You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

শরণার্থীর দিনলিপি
কানাই লাল চক্রবত্তী

ভূমিকা সরল, সহজ ও সুন্দরভাবে নিত্যনৈমিত্তিক কাজে নিরত থাকিয়া নিজেকে পরম সুখী বলিয়া গর্ববােধ করিতাম। গত ডিসেম্বর, ১৯৭০ইং এর প্রথম ভাগে দেশে (পূর্ব পাকিস্তানে বাংলাদেশে) গণভােটের তােড়জোর চলিতেছে। যথারীতি ভােট দিলাম।
ফল প্রকাশ হইল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একক সংখ্যাগরিষ্ঠ ভােট লাভে জয়ী হইলেন।
তারপর, নানা রাজনৈতিক আলােচনা গুনগুন স্বরে শুনা যায়, কিন্তু কাজের ঝামেলায় ও রাজনীতিতে আগ্রহ নাই বলিয়া সেদিকে আমার মনােযােগ তেমন নাই। সবাই মনে করিয়াছিলেন, বঙ্গবন্ধু আসনে বসিবেন ও বাঙালীদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বর্তমানের চেয়েও সুখতর হইয়া সুখতমে গিয়া পৌঁছাইবে। কিন্তু হায়রে দুর্ভাগ্য, এমন সুখের জীবন ইতিহাসে কেউ আর কোনদিন পাইয়াছেন কিনা সন্দেহ।
লক্ষ লক্ষ লােক বাড়ীঘর ছাড়িয়া বাহির হইয়া আসিতে হইল। কারও ভাই আছে, মা নাই, আত্মীয়স্বজনের সাথে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন। কেউ পাঞ্জাবীর গুলিতে প্রাণ দিয়াছে, কেউ গুণ্ডার কবলে প্রাণ হারাইয়াছে, কেউ পথে মারা গিয়াছে। বাকী কিছু (প্রায় এক কোটি) নানা সীমান্ত দিয়া রিক্ত হস্তে, ভাঙ্গাবুকে, জীর্ণ শরীর নিয়া ভারতে আসিয়া উপস্থিত হয়।

শরণার্থীর দিনলিপি
এক। যুদ্ধ আরম্ভ ৩রা মার্চ ১৯৭১। হরতাল বা ধর্মঘট ১লা মার্চ, ১৯৭১ইং পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে রাহুর দৃষ্টি পড়াতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের বৈঠক বাতিল করিয়া দিলেন। পরদিন হইতে দেশে অসহযােগ আন্দোলন শুরু হয়। যানবাহন, অফিস-আদালত, কলকারখানা এমন কি আরক্ষা বিভাগও (থানা) বন্ধ হইয়া যায়।
বলাবাহুল্য, কোন লােক হয়ত দূর-দূরান্তে তার আত্মীয়-স্বজন বা বন্ধু-বান্ধুবদের বাড়ীতে গিয়াছে, সে সেই খানেই রহিয়া গিয়াছে। এই রূপ দৃষ্টান্ত অনেক। জিনিষপত্রের চড়াদাম ও দোকানপাট প্রায় বন্ধ। এইভাবে ২৫/৩/৭১ ইং বৃহস্পতিবার পর্যন্ত চলিল।
২৬শে মার্চ ১৯৭১ইং, শুক্রবার পূর্বরাত্রে (২৫/৩/৭১) শুনিয়াছিলাম, চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজে নাকি সাধারণ গুলি-গােলা ও গন্ডগােল হয়েছে বাঙালী ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে। এর বেশ কিছু নয়। কিন্তু শেষ রাতে ঘুম থেকে আমাকে (লিখক স্বয়ং) জাগিয়ে দেওয়ার পর শুনিতেছি, অসম্ভব সােরগােল। আমার বাড়ীর নিকটে পূৰ্ব্বদিকে ঢাকা ট্রাঙ্ক রােডের উপর বড় কুমিরা বাজার ও উক্ত বাজারেই আমার হােমিও ডিসপেনসারী। বন্ধুদের সঙ্গে বাজারে গেলাম ও প্রভাতের সামান্য প্রাতরাশ সারিয়া অবসর হওয়ার সাথেই দেখি অনেক মিলেটারী, মানুষজন ও কিছু সংখ্যক গুলিগােলা ইত্যাদি। বাজারের রাস্তা, ঢাকা ট্রাংক রােড লােকে লােকারণ্য, শুধু বলাবলি ও দৌড়াদৌড়ি করিতেছে।।
সকাল দশটায় জেনারেল টিক্কা খানের ভাষণ এবং সামরিক শাসনের ধারা বৃদ্ধি।
আরও শুনিতেছি: একদল পাঞ্জাবী সরকারী সৈন্য পায়দলে উত্তর দিকে হইতে (কুমিল্লার দিক হইতে) চট্টগ্রাম অভিমুখে রওনা হইয়াছে। তাহাতে আমার বা আমাদের কি ক্ষতি বা অসুবিধা হইতে পারে তাহা।

কানাই লাল চক্রবর্ত্তী
কল্পনার বাহিরে, কারণ যুদ্ধের কথা শুধু কানে শুনিয়াছিলাম, কখনও দেখি নাই। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় নেহাত ছােট ছিলাম। তাই অন্তরে ভয় থাকিলেও যুদ্ধ দেখার উৎসাহ আমার মত বােকাটে লােকের কম নয়। এইভাবে দৌড়াদৌড়িই সেই দিন সার হইল। কাৰ্য, ব্যবসার কথা মনে নাই এবং এইভাবে প্রায় বিকাল ৩/৪ টা পর্যন্ত কাটিয়া গেল। তখন শুনিতেছি, বাঙালী সৈন্যরা কুমিরা রেলওয়ে ষ্টেশনের সংলগ্ন যক্ষা হাসপাতালে ঘাটি করিয়াছে। বাজার হইতে ইহার দুরত্ব প্রায় আধ-মাইল। নিত্য প্রথামত দৈনিক বাজার বসিয়াছে, অবশ্য প্রতিদিন রাস্তার ধারে যেই স্থানে বসিত সেই স্থানের সাধারণ পশ্চিমে ও আমার নিজ বাসস্থানের সাধারণ পূর্বদিকে একটি খােলা জমিতে বাজার বসিয়াছে কারণ কোন কোন বাজারে মিলেটারীরা হেলিকাপ্টার থেকে মেশিনগান চালিয়ে বহু লােককে হতাহত করেছে। এদিকে কুমিরায় সবারই মন টানা, পাঞ্জাবী আসিতেছে, দেখিতে হইবে।
আমি দোকানের বাহিরের দিক বন্ধ করিয়া ভিতরে রােগীপত্র বিদায় কেিতছি। এমন সময় কয়েকজন বন্ধু আসিয়া আমাকে বাড়ী চলিয়া যাইবার নির্দেশ দেয়। আমি বাহির হইলাম, দুই একজন রােগীও আমার পিছু ছুটিল, কারণ যতই ঝামেলাই থাকুক না কেন, রােগ মানে না। গাড়ী নাই, কিন্তু অনেক দুরগ্রাম হইতেও অনেক রােগী পায়ে হাঁটিয়া আসিয়াছে।
বাড়ীতে আসিয়া উক্ত রােগী তিনজন ও ২/১ জন বন্ধুবান্ধবসহ বারান্দায় দাঁড়াইয়া রাস্তার দিকে তাকাইয়া দেখিলাম পায়দলে পাঞ্জাবী সৈন্য দক্ষিণ দিকে যাইতেছে। তখনও আমার নিজের ধারণা, আগেকার দিনের ‘রাম-রাবণের যুদ্ধের মত দুই দলে রাস্তার এই পাশে ও ঐ পাশে যুদ্ধ হইবে। ইহাতে আমাদের ক্ষতিই বা কি?
পাঞ্জাবী আর দেখা যাইতেছে না। রােগী তিনজন ঔষধের জন্য তাড়াহুড়া করিতে লাগিলেন। তন্মধ্যে ১নং মােহাং কামাল কাদের (আলেকদিয়া), ২নং আবুল কালাম (মঘপুকুরিয়া) এবং ৩নং রায়মােহন (ঘােড়ামারা)। কোনক্রমে ১নং রােগীকে ঔষধ দেওয়ার

________________________________________
শরণার্থীর দিনলিপি
পর উনি বলিলেন: ‘ডাক্তারদা আমার ঔষধ ও কাপড়ের বান্ডিলটা রহিল, আমি একটু দেখিয়া আসি।’
২নং ও ৩নং দুইজনের ঔষধ এক সাথে তৈয়ার করিয়া একসাথে সেবনবিধি বুঝাইয়া দিব ঠিক সেই সময়ে হঠাৎ বিকট শব্দ ট্র-টু-ট্র-ট্রট্র-ঐ-ট্র-চুম্-শোঁ-শোঁ, শোঁ-শোঁ । এতগুলি আওয়াজ ও এত অগ্নিকণা আর দেখি বা শুনি নাই। এমতাবস্থায় কি করা কর্তব্য তাহা জানিও
। গত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় শুনিয়াছিলাম, ‘সাইরেন’ নামে বিপদ-সংকেত বাজিত, কিন্তু কই? কোথায় গেল আমার রােগীপত্র, কোথায় গেল হাটবাজার, ছােট বাচ্চাকাচ্চাসহ কোঠায় ঢুকিয়া পড়িলাম। প্রথম দিকে গুলি শুধু উত্তরাভিমুখে গিয়াছিল। কয়েক মিনিটের মধ্যে অনবরতঃ গুলি শুরু হইল এবং গুলি যে কোন দিক হইতে পড়ে তাহা বুঝা মুস্কিল। রান্নাবান্না ও খাওয়ার প্রশ্ন উঠিতেই পারে না। ছােট ভাই হিরন্ময়, ভগ্নীপতি অমিয় বাবু, ভাইপাে দুলাল চৌধুরী, বিশিষ্ট বন্ধু মাষ্টার সন্তোষ বাবু ও প্রাণের জেঠা মনােরঞ্জন বাবু… এঁদের সবাইর জন্য চিন্তা।
যখন সন্ধ্যায় ছায়া পার হইয়া রাত্রের কিছু অংশ অতিবাহিত হইল, তখন ছােট ভাই হিরন্ময় ও অমিয়বাবু কোন রকমে পলাইয়া ও কাঁটার আঁচড় খাইয়া বাড়ী আসিয়া পৌছাইয়াছে। তখন দেখি, আমার পাকের ঘর, বাহিরের বৈঠকখানা ও অন্যান্য ঘরে প্রবেশপথ নাই। বাজারের পথিক, উক্ত ১নং ও ৩নং রােগী ও বিশিষ্ট বন্ধুবান্ধবগণ সবাই সেখানে বসিয়া আছে। হঠাৎ শো করিয়া একটি গুলি আসিয়া আমার চায়ের ঘর ভেদ করিয়া টেকি ঘরে গিয়া পড়িল। হায়রে হায়, আমরা দুই ভাইয়ের মধ্য দিয়া গুলি চলিয়া গেল। প্রথম যাত্রায় দুই ভাই-ই রক্ষা পাইলাম।
আমি পূর্ব হইতেই ভীতু ছিলাম। আমার শরীরে কম্প দিয়া , মাথা ঘুরা আরম্ভ হইল। ঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া আমাকে কেহ কেহ মাথায় জল দিতে লাগিল। তাহাদের মধ্যে হীরেন্দ্র (ননী) প্রধান। একটু তন্দ্রার মত আসিল। আর বলিতে পারি না।

শরণার্থীর দিনলিপি
| হঠাৎ রাত্রি সাড়ে দশটায় জাগরিত হলাম। তখন গুলিগােলার শব্দ কম, কিন্তু চলিতেছে। তখন দক্ষিণ কোঠায় দেখি কয়েক জন বিশিষ্ট বন্ধু-বান্ধব ও ছেলেবেলার বিদ্যালয়ের সাথী উপস্থিত আছেন। তাঁহারা ক্রমে আস্তে আস্তে চলিয়া গেলেন। রাতেও গােলাগুলি কিছু চলেছে। ঘুমে ছিলাম, সকাল বেলা উঠিয়া দেখি আবার গােলাগুলি শুরু হইল।
২৭শে মার্চ, ১৯৭১, শনিবার সকালে প্রায় ৮টা পর্যন্ত ধুমধাম আওয়াজ শুনিলাম। ভয়ে আত্মহারা হইয়া পূৰ্ব্ব রাত্রের মতই কোঠাঘরের দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া পরিবারের প্রত্যেকটা প্রাণীই বসিয়া রহিলাম। দেখিতে দেখিতে এক ঘন্টা কাটিয়া গেল। প্রায় নয়টার সময় শান্ত পরিবেশ মনে করিলাম। পাশের চৌধুরীদের বাড়ীতে বিশেষতঃ বিমল চৌধুরীর (টুকু চৌধুরী) বাড়ীতে বেশ কয়েকজন ভদ্রলােক পূর্বরাত্রেই আশ্রয় নিয়েছিলেন, তন্মধ্যে:
১। ডাঃ এম.এ. জামান (এম.বি.বি.এস.) ও তাঁহার পত্মী ২। ডাঃ আজমল হােসেন খান (সরকারি হাসপাতাল),
তাঁহার স্ত্রী ও পঞ্চকন্যা ৩। ডাঃ হারেচ আহম্মদ এবং
৪। মৌঃ মমতাজুল করিম (তহশীলদার, কুমিরা)। উক্ত আশ্রিত ব্যক্তিদের সবাইর সঙ্গে আমি ওতপ্রেতভাবে জড়িত। একটু আলাপ করিব ভাবিয়া চৌধুরীবাড়ী গেলাম ও মাত্র ৫/৭ মিনিট আলাপের পর বাড়ী ফিরিয়া আসিলাম। ইহার পর আমার মা (শ্রীমতি চারুবালা দেবী) আমার মেয়ে মিষ্টিকে সঙ্গে লইয়া তাহাদের দেখিতে গেলেন। উনিও উঠানে গিয়া হাজির এবং অমনি আবার ট্র-টু-ট্র, শোঁ, শোঁ, শোঁ আওয়াজ শুরু। আশ্রিত ব্যক্তিরা আমার মায়ের কথা চিন্তা না করিয়াই ঘরের দরজা বন্ধ করিয়া দিল। মা গুলির মধ্য দিয়া ঘরে ফিরিয়া আসিলেন। আমার ঘরের দরজা-জানালা আবার বন্ধ হইল।

কানাই লাল চক্রবর্তী
কিছুক্ষণ পর আবার সব শান্ত। বারান্দায় দাঁড়াইয়া দেখিতেছি, গ্রামের বিভিন্ন রাস্তা দিয়া পাক সৈন্য (সশস্ত্র) ঘুরাঘুরি করিতেছে। রাজাপুর, মছজিদ্যা, আকিলপুর, কাজীপাড়া, জমাদারপাড়া ও অন্যান্য গ্রামে। শুনিতেছি, কয়েকজন পাক-সৈন্যের গুলিতে আহত এবং নিহত হইয়াছে। | ক্রমে বেলা বাড়িতে থাকে। প্রায় বারােটা বাজে কিন্তু নিজ বাড়ীতে নিত্য পূজার ব্রাহ্মণ তখনও আসেন নাই। ব্রাহ্মণের গ্রাম মছজিদ্যা, এই দুর্যোগে ব্রাহ্মণ-ঠাকুর আসিবেন না, ইহাই মনে করিলাম। কাজেই নিজে স্নান করিয়া নিজ মণ্ডপে পূজা সারিয়া পাশে চৌধুরী বাড়ীর নিত্য জগদ্ধাত্রী পূজা সমাপন করিলাম।
এইভাবে পূজার দায়িত্ব আমিই পালন করিতে লাগিলাম ।
*
*
*
সেদিন শনিবার, কুমিরায় হাটের দিন। অন্যান্য শনিবার এমন সময়ে দুপুর বেলায় রাস্তা লােকে লােকারণ্য, অথচ আজ মানুষ নাই । রৌদ্র খাঁ-খাঁ করিতেছে। রেডিওর সঙ্গে স্তুপে স্তুপে ২০/২৫ জন বসা। মধ্যাহ্ন ভােজন হইয়াছে সবাইর, আমার শুধু হয় নাই। যাহা হােক, প্রায় ২টার সময় হঠাৎ প্রাণের জেঠা (মনােরঞ্জন দে) আসিয়া হাজির । ভয়ে, মুখ জড়সড়। তখন আমি আর জেঠা একসঙ্গে খাইতে বসিলাম। পূৰ্ব্বদিন গােলাগুলির কারণে মাংস ও অন্যান্য সারভােগ গ্রহণ করিতে পারি নাই। দুই জনে খাইতে বসিয়াছি, পুনঃ গােলাগুলি শুরু। তখন ‘দুই বন্ধু ও ভল্লুকের গল্প’ এর মত জেটার কথা না ভাবিয়া ‘মাংস ভাত ফেলিয়া ঘরে ঢুকিয়া দরজা-জানালা বন্ধ করিয়া দিলাম। গােলাগুলি অবশ্য বেশিক্ষণ হইল না। মনে হয়, যুদ্ধের তালিম দিতেছে। | বেলা প্রায় ৩টার সময় রেডিওতে সংবাদ প্রচারিত হইল (মিথ্যা বা ভুল সংবাদ): লেঃ জেঃ টিক্কাখান সদলবলে নিহত’। উপস্থিত শ্রোতাগণ মুহূর্তের জন্য আনন্দিত হইল। তখন বারান্দায় লােকজন আলাপ করিতেছেন, কি করা যায়? কারণ গ্রামের প্রায় লােক দলে

শরণার্থীর দিনলিপি
দলে হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে নিজ বাস ছাড়িয়া গ্রাম হইতে গ্রামান্তরে পলাইতেছে। কেহ আত্মীয় বা বন্ধু-বান্ধবের বাড়ীতে, কিন্তু সবাই উত্তরাভিমুখে ধাওয়া হইতেছে।
এই করুণ দৃশ্যে সবাইর মন বিচলিত হইল। আমাদের পাড়ারও কেহ কেহ বিশেষতঃ চৌধুরী বাড়ীর সবাই ও উক্ত আশ্রিত ডাক্তারদ্বয়ের পরিবার উত্তরাভিমুখে রওনা হইল। যিনি যানবাহন ছাড়া কখনও চলেন নাই, আজ ইজ্জতের চরম কোঠায় তিনি রৌদ্রে পায়ে হাঁটিয়া চলিলেন। উপস্থিত অনিলবাবু ও আমাদের ইন্টারন্যাশানেল (International) মামা (অর্থাৎ ছােট-বড় সবার মামা) বাবু নিরঞ্জন | চৌধুরী, বাবু সুবােধ চৌধুরী ও অন্যরা চলিলেন বাস্তুত্যাগ করিয়া… দূরে ও অনির্দিষ্ট ঠিকানায়।
ইতিপূর্বে জলােচ্ছাস, ভূ-কম্পন, তুফান ও অনেক দুর্যোগের মধ্যেও বাড়ী হইতে বাহির হই নাই। সবাই বাস্তুত্যাগ করাতে আমার কি রকম বােধ হইল তাহা বুঝিতে পারি হৃদয়ের পঞ্জরে পঞ্জরে, কিন্তু বুঝাইবার মত ভাষা নাই।
অভিভাবক গােছের লােক নরেনবাবু (নরেন্দ্র দাশ), তাহার সহকর্মী শৈলেন, ছােট ভাই হিরন্ময় কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারিল না। আমরা কয়েকটা পরিবার থাকিয়া গেলাম। কিছুক্ষণ পর খবর আসিল: বাজারে সাধারণ উত্তরে ফকির বাড়ীর মসজিদে পুনঃ তের ট্রাক পাঞ্জাবী সৈন্য ঘাটি করেছে। মনে হইল, এইবার আর নিস্তার নাই। দিন থাকিতেই সন্ধ্যার আবছায়া নামিল, ভয়-ভয়-ভয়, সে কি ভয়। ঝি ঝি পােকার শব্দও নাই। চুপি চুপি কথা বলিতেছি। কোন রকমে পেটুক মহাজনের খাজানা চুকাইয়া (অর্থাৎ রাতের খাবার খেয়ে) শুইলাম। চৌধুরী বাড়ীর সবাই চলিয়া গেল। ভাইপাে দুই জন দুলাল চৌধুরী ও মুকুল চৌধুরী (ঝুনু) (এরা প্রতিবেশী সুবােধ চৌধুরীর পুত্র এবং হীরেন্দ্র (ননী) সবাই শুইয়া কথাবার্তা বলিতেছে। | গুলি চলিল, তবে অবস্থা পুৰ্ব্ব রাত্রের মত ভয়াভহ রকমের নহে। কোন রকমে রাত্রি প্রভাত হইল।

কানাই লাল চক্রবর্তী
এদিকে দোকানপাট বন্ধ ও বিশিষ্ট বন্ধুদের মধ্যে আবুল কাসেম (লেদু), আমিনুর রহমান (IWTA এর কর্মচারী), আবদুল রহিম, শামসুল হক, ভাগিনা ইউনুছ এবং চাঁন মিয়া Cat বলী (চান মিয়াকে আড়ালে ‘Cat বলী’ বলা হতাে] । সবাই প্রাণভয়ে ভীত ও কাহারও দেখা নাই। জেঠা মাখন বাবু ঘণ্টায় পঁচিশবার বাবাজীর (অর্থাৎ লিখকের) মত কি জানিতে ব্যস্ত।
২৮শে মার্চ, ৭১ইং, রবিবার রবিবার সকালে প্রথম একদফা খুবই শব্দ শুনিলাম। শব্দগুলি খুবই ভীষণ। কিসের শব্দ তাহা পাঠকের বুঝিতে বিলম্ব হইবে না। সকাল সাতটায় দেখি দক্ষিণ দিকে অর্থাৎ কুমিরা যক্ষা হাসপাতালের দিকে ঢাকা ট্রাংক রােড়ের দুই পাশেই আগুনের শিখা । ধুয়া ও পােড়া ছাই উড়িয়া আসিতেছে এবং ঘরদুয়ার সব ছাইময় হইতেছে। শব্দ নাই, বারান্দায় দাড়াইয়া লক্ষ্য করিলাম ২/১ জন লােক সামনের গ্রাম্য রাস্তা দিয়া চলাচল করিতেছে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিতে পারিলাম, বাঙালী সৈনরা কোথায় তাহারা জানে না, তবে পাক-সরকার বাহিনী দক্ষিণ দিকে পায়ে হাঁটিয়া যাইতে যাইতে সরকারী রাস্তার দুই পাশে ২০০ (দুইশত) ফুট আগুনে ধ্বংস করিতেছে। কোন লােক দেখিলে হাত পা বাঁধিয়া আগুনে নিক্ষেপ করিতেছে গুলি করিয়া মারিতেছে। তবে বিশেষত্ব এই যে কোন বৃদ্ধ বা বৃদ্ধা রমণীর তেমন কোন ক্ষতি তাহারা করে নাই।
ইতিমধ্যে অনেকে বুদ্ধির তীক্ষতা জাহির করিবার মানসে জাতীয় পতাকা (Pakistani flag) উত্তোলন করিয়া দিয়া বাড়ীঘর ছাড়িয়াছে, কিন্তু তাহাদের বাড়ীও বাদ যায় নাই। | রবিবার সন্ধ্যা ও সােমবার শান্ত অবস্থা। বহুদিন আগে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঘােড়ামারা নিবাসী মৌং নিজামপুরী (মৌঃ ফোরক, যিনি স্বদেশী পােশাক পরিধান করিতেন) এক কবিতা বাহির করিয়াছিলেন :

শরণার্থীর দিনলিপি
“চট্টগ্রামের ভয়াভহ কাহিনী শুনে পলায় বনের প্রাণী। তবখানা [তােপখানা বা অস্ত্রাগার] বিদ্রোহী রাণা
অবশেষে আগুন দেয় না, পথে ঘাটে শূন্য মটর মৃতদেহে পূর্ণ শহর।
মৃতদেহে পূর্ণ শহর”। বােধ হয় সেই রকম শান্ত অবস্থা। রাস্তাঘাট প্রায় অচল, অনেক কষ্টে লােকেরা বঙ্গোপসাগরের ধার দিয়ে হাঁটাহাঁটি করিতেছে। শুনিতেছি, পাঞ্জাবীরা ফৌজদার হাট কেডেট কলেজে ঘাঁটি করিয়াছে। অনেকে ভয়ে ট্রেনসে আশ্রয় নিয়াছিল, কিন্তু সেইখানেও দুষ্টের হাত হইতে নিস্তার পায় নাই। দুপুরে শুনিলাম, বার আওলিয়াতে অনেক মানুষ আহত ও নিহত হইয়াছে, তাহার মধ্যে হরিলাল দর্জিও একজন।
২৯শে মার্চ, ১৯৭১, সােমবার দরজা বন্ধ অবস্থায় দোকানপাট চলিতেছে, রাস্তাঘাট-শহরে-বন্দরে যাওয়ার ও মাল আনার কোন ব্যবস্থা বা প্রয়ােজন নাই। দোকানীরা কোনক্রমে অবশিষ্ট মাল বিক্রি করিয়া দোকান খালি করিবার চেষ্টায় আছে, কারণ লুটতরাজ হইলে সর্বস্বান্ত হইতে হইবে। আমি দরজা বন্ধ করিয়া দোকান শুরু করিলাম। কিসের ডাক্তারী? ভয়ে নিজের বাবার নাম ভুলিবার উপক্রম।
যাহা হউক, দেখি, দলে দলে কাতারে কাতারে লােক স্ত্রী-পুত্রকন্যা নিয়া, রিক্ত হস্তে, সরকারি রাস্তায় চট্টগ্রাম শহরের দিক হইতে উত্তরদিকে চলিয়াছে। জিজ্ঞাসাবাদেও বিরক্ত হয়, কারণ তাহারা বাস্তহারা ও হৃদয়ভাঙ্গা। অবস্থা দেখিতেছি, কিন্তু কিছুই বুঝিতে পারিতেছি না। ক্রমে বেলা বাড়িতে লাগিল এবং শনিবারের পলাতক লােকেরা পুনঃ (কুমিরা গ্রামের) নিজ বাসভবনে ফিরিতে লাগিল। পাশের চৌধুরী বাড়ীর লােকেরাও ফিরিয়া আসিল।
তখন লােকের মনে ভয়। ‘টক’ করিয়া ঘড়ির কাঁটার শব্দেও জাগরিত হই।

কানাই লাল চক্রবর্তী
দুপুরের খাওয়ার পরেই সমুদ্রের দিকে ভীষণ চিক্কার। অল্প তুফানের বাতাসের মতই অস্পষ্ট সেই চিঙ্কার। লােকেরা গত দিনের মত কেবল স্ত্রী ও পুত্র-পরিজন নিয়া দৌড়াইতেছে। ছােট ভাই হিরণয়, নরেন বাবু ও শৈলেন বাবুসহ কয়েকজন ঘটনাস্থলে গিয়া খরর নিয়া আসার আগেই লােকেরা দৌড়াইতেছে, জিজ্ঞাসাবাদের উত্তর দিতে দিতেই দৌড়াইতেছে: ‘মাননায়ার (Man of War) আসিতেছে!
উক্ত ‘মাননায়ার আগে দেখিয়াছি, তাই বঙ্গোপসাগরে কিভাবে এত বড় জাহাজ আসিতে পারে ভাবিয়া পাইলাম না। তখন যুক্তি ও তর্কের অভাব নাই। কেহ বলিল, মনােয়ার অনেক দুরে থাকিবে এবং বােট নিয়া তীরে আসিয়া গুলি চালাইবে।।
ইতিমধ্যে প্রতিবেশী অভিভাবক শ্রী সুবােধ চৌধুরী সমস্ত পরিবারবর্গকে নিয়া পুনঃ ছুটিলেন এবং পরে শুনিলাম তাঁহারা নাকি বােনের বাড়ীতে (মিরেশ্বরাই) আশ্রয় নিয়েছেন। পূর্বের মত তাহাদের ছেলে দুটি ঝুনা ও দুলাল আমার সঙ্গে আছে। তাহাদের কি হইল সে কথা পরে জানিবেন। লিখক নই, তাই এলােমেলাে হইয়া যায়। পাঠকবর্গ নিজ গুনে বুঝিয়া নিবেন।
উক্ত সাংবাদিকেরা সংবাদ নিয়া আসিল: ‘সমুদ্রের বাতাস দারুণ শান্ত, ‘মাননায়ার’ বা ‘জানােয়ার কিছুই দেখিলাম না!’
| দোকারপাট সাধারণভাবে চালাইতেছি। ইতিমধ্যে চট্টগ্রামে শহরের অবস্থা কাহিল। জমা ঔষধ শেষ, তাই রােগীদের নিয়া কষ্টে পড়িলাম।
৩০শে মার্চ হইতে ১৫ই এপ্রিল ১৯৭১ইং বাস্তহারার দল চলিতেছে। বিরাম নাই, কোথায় যাইবে হদিস নাই, আবার কৃপণ কৃষক ও লােভী ব্যবসায়ীরা ভিতরে ভিতরে তাদের কাৰ্য্য হাসিলে ব্যস্ত। বন্ধু-বান্ধবদেরও পুনর্মিলন হইতেছে, কিন্তু স্থায়ী মিলন নহে। রেডিওর খবরের পরে আর কাহাকেও পাওয়া যায় না।

শরণার্থীর দিনলিপি
প্রায় সবাই গ্রামান্তরে, আত্মীয়ের বাসায়। তবে তখনও কুমিরা মেইন গ্রামে তেমন অগ্নিসংযােগ ও লুটতরাজ হয় নাই। চাটনি: পাঠকবর্গ, আমি গৌহাটি শফরে গিয়া গত দুই রাত্র অদ্রিায় কাহিল। আমি আপনাদের কিছুক্ষণ বিশ্রাম দিতে ইচ্ছুক। সময়: দুপুর ২/১০ মিঃ, তাং-৪/৮/৭১ইং কুমিরা গ্রামে আস্তে আস্তে নানা বিশৃঙ্খলা শুরু হইতেছে। কারণ এডমিনিস্ট্রেশন’ বন্ধ। থানা, কোর্ট-কাচারী, স্কুল-কলেজ, স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ কিছুই নাই। সুতরাং নিরীহ ও সভ্য লােকদের কিছু কষ্ট হইতেছে। লুট’ সাধারণভাবে চলিতেছে। অবশ্য জনসাধারণের নহে, সরকারী মাল মাত্রার ক্ষয়-ক্ষতি হইতেছে।
প্রায় সন্ধ্যার পরে বড় বড় আওয়াজ ও বহু দুরে আগুনের শিখায় আকাশ লালবর্ণ দেখা যায়। শহরের কাছেই, আজ এখানে, কাল ওখানে এভাবে আগুন দেওয়া চলিতেছে। মাঝে মাঝে হঠাৎ কেডেট কলেজের ঘাটি হইতে কয়েক গাড়ী পাক সৈন্য সশস্ত্রে কুমিরা পর্যন্ত ঘােড়াঘুড়ি করিতেছে। হঠাৎ কোন লােককে ধরে, নানা রকম প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করে, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মী সম্বন্ধে, হয়ত ধাক্কা ও চপেটাঘাত করে। তবে তেমন প্রাণনাশ করে নাই কারওর। | পরে শুনিতেছি, কর্নেল হাটের কাছে রাস্তায় সব সময় টহল থাকে। লােকেরা ভয়ে চলিয়া আসিতেছে। হঠাৎ গুলি করে। আবার কোন সময়ে প্রশ্ন করে, তােম্ হিন্দু আদৃমী হ্যায়?’ মিথ্যা বলার জো কই? শেষে আরও ভয়ঙ্কর প্রশ্ন, প্রয়ােজনবােধে শেষ পরীক্ষা। পর্যন্ত হয়। | তখন কিছু কিছু লােক কুমিরা পাহাড়ের ঢালা পার হইয়া হাটহাজারি, নাজির হাটের দিকে পলাইয়াছে। কেহ আবার পাহাড়ের মধ্যে মেয়ে, ছেলে, টাকাপয়সা হারাইয়া ফিরিয়া আসিয়াছে ইত্যাদি।
আমি বাড়ীতে বসিয়াই ডাক্তার করিতেছি। রােগীপত্র ঔষধ নিতেছে, পয়সাও কোনরকম হয়। কিন্তু সুগার অফ মিল্ক’ নাই, শহরে যাওয়ার লােকও নাই। কোন ব্যবসায়ী অনেক ভয়ে ভয়ে দুই/এক পদ মালমাত্ৰা শহর হইতে আনিয়া (হাঁটিয়া) গ্রামে বিক্রী

কানাই লাল চক্রবর্তী
করিতেছে। আবার পাঞ্জাবীর দয়ায় মাল হারাইয়াও আসিতেছে। একদিন ভাগিনা ইউনুস শহরে গিয়ে কোন রকমে সাধারণ ঔষধ ও উক্ত সুগার আনিয়া দিল। কিন্তু দুই দুই বার সীতাকুন্ড গিয়াও হীরেন্দ্র (ননী) কোন ঔষধ পায় নাই। | সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার, তারিখ ও তিথি-নক্ষত্র মনে নাই। হঠাৎ দুপুর দেড়টার সময় আমার উপদেষ্টা ও ভগ্নীপতি গুরুপদ বাবু (PTC অর্থাৎ পাকিস্তান ট্যোবাকো কোম্পানীর কর্মচারী) আসিয়া উপস্থিত। তাহাদের বর্তমান বাসা দক্ষিণ কাট্টলী, সাগরিকা রােডের দক্ষিণ পার্শ্বে। তখন আমি সবেমাত্র বাড়ীর পূজা সারিয়া ঘরে ঢুকিতেছি।
‘কানাই’, এখনও তুমি পুজা করিতেছ, পান-চা খাও?
গুরুপদ বাবুর কথায় আমার মনে বিস্ময়ের সৃষ্টি হইল। তাহার কথা কৌতুক-রঙ্গ বলিয়াও মনে হয় না, আবার অবাস্তব প্রশ্নেরইবা কি জবাব দিব? ইতস্ততঃ করিতেই পুনঃ প্রশ্নের রােল উঠিল।
তিনি বলিলেন: “আমাদের বাড়ি পােড়াইয়া দিবার পর আমরা কোন রকমে ভাটিয়ারী অমুক বাড়ীতে আশ্রয় নিয়াছি। আগামী রবিবার সবাই হাঁটিয়া ছুটিব, হয়তাে এই ছুটাতেই একেবারে ভারত সীমান্ত।’
১৯৪৭ সালের পরে বারে বারে অনেক হিন্দু ভারতে চলিয়া গিয়াছিল। কিন্তু পরম করুণাময়ের অপার অনুগ্রহে আমরা পূর্ব পাকিস্তানে যথেষ্ট ইজ্বত ও সম্মানের সহিত ছিলাম বলিয়া স্থানান্তর হইবার কথা আমাদের কল্পনার বাহিরে ছিল।
১০/১৫ মিনিট আলােচনার পর গুরুপদ বাবু চলিয়া গেলেন, আজ (৫/৮/৭১, পুনঃ ১৯/১২/৭১ইং) পর্যন্ত যােগাযােগ নাই। এদিকে সীতাকুন্ডে বাঙালী সৈন্যরা পুনঃ শক্তভাবে ঘাঁটি করিল এবং ক্রমে দক্ষিণাভিমুখে অগ্রসর হইল। ইতিমধ্যে হঠাৎ একদিন রেলওয়ে কলােনীর মেয়ে নমিতা সাহা (দশম মান, কুমিরা উচ্চ বিদ্যালয়) আমাদের বাড়ীতে আশ্রয় নিয়াছে। তখন আমাদের

শরণার্থীর দিনলিপি
পাড়ার ও গ্রামের অনেক লােক পুনঃ গ্রামান্তরে সরিয়া যাইতেছিল নিরাপত্তার খোঁজে। | গ্রামের হিন্দুদের মধ্যে আর আমরা মাত্র কয়েক পরিবার আছি। তখন অনেক স্থানীয় লােকের (বিশেষত মুসলিম) ধারণা, হিন্দু যদি বাড়ীতে না থাকে তবে সে নিশ্চয়ই হিন্দুস্থান (India) চলিয়া গিয়াছে। বন্ধু-বান্ধুবও অনেকে প্রশ্ন করিল: ‘সুনীল বাবু ও অন্যান্য সবাই বাড়ীঘর ছাড়িয়া চলিয়া গিয়াছে। ডাক্তারবাবু আপনি কবে যাইবেন? প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে জবাব: “যেদিন কুমিরা গ্রামে একটা। মুসলমানও থাকিবে না, সেই দিন আমি যাইব, এর আগে নয়।’ শক্ত প্রশ্নের শক্ত জবাব বিশ্বাসযােগ্য, কারণ কোন দিন বাড়ী ছাড়িয়া যাইব ঐ কল্পনা নিজেরও ছিল না।
অনেক প্রতিবেশী গ্রাম ছাড়িয়া যাওয়ার সময় আমাদের বাড়ীতে অনেক মালমাত্রাও রাখিয়া গিয়াছিল। বাড়ীতে থাকিয়া সেগুলি পাহাড়া দেওয়ার কাজও চলিতেছে। এদিকে প্রাণের জেঠা মনােরঞ্জন বাবু বর্তমান বাড়ীতে গিয়া স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে দেখিবার জন্য কোন রকমে পাহাড়ের ভিতর দিয়া অন্য লোেকদের সঙ্গে চলিয়া গেলেন। স্থায়ী কমপাউন্ডার শ্রী খােকন চন্দ্র ধর (পটীয়া থানা, সুচিয়া, বাইনজুরি গ্রাম) এই ঝামেলার পূর্ণ এক সপ্তাহ আগে অসুখবশতঃ বাড়ী গিয়াছিল। তাহার খবর অন্য অধ্যায়ে পাওয়া যাইবে। এদিকে শুনাশুনি ও বলাবলির অন্ত নাই। বাঙালী সৈন্যদের ঘাঁটি কুমিরায় স্থান নিয়াছে। এই ভাবে দুই একদিন চলিল। | হঠাৎ একদিন মঙ্গলবার সাধারণভাবে দোকানে বসিয়া আছি, এমতাবস্থায় দেখি, সবাই দৌড়াদৌড়ি করিতেছে। কেবল শুনি: ‘আসিতেছে। কি আসিতেছে তাহার হদিস নাই। শুধু যে যেদিকে পারে, দৌড়াইতেছে। আমি চেয়ার হইতে উঠিয়া এক দৌড়ে বাড়ীর বারান্দায়। তখন লেদু ও হীরেন্দ্র (ননী) বাজারে গিয়া দোকান বন্ধ করিয়া আমার সমস্ত নিত্য প্রয়ােজনীয় আসবাবপত্র বাড়ীতে লইয়া গেল। সন্তোষ বাবুও দোকানে ছিলেন, কখন যে উনি পালাইয়া গেলেন তাহা আমার দৃষ্টির অগােচরে ছিল।

শরণার্থীর দিনলিপি
এদিকে দৌড়াদৌড়িতে জেঠা মাখন বাবু বেচাকেনার ধার না ধারিয়া একজোড়া চপ্পল ও দাঁড়িপাল্লা ফেলিয়া কেবল চনাবুটের লাই নিয়া কোন রকমে আমাদের বাড়ীতে আসিয়া প্রবেশ করিল। শেষে অনেকক্ষণ পর প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণীতে জানা গেল, পাকবাহিনী উড়ােজাহাজ হইতে সীতাকুণ্ড, মিরেশ্বরাই, ইত্যাদি ২-৩টি বাজারে একসঙ্গে মেশিনগানে গুলি ছাড়িয়া অনেক লােককে আহত ও নিহত করিয়াছে। ইহাতে বুঝা যায়, হিন্দু মুসলমান, মুসলিম লীগ বা আওয়ামী লীগের প্রশ্ন নাই, শুধু অভাগা বাঙ্গালী’-কে হত্যা করাই তাহাদের মূল লক্ষ্য।
গ্রাম দিন দিন আরও খালি হইতেছে, এইভাবে, দিন যায় কথা থাকে, কোন রকমে ১৪ই এপ্রিল বুধবার আসিয়া পড়িল।
দুই। চৈত্র সংক্রান্তি ১৪ই এপ্রিল, ১৯৭১; ৩১শে চৈত্র, ৭৭ বাং: বুধবার সেদিন চৈত্র-সংক্রান্তি ‘চড়কপূজা। পুরাতন বৎসর সমাধা করিয়া পরদিন নূতন প্রভাত। নূতন বৎসর হিন্দুদের মধ্যে নূতন আশার সঞ্চার করিয়া থাকে। ব্যবসায়ীদের হালখাতা-মহরৎ হিসাবে মুসলমানদের জন্যেও নববর্ষ উৎসবের দিন ছিল। কিন্তু এই বৎসর দোলপূজার পর হিন্দুর অনেক তীর্থস্থানের অস্তিত্ব পাক সৈন্যেরা নষ্ট করিয়াছে, সঙ্গে সঙ্গে কয়েকটা মসজিদও। সেদিন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, কিন্তু বর্ষণ নাই। স্থানীয় লােক অনেকে চলিয়া গিয়াছে, তাই বুঝি ধরার এত বিষাদ, এত ক্রন্দন। বাতাসও প্রতি মুহূর্তেই ভয়ের বাণী বহন করিয়া আনিতেছে। অচল অবস্থায় চলিতেছি। মন কেমন করে। দুপুরে ধরার অশ্রুজলও বর্ষণ হইল।

শরণার্থীর দিনলিপি
চার। শ্রীনগর শ্রীনগরে দোকানপাট অনেক আছে, কিন্তু আমাদের প্রতি স্থানীয় লােকজনের সহানুভুতি তেমন নাই। পাকিস্তানী পয়সাতে কোন মাল বিক্রি করিবে না। প্রথমে ছেলের কান্নাকাটি সহ্য করিতে না পারিয়া প্রকৃত মুল্য পনের পয়সার স্থলে পাকিস্তানী ত্রিশ পয়সা দিয়া মাত্র একটা চেপটা (রােজ) বিস্কুট নিয়া তিন টুকরা করিয়া তিনজনকে দিলাম। ইহাতে যে ভীমরুলের মৌচাকে ঢিল সংযােজন করিলাম তাহা পিতামাতা ভিন্ন স্বয়ং ভগবানেরও বুঝিবার সাধ্য নাই। খুঁজিতে লাগিলাম, কিভাবে টাকা পরিবর্তন করা যায়। নেপাল বিশ্বাসের নিকট হইতে চারিটি পাক টাকা দিয়া দুটি ভারতীয় টাকা নিলাম। ক্রমে কিভাবে আরও ২/৩ টাকা সংগ্রহ করিলাম মনে নাই। লােক প্রায় ৩০/৩৫ জন আমরা, রান্নার কোন তৈজসপত্র নাই। লােকে লােকারণ্য। অনেক অনুরােধের পর এক দ্রলােক তার ছােট এক কামরায় স্থান দিল। গরু ঘরের দাওয়ায় পুরানাে হাড়িতে খিচুড়ি তৈয়ারী হল। তখন প্রবাসে নিয়ম নাস্তি’। কদলীপত্র সংগ্রহ করিয়া, কঞ্চির আঁটি জ্বালাইয়া এক পাতায় ৩ জন হিসাবে ব্রাহ্মণ-শুদ্রের ভেদ না রাখিয়া অর্ধভােজনেই উঠিয়া পড়িলাম। | সন্ধ্যার পর শীতও মনে হইতেছে, প্রত্যেকেরই পা ফুলা, রাত্রে শুইবার জায়গা নাই। একটি ‘কুইজ্যাতলে’ (খড়ের গাদার নীচে) শুকনা খড়ের উপর শুইয়া পড়িলাম। কিছুক্ষণ পর হঠাৎ মাখন জেঠা উঠিয়া বসিল। দেখিল, একটা বেশ ‘দাড়িগোঁফ ওয়ালা (পাঞ্জাবীর মত) ছাগল তাহার মাথায় প্রস্রাব করিয়াছে ও কিছু ছাগলাদ্য বটিকাও দিয়াছে। উপায় নাই, দুর, দুর করিয়া আবার শুইয়া পড়িল। চোখ খুলিয়া দেখি প্রভাত। (লেখার তারিখ: ৬/৮/৭১; ৯ AM)

কানাই লাল চক্রবর্তী
পাঁচ: মনু বাজার।
অচেনা ও অনির্দিষ্ট পথে সকালে প্রাতরাশ না সারিয়াই সুবােধ বাবুর পরিচালনায় রওনা হইলাম। পাহাড়ের রাস্তা, কত উঠানামা ও কঙ্কর-ধূলাময়। ভীষণ রাস্তা, শুনিলাম ‘বার মাইল। কয়েকটা জীপ ও ট্রাক চলাচল করিতেছে, কিন্তু একটু জায়গাও নাই কোন গাড়িতে। তদুপরি ছােট বাচ্চাকাচ্ছা নিয়া জীপের পরিবর্তে হাঁটিয়াই চলিলাম। চলিলাম শুধু মনের জোরে এবং সকালে কিছু না খাইয়া। পুৰ্বের রাত্রে অর্ধভােজন করিয়া পরদিন হাঁটার গতি কি রকম হইতে পারে পাঠকের অনুমেয়। যাহা হােক, প্রথম ঘণ্টা খানেক চলার পর পথিককে জিজ্ঞাসা করিয়া উত্তর পাই বার মাইল’, ‘আট মাইল” ইত্যাদি। আগে ও পিছে অনেক চলিয়াছে। কিন্তু যােগাযােগ নাই। কারও সাথে কারও।
পথে কুমিরার রাখাল ও নেপাল মিস্ত্রীও ছিল। চলার পথে একটু বিশৃঙ্খলা দেখা গেল, কারণ আমাদের সবাইর কোলে ছেলে বা মেয়ে, তাই হাঁটিতে কষ্ট। পূর্বে উল্লেখিত ভগ্নী ও ভগ্নীপতি দুইজন মৃতপ্রায়। সবার চেহারা যে কত স্লান হইয়াছে তাহা যদি ‘পাতাল ভৈরবী’ ছায়াছবি দেখিয়া থাকেন, তবে ‘রামুর’ চলার কথা স্মরণ করেন।
চৌধুরী বাড়ীর সবাই আগে বিশ্রাম পেয়েছেন এবং আমরা বিশ্রাম পাই নাই। তাই তাহারা একটু আগাইয়া বিশ্রাম করিতে পারেন, আমরা পিছনে পড়িয়া থাকি। অর্ধপথে পাহাড়ের উপর একটা চায়ের দোকান দেখিলাম, খুবই ভীড়, কোনক্রমে ২/৩ কাপ চা পান করিয়া পুনঃ রওনা হইলাম। দীর্ঘ পথে খাওয়ার কোন ব্যবস্থা নাই, তদুপরি পথে দোকানীরা পাকিস্তানী পয়সা বাটা দিয়াও নিতে চায় না।
সেই দীর্ঘ পথের অনেক ঘটনাই মনে নাই। যত দূর মনে পড়ে, প্রায় যখন চলিয়া আসিয়াছি, আর হাঁটিতে পারি না, তখন একটা ট্রাকে করিয়া চলৎশক্তিরহিত বােন ও ভগ্নীপতিকে পাঠাইয়াছিলাম।

শরণার্থীর দিনলিপি
সব শেষে আমি নিজে, মাখন জেঠা এবং তাহার শ্বাশুড়ীসহ কাছাকাছি এক দোকানে সাগু খরিদ করিয়া কোনক্রমে গরম করিয়া লইয়া গ্রামের ভিতরের রাস্তা দিয়া মনুবাজারে পৌছিয়াছিলান।
তখন আমারও চলৎশক্তি রহিত। তখন বেলা প্রায় দুইটা। হীরেন্দ্র আসিয়া বর্ডার স্লিপ হাতে দিল। এক কার্ডে ১১ (এগার) জন। মাখন বাবুদের ও চৌধুরী বাড়ীদেরও পৃথক পৃথক কার্ড হইল। এরপর হীরেন্দ্র আমাদের ডাকিয়া মনুবাজার উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে লইয়া গেল। সেখানেও ভীড়।
কিছুক্ষণের মধ্যে রেশনও হীরেন্দ্র নিয়া আসিল, কিন্তু রান্না করার সরঞ্জাম কই? দেশের মৃত্যুঞ্জয় ও মাখন জেঠা দুইটা থালা কিনিল এবং হিরন্ময় একটি সিলভারের ডেক্সি কিনিল। চৌধুরীরাও কিছু কিছু বাসনপত্র কিনিল।
থাকার ব্যবস্থা ঠিক হইল অনেক ঝগড়ার পর। স্কুলের বিজ্ঞান কক্ষে ৮/৯ পরিবার এক সাথে । এখানে স্বার্থপরতা শুরু হইল। যারা ঝামেলার লােক তারাই বেশি জায়গা দখল করিল। আমরা ভিতরে মেয়েদের ব্যবস্থা করিয়া পুরুষেরা বাহিরের বারান্দায় প্রস্থভাবে শশায়ার জায়গা করিলাম। রাত কোন রকমে কাটিল।
বিদ্র: ১৯শে এপ্রিল হইতে ৭ই মে পর্যন্ত সংক্ষিপ্ত ঘটনা লিখিতেছি।
১৯শে এপ্রিল, ৭১ ইং ৫ই বৈশাখ, ৭৮ বাংলা, সােমবার কি করিব, তাহা ঠিক করিতে পারি না, টিউব ওয়েল আছে, মাঠে রান্না চলিতেছে। কদলীপত্র ও লাকড়ীর অভাব নাই। পাহাড় হইতে লাকড়ী কাটিয়া আনি। তাহা ছাড়া ছােটদের সাগু, বার্লি ইত্যাদি আরও তৈজসপত্রও কিনিতেছি। ভাংতি পয়সার অভাব, তবে চুরি নাই। জিনিষপত্রের দাম বেশী। | আত্মীয়দের নিকট প্রাথমিক সাহায্য চাহিতে হইবে, কারণ রিক্তহস্ত। হঠাৎ মনে হইল, আগরতলায় নরসিংগড়ে আমার দেশের দেবেন্দ্র কাকা বাড়ী করিয়াছেন। যদি কোন ক্রমে তার কাছে যাই হয়তঃ পূর্ব উপকার স্মরণ করিয়া সাহায্য পাইতে

কানাই লাল চক্রবর্তী
পারি। এক কথায় ভিক্ষায় বাহির হইলাম। সংগে রাখাল মিস্ত্রীও যাইবে।
রাখাল মিস্ত্রীসহ জীপে উঠিলাম। পয়সা কিভাবে যােগাড় হইল তাহা আর লিখা হইল না। আগরতলা যাওয়ার পথে বিশ্রামগঞ্জ নামক এক জায়গায় পৌঁছার পর ঝড়-তুফান শুরু হইল। জীপ খারাপ হওয়ার দরুণ একটু অপেক্ষা করায় এক লােকের সঙ্গে আলাপ। উক্ত লােকের নিকট দেবেন্দ্র দত্তের (বর্তমান নাম: ধীরেন্দ্র দত্ত PW.D) বাড়ির ঠিকানা ভালভাবে জানিয়া নিলাম। | ১২২ মাইল পথ পার হইয়া আগরতলা শহরে পেীছিলাম, তথা হইতে রিক্সায় ‘কামান চৌমুহনী’ গিয়া ৪নং বাসে উঠিয়া নরসিংগড় নামিলাম ও দেবেন্দ্ৰ কাকার বাসায় পৌছিলাম।
কাকীমা চিনেনা। চৌদ্দ বৎসর আগে তাহারা ভারতে আসিয়াছে। কাকা আসিয়া দুঃখ করিল, কেন তােমার মাকে আনিলে না ইত্যাদি। তাদের বর্তমান অবস্থা ভাল, আগের কথা সবই ভুলে যাবারই কথা। অবশ্য আদরযত্ন মন্দ নয়, রান্না করিয়া রাত্রে খাওয়া হইল। গল্পের পর রাত কাটিল। সকালে চা খাওয়ার পর দশটি টাকা দিয়া বিদায় করিল। টাকা না আনিলে মনে কষ্ট পাইবে, তাই আনিলাম। | বিকাল চারটায় ২০/৪/৭১ইং মনুবাজার ফেরত আসিলাম, আসিবার সময় আগরতলায় নিজ হাতের আংটি ৩১ (একত্রিশ) টাকায় বিক্রি করিলাম। জীপ ভাড়া ও বাস ইত্যাদিতে মােট ২০/২২ টাকা খরচ হইয়া গেল।
মনুবাজারে রেশান প্রতিদিন নিতে হয়। তবে কষ্ট আমার নিজের তেমন নাই। সব কাজই লােকেরা করিতেছে। আমার কয়েক দিন পানের পয়সা জুটে নাই। পান খাইতে না পারিয়া ২/৩ দিন বাজে বিড়িও টানিয়াছি।
ইতিমধ্যে মনস্থ করিলাম, সাধারণ ব্যবসা করিব। আমরা শ্রীনগর হইতে মনুবাজার আসিবার পথে খাবারের অভাবে যথেষ্ট কষ্ট পাইয়াছি। এই পথে সাধারণ খাবার বিক্রি করিলে লােকেরও সুবিধা হইবে, কিছু পয়সাও আয় হইবে। টুন্টু ও ঝুনাকে লইয়া বাজার

শরণার্থীর দিনলিপি
করিলাম। লাল আলু, চনাবুট, লজেন্স, বিড়ি, সিগারেট ও মেচ লইয়া শ্ৰী নগরের পথে ২/৩ মাইল হাঁটিয়া গিয়া এক ছড়া’র (নদী) নিকটে (যাহাতে জলের সুবিধা হয়) বসিয়া বিক্রী করিল। এইভাবে ৩/৪ দিন ব্যবসা করিয়া আমার (মূলধন) আমাকে ফেরৎ দিয়া ১৫/২০ টাকা লভ্যাংশ যােগাড় করিল। তাহারা এই টাকা দিয়া পুনঃ বাড়ীতে (দেশে) গিয়া দেশের অবস্থা বুঝিবার জন্য ও আমার মাকে নিয়া আসিবার জন্য আলােচনা করিতেছে। এই ২/৩ দিনের মধ্যে আরও অনেকে আমাদের মত ব্যবসা আরম্ভ করিয়া দিল।
তার পর একদিন বুধবার হিরন্ময়, ঝুনা ও ননাই (দীপক দাশ) রামগড় বর্ডার হইয়া বাড়ীর দিকে ছুটিল। পথে হারুয়ালছড়ি (ফটিকছড়ি থানা) নিবাসী মাসতুতাে বােনের জামাই ডাঃ হরিহর চক্রবর্তীর সঙ্গে হিরন্ময়ের দেখা। কথােপকথনের পর একটি পাটী আমার ছেলেমেয়েদের জন্য ‘গ’ বিভাগের দিলীপকে দিয়া পাঠাইয়া দিল। উক্ত দিলীপ জাফরনগর হইতে প্রতিবেশী বিমল চৌধুরী (টুকু চৌঃ)-র সঙ্গে হরিণাতে আসিয়াছিল, পরে তাহার ভাই প্রণব (ধনা)কে নিয়া মনুবাজার আসিয়াছে। দিলীপের পরণে আমাদের মতই এক লুঙ্গি ও এক সার্ট, প্রণবেরও একই অবস্থা। তাহাদের খাওয়াদাওয়া চৌধুরী বাড়ীর সাথে চলিতেছে।
দিন যায় । কি করিব, না করিব ঠিক নাই। ইতিমধ্যে ২২/৪/৭১ ইং বৃহস্পতিবার ছােট কুমিরার বিশিষ্ট সঙ্গী ও বন্ধু অমলের দেখা। সে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা ও বৃদ্ধ পিতা-মাতাকে নিয়া বাসে আগরতলা যাইতেছে। বাস দাঁড়ানাে অবস্থায় ২/৩ মিনিট তাহার সহিত কথা বলিলাম। কথােপকথন চলিতেছে, এমন সময় হঠাৎ কানাই’ শব্দ উচ্চারণে বাসের ভিতর হইতে আমার শ্বশুর মহাশয় আমাকে ডাকিলেন। সময় খুবই কম, বিশেষ কিছু কথা হইল না। শুধু উদয়পুর যাইতেছেন, পরদিন দেশে ফিরিবেন, এই বলিলেন। আমি বলিলাম, আগামী কাল যাওয়ার সময় যে কোন প্রকারে এখানে (অর্থাৎ মনুবাজার স্কুলের বারান্দায়) একবার আসিবেন।

কানাই লাল চক্রবর্তী
এদিকে মনুবাজারে ২/১ জন স্থানীয় লােকের সঙ্গে দেখা হইতেছে। ২/১ জন রােগীপত্র আর যৎসামান্য পয়সাও পাইতেছি। কিন্তু মন খারাপ, ভবিষ্যতে কি হইবে? ইতিমধ্যে দেশের অনেক লােক এই কেম্পে আসিয়াছে, বিশেষ করিয়া শৈলেন বাবু, রাজেন্দ্র (সুফী), বিমল (বেঙ), বালক সাধু (দুলাল শীল), পরেশ নাথ, মামা সুমন্ত, মছজিদ্যা স্কুলের প্রধান শিক্ষক বাবু সতীন্দ্র বিশ্বাস। আবার শৈলেন বাবুর সঙ্গে খ বিভাগের রমেশ চন্দ্র, চা-দোকানী ধীরেন্দ্র (কাশ), সারদা ও কালাবুড়ী প্রভৃতি। ছােট কুমিরার আমার পুরােনাে গ্রাহক হিমাংশু শীলও আসিয়া হাজির। এইভাবে কোন ক্রমে চলিতেছে। চিঠি বা আত্মীয়দের ভিক্ষার আশায় শকুনের মত বসিয়া আছি। বাড়ী হইতে বাহির হওয়ার এগার দিন পর ছড়াতে স্নান করি। কাপড়-চোপড় কিছুই নাই।
তিনটা নিকৃষ্ট দোকান ঠিক করিলাম। একটা চায়ের দোকান, একটা ষ্টেশনারী বা (টং দোকান) আর একটা বাজে মালের দোকান। এতই যখন লিখিলাম, তখন দোকানের বাখানও কিছু লিখি না কেন।
চায়ের দোকান দৈর্ঘ্য প্রস্থ ৪x৪ হাত, একটা বেঞ্চ, কিছু বিস্কুট একটি ঠোংগায় থাকে। দোকানদারের চেহারা দেখিতে একটা তক্ষকের (গিরগিটি) মতাে। ডান হাত ভাঙ্গা, গরীব ও অশিক্ষিত। কিন্তু মুখে মধু। এই রকম অশিক্ষিতেরাই সব সময় ভগবানের করুণা পাইয়া থাকে। দোকানদারের নাম ‘বেচু’। কেন যে আমার প্রতি বেচুর মন টলিল তাহা জানি না। চা প্রতি কাপ ১৫ (পনের) নয়া, কিন্তু ডাক্তার বাবুর নাম বলিয়া পাঠক, আপনিও চা খাইয়া আসিতে পারেন। এতদুর আসিয়াও যে দেশের মত সম্মান পাইলাম, তাহার জন্য বেচুকে কৃতজ্ঞতা জানাইবার ভাষা আমার নাই।

শরণার্থীর দিনলিপি
টং দোকান। দোকানটি মনুবাজার স্কুলের সামনে। দোকানদারের নাম যতীন্দ্র দত্ত। খুবই ভাল লােক, ওনার কাছে যে সাহায্য ও আন্তরিক সহানুভুতি পেয়েছি তাহা জীবনে ভুলিবার নহে।
বাজে মালের দোকান। দোকানদার ভাল, কিন্তু ভাংতি পয়সার অভাব, বাজার করিলে টাকা পুরাইয়া করিতে হইবে। না হয় টাকা জমা দিয়া আসিতে হইবে। তবে বাকীও দিবে।
এদিকে ঝুনা ও হিরন্ময়কে বাড়ী যাইতে দিবার জন্য ডাঃ প্রবােধ চৌধুরী (লেদদা) পরােক্ষভাবে আমাকে দোষারােপ করিতেন। মনে মনে ভগবানকে স্মরণ করা ছাড়া আর আমার হাতে কি ছিল?
চিঠি ও টিএমও কোনক্রমে দিনে দুইবার ডাকঘরে হাঁটাহাঁটি করিয়া স্থানীয় সাক্ষী যােগাড় করিয়া প্রথম দিনে (৫০+৫০)=১০০ একশত টাকা টেলিগ্রাম মানিঅর্ডার গ্রহণ করিলাম।
আমার বাল্য বন্ধু ব্রজেন্দ্র সাহা (বটু) লামডিং হইতে লিখিল: প্রিয় বিদেশ, তােদের আসার সংবাদে আশ্বস্ত হইলাম, আপাতত ৫০ পঞ্চাশ টাকা পাঠাইলাম। এই টাকা পাইয়া বসিয়া না থাকিয়া এই দিকে চলিয়া আসিবার ব্যবস্থা করিস। শুনিলাম, ধর্মনগর হইতে ট্রেনভাড়া ফ্রি। আমি ভাল, ভালবাসা নিবি। ইতি,
বটু।
যাদবপুর হইতে মামা অমৃত বাবুর চিঠি পেলাম। চিঠির সংক্ষিপ্ত বিবরণ হইল:

শরণার্থীর দিনলিপি
কল্যাণীয় বিদেশ, আশীষ নিও। তােমার মাকে আনিলে না কেন? রিফুজি কার্ড ভিন্ন ভিন্ন করাইও। তােমার জেঠার নিকটও পত্র দিয়াছি। আপাততঃ ৫০ টাকা পাঠাইলাম, ধীর স্থির মস্তিষ্কে কাজ করিও। কেম্পে ডাক্তারী করার ব্যবস্থা করিও। যে কোন অবস্থায় কেম্প ছাড়া হইও না। তাহা হইলে ভবিষ্যতে Settlement হওয়ার সম্ভাবনা কম। আমি কাজে ব্যস্ত। এখানে পার্টীগত (নকশাল/কংগ্রেস, সম্পাদক) গােলমাল বেশী। কত দুর অগ্রসর হয় জানাইও । ইতি আর্শীবাদক, তােমারই মেজ মামা
২/৩ বৎসর আগে পর্যন্ত চলিয়া আসিবার জন্য বড় মাসী (চন্দন নগর) খুব লিখিতেছিলেন। এখন বড় মাসীর কোন জবাব নাই কেন? মনে ক্ৰমে অশান্তি বাড়িতে লাগিল। ত্রিপুরা, মনুবাজারের আবহাওয়া ঠিক আমাদের দেশের মতই। মাঠে রান্না হয়, সন্ধ্যা আটটার মধ্যে খাওয়া দাওয়া শেষ হইয়া যায়। মাঝে মাঝে যেদিন বৃষ্টি হয় সেদিন রান্না করা হয় না, হয়ত মুড়ি, চিড়া ইত্যাদি খাই। কিন্তু ঘুমাইবার ভীষণ কষ্ট। অনেক রাত্রে বৃষ্টির দরুণ বসিয়া থাকি। একদিন বাহিরে শুইয়া আছি, অর্ধরাত্রে হঠাৎ খুবই বৃষ্টি আসিল। ১৮/৪/৭১ইং হইতে আজ ৭/৮/৭১ ইং পর্যন্ত মাথায় বালিশ নাই। পায়ের চাপ্পাল (Chappal) জুতা মাথায় দিয়া গায়ের চাদর গায়ে দিয়া শুই। এক মধ্য রাত্রে জাগরিত হইয়া দেখি বৃষ্টিতে আমার পায়ের দিকে ভিজিয়া গিয়াছে। একটু তন্দ্রাও আছে, হঠাৎ পায়ের তলায় বালিশের মত মনে হইল। লক্ষ্য করিলাম, একটা কুকুর আমার চাদরের নীচে। কুকুরটিকে তাড়াইয়া দিয়া পুনঃ চিন্তা করিতেছি, সেও বােধ হয় পাক-সৈন্য কর্তৃক বিতাড়িত কোন শরণার্থী কুকুর হইবে। সকালে দেখি, আমার চাদরে কতকগুলি (কুকুরের) কেশ লাগিয়া আছে।
যাহা হােক, এভাবে ১৭/১৮ রাত্রি যেভাবে কাটাইলাম তাহা লিখার প্রয়ােজন মনে করি না। এদিকে ছেলেমেয়ের জন্য সাধারণ যাহা ঔষধ বাড়ী হইতে আসার সময় আনিয়া ছিলাম তাহাও শেষ

কানাই লাল চক্রবর্তী
প্রায়, টাকা পাওয়ার পর ২/১টা অতি প্রয়ােজনীয় জিনিষ খরিদ করিলাম: সিলভারের কলস, বিছানার চাদর (ছােট), ২/১ টা সাগুর বােতল, শিশিরের প্যান্ট, একটি দাও (কাটারী) ইত্যাদি। রেশনের চাউল জমা থাকে, অন্যান্য সব জিনিষই কিনিতে হয়। এদিকে পােস্টকার্ড ও খাম কিনিতেই অনেক পয়সা ব্যয় হইতে লাগিল।
হীরেন্দ্রের ছােট ভাই দীপক ও ছােট বােন গীতা অসিয়াছে। আমরা সবাই এক সাথে খাওয়া চালাইতেছি। ‘গ’ বিভাগের নমিতা সাহা অনেক কাজ করিতেছে অর্থাৎ আমাদের সাহায্য করিতেছে। বিশেষতঃ তাপস ও আতসের দেখার ভার সেই চালাইয়া নিতে লাগিল, ছেলেমেয়ের স্নান, পায়খানা, প্রস্রাবের দায়িত্বও তার হাতে। | এদিকে রব (হুজুগ) উঠিল, রেশন ৪/৫ মাইল দূরে কলাছড়া হইতে আনিতে হইবে ইত্যাদি। অবশ্য পায়খানা প্রস্রাব ও স্নানের তেমন সুবিধা এখানে নাই। কিছু দুরেই একটা নদী (ছড়া)। অনেক সময় সেইখানেই স্নান করিতাম।
একদিন সন্ধ্যায় নিজে রেশানের জন্য গিয়াছি। এমন সময় খবর গেল, ঝুনা (মুকুল) আসিয়াছে। সে এবং হিরন্ময় দশ/এগার দিন আগে পুনঃ দেশের বাড়ীতে গিয়াছিল। একা ঝুনাকে ফিরিতে দেখিয়া হিরন্ময় সম্বন্ধে কত রকম যে সন্দেহ হইল তাহা আর লিখিলাম না।
ঝুনা আসিবার আধ-ঘণ্টা পর্যন্ত তার সঙ্গে কথা বলিতে সক্ষম হইলাম না। তাহার বাড়ীর ও অন্যান্য লােকজনেরা তাহাকে বেড়াজাল দিয়া রাখিয়াছে। বাড়ীর খবর শুনিবার জন্য আমি তেমন ব্যস্ত হই নাই। কারণ যত কিছু আসল কথা তাহা ঝুনা প্রথমেই আমাকে বলিবে।। | অনেকক্ষণ পরে তার সঙ্গে কথােপকথন শুরু হইল। হিরণয় আসিতে একটু দেরি হইতেছে। ক্রমে বর্ডারের অবস্থা খারাপের দিকে। কুমিরায় তাহাদিগকে নাকি কয়েকজন গুন্ডা প্রকৃতির লােক খোঁজ করিয়াছে। তাই সে ভয়ে ভয়ে ফিরিয়া আসিয়াছে। ২/১ দিন পর ঝুনা কিছু আর্থিক সাহায্যও আমাকে করিল।

শরণার্থীর দিনলিপি
হিরন্ময় (টুন্টু) আসিল না। আমি একা এতগুলি লােক নিয়া কোথায় যাইব এবং কি করিব তাহার চিন্তা জাগিতে লাগিল। যদি টুন্টু বাড়ী হইতে ঠিক সময়ে ফিরিয়া আসিতে পারিত তবে কিছু আর্থিক সাহায্য যােগাড় হইত। | আমি জানি, টুন্টু আসিয়া উক্ত যতীনবাবু ও চা-বেচুর নিকট আমার খোঁজ করিবে। তাহারাও সমদুঃখী কারণ আমি চলিয়া আসিব। ১৭/১৮ দিনে যে অকৃত্রিম মায়া তাহাদের কাছে পাইয়াছি তাহা লিখিবার মত ভাষা আমার নাই।
ছয়। আগরতলা ও ধর্মনগর ৮ই মে হইতে ১০ই মে, ১৯৭১ ৮ই মে/৭১ইং শনিবার সকালে ভাত খাইয়া মাথা ধুইবার পর হঠাৎ ‘চল চল’ শব্দ। কারণ সবাই চলিয়া যাইতেছে। আমি পরৈস্মপদী’, সুতরাং কাজের লােক নহি। লরি দন্ডায়মান, মনু বাজারের দৃশ্যই আমাদের দৃশ্যকে দেখিতে লাগিল। জনপ্রতি ভাড়া ৫(পাঁচ) টাকা। দিলীপ ও ধনার ভার আমার উপর পড়িল। তাড়াতাড়ি যতীন বাবুর ৮ আট টাকা ও বেচুর ১.৮০ পয়সা দিয়া লরিতে উঠিলাম। দেশের লােক কান্নাকাঠি করিতেছে, কবে আর দেখা হয় না হয়। ছুটিলাম ঠাকুরের নাম নিয়া। সন্ধ্যার সাধারণ পুৰ্ব্বে আগরতলা দুর্গাবাড়ীতে আশ্রয় নিলাম। জায়গা নাই। কোন রকমে খােলা জায়গায় বসিয়া সারা রাত মশাকে নেমন্তন্ন খাওয়াইলাম। এদিকে জেঠী (প্রভা) মাখন বাবুর স্ত্রীর ডাইরিয়া শুরু হইল। তাহাকে Capsul খাওয়াইলাম। Homoeo Store থেকে ২/১ টা অতি প্রয়ােজনীয় (নিজ ব্যবহার্য) ঔষধ খরিদ করিলাম। সকালে সাধারণ মুড়ি খাইয়া, গাড়ীর খোঁজে বাহির হইলাম, কারণ ধর্মনগর যাইতে হইবে।
ধর্মনগরের গাড়ীতে চড়িলাম বেলা এগারটার দিকে। এটা ওটা, গুনাগুনি, নানা কাণ্ডকীৰ্ত্তণের পর একটা ট্রাক ছাড়িল। কি ভীষণ রাস্তা, কিছুক্ষণ পর পর মােড় ও উঠা নামা (১৮ মুড়া)। সেই রাস্তায় আর কোন দিন যাওয়া হইবে কিনা জানি না। ঘণ্টা খানেক চলার

কানাই লাল চক্রবর্তী পর যাত্রীদের বমি শুরু হইল। প্রথমে চৌধুরী বাড়ীর বড় বৌদি (বাবুলের মা) এবং তারপর ক্রমে অনেকেই বমি, পায়খানা করিতে শুরু করিল। নরককুন্ডই বটে! বমি ও পায়খানার উপরই চাপিয়া বসিয়া আছি এবং লেবু, লজেন্স ইত্যাদি বিলি করিতেছি। অবশ্য ভগবানের কৃপায় আমরা ২/৩ জন সে বিপাকে পরি নাই। কেহ বেহুসের মত হইল, মাঝে মাঝে জলের নিকট লরি দাঁড়ায়। জল খাওয়া ইত্যাদি চলে। লরি চালক (Driver) এর বাহবা আছে বটে।
সন্ধ্যা হইল। একটু বৃষ্টি আসিল। ঠান্ডা বাতাসে কাহিল হইলাম। উপায় নাই। হঠাৎ দুর্ঘটনা হইলে সবাই মরির। অতি কষ্টে অনেক জলের উপর দিয়া রাত আটটায় ধর্মনগর রেলওয়ে ষ্টেশনে পৌছিলাম। টর্চ মারিয়া দেখিলাম, ছেলেরা জীবিত কি মৃত? দেখি সবাই জীবমৃত অবস্থায় আছেন। | চৌধুরী বাড়ীর সবাই প্লেটফরমের একদিকে গেল, আমরা অন্যদিকে আশ্রয় নিলাম। পুনঃ চিড়ামুড়ি চলিল। ষ্টেশনে ঘুরাঘুরি করিতেছি। সেই দিন রাত্রে গাড়ীতে উঠিতে পারিলাম না। পরদিন প্রাতে শিলচরের গাড়ীতে উঠিয়া দুপুর দেড়টায় শিলচর আসিয়া পৌছিলাম।
সাত। শিলচর ও লামডিং শিলচর পৌছিবার সঙ্গে সঙ্গেই চৌধুরী বাড়ীর দাদা সুবােধ বাবুর ডাইরিয়া (Diarrhoea) শুরু হইল। প্লেটফরমে আবার দুই ভাগে জায়গা নিলাম। তখন আমার তাপসের জ্বর ও সর্দি। পায়ে ফুলা, ধৰ্ম্মনগরের রাস্তার প্রতিফল। তাহার জন্য সাধারণ ঔষধ কিনিয়া আনার আগেই সুবােধদাকে ঝুনা, তার মা ও হীরেন্দ্রকে দিয়া শিলচর হাসপাতালে পাঠাইয়া দিলাম। পরে অন্য রিক্সায় আমিও গেলাম। স্নানের ও পানীয় জলের সুবিধা মন্দ নহে কিন্তু শিলচরে মাছির (Fly) উপদ্রব বেশী । তখন ছােট ছেলে আতসও অসুস্থ।

শরণার্থীর দিনলিপি
| স্টেশনে মিলেটারিরা যেখানে টিকেট কাটে সেই টিকেট কাউন্টারের কাছেই আখেরা করিলাম। এ সময় হঠাৎ বাবু অরবিন্দু বিশ্বাস (কুমিরার হেরম্ব বিশ্বাসের ছােট ভাই) এর সাথে দেখা। তিনি আদর-যত্ন করিলেন এবং অনেক আলােচনার পর বলিলেন, লামডিং চলে যান।
অনেক লােক ও ভােলানটিয়ারগণ শিলচর কেম্পে ভর্তি হইবার জন্য বলিয়াছিল। কেন ঐ কেম্পে গেলাম না এবং তাহাতে যে কত বড় ক্ষতি হইল তাহা পরে লিখিব। দুইদিন পর সুবােধ দাদা ভাল হইলেন ও তাঁহারা সবাই শিলচর কেম্পে ভর্তি হইলেন। পরদিন সকালের মেইলে লামডিং রওনা হইলাম।
গাড়ীতে ভীড়, জামা পাকড় ও বিছানার অভাব, ছােট ছেলেদের বেঞ্চের নিচে মালের মত শােয়াইয়া রাখিলাম। অতি কষ্টে সন্ধ্যা ছয়টায় লামডিং আসিলাম। আবার প্লেটফরমে জায়গা নিলাম। চাখাওয়া সারিয়া বাল্যবন্ধু ব্রজেন্দ্রের খোঁজ করিলাম। সেদিন দেখা হইল না। পরদিন সকালে বাসায় গিয়া দেখা হইল। বটু আসিয়া সবই দেখিল এবং মন্তব্য করিল, এত লােক সে তার বাসায় কিভাবে জায়গা দিবে? ব্রজেন্দ্রের কথায় মন পরিবর্তন হইল। এতগুলি লােক নিয়া কলিকাতার বাজারে আত্মীয়দের বাড়ীতেইবা কিভাবে উঠিব? ক্যাম্পে থাকাই শ্রেয় মনে করিলাম। হায়! যদি ক্যাম্পেই যদি থাকিব, তবে শিলচর বা মনুবাজার খারাপ কি ছিল? তখনও অবশ্য চন্দন নগরের বড় মাসীর নিকট হইতে কোন চিঠি পাই নাই।
লামডিং শহরে অস্থায়ী Camp আছে। ক্যাম্পের লঙ্গরখানায় খাওয়া চলিতে লাগিল।
বাহ্যিক সাহায্য ব্রজেন্দ্র যাহা করিয়াছে তাহা যথেষ্ট। কিন্তু নিজের বল না থাকিলে Coramine injection এ কতক্ষণ রােগী রাখিতে পারে? ব্রজেন্দ্রর সাহায্যের মধ্যে শতরঞ্জী, কম্বল, মগ (জগ), টিফিন বাটী, একটি ষ্টোভ, কয়েকটা খালি বােতল। হায়! কত বােতল লাথি দিয়া ফেলিয়া দিয়াছি। আজ একটি বােতলের দামও আমার হাতে নাই।

শরণার্থীর দিনলিপি
অফিসে (Relief transit) দৌড়াদৌড়ি করিয়া শুনিলাম, হােজাই কেম্প জায়গা ভাল ও সেখানে সুবিধা হইবে। লামডিং অফিস হইতে ক্রমিক নম্বর হিসাবে হােজাই কেম্পে পাঠায়। সেখানে সন্দ্বীপের একজন ছেলে সাহাবাবু (সাহা-দা) কাজ করে। লিষ্টে নাম উঠিল। ২০ (বিশ) মে দুপুরে রওনা হইব। এদিকে ছেলে দুইটার অসুখ । বড় ছেলে তাপস হাঁটিতে পারে না। ছােট ছেলের আমাশয়।
হীরেন্দ্র তার ছােট ভাই দীপক ও গীতাকে আগরতলায় তার দাদা (রথীন্দ্র) এর নিকট রাখিয়া আসিয়াছিল। ২/৩ দিন লামডিং থাকিয়া সে তাহার মামার বাসায় (গৌহাটি) যাওয়ার জন্য উদগ্রীব হইল। নিজের ক্ষমতা যখন নাই, তাহাকে আটকাইয়া কি ফল হইবে? অন্তরে অন্তরে মরণযন্ত্রণা অনুভব করিলাম। কিছুই না বলিয়া মাথা নাড়িয়া ইশারা করিলাম: “যাও’।
সে অবশ্য এই প্রতিশ্রুতি দিয়া গেল যে তাহাকে স্মরণ করা মাত্রই সে আসিয়া হাজির হইবে। রাত্রে সাড়ে আটটায় ট্রেন ছাড়িয়া দিল। তাপসকে কোলে নিয়া জানালার দিকে তার নুনু বদ্দার যাওয়ার দৃশ্য দেখাইতেছি। সে শিশু, তার মনেও যে বিষাদের ছায়া নামিল, একথা নিঃসন্দেহে বলা যায়, কারণ দুইজনেই এক প্রাণ ছিল।

কানাই লাল চক্রবর্তী
আট। হােজাই। ২০শে মে, ৭১ইং, বৃহস্পতিবার লঙ্গরখানায় খাইয়া যাযাবরের মত জিনিসপত্র বাঁধিয়া লইলাম। পৌনে তিনটায় দুইটা বাস আসিল। কোন রকমে বাসে উঠিলাম। প্রায় (সন্ধ্যা) ৫ টায় বাস ছাড়িল। তখনও শিবুর (মাখন জেঠার ছেলে) জ্বর বেশি। যাহা হােক, সে কথা পরে হইবে। পুনঃ রাস্তার অবস্থা দেখিয়া ধৰ্ম্মনগরের রাস্তার কথা মনে হইল এবং হৃৎকম্প শুরু হইল। এক ঘন্টার মত পাহাড়ের রাস্তা শেষ হইয়া গাড়ি সমতলের রাস্তায় চলিল। রাত ৮টায় হােজাই কেম্পের সামনে বাস দাঁড়াইল। এক জায়গায় ইলেকট্রিক লাইট জ্বলিতেছে, লােকজনের আনাগােনা আছে। ইতিপূর্বে প্রথম ২ বাস লােক আনিয়াছে। ১৮/২০ টি পরিবার।
দেখিলাম, মাত্র দুইটি ব্যারাক ঘর উঠিয়াছে। ৮x১১ হাত, পেছনে টিনের বেড়া, উপরে টিন, এবং ভােলা ঘর। যে কোনটায় ঢুকি, আগেই জায়গা দখল হইয়া গিয়াছে। প্রথম দিন যে পরিবারগুলি আসিয়াছিল তাহারা পাকা ঘর অর্থাৎ হােস্টেল ও অফিস সংলগ্ন ভালাে ঘরগুলি আগেই দখল করিয়া নিয়াছে।
| কোন রকমে গড়মিলে মালপত্র ও নিজেরা সাধারণভাবে এক রাত্রির জন্য একটি ঘরে আশ্রয় নিলাম। Identification হইল ও অফিসার বলিলেন: নূতন ঘর তৈরি হইবে, ঘর দেওয়া যাইবে, আপাততঃ কোন প্রকারে থাকুন। কিভাবে যে সেই রাত কাটাইলাম তাহা ভগবান জানেন।
পরদিন বেলা তিনটার সময় ব্রজেন্দ্র দেখিতে আসিল। গল্প করিতেছি, এমন সময় কার্যকারকেরা হঠাৎ বাঁশের বেড়া দিয়া দিল। দেখি, আপনা আপনিই আমরা চারভাগে বিভক্ত হইলাম। কিরূপ তাহার বর্ণনা দিলাম:
১নং উত্তর দিকের কামরায় বাসন্তি (দিদি) সৃষ্টি ও পঞ্চু। ২নং মালের কামরায় আমার পরিবারসহ ছয়জন।

শরণার্থীর দিনলিপি
৩নং মাখন জেঠার পরিবারসহ চার জন।
৪নং দিলীপ, ধনা, অমিয়বাবু খােলা মাঠে। সব মিলাইয়া মােট ১৭ (সতের) জন মেম্বার একই সঙ্গে খাওয়া| দাওয়া ইত্যাদি। খাওয়া চলিতেছে লঙ্গর খানায়। দিবা কোন সময় ২/৩টায় এবং রাত্রি বারােটায়। থালাবাসন নাই। বাতি নাই। ঘরে ছােট ছেলেদের অসুখ। তাই এক সাথে সবার খাইতে যাওয়া সম্ভব হয় না। প্রথম ব্যাচে খাইতে না পারিলে পরে খাবারের অভাবও থাকে। কোনক্রমে ৩১/৫/৭১ইং পর্যন্ত কাটাইলাম। উক্ত তারিখে প্রথম রেশান পাইলাম।
এদিকে, এক রুমে তিন পরিবার করে থাকায় কান্নাকাটি ও | ঝগড়া ইত্যাদি চলিতেছে। আরও আশ্চর্যের বিষয় এই যে, নূতন | ঘর উঠিতেছে, কিন্তু খুঁটি পােতার সঙ্গে সঙ্গেই অন্য লােকেরা সেই সব ঘর দখল করিতেছে। এইভাবে অনেক কষ্ট করিলাম। অফিসার এর কাছে আপত্তি করিয়া Accomodation এর সুব্যবস্থা হইল না বলিয়া মনে মনে নিজেকে ঘৃন্য বােধ করিলাম।
এইভাবে শেষে ২৬/৫/৭১ ইং S.D.C. (Subdeputy Collector | R/R Hojai) সমীপে দরখাস্ত করিলাম: বাসস্থানের অভাবহেতু
আমি কলিকাতা চলিয়া যাইব। মনে হইল, দরখাস্ত মঞ্জুর করিয়া দিলেন, কিন্তু দরখাস্তের উপর কি যে তিনি লিখিলেন তাহা আমি ঠিক বুঝি নাই। এমন সময় হঠাৎ দেবদূতের মত এক হাজারী বাবু আসিয়া উপস্থিত হইলেন। একটি রুমে আটজন শরণার্থী ছিল। সেই আটজনকে অন্য রুমে ব্যবস্থা করিয়া তাহাদের রুমে আমাদের সতের জনকে ঢুকাইয়া দিলেন। আমরা রুমে ঢুকিবার পর পরই ঝড়-তুফান শুরু হইল।
কোনও ক্রমে চলিতেছে। বেশির ভাগ লােককে বাহিরে খােলা জায়গায় থাকিতে হয়। কলিকাতা যাওয়ার Programme বাতিল হইল। ক্রমে আবহাওয়ার দরুণ ও সুচিকিৎসার অভাবে ছেলেদের অবস্থা চরমে উঠিতে লাগিল।

কানাই লাল চক্রবর্তী
জুনের ১লা তারিখ ব্রজেন্দ্র (বটু) দেখা করিতে আসিল। জানাইল, হিরণয় তাহাকে Telegraph (টেলিগ্রাফ) দিয়াছে, মাকে নিয়া লামডিং আসিতেছে। মন একটু আশ্বস্ত হইল। ব্রজেন্দ্র চলিয়া গেল। ৪/৬/৭১ইং হােজাই বাজারে শুনিলাম, লামডিং ব্রজেন্দ্রের বাসায় মা ও আরও ২/১ জন আসিয়াছে, মন টিকিল না। এগারটার (Dibrugarh mail) গাড়ীতে লামডিং গিয়া দেখিলাম, মা, হিরণয়, ঝুনা (শিলচর) হইতে এবং আপেল রাণী (নমিতার মা) আসিয়াছে। কথাবার্তার পর হিরণয় ও ঝুনা কেম্পে (হােজাই) আসিয়া আমাদের দেখিয়া গেল এবং রাত্রেই চলিয়া গেল।
কথা রহিল, সােমবার (৭/৬/৭১ইং) সকালে মা, হিরন্ময় ও আপেল রাণী আসিবে।
নয়। শিবু। ৬ই জুন, ৭১ইং রবিবার সাধ করিয়া আমি নাম রাখিয়াছিলাম ‘শিবু’। কেন রাখিয়াছিলাম তাহা আমিই জানি। অনেক বিপর্যয়ের পর দীর্ঘ দেড় বৎসর হইতে দুই বছর চিকিৎসার ফল শিবু। জেঠা মাখন বাবুর ছেলে। জন্মের ঠিক একমাস বিশদিন পরে এই দুগ্ধপােষ্য শিশুকে কোলে লইয়া মাখন জেঠা ও তার পরিবারের ভারতে আগমন। শিবুর জীবনের আজ শেষ দিন।
| ছেলেকে আমার চিকিৎসাধীন রাখিবার মানসেই বন্ধু-বান্ধুব ত্যাগ করিয়া জেঠা আমার পাশ ধরিয়াছিল। কিন্তু যতই ঔষধ চলুক
কেন, পথ্যাপথ্য, অনিয়ম ইত্যাদি আর কত সহ্য হয়। ইতিমধ্যে ছােট দুধের শিশু কেম্পের মধ্যে মারা যাইতেছে। সুস্থ ও সবল ছেলের চেহারা বিবর্ণ ও ফ্যাকাসে হইতেছে। শিবু শুকাইয়া শুকাইয়া মরিতেছে।

শরণার্থীর দিনলিপি
সেদিন রবিবার। কেম্পে আসা পর্যন্ত এক বাজার করিতে যাওয়া ছাড়া ঘরের বাহির হই নাই। সেদিন জেঠাসহ উত্তরদিকে রাস্তায় বেড়াইতে গেলাম। সন্ধ্যার সময় প্রায় এক মাইলের মত গিয়া, রাস্তায় উপর একটি খাল ও খালের উপর একটি পুল দেখিতে পাইলাম। বৈকালিক ভ্রমণ শেষে কেম্পে ফেরৎ আসিলাম।। | এখানকার হিসাবে অনেক চেষ্টা করিলাম। রাখা গেল না। রাত দেড়টায় শিবু শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিল।
কেম্পের সংলগ্ন এক মাসীর চায়ের দোকান ছিল। মাসী International, অর্থাৎ সবার মাসী। মাসীর সাথে আমাদের সবার বড় ভাব ছিল। মাসীর কাছে গেলাম এবং শ্মশানের খবর লইয়া আসিলাম। সেদিন যেখানে বৈকালিক ভ্রমণ করিতে গিয়াছিলাম, জানিলাম, সেই স্থানটিই শ্মশান। | কেম্পে দিনে ঘর বাঁধার কাজ হয়, তাই বাঁশ ও কঞ্চির অভাব নাই লাশ মাটি দেওয়ার সময় উপরে কিছু বাঁশ-কঞ্চি দিতে হয় যাতে শিয়ালে লাশ টেনে বের করতে না পারে।] দিলীপসহ দৌড়াদৌড়ি করিয়া একটা কোদালের (Spade) খবর পাইলাম। কোদালটি এক মেয়েছেলের এবং মেয়েছেলেটি ঢাকার । অনেক কাকুতি-মিনতি সত্ত্বেও কোদাল তার নয়’ অজুহাতে সে কোদাল দিল না। শেষে কেম্পের এক অফিসার গিয়া কোদাল ও শাবল (খুন্তি) বাহির করিয়া দিলেন। রাত প্রায় সাড়ে তিনটার সময় শ্মশানে শিবুকে নিয়া ভাের। পাঁচটায় গর্তের মধ্যে পুঁতিয়া কেম্পে ফিরিয়া আসিলাম।
দশ। পুনর্মিলন সােমবার ৭/৬/৭১ইং সকালে আমার মা ও নমিতার (আপেলরাণী)। আসিলেন। মা ও মেয়ের দেখা হইল। আমার মা’কে দেখিয়া আমার ছেলেমেয়েরা ও ভাগিনা-ভাগিনীরা উতলা হইয়া উঠিল। কারণ অনেক দিন পর তাহারা তাহাদের দিদিমা ও ঠাকুরমাকে পাইয়াছে।

কানাই লাল চক্রবর্তী
হিরন্ময় লামডিং বটুর বাসায় চলিয়া গেল। সে কেম্পে ভর্তি হইল না।
ইতিমধ্যে আপেল রাণী তাহার বােনের বাড়ীতে, গ্রাম: বাসুগাঁও, থানা: কোঁকড়ঝার, জেলা: গােয়ালপাড়া, আসাম) তাহাদের পৌছসংবাদ দিলেন ও তাহাদের লইয়া যাইবার জন্য চিঠিপত্র দিলেন। Camp Officer এর নিকট মেয়েকে সাথে লইয়া যাইবার জন্য দরখাস্তও করিলেন। অনেক প্রশ্নোত্তরের পর দরখাস্ত মঞ্জুর হইল এবং লামডিং ব্রজেন্দ্রের বাসায় তাহাদের মা ও মেয়েকে পাঠাইয়া দিলাম। ২/৩ দিন পর আপেল রাণীর বেহাই গনেশ সাহা গােয়ালপাড়া হইতে আমাদের কেম্পে আসিল। যথারীতি দিলীপকে সঙ্গে দিয়া তাহাকে লামডিং পাঠাইয়া দিলাম। শুনিলাম, সেই রাত্রেই তিনি নিও বনগাই গাঁও (New Bangaigon) এর গাড়ীতে সবাইকে নিয়ে চলে গেছেন।
ওঁ শান্তি। এতদিন পর একটা বিষবৎ বােঝা হইতে মুক্তি হইলাম। আমাদের মােট মেম্বার কমিয়া (১৭-২) ১৫ (পনের) হইল।।
এগার। হােমিও সেবাসদন। ডাঃ হিমাংশু চক্রবর্তী (এইচ.এম.বি.) ‘বাহ্মনস্য ব্রাহ্মনায়াং জ্ঞাতি’ বলে একটা কথা আছে। তিনি হােমিওপ্যাথ এবং আমারই মত তাঁহার পান খাওয়ার অভ্যাস আছে। ডাক্তার বাবুর চেহারা এবং ব্যবহার খুবই সুন্দর। কোন দিন। পৌছ-পরিচয় নাই। অথচ কিভাবে আজ পর্যন্ত তাঁহার বুকে স্থান পাইয়াছি তাহা জানাইবার মত ভাষা আমার নাই। আমার চিঠিপত্র ডাক্তারবাবুর ঠিকানায় আসে। প্রতিদিন চিঠির লােভে গিয়া তাঁহার ডিসপেনসারিতে বসি।
শরণার্থীদের মধ্যে কত জন যে অস্থায়ী ছােটখাট ব্যবসা করিতেছে তাহার অন্ত নাই। আমরা দুই জন (মাখনবাবুসহ) চিন্তিত মনে বসিয়া থাকি, সংবাদপত্র দেখি ও ডাক্তার বাবুর সাথে অবসর

শরণার্থীর দিনলিপি
সময়ে রসিকতা করি। যাহা হােক, দিন যায়, কথা থাকে। তাঁহার সহকর্মী শ্রী মদন সিংহও আমাদের যথেষ্ট আদর-শ্রদ্ধা করেন। অথচ মুখের কথা ছাড়া আর কিই বা আমি দিতে পারি। যখন বসি, তখনই মাথার মধ্যে অনেক পুরানাে গল্প, নিজের প্রতিষ্ঠান, তিন জন সহকর্মীর কথা ও হাজার হাজার জীর্ণ রােগীর ইতিহাসের কথা মনে পড়ে। কিন্তু কি করিব? দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া উপায় কি ?
ডাক্তার বাবু ছাড়িবার পাত্র নহেন। অনেক রসিকতা করেন। ও অন্যান্য প্রসঙ্গে অবসর সময়ে আলােচনা করিয়া আমাদের মন উৎফুল্ল রাখিবার চেষ্টা করেন। আন্তরিক সাহায্যও করেন। কিন্তু হায়! এইরূপ সাহায্যে কিভাবে মানুষ চলিতে পারে? কয়দিনই বা চলিবে, যাহা হউক, ইচ্ছা বা অনিচ্ছা সত্ত্বেও তাঁহার ‘দান মাথা পাতিয়া গ্রহণ করিয়া আসিতেছি।
ইতিমধ্যে গৌহাটি হইতে হীরেন্দ্র (নুনুজেঠা) হােজাই কেম্পে আসিয়া আমাদের দেখিয়া গেল এবং কলিকাতা গেল। সেখানে সে যাদবপুরে মেঝ মামার সাথে দেখা করিল। আমরা মামা একটি ব্যাগসহ কতক ঔষধ আমাকে পাঠাইয়াছেন, কিন্তু ডাক্তারী ব্যবসার সুযােগ কেম্পে নাই। হীরেন্দ্র আবার তাহার মামার বাসায় গৌহাটি চলিয়া গেল।

শরণার্থীর দিনলিপি
বার। আতস ১৮ ই জুন, শুক্রবার/৭১ইং ছােট ছেলে আতস জন্ম (৯-২-৭১ইং) মঙ্গলবার বেলা পৌনে তিনটা। স্বাস্থ্য ভাল ছিল। কিন্তু শিলচর আসার পর আমাশয় এবং শেষে কাশি ও বমিভাব হইল। সর্বশেষে গুহ্য ও মুখে লাল ক্ষত দেখা গেল। অতি অল্প দিনেই স্বাস্থ্য শুকাইয়া গেল ও গলার স্বর বসিয়া গেল।
উক্ত ডাক্তার বাবুর নিকট চিকিৎসা করাইলাম। ‘নিয়তি কেন বাধ্যতে’। ১৮ই জুন, শুক্রবার ভােররাত্রি পৌনে চারটায় আতস শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিল।
মৃত্যুর খবর যথারীতি অফিসে দিয়াছি।
এই বিষয়ে হীরেন্দ্রের নিকট চিঠি দিলাম। আসিতে পারিল না, জবাব দিল, যাহা হােক।
তের। তাপস ২৭শে জুন, রবিবার মনুবাজার থাকাকালীন তাপসের সাধারণ জ্বর-সর্দি ছিল। চলার পথে চিকিৎসার সুবিধা হইল না। শিলচর হাসপাতাল হইতেও ঔষধ নিয়াছিলাম। পরে লামডিং আসিয়া নিজেও ঔষধ দিলাম। হােজাই কেম্পে চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা হয় নাই তখনও। ছেলেকে রেলওয়ে ষ্টেশনের দক্ষিণ দিকে সরকারী হাসপাতালে নিয়া গেলাম ২৫শে মে, ৭১ইং। ডা, সূত্রধর। সরকারী ডাক্তারখানার অবস্থা আমার অজ্ঞাত নহে, কারণ বিগত তের বত্সর যাবত ডাক্তার করিতেছি। ডাক্তারী শিখিতে না পারিলেও মানুষ চিনিতে শিখিয়াছিলাম। কেম্পের শরণার্থী হিসেবেই গেলাম। দেখিতে দেখিতে এক সপ্তাহ কাটিয়া গেল। ১/৬/৭১ইং ডা, সূত্রধর বাবুর পয়সার লােভ ও গাফেলতি দেখিয়া এবং ব্যবহারে মুগ্ধ হইয়া ছেলেকে কোলে নিয়া হােজাই রেলওয়ে ষ্টেশনে দাড়াইয়া আছি। চোখের জল লজ্জায় আসে নাই।

কানাই লাল চক্রবর্তী
হঠাৎ মনে হইল ‘স্বধর্মে মরণং শ্রেয়। আমি ছেলেকে হােমিও চিকিৎসাই করাইব। এতদিন সুচিকিৎসার অভাবে, আবহাওয়া ও সুপথ্যের অভাবে ছেলে একেবারে কাহিল হইয়া গিয়াছে। হাতে ও পায়ে ফুলা (শােথ), জ্বর, পায়খানা ইত্যাদি। কত রােগীর চিকিৎসা করিয়াছি আজ আমার ছেলের চিকিৎসা-বিভ্রাট।
হােমিও সেবাসদনে বসিয়া আছি। অল্পক্ষণ ডাক্তারবাবু তাপসকে নিরিক্ষণ-পরীক্ষণ করিলেন। ছেলে তাপসকে দিলীপের মারফৎ কেম্পে পাঠাইয়া দিলাম। | ডাক্তার বাবু আশীর্বাদ করিলেন। চিকিৎসা যথারীতি বিনা পয়সায় চলিতে লাগিল। জ্বর বন্ধ হইল, কিন্তু নিজের চা খরচ, ছেলের দুধ-মিশ্রি ইত্যাদি কিছুরই ব্যবস্থা করিতে পরিতেছি না। আমার দুই ছেলেকেই ডাক্তার বাবু চিকিৎসা করিয়াছেন।
১৮ই জুন শুক্রবার ছােট ছেলে মারা যাওয়ার পর আমার মা অধৈৰ্য্য হইয়া কেম্পের শরণার্থী ডাক্তার চট্টগ্রাম জেলার হাটহাজারী থানার (সরকার হাট) মির্জাপুর গ্রাম নিবাসী ডাঃ ফনী ভূষণ রায়কে (পুরান পদবী ‘শীল) তাপসের চিকিৎসার ভার দিলেন। চিকিৎসা চলিতেছে। আমার শ্রদ্ধেয় ডাক্তার বাবুকে সবকিছুই জানাইতেছি।
সেদিন ২৭শে জুন রবিবার। সারাদিন ছেলের অবস্থা একেবারে খারাপ ছিল না। পকেটে মাত্র তিনটি ভারতীয় নয়া পয়সাই সম্বল। পান-সুপারীর কিছু টাকা ও ডাক্তার বাবুর (ফনী বাবু) কিছু টাকা বাকী আছে, দিতে হইবে। সন্ধ্যা সাতটায় অনন্যোপায় হইয়া মায়ের নিকট হইতে ১৯১৮ইং সালের দুটা রূপার টাকা লইয়া বিক্রি করিবার জন্য হােজাই বাজারে গেলাম, কিন্তু রবিবার বলিয়া সেদিন দোকান বন্ধ ছিল। টাকা বিক্রি হইল না, অনেক বার ডাক্তার বাবুর নিকট পাঁচটি টাকা ধার চাহিব বলিয়া মনস্থ করিলাম। কিন্তু ঋষিবাক্য মনে উঠিল: ‘বন্ধুর কাছে টাকা হাওলাত চাহিবার পূর্বে ভালভাবে চিন্তা করিও, তােমার বন্ধুর দরকার বেশী, না টাকার? চাহিবামাত্রই পাইব, আশা আছে, কিন্তু লজ্জায় চাহিতে পরিলাম না। মনের দুঃখ মনেই রহিল। কিন্তু বাহ্যিক রস-কৌতুকও করিলাম।

শরণার্থীর দিনলিপি
এদিকে জেঠা মাখন বাবুর নিকট হইতে ২০ (বিশ) পয়সা হাওলাত নিয়াছিলাম পাওনাদার চুকাইবার জন্য। সেই বিশ পয়সা আমার হাতেই রহিল। চা-খাওয়াও গােল্লায় গেল। জেঠা বাসায় (কেম্পে) ফিরিবার জন্য তাগিদ দিতে লাগিল। অবশেষে রাত নয়টায় উঠিলাম। পথে ‘অজিত’ নামে একটা চা-মিষ্টির দোকান, তার সামনে একটা টিউবওয়েল। জেঠা ও ভাইপােতে মিলিয়া ইচ্ছামত জল খাইলাম, পেট ভরিয়া গেল। জেঠাকে এই বলিয়া সান্তনা দিলাম, যদি বেশি ক্ষিধার সঞ্চার হয় তবে জল খাইও, ক্ষিধা নিবৃত্তি হইবে। কেম্পে ফিরিয়া আসিবার পথে আসাম-অয়েল এর নিকটে রিক্সা হইতে ভগ্নিপতি অমিয় বাবুর ‘কানাই’ ডাক শুনিয়া বুঝিতে বাকী রহিল না। | রিক্সা ওয়ালাকে হাতের বিশ পয়সা দিয়া তাড়াতাড়ি রুমে ঢুকিলাম। দেখি, ছেলের অবস্থা ভাল নয়, ডা. ফনী বাবু Coramine দিয়াছেন ও আশা ত্যাগ করিয়াছেন। ঘর লােকে লােকারণ্য। মেয়ে মিষ্টি ও ভাগিনা শিশির অর্ধভােজন করিয়া বসিয়া আছে। তাহাদের ব্যবস্থা আগে করিয়া মৃতপ্রায় শিশুর শেষ চেষ্টায় ব্রতী হইলাম । | রাত এগারটায় চোখ খুলিল ও ‘মা’ বলিল। মনে শান্তি আসিল। বাঁচিবে না, তবে আজ রাত থাকিতে পারে। রাত ১১/১৫ মিনিটে পুনঃ খিচুনি শুরু হইল। এমতাবস্থায় কোথায় একটু মিছরির জল ও গরম দুধ দিব তা না, ছেলের মুখে টিউবওয়েলের কাঁচা জল দিতে লাগিলাম। রাত বারােটায় ছেলে ফাঁকি দিল। তাহার মায়ের অবস্থা আর লিখিলাম না। দশদিন আগে ছােট ছেলে ও দশদিন পর বড় ছেলে ফাঁকি দিলে মায়ের অবস্থা অনুমেয়।।
একটু আগে এক পসলা বৃষ্টি হইয়াছে। সাধারণ বাতাস আছে, আকাশও মেঘাচ্ছন্ন। মধ্য রাত্রে ছেলেকে নিয়ে শ্মশানে যাইতে হইবে। অগ্নিসংযােগ হইবে না, ব্রাহ্মণের কোন চিহ্ন বর্তমানে নাই। শ্মশানেরও দরকার নাই। কারণ এক সাইনবোের্ড আছে, আমরা শরণার্থী। লক্ষীছাড়া ‘ইয়াহিয়া খান’!

কানাই লাল চক্রবর্তী
যাহা হউক, চোখের জল আমার নাই। আজ দিলীপ ও ধনা তাহাদের বাবা-মায়ের নিকট চলিয়া গিয়াছে, সুতরাং লােক কম। কোন রকমে কেম্পে আমাদের দেশের হিমাংশু শীলকে সঙ্গে লইয়া মাখন বাবু, অমিয় বাবু ও আমি নিজে সহ চার জন চলিলাম। ভাের। চারটায় ফিরিয়া আসিলাম। সমাধি হল তার ছােট ভাই আতস এবং শিবুর অতি কাছেই। যাহাদের বাঁচাইবার জন্য এত সাত সমুদ্র পার হইলাম, তাহাদের আজ হােজাইর মাটিতে পুঁতিয়া দিয়া গেলাম। তখনই অনেক দিন আগে পড়া একটি কবিতার কথা মনে পড়িল:
“ডেকে দাও, ডেকে দাও, দাদারে আমার, একা আমি পারি না খেলিতে, আইল নিদাঘ লয়ে ফল ফুল ভার, দাদা মাের গেল কোন পথে? দু’ভায়ে রূপেছি তরু, যতন করিয়ে জল বিনা তারা শুকাইল, লতাগুলি পড়ে রইল, মাটিতে লুটায়ে
তবু মাের দাদা নাহি এল। পরদিন সংবাদে জানিলাম, হিরন্ময় ও ব্রজেন্দ্ৰ গৌহাটিতে আছে। সুতরাং তাহাদের চিঠি দেওয়া বৃথা। তাই শিলচরে ঝুনার কাছে ও গৌহাটিতে হীরেন্দ্রের নিকট চিঠি দিলাম। মাথা অস্থির। বােধ হয় এইভাবে লিখিয়াছি।
Express Letter
১নং। হীরেন্দ্র (নুনু জেঠা) Hojai, 28/6/71 Jetha, “Tapash’ expired last night (at 12), inform Brajendra & Tuntu at Gauhati. Come immediately any how. Kanai

শরণার্থীর দিনলিপি
২নং ঝুনা (শিলচর) Jhuna, Tapash expired last night (at 12). Come immediately (if possible). Kanai
যথারীতি তিন দিন অশৌচ শেষ করিলাম। চতুর্থ দিবসে তাপসের উদ্দেশ্যে ভাত দিব। সে জীবিত থাকাকালীন যাহা যাহা পছন্দ করিত, তাহাই একটু একটু আনিলাম ও ভাত দিলাম। মনে হইল, আমি কত বড় দুর্ভাগা। লােকে নিজের মা ও বাবার উদ্দেশ্যে ভাত দেয়, আর আমি ছেলের উদ্দেশ্যে ভাত দিয়া আসিলাম।
পরদিন সকালে খুবই ভােরে পুনঃ দেখিতে গিয়াছি, ছেলে ভাত খাইল, নাকি শেষ বারের মত মা-বাবার উপর অভিমান করিল? না, অভিমান করে নাই, খাইয়াছে। ফিরিয়া আসিয়া সকাল ছয়টার পুনঃ তন্দ্রাভিভূত হইয়াছি, এমন সময় হঠাৎ ঘরে শুনি কান্নার রােল। চোখ খুলিয়া দেখি, হীরেন্দ্র, ব্রজেন্দ্র (বটু) ও টুন্টু আসিয়াছে। | ইতিপূর্বে অনেক স্বপ্নই দেখিয়াছি। আতস মারা যাওয়ার ৩/৪ পর একদিন স্বপ্নে দেখি, দেশের বাড়ীতে কোঠার উত্তর দিকের কামরা হইতে বড় ছেলে তাপসকে টানিয়া লইয়া গিয়া বাড়ীসংলগ্ন দেওয়ানজী বাড়ীতে শৃগালে ভক্ষণ করিতেছে। হঠাৎ চিৎকার শুনিয়া ঘুম ভাঙ্গিল।
সংখ্যায়, যােগ-বিয়ােগের প্রশ্ন আসিল। শিবু, তাপস, আতস মৃত।
নমিতা, দিলীপ, ধনা ও জেঠার শাশুড়ী কেম্প হইতে অন্যত্র চলিয়া গিয়াছে।
শেষে মাকে ভর্তি করা হইল। তখন আমার কার্ডে (Identify Card) মােট নয়জন ও মাখন জেঠার কার্ডে মােট দুইজন হইল।

কানাই লাল চক্রবর্তী
চৌদ্দ: প্রত্যাবর্তন। পরদিন কেম্প-অফিস হইতে ডাক আসিল। S.D.D. স্বয়ং দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ে Identify Card হইতে ছেলেদের নাম কাটিয়া দিলেন। এই কেম্পে প্রথম রেকর্ড ভঙ্গ করিলাম। অবশ্য বর্তমানে আমার মত দুর্ভাগা আরও অনেক আছে। | পর দিন Camp Gi Medical Officer Statement এর জন্য ডাকিলেন ও মৃত ছেলেদের চিকিৎসা সম্বন্ধে আমাকে জিজ্ঞাসাবাদ করিলেন। উত্তর দিলাম: ‘আমার ছেলের রােগের প্রাথমিক ও মাঝামাঝি সময়ে কেম্পে চিকিৎসার কেন্দ্র খােলা হয় নাই।’ শেষ প্রশ্ন আসিল: ‘আপনার ছেলেদ্বয় মারা যাওয়াতে আপনার কোন অভিযােগ আছে? এক মুহূর্ত চিন্তা না করিয়া জবাব দিলাম: ‘না। অভিযােগ কিসের? আমি নিজে মরিয়া গেলেও কোন অভিযােগ নাই।’
এই পর্যায়ে কয়েকদিন পর মনে করিলাম, কলিকাতা একটু ঘুরিয়া আসি। গত ৯/৭/৭১ তাং শুক্রবার রওনা হইয়াছিলাম। কলিকাতায় বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়দের সঙ্গে এবং শ্রদ্ধেয় শিক্ষক ও অভিভাবক নরেশ বাবুর সঙ্গে এবং বিশিষ্ট ভাগিনা অরবিন্দ চৌধুরীর (বাবুল) সংগে দেখা হইল। কিছু ভিক্ষাও জুটিল। ১৯/৭/৭১ইং কলিকাতার গাড়ীতে উঠিয়া ২১/৭/৭১ইং হােজাইতে ফিরিলাম।
ইহার কিছু দিন পরেই কেম্পে গৃহবিবাদ শুরু হইল এবং ইহাতে আমার মন ভারাক্রান্ত হইল। মনে করিলাম, এই কেম্প হইতে নিজ স্ত্রী, কন্যা, মা ও ভাগিনা শিশিরকে নিয়া অন্য কোথাও চলিয়া যাইব। দরখাস্ত করিলাম ২৪/৭/৭১ইং। আমাদের অফিসার SDC আমার দরখাস্ত D.C. (R.R. DEPT) Nowgong এর কাছে Forward করিলেন। আজ ১৫ দিন অতিবাহিত হইয়াছে, কি হয় জানি না। রেশান পাওয়া সত্ত্বেও চা পান বন্ধ করিয়াছি। কেম্প ছাড়িয়া দিলে, রেশানও পাইব না। তখন কি অবস্থা হইবে? কিন্তু এখানে আর থাকিব না, এই দৃঢ় পণ। এদিকে খবর আসিতেছে, দেশের অবস্থা

শরণার্থীর দিনলিপি
ভাল। কিন্তু ভারত-মাতা কোল হইতে নামাইয়া দিলেই যাইব, নয়ত নয়।
বর্তমানে চলিতেছে কিভাবে তাহা জানি না। যে ভিক্ষাবৃত্তিকে একদিন মনে প্রাণে ঘৃণা করিতাম, তাহাই আজ আমার পেশা হইয়াছে। অবশ্য ‘শিক্ষিত ভিক্ষুক আমরা, আমাদের কায়দা কানুন আলাদা! বাকী আর কতদুর নীচে নামিতে হয় তাহা ভগবান জানেন।
এখানে মন টিকিতেছে না, অন্য কোথাও যে ভাল লাগিবে তাহাও নহে, কারণ কর্মহীন অবস্থায় আমার কী ভীষণ খারাপ লাগিতেছে তাহা বলার অযােগ্য। ভাগিনা শিশিরেরও লেখাপড়া বন্ধ। বাড়ীতে থাকাকালীন খাতা ও কলমের অভাব ছিল না। সময়ের অভাবে তাহাকে পড়াইতে পারি নাই। আজ সে খাতা-কলমের অভাব ভােগ করিতেছে। যাই হােক, ‘জয় বাংলা’ হইলেই বাড়ীতে ফিরিব। ইতিমধ্যে প্রত্যহই বাড়ী যাওয়ার স্বপ্ন দেখি। সে স্বপ্ন সফল হইবে কিনা পরম করুণাময় জানেন।
২৮/১২/৭১; সন্ধ্যা ৫টা ৫০ মিনিট। মঙ্গলবার। পাঠকবর্গের নিশ্চয় মনে আছে গত ২৪/৭/৭১ইং শনিবার আমার নিজের পরিবার নিয়া (অর্থাৎ বােনের পরিবার ও মাখন জেঠার পরিবার উক্ত হােজাই শিবিরে রাখিয়া) অন্য যে কোন কেম্পে চলিয়া গিয়া পারিবারিক অশান্তির সমাপ্তি দিবার মানসে Camp Office এর Trough wqv D.C R. Dept. Nowgong, Assam এর কাছে দরখাস্ত পেশ করিয়াছিলাম। এছাড়া আমি ইতিপূর্বে এই কেম্প অফিসে একটি চাকুরীর জন্য দরখাস্ত করিয়াছিলাম। ২৪/৭/৭১ইং শনিবার তারিখেই আমার দরখাস্তের উত্তরে হােজাই শরণার্থী শিবির অফিসে সাধারণ লিখাপড়ার কাজে ডাক পড়িয়াছিল। অফিসে গিয়া ‘না’ করিয়াছিলাম, কারণ আমি এই কেম্প হইতে Release এর দরখাস্ত করিয়াছি। এক সপ্তাহ পর পর খবরাখবর নিতেছি, কবে আমাকে রিলিজ দিবে।

কানাই লাল চক্রবর্তী
ইতিমধ্যে আরও কিছু ঘটনার কথা বলি। হােজাই শরণার্থী। শিবিরে রেশানপত্র নিয়মিত চলিতেছে, কিন্তু তখনও সরকার নগদ আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করেন নাই। বিশেষ পরিতাপের বিষয় এই যে পুরানাে অফিসার, বাবু সুশীল দাশ (অহমিয়া) S.D.C, জজ Hojai আমাদের শিবিরের কাৰ্যভার হইতে অবসর নিয়া কাছাকাছি নীলবাগানে নূতন একটি শরণার্থী-শিবির নির্মাণের ভার হাতে নিয়াছেন। হােজাই শরণার্থী-শিবিরে নূতন অফিসার নিযুক্ত হইয়াছেন বাবু নির্মল চৌধুরী। বিশ্বস্ত সুত্রে জানিতে পারিলাম কোন এক কালে উনি পূর্ববঙ্গের লােক ছিলেন এবং বেশ কয়েক বৎসর ধরে তিনি Refugee Camp এ A.R.0. হিসাবে কাজ করিতেছেন। আরও শুনিলাম, তাঁহার চাকুরী-জীবনে মাত্র চারবার তিনি Suspend হইয়াছেন! তার কার্যকলাপের আরও বিশেষত্ব এই যে, হােজাই শরণার্থী শিবির তৈয়ার হইবার অল্প আগে তিনি লামডিং শহরে অস্থায়ী এক শরণার্থী শিবিরের দায়িত্বে ছিলেন এবং সে সময়ে সেই অস্থায়ী শিবিরে দারুণভাবে বিপর্যস্ত ও হৃদয়ভাঙ্গা শরণার্থীদের তিনি দুই বেলা উপবাসী রাখিয়াছিলেন। হােজাই শিবিরের ২৫০০ শরণার্থী নির্মল চৌধুরীর সঙ্গে কথা বলিতে দ্বিধা করিত। অথচ পুরানাে অফিসার সুশীলবাবুর আদর ও শাসনে শরণার্থীগণ ভালােই ছিলেন। নূতন অফিসারের আমলে অফিসের কার্যক্রম ও রেশনের ব্যাপারে কিছুটা রদবদল হইল যার প্রায় সবই শরণার্থীদের অশান্তির পরিপূরক হইল।
ইতিমধ্যে গৌহাটিতে নানা বিশৃঙ্খলা [জাতিগত দাঙ্গা] দেখা দেওয়ায় হীরেন্দ্র ও তার ভাই দীপু যে কোন শরণার্থী শিবিরে ভর্তি হওয়ার মানসে হােজাই আসিয়া দেখা করিল। আমিও মনে মনে। তাহাদের সঙ্গী হইতে মনস্থ করিলাম।
ইতিমধ্যে আমার মায়ের সাধ হইল, এত দুরে আসিয়া এবং রেলভাড়া ছাড়া যাদবপুর কলিকাতা] গিয়া ভাইদের সঙ্গে দেখা না করিলে আর এই সুবর্ণ সুযােগ মিলিবে না। মনে করিলাম, আমাকে নিজের পরিবার লইয়া সহজ পথে বা বক্র পথে অন্য যে কোন

শরণার্থীর দিনলিপি
শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিতে হইবে। এমতাস্থায় মা এবং শিশিরকে কলিকাতা পাঠাইয়া দিতে পারিলে ঝামেলামুক্ত হইব।
সেদিন মঙ্গলবার, ৭.৯.৭১ ইং বটুর সঙ্গে দেখা করিতে লামডিং গেলাম। সঙ্গে মাখন জেঠাও আছে। অল্পক্ষণ কথােকথনের পর হঠাৎ বিশিষ্ট বন্ধু মাষ্টার সন্তোষবাবু আসিয়া উপস্থিত। যে সন্তোষ বাবুকে মিরেশ্বরাই বাজারে পাঞ্জাবীর কবলে পতিত হইয়াছেন বলিয়া অনুমান করিয়াছিলাম দীর্ঘ পাঁচ মাস পর সেই বিশিষ্ট বন্ধুকে হঠাৎ দেখিয়া মনের অবস্থা তড়িৎগতিতে তােলপাড় হইয়া গেল। কথােপকথনে জানিতে পারিলাম, ত্রিপুরার হরিণা শরণার্থী শিবিরে প্রতিবেশী টুকু চৌধুরী, অনিল বাবুদের নিকট আমার ঠিকানা সংগ্রহ করিয়া কলিকাতা যাওয়ার পথে হােজাই পৌছিবার আগেই সৌভাগ্যক্রমে লামডিং শহরে আমার সহিত তাহার দেখা হইল।
যথারীতি সন্তোষ বাবুসহ সন্ধ্যায় হােজাই ফিরিয়া আসিলাম। রাত্রি নয়টায় ননী ও দীপকও আসিয়া পড়িল। তখন মায়ের কলিকাতা যাওয়ার বায়না প্রবল হইতে প্রবলতার উঠিল। শিশিরবাবুও ছাড়িবার পাত্র নহে। যদি তার দিদিমা সঙ্গে না থাকিত তার মা ও বাবার সঙ্গ ছাড়িয়া সে আমার সঙ্গেই থাকিত। শেষ পর্যন্ত দিদি ও নাতিকে উক্ত সন্তোষবাবুর সঙ্গে দুই একদিনের মধ্যেই কলিকাতা পাঠাইয়া দিব স্থির করিলাম। কিন্তু সমস্যা হইল, তখনও কেম্প হইতে রিলিজ হইতে পারি নাই। আমি রিলিজ না নিয়া গেলে ভগ্নীপতি অমিয়বাবু রেশান তুলিতে পারিবেন না।
পুরানাে অফিসার সুশীল বাবুর বাসায় গিয়া ব্যক্তিগতভাবে আমার পরিবারিক অশান্তির কথা ভালভাবে বুঝাইয়া উক্ত কেম্প থেকে পলায়ন এবং অন্য কেম্পে আশ্রয় গ্রহণ সম্পর্কে তাহার বুদ্ধিই গ্রহণ করিলাম। তাঁহার উপদেশ অনুসারে গত ১০.৯.৭১ ইং শুক্রবার নূতন অফিসার নির্মলবাবুর সমীপে এক দরখাস্ত পেশ করিলাম। দরখাস্তের সারমর্ম এই: ‘আগরতলায় আমার ছােট ভাই হিরন্ময় (টুন্টু) খুব বেশী অসুস্থ। তাহার শূষার জন্য উক্ত সন্তোষ বাবু ও আমার পরিবারকে নিয়া মা ও শিশিরবাবুসহ আগরতলা যাইব।’

কানাই লাল চক্রবর্ত্তী
পনের দিনের ছুটি চাহিলাম। দরখাস্তে দুই একজন সুপারিশদারের স্বাক্ষরেরও দরকার হইয়াছিল।
কোন রকমে দশ দিনের ছুটি মঞ্জুর হইল। চৌধুরী বাবুকে বড় রকমের একটা নমস্কার করিয়া অফিসকক্ষ ত্যাগ করিলাম। পরদিন দুপুরে ক্ৰিগড় মেইলে সন্তোষবাবুর সঙ্গে মা ও শিশিরবাবুকে কলিকাতা পাঠাইয়া দিলাম। ১২/৯/৭১ ইং সকাল দশটায় আমরা উক্ত ক্যাম্প হইতে ত্রিপুরার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হইলাম। ইতিপূর্বে সন্তোষবাবুর মুখে শুনিয়াছিলাম, ত্রিপুরার অনেক শরণার্থী শিবিরে আমাদের গ্রামের অনেক পরিবারই শরণার্থী হিসাবে আছেন। তাহাদের কাছাকাছি আশ্রয় লইলে মনে কিছুটা শান্তি হইবে। | শরণার্থীদের রেলভাড়া ফ্রি, কিন্তু ৩/৪ দিনের পথ। পথের খরচ। ও এদিকে বাসভাড়া, ট্রেনভাড়া ইত্যাদি খরচ পােষণের জন্য হােমিও সেবাসদনের ডাক্তারবাবুর নিকট একটা স্বর্ণের হার বিক্রয় করিয়া কোন রকমে ৩০০ (তিন শত) টাকার মত নিয়াছিলাম। হােজাই শরণার্থী শিবির ত্যাগ করিবার সময় উক্ত শিবিরের অনেক মেয়ে ও পুরুষ আমার জন্য কান্নাকাটি করিতেছে, কারণ শিবিরে সকলের আদরণীয় ছিলাম। ভগ্নীপতি অমিয় বাবুও কান্নাকাটি করিলেন। বিশেষতঃ বশিদির (আমার দিদির) কান্নাকাটিতে একেবারে মনে আঘাত আসিল। কারণ, এই ভাবে দূর দেশে অসহায় অবস্থায় এক সাথে মা ও ভাই ছাড়িয়া গেলে কষ্ট হইবারই কথা। | আসিবার সময় অমিয়বাবুর হাতে ১৫ (পনের) টাকা দিয়া আসিলাম। ডাক্তার হিমাংশু চক্রবর্তী আসিবার সময় আমার মেয়ে মিষ্টিকে জামা কিনিয়া দিলেন এবং আমাকে ডাক্তারী করিবার জন্য কিছু ঔষধপত্র, থার্মোমিটার ইত্যাদি সাহায্য করিলেন। হােজাই রেলওয়ে স্টেশনে অমিয়বাবু ও মাখনবাবু আগাইয়া দিতে আসিলেন। যথারীতি সকাল এগারটায় ট্রেন ছাড়িয়া দিল ও বিকাল তিনটায় লামডিং বটুর বাসায় এক রাত্র থাকিয়া পরদিন সকালের ট্রেনে উঠিয়া রাত্রে তিনটায় ধর্মনগর ষ্টেশন আসিয়া পৌছিলাম। পরদিন প্রাতে বাসে উঠিলাম ও পাহাড়ের কঠিন রাস্তা পার হইয়া

শরণার্থীর দিনলিপি
রাত ৮ টায় আগরতলা পৌঁছিলাম। ভাতের হােটেলে কোন রকমে রাত্রিভােজন সারিয়া আপাততঃ আগরতলা দুর্গাবাড়ীতে এক খােলা। বারান্দায় প্রবাস কাটাইলাম। মশার নিমন্ত্রণ চলিল বটে।
পনের হরিণা
পরদিন সকালে টুন্টুর সঙ্গে দেখা করিয়া জীপে চড়িলাম ও উদয়পুর আসিয়া পালাটানা কেম্পে আমার শ্বশুর মহাশয়ের বাসায় গেলাম। দীপু ও ননী সঙ্গে আছে।
পরদিন বৃহস্পতিবার বিকাল ৩টায় মনুবাজার আসিয়া পৌছিলাম। তখন আমাদের প্রতিবেশী দাদা মনােরঞ্জন চৌধুরী (দিলীপ ও ধনার বাবা) মনুবাজারে ঘর ভাড়া করিয়াছিলেন। কয়েকদিনের জন্য আশ্রয় লইবার অভিপ্রায়ে তাঁহার বাসায় এক রাত্রি যাপন করিলাম। কিন্তু শুনিলাম, তিন মাইল দূরে হরিণা কেম্পে তাঁহারা ঘর পাইয়াছেন এবং পরদিনই ওনারা সেই ভাড়াটে বাসা ত্যাগ করিয়া সেইখানে চলিয়া যাইবেন। হায়রে দুভার্গ! এত কষ্ট করিয়া আসিয়াও বােধহয় শেষ ফল হইল না। | সন্ধ্যায় হীরেন্দ্রসহ হরিণা পরিদর্শনে বাহির হইলাম এবং তাহার বন্ধু-বান্ধুবের সাহায্যে বর্তমানে ভাড়া বাসাটি ঠিক করা হইল। ভাড়া প্রতি মাসে বার টাকা। পরবত্তী ২/১ দিনের মধ্যেই (কার্ড) Identify Card হইল। রেশান ও নগদ টাকা (আর্থিক সরকারী সাহায্য) পাইতেছি।।
শুধু হরিনায় নহে, প্রায় সমগ্র ত্রিপুরা রাজ্যে ভাংতি পয়সার অভাবে বাজার খরচ করা খুবই কষ্ঠ । প্রথম প্রথম বিরক্ত হইতাম, বর্তমানে অভ্যাসে পরিণত হইয়াছে।
হােজাই থাকাকালীন স্কুল-কলেজের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আলাপ করা, সংবাদপত্র পড়া, রেডিও শােনা ইত্যাদির কোন সুযােগ পাই নাই, কারণ অধিকাংশ শরণার্থীই চাষাভুষা ও খেটে খাওয়া লােক ছিল। হরিণায় কোন রকমে ২/৪ দিন চলার পর বয়ােবৃদ্ধদের

কানাই লাল চক্রবর্তী
অনুরােধে (অনিল বাবু, সুনীল বাবু, মামা সুমন্ত প্রভৃতি) দীর্ঘ ৫/৬ মাস পর পুনঃ তাসখেলা হাতে নিলাম। এখানেও অবশ্য লেখাপড়ার কোন সুবিধা নাই, কাগজপত্র, কালি-কলম ইত্যাদি সব কিছুই অগ্নিমূল্য। কোন রকমে দিন চলিতেছে। পাকীস্তানী ও ভারতীয় রেডিওর সংবাদ শুনার আশায় প্রতিদিন লােকের বাড়ীতে গিয়া বাসিয়া থাকিতাম। সঙ্গী কাকা অনিল দাশ।
যােল: জয় বাংলা হঠাৎ ১৬ই ডিসেম্বর, সমস্ত কেম্পে আলােড়ন শুরু হইল। ‘জয় বাংলা’, ‘শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’, ‘শ্রীমতি গান্ধী জিন্দাবাদ’, ‘ভারতবাংলাদেশ মৈত্রী জিন্দাবাদ’। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সুৰ্য্যের উদয় হইল। ঠিক সেইদিন হইতে আজ ২৯/১২/৭১ পর্যন্ত ঘুম নাই। শুধু চিন্তা, কিভাবে দেশে গিয়া বন্ধুবান্ধুবদের সহানুভুতি পাইব। ইতিমধ্যে গত শনিবার হীরেন্দ্রকে দেশে (কুমিরা) পাঠাইলাম।
কুমিরার বন্ধু-বান্ধবেরা আর্থিক সাহায্য পাঠাইলেন। তাহাতে আমার যথেষ্ট উপকার হইয়াছে। এখন বাড়ী যাওয়ার তাগিদ। ইতিমধ্যে অনেক শরণার্থী নিজের খরচেই দেশে ফিরিয়া গিয়াছে। বােধ হয় আগামী ২রা জানুয়ারী রবিবার আমাদেরও কেম্প হইতে Release করা হইবে। হীরেন্দ্রের মুখে শুনিলাম, প্রাণের জেঠা মনােরঞ্জন বাবু, কাকা শুধাংশু ঘােষ দেশে জীবিত আছেন। কম্পাউন্ডার খােকন আমার অবর্তমানে রােগীপত্র দেখিতেছে। কখন তাহাদের সহিত দেখা হইবে এখন তাহাই শুধু ভাবনা।
পরম করুণাময়ের নিকট প্রার্থনা, যেন অতি সহসা দেশে ফিরিয়া গিয়া নবজীবনে, নূতন সুরে পুনঃ মুকলিত হইতে পারি। | এতদিনে বুঝি ভারতমাতা তাঁহার কোল হইতে নামাইয়া দিলেন। ইতি ১৯/১২/৭১, বুধবার।
শ্রী কানাই লাল চক্রবর্তী