, পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্যদান বাংলাদেশের নরহত্যার শামিল।
পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য না দেয়ার জন্য প্রচারণা চালাবার উদ্দেশ্যে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’ ১৫ জুন দু’জন এবং ১৯ জুন আরও ৬ জন প্রতিনিধিকে পারীতে লৰি’ করার জন্য পাঠায়। | ২১ জুন পারীতে ‘এইড পাকিস্তান কন্সরশিয়াম”-এর বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠক উপলক্ষে অ্যাকশন বাংলাদেশ’ বাঙালিদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একজোট হয়ে ওয়ার্ল্ড ব্যাংক ভবনের সামনে বিক্ষোভের আয়ােজন করে। সেদিন লন্ডন ও বার্মিংহাম থেকে দুটি কোচযােগে প্রায় দেড়শ’ বাঙালি পারীতে গিয়ে হাজির হন। বিকেলবেলা অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে বাংলাদেশ থেকে পালিয়ে-আসা তিনজন প্রত্যক্ষদর্শী পাকিস্তানি সৈন্যদের নারকীয় অত্যাচারের কাহিনী বর্ণনা করেন। ফরাসি সংবাদপত্র কমব্যাট পরের দিন সেসব কাহিনী সবিস্তারে প্রকাশ করে। | ৩০ জুন ‘দি টাইমস-এ প্রকাশিত পুরাে-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনে “অ্যাকশন বাংলাদেশ’ পূর্ববঙ্গে সংঘটিত ‘গণহত্যা’ সম্পর্কে সিকিউরিটি কাউন্সিলের পদক্ষেপ গ্রহণ এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে কূটনৈতিক স্বীকৃতিদানের দাবি জানায়। [ ৩০ জুলাই ‘দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত পূর্ববঙ্গে গণহত্যা’ শীর্ষক অর্ধ-পৃষ্ঠাব্যাপী এক বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে ১ আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে অ্যাকশন বাংলাদেশ’ আয়ােজিত এক জনসভায় যােগদানের জন্য জনসাধারণকে আহ্বান জানানাে হয়।
ট্রাফালগার স্কোয়ারের গণসমাবেশে বক্তৃতাদান প্রসঙ্গে পল কনেট বলেন : ‘বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পক্ষে রয়েছে বিশ্বের সকল দেশের সকল ধর্মের, সকল বর্ণের মুক্তিকামী মানুষ। এই যুদ্ধ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাঙালির যুদ্ধ নয়, এই যুদ্ধ স্বাধীনতা হরণকারীদের বিরুদ্ধে মুক্তিকামী মানুষের। আপনাদের এই আদর্শের সংগ্রামের সঙ্গে। আমরা সম্পূর্ণ একাত্মতা ঘােষণা করছি। | উল্লিখিত গণসমাবেশের একটি বিশেষ আকর্ষণ ছিল ‘অপারেশন ওমেগা’র উদ্যোগে গঠিত “ইন্টারন্যাশনালে পিস্ টিম গৃহীত কর্মসূচির বাস্তবায়ন। পাকিস্তানিদের আক্রমণের ফলে আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে মিসেস এলেন কনেট এবং আরও একজন মহিলা একটি মােটরভ্যানযােগে ট্রাফালগার স্কোয়ার থেকে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হন। ১৫ আগস্ট ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্টের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ-বিরােধী সমাবেশের প্রতিবাদে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সমর্থকরা সেদিন বিকেলবেলা লন্ডনস্থ মার্কিন দূতাবাসের কাছে একটি নাটকীয় দৃশ্যের অবতারণা করেন। ১৬ আগস্টের ‘মর্নিং স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদ-চিত্রে কয়েকজন শাড়ি পরিহিতা বাঙালি মহিলাকে পায়েচলা রাস্তার ওপর শুয়ে থাকতে দেখা যায়। তিনটি গাড়ি বােঝাই সৈন্যরা নির্বিচারে গুলি চালিয়ে তাদের হত্যা করে। সৈন্যদের গায়ে ছিল পাকিস্তানি সামরিক পােশাক। বাংলাদেশে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের প্রতি জনসাধারণের দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য এই ‘হত্যা’ অভিনয় অনুষ্ঠিত হয়। ১৭ আগস্ট ইন্টারন্যাশনাল পিস্ টিম’-এর ৮জন ব্রিটিশ ও ৩জন আমেরিকান কর্মী আহত ও ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য ওষুধপত্র ও অন্যান্য সাহায্যসামগ্রী নিয়ে পেত্রাপােল পার হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। ১৮ আগস্ট ‘দি টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সৈন্যরা তাদের গ্রেফতার করে জেলখানার আটক রাখে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা মুক্তিলাভ করেন।
বালাদেশ মহিলা সমিতি
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে থেকেই যুক্তরাজ্য প্রবাসী নেত্রীস্থানীয় বাঙালি মহিলারা পূর্ববঙ্গের রাজনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। দেশে ভয়ঙ্কর একটা কিছু হতে যাচ্ছে বলে তারা আশঙ্কা করেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের খবর পাওয়ার পর তারা অবিলম্বে সংগঠিত হওয়ার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করেন। ২ এপ্রিল এক বৈঠকে মিলিত হয়ে তারা বাংলাদেশ উইমেনস্ অ্যাসােসিয়েশন ইন গ্রেট ব্রিটেন’ (বাংলাদেশ মহিলা সমিতি) গঠন করেন। মিসেস জেবুন্নেসা বস্ প্রতিষ্ঠানটির কনভেনার মনােনীত হন। প্রথম কয়েক মাস মিসেস সুফিয়া রহমান প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করেন। জনসংযােগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন মিসেস আনােয়ারা জাহান, মিসেস ফেরদৌস রহমান ও মিসেস মুন্নী রহমান। পরবর্তীকালে জেবুন্নেসা বস্ মহিলা সমিতির প্রেসিডেন্ট পদে নিয়ােজিত হন। আনােয়ারা জাহান ও খালেদাউদ্দিন যথাক্রমে প্রতিষ্ঠানটির জেনারেল সেক্রেটারি এবং ট্রেজারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে স্মৃতিচারণ উপলক্ষে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী লিখেছেন, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি গঠিত হওয়ার পর প্রবাসী বাঙালি মহিলারা বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থনে কাজ করতে শুরু করেন। তাঁৱা স্টিয়ারিং কমিটি আয়ােজিত প্রতিটি সভায় যােগদান করেন। স্টিয়ারিং কমিটিকেও তারা নানাভাবে সাহায্য করেন। তারা পােস্টার লিখেছেন, প্রচারপত্র প্রকাশ করেছেন এবং হাউস অব কমন্সে গিয়ে পার্লামেন্ট। সদস্যদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারকালে বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সমর্থনদানের জন্য। অনুরােধ জানান। | বিচারপতি চৌধুরী আরও বলেন, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি অত্যন্ত কর্মচঞ্চল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছিল। তারা পৃথকভাবে কয়েকটি সম্মেলনের আয়ােজন করেন। স্টিয়ারিং কমিটি ও অন্যান্য সমিতির বিভিন্ন সভায় যােগ দিয়ে লুলু বিলকিস বানু, আনােয়ারা জাহান, ফেরদৌস রহমান ও জেবুন্নেসা খস্ বক্তৃতা করেন। বাংলাদেশ আন্দোলনের কাজে ব্যবহৃত পােস্টারগুলাে লেখার ব্যাপারে তাদের অবদান ছিল অপরিসীম। ফেরদৌস রহমানের বাড়িতে গিয়ে তিনি দেখেছেন, সবাই মিলে তৈরি করছেন পােস্টার ও বাংলাদেশের পতাকা।
পল কনেট প্রতিষ্ঠিত ‘অপারেশন ওমেগা’ সম্পর্কিত কাজে মহিলা সমিতি যথেষ্ট সহায়তা করে। নিচে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির মুক্তিযুদ্ধকালীন কার্যকলাপের বিবরণ দেয়া হলাে : ৩ এপ্রিল (১৯৭১) বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সংঘটিত গণহত্যা, ধর্ষণ ও লুটপাটের প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ করার উদ্দেশ্যে প্রবাসী বাঙালি মহিলারা একটি বিক্ষোভ মিছিলের আয়ােজন করেন। প্রায় ৩০০ মহিলা এই মিছিলে যােগদান করেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ও বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি সংবলিত স্মারকলিপি পেশ করেন। মিছিলে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন জেবুন্নেসা বখস, আনােয়ারা জাহান, লুলু বিলকিস বানু, জেবুন্নেসা খায়ের, শেফালি হক, খালেদাউদ্দিন, পুষ্পিতা চৌধুরী ও সেলিনা মােল্লা। ৪ এপ্রিল বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করার দাবি জানিয়ে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে জরুরি তারবার্তা পাঠানাে হয়। ৮ এপ্রিল মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে কয়েকটি ছােট ছােট দল লন্ডনে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশ আন্দোলনের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেন। এ সম্পর্কে একটি স্মারকলিপিও তারা পেশ করেন। ১০ এপ্রিল বাংলাদেশের ভয়াবহ পরিস্থিতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেল, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও সােভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্টকে সমস্যা সমাধানের জন্য অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করার অনুরােধ জানিয়ে তারবার্তা প্রেরণ করা হয়। ১৩ এপ্রিল পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘এইড পাকিস্তান কসরসিয়ামকে সাহায্যদান বন্ধ রাখার জন্য মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে আবেদন জানানাে হয়। সেদিন লন্ডনে অবস্থিত চীনা দূতাবাসেও একটি স্মারকলিপি পেশ করার ব্যর্থ চেষ্টা করা হয় । দূতাবাসের কর্মকর্তারা স্মারকলিপি গ্রহণ করতে অস্বীকার করেন। ১৮ এপ্রিল মহিলা সমিতি কর্তৃক বিভিন্ন দেশের ‘ফার্স্ট লেডি’কে (রাষ্ট্রপ্রধানের সহধর্মিনী) পাঠানাে তারবার্তায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর নারী-হত্যা ও ধর্ষণ এবং শিশু হত্যা বন্ধ করার ব্যাপারে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের অনুরােধ জানানাে হয় । এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি থেকে মহিলা সমিতির সদস্যরা ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ভবনে গিয়ে এম পিদের লবি’ করেন। ঘণ্টার পর ঘণ্টা মহিলারা পার্লামেন্ট ভবনের দোরগােড়ায় অপেক্ষা করে তাদের নিজ নিজ এলাকার এমপিদের চিরকুট পাঠিয়ে দেখা করেন।
পাকিস্তানি সৈন্যদের বর্বরতার কাহিনী বর্ণনা করে তারা দুস্থ মানবতার প্রতি এম পিদের দায়িত্বের কথা স্মরণ করিয়ে দেন সবাই মন দিয়ে তাঁদের কথা শুনেছেন। কেউ হয়তাে দুঃখ প্রকাশ করেছেন; কেউ-বা বলেছেন, তার পক্ষে যা করা সম্ভব তা তিনি করবেন। মহিলা সমিতির সদস্যরা বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে পার্লামেন্টে আলােচনা, স্বাধীন বাংলাদেশকে ব্রিটিশ সরকারের স্বীকৃতিদান এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের মুক্তিলাভের উদ্দেশ্যে যথােপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য এম পিদের কাছে দাবি জানান। লবি’তে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে ছিলেন আনােয়ারা জাহান, কুলসুমউল্লা, জেবুন্নেসা খায়ের, বেলা ইসলাম, বদরুন্নেসা পাশা (বার্মিংহাম) ও মিসেস শরফুল ইসলাম। ২৭ এপিল আসন্ন সিয়াটো’র অধিবেশন উপলক্ষে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবেন এক বৈঠক অনুষ্ঠানকালে মহিলা সমিতির কয়েকজন সদস্যা প্ল্যাকার্ড হাতে নিয়ে ডাউনিং স্ট্রিটে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। প্ল্যাকার্ডে লেখা শ্লোগানগুলাের মধ্যে ছিল : পাকিস্তানকে ‘সিয়াটো থেকে বহিষ্কার কর,’ রক্তই যদি স্বাধীনতার মূল্য হবে তবে বাংলাদেশ অনেক দিয়েছে এবং ‘বাংলাদেশ আরেক মাইলাই।’ বিক্ষোভ শেষে মহিলারা একটি স্মারকলিপি পেশ করেন। ৭ মে বাংলাদেশ মহিলা সমিতি ব্রিটিশ ত্রাণকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর (War on Want) মাধ্যমে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী বাঙালিদের জন্য প্রায় এক টন ওজনের পুরাতন কাপড়-চোপড় পাঠাবার ব্যবস্থা করে। ২২ মে ইংল্যান্ডের ব্রাডফোর্ড শহরে বাংলাদেশ মহিলা সমিতির একটি শাখা অফিস খােলা হয়। পরে গ্লাসগাে, সাউদাম্পটন ও ম্যাঞ্চেস্টারসহ মােট ৮টি শহরে শাখা খােলা হয়। ৪ জুন মহিলা সমিতির উদ্যোগে প্রায় তিনশ’ বাঙালি মহিলা লন্ডনের সেন্ট জেমস পার্কে সমবেত হয়ে মিছিল সহকারে ‘সেইভ দি চিলড্রেনস ফান্ড’, ‘রেডক্রস’ এবং “ক্রিশ্চিয়ান এইড’-এর অফিস হয়ে ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যান। মহিলাদের কেউ কেউ নিজ নিজ শিশু-সন্তানকে সঙ্গে নিয়ে মিছিলে যােগদান করেন। বিভিন্ন প্ল্যাকার্ড ও স্লোগানের মাধ্যমে তারা বাংলাদেশের ভেতরে এবং ভারতের শরণার্থী শিবিরে অসুস্থ ও অভুক্ত শিশুদের প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করে অধিকতর সাহায্য পাঠানাের অনুরােধ জানান। পরদিন লন্ডনের পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশের দুর্দশাগ্রস্ত শিশুদের কথা প্রকাশিত হয়। সাহায্যদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলােও ভারতের শরণার্থী শিবিরে বসবাসরত শিশুদের জন্য ওষুধ, খাবার ও অর্থসাহায্য পাঠাবার খবর প্রচার করে। | ১৬ জুন পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধ করার দাবি জানিয়ে মহিলা সমিতির সদস্যরা ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’-এর সঙ্গে যােগ দিয়ে পশ্চিম জার্মানি ও অস্ট্রিয়ার দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। পাকিস্তানকে সাহায্যদান বন্ধ করার দাবি। সম্পর্কিত সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি পালন উপলক্ষে এই বিক্ষোভের আয়ােজন করা হয়। ১৮ জুন পরীতে অনুষ্ঠিত ‘এইড পাকিস্তান কনসরসিয়াম’-এর বৈঠক চলাকালে বিক্ষোভে যােগদানের জন্য মহিলা সমিতির একজন প্রতিনিধিকে ফরাসি দেশে পাঠানাে হয়। ২১ জুন মহিলা সমিতির পক্ষ থেকে একটি প্রতিনিধিদল লন্ডনে ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী | শরণ সিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে আলােচনা করেন।
২৪ জুন বাংলাদেশ আন্দোলনকে সমর্থন এবং মুক্তিবাহিনীকে সাহায্যদানের আবেদন জানিয়ে মহিলা সমিতি ব্রিটেনের ছ’শর বেশি ছাত্র ইউনিয়নের কাছে চিঠি পাঠায়। | ২৫ ও ২৬ জুন পাকিস্তানকে যুদ্ধাস্ত্র সরবরাহের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের লন্ডনস্থ দূতাবাসের সামনে মহিলা সমিতির বিশিষ্ট সদস্যা মিসেস রাজিয়া চৌধুরী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আবদুল হাই খানসহ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে যােগ দিয়ে অনশন পালন করেন। জুলাই মাসের মুজিবনগর সরকারের একজন প্রতিনিধি লন্ডনে আসেন। তার কাছে অভাব-অনটনের কথা শােনার পর মহিলা সমিতি মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য তাৎক্ষণিকভাবে দু’শ পাউন্ড দিয়েছেন বলে জেবুন্নেসা বস্ বিলেতে বাংলার যুদ্ধ’ বইটির লেখককে বলেন। ৬ আগস্ট মহিলা সমিতি বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশনের মাধ্যমে। মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য চারশ’ শার্ট ও ট্রাউজারস পাঠাবার ব্যবস্থা করে। ৭ আগস্টট মহিলা সমিতি মুক্তিযােদ্ধা ও বাঙালি শরণার্থীদের সাহায্যার্থে তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে কনওয়ে হলে একটি মীনাবাজার’-এর আয়ােজন করে। মেয়েদের নিজ হাতে রান্নাকরা খাবার ও হাতের কাজ বিক্রি এবং মহিলা ও শিশু-কিশােরদের গান-বাজনার আসর করে ৭০০ পাউন্ড সংগৃহীত হয়। ২১ আগস্ট মহিলা সমিতির সদস্যরা শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় গ্রহণকারী শিশুদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে একটি জাম্বল সেইল’ (পাঁচমিশালি জিনিসপত্র সস্তা দরে বিক্রি) আয়ােজন করে। ৫ সেপ্টেম্বর মহিলা সমিতি বাংলাদেশ আন্দোলনের জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে বেজওয়াটার এলাকায় একটি সিনেমা হলে ‘চ্যারিটি শাে’র আয়ােজন করেন। এই উপলক্ষে মহিলারা নিজ হাতে তৈরি খাবার বিক্রি করে তহবিল সংগ্রহ করেন। ৬ ও ১৩ অক্টোবর মহিলা সমিতির প্রতিনিধিরা যথাক্রমে শ্রমিক ও টোরি দলের বার্ষিক সভায় উপস্থিত হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি সম্পর্কে অধিকতর সহানুভূতিশীল হওয়ার জন্য উভয় দলের সদস্যদের, বিশেষ করে মহিলা সদস্যদের প্রতি আহ্বান জানান। ১১ অক্টোবর লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বাংলাদেশ সােসাইটি গঠনের ব্যাপারে মহিলা সমিতি উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত বাঙালি ছাত্রদের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযােগিতা দান করে। এই প্রচেষ্টায় অধ্যাপক আবুল খায়ের, খােন্দকার মােশাররফ, জেবুন্নেসা খায়ের, লুলু বিলকিস বানু ও আনােয়ার জাহান উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন।
২৪ নভেম্বর থেকে ২ ডিসেম্বরের মধ্যে মহিলা সমিতি বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ ও জাতিসংঘের সেক্রেটারি-জেনারেলের কাছে বাংলাদেশে সংঘটিত পাকিস্তানি ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষণ ও লুটপাট সম্পর্কিত চিঠি এবং বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত প্রতিবেদনের কাটিং’ পাঠায়। বাংলাদেশ থেকে ইয়াহিয়া খানের দখলকারী সৈন্যবাহিনীকে প্রত্যাহার করার ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিভিন্ন দেশের সরকার ও জাতিসংঘের ওপর চাপ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এসব চিঠি ও প্রতিবেদনের ‘কাটিং’ পাঠানাে হয়। ১০ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবি জানানাের উদ্দেশ্যে মহিলা সমিতির উদ্যোগে হাউড পার্কের ‘স্পিকার্স কর্নার’-এর কাছে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভার পর একটি মিছিল বিভিন্ন দূতাবাসে গিয়ে বাংলাদেশকে অবিলম্বে স্বীকৃতিদানের অনুরােধ জানায়। বাংলাদেশ আন্দোলন পরিচালনার জন্য তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে মহিলা সমিতি বিভিন্ন সময়ে মেলা, সিনেমা শশা, বিচিত্রানুষ্ঠান ইত্যাদির আয়ােজন করে। এসব অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতীক সংবলিত নেকটাই, ব্যাজ ও ক্যালেন্ডার ইত্যাদি বিক্রির ব্যাপারে শিশু ও কিশাের-কিশােরী এবং অল্পবয়সী সদস্যরা উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করে। মহিলা সমিতির তহবিল থেকে বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসােসিয়েশন’কে এক হাজার ” পাউন্ড মূল্যের ডাক্তারি সরঞ্জাম কিনে দেয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সদ্য স্থাপিত শিশু হাসপাতালের আসবাবপত্র, ঘড়ি এবং খেলনা ইত্যাদি কেনার জন্য ১,৪৫০ পাউন্ড অনুদান হিসেবে দেয়া হয়।১৪৭
বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ লন্ডনে অনুষ্ঠিত বাঙালি ছাত্রদের সর্বদলীয় এক বিরাট সভায় বিস্তারিত আলােচনার পর ১১-সদস্যবিশিষ্ট বাংলাদেশ স্টুডেন্টস অ্যাকশন কমিটি (বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ) গঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠান গঠিত হওয়ার এক সপ্তাহ আগে (২৮ ফেব্রুয়ারি) সংগ্রামী ছাত্ররা পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের বিরুদ্ধে লন্ডন আওয়ামী লীগ আয়ােজিত বিক্ষোভে অংশগ্রহণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে যােগদান করে। ১ থেকে ৭ মার্চ পর্যন্ত বাঙালি ছাত্ররা লাউন্ডস্ স্কোয়ারে অবস্থিত পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে ২৪-ঘণ্টা অবস্থান-ধর্মঘট করে সামরিক কর্তৃপক্ষের দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানায়। ৭ মার্চ যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আহূত এক প্রতিবাদ-মিছিলে হাজার হাজার বাঙালি জনসাধারণের সঙ্গে ছাত্ররাও যােগ দেয়। আন্দোলনের প্রথমদিকে ছাত্ররা দলে দলে বিভক্ত হয়ে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে (১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিট) এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, ভারত, শ্রীলঙ্কা ও বার্মার (মায়ানমার) দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের কাছে প্রেরিত তারবার্তায় বাংলাদেশে পাকিস্তান সংঘটিত গণহত্যার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে সংবাদপত্রের কাটিং ও বিভিন্ন তথ্য সংবলিত প্রচারপত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। শ্রমিকদলীয় সদস্য পিটার শশারের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের) সঙ্গে ছাত্র প্রতিনিধিদের দ্বিতীয়বার সাক্ষাতের পর তিনি শেখ মুজিবের শারীরিক নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এরপর থেকে জন স্টোনহাউস, ক্ৰস্ ডগলাসম্যান, ফ্রেড ইভান্স, টোবি জ্যাসেল এবং আরাে অনেক পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশ আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতি জ্ঞাপন করে সর্বপ্রকার সাহায্যের আশ্বাস দেন। পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগকালে ছাত্র প্রতিনিধিরা জোর দিয়ে বলেন, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোনাে ব্যবস্থা বাংলাদেশের জনগণের কাছে গ্রহণযােগ্য হবে না। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটরদের সঙ্গেও যােগাযােগ স্থাপন করে। পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্যদান স্থগিত রাখার জন্য ১৯৬১ সালের বৈদেশিক সাহায্যদান আইনের সংশােধনী প্রস্তাব উত্থাপনকারী সিনেটর উইলিয়াম স্যাক্সবি ও ফ্রাঙ্ক চার্চের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করা হয়।
জুলাই মাসের শেষদিকে লন্ডনে আমেরিকান বার অ্যাসােসিয়েশনের বার্ষিক সম্মেলনে যােগদানকারী আইনজীবীদের বাংলাদেশ সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করা হয় এবং সেই সঙ্গে মানবতার খাতিরে বাংলাদেশকে সাহায্যের আবেদন জানানাে হয়। আমেরিকায় ফিরে গিয়ে বহু আইনজীবী তাদের এলাকার সিনেটর ও কংগ্রেসম্যানদের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য চাপ দেন। সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে স্বাধীনতা সগ্রামের ছ’মাস পূর্তি উপলক্ষে হাইড পার্কে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের কনভেনার মােহাম্মদ হােসেন মঞ্জুর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বক্তৃতাদানকারীদের মধ্যে ছিলেন আবদুস সামাদ আজাদ, সৈয়দ আবদুস সুলতান, ড. আসাবুল হক এবং ফনিভূষণ মজুমদার। ১৯৭১ সালের ৩০ অক্টোবর লন্ডনের হেনরি থর্নটন স্কুলে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ জাতীয় ছাত্র সম্মেলনে সংগ্রাম পরিষদের প্রথম আট মাসের কার্যবিবরণী পেশ করা হয়। কার্যবিবরণীতে বলা হয়, পরিষদের উদ্যোগে বিভিন্ন উপলক্ষে প্রকাশিত প্রেস বিজ্ঞপ্তি ছাড়াও মােট ২০টি তথ্য-বিজ্ঞপ্তি ও পাঁচটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়েছে। এর মধ্যে মুক্তি সংগ্রামের প্রথম ছ’মাস’ শীর্ষক পুস্তিকাটি অন্যতম। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের “পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ” শীর্ষক ঘােষণা পুস্তিকা হিসেবে প্রকাশ করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে লন্ডনের দৈনিক সংবাদপত্রগুলােতে মােট চারটি বিজ্ঞাপন প্রকাশ করা হয়। ২৩ মার্চ ‘দি টাইমস’-এ, ২৭ মার্চ ও ২০ জুলাই “দি গার্ডিয়ান’-এ এবং ১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস’-এ বিজ্ঞাপনগুলাে প্রকাশিত হয়। ২০ আগস্টের বিজ্ঞাপনটি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে আমেরিকার বার অ্যাসােসিয়েশনের সদস্যদের প্রতি খােলা চিঠি’ হিসেবে প্রকাশিত হয়। ১৬ আগস্টের বিজ্ঞাপনে পাকিস্তানের কারাগারে শেখ মুজিবের গােপন-বিচারের প্রহসন সম্পর্কে বিশ্ব জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়। এছাড়া আরও একটি বিজ্ঞাপন সাপ্তাহিক জনমত’-এ প্রকাশিত হয়। এই বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে পাকিস্তান হাই কমিশনে নিয়ােজিত বাঙালি অফিসারদের বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের আহ্বান জানানাে হয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন ট্রেড ইউনিয়ন এবং রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের। বার্ষিক সম্মেলনে ‘লবি’ করার ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে এ্যাবারডিনে অনুষ্ঠিত খনি। শ্রমিকদের সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন জ্ঞাপন করে প্রস্তাব পাশ করা হয়। স্কারবারায় অনুষ্ঠিত ট্রান্সপাের্ট ও জেনারেল ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলনে যােগদানকারী নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর ইউনিয়নের জেনারেল সেক্রেটারি জ্যাক জোন্স তাদের জাতীয় কার্যনির্বাহী কমিটির সভায় বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে। আলােচনার প্রতিশ্রুতি দেন। এই ইউনিয়নটি ব্রিটেনের সর্ববৃহৎ (সদস্য-সংখ্যা প্রায় ১৪ লক্ষ) শ্রমিক প্রতিষ্ঠান। শ্রমিক ও উদারনৈতিক দলের বার্ষিক সম্মেলনেও বাংলাদেশের সপক্ষে প্রস্তাব পাশ করা হয়। রক্ষণশীল (টোরি) দলের বহু সদস্য ব্যক্তিগতভাবে বাংলাদেশের সমর্থক হওয়া সত্ত্বেও তাদের বার্ষিক সম্মেলনে বাংলাদেশের সপক্ষে প্রস্তাব গ্রহণের প্রচেষ্টা সফল হয় নি। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে বিভিন্ন সদস্য ইউরােপের অন্যান্য দেশ সফর করে বাংলাদেশের পক্ষে প্রচারণা চালান। পরিষদের সদস্য ওয়ালী আশরাফ বাংলাদেশ সরকারের অনুরােধ অনুযায়ী বুদাপেস্টে অনুষ্ঠিত বিশ্বশান্তি সম্মেলনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসেবে যােগদান করেন। হল্যান্ডে সংগঠিত ‘ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ’-এর আমন্ত্রণে খােন্দকার মােশাররফ হােসেন ও নজরুল ইসলাম এক সাংবাদিক সম্মেলনে যােগদান করেন। সম্মেলনের পর তারা বেলজিয়াম সফর করেন। পারীতে অনুষ্ঠিত “ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন’-এর সম্মেলনে ‘লবি” করার জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে। ড. এ এইচ প্রামাণিক, নজরুল ইসলাম এবং এ জেড মােহাম্মদ হােসেনকে পাঠানাে হয়। মােট ৭০টি দেশের প্রতিনিধিরা এই সম্মেলনে যােগদান করেন।
সংগ্রাম পরিষদের প্রতিনিধিদের সঙ্গে আলাপ-আলােচনার পর সম্মেলনে বাংলাদেশ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব পাশ করা হয়। রুমানিয়ায় বিজ্ঞান ও বিশ্ব শান্তি’ সম্পর্কে অনুষ্ঠিত ‘পাগওয়াস’ সম্মেলনে ‘বি’ করার জন্য স্টিয়ারিং কমিটির অনুরােধে এ জেড মােহাম্মদ হােসেনকে পাঠানাে হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যদের সহায়তায় স্ক্যান্ডিনেভিয়া, পশ্চিম জার্মানি, বেলজিয়াম ও ফ্রান্সে বাংলাদেশ আন্দোলনে সমর্থনকারী প্রতিষ্ঠান গঠন করা সম্ভব হয়। সংগ্রাম পরিষদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সৌদি আরব ও গাল্ফ স্টেটে বসবাসরত বাঙালিদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করে। ব্রিটেনের বিভিন্ন শহরে সংগঠিত বাংলাদেশে অ্যাকশন কমিটিগুলাের সময়ে একটি কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটি গঠনের জন্য ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উদ্দেশ্যে ১৯ মার্চ এক সভার আয়ােজন করা হয়; কিন্তু গুরুতর মতানৈক্যের ফলে। কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করা সম্ভব হয় নি। ছাত্রদের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি বিক্ষোভ প্রদর্শন করা হয়। অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের। উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভেও তারা যােগদান করেন। লন্ডনে সর্বপ্রথম অনুষ্ঠিত যে সভায়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ও পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউস বক্তৃতা করেন, সেই সভা ছাত্রদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানি ক্রিকেট টিমের বিরুদ্ধেও ছাত্ররা বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের দাবিতে ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের সদস্য শামসুদ্দীন চৌধুরী (মানিক) ও আফরােজ আফগান ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটের নিকটবর্তী। ফুটপাতে অনশন পালন করেন। পাকিস্তানের জন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমরাস্ত্র প্রেরণের প্রতিবাদে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য আবদুল হাই খান ও মিসেস রাজিয়া চৌধুরী লন্ডনে। যুক্তরাষ্ট্রের দূতাবাসের সামনে অনশন পালন করেন। বিচারপতি চৌধুরীর অনুরােধক্রমে তারা অনশন প্রত্যাহার করেন। ২৫ মার্চ ছাত্রদের একটি বিরাট দল লন্ডনস্থ পাকিস্তান হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভরত বহুসংখ্যক বাঙালির সঙ্গে যােগদান করেন।
মুক্তিযুদ্ধকালে প্রকাশিত পত্র-পত্রিকা
মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে লন্ডনের একমাত্র বাংলা পত্রিকা ছিল সাপ্তাহিক জনমত ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবের ছ’দফা পুস্তিকা হিসেবে ছাপিয়ে বিতরণ করার পর প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে কর্মচাঞ্চল্য দেখা দেয়। তখন রাজনীতি-সচেতন বাঙালিরা যােগাযােগের মাধ্যম হিসেবে একটি পত্রিকা প্রকাশের কথা চিন্তা করেন। ১৯৬৮ সালে লন্ডনের কেনসিংটন এলাকায় অবস্থিত ‘তাজমহল’ রেস্তোরায় অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ওয়ালি আশরাফ, সুলতান মাহমুদ শরীফ, সালাহউদ্দিন, আনিস আহমদ এবং আরাে কয়েকজন একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশের সম্ভাবনা সম্পর্কে আলাপ-আলােচনা করেন। বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ১৯৬৯ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি সাপ্তাহিক জনমত প্রকাশিত হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ১৯৬৯ সালের অক্টোবর মাসে লন্ডন সফরে আসেন। তখন ‘জনমত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক ওয়ালি আশরাফ ও ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহমদ বঙ্গবন্ধুর হােটেলে গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করেন। পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ উপলক্ষে ওয়ালি আশরাফ বলেন : ‘কথা প্রসঙ্গে তাঁকে (শেখ মুজিব) বললাম, এখন আপনি ছ’দফার বদলে একদফা বলছেন না কেন? উনি হেসে বললেন, তােরা বল। আমরা বুঝলাম, আমাদের কী নির্দেশ দিলেন। আমরা এরপর জনমত’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় শিরােনাম দিলাম-‘স্বাধীনতা ছাড়া বাঙালিদের গত্যন্তর নেই।”৯৫০ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর সাপ্তাহিক জনমত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। মুক্তিযুদ্ধের অগ্রগতি, মুজিবনগর সরকারের কার্যকলাপ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। পাকিস্তানি সৈন্যদের হত্যাকাণ্ড, নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের বিবরণ, যুক্তরাজ্যে সংগঠিত অ্যাকশন কমিটিগুলাের কার্যকলাপ সম্পর্কিত রিপাের্ট এবং বিদেশি সংবাদ ‘জনমত’-এ নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। | পরবর্তীকালে স্মৃতিচারণ উপলক্ষে স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক ও বিচারপতি চৌধুরীর বিশ্বস্ত সহকর্মী শেখ আবদুল মান্নান বলেন : “পত্রিকাটির প্রধান সম্পাদক ওয়ালি আশরাফ, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক আনিস আহমদ এবং আরাে অনেকে যারা এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তারা আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন। ব্রিটেনে বসবাসকারী বাঙালি যারা ইংরেজি জানেন না, তাদের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ পৌঁছে দেয়া ছাড়াও পাকিস্তানপন্থী। বাঙালি এবং বাংলাদেশবিরােধী পাকিস্তানিদের অপপ্রচারের পাল্টা জবাব এবং তাদের গােপন তথ্য ফাঁস করে দিয়ে পত্রিকাটি আমাদের সংগ্রামের সহায়তা করে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানাের জন্য পাকিস্তান অবজারভার’-এর মালিক হামিদুল হক চৌধুরী ও তকালীন গণতন্ত্রী দলের সেক্রেটারিজেনারেল মাহমুদ আলীকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার ইউরােপ ও আমেরিকা সফরে পাঠায়। তাদের ভাতাদান সম্পর্কি সরকারি দলিলের ‘ফ্যাক্সিমিলি সাপ্তাহিক জনমত’-এর ৫ সেপ্টেম্বর (১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। | স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালানাের জন্য হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান ও তার স্বামী এস সােলায়মানকেও পাকিস্তান সরকার ব্রিটেন সফরে পাঠায়। তাদের ভাতাদান সম্পর্কিত সরকারি দলিলের ‘ফ্যাক্সিমিলি’ সাপ্তাহিক জনমত’-এর ১২ সেপ্টেম্বর (১৯৭১) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর ব্রিটেনে প্রকাশিত সর্বপ্রথম পত্রিকা ছিল একটি ইংরেজি “নিউজলেটার । বাংলাদেশে পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের সংবাদ পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ আন্দোলনের কয়েকজন সমর্থক প্রাথমিক আলাপ-আলােচনার পর ২৭ মার্চ (শনিবার) একটি ইংরেজি সংবাদ বুলেটিন প্রকাশের সিদ্ধান্ত করেন। এদের মধ্যে ছিলেন “দি গ্যাঞ্জেস’ রেস্তোরাঁর মালিক তাসাদুক আহমদ, তার স্ত্রী রােজমেরী আহমদ ও সাংবাদিক আবদুল মতিন। উল্লিখিত সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ মার্চ (মঙ্গলবার) নিউজলেটার – এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। বাংলাদেশ আন্দোলনের অকুণ্ঠ সমর্থক ফরিদ জাফরী সম্পাদনার দায়িত্বভার গ্রহণ করেন। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন এয়ার কমােডাের এম কে জানজুয়া সম্পাদনা পরিষদের সদস্য ছিলেন। কিছুকাল পর ড. প্রেমেন আডিডও এই উদ্যোগে অংশগ্রহণ করেন। পত্রিকাটি এপ্রিল মাসে সাপ্তাহিক, মে মাসে পাক্ষিক এবং জুন মাস থেকে মাসিক সংবাদপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আন্তর্জাতিক সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এ প্রবাসী বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিবরণ, মুজিবনগর সরকারের কার্যক্রম, মুক্তিবাহিনীর সামরিক তৎপরতা, বাংলাদেশ আন্দোলনে বিদেশি সমর্থকদের অবদান, মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পর্যুদস্ত পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী সম্পর্কিত খবর এবং বিদেশি সংবাদপত্রে প্রকাশিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত খবর ও সম্পাদকীয় মন্তব্য প্রকাশিত হয়। এর ফলে স্বাধীনতা সংগ্রামের গতি ও প্রকৃতি সম্পর্কে একটি পরিষ্কার চিত্র তুলে ধরা সম্ভব হয়।
পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যায় ব্রিটিশ সােশ্যালিস্ট ও ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের কাছে খােলা চিঠি’ এবং মার্চ মাসে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে বাংলাদেশের সমর্থনে গঠিত অ্যাকশন কমিটির কার্যকলাপ সম্পর্কে রিপাের্ট প্রকাশিত হয়। খােলা চিঠিতে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর আক্রমণের অন্তর্নিহিত কারণ উল্লেখ করে অবিলম্বে হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা, শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযােগ প্রত্যাহার করে তাঁকে মুক্তি দান, আওয়ামী লীগের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, সৈন্যবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরে যাওয়ার দাবি এবং হত্যা ও অমানুষিক নির্যাতন সম্পর্কে তদন্ত করার উদ্দেশ্যে জাতিসংঘের একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণের দাবি সমর্থন করার জন্য আহ্বান জানানাে হয়। পারী থেকে লাল সালু’র লেখক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ ফরাসি সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবাদ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এ প্রকাশের জন্য পাঠান। তার স্ত্রী এ্যানমারী ওয়ালিউল্লাহ এসব সংবাদ ও সম্পাদকীয় মন্তব্য অনুবাদ করেন। বাংলাদেশ। স্বাধীন হওয়ার দু’মাসেরও বেশ কিছু কাল আগে (১০ অক্টোবর, ১৯৭১) হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি মারা যান। বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এ প্রকাশিত সংবাদ, মন্তব্য ও নিবন্ধগুলাে রােজমেরী আহমদ তার আই বি এম টাইপরাইটারের সাহায্যে টাইপ করেন। পত্রিকাটি ছাপানাে ও ডাক খরচের দায়িত্ব বিনা দ্বিধায় তাসাদুক ও রােজমেরী আহমদ গ্রহণ করেন। ‘বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর উদ্যোগে বাংলার কথা শীর্ষক একটি সাময়িক পত্রিকাও প্রকাশিত হয়। যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন শহরে সংগ্রামরত বাঙালি, তাদের সমর্থক, পার্লামেন্ট সদস্য, সরকারি অফিসার এবং বিদেশি দূতাবাসে পৌঁছে দেয়া ছাড়াও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, ভারত ও পশ্চিম ইউরােপের দেশগুলােতে বাংলাদেশ নিউজলেটার’ নিয়মিতভাবে পাঠানাে হয়। এর ফলে বাংলাদেশে আন্দোলনে জড়িত প্রবাসী বাঙালি ও প্রগতিশীল পাকিস্তানি এবং বিদেশি সমর্থনকারীদের কয়েকটি গ্রুপের সঙ্গে “বাংলাদেশ নিউজলেটার’ গ্রুপের ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপিত হয়।১৭২ এই প্রসঙ্গে বাংলাদেশ নামটি কি এক শব্দ, নাকি দু’শব্দবিশিষ্ট সে সম্পর্কে একটি ঐতিহাসিক তথ্য উল্লেখ করা প্রয়ােজন।
মুজিবনগর সরকারের পক্ষ থেকে লন্ডনে প্রকাশিত ডাকটিকেটে বাংলাদেশ নাম দু’শব্দ হিসেবে দেখানাে হয়েছে। এ সম্পর্কে গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিককে কোনাে নির্দেশ দেয়া হয় নি বলে তিনি ডাকটিকেটের ডিজাইনে বাংলাদেশ দুটি পৃথক শব্দ হিসেবে দেখান। ১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর কিংবা অক্টোবর মাসে বাংলাদেশ নিউজলেটার’-এর অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আসাদুক আহমদ ডাকযােগে মুজিবনগর সরকার প্রকাশিত একটি ইংরেজি বুলেটিন পান। এই বুলেটিনের শীর্ষে ইংরেজিতে বাংলাদেশ নামটি বাংলা’ ও ‘দেশ’ আলাদা করে ছাপানাে ছিল। তাসাদুক আহমেদ চিঠি লিখে তাদের জানালেন–দয়েচল্যান্ড, নেদারল্যান্ড, সুইজারল্যান্ড, আইসল্যান্ড প্রভৃতি দেশের নামের মতাে বাংলাদেশ নামটিও এক শব্দ হওয়া উচিত। এই যুক্তি গৃহীত হওয়ার পর আসাদুক আহমেদ লন্ডনে ‘দি টাইমস পত্রিকায় চিঠি লিখে বললেন, Bangla এবং Desh শব্দ দুটি এক সঙ্গে Bangladesh হিসেবে ‘মুজিবনগর সরকারের দলিলপত্রে ব্যবহার করা হচ্ছে। এই চিঠির সঙ্গে তিনি মুজিবনগর সরকারের ‘লেটারহেড’-এর ‘ফ্যাক্সিমিলি পাঠিয়ে ছিলেন। দি টাইমস’-এ আসাদুক আহমদের চিঠি। প্রকাশিত হওয়ার পর থেকে যুক্তরাজ্যের সংবাদপত্রে বাংলাদেশ নামটি এক শব্দ হিসেবে। গ্রহণ করা হয়। তৎকালে তাসাঙ্গুক আহমদ এ সম্পর্কে একটি বুলেটিন’ প্রকাশ করেন। ( ২৩ জুন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হল্যান্ড থেকে লন্ডনে ফিরে আসার পর। স্টিয়ারিং কমিটির এক বৈঠকে বাংলাদেশ টু-ডে’ শীর্ষক একটি ইংরেজি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় । এই বৈঠকে শেখ আবদুল মান্নান সভাপতিত্ব করেন। পত্রিকাটি প্রকাশনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন আমীর আলী, ড. কবীর উদ্দিন আহমদ (ব্রুনেল বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক) এবং আরাে কয়েকজন উৎসাহী কর্মী। সুরাইয়া খানম, শিল্পী আবদুর রউফ এবং মহিউদ্দিন আহমেদ চৌধুরীও এ ব্যাপারে সাহায্য করেন। ১ আগস্ট পত্রিকাটির প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। – স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে ‘সংবাদ পরিক্রমা শীর্ষক একটি বুলেটিনও ১১ নম্বর।
গােরিং স্ট্রিট থেকে প্রকাশিত হয়। স্টিয়ারিং কমিটি এবং বিভিন্ন আঞ্চলিক কমিটি আয়ােজিত সভার রিপাের্ট সংবাদ পরিক্রমায় প্রকাশিত হয়। মহিউদ্দীন আহমদ চৌধুরী এসব রিপাের্ট তৈরি করেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সংবাদ সংস্থায় এসব রিপোের্ট প্রেস বিজ্ঞপ্তি হিসেবে পাঠানাে হয়। গােরিং স্ট্রিট থেকে আফরােজ চৌধুরীর সম্পাদনায় ‘বাংলার রণাঙ্গণ শীর্ষক আরাে একটি পত্রিকা নিয়মিতভাবে প্রকাশিত হয়। উত্তর ইংল্যান্ডের লিডস শহরে বসবাসকারী বাঙালি কর্মীরা জয় বাংলা’ শীর্ষক একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। লিডসে অধ্যয়নরত ছাত্র মােহাম্মদ নূরুল দোহা পত্রিকাটির সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেন। | ‘লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস্ রিপাবলিক অব বাংলাদেশ’-এর মুখপত্র হিসেবে ‘জয় বাংলা’ শীর্ষক আরাে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয় । আমীর আলীর সম্পাদনায় পত্রিকাটির মােট ৪ সংখ্যা প্রকাশিত হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার আগে বার্মিংহাম শহরে একটি উৎসাহী বাঙালি গ্রুপের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান লিবারেশন ফ্রন্ট’ গঠিত হয়। ১৪ মার্চ লন্ডনের হাইড পার্কে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের পর সংগঠনটির নাম পরিবর্তন করে বার্মিংহাম অ্যাকশন কমিটি নাম গ্রহণ করে। এই কমিটি বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে সংবাদ পরিবেশনের উদ্দেশ্যে ‘বিদ্রোহী বাংলা শীর্ষক একটি পত্রিকা প্রকাশ করে। | উত্তরে লন্ডনের এজওয়ার এলাকা থেকে বাংলাদেশ নামে আরাে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। বি করিম পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর লন্ডন থেকে বাংলাদেশ-বিরােধী ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট’-এর মুখপত্র হিসেবে মুক্তি নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন পাকিস্তানপন্থী বাঙালি আবুল হায়াত।
উভয় প্রতিষ্ঠানের জন্য পাকিস্তান সরকার লন্ডনস্থ দূতাবাস মারফত প্রয়ােজনীয় অর্থ সরবরাহ করে। এ সম্পর্কিত একটি গােপন দলিল ১০ অক্টোবর লন্ডনের ‘দি সানডে টাইমস্ -এ ফাঁস করে দেয়া হয়। পত্রিকাটির মাধ্যমে আবুল হায়াত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের বিরােধিতা অব্যাহত রাখেন। বিচারপতি চৌধুরী সম্পর্কে একাধিক মিথ্যা ও মানহানিকর গুজব পত্রিকাটিতে প্রকাশিত হয়। আবুল হায়াত ধর্মকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেন। মুক্তিযুদ্ধকে তিনি ভারতীয় হিন্দুদের মুসলমান-বিরােধী ষড়যন্ত্র বলে প্রচার করেন। মুক্তি পত্রিকায় কখনাে কখনাে ইংরেজিতে সংবাদ ও মন্তব্য প্রকাশিত হয়। ইংরেজি লেখাগুলাে পাকিস্তান হাই কমিশন থেকে সরবরাহ করা হয়। | চীনপন্থী বাঙালিরা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে সরে গিয়ে নিজেদের আদর্শ ও কর্মপন্থা অনুযায়ী কাজ করেন। তাদের মুখপত্র হিসেবে গণযুদ্ধ’ শীর্ষক একটি পত্রিকা প্রকাশিত হয়। এই পত্রিকার সম্পাদকীয় বাের্ডের সদস্যদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, মেসবাহউদ্দিন, জগলুল হােসেন ও ব্যারিস্টার লুৎফর রহমান শাজাহান। স্টিয়ারিং কমিটির উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভায় তারা ‘গণযুদ্ধ বিক্রির চেষ্টা করেছেন। পত্রিকা বিক্রি করতে গিয়ে তারা অনেক জায়গায় স্বাধীনতা সংগ্রামের একনিষ্ঠ। সমর্থকদের হাতে নাজেহালও হয়েছেন।
যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের ভূমিকা
১৯৮৭ সালের প্রথমদিকে এক সাক্ষাৎকারে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আতাউর রহমান খান বলেন, ১৯৭১ সালে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কভেন্ট্রি সম্মেলনের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কিছুটা সন্দিহান ছিলেন। কারণ, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর রাজনৈতিক অবস্থান সম্পর্কে তারা অবহিত ছিলেন না। এর ফলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গাউস খান অস্বস্তি বােধ করেন। কভেন্ট্রি সম্মেলনে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধির পরিবর্তে আঞ্চলিক অ্যাকশন কমিটির প্রতিনিধিদের নিয়ে পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। সদস্যদের মধ্যে আওয়ামী লীগের প্রতিনিধি না থাকায় আন্দোলনের কর্মপন্থা নির্ধারণের ব্যাপারে এবং কমিটির দৈনন্দিন কার্যকলাপের সঙ্গে তাদের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক ছিল না। গাউস খানের এলাহাবাদ রেস্তোরার ওপরতলায় স্টিয়ারিং কমিটির জন্য বিনা ভাড়ায় অফিস দেয়ার প্রস্তাব গৃহীত না হওয়ায় তিনি নিরুৎসাহিত বােধ করেন। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় লিখেছেন : ‘লন্ডনের বিভেদকে এড়িয়ে ২৫ এপ্রিল এই শহরে সকল দলকে নিয়ে স্টিয়ারিং কমিটির সঙ্গে সহযােগিতার উদ্দেশ্যে একটি কমিটি। গঠন করা সম্ভব হয়। এই সভাতেও আপসের জন্য শেখ আবদুল মান্নানসহ কয়েকজন কর্মী যথেষ্ট পরিশ্রম করেন। সভায় আওয়ামী লীগ নেতা গাউস খান সভাপতি, মিনহাজউদ্দিন। সহ-সভাপতি এবং ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। প্রথমে মিনহাজউদ্দিনের নাম সভাপতিরূপে প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু শেখ আবদুল মান্নান এবং আরাে কয়েকজন বাঙালি নেতার অনুরােধে মিনহাজউদ্দিন সহ-সভাপতি হতে সম্মত হন।১৫৫ শেখ মান্নান লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ২৪ এপ্রিল কভেন্ট্রি সম্মেলন থেকে কোচযােগে লন্ডন থেকে ফিরে আসার পথে তিনি কাউন্সিল ফর দি রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন দি ইউ কে ভেঙে দিয়ে লন্ডন এলাকার জন্য নবগঠিত কেন্দ্রীয় কমিটির এক শাখা কমিটি গঠনের প্রস্তাব করেন। এই প্রস্তাব অনুযায়ী ২৬ এপ্রিল পূর্ব লন্ডনে অনুষ্ঠিত এক সভায় আপসের মনােভাব নিয়ে গাউস খান অনুপস্থিত থাকা সত্ত্বেও তাকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে লন্ডন অ্যাকশন কমিটি ফর দি পিপলস রিপাবলিক অব বাংলাদেশ গঠিত হয়।
গাউস খান খুশি হন নি। তিনি আশা করেছিলেন, কেন্দ্রীয় অ্যাকশন কমিটিতে তার স্থান হবে। শেষ পর্যন্ত তিনি লন্ডন কমিটির প্রেসিডেন্ট পদ গ্রহণ করতে রাজি হন। | ৪ জুন বাংলাদেশ সমর্থক ভারতীয় জননেতা জয়প্রকাশ নারায়ণের সম্মানার্থে লন্ডন কমিটি একটি চা-চক্রের আয়ােজন করে। এই সমাবেশে লন্ডন কমিটির পক্ষ থেকে গাউস খান এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান তাঁকে অভ্যর্থনা জানিয়ে বক্তৃতা করেন। ৬ জুন লন্ডন কমিটির উদ্যোগে পূর্ব লন্ডনে একটি জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন : “এই সভায় আমি পুনরায় লক্ষ্য করলাম যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে সম্পূর্ণ নিবেদিত বাঙালিদের মধ্যে তখনও লন্ডন কমিটির নেতৃত্ব নিয়ে চাপা কোন্দল রয়েছে।১৫৬ স্টিয়ারিং কমিটিকে গণতান্ত্রিক পন্থায় নির্বাচনের মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ সাংগঠনিক রূপ দেয়ার জন্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে প্রচেষ্টা চালানাে হয়। এই প্রচেষ্টা সাফল্যমণ্ডিত হয়নি। | আওয়ামী লীগের প্রচেষ্টা সফল না হওয়া সত্ত্বেও নীতিগতভাবে কমিটির বিরােধিতা না করে গাউস খান ও তার সহকর্মীরা তাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী নিজস্ব পন্থায় আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তাঁরা টেলিফোন ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সদস্যদের স্থানীয় পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে যােগাযােগ করে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য ব্রিটিশ সরকারের ওপর চাপ দেয়ার নির্দেশ দেন। | যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের হাইড পার্ক, ট্রাফালগার স্কোয়ার ও কনওয়ে হল এবং বার্মিংহাম, কার্ডিফ, লুটন, ম্যাঞ্চেস্টার ও অন্যান্য শহরে প্রতিবাদ-সভা অনুষ্ঠিত হয়। তাছাড়া আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিক্ষোভ-মিছিল হাইড পার্ক থেকে চীন ও মার্কিন দূতাবাসে গিয়ে স্মারকলিপি পেশ করে। গাউস খান মিছিলের নেতৃত্ব দেন। ১ আগস্ট ট্র্যাফালগার স্কোয়ারে ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ”-এর উদ্যোগে অনুষ্ঠিত বিরাট জনসভায় গাউস খান উদ্দীপনাময় বক্তৃতা দেন।
আওয়ামী লীগের কর্মতৎপরতার ফলে পাকিস্তান-সমর্থক বাঙালিরা গাউস খান ও আতাউর রহমান খানকে নানা রকম ভীতি প্রদর্শন করে। বাংলাদেশ আন্দোলনের সঙ্গে সম্পর্ক ত্যাগ না করলে তাদের রেস্তোরার ক্ষতিসাধন করা হবে, তারা দেশে ফিরতে পারবেন না এবং তাদের দেশের আত্মীয়-স্বজনকে খতম করা হবে ইত্যাদি নানা ধরনের ভীতি প্রদর্শন করা সত্ত্বেও তারা আন্দোলন পরিত্যাগ করেন নি। ভীতি প্রদর্শনকারীদের মধ্যে পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের চিনতে পেরেছলেন বলে আতাউর রহমান খান বলেন। আতাউর রহমান খানের সঙ্গে ব্যক্তিগত যােগাযােগের ফলে সেন্ট্রাল লন্ডন পলিটেকনিকের ডাইরেক্টর কলিন এ্যাডামস বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগের প্রায় সকল বৈঠক ও সভায় তিনি যােগদান করেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত প্রকাশ্য সভার জন্য বিনা ভাড়ায় পলিটেকনিকের মিলনায়তন ব্যবহার করার অনুমতিও তিনি দেন। আন্দোলনের প্রথম দিকে আতাউর রহমান খান শ্রমিকদলীয় সদস্য ব্রুস ডগলাসম্যানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে সাহায্য করার অনুরােধ জানান। কিছুকাল পর পূর্ব লন্ডনে বসবাসকারী আবদুল মালেকের সহায়তায় যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ প্রভাবশালী শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শােরের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের) সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ স্থাপন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের অকপট সমর্থক মি, শাের লন্ডনের যে এলাকা থেকে নির্বাচিত হন, সে এলাকায় বহুসংখ্যক বাঙালি বসবাস করেন। মি. মালেকও সেই এলাকার পুরনাে অধিবাসী। ১৯৮৪ সালে গৃহীত এক সাক্ষাৎকারে মি, মালেক বলেন, যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে পিটার শােরের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার ব্যাপারে তিনি উদ্যোগী হন। এ সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য ব্যারিস্টার রুহুল আমিনের সহায়তায় এক বৈঠকের আয়ােজন করা হয়। তাঁর বাড়িতে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে যােগদানকারীদের মধ্যে ছিলেন গাউস খান, তৈয়েবুর রহমান, মিম্বর আলী, আতাউর রহমান খান ও আবদুল মালেক। এই বৈঠকে পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গে আওয়ামী লীগের সরাসরি যােগাযােগ স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
মি. মালেক এ ব্যাপারে মি, শশারের সঙ্গে প্রাথমিক আলােচনার Tদায়িত্ব গ্রহণ করেন। সপ্তাহখানেক পর প্যাডিংটন স্ট্রিটে আতাউর রহমান খানের ‘রাজদূত’ রেস্তোরায় মি. শােরের সঙ্গে এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এই বৈঠকে আওয়ামী লীগের ১৫/১৬ জন নেতাকর্মী যােগদান করেন। বাংলাদেশ থেকে সদ্য আগত আওয়ামী লীগ দলীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য আবদুল মান্নানও (ছানু মিয়া) এই বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। বিস্তারিত আলাপ-আলােচনার পর আওয়ামী লীগের অনুরােধ অনুযায়ী মি. শাের বাংলাদেশের স্বাধানতা আন্দোলনকে পূর্ণ সমর্থন দেয়ার প্রতিশ্রুতি দেন। সপ্তাহ দুয়েক পর মি. শাের বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য হাউস অব কমন্সে একটি সভার আয়ােজন করেন। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলভুক্ত পার্লামেন্ট সদস্য এই সভায় যােগ দেন। গাউস খান, পিটার শাের এবং আরাে কয়েকজন বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে বক্তৃতা করেন। ভারতের প্রাক্তন দেশরক্ষা মন্ত্রী মি. কৃষ্ণমেনন আগস্ট মাসের মাঝামাঝি লন্ডনে আসেন। তিনি আতাউর রহমান খানের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। রাজদূত’ রেস্তোরায় তার সঙ্গে বাংলাদেশ সম্পর্কে আলােচনা অনুষ্ঠিত হয় । এই বৈঠকের পর গাউস খান তার সম্মানার্থে | এক ঘরােয়া ভােজসভার আয়ােজন করেন। | লন্ডনে নিয়ােজিত ভারতীয় হাই কমিশনার আপা পন্থ গাউস খানের সঙ্গে সরাসরি যােগাযােগ স্থাপন করেন। তাঁর সঙ্গে মি. খানের সাক্ষাৎকালে তৈয়েবুর রহমান, ম্যাঞ্চেস্টারের আবদুল মতিন ও বার্মিংহামের এ কে এম হক উপস্থিত ছিলেন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সঙ্গে তার যােগাযােগ ঘনিষ্ঠ ও বন্ধুত্বপূর্ণ ছিল বলে আওয়ামী লীগ মহল প্রকাশ করে।
লন্ডনে কলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকা সংস্থার প্রতিনিধি এবং লন্ডন থেকে প্রকাশিত | ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘ইন্ডিয়া উইকলি’র প্রতিষ্ঠাতা-সম্পাদক ড. তারাপদ বসু যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দকে বিভিন্ন মহলের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি আওয়ামী লীগকে নানাভাবে সাহায্য করেন। ১৯৭১ সালের ৫ এপ্রিল ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউম (পরবর্তীকালে লর্ড হিউম) পার্লামেন্টে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে বলেন, ব্রিটিশ সরকার। পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করবে না। প্রবাসী বাঙালিরা তার এই মন্তব্যে মর্মাহত হন। যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মােহাম্মদ ইসহাক ও কয়েকজন নেতৃস্থানীয় বাঙালি ছাত্র তকালীন রক্ষণশীল দলীয় (টোরি) পার্লামেন্ট সদস্য কুইনটিন হগের (পরবর্তীকালে লর্ড হেইলশ্যাম) সঙ্গে সাক্ষাৎ করে স্যার আলেক ডগলাস হিউমকে এই উক্তি প্রত্যাহারে রাজি করানাের জন্য অনুরােধ করেন। অন্যান্য মহল থেকেও তাকে এ ধরনের অনুরােধ জানানাে হয়। কিছুকাল পর স্যার আলেক বাংলাদেশে সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয় বলে ঘােষণা করেন। | সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে মুজিবনগর সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা আবদুস সামাদ আজাদ জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে নিউইয়র্কের পথে রওনা হয়ে লন্ডনে পৌঁছান। স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রগতি সম্পর্কে প্রবাসী বাঙালি ও তাদের সমর্থকদের অবহিত করার উদ্দেশ্যে লন্ডনের রুমসবারি হােটেলে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ আয়ােজিত এক সভায় মি, আজাদ বক্তৃতা করেন। গাউস খান এই সভায় সভাপতিত্ব করেন। এরপর মি. আজাদ ইংল্যান্ডের কয়েকটি শহরে আওয়ামী লীগ আয়ােজিত জনসভায় বক্তৃতা করেন। | বাংলাদেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব সম্পর্কে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন দেশের সরকারি কর্তৃপক্ষকে অবহিত করার জন্য ব্যাপক সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ সালের ২৯ অক্টোবর লন্ডনে পৌঁছান। লন্ডনে অবস্থানকালে তাঁর সঙ্গে গাউস খানের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করা হয়। এই সাক্ষাৎকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল বলে আওয়ামী লীগ মহল মনে করে।
বাংলাদেশের প্রথম ডাকটিকেট
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি বহির্বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ ও বিভিন্ন বন্ধুভাবাপন্ন দেশের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশ ডাকটিকেট প্রচলন করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ব্রিটিশ ডাকযােগাযােগ দপ্তরের প্রাক্তন মন্ত্রী ও তৎকালীন শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য জন স্টোনহাউসের (John Stonehouse) পরামর্শ অনুযায়ী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রবাসী সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। | ১৯৭১ সালে যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিরা ‘মুজিবনগর সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে আন্দোলন পরিচালনা করেন। আন্দোলনের সমর্থনে যুক্তরাজ্যের বিভিন্ন এলাকায় গঠিত অ্যাকশন। কমিটিগুলােকে নেতৃত্ব দেয়ার জন্য ২৪ এপ্রিল ইংল্যান্ডের কভেন্ট্রি শহরে অনুষ্ঠিত এক প্রতিনিধি সম্মেলনে ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয়। বিচারপতি চৌধুরী ছিলেন এই কমিটির প্রধান উপদেষ্টা। | স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার আগেই কয়েকজন শ্রমিক দলীয় পার্লামেন্ট সদস্য তৎকালীন পূর্ববঙ্গে পাকিস্তানি হত্যাযজ্ঞের ভয়াবহতার প্রতি বিশ্বের দৃষ্টি আকর্ষণ এবং স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থনদানের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন জন স্টোনহাউস ও ক্রস ডগলাসম্যান (Bruce Douglasman)। | ২৪ এপ্রিল (১৯৭১) ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, পূর্ব বাংলা থেকে ভারতে আগত শরণার্থীদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য মি. ডগলাসম্যান ও মি. স্টোনহাউস সম্প্রতি কলকাতায় পৌঁছান। ২৩ এপ্রিল এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে মি, ডগলাসম্যান বলেন, দক্ষিণ ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে মার্কিন সৈন্যবাহিনী সংঘটিত অমানুষিক হত্যাকাণ্ডের মতাে বহু ঘটনা পূর্ব বাংলায় প্রতিনিয়ত ঘটছে। উল্লিখিত সফরকালে মি, স্টোনহাউস মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এই সাক্ষাৎকালে তিনি প্রধানমন্ত্রীকে বলেন, বাংলাদেশ ডাকটিকেট প্রচলন করা হলে মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানাে চিঠিপত্রের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের অস্তিত্ব বাস্তব সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা সহজ হবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আললাচনাকালে অর্থমন্ত্রী মনসুর আলীও উপস্থিত ছিলেন। সহকর্মীদের সঙ্গে,
আলাপ-আলােচনার পর প্রধানমন্ত্রী মি, স্টোনহাউসকে জানান, মন্ত্রিসভা তার প্রস্তাব অনুমােদন করেছে। ডাকটিকেট প্রকাশের দায়িত্ব তাঁকে দেয়া হয়। যথারীতি ‘মুজিবনগর সরকারের সিলমােহর সংবলিত অনুমতিপত্রও তাকে দেয়া হয়। | লন্ডনে ফিরে আসার পর মি. স্টোনহাউস পশ্চিমবঙ্গের বাঙালি গ্রাফিক শিল্পী বিমান মল্লিকের সঙ্গে যােগাযােগ করে বাংলাদেশের জন্য এক সেট’ ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করার জন্য তাকে অনুরােধ করেন। মি. স্টোনহাউস যখন পােস্টমাস্টার জেনারেল (ডাক ও টেলিযােগাযােগ মন্ত্রী) ছিলেন তখন মি. মল্লিক ব্রিটিশ পােস্ট অফিসের জন্য গান্ধী। স্মারক ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।১৫৮ লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারকালে বিমান মল্লিক বলেন, ২৯ এপ্রিল (১৯৭১) মি. স্টোনহাউস তার সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করে বাংলাদেশ ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করার অনুরােধ জানান। ৩ মে তিনি হাউস অব কমন্সে গিয়ে মি. স্টোনহাউসের সঙ্গে এ সম্পর্কে প্রাথমিক আলাপ-আলােচনা করেন। আলােচনাকালে মি. স্টোনহাউস বলেন, বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি বিচারপতি চৌধুরীর নির্দেশমতাে তিনি বাংলাদেশ ডাকটিকেটের সম্পূর্ণ পরিকল্পনা, নকশা তৈরি ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব মি. মল্লিককে দিতে চান।১৫৯ | সংবাদপত্র, রেডিও ও টেলিভিশনের মাধ্যমে নিরপরাধ বাঙালি জনসাধারণের ওপর। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনীর অমানুষিক অত্যাচারের কাহিনী মি. মল্লিকের জানা ছিল। নিপীড়িত জনসাধারণের দুর্দশার চিত্র তাকে অভিভূত করেছিল। তিনি ভাবলেন, মি. স্টোনহাউসের প্রস্তাব গ্রহণ করলে পূর্ববঙ্গের বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাধ্যমত সাহায্যদানের সুযােগ তিনি পাবেন। মি. স্টোনহাউসের প্রস্তাবে সম্মতি জানিয়ে তিনি অবিলম্বে তার পরিকল্পনা পেশ করার প্রতিশ্রুতি দেন। | কয়েক দিন পর মি. মল্লিক নিচে উল্লিখিত প্রস্তাবগুলাে পেশ করেন : ক. দৈনন্দিন ডাক-ব্যবস্থার প্রয়ােজনে বিভিন্ন মূল্যের আটটি ডাকটিকেট প্রচলন করা হবে, খ, ডাকটিকেটগুলাের মূল্য এক পাউন্ড রাখা হলে উৎসাহী ডাকটিকেট সংগ্রহকারীদের পক্ষে তা সংগ্রহ করা সহজসাধ্য হবে, গ, প্রথম দিনের খামের (First Day Cover) ওপর। ৮টি ডাকটিকেটের একটি ‘সেট’ মানানসই হবে, ঘ, বলিষ্ঠ গ্রাফিক-চিত্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের কাহিনী ও বিদ্যমান পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করতে হবে, ও, ডাকটিকেটের ওপর অঙ্কিত প্রতিকৃতির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি সম্ভাবনাপূর্ণ প্রগতিশীল দেশ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে, চ, ডাকটিকেটগুলােকে আকর্ষণীয় এবং বাংলাদেশের সংগ্রামের মর্মবাণী প্রচারের বাহক হিসেবে তুলনামূলকভাবে বড় আকারের ও রঙিন হতে হবে। মি. স্টোনহাউসের সঙ্গে দ্বিতীয়বার সাক্ষাৎকালে বাংলাদেশের বিশেষ প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে মি, মল্লিককে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। তারা উভয়ে মি, মল্লিকের প্রস্তাবগুলাে গ্রহণ করে তাকে ডাকটিকেটের নকশা তৈরি করার দায়িত্ব দেন। বিমান মল্লিক তখন কেন্টের ফোকস্টোন স্কুল অব আর্ট-এ প্রতি সপ্তাহে দু’দিন এবং এসেক্সের হারলাে টেকনিক্যাল কলেজে প্রতি সপ্তাহে তিন দিন হিসেবে অধ্যাপনায় নিয়ােজিত ছিলেন। এই উপলক্ষে তাকে প্রতি সপ্তাহে প্রায় চারশ’ মাইল যাতায়াত করতে। হতাে। কাজেই তিনি সন্ধ্যার পর এবং সপ্তাহের শেষ দিকে নকশা তৈরির কাজ করতেন।
ছ’ সপ্তাহের মধ্যে তিনি নকশা তৈরির কাজ শেষ করেন। সাধারণত তিনি একাধিক বিকল্প-নকশা তৈরি করেন। ১৯৬৯ সালে গান্ধী স্মারক ডাকটিকেটের জন্য তিনি ১৭টি বিকল্প-নকশা তৈরি করেছিলেন। সময়াভাবের ফলে বাংলাদেশ ডাকটিকেটের জন্য তিনি একাধিক বিকল্প-নকশা তৈরি করতে পারেন নি। শুধু ‘সাপাের্ট বাংলা দেশ’ (Support Bangla Desh) লেখা ডাকটিকেটখানির একটি মাত্র বিকল্প-নকশা তৈরি করেছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী ও মি. স্টোনহাউস নকশাগুলাের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন (পরবর্তীকালে বাংলা দেশ’ শব্দ দুটি এক শব্দ হিসেবে গৃহীত হয়)। | লন্ডনে এক সাক্ষাৎকারে শিল্পী বিমান মল্লিক বলেন, ডাকটিকেটগুলাের নকশা তৈরি করার সময় তিনি বিচারপতি চৌধুরী ও মি, স্টোনহাউসের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রক্ষা করেন। ডাকটিকেটে ব্যবহৃত বিভিন্ন তথ্য ও প্রতীক সম্পর্কে কোনাে লিখিত নির্দেশ না থাকায় তিনি নিজেই গবেষণার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। এই গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য কোনাে পারিশ্রমিক তিনি গ্রহণ করেন নি। শিল্পীর প্রাপ্য ‘রয়ালটি’ সম্পর্কে কোনাে চুক্তিপত্রেও তিনি স্বাক্ষর করেন নি। ব্রিটিশ দাতব্য প্রতিষ্ঠান ‘ওয়ার অন ওয়ান্ট’-এর (War on Want) চেয়ারম্যান ডােনাল্ড চেসওয়ার্থ (Donald Chesworth) প্রথম থেকেই বাংলাদেশ আন্দোলনের সক্রিয় সমর্থক ছিলেন। তিনি ডাকটিকেটগুলাের নকশা সঙ্গে নিয়ে মুজিবনগর সরকারের অনুমােদনের জন্য কলকাতায় যান। কয়েক দিনের মধ্যেই মন্ত্রিসভার অনুমােদন নিয়ে তিনি ফিরে আসেন। বাংলাদেশের ডাকটিকেটগুলাে ছাপানাের জন্য জন স্টোনহাউস দক্ষিণ লন্ডনের ফরম্যাট ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি প্রিন্টার্স লিমিটেড-এর (Format International Security Printers Ltd.) সঙ্গে যােগাযােগ করেন। তারা অত্যন্ত যত্নের সঙ্গে ছাপার কাজ সম্পন্ন করে। ২৬ জুলাই (১৯৭১) হাউস অব কমন্সের হারকোর্ট রুমে (Harcourt Room) অনুষ্ঠিত এক আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলনে বিচারপতি চৌধুরী ঐতিহাসিক ডাকটিকেটগুলাে এবং ফাস্ট ডে কভার প্রদর্শন করেন।
পরদিন (২৭ জুলাই) লন্ডনের ‘দি টাইমস’, ‘দি গার্ডিয়ান’, ‘দি ডেইলি টেলিগ্রাফ’, “ডেইলি মিরর ও ‘দি মর্নিং স্টার’সহ বিভিন্ন পত্রিকায় ডাকটিকেটগুলাের ফ্যাক্সিমিলি’সহ সংবাদ প্রকাশিত হয়।১৬০ পরবর্তীকালে বিচারপতি চৌধুরী তার স্মৃতিচারণমূলক বইতে বলেন, এই ডাকটিকেট। প্রকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল। এর ফলে ‘মুজিবনগর সরকার বাংলাদেশ রাষ্ট্র। পরিচালনা করছে, এই ধারণা বিদেশে সমর্থন লাভ করে। বাংলাদেশের ডাকটিকেটের একটিতে বাংলাদেশের মানচিত্র ছিল, অন্যটিতে ছিল ব্যালটক্স। ব্যালটবয় গণতন্ত্রের প্রতীক। আরেকটিতে শিকল ভাঙার ছবি। এর দ্বারা বলা হয়েছে, বাংলাদেশ পাকিস্তানের পরাধীনতা থেকে মুক্ত হয়েছে। একটি টিকেটে ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতি। আরেকটি ডাকটিকেটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে রক্তপাত দেখানাে হয়েছে। ডাকটিকেট প্রকাশনা অনুষ্ঠানে পার্লামেন্টের সকল দলের সদস্য উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে পিটার শাের (পরবর্তীকালে লর্ড শাের), জন স্টোনহাউস এবং আরাে কয়েকজন পার্লামেন্ট সদস্য বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করে বক্তৃতা করেন। বিচারপতি। চৌধুরী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে সমবেত পার্লামেন্ট সদস্য, সম্মানিত অতিথি ও সাংবাদিকবৃন্দকে ধন্যবাদ জানান। শিল্পী বিমান মল্লিক এই ডাকটিকেটগুলােতে যে চিন্তাশীলতার পরিচয় দিয়েছেন সেজন্য তাকে তিনি অভিনন্দন জানান। ২৯ জুলাই (১৯৭১) বাংলাদেশ ডাকটিকেট ও ‘ফার্স্ট ডে কভার বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল, ভারত, যুক্তরাজ্য, উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইজরায়েল, ইউরােপ, অস্ট্রেলিয়া ও দূরপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে আনুষ্ঠানিকভাবে প্রকাশ করা হয়। এই উপলক্ষে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের একটি কক্ষে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়ােজন করা হয়। অনুষ্ঠানকালে নতুন ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কভার নিলামে বিক্রয় করা হয়। আটটি ডাকটিকেট সংবলিত প্রথম ‘সেটও ‘ফার্স্ট ডে কভার’ বাংলাদেশের একজন ব্যবসায়ী দু’শ ত্রিশ পাউন্ড দিয়ে ক্রয় করেন। দু’শ বিশ পাউন্ড দিয়ে দ্বিতীয় সেট ও ফাস্ট ডে কভার ক্রয় করেন। মুক্তিযুদ্ধের আরেকজন বাঙালি সমর্থক। ফাস্ট ডে কভার’-এর ওপর ছিল বিচারপতি চৌধুরী, জন স্টোনহাউস ও বিমান মল্লিকের ‘অটোগ্রাফ’।
নিলাম পরিচালনায় বিচারপতি চৌধুরী অংশগ্রহণ করেন। প্রায় এক ঘণ্টা স্থায়ী অনুষ্ঠানের শেষে মি. স্টোনহাউস জানান, ডাকটিকেট ও ফাস্ট ডে কভার বিক্রয় করে কমপক্ষে এক হাজার পাউন্ড সংগৃহীত হয়েছে।১৬২ যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালি নেতৃবৃন্দ এই অনুষ্ঠানে যােগদান করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন গাউস খান, মিনহাজউদ্দিন, শেখ আবদুল মান্নান ও আজিজুল হক ভূঁইয়া। মি. স্টোনহাউসের অনুরােধ অনুযায়ী শিল্পী বিমান মল্লিক ডাকটিকেটগুলাের তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেন। আটটি ডাকটিকেট সংবলিত প্রতি ‘সেট’-এর মূল্য ছিল ২১ টাকা ৮০ পয়সা। তকালীন পাউন্ডের মূল্য ২০ টাকা হিসেবে ব্রিটিশ মুদ্রায় ডাকটিকেটগুলাের মূল্য ছিল ১ পাউন্ড ৯ পেনি। আলাদাভাবে ডাকটিকেটগুলাের মূল্য এবং নকশা ও রঙের বিবরণ নিচে উল্লেখ করা হলাে : | ক, বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত দশ পয়সা মূল্যের টিকেটে নীল, টকটকে লাল ও বেগুনি-লাল রঙ, খ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে হত্যাকাণ্ড শীর্ষক ২০ পয়সা মূল্যের টিকেটে হলুদ, টকটকে লাল ও গাঢ় সবুজ রঙ, গ, সাড়ে সাত কোটি বাঙালি জাতি শীর্ষক ৫০ পয়সার টিকেটে কমলা, হালকা বাদামি ও ধূসর রঙ, ঘ, বাংলাদেশের মানচিত্রসহ জাতীয় পতাকা সংবলিত এক টাকার টিকেটে হলদে, টকটকে লাল ও সবুজ রঙ, ও, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বাংলাদেশের পক্ষে শতকরা ৯৮ ভাগ ভােট প্রদান শীর্ষক দু টাকার টিকেটে নীল, গাঢ় নীল ও ম্যাজেন্টা রঙ, চ, ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘােষণাসহ শিকল। ভাঙার চিত্র সংবলিত তিন টাকার টিকেটে সবুজ, গাঢ় সবুজ ও নীল রঙ, ছ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ফটো সংবলিত পাঁচ টাকার টিকেটে সােনালিসদৃশ, কমলা, গাঢ় বাদামি ও হাফ-টো কালাে রঙ এবং জ, বাংলাদেশকে সমর্থন করুন শীর্ষক ১০ টাকার টিকেটে। সােনালিসদৃশ, ম্যাজেন্টা ও গাঢ় নীল রঙ ব্যবহার করা হয়। ডাকটিকেটগুলােতে। বাংলাদেশ’ শব্দটি ইংরেজি ও বাংলায় দুটি পৃথক শব্দ হিসেবে লেখা হয়েছিল। বাংলাদেশ ডাকটিকেট বিক্রয়ের জন্য বাংলাদেশ ফিলাটেলিক এজেন্সি (Bangladesh Philatelic Agency) নামের একটি ব্রিটিশ প্রতিষ্ঠানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। এই প্রতিষ্ঠানটি বাংলাদেশ ডাকটিকেট ও ফাস্ট ডে কভার’ বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিলাটেলিস্টদের কাছে পৌঁছে দেয়।
২৯ জুলাই মুজিবনগর সরকারও কলকাতায় ডাকটিকেট ও ‘ফাস্ট ডে কভার প্রকাশনা অনুষ্ঠানের আয়ােজন করে। ১ আগস্ট কলকাতার দৈনিক যুগান্তর পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয় : প্রথম প্রকাশিত বাংলাদেশের ডাকটিকেট ও ফার্স্ট ডে কভার কেনার জন্য আবার (অর্থাৎ ৩০ জুলাই) শত শত ক্রেতা বাংলাদেশ মিশনের ফটকে গিয়ে ভীড় করে।’ ১ আগস্ট দৈনিক ‘অমৃতবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়, বাংলাদেশের ডাকটিকেটগুলাের বিপুল চাহিদা মেটানাের জন্য সেদিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন (রােববার) হওয়া সত্ত্বেও স্থানীয় বাংলাদেশ মিশনের ডাকটিকেট কাউন্টার’ সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত খােলা রাখার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে। বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলে মুজিবনগর সরকার পরিচালিত ‘ফিল্ড পােস্টঅফিস থেকেও বাংলাদেশ ডাকটিকেট এবং ‘ফাস্ট ডে কভার বিক্রয় করা হয়। একটি ফিল্ড পােস্টঅফিস’ পাহারারত তিনজন মুক্তিযােদ্ধার ছবি পরবর্তীকালে লন্ডনের ‘মর্নিংস্টার’ পত্রিকায় ছাপা হয়। জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে আবুল হাসান মাহমুদ আলী বাংলাদেশ ডাকটিকেট এবং ‘ফার্স্ট ডে কভার যুক্তরাষ্ট্রে উপস্থাপন ও প্রচারের ব্যবস্থা করার জন্য মুজিবনগর সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তর থেকে এক জরুরি নির্দেশ পান। ১৯৭১ সালে মি. মাহমুদ আলী। নিউইয়র্কে পাকিস্তান কনসুলেট-জেনারেলের অফিসে ভাইস-কন্সল পদে নিয়ােজিত ছিলেন। ২৬ এপ্রিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি। পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। মে মাসে মুজিবনগর সরকার তাঁকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে তাদের প্রতিনিধি পদে নিয়ােগ করে। | সদ্য প্রকাশিত ডাকটিকেটগুলাের একটি ‘সেট’ সঙ্গে নিয়ে মি. মাহমুদ আলী। জাতিসংঘের সদর দপ্তরে নিয়ােজিত ‘নিউইয়র্ক টাইমস্ -এর সংবাদদাতা ক্যাথলিন টেন্টসের (Ms. Kathleen Teltsch) সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। তার ডাকনাম ছিল কিটি। মি. মাহমুদ আলী জানতেন, তাঁর দশ বছর বয়সী একটি পুত্র-সন্তান ছিল। ডাকটিকেটের ‘সেটটি তার হাতে দিয়ে মি. মাহমুদ আলী বললেন, ‘কিটি, স্বাধীন বাংলাদেশের এই নতুন ডাকটিকেটগুলাে তােমার ছেলের জন্য এনেছি।’ কিটি ডাকটিকেটগুলাে দেখে খুশি হয়ে বললেন, এ সম্পর্কে প্রচারণার ব্যাপারে তিনি সাহায্য করবেন। রবিবাসরীয় নিউইয়র্ক
টাইমসের ডাকটিকেট বিভাগের সম্পাদককে তিনি মি, মাহমুদ আলীর সঙ্গে পরিচয় করিয়ে | দেন। অতঃপর তিনজনে মিলে আলােচনা করে নিম্নে উল্লিখিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন : ১. মি. মাহমুদ আলী নিউইয়র্ক টাইমসের দক্ষিণ এশিয়ায় নিয়ােজিত সংবাদদাতা সিডনি শানবার্গের (Sydney Schanberg) সঙ্গে যােগাযােগ করে মুজিবনগর’ এবং বাংলাদেশের – মুক্তাঞ্চলে নতুন ডাকটিকেট প্রকাশ সম্পর্কিত সংবাদ সংগ্রহ করে পাঠাবার জন্য অনুরােধ করবেন, ২. ব্রিটিশ পার্লামেন্টে বাংলাদেশ ডাকটিকেটের প্রকাশনা অনুষ্ঠানের সংবাদ পাঠাবেন নিউইয়র্ক টাইমসের লন্ডন সংবাদদাতা এবং ৩, সর্বশেষে ডাকটিকেট বিভাগের – সম্পাদক রবিবাসরীয় সংখ্যায় বাংলাদেশ ডাকটিকেট সম্পর্কে আলােচনা ও মতামত প্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করবেন। উল্লিখিত পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগৃহীত বিভিন্ন সংবাদ এবং ডেভিড লিড়ম্যানের (David Lidman) প্রতিবেদন ১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট নিউইয়র্ক টাইমসের রবিবাসরীয় সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য সংবাদপত্রেও বাংলাদেশ ডাকটিকেট সম্পর্কিত সংবাদ প্রকাশিত হয়। ওয়াশিংটনের ‘ইভিনিং স্টার পত্রিকার সংবাদদাতা হেনরি ব্র্যাড়শ (Henry Bradshaw) প্রদত্ত সংবাদ ২৭ জুলাই প্রকাশিত হয়। এই সঙ্গে ৮টি ডাকটিকেটের ফ্যাক্সিমিলিও ছাপানাে হয়। তাছাড়া বহুল প্রচারিত মার্কিন সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নিউজউইক’-এর ৯ আগস্ট সংখ্যায় ‘রিবেল স্ট্যাম্প’ (Rebel Stamp) শিরােনাম দিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। | মি. স্টোনহাউস তার স্মৃতিচারণমূলক বইতে বলেন, বাংলাদেশ ডাকটিকেট এবং ‘ফার্স্ট ডে কভারগুলাে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের ফিলাটেলিস্ট, সরকার ও সংবাদপত্রের দপ্তরে পৌঁছানাের ফলে এক বিপুল আলােড়ন সৃষ্টি হয়। ইন্টারন্যাশনাল পােস্টাল ইউনিয়নের সদর দপ্তরে পেশ করা এক অভিযােগে পাকিস্তান দাবি করে, ডাকটিকেটগুলাে বেআইনি বলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পাওয়ার যােগ্য নয়। কিন্তু মুক্তাঞ্চল থেকে বাংলাদেশ ডাকটিকেট সংবলিত চিঠি বিদেশের বিভিন্ন ঠিকানায় পাঠানাের প্রমাণ হাজির করে মুজিবনগর সরকার পাকিস্তানের অভিযােগ উপেক্ষা করে। বাংলাদেশের ডাকটিকেট ব্যবহার করে মুক্তাঞ্চল থেকে পাঠানাে বহু চিঠিপত্র বিদেশে বিলি করা হয়। আন্তর্জাতিক বিমান ডাকযােগে মি. স্টোনহাউসের নামে পাঠানাে চিঠি হাউস অব কমন্সের নিজস্ব পােস্ট অফিসের সিলমােহরাঙ্কিত হয়ে তার হাতে পৌঁছায়।
| বিজয় দিবসের ৪ দিন পর (২০ ডিসেম্বর, ১৯৭১) দশ পয়সা, পাঁচ টাকা ও দশ টাকা মূল্যের ডাকটিকেটগুলাের ওপর ‘Bangla Desh Liberated’ ও বাংলা দেশের মুক্তি শব্দগুলাে ছাপিয়ে বাজারে ছাড়া হয়।৬৫ | উল্লিখিত পত্রিকার একই সংখ্যায় বলা হয়, ১ ফেব্রুয়ারি (১৯৭২) বাংলাদেশ ডাকটিকেটের দ্বিতীয় সিরিজে মােট ১৫টি টিকেট বাজারে ছাড়া হয়। এই টিকেটগুলাের মূল্য ছিল যথাক্রমে ১ পয়সা, ২ পয়সা, ৩ পয়সা, ৫ পয়সা, ৭ পয়সা, ১০ পয়সা, ১৫ পয়সা, ২০ পয়সা, ২৫ পয়সা, ৪০ পয়সা, ৫০ পয়সা, ৭৫ পয়সা, ১ টাকা, ২ টাকা ও ৫ টাকা। বিমান মল্লিকের আঁকা প্রথম সিরিজের ৮টি ডিজাইনের তিনটি (১০ পয়সা, ২০। পয়সা ও ৫০ পয়সা) দ্বিতীয় সিরিজের ১৫টি টিকেট ব্যবহার করা হয়। তাঁর মূল। ডিজাইনগুলােতে বাংলা দেশ’ কথাটি দুটি শব্দে বিভক্ত ছিল। দ্বিতীয় সিরিজের টিকেটে বাংলাদেশ এক শব্দ হিসেবে দেখানাে হয়। অতএব, ভিন্ন অক্ষর বিন্যাসের প্রয়ােজন হয়। অক্ষর বিন্যাস এবং এই অংশে রঙের ব্যবহার ছিল ত্রুটিপূর্ণ। বিমান মল্লিক বলেন, এ সম্পর্কে তিনি কিছুই জানেন না। কেউ তার অনুমতিও গ্রহণ করেন নি। তার শিল্পকর্মকে এভাবে বিকৃত করার জন্য তিনি অত্যন্ত মনােক্ষুন্ন হন। ১৯৭২ সালের ২৩ মার্চ বাংলাদেশ অবজারভার’-এ প্রকাশিত এক পত্রে কলকাতা থেকে এস কে চৌধুরী ১৯৭১ সালের জুলাই মাসে প্রকাশিত প্রথম সিরিজের ডাকটিকেটগুলাের প্রশংসা করে বলেন, দ্বিতীয় সিরিজের ডাকটিকেটগুলাের ডিজাইন ত্রুটিপূর্ণ এবং রঙ নির্বাচনে সৌন্দর্যবােধের অভাব পীড়াদায়ক। তাছাড়া ইংরেজি ও বাংলা অক্ষরগুলাে অবিন্যস্ত বলে তিনি অভিমত প্রকাশ করেন। পত্রলেখক আরও বলেন, পরবর্তীকালে বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত ২০ পয়সা মূল্যের শহীদ স্মরণে’ শীর্ষক ডাকটিকেটটির নকশা দেখে তিনি সবচেয়ে বেশি হতাশ হয়েছেন।৬৬
লন্ডনের স্ট্যাম্প কালেক্টিং’ (Stamp Collecting) পত্রিকার ২৭ জুলাই (১৯৭২) সংখ্যায় ডাকটিকেট সম্পর্কিত ভারতীয় পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ উল্লেখ করে বলা হয়, বাংলাদেশ পােস্ট অফিসের ডাইরেক্টর-জেনারেল এ এম আহসানউল্লাহ এবং পােস্টমাস্টার জেনারেল ফরিদউদ্দিন আহমেদ বাংলাদেশ ডাকটিকেটের দ্বিতীয় সিরিজের দায়দায়িত্ব গ্রহণ করতে অস্বীকার করেছেন। তাঁরা বলেন, ডাকটিকেটের নকশা সম্পর্কে ঢাকায় অধিষ্ঠিত সরকারের অনুমােদন গ্রহণ না করেই ডাকটিকেটগুলাে ছাপিয়ে বিশ্বের বাজারে ছড়িয়ে দেয়া হয়। যুক্তরাজ্যের বৃহত্তম ডাকটিকেট সংগ্রহকারী ও বিক্রেতা স্টানলি গিবন্-এর (Stanely Gibbone) পক্ষ থেকে বলা হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকাশিত ডাকটিকেটের দ্বিতীয় সিরিজ বাংলাদেশ সরকারের কাছে গ্রহণযােগ্য নয় বলে ডাকটিকেট হিসেবে তা মূল্যহীন। | বিতর্কিত ডাকটিকেটগুলাের প্রকাশক বাংলাদেশ ফিলাটেলিক এজেন্সির পক্ষ থেকে প্রচারিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, ১৯৭১ সালের ২০ ডিসেম্বর প্রথম সিরিজের তিনটি টিকেটের ওপর ‘Bangla Desh Liberated’ এবং বাংলা দেশের মুক্তি’ ছাপানাের পর বাংলাদেশের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ১৫টি টিকেট সংবলিত দ্বিতীয় সিরিজ ছাপানাের লিখিত অনুমতি দেন। ডিসেম্বর মাসের শেষের দিকে তৎকালীন পােস্ট মাস্টার জেনারেল এ, আকন (A. Akon) নির্দিষ্টসংখ্যক টিকেট ছাপানাের লিখিত নির্দেশ দেন। পরবর্তী ফেব্রুয়ারি মাসে টিকেটগুলাে ঢাকায় সরবরাহ করা হয়। ইতােমধ্যে ঢাকায় বিবিধ রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে মি. আকনকে সরিয়ে দিয়ে নতুন ডাইরেক্টর-জেনারেল নিয়ােগ করা হয়। স্বাধীনতা অর্জনের কয়েক সপ্তাহের মধ্যে কোনাে কোনাে ডাকটিকেটের নকশা সম্পর্কে দ্বিমত দেখা দেয়। বাংলাদেশের মানচিত্র সংবলিত ডাকটিকেটটি ছিল এর মধ্যে অন্যতম। ইতােমধ্যে বাংলাদেশের পতাকার জন্য নতুন নকশা গৃহীত হয়। তাছাড়া নতুন রাষ্ট্রের ডাকটিকেটে স্বাধীনতা অর্জনের পরবর্তীকালে আঁকা বিভিন্ন নকশা এবং জাতীয় জীবনের বহু গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার স্মারক অথবা প্রতীক ব্যবহারের যৌক্তিকতা সম্পর্কেও আলাপ-আলােচনা অব্যাহত ছিল। এসব কারণে দ্বিতীয় সিরিজের টিকেটগুলাে ব্যবহার না করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
লন্ডন, ২০ ডিসেম্বর, ১৯৯৯
পাকিস্তান সমর্থক ও মাওপন্থী বাঙালি
যুক্তরাজ্য-প্রবাসী বাঙালিরা প্রায় সবাই বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামকে সমর্থন করেন। এদের মধ্যে অনেকেই বাংলাদেশ আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। কিছুসংখ্যক বাঙালি দ্বিধা-দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠতে পারেন নি বলে নিষ্ক্রিয় ছিলেন। খুব অল্পসংখ্যক বাঙালি প্রকাশ্যে পাকিস্তানকে সমর্থন করেন। এদের সংখ্যা দু’ডজনের বেশি হবে না বলে স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নান মনে করেন। বাঙালি হয়েও ব্যারিস্টার আব্বাস আলী, আজহার আলী, আফজল হামিদ, আবদুল হক, আবুল হায়াত এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তান সরকারের সাথে পুরােপুরি সহায়তা এবং প্রকাশ্যে বাংলাদেশ আন্দোলনের বিরােধিতা করেছেন। মাওপন্থী বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করেন নি। তাঁরা বিচারপতি চৌধুরীর নেতৃত্বে পরিচালিত আন্দোলনে অংশগ্রহণ না করে নিজেদের আদর্শ অনুযায়ী। কর্মপন্থা নির্ধারণ করে পৃথকভাবে আন্দোলন করেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী তার স্মৃতিকথায় বলেন : “সেই দিন (১ মে, ১৯৭১) অপরাহে বামপন্থী বাঙালিদের একটি সভা কনওয়ে হলে অনুষ্ঠিত হয়। তারা স্বাধীনতার বিরুদ্ধে একটি কথাও বলেন নি। তবে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতৃত্বে স্বাধীনতা। অর্জিত হলেও সর্বহারাদের কল্যাণ সাধিত হবে না বলে অভিমত ব্যক্ত করেছিলেন। শেখ। আবদুল মান্নান ও ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হােসেন সেই সভায় উপস্থিত ছিলেন। তাঁরা। সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় স্বাধীনতা অর্জন কর্তব্য বলে মন্তব্য করেন। | তৎকালীন বামপন্থী আন্দোলনের দুটি ধারার মধ্যে একটি মস্কোপন্থী এবং অন্যটি। চীনপন্থী হিসেবে পরিচিত ছিল। মস্কোপন্থীরা বঙ্গবন্ধুর ছ’দফার পক্ষে এবং চীনপন্থীরা । বিপক্ষে ছিলেন। ছ’ দফার সঙ্গে যারা একমত তাদের মধ্যে ছিলেন সাইদুর রহমান মিয়া, শ্যামাপ্রসাদ ঘােষ, নিখিলেশ চক্রবর্তী, ডা. সাইদুর রহমান ও হাবীবুর রহমান। ছ’দফার। যারা বিরােধিতা করেন তাদের মধ্যে ছিলেন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ, ব্যারিস্টার লুৎফর রহমান। শাজাহান, জগলুল হােসেন এবং আরাে অনেকে।
১৯৭১ সালের ২৯ মার্চ গাউস খানের নেতৃত্বে কাউন্সিল ফর দি পিপল’স রিপাবলিক অব বাংলাদেশ ইন ইউ কে গঠিত হওয়ার পর ২২ নম্বর উইন্ডমিল স্ট্রিটে অনুষ্ঠিত এক। সাংবাদিক সম্মেলনে উল্লিখিত সংগঠনের নেতৃবৃন্দকে পরিচয় করিয়ে দেয়া হয়। একটি বামপন্থী পত্রিকার সংবাদদাতা জানতে চান, উপস্থিত নেতৃবৃন্দের মধ্যে কেউ কমিউনিস্ট বা মার্কসীয় মতবাদে বিশ্বাস করেন কিনা। তখন জিয়াউদ্দিন মাহমুদ হাত উচু করে বলেন, তিনি মার্কসিস্ট-লেনিনিস্ট এবং মাও সে-তুং-এর চিন্তাধারার প্রতি আস্থাশীল। এই উপলক্ষে প্রদত্ত বক্তব্যে তিনি দীর্ঘস্থায়ী গেরিলাযুদ্ধের মাধ্যমে কীভাবে দেশের মুক্তি আসবে তা ব্যাখ্যা করে বলেন, সেই মুক্তি হবে আসল মুক্তি, অন্যের ওপর নির্ভরশীল মুক্তি নয়। সম্প্রসারণবাদী’ ভারত এবং সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী’ রাশিয়ার সেখানে কোনাে প্রভাব থাকবে না। আমরা সম্পূর্ণ মুক্ত হবাে। | ২৪ এপ্রিল স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হওয়ার পর লন্ডনের রেড লায়ন স্কোয়ারে অবস্থিত কনওয়ে হলে জিয়াউদ্দিন মাহমুদ পরিচালিত একটি জনসভায় লন্ডন অ্যাকশন কমিটির সেক্রেটারি হিসেবে সাখাওয়াত হােসেন এবং স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে শেখ আবদুল মান্নান যােগদান করেন। জিয়াউদ্দিন তার বক্তৃতায় দাবি করেন, তিনি ঢাকা জেলে। তাজউদ্দিন আহমদের সঙ্গে একই সেলে বন্দি ছিলেন। তাজউদ্দিন সাহেবের তিনি ভূয়সী প্রশংসা করেন। কিন্তু বিচারপতি চৌধুরীকে তিনি চিত্রিত করেন একজন স্বামী ও সামন্ততান্ত্রিক মনােবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তি হিসেবে। বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনে তার নেতৃত্বের যােগ্যতা সম্পর্কেও জিয়াউদ্দিন প্রশ্ন করেন। জগলুল হােসেন, ব্যারিস্টার লুঙ্কর। রহমান শাজাহান এবং আরাে কয়েকজন বক্তৃতা করেন। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ। খােলাখুলিভাবেই নিজেদের নকশালপন্থী বলে দাবি করেন।১৬৯ বাঙালি হয়েও মুক্তিযুদ্ধকালে যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে কাজ করেছেন। তাদের মধ্যে আবুল হায়াতের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। তার দেশের বাড়ি বৃহত্তর সিলেট জেলায়। যুক্তরাজ্যে বসবাসকারী বাঙালিদের অধিকাংশ এই অঞ্চলে থেকে এসেছেন। তাদের মধ্যে তিনি বাংলাদেশ-বিরােধী প্রচারণা চালান। পাকিস্তান সরকার। মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী প্রচারণা চালাবার জন্য আবুল হায়াতের সম্পাদনায় মুক্তি নামের একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশের ব্যবস্থা করে।
১৯৭১ সালের ১৫ আগস্ট লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপনের অজুহাতে বঙ্গবন্ধু ও বাংলাদেশ-বিরােধী এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন আবুল হায়াত। ১৬ আগস্ট ‘দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় প্রকাশিত এক রিপাের্টে বলা হয়, দু’সপ্তাহ আগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে বাংলাদেশ সমর্থক। বাঙালিদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত গণসমাবেশের জবাব হিসেবে ‘পাকিস্তান সলিডারিটি ফ্রন্ট এই সমাবেশের আয়ােজন করে। এপ্রিল মাসে আবুল হায়াতের নেতৃত্বে বার্মিংহামে প্রতিষ্ঠানটি জন্মলাভ করে। পূর্ববঙ্গে গণহত্যা সংঘটনের অভিযােগ অস্বীকার করে পাকিস্তান হাই কমিশন প্রকাশিত একটি প্রচারপত্র এই সমাবেশে বিলি করা হয়। ১৯ আগস্ট “দি গার্ডিয়ান’-এ প্রকাশিত এক চিঠিতে এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের – অধ্যাপক জি কিয়ারনান বলেন, বহুসংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানি তাদের বর্বর সরকার এবং পূর্ববঙ্গে তাদের সামরিক বাহিনী সংঘটিত পাশবিক অত্যাচারের সমর্থনে ১৫ আগস্ট লন্ডনে যে সমাবেশের আয়ােজন করে, তার সংবাদ অবগত হয়ে তিনি অস্বস্তিবােধ করেন। এই সমাবেশ থেকে মনে হয়, অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই রাজনৈতিক দৃষ্টিহীনতা, গোঁড়ামি এবং নিন্দনীয় নেতৃত্বের মনােভাব সঙ্গে নিয়ে এসেছে। এসব তাদের নিজের দেশে রেখে আসা উচিত ছিল। ২৩ আগস্ট উল্লিখিত পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবাদপত্রে আবুল হায়াত নিজেকে পূর্ব পাকিস্তানি হিসেবে পরিচয় দিয়ে সমাবেশে অংশগ্রহণকারীদের অধিকাংশই পূর্ববঙ্গের নাগরিক বলে দাবি করেন।
যুক্তরাজ্যে গোঁড়া পাকিস্তানপন্থী বাঙালিদের মধ্যে নেতৃস্থানীয় ছিলেন ব্যারিস্টার আব্বাস আলী। তিনি ইংল্যান্ডে আইনের ছাত্র হিসেবে বিচারপতি চৌধুরীর সমসাময়িক ছিলেন। ভারত-বিভাগের আগে বিচারপতি চৌধুরী যখন এ দেশে আসেন, তার আগেই আব্বাস আলী আসেন। লন্ডন অবস্থানকালে তাকে দেখাশােনা করার অনুরােধ জানিয়ে বিচারপতি চৌধুরীর পিতা আব্বাস আলীকে চিঠি লেখেন। লন্ডনের ছাত্রজীবনে তার সৌজন্যের কথা স্মরণ করে বিচারপতি চৌধুরী আব্বাস আলীর কাছে ঋণী বােধ করেন। আব্বাস আলীর মৃত্যু পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করেন। সত্তরের দশকের শেষদিকে আব্বাস আলী গুরুতর অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ছিলেন। বিচারপতি চৌধুরী তাকে দেখতে যান। তিনি তখন মৃত্যুশয্যায়। আব্বাস আলী বিচারপতি চৌধুরীর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন এবং কথা বলতে রাজি হলেন না। বিচারপতি চৌধুরী আন্তরিক কণ্ঠে বিনয়ের সঙ্গে বলেন, আমি তােমাকে মুক্তিবাহিনীর প্রতিনিধি হিসেবে নয়, বন্ধু হিসেবে দেখা করতে এসেছি। তুমি অতীতে আমার সঙ্গে যে সৌজন্যমূলক ব্যবহার করেছ তার জন্য আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে এসেছি; কিন্তু আব্বাস আলী কোনাে কথা বললেন না। মৃত্যুর আগে আব্বাস আলী নির্দেশ রেখে যান, তাকে যেন পাকিস্তানে কবর দেয়া হয়। তার মৃত্যুর পর পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর কবরের পাশে যথারীতি মর্যাদার সঙ্গে তাকে কবর দেয়া হয়। জুলাই মাসের গােড়ার দিকে পাকিস্তান সরকারের উদ্যোগে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হুসাইন ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভারের রিডার ড, মােহর আলী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানাের জন্য লন্ডনে আসেন। ৭ জুলাই (১৯৭১) ‘দি টাইমস্ -এর চিঠিপত্র কলামে প্রকাশিত এক দীর্ঘ চিঠিতে তারা দাবি করেন, ২৫ মার্চ কিংবা তারপর চট্টগ্রাম কিংবা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনাে শিক্ষককে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী ইচ্ছাকৃতভাবে হত্যা করে নি। তাঁরা স্বীকার করেন, ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ইকবাল হল (বর্তমান সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) এবং জগন্নাথ হলের। আশপাশে সশস্ত্র সংঘর্ষের ফলে নয়জন শিক্ষক মারা যান। আওয়ামী লীগের স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী হল দুটি ও তার পার্শ্ববর্তী এলাকা সামরিক আক্রমণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার না করলে এই ‘দুঃখজনক ঘটনা এড়ানাে যেতাে বলে তারা দাবি করেন। দেশপ্রেমিক বাঙালিরা ইউরােপ, আমেরিকা ও যুক্তরাজ্যে সাজ্জাদ হুসাইন ও মােহর আলী পরিবেশিত নির্লজ্জ মিথ্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানিয়ে প্রকৃত সত্য তুলে ধরতে সক্ষম হন। ১৬ আগস্ট ‘দি টাইমস্ -এ প্রকাশিত এক চিঠিতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম হােসেন এবং বাংলার অধ্যাপক এম ইসলাম উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. সাজ্জাদ হুসাইন পাকিস্তানপ্রীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা সম্পর্কিত গুরুত্বপূর্ণ তথ্য হাজির করেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে মিথ্যা প্রচারণা চালানাের জন্য পাকিস্তানের সামরিক চক্র বেসরকারিভাবে যাদের বিদেশে পাঠায়, তাদের মধ্যে ছিলেন হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কন্যা বেগম আখতার সােলায়মান। তিনি তার স্বামী, এস এ সােলায়মানের সঙ্গে ২০ জুলাই লন্ডনে এসে হাজির হন। তাঁর বক্তব্য ছিল স্বাধীন ও সার্বভৌম পাকিস্তানে যে যুদ্ধের কথা বলা হচ্ছে তা গৃহযুদ্ধ এবং পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার। ঢাকায় গণহত্যা সম্পর্কে ভারতীয় প্রচার ভিত্তিহীন। | পূর্ববঙ্গে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সংঘটিত গণহত্যাকে সমর্থন করে বেগম সােলায়মান জুন মাসে একটি বিবৃতি দেন। এই বিবৃতিতে তিনি দাবি করেন, তাঁর পিতা বেঁচে থাকলে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করতেন। | লন্ডনে এসে বেগম সােলায়মান ও তার স্বামী প্রবাসী বাঙালিদের মধ্যে পাকিস্তান সমর্থক হিসেবে পরিচিত ব্যারিস্টার আব্বাস আলী, আজহার আলী, আফজাল হামিদ, আবদুল হক এবং আরাে কয়েকজনের সঙ্গে যােগাযােগ করেন। সাপ্তাহিক ‘মুক্তি পত্রিকার সম্পাদক আবুল হায়াত তাদের সঙ্গে ঘােরাফেরা করেন। কয়েকজন পাকিস্তান সমর্থক পার্লামেন্ট সদস্যদের সঙ্গেও তারা দেখা করেন। এঁদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান কাউন্সিলের চেয়ারম্যান বিগ ডেভিডসন এবং মিসেস জিল নাইট (পরবর্তীকালে ডেইম নাইট)। তবে বাঙালি মহলে বেগম সােলায়মান সুবিধা করতে পারেন নি। দেশপ্রেমিক বাঙালিরা তাকে _ আমল দেন নি। শিগগিরই বেগম সােলায়মান স্টিয়ারিং কমিটির ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক শেখ আবদুল মান্নানের সঙ্গে টেলিফোনে যােগাযােগ করেন। তিনি বলেন : “মান্নান ভাই, জেনােসাইড” (গণহত্যা) হয় নি, অফিসার হত্যা করা হয় নি, সব ভারতীয় প্রােপাগাণ্ডা। ‘বর্ডারে’ কিছুসংখ্যক রিফিউজি মরেছে; ওরা তাদের লাশ দেখিয়ে দিয়েছে। আর ইউনিভারসিটির ওখানে ওরা কয়েকজন ছাত্র মেরে তাদের ফটো বাইরের দুনিয়ায় পাঠিয়ে দিয়েছে।’ শেখ মান্নান বলেন ‘আপনি তাে অনেক কিছুই জানেন; নিহত অধ্যাপকদের নাম সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে; তারা কি তা হলে বেঁচে আছেন? আপনি কি তাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলেছেন। তারা জীবিত কি মৃত—সে সম্পর্কে খোঁজ নিয়েছেন? বেগম সােলায়মান বললেন : ‘আমি কি করে যাব?
শেখ মান্নান বলেন : আপনার জন্য তাে পূর্ব পাকিস্তানে যাওয়ার ব্যাপারে কোনাে বাধা নেই। গিয়ে নিজের চোখে দেখে আসুন। খোঁজখবর না নিয়ে এখানে এসে বিচারপতি চৌধুরীকে টেলিফোন করবেন না।’ | শেখ মান্নানের মুখে বেগম সােলায়মানের বক্তব্য শােনার পর বিচারপতি চৌধুরী শহীদ সােহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদের সঙ্গে যােগাযােগের প্রস্তাব করেন। স্ট্রাটফোর্ড-আপনএ্যাভনে অবস্থিত কাশ্মীর রেস্তোরার মালিক আরব আলীর সঙ্গে রাশেদ সােহরাওয়ার্দীর পরিচয় ছিল। রাশেদ তখন রয়াল সেক্সপিয়র থিয়েটার কোম্পানির সদস্য হিসেবে স্ট্রাটফোর্ডে থাকতেন। | অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে আরব আলী নিজের গাড়িতে করে রাশেদ সােহরাওয়ার্দীকে স্টিয়ারিং কমিটির অফিসে নিয়ে আসেন। বিচারপতি চৌধুরীর পরামর্শ অনুযায়ী রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বেগম সােলায়মানের বিবৃতির প্রতিবাদ জানাতে রাজি হন। এই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তিনি মুজিবনগর সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের কাছে একটি পত্র লেখেন। এই পত্রের বক্তব্য যথাসময়ে সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়। ৭ অক্টোবর লিখিত পত্রে রাশেদ সােহরাওয়ার্দী বলেন : ‘পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনীর উদ্যোগে গণহত্যা শুরু হওয়ার পর থেকে আমি বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানুভূতিশীল এবং তাদের মুক্তি সংগ্রামের দৃঢ় সমর্থক। রাজনীতিতে জড়িত না থাকায় আমি ব্যক্তিগতভাবে বিবৃতি দেয়ার প্রয়ােজন বােধ করি নি। আমাদের পরিবারের একজন সদস্য (বেগম সােলায়মান) তার বিবৃতির মাধ্যমে আমার প্রিয় পিতা হােসেন শহীদ সােহরাওয়াদরি ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করেছেন বলে বুঝতে পারার পর আমার বক্তব্য পেশ করা অবশ্যকর্তব্য বলে আমি মনে করি। ‘আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশের জনগণের বিজয় আমি কামনা করি। গত ২৪ বছর যাবৎ পশ্চিম পাকিস্তান তাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে শােষণ করে এবং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কর্তৃত্বাধীনে রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যবাহিনী গণহত্যা ও অন্যান্য জঘন্য অপরাধজনক কর্মকাণ্ড শুরু করার পর তারা (বাংলাদেশের জনগণ) অস্ত্র হাতে নিতে বাধ্য হয়েছে। | ‘মুক্তিবাহিনীর বীর যােদ্ধারা আক্রমণকারী সৈন্যদের উৎখাত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করবে, এ সম্বন্ধে আমি নিঃসন্দেহ। ‘আমি আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশে গিয়ে দেখবাে বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী এবং রাজনৈতিক দলের সমর্থকরা শান্তি ও সম্প্রীতিমূলক পরিবেশে জীবনযাপন করছে। ‘বাংলাদেশ সরকারকে আমি অভিনন্দন জানাচ্ছি। এই সরকারের সদস্যবৃন্দের সবাই আমার পিতার সহকর্মী এবং স্নেহের পাত্র ছিলেন।
বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধ-বিরােধী প্রচারণা চালানাের জন্য পাকিস্তান সরকার যাঁদের বিদেশে পাঠায় তাদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান অবজারভার -এর (পরবর্তীকালে ‘বাংলাদেশ অবজারভার) মালিক হামিদুল হক চৌধুরী এবং তৎকালীন গণতন্ত্রী দলের সেক্রেটারি জেনারেল মাহমুদ আলী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জুলফিকার আলী জুটো মাহমুদ আলীকে দালালির পুরস্কার হিসেবে মন্ত্রী পদে নিয়ােগ করেন। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হামিদুল হক চৌধুরী ইউরােপের কয়েকটি দেশ সফর করে লন্ডনে পেীছান। ইতােমধ্যে মাহমুদ আলীও লন্ডনে পৌঁছান। তারা উভয়ে বেজওয়াটার এলাকার ব্যয়বহুল রয়াল ল্যাঙ্কাস্টার হােটেলে ওঠেন। পাকিস্তান সরকার তাদের ব্যয়ভার বহন করে। তাদের ভাতাদান সম্পর্কিত দলিলের ফ্যাক্সিমিলি’ লন্ডনের সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকার ৫ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। | মি, চৌধুরী ও মি, আলী লন্ডনে মাত্র কয়েক দিন অবস্থান করেন। কয়েকটি বাঙালি রেস্তোরায় গিয়ে তারা ঘরােয়া আলাপ-আলােচনাকালে ভারতের তথাকথিত দুরভিসন্ধির কথা উল্লেখ করেন। তারা দাবি করেন, ১৯৪৭ সালে ভারত দেশ-বিভাগ মেনে নেয় নি। তাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে তারা আওয়ামী লীগকে সমর্থন করছে। ব্যারিস্টার আব্বাস আলী এবং আরাে কয়েকজন পাকিস্তানপন্থী তাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। ব্রিটিশ স্বরাষ্ট্র দপ্তর থেকে মি, চৌধুরী এবং মি. আলীকে বলা হয়, জনসভায় বক্তৃতাদান করার চেষ্টা করা হলে তাদের নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। তার ফলে তারা জনসভায় বক্তৃতাদানের পরিকল্পনা ত্যাগ করে আমেরিকায় চলে যান। হামিদুল হক চৌধুরী ও মাহমুদ আলী পূর্ববঙ্গে হত্যাযজ্ঞ সংঘটনের লক্ষ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নির্দেশে ও সহায়তায় গঠিত শান্তি কমিটিতে সক্রিয় ছিলেন।১৭৯
লন্ডন, ৩০ মে, ২০০০