You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.05.22 | বাংলাদেশ একটি প্রত্যক্ষ প্রশ্ন | কম্পাস - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলাদেশ একটি প্রত্যক্ষ প্রশ্ন

এটা আজ স্পষ্ট অকাট্য সত্য যে বাংলাদেশ সম্পর্কে স্বাধীন সিদ্ধান্তগ্রহণে ভারত সরকার আজ অক্ষম ও দ্বিধাবিষ্ট। “কমিউনিস্ট’ বলে অভিহিক্ত জনগণতান্ত্রিক চীনের বিবেক অবশ্য এরকম কোনাে দ্বিধাতেই পর্যদস্ত নয়। যার পাকিস্তান নীতির মূল কথাই সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদীস্বার্থ পরিপুষ্ট সেই জনগণতান্ত্রিক চীনের পক্ষে যথার্থ কারণেই বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক গােষ্ঠীর ঘৃণ্যতম জান্তব অত্যাচারকে “পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষার্থে ন্যায়যুদ্ধ” আখ্যা দান করা সম্ভব হয়েছে। পাকিস্তান যে সিয়েটো ও সেন্টোর এভ), মার বিয়েটা সেন্টোর সভ্য অন্যান্য রাষ্ট্রগুলাের তরফ থেকে পাকিস্তান রণভাণ্ডারকে যেসব অস্ত্রদান করা হচ্ছে, মূলত আমেরিকাই যে সেগুলাের উৎস, এই সত্যও বাংলাদেশ-নিধনযজ্ঞের পিশাচনৃত্যে অজস্র অস্ত্রবিতরণ থেকে জনগণতান্ত্রিক চীনকে নিরস্ত্র করতে পারেনি।
এর কারণটি সহজবােধ্য। হংকংয়ের ব্রিটিশ উপনিবেশ ব্যতীত পশ্চিমদিকে এই চীনের একমাত্র বহিপথ পশ্চিম পাকিস্তান। পাকিস্তান এয়ারলাইনস ও করাচীপপার্টের সংযােগকারী কারাকোরাম হাইওয়েই (পাকিস্তান-চীন ফ্রেন্ডশিপ হাইওয়ে) আফ্রিকা ও ইউরােপে জনগণতান্ত্রিক চীনের অধিবাসীদের যাতায়াত ও আমদানিরপ্তানির প্রধান সড়ক। পাকিস্তানি সংবাদপত্রের ইদানীন্তন খবরে প্রকাশ যে, চীন শুরু থেকেই বছরে অন্তত ২৫০০ লক্ষ ডলার মূল্যের পণ্যদ্রব্য পাকিস্তানে রপ্তানি করে ব্যবসায়িক সম্পর্ক গড়ে তুলতে ইচ্ছুক। করাচী ডেইলি নিউজের খবর “চীনের রপ্তানিবাণিজ্যে সাহায্যের জন্য পাকিস্তান শিপিং কর্পোরেশন তার বর্তমান নৌবহরে আরাে তিরিশটি জাহাজ বাড়াবার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।” চৈনিক কর্মচারীরাও পাকিস্তান সামরিক বাহিনীকে পরামর্শ দিচ্ছেন এ সম্পর্কেও খবর প্রকাশিত হচ্ছে।
যদি এই ভৌগলিক রাজনৈতিক স্বার্থ ও বণিকী স্বার্থই জনগণতান্ত্রিক চীনের তথাকথিত “সাম্যবাদী” বিবেককে পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদী পাশবিকতাকেও “ন্যায়যুদ্ধ” আখ্যায় আশীর্বাদধন্য করতে অনুপ্রাণিত করে থাকে, মার্কসবাদের মহৎ আদর্শের এই লজ্জাকর অবমাননায় মাথা নত করলেও আমাদের ভারত সরকারের বর্তমান দ্বিধাদোদুল্যমানতার পেছনে, সিদ্ধান্ত গ্রহণে অসমর্থতার পেছনে কোনাে যুক্তিসঙ্গত নৈতিক, রাজনৈতিক, অথবা জাতীয় স্বার্থরক্ষার কারণ খুঁজে বের করা আরাে বেশি দুষ্কর বলে মনে হয়।
পরিস্থিতিটা কী? ভারত সরকার কি একথা বলতে পারেন যে বাংলাদেশের ঘটনাস্রোত কোন্ পথে চলছে তার কোনাে ঝটিকা সংকেত তারা যথেষ্ট পূর্বাহ্নেই পাননি? না, বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন, যে নির্বাচনে শেখ মুজিব শীর্ষ ক্ষমতায় আরােহণ করেছিলেন, তারও অন্তত দু’মাস আগেই ভারত সরকার, অনিবার্য যবনিকাপতন এবং অন্য এক বিধ্বংসী অধ্যায় সূচনার নিশ্চিত সম্ভাবনা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবেই অবহিত হয়েছিলেন। এটা কোনাে যুক্তিতেই গ্রাহ্য করা চলে না যে, শধুমাত্র নৈতিক-রাজনৈতিক বিজয়ের ভাবাদর্শের বলেই একটি সামরিক শাসনচক্রকে তার কুক্ষিগত উপনিবেশ পূর্ববাংলার উপর থেকে সম্পূর্ণ ক্ষমতা বর্জন করে নিতে বাধ্য করা যাবে শেখ মুজিবর এই রকমের একটা অবাস্তব মােহে আবিষ্ট হয়েছিলেন এটা কোনাে যুক্তিতেই গ্রহণযােগ্য বা বিশ্বাসযােগ্য নয়। এটা অসম্ভব। আজ মুজিবর রহমানের যে বক্তৃতা বিশ্ববিখ্যাত, সেই সাতই মার্চের বক্তৃতায় এটা খুব পরিষ্কার ভাবেই স্পষ্ট যে সশস্ত্র সংগ্রামের সম্ভাবনা সম্পর্কে তিনি পূর্ণতই সচেতন। ২৫শে মার্চের আগে অন্তত কয়েকবার, এমন কি যথেষ্ট আগে ১০ই মার্চ তারিখেও যে ভারত সরকার আওয়ামী লীগের তরফ থেকে তীব্র ঘটনাস্রোতের অনিবার্য সঙ্কটমুখীনতা সম্পর্কে একাধিক সংকেত এবং সাহায্যের জন্য একাধিক আবেদন লাভ করেছেন ভারত সরকারের পক্ষে আজ তা অস্বীকার করা অসম্ভব। শ্রীমতী গান্ধী নিজেই এ ব্যাপারে তাঁর মন্ত্রীসভার আস্থাসূচক আশ্বাসের অপেক্ষা করছিলেন, তাঁর নিষ্ক্রিয়তার কৈফিয়ৎ বা অ্যালিবাই হিসেবে এই হাস্যকর নড়বড়ে যুক্তি এক মুহূর্তও টিকতে পারে না। এতৎসত্ত্বেও সত্য ঘটনা এইটাই যে শেষ মুহূর্তে বাঙালি পুলিশ বাহিনী এবং ই.পি.আর ও ই.বি.আর সৈন্যদের বীরত্বপূর্ণ সগ্রাম ছাড়া যথেষ্ট অস্ত্রশস্ত্র ও সগ্রামের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক আক্রমণকে প্রতিহত করার জন্যে প্রায় আর কোনাে সশস্ত্রবাহিনীই ছিল না। এটাই বিশ্বাস করার পক্ষে যথেষ্ট যুক্তি রয়েছে যে ইয়াহিয়ার সঙ্গে আলাপ আলােচনার শেষ কয়দিন শেখ মুজিব একটা দুঃসাহসিক অথচ নিরুপায় আশা নিয়েই আন্তর্জাতিক স্থবিরতায় সামান্যতম স্পন্দনের জন্য কালক্ষেপ করছিলেন। এদের পূর্বাহ্নেই অবহিত করতে তিনি চেষ্টার ত্রুটি করেননি। কিন্তু সেই বহুপ্রতীক্ষিত শিরসঞ্চালনটুকুও এসে পৌছালাে না। তিনি বন্দিত্বই স্বীকার করে নিলেন।
আর আজ যখন জনগণতান্ত্রিক চীন নিষ্পলক দিবালােকেই বৈপ্লবিক বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সংহতির সমস্ত মৌলিক আদর্শের নির্বিচার নিধনকুণ্ডে তার বিবেকহীন মারণাস্ত্র সরবরাহ করে চলেছে বিনা বাধায়, তখন সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে সগ্রামরত পৃথিবীর সমস্ত সমাজবাদী শক্তিগুলাে ঘূণাকণ্টকিত লজ্জায় তাকিয়ে দেখছে যে সাম্যবাদী বলে পরিচিত, শান্তিবাদী বলে অচিত বৃহৎ গােষ্ঠীগুলাের সেই অর্থপূর্ণ শিরসংকেত এখনাে আসেনি, এখনাে তারা ‘পরিস্থিতি বিচারবিবেচনা করছেন, অবস্থা সম্পর্কে তাঁরা “সচেতন”! এমন কি মধ্যপ্রাচ্য থেকে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া হয়ে বিশ্বসাম্যবাদী আন্দোলনের খণ্ড ছিন্ন অংশগুলাে আজ যে সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের করতলগত হয়ে পড়েছে, তা-ই আজ সােভিয়েত রাশিয়ার তরফ থেকে বাংলাদেশের প্রতি সতর্ক প্রদশিত সামান্য করুণাকেও আষ্টেপৃষ্ঠে কোণঠাসা করে রেখেছে। এমন কি কয়েকজন আন্তর্জাতিক নেতা পর্যন্তও যেন এটা ভুলে গেছেন যে শুধু একতরফাভাবে কোন “সংহতিই টিকে থাকতে পারে না।
এখন, আজ আমাদের stake বা প্রত্যক্ষ প্রশ্নগুলাে কী? ভারতবর্ষের পক্ষে এই প্রত্যক্ষ প্রশ্নগুলাের গুরুত্ব পশ্চিম পাকিস্তানে জনগণতান্ত্রিক চীনের বণিকীস্বার্থের চেয়ে অনেক বেশি। যথা
ক. যে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত বিভক্ত হয়েছিল সেই তত্ত্বটি যদি এই উপমহাদেশকে চিরতরেক ক্ষীণশ্বাস করে রাখার জন্যে সাম্রাজ্যবাদী গােষ্ঠীর মুখ্য অস্ত্র হয়ে থাকে তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের এই অভ্যুদয় পাক-ভারত উপমহাদেশের দ্বিজাতিতত্ত্ব এবং এর সহযােগী সাম্রাজ্যবাদী স্বার্থেরই সমাধি নির্মাতা। এই কারণেই ব্রিটেন ও আমেরিকাতে আজ মানুষের বিবেক যতই ধিক্কারে মুখর, প্রতিবাদে সােচ্চার হয়ে উঠুক না কেন, ব্রিটেনের টোরি সরকার ও যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার বাংলাদেশে এই যুগান্তকারী বিপর্যয়কে পাকিস্তানের “আভ্যন্তরীণ ব্যাপার” বলে অভিহিত করে ইয়াহিয়া খানের উপরেই সমাধানের দায়িত্ব ন্যস্ত করে পরিস্থিতি বিচারবিবেচনা করছেন। পাকিস্তানের ঘৃণ্য বর্বরতাকে অনেকটা এই কারণেও চীনের পক্ষে “ন্যায়যুদ্ধ” বলে সমর্থন করা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই। এটি প্রকৃত অর্থে ধর্ম নিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ও সুসংহত ভারতীয় উপমহাদেশ ব্রিটেন, আমেরিকা, ও জনগণতান্ত্রিক চীনের বর্তমান শাসনচক্রের পক্ষে অভিনন্দনযােগ্য নয়।
খ.দিল্লী প্রাসাদকুটের অলিন্দে অলিন্দে যে অসুস্থদৃষ্টি আমলাতান্ত্রিকেরা নিজেদেরকে ভারতবর্ষের ভাগ্যনিয়ন্তা ভেবে পায়চারী করে ঘুরছেন, একমাত্র তাদের পক্ষেই সার্বভৌম স্বাধীনতার দাবীতে পূর্ববাংলার এই সগ্রামকে ভারতরাষ্ট্র, বিশেষত পূর্ব-ভারতের ভিতরকার বহির্মুখীন শক্তিগুলাের (centrifugal) ক্ষমতাবৃদ্ধির সহায়ক ভেবে এই স্বাধীনতাসংগ্রামকে ভারতবর্ষের পক্ষে রাজনৈতিক ক্ষতিকারক বলে আশঙ্কিত হওয়া সম্ভব। কিন্তু অন্য দিকে, বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক জাগরণের মাধ্যমে ধর্মভিত্তিক রাষ্ট্র ও দ্বিজাতিতত্ত্বের এই ঐতিহাসিক সমাধি ভারতীয় রাজনীতির পুনঃসংহতির পথে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ অনন্য সাধারণ পদক্ষেপ বলে ভাবীকালে পরিগণিত হবে। একদিকে, এর ফলে কাশ্মীর সমস্যার একটা স্থায়ী সমাধান প্রশস্ত হবে, কারণ কাশ্মীর সমস্যার মৌলিক আদর্শগত ভিত্তি বিচ্ছিন্নতাবাদই চূর্ণ বিচুর্ণ হয়ে যাবে। ভারতীয় রাজনীতির দক্ষিণমুখী প্রতিক্রিয়াশীলতা হিন্দু সাম্প্রদায়িকতাও ইতিহাসের এই পদাঘাতে ধূলিসাৎ হয়ে যাবে।
গ. অন্য দিকে যদি আজ বাংলাদেশের বিপ্লব ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়, তাতে যে শুধু পাক-ভারত উপমহাদেশে ইয়াহিয়া খানের মতাে বণিকী-ভূস্বামী দাসমনােবৃত্তি ও সাম্প্রদায়িক প্রতিক্রিয়াশীলতার (compradore landlord communal reaction) ধারক এবং বাহক যুদ্ধবাদীরাই পরিপুষ্ট হবে তাই নয়, সমস্ত পূর্বভারত, বিশেষ করে পশ্চিমবাংলার যে অবদমিত বহির্মুখী বিচ্ছিন্নতাবাদী স্বার্থগুলাে বারেবারে মাথা চাড়া দিতে চেষ্টা করবে, এক নিরাপত্তাহীন টলটলায়মান পরিস্থিতি দেখা দেবে। ভারতীয় বাংলাদেশের সঙ্গে সুস্থ সংহতির সম্পর্কযুক্ত বিজয়ী স্বাধীন বাংলাদেশ নয়, পরাজিত বাংলাদেশের হতাশাদীর্ণ বাঙালি জাতীয়তাবাদ পূর্বভারত এবং পশ্চিমবাংলাতে এক বিস্ফোরণমুখী সংকট সৃষ্টি করবে। নবজাগ্রত জাতীয়তাবাদ নয়, নৈরাশ্যনত জাতীয়তাবাদ থেকে বিচ্ছিন্নতাবাদ ও সংকীর্ণ স্বাদেশিকতা প্রণােদিত যুদ্ধবাদের (chauvinism) সৃষ্টি হয়।
ঘ. বাংলাদেশের বিপ্লব যদি ব্যর্থ হয় তাহলে প্রায় ৩০ লক্ষ বাঙালি উদ্বাস্তুর স্থান সংকুলান সমস্যায়
সমস্ত পূর্বভারতে বিরাট জটিলতা দেখা দেবে। এর ফলে পশ্চিমবাংলার ভগ্নপ্রায় অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাঠামােটি চূড়ান্তভাবে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যাবে এবং বাঙালি ও অবাঙালিদের মধ্যে রক্তাক্ত সংঘর্ষে সমস্ত পূর্বভারত বিপর্যস্ত হয়ে যাবে। এটা অসম্ভব নয় যে এই ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা পর্যালােচনা করেই বর্তমানে এই চীন আমেরিকার কর্ণধারেরা তাঁদের কার্যকলাপ নির্ধারিত এবং বিস্তৃত করছেন।
এইগুলােই যদি আজ ভারতবর্ষের প্রত্যক্ষ জটিল প্রশ্ন হয়, তাহলে সারা পৃথিবীর প্রগতিশীল শক্তিগুলাের প্রত্যক্ষ প্রশ্ন বা দায়িত্বের গুরুভারও কম নহে। সেই প্রশ্নগুলােকে নিম্নোক্ত শ্রেণীতে ভাগ করা যায় :
ক. সমস্ত ইসলামীয় জগতে যে প্যান-ইসলামীয় মতাদর্শ বিজ্ঞানশীল যুক্তিবিচারে ও উপলব্ধিতে প্রতিষ্ঠিত বা স্বীকৃত ধর্মনিরপেক্ষতা (শুধু ধর্মনিরপেক্ষতা সেকুলারিজম শব্দটির স্বয়ংসম্পূর্ণ প্রতিশব্দ নয়) ও সমাজবাদের অগ্রগতির পথে বহুকালের শিলাস্তুপের মতাে অনড় অটল বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল আজ পূর্বদিগন্তে বাংলাদেশের অভ্যুদয় তীব্র রশিতে প্রবল ক্ষমতায় তাকে উৎসাদিত করার সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ একক প্রাণশক্তি হিসেবে উপস্থিত হয়েছে। এই প্যানইসলামিবাদ আরব জাতীয়তাবাদেরও একটি নেতিবাচক দিক। বস্তুনিষ্ঠ বা অবজেকটিভ বিচারে আন্তর্জাতিক বিশ্বপটে আজ বাংলাদেশের এই স্থির প্রতিজ্ঞ প্রতিদ্বন্দী বৈশিষ্ট্যে (contrapuntal) আত্মপ্রকাশের মধ্যে এক গভীর ঐতিহাসিক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরােধী ফলশ্রুতি নিহিত রয়েছে।
খ. সমগ্র এশিয়া ও আফ্রিকার সমসাময়িক, বিভিন্ন চরিত্রের অন্যান্য বহু জাতীয়তাবাদের চেয়ে বাংলাদেশের বাঙালি জাতীয়তাবাদ অনেক বেশি মৌলিকভাবে প্রবল এবং প্রদীপ্ত। নব ঔপনিবেশিকতাবাদী, বণিকীদাসত্ব ও সামন্ততান্ত্রিকতার (compradore-feudal) দাম্পত্য সৃষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক গােষ্ঠীর প্রতিরােধে সগ্রামরত বলেই এই বাঙালি জাতীয়তাবাদ মৌলিকভাবে অত্যন্ত গভীর অর্থে গণতান্ত্রিক এবং সামন্ততন্ত্র ও সাম্রাজ্যবাদবিরােধী এক প্রচণ্ড আনবিক শক্তি। সম্ভবত এটা অতিশয়ােক্তি হবে না যে ভারতীয় উপমহাদেশের চেয়ে বাংলাদেশে সমাজতন্ত্রের অগ্রগতি অনেক বেশি দ্রুতগামী হবে। কারণ, প্রথমত, বাংলাদেশে স্বদেশীয় পুঁজিবাদ যথেষ্ট দুর্বল, দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগের অন্তর্ভুক্ত বা বহির্ভূত দুই দিক থেকেই দেখতে গেলে প্রাবল্যপূর্ণ শক্তিগুলাে ভারতীয় উপমহাদেশের সঙ্গে তুলনামূলকভাবে বাংলাদেশে অনেক বেশি সম্ভাবনাময়; তৃতীয়ত, বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের সর্বজনগত নির্বাচনী সমর্থন লাভের পেছনে ছিল অজস্র একনিষ্ঠ তরুণের অহর্নিশ সহযােগিতা। যৌবন নিঃশেষ হতে পারে না।
গ. সর্বশেষে এই সগ্রামে বাংলাদেশের জয়ী হবার মাধ্যমে সর্বজনের মনে এক জীবনশীল আদর্শ প্রতিষ্ঠিত হবে, একমাত্র ভিয়েতনামের মৃত্যুহীন সগ্রামের সঙ্গেই যার গতিবেগের তুলনা চলতে পারে।
আজ এতবড় মহান আদর্শের সমর্থনে, এতবড় ঐতিহাসিক যুগসন্ধিক্ষণে যদি বিশ্বের প্রগতিশীল মানুষেরা এগিয়ে আসতে না পারেন সেই কলঙ্কের, সেই গ্লানির কোনাে পরিসীমা নেই। জনগণতান্ত্রিক চীনকেও একদিন ইতিহাসের বিচারশালায় অপরাধী হিসাবে নাকে খৎ দিয়ে উপস্থিত হয়ে শুরুদণ্ড স্বীকার করে নিতে হবে। আন্তর্জাতিক সমাজবাদের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশগুলাে যতবেশি দ্বিধাগ্রস্তভাবে রঙ্গমঞ্চে স্বগত কৈফিয়ৎ দিয়ে পথচারী করবেন তত বেশি মাত্রাতেই তারা এই ঐতিহাসিক অপরাধের সহযােগী হয়ে পড়বেন। আজ যে যুগে সাম্রাজ্যবাদ এবং প্রতিক্রিয়াশীলতার চেয়ে সমাজবাদই বেশি ক্ষমতাশালী বলে শােনা যায়, সেই প্রগতিমান যুগে পৃথিবীতে যেন আরেকটি স্পেন তৈরি না হয়।
কোনাে কোনাে তরফ থেকে একটা মূল্যবান ওজর (plea) উঠেছে যে আওয়ামীলীগ নেতৃত্ব ও বাংলাদেশের সংগ্রামী জনতা যদি রণক্ষেত্রে অধিকতর দৃঢ়তা ও ফলপ্রসূতা প্রমাণ করতে না পারেন তাহলে বাংলাদেশে গণতন্ত্রের বাস্তবতা একটা প্রশ্নসাপেক্ষ ব্যাপার। এই ভদ্রমহােদয়দের কয়েকটা তথ্য মনে রাখা উচিত :
ক. কবে কোন্ কালে বিপ্লববাদীরা শুধু বিজয়পরাক্রান্ত ঘােড়র উপরেই বাজী ধরেছেন? আমাদের মনে রাখা উচিত কার্ল মার্কস ও লেনিনের মতাে আধুনিক বিপ্লব আন্দোলনের পিতৃপুরুষেরা পরাজিত প্যারি কমিউন ও পরাজিত জার্মান বিপ্লব আন্দোলনে গভীরতর-অর্থ নিহিত দেখেছিলেন।
খ. কোন অর্থে কাম্বােডিয়াতে প্রিন্স নরােদম সিহানুক সরকারের ক্ষমতা বাংলাদেশের উপর বাংলাদেশ সরকারের ক্ষমতার চেয়ে বেশি? নিশ্চয়ই শেখ মুজিবরের চেয়ে প্রিন্স সিহানুককে অধিকতর গণতান্ত্রিক বা প্রবলতর যােদ্ধা বলা চলে না। এটাও বলা চলে না যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ফ্রান্সের উপর দ্যগলের বহিরাশ্রিত বা প্রবাসী (emigre) সরকারের ক্ষমতা অধিকতর প্রভাবশালী ছিল।
গ. শেষমুহূর্ত পর্যন্ত যে মুজিবর রহমান অস্খলিত নিষ্ঠায় এই অসম ক্রীড়াতে তার নীতি ও আদর্শ রক্ষা করেছেন এবং মরণজয়ী নির্ভীকতায় একমাত্র যে মুজিবর রহমানেরই আদেশ পালন করার জন্যে বীভৎসতম নারকীয় অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে সারা বাংলাদেশের সর্বস্তরের মানুষ, সরকারি বেসরকারি কর্মচারী, রাজনৈতিক দল নেতারা পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্রের আদিম বর্বরতা ও বণিকী শক্তিমদমত্ততার উপরে প্রচণ্ডতম নৈতিক-রাজনৈতিক পরাজয়ের কলঙ্কলেপন করেছেন, সেই মুজিবর রহমানের অনন্যসাধারণ আদর্শগত বিজয়ের শক্তি এবং ফলপ্রসূতা আমরা যেন মুহূর্তের জন্যেও বিস্মৃত না হই। সমস্ত আঘাত প্রত্যাঘাতের মধ্য দিয়ে শেষ পর্যন্ত এই নৈতিক শক্তিই উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে, জনসাধারণের প্রতিরােধকে বাঁচিয়ে রাখবে।
বাংলাদেশের এই আন্দোলনে যে কতকগুলাে দুর্বলতা ছিল তা আমরা অস্বীকার করছি না। যেমন আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আরাে সুসংগঠিত এবং তার বিভিন্ন শাখাগুলাে আরাে দৃঢ়ভাবে পরস্পর সংযুক্ত থাকা প্রয়ােজন ছিল। তবে এসব দুর্বলতা সত্ত্বেও ইন্দোনেশিয়ার কমিউনিস্ট নেতৃত্ব বা দ্বিতীয় যুদ্ধকালীন ফরাসি বাহিনীর চেয়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব আজ কিছু অধিকতর ক্ষমতার অভাব প্রদর্শন করেছেন কি না এতে সন্দেহ আছে। মাকুইস পর্যন্ত প্রত্যাঘাত করতে কিছুটা সময় নিয়েছিলেন, এবং সমস্ত ফ্যাসিবাদ বিরােধী মিত্রশক্তি ফরাসি প্রতিরােধ আন্দোলনের সহায়তা করতে এগিয়ে এসেছিলেন। এতে কোনাে সন্দেহ নেই যে সেই সহযােগিতার একটি ভগ্নাংশ পেলেও নবজাগ্রত বাংলাদেশের প্রতিরােধ সংগ্রাম তকালীন ফরাসি সংগ্রামের চেয়ে কিছু কম প্রােজ্জ্বল হতাে না। আজ এই ঐতিহাসিক মুহূর্তে আন্তর্জাতিক ক্ষমতালুব্ধ পাশা খেলার ছকবন্দি তমসাগর থেকে পৃথিবীর সমস্ত বিপ্লবী শক্তিগুলাের মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে প্রত্যক্ষ প্রশ্নে নিজেদের ক্ষমতা পরীক্ষার শুভযােগ উপস্থিত হয়েছে।
যদি জনগণতান্ত্রিক চীন আজ তার নির্লজ্জ ব্ল্যাকমেল চালিয়ে যেতে প্রস্তুত, তাহলে অন্তত এই ভারতীয় উপমহাদেশের ৭০ কোটি মানুষের পক্ষে পৃথিবীর সমস্ত প্রগতিশীল শক্তিগুলাের চোখের তুলে না ধরলে চলবে না যে এই জনগণতান্ত্রিক চীনকে এতাে বেশি-অতিআবশ্যক পদার্থ বলে মনে করে সন্ত্রস্ত থাকার কোনাে কারণ নেই।
অবশ্য এটাও সত্য যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেও আজ একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন ভেবে দেখতে হবে; দেখতে হবে যে প্রত্যাঘাতের সৃদৃঢ় ভিত্তি এবং ঘাঁটি গড়ে তােলার জন্য তাদের মন্ত্রীসভাকে আজ অধিকতর সম্প্রসারিত করা প্রয়ােজনীয় কিনা, যে বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন অথচ গুরুত্বপূর্ণ দলগুলাে ইতিমধ্যেই বর্তমান মন্ত্রীসভার প্রতি তাদের আস্থা প্রকাশ করেছেন, তাদেরও আজ মন্ত্রীসভায় অন্তর্ভুক্ত করার একটি দূরদর্শিতাপূর্ণ রাজনৈতিক গুরুত্ব আছে কিনা এবং তাদের ছয় দফা দাবীর সঙ্গে বিশেষভাবে কৃষক সমাজেরই স্বার্থে আরাে কয়েকটি সামাজিক ও অর্থনৈতিক দাবী যােগ করা আজ আবশ্যক কিনা। এছাড়া আজ যারা প্রকৃত সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন এবং প্রশ্নাতীতভাবে এই সর্বজনবিরােধী পশ্চিম পাকিস্তানি সামরিক চক্র বা common enemy’ র বিরুদ্ধে যারা ব্যাপকতর এবং গভীরতরভাবে অর্থপূর্ণ দীর্ঘস্থায়ী সুদৃঢ় সংগ্রাম সংগঠিত করার চেষ্টা করছেন তাদের সকলের ঐক্যবদ্ধ নেতৃত্বের অধীনে আজ একটি বৃহত্তর এবং দৃঢ়তর যুক্তফ্রন্ট তৈরি করার জন্যে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকে দূরদৃষ্টি এবং স্থিরচিন্তা নিয়ােগ করতে হবে।
কিন্তু সে যা-ই হােক, আমাদের ভারত সরকারের এসব নিয়ে চিন্তা করে দ্বিধাবিকলতায় কালক্ষেপ করার কোনাে কারণ নেই। ভাববাদী মানবিকতার কথা ছেড়ে দিলেও নিতান্ত বস্তুসর্বস্ববাদী দৃষ্টিতেও তার পক্ষে নিজেরই গৃহসংকট বা “আভ্যন্তরীণ ব্যাপারটির নিশ্চিত অস্বীকার করার উপায় দেখি না। আর সঙ্গীর অপেক্ষা না করে একলাই চলতে হবে, নতুবা এই ভীরুবাক নিশ্চলতা শতধাবিদীর্ণ করে দেবে প্রলয়কালীন আগ্নেয় ভূকম্পন।

সূত্র: কম্পাস, ২২শে মে ১৯৭১