You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

মুখোশের অন্তরালে জামাত

জামায়াতে ইসলামীর পরিচয়
জামায়াতে ইসলামী কেবল বাংলাদেশেই নয়, সমগ্র উপমহাদেশ জুড়ে একটি উগ্র সাম্প্রদায়িক, মৌলবাদী দল হিসেবে পরিচিত। এই দলের জন্ম ১৯৪১ সালে বৃটিশ ভারতে। ভারতে এই দলের পরিচয় বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির তল্পিবাহক হিসেবে। পাকিস্তানের জন্মলগ্নে এর পরিচয় ছিল পাকিস্তান বিরােধী এবং এখন এর পরিচয় প্রতিক্রিয়াশীল * সামরিক জান্তার সহযােগী হিসেবে। বাংলাদেশে এই দলটির পরিচয় মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা বিরােধী এবং ‘৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সহযােগী, খুনি আলবদর, রাজাকার, আলশামস-এর সংগঠক যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে। জামায়াত নিজেকে ইসলামের নিশান বরদার হিসেবে দাবি করে। এই দল পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মওদুদীবাদী এমন সব ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ উপস্থাপন করে, যা কেবল বিভ্রান্তিকরই নয়, প্রকৃত ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য তা চরম ক্ষতিকরও বটে। অতএব, জামায়াতের আসল পরিচয়, ধর্মের মুখােশধারী দলটির প্রকৃত স্বরূপ কি, তার উন্মােচন খুবই জরুরি। মওলানা মওদুদীর বাতিল ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। অন্যভাবে বলা যায়, পবিত্র ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে মওদুদী তার বাতিল ধ্যান-ধারণা প্রচারের মাধ্যমে কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই ১৯৪১ সালের ২৬ শে আগস্ট জামায়াতে ইসলামী গঠন করেন। মওদুদীকে মওলানা লিখা হলেও তার শিক্ষাগত যােগ্যতা কি, তিনি কখনাে প্রকাশ করেননি।
কোনাে প্রমাণও পাওয়া যায় না। তবে এতটুকু জানা যায়, প্রথম জীবনে তিনি। সংবাদপত্রের সাথে জড়িত ছিলেন। এক পর্যায়ে হায়দরাবাদে চলে যান। সেখানে নিজামের পৃষ্ঠপােষকতায় তরজমানুল কোরআন শীর্ষক একটি সাময়িকী বের করেন। এক পর্যায়ে তিনি বৃটিশভক্ত মুসলিম আমলাদের মাধ্যমে তৎকালীন ঔপনিবেশিক শাসকদের নজরে পড়েন। একজন অবসরপ্রাপ্ত এসডিওর তত্ত্বাবধানে তাকে পাঞ্জাবের পাঠানকোটে বসিয়ে দেয়া হয়। এখান থেকে তিনি তার জামায়াতে ইসলামী ও তরজমানুল কোরআন সাময়িকীটির মাধ্যমে বৃটিশের দালালী আরম্ভ করেন। তিনি তার বক্তৃতা, বিবৃতি ও লেখায় একদিকে কংগ্রেসকে, অপরদিকে মুসলিম লীগকে জঘন্য ভাষায় গালিগালাজ করতেন। এমনকি উপমহাদেশের আলেম সমাজও তার গালিগালাজ থেকে অব্যাহতি পায়নি। তিনি অবিভক্ত ভারতে বৃটিশদের দালালী করতে গিয়ে বলেছেন, “যদি ইংরেজদের সাথে আপনার শত্রুতা এজন্য যে, সে ইংরেজ, ছ’হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে, আপনার দেশের বাসিন্দা। নয়, তবে আপনার শত্রুতা ইসলামী শত্রুতা নয়-অজ্ঞতাপ্রসূত শক্রতা। (সিয়াসী কাশমকাশ-মওদুদী) এভাবে ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ পর্যন্ত মওলানা মওদুদী ও তার দল। জামায়াতে ইসলামী বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দালালী করতে থাকে। পাকিস্তান হওয়ার পর তিনি লাহােরে চলে আসেন। পাকিস্তান বিরােধী ভূমিকার জন্য মওদুদী ও তার জামায়াতে ইসলামী কঠোর সমালােচনার সম্মুখীন। মওদুদী তার অতীত ভূমিকা বেমালুম ভুলে যান। তিনি বলেন, জামায়াত মুসলমানদের জন্য পৃথক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র চায়নি। তা নয়। পাকিস্তান দাবি সমর্থন না করার কারণ ছিল, যদি মুসলিম লীগ ব্যর্থ হয়, জামায়াত মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় এগিয়ে আসবে। এজন্য জামায়াতকে সংরক্ষিত শক্তি (Reserve Force) হিসেবে রাখা। হয়েছিল। কী অদ্ভুত যুক্তি! বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীও তাদের গুরু মওলানা মওদুদীর সে নীতিই অনুসরণ করেছে। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতীদের ভূমিকা কারাে অজানা নয়। কিন্তু তারা এখন বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। যে দল মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেছে, যেসব বীর মুক্তিযােদ্ধা এদেশকে স্বাধীন করেছেন উল্টো তাদেরকেই জামায়াতীরা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের চেষ্টা করছে। পাকিস্তানে এসে মওলানা মওদুদী ও তার দল জামায়াতে ইসলামী। পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীদের পক্ষে অবস্থান গ্রহণ করে।
এজন্যই জামায়াতীরা মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার, আলবদর গঠন করে পাকিস্ত নী হানাদার বাহিনীর প্রতি সশস্ত্র সমর্থন জানায়। এক্ষেত্রেও তারা পবিত্র ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে অপপ্রচার করতে থাকে, পাকিস্তান না টিকলে এদেশে ইসলাম থাকবে না। ভারত এদেশ নিয়ে যাবে। তাদের বিরােধিতা সত্ত্বেও আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এদেশে ইসলাম আছে, থাকবে। ভারতও এদেশ নিয়ে যায়নি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যুদ্ধবন্দীদের তাদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী হত্যা কিংবা দাস-দাসীতে পরিণত করা হতাে। কাউকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হতাে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিতদেরকে কখনাে রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়নি। আর যারা বিনাযুদ্ধে মুসলমানদের সাথে সন্ধি স্থাপন করতাে, তাদের জিম্মি হিসেবে গণ্য করা হতাে। তাদেরকে জিযিয়া কর দিতে হতাে। বাংলাদেশে বর্তমানে জামায়াতসহ যারা পবিত্র ইসলামকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা পাক হানাদার বাহিনীকে সর্বোতভাবে সহযােগিতা করেছে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও জামায়াত, মুসলিম লীগ প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার লাভের কথা নয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পবিত্র ধর্মকে রাজনীতি ও শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী সাধারণ দালালরা বাংলাদেশে বাঁচার অধিকার লাভ করেছিল। রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযােগ পায়নি। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনীতি করা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়। বস্তুত এই সিদ্ধান্তে ইসলামের নীতি ও আদর্শই বাস্তবায়িত হয়েছিল। সত্যিকথা বলতে কি, যারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিরােধিতা করেছে, তারা সুযােগ পেলেই বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া কল্যাণ করবে না, করতে পারে না। তারা চাইবে একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধ। সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর এদেশে আবার পাকিস্তানী স্টাইলের রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়।
১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে। সামরিক সরকার একটি অধ্যাদেশ ঘােষণা করে। সামরিক সরকারের এই অধ্যাদেশ জারির পর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে পবিত্র ইসলামকে হাতিয়ার হিসেবে গ্রহণ করে। তারা মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে অপপ্রচার করতে থাকে, পাকিস্তান না টিকলে এদেশে ইসলাম থাকবে না। ভারত এদেশ নিয়ে যাবে। তাদের বিরােধিতা সত্ত্বেও আল্লাহর রহমতে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। এদেশে ইসলাম আছে, থাকবে। ভারতও এদেশ নিয়ে যায়নি। ইসলামের প্রাথমিক যুগে যুদ্ধবন্দীদের তাদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী হত্যা কিংবা দাস-দাসীতে পরিণত করা হতাে। কাউকে মুক্তিপণের বিনিময়ে ছেড়ে দেয়া হতাে। কিন্তু যুদ্ধে পরাজিতদেরকে কখনাে রাজনৈতিক অধিকার দেয়া হয়নি। আর যারা বিনাযুদ্ধে মুসলমানদের সাথে সন্ধি স্থাপন করতাে, তাদের জিম্মি হিসেবে গণ্য করা হতাে। তাদেরকে জিযিয়া কর দিতে হতাে। বাংলাদেশে বর্তমানে জামায়াতসহ যারা পবিত্র ইসলামকে রাজনীতির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা পাক হানাদার বাহিনীকে সর্বোতভাবে সহযােগিতা করেছে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও জামায়াত, মুসলিম লীগ প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার লাভের কথা নয়। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পবিত্র ধর্মকে রাজনীতি ও শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী সাধারণ দালালরা বাংলাদেশে বাঁচার অধিকার লাভ করেছিল। রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযােগ পায়নি। সাংবিধানিকভাবে তাদের রাজনীতি করা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ গ্রহণ নিষিদ্ধ করা হয়।
বস্তুত এই সিদ্ধান্তে ইসলামের নীতি ও আদর্শই বাস্তবায়িত হয়েছিল। সত্যিকথা বলতে কি, যারা বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে বিরােধিতা করেছে, তারা সুযােগ পেলেই বাংলাদেশের ক্ষতি ছাড়া কল্যাণ করবে না, করতে পারে না। তারা চাইবে একাত্তরে পরাজয়ের প্রতিশােধ নিতে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধ। সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর এদেশে আবার পাকিস্তানী স্টাইলের রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে। সামরিক সরকার একটি অধ্যাদেশ ঘােষণা করে। সামরিক সরকারের এই অধ্যাদেশ জারির পর লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত রাজাকার আল-বদর ও অন্যান্য দালালরা বেরিয়ে আসে কারাগার থেকে। হাজার হাজার রাজাকার আল-বদর সগর্বে বিচরণ করতে থাকে স্বাধীন বাংলার শহর-বন্দর ও গ্রামে-গঞ্জে । এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযােদ্ধাদের পিতামাতা, বিধবা স্ত্রী ও সন্তানদের নিভৃতে অশ্রুপাত ছাড়া কিছুই করার ছিলাে না। কিন্তু এসব ঘটনার মূল নায়ক সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমান তাঁর সহযােদ্ধাদের রক্তদানের কথা একটি বারও স্মরণ করেননি। দালাল হত্যাকারীদের ছেড়ে দিলে শহীদ পরিবারগুলাের মনের কি প্রতিক্রিয়া হবে, তিনি তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি। আসলে তখন তাঁর এসব ভাবার সময়ও ছিলাে না। তিনি তখন দালালদের নিয়ে দল করে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারটি দখল করার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলেন। যার জন্য শাহ আজিজ, আবদুল আলিমের মতাে লােকদের স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় নিতেও তাঁর এতটুকু বাধেনি। সে যাই হােক, ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘােষিত হয়। এই সুযােগে স্বাধীনতা বিরােধী দলগুলােও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বাংলাদেশে রাজনীতি করার সুযােগ লাভ করে। ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই গােলাম আযম পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে। পাকিস্তানী পাসপাের্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তিনি অসুস্থ মাকে দেখার জন্য তিন মাসের ভিসা নিয়ে ঢাকায় আসেন। মুক্তিযােদ্ধা জিয়ার সরকারই গােলাম আযমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি প্রদান করে। ১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ঢাকায় জামায়াতে ইসলামীর বাংলাদেশে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। গােলাম আযমকে গােপনে আমীর নির্বাচিত করা হয় নাগরিকত্ব লাভ সাপেক্ষে। প্রকাশ্যে আব্বাস আলী খানকে অস্থায়ী আমীর এবং মওলানা ইউসুফকে সেক্রেটারী জেনারেল নির্বাচিত করা হয়।
১৯৯২ সালে বিএনপি সরকারের আমলে গােলাম আযম জামায়াতের আমীর হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। পাকিস্তানী নাগরিক জামায়াতের আমীর হওয়ায় সারাদেশে আন্দোলনের ঝড় ওঠে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে আমরা যারা আন্দোলনের পুরােভাগে ছিলাম, বিএনপি সরকার আমাদের ২৪ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার মামলা করে। গােলাম আযমকে নাগরিকত্ব দেয়া হয়। দু’হাজার সালের নভেম্বর মাসে তিনি জামায়াতের আমীরের পদ থেকে সরে দাঁড়ান। মতিউর রহমান নিযামীকে বর্তমানে আমীর করা হয়েছে। জামায়াতের বিগত ৬৩ বছরের রাজনীতির প্রতি তাকালে দেখা যায় পবিত্র ধর্মের নামে কায়েমী স্বার্থ রক্ষায় এই দলটি শঠতা, সুবিধাবাদ এবং অন্তর্ঘাতমূলক নাশকতার নীতি কোনাে সময়ই হাতছাড়া করেনি। অবশ্য ধ্বংসাত্মক উদ্দেশ্যে তারা কোনাে কোনাে সময় জনগণের অধিকারের দাবি কেন্দ্র করে আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিনয়ও করেছে। কিন্তু অপ্রিয় হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলাে জামায়াতের এই ধূর্ততা উপলব্ধি করেনি। তবে হালে তারা অনেকটা উপলব্ধি করেছে। কিন্তু ইতিমধ্যে পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। জামায়াত এখন পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত। বিগত নির্বাচনের পর বিএনপি তাে পাকিস্তান আলবদর বাহিনীর প্রধান মওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও তার সহযােগী আলী আহসান মােঃ মুজাহিদকেও মন্ত্রী পরিষদে গ্রহণ করেছে। ইতিহাসের কি নির্মম পরিণতি!

গণতন্ত্র ও জামায়াত
জামায়াতে ইসলামী বর্তমানে বেশ বড় গলায় গণতন্ত্রের কথা বলছে। এক কথায় বলতে হয় তারা গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেজেছে। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবানমাত্র অন্তত তাদের এ ভূমিকার নিন্দা করবেন না। কিন্তু জামায়াত কবে থেকে গণতন্ত্রের ভক্তে পরিণত হলাে, এটাই হলাে ভাববার বিষয়। ১৯৫৫ সালের প্রথমার্ধে মওলানা মওদুদীর মধ্যে একটা পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। এ সময় তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের চিন্তাধারা থেকে অনেকটা সরে পড়েন এতদিন যে গণতন্ত্রকে তিনি তাঁর বিশেষ ইসলামের দৃষ্টিতে অবাস্তব, অবৈধ, অভিশপ্ত ইত্যাকার বলেছেন, এ সময় সে গণতন্ত্রকে তিনি বৈধ, ইসলামের সারমর্ম, সমগ্র জাতির। অনুসরণীয় বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে আরম্ভ করেন। এ সময় থেকে তিনি গণতন্ত্রের চরম ভক্তে পরিণত হন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এ সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন সেগুলাে বেমালুম ভুলে যান তিনি তাঁর বিশেষ প্রকাশভঙ্গিতে গণতন্ত্রের মাহাত্ম প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। ১৯৫৫ সালে তরজমানুল কোরআনের আগস্ট সংখ্যায় গণতন্ত্র সম্পর্কে। আলােচনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী লিখেছেন, “দ্বিতীয় ভিত্তি, যার উপর একমত হওয়া যায় তা হলাে ‘গণতন্ত্র। কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্ম। এবং দেশের অধিবাসীদের ইচ্ছাও তাই। এর সরল অর্থ এই যে, দেশ। কোনাে বিশেষ শ্রেণী বা গােষ্ঠির নয়। বরং এদেশে যারা বসবাস করছে। তাদের সবার। সুতরাং এর ব্যবস্থাপনা তাদের সবার কিংবা ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী চলতে হবে। তাদের নীতিগতভাবে এই অধিকার ও কার্যত এ সুযােগ থাকতে হবে যে, নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী। শাসক নির্বাচন ও পরিবর্তন করতে পারবে।” মওলানা মওদুদী উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে গণতন্ত্রের কল্যাণকর দিকগুলাের যে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ইসলামের সাথে এর সাযুজ্যতার যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু তাঁর এ গণতন্ত্রপ্রিয়তা বেশিদিনের নয়। ১৯৩৩ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৯৫৩ সালে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মওলানা তাঁর লেখনী ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরােধিতা করে এসেছেন।
ইসলাম ও গণতন্ত্র দু’টো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরােধী বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বর্তমান যুগে যতগুলাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, এগুলাে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।” (তরজমানুল কোরআন, ডিসেম্বর ১৯৩৫)। “তাদের (মুসলমানদের উদ্দেশে আমি পরিষ্কার বলছি, বর্তমান যুগের ধর্মহীন (ধর্মনিরপেক্ষ) জাতীয় গণতন্ত্র তােমাদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তােমরা যদি এর সামনে মাথা নত করাে তবে কোরআনের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। তার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করলে নিজের রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এর পতাকা উত্তোলনের জন্য দাঁড়ালে নিজের খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা হবে।” (জামায়াতে ইসলামী কি দাওয়াত-মওদুদী) “যেসব জামায়াত কোনাে শক্তিশালী আদর্শ ও সজীব সামগ্রিক (ইজতেমায়ী) দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তারা সবসময়ই লঘিষ্ঠ হয় । সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করে থাকে। মুসােলিনীর ফ্যাসী পার্টির সদস্য হলাে মাত্র চার লাখ এবং রােমে মার্চ করার সময় ছিলাে মাত্র তিন লাখ। কিন্তু এই সংখ্যালঘিষ্ঠরা সাড়ে চার কোটি ইটালীয়ের উপর ছেয়ে গেছে। এই অবস্থা জার্মানীর নাজি পার্টিরও। একটি মজবুত সুসংহত দল শুধু বিশ্বাস ও শৃংখলার জোরে ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সদস্য সংখ্যা দেশের অধিবাসীদের মধ্যে প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন।” (সিয়াসী কাশমকাশ-মওদুদী) “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য-এ মতাদর্শের . আমি সমর্থক নই।” (সিয়াসী কাশমকাশ-মওদুদী) “এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সেসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম। (রাসায়েল ও মাসায়েল-মওদুদী) মওলানা একদিকে বলেছেন, কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্মই হলাে। গণতন্ত্র। অপরদিকে বলেছেন, গণতন্ত্র ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ।
গণতন্ত্রপ্রিয়তা বেশিদিনের নয়। ১৯৩৩ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৯৫৩ সালে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মওলানা তাঁর লেখনী ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরােধিতা করে এসেছেন। ইসলাম ও গণতন্ত্র দু’টো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরােধী বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “বর্তমান যুগে যতগুলাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, এগুলাে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত।” (তরজমানুল কোরআন, ডিসেম্বর ১৯৩৫)। “তাদের (মুসলমানদের) উদ্দেশে আমি পরিষ্কার বলছি, বর্তমান যুগের ধর্মহীন (ধর্মনিরপেক্ষ) জাতীয় গণতন্ত্র তােমাদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তােমরা যদি এর সামনে মাথা নত করাে তবে কোরআনের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শন করবে। তার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করলে নিজের রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এর পতাকা উত্তোলনের জন্য দাঁড়ালে নিজের খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা হবে।” (জামায়াতে ইসলামী কি দাওয়াত-মওদুদী)। “যেসব জামায়াত কোনাে শক্তিশালী আদর্শ ও সজীব সামগ্রিক (ইজতেমায়ী) দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তারা সবসময়ই লঘিষ্ঠ হয় । সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করে থাকে। মুসােলিনীর ফ্যাসী পার্টির সদস্য হলাে মাত্র চার লাখ এবং রােমে মার্চ করার সময় ছিলাে মাত্র তিন লাখ। কিন্তু এই সংখ্যালঘিষ্ঠরা সাড়ে চার কোটি ইটালীয়ের উপর ছেয়ে গেছে। এই অবস্থা জার্মানীর নাজি পার্টিরও। একটি মজবুত সুসংহত দল শুধু বিশ্বাস ও শৃংখলার জোরে ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সদস্য সংখ্যা দেশের অধিবাসীদের মধ্যে প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন।” (সিয়াসী কাশমকাশ-মওদুদী) “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য-এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই।” (সিয়াসী কাশমকাশ-মওদুদী)। “এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত সেসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম। (রাসায়েল ও মাসায়েল-মওদুদী)। মওলানা একদিকে বলেছেন, কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্মই হলাে গণতন্ত্র। অপরদিকে বলেছেন, গণতন্ত্র ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ।
বিপরীত। গণতন্ত্র মুসলমানদের ধর্ম ও ঈমানের পরিপন্থী। গণতন্ত্রের সামনে মাথা নত করা কোরআনের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনের নামান্তর। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করা রাসুলের সাথে। বিশ্বাসঘাতকতা করা। খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা। ইসলামের সারমর্ম গণতন্ত্রের সারমর্মের সাথে সব সময়ই সংগ্রামমুখর। ইসলাম ও গণতন্ত্র পরস্পর কোথাও সমঝােতা করতে পারে না। মওলানা একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি সর্বাধিক জোর দিয়েছেন, অন্যদিকে বলেছেন, জনসাধারণ অজ্ঞ। তাদের মতামতের মূল্য দিলে বিপথগামিতার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরাে বলেছেন, আদর্শবান দলের অনুসারীরা সংখ্যায় কমই হয়ে থাকে। তাদের সংখ্যা প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন, তারাই শাসনক্ষমতা পরিচালনা করে থাকে। এজন্য তিনি মুসােলিনী ও হিটলারের অনুসারীদের দৃষ্টান্ত। ও তুলে ধরেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মওলানা মওদুদীর কোন্ উক্তিকে। সঠিক বলে ধরে নেয়া যাবে। অথচ গণতন্ত্রের সপক্ষ-বিপক্ষ উভয়। ক্ষেত্রেই তিনি ইসলামের দোহাই পেড়েছেন। ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এর চাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে! বস্তুত ইসলামের মুখােশ পরে যখন যেমন তখন তেমন কথা বলাই মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল জামায়াতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশল। বাংলাদেশেও জামায়াতে ইসলামী এই কৌশলই অনুসরণ। করে চলেছে।
মহিলাদের অধিকার ও জামায়াত
জামায়াতিরা সব সময় প্রচার করে বেড়ায়, দেশে ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েম করাই তাদের চরম ও পরম লক্ষ্য। কিন্তু তাদের এ প্রচারণা ও কর্মধারায় কোনাে সাদৃশ্য নেই বললে অত্যুক্তি করা হবে না। মূলত তাদের নীতি বলতে কিছুই নেই। সময় ও সুযােগ বুঝে তারা যেকোনাে রূপ ধারণ করতে পারে। তবে এই পরিবর্তনে একটা বিষয় লক্ষণীয় হলাে, ইসলামী মুখােশটা সব সময় ও অবস্থায় তাদের মুখে থাকে। এটা ভুলেও কোনাে সময় তারা ছাড়ে না। ধর্মের তথাকথিত ছদ্মাবরণেই তারা সব সময় বাজিমাৎ করার চেষ্টা করে। আমাদের এ দাবির একাধিক প্রমাণ আপনারা পেছনে দেখতে পেয়েছেন। এ ধরনের আর একটা দৃষ্টান্ত হলাে, পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেবার মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থিনীর সপক্ষে তারা যে অভিনয় করেছে তা পূর্ববর্তী সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মওলানা মওদুদী ১৯৬৫ সালের নির্বাচনের কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তাঁর একাধিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বলে এসেছেন মহিলা সমাজকে রাজনীতিতে টেনে আনা, আইন পরিষদের সদস্য হওয়ার অধিকার দেয়া, এমনকি কোনাে দায়িত্বপূর্ণ সরকারী পদে নিয়ােগ করাও ইসলামের মূলনীতি বিরােধী। তিনি বলতেন, এটা পাশ্চাত্য জগতের অন্ধ অনুকরণ বই কিছু নয়। মওলানা বলেছেন, “আইন পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্য হওয়ার অধিকার দেয়া হলাে পাশ্চাত্য জাতিসমূহের অন্ধ অনুকরণ। ইসলামের। নীতিমালা এর এতটুকু অনুমতি দেয় না। ইসলামের রাজনীতি ও দেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব কেবলমাত্র পুরুষের উপরই ন্যস্ত। এসব দায়িত্ব। মহিলাদের কর্মক্ষেত্রের বাইরে।” (দস্তুরী তাজাবি-মওদুদী)। তিনি বলেছেন, “পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও এ কথার কী অবকাশ আছে যে, মুসলিম মহিলারা কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের সদস্য হবে? ঘরের বাইরে সামাজিক তৎপরতায় দৌড়াদৌড়ি করবে, সরকারী দফতরে পুরুষের সাথে কাজ করবে, কলেজগুলােতে ছেলেদের সাথে শিক্ষাগ্রহণ করবে, পুরুষদের হাসপাতালে নার্সিংয়ের দায়িত্ব পালন করবে, বিমান ও রেলকারে যাত্রীদের মনােরঞ্জনে ব্যবহৃত হবে এবং শিক্ষাদীক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা-ইংল্যান্ড যাবে?” (তাফহিমুল কোরআন, ৪৬ পৃষ্ঠা-মওদুদী) । উপরােক্ত উদ্ধৃতি দুটোর প্রথমটি তাে একেবারে স্পষ্ট। তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়ােজন। দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি মওলানা মওদুদী রচিত তাফহিমুল
কোরআন থেকে সংকলিত। তিনি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতে ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, “মহিলাদের কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের সদস হওয়া, ঘরের বাইরে সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা, পুরুষের সাথে চাকরি করা, সহশিক্ষা, নার্সিং প্রভৃতি ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের এসব। ব্যাপারে অংশ নেয়ার কোনাে অবকাশ নেই।” এ হলাে সকল মুসলিম মহিলার অধিকার সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ইসলামিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা অভিমত। মহিলাদের ব্যাপারে মওলানার বিভিন্ন গ্রন্থে এ ধরনের আরাে বহু উদ্ধৃতি রয়েছে। ১৯৬৪ সালে মিস ফাতিমা জিন্নার মনােনয়ন লাভের পূর্ব পর্যন্ত এ ছিলাে মহিলাদের সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ১৯৬৪ সালের শেষদিকে জামায়াতে ইসলামী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যফ্রন্টে যােগদান করে। জামায়াতে ইসলামী প্রমাদ গােনে, ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধী দলীয় প্রার্থিনী মিস ফাতেমা জিন্না হবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তাতে করে জামায়াতে ইসলামীও ক্ষমতার বখড়া লাভ করবে। নিছক ক্ষমতার লােভে সেবার জামায়াতে ইসলামী মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থিনীকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই নয়, মিস। ফাতেমা জিন্নার সপক্ষে জামায়াতে ইসলামীর পুরাে মিশনারী নিয়ােগ করা হয়। এরূপে মওলানা মওদুদী অতীতে মহিলাদের ব্যাপারে যেসব ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে আসছিলেন সেগুলাে বেমালুম ভুলে যান। মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের অধিকার তিনি যে কোরআনের দোহাই পেড়ে হরণ করার প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন, ক্ষমতার মােহে সে কোরআনের নামেই মওলানা পুনরায় মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থী হওয়ার সপক্ষে প্রচারণা চালান।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনী প্রচারণায় মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামায়াত মিস ফাতেমা জিন্নার সমর্থনে যেসব বিবৃতি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন, বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংক্ষেপে এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। তিনি বলেছেন, “মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে নির্বাচন করায় এ ছাড়া কোনাে অসুবিধা নেই যে, তিনি একজন মহিলা। এদিক ছাড়া আর সব গুণাবলীই তাঁর মধ্যে রয়েছে যা একজন যােগ্য রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থীর জন্য বলা হয়েছে।” (সাপ্তাহিক শেহাব, ১১ অক্টোবর, ‘৬৪) “মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে কোনােই বাধ্যবাধকতা নেই। মহিলার নেতৃত্বে যুদ্ধ করা কিংবা হজ করা অবৈধ বলাও অন্যায়।” (শেহাব, ১৮ই অক্টোবর, ‘৬৪) “আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থী মাদারে মিল্লাত মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের চাইতে হাজার গুণ উত্তম।” (নাওয়ায়ে ওয়াকত, ২৪ ডিসেম্বর, ‘৬৪)। “বর্তমান অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বিরােধী দলগুলাের পক্ষ থেকে মিস ফাতেমা জিন্নার পরিবর্তে যদি কোনাে ন্যায়নিষ্ঠ ও খােদাভীরু পুরুষকে রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দেয়া হতাে তবে তা হতাে পাপ। কাজ।” (শেহাব, ১ জানুয়ারি, ‘৬৫) “জনসাধারণের এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা উচিত নয় যে, যদি তাদের অবহেলার দরুন তাদের প্রতিনিধিরা ভুল সিদ্ধান্ত করে (মিস ফাতেমা জিন্নাকে রাষ্ট্রপ্রধান মনােনীত না করে তবে খােদাও তাদের প্রতি অনুগ্রহ। প্রদর্শন করবেন না।” (এশিয়া, ২৭ ডিসেম্বর, ‘৬৪)। “আমাদের উপর ফরজ হলাে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে বর্তমান সরকারকে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতাচ্যুত করা। আল্লাহ্ তায়ালাও এর চাইতে সুবর্ণ সুযােগ আর দান করতে পারেন না।” (নাওয়ায়ে ওয়াকত, ২৬ অক্টোবর, ‘৬৪) এসব হলাে মওলানা মওদুদীর উক্তি। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি মিস ফাতিমা জিন্নার সপক্ষে এসব বলেছিলেন। চিন্তা করুন, স্বার্থসিদ্ধির মােহে মওলানা মওদুদী ও তার দল জামায়াত কাহাতক গিয়ে পৌছে! যদি অন্য কারাে মুখ থেকে এরূপ উক্তি বেরুতাে তাহলে সবার আগে এই মওলানাই তাকে কাফের ফতােয়া দিতেন। অপরদিকে মওলানা মওদুদী ১৯৬৪ সালে ফাতেমা জিন্নাহকে বিরােধী দলের তরফ থেকে মনােনয়ন দানের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া দূরে থাক, মহিলাদের সাধারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার দানেরও। বিরােধিতা করেছেন। তিনি একে কোরআন-সুন্নাহ বিরােধী ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ বলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেছেন। মওলানা মওদুদীর অনুসারী বাংলাদেশের জামায়াতীরাও বর্তমানে মহিলা নেতৃত্বের সাথে জোট করেছেন, একসাথে পােস্টার ছেপেছেন। ষড়যন্ত্র করে সংখ্যা গরিষ্ঠ আসন নিয়ে সরকার গঠন করেছেন, মন্ত্রী হয়েছেন। আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে, জামায়াতীরা যে মুখে দীর্ঘদিন যাবত এসব উক্তি করেছিলেন, স্বার্থ হাসিলের মােহে সে মুখ দিয়েই এগুলাের বিপরীত কাজ করছেন । এর পরেও কারাে পক্ষে বিশ্বাস করা কি সম্ভব, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য জামায়াতে ইসলামী দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন। এবং ইসলামই তাদের দলের একমাত্র আদর্শ !
জামায়াতের স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাত থেকে পাকিস্তানী দখলদার বাহিনী নিধন অভিযান শুরু করলে জামায়াতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য নগ্নভাবে উন্মােচিত হয়ে পড়ে। নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ৪ এপ্রিল প্রথম সুযােগেই খুনী জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গােলাম আযম ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। দু’দিন পর ৬ এপ্রিল গােলাম আযম পৃথকভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে আবার দেখা করেন। এই বৈঠকে অন্য দালালদের মতাে গােলাম আযম স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, “ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে।” (দৈনিক পাকিস্তান, ৭ এপ্রিল, ‘৭১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে অংকুরেই ধ্বংস করার পাশবিক প্রক্রিয়ায় সহযােগিতা দানের উদ্দেশ্যে ১০ এপ্রিল গঠিত ‘শান্তি কমিটিতে জামায়াতে ইসলামী প্রধান ভূমিকা রাখে। এরপর ১৫ এপ্রিল গঠিত প্রাদেশিক শান্তি কমিটির তিন নম্বর সদস্য মনােনীত হন গােলাম আযম। আহ্বায়ক ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খায়রুদ্দিন। (দৈনিক পাকিস্তান, ১৭ এপ্রিল,৭১) এপ্রিলেই অবরুদ্ধ বাংলাদেশের সর্বত্র শান্তি কমিটি তার স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা শুরু করে। প্রতিটি জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে। জামায়াতে ইসলামী এর নেতৃত্ব দখল করে। জামায়াতের দালালরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে গ্রামে গ্রামে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতাে। মানুষের গরু-খাসিসহ অর্থ-সম্পদ লুট করতাে, মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতাে, নারী নির্যাতনেও সহায়তা করতাে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলােতে খুনী জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলাে জামায়াতে ইসলামী। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘আজাদী দিবস উদযাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে অনুষ্ঠিত এক সিম্পােজিয়ামে গােলাম আযম বলেন, “কিন্তু এবার পাকিস্তানের ভেতরে হাজারাে দুশমন সৃষ্টি হয়েছে। তাই এবারের সংকট কঠিন। কারণ বাইরের দুশমনের চেয়ে ঘরে ঘরে যেসব দুশমন রয়েছে তারা অনেক বেশি বিপজ্জনক।”
এর চারদিন পরের বিবৃতিতে বােঝা যায়, গােলাম আযম মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর কি পরিমাণ রুষ্ট ছিলেন। ১৮ আগস্ট লাহােরে তিনি বলেন, “ভারত দুষ্কৃতকারীদের (‘৭১ সালে পাকিস্তানের ভাষায় মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন দুস্কৃতকারী) সাহায্য করছে। তাই পাকিস্তানের উচিত কালবিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।” স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ২৩ আগস্ট গােলাম আযম লাহােরে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল। একমাত্র ইসলামের শক্তিই দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারে।” ৩১ আগস্ট গােলাম আযম হায়দরাবাদের এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান। এ প্রসঙ্গে গােলাম আযম বলেন, ‘বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত ও সরকার কর্তৃক বহাল ঘােষিত ৮৮ জন সদস্যের অধিকাংশই পাকিস্তানে নেই। তিনি বলেন, ‘বর্তমান মুহূর্তের আশু প্রয়ােজন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক ও ইসলামপ্রিয় লােকজনের হাত শক্তিশালী করা। এসব লােক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে। এবং ‘দুষ্কৃতকারীদের রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ ও ‘বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে পূর্ণ সহযােগিতা দান করছে। অধ্যাপক গােলাম আযম দেশকে খণ্ডবিখণ্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্যে সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে।’ পরদিন গােলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষণা করা এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে শাস্তি দেয়ার দাবি জানান। তিনি এ প্রসঙ্গে ভাসানী ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, ওয়ালী খান ন্যাপের পূর্ব পাকিস্ত নি শাখার নাম উল্লেখ করেন। তাঁর মতে এসব দলের সদস্যরা এখনাে পূর্ব পাকিস্তানে গােপন তৎপরতা চালাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে হতাশার ভাব সৃষ্টি করছে। অধ্যাপক গােলাম আযম বলেন, ” কোনাে ভাল মুসলমানই তথাকথিত ‘বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে
। তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্য একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ২২ নভেম্বর গােলাম আযম পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। গােলাম আযম দীর্ঘ সাত বছর পর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন ‘৭৮ সালের ১১ জুলাই। ২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে গােলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ লােক ভারতের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে এবং তা পবিত্র মাতৃভূমির এক ইঞ্চি জমিও ভারতকে দখল করে নিতে দেবে না। ‘ ২ ও ৩ ডিসেম্বর গােলাম আযম সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এপিপির খবরে লাহাের থেকে বলা হয়, ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লাহােরে ফিরে এসে গােলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনাে তাদের দাবির প্রতি মিসেস গান্ধীর সমর্থন চায়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আযম বলেন, পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যে অবিলম্বে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা উচিত।’ এ পর্যন্ত উপস্থাপিত তথ্য ও ঘটনাবলীর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে জামায়াতে ইসলামী কেবল বিরােধী অবস্থানই নেয়নি, একে সমূলে নস্যাতের জন্যও দলটির প্রচেষ্টা ছিলাে সর্বাত্মক। স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন না করাটা অন্যায় হলেও মারাত্মক অপরাধ নয় সত্য, কিন্তু একাত্তরে জামায়াতে ইসলামী তার ভূমিকাকে এমনিতর নীতিগত প্রশ্নেই শুধু সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইতিহাসের পর্যালােচনা বরং এই সত্যই তুলে ধরে যে, বিরােধিতার নামে স্বাধীনতা সংগ্রামকে নির্মূল করার চেষ্টার পাশাপাশি নৃশংসতার সাথে জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের উৎখাতেরও ভয়ংকর কর্মসূচি নিয়ে জামায়াতিরা এগােতে শুরু করেছিলাে। এজন্যই তারা রাজাকার ও বদর বাহিনী তৈরি করেছে, শান্তি কমিটিতে যােগদানসহ সর্বতােভাবে সমর্থন ও সহযােগিতা দিয়েছে পাকিস্তানের খুনী সেনাবাহিনীকে। বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষিত বাঙ্গালী মাত্রকেই হত্যা করার সুপরিকল্পিত কার্যক্রম এবং মন্ত্রিত্বের সুযােগ নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগও ছিলাে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই উদ্ভাবিত। শােষণ ও শাসনের স্থায়ী পদানত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার যে প্রক্রিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলে আসছিলাে, ইসলাম এবং মুসলিম জাতীয়তার নামে জামায়াতে ইসলামী স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার উদ্ধত পদক্ষেপ নিয়েছিলাে। বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিনাশ ছিলাে জামায়াতের সকল আয়ােজনের উদ্দেশ্য। বাঙ্গালীর জাতিগত ঠিকানা এবং স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়েই জামায়াতিরা অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করে। তাদের নৃশংসতা এমনকি পাক হানাদার বাহিনীকেও অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে।
রাজাকার-আলবদর বাহিনী
শান্তি কমিটির মাধ্যমে স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতাকে সর্বাত্মক করার জন্য একই সঙ্গে জামায়াতে ইসলামী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীও গড়ে তােলে। ৯৬ জন জামায়াত কর্মীর সমন্বয়ে খুলনার খান জাহান আলী। রােডের আনসার ক্যাম্পে ‘৭১ সালের মে মাসে রাজাকার বাহিনীর প্রথম দলটি গঠন করেন জামায়াত নেতা মওলানা এ কে এম ইউসুফ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জামায়াতে ইসলামীর এই সশস্ত্র বাহিনী হত্যা, নির্যাতন এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিতে পাক হানাদার বাহিনীর কেবল তল্পীবাহক হিসেবেই কাজ করেনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অত্যাচার হানাদার বাহিনীর চাইতেও অনেক বেশি ক্ষতি ও সর্বনাশের কারণ ঘটিয়েছিলাে। শক্রকবলিত বাংলাদেশের একটি পরিবারও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা এই রাজাকারদের হত্যা, লুণ্ঠন এবং নির্যাতনের শিকার হননি। জামায়াতে ইসলামীর নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার অল্পদিনের মধ্যেই আধা-সামরিক বাহিনীতে পরিণত করে। পাক সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে কার্যকর সহযােগিতা প্রদানে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তােলার জন্য এদের এক থেকে তিন-চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণের সরকারী ব্যবস্থা করা হতাে। সাধারণত ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তাদের সশস্ত্র করা হতাে। রাজাকাররাও তাদের দেশপ্রেমের সরকারী স্বীকৃতি পেতে থাকে। সিলেট সফরকালে ৮ জুলাই জেনারেল নিয়াজী ‘দুষ্কৃতকারীদের নাশকতামূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রাজাকারদের প্রশংসা করেন। ১১ আগস্ট রংপুরে গভর্নর টিক্কা খান একই সুরে বলেন, “রাজাকাররাও দুষ্কৃতকারীদের হামলার মুখে নিজ নিজ এলাকা রক্ষা এবং সেতু ও কালভার্ট পাহারা দিয়ে বিশেষ দরকারী ভূমিকা পালন করছে।’ ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে ট্রেনিং গ্রহণরত রাজাকারদের পরিদর্শনকালে জেনারেল নিয়াজী তাদের মনােবল ও উৎসাহের প্রশংসা করেন। জামায়াতে ইসলামী রাজাকার বাহিনীর প্রশ্নেও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলাে। ১ সেপ্টেম্বর করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গােলাম আযম ‘পাকিস্তান রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাক সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। গােলাম আযম বলে ‘কোনাে ভাল মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ তিনি বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বিছিন্নতাবাদীদের নির্মল করার জন্য একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন। রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। নিহত রাজাকার রশীদ মিনহাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গােলাম আযম বলেন, এই আত্মত্যাগের নিদর্শন থেকে তরুণরা উপকৃত হতে পারবে।’ (দৈনিক পাকিস্তান, ২ সেপ্টেম্বর, ’৭১) ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার হােটেল এম্পায়ার’-এ এক জামায়াতী সমাবেশে গােলাম আযম শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার কথা উল্লেখ করে বলেন, “জামায়াতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়।” গােলাম আযম বলেন, জামায়াতের কর্মীরা। শাহাদাত বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে করতে রাজী নয়।’ গােলাম আযম আরাে বলেন, “সারা দেশ সামরিক বাহিনীর পূর্ণ। নিয়ন্ত্রণে আসার পরও যে কয়েক হাজার লােক শহীদ হয়েছেন, তাদের। অধিকাংশই জামায়াতের কর্মী।” (ঐ, ২৬ সেপ্টেম্বর, ৭১)। রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওলানা ইউসুফ ১১ অক্টোবর খুলনার জেলা স্কুল মিলনায়তনে এক রাজাকার সমাবেশে ‘দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের কার্যকলাপ দমনের জন্য রাজাকারদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। (ঐ, ১২ অক্টোবর, ‘৭১) স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জামায়াতে ইসলামীর উল্লেখযােগ্য অপর এক প্রচেষ্টা ছিলাে আলবদর নামের সশস্ত্র খুনী বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। বদর বাহিনী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে। প্রথম দিকে নেতৃত্বে ছিল তকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি আশরাফুল ইসলাম। পাক দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশে জামায়াতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতাে। বদর বাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন গােলাম আযম । এর প্রকাশ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে। ছিলেন বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর আমীর মতিউর রহমান নিযামী (সারা পাকিস্তান প্রধান), বর্তমান সেক্রেটারী জেনারেল আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ (প্রাদেশিক প্রধান), মীর কাশেম আলী (তৃতীয় নেতা) এবং জামায়াত নেতা মােহাম্মদ কামরুজ্জামান (প্রধান সংগঠক)। জামায়াতে ইসলামীর মুখপাত্র দৈনিক সংগ্রাম’ও সে সময় বদর বাহিনীকে উত্তেজিত করা শুরু করেছিলাে। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘আলবদর শিরােনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘সংগ্রাম’ লিখেছ, “আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়! আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুস্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয় চর কিংবা দুস্কৃতকারীদের কাছে। আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।” ঢাকার আলিয়া মাদ্রাসাস্থ বদর বাহিনী ক্যাম্পের এক সমাবেশে বদর বাহিনী প্রধান মতিউর রহমান নিযামী ২৩ সেপ্টেম্বর বলেছিলেন, “যারা ইসলামকে ভালােবাসে শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালােবাসে। এবারে উদ্ঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।” বদর দিবসের সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে বদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মতিউর রহমান নিযামী ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে লেখেন, “….বদর যােদ্ধাদের যেসব গুণাবলীর কথা আমরা আলােচনা করেছি, আলবদরের তরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ্ সেসব গুণাবলী আমরা। দেখতে পাবাে। …সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পযুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উডডীন করবে।” স্বাধীনতার পর পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত শত শত প্রতিবেদনে বদর বাহিনীর নৃশংসতার এক ভয়াবহ চিত্র রয়েছে। এই চিত্র হিটলারের। গেস্টাপাে, ভিয়েতনামের মাইলাই কিংবা লেবাননে প্যালেস্টাইনীদের সাবরা শাতিলা শিবিরের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও হাজার গুণ ভয়াবহ।
বাংলাদেশ বিরােধী অপপ্রচার
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও পাক হানাদার বাহিনীর অন্যান্য সহযােগীরা গা ঢাকা দেয়। অনেকে দেশের বাইরে চলে যায়। শুধু দেশের ভেতরেই নয়, বাইরেও তারা বাংলাদেশ বিরােধী অপপ্রচার অব্যাহতভাবে চালিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসেই জামায়াত নেতা অধ্যাপক গােলাম আযমের নেতৃত্বে লাহােরে “পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি” গঠিত হয়। পুরাে এক সপ্তাহব্যাপী মিছিল, সমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে এই কমিটি তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন পরিচালনা করে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে গােলাম আযম পাকিস্তান সরকারের তীব্র বিরােধিতা করেন। ‘৭২ সালের নভেম্বরে গােলাম আযম বাংলাদেশ বিরােধী আন্দোলনকে ব্যাপকতা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানী পাসপাের্ট নিয়ে দেশত্যাগ করেন। ‘৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির নেতা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলােতে বাংলাদেশ বিরােধী প্রবল মনােভাব গড়ে তােলেন। “হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে। সেখানে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে। মসজিদগুলাে মন্দিরে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।”- এ ধরনের উদ্ভট এবং ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিকারী বক্তব্য তুলে ধরে তিনি সাহায্যের আবেদন জানান। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ এবং সংগৃহীত অর্থের বিরাট অংশ আত্মসাতের অভিযােগ রয়েছে তার বিরুদ্ধে। ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার পর ক্ষিপ্ত গােলাম আযমের এই তৎপরতা আরাে ব্যাপকতা পেয়েছিলাে। সে মাসেই তিনি লন্ডনে চলে যান। সেই সাথে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির সদর দফতরও প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তার এই তৎপরতা। অব্যাহত থাকে। জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বিধ্বস্ত মসজিদ পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে গােলাম আযম ৪৫ লাখ রিয়াল সংগ্রহ করেন। এ টাকার একটি অংশ দিয়ে গােলাম আযম যুক্তরাজ্যের ম্যানচেস্টারে একটি বাড়ি কেনেন।
জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস
জামায়াত দয়ামায়াহীন একটি ফ্যাসিস্ট চক্র। জামায়াতের ৬৩ বছরের ইতিহাসে ফ্যাসিজমের অজস্র প্রমাণ রয়েছে। ইসলামই দলটির আদর্শ’-একথা প্রচার করা হলেও, মহান শান্তির ধর্ম ইসলামের উদারতা, বিশালতা ও সহনশীলতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন এদের কার্যকলাপে পাওয়া যায় না, বিশেষ করে যখন তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মােকাবিলা করে। বিরােধী শক্তি মুসলিম-অমুসলিম যাই হােক না কেন, তারা জামায়াতের ভাষায় ‘কাফের। অধ্যাপক গােলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নায়ক হিসেবে পরিচিত। ৭১ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে গােলাম আযম বুদ্ধিজীবী নিধনের একটা নীলনকশা পেশ করেন। সে নীলনকশা অনুযায়ী পরবর্তীকালে ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত যে দলিলপত্র পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট করে নির্দেশ ছিল, “পূর্ব পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হবে না। তবে একটি কাজ করতে হবে, এখানকার সব বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিজ্ঞানীকে চিরতরে ‘শেষ করে দিতে হবে যাতে পাকিস্তানকে হারালেও তারা দেশ চালাতে না পারে। অধ্যাপক গােলাম আযম এই নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য তার দলীয় ক্যাডার, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসকে নির্দেশ দেন। এলাকাও ভাগ করে দেয়া হয়। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সাথে মিলে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে জামায়াতের রাজাকার, আলবদর, আলশামসরা বহু বাঙ্গালীকে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর সামরিক শাসক জেনারেল জিয়ার পৃষ্ঠপােষকতায় এক পর্যায়ে জামায়াত আত্মপ্রকাশ করে। কিন্তু স্বাধীন বাংলাদেশেও তাদের ফ্যাসিবাদী ধ্বংসাত্মক তৎপরতার এতটুকু পরিবর্তন হয়নি। তারা প্রতিপক্ষের হাত-পায়ের রগ কাটছে, হত্যা করছে। বিগত বছরগুলােতে তারা সারাদেশে বহু লােককে হত্যা করেছে। ২০০০ সালের ১২ জুলাই। জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা চট্টগ্রামে ব্রাশ ফায়ার করে ৬ জন ছাত্রলীগ। নেতাসহ ৮ জনকে হত্যা করেছে। ২০০০ সালের প্রথমদিকে কক্সবাজার জেলার জামায়াত-শিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার ডালিম পুলিশের হাতে ধরা পড়ে। রিমাণ্ডে ডালিম পুলিশকে বলেছে, কোটি কোটি টাকা। অবৈধভাবে কামাই করে সে জামায়াত-শিবিরের সংগঠনে ব্যয় করছে। জামায়াত-শিবির তাকে অস্ত্রের ট্রেনিং ও ক্যাডার বাহিনী গড়ে তােলার জন্য সক্রিয় সহযােগিতা প্রদান করেছে। ডালিম বাহিনীর সবাই অস্ত্র চালানাের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত। তারা র্যাংগস নামে গড়ে তুলেছে বেশ কয়েকটি সংগঠন। (আজকের কাগজ, ১৮ নভেম্বর, ২০০০) ২০০০ সালের ২৭ নভেম্বর জনকণ্ঠে জামায়াত-শিবির সম্পর্কে একটি চাঞ্চল্যকর প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। তাতে বলা হয়েছে মৌলবাদী জামায়াতের আর্মড ক্যাডার সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের গােপন কর্মকাণ্ড নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে এক চাঞ্চল্যকর রিপাের্ট পেশ করা হয়েছে। রিপাের্টে তুলে ধরা হয়েছে, শিবির ক্যাডারদের অস্ত্র প্রশিক্ষণের আস্তানা, সরকারী অস্ত্র ব্যবহার, অস্ত্রপ্রাপ্তির কানেকশন এবং বিদেশী। সশস্ত্র গ্রুপের সাথে প্রত্যক্ষ যােগাযােগসহ নানা উদ্বেগজনক চিত্র। রিপাের্টে প্রতিটি ঘটনার জন্য তথ্যপ্রমাণও সরবরাহ করা হয়েছে। দীর্ঘ এ রিপাের্টে তুলে ধরা হয়েছে প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ বিভাগগুলােতে জামায়াতের ক্যাডার নিয়ােগের বর্তমান ও ভবিষ্যত পরিকল্পনাসমূহ। আট পৃষ্ঠাব্যাপী এ রিপাের্টটি দীর্ঘ তদন্ত শেষে তৈরি করেছে সরকারী একটি সংস্থার বিশেষ একটি বিভাগ। সে রিপাের্টে পেশকৃত প্রতিটি ঘটনার প্রমাণও সংযুক্ত করা হয়েছে। রিপাের্টে বলা হয়েছে, শিবিরের বৃহত্তম ঘাটি চট্টগ্রাম এবং দক্ষিণ চট্টগ্রাম জুড়ে এর গােপন কার্যক্রম বিস্ত ত। মিয়ানমারের আরএসও বা রােহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন। নামের একটি সংগঠনের সাথে শিবিরের রয়েছে গভীর যােগাযােগ। আর এই আরএসও’র সাথে যােগাযােগ রয়েছে মিয়ানমারের আরাকান আর্মি নামের একটি সশস্ত্র গ্রুপের। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি উপজেলার সােয়াবিল পাহাড়ে শিবির ক্যাডারদের ইনফ্যান্ট্রি প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। পরিচালিত হয় রিফ্রেশার কোর্সও। সশস্ত্র ক্যাডার তৈরির আগে শিবির সদস্যদের সুকৌশলে বাংলাদেশ ন্যাশনাল
ক্যাডেট কোরে (বিএনসিসি) ঢােকানাে হয়। ব্যবস্থা হয় বিভিন্ন ক্যাম্পে পাঠানাের । রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়েছে, অস্ত্র চেনা ও ব্যবহারের প্রথম সুযােগ হিসেবে সরকারী অস্ত্র ব্যবহারের এ সুযােগ করে নেয়া হয়। রিপাের্টে বলা হয়েছে, শিবির মনে করে বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ। ইসলাম পছন্দ করে এবং এদেশে ভারতবিরােধী মনােভাব প্রবল। তবে আন্দোলন গতিলাভ না করার কারণ হিসেবে শিবির এও মনে করে ‘৭১ সালে জামায়াতের নীতি এবং সেকুলার ব্যক্তিদের হাতে রাষ্ট্রের নেতৃত্ব থাকা। আবার শিবির এ ধারণাও পােষণ করে, ভারতের অধিকাংশ। মুসলমান কংগ্রেস রাজনীতিতে বিশ্বাসী বিধায় সে দেশে মুসলমানদের কোনাে ভবিষ্যত নেই। অন্যদিকে পাকিস্তান বরাবরই ইসলামী কোন্দল নিয়ে থাকবে। শিবিরকর্মী ও ক্যাডাররা মামলায় জড়িয়ে পড়লে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন লিগ্যাল এইড কমিটি থেকে জনকল্যাণের নামে আর্থিক সহযােগিতা প্রদান করা হয়। আবার কর্মীদের থেকে চাঁদা সংগ্রহ করে বায়তুলমাল’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। জরুরীভিত্তিতে কোনাে সদস্যের রক্তের প্রয়ােজন হলে নির্দিষ্ট করা আছে। রক্তদানকারী গ্রুপ। এদের নাম, ঠিকানা, অবস্থান ও রক্তের গ্রুপ চিহ্নিত করে লিস্ট করা আছে। রিপাের্টে এ ধরনের লিস্টেড রক্তদানকারীদের নামের তালিকা পেশ করা হয়েছে। রিপাের্টে তুলে ধরা হয়েছে বিএমএ লং কোর্স, পুলিশ এবং বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পেশায় শিবির সমর্থকদের ঢােকানাের তৎপরতার নানাবিধ প্রচেষ্টার চিত্র। সাম্প্রতিক সময়ে শিবিরের উদ্যোগে দি ফোরাম অব ইঞ্জিনিয়ার্স এ্যান্ড আর্কিটেক্টস নামের একটি সংগঠন গড়ে তােলা হয়েছে। এর মূল লক্ষ্য ইন্সটিটিউট অব ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ সংগঠনের কর্মকর্তার পদসমূহ দখলে আনা। রিপাের্টে দি ফোরাম অব ইঞ্জিনিয়ার্স এ্যান্ড আর্কিটেক্টস চট্টগ্রাম কেন্দ্রের ২১ প্রকৌশলী নিয়ে। পরিচালনা পরিষদের তালিকা তুলে ধরা হয়েছে। রিপাের্টে আরও তুলে ধরা হয়েছে সদস্য সংগ্রহ, মসজিদ দখল, মেসকোচিং সেন্টার সৃষ্টি, প্রতি বছর গাইড প্রকাশ, নিজস্ব গ্রন্থাগার প্রতিষ্ঠা করার বিশদ চিত্র। সর্বশেষ শিবির ভারতের বিজেপি স্টাইলে। অমুসলিমদের মধ্যে সংগঠন গড়ে তােলার প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
প্রদত্ত এ রিপাের্টে উল্লেখ করা হয়েছে, শিবির দলের জন্য প্র; শুভাকাঙ্ক্ষী, সক্রিয় শুভাকাঙ্ক্ষী, সমর্থক, সক্রিয় সমর্থক, কর্মী, সক্রিয় কর্মী, সাথী, সক্রিয় সাথী এবং সবশেষে সদস্য পদে নির্বাচিত করে। সক্রিয় সাথীদের নিয়ে সাথী পরিচালনা কমিটি তৈরি করা হয়। এই সাথী পরিচালনা কমিটির বৈঠক চলাকালে সর্বদা নিজস্ব সেন্ট্রি মােতায়েন থাকে। শিবিরের একটি তালিম-তরবিয়ত গ্রুপও আছে, যারা কর্মীদের রাজনৈতিক শিক্ষা দিয়ে থাকে। শিবির ইদানিং এনজিও কার্যক্রমও বৃদ্ধি করেছে। সাধারণ মানুষদের বাগে আনতে শিবির দেশী-বিদেশী নামে এনজিও পরিচালনা করে। রিপাের্টে সরকারী-বেসরকারী বিভিন্ন সংস্থায় কর্মরত ২৮ জনের একটি তালিকা দেয়া হয়েছে যারা শিবির কর্মীদের নিয়মিত পরামর্শ প্রদান। করে। এ ছাড়া দেয়া হয়েছে চট্টগ্রাম কলেজ, মহসিন কলেজ শিবিরের সাথীদের তালিকা এবং মহানগরী শিবির সদস্যদের ৬৬ জনের দীর্ঘ এক তালিকা। রিপাের্ট প্রদানকারী সংস্থার পক্ষে জানানাে হয়, শিবিরের প্রতিটি গােপন। তৎপরতার ডকুমেন্ট সংগ্রহ করে তারা এ রিপাের্ট পেশ করেছে। এর পরও কি কেউ বলতে পারেন, এই দলটি ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে কাজ করছে? জামায়াত-শিবিরের সন্ত্রাস সম্পর্কে উপরে যে সংক্ষিপ্ত ধারণা দেয়া হয়েছে তা ২০০১ সালের নির্বাচনের আগেকার। বর্তমানে তারা চার। দলীয় জোটের শরিক দল হিসেবে ক্ষমতাসীন। স্বাভাবিকভাবেই পুলিশ প্রশাসন তাদের সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড সম্পর্কে রিপাের্ট দিতে এবং অভিযুক্তদের গ্রেফতার করতে ব্রিত বােধ করছে। তারপরও দেখা গেছে দেশের বিভিন্নস্থানে ধৃত জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসীদের মধ্যে অধিকাংশই জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মী। এ সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত প্রতিবেদন এই পুস্তিকার শেষাংশে উল্লেখ করা হবে।
নবী-রাসূল সম্পর্কে মওদুদীর ধৃষ্টতা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই মানুষের সুষ্ঠু চিন্তা, জ্ঞানের প্রসার ও পরিপকৃতার মূল ভিত্তি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষ যতােই মেধাবী হােক না কেন তার মধ্যে স্বচ্ছ চিন্তাধারার বিকাশ অনেক ক্ষেত্রে হয় না। নিজের চেষ্টাসাধনায় যখন যা শেখে বা জানে তাই বলে। এভাবে সে অজস্র স্ববিরােধী উক্তি করে থাকে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষটি যদি উচ্চাভিলাষী হয়, তাহলে তাে কথাই নেই। সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে। মনে করে তার মতাে জ্ঞানের অধিকারী লােক পৃথিবীতে আর কেউ জনেনি। এ জাতীয় লােকের মুখে অন্যের সমালােচনা ছাড়া প্রশংসা ভুলেও শােনা যায় না। আমাদের এই বক্তব্যের দৃষ্টান্ত হচ্ছেন। জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী সাহেব। কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের পঞ্চাশ বছরে তার বক্তৃতা বা লেখায় কারাে প্রশংসা বড় একটা দেখা যায়নি। তাঁর এই সমালােচনা রাজনৈতিক ব্যাপারেই সীমিত ছিলাে না, ধর্মীয় বিষয়েও তিনি অনেক বাড়াবাড়ি করেছেন। নবী-রাসূল, সাহাবা কেরাম, ইমাম-মুজতাহিদ ও মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কেও তিনি অনেক ধৃষ্টতামূলক উক্তি করেছেন। আমরা এক্ষেত্রে তাঁর বিভিন্ন লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করছি। নবী-রাসূলদের নিস্পাপ হওয়া সম্পর্কে সকল মত ও পথের ইমামমুজতাহিদ, আলেম-ওলামা ও ইসলামিক চিন্তাবিদরা অভিন্ন মত পােষণ করেন। কিন্তু শুধু মওদুদী সাহেব ভিন্ন মত পােষণ করেন। তিনি বলেছেন, “ইসমত বা নিস্পাপ হওয়াটা মূলত নবীদের প্রকৃতিগত গুণ নয়। বরং নবুয়তের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য আল্লাহ তায়ালা কৌশলগতভাবে তাদেরকে ভুলত্রুটি ও পদস্খলন থেকে নিরাপদ রেখেছেন। নতুবা তাদের উপর আল্লাহ তায়ালার হেফাজত ক্ষণিকের জন্য উঠে গেলে সাধারণ মানুষের মতাে তারাও ভুলভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় এই যে, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করেই প্রত্যেক নবীর উপর থেকে কোনাে না কোনাে সময় তার হেফাজত উঠিয়ে নেন এবং তাঁকে দু’ একটি গুনাহে লিপ্ত হতে দেন। তাতে করে
মানুষ যেন নবীদেরকে খােদা বলে ধারণা না করে এবং জেনে রাখে এরাও মানুষ।” (তাফহিমাত, ২য় খণ্ড, ৪৩ পৃষ্ঠা-মওদুদী)। মওদুদী সাহেবের এই উক্তিটি ব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসলামের নামে তিনি সম্পূর্ণ ভুল ও বাতিল ধারণা প্রকাশ করেছেন। তিনি তার এই অভিমত প্রমাণের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন নবী ও রাসূলের নিস্পাপ জীবনকে কলংকিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছেন। হযরত মূসা (আঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “নবী হওয়ার পূর্বে হযরত মুসা (আঃ) দ্বারা একটি বড় গুনাহ হয়েছিল। তিনি এক ব্যক্তিকে কতল করেছিলেন।” (রাসায়েল ও মাসায়েল, ১ম খণ্ড, ৩১ পৃষ্ঠা-মওদুদী) মওদুদী সাহেব পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন, “এখানে আর একটি প্রশ্নের, উদ্রেক হয় যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন নক্ষত্র দেখে বলেছিলেন, ‘এটা আমার প্রতিপালক’ এবং চন্দ্র-সূর্য দেখে এগুলােকে নিজের প্রতিপালক হিসেবে অভিহিত করেন তখন সাময়িকভাবে হলেও তিনি কি শিরক-এ নিপতিত হননি? (তাফহিমুল কোরআন, ১ম খণ্ড, ৫৫৮ পৃঃ) মওদুদী সাহেব তার তফসীরে হযরত ইউনুস (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন, “কোরআনের ইংগিতগুলাে ও ইউনুসের পুস্তিকা (সহিফা) বিস্তারিত পর্যালােচনা করলে এটা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হযরত ইউনুস দ্বারা নবুয়তের দায়িত্ব পালনে কিছুটা অবহেলা বা অসতর্কতা হয়েছিলাে। সম্ভবত অধৈর্য হয়ে তিনি সঠিক সময়ের আগেই বাসস্থান ত্যাগ। করেছিলেন। (ঐ, সূরা ইউনুস) এক্ষেত্রে মওদুদী সাহেব হযরত ইউনুসের (আঃ) উপর তিনটি দোষা আরােপ করেছেন। প্রথমত, তিনি নবুয়তের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি আল্লাহ্ তায়ালার নির্ধারিত সময়ের আগেই অধৈর্য হয়ে বাসস্থান ত্যাগ করেন। তৃতীয়ত, তিনি নিজের সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহ্ তায়ালার প্রমাণ (হুজ্জত) পরিপূর্ণ করেননি। মওদুদী সাহেব হযরত ইউসুফকে (আঃ) বিংশ শতাব্দীর ঘৃণ্য ডিকটেটর মুসােলিনীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফের মর্যাদাকে মুসােলিনীর সমমর্যাদার বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, “ইউসুফের (আঃ) দাবি নিছক অর্থ মন্ত্রণালয়ের প্রার্থনাই ছিলাে না, যেমনটি কোনাে কোনাে লােক ধারণা করে থাকে
বরং তা ছিলাে ডিকটেটরশীপ লাভের দাবি। এর ফলশ্রুতি হিসেবে হযরত ইউসুফের (আঃ) যে মর্যাদা অর্জিত হয়েছিলাে, তা ছিলাে অনেকটা বর্তমান মুসােলিনীর মর্যাদার অনুরূপ।” (তাফহিমাত, ২য় খণ্ড, ১১২ পৃঃ)। পবিত্র কোরআনে হযরত ইউসুফের নামে একটি সূরা রয়েছে। উক্ত সূরাকে আল্লাহ তায়ালা সুন্দরতম কাহিনী’ আখ্যায়িত করেছেন। আর মওদুদী সাহেবের ভাষায় হযরত ইউসুফ ডিকটেটরশীপের দাবি করেছিলেন। তিনি হযরত ইউসুফকে ইতিহাসের অন্যতম ঘৃণ্য ব্যক্তি মুসােলিনীর সমমর্যাদায় নামিয়ে এনেছেন। আল্লাহ তায়ালার সম্মানিত নবী সম্পর্কে এর চেয়ে ধৃষ্টতামূলক উক্তি আর কি হতে পারে? হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “উরইয়ার স্ত্রীর ব্যাপারটির মূলতত্ত্ব শুধু এতটুকু ছিল যে, হযরত দাউদ (আঃ) সমকালীন ইসরাইলী সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উরইয়ার নিকট তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অনুরােধ করেছিলেন। …(তাফহিমাত, ২য় খণ্ড, ৪২ পৃঃ)। হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে জনাব মওদুদী আরাে বলেছেন, “এর দ্বারা স্বভাবতই প্রকাশিত হয়, যে কাজ তাঁর (হযরত দাউদ) দ্বারা হয়েছিলাে তাতে তার কুপ্রবৃত্তির কিছু না কিছু দখল বা প্রভাব ছিলাে। তার শাসকসুলভ অসংগত ব্যবহারেরও কিছুটা সম্পর্ক ছিলাে। আর তা এমন কাজ ছিলাে, যা ন্যায়পরায়ণ কোনাে শাসকের জন্য শােভনীয় ছিলাে
।” (তাফহিমুল কোরআন, ৪র্থ খণ্ড, ২২৭ পৃঃ) পবিত্র কোরআনে হযরত দাউদের (আঃ) প্রতি আল্লাহ্ তায়ালা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মওদুদী সাহেব এই মহান মর্যাদার অধিকারী রাসূলকে কুপ্রবৃত্তির বশীভূত ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী’ বলে মন্তব্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সত্যি মওদুদী সাহেবের এসব বাতিল ধ্যান-ধারণা দেখে যেকোন বিবেকবান লােক বিস্মিত না হয়ে পারেন না। মওদুদী সাহেব তার বিভিন্ন লেখায় মহানবী (সঃ) সম্পর্কেও সমালােচনা করেছেন, তাঁর সম্পর্কে ধৃষ্টতামূলক উক্তি করেছেন। দজ্জাল সম্পর্কিত হাদীসগুলাে সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন “এ সম্পর্কে
যেসব কথা হুজুরের নিকট থেকে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মূলত এগুলাে ছিলাে তার অনুমান (কিয়াস)। এসব সম্পর্কে তিনি নিজেও সন্দিহান ছিলেন। এসব কথা তিনি ওহী লাভের ভিত্তিতে বলেননি, বরং অনুমান করে বলেছিলেন।…..(রাসায়েল ও মাসায়েল, ৫৫-৫৬ পৃঃ -মওদুদী) মহানবীর (সঃ) হাদীস সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “হাদীস কিছু লােক থেকে কিছু লােক পর্যন্ত অর্থাৎ মানুষের মুখে মুখে বর্ণিত হয়ে আসছে। এসব বড়জোর সঠিক বলে ধারণা করা যায়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায় না। আর এ কথা স্পষ্ট যে, আল্লাহর ধর্মের যেসব বিষয় এত গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলাের দ্বারা ঈমান ও কাফেরের পার্থক্য পিরষ্কার হয়ে যায়, সেগুলাে কয়েকজন লােকের বর্ণনা নির্ভর করে মানুষকে বিপদাপন্ন করা আল্লাহ তায়ালা কখনাে পছন্দ করতে পারেন।
।” (ঐ, ৬৭ পৃঃ) পবিত্র কোরআনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “কোরআন করিম হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট; কিন্তু নাজাত বা মুক্তির জন্য নয়।” (তাফহিমাত, ১ম খণ্ড, ৩১২ পৃঃ) ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে ইহকালের কল্যাণ এবং পরকালের নাজাত বা মুক্তিলাভই হচ্ছে হেদায়েত বা সৎপথ গ্রহণের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মওদুদী সাহেবের মতে পবিত্র কোরআন হেদায়েতের জন্য। যথেষ্ট, মুক্তির জন্য নয়। তার এই উদ্ভট উক্তি থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে মুক্তির জন্য মানুষ অপর কোন্ ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করবে? সেসব কি মওদুদী রচনাবলী? মনে হয় স্পষ্ট বলতে সাহস না করলেও কৌশলে তিনি তাই বােঝাতে চেয়েছেন। নবী-রাসূলদের পরই সাহাবাদের মর্যাদা। তাঁদের সম্পর্কে মহানবী (সঃ) বলেছেন, ‘আমার সাহাবারা নক্ষত্রের মতাে। তাদের মধ্যে যাকে তােমরা অনুসরণ করবে, সঠিক পথ লাভ করবে। আর মহানবী প্রশংসিত সাহাবা কেরামও মওলানা মওদুদীর সমালােচনা থেকে অব্যাহতি পাননি। তাঁদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “দীর্ঘ দিনের শিক্ষাদীক্ষার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাদেরকে রণাঙ্গনে নিয়ে আসেন। তাদের মন-মানসিকতায় মহাবিপ্লব চিত্রিত হওয়ার পরও ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধগুলােতে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদের মূল তাৎপর্য অনুধাবনে সাহাবা কেরামরা বার বার ভুল করতেন।” (তরজমানুল কোরআন, রবিউসসানী, ১৩৫৭ হিঃ)। মওদুদী সাহেব সাহাবাদের সম্পর্কে বলেছেন, “সাহাবায়ে কেরামের অনেকে মনগড়া হাদীস বর্ণনা করেছেন।” (তরজমানুল কোরআন, ৩৫শ সংখ্যা) “সাহাবাদের মধ্যে জাহিলিয়াতের বদস্বভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটে।” (তাফহিমাত, ২য় খণ্ড, ১৫৫ পৃঃ)। “অনেক সময় সাহাবাদের মধ্যেও মানবিক দুর্বলতা প্রাধান্য লাভ করতাে। তারা একে অপরকে আক্রমণ করে বসতেন এবং পরস্পরে গালিগালাজ শুরু করতেন।” (তরজমানুল কোরআন, ৩শ সংখ্যা) ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব লিখেছেন, “ইসলাম মানুষকে এই নির্দেশ দেয় যে, সে যেন। কখনাে রিপুর প্রভাবে প্রভাবিত না হয় …এটা অত্যন্ত সূক্ষ্ম ব্যাপার। একবার হযরত আবু বকর সিদ্দিকের মতাে রিপুর তাড়নামুক্ত খােদাভীরু ও আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিও তা পূরণ করতে ব্যর্থ হন।” (ঐ) তরজমানুল কোরআনের একই সংখ্যায় হযরত ওমর (রাঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “বিশ্ব প্রতিটি উচুর সামনে মাথা নত করতে অভ্যস্ত ছিলাে এবং প্রত্যেক বুজুর্গ মানুষকে সাধারণ মানুষের স্তর থেকে কিছু না কিছু উর্ধে ধারণা করে আসছিল। এই ধারণার প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার পথও কখনাে কখনাে স্পষ্ট হয়ে উঠতাে..। সম্ভবত এই ব্যক্তিশ্রেষ্ঠত্বের ধারণাই রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও কিছুক্ষণের জন্য হযরত ওমরকে পরাভূত করে ফেলেছিলাে।” (ঐ) খেলাফতে রাশেদার প্রতি জাহিলিয়াতের হামলার বর্ণনা প্রসঙ্গে মওদুদী। সাহেব হযরত ওসমানের (রাঃ) সমালােচনা করে বলেছেন, “একদিকে ইসলামী রাষ্ট্র দ্রুত সম্প্রসারণের দরুন কাজ দিন দিন কঠিনতর হচ্ছিলাে, অপরদিকে হযরত ওসমান যার উপর এই বিরাট কাজের বােঝা ন্যস্ত করা হয়েছিল, তিনি ততটা যােগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন না যা তাঁর পূর্বসূরীদের ছিলাে। এজন্য জাহেলিয়াত ইসলামী সমাজব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের পথ পেয়ে যায়।” (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দিন, ৩৩ পৃঃ)। হযরত ওসমান (রাঃ) হত্যাকাণ্ডের প্রতিশােধের দাবি উঠানাে হলে হযরত মায়াবিয়ার লােকদের উদ্দেশ্যে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ)
বলেন, এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যথাসময়ে অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশােধ নেয়া হবে। কিন্তু মওদুদী সাহেব হযরত আলীর (রাঃ) এই জবাবের সমালােচনা করে বলেন, “ইনসাফ করাে, তুমি যদি মায়াবিয়া হতে কিংবা মায়াবিয়া না হও অন্তত সিরিয়ার একজন সাধারণ নাগরিক হতে, তাহলে বর্ণিত পটভূমির প্রেক্ষিতে তুমি কি আলীর জবাবকে একটা বাহানা, গড়িমসি, ছলনা ও অস্বীকৃতি ছাড়া সৎ উদ্দেশ্য প্রণােদিত মনে করতে?” (তাজাল্লী, ডিসেম্বর, ১৯৫৭) উপমহাদেশের আলেম সমাজ মওদুদীর এসব উক্তির কঠোর সমালােচনা করলেও জামায়াতীরা এসব সঠিক বলে বিশ্বাস করে। মওদুদী রচনাবলী কোরআন-হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা ও ধর্মতত্ত্ব হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। দেশের আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব বই-পুস্তক ও কোরআনের তফসীর পরিকল্পিতভাবে ছড়ানাে হচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন ধর্মপরায়ণ লােকেরা মওদুদীর ইসলামের নামে আপত্তিকর ও চটকদার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে। মওদুদীর অনুসারীরা তাকে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ বলে প্রকাশ করে। এজন্য দেশের সচেতন নাগরিক, বিশেষ করে আলেম সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আর এটা করা আলেম সমাজেরই ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।
জামায়াতের দৃষ্টিতে পীর-মুরিদী
ইসলাম ও মুসলমানদের ইতিহাসে শরীয়তভিত্তিক আধ্যাত্মিক শিক্ষাদীক্ষা বা পীর-মুরিদীর ধারা যুগ যুগ থেকে চলে আসছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়েও নির্দ্বিধায় বলা চলে, এ হচ্ছে। বাস্তব ইতিহাস। একথা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, পৃথিবীতে অস্ত্রবলে ইসলাম বিস্তার লাভ করেনি। সূফী-সাধক, আওলিয়া-দরবেশ ও পীর-মাশায়েখদের মাধ্যমেই ইসলামের প্রচারপ্রসার হয়েছে। বিশেষ করে, উপমহাদেশে তারাই এই মহান দায়িত্ব পালন করেছেন। এক্ষেত্রে কোনাে মুসলিম রাজা-বাদশাহ কিংবা তথাকথিত স্বঘােষিত ইসলামিক ভাষ্যকারের উল্লেখযােগ্য ভূমিকা বা অবদান নেই বললেই চলে। পীর-ফকির নামধারী দু’চারজনের ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা ও কর্মকাণ্ড সম্পর্কে কথা থাকলেও সবার বিরুদ্ধে এবং সুফিবাদ সম্পর্কে ঢালাও সমালােচনা অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ। কিন্তু মওদুদী সাহেব আধ্যাত্মিক শিক্ষা-দীক্ষার এই ঐতিহাসিক ধারার বিরুদ্ধে অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, “অনৈসলামিক বৈরাগ্যজনিত অজ্ঞতার আক্রমণ থেকে ওলামা, মাশায়েখ, পীর-দরবেশ এবং মােত্তাকী-পরহেজগার কারাে রেহাই মেলেনি। পরিণামে এই হয়েছে যে, তাদের মধ্যে বৈরাগ্যজনিত অজ্ঞতার ব্যাধি সংক্রামক আকারে বিস্তার লাভ করেছে।” “বৈরাগ্যজনিত অজ্ঞতার ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “এর ভিত্তিতে এক বিশেষ ধরনের জীবন ব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। এর বিভিন্ন রূপজ্জবৈদিক মত, মানবতাবাদ, সম্মােহন, যােগ, তাসাউফ, খৃষ্টীয় সন্ন্যাসবাদ এবং বৌদ্ধ মত প্রভৃতি নামে খ্যাত।” (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দীন, ২৩ পৃঃ-মওদুদী) একই গ্রন্থের অপর এক স্থানে তিনি বলেছেন, “তরীকতের মাধ্যমে মুসলমানদের আফিম খাওয়ানাে হয়। তাতে তাদেরকে অচেতন, অকেজো ও অকর্মণ্য করে দেয়া হয়।” (পূর্ববৎ, ৪২ পৃঃ)। তিনি আরাে বলেছেন, “বায়য়াত বা মুরীদ হওয়ার পর তরীকতের পীর ও মুশরিক বা অংশীবাদীদের দেবতার মধ্যে কোনাে পার্থক্য থাকে। ।”(ঐ, ১৩২ পৃঃ)
এভাবে মওদুদী সাহেব তার তাসাওফ সম্পর্কিত লেখায় পীর-মুরীদ ও অধ্যাত্মবাদ সম্পর্কে বহু আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। আমরা পূর্বে একাধিকবার উল্লেখ করেছি, পবিত্র ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করতে গিয়ে মওদুদী অসংখ্য স্ববিরােধী উক্তি করেছেন। একই বিষয়কে পবিত্র ইসলামের নামে একবার জায়েজ আবার নাজায়েজ বলেছেন। এক্ষেত্রেও তিনি ব্যতিক্রমটি করেননি। পীর-মুরিদী ও তাসাওফ সম্পর্কে উপরে উল্লিখিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণগুলাে মওদুদী সাহেবের পরিণত জীবনের। কিন্তু তার আগে তিনি এ সম্পর্কে অনেকটা প্রচলিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। প্রথম জীবনে, বিশেষ করে তিরিশের দশকে মওদুদী সাহেব তাসাওফের ব্যাখ্যা দান প্রসঙ্গে বলেছেন, “ইসলামী তাসাওফ শরীয়ত থেকে স্বতন্ত্র কিছু নয়, বরং শরীয়তের বিধানগুলােকে সর্বাধিক আন্তরিকতা ও সৎসংকল্প সহকারে পালন করা এবং আনুগত্যের ভিতরে আল্লাহর প্রেম ও ভীতির মনােভাব সঞ্চয় করার নামই হচ্ছে তাসাওফ।” (রাসায়েলে দ্বীনিয়াত, বাংলা সংস্করণ, ইসলাম পরিচিতি, ১৬৭ পৃঃ) পাঠকদের মনে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগতে পারে, পরবর্তী জীবনে মওদুদী সাহেব পীর-মুরিদীর উপর এরূপ ক্ষেপে গেলেন কেন? পীর-মুরিদীকে কেন তিনি দেব-দেবীর পূজার সাথে মিলিয়ে দিলেন? এই প্রশ্নের ব্যাখ্যা মওদুদী সাহেবের অনুসারী জামায়াতিরা কি দেবেন জানি না। তবে আমাদের নিকট এর জবাব অত্যন্ত সহজ। প্রথম জীবনে মওদুদী সাহেব পীর-মুরিদীকে তার চলার পথে, উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার পথে কোনােরূপ বাধা মনে করেননি। তাই তিনি তাসাওফ সম্পর্কে প্রচলিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। কিন্তু পরবর্তী জীবনে দেখেন, উপমহাদেশের প্রায় সব মুসলমানই কোনাে না কোনাে পীর-মাশায়েখের। মুরীদ বা অনুসারী। আর মুসলমানদের এই সামাজিক পরিবেশ পবিত্র ইসলামের নামে তার তথাকথিত জামায়াতের প্রচার-প্রসারের পথে বিরাট বাধা হয়ে দাড়িয়েছে। জামায়াতের প্রচার-প্রসারের পথের এই বাধা সরানাের লক্ষ্যে তিনি তাসাওফ ও পীর-মাশায়েখদের বিরুদ্ধে কলমা জেহাদ ঘােষণা করেন। তাদেরকে তিনি দেব-দেবীর কাতারে নিয়ে দাড় করান। এজন্যই আমরা বলে আসছি, পবিত্র ইসলাম হচ্ছে মওদুদী সাহেব ও তার অনুসারী জামায়াতিদের একটা হাতিয়ার, একটা মুখােশমাত্র। এই হাতিয়ার তারা যখন যেভাবে প্রয়ােজন প্রয়ােগ করছেন। বাংলাদেশে বর্তমানে বহু পীর-মাশায়েখ রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে কারাে কারাে ভক্ত-মুরীদের সংখ্যা কয়েক লাখ রয়েছে। কিন্তু একথা অপ্রিয় হলেও সত্য যে, তাদের মধ্যে দু’একজন ছাড়া কেউই ‘ঘরের শত্রু বিভীষণ’ জামায়াত সম্পর্কে কোনাে কথা বলছেন না। আমরা এদেশের পীর-মাশায়েখদের অনুরােধ করবাে, আপনারা ইসলাম ও মুসলমানদের বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসের দিকে তাকান। আমাদের সাথে একমত হবেন, প্রকাশ্য শত্রু বা বিরােধীরা মুসলমানদের যতাে না ক্ষতি করেছে, পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী বাতিল ফেরকাগুলাে তার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি করেছে। এজন্যই আল্লাহ্ তায়ালা পবিত্র কোরআনে। মুনাফিকদের বিরুদ্ধে কঠোর শাস্তির বিধান করেছেন। পীরমাশায়েখদের প্রতি আবেদন, মুনাফিকদের বিরুদ্ধে আল্লাহ তায়ালার কঠোর শাস্তি ঘােষণার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করুন। বাতিল ফেরকা জামায়াত সম্পর্কে মুখ খুলুন। এদেশের সরলপ্রাণ মুসলমানদের নিকট, বিশেষ করে আপনাদের নিজ নিজ ভক্ত ও মুরীদদের সামনে জামায়াতের আসল চেহারা তুলে ধরুন। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও এই দায়িত্ব আপনারা এড়াতে পারেন না। এটা আপনাদের পবিত্র দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।
আলেম সমাজের অভিমত
জামায়াত দাবি করছে তাদের সব কর্মকাণ্ডই নাকি ইসলাম রক্ষা করার জন্য। কিন্তু আমরা মনে করি জামায়াত ইসলামের মুখােশধারী একটি ফ্যাসিস্ট চক্র। চল্লিশের দশকের শুরুতে মওদুদী সাহেবের উদ্ভট ধ্যানধারণার ফলশ্রুতি হিসেবে জামায়াতের অভ্যুদয় ঘটে। একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে মওদুদী সাহেব তার দলের নামে পবিত্র ইসলাম শব্দটি সংযােজন করেন। উপমহাদেশের ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের জামায়াতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। তাছাড়া যারা জামায়াতের বিরােধিতা করবে তাদেরকে সহজে ‘ইসলামবিরােধী হিসেবে চিত্রিত করা যাবে। বস্তুত দলমত নির্বিশেষে উপমহাদেশের কোনাে খাটি আলেমই এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না। শুধু সমর্থন করেন না বললেই ঠিক হবে না, তারা এসবের চরম বিরােধিতা করে থাকেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র, সাময়িকী ও বই-পুস্তকের মাধ্যমে তারা জামায়াত ও মওদুদী সম্পর্কে তাদের অভিমত প্রকাশ করে থাকেন। এখানে জামায়াত ও মওদুদী সম্পর্কে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় এবং সর্বজনবরেণ্য কয়েকজন আলেমের অভিমত সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব। দেওবন্দের ওলামা কেরামের একটি ফতােয়ায় বলা হয়েছে, “মওদুদী। জামায়াত ও তাদের বই-পুস্তক সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইমামদের অনুসরণ থেকে মানুষকে সম্পর্কহীন করে ফেলে। আর এটা জনসাধারণের জন্য ধ্বংস ও পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের সাথে সঠিক সম্পৃক্ততা রাখার জন্য সাহাবা কেরাম ও ইমাম-মুজতাহিদদের সাথে যে সম্পর্ক থাকা দরকার জামায়াতের বই-পুস্তক তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। আর এটা নিঃসন্দেহে মুসলমানদের ধর্মের জন্য ক্ষতিকর ব্যাপার। এজন্য মওদুদীর বই-পুস্তক ও সেসবের উপর ভিত্তি করে গঠিত আন্দোলন জামায়াতকে আমরা ভ্রান্ত এবং মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করি। এজন্য আমরা এসবের সাথে সম্পর্কহীনতার কথা ঘােষণা করছি। (দু’মাসআলে, ১৬ পৃঃ)।
অপর একটি ফতােয়ায় মওদুদীর বই-পুস্তক ও তার সংগঠন জামায়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে, “মওদুদী জামায়াত ও এই দলের বই-পুস্তকের দ্বারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ইমামদের অনুসরণের প্রতি অনীহা ও সম্পর্কহীনতার সৃষ্টি হয়। আর এটা সাধারণ মানুষের ধ্বংস ও পথভ্রষ্টতা | ডেকে আনে।’ -স্বাক্ষর মওলানা মুফতি কেফায়েত উল্লাহ্, মওলানা | হােসাইন আহমদ মাদানী, মােহাম্মদ তৈয়ব, মুহতামিম, দারুল উলুম। দেওবন্দ, মওলানা আবদুল লতিফ, মুহতামিম, মাজাহেরুল উলুম, সাহারানপুর, প্রমুখ।” (আল জমিয়ত, ৩০ আগস্ট, ১৯৫১) দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি হযরত মওলানা সৈয়দ মাহদী। হাসান প্রদত্ত অপর একটি ফতােয়ায় মওদুদী জামায়াত সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এই আন্দোলনে মুসলমানদের শরীক হওয়া কখনাে উচিত হবে না। এটা তাদের জন্য জীবন সংহারক বিষ। মানুষকে এই আন্দোলনে শরীক হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। নতুবা তারা। গােমরাহ হয়ে যাবে। এটা তাদের জন্য কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষতিকর। শরীয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ মােটেও জায়েজ নয়। যে ব্যক্তি এই জামায়াতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রচার-প্রসার করে সে কল্যাণের পরিবর্তে পাপ কাজ করে। সে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে না। এবং মানুষকে পাপের দিকে আহ্বান জানিয়ে থাকে। যদি কোনাে মসজিদের ইমাম মওদুদী জামায়াতের সদস্য হয়, তাহলে তার পেছনে নামাজ পড়া মাকরূহ।” (জামায়াতে ইসলামী- কা রুখে কেরদার, ১৬৮ পৃঃ)। তাবলীগ জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মওলানা ইলিয়াস সাহেবের উত্তরসুরি তাঁর পুত্র হযরত মওলানা মােঃ ইউসুফ মওদুদী জামায়াতের কয়েকজন সদস্যের সাথে আলােচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, “মওদুদী জামায়াত একটি রাজনৈতিক ও ক্ষমতালােভী দল। তারা এমন জিনিসের প্রত্যাশী যা শরীয়তের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য।” (জামায়াতে ইসলামী- কা রুখে কেরদার, ৪১-৪২ পৃঃ) বেরেলবী চিন্তাধারার বিশিষ্ট আলেম হযরত মওলানা মােস্তফা খান সাহেব বেরেলবী ও মওলানা সাইয়েদ আফজাল হােসাইন, মুফতি, দারুল উলুম মানজারুল ইসলাম বেরেলবী মওদুদী জামায়াত ও তার ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে একটি ফতােয়া প্রদান করেন। তাতে তারা বলেন, “কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি মওদুদীর ভাষণের প্রথম খণ্ডটি আমাদের নিকট নিয়ে আসেন। আমরা তা গভীরভাবে দেখি। তাতে আমরা এই।
সিদ্ধান্তে পৌছি যে, তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসার ও উন্নতি বিধানের দাবি করে থাকেন। কিন্তু মূলত তার আন্দোলন ইসলামের ছিদ্র অন্বেষণ মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং কুফরী ও কাফেরী ছাড়া কিছু নয় । তিনি ইসলামের ভিন্ন অর্থ করে থাকেন। সাধারণ মুসলমানদের তিনি মুসলমান মনে করেন না। (ফেতনায়ে মুদুদিয়াত, ৫৮ পৃঃ)। বেরেলবী চিন্তাধারার অপর একজন বিশিষ্ট আলেম মওলানা সাইয়েদ। মােঃ রেজওয়ান মওদুদী সম্পর্কে বলেছেন, “মওলবী মওদুদী সাহেবের বিভিন্ন উদ্ধৃতি পাঠ করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌছেছি যে, তার মস্তিষ্ক। সর্বজনমান্য মনীষীবৃন্দ ও আম্বিয়া কেরামের প্রতি বেয়াদবি ও ধৃষ্টতায় পরিপূর্ণ। বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আমার অনুরােধ, তার বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা থেকে সতর্ক থাকুন। তাঁকে গােলাম আহমদ কাদিয়ানী ও গােলাম আহমদ পারভেজদের মতাে ইসলামের চরম শত্রু গণ্য করুন। কেউ তার প্রতারণার শিকার হবেন না। নবী করীম (সাঃ) বলেছেন, “আসল দাজ্জাল আত্মপ্রকাশের আগে তার পথ পরিষ্কার করার জন্য আরাে তিরিশজন দাজ্জাল আসবে। আমার মতে মওদুদী তাদের একজন।’ (মওদুদিয়াত কা পােস্ট মর্টাম, ৭ পৃঃ)। অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের সভাপতি বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মওলানা আবদুল ওহাব বলেছেন, “আমি আহলে হাদীস ভাইদের অনুরােধ করছি, তারা যেন নিজেদেরকে এই সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। নতুবা এই ব্যাধি শুধু তাদেরকে নয়, পুরাে আহলে হাদীস জামায়াতকে ধ্বংস করে ফেলবে। শুধু জোরে ‘আমিন’ বলা, “রাফে ইয়াদাইন করাই আহলে হাদীসের কাজ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের। আকায়েদ বা বিশ্বাস সংশােধন না করবে এবং পূর্ববর্তী মনীষী ও বুজুর্গদের দ্বীনের পথ আঁকড়ে না ধরবে ততক্ষণ দ্বীন ও নাজাত লাভ করা কঠিন হবে। সুতরাং বীরত্বের সাথে জামায়াতে ইসলামীর মােকাবিলা করতে হবে এবং তার শক্তি নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।” (মওদুদী জামায়াতের স্বরূপ, ৩৬৫ পৃঃ)। চট্টগ্রাম হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার মুফতী হযরত মওলানা ফয়জুল্লাহ্ সাহেব মওদুদী জামায়াত সম্পর্কে একটি ফতােয়া প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেছেন, “মওলানা মওদুদী আহলে সুন্নাত ওয়াজামায়াতের নীতি ও মতবাদ বিরােধী বিভ্রান্তিকর ও ত্রুটিপূর্ণ ধ্যান ধারণা পােষণকারী। তার অধিকাংশ লেখায় বিগত মনীষী, সাহা
কেরাম, তাবেয়ীন, ইমাম মুজতাহিদ ও আওলিয়া কেরামের প্রতি বেআদবি প্রকাশ পেয়েছে। তার ধৃষ্টতামূলক আক্রমণ থেকে মহান নবীরাও রেহাই পাননি। সুতরাং এই দলের সাথে ওঠাবাসা করা, সংশ্রব রাখা মুসলমানদের জন্য কোনাে অবস্থাতেই জায়েজ নয়।” (পূর্ববৎ, ৩৪৫ পৃঃ)। তাঁর এ ফতােয়ার প্রতি অভিন্ন মত প্রকাশ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্ত পনের ১৭ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম স্বাক্ষর করেন। এই ফতােয়ায় স্বাক্ষরদান প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হযরত মওলানা তাজুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের অভিমত সমর্থন করি। বস্তুত মওদুদী ফেতনা কাদিয়ানী ফেতনার চেয়ে কম নয়।” বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত মওলানা জাকারিয়া (রঃ) মওদুদী জামায়াত সম্পর্কে “ ফিয়ে মওদুদীয়াত” শীর্ষক একটি তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তক লিখেছেন। তিনি তাঁর এই পুস্তকে মওদুদী জামায়াতের ইসলামবিরােধী বিষয়গুলাে পবিত্র কোরআন-হাদীসের আলােকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তার বইয়ের এক জায়গায় মওদুদী জামায়াত সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “আমি এই ভ্রান্ত দলে যােগদান করা হারাম মনে করি। তাদের বই-পুস্তক পাঠ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর।” লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়ার প্রিন্সিপাল হযরত মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ‘ভুল সংশােধন’ শীর্ষক একখানা পুস্তক লিখে জামায়াতের ইসলাম বিরােধী ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দেন। তিনি তাঁর পুস্তকের এক জায়গায় লিখেছেন, “যাবৎ পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামীর মূলনীতিতে এই ঘােষণা দিয়া না দিবেন যে, আমরা মওদুদী সাহেবের এ ভুলসমূহ সম্পূর্ণ বর্জন করিয়াছি, তাবৎ পর্যন্ত জামায়াতে যােগদান করা, কাজ করা কোনাে মুসলমানের জন্য জায়েজ হইবে না। যাহারা সাহাবায়ে কেরামের দোষ চর্চায় লিপ্ত তাহারা যে কেহই হােন না কেনজ্জতাহাদিগকে ইমাম বানাইয়া পিছনে নামাজ পড়া কিছুতেই জায়েজ হইবে না। কারণ তাহারা সাহাবায়ে কেরামের দোষ চর্চার কারণে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত হইতে খারিজ হইয়া গিয়াছে।” খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মওলানা মােহাম্মদউল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর মওদুদী জামায়াত সম্পর্কে সতর্কবাণী’ শিরােনামে একটি পুস্তক লেখেন। তাতে তিনি মওদুদীর ভ্রান্ত মতবাদ ও জামায়াতে ইসলামীকে মুসলমানদের ঈমান ও ধর্মবিশ্বাস ধ্বংসকারী ফিতনা। হিসেবে আখ্যায়িত করেন। তিনি মুসলমানদেরকে ইসলামের মুখােশধারী এই দল থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। হাফেজ্জী হুজুরের এই পুস্তকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় চার শতাধিক আলেম অভিন্ন মত প্রকাশ করে স্বাক্ষর করেন। তাদের মধ্যে শেখুল হাদীস মওলানা আজিজুল হকও রয়েছেন। এ ছাড়া তিনি তার বােখারী শরীফ অনুবাদ গ্রন্থের শেষে জামায়াতের সমালােচানা করে শতাধিক পঠা লিখেছেন। তাতে তিনি মওদুদী ও জামায়াতে ইসলামীর ভ্রান্ত ধ্যানধারণা সম্পর্কে কোরআন-হাদিস এবং উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেম-ওলামাদের অভিমত উল্লেখ করে সারগর্ভ আলােচনা করেছেন। কিন্তু অপ্রিয় হলেও বলতে হয়, এই শেখুল হাদীস মওলানা আজিজুল হক বিগত নির্বাচনে সেই জামায়াতের সাথেই ঐক্যজোট করেছেন। এর চেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার আর কি হতে পারে! মওদুদী ও বাংলাদেশে তার দল জামায়াতে ইসলামীর বাতিল ধ্যানধারণা সম্পর্কে লালবাগ জামেয়া কোরানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মুফতি ফজলুল হক আমিনী বলেন, “যে মওদুদীবাদের উপর ভিত্তি করে জামায়াতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত সেই মওদুদী আকীদাকে আমাদের বুজুর্গানে দ্বীন ও অলি-আল্লাহরা ভ্রান্ত মতবাদ বলে মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বিগত নির্বাচনে এই মুফতি আমিনীও জামায়াতের সাথে ঐক্যজোট করেছেন। জামায়াতের সাথে মুফতি আমিনীর এই গাঁটছড়া বাঁধার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের হাক্কানী আলেম-ওলামাদের পক্ষ থেকে আপত্তি উঠলে তিনি ইদানীং বলতে শুরু করেছেন, ‘আমরা। জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক ঐক্য করেছি। আদর্শগত ঐক্য করিনি।’ রাজনৈতক ঐক্য বলতে মুফতি আমিনী কি বােঝাতে চাইছেন? ভাল হােক খারাপ হােক, আদর্শ ছাড়া কি কোন্ রাজনীতি আছে? তাছাড়া আমিনীরাই এতাে দিন বলে আসছেন, ধর্ম থেকে রাজনীতি আলাদা নয়। আধুনিক রাজনৈতিক দলগুলাের বিরুদ্ধে হুংকার দিয়ে আসছিলেন, তারা ধর্ম থেকে রাজনীতিকে আলাদা করছে। ধর্ম ও রাজনীতি অভিন্ন সত্তা। কিন্তু জামায়াতের সাথে ঐক্যজোট করতে গিয়ে রাজনৈতিক ঐক্য করে তার ধর্মীয় আদর্শটা তিনি রাখলেন কোথায়? কেন রাখলেন, কিসের লােভে রাখলেন? আলেম সমাজ মুফতি আমিনীর এসব স্বার্থান্ধ ও অর্থহীন কথাবার্তার ব্যাখ্যা চাইতে পারেন। বায়তুল মােকাররম মসজিদের খতিব হযরত মওলানা ওবায়দুল হক মওদুদী জামায়াত সম্পর্কে অভিমত দান প্রসঙ্গে বলেছেন, তার প্রতি পূর্ণ পুস্তিকাদি দ্বারা সাধারণ ও নব্যশিক্ষিত লােকদের মধ্যে গােমরাহ। বিস্তার লাভ করছে।” (মওদুদী ফিতনা, ৩৫-৩৬ পৃঃ)
জালালাবাদ ইমাম সমিতির ৬৭ জন ইমাম ও বিশিষ্ট আলেম মওলানা মওদুদী ও তার অনুসারী জামায়াতিদের সম্পর্কে একটি ফতােয়া প্রদান করেন। উক্ত ফতােয়ায় তারা বলেন, “মওদুদী সাহেব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পরিপন্থী এক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে চান। তাই উপমহাদেশের সকল দলমতের হাজার হাজার ওলামা, মাশায়েখ ও মুফতী সাহেবান মওদুদী সাহেবকে পথভ্রষ্ট, তার দলে যােগদান করা হারাম এবং মওদুদী আকীদায় বিশ্বাসী ইমামদের পেছনে নামায আদায় মাকরূহে তাহরিমী বলে ফতােয়া দিয়েছেন। (জালালাবাদ ইমাম সমিতি কর্তৃক ১-৫-৮৮ তারিখে প্রকাশিত ফতােয়া)। এ ছাড়াও উপমহাদেশের যেসব শীর্ষস্থানীয় আলেম মওদুদী ও তার জামায়াতের পবিত্র ধর্মের নামে রাজনৈতিক ব্যবসায় ও ভ্রান্ত ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে বই লিখেছেন কিংবা ফতােয়া প্রদান করেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট তফসীরকার মওলানা আবদুল মজিদ দরিয়াবাদী, জামায়াতের প্রাক্তন নেতা মওলানা আমীন ইসলাহী, হযরত মওলানা গােলাম গাউস হাজারবী, হযরত মওলানা মুফতী মােঃ শফী, হযরত মওলানা জাফর আহমদ ওসমানী, হযরত মওলানা আতাহার আলী, মওলানা সােলায়মান নদবী প্রমুখ। উপমহাদেশের সকল মত ও পথের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের উল্লিখিত ভাষ্যগুলাে অত্যন্ত স্পষ্ট। এগুলাে ব্যাখ্যা করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। তারা অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় মওদুদী ও তার ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপ জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে তাদের সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইসলামের মুখােশধারী জামায়াতের আসল রূপটি এসব দেশবরেণ্য আলেমদের নিকট অস্পষ্ট নয়। তাই তারা জামায়াতকে মুসলমানদের ঈমান-আকীদার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। শুধু উল্লিখিত আলেমগণই নন, উপমহাদেশের খুঁটি আলেমরা সবাই জামায়াতের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা অনেকে বিভিন্ন ভাষায় জামায়াতের বিরুদ্ধে পুস্তক লিখেছেন। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেসব উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
মাদ্রাসা নিয়ে জামায়াতের রাজনীতি
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে সারা দেশের বেসরকারী মাদ্রাসাগুলাে সম্পর্কে একটি জরিপ চালানাে হয়। তাতে দেখা যায়, সরকারী নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে যেখানে সেখানে সাইনবাের্ড সর্বস্ব কতকগুলাে মাদ্রাসা গড়ে উঠেছে। কোনাে কোনাে মাদ্রাসায় ছাত্র। সংখ্যার চেয়ে শিক্ষকের সংখ্যা বেশি। একটি মাদ্রাসায় ছাত্র ছিল ১৩ জন আর শিক্ষক ছিলেন ১৭ জন। এক মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষক দিয়ে একাধিক মাদ্রাসা চালানাে হয়। ইনকিলাবী মওলানা মান্নানের মন্ত্রিত্বের আমলেই নাকি এধরনের সাইনবাের্ডসর্বস্ব মাদ্রাসা যত্রতত্র গজিয়ে ওঠে। কোনাে কোনাে মাদ্রাসা শিক্ষকের নিকট শােনা গেছে, তিনি বিশেষ ব্যবস্থায় এধরনের মাদ্রাসার অনুমােদন পাইয়ে দিতেন। এক পর্যায়ে এরশাদ সরকার মাদ্রাসার অনুমােদন দেয়া বন্ধ করে দেয়। ভুয়া মাদ্রাসার নামে জালিয়াতি করে জনগণের অর্থ আত্মসাৎ বন্ধ করার মহান লক্ষ্যে আওয়ামী লীগ সরকার পদক্ষেপ গ্রহণ করে। তারা সম্ভবত এমপিওভুক্ত ২৫১টি ভুয়া মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। সে সময় সরকারের এই সিদ্ধান্ত বিকৃত করে দৈনিক ইনকিলাবে একাধিক প্রতিবেদন ছাপা হয়। বলা হয়, সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে। জামায়াতের আমির মওলানা মতিউর। রহমান নিজামী, জামায়াত নেতা মওলানা দেলােয়ার হােসেন সাঈদী, ইসলামী ঐক্যজোট নেতা মুফতি ফজলুল হক আমিনীরা বিভিন্ন বকতৃতা-বিবৃতি ও সভা-সমিতিতে বলতে শুরু করেন, আওয়ামী লীগ সরকার মাদ্রাসা শিক্ষা উঠিয়ে দিচ্ছে। সরকারের ইসলাম বিরােধী এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তওহিদী জনতাকে রুখে দাঁড়ানাের আহ্বান জানানাে হয়। জামায়াতের আমির মওলানা মতিউর রহমান নিজামী এক সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, বিগত সরকার নাকি মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। মওলানা দেলােয়ার হােসেন সাঈদীও একাধিক সমাবেশে অনুরূপ বক্তব্য রেখেছেন। ২০০১ সালে পল্টনে, আয়ােজিত এক সমাবেশে মুফতি আমিনী সরকারের বিরুদ্ধে মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধের অভিযােগ করে কঠোর ভাষায় বক্তৃতা করেন।
সে সমাবেশেই তিনি তালেবান স্টাইলে বাংলাদেশের ক্ষমতা দখলের হুঙ্কার দেন। মজার ব্যাপার হলাে, মুফতি আমিনী সরকারী মাদ্রাসার ছাত্রও ছিলেন এবং শিক্ষকও নন। তিনি কওমী মাদ্রাসায় পড়ালেখা করেছেন। ঢাকার লালবাগে একটি কওমী মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন। তিনিও বিগত সরকারের আমলে এমপিওভুক্ত ভুয়া মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের কঠোর সমালােচনা করেন। অথচ তিনি যে চিন্তাধারার অনুসারী বলে দাবি করেন, তার পূর্বসূরি ওলামা-মাশায়েখরা বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির উদ্যোগে স্থাপিত আলিয়া মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই এর সমালােচনা করে আসছেন। হযরত মওলানা হােসাইন আহমদ মাদানী, হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানবী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হযরত মওলানা তাজুল ইসলাম, হাটহাজারীর হযরত মওলানা মুফতি ফয়জুল্লাহ, এমনকি আমিনী সাহেবের শ্বশুর হযরত মওলানা মােহাম্মদ উল্লাহ। হাফেজজি প্রমুখ ওলামা-মাশায়েখ মনে করতেন, উপমহাদেশে মুসলমান ও হিন্দুদের তাহজিব-তমদুন ও সভ্যতা-সংস্কৃতি ধ্বংস করে। ঔপনিবেশিক শাসন-শােষণ চিরস্থায়ী কিংবা দীর্ঘস্থায়ী করার ষড়যন্ত্র হিসেবেই বৃটিশরা কলকাতায় আলিয়া মাদ্রাসা এবং বেনারসে হিন্দু ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠা করেছিল। ইসলামের নামে প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানে এধরনের একটি মাদ্রাসাও নেই। সেখানে আছে ৩৬ শ’ কওমী মাদ্রাসা। এসব মাদ্রাসায় সরকারী কোনাে বরাদ্দ দেয়া হয় না। জেনারেল মােশাররফ ক্ষমতায় এসে কওমী মাদ্রাসা, এমনকি মসজিদ নির্মাণের ক্ষেত্রেও নানা বাধ্যবাধকতা আরােপ করেছেন। ২০০২ সালের ১২ জানুয়ারি জেনারেল মােশাররফ জাতির উদ্দেশে দেয়া এক নীতি নির্ধারণী ভাষণে পরিষ্কার ঘােষণা করেছেন, এখন থেকে ছাড়পত্র ছাড়া কোনাে মাদ্রাসা ও মসজিদ স্থাপন করা যাবে না।’ এ ধরনের কোনাে ঘােষণা যদি বাংলাদেশের কোনাে রাষ্ট্র প্রধান কিংবা সরকার প্রধান দিতেন তাহলে নিজামী সাঈদী আমিনীরা কি করতেন। তা কল্পনাও করা যায় না। এক শ্রেণীর টাউট মাদ্রাসার সাইনবাের্ড ঝুলিয়ে প্রতারণা করে সরকারী অর্থ আত্মসাৎ করছিল। বিগত সরকার সেসব মাদ্রাসার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নিলে নিজামী সাঈদী আমিনীরা কুট রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণােদিত হয়ে পবিত্র ধর্মের নামে কোরাস গাইতে শুরু করলেন, আওয়ামী লীগ সরকার দেশ থেকে মাদ্রাসা শিক্ষা বন্ধ করে দেয়ার ষড়যন্ত্র করছে! অথচ বর্তমান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও একই ধরনের মাদ্রাসাগুলাের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জোট সরকার। নিম্নমানের ৩ হাজার বেসরকারী শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে কারণ দর্শাও নােটিশ প্রদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তার মধ্যে মাদ্রাসা রয়েছে প্রায় এক হাজার। কিন্তু নিজামী সাঈদী আমিনীরা জোট সরকারের অংশীদার হওয়া সত্ত্বেও টু শব্দটি করেননি। তারা এখন নীরব কেন? তারা কি বলবেন, বিগত সরকারের মতাে বর্তমান বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারও ভুয়া মাদ্রাসাগুলাের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে মাদ্রাসা শিক্ষা উঠিয়ে দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে? আমরা জানি, তারা তা কখনাে বলবেন । সত্যি কথা বলতে কি, তাদের এই ভূমিকাই হচ্ছে পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
মদ ও বিয়ার নিয়ে জামায়াতের রাজনীতি
বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার ২০০৩-৪ অর্থবছরের বাজেটে অন্যান্য পণ্যের সাথে মদ ও বিয়ারের শুল্ক ১শ’ শতাংশ হ্রাস করে। জায়নামাযের উপর ১৫ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরােপ করে। কয়েকটি | সংগঠন মদ ও বিয়ারের শুল্ক হ্রাস প্রস্তাব প্রত্যাহারের দাবি জানায়। বিরূপ প্রতিক্রিয়ার প্রেক্ষিতে প্রধানমন্ত্রী মদ ও বিয়ারের শুল্ক হ্রাসের প্রস্ত বি প্রত্যাহারের নির্দেশ প্রদান করেন। এর আগেও বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার দুটো শিল্প কারখানাকে মদ তৈরির অনুমতি দিয়েছিল। ব্যাপারটা সম্পর্কে সংবাদপত্রে লেখালেখি ও বাদ-প্রতিবাদ শুরু হলে জনমতের চাপে সরকার উক্ত অনুমতি প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। মদ ও বিয়ারের উপর শুল্ক হ্রাস এবং জায়নামাযের সম্পূরক শুল্ক আরােপ সম্পর্কে জোট সরকারের শরীক দলগুলাের মধ্যে কারাে বিবৃতি দেখা যায়নি। জামায়াত প্রধান মওলানা মতিউর রহমান নিযামী গত ২৮ জুন জাতীয় সংসদে বক্তৃতা প্রসঙ্গে মদ সম্পর্কে যে মন্তব্য করেছেন, তাতে পবিত্র ধর্মের মুখােশধারী জামায়াতের স্বরূপ আরেকবার উন্মােচিত হয়েছে। মদের দাম কমানাের পূর্ববর্তী প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি প্রকারান্তরে সমর্থন করে বলেন, প্রকৃত ঈমানদারের কাছে এর দাম হ্রাস-বৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না। তা ছাড়া ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা চালু না করা পর্যন্ত মদ পুরােপুরি নিষিদ্ধ করা সম্ভবও নয়। জনাব নিযামীর উপরােক্ত বক্তব্য দেখে সারা জাতি বিস্মিত হয়েছে। তিনি প্রকৃত ঈমানদারের কাছে ‘মদের দাম হ্রাস-বৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না’ বলে পরােক্ষভাবে মদের দাম হ্রসের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। কিন্তু জায়নামাযের উপর শুল্ক আরােপ সম্পর্কে তার কোনাে মন্তব্য সংবাদপত্রে দেখা যায়নি। গত ৩০ জুন জাতীয় সংসদে ২০০৩-৪ অর্থ বছরের বাজেট অনুমােদিত হয়েছে। শুল্ক হ্রাসকৃত পণ্যসামগ্রীর তালিকায় জায়নামায দেখা গেল না। এক্ষেত্রেও কি নিযামী সাহেব মনে করেন প্রকৃত ঈমানদারদের কাছে জায়নামাজের দাম হ্রসবৃদ্ধিতে কিছু আসে যায় না?
মদ সম্পর্কে অতীতেও জামায়াতের দ্বৈত ভূমিকা দেখা গেছে। ক্ষমতাসীন সরকারের প্রতি জামায়াতের সমর্থন থাকলে কিংবা ক্ষমতার অংশীদার হলে জাতীয় সংসদে মদ সম্পর্কিত আলােচনায় জামায়াত। নেতারা নীরব থাকেন। আবার বিরােধী দলে থাকলে মদ সম্পর্কিত আলােচনায় বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেন। পঞ্চম জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনে বিরােধী দলীয় আওয়ামী লীগ সদস্য এডভােকেট রহমত আলী সারা দেশে মদ্যপান ও জুয়া অনতিবিলম্বে বন্ধ করার। আহ্বান জানিয়ে একটি সিদ্ধান্ত প্রস্তাব উত্থাপন করেন। প্রস্তাবটি কণ্ঠভােটে নাকচ হয়ে যায়। সে সংসদে মওলানা মতিউর রহমান নিযামী ও মওলানা দেলােয়ার হােসেন সাঈদীসহ জামায়াতে ইসলামীর তিনজন সদস্য ছিলেন। কিন্তু প্রস্তাবটির পক্ষে কিংবা বিপক্ষে তাদের কোনাে বক্তব্য সে সময় সংবাদপত্রে দেখা যায়নি। তারা সে সময় সরকারে না থাকলেও বিএনপি সরকারের প্রতি তাদের সমর্থন ছিল। আর তাই তারা এব্যাপারে কোনাে বক্তব্য রাখেননি। অপর দিকে বিগত অষ্টম সংসদে মওলানা দেলােয়ার হােসেন সাঈদী মদ জুয়া নিষিদ্ধ করার আহ্বান জানিয়ে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করেন। বেসরকারী বিল সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে মদ সম্পর্কিত আলােচনায় জামায়াতের অতীত ভূমিকা টেনে এনে সাঈদীদের আন্ত রিকতা নিয়ে প্রশ্ন তােলা হয়। কিন্তু সাঈদী এর জবাব দিতে ব্যর্থ হয়ে উঠে চলে যান। আসলে ইসলামী বিপ্লব, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামী সমাজ প্রতিষ্ঠা প্রভৃতি শ্লোগান জামায়াতিদের মুখােশ ছাড়া কিছু নয়। উঠতে-বসতে এসব শ্লোগান তারা এদেশের ধর্মপরায়ণ মানুষের বিবেক কেনার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। তাদের মূল লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রক্ষমতা। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা পবিত্র ইসলামকে বাহন হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন। তাদের এই কৌশল জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীই শিক্ষা দিয়ে গেছেন। মওদুদীকে লেখা পাকিস্তান জামায়াতের এককালের নেতা মওলানা কাউসার নিয়াজি তাঁর একাধিক চিঠিতে এ বিষয়টি পরিষ্কার তুলে ধরেছেন। ষাটের দশকে এসব চিঠি ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। একটি চিঠিতে মওলানা নিয়াজি লিখেছেন, “প্রথমে আমরা নিজে সংসদে প্রার্থী হওয়া হারাম মনে করতাম।
কিন্তু এখন বিরােধী দলগুলাের সাথে মিলিত হয়ে নিজেরাও প্রার্থীদের নিকট থেকে দরখাস্ত আহ্বান করছি। প্রথমে আমরা পার্টি টিকিট প্রথাকে অভিশপ্ত মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা সম্মিলিত জোটের সাথে অসৎ লােকদেরও টিকিট বিতরণ করছি।… প্রথমে আমরা নারী-পুরুষের সম্মিলিত সভাসমিতিতে যােগদান করতাম না। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই এধরনের সমাবেশে বক্তৃতা করছি, সভাপতিত্ব করছি। প্রথমে আমরা। আলেমদেরকে ঐকদ্ধ করার চেষ্টা করতাম। রাজনৈতিক দলগুলােকে সঙ্গে নেয়া নাজায়েয মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা রাজনৈতিক দলগুলাের ঐক্যজোটকে শক্তিশালী করা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কর্তব্য মনে করছি। প্রথমে আমরা মহিলাদের ভােটাধিকার প্রদানের। বিরােধিতা করতাম। কিন্তু এখন আমরা মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান করার জন্য। উঠেপড়ে লেগেছি। প্রথমে আমরা ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বারণ করতাম। কিন্তু এখন আমরাই তাদেরকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করার আহ্বান জানাচ্ছি। প্রথমে আমরা মিছিল বের করা ও শ্লোগান দেয়া ইসলাম বিরােধী মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই মিছিল বের করছি, শ্লোগান দিচ্ছি, নেতাদের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছি। প্রথমে আমরা মানব রচিত আইন-কানুন দ্বারা পরিচালিত আদালতগুলােতে বিচার প্রার্থনা করা পাপ কাজ মনে করতাম। কিন্তু এখন আমরা এসব আদালতই ইনসাফ ও ন্যায়নীতি প্রতিষ্ঠার রক্ষক সাব্যস্ত করছি। প্রথমে আমরা আইনজীবীদেরকে শয়তানী সংঘের সদস্য মনে করতাম। কিন্তু এখন তাদেরকেই আমরা গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষক আখ্যায়িত করছি। … সময়ের দোহাই দিয়ে এতসব পরস্পর বিরােধী অভিমতকে আমরা ইসলামী ও দ্বিনী বলে গ্রহণ ও বর্জন করছি। এখন বিচার্য বিষয় হলাে, গ্রহণ ও বর্জনের এই মহড়ার পর জামায়াতের স্বার্থান্বেষী সদস্য ছাড়া কে আমাদের এই চিন্তাধারার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে? …” (সাপ্তাহিক শিহাব, লাহাের, ২৮ ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৫)।
মওলানা কাউসার নিয়াজির উপরােক্ত চিঠিটির অংশ বিশেষ উদ্ধৃত করার পর এই সীমিত পরিসরে বাংলাদেশে জামায়াতের মদ বিয়ার নিয়ে রাজনীতি সম্পর্কে বেশি কিছু বলার প্রয়ােজন আছে বলে মনে হয় এক কথায় বলা যায়, বাংলাদেশে তারাও তাদের প্রতিষ্ঠাতা মওলানা মওদুদীর উল্লিখিত কৌশলই অনুসরণ করছেন। পবিত্র ইসলাম নিয়ে তাদের এই কৌশল দেখে মহানবীর (সঃ) একটি হাদিস মনে পড়ছে। তিনি বলেছেন, শেষ যমানায় কিছু প্রতারক সৃষ্টি হবে। তারা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করবে। তারা মানুষের নিকট নিজেদের সাধুতা প্রকাশ ও মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ভেড়ার চামড়ার পােশাক পরবে (মানুষের কল্যাণকামী সাজবে)। তাদের রসনা হবে | চিনির চেয়ে মিষ্টি। কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ের হৃদয়ের মতাে। | হিংস্র…।” (তিরমিযি) মহানবীর (সঃ) উপরােক্ত হাদিসের সাথে জামায়াতের আমির মওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও অন্যান্য নেতা-কর্মীকে তাদের আচারআচরণ মিলিয়ে দেখার অনুরােধ করছি।

বিভিন্ন মুখােশে জামায়াত
মওলানা মওদুদীর ইসলামের নামে বাতিল ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপই হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। উপমহাদেশের রাজনীতি সচেতন নাগরিকরা সবাই জানেন, জামায়াতে ইসলামী একটি কালাে শক্তি। প্রতিষ্ঠাকাল থেকে এই দলটি ইসলামের মুখােশ পরে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিসহ বিভিন্ন কায়েমী স্বার্থের দালালী করে আসছে। বৃটিশ-ভারতে স্বাধীনতা আন্দোলনের দিনগুলােতে মওদুদী একদিকে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করেছেন, অপরদিকে বলেছেন, “যদি ইংরেজদের সাথে আপনার শত্রতা এজন্য যে, সে ইংরেজ, ছ’ হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে, আপনার দেশের। বাসিন্দা নয়, তাহলে আপনার এ শক্রতা ইসলামী শক্রতা নয়, অজ্ঞতাপ্রসূত শক্রতা।’ তিনি ব্যঙ্গ করে পাকিস্তানকে ‘লেংড়া পাকিস্তান’ ‘লুলা পাকিস্তান’ আরাে কত কিছু বলেছেন। আবার পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার। পর ভারত থেকে পাকিস্তানে এসে তাঁর ও দলের অতীত ভূমিকা। বেমালুম ভুলে যান। বলতে শুরু করেন, তিনি নাকি পাকিস্তান আন্দোলনের সময় জামায়াতে ইসলামীকে রিজার্ভ ফোর্স হিসেবে আলাদা রেখেছিলেন। মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে তিনি দল নিয়ে মাঠে নামতেন। সে সময় উল্টো তিনি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার জন্য মুসলিম লীগ নেতৃত্বকে দায়ী করেন। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতেও জামায়াতের ভূমিকা একই ছিল। মুক্তিযুদ্ধে জামায়াতিদের জঘন্য ভূমিকা এদেশের মানুষ আজো ভুলতে পারেনি। জোট সরকারের শরিক দল হওয়া সত্ত্বেও একাত্তরে স্বাধীনতা বিরােধী ভূমিকার জন্য এদেশের সচেতন নাগরিকরা জামায়াতকে পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী দয়ামায়াহীন একটি ফ্যাসিস্ট চক্র মনে করে। ১৯৭৯ সালে তৎকালীন সামরিক সরকারের আশীর্বাদে আত্মপ্রকাশের পরও জামায়াত স্বাভাবিক সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে পারেনি। এরূপ পরিস্থিতিতে তারা নানা ধরনের অঙ্গ ও সহযােগী সংগঠন গড়ে তােলার প্রতি গুরুত্বারােপ করে। পাকিস্তান আমলের ইসলামী ছাত্র সংঘের সংঘ’ শব্দটি বাদ দিয়ে শিবির শব্দ সংযােজন করা হয়।
এছাড়া ছাত্র সংঘের দলীয় পতাকা, মনােগ্রাম ইত্যাদি সবই ঠিক রাখা হয়। প্রতিষ্ঠালগ্নে এর কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা নেতৃত্বের সবাই ছিল আগেকার ছাত্র সংঘের নেতা ও খুনী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কিংবা সদস্য। জামায়াতের অন্যান্য সংগঠনগুলাের মধ্যে রয়েছে ছাত্র শিবির, যুব শিবির, ফালাহ আম ট্রাস্ট, ইসলামিক সমাজ কল্যাণ। পরিষদ, ইসলামিক ইকোনমিকস্ বুরাে, ইসলামিক সেন্টার, বিপরীত উচ্চারণ, সাইমুম শিল্পী গােষ্ঠী, ফুলকুড়ি আসর, আধুনিক প্রকাশনী, ইসলামিক এডুকেশন সােসাইটি, চাষী কল্যাণ সমিতি, শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন, মসজিদ মিশন, দারুল ইসলাম ট্রাস্ট, ইবনে সিনা ট্রাস্ট, ইসলামী ব্যাংক প্রভৃতি রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক প্রতিষ্ঠান। এসবের রয়েছে হাজারাে শাখা-প্রশাখা। অনেকের মতে এছাড়াও রয়েছে শতাধিক ইসলামিক এনজিও। জামায়াতের নেতা ও রােকনরা। এসব পরিচালনা করেন। এছাড়াও রয়েছে মােমিনীন সালেহীন নামের একটি আর্মড ক্যাডার সংগঠন। অনেকের মতে একাত্তরের বদর বাহিনীর বাংলাদেশ সংস্করণ হচ্ছে মুমিনীন সালেহীন সংগঠন। ১৯৭৫ সালের পর কোনাে এক সময়ে এই সংগঠন প্রতিষ্ঠা করা হয়। বিগত দুই দশকেরও বেশি সময় থেকে শিবির ও মুমিনীন সালেহীনের তাণ্ডব সারা দেশবাসী প্রত্যক্ষ করেছে। চট্টগ্রাম, রাজশাহী ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ এবং ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অসংখ্য নিরীহ ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কাটা ও হত্যার অভিযােগ রয়েছে শিবির ও মুমিনীন সালেহীন ক্যাডারদের বিরুদ্ধে। এমনকি, আশির দশকের শেষ দিকে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্র সমাজ ও ছাত্র দলের নেতা-কর্মীরাও শিবিরের নির্যাতনের খড়গ থেকে রেহাই পায়নি। সাপ্তাহিক বিচিত্রার ২৬ জুন, ‘৮৭ সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে,“আমাদের বিশেষ অনুসন্ধানে জামায়াতে ইসলামীর বিভিন্ন অপকৌশল এবং স্বাধীনতা বিরােধী কর্মকাণ্ডের বিচিত্র তথ্য উদ্ঘাটিত হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় আমরা জামায়াত এবং শিবিরের সঙ্গে আলাপ করেছি। জামায়াতের জনৈক ফয়সাল আহমেদ আলােচনা
প্রসঙ্গে আমাদেরকে জানান, ‘… প্রয়ােজনের সময় একাত্তরের অস্ত্রগুলাে আবার ব্যবহার হবে।… জামায়াত কাউকে ক্ষমা করে না।” গত ক’বছরে সারা দেশে আরাে বেশ কিছু জঙ্গী মৌলবাদী আন্ডারগ্রাউন্ড সংগঠন গজিয়ে উঠেছে। গােয়েন্দা বিভাগের মতে এসব সংগঠনের সংখ্যা ১২। প্রকৃতপক্ষে এই সংখ্যা আরাে অনেক বেশি। এসবের মধ্যে রয়েছে হরকাতুল জিহাদ, জামায়াতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ, শাহাদাতে আলহিকমা, জামায়াতে ইয়াহিয়া আততুরাত, হিজবুত তওহীদ, আল হারাকাত আল ইসলামিয়া, আল মারকাজুল ইসলামী, জামায়াতুল ফালাইয়া, তওহিদী জনতা, বিশ্ব ইসলামী ফ্রন্ট, জামায়াতুল আল সাদাত, শাহাদাতে নবুয়ত, আল্লাহর দল প্রভৃতি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী থেকে পরিচালিত এসব সংগঠনের শীখাপ্রশাখা বিভিন্ন জেলা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে। রাজশাহী, বগুড়া, নাটোর, চাঁপাইনবাবগঞ্জে বিভিন্ন সময়ে এসব সংগঠনের জঙ্গীরা ধরা পড়ার পর তাদের কাছ থেকে টাইম বােমা তৈরির সার্কিট, ব্যাটারি, রিমােট কন্ট্রোল, রিভলবার, গুলি, লিফলেট, বই, মােবাইল ফোন, অডিও ক্যাসেট, চাঁদার রসিদ বই, জেহাদী কাগজপত্র ইত্যাদি উদ্ধার করা হয়েছে।— রাজশাহীর পবা উপজেলায় জামায়াতে ইসলামীর স্থানীয় নেতা ডা. মােজাম্মেল হকের দারুশা বাজারস্থ বাড়িতে বােমা তৈরির সময় ৭ জামায়াত কর্মী গুরুতর আহত হওয়ার পর দুজন মারা যায়। মামলার তদন্ত শেষে সিআইডি চাশিীট দাখিলের পর বিচার কাজের জন্য আদালতে উঠলে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় রাজনৈতিক কারণ দেখিয়ে মামলা প্রত্যাহারের নির্দেশ দেয়।” (জনকণ্ঠ, ১৯/৮/০৩)। অপর একটি সংবাদে বলা হয়,“রাজশাহীর আতঙ্ক বলে খ্যাত নিষিদ্ধ ঘােষিত জঙ্গী মৌলবাদী সংগঠন শাহাদাত আল হিকমা এখনাে সক্রিয়। তবে বদলে গেছে তাদের কার্যকলাপের ধরন। আপাতত পাঠচক্র, খেলাফত সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি প্রভৃতি কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে তাদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হচ্ছে। … রাজশাহী মহানগরী জামায়াতের একজন নেতাই সার্বিকভাবে দলটির দেখাশােনা করছেন।” (ভােরের কাগজ, ২০/৮/০৩) এক প্রতিবেদনে বলা হয়,“জয়পুরহাটে ইসলামী জঙ্গী হামলার ঘটনা নিয়ে সরকার বিপাকে পড়েছে। প্রথমত, এখন পর্যন্ত লুট করা অস্ত্র,
গুলি এবং ওয়্যারলেস সেট পুলিশ উদ্ধার করতে পারেনি। দ্বিতীয় গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে এমন সব তথ্য বেরিয়ে আসছে, যা জো৯ সরকার এতােদিন অস্বীকার করে এসেছে। পুলিশের কাছে দেয়া গ্রেফতারকৃত সন্ত্রাসীদের জবানবন্দী এবং উদ্ধার করা কাগজপত্র থেকে | জানা গেছে, ক্ষমতাসীন জোটের অন্যতম শরিক জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক ছিল। তারা এও স্বীকার করেছে, দিনাজপুরসহ দেশের অন্যান্য স্থানে বােমা হামলা ঘটনার সঙ্গে তাদের সংগঠন জামায়াতুল মুজাহিদীন জড়িত। দেশের প্রায় সকল জেলায় এই সংগঠনের নেটওয়ার্ক এবং ঘাঁটি রয়েছে। এদের রয়েছে অস্ত্র তৈরির বিশেষজ্ঞ। নিজেদের তৈরি অস্ত্র দিয়েই এরা বিভিন্ন অপারেশন পরিচালনা করে থাকে। দেশের যেখানেই তাদের অপারেশনের পরিকল্পনা হয় সেখানে সারা দেশ থেকে জঙ্গীদের সমবেত করা হয়। এসব তথ্য প্রকাশ পাওয়ার পর জামায়াতুল মুজাহিদীন জোট সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামীর একটি গােপন অঙ্গ সংগঠন কিনা, এ নিয়ে। আইন-শৃংখলা বাহিনীকে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে।…” (জনকণ্ঠ, ২০/৮/০৩) ‘জামায়াতুলের আবরণে ইসলামী গণবাহিনী’ শীর্ষক এক প্রতিবেদনে বলা হয়, “সত্তরের দশকে জাসদের গণবাহিনীর মতাে জামায়াতুল মুজাহিদীনের মাধ্যমে সারা দেশে ইসলামী গণবাহিনী গড়ে তােলা হচ্ছে। যেখনেই জামায়াতুল মুজাহিদীনের সদস্য ধরা পড়ছে, দেখা যাচ্ছে তারা কোনাে না কোনােভাবে জামায়াতে ইসলামীর সাথে জড়িত। জয়পুরহাটের ক্ষেতলালের উত্তর মহেষপুরের যে বাড়িতে পুলিশের সাথে মুজাহিদীনদের সংঘর্ষ হয়, সে বাড়ির মালিক মুনতেজার দু’বছর আগেও জামায়াতে ইসলামীর সাথে জড়িত ছিল। সংঘর্ষের আগ পর্যন্ত মানুষ তাকে স্থানীয় জামায়াত নেতা বলেই জানতাে। এই ঘটনায় আরাে যাদের গ্রেফতার করা হয় তাদের অধিকাংশ জামায়াতের সাথে সরাসরি জড়িত ছিল। ফলে এরূপ সন্দেহ করার কারণ জোরালাে হচ্ছে। | যে, এরা এখন জামায়াতের প্রকাশ্য রাজনীতির পরিবর্তে গণবাহিনীর মতাে গােপন সংগঠনে কাজ করছে। এরূপ মনে করার আরাে কারণ হচ্ছে যেসব জায়গায় জামায়াতে ইসলামীর শক্ত ঘাঁটি রয়েছে সেসব স্থানেই জামায়াতুল মুজাহিদীনের নেটওয়ার্কের সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। গত মার্চে চাপাইনবাবগঞ্জের পােড়াবাগ মহল্লায় জামায়াতু”
মুজাহিদীনের ঘাঁটি আবিষ্কার থেকে শুরু করে জয়পুরহাট, দিনাজপুর সর্বত্রই এমন প্রমাণ মিলছে। “জামালপুর শহরের নয়াপাড়ার সদর দফতর থেকে জামায়াতুল মুজাহিদীনের সকল জঙ্গী তৎপরতা পরিচালিত হচ্ছে। আহলে হাদিসপন্থী মাদ্রাসার শিক্ষক, ছাত্র, মসজিদের ইমাম, অধ্যাপক, ব্যবসায়ীসহ যারা এর সদস্য তাদের অধিকাংশই জামায়াত-শিবির রাজনীতির দীক্ষাপ্রাপ্ত। চীফ কমান্ডার মওলানা আবদুর রহমান ইবনে আবদুল্লাহও এক সময় জামায়াতের প্রকাশ্য রাজনীতি করতাে বলে জানা গেছে। এছাড়া জঙ্গীরা যেখানেই ধরা পড়ছে সেখানেই জামায়াতের সাথে তাদের সম্পৃক্ততার প্রমাণ মিলছে। একাত্তরের কুখ্যাত আলবদর বাহিনী, যা জামায়াতে ইসলামীর ছত্রছায়ায় গড়ে উঠেছিল, তাদের সাথে জামায়াতুল মুজাহিদীনের সাদৃশ্য থাকায় এ সন্দেহ আরাে জোরালাে হয়ে উঠেছে। বদর বাহিনীরও জন্ম হয়েছিল তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের ময়মনসিংহ জেলা কমিটির সভাপতি আশরাফুল ইসলামের নেতৃত্বে এই ময়মনসিংহেই। “দিনাজপুরের রানীশংকৈল উপজেলায় গ্রেফতারকৃত জামায়াতুল মুজাহিদীনের প্রশিক্ষক ফজলে রাব্বী ও তার সহযােগী লুত্যর রহমানকে সিআইডি পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করছে। তারা দিনাজপুরের বােমা বিস্ফোরণের সাথে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেছে। লুত্যর জামায়াতে ইসলামীর একজন সক্রিয় সদস্য বলে পুলিশই জানিয়েছে। সে যে দলকে নিয়মিত চাঁদা দেয় তার কাগজপত্রও পুলিশ উদ্ধার করেছে। পঞ্চগড়, নীলফামারী, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা, জয়পুরহাট, বগুড়া, রাজশাহী প্রভৃতি এলাকায় জামায়াতুল মুজাহিদীনের শক্ত ঘাঁটি থাকার বিষয়টি পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। কিন্তু জঙ্গীদের চিহ্নিত করতে তাদের এজন্যই বেগ পেতে হচ্ছে যে, তারা প্রায় সকলেই সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মী।…” (জনকণ্ঠ, ২৫/৮/০৩) সারা দেশে ইসলামী জঙ্গীদের সন্ত্রাসী তৎপরতার এধরনের বহু খবর সংবাদপত্র-সাময়িকীগুলােতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলাে। তাছাড়া প্রত্যন্ত অঞ্চলের ঘটনাগুলাে সংবাদপত্রেও আসে না। এসব খবর প্রকাশ শুরু হওয়ার পর
জোট সরকারের শরিক জামায়াতে ইসলামীর নেতাদের বক্তৃতাবিবৃতিতে হঠাৎ একটা পরিবর্তন দেশের সচেতন নাগরিকদের দৃষ্টি এড়াবার কথা নয়। আগে জামায়াতের আমির থেকে শুরু করে নেতাপাতিনেতারা প্রায়ই বক্তৃতা-বিবৃতিতে ইসলামী আন্দোলন ইসলামী বিপ্লবের’ হুঙ্কার দিতেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, আমির মওলানা নিজামী পল্টনে ঢাকা মহানগর জামায়াতের কর্মী সম্মেলনে বলেছেন, “জামায়াত ক্ষমতার অংশীদার হয়েছে ইসলামী বিপ্লব করতে।” (জনকণ্ঠ, ৪/১/০৩)। কিন্তু জঙ্গী মৌলবাদীদের একটার পর একটা নাশকতা ফাঁস হয়ে পড়তে দেখে জামায়াতিরা এখন তথাকথিত ইসলামী বিপ্লবের শ্লোগান বাদ দিয়ে গণতন্ত্রের বয়ান আরম্ভ করেছে। জামায়াতের আমীর মতিউর। রহমান নিজামী সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বলেছেন, “ইসলামকে সন্ত্রাসী ধর্ম হিসেবে অপবাদ দেয়ার জন্য বিশ্ব ইহুদী চক্র বিভিন্ন দেশে জঙ্গী গ্রুপ তৈরী করছে। এই জঙ্গী তৎপরতার সাথে বিশ্বের মূলধারা ইসলামী শক্তির কোনাে সম্পর্ক নেই। … নবী-রাসূলগণ (আঃ) মানুষের উপর বল প্রয়ােগ করে ইসলাম চাপিয়ে দেননি। অথচ আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রকারী ইহুদীগােষ্ঠি অপপ্রচারের মাধ্যমে বােঝাতে চাচ্ছে, ইসলাম মানে সন্ত্রাস।…” (সংগ্রাম,৩০/৮/০৩) । তিনি লালমনিরহাটে বলেছেন, “ইসলামে সন্ত্রাসের কোনাে স্থান নেই। ইসলামের লেবেল এঁটে যারা সশস্ত্র আন্দোলন করছে এরা প্রকৃতপক্ষে ইহুদীচক্রের ক্রীড়নক। প্রকৃত ইসলামী আন্দোলন ধ্বংস করার জন্যই এসব করা হচ্ছে। ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। অথচ সারা বিশ্বে ইসলামের নামে জঙ্গীবাদী সন্ত্রাস চালিয়ে ইসলামী চেতনা ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হচ্ছে। আল কায়েদা, তালেবান, জামায়াতুল মুজাহিদীন। নানা নামে সাধারণ মুসলমানদের ব্ৰিত করা হচ্ছে।” (সংগ্রাম, ১৪/৯/০৩)। আগে যে ক’টি নাশকতার ঘটনা উল্লেখ করা হয়েছে তাতে দেখা যায় পুলিশের জিজ্ঞাবাদে অধিকাংশ অভিযুক্ত বলছে, তারা জামায়াতের স্থানীয় নেতা-কর্মী। জনাব নিজামীর দুটো বয়ান থেকে স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসে, তাহলে জামায়াত কি বিশ্ব ইহুদী চক্রের সাথে আঁতাত করে এসব জঙ্গীকে বাংলাদেশে নাশকতা তৎপরতায় নিয়ােগ করেছে?
নিজামী এখন আল কায়েদা-তালেবানের সমালােচনা করছেন। অথচ আফগানিস্তানে মার্কিন অভিযানের সময় তালেবান আল কায়েদার সমর্থনে জামায়াত-শিবির মিছিল-শােভাযাত্রা বের করে ঢাকার রাজপথ জনপদ গরম করেছে। খােদ নিজামী আফগানিস্তানের কারজাই সরকারের সমালােচনা করেছেন। সাবেক আমির গােলাম আজম লন্ডনের সাপ্তাহিক ‘ইউরাে বাংলায়’ (৮-১৪/১/০২ সংখ্যা) আশা প্রকাশ করেছেন, তালেবানদের প্রতি তাদের সমর্থন বহাল রয়েছে। তারা যথাসময়ে সংগঠিত হয়ে পুতুল সরকারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এবং তাদেরকে উৎখাত করবে ইনশাআল্লাহ।… তালেবান সরকারের পতনের ফলে বিশ্ব ইসলামী আন্দোলন বিরাট ক্ষতির সম্মুখীন হলাে, নতুন করে কোনাে দেশে ইসলামী সরকার কায়েমের আন্দোলন। ক্ষতিগ্রস্ত হলাে।’ (জনকণ্ঠ, ২/৩/০২)। এখন জামায়াতেরই পরবর্তী আমির মাওলানা নিজামী তালেবান আল কায়েদার সমালােচনা করছেন, ইহুদী এজেন্ট বলছেন। আজ যদি এসব জঙ্গী মৌলবাদী গ্রুপ ইহুদী এজেন্ট হয়ে থাকে, সেদিন তারা কার এজেন্ট ছিল? সেদিন নিজামীরা তাদেরকে সমর্থন করেছিলেন কেন। এ প্রসঙ্গে বলতে হয়, পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে আরাে বহু জঙ্গী মৌলবাদী। সংগঠন রয়েছে। যেমন মিসরে ইখওয়ানুল মুসলিমীন, ফিলিস্তিনে হামাস, হিজবুল মুজাহিদীন, লেবাননে হিজবুল্লাহ, আলজিরিয়ায় ইসলামিক সালভেশন ফ্রন্ট, তিউনিসিয়ায় আননেদাউল মুসলিমীন, ইন্দোনেশিয়ায় জামা ইসলামিয়া, পাকিস্তানে জায়শে মােহাম্মদ, লশকরে তাইয়েবা প্রভৃতি। নিজামীর ভাষায় এসব সংগঠনও কি আন্ত র্জাতিক ইহুদী চক্রের এজেন্ট? এরাও কি সাধারণ মানুষকে ‘ব্রিত’ করছে? রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে নিজামীদের থলের বিড়াল বেরিয়ে পড়েছে। এই বিড়াল আড়াল করার জন্য এখন নিজেদের অতীত ভূমিকার দিক না তাকিয়ে যা ইচ্ছে তাই বলছেন। মওলানা নিজামী বলেছেন, ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কিন্তু তাঁর গুরু মওলানা মওদুদী বলেছেন, বর্তমান যুগে যতগুলাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, এগুলাে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী।”(তরজমানুল কোরআন, ডিসেম্বর, ১৯৪৫) “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই।” (সিয়াসী কাশমকাশ, তৃতীয় খণ্ড) “এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রাতাত, সেসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম।” (রাসায়েল ও মাসায়েল, প্রথম খণ্ড, ৪৫ পৃষ্ঠা-মওদুদী). মওলানা নিজামীর কথা তার গুরুর কথার সম্পূর্ণ বিপরীত। নিজামী বলছেন, ইসলাম একটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। তাঁর গুরু বলেছেন, বর্তমান যুগের সব কটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তাঁর গুরু বলেছেন, বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর। প্রতিষ্ঠিত পার্লাসেন্টের সদস্য হওয়া, ভােট দেয়া হারাম। তাহলে পার্লামেন্টের সদস্য ও মন্ত্রী হয়ে, নির্বাচনে ভােট দিয়ে নিজামীরা কি হারাম কাজ করেছেন এবং করছেন? কোন্‌টা সঠিক আর কোন্টা বেঠিক তা দেশবাসীকে জানিয়ে দেয়ার দায়িত্ব মওদুদীর উত্তরসূরি হিসেবে জামায়াতের আমির মওলানা নিজামীর উপরই বর্তায়। এই দায়িত্ব নিজামী কোনােভাবেই এড়াতে পারেন না। সম্প্রতি জামায়াতের আমির মওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেছেন, তারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িত নন। কিন্তু বিভিন্ন স্থানে জামায়াতের যেসব নেতাকর্মী ধরা পড়ছে, তাদের সম্পর্কে নিজামী সাহেবের পরিষ্কার কোনাে বক্তব্য নেই। তিনি উদোর পিণ্ডি বুধাের ঘাড়ে চাপানাের চেষ্টা করেছেন। তিনি আওয়ামী লীগকে এসব ঘটনার সাথে জড়ানাের চেষ্টা করছেন। তার এই বক্তব্য কি এদেশের গণমানুষকে বিশ্বাস করানাে যাবে? প্রতিটি সচেতন নাগরিক জানে, আওয়ামী লীগ একটি গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দল। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্ব দানকারী আওয়ামী লীগের ইতিহাস নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাস। অপর দিকে পাকিস্তান আমল থেকেই জামায়াতে ইসলামীর আন্ডারগ্রাউন্ডে তৎপরতা চালানাের প্রশিক্ষণ ও অভিজ্ঞতা রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম আন্ডারগ্রাউন্ড দল হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী। স্বয়ং গােলাম আজম এই তথ্য প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন,“ঐ সময় জামায়াতে ইসলামীসহ সকল ইসলামী দল এবং স্বাধীনতা আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেনি (হানাদান পাকিস্তানী বাহিনীকে। সহযােগিতা করেছে) এমন সকল রাজনৈতিক দলই বে-আইনি ছিল । আদর্শবাদী দল হিসাবে জামায়াত আইনের পরােয়া না করে ‘৭২ সালের জুন মাসেই আন্ডারগ্রাউন্ড অবস্থায় সাংগঠনিক কাঠামাে দাঁড় করায়। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময়ও জামায়াত অপ্রকাশ্যে সুসংগঠিত ছিল। ‘৭২ সালের পরিবেশ ও পরিস্থিতি ঐ সময়কার তুলনায় অনেক বেশি কঠিন, প্রতিকূল ও বিপদসংকুল ছিল।” (জীবনে। যা দেখলাম, ১৩০ নং কিস্তি, সংগ্রাম, ১২/৯/০৩) রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে, পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের সময় এবং ১৯৭২ সালে স্বাধীন বাংলাদেশে চরম প্রতিকূল অবস্থায় যে দল আন্ডারগ্রাউন্ডে তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে, তাদের পক্ষে বর্তমানে ক্ষমতায় থাকা অবস্থায় আন্ডারগ্রাউন্ড সশস্ত্র সংগঠন গড়ে তােলা বিচিত্র কিছু নয়। তাতে করে সময় ও সুযােগ মতাে বিএনপিসহ শরিক দলগুলােকে ল্যাং মেরে ক্ষমতায় থাকা যাবে। জোট সরকারের শরিক দল জামায়াতে ইসলামীর এধরনের স্বপ্নবিলাসী পরিকল্পনা থাকা অস্বাভাবিক কিছু নয়। এই উদ্দেশ্যে জামায়াতে ইসলামী সারা দেশে বিভিন্ন নামে সশস্ত্র ইসলামী গণবাহিনী গড়ে তােলার একটা ব্যাপক উদ্যোগ নিয়ে থাকতে পারে।
উপসংহার
পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী জামায়াত একটি ফ্যাসিবাদী ধ্যান-ধারণার বাস্তবরূপ। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে ক্ষমতার মসনদ দখল করাই তার চরম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জামায়াতের রূপকার মওলানা মওদুদী ও জামায়াতের বিগত ষাট বছরের কর্মতৎপরতা তা-ই প্রমাণ করে। এ লক্ষ্য অর্জনের জন্যে হাতিয়ার হিসেবে তারা পবিত্র ইসলামকে বেছে নিয়েছে। জামায়াতের স্থপতি মওলানা মওদুদী প্রথম জীবনে হায়দরাবাদের নিযামের স্বার্থে পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দালালীর সময়ও ইসলাম ছিল তার একমাত্র হাতিয়ার। ইসলামের নামেই তিনি কংগ্রেস ও তার নেতৃবৃন্দকে গালিগালাজ করেছেন। মুসলিম লীগ ও তার নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তানের বিরােধিতায়ও তিনি একই অস্ত্র ব্যবহার করেন। মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা দেয়ার বিরােধিতায়ও যেমন ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছে, আবার ষাটের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নার সমর্থনে ইসলামই ছিলাে জামায়াতের হাতিয়ার। ইসলামের নামেই মওলানা মওদুদী বলেছেন, গণতন্ত্র অভিশপ্ত। আবার এই পবিত্র ইসলামের নাম মুখে নিয়েই তিনি বলেছেন, ইসলামের সারকথাই হচ্ছে গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতায়ও জামায়াতের হাতিয়ার ছিলাে ইসলাম। লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ ও নিরীহ নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞে জামায়াত পাক দখলদার বাহিনীর সহযােগিতা করেছে ইসলামের নামে। এক পর্যায়ে নিজেদের কর্মীদের রাজাকার, আলবদরের সাইনবাের্ডে বাঙ্গালী নিধন অভিযানে নামিয়ে দেয়। আর এসব নাকি তারা এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও পাকিস্তান রক্ষার জন্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে জামায়াতিদের স্লোগান ছিলাে-উপমহাদেশের এই অংশে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে ইসলামকে রক্ষা করা যাবে না। ভারত বাংলাদেশ দখল করে নেবে। ইসলাম ও মুসলমানদের নাম-নিশানাও এদেশে থাকবে না। ইসলাম রক্ষার জন্যই পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে হবে। কিন্তু। জামায়াত প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারত এদেশ দখল করে নেয়নি। ইসলাম ও মুসলমানরাও এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আগে যেমন ছিলাে আজো তেমনি আছে। এ থেকে প্রমাণিত হয়, পবিত্র ইসলামের নামে জামায়াতের স্লোগান কতাে অন্তঃসারশূন্য, কতাে অবাস্ত ব! এজন্যই উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ একবাক্যে ফতােয়া দিয়েছেন ইসলামের নামে মওদুদীর ধ্যান-ধারণা বিভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা। মওদুদী জামায়াত একটি বাতিল ফেরকা। এই জামায়াত থেকে দূরে থাকা মুসলমানদের ফরজ। মওদুদীর অনুসারীদের পেছনে নামায পড়া জায়েজ নয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে অবস্থানকারী জামায়াতিরা ঘাপটি মেরে থাকে এবং গােপনে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাতে থাকে। অপরদিকে গােলাম আযমসহ যারা পাকিস্তানে গিয়েছিল, তারা বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলাের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তােলে। জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতাবিরােধীদের পুনর্বাসন নীতির সুযােগে জামায়াতিরা পরাজিত শক্তি হয়েও পুনরায় স্বনামে আত্মপ্রকাশের সুযােগ লাভ করে। বর্তমানে পাইপলাইনে পেট্রো-ডলার আসছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে জামায়াতিরা মায়াকান্না করছে। কিন্তু অর্থ সরবরাহকারী রাজতান্ত্রিক দেশগুলােতে যে মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে কিছু নেই, সে সম্পর্কে টু শব্দটিও করছে না। জামায়াত যে ইসলামের মুখােশধারী একটি ফ্যাসিস্ট চক্র, তাদের এই দ্বিমুখী ভূমিকা থেকেই তা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়। সারকথা, জামায়াতের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার জন্যে যেকোনাে সাধারণ মানুষও নির্দ্বিধায় বলবে, জামায়াত বাংলদেশে পরাজিত শক্তি। আর ইসলাম রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের পর পরাজিত শক্তিকে জীবনে বেঁচে থাকার সুযােগদান করলেও কোনাে অবস্থায়ই রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করেনি। ইসলামের বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে পরাজিত শক্তিকে রাজনৈতিক অধিকার দেয়ার একটি দৃষ্টান্ত ও কেউ দেখাতে পারবে না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবীর (সঃ) আমলে পরাজিতদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী হত্যা কিংবা দাসদাসীতে পরিণত করা হতাে। পরবর্তীকালে পরাজিতদের জিম্মি হিসেবে গণ্য করা হতাে। তাদের নিকট থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হতাে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে পরাজিতদের মতামতের কোনাে মূল্য দেয়া হতাে না। তাদের কোনাে প্রকার রাজনৈতিক অধিকার ছিল না। সুতরাং বাংলাদেশেও পরাজিত শক্তি জামায়াত ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেই রাজনৈতিক অধিকার পেতে পারে না। এদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি জামায়াতের রাজনৈতিক তৎপরতা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই অবৈধ। অথচ ইসলামের নামেই জামায়াতিরা বাংলাদেশে ইসলাম বিরােধী কাজটি করে যাচ্ছে। এব্যাপারে দলমত নিবিশেষে সবাইকে, বিশেষ করে আলেম-ওলামা ও পীর-মাশায়েখদের সতর্ক হওয়া এবং সাধারণ মানুষকে জামায়াত সম্পর্কে সতর্ক করা ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি।