You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

রক্তে রাঙা বিজয় ৭১
মোঃ কামরুজ্জামান

স্মৃতির অলিন্দে দাঁড়িয়ে। কাল পরিক্রমায় শতাব্দী এসে দাঁড়িয়েছে যেমন অপরাহ্নে, অপর দিকে জীবনেরও দীর্ঘ চক্র পথ পেরিয়ে আজ যখন জীবন সায়াহ্নে পৌঁছেছি তখন একটি বােধ, একটি প্রত্যাশা চেতনার অনুপরমাণুতে নিশিদিন নাড়া দিয়ে যাচ্ছে। এই বােধে তাড়িত হয়ে পঁচিশ বছরের সঞ্চিত স্মৃতির মণি কোঠায় হাত বাড়ালাম, জানি না কতটুকু অর্জন করতে পারব। আমার গৌরবােজ্জ্বল বাঙালী জীবনের গর্বিত খন্ডটুকু আজকের প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার মানসে আমার তথা আমাদের অহংবােধের পথে যাত্রা শুরু করছি। বাঙালী জীবনের শ্রেষ্ঠ অহংকার, শ্রেষ্ঠ উৎসব মহান স্বাধীনতার রজত জয়ন্তীতে বসে যে কথা উচ্চারণ করতে চাই, স্তরভেদে তার উপযােগিতা আজ ভিন্ন ভিন্ন রকমের। কেউ কেউ বলবেন ইনিয়ে বিনিয়ে একটা পুরনাে গল্পের আর কি বলতে চাওহে বাপু? কারাে কারাে কাছে ওটা একটা মওকা হাসিলের নয়মাস, থলের বিড়াল বেড়িয়ে পড়ার সদা আতঙ্ক। নাটকীয় কায়দায় রাজাকার থেকে বীর মুক্তিযােদ্ধায় রূপান্তরিত হওয়ার রূপকথা । শতাব্দীর ভয়ঙ্কর কালাে রাতের সেই নৃশংস হত্যাযজ্ঞের কাহিনী আজ (যা সেদিন বিশ্ব বিবেককে স্তব্দ করে দিয়েছিলাে) এমনি ভাবে টক, ঝাল, মিষ্টি স্বাদে ভরা একটা গল্প মাত্র হয়ে ক্ষীণ রশ্নিতে নিভে যাওয়ার প্রহর গুণছে তার আপন ঐতিহ্য অস্তিত্ব থেকে। একথা আজ দুঃখ ক্ষোভের সাথে উচ্চারণ করতে হয়। যখন দেখি অনেক সচেতন বিদগ্ধ প্রাজ্ঞজনেরাও রেডিও টিভিতে মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক নাটক বা স্মৃতি তর্পণ দেখে নাক সিটকে বলে ওঠেন ঐ পেয়েছে এক গল্প মুক্তিযুদ্ধ। Bed tea দিয়ে ঘুম ভেঙ্গে দামী টুথ ব্রাশে দামী পেস্ট লাগিয়ে হট মিউজিক এর তালে তালে কিছুক্ষণ শরীর চর্চা, বিদেশী ফিল্ম চালিয়ে বাথটাবে স্নান সেরে দামী। গাড়ী চরে কোটি কোটি মুদ্রাগুণে স্বাধীন বাংলা দেশে আঙুল ফুলে কলা গাছ বনে গিয়ে যারা স্বাধীনতার ইতিহাসকে পুরনাে গল্প আর বস্তা পচা নাটকের কাহিনী। মনে করে। আজ তাদের সাথে আমারও বলতে ইচ্ছে হয় আমাদের ৯টি মাসের সশস্ত্র আন্দোলন ৫২র ভাষা আন্দোলন, ৫৪র নিবচিন, ৬১-৬২র শিক্ষা আন্দোলন। ৬৬র ৬ দফা, ৬৯-এর ১১ দফা ভিত্তিক গণ অভ্যুত্থান ৭০-এর নির্বাচন ৭১ এর মার্চ মাসের নজির বিহীন অসহযােগ আন্দোলন সত্যিই কি এক নস্ট্যালজিক অধ্যায় পুরনাে গল্প মাত্র? আমাদের সচেতন বিবেককে কি মূল্যবােধের কষ্টি পাথরে একবারও যাচাই করা যায় না? হাজার বছরের বীরত্বের ঐতিহ্যে লালিত বাঙালী বিবেক কি আজ ঘুমিয়ে? যখন দেখি বিশ্ব ইতিহাসের অন্যতম ট্রাজিক হত্যাকান্ড বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান শিশুপুত্র রাসেল সহ সপরিবারে নিহত হন ঘৃণ্য ঘাতক চক্রের হাতে। বাঙালী জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতা, সমাজতন্ত্র শব্দগুলাে পাঠ্য বই থেকে সুকৌশলে তুলে দেয়া হয়। পাকিস্তান জিন্দাবাদের আদলে বাংলা দেশ জিন্দাবাদ, বাংলাদেশ বেতারের স্থলে রেডিও বাংলাদেশ বসানাে হল ঠিক রেডিও পাকিস্তান শব্দের মত। (অথচ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র যা স্মৃতির মহিমায় ভাস্বর হয়ে আছে প্রতিটি বাঙ্গালী শিল্পী শ্রোতার হৃদয় গভীরে, সে নাম আমাদের গর্বিত স্বাধীনতার ঐতিহ্য বহন করে।) স্বাধীন বাংলাদেশে রক্ত ভেজা মানচিত্রে অঙ্কুরিত হয়ে নয়মাসে হামাগুড়ি দিতে শিখেছিল যে শিশু সে আজ ২৫ বছরের পরিপূর্ণ যুবক মহীরুহ বৃক্ষ। সেই একই মাটিতে রক্ত চোষা শােষক বৃক্ষ রাজাকাররা সদম্ভে পুনঃবার্মিত হয়ে আজ চেপে বসেছে নতুন সতেজ বৃক্ষ গুলাের কান্ড শীর্ষে। তাদের বিনাশী ছায়ায় বেড়ে উঠতে পারে না আজকের প্রজন্ম আগামী দিনের স্বপ্ন নায়কেরা। মন্ত্রী, আমলা, ধনাঢ্য থেকে রাষ্ট্রনায়ক আজ তারাই। আর সত্যিকার মুক্তিযােদ্ধারা হয় অবহেলিত। এমন কি পঙ্গু মুক্তিযােদ্ধাদের কেউ কেউ ভিক্ষা বৃত্তি পর্যন্ত বেছে নিয়েছে এমন ঘটনা বিরল নয়। অথচ এমনতাে কথা ছিলনা। যারা স্বাধীনতার মহান স্বপ্নসাধ নিয়ে নয়টি মাস সশস্ত্র সংগ্রাম করলাে, যুদ্ধ করলাে, প্রত্যাশিত স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে আনলাে। তারাই আজ দেশের মাটিতে উদ্বাস্ত উপেক্ষিত অবহেলিত। আর যারা এ দেশের কচি সবুজ সন্তানদের তুলে দিয়েছে পাকিস্তানী হায়েনাদের হাতে, ওদের দেখিয়ে নিয়ে এসেছে আমাদের ঘরে। তুলে দিয়েছে মা বােনের ইজ্জত। তারাই আজ সদম্ভে পুনঃর্বাসিত এ দেশের মাটিতে। সুসংগঠিত হয়ে আবার কালাে থাবার ছােবল হানতে আছে। অবস্থাদৃষ্টে আমার রবী ঠাকুরের সেই বহু বিশ্রুত কবিতার একটি পংক্তি মনে হচ্ছে তুমি মহারাজ সাধু হলে আজ আমি চোর বটে। আমি নিজেকে প্রশ্ন করে ক্ষত-বিক্ষত হই যখন দেখি এই স্বাধীন দেশের মাটি আবার শ্রমিকের রক্তে রঞ্জিত হয়। নির্বিচারে হত্যা করা হয় রাজপথে ছাত্রদের। ব্রেকহীন ট্রাক চাপিয়ে দেয়া হয় মিছিলের উপর। সরব প্রতিবাদকে স্তব্ধ করে দেয়া হচ্ছে চিরতরে। কৃষি ভিত্তিক সােনার বাংলার কৃষকরা তাদের ন্যায্য পাওনা পাটের দাম থেকে বঞ্চিত হয়। সার কীট নাশকের অভাবে দীন দশা ক্রমশঃ বেড়ে চলেছে। নাম মাত্র অঙ্কের ব্যাংক ঋণ গ্রহণ করে সুদের ভারে জর্জরিত কৃষক কুল
বিকৃতির হাত থেকে এর ইতিহাসকে। আগামীর সুকঠিন বাস্তব তােমার পথ চেয়ে তাই আজকের চর্বিত চর্বণ। সেই ভয়াল রাত যা আজকের সূর্যস্নাত দিনে বসে উপলব্ধি করা সম্ভব নয় যে কী ঘটে গিয়েছিলাে সেদিন জাতির জীবনে। ২৫শে মার্চের সেই ভয়াল রাত্রি । আর ১০টি রাতের মত সেদিনও শিশু সন্তান মায়ের দুধ পান করে শান্তিতে ঘুমিয়ে ছিলাে। কিন্তু কে জানত মানুষরূপী ভয়ানক দানবের হাত সে শিশুকেও রেহাই দিবেনা। মানুষ আর পশুর চিৎকারে সেদিন ‘ঢাকার রাত্রি পরিণত হয়েছিলাে এক প্রেত মৃত্যুপুরীতে। নিরস্ত্র অসহায় মানুষের। উপর বর্ষিত হচ্ছিল ভারী ভারী মেশিনগানসহ ট্যাঙ্ক এর গােলা। যেন নিরস্ত্র শিশু কিশাের মানুষ হত্যার জন্যই ওরা যােদ্ধা। খাটের নীচে প্রাণভয়ে জড়াজড়ি করে যে সন্তান পিতা-মাতা শুয়েছিলাে। সেই ভাবেই মৃত্যুর হিম শীতল স্পর্শে শান্ত হয়ে গিয়েছিলাে। মানুষের কান্না আহাজারী মিলিয়ে গিয়েছিলাে ভারী আগ্নেয়াস্ত্রের কাছে। বাতাসের শব্দকে মনে হয়েছিলাে মৃত্যুর লােলুপ রসনা মেলে এগিয়ে আসছে। গ্রাস করতে। ঘরে ঘরে বৃদ্ধরা জায়নামাযে দাঁড়িয়ে নফল নামাজ, কোরআন শরীফ তেলাওয়াত শুরু করেছিলাে, কিন্তু পাকিস্তানীরা তখন অসহায় মানুষ হত্যার নেশায় উম্মাদ হয়ে উঠেছিল। ট্রাক ভর্তি সৈন্যরা পিলখানা রাজারবাগ পুলিশ লাইন বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে নির্বিচারে চালায় পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গণহত্যা যজ্ঞ । কিন্তু ইতিহাস। সাক্ষ্য দেয়, চিরকাল বীরত্বের ঐতিহ্যে লালিত এ জাতি পরাভব মানেনি, পরাজয় স্বীকার করেনি। আমি সৈনিক, রক্তে দ্রোহের উম্মাদনা কিন্তু তাই থেকে বলছি না, আমার বােধের চাষবাসে এ ধারণা জন্মেছে। দুদিন আগে হােক পরে হােক বাঙালীরা চরম প্রতিশােধ গ্রহণ করবে। কেননা শান্তিপ্রিয় নিরীহ বাঙালীর উপর। ওরা রাতের অন্ধকারে ঝাপিয়ে পড়ে আমাদের চরম জিঘাংসা জাগিয়ে তুলেছে। নিরস্ত্র জনতার উপর চেপে পড়ায় চিরকালের মৌন পাহাড়গুলাে অগ্নিগিরি হয়ে উঠেছে। শিশু হত্যার বিপ্লবে সত্যি সেদিন বসুন্ধরা কেঁপে উঠেছিলাে। আর এই ঘৃণ্য হত্যাকান্ডই অত তাড়াতাড়ি আমার তথা আমার মত অনেক সৈনিকের হাতে রাইফেল তুলে দিয়েছিলাে। আর মুক্তির স্বপ্ন বৈপ্লবিক চেতনাকে করেছিলাে শাণিত। সেই নৃশংস হত্যাকান্ডের রাতে এ হেন পরিস্থিতিতে স্বাধীনচেতা দামাল সন্তানরা খালি হাতে বুক চিতিয়ে দাড়িয়েছিলাে। গড়ে তুলেছিলাে প্রতিরােধ। ২৫শে মার্চের রাতে হােটেল শেরাটন সাবেক ইন্টারকন্টিনেন্টাল এর কাছে ১০ থেকে ১৫জন বিক্ষুব্ধ বাঙালীদল উদ্ধত মুষ্ঠি তুলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিতে থাকে। সৈন্যরা সে
ভাষা বােঝেনি তাই ওদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের এক ঝাঁক গুলী দিয়ে সে শ্লোগানের জবাব দেয়। কি নিঃশঙ্ক চিত্ত যেন সেই মরণ জয়ী বাণী শুনেছিলােউদয়ের পথে শুনি কার বাণী ভয় নাই ওরে ভয় নাই, নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান। ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই। এই প্রেরণায়ই বীর বাঙালীরা অচিরে সংগঠিত হতে পেরেছিল। পাকিস্তানী সামরিক জান্তা অতর্কিতে আক্রমণ শুরু করলে প্রথমত সীমান্তে ই.পি.আর বাহিনী এবং পরে পাকিস্তানী সেনা বাহিনীর কিছু বাঙালী সদস্য ও অফিসাররা পালিয়ে এসে প্রতিরােধ গড়ে তুলে। পর্যায়ক্রমে ছাত্র-শিক্ষক, কৃষকসহ সর্বস্তরের জনতাই নেমে এলাে। যুদ্ধ কৌশলের স্বল্পতম প্রশিক্ষণ নিয়ে লড়াইয়ের যে কিংবদন্তী বাংলার মানুষ সৃষ্টি করেছে তা বিশ্বে নজির বিহীন ঘটনা। এর জন্য সবচেয়ে বেশী মনােবল যুগিয়েছিল বাঙালীর জাতীয়তা বােধ ও প্রবল দেশ প্রেম । বহু বছরের জুলুম নির্যাতন নিপীড়ন বাঙালীর মনে যে খন্ড খন্ড মেঘ সৃষ্টি করে তা ৭০-এর নির্বাচনের পর পাকিস্তানীদের অনমনীয় মনােভাব, চরম অসহযােগিতা মূলক আচরণ ও স্বৈরতন্ত্র মূলক কার্যক্রমে অনিবার্য আন্দোলনে রূপ নিয়ে তুমুল ঝড় ওঠে। একাত্তরের ফেব্রুয়ারী মার্চ এ আন্দোলনের জোয়ারে উত্তাল হয়ে মাতঙ্গী মেতে উঠে। সমর রঙ্গে। প্রতি জনমনে যে বিদ্রোহের রােষানল ধীরে ধীরে সঞ্চিত হচ্ছিলাে। পঁচিশে মার্চের চরম আঘাতে তা প্রমাণ করলাে। শুধুমাত্র যুবকরাই নয় কিশাের বৃদ্ধ এমন কি অন্তরীনে অবরােধ বাসীগণ নারীরাও বসে থাকেনি। আজ লিখতে বসে এ প্রেরণা আমাকে এখনও উদ্বেলিত করে। মনে পড়ে বাঙালী মনে কী অভূতপূর্ব জাতীয়তা বােধ, দেশপ্রেম। মনে পড়ে ১৯৭২ সালের ১০ই জানুয়ারী স্বাধীন বাংলার মাটিতে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাঙালী বাংলাদেশের জাতির। পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দেশের মাটিতে প্রত্যাবর্তন। বাংলার আবাল বৃদ্ধ বণিতা মহানায়কের আগমণে হাটে-মাঠে-ঘাটে-রাজপথে নেমে আসে। লক্ষ। মানুষের ঢল নামে বিমান বন্দর, রমনা রেস কোর্সের ময়দানে। লক্ষ লক্ষ মানুষ বাংলার নয়নের মণি তাদের প্রিয় নেতাকে শুধু এক নজর দেখার জন্য মহা সােৎসাহে প্রতীক্ষা করতে থাকে। প্রধান মন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদের উপদেশ অনুযায়ী বিমান বন্দরে আয়ােজিত মঞ্চে জনগণকে শৃঙ্খলাবদ্ধ রাখার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু যে মুহূর্তে বঙ্গবন্ধুকে বহনকারী এ্যালুমিনিয়ামের রঙের ব্রিটিশ রাজকীয় বিমানটি দেখা যায় তখন লাখ লাখ মানুষ ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ ধ্বনি নিয়ে সমগ্র বিমানবন্দর এলাকা প্রকম্পিত করে তােলে। ১.৪৪ মিনিটে বিমানটি রানওয়ে স্পর্শ করার সাথে সাথেই সমস্ত শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। ফলতঃ বঙ্গবন্ধুকে আর মঞ্চে নেয়া হলাে না। হাজার হাজার ফুলের মালায় বঙ্গবন্ধু ঢেকে যান। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে রমনা রেস কোর্সের উদ্দেশ্যে শুরু হয় ট্রাক মিছিল। সাথে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, কামরুজ্জামান, তাজউদ্দিন আহমেদ ও মনসুর আলীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দ। বিমান বন্দর থেকে রেস কোর্স যেতেই সময় লাগে ৫ ঘন্টা। জনারণ্যের মধ্য দিয়ে কোন মতে এগিয়ে চলছেন ৭ কোটি মানুষের নয়নের মণি। রেস কোর্স ময়দান জন সমুদ্র; প্রিয় নেতার আগমণে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগানে। ইতিহাসের রাখাল রাজা কিংবদন্তির মহানায়ক চির দেব শিশু প্রিয় বন্ধু মঞ্চে উঠলেন। জনসমূদ্রের সামনে দাঁড়িয়ে শিশুর মত কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। অশ্রু বিগলিত কণ্ঠে উচ্চারণ করলেন, ‘বিশ্ব কবি তুমি বলেছিলে, ৭ কোটি সন্তানের হে মুগ্ধ জননী, রেখেছ বাঙালী করে মানুষ করনি।’ হে বিশ্ব কবি তােমার কথা মিথ্যা প্রমাণিত করে আজ ৭ কোটি বাঙালী যুদ্ধ করে রক্ত দিয়ে এদেশ স্বাধীন করেছে। হে বিশ্ব কবি তুমি আজ জীবিত থাকলে বাঙালীর বীরত্বে মুগ্ধ হয়ে তুমি নতুন কবিতা রচনা করতে । তিনি আরাে বললেন, ইয়াহিয়া খান আমার ফাসীর হুকুম দিয়েছিলেন। আমি বাঙালী, আমি মানুষ, আমি মুসলমান। বাঙালীরা একবারই মরতে জানে। তাই বলছি, ক্ষমা চাইনা। তাদের বলেছি, তােমরা আমাকে মারলে ক্ষতি নেই। কিন্তু আমার লাশ বাংলার মানুষের কাছে পৌছে দিও। একথা বলে তিনি পুনরায় কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, ‘বাংলাদেশ আজ মুক্ত, স্বাধীন। একজন বাঙালী বেঁচে থাকতেও এই স্বাধীনতা নষ্ট হতে দেব না। বাংলাদেশ ইতিহাসে স্বাধীন দেশ হিসেবেই বেঁচে থাকবে। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে এমন শক্তি কারাে নেই’। দেশবাসীকে সতর্ক করে দিয়ে তিনি বলেন, ‘আমার দেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এখনাে শেষ হয়নি। বাঙালী সাবধান’। এই কণ্ঠটিই একদিন ৭ই মার্চে গর্জে উঠেছিল বজ্র নির্ঘোষে উচ্চারণ করেছিলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি তখন আরাে দেব তবু এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ’। বৃথা যায়নি সে আহবান, চেতনায় শাণিত। বাঙালী এই আহবানে সাড়া দিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলাে। কে বলে বাঙালী অলস ভীরু ভীতু জাতি? ৭১-এর নয়টি মাসে বাঙালী যে ইতিহাস সৃষ্টি করেছে সে গর্বে গর্বিত আমি কোনদিন ভুলব না বাঙালীর বীরত্বের ইতিহাস। বঙ্গবন্ধুর আহবান
যেমন বৃথা যায়নি বৃথা হয়নি তার অনুমান। বন্ধুর সােনার বাংলা হয় আজ নতুন বাংলা, স্বাধীনতার ঘােষক হয় পাঠক সৈনিক। স্বাধীনতার ইতিহাস হচ্ছে বিকৃত আর বন্ধুকে প্রাণ দিতে হলাে আবার এই বাংলার মীরজাফর মীর মােশতাক গং ঘাতক চক্রের হাতে। স্মৃতির বেলা ভূমিতে দাড়িয়ে কেবলই মনে হয় সবই কি বৃথা? স্বাধীনতা কি মিথ্যে হয়ে গেছে। বাতাস আসে বাতাস যায় পতপত করে ওড়ে লাল সবুজের পতাকা চোখে ভেসে ওঠে ৭১-এর রণাঙ্গন। ভয়াল যুদ্ধের স্মৃতি। ক্রলিং করে এগিয়ে যাচ্ছি। সামনে আরাে সামনে সৈন্যদের হুকুম দিয়ে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। অকস্মাৎ দেখি চারদিক থেকে আমাদের ঘিরে ফেলা হয়েছে, ভারী শেল ছুঁড়ছে পাক বাহিনী; আসন্ন মৃত্যু দুয়ারে দাঁড়িয়ে। মুহূর্তে পট পরিবর্তন; আমাদের গেরিলা পদ্ধতি যুদ্ধ কৌশল বাঁচিয়ে দিয়েছে আমাদের। শুধু তাই নয়, এমনি করে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা। লড়ে একের পর এক বিজয় অর্জন করেছি, মনে হয় বৃথা নয় কিছুই বৃথা যাবে না। পৃথিবীর মানচিত্রে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা দেশ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তার সন্তানদের একদিন চৈতন্য ফিরে আসবেই । চিনে নেবে তাদের স্বজনকে সঠিক ইতিহাসকে। যতদিন বাংলার বুকের পদ্মা-মেঘনা-যমুনা-গৌরী বয়ে যাবে ততদিন বেঁচে থাকবে স্বাধীনতার সূর্য সৈনিকেরা থাকবে বন্ধু মুজিব বঙ্গের ।। কোনাে ইতিহাস সৃষ্টির সােনালী প্রত্যাশায় সেদিন যুদ্ধ করিনি, করেছি দেশপ্রেম নিয়ে, জাতীয়তা বােধে উজ্জীবিত হয়ে। যুদ্ধপূর্ব কালীন সময় থেকেই প্রাক প্রস্তুতী নিয়েছিলাম আমরা সংশ্লিষ্ট হয়েছিলাম সশস্ত্র বিপ্লবী সংস্থার সাথে, দোষী সাব্যস্ত হয়েছিলাম তথা কথিত আগড় তলা ষড়যন্ত্র মামলায়। দেশ প্রেম আছে, আছে। ভালবাসা তাইতাে আজকের প্রজন্মের কাছে আমার জীবনাভিজ্ঞতার আলােকে যুদ্ধকালীন স্মৃতি তর্পণ করতে চাই। শিশু আর অসহায় নারী হত্যায় পারদর্শী এক বীর বাহিনীর বীরত্বের গল্প বলতে চাই। কী যে নির্মমতা ছিলাে ওদের মধ্যে চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না। নিস্পাপ দুধের শিশু উপর দিকে ছুঁড়ে দিয়ে ওরা নীচে বেয়ােনেট পেতে রেখেছে। শিশু তার উপর পড়ে একটি মাত্র চিঙ্কার দিয়ে মৃত্যুর পেয়ালা পান করেছে। আর ওরা হেসেছে পৈশাচিক হাসি। পাকিস্তানী সৈন্যদের বলা ছিলাে হত্যার ব্যাপারে যেন কোন বৈষম্য কিংবা বাদ বিচার না করা হয়। তাই ওরা নির্বিচারে হত্যা করলাে জাতির বিবেককে জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের। সেদিন প্রাণ দিতে হয়েছিল, যারা আসন্ন স্বাধীনতার মাত্র দু’দিন আগে শিকার হয়েছিল পৈশাচিক মৃত্যুর । সর্বজন শ্রদ্ধেয় মুনীর চৌধুরী, জি সি দেব, মােফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, সন্তোষ ভট্টাচার্য, শহীদুল্লা কায়সার, সিরাজ উদ্দীন হােসেন, আবুল
খায়ের, গিয়াস উদ্দীন আহমদ, অধ্যাপক মুনীরুজ্জামান, আনােয়ার পাশা, নিজামউদ্দীন, গােলাম মােস্তফা লাডু ভাই, রশিদুল হাসান, সিরাজুল হক খান, ডঃ আলীম, ডঃ রাব্বী, নাজমুল হক, আবুল বাশার, মােঃ আবু তালেব, ডঃ মুক্তাদির, জহির রায়হান প্রমূখ। এখানে আরাে গর্বের সাথে স্মরণ করছি সেই সাতজন অমর শহীদ বীর শ্রেষ্ঠ বাঙালীদের-সিপাহী হামিদুর রহমান, সিপাহী মােস্তফা কামাল, ক্যাপ্টেন মহীউদ্দীন জাহাঙ্গীর, মােঃ রুহুল আমিন ই-আর এ-০১, ফ্লাইট লেঃ মতিউর রহমান, শহীদ ল্যাঃ নায়েক মুন্সী আব্দুর রব, শহীদ ল্যাঃ নায়েক নূর মােহাম্মদ শেখ, এছাড়া আমার সহযােদ্ধা হাবিলদার কোবাদ আলী (ই.পি.আর) নজরুল (ছাত্র)। কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি শ্রীপুর বাহিনী, হরিণা কুন্ড বাহিনী ও সংশ্লিষ্ট সকলকে যারা সহযুদ্ধে আমার সাথে অবতীর্ণ হয়েছিলেন ১৯৭১এ। ৩০ লক্ষ শহীদ আর দু’লক্ষ মা বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে ফিরে পাওয়া এ স্বাধীনতা পুরনাে গল্প নয়। বাঙ্গালী জাতি সত্ত্বার সাথে মিশে থাকা এক জীবন্ত গল্প যার শুরু আছে শেষ নেই। যত দিন বাংলার বুকে নদী বয়ে যাবে, মাতার চোখে অশ্রু ঝরবে, ততদিন এ গল্প থাকবে। এ গল্প ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হবে নবনব বীরত্ব ব্যঞ্জনার কৃতিত্বের ইতিহাস নিয়ে। ক্রমশঃ এ ভূমি হবে উর্বর, ফলবে সােনালী ফসল আদর্শ কৃষক সন্তানের কর্ষণে। বাংলা মায়ের জীর্নদশা ঘুচবে, শীর্ন কপালে চাঁদের ঔজ্জ্বল্য ফিরে পাবে। স্বাধীনতার মূল্যবােধ উজ্জীবিত হবে এ প্রত্যাশা আজকের প্রজন্মের কাছে। যাদের মধ্যে আছে শৌর্য বীর্য সাহস বীরত্ব। আছে নিষ্ঠা, মেধা, প্রজ্ঞা, অজানাকে জানার প্রবল উৎসাহ। সর্বোপরি যাদের মধ্যে আছে মাতৃভক্তি দেশ প্রেম। আমার সমস্ত উচ্চারণই নিবেদিত রইল সেই সাহসী যুবক, ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক, কবি, শিল্পী, বুদ্ধিজীবির কাছে যারা এ মাটিতে জন্ম নিয়ে এ মাটি আর মানুষকে ভাল বাসতে শিখেছে। ‘৭১ এর সেই সুমহান পবিত্র যুদ্ধে দেশকে মুক্ত করার সুকঠিন শপথের আগুনে জুলে আমার মধ্যে যে প্রত্যাশার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছিলাে জানিনা তার ফসল ফলবে কিনা। তবু বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে হয়ত একদিন ফুল আসবে ফল আসবে। কিন্তু তার লালনের ভার রইলাে আজকের দেশপ্রেমী তরুণদের কাছে। আর মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি নিয়ে আমার যাত্রা শুরু হলাে। যাত্রারম্ভে আবারাে স্মরণ করছি ৩০ লক্ষ শহীদদের স্মরণ করছি জানা-অজানা অসংখ্য সহযােদ্ধাদের যাদের রক্তে | আজকে উড়ছে লাল সবুজের পতাকা। বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের প্রেক্ষিত (১৭৫৭-১৯৭০) নমঃ নমঃ বাংলাদেশ মম চির মনােরম চির মধুর, বুকে নিরবধি বহে শত নদী চরণে জলধির বাজে নূপুর । – কাজী নজরুল ইসলাম কবির কথায় সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা মলয়জ শীতলা শতনদী বিধৌত এই বাংলাদেশ। হাজার বছরের পুরনাে কীর্তি আবহমান কালের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে লালিত আমাদের প্রিয় ভূমি। উত্তরে শিয়রের কাছে সদা জাগ্রত সুবিশাল গিরিরাজ হিমালয়, দক্ষিণ প্রান্তিকে চরণের কাছে জলের নূপুর বাজায় বঙ্গোপসাগর । পাশাপাশি মায়া মমতার হাত ছানি দিয়ে ডাকে পশ্চিমে বিহার, পূর্বে আসাম আর লুসাই পাহাড়। অপূর্ব বৈচিত্র্যে ভরা এদেশ মহামতি আলেকজান্ডার যার সৌন্দর্যে। মুগ্ধ হয়ে সেলুকাসকে বলেছিলেন, “সেলুকাস কি বিচিত্র এই দেশ।’ দার্জিলিং-এর জংগার কাঞ্চন বিমােহিত রূপ, পূর্ব বাংলার জালের মত ছেয়ে অসংখ্য নদী এঁকে বেঁকে চলা তার গতিপথ, সাগর বিধৌত চট্টগ্রাম, মেদিনীপুর ও বরেন্দ্রের গৈরিক বসন পরিব্রাজককে চমকিত করে। সাগরের বুক থেকে উঠে আসা এই দেশ যার বিকাশ পশ্চিম থেকে পূর্বে। প্রকৃতি অকৃপণ হাতে যাকে তিল তিল করে সৌন্দর্যের তিলােত্তমা করে সৃষ্টি করেছে। সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে দূর-দূরান্ত থেকে যেমন ছুটে এসেছে পরিব্রাজকেরা তেমনি এসেছে দস্যু তস্কর লুটেরা। প্রাচীন পৃথিবীর মানচিত্রে ‘বঙ্গ’ দেশ বলে চিহ্নিত এই ভূখন্ডের খ্যাতি ছিল ‘রত্ন ভান্ডার’ হিসেবে। আর তাই এখানে বার বার হানা দিতে এসেছে লুণ্ঠন করতে এসেছে মগ, পর্তুগীজ, ওলন্দাজ, বগী, আরবীয় সুলতান, সর্বোপরি ব্রিটিশ বেনিয়ারা। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় ওরা যতবার আমাদের হানা দিয়েছে। ততবারই আমাদের চেতনার দ্বারে আঘাত হেনেছে। আর তাই বুকের রক্তে তাদের প্রতিহত করতে চেয়েছে এদেশের তাজা প্রাণ সূর্য সৈনিক দামাল ছেলেরা। আর শতবীর জন্ম প্রসূ বীর মাতা বাংলার স্পর্ধিত রক্তের উত্তর সূরী হয়ে জন্মেছে তাই তিতুমীর, ঈসা খা, সূর্যসেন, কৃষক নেতা নূরুল দীন, বলাকী শাহ, ফকির মনজু। শাহ, দেবী চৌধুরাণী, হাজী শরিয়তুল্লাহ, দেশবন্ধু, নওয়াব বাহাদুর আঃ লতিফ, হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী, শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক ও কিংবদন্তীর মহান। নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। এদের সংগ্রাম আন্দোলন আর রক্ত ঝরা পথ দিয়ে এসেছিল মূলতঃ স্বাধীনতা। দিল্লীর বাদশাহগণ বাংলাদেশকে আখ্যায়িত করেছিলেন ‘বুগলকপুর’ বা বিদ্রোহের। দেশ হিসেবে। এ সময় থেকে বাংলা ছিল ভারতীয় রাজধানী দিল্লী থেকে
অনেকদূর। আমাদের ঐতিহ্যের ধারায় দেখি বাংলার মানুষ আজন্ম বিদ্রোহ আর। বিপ্লবী চেতনায় শানিত। আমাদের ঐতিহ্যের অনু বিশ্লেষণে আর একটু পিছন ফিরে তাকালেই দেখতে পাই ভারতীয় রাজধানী দিল্লী থেকে অনেক দূরে অবস্থিত এ বাংলা (পূর্বোক্ত) নদী নালায় ভরপুর এক প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিভূষিত দেশ। খিলজী পরবর্তী শাসকগণ (মুসলিম শাসকগণ) প্রায় সকলেই দিল্লীকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বাংলাকে স্বাধীনভাবে শাসন করেছেন এবং ঔপনিবেশিক চেতনাকে বিসর্জন দিয়ে আপন ভূমি হিসেবেই একে লালন ও বিকশিত করার সার্বক্ষণিক প্রয়াস চালিয়েছেন। ফলে বাংগালীষ্মের বীজটি গভীরে প্রােথিত হওয়ার সুযােগ পেয়েছিল এবং কাল পরিক্রমায় যে বীজটি অঙ্কুরিত হয়েছিল তা বিশালত্বে বাঙালী মহিমারই জয়গান করেছিল। গােলাভরা ধান, গােয়াল ভরা গরু পুকুর ভরা মাছের এ সমৃদ্ধ বাংলা ১৭৫৭ সালের ২৩শে জুন পলাশীর প্রান্তরে এক প্রহসন মূলক যুদ্ধে বাংলার শেষ নবাবের হাতে স্বাধীনতা বিসর্জন দেয়। কালক্রমে তা ঔপনিবেশিক শাসনের দিকে যেতে থাকে। এবং ১৭৬৫ খৃষ্টাব্দে চূড়ান্ত ভাবে বেনিয়া ইংরেজ শশাষকদের হাতে চলে যায়। চিরকালীন বিদ্রোহী বিপ্লবী আজাদী বাঙালীর হাতে পায়ে পরিয়ে দেয়া হয় শৃঙ্খল। শােষণের যাতাকলে তারা নিস্পেষিত করে দু’শ বছর। সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়িয়ে নজির বিহীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির এদেশে ভাইয়ে ভাইয়ের মধ্যে ছড়ায় ঘৃণা আর হিংসার রক্তাক্ত বীজ। শ্রেণী বৈষম্যের দেয়াল দিয়ে আমাদের মধ্যে সৃষ্টি করে বিভেদের বিশাল দেয়াল। ওদের হীন চক্রান্তে নিঃস্ব থেকে নিঃস্বতর হয়ে চলে স্বয়ংসম্পূর্ণ এই দেশটি। কিন্তু না নীরবে নিঃশব্দে কেউ মেনে নেয়নি ওদের অন্যায়। জুলুম নির্যাতন। এদের নিপীড়নের পথ বেয়ে ছুটে আসে বিদ্রোহের উত্তাল তরঙ্গ। শুরু হয় সিপাহী বিদ্রোহ, ফকির বিদ্রোহ, রংপুর বিদ্রোহ ১৭৮৩ লাকী শাহের সশস্ত্র বিদ্রোহ (১৭৯১-৯২) আগা মােহাম্মদ রেজার বিদ্রোহ (১৭৯৯) খৃষ্টাব্দে চাকমাদের বিদ্রোহ, সাওতাল বিদ্রোহ, পাগল পন্থী বিদ্রোহ, তিতুমীরের বিদ্রোহ (১৮৩১) ফরায়েজী বিদ্রোহ। ইংরেজ শাসনামলের শেষ পর্যায় এসে অসহযােগ আন্দোলন, কমিউনিস্ট আন্দোলন, স্বদেশী আন্দোলন ইত্যাদি আজকের স্বাধীনতায় উত্তরণের পথে এক একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় । দু’শ বছরের নিঠুর শাসনে গড়া পাষাণ বেদীর অন্তর ভেদে নূতন প্রাণের অঙ্কুর গজিয়ে উঠে। দুঃস্বপ্নের কালাে রাত কেটে একদিন সূর্যস্নাত সকাল আসে। তবে এ উত্তরণ কোন সহজ সাধ্য নয়। জটিল বন্ধুর পথ পেরিয়ে, মৃত্যুর মহা দূর্লঙ্ঘ্য বাঁধাকে উপেক্ষা করে সংগ্রাম আর বিপ্লবের রক্তাক্ত পথে বিদ্রোহের অগ্নিমশাল প্রজ্জ্বলিত করে ইতিহাসের অমর সন্তানেরা ছিনিয়ে আনে এ বিজয়। ১৭৫৭ সালের যুদ্ধের পর রবার্ট ক্লাইভ তার এ দেশীয় দোসর বিশ্বাস। ঘাতক মীর জাফরকে এনে ক্ষমতায় বসান। বণিক হয়ে এদেশে রাজা বানানাের।
কর্তায় রূপান্তরিত হলাে বেনিয়া ক্লাইভ আর বাঙালীর জীবনে নেমে আসে অমানিশার ছায়া দ্বৈত শাসনের অভিশাপ। মীর জাফরের পর তাঁর জামাতা মীর কাশিম ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলাে। কিন্তু শ্বশুরের পথ পরিহার করে ইংরেজদের মিত্র না ভেবে তিনিই প্রথম পরাধীনতার শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলার রুদ্ররূপ ধারণ করেন। স্বদেশ প্রেম ও জাতীয়তা বােধে উজ্জীবিত হয়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন। পবিত্র দেশ প্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন দেশীয় রাজা জমিদার অন্যান্য প্রভাবশালী ও গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের। ব্যবসা ক্ষেত্রে বণিকদের ছাড় দিতে অস্বীকৃতি জানান। ফলতঃ যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। প্রবল পরাক্রমে জাতীয়তাবােধ বিশ্বাসী তরুণ মীর কাশিম একে একে যুদ্ধ করেও কাটোয়া, গিরিয়া, উদয় নালা ও পাটনার যুদ্ধে হেরে গেলেন এবং এর জন্য হারাতে হলাে চট্টগ্রাম, বর্ধমান ও মেদিনীপুরের জমিদারী । পলাশীর পর ক্ষীয় রশ্মিতে বাংলার ভাগ্যাকাশে যে প্রদীপ জ্বলে উঠেছিলাে মীর কাশিমের পরাজয়ের মধ্য দিয়ে সে স্বপ্ন ধুলিসাৎ হয়ে গেলাে। বাংলা থেকে অবসান হলাে গৌরবময় মুসলিম শাসন। কবি সুকান্তের কথায়, ‘সাবাস বাংলাদেশ, এ পৃথিবী অবাক তাকিয়ে রয়/জ্বলে পুড়ে মরে ছারখার তবু মাথা নােয়াবার নয়।’ না মাথা নােয়ায়নি বীর বাঙালীরা। মীর কাশিম যে রক্তাক্ত মুক্তির পথ বিনির্মাণ করে গেলেন সে পথ ধরে এগিয়ে চললাে একের পর এক বিদ্রোহ আর আন্দোলনের ধারাবাহিকতা। এর পরের দীর্ঘ ইতিহাস আরও রক্তাক্ত। বিজিত জাতি ভিন দেশ থেকে আসা বেনিয়া শাসকদের বিরুদ্ধে লড়ে গেছে একটানা, কখনাে বিরামহীন কখনাে থেমে থেমে। ইংরেজরা এদেশের শাসন ক্ষমতা অর্জন করে দেশ শাসনের জন্য যেমন অনুধাবন করেছিলাে এদেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি চর্চার, তেমনি ভাবে এর মর্মমূলে আঘাত হানার জন্য প্রস্তুতিও তেমনি নিল-আমাদের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বিলুপ্তির জন্য। খুব সুকৌশলে আমাদের মধ্যে বপন করেছে হিংসা ও বিদ্বেষের বীজ। চালু করেছে শ্রেণী বৈষম্য মূলক শিক্ষা ও সমাজ ব্যবস্থা। ধ্বংসমূখী অর্থনীতি তৈরি দেশীয় শিল্পকে নিরুৎসাহিত করা ছিল তাদের উদ্দেশ্য। ঢাকার এক সময়ের বিশ্বখ্যাত মসলিন শিল্পকে ধ্বংস করে দেয়া হয়। জানা যায় সমকালীন বিশ্বে সভ্য ও উন্নত জীবন যাপনের সর্বাধিক সুযােগ পাওয়ায় ইংরেজরা আমাদের ঐশ্বর্য ও সমৃদ্ধিতে চমকে ওঠে। মুর্শিদাবাদ নগরীতে প্রবেশ করে মুর্শিদাবাদের সমৃদ্ধি ঐশ্বর্য, জ্ঞান চর্চার বিদ্যাপীঠগুলাে দেখে ক্লাইভ | বিস্মিত হয়ে যান এবং লন্ডন নগরীর সাথে এর তুলনা করেন।
ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিভিন্ন বিদ্রোহ
মীর নিসার আলী তিতুমীর যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ অসামান্য ত্যাগ, অসীম দেশপ্রেম, জাতীয়তাবােধ, সংগ্রামী ও পৌরুষ কঠিন মনােভাব নিয়ে মাতৃ মুক্তির শপথ নিয়ে শহীদের পেয়ালা গ্রহণ করেছেন, বীর বাঙালীর ঐতিহ্যকে করেছেন সমুন্নত। তাদের মধ্যে মীর নিসার আলী ওরফে তিতুমীর অন্যতম। অসামান্য বীরত্ম প্রদর্শনকারী সুকঠিন আত্মবিশ্বাসী তিতুমীর ছিলেন বাংলাদেশের প্রথম মুক্তিযােদ্ধা ও শহীদ। কলকাতা থেকে প্রায় ২১ মাইল দূরে বারাসতের চাদপুর তার গ্রাম। তিনি প্রথম জীবনে ছিলেন একজন লাঠিয়াল এবং অত্যন্ত সাহসী যুবক। শােনা যায় প্রথম জীবনে তিনি একজন দুর্ধর্ষ ও মন্দ প্রকৃতির লােক ছিলেন। পরবর্তীতে তিনি নদীয়ায় হিন্দু জমিদারদের অধীনে কাজ গ্রহণ করেন। জমিদাররা তাঁকে মারপিট এবং খাজনা আদায়ের কাজে ব্যবহার করতেন। কোন এক ঘটনায় জড়িয়ে ফৌজদারী মামলায় তাকে কারাবরণ করতে হয়। এখান থেকেই তাঁর মধ্যে একটা মানসিক পরিবর্তন আসতে থাকে এবং ধর্মের প্রতি গভীর অনুরাগী হয়ে ওঠেন। কারাগার হতে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি ঘটনাক্রমে দিল্লীর। রাজ পরিবারের একজন সদস্যের সুনজরে আসেন। তিতুমীর তার সেবক হিসেবে মক্কায় হজ্ব যাত্রার সঙ্গী হন। সেখানে এক কালের ইসলামের বিপ্লবী নেতা সৈয়দ আহমদের শিষ্যত্ব লাভ করেন। ১৮২৭ সালে মক্কা হতে প্রত্যাবর্তন করে তিনি নদীয়া জেলার অন্তর্গত নারকেল বাড়িয়ার নিকট হায়দারপুর গ্রামে বসতি স্থাপন করেন। এবং ইসলামের বিশুদ্ধ রূপ প্রচারে আত্ম নিয়ােগ করেন। খুব অল্প দিনের মধ্যেই বহুলােক তার শিষ্যত্ব গ্রহণ করে। ইসলামী সাম্যের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা তার বাহিনী এবং নিজে ছিলেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে সােচ্চার। সে কারণেই স্থানীয় অত্যাচারী জমিদার কৃষ্ণরায়ের সাথে তাঁর সংঘর্ষ বেঁধে যায়। তিনি তাঁর সুশিক্ষিত বাহিনী নিয়ে ১৮৩১ সালের ৬ই নভেম্বর কৃষ্ণরায়ের কাছারী ধ্বংস, নীল কুঠি ধুলিসাৎ এবং নীল সাহেবদের অপমান এবং দারােগাকে হত্যা করেন। রণ কৌশলী সাহসী যােদ্ধা তিতুমীর তাঁর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সমর প্রস্তুতীর অংশ হিসেবে নারিকেল বাড়িয়ায় বাঁশের কেল্লা স্থাপন করেন। এর পর ইংরেজগণ সন্ত্রস্ত হয়ে ওঠেন। ঐ একই মাসে তিতুমীরকে দমনের জন্য কলকাতা থেকে এক মিলিশিয়া বাহিনী প্রেরণ করে। কিন্তু তিতুমীর এদের সহজেই পরাস্ত করেন। এরপর ইংরেজগণ প্রতিশােধ কল্পে তার বিরুদ্ধে আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত এক বিশাল সামরিক বাহিনী প্রেরণ করে। তিতুমীর তুমুল যুদ্ধে বীরের ন্যায় যুদ্ধ করতে করতে শাহাদাৎ বরণ করেন এবং তাঁর ৩৫০ জন অনুসারী ইংরেজদের হাতে বন্দী হন। ইংরেজগণ তাঁর প্রধান সেনাপতি গােলাম মাসুমকে ফাঁসিতে চড়িয়ে হত্যা করে। ফরায়েজী আন্দোলন ফরিদপুর জেলার অন্তর্গত মাদারীপুরের বাহাদুরপুর গ্রামের হাজী শরিয়ত উল্লাহ ছিলেন ফরায়েজী আন্দোলনের প্রবক্তা, তিনি তাঁর শিষ্যদের পীর শিষ্যত্বের সম্পর্ক তুলে দিয়ে ইসলামের ব্যাপক সংস্কারের মধ্যদিয়ে এক বিপ্লব সাধন করার প্রচেষ্টা। চালান। এতে করে শােষক জমিদার ও প্রাচীন পন্থী মুসলমানরা তার উপর ক্ষেপে ওঠে। তিনি সুদীর্ঘ বাইশ বছর আন্দোলন চালিয়ে ১৮৪০ খৃস্টাব্দে মৃত্যু বরণ করেন। তার মৃত্যুর পর তার সুযােগ্য উত্তরসূরী পীর দুদুমিয়া অধিকতর সংগঠন শক্তির অধিকারী হন। তার প্রতিবাদী এবং দৃঢ় চেতা মনােভাবের জন্য সংস্কার আন্দোলন রাজনৈতিক অধিকার আন্দোলনের রূপ পরিগ্রহ করে। তিনি তাঁর অনুসারীদের নিয়ে ইংরেজ এবং জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলেন। তিনি জমিদারদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান চালান। পঞ্চগড়ের নীল কুঠি এবং জমিদারবাড়ী লুট ও ধ্বংস করেন। অসম্ভব জনপ্রিয়তার কারণে ইংরেজরা তাঁকে অন্তরীন রাখেন। তাঁর মৃত্যুর পর দূর্বল নেতৃত্বের কারণে পরবর্তীতে তা স্তিমিত হয়ে যায়। আমাদের মুক্তির আন্দোলনে এবং ভারত বর্ষের স্বাধীনতায় এ আন্দোলনের গুরুত্ব নেহায়েত কম নয়। ফকির বিদ্রোহ বেনিয়া ইংরেজদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে এদেশে যে সমস্ত আন্দোলন ও বিপ্লব সংগঠিত হয়েছিলাে ফকির ও সন্নাস বিদ্রোহ তার মধ্যে অন্যতম একটি। এ সমস্ত ফকিররা ছিলেন প্রকৃত শিক্ষায় শিক্ষিত । আধুনিক কালের ফকিরদের মত প্রগতির অন্তরায় ছিল না এরা। মুর্শিদাবাদ থেকে যে সমস্ত ফকিররা পালিয়ে যায় তারাই পরবর্তীতে সংগঠিত হয়ে ইংজেরদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ধারণ করে এবং প্রায় চল্লিশ বছর যাবত তাদের সশস্ত্র আন্দোলন অব্যাহত রাখে। এই ফকির দরবেশদের অন্যতম নেতা ছিলেন ফকির মজনু শাহ এবং তাঁর শিষ্যদের অন্যতম প্রধান ছিলেন মুসা শাহ, চেরাগ আলী শাহ এবং পরাগল শাহ। আর হিন্দু সন্নাসদের অন্যতম নেতা ছিলেন ভবানী পাঠক।
আধুনিক গেরিলা যুদ্ধের মত চমৎকার রণকৌশলে তারা দীর্ঘ কাল ইংরেজদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যায়। ১৭৬০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত তারা দীর্ঘ ৪০ বছর। যুদ্ধ চালিয়ে যায়। এরা বহু সফল সশস্ত্র সংগ্রামের অধিকারী। এদের হাতে বহু ইংরেজ সেনা নিহত হয়। এরা ঢাকা ও বাকেরগঞ্জ কোম্পানী লুট ও দখল করে। প্রকাশ্যভাবে তারা ১৭৬৯ সালে রংপুরে আক্রমণ চালায় এবং লেফটটেন্যান্ট কীন এবং তাঁর নেতৃত্বাধীন সেনাগণকে পরাজিত ও হত্যা করেন। এরা সন্নিবেশিত ও ঐক্যবদ্ধ হয়ে ১৭৭২ সালে রংপুরের নিকট শ্যাম গঞ্জে ক্যাপ্টেন টমাসের নেতৃত্বে ইংরেজ সেনা বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হন। এ যুদ্ধে ক্যাপ্টেন টমাস পরাজিত ও নিহত হন। অথচ এত সুসংগঠিত আন্দোলন, স্বাধীন চেতা মনােভাব সম্পন্ন আন্দোলনকারীরা ধীরে ধীরে অর্থবল ও আধুনিক প্রশিক্ষণের অভাবে দূর্বল হয়ে পড়ে এবং ১৮০০ সালে তাদের আন্দোলনের বিলুপ্তি ঘটে। শােষক বৃক্ষের মূলােৎপাটন করে বাংলায় আবার স্বাধীন সূর্যোদয়ের জন্য যে সমস্ত আন্দোলন সংগঠিত হয় যার প্রত্যক্ষ প্রভাবে ১৯৪৭ সালে আমাদের স্বাধীনতা এবং পরবর্তীতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছি সে ইতিহাসে ফকির সন্নাস বিদ্রোহ একটা গুরুত্বপূর্ণ। অধ্যায়। রংপুর বিদ্রোহ। ইংরেজ প্রবর্তিত জমিদারী ব্যবস্থায় ইংরেজরা দেশীয় রাজা ও জমিদারদের থেকে অধিক টাকা ইজারা নেয়ায় জমিদাররা সে সমস্ত টাকা নিরীহ প্রজাদের নিকট থেকে আদায় করার জন্য চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। ১৭৮১ খৃস্টাব্দে রংপুরে মহা দুর্ভিক্ষের মধ্যেও রাজা দেবী সিংহ প্রজাদের উপর নানা কর আরােপ করেন এবং তা আদায়ের জন্য অত্যাচার করতে থাকেন। এ ব্যাপারে কৃষকরা জেলা কালেক্টরের নিকট আবেদন করেও কোন সুফল পায়নি এবং কালেক্টর সাহেব দেবী সিংহের পক্ষ অবলম্বন করেন। এতে করে কৃষকরা এত দিনের পুঞ্জীভূত ক্ষোভে ফেটে পড়ে। এরা সুসংগঠিত হয়ে ১৭৮৩ সালের জানুয়ারী মাসে অত্যাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করে। কাজীরহাট, কংকনিয়া এবং টেপায় প্রাথমিক পর্যায়ে, এ বিদ্রোহ বিস্তার লাভ করে এবং তার পরবর্তীতে জেলার বিভিন্ন অংশে ছড়িয়ে পড়ে। এ বিদ্রোহের শেষ পরিণতিতে দেবী সিংহ পালিয়ে যায় এবং কৃষকরা তাদের একজন প্রিয় নেতাকে নবাব ঘােষণা করে। দেবী সিংহ পালিয়ে গেলেও তাঁর কিছু বিশ্বস্ত অনুচর কৃষকদের হাতে ধৃতও নিহত হয়। অবশেষে ব্রিটিশ সরকার সুশিক্ষিত সেনা বাহিনী প্রেরণের মধ্য দিয়ে এ বিদ্রোহ দমনে সক্ষম হয়। বলাকী শাহের বিদ্রোহ (১৭৯১-৯২) রংপুরের কৃষক আন্দোলনের সূত্র ধরে একই অবস্থা ও প্রেক্ষিতে ১৭৯১-৯২ সালে বরিশালে বলাকী শাহের নেতৃত্বে এক সশস্ত্র আন্দোলন সংগঠিত হয়। দীর্ঘকালের। নিপীড়িত কৃষককুল ছিল তাঁর অনুসারী। ইংরেজদের নিকট থেকে জমিদারী লাভ করা সামন্ত প্রভুরা অকথ্য নির্যাতন নিপীড়ন চালাতে থাকে কৃষকদের উপর। এ অবস্থায় অত্যাচারিত কৃষকরা বলাকী শাহের আশ্রয় প্রার্থনা করে। এই ফকির তাদের আশ্রয় দেয় এবং তাদের নিয়ে সংঘবদ্ধ হতে থাকে। ধীরে ধীরে তারা প্রতিরােধ সংগ্রামের আয়ােজন করে। বলাকী শাহ একটি কাঁচা দূর্গ নির্মাণ করে মােগল আমলের পুরনাে কামানগুলাে মেরামত করে সমর প্রস্ততী গ্রহণ করতে থাকেন। তিনি কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়ে রীতিমত তৈরি করে তােলেন। এরপর ১৭৯১ খৃষ্টাব্দে বিদ্রোহ ঘােষণা করে চন্দ্রদ্বীপ, সলিমাবাদ ও সুজাবাদ পরগণার সমস্ত নিপীড়ক জমিদার তালুকদার এবং তাদের অনুচরদের গ্রেপ্তার করেন। এই সালের ডিসেম্বর মাসে পাঁচ হাজার অনুসারী সৈন্য নিয়ে এ এলাকায় স্বাধীনতা ঘােষণা করেন। এরপর তিনি বিঘা প্রতি দু’টাকার বেশী খাজনা দিতে কৃষকদের নিষেধ করেন। প্রথম দিকে ইংরেজরা তাঁকে দমনের জন্য ক্ষুদ্র সেনা দল প্রেরণ। করেন। কিন্তু বলাকী শাহ এদের সহজেই পরাস্ত করেন। ইংরেজদের পুরােপুরি টনক নড়ে যায় এ ঘটনায়। এরপর তাকে চূড়ান্ত ভাবে দমনের জন্য ঢাকা থেকে প্রচুর সৈন্যসহ এক সুসজ্জিত সেনাবাহিনী প্রেরণ করে। বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে বলাকী শাহ গ্রেপ্তার হলেন। অনুসারীদের অনেকেই নিহত হলাে ইংরেজের বিচারে তিনি আজীবন কারাদন্ড প্রাপ্ত হন। আগা মােহাম্মদ রেজার বিদ্রোহ-১৭৯৯ খৃঃ ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে কৃষক শ্রমিক-ফকির সন্নাস হিন্দু-মুসলিমের অংশগ্রহণে বহু রক্তক্ষয়ে একদিন স্বাধীনতা এসেছিলাে। এ সমস্ত বিদ্রোহ সব সময় শুধুই রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সংঘটিত হয়েছে এমন নয়। প্রচন্ড ব্রিটিশ বিদ্বেষী মনােভাবও অনেকাংশে এদের প্রেরণা যুগিয়েছে। এমনি এক সংগ্রামী বীর পুরুষ আগা মােহাম্মদ রেজা। মােগল বংশােদ্ভুত এই দরবেশের সশস্ত্র সংগ্রামের পেছনে স্বচ্ছ কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য না থাকলেও প্রচন্ড ইংরেজ বিদ্বেষ ও ইংরেজ বিতাড়নই ছিল মূল লক্ষ্য। ইংরেজদের সম্পর্কে তিনি ভবিষ্যত বাণী করেছিলেন ইংরেজ শাসন
এদেশে চল্লিশ বছরের বেশী স্থায়ী হবে না। কিন্তু যখন তার এ ভবিষ্যত বাণী। সফল হলাে না তখন নিজেই তাদের বিরুদ্ধে সমর প্রস্তুতী আরম্ভ করলেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি জমিদার ও ধনবানদের ইংরেজ পক্ষ ত্যাগ করে তার সাথে সাড়া দেয়ার উদাত্ত আহবান জানান। সুবিধাভােগী স্বার্থান্বেষী মহল তার এ ডাকে সাড়া দেননি। ফলে তিনি একাই ১৭৯৯ সালের ১৪ই জুলাই পাঁচ হাজার সৈন্য নিয়ে। সিলেটের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। সুসজ্জিত ইংরেজ বাহিনীর সঙ্গে সিলেট উপকণ্ঠে। তিনি যুদ্ধে লিপ্ত হন। কিন্তু পুরনাে অস্ত্রধারী মােহাম্মদ রেজা প্রবল বিক্রমে যুদ্ধ করেও সুশিক্ষিত ইংরেজের বিরুদ্ধে পিছু হটতে বাধ্য হন। ঠিক একমাস পর। ইংরেজরা পুনরায় সামরিক অভিযান পরিচালনা করে, প্রচন্ড রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে তারা। পরাস্ত হল। মােহাম্মদ রেজা ত্রিপুরার পথে পালাতে গিয়ে ধৃত ও বন্দী হন বিচারে যাবজ্জীবন কারাদন্ডে দন্ডিত হন। পার্বত্য চট্টগ্রামে চাকমা বিদ্রোহ-১৭৭৭ খৃঃ স্বাধীনচেতা পাহাড়িয়া অধিবাসী চাকমারা বহুকাল থেকে স্বতন্ত্র বােধ নিয়ে স্বাধীনভাবে বসবাস করে আসছিলাে। মােগল বাদশাদেরও তারা তেমন কোন কর দিত না । মােগল শাসকরাও এদের ঘাটাত না। নাম মাত্র খাজনা দিয়ে তারা মােগল অধীনতা মেনে নিয়েছিলাে। কিন্তু ১৭৬০ সাল থেকে কোম্পানী এদেরকে আওতায় নিয়ে যাওয়ার পর একের পর এক করের বােঝা চাপাতে থাকে। কর ভারে জর্জরিত হয়ে তারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্রোহী মনােভাব পােষণ করতে থাকে এবং এক পর্যায় যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে উঠে। ১৭৭৭ সালের এপ্রিল মাসে রাজা জোয়ান বখশাের অনুমতিক্রমে তার দেওয়ান রুনু খান পার্বত্য চট্টগ্রামে স্বাধীনতার পতাকা উড়িয়ে ঐ এলাকা থেকে কোম্পানীর সমস্ত কর্মচারীকে বিতাড়িত করেন। রুনু খানকে পরাস্ত করতে ইংরেজরা সশস্ত্র আন্দোলন শুরু করেন। কিন্তু পাহাড়িয়া দূর্গম পথে অভিযান পরিচালনা ছিলাে অত্যন্ত কষ্টসাধ্য ব্যাপার। পক্ষান্তরে চাকমারা গেরিলা যুদ্ধ কৌশল অবলম্বন করে ফলে তাদের বিতাড়ন অসম্ভব হয়ে উঠে। এরপর ধুরন্ধর ইংরেজরা এই এলাকাকে অর্থনৈতিক ভাবে বিচ্ছিন্ন এলাকা। ঘােষণা করে তাদের আয়ত্ত্বে আনতে চেষ্টা করে। তারা বিশেষ করে কেরােসিন, লবণ, তেল, মাছ, লৌহজাত দ্রব্য সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। এর জবাবে রুনু খান। জ্বালানী কাঠ সরবরাহ বন্ধ করে ইংরেজদের লাভজনক ব্যবসা লবণ উৎপাদনে। বাধা সৃষ্টি করে। এই অবস্থা দীর্ঘ ১০ বছর পর্যন্ত চলতে থাকে ফলে ইংরেজরা এই প্রথম কোন দেশীয় শক্তির সাথে সমঝােতা করতে বাধ্য হয়। পাগলপন্থী বিদ্রোহ (১৮২৫-৩৩) ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন শােষণের শৃঙখল ভাঙ্গার জন্য যে সমস্ত বিদ্রোহ বাংলায়। সংগঠিত হয় তার মধ্যে পাগলপন্থী বিদ্রোহও এক উল্লেখযােগ্য ঘটনা। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ দিকে এক যাযাবর দরবেশ করিম শাহ জামালপুরে স্থায়ী ভাবে বসবাস শুরু করেন। ময়মনসিংহ জামালপুরে তথাকথিত জমিদারদের অকথ্য অত্যাচার নিপীড়নের বিরুদ্ধে তিনি পাহাড়িয়া অঞ্চলের হাজং, গারাে, হিন্দুমুসলিমদের সংগঠিত করে এক সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনা করেন। গারাে হাজং হিন্দু। মুসলিমদের সমন্বিত প্রচেষ্টায় এ আন্দোলন ১৮২৫-৩৩ পর্যন্ত স্থায়ী হয়। করিম শাহ ছিলেন ফকির মজনু শাহের একজন শিষ্য। করিম শাহ অন্যান্য ধর্মের লােকদের ধর্মান্তরিত না করে শিষ্যত্বে বরণ করে নিতেন যার ফলে তাঁর শিষ্যের সংখ্যা ছিল অনেক বেশী। তিনি নিজেকে পাগল বলে পরিচয় দিতেন। এ কারণে তাঁর শিষ্যরা ‘পাগল পন্থী হিসেবে পরিচিত ছিল। করিম শাহর মৃত্যুর পর তাঁর সুযােগ্য সন্তান টিপু পাগল নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। সুদক্ষতার সাথে টিপু পাগল এ আন্দোলন পরিচালনা করতে থাকে। টিপু পাগলের সংগঠন শক্তি ছিল বিস্ময়কর রকমের। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ফলে নাটোরের জমিদারী যখন কলকাতার নব্য জমিদারদের হাতে চলে যায় তখন তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য ছিল অর্থ সংগ্রহ করা । ফলে তারা। কৃষকদের উপর সীমাহীন নির্যাতন শুরু করে। এর ফলে অত্যাচারিত কৃষকরা টিপুর আশ্রয় গ্রহণ করে। টিপু তাদের নির্দেশ দেন পূর্বের অতিরিক্ত কোন খাজনা দেয়া হবে না। এতে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৮২৫ খৃঃ টিপু তার অনুসারীদের নিয়ে জমিদার বাড়ী লুট ও কয়েকজন গােমস্তাকে হত্যা করে। জমিদারগণ প্রাণভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। টিপু পাগল তখন নিজেকে এ এলাকার স্বাধীন শাসক ঘােষণা করেন। এর ফলে ইংরেজরা এক সেনাবাহিনী পাঠিয়ে তাকে বন্দী করেন। প্রচন্ড জনপ্রিয়তার কারণে নজির বিহীন আন্দোলনের মুখে ইংরেজরা তাকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। পুনরায় তিনি সংগঠিত হতে থাকলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযােগে তিনি পূণরায় গ্রেফতার হন। আন্দোলন আবার ধূমায়িত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা জামালপুরের সবধরনের সরকারী ভবন ও সম্পত্তিতে আগুন লাগিয়ে দেয় এবং জামালপুর হতে গারাে পাহাড় পর্যন্ত সমস্ত এলাকা নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসে। অবস্থা বিবেচনা করে ইংরেজ শাসকরা ঢাকা থেকে প্রচুর সৈন্য এনে। জামালপুরের প্রতি ঘরে ঘরে অমানুষিক অত্যাচার চালায়। যার ফলে ইতিহাস খ্যাত এই পাগলপন্থী বিদ্রোহ ধীরে ধীরে স্তিমিত এবং নিঃশেষ হয়ে যায়।
ঔপনিবেশবাদ শক্তির যাতাকলে নিষ্পেষিত শৃঙ্খলিত ভারতবাসী বিশেষ করে মুসলিম শক্তি পরাধীনতার পরদিন থেকে অবিরাম অবিশ্রান্তভাবে আন্দোলন চালিয়ে গেছে। সে সংগ্রামের ঢেউ পৌছে গেছে বাংলার প্রতি আনাচে কানাচে। বাংলার সগ্রামী শক্তি যখন ধূমায়িত আন্দোলনে ইংরেজদের বিরুদ্ধে দ্রোহের আগুনে জ্বলছে তখন এরা বাংলার বাইরে অন্য প্রতিরােধ শক্তিকে লােকবল অর্থবল দিয়ে সাহায্য করেছে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের উঁচু ভূমির পাদদেশে বিভিন্ন প্রদেশ ও উপজাতির মুসলমানদের সৈয়দ আহমদ সিপাহী বিদ্রোহের পূর্বক্ষণে সন্নিবেশিত করে তাদের এক অপ্রতিরােধ্য বাহিনীতে রূপান্তরিত করেন। এক যােগে তিনি আক্রমণ হানেন ইংরেজ ও শিখদের বিরুদ্ধে। উপনিবেশবাদী ইংরেজ শক্তি বিপদের ভয়াবহতা আঁচ করতে পেরে নিশ্চিত ভাবে এই যুদ্ধে বিশ্বের বুকে প্রথম মানব জাতির বিরুদ্ধে রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার করে। এ যুদ্ধে বাংলার ক্ষণজন্মা কৃতি সন্তান স্যার সৈয়দ আহমদ শাহাদাৎ বরণ করেন। এরপর ইংরেজগণ মুসলমানদের সীমাহীন প্রতিরােধ আন্দোলনের উৎস খুঁজে নিমূলের চেষ্টা চালাতে লাগলেন। এতদ উদ্দেশ্যে মুসলিম শিক্ষাকে পঙ্গু ও সভ্যতাকে ধ্বংসের মহা। পরিকল্পনা গ্রহণ করে। ইংরেজদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কলকাতার আলিয়া মাদ্রাসা এর অন্যতম উদাহরণ। ইসলামী শিক্ষা ব্যবস্থায় ব্যবহারিক শিক্ষাকে যথেষ্ট গুরুত্ত্ব। দেয়া হয়েছে। কিন্তু ইংরেজ প্রবর্তিত এ বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে এক অনুৎপাদিত খাতে প্রবাহিত হয়। হিন্দু কলেজ প্রতিষ্ঠা এবং আলিয়া মাদ্রাসা স্থাপনের মাধ্যমে তারা এদেশে শ্রেণী বৈষম্যমূলক শিক্ষা ব্যবস্থার ভিতকে দৃঢ় মজবুত করে। সগ্রাম আর আন্দোলনের রক্তাক্ত পথে ইংরেজদের শঙ্কিত পদযাত্রা চলতে থাকে। বিদ্রোহ বিপ্লবের প্রবল জোয়ারে ধীরে ধীরে তাদের পায়ের নীচের শক্ত ভূমি ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আসতে থাকে। বিভিন্ন ব্যক্তি থেকে সমষ্টিক পর্যায়ে একের পর এক বিদ্রোহ সংগঠিত হতে থাকে। মােট কথা দুশ’ বছরের ইংরেজ শাসন কখনও নিরুপদ্রব ছিল না। বিভিন্ন মহৎ রাজনৈতিক নেতৃবর্গের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার কারণে ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন সার্থক হয়েছিল আমরা পেয়েছি বাংলাদেশের এক ঐতিহাসিক ও শাসনতান্ত্রিক পটভূমি। ফজলুল হকের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব বাংলার কৃতী সন্তান শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক একজন দেশ প্রেমিক সমাজ হৈতৈষী বিদ্যানুরাগী কৃষক শ্রমিকের বন্ধু সর্বোপরি মহান রাজনীতিক হিসেবে
স্মরণীয় হয়ে আছেন। ভারত বর্ষের রাজনৈতিক আন্দোলনের ইতিহাসে লাহাের। প্রস্তাব তার অনন্য ঐতিহাসিক ভূমিকার জন্য উজ্জ্বল ও খ্যাত হয়ে আছেন। ১৯৪০ সালের ২৩শে মার্চ সর্বভারতীয় মুসলীমলীগ লাহাের অধিবেশনে ভারত বিভাগ এবং মুসলমানদের জন্য স্বতন্ত্র আবাস ভূমি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ঐতিহাসিক প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় । ‘ভারতের যে সকল অঞ্চলে মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ট যেমন ঃ উত্তর পশ্চিম ও পূর্বাঞ্চলের এলাকা সমূহকে একত্রিত করে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করা হবে এবং উক্ত রাষ্ট্রগুলাের অঙ্গরাজ্য সমূহ হবে স্বাধীন ও সার্বভৌম’ -এ লাহাের প্রস্তাবে আমাদের আজকের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলারও স্বপ্নবীজ বপন হয়েছিলাে। দেখা হয়েছিলাে ভারতের স্বাধীনতার স্বপ্ন। দেশবন্ধু চিত্ত রঞ্জন যে সকল ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ অসামান্য ত্যাগ, আসীম দেশপ্রেম এবং বিচক্ষণতার দ্বারা বাঙালী জাতিকে মর্যাদার আসনে সমাসীন করেছেন-দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন তাঁদের মধ্যে অন্যতম। স্বরাজ দল গঠন, হিন্দু মুসলিম সম্পর্ককে উন্নীত করণ, অহিংসা রাজনীতির জন্য তিনি বিশেষ ভাবে বরণীয়। তিনি নিজেকে বাঙ্গালী বলে পরিচয় দিতে ভালবাসতেন বাঙ্গালী সংস্কৃতির জন্য গর্ববােধ করতেন। তিনি কতটা খাঁটি বাঙ্গালী ও দেশপ্রেমী ছিলেন তা নিম্নের উদ্ধৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায় । ‘আমি নিজেকে বাঙ্গালী বলতে এক অনির্বচনীয় গর্ব অনুভব করি। বাঙ্গালীর নিজস্ব একটি সাধনা আছে, শাস্ত্র আছে, ধর্ম আছে, কর্ম আছে, ইতিহাস আছে, ভবিষ্যত আছে। বাঙ্গালীকে যে অমানুষ বলে সে আমার বাংলাকে জানেনা’। স্বাধীনতা আন্দোলনে তাঁর অন্যতম অবদান ‘স্বরাজ দল গঠন’। এ সম্পর্কে তিনি বলতেন, ‘আমাদের শাসনতন্ত্র আমরাই পরিচালনা করব। এ আমাদের জন্মগত অধিকার। কোন শাসননীতিই যেন আমাদের এ অধিকার হতে বঞ্চিত করতে না পারে। যে মুহূর্তে তােমরা একথা ভাল করে বুঝবে, সে মুহূর্তেই তােমাদের স্বরাজ লাভ হবে।’ ব্যক্তি জীবনে অত্যন্ত বিলাসী পুরুষ এক সময় সব কিছু ত্যাগ করে দেশ প্রেমের মৌলমন্ত্রে দীক্ষিত হয়ে স্বাধীনতা আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়েন। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী অসামান্য রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, অসাধারণ মেধাবী, তীক্ষ্ণ ও চৌকষ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির হাত থেকে।
ভারতের মুক্তি স্বপ্নের এক অন্যতম দ্রষ্টা। খুব অল্প সময়ের মধ্যে ভারতীয় রাজনীতিতে তিনি একটি গৌরবােজ্জ্বল ভূমিকা গ্রহণ করেন। তাঁর দূর দৃষ্টি সম্পন্ন রাজনৈতিক প্রজ্ঞার পরিচয় মেলে তার সাংগঠনিক তৎপরতায়। ১৯২১ সালে তিনি খিলাফত ও অসহযােগ আন্দোলনে যােগদান করেন। খুব অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি একে একে সাফল্যের শীর্ষে পৌঁছে যান। ব্রিটিশ মুক্ত ভারতের স্বাধীনতার জন্য যে সমস্ত নেতা ও আন্দোলন উজ্জ্বল হয়ে আছে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী তাঁদের অন্যতম। খিলাফত আন্দোলন। ব্রিটিশ ভারতে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের পরবর্তী রাজনৈতিক ঘটনা খিলাফত আন্দোলন। খিলাফত আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন মৌলানা মােহাম্মদ আলী, তদীয় ভ্রাতা মৌলানা শওকত আলী এবং মৌলানা আবুল কালাম আজাদ প্রমূখ। ১৯২০ সালের শেষ দিকে কংগ্রেস পরিচালিত অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়। উভয় আন্দোলনের নেতৃত্ব অর্পণ করা হয় মহাত্মা গান্ধীর উপর। গান্ধীজি অহিংস আন্দোলনের নির্দেশ দান করেন। এছাড়া গান্ধীজি বিলেতী পণ্য বর্জনেরও নির্দেশ দান করেন। হিন্দু মুসলমানদের মিলিত ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলন খুব জোরদার হয়ে ওঠে। এর নেতৃত্ব দানকারী নেতৃবর্গও অসামান্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেন। মৌলানা মােহাম্মদ আলী, মৌলানা শওকত আলী ও মৌলানা আবুল কালাম আজাদের আহবানে হাজার হাজার মুসলমান সরকারী চাকরি ছেড়ে দেয়। অসংখ্য ছাত্র ও শিক্ষক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ত্যাগ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ে। ব্রিটিশ বিরােধী এই আন্দোলন খুব অল্প সময়ের মধ্যে জনপ্রিয় স্বাধীনতা আন্দোলনে রূপ নেয়। কৃষক শ্রমিক সবার মধ্যেই এ আন্দোলননের বােধ ছড়িয়ে পড়ে এবং তারা একক ভাবে সাড়া দিতে থাকে। এ আন্দোলনের সমর্থনে ১৯২০ সালেই কমপক্ষে ২০০ বার ধর্মঘট হয়। গণমুখী এ আন্দোলন রাজনৈতিক দিক থেকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও শেষ পর্যন্ত সহিংস। আন্দোলনে রূপ নেয় এবং পর্যায়ক্রমে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটতে থাকে। উৎপীড়িত মুসলিম প্রজা বৃন্দ নানা স্থানে হিন্দু জমিদারদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করে। হিংস্রতার জন্য গান্ধী আন্দোলন বন্ধ করার নির্দেশ দেন। ফলে খিলাফত আন্দোলনের পরিসমাপ্তি ঘটে।
অসহযােগ আন্দোলন।
একই সময়ে ইংরেজদের বিরুদ্ধে ভারতে মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস অসহযােগ আন্দোলন শুরু করে। যে সমস্ত কারণে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়(১) প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয়দের সাহায্য কামনা করে প্রতিশ্রুতি দেয় যুদ্ধ জয়ের পর ভারতকে স্বাধীনতা দেয়া হবে কিন্তু যুদ্ধে মিত্রশক্তির জয় হবার পর ব্রিটিশ তাঁদের প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে। (২) ১৯১৯ সালের আইনে প্রদেশগুলােতে আংশিক স্বায়ত্ত শাসন। (৩) ব্রিটিশ সরকারের রাউলাট আইন পাস ও ঔপনিবেশিক শক্তিকে দৃঢ় মজবুত করার প্রয়াসে এবং কংগ্রেসের সত্যাগ্রহ আন্দোলনের প্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার। কুখ্যাত রাউলাট আইন পাস করে। এ আইনের আওতায় যে কোন ব্যক্তিকে বিনা কারণে আটক করে রাখা যেত। ব্রিটিশ প্রবর্তিত অত্যাচার এবং নিপীড়নের জন্য এ দেশের মানুষের বিরুদ্ধে যে সমস্ত হাতিয়ার ব্যবহার করে এটি ছিলাে তার। অন্যতম। (৪) জালিনওয়ালা বাগের হত্যাকান্ড ঃ কুখ্যাত ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ারের হুকুমে ১৯১৯ সালের ১৩ই এপ্রিল পাঞ্জাবের জালিওয়ালা বাগে আহুত এক প্রতিবাদ সভায় নির্বিচারে গুলি চালানাে হয়। এর ফলে ৩৭৯ জন লােক মারা যায় এবং প্রায় ১২০০ লােক আহত হয়। খিলাফত এবং অসহযােগ এই উভয় আন্দোলনের নেতৃত্ব দেন ভারতের অবিসংবাদিত নেতা মােহন লাল করম চাঁদ গান্ধী মহাত্মা গান্ধী। সুযােগ্য নেতৃত্ব এবং গণমুখী হওয়ার কারণে এ আন্দোলন অচিরেই সর্বভারতীয় রূপ লাভ করে। বিলেতী পণ্য বর্জন জনগণ অব্যাহত রাখে এবং সরকারী অফিস আদালত স্কুল কলেজ বর্জন করতে থাকে। এ আন্দোলনে সমভাবে শ্রমিক শ্রেণী ও অংশ গ্রহণ করে। এ আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত সহিংসতায় রূপ নেয়। মালাবারের মােপালা মুসলমানগণ জমিদার ও মহাজনদের বিরুদ্ধে হিংসাত্মক কার্যক্রম শুরু করে। ফলে এ আন্দোলনও শেষ পর্যন্ত ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এ আন্দোলনে ব্যর্থতার ফলে হিন্দু মুসলিম ঐক্যে ফাটল ধরে। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগ স্বতন্ত্র ভাবে আন্দোলনের পথ বেছে নেয়। এর ফলশ্রুতিতে দিল্লী, এলাহাবাদ, গুলবার্গ, লক্ষী,
জবপুর, নাগপুর প্রভৃতি স্থানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা হয়। সরকারী অফিস বর্জনের কারণে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। স্কুল কলেজ বর্জনকারী ছৈলে মেয়েদের অধিকাংশেরই লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। এবং তারা আর কখনাে লেখা পড়া করতে পারেনি। ১৯২৭ সালে ১৯১৯ সালের ভারত শাসন আইনের কার্যকারিতা পর্যালােচনার জন্য সাইমন কমিশন গঠিত হয়। কিন্তু কোন ভারতীয় এ কমিশনে ছিলেন না বলে একে ‘সাদা কমিশন’ বলে অভিহিত করে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই বর্জন করে। কংগ্রেস এ কমিশনের বিরুদ্ধে মতিলাল নেহেরুর নেতৃত্বে ভারতের ভবিষ্যৎ সংবিধান সম্পর্কে রিপাের্ট প্রদানের জন্য একটি কমিটি গঠন করেন। এ কমিটির রিপাের্টকে ‘নেহেরু রিপাের্ট’ বলা হয়। কিন্তু এ রিপাের্ট মুসলমানদের দাবী সর্বতােভাবে উপেক্ষা করা হয়। জিন্নাহর ১৪ দফা দাবী এর প্রতিবাদে এ বছরই মুহম্মদ আলী জিন্নাহ শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য মুসলমানদের দাবী দাওয়া সম্বলিত একটি দলিল পেশ করেন এটাই জিন্নাহর ১৪ দফা দাবী বলে খ্যাত। স্বাধীনতার পথে উত্তরােণ ও ঔপনিবেশিক শােষণ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলনের ইতিহাসে জিন্নাহর ১৪ দফা দাবীর গুরুত্ব অনস্বীকার্য। নেহেরুর রিপাের্টে যেমন মুসলমানদের উপেক্ষা করা হয় তেমনি ভাবে জিন্নাহর রিপাের্টে মুসলমানদের ন্যায্য দাবী দাওয়া উপস্থাপন করে মুসলমানদের স্বাতন্ত্র ও শক্তিকে স্বীকার করা হয়। জিন্নাহ ১৯২৯ সালে তাঁর এ ১৪ দফা দাবী পেশ করেন। গােল টেবিল বেঠক সমূহ ব্রিটিশের উদ্দেশ্যপ্রণােদিত সাইমন কমিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হওয়ার পর ভারতে যখন বিভিন্ন জাতীয় আন্দোলনের মাধ্যমে স্বাধীনতার পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছিল তখন ব্রিটিশ শক্তি ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য লন্ডনে ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে তিনটি গােল টেবিল বৈঠক আহবান করা হয়। এটাই ইতিহাসে গােল টেবিল বৈঠক হিসেবে খ্যাত। প্রথম গােল টেবিল বৈঠক ১৯৩০ সালে বসে। এতে কংগ্রেস ছাড়া ভারতের অনেক রাজনৈতিক দলই অংশ নেয় এবং এই বৈঠকে অনেক অগ্রগতি সাধিত হয়।
দ্বিতীয় গােল টেবিল বৈঠক বসে ১৯৩১ সালে এতে কংগ্রেস থেকে মহাত্মাগান্ধী এবং ভারতীয় মুসলমানদের পক্ষ থেকে মুহম্মদ আলী জিন্নাহ ও শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক যােগদান করেন। তৃতীয় গােল টেবিল বৈঠক হয় ১৯৩২ সালে। এ বৈঠকে আলােচনার কোন অগ্রগতি হয়নি। ভারতে আইন অমান্য আন্দোলন তখনাে পুরােপুরি চলছে। ১৯৩৩ সালের মার্চ মাসে ভারতের ভবিষ্যত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে শ্বেতপত্র (white paper) প্রকাশিত হয়। এর উপর ভিত্তি করেই ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন রচিত ক্রিপস মিশন-১৯৪২ বিজয়ের পথে এগিয়ে যাচ্ছে ভারতীয় আন্দোলন, অসন্তোষ আর বিদ্রোহের আগুন জ্বলছে দিকে দিকে। এদিকে চলছে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ, জাপানীরা ভারতের একেবারে পূর্ব প্রান্তে এসে হানা দেয়। এ অবস্থায় ভারতীয়দের সাহায্য ব্রিটিশের একান্ত ভাবে প্রয়ােজন হয় এবং তারা ভারতীয়দের সহযােগিতা কামনা করে। এতদ উদ্দেশ্য স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস নামক ব্রিটিশ কেবিনেটের একজন সদস্যকে ভারতের শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য ১৯৪২ সালে প্রেরণ করা হয়। তিনি একটি প্রস্তাব নিয়ে আসেন এটিই ক্রিপস মিশন হিসেবে খ্যাত। ক্রিপস মিশনের প্রস্তাব। (১) ডােমিনিয়ন সৃষ্টি। (২) গণপরিষদ গঠন। (৩) ডােমিনিয়নের সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা। (৪) অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। (৫) নতুন শাসনতন্ত্র রচনা হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দেশ রক্ষার দায়িত্ব ব্রিটিশ সরকারের হাতেই থাকবে। কংগ্রেস এবং মুসলীম লীগ উভয়ই ক্রিপস্ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। প্রদেশগুলি ডােমিনিয়নের বাইরে থাকার অধিকার ভারতীয় ঐক্যের প্রতি ক্ষতিকর বিবেচনান্তে কংগ্রেস এ সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি। ওদিকে এতে পাকিস্তান প্রস্তাব স্বীকৃত হয়নি বলে মুসলীম লীগ প্রত্যাখ্যান করে। তাছাড়া এতে অবিলম্বে স্বাধীনতা দানের কোন লক্ষণও ছিল না। অবশেষে ক্রিপস মিশন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়।
অনেক সংগ্রাম আর আন্দোলনের রক্তাক্ত পথে অবশেষে প্রত্যাশিত স্বাধীনতা। এলাে। আর এ স্বাধীনতার মাধ্যমে পাকিস্তান সৃষ্টি হলাে। পাকিস্তান সৃষ্টির মধ্যেই আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার স্বপ্নের বীজ রােপিত হয়েছিলাে। ৩রা জুন পরিকল্পনার উপর ভিত্তি করে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৪৭ সালের ১৮ই জুলাই ভারতীয় স্বাধীনতা আইন পাস করে। এ আইন অনুযায়ী ভারতের গভর্ণর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটেন ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট করাচীতে পাকিস্তানের গণ পরিষদের কাছে আনুষ্ঠানিক ভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করে। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের প্রথম গভর্ণর জেনারেল হন। অনুরূপভাবে ১৯৪৭ সালের ১৫ই আগস্ট গভর্ণর জেনারেল নয়া দিল্লীতে ভারতের গণ পরিষদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করেন। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন নিজেই কিছু দিনের জন্য ভারতের গভর্ণর জেনারেল নিযুক্ত হন। অতঃপর ১৯৪৭ সালের ভারতীয় স্বাধীনতা আইন অনুযায়ী পাকিস্তান এবং ভারত নামে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্ম লাভ করে। দুশ’ বছরের নিঠুর শাসনে গড়া যে পাষাণ বেদী তার বক্ষ চিরে নূতন প্রাণ নিয়ে অঙ্কুরিত হলাে স্বাধীনতা। রক্তস্নাত পথে অর্জিত হলাে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারত। এ উত্তরােণে লাখাে বীর সন্তান আত্মােৎসর্গে প্রমাণ করে গেছে আজন্ম বিদ্রোহী বিপ্লবী জাতি কখনাে পরাজয় স্বীকার করেনা কারাে অধীনতা মানে না। এ রক্ত আমাদের ধমনীতে প্রবাহিত বলেই স্বাধীনতার আবার মাত্র ২৪ বছর পর মাতঙ্গীকে মাততে হলাে সমর রঙ্গে। রক্তে সৃষ্টি হলাে অসংখ্য নদী। যে নদী আজ উর্বরা করে রেখেছে সােনালী বাংলাকে। ঝড়ে গেলাে ৩০ লক্ষ তাজা প্রাণ। কেড়ে নিলাে পাকিস্তানী বর্বরেরা দু’লক্ষ মা বােনের ইজ্জত । লুষ্ঠিত হলাে এ রত্নভান্ডার দস্যু তস্করের হাতে। বাংলার প্রতিবাদী সূর্য সৈনিকেরা আবার বুক চিতিয়ে দাড়ালাে, গড়ে তুললাে মরণমূখী প্রতিরােধ। এ প্রতিরােধের সামনে শিশু আর নারী হত্যাকারী পিশাচেরা বেশী দিন টিকতে পারেনি। মাত্র ৯টি মাসের সশস্ত্র সংগ্রামে পরাভূত হলাে তথাকথিত বীর পাকিস্তানী সৈন্য। আবার বাংলার নীলাকাশে সগর্বে উকি মারলাে লাল সবুজের পতাকা।
পাকিস্তানী শােষণের চব্বিশ বছর রক্তনদী পেরিয়ে আমাদের কাংখিত স্বাধীনতা এলাে। এ স্বাধীনতা কোন দৈব ঘটনা নয়। অনেক সগ্রাম, আন্দোলনের চরাই উত্রাই পেরিয়ে, রক্ত সাগর বইয়ে, বহু ত্যাগ আর তিতীক্ষার মধ্য দিয়েই এসেছিলাে। এ স্বাধীনতা অর্জিত হওয়ার পর পূর্ব পাকিস্তানের জন সাধারণ আশা করেছিলাে বৃটিশ চলে গেছে এবার তাদের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে। সগর্বে স্বাধীন দেশের স্বাদু মাটিতে পা রেখে আপন মনে কাজ করবে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সে আশা পূরণ হয়নি। কেননা শাসক যায় শাসক আসে শােষণের হাত বদলায় মাত্র। সাধারণ মানুষের ভাগ্যের। কোন পরিবর্তন হয়না। পশ্চিম পাকিস্তানীরা হয়ে পড়লাে ব্রিটিশেরই অন্যরূপ। অর্থাৎ বৃটিশ পাকিস্তান শােষণ শাসনের দিক থেকে একই মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক থেকে আমরা পরিণত হলাম পাকিস্তানী কলােনীতে। পশ্চিম পাকিস্তানীরা তাদের ঔপনিবেশিক শাসন শােষণ পাকাপােক্ত করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালাতে থাকে এবং বিভিন্ন কৌশল অবলম্বন করে। তারা নানা দিক দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের সাথে গড়ে তােলে বৈষম্যের কঠিন দেয়াল। কিন্তু বিপ্লবী বাঙালীরা। নিঃশব্দে মেনে নিতে পারল না তাদের এ অন্যায় শাসন শােষণ । জেগে উঠল এ মাটির সন্তানেরা। আবার অনিবার্য হয়ে উঠলাে এক রক্তাক্ত সংগ্রাম। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর মুসলীম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। মুসলীম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ, ঢাকায়। এর প্রতিষ্ঠাতা নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহ এবং নওয়াব ভিকারুল মূলক ছিলেন বাংলাদেশের মানুষ। কিন্তু পাকিস্তানের নেতৃত্ব চলে যায় পশ্চিম পাকিস্তানীদের হাতে। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠিত হয় করাচীতে। এ দুটি কারণে বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঔপনিবেশিক শাসনের সূত্রপাত হয়। এছাড়া এক হাজার মাইলের ব্যবধানে এ দুটি রাষ্ট্রের মধ্যে জাতীয় সংহতি ছিল এক দূরূহ ব্যাপার। অধিকন্ত অনেক আগে থেকেই পাকিস্তানী সামরিক ও অসামরিক আমলা, ভূস্বামী, বড় বড় ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতিরা বিশ্বাস করতেন যে পাকিস্তান একদিন বিভক্ত হয়ে যাবে। জেনারেল আয়ুবের Friends, not Master গ্রন্থে এরূপ মনােভাব ব্যক্ত করা। হয়েছে। তাই মূলতঃ শােষণ নীতিই ছিল তাদের মূল চালিকা শক্তি। এদিকে লক্ষ্য রেখেই পূর্ব পাকিস্তানকে শােষণ করে তারা স্বাবলম্বী হওয়ার বিভিন্ন কৌশল চালাতে থাকে।

এছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তান সুপরিকল্পিত ভাবে ব্যাংক ও বীমা কোম্পানী গুলাের মাধ্যমে মূলধন পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে স্থানান্তরিত করতে থাকে। এভাবে পশ্চিম পাকিস্তানীদের চাপিয়ে দেয়া শােষণ ব্যবস্থা ও বৈষম্যের মধ্যে পরে গুমরে মরতে থাকে বাঙালীরা। দ্রোহের মনােভাব জেগে ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের। জনমনে। সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠে। দাবী ওঠে পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্ব শাসনের। পূর্ব পাকিস্তানের আওয়ামী লীগ প্রধান অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে ৬ দফা কর্মসূচী জনসমক্ষে পেশ করে প্রথম। স্বায়ত্ত শাসনের আন্দোলনের সূত্রপাত করেন। এ সংগ্রামের পরিণাম আঁচ করতে পেরে পাকিস্তানীরা আন্দোলনকে স্তব্ধ করে দেয়ার জন্য শেখ মুজিবসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা রুজু করে। এ মামলা চলাকালে ঢাকা সেনা নিবাসে আটক সার্জেন্ট জহুরুল হককে হত্যা করা হয়। শুরু হয় সর্বাত্মক গণ আন্দোলন। দাবী ওঠে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তি। দলমত নির্বিশেষে সর্বস্তরের জনতা এই আন্দোলনে অংশ নেয়। এ আন্দোলনের চরম রূপ পরিগ্রহের পরিণতিতে ১৯৬৯ সালে গণ অভুথান হয়। জনতার রােষানলে পতন হলাে লৌহ মানব শাহী আয়ুবের। আওয়ামী লীগের এ ৬ দফা কর্মসূচী ছিল মূলতঃ স্বাধীনতার মহা সনদ। ৬ দফাঃ (১) যুক্ত রাষ্ট্রীয় ও সংসদীয় সরকার। (২) দু’টি ক্ষমতা সম্পন্ন কেন্দ্রীয় সরকার। (৩) বিশেষ ধরণের যুক্তরাষ্ট্রীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা। (৪) অঙ্গ রাষ্ট্রের কর ও শুল্ক ধার্যের ক্ষমতা। (৫) অঙ্গ রাষ্ট্রের স্বাধীন বর্হিবাণিজ্যের ক্ষমতা। (৬) অঙ্গ রাষ্ট্রের আধা সামরিক বাহিনী গঠনের ক্ষমতা। শােষিত নিপীড়িত পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যোন্নয়নের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক পেশকৃত এ ছয় দফা দাবীতে বাঙ্গালীরা তাদের মুক্তির প্রথম স্বপ্ন দেখতে পেয়েছিল। ফলতঃ এ ৬ দফার প্রতি ছিল জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন। বিভিন্ন বৈষম্য মূলক আচরণ ছাড়াও পাকিস্তানীরা প্রথমেই বাঙ্গালীর চেতনার মর্মমূলে আঘাত হেনে ছিল রাষ্ট্র ভাষা উর্দু কায়েম করার ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে।
পাকিস্তানী শাসক গােষ্ঠী শুরুতেই বাঙালীদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দিয়ে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এর প্রেক্ষিতে পূর্ববঙ্গের মানুষ বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষা করার সংগ্রামে ঝাঁপিড়ে পড়ে। রাষ্ট্র ভাষাকে কেন্দ্র করে ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারীতে ঘটে যায় এক রক্তাক্ত অধ্যায়। ছাত্র সমাজ সহ সর্বস্তরের জনতা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় নেমে পড়ে। নির্বিচারে গুলী চালায় পাকিস্তানী সৈন্যরা। শহীদ হয় সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, মরিয়া হয়ে ওঠে। বাঙালীরা। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই আবার বাঙালী জনমনে স্বাধীনতার স্বপ্ন। জেগে ওঠে। এ আন্দোলন নব জাতীয় চেতনা তথা ভাষা ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটায়। বাঙালীরা সচেতন হয়ে ওঠে তাদের স্বাধিকার সম্পর্কে। ভাষা আন্দোলন বাঙালীদের রক্তের বিনিময়ে জাতীয়তাবাদী দাবী আদায়ের শিক্ষা দেয়। সমগ্র জাতিই সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ভবিষ্যতে আরাে প্রবল আন্দোলন গড়ে তােলার সাহস ও অনুপ্রেরণা লাভ করে। অন্যদিকে এ আন্দোলনে হিন্দু মুসলিম উভয়ের অংশ গ্রহণের মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ঃ ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত পূর্ব বঙ্গ প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচনের ফলে বাঙালী জাতীয়তাবােধ ক্রমশ জোরদার হয়। এ নির্বাচনে কেন্দ্রের বিমাতা সুলভ শাসনের প্রতি বাঙালীদের বিরােধিতার প্রকাশ ঘটে। তারা তাদের স্বায়ত্বশাসন ও স্বাধিকারের দাবীর প্রতি ঐক্যবদ্ধ ভাবে সমর্থন জানায়। এ নির্বাচনের ফলে পূর্ব বঙ্গের যথার্থ প্রতিনিধিরা দ্বিতীয় গণপরিষদের সদস্যপদ লাভ করেন। বাঙালীরা তাদের ঐক্যের গুরুত্ব ও শক্তি সম্পর্কে সচেতন হয়ে ওঠে। ১৯৬৮-৬৯-এর গণআন্দোলন ও পূর্ব বাংলার ছাত্র সমাজ কর্তৃক উত্থাপিত ১১ দফা দাবীতে পরিচালিত আন্দোলন বাঙালীদের জাতীয় চেতনাকে চরম সংগ্রামী রূপদান করে। এগার দফার দাবীতে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্ত্বশাসনের দাবী ছাড়াও ছাত্র, কৃষক, শ্রমিকদের দাবী অন্তর্ভুক্ত ছিল। ফলে সব শ্রেণীর বাঙালীরা এ আন্দোলনে শরীক হয়। এ আন্দোলনের চূড়ান্ত পরিণতিতে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং বাঙালীরা চূড়ান্ত ভাবে তাদের আত্ম শক্তিতে আস্থাশীল হয়ে ওঠে। এই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে বাঙালীর মনে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন চূড়ান্ত হয়ে দেখা দেয়। বাঙালীরা পাকিস্তানীদের সাথে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করার মানসিক প্রস্তুতী গ্রহণ করতে থাকে। পাকিস্তান বিরােধী যে কোন আন্দোলনেই তারা স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন দিতে থাকে।
১৯৭০ সালের নির্বাচন ঃ বাংলাদেশের অভ্যুদয় ও বাঙালী জাতীয়তাবাদের বিকাশে ১৯৭০ সালের নির্বাচন ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগের সমর্থনে। একচেটিয়া ভাবে ভােট দিয়ে প্রমাণ করে যে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানীদের ঔপনিবেশিক শাসন থেকে মুক্ত হয়ে নিজেদের ভাগ্য নিজেরা গড়তে চায়। এ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত বিজয়ের মধ্য দিয়ে বাঙালীদের জাতীয় সংহতি দৃঢ় ভিত্তি মজবুত হয়। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও শােষণ নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাগ্রত বাঙালী অবশেষে ঝাপিয়ে পড়ে তাদের মুক্তি সংগ্রামে। অনিবার্য হয়ে ওঠে যুদ্ধ। ১৯৭১ সালের ৭ই মার্চে রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জন সমুদ্রে বাংলার কিংবদন্তির নেতা ইতিহাসের রাখাল রাজা বঙ্গবন্ধু বজ্র কণ্ঠে ঘােষণা দেন এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ শুধু তাই নয় তিনি সর্বাত্মক আন্দোলনে সাড়া দেয়ার মাধ্যমে যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহবান জানান। বাংলার আপামর জনসাধারণ তাদের এই প্রিয় নেতার ডাকে সাড়া দেয়। শুরু হয় সর্বাত্মক আন্দোলন। অবশেষে ২৫শে মার্চের রাতের অন্ধকারে নিরীহ বাঙালীর উপর ঝাপিয়ে পড়ে পাকিস্তানী সামরিক জান্তা, নির্বিচারে চালায় হত্যা কান্ড। গ্রেফতার হন বাংলার প্রিয়নেতা শেখ মুজিবুর রহমান, গ্রেফতারের প্রাক্কালে লিখে পাঠান। স্বাধীনতার ঘােষণা। ওদের বর্বরতা থেকে রেহাই পায়নি অসহায় শিশু কিংবা নারীরা। এই জঘন্য হত্যা কান্ডে মনে হয়েছিলাে ওরা যুদ্ধে পারদর্শী নয়, পারদর্শী কেবল শিশু আর নারী হত্যায়। বেশী দিন টিকতে পারল না। সূর্যসন্তান বাঙালী যুবকের প্রতিরােধের সামনে মাত্র ৯টি মাসের যুদ্ধে পরাজয় বরণ করতে হলাে ওদের। অবশেষে ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় হলাে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। ৩০ লক্ষ শহীদ আর দু’লক্ষ মা বােনের ইজ্জতের বিনিময়ে পেলাম লাল সবুজের পতাকা, যা আজ সগর্বে বাংলার আকাশে উড়ছে আর চিরকাল ঘােষণা করছে—চির বিদ্রোহী বাঙালীর বীরত্ব।
৭১-এর রণাঙ্গন। গােপন বৈঠক-আসন্ন ঝড়ের পূর্বাভাস নিদাঘের প্রচন্ড দাবদাহে চৌচির হয়ে ফেটে যায় মাটির বুক; সমগ্র প্রকৃতিতে বিরাজ করে একটা থমথমে নিস্তদ্ধতা, তারপরই শুরু হয় ঝড়ের মাতম। ৭০-এর নির্বাচনের পর পরই পাকিস্তানী চক্রের টালবাহানায় নির্বাক হয়ে যায় বাঙ্গালীরা। তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা দেয়া হচ্ছে না। অধিকন্তু তাদের উপর শুরু হয় নানা হয়রানি নির্যাতন। নির্বিচারে গুলী চালানাে শুরু হয় নিরীহ বাঙ্গালীর বুকে। অবস্থা দৃষ্টে ঝড়ের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। সাধারণ মানুষের মধ্যেও সে। চেতনা সমান ভাবে ছড়িয়ে পড়ছে। প্রত্যেকেই অনুমান করতে পারছে তাদের ভাগ্যে কি আছে। পাকিস্তানী সেনা বাহিনী নৌ বাহিনী বিমান বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীতে নিযুক্ত বাঙ্গালী অফিসার সৈনিকদের মধ্যেও সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে দ্রোহের আগুন। অনেকেই মনে মনে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে কিভাবে এই ঘৃণ্য। জাতির হাত থেকে মুক্তি পেয়ে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা করা যায়। এর অংশ হিসেবে আমাদের মধ্যেও চেতনার অগ্নিবীজ রােপিত হয়। আমি স্বাধীন সার্বভৌম একটি সােনালী দেশের স্বপ্ন দেখি। ছাত্রজীবন থেকেই রাজনীতি সচেতন ছিলাম বুকে ছিল দেশ প্রেম। তাই দেশ সেবার, দেশকে ভালবাসার প্রেরণায়ই যােগদান করেছিলাম পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে। ১৯৫২ সনের ২রা এপ্রিল আমি রাউল পিন্ডিতে বিমান সৈনিক হিসেবে যােগ দিই। এবং ১৯৬৭ সালে সার্জেন্ট হিসেবে পদোন্নতি লাভ করি । যােগ দেয়ার পর থেকে পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায় চাকরী করি। এ চাকুরীর সুবাদে বিভিন্ন পর্যায়ে ঘােরার ও দেখার সুযােগ পাই। এর মাঝেই নজরে পড়ে পূর্ব পাকিস্তানের উপর পশ্চিম পাকিস্তানের সীমাহীন বৈষম্যমূলক আচরণ। তখন। সিভিলিয়ান জীবন সম্পর্কে হয়ত ততটা অবহিত নই। কিন্তু সৈনিকদের মাঝেই চলে এই সীমাহীন বৈষম্যমূলক আচরণ। ওরা সব সময়ই বাঙালী হিসেবে আমাদের। আলাদা চোখে দেখত। যখন তখন আমাদের উপর যে সে Order Impose করে। এবং আমাদের ইচ্ছা অনিচ্ছার মূল্য না দিয়ে বদলী করা হত এবং অনেকাংশে তা। of Forcibly! ৫২ সালের ভাষা আন্দোলননের পর থেকে পাকিস্তানীদের মনে সন্দেহের বীজ রােপিত হয়। পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে যাবে তাই এদের বিচ্ছিন্ন হবার সংগ্রাম। ক্রমান্বয়ে তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তা লাভ করছে। তারা প্রথম থেকেই আমাদের।
সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখতে থাকে। আর ওদের এই বৈষম্য মূলক আচার আচরণই আমাদের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগ্রত করে। আমরাও সমান ভাবে ওদেরকে। ঔপনিবেশিক শক্তি এবং শােষক হিসেবে ভাবতে শুরু করি। শুধু ভাবনাই নয়, শােষক বৃক্ষকে গুড়িয়ে শােষণমুক্ত দেশ ও সমৃদ্ধ আগামীর স্বপ্ন দেখতে থাকি। ভেতরে ভেতরে সবাই একই ভাবে দন্দীভূত। বিমান বাহিনী সেনা বাহিনী নৌ বাহিনী পুলিশ বাহিনী ইপিআর সবার মধ্যে একই উম্মাদনা। অবকাশে যেখানে সুযােগ পাই মিলিত হলে সবার মনে একই আশার আলাে। স্বাধীন সার্বভৌম এক খন্ড জমিন। এদিকে ৬ দফা ভিত্তিক ৬৯ এর অভ্যুথান অত্যুঙ্গ। চারদিক রােষের আগুনে জ্বলছে। ছাত্র-শিক্ষক কবি কেরাণী বুদ্ধিজীবি কৃষক শ্রমিক তাঁতী মজুর সহ মজলুমের সমবেত সংগ্রামী উচ্চারণ পাকিস্তানের ভিত্তিমূলে নাড়া দিচ্ছে। এই চরম সংগ্রাম ও আন্দোলনের মধ্যেই ১৯৬৮ সালে আমি করাচী থেকে ঢাকায় আসি। ঢাকায় এসে বিভিন্ন কনারে যােগাযােগ করতে চেষ্টা করি। ইতােমধ্যে জানতে পারি ঢাকা ভিত্তিক স্বাধীনতার জন্য সৈনিদের মধ্যে ‘সশস্ত্র বিপ্লবী সংস্থা গঠিত হয়েছে। এই দলের উদ্দেশ্য সশস্ত্র বিপ্লবের মাধ্যমে দেশকে স্বাধীন করা। এ উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের লক্ষ্যে প্রথমত সৈনিক অফিসারদের মধ্যে এর সপক্ষে ঐক্যমত গঠন করা এবং বিভিন্ন আর্মারী দখল। আর্মারী গুলাে দখল করতে পারলে বিপুল অস্ত্র শস্ত্র উদ্ধার হবে। এগুলাে দিয়ে জনতার মধ্যে থেকেও খুব শীঘ্রই সৈনিক তৈরি করা যাবে। আমার এতদিনের স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিতে যাচ্ছে। আমি ঠিক এমন একটি সংগঠনের মাধ্যমে কাজ করার কিংবা একটা সংগঠন করার স্বপ্নই দেখছিলাম। এই শুভ সংবাদে আমার চোখ জোড়া আশায় চকচক করে উঠে। আমি তখন পি.এ.এফ বাশার ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে জয়েন করি। সংস্থার কথা জানতে পেরে এর সঙ্গে সক্রিয় হবার চেষ্টা করি। কয়েকদিনের মধ্যে সুযােগ এসে যায়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ৪নং আসামী সার্জেন্ট সামসুদ্দীন আহমদের সঙ্গে আমার দেখা হয়। করাচী পােস্টিং থাকা কালেই তাঁর সঙ্গে একবার আমার দেখা এবং কথা হয়। কিন্তু তখনও সংগঠনটি পুরােরূপ নেয়নি। উনিও এখন ঢাকায় পােস্টিং উনি আমাকে সমস্ত বিষয়ে অবহিত করেন। আমি অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে দলের সক্রিয় সদস্য হয়ে উঠি। আমাদের কেবল উদ্দেশ্য সশস্ত্র বিপ্লব সংঘটিত করে দেশ স্বাধীন করা। কিন্তু স্বাধীন দেশের রূপরেখা অর্থনীতি শিক্ষানীতি কোন বিষয়েই আমাদের কোন পরিকল্পনা ছিল না। কেননা দেশ চালাবেন রাজনীতিবিদরা আমরা শুধু স্বাধীন করব। রাজনীতিবিদরা নানা
আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু তাদের উপর নানা রকম জেল জরিমানা জুলুম নির্যাতন হচ্ছে। বিভিন্ন কায়দায় হয়রানির মাধ্যমে দমন করার চেষ্টা করছে। পাকিস্তানী চক্র। তাই আমরা ভাবছি এভাবে কখনাে দেশ স্বাধীন হবে না। দেশকে স্বাধীন করার জন্য এখন সশস্ত্র বিপ্লবই একমাত্র মুক্তির উপায় । এতদ উদ্দেশ্যে। আমাদের সংগঠনের সদস্যরা সক্রিয়ভাবে কাজ করতে থাকে। আমি যােগ দিয়েই একটি মিটিং-এ এটেন্ড করি। এসময় আমাদের গােপন বৈঠক বিভিন্ন জায়গায় হতে থাকে। এর মধ্যে একটি জায়গা ছিল ঢাকা আওলাদ হােসেন মার্কেটে এক্স ফ্লাইট সার্জেন্ট আঃ রাজ্জাক সাহেবের মেডিসিনের দোকান। আমি প্রথম মিটিং-এ স্বাধীনতার সপক্ষে আমার বক্তব্য তুলে ধরি। আমাদের যে কোন মূল্যে আর্মারী দখল করতে হবে তবেই আমাদের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জিত হতে পারে। সাধারণ ভাবে সিভিলিয়ান আন্দোলনে কিছু হবে না তাদের শুধু জেল জুলুম নির্যাতনই জুটবে ভাগ্যে। ইতােমধ্যে আর একজন সার্জেন্ট যিনি তখন করাচীতে পােস্টিং সার্জেন্ট সামসুল হক। ইনি আমাদের সবকিছু জানতে আগ্রহী হন এবং আমাদের সাথেই সংগ্রামের দীপ্ত শপথ গ্রহণ করেন। তাঁকে সক্রিয়ভাবে পেয়ে আমাদের উপকার হলাে এই জন্য যে করাচী বেড সমস্ত তথ্য তিনি সরবরাহ করতে পারবেন। ওখানে ও বিপ্লবসংগঠিত করতে সাহায্য করবেন। এর পর আমি আরও ৪টি মিটিং করি । কিছু দিনের মধ্যে করাচী থেকে গােপন সংকেতের মাধ্যমে সার্জেন্ট সামসুল হকের চিঠি পাই। আমাদের যে গােপন সংকেত দেয়া ছিল সেভাবে উনি লিখেছেন, ‘আমরা গহনা তৈরি করছি মেয়ের বিয়ে ঠিক । (অর্থাৎ অস্ত্র সংগ্রহ হচ্ছে এবং নিজেদের সংগঠিত করছি) আমরা যথারীতি প্রস্তুতী নিচ্ছি। এর মধ্যে এক্স ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক সাহেবকে পেলাম। এই সশস্ত্র বিপ্লবের অভিযান তখন পূর্ব পাকিস্তানের সেনা বাহিনী নৌ বাহিনী বিমান বাহিনী রাইফেলস পুলিশ সবার মধ্যেই সংগঠিত হচ্ছে। কিন্তু সবাই বিচ্ছিন্নভাবে করছি। নানা প্রতিকূলতার কারণে পারস্পরিক যােগাযােগ সাপেক্ষে সমন্বিত আন্দোলন গড়ে তুলতে পারছি না। আমি ঢাকায় ফ্যামিলি নিয়ে থাকি। সামসুদ্দীন সাহেব থাকেন একা-একা। বিভিন্ন জায়গায় আমাকে মিটিং কনট্রাক্ট করতে হয় এমন কি আর্মির মধ্যেও আমাকেই পাঠান হয়। কিন্তু অকস্মাৎ আমাদের বিপ্লবী সংস্থার সংবাদ পাকিস্তানী ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ জেনে ফেলে। মনে মনে অবশ্যম্ভাবী পরিণতি অনুভব করি। শাস্তির জন্য প্রস্তুতী নিই। কি আছে ভাগ্যে আঁচ করতে পারি। এই সশস্ত্র বিপ্লব চলাকালীন সময়ে চট্টগ্রাম এয়ারপাের্টে আইয়ুব খানের প্লেনে বােমা রাখার অপরাধে ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মীর্জা।
ধরা পড়ে যায়। ধরা পড়ার পর অমানুষিক নির্যাতনে মীর্জা সব স্বীকার করে। শুধু তাদের গ্রুপই নয় তাঁর কথায় সশস্ত্র বিপ্লবী সংস্থার ব্যাপারটিও প্রকাশ হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে শুরু হয় একচেটিয়া ধরপাকড় নানা নির্যাতন হয়রানি। অবশ্য এ ব্যাপারটি স্বীকার করেই আমরা সশস্ত্র বিপ্লবী সংস্থা গঠন করেছিলাম। আমাদের ভূমিকা ছিল সংশপ্তকের; কেন না আমরা যে মৃত্যুমুখী বিপ্লব রচনা করেছি তার। পরিণতি হয় স্বাধীনতা না হয় মৃত্যু। জীবনের জয়ভেরী বাজিয়ে মৃত্যুর দরজায়ই কড়া নাড়ছি একথা আমরা জানি। তবুও অমানুষিক নির্যাতনের কথা চিন্তা করে মাঝে মাঝে শিউরে উঠি। কেননা পাকিস্তানীরা যে মানুষ ছিল এটা ভাবতে বিস্ময় বােধ করতাম। ওরা নিচ্ছিদ্র অভিযান চালাতে থাকে। আমাদের বিপ্লবী সংস্থার সংদস্য সার্জেন্ট সামসুদ্দীন, পাটোয়ারীসহ কয়েকজন ধরা পড়ে যায়। কয়েক দিন । পর আবার ধরা পড়ে ফোর্সের জহরুল হক, ফজলুল হক। ধরা পড়ার আগের দিন আমরা একটা মিটিং করে সবাইকে সাবধানতা অবলম্বনের পরমর্শ দিই, কিন্তু ওদের ঈগল দৃষ্টি এড়ানাে সম্ভব হয়নি। আমি তখন সাইকেল রাইডিং করতাম। স্টেশন থেকে বাসায় বাই সাইকেলের মাধ্যমেই যাতায়াত করি। অন্যান্য দিনের মত সেদিনও বাই সাইকেলে স্টেশনে যাচ্ছি। হঠাৎ পাকিস্তানী ৩জন অফিসার এর মধ্যে একজন উইং কমান্ডার মিঃ কোরেশী একজন ওয়ারেন্ট অফিসার তাজ অন্যজনের নাম এ মুহূর্তে স্মরণ করতে পারছি না আমাকে এ্যারেস্ট করে। এ তিনজনই করাচীতে থাকতে আমাকে চিনতেন। আমাদের সংস্থার লিডার ছিলেন। তখন নেভীর কমান্ডার Moazzem. এটা প্রথম শুরু হয় করাচীতে ক্রমশঃ সম্প্রসারিত হয় পূর্ব পাকিস্তানের বিভিন্ন জায়গায়। আইয়ুব খানের বিমানে যে। বােমা রাখা ছিল মূলতঃ তা ছিল এই সশস্ত্র বিপ্লবেরই অংশ। এ ঘটনা ছিল ৬৯। সনের প্রথম দিকে। যাহােক আমাকে এ্যারেস্ট করে স্টেশন থেকে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হলাে। মনে মনে প্রস্তুতী নিতে থাকি কিভাবে ওদের Face করব। আমাকে যে করে হােক খুব শক্ত সাহসী থাকতে হবে। যেন কোন রকম নার্ভাসনেস কাজ না করে। আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ডার্করুমে। এক থমথমে পরিবেশ। এখানে বিশেষ ভাবে কথা আদায়ের জন্য টর্চার করা হয়। পরিবেশটা এতই ভয়াবহ যে গােটা অবস্থা দেখেই মনে এক ধরণের প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ফলে দোষী ব্যক্তি আপনা থেকেই অনেক কিছু বলে দেয়। উইং কমান্ডার কোরেশী। আমাকে ইন্ট্রোগেট করতে আরম্ভ করলেন। প্রথমে বললেন, করাচী থাকতেই
তােমাকে আমি জানি You are a gentle man, Please tell us everything তােমার কোন ভয় নেই’ । আমি মনে মনে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ; জীবন গেলেও কোন কিছু স্বীকার করব না। যত ধরনের ফিজিক্যাল টর্চারই হােক না কেন আমি চুপচাপ; কোন বাক্যই সরছেনা মুখে। ছড়ি হাতে বিশাল দেহী মিঃ কোরেশী, চোখ দুটো রক্ত জবার মত টক টক করছে। তারমধ্য থেকে মাঝে মাঝে আগুন ঝলসে উঠছে। আবার গর্জে উঠলেন কোরেশী Tell us every thing. আমি চুপচাপ। তিনি পুনরায় একটু কৌশলী হয়ে উঠলেন, গলার স্বর এবার আবার একটু নীচে নামিয়ে কিছুটা বিনয়ের ভঙ্গিতে বললেন ‘মিঃ জামান কোন ভয় নেই; আমাদের সব কিছু বল What do you know, আমি চুপচাপ থেকেএকটিই উত্তর দিলাম । আমি কিছু জানি না স্যার; এ ঘটনার সাথে আমি সংশ্লিষ্ট নই; আমি কিছু জানি না। আপনি আমাকে মেরে ফেললেও এর বেশী আর কিছুই আমি বলতে পারব না।’ অপ্রত্যাশিত উত্তর শুনে বাঘের মত গর্জে উঠলেন কোরেশী You bastard get out বলেই ছিটকে ফেলে দিলেন পাশের দেওয়ালে। কোন মতে সামলে নিয়ে উঠে। দাড়ালাম। আমাকে দাড় করিয়ে দেয়া হলাে দেয়ালের সাথে। সারা শরীর কাপছে, ভয়ে নয় রাগে। এই দুশমনদের হাতে আমরা ফোর্সের লােক হয়েও সৈনিক অফিসার নির্বিশেষে এভাবে টর্চার্ড হচ্ছি। না জানি ওরা বাংলার নিরীহ সাধারণ মানুষের উপর কি অত্যাচারই না চালাচ্ছে। ইচ্ছে হলাে একটা কিক মেরে ওর মাথাটা ছিড়ে ফেলি। কিন্তু এখানে আমরা অসহায়, ওদের কারাগারে ওরাই জীবন মরণের অধিকর্তা। এরপর আনা হলাে সার্জেন্ট শামসুদ্দীনকে। চেহারাটা কুকরে গেছে। অবিন্যস্ত চুল, চোখের নীচে কালি। পরনের পােশাক মলিন ও ছিন্ন প্রায়। প্রথমে আমার পাশে দাঁড় করানাে হলাে, আমি ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করলাম “কি খবর? সামসুদ্দীন বলল আমি সব অস্বীকার করে গেছি। জীবন থাকতে শেষ পর্যন্ত চেস্টা করে যাব তারপর খােদার ইচ্ছে। তবে জেনাে জামান এদেশ স্বাধীন হবেই, অত্যাচারীর অত্যাচারের মধ্যেই তার পতনের ইঙ্গিত বহন করে। ওরা যা করছে তাতে ওদের পরিণতি ওদেরকে পতনের দিকেই টানছে।’ সামসুদ্দীন সাহেবের কথায় মনে আরাে সাহস সঞ্চয় করলাম। যে করেই হােক আমাকে শক্ত ও সাহসী হতেই হবে। এবং নরম্যাল থাকার চেষ্টা করতে হবে। শুরু হলাে সামসুদ্দীনের পালা। সামসুদ্দীন, অস্বীকার করে যাচ্ছে। এর আগেও সামসুদ্দীনকে যে অমানুষিক দৈহিক নির্যাতন চালিয়েছে সে কথা আমাকে বললেন
যে ‘ভাই সহ্য করা যায় না।’ এর পর আবার শুরু হলাে বিভিন্ন কৌশলে দৈহিক নির্যাতন। ওরা সামসুদ্দীনের ব্যাপারে Over Confident ছিলাে। তাই যে কোন মূল্যে সব তথ্য বের করতে চেষ্টা করছে। ক্রমাগত ৫/৬ ঘন্টা এভাবে টর্চারের পর। সামসুদ্দীন সব বলে দিলাে। আমি চোখে ঘাের অন্ধকার দেখছি। মনে মনে প্রমাদ গুণলাম, হে আল্লাহ তুমি ছাড়া এই বেঈমানদের হাত থেকে দুঃখিনী বাংলা মাকে কেউ রক্ষা করতে পারবে না। আমি সৈনিক; মরতে চাই। কিন্তু পাষাণ কারার ঘাের অন্ধকারে নয়, বীরের মত যুদ্ধ করতে করতে যুদ্ধের ময়দানে। সামসুদ্দীন সব স্বীকার করার পর তাকে নিয়ে যাওয়া হলাে। পরবর্তীতে কোরেশী। এবং তাজ এসে আমাকে বললাে, ‘You bastard তুমি কিছুই স্বীকার করছ না। ঠিক আছে তােমাকে এদের বিরুদ্ধে সাক্ষী দিতে হবে। মনে মনে বললাম জীবন গেলেও । উপরে উপরে কিছু বললাম না। আমি শুধু চিন্তা করছিলাম এই হায়েনাদের কবল থেকে কোন মতে নিজেকে আগে উদ্ধার করার প্রয়ােজন। তারা আরাে বললেন Now you will get seven days time. এই বলে আমাকে ধাক্কা মেরে। বের করে দেয়া হলাে। আমাকে আমার শাস্তি এবং পরিণতি সম্পর্কে পুনরায় অবহিত করা হলাে। এদিকে আমার এ অবস্থা বাসার কেউ জানে না। আমি কাউকে কিছু বললাম না চুপ। চাপ রইলাম। মনে মনে ভাবছি কিভাবে এ অবস্থার উত্তরােণ হবে। ওদের হাত থেকে সহজে রেহাই মিলবেনা। দু’এক দিন চিন্তা করে ফিল্ড ইন্টিলেজেন্স-এর এক অফিসার আমার বিশেষ বন্ধু সার্জেন্ট ইসলামের কাছে গেলাম এবং এ ব্যাপারে তার পরামর্শ চাইলাম। সার্জেন্ট ইসলাম বললেন, যদিও আমি ইন্টিলিজেন্স-এর লােক। তবুও তােমাকে বলছি, তােমাদের সম্পর্কে আমাদের কাছে তথ্য আছে কিন্তু তুমি শেষ পর্যন্ত নাে-ই বলে যাবে। কোনক্রমেই No থেকে যেন Yes না হয়। প্রথম দিকে অস্বীকার করেছ শেষ পর্যন্ত তােমাকে এটাই বজায় রাখতে হবে। আমার। সিদ্ধান্তও পূর্ব থেকেই এরকম ছিলাে। কিন্তু এবার তাতে সাহসের আরও একটি মাত্র যােগ হলাে। গভীর সংশয়ের মধ্যে প্রতিটি দিন অতিবাহিত করছি। এরপর সাতদিন গেলাে কিন্তু ওদের আর কোন খোজ নেই । সাত দিন, আট দিন, নয় দিন, দশ দিন চলে গেলাে। ইতােমধ্যে একদিন স্টেশন ইনচার্জ তাজ ডেকে নিয়ে বললেন তােমাকে আমাদের উইং কমান্ডার মিঃ কোরেশী ছেড়ে দিয়েছেন শুধু Involbement এর জন্য। অর্থাৎ আমরা চিন্তা করেছি তুমি পাকিস্তানে বিয়ে করেছ তােমার Wife পাকিস্তানী । তুমি কেন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য এভাবে ফিল করছ?
আমরা তােমাকে ভদ্র হিসেবেই জানি। তুমি কেন স্বীকার করছ না? আমি একই কথার পুনরাবৃত্তি করলাম স্যার I am sorry to say that I dont know about it. পরে তাজ বললেন, Naturaly তােমার উপর আমাদের একটা সফট কর্নার আছে। বলেই তােমাকে ছেড়ে দিলাম, তবে আশা করি ভবিষ্যতে তােমার সহযােগিতা পাব। এরা যে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজিয়েছিলাে তার ১নং আসামী ছিলেন। শেখ মুজিব ২নং আসামী ছিলেন Comander Moazzem Hossain. ইনিই সশস্ত্র বিপ্লবী বিশেষ করে আইয়ুব খান হত্যা পরিকল্পনা ও সশস্ত্র বিপ্লবীদের দলের নেতা। ছিলেন। এবং সার্জেন্ট সামসুদ্দীন ছিলেন ৪নং আসামী। আমার বন্ধু সার্জেন্ট ইসলাম ও ইন্টিলিজেন্স ব্রাঞ্চ-এর লােক ছিলেন স্বভাবতই আমাদের বিরােধী তবুও তিনি সেদিন আমার মনে যে সাহস সঞ্চার করেছিলেন তার জন্য আমি তাঁর কাছে চির কৃতজ্ঞ। মূলতঃ আগরতলা ষড়যন্ত্র বলে কোন ষড়যন্ত্রই হয়নি এটা ছিল পাকিস্তানীদের এক সাজানাে নাটক এবং এর বিচার ব্যবস্থার আয়ােজন ছিল প্রহসন মূলকঃ। বিশেষ করে রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযােগ এনে শেখ মুজিবকে ফাসি, নেতাদের দমননীতি ও প্রতিরােধের জন্য ছিল এটা এক চরম কৌশল। কিন্তু সারা দেশে এর বিরুদ্ধে আন্দোলন ধূমায়িত হতে থাকে। শুধু তাই নয়, গণরােষে ফেটে পড়ে বাঙ্গালীরা। তারা ব্যাগ্র গাত্রোত্থানে জেগে উঠে সেদিন। এই ব্যাপক গণরােষের মুখে অবশেষে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা উইথ ড্র করে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেয়া হলাে। শুধু তাই। নয় এই ব্যাপক গণ আন্দোলনের মুখে পতন হলাে লৌহ মানব শাহী আইয়ুবের। প্রাথমিকভাবে বাঙ্গালীর জয় হলাে, আন্দোলনের ফসল ঘরে উঠলাে আমাদের। এদিকে আমার বড় ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান ভীষণ অসুস্থ্য হয়ে সি,এম,এইচ এ চিকিৎসাধীন আছে। অথচ এ অবস্থায় আমাকে করাচীতে ট্রান্সফার করা হলাে। আমি Section Incharge উইং কমান্ডার এর নিকট আমার অবস্থা জানিয়ে অনুরােধ করি যেন এই মুহূর্তে আমাকে ট্রান্সফার না করা হয়। কিন্তু আগেই বলেছি আমাদের সুবিধা-অসুবিধা সমস্যার কোন মূল্যই ছিল না ওদের কাছে। ওদের খেয়াল খুশী মর্জি মাফিক যে কোন ইচ্ছাই যখন তখন চাপিয়ে দিতাে আমাদের উপর। এ সময়টা ছিল ৬৯-এর এপ্রিল। যখন আমার রিলিজ অর্ডার হয়ে যাচ্ছে তখন আমি উপায়ন্তর না দেখে চাকরী থেকে Resigne দেয়ার ইচ্ছে পােষণ করি। কিন্তু তাও কার্যকর হয় না। আমি বিভিন্ন পথে চেষ্টা করি কিন্তু আমার Application রিকমান্ড। করে না। কেননা দেশের আবহাওয়া তখন খুবই উত্তপ্ত। যে কোন সময় বড় কোন ঘটনা ঘটে যেতে পারে। গভীর সংশয় আর ভীতির মধ্য দিয়ে কাটছে প্রতিটি
মুহূর্ত। পাকিস্তান বুঝে গেছে আমরা ওদের থেকে পৃথক হচ্ছি তাই যেভাবে পারে আমাদের সৈনিকদের বিশেষ করে West এ close করার চেষ্টা করছে। আমার সমস্ত চেষ্টাই ব্যর্থ হলাে । Section Incharge উইং কমান্ডার আবারও গর্জে উঠলেন মিঃ জামান you must go to korachi. আমাকে ফোর্সলি করাচী যেতে বাধ্য করছে। অথচ আমার বড় সন্তান মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে। তাকে ফেলে পরিবার পরিজনকে অসহায় অবস্থায় রেখে যেতে মন সরছে না। রেজিগনেশওটাও কার্যকরী হলাে না। বাসায় এসে স্ত্রীর সাথে আলাপ করলাম। স্ত্রী আমাকে সান্ত্বনা দিলাে, আমার সকল অবস্থায় আমার স্ত্রী ধীর স্থির বুদ্ধির সাথে শান্ত করতেন এবং বিশ্বস্ততার সাথে সহযােগিতা করেন। সৈনিক জীবন ছেড়ে স্বাভাবিক জীবনে এসে মুক্তিযুদ্ধের আন্দোলন
আমি চাকরী ছেড়ে ব্যবসায় করার সিদ্ধান্ত নিই। বিশেষ করে স্বাধীন জীবন যাপনের ইচ্ছেয়। অবশেষে আমাকে এই প্রতিকূল অবস্থা স্বীকার করে করাচীই যেতে হলাে। করাচী জয়েন করেই আমি আবার বিভিন্ন পথে চেষ্টা করতে থাকি। শেষ পর্যন্ত আমার Application কার্যকর হয়। ১৯৭০ সালের ১৬ই জুন আমি। চাকরী ছেড়ে দিয়ে করাচী থেকে ঢাকায় আসি। স্বাধীন জীবনে ঢাকার মাটিতে পা রেখে উল্লসিত হয়ে উঠলাম। কিছু দিন পর থেকে আমি শেরে বাংলা নগর বাজারে একটা ব্যবসা শুরু করলাম। আমি ছিলাম এই বাজারের প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী । সৈনিক জীবনে যেভাবে সশস্ত্র বিপ্লবী সংস্থার সাথে সংশ্লিষ্ট ছিলাম, সিভিল লাইফে জীবনে এসেও আবার নতুন উদ্যমে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করি। আবার গােপন বৈঠক করতে থাকি। জনমত গঠন করে একটা নিজস্ব দল তৈরি করি। কিন্তু সৈনিক অবস্থায় যেভাবে রাজনৈতিক দলের সমন্বয় ছাড়াই কাজ করেছি সিভিল জীবনে তা সম্ভব নয়। এখানে যে করেই হােক কোননা কোন রাজনৈতিক দলের ছত্রছায়ায় কাজ করতে হবে। যদিও তাদের সাথে আমার একটা মৌলিক পার্থক্য থাকবে। অর্থাৎ আমি আমার Style এ move করব। কিন্তু রাজনৈতিক দল ছাড়া কোন বৃহত্তর কর্মসূচী পাব না এবং পরিকল্পনা মাফিক আগানাে যাবে না। আমি আওয়ামী লীগকে সমর্থন করলাম। বিশেষভাবে দেখলাম তখন আওয়ামী লীগ হচ্ছে একমাত্র রাজনৈতিক দল যে স্বাধীনতার সপক্ষে ব্যাপক আন্দোলন এবং নিরবিচ্ছিন্ন ভাবে কাজ করে যাচ্ছে। আওয়ামী লীগের তখন কোন বিকল্প নেই। এরপর থেকেই আমি বিভিন্ন মিছিল মিটিং-এ অংশ গ্রহণ করতে থাকি। ৭০-এর। নির্বাচনে যাতে আওয়ামী লীগ বিজয় অর্জন করতে পারে তার জন্যও চূড়ান্ত সংগ্রাম করছি, সক্রিয় সাহায্য অব্যাহত রেখেছি। তখন এ এলাকায় অর্থাৎ ধানমন্ডি
মােঃপুর আসন থেকে ডাঃ মােশাররফ হােসেন আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচন করলেন। আমার দলসহ আমি তাকে সমর্থন দেই এবং সক্রিয়ভাবে তারপক্ষে কাজ করি। কিন্তু আমি সৈনিক মানুষ, আমার চিন্তা সশস্ত্র বিপ্লবের দিকে । যতটা রাজনৈতিক ভাবে দেশের মধ্যে কাজ করব তার চেয়ে বেশী ভূমিকা থাকবে অস্ত্র হাতে যুদ্ধ ক্ষেত্রে। তখন আমি একটা বিশেষ গ্রুপ তৈরির পরিকল্পনা করি। এ উদ্দেশ্যে কিছু যুবক ছেলেদের নিয়ে আগারগাঁওয়ের ভেতরে একটা গােপন জায়গায় ট্রেনিং দিতে শুরু করলাম। এরা স্বল্প সময়ে অস্ত্র চালনা এবং যুদ্ধের কৌশলগুলাে রপ্ত করে ফেলে। মনে মনে সব সময় জেনেছি পাকিস্তান অনিবার্য ভাবে আমাদের উপর। একটা যুদ্ধ চাপাবেই। তাই আমাদের সশস্ত্র ভাবে ওদের মােকাবেলা করা ছাড়া। মুক্তি মিলবেনা। এসব ছেলেদের মধ্যে অফুরন্ত উৎসাহ যেমন আছে তেমনি আছে অমিত তেজ বিপুল উদ্দীপনা। আমি প্রচ্ছন্নভাবে আশার আলাে দেখলাম। পাকিস্তান যেভাবেই যুদ্ধ চাপাক না কেন বাংলার বিপুল উৎসাহী দামাল ছেলেরা। বসে থাকবে না। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে এরা যুদ্ধে নামবে। বাংলা অবশ্যই স্বাধীন হবে। কিন্তু এখন আমাদের কিছু অস্ত্র প্রয়ােজন। দিন যতই যেতে থাকে আমরা ততই নিশ্চিত হতে থাকি একটা অনিবার্য রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের জন্য। ৭০-এর ৭ই ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় জাতীয় পরিষদের নির্বাচন, ১৭ই ডিসেম্বর প্রাদেশিক নির্বাচন এবং দূর্গত এলাকায় পূর্ব পাকিস্তানে ৭১ সালের ১৭ই জানুয়ারী নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিস্ময়কর সাফল্যের পরিচয় দেয়। আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে পূর্ব বাংলায় ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসন লাভ করে। অপরপক্ষে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসন লাভ করে। বিপুল সংখ্যা গরিষ্ঠতার মধ্য দিয়ে অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে শেখ মুজিব প্রমাণিত হলেন। ৭০-এর এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয়ের পর পশ্চিম পাকিস্তানী নেতারা বিশেষ করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলী ভুট্টো এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হল। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় যেতে না পারে, সে উদ্দেশ্যেই ঐ ষড়যন্ত্র চলে। অথচ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াই বলেছিলেন, জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের তারিখ ১৯৭১ সালের ৩রা। মার্চ বলে ধার্য করেন এবং ঢাকায় এ অধিবেশন ডাকা হয়। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারী ভুট্টো ঘােষণা করেন যে, আওয়ামী লীগ ছয় দফা দাবীর প্রশ্নে আপােষ না করলে তাঁর দল পিপলস পার্টি ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যােগ দেবে না। তিনি বলেন, বর্তমান অবস্থায় ঐ অধিবেশনে যােগ দেয়ার অর্থ হবে আওয়ামীলীগের তৈরি করা সংবিধানকেই কেবল অনুমােদন করা। জাতীয় পরিষদ কসাই খানায় পরিণত হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন। এদিকে আওয়ামী লীগ। নেতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রত্যেকের যে কোন গঠন মূলক প্রস্তাব মেনে নেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ভুট্টো জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বর্জনের সিদ্ধান্তে অনড় থেকে হুমকী দেন যে, কোন পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্য অধিবেশনে যােগ দিলে তাকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এরূপ পরিস্থিতিই কামনা করছিলেন। তিনি ১৯৭১ সালের ১লা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত রাখার কথা ঘােষণা করেন। এ ব্যাপারে তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে কোনরূপ পরামর্শ করার প্রয়ােজন বােধ করেননি। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তাঁর নেওয়া ব্যবস্থার অজুহাত হিসেবে জাতীয় পরিষদে ভুট্টোর যােগ দেওয়ার অনিচ্ছার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করেন। জেনারেল ইয়াহিয়া জাতীয় পরিষদের অধিবেশন হঠাৎ স্থগিত করে দিলে পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল বিক্ষোভ দেখা দেয়। সব শ্রেণীর মানুষ রাজপথে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার দাবীতে শ্লোগান দিয়ে মিছিলে যােগ দেয়। এ অবস্থায় তারা। মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান-সরকারের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন চালিয়ে যেতে বাঙালীদের প্রতি আহবান জানান। বাঙালীরা এ আহবানের প্রতি অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। পূর্ব পাকিস্তানে তখন পাকিস্তান সরকারের বেসামরিক শাসন প্রায় অচল হয়ে পড়ে। এদিকে, ৩রা মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আগামী ১০ই মার্চ এক বৈঠকে মিলিত হবার জন্য শেখ মুজিব, জেড এ ভুট্টোসহ ১৩জন নেতার প্রতি আমন্ত্রণ জানান। কিন্তু ঢাকা ও অন্যান্য শহরে সেনা বাহিনীর গুলীতে অনেক লােক হতাহত হওয়ার ঘটনার প্রতিবাদে শেখ মুজিব ঐ আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করেন। শেষ পর্যন্ত জেনারেল ইয়াহিয়া ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহবান করেন। বাংলার নয়ন মণি অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বিশাল জন সমূদ্রের ঐতিহাসিক জনসভায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে
যােগ দেওয়ার কথা বিবেচনার পূর্বশর্ত হিসেবে চারটি দাবী ঘােষণা করেন। এগুলাে ছিলাে সামরিক আইন প্রত্যাহার, অবিলম্বে সেনা বানিহীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়া, সেনা বাহিনী সংগঠিত হত্যাকান্ডের তদন্ত করা এবং জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তিনি সেদিনের সভায় লাখাে লাখাে বাঙালীর সামনে ঘােষণা করেন, “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম।” বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের জনসভায় অংশ গ্রহণের জন্য কয়েক দিন যাবত আমি জনমত সংগ্রহের কাজ করছিলাম। তার পরিণতি হিসেবে ৭ই মার্চ শেরে বাংলা নগর, আগারগাও থেকে প্রায় ৬০০০ (ছয় হাজার) লােকের এক বিশাল মিছিল বের করি। এবং এই মিছিলে আমি নেতৃত্ব দিই। এত বিশাল মিছিল দেখে পাকিস্তানীরা হতভম্ব হয়ে যায়। ঢাকা শহরের বিভিন্ন প্রান্তিক থেকে এদিন খন্ড খন্ড কোথাও থেকে বিশাল মিছিল বের হতে থাকে। সেদিন গােটা ঢাকা শহর এক মিছিলি নগরে। পরিণত হয়। আমি মিছিল নিয়ে সংসদ ভবন অতিক্রম করার সময় সংসদ ভবনের সামনে অপেক্ষমান (৯) নাইন ডিভিশন পাকিস্তানী সৈন্য আমাদের দিকে রাইফেল তাক করে থাকে। ওদের উদ্দেশ্য আমাদেরকে ছত্রভঙ্গ করা। মিছিলটি এতই বিশাল ছিল যে তা কিছুক্ষণের মধ্যে জঙ্গী হয়ে ওঠে। এদিকে সৈন্যদের এমন অবস্থায় দেখে আতঙ্কে ছত্রভঙ্গ হয়ে মিছিলটি বিশৃংখল হয়ে যায়। আমি অনেক কষ্টে ওদের নিয়ন্ত্রণ করে আবার মিছিল নিয়ে এগুতে থাকি। ঢাকার অনেক জায়গায়ই সেদিন এভাবে মিছিলগুলাে বাধা প্রাপ্ত হয়। ওরা আমাদের মিছিল দেখে সহ্য করতে পারছিল না। রেসকোর্স ময়দানে গিয়ে আমরা উল্লাসে ফেটে পড়ি। বাঙালীর মনে যে স্বাধীনতার বীজ রােপিত হয়েছে তার আজ নবান্নের উৎসব। সবার হাতে হাতে স্বাধীন বাংলার পতাকা, বঙ্গবন্ধুর প্রতিমূতি, স্বাধীনতার পােস্টার, প্লাকার্ড, মুখে মুখে ফিরছে। শ্লোগান ‘জয় বাংলা, বাংলার জয়, বঙ্গবন্ধুর বজ্র নির্ঘোষ ঘােষণা ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরাে দেবাে তবু এদেশকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।’ রেসকোর্সের ভাষণে সুস্পষ্ট হয়ে যায় বাংলার স্বাধীনতার দাবী। স্বাধীনতা সংগ্রামের চূড়ান্ত প্রস্তুতী এদিন। থেকেই বাঙালীরা গ্রহণ করে। বঙ্গবন্ধু ও এভাবে সতর্ক করে দেন “তােমরা বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঘরে ঘরে দূর্গ গড়ে তােল। যার হাতে যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মােকাবিলায় ঝাপিয়ে পড়।’ বাঙালীরা বঙ্গবন্ধুর এ । আহবানে সত্যিই যথােপযুক্ত সাড়া দিয়েছিলাে। একটা সুশিক্ষিত সুসজ্জিত শ্রেষ্ঠ
সেনা বাহিনীর বিরুদ্ধে একরকম খালি হাতের প্রতিরােধ শুরু করে মাত্র নয়টি মাসেই স্বাধীন করে ছিল মাতৃভূমিকে। এই বিজয় সম্ভব হয়েছিলাে প্রবল দেশপ্রেম, জাতীয়তাবােধ, শােষণ শাসনে তিক্ততা, সর্বোপরি সুযােগ্য নেতৃত্বের কারণে। বীর বাঙ্গালী ব্যগ্র গাত্রোত্থানে জেগে উঠলাে, প্রবল প্রতিরােধ আন্দোলন শুরু হলাে বাংলার বিভিন্ন প্রান্তে। আসন্ন যুদ্ধ নিশ্চিত জেনে সর্বাত্মক প্রস্তুতীর অংশ হিসেবে আমি অস্ত্র সংগ্রহের চেষ্টা। চালাচ্ছিলাম। আমি এসময় আরও কিছু বন্দুকের লাইসেন্স এর জন্যও চেষ্টা করি। M.P. র মাধ্যমে লাইসেন্স পাওয়ার চেস্টা করলাম যােদ্ধাদের জন্য, কিন্তু কোন ক্রমেই Gun লাইসেন্স পাচ্ছিলাম না। এদিকে বঙ্গবন্ধু আহবান করেছেন আপনারা যে যা পারেন আমার তহবিলে দান। করবেন। আমরা বাজার কমিটি বাজার থেকে চাঁদা সংগ্রহ করি। এ সময় স্বতঃস্ফূর্তভাবে সবাই সাড়া দেয়। আমরা পনের শত টাকা (১৫০০) সংগ্রহ করে। ২৩শে মার্চ বঙ্গবন্ধুর হাতে দিই। এই টাকা হস্তান্তর অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখলাম। এই বক্তব্যে আমি বঙ্গবন্ধুকে বিশেষভাবে সতর্ক থাকার অনুরােধ করলাম। বললাম, আপনাকে বিশেষভাবে সাবধান থাকতে হবে ওরা আপনাকে মেরে ফেলার ষড়যন্ত্র করছে। ওখান থেকে ফিরে এসে চিন্তা করলাম মােহাম্মদপুর এলাকায় অনেক পাঞ্জাবী এবং বিহারী আছে। এরা যে কোন মুহূর্তে আমাদের আক্রমণ করতে পারে। এদের থেকে সাবধান থাকতে হবে। এবং যে কোন ধরনের আক্রমণ প্রতিহত করতে নিজেদের। সংগঠিত করা প্রয়ােজন। এই উদ্দেশ্যে আমি ২৪মে মার্চ আমার অঞ্চল নিয়ে এক। মিটিং করি। মিটিংয়ে সবাইকে সাবধান থাকতে বললাম-যে কোন মুহূর্তে আমাদের উপর আঘাত আসবে। আপনারা প্রস্তুত থাকুন। আর একটা ব্যাপার আমাদের শত্রু শুধু বাইরে নয় ভেতরেও আছে। এরা আমাদের বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করবে। এদের থেকে সাবধান। মনে রাখবেন এদেশ আমাদের, এ মাটি আমাদের। ওরা উপর্যপুরি আমাদের শাসন শােষণ করছে। আমাদের মাঝে বৈষম্যের দেয়াল গড়ে তুলছে, নিজেদের মধ্যে শত্রুতার বীজ বপন করছে। নজির বিহীন সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে ওরা মুসলমানের ধোয়া তুলে সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প ছড়াচ্ছে। এরা ইসলামের সেবক নয় বরং ইসলাম এদের ছদ্মাবরণ। আপনারা হুশিয়ার হােন, যুদ্ধের জন্য প্রস্তুতী নিতে হবে। মনে রাখবেন ওরা আমাদের উপর যুদ্ধ চাপাবে। এবং আমাদের যুদ্ধ করেই স্বাধীন হতে হবে। সবার মধ্যেই দেখলাম একই দ্রোহের উম্মাদনা একই সাড়া একই কথা। আর শােষণ শাসন নয় এবার শােষক বৃক্ষকে গুড়িয়ে দিতে হবে। বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করতে
চরম আঘাতের কালাে রাত এবং আমার ঢাকা ত্যাগ। ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ রােজ বৃহস্পতিবার। বাঙালীর জীবনে সবচেয়ে অমানিশার রাত। ঐ তারিখে রাতের কালাে আঁধারে কালাে পােশাক পরে নেমেছিলাে অজস্র মৃত্যু। গ্রাস করেছিলাে অসংখ্য নিরীহ বাঙালী শিশু-কিশাের, যুবক, বৃদ্ধ-বণিতাকে। ঢাকার রাত সেদিন হয়েছিলাে মৃত্যুর উলঙ্গ প্রেতপুরী। মৃত্যুর কালাে কফিন পরে রাতের ঢাকা হয়েছিলাে ক্ষত বিক্ষত। ২৫শে মার্চ রাতে যখন শেরে বাংলানগর বাজারে গেলাম দেখলাম ৮টি লড়ি অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত পাক বাহিনী নিয়ে টহল দিচ্ছে। আমাদের একটি গােপন সংকেত ছিলাে কোন বিপদের সম্ভাবনা দেখলে ইলেকট্রিক পিলারের গায়ে পেটাতে হবে। সেই মােতাবেক সংকেত পেয়ে Gun হাতে বেরুলাম। কিন্তু লড়ি দেখে আর এগুতে সাহস করলাম না। এলাকায় এসে নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করলাম কি করা যায়? অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে চূড়ান্ত কিছু ঘটাবে ওরা। বিশেষ করে ক্র্যাকডাউন এর সম্ভাবনা আছে। আলাপ আলােচনা করে নিজেদের মত করে প্রস্তুতী গ্রহণ করি। বেলা ২টার দিকে বালুচ রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী খেলার পােশাকে পিলখানা এলাকার চার দিকে ঘুরে দেখলাে। তারা এমন ভাব দেখালো যেন এটা তাদের নিয়মিত শরীর চর্চারই অঙ্গ। এভাবেই বিভিন্ন জায়গা ছদ্মবেশে ঘুরে ঘুরে দিনের বেলাতেই ওরা বাঙালী সেনাদের আক্রমণের অবস্থান নির্ণয় করছিলাে। সকাল থেকে সাদা পােশাকধারী পাঞ্জাবী পাক সেনাবাহিনীর বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত কমান্ডােরা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমন্ডিস্থ বাড়ি ঘেরাও করে কড়া পাহারায় রেখেছে। বঙ্গবন্ধু আসন্ন বিপদ অনুমান করে আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীদের নিরাপদ স্থানে সরে পড়ে স্বাধীনতা যুদ্ধের নির্দেশ দিলেন। অকুতােভয় এই স্বাধীনতার সূর্য পুরুষ পালাননি। বরং নিজের জীবন বিপন্ন জেনেও ঘরেই অবস্থান করছিলেন। রাতে গ্রেফতার হওয়ার আগে পিল খানা ই.পি.আর হেড কোয়ার্টার, রাজার বাগ পুলিশ লাইন ও চট্টগ্রাম ই.পি.আর হেডকোয়ার্টারে তার বাস ভবনে স্থাপিত ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তিনি সর্বাত্মক স্বাধীনতা যুদ্ধ করার জন্য চূড়ান্ত নির্দেশ প্রদান করলেন। এবং এ নির্দেশ লিখিতভাবে আওয়ামী লীগের নেতাদের মাধ্যমে বিভিন্ন জায়গায় প্রেরণ করলেন। রাতের অন্ধকারে ট্যাঙ্ক, মেশিনগান, কামানসহ অনেক আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাঞ্জাবী সৈন্য ঝাপিয়ে পড়ে নিরীহ নিরস্ত্র বাঙ্গালীর উপর। এরা বিভিন্ন প্লাটুনে ভাগ।
হয়ে আক্রমণ করে। তারা ধানমন্ডি বত্রিশ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়ি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল, এস.এম. হলসহ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন ছাত্রাবাস, শিক্ষকদের বাস ভবনে হামলা চালায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি ছিল ওদের বিশেষ টার্গেট, কারণ এখানেই প্রথম বিদ্রোহের সূচনা হয়। এখান থেকে ছাত্রদের দ্বারাই আন্দোলন উজ্জীবিত হচ্ছিল, এখান থেকেই বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা প্রথম উত্তলােন করা হয়। একইভাবে শিক্ষকরাও ছিলেন ওদের লক্ষ্য বস্তু। এছাড়া রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ই.পি.আর হেড কোয়ার্টার, পিলখানা, পুরনাে ঢাকার বিভিন্ন মহল্লায় ওরা পৈশাচিকভাবে আক্রমণ করে পুলিশ, ই.পি.আর ছাত্র শিক্ষকসহ নিরস্ত্র মানুষ ও পথচারীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। ওদের আক্রমণের হাত থেকে রেহাই পায়নি রিকশাওয়ালা ও ফুটপাতের ক্ষুদ্র দোকানীরা পর্যন্ত। রাজারবাগের পুলিশ ও পিল খানার ই.পি.আর সদস্যরা অপ্রস্তুত অবস্থায় যুদ্ধ শুরু করে। এই ঘৃণ্যচক্র শুধু গুলী ছুঁড়ে হত্যা করে ক্ষান্ত হয়নি। তারা রাজার বাগ ও পিল খানায় আগুন ধরিয়ে দেয়। পুরনাে ঢাকার শাঁখারী পট্টি, তাতি বাজারসহ বিভিন্ন মহল্লার সব কিছু আগুনের লেলিহান শিখা গ্রাস করতে থাকে আর শয়তান বর্বর পাকবাহিনী পিশাচরা হত্যাযজ্ঞ ও আনন্দে উল্লাসে মেতে ওঠে। শুধু তাই নয়, রােকেয়া হল, শামসুন্নাহার হল, ইডেন কলেজ ছাত্রী আবাস এবং অন্যান্য জায়গায় আক্রমণ করে ছাত্রীদেরকে ধরে নিয়ে পাশবিক অত্যাচার চালিয়ে হত্যা করে। ওরা মূলতঃ বেশী পারদর্শী ছিল শিশু ও নারী হত্যা এবং ধর্ষণে যতটা না যুদ্ধ ক্ষেত্রে। গভীর রাত অবধি শুনলাম ভারী ট্যাঙ্ক মেশিন গানের গর্জন। বুঝতে পারছি ঢাকার বুকে ঘটে যাচ্ছে এক মহা প্রলয়ংকারী ঘটনা। স্ত্রী-পুত্র পরিজন নিয়ে গভীর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে কাটাচ্ছি রাত। অপেক্ষা করছি ভােরের। এক সময় আওয়াজ। কমে এলাে, বাঙালীর জীবনের এক শ্রেষ্ঠ কালাে রাত পার হয়ে ভাের এলাে। ২৬শে মার্চ সকালে বের হয়ে আগার গাঁও বাজারের দিকে এগুলাম। ৪/৫জন বন্ধু বাজারের এক পাশে দাড়িয়ে আলাপ করছিলাম। এদিকে বাজারের পশ্চিম পাশ। থেকে আর্মির গাড়ী আমাদের লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়লাে। অকস্মাৎ ছোড়া এই গুলীতে আমাদের মধ্য থেকে একজন পড়ে গেলাে। আবার গুলী; প্রাণভয়ে দৌড় দিলাম। এছাড়া উপায় কি? অবস্থা বুঝে ওঠার আগেই চোখের নিমিষে ঘটে যাচ্ছে সব। আমরা নিরস্ত্র অসহায়, সাথের সঙ্গীটিকে নিয়ে যাওয়ারও উপায় রইলাে না। ছুটে এলাম বাসায়। বাসায় এসে রেডিও খুললাম। রেডিও পাকিস্তান শেখ মুজিবকে গালাগালি করছে দেশদ্রোহীতার অভিযােগে অভিযুক্ত করছে। এবং তাঁকে দোষী
সাব্যস্ত করেছে। আমরা আগেই জানি মুজিব জাতির সংগে বেইমানী করতে পারেনা তিনি তাঁর অবস্থানে দৃঢ় থেকে স্বাধীনতার চেষ্টা করে যাচ্ছেন। আর এজন্য ইয়াহিয়া খান তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করে গালাগালি করছে। Indian News শােনার জন্য নব ঘুরালাম। পশ্চিম বাংলার আকাশ বাণী থেকে ভেসে এলাে আমাদের জাতীয় সঙ্গীতের সুর; এবং বাংলাদেশের বিভিন্ন খবরা খবর। এদিকে সারা ঢাকায় কাফু দেয়া, ঘর থেকে কোন রকম বের হতে পারছি না। সর্বত্র তখন ও চরম বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছে। কোন রকম কোথাও কাউকে দেখা গেলেই পাক সেনারা গুলি ছোঁড়ে আর ওদের গুলী খেয়ে পাখীর মত ঝড়ে পড়ছে। বাঙালীরা। ঢাকা নগরী তখন লাশের শহর। চারদিকে দাউ দাউ আগুনের লেলিহান। শিখা। পৈশাচিক বর্বরতায় মেতে আপন মনে ওরা চালাচ্ছে হত্যা আর ধ্বংস যজ্ঞ। বাজার দোকান পাট বন্ধ, খাদ্য সংকট দেখা দিচ্ছে ঘরে ঘরে। এক ফোটা দুধের অভাবে কচি বাচ্চারা তড়পাচ্ছে। সেদিন ঢাকার বুকে যে কী দূর্বিসহ নারকীয় ঘটনা ঘটে গিয়েছিলাে কেবল ভূক্ত ভােগীরা ছাড়া সে অবস্থা অনুমান করা সম্ভব নয়। ২৬শে মার্চ রাত্রে জানলাম আগার গাঁও বাজার জ্বালিয়ে দিয়েছে। সদ্য গড়ে ওঠা আমার ব্যবসা বাণিজ্য সব ধ্বংস হয়ে গেছে। চাকরী ছেড়ে দিয়ে ব্যবসায় করে স্বাধীন জীবন যাপন করার স্বপ্নে শেষ সম্বল দিয়ে শুরু করেছিলাম ব্যবসায়। স্বল্প সময়ে শুরু করে বেশ সাফল্যও অর্জন করেছি। এখন তা পাক সেনাদের রােষানলে পড়ে জ্বলে পুড়ে ছারখার হলাে। এতে করে আমার বেঁচে থাকার শেষ অস্তিত্বটুকু ধ্বংস হয়ে গেলাে। বেঁচে থাকলেও এখন স্ত্রী পুত্র-কন্যাদের নিয়ে না খেয়েই মরতে হবে। আমি ভীষণ কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। এদিকে দোকানপাটের খোজে যারা জীবন বাজী রেখে বাজারের দিকে আসছিলাে, পাক সেনারা তাদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তাদের ভাগ্যে জুটছে নির্মম অত্যাচারের পর মৃত্যু। আমি ও জীবন বাজী রেখে ২৬শে মার্চ একটু খোজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। দেখলাম শুধু আমার তেলের ব্যবসয়াই নয় এরকম হৃত সর্বস্ব হয়েছে অনেকেই। কিছুটা সান্ত্বনা পেলাম এই ভেবে যে সবার ভাগ্যে যা আছে আমারও তাই হবে। এরপর খোঁজ নিয়ে জানলাম আমার দোকান তাে জ্বালিয়েছে সাথে আমার ছােট মামাতাে ভাই এবং ভাইকেও ধরে নিয়ে গেছে। এ খবরে খুবই মর্মাহত হলাম । সংবাদ বাসায় পৌছার সাথে সাথে সাড়া বাসায় কান্নার রােল পড়ে গেলাে। আমার ব্যবসা গিয়েছে যাক কিন্তু ভাইকে পেলাম না। দুঃখ কষ্টে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছি। কোথাও বের হয়ে খোঁজ নেয়ার উপায় নেই। শুধু ঘরে বসে কান্না ছাড়া অন্য কোন কিছুই করার নেই। আমি নিঃস্পন্দ নিস্পৃহ হয়ে বসে আছি। ঘরে বসে গভীর উদ্বেগ আর উৎকণ্ঠা নিয়ে আকাশ বাণী শুনছি। এ অবস্থায় আমাদের শেষ ভরসা আকাশ বাণী । চট্টগ্রাম কালুর ঘাটে ‘স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র স্থাপিত হলেও তা মাত্র ৬০ মাইল ব্যাসার্ধের কারণে সারা দেশবাসী তখনও তা শুনতে পারছিল না। এখান থেকে ২৭শে মার্চ প্রথমে আওয়ামী লীগের আঃ হান্নান এবং পরবর্তীতে মেজর জিয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশে স্বাধীনতার ঘােষণা পত্র পাঠ করেন। যখন গভীর উদ্বেগ আর সংশয়ের মধ্য দিয়ে কাটছিলাে আমাদের সময়। এমন সময় হঠাৎ করেই আমাদের মধ্যে ছােট ভাই উপস্থিত হয়ে সবাইকে আশ্বস্ত করলাে। ও। এসে জানালাে পাক সেনারা যখন বাজার জ্বালাতে এলাে তখন আমি ক্রলিং করে কোন মতে পালিয়ে যেতে সক্ষম হই। এবং পরে বিভিন্ন অলিগলি ড্রেনের মধ্য দিয়ে পালিয়ে পালিয়ে জীবন রক্ষা করেছি। ২৭শে মার্চ সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত কার্টু শিথিল করা হলে আমি বাজারে গেলাম। দেখলাম বিশাল বাজারের কোথাও আর এতটুকু অস্তিত্ব অবশিষ্ট নেই। সব হায়েনার করাল গ্রাসে চলে গেছে। আশপাশের মহল্লাও জ্বালিয়ে দিয়েছে। সেখান থেকে ভেসে আসছে স্বজন হারাদের আর্তচিৎকার, সে চিৎকার বুঝি বিধাতার সুনীল আকাশকেও চৌচির করছে। এ হৃদয় বিদারক ঘটনায় বুক ফেটে আসছে আর রক্ত জ্বলছে দ্রোহের উন্মাদনায়। চরম সংকল্প আসছে মনে অস্ত্র। হাতে যুদ্ধের । কিন্তু এখন কোথায় পাব অস্ত্র সৈন্য? কার কাছে যাব? কোন হদিস করতে পারছি না। বাসায় এসে মেজ মেয়ের মাথায় হাত রেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাম। আমার স্ত্রী। আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে শক্ত হতে সাহায্য করলেন। তিনি বললেন সব গেছে সব পাব জীবনে বেঁচে থাকলে এর সব কিছুই আমরা আবার করতে পারবাে। তােমাকে এখন ভীষণ শক্ত হতে হবে। তুমি না সৈনিক এত সহজে তােমার ভেঙ্গে পড়া হবে কাপুরুষতা। আমি সাহস সঞ্চয় করে আশায় বুক বাঁধি। ইতােমধ্যে আমার এক মাদ্রাজী বন্ধু এসে জানালেন পাক সেনারা আমাকে খুঁজছে। বাঙালীরা বিশেষভাবে যারা আমাদের মধ্য থেকে শক্রর হয়ে কাজ করছে। তারাই ওদেরকে আমাদের সম্পর্কে তথ্য সরবরাহ করছে। আমি ছিলাম বাজার কমিটির সেক্রেটারী এবং স্বাধীনতার সপক্ষের সংগঠক, এ সম্পর্কে ওরা অবহিত হয়েছে। বলে আমাকে বিশেষ ভাবে খুঁজছে। অবস্থা অনুমান করে মনে হলাে আর এক মুহূর্ত এখানে থাকা সমীচিন হবে না। আমাকে যে করেই হােক ঢাকা ত্যাগ করতে হবে।
কালবিলম্ব না করে আগার গাঁও বাজারে গ্রামের এক বন্ধু আহমদ মেম্বারের গাড়ী ছিলাে। আমি তাকে গিয়ে বললাম, ‘বন্ধু এখন যে অবস্থা তাতে যে কোন মুহূর্তে সবার ভাগ্যেই নির্মম কিছু জুটতে পারে। এ অবস্থায় তুমিও পালাও এবং আমাকেও সুযােগ দাও। বাসায় এসে স্ত্রী সন্তানদের এবং বৃদ্ধ বাবাকে নিয়ে রওয়ানা হলাম। মাত্র ৪টা পর্যন্ত। কার্ফ শিথিল অতএব এর মধ্যেই আমাদের ঢাকা ত্যাগ করতে হবে। তাই যত তাড়াতাড়ি যে করেই হােক প্রাণপন চেষ্টা করছি পালাতে। কিন্তু মীরপুর ব্রীজের এখানে এসে দেখি ব্রীজে ফায়ার হচ্ছে। বিউটি সিনেমা হলের পাশ দিয়ে নদীর পাড় ধরে যাত্রা করলাম। দেখলাম অসংখ্য লাশ পড়ে আছে, গাড়ী আমিন বাজার। পর্যন্ত কোনমতে এলাে আর সামনে এগুতে পারলাম না। আমরা নৌকায় নদী পার হয়ে এপার এলাম। কিন্তু কোন গাড়ী নেই। কোন মতে একটা ট্রাক ম্যানেজ করলাম, ভাড়া প্রায় ৪ গুণেরও বেশী নিল। তবু চিন্তা করছি কোন মতে পরিবার নিয়ে যাতে ঢাকা ত্যাগ করতে পারি। আমিন বাজার এসে দেখতে পেলাম বিভিন্ন সাহায্য সহায়ক কমিটি বেড়িয়েছে। এখানে এলে এরা আমাদেরকে খুিচরী খাওয়ালাে। এভাবে যারা অনাহারে অর্ধাহারে থেকে কোনমতে জীবন নিয়ে পালাচ্ছে রাস্তায় তাদের সাহায্যের জন্য এ সমস্ত কমিটি বেড়িয়েছে। এদের দেখে খুব ভাল লাগলাে, আশ্বস্ত হলাম সবার মধ্যেই। একটা সাড়া জেগেছে। নয়ার হাট এসে দেখলাম অনুরূপ সাহায্য সহায়ক কমিটি। তাঁরা বাচ্চাদের দুধ। খাওয়ালাে। ধীরে ধীরে সতর্কতার সাথে এক সময় আমরা আরিচা পেীছলাম। আরিচা আসতে রাত হয়ে গেলাে। আমাদের সাথে রেডিও নিয়ে এসেছিলাম। রেডিওর নব ঘুরাতে স্পষ্টত শুনলাম মেজর জিয়ার ঘােষণা I major Zia, do hereby decleared that Independends of Bangladesh on behalf our National leader Sheikh Mujibur Rahaman, আনন্দে উল্লাসে চিল্কার করে উঠলাম জয়। বাংলা, বাংলার জয়। অবশ্যই বাংলাদেশ স্বাধীন হবে। বাংলার দামাল সূর্য। সৈনিকেরা জেগে উঠছে। ভাষণ শুনে বুঝতে পারলাম যুদ্ধ শুরু হয়েছে। ঘাটে গিয়ে দেখি পার হওয়ার জন্য কোন ফেরী নেই। অনেক কষ্টেও কোন ফেরী জোগাড় করা গেল না। নিরুপায় হয়ে সবাইকে নিয়ে হােটেলে অবস্থান নিলাম। ২৮শে মার্চ ফেরী পাওয়া গেলাে। ওপার গিয়ে একটা গাড়ী পেলাম। সে গাড়ীটা। নিয়ে কিছুদূর এগুতেই দেখলাম একটা ট্রেন গােয়ালন্দ থেকে ফরিদপুর যাচ্ছে। আমরা সবাই গাড়ী থেকে নেমে ট্রেনের সামনে গিয়ে হাত উচু করতেই ট্রেনটা।
থেমে গেলাে। উঠে পড়লাম ট্রেনে। ফরিদপুর নেমে প্রথমে আমরা আওয়ামীলীগ অফিসে গেলাম। ফরিদপুরের তখন আওয়ামীলীগ নেতা ইমাম উদ্দীনসহ অনেকেই অফিসে আমাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন। রেডিও তখন পাক সেনাদের দখলে; অন্যান্য গণমাধ্যমও অচল। রাজধানী ঢাকার থেকে তাই জেলা শহরগুলাে একেবারেই বিচ্ছিন্ন। ফলতঃ এরা কোন খবরই জানেন। না। তাঁরা গভীর আগ্রহের সাথে আমাদের কাছ থেকে বিভিন্ন সংবাদ জানতে চাচ্ছেন। আমি জানালাম ঢাকায় কিছু নেই ওরা সব অবলীলায় ধ্বংস করছে হত্যা করছে। আমাদের উপর ওরা অনিবার্য যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। আমার কথা শুনে সবাই খুব মর্মাহত হলেন। এরপর আমাদের যথেষ্ট আপ্যায়ন করলেন। আমি তাঁদের সাবধান করে বললাম। আপনারা সাবধান হােন এবং যুদ্ধের সর্বাত্মক প্রস্তুতী নিন। যুদ্ধ ছাড়া এখন আর আমাদের কোন বিকল্প নেই। এরা আমার কাছে জানতে চাইলেন আমরা কোথায় যাব। আমি জানালাম আমার এলাকা শৈলকূপায়। তখন তারা পেট্রোল ভরে একটা জীপ আমাদের দিলেন। জীপটা কামারখালী ঘাট পর্যন্ত পৌছে দেয়। কামারখালীর ওপার থেকে আবার একটা মাইক্রোবাস সংগ্রহ করে ২৮শে মার্চ বাড়ীতে পৌছলাম। আমি সম্পূর্ণ নিঃস্ব অবস্থায় ফিরেছি আমার সব ধ্বংস হয়ে গেছে, দোকান পাট জ্বালিয়ে দিয়েছে এ খবর শুনে মা খুব কান্নাকাটি শুরু করলেন। মাকে আমি সান্ত্বনা দিলাম ‘মা কোন চিন্তা করাে না আবার হবে আমার সব হবে । মা এ সংবাদটিই শুধু জানেন কিন্তু জানেন না আমার জীবন কতটা সংশয়াপন্ন ছিল। আমরা কোনমতে যে জীবন নিয়ে ফিরে এসেছি তাই আমাদের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মা সেটা জানেন না। বলে দোকান ব্যবসার জন্যই উদ্বিগ্ন হয়ে হাহাকার করছেন। যা হােক রাতটা কোন মতে কাটিয়ে ২৯শে মার্চ আমি মাগুরায় যাই। মাগুরায় গিয়ে তখন সংসদ সদস্য এবং পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী জনাব সােহরাব হােসেনকে খোজ করি। ইতিমধ্যে আমি আসাদুজ্জামান M.P.কে পাই। সােহরাব সাহেব আমাকে চিনতেন, রাউল পিন্ডিতে ওনার সাথে আমার অনেক কথা হয়েছিলাে। আসাদুজ্জামান সাহেব অনেক ভেবে আমাকে যাচাই করে বুঝে নিয়ে অবশেষে সােহরাব সাহেবের সাথে দেখা করাতে সম্মত হলেন। উনি আমাকে নিয়ে গেলেন এখান থেকে ১মাইল দূরে আঠার খাদা গ্রামের পাশে এক জঙ্গলে। সেখানে সােহরাব সাহেব অবস্থান করছেন। উনি আমার কাছে সবিস্তারে সব ঘটনা শুনে বেরিয়ে এলেন।
মাগুরায় এসে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন। তারপর আমাকে প্রস্তাব করলেন যে ইন্ডিয়ার সাথে আমাদের একটা চুক্তি ছিলাে; কিন্তু চুক্তিটা পরবর্তীতে জানাজানি হয়ে যাবার কারণে তাজউদ্দীন সাহেব জ্বালিয়ে দিয়েছেন। এখন তুমি ইন্ডিয়ায় আমাদের হাই কমিশনার হােসেন আলীর কাছে যাও। তাঁকে গিয়ে বললাে আমাদের যে চুক্তি ছিলাে সেই মােতাবেক ভারত সরকার আমাদের সাহায্য করবে কিনা? এবং তা নিয়ে ভারত সরকারের সাথে আলােচনা করতে বল। আমি তখনও ভারত যাইনি। তেমন কাউকে চিনিনা জানি না। তবু সােহরাব সাহেবের নির্দেশে মাগুরা পৌরসভার প্রাক্তন চেয়ারম্যান জনাব মাজেদ আলীকে নিয়ে সাইকেল যােগে ঝিনাইদহ রওয়ানা হলাম। সােহরাব সাহেব ওখানকার এস.ডি.পি.ও. পরবর্তীতে ঢাকার সিনিয়র এস.পি জনাব মাহবুবউদ্দীনকে ফোন করে বলে দিয়েছেন আমাদের প্রয়ােজনীয় সাহায্য করার জন্য। এস.ডি.পি.ও, সাহেব আমাদের ওখান থেকে গাড়ী করে ইন্ডিয়ার বর্ডারে নামিয়ে দিয়ে আসবেন। আমরা ঝিনাইদহ গিয়ে এম.পি. আজিজুল হক সাহেবের সঙ্গে দেখা করলাম। আজিজুল হক সাহেবকেও সােহরাব সাহেব আগেই ফোন করে সব জানিয়ে দিয়েছেন আমাদের সম্পর্কে। হক সাহেবের বাসায় গিয়ে পৌছলে উনি আমাদের সাদরে গ্রহণ করলেন। এবং বেশ আন্তরিকতার সাথে আপ্যায়ন করলেন। সন্ধ্যায় তিনি এস.ডি.পি.ও, সাহেবের অফিসে আমাদের নিয়ে গেলেন। ওখানে গিয়ে আরও উৎসাহিত হলাম দেখলাম এখানে যুদ্ধের সব রকম প্রস্তুতী চলছে। আমরা। গিয়ে আমাদের পরিচয় দিলাম। যুদ্ধ সম্পর্কেও উনার সাথে অনেক আলাপ আলােচনা হলাে। উনি আমাদের বললেন ভাের ৪টায় আমার গাড়ী গিয়ে আপনাদের নামিয়ে দিয়ে আসবে। আমরা এই সিদ্ধান্ত মােতাবেক এস.ডি.পি.ও’র অফিস থেকে বের হলাম। এরপর আমরা তখনকার ছাত্রনেতা জনাব নূরে আলম সিদ্দীকির বাসায় গেলাম। সেখানে খাওয়া দাওয়া করে রাত্রি যাপন করলাম। জনাব সিদ্দিকীর ভগ্নিপতি আমাদের খুবই আদর আপ্যায়ন করলেন। রাত থেকে আমরা গভীর উদ্বেগের মধ্য দিয়ে সময় কাটাচ্ছি। একটাই কর্তব্য বােধে তাড়িত সবাই। মনে মনে প্রস্তুতী নিচ্ছি কিভাবে যাৰ-কোথায় গিয়ে কি করব? এভাবে সংকল্পে প্রস্তুতী নিয়ে বসে আছি। কিন্তু ভাের ৪টার সময় আর গাড়ী আসছে না দেখে খুব উৎকণ্ঠায় আছি। ৪টা-৫টা বেজে গেলাে অবশেষে আমরা কিছুটা উদ্বেগ নিয়ে এগুতে থাকলাম।
ঝিনাইদহ মােড়ে গিয়ে দেখলাম একটা হােটেলে সােহরাব সাহেব অপেক্ষা। করছেন। আমরা উৎকণ্ঠার সাথে গাড়ী না যাওয়ার কারণ জানতে চাইলে উনি আমাদের শান্ত করে বললেন তােমাদের আর যেতে হবে না। এ উদ্দেশ্যে কেন্দ্রীয় নেতা তাজউদ্দীন সাহেব নিজেই আসছেন। উনি মাগুরা হয়ে ঝিনাইদহ আসছেন। এখান থেকে কলকাতা যাবেন। যথা সময়ে তাজউদ্দীন সাহেব এলেন এবং ঝিনাইদহ হয়ে কোলকাতা চলে গেলেন। অতঃপর আমরা মাগুরায় ফিরে এলাম। মাগুরায় ফিরে এসে দেখলাম যুদ্ধের প্রস্তুতী হিসেবে ট্রেনিং শুরু হয়েছে। বিভিন্ন জায়গা থেকে সাহায্য আসছে। এখানে মুক্তি যুদ্ধের সপক্ষে সংগঠিত করার জন্য অফিস নেয়া হলাে, সাহায্যের মালামাল রক্ষণাবেক্ষনের জন্য অফিস সংলগ্ন স্টোরও নেয়া হলাে। পুরােমাত্রায় যুদ্ধ প্রস্তুতী চলছে। একই সাথে জনমত তৈরী এবং মুক্তিযুদ্ধ সংগঠিত করার কাজ করছি। প্রচুর সাহায্য আসা শুরু হলাে। আসাদুজ্জামান সাহেব এসময় আমাকে অনুরােধ করলেন (জামান ভাই আপনি স্টোরের দায়িত্ব গ্রহণ করুন)। এখানে সাহায্যের বিভিন্ন উপকরণের মধ্যে কিছু যুদ্ধ সরঞ্জামও ছিল বলে কোন একজন বিশ্বস্ত লােক। ষ্টোরের দায়িত্ব নেয়ার প্রয়ােজন ছিল। এদের বিবেচনা সাপেক্ষে আমাকেই দায়িত্ব অর্পণ করা হলাে। আমি বিশ্বস্ততার সাথে আমার কর্তব্য পালন করছি। ইতােমধ্যে হঠাৎ এক রাতে আমাদের গার্ডরা সামসুদ্দীন সাহেব নামে একজন ভদ্রলােককে (বর্তমানে তিনি জাতীয় সংসদের চীফ ট্রান্সসেলেটর) স্পাই সন্দেহে ধরে নিয়ে এসেছে। ভদ্রলােকের পরিণতি ততক্ষণ ভয়ঙ্কর। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে দেখি সামসুদ্দীন সাহেব, আমার বিশেষ পরিচিত ভদ্রলােক, বাড়ী নােয়াখালী। খুব বন্ধু মানুষ আমার। আল্লাহপাকের ইচ্ছায় আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে পৌঁছে ছিলাম বলে রক্ষা। নইলে তার ভাগ্যে হয়ত নির্মম কিছুই জুটতে পারত। কেননা আমাদের মধ্যে তখন ক্রোধের আগুন জ্বলছে দাউ দাউ করে। প্রত্যেকে খুবই সতক, যে। কোন মুহূর্তে আমাদের মধ্যে শক্র ঢুকে পড়তে পারে। তখন মাগুরার এস,ডি,ও ছিলেন জনাব ওলিউল ইসলাম। এখন তিনি সচিব পর্যায়ে আছেন। আমাদেরকে উৎসাহিত করে সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ এবং সংগঠিত করতে তার ছিল। ব্যাপক ভূমিকা। সে কথায় পরবর্তী পর্যায়ে আসছি। অপারেশন সিতালী আমরা হঠাৎ জানতে পারলাম পাকবাহিনীর একটা কোম্পানী যশাের থেকে কুষ্টিয়া গিয়ে ফেরত আসার সময় শৈলকূপার মাঝে গারাগঞ্জ নামক স্থানে মুক্তিযােদ্ধা
কর্তৃক বাধা পেয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে গেছে। এই বিচ্ছিন্ন দলের ১৮জন সৈন্যের একটা প্লাটুন এদিকে আসছে। এরা এইটিন রেজিমেন্টের ফোর্স, ওদের কাছে প্রচুর। গােলাবারুদ এবং অস্ত্র আছে। এদেরকে আক্রমণ করে যে করেই হােক এ সমস্ত অস্ত্র এবং গােলা বারুদ উদ্ধার করতে হবে। কিন্তু আমাদের কাছে তেমন কোন অস্ত্র নেই, ফোর্স নেই। এ সমস্ত পাকসেনা দেখে এলাকার প্রায় ২০/২৫ হাজার লােক ঢাল, শড়কী সহ গ্রাম্য অস্ত্র শস্ত্র নিয়ে মােকাবিলা করতে নেমে পড়েছে। কিন্তু ওদের আধুনিক অস্ত্রের সামনে এগুতে পারছে না। একটু এগুচ্ছে আর গুলী খেয়ে মরছে। ঝিনেদা এবং মাগুরার মধ্যে সিতালী নামক স্থানে ওরা তখন অবস্থান নিয়েছে। এদিকে মাগুরা থেকে ফোর্স পাঠানাের আবেদন এলাে। কিন্তু মাগুরায় কোন ফোর্স নেই। শুধু ন্যাশনাল ব্যাংক-এর ৬জন পুলিশ এবং একজন হাবিলদার আছে । আসাদুজ্জামান সাহেব আমাকে অনুরােধ করলেন জামান ভাই টেকওভার করুন। আমি টেক ওভার করলাম, ইতােমধ্যে একটা অস্ত্রও পেলাম। এই ৬জন গার্ড নিয়ে আমি এগুতে থাকলাম। রাস্তায় দেখলাম র্যাকি করা গাছ শােয়ানাে, কোন মতে এগিয়ে গিয়ে তাদের দেখতে পেলাম। রাস্তা দিয়ে এগুনাে ঝুঁকিপূর্ণ ছিলাে বলে সাবধানে এগুতে হয়েছে। আমরা একটা সাইড পেলাম। ওরা ছিল নদীর এপারে। পুলিশরা বললাে চলুন স্যার নদী পার হয়ে পশ্চিমে যাই। কিন্তু এরা পার হয়ে পাকসেনা দেখার পরপরই আমাকে ফেলে চলে গেলাে, কোন আক্রমন করলাে না। যশােহর ক্যান্টনমেন্ট আক্রান্ত হলে অনেকে বেড়িয়ে পড়েছিলাে এদের কিছু সৈন্য এসে আমার সাথে যােগ দিল। তার মধ্যে একজন সৈন্য ছিল খুবই দুঃসাহসী, এর কাছে একটা এল.এম.জিও ছিলাে। এল,এম,জিটা আমার পাশে পেয়ে আমার বুকে কিছুটা আশার সঞ্চার হলাে। পাকবাহিনী বট গাছের গােড়ায় ট্রেন্স করে পজিশন নিয়ে আছে। আমরা নদীর ধারে, ওরা আমাদের দেখতে পায় কিন্তু আমরা ওদের দেখতে পাচ্ছি না। এমন একটা অকুয়ার্ড পজিশনে পড়ে গেলাম আমরা। একের পর এক ফায়ার দিচ্ছি কিন্তু টার্গেট করতে পারছি না। কয়েকজন আনসার আমার নিষেধ অমান্য করে এগিয়ে গেলাে, কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই তারা মারা পড়লাে। ওদের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি খুবই মর্মাহত হলাম। অবস্থা বেগতিক দেখে আমি মাগুরায় ফোন করলাম সৈন্য পাঠাও। তখন এস.ডি.ও অলিউল ইসলাম এবং আসাদুজ্জামান সাহেব একজন সুবেদারসহ এক কোম্পানী ই.পি.আর পাঠালেন। ওরা এসে আমার সাথে যােগ দিল। একসঙ্গে কিছুক্ষণ ফায়ারিং করলাম কিন্তু কোন কাজ হচ্ছে না। এরা সাথে মটার নিয়ে এসেছিলাে। আমি বললাম মর্টার চালান, শেলিং করুন। কিন্তু মর্টার
ওভার রেঞ্জ এ চলে যাওয়ায় শেলিং পজিশন মত হলাে না। এই অবস্থায় যুদ্ধ করতে করতে রাত নেমে এলাে। ওদের কাবু করতে পারছি না। আমার সহযােদ্ধারা উঠে পড়তে চাইলে আমি বললাম পাকসেনাদের এখানে ঘিরে রাখতে হবে। কিন্তু ই.পি.আর বাহিনী কথা শুনল না উঠে চলে গেলাে। এর কিছুক্ষণ পর আমাদের চোখের সামনেই ওরা ফায়ার দিয়ে উঠে পড়লাে। সৈনিক হয়েও দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আমি এই দৃশ্য অবলােকন করছি। পরদিন সকালে আমি গােপালপুর নামক স্থানে অবস্থান নিলাম। ইতােমধ্যে লােক মুখে শুনলাম গতকাল আমাদের গুলীতে ৩জন পাকসেনা মারা গেছে। খবর শুনে স্পটে গেলাম তারপর ডেডবডি গুলােকে একসঙ্গে করে গণকবর দিলাম। মাগুরা ফিরে এলে সবাই আমাকে ধরলেন ডেডবডি কেন আনিনি ডেড বডি আনতে হবে। বাধ্য হয়ে আবার একটা গাড়ী নিয়ে ডেড বডিগুলাে আনলাম। এই অভিযানে যদিও আমরা আংশিক সফল হলাম তবুও প্রাথমিক ভাবে এই অপারেশনের গুরুত্ব ছিল অসীম। কেননা এই অভিযান থেকে স্থানীয় যুবক ভায়েরা খুব উৎসাহ বােধ করে এবং স্বতঃস্ফুর্ত ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণের জন্য আগ্রহ প্রকাশ করে। স্থানীয় জনগণকেও ব্রীফিং দেয়া হচ্ছে। আমরা কখনই দূর্বল নই অস্ত্র ও রসদ পেলে আমাদের মুক্তি যােদ্ধারা অবশ্যই বিজয় অর্জন করতে পারবে। তাছাড়া ওরা এদেশে এসেছে অন্য দেশ থেকে, রাস্তা পথঘাট কিছু জানেনা। পক্ষান্তরে এর সবই আমাদের নখদর্পণে। আমরা গেরিলা কায়দায় যুদ্ধ করে ওদের সহজেই পরাস্ত করতে পারব। এই ব্রীফিং খুব সহজেই কার্যকর হয়। অনেক যুবক এসে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করে। তাছাড়া কয়েক দিন পর জানলাম ঐ বিচ্ছিন্ন। দলের বাকী ১৫জন সদস্যের সকলেই খাদ্য পানির অভাবে-স্থানীয় জনগণের অসহযােগিতা ও বিভিন্নভাবে অত্যাচারের ফলে মারা গেছে। এই অপারেশন সাকসেসফুল করে মাগুরায় ফেরার পর আমার নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে স্থানীয় প্রাক্তন মন্ত্রী সােহরাব সাহেব, এম.পি আসাদুজ্জামানসহ সকলে সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাকে কমান্ডার নিযুক্ত করলেন। আমি মাগুরার কমান্ডার হলাম। এরপর আরও ছােটখাটো কয়েকটি অপারেশনে নেতৃত্ব দিই। এদিকে জানতে পারলাম নড়াইলে ২৮০জন পাকসেনা ধরা পরেছে। এদেরকে যারা অপারেশন করে তার পুরাে গ্রুপটাই মাগুরা এলাে। কিন্তু তারা স্টে করে না। আমি চেয়েছিলাম মাগুরার নেতৃত্ব এদের কাউকে দিতে, কিন্তু এরা চলে গেলাে। বাধ্য হয়ে নেতৃত্ব আমার উপরই পড়লাে। ইতােমধ্যে একদল ই.পি.আর এলাে আমি তাদেরকে দলে ইনভলব করে নিই। অন্যান্যদেরকে আনসার ট্রেনিং দিতে থাকি।
আমাদের কিছু সৈন্য ছিলাে খাজুরা। এরা ই.পি.আর, সদস্য, মুক্তিযুদ্ধে কাজ করছিলাে। যশাের মাগুরার মাঝ সীমান্তে অবস্থিত এই, খাজুরা। এই সৈন্যদের দুটো। এল.এম.জি নষ্ট হয়ে যায়। ফলে এগুলাে রিপিয়ার করা দরকার হয়। কিন্তু এরা এগুতে পারছে না। যশাের ক্যান্টনমেন্ট তখনও ঘেরাও, পথে পথে পাক সেনাদের ভয়। অতঃপর এ দায়িত্বও আমার উপর পড়লাে। আমি ১১ই এপ্রিল রণকৌশল হিসেবে দুটোগাড়ী চাই। এর প্রথমটি থাকবে সামনে এবং খালি, দ্বিতীয়টিতে আর্মসসহ লােক থাকবে। আমার ডিম্যান্ড অনুযায়ী দুটি গাড়ীই পেলাম। সাথে দু’জন সহযােদ্ধা নিয়ে ঝিনেদা থেকে আর্মস রিপিয়ার করে খাজুরায় ই.পি.আর সেনাদের হাতে দিলাম। এটা একটা অপারেশনেরই অংশ ছিল। কেননা পথে আমরা যে কোন সময় আক্রান্ত হতে পারতাম। আমাদের জীবন যেমন যেতে পারত সাথে এতগুলাে আর্মসও। এই অকেজো অস্ত্র ছাড়াও আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আমার সাথে গােলাবারুদসহ অস্ত্র ছিলাে। আমরা কোন বাধার মুখােমুখি না হয়ে নির্ভয়ে নিরাপদে ১১ই এপ্রিল রাতে খাজুরায় সৈন্যদের হাতে আর্মস বুঝিয়ে দিয়ে মাগুরায় ফিরে এলাম। কিন্তু আমি আকস্মিকভাবে কমান্ডার নিযুক্ত হওয়ায় অনেকেই মনে মনে ঈর্ষান্বিত হন। প্রকাশ্যে তারা দু’একজন প্রতিবাদও করলাে। জবাবে এস.ডি.ও অলিউল ইসলাম সাহেব জানালেন যাও ফ্রন্ট-এ টেক ওভার কর। কিন্তু তা কেউ করছে না বা সে সাহস দেখাতে পারে না। ফলে এক সময় আপনা থেকেই স্তিমিত হয়ে যায়। অতএব আমাকে কমান্ডার হিসেবে মানতে আর কারও দ্বিধা থাকে না। বিষয়খালী রণাঙ্গণে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহ । বিভিন্ন এলাকা ফল করছে পাক বাহিনীর হাতে। আমাদের ভারত গিয়ে আশ্রয় নেয়ার সমস্ত পথঘাটও ক্রমশ রুদ্ধ হয়ে আসছে। ইতােমধ্যে আমি মাগুরার কমান্ডার হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছি। মুক্তিযােদ্ধাদের সংগঠিত করে ছােট খাট কিছু অপারেশন পরিচালনা করছি। সিতালী অপারেশনের পর পরই আবার পাক বাহিনীর মুখােমুখী হই। স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম দিকে ঝিনেদার মাহবুবউদ্দীন ও লেঃ মতিউর রহমানের নেতৃত্বে অপারেশন বিষয়খালী ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই অপারেশনে আমরা বিষয়খালী ব্রীজ উড়িয়ে দেই। এ সময় বিষয়খালী ব্রীজ উড়িয়ে পাক সেনাদের প্রতিরােধ না করতে পারলে ওরা সঙ্গে সঙ্গে ঝিনেদা অধিকার করতাে ফলতঃ আমাদের ভারতে আশ্রয় গ্রহণেরও সমস্ত পথরুদ্ধ হয়ে যেত। ঝিনেদার মধ্যদিয়ে যুদ্ধকালীন সময়ে সিংহ ভাগ শরনার্থীরা প্রত্যহ
গমন করেছে। এসব বিবেচনায় এনে দেখা যায় ভারত যাবার প্রাক্কালে আমাদের যে সমস্ত অপারেশন সংগঠিত হয় বিষয়খালী ছিল তার অন্যতম। মার্চের ক্র্যাকডাউনের পর থেকেই পাক বাহিনী যশাের ক্যান্টনমেন্টে সাদা পতাকা। উড়িয়ে যুদ্ধ বিরতির আপাতঃ ছদ্মাবরণ নিয়ে ভেতরে ভেতরে খুবই সংগঠিত হতে থাকে। তারা U.S Made C-130 B Air Craft-এ করে চট্টগ্রাম এবং ঢাকা থেকে অস্ত্র ও সৈন্য আমদানী করতে থাকে। আমরা ওদের গতিবিধি দেখে পূর্বেই অনুমান করতে পারলাম ভেতরে ভেতরে ওদের সংগঠিত হওয়া সম্পর্কে। ফলে। ওদের প্রতিরােধ করার জন্য আমরা বিভিন্ন পথে ও স্থানে ক্যাম্প তৈরী করি। এ সমস্ত ক্যাম্পের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিল যশাের ঝিনেদার মাযখানে বিষয়খালী নামক ব্রীজের অদূরে বিষয়খালী ক্যাম্প, মাগুরা কামারখালীর মাঝখানে বেলনগর। ক্যাম্প, মাগুরা এবং ঝিনেদার মাঝখানে আলমখালী ক্যাম্প, মাগুরা থেকে যশােরের। সরাসরি রাস্তায় চিত্রানদীর পাড়ে সীমাখালী ক্যাম্প, সীমাখালী থেকে যশােহরের রাস্তায় খাজুরা নামক স্থানে খাজুরা ক্যাম্প। এই খাজুরা ক্যাম্পে ই. পি. আর এর। একটি পুরাে কোম্পানী ছিল। এখানে পাকবাহিনীর সঙ্গে মুখােমুখী একটি যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যাতে আমাদের দু’জন মুক্তিযােদ্ধা আহত হয়। এদেরকে পরবর্তীতে চিকিৎসার জন্য মাগুরায় স্থানান্তরিত করা হয়। অত্যন্ত স্বল্প সময়ের মধ্যে তৈরী এ সমস্ত ক্যাম্পের উদ্দেশ্য ছিল রাস্তায় পাক। বাহিনীকে চরম ভাবে প্রতিরােধ করা। মাগুরার কমান্ডার হিসেবে এ সমস্ত ক্যাম্প গুলাের দায়িত্ব ছিলাে আমার উপর। এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে আমরা জানতে পারলাম যশােহর থেকে পাকবাহিনীর অত্যন্ত সুসংগঠিত একটি অগ্রবর্তীদল ঝিনেদা আক্রমণের জন্য এগিয়ে আসছে। তখন আমরা বিষয়খালী থেকে ১০/১২ মাইল দূরে আলমখালী ক্যাম্পে অবস্থান করছিলাম। সংবাদ শুনে প্রায় ১০০শত মুক্তি যােদ্ধা নিয়ে বিষয়খালীতে আমরা পূর্বে নির্মিত ট্রেঞ্চে অবস্থান নিই। এই অপারেশনে যৌথ ভাবে নেতৃত্ব দেন ঝিনেদার এস, ডি, পি, ও মাহবুব উদ্দীন লেঃ মতিউর রহমান এবং আমি নিজে। অত্যন্ত ভারী এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকবাহিনীর সাথে আমাদের এক তুমুল যুদ্ধ সংগঠিত হয়। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ভারী কামান দিয়ে ওরা শেলিং করতে থাকে। প্রচন্ড আক্রমণে ওদের প্রতিহত করতে না পেরে আমরা রিট্রিট করে পিছিয়ে এসে বিষয়খালী ব্রীজ উড়িয়ে দেই। এভাবে এক শক্তিশালী বাহিনীকে আমরা সেদিন ঠেকিয়ে দিই এক প্রচণ্ড লড়াইয়ে। এখানে এই ব্রীজ উড়িয়ে না দিলে ঝিনেদা ফল করত ফলে আর কোন শরনার্থীই। ভারত গমন করতে পারতনা।

অপারেশন সীমাখালী। বিষয়খালী যুদ্ধের পূর্বেই আমাদের সীমাখালীতে পাকবাহিনীর মুখােমুখী হতে হয়। সংগঠিত এই যুদ্ধে পাকবাহিনীর সিগন্যাল কোরের একজন হাবিলদার গ্রেফতার হন। তাঁকে আমি মাগুরার জেলে পাঠিয়ে দিই। কিন্তু মাগুরা পৌঁছানাের পরই ক্ষিপ্ত জনতা তাকে হত্যা করে। মাগুরার সেদিন এম, পি, আসাদুজ্জামান এস. ডি. ও অলিউল ইসলাম এবং প্রাক্তন মন্ত্রী সােহরাব হােসেন অকস্মাৎ আমাকে কমান্ডারের যে গুরু দায়িত্ব অর্পণ করেন এ সমস্ত সাকসেসফুল অপারেশনের মধ্যদিয়েই আমি আমার যােগ্যতা প্রমাণের চেষ্টা . করি। কিন্তু প্রচন্ড শক্তি নিয়ে লড়েও যখন নিজেদের এলাকাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলাম না। তখন আমাদের ভারত যাওয়ার প্রয়ােজন দেখা দেয়। ইতােমধ্যেই আমাদের অস্ত্রের প্রয়ােজনে সােহরাব সাহেবকে ভারত পাঠিয়ে দিই। আমাদের। প্রত্যেকটি অপারেশনে যে পরিমাণ আন্তরিকতা ও মনােযােগ ছিল সে পরিমাণ অস্ত্র ছিলনা। শুধুমাত্র বিভিন্ন অস্ত্রের অভাবেই যথেস্ট ডিভােশন এবং রণকৌশল থাকা সত্ত্বেও আমাদের রিট্রিট করতে হয় ।
দ্রোহের উন্মাদনায় মুক্তির স্বপ্ন ভারত অভিমুখে যাত্রা প্রায় এপ্রিলের মাঝামাঝি। পাকসেনারা যশাের, কুষ্টিয়া, মাগুরায় তাদের সৈন্য সংখ্যা ক্রমশঃ জোরদার করছে। আমাদের সামান্য অস্ত্র এবং স্বল্প সংখ্যক সেনা ও বাকী হাল্কা প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত আনসার দিয়ে মাগুরা রক্ষা করতে পারবাে না। যে কোন সময় মাগুরা ফল করতে পারে। ঝিনেদা ফল করলে আমাদের সমস্ত রাস্তাই বন্ধ হয়ে যাবে। এমন কি আর ইন্ডিয়ায়ও যেতে পারব না। আমাদের এ মুহূর্তে আগে প্রয়ােজন ভারত যাওয়ার, ভারত গিয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা এবং অস্ত্র সংগ্রহ সর্বাগ্রে প্রয়ােজন। আমরা রিট্রিটের প্রস্তুতী নিই। বিশেষভাবে সােহরাব সাহেব এবং আসাদুজ্জামান আমাকে ভারত যাওয়ার ব্যাপারে অনুরােধ করলেন। আমার চলে আসার সময় ঘনিয়ে এলে কর্মী বাহিনী আমার কাছে এসে কান্না করতে থাকে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য ছিল আবুল খায়ের, ফাত্তাহ, রুস্তম আলী। আমি তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বললাম আমরা চলে যাচ্ছি তােমরা যুদ্ধের প্রস্তুতি নাও। তাছাড়া বৃহত্তর স্বার্থে এখন আমাদের যেতে হচ্ছে। দু’দিন আগে পরে। তােমাদেরকেও যেতে হবে। দেশকে শত্রু মুক্ত করে স্বাধীন করতে হলে আরাে শক্ত হতে হবে। তাছাড়া আমরা অস্ত্র সংগ্রহ করেই ফিরে আসব। তােমরা আমাদের জন্য দোয়া করাে । ১৩ই এপ্রিল রাত ৮টায় আমি এস.ডি.ও অলিউল ইসলাম, আসাদুজ্জামান ও সামসুদ্দীন সাহেব একটা জীপে করে মাগুরা থেকে রওয়ানা হই। আমরা ঝিনেদা পৌঁছে ওয়াপদার রেস্ট হাউসে উঠলাম। রেস্ট হাউজে গিয়ে দেখি গরম ভাত এবং গােশত পরে আছে কিন্তু কোন লােক নেই । বুঝতে পারলাম এরা রিট্রিট করেছে। এখানে আছেন এস,ডি,পি,ও মাহবুব উদ্দীন এবং লেঃ মতিউর রহমান। এরা সবাই অপারেশনে আছেন এবং ফ্রন্টে যুদ্ধ করছেন। এ মুহূর্তে তারা কোথায় কি অবস্থায়। যুদ্ধ করছে জানতে পারিনি। আমরা আবার রওয়ানা হই, চুয়াডাঙ্গা পৌছাতে রাত ১০টা বাজলাে। চুয়াডাঙ্গায় পৌছে মেজর ওসমানের সঙ্গে দেখা করলাম। ওসমান চৌধুরী সাহেব আমাদের ডাক বাংলায় থাকতে বললেন। পথে আমাদের কোন। খাওয়া-দাওয়া হয়নি। রাতে মুক্তিযােদ্ধা কর্মীরা খিচুরী খাওয়ালাে। রাত কাটিয়ে সকালে আওয়ামী লীগের লিডার ডাঃ আসাব উদ্দীনের সঙ্গে দেখা করলাম। এখানে। তখন দু’একজন লােকাল লিডারও ছিলেন। উনারা বললেন মেহেরপুর যান। মেহেরপুরে যুদ্ধ চলছে। যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছেন তৌফিক এলাহী সাহেব-মেহেরপুর এর এস.ডি.ও.। উনার সঙ্গে দেখা করলে খুবই উৎসাহিত হলেন, আমাদের ক্যাম্প এ যেতে বললেন। আমরা ক্যাম্পে গিয়ে আশ্রয় নিলাম। দুপুরে খেয়ে দেয়ে যা টাকা পয়সা ছিল ফুরিয়ে গেল। এখন ভরসা রইলাে ক্যাম্পের খাবার উপরেই। আমরা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে ভাবতে থাকলাম এখানে লােকাল পিপল এবং লিডারদের নিয়ে একটা মিটিং করার প্রয়ােজন। এ উদ্দেশ্যে ১৪ই এপ্রিল আমরা স্থানীয়ভাবে একটা। মিটিং ডাকি। এ মিটিং-এ কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক সামসুল হক, পাবনার জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের যােগ দিলেন। মিটিংয়ে এখানকার সভাপতি হিসেবে নির্বাচিত করা হলাে পাবনার ডি.সি. নূরুল কাদের সাহেবকে। উনি অত্যন্ত আত্মবিশ্বাসী এবং যুদ্ধ সম্পর্কে দৃঢ়প্রত্যয় ব্যক্ত করলেন। বক্তৃতায় বললেন আমাদের কাছে যা আছে এবং আমরা যারা আছি এরাই গেরিলা কায়দায় প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারব। চেয়ারম্যান হিসেবে তিনি অত্যন্ত জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে। সবাইকে উদ্বুদ্ধ করলেন। আমরা দৃপ্ত শপথ নিলাম মেহেরপুর বাঁচানাের জন্য। আমরা যখন মেহেরপুরে যুদ্ধের জন্য এভাবে সর্বাত্মক প্রস্তুতী গ্রহণ করছি ঠিক। তখনই আমাদের উপর নির্দেশ এলাে রিট্রিটের জন্য। অর্থাৎ মাত্র ১ দিন পরই তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের ভারত ফিরে যাবার নির্দেশ দিলেন। আমরা যেভাবে মেহেরপুরে যুদ্ধের প্রস্তুতী নিয়েছিলাম তাতে খুবই আত্মপ্রত্যয়ী ছিলাম। মরণপণ লড়াইয়ের জন্যই ছিল আমাদের প্রতিজ্ঞা। তাছাড়া শুরু থেকেই কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গায় ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে আসছে। তাই এখানে ওদেরকে প্রতিরােধ করা ছিল একান্ত প্রয়ােজন। এখানে ওদের প্রতিরােধ না করতে পারলে আমাদের সীমান্ত পথ নিষ্কন্টক হবে না। কিন্তু কি করা যাবে, কেন্দ্রীয় নেতার নির্দেশ আমাদের মানতেই হবে। অতঃপর আমরা ওয়ার কাউন্সিল ডিসলভ করে ভারত যাবার প্রস্তুতী। নিলাম। কেবলমাত্র স্বদেশ ত্যাগ করলেই দেশের গভীরে যে মমতার শেকড় ডুবে থাকে তা। উপলব্ধি করা যায়। আমরা অবশেষে ভারত অভিমুখে যাত্রা করলাম। সীমান্তে পা রেখে একবার পেছন ফিরে তাকালাম প্রিয় মাতৃভূমির দিকে। দেশের আর এক ইঞ্চি মাটিও পায়ের নীচে রইল না। চিরায়ত সৌন্দর্যের লীলা ভূমি সুজলা সুফলা। মাতৃভূমি পূর্ববাংলাকে পেছনে ফেলে চললাম। জানি না এ মাটিতে আর কখনাে ফিরে আসতে পারব কিনা? দেখতে পাব কিনা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ পৃথিবীর বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। তবে আমাদের নিশ্চিত বিশ্বাস ছিল
এদেশ স্বাধীন হবেই। আজ হােক আগামী কাল হােক এই ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে আমরা মুক্তি পাবই ইনশাআল্লাহ। যাবার প্রাক্কালে আমাদের কর্মী আতাউর রহমান এম,পি মাগুরা এবং ডি,সি নূরুল কাদের সাহেবের একজন সিপাহী কান্নায় ভেঙ্গে পড়লাে। আমরা তাদের সান্ত্বনা দিলাম। এই আতাউর রহমান এম.পি পরবর্তীকালে ভারত থেকে আর ফিরে আসেনি। ভারতের মাটিতেই তিনি মারা যান। আমরা একেবারেই নিঃস্ব রিক্ত অবস্থায় ভারত রওয়ানা হলাম। এস,ডি,ও অলিউল ইসলাম সাহেব চিন্তা করলেন আমরা যদি ডি.সি নূরুল কাদের সাহেবের সঙ্গ পাই তাহলে কিছু একটা ব্যবস্থা হবে। এই Understanding এ আমাদের যাত্রা শুরু হলাে। বেতাই বর্ডার দিয়ে ঢুকে প্রথমে উনি বি.এস.এফ-এর কাছ থেকে আমাদের সেইফ করে নিলেন; কিন্তু আমার কাছে একটা এস.এম.জি ছিলাে, বর্ডার ক্রস। করার পর বি,এস,এফরা আমার এস.এম.জিটা সিজ করে নিয়ে নিলাে। এতে করে আমার খুব দুঃখ লাগলাে। আমি শেষ সম্বল টুকু হারানাের বেদনায় রীতিমত কেঁদে ফেললাম। কিন্তু বি,এস,এফ, এর সদস্যরা আমাকে বােঝালাে ভারতের অভ্যন্তরে নকশাল বাহিনী আছে। তারা এ সমস্ত অস্ত্র কেড়ে নিবে। আপনার দুঃখ করার কিছু নেই। আমি কিছুটা সান্ত্বনা খুঁজে নিলাম। আর্মস দিয়ে আবার রওয়ানা হলাম। আমরা সবাই তখন নূরুল কাদের সাহেবকে ফলাে করছি। উনি আমাদের গাইড . এবং নেতা হিসেবে কাজ করছেন। রাত ১১টা নাগাদ আমরা কৃষ্ণনগর পৌছলাম। নূরুল কাদের সাহেব প্রথমেই। আমাদের ডি,সি কৃষ্ণনগর এর বাসায় নিয়ে গেলেন। কৃষ্ণনগরের ডি.সি, আমাদেরকে ডাক বাংলােয় থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। আমি আসাদুজ্জামান এম.পি, আতাহার আলী এম.পি, ডি.সি, নূরুল কাদের প্রমূখ। ডাক বাংলােয় উঠলাম। থাকার বন্দোবস্ত আপাতঃ বেশ ভালই হলাে। কিন্তু খাবার। পাব কোথায়? কয়েকদিনই অনাহার অর্ধাহারে কেটে যাচ্ছে। রাতে খুব ক্ষুধা লাগলাে। আসাদুজ্জামান ১০টি টাকা দিলেন। সে টাকা এক্সচেঞ্জ করে ভারতীয় মুদ্রা পেলাম ৭ রুপী। তাই দিয়ে কোন মতে ভাত খেয়ে ক্ষুন্নি বৃত্তি করলাম। ভীষণ ভাবে হতাশ হয়ে পড়লাম। কি হবে, কিভাবে বাচবাে? কোথায় পাব টাকা পয়সা, অস্ত্রশস্ত্র? তবু সামনে ছিল একটিই আদর্শ, যুদ্ধ করতে হবে, যুদ্ধ করেই মুক্তি অর্জন। করব। এর কোন বিকল্প নেই। তাই শেষ পর্যন্ত আশায় বুকে বেঁধে পড়ে থাকি। মনকে সান্ত্বনা দিই একদিন শত্রুমুক্ত দেশে ফিরতে পারলে জীবনের এসব দুঃখ বেদনা ঘুচে যাবে।
১৫ই এপ্রিল সােহরাব সাহেব এলেন। উনি এখানে এক এরিয়া লিডার এর কাছে। আমাকে পাঠালেন। তার কাছে মাগুরার খবর আদান প্রদান করতে হবে। অন্য দিকে সােহরাব সাহেব কিছু টাকা দেওয়ার জন্যও বলে দিলেন। এই আনসার এ্যাডজুটেন্ড এর কাছ থেকে আমি দুই হাজার টাকা নিয়ে এলাম। এটা আবার। কারেন্সী করতে আমাকেই পাঠালেন। এ্যাডজুটেন্ড তখন মুর্শিদাবাদের তেহাট্টা নামক এক স্থানে থাকেন। যা হােক আমার সাথে আর একটি ছেলেকে দেয়া হলাে। এই ছেলেটি দেশে থাকতে আমার সাথেই ব্যবসা বাণিজ্য করত। আমাকে পেয়ে ও খুবই আনন্দিত। মনের অনেক জ্বালা দুঃখ কষ্ট নিয়ে আমার সাথে আলাপ করল। ১৬ই এপ্রিল বাংলাদেশে যাবার প্রস্তুতী নিচ্ছি। ১৭ই এপ্রিল মুজিব নগর উদ্বোধন এবং বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকার গঠন হয়। কিন্তু দুঃখিত আমাকে থেকে যেতে হলাে। সােহরাব সাহেব আসাদুজ্জামান সবাই গেলেন। এরপর আমরা কলকাতায় প্রিন্স অফ স্ট্রীট এম.পি হাউসে উঠলাম। এখানে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা উঠেন তারপর কেউ কেউ অন্যত্র অবস্থান নিয়েছেন। এখানে এসে মিজানুর রহমান চৌধুরীসহ অনেকের সঙ্গেই দেখা হলাে। এক রুমে দুই সীট এক সীটে সােহরাব সাহেব অন্য সীটে প্রফেসর ইউসুফ। সাহেব। আমি প্রফেসর ইউসুফ সাহেবের সঙ্গে রইলাম। প্রফেসর ইউসুফ রাত্রে সােহরাব সাহেবকে বললেন কামরুজ্জামান ভাইকে বর্ডারে। পাঠিয়ে দিন। উনি যােদ্ধা মানুষ এখানে থেকে কি করবেন? ওখানে গেলে বাংলাদেশের অনেক যুবকদের পাবেন তাদের সংগঠিত করে দেশের মধ্যে কিছু অপারেশনও করতে পারবেন’। সােহরাব সাহেব সেই মােতাবেক আমাকে অনুরােধ করলে আমি বনগাঁ চলে গেলাম। বনগাঁয় গিয়ে আমার সঙ্গে দেখা হলাে ঝিনাইদহের এস.ডি.পিও মাহবুবউদ্দীনের সঙ্গে। উনি এখানে যুদ্ধ করছেন, যুবকদের সংগঠিত করছেন। আমি এলে মাহবুব উদ্দীন সাহেব খুবই খুশী হলেন। আমাকে অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথেই গ্রহণ করলেন। মাহবুব সাহেব আমাকে বেনাপােল কাস্টমস হাউজে যেতে অনুরােধ করলেন। এখানে আমাদের অনেক ই.পি.আর সৈন্য, ছাত্র এবং নেতারা আছেন। তখন এখানে প্রায় ২০০/২৫০ জন ছাত্রই ছিল। সবাই যুদ্ধের প্রস্তুতী নিচ্ছে। কিন্তু এদের তেমন কোন প্রশিক্ষণ ও ভারী অস্ত্র নেই। তবু এদের ব্যাপক উৎসাহ উদ্দীপনা দেখে আমার খুব ভালাে লাগলাে। আমি এদের উদ্দেশ্যে উৎসাহ মূলক বক্তৃতা দিলাম । ২৩শে এপ্রিল আমাদের ফল-ইন হলাে আর্মি কায়দায়। এরপর
আমরা পরবর্তী প্রােগ্রামের জন্যেও সমবেত হলাম। এ সময় ই.পি.আর এর একজন হাবিলদার নাম মুজিবর রহমান সবার উদ্দেশ্যে খুবই জ্বালাময়ী বৃক্ততা করলেন। তিনি বললেন “দেখুন অফিসাররা কখনাে ফিল্ডে ফ্রন্টে যুদ্ধ করেন না। যুদ্ধ করে সাধারণ সিপাহীরা। প্রিয় বন্ধুরা; যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে। আমরাই যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করব। অতএব সকলেই মনে মনে জান কোরবাণীর জন্য প্রস্তুত থাকুন। এই বৃক্ততার পর সবার মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার সঞ্চার হলাে। যুদ্ধের জন্য সকলের মধ্যে গভীর আগ্রহ। ২৪শে এপ্রিল আমরা বেনাপােলের অদূরে পাক সেনাদের একটা অবস্থানের উপর হামলার প্রস্তুতী নিলাম। সকাল বেলাই ফ্লাংক করে আমরা পজিশন নিলাম। ফিল্ডে আমি রাইট ফ্লাংক পেলাম। পাকবাহিনী ছিল ভারী অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত । ওরা আমাদের অদূরে পূর্ব দক্ষিণ কোন ধরে পজিশন নিল। এরপর জীপের সাহায্যে আর,আর, বােমা নিক্ষেপ করতে লাগলাে। এই বােমার প্রচন্ডতা এত ছিল যে এক একটা আঘাতে বড় বড় পুকুর সৃষ্টি হয়ে। যাচ্ছিলাে। আমরা ফ্লাংক পরিবর্তন করে পুনরায় পজিশন নিলাম। ফায়ার দিয়ে যাচ্ছি অনবরত কিন্তু তেমন কিছুই করতে পারছি না। ক্রমশঃ দুপুর হয়ে এলে, ই.পি.আর এর একজন হাবিলদার এল.এম.জি কাঁধে নিয়ে আমার ফ্লাংক-এ এসে। বললেন কি ব্যাপার আপনারা এখনও আছেন? আমরা অনেক আগেই ফ্লাংক ছেড়ে দিয়েছি। আমাদের মধ্যে অনেকেই মারা গেছে। পিছু হটে যান নইলে মারা পড়বেন। খুব দুঃখ ভরা মন নিয়ে অবশেষে ফিরে এলাম। খুব উৎসাহ থাকা সত্ত্বেও আমাদের ব্যর্থ হয়ে ফিরতে হলো। ইতােমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল আতাউল গণি ওসমানীকে নিয়ে তাজউদ্দীন সাহেব আমাদের মধ্যে এলেন। উনি তখন বিপ্লবী সরকারের। প্রধানমন্ত্রী । আমরা আগে থেকেই অপেক্ষা করছিলাম সরকার গঠিত হওয়ার জন্য। কেননা সরকার গঠিত হলে বৈদেশিক সমর্থন ও সাহায্য পেতে সুবিধা হবে। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধ সঠিক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য অচিরেই বিপ্লবী সরকার গঠন ছিল একান্ত অপরিহার্য। সরকার গঠন হলে ধীরে ধীরে সব অসুবিধা দূর হবে, একটি সুষ্ঠু সমন্বয় ব্যবস্থা গড়ে উঠবে। এটাই ছিলাে আমাদের প্রত্যাশা। কিন্তু জানি না আমাদের প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ হচ্ছে? আমাদের দুঃখ কষ্ট দেখে তাজউদ্দীন সাহেব অনেক সান্ত্বনা দিলেন। স্বাধীনতা যুদ্ধ। করলে কষ্ট ও ত্যাগ স্বীকার এবং অসুবিধার মুখােমুখি হওয়াটা স্বাভাবিক। সবকিছু পরিহার করে স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যেতেই হবে। যুদ্ধ মানেই কষ্ট, জীবন বাজি রাখা। ধৈর্য্য ধরে সব কিছুর মােকাবিলা করতে হবে। বঙ্গবন্ধু কোথায় আছে তখনও আমরা জানি না। বঙ্গবন্ধুর কথায় সবারই চোখ। ছলছল করে ওঠে। উনারা সান্ত্বনা দেন বন্ধু আমাদের সাথেই আছেন।
তাজউদ্দিন সাহেবের নির্দেশে পরবর্তীতে আমরা ব্যাগ এন্ড ব্যাগেজ আবার বনগাঁ। যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। রাস্তার এক পাশ ধরে আমরা বনগাঁর দিকে অগ্রসর হচ্ছি, রেল ষ্টেশনে এসে দেখলাম Indian army Arms নিয়ে আমাদের সাহায্যার্থে অগ্রসর হচ্ছে। পথে আমাদের সাথে দেখা হলে তারা আমাদের অভয় দিয়ে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পরামর্শ দিলেন। এবং সর্বতাে সাহায্যের ও আশ্বাস জানিয়ে বললেন ভয় নেই তােমাদের পেছনে আমরা আছি । ওদের বড় বড় কনভয় আর রেলের ওয়াগনে সুসজ্জিত অবস্থায় দেখে বুক ভরে গেল আমার। অনেক স্বপ্ন চোখের তারায় দুলছে। অবশ্যই আমরা স্বাধীন হব। আমরা এখন শুধু একটি বাস্তহারা উদ্বাস্ত জাতি নই। আমাদের অনেক বন্ধু আছে। তারা প্রয়ােজনে যে কোন সাহায্য করবে। আমাদের। আমার সহযােদ্ধা প্রশিক্ষণার্থী সবাই হর্ষোৎফুল্ল। সন্ধ্যে নাগাদ পেট্রোপােল হাইস্কুলে এসে উঠলাম। রাতে সমস্ত আর্মস ক্লোজ করলাম। তারপর একটা অস্থায়ী আর্মারী তৈরী করে সেখানে সমস্ত অস্ত্র জমা করলাম। এরপর সেনাবাহিনীর নিয়মে আর্মারীতে পর্যায় ক্রমিক ডিউটি দিলাম। আমাদের মধ্য থেকে বেছে বেছে যুবকদের নিয়ে একটি ডিউটি রােস্টার করলাম। এতে করে। পরিবেশটা সুশৃঙ্খল হলাে। আমার সাথের সমস্ত ছাত্র যুবক নেতাদের নিয়ে এই এই একটি স্কুলে জায়গা সংকুলান হচ্ছিলনা। ফলে কিছু সংখ্যক ছাত্র নিয়ে পাশের এক প্রাইমারী স্কুলে আশ্রয় নিলাম। ভারতে আসা অবধি প্রতিদিনই ক্ষুধার কষ্ট করছি। বিভিন্ন জায়গায় প্রচুর শিবির, আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে। সুষ্ঠু যােগাযােগ, ব্যবস্থাপনার অভাবে প্রতিটি ক্যাম্পে নানা রকম সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। এর মধ্যে অন্যতম সমস্যা খাদ্যও পানি। সংকট। ভারত সরকার ও স্থানীয় জনগণ সাহায্যের হাত প্রসারিত করেছে। তারা যথেষ্ট সাহায্য করছে আমাদের। কিন্তু এত ব্যাপক পরিসরে কোন নেট ওয়ার্ক গড়ে উঠতে পারছেনা, ফলে এক যােগে সমাধান সম্ভব হচ্ছে না। আমরা একটা অপারেশন শেষ করে এত দূর থেকে পায়ে হেটে এসে অত্যন্ত ক্লান্ত এবং ক্ষুধার্ত হয়ে পড়েছি। কিন্তু হঠাৎ করে রাতে এত লােকের খাবার যােগাড় সম্ভব নয়। আমাদের যার সাথে যা সামান্য চিড়া, মুড়ি, গুড় ছিল তাই খেয়ে। কোনমতে ক্ষুন্নিবৃত্তি করলাম। তাছাড়া আমাদের মধ্যে সেই হাবিলদার মুজিবর রহমান মিনি জ্বালাময়ী বক্তৃতা করে সবাইকে উদ্বুদ্ধ করেছিলেন তিনি এবং তার একজন সহযােগী যােদ্ধা মারা যান। আমরা এদের ডেড বডি পর্যন্ত আনতে পারিনি। সবাই ছিলাম তাই শােকে মূহ্যমান। আর এই অপারেশনে নেতৃত্ব দেন। মেজর ওসমান (পরবর্তীতে কর্নেল) চৌধুরী। এরপর ঘুমানাের পালা; বিছানা বালিশ মশারীতাে দূরের কথা। সামান্য মাথা গোঁজার মত একটু খানি জায়গাই ছিল তখন বড় কথা। স্কুলের বেঞ্চগুলি কয়েকটি একত্রিত করে করে তার উপর। ৫/৭ জন করে শুয়ে কোনমতে রাতটা কাটিয়ে দিলাম। পরদিন সকালে ফল-ইন হলাে। সকাল ৮.০০ টার সময় আমরা রিপাের্ট করলাম ইতােমধ্যে জানতে পারলাম ‘বাংলাদেশ সাহায্য সংস্থা’ নামক একটি আশ্রয় কেন্দ্র হয়েছে। এখানে অনেক বাঙালী ছাত্র-যুবক নেতারা আছেন। এদিকে আমাদের। অপারেশনের পর অস্ত্র জমা নিয়ে নেয়া হলাে। তৎকালীন মেজর আবু ওসমান চৌধুরী (বর্তমান অবঃ লেঃ কর্ণেল) ইনি ছিলেন ক্যাম্প ইনচার্জ । আমাদের সব অস্ত্র জমা নিয়ে নিলেন। কেননা আশপাশে নকশাল পার্টি আর্মস সিজ করে নিতে পারে। ভেবে এ ব্যবস্থা নেয়া হলাে। অতঃপর আমরা সিভিলিয়ান হয়ে গেলাম। বনগাঁ কালি বাবুর বাড়ী নামক স্থানে একটা শিবির তৈরি হয়েছে। আমরা সে শিবিরে গিয়ে উপস্থিত হলাম। এখানে এসে অনেক নেতা কর্মীদের সঙ্গে সাক্ষাত হলাে। এর মধ্যে ফরিদ পুরের ওবায়দুর রহমান, যশােহরের নূরে আলম সিদ্দিকী প্রমূখ ছিলেন। এই শিবিরটির ব্যবস্থাপনা ছিল বেশ সুষ্ঠু ও সুশৃংখল । নিয়মিত খাবার এবং রেশনিং এর ব্যবস্থা আছে। কেন্দ্রের সাথে নিয়মিত যােগযােগ এর ব্যবস্থা আছে। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতা ভারত সরকারের সংশ্লিষ্ট সমন্বয়কারী গণ খোঁজ খবর রাখছেন। এত দিন পর একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। দু’একটা দিন বেশ স্বস্তিতেই কাটিয়ে দিলাম।
প্রশিক্ষণ শিবির গঠন ও যােদ্ধা তৈরীতে.আমার ভূমিকা আমি সৈনিক মানুষ রক্তে আমার দ্রোহের উম্মাদনা। যেভাবে নির্যাতিত নিঃস্ব রিক্ত হয়ে দেশ থেকে বিতারিত হয়েছি তা শুধু পালিয়ে জীবন রক্ষার জন্য নয়, আত্মরক্ষার জন্য নয়, দু’বেলা দুমুঠো খেয়ে আপাতঃ বেঁচে থাকার জন্য নয়। অস্ত্র হাতে যুদ্ধের শপথ নিয়ে মাতৃভূমি ত্যাগ করেছি। অতএব এখনও একমাত্র প্রতিজ্ঞা। অস্ত্র হাতে যুদ্ধ করেই মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করব। আমি প্রথমেই যেটা ফিল। করলাম সেটা হলাে প্রশিক্ষণ। সুষ্ঠু সুন্দর প্রশিক্ষিত একটি বাহিনী গড়তে পারলে অস্ত্র পাওয়া যাবে। আর অস্ত্র পাওয়া গেলে প্রতিটি বাঙালী আপ্রাণ যুদ্ধ করবে। দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির জন্য এরা জীবন দিতে প্রস্তুত আছে। মনে এই সংকল্প করে আমি একদিন পাশের গার্লস স্কুলের মাঠে প্রায় ৪/৫শ ছাত্র-যুবকদের নিয়ে সমবেত হই। গভীরভাবে লক্ষ্য করলাম প্রত্যেকের মধ্যেই আছে প্রচন্ড হতাশা। দেশের মায়া ত্যাগ করে এরা জীবন নিয়ে পালিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের মধ্যেই দেশে ফেরার তীব্র বাসনা। অথচ দেশ শত্রু কবলিত। এদের মধ্যে কেউ বাবা হারিয়েছে কেউ ভাই-বােন-মা। এভাবে স্বজন হারানাের ব্যথা প্রায় সবার বুকে বাজছে। তাই দ্রোহের আগুনে সবাই প্রতিশােধের নেশায় জ্বলছে। আমার প্রশিক্ষণ দেয়ার প্রস্তাবে। স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে সকলে সাড়া দিল। পরবর্তীতে সম্পূর্ণরূপে নিজস্ব উদ্যোগে আমি ক্যাম্প সংলগ্ন স্কুলের মাঠে প্রশিক্ষণ শুরু করি। যেহেতু প্রতিটি যুবকের মধ্যেই স্বাধীনতা এবং দেশকে শত্রুমুক্ত করার ব্যাপারে ডিভােশন ছিল, ফলে খুব স্বল্প সময়ের মধ্যেই এরা বিভিন্ন যুদ্ধ কৌশল রপ্ত করে। ফেলে। প্রতিদিনই বিভিন্ন জায়গা থেকে প্রশিক্ষণার্থীরা আসতে লাগলাে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে ট্রেনিং নিতে থাকে। আমার প্রশিক্ষণার্থী ৫০০ থেকে ক্রমে হাজার তারপর দু’হাজার এবং শেষ দিকে ৫ হাজারে গিয়ে উন্নীত হলাে। বলা বাহুল্য। আমার আগে তখন অন্য কোন ক্যাম্পে এভাবে প্রশিক্ষণ দেয়ার ব্যবস্থা শুরু হয়নি। আমার এই ট্রেনিং-এ অল্প সময়ের মধ্যে একটি সুশৃংখল বাহিনী গড়ে উঠছে। ইতােমধ্যে এই ট্রেনিং ক্যাম্পের খবর বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। পশ্চিম বাংলার রাজ্য সরকারের পদস্থ কর্মকর্তা নেতা এবং বাংলাদেশ বিপ্লবী সরকারের নেতারা আমার ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শনে আসেন। এদের মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক কর্নেল ওসমানী ও ক্যাপঃ সালাউদ্দীনও আমাদের ক্যাম্পে আসেন। আমাদের ক্যাম্পে খাবার এবং সাহায্য ব্যবস্থা মােটামুটি ভাল ছিল। বাংলাদেশ সাহায্য সংস্থা নামে এই শিবিরে ভারতের মােট ৮টি দল সাহায্য করত। প্রথম। দিকে প্রশিক্ষণার্থী যারা আসত সবাইকেই নিয়ে নেয়া হতাে। কিন্তু পরবর্তীতে
জায়গার সংকুলান হচ্ছিল না, ফলে ক্যাম্পের সীমাবদ্ধতার কথা চিন্তা করে বাছাই করে করে শক্ত সামর্থ উৎসাহী যুবকদেরই ট্রেনিং-এর জন্য মনােনীত করা হতাে। প্রথম প্রথম আমি একাই প্রশিক্ষণ পরিচালনা করছিলাম। কিন্তু ক্রমান্বয়ে যখন ট্রেইনীর সংখ্যা বাড়তে থাকলাে তখন একার পক্ষে আর কুলিয়ে ওঠা সম্ভব হচ্ছিল । তখন এয়ার ফোর্সের করপােরাল কবির (পরবর্তীতে উইং কমান্ডার) এসে। যােগ দিলে উভয় মিলে প্রশিক্ষণ স্কুল তৈরি করি। করপােরাল কবির ছিলেন একজন অত্যন্ত দক্ষ সেনা। সব বিষয়েই তার চমৎকার অভিজ্ঞতা ছিল। পরবর্তীতে আর্মির একজন হাবিলদার, পুলিশের হাবিলদার নিয়ে এভাবে ক্রমান্বয়ে ১৫ জন। ইন্সট্রাকটর নিযুক্ত করলাম। আমি প্রথমে চীফ ইন্সট্রাকটর হিসেবে কাজ করি পরে লেঃ মতিউর রহমান ক্যাম্প ইনচার্জ হলে আমাকে করা হলাে ওয়ারেন্ট অফিসার। শেষ পর্যন্ত আমাদের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যােদ্ধার সংখ্যা ৫ হাজারে উন্নীত হলাে। আমরা প্রশিক্ষণের সাথে সাথে বিভিন্ন রকম প্রােগ্রাম ও দিতে থাকলাম। আমাদের জায়গার যখন আর সংকুলান হচ্ছিল না তখন শিবির এক্সটেনশন করে টালি খােলায় ক্যাম্প করলাম। এখানে বিরাট জায়গা খােলা ক্যাম্প-এর মধ্যে রান্নার জায়গা থাকার জায়গা সব আলাদা আলাদা করে নিলাম। হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম যশােরের মশিউর রহমান এম,পি,কে পাক বাহিনীরা ধরে নিয়ে নির্মমভাবে বেয়ােনেট চার্জ করে হত্যা করেছে। শুনে ভীষণ দুঃখ পেলাম। সারাটা ক্যাম্পেই এই ঘটনায় শােকের ছায়া নেমে এলাে। মশিউর রহমান ছিলেন একজন বলিষ্ঠ নেতা। তার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত সফল ও কার্যকর। ব্যক্তি জীবনে নির্মোহ এই ব্যক্তিত্ব সেদিন অন্য সবার মত না পালিয়ে দেশের। অভ্যন্তরে রয়ে গেলেন। এখানেই তিনি যুদ্ধের সপক্ষে জনমত গঠন করবেন মুক্তি যােদ্ধাদের সংগঠিত করে যুদ্ধ পরিচালনা করবেন। কিন্তু দেশীয় দালাল রাজাকারদের সহায়তায় পাকবাহিনীরা তাকে ধরে নিয়ে নির্মম ও পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করলাে। কিছু দিন পর আমাদের পাশের ক্যাম্পে বাংলাদেশ থেকে যাত্রা দলের কিছু মহিলা। এসেছে। তারা এসেই নানাভাবে শিবিরের যুবকদের প্রলুব্ধ করতে থাকে। শিবিরে অধিকাংশই যুবক; তারা সহজাত কারণে ওদের দিকে ঝুঁকে পড়তে থাকে। এতে করে আমার স্বাভাবিক কার্যক্রম দারুণভাবে ব্যাহত হয়। যে আদর্শের জন্য আমরা মাতৃভূমি ত্যাগ করে এসে জীবন মরণ লড়াইয়ে লিপ্ত হয়েছি তা যদি এই জাতীয়
ছােটখাট ঘটনা দ্বারা বিঘ্নিত হয় তাহলে নির্মম দুঃখ ছাড়া আর কি থাকতে পারে? দুঃখ এবং ক্ষোভ নিয়ে আমি এ্যাকশনে গেলাম। আমাদের ক্যাম্পে এস.ডি.ও সাহেবের ড্রাইভার ছিল সে এ ঘটনার সঙ্গে জড়িয়ে পড়ে। পরে ঘটনা তদন্ত সাপেক্ষে এই ড্রাইভারসহ কয়েকজনকে আমি ক্যাম্প থেকে তাড়িয়ে দেই। এবং ঐ মহিলাদেরও অন্যত্র স্থানান্তরের ব্যবস্থা করলাম। এভাবে উক্ত ঘটনার নিরসন হলাে। প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত যােদ্ধারা ক্রমান্বয়ে যুদ্ধের জন্য খুবই আগ্রহী হয়ে ওঠে। তারা তখন তারুণ্যে দীপ্ত তাই রক্তে বিদ্রোহের তীব্র ঝলকানি, ওরা মুক্তি পাগল হয়ে উঠেছে। ইতােমধ্যে একদিন কর্নেল ওসমানী এবং ক্যাপঃ সালাউদ্দীন এসে জানালেন। উনাদের অপারেশনের জন্য কিছু ভাল ছেলে প্রয়ােজন। মােক্ষম সময় এলাে, এরা যে যােদ্ধা হিসেবে সুশিক্ষিত এবং সুসংগঠিত হয়েছে তা প্রমাণের জন্য এটা ছিল একটা চমৎকার সুযােগ। আমি এই সময়ের জন্যই মনে মনে অপেক্ষা করছিলাম। কর্নেল ওসমানীর এই অপারেশনের জন্য আমি ক্যাম্প থেকে ৩৬জন প্রশিক্ষিত মুক্তিযােদ্ধাকে মনােনীত করলাম। এদেরকে দুটি রাইফেল কয়েকটি বেয়ােনেট এবং একটি পিস্তল দিয়ে বাংলাদেশের ১০ মাইল অভ্যন্তরে পাঠানাে হলাে। অত্যন্ত সাহসের সঙ্গে গেরিলা কায়দায় এরা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে স্বাধীনতা বিরােধী রাজাকার ধরে নিয়ে এলাে। এতে প্রমাণ হলাে এরা এই স্বল্প সময়ের প্রশিক্ষণে যে। সাহসিকতার পরিচয় দিয়েছে তাতে আরাে ভাল প্রশিক্ষণ পেয়ে দীর্ঘ সময় প্রাকটিস করতে পারলে খুবই ভাল করতাে। যা হােক এই ছােট্ট অপারেশন থেকে এরা খুবই প্রশংসিত হলাে। এটা ছিল এদের জন্য একটা এক্সপেরিন্টাল। অপারেশন। কিছুদিন পর ক্যাম্পে সােহরাব সাহেব এলেন। উনি জানালেন এখানে বাংলাদেশ সাহায্য সহায়ক কমিটিকে সাহায্য করার জন্য মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে একটা কমিটি হওয়া দরকার। এই কমিটি গঠিত হলে উনি নেতা হিসেবে এর চেয়ারম্যান। নির্বাচিত হলেন। এদিকে আমার ক্যাম্পে ফোর্সের বিভিন্ন পর্যায়ের লােক আসছেই। আবার একদিন কর্নেল ওসমানীর সঙ্গে এলেন মেজর ডালিম। ক্যাম্পে আমার প্রশিক্ষণার্থীদের দিয়ে সম্মানিত অতিথিদের গার্ড-অব অনার দিলাম । ওসমানী এবং ডালিম আমাদের । প্রশিক্ষণ দেখে খুবই আনন্দিত হলেন। মেজর ডালিম আমাকে বললেন ফাস্ট বেঙ্গল
রেজিমেন্ট গঠন করা হচ্ছে কিছু ভাল ছেলে প্রয়ােজন। আমি উত্তরে জানালাম। আমার শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে আপনার যা প্রয়ােজন নিয়ে নিন। উনি ফলইন করে বেছে বেছে ৫০ জন ছেলেকে নিয়ে নিলেন। আমার এখান থেকে ট্রেইন্ড মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন কমান্ডিং-এ নিয়ে নেয়া হতাে। সংশ্লিষ্টরা স্ব স্ব ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকা রাখতে চেষ্টা করছে। আমার উদ্দেশ্য ছিল একটাই; মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে তাদের গড়ে তােলা। তারপর কে কোথায় কাজ করবে তা হয়ত লিডার এবং কমান্ডিং-এ যারা আছেন তারাই ঠিক করবেন। ট্রেনিং চলছে এর মাঝে আবার এলেন আওয়ামী লীগ এর নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুর রাজ্জাক, তােফায়েল আহমেদ প্রমূখেরা। এরা এসেও কিছু সেনা চাইলে আমি বললাম প্রয়ােজনমত নিয়ে নিন। তারা যখন সেনা বাছাই করে নিয়ে যাচ্ছিলেন, জানতে চাইলাম এদেরকে কোথায় নেয়া হচ্ছে। পরে জানতে পারলাম এদের মধ্যে বিশেষ করে যারা ছাত্র লীগ নেতা আছে তাদেরকে দেরাদুন পাঠানাে হচ্ছে। আর্মি অফিসাররা এদের ট্রেনিং করাচ্ছেন। দেরাদুনে ট্রেনিং প্রাপ্তরাই পরবর্তীতে মুজিব বাহিনী হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আমিও এখানকার ডেডিকেটেড কিছু ছেলেকে উচ্চতর প্রশিক্ষণের জন্য নাম পাঠালাম উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে। তারা তখন গ্রান্ড করে সেনা চেয়ে পাঠান, পরবর্তীতে এদেরকে ভারতের চাকুলিয়ায় ট্রেনিং দেয়া হয়। এই ক্যাম্পে সিভিলিয়ান-এর পক্ষ থেকে ক্যাম্প ইনচার্জ ছিলেন ফরিদপুরের ওবায়দুর রহমান। সেখানে আমার সেনারা সাফল্যের সাথে ট্রেনিং গ্রহণ করে। বিভিন্ন ক্যাম্পেই আমার ট্রেইন্ড গ্রুপ বিশেষ কৃতিত্ব দেখাতে সক্ষম হয়েছিলাে। আমাদের ক্যাম্পে সামান্য ক্রটি বিচ্যুতি ছাড়া সব সময়ই ছিল সুশৃংখল পরিবেশ। এর মাঝে একদিন খাবার দিতে দেরী হলে আমরা খুব রাগারাগি করি। বিশেষভাবে সহযােদ্ধারা যশােরের সালাম, ‘জামাল, সাত্তার, এরা ছিল তখন খাবারের ইনচার্জ। কোন ব্যাপারে আমি রাগ করলেও পরবর্তীতে আবার ব্যবহার দিয়ে খুশী করার চেষ্টা করতাম। এতে করে তারা ভেতরে কোন রাগ বা দ্বন্দ্ব পুষে রাখতে পারেনা। লিডার হিসেবে এক সঙ্গে সবার মনরক্ষা করা সম্ভব নয়। তাই বিশেষ কায়দায় সবার সাথেই ভাল ব্যবহার করে যাওয়ার চেষ্টা করতাম। আজ লিখতে বসে বিশেষ ভাবে আমি কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা কর্মী এবং সাধারণ জনগণের প্রতি। তাঁরা যে আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা প্রদর্শন করেছে আমাদের প্রতি-তা কখনাে ভােলার
নয়। আমরা বিভিন্ন ভাবে এদের উত্যক্তই করেছি অথচ তারা ন্যূনতম বিরক্তি তাে। দূরের কথা হাসি মুখে সর্বাত্মক সহযােগিতাই দিয়ে গেছেন। এভাবে যখন আমার অধীনে দু’টি ক্যাম্পে প্রশিক্ষণ চলছে এবং প্রশিক্ষণার্থীর সংখ্যা প্রায় ৫ হাজার ছাড়িয়ে যাচ্ছে তখন আমাদের নেতা সােহরাব সাহেব লিখে পাঠালেন “জামান তুমি রানাঘাট চলে এসাে। এখানে প্রচুর ছাত্র যুবক বসে আছে। এদের ট্রেনিং দিয়ে তৈরী করতে হবে।” নির্দেশ মত আমি রানাঘাট চলে যেতে প্রস্তুতী নেই । কিন্তু আমার ক্যাম্পের অফিসার সেনা কেউ আমাকে ছাড়তে চায়না। তারা চোখের জল ফেলতে থাকে। এর মধ্যে ৭২টি ছেলেকে আমি কিছুতেই রেখে যেতে পারছিনা। যে করেই হােক তারা আমার সাথে যাবেই। আমি না থাকলে এরা। এখানে থাকবেনা। তখন বাধ্য হয়ে কল্যাণী আমাদের হেড কোয়ার্টারের মাধ্যমে এদেরকে চাকুলিয়া ট্রেনিং এর জন্য পাঠালাম। অতঃপর আমি রানাঘাট এসে ট্রেনিং শুরু করলাম। এখানেও ছাত্র যুবকদের মধ্যে। বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা। আমার ভাল লাগছে এই ভেবে যে, যে কটা ছেলেকে ট্রেইন্ড আপা করলাম তারাই মুক্তি যােদ্ধা হয়েছে। এরা কোন না কোন জায়গায় যুদ্ধ করবে দেশের সেবা করবে। এইতাে আমার পরম পাওয়া। সময় স্বল্পতার কারণে। পুরাে উদ্যমে একটা শর্ট কোর্স কমপ্লিট করালাম। এখানেও বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা তৈরী হলাে। এতদিন বিভিন্ন শিবিরে প্রশিক্ষণ দিয়ে আমার হাতে প্রায় ৭/৮ হাজার। মুক্তিযােদ্ধা তৈরী হয়েছে। যারা পরবর্তীতে প্রত্যেকে দেশে ফিরে প্রত্যক্ষ ভাবে স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে। এদের কেউ কেউ হারিয়ে গেছে চিরদিনের জন্য। কেউ পঙ্গু হয়ে বেঁচে আছে। কেউ কেউ সদম্ভে অর্থে বিত্ত বৈভব নিয়ে বসবাস করছে। কিন্তু একটা সত্য অন্তত কোন মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণ নিয়ে বসে থাকেনি।
সশস্ত্র মুক্তি যােদ্ধার বেশে স্বদেশ প্রত্যাবর্তন বাংলাদেশ থেকে আসা অবধি ছােট দু’একটা অপারেশন ছাড়া শুধু প্রশিক্ষণ দেয়ার কাজ করেছি। এতদিন ধরে যে বীজ বপন করেছি এবার এলাে তার ফসল কর্তনের সময়। অর্থাৎ এবার প্রশিক্ষণ শেষে দেশে ফেরার পালা। সশস্ত্র যুদ্ধ করতে হবে, দেশকে মুক্ত করতে হবে। মাতৃভূমি আজ তার যােগ্য সন্তানদের হাতছানি দিয়ে ডাকছে । সােহরাব সাহেব বললেন “জামান এবার দেশে ফিরে যাও। দেশের অভ্যন্তরে শক্রকে মােকাবিলা কর।” আমি তখন রানাঘাট থেকে বনগাঁ এলাম। শুনলাম মেহেরপুরের এস.ডি.ও তৌফিক এলাহী সাহেব কোম্পানী কমান্ডার বনগাঁ। উনাদেরকে আর্মি র্যাঙ্ক দেয়া হয়েছে। চৌধুরী তৌফিক এলাহী সাহেব অনেক মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে কাজ করছেন। আমি গিয়ে দেখলাম এখানে আমার অনেক ছাত্রই আছে। আমি এদের থেকে দেশে। কাজ করার জন্য ৮০ জন ছাত্রকে বেছে নিলাম । এলাহী সাহেবের সঙ্গে আলাপ করে আমার আশি জন ছাত্র অর্থাৎ মুক্তি যােদ্ধা নিয়ে আমি দেশে ফেরার জন্য। প্রস্তুতী নিলাম। বিদায়ের আগে আমাদের সকলকে সমবেত করে ইন্ডিয়ান এক অফিসার মেজর বাজুয়া বক্তৃতা করলেন “তােমরা ট্রেনিং নিয়ে দেশে ফিরছ আমরা আর্শীবাদ করি যুদ্ধ করে জয়ী হও মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত কর। সাথে সাথে তিনি। আমাদের কিছু পরামর্শও দিলেন। দেশে ফিরে তােমাদের টাকা পয়সার অভাব হলে। রাজাকার মুসলীম লীগ আল শামসূদের কাছ থেকে চার্দা সংগ্রহ করবে। কিন্তু কখনাে সীমা লংঘন করােনা। সর্বাবস্থায় সংগ্রামে অবিচল থাকেব। তােমাদের দেশ তােমাদেরকেই যুদ্ধ করে শক্র মুক্ত করতে হবে । আসার সময় তিনি আমাদের পথে খাওয়ার জন্য আটা ময়দা দিয়ে এক রকমের কেক তৈরী করে দিলেন। এবং দেশে পৌছানাের জন্য, যুদ্ধে ব্যবহারের জন্য একটা ম্যাপ দিলেন। এই ম্যাপে ছিলাে। কিভাবে মাগুরায় এবং শৈলকূপায় পৌছাবাে তার নির্দেশনা। অন্যদিকে শক্রর। অবস্থান সমূহ ও তাতে সম্ভাব্য আক্রমনের স্থানের নির্দেশনা। আমরা যারা প্রশিক্ষিত মুক্তি যােদ্ধা, অস্ত্র ও গােলা বারুদ নিয়ে দেশকে শত্রুমুক্ত করার দৃপ্ত অঙ্গীকার নিয়ে বাংলাদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম। পেছনে পড়ে রইলাে এতদিনের পুরনাে বন্ধুরা, ক্যাম্প আর স্বল্প সময়ের অজস্র স্মৃতি। ইন্ডিয়ান আর্মিরা আমাদেরকে স্কড করে ঝিনাইদহ জেলার মহেশপুর থানা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে গেলাে। ওরা চলে গেলে ম্যাপ এর সাহায্য নিয়ে অগ্রসর হচ্ছি। কিন্তু কয়েক মাইল অগ্রসর হওয়ার পর সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে। ক্রমশঃ রাত বাড়তে লাগলাে, অন্ধকার গাঢ় থেকে গাঢ়তর হচ্ছে। আর আমরাও পথের নিশানা ঠাহর
করতে না পেরে পথ হারাচ্ছি। কিছুদূর হাটার পর বুঝতে পারলাম আমরা সঠিক পথে যেতে পারছিনা। আশ পাশের এলাকায় লােকজনের সাহায্য চেয়েও পাচ্ছিনা। কেউ আমাদের পথ দেখাতে কিংবা সাহায্য সহযােগিতা করছেনা। মূলতঃ দীর্ঘদিন শক্রবেষ্টিত দেশে রাজাকার আলবদর আল শামসদের নিয়মিত যােগাযােগ ও তথ্য সরবরাহের কারণে প্রতিটি মানুষের মধ্যেই প্রচন্ড ভীতি এবং আতঙ্ক। এদের ধারণা মুক্তি যােদ্ধারা সামান্য অস্ত্র, শক্তি দিয়ে এত বিশাল সুসংগঠিত বাহিনীকে কখনাে হঠাতে পারবেনা। তাই তারা মনে মনে আস্থা হারিয়ে ফেলছিলাে। ফলে যে কোন মুক্তি যােদ্ধার নামেই তাদের আতঙ্ক। তাদের কোন সাহায্য করা পথ দেখিয়ে আনা। মানেই মৃত্যুকে নিশ্চিত আহ্বান করা। এজন্য এলাকার কোন মানুষই আমাদের সাহায্য করছেনা। অথচ অন্ধকার রাত; পথ চিনে চলতে পারছিনা। এ হেন বিপদ। সংকুল অবস্থায় আমি আলম নামে একজন মুক্তিযােদ্ধাকে ডেকে নির্দেশ দিলাম । আর্মস ঠেকিয়ে কোন লােককে বাধ্য কর সাহায্য করতে। এছাড়া আমাদের আর কোন উপায় নেই। এরা ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও পাক বাহিনীর ভয়ে আমাদের সাহায্য করছেনা। আমার নির্দেশ মত আলম এক লােককে অস্ত্র ঠেকিয়ে ভয় দেখাতেই সে রাজী হয়ে। গেলাে। অতঃপর লােকটি আমাদের গাইড হিসেবে পথ দেখিয়ে নিয়ে চললাে। এরপর আরও একজন লােককে এভাবে ম্যানেজ করলাম। আমরা দুজন গাইড পেয়ে গেলাম। সামরিক জীবনে দীর্ঘ দিন খালি পায়ে চলার অভ্যেস নেই। সিভিল জীবনে এই এক দেড় বৎসরেও খালি পায়ে হাটা পরেইনি বলা চলে। কিন্তু এখন হাটতে হচ্ছে। একে অন্ধকার, তারপর পথ উচু নীচু জল কাদায় পরিপূর্ণ, আমাদের খুবই কষ্ট হচ্ছিলাে। আর আমাদের গাইড দু’জন চলছিলাে ঝড়ের বেগে। তাদের সাথে। কুলিয়ে উঠতে আমাদের জীবন সংশয়াপন্ন হয়ে উঠছে। আমাদের লক্ষ্য কালিগঞ্জ পৌছানাে। কিন্তু এত কষ্ট করে রাতের অন্ধকারে পথ চলেও রাত ৩.০০ টার সময় বুঝতে পারলাম আমরা পথ হারিয়ে ভিন্ন পথে চলে এসেছি। আমরা যাব কালিগঞ্জ কিন্তু এসে পড়েছি কোটচাঁদপুর থানার সন্নিকটে। টেলিফোনের পিলার দেখেই হঠাৎ আমরা বুঝতে পারলাম ভুল পথে এসেছি। দুঃখে যন্ত্রণায় কষ্টে চোখে তখন অন্ধকার দেখছি। কিন্তু কি করা যাবে হাটতে তাে হবেই। আমরা পথ পরির্বতন করে ম্যাপ দেখে দুলাল মন্দিরের দিকে রওয়ানা হলাম। ভাের নাগাদ দুলাল মন্দির। পৌছলাম। এখানে এসে গাইডদের ছেড়ে দিলাম। ততক্ষণে ক্ষুধায় তেষ্টায় জীবন শেষ হবার উপক্রম প্রায়। রাস্তার পাশ থেকে ডাল রুটি কিনে খেয়ে আবার । দু’পায়ের উপর ভরসা করে পথ চলা শুরু করলাম। একটানা সারা দিন রাত হেটে
পায়ে ভীষণ ব্যথা হয়ে গেছে। কোন ক্রমে চলছি পা চলেনা। আর সময়টা ছিল আগষ্ট মাস তাই বৃষ্টি কাদায় কর্দমাক্ত গাঁয়ের পথ ঘাট । দুলাল মন্দির থেকে আমরা যখন পেছনের পথ দিয়ে মােবারক গঞ্জ এসে পৌছলাম, দেখলাম রাস্তায় পাক সেনারা কিছু শিখ সৈন্যের ডেড বডি ফেলে রেখেছে। কাজটা করেছে ভীতি প্রদর্শনের জন্য। আমরা খুব সাবধানে পথ চলছি। রাস্তার মাঝে মাঝে পাকবাহিনীর গাড়ীর শব্দ শুনছি। রাজাকার আল বদর বাহিনী দেখা যাচ্ছে। কিন্তু পরিকল্পনাহীন ভাবে আকস্মিক কোন আক্রমণ করা সম্ভব নয়। শক্রর আশপাশের অবস্থান সম্পর্কে আমরা এখনও জ্ঞাত নই। তাই সাবধানে পথ চলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। আমি সিদ্ধান্ত নিলাম প্রথমে আমরা হজিপুর মাগুরায় আমার ভগ্নিপতি জনাব শান্তি মিঞার বাড়ীতে যাব। সেখানে বিশ্রাম নিয়ে খাওয়া দাওয়া করব। মহেশপুর থেকে দুলাল মন্দির ৫০ মাইল । তখনও প্রায় ৩০মাইল পথ বাকী। পথ ভুল করার কারণে আমাদের উপর্যপুরী এত পথ হাঁটতে হচ্ছে। আমরা যখন মাগুরা আসছি। পথে দেখলাম এক হৃদয় বিদারক দৃশ্য। “প্রাণের ভয়ে হাজার হাজার শরণার্থী দেশ ত্যাগ করে ভারতের উদ্দেশ্যে যাচ্ছে। এরা প্রায় সকলেই পায়ে হেটে যাচ্ছে । বুদ্ধপঙ্গু-শিশু-কিশাের সব যাচ্ছে। ক্ষুধা তৃষ্ণার যন্ত্রণায় ছটফট করছে। এ ক’মাসে পাকিস্তানীদের নির্যাতনের সাক্ষ্য তাদের চোখে মুখে। হাড় বেড়িয়ে গেছে, চোখ কোটরাগত, শ্বাস প্রশ্বাস কোনমতে ঝরে পড়ছে। কঙ্কালসার দেহ টেনে টেনে তবু ছুটছে প্রাণপণে-গন্তব্য বুঝি জানা নেই। কোথায় কোন অজানার পথে ছুটছে এ কাফেলা। এমন বিরল ঘটনাও দেখা যাচ্ছে। অতিশয় বৃদ্ধ কিংবা বৃদ্ধাদের ঝাকায় ভরে মাথায় নিয়ে যাচ্ছে তাদের যুবক ছেলে কিংবা নাতিনরা। কঙ্কালসার কোন এক মহিলার পিঠে কাধে বুকে ঝুলে আছে তিনটি শিশু তাও আবার মরণ পথ। যাত্রী। এর মধ্যে একটি শিশু বাদুরের মত ঝুলে মায়ের খােলা বুকে দুধের বোটা চুষছে। এই মহিলার মাথায় আবার একটা বড় সাইজের বােচকী। ক্ষুধার তাড়নায় শিশুদের কান্নার এক মহারােল। কাঁধে লাঠি দিয়ে তার দু’পাশে দুই ঝাকায় নিয়ে যাচ্ছে শিশু বৃদ্ধাদের। ছােট শিশুদের পা ফেটে রক্ত ঝরছে তবুও জীবনের ভয়ে মা বাবাকে অনুসরণ করছে, ছুটতে চেষ্টা করছে। মাঝে মাঝে শােনা যায় গুলীর শব্দ; ঐ বুঝি পাকসেনারা আসছে। তখন যে এদের মধ্যে কি হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় চোখে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। একমাত্র পায়ের উপর ভরসা তাদের। ছুটছে সর্বস্ব ফেলে নিঃস্ব রিক্ত সর্বহারা হয়ে । আজ এরা আপন মাতৃভূমি থেকে উদ্বাস্তু। নিজ মাতৃভূমি থেকে এদের উচ্ছেদ করেছে বর্বর পাকসেনারা। পথে পথে বিভিন্ন সাহায্য সংস্থা এদেরকে গণখিচুরী খাওয়াচ্ছে সাহায্য করছে।” অনেক কষ্টে চরাই উৎরাই বন্ধুর পথ পার হয়ে যখন আমরা আলমখালী ব্রীজে এলাম। দেখলাম রাজাকাররা ব্রীজ পাহারা দিচ্ছে। বাধ্য হয়ে ব্রীজের পিছন দিক দিয়ে নীচে নেমে নৌকায় নদী পার হলাম। পরবর্তীতে হেটে এসে ইছেখাদা পুল
পার হয়ে আমরা হজীপুরের দিকে অগ্রসর হচ্ছি। আমাদের উদ্দেশ্য মাগুরা বােনের বাড়ীতে গিয়ে উঠব বিশ্রাম নেব। সেই ভােরে দুলাল মন্দির থেকে সবাই ডাল রুটি খেয়ে রওয়ানা দিয়েছি। তারপর একটানা হেটেছি, পেটে কোন দানা পানি পরেনি। অভূক্ত অবস্থায় অবিরাম চলছি। মাঝে মাঝে শক্রর ভয়ে এপথ ওপথ পরিবর্তন করে খুব সন্তর্পণে যাচ্ছি। বােনের বাড়ী ছাড়া অন্য কোন নির্ভরযােগ্য জায়গাও খুঁজে পাচ্ছি না যেখানে ৮০ জন মুক্তিযােদ্ধাকে এক সময়ে আপ্যায়ন করতে পারে। ওখানে গেলে আমরা নিশ্চিত থাকতে খেতে পারব। আমরা প্রায় এসে গেছি ভেবে সবার মধ্যে একটু চাঞ্চল্য দেখা দিলাে। এই দুঃসময়েও আমাদের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার হলাে। তখন রাতের অন্ধকার ক্রমশঃ গাঢ় হচ্ছে। হঠাৎ হজীপুরের এক পাশ থেকে তীর্যক বেগে আলাে এসে পড়লাে। ৩ ব্যাটারী টর্চের আলাে। বুঝতে পারলাম নিশ্চয় শত্রুদের কোন পর্যবেক্ষক দল আমাদের অনুসরণ করছে। মুহূর্তে এক দন্ড স্থির থেকে সবাইকে নির্দেশ দিলাম সাবধান। চোখের পলকে রাস্তার নীচ দিয়ে নেমে প্রায় ১০০ গজ ক্রলিং করে পাশের পাট খেতের আল ধরে গা ঢাকা দিয়ে শত্রুর দৃষ্টির আড়াল হয়ে পজিশন নিলাম-প্রতিরােধ করার জন্য। রাতের অন্ধকার ওরা আলাে ফেলে সামনে অগ্রসর হলেই আমরা আলাে অনুসরণ করে ফায়ার দেবাে। আমাদের পজিশন খুবই অনুকুলে শত্রু পক্ষকে সহজেই কাবু করা যাবে। কিন্তু এভাবে কিছু সময় অপেক্ষার পর ওদের আর কোন খোঁজ পাওয়া গেলাে না। আমরা পজিশন ছেড়ে উঠে পড়লাম। এরপর জানতে পারলাম হজীপুরে আমাদের অনতিদূরে রাজাকারদের ক্যাম্প হয়েছে। এখানে আমাদের আশপাশের গ্রামের বেশ কিছু যুবক রাজাকার বাহিনীতে নাম লিখিয়ে পাকসেনাদের সাহায্য করে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত অর্থাৎ আগস্ট মাস পর্যন্ত এরা কোন প্রতিরােধের মুখােমুখি হয়নি। যা হােক শত্রুদের চোখ এড়িয়ে হজিপুর নামক জায়গায় আমার বােনের বাড়িতে সব মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে উঠলাম। বােনতাে এত দিন পর আমাকে পেয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লাে। এদের ধারণা হয়ত আমি বেঁচে নেই। বােনকে সান্ত্বনা দিলাম। খুব ত্বড়িৎ গতিতে এরা ৮০ জন মুক্তিযােদ্ধার খাবার ব্যবস্থা করলাে। দু’দিন দুরাত্রি হেটে আমি বেহুশের মত হয়ে পড়েছি। সারা গা হাত পায়ে ভীষণ ব্যথা। বােন সারা রাত জেগে জেগে আমার সেবা শুশ্রুষা করলাে। তেল গরম করে সারা গা ম্যাসেজ করে দিলে একটু স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়ে পেটপুরে খেলাম, তারপর এত দিন পর একটা রাত শান্তিতে ঘুমালাম।
সকালে আমার বাহিনীকে আমার গ্রাম মীন গ্রামে পাঠিয়ে দিলাম। আমি বােনের বাড়ীতে আরও একদিন অবস্থান করে পরদিন বাড়ীতে রওয়ানা দিলাম। পথিমধ্যে খামার পাড়া নামক স্থানে এসে শুনতে পেলাম আমার স্ত্রী-ছেলে মেয়েদের নিয়ে টুপী পাড়া মামার বাড়ীতে আছেন। এর আগে পর্যন্ত আমি তাদের কোন খোঁজ পাইনি। জানিওনা কে কি অবস্থায় আছে এবং আদৌ বেঁচে আছে কিনা। আমি সাথে সাথে টুপীপাড়া মামা বাড়ীতে চলে গেলাম। সেখানে গিয়ে জানতে পারলাম আমার বড় ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান এর অবস্থা খুবই খারাপ ছিলাে। আমাদের এলাকা আক্রান্ত হলে আর বিশেষ করে যেহেতু আমি মুক্তিযােদ্ধা সেহেতু আমার স্ত্রী সন্তান সন্ততি বাবা মা ছিলেন খুবই বিপদাপন্ন। এ অবস্থায় আমার স্ত্রী-ছেলে মেয়েদের নিয়ে কোন মতে পালিয়ে মামা বাড়ী টুপী পাড়ায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে। আমি স্ত্রী ছেলে মেয়েদের নিয়ে বাড়ীতে চলে এলাম। দীর্ঘ দিন পর আবার আল্লাহর ইচ্ছায় সবার সঙ্গে দেখা হলাে। বাড়ীতে এসে আমার সঙ্গে আগত সব মুক্তিযােদ্ধাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করলাম। আমার চাচাতাে ভাই ডাঃ মােশাররফ হােসেন তখন লন্ডন-এর বাসিন্দা। তার বিশাল বাড়ী একদম ফাকা। পড়ে আছে। এখানেই সবাইকে থাকতে দেয়া হলাে। এটাই হলাে আমাদের। মুক্তিযােদ্ধাদের অস্থায়ী ক্যাম্প। এদিকে এলাকায় এসে শুনতে পেলাম আমাদের আসার আগেই এখানে মুক্তিযুদ্ধের দুইটি দল হয়েছে। একটা হচ্ছে শ্রীপুর বাহিনী অন্যটি অধিনায়ক সােনা মােল্যার নাম অনুসারে গঠিত হয়েছে সােনা বাহিনী। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এ সমস্ত বাহিনী শক্ত প্রতিরােধের পরিবর্তে আভ্যন্তরীণ বিশৃংখলার সৃষ্টি করছেই বেশীর ভাগ। বিশেষ করে তারা মুক্তিযুদ্ধের লক্ষ্য ও আদর্শচ্যুত হয়ে লুটপাট ও নানা রকম অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত রয়েছে। এ সংবাদে আমি খুবই মর্মাহত হলাম। এ কি শুনছি! মুহূর্তে দ্বিধা গ্রস্থ হয়ে পড়লাম, আমি এখন লড়ব কার সাথে? মুক্তিযােদ্ধা হয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে না শত্রুপক্ষ পাকসেনা রাজাকার, আলবদর আল শামসের বিরুদ্ধে? অবশ্য ভারতে থাকতেও শুনেছি বিশেষ করে অফিসারগণও আমাদের ট্রেনিং-এর সময় ব্রিফিং দিয়েছেন। অস্ত্র হাতে পেয়ে অনেকের বিপথগামী হবার সম্ভাবনা রয়েছে। আদর্শচ্যুত হয়ে অসামাজিক কার্যকলাপে লিপ্ত হতে পারে। এসব বিষয় খুব ধৈর্য্যের সাথে মােকাবিলা করতে হবে। খুব কৌশলে তাদের নিয়ন্ত্রণ করতে হবে। আমিও চিন্তা করতে থাকি ভাইয়ের হাতে যেন ভাইয়ের রক্ত ঝরে পবিত্র মাটি কলুষিত না হয়। এ জাতীয় অর্ন্তদ্বন্দ্বে লিপ্ত হলে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস। হারাব। পক্ষান্তরে শত্রুবাহিনীও এ জাতীয় ছিদ্র অন্বেষণ করছে। আমি কিভাবে এদেরকে নিয়ন্ত্রণ করব? এরাতাে আমাদের অধীনস্ত সেনাও নয়।
আমি যখন এ রকম দোলাচল বৃত্তির মধ্যে আছি তখনই আকস্মিক এক ঘটনা ঘটে। গেলাে। আমি যে ৮০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে দেশে ফিরে এসেছি এ খবর তখন চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। এমনকি শ্রীপুর বাহিনী এবং সােনা বাহিনীও এ সম্পর্কে অবগত। রাতে আমাদের অস্থায়ী ক্যাম্পে অর্থাৎ আমার চাচাতাে ভাই ডাঃ । মােশাররফ হােসেনের বাড়ীতে যখন আমার বাহিনীর সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন প্ল্যানিং প্রােগ্রাম নিয়ে আলাপ করছি। হঠাৎ সােনা মােল্লা তাঁর দল বল নিয়ে হাজির। অবস্থা বুঝে উঠার আগেই সােনা মােল্লা নাটকীয় কায়দায় তার অস্ত্র আমার পায়ের কাছে রেখে বলল ‘কামরুজ্জামান ভাই আজ থেকে আপনিই আমাদের লিডার এবং কমান্ডার। আপনি আমাদের সবাইকে চালান, আমরা আপনার অধীনে কাজ করব, আপনার নির্দেশ মত চলব। আমাদেরকে আপনার দলভূক্ত করে নিন। আমরা আপনার অধীনস্থই থেকে যাব।’ আমি যােদ্ধা মানুষ, যুদ্ধ এবং সংগঠিত করাই আমার উদ্দেশ্য। কিন্তু এ ধরনের ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুটা কিং কর্তব্য বিমূঢ় হয়ে যাই। তাছাড়া সােনা মােল্লা নিজেই একজন কমান্ডার। সে কেন এমন করছে বুঝতে পারছি না। আসা অবধি। সােনা মােল্লা সম্পর্কে যে সমস্ত তথ্য পেয়েছি তাতে এত সহজে তাকে অন্তর্ভুক্তি করাও ঠিক হবে না। আমি তাদের বাহিনীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিই । আমরা মুক্তিযােদ্ধা আমাদের প্রধান ও একমাত্র উদ্দেশ্য হলাে দেশকে শত্রুমুক্ত ও স্বাধীন করা। এ মহান লক্ষ্যে প্রত্যেককে স্ব স্ব অবস্থানে অবিচল থাকতে হবে, শত্রুকে ঘায়েল করতে হবে; দেশ স্বাধীন করতে হবে। কে কার অধীনে থাকবে সেটা বড় কথা নয়। আমরা পাশাপাশি কাধে কাধ মিলিয়ে যুদ্ধ করব। কোন দ্বিধা বিভক্তি কিংবা অসামাজিক কার্যকলাপ যেন আমাদের মধ্যে না দেখা দেয়। অহেতুক চাদাবাজি লােকজনকে হয়রানি করা থেকে বিরত থাকতে হবে। নইলে আমাদের ঐক্য থাকবে না। দেশের মানুষ আমাদের সাহায্য করার বদলে অসহযােগিতা করবে, এতে করে শত্রুরা সুযােগ বুঝে আমাদের সহজেই পরাস্ত করবে। যা হােক বন্ধুরা; আমরা এখন থেকে। একসঙ্গে চলব যুদ্ধ করব। আপনারা প্রােগ্রাম করুন শক্রর উপর আঘাত হানার প্রস্তুতি নিন।’ কয়েক দিন হলাে দেশে এসেছি এখনও কোন অপারেশন করা হয়নি। আমার বিশ্বস্ত কর্মীদের বিভিন্ন জায়গায় গুপ্তচর বৃত্তিতে পাঠালাম। তারা এসে আশপাশে শক্রর অবস্থান সম্পর্কে সংবাদ দিলাে। আমার এখন একমাত্র উদ্দেশ্য অপারেশন। করা। আমাদের প্রয়ােজনের তুলনায় অস্ত্র অপ্রতুল, অস্ত্র সংগ্রহ করা একান্ত প্রয়ােজন। অতএব এখন দু’একটা অপারেশন অনিবার্য হয়ে দেখা দিলাে। এ উদ্দেশ্যে আমি সােনা মােল্লাকে ডেকে তার বাহিনীকে আস্তে আস্তে অন্তর্ভুক্ত করে। অগ্রসর হই। আমার অধীনস্থরাই শুধু নয় অন্যান্য বাহিনীর কর্মীরাও আমার
আচরণ, উদ্দেশ্য ও কার্যকলাপে খুবই সন্তুষ্ট ছিল। বিধায় এরা প্রত্যেকেই ছিল। আমার একান্ত অনুগত। এসময় আমার বাহিনীতে সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনী, রাইফেলস্ ও পুলিশ বাহিনীর অনেক সদস্যই ছিল। এরা ছিল খুবই বিশ্বস্ত ও অনুগত। অপারেশন শৈলকূপা -১ আমার মীন গ্রামে আগস্ট মাসের দিকে শ্রীপুর বাহিনী এবং আমার অধীনস্থ বাহিনী ও সােনা মােল্লার দলের কিছু যােদ্ধা নিয়ে শৈলকূপা থানায় অপারেশনের সিদ্ধান্ত। নিই। ভারত থেকে ফেরার পর বাংলাদেশের অভ্যন্তরে এ জাতীয় অপারেশনের। মধ্যে এটাই ছিল প্রথম। আমি রাতে সব মুক্তিযােদ্ধাদের সমবেত করে ব্রিফিং দিলাম। বিশেষ করে যে সমস্ত ছাত্র যুবক স্বল্পকালীন প্রশিক্ষণ নিয়ে মুক্তিযােদ্ধা। হয়েছে। তাদের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন রকম রণকৌশল ব্যাখ্যা করলাম। এরপর আমার তৈরি ম্যাপ একটা বাের্ডে টাঙ্গিয়ে শক্রর অবস্থান ও আক্রমণের চিহ্নিত স্থানগুলাে ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দিলাম। এসময় আমাদের অস্ত্র শস্ত্র ছিল খুবই সামান্য। শৈলকূপা থানায় অপারেশনের প্রধান ও অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল অস্ত্র সংগ্রহ করা। সমস্ত ব্রিফিং শেষ হলে কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈন্যকে ওয়াচিং এ পাঠালাম। আর যেহেতু অপারেশন ছিল আমার নেতৃত্বে সেহেতু এদেরকে বলা ছিলাে আমার নির্দেশই হবে চূড়ান্ত। ওয়াচাররা এসে ক্লীয়ার সিগন্যাল দিলে আমরা অপারেশনের প্রস্তুতী নিলাম। আমি আমার সৈন্যদের তিনটি ফ্লাংকে বিভক্ত করে তিন দিক থেকে আক্রমণ রচনার নির্দেশ দিই। কথামত ওরা ৩টি দলে বিভক্ত হলাে। এর এক প্লাটুনের নেতৃত্বে শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হােসেন অপরটিতে আলম কাজী এবং চূড়ান্ত ভাবে ৩ দলেরই নেতৃত্ব এবং তৃতীয় দল থাকলাে আমার অধীনে। এ অপারেশনে সােনা মােল্যাকে বিরত রাখা হয়। আমরা ৩ দিক থেকে আক্রমণ করলে ওরা অকস্মাৎ প্রচন্ড আক্রমণ চিন্তা করতে না পেরে দক্ষিণের ভােলা দিক। দিয়ে রিট্রিট করে। আমরা মাত্র কিছুক্ষণের যুদ্ধে ওদের পরাস্ত করে থানায় ঢুকে পড়ি। বাইরে কয়েকজন সৈন্যকে পর্যবেক্ষণে রেখে ভেতরে ঢুকি। ঝটিকা বেগে আর্মারী ভেঙ্গে অস্ত্র নিয়ে আমরা ‘জয় বাংলা’ বিজয় সূচক শ্লোগান দিয়ে বেড়িয়ে পড়ি। তেমন কোন প্রতিরােধ ছাড়াই এক রকম আমাদের বিজয় অর্জিত হলাে। শুধু একজন সাব রেজিষ্টার এ অভিযানে মারা যান। প্রাথমিক এ বিজয়ে আমাদের সৈন্যদের মনােবল বেড়ে গেলাে। এ অভিযান আমার বাহিনীকে সুসংঠিত করতে দৃঢ় মনােবল যােগায়। আমি এ বিজয়ের সাফল্য সৈন্যদেরই পাওনা হিসেবে ঘােষণা দিয়ে তাদের ধন্যবাদ জানাই এবং বৃহত্তর অপারেশনে অংশ নেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকার নির্দেশ দেই। এই অপারেশনে যে। সমস্ত অস্ত্র উদ্ধার হলাে তা তিন বাহিনীর মধ্যে ভাগ করে দিলাম। আমি ভাগে ৬টি
রাইফেল কিছু গুলী পেলাম। যা হােক এ অপারেশন ছিল অত্যন্ত সুশৃংখল এবং সুনিয়ন্ত্রিত। এ অপারেশন আমাদের বৃহত্তর অপারেশনের প্রস্তুতি হিসেবে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অধিনায়ক শৈলকূপা হিসেবে আমার স্বীকৃতি সেপ্টেম্বর মাসের দিকে আমার বাহিনীতে সেনা বাহিনী, বিমান বাহিনী, নৌবাহিনী, রাইফেলস্ পুলিশের বিভিন্ন সেনা যুবক ও ছাত্রদের নিয়ে গঠিত বাহিনীর সদস্য সংখ্যা দাঁড়ায় ৩০০ জনে। আমি এই বাহিনীর নাম দিলাম শৈলকূপা বাহিনী। পুরাে বাহিনী বিভিন্ন অপারেশনে খুবই সাফল্য অর্জন করতে থাকে। আমি স্থায়ীভাবে বাহিনী গঠন ও স্বাধীনভাবে কাজ করার প্রয়ােজন অনুভব করি। এ উদ্দেশ্যে আমার বাহিনীর ৩০০ জন সৈন্যের নাম লিস্ট করে আমার সহযােদ্ধা চান মিয়াকে ভারতের কল্যাণীতে (যার দায়িত্বে ছিলেন সেক্টর কমান্ডার মেজর আবুল মঞ্জুর)। তার কাছে পাঠালাম। মেজর মঞ্জুর (পরবর্তীতে মেজর জেনারেল) আমাদের অত্যন্ত আনন্দের সাথে স্বীকৃতি দিয়ে সনদ পাঠালেন। মেজর মঞ্জুর পূর্বেই আমার সম্পর্কে অবগত ছিলেন। ভারতে তিনি আমার ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শনও করেন। মেজর মঞ্জুর আমাদের বাহিনীকে শৈলকূপা বাহিনী এবং আমাকে অধিনায়ক। শৈলকূপা হিসেবে স্বীকৃতি দেন। আমাদের এরিয়া কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওয়াহাব (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) সাহেব আমাদের OATH পড়ালেন। এরপর এক অনানুষ্ঠানিক পরিবেশে আমাদের সনদ প্রদান করেন। ক্যাপ্টেন ওয়াহাব সাহেব মেজর মঞ্জুরের নির্দেশেই ভারত থেকে আমাদের সনদ প্রদানের উদ্দেশ্যে আসেন। সনদ প্রদান শেষে তিনি আমাদের বললেন আপনারা। এরিয়া কমান্ডার এবং হেড কোয়ার্টারের নির্দেশে কাজ করবেন। আমি ক্যাপ্টেন ওয়াহাবকে ধন্যবাদ জানিয়ে সব নির্দেশ মেনে চলার প্রতিশ্রুতি দিলাম। এই অনুষ্ঠানেই তিনি অধিনায়ক শ্রীপুর বাহিনীতে আকবর হােসেনকে অধিনায়ক এবং তার বাহিনীকে শ্রীপুর বাহিনী এবং হরিণা কুন্ডু বাহিনীর অধিনায়ক হিসেবে মজিদ মাস্টার ও তার বাহিনীকে স্বীকৃতি দিয়ে সনদ প্রদান করেন। এ বাহিনীগুলাে সম্পর্কে আমিই কল্যাণীতে লিস্ট পাঠিয়ে ছিলাম ।
অপারেশন আলফাপুর। (শৈলকূপা এবং শ্রীপুর থানার সীমান্তে কুমার নদীর উত্তর পাড়ে) সেপ্টেম্বর-অক্টোবরের দিকে পাকবাহিনীর সম্প্রসারিত অভিযানের অংশ হিসেবে মাগুরা এবং ঝিনাইদহ টার্গেটে আসে। এ এলাকায় তখন পাকবাহিনী ক্রমশঃ প্রবল চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। অক্টোবরের দিকে তখন আমরা আমাদের আবাইপুর মীন গ্রামের ক্যাম্পে আছি। আশপাশের চারদিকে শত্রুর অবস্থান সম্পর্কে নিয়মিত ওয়াচিং এর জন্য গ্রুপে ভাগ করে আমার সেনাদলকে পাঠাচ্ছি । র্যাকি করার জন্য এক গ্রুপ এবং ক্যাম্প পাহাড়ায় এক গ্রুপ এমনিভাবে আমার বাহিনীকে সতর্কাবস্থানে রেখেছি। এর মাঝে হঠাৎ এক রাতে আমার র্যাকি বাহিনীর কমান্ডার মুক্তিযােদ্ধা আমিনুল ইসলাম চাঁন মিঞা এসে সংবাদ দিল ঝিনাইদহ থেকে ৪/৫ প্লাটুন আর্মি আমাদের ক্যাম্পের দিকে আসছে। কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা সহ চাঁন মিঞাকে আবাইপুর থেকে ৬ মাইল দূরে র্যাকি করতে পাঠানাে হয়েছিল। আকস্মাৎ চাঁন মিঞা পাকবাহিনীর অগ্রসরমান অবস্থা দেখে নির্দিষ্ট দূরত্বে থেকে ফায়ার দেয়। পাক বাহিনীর নিয়ম অনুযায়ী ফায়ারের জবাব ফায়ার। এমনকি ওরা একটি ফায়ার এর জন্য একশত, প্রয়ােজনে এক হাজার ফায়ার দেবে। আমার মুক্তি যােদ্ধাদের এ মােতাবেকই নির্দেশ দেয়া ছিল। পালাতে হলেও ফায়ার দিয়ে শক্রদের ব্যস্ত করে রিট্রিট করবে। চাঁন মিঞা যেহেতু আর্মির লােক সহজেই সে এ কৌশল অবলম্বন করে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ফায়ার দিয়েই পেছনে চলে আসে। বেশ রাত; আমি তখন নিজের বাড়ীতে শুয়ে শুয়ে চিন্তা করছিলাম হঠাৎ চাঁন মিঞা হন্তদন্ত হয়ে এসে আমাকে পাকবাহিনীর সংবাদ দিল। এই প্রান্তে তখন একমাত্র আমাদের ক্যাম্পই মুক্তিযােদ্ধাদের শক্তিশালী অবস্থান। এ কারণে রাজাকার, আলবদর, আল শামস বাহিনীর প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী ওরা আমাদেরকেই টার্গেট করেছে। এই অবস্থায় কয়েকজন কোম্পানী কমান্ডার ছুটে এলাে আমার কাছে, আমাকে বললাে ‘এ অবস্থায় আমরা হাল্কা অস্ত্র নিয়ে কি করতে পারি?’ আমি বললাম এ মুহূর্তে আমাদের একমাত্র করনীয় বিষয় হচ্ছে সুষ্ঠু পরিকল্পনা মাফিক অগ্রসর হওয়া। গেরিলা কায়দায় অগ্রসর হতে হবে-নইলে পাকবাহিনীর সাথে। আমরা টিকে উঠতে পারবনা। আমাদের আগে জীবন বাঁচাতে হবে তারপর আক্রমণ। নইলে আবাইপুরের শেষ চিহ্নটুকু আমরা রাখতে পারবনা। এ এলাকার এক ইঞ্চি মাটি রক্ষা করতে আমরা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়েও লড়ে যাব। কিন্তু
রণকৌশল ছাড়া আগানাে যাবেনা। প্রথমতঃ যেহেতু ওরা ক্যাম্পকে টার্গেট করেছে। সেহেতু ক্যাম্পে থেকে যুদ্ধ করা ঠিক হবেনা। ভারী অস্ত্রে অর্থাৎ মর্টার দিয়ে শেলিং করতে পারে তাই আমাদের ক্যাম্প ছাড়তে হবে। দ্বিতীয়তঃ এলাকা ছেড়ে বেশী। দূর যাওয়া যাবে না। কারণ তাতে আমরা নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়ব। আমরা তখন চারদিক থেকে ছিলাম শক্র পরিবেষ্টিত। শ্রীপুর থানা, লাঙ্গল বাঁধ, শৈলকূপায় আর্মিদের ঘাটি। অতএব আমাদের এলাকায় নির্দিষ্ট রেঞ্জের মধ্যে থেকেই ওদের মােকাবিলা করতে হবে। আমি দ্রুত বেগে সবাইকে মীন গ্রাম স্কুলের মাঠে সমবেত হওয়ার নির্দেশ দিলাম। ভাের ৪টায় আমরা সমবেত হলাম। গ্রামের লােকজন আর্মি আসার সংবাদে ভীষণভাবে আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। কেননা আর্মিরা যেখানে একবার ঢুকে শূন্য হাতে ফেরে না। মুক্তিযােদ্ধাদের না পেয়ে অপারেশনে ব্যর্থ হলে ওরা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে বিভীষিকার সৃষ্টি করে। এ অবস্থায় আমি গ্রামের লােক এবং মুক্তিযােদ্ধাদেরও অভয় দিলাম। মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ সম্পর্কে আমি ব্রিফিং করছিলাম অর্থাৎ পৌনে ৫টার দিকে। আমাদের অদূরে হঠাৎ ফায়ারিং এর শব্দ শােনা গেলাে; অতর্কিত এ ফায়ারিং-এর শব্দে নতুন মুক্তিযােদ্ধাসহ অনেকেই ছত্রভঙ্গ হবার উপক্রম করলাে। আমি তাদের এই বলে শান্ত করলাম যে ওরা বিনা প্ল্যানিং এ আমাদের মধ্যে আসবে না। বিশেষ করে র্যাকি করে ইন্টিলিজেন্স ইনফরমেশান এর মাধ্যমে ওরা আক্রমণ করবে। অতএব এতটা ভীত হবার কোন কারণ নেই ! এরপর আমার মুক্তিযােদ্ধা সােনা মােল্লা-মন্টু, কাজী আলম এরা দক্ষিণে বিলের ভিতরে কতগুলাে গ্রামে আছে সেখানে গিয়ে অবস্থান নিলাে। আমি বললাম আমরা ওদের গতিবিধি লক্ষ্য করে তবেই মুভ করব। আমাদের মাঠ ছেড়ে মাত্র এক ফালং দূরে আলফাপুর খেয়া ঘাট। আমি দ্রুত ৩০জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সেদিকে অগ্রসর হতেই আবার ফায়ারিং এর শব্দ পেলাম। শব্দের দূরত্ব হিসেব করে বুঝলাম এতক্ষণে আমাদের ক্যাম্পের উপর ফায়ারিং হচ্ছে। আমরা যখন খেয়াঘাটে পৌছলাম তখনও চারদিকে আলাে আঁধারীর আবছায়া। কুমার নদীর দক্ষিণ ঘাটে এসে দেখলাম পার হওয়ার কোন ব্যবস্থা নেই। এপারে কোন নৌকা কিংবা লােকজন কিছুই নেই। এহেন সঙ্কটাপন্ন অবস্থায় আমার দু’জন মুক্তিযােদ্ধা বলল ওপারে ডুবন্ত নৌকা আছে আপনি অর্ডার দিলে সাঁতরিয়ে গিয়ে নৌকা সেচে আনতে পারি। আমি যাবার অনুমতি দিয়ে বললাম যা কর সব দ্রুততার সাথে করতে হবে। ওরা হুকুম মত খুব তাড়াতাড়ি নৌকা সেচে। নিয়ে এলাে। কিন্তু ৩০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে এক নৌকায় উঠা সম্ভব নয়। অথচ একবারেই সবাইকে পার হতে হবে। আমি কোন মতে কাউকে আলাদা কিংবা দলছুট হতে সুযােগ দিচ্ছিনা। এ মুহূর্তে একত্রিত অবস্থান একত্রিত মার্চ করাই
রণকৌশল। অবস্থা বিবেচনা করে আমি সাথে আনা গামছা পরে অস্ত্র নৌকার উপর। রাখলাম। সবাইকে একই পদ্ধতি অবলম্বন করার নির্দেশ দিলাম। নির্দেশ মত সবাই। নৌকার উপর অস্ত্র রেখে পানিতে নেমে নৌকা ধরে সাঁতরিয়ে ওপার গেলাম। আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য অস্ত্র রক্ষা করা। এভাবে নদী পার হয়ে আলফাপুর খালের। পূর্ব পারে অবস্থিত এক প্রাইমারী স্কুলে অবস্থান নিলাম। স্কুলে পৌঁছেই আমরা ট্রেন্স করে ফেললাম। এদিকে সকাল বেলা এলাকার লােকজন আমাদের স্কুলের মাঠে দেখে অল্প সময়ের মধ্যে বাড়ী থেকে খিচুরী রান্না করে এনে খাওয়ালাে। খেয়ে। দেয়ে পুনরায় একদলকে ট্রেন্স করতে দিয়ে অপর তিনটি গ্রুপ পাঠালাম র্যাকি করতে। র্যাকি বাহিনী কিছু সময় পর এসে জানালাে পাক বাহিনী আবাইপুরে আছে। ওরা ওয়াপদার বিল্ডিং-এর উপর উঠে বালির বস্তা দিয়ে খুব মজুত অবস্থান বানিয়েছে। রাত্রে ওদের অবস্থান সম্পর্কে আরও নিশ্চিত হতে আমি ৬ জনের খুব স্ট্রং একটা গ্রুপ পাঠালাম। এদেরকে ৩টি ফ্লাঙ্কে বিভক্ত হয়ে অপারেশন করার নির্দেশ দিলাম। এরা আবাইপুরের পাশের গ্রাম বগুড়া এবং মীনগ্রাম থেকে ওদের অবস্থানও গতিবিধি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়ে আমাকে সংবাদ জানালাে। আমি ওদের অবস্থান জেনে আশ্বস্ত হলাম। ওরা এখনও ওখানেই আছে এই ফাকে আমি আমার প্রস্তুতী সম্পন্ন করতে পারব। আলফাপুরের মধ্যদিয়ে একটি মাত্র রাস্তা চলে গেছে শৈলকূপা এবং শ্রীপুরের দিকে। এই একমাত্র রাস্তা ছাড়া অন্যকোন রাস্তা নেই। নদীর উত্তর দিকে একটা খাল আছে। যে খালটি শৈলকূপা এবং শ্রীপুরকে বিভক্ত করেছে। তার উপর একটা পুল আছে। এই পুলের পূর্ব পাশে খালের পারের উঁচু জায়গা আলফাপুরের নদীর মুখে কিছু জঙ্গল ছিল। এই জঙ্গলের মধ্যে আমি কয়েকটি ট্রেন্স করে প্রস্তুতি নিলাম। একটা ফ্লাংক রাখলাম খালের মুখে আর অন্যটি ব্রীজের পূর্বে। আমরা জানি আর্মিরা অগ্রসর হলে একমাত্র এই রাস্তা এবং পুলের উপর দিয়েই অগ্রসর বেলা ১২টার দিকে যখন আমরা দুপুরের খাবার খাব এমন সময় বগুড়া থেকে। র্যাকি পার্টি এসে সংবাদ দিলাে পাকবাহিনী আলফাপুরের দিকে আসছে আপনারা তৈরি হন। আমরা দ্রুত স্কুলের মাঠ থেকে খালের পারে আলফাপুর জঙ্গলে নির্মিত ট্রেন্সে অবস্থান নিলাম। একে বর্ষার মৌসুম, চারদিকে জল, অন্য পথ নেই কেবল মাত্র এই একটি পথে আর্মিদের আসতে হবে। তার উপর আলফাপুরে আমাদের পজিশন ছিল একেবারেই কুদরতী। কেননা এই অবস্থান থেকে আমরা শত্রুর গতিবিধি বুঝতে পারব, ওদেরকে লক্ষ্য করে গুলী ছুঁড়তে পারব ঠিকই, পক্ষান্তরে ওরা আমাদের দেখতে পারবে না। এমন একটা ঐশ্বরিক সুযােগ পেয়ে খােদা তায়ালাকে ধন্যবাদ জানালাম। আশপাশে যত নৌকা ছিল সব ডুবিয়ে দিলাম। কয়েকটি গ্রুপে সৈন্যদের বিভক্ত করলাম। এর এক গ্রুপ খালের নীচে অন্যটা পূর্ববর্তী অবস্থানে, তৃতীয় গ্রুপকে ব্রীজের নীচে দিলাম। এভাবে আলফাপুরে আমার সৈন্যদের বিন্যস্ত করলাম। আমি মুক্তিযােদ্ধাদের বিশেষভাবে নির্দেশ দিলাম যত সুযােগই বুঝ নির্দেশ না পাওয়া পর্যন্ত ফায়ার দেবে না এবং শেষ সংকেত না। পাওয়া পর্যন্ত কোনক্রমেই কেউ ফ্লাঙ্ক ছেড়ে যাবে না । অবশেষে আমাদের পরিকল্পিত ফাঁদেই ওরা পা দিলাে। আলফাপুর ব্রীজে এসেই ওরা বুঝতে পারল আশপাশে মুক্তিযােদ্ধা আছে। এসেই ফায়ার দিলাে। আমরা একটি মাত্র ফায়ার দিলাম ফায়ারের জবাবে। ওরা একটানা দেড় ঘন্টা ধরে ফায়ারিং করতে থাকে। আমরা বিভিন্ন অবস্থান থেকে একটা করে মাত্র ফায়ার দিয়ে ওদের ব্যস্ত করে রাখলাম। ক্রমাগত দেড় ঘন্টা ফায়ারিং করে করে ওরা বুঝতে পারল মুক্তিযােদ্ধাদের ওঠানাে যাবে না। (ওরাএই ফায়ারিং-এ এইচ,এম.জি-এল.এম.জি ব্যবহার করেছে)। কিন্তু আমাদের কিছুই হয়নি। যেহেতু আমরা নিরাপদ অবস্থানে আছি ওরা গুলী করলে সবই আমাদের উপর দিয়ে চলে যায়। পক্ষান্তরে আমরা ওদের দেখছি তবুও ওদের বিশেষ কায়দায় ফেলতে ফায়ার দিচ্ছি না। তাছাড়া এখানে ওরা মর্টার দিয়ে শেলিং করতে পারে। মাঝে মধ্যে আমার মুক্তিযােদ্ধারা অস্থির হয়ে ওঠে আক্রমণের জন্য। আমি ওদের শান্ত করি-ধীরে; আমাদের জন্য আরাে ভালাে সুযােগ অপেক্ষা করছে। এদিকে আর্মিরা দেড় ঘন্টা ফায়ার করে ব্যর্থ হয়ে রিট্রিট করে। কিন্তু ওরা নিয়মানুযায়ী যে পথে। এসেছে সে পথে ফিরে না গিয়ে উত্তর দক্ষিণ কর্ণার ধরে খালের পার দিয়ে অগ্রসর হতে থাকে। আমি এই সুযােগেরই অপেক্ষায় ছিলাম। কেননা আমি জানি ওরা রণকৌশল হিসেবে এটাই করবে এ পথে আর ফিরবে না। আর বাকী যে পথেই ফিরবে সেটা হবে ওদের জন্য মরণ ফাঁদ আর আমার জন্য চমৎকার সুযােগ। পরিণতিতে তাই হলাে। পুরাে এক কোম্পানী সৈন্যসহ ওরা পার দিয়ে সমতলে পরিস্কার জায়গায় এসে পৌছলে আমি অর্ডার দিলাম ‘ফায়ার’। অমনি ৩ দিকে বিভক্ত ৩টি ফ্লাঙ্ক থেকে অবিরাম বৃষ্টির মত গুলী বর্ষণ শুরু হলাে। নিকটবর্তী দূরত্বে আমার ফ্লাঙ্কে ছিল মুক্তিযােদ্ধা চাঁন মিঞা, আঃ বারিক, রাজু জোয়ার্দার, সােবহান জোয়ার্দার, করিম, রানু অনবরত ফায়ার এবং উল্লাসে গালিগালাজ করতে। থাকে। ওরা এইচ.এম.জি লাগাতে কিংবা পজিশন নিতে বিন্দুমাত্রও সময় পেলাে
। ৩ দিক থেকে একযােগে আক্রমণ । ওরা বিন্দুমাত্রও ভাবতে পারেনি এমন গেরিলা কায়দায় এখানে আক্রান্ত হবে। চোখের পলকে পুরাে এক কোম্পানী সৈন্যের সব শেষ হয়ে গেলাে। শুধু একজন মেজর যার হাতে অয়্যারলেস সেট ছিল
সে গুলী খেয়ে আহত হয়ে পার্শ্ববর্তী জঙ্গলে অবস্থান নেয়। তাও কিছুক্ষণ পর মারা। যায়। পরবর্তীতে আর্মিরা এই মেজরের লাশ নিয়ে লাঙ্গল বাঁধ বাজারের কাছে কবর। দেয় yY একটু পরেই বুঝতে পারলাম আমাদের চোখ গলিয়ে কোন মতে ৩জন পাক সেনা। ক্রলিং করে জীবন নিয়ে পালাচ্ছে। আমরা নৌকা সেচে পার হয়ে ওদের পিছু ধাওয়া করলাম ধরার জন্য। কিন্তু কিছুক্ষণ পর এলাকার লােকজন সংবাদ দিলাে। ওরা আবার আসছে। আমরা ব্যাক করে আলফাপুরে পুনরায় পজিশন নিলাম। আর্মিরা এবার এলাে শুধু ডেড বডি নিতে। কিন্তু তাও এসে ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহার। করলাে। আমাদের অবস্থান বরাবর কিছুক্ষণ শেলিং করলাে কিন্তু শেলিং ওভাররেঞ্জ করছে বরাবরই। শেলের আঘাতে আমাদের করিম আহত হলাে। আমরা ভাবলাম মূল অপারেশন হয়ে গেছে এখান থেকে আমরা অনেক অস্ত্র ও গােলাবারুদ উদ্ধার করেছি অতএব এখন আমাদের হাল্কা অস্ত্রে মােকাবিলার চেয়ে রিট্রিট করাই শ্রেয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ব্রিজের পিছন দিক দিয়ে রিট্রিট করলাম। আমাদের জন্য মন্টু মিয়া আগেই নৌকা প্রস্তুত করে রেখেছিল। নৌকায় করে আমরা মালতিহা আহমেদ সাহেব নামক এক ব্যবসায়ীর বাড়ীতে প্রথমে অবস্থান নিলাম। উনি আন্তরিকভাবে আমাদের গ্রহণ করে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। ইতােমধ্যে দল ত্যাগকারী কতিপয় মুক্তিযােদ্ধা, লিডার ও আশপাশের লােকজন আমাদের এ বিজয়ে সাধুবাদ। জানাতে লাগলেন। কিছু সংখ্যক আবার দলে অন্তর্ভুক্তির আবেদন জানালাে। আলফাপুরের এ অপারেশন ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ অপারেশন থেকে। পাকবাহিনী এখানে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে অবহিত হয়। যার ফলে মাগুরা অনেকাংশে সুরক্ষিত হয়। একদিন অবস্থান নেয়ার পর অনুমান করলাম যেহেতু এখানে ওদের পুরাে একটা কোম্পানী সৈন্য শেষ হয়ে গেছে সেহেতু ওরা সহজে ছাড়বে না। মরিয়া হয়ে উঠবে, সমগ্র এলাকা তছনছ করবে। আমাদের এখানে অবস্থান আর নিরাপদ নয় ভেবে একটা বড় নৌকা নিয়ে গড়াই নদী দিয়ে ফরিদপুর জেলায় প্রবেশ করলাম। ফরিদপুর জঙ্গল ইউনিয়নে পৌছে দেখলাম এটা অধিকাংশই হিন্দু এলাকা। সবাই ঘর বাড়ী ছেড়ে ভারত চলে গেছে। ফলে সবই ফাকা। এখানে এক বাড়ীতে ৫/৬ দিন অবস্থান করে-পরে খোঁজ নিয়ে জানতে পারলাম পাকবাহিনী এলাকা ছেড়ে চলে গেছে। তখন আমরা আবার ফিরে এলাম শৈলকুপায় । অন্যান্য সংগঠন ও গণসংযােগ কার্যক্রম মুক্তিযুদ্ধ বলতে কেবল মুখােমুখি শত্রুকে আঘাত করা, হত্যা নয়। মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে জনমত তৈরি, আভ্যন্তরীণ পরিবেশ সুস্থ রাখা। কেউ যেন রাজাকার,
আলবদর, আলশামস হতে সুযােগ না পায় এ সমস্ত দিকে লক্ষ্য রাখা এবং ভেতরের শত্রুকে নির্মূল করা। সর্বোপরি ভয় পেয়ে দেশের মানুষ মুক্তিযােদ্ধাদের অসহযােগিতা না করে সেদিকে কঠোর নজর দেয়া। ভারত থেকেও ট্রেনিং-এর সময় বিশেষভাবে আমাদের নির্দেশ ছিল মােটিভেশন এর জন্য। এছাড়া আমার বা অন্য কোন মুক্তিযােদ্ধা কর্তৃক কোন রকম অসামাজিক বা বিশৃংখল কার্যক্রম। পরিলক্ষিত হলে তার সুষ্ঠু বিচার করা। অনেক সময় দেখা গেছে এলাকায় কোন মাতবর বা গ্রাম্য নেতা গােছের লােকজন হঠাৎ করে রাজাকার বনে গিয়ে। লুটতরাজে লিপ্ত হয়েছে। আমরা প্রথমে তাদের সাবধান করেছি তারপর চূড়ান্ত ভাবে বিচার করেছি। লুটতরাজের মালামাল ফেরত দিতে বাধ্য করেছি। এটা আমার বাহিনীর একটা। নিয়মিত কার্যক্রমের অংশ ছিলাে। আর দু’একদিন পরপরই আমরা গ্রুপ করে বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে গণসংযােগ এর কাজ করতাম। মানুষকে বুঝতাম আমাদের বিজয় সুনিশ্চিত, আমরা অবশ্যই স্বাধীন হবাে। আর যুদ্ধ আমরা ইচ্ছে করে করছি আমাদের উপর ওরা চাপিয়ে দিয়েছে। ওরা ধর্মের দোহাই দিয়ে আমাদের মন। গলাতে চেষ্টা করছে। অথচ ওরা অকাতরে শিশু কিশাের বৃদ্ধদের হত্যা করছে। নারী ধর্ষণ করছে। এ সমস্ত কথায় দেখেছি দ্বিধা গ্রস্থ জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে মুক্তি যুদ্ধের সপক্ষেই তাদের মতামত ব্যক্ত করেছে। এদিকে আলফাপুর অপারেশনের পরপরই সঙ্গত কারণে আমাদের ক্যাম্প পরিবর্তন। জরুরী হয়ে পড়ে। বহিঃশত্রু, আভ্যন্তরীণ শত্রু সবাই ক্যাম্প সম্পর্কে জেনে গেছে। তাই আমরা ফরিদপুর জঙ্গল ইউনিয়ন থেকে ফিরেই ক্যাম্প পরিবর্তন করি। এবার। আমরা আবাইপুর থেকে রতনপুর ক্যাম্প স্থানান্তরিত করি। রতনপুর ছিল বেশ চমৎকার একটা জায়গা। চারদিক জলবেষ্টিত মাঝখানে আমাদের অবস্থান। রতনপুর ক্যাম্পে দু’একদিন অবস্থান নেয়ার পরই জানতে পারলাম বিভিন্ন জায়গায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস্ খুব বাড়াবাড়ি করছে। স্থানীয় অনেকেই রাজাকারে নাম লিখাচ্ছে। আর এখানে রাজাকাররা দিন দিন শক্তিশালী হয়ে উঠছে, স্থানীয় জনগণ ও তাদের সমর্থন করছে। আমরা সশস্ত্র অবস্থায়ই রাধা কান্তপুর অপারেশনে গেলাম । অস্ত্রের খবর তারা জানতে না পারে এমন ভাবে লুকিয়ে নিলাম। আমরা প্রথমে লাঙ্গল বাঁধের পশ্চিমে উলু বাড়িয়া গেলাম। কিন্তু রাজাকার আলবদররা আমাদের উপস্থিতি টের পেয়েই পালিয়ে গেল। বাকী যারা ছিল তারা সহজেই আমাদের আনুগত্য স্বীকার করল। স্থানীয় জনগণকে সমবেত করে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে বক্তব্য রেখে তাদের উদ্বুদ্ধ। করার চেষ্টা করি। বুঝতে পারলাম জনতার মধ্যে বিপুল সাড়া এসেছে। যারা
আমাদের আনুগত্য স্বীকার করল পরবর্তীতে তারা মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষেই তাদের কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। আসলে যে সমস্ত এলাকা আমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। সেখানে সহজেই রাজাকার আল শামস আল বদররা লােককে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে মুক্তিযুদ্ধের বিপরীতে অবস্থান নিতে বাধ্য করেছিল। আমরা যখন একটার পর। একটা এলাকায় এভাবে অপারেশন চালাতে থাকি তখন একটা একটা এলাকা আমাদের করতল গত হয় এবং মুক্তিযােদ্ধা শিবির গড়ে ওঠে। জনমত আমাদের পক্ষে আসতে থাকে। একই ভাবে আমরা অন্যান্য জায়গায় অপারেশন চালিয়ে কিছু রাজাকার ধরে ফেলি। বাকীরা পালিয়ে যায়। কিন্তু যারা ধরা পড়ে তাদের হত্যা বা নির্যাতন না করে। আমদের আনুগত্য স্বীকার করাই। শুধু তাই নয় অস্থায়ী ক্যাম্প করে তাদেরকে আমাদের নেট ওয়ার্কে নিয়ে আসি। ভ্রাম্যমান দল গঠন করে এ সমস্ত ক্যাম্পের সঙ্গে যােগাযােগ ও নিয়মিত গণ সংযােগ কার্যক্রম রক্ষা করি। ফলে আমাদের এ ধরনের কার্যক্রমে এলাকার সবাই খুব প্রীত ছিল। কেননা আমাদের এক মাত্র লক্ষ্য। হত্যা কিংবা নির্যাতন ছিলনা। ছিল বৃহত্তর পরিসরে মুক্তিযুদ্ধ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে সম্প্রসারিত করা। খুব স্বল্প সময়েই আমি এর এর ফল লাভ করেছি। আমি কোন এলাকায় অবস্থান নিতে গেলে কিংবা অপারেশনে গেলে সব সময়ই স্থানীয় লােকজনের আন্তরিকতা পেয়েছি প্রাঞ্জল ভাবে। অপারেশন কাজী কান্দা মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যকারী কেউ কেউ আবার পরােক্ষভাবে বিভিন্ন রকম সুযােগ সুবিধাও গ্রহণ করেছে। এরা সাধারণত গ্রাম এলাকার প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করে আবার পরােক্ষ ভাবে মুক্তি যােদ্ধাদের দিয়েই বিভিন্ন স্বার্থ চরিতার্থ করেছে। এরা ছিল বিশেষ সুযােগ সন্ধানী রক্ষকরূপী ভক্ষক দল। এর মধ্যে বিশেষ করে ফরিদপুর জেলার পাংশা থানাধীন নটা ভাঙ্গা গ্রামের ইয়াছিন। খান অন্যতম। এই ব্যক্তি তাঁর ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থের উদ্দেশ্যে আমার সহযােদ্ধা চান। মিঞার ভগ্নিপতির জামাই এবং ভাইকে এক সঙ্গে হত্যা করে। এরাও ছিলেন। মুক্তিযােদ্ধা অথচ মুক্তি যােদ্ধারাই এই মুক্তিযােদ্ধাদের অন্যের জিঘাংসা চরিতার্থের জন্য হত্যা করে। আমরা সংবাদ পেয়ে কাজিকান্দা অভিমুখে রওয়ানা হলাম। এবং নটাভাঙ্গার ইয়াছিন খানকে অপারেশনের প্রস্তুতি নিলাম। প্রথমে আমরা কাজিকান্দায় নিহত মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়ীতে গেলাম। গিয়ে যে হৃদয় বিদারক দৃশ্য দেখলাম তাতে খুবই মর্মাহত হলাম। একই পরিবারের জোয়ান দুইটি ভাই, উভয়ে ছিলাে। মুক্তিযােদ্ধা। তাদেরকে রাতের অন্ধকারে একই সাথে বৃদ্ধ বাবার চোখের সামনে হত্যা করে। বৃদ্ধ বাবাকেও শারীরিক ভাবে নির্যাতন করে। শুধু হত্যা নির্যাতন করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। বাড়ীতে লুটতরাজ করে সম্পূর্ণ মালামাল নিয়ে যায়। বৃদ্ধ বাবা পুত্রশােকে কেদে কেদে অন্ধপ্রায়। আমরা সেখানে পৌছালে বৃদ্ধ আমাদের। বুকে জড়িয়ে চিৎকার করতে থাকেন ‘বাবারা আমার ছেলেরাও তাে মুক্তিযােদ্ধা ছিল। তারা কি অপরাধ করেছিলাে মুক্তিযুদ্ধ করে? যে তাদের এমন নির্মম ভাবে হত্যা করা হলাে? তাও কোন শক্রর হাতে তারা মরেনি মরলাে ভাই হয়ে ভাইয়ের হাতে। ওরা পাকবাহিনীর হাতে মরলে আমার কোন আফসােস থাকতনা কিন্তু। আফসােস মুক্তিবাহিনী হয়ে মুক্তিবাহিনীরাই কোন অপরাধে আমার সন্তাদের। মারলাে? আমার আরতাে বাকী কিছুই রইলনা বাবারা। ওরা আমার বাড়ী পর্যন্ত লুট পাট করে নিয়ে গেছে।” সেদিন সেই জোড়া সন্তান হারা বাবাকে কি বলে সান্ত্বনা দেব তার ভাষা আমার। জানা ছিল না। আমি ও তাে মুক্তিযােদ্ধা। আমি তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে আর কি জবাব দেব? আমার হাতের অস্ত্র কেপে উঠে, চোখ থেকে গড়িয়ে পড়লাে। দু’ফোটা লােনা অশ্রু। আমরা মুক্তি যােদ্ধারা যদি এভাবে ব্যক্তি স্বার্থ চরিতার্থেই ব্যস্ত আর আভ্যন্তরীণ সঙ্কটকে তীব্র করে তুলি তবে বহিঁশক্রকে রুখব কখন? তবুও দ্রোহের আগুনে ঝলসে উঠি। গায়ের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। প্রতিশােধের নেশা জেগে উঠে প্রতিটি মুক্তিযােদ্ধার চোখে মুখে। আমরা প্রথমে সরাসরি আক্রমণ না করে উপর্যপুরী ঘটনার সত্যতা যাচাইয়ের জন্য তদন্তের ব্যবস্থা নেই। তদন্তের মাধ্যমে যখন ঘটনার সত্যতা প্রমাণিত হলাে তখন ইয়াছিন খানের বাড়ী ঘেরাও করে ইয়াছিন খানকে ধরার পরিকল্পনা করলাম। আমার নির্দেশ মত সাতটি নৌকা প্রস্তুত করা হলাে। মুক্তি যােদ্ধাদের সশস্ত্র অবস্থায় নৌকায় ওঠার নির্দেশ দিলাম। এ সময় ছিল বর্ষার মৌসুম; চারদিক থেকে আমরা নিচ্ছিদ্র আক্রমণ রচনা করলাম কেউ যাতে কোন দিক থেকে পালাতে না পারে। সাতটি নৌকা নিয়ে যখন এক যােগে বাড়ী ঘেরাও করলাম তখন পর্যন্ত বাড়ীর একটি প্রাণীও জানলােনা তারা চারদিক থেকে শত্রু পরিবেষ্টিত। আমরা বাড়ীতে পেীছে প্রথমেই সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রেনেড চার্জ করার। কিন্তু হঠাৎ বাড়ী থেকে অনেক কলস্বরে চমকে উঠলাম। নিশ্চয় এ বাড়ীতে এত সদস্য নেই অতএব এরা কারা? এরা বহিরাগত । বহিরাগত কারা হতে পারে? দু’জন ওয়াটার পাঠালাম খোজ নিতে। তারা নিঃশব্দে ওয়াচিং করে এসে জানালাে এরা সবাই মুক্তিযােদ্ধা, অনেকেই সশস্ত্র অবস্থায় আছে। যেহেতু আমাদের অপারেশন নিঃশব্দ নীরবে সেহেতু গ্রেনেড চার্জ করলে এদের সবাই মরতাে। মুক্তি যােদ্ধা হয়ে মুক্তি যােদ্ধাদের হত্যা কি করে সম্ভব ? আর এখানে এত মুক্তি যােদ্ধারা অবস্থান নিয়েছে। অর্থাৎ ইয়াছিন খানই এদের সাহায্য করছে। মনটা হঠাৎ করেই পরিবর্তন হয়ে
গেলাে। এভাবে আক্রমণ না করে আমরা গিয়ে ইয়াছিন খানকে ধরলাম। তাকে বললাম যেহেতু আপনি মুক্তি যােদ্ধাদের সাহায্য করছেন শুধু সে কারণে আপনাকে হত্যা করিনি। আপনি এদের যে অপূরণীয় ক্ষতি করেছেন তার মূল্য কখনাে দিতে পারবে না। তবু অন্তত যে লুটপাট করেছেন সে বাবদ দশহাজার টাকা ক্ষতি পূরণ অবিলম্বে দিয়ে দিবেন। পূর্বেই বলেছি আমার বাহিনীর এটা ছিল এক ধরনের বিচার ব্যবস্থা। শুধু হত্যাতেই কোন সমাধান আসেনা। যার ফলে সূক্ষ্ম বিচারের মাধ্যমে। যেগুলাে সমাধান করা যায় আমি তার চেষ্টা করেছি। ইয়াছিন খান ক্ষতি পূরণের প্রতিশ্রুতি দিলে তাঁকে ছেড়ে দেয়া হলাে। এবং ভবিষ্যতে এ জাতীয় ঘটনার পুনুরাবৃত্তি হলে তাকে হত্যা করা হবে বলে ভীতি প্রদর্শন করে এলাম। তাকে সাতদিনের সময় দিয়ে আমার বাহিনী নিয়ে আমি ফিরে এলাম। কিন্তু কিছুদিন পর জানতে পারলাম ইয়াছিন খান কথা রাখেনি। সে তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেনি। বাধ্য হয়ে আমি আমার ফোর্স দিয়ে তাঁকে ধরিয়ে আনলাম। পরবর্তীতে উক্ত প্রতিশ্রুত টাকা কালেকশন করে বৃদ্ধের পরিবারকে পৌঁছে দিলাম। আমার পরিবার পরিজন অসহনীয় দূর্ভোগের শিকার মুক্তিযােদ্ধারা যেমন দেশের অভ্যন্তরে সহযােগিতা পেয়েছে তেমনি পেয়েছে অসহযােগিতা এবং নিদারুণ দুঃখ কষ্ট। শুধু মুক্তি যােদ্ধারাই এ জাতীয় দূর্ভোগের শিকার হয়েছে তাই নয়। তাদের পরিবার পরিজনও নানা দুঃখ কষ্ট নির্যাতন এবং দূর্ভোগের শিকার হয়েছে। আমি একজন মুক্তিযােদ্ধা স্বভাবতই আমার স্ত্রী মুক্তিযােদ্ধার স্ত্রী। আমার স্ত্রী মিসেস রােজী জামান মূলত পাকিস্তানী মেয়ে, অত্যন্ত সাহসী এবং শক্তি শালী। একজন সৈনিকের স্ত্রী হিসেবে সে পূর্ব থেকেই মানসিক ভাবে প্রস্তুত। যে কোন অবস্থা স্বীকার করে নেয়ায় তার কোন কুণ্ঠা বােধ নেই। তা ছাড়া দেশে ফিরে যখন আমি। সশস্ত্র বিপ্লবীদের সাথে সংশ্লিষ্ট হই তখন থেকেই সে আমাকে প্রেরণা দিয়েছে। বিভিন্ন অবস্থায় আমার মনােবল যুগিয়েছে। আমি ২৫শে মার্চের ক্র্যাক ডাউনে। যখন সর্বস্বান্ত হয়ে ফিরে আসি তখন রােজী জামানই আমাকে সান্ত্বনা দিয়ে মনােবল যােগায় এবং দেশে ফিরে যাওয়ার পরামর্শ দেয়। তার পরামর্শ মত আমি ঢাকা ত্যাগ না করলে হয়তাে মারা পড়তাম। মুক্তিযুদ্ধ স্বাধীনতার স্বপ্ন সাধ সব। চুরমার হয়ে যেত। মুক্তিযােদ্ধার স্ত্রী হয়ে আজ যেমন সে গর্বে সমুন্নত তেমনি সেদিন তাঁকে অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্টও ভােগ করতে হয়েছে। দুঃখ কষ্ট সহ্য করেছে আমার ছােট ছােট ছেলে। মেয়েরা। বিশেষ করে আলফাপুর অপারেশনের সময় রত্নার হাট গ্রামে আমার স্ত্রী,
বড়ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান ছােট ছেলে শহীদুজ্জামান নাভিদ দুই মেয়েকে নিয়ে আর্মির আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে সাবি নগর চলে যায়। কিন্তু সে মুক্তিযােদ্ধার স্ত্রী-এই অপরাধে সেখানে কোন ঠাই না পেয়ে পালিয়ে মালতিহা গ্রামে যায়। সেখান থেকেও একই ভাবে বিতাড়িত হয়ে ধলহচন্দ্র গ্রামে যায়। তার একটিই অপরাধ সে একজন মুক্তিযােদ্ধার স্ত্রী। তাকে আশ্রয় দিলে যে কোন বিপদই ঘটতে পারে। সেই আশংকায় কেউ আশ্রয় দিতে রাজী হয়নি। আমার ছােট ছােট ছেলে মেয়েদের দু’জনকে ঘাড়ে দু’জনকে দুই হাতে নিয়ে গ্রামের পর গ্রাম, দ্বার থেকে দ্বারে তাঁকে ছুটতে হয়েছে। অথচ এ দেশের প্রতি ইঞ্চি মাটির জন্য যার স্বামী প্রত্যক্ষ ভাবে। যুদ্ধ ক্ষেত্রে লড়ে যাচ্ছে তার স্ত্রী কোথাও এতটুকু ঠাই পাচ্ছেনা । না খেয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণার অসহ্য যন্ত্রণা নিয়ে সে এমনি ভাবে নিজেকে এবং সন্তানদের রক্ষা করার চেষ্টা করেছে। শুধু সন্তানই নয় আমার বৃদ্ধা মাও ছিলেন তার সাথে। এহেন অবস্থায় আমার সন্তান বিশেষ করে ওয়াহিদুজ্জামান ,শহীদুজ্জামান (নাভিদ) ওদের মধ্যে ছিল আশ্চর্য মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। ওরা জানে বাবা যুদ্ধ করছে দেশ স্বাধীন। হবে। এ সমস্ত দুঃখ কষ্ট সাময়িক, তারা ভুলে যায় তাদের ক্ষুধা তৃষ্ণার কথা। এবং এরা দু’ভাই প্রয়োজনে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করে সাহায্য করেছে। আলফা পুর অপারেশনের সময় আমার স্ত্রী এভাবে বিভিন্ন জায়গা থেকে বঞ্চিত হয়ে সাবিনগরের পাশের ধলহ চন্দ্র গ্রামে পরিত্যক্ত এক বাড়ীতে রাতে আশ্রয় নিয়েছে। খেজুরের মাদুর মাটিতে পেতে রাতে যখন ঘুমুতে গিয়েছে অমনি মাটির গর্ত থেকে ফোস ফোস করে বেড়িয়ে এসেছে অজগর সাপ। আবার সে স্থান ত্যাগ করে কিছুদুর গিয়ে এক জায়গায় জঙ্গলের পাশে আশ্রয় নিয়েছে অমনি জঙ্গল থেকে ঘ্যোৎ ঘ্যোৎ করে বেড়িয়ে আসে দাঁতাল শুয়াের। অথচ মেয়ে মানুষ রাতের অন্ধকারে একা অসহায় ভাবে এক স্থান থেকে অন্য স্থানে পালিয়ে পালিয়ে কোন মতে সন্তানদের নিয়ে সে জীবন রক্ষা করেছে। মুক্তি যােদ্ধা কমান্ডারের স্ত্রী হিসেবে কোথাও থেকে ন্যূনতম সহযােগিতা আমার স্ত্রী পায়নি। আমরা আলফাপুর অপারেশন শেষ করে ফিরে এসে আর স্ত্রী সন্তানদের পাইনা। খুবই দুঃশ্চিন্তায় পড়ে যাই। অবশেষে অনেক খোঁজাখুজির পর আমার বােনের বাড়ী হজিপুর থেকে তাদের উদ্ধার করে আনি। রাতের পর রাত দিনের পর দিন এই ভাবে তারা পায়ে হেটে হেটে ১৫/২০ মাইল রাস্তা পেরিয়ে ক্ষুধা তৃষ্ণার জ্বালা নিয়ে। অবর্ননীয় দুঃখ কষ্ট সহ্য করে বােনের বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় পায়। এরকম ভাবে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে তারা অবর্ণনীয় দুঃখ কষ্ট ভােগ করে।
আভ্যন্তরীণ ষড়যন্ত্রের শিকার আমি শহীদ হাবিলদার কোবাদ আলী রতনপুর ক্যাম্পে থাকাকালীন সময়ে আমরা ছােটখাটো আরাে কিছু অপারেশন করি। আর এ সমস্ত অপারেশনের ফাঁকে ফাঁকে মােটিভেশনই ছিল কার্যতঃমূখ্য। এভাবে যখন মােটিভেশনে ব্যস্ত আমি। একদিন ক্যাম্পে সংবাদ এলাে ফাজিলপুরে কিছু রিলিফের মাল ধরা পড়েছে। আমি সশস্ত্র অবস্থায় কয়েকজন সেনাকে নিয়ে গেলাম। দেখলাম সাহায্যের জন্য যে সমস্ত রিলিফ গুড় আসছে সেগুলাে এলাকার কিছু স্বার্থান্বেষী প্রভাবশালী ব্যক্তি গরীবদের মধ্যে বিতরণ না করে নিজেরাই আত্মসাৎ করছে। আমি যাওয়ার পরই এদের কিছু সংখ্যক পালিয়ে গেলাে আর যারা ছিলাে তারা ক্ষমা চাইলাে এবং ভবিষ্যতে এমন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলাে। আমি হত্যা নির্যাতনের চেয়ে সংশােধনটাই বেশী পছন্দ করতাম। ওদেরকে সংশােধন হতে সুযােগ দিয়ে এখনকার মত নিজেরাই সুষ্ঠুভাবে জনগণের মধ্যে গম। বিতরণ করে এলাম। ক্যাম্পে ফেরার পর বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেলাম সােনা মােল্লা কয়েকজন নিজস্ব ছেলেকে নিয়ে কি সব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। এমন কি আমার খুবই বিশ্বস্ত দুজন মুক্তিযােদ্ধা তথ্য দিল ওরা আপনাকেও মেরে ফেলতে ষড়যন্ত্র করছে। বুঝতে পারলাম না কি আমার অন্যায় কি আমার অপরাধ? দেশের মাটিকে মুক্ত করতে সৎভাবে লড়ে যাচ্ছি এটাই কি অন্যায়? এর বাইরে সচেতন ভাবে আমি তাে কোন অন্যায় করিনি। তবে আমার অধিনায়ক শৈলকুপা হিসেবে স্বীকৃতি প্রাপ্তির পরই কিছু লােকের মধ্যে এক জাতীয় ঈর্ষার সৃষ্টি হয়। কি কারণে কেন ঈর্ষা করে জানি। আপাতঃ এই একটি কারণই আমার স্পষ্ট হয় যে আমাকে যারা অধিনায়ক হিসেবে মেনে নিতে দ্বিধা গ্রস্থ তাদের মধ্যেই এ ষড়যন্ত্রের বীজ উপ্ত হয়েছে। তবু এদের নিয়ে আমি কাজ করে যাচ্ছি। স্পষ্টত কাউকে চিহ্নিত করতে পারছি না। আর এদের সবাইকেই আমার আপনজন স্বজন বলেই মনে হতাে। কাকে আমি সন্দেহ করব? বিশ্বাস তাে আমাকে কাউকে না কাউকে করতেই হবে। এরি মাঝে হঠাৎ একরাতে সােনা মােল্লা সেই সব ছেলেকে নিয়ে ক্যাম্পে এলাে। আমাকে জানালাে একটা অপারেশন আছে। কিন্তু আমরা নিজেরাই করতে পারব; আপনার প্রয়ােজন নেই। আপনি শুধু আপনার স্টেনগানটা আমাদের দিন। প্রতিটি অপারেশন মানেই কোন না কোন ভাবে আমাদের সাফল্য। সে সাফল্য যার। মাধ্যমেই অর্জিত হােক না কেন সেটা কথা নয় কথা হলাে সাফল্য আসুক। আমি ওদের একান্ত ভাবে বিশ্বাস করে সরল মনে স্টেনগানটা দিয়ে দিলাম ।
আমি জানি যুদ্ধের মাঠে অস্ত্রের চেয়ে আপন আর কিছুই নেই। কোন অবস্থাতেই অস্ত্র হাতছাড়া করা উচিত নয়, তবু আমি সরল বিশ্বাসে আমার সহযােদ্ধাদের অস্ত্র দিয়ে দিলাম। যদিও দেশে আসার পরপরই এই সােনা মােল্লার নামে বিভিন্ন অভিযােগ আমার কানে এসেছিল। এবং মাঝে মধ্যে এখনও আসে। তবু সােনা মােল্লা সম্পর্কে আমার এতদিনে একটা বিশ্বাস সৃষ্টি হয়েছিল যে; অন্তত আমার ছত্রছায়ায় এসে সে এখন সঠিক পথেই চলছে। আমার কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে ওরা রাতে অনেক দূর এক গ্রামে গিয়ে নিজেদের মধ্যে মিটিং করে সিদ্ধান্ত নেয়। তারপর দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে সকাল বেলা এক এপ যায় রতনপুর ক্যাম্পের দিকে অন্য গ্রুপ আমার ঘাম মীন গ্রামের দিকে। তখনও এদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কেউ কিছু জানে না। সকাল বেলা আমার অত্যন্ত ঘনিষ্ট সহযােগী সহযােদ্ধা ই.পি.আর এর হাবিলদার কোবাদ আলী ক্যাম্প থেকে গ্রামের বাড়ীতে যেতে অনুরােধ করলাে। কিন্তু আমি গেলাম না। তখন পাবনা এবং অন্যান্য জায়গা থেকে কিছু লােক এসেছে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে ভর্তি হতে। আমি তাদের সাথে কথা বলে যখন বাড়ীর দিকে যাচ্ছি। তখন বেশ বেলা হয়েছে। আমি ওয়াপদার ক্যানেলের কাছাকাছি পৌঁছতেই দেখি আমার মা ছােট ভাই স্ত্রী ছেলে। এগিয়ে আসছে। ওরা কাঁদতে কাঁদতে জানালাে সােনা মােল্লারা হাবিলদার কোবাদ আলীকে মেরে ফেলেছে। আমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়লাে। কোবাদ আলীর মত এমন বিশ্বস্ত সাহসী যােদ্ধা আর হয় না। বিশেষ এক অপারেশনে সারা দিন সে পাকবাহিনীকে ফায়ারিং করে ঠেকিয়ে রাখে। সে কখনাে ভারতেও যেতে চায়নিভয় পায়নি। জানি না কি অপরাধে কি স্বার্থ চরিতার্থ করতে এরা কোবাদ আলীর মত মুক্তিযােদ্ধাকে মেরে ফেললাে? আমি খুবই মর্মাহত হলাম এবং ঘটনার আকস্মিকতায় ভেঙ্গে পড়ি। মুক্তিযােদ্ধা হয়ে এমন একজন বীর মুক্তিযােদ্ধাকে মেরে ফেললাে! আমি কেঁদে মাটিতে বসে পড়লাম। এরা আরাে জানালাে আমার ভগ্নিপতি সহযােদ্ধা চাঁন মিয়াকেও ওরা ধরে নিয়ে গিয়েছিলাে। কিন্তু আমার বৃদ্ধ বাবা মা গিয়ে ওদের হাতে পায়ে ধরে কান্না কাটি করে ছাড়িয়ে এনেছে। অবশ্য দুষ্ট লােককে বিশ্বাস অর্বাচীনেরই কাজ। সােনা মােল্লা সম্পর্কে আমার অনেক আগে। থেকেই সতর্ক থাকা উচিত ছিল। ওর আনুগত্য ছিল কপট আনুগত্য, এর ছদ্মাবরণে ও শুধু এতদিন সুযােগই খুঁজে ফিরছিল, তার সদ্ব্যবহার করলাে এ মুহূর্তে। কোবাদ আলী এবং চান মিয়া আমার গ্রুপের সাহসী যােদ্ধাদের মধ্যে অন্যতম এবং আমার বিশ্বস্ত সহযােগী। ঘটনা থেকে অনুমান করলাম আমিও ওদের
লিস্টের বাইরে নই। কেননা ওরা আমাকে ঘিরেই ষড়যন্ত্র করেছে, এজন্য আমার ঘনিষ্টদেরই প্রথম টার্গেট করে হত্যা করলাে। কোবাদ আলীর মৃত্যুতে আমার মন একে বারেই ভেঙ্গে যায়। খুব হতাশ হয়ে পড়ি। আমার স্টেনগানটাও ওদের চক্রান্তে লস্ট করলাম। কোবাদ আলী সকালে ক্যাম্প থেকে ফিরে আমার বাড়ীতে নাস্তা করে বিশ্রাম নিচ্ছিলাে। এমন সময় সােনা মােল্লা তার দোসরদেরসহ এসে কোৰাদ আলীকে। জানালাে অপারেশন আছে। আমাদের সাথে যেতে হবে। পূর্বেই বলেছি কোবাদ আলী ছিল সাহসী যােদ্ধা, তাই অপারেশনের কথা শুনে তার রক্ত টগবগিয়ে উঠে। সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে উঠে বললাে চলুন। কোবাদ ঘুর্ণাক্ষরেও তাদের এ ষড়যন্ত্রের। কথা জানতে পারেনি, তাই সরল মনে সে পথ চলছিলাে। তাছাড়া সে আগে থেকেই কিছুটা সরল প্রকৃতির ছিল। সকালে যখন আমাকে বাড়ীতে আসতে অনুরােধ করলাে আমি এলাম না বলে ও রাগ করেই চলে এলাে। এটা ছিল ওর সরলতারই বৈশিষ্ট্য। যা হােক যখন কোবাদ আলী মনে মনে যুদ্ধের এক দুঃসাহকি সংকল্প নিয়ে পথ চলছিল। তখন আমাদের গ্রামের স্কুলের কাছাকাছি আসতেই পিছন দিক থেকে ওরা কোবাদ আলীকে বেঁধে ফেলে কানের মধ্য দিয়ে গুলী করে। বীর মুক্তিযােদ্ধার তেজস্বী শরীরটা তখন মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। আমি কোবাদ আলীর লাশ দেখে বিচলিত হয়ে যাই, কি ভয় শূন্য দুটি চোখ আগুনের মত তখনও জ্বলছে শত্রু ধ্বংসের সংকল্পে। এমন নিঃশঙ্ক চিত্তের অকুতােভয় সৈনিকের বর্বরােচিত মৃত্যু। আমার স্মৃতি থেকে কখনাে মুছে যাবে না। এদের সাথে আর কিভাবে কাজ করব ভেবে পাই না। আমার কাছে অস্ত্র নেই। আমাকে আবার নতুন করে সংগঠন করতে হবে। দলকে নতুন ভাবে সংগঠিত করার প্রয়ােজন হয়। ইতােমধ্যে আমি অস্ত্রের জন্য কয়েকটি অপারেশন করি। সহজ বিজয় সূচক এই সমস্ত অপারেশন থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার হলে আমি নতুন। বল আর উদ্যম নিয়ে এগুতে থাকি। আমার নিজস্ব এলাকা আর আমার কাছে নিরাপদ নয় ভেবে ২০/২৫টির মত রাইফেল নিয়ে পূর্বে শ্রীপুরের দিকে সরে যাই। শ্রীপুর বাহিনী আমাকে সাদরেই গ্রহণ করলাে । শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হােসেন অনেক আগেই অনুরােধ করেছিল আপনিই আমাদের কমান্ড দিন। আমরা আপনার কমান্ড ফলাে করে আপনার অধীনে থেকে যুদ্ধ করব। আপনিই আমাদের কমান্ডার। আমি বলেছিলাম তুমি একজন অধিনায়ক, তােমার বাহিনী শ্রীপুর বাহিনী আমার শৈলকূপা বাহিনী। দুটি ভিন্ন বাহিনীই থাকুক আমরা প্যারালাল ভাবে কাজ করব। প্রয়ােজনে একে
অপরকে সাহায্য করব। যাহােক আজ শ্রীপুর বাহিনীর সেই দিন এলাে। আর আমার এলাে গ্রহণের দিন। আমি এদের সাথে মিলে মিশে কাজ শুরু করলাম। নতুনভাবে অস্ত্র সংগ্রহ এবং মুক্তিযােদ্ধা সংগঠিত করায় আত্ম নিয়ােগ করলাম। খুব। স্বল্প সময়েই ইনশাআল্লাহ আমার বাহিনী আবার একটি সুসংগঠিত বাহিনীতে রূপ। নিল। আমরা নতুন উদ্যম নিয়ে আবার অপারেশন শুরু করলাম। কতিপয় প্রভাবশালী ব্যক্তিকে মুক্তিযুদ্ধের স্বপক্ষে উদ্বুদ্ধ করণ পাকবাহিনী এদেশীয় দোসর দালালদের সাহায্যে আমাদের অনুসন্ধান করেছে, ঢুকেছে ঘরে ঘরে। এ সমস্ত সাহায্যকারীদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন সমাজের বিত্তবান ও প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। একদিন আমাদের ক্যাম্পে সংবাদ এলাে জনৈক মােক্তার হােসেন তৎকালীন মুসলীম। লীগ পরবর্তীতে উপজেলা চেয়ারম্যান ছিলেন। প্রথম দিকে উনি মুসলীম লীগ। করতেন। কিন্তু উনার এলাকায় মােটিভিশনের সময় আমার বক্তৃতায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সম্পূর্ণ ভাবে মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন। এবং পরবর্তীতে আমাদেরকে সাহায্য করেছেন। আমাদের যেহেতু কোন রেশনিং এর ব্যবস্থা এবং সুনির্দিষ্ট সাের্স ছিল না বিধায় অর্থনৈতিক সমস্যা ছিল প্রকট। এ অবস্থায় আমরা এলাকার বিত্তবান ধনাঢ্য ব্যক্তিদের থেকে কিছু কিছু সাহায্য নিয়ে দল পরিচালনা করেছি। তাদেরকে নিয়ে মিলে মিশে কাজ করেছি। আমাদের পাশের মালতিহা গ্রামের জনৈক মােজাহার আলী ছিলেন পাকবাহিনীর একজন অন্যতম দোসর। অত্র এলাকায় তিনি জমিদার হিসেবে খ্যাত। পাকসেনারা। এলে তিনি তাদের অত্যন্ত আন্তরিক পরিবেশে আপ্যায়ন করতেন। খাসী জবাই করে বড়বড় রুই মাছ এনে তাদেরকে খাওয়াতেন। বিভিন্ন রকম তথ্য সরবরাহ করতেন। আমি এ সংবাদ জেনেও প্রথমে তাকে আঘাত না করে সংশােধন হবার সুযােগ দিই। অন্যভাবে চিন্তা করে আমি মােজাহার আলীকে শাস্তিদান করা থেকে বিরত থাকি। কেননা গ্রামে এ সমস্ত লােকের সাথে বিরাট সংখ্যক জনতা রয়েছে। এদেরকে শাস্তি না দিয়ে বরং কৌশলে আয়ত্বে আনতে পারলে পুরাে গ্রুপটাকেই। পাওয়া যাবে। কিন্তু চোরে না শােনে ধর্মের কাহিনী। মােজাহার আলীকে যতবারই সংশােধনের সুযােগ দেয়া হলাে ততবারই তিনি ভিন্ন পথে প্রবাহিত হলেন। অর্থাৎ একের পর এক অপকর্ম করে যেতে থাকেন। ইতােমধ্যে একদিন শুনলাম মােজাহার আলী লাঙ্গল বাঁধের এক হিন্দু ব্যবসায়ীর গুদাম লুট করে নিয়ে গেছে। উক্ত ব্যবসায়ী তখন আমাদের শরণাপন্ন হয়ে বিচার দাবী করে। আমাদের সুনাম এবং সুষ্ঠু পরিচালনার জন্য এলাকায় অনেক হিন্দুরা পর্যন্ত নিরাপদে অবস্থান করছিলাে। কিন্তু
এ মুহূর্তে এ ধরনের ঘটনার প্রেক্ষিতে আমাদের সমস্ত প্রশংসা ধুলায় লুটাবে। অতএব সঙ্গে সঙ্গে আমি রান্ন নামে একজন ই.পি.আর এর নায়েককে পাঠালাম। মােজাহার আলীকে ধরে আনার জন্য। কিন্তু অসুস্থতার অভিযােগে তিনি এলেন না। পরে দু’জন কমান্ডারকে পাঠিয়ে বললাম তিনি অসুস্থ হলে প্রয়ােজনে ঘােড়ার গাড়ীতে করে নিয়ে আসবে। তাকে বলবে এটা আমার নির্দেশ। অনতি বিলম্বে আমার সঙ্গে দেখা করতে হবে। পরবর্তীতে মােজাহার আলী নির্দেশ মতাে আমার কাছে হাজির হলাে। আমি লুটকৃত অর্থের হিসাব করে সমপরিমাণ টাকা উক্ত হিন্দু ব্যবসায়ীকে ফেরত দেয়ার এবং মুক্তিযুদ্ধে আর বিরােধিতা না করার প্রতিশ্রুতি নিয়ে ছেড়ে দিলাম। কয়েক দিনের মধ্যে সমুদয় টাকা পরিশােধ এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলেন উক্ত মােজাহার আলী। মােজাহার আলীদের মত অনেক লােককে শুধু হত্যা করে একটি ব্যক্তিকে নিঃশেষ করে কি হত? তার চেয়ে তাদেরকে কৌশলে আয়ত্বে এনে অনেক বড় রকম স্বার্থই উদ্ধার হয়েছে। এ জাতীয় লােকদের প্রত্যক্ষ সহযােগিতা পরবর্তীতে মুক্তিযােদ্ধারা পেয়ে উপকৃতই হয়েছে। আমাদের এলাকার এরিয়া কমান্ডার ক্যাপঃ ওয়াহাব (পরবর্তীতে ব্রিগেডিয়ার) তখন বিভিন্ন ক্যাম্পের খোজ খবর নিতে এলাকায় এলেন। উনাকে আমি আন্তরিক ভাবে অভিনন্দন জানালাম। কিন্তু আমার ক্যাম্পে Stay করলেন না, পাশে একটা ক্যাম্প তৈরি করে সেখানে অবস্থান নিলেন। ক্যাপ্টেন ওয়াহাব সাহেবের নিকট একটা অয়্যারলেস সেট ছিলাে। তা দিয়ে ভারত ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ স্থানে যােগাযােগ করা হত। আমরা এখান থেকে ভারতে অস্ত্র চেয়ে অয়্যারলেসে কথা। বললাম। খুব স্বল্প সময়ের মধ্যে অস্ত্র এসে গেলাে। ক্যাপঃ ওয়াহাব সাহেব আমাদের সাথে কয়েকদিন বিভিন্ন জায়গা অর্থাৎ মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প পরিদর্শন। করেন। অবশেষে ফরিদপুরের পাংশাতে অবস্থান নিলেন। এরিয়া কমান্ডার হিসেবে তার থেকে বিভিন্ন রকম সহযােগিতা পেয়েছি। যা আজ কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছি। আমরা রণনীতি অবলম্বন করে এক জায়গায় বেশী সময় অতিবাহিত করিনি। কেননা কোন না কোন ভাবে আমরা আক্রান্ত হতে পারি। তাই এক বাড়ী ছেড়ে অন্য বাড়ীতে এমনকি একই রাতে কয়েক বার অবস্থান পরিবর্তন করতে হতাে। আমাদের। আমার বিভিন্ন অপারেশন সাকসেসফুল, শত্রু নিধন এবং অস্ত্র সংগ্রহের সংবাদ। জেনে ক্যাপঃ ওয়াহাব আমাকে দারুনভাবে এনকারেজ করেন। এবং যে কোন। ধরনের সাহায্য সহযােগিতার পূর্ণ আশ্বাস দিলেন।
নাকোল, শ্রীপুর থানাসহ কতিপয় অপারেশন রণকৌশলের অংশ হিসেবে আমরা প্রায়ই স্থান পরিবর্তন করি। বিশেষ করে রাত্রি যাপনের ব্যাপারে অধিকতর সচেতন থাকতে হয়। আর আমাকে অধিনায়ক হিসেবে এ ব্যাপারগুলাে বিশেষভাবে ভাবতে হয়। কেননা আমার পরিকল্পনা এবং সিদ্ধান্তের উপর নির্ভর করে অনেকগুলাে মুক্তিযােদ্ধার জীবন মরণ। আমরা উপর্যপুরী কয়েক বার পাকবাহিনীর ছােবলে স্থানত্যাগ করে গােয়াল বাড়ী গ্রামে আছি। সারা রাত বিলের মধ্যে কাটিয়ে দিচ্ছি। বিশ্বস্ত সংবাদের ভিত্তিতে। যখন জানলাম শত্রু বাহিনী চলে গেছে তখন এলাকায় ফিরে সব মুক্তিযােদ্ধাদের ক্লোজ করলাম। এর মধ্যে হঠাৎ সংবাদ এলাে পাকবাহিনী শ্রীপুর থানার নাকোল গ্রাম আক্রমণ করে বাজার জ্বালিয়ে দিয়েছে। খবর পেয়ে আমি দ্রুত আমার বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হলাম। শ্রীপুর থেকে সংবাদ পেলাম শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হােসেন তার গ্রুপ নিয়ে এগিয়ে আসছে। আমরা অগ্রসর হয়ে রেঞ্জের মধ্যে পৌছে প্রস্তুতী গ্রহণ করলাম। কিন্তু দীর্ঘ সময় শত্রুবাহিনীর অদূরে অপেক্ষা করেও যখন শ্রীপুর বাহিনীর কোন সাড়া পেলাম না তখন আমার মন ভেঙে গেলাে। কেননা আমরা শৈলকূপা বাহিনী হয়েও শ্রীপুরের অস্তিত্ব রক্ষার্থে জীবন বাজী রেখে এগিয়ে গিয়েছি। অথচ শ্রীপুর বাহিনী তাদের নিজস্ব অস্তিত্ব রক্ষার্থে এগিয়ে এলাে না। আমি দেখলাম বিশাল পাকবাহিনীর সাথে আমরা স্বল্প সংখ্যক সৈন্য বাহিনী হালকা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে টিকে উঠতে পারব না। আমাদের সর্বাত্মক প্রস্তুতী এবং ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও রিট্রিট করতে বাধ্য হলাম। এর কয়েক দিন পর পাকিস্তান সরকারের অধীন শ্রীপুর থানাস্থ পুলিশ বাহিনী পালিয়ে যাবার পর আমরা খবর পেলাম পাকবাহিনী শ্রীপুর থানায় অবস্থান নিতে আসছে। এই শূন্য স্থানে দখল নিয়ে ওরা আস্তে আস্তে সমস্ত এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করবে। এবারও আমাদের অস্তিত্বের প্রশ্ন; বিশেষ করে আমাদের এলাকায়ও অর্থাৎ শৈলকূপাতে এর প্রভাব পড়বে। শ্রীপুর বাহিনীর অধিনায়ক আকবর হােসেনই আমাকে ওদের অগ্রসরের সংবাদ দিলাে। আমি আকবর হােসেনকে বললাম তােমার ফোর্স দাও। আকবর হােসেনের ফোর্স এলে আমি। আমার ফোর্স সহ অগ্রসর হলাম পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করতে। এ সময় বিশেষ করে আমার সাথে ছিলেন আমার সহ যােদ্ধা কমান্ডার চান মিয়া। ইনি এবং কোবাদ।
আলী পূর্বেই বলেছি সব সময় আমার মনােবল যােগাত। আজ কোবাদ আলী শহীদ। হয়েছেন, তিনি আমার সাথে নেই আছেন চান মিয়া। আমার গ্রুপ নিয়ে ফ্রন্টে যাচ্ছি হঠাৎ আকবর বাহিনী পিছু হটা শুরু করলাে। পাকবাহিনীর অগ্রযাত্রার খবর পেয়েই তারা পিছু হটা শুরু করলাে। আমি পিছিয়ে এসে আকবরকে সংবাদ দিয়ে আনিয়ে বললাম তােমার দল ভীরু দূর্বল এরা সামনে এগুতে ভয় পায়। আকবর হােসেন এদেরকে খুব রাগা রাগি করলাে। এরপর আমি সেনাদের উদ্দেশ্যে তেজোময় বক্তৃতা দিয়ে তাদের উদ্বুদ্ধ করলাম । সৈন্যরা যখন এ পর্যায়ে আবার সামনে এগুতে প্রস্তুতী নিচ্ছিলাে তখন আমি বরিষাট গ্রামের শেষ দিকে একটা বটগাছে উঠে শত্রুদের অবস্থান সম্পর্কে খোঁজ নেয়ার চেষ্টা করলাম। গাছে উঠে দেখলাম এখান থেকে প্রায় দেড় মাইল দূরে তাদের অবস্থান। কিন্তু বাহিনীতে পাকসেনার পরিবর্তে রাজাকারদের সংখ্যাই বেশী। দ্রুত গাছ থেকে। নেমে সৈন্যদের ফরওয়ার্ড মার্চের নির্দেশ দিলাম। এবং শত্রু সম্পর্কে অভয় দিলাম। আমরা তিনটি ফ্লাঙ্কে বিভক্ত হয়ে আক্রমণ রচনা করলাম। এ সময় পূণরায় আমি স্টেনগান সংগ্রহ করেছি। আমার কাছে স্টেনগান এক আর্মি সেনার কাছে ছিলাে একটা এল,এম,জি। এগুলাে নিয়ে তিন ফ্লাংকে অগ্রসর হওয়ার পরই ইট খােলায় রাজাকাররা আক্রান্ত হয়। আমরা ওদের নিকটবর্তী অবস্থানে পৌঁছানাের পরই বিনা যুদ্ধে সতের জন রাজাকার হাত উচু করে সারেন্ডার করলাে। রাজাকারদের সঙ্গে কোথাও আমাদের তেমন কোন রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়নি। বিনা যুদ্ধেই সাধারণত ওরা সারেন্ডার করে। কেননা ওদের তেমন প্রশিক্ষণ নেই আর ওরা ছিলাে খুব ভীতু প্রকৃতির। যাহােক সতেরজন রাজাকার সারেন্ডার করলাে আর বাকীরা দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করলে আমরা পিছু নিলাম। ধাওয়া করে চৌদ্দজন রাজাকারকে ধরে ফেললাম। বাকীদের তিন মাইল পর্যন্ত ধাওয়া করে নিয়ে গেলাম কিন্তু ধরতে পারলাম না। ওরা পালিয়ে মাগুরা চলে গেলাে। এদিকে আমাদের আক্রমণ ও অগ্রযাত্রার খবর শুনে এরিয়া কমান্ডার ক্যাপ্টেন। ওয়াহাব সাহায্যের জন্য এগিয়ে এলেন। উনি তখন মুক্তিযােদ্ধাদের ক্যাম্প পরিদর্শন ও এলাকার খবর জানার জন্য খামার পাড়া বাজারে এসেছিলেন। কিন্তু তখন আমাদের আর কোন সাহায্যের প্রয়ােজন ছিল না। ওয়াহাব সাহেব আমাদের এ সাফল্যে ধন্যবাদ জানালেন। এলাকার লােকজনও আমাদের ধন্যবাদ জানাতে থাকলেন। এলাকাবাসী জানালাে আপনারা ঠিক সময়ে ওদের প্রতিরােধ করতে না পারলে আমাদের গ্রামে ঢুকে ওরা অমানুষিক অত্যাচার করে সম্পূর্ণ গ্রাম জ্বালিয়ে দিতাে। ওদের কার্যক্রমই ছিলাে এরকম, গ্রামে ঢুকে নিরীহ শিশু-কিশাের-বৃদ্ধদের হত্যা করতে মেয়েছেলেদের ক্যাম্পে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করতাে।
বাড়ীতে সাধারণত যুবকদের না পেয়ে এ কাজটিই করত। আর যুদ্ধের চেয়ে এ কাজটিতেই অর্থাৎ গ্রাম জ্বালানাে, শিশু-কিশাের হত্যাতেই ওরা বেশী পারদশী। ছিল। যাহােক কমান্ডারের নির্দেশে ধরে আনা রাজাকারদের হত্যা করা হলাে। কেননা এদেরকে সুযােগ দেয়া বােকামী ওরা আমাদের বিরুদ্ধে অগ্রযাত্রায় অর্থাৎ মুখােমুখি আক্রমণে ধরা পড়েছে অতএব ওদের হত্যা করাই সমীচিন। এরপর একদিন অকস্মাৎ পাকবাহিনী শ্রীপুরে আকবর বাহিনীর ক্যাম্প আক্রমণ করে সম্পূর্ণ ধ্বংস করে ফেলে। এবং খামারপাড়া বাজার জ্বালিয়ে ভস্মীভূত করে ফেলে। কিন্তু মুক্তিযােদ্ধারা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। আমি আকবর হােসেনের কাছে গিয়ে তাকে সান্ত্বনা দিলাম। আমার নিজের এক সময়ে দূরাবস্থার কথা বলে তাকে ধৈর্য্য ধরে আবার সুসংগঠিত হতে পরামর্শ দেই এবং যথাযথ সাহায্য করি। আমি সব সময় আকবর বাহিনীর সঙ্গে প্যারালালভাবে কাজ করতে চাইতাম। বিপদে পরস্পরকে সাহায্য করার জন্য প্রস্তুত থাকতাম। কিছুদিন পর আমার বাহিনী নিয়ে আমি গােয়ালবাড়ী গ্রামে গিয়েছি। এ গ্রাম শ্রীপুরের শেষ গ্রাম। চারদিকেই পানি, মাঝখানে আমরা। হঠাৎ পথিমধ্যে আকবরের চিঠি পেলাম ‘আমরা আক্রান্ত পাকবাহিনী আসছে। জামান ভাই আপনি এগিয়ে আসুন। আমরা আক্রমণ করব।’ সঙ্গে সঙ্গে দুটি কোম্পানী নিয়ে এগিয়ে যাই। কিন্তু মাঝখানে গিয়ে দেখি আকবর বাহিনী নেই। আমরা দিশেহারা হয়ে পড়ি। সামনে বিশাল পাকবাহিনী সুসজ্জিত হয়ে আসছে। স্থানীয় দু’একজন কৃষকের কাছে জানতে পারলাম পাকবাহিনী অত্যন্ত সুসংগঠিত হয়ে এদিকে আসছে। ওরা বললাে আপনারা পালান এতবড় বিশাল বাহিনীর সাথে টিকে উঠতে পারবেন না মারা পড়বেন। আমরা বাধ্য হয়ে পশ্চাদপসরণ করি। ফিরে এসে আকবরের খোঁজ করলাম। কিন্তু কোথাও অধিনায়ক আকবর হােসেন ও তার বাহিনীকে পাওয়া গেল না। যখন পাকবাহিনী এসে আমাদের পেল না তখন তারা দুটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয় এবং ১৪ জন লােককে হত্যা করে। আমি এভাবে বারবার আকবর বাহিনীর অসহযােগিতার মুখােমুখি হচ্ছি। তবুও ধৈৰ্য্য হারাইনি, নিজ বাহিনীর উপর ভরসা করেই অভিযান পরিচালনা করতে থাকি। আমাদের গ্রুপ থেকে বিচ্ছিন্ন হবার পর সােনা মােল্লা ২০০ জন মুক্তিযােদ্ধাকে সংগঠিত করে মীনগ্রাম থেকে ১ মাইল দূরে আবাইপুর নামক স্থানে অবস্থান নিয়েছিলাে। এখান থেকে তারা প্রথম পাকবাহিনী দ্বারা আক্রান্ত হয়। পাকবাহিনীর। সাথে যুদ্ধে ২৮জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়। তাদের স্মৃতি ফলক আৰাইপুর ইউনিয়নের গােডাউনের পাশে রয়েছে। কিছু দিন পর আমি কামারিয় গ্রাম এসে গুলীর আওয়াজ পেয়ে এগিয়ে এসে জানতে পারলাম ঘটনা। এ ঘটনায় খুবই দুঃখ পেলাম এবং মর্মাহত হলাম। যে সমস্ত মুক্তি যােদ্ধাদের আমি বুদ্ধি খাটিয়ে পরিকল্পনা করে নিরাপদে রেখেছি এবং বর্তমান বাহিনীকেও রাখছি অথচ সােনা মােল্লার অদূরদর্শীতা এবং পরিকল্পনার অভাবে এভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের প্রাণ দিতে হলাে। সােনা মােল্লা কেন জেনে শুনে পাকবাহিনীর এত নিকটবর্তী স্থানে অবস্থান নিলাে? আর আমাকেও জানাল না। শ্রীপুরে পাকবাহিনী আবাইপুর আক্রমণ করে দক্ষিণে ক্যানেলের পারে অবস্থান নিলাে। সােনা মােল্লা তার বিশ্বস্ত লােক নিয়ে আর কাউকে না জানিয়ে একটি ফ্লাঙ্ক ছেড়ে দেয়। পাকবাহিনী ক্রলিং করে এগিয়ে এসে শূন্য ফ্লাঙ্কটি দখল করে নির্মমভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের মেরে ফেলে। কখনাে এভাবে পরিকল্পনা ছাড়া যুদ্ধ করা যায় না। যুদ্ধের কৌশল হিসেবে সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে শত্রুর মুখােমুখি হতে হবে, নিরাপদ অবস্থানে থেকে আক্রমণ করতে হয়। সােনা-এর কিছুই করেনি শুধু তার অদূরদর্শীতার কারণে নজরুলসহ ২৮জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন। তারা ঘেড়ের মধ্যে পড়ে যায় এবং নির্মমভাবে নিহত হয়। আমি ছুটে গিয়ে দেখলাম তখন সব শেষ। ডেড বডিগুলাে সংগ্রহ করে এনে কবরস্থ করলাম। এবং এ রণক্ষেত্র থেকে কিছু অস্ত্র উদ্ধার করলাম। এরমধ্যে আমার অনুগত অনেক সৈন্যই ছিল। বুক ফেটে কান্না আসছে। চোখের জলে ওদের সমাধিস্থ করে ফিরে এলাম। এর কিছু দিন পর হঠাৎ করেই পাকবাহিনীরা আমাকে খুঁজতে এসে আমার পিতা কেরামত আলী জোয়ার্দারকে মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডারের পিতা হিসেবে ধরে নিয়ে যায়। আমার বাবার অপরাধ তিনি একজন মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডারের পিতা। তাই তাকে আমাদের মীনগ্রাম থেকে ধরে পাশের নদীর মধ্যে নিয়ে যায়। সেখানে নিয়ে। তাকে হত্যার সম্পূর্ণ প্রস্তুতী সম্পন্ন করে। বাবাকে ওরা চোখ বেঁধে কলমা পড়াচ্ছেন। এমন সময় আমার বড়ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান দৌড়ে ঘটনা স্থলে গিয়ে কাদতে কাদতে উর্দুতে বলতে থাকে আপনারা আমার দাদাকে মারবেন না । আমার মা পাকিস্তানী মহিলা।’ ওরা এই ছােট্ট ছেলের মুখে উর্দু কথা এবং ওর মার কথা শুনে বেশ কৌতুহলী হয়ে ওঠে। ওরা এরপর ওয়াহিদকে নানা প্রশ্ন করে, ‘তােমার মা পাকিস্তানের কোথাকার মেয়ে? তিনি এখন কোথায় আছেন? ওয়াহিদুজ্জামান নির্ভীকভাবে এসব প্রশ্নের উত্তর দিয়ে যাচ্ছিলাে। এতে ওরা খুশী হয়ে শেষ পর্যন্ত বাবাকে ছেড়ে দেয়। এদিন পাকবাহিনী কম্বিং অপারেশনে এসে ক্যাপঃ ওয়াহাবকেও ধরার চেষ্টা করে। কিন্তু উনি সময়মত সরে এসে প্রাণে রক্ষা পান।
পূর্বেই বলেছি আমার দুই ছেলে ওয়াহিদুজ্জামান এবং শহীদুজ্জামান (নাভিদ) এই বয়েসেই যথেষ্ট সাহসিকতার পরিচয় দেয়। ওদের বাবা মুক্তিযুদ্ধ করছে জেনে ওরা মুখ বুজে অনেক কষ্ট সহ্য করে গেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মনে রেখে সাহসের সাথে অনেক কাজ করেছে। পাকবাহিনীরা যখন বাবাকে ধরে নিয়ে গিয়েছিলাে তখন বড় ছেলে এমনভাবে সাহসিকতার সাথে মােকাবিলা না করলে হয়ত তিনি। মারা যেতেন। অপারেশন শৈলকূপা -২ নভেম্বরের শেষ দিকে শৈলকূপায় পাক সেনাদের ঘাঁটি আবার খুব শক্তিশালী হয়ে ওঠে। ভারত থেকে ফিরে প্রথমেই আমরা এখানে অপারেশন করি। তখন যে সমস্ত সৈন্যরা পালিয়ে যায় পরবর্তীতে তারা এবং যশাের থেকে কয়েক প্লাটুন আর্মি এসে এখানে শক্তিশালী অবস্থান গড়ে তােলে। ফলে শৈলকূপায় পূণরায় অপারেশন খুব জরুরী হয়ে পড়ে। এ মতাবস্থায় ৮৯নং সেক্টরের এরিয়া কমান্ডার ক্যাম্পঃ। ওয়াহাবের নির্দেশে এবং সাব এরিয়া কমান্ডার লেঃ মােস্তফার (পরবর্তীতে মেজর) নেতৃত্বে উভয়ের যৌথ ফোর্স নিয়ে আমরা শৈলকূপা আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই। আমরা তথন ক্যাম্প পরিবর্তন করে কামারিয়া ক্যাম্পে আছি। এই কামারিয়া ক্যাম্প থেকে ১২ মাইল পশ্চিমে শৈলকূপা থানা । আমরা র্যাকি বাহিনীর মাধ্যমে সংবাদ পেলাম এখানে প্রচুর সৈন্য আধুনিক অস্ত্র ও গােলা বারুদ মজুদ আছে। প্রথমবার আক্রান্ত হওয়ার পর দ্বিতীয় পর্যায়ে ওরা অধিকতর শক্তিশালী অবস্থান তৈরী করেছে। বিভিন্ন এলাকাকে নিয়ন্ত্রণের জন্য এটা ছিল অত্র এলাকার শক্ত ঘাঁটি। নির্দিষ্ট দিনে আমরা পূনরায় র্যাকি বাহিনীর মাধ্যমে ওদের সর্বশেষ পরিস্থিতি জেনে অগ্রসর হলাম। ১২ মাইল পায়ে হেঁটে প্রায় রাত ২.০০ টার দিকে শৈলকূপায় পেীছলাম। লেঃ মােস্তফার সুযােগ্য নেতৃত্বে আমরা ৫টি ফ্লাঙ্কে বিভক্ত হয়ে পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ করলাম। পূর্ব থেকেই আমরা আর্মি কমান্ডে যুদ্ধ করছিলাম। বলা বাহুল্য পুরাে মুক্তি যুদ্ধ সংগঠিত হচ্ছিল আর্মি কমান্ডে। আমরা যারা আর্মি কমান্ডে কমান্ডারের নেতৃত্বেও নির্দেশে যুদ্ধ করছিলাম তারাই মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে স্বীকৃত। এর বাইরেও বিছিন্ন ভাবে অনেকে যুদ্ধ করেছে কিন্তু তারা স্বীকৃতি পায়নি। যাহােক এ যুদ্ধে আমাদের ৩ ইঞ্চি মর্টার সহ প্রচুর আধুনিক অস্ত্র শস্ত্র ছিল। ইতােপূর্বে আমরা কোন অপারেশনেই এরকম অস্ত্র ও পর্যাপ্ত সৈন্য পাইনি। উপরন্ত দু’জন এরিয়া কমান্ডারের নির্দেশনা।
আমরা ৫ ভাগে বিভক্ত হয়ে পূর্ব দিক থেকে মরণ পণ আক্রমণ চালালাম। শত্রু পক্ষও সমভাবে প্রতি আক্রমণ রচনা করে। শুরু হলাে তুমুল যুদ্ধ গুলী বৃষ্টি। কিছুক্ষণ যুদ্ধের পর বুঝতে পারলাম ওদের শক্তি অনেক বেশী। তবু আমরা মরণপণ লড়ে যাচ্ছি। উভয় পক্ষে প্রচুর হতাহত হয়। কিন্তু সকাল হয়ে যাবার কারণে আমাদের ফিরে আসতে হলাে। আহতদের ফিল্ড হসপিটালে ভর্তি করা পরবর্তীতে জানতে পারলাম আমাদের চেয়ে ওরা বেশী আহত হয়েছে। হয়ত রাত শেষ না হলে আমাদের বিজয় অর্জিত হত। প্রথমতঃ ১২ মাইল হেঁটে সৈন্যরা ক্লান্ত হয়ে যায় তারপর সারা রাত না খেয়ে সবাই যুদ্ধ করেছে। ফলতঃ এহেন পরিস্থিতিতে আমরা ফিরে আসি। সকালে কামান্না নামক গ্রামে এসে স্থানীয় লােকদের ডেকে কিছু টাকা দিয়ে বললাম আমাদের অন্ততঃ খিচুরী রান্না করে খাওয়ান। খাবার খেয়ে কিছুটা শক্তি সঞ্চয় করে আমাদের কামারিয়া ক্যাম্পে ফিরে এলাম। পরবর্তী কালে আমি যখন রাজবাড়ীতে অপারেশনে ব্যস্ত তখন আমার অধীনস্থ কিছু মুক্তিযােদ্ধা ১৪ই ডিসেম্বর পূণরায় শৈলকূপা আক্রমণ করে। ইতােমধ্যে অনেক আমিই সরে পড়েছিলাে। অল্প কিছু আর্মি এবং রাজাকার সমন্বয়ে ক্যাম্প চলছিলাে। ১৪ই ডিসেম্বর আমরা মুক্তিযােদ্ধারা শৈলকূপা আক্রমণ করে খুব সহজেই বিজয় অর্জন করে। ১৪ই ডিসেম্বর শৈলকূপা সম্পূর্ণরূপে অবমুক্ত হ’লাে। রাজাকার যারা ছিল আত্মসমর্পণ করলাে। অনানুষ্ঠানিক ভাবে শৈল কূপায় স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তলােন করা হলাে। ঘনিয়ে এলাে ডিসেম্বর আরাে কয়েকটি অপারেশন ডিসেম্বর ঘনিয়ে এলে আমাদের কিছু কিছু এলাকা পাকবাহিনীরা দখল করলাে এবং তাদের সর্বশক্তি নিয়ােগ করে আমাদের উপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকে। কিন্তু টিকে উঠতে পারে না। বিজয়ের উল্লাস তখন দিকে দিকে। এ সময় আমাদের এরিয়া কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওয়াহাব সাহেব তার ফোর্স নিয়ে ফরিদপুর পাংশায় অবস্থান করছেন। ওখানে থেকে তিনি সংবাদ পাঠালেন যশাের যখন ফল করেছে চলআমরা ঢাকা যাই। যেহেতু এরিয়া কমান্ডার এর নির্দেশ। আমি তাই ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হবার উদ্যোগ নিই। কিন্তু পাংশার কাছাকাছি এলে সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর এর নির্দেশ পেলাম তােমরা ব্যাক কর, মাগুরা ফল করেছে। যশােরের নাইন ডিভিশন সৈন্য ওখানে শিফট করেছে। মাগুরা ফল হয় এজন্য মাগুরার দিকে এলাম। তখন বিজয়ের আনন্দে গর্বিত বুকে অবমুক্ত মাগুরায় পা রাখলাম। শত দুঃখ, বঞ্চনার জ্বালা বুকে নিয়ে কষ্ট সহিঞ্চ বিজয় অর্জিত হলাে।
স্থানীয় লােকের সাহায্যে লাঙ্গল বাঁধ বাজারে বাংলাদেশের পতাকা তুললাম । মাগুরায় এসে দেখলাম ক্যাপঃ ওয়াহাব সাহেবের লােকজন অনেক লােককে এ্যারেস্ট করেছে। আমি মনে করলাম এতে স্থানীয় লােকের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ সৃষ্টি হচ্ছে। কেননা এদের সকলেই অন্যায় বা ক্ষতি করেনি অথচ তাদের বিনা কারণে এ্যারেস্ট করা হয়েছে। অসন্তোষ তীব্র এবং ধূমায়িত হওয়ার আগেই আমি তাতে হস্তক্ষেপ করি। ওয়াহাব সাহেব আমাকে ভীষণ ভালবাসতেন তাঁর কাছে। আমি ছিলাম খুবই বিশ্বস্ত। উনি আমাদের এলাকায় এসে আমার ক্যাম্পের পাশে ক্যাম্প তৈরি করলেও সারাক্ষণ আমার ক্যাম্প এবং আমার সাথেই থাকতেন। ফলতঃ এখানকার যে কোন অপ্রত্যাশিত ঘটনা তার মর্যাদাকে ক্ষুন্ন করতে পারে ভেবে আমি হস্তক্ষেপ করি। মাগুরায় ফেরার কয়েকদিন পর অর্থাৎ ডিসেম্বর-এর প্রথম দিকে এখানে ইন্ডিয়ান ফোর্স আসে। আমরা খবর পেলাম আড়পারায় রাজাকার আল বদরদের ক্যাম্প আছে। সেটা আমাদের পেছন দিকে। ইন্ডিয়ান গুর্খা বাহিনী নিয়ে আমি অপারেশন করার উদ্দেশ্যে অগ্রসর হলাম । কিন্তু রাজাকাররা ভয়ে আগেই পালিয়ে গেলাে। আড়পারা পৌঁছলে স্থানীয় পােস্ট মাস্টার এর সাথে দেখা হলাে। প্রথম যখন এপ্রিলের দিকে আমরা প্রতিরােধ আন্দোলন গড়ে তুলছিলাম তখন এখানে মিটিং করে স্থানীয় লােকদের অভয় দিয়েছিলাম এবং আশ্বাস দিয়েছিলাম ইনশাআল্লাহ। আমরা জিতবই এদেশ স্বাধীন হবে। এ সময় এই পােস্ট মাস্টার সাহেব আমার সামনে ছিলেন তার সঙ্গেও আমার কথা হয়েছিলাে বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিয়ে। আজ পরিণতিতে যখন আমরা সেদিক এগিয়ে যাচ্ছি তার সঙ্গে আবার দেখা হলাে এবং নিজ চোখে পরিণতি দেখছেন ভেবে আমি মনে মনে খুবই সুখী হলাম। দেশ ইনশাআল্লাহ অনিবার্য স্বাধীনতার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আমরা বুঝতে পারছি দুদিন আগে হােক আর পরে হােক পাকবাহিনীকে সারেন্ডার করতেই হবে। অপারেশন রাজবাড়ী ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহেই কিছু কিছু এলাকা শত্রুমুক্ত হতে শুরু করে। আমি মাগুরায় আছি; ইন্ডিয়ান ফোর্সদের নিয়ে বিভিন্ন অপারেশন এবং প্ল্যানিং-এ ব্যস্ত। এমন সময় রাজবাড়ী থেকে আমার ছাত্র মুক্তিযােদ্ধা জিলুর রহমান এবং মতিউর (পাংশা থানার এম.পি’র ছেলে) সংবাদ নিয়ে আসে। এরা ভারতে সকলেই আমার অধীনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত দীর্ঘদিন রাজবাড়ীতে পাকবাহিনী কর্তৃক আক্রান্ত। ৬/৭ মাস পাকবাহিনী এখানে মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে মিলে মিশে হত্যা নির্যাতন এবং লুটপাট করছে। তাদের অবস্থান খুব মজবুত দৃঢ় ভিত্তি। তাদেরকে কিছুতেই হটানাে যাচ্ছে না। এ অবস্থায় ওরা আমার সাহায্য চেয়েছে।
আমি অবশ্যই যাব আমার প্রিয় ছাত্র যাদেরকে নিজ হাতে প্রশিক্ষণ দিয়ে তৈরি করেছি তারা যুদ্ধ ক্ষেত্রে শত্রু নিধনের জন্য লড়ে যাচ্ছে। সেখান থেকে আমার সাহায্য চেয়েছে অবশ্যই আমি সাহায্য করব। আমি সেখানে যাব। মাগুরায় আমার সমস্ত সৈন্যদের সমবেত করে নির্দেশ দিলাম রাজবাড়ী যেতে হবে তােমরা প্রস্তুতী। নাও। আমাদেরকে সােজাসুজি যেতে হলেও কমপক্ষে ৪৫/৫০ মাইল হাঁটতে হবে। আমার অস্ত্রটি খুব দূর্বল অথচ একটা ভারী অপারেশনে যাচ্ছি। আমার ভাল একটা আর্মস এর প্রয়ােজন। আমি ক্যাপঃ ওয়াহাব সাহেবের নিকট একটা এল.এম.জি. চাইলাম। কিন্তু জানি না কোন অদৃশ্য কারণে ওয়াহাব সাহেব আমাকে আর্মস দিলেন না। বাধ্য হয়ে আমার কাছে যা ছিল তাই নিয়ে রওয়ানা হলাম। পাকবাহিনীর নাইন ডিভিশন সৈন্য তখন মাগুরা ছেড়ে কামার খালীতে ঢুকে পড়েছে। ওরা তখন গ্রামে সাধারণ জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে; যেন ওদের লক্ষ্য করে বােমা মারতে না পারে। আমরা খুব সন্তর্পনে কামারখালী থেকে ৫/৬ মাইল উজান দিয়ে রাজবাড়ীর পথে রওয়ানা হলাম। গড়াই নদী পার হয়ে ৪৫ মাইল পায়ে হেটে দুই দিন পর ১১ই ডিসেম্বর রাজবাড়ী থেকে ৬/৭ মাইল দূরে বাণীবহ নামক গ্রামে পৌঁছলাম। পৌছানাের পর গ্রামবাসী আমাদেরকে সাদরে গ্রহণ করলাে। তারা জানালাে ফরিদপুরের মুক্তিযােদ্ধারা এসেছে। তারা কয়েকদিন যাবত চেষ্টা করছে কিন্তুই কিছুই করতে পারছে না। এখন আপনারা যশােরের পাটি এসেছেন দেখুন কি করতে পারেন? আমি বললাম। ঠিক আছে আল্লাহ পাক যখন আমাদের এনেছেনই দেখি কি করতে পারি। এই গ্রামে আমরা রাত্রি যাপন করলাম। সকালে খেয়ে দেয়ে রাজবাড়ী শত্রুদের মূল। অবস্থানের দিকে অগ্রসর হলাম। আমার একটা অগ্রবাহিনীকে আগেই রওয়ানা করিয়ে দিয়েছিলাম। আমি রাজবাড়ীর মূল শহরে পৌঁছানাের পূর্বেই তারা থানা আক্রমণ করে বসে। আমি গিয়ে ওদেরকে প্রপারলি গাইড করলাম। থানা ফল। করলে ও.সি ধরা পড়লাে । সে আমার পায়ে পড়ে প্রাণ ভিক্ষা চাইলাে। আমি তার কাকুতি মিনতিতে ছেড়ে দিলাম। এই অপারেশনে রাজবাড়ীর মুক্তিযােদ্ধা ইলিয়াছ (ছাত্র) মাথায় গুলী লাগে। পরবর্তীতে ফিল্ড হসপিটালে অপারেশন করে সুস্থ করা হয়। এখানে উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে একটা এল.এম.জি পেলাম। আমার খুব উপকার হলাে এল.এম.জি.টা পেয়ে। এরপর রাজবাড়ীতে মুজিব বাহিনীর কমান্ডার এম, এ, মতিনের কাছে গেলাম। তার সাথে দেখা করে শক্ৰমিত্রের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলাম। তিনি জানালেন দক্ষিণে ২০০ উত্তরে ৩০০ এরকম ভাবে হাজার দেড়েক মুক্তিযােদ্ধা আছে। তারা ৩ দিন ধরে ফায়ারিং করছে কিন্তু কিছুই করতে পারছে। শত্রুদের নিকট এগুতে পারছে না। তিনি শক্রর সঠিক অবস্থান জানাতে পারলেন না। আমার ফোর্স নিয়ে আমি স্থানীয় এক কলেজে অবস্থান নিলাম। এরপর ওয়াচিংএর জন্য ৫জন ছেলেকে পাঠালাম। কিন্তু ওরাও কোন তথ্য এনে দিতে পারলনা। কোথায় কার অবস্থান জানতে না পারলে আমরা এডভাঞ্চ করতে পারছিনা। এমতাবস্থায় আমি স্থানীয় ফাজিল নামক একটি ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলাম ‘ভাই পাকবাহিনী কোথায় আছে বলতে পার’? জবাবে ছেলেটি বলল ‘আসুন আমার সাথে, আমি দেখিয়ে দিচ্ছি।’ তাকে অনুসরণ করতে থাকলাম, সে শহরের বিভিন্ন রাস্তা ঘুরে অলিগলির ভেতর দিয়ে রাজবাড়ী রেলওয়ে কলােনীর কাছে নিয়ে বললাে, এই যে কলােনী এর বিল্ডিংগুলাের ফাকে ফাকে বাংকার করে তার ভেতর ওরা আছে। যদি আপনারা এসব বাংকার ভাঙতে পারেন তবে এদের কাবু করতে পারবেন। আমি এতক্ষণে ওদের সঠিক অবস্থান নির্ণয় করলাম। দেখলাম সত্যি এদের এই বাংকার আক্রমণ করতে পারলেই সহজে এদের পরাস্ত করতে পারব। আমাদের এসব বিল্ডিং দখল করে বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করতে হবে। এই অবস্থান পুরাে পর্যবেক্ষণ করে আমার বাহিনীকে ফলইন করালাম। আমি বেছে বেছে ২০জন সাহসী মুক্তিযােদ্ধা নিলাম। তাদের বললাম পেছন থেকে এই কলােনীর বিল্ডিং দখল করতে হবে। আমার কমান্ড মত ওরা ঝটিকা বেগে কলােনীর বিল্ডিং দখল করবে তারপর যে সমস্ত খালি জায়গায় বাংকার আছে তার মধ্যে গ্রেনেড চার্জ করব। আক্রমণ সংক্রান্ত এভাবে ব্রিফিং করে সবাইকে তৈরি করলাম। বিশেষ করে। আমার সৈন্যরা যখন এগুবে আমরা পাশ থেকে ফায়ারিং করতে থাকব। জবাবে পাকবাহিনী ফায়ার দিবে এই ক্রস ফায়ারিংয়ে ওরা বাংকারে মাথা নীচু করে বসে থাকবে কোনভাবে আমাদের ওয়াচ করতে পারবে না। এ সুযােগে বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করে ঢুকতে হবে। পরিকল্পনা মত আমার বিশ জন মুক্তিসেনা ক্রলিং করে এগুলাে কিন্তু হঠাৎ শক্রসেনারা টের পেয়ে এই অগ্রবর্তী দলকে আক্রমণ করে। ওদের বােমার আঘাতে আমার ৫জন সেনা আহত হয়। উপায়ন্তর না দেখে আমরা রিট্রিট করি। এরপর আহতদের মুক্তিযুদ্ধ ফিল্ড হসৃপিটালে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়ে পুনরায় আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিলাম। এবার আরও ৫জন নতুন সেনাকে নিয়ে একটা অগ্রবর্তী দলকে সামনে দিয়ে সামনে থেকে ফায়ার দিলাম। ওরা এবার আর বুঝতে পারেনি এত শীঘ্রই আমরা আবার আক্রমণ করবাে। ওদের বিন্দুমাত্র বুঝে উঠার আগেই আমরা ক্রস ফায়ার দিয়ে এগুতে থাকি। ওরা বাংকারে বসে মাথা নীচু করে ফায়ার দিচ্ছিলাে তখন আমার অগ্রবর্তী দল বাংকারে একযােগে গ্রেনেড চার্জ করে অতর্কিতে ঢুকে পরে। এতে ৫জন পাকসেনা নিহত এবং বেশ কিছু আহত হয়। বাকীরা ফায়ার দিতে দিতে পালিয়ে যায়। প্রথম বাংকার অপারেশনের পর দেখা গেল এসমস্ত বাংকারগুলাে বিশাল। এরমধ্যে খাট পালঙ্কসহ পুরােপুরি আবাসিক সুযােগ সুবিধা রয়েছে। এ সমস্ত কারণে বাংকার গুলােতে ওদের অবস্থান খুব মজবুত ছিল। একই কায়দায় আমরা দ্বিতীয় বাংকার আক্রমণ করলাম। প্রথমে সামনে থেকে ফায়ার দিই ওরা জবাব দিতে থাকে। ক্রস ফায়ার এর সুযােগে বাংকারে গ্রেনেড চার্জ করে বাংকার ভেঙে দিলে ওরা প্রাণ ভয়ে পালাতে থাকলাে। ১০জনের মত পাকসেনা আহত হয়ে বাংকারে পড়ে থাকে, বাকীরা সব সব পালিয়ে যায়। তৃতীয় বাংকার আক্রমণ করলে দেখা গেলাে প্রথম দ্বিতীয় বাংকারের কিছু আহত পাকসেনাসহ অনেকে আশ্রয় নিয়েছে। এখানে গ্রেনেড চার্জ করলে আরও ৫জন মারা যায়, বাকীরা পালিয়ে যায়। এভাবে পরপর ৪টি বাংকার ফল করলাে। পাকবাহিনীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে পালিয়ে গেলাে। একটা বিরাট প্রতিরােধ শক্তি বলা যায় শক্তিশালী এক দূর্গেরই পতন ঘটলাে। এই ফলইন এর খবর বিদ্যুৎ বেগে শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়লাে। যশােরের পাটি এসেছে এবার আর রক্ষা নেই। মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার কামরুজ্জামান রাজবাড়ী ফল করিয়েছে। এদিকে পরপর কয়েকটি বাংকার অপারেশন করতে করতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে। তখন আমি ফরিদপুর বাহিনীর হাবিলদার জামালকে বললাম, আমি এই পর্যন্ত দখল করেছি। কিন্তু এখন অত্যন্ত ক্লান্ত, সারাদিন কিছু খাইনি আমি আর পারছি না। তুমি রাতটা তােমার সেনা দিয়ে পাহারা দেবে যেন ওরা পালাতে না পারে। তারা সকাল পর্যন্ত পাহারা দেয়ার দায়িত্ব নিলাে। আমি এতগুলাে মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে কোথায় খাব চিন্তা করছি এমন সময় কিছু লােক এসে জানালাে আপনাদের খাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা তখন রেলওয়ে কলােনী থেকে এক দেড় মাইল দূরে ধইঞ্চা গ্রামের আবুল মেম্বারের বাড়ীতে গেলাম। সেখানে রাতের খাবার খেয়ে রয়ে গেলাম। সকালে আবার নাস্তা করে অপারেশন টেকওভার করলাম। কিন্তু খোজ করে দেখলাম ওরা আগেই সব পালিয়েছে আর ফেরেনি। এ অবস্থায় আমরা রণকৌশল হিসেবে কম্বিং অপারেশন করি। বিভিন্ন ফ্লাংক করে শহরের বিভিন্ন জায়গায় অপারেশন শুরু করি। তখন রাজবাড়ীর পৌর চেয়ারম্যান আলাউদ্দীন ছিলেন পাকবাহিনীর অন্যতম একজন দোসর। তার বাড়ীতে সার্চ করতে গেলেই আমরা বাঁধা প্রাপ্ত হই। এখানে পাকবাহিনী আশ্রয় নিয়েছিলাে, ওদের ছোড়া বােমার আঘাতে আমাদের কোম্পানী কমান্ডার রান্ন ও আবুল আহত হয়। এদেরকে ফিল্ড হসৃপিটালে চিকিৎসার জন্য পাঠানাে হলাে।
আমরা ওদের খুঁজে পাচ্ছি না। এমতাবস্থায় দূর থেকে হঠাৎ টুসটাস শব্দ পাচ্ছিলাম কিন্তু কোথাও কাউকে পাচ্ছি না। খুঁজতে খুঁজতে দেখি শহরের মধ্যে এক বটগাছের উপর থেকে বাহাদুর নামক এক কসাই রাজাকার ৩টি চায়নিজ রাইফেল নিয়ে বসে বসে ফায়ার দিচ্ছে। আমরা ঘিরে ফেলে তাকে অভয় দিয়ে গাছ থেকে নামালাম। এরপর ওকে না মেরে জেলে পাঠালাম। আমাদের এ কম্বিং অপারেশনে পাক, মিলিশিয়া, রাজাকার, আলবদর, আলশামস সহ প্রায় দেড় হাজার সৈন্য ধরা পড়ে। আমরা ওদের মেরে না ফেলে বরং নিরাপত্তার জন্য সব জেলে পাঠাই। এদের কাছ থেকেই জানতে পারি যশােহরের মুক্তিপার্টি শহরে ঢােকার পরই ওদের মধ্যে এক জাতীয় আতঙ্কের সৃষ্টি হয় এবং পালাতে থাকে। আমরা ১৩ ও ১৪ই ডিসেম্বর দু’দিন অপারেশন করি। ইতােমধ্যে রাজবাড়ী সম্পূর্ণ রূপে অবমুক্ত হলাে। জনতার মধ্যে উল্লাস ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু তখনও আমরা রাজবাড়ী ছেড়ে আসতে পারছি না কেননা সেখানে ৮/১০টা ব্যাংক আছে যা সাথে সাথে লুটপাট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাছাড়া আমার ৭জন মুক্তিযােদ্ধা তখনও চিকিৎসাধীন ছিল। এরপর ১৫ই ডিসেম্বর রাজবাড়ীতে এরিয়া কমান্ডার ক্যাপ্টেন ওয়াহাব এলেন সাথে ইন্ডিয়ান এক মেজর, ইন্ডিয়া থেকে আগত রাজবাড়ীর ডাঃ মালেক, ছাত্রনেতা আলী আকবর সবাই বসলেন। ওয়াহাব সাহেব এখানে ল এন্ড অর্ডার এস্টাবলিস্ট করার জন্য সকলকে ডাকলেন। তখনও অনেক ডেড বডি পড়ে আছে। এগুলােকে দাফন-কাফন করার জন্য আমাকে নির্দেশ দিলেন। আমি আমার বাহিনীসহ এগুলােকে সরিয়ে দাফন-কাফন করলাম। এখানে ফরিদপুর বাহিনীর দ্বারা কিছু অপরিকল্পিত হত্যা কান্ড হয়েছিলাে, যা আন্তর্জাতিক রেড ক্রস সােসাইটির দৃষ্টি গােচর হতে পারে ভেবে ক্যাপ্টেন ওয়াহাব আমাদের দিয়ে এ ত্বড়িৎ ব্যবস্থা নিলেন। যা হােক রাজবাড়ী এক কৌশলী প্রতিরােধের মাধ্যমে রক্ষা পেয়ে শত্রুমুক্ত হলাে। অত্যন্ত সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে ল এন্ড ফোর্স এস্টাব লিস্ট হলাে। এবার আমাদের ফেরার পালা। এসময় বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকা অবমুক্ত হচ্ছে। ভারতের জেনারেল সাম মানেকশ বারবার আত্মসমর্পনের চূড়ান্ত নির্দেশ দিচ্ছেন। আমাদের ধন্যবাদ জানিয়ে ক্যাপঃ ওয়াহাব বিদায় দিলেন। এরপর ১৬ই ডিসেম্বর আমি আমার বাহিনী নিয়ে অবমুক্ত শৈলকূপায় ফিরে এলাম। বিজয়ের গৌরবােজ্জ্বল দীপ্তি নিয়ে স্বাধীন মাটিতে প্রথম পা রাখলাম। মাগুরা থেকে শুরু করে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় স্বাধীন বাংলার পতাকা তুললাম। রক্তনদী পেরিয়ে লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে বাংলার নীলাকাশে উঠল স্বাধীনতার রঙীন সূর্য। অর্জিত হতে চললাে আমাদের রক্তে রাঙা বিজয়।
১৬ই ডিসেম্বরের হিরন্ময় সেই বিকেল ১৯৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর বেলা ১.০০টা। ভারতীয় বিমান বাহিনীর একটি হেলিকপ্টারে জিওসি এবং পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা সস্ত্রীক ঢাকা বিমান বন্দরে অবতরণ করলেন। এ সময় লেঃ জেনারেল নিয়াজী অভিবাদনসহ তাদেরকে সংবর্ধনা জানান। অভূতপূর্ব এক দৃশ্যের অবতারণা হল বিমান বন্দরে তখন। বিজয়ের আনন্দে হর্ষোৎফুল্ল লক্ষ লক্ষ বাংগালী ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে জেনারেল অরােরার গলায় জয় মালা পরিয়ে দিয়ে আনন্দে নাচতে থাকে, আর জেঃ নিয়াজীর দিকে ঘৃণায় থুথু ফেলতে থাকে। তাদের অনেকের চোখেই তখন আনন্দের অশ্রু । দীর্ঘ সংগ্রাম অনেক ত্যাগ আর রক্তনদী পেরিয়ে এলাে বিজয়ের সেই হিরন্ময় বিকেল। যার জন্য লক্ষ কোটি বাঙালী অপেক্ষা করছিলাে সুদীর্ঘ কাল। ১৬ই ডিসেম্বর বিকেল ৪.৩১ মিনিটে পাকিস্তান বাহিনী আত্মসমর্পণ করলাে। আর পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় হলাে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের। রমনা রেসকোর্স ময়দানে আবার লক্ষ মানুষের ঢল নেমেছে যেমনি নেমেছিল সেদিন ৭ই মার্চে। এমনি জনসমুদ্রের মাঝেই গর্জে উঠেছিল বাংলার অবিনাশী বজ্রকণ্ঠ “এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। ভূবন। কাঁপিয়ে লক্ষ জনতার কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছিলাে ‘জয় বাংলার শ্লোগান। সেই ময়দানেই আবার মহা জনসমুদ্রের মাঝে বর্বর পাকসেনাদের আত্ম সমর্পণ অনুষ্ঠান হচ্ছে। জয় বাংলা শ্লোগানে মুখর লক্ষ লক্ষ বাংগালীদের সঙ্গে করে যৌথ বাহিনীর অধিনায়ক জেনারেল অরােরা রমনা রেস কোর্সে এসে হাজির হলেন পাক বাহিনীর আত্মসম্পনের দলিলে স্বাক্ষরের জন্য। সময় ছিলাে এক স্বর্ণালী বিকেল। সমগ্র বাঙ্গালীর জীবনে বােধ করি এমন হিরন্ময় বিকেল এমন উজ্জ্বলতর আনন্দের দিন আর একটিও নেই হতে পারে না। পাকবাহিনীর একটা দল জেনারেল অরােরাকে গার্ড অব অনার জানালাে আর পাকবাহিনীর পাহারায় নিয়ােজিত রইলাে যৌথ বাহিনীর অন্যদল। সমস্ত দর্প অহংকার চুর্ণ হলাে দাম্ভিক পাকিস্তানীদের। মাত্র নয়টি মাসের যুদ্ধেই আত্মসমর্পণে বাধ্য হলাে ওরা। বিকেল ৪.৩১ মিনিটে আত্মসমর্পনের দলিলে স্বাক্ষর করলেন লেঃ জেঃ নিয়াজী আর যৌথ বাহিনীর পক্ষে লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরােরা। এ সময় মুক্তি বাহিনীর পক্ষ থেকে উপস্থিত রইলেন ডিপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে. খোন্দকার আর তার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন মুক্তিযুদ্ধের বীর নায়ক কাদের সিদ্দিকী। ডিসেম্বরের ৮ তারিখ থেকেই আকাশ বাণী বাংলা ও হিন্দীতে জেনারেল মানেকশএর বার্তা প্রচার শুরু করেছিল হাতিয়ার ডাল দো’মিত্র বাহিনী আপনার সৈন্যদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আপনার বিমান বাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস। আপনি অস্ত্র সমর্পণ করুন।’ ঘােষণায় আরাে বলা হলাে বিজয়ী সৈন্যের কাছে আত্মসমর্পণে কোন দোষ লজ্জা নেই। ডিসেম্বরের ১৪ তারিখে বিমান থেকেও ঐ সম্পর্কে ছাপানাে প্রচার পত্র বিভিন্ন সেনা ছাউনিতে বিলি করা হয়। ১৬ই ডিসেম্বর সকালে মীরপুর ব্রীজের ওপারে দাড়িয়ে যৌথ বাহিনীর মেজর জেনারেল নাগরা লেঃ জেনারেল নিয়াজীর কাছে চূড়ান্তভাবে আত্মসমর্পণের আহবান জানান। এই বার্তা পেয়ে পাপাের ভারে জর্জরিত গণহত্যার নায়ক লেঃ জেঃ এ. এ. কে, নিয়াজী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। এবং জেঃ নাগরা ও জেঃ জামশেদের মাধ্যমে ঐদিনই সকাল ১১.০০ টায় আত্মসমর্পণের বিষয়টি নির্ধারণ করা হয়। মেজর জেনারেল নাগরা এই খবর জেনারেল অরােরার কাছে পাঠিয়ে দিলে জেনারেল অরােরা চীফ অব আর্মি স্টাফ মেজর জেনারেল জ্যাকবকে ঢাকায় পাঠিয়ে দেন আত্মসমর্পণের বিষয় চূড়ান্ত করতে। এরপরই জেঃ অরােরা বেলা ১.০০টায় সস্ত্রীক ঢাকায় আসেন। আত্মসমর্পণের দলিল (ইংরেজী থেকে অনুদিত) পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড পূর্ব রণক্ষেত্রে ভারতীয় এবং বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল অরােরার কাছে আত্মসমর্পণে সম্মতি প্রদান করছেন। এই আত্মসমর্পনে বাংলাদেশে অবস্থানরত পাকবাহিনীর স্থল, নৌ ও বিমান বাহিনীর সকল সদস্য, সকল আধা সামরিক এবং অসামরিক অস্ত্রধারী সৈনিক অন্তর্ভুক্ত থাকবে। এই সকল সৈন্যরা যে যেখানে যেভাবে আছেন সেইভাবে অস্ত্র পরিত্যাগ করবেন এবং তাদের নিকটস্থ জেনারেল অরােরার অধীনস্থ বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করবেন। এই দলিল স্বাক্ষরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ড জেঃ অরােরার আদেশাধীনে ন্যস্ত হবে। তার আদেশের।
বরখেলাপ আত্মসমর্পণ চুক্তি ভঙ্গের সামিল হবে এবং যুদ্ধের সর্বগ্রাহ্য নিয়মাবলীও বিধি অনুযায়ী অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। এই আত্মসমর্পন চুক্তির ব্যাখ্যা সম্পর্কিত কোন সন্দেহের উদ্ভব হলে লেঃ জেঃ জগজিৎ সিং অরােরার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে। লেঃ জে অরােরা এই মর্মে পবিত্র আশ্বাস প্রদান করেন যে, যারা আত্মসমর্পণ করবে তাদের প্রতি জেনেভা চুক্তি অনুযায়ী যােগ্য সম্মান ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা দেয়া হবে। লেঃ জেনারেল অরােরার অধীন সেনা বাহিনীর সাহায্যে বিদেশী নাগরিক, সংখ্যালঘু সম্প্রদায় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করা হবে। স্বাক্ষর
স্বাক্ষর জগজিৎ সিং অরােরা
আমির আবদুল্লা খান নিয়াজী লেঃ জেনারেল
লেঃ জেনারেল জিওসি এবং পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয়
সামরিক আইন প্রশাসক বাহিনী ও বাংলাদেশ বাহিনীর জোন-বি এবং পাকিস্তান বাহিনী পূর্বাঞ্চল সর্বাধিনায়ক
কমান্ডের সর্বাধিনায়ক বাঙালীর সংগ্রাম আর বিপ্লবের ইতিহাস ২৪ বছর ধরে পাকিস্তানের করাল গ্রাস থেকে বাংলাকে মুক্ত করার ইতিহাস নয় বরং ১৭৫৭ সাল থেকে। যেদিন পলাশীর প্রান্তরে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হয়েছিল মূলতঃ তারপর থেকেই মীর কাশিমের মাধ্যমে শুরু হয় বিদ্রোহ বিপ্লবের রক্তাক্ত ধারাবাহিকতা। এই ধারাবাহিকতায় অনেক সংগ্রাম কঠোর ত্যাগ আত্ম হুতির মাধ্যমেই এলাে আমাদের রক্তে রাঙা বিজয়। কিন্তু স্বাধীনতার যে মহান স্বপ্ন সাধ নিয়ে আমরা সেদিন অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলাম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার অব্যবহিত পরই আমাদের সে স্বপ্ন ভূলুণ্ঠিত হলাে। বিশেষ করে ৭৫-এর ১৫ই আগস্ট যখন বাংলার ইতিহাসের অমর নায়ক স্বাধীনতার মহান স্থপতিকে রাতের অন্ধকারে হত্যা করা হলাে। তারপর থেকেই বাংলার পরাজিত শক্ররা ধীরে ধীরে পুনঃর্বাসিত হতে থাকলাে। সুকৌশলে ইতিহাস এবং সংবিধান থেকে একে একে মুছে দেয়া হলাে মহান বন্ধুর স্বপ্ন সাধ। বাংলার মানুষ আশা করেছিল দেশ স্বাধীন হলে তাদের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে তৈরি হবে স্বনির্ভর অর্থনীতি, বৈষম্যহীন শিক্ষা ব্যবস্থা, কৃষি নির্ভর বাংলাদেশে আদর্শ কৃষি ব্যবস্থা। কিন্তু তার কিছুই সফল হলােনা অধিকন্ত আবার হত্যা কু সন্ত্রাস ষড়যন্ত্রে কালাে হলাে ইতিহাসের পাতা। সত্যিকারের ইতিহাস হয়েছে। বিকৃত বিধস্ত । আজ ২৫ বছরে জীবনের চাওয়া পাওয়ার খতিয়ান মেলাতে গেলে ভয়াল নৈঃশব্দের ওপাড় থেকে এক ব্যর্থ দীর্ঘশ্বাসই ফিরে আসে। আমার সংকল্প সাধের কিছুই পূরণ হয়নি করতে পারিনি। দেশের জন্য এমন কিছু রেখে যেতে পারিনি যার জন্য একদিন মৃত্যুকে সার্থক মনে করর। তাই অবশেষে অনেক হতাশার মধ্যেও আমার চাচাতাে ভাই ডাঃ মােশাররফ হােসেনকে নিয়ে সম্পূর্ণ ব্যক্তি উদ্যোগে ১৬ লক্ষ ৪৪ হাজার টাকার একটা স্কীম হাতে নিই। এই স্কীমের লক্ষ্য স্বনির্ভর গ্রাম গড়ে তােলা। মডেল হিসেবে নিয়েছি আমাদের মীন গ্রামকে। এই স্কীমের আওতায় থাকবে একটা গার্লস স্কুল, বয়েজ স্কুল, এবতেদায়ী মাদ্রাসা, মসজিদ, একটা কলেজ, ভকেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, দুঃস্থ মেয়েদের জন্য সেলাই প্রকল্প, নিরক্ষরতা দূরীকরণের জন্য গণশিক্ষা কেন্দ্র, গ্রাম্য হাট বাজার ইত্যাদি। ইতােমধ্যে মীন গ্রামে একটা মাধ্যমিক গার্লস স্কুল, পাকা মসজিদ ও হাটবাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বাকীগুলাে বাস্তবায়নের পথে। ইনশাআল্লাহ্ বাকীটা অবশ্যই বাস্তবায়িত হবে। এই আংশিক কাজ যদি এ জীবনে সমাধান করতে পারি মনে হবে হয়ত এ বিজয়ের আংশিক সফলতা আমি অর্জন করতে পেরেছি।
খােদা-হাফেজ