You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

শের এ বাংলা এ. কে. ফজলুল হক
ড. মোঃ এনামুল হক খান

প্রথম অধ্যায়কের
এ. কে. ফজলুল হক ও পরিচিতি

‘শের-এ-বাংলা’ (বাংলার বাঘ) নামে সুপরিচিত আবুল কাসেম ফজলুল হকে’র জন্ম ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর (বাংলা ১২৮০ সালের ৯ কার্তিক)। দক্ষিণ বাংলার তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার (বর্তমান বরিশাল জেলা)। পিরােজপুরের আদর্শ গ্রাম সাতুরিয়ায় মামার বাড়িতে তাঁর জন্ম।১ একই জেলার বানরীপাড়া থানাধীন চাখার গ্রামে তাঁর পৈত্রিক নিবাস।২ কিন্তু ফজলুল হকের পূর্বপুরুষগণ মূলত এ গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন না। পার্শ্ববর্তী বাউফল থানাধীন বিলবিলাস গ্রাম থেকে তাঁরা চাঘারে বসতি গড়ে তােলেন।৩ ১৮৩০ সালের শেষের দিকে পারিবারিক সমস্যার কারণে ফজলুল হকের দাদা কাজী আকরাম আলী (১৮২০-১৯০০) সেখানে গিয়ে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন।৪
চাখার মূলত একটি মুসলিম অধ্যুষিত গ্রাম। ফজলুল হকের পরিবার ছাড়া গ্রামের অন্য বাসিন্দারা ছিলেন নিরক্ষর কৃষক। ফজলুল হকের দাদা কাজী আকরাম আলী ছিলেন আরবি ও ফার্সি ভাষার পণ্ডিত। আসলে তিনি ছিলেন মােক্তার (উকিল/আইনজীবী), বাকেরগঞ্জ জেলা কোর্টে যখন ফার্সি ভাষায় কোর্টের কার্যক্রম চলত, যখন তিনি ফার্সি ভাষায় কোর্টে জেরা করতেন তখন অন্য উকিলরা তাঁর সাথে পেরে উঠতেন না। তিনি শহরের কাজিও ছিলেন।৫ ব্যক্তি হিসেবে তিনি দানবীর বলে পরিচিত ছিলেন এবং বলা হয়ে থাকে তিনি গরীব ও অনাথদের ফ্রি থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থাও করতেন।৬
ফজলুল হকের পিতা মৌলভি মুহাম্মদ ওয়াজেদ (১৮৪৩ – ১৯০১) ছিলেন একজন আলােকিত মানুষ। তিনি ফার্সি ভাষায় আধুনিক শিক্ষা লাভ করেন।

১৮৬৯ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএ পাস করেন৭ এবং কলকাতার হেয়ার স্কুলে কিছুদিন শিক্ষকতা করেন। মৌলভি মুহাম্মদ ওয়াজেদ ১৮৭১ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইনে ডিগ্রি লাভ করেন এবং কলকাতার হাইকোর্টে একই সালে যােগদান করেন। কলকাতায় এক বছর প্রাকটিস করার পর তিনি বরিশালে ফিরে আসেন।৮ কয়েক বছরের মধ্যে তিনি ফৌজদারি ওকালতিতে চারদিকে বেশ হৈ চৈ ফেলে দেন এবং জেলা বারে একজন শীর্ষ পর্যায়ের আইনজ্ঞ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর মেধার স্বীকৃতিস্বরূপ সরকার তাঁকে সিনিয়র সরকারি উকিল হিসেবে বাকেরগঞ্জ জেলায় নিয়ােগ দান করেন যেখানে তিনি তাঁর শেষজীবন পর্যন্ত অধিষ্ঠিত ছিলেন।৯
মুহাম্মদ ওয়াজেদ তাঁর প্রাত্যহিক এবং পেশাগত জীবনে ছিলেন একজন অতি সজ্জন মানুষ। তিনি উদার মনের মানুষ ছিলেন আর এজন্য মুসলিম – হিন্দু সকলের কাছে খুবই জনপ্রিয় ছিলেন। জনপ্রিয়তার জন্যই হিন্দু – মুসলিম সকলের মিলিত ভােটে তিনি বাকেরগঞ্জ জেলা বাের্ডের ভাইস-চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।
মুহাম্মদ ওয়াজেদ তাঁর ওকালতি পেশা থেকে তখন মাসে ২০০০ থেকে ৩০০০ টাকা আয় করতেন। এছাড়া তাঁর জমিদারী ছিল। কিন্তু প্রতি মাসে তিনি তার আয়ের সিংহভাগ দরিদ্র ও অভাবগ্রস্তদের জন্য ব্যয় করতেন। একজন শিক্ষানুরাগী হিসেবে মুহাম্মদ ওয়াজেদ বাকেরগঞ্জে অনেক মক্তব এবং মাদ্রাসার সাথে যুক্ত ছিলেন এবং সেগুলাে নির্মাণেও সাহায্য-সহযােগিতা করেন।
ফজলুল হকের মা বেগম সৈয়দুন্নেছা খানম একজন ধার্মিক ও বিদুষী মহিলা ছিলেন যিনি তখনকার প্রচলিত রুচিবােধ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন। ফজলুল হক তাঁর মাতাপিতার একমাত্র পুত্রসন্তান ছিলেন। তাঁর ছােট দুই বােন – একজন বদরুন্নেছা বেগম ও অপরজন আফজালুন্নেছা বেগম। | ধনী পিতার আদুরে সন্তান হওয়ায় ফজলুল হক প্রচর বিত্ত-বৈভবের মধ্যে বাল্যকাল অতিবাহিত করেন। বরিশালের পৈতৃক বাড়ি ফ্লোরা হাউজে” তাঁর প্রাথমিক শিক্ষা চলে। ফার্সি ও আরবি ভাষার আলাদা শিক্ষকগণ ঘরে বসে তাঁকে শিক্ষা দিতেন। মাওলানা কাশগড়ি, যিনি পরবর্তীতে ঢাকার মাদ্রাসায়

অধ্যাপনা করতেন তাঁর প্রচেষ্টায় ফজলুল হক তাফসিরে পারদর্শী হয়ে ওঠেন। অতপর ১৮৮১ সালে ফজলুল হক বরিশাল জেলা স্কুলে তৃতীয় শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৮৮৯ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে সেখান থেকে প্রথম বিভাগে এন্ট্রান্স (প্রবেশিকা) পাস করেন। এরপর তিনি জুনিয়র কলেজ লেভেলে পড়ার জন্য কলকাতায় যান এবং সেখানকার বিখ্যাত কলেজ প্রেসিডেন্সি থেকে ১৮৯১ সালে এফ. এ. পরীক্ষায় ঢাকা বিভাগের মধ্যে মেধা তালিকায় প্রথম স্থান অধিকার করেন। এরপর তিনি কলকাতার একই কলেজ থেকে রসায়ন, পদার্থ ও গণিতে আন্ডার গ্রাজুয়েট অনার্স কোর্স সম্পন্ন করেন। ১৮৯৩ সালে তিনটি অনার্স বিষয়ে প্রথম স্থান অধিকার করে তিনি বিশেষ কৃতিত্বে ভাস্কর হয়ে ওঠেন। বাংলার প্রথম মুসলিম ছাত্র হিসেবে তিনিই এমন সম্মানের অধিকারী হন। দু’ বছর পরে ফজলুল হক গণিতে মাস্টার্স করার জন্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির যােগ্যতা অর্জন করেন এবং ১৮৯৫ সালে তিনি ঐ বিষয়ে একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গণিতশাস্ত্রে এম. এ. পাস করেন। এ বিষয়ে পরীক্ষক হিসেবেও নিযুক্ত হন। ১৮৯৭ সালে কলকাতা ইউনিভার্সিটির অধীন রিপন কলেজ থেকে ডিস্টিংশনসহ বি. এল. (ব্যাচেলর অব ল) ডিগ্রি অর্জন করেন। ছােটবেলা থেকেই ফজলুল হক একজন ক্রীড়াবিদ ছিলেন। ফুটবল এবং ক্রিকেট ছিল তার বেশি প্রিয়। তিনি কলকাতা মােহামেডান স্পাের্টিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন এবং কলকাতায় থাকাতে এর নামকরণ তিনি এভাবেই করেছিলেন।১০ পাশাপাশি তিনি প্রথম সারির দাবাড় ছিলেন এবং একজন দক্ষ সাঁতারুও ছিলেন।
ফজলুল হক ১৮৯৭ সালে খুরশিদ তালাত বেগমের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। খুরশিদ তালাত বেগম নওয়াব সৈয়দ মােহাম্মদ আজাদ খানের কন্যা এবং নওয়াব বাহাদুর আবদুল লতিফ, সিআইই-এর নাতনী – যারা দু’জনই উচ্চ শিক্ষিত এবং বাংলাতে সামাজিক সংস্কারের অগ্রদূত ছিলেন। ফজলুল হকের প্রথম স্ত্রীর দুটি কন্যা সন্তান ছিল। তাদের বিবাহবিচ্ছেদ ঘটে। তাঁর দ্বিতীয় স্ত্রী মােসাম্মৎ জিন্নাতুন্নেসা ছিলেন সৈয়দ ইবনে আহমদের কন্যা, যিনি পশ্চিমবঙ্গের হাওড়া জেলার ফুরফুরা শরীফের পীর মাওলানা আবু বকর সিদ্দিক-এর ভ্রাতা। নিঃসন্তান অবস্থায় তিনি ইন্তেকাল করেন। মিরাট (উত্তর

প্রদেশ)-এর অভিজাত পরিবারের মেয়ে খাদিজা বেগমকে ১৯৪১ সালে ফজলুল হক তার তৃতীয় স্ত্রী হিসেবে গ্রহণ করেন। তাঁদের একমাত্র সন্তান ফায়েজুল হক বাংলাদেশের একজন উকিল ও রাজনীতিবিদ ছিলেন।
১৮৯৭ সালে ফজলুল হক তার পেশাগত জীবন শুরু করেন। আইনে ডিগ্রি লাভের পরপরই তিনি কলকাতা হাইকোর্টে বাংলার বুদ্ধিজীবী এবং আইন পেশার উজ্জ্বল তারকা স্যার আশুতােষ মুখার্জীর সহকারী আর্টিকেলড হিসেবে নিজেকে নিয়ােজিত করেন। স্যার আশুতােষ মুখার্জীর কাছ থেকে প্রশিক্ষণ লাভ করে ফজলুল হক ১৯০০ সালে নিজেই কলকাতায় প্রাকটিস শুরু করেন। ঐ বছরেই তাঁর পিতা মুহাম্মদ ওয়াজেদ পরলােকগমন করেন।
পিতার মৃত্যুশােকে মুহ্যমান হয়ে পড়ায় আইন পেশাসহ বরিশাল ও চাখারে তাঁর পিতার বিশাল সম্পত্তি দেখাশুনা করা অসম্ভব হয়ে পড়ে। তিনি এরপর বরিশালে ফিরে এসে ওকালতি পেশা শুরু করেন। একই সঙ্গে রাজেন্দ্র কলেজের অধ্যক্ষ ড. হরেন্দ্র নাথ মুখার্জীর অনুরােধে তিনি গণিতের খণ্ডকালীন শিক্ষক হিসেবে সেখানে যােগদান করেন।১১ বরিশালে অবস্থানকালে ফজলুল হক স্বদেশী আন্দোলনের বৈপ্লবিক নেতা অশ্বিনী কুমার দত্তের সংস্পর্শে আসেন। অশ্বিনীদত্তের অনুপ্রেরণায় ফজলুল হক জেলার স্থানীয় রাজনীতিতে জোরালাে ভূমিকা পালন করেন।
ফজলুল হক বাকেরগঞ্জ জেলা পর্ষদের সদস্য এবং বরিশাল শহর পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হন। নিজ পেশায় ও বরিশালের রাজনীতিতে সক্রিয় থাকার পাশাপাশি তিনি একটি সাপ্তাহিক সাময়িকপত্র প্রকাশ (১৯০১) করেন, যার নাম বালক’। এছাড়া তিনি বরিশালের সমাজ সংস্কারক ও রাজনৈতিক কর্মী শ্রী রায় বাহাদুর নিবারণচন্দ্র দাসের সঙ্গে ‘ভারত সুহৃদ (১৯০১) নামে অপর একটি মাসিক সাময়িকপত্র প্রকাশ করেন।১৩ পত্রিকাগুলাে প্রকাশের মূল লক্ষ্য ছিল জনসাধারণকে সচেতন করা এবং রাজনীতি সম্পর্কে জনমত তৈরি করা।

ফজলুল হকের ওকালতির সুখ্যাতি এবং নেতৃত্বের দক্ষতা চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল এবং ১৯০৫ সালের বঙ্গভঙ্গের সমর্থক ও মুসলিমদের নেতা ঢাকার নওয়াব সলিমুল্লাহর কাছেও তা পৌছাল।১৪
ঐ সময়ে নওয়াব ইংরেজদের দুঃশাসন বন্ধে ও ভারতীয় মুসলমানদের জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সবেমাত্র অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা পর্বের কাজ শুরু করেছেন। ফজলুল হকের মধ্যে তিনি অনেক সম্ভাবনা দেখতে পান এবং তাঁর কর্মকাণ্ডের গুণাগুণকে সকলের সামনে তুলে ধরেন। সলিমুল্লাহ অল ইন্ডিয়া মুসলিম পলিটিক্যাল অর্গানাইজেশন গড়ে তােলা সম্পর্কে তরুণ ফজলুল হকের প্রতি জোরাল সমর্থন পেয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ নওয়াব সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে ঢাকায় প্রতিষ্ঠা লাভ করে।১৫
লীগ গঠিত হওয়ার পরপরই ফজলুল হক নবগঠিত পূর্ববাংলা ও আসামে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে সিভিল সার্ভিসে ঢাকায় নিযুক্ত হন। এর কিছুদিন পরই তিনি এসডিও (সাব-ডিভিশনাল অফিসার) হিসেবে তাৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমায় বদলি হয়ে আসেন। বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলন তখন পুরােপুরি চলছিল, আর তার ফলে জামালপুরে কিছুদিন হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে । ফজলুল হক দ্রুত তা নিরসনে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন এবং সকল দলের মধ্যে শান্তি ও স্থিতি ফিরিয়ে আনেন। জামালপুরে কিছুদিন পেশাগত দায়িত্ব পালন করার পর তিনি ফরিদপুর জেলার মাদারীপুর মহকুমায় বদলি হয়ে আসেন। এরপরই তিনি পূর্ববাংলা এবং আসামের রুরাল কো-অপারেটিভ সােসাইটির সহকারী রেজিস্ট্রারের পদ লাভ করেন। ১৯১২ সালে ফজলুল হক সরকারি চাকরি থেকে ইস্তফা দিয়ে পুনরায় তাঁর আইন পেশায় যুক্ত হন এবং পুরােপুরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন। বিশ শতকের প্রথমার্ধে তিনি এ উপমহাদেশের বিশেষ করে পূর্ববাংলায় প্রায় চল্লিশ বছর ধরে রাজনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

তথ্যসূত্র ঃ
১. দি ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া, ভলিউম ১ (লন্ডন, ১৮৮৫), সংস্করণ ২, পৃষ্ঠা ৪৩৯।
২. ঐ পৃষ্ঠা ৪৪৪।
৩. দি ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া, ভলিউম ২, (লন্ডন, ১৮৮৫), সংস্করণ ২, পৃষ্ঠা ২১৬।
৪. এ. এস, এম, আবদুর রব, এ. কে. ফজলুল হক ও লাইফ এন্ড এচিভমেন্ট (লাহাের, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ১।
৫। রেজিস্ট্রার অব মুসলিম ম্যারিজেস এন্ড ডিভাের্সেস, জি. সি. ক্লিফোর্ড হুইটওয়ার্থ, এন এংলাে – ইন্ডিয়ান ডিকশনারী (লন্ডন, ১৮৮৫), পৃষ্ঠা ১৫৭।
৬. রব, এন – ৪, পৃষ্ঠা ২।
৭. পুরাে বাংলার মধ্যে মােহাম্মদ ওয়াজেদ ছিলেন তৃতীয় মুসলিম গ্রাজুয়েট । প্রথম জন ছিলেন হুগলীর জনাব আহমেদ মিয়া এবং দ্বিতীয় জন ছিলেন কুমিল্লার (পরবর্তীতে নওয়াব) সিরাজুল ইসলাম । আহমেদ মিয়া ১৮৬১ এবং সিরাজুল ইসলাম ১৮৬৭ সালে গ্রাজুয়েট হয়েছিলেন।
৮. বাকেরগঞ্জের জেলা সদর দফতর। দি ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়া, ভলিউম ২ (লন্ডন, ১৮৮৫), সংস্করণ ২, পৃষ্ঠা ১৫৫।
৯. রব, এন – ৪। বিডি হাবিবুল্লাহ ও শের-এ-বাংলা (ঢাকা, ১৯৬৯), পৃষ্ঠা ৫।
১০. ‘শের-এ-বাংলা সাপ্লিমেন্ট ; পাকিস্তান অবজারভার (ঢাকা), ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭। কলকাতা মােহামেডান স্পাের্টিং ক্লাব হল শীর্ষ স্থানীয় ক্লাবগুলাের মধ্যে একটি যা মুসলিমগণ প্রতিষ্ঠা করেছেন এবং অর্থায়নও করেছেন। বঙ্গভঙ্গের সময়ে অনেক বছর যাবত এ ক্লাবটি কলকাতা ফুটবলে এমনকি সমগ্র ভারতে সুনাম ও নৈপুণ্য দেখিয়েছে । কলকাতার ফুটবল লীগে এ ক্লাবটির জয়গুলাে ছিল খুবই সুন্দর যেখানে অন্য দলগুলাে ইউরােপিয়ান প্রতিপক্ষের সাথে খুব কমই নৈপুণ্য দেখিয়েছে। মুসলিম সমর্থকগণ তাদের নৈপুণ্যে খুবই উত্তেজিত থাকতেন। বস্তুত যখন মুসলিমগণ হিন্দুদের সমকক্ষ হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাঁপ করতেন ঠিক তখনই ক্লাবটির জয়গুলাে তাদের মনের দৃঢ়তা আরও মজবুত করে তুলত। দেখন ঃ আবুল কালাম শামসুদ্দীন, অতীত দিনের স্মৃতি (ঢাকা, ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ১৫৪ – ১৫৮।
১১. ১৯৪৭ সালে বঙ্গভঙ্গের পর কিছু সময়ের জন্য হরেন্দ্র নাথ মুখার্জী পূর্ববাংলার গভর্নর
হয়েছিলেন।
১২. কে. এ. খালেক ও ‘এক শতাব্দী’ (ঢাকা, ১৯৬২), পৃষ্ঠা ৩৫, আরও দেখুন এ. এস. এম. রব, প্রাগুপ্ত ৪, পৃষ্ঠা ৮।
১৩. ঐ
১৪. দ্বিতীয় অধ্যায়ে বিস্তারিত বর্ণনা দেয়া হয়েছে।
১৫. শের-এ-বাংলা সাপ্লিমেন্ট ও পাকিস্তান অবজারভার (ঢাকা), ২৭ এপ্রিল ১৯৬৭ আরও
দেখুন ঃ রব, এন – ৪, পৃষ্ঠা ১১ এবং খালেক, এন – ১৮, পৃষ্ঠা ৪৯।

দ্বিতীয় অধ্যায়
এ. কে. ফজলুল হক ও মুসলিম লীগ
[১৯০৬ – ১৯২৮ ]
.
– এক –

৮ম শতকে শুরুতে আরবের উমাইয়া সেনাপতি মােহাম্মদ বিন কাসিম পশ্চিম ভারতের সিন্ধু ও মুলতান জয় করে মুসলিম শাসন প্রতিষ্ঠা ও ইসলাম প্রচার করলেও তা আর বেশিদূর অগ্রসর হয়নি। তবে তার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তুর্কি, আফগান ও মুঘলরা ক্রমান্বয়ে ভারতবর্ষে ইসলামের প্রচারধারা অব্যাহত রাখেন এবং নিজেদেরকে এদেশের একটি বড় অংশের শাসক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেন। আঠার শতকে ব্রিটিশদের ক্ষমতা দখলের পূর্ব পর্যন্ত এসব মুসলিম শাসকগােষ্ঠী ভারতবর্ষ শাসন করে। মুসলিম রাজত্বের এ দীর্ঘ সময়ে অনেক হিন্দু বিশেষ করে সমাজের নিচ বর্ণের হিন্দুরা ইসলামকে আলিঙ্গন করে।১ অনেক বিষয় যেমন রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপােষকতা, হিন্দুত্ববাদের মন্দ দিকসমূহ এবং সর্বোপরি অর্থনৈতিক সুবিধালাভ ছিল তাদের ধর্মান্তরিত হওয়ার মূল কারণ।২ পাশাপাশি মুসলিম শাসকদের অধীনে কাজ করার জন্য মধ্য এশিয়ার সভ্য শহর থেকে বহুসংখ্যক সৈন্য, শিক্ষাবিদ, শিল্পী এবং প্রশাসক এখানে এসেছিল।৩ তারা এখানে মুসলিম আভিজাত্য প্রতিষ্ঠা করতে লাগল। মুসলিম শাসনের ঐ সময়ে সামরিক এবং বেসামরিক সব গুরুত্বপূর্ণ পদে মুসলিমদের একচ্ছত্র আধিপত্যের বিস্তার ঘটেছিল।
১৯৫৭ সালে বাংলায় মুসলিম শাসনের অবসানে এবং ইংরেজ কোম্পানির শাসন প্রতিষ্ঠায় দ্রুত সব কিছু বদলে গেল। বাংলাতেই এ পরিবর্তন প্রথম অনুভূত হয়। কারণ, বাংলাই ছিল ব্রিটিশদের সর্বপ্রথম উপনিবেশ। ব্রিটিশ সরকার সকল উচ্চপদে তাদের নিজেদের জন্য সংরক্ষিত করে মুসলিমদের

পদচ্যুত করে। ১৭৯৩ সালের চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত কার্যত মুসলিম আভিজাত্যের বিলােপ ঘটায়।৪ খুব দ্রুত তাদের সামরিক বাহিনী থেকে ছাঁটাই করা হয়। কারণ, সেখানে তাদেরকে রাখা কোম্পানি শাসকগােষ্ঠী নিরাপদ মনে করেনি। উপরন্তু মুসলমানগণ সাধারণত তথ্য আদান-প্রদান ও প্রশাসনিক কাজে ফার্সির বদলে ইংরেজি অন্তর্ভুক্ত করাকে অতটা সহজে মেনে নিতে পারেনি। অপরদিকে শিক্ষিত হিন্দুরা সহজে ইংরেজি ভাষাকে আত্মস্থ করে নিজেদের বিভিন্ন পেশায় সংশ্লিষ্ট করার মত যােগ্যতা অর্জন করে নেয়। যার ফলে মুসলিমগণ সকল সরকারি চাকরি থেকে বাদ পড়তে লাগল । ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টারের পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সরকারি চাকরি থেকে মুসলিমগণ এমনভাবে বাদ গিয়েছে, সেখানে নিম্ন পর্যায়ের বার্তাবাহক, দফতরি বা পিয়ন থেকে বড় কোন পদ তারা আশাই করতেন না।৫
এছাড়া, ব্রিটিশ শাসনের শুরু থেকেই মুসলমানদের অবিশ্বাসের চোখে দেখা হত । রাজনৈতিক ক্ষমতা পুনরুদ্ধারও তাদের জন্য কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ল। বাংলায় ওহাবি আন্দোলন ছিল ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে তাদের ঘৃণার বহিঃপ্রকাশ। আন্দোলনটি পরে স্তিমিত হলেও বিটিশরা মুসলমানদের প্রতি আরও সন্দেহপ্রবণ হয়ে ওঠে। আবার, ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহে মুসলমানদের ঢালাওভাবে দমন করা হয় এ ধারণা থেকে যে, মুসলমান অভিজাতরাই এ বিদ্রোহের আগুন প্রজ্বলিত করে।৬
এভাবে মুসলমানদের সকল উচ্চপদ থেকে বঞ্চিত করা এবং তাদের সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখাতে তারা অসহায় হয়ে পড়ল। মুসলমানদের এমন দুর্দশা দেখে ১৮৬৯ সালে কলকাতার ফার্সি পত্রিকা ‘দূরবীন’ মন্তব্য করল ঃ
ছােট-বড় সকল পদ থেকে ক্রমান্বয়ে মুসলমানদেরকে ছুঁড়ে ফেলা হল এবং তা অন্য ধর্মের লােকদের ওপর অর্পিত হল, বিশেষ করে হিন্দুদের ওপর। সরকার সকল ধর্মের লােকদের সমানভাবে বিবেচনা করতে বাধ্য, যদিও এখন সেই অবস্থা উপনীত হয়েছে যেখানে সরকারের জন্য শুধু মুসলমানদের সকল পদ থেকে বাদ দেয়ার জন্য গেজেট প্রকাশ বাকি আছে। সম্প্রতি, যখন সুন্দরবনের কমিশনারের কতিপয় পদ খালি হয়েছে তখন চাকরির বিজ্ঞাপনে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা গেজেটের মাধ্যমে ঘােষণা করেছেন, উক্ত পদসমূহে শুধুমাত্র হিন্দুরা ছাড়া কেউ আবেদন

করতে পারবে না। মুসলমানদের অবস্থা এমন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে, সরকারি চাকরিতে নির্বাচিত হলেও কায়দা করে নােটিসের মাধ্যমে তাদেরকে সরিয়ে দেয়া হচ্ছে। কেউ তাদের দুরবস্থার কথা আমলে নেয়নি, এমনকি উচ্চপদের অধিকর্তারা তাদের অস্তিত্বকেও স্বীকার করতে চায়নি।”৮
এক সময় যখন ভারতীয় মুসলমানগণ এভাবে সাক্ষাৎ ক্ষয়িষ্ণুতায় পর্যবসিত হল, তখন এ অবস্থা থেকে উদ্ধারকল্পে নেতা হিসেবে স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আবির্ভাব হল। তিনি অনুধাবন করলেন, মুসলিমদের অবস্থার উন্নতি করতে গেলে তা শুধুমাত্র পশ্চিমা শিক্ষা গ্রহণের মাধ্যমেই সম্ভব। এক্ষেত্রে তিনি এ্যাংলাে-মুসলিম মিলন অভিযানে নামলেন এবং পশ্চিমা শিক্ষার প্রসার ঘটাতে লাগলেন। মুসলিমদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার জন্য তিনি ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য চাইলেন এবং ১৮৭৭ সালে উত্তর-ভারতের আলীগড়ে মুসলিম নেতৃত্বের সূতিকাগার আলীগড় আন্দোলনের কেন্দ্র’ মােহামেডান এ্যাংলােওরিয়েন্টাল কলেজ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৮৮৫ সালে যখন ইন্ডিয়ার ন্যাশনাল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা হয় স্যার সৈয়দ আহমেদ খান নিজে তা থেকে দূরে থাকেন এবং অন্য মুসলমানদেরও তাতে যুক্ত হওয়া থেকে বিরত থাকতে অনুরােধ করেন। কারণ, তিনি অনুধাবন করেছিলেন, কংগ্রেসের ব্রিটিশ বিরােধী নীতি মুসলমানদের স্বার্থের জন্য পরিপন্থি।১০ এর বদলে, তিনি পারিপার্শ্বিক মূল্যবােধ এবং মুসলমানদের মধ্যে শান্তি স্থাপনের লক্ষ্যে ১৮৮৬ সালের ডিসেম্বরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম এডুকেশনাল কনফারেন্স প্রতিষ্ঠা করেন।১১ পরবর্তীতে তিনি কংগ্রেসকে প্রত্যুত্তর এবং তাদের কার্যক্রমকে রুখে দিতে ১৮৮৮ সালের আগস্ট মাসে ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক এসােসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।১২ ১৮৯৩ সালের ৩০ ডিসেম্বর স্যার সৈয়দ আহমদ খান তখনকার প্রভাব বিস্তারকারী মুসলিম নেতাদের নিয়ে তার নিজ গৃহে মুসলিম রাজনৈতিক অবস্থা ও মুসলিম রাজনৈতিক সংগঠন সৃষ্টি করে মুসলমানদের মতামত কিভাবে সরকারের কাছে। তুলে ধরা যায় – সেসব বিষয়ে একটি বৈঠক করেন। আলােচনায় সর্বতােভাবে একটি মুসলিম সংগঠনের প্রয়ােজনীয়তা অনুভূত হয় এবং সে মতে মােহামেডান এ্যাংলাে-ওরিয়েন্টাল ডিফেন্স এসােসিয়েশন গঠন করা হয় যার

প্রধান কার্যালয় আলীগড়ে। এসােসিয়েশনের উদ্দেশ্যসমূহের মধ্যে নিম্নলিখিতগুলাে উল্লেখযােগ্য ঃ
১. ইংরেজ এবং ভারত সরকারের কাছে মতামত উপস্থাপনের মাধ্যমে মুসলিমদের রাজনৈতিক স্বার্থের উন্নতি ঘটানাে।
২. মুসলমানদের মধ্যকার সাধারণ এবং রাজনৈতিক উৎকণ্ঠা নিরুৎসাহিত করা।
৩. ব্রিটিশ সরকারের স্থায়িত্ব রক্ষা এবং রাজত্বের নিরাপত্তা বিধানের সব পদক্ষেপে সহযােগিতা প্রদান করা।
৪. ভারত রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কঠোর পরিশ্রম করা এবং জনগণের মধ্যে আনুগত্যের অনুভূতি সংরক্ষণের জন্য তাদের উৎসাহ দেয়া।
১৮৯৪ – ৯৬ পর্যন্ত ডিফেন্স এসােসিয়েশনের কার্যক্রমে প্রতীয়মান হয়, ইহা ছিল মুসলিম লীগের খাঁটি অগ্রদূত এবং ১৯০৬-এর সিমলা ডেপুটেশন যা কিছু চেয়েছিল তাতে সেগুলােই বিদ্যমান।
স্যার সৈয়দ আহমদ খানের আদর্শ ও কর্মকান্ডের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পশ্চিমা শিক্ষায় শিক্ষিত কতিপয় ব্যক্তিবর্গ যেমন নওয়াব আবদুল লতিফ (১৮২৮ – ১৮৯৩) এবং সৈয়দ আমীর আলী (১৮৪৯-১৯২৮) মুসলমানদের পুনঃজাগরণের লক্ষ্যে তাদের আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত করার কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। এ লক্ষ্যে আবদুল লতিফ মােহামেডান লিটারারী সােসাইটি (১৮৬৩) এবং সৈয়দ আমীর আলী সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশন (১৮৭৭) গঠন করেন। অল্প কয়েকজন মুসলমান নেতা নবগঠিত ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসে যােগদান করেছিলেন যে দলে হিন্দুদের আধিপত্য বেশি ছিল। অন্যরা আলীগড় মুভমেন্টের সাথে শরীক হয়ে হিন্দু আধিপত্যের বিরুদ্ধে মুসলিমদের অধিকার রক্ষার স্বার্থে উল্লেখযােগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁদের প্রচেষ্টাতে বাংলার মুসলিমরা নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার এবং অবস্থান নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছিলেন।
স্যার সৈয়দ আহমদ ১৮৯৮ সালে ইন্তেকাল করেন। কিন্তু সমাজে উঁচুতে অবস্থানরত মুসলিম নেতারা বিশেষ করে উত্তর-ভারত ও বাংলার নেতৃবৃন্দ তাঁর
১০
মতই ব্রিটিশদের প্রতি আনুগত্য ও কংগ্রেসদের প্রতি বৈরিতা দেখাতে লাগলেন। কিন্তু ১৯০০ সালে দেশের রাজনৈতিক অবস্থার আরও অবনতি ঘটল এবং হিন্দুমুসলিম সম্পর্ক অনেক অশান্তিকর হয়ে উঠল।
বিশেষ করে বাংলায় হিন্দু-মুসলিম সম্পর্কের অবনতির অন্যতম কারণ ঘটে ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গকে কেন্দ্র করে। বিশ শতকের শুরুতে সমগ্র ভারতে বাংলা ছিল সবচেয়ে বৃহৎ এবং জনাকীর্ণ প্রদেশ। বাংলা সদর, বিহার, ছােট নাগপুরসহ এর আয়তন ছিল প্রায় ১ লক্ষ ৯০ হাজার বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ছিল প্রায় ৮ কোটি।১৫ লর্ড কার্জন এ প্রদেশকে দু’ভাগে ভাগ করেন। পূর্ববাংলাকে আসামের সাথে যুক্ত করা হয় যার রাজধানী ছিল ঢাকা। আর পশ্চিমবঙ্গ, বিহার ও উড়িষ্যাসহ আলাদা একটি প্রদেশ করা হয় যার প্রধান কার্যালয় কলকাতাতে ছিল।
ব্রিটিশ ভারতীয় সরকার কিসের ভিত্তিতে বাংলাকে ভাগ করল বা ভাগের পেছনে কি লক্ষ্য ছিল এ লেখাটির উদ্দেশ্য তা বের করা নয়।১৬ বাংলা ভাগের পেছনে যে কারণই থাকুক না কেন বাংলার মুসলমান বিষয়টিকে স্বাগত জানায়। কারণ, তারা বুঝতে পারে, এর ফলে নতুন প্রদেশ থেকে তাঁরা নিজেদের হিন্দুদের বিরুদ্ধে প্রতিযােগিতায় ভাল অবস্থানে নিতে পারবে এবং তাঁদের রাজনৈতিক তৎপরতা এখান থেকে আরও সুসংহত করা যাবে। অবশ্য তা সত্য, ১৯০৩ সালে দেশ বিভাগের বিষয়টি যখন প্রথম জনসম্মুখে আসে তখন সর্বপ্রথম বাংলার মুসলমানগণ বিশেষ করে পূর্ববাংলার মুসলমান সবার আগে এর বিরােধিতা করেছিল। তাদের অভিযােগের কারণ ছিল, চীফ কমিশনার দ্বারা অপেক্ষাকৃত বেশি অগ্রসরমান অঞ্চল শাসিত হওয়াকে কেন্দ্র করে।১৭ বাংলা বিভাগের ধারাসমূহ যখন মুসলমান শিক্ষিত জনগােষ্ঠীর নজরে এল এবং এর সুফল পেতে লাগল তখন তারা এর প্রতি পূর্ণ সমর্থন দিল । দেশ বিভাগের পক্ষে সমর্থনকারী সকল মুসলমানের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্ব ছিলেন ঢাকার নবাব খাজা সলিমুল্লাহ। তিনি বঙ্গভঙ্গের পক্ষে ব্যাপক আন্দোলনও গড়ে তােলেন।১৮ ১৯০৫ সালের ১৬ অক্টোবর বঙ্গভঙ্গের কার্যপ্রণালী যখন কার্যকর হল তখন ঢাকায় তিনি মুসলমানদের প্রাদেশিক সভা ডাকলেন। সভাপতির বক্তব্যে তিনি ঘােষণা দিলেন, এই বঙ্গভঙ্গ “মুসলিমদেরকে নিষ্ক্রিয় অবস্থা থেকে জাগিয়ে
১১
তুলেছে এবং সক্রিয়তা ও সংগ্রামের দিকে মনােযােগ দিতে শিখিয়েছে” এবং তিনি এ বিভাজনের কারণ সকল মুসলিমের কাছে তুলে ধরার ইঙ্গিত দিলেন।১৯ পরবর্তীতে নবাব খাজা সলিমুল্লাহকে পৃষ্ঠপােষক করে ‘মােহামেডান পলিটিক্যাল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয় যার উদ্দেশ্য ছিল, পূর্ববাংলা এবং আসামের সকল মুসলমানদের একত্র করা এবং সরকারের কাছে তাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকারসহ মতামত তুলে ধরা।২০
এদিকে খ্যাতিমান ও জনপ্রিয় কংগ্রেস নেতা সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, ভূপেন্দ্রনাথ বসু এবং অন্যান্য নেতার নেতৃত্বে লাগাতারভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে উত্তেজনা ছড়াতে থাকল। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করা জরুরি, বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে থাকা আন্দোলনের সপক্ষের নেতারা ব্রিটিশ সরকারের কাছে। এ বিষয়ে আবেদন করতে পারবে বলে তখন আশাবাদী ছিলেন।২১ পরে যখন ব্রিটিশ সরকার তাঁদের আবেদন ও স্মারক উপেক্ষা করল তখন আন্দোলন চরমে। পৌছে তা “স্বদেশী আন্দোলনে রূপ নিল। সকল গুরুত্বপূর্ণ শহরে অনেক প্রতিবাদ সভা হল। এর মধ্যে ১৯০৫ সালের ৭ আগস্ট কলকাতার টাউন হলে কাশিমপুরের মহারাজা মনীন্দ্র চন্দ্র নন্দীর সভাপতিত্বে একটি মিটিং হয়েছিল যাতে তিনি বলেছিলেনঃ
“নতুন প্রদেশে মুসলিম সংখ্যা অনেক বেশি …… বাঙালী হিন্দুরা সংখ্যালঘু, আমরা নিজেদের দেশে আগন্তুক। ভবিষ্যতে আমাদের জাতির কি পরিণতি হবে তা ভেবেই আমি উদ্বিগ্ন।”২২
নতুন প্রদেশের নতুন গভর্নর লেফটেন্যান্ট গভর্নর স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার ঢাকায় দায়িত্ব গ্রহণ করেন।২৩ তাঁর বিরুদ্ধে বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনকারী জনমত গড়ে তােলে এবং কংগ্রেস সমর্থিত সংবাদপত্র ব্যাপক প্রচারণা চালায়। অবশেষে স্বদেশীদের সন্ত্রাসবাদী বিরােধী আন্দোলনের মুখে ফুলার পদত্যাগে বাধ্য হন।২৪
ফুলারের পদত্যাগ মুসলমানদের বিরুদ্ধে হিন্দুদের এক ধরনের বিজয় সাধিত হয়। এতে পূর্ববাংলার মুসলমান হতাশ হয়ে পড়েন। তারা এর বিরুদ্ধে আপত্তি করেন। ১৯০৬ সালের ৬ আগস্ট নবাব সলিমুল্লাহ ঢাকাতে একটি সভা ডাকেন তাতে দুঃখ প্রকাশ করা হয়, নীতিবান, জ্ঞানী ও সহানুভূতিশীল লেফটেন্যান্ট গভর্নর ফুলারের পদচ্যুতিতে মুসলমানদের প্রতি অন্যায় করা হয়েছে
১২
যেখানে তারা নতুন প্রদেশের জনসংখ্যার প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ। সভায় আরও বলা হয়, “সরকার তার নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা না করার যে ব্যবস্থা নিচ্ছে তাতে মুসলমানদের সমর্থন নেই।”২৫ যদিও সরকার ঐ বঙ্গভঙ্গকে “মীমাংসিত বিষয়” বলে মুসলমানদের আশ্বস্ত করেছিল তবুও ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী স্যার হেনরী ব্যানারমানের দেশ বিভাজন নিয়ে প্রশ্ন তােলাতে মুসলমান নেতৃবৃন্দ এর ভবিষ্যৎ অবস্থান সম্পর্কে আঁচ করতে পেরেছিল।২৬
কংগ্রেস সমর্থিত হিন্দুদের দ্বারা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধাচরণ ও তাদের প্রতি সরকারের পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গি দেখে মুসলমান নেতারা তাঁদের নিজেদের জন্য সমগ্র ভারতে একটি আলাদা রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা করার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করলেন।২৭ প্রশাসনের উপর কংগ্রেসের চাপ কমাতে ১৯০৬ সালের জুলাই মাসে হাউস অব কমনস-এ বাজেট বক্তৃতায় রাষ্ট্র সচিব লর্ড মর্লি আইন পরিষদকে নতুনভাবে ঢেলে সাজানাের ইচ্ছে প্রকাশ করেন। তারপরই তখনকার ব্রিটিশ-ভারতের ভাইসরয় লর্ড মিন্টো এ বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণ করার জন্য একটি কমিটি করেন। কমিটি গঠনের কথা শুনে মুসলমানরা কাজে নেমে পড়েন এবং তাদের মতামত ভাইসরয়ের কাছে প্রকাশ করার জন্য একটি প্রতিনিধিদল পাঠানাের সিদ্ধান্ত নিলেন।
তদনুসারে, আগা খানের নেতৃত্বে সারা ভারতবর্ষ থেকে ৩৫ সদস্যের একটি মুসলিম প্রতিনিধিদল ১৯০৬ সালের ১ অক্টোবর সিমলায় ভাইসরয়ের সাথে সাক্ষাৎ করেন।২৮ বলা হল, মুসলমানরা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে যা-ই বলুক না কেন তাদেরকে সংখ্যার দিক দিয়ে বিচার না করে তাদের রাজনৈতিক গুরুত্ব ও ব্রিটিশদের নিরাপত্তায় তাদের অবদান দেখে যেন মূল্যায়ন করা হয়। প্রতিনিধিদল ছাড়াও পৌরসভা, জেলা পরিষদ ও আইনসভার আলাদা নির্বাচন ব্যবস্থার মাধ্যমে কিভাবে মুসলমানদের স্বার্থ সংরক্ষিত হবে তার উপায় সম্পর্কে পরামর্শ দেন। ভাইসরয় তাঁদের আশ্বস্ত করেন, নির্বাচিত প্রতিনিধির মাধ্যমে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থ ও সামাজিক স্থিতি সংরক্ষণ করা হবে।২৯
সিমলা সভার সফলতায় মুসলমান নেতারা তাঁদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও নিরাপত্তার লক্ষ্যে নতুন একটি মুসলিম সংগঠন করার উৎসাহ বােধ করলেন।
১৩
ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ এই জাতীয় সংগঠন তৈরিতে সর্বপ্রথম বাস্তব পদক্ষেপ নিলেন, যদিও তিনি চোখের অপারেশনের জন্য সিমলার বৈঠকে যেতে পারেননি।৩০
নভেম্বর ১৯০৬ সালে তিনি অল ইন্ডিয়া মুসলিম কনফেডারেসি’ মৈত্রী সংঘটি তৈরির পরিকল্পনা প্রণয়ন করলেন৩১, যে অঙ্কুর থেকেই অচিরেই মুসলিম লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটে। পূর্ববর্তী অধ্যায়ে বলা হয়েছে, নওয়াব সলিমুল্লাহর সাথে তরুণ রাজনীতিবিদ এ. কে. ফজলুল হকের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল এবং তাঁর নেতৃত্বে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে থাকে।
১৯০৬ সালের ডিসেম্বরে ‘অল ইন্ডিয়া মােহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্সে যােগ দিতে সমগ্র ভারত থেকে মুসলমান নেতারা ঢাকায় আসেন। এ সুযােগটি কাজে লাগিয়ে ১৯০৬ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঢাকার ঢাকার শাহবাগে নওয়াব সলিমুল্লাহ মুসলমান নেতাদের একটি বৈঠকে আমন্ত্রণ করেন।৩২ বৈঠকে তিনি সমগ্র ভারতের মুসলমানদের নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করলে তা সর্বসম্মতভাবে গৃহীত হয়। এভাবে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয় যার প্রথমদিকে প্রধান লক্ষ্যগুলাে ছিলঃ
ক. ব্রিটিশ রাজত্বের প্রতি ভারতবর্ষের সকল মুসলমানের আনুগত্যের মনােভাব জাগ্রত করা এবং ব্রিটিশ সরকারের গৃহীত পদক্ষেপের বিরুদ্ধে অবস্থানরত সকল ভ্রান্ত ধারণার অবসান ঘটান।
খ. মুসলমানদের রাজনৈতিক অধিকার এবং স্বার্থ সংরক্ষণ ও তা অগ্রসর করা এবং সরকারের কাছে তাদের চাহিদা ও আকাক্ষা প্রকাশ করা।
গ. লীগের অন্যান্য লক্ষ্য পালনের ক্ষেত্রে কোন সম্প্রদায়ের প্রতি মুসলমানদের যেন বৈরী মনােভাব না জন্মে তার ব্যবস্থা নেয়া।৩৩
আগেই বলা হয়েছে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা হওয়ার পরপরই নবগঠিত ইস্ট বেঙ্গল ও আসাম প্রদেশে সিভিল সার্ভিসে এ. কে. ফজলুল হক যােগ দেন। অতপর তিনি ১৯১২ সালে সরকারি চাকরি ছেড়ে দেন এবং পুরােমাত্রায় মন-প্রাণ দিয়ে রাজনীতিতে যােগ দেন।
১৪

– দুই –
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হিন্দুরা বাংলা প্রদেশ বিভাজন হওয়ায় খুব ক্ষুব্ধ হয়। তারা এর বিরুদ্ধে ব্রিটিশ সরকারের কাছে তাদের বিভিন্ন বিষয় উত্থাপন করেন। এর ফলে লর্ড হার্ডিঞ্জ, যিনি লর্ড মিন্টোর পর ভাইসরয় হয়েছিলেন, কলকাতা থেকে সরকারি প্রধান দফতর দিল্লীতে স্থানান্তরের পরামর্শ দেন। রাজা পঞ্চম জর্জের অভিষেকের সময় ১৯১১ সালে এ বিষয়ে দাফতরিক ঘােষণা আসে। বঙ্গভঙ্গ রদ করা হলে তাতে মুসলমানদের মনে জোরালাে আঘাত লাগে। পূর্ববাংলার মুসলমান নেতৃবৃন্দ মনে করল, সরকারের এ সিদ্ধান্ত হিন্দুদের শান্ত করার কৌশল এবং এভাবে তাদের তুষ্ট করতে মুসলমানদের বলিদান করা হল। এমনকি ব্রিটিশ সরকারের খুব ঘনিষ্ঠ নওয়াব সলিমুল্লাহকেও বঙ্গভঙ্গ বাতিলের বিষয়ে অন্ধকারে রাখা হয়েছিল। তিনি এতে এতই আঘাত পেয়েছিলেন যে, ১৯১২ সালে তিনি রাজনীতি থেকেই ইস্তফা দিয়েছিলেন।
বঙ্গভঙ্গ রদের বিষয়টি মুসলমানদের দৃঢ়তা দেখানাের একটি কঠিন পরীক্ষা ছিল। এ সমস্যার মধ্যেও মুসলিম লীগের সর্বভারতীয় নেতাগণ আনুগত্য প্রদর্শনের ধারা অব্যাহত রাখলেন ; কারণ, তাঁদের আভিজাত্যের ভিত্তিই ছিল রাজসেবা। এ সকল অভিজাত নেতৃবৃন্দ পূর্ববাংলার মুসলমানদের সরকারের সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধাচরণ না করতে অনুরােধ করলেন৩৪ এবং তাঁরা ধরে নিলেন, আনুগত্য প্রকাশ অব্যাহত রাখলে, তারা শিক্ষা ও সরকারি চাকরিতে বিশেষ ছাড় পাবেন।৩৫
অভিজাত মুসলমানরা অল্প সংখ্যক মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানদের বােঝাতে ব্যর্থ হলেন। যদিও তারা ব্রিটিশদের অঙ্গীকারের প্রতি বিশ্বাস হারাল এবং তাদের প্রতি বিমুখ হল।৩৭ পরিবর্তিত অবস্থার আলােকে তারা মুসলিম নীতি ঢেলে সাজানাের প্রয়ােজনীয়তা তুলে ধরলেন অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের সভায় যা ১৯১২ সালের মার্চে কলকাতায় স্যার নওয়াব সলিমুল্লাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।৩৮ ঐ বছরই কলকাতায় যখন ‘বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হয় তখন অনেক বাঙালি মুসলিম যুবক ও সংস্কারবাদী মুসলমানরা সেখানে যােগ দেন।৩৯
১৫
বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এ অংশে এ. কে. ফজলুল হক নেতৃত্ব। দেন। অভিজাত মুসলিম নেতাদের মত না করে, এ. কে. ফজলুল হক মধ্যবিত্ত মুসলমানদের খুব কাছের মানুষ হতে পেরেছিলেন এবং সবাই তাঁকে সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন। ১৯১৩ সালে তিনি বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং এই পদে তিনি ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন।৪০
মুসলিম মধ্যবিত্ত শ্রেণির প্রতিনিধি হিসেবে এ. কে. ফজলুল হক ১৯১৩ সালে বেঙ্গল লেজিসলেটিভ রাজনীতিতে যােগদান করেন। ক্ষমতাবান হিন্দু প্রতিপক্ষ রায় বাহাদুর কুমার মহেন্দ্রনাথ মিত্রকে উপনির্বাচনে পরাজিত করে তিনি বঙ্গীয় বিধান সভার সদস্য নির্বাচিত হন।৪১ বিধান সভায় নির্বাচিত হয়েই তিনি মধ্যবিত্ত মুসলিমদের প্রতিনিধি হিসেবে অভিজাত মুসলিম নেতাদের পূর্বাপর ব্রিটিশরাজ আনুগত্য নীতি পরিহার করেন। ১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিল আইন পরিষদে তাঁর প্রথম বক্তৃতাতে গতানুগতিক মুসলিম রাজনীতির ধারা যা ব্রিটিশদের অনুগ্রহের বশবর্তী ছিল তার অবসান ঘটে। ফজলুল হক বলেন ঃ
আমার মতে সরকারের এমন কোন পন্থা অবলম্বন করা ঠিক হবে না যাতে মুসলমানগণ সমস্যায় পড়ে। সরকার চাহিদা অনুযায়ী ২ কোটি ২০ লক্ষ মুসলমানের যা প্রয়ােজন তা দিচ্ছে না ….. আমি সরকারকে নিশ্চিত করতে পারি যে, তাদের মন বিক্ষিপ্ত আছে ….. যদিও তাদের আন্দোলনে না যাওয়ার ইচ্ছে। আস্তে আস্তে তারা রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের দিকে এগুচ্ছে। আমরা মনে করি, সময়ের হাল ধরে আমাদের এগুতে হবে, না হলে সর্বনাশ। কর্মকর্তাদের ইহা মনে করলে চলবে না যে তাদের নেতাদের বড় বড় পদ দিয়ে সাজিয়ে রাখলে সমগ্র সম্প্রদায়ের মন ঠিক হয়ে যাবে। সামান্য মনের খােরাকের যােগান ছাড়াও আমাদের আরও অনেক কিছুর দরকার।৪২
হকের বক্তৃতা ছিল তােষামােদী রাজনীতির বিপরীত যা সনাতন মুসলিম লীগের নেতারা অনুসরণ করতেন না এবং এ কারণে তারা তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হন। এর ফলে বাংলার অন্যতম অভিজাত মুসলিম লীগ নেতা শামসুল হুদা যিনি সদ্য নওয়াব’ খেতাবে ভূষিত হয়েছেন তিনি ফজলুল হকের এমন বক্তৃতার প্রতিবাদ
১৬
করেন।৪৩ কিন্তু হকের বক্তৃতা হল সাধারণ মুসলমানদের অবস্থাকে নিয়ে যা তাঁর প্রতিটি বক্তৃতায় সকলে জানতে পারত। বাংলার সাধারণ মুসলমানগণ তখন আর আনুগত্যের রাজনীতি পছন্দ করত না।
এভাবে বাংলার মুসলমানদের চিন্তাধারার পরিবর্তনে সমগ্র ভারতে কয়েকজন মুসলিম নেতার আবির্ভাব ঘটল যারা বিশ্বাস করতেন, ব্রিটিশদের প্রতি এরূপ আনুগত্য প্রদর্শন নিরর্থক। ভারতীয় রাজনীতির ধারা পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে সকলের মনে হতে লাগল যে, এদেশের সাধারণ মুসলমানদের রাজনৈতিক সুবিধা থেকে দূরে সরিয়ে রাখা সম্ভব না।৪৪ ১৯১২ সালে তুর্কিদের বিপক্ষে বলকান যুদ্ধ এবং পারস্যদের উপরে রাশিয়ার হামলা এ চিন্তাধারাকে আরও বেগবান করেছিল। ব্রিটিশ রাজত্বের প্রতি মুসলমানরা তখন আরও সন্দেহ প্রবণ হয়ে উঠল। বলকানের ঘটনা সকল মুসলমানকে একত্রিত হতে উৎসাহ দিল এবং তারা স্যার সৈয়দ আহমদ খানের সরকার আনুগত্য নীতি পরিহারমূলক আদর্শের পুনঃস্থাপন চাইল৪৫। ফলে ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে মুসলিম লীগের এক সভায় লীগের লক্ষ্যসমূহের পরিবর্তন করা হয় যা ১৯১৩ সালের মার্চে অনুষ্ঠিত লক্ষৌর সভাতে নতুন করে গঠন করা হয়। স্বরাজ সরকার প্রতিষ্ঠার হিসেবে লক্ষ্য স্থির করে বিভিন্ন সময় লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের নিয়ে বৈঠক করে একত্রে অগ্রসর হওয়ার কার্যপ্রণালী ঠিক করে ।৪৬
প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশ ও তাদের মিত্ররা মিলে তুর্কির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে এবং এ বিষয়টি এদেশের মুসলমানদের ব্রিটিশ রাজের প্রতি পূর্বাপর আনুগত্যের উপর চাপ সৃষ্টি করে। এমনকি সমাজের রক্ষণশীল ব্যক্তিরাও ব্রিটিশদের তুর্কি-বিরােধী নীতির পরিবর্তন ঘটাতে কংগ্রেসের প্রতি ঝোঁকে। পাশাপাশি ঐ যুদ্ধটি সকলের মনে সংবিধানের উন্নতি এবং হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের আশা জাগিয়ে তােলে। বিষয়টি ১৯১৩ সালে লক্ষ্ণৌতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বৈঠকে সকলের নজরে। আনা হয়। এ অবস্থায় মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থী নেতারা কংগ্রেসের সঙ্গে এক সাথে কাজ করতে লীগকে আরেকটু সামনে এগিয়ে নেয়।
ফজলুল হক, যিনি বাংলার মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থী নেতা ছিলেন, তিনিই লীগ এবং কংগ্রেসকে ঘনিষ্ঠ হতে প্রথম উদ্যোগ নেন। এ লক্ষ্যে তিনি সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীকে সাথে নিয়ে লীগ এবং বিভিন্ন প্রদেশের কংগ্রেস নেতাদের।
১৭
সাথে বিভিন্ন সময় বৈঠক করেন যার ফলে ১৯১৬ সালের ডিসেম্বরে লক্ষ্ণৌতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস একটি যৌথপরিকল্পনা গ্রহণ করে। লীগ-কংগ্রেসের এ যৌথ কার্যক্রম “লক্ষৌ চুক্তি” নামে সুপরিচিত, যাতে মুসলমানদের জন্য আলাদা করে ভােটের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। ও প্রাদেশিক সভায় সংখ্যালঘুদের রক্ষা করা হয়েছে। যেসব প্রদেশে মুসলমানগণ সংখ্যালঘু সেখানে তাদের বেশি প্রতিনিধিত্ব করার সুযােগ দেয়া হয়েছে এবং পরিবর্তে বেঙ্গল ও পাঞ্জাবে তাদের কম প্রতিনিধিত্ব করার সুযােগ দেয়া হয়েছে যেখানে তারা সংখ্যায় বেশি। মুসলিম লীগের সংস্কারপন্থীদের বিজয় হয়েছিল লক্ষৌ চুক্তির মাধ্যমে। এর ফলে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগে এবং কংগ্রেসে ফজলুল হকের প্রভাবও মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়।
বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে লক্ষৌ চুক্তিটি নিয়ে অনেক সমালােচনা হয়, আর সমালােচনাকারিদের মধ্যে ছিলেন মরহুম নওয়াব সলিমুল্লাহ (মৃত্যু ১৯১৫) এবং ময়মনসিংহের ধনবাড়ির জমিদার নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরীর অনুসারীরা। তারা মনে করেন, স্থানীয় আইন পরিষদে হিন্দু প্রতিনিধিত্বের অনুমােদন হল এই মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থের বিরুদ্ধে প্রতারণা এবং এ সুযােগটি দেয়া হয়েছিল ভারতের সর্বস্তরের হিন্দুদের সাথে আপােস-রফার ফলস্বরূপ।
বাঙালি মুসলিমদের দৃষ্টিতে বিশেষভাবে দেখলে আসলেই লক্ষ্ণৌ চুক্তিটি কোন ভাল চুক্তি না। ৫২.৬% জনগােষ্ঠী হলেও তারা আইন পরিষদে মাত্র ৪০% নির্বাচিত আসন পাবে। এর প্রতিবাদে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্টের পদ থেকে নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহর একান্ত সহযােগী রাজনীতিবিদ নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী ইস্তফা দিয়ে সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশনে যােগদান করেন, যে সংগঠনটি প্রাথমিক পর্যায়ে মুসলমানদের শিক্ষাদানের কাজে নিয়ােজিত ছিল।৪৭ লক্ষ্ণৌ চুক্তিটি মুসলিম লীগের উচ্চ পদের নেতাদের বিভক্ত করে ফেলে এবং ফজলুল হকের পক্ষে দলের নেতৃত্ব দেয়া খুব চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে।
১৯১৮ সালে নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশনের সভাপতি নির্বাচিত হন এবং লক্ষ্ণৌ চুক্তি ও লীগের প্রতি বিরুদ্ধাচরণ অব্যাহত রাখেন। তিনি ধরে নিয়েছিলেন বাংলার মুসলমানদের পক্ষে লীগ আসলে কোন প্রতিনিধিত্বই করে না আর কংগ্রেস-লীগের নীতিসমূহ
১৮
হল ১৯১১ সালের “পুনরেকত্রীকরণ”-এর ন্যায় তাঁর লােকজনদের প্রতি ধোঁকাবাজি।”৪৮ তিনি এখানেই থেমে যাননি। সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশনের মাধ্যমে তিনি বাংলার নানা জায়গায় কনফারেন্স করে বাংলার জনগণের পক্ষে লীগের কথা বলা বন্ধ করতে বলেন এবং ব্রিটিশদের তাঁর এলাকার জনগণের দাবি মেনে নিতে অনুরােধ করেন।৪৯ নওয়াব আলী চৌধুরীর লােকদের এমন বিরােধপূর্ণ অবস্থান সত্ত্বেও ফজলুল হক এবং তাঁর সংস্কারপন্থী। অনুসারীরা হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের ভিত্তি নিয়ে কংগ্রেসের সাথে একত্রে ভারতবর্ষে স্বরাজ সরকার প্রতিষ্ঠার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন।
হিন্দু-মুসলিম ঐক্য সমুন্নত করার ক্ষেত্রে ফজলুল হকের নিরলস প্রচেষ্টাতে মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের সকলের কাছে তিনি খুবই জনপ্রিয় নেতা হয়ে উঠেন। ফজলুল হক নেতৃত্বের গুনে ১৯১৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভাপতি এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সেক্রেটারী নির্বাচিত হন।৫০ ঐ বছরেই তিনি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সভাপতির ভাষণে বলেন ঃ
“ব্রিটিশদের রাজত্ব অলঙ্কৃত হওয়া ও সফলতার পেছনে ভারতের জাতীয় গৌরব ও অনেক আশা নিহিত রয়েছে। আমরা আশাবাদী যে, আমাদের চাহিদাসমূহের সঠিক মূল্যায়ন করা হবে এবং এ আশা তখনই পরিপূর্ণতা পাবে যখন আমরা স্বরাজ সরকার ব্যবস্থার প্রচলন ঘটাতে পারব।”৫১
তিনি তুর্কিদের অবস্থার বিশদ বর্ণনাসহ আসন্ন শান্তি আলােচনায় মুসলমানদের কিভাবে মূল্যায়ন করা হবে তার ব্যাখ্যা দেন। তুর্কির সুলতান যাকে সকল মুসলমান খলিফার মত সম্মান করেন — তার ভবিষ্যতের প্রতি উদ্বেগ প্রকাশ করে সভা শেষ হয়।

তিন

দিল্লীর অধিবেশন থেকে (১৯১৮) অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের যে খেলাফত আন্দোলন শুরু হয়েছিল তাতে সারা ভারতের মুসলমানদের মধ্যে সাড়া পড়ে যায়। আন্দোলনকে কার্যকরভাবে পরিচালনা করার লক্ষ্যে মাওলানা মােহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে একটি কেন্দ্রীয় খেলাফত মজলিশ গঠন করা হয় – যার প্রধান। কার্যালয় ছিল বােম্বেতে।৫২ শিগগিরই এর শাখা সারাদেশে ছড়িয়ে পড়ে।
১৯
ফজলুল হক খেলাফত আন্দোলনে অগ্রগামী ভূমিকা পালন করেন। মাওলানা মােহাম্মদ আলী ও অন্যান্য মুসলমান নেতার সাথে একাত্ম হয়ে খেলাফত আন্দোলনের প্রতি তিনি জনসচেতনতা তৈরি করেন।৫৩ এছাড়াও তিনি ১৯১৯ সালের ২৪ নভেম্বর দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া খেলাফত কনফারেন্সের উন্মুক্ত সেশনে সভাপতির প্রথম ভাষণ দেন। সভায় ১ম বিশ্বযুদ্ধে ব্রিটিশদের জয় লাভে মুসলমানদের বিজয় উৎসব না করতে অনুরােধ করা হয়। সভায় আরও সিদ্ধান্ত হয়, যদি ব্রিটিশরা আন্দোলনকারীদের দাবি-দাওয়ার প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে তাহলে ব্রিটিশ পণ্য বর্জন ও তাদের প্রতি অসহযােগিতা প্রকাশ করা হবে।৫৪ ইতােমধ্যে রাওলাট বিল এবং পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের হত্যাকণ্ডের কারণে সরকারের সঙ্গে কংগ্রেসকেও দূরে সরানাে হল । সমগ্র ভারতবর্ষ এতে জেগে উঠল আর মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেস অসহযােগ আন্দোলন শুরু করল এবং ভারতবর্ষে স্বরাজ সরকার প্রতিষ্ঠার সংকল্প করল।৫৫
খেলাফত ও অসহযােগ আন্দোলন ব্রিটিশদের বিপক্ষে হিন্দু-মুসলমানের একই মঞ্চে দাঁড় করাতে সক্ষম হয়েছিল এতে করে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতিও তৈরি হয়েছিল। কিন্তু এরই মধ্যে কংগ্রেসের সাথে ফজলুল হকের সম্পর্কের। অবনতি ঘটে। তিনি নাকি পুরােমাত্রায় অসহযােগে অংশগ্রহণ করছিলেন না। তবে তিনি ইংল্যান্ডের তৈরি পণ্য ও উপাধি বর্জন করার পক্ষে থাকলেও শিক্ষার সরঞ্জামাদি বয়কট করার বিপক্ষে ছিলেন। তিনি যুক্তি দেখালেন, যদি এ বিষয়গুলােও বর্জন করা হয় তাহলে মুসলমানদের মধ্যে পিছিয়ে থাকা নিরক্ষর জনগােষ্ঠীই বেশি ক্ষতির সম্মুখীন হবে।৫৬ হকের এমন অবস্থানকে মুসলিম। লীগের অনেক বড় বড় নেতা সমর্থন করেছিলেন।৫৭ যাহােক, ১৯২০ সালে কলকাতায় অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের সভায় অসহযােগের বিষয়ে প্রস্তাব এলে ফজলুল হক এর বিরােধিতা করলেও তা সর্বসম্মতিক্রমে পাস হয়। যাতে মহাত্মা গান্ধীর সমর্থন ছিল এবং এতে ক্ষুব্ধ হয়ে ফজলুল হক দল থেকে নিজেই ইস্তফা দেন।
হিন্দু-মুসলিম সকল নেতা মিলে সমগ্র ভারতবর্ষে যে খিলাফত অসহযােগ আন্দোলন গড়ে তােলে তা ক্রমশ ব্যাপকতা পেতে থাকে। কিন্তু ১৯২২ সালের চাউরিচৌরার জনতা কর্তৃক পুলিশ হত্যাকাণ্ড, যাতে ১৮ জন পুলিশ নিহত হন। ঐ ঘটনার পর অহিংস আন্দোলন সহিংস রূপ নেয়ায় মহাত্মা গান্ধী অসহযােগ।
২০
তুলে নেন। এতে করে আন্দোলনটি মাঝপথে এসে দুর্বল হয়ে পড়ে। পরে অবশ্য মুসলিম নেতারা পুনরায় এ আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে যদিও মহাত্মা গান্ধীর ঐ সিদ্ধান্তে তারা হতাশ হয়েছিলেন। খেলাফত আন্দোলনটি মুখ থুবড়ে পড়ে যখন ১৯২৪ সালে তুর্কির জাতীয়তাবাদী জনতার নেতা কামাল আতাতুর্ক নিজেই খলিফার অফিস বা খিলাফত বিলুপ্ত করে গণপ্রজাতন্ত্রী ধারা চালু করেন।

– চার –

খেলাফত আন্দোলনের সাথে যুক্ত হওয়াতে মুসলমানগণ তাদের পরিচিতি এবং ধ্যান-ধারণাকে নতুন করে বুঝতে পেরেছিল। আন্দোলনটি হঠাৎ করে বন্ধ হওয়াতে একটি শূন্যতা তৈরি হয়েছিল যা তখনই পূর্ণ করা যায়নি। এমতবস্থায়, খেলাফত আন্দোলনের ফলে স্তিমিত হয়ে আসা মুসলিম লীগ নতুন করে জেগে উঠতে লাগল এবং নৈতিকতার দিক দিয়ে নেতারা দু’ভাগে ভাগ হয়ে গেল। পাঞ্জাবের স্যার মিয়া মােহাম্মদ শাফীর নেতৃত্বে একটি রক্ষণশীল মুসলিম দল গড়ে উঠল যাদের প্রধান লক্ষ্য ছিল ভারতের সংখ্যালঘু মুসলমানদের স্বার্থসংরক্ষণ ও তাদের এগিয়ে নেয়া। এ দলের কাছে ভারতীয় জাতীয়তাবােধ গ্রহণীয় ছিল না। অন্য একটি দল যাদের নেতৃত্বে এম. এ. জিন্নাহ ছিলেন, তাদের জাতীয়তাবাদী বলা হত। তাঁদের কাছে ভারত, জাতীয়তাবােধ এবং মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার মধ্যে কোন পার্থক্য ছিল না। তারা মনে করতেন ভারতীয় জাতীয়তাবাদের পুরাে কাঠামাের মধ্যেই ভারতের সকল মুসলিম নাগরিকের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধাদি বিদ্যমান রয়েছে। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সমুন্নত করতে এবং নীতিমালার পরিবর্তন করতে ১৯২৭ সালে দিল্লী প্রস্তাব করা হয় যেখানে বিশেষ ক্ষেত্রে দ্বৈত নির্বাচনী ব্যবস্থার নীতিমালা গ্রহণ করা হয়।৫৮
তাঁরা কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়ে শাসনতন্ত্রের খসড়া তৈরিতে একটি দল গঠন করেন যার চেয়ারম্যান ছিলেন মতিলাল নেহেরু। মুসলিম লীগের শাফীর পরবর্তী অনুসারিদের কাছে এ কাজটি ক্ষতিকর মনে হয়েছিল। ১৯২৮ সালের সায়মন কমিশন দ্বারা লীগের এ দু’ গ্রুপের বিদ্বেষের চরম অবস্থান টের পাওয়া গিয়েছিল। একটি শাফী গ্রুপ, যেখানে শাফীর দল পূর্ণমাত্রার সমর্থন দিয়েছিল
২১
কিন্তু জিন্নাহ গ্রুপ তা প্রত্যাখ্যান করেছিল।৫৯ পরবর্তী একত্রিকরণ পদক্ষেপ গ্রহণ করা হলেও তা ব্যর্থ হয়েছিল। লীগের এ বিভক্তি অনেকদিন বিদ্যমান থাকে এবং বিভক্তিতে দলটি বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে, পরে যদিও জিন্নাহ কংগ্রেসের দৃষ্টিতে খারাপ হয়েছিলেন তবুও তিনি তাঁর ১৪ দফা পেশ করেছিলেন।
দলগতভাবে বিভক্ত হয়ে পড়া মুসলিম লীগ স্থানীয় সংগঠনের মধ্যেও প্রভাব ফেলেছিল। ১৯২৮ সালে বাংলায় অনেক মুসলিম নেতা দলটির প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। দলের ঐক্য শক্তিশালী হওয়ার পরিবর্তে তা থেকে ছােট ছােট অনেক দল তৈরি হয় ; যেমন, বেঙ্গল মুসলিম পার্টি, দি সেন্ট্রাল মুসলিম কাউন্সিল পার্টি এবং ইন্ডিপেন্ডেন্ট মুসলিম পার্টি – যাদের মূল লক্ষ্যই ছিল বাংলার স্থানীয় পর্ষদে নিজেদের রাজনৈতিক প্রভাব বিস্তার করা।৬০ মুসলিমদের রাজনীতির এ অবস্থায় ফজলুল হক সন্তুষ্ট ছিলেন না। এর সাথে তিনি মুসলিম লীগের কার্যকলাপে বিরক্তি প্রকাশ করে শুধুমাত্র অল্প কিছু বিষয়ে তাঁদের সাথে যােগাযােগ রাখলেন। তিনি তখন বাংলার বৃহৎ জনগােষ্ঠী কৃষক আন্দোলনে অনেক বেশি মনােনিবেশ করলেন এবং তাঁর নেতৃত্বেই “কৃষক-প্রজা দল” প্রতিষ্ঠা লাভ করে।

তথ্যসূত্রঃ
১. পার্সিভাল স্পিয়ার ঃ “ইন্ডিয়া, পাকিস্তান এন্ড দ্য ওয়েস্ট” (লন্ডন, ১৯৫৮), পৃষ্ঠা ৮১।
২. আই. এইচ. কোরেশী দ্বারা ইন্ডিয়ার অনেক এলাকায় ইসলামের প্রসার সম্পর্কে বর্ণনা এ বইয়ে দেয়া হয়েছে । দি মুসলিম কমিউনিটি অব ইন্দো-পাকিস্তান সাব-কন্টিনেন্ট ৬১০-১৯৪৭ (দি হউগ, ১৯৬২)। কিন্তু তার এ মন্তব্যটি মেনে নেয়া কঠিন, “মিশনারীর কার্যক্রম দ্বারা বিপুল সংখ্যক লােক আস্তে আস্তে ধর্মান্তরিত হয়েছিল।” পৃষ্ঠা ৮৭, এছাড়াও দেখুন এম. মুজিব ও ইন্ডিয়ান মুসলিমস’ (লন্ডন, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ২০-২২।
৩. স্যার থিয়ােডর মরিসন ও মােহামেডান মুভমেন্টস, উদ্ধৃত, স্যার জন কমিং (সংস্করণ), “পলিটিক্যাল ইন্ডিয়া ১৮৩২-১৯৩২ ঃ এ কো-অপারেটিভ সার্ভিস অব এ সেঞ্চুরী” (পুনঃসংস্করণ, দিল্লী ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ৮৬।
৪. চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত দ্বারা যেসব পরিবর্তন এসেছিল তা জেমস ওকিনেয়েলি’র দ্বারা নিমােক্তভাবে বর্ণিত হয়েছেঃ
“ঐ সময়ে যে সকল হিন্দু ছােট-খাট সরকারি চাকরি করতেন তারা পরে জমির মালিক হয়ে স্বতন্ত্রভাবে সম্পদ গােছাতে পেরেছিলেন যা কিনা মুসলিম শাসকদের অধীনে থেকে পারত।”
২২
ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার ঃ দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস (ভারানসি, ১৯৬৭), তৃতীয় সংস্করণ ভচ থেকে পুনঃমুদ্রণ, পৃষ্ঠা ১৫৫।
৫. ঐ, পৃষ্ঠা ১৬২।
৬. ইন্ডিয়াতে এ আন্দোলনটি হয়েছিল সাইয়িদ আহমেদ বেরলভীর নেতৃত্বে যিনি সৈয়দ আহমদ শাহীদ নামেই বেশি পরিচিত। যা ছিল, ওহাবী নেতাদের মতে দারুল হার্ব (কাফেরদের দ্বারা শাসন)-কে রূপান্তরিত করে ইন্ডিয়াতে দারুল ইসলাম (বিশ্বাসীদের দ্বারা শাসন) প্রতিষ্ঠা করা। আরও দেখুন ও কেয়ামুদ্দিন আহমেদ ও “দি ওহাবী মুভমেন্টস ইন ইন্ডিয়া” (কলকাতা, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ৩২৪-৩২৫।
৭. এ বিষয়ে ডব্লিউ. সি, স্মিথ লিখেছেনঃ
“………… বিষয়টি (বিদ্রোহ) ছিল জটিল এবং এর অনেকগুলাে মানদণ্ডের একটি ছিল ইসলামী জিহাদ। ইহা এক সময় অনেক আলীম দ্বারা সুসংগঠিত হয়ে বস্তুত তলােয়ার হাতে প্রকৃত যুদ্ধের রূপ নিয়েছিল যা প্রধানত নিয়মতান্ত্রিক ইসলামী মূল্যবােধের আলােকে মুসলিমদের অংশগ্রহণমূলক আন্দোলন। নৈতিকতা ও আবেগতাড়িত হয়ে তারা বিশেষ দল হিসেবে আন্দোলনে শরীক হয়েছিলেন।”
আর্টিকেলটি ছিল “দি উলেমা ইন ইন্ডিয়ান পলিটিক্স”, সি, এইচ, ফিলিপস (সংস্করণ)।
“পলিটিক্স এন্ড সােসাইটি ইন ইন্ডিয়া” (লন্ডন, ১৯৬৩), পৃষ্ঠা ৫০।
৮. দেখুন ঃ হান্টার, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৬৭।
৯. ইহা স্মরণ রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, যখন সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জী, যিনি আন্দোলন করে সিভিল সার্ভিসে চাকরির বয়স ১৯ থেকে ২১-এ উন্নীত করেছিলেন এবং ইন্ডিয়ার বিভিন্ন পরীক্ষার ক্ষেত্রে দ্রুপ করেছিলেন, ইন্ডিয়ার জনগণের পক্ষে আন্দোলনের জন্য তিনি যখন যাত্রা শুরু করেন তখন স্যার সৈয়দ তাঁকে স্বাগত জানালেন এবং স্মারকে নিজে স্বাক্ষর দিয়ে ইন্ডিয়ার সচিবালয়ে পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু খুব শীঘ্রই বেঙ্গল ন্যাশনাল লীগের আত্মপ্রকাশ ঘটল এবং “স্টার ইন দ্য ওয়েস্ট”-এর মত অনেক পত্রিকাতে বিদ্রোহীদের কথাবার্তা, তাদের প্রতি অমানবিক আচরণের ফিরিস্তি ইত্যাদি প্রকাশ হওয়ায় মানুষের মনে রাজদ্রোহ দানা বেঁধে উঠল আর এতে সবার মাঝে অদম্য উৎসাহের সঞ্চার ঘটল। স্যার সৈয়দ ভাবলেন, বাঙালীদের সাথে নিলে এই অধীরতা যুক্তিযুক্ত কিনা ? কারণ, মুসলিমগণ এমন অসন্তোষকারী হিসেবে চিহ্নিত হােক তা তিনি চাননি। স্যার সৈয়দ-এর কাছে মুসলিমদের অসন্তোষ মানে বিদ্রোহ যার ঝুঁকি নেয়ার জন্য তিনি প্রস্তুত ছিলেন না। দেখুন ঃ এম. নােমান ঃ “মুসলিম ইন্ডিয়া” (এলাহাবাদ, ১৯৪২), পৃষ্ঠা ৫০।
১০. ১৮৯০ সালের নামটি পরিবর্তিত হয়ে মােহামেডান এডুকেশনাল কনফারেন্স হয়েছিল।
১১. সৈয়দ শরীফুদ্দিন পীরজাদা ও ফাউন্ডেশনস অব পাকিস্তান ও অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ডকুমেন্টস” ১৯০৬-১৯৪৭ (করাচি, এন, ডি.), ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ২৩।
২৩
১২. ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক এসােসিয়েশনের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ছিল ঃ
ক. সংসদ সদস্যদের তথ্য প্রকাশ ও তা প্রচারপত্র আকারে বিলি করা। ইংরেজদের কাছে কংগ্রেস দ্বারা যে ভুল তথ্যাদি উপস্থাপন করা হয়েছে এবং যেভাবে দেখানাে হয়েছে যে সকল ব্যক্তি এবং নেতারা কংগ্রেসকে সমর্থন করে তা ভুল হিসেবে সবাইকে জানানাে।
খ. একই উপায়ে সংসদে এবং ব্রিটিশ পত্রিকাতে তুলে ধরা মােহামেডানরা, ইসলামিক আঞ্জুমান এবং হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকেরা কংগ্রেসের আদর্শের সাথে একমত নন।
গ. ইন্ডিয়া এবং ব্রিটিশ রাজত্বের অগ্রগতির স্বার্থে সর্বত্র শান্তি বজায় রাখা এবং লােকদের মধ্যে কংগ্রেস দ্বারা ইংরেজদের বিরুদ্ধে যে খারাপ অনুভূতির জন্ম দিয়েছে তা নিরসন করা । প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৫-১৬।
১৩. প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৭-১৮।
১৪. এম. এস. জেইন ও দি আলীগড় মুভমেন্ট (আগ্রা, ১৯৬৫), পৃষ্ঠা ২১৮।
১৫. লােভাত ফ্রেসার ও ইন্ডিয়া আণ্ডার কার্জন এন্ড আফটার’ (লন্ডন, ১৯১১), পৃষ্ঠা ৩৬৯।
১৬. তদসত্ত্বেও, প্রশাসনিক প্রয়ােজনীয়তা ছাড়াও দেশ ভাগের অন্যান্য আরও অনেক কারণ আছে। বঙ্গভঙ্গের প্রধান কারণ হল, হিন্দুদের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা বিস্তার করে পূর্ববাংলা ও আসামে মুসলিম ও হিন্দুদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব করার সুযােগ সৃষ্টি করা। “জেনেসিস অব দ্যা পার্টিশন অব বেঙ্গল”, পি, সি, চক্রবর্তী, মডার্ন রিভিউ, এপ্রিল ১৯৫৯। এ সম্পর্কে বিশদ জানতে দেখুন ঃ এস, গােপাল ও ব্রিটিশ পলিসি অব ইন্ডিয়া ১৮৫৮-১৯০৫ (লন্ডন, ১৯৬৫) পৃষ্ঠা ২৬৯-২৭১।
১৭. সুফিয়া আহমেদ ঃ “মুসলিম কমিউনিটি ইন বেঙ্গল ১৮৮৪-১৯১২” (ঢাকা, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ২৪৮-৪৯।
১৮. পরে নওয়াব সলিমুল্লাহ ব্রিটিশ সরকারের কাছ থেকে চৌদ্দ লক্ষ রুপি ঋণ নিয়ে তদদ্বারা নিজের ঋণ পরিশােধ করেন। সুপারিশ করতে গিয়ে ভাইসরয় লিখেন, “তাকে (নওয়াবকে) দেউলিয়া হওয়া থেকে রক্ষা করা রাজনৈতিকভাবে খুবই গুরুত্বপূর্ণ, যা না করলে মুসলমান এবং ইন্ডিয়ার জন্য অনেক সমস্যার সম্ভাবনা আছে।” টেলিগ্রাম, ২৯ জুন ১৯০৭, মাধ্যম মিন্টো পেপারস।
১৯. দি স্টেটসম্যান (কলকাতা), ১৮ অক্টোবর ১৯০৫।
২০. “মুসলিম ক্রনিক্যালস” ২১ অক্টোবর ১৯০৫। অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারা হলেন, খান বাহাদুর মােহাম্মদ ইউসুফ, ত্রিপুরার খান বাহাদুর আলী নওয়াব চৌধুরী, সিলেটের মােহাম্মদ আহিয়া, ময়মনসিংহের আবদুল হাই আখতার, বগুড়ার খন্দকার হাফিজুদ্দিন, ধনবাড়ির নওয়াব আলী চৌধুরী ও বরিশালের এ. কে. ফজলুল হক।
২১. “লর্ড মিন্টো এন্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিজম” ও দি সিং (এলাহাবাদ, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা ১৯।
২২. “প্রসিডিংস অব দি টাউন হল প্রটেস্ট মিটিং” । ৭ আগস্ট ১৯০৫, মাধ্যম পি, মুখার্জী, সংস্করণ – “অল এবাউট পার্টিশন” (কলিকাতা ১৯০৬), পৃষ্ঠা ৮৮।
২৪
২৩. “দি বেঙ্গলী ও এন ইনফ্লুয়েন্সিয়াল কংগ্রেস মাউথ পিস”, ২৪ জুন ১৯০৬-এর ইস্যুতে
লেখা ঃ “আমাদের সময়ে আমরা অনেক ভাল লেফটেন্যান্ট গভর্নর পেয়েছি কিন্তু তার মত এত মর্যাদাবান লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কথা আমাদের স্মরণে নেই ….. তিনি তাঁর অফিস কার্য ঠিকমত পালন করতে সব কিছু করেছেন।”
২৪. স্বদেশী বিষয়ের বিরুদ্ধে কিছু কর্মকাণ্ডের জন্য ভারত সরকারের সাথে বনিবনা না হওয়ায় স্যার ব্যামফিল্ড ফুলার ১৯০৬ সালের আগস্ট মাসে ইস্তফা দেন। বিস্তারিত জানতে দেখুন ঃ এস, আর, ওয়াস্তি ঃ “লর্ড মিন্টো এন্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট ১৯০৫-১৯১০” (লন্ডন, ১৯৬৪), পৃষ্ঠা ৩৪-৪৬।
২৫. ইস্টার্ন বেঙ্গল এন্ড আসাম এরা, ১১ আগস্ট ১৯০৬।
২৬. এ. হামিদ ও মুসলিম সেপারিটিজম (লাহাের, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৫৭।
২৭. ইন্ডিয়ান প্যাট্রিয়টিক এসােসিয়েশন এবং মােহামেডান এ্যাংলাে ওরিয়েন্টাল এসােসিয়েশন যথাক্রমে ১৯৮৮ ও ১৮৯৩ সালে স্যার সৈয়দ আহমদ খান দ্বারা প্রতিষ্ঠিত হয়, যার লক্ষ্য ছিল মুসলিমদের স্বার্থ সংরক্ষণ ও কংগ্রেসের মুসলিম বিরােধী নীতির বিরােধিতা যার সমাপ্তি ১৮৯৮ সালে তার মৃত্যুর মাধ্যমে ঘটে।
২৮, সিমলা চুক্তি নিয়ে ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে এখনও সংশয় রয়েছে, আসলেই কি ইহা মুসলিমদের ইচ্ছেতে করা হয়েছিল নাকি ইংরেজদের কারসাজির ফসল। প্রথম অংশে মত দিয়েছেন, শরিফুদ্দিন পীরজাদার ফাউন্ডেশন অব পাকিস্তান অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ডকুমেন্ট (১৯০৬-১৯৪৭), করাচি (এন. ডি.), ভলিউম ১; এস, আর, ওয়াস্তির “লর্ড মিন্টো এন্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনালিস্ট মুভমেন্ট ঃ ১৯০৫-১৯১০” (লন্ডন, ১৯৬৪), এম, এন, দাসের ইন্ডিয়া আন্ডার মুরলী এন্ড মিন্টো ও পলিটিক্স বিহাইও রিভলুশন, রিপ্রেশন এন্ড রিফর্মস (লন্ডন, ১৯৬০), মতিউর রহমানের “ফ্রম কন্সালটেশন টু কন্টেশন ঃ “এ স্ট্যাডি অব দ্য মুসলিম লীগ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান পলিটিক্স ১৯০৬১৯১২” (লন্ডন, ১৯৭০) এবং দ্বিতীয় অংশে মত দিয়েছেন – এ. পাটোয়ারধন ও অশােক মেহতার “দি কমিউনাল ট্রায়াঙ্গেল ইন ইন্ডিয়া” (এলাহাবাদ, ১৯৪২) ; এন, নােমানের “মুসলিম ইন্ডিয়া” (এলাহাবাদ, ১৯৪২), এন, সিং-এর “ল্যান্ড মার্ক ইন ইন্ডিয়ান কনস্টিটিউশন এন্ড ন্যাশনাল ডেভলপমেন্ট” (দিল্লী, ১৯৫০) ; লাল বাহাদুরের “দি মুসলিম লীগ ও ইটস হিস্টরী, এক্টিভিটিস এন্ড এচিভমেন্টস” (আগ্রা, ১৯৫৪) ; রাম গােপালের “ইন্ডিয়ান মুসলিমস ঃ এ পলিটিক্যাল হিস্টরী” (লন্ডন, ১৯৫৯); বি. এম. চৌধুরীর মুসলিম পলিটিকস ইন ইন্ডিয়া (কলকাতা, ১৯৬৫)।
২৯. পীরজাদা, প্রাগুক্ত ১১, পৃষ্ঠা ৩৮।
৩০. ওয়াস্তি, প্রাগুক্ত ২৪, পৃষ্ঠা ৭৭।
৩১. পীরজাদা, প্রাগুক্ত ১১, পৃষ্ঠা ৪৫; আরও দেখুন ও অমৃতবাজার পত্রিকা (কলিকাতা), ১৩ ডিসেম্বর ১৯০৬।
৩২. ঢাকার নবাবের গার্ডেন প্যালেস।
২৫
৩৩. পীরজাদা, প্রাগুক্ত ১১, পৃষ্ঠা ৫০; আরও দেখুন ঃ লাল বাহাদুর ঃ “দি মুসলিম লীগ – ইটস হিস্টরী, একটিভিটিস এন্ড এচিভমেন্ট” (আগ্রা, ১৯৫৪), পৃষ্ঠা ৪৩-৪৫।
৩৪. কে. কে. আজীজ ঃ “দি মেকিং অব পাকিস্তান” – এ স্ট্যাডি ইন ন্যাশনালিজম” (লন্ডন, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৭২। মত
৩৫. ১৯১২ সালের ৩ ফেব্রুয়ারিতে ভাইসরয়ের নিকট উত্থাপিত মুসলমানদের একটি আরজি ছিল এবং বলা হয়েছিল, খুব শিগগিরই ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হবে। কংগ্রেসের অনেক বাধার মধ্যেও ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং তা একটু দেরি হয়েছিল প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কারণে। “এ চ্যাপ্টার ইন দি মুসলিম স্ট্রাগল ফর ফ্রিডম ও এস্টাব্লিসমেন্ট অব ঢাকা ইউনিভার্সিটি” এম, এস, খান, ঢাকা ইউনিভার্সিটি স্ট্যাডিস, ভলিউম ১৬, জুন ১৯৬৮, পার্ট ১, পৃষ্ঠা ৯২।
৩৬. সেপ্টেম্বর ১৯৭৭ সালে বাংলার সরকার এক অধ্যাদেশ জারি করল যাতে বলা হল, “কোন নির্বাচিত মুসলিম প্রার্থী চাকরির ক্ষেত্রে বাদ যাবে না যদিও তার থেকে মেধাবী হিন্দু প্রার্থী থেকে থাকে যতক্ষণ না পর্যন্ত দুই-তৃতীয়াংশ পদ মুসলমান প্রার্থী দ্বারা পূর্ণ হয়” ডিএলও (সংস্করণ) “সাউন্ডিং ইন মডার্ন সাউথ এশিয়ান হিস্টরী” (লন্ডন, ১০৬৮), সংস্করণ ২, পৃষ্ঠা ২০১।
৩৭. বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়াতে মুসলমানদের প্রতিক্রিয়া জানতে আরও দেখুন ঃ মতিউর রহমানের “ফ্রম কন্সাল্টেশন টু কনফ্রন্টেশন ও এ স্টাডি অব দ্য মুসলিম লীগ ইন ব্রিটিশ ইন্ডিয়া পলিটিকস ১৯০৬-১২”, (লন্ডন, ১৯৭০), পৃষ্ঠা ২৩৭-৫০।
৩৮. ঐ, পৃষ্ঠা ২৫৩।
৩৯, ঐ, পৃষ্ঠা ২৪২।
৪০. কালীপদ বিশ্বাস ঃ “যুক্ত বাংলার শেষ অধ্যায়”, (কলকাতা, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ১৯।
৪১. খন্দকার আবদুল খালেকের “এক শতাব্দী” (ঢাকা, ১৯৬২), পৃষ্ঠা ৬৬; আরও দেখুন ঃ এ. এস, এম, আবদুর রবের ‘এ. কে. ফজলুল হক ও লাইফ এন্ড এচিভমেন্ট
(লাহাের, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ১৭।
৪২. বাংলার আইন পর্ষদে ১৯১৩ সালের ৪ এপ্রিল এ. কে. ফজলুল হকের বক্তৃতা, মাধ্যম বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল প্রসিডিং, ভলিউম ৪৫, পৃষ্ঠা ৫৯৫-৯৬।
৪৩. সেরাজুল ইসলাম ও “ফজলুল হক স্পিকস ইন কাউন্সিল” (ঢাকা, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা ২।
৪৪. দিল্লীতে ১৯১০ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় রিসিপসন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে হাকিম আজমল খানের বক্তৃতা ; সূত্র ঃ পীরজাদা প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯০।
৪৫. রহমান, এন – ৩৭, পৃষ্ঠা ২৫৩।
৪৬. জি. এলানা সংস্করণ “পাকিস্তান মুভমেন্ট ও হিস্টরিক ডকুমেন্টস” (করাচি) এনডি, এ পৃষ্ঠা ২৪-২৫।
৪৭. জে. এইচ. ক্ৰমফিল্ডের “এলিট কনফ্লিক্ট ইন এ পুরাল সােসাইটি ও টুয়েনটিথ সেঞ্চুরী বেঙ্গল” (বার্কলি এন্ড লস এঞ্জেলস, ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ১১৬।
২৬
৪৮. ঐ, পৃষ্ঠা ১২৬।
৪৯. ঐ, পৃষ্ঠা ১২৭।
৫০. খালেক, এন – ৪১, পৃষ্ঠা ৮৫।
৫১. ইন্ডিয়ান রিভিউ, জানুয়ারি ১৯১৯, পৃষ্ঠা ৪৩।
৫২. “এ হিস্টরী অব দ্য ফ্রিডম মুভমেন্ট” (করাচি, ১৯৬২), ভলিউম ৩, পার্ট ১, পৃষ্ঠা ২১৬।
৫৩. রব, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫১।
৫৪. ঐ, পৃষ্ঠা ৫২।
৫৫. পেন্ডেরাল মুন ঃ “গান্ধী এন্ড মডার্ন ইন্ডিয়া” (লন্ডন, ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ৯৯।
৫৬. মােঃ আবদুল খালেক “শের-এ-বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক” (ঢাকা, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা ১৬৬; আরও দেখুন ঃ এম. এ. রহিম “মুসলিম সােসাইটি এন্ড পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ১৯৫৭-১৯৪৭” (ঢাকা, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ২৩২।
৫৭. এম. এ. জিন্নাহ এবং স্যার মােহাম্মদ শাফীও অসহযােগ আন্দোলনের বিরােধিতা করেছিলেন।
৫৮. যৌথ নির্বাচনী ব্যবস্থাকে নিমবর্ণিত শর্তাধীনে মুসলিম লীগ গ্রহণ করেছিলঃ
ক. সিন্ধুকে আলাদা প্রদেশ হিসেবে মর্যাদা দিতে হবে।
খ. এনডব্লিউএফপি এবং বেলুচিস্তানকে প্রদেশের সমান ধরতে হবে।
গ. বেঙ্গল ও পাঞ্জাবে জনসংখ্যার আনুপাতিক হারে সেখানে প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।
ঘ. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে মুসলমানদের এক-তৃতীয়াংশ প্রতিনিধিত্ব থাকতে হবে।
৫৯. এস. আর. মেহরােত্রা ঃ “ইন্ডিয়া এন্ড দি কমনওয়েলথ ১৮৮৫-১৯২৯” (লন্ডন,
১৯৬৫), পৃষ্ঠা ২০০।
৬০. বজলুর রহমান খান “পলিটিক্স এন্ড বেঙ্গল ১৯২৯-১৯৩৬” (ঢাকা, ১৯৮৭), পৃষ্ঠা
১৯।
২৭
তৃতীয় অধ্যায়
কৃষক-প্রজা পার্টি গঠন ও
ফজলুল হকের সাথে মুসলিম লিগের দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঃ ১৯২৯ – ৩৬

১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের জন্ম হলেও কিন্তু দেখা যায়, ১৯৪০ সালের পূর্ব পর্যন্ত বাংলায় মুসলমানদের এ দলটি সুসংগঠিত হতে পারেনি। মুসলিম লীগের অন্যতম নেতা ছিলেন ঢাকার নওয়াব খাজা সলিমুল্লাহ, যার মূল লক্ষ্য ছিল কিভাবে সকল মুসলমানকে একত্র করে, নিজেদের দাবি আদায় করা যায় ও বঙ্গভঙ্গ দাবি আদায়ে সকলের সমর্থন লাভ করা যায় । প্রতিষ্ঠাকালে লীগ যে সংকল্প গ্রহণ করে তাহল ঃ
“বঙ্গভঙ্গ হলে মুসলমানরা অবশ্যই লাভবান হবে যেহেতু তারা পূর্ববাংলার জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ। বাংলা ভাগের বিপক্ষে যত ধরনের অসন্তোষ আছে সেগুলাে পরিহার করতে হবে এবং নিরুৎসাহিত করতে হবে।”১
বাংলার হিন্দুদের অসন্তোষের ফলে ১৯১১ সালে যখন বঙ্গভঙ্গ রহিত করা হয় তখন নওয়াব সলিমুল্লাহর স্বপ্ন শেষ হয়ে গেল এবং তিনি এ দুঃখ নিয়েই পরলােকগমন (১৯১৫) করেন। ১৯০৫ থেকে ১৯১১ সাল এ সময়টায় বাংলার উপর দিয়ে চরম রাজনৈতিক ঝড় বয়ে গিয়েছিল যদিও সে ঝড়ের প্রভাব সামান্য কিছু জনগণকে স্পর্শ করতে পেরেছিল। বিভিন্ন প্রতিবাদ, সভা, মিছিল ইত্যাদি যা কিছু কংগ্রেস করেছিল তার সিংহভাগই ছিল শহরকেন্দ্রিক। মুসলিম লীগের মত না গিয়ে কংগ্রেস গ্রাম পর্যায়ে তাদের সংযােগ স্থাপন করেছিল। এতে শুধু বাংলার গ্রাম এলাকায় হিন্দু শিক্ষিত লােকই বেশি ছিল বিষয়টি এমন নয়, মূলত গ্রাম এলাকায় প্রাদেশিক কংগ্রেসের বড় বড় নেতাও এতে ছিলেন। অন্যদিকে
২৮
বাংলায় লীগের নেতা হিসেবে হাতেগােনা কয়েকজন নাইট উপাধিপ্রাপ্ত অভিজাত নেতা ছিলেন। যেমন, নওয়াব ও জমিদার, ভূ-স্বামী। অধিক বিত্তশালী হওয়াতে এবং প্রদেশের আসন সংখ্যা কম হওয়াতে এ অভিজাতশ্রেণির কাছে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রদান করা হত। আর ক্ষমতাবলে তারা নিজেদের মত করে মুসলমানদের রাজনৈতিক গতিবিধি সাজাতেন। এ সকল নেতা গ্রামের বিপুল জনগােষ্ঠীর সাথে কখনও যােগাযােগ রাখতেন না। কারণ, ঐ সকল জনগণের ভােটাধিকার ছিল না। মুসলিম লীগের সদস্য হয়েও কিছু কিছু নেতা কলকাতার সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশনের১ সাথে যুক্ত ছিলেন এবং তাঁরা কখনও মুসলিম লীগকে বাংলার মুসলমানদের রাজনৈতিক মুখপাত্র বানানােরও চেষ্টা করেননি।
শিক্ষা প্রসার এবং কিছু উদার প্রগতিশীল মনের যুবকদের উত্থানে আস্তেধীরে হলেও বাংলার মুসলমানদের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পাচ্ছিল। ফলে গতানুগতিক আভিজাত্যমণ্ডিত নেতার বদলে ভিন্ন বৈশিষ্ট্যের নেতার আবির্ভাবের পরিস্থিতি তৈরি হল। ১৯১৩ সালে বাংলার আইন পরিষদের যে সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন এ. কে. ফজলুল হক, তার মধ্যে এমনই একজনের নেতা হওয়ার সম্ভাবনা দেখা গেল। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হওয়ায়, গ্রাম্য এলাকায় শিক্ষাজীবন ও ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে দায়িত্ব পালন করায় ফজলুল হক গ্রাম সম্পর্কে খুব ভাল জানতেন এবং অভিজাত মুসলিম নেতাদের থেকেও তার জ্ঞান অনেক বিস্তৃত ছিল। তিনি অনুধাবন করতে পেরেছিলেন, বাংলার মুসলমানদের এগিয়ে নিতে গেলে সর্বপ্রথম গ্রামের কৃষক-চাষিদের বিশেষত অবহেলিত মুসলিম কৃষকদের অবস্থার উন্নতি ঘটাতে হবে। এজন্য তিনি তার রাজনৈতিক জীবনের শুরুতে কৃষকদের দাবি-দাওয়ার কথা তুললেন। ১৯১৩ সালের নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি জানালেন, তিনি কৃষক, শ্রমিক এবং বিপুল জনগােষ্ঠীর প্রতিনিধি আর তাদের কল্যাণেই তাঁর সংগ্রাম। ফজলুল হক নিজেকে একজন কৃষক বলে দাবি করে বাংলার কৃষকদের অধিকার সংরক্ষণে বিশেষ কর্মসূচি হাতে নিলেন।৩
বাংলার কিছু কিছু জায়গায় প্রজা-আন্দোলন হওয়ার কারণ হল, প্রজারা জমিদারদের শােষনের বিপক্ষে গিয়ে নিজেদের ভাগ্যের পরিবর্তনে সচেতনতা অর্জন করতে পেরেছিল এবং অনেকে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা আন্দোলনের
২৯
দ্বারা অনুপ্রাণিতও হয়েছিল। ১৯১৪ সালের গােড়ার দিকে হকের কর্মকাণ্ড দেখে জামালপুরের খােশ মােহাম্মদ সরকার তৎকালীন ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর কামারচরে কৃষকদের নিয়ে একটি সভা করার উদ্যোগ নিলেন। তিনি ফজলুল হকসহ একই ভাবধারার বাংলার মুসলিম নেতা যেমন আবুল কাশেম, খান বাহাদুর আলীমুজ্জামান চৌধুরী, রাজীবউদ্দিন তরফদার, মাওলানা আকরম খাঁ এবং মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদীকে উক্ত সভায় আমন্ত্রণ করলেন। সভায় এ. কে. ফজলুল হক সভাপতিত্ব করেন এবং ভাষণে সকলকে ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নিজেদের ভাগ্য পরিবর্তনে একত্রে কাজ করার আহ্বান জানান।৫ সভা ফলপ্রসূ ছিল এবং তাতে যেসব সিদ্ধান্ত হয় তার মধ্যে অন্যতম ছিল, ‘আবওয়াব’ উচ্ছেদের মাধ্যমে জমিদারদের কাছ থেকে সুবিধা পাওয়া।৬
এ সময় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠলে কৃষকদের নিয়ে সভাসমাবেশ করার ক্ষেত্রে অনেক বাধা-বিপত্তি তৈরি হয়। ফলে কৃষকদের আন্দোলনকে তেমন করে সুসংগঠিত করা যায়নি। ওদিকে কামারচরের কৃষক আন্দোলনের জোয়ার ফজলুল হকের নিজ জেলা বাকেরগঞ্জের লােকদের মধ্যে উৎসাহের সৃষ্টি করে।
১৯১৫ সালে এ. কে. ফজলুল হক তাঁর জেলায় কৃষকদের নিয়ে বেশ কয়েকটি সভা করেন এবং মুসলিম ও হিন্দুদের কয়েকটি গােষ্ঠীকে একত্র করার চেষ্টা করেন।৭ কিন্তু কামারচরের সভার মত এর ছোঁয়া মােটেই লাগল না।৮ এছাড়া তখন বাকেরগঞ্জের যােগাযােগ ব্যবস্থা বেশ অনুন্নত ছিল। সেখানে কোন রেলপথ নেই এবং ঢাকা থেকে স্টিমারে করে বাকেরগঞ্জ যেতে প্রায় এক সপ্তাহ সময় লাগত । তাই সমগ্র বাংলার আদলে এ সমাবেশগুলাে সম্পন্ন করা সম্ভব ছিল না।
এমতবস্থায় পল্লী এলাকার খোঁজ-খবর রাখেন এমন কয়েকজন উকিল ও সাংবাদিককে সাথে নিয়ে ফজলুল হক ১৯১৭ সালের ডিসেম্বরে ক্যালকাটা এগ্রিকালচারাল এসােসিয়েশন’ প্রতিষ্ঠা করেন।৯ এর কয়েক বছর পরই বাংলায় ‘জোতদার’ এবং ‘রায়ত’ নামক গােষ্ঠীর আবির্ভাব হয়।১০ এ সংগঠনগুলাে বস্তুত কৃষকদের কোন সংগঠন না এবং এগুলাে তাৎক্ষণিকভাবে কোন গুরুত্ব বহন না। করলেও পরবর্তীকালে কৃষক সংগঠনের অগ্রদূত হিসেবে কাজ করে।
৩০
১৯২১ সালে ফজলুল হকের অনুপ্রেরণায় বাকেরগঞ্জ জেলার গৌরনদী থানার আগৈলঝড়া গ্রামে ‘প্রজা সম্মেলন করা হয়। এ সম্মেলনে বহু মুসলিম কৃষক ও দলিত হিন্দুগােষ্ঠীর অনেক কৃষক উপস্থিত হয়।১১ স্থানীয় প্রভাবশালী কৃষক নেতা খান বাহাদুর হাসেম আলী খানের সভাপতিত্বে ঐ সভায় হিন্দুমুসলিম অনেক কৃষক বক্তৃতা করেন। এরপর এদেশের অনেক জেলায় ঐ আন্দোলন ক্রমান্বয়ে ছড়িয়ে পড়ে। হক সাহেব বিভিন্ন জেলায় প্রজা আন্দোলনের জন্য ভ্রমণ করেন এবং এতে করে গ্রামের বিপুল জনগােষ্ঠী তাঁর সংস্পর্শে আসে। এ সময়ে জমিদার এবং মহাজনদের (ঋণদাতা) অত্যাচারের বর্ণনা দিয়ে অনেক জেলাতে প্রচারপত্র বিলি করা হয়।১৩ এ প্রচারপত্র বিলি হওয়ায় জমিদার এবং মহাজনদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বহু কৃষক ধারণা পেতে থাকে যা প্রজা আন্দোলনকে পরবর্তীতে আরও বেগবান করে তােলে। বাংলার বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম এবং উদীয়মান কমিউনিস্ট নেতা মুজাফফর আহমেদকে সাথে নিয়ে ফজলুল হক ১৯২০ সালে নবযুগ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন।১৪ কৃষক শ্রমিকদের খবরে উপজীব্য থাকায় এ পত্রিকাটি অন্যান্য পত্রিকা। থেকে আলাদা ছিল। পরে পত্রিকাটি কৃষক-প্রজা পার্টির মুখপত্রের ভূমিকা পালন করে।১৫
১৯২৬ সালে প্রজা আন্দোলনের সক্রিয় রূপ প্রদর্শিত হয়, যখন ঢাকার মানিকগঞ্জে কৃষক-প্রজা দল স্থানীয় জমিদার-মহাজনদের বিরুদ্ধে বন্ধকী জমি নিয়ে সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। কৃষক-প্রজার অধিকার আদায়ে স্থানীয় প্রজাদের নেতা আবদুল লতিফ বিশ্বাস এবং অন্য নেতারা একত্রিত হয়ে দীর্ঘ পরিসরে প্রজা সম্মেলনের আয়ােজন করেন। যেখানে ঢাকা সদর, পাবনা, টাঙ্গাইল ও অন্যান্য অঞ্চলের প্রজাদের প্রতিনিধিরা যােগ দেন।১৬ ফজলুল হক এ সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন এবং উদ্বোধনী ভাষণে তিনি কৃষকদের অধিকার আদায়ের পক্ষে নিম্নরূপ ঘােষণা দেনঃ
আমি সুযােগ পেলে, আল্লাহর রহমতে আপনাদের অধিকার আদায় করতে – সক্ষম হব – যাতে করে আপনারা নিজেদের ইচ্ছেমত আপনাদের আওতাধীন ভূমিতে বাড়ি ও পুকুর তৈরি করতে পারেন, আপনাদের
৩১
ছেলেমেয়েদের বিয়ে-শাদী দিতে পারেন, আর অবৈধ বকেয়া থেকে মুক্ত য় হতে পারেন। আমি ক্ষতিকর সুদ ব্যবস্থা উচ্ছেদ করে আপনাদের বন্ধকী জমি মুক্ত করব।১৭
জমিদারের অত্যাচার থেকে মুক্তি পেতে তিনি তাৎক্ষণিকভাবে প্রজাদের নির্দেশ দিলেন তারা যেন জামিদারদের সহযােগিতা না করে এবং তাদের জমিতে চাষাবাদ বন্ধ করে দেয়। জমিদাররা যখন জমি নিয়েছেন তখন তাতে তাদেরকেই চাষাবাদ, বীজ বােনা, ফসল ফলানাে ইত্যাদি কাজ করতে দেন।১৮ তদনুসারে কৃষকরা জমিদারদের অধীনে থাকা জমির চাষাবাদ বন্ধ করে দিল। আন্দোলনটি এক বছর চলার পর জমিদাররা কৃষকদের সাথে সমঝােতায় এল এবং তাদের জমি ফিরিয়ে দিল।১৯ এ আন্দোলন সফল হওয়ায় তা শ্রমিকদের মধ্যে উৎসাহ দেখা দেয়। এরপর প্রদেশে অনেকগুলাে জেলায় কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক ঐ সভাগুলােতে প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয়বার সভাপতিত্ব করেন যা পর্যায়ক্রমে কলকাতা, কুষ্টিয়া এবং ময়মনসিংহে অনুষ্ঠিত হয়েছিল।২০
এদিকে অসহযােগ আন্দোলন বাদ হওয়ায় খেলাফত আন্দোলন ও যখন থেমে গেল তখন সমগ্র ভারত জুড়ে হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক চরম আকার ধারণ করে।২১ বাংলাতে অবশ্য এ সম্পর্ক বেশ ভালই ছিল। কারণ, চিত্তরঞ্জন দাসের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব — যিনি হিন্দু-মুসলমান সকলের কাছে সম্মানের পাত্র ছিলেন। ১৯২৩ সালের শেষ ভাগে সি আর দাস মুসলিম নেতাদের সাথে একটি চুক্তিতে আবদ্ধ হলেন২২ যা ছিল, “বেঙ্গল প্যাক্ট” নামে পরিচিত। এ প্যাক্টের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের বৈষম্য হ্রাস করা এবং চিরতরে তাদের মধ্যকার ভেদাভেদ ঘুচিয়ে দেয়া।২৩
সি আর দাসের অকাল মৃত্যুতে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি অবশ্য বেশিদিন স্থায়ী হল না। বেঙ্গল প্যাক্টটি অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস বাতিল করে দেয় এবং বাংলার হিন্দু পরিচালিত রক্ষণশীল কিছু পত্রিকা একে “গাে-হত্যা”-র সমতুল্য আখ্যা দিয়ে এর বিপক্ষে বিপুল প্রচারণা চালায়।২৪ সি আর দাসের অকাল মৃত্যুর পর ১৯২৫ সালে কংগ্রেসের মধ্যে নেতৃত্ব নিয়ে ফাটল ধরায় সেখানে আর কোন নেতা পাওয়া গেল না যা কি-না সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্প্রীতি বজায় রাখতে বেঙ্গল
৩২
প্যাক্টের প্রয়ােজনীয়তার বিষয়টি তুলে ধরতে পারতেন।২৫ পরিশেষে ১৯২৬ সালে কলকাতায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা চরমভাবে ছড়িয়ে পড়ে এবং চুক্তির বিরুদ্ধে অবস্থানকারী হিন্দু নেতারা ১৯২৬ সালের ২৬ মে কৃষ্ণনগরে কংগ্রেসের প্রাদেশিক সভায় বেঙ্গল প্যাক্ট সম্পূর্ণ বাতিল করে দেয়।২৬ ১৯২৮ সালে বাংলা টেন্যান্সি সংশােধনী আইন পাস হওয়ার সময়ে দুই সম্প্রদায়ের মারামারি ছিল
সেলামী প্রদানের প্রশ্নে কংগ্রেসের ভেতরকার বা কংগ্রেসের বাইরের সকল হিন্দু সদস্য এর পক্ষে ভােট দিল আর কিছু হিন্দু জমিদারসহ সকল মুসলিম সদস্য এর বিপক্ষে ভােট দিল।২৭ হিন্দু কংগ্রেস সদস্যদের এমন আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিম কংগ্রেস সদস্য যেমন মাওলানা আকরম খাঁ এবং তমিজুদ্দিন খান দল ত্যাগ করেন এবং প্রজা আন্দোলনে ফিরে আসেন। ১৯২৮ সালের প্রজাস্বত্ব সংশােধনী অধিবেশনে মুসলিম সদস্যরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেন তাতে তারা নিজেদের স্বার্থের জন্য একটি নতুন সংগঠন তৈরি করার কথা ভাবলেন। এভাবে ১৯২৯ সালের শুরুতে প্রাদেশিক নির্বাচনে মুসলমানদের যে ২৭ জন সদস্য নির্বাচিত হলেন তারা সকলে একত্রিত হয়ে ১৯২৯ সালের ১ জুলাই কলকাতায় একটি সভা করলেন এবং সকল মুসলমানকে একত্র করে নিজেদের স্বার্থ সংরক্ষণের লক্ষ্যে “বেঙ্গল মুসলিম কাউন্সিল এসােসিয়েশন” নামীয় একটি দল গঠন করার সিদ্ধান্ত নিলেন।২৮ ঐ সময়েই এসােসিয়েশনের ২৮ জন সদস্যের একটি দলকে নিয়ে “বেঙ্গল কাউন্সিল প্রজা পার্টি” গঠন করা হয় যাদের মূল লক্ষ্য ছিল, কৃষি কাজের সাথে জড়িত সকলের আকাঙ্ক্ষা ও জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করা।২৯ কাউন্সিলে ঐ প্রজা পার্টির কার্যত উদ্বোধন হয়, ১৯২৯ সালের ৪ জুলাই।”৩০
এ. কে. ফজলুল হক ছিলেন এর সর্বোচ্চ নেতা। ফরিদপুরের তমিজউদ্দিন খান ছিলেন এর সেক্রেটারি এবং নড়িয়ার খান বাহাদুর আজিজুল হক ও ময়মনসিংহ উত্তরের শাহ আবদুল হামিদ ছিলেন এর জয়েন্ট সেক্রেটারি ।
৩৩
কাউন্সিলে প্রজা পার্টি গঠন হওয়ার পরপরই “নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি” নামে প্রজাদের একটি বড় দল কলকাতায় গঠন করা হয়।৩১ স্যার আবদুর রহিম প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন সংগঠনের। পাঁচ জন ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তারা হলেন, এ. কে. ফজলুল হক, ডা. আবদুল্লাহ শহীদ সােহরাওয়ার্দী, খান বাহাদুর আবদুল মােমেন, আবদুল করিম এবং মজিবর রহমান। সেক্রেটারি ছিলেন মাওলানা আকরম খাঁ। আর দলটিতে দু’জন ছিলেন জয়েন্ট সেক্রেটারি একজন ছিলেন শামসুদ্দিন আহমেদ ও দ্বিতীয়জন ছিলেন তমিজদ্দিন খান। সমিতির নামে পরে প্রতি জেলায় এর অনেক শাখা-প্রশাখা গড়ে ওঠে। জমি বর্গা ও ঋণ নেয়া সম্পর্কে বৃহৎ কৃষক জনগােষ্ঠীর উন্নতি বিধানই ছিল এ সকল কৃষক সংগঠনের লক্ষ্য।৩২ জেলা পর্যায়ে কিছু উন্নত ধরনের প্রজা সমিতির দফতর গড়ে উঠেছিল ; যেমন, ময়মনসিংহ জেলা প্রজা সমিতি, যাদের নিজস্ব প্রেস ছিল এবং সেখান থেকে বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা “চাষী” প্রকাশ করা হত।
১৯৩০ সালে বাংলায় প্রজা আন্দোলনের মাত্রা আরও বেগবান হয়। শস্যের দাম পড়ে যাওয়ায় বিশেষত কাঁচা পাট ও ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়াতে পল্লী অধ্যুষিত জেলাগুলােতে নগদ অর্থের অভাব দেখা দেয়। এতে করে অর্থনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়।৩৪ এর ফলে চাষাবাদকারী প্রজা ও তাদের বর্গাদারদের মধ্যে চরম বৈরীভাব দেখা দেয়।৩৫ এমন পরিস্থিতিতে বর্গাদারদের বিরুদ্ধে প্রচারণা এবং প্রজাদের অতি উৎসাহ – প্রজা সমিতির বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল।
১৯৩২ সালে কৃষকদের স্বার্থরক্ষার আন্দোলনকে আরও গতিশীল করার লক্ষ্যে নিখিল বাংলা প্রজা সমিতি জেলা পর্যায়ের সকল প্রান্তিক সমিতিকে নির্দেশ। দেয় তারা যেন মূল সমিতিতে বৈধভাবে অন্তর্ভুক্ত হয়।৩৬ নির্দেশ মত শুধুমাত্র ত্রিপুরা কৃষক সমিতি ছাড়া সবাই অন্তর্ভুক্ত হয়। এভাবে সকল জেলায় শাখা সমিতির বিস্তার ঘটিয়ে নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত হয়।
৩৪
১৯৩৪ সালে আবদুর রহিম কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের স্পিকার মনােনীত হওয়ায় লিখিলবঙ্গ প্রজা সমিতির প্রেসিডেন্ট পদ থেকে সরে যান। এর ফলে প্রেসিডেন্টের পদ প্রাপ্তি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। বর্ধমানের খান বাহাদুর আবদুল মােমেন ও এ. কে. ফজলুল হক উভয়ই এ পদে বসার উপযুক্ত ছিলেন। এ বিষয়ে এলাকাভিত্তিক সদস্যরা দ্বিধাবিভক্ত হয়ে গেলেন — ফজলুল হক নিজে পূর্ববাংলার হওয়াতে পূর্ববাংলার সদস্যরা তাকে চাইলেন আর যারা পশ্চিম বাংলার তারা বিশেষ করে মাওলানা আব্বাস খান, খান বাহাদুর আবদুল মােমেনকে সমর্থন দিলেন। সমিতিতে হকপন্থীরা সবাই প্রগতিশীল যুবক অন্যদিকে মােমেনের সমর্থনকারীরা বেশির ভাগ বয়ঃবৃদ্ধ-রক্ষণশীল।৩৯ দু পক্ষই ভােটের ফলাফল সম্পর্কে নিশ্চিত হতে না পেরে স্যার আবদুর রহিমকে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে মেনে নিলেন। তিনি খান বাহাদুর আবদুল মােমেনকে প্রেসিডেন্ট হিসেবে বেছে নিলেন।৪০ আবদুর রহিম যেভাবেই বাছাই করুক না কেন হকের অনুসারীরা ফলাফল হিসেবে মােমেনকে প্রেসিডেন্ট মেনে নিলেন।৪১
হকপন্থী ও মােমেনপন্থীদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব চরমে পৌছাল ১৯৩৫ সালে ময়মনসিংহে আয়ােজিত নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির বার্ষিক সাধারণ সভা শুরুর প্রাক্কালে। ১৯৩৪ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আবদুল মােমেনকে সমর্থনকারী মাওলানা আকরম খাঁসহ পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিরা চাইলেন মােমেন যেন উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন। ওদিকে হকের শক্ত ঘাঁটি ময়মনসিংহ হওয়ায়, পূর্বেকার সভায় ফজলুল হক সভাপতির ভাষণ দেয়া সত্ত্বেও সে বছর ১৯৩৫ সালে ফজলুল হককেই সভাপতির আসনে বসানাে হয়েছিল।৪২ প্রাদেশিক কমিটির সেক্রেটারি মাওলানা আকরম খাঁ তাঁর ক্ষমতাবলে সভাটি বাতিল করে দেন।৪৩ কিন্তু হকপন্থীরা বেশ শক্তিশালী হওয়ায় হককে সভাপতি করে কার্যপ্রণালী মােতাবেক সভা সম্পন্ন করে। এরপরই মাওলানা আকরম খাঁসহ তাঁর অনুসারিদের সমিতি থেকে বাদ দেয়া হয়। ১৯৩৬ সালে অনুষ্ঠিত সমিতির পরবর্তী বার্ষিক সভায় হকপন্থীরা সংগঠনটির নাম “নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতির বদলে “কৃষক-প্রজা পার্টি” নামকরণ করে৪৫ কৃষকসহ বিপুল জনগােষ্ঠীর জন্য দলটি যাত্রা শুরু করে। একই বছর সেপ্টেম্বরে, দলটি তাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ঘােষণা করে যা মূলত কৃষি সমস্যা বিষয়ক।৪৬ কৃষক-প্রজা পার্টির অন্তর্দ্বন্দ্ব
৩৫
নিঃসন্দেহে দলটিকে বেশ দুর্বল করে দিয়েছিল যদিও ১৯৩০-এর সময়ে এ দলটি মুসলিম অধ্যুষিত বাংলায় সবচেয়ে জনপ্রিয় দল ছিল।৪৭ ১৯৩৫ সালে ভারত সরকার আইন করে ভােটাধিকার প্রয়ােগের যােগ্যতা শিথিল করে এবং বিপুল সংখ্যক কৃষক ও প্রজা এর আওতায় চলে গেল।৪৮ এতে করে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে অভিজাত মুসলিমশ্রেণী চিন্তিত হয়ে পড়লেন। এই মুসলিম অভিজাতগণ বুঝতে পেরেছিলেন, গ্রামের বিপুল ভােটারদের ভােট তারা পাবেন না । কারণ তাদের রাজনীতির সঙ্গে প্রান্তিক পর্যায়ের কৃষক-প্রজার সম্পর্ক গড়ে উঠেনি। এছাড়াও অভিজাত মুসলমান রাজনীতিবদগণ আরও দুশ্চিন্তাতে ছিলেন এ কারণে যে, ফজলুল হকের জনপ্রিয়তা এবং পার্টিতেও ছিল তার ব্যাপক প্রভাব। তারা ভাবলেন এখনই ফজলুল হক ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে একটি বিকল্প ধারা গড়ে তোলা দরকার। সে প্রেক্ষাপটে ১৯৩৬ সালে ফজলুল হক বিরােধী অভিজাত মুসলমান উপদলটি নতুন রাজনৈতিক “ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি” গঠন করলেন। এর পরপরই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের কিছু পূর্বে “ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি” জিন্নাহর মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত হয়ে যায় এবং ফজলুল হক ও তাঁর দলের বিপরীতে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। বাংলার রাজনীতিতে এভাবেই ফজলুল হকের সঙ্গে লীগের দ্বন্ধের সূচনা হয়।

তথ্যসূত্র ঃ
১. সৈয়দ শরীফুদ্দিন পীরজাদা “ফাউন্ডেশন অব পাকিস্তান ঃ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ডকুমেন্ট ১৯০৬ – ৪৭” করাচি, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ১২।
২. কলকাতায় ১৮৭৭ সালে সৈয়দ আমীর আলী সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশন প্রতিষ্ঠা করেন। এর নীতিসমূহের মধ্যে বলা ছিলঃ
ইন্ডিয়ার মুসলমানদের সংবিধানিক অধিকার আদায় করাই হল এ সংগঠনের মূল লক্ষ্য। এটি ব্রিটিশদের রাজত্বের প্রতি সঠিক আনুগত্য করার প্রত্যয়ে প্রতিষ্ঠিত। এরা সময়ের সাথে পশ্চিমা সংস্কৃতির সাথে তাল মিলিয়ে চলবে। মুসলমানদের সঠিক ও ন্যায্য চাহিদাগুলাে সরকারের কাছে তুলে ধরার মাধ্যমে তাদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটাবে। এছাড়াও এর লক্ষ্য হল, জনগণের চাহিদা পূরণ ।
দেখুন ঃ বি. বি. মজুমদার “ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল এসােসিয়েশন এন্ড রিফর্ম অব লেজিসলেচার ১৮১৮ – ১৯১৭’ (কলকাতা, ১৯৬৫); পৃষ্ঠা ২২১।
৩৬
৩. এ. এস. এম. আবদুর রব ঃ “এ. কে. ফজলুল হক ও লাইফ এন্ড এচিভমেন্টস (লাহাের, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ২৮ – ৩০। আরও দেখুন ঃ এম. এ. রহিম ঃ “মুসলিম সােসাইটি এন্ড পলিটিকস ইন বেঙ্গল ১৭৫৭ – ১৯৪৭” (ঢাকা, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ২৪৩।
৪. আবুল মনসুর আহমদ ; “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” (ঢাকা, ১৯৭৫), সংস্করণ ৩, পৃষ্ঠা ২৩ – ২৪।
৫. আবদুল খালেক (সংস্করণ) “শের-এ-বাংলা এ. কে. ফজলুল হক” (ঢাকা, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ২৯৮।
৬. ঐ
৭. বি. ডি. হাবীবুল্লাহ ও “শের-এ-বাংলা” (ঢাকা, ১৯৬৩), পৃষ্ঠা ৩০ – ৩১।
৮. ঐ, পৃষ্ঠা ৩৬।
৯. মসিক মােসলেম হিতৈষী, ২১ ডিসেম্বর ১৯১৭।
১০. হুমায়রা মােমেন ও মুসলিম পলিটিকস ইন বেঙ্গল ও এ স্ট্যাডি অব দ্য কৃষক-প্রজা | পার্টি এণ্ড দ্য ইলেকশন অব ১৯৩৭” (ঢাকা, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ৩৭।
১১. বি. ডি. হাবীবুল্লাহ, প্রাগুক্ত ৭, পৃষ্ঠা ৩১। হকের পাশাপাশি, মুসলিম প্রজা পার্টির অন্যান্য স্থানীয় নেতারা যেমন খান বাহাদুর হাশেম আলী খান, হাশেম তালুকদার, মজিদ কাজী এবং খাদেম আলী মৃধাও সভায় বক্তৃতা করেন। হিন্দু নেতাদের মধ্যে বাণীকান্ত সেন, দ্বিজেন ঠিকাদার, ললিত কুমার বল ও জগেন্দ্রনাথ মদাল বক্তৃতা করেন।
১২. ঐ, পৃষ্ঠা ৩৩ – ৩৫।
রাজেশ্বর রায় চৌধুরী বরিশালের কৈলাসকাঠীর একজন প্রভাবশালী জমিদার ছিলেন। একই জেলার বাগদিয়া গ্রামের মুন্সী মােহাম্মদ ইয়াসিন হাওলাদার তার অধীনস্থ একজন কর্মচারী ছিলেন যদিও তাদের মধ্যে সম্পর্ক ভাল ছিল না। মুন্সী মােহাম্মদ ইয়াসিন হাওলাদার বাংলায় একটি ছােট বই লেখেন যার নাম “জমিদারের দ্বারা প্রজার শাসন” – যাতে প্রজাদের প্রতি জমিদারদের অমানবিক অত্যাচারের বিশদ বর্ণনা রয়েছে। এ বইয়ের মাধ্যমে তিনি জমিদারদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে সকলকে জেগে উঠার আহ্বান জানান। মুন্সী ইয়াসিনসহ অন্যান্য আরও অনেকে লেখা ছাপান যার মধ্যে বাংলায় ফজলুল হকের মন্ত্রিত্বের সময় প্রকাশিত হয় – “হক সাহেবের আইনে প্রজার মুক্তি”।
১৪. মােজাফফর আহমেদ ও “কাজী নজরুল ইসলামের স্মৃতিকথা” (কলকাতা, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৬৫।
১৫. মােজাফফর আহমেদ ঃ “কমিউনিস্ট পার্টি অব ইন্ডিয়া ও গঠনকাল ১৯২১ – ১৯৩৩” (কলকাতা ১৯৬৯), পৃষ্ঠা ৫।
৩৭
১৬. কে. এ. খালেক ঃ “এক শতাব্দী” (ঢাকা, ১৯৬২), পৃষ্ঠা ১২০।
১৭. রহিমের উক্তি, এন – ৩, পৃষ্ঠা ২৪৪ – ৪৫।
১৮. খালেক, এন – ১৬, পৃষ্ঠা ১২১।
১৯. ঐ, পৃষ্ঠা ১২২।
২০. হাবীবুল্লাহ, এন – ৭, পৃষ্ঠা ৩১।
২১. হিন্দুদের “শুদ্ধি” ও “সংগঠন”-এর কার্যক্রমের মাধ্যমে আর মুসলিমদের “তাবলীগ ও “তানজিম”-এর কার্যক্রমের মাধ্যমে সহজেই বােঝা যায় তখনকার সময়ে হিন্দু – মুসলিম দাঙ্গা কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল ।
২২. সংঘের প্রতিনিধি হিসেবে ১৯২৩ সালের সভাপতি – ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস – আবুল কালাম আজাদ, প্রাক্তন উকিল ও ব্যারাকপুর পৌর মােহামেডান সদস্য ওহায়েদ হাসান অবাঙালী মুসলিমদের পক্ষ থেকে এবং ২৪ পরগণার গ্রামের মােহামেডানের সদস্য সৈয়দ নাসিম ও সিলেট স্টেট কাউন্সিলের প্রাক্তন সদস্য শিক্ষাবিদ আবদুল করিম বাঙালী মুসলিমদের পক্ষে যােগ দিয়েছিলেন। সূত্র বি. আর. খান, “বাংলার রাজনীতি ১৯২৯ – ১৯৩৬” (ঢাকা ১৯৮৭), পৃষ্ঠা ১৬।
২৩. বেঙ্গল প্যাক্টের চুক্তির প্রধান শর্তগুলাে হল ঃ
ক. বঙ্গীয় আইনসভায় প্রতিনিধিত্ব পৃথক নির্বাচকমন্ডলীর মাধ্যমে জনসংখ্যার | ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নির্ধারিত হবে।
খ. স্থানীয় পরিষদসমূহে প্রতিনিধিত্বের অনুপাত হবে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের শতকরা ৬০ ভাগ ও সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের শতকরা ৪০ ভাগ।
গ. সরকারি চাকরির শতকরা ৫৫ ভাগ পদ পাবে মুসলমানরা। যতদিন ঐ = অনুপাতে না পৌছাতে পারবে ততদিন মুসলমানরা পাবে শতকরা ৮০ ভাগ পদ আর বাকি শতকরা ২০ ভাগ পদ পাবে হিন্দুরা।
ঘ, কোন সম্প্রদায়ের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ৭৫ শতাংশের সম্মতি ছাড়া এমন কোন আইন তৈরি করা যাবে না যা ঐ সম্প্রদায়ের স্বার্থের পরিপন্থি। সূত্র : ডি. কে, চ্যাটার্জী ও “সি, আর, দাস এন্ড ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল মুভমেন্ট” (কলকাতা, ১৯৬৫), পৃষ্ঠা ১৩১ – ১৩২।
২৪. বি. আর. খান, প্রাগুক্ত ২২, পৃষ্ঠা ১৭।
২৫. আবুল কালাম আজাদ ঃ “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” (কলকাতা, ১৯৫৯), পৃষ্ঠা ২১।
২৬. ইন্ডিয়ান কোয়ার্টারলী রেজিস্টার, ১৯২৬, ভলিউম ১, জানুয়ারি – জুন, পৃষ্ঠা ৪১৭ – ৪২১।
২৭. আজিজুল হক, আবদুর রহিম, ৪ সেপ্টেম্বর, ১৯২৮, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিল প্রসিডিং, ভলিউম ৩০, নং ২, পৃষ্ঠা ১০০৪ – ৬।১ ৫৫ তম)
৩৮
২৮. দি স্টেটসম্যান (কলকাতা), ২ জুলাই ১৯২৯, নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহকে দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়।
২৯. প্রাগুক্ত।
৩০. দি স্টেটসম্যান (কলকাতা), ৫ জুলাই ১৯২৯।
৩১. আবুল মনসুর আহমেদ, প্রাগুক্ত ৪, পৃষ্ঠা ৬৩।
৩২. বি. আর. খান, প্রাগুক্ত ২২, পৃষ্ঠা ২০।
৩৩. আবুল মনসুর আহমেদ, প্রাগুক্ত ৪, পৃষ্ঠা ৬৪।
৩৪. জ্যাকসন টু টেম্পেলউড (প্রাইভেট), ২৭ আগস্ট ১৯৩১, টেম্পেলউড কালেকশন, পৃষ্ঠা ৩ – ৪, উদ্ধৃত, বি. আর. খান, প্রাগুক্ত ২২, পৃষ্ঠা ৭০।
৩৫. ঐ।
৩৬. শাহ আবদুল হামিদ এবং অন্যান্য, “নিখিল বাংলা প্রজা সমিতি, একটি আবেদন”, আজাদ (কলকাতা), ৬ ডিসেম্বর ১৯৩৬।
৩৭. আবুল মনসুর আহমদ, প্রাগুক্ত ৪, পৃষ্ঠা ৯৩।
৩৮. কামরুদ্দিন আহমেদ “এ সােশ্যাল হিস্টরী অব বেঙ্গল” (ঢাকা, ১৯৭০), ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩০।
৩৯. আবুল মনসুর আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৯৩।
৪০. ঐ পৃষ্ঠা ৯৪।
৪১. “দি ফিউচার অব দ্য প্রজা মুভমেন্ট, নিড ফর ফার সাইটেড লিডারশীপ” (প্রধান শিরােনাম) “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ২২ মে ১৯৩৫।
৪২. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ২৯ জানুয়ারি ও ১০ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫।
৪৩. ঐ ৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫।
৪৪. ঐ ১১ ও ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৫।
৪৫. ঐ ১১ – ১৮ জুলাই, ১৯৩৬।
৪৬. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬। কৃষক-প্রজা পার্টির উদ্দেশ্য ও
লক্ষ্য জানতে আরও দেখুন উক্ত গ্রন্থের পরিশিষ্ট ১। কৃষক-প্রজা পার্টির অনুসারিদের মধ্যে অনেক উচ্চবর্ণের হিন্দু থাকলেও দলটির নেতৃত্ব মূলত মুসলিম নেতাদের হাতে ছিল। বাংলার বিশেষ সমাজব্যবস্থা এমন ধারা তৈরি করতে সহায়ক ছিল যেখানে অল্প কিছু উচ্চবর্ণের হিন্দুরা ছিলেন জমিদার ও ঋণদাতা
আর বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ কৃষক জনগােষ্ঠী যারা মুসলমান।
৪৮. হুমায়রা মােমেন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৩২ – ৩৩।
৩৯
চতুর্থ অধ্যায়
ফজলুল হক বনাম মুসলিম লীগ-এর ভােটযুদ্ধ
[ ১৯৩৬ – ৩৭ ]

– এক –

হিন্দুদের নেতৃত্বে কংগ্রেস দ্বারা বেঙ্গল প্যাক্ট (১৯২৬) বাতিল হওয়ার সাথে সাথে বাংলার রাজনীতি সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষে রূপ নেয়। বাংলার প্রজাস্বত্ব সংশােধন বিল (১৯২৮) নিয়ে বিরােধী হিন্দুদের কর্মতৎপরতা আরও ঘনীভূত হল। নির্বাচন ব্যবস্থা ও সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের নীতিমালা সম্পর্কে ১৯৩২ সালে হিন্দু মুসলমান সব নেতা এক সাথে গােলটেবিল আলােচনা করেও যখন তা সমাধানে ব্যর্থ হলেন তখনই ঘটল মজার ঘটনা। ঘটনাটি হল ; ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী রামজে ম্যাকডােনাল্ড ১৯৩২ সালের আগস্ট মাসে সাম্প্রদায়িক প্রতিনিধিত্বের একটি নীতিমালা ঘােষণা করলেন, পরবর্তীতে যাকে “কমিউন্যাল এওয়ার্ড” (সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ) বা “মাকডােনাল্ড এওয়ার্ড” বলা হয়।১ বাংলাতে ২৫০ ২ আসনবিশিষ্ট একটি নির্বাচন ব্যবস্থা করা হল যেখানে মুসলমানদের ১১৯ আসন ও হিন্দুদের ৮০টি তার মধ্যে আবার ১০টি ছিল হিন্দু দলিত শ্রেণীর৩ যাদের পরবর্তীতে সংখ্যালঘু বলে সম্বােধন করা হত। উচ্চবর্ণের হিন্দুরা এতে খুশি হতে পারেনি। কারণ, এ বিধানের ফলে তাদের প্রতিনিধিত্বের হার কমে গিয়েছিল। আর এ অংশের প্রতিনিধিত্ব তারা এতকাল আনন্দের সাথে করে এসেছে শুধুমাত্র সমাজের উঁচু স্তরে থাকার কারণে। সংবাদ সম্মেলন ও সভা করে তারা এ কমিউন্যাল এওয়ার্ড’-এর বিপক্ষে কঠিন প্রতিবাদ জানাল। প্রথম সারির হিন্দু পত্রিকা “অমৃতবাজার’ একটু বাড়িয়ে লিখলঃ
“যে কেউ নির্দ্বিধায় স্বীকার করবে যে, গত সন্ধ্যায় এমন অসঙ্গতিপূর্ণ নথি আমাদের হাতে এসেছে যে ধরনের সংবাদ বহুদিন আমাদের
৪০
কাছে আসেনি ….. বাংলায় ২৫০ আসনের আইন পরিষদে হিন্দুদের জন্য মাত্র ৮০টি আসন !”৪
কলকাতাভিত্তিক জাতীয় দৈনিক এ্যাডভান্স ও লিবার্টি একে বাংলা ও হিন্দু জনগণের৫ প্রতি অবিচার আখ্যায়িত করে এ মাটির সন্তানদের৬ স্বায়ত্তশাসনে বঞ্চিত করা হল বলে তাতে নিন্দা করে। আর এ পক্ষপাতমূলক পদক্ষেপের ফলে প্রদেশের সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক জীবন হুমকিতে পড়বে। বলেও তারা মন্তব্য করল।৭ এছাড়া বাংলার বড় বড় শহরে “কমিউন্যাল এওয়ার্ড”-এর বিরােধিতা করে অনেক সভা-সমাবেশ করা হল। কলকাতা টাউন হলে এমনই একটি সভায় কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সভাপতি হয়ে হিন্দুদের পক্ষে ভাষণ দিয়েছিলেন।৮
সম্প্রদায়িক রােয়েদাদ (কমিউনাল এওয়ার্ড)-এর বিরুদ্ধে উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আন্দোলন ফলপ্রসূ হল না। কমিউন্যাল এওয়ার্ড”-কে ১৯৩৫ সালে পুনা প্যাক্ট-এর মত সংশােধন করল ভারত সরকার। প্রতি ৩ জন হিন্দু ভােটারের বিপরীতে ৪জন নতুন মুসলমান ভােটারের সংযােগ ঘটিয়ে এর আওতা শতকরা ৬০০ ভাগ বৃদ্ধি করা হল এবং এর ফলে ভােটের ক্ষেত্রে শহরতলীর গুরুত্ব কমানাে হল। এরূপ নির্বাচন ব্যবস্থা গ্রহণ করার ফলে বাংলার সম্প্রদায়গুলাের মধ্যে পেশী-শক্তি প্রদর্শনের হার বেড়ে গেল। সুতরাং বিধান সভাতে আসন বেশি হওয়ায় মুসলমানরা এর মধ্যে আধিপত্য বিস্তার করার সুযােগ পেল। ফলস্বরূপ, প্রাদেশিক নির্বাচনের তারিখ ১৯৩৭ সালের জানুয়ারির শেষ ও ফেব্রুয়ারির শুরুতে অনুষ্ঠিত হওয়ার ঘােষণা হলে তারা উৎসাহের সঙ্গে গ্রহণ করে।
এদিকে, বাংলার মুসলিম লীগ ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের ঘােষণায় বেশি আনন্দিত হতে পারল না। বাংলায় তখন মুসলিম লীগের সাংগঠনিক অবস্থা কার্যত স্তিমিত হয়ে পড়েছিল।৯ অন্যান্য স্থানেও মুসলিম লীগের অবস্থা একই রকম ছিল। কারণ মুসলিম লীগের নেতারা ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে গিয়েছিলেন। বিভক্ত হয়ে পড়া দলগুলাের মধ্যে “নিখিল বঙ্গ প্রজা সমিতি” অনেক দিক দিয়ে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠল। ১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠা লাভের পর এ সংগঠনটি আস্তে আস্তে মধ্যম শ্রেণির উঠতি মুসলমানদের বিশেষ করে
৪১
কৃষকদের সমর্থন লাভ করে জেলা পর্যায়ে এদের কার্যক্রম বিস্তৃত করতে সক্ষম হয়েছিল। ১৯৩৬ সালে সমিতির নতুন নামকরণ করা হয় “কৃষক-প্রজা পার্টি” এবং এ. কে. ফজলুল হকের নেতৃত্বে নতুন আঙ্গিকে সংগঠনটির উন্মেষ ঘটে।
মধ্যম শ্রেণির উঠতি মুসলমান ও মুসলিম কৃষকদের একত্রিত করে সংগঠনটির নেতৃত্ব গ্রহণ করে ফজলুল হক যা অন্যান্য অভিজাত মুসলিম নেতাদের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে উঠে। এমতবস্থায় অভিজাত মুসলিম নেতৃবৃন্দ হক এবং তাঁর দলের বিপরীতে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের চিন্তা করলেন। এর ধারাবাহিকতায় তারা কলকাতার কিছু অবাঙালী ব্যবসায়ীকে নিয়ে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি’ প্রতিষ্ঠা করলেন। পরে অবশ্য ঐ ব্যবসায়ীরা ১৯৩২ সালে “নিউ মুসলিম মজলিশ” নামের আলাদা একটি সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যে সংগঠনটি মূলত কলকাতা শহরে তাদের কার্যক্রম চালু রেখেছিল। ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির প্রেসিডেন্ট ছিলেন ঢাকার নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ আর ভাইস প্রেসিডেন্ট ছিলেন জলপাইগুড়ির নওয়াব মােশাররফ হােসেন।১০ নবপ্রতিষ্ঠিত ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতারা ঘােষণা দেয়, তাদের সংগঠনটির মূল লক্ষ্যই হল হিন্দু-মুসলিম সম্পর্ক উন্নয়ন করা এবং খেটে খাওয়া মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করা।১১ তাঁরা এ প্রচারণায় সামান্য সফলতা পেল আর তাহল প্রজা পার্টির পরাজিত কিছু লােক যারা মাওলানা আকরম খাঁ ও খান বাহাদুর আবদুল মােমেনের অন্ধ সমর্থক ছিল তারা এসে যুক্তফ্রন্টে যােগ দিল।১২
কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্যদের বিপরীতে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতারা আসন্ন নির্বাচনে তাদের নির্বাচনী ভবিষ্যৎ যে অবশ্যই অন্ধকারাচ্ছন্ন হবে তা বুঝতে পারেন। অন্যদিকে কৃষকদের মধ্যে কৃষক-প্রজা পার্টি ছিল ভীষণভাবে জনপ্রিয়। ইউনাইটেড ফ্রন্ট তাই সাম্প্রদায়িক স্থিতি বজায় রাখার স্বার্থে কৃষকপ্রজা পার্টির সমর্থন আদায় করতে তাদের নেতাদের এক বৈঠকে আমন্ত্রণ জানালেন। তাতে সাড়া দিয়ে কলকাতার নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহর বাসভবনে উভয় দলের নেতারা বৈঠক করলেন। কিন্তু নেতৃত্ব দানের প্রশ্নে আলােচনা বিফলে গেল।১৩ কৃষক-প্রজা পার্টির লােকজন জোটের নেতা হিসেবে এ. কে. ফজলুল হককে চাইল কিন্তু অভিজাতশ্রেণির অন্যরা তা মানতে পারল না। নেতৃত্বের প্রশ্নটি ছিল পর্বত সমান গুরুত্বের। কেননা যিনি নেতা মনােনীত হবেন
৪২
তিনিই হবেন পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী। ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বিফল আলােচনা এভাবেই তাঁদের মধ্যে বৈরী ও তিক্ত মনােভাবের জন্ম দিল। যার ফলে একে অন্যের প্রতি কাদা ছোড়াছুড়িতে তাঁরা উঠে-পড়ে লেগে গেলেন। ফজলুল হক তার এক বাণীতে বললেন ঃ
“কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির ঐক্যের আহবানটি ছিল তাদের এক ধরনের নির্বাচনী ছল” – যার মাধ্যমে ভােটগুলাে তাদের না। পক্ষে হাতিয়ে নিয়ে, আসন্ন নির্বাচনে নিজেদের ঐ সকল নেতাদের স্থান | পাকাপােক্ত করা।”১৪
ঐ বাণীতে ফজলুল হক তাদের আন্তরিকতা ও মতলব নিয়ে প্রশ্ন তােলেন এবং চিরস্থায়ী বন্দোবস্তকে বাতিল বলে ঘােষণা তারা প্রকাশ্যে দিতে পারবে কি-না। তার প্রতি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেন।১৫ এর পাল্টা জবাবে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতা জানালেন ঃ
কৃষক-প্রজা পার্টি কোন খাঁটি মুসলিম সংগঠন না” এবং এটি “বাংলার টি মুসলিম সম্প্রদায়ের আকাক্ষা ও চাহিদা পূরণে সদা সােচ্চার থাকা অভিজাত মুসলিম নেতাদের কখনও সহযােগিতা ও স্বাগত জানায়নি।১৬
এদিকে মৃতপ্রায় মুসলিম লীগের পুনর্গঠনের জন্য এম. এ. জিন্নাহ দায়িত্ব নেন। এ লক্ষ্যে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় পরিষদের নেতাদের নিয়ে তিনি ১৯৩৬ সালে লাহােরে একটি সভা ডাকলেন।১৭ বেশির ভাগ নেতা জিন্নাহর আমন্ত্রণে সাড়া দিলেন না ; কারণ, নিজ এলাকার নেতৃত্বে তারা জিন্নাহকে অন্তর্ভুক্ত করতে চাননি। জিন্নাহর কাছে বিষয়টি খুব হতাশাব্যঞ্জক ছিল ; কারণ, বাংলার শুধুমাত্র তিনজন ব্যক্তি এম, এ, এইচ, ইস্পাহানি, আবদুর রহমান সিদ্দিকী ও খাজা নুরুদ্দিন তাতে সাড়া দিয়েছিলেন যদিও প্রথম দুই ব্যক্তি ঐ নিমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে লাহােরের সভায় যােগ দিয়েছিলেন।১৮ কিন্তু নির্ভীক জিন্নাহ মুসলিম লীগের পুনর্জাগরণে সহায়ক হিসেবে ইস্পাহানি ও সিদ্দিকীর উপর আস্থা রাখলেন এবং তাদের আশ্বস্ত করলেন ঃ
“তিনি যেকোন সাহায্য ও পরামর্শ দিতে প্রস্তুত এবং এজন্য তাকে যখন যেখানে দরকার তিনি যেতে প্রস্তুত।”১৮
৪৩
স্তিমিত হওয়া মুসলিম লীগকে বাঁচাতে জিন্নাহ যখন মুসলিম সম্প্রদায়কে একত্রিকরণে মনােনিবেশ করলেন ঠিক তখন কমিউনাল এওয়ার্ড নিয়ে হিন্দুদের অসন্তোষ আরও দানা বেঁধে উঠল। আর তাতে জিন্নাহ মুসলমানদের রাজনীতিকে মজবুত করার একটি ভাল সুযােগ পেয়ে গেলেন। ১৯৩৬ সালের ২৭ জুন কবি রবীন্দ্রনাথসহ ১২০ জন নামকরা হিন্দুদের মতামত সংবলিত একটি স্মারক ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী লর্ড জেটল্যান্ডের দফতরে পাঠানাে হল।২০ তারা “কমিউনাল এওয়ার্ড” বাতিল করে আইন পরিষদে হিন্দুদের আসন বাড়াতে অনুরােধ করল এবং এর কারণ হিসেবে তারা উল্লেখ করল যে, বিদ্যাবুদ্ধি এবং সংস্কৃতির মর্যাদায় অন্যদের থেকে তাঁরা অনেক এগিয়ে আছে। আর প্রদেশের অন্যদের তুলনায় তারাই বেশি রাজস্বের যােগান দেয়। অনুরােধের ঐ স্মারকে ১৫ জুলাই কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত বিশাল বৈঠকে উপস্থিত বড় বড় নেতা স্বাক্ষর করেন। ঐ বৈঠকের সভাপতিত্ব করেন কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।২১
সাম্প্রদায়িক রােয়েদাদ “কমিউনাল এওয়ার্ড” বিরােধী হিন্দুদের আন্দোলনটি, ১৯১১ সালের বঙ্গভঙ্গ বিরােধী আন্দোলনের সফলতার কথা মুসলমানদের স্মরণ করিয়ে দিল। “কমিউনাল এওয়ার্ডের” ভাগ্যে তেমন ঘটতে পারে এমন আশংকা থেকে মুসলমান নেতৃবৃন্দ অধিক সভা-সমাবেশ করে মুসলিমদের স্বার্থরক্ষায় তাদের ঐক্যবদ্ধ করার কাজ শুরু করলেন। ১৯৩৬ সালের ১০ আগস্ট কলকাতার টাউন হলের এক সভায় “সকল দলের মুসলিমদের এক সংগঠনের পতাকা তলে” আনার লক্ষ্যে তিন সদস্যের কমিটি গঠনের সুপারিশ করা হয়, যাতে ছিলেন ফজলুল হক, নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ এবং এম. এ জিন্নাহ।২২
এমন নতুন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার স্বাভাবিক কারণে তখন কৃষক-প্রজা পার্টি ও ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির মধ্যকার দ্বন্দ্ব নিরসনের লক্ষ্যে জিন্নাহকে বাংলায় আমন্ত্রণ জানানাে হয়। প্রদেশে মুসলিম লীগের সম্মান পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং এর শক্তি বৃদ্ধি করার জন্য জিন্নাহর কাছে তা অবশ্যই একটি ভাল সুযােগ। কাজেই তিনি সুযােগটি হাতছাড়া করতে চাননি। ১৯৩৬ সালের ১৭ আগস্ট তিনি এ আহ্বানে সাড়া দিয়ে দ্রুত কলকাতায় চলে আসেন।২৩
৪৪
কলকাতায় আসার সাথে সাথে জিন্নাহ উভয় দলের নেতাদের সাথে সাক্ষাৎ করলেন। প্রথমে তিনি দু’ দলকে একত্রে নিয়ে মিটিং করার প্রয়াস চালালেন। কিন্তু একের প্রতি অন্যের অবিশ্বাসের কারণে তা সম্ভব হল না।২৪ তিনি আলাদা করে উভয় দলের নেতাদের সাথে মিলিত হলেন২৫ এবং চাইলেন যেন অন্তত কোন একটি দল মুসলিম লীগের সাথে থাকে। কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে তাঁর খুব অন্তরঙ্গ আলােচনা হল। মফস্বলে কৃষক-প্রজা পার্টির বড় সমর্থন থাকায় জিন্নাহকে তাদের সাথে আলাপের সময় বেশ আশাবাদী দেখাল। আলােচনার এক পর্যায়ে তিনি ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতাদের সাথে তার যুক্ত না হওয়ার কথা ব্যক্ত করে তাদেরকে “পা-চাটা” বলে সম্বােধন করলেন।২৬ দীর্ঘ আলােচনা চলার পর এক পর্যায়ে মনে হল জিন্নাহর নেতৃত্বাধীন মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের সাথে কৃষক-প্রজা পার্টি এক হয়ে যাবে।২৭ কিন্তু আলােচনা ফলপ্রসূ হতে পারেনি পার্টির তরুণ নেতাদের দুটি দাবির জন্য –
প্রথম ছিলঃ কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারী প্রথা বাতিল করতে হবে এবং
দ্বিতীয়টি ছিলঃ ৪ কৃষক-প্রজা পার্টির স্বীকৃতি থাকবে সাধারণ আসনে নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার।২৮
দাবিগুলাের কোনটিই জিন্নাহ মেনে নিতে পারলেন না। যার কারণ হিসেবে যুক্তি দিলেন, প্রথম দাবিটি মানলে ব্যক্তিমালিকানার বিষয়ে ইসলামে যে নীতি রয়েছে। তা লঙ্ঘন করা হবে ; আর দ্বিতীয় দাবিটি মেনে নিলে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের পতাকাতলে সকল মুসলমান দলের নেতাদের একত্রিত করার যে অভিযানে তিনি নেমেছেন তা বিফলে যাবে।২৯
কৃষক-প্রজা পার্টিকে বােঝাতে জিন্নাহ তখনও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন, আর এরই মধ্যে এক আলােচনায় “ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি” তাঁকে ও তাঁর দলকে। পাশাপাশি থেকে সমর্থন দেয়ার কথা জানালেন। সকল সদস্যই জিন্নাহর বেঁধে দেয়া একটি শর্ত মেনে মুসলিম লীগের সংসদীয় দলে যােগ দিতে সম্মত হলেন। আর শর্তটি ছিল, ঐ বাের্ডের প্রতিনিধিত্বের জন্য ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি থেকে
৪৫
জিন্নাহ নিজে প্রতিনিধি বাছাই করবেন।৩০ ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির সদস্যদের এ সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণ ছিল, তারা অনুমান করতে পেরেছিলেন, তাঁদের একক শক্তি দিয়ে কৃষক-প্রজা পার্টিকে কখনও হারাতে পারবে না, তার থেকে বরং মুসলিম লীগের সাথে যােগ দিলে তাদের দলের চাহিদা বাড়বে আর তারা পল্লী অঞ্চলের বেশি ভােট পাবে। এছাড়া তারা সহজে বুঝতে পেরেছিল, লীগ-প্রজা’র আঁতাত তাদের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিবে এবং এ কারণে দলটিকে দমনের জন্য তারা খুবই উদ্বিগ্ন ছিল। নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহকে প্রেসিডেন্ট করে ঢাকাতে “মুসলিম লীগ বেঙ্গল পার্লামেন্টারী বাের্ড গঠন করা হল যা মূলত ১৯৩৬ সালের ২৫ আগস্ট আনুষ্ঠানিকভাবে ঘােষণা দেয়া হয়।
ঐ বাের্ডে ছিলেন ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির ১৫ জন, নিউ মুসলিম মজলিশের ৭ জন, মুসলিম লীগের ৭ জন এবং জিন্নাহর দ্বারা মনােনীত নির্দলীয় স্বাধীন সদস্যরা।৩১ যেখানে ১৫ সদস্যের জন্য একটি কোটা রাখা হল । কারণ যদি মুসলিম লীগ সংসদীয় দলে কৃষক-প্রজা পার্টির কেউ যােগ দিতে চায় তাহলে সেখানে তাদের নেয়া হবে। ফজলুল হক এবং কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা তখন একটি কঠিন অবস্থায় পড়ে গেলেন। তাঁরা কৃষক-প্রজা পার্টিকে বিলুপ্ত করতে সম্মত হল না, কেননা তাতে রাজনৈতিকভাবে নিজেদের আত্মহনন ঘটানাে হবে। আবার, তারা লীগের বাইরেও থাকতে পারছিল না। কারণ, বাইরে থাকলে তাদেরকে মুসলিম ঐক্য ভঙ্গকারী হিসেবে চিহ্নিত করা হতে পারে। এ কারণে লীগের সংসদীয় দলের সাথে যুক্ত হতে তারা বাধ্য হলেন। মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারী বাের্ডে যােগ দিতে গিয়ে তারা অন্য সব শর্ত মেনে নেয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও দলটি ভাঙ্গা সম্পর্কে তারা কোন প্রতিশ্রুতি দিলেন না।৩২ বস্তুত কৃষক-প্রজা পার্টি এবং পুনর্গঠিত মুসলিম লীগের মধ্যকার জোট ভেতর থেকে অতটা ঘনিষ্ঠ ছিল না যা বাইরে দেখানাে হত।
লীগের সংসদীয় সদস্যদের মধ্যে অনেকেই বিশেষ করে সদ্য বিলুপ্ত ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতারা বাের্ডে কৃষক-প্রজা পার্টির অন্তর্ভুক্তিতে খুশি ছিলেন না। কারণ, তাঁদের ধারণা ছিল এতে করে বাের্ডের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড যথেষ্ট ব্যাহত হবে। কৃষক-প্রজা পার্টির এমন প্রভাব কমানাের জন্য, এমনকি তাঁদের প্রতিনিধিদের তালিকা জমা দেয়ার পূর্বেই বাের্ড ১৯৩৬ সালের ৬
৪৬
সেপ্টেম্বর মিটিং করে অফিস বেয়ারার ও নির্বাচনী ইস্তেহারের ধারা তৈরি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।৩৩ এ বিষয়ে এ. কে. ফজলুল হক ক্ষুব্ধ বিবৃতি বলেনঃ
এটি কৃষক-প্রজা পার্টির জন্য পরিষ্কার ও নির্জলা অপমান আর তাদের বুঝিয়ে দিল, নওয়াব আর জমিদাররা কৃষক এবং প্রজাদের যেভাবে মূল্যায়ন করত, এখানে তাদেরকে তেমনভাবেই মূল্যায়ন করা হচ্ছে।৩৪
বিভাজনটা এখন যেন শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার আর বেশ শিগগিরই তা হল। ১৯৩৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর যখন বেঙ্গল মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের প্রথম সভা বসে তখন নির্বাচনী ইস্তেহার সম্পর্কে দ্বিমত পােষণ করে কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে কতিপয় সদস্য ওয়াক আউট করে। কৃষক-প্রজা পার্টি ইস্তেহারে তাদের দলের নিজস্ব কার্যক্রম “জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের সংযুক্তি চেয়েছিল যাতে বাের্ডের অন্যরা সম্মত ছিলেন না।৩৫ এরপর কৃষক-প্রজা পার্টি লীগের সংসদীয় দল থেকে বের হয়ে গিয়ে নিজেদের প্রতীকে নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নিল । এভাবেই মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টির অঙ্কুরিত মৈত্রীবন্ধনের পরিসমাপ্তি ঘটল।
অল্প কিছুকাল পরে, হক সাহেব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম ছাত্রদের নিকট মুসলিম লীগের সংসদীয় দল থেকে বেরিয়ে আসার কারণ ব্যাখ্যা দেন। বাঙালি মুসলিমদের মধ্যে ঐক্য গড়ে না ওঠার জন্য তিনি কলকাতার অবাঙালি ব্যবসায়ীদের দায়ী করলেন এবং ঘােষণা দিলেন, তিনি থাকতে বাঙালি মুসলমানদের লক্ষ্যকে কখনও তারা নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।৩৬ ইউনাইটেড মুসলিম পার্টিকে মনােনয়ন দেয়ার জন্য ও বাের্ডকে জিন্নাহর নিজস্ব মনােনয়ন দেয়ার জন্য সমালােচনা করেন। তিনি দেখালেন, যেখানে মুসলিম পার্টির মনােনীতদের তিনজন ঢাকার নওয়াব পরিবারের৩৭ আর চারজন কলকাতার৩৮ সেখানে জিন্নাহর নিজস্ব মনােনীতরা সবাই কলকাতায় বসবাসরত অবাঙালি ব্যবসায়ী৩৯ যাদের কারােরই মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করার কথা নয়। মূলত এমন ব্যবস্থা করার জন্য জিন্নাহ একজন প্রভাব বিস্তারকারী নেতা হয়ে দাঁড়ালেন যেখানে হক তেমন কোন কিছুই না এবং এ বিষয়টি কৃষক-প্রজা পার্টির কেউ মেনে নিতে চাইল না।
৪৭
সমসাময়িক একজন পর্যবেক্ষকের মতে, কলকাতার একদল ইউরােপীয় ব্যবসায়ী যাদের বেশিরভাগ পাট শিল্পের সাথে জড়িত, তাদেরও বাংলার রাজনৈতিক দলগুলােকে একত্রিত করার ক্ষেত্রে জোরালাে ভূমিকা ছিল।৪৩০এছাড়া কলকাতার ইউরােপীয় পাট ব্যবসায়ীরা ব্রিটিশ কূটনীতিকদের কাছে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির জন্য সুপারিশে জড়িত ছিল। তাঁরা অনেকেই ঐ দলের বেশ কয়েকজন নেতার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। প্রদেশকে নিজেদের স্বায়ত্তশাসনের আওতায় আনার বিষয়ে ইউরােপীয়রা কৃষক-প্রজা পার্টির পরিবর্তে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টিকেই সমর্থন দিল ; কারণ, তাদের ব্যবসায়িক স্বার্থ উদ্ধারে এ দলটি বেশি নিরাপদ বলে তারা মনে করল। মূলত কৃষক-প্রজা পার্টির দলীয় কর্মকাণ্ডে কাঁচা পাটের মূল্য কমানাের দাবি ছিল আর তাতে পাটজাত পণ্যের ব্যবসায় ইউরােপীয়দের লাভের পরিমাণ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল।৪১ এসব কারণে ইউরােপীয়দের কাছে হক সাহেবের তেমন গ্রহণযােগ্যতাও ছিল না, তাদের কাছে প্রিয় ছিল ব্রিটিশ শিক্ষায় শিক্ষিত স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন।৪২ এছাড়া নাজিমুদ্দিনসহ ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির নেতারা ইউরােপীয়দের সাথে যেমন যােগাযােগ রক্ষা করে চলতেন, হক সাহেব তেমনটি | না করে উল্টো জনসম্মুখে ইউরােপীয়দের সমালােচনা করতেন। একটি খােলা চিঠিতে ফজলুল হক জিন্নাহকে প্রকাশ্যে জানিয়ে দিলেন, প্রাদেশিক গভর্নরসহ ব্রিটিশ কূটনীতিকরা গােপন রাজনৈতিক চক্রান্ত করেই জিন্নাহর সাথে ইউনাইটেড ন্যাশনাল পার্টির আঁতাত করান ও কৃষক-প্রজা পার্টিকে তিনি পরিত্যাগ করেন। জিন্নাহকে ভুলাে-মনের এবং পক্ষপাতমূলক দৃষ্টিভঙ্গির মানুষ হিসেবে নিন্দা জানিয়ে হক সাহেব লিখলেন ঃ
২০ আগস্ট আপনি সরকারি দফতরে গেলেন, কেউ জানল না, কার সাথে এবং কেন (পুরাে বিষয়টি রাষ্ট্রীয় গােপনীয়তা হিসেবে জানানাে হল) ঐ মিটিংটি ছিল, কিন্তু সেখান থেকে বের হয়ে আসার পর থেকে আপনি বদলে গেলেন। মনে হল, আপনার সব কিছু বদলে গিয়েছে। যে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টিকে পদলেহনকারী বলে আপনি সবসময় ভর্ৎসনা করতেন, তাদের সাথেই আপনি প্রথম কথা বললেন – অবশেষে যা হওয়ার ছিল তাই হল। প্রজা পার্টির সদস্যরা আপনার
৪৮
উন্নাসিকতা ও স্বৈরাচারী আচরণ সহ্য করতে না পেরে ২১ আগস্ট আপনাকে তীব্র ঘৃণার সাথে ত্যাগ করেছিল।
কথাগুলাে তীর্যক হলেও অবাক করার বিষয় ছিল যে, সরকারি দফতর বা জিন্নাহ। কারও কাছ থেকে এর কোন প্রতিবাদ আসেনি। সে সময় সম্ভবত প্রজা-লীগের যাত্রাকে রুখে দিতে অপ্রয়ােজনীয় কথার জন্ম দিয়েছিল ঐ ইউনাইটেড মুসলিম পাটি।

– দুই –
মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি বাের্ড থেকে কৃষক-প্রজা পার্টি আলাদা হয়ে গিয়ে ফজলুল হককে প্রেসিডেন্ট মনােনীত করে নিজেরাই একটি বাের্ড গঠন করে। সেক্রেটারি মনােনীত হন শামসুদ্দিন আহমেদ। পরে তারা নির্বাচনী ইস্তেহার প্রকাশ করলেন যাতে তাদের কর্মসূচি ছিলঃ৪৪
১. ভূমি রাজস্বব্যবস্থা বা চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নামে পরিচিত সেই ব্যবস্থা ও তার দ্বারা প্রণীত অন্যান্য বিধানের ফলে প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার যে স্থবিরতা বিরাজ করছে, যেকোন উপায়ে তা রদ করে। জনগণের কল্যাণে আরও উপযুক্ত বিধান প্রণয়ন করা। এক কথায় কোন ক্ষতিপূরণ ছাড়াই জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ।
২. প্রত্যেক শ্রেণির জমির জন্য সর্বোচ্চ হারে খাজনা কমাতে হবে এবং কোন ফি ছাড়াই জমির শ্রেণি ও মালিকানা পরিবর্তনের স্বীকৃতি দেয়া।
৩. ভূ-স্বামিদের অগ্রাধিকার উচ্ছেদ করা।
৪. নজর সেলামী উচ্ছেদ করা এবং “আবওয়াব”-এর ন্যায় অতিরিক্ত অর্থ অবৈধভাবে দাবি করা হলে তার জন্য ফৌজদারী শাস্তির বিধান রাখা।
৫. ঋণ সালিসি বাের্ড গঠনের মাধ্যমে কৃষকদের বিশাল ঋণের বােঝা থেকে মুক্ত করা।
৬. প্রাথমিক পর্যায়ের কাঁচা পাট উৎপাদনকারীদেরকে এর ন্যায্য দাম।
নির্ধরিত করে দেয়া।
৭. প্রাথমিক শিক্ষা অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করা।
৪৯
৮. স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে ভরাট হয়ে যাওয়া খাল ও পুকুর পুনরুদ্ধার করা।
৯, প্রতিটি জেলার প্রতিটি থানায় একটি করে হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা করা।
১০. বাংলায় সম্পূর্ণরূপে স্ব-শাসিত সরকার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা।
১১. প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন নীতি গ্রহণের উদ্যোগ নেয়া।
১২. মন্ত্রিদের বেতন মাসে এক হাজার রুপি নির্ধারণ করা।
১৩. যাবতীয় দমন-পীড়ন আইন রদ করে সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া।
একটি প্রদেশিক দল হওয়া সত্ত্বেও কৃষক-প্রজা পার্টির কর্মসূচিতে সকলের চাহিদার প্রতিফলন দেখা যায় যা মূলত প্রদেশের বৃহত্তর কৃষকগােষ্ঠীর চাহিদাই প্রকাশ করে। অন্যদিকে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের মত বড় দুটি দল সামান্য কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচি ছাড়া সবসময় রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক পুনর্গঠন সংক্রান্ত কর্মসূচি নিয়েই অধিক প্রচারনা চালায়।
লীগ সবসময় মুসলিম সংহতির উপর জোর দিতে লাগল ; কারণ, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন কায়েম করতে গেলে মুসলমানদের একত্রিত করা অপরিহার্য। কার্যত এটিই হল, মুসলিম লীগের নির্বাচনী ইস্তেহারের মূল বক্তব্য। কৃষক-প্রজা পার্টি মনে করল, মুসলিমদের একত্র করতে অভিজাত নওয়াব আর জমিদারদের ঐক্য কোনদিনও বাংলার কৃষকদের কাছে প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন অর্থবহ করতে পারবে না। অর্থবহ তখনই হবে, প্রদেশে যখন সবার মৌলিক চাহিদা বা অন্য কথায় প্রত্যেকের জন্য অন্তত “ডাল-ভাত”-এর যােগান হবে।৪৫ বাস্তবিক পক্ষে মুসলিম লীগের স্লোগান “মুসলিম ঐক্য” অথবা কংগ্রেসের শ্লোগান “স্ব-রাজ”-এর থেকেও কৃষক-প্রজা পার্টির “ডাল-ভাত” স্লোগানটি সকলের মন আকৃষ্ট করল । কেননা ঐসব শ্লোগান হল, তাঁদের সমস্যাগুলাে নিয়ে পরিবেষ্টিত।
এ পর্যায়ে প্রধান তিনটি দলের নির্বাচনী কৌশল পর্যবেক্ষণ করা যেতে পারে। কংগ্রেস হল মুখ্যত একটি হিন্দু সংগঠন, অন্যদিকে মুসলিম সাম্প্রদায়িক বন্ধন উচ্চে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য খাঁটি মুসলিম দল মুসলিম লীগ প্রতিজ্ঞাবদ্ধ।
৫০
কৃষক-প্রজা পার্টি সম্পূর্ণভাবে মুসলমানদের কোন সংগঠন নয়, কেননা এতে অনেক হিন্দু নেতা এবং নিম্নবর্ণের প্রতিনিধিত্বের হিন্দু ছিলেন। এ পরিস্থিতিতে মুসলিম আসনগুলােতে কংগ্রেসের আর সাধারণ নিম্নবর্ণের হিন্দুদের আসনগুলাের ক্ষেত্রে কৃষক-প্রজা পার্টি ও মুসলিম লীগের কেমন আচরণ হবে ? বাংলাতে রাজনীতির মেরুকরণ হিসেবে তখন হিন্দু ও মুসলমানরা সম্পূর্ণভাবে দুই ধারায় বিভক্ত হয়ে পড়েছে। কংগ্রেস চিন্তা করেও স্থির করতে পারল না যে, মুসলিম আসনগুলােতে তারা কিভাবে প্রার্থী দেবে, আর কোন মুসলমানও চাইবে না কংগ্রেসের হয়ে নির্বাচনে লড়তে । অন্যদিকে কৃষক-প্রজা পার্টিও সাধারণ আসনে নির্বাচন করা থেকে বিরত থাকল। কৃষক-প্রজা পার্টি সিডিউল কাস্টের আসনগুলােতেও নির্বাচন করতে পারছিল না, পাছে এমন গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে, মুসলিম লীগই হল একমাত্র দল যারা মুসলিমদের চাহিদা পূরণের যােগ্যতা রাখে। যাহােক, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে মুসলিম আসনে নির্বাচন না করার সিদ্ধান্ত হওয়ায় কৃষক-প্রজা পার্টি যথেষ্ট লাভবান হল। এতে তারা নিজেদের মুসলিম দল হিসেবে চিহ্নিত করার সুযােগ পেল এবং মুসলিম আসনে লড়াই করার সিদ্ধান্ত নিতে পারল যেখানে একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী হল মুসলিম লীগ।

– তিন –
নিজেদের নির্বাচনী ইস্তেহার ও নির্বাচন পরিকল্পনা ঠিক করে তিনটি দলই নির্বাচনী প্রচারণায় নেমে পড়ল। মুসলিম আসন নিয়ে মুসলিম লীগ ও কৃষকপ্রজা পার্টি একে অপরকে টেক্কা দিতে লাগল । কিন্তু শক্তির দিক দিয়ে দু দলের মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য ছিল। কৃষক-প্রজা পার্টির প্রার্থীদের থেকে মুসলিম লীগের প্রার্থীরা আর্থিক দিক দিয়ে ছিল অনেক সচ্ছল। এছাড়া ১৯৩৬ সালে যখন ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি গঠিত হয় তখন ৬ জন জমিদার যারা অন্যদের সাথে মিলেমিশে এই পার্টি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁরা প্রত্যেকে এর নির্বাচন তহবিলে ৩০,০০০ হাজার রুপি দান করেছিলেন। আবার বাংলার প্রাদেশিক খলিফা কমিটির কিছু টাকা এইচ. এম. সােহরাওয়ার্দীর হাতে ছিল, যে কমিটির সেক্রেটারি ছিলেন তিনি নিজেই। সর্বোপরি মুসলিম লীগের দু’জন প্রসিদ্ধ নেতা সরকারে ছিলেন একজন খাজা নাজিমুদ্দিন যিনি গভর্নরের এক্সিকিউটিভ
৫১
কাউন্সিলের সদস্য এবং অপরজন নওয়াব কে. জি. এম. ফারুকী – যিনি প্রাদেশিক সরকারের মন্ত্রী ছিলেন।
এজন্য তারা সরকারি যানবাহন ও সরকারি পদবি ব্যবহার করার সুযােগ পেয়েছিলেন। অপরদিকে কৃষক-প্রজা পার্টির অর্থ-বল ছিল খুবই দুর্বল। এছাড়া যে গুটিকয়েক জমিদার, তালুকদার ও ধনী ব্যক্তি সাথে ছিলেন তারা নিজেদের নির্বাচনী প্রচারণা করতে গিয়ে দলে কোন অর্থের যােগান দিতে পারেননি।
সংবাদ-সাময়িকপত্র ব্যবহার করে গুজব ছড়ানাের ক্ষেত্রেও দু’ দলের মধ্যে কোন তুলনা চলে না। ময়মনসিংহ শহরতলী থেকে অল্প সংখ্যায় প্রকাশিত সাপ্তাহিক পত্রিকা চাষী ছাড়া কৃষক-প্রজা পার্টির আর কোন পত্রিকা বা সাময়িকপত্র ছিল না। অথচ লীগের দুটি দৈনিক পত্রিকা ছিল, একটি ইংরেজি পত্রিকা দ্য স্টার অব ইন্ডিয়া৪৮ এবং অপরটি বাংলা পত্রিকা দৈনিক আজাদ।৪৯
মুসলিম লীগের সারা বাংলায় বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক পত্রিকা মােহাম্মদী ছিল।৫০
নির্বাচনী প্রচারণায় এসব পত্রিকাগুলাের সদ্ব্যবহার মুসলিম লীগ পুরােপুরি করতে পেরেছিল। মুসলিম লীগের এসব সুবিধার বিপরীতে কৃষক-প্রজা পার্টির আশা হল, তাদের প্রতি ভােটারদের উৎসাহ ও সমর্থন, আর এটি হয়েছে বিশেষত কৃষিব্যবস্থার সংস্কার ও ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদের মত কর্মসূচি দলটি স্থির করতে পেরেছিল। এর সাথে বিপুল সংখ্যক কৃষকের সমর্থন ছিল। প্রতিপক্ষের তুলনায় আরও কিছু বিশেষ সুবিধা এ দলটির ছিল। দলে একগুচ্ছ ত্যাগী কর্মী ও ছাত্র ছিল যারা বনেদী ঘরানার রাজনীতির বিপক্ষে লড়াই চালানাের মানসিকতা ধারণ করত । এছাড়া কৃষক-প্রজা পার্টির নেতারা গ্রামের লােকদের সংস্পর্শে থাকায় তারা সহজেই আঞ্চলিক ভাষায় তাদের সাথে কথা বলত। ওদিকে মুসলিম লীগের প্রভাবশালী বেশ কয়েকজন নেতা যেমন নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং এম. এ. এইচ. ইস্পাহানি বাংলাভাষায় তেমনভাবে অনর্গল কথা বলতে পারদর্শী ছিলেন না।৪১
৫২
নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হল ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি এবং ১৯৩৭ সালের প্রথম সপ্তাহে। যখন প্রতিনিধিত্বকারী দলগুলাের প্রার্থী বাছাই চূড়ান্ত হল তখনই এ প্রচারণা নতুন মাত্রা পেল। নির্বাচনী প্রচারণায় মুসলিম লীগ কৃষক-প্রজা পার্টির দুর্নাম করতে কৌশল অবলম্বন করল, তারা প্রচার করা শুরু করল যে, কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে কংগ্রেসের যােগাযােগ রয়েছে আর তারা সাম্প্রদায়িকতা উসকে দিচ্ছে। নিজেদেরটি সত্যিকারের প্রজা পার্টি উল্লেখ করে লীগ সবাইকে জানাতে লাগল, ছিন্নমূল মুসলিম কৃষকগােষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা পূরণে তাদের দলের মত অবদান আর কোন দল রাখতে পারবে না। এ বিষয়গুলাে তুলে ধরতে তারা সভা-সমাবেশ করল এবং পত্র-পত্রিকায় গুজব ছড়াতে লাগল। এছাড়া মােল্লা আর মৌলভীদের এনে কৃষক-প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে ফতােয়া হাজির করতে লাগল। এভাবে ফুরফুরা শরীফের বিখ্যাত পীর শাহ সুফী মাওলানা আবু বকর ফতােয়া জারি করলেন, “মুসলিম লীগ সত্যিকার মুসলিমদের দল হওয়ায় এবং আসল মুসলিম প্রজা সমিতি হওয়ায় তাদের বিপক্ষে গিয়ে কৃষক-প্রজা পার্টিকে ভােট প্রদান আর কংগ্রেসের অধীনে কাজ করার অর্থ হল, মুসলিম সম্প্রদায়ের মৃত্যু ডেকে আনা।”৫২
মুসলিম লীগের পত্রিকাগুলাে ফজলুল হক এবং তাঁর পার্টির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লাগল। দৈনিক আজাদ এবং স্টার অব ইন্ডিয়া – এ দুটি পত্রিকা ফজলুল হককে ব্যক্তিগত আক্রমণ শুরু করল। স্টার অব ইন্ডিয়া লিখল, “মুসলমান ভােটারগণ জেগে উঠ ! তােমরা কি চাও কংগ্রেসের লােকেরা বাংলা শাসন করুক ? যদি না চাও তাহলে ফজলুল হককে পিছে ঠেলে দাও আর প্রজা পার্টিকে ধ্বংস কর।”৫৩
* আজাদ পত্রিকাটি ফজলুল হক এবং তাঁর দলকে অত্যন্ত রূঢ় ভাষায় নিন্দা করল। এক সম্পাদকীয়তে মন্তব্য করা হলঃ
“সম্মানিত ফজলুল হক ভুলে যাচ্ছেন, ১৯৩৫ সালের প্রজা সম্মেলন। থেকে শুরু হওয়া তাঁর কৃষক-প্রজা পার্টির যাত্রাটি ক্রমেই কারবালার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। ধ্বংস অবধারিত।”৫৪
নির্বাচনী প্রচারণা যখন তুঙ্গে তখন জিন্নাহ নিজে বাংলায় এলেন এবং লীগের প্রার্থীদের পক্ষে জেলায় জেলায় ঘুরলেন এবং অনেক জনসভায় ভাষণ দিলেন।
৫৩
১৯৩৭ সালের ৩ জানুয়ারি কলকাতার মােহাম্মদ আলী পার্কের এক জনসভায় তিনি মুসলিম লীগের পতাকাতলে সবাইকে শামিল হতে অনুরােধ করলেন আর যারা রাতারাতি সব সমস্যা সমাধানের আশা দেখাচ্ছেন তাদের কথা বিশ্বাস না করতে আহ্বান জানালেন।
কংগ্রেস নেতারা কৃষক-প্রজা পার্টিকে সর্বতােভাবে সাহায্য করায় পরােক্ষ ইঙ্গিতে জিন্নাহ মুসলমানদের বিরক্ত না করতে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের সতর্ক করে দিলেন।৫৫ ঢাকার একটি মিটিং-এ জিন্নাহ মন্তব্য করলেন ঃ
“তারা স্বার্থপর এবং মুসলমানদের ঐক্যের পথে তারা বাধাস্বরূপ।”৫৬
খাজা নাজিমুদ্দিন এবং এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দীও বিভিন্ন জেলায় গেলেন এবং মুসলিম লীগের প্রার্থীদের প্রতি সমর্থন যােগাতে অনেক জন-সমাবেশ করলেন। সৰ সভাতেই তারা ফজলুল হক সাহেবকে ব্যক্তিগতভাবে আক্রমণ করলেন আর তাঁকে কংগ্রেস এবং হিন্দু মহাসভার দোসর বলে চিহ্নিত করলেন। বস্তুত পত্রপত্রিকা ব্যবহার করে মুসলিম লীগ যেভাবে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে গুজব ছড়াতে লাগল তাতে মনে হতে লাগল যেন লড়াইটা শুধু হক আর মুসলিম লীগের মধ্যেই চলছে। এজন্য কৃষক-প্রজা পার্টি তাদের প্রচারাভিযানের কৌশল পরিবর্তন করল। লীগের মত পত্র-পত্রিকায় ভর করে গুজব ছড়ানাে বাদ দিয়ে তারা সকলে গ্রামাঞ্চলের নির্বাচনী এলাকায় গিয়ে প্রচার-কাজ চালাতে লাগলেন। তাঁরা ভােটারদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভােট চাওয়া ও জনসভার উপর বেশি মনােযােগ দিলেন। তাঁরা হাটে গিয়ে এবং নামাযের সময়ে মসজিদে গিয়ে সবার সাথে জনসংযােগ করতেন। মুসলিমদের ঐক্য সম্পর্কে মুসলিম লীগ যে ধরনের কথা বলে, তেমন কথার বিপরীতে প্রজা পার্টি কোন সমাবেশে কোন ধরনের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দেয়নি। বাংলার মুসলমানদের মধ্যে ৯০ ভাগ কৃষক তাই জমিদার বাদে কৃষক শ্রেণীর সকলের দ্বারে দ্বারে গিয়েই মুসলিমদের মাঝে ঐক্য গড়ে তােলা সম্ভব।৫৭ তাঁরা সকলকে বােঝাল, জমিদারী প্রথা বাতিল অথবা প্রজাজমিদার সম্পর্কের পরিবর্তন আনার বিষয়ে লীগ কখনও রাজি না। তাই তাদের ভােট দিলে মুসলিম জমিদাররা হিন্দু জমিদারদের সাথে এক হয়ে প্রজাদের অবস্থা আরও দুর্বিষহ করে তুলবে।
৫৪
নির্বাচনের প্রাক্কালে পটুয়াখালী অঞ্চল সবার আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হল। নির্বাচনী এ আসনটিতে দুই দলের দুই শক্তিধর নেতা ফজলুল হক এবং মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন তাঁদের শক্তি পরীক্ষার ভােটযুদ্ধে অবতীর্ণ হন। পটুয়াখালী নিজ জমিদারী অঞ্চল হওয়ায় খাজা নাজিমুদ্দিন ভাবলেন এ এলাকা থেকে সহজেই তিনি ফজলুল হককে পরাজিত করতে পারবেন। কিন্তু তিনি পরে বুঝলেন, জনগণের সমর্থনই হল হকের প্রধান হাতিয়ার এবং তা দমাতে সারা বাংলার মাওলানা ও মৌলভীদের ডেকে এনে তিনি গ্রামবাসীকে বােঝানাের কাজে লাগালেন যাতে করে তারা ফজলুল হককে ভােট না দেয়।৫৮ এমনকি লীগের অনুগত পাঞ্জাবের মুসলিম ছাত্র এনডব্লিউএফপি ও যুক্ত প্রদেশের নেতা-কর্মীদের ডেকে এনে খাজা নাজিমুদ্দিনের পক্ষে প্রচারাভিযান চালানাে হল।৫৯ পাশপাশি নওয়াবের এস্টেটের কর্মকর্তা-কর্মচারী এবং অনেক মুসলিম আইনজীবিও এ কাজে অংশ নিলেন। লীগের বিপরীতে কাজ করতে গিয়ে ফজলুল হক মাওলানাদেরও তাঁর দলের কর্মী ও ছাত্রদের পাশাপাশি নির্বাচনী কাজে অন্তর্ভুক্ত করলেন।৬০ মূলত তিনি তাঁর বাগ্মিতা ও জনসাধারণের মনে তার প্রতি ভালবাসার উপরই বেশি নির্ভরশীল ছিলেন। পটুয়াখালীর এক নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি ঘােষণা করলেন ঃ
আজ থেকে জমিদার ও কৃষকদের মধ্যে প্রাণপণ যুদ্ধ শুরু হল। আল্লাহর অনুগ্রহে আমি অল্প সময়ের মধ্যে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ করব। আট কোটি বাঙালি মাথা উঁচু করে দাঁড়াবে এবং তাদের প্রাপ্য সুযােগ-সুবিধা ভােগ করবে। আল্লাহ আমাদের সাথে আছেন আর আমাদের বিজয় নিশ্চিত। আল্লাহ না করুক, যদি আমার পরাজয় ঘটে তবে তা নেপােলিয়ানের ওয়াটারলু’র পরাজয়ের থেকেও মহিমান্বিত হবে।৬১
নির্বাচনের ফলাফলের লক্ষণীয় দিক ছিল লীগের মদদপুষ্ট স্বতন্ত্র মুসলিমরা সবচেয়ে অধিক আসন পেল। কৃষক-প্রজা পার্টি হল তৃতীয়। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা দুটি বিশেষ আসনসহ ৪৩টি, মুসলিম লীগ ৪টি বিশেষ আসনসহ ৩৯টি, কৃষক-প্রজা পার্টি ৩৬টি এবং ত্রিপুরা কৃষক সমিতি ৫টি আসনে জয়লাভ করল। যদিও লীগ বেশি আসন পেয়েছিল, তবুও মজার বিষয় হল কৃষক-প্রজা পার্টি বা স্বতন্ত্র মুসলিম দলে যতগুলাে ভােট পড়েছে, লীগের পক্ষে ততগুলাে ভােট পড়েনি।
৫৫
মুসলিম লীগ শহর এলাকার ৬১.৪৭% ভােট, গ্রাম এলাকার ২৬.৫২% ভােট এবং সব মিলিয়ে ২৭.১০% মুসলিমদের ভােট পেয়েছিল। অন্যদিকে কৃষকপ্রজা পার্টি শহরতলীর ১৫.৩৯% ভােট, গ্রাম এলাকার ৩১.৭৮% ভােট এবং ৩১.৫১% মুসলিমদের ভােট পেয়েছিল। পটুয়াখালীর সব গুরুত্বপূর্ণ আসনে ফজলুল হক ১৩,৭৪২ ভােট পেয়ে নাজিমুদ্দিনের প্রাপ্ত ৬৩০৮ ভােটের বিপরীতে বিজয়ী হয়েছিলেন। তাই ১৯৩৭ সালের নির্বাচনটি বাংলায় লীগের অবস্থান যেমন পাকাপােক্ত করেছিল তেমনি ফজলুল হক ও তাঁর দল কৃষক-প্রজা পার্টির অবস্থান ঐ প্রদেশের জনসংখ্যা অধ্যুষিত গ্রামগুলােতে মজবুত হয়েছিল।

তথ্যসূত্র ঃ
১. প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এওয়ার্ড এবং বঙ্গীয় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের জন্য আনুপাতিক হারে বাংলার আইন পরিষদের আসন বিন্যাসের বিষয়ে জানতে দেখুন ঃ “ইস্ট ইন্ডিয়া (সংবিধান সংশােধন) ও কমিউনাল ডিসিশন ১৯৩২” সিএমডি ৪১৪৭।
২. কমিউন্যাল এওয়ার্ড-এর অধীনে বাংলার আইন পরিষদের আসন বিন্যাস ঃ মােহামেডান ১১৯ (২টি মহিলা আসনসহ), সাধারণ (হিন্দু) ৮০ (৫টি মহিলা আসন এবং ১০টি দলিত শ্রেণী) ; ইন্ডিয়ান খ্রিস্টান ২ ; এ্যাংলাে ইন্ডিয়ান ৪ (১টি মহিলা আসনসহ); ইউরােপীয়ান ১১ ; কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রি, মাইনিং এন্ড প্লান্টিং ১৯; ভূমির মালিক ৫; ইউনিভার্সিটি ২; লেবার ৮।
৩. উচ্চবর্ণ ও দলিত শ্রেণীর হিন্দু, এদের মধ্যে ভাগ করা হল যা পুনা-প্যাক্ট নামে পরিচিত, যেখানে তাদেরকে পূর্বেই প্রদান করা হয়েছে এমন আসন ছেড়ে দেয়ার বিনিময়ে অতিরিক্ত ২০টি আসন দেয়া হল, এতে তারা ৩০টি আসন বেশি পেল আর উচ্চবর্ণের হিন্দুদের আসন কমে দাঁড়াল ৫০টিতে। দেখুন ঃ আর. কৌপল্যান্ড ও “ইন্ডিয়া ও এ রিএস্টেটমেন্ট” (লন্ডন, ১৯৫৪), পৃষ্ঠা ১৪১।
৪. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), সম্পাদকীয়, ১৭ আগস্ট ১৯৩২।
৫. “এডভান্স” (কলকাতা), ১৭ ও ১৮ আগস্ট ১৯৩২।
৬. ঐ
৭. লিবার্টি (কলকাতা), ২ আগস্ট ১৯৩২।
৮. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ২৮ সেপ্টেম্বর ১৯৩২।
৯. একজন সমসাময়িক পর্যবেক্ষকের বর্ণনা মতে, ১৯৩৭ সালের নির্বাচনের আগে লীগের অবস্থা ছিল ঃ “নামসর্বস্ব ও মৃতপ্রায় দল।” দেখুন ঃ এ. এম. আহমেদ “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” (ঢাকা, ১৯৭৩), ৩ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১১৬।
১০. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ২৫ মে ১৯৩৬। দলের অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ নেতারা ছিলেন – নওয়াব খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দীন, খাজা নূরুদ্দীন, নওয়াব
৫৬
মােশাররফ হােসেন, স্যার কে. জি. ফারুকী, স্যার এ. এইচ. গজনভী, খান বাহাদুর আজিজুল হক, মাওলানা আকরম খাঁ, এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী, এ, আর, সিদ্দিকী, এম, এ, এইচ ইস্পাহানি, তমিজুদ্দীন খান এবং খান বাহাদুর আবদুল মােমেন।
১১. দি স্টেটস ম্যান (কলকাতা), ২৫ মে ১৯৩৬।
১২. দলের প্রেসিডেন্টের পদ নিয়ে মাওলানা আকরম খাঁ ও খান বাহাদুর আবদুল মােমেনের সাথে ফজলুল হক এবং তার সংস্কারপন্থী নেতাদের মতপার্থক্য ঘটায় তারা প্রজা পার্টি থেকে বের হয়ে যান।
১৩. এ. এম. আহমেদ, প্রাগুক্ত ৯, পৃষ্ঠা ১১৪।
১৪. দি এস্টেটস ম্যান (কলকাতা), ১৬ জুন ১৯৩৬।
১৫. ঐ।
১৬. ঐ, ৩০ জুন ১৯৩৬।
১৭. ১৯৩৬ সালের ১১ ও ১২ এপ্রিল বােম্বেতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের ২৪তম বার্ষিক সভাতে জিন্নাহর নেতৃত্বে বাের্ডটি আগেই তৈরি করা হয়েছিল । দেখুন ঃ লিয়াকত আলী | খান, “রেজুলেশন অব দ্য অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ – মে ১৯২৪ টু ডিসেম্বর ১৯৩৬” (দিল্লী এন. ডি.) রেজুলেশন ৯।
১৮. এম. এ. এইচ, ইস্পাহানি, “কয়েদ-ই-আযম জিন্নাহ এজ আই নিউ হিম” (করাচি ১৯৬৭), সংস্করণ ২, পৃষ্ঠা ১৪-১৬।
১৯. ঐ, পৃষ্ঠা ২০।
২০. মডার্ন রিভিউ, ভলিউম ৬০, নং ২, জুলাই ১৯৩৬, পৃষ্ঠা ১০৭ এবং “ইন্ডিয়ান রিভিউ’, ভলিউম ৩৮, নং ৮, আগস্ট ১৯৩৬, পৃষ্ঠা ৪৯৫।
২১. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ১৬ জুলাই ১৯৩৬ এবং “ইন্ডিয়ান অ্যানুয়াল রেজিস্টার”, ভলিউম ২, ১৯৩৬, পৃষ্ঠা ২৬৬।
২২. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ১১ আগস্ট ১৯৩৬।
২৩. প্রাগুক্ত, ২০ আগস্ট ১৯৩৬।
২৪. এম, এইচ, ইস্পাহানি, প্রাগুক্ত ১৮, পৃষ্ঠা ২৭।
২৫. কৃষক-প্রজা পার্টির হয়ে প্রতিনিধিত্বকারী আবুল মনসুর আহমেদ অভিযােগ করলেন, ইউনাইটেড মুসলিম পার্টির লােকদের জিন্নাহ আলােচনার সময় যে সাথে করে নিয়ে এসেছেন – তা মূলত কৃষক-প্রজা পার্টির নেতাদের তিনি আগে জানাননি। দেখুন ঃ আহমেদ প্রাগুক্ত ৯, পৃষ্ঠা ১১৯।
২৬. ফজলুল হক, স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ৩০ অক্টোবর ১৯৩৬।
২৭. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা) ২৫ আগস্ট ১৯৩৬, এছাড়া অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ২৬ আগস্ট ১৯৩৬।
২৮. আহমেদ। এন – ৯, পৃষ্ঠা ১১৮।
২৯. ঐ, পৃষ্ঠা ১৯৯।
৩০. “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ২৫ আগস্ট ১৯৩৬।
৫৭
৩১. ঐ।
৩২. হুমায়রা মােমেন মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ঃ এ স্টাডি অব দি কৃষক-প্রজা পার্টি এন্ড দ্য ইলেকশনস অব ১৯৩৭ (ঢাকা, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ৫০।
৩৩. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬।
৩৪. ঐ। এছাড়া “স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬।
৩৫. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬।
৩৬. কামরুদ্দীন আহমেদ, “এ সােশ্যাল হিস্টরী অব বেঙ্গল” (ঢাকা, ১৯৬৭), ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৩।
৩৭. তাঁরা হলেন ঃ নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ, নওয়াব খাজা নাজিমুদ্দীন এবং খাজা শাহবুদ্দিন, দেখুন ঃ ঐ, পৃষ্ঠা ৩৪।
৩৮. তাঁরা হলেন ঃ এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী, স্যার এ. এফ. রহমান এবং মাওলানা আকরম খা। দেখুন ঃ ঐ ।
৩৯. জিন্নাহর মনােনীতরা হলেন ঃ আহমেদ ইস্পাহানি, আদমজী হাজী দাউদ, ফাইজুল্লাহ গাজী এবং আবদুল আজীজ আনসারী । ঐ, আরও দেখুন ঃ “স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ২৫ আগস্ট ১৯৩৬।
৪০. কালিপদ বিশ্বাস, যুক্ত বাংলার শেষ অধ্যায় (কলকাতা, ১৯৬৩), পৃষ্ঠা ৩৩।
৪১. কলকাতা ইউরােপীয় এসােসিয়েশন আয়ােজিত এক মধ্যাহ্ন ভােজের নিমন্ত্রণে যােগ দিয়ে খাজা নাজিমুদ্দিন ইউনাইটেড মুসলিম পার্টিকে তাদের সমর্থন দিতে অনুরােধ করেন আর আশ্বস্ত করেন যে, তাদের সহযােগিতা করলে ইউরােপীয় ইউনিয়নের স্বার্থ সংরক্ষণ করা হবে। দেখুন ঃ “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ২৯ জুলাই ১৯৩৬।
৪২. কালিপদ বিশ্বাস, পৃষ্ঠা ৩৪।
৪৩. এম. এ. জিন্নাহকে ফজলুল হকের চিঠি, “স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ৩০ অক্টোবর ১৯৩৬।
৪৪. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১৭ নভেম্বর ১৯৩৬, আরও দেখুন ঃ আবুল মনসুর আহমেদ, পৃষ্ঠা ১১৩।
৪৫. ভাত এবং ডাল – দরিদ্র বাঙালীর প্রধান খাদ্য।
৪৬. শীলা সেন, “মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ১৯৩৭-১৯৪৭” (দিল্লী, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা ৮২।
৪৭. এটা বলা মুশকিল যে, সরকারি জিনিসপত্র নিজেদের কাজে কি পরিমাণে লীগ ব্যবহার করেছিল। তবে এ বিষয়ে শুধুমাত্র কৃষক-প্রজা পার্টিই অভিযােগ তােলেনি, অন্যান্য পর্যবেক্ষকরাও এ অভিযােগ এনেছিলেন। জনৈক এসেক্স অধিবাসী (লন্ডন) মিঃ এন্থনী গ্রিনউড ১৯৩৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত নিউ স্টেটসম্যান ও “নেশন অব লন্ডন” পত্রিকায় চিঠি পাঠিয়ে অভিযােগ করেন, তিনি জানতে পেরেছেন যে, সরকারি কর্মকর্তারা নির্বাচনী প্রচারণার অনুমতি পেয়েছিলেন এবং কৃষক-প্রজা পার্টিতে যােগ দেয়া থেকে জনগণ যেন বিরত থাকে তার জন্য প্রচার চালানাের নির্দেশও পেয়েছিলেন। মডার্ন রিভিউ-তে উল্লেখ করা হয়েছে। (কলকাতা, ১৯৩৬), পৃষ্ঠা ৫৯৭ – ৯৮।
৫৮
৪৮. স্টার অব ইন্ডিয়া পত্রিকাটির কার্যক্রম শুরু হয় ১৯৩২ সালে। এর মালিক ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন এবং এতে কিছু পরিমাণ অর্থায়ন করেন ইস্পাহানি। পত্রিকাটির সম্পাদক ছিলেন, একজন ইংরেজ যার নাম এ্যাটকিনসন।
৪৯. সরকারের অনুদানে ১৯৩৬ সালের অক্টোবর মাসে “আজাদ” পত্রিকা যাত্রা শুরু করে। আর এটি করেন মাওলানা আকরম খাঁ। মওলানা নিজেই ঐ পত্রিকার মালিক ছিলেন।
৫০. সাপ্তাহিক ও মাসিক মােহাম্মদী” পত্রিকা দুটির মালিক ছিলেন মওলানা আকরম খাঁ।
৫১. উদাহরণস্বরূপ ১৯৩৬ সালের ডিসেম্বরে “বেঙ্গল মুসলিম ইলেক্টোরস বাের্ড”-এর এক সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে ঢাকার নওয়াব ভাল বাংলা বলতে না পারায় সেই লিখিত বক্তব্যটি জনৈক মৌলভী আবদুস সামাদকে দিয়ে পাঠ করান। এজন্য দেখুন ঃ “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ২১ ডিসেম্বর ১৯৩৬। আরও দেখুন : স্যার রবার্ট রেইড, “ইয়ারস অব চেঞ্জ ইন বেঙ্গল এন্ড আসাম” (লন্ডন, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ১২১।
৫২. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ১৪ নভেম্বর, ১৯৩৬।
৫৩. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ১১ জানুয়ারি, ১৯৩৭।
৫৪. আজাদ (কলকাতা), সম্পাদকীয়, ২১ জানুয়ারি, ১৯৩৭।
৫৫. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ৪ জানুয়ারি, ১৯৩৭।
৫৬. দি স্টেটসম্যান (কলকাতা), ৯ জানুয়ারি, ১৯৩৭।
৫৭. আবুল মনসুর আহমেদ, আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর, পৃষ্ঠা ১২৭।
৫৮. “আনন্দবাজার পত্রিকা” (কলকাতা), ১০ জানুয়ারি, ১৯৩৭।
৫৯. এ. এস. এম. আবদুর রব, “এ. কে. ফজলুল হক ঃ লাইফ এও এচিভমেন্টস” (লাহাের, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ৮৮।
৬০. বি, ডি, হাবীবুল্লাহ, “শের-ই-বাংলা” (ঢাকা, ১৯৬৩) পষ্ঠা ৬৬।
৬১. উদ্ধৃত, এ. এস, এম, আবদুর রব ৫৯, পৃষ্ঠা ৯০।
৬২. “গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ১২৯/৩৭; ইলেকশন রেজাল্ট ইন
ইণ্ডিয়া ১৯৩৭, সিএমডি ৫৫৮৯।
৫৯
পঞ্চম অধ্যায়
হকের পশ্চাদপসরণ
লীগের সাথে জোট গঠন
(১৯৩৭-১৯৪১)

– এক –
১৯৩৬ – ১৯৩৭ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফলটি ছিল বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। কোন রাজনৈতিক বড় দলই যেমন কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টি এককভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের মত সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভ করতে পারেনি। তাই কংগ্রেস, মুসলিম লীগ, কৃষক-প্রজা পার্টি, স্বতন্ত্র মুসলিম, স্বতন্ত্র হিন্দু এবং ইউরােপীয় দলের মত নামকরা দলগুলাের মধ্যে সরকার গঠনের জন্য জোট গঠন করা অপরিহার্য হয়ে উঠে। যেহেতু মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টি নির্বাচনে একে অপরের প্রধান বিরােধী দল ছিল, তাই এ দু’ দলের মধ্যে কোয়ালিশন বা জোটগঠনের সম্ভাবনা একেবারেই ছিল না। একক বড় দল হিসেবে সমমনা দলকে নিয়ে কংগ্রেস সরকার গঠন করতে পারত। আর সবার ধারণা ছিল কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা পার্টি যেহেতু কোন সাম্প্রদায়িক সংগঠন নয় তাই এদের মধ্যে জোট হলে সেটিই সবচেয়ে ভাল হবে। দুটি দলের একত্রে ৯৬টি আসন ছিল, আর মাত্র ৩০ জন সদস্য পেলেই তারা সরকার গঠন করতে পারবে। তারা সহজেই হিন্দু ও মুসলিম স্বতন্ত্র সদস্য থেকে ৩০ জন সদস্যকে কোয়ালিশন বা জোটে অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হত। ভােটের আগে কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা পার্টির১ মধ্যে যেমন সুন্দর একটি সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল তাতে করে আশা জেগেছিল যে, এ দু’ দল জোট হয়েই বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠন করবে। যাহােক, সমস্যা আরও ঘনীভূত হল যখন দেখা গেল বাংলার কংগ্রেস নেতাদের অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি অফিস নেয়ার বিষয়ে তখনও পর্যন্ত কোন
৬০
সিদ্ধান্ত দিতে পারল না। নির্বাচনের অদ্ভুত ফলাফল আর অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটির মৌনতায় বাংলার কংগ্রেস নেতৃবৃন্দ হককে নিয়েই মন্ত্রিসভা গঠন করে সহজে মুসলিম লীগকে আটকাতে পারত। কিন্তু প্রাদেশিক কংগ্রেসের এ নেতারা বাংলার সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক অবস্থার পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হলেন। ফলে সব কিছু অনুকূলে থাকার পরও কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা পার্টির মধ্যকার জোট গঠন বাস্তব রূপ নিতে পারল না।
১৯৩৭ সালে জানুয়ারির শেষের দিকে নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশের পরপরই, হক এবং তাঁর দল জোট গঠনের লক্ষ্যে কংগ্রেসের সমর্থন পেতে তাঁদের সাথে আলােচনা শুরু করে।২ শুরুতে আলােচনাটি এমন এক জায়গায় গিয়েছিল যা দেখে মনে হচ্ছিল, এখন শুধু চুক্তিতে স্বাক্ষরের অপেক্ষা। কিন্তু তখনই, মন্ত্রিসভার কর্মসূচির মধ্যে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে কোন কাজটি আগে সম্পন্ন করা হবে তা নির্ধারণে মতবিরােধ তৈরি হল।৩ ঐ আলােচনায় অংশ নেয়া আবুল মনসুর আহমেদ সর্বপ্রথম ঐ মতপার্থক্যের বিষয়ে বিস্তারিত তুলে ধরেন। তিনি প্রকাশ করেন, ঐ চূড়ান্ত চুক্তিপত্রে স্বাক্ষরের জন্য উভয় দলের নেতারা জে. এম. সেনগুপ্তের বাসায় একত্রিত হয়েছিলেন। চুক্তিতে মন্ত্রিসভার কার্যপ্রণালীর ধারা ছিল এমন ঃ
ক, স্ব-রাজ বা স্ব-নিয়ন্ত্রিত সরকার ব্যবস্থার দাবি উত্থাপন
খ. রাজবন্দিদের মুক্তি
গ. প্রজাস্বত্ব আইনের সংশােধন
ঘ. দেনাদার আইন পাস ইত্যাদি।
আবুল মনসুর আহমেদ এ ক্রমধারা বদল করতে চাইলেন আর (খ) ধারা-কে। (গ) এবং (ঘ)-এর পরে আনলেন। তার যুক্তি ছিল ? যদি গভর্নর রাজবন্দি মুক্তির বিষয়টি নামঞ্জুর করেন আর তাতে অসন্তুষ্ট। পরিবর্তন সাধনের আগেই যদি তারা মন্ত্রিসভা থেকে ইস্তফা দেয়, তবে তা হবে। কৃষক-প্রজা পার্টির দেয়া নির্বাচনী ওয়াদার বরখেলাপ ; এখানে প্রথমে দরকার প্রজাদের স্বার্থ রক্ষার্থে কিছু আইন প্রণয়ন আর তারপরই রাজবন্দি মুক্তির বিষয় তােলা উচিত। কিন্তু কংগ্রেস নেতারা ঐ যুক্তি মানলেন না; তারা বুঝাতে চাইলেন, প্রজাদের অবস্থার পরিবর্তন আর রাজবন্দিদের মুক্তির বিষয়টি একই রকম গণ্য করা উচিত নয়। ফলে, আলােচনাটি সেখানেই পণ্ড হয়ে গেল।৪
৬১
তখনকার পত্রিকাতেও এ বিষয়টি সুনিশ্চিত করা হয়েছে। ১৯৩৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি ফরােয়ার্ড’ পত্রিকা নিউজ ছাপল ঃ
এমন পরিস্থিতে আমরা জানাচ্ছি যে, বাংলার প্রথম মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষেত্রে কংগ্রেস ও কৃষক-প্রজা পার্টির মধ্যে যে জোট গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছিল তা অবশেষে ঝরে পড়ল। রাজবন্দিদের মুক্তির বিষয়টি ধারায় যুক্ত হওয়াতে আশা করা যাচ্ছিল যে, উভয় দল এবার একত্রে কাজ করবে কিন্তু পরে দেখা গেল, প্রজা পাটি গভর্নরের সাথে ঐ বিষয়ে ঝামেলা বাধাতে চায় না । এতে করে কংগ্রেসের জন্য তাদের রাজবন্দিদের মুক্ত করা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াল।
মুসলিম লীগ দূর থেকে এগুলাে পর্যবেক্ষণ করছিল। এদিকে নির্বাচনের ফলাফল ইহাই প্রমাণ করে যে, জিন্নাহ বিপুল সংখ্যক মুসলিম একত্রিত করতে ব্যর্থ হয়েছেন। তিনি স্বীকার করলেন, লীগের পতাকাতলে বিপুল সংখ্যক মুসলমান এলেই এর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হত এবং অনুধাবন করলেন, কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে জোট বাঁধলে তা হয়ত সম্ভব হত। তাঁদের সাথে জোট বাঁধতে পারলে কৃষকপ্রজা পার্টির জনপ্রিয়তা ও হকের পরিচিতিকে তাঁর দল বিশেষভাবে কাজে লাগাতে পারত। তাই কংগ্রেস এবং কৃষক-প্রজা পার্টির মধ্যকার আলােচনা যখন ভেস্তে গেল, তখনই সুযােগটি কাজে লাগিয়ে তারা কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে ঐক্য গঠনের জন্য তাদেরকে প্রস্তাব করল যেখানে হককে প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাব দেয়া হল, যদিও হকের দলটি আইন পরিষদে ছােট ছিল।৫ হকের মন্ত্রিসভা গঠনের অন্য কোন বিকল্প পথ না থাকায় তিনি ঐ প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলেন ; কারণ, কৃষক-প্রজা পার্টির মত নতুন একটি দল হয়েও তারা কৃষক-প্রজাদের ভাগ্য উন্নয়নে অঙ্গীকারাবদ্ধ হয়েছিলেন। আর যদি তারা ক্ষমতায় থেকে রাজনীতি। করতে না পারে তাহলে এক সময় হয়ত পুরাে দলটি নিঃশেষ হয়ে যাবে।
কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে জোট বাঁধতে কংগ্রেসের অসম্মতি ছাড়াও আরেকটি যে বড় কারণে কৃষক-প্রজা পার্টি ও লীগের মধ্যে ঐক্য হয়েছে তাহল, বিপুল সংখ্যক মুসলমানের মধ্যে মুসলিম ভ্রাতৃত্ববােধ জেগে ওঠা। গভর্নরের ভাষায়ঃ
“গণনার মধ্যে একটি কারণও যদি ধরা যায় তাহল, সকল মুসলিম জনতার মধ্যে তৈরি হওয়া প্রবল চেতনাবােধে যেন তাদের নেতারা যেকোন উপায়ে। একত্রিত হয়।”
৬২
চেতনাবােধের জন্ম হয়েছিল মূলত কংগ্রেসের মন্ত্রিসভা গঠন ও তা গঠনের পর ক্ষমতার ভাগাভাগির ক্ষেত্রে তাদের অনিশ্চয়তা থেকে। কলকাতার মুসলিম ঘরানার পত্রিকা গল্প বানাল যে, কংগ্রেস মুসলিমদের বিভক্ত করার চেষ্টা চালাচ্ছিল তাই তারা প্রদেশে সরকার গঠনে মুসলিমদের প্রাপ্য ভাগ দিতে রাজি হচ্ছিল না।৭ এতে মুসলিমদের সাথে জোট গঠনে লীগের সুবিধা হয়েছিল, বিশেষত মুসলিমদের একটি ছাত্রদল যারা একই বছরে অনুষ্ঠিত কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা বার্ষিকীকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা এক বিরােধে ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারা এতে যােগ দিল।৮ ঐ বিরােধটি দ্রুত রাজনীতির রং পায়। ফলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল মুসলিম ছাত্র ও অন্যান্য যুব সংগঠনগুলাে মনে করল, নিজেদের রাজনৈতিকভাবে শক্তিশালী করতে এবং ঐক্য বিনষ্টকারিদের প্রতিহত করতে মুসলিম সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে এ প্রদেশে একটি শক্তিশালী গ্রুপ থাকা প্রয়ােজন।৯ এমন আবেগঘন পরিস্থিতিতে, সত্যিকারের কোন রাজনীতিবিদ চাইবেন না মুসলিম ঐক্য ও রাজনৈতিক সম্প্রীতির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে বিরােধী খেতাব লাভ করুক। আর সেজন্যই কৃষক-প্রজা পার্টি ও লীগের মধ্যকার জোট গঠিত হল।

-দুই-
ফজলুল হকের প্রথম জোট মন্ত্রিসভা ছিল ১১ সদস্যের। প্রধানমন্ত্রীসহ ৫ জন মুসলমান ও ৫ জন হিন্দু মন্ত্রী ছিলেন ; যদিও হিন্দুদের দলটি ছােট ছিল।১১ অনেকেই এ মন্ত্রিসভাকে স্বাগত জানালেও মােটের উপর সকল হিন্দু সম্প্রদায়ই এতে অতটা সন্তুষ্ট হতে পারেনি। তাদের অভিযােগ ছিল ফজলুল হক বিনা। কারণে তাঁর মন্ত্রিসভায় হিন্দুদের নিয়েছেন।১২ মুসলিম মন্ত্রিদের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, এতে কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে ৩ জন এবং মুসলিম লীগ থেকে ৩ জন থাকবে। এভাবে লীগ থেকে মন্ত্রিসভাতে থাকবেন নওয়াব হাবীবুল্লাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন১৩ এবং এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী আর কৃষক-প্রজা পার্টির থাকবেন ফজলুল হক, নওশের আলী আহমেদ এবং শামসুদ্দিন আহমেদ। মন্ত্রিদের নামের চূড়ান্ত তালিকা গভর্নরের কাছে পাঠানাের ঠিক একদিন আগে শামসুদ্দিন আহমেদকে বাদ দিয়ে সেখানে মুসলিম লীগের নওয়াব মােশাররফ হােসেনের
৬৩
নাম দেয়া হয়। ফলে ২ জন সদস্যসহ ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির তুলনায় সেখানে লীগের ৪ জন সদস্য হওয়ায় মন্ত্রিসভাতে লীগের অবস্থান শক্ত হল। এভাবে বাংলার প্রথম মন্ত্রিসভায় বাস্তবিকভাবে লীগের আধিপত্য থাকল। মন্ত্রিদের দফতর বিন্যাস হল ঃ
এ. কে. ফজলুল হক (কৃষক-প্রজা) – প্রধানমন্ত্রী ও শিক্ষার
নলীনিরঞ্জন সরকার (বর্ণ হিন্দু) – অর্থ
খাজা নাজিমুদ্দিন (মুসলিম লীগ) – স্বরাষ্ট্র
বিজয় প্রসাদ সিং (বর্ণ হিন্দু) – রাজস্ব
নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ (মুসলিম লীগ) – কৃষি ও শিল্প
মহারাজা শিরীষ চন্দ্র নন্দী (বর্ণ হিন্দু) – যােগাযােগ ও কর্ম পূর্ত
এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী (মুসলিম লীগ) – বাণিজ্য ও শ্রম
নওয়াব মােশাররফ হােসেন (ঐ) – আইন ও সংসদ
সৈয়দ নওশের আলী (কৃষক-প্রজা পার্টি) – স্থানীয় সরকার ও স্বাস্থ্য
প্রসন্নদেব রায় (হিন্দু তফসিল) – আবগারী ও বন
মুকুন্দ বিহারী মল্লিক (হিন্দু তফসিলি) – কর্পোরেশন, সমবায়, কৃষিঋণ।
মন্ত্রিসভার ধরন, অফিস সহকারী এবং কর্মপন্থা এমনভাবে গঠন করা হল যেন ফজলুল হক ক্ষমতাধর মন্ত্রিদের কৃপায় রয়েছেন এবং মন্ত্রিদের আসল দফতরগুলাের কাজ নাজিমুদ্দিন – মােশাররফ – বিপি সিং-দের দ্বারা একত্রে সম্পন্ন হওয়াতে কৃষক-প্রজা পার্টির দলীয় কর্মসূচিগুলাে পালন করা কঠিন হয়ে পড়ল। মূলত কৃষক-প্রজা পার্টির নেতাগণ মন্ত্রিদের দফতর এভাবে বণ্টন হওয়ায় তারা তাতে সন্তুষ্ট ছিলেন না। প্রজা পার্টির ২৮ জনের দেয়া প্রতিবেদন পেয়েও “জমির ভােগদখল” ও “দেনাদার পাওনাদার” ব্যবস্থা সম্পর্কে তারা বিতর্ক শুরু করল এই বলে যে, শ্ৰেণী-কাঠামাে থাকায় মন্ত্রিদের পক্ষে এর পরিবর্তন আনা কষ্টকর।১৫ পরে এ অংশটি নিজেদের জোট থেকে সরিয়ে নিয়ে স্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি হয়ে বিরােধী দলের আসনে বসল।১৬ ইতােমধ্যে কৃষকপ্রজা পার্টির নেতাদের মধ্যকার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ শামসুদ্দিন আহমেদকে মন্ত্রিসভা থেকে বাদ দেয়ায় বেশ নাখােশ হয়েছিলেন।১৭ পরে তাঁরা নির্বাচনী ইস্তেহারে দেয়া দু দলের নিজস্ব সব কর্মসূচি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভার
৬৪
কার্যক্রমের নতুন একটি প্রােগ্রাম তৈরি করতে ৩ জন কৃষক-প্রজা পার্টির ও ৩ জন লীগের থেকে নিয়ে মােট ৬ জনের একটি পরামর্শক দল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিল।১৮ কিন্তু তখন “মন্ত্রিদের বেতন” এবং “ক্ষতিপূরণ ছাড়া জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ”-এর প্রশ্নে মতবিরােধ দেখা দিল। সমস্যা আরও ঘনীভূত হল যখন কৃষক-প্রজা পার্টির সেক্রেটারি শামসুদ্দিন আহমেদ ২০ জন এমএলএ-সহ পত্রিকায় বিবৃতি দিলেন যে, “ফজলুল হক নির্বাচনী ওয়াদা ভঙ্গ করছেন।”২০ এর ফলে ফজলুল হক কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে ১৭ জনকে বহিষ্কার করে নতুন আদলে কৃষক-প্রজা এসেম্বলী পার্টি গঠন করলেন এবং নতুন অফিস সহকারী নিয়ােগ দিলেন।২১ ইহা এমন এক জটিল সিদ্ধান্ত ছিল যে, এর ফলে কৃষক-প্রজা পার্টিতে আরেকটি ফাটলের সৃষ্টি হল। ফজলুল হকের যখন কৃষক-প্রজা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ অংশের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে গেল তখন তিনি জোটের মধ্যে সংখ্যালঘু হয়ে পড়লেন আর এতে করে আইনসভাতে লীগের অন্যান্য সহকর্মীর উপর তিনি বেশি নির্ভরশীল হয়ে পড়লেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য তিনি কংগ্রেস এবং এর অনুসারীদের সাথে নিতে চেষ্টা চালালেন যদিও তাতে তাঁরা কোন সাড়া দেননি।২২ তাঁর কাজকে ঘিরে ক্রমাগত সমালােচনা, জনসভা ও প্রেসে ব্যক্তিগত আক্রমণ আর নিন্দায় তাঁর অবস্থান আরও অনিশ্চয়তার দিকে যেতে লাগল।২৩ কংগ্রেস থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে হক লীগের উপর বেশি ভরসা করতে লাগলেন। এক্ষেত্রে জিন্নাহর মর্জিমাফিক কিছু সুযােগ-সুবিধা তার ভাগ্যে জুটল যদিও সেগুলাে লীগের নিজেদের সুবিধার জন্য করা হত।
১৯৩৭ সালের ১৫ অক্টোবর লক্ষ্ণৌতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় হাজার করতালির মধ্যে ফজলুল হক জিন্নাহকে আলিঙ্গন করে লীগের অঙ্গীকার পত্রে স্বাক্ষর করলেন আর পরক্ষণেই তিনি কৃষক-প্রজা পার্টির সকল সদস্যকে লীগে যােগ দিতে আহ্বান করলেন।২৪ লীগে হকের যােগদানটি ছিল বাংলার মুসলিম রাজনীতির ইতিহাসে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা। তাঁর এ যােগদানের ফলে বাংলায় একটি প্রতিনিধিত্বমূলক অবস্থান তিনি অর্জন করলেন। পূর্ববাংলার মুসলিম জনগণ ফজলুল হকের প্রতি খুবই অনুরক্ত ছিল আর এ কারণে সবাই তখন লীগকেও সমর্থন করা শুরু করল । লক্ষ্ণৌতে তখন কৃষকপ্রজা পার্টিকে ভাঙ্গার জন্য জিন্নাহ ফজলুল হকের কাছে যে পীড়াপীড়ি শুরু
৬৫
করেছিলেন, তা ফজলুল হক থামাতে পেরেছিলেন। কারণ হিসেবে তিনি জিন্নাহকে বুঝালেন, লীগ হল একটি রাজনৈতিক সংগঠন তাই তাদের মুসলমানদের রাজনৈতিক স্বার্থ দেখা উচিত, কিন্তু কৃষক-প্রজা পার্টির কিছু অর্থনৈতিক কর্মসূচিও রয়েছে আবার যার অনেক সদস্য হিন্দু ; সুতরাং বাংলার বিপুল জনতার অর্থনৈতিক স্বার্থে কৃষক-প্রজা পার্টির সচল থাকা দরকার।২৫ লীগের সাথে যুক্ত হওয়ার পর ফজলুল হক কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে তাঁর যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়নি। তিনি কৃষক-প্রজা পার্টির সভাপতির দায়িত্বে বহাল থাকেন। দুদিকে দায়িত্ব পালন করায় তিনি ভাবলেন, বাংলার জন্য দুটি দলেরই প্রয়ােজনীয়তা রয়েছে ; তিনি যদি কৃষক-প্রজা পার্টির হাল ছেড়ে দেন। তাহলে কংগ্রেস এসে তাদের উপর ভর করতে পারে। আর এদিকে মুসলিম লীগ ছাড়লে মুসলিম সামন্ততান্ত্রিক প্রভুরা তা দখল করে নিতে পারে।২৬ হক কৃষকপ্রজা দলের সমর্থনে ক্ষমতা পেয়েছিল কিন্তু ১৯৩৭ সালে লীগে যােগদান করার পর স্বাভাবিক কৃষক-প্রজা পার্টির কার্যক্রমে তিনি পূর্বের ন্যায় কর্মদক্ষতায় মনােনিবেশ করতে পারেন নি। যদিও তিনি তখনও দলটির সভাপতির দায়িত্বে। রয়েছেন।
বাংলায় এ. কে. ফজলুল হকের প্রথম মন্ত্রিসভা ১৯৩৭ থেকে ১৯৪১ সাল পর্যন্ত স্থায়ী হল। এ সময়ে হকের মন্ত্রিসভা বাংলার মুসলমানদের স্বার্থরক্ষায় কিছু সুবিধাজনক আইন পাস করল। মন্ত্রিসভায় মুসলিম লীগ প্রধান শরীক দল হওয়াতে এসব কাজের সুনাম লীগের নেতারাই পেয়েছিলেন আর বাংলার বিপুল মুসলিম জনগােষ্ঠীর কাছে মুসলিম লীগ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। মন্ত্রিসভার প্রথম কার্যতালিকায় ছিল চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের ভিত্তিতে যেকোন উপায়ে ভূমি রাজস্ব সংক্রান্ত চলমান প্রক্রিয়ার পুনঃসংস্কারে তাৎক্ষণিক একটি কমিটি করা । কিন্তু কিছুকাল ধরে এ বিষয়ে কোন ফলপ্রসূ উপায় বের করা যাচ্ছিল না। তাই ১৯৩৮ সালের শেষের দিকে কংগ্রেস ও স্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্যরা আইনসভাতে ইহা বাস্তবায়নের জন্য যখন চাপ দিলেন তখন স্যার ফ্রান্সিস ফ্লাউডকে চেয়ারম্যান করে সরকার ভূমি রাজস্ব কমিশন গঠন করলেন। ঐ কমিশন চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত ও জমিদারী প্রথার বদলে ‘রায়তী’ প্রক্রিয়া চালু করার সুপারিশ করল – যদিও তা কখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি।২৭
৬৬
এরই মধ্যে সরকার কৃষকদের দুর্দশা লাঘবের জন্য আইনগত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণ করে। প্রজাস্বত্ব আইন (সংশােধনী) বা “বেঙ্গল টেন্যান্সি এ্যাক্ট (সংশােধিত), ১৯৩৮” পাস করা হল। ভূমি মালিকানা হস্তান্তর ফি বা “সেলামী”, বাংলার প্রজাস্বত্ব আইন (সংশােধিত), ১৯২৮-এর অগ্রক্রয়াধিকার এবং ভূমি ব্যবহারের সম্মতি –– এ আইন দ্বারা বাতিল করা হয়। এ আইনে কোন চাষী ২০ বছর কোন জমি ব্যবহার করলে তা ৪ বৎসরের খাজনা পরিশােধের মাধ্যমে নিতে পারবে আর একজন নিমস্বত্ব রায়ত কোন নির্দিষ্ট জমি ক্রমাগত ১২ বছর ব্যবহার করে থাকলে প্রতিযােগিতামূলকভাবে নিয়মিত রাজস্ব প্রদানের ভিত্তিতে সেই জমির উপর সে অধিকার লাভ করবে। বকেয়া খাজনার উপরকার সুদের হার ১২.৫% থেকে কমিয়ে ৬.২৫% রায়তদের ক্ষেত্রে ধার্য করা হয়। বাংলা প্রজাস্বত্ব আইন (সংশােধিত), ১৯২৮, ধারা ৫২-সহ খাজনার । ক্ষেত্রে ভূ-স্বামীদের অতিরিক্ত খাজনা আদায়ের প্রথা ১০ বছরের জন্য স্থগিত করা হয়। প্রজাদেরকে নিজেদের জমি ভাগাভাগি করারও অধিকার দেয়া হয়।২৮ এরপর সরকার প্রতি জেলায় ঋণ সালিসি বাের্ড গঠন করে।
১৯৩৮ সালের মধ্যে প্রদেশ জুড়ে প্রায় ৩০০০ গ্রামে ঋণ সালিসি বাের্ড গঠন করা হয়। এ বাের্ড ১৯৩৮ সালের মধ্যে ৩,৬৭,১৬,২০২ রুপির ঋণ সালিস মীমাংসা করে যার মধ্যে ১৭,৮৭,৪১৮ রুপির মামলা নিষ্পত্তি করা হয় আর ২,৬০,৯৫,৪৩০ রুপির মামলা অমীমাংসিত থেকে যায়।২৯ এর সাথে। ১৯৪০ সালে প্রণীত বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ডেটরস এ্যাক্ট, ১৯৪০, মূলত যা সব ধরনের ঋণের একটি আইন, সর্বত্র তা চালু করা হল। আইনটিতে বলা হল, সব ধরনের ঋণদাতাকে সরকার কর্তৃক নিবন্ধিত হয়ে ট্রেড লাইসেন্স নিয়ে ব্যবসা পরিচালনা করতে হবে। বন্ধক ও বন্ধকবিহীন সব ধরনের ঋণের সুদের হার যথাক্রমে ৬% ও ৮% হবে।৩০
উপরােক্ত এসব আইন করার সময় এর সফলতা বা উপকারিতা নিয়ে মন্ত্রিরা যতটা ধারণা করেছিলেন, কৃষক-প্রজা পার্টির সকলের মাঝে তার চেয়ে বেশি স্বস্তির আনন্দ তাঁরা দেখতে পেলেন। ইহা সত্য যে, ঋণদাতাদের দাপট পুরােপুরি এ আইন দ্বারা ভেঙ্গে ফেলা যায়নি তবুও এর ফলে কৃষকদের দেয়া ঋণের উপর সুদের হার অনেকটা কম করানাে সম্ভব হয়েছে।৩১ উপরন্তু প্রজাস্বত্ব আইনে মাধ্যমে জমিদার ও মহাজনদের অত্যাচার ও ঋণের বােঝা থেকে প্রজারা বহুলাংশে পরিত্রাণ পেয়েছে। এসবের জন্য বাংলার সকল মুসলিমের কাছে
৬৭
মন্ত্রিসভাসহ দলটির বিশেষ ভাবমূর্তি তৈরি হয়েছিল। মূলত বাঙালিদের দৃষ্টিতে ফজলুল হকের মন্ত্রিসভা ও মুসলিম লীগ ছিল একই।
মুসলিম চাহিদার দিকে নজর রেখে মন্ত্রিসভা শিক্ষাব্যবস্থারও অনেক উন্নতি সাধন করেছিল। ফি ছাড়া গরীব ছাত্রীদের প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার কর্মপরিকল্পনা তারা হাতে নিয়েছিল। তাই সম্পূর্ণ সরকারি অনুদান নিয়ে কলকাতার পার্ক সার্কাস এলাকায় “লেডি ব্রাবাের্ন ডিগ্রী কলেজ” প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল শুধুমাত্র মুসলিম মেয়েদের শিক্ষাদানের জন্য। অন্যদিকে ১৯৪০ সালে হিন্দু ও বৌদ্ধ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে সরকারি অনুদানও বন্ধ করে দেয়া হয়েছিল। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকারি অনুদান কিছু মাত্রায় সংকুচিত করা হয়েছিল।৩৪ গ্রাম এবং গ্রাম্য জনগােষ্ঠীর উন্নয়নের জন্যও সরকার বেশ কিছু কর্মসূচি গ্রহণ করেছিল।৩৫ কর্মসূচি অনুযায়ী সরকার কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করে আর তাতে সফলও হয়। তাঁরা যেসব বিষয়ে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিল সেগুলাে হল ঃ
খাল সংস্কার, নদী খনন, জল ও স্থলপথের যােগাযােগ ব্যবস্থার উন্নয়ন, ইউনিয়নভিত্তিক স্বাস্থ্যসেবা গঠন, নােয়াখালী জেলায় দুটি আদর্শ গ্রাম তৈরি করা ইত্যাদি।
১৯৩৭-৪০ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে এসব উন্নয়নের তথ্য প্রকাশ করা হয়।৩৬ এসব উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের ফলে গ্রামের বিপুল দরিদ্র মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছিল আর মুসলিম লীগের অনেক অনুসারীও তৈরি হয়েছিল। মন্ত্রিসভার বাণিজ্য ও শ্রম বিভাগও তাঁদের জনপ্রিয়তা অর্জনে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ নিয়েছিল। ১৯৩৭ সালে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্মকাল থেকে কংগ্রেস ও কমিউনিস্ট পার্টির মদদে ১৯৩২ সাল থেকে শুরু হওয়া শিল্প আন্দোলনের মাত্রা আরও চরম আকার ধারণ করে। এর ফলে কলকাতাসহ বাংলার অনেক জায়গায় কারখানা ধর্মঘট দেখা দেয়। সরকার তখন দেখল, এখনই শ্রমের জন্য একটি সুন্দর নীতিমালা প্রণয়ন অতি জরুরী। এ নীতির আলােকে সরকার ট্রেড ইউনিয়নের গতিবিধি পর্যালােচনা করে জানতে চেষ্টা করল যে, বস্তুত কোন সংগঠনগুলাে আসল আর কোন সংগঠনগুলাে শুধুমাত্র মিথ্যা অজুহাত তুলে আন্দোলনের মাধ্যমে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার চেষ্টা করছে। ১৯৩৯ সালে “ট্রেড ইউনিয়ন কনস্টিটিউশনাল ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। এ ট্রাইব্যুনাল আবেদনকারী ৬১টি ইউনিয়নের মধ্যে ২৭টিকে অনুমােদন দিল ।
৬৮
এছাড়া ফজলুল হকের কোয়ালিশন সরকারে মুসলিম লীগের নেতা বাণিজ্য ও শ্রমবিভাগের মন্ত্রী হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী কৌশলে করে নিজের লােকদের শ্রমিক রাজনীতিতে ঢুকিয়ে তাদেরকে দিয়ে ঐসব লেবার সংগঠনের মধ্যে চিড় ধরালেন। এ প্রক্রিয়াতে সরকারের সমর্থনকারী অনেক শ্রমিক দল তৈরি হয়ে গেল। ক্যাডার হিসেবে এ দলগুলাে মুসলিম লীগের হয়ে কাজ শুরু করল এবং এতে করে শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে লীগের জনপ্রিয়তার মাত্রা বেড়ে গেল। স্থানীয় সরকার ব্যবস্থায়ও মন্ত্রিসভা অনেক পদক্ষেপ নিল। স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে এমন পরামর্শ দেয়া হল যেন “স্থানীয় লোেক যারা মন্ত্রিদের কার্যক্রমের সক্রিয় বিরােধী”— তাদের যেন চাকরিতে নেয়ার চেষ্টা না করা হয়।”৩৮ মন্ত্রিদের নিজস্ব ঘরানার লােকজনদের প্রশাসনিক পদে অধিষ্ঠিত করার ক্ষেত্রে তাদের বেশি জোর দিতে বলা হয়। ১৯১৯ সালের ভিলেজ সেলফ গভর্নমেন্ট এ্যাক্টের ধারা ৬(৩) সংশােধন দ্বারা ইউনিয়ন বাের্ডে নিজেদের প্রতিনিধি রাখার ব্যবস্থা করা হল যাতে করে প্রশাসনকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণাধীন করা যায় ; এভাবে ইউনিয়ন বাের্ডের ৩ ভাগের ১ ভাগ মেম্বারদের তারা প্রতিনিধি হিসেবে মনােনীত করার ক্ষেত্র তৈরি করে ফেলল।৩৯ এর ফলে মন্ত্রিরা ইউনিয়ন বাের্ডের বিষয়ে সরাসরি হস্তক্ষেপ করল আর বাের্ডের যেটুকু ক্ষমতা ছিল তা শুধু আনুষ্ঠানিকতা। এ জাতীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করাতে এদেশের বিভিন্ন জায়গায় মুসলিম লীগ তাদের প্রতিনিধি ও সমর্থকদের উত্থান ঘটাতে পারল ।
১৯৩৫ সালের আইনে ভােটারদের যে শিক্ষাগত যােগ্যতা থাকার বিধান ছিল তা পরিবর্তনের জন্য নতুন আইন কাঠামাে তৈরি করল । ১৯৩৯ সালে তারা বাংলার আইনসভা নির্বাচনের ভােট প্রদানের ন্যূনতম শিক্ষাগত যােগ্যতায় ভারতীয় স্কুল পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের হিসেবে ধরার বিধান করল । বিধানে এ জাতীয় ভােটারদের ক্ষেত্রে বলা হল ঃ
“আবেদনের মাধ্যমে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে আর আবেদনের ক্ষেত্রে যােগ্যতার প্রমাণপত্র দিতে হবে।”
ভােটারের ভােট প্রদানের যােগ্যতা এভাবে পরিবর্তন করার ফলে মুসলিম ভােটারদের সংখ্যা বৃদ্ধি পেল এবং ক্ষমতাসীন দল হিসেবে নিজেদের সুবিধামাফিক ভােটার তালিকা পরিবর্তনের সুযােগ করে নিল। আগে থেকেই মুসলিম সম্প্রদায়ের একটি অভিযােগ ছিল, সরকারি চাকরির ক্ষেত্রে শতকরা হিসেবে হিন্দু সম্প্রদায়ের অল্প সংখ্যক ব্যক্তি থেকে মুসিলম সম্প্রদায়ের অধিক
৬৯
সংখ্যক ব্যক্তির সুযােগ কম। স্বাভাবিকভাবে লীগ যখন ক্ষমতায় তখন এ অভিযােগের অবসান হওয়ার কথা। তাই মন্ত্রিসভা দ্রুত ও কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করল । ১৯৩৮ সালের ২৫ আগস্ট বাংলার আইনসভাতে একটি বিল পাস করা হল যেন সরকারি চাকরিতে ৬০ ভাগ মুসলিম কোটা থাকে। ১৯৩৯ সালে সরকার আবার একটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল যেন সরাসরি বাছাইয়ে মুসলিমদের জন্য শতকরা ৫০ ভাগ পদ সংরক্ষিত থাকে। চাকরিতে প্রমােশনের ক্ষেত্রে যদি পদ পূরণে শতকরা ৫০ ভাগের বেশি হিন্দুরা পেতে যায় তাহলে মুসলিমদের দ্বারা বা সংরক্ষিত মুসলিমদের এনে ঐ পদে বহাল করে হিন্দু-মুসলিম কর্মকর্তাকর্মচারিদের সমতা আনতে হবে।৪০ পরে ১৯৪০ সালে “বেঙ্গল সার্ভিস রিক্রুটমেন্ট রুলস” বা কমিউনাল রেসিও রুলস” করে তার জন্য একজন বিশেষ কর্মকর্তা বা কমিউনাল রেসিও অফিসার” রাখা হল ; যে অফিসার মূলত সরকারের এ সিদ্ধান্তসমূহ সঠিকভাবে কার্যকর করা হচ্ছে কি-না তা তদারকি করতেন। এর আগে ১৯৩৮ সালের “পুলিশ রিক্রুটমেন্ট রুলস”-এর সংশােধনী (ধারা ৮৩৩, পুলিশ রেগুলেশন) এনে তারা নতুন ধারা সংযােগ করল যে, “পুলিশের সুপারিনটেনডেন্ট বাঙালি পুলিশ কনস্টেবল নিয়ােগের ক্ষেত্রে লক্ষ্য রাখবেন যেন তালিকাতে মুসলমানদের নিয়ােগের হার শতকরা ৫০ ভাগের কম না হয়।৪১ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও কর্মকর্তা নিয়ােগের ক্ষেত্রে একটি পরিবর্তন আনা হল। ১৯৩৭ সালে প্রণীত বিধানে “বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস (এক্স)” এবং “বেঙ্গল জুনিয়র সিভিল সার্ভিস কর্মকর্তা নিয়ােগের নির্ধারিত মাত্রা যথাক্রমে ৩২২ ও ৪৫০ জন পরিবর্তন করে ১৯৩৯ সালের সংশােধনীর মাধ্যমে তা যথাক্রমে ২৩২ ও ৫৬০ করা হল। এছাড়া আরেকটি নীতিও গ্রহণ করা হল যাতে বেঙ্গল জুনিয়র সিভিল সার্ভিস অফিসারগণ বেঙ্গল সিভিল অফিসারদের স্থলে গিয়ে তাদের পরিপূরক হিসেবে কর্ম সম্পাদন করতে পারবেন। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে সরকারি চাকরিতে মুসলমানদের অংশগ্রহণ ত্বরান্বিত হল এবং তাদের বহুদিনের অভিযােগের অবসান হল ; এতে করে সরকারি দফতরে মুসলিমদের সংখ্যাধিক্য হল আর সাথে সাথে বাংলায় মুসলিম লীগের অবস্থানও অনেক পাকাপােক্ত হয়ে দাঁড়াল।
বহুদলীয় গণতন্ত্র প্রক্রিয়ায় প্রচারণার গুরুত্বের কথা বিবেচনা করে বাংলায় ১৯৩৮ সালে হকের মন্ত্রিসভা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অধীনে একটি প্রচার বিভাগ চালু করলেন যার সেক্রেটারি হলেন প্রধানমন্ত্রীর চিফ সেক্রেটারি ।
৭০
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর বিশ্বস্ত প্রতিনিধি আলতাফ হােসেন হলেন ঐ তথ্য বিভাগের পরিচালক। গণসংযােগের কাজে নিয়ােজিত সব দফতরের যাবতীয় দেখাশুনা ও ব্যয়ভার মেটাতে এ বিভাগকে সব ধরনের ক্ষমতা প্রদান করা হল। এখান থেকে দুটি সাপ্তাহিক পত্রিকা বেঙ্গল উইকলি ইংরেজিতে ও বাংলার কথা বাংলায় প্রকাশ করা হত।
নিপীড়িত জনতার কাছে মন্ত্রিসভার গৃহীত বিভিন্ন যুগােপযােগী পদক্ষেপের প্রচারণা ছাড়াও পত্রিকাগুলাে তাদের জানাতে লাগল, মুসলিম লীগ ক্ষমতায় আসার পূর্বে মুসলমান প্রজা ছিল সবচেয়ে বেশি দুর্দশাগ্রস্ত। এভাবে মন্ত্রিসভার প্রতি জনসমর্থন বৃদ্ধির লক্ষ্যে সব ধরনের প্রচারণা চলতে লাগল আর এতে করে স্বাভাবিকভাবেই বাংলার মুসলমানদের কাছে মুসলিম লীগের গ্রহণযােগ্যতা বাড়তে লাগল। ফলে ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টির কৃতিত্ব আড়াল হয়ে থাকল। যদিও প্রধানমন্ত্রি নিজেই কৃষক-প্রজা পার্টির সভাপতি।
মন্ত্রিসভা দ্বারা গৃহীত সাংবিধানিক এবং প্রশাসনিক সব পদক্ষেপে মুসলমানরা খুবই খুশি হয়েছিল। কিন্তু ঐসব কার্যক্রম হিন্দুদের সমালােচনার মুখে পড়ল। ঋণ সংক্রান্ত বিধি-বিধান মূলত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর হিন্দুদের জন্য করা হয়েছিল ; অবশ্য এতে প্রজাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার উন্নতির জন্য মন্ত্রিসভা তেমন কোন ব্যবস্থা নেয়নি। কারণ, তাতে অল্প সংখ্যক ভূ-স্বামী ও জোতদারদের সমস্যা হত, যাদের মধ্য থেকে অনেকেই লীগ ও প্রজা পার্টিতে এসেছেন। ১৯৪০ সালে বাংলার মাধ্যমিক শিক্ষা বিল আনা হলে হিন্দুরা দেখল যে, তা তাদের স্বার্থের অনুকূলে নয়। এর পরপরই যখন কংগ্রেসের বিরােধিতা সত্ত্বেও ৬০ ভাগ মুসলিমদের সরকারি চাকরিতে সুযােগ দিয়ে বিলটি পাস হল তখন হিন্দুদের ক্ষোভ আরও বেড়ে গেল। তাদের এ বিষয়ে বক্তব্য ছিল আইন পরিষদে ঐ মুসলিম লীগের ক্ষমতা বেশি এবং তারা হিন্দু-বিরােধী নীতিমালা গ্রহণ করছে কেবল বিরােধিদের পরাস্ত করার জন্য।৪২ এছাড়া তারা যুক্তি তুলে ধরল, এক সম্প্রদায়কে বাদ দিয়ে আরেক সম্প্রদায়ের লােকদের চাকরিতে বহাল রাখতে পারছে তার কারণ হল, মুসলিম লীগ আইন পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের কাছ থেকে সুবিধা নিতে পারছে এবং “সম্প্রদায়ের সেবা” স্লোগান তুলে মুসলিমদের একত্র করছে।৪৩ এসব কারণে বাংলা জুড়ে হিন্দু মুসলমানদের মধ্যকার সাম্প্রদায়িক তিক্ততা আরও বৃদ্ধি পেল। বিশেষ করে পাবনা, নােয়াখালী ও চট্টগ্রাম জেলায় এ পরিস্থিতি আরও প্রকট হল। অফিসিয়াল
৭১
প্রতিবেদনে দেখা যায়, পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ সাব-ডিভিশনে ১৯৩৯ সালের এপ্রিল মাসে মাত্র তিন সপ্তাহের মধ্যে মােট ১৬টি প্রতিকৃতি নষ্ট করার ঘটনা ঘটেছে।৪৪ সবগুলাে ঘটনাতেই দেখা গিয়েছিল প্রতিমূর্তি নষ্ট করে সেগুলাের গলায় গরুর হাঁড়ের মালা পরিয়ে রাখা হয়েছে।৪৫ সিরাজগঞ্জের এসডিও এবং ম্যাজিস্ট্রেটের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “বিপুল সংখ্যক অশিক্ষিত লােকদের জড়াে করে তাদের উদ্দেশ্যে মুসলিম লীগের নেতাদের লাগামহীন উসকানিমূলক বক্তব্যই বেশির ভাগ ক্ষেত্রে এ ঘটনাগুলাের জন্ম দিয়েছে।৪৬ এ ঘটনাগুলাের জন্য গ্রামে হিন্দু মহাসভা ও শহরতলীতে হিন্দুদের মধ্যে হিন্দু স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য কর্মী সংগ্রহ বেড়ে গেল। স্বাভাবিকভাবেই তাদের দমাতে মুসলিম লীগের নেতারা তাদের দলকে সুসংগঠিত করার কাজে নেমে পড়ল আর সকল মুসলমানকে লীগের পতাকাতলে সমবেত হওয়ার জন্য আহ্বান জানাল।

– তিন –
প্রজা-লীগ জোট মন্ত্রিসভা যখন বাংলায় মুসলিম লীগের ভিত ও অবস্থান শক্তিশালী করে তুলছিল তখন অবশ্য মন্ত্রিসভাতে হকের অবস্থান আরও অবনতির দিকে যাচ্ছিল। তিনি অনুধাবন করলেন, প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাঁর অবস্থান এবং জোট নেতা হিসেবে তাঁর মর্যাদা সবকিছুই মুসলিম লীগ ও ইউরােপীয় সদস্যদের উপর নির্ভরশীল যাদের সাথে তার তেমন একটা ভাল সম্পর্ক ছিল না। হকের অবস্থান আরও নাজুক হয়ে পড়ল যখন মন্ত্রিসভার সদস্য নওশের আলীর সাথে একটি বিষয় নিয়ে তাঁর মতবিরােধ তৈরি হল।৪৭ তিনি যখন ইস্তফা দিতে রাজি হলেন না৪৮, তখন ফজলুল হক নিজে ১৯৩৮ সালের ২২ জুন তাকে বাদ দিয়ে সেখানে অন্য একজনকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করলেন।
মুসলিম লীগের বাইরের একমাত্র মুসলিম সদস্য নওশের আলীকে বাদ দেয়ায় পুরাে মন্ত্রিসভা যেন মুসলিম লীগ হয়ে দাঁড়াল, যেখানে একমাত্র ফজলুল হক ছিলেন কৃষক-প্রজা পার্টির । কিন্তু তিনিও ১৯৩৭ সালের অক্টোবরে মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছিলেন। এদিকে কংগ্রেস ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাকে হেনস্তা করতে সকল অপতৎপরতা চালাতে লাগল এবং এরই অংশ হিসেবে কৃষক-প্রজা পার্টির কয়েকজন নেতাকে (বিদ্রোহী দল) নিয়ে ১৯৩৮ সালের বর্ষাকালের অধিবেশনে কংগ্রেস সদস্যগণ মন্ত্রিদের বিপক্ষে ১০টি অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। সৌভাগ্যক্রমে ইউরােপীয় সদস্যদের ভেটোতে তা নাকচ হয়ে যায়।
৭২
মুসলিম লীগ এ বিষয়টিকে পুঁজি করে অপপ্রচার শুরু করল এই বলে যে, “এটি মুসলিম মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়ে, বাংলায় হিন্দুরাজ চালু করার লক্ষ্যে হিন্দুদের একটি ষড়যন্ত্র।”৪৯ এ অপপ্রচার চরমভাবে কাজে লাগাল মুসলিম লীগের পত্রিকা স্টার অব ইন্ডিয়া এবং দৈনিক আজাদ। এছাড়া ১৯৩৮ সালের ৮ আগস্ট বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ও খেলাফত কমিটি (এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী উভয় দলের সেক্রেটারি ছিলেন) এক হয়ে এক লক্ষ লােকের সমাবেশ ঘটিয়ে এসেম্বলী হাউসের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে আর সেখান থেকেই ৮ ও ৯ আগস্ট মন্ত্রিসভার সমর্থনে হরতাল ডাকে। এসব কর্মকাণ্ডের ফলে মন্ত্রিসভার অবস্থান আরও সুদৃঢ় হয় এবং বিশাল মুসলিম জনগােষ্ঠীর সম্মুখে লীগের মর্যাদা আরও বৃদ্ধি পায়।
মন্ত্রিসভা সরাতে বিরােধিদের ক্রমাগত চেষ্টা দেখে ফজলুল হক বলেন, যদি মন্ত্রিসভা রক্ষা করতে হয় তাহলে তাকে, মুসলিম লীগ যেন কংগ্রেস-বিরােধী প্রচারণা চালাতে পারে সেজন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। এরই ধারাবাহিকতায় তিনি ১৯৩৮ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের এক বিশেষ অধিবেশনে বসে মুসলিমদের উপর বিহারে এবং কংগ্রেসের এলাকায় হিন্দুদের অত্যাচারের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেন।৫০ এছাড়াও তিনি প্রেসে একটি বিবৃতি দেন যা পরবর্তীতে প্রচারপত্র আকারে বিলি করা হয়। শিরােনাম “কংগ্রেস শাসনের অধীনে মুসলিমদের দুর্দশা” উল্লেখ করে কংগ্রেস মন্ত্রিদের দ্বারা মুসলিমদের প্রতি অন্যায়ের বিশদ বর্ণনা তাতে দেয়া হয়েছিল।৫১ অভিযােগগুলােতে কোন সত্যতা থাকুক বা না থাকুক, এর ফলে ফজলুল হক এবং মুসলিম লীগ বাংলার মুসলমানদের কাছে আরও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠল। আর একই সঙ্গে সকলের মনে কংগ্রেস-বিরােধী মনােভাব আরও বাড়িয়ে দিল।
তখন কংগ্রেসের সমালােচনা করে হক বললেন, কংগ্রেস সবসময় নিজেকে প্রজা-বান্ধব বলে থাকে অথচ বিহারে কংগ্রেস কৃষকদের অবস্থার উন্নতির জন্য তেমন কিছুই করেনি যা কি-না লীগ মন্ত্রিসভা বাংলার প্রজাদের জন্য করেছে। তিনি উল্লেখ করেনঃ
“বিহারে সেলামী ৮% করা হয়েছে অথচ কংগ্রেসহীন বাংলাতে তা সমূলে বিলােপ করা হয়েছে। বাংলায় ১০ বছরের জন্য খাজনা দেয়া বন্ধ করা হয়েছে অথচ বিহারে গরীবদের জন্য এমন কোন সুব্যবস্থা করা হয়নি।”৫২
৭৩
এ ধরনের প্রচারণায় মুসলিম লীগের উদ্দেশ্য সফল হতে লাগল আর সকল মুসলমান মেনে নিল যে, তাদের স্বার্থ সংরক্ষণে মুসলিম লীগ সবসময় ভাল কাজগুলােই করে থাকে।
কংগ্রেস-বিরােধী প্রচারণা চালানাের পাশাপাশি ফজলুল হক এ পর্যায়ে কংগ্রেস থেকে কৃষক-প্রজা পার্টিকে দূরে রাখার জন্য দলটিকে একটু পরিচর্যা করলেন। তাই তিনি তার মন্ত্রিসভায় কৃষক-প্রজা পার্টির গঠনতন্ত্রে উল্লেখিত কর্মসূচিগুলাে বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তমিজুদ্দিন খান৫৩ এবং শামসুদ্দিন আহমেদকে৫৪ নিযুক্ত করলেন।৫৫ শামসুদ্দিন আহমেদ অবশ্য পরে ১৯৩৯ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি ইস্তফা দেন এই দেখিয়ে যে, ফজলুল হক নাকি কৃষকপ্রজা পার্টির কাছে যে অঙ্গীকার করেছিলেন তা যথাযথভাবে পালন করেননি।৫৬ কিন্তু ততক্ষণে কৃষক-প্রজা পার্টি ভেঙ্গে গিয়ে যা ক্ষতি হওয়ার তা হয়ে গিয়েছে।

– চার –
বঙ্গীয় প্রাদেশিক পরিষদে কৃষক-প্রজা পার্টির সমর্থন নিয়ে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় বসার সময় থেকেই এর এমএলএ’গণ (মেম্বার অব লিজেসলেটিভ এসেম্বলি) পার্টির সব বিষয়ে নাক গলাতে শুরু করল। তাই প্রাদেশিক লীগকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ১৯৩৭ সালের অক্টোবর মাসে জিন্নাহ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের লক্ষৌ অধিবেশনে ২০ সদস্যের একটি কমিটি গঠন করেন, যে কমিটির কাজ হল বাংলার বিভিন্ন প্রাদেশিক ও জেলাভিত্তিক লীগের শাখা দলগুলােকে সুসংগঠিত করা।৫৭ এভাবে পরে ১৯৩৭ সালে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করা হল যার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ফজলুল হক এবং সেক্রেটারি এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী। এ সময় হক কৃষক-প্রজা পার্টির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ভেঙ্গে দিলেন যার ফলে লীগে তার অনুসারীর সংখ্যা কমে গেল।
এম. এ. জিন্নাহ ভাবলেন, বাংলার রাজনীতিতে হকের প্রভাব কমানাে দরকার ; কারণ, সমগ্র বাংলার মুসলিম রাজনীতিতে এম. এ. জিন্নাহর আধিপত্য বিস্তারে একমাত্র বাধা ছিলেন ফজলুল হক।৫৮ জিন্নাহর মতে, যদি কৃষক-প্রজা পার্টির ক্ষতি করা যায় তাহলে তাতে হকের জন্য বেশ সমস্যা হবে। এ চিন্তা করে জিন্নাহ কৃষক-প্রজা পার্টির সকল প্রােফাইল বা কর্মকাণ্ড বন্ধ করতে লীগের
৭৪
সর্বস্তরের নেতাদের নির্দেশ দিলেন। এ কাজে কলকাতার খেলাফত কমিটি ও বাংলার জামায়েত-উল-উলেমাও যােগ দিল ।
১৯৩৭ সালের অক্টোবরের শেষে মুর্শিদাবাদের বহরমপুরের অল বেঙ্গল মুসলিম লীগ কনফারেন্সে যােগ দিয়ে জিন্নাহ তাতে সভাপতিত্ব করেন । চতুরতা করে কৃষক-প্রজা পার্টিকে কোণঠাসা করতে জিন্নাহ বাংলার মুসলমানদের পরামর্শ দিলেন যে, তাঁর দল ছাড়া অন্য কোন দলে কেউ যেন না যায়, অন্যথায় “তারা ধ্বংস হবে ও নিজেদের পরিচিতি হারাবে।”৫৯ জিন্নাহর পদাঙ্ক অনুসরণ করে এক দল লীগ সমর্থক প্রচার শুরু করল এই বলে যে, মুসলমানদের আসল সমস্যা হল রাজনৈতিক, তাদের অর্থনৈতিক সমস্যা তেমনটি নেই ; তাই মুসলমানদের চাহিদা পূরণের জন্য সকলেরই লীগে যােগদান করা উচিত।৬০ এছাড়া, কৃষক-প্রজা পার্টি থেকে যে মুসলমানরা বের হয়ে গিয়ে বিরােধী দল কংগ্রেসের সাথে যুক্ত হয়েছে, লীগের লােকজন তাদের মুসলিম ঐক্যের অন্তর্ঘাতক এবং “সােয়াবে আজম” (সঠিক পথ) বাদ দেয়ায় তাদের “ঈমান” ঝুঁকির মধ্যে আছে বলে প্রচারণা চালাতে লাগল।৬১ তাই “বাংলার মুসলিমদের রাজনৈতিক পরিত্রাণ পেতে মফস্বলে লীগের দলীয় কার্যালয় তৈরির চেষ্টা শুরু হয়। জিন্নাহর দলের বাঙালি অনুসারীরা ভেবে আশ্বস্ত হতে লাগল যে, লীগ যত শক্তি-সামর্থ্য অর্জন করবে কৃষক-প্রজা পার্টি তত নড়বড়ে ও ক্ষয়প্রাপ্ত হবে।৬২ মন্ত্রিসভার কার্যক্রমে হিন্দুদের বিরােধিতা করার বিষয়টি সামনে রেখে লীগ প্রচার করা শুরু করল ঃ
“মুসলমানদের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা বিপন্ন হতে চলেছে আর তা থেকে রক্ষা পেতে একমাত্র লীগের অভিভাবকত্বই প্রয়ােজন।”
এদিকে ফজলুল হকের নেতৃত্ব ছাড়া কৃষক-প্রজা পার্টির ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। একই সঙ্গে ফজলুল হক কৃষক-প্রজা পার্টি এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সর্বোচ্চ পদে বহাল থাকার কারণে দল দুটির অনুসারিদের আলাদা করে চেনা যাচ্ছিল না। যেহেতু হক লীগের কর্মকাণ্ডে বেশি আগ্রহী তাই কৃষক-প্রজা পার্টির গুরুত্বপূর্ণ অংশের নেতারা লীগের সহায়ক হিসেবেই যেন সব কাজ করা শুরু করল। আর অপর অংশের কর্মকাণ্ড দেখে মনে হতে লাগল যেন তারা কংগ্রেসের অধীনস্থ। এভাবে কৃষক-প্রজা পার্টি নিঃশেষ হতে লাগল যা কোন এক সময় বাংলার খুব সম্ভাবনাময়ী একটি রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হয়েছিল । দুর্ভাগ্যবশত এ. কে. ফজলুল হক, যিনি এ দলের প্রতিষ্ঠাতা, তিনি নিজেই
৭৫
দলের ভাঙন প্রক্রিয়া বাতলে দিলেন। এমনি করে, ১৯৩৭ সালের শেষের দিকে ইহা একটি বিশৃঙ্খল দলে পরিণত হল বিপরীতে বাংলাতে মুসলিম লীগের অবস্থান সুদৃঢ় হল। এ পরিস্থিতিতে জিন্নাহ খুব সতর্ক হয়ে, ফজলুল হকের সাথে সদ্ভাব বজায় রেখে অগ্রসর হতে লাগলেন আর তাকে দিয়েই ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহাের প্রস্তাব উত্থাপন করলেন যা “লাহাের রেজুলেশন” নামে পরিচিত। বিখ্যাত ব্রিটিশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডব্লিউ, এইচ, মরিস জোনসের লেখায় এর সত্যতা পাওয়া যায়।৬৩
পূর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে, হক বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাধ্য হয়েই লীগে যােগ দিয়েছিলেন এবং বাংলার বিপুল দরিদ্র জনগােষ্ঠীর জন্য তিনি যা করেছেন তা লীগে যােগদান না করে অন্য কোনভাবে এতটা করতে পারতেন না। তিনি মূলত সেকুলার মানসিকতার ব্যক্তি হওয়ায় সবসময় বিশ্বাস করতেন যে, সমাজের উঁচু শ্রেণির বাঙালিদের একত্র করার উদ্যোগ ছাড়া এই বিপুল জনগােষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষা কোনদিন পূরণ হতে পারবে না।৬৪ ১৯৩৭-৪১ সাল পর্যন্ত যেসব কর্মসূচি মুসলিম লীগ হাতে নিয়েছিল এবং তার ফলে হিন্দুদের যে প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়েছিল তাতে করে বাংলার সাম্প্রদায়িক অবস্থা পূর্বেকার সব সময়ের চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠল। এ অবস্থা ফজলুল হককে আরও উদ্বিগ্ন করে তুলল। কারণ, তিনি অনুধাবন করতে পারলেন, এর ফলে প্রদেশে অরাজকতার সৃষ্টি হবে। কাজেই, লাহাের প্রস্তাবের পরিচিতি দেয়া সত্ত্বেও ফজলুল হক হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের স্বার্থে রাজনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণে উদ্যোগী হলেন। তাই হলওয়েল মনুমেন্ট সরানাের জন্য কলকাতার ছাত্ররা যাত্রা শুরু করলে ফজলুল হক লিখিত দিলেন ঃ
লীগের কিছু নেতার হুঁশিয়ারি ও তাঁর ইউরােপীয় সমর্থকদের নাখােশ হওয়ার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও আমার মতে মনুমেন্টটি সরানাে উচিত।”৬৫
এরই সাথে তিনি জোটের মুসলিম নেতাদের বিরােধের মুখে, প্রদেশের তখনকার সমস্যা নিয়ে বিভিন্ন দলের সাথে বসে সভা করার জন্য, ১৯৪১ সালের ১০ মার্চ একটি সভা ডাকতে গভর্নরকে অনুরােধ করেন।৬৬
প্রাদেশিক লীগের সকলের উপর একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ দেখাতে উদগ্রীব জিন্নাহ, ফজলুল হকের এ আচরণে খুশি হতে পারলেন না। এছাড়া পূর্বের অভিজ্ঞতা থেকে জিন্নাহ বুঝতে পারলেন, হককে লীগের “আচরণবিধি” দ্বারা কখনও কাবু
৭৬
করা যাবে না । জিন্নাহ তখন ফজলুল হককে মুসলিম লীগ থেকে বের করে দেয়ার অজুহাত খুঁজতে লাগলেন আর তিনি সফলও হলেন যখন দেখা গেল অল্প কিছুদিনের মধ্যে ফজলুল হক, ভাইসরয়ের ওয়ার কাউন্সিলে যােগ দিলেন। পরবর্তী অধ্যায়ে এসব ঘটনার অগ্রগতি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে।

তথ্যসূত্র ঃ
১. দেখুন, উক্ত গ্রন্থের ৪র্থ অধ্যায়ের দ্বিতীয় অনুচ্ছেদে।
২. ১৯৩৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কলকাতার অনেক পত্রিকা যেমন দৈনিক এডভান্স, আনন্দবাজার পত্রিকা, আজাদ, ফরােয়ার্ড, স্টার অব ইন্ডিয়া এবং স্টেটসম্যান কৃষকপ্রজা পার্টির মেনােফেস্টু প্রকাশ করে। আরও দেখুন ঃ হুমায়ুন কবীর ; “মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল – ১৯০৬-৪২” (কলকাতা ১৯৪৩), পৃষ্ঠা ১৩ এবং এ. এম, আহমেদ, “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” (ঢাকা, ১৯৭৫), ৩য় সংস্করণ, পৃষ্ঠা ১৩৬।
৩. কামরুদ্দিন আহমেদ, “এ স্যোশাল হিস্টরী অব বেঙ্গল” (ঢাকা, ১৯৭০), ৩ সংস্করণ, পৃষ্ঠা ৩৫।
৪. এ. এম. আহমেদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৩৬-৩৯।
৫. ঐ, পৃষ্ঠা ১৪১।
৬. প্রভিন্সিয়াল রিপাের্ট ও বাংলা, এন্ডারসন টু লিনলিথগাে, মার্চ ৯, ১৯৩৭।
৭. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ১৯ জানুয়ারি ১৯৩৭।
৮. অনুষ্ঠানে “শ্রী” লেখা ও পদ্ম চিহ্নের আকৃতি সংবলিত ফ্ল্যাগ উত্তোলন করা হয় এবং সেলুট দিয়ে সম্মান দেখানােসহ “বন্দে মাতারাম” জাতীয় সঙ্গীত গাওয়া হয়। গান এবং পতাকার চিহ্ন দুটিই হিন্দু ধর্মের জাতীয় প্রতীক আর এ প্রতীক অনুষ্ঠানে ব্যবহার করাকে অনেক মুসলমান গর্হিত কাজ মনে করে। “বেঙ্গল ইলেকশন ১৯৩৭ ফজলুল হক এবং এম. এ. জিন্নাহ ; এ স্ট্যাডি ইন লিডারশীপ স্টেট ইন বেঙ্গল পলিটিক্স”, এনায়েতুর রহিম ঃ “জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সােসাইটি অব বাংলাদেশ”, ভলিউম ২২ নং ২, আগস্ট ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ১১৮।
৯. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৩৭।
১০. মন্ত্রিদের মধ্যে নলীনি রঞ্জন সরকার, বিপি সিং রায় এবং কাশিম বাজারের মহারাজা শিরিষচন্দ্র নন্দী হলেন উচ্চবর্ণের হিন্দু আর মুকুন্দ বিহারী মল্লিক এবং প্রসন্ন দেব রায় হলেন সিডিউল কাস্টের হিন্দু।
১১. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ২৫ মার্চ ১৯৩৭।
১২. উল্লেখ্য যে, হিন্দু মন্ত্রিদের মধ্যে কেউ কোন দলের প্রতিনিধি হয়ে আইন পরিষদে ছিল না কারণ তারা কোন রাজনৈতিক দলের সদস্য ছিলেন না।
৭৭
১৩. ১৯৩৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি খাজা নাজিমুদ্দিন উত্তর কলকাতার একটি আসন থেকে উপ-নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হয়ে আসেন। কারণ দুই আসনে এইচ. এস, সােহরাওয়ার্দী নির্বাচিত হওয়ার পর তিনি উক্ত আসনটি ছেড়ে দেন।
১৪. আবুল মনসুর আহমদের বর্ণনানুসারে, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৪, গভর্নর ইনভেস্টিগেশন ব্যুরাের গােপন প্রতিবেদনের জন্য শামসুদ্দিনকে মন্ত্রিসভায় নিতে চাননি। দেখুন ঃ মােহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ, “যুগ বিচিত্রা” (ঢাকা, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৩৪৩।
১৫. অমৃতবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ৫ এপ্রিল ১৯৩৭ সালের ইস্যুতে দেখা যায়, কৃষকপ্রজা পার্টির ২৮ জন নামকরা নেতা ১৯৩৭ সালের ৩০ মার্চ বিবৃতিটি প্রদান করেন। বিবৃতিতে বলা হয়েছিল, ১১ জন সদস্যের মধ্যে ৯ জনই ছিলেন জমিদার এবং কমপক্ষে ৬ জন মেম্বার বিশেষ আসন থেকে নির্বাচিত হয়েছিলেন যাদের সাথে বিপুল জনগােষ্ঠীর কোন সংযােগ নেই।
১৬. “এডভান্স” (কলকাতা), ১৯ আগস্ট ১৯৩৭। আরও দেখুন ঃ “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ২০ আগস্ট ১৯৩৭ এবং আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১ সেপ্টেম্বর ১৯৩৭।
১৭. আবুল মনসুর আহমেদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৪৯।
১৮. ঐ ৪ পৃষ্ঠা ১৪৯-১৫০। বাের্ডে লীগের প্রতিনিধিত্বকারিরা হলেন, নওয়াব খাজা। হাবীবুল্লাহ, খাজা নাজিমুদ্দিন এবং এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী এবং কৃষক-প্রজা পার্টির প্রতিনিধিত্বকারিরা হলেন, ফজলুল হক, নওশের আলী এবং আবুল মনসুর আহমেদ।
১৯. ঐ ঃ পৃষ্ঠা ১৫০-১৫২।
২০. “এডভান্স” (কলকাতা) ১৯ আগস্ট ১৯৩৭। এছাড়া “আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১৯ আগস্ট ১৯৩৭।
২১. নতুন কৃষক-প্রজা পার্টির তখন ৩২ জন সদস্য ছিল । যখন ফজলুল হক মন্ত্রিসভায় যােগ দিলেন তখন অনেক স্বতন্ত্র এম. এল. এ. কৃষক-প্রজা পার্টিতে যােগ দেয় এবং ঐ বিভাজনের পরও তারা দলটিতে থেকে গিয়েছিলেন।
২২. কৌপল্যান্ড, রেজিন্যাল্ড, “দি ইন্ডিয়ান প্রােব্লেম” (নিউইয়র্ক, ১৯৪৪), দ্বিতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ২৮।
২৩. “এডভান্স” (কলকাতা), ৪ জুলাই ১৯৩৭, সম্পাদকীয় ।
২৪. “স্টার অব ইন্ডিয়া”, ১৬ অক্টোবর ১৯৩৯, ঐ সময়ে ফজলুল হক “শের-এ-বাংলা”
“বাংলার বাঘ” উপাধি পেয়েছিলেন ।
২৫. বিবৃতিটি ফজলুল হক ১৯৩৭ সালের ৫ অক্টোবর দিয়েছিলেন। দেখুন ঃ “স্টার অব
ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ১৬ অক্টোবর ১৯৩৭।
২৬. আবুল মনুসর আহমেদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮১।
৭৮
২৭. ভূমি রাজস্ব বাের্ডের রিপাের্ট (কলকাতা, ১৯৪০), ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ৪৯-৬১। ১৯৪০ সালের কমিশন কর্তৃক প্রতিবেদনটি দেয়া হয় যা ঐ বছরের শেষের দিকে সরকারি কর্মকর্তা হিসেবে সি. ডব্লিউ, গার্নারকে দিয়ে নিরীক্ষা করান হয়।
২৮. “বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস”, ১৯৩৭। ভলিউম ৫১ নং ৪, পৃষ্ঠা ১৩১৯-১৪০৩ এবং ২৭৭৪-২৩১৫।
২৯. আজিজুল হক ও “দি ম্যান বিহাইন্ড দ্য প্লাউ” (কলকাতা, ১৯৩৯), পৃষ্ঠা ১৬৯।
৩০. “দি বেঙ্গল মানি লেন্ডারস এ্যাক্ট, ১৯৪০” (কলকাতা, ১৯৪০)।
৩১. সিরাজুল ইসলাম ঃ “বেঙ্গল পেজেন্টি ইন ডেট, ১৯০৪-১৯৪৫।” অপ্রকাশিত কাগজ যা “ফজলুল হকের সময় ও জীবনী” নামক ঢাকার সেমিনার ১৯৭৩ সালের নভেম্বরে পাঠ করা হয়েছিল।
৩২. এ. কে. ফজলুল হক, ১৮ মার্চ ১৯৩৮ “বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস”, ভলিউম ৫২, নং ৫, পৃষ্ঠা ৩৬।
৩৩. “বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস ১৯৪০”, ভলিউম ৫৭, নং ৫, পৃষ্ঠা ৬০।
৩৪. ১৯৩৭-৪০ সালের বাজেট দ্রষ্টব্য।
৩৫. দেখুন, “টু ইয়ারস অব প্রভিন্সিয়াল অটোনমি” – পরিচালক, পাবলিসিটি গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, আগস্ট ১৯৩৯।
৩৬. ১৯৩৭, ১৯৩৯-১৯৪০ সালের বাংলার প্রাদেশিক রাজনীতির সার-সংক্ষেপ যা ইন্ডিয়া সরকারের কাছে বার্ষিক প্রতিবেদন হিসেবে গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল পেশ করেন।
৩৭. ভারত সরকার, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ১৩২/৩৮ ; ইন্ডাস্ট্রিয়াল রিভিউ অব বেঙ্গল । ডিউরিং দ্য ইয়ার ১৯৩৭।
৩৮. গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, স্থানীয় সরকারের সার্কুলার নং ৪২৮(৫), এলএসজি ; তারিখ ১৯ এপ্রিল ১৯৩৯, ফাইল নং ২০-২৩ (১৯৩৮)।
৩৯. “ভিলেজ সেলফ গভর্নমেন্ট এ্যাক্ট, ১৯১৯”-এর ধারামতে প্রতিটি ইউনিয়ন বাের্ডের জন্য বাের্ডের এক-তৃতীয়াংশ সদস্য ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা মনােনীত হবেন ; এর কারণ হল, সংখ্যালঘুরা যাতে এর প্রতিনিধিত্ব করতে পারে এবং ইউনিয়নের অন্য বিষয়গুলাে যথাযথভাবে পালন করা যায়।
৪০. গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, হােম এপয়েন্টমেন্ট ফাইল আইই – ৪৭, প্রসেডিংস বি ১৭১ ১৭৪ (১৯৩৯)।
৪১. গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, হােম পুলিশ ফাইল পি ৩-১-১৯, প্রসিডিংস এ-৭৯-৪১,
ডিসেম্বর ১৯৩৮।
৪২. আনন্দবাজার পত্রিকা (কলকাতা), ১২ জুলাই ১৯৪০।
৪৩. দি স্টেটসম্যান (কলকাতা), ২৫ জুলাই ১৯৪০।
৭৯
৪৪. ৩০ এপ্রিল ১৯২৯ পর্যন্ত এসডিও কর্তৃক পাবনা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে পেশকৃত পাক্ষিক গােপন প্রতিবেদন, গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ৮৭/৩৯।
৪৫. পাবনার জেলা ম্যাজিস্ট্রেট জনাব মাহমুদের কাছে সিরাজগঞ্জের এসডিও জনাব কোরেশীর প্রেরিত ডিও লেটার তারিখ ৭ মে ১৯৩৯ এবং রাজশাহীর কমিশনার এ. দাসের বরাবরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের প্রেরিত ডিও লেটার ৪০৯৬ তারিখ ৯ মে ১৯৩৯।
৪৬. ঐ
৪৭. মনের সন্দেহে মন্ত্রিদের ধারণা হতে লাগল – নওশের আলী তাদের সাথে সঙ্গতি রেখে কাজ করছেন না আর বিরােধীদের সাথে মিলে কূট পরিকল্পনায় লিপ্ত ; আর এজন্যই মন্ত্রিসভার সাথে তার বিরােধ তৈরি হল। “গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া” হােম পলিটিক্যাল ফাইল ৬৬/৪০।
৪৮. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ২৩ জুন ১৯৩৮।
৪৯. দৈনিক আজাদ (কলকাতা), ৩ আগস্ট ১৯৩৮।
৫০. ১৯৩৮ সালের ১৭ এপ্রিল, কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে দেয়া ফজলুল হকের বক্তৃতা, উদ্ধৃত এ. এম. জাইদী (সংস্করণ), “ইভল্যুশন অব মুসলিম পলিটিক্যাল থট ইন ইন্ডিয়া”, ভলিউম ৫ (দিল্লী, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ৬৯।
৫১. আই. এইচ. কোরেশী, “দি মুসলিম কমউনিটি অব ইন্দো-পাক সাব-কন্টিনেন্ট” (দি হজ ১৯৬২), পৃষ্ঠা ১০০-১০৩।
৫২. ১৯৩৮ সালের ১৭ এপ্রিল কলকাতায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বিশেষ অধিবেশনে দেয়া ফজলুল হকের বক্তৃতা, মাধ্যম – জাইদী, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৭০।
৫৩. তমিজ উদ্দিন খান “স্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা ছিলেন।
৫৪. শামসুদ্দিন আহমেদ এসেম্বলীতে কৃষক-প্রজার পার্টির (বিদ্রোহী গ্রুপ) নেতা ছিলেন।
৫৫. আবুল মনসুর আহমেদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ১৮৪।
৫৬. ঐ।
৫৭. “স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা) ২৬ অক্টোবর ১৯৩৭। বাংলায় মুসলিম লীগের সাংগঠনিক কাজে ছিলেন এ. কে. ফজলুল হক, খাজা নাজিমুদ্দিন, খাজা শাহাবুদ্দিন, নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী এবং ইস্পাহানি ভ্রাতাগণ।
৫৮. উল্লেখ্য, খাজা নাজিমুদ্দিন, এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী, ইস্পাহানি, মওলানা আকরম খাঁ প্রমুখ প্রভাবশালী নেতারা যখন অবাধে এম. এ. জিন্নাহর মুসলিম লীগে যােগ দিল তখন ফজলুল হকও তাদের সাথে যােগ দিলেন তবে তিনি তার কৃষক-প্রজা পার্টিকে ছাড়লেন না, আর এ বিষয়টি জিন্নাহর কাছে আপত্তিকর ছিল।
৫৯. এন. এন. মিত্র, “ইন্ডিয়ান এনুয়াল রেজিস্ট্রার” (কলকাতা) ভলিউম ২, ১৯৩৭, পৃষ্ঠা
৪১৮।
৮০
৬০. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ২৯ ডিসেম্বর ১৯৩৭।
৬১. ঐ। ২৮ মার্চ ১৯৩৮।
৬২. ইন্ডিয়া অফিস লাইব্রেরী এন্ড রেকর্ড, এম-এস-এস-ই-ইউ-আর ৯৭, বারবােন কালেকশন, বারবােন টু লিনলিথগাে, ৫ মে ১৯৩৮। মাধ্যম – এনায়েতুর রহমান, “বেঙ্গল ইলেকশন, ১৯৩৭ ঃ ফজলুল হক এন্ড জিন্নাহ ঃ এ স্ট্যাডি ইন লিডারশীপ স্ট্রেস ইন বেঙ্গল পলিটিক্স”, জার্নাল অব দি এশিয়াটিক সােসাইটি অব বাংলাদেশ, ভলিউম ২২, নং – ২, আগস্ট ১৯৭৭।
৬৩. ডব্লিউ. এইচ. মরিস জোনস, “পাকিস্তান পােস্টমর্টেম এন্ড দ্য রুটস অব বাংলাদেশ”, পলিটিক্যাল কোয়ার্টারলী, ভলিউম ৪৩, নং ২ (এপ্রিল-জুন ১৯৭২), পৃষ্ঠা ১৯৪-৯৫।
৬৪. অবশ্য ইহা সত্য যে, ফজলুল হক তাঁর মন্ত্রিত্বকালে (১৯৩৭-৪১) ধর্ম বিষয়ে মাঝেমধ্যে মুসলিমদের সাথে কথা বলতেন এবং কংগ্রেসের বিরুদ্ধে কড়া ভাষা ব্যবহার করতেন। ইহা তিনি মূলত তাঁর রাজনৈতিক অবস্থান বােঝাতে করতেন, যখন কংগ্রেস এবং কংগ্রেসের বাইরের হিন্দুরা বিরােধী দলের ভূমিকা নিয়ে মিলিত শক্তি হয়ে তার বিপক্ষে দাঁড়াত।
৬৫. ১৯৪০ সালের ৩ জুলাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা সুভাষ বােসের নেতৃত্বে “সিরাজুদ্দৌলা দিবস” পালন করে ; এতে তারা নবাবকে বাঙালি জাতীয়তাবাধের শেষ চিহ্ন হিসেবে তুলে ধরে । দেখুন ঃ “মনিং নিউজ” (কলকাতা), ২ জুলাই ১৯৪০ এবং | “আজাদ” (কলকাতা), ১০ জুলাই ১৯৪০।
৬৬. গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ২৪১/৪১ পােল (১), কলকাতার সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্ট অফিস প্রতিবেদন। প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, “জোটের সদস্যদের কাছে সম্মেলনটি অপছন্দনীয় কেননা তারা মনে করেন, আদমশুমারী, মাধ্যমিক শিক্ষা বিল এবং ক্যালকাটা মিউনিসিপ্যাল এমেন্ডমেন্ট বিলের বিষয়ে হিন্দুদের সাথে কোন আপােস করা যাবে না । হক নিশ্চিত করলেন এ বলে যে, প্রথম দুটি সম্পর্কে তিনি অটল যদিও তৃতীয়টি সম্পর্কে তিনি কিছু বলতে পারছেন না। জোট সদস্যদের মধ্যে তখন সন্দেহের উদয় হল – হয়ত তিনি এ বিষয়ে অন্য কোন দলকে কথা দিয়েছেন। তখনকার জন্য এ বিষয়টি তারা বেশিদূর গড়াতে দিতে চাননি, পরে কখনও তােলা যেতে পারে।
৮১

ষষ্ঠ অধ্যায়
হক-লীগ দ্বন্দ্বঃ হক – শ্যামা মন্ত্রিসভা
(১৯৪১ – ১৯৪৩)

– এক –
১৯৪০ সালে গভর্নর জেনারেলের (ভাইসরয়) ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল (ওয়ার কমিটিতে) যােগদান করার প্রশ্নে ১৯৪০ সালে পাঞ্জাবের মুসলিম লীগের প্রধান সিকান্দার হায়াত খানের সাথে এম. এ. জিন্নাহর যখন মতপার্থক্য তৈরি হয় তখনই হক – জিন্নাহ দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ ধারণ করে। কারণ, ফজলুল হক সিকান্দারের পক্ষে ছিলেন।১ পরে ১৯৪১ সালে তাদের মধ্যকার বিরােধ মুখােমুখি অবস্থান নেয় যখন ভাইসরয়ের আমন্ত্রণে আসাম, বাংলা এবং পাঞ্জাবের প্রাদেশিক মুসলিম লীগ প্রধানগণ ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগদান করেন। জিন্নাহর সাথে এ সম্পর্কে পূর্বে কোন আলাপ না করায় তা তাঁর কাছে আপত্তিকর মনে হয় এবং শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়ার প্রয়ােজনীয়তার উপর তিনি বিবৃতি প্রদান করেন। সাথে সাথে হক এক বিবৃতিতে ঐ অবস্থার ব্যাখ্যা দেন এবং প্রতিবাদ করেন, যেহেতু তারা প্রদেশের প্রধান এবং যােগ্যতাসম্পন্ন তাই মহামান্য ভাইসরয়ের নির্দেশিত কোন চুক্তিতে তারা যােগদান না করে পারেন না।২ ফজলুল হক ভাবলেন বিষয়টি তিনি পরিষ্কার করেছেন এবং বিষয়টি এখানেই শেষ হবে। কিন্তু জিন্নাহ এবং বেঙ্গল মুসলিম লীগের সমর্থকরা ঐ ব্যাখ্যায় সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। ৩০ জুলাই হায়দ্রাবাদ থেকে জিন্নাহ আরেকটি বিবৃতি দিলেন যাতে তিনি বললেন, ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিলে হক এবং অন্যান্য লীগের সদস্যদের যােগদান সম্পর্কে তিনি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।৩ ১৯৪১ সালের ২৫ আগস্ট তারিখে বােম্বেতে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদে তিনি বিষয়টি উত্থাপন করেন। ঐ সভায় এম. এ. জিন্নাহ সিকান্দার হায়াত খানকে ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে ইস্তফা দিতে রাজি করান। আসামের প্রধান স্যার
৮২
মােহাম্মদ সাদউল্লাহও তা মেনে নিলেন। ফজলুল হক ঐ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন । লীগের কার্যকরী পরিষদ একমত হয়ে ফজলুল হককে ১০ দিনের মধ্যে ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে বিনা শর্তে ইস্তফা দিতে বলেন।৪ ঐ সিদ্ধান্তে ফজলুল হক বিস্মিত হলেন। তিনি অবশেষে ইস্তফা দিলেন। তবে বিরক্তি প্রকাশ করলেন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল এবং এর কার্যকরী পরিষদের উপর । অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খানকে এ বিষয়ে। তিনি যে পত্রটি লেখেন তা ছিল একটি ঐতিহাসিক দলিল।৫ চিঠিতে তিনি লীগের কিছু নেতাসহ নিজে ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগদানের বিরুদ্ধে। জিন্নাহর নেয়া সিদ্ধান্তের কড়া সমালােচনা করেন এবং প্রেসিডেন্ট তার ক্ষমতার নির্বিচার ব্যবহারের জন্য তিনি এর জোর প্রতিবাদ জানালেন। তিনি লিখলেন ঃ
প্রেসিডেন্টের এ আচরণ সম্পূর্ণ অসাংবিধানিক। মাদ্রাজ রেজুলেশন দ্বারা বিপথগামী কোন সদস্যের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার তিনি যে বিপুল ক্ষমতা পেয়েছেন, তাতে করে আমাদের নিজস্ব ব্যাখ্যা বা বিষয়টি সম্পর্কে আমাদের যে আত্মপক্ষ সমর্থনের জন্য যুক্তিও থাকতে পারে তিনি তা বিবেচনায় নিলেন না। ইহা একটি সাংবিধানিক অধিকার যা যে কেউ দাবি করতে পারে এবং বিশেষ জরুরী অবস্থা ছাড়া কেউ এ যুক্তি না নিয়ে একতরফা সিদ্ধান্ত দিতে পারে না যা বর্তমানের এ ঘটনাটির ক্ষেত্রে করা হয়েছে।৬
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগসহ এর কার্যকরী পরিষদেরও সমালােচনা করে ফজলুল হক বলেনঃ
কার্যকরী পরিষদও প্রেসিডেন্টের এ কাজে সমর্থন দিয়েছে। কারণ, তাদের সামনে অন্য আর কোন পথ খােলা ছিল না। তারা যদি প্রেসিডেন্টের এ কাজে অনুমােদন না দিত তাহলে তা প্রেসিডেন্টের উপর অনাস্থা জ্ঞাপন হয়ে দাঁড়াত আর এ ঝামেলার মুখােমুখি তারা হতে চাননি। এজন্যই ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে নিঃশর্তভাবে বেরিয়ে আসার জন্য তারা ঐ প্রস্তাবে অনুমােদন দেয়।৭
ফজলুল হক পুনরায় জিন্নাহকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর সময় থেকে তিনি তার সব ধরনের অফিসিয়াল ও ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে যুদ্ধপ্রচেষ্টায় বাংলার জনগণের সমর্থন আদায় করেছেন।৮ এ কাজের জন্য তিনি জনগণের সহায়তায় তহবিল গঠন করেছেন। যুদ্ধ-প্রচেষ্টার সমর্থনে তিনি
৮৩
রেডিওতে জনগণের উদ্দেশ্যে অনেক ভাষণ দিয়েছেন। এম. এ. জিন্নাহ কোন অবস্থাতেই তখন এসব প্রচেষ্টার প্রতি অমত ছিলেন না। অপরদিকে তিনি মুসলিম লীগের বড় বড় নেতাদের এ জাতীয় কাজ করতে সম্মতি দিতেন।৯ এসব বিষয়ের উদাহরণ টেনে হক জানালেন, ভারতের কেন্দ্রীয় সরকারকে কোনভাবেই লীগের প্রেসিডেন্টের পক্ষে অসহযােগিতা করা সম্ভব নয়।
অন্যদিকে জিন্নাহ হককে দোষারােপ করলেন, তিনি মুসলমানদের স্বার্থ বিরােধী কাজ করেছেন এবং ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগ দেয়ায় মুসলিম ভারতের মর্যাদা ক্ষুন্ন করেছেন। তিনি আরও জানান, ফজলুল হক ওপরওয়ালাদের খুশি করার স্বার্থ নিয়েই ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ করেছিলেন এবং এ কারণেই ডিফেন্স কাউন্সিলে ফজলুল হকের সদস্যপদটি মুসলিমরা সাদরে গ্রহণ করেনি।১০ তাঁর বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযােগ করা হয়েছে উল্লেখ করে ফজলুল হক বলেন, অল্প কিছু কলকাতার অবাঙালী ও মিল শ্রমিকদের নাখােশ হওয়ার বিষয়টিকে বাংলার সকল মুসলিমের অমত বলে চালিয়ে দেয়া হয়েছে। অন্যদিকে বরং বাংলার বাইরের অনেক মুসলিম তার এ ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগ দেয়ার সমর্থন করেছেন। তিনি লিখলেনঃ
ডিফেন্স কাউন্সিলে আমার সদস্যপদ গ্রহণ করাকে যে অধিক সংখ্যক মুসলিম অসমর্থন করেছে – তা আমি মানি না। অল্প কিছু কলকাতার অবাঙালি ও মিল শ্রমিক ছাড়া অন্য কোন বাঙালী মুসলমানদের কাছ থেকে এমন কিছু শুনিনি যাতে মনে হয় যে তারা এর নিন্দা করেছে। আমার এ প্রদেশ ছাড়াও অন্যান্য প্রদেশের বিপুল সংখ্যক জনগণের মতামতও আমার পক্ষে রয়েছে ……… বাংলা এবং বাংলার বাইরের জামায়েত-উল-উলেমার অনেক সদস্য আমাকে চিঠি দিয়ে ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে ইস্তফা না দেয়ার জন্য অনুরােধ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, আমার কাছে অসংখ্য চিঠি-টেলিগ্রাম এসেছে যাতে প্রমাণ হয় ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ করার ক্ষেত্রে আমার প্রতি বিপুল সংখ্যক জনগণের সমর্থন রয়েছে।
এতদসত্ত্বেও ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদ থেকে ফজলুল হক ইস্তফা দিলেন। তিনি বিষয়টিকে একে একে ব্যাখ্যা করলেন যে, জিন্নাহর কথামত তিনি ইস্তফা দেননি, ইস্তফা দিয়েছেন কারণ ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে অন্যরা চলে আসার পরও যদি তিনি সেখানে থেকে যেতেন তাহলে কাউন্সিলের ভাল হােক বা না
৮৪
হােক, মুসলিম সম্প্রদায়ের মর্যাদা অনেকাংশে নষ্ট হয়ে যেতে পারত।১২ এছাড়া ফজলুল হক বিরক্তি প্রকাশ করে আরও বললেন, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ দ্বারা বাংলার মুসলমানদের (যারা ভারতে গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত) উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব বহাল রাখলে তা খুবই ক্ষতিকারক হবে এবং বাইরের কেউ এসে তাদের চাওয়া-পাওয়ার উপর খবরদারি করুক ইহা তিনি বরদাস্ত করবেন না।১৩ মুসলিম রাজনীতিতে একক আধিপত্য প্রমাণ করতে গিয়ে জিন্নাহ যখন মুসলিম লীগের প্রাদেশিক শাখাগুলাের উপর কর্তৃত্ব দেখানাে শুরু করলেন তখনই ফজলুল হক জিন্নাহকে চ্যালেঞ্জ করলেন। এর ফলে মুসলিম লীগের জিন্নাহ অনুসারী নেতাদের মধ্যে চরম প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করা গেল, যে পক্ষের সাথে হকের সম্পর্ক ইতােমধ্যেই অনেক অবনতি ঘটেছে। জিন্নাহর প্রতি এ গ্রুপের প্রতিশ্রুতি ছিল প্রশ্নাতীত যা হকের কাছে ছিল খুবই বিরক্তিকর। তাই হক লীগ থেকে তাঁর কিছু অনুসারী নিয়ে বাইরে এসে বিরােধী দলের সাথে লীগ-বিপক্ষ জোট গঠনের জন্য আলােচনা শুরু করলেন।১৪ বাংলার মুসলিম লীগের ভেতরকার প্রতিবেদন দিতে গিয়ে ১৯৪১ সালের আগস্ট মাসের শেষ ভাগের প্রতিবেদনে সেন্ট্রাল ইন্টিলিজেন্স অফিসার লিখলেন ঃ
ফজলুল হক এবং অন্যান্য মুসলিম লীগের নেতার মধ্যে বিভাজনের যে লক্ষণ চিহ্নিত করা গিয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, হকের অনুসারীরা আজাদ পত্রিকার বিরুদ্ধে সমালােচনা শুরু করার উদ্যোগ নিয়েছিল, যে পত্রিকাটির সম্পাদক হলেন বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের ভাইস প্রেসিডেন্ট মওলানা আকরম খাঁ । কিছু সদস্য যখন এরূপ সমালােচনায় উদ্যোগী হয়ে এ বিষয়ে সভার আয়ােজন করল তখন আরেক গ্রুপ তাদেরকে হটিয়ে নিজেরা সভা করে জিন্নাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করল এবং ঐ পত্রিকার কার্যক্রমকে সমর্থন জানাল।১৫
বাংলার মুসলিম লীগের জিন্নাহ সমর্থিত সংগঠনগুলােও চুপচাপ বসে থাকল না। হকের বিরুদ্ধে মুসলমানদের মধ্যে বিরূপ মনােভাব গড়ে তােলার লক্ষ্যে ১৯৪১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর কলকাতার ময়দানে এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী বিশাল জনসভা করলেন এবং ঐ সভায় তিনি জিন্নাহকে লেখা ফজলুল হকের ১৯৪১ সালের ৮ সেপ্টেম্বরের চিঠির বক্তব্যের নিন্দা জানালেন। ১২ সেপ্টেম্বরের বিবৃতিতে ফজলুল হককে সমালােচনা করে, “বাংলার প্রতিভাবান লােকেরা স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে জেগে উঠেছে এবং আমি ও রাজনৈতিক আলাপচারিতায়
৮৫
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারিকে এই এক স্বৈরাচার ব্যক্তির কার্যকলাপ সম্পর্কে চিঠিতে না লিখে থাকতে পারিনি।”১৬
১৯৪১ সালের ২৭ অক্টোবর অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদ একটি প্রস্তাব পাস করল, তাতে বলা হল জিন্নাহর বিরুদ্ধে করা ফজলুল হকের সব অভিযােগ যেন তিনি নিজেই প্রত্যাহার করেন। এতে ফজলুল হক ভাবলেন, এ অবস্থায় মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্কের অবনতি করা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না । কারণ, মুসলিম লীগের বিপক্ষে অবস্থানের জন্য বিরােধীদলের সাথে “সমর্থন পাওয়ার আলােচনা” এখনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসেনি। তখন তিনি মুসলিম লীগের নেতাদের প্রতি তাঁর মতবিরােধ কিছু সময়ের জন্য আড়াল করলেন আর সময়ের অপেক্ষায় রইলেন।১৭ এ অবস্থায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খানকে চিঠি লিখে জানালেন, কাউকে মনে আঘাত দেয়া বা কাউকে দুর্নাম করার কোন অভিপ্রায় তাঁর ছিল না।১৮ লীগের কার্যকরী পরিষদ ঐ চিঠিটি তার ক্ষমা চাওয়া মনে করে বিষয়টি সেখানেই শেষ হয়ে গিয়েছে বলে ধরে নিলেন।১৯
কিন্তু হক-জিন্নাহ মতবিরােধ বিষয়টি সেখানেই শেষ হয়নি। ফজলুল হকের অনুসারীরা তখন ভেতরে-ভেতরে আইন পরিষদে তাদের জোর তৎপরতা চালাচ্ছিলেন এবং সফল আলােচনা শেষে তারা হিন্দু বিরােধী দলকে সাথে নিয়ে ১৯৪১ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর এইচ. এম. সােহরাওয়ার্দীর প্রতি অনাস্থা প্রস্তাব আনলেন। তখনকার মত তিনি ডেপুটি স্পিকারের দ্বারা রক্ষা পেলেন, কারণ ডেপুটি স্পিকার ঐ দিনের মত অধিবেশন মুলতবী করেছিলেন। পরবর্তী শীতের মৌসুমে ২৭ নভেম্বর আবার অধিবেশন বসল। এরই মধ্যে ফজলুল হকের অনুসারীরা মন্ত্রিজোট থেকে আলাদা হয়ে প্রগ্রেসিভ এসেম্বলী পার্টিতে রূপান্তরিত হল। শক্তিশালী মন্ত্রিপরিষদ গঠনের লক্ষ্যে তারা আরও শরিক দল খুঁজতে লাগল।২০ ঐ সময় ফজলুল হক এবং বাংলার মুসলিম নেতাদের মধ্যে আপােস করাতে ইউরােপীয় দল জোর তৎপরতা চালাল। কিন্তু তাদের চেষ্টা বিফলে গেল। জিন্নাহ সমর্থিত বাংলার মুসলিম লীগের সংগঠনগুলাে তখন বুঝে গিয়েছিল, ফজলুল হককে মন্ত্রিপরিষদের প্রধান থেকে না সরানাে গেলে এ প্রদেশে তাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ একদম অন্ধকার। কিন্তু তা সম্ভব নয় যতক্ষণ না গভর্নর তাকে সরাবেন বা তিনি নিজে ইস্তফা দিবেন অথবা তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব এনে তাঁকে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা হবে। এ পরিস্থিতিতে তাদের কাছে একটিমাত্র উপায় ছিল যাতে হককে ক্ষমতাচ্যুত করা যায়।
৮৬
জোটের মুসলিম লীগের নেতারা একত্রে ইস্তফা দিয়ে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিতে পারতেন। অবশেষে তারা এমনটি করতে উদ্যত হল ; কারণ, তাদের আশা ছিল যদি এভাবে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া যায় তাহলে গভর্নর তাদের কাউকে না। কাউকে ডেকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলবেন।২১ তাই ১৯৪১ সালের ১ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের মন্ত্রিরা পদত্যাগ করলেন এবং এর কারণে ফজলুল হক’কেও ইস্তফা দিতে হল।
ফজলুল হক বুঝে ফেললেন, জিন্নাহ সমর্থক লীগ নেতারা ছক এঁকে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করেছে আর তাই তিনি নীরব দর্শকের ভূমিকা নিলেন না। ১৯৪১ সালের ২৮ নভেম্বর তিনি জোটের নিজ অনুসারীদের নিয়ে, বিরােধীদলের নেতাদের সাথে ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সাজাতে, ফরােয়ার্ড ব্লকের নেতা জেসি গুপ্তের নিজস্ব বাসভবনে একটি আলােচনায় বসলেন।২২ ঐ আলােচনায় শরৎ বােস নতুন কেবিনেট গঠনের জন্য একটি খসড়া তালিকা করলেন। ঐ খসড়া অনুযায়ী কৃষক-প্রজা পার্টি, ফরােয়ার্ড ব্লক, হিন্দু মহাসভা এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের স্বতন্ত্র সদস্যদের নিয়ে নতুন একটি দল “দি প্রােগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি” গঠন করা হল।২৩ ফজলুল হককে নতুন দলের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য। আহ্বান করা হল। কিন্তু হক লীগ জোটের মন্ত্রি হিসেবে ঐদিনও তিনি বহাল থাকায় সেদিন তা গ্রহণ করলেন না। মুসলিম লীগের মন্ত্রিরা ১ ডিসেম্বর ইস্তফা দেয়ার পর যখন হক-লীগ যৌথ মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে যায় তারপরই ৩ ডিসেম্বর ফজলুল হক নতুন পার্টির নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। ফজলুল হক ঘােষণা দিলেন, “এই দল গঠিত হওয়ায় ভারতের জাতীয় জীবনের অনেক উপাদান একত্রিত হল যা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অভূতপূর্ব অধ্যায় এবং ভবিষ্যতের জন্য আমি আশাবাদী যে, এর দ্বারা সাম্প্রদায়িক শত্রুতারই শুধু অবসান হবে না, এদেশের সর্বস্তরের মানুষের মঙ্গলের জন্য সব ধরনের কর্মসূচিরও বাস্তবায়ন হবে।” গভর্নর ১৯৪১ সালের ১২ ডিসেম্বর ফজলুল হককে নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করতে আহবান করেন। ফজলুল হকের সঙ্গে এ কোয়ালিশনের অন্যতম নেতা ছিলেন ডা. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জি। আর তা হক-শ্যামা মন্ত্রিসভা নামে পরিচিত হল । এভাবে ক্ষমতার বাইরে রাখার জন্য জিন্নাহ সমর্থকদের নেয়া সকল উদ্যোগ ফজলুল হক বানচাল করে দিলেন।
এদিকে, বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের ২ ডিসেম্বরের সভায় আইন পরিষদের সকল মুসলিম সদস্যকে প্রগেসিভ কোয়ালিশন পার্টি থেকে আলাদা হয়ে যেতে বলা হয় এবং এভাবে নতুন মুসলিম লীগ লেজিসলেচার পার্টি গঠিত হয়। ১৯৪১ সালের ৫ ডিসেম্বর মুসলিম লীগের
৮৭
মন্ত্রিরা একটি বিবৃতি প্রদান করেন যাতে মুসলিম লীগকে ধোঁকা দেয়ার জন্য ফজলুল হকের নিন্দা জ্ঞাপন করা হয়ঃ
সবাই জানত যে, গত দু বছর ধরে, থেকে থেকে গােপনে ফজলুল হক বিকল্প একটি মন্ত্রিসভা গঠনের লক্ষ্যে কংগ্রেস ফরােয়ার্ড ব্লকের নেতা মিঃ শরৎ বােস এবং হিন্দু মহাসভার কয়েকজন নেতার সাথে আলাপ করেছেন …… মুসলিম সংহতির স্বার্থে …… আমরা এ রকম অনেক বিষয়ে ভ্রক্ষেপ করিনি। কিন্তু সমস্যা তখনই গুরুতর হল যখন হক অল ইণ্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারির কাছে জিন্নাহর কুৎসা রটিয়ে বাঙালি-অবাঙালি পার্থক্য করে ভারতের রাজনীতিতে বিভেদ সৃষ্টি করলেন এবং বাংলার মুসলিমদের অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ থেকে সরে যেতে বললেন।২৪
১৯৪১ সালের ১০ ডিসেম্বর জিন্নাহ ফজলুল হককে “লীগের সাথে বিশেষ করে মুসলমানদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করার জন্য মুসলিম লীগ থেকে বহিস্কার করে দেন। ১৯৪১ সালের ২৬ ডিসেম্বর নাগপুরে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদে তা অনুমােদন করা হয়।২৫

– দুই –
হক-লীগ যৌথ মন্ত্রিসভা গঠন হওয়ায় বাংলার মুসলিম লীগ নেতাদের মনে নতুন আশার সঞ্চার হয়েছিল। কিন্তু ঘটনাচক্রে যে পরিস্থিতি তৈরি হল তাতে সবাই খুব হতাশাগ্রস্ত অবাক হল। ফজলুল হকের নেতৃত্বে নতুন করে মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ায় তাদের সব হিসাব-নিকাশ পাল্টে গেল। তারা এ রাজনৈতিক পরাজয় মেনে নিতে না পারায় ফজলুল হক ও নতুন মন্ত্রিসভা নিয়ে অপপ্রচার। চালাতে লাগল । স্বাভাবিকভাবে লীগের অপপ্রচার থামাতে ফজলুল হকের কিছু পদক্ষেপ নিতে হল, যার ফলে লীগ ও ফজলুল হকের দ্বন্দ্ব আরও চরম রূপ ধারণ করল।
বাংলায় হক – শ্যামা যৌথ মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার পরপরই মুসলিম লীগের প্রাক্তন মন্ত্রিরা খাজা নাজিমুদ্দিন, এইচ. এম. সােহরাওয়ার্দী, তমিজুদ্দিন খান এবং বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দ যেমন মওলানা আকরম খাঁ, মােয়াজ্জেম উদ্দিন হােসেন, নওয়াবজাদা নসরুল্লাহ প্রমুখ প্রদেশব্যাপী দীর্ঘ সফরে বের হন। মুসলিম লীগের
৮৮
পত্রিকা দৈনিক আজাদ’ ১৯৪২ সালের ৩ জানুয়ারির সম্পাদকীয়তে এই সকল নেতাদের স্বাগত জানানাের পাশাপাশি এ কর্মসূচিকে “কাফেলা যাত্রা’ বলে এর জয়গান করে।২৬ এ যাত্রায় লীগের নেতারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে সভা-সমাবেশ করেন। সমাবেশে ফজলুল হককে একজন ধোঁকাবাজ চিহ্নিত করে বক্তৃতা দিতে থাকেন যাতে করে মুসলমানদের অন্তরে তার বিরুদ্ধে খারাপ ধারণা জন্মে। নােয়াখালীতে এ রকম একটি সমাবেশ হয়েছিল ১৯৪২ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি, যেখানে এইচ. এস. সােহরাওয়াদী বলেছিলেনঃ
আজ লােকজন কেন আমাদেরকে ভালবাসে। আপনারা ভাল করেই জানেন যে, যারা সম্প্রদায়ের জন্য জীবন বিলিয়ে দিতে প্রস্তুত তারা সবসময়ই অনুসরণীয় ও সম্মান পাওয়ার যােগ্য। যারা তাদের নিজেদের সম্প্রদায়কে দূরে ঠেলে বা অন্য সম্প্রদায়ের সাথে মিলিত হয় তাদেরকে কেউ ভালবাসে না। ফজলুল হক এখন আমাদের মন্ত্রী হয়েছেন। জনগণ তাঁকে চায় না। তাঁর সব পদক্ষেপ মানুষ অগ্রাহ্য করে। এ মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে নতুন মন্ত্রিসভা করা না হলে সঠিক প্রশাসন হবে না।২৭
মুসলিম লীগ নেতাদের ঐ যাত্রায় সাহায্যের হাত বাড়িয়েছিলেন সচিবালয়ের স্থায়ী কর্মকর্তারা, যেমনটি দেখা গিয়েছিল মােহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহর ক্ষেত্রে, বাংলার প্রাদেশিক মুসলিম লীগের এই কর্মী সব জায়গায় ঐ নেতাদের সাথে। থেকে তাদের সহযােগিতা করেছেন।২৮ তিনি তাদের যাত্রার সকল ব্যয়ভারও বহন করেছিলেন। তিনি জানান, ময়মনসিংহ জেলা পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টও একবার বেনামে তাদের নৈশভােজের নিমন্ত্রণ করেছিলেন। এছাড়াও বিভিন্ন কর্মকর্তা বিশেষ করে কমিশনার, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট এবং পুলিশ সুপারিন্টেনডেন্টও তখন নাজিমুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করেছিলেন। যদিও বিভিন্ন জনসমাবেশে বক্তারা খুব আপত্তিকর বক্তৃতা দিয়েছিলেন তবুও তাঁদের বিরুদ্ধে কোন রকম ব্যবস্থা নেয়া হয়নি।
লীগ নেতাদের ঐ প্রচারণা যাত্রার কার্যক্রমের সাথে সঙ্গতি রেখে মুসলিম লীগের মাওলানা আকরম খাঁর আজাদ এবং খাজা নাজিমুদ্দীনের “স্টার অব ইন্ডিয়া” পত্রিকা ফজলুল হক ও তাঁর মন্ত্রিপরিষদের মুসলিম নেতাদের নিয়ে অনেক ধরনের লেখালেখি চালিয়ে যাচ্ছিল।২৯ এ পত্রিকাগুলাে অভিযােগ করে
৮৯
লিখল, সরকারি চাকরিতে মুসলিমদের যে হারে নিয়ােগ দেয়ার কথা তা না করে এ সরকার “এয়ার রেইড-প্রিকশান সার্ভিস”-এ হিন্দুদেরই শুধু নিয়ােগ দিচ্ছে।৩০ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে অপপ্রচারের ক্ষেত্রে ইহাই ছিল তখন মুসলিম লীগের বড় হাতিয়ার। তারা এ বিষয়টিকে পুঁজি করে মন্ত্রিদের বিরুদ্ধে। আন্দোলন শুরু করল। আন্দোলন বেগবান করতে কলকাতার এক সভায় এ কাজের জন্য কর্মপরিষদ গঠন করা হল যার সেক্রেটারি ছিলেন জনৈক নূরুল হুদা ।৩১
লীগের নেতারা ছাত্রদেরও হক-বিরােধী আন্দোলনে জড়াতে দ্বিধা করলেন । ছাত্রদের দ্বারা তাই শত শত সভা অনুষ্ঠিত হল আর সেখান থেকে ফজলুল হক ও তার মন্ত্রিসভার বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে ভাষণ দেয়া হল।
১৯৪২ সালের সিরাজগঞ্জে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের প্রাদেশিক এক সভায় যােগ দিতে জিন্নাহ যখন বাংলায় এলেন ঠিক ঐ সময়ে হক-বিরােধী প্রচারণা ব্যাপকতা পেল। হকের বিরুদ্ধে পুনরায় অভিযােগ করে তিনি বক্তৃতা দিলেন, “শুধু কি মুসলিম লীগ ; সমগ্র মুসলিম ভারতের জন্যও ইহা কি চরম বিশ্বাসঘাতকতা নয় ?” বাংলায় লীগের আন্দোলন ও সকল কার্যক্রমকে এ মন্ত্রিসভা শেষ করে দিবে মনে করে তিনি মন্ত্রিসভার তিরস্কার করে বক্তৃতা দিলেন – “ব্রিটিশ রাজত্বের এ সময়ে যদি গভর্নর অতি দ্রুত কোন পদক্ষেপ না। নেয় তাহলে বাংলার ইতিহাসে ইহা একটি অপ্রতিরােধ্য পরিস্থিতির জন্ম দিবে। মুসলিম প্রতিনিধিত্বহীন এ মন্ত্রিসভা দ্বারা আমরা আতঙ্কগ্রস্ত ও কোণঠাসা হতে চাই না।”৩৩ নতুন করে প্রাদেশিক নির্বাচনের দাবি ও পাকিস্তানের উপর আস্থা পুনর্ব্যক্ত করে সভার সমাপ্তি হয়।
এম. এ. জিন্নাহর বাংলায় আগমনের ফলে বাংলার মুসলিম লীগের রাজনীতিতে এর চরম প্রভাব পড়ল। মুসলিম লীগের ছাত্রসমাজের মনােবল চাঙ্গা হয়ে উঠল আর তারা নানা কর্মসূচি গ্রহণ করল। তখন সমগ্র বাংলার মুসলিম ছাত্রলীগ ও লীগের জঙ্গী গ্রুপ নতুন করে প্রেরণা পেল। জেলা মুসলিম লীগের জাতীয় রক্ষা কমিটিও গঠন করা হল। কলকাতা থেকে এসব সংগঠন সারা দেশের আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে পড়ল এবং সভা-সমাবেশ করে ফজলুল হক ও তাঁর মন্ত্রিসভার বিপক্ষে জনমত গড়ে তুলতে লাগল। আর এর সাথে তারা পাকিস্তান ও মুসলিমদের জন্য জনসমর্থন আদায়ে লেগে গেল।
৯০
ফজলুল হকও নিজের এবং তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে আনীত মুসলিম লীগের অপ্রপ্রচার ঠেকাতে বিভিন্ন উপায় বের করলেন। তিনি ১৯৪২ সালের ২০ জুন ভারতের নামকরা মুসলিম নেতাদের বরাবর নতুন দল প্রগেসিভ মুসলিম লীগ গঠনের প্রস্তাব করে চিঠি লিখলেন।৩৪ তখনকার মুসলিম লীগ নেতাদের কড়া সমালােচনা করে তিনি চিঠিতে লিখলেন ঃ এখানে একজন লােকেরই শুধু কর্তৃত্ব। চলে আর লীগের অন্য নেতাদের নিজস্ব কোন চিন্তার প্রতিফলন হতে দেয়া হয় না ।”৩৫ জিন্নাহকে কঠোরভাবে তিরস্কার করে তিনি আরও লিখলেন ঃ
এই ব্যক্তি ফেরাউনদের থেকেও বেশি উদ্ধত ও অহংকারী। আমাদের অবস্থা দুর্বিষহ করে তুলতে এ অতিমানব তার কাণ্ডজ্ঞানহীন ক্ষমতা এমনভাবে প্রয়ােগ করেছেন যে জারেরাও অমনটা তাদের স্বপ্নে ভাবতে গিয়ে ঈর্ষান্বিত হবেন।৩৬
আবার মুসলিম লীগের সার্বিক কার্যকলাপ “অ-ইসলামিক” এবং তাদের নীতি “না ইসলামিক – না দেশাত্মবােধক ধরে নিয়ে হক বিশ্বাস করেন, এ দলটি মুসলমানদের রাজনৈতিকভাবে ধ্বংসের দিকে ঠেলে দিবে। তিনি লিখলেন ঃ
বর্তমানে মুসলিম লীগের কার্যকলাপ অনৈসলামিক। আমি দৃঢ়তার সাথে বিশ্বাস করি মুসলিম লীগ প্রকৃত এবং খাটি মুসলমানদের দ্বারা পরিচালিত হওয়া উচিত। কেউ নিজেকে প্রকৃত এবং খাঁটি মুসলিম লীগ বলে দাবি করতে গেলে তার উচিত হবে নিজেকে আগে খাটি মুসলমান হিসেবে তৈরি করা। যেসব কার্যক্রম মুসলিম লীগ হাতে নিয়েছে তাতে না আছে কোন ইসলামী মূল্যবােধ, না আছে কোন দেশপ্রেম। মুসলিম বা অন্য কেউই তাদের কোন সেবা পায়নি। নিজেদের মুসলিম দাবি করে শুধুমাত্র মুসলমানদের জন্য কাজ করার কথা বললেও এরা মূলত মুসলমানদের রাজনৈতিক পতনের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
পরিশেষে, প্রস্তাবিত প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ফজলুল হক লিখলেন ঃ
ইসলামের স্বার্থে প্রত্যেক মুসলমানকে তার নিজের সততা রক্ষা করার ক্ষেত্রে সর্বোতভাবে দেশের স্বার্থের বিষয়টির প্রতি তার খেয়াল রাখতে
৯১
হবে। অন্য ভাষায়, প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগের প্রথম আদর্শ হবে ইসলাম ও সর্বব্যাপী ইসলামিক কর্মকাণ্ড, কিন্তু তা সম্প্রদায়ের বৈধ অধিকারসমূহ উপেক্ষা করে নয়। আমি মনে করি, সকলের অন্তরে এ সত্য ধারণ করা উচিত যে, ইসলামের যাত্রা সকল মানবজাতির লক্ষ্যে এবং তা বিশ্ব ক্যাথলিকদের মধ্যেও প্রচারিত হয়েছিল আর এতে অনেক কষ্টও সহ্য করতে হয়েছে। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অগ্রগতির জন্য মুসলমান এবং অন্য সম্প্রদায়ের মধ্যকার সম্প্রীতি তৈরি হওয়াটা এখন বিশেষভাবে প্রয়ােজন।৩৮
এসব আদর্শের বাস্তবায়ন করতে ফজলুল হক ঢাকার নওয়াব বাহাদুরকে প্রেসিডেন্ট করে এবং সৈয়দ বদরুদ্দোজাকে সেক্রেটারি করে কলকাতায় একটি সাংগঠনিক কমিটি গঠন করলেন। এরপর তিনি বাংলার গ্রামাঞ্চলের সর্বত্র আঞ্চলিক দল গঠন করতে মুসলিম নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানালেন।৩৯
ফজলুল হক বুঝতে পারলেন, বাংলায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের উন্নতি ঘটিয়েই কেবলমাত্র মুসলিম লীগের কর্মকাণ্ডকে পরাস্ত করা যাবে। তাই তিনি হিন্দুমুসলিম ঐক্য গঠনে পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। ১৯৪২ সালের ২০ জুন কলকাতার টাউন হলে ঢাকার নওয়াবের সভাপতিত্বে একটি সভা হল । বাংলার বিশিষ্ট হিন্দু ও মুসলিম ব্যক্তিবর্গ তাতে যােগ দিলেন। উভয় সম্প্রদায়ের নেতারা ঐ সভায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহযােগিতার বিষয়ে জোর দেন।৪০ সভাতে হক খুব উৎসাহমূলক বক্তৃতা দেন। তিনি বলেন, “হিন্দু ও মুসলমানদের বুঝতে হবে, তাদের একত্রে থাকতে হবে, বাঁচা-মরা এক সাথে, এমনকি প্রয়ােজন হলে মাতৃভূমির জন্য একত্রে জীবন বিলিয়ে দিতে হবে।”৪১ তিনি আরও উল্লেখ করলেন, “ঐ সময়টি বহু পূর্বেই শেষ হয়ে গেছে যখন দুষ্কৃতকারীরা সহজেই মুসলিম সম্প্রদায়ের সাথে প্রতারণা করত এ বলে যে, মুসলিমদের পরিত্রাণের পথ ঐক্যে নয় বরং অনৈক্যে।”৪২ সভায় অরাজনৈতিক দল “কাউন্সিল অব হিন্দু-মুসলিম ইউনিটি এসােসিয়েশন” প্রতিষ্ঠা করা হয়, যাদের কাজ হল সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি ও সহযােগিতার পরিবেশ তৈরি করা।৪৩
ফজলুল হক সাম্প্রদায়িক সহাবস্থান নিশ্চিত করতে সরকারি পর্যায়েও কিছু পরিকল্পনা হাতে নিলেন যা “মডেস্ট স্কিম” নামে পরিচিত এবং এর জন্য তিনি ১৯৪২-৪৩ অর্থ বছরে ১,০০,০০০ লক্ষ রুপি বাজেটে বরাদ্দ করলেন।৪৪
৯২
এছাড়া ফজলুল হক, ১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে, ভারতবর্ষে ভ্রমণে আসা তুর্কির সাংবাদিক দলের সম্মানে কলকাতায় তাদেরকে দেয়া এক অভ্যর্থনা সভায় জিন্নাহ এবং মুসলিম লীগের সমর্থিত “দ্বিজাতি তত্ত্ব”-র সমালােচনা। করেন।৪৫
উল্লেখিত ঘটনাগুলাে থেকে বুঝা যায়, ১৯৪০ সালের পাকিস্তান প্রস্তাবে ধর্মভিত্তিক যে পাকিস্তান চাওয়া হয়েছিল তা ফজলুল হকের কাছে ছিল খুবই অযৌক্তিক আর তিনি মনে করেন এর ফলে ভারতবর্ষের সকল মুসলমানের উপর বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের স্বার্থের উপর ক্ষতিকর প্রভাব পড়বে। হক অবশ্য পাকিস্তান প্রস্তাবের সরাসরি বিরােধিতা করেননি। কারণ, তিনি দেখলেন, বাংলায় যে হারে লীগের জনপ্রিয়তা বাড়ছে তাতে যদি লীগের নেতারা অশিক্ষিত লােকদের মনে ঢুকিয়ে দেয় যে, “ফজলুল হক মুসলিম বিরােধী বলেই এর বিরুদ্ধাচরণ করছেন”- তাহলে সবাই তা মেনে নেবে। তিনি তখন বাংলার মুসলিমদের স্কিমের একটি অংশ বর্ণনা করে এর ক্ষতিকর প্রভাব সম্পর্কে বললেন ঃ
আমি বহুল আলােচিত এ স্কিম (পাকিস্তান) সম্পর্কে একটি মন্তব্য করতে চাই। আমরা জানি, তিনটি প্রদেশ – আসাম, বিহার এবং উড়িষ্যার অবস্থান। হল, বাংলার সাথে ভৌগােলিকভাবে যুক্ত। আসামে মুসলমান ৩৩%, বিহারে ১০% আর উড়িষ্যায় মাত্র ৪%। তাই বাংলার অবস্থান দেখে বুঝা যাচ্ছে, তা পার্শ্ববর্তী প্রদেশগুলােকে নিয়ে স্বায়ত্তশাসনের অবস্থানে নেই। আর যদি বাংলাকে দু’ভাগে ভাগ করা হয় তাহলে পূর্বের অংশ, যা আগেই মুসলিম অধ্যুষিত, তা হিন্দু অধ্যুষিত চারটি প্রদেশ দ্বারা পরিবেষ্ঠিত হয়ে। পড়ছে। তাই বাংলার মানুষের সাথে প্রতারণা করে তাদের বুঝানাে যাবে না। যে, পাঞ্জাবের ক্ষেত্রে যা ভাল হয়েছে তা বাংলার জন্যও ভাল হবে। একই সাথে বাংলার মুসলমানদের বুঝতে হবে যে পাকিস্তান প্রস্তাব বাস্তবায়ন করা হলে তারা সমগ্র ভারত থেকে আলাদা হয়ে একটি সারিতে পড়ে থাকবেন।৪৬
কিন্তু ফজলুল হকের এসব প্রচেষ্টা লীগের প্রচার এবং অপপ্রচারের সাথে পেরে উঠল না। আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, হকের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা ১৯৩৭-৪১ সাল পর্যন্ত বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনতার জন্য অনেক উন্নয়নমূলক কাজ করে তাদের হৃদয় জয় করে নিয়েছে। তাই, প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগের মত
৯৩
নতুন একটি দলের কার্যক্রম, পুরনাে মুসলিম লীগের কার্যক্রমকে ছাপিয়ে জনগণকে অতটা প্রলুব্ধ করল না। এছাড়া হককে সাংগঠনিকভাবে সমর্থন দেয়ার মত কোন দল তখন তাঁর পক্ষে ছিল না। যে কৃষক-প্রজা পার্টি হকের একটি কথায় মাঠে ঝাপিয়ে পড়ত তাদেরও তখন আর তেমন কার্যক্রম ছিল না। ১৯৩৭-৪১ সালের মধ্যে জনগণের কাছে তাদের চাহিদা ও উপযােগিতা হ্রাস পেতে থাকে, যে সময়টায় ফজলুল হক মুসলিম লীগে যােগ দিয়েছিলেন।
ফজলুল হক মুসলিম লীগকে বাদ দিয়ে নানা মতের মন্ত্রিদের সমন্বয়ে বাংলায় একটি আন্তঃসম্প্রদায় ভিত্তিক রাজনীতির ধারা চালু করার লক্ষ্যে নতুনভাবে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য যখন প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন ঠিক ঐদিন ভােরেই শরৎ বােস গ্রেফতার হওয়াতে তা নস্যাৎ হয়ে যায়।৪৭ ফজলুল হক এবং শরৎ বােস উভয়েই হিন্দু-মুসলিম সকলের কাছে সমান জনপ্রিয় ছিলেন।
আসলে উভয়ের পেছনে ফরােয়ার্ড ব্লক-এর নেতা সাংগঠনিক সমর্থন থাকায় বাংলার রাজনীতিকে নতুন উদ্যোগে সামনের দিকে এগিয়ে নেয়াসহ সাম্প্রদায়িকতা থেকে বাংলাকে মুক্ত করার মত অবস্থানে তারা ছিলেন। কিন্তু শরৎ বােসের গ্রেফতার হওয়ার ঘটনায় তা অঙ্কুরেই বিনষ্ট হল।
শরৎ বােস গ্রেফতার হওয়ার পর ফজলুল হকের মন্ত্রিসভার হিন্দু নেতৃত্ব ডাঃ শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর কাঁধে এসে পড়ল যা কিনা বাংলার রাজনীতিতে সাম্প্রদায়িকতার এক নতুন মাত্রাযুক্ত হল। ফজলুল হকের প্রতি মুসলিমদের যে ভালবাসা ছিল তা কমে গেল ; কারণ, হিন্দু রক্ষণশীল নেতা শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ও হিন্দু মহাসভাকে মুসলমানরা চরম ঘৃণা করত। শরৎ বােস বিহীন তাদের এ জোটকে নিয়ে তাই মুসলিম লীগ অপপ্রচার করার সুযােগ পেল এ বলে যে, ফজলুল হক নিজ স্বার্থে এমন একজনের সাথে হাত মিলিয়েছেন যিনি ব্যক্তিগভাবে মুসলিম বিদ্বেষী । আইনসভায় হকের মুসলিম সমর্থকদের সামাজিক চাপ তাই ক্রমেই বাড়তে লাগল। ফলে ফজলুল হককে ত্যাগ করে অনেকেই মুসলিম লীগের সংগঠনগুলােতে যােগ দিল ।
উপরে বর্ণিত কারণগুলাে ছাড়াও অন্য অনেক কারণ ছিল যেগুলাের জন্য। হক তাঁর ইচ্ছাগুলাের বাস্তব রূপ দিতে পারেননি। মন্ত্রিসভা সুন্দর করে সাজানাের ক্ষেত্রে প্রশাসনিক জটিলতা তখন বেশ সমস্যা সৃষ্টি করছিল, আর তা দূর করতে ফজলুল হক উদ্যোগী হলেন। তবে সেটিও সফলতার সঙ্গে সম্পন্ন। করা সম্ভব হল না শুধুমাত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ফলে এবং উদ্ভূত পরিস্থিতির কারণে। এর ফলে ঐ মন্ত্রিসভা বাংলার জনগণের কাছে ক্রমেই অগ্রহণযােগ্য
৯৪
হয়ে উঠল। আইনসভাতে মুসলিম লীগের সংসদীয় নেতারা এ বিষয়টিকে পুঁজি করে ফজলুল হক এবং তার দলকে নিয়ে বাকবিতণ্ডা করার সুযােগ পেল। আইনসভার ইউরােপীয় দলও তখন মুসলিম লীগের সাথে যােগ দিয়ে এ নিয়ে অনেকক্ষণ বিতর্ক করল। এ বিষয়ে ফজলুল হককে বাংলার গভর্নর কোন সহযােগিতা করলেন না ; কারণ, তখন বাংলার গভর্নর জন হার্বার্ট ঐ মন্ত্রিসভার প্রতি নাখােশ ছিলেন। তাঁর অসন্তুষ্ট থাকার কারণ হল, কংগ্রেসের সাথে হকের যে জোট হয়েছিল পরবর্তীতে তা ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনের রূপ নেয়। এসব কারণে বাংলায় ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার পতন ঘটে।

– তিন –
ফজলুল হক তার দ্বিতীয় মন্ত্রিসভায় সর্বপ্রথম যে সমস্যার মুখােমুখি হয়েছিলেন তাহল বাংলাতে ১৯৪২ সালের অধ্যাদেশ ১১-এর প্রয়ােগ। গভর্নর জেনারেল এ অধ্যাদেশ ঘােষণা করেন। এ অধ্যাদেশ দ্বারা রাজতন্ত্র বা রাজনৈতিক কোন মামলা চালানাের জন্য বিশেষ ফৌজদারী আদালত গঠনের নির্দেশ দেয়া হয়। যেকোন প্রদেশেই এমন আদালত বসানাে যাবে যদি প্রাদেশিক সরকার মনে করে যে, ইন্ডিয়া বা এর পার্শ্ববর্তী দেশ যেকোন ধরনের শত্রুতাপূর্ণ আক্রমণের শিকার হতে যাচ্ছে। ১৯৪২ সালে বাংলায় এ অধ্যাদেশ প্রয়ােগ করা হয়।
অধ্যাদেশ অনুযায়ী কাজ শুরু হওয়ার পর বাংলার মানুষ এর প্রতি বিরক্তি প্রকাশ করে। অনেক সাধারণ মামলা এ অধ্যাদেশের আওতায় করা হয়। যেমন সাধারণ একটি চুরির মামলারও বিশেষ ম্যাজিস্ট্রেট দ্বারা বিচার করা হয়েছিল, আর এমনটি করা হয়েছিল রাজশাহীর নাটোরে ১৯৪২ সালের সেপ্টেম্বরের কোন এক সময়ে ঐ মামলায় দোষীর ২ বছরের সাজাও হয়।৪৮ আবার ঢাকার মুন্সীগঞ্জের এক প্রাইমারী শিক্ষকেরও সাজা হয়। তাঁর দোষ ছিল তিনি এক দোকানদারকে বলেছিলেন, “দোহাই লাগে, লােকজন না খেয়ে আছে, তুমি চালের দাম কমাও, না হলে লােকজন এমন ক্ষেপে যাবে যে তােমার দোকান লুট হতে পারে।”৪৯ এরপর দেখা গেল, ঐ লােকালয়ের কিছু দূরে একটি নৌকাতে লুটতরাজ হয়। চার-পাঁচদিন পর আরেকটি নৌকাতে লুটের ঘটনা ঘটল। দোকানদারকে ঐ ধরনের কথা বলেছিল বলে শিক্ষককে ঐ অধ্যাদেশের ধারায় এনে তাকে বিচারের মুখােমুখি করা হয় এবং তাকে ১৮ মাসের কড়া সাজা দেয়
৯৫
হয়।৫০ শিক্ষক আসলেই লুটতরাজের সাথে যুক্ত ছিলেন কিনা বা ঐ কথাটি দোকানদারকে এমনিই বলেছিলেন কিনা তা খতিয়ে দেখার কোন উদ্যোগই তখন নেয়া হয়নি।
অধ্যাদেশটি জারি এবং এর অপব্যবহারের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক নেতারা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতিবাদ জানালেন। বাংলায় এ অধ্যাদেশ চালু করার বিষয়ে এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী বেশ সন্দিহান হয়ে উঠলেন।৫১ কক্সবাজারের খান বাহাদুর জালালুদ্দিন একে “সর্বনাশা” বলে চিহ্নিত করলেন।৫২ ঢাকার অতুল চন্দ্র সেন বললেন, “অধ্যাদেশবলে আইন জারি করাকে আমি অপছন্দ করি, যেকোন শালীন ব্যক্তি তাই-ই করবেন। এটি হল আইনহীন বিধি ; কারণ, এর দ্বারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কোন ধরনের মতামত না নিয়েই জনগণের উপর আইন চাপিয়ে দেয়া হয়।”৫৩
বাংলায় এ ফৌজদারী আদালত গঠনের অধ্যাদেশটি প্রয়ােগের যৌক্তিকতা থাকুক বা না থাকুক, ফজলুল হককে একজন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দাফতরিকভাবে এর পক্ষে সাফাই গাইতে হয়েছিল। তিনি দেখান, বাংলা ও জাপানের প্রতিবেশী রাষ্ট্রগুলাে ১৯৪২ থেকেই বেশ আতঙ্কগ্রস্ত অবস্থায় রয়েছে। এদিকটি বিবেচনায় নিয়েই জরুরীভিত্তিতে এ অধ্যাদেশ জারি করতে হয়েছে। অবশ্য তিনি অকপটে স্বীকার করলেন, কোন কোন ক্ষেত্রে এ অধ্যাদেশের অপপ্রয়ােগ হয়েছে। জনগণের উপর ইহা কঠিনভাবে প্রয়ােগ করা হয়েছে আর সাধারণ আইনের অধিকার থেকে তাদের বঞ্চিত করা হয়েছে।”৫৪
প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক আরও জানালেন, ১৯৪২ সালে গভর্নর জেনারেলের ১১নং অধ্যাদেশ “জনগণের মুক্ত চলাফেরার স্বাধীনতাকে খর্ব করে। প্রথমেই। কোন মামলা এ অধ্যাদেশের অধীনে পরিচালনা করা হলে, জুরিদের দ্বারা তা করার অধিকারটি কেড়ে নেয়া হয়। এ অধ্যাদেশে ম্যাজিস্ট্রেট ও বিচারককে। একক ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। আমরা জানি, জুরিদের মতামতভিত্তিক বিচার। পাওয়া জনগণের অধিকার – যে মূল্যবান অধিকারবলে নিজের পক্ষে জোর দিয়ে বলা যায়, আর জুরিরা সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারে।৫৫ অধ্যাদেশটির অপপ্রয়ােগের ফাঁক-ফোকর নির্দিষ্ট করতে কি কি পদক্ষেপ গ্রহণ করলে ভাল হয়। সে সম্পর্কে ফজলুল হক ব্যবস্থা গ্রহণের উদ্যোগ নিলেন। আর তাই সংশ্লিষ্ট দফতরসমূহে তিনি এ বিষয়ে কাজ করতে নির্দেশনা পাঠালেন। তখন দেখা গেল, উদ্ভূত জটিল পরিস্থিতির আশু সমাধানের লক্ষ্যে প্রশাসন মামলার দ্রুত নিষ্পত্তি করতে এই বিশেষ ফৌজদারী অধ্যাদেশ ব্যবহার করছে। যদিও
৯৬
হক-লীগ দ্বন্দ্ব ৪ হক – শ্যামা মন্ত্রিসভা।
স্বাভাবিক আদালতে এরূপ মামলা নিষ্পত্তি করা যেত কিন্তু প্রাদেশিক সরকার সরাসরি ঐ অধ্যাদেশের আওতায় নিয়ে তা বিশেষ কোর্টে প্রেরণ করত।৫৬
ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভা মুখােমুখি হলেন এক চরম খাদ্য ঘাটতি সংকটের। ৯৩ লক্ষ টন খাদ্য চাহিদার বিপরীতে ১৯৪২-৪৩ সালের অর্থবছরে খাদ্যের উৎপাদন হল ৬৯ লক্ষ টন। তখন প্রায় ২৪ লক্ষ টন খাদ্যের ঘাটতি তৈরি হল।৫৭ আস্তে আস্তে খাদ্য সমস্যা আরও বেশি প্রকট আকার ধারণ করতে লাগল। সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য ১৯৪২ সালের আগস্ট মাসে আইজি পিন্নেলকে পরিচালক করে “ডাইরেক্টরেট অব সিভিল সাপ্লাইস” দফতর স্থাপন করা হল। কয়েক মাস পরে পিন্নেল’র স্থলাভিষিক্ত হলেন হাইকোর্টের জজ টি. জে. ওয়াই রক্সবার্গ এবং চিটাগাং-এর একটি ব্যাংকের ব্রাঞ্চ ম্যানেজার এ. এ. ম্যাক ইনেসকে খাদ্যশস্য ক্রয় কর্মকর্তা হিসেবে সেখানে নিয়ােগ দেয়া হল। ম্যাক ইনেস’র নিয়ােগ নিয়ে বিতর্ক ছিল। প্রধানমন্ত্রীর সাথে বনিবনা না হওয়ার জন্যই যে এই বদলি, তা গভর্নর জানতে পেরেছিলেন। কিন্তু ফজলুল হক জানালেন ভিন্ন কথা। তিনি এ নিয়ােগে সন্তুষ্ট ছিলেন না বলে জানালেন, “আমি ঐ ব্যক্তি সম্পর্কে কিছুই জানি না এবং যে কাজ তিনি করতে যাচ্ছেন সে সম্পর্কেও আমি। তেমন কিছু জানি না। আর সর্বোপরি, অর্থমন্ত্রী হয়ে আমি তাকে নিয়ােগ দেইনি।”৫৮ যাহােক খাদ্যশস্য সহজলভ্য করতে সরকার কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করলেন। পরিকল্পনা অনুসারে ঃ
প্রথমত প্রদেশের নির্দিষ্ট কিছু এলাকা থেকে ধান ও চাল নিয়ে আসা হবে।
দ্বিতীয়ত, অনুমােদিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে নির্দিষ্ট মূল্যে তা ক্রয় করা হবে।
তৃতীয়ত, ধান ও চাল সরবরাহ নিয়ন্ত্রণ করবেন ডাইরেক্টরেট অব সিভিল সাপ্লাইস-এর খাদ্যশস্য ক্রয় কর্মকর্তা।৫৯
খাদ্যশস্যের সরবরাহ নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে আশা করা হচ্ছিল, অসাধু ব্যবসায়ীদের। দৌরাত্ম এবং প্রতিযােগিতামূলক ক্রয় দুটিই রােধ করা যাবে। পরিকল্পনাটি এভাবেই গ্রহণ করা হয়েছিল যেন চালের বাজার নিয়ন্ত্রণে রাখা যায় এবং যে। চাল অবশিষ্ট রয়েছে তা সমানভাবে বিতরণ করা যায়।
সরকারের পরিকল্পনা ও স্কিমটি সাথে সাথেই কার্যকর করা হল । সরকার এর জন্য ৫০ লক্ষ রুপি মঞ্জুর করল এবং চাল ক্রয় ও সংগ্রহের জন্য বিশেষত উপকূলীয় অঞ্চলে প্রতিনিধি নিয়ােগ করল।৬০ এসব কার্যক্রম শুরু করা সত্ত্বেও খাদ্য সমস্যার সমাধান হল না। এখানে অনেকগুলাে কারণ ছিল। জাপান বার্মা (মিয়ানমার)-কে আক্রমণ করার পর যখন ইয়াঙ্গুনের পতন হল তখন মূলত
৯৭
খাদ্য সমস্যা চরম আকারে দেখা দিল। প্রায় ২ লক্ষ টন চাল বার্মা থেকে। আমদানি ঘাটতি হল। এছাড়া আরাকান ও বার্মা থেকে শরণার্থীরা বাংলায় এসে চালের উপর ভাগ বসাল।৬১ এছাড়া মিলিটারিতে লােক জড় করানাে হচ্ছিল বলে সেখানে বহু লােকের আগমন ঘটে এবং ভােক্তার সংখ্যাও এতে করে বৃদ্ধি পায়। স্থানীয় উৎস থেকে তাদের চাহিদা মেটানাে হচ্ছিল।
১৯৪২ সালের এপ্রিলে সেখানে অতিরিক্ত মিলিটারি কার্যক্রম চালু হলে “ডিনায়াল পলিসি”৬২ চালু করা হয় এবং এর ফলে বাংলার খাদ্যাবস্থায় এক দীর্ঘচাপ পড়ে। নৌকা চলাচলের ক্ষেত্রে এ পলিসি উৎস থেকে বিভিন্ন এলাকায় চাল সরবরাহ কমিয়ে দেয় এবং চর এলাকায় চাষাবাদসহ গভীর সমুদ্রের মৎস্য আহরণে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এর ফলে মানুষের মনে এক বিরূপ প্রতিক্রিয়া তৈরি হয় আর তার ফলে প্রদেশের অর্থনৈতিক অবস্থার মারাত্মক স্থানচ্যুতি ঘটে। মন্ত্রিসভা বা প্রধানমন্ত্রীর অনুমতি ছাড়াই সরকারি কর্মকর্তাকে দিয়ে গভর্নর সরাসরি এ কাজটি করিয়েছিলেন। ১৯৪২ সালের ২ আগস্ট এক চিঠিতে ফজলুল হক গভর্নরকে অভিযােগ করে চিঠি লিখেন, “বর্তমানে আমরা বাংলায় চাল সংকটের জন্য দুর্ভিক্ষে ভুগছি আর এটি শুধু আপনার পক্ষ থেকে অবরােধ। প্রত্যাহার না করা ও জয়েন্ট সেক্রেটারির হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলাফল।”৬৩
বাংলার খাদ্য সমস্যার সুষ্ঠু সমাধানে ব্যর্থ হওয়ায় মন্ত্রিসভাকে মুসলিম লীগ তীর্যকভাবে আক্রমণ করল। মন্ত্রিসভাকে অভিযােগ করে লীগ সদস্য আবদুর রহমান সিদ্দিকি বললেন, “এরা উদাসীন, কর্মকর্তারা অনুপযুক্ত, আর এর ফলে জনগণের দুর্ভোগ আরও চরমে পৌঁছেছে এবং সারাদেশ অসহায় হয়ে পড়েছে।৬৪ আর এ অনুপযুক্ত লােকেরা, তিনি বলতে থাকলেন, “আমাদের ঘাত-প্রতিঘাতের দুর্বিপাকে ফেলে দিয়েছেন। কেন তারা বেরিয়ে গিয়ে সত্যিকার জনপ্রতিনিধিদের হাতে এ সমস্যা সমাধানের দায়ভার প্রদান করছেন না ?”৬৫ “সত্যিকার প্রতিনিধি” বলতে সিদ্দিকি সম্ভবত মুসলিম লীগ ও এর সমর্থনকারীদের বােঝাতে চেয়েছেন। বিষয়টি নিয়ে তিনি অবশ্য বেশিদূর এগুতে পারলেন না। তার আক্রমণে এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী যােগ দিলেন। তিনি বললেন, “এ মন্ত্রিসভা সমগ্র ভারতবাসীর কাছে “উপহাসের পাত্র” আর প্রদেশের বুকের উপরে এরা দুঃস্বপ্নের মত চেপে বসেছে।”৬৬ “কোন কিছুই আর এখন কাজে আসবে না”, তিনি ভবিষ্যদ্বানী করলেন, “যতক্ষণ না মূল উৎপাটন করা হয় এবং মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়।”৬৭ কেন মন্ত্রিসভা “উপহাসের পাত্র” তা অবশ্য সােহরাওয়াদী ব্যাখ্যা করেননি। বাংলার খাদ্যের অবস্থার সাথে
৯৮
অন্যান্য প্রদেশের খাদ্যের অবস্থার তুলনা করেও তিনি তাঁর বক্তব্য সুপ্রতিপন্ন করেননি। তাঁর বক্তব্যে মনে হল, গঠনমূলক সমালােচনার চেয়ে। রাজনৈতিকভাবে মন্ত্রিসভাকে হেয় করার জন্যই তিনি এরূপ বলেছেন।
যাহােক, ফজলুল হক নিজে তার মন্ত্রিদের সমর্থন দিতে এগিয়ে এলেন। মন্ত্রিদের প্রতি করা সব অভিযােগ খণ্ডন করতে ফজলুল হক বক্তৃতা দিলেন, “অবস্থা সামলাতে আমরা আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছি এবং কোন দিকে আমাদের যদি কোন ব্যর্থতা থেকেও থাকে, তা আমাদের চেষ্টার ত্রুটির কারণে। নয়।”৬৮ হক এই বলে শেষ করেন যে, “ঐ বিষয়গুলাে আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।”৬৯ শেষ কথাটি সম্ভবত গভর্নরকে খোঁচা দিয়ে বলা হয়েছিল কারণ প্রশাসনের বিষয়ে তিনি সাধারণত হস্তক্ষেপ করে থাকেন।
খাদ্য সমস্যা নিয়ে যখন মন্ত্রিসভা ব্যস্ত, তখন আরেকটি সমস্যা মুখােমুখি হতে হল সরকারকে। ১৯৪২ সালের ৮ আগস্ট অল ইন্ডিয়া কংগ্রেস কমিটি “ভারত ছাড়” আন্দোলন শুরু করার সিদ্ধান্ত নিল। আন্দোলনটি জেগে উঠতেই সমগ্র ভারত জুড়ে গােলমাল শুরু হয়ে গেল। মেদিনীপুর জেলার তামলুক ও কন্তাই সাব-ডিভিশনে এমন খারাপ পরিস্থিতি তৈরি হল যে, সরকার ঐ এলাকার পরিস্থিতি শান্ত করতে জরুরী অবস্থা ঘােষণা করল । আর ঐ কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করায় জনগণের কাছে সরকারের জনপ্রিয়তা কমে গেল।
এদিকে আইনসভার ভেতরে কংগ্রেসের ডাকা ঐ আন্দোলনটি ফজলুল হকের জন্য এক কঠিন পরিস্থিতির সূত্রপাত করল। কংগ্রেসের এমন আচরণে। উদ্বেগ প্রকাশ করে মুসলিম লীগ তাকে এ বিষয়ে বিবৃতি দিতে বলল । ১৯৪২ সালের আগস্ট আন্দোলনকে যারা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পুনঃপ্রাদুর্ভাব বলে আখ্যায়িত করেছিল, সেই ইউরােপীয় দলও মুসলিম লীগের সাথে সুর মিলাল। ১৯৪২ সালে তারা মন্ত্রিসভায় একটি প্রস্তাব পাস করল যাতে বলা হল সরকারের দ্বারা ঐ আন্দোলন থামানােতে সবাই সমর্থন দিবে এবং তারা মন্ত্রিসভার কাছে দমনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের প্রতিশ্রুতি চাইলেন। কিন্তু ফজলুল হক আন্দোলনের বিষয়টি না বিবেচনায় নিলেন, না থামাতে মনে-প্রাণে উদ্যোগী হলেন। কংগ্রেসের একটি গ্রুপের সমর্থনের জন্য তিনি এ বিষয়ে তেমন আগ্রহী হতে পারলেন না। আবার যুদ্ধে ব্রিটিশদের মনে-প্রাণে সহযােগিতা করার যে পলিসি তিনি ঘােষণা করেছিলেন, সেদিকেও তিনি ফিরে যেতে পারছেন না। কারণ, তিনি মনে করেন, যদি এখন তা করা হয় তাহলে তিনি মন্ত্রিত্ব বাহল রাখতে
৯৯
পারবেন না। অধিবেশনে তার বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছিল, নেহাৎ তিনি প্রশাসনকে রক্ষা করার জন্যই কথা বলছেন।৭০
যাহােক, আইনসভার সকলেই যখন তামলুক এবং কন্তাই-এর দমন-পীড়ন সম্পর্কে স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচারবিভাগীয় তদন্তের দাবি জানাল তখন ফজলুল হক তাতে দ্রুত রাজি হয়ে গেলেন। কিন্তু গভর্নর জন এ. হার্বাট ফজলুল হকের এ তদন্তের বিষয়টি পছন্দ করলেন না। তিনি লিখলেন ঃ “আপনি নিশ্চয়ই এ বিষয়ে আমার বিশেষ দায়িত্ববােধ সম্পর্কে সচেতন আছেন এবং আপনি এও বুঝতে পারছেন যে, এ তদন্তে আমার মতন নেই।”৭২
ফজলুল হক-এর কড়া জবাবে, ১৯৪৩ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি তাকে পরিষ্কার জানালেন, তার (হার্বার্টের) ইচ্ছে না থাকার কারণ সম্পর্কে ফজলুল হকের কিছুই জানা ছিল না।৭৩ ফজলুল হক গভর্নরকে লিখলেন ঃ
“আমি আমার সহকর্মীদের সাথে এ সম্পর্কে কথা বলে বুঝতে পেরেছি, যে তদন্তের দাবি উত্থাপন করা হয়েছে, তা কোনভাবেই থামানাে সম্ভব
নয় ।”৭৪
অবশেষে কোন তদন্তই হল না। আর তাতে করে কলকাতার জাতীয়তাবাদী। সংবাদপত্রগুলাে অভিযােগ করল, প্রধানমন্ত্রীর পদ নগণ্য হয়ে পড়েছে। বাংলার প্রশাসনিক কাজগুলাে স্বৈরাচারী কায়দায় গভর্নর ও স্থায়ী কর্মকর্তারা চালাচ্ছেন, কখনও মন্ত্রিদের মাথার উপর দিয়ে আবার কখনও তাদের পেছনে বসে।৭৫, দমন-পীড়নের ঐ ঘটনার জন্য ১৯৪২ সালের ২০ নভেম্বর শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী ইস্তফা দেন। এক বিবৃতিতে তিনি জানান, “…. আইনসভা ও জনগণের কাছে জবাবদিহি থাকার প্রতিজ্ঞা করে মন্ত্রী হিসেবে গুরুদায়িত্ব গ্রহণ করলেও তাদের ক্ষমতা দেয়া হয়েছে খুবই সামান্য, বিশেষ করে জনগণের দায় এবং তাদের অধিকারের ক্ষেত্রে। মন্ত্রিরা চান বা না-চান, গভর্নর কিছু স্থায়ী কর্মকর্তার উপর। নির্ভরশীল থেকে তাদের পরামর্শ মত অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে হাত দেন।৭৬
১৯৪৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে বাজেট অধিবেশনের দ্বিতীয় সেশনে যখন আইনসভার কার্যক্রম শুরু হল ঠিক তখনই শ্যামা প্রসাদ তার ইস্তফার কারণ ব্যাখ্যা করে বড় একটি বিবৃতি দিলেন ঃ
১০০
আইনসভার সকল সদস্যই জানেন, আমি ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়েছি ;
কারণ হল, আমি দেখেছি যে ইন্ডিয়ার লােকজন যাতে রাজনৈতিকভাবে
শক্তিশালী না হতে পারে এজন্য ব্রিটিশরা সর্বক্ষণ লােকজনের চাহিদাকে অবহেলা করার উপায় খুঁজে বের করছে। মন্ত্রী থাকাকালে
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করেছি, মানুষের অধিকারের জন্য মন্ত্রিদের দেয়া সব পরামর্শই নিজস্ব কিছু বিশেষ চরিত্রের লােক দ্বারা ঘঁষে-মেজে অন্য রকম করে উপস্থাপন করা হচ্ছে।৭৭
ফজলুল হকের অবস্থা আরও কঠিন হয়ে পড়ল যখন তাঁর কিছু মুসলিম অনুসারী ১৯৪২ সালের অক্টোবরে তাঁকে ছেড়ে গিয়ে জোটের মধ্যেই স্বতন্ত্র মুসলিম এসেম্বলী পার্টি বানিয়ে তাতে যােগ দিল। হিন্দুদের প্রতি অতি-নির্ভরশীলতার জন্যই তারা হককে ছেড়ে এভাবে নতুন দল গঠন করল। শ্যামা প্রসাদকে ছেড়ে আসার জন্য ইউরােপীয় দলও তাকে পরামর্শ দিয়েছিল, কিন্তু তিনি তা করেননি। উপরন্তু তিনি বললেন, “ব্যক্তিগতভাবে আমি ডাঃ শ্যামা প্রসাদ মুখাজীর সব অভিযােগ সুনিশ্চিতভাবে নাকচ করার জন্য প্রস্তুত ছিলাম না এবং বিবৃতিতে অনেক বিষয় ছিল যাতে আমি পুরােপুরি একমত।”৭৮
আরেকটি ঘটনা যা ফজলুল হককে আরও সমস্যায় ফেলেছিল তাহল, ময়মনসিংহ জেলার কিশােরগঞ্জের এক মসজিদে পুলিশের গুলি করার ঘটনা। ১৯৪২ সালের ১৯ অক্টোবর ক্ষিতিশ চন্দ্র বর্মন নামের এক ব্যক্তি মসজিদের সামনে দিয়ে বাজনা বাজিয়ে পূজার শােভাযাত্রা নিয়ে যাচ্ছিলেন, যদিও দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বােঝাপড়া ছিল যে যখন মসজিদের পাশ দিয়ে এমন শােভাযাত্রা যাবে তখন বাদ্য-বাজনা বন্ধ থাকবে। ঐ এলাকার মুসলিমরা তখন পুরানাে থানা মসজিদে জড় হল আর পুলিশ পাহারায় শােভাযাত্রা তাদেরকে অতিক্রমকালে সেখানে লাঠিপেটা করা হয় ; কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পুলিশকে লক্ষ্য করে তারা ইট-পাটকেল মেরেছিল।৭৯ পুলিশ তখন তা ঠেকাতে গুলি ছুঁড়লে মসজিদের ভেতর দু’জন মারা যায় এবং হাসপাতালে ভর্তির কয়েক ঘণ্টা পর আরও দু’জনের মৃত্যু ঘটে। মসজিদের দেয়াল ও মিনারে অনেকগুলাে গুলির ছাপও দেখা গিয়েছিল। ঐ ঘটনায় বাংলার সকল মুসলিমের মধ্যে উদ্বেগউৎকণ্ঠার সৃষ্টি হয়। মুসলিম লীগ এ ঘটনাকে পুঁজি করে বলতে লাগল, যতক্ষণ হকের মন্ত্রিসভা ‘হিন্দু মহাসভা দ্বারা পরিচালিত হবে ততক্ষণ মুসলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষা এভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। লীগ ঘটনাটি তদন্ত করে একটি
১০১
প্রতিবেদন পেশ করল যাতে জেলা কর্মকর্তাদের দায়ী করে তাদের বিচার চাওয়া হয়৮০, কিন্তু তাতে কোন কাজ হল না। সরকার শুধু নির্দেশ দিল যেন মসজিদের পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় কেউ বাদ্য-বাজনা না বাজিয়ে যায়। সরকারের এ সামান্য আদেশে বাংলার মুসলমানরা সন্তুষ্ট হল না ; কারণ, তারা এ বিষয়টি নিয়ে বেশ কদিন ধরে খুব আগ্রহী ছিল।
ফজলুল হক ঐ ঘটনার বিচারবিভাগীয় তদন্তের নির্দেশ দিলেন না ; কারণ, তখন গভর্নরের সাথে তার সম্পর্কটি ভাল যাচ্ছিল না আর তিনি বুঝতে পারছিলেন না যে তদন্তের নির্দেশে গভর্নর সম্মত হবেন কি-না। এছাড়া তিনি হয়ত ভেবেছিলেন, তাঁর প্রতি ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে জনগণের ভালবাসাকে হয়তবা কংগ্রেস ও হিন্দু সমর্থকরা ভুল বুঝতে পারে ।
উপরে বর্ণিত বিভিন্ন সমস্যাদি, যেগুলাের মুখােমুখি ফজলুল হক তাঁর মন্ত্রিত্বকাল ১৯৪১-৪৩ সাল পর্যন্ত ছিল, তাতে পরিষ্কার বুঝা যাচ্ছে, অবশ্যই তাকে অনেক সীমাবদ্ধতার মধ্যে কাজ করতে হয়েছে। যদিও তিনি সমস্যাগুলাের প্রতিকারে অনেক চেষ্টা করেছেন তবুও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধাচরণ, ইউরােপীয় দলের বৈরী আচরণ এবং গভর্নর ও স্থায়ী কর্মকর্তাদের অসহযােগিতা তাঁর কাজকে অনেক ক্ষেত্রে ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছিল । এর ফলে আস্তে আস্তে তার মন্ত্রিসভা জনগণের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠল। এছাড়া শ্যামা প্রসাদ মুখার্জীর ইস্তফা এবং স্বতন্ত্র কিছু মুসলিম সদস্য তাঁর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় তিনি এত অনিশ্চতায় ভুগছিলেন যে, তিনি ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে থাকতে চান না বলে নিজের ইচ্ছার কথা জনগণকে জানিয়ে দেন। ১৯৪৩ সালের ২৭ মার্চ তিনি বেশ পরিষ্কার করে বললেন ঃ
আমি মহামান্য গভর্নরকে বলেছি যেন সকল শ্রেণির প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলায় একটি জাতীয় সরকার প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয় ……. ইহা করতে গিয়ে কোনভাবে যদি পরিলক্ষিত হয় যে, এ কাজ আমার জন্য প্রতিবন্ধকতার মুখে পড়ছে, তাহলে বলা মাত্রই আমি আমার পদ থেকে সরে দাঁড়াব যাতে করে সুন্দরভাবে এ জাতীয় সরকার গঠন করা সম্ভব হয় ……… শুধুমাত্র গভর্নর আমাকে বললেই আমি আমার পদত্যাগপত্র সাথে সাথে তার হাতে দিয়ে দিব ………. মাঝে-মাঝে আমাদের কঠিন সময় পার করতে হয়, অনেক সমস্যার মধ্য দিয়ে
১০২
যেতে হয়, সেসব ক্ষেত্রে শুধুমাত্র দলগত প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে দেশকে নিয়ন্ত্রণ করা ঠিক নয়।৮২
এ বিবৃতির মাধ্যমে হক তাঁর ইস্তফা দেয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করেছেন। এ বিবৃতি দেয়ার সাথে সাথে গভর্নর তাকে ইস্তফা দিতে ডাকলেন। গভর্নর নিশ্চিত ছিলেন, মন্ত্রিদের হাতে প্রশাসনিক ক্ষমতা আর অতটা জোরালাে নেই। তবে তিনি খুবই আশাহত হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী যখন বললেন, নানা বিষয়ে নির্বাহী প্রধানের সাথে মন্ত্রিসভার দ্বিমত রয়েছে। মন্ত্রিসভার সাথে গভর্নরের যে তিক্ত সম্পর্ক রয়েছে তা গভর্নর যেমন খুব ভাল জানতেন আবার এর জন্য যে মুসলিম লীগের সমর্থনের পাল্লা তার দিকে ভারী হচ্ছে তাও তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। এরই মধ্যে মুসলিম লীগ অবশ্য তার দলের জনপ্রিয়তার প্রমাণ দিতে পেরেছে, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের কাছে দলটি অধিকতর জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। উদাহরণস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, ১৯৪৩ সালের একটি উপনির্বাচনের ঘটনা সেখানে লীগের একজন প্রার্থী ফজলুল হকের এক প্রার্থীকে ১০৮৪৩ – ৮৪০ ভােটে পরাজিত করেছিল।৮৩ এসব কারণে সহজেই বুঝা যায়, কেন তখন গভর্নর ত্বরিৎ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন। পরের দিন ২৮ মার্চ রােববার গভর্নর তার কাছে হক’কে ডেকে পাঠালেন। গভর্নর প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে তার সাথে আলাপ করলেন আর ন্যাশনাল কেবিনেট গঠনের জন্য নানা ধরনের প্রস্তাব তার সামনে রাখলেন। অবশ্য ঐসব প্রস্তাবের বিষয়াদি কোথাও সংরক্ষণ করা হয়নি। একটি এমন ছিল, যা হক তাঁর সহকর্মীকে পরে জানিয়েছিলেন, “আত্মসম্মানের সাথে মানায় না বলে আমি গ্রহণ করতে পারলাম না।”
গভর্নর জন হার্বার্ট প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হককে উপদেশ দিলেন তিনি যেন দাফতরিক প্রক্রিয়ায় তাঁর ইস্তফা পত্র পেশ করেন। হক জানালেন, তিনি তার দল এবং মন্ত্রিসভার সহকর্মীদের সাথে এ সম্পর্কে আলাপ করে তবেই সিদ্ধান্ত নিবেন, যদিও তিনি ইস্তফা দিতে আগ্রহী বলে জানালেন। সহকর্মীদের ইহা জানানাে তাঁর একটি নৈতিক দায়িত্ব এবং তিনি তা অবহেলা করতে পারেন না। গভর্নর তাতে রাজি ছিলেন না বলে হক জানালেন, “আমাকে ইস্তফার জন্য দরখাস্তে স্বাক্ষর করতে হয়েছিল ……… যা আগেই টাইপ করে প্রস্তুত রাখা হয়েছিল।”৮৪ ঐ রাতেই ১০টার সময় ফজলুল হক গভর্নরের কাছ থেকে তাঁর ইস্তফাপত্র গৃহীত হয়েছে মর্মে একটি চিঠি পেলেন। এভাবে বাংলায় হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার পর্বটির সমাপ্তি ঘটল।
১০৩

তথ্যসূত্র ঃ
১. ১৯৪০ সালের ১৫ জুন বােম্বেতে (বর্তমান মুম্বাই) অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের এক সভায় সিদ্ধান্ত হয়, মুসলমানরা যেন ওয়ার কমিটিতে যােগদান করে, আর তা দেখে সিকান্দার হায়াত খান ১৯৪০ সালের ১৮ জুন একটি বিবৃতি দেন | যে তা পাঞ্জাব এবং বাংলায় কার্যকর করা হয়নি। তা দেখে জিন্নাহ ১৯ জুন সিকান্দার ১১. হায়াত খানকে তার মন্তব্যের জন্য জবাব পাঠালেন যে, ঐ কাজটি হল আপনার “ছেলেমানুষী,” দেখুন ঃ আবুল মনসুর আহমেদ “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” (ঢাকা, ১৯৭৫), সংস্করণ ৩, পৃষ্ঠা ২২০।
২. লিয়াকত আলী খানকে লেখা ফজলুল হকের চিঠি, লিয়াকত আলী অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি, তারিখ ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪১। মাধ্যম ; “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ১১ সেপ্টেম্বর ১৯৪১।
৩. ঐ
৪. ১৯৪১ সালের ২৫ আগস্ট বােম্বেতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের গৃহীত প্রস্তাব। দেখুন ঃ এম. এ. জাইদী (সংস্করণ), “ইভল্যুশন অব 2 মুসলিম পলিটিক্যাল থট ইন ইন্ডিয়া” (দিল্লী, ১৯৭৮), ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ৩১২।
৫. অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খানকে লেখা ফজলুল হকের চিঠি, ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪১। মাধ্যম : “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ১১ সেপ্টেম্বর মাস ১৯৪১। সম্পূর্ণ চিঠির জন্য দেখুন গ্রন্থের পরিশিষ্ট দুই’ ।
৬. ঐ
৭, ঐ।
৯. ঐ
১০. ঐ
১১. ঐ
১২. ঐ
১৩. ঐ
১৪. দাফতরিক প্রতিবেদনে রয়েছে, মুসলিম লীগের বিপক্ষে কাজ করার জন্য ফজলুল হক বিরােধীদলের সাথে আলােচনা করেছিলেন। দেখুন ঃ গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ১৭-৪-৪১ পেপাল (১); সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স কর্মকর্তার প্রতিবেদন, ১৯৪১ সালের আগস্টের শেষার্ধ।
১৫. ঐ।
১৬. “অমৃতবাজার পত্রিকা” (কলকাতা), ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৪১।)
১৭. ফজলুল হকের এক রাজনৈতিক সহকর্মী আবুল মনসুর আহমদের লেখা বইয়ে তিনি বলেছেন, ফজলুল হকের সমর্থকদের একপক্ষ যখন হক – লীগ সমস্যা সমাধানের
১০৪
বিষয়ে অসন্তুষ্ট হলেন তখন হক বলেছিলেন, “অপেক্ষা করুন আর দেখুন।” দেখুন ঃ এ. এম. আহমেদ, এন-১, পৃষ্ঠা ২২৪।
১৮. গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ১৭-৪-৪১ পােল (১) সম্পূর্ণ চিঠির জন্য দেখুন পরিশিষ্ট ৩।
১৯. ব্রিটিশ সরকারকে জিন্নাহর চ্যালেঞ্জ এবং যুদ্ধ কাজে সমর্থন দেয়ার জন্য তার দ্বারা তিনজন প্রধানের বরখাস্তের ঘটনায় সারা ভারত জুড়ে মুসলিম লীগ প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছিল। এতে লীগের নেতারা জিন্নাহকে নমনীয় হতে চাপ দিলে তিনি ১৯৪১ সালের নভেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে হকের সাথে আপােস করেন। দেখুন ঃ শীলা সেন, “মুসলিম পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ১৯৩৭-৪৭” (দিল্লী, ১৯৭৬), পষ্ঠা ১২৯-৩০।
২০. “স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা) ৫ ডিসেম্বর ১৯৪১।
২১. দেখুন ৪ জিন্নাহকে লেখা খাজা নাজিমুদ্দিনের চিঠি, তারিখ ১৪ ডিসেম্বর ১৯৪১। মাধ্যম ও গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ২৩২/৪১।
২২. এ. এম. আহমেদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২২৫। সভায় উপস্থিত ছিলেন ফজলুল হক, শরৎ বােস, ড. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, শামসুদ্দিন আহমেদ, হেমচন্দ্র লস্কর এবং খান বাহাদুর হাশেম আলী খান।
২৩. ৪৭ জন মন্ত্রিমণ্ডলীর পৃষ্ঠপােষক ছাড়াও প্রগেসিভ কোয়ালিশন পার্টিতে ছিল ১৯ জন কৃষক-প্রজা পার্টির, ২৭ জন ফরােয়ার্ড ব্লকের, ১২ জন স্বতন্ত্র সিডিউল কষ্টের এবং ১১ জন হিন্দু মহাসভার সদস্য।
২৪. স্টার অব ইন্ডিয়া (কলকাতা), ৫ ডিসেম্বর ১৯৪১।
২৫. ১৯৪১ থেকে ১৯৪২ সাল পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের রেজুলেশন । (দিল্লী, এনডি), পৃষ্ঠা ৩৯।
২৬. “দৈনিক আজাদ” (কলকাতা), ৩ জানুয়ারি ১৯৪২।
২৭. গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ৯৬/৪২।
২৮. মােহাম্মদ ওয়ালী উল্লাহ “যুগ বিচিত্রা” (ঢাকা, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৩৮৮-৪০৫।
২৯, পত্রিকা দুটির জানুয়ারির ইস্যু পড়লে ঐ সময়ে হক ও তার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে তাদের অপপ্রচারের নমুনা পাওয়া যাবে।
৩০. “দৈনিক আজাদ” (কলকাতা), ২৮ আগস্ট ১৯৪২। আরও দেখুন ঃ “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪২।
৩১. “স্টার অব ইন্ডিয়া”, ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৪২।
৩২. “মনিং নিউজ” (কলকাতা), ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯৪২।
৩৩. ঐ।
৩৪. “হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড” (কলকাতা), ২১ জুন ১৯৪২। চিঠির ভাষা দেখতে পরিশিষ্ট ৪।
৩৫. ঐ।
১০৫
৩৬. ঐ।
৩৭. ঐ।
৩৮. ঐ।
৩৯. ঐ।
৪০. সভায় যারা উপস্থিত হয়ে বক্তৃতা দিয়েছিলেন তারা হলেন ঃ এ. কে. ফজলুল হক, ‘ঢাকার নবাব হাবীবুল্লাহ বাহাদুর, মুর্শিদাবাদের নওয়াব, টি. সি. গােস্বামী, এস, কে, বসু, এন, সি, চ্যাটার্জী, শামসুদ্দিন আহমেদ, খান বাহাদুর হাশেম আলী খান, ডাঃ নলীনাক্ষ্য সান্ন্যাল, সৈয়দ বদরুদ্দোজা, হুমায়ুন কবীর, হেমেন্দ্র প্রসাদ ঘােষ, এ. কে. এম. জাকারিয়া, মওলানা আহমেদ আলী, ডাঃ বি. সি. রায়, কিরণ শংকর রায়, এস, এন. মজুমদার, স্যার এ. এইচ. গজনভী, রাজেন দেব এবং সৈয়দ নওশের আলী। দেখুন ও হিন্দু মুসলিম ইউনিটি সভার প্রসেডিংস – কলকাতা ২০ জুন, ১৯৪২। সূত্র ঃ “হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড” (কলকাতা), ২১ জুন ১৯৪২।
৪১. ঐ
৪২. ঐ।
৪৩. ঐ । ইহা অবশ্য নতুন উদ্যোগ নয়। ১৯৩৭ সালের গােড়ার দিকে মুর্শিদাবাদের নওয়াব ও হিন্দু মুসলিম ঐক্যতার জন্য “হিন্দু – মুসলিম ইউনিটি এসােসিয়েশন” গঠন করেছিলেন। কিন্তু ১৯৩৭-৪১ সাল পর্যন্ত মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক অপপ্রচারের ফলে তিনি তা ঠিকমত গড়ে তুলতে পারেননি।
৪৪. বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ১৩তম অধিবেশন ১৯৪২, ভলিউম ৬২, নং ১, পৃষ্ঠা ১৭৩-২৩৫। আরও দেখুন ঃ “অমৃতবাজার পত্রিকা” (কলকাতা), ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩।
৪৫. “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩।
৪৬. ঐ । ২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩।
৪৭. গভর্নমেন্ট অব বেঙ্গল, ওয়ার ফাইল রিভিউ ১৪২/১৯৪২। বাংলাদেশের সচিবালয়ের রেকর্ডরুমে সংরক্ষিত।
৪৮. এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী, ৩ মার্চ ১৯৪৩। বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ভলিউম ৬৪, নং ২, পৃষ্ঠা ১৭৩।
৪৯. ঐ।
৫০. ঐ।
৫১. ঐ। পৃষ্ঠা ১৭৪।
৫২. খান বাহাদুর জালালুদ্দিন আহমেদ, মার্চ ৩ ১৯৪৩, ঐ। পৃষ্ঠা ১৮০।
৫৩. অতুল চন্দ্র সেন, ৩ মার্চ ১৯৪৩, ঐ। পৃষ্ঠা ১৮৩।
৫৪. এ. কে. ফজলুল হক, ৩ মার্চ ১৯৪৩, ঐ। পৃষ্ঠা ১৯১।
১০৬
৫৫. ঐ।
৫৬. ঐ।
৫৭. সৈয়দ আবদুল মজিদ, ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, ঐ। পৃষ্ঠা ১১।
৫৮. জন এ. হার্বার্টকে এ. কে. ফজলুল হক, ৯ জানুয়ারি ১৯৪৩, মাধ্যম ঃ এ. এস. এম. আবদুর রব, “এ. কে. ফজলুল হক” (লাহাের, এনডি) পৃষ্ঠা ১৩১।
৫৯. নওয়াব খাজা হাবীবুল্লাহ বাহাদুর, ১০ মার্চ ১৯৪৩, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ভলিউম ১৪, নং ৩, পৃষ্ঠা ১৬।
৬০. ডাঃ নালীনাক্য সান্ন্যাল, মার্চ ১৯৪৩, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ভলিউম ১৪, নং ২, পৃষ্ঠা ১১৭।
৬১. ১৯৪২ সালে যখন বার্মাকে জাপান আক্রমণ করে তখন প্রায় ১৫ লক্ষ ভারতীয় বার্মায় বসবাস করত। ভারতে আসার পথে অনেকেই তখন মৃত্যুবরণ করেছিল । দেখুন ৪ এম. ওয়ালী উল্লাহ ঃ “যুগ বিচিত্রা” (ঢাকা, ১৯৬৭), পৃষ্ঠা ৪৩৯।
৬২. ডিনায়াল পলিসির মাধ্যমে উপকূল ও সীমান্ত এলাকার জিনিসপত্র সরানাে হয়েছিল কারণ তা জাপানীদের অবতরণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারত।
৬৩. জন এ. হার্বার্টকে ফজলুল হক, ২ আগস্ট ১৯৪২। সূত্র ও বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস। ৩ জুলাই ১৯৪৩, ভলিউম ৬৫, পৃষ্ঠা ৪৬-৫৪, চিঠির কথা দেখতে পরিশিষ্ট ৫ দেখুন ।
৬৪. আবদুর রহমান সিদ্দিকি, ১০ মার্চ ১৯৪৩, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ভলিউম ৬৪, নং ৩, পৃষ্ঠা ৩৩।
৬৫. ঐ।
৬৬. এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী, ১০ মার্চ ১৯৪৩, ঐ। পৃষ্ঠা ৪৫।
৬৭. ঐ । পৃষ্ঠা ৪৭।
৬৮. এ. কে. ফজলুল হক, ১০ মার্চ ১৯৪৩, একই স্থানে। পৃষ্ঠা ৫১।
৬৯. ঐ।
৭০. অধিবেশনে ফজলুল হকের বক্তৃতা, ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩, ঐ । ভলিউম ৬৩, নং ১,
পৃষ্ঠা ৪৪।
৭১. এ. কে. ফজলুল হক, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, ঐ । ভলিউম ৬৪, নং ১, পৃষ্ঠা ৯৮।
৭২. ফজলুল হককে জন এ. হার্বার্ট, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, মাধ্যমে ঃ এ. কে. ফজলুল হক,
“বেঙ্গল টুডে” (কলকাতা), ১৯৪৪, পৃষ্ঠা ২৭-২৮।
৭৩. জন এ. হার্বার্ট’-কে এ. কে. ফজলুল হক, তারিখ ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩। দেখুন ঃ ঐ। পৃষ্ঠা ২৮-৩১, চিঠিতে গর্ভনরের সাথে ফজলুল হকের যে ঝামেলা হয়েছিল তার বর্ণনা
রয়েছে। চিঠির কথাগুলাে জানতে দেখুন পরিশিষ্ট ৬।
৭৪. ঐ। পৃষ্ঠা ৩০।
১০৭
৭৫. “অমৃতবাজার পত্রিকা” ২০ অক্টোবর ১৯৪২, মন্ত্রিসভার সাথে গভর্নর ও কর্মকর্তাদের সম্পর্কের বিষয়ে বিস্তারিত জানতে দেখুন শীলা সেন, নং ১৯ পৃষ্ঠা ১৪৭-১৫৮।
৭৬. “এডভান্স” (কলকাতা), ২৩ নভেম্বর ১৯৪২।
৭৭. শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী, ১২ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ভলিউম ৬৪, নং ১, পৃষ্ঠা ২৫-২৭।
৭৮. এ. কে. ফজলুল হক, “বেঙ্গল টুডে” নং ৭২, পৃষ্ঠা ২৫।
৭৯. “অমৃতবাজার পত্রিকা” (কলকাতা), ২০ অক্টোবর ১৯৪২। আরও “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ২০ অক্টোবর ১৯৪২।
৮০. আবুল মনসুর আহমদ, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ২৩৫।
৮১. এ. কে. ফজলুল হক, ২৭ মার্চ ১৯৪৩, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, ভলিউম ৬৪, নং ৩, পৃষ্ঠা ৭৪৭।
৮২. ঐ
৮৩. আর, কৌপল্যান্ড, “দি ইন্ডিয়ান প্রব্লেম”, দ্বিতীয় খণ্ড (লন্ডন, ১৯৪৪) পৃষ্ঠা ৩০।
৮৪. এ. কে. ফজলুল হক, ২৯ মার্চ ১৯৪৩, বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস, CC ভলিউম ৬৪, নং ৩, পৃষ্ঠা ৭৫৩।
১০৮

সপ্তম অধ্যায়
খাজা নাজিমুদ্দীনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগের ক্ষমতা গ্রহণ :
ফজলুল হকের রাজনীতির অর্ধমুখী
[১৯৪৩ – ৪৫ ]

– এক –
১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ বাংলার গভর্নরের অসহযােগিতা আর চক্রান্তে হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার পতন ঘটলে গভর্নর জন হার্বার্ট খাজা নাজিমুদ্দিনকে শুধুমাত্র মুসলিম লীগের সদস্যদের দ্বারা মন্ত্রিপরিষদ গঠনের দায়িত্ব দিলেন। ইহা ঐ ইস্তফাপত্রে লেখা কথার বরখেলাপ, যাতে হককে স্বাক্ষর দিতে বাধ্য করা। হয়েছিল।১ প্রগ্রেসিভ এসেম্বলী পার্টির নেতা ফজলুল হক এবং কৃষক-প্রজা এসেম্বলী পার্টির নেতা শামসুদ্দিন আহমেদ সাথে সাথে গভর্নরের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করেন ও ২১ এপ্রিল তারা একত্রে দিল্লীতে ভাইসরয়ের কাছে টেলিগ্রাম পাঠান।
কোন একটি বিশেষ দলকে যদি তাদের রাজনৈতিক মতাদর্শের জন্য। মন্ত্রিসভা গঠন করতে দেয়া হয় তাহলে তাতে বাংলাকে সমস্যার মধ্যে ঠেলে দেয়া হবে আর যুদ্ধের জন্য নেয়া সকল প্রচেষ্টার ব্যাঘাত ঘটান হবে।২
তাঁরা দুজনেই সকল দলের অংশগ্রহণমূলক মন্ত্রিসভা গঠনে সহযােগিতার আশ্বাস দিয়ে পুনরায় তাঁকে অনুরােধ করেন, “সকল দলের অংশগ্রহণমূলক মন্ত্রিসভা গঠনের সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন না হওয়া পর্যন্ত ৯৩ ধারায় আনীত ঘােষণাটি প্রত্যাহারে যেন অনুমতি না দেয়া হয়।”৩ দুই নেতা তাদের দলের
১০৯
পক্ষ থেকে বাংলার গভর্নরকেও মাত্র একটি দলকে দিয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের ব্যবস্থা নেয়ায় প্রতিবাদ জানালেন।৪ আইন পরিষদ ভবনে ১৯৪৩ সালের ২১ এপ্রিল বর্ধমানের মহারাজাধিরাজ বাহাদুরের সভাপতিত্বে কংগ্রেসের অসংসদীয় পার্লামেন্টারি দল ও ন্যাশনালিস্ট পার্টির মধ্যে একটি যৌথ সভা অনুষ্ঠিত হয় ; যেখানে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়, আইন পরিষদের হিন্দু, মুসলিম ও অন্যান্য দলের সদস্যদের সমন্বয়ে বাংলায় সর্বদলীয় মন্ত্রিসভা গঠনের লক্ষ্যে তারা কাজ করবে।৫ কিন্তু এ জাতীয় সব কার্যক্রম অবশেষে ভেস্তে গেল।
খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল বাংলায় মুসলিম লীগের নতুন করে মন্ত্রিসভা গঠিত হল।৬ যদিও কিছুসংখ্যক দলত্যাগী হিন্দু ঐ মন্ত্রিসভায় যােগ দিয়েছিল তবুও সকল মুসলিম মন্ত্ৰী লীগের পক্ষ থেকে তাতে যােগ দেয়ায় ইহা মূলত লীগ সর্বস্ব একটি মন্ত্রিসভা হয়ে উঠল। মুসলিম লীগ অবশ্য ঐ মন্ত্রিসভাকে একটি প্রতিনিধিত্বমূলক মন্ত্রিসভা হিসেবে আখ্যায়িত করল । মুসলিম লীগের এমন দাবির বিরােধিতা করে ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতার টাউন হলে ফজলুল হক বললেন, নতুন মন্ত্রিসভায় শুধুমাত্র মুসলিম লীগ আর হিন্দু তফসিলি সম্প্রদায়ের সদস্য রয়েছেন যারা কোনভাবেই বাংলার সকল মুসলমান ও হিন্দুদের প্রতিনিধিত্ব করেন না।৭ খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভা পূর্ণাঙ্গভাবে গঠন করা হলে ঐ মন্ত্রিসভা বিরােধীদলের নেতা হিসেবে ফজলুল হককে মনােনীত করা হল। যদিও ফজলুল হক তখন বেশ বৃদ্ধ এবং তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা অতটা ভাল ছিল না, এরপরও বিরােধীদলের সকল সদস্য তাঁকে বিনা দ্বিধায় আইন পরিষদের বিরােধীদলের নেতা হিসেবে মেনে নিলেন। এরপর তিনি আইন পরিষদে এবং আইন পরিষদের বাইরে, উভয় ক্ষেত্রেই মুসলিম লীগের বিরােধী পক্ষের ভূমিকা পালন করতে লাগলেন।
১৯৪৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি মুসলিম লীগের বিরােধী পক্ষ হিসেবে আইন। পরিষদে দাঁড়িয়ে ফজলুল হক বললেনঃ
সাংবিধানিক অর্থে বাংলায় আপাতত কোন সরকার নেই…… আইন। পরিষদের প্রতি মন্ত্রিদের কোন দায়বদ্ধতা নেই, যা রয়েছে তাহল জিন্নাহর
১১০
উপর যিনি মুসলিম লীগের প্রধান। যতক্ষণ জিন্নাহর সম্মতি থাকবে । ততক্ষণ মন্ত্রিরা তাদের নিজস্ব কোন মতামতের প্রতিফলন ঘটাবেন না। কারণ, জিন্নাহর বিশেষ মতামত রক্ষা করাই তাদের লক্ষ্য। বিষয়টি অবাক করার মত শােনালেও বস্তুত ইহাই সত্য।”৮
আবার, যখন বাজেটের ঘাটতি বিষয়ে হক বক্তৃতা দিচ্ছিলেন তখনও তিনি সম্পূর্ণভাবে মন্ত্রিসভাকেই দায়ী করলেন ঃ
সকল কার্যকর ক্ষেত্রেই, বাংলায় এ মন্ত্রিসভা হওয়ার পর থেকে, সুষ্ঠু সরকারি ব্যবস্থাপনা ছাড়া শুধুমাত্র অরাজকতা চলছে। মন্ত্রিগণ এ অরাজকতার সুযােগ নিয়ে ন্যূনতম স্বাধীনতাবােধ না রেখেই জনগণের অর্থ তছনছ করে চলছে। আর চারদিকে অভাব সৃষ্টি করছে।৯
যাহােক, বাজেটের ঘাটতি পােষানাের জন্য মন্ত্রিসভা জনগণের উপর নতুন করে কর আরােপ করল। হক ইহার তীব্র প্রতিবাদ করলেন আর বললেন, ক্ষুধায় মরতে বসা জনগণের জন্য এই কর-আরােপ আরও বড় বােঝাস্বরূপ।১০ এছাড়া সংবাদপত্রের স্বাধীনতা সেন্সর করার মাধ্যমে খর্ব করা হলে হক মন্ত্রিসভাকে আক্রমণাত্মক সুরে বলেন, “বাংলার মিডিয়া ও সংবাদপত্রের কণ্ঠরােধ করার মাধ্যমে মন্ত্রিরা সম্পূর্ণভাবে নিজেদের স্বৈরাচার হিসেবে সংকেত দিচ্ছেন।… এমনকি আইন পরিষদের বক্তৃতাও সেন্সর করে কাট-ছাঁট করা হচ্ছে আর সেন্সর বাের্ডের মনপুত অংশটিই শুধু প্রকাশ করার অনুমতি পাচ্ছে।”১১
খাজা নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার শাসনকালে আইন ও নির্বাহী বিভাগের তেমন কোন কর্মতৎপরতা ছিল না, শুধুমাত্র ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে যখন হাজার হাজার লােক মারা গেল তখন তাদের একটু কাজ করতে দেখা গেল। সরকারি হিসাব অনুযায়ী ঐ দুর্ভিক্ষে ১৫ লক্ষ লােক মারা গিয়েছিল১২ আর বেসরকারি হিসাব অনুযায়ী মৃতের সংখ্যা ছিল ৩৫ লক্ষ । এছাড়া বাংলার ৬ কোটি লােকের মধ্যে ২ কোটি লােক এর দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল।১৩ দুর্ভিক্ষ কবলিত এলাকার ১০% জনগণ অর্থাৎ প্রায় ১২ থেকে ১৫ লক্ষ নারী, শিশু ও লােকজন নিঃস্ব হয়ে ভিক্ষাবৃত্তি বেছে নিয়েছিল। ২৭ লক্ষ মিল-শ্রমিক ও ২৫ হাজার দরিদ্র স্কুল
১১১
শিক্ষক মিলিয়ে আরও মােট ৬০ লক্ষ লােকের একই পরিণতি বরণ করতে হয়েছিল।১৫
অবশ্য বাংলার ঐ ভয়ঙ্কর দুর্ভিক্ষের পেছনে নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার কোন হাত ছিল না। আগের অধ্যায়ে যেমনটি বলা হয়েছে, হকের মন্ত্রিত্বকালেই বাংলায় ২৪ লক্ষ টন চালের ঘাটতি ছিল। আর ঐ ঘাটতির সাথে আরও যােগ হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ-প্রস্তুতিতে চাল সরবরাহ ও উপকূলীয় এলাকার নৌচলাচলের উপরে নিষেধাজ্ঞা। এছাড়া যুদ্ধের জন্য বিশেষ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণেও এরূপ সমস্যা তৈরি হয়েছিল ।
যাহােক, ন্যায়সঙ্গত দৃষ্টি দিয়ে দেখলে পরিষ্কার বােঝা যায়, ফজলুল হক ঐ খাদ্য সঙ্কটকালে যথেষ্ট কার্যকরী পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন । কিন্তু গভর্নরের হস্তক্ষেপের কারণে তা আর যথাযথভাবে তিনি করে উঠতে পারেননি।
১৯৪২ সালের ২ আগস্ট গভর্নরকে লেখা এক চিঠিতে ফজলুল হক গভর্নরের কিছু ভুল সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ জানিয়ে তাকে লিখেছিলেন, “এরূপ সিদ্ধান্তের ফলে প্রদেশের খাদ্য সঙ্কট আরও বাড়বে।১৬ আর এর পরপরই গভর্নর আর আইন পরিষদের ইউরােপীয় দলের কৃপায় নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিত্বকাল যখন শুরু হল তখনই দুর্ভিক্ষ চলে এল। কাজেই নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার কাঁধে তার সব দায়-দায়িত্ব এসে পড়ল এবং এর জন্য তাদের কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হল। চাল আমদানিসহ তা সরবরাহে সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনার দিকে তাদের নজর দিতে হল। সরকার তখন আসলেই চালের যােগান ও সরবরাহের ব্যবস্থাপনা হাতে নিয়েছিল, কিন্তু তার কার্যভার শুধু লীগের সমর্থক এবং নিজস্ব লােকজনকে দেয়া হয় যাদের ব্যবসা-বাণিজ্য করার কোন অভিজ্ঞতাই ছিল না ।১৭ দুর্ভিক্ষের জন্য গঠিত অনুসন্ধানকারী কমিশন বরাবরে প্রেরিত স্মারকে হক জানালেন, “নাজিমুদ্দিনের সরকারি লােকদের নিয়ন্ত্রণবিহীন একক ক্রয় ব্যবস্থাপনার জন্যই মূলত এ দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে।”১৮ অধিবেশনে বিরােধী পক্ষ ইস্পাহানি কোম্পানিকে পৃষ্ঠপােষকতা করার জন্য মন্ত্রিসভাকে দোষারােপ করলেন। সিভিল সাপ্লাই মন্ত্রী এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী তখন মন্ত্রিদের খাদ্য সরবরাহ প্রক্রিয়ার সাফাই গাইতে গিয়ে জানালেন, প্রদেশে মুসলমানদের সংখ্যা
১১২
বেশি থাকলেও সেখানে কোন মুসলমান এ সরবরাহ ও বাণিজ্যের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন না।১৯ অবশ্য মুসলিমদের প্রতি লীগের মন্ত্রিদের এমন পক্ষপাতিত্বকে হিন্দুরা ভালভাবে নিল না। তারা বুঝে নিল, ত্রাণ বিতরণের ক্ষেত্রেও মুসলিম লীগ শুধুমাত্র মুসলিমদের সহায়তা করেছে আর তাদেরকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে মন্ত্রিসভা যাবতীয় উদ্যোগ নিয়েছে।২০ এর মধ্যে আইনসভার হিন্দু সদস্যগণ যারা ১৯৪৩ সালে নাজিমুদ্দিনকে সমর্থন দিয়েছিলেন, তারাও “শুধুমাত্র মুসলিমদের পক্ষে কাজ করার জন্য মন্ত্রিসভার উপর অসন্তুষ্ট হয়ে আস্তে আস্তে তাদের সমর্থন তুলে নিল। ১৯৪৫ সালের ২৮ মার্চ সরকারি দলের এমন ২১ সদস্য দলত্যাগ করে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন বিরােধীদলে যােগ দিল। এ পরিস্থিতির সুযােগ নিয়ে কংগ্রেসের ডেপুটি লিডার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত তখন কৃষিমন্ত্রী সৈয়দ মােয়াজ্জেম উদ্দিনের বাজেট বরাদ্দের ২,০৪,০০,০০০ কোটি রুপির বিষয়ে বিরােধিতা করলেন। চীফ হুইপ (কংগ্রেস) নলীনাক্ষ সান্ন্যাল তখন এর উপর ভােটাভুটি করার প্রস্তাব দিলেন। ক্ষমতাসীন দল এর জোর বিরােধিতা করে এ বিষয়ে যুক্তিতর্ক উপস্থাপনের দাবি জানালেন। অবশেষে এ বিষয়ে ভােটাভুটি হলে তা ১০৬-৯৭ ভােটে নাকচ হয়ে যায়। তখন স্পিকার সৈয়দ নওশের আলী অধিবেশন মুলতবী করে ঘােষণা দিলেন, “যেহেতু মন্ত্রিসভার পরাজয় হয়েছে তাই নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত না হওয়া পর্যন্ত সংসদ অধিবেশন বসবে না।” এভাবে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন বিরােধীদলের কৌশলে নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভারও পতন হল।
১৯৪৫ সালে নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার পতনের পর বিরােধী দলীয় নেতা ফজলুল হক তাঁর নেতৃত্বে একটি মন্ত্রিসভা গঠনের চেষ্টা চালালেন। কিন্তু তখনকার নতুন গভর্নর আর. জি. ক্যাসি ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের ক্ষমতা দিলেন না ; কারণ, তখন বাংলায় রাজনৈতিক অবস্থা নানা কারণে জটিল আকার ধারণ করে। বাংলায় তখন ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত গভর্নরের শাসন বলবত ছিল। আর এরপর ১৯৪৬ সালে প্রাদেশিক নির্বাচন হলে এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দী নেতৃত্বে মুসলিম লীগ জয়ী হয় এবং নতুন করে মুসলিম লীগের মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
১১৩
– দুই –
১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষ মােকাবেলায় ব্যর্থ নাজিমুদ্দিনের সরকার যদিও জনগণের কাছে অপ্রিয় হয়ে উঠেছিল তবুও তাদের শাসনকাল দুটি কারণে উল্লেখযােগ্য হয়ে আছে ঃ
প্রথমত, এ সময়ে মুসলিম লীগ নিজেদের একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে দ্রুত গড়ে তুলতে পেরেছিল।
দ্বিতীয়ত, বাংলায় তারা পাকিস্তান দাবি আন্দোলনের প্রতি একটি আলােড়ন তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল, যার ফলে বাংলার প্রধান রাজনৈতিক ধারা থেকে মুসলিম লীগের বাইরে অবস্থানরত মুসলিম নেতারা অনেকটা একাকী ও আলাদা হয়ে পড়েছিল।
তাই এখানে দেখা দরকার, কোন্ অদৃশ্য শক্তির বলে মুসলিম লীগের এতটা অগ্রযাত্রা হয়েছে আর অতি স্বল্প সময়ে কিভাবে পাকিস্তান দাবি আন্দোলনের পক্ষে জনমত তৈরি করতে পেরেছে।
১৯৪৩ সালের পূর্ব পর্যন্ত মুসলিম লীগ বাংলার বিভিন্ন স্থানে ছােট দল হিসেবে তাদের সীমিত কার্যক্রম নিয়েই থাকত বা শুধুমাত্র তাদের প্রতিষ্ঠাতা যেমন নওয়াব এবং জমিদারদের অধীনে থেকে কাজ করত, সে প্রতিষ্ঠাতারা কখনও মনে করতেন না যে ব্রিটিশরা বাংলা ছেড়ে চলে যাবে।২১ তারা দলকে কখনও বড় সংগঠন হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে চাননি বা তেমনটা করার মত সক্ষমতাও তাদের ছিল না। বাংলায় মুসলিম লীগের অবস্থা এত নিম্নমানের ছিল যে, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাপ্রবণ এলাকা নােয়াখালী ও পাবনা জেলা ছাড়া সারাদেশের কোথাও তাদের কোন কর্মী-সমর্থক ছিল না। ১৯৪৩ সালে পার্টির কার্যক্রমে একটু চাঙ্গাভাব দেখা গেল যখন এম. এ. জিন্নাহ নির্দেশ দিলেন, দলের কার্যনির্বাহী কোন সদস্য সংসদীয় বা গভর্নমেন্টর কোন পদে আসীন হতে পারবে না ।২২ সেই নির্দেশ অনুযায়ী নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভার মন্ত্রী এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগের সেক্রেটারির পদ থেকে ইস্তফা দিয়েছিলেন।
মুসলিম লীগের প্রগতিশীল দৃষ্টিভঙ্গির নেতা আবুল হাসিম, এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দীর পর মুসলিম লীগের সেক্রেটারির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। আবুল হাসিম আসার পর প্রাদেশিক লীগের ক্রমেই উন্নতি হতে লাগল। তিনি বাংলার
১১৪
বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বিভিন্ন জেলার লীগ-কর্মীদের সাথে যােগাযােগ গড়ে তুললেন। জেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায়ে লীগের সাংগঠনিক কার্যক্রম চালু হল। লীগের মৌখিক কিছু বিষয়ের পরিবর্তন এনে বর্ধমানের আবুল হাসিম দলটিকে গণতান্ত্রিক ধারায় আনার পদক্ষেপ নিলেন। এর আগে কাউন্সিল মেম্বারদের সংখ্যা নির্ধারিত হত ঐ জেলার মুসলিম জনগণের সংখ্যার উপর ভিত্তি করে আর কলকাতা ছিল এদিক দিয়ে সবচেয়ে এগিয়ে। এর ফলে কলকাতা ভিত্তিক অভিজাত মুসলিম নেতাদের দ্বারা প্রাদেশিক লীগের কার্যক্রম বেশি নিয়ন্ত্রণ করা হত। কিন্তু আবুল হাসিম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কাউন্সিল সদস্যপদ কলকাতাসহ জেলা পর্যায়ে ভাগ করে দিলেন। ২৫ জন সদস্য প্রতিটিতে নির্বাচিত হবেন এমন ব্যবস্থা করা হল। নতুন এ ব্যবস্থা গ্রহণের ফলে প্রাদেশিক লীগে মুসলিম অভিজাতশ্রেণির আধিপত্য উল্লেখযােগ্য হারে কমে গেল এবং জেলা ও প্রাদেশিক লীগ কাউন্সিলে যুবক ও ত্যাগী শ্রেণির লীগ সমর্থকদের জায়গা হল।২৩ এর দ্বারা তাদের মনে রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি পেল এবং বাংলার মুসলমানদের মুসলিম লীগের প্রতি আকৃষ্ট করার কাজে তারা আরও বেশি উৎসাহী হল।
মুসলিগ লীগের আদর্শসমূহের বর্ণনা দিয়ে আবুল হাসিম এর একটি খসড়া ইস্তেহার প্রস্তুত করলেন এবং তাতে পরিষ্কার করে ধাপে ধাপে পাকিস্তানের নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক উদ্দেশ্যগুলাে তুলে ধরলেন।২৪ তিনিই প্রথম ব্যক্তি যিনি বাংলার মুসলমানদের কাছে পাকিস্তানের লক্ষ্যসমূহ স্পষ্ট ও ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করেছিলেন।
ছাত্রদের রাজনীতিতে যুক্ত করার প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করে আবুল হাসিম। মুসলিম ছাত্রদের লীগের পতাকাতলে নিয়ে আসার ব্যবস্থা গ্রহণ করলেন। ছাত্ররা তাঁর বাগ্মীতা ও প্রগতিশীল আচরণের জন্য তাঁর প্রতি বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছিল । লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি এবং পাকিস্তানের আদর্শ গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে। দিতে তাদের সেবাকে কাজে লাগান হয়েছিল।
গণতান্ত্রিক দল হিসেবে বাংলায় মুসলিম লীগকে প্রতিষ্ঠিত করতে আবুল হাসিম যেমনটি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তার সাথে সামঞ্জস্য রেখে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগও তাদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলল।
১১৫
১৯৪২ থেকে ১৯৪৫ সালের মধ্যে “ভারত-ছাড়” আন্দোলনের ফলে বেশির ভাগ কংগ্রেস নেতার জেল-জরিমানা হল। ইন্ডিয়ার রাজনীতিতে কংগ্রেসের পুরােপুরি অনুপস্থিতির ফাঁকে মুসলিম লীগ এককভাবে নিজেদের শক্তি বৃদ্ধি করে চলল। পূর্বের যেকোন সময়ের চেয়ে মুসলিম লীগ তখন ভারতের মুসলমানদের জন্য একক কর্তৃত্বপরায়ণ দল হিসেবে নিজেকে প্রকাশ করল । এই কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণ তখনই প্রকাশ পেল যখন ১৯৪৫ সালে সিমলা আলােচনায় তারা মধ্যবর্তী সরকারে লীগের বাইরের কোন মুসলিমকে সদস্য হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানাল আর এজন্য ঐ আলােচনাও তখন বাতিল হয়েছিল।২৫
সিমলা আলােচনা বাতিল হওয়ার পর ব্রিটিশ সরকার ঘােষণা করল, আসন্ন শীতে কেন্দ্রীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এম, এ. জিন্নাহ তাতে ঘােষণা দিলেন, “এটি পাকিস্তানের প্রতি ভারতীয় মুসলিমদের গণভোেট”২৬ এবং তাঁর চাওয়া হল, “ভারতের মুসলমানরা বিশ্বকে দেখিয়ে দিবে যে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগই শুধু এদেশে মুসলমান জাতির প্রতিনিধিত্ব করে।” বেঙ্গল মুসলিম লীগও এ চ্যালেঞ্জ কঠিনভাবে নিল। বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাসিম “আসুন আমরা ভােট-যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ি” শিরােনামে একটি ইস্তেহারের খসড়া তৈরি করলেন এবং খুবই স্বাভাবিক ভাষায় সেখানে বাংলার মুসলিমদের কাছে নির্বাচনের আসল উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করলেন।২৭ এর পাশাপাশি, হাসিম এবং হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছাত্রদের সহায়তায় বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চল ঘুরে ঘুরে সভা-সমাবেশ করলেন। আর মুসলিম লীগের প্রার্থীদের পক্ষে ভােট দেয়ার জন্য মুসলমানদের অনুরােধ জানালেন।
বাংলা ও আসামের চলমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটের উদাহরণ টেনে লীগ নেতারা “পাকিস্তান-ধারণা” সবার কাছে ব্যাখ্যা করলেন। বাংলার মুসলমানদের তারা যা বােঝালেন তাহল পাকিস্তান স্কীমের আওতায় বাংলা এবং আসাম স্বশাসিত অঞ্চল হিসেবে গড়ে উঠবে। আর এর ফলে সংখ্যাগরিষ্ঠ যে সকল মুসলমান এ এলাকাগুলােতে পিছিয়ে রয়েছে তারা নিজেদের উন্নতিসাধন করতে পারবে। মুসলিম লীগের এ প্রচারণার সাথে বাংলার মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের আকাক্ষারও মিল পাওয়া যায় যখন দেখা যায় এরাও লাহাের প্রস্তাবের ধারা উল্লেখপূর্বক বাংলা ও আসাম একত্র করে পূর্ব-ভারতে মুসলিম জাতীয়তাবাদী
১১৬
রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছেন।২৮ বাংলার এ বুদ্ধিজীবিগণ অবশ্য পাকিস্তান বিষয়ে, সভা-সেমিনারের মাধ্যমে জনমত গড়ে তুলতে, মুসলিম লীগকে সম্পূর্ণভাবে সমর্থন দিতে প্রস্তুত।
আরও একটি শক্তি হল, “উলেমা” ; যারা বাংলার মুসলমানদের কাছে। মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান ধারণা বেশ জনপ্রিয় করে তুলতে পেরেছিলেন। ১৯০৬ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা লাভ করার সময় থেকে এই উলেমাগণ তাদের ধর্মীয় অস্ত্র নিয়ে অভিজাত মুসলিম রাজনীতিবিদদের পাশে আছেন। উভয় দলই মুসলমানদের স্বতন্ত্র ও আলাদা সম্প্রদায় হিসেবে সংগঠিত করার চেষ্টা করেছে।২৯ ১৯৩৬ – ৩৭ সালের ভােটযুদ্ধে উলেমা-দল মুসলিম লীগের পক্ষ নিয়ে হক-বিরােধী প্রচারণা চালিয়েছিল।৩০ ১৯৪০ সালের মার্চে “লাহাের রেজুলেশন” যা বিশেষভাবে “পাকিস্তান রেজুলেশন” নামে প্রতিষ্ঠিত, তা গৃহীত হওয়ার পর মুসলিম লীগ ও উলেমা নেতারা বাংলার বিভিন্ন এলাকায় গিয়ে এর পক্ষে মুসলিম জনমত গড়ে তােলেন। এরপর মুসলিম লীগ নেতারা যখন ১৯৪৫ – ৪৬-এর নির্বাচনকে পাকিস্তান-হিন্দুস্থান লড়াই বলে ঘােষণা দিল তখন এই উলেমা দল পাকিস্তান প্রচারনাকে সমর্থন দিতে এগিয়ে এল। এ উদ্দেশ্যে তাঁরা আলাদা দল “নিখিল ভারত জামায়েত-ই-উলেমা-ই-ইসলাম” গঠন করল। কলকাতার মােহাম্মদ আলী পার্কে ২৬-২৯ অক্টোবর এ দলের ঐতিহাসিক সম্মেলন হয়েছিল যাতে বাংলা, আসাম, বিহার, পাঞ্জাব, যুক্ত প্রদেশসহ ইন্ডিয়ার বিভিন্ন অঞ্চল থেকে নামী-দামী আলেম ও ফাজেল (ইসলামী পণ্ডিত)-গণ যােগ দিয়েছিলেন। সম্মেলনে ফুরফুরা শরীফের পীর আবদুল হাই সিদ্দিকি যােগ দিয়ে বক্তব্য রাখেনঃ
জামিয়াত এই লীগকে মুসলমানদের জন্য জাতীয় দল বলে স্বীকৃতি প্রদান তী করল। আজ, সকল মুসলমানের উপর ফরজ (অবশ্যপালনীয়) হল, লীগের হাতকে শক্তিশালী করা। ইহা একক কোন ব্যক্তির আদেশ নয়। ইহা কোরআনের আদেশ। তাই মুসলিম লীগকে এই নির্বাচনে সমর্থন করতে সব মুসলিমকে এগিয়ে আসা উচিত। লীগের বিজয়ে আমাদেরই ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে।৩১
লাহাের জামে আলমগীর মসজিদের ইমাম – আল্লামা গােলাম মুর্শেদ লাহােরী, যিনি এ সম্মেলনের সভাপতি ছিলেন, তিনি বললেনঃ
১১৭
আমাদের আল্লাহ এক, আমাদের রসুল এক, আমাদের কোরআন এক, আমাদের কেবলা এক, আমাদের রাজনৈতিক লক্ষ্য এক। দাসত্ব থেকে মৃত্যুই আমাদের কাছে শ্রেয়। পাকিস্তান না হওয়া পর্যন্ত আমাদের লড়াই চলবে।৩২
“জামায়েত-ই-উলেমা” প্রতিষ্ঠিত হওয়ার খবরে মওলানা আকরম খা খুবই উচ্ছ্বসিত হয়েছিলেন। তিনি মুসলমানদের কোরআন থেকে শিক্ষা নিতে বললেন এবং সবাইকে অন্যায় অত্যাচার মােকাবিলায় এক হতে বললেন। পাকিস্তান হওয়ার গুরুত্ব বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বলেন ঃ
ব্রিটিশরা ভারত ছেড়ে যাওয়ার পর কংগ্রেস এই প্রদেশে “হিন্দু-রাজ” কায়েম করবে এবং মুসলমানরা দাসত্বের জীবন গ্রহণ করবে। তখন হিন্দুমুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে অযথা সংঘাত বাধবে। এ সমস্যা এড়াতে এবং ভারতের ভবিষ্যৎ সুন্দর ও উন্নত করতেই মুসলিম লীগ পাকিস্তানের দাবি করছে। ইহা একটি সঠিক ও স্বাভাবিক চাওয়া। কেউ পাকিস্তান হওয়াকে থামাতে পারবে না।
সম্মেলনে আরও অনেক উলেমা বক্তৃতা করেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এম. এ. জিন্নাহও বড় একটি শুভেচ্ছা বার্তা পাঠিয়ে সম্মেলনের সফলতা কামনা করেন।৩৪ উলেমা সম্মেলনের সফলতায় বহু মুসলমান। অনুপ্রাণিত হয়ে মুসলিম লীগের একনিষ্ঠ কর্মী হিসেবে এই দলে যােগদান করে এবং পাকিস্তান দাবির প্রতি সমর্থন দিতে থাকে।
উলেমা-লীগ জোটকে শক্তিশালী করে তােলেন মওলানা আবদুল হামিদ খান। যিনি মওলানা ভাসানী নামে সুপরিচিত। যদিও তিনি আসাম প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট ছিলেন তবুও তার প্রভাব অনেক দূর, যেমন উত্তর-পূর্ব বাংলা এবং বাংলার সাথে যুক্ত আসামের কিছু অঞ্চল পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। তিনি একাধারে ছিলেন একজন আলেম ও রাজনীতিবিদ এবং সকল মুসলমানের কাছে। তিনি আলেম ও মজলুল নেতা হিসেবে সমাদৃত ছিলেন।৩৫ মওলানা ভাসানী কোন দরবেশ ছিলেন না। তিনি ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলতেন। তিনি আলাপআলােচনা ধর্মানুষ্ঠানের মত মনে করতেন আলাপ-আলােচনা আধ্যাত্মিক গুরুত্ব
১১৮
বহন করত। তিনি সহজেই মুসলিমদের লীগের মিছিলে জড়াে করতে পারতেন। বস্তুত তিনি ১৯৪০ – ৪৫ সালের মধ্যে পাকিস্তানের পক্ষে বক্তৃতা দিয়ে বাংলায় বিশাল আলােড়ন সৃষ্টি করেছিলেন।৩৬
১৯৪৫ – ৪৬-এর নির্বাচনের আগে উলেমা দলের সুখ্যাতি অনেকদূর পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছিল। তাই লীগের নেতারা ইহাকে তাদের নির্বাচনী কাজে লাগাতে যথেষ্ট তৎপর হয়ে উঠেন। এমনকি লীগের “আধুনিক নেতা হিসেবে পরিচিত আবুল হাসিমও তার বাংলা পত্রিকা মিল্লাত-এ এই উলেমা দলের মতাদর্শের পক্ষে প্রচারণা চালিয়েছিলেন।৩৭ একই সঙ্গে লীগের নেতারা ‘উলেমা’ দলের ফতােয়াগুলােও মুসলিম জনগণের মধ্যে প্রচার করতে লাগলেন। উলেমা দলের ওস্তাদ মওলানা মােহাম্মদ ওসমানী শরীয়তের উদ্ধৃতি দিয়ে মুসলমানদের পাকিস্তানের পক্ষে লড়াই করার জন্য ফতােয়া দিলেন।৩৮
১৯৪৬ সালের শুরুর দিকে লীগ এবং উলেমা দল বাংলার পল্লী অঞ্চলে একত্রে ভ্রমণ করে সেখানে লীগের আয়ােজিত সভা-সমাবেশে বক্তৃতা করেন। লীগের সকল সভায় উলেমা দলের লােকজনের বেশি উপস্থিতি লক্ষ্য করা গিয়েছিল। এর মধ্যে চোখে পড়ার মত লােক সমাগত হয়েছিল ময়মনসিংহের গফরগাঁয়ে, ১৯৪৬ সালের ১২ জানুয়ারি ময়মনসিংহ জেলা লীগ আয়ােজিত সভায়। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খান ঐ সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং উর্দুতে বক্তৃতা করেন। সভার আলােচিত দাবিগুলাে হল, পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ, বিনামূল্যে প্রাথমিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু, পাটের ন্যায্যমূল্য নিরূপণ ইত্যাদি।৩৯
এই দাবি উত্থাপন করায় মুসলিম জনগণের কাছে লীগের জনপ্রিয়তা আরও বৃদ্ধি পেল। গফরগাঁও-এর ঐ সভায় অনেক উলেমা অংশগ্রহণ করলেন। লীগের সভা শেষ হওয়ার পর ঐ একই স্থানে ১৯৪৬ সালের ৩ জানুয়ারি জামায়েত-ইউলেমা-ই-ইসলাম-এর সভা অনুষ্ঠিত হল । বিখ্যাত আলেম মাওলানা জাফর আহমেদ থানভী সাহেব আসন গ্রহণ করলেন। পাকিস্তানের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে তিনি বলেন ঃ
১১৯
ইসলামিক হুকুমত ছাড়া ইসলামিক তমদুন প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। তাই পাকিস্তান হওয়ার জন্য উত্থাপিত দাবিটি একটি ন্যায্য দাবি। স্বাধীনতার নামে মুসলমানরা হিন্দু কংগ্রেসের অধীনে দাসত্ব করাকে মেনে নিতে পারে না । ধর্ম এবং তমদুনের ক্ষেত্রে হিন্দু ও মুসলিমদের অনেক পার্থক্য রয়েছে। এই দু’ জাতির উন্নতির লক্ষ্যে ভারতকে হিন্দুস্থান ও পাকিস্তান এই দু’ভাগে ভাগ করা উচিত।৪০
মুসলিম লীগের হাতকে শক্তিশালী করার জন্য মাওলানা জাফর আহমেদ থানভী মুসলমানদেরকে উপদেশ দিলেন। সমাবেশে উপস্থিত হয়ে আরও বক্তব্য রাখেন ; আল্লামা আজাদ সােবহানী, মাওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, মাওলানা মােসলেহ উদ্দিন, মাওলানা ফজলুল হক এবং আরও অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ।৪১
গফরগাঁও-এ অনুষ্ঠিত লীগ এবং উলেমা দলের ঐ দুটি সভায় বক্তারা হিন্দুকংগ্রেসকে কঠোরভাবে আক্রমণ করেন। বাংলার বাঘ এ. কে. ফজলুল হক ও অন্যান্য জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদের মীরজাফরের সাথে তুলনা করেন।
লীগের প্রচারণা ও উলেমা দলের মুসলিম লীগ সমর্থন এ দুটির সাথে মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের পাকিস্তান সমর্থনে যােগ হওয়ায় প্রদেশের বিপুল সংখ্যক মুসলিম জনগণ উপলব্ধি করল, লীগের তত্ত্বাবধানে পাকিস্তান গঠনের মধ্যেই তাদের রাজনৈতিক অর্থনৈতিক মুক্তি নিহিত রয়েছে। ১৯৪৫ সালের শেষে এবং ১৯৪৬ সালের শুরুতে যথাক্রমে প্রাপ্ত কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক নির্বাচনের ফলাফল এরই সাক্ষ্য বহন করে।
বাংলার কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের ৬টি আসনের সব কয়টিতে মুসলিম লীগের প্রার্থিরা জয়ী হলেন। বাংলার প্রাদেশিক আইনসভার ২৫০টি আসনের মধ্যে মােট ১৯৯টি মুসলিম আসনের বিপরীতে মুসলিম লীগের প্রার্থিরা ১১৩টিতে জয়ী হলেন। এই নির্বাচনগুলােতে মুসলিম লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন এ. কে. ফজলুল হকের ন্যাশনালিস্ট মুসলিম অনুসারিগণ। কিন্তু ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিদের কারণে তারা প্রতিপক্ষ হিসেবে অতটা লড়াই করতে পারেনি ;
১২০
কারণ, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবিরা পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলেন। ফজলুল হক সমর্থিত প্রার্থিদের মধ্যে কেবলমাত্র সৈয়দ মােহাম্মদ আফজাল, খুদা বক্স এবং মাওলানা শামসুল হুদা তাঁদের নিজস্ব জনপ্রিয়তার জন্য যার যার আসনে জয়লাভ করেছিলেন। ফজলুল হক তাঁর জনপ্রিয়তায় দুটি আসনেই জয়লাভ করেছিলেন। এ আসন দুটি হল, বরিশাল সদর (দক্ষিণ) ও খুলনা জেলার বাগেরহাট। কিন্তু তাঁর সমর্থকদের মধ্যে নামকরা যেমন আবু হােসেন সরকার, আশরাফুদ্দিন আহমেদ চৌধুরী, হাশেম আলী খান, হুমায়ুন কবীর প্রমুখ প্রার্থিরা তাদের প্রতিপক্ষের কাছে শােচনীয়ভাবে পরাজিত হয়েছিলেন।

তথ্যসূত্র ঃ
১. যে ইস্তফাপত্রে এ. কে. ফজলুল হক স্বাক্ষর দিয়েছিলেন তার ভাষা ছিল ঃ
“আমার মনে হল, এ ইস্তফাপত্র দেয়ার পর অধিকাংশ দল থেকে ব্যক্তি বাছাই করে মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। আমি দৃঢ়ভাবে আশা প্রকাশ করছি, মন্ত্রীর পদ থেকে আমার এ ইস্তফা প্রদানটি যে বাংলার মানুষের স্বার্থে তা অবশ্যই প্রমাণিত হবে।” দেখুন ঃ এ. কে. ফজলুল হক, “বেঙ্গল টুডে” (কলকাতা, ১৯৪৪), পৃঃ ৩৯। আরও দেখুন ঃ “কেন আমি পদত্যাগ করলাম” বলে আইনসভায় ১৯৪৫ সালের ৫ জুলাই তার বক্তৃতা, “বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসেডিংস”, ১৯৪৩, ভলিউম ৭০, পৃষ্ঠা ৬০।
২. উদ্ধত : “দ্য স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ২২ এপ্রিল ১৯৪৩।
৩. ঐ।
৪. ঐ।
৫. ঐ।
৬. ঐ। দফতরসহ মন্ত্রিদের নামের তালিকা নিমে দেয়া হলঃ
খাজা স্যার নাজিমুদ্দিন – স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় (সিভিল ডিফেন্স কো-অর্ডিনেশন সহ)।
এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী – সিভিল সাপ্রাইস
টি. সি. গােস্বামী – অর্থ
তমিজুদ্দিন খান – শিক্ষা
বরুড়া প্রসন্ন পাইন – কমিউনিকেশন এন্ড ওয়ার্কস
খান বাহাদুর সৈয়দ মােয়াজ্জেম হােসেন – কৃষি (পল্লী উন্নয়নসহ)
তারক নাথ মুখার্জী – রেভিনিউ (নির্বাসন ও ত্রাণসহ)
১২১
নওয়াব মােশাররফ হােসেন – আইন ও সংসদ
খাজা শাহাবুদ্দিন – বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প (যুদ্ধ পরবর্তী পুনর্গঠন ব্যবস্থাসহ)
প্রেমহরি বর্মন – বন ও আবগারী শুল্ক
খান বাহাদুর মৌলভী জালালুদ্দিন আহমেদ – স্বাস্থ্য ও স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
পুলিন বিহারী মল্লিক – প্রচার
যােগেন্দ্র নাথ মন্ডল – কো-অপারেটিভ, ক্রেডিট ও রুরাল ইনডেটেডনেস।
৭. ১৯৪৩ সালের ২৪ এপ্রিল কলকাতার টাউন হলে অনুষ্ঠিত প্রতিবাদ সভায় ফজলুল হকের বক্তৃতা। সূত্র ঃ “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ২৫ এপ্রিল ১৯৪৩।
৮. ১৯৪৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে দেয়া ফজলুল হকের বক্তৃতা। সূত্র ঃ এ. কে. ফজলুল হক, “বেঙ্গল টুডে” (কলকাতা, ১৯৪৪), পৃষ্ঠা ৪৯।
৯, ঐ। পৃষ্ঠা ৪৮।
১০. ঐ।
১১. ঐ, পৃষ্ঠা ৫৪ ।
১২. স্যার জন উডহেডের নেতৃত্বে গঠিত দুর্ভিক্ষ বিষয়ক তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন (দিল্লী, ১৯৪৪), ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ১২৭৪।
১৩. ভবানী সেন, “ভাঙ্গনের মুখে বাংলা” (কলকাতা, ১৯৪৫), পৃষ্ঠা ১০।
১৪. ঐ । পৃষ্ঠা ৭।
১৫. ঐ। পৃষ্ঠা ১০।
১৬. দেখুন : পরিশিষ্ট ৫।
১৭. ১৯৪৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি বাংলা প্রাদেশিক পরিষদ সভায় এ. কে. ফজলুল হকের বক্তৃতা। সূত্র ঃ হক, নং ৯, পৃষ্ঠা ৫৯।
১৮. দুর্ভিক্ষের জন্য গঠিত তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদন, নং ১২, ভলিউম ১, পৃষ্ঠা ২৭৬।
১৯. খালেদ বি. সাইদ ও “পাকিস্তান ঃ দি ফরমেটিভ ফেইজ ১৮৫৭ – ১৯৪৮” (লন্ডন, ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ২১৪।
২০. “ইন্ডিয়ান এনুয়াল রেজিস্টার, ১৯৪৪”, ভলিউ ১ (জানুয়ারি – জুন), পৃষ্ঠা ৮৪।
২১. আবুল হাসিম ঃ “অতীত দর্শন” (ঢাকা, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১৫৩।
২২. ১৯৪৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর এক বিবৃতির মাধ্যমে জিন্নাহ এ সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন।
দেখুন ঃ “স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা) ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৪৩।
২৩. কামরুদ্দিন আহমেদ ঃ “এ স্যোশাল হিস্টরী অব বেঙ্গল” (ঢাকা, ১৯৭০), সংস্করণ ৩য়, পৃষ্ঠা ৬১ – ৬৫।
১২২
২৪. আবুল হাসিম কর্তৃক প্রস্তুতকৃত বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের খসড়া ইস্তেহার যা পূর্ব পাকিস্তান পাবলিশিং হাউস থেকে প্রকাশ করেন শামসুদ্দিন আহমেদ।
২৫. নিকোলাস ম্যানস্যাগ সংস্করণ “দি ট্রান্সফার অব পাওয়ার ১৯৪২ – ১৯৪৭” (লন্ডন, ১৯৭৪), ভলিউম ৫, পৃষ্ঠা ১১৫৪ – ৫৪)।
২৬. জামিল উদ্দিন আহমেদ ও “স্পিসেস এন্ড রাইটিংস অব মিঃ জিন্নাহ” (লাহাের, ১৯৬৪), ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ২০২।
২৭. ঢাকাস্থ সােসাইটি ফর পাকিস্তান স্টাডিজ কর্তৃক প্রকাশিত ১৯৪৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে আবুল হাশেম কর্তৃক পেশকৃত খসড়া ইস্তেহার ।
২৮. পাকিস্তান সম্পর্কে মুসলিম বুদ্ধিজীবিদের তখনকার ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে জানতে দেখুন ঃ শীলা সেন ঃ “মুসলিম পলিটিক্স অব বেঙ্গল, ১৯৩৭ – ৪৭” (দিল্লী, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা ১৭৫ – ৮১।
২৯. অমলেন্দু দে ঃ “বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও বিচ্ছিন্নতাবাদ” (কলকাতা, ১৯৭৪), অধ্যায়। প্রথম।
৩০. বিস্তারিত দেখুন ঃ ৪ অধ্যায়।
৩১. ১৯৪৫ সালের ২৬ থেকে ২৯ অক্টোবর কলকাতায় মােহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত “নিখিল ভারত জামায়েত-ই-উলেমা-ই-ইসলাম”-এর সভার কার্যক্রম। সূত্র : “মিল্লাত” – ১ম ইস্যু, ১৬ নভেম্বর ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ১১।
৩২. ঐ।
৩৩. ঐ।
৩৪. ঐ।
৩৫. কাজী আহমেদ কামাল ও “পলিটিশিয়ানস এন্ড ইনসাইড স্টোরিজ” (ঢাকা, ১৯৭০), পৃষ্ঠা ১৫১। আরও দেখুন ঃ “প্রাচ্যবার্তা ঃ মওলানা ভাসানী স্মরণিকা সংখ্যা” ঢাকা, ১৭ নভেম্বর ১৯৭৭, পৃষ্ঠা ৩।
৩৬. “মুসলিম রাজনীতির পটভূমি ও পরিচয়” মিল্লাতে আবুল মনসুর আহমদের নিবন্ধ, ২য় ইস্যু, ২৩ নভেম্বর ১৯৪৩, পৃষ্ঠা ৩।
৩৭. মিল্লাত-এর ফাইল, ১৯৪৫ – ৪৬।
৩৮. মিল্লাত-এ উস্তাদাতুল উলেমা মাওলানা মােহাম্মদ শাহুল উসমানী (ভগলপুর)’র ফতােয়া, ৪র্থ ইস্যু, ৭ ডিসেম্বর ১৯৪৫, পৃষ্ঠা ৬।
৩৯. মিল্লাত, ৮ম ইস্যু, ১১ জানুয়ারি ১৯৪৬, পৃষ্ঠা ৩।
৪০. ঐ। ৯ম ইস্যু, ১৮ জানুয়ারি ১৯৪৬, পৃষ্ঠা ৮।
৪১. ঐ।
১২৩

অষ্টম অধ্যায়
এ. কে. ফজলুল হকের রাজনীতির ক্রান্তিকাল ও মুসলিম লীগঃ দেশ বিভাগের প্রাক্কালে

– এক –
১৯৪৬ সালে বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচনে বিজয়ের পর বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সংসদীয় দলের নেতা এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দীকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য বেঙ্গল প্রেসিডেন্সির গভর্নর আহবান জানান। যেহেতু লীগ সংসদীয় আসনে সংখ্যাগরিষ্ঠ হতে পারেনি তাই এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দী আইন পরিষদের কিছু মুসলিম সদস্যকে দলে নিয়ে ১৯৪৬ সালের এপ্রিল মাসে মন্ত্রিপরিষদ গঠন করলেন। এতে ১১ জন সদস্য ছিলেন। নতুন মন্ত্রিসভার একটি বিশেষ দিক হল, যেখানে ফজলুল হক ও নাজিমুদ্দিনের মন্ত্রিসভায় সমান। সংখ্যক হিন্দু ও মুসলমান সদস্য রেখে (প্রধানমন্ত্রী ছাড়া) সমতা বিধান করা হয়েছিল, সােহরাওয়ার্দী সেখানে শুধুমাত্র তিনজন হিন্দু রাখলেন তাও তাদের মধ্যে দু’জন হলেন তফসিলি সম্প্রদায়ের। সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার (১৯৪৬ – ৪৭) স্থায়িত্ব কম সময়ের হলেও সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পূর্ব প্রাদুর্ভাব এমনই চিহ্ন রেখে গিয়েছিল যে, তার রেশ ধরে পরবর্তীতে মুসলিম-হিন্দু সম্পর্কের চরম অবনতি ঘটে এবং ভারত ও বাংলার বিভক্তি অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এসব দাঙ্গার মধ্যে সবচেয়ে মারাত্মক ছিল কলকাতায় মুসলিম লীগের “ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে” কর্মসূচি পালন করার দিনের ঘটনা। এখানে তাই মুসলিম লীগের “ডাইরেক্ট এ্যাকশান” কর্মসূচির প্রেক্ষাপট এবং তার পরের ঘটনাগুলাে আলােচনা করা দরকার।
১২৪
১৯৪৬ সালের মার্চে, লর্ড প্যাট্রিক লরেন্স, স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস এবং মিঃ এ. ভি. আলেকজান্ডার এ তিনজনের একটি মন্ত্রী মিশন আলােচনায় ভাইসরয়কে সহযােগিতা করতে লন্ডন থেকে ভারতে এলেন। আলােচনার লক্ষ্য ছিল, ভারতের রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বসে শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে তৈরির উপায় বের করা একই সঙ্গে অন্তর্বর্তীকালীন নির্বাহী পরিষদ গঠন করা যাতে করে সরকারি কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চলমান থাকে। কিন্তু প্রধান দুই দল মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের বিতর্কিত লক্ষ্যসমূহের মধ্যে সমঝােতা করতে না পারায় মিশনটি ব্যর্থ হয়। লীগের চাওয়া ছিল, “পাকিস্তান একটি আলাদা সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে যাতে থাকবে ভারতের উত্তর-পূর্ব দিকের বাংলা ও আসাম এবং উত্তর-পশ্চিম দিকের পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান।১ কিন্তু এ ফর্মুলায় কংগ্রেস সম্মত ছিল না। এতে করে ঐ মিশন ১৬ মে নিজেদের মত একটি পরিকল্পনা তৈরি করে তাদের সামনে উত্থাপন করল যা “কেবিনেট মিশন” নামে পরিচিত। মুসলিম লীগের সার্বভৌম পাকিস্তান করার দাবি নাকচ করা হল এবং ভারত ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠাকল্পে গণপরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বলা হল। কেন্দ্র শুধু পররাষ্ট্র বিষয়াবলী, প্রতিরক্ষা এবং যােগাযােগ ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করবে। গণপরিষদ নির্বাচনের সময় প্রাদেশিক পরিষদসমূহকে তিনটি শাখায় দলবদ্ধ করতে হবে। শাখা –
ক. হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশসমমূহ,
খ. ৪ পাঞ্জাব, উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশ, সিন্ধু এবং বেলুচিস্তান এবং
গ. বাংলা এবং আসাম।
এ শাখাসমূহের অন্তর্গত প্রাদেশিক প্রতিনিধিরা সিদ্ধান্ত নিবেন যে, সেখানে তারা মাঝারি পর্যায়ের নির্বাহী ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করবেন কি-না।২ কংগ্রেস তখন মিশনকে আরেকটি অংশ রাখতে অনুরােধ করল, সেখানকার প্রতিটি প্রদেশ তার ইচ্ছানুযায়ী যে শাখায় তা রাখা হয়েছে তার পার্শ্ববর্তী এলাকার সাথে যুক্ত হতে পারবে । কিন্তু মিশন তা নাকচ করে জানাল যে, প্রতি শাখায় প্রদেশগুলােকে এভাবে রাখা স্কিমের একটি অংশ যা কোনভাবেই দুই দলের সম্মতি ছাড়া পরিবর্তন করা যাবে না। মিশনের এ পরিকল্পনায় কংগ্রেস “না গ্রহণ করলাম, বাদ দিলাম” আচরণ করল। অন্যদিকে লীগ ৬ জুন এ পরিকল্পনা গ্রহণ
১২৫
করতে সম্মত হল। কারণ তারা লক্ষ্য করল, শাখা (খ) ও (গ)-তে যুক্ত হওয়ার যে কথা রয়েছে তাতে ৬টি মুসলিম প্রদেশ একত্র হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন করার সম্ভাবনা রয়েছে।৪
এদিকে লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে অন্তর্বর্তীকালীন একটি সরকার ব্যবস্থার বিষয় সমঝােতা আনয়নের লক্ষ্যে ভাইসরয়ের গৃহীত উদ্যোগও ব্যর্থ হল। এরপর ১৬ জুন, কংগ্রেস সাংবিধানিক স্কিমের বিষয়ে কিছু বলার আগেই, মন্ত্রীমিশনের সাথে আলাপ করে ভাইসরয় ঘােষণা দিলেন, মধ্যবর্তীকালীন সরকার গঠনের জন্য তিনি ১৪ জন ব্যক্তিকে আসতে বলেছেন। এই ১৪ জনের মধ্যে ৬ জন কংগ্রেসের হিন্দু সদস্য (সিডিউল কাস্টের ১ জন সহ), ৫ জন মুসলিম সদস্য, ১ জন শিখ, ১ জন ফারসি এবং একজন ভারতীয় খ্রিস্টান।৫ ঘােষণা দেয়া হল, অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা তৈরির লক্ষ্যে ভাইসরয় বড় দুটি দলকে নিয়ে কাজ করতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তারা একত্রে মিলে এ কাজটির লক্ষ্য স্থির করতে না পারায় ভাইসরয় নিজেই উদ্যোগী হয়ে, যারা ১৬ মের বিবৃতিতে সম্মতি দিয়েছেন, তাদের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে এ অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের রূপরেখা তৈরি করলেন।৬ এরই মধ্যে অবশ্য ৪ জুন ভাইসরয় একটি চিঠি ব্যক্তিগতভাবে জিন্নাহকে পাঠালেন যাতে তিনি লিখলেন, “যদি দুই দলের কোন একটি দল পরিকল্পনাটি গ্রহণ করে তবে অবস্থার আলােকে এগিয়ে যাওয়া যাবে।”৭
২৪ জুন কংগ্রেস মন্ত্রী-মিশনের প্ল্যান থেকে শুধুমাত্র রাষ্ট্র-কাঠামাের অংশটি গ্রহণ করল। কিন্তু অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার অংশটি প্রত্যাখ্যান করল । কারণ, একটি জাতীয় পর্যায়ের দল হয়েও ৬ সদস্যের কোটায় একজন জাতীয়তাবাদী মুসলিমকে মনােনয়ন দেয়ার অধিকার তারা ত্যাগ করতে পারল না ।৮ জিন্নাহ যখনই জানতে পারলেন, কংগ্রেস অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছে সাথে সাথে তিনি লীগের কার্যকরি পরিষদকে তা গ্রহণ করে নিতে বলল। তিনি দাবি করে জানালেন, ভাইসরয় অবশ্যই তার ১৬ জুনের বিবৃতি অনুযায়ী কংগ্রেসকে অগ্রাহ্য করতে বাধ্য এবং লীগ বা অন্য দল যদি চায় তবে তাদের প্রতিনিধিদের নিয়ে সরকার গঠনে এগিয়ে যাবেন।৯ কিন্তু ভাইসরয় তা না করে স্থায়ী কর্মকর্তাদের দিয়ে একটি তত্ত্বাবধায়ক সরকার বানালেন।
১২৬
ভাইসরয়ের এমন পশ্চাদপসরণ দেখে লীগ ফিরে গেল এবং তার এ কাজকে “ব্রিটিশ বিশ্বাসঘাতকতা” বলে আখ্যায়িত করল।১০
মুসলিম লীগের হতাশা আরও বেড়ে গেল যখন কংগ্রেসের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট জওহরলাল নেহেরু ১০ জুলাই একটি বিবৃতি দিলেন যে, তারা এসেম্বলী গঠনে অংশ নিতে আগ্রহী এবং তারা মন্ত্রী-মিশনের পরিকল্পনামাফিক তা যেভাবে খুশি পরিবর্তন বা সংশােধন করতে প্রস্তুত।১১ এরই সাথে তিনি “মিলে যাওয়া” অংশের ক্ষেত্রে জানিয়ে দিলেন, “কোনভাবে একত্রিত করা যাবে না।”১২ এ অবস্থায় মন্ত্রী-মিশনের পরিকল্পনা গ্রহণ করার বিষয়টি লীগের জন্য পুনর্বিবেচনা করা জরুরি হয়ে উঠল। ১৯৪৬ সালের ২৭ – ২৯ জুলাই বােম্বেতে এ বিষয়ের উপর আলােচনা করার জন্য মুসলিম লীগ কাউন্সিলের বৈঠক ডাকা হল। এ সভায় দুটি প্রস্তাব গৃহীত হল ঃ
প্রথমটি হল, তারা মন্ত্রী-মিশনের ঐ পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করবে এবং
দ্বিতীয়টি হল, পাকিস্তান রাষ্ট্র দাবির পক্ষে তারা “ডাইরেক্ট এ্যাকশান-ডে” বা প্রত্যক্ষ সংগ্রামের জন্য এগিয়ে যাবে।
পাকিস্তান প্রশ্নে তারা যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করল তার রেজুলেশন ছিলঃ
….. মুসলিম লীগের সম্মতি ছাড়াই কেন্দ্রে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ব্যবস্থা নেয়ায় ….. অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল নিশ্চিত হতে পেরেছে যে নিজেদের অধিকার ও নিজেদের সম্মান রক্ষা করার জন্য। পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্যে সকল মুসলমানকে ডাইরেক্ট এ্যাকশানে নেমে পড়া উচিত, না হলে বর্তমানের ব্রিটিশ দাসত্ব আর হিন্দু আধিপত্য থেকে আমাদের রেহাই নেই।”১৩
ঐ সিদ্ধান্ত গৃহীত হওয়ার পরপরই লীগের কার্যকরী পরিষদ ১৬ আগস্ট “ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে” ঘােষণা করল এবং সকল মুসলমানকে ব্যবসা-বাণিজ্য বাদ দিয়ে হরতাল করার আহ্বান জানাল। তারা প্রাদেশিক এবং জেলা লীগের কমিটিকে নির্দেশ দিল যেন সভা-সমিতি করে জনগণের কাছে রেজুলেশনের দুটি বিষয় তারা ব্যাখ্যা করেন।১৪ তদনুসারে কলকাতা ও বাংলার বিভিন্ন স্থানে সভাসমাবেশ করা হল। সমাবেশে মুসলিম লীগের নেতারা প্রয়ােজনে পাকিস্তানের
১২৭
জন্য লড়াই করার প্রস্তুতি নিয়ে থাকতে মুসলমানদের আহ্বান করেন। এর সঙ্গে নেতারা জ্বালাময়ী প্রচারপত্র বিলি করতে থাকল যেগুলােতে পরিষ্কারভাবে সাম্প্রদায়িকতা সম্পর্কে উপদেশ দেয়া ছিল। এমনই কিছু প্রচারপত্রের নমুনা নিমে দেয়া হল ঃ
আল্লাহর ইচ্ছায়, আমরা ভারতের দশ কোটি লােক, দুর্ভাগ্যবশত হিন্দু আর ব্রিটিশদের দাসে পরিণত হয়েছি। আমরা, আল্লাহ তােমার ইচ্ছায়, এ পবিত্র রমজান মাসে জিহাদের ডাক দিলাম। আমরা অবশ্যই তােমার উপর নির্ভরশীল। কাফেরদের উপর আমাদের বিজয় নিশ্চিত করে দাও যাতে আমরা ভারতবর্ষে মুসলিম শাসন কায়েম করত পারি…।১৫
এই রমজান মাসে, ইসলামের সাথে কাফেরদের প্রথম যুদ্ধ শুরু হয় আর মুসলমানরা জিহাদের অনুমতি পায়….. এবং ইসলাম বিশাল বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল….. আল্লাহর ইচ্ছায়, মুসলিম লীগ পাকিস্তান গঠনের লক্ষ্যে এই পবিত্র মাসে জিহাদের ঘােষণা দিচ্ছে।”১৬
মুসলিম লীগের নেতাদের আধ্যাত্মিক বক্তৃতা আর জ্বালাময়ী প্রচারপত্র বিলি করাতে নিঃসন্দেহে বিপুল সংখ্যক মুসলিম এতে অনুপ্রাণিত হয়েছিল। কলকাতায় বড় সমস্যা তৈরি হল যখন মুসলমানরা “ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে” পালন করার সময় জোরপূর্বক হিন্দুদের দোকানপাট হরতাল দেখিয়ে বন্ধ করতে লাগল, আর তারা তাতে প্রতিবাদ করল। এতে করে দ্রুত ঐ শহরে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে চরম দাঙ্গা বেঁধে গেল। দুষ্কৃতকারীরা তখন ঘৃণ্য কাজ যেমন করল। এরূপ উন্মাদনা টানা চারদিন চলল। হত্যাযজ্ঞ ও অনাচারের ঐ দিনগুলােতে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী নিজেদের অনেক জায়গায় নিষ্ক্রিয়। রেখেছিল। ব্রিটিশ সরকারের পুলিশ দাঙ্গা দমনে কঠিন পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ হয়। অনেকে মনে করে, তা ছিল পুলিশের পক্ষপাতমূলক আচরণ । সােহরাওয়াদী সরকারের পক্ষ থেকে ১৬ আগস্ট সরকারি ছুটির দিন ঘােষণা দেয়া ছিল অদূরদর্শিতা। কারণ, তাতে ছাত্র, চাকরিজীবি ও অন্যান্য লােকজন সবাই রাস্তায় নেমে এসে গােলযােগের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিয়েছিল।
১২৮
হতাহতের সংখ্যা নিশ্চিত করা যায়নি। হডসন এ সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। যে, কলকাতায় ৫০০০ লােক নিহত এবং ১৫,০০০ লোক মারাত্মক আহত হয়েছিলেন। তার মধ্যে যেমন হিন্দু ছিল তেমনি মুসলিম ছিল।
হিন্দু এবং মুসলিম লীগ নেতারা ঐ দাঙ্গার জন্য একে অন্যকে দায়ী করলেন। ১৯৪৬ সালে বাংলা আইনসভায় কংগ্রেসের নেতারা সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার উপর অনাস্থা প্রস্তাব আনল। কারণ, তাদের দাবি, লীগ ইচ্ছাকৃতভাবে এবং প্রস্তুতি নিয়েই হিন্দুদের উপর হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে আর সরকার লীগের ঐ কর্মকাণ্ডকে উৎসাহ যুগিয়েছে। সােহরাওয়ার্দী তা অস্বীকার করে উল্টো হিন্দুদের দোষারােপ করল যে, তারা লীগের “ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে”র কার্যক্রম ব্যাহত করতে গিয়েই সহিংস পদ্ধতি বেছে নেয়। “হাজারাে মানুষের দুর্ভাগ্য যে, ১৬ আগস্টের কর্মসূচিতে বাংলা এবং কলকাতার হিন্দুরা অকার্যকর করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিল, তিনি আরও বলেন, “তাদের ভুল ধারণা ছিল যে, যদি ১৬ আগস্টের কর্মসূচি সফল হয় তাহলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়ে যাবে।”১৯ সােহরাওয়ার্দী তখন হিন্দু মহাসভা দ্বারা প্রচারিত একটি প্রচারপত্রের উদাহরণ দিলেন। যাতে লেখা ছিল ।
“১৬ আগস্ট পালন করা মানে হল, লীগকে সমর্থন দেয়া এবং তাদের পাকিস্তান রাষ্ট্র বানানাের দাবিকে সমর্থন দেয়া।”২০
ঐতিহাসিক এ বাদানুবাদের মুহূর্ত বর্ণনা দিতে গিয়ে লেখক স্নার সবচেয়ে সঠিক উক্তিটি করেছিলেন, যা ছিলঃ
মনুষ্য সৃষ্ট যেকোন বিপর্যয়ের ক্ষেত্রে অংশগ্রহণকারী দলগুলাের কিছু না। কিছু ভূমিকা থাকেই। দলগত রাজনীতির ক্ষেত্রে এ ভূমিকা সম্পূর্ণরূপে সঠিক, যেখানে একে অপরকে দোষারােপ করে এবং নিজেকে সম্পূর্ণভাবে নির্দোষ বলে দাবি করে।২১
দাঙ্গাটি কে সৃষ্টি করল বা কখন তা শুরু হল – এ প্রশ্ন এক পাশে সরিয়ে রেখে ইহা বলা যায়, কলকাতা হত্যাযজ্ঞের ঘটনায় ভারতের রাজনীতিতে একটি বড় প্রভাব পড়েছিল । মনে রাখা দরকার, কলকাতার ঐ হত্যাকাণ্ডে বেশিরভাগ নিহত লােক ছিল উভয় সম্প্রদায়ের দরিদ্র জনগােষ্ঠী। বেশিরভাগ দোকানদার ও ঘাটের
১২৯
কুলি, ছিল নােয়াখালীর মুসলমান আর বিহার থেকে আসা হিন্দুদের মধ্যে ছিল গােয়ালা, ঠেলাগাড়ির চালক, রিকশাচালক আর দারােয়ান।২২ স্বাভাবিকভাবে, কলকাতার ঐ দাঙ্গার রেশ পর্যায়ক্রমে নােয়াখালী ও বিহারেও ছড়িয়ে পড়ে। শীঘ্রই তা ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে এবং ক্রমেই তা মারাত্মক গৃহযুদ্ধের আকার ধারণ করে। এর ফলে পাকিস্তান রাষ্ট্র বানানাের যে আন্দোলন তা আরও এক ধাপ এগিয়ে যায়। কারণ, মুসলিম, হিন্দু এবং ব্রিটিশ সরকার সবার কাছে মনে হতে লাগল, ভারতের এ সাম্প্রদায়িক অবস্থার একমাত্র সমাধানের উপায় হল দেশ ভাগ করা। চারদিকে এরূপ পরিস্থিতি আর তার সাথে পাকিস্তানের পক্ষে ক্রমাগত লীগের প্রচারণার ফলে ছােট ছােট মুসলিম দলগুলাে বুঝে গেল, তাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব রক্ষা করতে হলে আলাদা থাকা চলবে না। বাংলা এবং ভারত জুড়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা এরূপ ছােট দলগুলাে তাই দ্রুত মুসলিম লীগে এসে যােগ দিল।

– দুই –
১৯৪৬ সালের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এবং জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদের মুসলিম লীগে যােগদান করার পর সাবেক প্রধানমন্ত্রী ফজলুল হক বুঝতে পারলেন, পাকিস্তান দাবির আন্দোলনে যেভাবে জনমত গড়ে উঠেছে, তাতে লীগের বাইরে থাকলে নিজের জন্য তা কোন সুফল বয়ে আনবে না বরং তাতে রাজনীতির ময়দান থেকে তাঁর অবস্থান আস্তে আস্তে হারিয়ে যেতে পারে। এমনটি মনে করে রাজনৈতিক মূল স্রোতধারায় ফিরে আসতে তিনি ১৯৪৬ সালের ১ সেপ্টেম্বর তারিখে মুসলিম লীগে পুনরায় যােগদানের ইচ্ছে সকলের সামনে প্রকাশ করলেন। দুদিন পর তিনি এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিলেন এবং নিঃশর্তভাবে লীগে যােগদান এবং তাঁর প্রতি সকল নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য জিন্নাহকে চিঠি লিখে জানালেন।২৩ পরবর্তীতে বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের সুপারিশক্রমে জিন্নাহ মুসলিম লীগে হকের পুনরায় যােগদানের উপরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলেন এবং ৮ সেপ্টেম্বর সংবাদপত্রে তিনি একটি বিবৃতি প্রদান করলেন যে, হয়ত জনগণ হককে লীগের প্রতি তাঁর বিশ্বাসঘাতকতামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষমা করে দিবে। জিন্নাহর বিবৃতিটি ছিলঃ
১৩০
“১- ৩ সেপ্টেম্বর জনসম্মুখে ফজলুল হকের ঘােষণা এবং আমার কাছে লিখিতভাবে তার দেয়া লীগের প্রতি বিশ্বস্ততা ও ভক্তি রেখে নিঃশর্তে যােগদানের অঙ্গীকার ; এবং
৩ সেপ্টেম্বর চিঠির মাধ্যমে তাঁর লীগে যােগদানের উপর পাঁচ বছর পূর্বের দেয়া নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের অনুরােধসহ লীগের দায়ভার নিষ্ঠার সাথে পালনের প্রতিশ্রুতি ; এবং
মুসলিম লীগের কলকাতা জেলা দলের দ্বারা আমার কাছে প্রেরিত তাঁর পুনরায় লীগে যােগদান করার বিষয়ে বিশেষ সুপারিশ-এর পরিপ্রেক্ষিতে আমি তাঁর উপরকার নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নিলাম এবং
আশা করছি ফজলুল হক নিষ্ঠা, আন্তরিকতা এবং নিঃস্বার্থভাবে মুসলিম লীগ ও এর অঙ্গ সংগঠনসহ সকল সমমনা দলের পক্ষ হয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে কাজ করে যাবেন।”
মুসলিম লীগে ফজলুল হক পুনরায় যােগ দিয়ে দাঙ্গাকবলিত মুসলিমদের দুর্ভোগ লাঘবের লক্ষ্যে “অল বেঙ্গল রিলিফ এণ্ড ওয়েলফেয়ার সােসাইটি” প্রতিষ্ঠা করলেন।২৫ এভাবে তিনি পুনরায় মুসলিম জনগণের মনে জায়গা করে নিতে লাগলেন। এরপর ফজলুল হকের অনুসারীরা তাঁকে আবারও বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি বানানাের জন্য কাজে লেগে গেল – যে পদটি পাঁচ বছর ধরে খালি পড়েছিল। মাওলানা আকরম খাঁ অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে অবসর নেয়ার পর থেকে ঐ পদটি শূন্য ছিল। তখনকার বাংলার প্রধানমন্ত্রী এইচ, এস, সােহরাওয়াদী ফজলুল হকের এমন আগমন দেখে একটু চিন্তিত হয়ে পড়লেন। কারণ ফজলুল হককে যদি প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি করে দেয়া হয় তাহলে হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর রাজনৈতিক অবস্থা। সংকটাপন্ন হয়ে উঠবে। তিনি তখন প্রাদেশিক লীগের সেক্রেটারি আবুল হাসিমকে হকের সাথে প্রতিযােগিতা করতে উৎসাহ দিলেন। কিন্তু পরে যখন দেখা গেল, প্রতিযােগী হিসেবে আবুল হাসিম, ফজলুল হকের কাছে খুবই নগণ্য আর নির্বাচনে ফজলুল হক সহজেই হাসিমকে পরাজিত করে দিবেন ; তখনই আকরম খাঁ তাঁর ইস্তফা প্রত্যাহার করে নিলেন।২৬ এ আচরণ দেখে ফজলুল হক স্পষ্ট বুঝতে পারলেন, সােহরাওয়ার্দী এবং জিন্নাহর ঘনিষ্ঠ লােকজন তাকে পার্টির জন্য গুরুত্বপূর্ণ কোন কাজ ঠিকমত করতে দিবে না বা পার্টির পক্ষে কোন
১৩১
কার্যকর ভূমিকা রাখতে দিবে না। এভাবে হকের সাথে পূর্বের মতই তাদের তিক্ত সম্পর্ক থেকে গেল।
যাহােক, বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদটি না পাওয়ায় ফজলুল হক সিদ্ধান্ত নিলেন, তিনি লীগের মধ্যে থেকেই ঐ সকল নেতার বিরুদ্ধে লড়াই চালাবেন। তাই সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার জানান সমালােচনা করা শুরু করলেন। তিনি ঐ মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযােগ আনলেন এবং বাংলার এমন কঠিন পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার জন্য তাদের দোষারােপ করলেন। এরপর ফজলুল হক তৎকালীন বাকেরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার প্রত্যন্ত অঞ্চল সফর এবং ফিরে এসে ঐসব অঞ্চলের ভীতিকর খাদ্য পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রেসে বিবৃতি দিলেন। তিনি জানালেন, ঐ অঞ্চলের বেশ কিছু এলাকা তখন দুর্ভিক্ষের কবলে পড়েছিল আর সরকারি খাদ্য সরবরাহ দফতরসহ অন্যান্য সংস্থাগুলাের দুর্নীতি ও অদক্ষতার ফলে ঐসব এলাকার লােকজনদের অবস্থার আরও অবনতি হচ্ছিল।২৭ তিনি কলকাতার ট্রামওয়ে ধর্মঘট সমস্যা সমাধানে সরকারের ব্যর্থতাকেও দায়ী করেন। কেননা, এর ফলে জনগণকে অনেক অসুবিধার মধ্যে পড়তে হয়েছিল ।২৮
মুসলমানদের শিক্ষাব্যবস্থায় কোন দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ না করার জন্যও ঐ মন্ত্রিসভাকে ফজলুল হক সমালােচনা করলেন। ফজলুল হক প্রেসে বিবৃতি দিলেন, প্রধানমন্ত্রী যেন যুদ্ধপরবর্তী এ সময়ের জন্য শিক্ষা খাতে মােট বরাদ্দের এক-তৃতীয়াংশ অনুদান দেয়ার প্রতিশ্রুতি করেন।২৯ বাংলার মুসলমানদের উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করার লক্ষ্যে বাংলায় একটি মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিও তিনি জানালেন এবং চাইলেন যেন বাংলার প্রধানমন্ত্রী জমি অধিগ্রহণের আইনের অধীনে এজন্য অন্তত ২,০০০ বিঘা জমি অধিগ্রহণ করেন। তিনি উপরের দাবিগুলাে মেনে নেয়ার ক্ষেত্রে সতর্ক করলেন যে, যদি সেগুলাে না মানা হয় তাহলে তিনি “ডাইরেক্ট এ্যাকশান” কর্মসূচি দিবেন।

– তিন –
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, কলকাতার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা পূর্ববাংলার ননায়াখালীতে ছড়িয়ে পড়ে। ইহা দ্রুত পার্শ্ববর্তী জেলা ত্রিপুরায়ও বিস্তার লাভ
১৩২
করে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লোেক অধিক আক্রান্ত হওয়ায় ঐ জেলার হিন্দুরা আতংকিত হয়ে উঠল এবং অবস্থার আরও অবনতি হল যখন কোথাও কোথাও জোরপূর্বক ধর্মান্তরের কিছু ঘটনাও ঘটল।৩১ বিষয়টির গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাসে মহাত্মা গান্ধী ননায়াখালী ছুটে এলেন এবং তিনি সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার মিশনে নামলেন। গান্ধী বিভিন্ন জায়গায় সভাসমাবেশ করলেন এবং সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি সম্পর্কে মহানবী (স.)-এর হাদিস উদ্ধৃতি করলেন। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার ক্ষেত্রে তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টার ফলে আস্তে আস্তে অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এল। কিন্তু বাংলার মুসলিম লীগের অতি উৎসাহী নেতারা মহাত্মা গান্ধীর এ কাজে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ল। কেননা, তারা মনে করল, মহাত্মা গান্ধীর সংস্পর্শে আসাতে তারা বিপুল সংখ্যক জনগণ থেকে আলাদা হয়ে পড়বেন। তাই মুসলিমদের উপর প্রভাব বজায় রাখার জন্য তারা মুসলমানদের মনে ধর্মীয় চেতনা জাগ্রত করা শুরু করল এই বলে যে, মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার নামে ইসলামের নীতিগত বিষয়ে হস্তক্ষেপ করছেন, আর তাই নােয়াখালী থেকে তাকে চলে যাওয়ার জন্য দাবি উঠল ।৩২
প্রায় একই সময়ে ফজলুল হক দাঙ্গাপীড়িত এলাকা পরিদর্শনের জন্য ননায়াখালী ও ত্রিপুরা জেলায় সফর করেন এবং সেখানে অনেকগুলাে সভাসমাবেশে বক্তৃতা করেন। এমনই একটি সভা হয়েছিল কুমিল্লায় ১৯৪৭ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি, যেখানে তিনি ভাষণে বলেছিলেন, মহাত্মা গান্ধী সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষা করার পরিবর্তে তা আরও উস্কে দিচ্ছেন।৩৩
ফজলুল হক তাঁর ভাষণে মহাত্মা গান্ধীকে নােয়াখালীতে বসে সময় নষ্ট না করে দিল্লী গিয়ে ভারতের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার জন্য কথা বলতে বলেন।৩৪ ঐ একই সভায় তিনি নােয়াখালী ও ত্রিপুরার মুসলমানদের উপর পুলিশি নির্যাতনের জন্য সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার কড়া সমালােচনা করেন। এছাড়া বিধানসভার মুসলিম লীগ নেতা-মন্ত্রিদের দুর্নীতি, ঘুষ, স্বজনপ্রীতি ও দালালির জন্য তিনি তাদেরকে দোষারােপ করেন এবং সকলকে এ মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়ার জন্য আন্দোলন গড়ে তুলতে আহ্বান জানান।৩৫
১৩৩
অন্যান্য মুসলিম লীগ নেতাদের মত না হওয়ায় ফজলুল হক দ্রুতই অনুধাবন করতে পারলেন, মহাত্মা গান্ধীর সমালােচনা করে তিনি ভুল করেছেন এবং তাই তিনি মহাত্মা গান্ধীর সাথে অন্তরঙ্গভাবে আলাপ করার অনুমতি চেয়ে তাঁকে টেলিগ্রাম পাঠালেন। মহাত্মা গান্ধী সাদরে তা গ্রহণ করলেন এবং এ দু’ নেতা ২২ ফেব্রুয়ারি (১৯৪৭) হাইমচরে (নােয়াখালী জেলা) প্রায় এক ঘণ্টার মত একান্তে আলাপ করলেন। আলাপের পর ফজলুল হককে বেশ উচ্ছ্বসিত দেখাচ্ছিল। কিন্তু তিনি আলােচনার বিষয়ে প্রেসের সামনে তখনই কোন মন্তব্য করেননি।৩৬
১৭ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৭ তারিখে চাঁদপুরের এক বিশাল জনসভায় ফজলুল হক ভাষণ দিলেন। সােহরাওয়ার্দীর মন্ত্রিসভার কঠোর সমালােচনা করে তিনি বলেন, যতক্ষণ পর্যন্ত এ মন্ত্রিসভা পরিবর্তন করা হবে ততক্ষণ পর্যন্ত মুসলমান কোন ন্যায়বিচার পাবে না।৩৭ এছাড়াও তিনি ১৯৪৬ সালের হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গার সময় নােয়াখালী ও ত্রিপুরা জেলা থেকে গ্রেফতারকৃত মুসলমানদের জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং মুসলমানদের কাছে আবেদন করেন তারা যেন কলকাতার বিধানসভার মুসলিম লীগ নেতাদের এখানে এনে পুলিশের দেয়া ঐ মামলাগুলাের মীমাংসা করেন।৩৮ সবশেষে ফজলুল হক মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় দফতরকে পরামর্শ দেন যেন তারা তাদের ফাণ্ডের গচ্ছিত বিপুল অর্থের কিছু অংশ নােয়াখালী ও ত্রিপুরার দুর্গত লােকদের সাহায্যার্থে দান করেন।৩৯
মহাত্মা গান্ধীর সাথে আলােচনার পর ১৯৪৭ সালের ৪ মার্চ ফজলুল হক ময়মনসিংহে গেলেন। সেখানে স্থানীয় এক বার সমিতির সাথে অনাড়ম্বর আলােচনা অনুষ্ঠানে ফজলুল হক মহাত্মা গান্ধীর পূর্ববাংলার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি রক্ষার পদক্ষেপসমূহের ভূয়সী প্রশংসা করেন এবং তিনি আরও জানালেন, তাঁর ইচ্ছে রয়েছে, সুখী ও সমৃদ্ধিশালী বাংলা গড়ে তােলার জন্য তিনিও বাকি জীবন। হিন্দু-মুসলিম সকলের মাঝে অমিয় বাণী প্রচার করে যাবেন।৪০

– চার –
হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা অনবরত চলতে থাকায় এ দু সম্প্রদায়ের মধ্যে এমনই দূরত্ব তৈরি হয়েছিল যে তাদের মধ্যে পুনরায় সম্প্রতি প্রতিষ্ঠা হওয়ার বিষয়টি
১৩৪
ছিল প্রশ্নাতীত। ব্রিটিশ সরকার লক্ষ্য করল, পরিস্থিতি ক্রমেই নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। তারা তখন ব্রিটিশ ভারতের দায়-দায়িত্ব এদেশের নেতাদের হাতে সপে দিয়ে ভারতবর্ষ ছেড়ে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সরকার ঘােষণা করল, ১৯৪৮ সালের মধ্যে তারা ভারত ত্যাগ করে চলে যাবে। ব্রিটিশ সরকারের এ ঘােষণার পরপরই হিন্দু মহাসভা বাংলার বিভক্তি চাইল। সরদার প্যাটেলকে লেখা এক চিঠিতে হিন্দু সভার নেতা শ্যামা প্রসাদ লিখলেন, “বাংলার সীমানার মধ্য থেকে আমরা আলাদা দুটি প্রদেশ চাই – পাকিস্তান অথবা পাকিস্তান ছাড়া।”৪১ এন. সি. চ্যাটার্জী বাংলা প্রাদেশিক হিন্দু কনফারেন্সে ভাষণদানকালে বলেন, বাংলার হিন্দুদের নিয়ে একটি আলাদা প্রদেশ বানানাে উচিত যাতে একটি শক্তিশালী জাতীয় সরকার ব্যবস্থা থাকবে। দেশ বিভাজনের বিষয় নয় – এগুলাে হল হিন্দুদের বাঁচা-মরার লড়াই।৪২
এসব কার্যক্রমের পাশাপাশি সাম্প্রদায়িক দল হিন্দু মহাসভার নেতারা। সংবাদপত্রের মাধ্যমে বিবৃতি ছড়িয়ে দিয়ে তাদের আন্দোলনের জন্য আলাদা একটি অবস্থান বা ভিত্তি তৈরি করল। তাদের আন্দোলনের মাত্রা আস্তে আস্তে বৃদ্ধি পেতে লাগল এবং কংগ্রেসের নেতারা এতে বেশ উৎসাহ পেল।
এদিকে অল্প কিছু হিন্দু নেতা যারা অখণ্ড বাঙালি জাতীয়তাবােধে বিশ্বাস করত তারা বাংলার বিভাজনের বিপক্ষে অবস্থান নিল। এদের অন্যতম নেতাজি সুভাস বসুর ভাই শরৎ বােস এক বিবৃতিতে জানালেন, বাংলার বিভাজনের পক্ষে চেঁচামেচি করার মানে হল, “হেরে যাওয়া মানসিকতার ফল।”৪৩ কংগ্রেসের এক নেতা অখিল দত্ত বাংলা বিভাজনের বিপক্ষে আন্দোলন শুরু করেন। সরদার প্যাটেলের কাছে এক চিঠিতে তিনি লিখলেন, “বাংলার বিভাজন করা – রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক, ভাষাগত, সামাজিক – মৌলিক সব দিক দিয়েই ভুল হবে। পরাস্ত মানসিকতা থেকে এ চিন্তার উৎপত্তি এবং বাংলার সাম্প্রদায়িক সরকার ব্যবস্থা থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে করা ইহা একটি ভ্রান্ত ধারণা।”88 মহাত্মা গান্ধীকেও তিনি চিঠিতে লিখলেন, “বাংলাকে ভাগ করার জন্য আন্দোলন করে হিন্দুদের আলাদা থাকার ব্যবস্থা করা মানে এক ধরনের সাম্প্রদায়িকতা। সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে আন্দোলন চালানাে দরকার — এতে
১৩৫
কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু তা হিন্দুদের আলাদা রাষ্ট্র করার মত আরেকটি সাম্প্রদায়িক ব্যবস্থা দ্বারা নয়….. এতে সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান তাে হবেই না বরং তা আরও ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে চিরস্থায়ী হয়ে যাবে।”৪৫ তিনি আরও যুক্তি তুলে ধরেন ঃ
যদি এভাবে ভাগ করা হয় তবে অবস্থাসম্পন্ন হিন্দুরা অবশ্যই পশ্চিমবঙ্গে চলে আসবে আর নিম্নবর্ণের দরিদ্র হিন্দুরা তাদের জীবন, অর্থ ও মানসম্মান রক্ষার জন্য দলে দলে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করবে।৪৬
এদিকে অমৃতবাজার পত্রিকা একটি অনুসন্ধান জরিপের সিদ্ধান্ত নিল । কারণ হল, “সঠিক জনমত যাচাই করে বাংলার হিন্দুদের জন্য আলাদা মাতৃভূমি করার যুক্তির পক্ষে – বিপক্ষে কতজন রয়েছে তা নির্ণয় করা।৪৭
জরিপের ফলাফল প্রকাশ করা হলে দেখা গেল, ৯৮.৩ ভাগ লােক এ বিভাজনের পক্ষে আর মাত্র ০.৬ ভাগ লােক এর বিপক্ষে।৪৮ এর ফলে হিন্দু মহাসভার পক্ষ থেকে তােলা দেশ ভাগের আন্দোলন আরও বেগবান হয়ে উঠল।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে, মুসলিম লীগের দাবি ছিল ও সমগ্র বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্গত করতে হবে। কিন্তু ক্ষমতাধর হিন্দুদের দ্বারা যখন দাবি তােলা হল যে, বাংলা পাকিস্তানের মধ্যে যেতে পারে না, তখন সােহরাওয়ার্দী হিন্দুদের অনুরােধ করে এভাবে বােঝালেন, “অবিভক্ত বাংলা, বৃহত্তর বাংলা”।৪৯ কিন্তু সােহরাওয়ার্দীর এ ভাষণ তাদের বিশেষ করে হিন্দু নেতাদের মনে তেমন। কোন দাগ কাটল না। কারণ, তারা মনে করত সদ্য ঘটে যাওয়া কলকাতা হত্যাকাণ্ডের পেছনে যে প্রাথমিকভাবে সােহরাওয়ার্দীর হাত ছিল। আর হত্যাকাণ্ডটি এখনও তাদের মন থেকে মুছে যায়নি। শুধুমাত্র শরৎ বােস ও কিরণ শংকর রায় সােহরাওয়ার্দীর ঐ অনুরােধের পক্ষে সাড়া দিয়েছিলেন। শরৎ বােস এবং কিরণ শংকর রায় উভয়ে এ বিষয়ে মহাত্মা গান্ধীর কলকাতা সফরের সময় তাঁর সাথে আলাপ করেছিলেন। কিন্তু তাঁরা বেশিদূর এগুতে পারলেন না। কারণ, মুসলিম লীগ বা কংগ্রেস কেউই অখণ্ড স্বাধীন বাংলার পক্ষে রাজি ছিল না । ওদিকে হিন্দু মহাসভা বাংলা ভাগের জন্য তখনই আন্দোলন শুরু করে দিয়েছিল। বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মাওলানা আকরম খাঁ
১৩৬
পাকিস্তান ছাড়া অখণ্ড সার্বভৌম বাংলা প্রতিষ্ঠা করার ঘাের বিরােধিতা করলেন। সংবাদপত্রে দেয়া এক বিবৃতিতে তিনি বললেন, “আমি একদম একমত না যে, দেশ ভাগের বিরােধিতা করতে গেলে পাকিস্তান সীমানা থেকে বাংলাকে আলাদা হতে হবে।৫০ যেহেতু তাঁর মতে ভারতবর্ষের মুসলমানরা একটি একক জাতি কাজেই আলাদাভাবে হিন্দু-মুসলিম মিলিয়ে বাঙালি জাতি তৈরি করার ধারণাটিকে তিনি অগ্রহণযােগ্য বলে জানিয়ে দিলেন। তিনি বললেন, “হিন্দু ও মুসলমান মিলিয়ে যারা অখণ্ড একটি বাংলা গড়ার কথা বলেন, তারা আসলে আমাদের শত্রুদের হাতের পুতুল হয়ে খেলছে।”৫১ এছাড়া সােহরাওয়ার্দীর অবস্থান আরও দুর্বল হয়ে গেল যখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এম. এ. জিন্নাহ তার অখণ্ড স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব অগ্রাহ্য করলেন।
কংগ্রেসও “অবিভক্ত ও বৃহত্তর বাংলা” প্রস্তাবের বিশেষভাবে বিরােধিতা করল। আমেরিকার এসােসিয়েটেড প্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাকে আলাদা প্রদেশ করার প্রশ্নে কংগ্রেস নেতা সরদার প্যাটেল অভিমত জোরালােভাবে ব্যক্ত করলেন, “কোন দল বা এলাকা যদি থাকতে না চায় তাহলে কংগ্রেস তাতে জোর করবে না। পাশাপাশি কংগ্রেসও কোন দল বা সম্প্রদায়ের সাথে জোর করে একত্রে থাকবে না….. কাজেই মুসলিম লীগ যদি দেশ ভাগের পক্ষে লেগেই থাকে তাহলে কংগ্রেস তাদের উপর কোন জোর খাটাবে না, তবে এর ফলে বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্ত হয়ে যাবে। আজ বাংলা ও পাঞ্জাবের অবস্থা যা আছে তাতে যদি এগুলাে পাকিস্তানের অন্তর্গত হয় তবে ভবিষ্যৎ ঝামেলা বাঁধবেই। এতে অমুসলিমদের পাকিস্তানে অন্তর্ভুক্ত হতে বাধ্য করা হবে আর গৃহযুদ্ধ বেঁধে যাবে।”৫২ ১৯৪৭ সালের ১৩ মে প্যাটেল বাংলার একজন কংগ্রেস নেতাকে তাঁর মন্তব্য জানিয়ে লিখলেন, “সার্বভৌম স্বাধীন বাংলার জন্য যে কান্না তাহল একটি ফাদ, যে ফাঁদে শরৎ বাবুসহ কিরণ শংকর আঁটকে যাবেন।”৫৩ “বাংলার হিন্দুদের রক্ষা করার একমাত্র উপায় হল, বাংলাকে ভাগ করার পক্ষে জোর দেয়া এবং অন্য কোন দাবিতে কর্ণপাত না করা” – ইহাই ছিল কংগ্রেস নেতাকে লেখা প্যাটেলের শেষ পরামর্শ।৫৪ তিনি তাদেরকে আশ্বস্ত করলেন, “কংগ্রেসের কার্যকরী পরিষদ বাংলার অবস্থা সম্পর্কে
১৩৭
সজাগ আছেন …..অমুসলিমদের বেঁচে থাকতে হলে বাংলাকে বিভক্ত করতেই হবে।”৫৫
এসােসিয়েটেড প্রেসকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে কংগ্রেস নেতা রাজেন্দ্র প্রসাদ বললেন, “আমরা ইন্ডিয়াতে কোন বিভাজনই চাই না, যদি কি-না মুসলিম লীগ পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগে সম্মত না হয়।”৫৬ এভাবে মুসলিম লীগের বিরােধীপক্ষ কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার জন্য সার্বভৌম যুক্ত বাংলা আন্দোলনের ভাগ্যটি নিঃশেষ হয়ে গেল।
এরই মধ্যে ব্রিটিশ সরকার নিশ্চিত হল, ভারত বিভাজন তথা বাংলা এবং পাঞ্জাবের ভাগ হয়ে যাওয়াটিই হল তখনকার ভারতের উদ্ভূত সমস্যার একমাত্র কার্যকর সমাধান এবং তারা তখন তেমনটি করার জন্য চিন্তা-ভাবনা করতে লাগল। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন তাঁর সরকারের সিদ্ধান্ত ঘােষণা করলেন। তখন অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল ৯ জুন দিল্লী গিয়ে ব্রিটিশ সরকারের সিদ্ধান্ত, বাংলা এবং পাঞ্জাব ভাগ হওয়াসহ ক্ষমতার হস্তান্তর, সমঝােতাস্বরূপ মেনে নিলেন। কংগ্রেসও সিদ্ধান্তটি মেনে নিল।
এ. কে. ফজলুল হক বাংলাকে এভাবে ভাগ করার সিদ্ধান্তকে ধিক্কার জানালেন এবং গত দু বছর যাবত ভারতবর্ষের রাজনীতিতে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলাের তীব্র নিন্দা জানালেন। ১৯৪৭ সালের ২৬ জুলাই এক প্রেস ব্রিফিংএ তিনি বলেন, “অনেক কম সংখ্যক ভারতীয়তের মধ্যে আমিও একজন যে কিনা ভারতের রাজনীতিতে গত দু’ বছরে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলাের নিন্দা করছি এবং আমি জনগণকে জানাচ্ছি যে, দুর্ভাগ্যবশত যে বিভাজন এ প্রদেশে হল, তার প্রতিও আমি ধিক্কার জানাচ্ছি।”৫৭
কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগ উভয়েই দেশ বিভাজনের এ সিদ্ধান্তে সম্মত হওয়ায় পূর্ববাংলার হিন্দুদের মনে এমন আতংক তৈরি হল যে, তারা দলে দলে পশ্চিম বাংলায় পাড়ি জমাতে লাগল । বিষয়টি ফজলুল হকের কাছে খুব একটা সুবিধার মনে হল না। কারণ, তিনি মনে করলেন, এর ফলে পশ্চিম বাংলায় যে প্রভাব পড়বে তাতে করে বাংলায় আবার আরেকটি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেঁধে
১৩৮
যাবে । এ পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে ফজলুল হক দ্রুত তাঁর নিজ জেলা বরিশালে ছুটে গেলেন এবং সেখানকার হিন্দুদের মনে বিশ্বাস ফিরিয়ে আনতে ১৯৪৭ সালের ১ আগস্ট বরিশাল শহরের অশ্বিনী কুমার হলে বহু লােকের উপস্থিতিতে একটি জনসভা করলেন। জনসভার ভাষণে হিন্দু-মুসলমানরা যেন একে অপরের ভ্রাতৃঘাতি হয়ে না ওঠেন – সেজন্য তিনি তাদের উৎসাহ দিলেন। তিনি হিন্দুদের আতংকিত না হতে এবং তাদের মাতৃভূমি ছেড়ে চলে যেতে নিষেধ করলেন। হিন্দুদের সম্পূর্ণভাবে সুরক্ষিত রাখার আশ্বাস দিয়ে ফজলুল হক তাদের জানালেন, ভাই হিসেবে, একই মাটির সন্তান হিসেবে এবং একই চিন্তা-চেতনার ধারক হিসেবে প্রয়ােজনে তিনি তাঁর জীবন হিন্দুদের রক্ষার জন্য উৎসর্গ করবেন।৫৮
তাই ঐ মুহূর্তে, যখন বাংলা বিভাজন অবশ্যম্ভাবী, ফজলুল হক হিন্দু-মুসলিম সাম্যের বাণী প্রচার করে বাঙালি জাতিকে মহাদুর্যোগের হাত থেকে রক্ষা করেছিলেন।

তথ্যসূত্র ঃ
১. ১৯৪৬ সালের এপ্রিলের শুরুর দিকে দিল্লীতে মুসলিম লীগের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্যদের নিয়ে জিন্নাহ একটি সম্মেলন করলেন। সেখানে জিন্নাহর নির্দেশে সােহরাওয়ার্দী লাহাের রেজুলেশনে উল্লেখিত “রাষ্ট্রসমূহ” শব্দটি বদল করে “রাষ্ট্র” বানিয়ে তা প্রস্তাব আকারে পেশ করলেন এবং তখন সকল সদস্য এক পাকিস্তান রাষ্ট্রের দাবিতে কণ্ঠ মেলালেন। রেজুলেশনে পরিষ্কার বলা হল ঃ “এলাকাগুলােতে উত্তর-পূর্ব ভারতে থাকবে বাংলা ও আসাম আর উত্তর-পশ্চিম ভারতে থাকবে পাঞ্জাব, সীমান্তবর্তী প্রদেশ, সিন্ধু ও বেলুচিস্তান। এ অঞ্চলগুলাে পাকিস্তানের এলাকা হিসেবে পরিগণিত হবে। কারণ, এগুলাে মুসলিম অধ্যুষিত ; তাই পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে, কালবিলম্ব না করে, এগুলােকে স্বাধীন-সার্বভৌম হিসেবে গড়ে তােলার জন্য দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রতিশ্রুতি দিতে হবে।” দেখুন ঃ “জানুয়ারি ১৯৪৪ থেকে ডিসেম্বর ১৯৪৬ পর্যন্ত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের রেজুলেশন” (দিল্লী), পৃষ্ঠা ৪৫ – ৪৭। বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি আবুল হাসিম অভিযােগ করলেন, ইহা মূলত লীগের সংসদীয় সদস্যদের দ্বারা পরিবর্তিত হওয়া লাহাের প্রস্তাব যা লীগ ১৯৪০ সাল থেকে দাবি করে আসছে ; কিন্তু সংসদীয় দল দ্বারা সম্মেলন করে তা পরিবর্তন করার সাংগঠনিক কোন এখতিয়ার নেই। তখন জিন্নাহ রুলিং দিলেন, ইহা হল, ছাপার ভুল। কারণ, “স্টেট” লিখতে গিয়ে “স্টেটস” ছাপা হয়েছে। এভাবেই বিষয়টি নিয়ে তৈরি হওয়া বিতর্কের অবসান ঘটানাে হল । দেখুন ও আবুল হাসিম, “ইন রিট্রোস্পেকশন” (ঢাকা, ১৯৪৭), পৃষ্ঠা ১০৯ – ১১০। আরও জানতে দেখুন ঃ অমলেন্দু
১৩৯
দে, “পাকিস্তান প্রস্তাব ও ফজলুল হক” (কলকাতা, ১৯৭২), পৃষ্ঠা ৬২ – ৬৬; এম. এ রহিম, “মুসলিম সােসাইটি এন্ড পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ১৭৫৭ – ১৯৪৭” (ঢাকা, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ২৯৯ – ৩০১; শীলা সেন, “মুসলিম পলিটিক্স ইনি বেঙ্গল ১৯৩৭ -৪৭” (দিল্লী, ১৯৭৬), পৃষ্ঠা ২০৪ – ২০৮।
২. পেন্ডেরাল মুন, “ডিভাইড এন্ড কুইট” (লন্ডন, ১৯৬১) পৃষ্ঠা ৪৮।
৩. ঐ। পৃষ্ঠা ৫২।
৪. ঐ। পৃষ্ঠা ৫১। আরও দেখুন ঃ হেক্টর বলিথাে, “জিন্নাহ দি ক্রিয়েটর অব পাকিস্তান” (লন্ডন, ১৯৫৪), পৃষ্ঠা ১৬০।
৫. মুন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫২।
৬. ঐ। পৃষ্ঠা ৫৩; আরও দেখুন ঃ বলিথাে, এন – ৪, পৃষ্ঠা ১৬২।
৭. রিচার্ড সায়মন্ডস, “দি মেকিং অব পাকিস্তান” (লন্ডন, ১৯৫১), সংস্করণ ৩, পৃষ্ঠা ৬৯।
৮. পেন্ডেরাল মুন, “গান্ধী এন্ড মডার্ন ইন্ডিয়া” (লন্ডন, ১৯৬৮), পৃষ্ঠা ২৪৫ – ৪৬।
৯. মুন, প্রাগুক্ত ২, পৃষ্ঠা ৫৬।
১০. বলিথাে, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা – ১৬৪।
১১. এ. কে. আজাদ, “ইন্ডিয়া উইনস ফ্রিডম” (দিল্লী, ১৯৫৯), পৃষ্ঠা ১৫৫।
১২. মুন, প্রাগুক্ত, পৃষ্ঠা ৫৭।
১৩. ১৯৪৬ সালের ২৯ জুলাই বােম্বেতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সভায় পাস হওয়া দ্বিতীয় রেজুলেশন । মাধ্যম : “রেজুলেশনস অব দি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ ফ্রম ১৯৪৪ টু ১৯৪৬” (দিল্লী, এনডি), পৃষ্ঠা ৬৫ – ৬৬।
১৪. ১৯৪৬ সালের ৩১ জুলাই বােম্বেতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের সভায় গৃহীত প্রস্তাব।
১৫. ১৯৪৬ সালের আগস্ট মাসে “ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে”-এর কর্মসূচিতে কলকাতা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি এস, এম, ওসমান কর্তৃক জিহাদের আমন্ত্রণ জানিয়ে প্রচারিত লিফলেট। সূত্র : “লেট পাকিস্তান স্পিকস ফর হারসেল্ফ” – মিনিস্ট্রি অব ইনফরমেশন এণ্ড ব্রড কাস্টিং, গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া (নিউ দিল্লী, ১৯৪৭), পৃষ্ঠা ৬।
১৬. কলকাতা মুসলিম লীগের সেক্রেটারি এস, এম, ওসমান কর্তৃক প্রচারিত ছােট পুস্তিকার উর্দু থেকে ইংরেজি অনুবাদ (কলকাতা, ১৯৪৬), “মডার্ন রিভিউ” সেপ্টেম্বর ১৯৪৬, পৃষ্ঠা ১৭০।
১৭. আইনসভার হিন্দু সদস্যদের বিরােধিতা সত্ত্বেও সােহরাওয়ার্দী এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। মুসলিম সদস্যরাও পরবর্তীতে এর সমালােচনা করেন। ১৯৮০ সালের ৯ – ১৪ জুন এ লেখকের সাথে মােঃ ওয়ালীল্লাহ, মােঃ নাসিরউদ্দিন এবং কামরুদ্দিন আহমেদের সাক্ষাৎকার।
১৮. তারাচঁাদ-এর বইয়ে উল্লেখিত, “হিস্টরি অব ফ্রিডম মুভমেন্ট ইন ইন্ডিয়া” (দিল্লী, ১৯৭২), ভলিউম ৪, পৃষ্ঠা ২৮৩।
১৪০
১৯. ১৯৪৬ সালের ২০ সেপ্টেম্বর অধিবেশনে সােহরাওয়ার্দীর অনাস্থা প্রস্তাব কংগ্রেস দ্বারা উত্থাপিত হয়। মাধ্যম : “ইন্ডিয়ান এনুয়াল রেজিস্টার, ১৯৪৬, ভলিউম ২, জুলাই – ডিসেম্বর, পৃষ্ঠা ১৮৯।
২০. ঐ।
২১. সম্পাদকের কাছে মুরের আরেকটি প্রশ্ন, “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ২৭ আগস্ট ১৯৪৬, ডি. জি ডালটনের উক্তি, “গান্ধী ডিউরিং পার্টিশান : এ কেইস স্টাডি ইন দি ন্যাচার অব সত্যগ্রহ”, সি. এইচ. ফিলিপস সংস্করণ, “পার্টিশান অব ইন্ডিয়া ও পলিটিক্স এন্ড পারসপেকটিভ ১৯৩৭ – ৪৭” (লন্ডন, ১৯৭০), পৃষ্ঠা ২২৯।
২২. দূর্গা দাস (সম্পাদিত) “সরদার প্যাটেলস করেসপনডেন্স ১৯৪৫ – ১৯৫০” (আহমেদাবাদ, ১৯৭২), ভলিউম ৩, পৃষ্ঠা ১৬৮।
২৩. এ. এস. এম. আবদুর রব, “এ. কে. ফজলুল হক ও লাইফ এন্ড এচিভমেন্টস” (লাহাের, ১৯৬৬), পৃষ্ঠা ১৫৮। আরও দেখুন ঃ আবুল হাসিম, “ইন রিট্রোস্পেকশন” (ঢাকা, ১৯৭৪), পৃষ্ঠা ১২৭।
২৪. ১৯৪৬ সালের ৮ সেপ্টেম্বর তারিখে প্রেসে দেয়া এম. এ. জিন্নাহর বিবৃতি। “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ৯ সেপ্টেম্বর, ১৯৪৬।
২৫. “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ১১ নভেম্বর ১৯৪৬।
২৬. রব, এন – ২৩, পৃষ্ঠা ১৫৮ – ১৫৯। আরও দেখুন ঃ কামরুদ্দিন আহমেদ, “এ স্যোশাল হিস্টরী অব বেঙ্গল” (ঢাকা, ১৯৭০), সংস্করণ ৩, পৃষ্ঠা ৭৬।
২৭. ১৯৪৭ সালের ২৩ মার্চ প্রেসে দেয়া এ. কে. ফজলুল হকের বিবৃতি। মাধ্যম : “হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড” (কলকাতা), ২৪ মার্চ ১৯৪৭।
২৮. একই স্থানে।
২৯. ১৯৪৭ সালের ৫ জানুয়ারি প্রেসে দেয়া এ. কে. ফজলুল হকের বিবৃতি । মাধ্যম : “হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড” (কলকাতা), ৬ জানুয়ারি ১৯৪৭।
৩০. একই স্থানে।
৩১. ১৯৪৭ সালের ৪ মার্চ পুলিশের ডিআইজি, বাকেরগঞ্জ রেঞ্জ নং ১১০ সিসি – ই, এইচ, লে, ব্রোয়েক-এর দ্বারা প্রেরিত পত্র। সূত্র : বাংলার সরকারের গােপন নথি ৪৭/৪৭ এবং ৪৯/৪৭ – যা বাংলাদেশ সচিবালয়ের রেকর্ডরুমে সংরক্ষিত।
৩২. “হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড” (কলকাতা), ৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭।
৩৩. ঐ ১৪ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭।
৩৩. ঐ।
৩৪. ঐ।
৩৫. ঐ
৩৬. ঐ ২৮ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৭।
৩৭. ঐন।
৩৮. ঐ ।
৩৯. ঐ
১৪১
৪০. ঐ । ৫ মার্চ ১৯৪৭।
৪১. ১৯৪৭ সালের ১১ মে, সরদার প্যাটেলকে শ্যামা প্রসাদ মুখার্জী । সূত্র : দূর্গা দাস, পৃষ্ঠা ৪০।
৪২. “অমৃতবাজার পত্রিকা” (কলকাতা), ৫ এপ্রিল ১৯৪৭।
৪৩. প্রাগুক্ত। ১৬ এপ্রিল ১৯৪৭।
৪৪. ১৯৪৭ সালের ১৩ মে, সরদার প্যাটেলকে পাঠানাে অখিল দত্তের টেলিগ্রাম। সূত্র – দূর্গা দাস, ভলিউম ৪, পৃষ্ঠা ৩০।
৪৫. ইউ, এন, প্যারেলাল, “মহাত্মা গান্ধী ও দি লাস্ট ফেইজ” (আহমেদাবাদ, ১৯৫৮), ভলিউম ২, পৃষ্ঠা ১৭৮।
৪৬. ঐ।
৪৭ . “অমৃতবাজার পত্রিকা” (কলকাতা), ২৩ মার্চ ১৯৪৭।
৪৮. ঐ। ২৩ এপ্রিল ১৯৪৭।
৪৯. “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ১০ এপ্রিল ১৯৪৭। “অবিভক্ত বাংলা এবং বৃহত্তর বাংলা” এর যাত্রার বিস্তারিত আলােচনা জানতে দেখুন এম. এ. রহমান ঃ “দি মুসলিম সােসাইটি এন্ড পলিটিক্স ইন বেঙ্গল ১৭৫৭ – ১৯৪৭” (ঢাকা, ১৯৭৮), পৃষ্ঠা ৩৩১ -৩৩৯।
৫০.“স্টার অব ইন্ডিয়া” (কলকাতা), ৪ মে ১৯৪৭; “আজাদ” (কলকাতা) ৫ মে ১৯৪৭।
৫১. “আজাদ” (কলকাতা), ৫ মে ১৯৪৭।
৫২. “দি হিন্দু” (মাদ্রাজ), ১১ মে ১৯৪৭।
৫৩. কে, সি, নিয়ােগীকে সরদার প্যাটেল, তারিখ ১৩ মে ১৯৪৭। মাধ্যম : দূর্গা দাস, এন ২২, পৃষ্ঠা ৩৯।
৫৪. ঐ।
৫৫. বি, কে, রায়কে সরদার প্যাটেল, তারিখ ২৩ মে ১৯৪৭। মাধ্যম : একই স্থানে, পৃষ্ঠা ৪৫।
৫৬. “দি হিন্দু” (মাদ্রাজ), ২১ মে ১৯৪৭।
৫৭. “হিন্দুস্থান স্টান্ডার্ড” (কলকাতা), ২৭ জুলাই ১৯৪৭।
৫৮. ঐ। ৩ আগস্ট ১৯৪৭।
১৪২

নবম অধ্যায়
সংক্ষিপ্ত-সারক

এ. কে. ফজলুল হক ১৯০৬ সালে ঢাকায় যে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠিত – সেখানে একজন তরুণ নেতা হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। অল্প কিছুদিন পর তিনি পূর্ববাংলা ও আসাম প্রদেশের সিভিল সার্ভিসে ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে যােগদান করেন।
অচিরেই তিনি শিগগিরই পল্লী কো-অপারেটিভ সােসাইটির সহকারী রেজিস্ট্রার পদে পদোন্নতি লাভ করেন। ১৯১৩ সালে যখন পদোন্নতি অতিক্রম করলেন তখন ফজলুল হক সরকারি চাকরি ছেড়ে দিয়ে আবারও ওকালতি পেশায় ফিরে আসেন এবং পুরােপুরি রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করেন।
১৯১৩ সালে এ. কে. ফজলুল হকের রাজনীতি সক্রিয়ভাবে শুরু হয় যখন তিনি ঢাকা বিভাগের একটি আসন থেকে বাংলার আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। তখন পর্যন্ত বাংলার মুসলিম সম্প্রদায়ের নেতৃত্বে ছিলেন অভিজাতশ্রেণির মুসলিম নেতৃবৃন্দ যারা গতানুগতিক ব্রিটিশ-রাজভক্ত ছিলেন। ১৯১১ থেকে ১৯২৪ সালের মধ্যে ভারত এবং সারাবিশ্বে এমন কিছু ঘটনা ঘটেছিল যাতে করে ব্রিটিশ এবং অভিজাতশ্রেণির মুসলিম নেতাদের বিপক্ষে বাংলায় মৌলবাদী মুসলিম অনুভূতির জাগরণ ঘটেছিল। ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ বাতিল হওয়াটি ছিল বাংলার মুসলমানদের জন্য হতাশাজনক ও একটি বড় আঘাত ; কারণ, ১৯০৫ সালে বাংলা ও আসাম ভাগ হওয়ার পর মধ্যম শ্রেণির মুসলিমগণ শিক্ষা, রাজনীতি ও চাকরির ক্ষেত্রে হিন্দুদের কাছে নিজেদের হারিয়ে যাওয়া অবস্থানকে আরও সুদৃঢ় করার একটি সুযােগ পেয়েছিল। এসব মূলধারার বাঙালি মুসলমানগণ, অভিজাতশ্রেণির মুসলিম নেতাদের থেকে অনেক সুবিধা পাওয়ার পরও, ব্রিটিশসহ তাদের প্রতি নিজেদের আস্থা ধরে রাখতে পারল না। পরিবর্তে তারা, ঐ সকল রাজভক্ত মুসলিমদের প্রতি বিরূপ মনােভাব পােষণ করল এবং ব্রিটিশদের
১৪৩
বিপক্ষে সাম্প্রদায়িকতার জন্য হিন্দুদের সাথে একাত্ম হয়ে তাল মেলাল। ১৯১৩ সালে কলকাতায় যখন বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা হল তখন কম বয়সী এই সকল মৌলবাদী মুসলিম তাতে বেশ সুখ্যাতি অর্জন করল। অভিজাতশ্রেণির মুসলিম নেতাদের ধারায় না গিয়ে, ফজলুল হক নিজেকে তাদের মত করলেন এবং সকল মধ্যম শ্রেণির মুসলিমদের অনেক ঘনিষ্ঠ হয়ে তিনি রাজনৈতিক মতাদর্শ এবং কার্যক্রমে তাদের সহায়ক হলেন। মুসলিম লীগের এ অংশের নেতৃত্ব তখন ফজলুল হক নিজেই দিতে লাগলেন। ১৯১৩ সালে আইনসভায় প্রথম বক্তৃতায় ফজলুল হক নিজেকে একভিন্ন স্বাধীন সত্তার নেতা হিসেবে পরিচয় দিলেন এবং মুসলিম জনতার পক্ষে কাজ করা ও সরকারের অন্যায় আচরণের প্রতিবাদ করায় তার এমন সুখ্যাতি তৈরি হয়েছে বলে তিনি জানালেন। তার এ বক্তৃতার মধ্য দিয়ে গতানুগতিক ধারার মুসলিম রাজনীতির অবসান হয়েছিল যার কার্যক্রমের মধ্যে শুধুমাত্র ছিল সাম্প্রদায়িকতা ও ব্রিটিশ তােষামােদী। ফজলুল হক এভাবেই মুসলিম জনগণের কাছে প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলেন। তিনি ১৯১৩ সালে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন এবং ঐ পদটিতে তিনি ১৯১৬ সাল পর্যন্ত বহাল ছিলেন। ঐ সময় তিনি ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসেও যােগ দেন এবং ভারতবর্ষকে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে কাছাকাছি আনার চেষ্টা করেন।
এদিকে, সমগ্র ভারতের ক্ষেত্রে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের অবস্থানও পরিবর্তিত হল। ১৯১২ সালের ডিসেম্বরে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় দলের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য পরিবর্তন করে একটি নতুন বিধানের খসড়া তৈরি করা হল যা পরবর্তীতে ১৯১৩ সালের মার্চে লক্ষ্ণৌ সেশনে গ্রহণ করা হয়। লক্ষৌ প্যাক্টে দু দলের সহযােগিতামূলক কর্মকাণ্ড এগিয়ে নেয়ার আশা ব্যক্ত করা হয় এবং তা পরবর্তীতে ১৯১৬ সালে কার্যকরী হয়। প্যাক্টে সংবিধান সংশােধনকল্পে লীগ – কংগ্রেস যৌথ কর্মপন্থা তুলে ধরে, অধিক মুসলিম প্রতিনিধিত্বের আলাদা প্রাদেশিক নির্বাচনী ব্যবস্থা করার অনুমােদন করা হয় যেখানে মুসলিমগণ সংখ্যায় কম। অনুরূপভাবে এর পরিবর্তে, পাঞ্জাব ও বাংলার হিন্দুরা যারা সংখ্যায় কম তারা তাদের প্রদেশের জনসংখ্যার দিক দিয়ে অনেক বেশি প্রতিনিধি রাখবেন। ফজলুল হক এ প্যাক্টের প্রধান প্রবক্তা ছিলেন এবং তিনি নিজে এতে স্বাক্ষর দিয়েছিলেন।
যদিও লক্ষৌ প্যাক্টে হিন্দু ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক সহযােগিতার একটি সূত্রপাত তৈরি হয়েছিল, তবুও এর ফলে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগের পদগুলােতে একটু চিড় ধরেছিল এবং এর ফলে ফজলুল হকের নেতৃত্ব অনেকাংশে ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গিয়েছিল। বাংলার “রক্ষণশীল – অনুগত” লীগের নেতারা ইহাকে অবমূল্যায়ন
১৪৪
করলেন এবং “১৯১১ সালের পুনরেকত্রিকরণের মত ধোঁকাবাজি” হিসেবে মূল্যায়ন করলেন।
বেঙ্গল প্রেসিডেন্সী মুসলিম লীগের সভাপতি নওয়াব সৈয়দ আলী চৌধুরীর নেতৃত্বে সমমনা এমন অনেকেই তখন প্রতিবাদস্বরূপ ঐ দল থেকে ইস্তফা দেন এবং মৃতপ্রায় সেন্ট্রাল ন্যাশনাল মােহামেডান এসােসিয়েশন দলটি পুনরুজ্জীবিত করেন শুধুমাত্র তাদের প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড়ানাের জন্য। এমনকি তারা বাঙালি মুসলিমদের পক্ষে মুসলিম লীগের কথা বলার অধিকারও নেই বলে মন্তব্য করতে থাকলেন। বিদ্রোহীদের এমন প্রতিবাদের মধ্যেও, হিন্দু-মুসলিম ঐক্য দ্বারা ভারতকে স্বরাজ সরকার দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ফজলুল হক তার অনুসারিদের সাথে নিয়ে কংগ্রেসের সাথে একত্রে কাজ করতে লাগলেন।
হিন্দু-মুসলিম একত্রিত করার পেছনে ফজলুল হকের নিরলস প্রচেষ্টা মুসলিম লীগ এবং কংগ্রেসের মধ্যে এতই জনপ্রিয়তা পায় যে তিনি ১৯১৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট এবং ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সেক্রেটারি নির্বাচিত হয়েছিলেন। ঐ বছরেই তিনি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের বার্ষিক সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সভাপতির ভাষণে তিনি ইন্ডিয়ায় স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠায় হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করেন। এ সময় তিনি তুর্কির পরিণাম এবং যুদ্ধ-পরবর্তী সকল মুসলিমজাহানের শান্তি আলােচনার উপর আলােকপাত করেন।
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের দিল্লী অধিবেশন থেকে খেলাফত আন্দোলন চালু হয়। এবং তা ভারতের সকল ধারার মুসলমানদের একত্রিত করে। ফজলুল হক খেলাফত আন্দোলনেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ১৯১৯ সালে দিল্লীতে অনুষ্ঠিত অল ইন্ডিয়া খেলাফত কনফারেন্সের প্রথম উন্মুক্ত অধিবেশনে তিনি সভাপতিত্ব করেন। মহাত্মা । গান্ধীর নেতৃত্বাধীন কংগ্রেস যখন খেলাফতের দাবিগুলাের সমর্থনে ব্রিটিশদের প্রতি অসহযােগ প্রকাশ করল এবং ভারতে স্বরাজ প্রতিষ্ঠার দাবি জানাল তখন খেলাফত আন্দোলনটি আরও চরম রূপ ধারণ করল। খেলাফত ও অসহযােগ একত্রে শুরু হওয়ায় ভারতে হিন্দু-মুসলিম একত্রিত হয়ে ব্রিটিশ বিরােধী মঞ্চে এসে দাঁড়াল। অসহযােগ আন্দোলনের দাবিগুলাের মধ্যে সবটুকু মেনে কাজ করার প্রশ্নে নেতাদের মধ্যে দ্বিমত থাকায় ফজলুল হক কংগ্রেসের সাথে বিতর্কে জড়ালেন । হক সাহের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাে বর্জন করতে চাইলেন না ; কারণ, তিনি মনে করলেন যদি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্জন করা হয় তাহলে পিছিয়ে পড়া নিরক্ষর মুসলিম জনগােষ্ঠীর অনেক ক্ষতি হবে। তিনি তাই ১৯২০ সালে কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করলেন। ১৯২২ সালে মহাত্মা
১৪৫
গান্ধী যখন অসহযােগ আন্দোলন তুলে নিলেন তখন খেলাফত আন্দোলনও বেশ দুর্বল হয়ে পড়ে। ১৯২৪ সালে খেলাফত আন্দোলন সম্পূর্ণ ভেঙ্গে পড়ে যখন পুনরুত্থানশীল তুর্কি জনগণের নেতা কামাল আতাতুর্ক নিজে খেলাফত ব্যবস্থাকে বাতিল করে তাঁর দেশকে গণপ্রজাতন্ত্রী রাষ্ট্র হিসেবে ঘােষণা দিলেন।
খেলাফতের দিনগুলাের ঘটনা মুসলিম রাজনীতিকে নতুন এক আদর্শ ও পরিচয় দান করল। খেলাফতের হঠাৎ পতন এমন এক শূন্যতা তৈরি করেছিল যা সহজে পূরণ করার মত নয়। এ অবস্থায়, যে খেলাফতের চাপে মুসলিম লীগ কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল তা পুনরুজ্জীবন লাভ করতে লাগল। লীগের নেতারা আদর্শগতভাবে দু’টি ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ল, একদল রক্ষণশীল – রাজভক্ত, যাদের নেতৃত্বে ছিলেন। পাঞ্জাবের স্যার মঈন মােহাম্মদ শাফী এবং অন্যদল জাতীয়তাবাদী যাদের নেতা ছিলেন এম. এ. জিন্নাহ। ১৯২৮ সালের সায়মন কমিশন গ্রহণের প্রশ্নে এই দু’ দলের যখন মতবিরােধ দেখা দেয় মূলত তখনই এ দু’ দলের বিবাদ চরমে পৌছায়। লীগের এ অন্তর্কলহ অনেক বছর চলল এবং এর ফলে প্রাদেশিক সংগঠনগুলােতে এর বিরূপ প্রভাব পড়ল। বাংলাতে ১৯২৮ সালের দিকে অনেক নেতাই মুসলিম লীগের উপর আগ্রহ হারিয়ে ফেললেন। তারা অনেক ছােট ছােট দলে ভাগ হয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক মর্যাদা তৈরি করতে লাগল। এ দলগুলাে হল, দি বেঙ্গল মুসলিম পার্টি, দি সেন্ট্রাল মুসলিম কাউন্সিল পার্টি এবং দি ইনডিপেনডেন্ট মুসলিম পার্টি। মুসলিম রাজনীতির ক্ষেত্রে এ প্রবণতা তৈরি হওয়ায় ফজলুল হক মােটেও সন্তুষ্ট ছিলেন না। লীগের সাথে স্বল্প পরিসরে যােগাযােগ রক্ষা করে তিনি বাংলার কৃষকদের স্বার্থ রক্ষার্থে তাদের সংগঠিত করার কাজে সরাসরি নেমে পড়লেন। কাউন্সিলে কৃষক শ্রেণির চাহিদা তুলে ধরার লক্ষ্যে ফজলুল হক ১৯২৯ সালে “বেঙ্গল কাউন্সিল প্রজা পার্টি” প্রতিষ্ঠা করলেন। একই বছর প্রাদেশিক প্রজাদের নিয়ে বৃহৎ আকারের একটি দল, আবদুর রহিমকে সভাপতি করে গঠন করা হল যার নাম “নিখিল বাংলা প্রজা সমিতি”। এ দলের পাঁচজন ভাইস-প্রেসিডেন্টের মধ্যে ফজলুল হকও ছিলেন। তিনি পরে ১৯৩৪ সালে এই দলের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছিলেন। ১৯৩৬ সালে “নিখিল বাংলা প্রজা সমিতি” নাম বদল করে “কৃষক-প্রজা পার্টি” নামে ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন বড় একটি সুশৃঙ্খল রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে যাদের মূল লক্ষ্য ছিল কৃষক এবং জনগণের চাওয়া-পাওয়াকে উর্ধ্বে তুলে ধরা।
১৯৩৫ সালের ভারতশাসন আইনে ভােটাধিকার প্রয়ােগের মাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় ও বিপুল সংখ্যক প্রজা এতে অংশগ্রহণ করার সুযােগ পাওয়ায় অভিজাত মুসলিম শ্রেণির নেতারা বেশ ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেল ; কারণ, প্রজাদের ভােটের উপরই ঐ সকল
১৪৬
নেতাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব নির্ভরশীল ছিল। এদিকে প্রজাদের দাবি-দাওয়া ছিল ঐ সকল অভিজাত নেতাদের চাহিদার সম্পূর্ণ বিপরীত। প্রজাদের এরূপ মানসিকতার জন্যই কৃষক-প্রজা পার্টির অবস্থান বেশ সুদৃঢ় হয়। এ অবস্থায় অভিজাতশ্রেণির নেতারা চাইলেন ফজলুল হক ও তার দলের বিরুদ্ধে একত্র হয়ে কাজ করতে। ফলস্বরূপ তারা ১৯৩৬ সালে “ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি” প্রতিষ্ঠা করলেন। অবশ্য কৃষক-প্রজা পার্টির প্রচুর জনপ্রিয়তা, বিশেষ করে গ্রামের লােকদের কাছে দলটি অধিক প্রিয় হওয়ায় ঐ সকল অভিজাতশ্রেণির নেতারা বুঝে গেলেন যে আসন্ন নির্বাচনে তাদের ভবিষ্যৎ বেশ অন্ধকার। তাই তারা কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে ঐক্য গড়তে চেষ্টা করলেন যদিও পরে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। এমন অবস্থা দেখে এম, এ. জিন্নাহ, যিনি মুসলিম লীগের দায়িত্বে ছিলেন, বাংলার সকল মুসলিম রাজনৈতিক দলকে মুসলিম লীগের সংসদীয় বাের্ডের অধীনে একত্র করতে চাইলেন। জিন্নাহর সাথে বিভিন্ন সময়ে আলাপ করে লীগের শর্তাদি মেনে ইউনাইটেড মুসলিম পার্টি লীগের সাথে ঐক্য করতে সম্মত হল। কিন্তু ফজলুল হকের কৃষক-প্রজা পার্টি কোনভাবেই মুসলিম লীগের সাথে এক হল না ; কারণ, জিন্নাহ তাদের জরিমানা ছাড়া জমিদারী প্রথা বিলােপ এবং আলাদাভাবে নির্বাচন করার দাবির পক্ষে একমত ছিলেন না। অবশেষে কৃষক-প্রজা পার্টি তাদের নিজস্ব ব্যানারে এককভাবে নির্বাচনের ঘােষণা দেয় এবং এতে করে ফজলুল হক ও মুসলিম লীগের মধ্যে প্রত্যক্ষ দ্বন্দ্বের সূত্রপাত ঘটে।
নির্বাচনের প্রাক্কালে মুসলিম লীগ এবং কৃষক-প্রজা পার্টি উভয়েই মুসলিম আসনের জন্য একে অপরকে টেক্কা দিয়ে নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে লাগল । নির্বাচনী প্রচারণায়, মুসলিম লীগ তাদের নিজস্ব পত্রিকা “দৈনিক আজাদ” এবং “স্টার অব ইন্ডিয়া” দ্বারা ফজলুল হককে ব্যক্তিগত আক্রমণ করে তাঁর বিরুদ্ধে মরণপণ প্রচারণায় লেগে গেল। এছাড়া তারা মৌলভী এবং মােল্লাদের দলে ভিড়িয়ে ফজলুল হক এবং কৃষক-প্রজা পার্টির বিরুদ্ধে বিষােদগার করা শুরু করে দিল। ফজলুল হকের বিরুদ্ধে লীগ যেভাবে অপপ্রচার চালাতে লাগল তাতে মনে হচ্ছিল যেন লড়াইটা হক এবং মুসলিম লীগের মধ্যেই হচ্ছে। যাহােক, মুসলিম লীগের এমন বিরােধী ভূমিকা সত্ত্বেও ফজলুল হকের নেতৃত্বাধীন কৃষক-প্রজা পার্টি ৩৬টি আসন পেয়ে ১৯৩৭ সালের নির্বাচনে চিত্তাকর্ষক বিজয় লাভ করল। মুসলিম লীগের প্রাপ্ত আসন ছিল ৩৯টি। নির্বাচনের ফলাফলের একটি আকর্ষণীয় দিক হল, যদিও মুসলিম লীগ আসন বেশি পেয়েছিল তবুও তারা মাত্র ২৭.১০ ভাগ মুসলিম ভােট পেয়েছিল, আর অন্যদিকে কৃষক-প্রজা পার্টি মুসলিম ভােট পেয়েছিল ৩১.৫১ ভাগ। এভাবে কৃষক-প্রজা পার্টি বাংলায় একটি শক্তিশালী
১৪৭
রাজনৈতিক দল হিসেবে আবির্ভূত হল। ফজলুল হক আবারও তার জনপ্রিয়তার স্বাক্ষর রাখলেন যখন তিনি দুটি আসনের দুটিতেই জয়যুক্ত হলেন এবং একটিতে তার শক্ত প্রতিপক্ষ মুসলিম লীগের রক্ষণশীল নেতা খাজা নাজিমুদ্দিনকে বিপুল ভােটের ব্যবধানে পরাজিত করলেন।
১৯৩৭ সালের নির্বাচনে বাংলার আইন পরিষদে কোন দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেল না। তাই জোট গঠন দরকার। ফজলুল হক কংগ্রেসের সাথে প্রথমে জোট গঠনের পদক্ষেপ নিলেন কিন্তু কেন্দ্রীয় কংগ্রেস নেতাদের সিদ্ধান্তহীনতা এবং বাংলার কংগ্রেস নেতাদের একরােখা আচরণের জন্য তা ব্যর্থ হল। এম. এ. জিন্নাহ তখন সময়ােপযােগী একটি সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি ফজলুল হককে মুসলিম লীগের সহযােগিতা প্রদানসহ তাকে প্রদেশের প্রধান করার প্রস্তাব দিলেন। অবস্থা এমন হল যে, ঐ প্রস্তাব গ্রহণ করা ছাড়া ফজলুল হকের সামনে আর কোন পথ খােলা ছিল না। এভাবে বাংলার মুসলিম লীগ ও কৃষক-প্রজা পার্টির জোট মন্ত্রিসভা গঠিত হল যেখানে উভয় দল থেকে তিনজন করে সমসংখ্যক সদস্য ছিল। কিন্তু মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ার প্রাক্কালে মুসলিম লীগের নওয়াব মােশাররফ হােসেনকে রেখে কৃষক-প্রজা পার্টির শামসুদ্দিন আহমদকে সরিয়ে দেয়া হল ; সম্ভবত গভর্নর মন্ত্রিসভায় শামসুদ্দিনকে রাখতে রাজি ছিলেন না। এর ফলে কৃষক-প্রজা পার্টিতে অনৈক্য দেখা দিল। পরবর্তীতে প্রজা পার্টি থেকে একটি গ্রুপ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়ে স্বাধীন প্রজা পার্টি” নামীয় অন্য আরেকটি দলে পরিণত হয় এবং আইনসভায় বিরােধীদলের ভূমিকা পালন করতে থাকে। কংগ্রেসসহ এ নবগঠিত বিরােধীদলের কারণে ফজলুল হকের অবস্থা এমনই সংকটাপন্ন হল যে তিনি বাধ্য হয়ে মন্ত্রিসভা গঠনের ছয় মাসের মধ্যে মুসলিম লীগে যােগদান করেন। শিগগিরই তিনি বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট মনােনীত হন। মুসলিম লীগে যােগ দেয়ার পরও হক কৃষক-প্রজা পার্টির সাথে সম্পর্ক রাখলেন এবং দলের প্রেসিডেন্ট পদ ধরে রাখলেন। এর ফলে কৃষক-প্রজা পার্টির সদস্য ও অনুসারিদের মধ্যে তাদের প্রকৃত অবস্থান নিয়ে বেশ সমস্যা তৈরি হল ; যারা কৃষক-প্রজা পার্টির প্রধান অংশ হিসেবে, ফজলুল হকের লীগে যােগদানের পরও তার। সাথে থেকে গিয়েছিল, তারা লীগের হয়ে যাবতীয় কাজ করতে লাগল । আর যারা হককে ছেড়ে চলে গিয়েছিল, তারা কংগ্রেসের হয়েই যেন কাজ করতে লাগল। এভাবেই কৃষক-প্রজা পার্টির অস্তিত্ব বিলীন হতে শুরু করল, যদিও বাংলার রাজনৈতিক মঞ্চে এ দলটি অনেক সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল। দুর্ভাগ্যবশত এ দলের প্রতিষ্ঠাতা ফজলুল হক নিজেই দলটি ভাঙ্গনের সূত্রপাত করেছিলেন।
১৪৮
প্রজা-লীগ জোট মন্ত্রিসভা বাংলায় মুসলমানদের ভাগ্যের উন্নয়নের জন্য অনেক ভাল কাজ করেছিল। মুসলিম লীগ যেহেতু ঐ মন্ত্রিসভার মধ্যে একটু প্রভাবশালী তাই মন্ত্রিসভার গৃহীত সব ভাল কাজের সুনাম তাদের দিকে এগিয়ে যেতে লাগল। বাংলার মন্ত্রিসভা আর মুসলিম লীগ তখন সবার কাছে একই রকম মনে হতে লাগল। এ অবস্থা দেখে এম. এ. জিন্নাহ খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজে নামলেন ; তিনি বাইরে বাইরে ফজলুল হকের সাথে সখ্যতা গড়ে তুললেন এবং বাংলায় ফজলুল হকের জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে তার মাধ্যমে ১৯৪০ সালে “লাহাের রেজুলেশন” জনগণের সামনে উত্থাপন করলেন – যা পরবর্তীতে “পাকিস্তান রেজুলেশন” হিসেবে পরিচিতি পায়। ফজলুল হককে কাজে লাগিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য জিন্নাহর যে এমন দুরভিসন্ধি ছিল তা ফজলুল হক তখন ধরতে পারেননি।
মুসলিম লীগের সাথে হকের জোট সরকার গঠন এবং পরবর্তীতে লীগে বাধ্য হয়ে তাঁকে যােগদান করতে হয়েছিল ; বিষয়টি এমন না যে লীগে যােগদানের ফলে তাঁর দ্বারা নিপীড়িত জনগণের কোন সেবা করা হবে না ; মূলত দলটিতে যােগ দিয়ে তিনি আরও ভাল কাজ করে যেতে পেরেছিলেন। তিনি যথেষ্ট উদার মনের মানুষ ছিলেন এবং বিশ্বাস করতেন, কষ্টে থাকা বাংলার জনগণের ভাগ্য ফেরাতে হলে বাংলার প্রথম সারির সমমনা নেতাদের একত্র করেই সে লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু মুসলিম লীগের দ্বারা গৃহীত ১৯৩৭ সালের কিছু কর্মসূচি এবং সেগুলাের প্রতি হিন্দুদের প্রতিক্রিয়ায় সমগ্র বাংলায় সাম্প্রদায়িক অবস্থা তখন বেশ জটিল হয়ে পড়েছিল। তাই, যদিও ফজলুল হক “লাহাের প্রস্তাব” সম্পর্কে জনগণকে জানিয়েছিলেন তবুও হিন্দুমুসলিম ঐক্য গঠনের প্রচেষ্টা তিনি অব্যাহত রাখলেন। ১৯৪০ সালে কলকাতার হলওয়েল মনুমেন্টটি সকল হিন্দু ও মুসলমান ছাত্র একত্র হয়ে যখন সরানাের জন্য আন্দোলনে নামল তখন তাতে হক সম্মতি দিয়েছিলেন ; যদিও তিনি ভাল করেই বুঝতে পেরেছিলেন, এর ফলে লীগ এবং ইউরােপীয় নেতাদের তােপের মুখে তিনি পড়তে পারতেন। এছাড়াও তিনি মুসলিম লীগের বিরােধিতা সত্ত্বেও বাংলার সমস্যাদি সম্পর্কে গভর্নরকে সকল দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে বৈঠকে বসার অনুরােধ জানালেন। অনেক বছর ধরে সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের জন্য প্রচেষ্টা চালিয়ে যাওয়া এম. এ. জিন্নাহর কাছে এ বিষয়টি খুবই অগ্রহণযােগ্য ছিল আর তাই পরবর্তী দিনগুলাের জন্য ফজলুল হক ও জিন্নাহর সম্পর্ক আরও অবনতির দিকে অগ্রসর হতে লাগল।
১৯৪১ সালে ভাইসরয়ের ওয়ার কাউন্সিলে যােগদানের প্রশ্নে হক এবং জিন্নাহর সম্পর্ক খুবই চরম আকার ধারণ করল। এ বিষয়টিতে তাদের দ্বন্দ্ব এমনই প্রকাশ্য হয়ে
১৪৯
উঠল যে, এর ফলে প্রজা-লীগ জোট সরকারের পতন হল এবং ফজলুল হককে লীগ থেকে বহিষ্কার করা হল। হক তখন আইন পরিষদে “প্রগ্রেসিভ কোয়ালিশন পার্টি” গঠনের মধ্য দিয়ে তার পূর্বের পদ ফিরে পেল। এ জোটের মধ্যে শরিক দলগুলাে হল, কৃষক-প্রজা পার্টি, কংগ্রেস (সুভাষ চন্দ্র বােসের অনুসারী) এবং হিন্দু মহাসভা। এ জোটের আগমনে মুসলিম লীগ একটু দমে গেল। এভাবে ফজলুল হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার মেয়াদকাল ২৮ নভেম্বর ১৯৪৩ পর্যন্ত স্থায়ী রইল। তবে এ সময়টিতে মুসলিম লীগের নেতারা সারা বাংলা ঘুরে ঘুরে ফজলুল হকের বিরুদ্ধে বাংলার মুসলমানদের মনে বিরূপ ধারণা তৈরি করতে লাগলেন। তারা ফজলুল হককে দোষারােপ করলেন যে, তিনি হিন্দু মহাসভার সাথে হাত মিলিয়ে বাংলার প্রথম মুসলিম মন্ত্রিসভার পতন ঘটিয়েছেন এবং মুসলমানদের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। নিজের এবং দলের বিরুদ্ধে মুসলিম লীগের এমন অপপ্রচার থামাতে ফজলুল হকও তখন বেশ কিছু পদক্ষেপ নিলেন। তিনি মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য “প্রগ্রেসিভ মুসলিম পার্টি” নামীয় একটি দল প্রতিষ্ঠা করলেন যদিও তা তেমন সফল হল না। এছাড়া তিনি মুসলিম লীগের “একক মুসলিম আদর্শ”-এর বিপরীতে “হিন্দু-মুসলিম সম্মিলিত আদর্শ”-এর বিষয়ে সকলের কাছে বাণী প্রচার করা শুরু করলেন। অবশ্য তার এ কর্মকাণ্ড বাংলার বৃহত্তর মুসলিম জনগােষ্ঠীর কাছে তেমন সাড়া তৈরি করতে পারল না। এর কারণ হল, ১৯৩৭ – ৪১ সালের মুসলিম মন্ত্রিসভা মুসলমানদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট অনেক ভাল কাজ করেছিল। তাছাড়া ঐ মন্ত্রিসভা এমন কিছু সমস্যা রেখে গিয়েছিল যেগুলাের সমাধান ফজলুল হক ঠিকমত করতে পারেননি। আইনসভায় প্রশ্নোত্তরকালে এ সমস্যাগুলাে তুলে ধরে মুসলিম লীগ সংসদীয় দল এবং ইউরােপীয় দল ফজলুল হকের মন্ত্রিসভাকে বেশ অবমূল্যায়ন করে। হকের সাথে কংগ্রেস যুক্ত থাকায় গভর্নর নিজেও যখন মন্ত্রিসভার উপর ক্ষুব্ধ হলেন তখন ফজলুল হকের অবস্থা আরও বেগতিক হয়ে উঠল। ব্রিটিশ কূটনীতিকগণও হককে কোন সহযােগিতা করল না। উপরােক্ত এসব কারণে বাংলায় হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভারও পতন ঘটল।
হকের দ্বিতীয় মন্ত্রিসভার পতনের পর খাজা নাজিমুদ্দিনের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করল এবং তা ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এ সময়টিতে সকল বিরােধীদলের একক নেতা হিসেবে ফজলুল হক মুসলিম লীগ সরকারের সমালােচনা করে যেতে থাকলেন। অবশ্য সে সময়ে মুসলিম লীগ বড় একটি গণতান্ত্রিক দল হিসেবে নিজেদের চিহ্নিত করতে সক্ষম হয়েছিল এবং প্রদেশের জনগণের মধ্যে
১৫০
“পাকিস্তান রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পক্ষে মনােভাব তৈরি করতে সক্ষম হয়েছিল। লীগের এ সফলতার পেছনে অবদান ছিল আবুল হাসিমের যিনি এইচ, এস, সােহরাওয়ার্দীর পরে ১৯৪৩ সালে বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সেক্রেটারি হয়েছিলেন। প্রগতিশীল চিন্তাধারার বাহক আবুল হাসিম গতানুগতিক ধারার মুসলিম লীগ নেতাদের মত ছিলেন না; তিনি গ্রাম-গঞ্জে গিয়ে লীগের মাঠপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের সাথে যােগাযােগ করেন এবং গণতান্ত্রিক ধারার দল হিসেবে বাংলায় লীগকে সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। তাঁর দক্ষ নেতৃত্বে মুগ্ধ হয়ে মুসলিম যুবক, ছাত্র এবং বুদ্ধিজীবিগণ দলে দলে লীগের পতাকাতলে সমবেত হতে থাকে। লীগের প্রতি এবং পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের দাবির প্রতি তারা পূর্ণমাত্রায় সমর্থন দিতে লাগল। কারণ, তাদের আশা ছিল যদি বাংলা ও আসাম আলাদা সার্বভৌম অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পায় তাহলে সেখানকার পিছিয়ে পড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনতার ভাগ্যের উন্নতি ঘটবে। এর সাথে উলেমাদের ঐ সকল বিষয়ের প্রতি সমর্থন যুক্ত হওয়ায় বাংলায় মুসলিম লীগের মর্যাদা আরও সমুন্নত হয়ে উঠল, বিশেষ করে পল্লী এলাকায়। ফলে ১৯৪৫ ও ১৯৪৬ সালে পর্যায়ক্রমে কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইন পরিষদের নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিশাল ব্যবধানে জয়লাভ করে।
কেন্দ্রীয় আইন পরিষদের মুসলিম লীগ বাংলার ৬টি মুসলিম আসনের বিপরীত ৬টিতেই জয়লাভ করে এবং বাংলার প্রাদেশিক আইন পরিষদে ২৫০টি আসনের মধ্যকার ১১৯টি মুসলিম আসনের বিপরীতে ১১৩টি আসনে জয়লাভ করে। এ নির্বাচনগুলােতে মুসলিম লীগের প্রধান বিরােধী পক্ষ ছিল ফজলুল হকের জাতীয়তাবাদী মুসলিম অনুসারিগণ, যদিও তারা নির্বাচনী ফলাফলে মুসলিম লীগের কাছে কোন প্রতিদ্বন্ধি গড়ে তুলতে পারেনি। অবশ্য ফজলুল হক যে দুটি আসনে লড়াই করেছিলেন তার দু’টিতেই তিনি জয়লাভ করেছিলেন কিন্তু তাঁর কিছু নামকরা অনুসারী ছিলেন যারা তাদের লীগের প্রতিপক্ষের কাছে বিপুল ভােটে পরাজয়বরণ করেছিলেন। এ ফলাফল দ্বারা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, বাংলায় লীগ-বিহীন কোন মুসলিম নেতা দ্বারা ভবিষ্যতে প্রদেশের রাজনৈতিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।
১৯৪৬ সালে বাংলা প্রাদেশিক নির্বাচনের পর এইচ. এস. সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে লীগ পুনরায় বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠন করে – যা ১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্ত হওয়ার সময় পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। স্বল্পকালীন এ মন্ত্রিসভা চরম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার পুনরুত্থানের সাক্ষী হয়ে রয়েছে। মন্ত্রী-মিশনের ব্যর্থতার পর পাকিস্তানের দাবিতে মুসলিম লীগ যখন
১৫১
“ডাইরেক্ট এ্যাকশান ডে” কর্মসূচির ডাক দেয় তখনই কলকাতায় এ দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। এর পরপরই পর্যায়ক্রমে নােয়াখালী এবং বিহারে দাঙ্গা শুরু হয়। সমগ্র ভারতে দ্রুত এ দাঙ্গা বিস্তার লাভ করে এবং সারাদেশ গৃহযুদ্ধের কাছাকাছি চলে যায়। এ ঘটনায় মুসলিম এবং হিন্দুদের মধ্যে এমন একটি দূরত্ব তৈরি হয় যাতে করে ভারত ভাগসহ বাংলা ও পাঞ্জাব প্রদেশ ভাগ করা অপরিহার্য হয়ে পড়ে। এ অবস্থায় পাকিস্তানের পক্ষে মুসলিম লীগ এমন প্রচারণা চালাতে শুরু করল যে, তাতে করে জাতীয়তাবাদী মুসলিম নেতাদের রাজনৈতিক অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা দুরূহ হয়ে পড়ল। বাংলাসহ ভারতের অন্যান্য এলাকা থেকে তারা দলে দলে মুসলিম লীগে যােগদান করতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। এ সময় ফজলুল হকও মুসলিম লীগে যােগ দিলেন । তিনি মনে করলেন, এ সময় মুসলিম লীগের বাইরে থাকা তার জন্য ভাল হবে না এবং বাইরে থাকলে তাঁর রাজনৈতিক জীবন শেষ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এছাড়া ফজলুল হক হয়ত ভেবেছিলেন, বিপুল জনপ্রিয়তার কারণে মুসলিম লীগে থেকে কাজ করলে বাংলার মুসলমানদের কাছে তার নিজস্ব অবস্থান আরও সুদৃঢ় হবে। বাংলা প্রাদেশিক মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট পদ থেকে যখন মওলানা আকরম খাঁ পদত্যাগ করলেন তখন হকের অনুসারীরা ঐ পদে ফজলুল হককে বসানাের জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেল। ওদিকে লীগের নেতারা যখন বুঝতে পারল, আবুল হাসিমের চেয়ে হকের প্রেসিডেন্ট পদে বসার সম্ভাবনা বেশি তখনই তারা মাওলানা আকরম খাঁকে ইস্তফা বাতিল করে তাতে পুনরায় আসীন হতে অনুরােধ করল এবং এতে করে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতির পদে হক আর অধিষ্ঠিত হতে পারলেন না। প্রগতিবিমুখ এ সকল মুসলিম লীগ নেতাদের এরূপ আচরণে হক পরিষ্কার বুঝতে পারলেন, এ সকল নেতা তাকে সুষ্ঠুভাবে দলের জন্য কোন কাজ করতে দিবে না। তাই বাংলায় লীগের নেতাদের সাথে তার বৈরিতা পূর্বের ন্যায় বহাল রইল। লীগে যুক্ত থাকা অবস্থায় তিনি তখন লীগের মন্ত্রিসভার বিরােধিতা এবং তাদের কার্যক্রমের সমালােচনা করতে থাকলেন। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে যখন মুসলিম লীগ সাম্প্রদায়িক বিভাজনে ব্যস্ত তখনও হক নিজ উদ্যোগে হিন্দু-মুসলিম একত্র করার প্রত্যয়ে তার প্রচারণা অব্যাহত রাখলেন যেন বাঙালী জাতি রক্ষা পায়। সাম্প্রদায়িকতার ঐ যুগে, নানাবিধ প্রতিকূলতার মধ্যেও হক তাঁর জাতীয়তাবাদী বাংলার মশাল জ্বালিয়ে এগুতে লাগলেন, যা পরবর্তীতে পূর্ববাংলার রাজনীতিকে এক বিশেষ দিক নির্দেশনা প্রদান করেছিল।
১৫২

পরিশিষ্ট

পরিশিষ্ট এক
কৃষক-প্রজা পার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রম

লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য
১. মুসলমানদের যথাযথ এবং কার্যকরী সুরক্ষা প্রদানের লক্ষ্যে ভারতে সম্পূর্ণ দায়িত্বশীল সরকার ব্যবস্থা এবং এ লক্ষ্যকে সামনে রেখে বর্তমানের প্রাদেশিক বিধান পরিবর্তন এবং সম্পূর্ণ গণতান্ত্রিক স্বায়ত্তশাসন ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রস্তাবিত কেন্দ্রীয় সংবিধান পরিবর্তনে কাজ করা।
২. ভারতের মুসলমানদের রাজনৈতিক, ধর্মীয় এবং অন্যান্য দাবি ও অধিকার সুরক্ষা ও সমুন্নত রাখা।
৩. ভারতের সকল সম্প্রদায় এবং মুসলমানদের মধ্যে বন্ধুত্ব ও একতাপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তােলার লক্ষ্যে কাজ করা।
৪. ভারতের মুসলমানদের সাথে অন্যান্য দেশের মুসলমানদের মধ্যে ভ্রাতৃত্ব ও সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখা ও তা শক্তিশালী করা।
৫. বর্তমান প্রচলিত জমিদারী প্রথার (স্থায়ী প্রথা), যা বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর স্বার্থের জন্য ক্ষতিকর, তা বৈধ এবং সাংবিধানিকভাবে সম্পূর্ণভাবে বিলুপ্ত করা।
১৫৩
কার্যক্রম
১. মুসলমানদের ধর্মীয় অধিকার সংরক্ষণ করা। ধর্মীয় সকল আচার-আচরণ পালনে জামাত-উল-উলেমা এবং মুজতাহিদদের মতামতের গুরুত্ব দেয়া।
২. দমনমূলক আইন যেমন বেঙ্গল ক্রিমিন্যাল ল’ এমেণ্ডমেন্ট এ্যাক্ট, দি পাবলিক সিকিউরিটি এ্যাক্ট ইত্যাদি রহিতকরণে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালান।
৩. বাংলা এবং ইন্ডিয়ার ক্ষতির কারণ হয় এমন পদক্ষেপসমূহ, যেগুলাে দ্বারা জনগণের মৌলিক চাহিদা খর্ব হয় এবং দেশের অর্থনীতি বিনষ্ট হয়, সেগুলাে থামানাের চেষ্টা করা।
৪. প্রদেশের প্রশাসনিক শাসনযন্ত্রের ব্যয়ভার কমানাে এবং জাতি গঠনে কার্যকর বিভাগ তৈরির জন্য অর্থ বরাদ্দ করা।
৫. কুটির শিল্পের উন্নয়নসহ শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ প্রদান এবং এ লক্ষ্যে –
ক. পাটের সর্বনিম্ন মূল্য নির্ধারণ করা
খ. প্রাদেশিক পর্যায়ে বিক্রয়-বিপণন সংস্থা গড়ে তুলে তার মাধ্যমে পণ্য বিক্রয় করা।
গ. ইন্ডিয়ার সরকারের সকল কাজে ইন্ডিয়ার পণ্য ব্যবহার করা।
ঘ. মাঝারি এবং বৃহত্তর শিল্প গড়ে তােলার লক্ষ্যে সরকারিভাবে ঋণ প্রদানের ব্যবস্থা করা।
৬. দেশের অর্থনৈতিক উন্নতি সাধনে মুদ্রা, বিনিময় এবং মূল্য নির্ধারণ পদ্ধতি নিয়ন্ত্রণ করা।
৭. গ্রামের জনগােষ্ঠীর সামাজিক, শিক্ষাগত এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নে তাদের পাশে দাঁড়ান ; যেমন, রাষ্ট্রীয়ভাবে জনগণের সুযােগ-সুবিধা ও সামাজিক সেবা প্রদান ও তা নিয়ন্ত্রণ করা।
৮. কৃষি ঋণ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার লক্ষ্যে প্রয়ােজনে অর্থ সংগ্রহের ব্যবস্থা করা।
৯. প্রজাদের প্রতি কোন ধরনের কর আরােপ ছাড়াই তাদের জন্য বিনাবেতনে ও বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা চালু করা।
১০. দেশী ভাষা সুরক্ষিত রেখে উর্দু ভাষা এবং বই রক্ষা করা ও তা বৃদ্ধি করা।
১১. মুসলমানদের সার্বিক অবস্থার উন্নয়নে বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করা, বিশেষ করে বাংলার মুসলমানদের উন্নতি বিধান করা।
১৫৪
১২. সকলের উপর থেকে বিশেষ করে গরীবদের উপরে চাপানাে করের বােঝা লাঘবের জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৩. সারাদেশের জনগণের সুষ্ঠু ধ্যান-ধারণা ও রাজনৈতিক সচেতনতা তৈরির জন্য কাজ করা।
১৪. ভূমি কর্ষণকারিদের ঐ ভূমির মালিকানা প্রদানসহ সকল কৃষিজীবির স্বার্থে বেঙ্গল টেন্যান্সি এ্যাক্টের আমূল সংস্কার করা, যাতে আরও থাকবেঃ
ক. প্রাক-সম্মতি অধিকারে জমিদারের “নজর” ও “সেলামী” প্রথার উচ্ছেদ।
খ, অতিরিক্ত ফি ছাড়াই প্রজাদের নামজারির অধিকার।
গ. খাজনার হার কমান।
১৫. জমিদার, ঋণদাতা এবং তাদের প্রতিনিধিদের বলপূর্বক অতিরিক্ত অর্থ আদায় বন্ধে উপযুক্ত এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৬. পাটের উপর আরােপিত সরকারের যাবতীয় করসমূহ পুনঃমূল্যায়ন করা এবং কৃষি ও পল্লী পয়ঃনিষ্কাশনের উন্নতিতে ব্যয় বৃদ্ধি করা।
১৭. কৃষি ও গবাদিপশুর উন্নয়নে পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
১৮. গ্রামে পর্যাপ্ত পানি সরবরাহের ব্যবস্থা করা।
১৯. মৃত এবং প্রায়-মৃত নদীসমূহের সংস্কার করা।
২০. চাকরিতে মুসলিম এবং সিডিউল কাস্টের পর্যাপ্ত প্রতিনিধিত্বকারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা – যাতে করে সকল সম্প্রদায়ের মানুষের প্রতি ন্যায়বিচার করা হয়।
২১. বেকারত্ব সমস্যা সমাধানে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা।
২২. শ্রমিকদের সর্বনিম্ন মজুরী নির্ধারণসহ পয়ঃনিষ্কাশন ও সুন্দর থাকার ব্যবস্থা করার মাধ্যমে তাদের সার্বিক অবস্থার উন্নতি সাধন করা।

উৎসঃ “অমৃতবাজার পত্রিকা” (কলকাতা)। ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৩৬।
১৫৫

পরিশিষ্ট দুই
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারী লিয়াকত আলী খানকে প্রেরিত ফজলুল হকের পত্র
তারিখ ও ৮ সেপ্টেম্বর ১৯৪১

“জুলাই মাসের শুরুর দিকে গভর্নরের মাধ্যমে ভাইসরয় তার ইচ্ছার কথা আমাকে জানিয়েছিলেন, বাংলার প্রধান হিসেবে আমি যেন প্রস্তাবিত “ওয়ার কাউন্সিলে” যােগদান করে এ প্রদেশের পক্ষ থেকে তার প্রতিনিধিত্ব করি। আমি তা গ্রহণ করি। কারণ, আমার মনে হয়েছিল, ইহা করা আমার কর্তব্য। আমি বুঝতে পেরেছিলাম, এখানকার প্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকায় তারা আমাকেই বেছে নিয়েছেন, আর সে কারণে ডিফেন্স কাউন্সিলের একজন সদস্য হতে আমার পক্ষ থেকে কোনরূপ আপত্তি তােলার প্রশ্নই ওঠে না। আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, কাউন্সিলের কর্মকর্তাদের নাম ঘােষণার সময়, লীগের প্রেসিডেন্ট আমিসহ লীগের কিছু নেতাদের নিয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছেন – যাতে কিনা প্রেসিডেন্ট ঠিক বুঝে উঠতে পারছেন না যে আমাদের উপর তিনি কোন ধরনের শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। আমি একবার বিবৃতি দিয়ে আমার অবস্থান পরিষ্কার করেছিলাম এই বলে যে, যেহেতু এখানকার প্রধান হিসেবে আমি দায়িত্ব পালন করছি তাই মহামান্য ভাইসরয় দ্বারা আমার উপর দেয়া ঐ দায়িত্বকে আমি কোনভাবেই অবহেলা করতে পারি না।
আমি ভেবেছিলাম হয়ত তিনি আমার অবস্থা বুঝতে পেরে বিষয়টি তখনই থামিয়ে দিবেন, কিন্তু আমি খুবই ব্যথিত হলাম যখন দেখলাম যে, প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও তিনি অসার বিবৃতি প্রদানপূর্বক মুসলিম জনগণের চিন্তাধারাকে ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করেছেন এবং এর ফলে সকলের পক্ষ থেকে দাবি ওঠে আমরা যেন ডিফেন্স কাউন্সিল সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ করি। আমি মনে করেছিলাম, পুরাে বিষয়টি কিছু মুসলিম ব্যক্তি ও মুসলিম পত্রিকা দ্বারা সৃষ্ট এক ধরনের ভুল বােঝাবুঝি যা নির্দিষ্ট সময় পরে ঠিক হয়ে যাবে । কিন্তু আমি বিস্মিত হলাম, যখন দেখলাম ৩০ জুলাই হায়দ্রাবাদের লীগ সভাপতি একটি বিবৃতি দিয়েছেন যে, লীগ নাকি আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা। গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন। সেখানে ভাষার কোন অস্পষ্টতা ছিল না এবং যে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছিল তাতে বিষয়টি পরিষ্কার ছিল।
১৫৬
“আমি মনে করি, প্রেসিডেন্টের এমন কর্মকান্ড সর্বোচ্চ মাত্রার অসাংবিধানিক । যাহােক, মাদ্রাজ রেজুলেশনে অভিযুক্ত সদস্যদের প্রতি ব্যবস্থা গ্রহণের যে ক্ষমতা তিনি পেয়েছেন, তাতে অন্তত আমাদের নিজেদের পক্ষের যুক্তিগুলাে না শুনে তার এমনটি করা ঠিক হয়নি। নিজের পক্ষে যুক্তি উপস্থাপন করার সুযােগ দেয়া হল একটি সাংবিধানিক অধিকার, বিশেষ পরিস্থিতি ছাড়া যে অধিকার সবার জন্য প্রযােজ্য ; যদিও এ ঘটনাটি বিশেষ পরিস্থিতির পর্যায়ে পড়ে না।
“আমি ইহাও মনে করি, পরবর্তীতে ওয়ার্কিং কমিটিতে তা পাঠানাের সিদ্ধান্তটি ছিল অর্থহীন। আমাকে যেমনটি দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছিল, ওয়ার্কিং কমিটিও তাই করল। প্রেসিডেন্ট যে ব্যবস্থা নিয়েছিলেন, ওয়ার্কিং কমিটিকেও তাই অনুমােদন করতে হল ; কারণ, তাদের সামনে বিকল্প কোন পথ খােলা ছিল না। প্রেসিডেন্টের দ্বারা গৃহীত ব্যবস্থাকে যদি তারা সংশােধন করত তাহলে তা প্রেসিডেন্টের উপর অনাস্থা আনার ভােটাভুটির পর্যায়ে চলে যেত ; এ ধরনের ঝামেলা তৈরি হােক ওয়ার্কিং কমিটি তা তখন চায়নি। এ কারণে ওয়ার্কিং কমিটি ঐ প্রস্তাবের অনুমােদন দেয়, যার একটি কপি আপনি আমাকে পাঠিয়ে বিনাশর্তে ন্যাশনাল ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করতে বলেন।
আরও কিছু বলার আগে আমি আপনাকে না জানিয়ে পারছি না, প্রথম থেকে এ বিষয়টি নিয়ে প্রেসিডেন্ট আমার সাথে কেমন ব্যবহার করেছেন। জানা গিয়েছে, ২১ জুলাই বােম্বেতে, গভর্নরের মাধ্যমে ভাইসরয় ঐ বিষয়ে প্রেসিডেন্টকে জানিয়েছিলেন, প্রধানগণ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষমতাপ্রাপ্ত হয়ে ডিফেন্স কাউন্সিলের কাজ করবেন। প্রাদেশিক প্রধান হিসেবে বা প্রতিনিধি হিসেবে, যেভাবেই চিঠিতে লেখা হােক না কেন, এ বিষয়টি পরিষ্কার যে, আমাদেরকে যে ডিফেন্স কাউন্সিলের জন্য বাছাই করা হয়েছে প্রেসিডেন্ট তা নাম ঘােষণার অন্তত একদিন আগে হলেও জানতে পেরেছিলেন। তাঁর তখন দায়িত্ব ছিল আমাদেরকে টেলিফোন বা টেলিগ্রাম করে জানানাে যে যা হতে চলেছে তিনি তাতে সম্মত নন বা ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে আমাদেরকে পদত্যাগ করার জন্যও তিনি বলতে পারতেন। কিন্তু তিনি এগুলাের কোনটিই করলেন না। তিনি চুপচাপ বসে আমরা কি করি তার প্রতীক্ষায় থাকলেন এবং কাউন্সিলে যখন আমাদের নাম প্রকাশ করা হল তখনই তিনি কালবিলম্ব না করে আমাদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণে এগিয়ে এলেন।
স্বাভাবিক সৌজন্যতার খাতিরে তার উচিত ছিল এরূপ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের পূর্বে আমাদের একটিবারের জন্য হলেও সতর্ক করা। তিনি এখনও অনুধাবন করতে
১৫৭
পারছেন না যে, তিনি যা করেছেন তাতে আমাদের অবস্থা কতটা শােচনীয় ; আমাদের আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ পর্যন্ত দিলেন না বরং নিজের কর্তৃত্বপূর্ণ আচরণটিই জনগণের সামনে প্রদর্শন করলেন। আমি মনে করি, এ পদক্ষেপে মুসলিম ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ছােট বিষয়কে বড় একটি রাজনৈতিক সমস্যায় রূপান্তর করা হল।
গঠনতন্ত্র এ বিতর্কের বিষয়ে কি বলে তা আমি পড়েছি এবং সেখান থেকে কিছু কথা আমি উল্লেখ করতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ করাতে লীগের নীতি ও ধারার কোনরূপ ব্যত্যয় ঘটেনি। লীগ গত বছর যা প্রত্যাখ্যান করেছিল তাহল ভাইসরয়ের, ইন্ডিয়ার স্টেটসমূহ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে একটি বর্ধিত কাউন্সিল গঠন করার প্রস্তাব। বর্তমানের ডিফেন্স কাউন্সিল ইন্ডিয়ার স্টেটসমূহ এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে হবে না বরং তা হবে ইন্ডিয়ার স্টেটসমূহ এবং প্রদেশের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে তৈরি।
আমার মনে হয় মূল পার্থক্যটি এখানেই, আর এতে করে লীগের রেজুলেশনে উল্লেখিত ধারামতে ডিফেন্স কাউন্সিলের মেম্বারপদ গ্রহণ করায় কোন ভুল হয়নি। “মুসলিম সম্প্রদায়ের প্রতিনিধি হিসেবে আমরা মনােনীত হয়েছি” বলে কার্যকরী পরিষদে প্রেসিডেন্টের দ্বারা ঘােষণা করা হলেও আমি মনে করি, আমাদের বাছাই করা হয়েছিল। কারণ, আমরা “প্রধান” ছিলাম। এদিক দিয়ে বিচার করলেও দেখা যায়, ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদ গ্রহণ লীগের নীতি ও আদর্শের সাথে কোন ধরনের সাংঘর্ষিক নয়। কিন্তু এখানেই সব বলা শেষ হয়নি।
যখন যুদ্ধ সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ল তখন আমি শুধুমাত্র যুদ্ধ প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে আগ্রহী-ই ছিলাম না, আমি আমার দফতরে এবং দফতরের বাইরের সকল মানুষের মনে উৎসাহ যুগিয়েছি এবং যুদ্ধ প্রচেষ্টায় আমাকে সব দিতে সকলকে রাজি করেছি। বাংলা সরকারের প্রশাসনিক সকল দফতরের প্রধান হিসেবে জাতির যুদ্ধের জন্য আমাকে পর্যাপ্ত অর্থ বরাদ্দ রাখতে হবে। ইন্ডিয়ার অন্যান্য প্রদেশের অর্থ বরাদ্দের সাথে তাল মিলিয়ে আমাকেও যথাযথ মাত্রায় অর্থ বরাদ্দের ব্যবস্থা রাখতে হবে। আমি জনসম্মুখে এবং রেডিওতে যুদ্ধ-প্রচেষ্টার বিষয়ে শত শত বক্তৃতা দিয়েছি। এখনও পর্যন্ত প্রেসিডেন্ট আমার এ কাজে কখনও বাধা দেননি বরং অন্যান্য নামকরা মুসলিম লীগ নেতাদের সারা ভারত জুড়ে এ জাতীয় পদক্ষেপই তিনি নিতে বলেছেন।
আমার অবস্থান পুনর্বিবেচনা করে এ সম্পর্কে আমার সিদ্ধান্ত জানানাের জন্য ওয়ার্কিং কমিটি বেশ দয়া দেখিয়ে আমাকে ১০ দিনের সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। এই | দশদিন এখন পার হয়ে গেছে, আর আমি চাইনি যে, তারা আর উৎকণ্ঠায় থাকুক।
১৫৮
আমি কখনই মনে করি না যে ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগদান করে আমি লীগের কোন নীতি বা আদর্শের প্রতি অবজ্ঞা করেছি।
আমি এও মনে করি না যে, ডিফেন্স কাউন্সিলে আমার যােগদান সম্পর্কে ভারতের মুসলিম সম্প্রদায়ের বেশিরভাগ লােকের অমত রয়েছে। ব্যতিক্রম শুধু কলকাতায় বসবাসরত কিছু অবাঙালি এবং অল্প কিছু অবাঙালি মিল-শ্রমিক ; আমি মুসলিম বাঙালিদের মধ্যে এমন কোন আচরণ লক্ষ্য করিনি যাতে মনে হয়, ডিফেন্স কাউন্সিলে আমার যােগদানের বিষয়ে তারা অসন্তুষ্ট। আমাদের প্রদেশের বাইরে থাকা জনগণের মতামত সম্পর্কে বলতে গেলে ইহাই বলতে হয় যে, বহু সংখ্যক জনগণের মত আমার পক্ষেই রয়েছে। লক্ষ্মেী থেকে আমার এক বন্ধু আমাকে বড় একটি চিঠি লিখেছে যাতে দেখা গেছে, তিনি বলতে চেয়েছেন, সব উর্দু পত্রিকাই যে জিন্নাহকে সমর্থন করে তা সত্য না। অনেক উর্দু পত্রিকা রয়েছে যেগুলাে জিন্নাহর স্বৈরাচারমূলক নীতির জোর প্রতিবাদ করছে, এমনকি কায়েদ-ই-আযম”-এর উপর অনেকের বিশ্বাসই নেই।
“আমি বাংলা এবং বাংলার বাইরের অনেক “জামায়েত-ই-উলেমা” দলের নেতাদের কাছ থেকে পত্র পেয়েছি যাতে তারা আমার ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগদান সম্পর্কে সমর্থন জানিয়েছেন এবং পরামর্শ দিয়েছেন যেন ডিফেন্স কাউন্সিল সদস্যপদ থেকে পদত্যাগ না করি। বস্তুত আমি এমন বহু পত্র ও টেলিগ্রাম পেয়েছি যাতে পরিষ্কার বােঝা গেছে, ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগদান করায় বহু লােকের সমর্থন আমার পক্ষে রয়েছে।
আমি এখনও এ মত প্রকাশ করছি, প্রেসিডেন্ট আমাদের এ পদক্ষেপ সম্পূর্ণ ভুল ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন এবং আমাদের বিরুদ্ধে যে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা তিনি নিয়েছেন তা সকলের কাছে অবিবেচকের ন্যায় প্রকাশ করেছেন। আমি এখনও মনে করি তার এ আচরণ অন্যায্য ও অসাংবিধানিক এবং বিনা প্রয়ােজনে আমাদেরকে মনঃকষ্ট দেয়া। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, মুসলিম সম্প্রদায়ের স্বার্থ পরিপন্থী কোন কাজই আমি করিনি আর তাই মুসলিম পদমর্যাদা ক্ষুন্ন করা হয়েছে বলে যে মন্তব্য তিনি করেছেন তা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। উপরে বর্ণিত এসব কারণে আমি মনে করি, প্রেসিডেন্টের নির্দেশমত এবং কার্যকরী পরিষদের কথামত ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে আমার ইস্তফা দেয়ার প্রস্তাবটি একেবারেই অহেতুক ।
“আরও অনেক বিষয় রয়েছে যেগুলাে বিবেচনায় আনা জরুরী। প্রেসিডেন্ট তড়িঘড়ি করে ও অপমানজনকভাবে যে বিবৃতি দিয়েছেন তাতে করে মুসলিম জনগণের কাছে আমরা দোষী হয়েছি ; আর সবার মনে হচ্ছে যেন আমরা ব্যক্তিগত স্বার্থে ও উপরওয়ালাদের করুণা পেতে ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগ দিয়েছি। বর্তমান প্রজন্মের খুব কম মুসলমানই জানেন, আমি কি পরিমাণ সেবা লীগ এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের জন্য
১৫৯
দিয়েছি। অতীতে যারা আমার বিরুদ্ধাচরণ করত তাদেরই অনুসারীরা কিছু না জেনেই আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দেয়। কারণ, আমার পূর্বের ভাল কাজগুলাে সম্পর্কে তারা মােটেও জানে না। আমি বড়াই করে কিছু বলতে চাই না, তবে যদি মুসলিমদের জন্য ভাল কাজ করা নেতাদের তালিকা তৈরি করা হয় তাহলে অবশ্যই সেই তালিকায় আমার নাম থাকতে বাধ্য। অনেক নেতাই আছেন যারা ধার্মিক চিন্তা-চেতনা দিয়ে শুধুমাত্র প্রস্তাবই রেখে গিয়েছেন কিন্তু আমি ঐসব প্রস্তাবের বাস্তবায়ন করার নজির সৃষ্টি করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় হল, বর্তমান রাজনীতি পরিণত হয়েছে স্লোগান-নির্ভর এবং আবেগের বশবর্তী।
আরেকটি বিষয় রয়েছে যা উপেক্ষা করা যায় না। আমি লক্ষ্য করেছি, সবার ভেতর আস্তে আস্তে এমন একটি ধারণা গড়ে উঠেছে, আমি নাকি উচ্চপদস্থ ব্যক্তিদের চাপের মুখে ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদ ধরে রেখেছি এবং কোন এক অদৃশ্য শক্তির বলে আমার এ পদে আঁকড়ে থাকাটি অনেক ভারতীয় মুসলিম পছন্দ করছেন না। আমি দৃঢ়তার সাথে বলতে চাই, আমার নিজস্ব বিচার-বিবেচনার পেছনে কারও কোন হস্তক্ষেপ নেই আর আমি যে সিদ্ধান্ত নিতে পছন্দ করি তার উপর কারও কোন হস্তক্ষেপ চলে না।
অতএব আমার এখন উভয় সংকট অবস্থা। আমি যদি নিজের মত চিন্তা করি। তাহলে আমাকে ডিফেন্স কাউন্সিলে থেকে যেতে হয়। আবার যেহেতু অন্যান্য প্রাদেশিক প্রধানগণ ডিফেন্স কাউন্সিল ছেড়ে চলে গিয়েছেন, তাই এখানে আমার থাকাটা সঠিক হবে না ; কারণ, এতে করে ভারতে মুসলিম পদমর্যাদায় ফাটল ধরার সম্ভাবনা রয়েছে। এরূপ করলে আমার কাজের দায়ভার অন্যদের উপর বর্তাবে যাদের এ বিষয়ে বিন্দুমাত্র মাথাব্যথা নেই। এমতবস্থায় আমার মনে হচ্ছিল, ডিফেন্স কাউন্সিলে থেকে যাওয়াটা কারও জন্য কোন সুফল বয়ে আনবে না। এ কারণে আমার গভর্নরের মাধ্যমে মাননীয় ভাইসরয়ের কাছে ছুটি চেয়ে পাঠিয়েছি যাতে করে ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে আমি পদত্যাগ করার প্রস্তুতি গ্রহণ করতে পারি।
এ পদক্ষেপ নেয়ার পূর্ব থেকেই আমার আকাঙ্ক্ষা ছিল, যে করেই হােক আমাকে এ বিতর্ক থেকে বেরিয়ে আসতে হবে ; কারণ, এর ফলে শুধু মুসলিম লীগ নয় ভারতের সমগ্র মুসলমানের মর্যাদা ক্ষুন্ন হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। এ কারণে আমার পদত্যাগটি স্যার সিকান্দার হায়াত খানের পদত্যাগ থেকে ভিন্ন। তিনি মূল বিষয়টির গভীরে না গিয়ে অবস্থার আলােকে পদত্যাগ করেছেন ; আর আমি মনে করি, যথাযথ চিন্তা-ভাবনা করেই আমি ডিফেন্স কাউন্সিলে যােগ দিয়েছিলাম, তথাপি এর ফলে সম্প্রদায়ের আশাআকাক্ষার বাস্তবায়ন বিঘ্নিত হওয়ার সম্ভাবনা থেকেই আমি পদত্যাগ করেছি।
১৬০
সিকান্দার হায়াত বুঝতে পেরেছেন, তিনি একটি ভুল করে ফেলেছেন তাই এভাবেই তিনি নিজের সংশােধন করেছেন ; কিন্তু আমি সঠিক ছিলাম যদিও ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে আমি আর ঐ সদস্যপদ ধরে রাখিনি।
আমি জানি, ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করার মাধ্যমে আমি পুনরায় আগের সদস্যপদে ফিরে আসব যদিও তাতে আমার নিজের মন সায় দিচ্ছে না। তবুও এরূপ আমাকে করতেই হবে ; কেননা এখন আমাদের মধ্যে একতা ধরে রেখে দেশ ও জাতির জন্য কাজ করতে হবে।
আমার আশা আছে, মুসলিম নেতারা বাংলা ও পাঞ্জাবের সকল সংখ্যালঘু মুসলমানদের জীবনযাত্রার আকাঙ্ক্ষা যেভাবে বিপন্ন করেছেন, তার বিরুদ্ধে জোর প্রতিবাদ গড়ে তােলা। ভারতের মধ্যে পাঞ্জাব আর বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা প্রায় ৫ কোটি যা মােট মুসলিম জনসংখ্যার প্রায় ৫০ ভাগ ; এছাড়া বাকি মুসলমানরা অসহায় সংখ্যালঘু হিসেবে সমগ্র ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে রয়েছে ; কিছু কিছু। ক্ষেত্রে ভারতে মুসলিম সংখ্যালঘুদের পরিমাণ ৪ অথবা ৫ ভাগে নেমে আসে আর এই সকল অসহায় ভাইয়েরা কখনও প্রশাসনের বিষয়ে চিন্তাও করে না, ক্ষমতায় আসার কথা তাে বাদই দিলাম। সহজেই অনুমান করা যায়, এই সকল জনগােষ্ঠী কখনও চিন্তাও করতে পারে না যে প্রশাসনের ক্ষেত্রে বাংলা ও পাঞ্জাবে মুসলিমরাই কর্তৃত্বকারী অবস্থানে রয়েছে। এমনকি ঐসব প্রদেশের প্রধানমন্ত্রীদের কি কাজ তাও তারা ঠিকমত জানে না। স্বাভাবিকভাবেই ভারতের সমগ্র মুসলিমের কল্যাণের লক্ষ্যে পাঞ্জাব বা বাংলার মুসলিমদের জন্য তাদের মন্ত্রিরা কি কি পদক্ষেপ নিচ্ছেন সে বিষয়ে তারা কোন ভ্রুক্ষেপই করে না। তাই আমার পক্ষ থেকে বাংলার ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মুসলমানের ভাগ্য কোন বাইরের কর্তৃপক্ষের কাছে ছেড়ে দেয়ার প্রশ্নই ওঠে না – তা সে যতই ভাল হােক না কেন।
ইদানিং আমার মনে হচ্ছে, বাইরের কোন রাজনৈতিক নেতার পরামর্শ বাংলার কেউ গ্রহণ করছেন না, যদিও ভারতের মােট মুসলিম জনগােষ্ঠীর মধ্যে আমাদের এখানে রয়েছে তিন ভাগের এক ভাগ। এ বিতর্কের মধ্যেও সংখ্যালঘু প্রদেশের নেতারা আমার দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে বিন্দুমাত্র আগ্রহ না দেখিয়ে উল্টো আমার বিরুদ্ধে স্লোগান দিয়ে চলেছে যা তাদের রাজনৈতিক দেউলিয়াত্বেরই বহিঃপ্রকাশ ; ইহা আমার প্রদেশের বর্তমান পরিস্থিতির সাথে সম্পূর্ণ বেমানান। প্রেসিডেন্টের কাছে আমার নিজস্ব মতামত তুলে ধরার পূর্বেই তিনি আমার নিন্দা করা শুরু করে দিলেন। ইন্ডিয়ার মুসলিম নেতারা এ নিন্দার সাথে একাত্মতা প্রকাশ করল যদিও তাদের কেউ কখনও জানার চেষ্টা করেননি যে আমি কোন পরিস্থিতিতে ভাইসরয়ের আহ্বানে ডিফেন্স কাউন্সিলের সদস্যপদে যােগ দিয়েছিলাম। আমি যে সারাজীবন এ সম্প্রদায়ের সম্মান সমুন্নত রেখে
১৬১
বিরােধিদের কঠিন বাধা পেরিয়ে ইন্ডিয়াতে অমুসলিমদের জন্য সুন্দর অবস্থান তৈরি করেছি তা হয়ত আমার সমালােচকরা একদম ভুলে গিয়েছেন।
উপরােল্লিখিত বিষয়গুলাে বিবেচনায় নিয়ে আমাকে বলতে হচ্ছে, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কার্যকরী পরিষদের সদস্যপদটি আমার পক্ষে আর ধরে রাখা সম্ভব হচ্ছে না। প্রেসিডেন্টের অবিবেচনাপ্রসূত ক্ষমতার অপব্যবহারের প্রতি প্রতিবাদ জানিয়ে আমি অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ কাউন্সিল এবং এর কার্যকরী পরিষদ থেকে ইস্তফা নিয়েছি। আমি বিষয়টি নিয়ে যতই গভীরে যাচ্ছি ততই আমার মনে হচ্ছে, যেখানে প্রাদেশিক নেতাদের প্রতি সামান্যতম সৌজন্য দেখানাে হয় না সে রকম দলে আমার থাকাই শ্রেয়।
বাংলা এবং পাঞ্জাবের মত সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের ক্ষেত্রে কোন সিদ্ধান্ত যদি প্রেসিডেন্ট নিতে যান তাহলে তাকে কিছু প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে প্রদেশিক মুসলিম লীগের নেতাদের সাথে আলােচনার মাধ্যমেই তা নেয়া উচিত। অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট বিধিসম্মতভাবে তার দাফতরিক দায়িত্ব পালনে এক্ষেত্রে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন।
এই পত্রটিকে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের কাউন্সিল এবং কার্যকরী পরিষদ থেকে আমার ইস্তফাপত্র বলে ধরে নিবেন। এ ইস্তফাপত্র প্রদানের সাথে সাথে আমি একটি বিষয়ে সতর্কবার্তা দিতে চাই, অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক বা অগণতান্ত্রিক সব নীতিই একজন ব্যক্তির ইচ্ছামাফিক সর্বক্ষমতা দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে ; এমনকি ৩ কোটি ৩০ লক্ষ মুসলিমের প্রদেশ বাংলাতেও তার একক কর্তৃত্ব বিদ্যমান।
সূত্র ঃ “দি স্টেটসম্যান” (কলকাতা), ১১ সেপ্টেম্বর, ১৯৪১
১৬২

পরিশিষ্ট তিন
অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগের সেক্রেটারী লিয়াকত আলী খানকে লেখা এ. কে. ফজলুল হকের পত্র
তারিখ ১৪ নভেম্বর ১৯৪১

আপনার ২৯ অক্টোবর তারিখের অবহিতকরণ পত্রের প্রাপ্তি স্বীকার করছি যার সাথে ছিল দুটি রেজুলেশনের কপি যা ২৭ অক্টোবর দিল্লীর সভায় মুসলিম লীগ কার্যকরী পরিষদ কর্তৃক গৃহীত ও মুসলিম লীগ কাউন্সিল কর্তৃক অনুমােদিত।
দেরিতে উত্তর দেয়ার জন্য আন্তরিকভাবে দুঃখ প্রকাশ করছি। আমার শারীরিক অবস্থা খুবই খারাপ থাকাতে এবং এমন গুরুত্বপূর্ণ পত্রের উত্তর ভেবে-চিন্তে দেয়ার । প্রয়ােজনীয়তা উপলব্ধি করাতে এরূপ বিলম্ব হয়েছে ।
শুধুমাত্র প্রেসিডেন্টই সব থেকে ভাল জানেন, আমি সর্বদাই লীগের একজন একনিষ্ঠ সদস্য ছিলাম ; আমার উপর যখন যে দায়িত্ব অর্পণ করা হয়েছে বা দলের স্বার্থে যখন যে প্রস্তাব গৃহীত হয়েছে তার দায়িত্ব আমার উপর না বর্তালেও, সবই আমি নিজের কাজ মনে করে একাগ্রচিত্তে পালন করে গিয়েছি। আমার এ কথায় যদি কোন সন্দেহ থাকে তাহলে ডিফেন্স কাউন্সিল থেকে আমার পদত্যাগ করার ঘটনাটি লক্ষ্য করলেই এর সত্যতা পেয়ে যাবেন।
একটি রূঢ় সত্য হল যারা তাদের সর্বোচ্চটা দিয়ে ইন্ডিয়ায় মুসলিম লীগের মত একটি জাতীয় সংগঠন দাঁড় করিয়েছেন তাদের মধ্যে শুধু আমার ক্ষেত্রে ভুল বুঝাবুঝি। ও যাবতীয় সমালােচনা। চিঠির কিছু অংশে হয়ত প্রেসিডেন্ট এবং আমার কতিপয় বন্ধু আঘাত পেয়েছেন। আপনার মাধ্যমে আমি তাদের আশ্বস্ত করতে চাই যে, কাউকে আঘাত দেয়ার কোন অভিপ্রায় আমার ছিল না বা কারও প্রতি আমার কোন ক্ষোভ নেই এবং আমি আশা করব, আমার নিজের থেকে দেয়া এ আশ্বাসের ফলে বিষয়টির নিষ্পত্তি হয়েছে বলে সবাই ধরে নিবে।
স্বাক্ষর
ফজলুল হক

উৎসঃ
গভর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়া, হােম পলিটিক্যাল ফাইল ১৭-৪-৪১ (পােল-১)।
১৬৩

পরিশিষ্ট চার
ইন্ডিয়ার সকল খ্যাতিমান মুসলিম নেতার কাছে একটি প্রগ্রেসিভ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ গঠনের লক্ষ্যে এ. কে. ফজলুল হকের প্রস্তাবপত্র
তারিখ ২০ জুন ১৯৪২

আপনার উদ্দেশ্যে লেখা আমার এ চিঠিতে যে বিষয় নিয়ে আলােচনা করা হয়েছে, আমি সুনিশ্চিতভাবে আশাবাদী যে, আপনি তা গুরুত্ব সহকারে ও আন্তরিকভাবে মূল্যায়ন করবেন।
আপনি জানেন, গত সাত মাস যাবত আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা সারাদেশকে আমার বিরুদ্ধে ও আমার মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে নিন্দা করার জন্য ক্ষেপিয়ে তুলেছে, আর আমি কেমন যেন মানব ইতিহাসের একজন খারাপ মানুষ হিসেবে চিহ্নিত হয়ে গিয়েছি। লােকজন অভিযােগ করছেন, আমি ইসলামের একজন শত্রু এবং পলাশীর মীরজাফরের মত আমি মুসলমানদের সাথে প্রতারণা করেছি। এই কয় মাসের মধ্যে সরকারি ছত্রছায়ায় প্রায় পাঁচ শতাধিক মিটিং আমার প্রতিপক্ষরা করেছেন যেখানে একের পর এক সকল বক্তাই আমার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার করেছেন এবং সম্প্রদায়ের কাছে আমার চরিত্রে কালিমা লেপনের উদ্দেশ্যে বিভ্রান্তিকর তথ্য উপস্থাপন করেছেন। এসব বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণার বিরুদ্ধে আমি একটি শব্দও উচ্চারণ করিনি বা কোনরূপ ব্যবস্থা নেইনি। আমি মনে করি, যদি এগুলাের বিরুদ্ধে আমি কোন ব্যবস্থা নিতে যাই তাহলে আবার কথা উঠবে এবং এভাবে চলতে চলতে মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে বিচ্ছেদ তৈরি হবে।
আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের লক্ষ্য হল, আমার বিরুদ্ধে গুজব ছড়িয়ে আমার রাজনৈতিক সুনাম ক্ষুন্ন করা আর এভাবে আমাকে সরিয়ে দিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থরক্ষা করা। রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক ষড়যন্ত্রের ইহাই তাদের জন্য উপযুক্ত সময় এবং পারিপার্শ্বিক অবস্থা তাদের অনুকূলেই রয়েছে (১৯৪১ সালের ১ ডিসেম্বরে যখন মন্ত্রিসভা বিলুপ্ত হল, তখন পুরাতন মন্ত্রিসভার অনেকেই আশাবাদী হয়েছিলেন যদিও পরবর্তী ঘটনাচক্রে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে তাতে তারা এখন বেশ হতবাক। নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হওয়ায় সব হিসেব-নিকেশ পাল্টে গেল আর তাদের ভাগ্যের
১৬৪
চাকা থেমে গেল। তারা পথের দিশা হারাল যদিও রাজনৈতিক সর্বোচ্চ ক্ষমতার স্বাদ পাওয়ার জন্য তারা অনেক আশাবাদী হয়েছিল)। তাদের মত আরও অনেকেই ছিলেন। বহু ব্যক্তি রয়েছেন যাদের জীবনে হতাশা নেমে এসেছে শুধুমাত্র প্রশাসনিক কিছু কার্যক্রম গ্রহণ করায় আর এ কার্যক্রম আমার দ্বারাই নেয়া হয়েছিল । ছােট-বড় সকল হতাশাগ্রস্ত ব্যক্তি তখন একত্র হয়ে আমার বিরুদ্ধে প্রতিশােধ নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। তারা ছক বেঁধে এগুতে লাগল। বলা হয়, মুসলিম লীগের ধ্বজা এখন প্রায় ভগ্নাবস্থায় এবং তা জাগিয়ে তুলতে হবে। প্রাক্তন মন্ত্রিরা তাদের দোসরদের সাথে নিয়ে সারাদেশের মানুষকে জানাতে লাগল, আমিই ষড়যন্ত্র করে ইসলামের এমন অবস্থা সৃষ্টি করেছি এবং রক্ষাকারী হিসেবে তারা এগিয়ে এলে আমিই তাদের এমন ক্ষতি করেছি। তারা শুধুমাত্র ঘােষণা দিয়েই ক্ষান্ত হননি। মুখে উসকানিমূলক স্লোগান তুলে বিভিন্ন প্রচারণার মাধ্যমে তারা পূর্ববাংলার মুসলিম জনগণকে বিভ্রান্ত করতে লেগে গেল। সবকিছুই কেমন যেন তাদের পক্ষে যেতে থাকল। আমাদের সরকার তাদেরকে ইচ্ছেমত সভা করার অনুমতি প্রদান করল ; তাদের ধোঁকাবাজিতে জনগণ বিভ্রান্ত হল, তাদের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল ইসলামের প্রতি তাদের অগাধ ভালবাসার নিশ্চয়তা ; তাদের বানানাে গল্প এতই মধুর ছিল যে, অচেতন জনতার মনে সবকিছুই সত্য বলে স্থান করে নিয়েছিল।
প্রচার-প্রচারণার এ যখন অবস্থা, তখন আমি আমার বন্ধুদের কাছে জানতে চাই, আসলে তারা কি নিয়ে আমার বিরুদ্ধে অভিযােগ করছে ? নতুন মন্ত্রিসভা যখন আমি। গঠন করি তখন শুরুতেই তারা বলল, আমি নাকি পলাশীর মীরজাফরের ন্যায় মুসলিমদের সাথে প্রতারণা করেছি। কিন্তু আসল ঘটনা কি ? মন্ত্রিসভায় সমস্যা তৈরি হওয়ার পূর্বে, আমি প্রধানমন্ত্রী ছিলাম, আমি ছিলাম জোটের নেতা, এসেম্বলীর নেতা, বেঙ্গল প্রভিন্সিয়াল মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট, প্রদেশের সব মর্যাদাপূর্ণ পদের অধিকারীই আমি ছিলাম। আসলে এ পদগুলােতে অধিষ্ঠিত থাকায় আর নতুন কিছু করতে যাওয়ায় আমার বিরুদ্ধে তাে ষড়যন্ত্র হবেই।
আমার প্রতিপক্ষরা সফল হওয়ার ক্ষেত্রে সবকিছুই তাদের অনুকূলে পেয়েছিলেন, যদি তারা আমাকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে সরাতে পারে তাহলে সহজেই তাদের নেতাকে সেখানে বসিয়ে প্রশাসনিক সকল সুযােগ-সুবিধা ভােগ করতে পারবে। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে আমাকে সরানাে সহজ কাজ নয় ; হয় আমি স্বেচ্ছায় মন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে পদ খালি করব, না হয় অনাস্থা ভােটের মাধ্যমে মহামান্য ভাইসরয়ের নির্দেশ অনুসারে আমাকে সরে যেতে হবে। তাই শেষ উপায় হিসেবে সবাই ইস্তফা
১৬৫
প্রদান করে মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দিল। বস্তুত ইহাই তারা করেছিল। আমার বন্ধুরা নিশ্চয়ই অবগত আছেন, নভেম্বরের শেষের দিকে আমার নামে মিথ্যা গুজব রটানাে হয়েছিল, আমি নাকি আগের জোট সরকার ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে মন্ত্রিসভা গঠনের চেষ্টা করছি। এগুলাে সবই ছিল কঠিন মিথ্যাচার এবং এ বিষয়ে সংশয় দূর করার জন্য গত ৩০ নভেম্বর ১৯৪১-এ পত্রিকায় আমি একটি বিবৃতি প্রদান করেছিলাম।
পত্রিকায় যেমন বিবৃতি এসেছিল তাতে দেখা গেল, যখন মন্ত্রিসভায় অনৈক্য দেখা দিল তখন প্রগেসিভ কোয়ালিশন পার্টি নামীয় নতুন একটি দলের নেতৃত্ব আমি গ্রহণ করেছিলাম।
প্রধানমন্ত্রী এবং সংসদের জোট-নেতা হিসেবে আমাকে স্মরণ করানাের প্রয়ােজন নেই যে বর্তমানের বিরােধী দলের সাথে আলাপ করে নতুন একটি দল গঠনের উদ্যোগ কতটা অসাংবিধানিক। জোটের মধ্যে সংহতি বজায় রাখা আমার কাছে মন্ত্রিদের মধ্যে সংহতি বজায় রাখার থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় এবং জোটের সিদ্ধান্ত দলের প্রতিটি সদস্য গ্রহণ করুক ইহাই আমি নিশ্চিত করতে চাই।
এর থেকে আর পরিষ্কারভাবে ব্যাখ্যা দেয়া সম্ভব নয়। তবে আমার বিবৃতি দেয়া সত্ত্বেও ১৯৪১ সালের ১ ডিসেম্বরে তড়িঘড়ি করে আমার বিরােধীরা ইস্তফা দিতে লাগলেন এবং এভাবেই মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। তারা তখন কংগ্রেস, কৃষক-প্রজা পার্টি, হিন্দু মহাসভা ও অন্যান্য দলের সাথে জোট গঠন করে আমাকে ক্ষমতা থেকে সরানাের আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত হল। কোন ঢালাও বিবৃতি না দিয়ে আমি খুব সুনির্দিষ্টভাবে প্রমাণসহ আমার পক্ষে বিবৃতি প্রদান করেছিলাম। যাহােক নিয়তি আমাকে রক্ষা করেছে। তাদের সব চেষ্টা বিফলে গিয়েছিল এবং আমি সৌভাগ্যবশত তাদের সাথেই জোট গঠন করি যাদেরকে নিয়ে জোট গঠনে তারা ব্যর্থ হয়েছিল। মূলত এদের সাথে জোট গঠন করার ফলে পূর্বের থেকে আরও কার্যকর মন্ত্রিসভা গঠন করতে পেরেছিলাম। তারা যদি ইস্তফা প্রদানের মত পদক্ষেপ না নিত তাহলে আগের এ মন্ত্রিসভা খুব সুন্দর মত কাজ করে যেতে পারত আর বর্তমানের এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হত না। মন্দের থেকে ভাল’র উৎপত্তি এ বিষয়টিই আমার কাছে প্রতিপন্ন হল।
সকল চেষ্টায় ব্যর্থ হয়ে তারা জিন্নাহ সাহেবের সহযােগিতা কামনা করল। তারা সম্পূর্ণ ঘটনার অপব্যাখ্যা করল এবং মিথ্যাচার করে জিন্নাহকে এমনভাবে আমার বিরুদ্ধে দাঁড় করাল যাতে করে জিন্নাহ আমাকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করে দেন। তারা মনে করেছিল যদি আমাকে মুসলিম লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয় তাহলে
১৬৬
মুসলিম এম. এল. এরা আমার উপর থেকে তাদের সমর্থন তুলে নেবে আর। স্বাভাবিকভাবেই আমি মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যর্থ হব। জিন্নাহ আমার সাথে তার সেই চিরচেনা স্বৈরাচারী আচরণ করলেন। তিনি ৬ ডিসেম্বর টেলিগ্রাম করে আমাকে জানালেন, আমি যা করেছি তা বিশ্বাসঘাতকতার শামিল, আর তাই যদি এ বিষয়ে আমার কোন বক্তব্য থাকে তাহলে তা যেন ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আমি জানাই। জনাব জিন্নাহর চিঠির কঠিন ভাষায় আমি অবশ্যই ক্ষুব্ধ হয়েছি কিন্তু সেদিকে না তাকিয়ে আমি মনে করেছি, ঘটনার আসল ব্যাখ্যাটি তাঁকে জানানাে সঠিক হবে। তারপর আমি তাকে টেলিগ্রামে জানালাম, তিনি যেহেতু লীগের প্রেসিডেন্ট তাই যেন স্ব-শরীরে এখানে উপস্থিত হয়ে নিজেই অনুসন্ধান করে বাস্তব ঘটনা জেনে যাক এবং তারপর যে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা উচিত তা যেন তিনি করেন। আমার কথায় কর্ণপাত না করে তিনি ৮ ডিসেম্বর আমাকে পুনরায় টেলিগ্রাম করে আগামী ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে আমার ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠান। আমি তারবার্তায় তাকে জানালাম, কোন বিষয়ে আমার প্রতি অভিযােগ করেছেন তা যদি আমি ঠিকমত না জানি তাহলে কিভাবে আমি ব্যাখ্যা দিব। এছাড়া আমি আরেকটি বিষয় উল্লেখ করলাম তাহল উনি ১০ ডিসেম্বরের মধ্যে দিল্লীতে যে ব্যাখ্যা চেয়ে পাঠিয়েছেন তা ঠিকমত তার কাছে পৌছাতে হলে সেদিনই বিকাল বেলায় কাগজ তৈরি করে আমাকে পােস্ট করতে হবে যা মােটেও সম্ভব নয়। কিন্তু জিন্নাহ কোন কারণ বা আবেদন গ্রহণ করার ক্ষেত্রে একদম নির্লিপ্ত থাকেন। স্বভাবসুলভ স্বৈরাচারী কায়দায় ১০ ডিসেম্বর আমাকে লীগ থেকে বহিষ্কার করার আদেশ জারি করলেন।
এ-ই হল পুরাে সত্য ঘটনার সার-সংক্ষেপ। বিরােধীপক্ষ আমার বিরুদ্ধে আপত্তিকর অভিযােগ তুলতে লাগল, যদিও সেগুলাের পক্ষে সত্য কোন ঘটনার উদ্ধৃতি তারা কখনই দিতে বা তুলে ধরতে পারেনি। আমি মনে করি, তাদের এ জাতীয় কর্মকাণ্ড সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক ও অ-ইসলামিক। সবচেয়ে ঘৃণ্য একজন আসামীরও অধিকার রয়েছে তার নিজের সম্পর্কে কিছু বলার ; কিন্তু আমি অবাক হয়েছি আমার বন্ধুরাও আমার নিজস্ব যুক্তিগুলাে তুলে ধরার জন্য কোন সুযােগই আমাকে দিলেন না যেমনটি কোন দাগি আসামীর ক্ষেত্রেও সাধারণত করা হয় না। একজন খুনিকেও প্রকাশ্য বিচারের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয় না। অথচ কিছু মুসলিম আমার সাথে এমন আচরণ করল তাতে বুঝা গেল, তাদের মধ্যে ইসলামের শিক্ষা খুবই কম আর আমার প্রতি তারা সম্পূর্ণ অ-ইসলামিক ব্যবহারই করেছে। এ ঘটনায় আমি অনুধাবন করেছি যে, মুসলিম লীগের ভেতরে এ জাতীয় কিছু অপচর্চা চালু হয়েছে। আপনি
১৬৭
নিশ্চয়ই জানেন, বর্তমানে অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ এবং এর অঙ্গসংগঠনগুলাে একটি গােষ্ঠী দ্বারা পরিচালিত হচ্ছে যারা কখনও বিরােধীদের সহ্য করে না আর সবকিছুই স্বৈরাচারী কায়দায় নিজেদের করায়ত্ত করতে চায়। সম্পূর্ণ পরিবেশটাই হয়ে উঠেছে অগণতান্ত্রিক ও অ-ইসলামিক। এখানে একজন ব্যক্তির ইচ্ছাই চলে এবং লীগের অন্য কোন সদস্যের ইচ্ছার কোন দাম নেই বা তাদের মতের কোন মূল্যায়ন নেই ; এই একক ব্যক্তিটি এতই উদ্ধত ও অহংকারী যে সে ফারাও’কেও ছাড়িয়ে যাবে। সমস্যা বাড়িয়ে দিতে এ অতিমানব ক্ষমতার এমন অপপ্রয়ােগ ঘটাতে পারেন যা জারেরা তাদের স্বপ্নে ভাবতে গেলেও ঈর্ষান্বিত হবে। বর্তমানে মুসলিম লীগের সব কিছুই অইসলামিক। আমি বিশেষভাবে মনে করি, প্রকৃত এবং খাঁটি মুসলিমদের দ্বারা মুসলিম লীগ পরিচালিত হওয়া উচিত। কেউ যদি নিজেকে মুসলিম লীগ বলে দাবি করে তাহলে তার সর্বপ্রথম দায়িত্ব হবে নিজেকে সত্য ও খাঁটি মুসলিম হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করা।
এসব বিষয় বিবেচনায় আমি উপসংহারে পৌছেছি যে, এখনই উপযুক্ত সময় হয়েছে প্রগ্রেসিভ অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করার, আশা করা যায় ভবিষ্যতে এ দলটি ইন্ডিয়ার বর্তমান অ-ইসলামিক মুসলিম লীগকে সরিয়ে দিতে সক্ষম হবে। আমরা মনে করি, মুসলিমদের সব ধরনের স্বার্থ সংরক্ষণে মুসলমানদের একটি ভিন্ন সংগঠন। তৈরি করা খুবই জরুরীঃ
প্রথমত, এই মুসলিম লীগের নেতৃত্ব এমন কিছু অভিজাতশ্রেণির নেতাদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে, যাদের অভিধানে অন্য কারও মতপ্রকাশের বিন্দুমাত্র স্বাধীনতা নেই।
দ্বিতীয়ত, লীগের সব ক্ষমতা একজন ব্যক্তির হাতে রয়েছে যিনি এর প্রেসিডেন্ট আর “কয়েদ-ই-আযম” নামে পরিচিত, যার নিজস্ব সকল ইচ্ছাই হল আইন এবং যিনি জনতার বিষয়ে বা লীগের প্রশাসনিক বিষয়ে নিজের ছাড়া অন্য কারও মতামতের তােয়াক্কা করেন না।
তৃতীয়ত, এসব কারণে লীগের মধ্যে স্বাধীন মতপ্রকাশের চর্চা একদম স্তিমিত হয়ে গিয়েছে।
চতুর্থত, চর্তমানে মুসলিম লীগ ভারতের মধ্যকার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম দলকে তাদের সাথে যুক্ত করতে পারছে না। এরকম দলগুলাের মধ্যে রয়েছে। “জামায়েত-ই-উলেমা-ই-হিন্দ” যারা ইসলামের জ্ঞানে আলােকিত এবং যাদের ইসলামিক ধর্মাচার ও সংস্কৃতিতে রয়েছে বিশেষ পাণ্ডিত্য ; | “মােমিন” – যারা ইন্ডিয়ার মুসলিম জনতার মধ্যে বড় একটি অংশ
১৬৮
দখল করে রয়েছে ; পাঞ্জাবের “আহরাব”-গণ ; “খােদা-ইখেদমতগণ” যারা উত্তর-পশ্চিম সীমান্তবর্তী প্রদেশে রয়েছেন ; “খক্ষর” যারা বেশির ভাগ সিন্ধু এবং অন্যান্য প্রদেশ জুড়ে রয়েছেন। সবচেয়ে কষ্টদায়ক হল, লীগের নামকরা নেতারা গুণ্ডামি ও দস্যপনাকে উৎসাহ দিতে কখনও দ্বিধাবােধ করেন না। মুসলিম লীগের এসব দস্যপনা ও গুণ্ডামিকে তাদের পত্রিকাই সবসময় পেছন থেকে বাহবা দিতে থাকে । লীগের এসব পত্রিকার মধ্যে কিছুসংখ্যক রয়েছে যারা শুধু মিথ্যাচারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে না, তাদের পছন্দের বাইরের কোন ঘটনাও তারা ছাপতে চায় না যদিও তাতে সত্য থাকে আর এভাবেই নিজেরা যা ছাপায় তাতে মিথ্যা ছাড়া আর কোন কিছুই পাওয়া যায়নি।
প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ নামের যে দলটি প্রতিষ্ঠা করার কথা আমি বলছি তা হবে ইসলামী আদর্শমণ্ডিত যা মুসলমানদের মধ্যে রাজনীতি সম্পর্কে বড় ধারণার উন্মেষ ঘটাবে আর ইসলামিক মূল্যবােধ জাগ্রত রেখে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করে যাবে। অন্যভাবে বলা চলে, প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগের সর্বপ্রথম আদর্শ হবে ইসলাম এবং ইসলামিক অগ্রসরতা তবে তা অন্যান্য সম্প্রদায়ের নৈতিক মূল্যবােধকে কখনও অবহেলা করে নয়। আমি মনে করি, সকলের সর্বদা মনে রাখা জরুরী, ইসলাম সমগ্র মানবজাতির কল্যাণের লক্ষ্যে এসেছে এবং ইসলাম ক্যাথলিকদের মধ্যেও বহু কষ্ট সহ্য করার পর প্রসার ঘটিয়েছে। ইন্ডিয়াতে রাজনৈতিকভাবে সফলতা অর্জন করতে গেলে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য তৈরি করা অতীব জরুরী।
বর্তমানে মুসলিম লীগ যে নীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে না আছে ইসলামের চর্চা, না আছে দেশপ্রেম। মুসলিম বা অন্য কারও জন্য এ দলটি কোন কাজ করছে না। দলটি এমনভাব প্রদর্শন করে যেন তারা ইসলামের পুরােপুরি চর্চা করে আর নিজেদের মুসলিম বলে দাবি করে যদিও বস্তুতপক্ষে মুসলিমদের রাজনৈতিক ধ্বংসই তারা টেনে আনছে।
উপরােল্লিখিত ধারণাগুলাে বাস্তবায়ন করার লক্ষ্যে কলকাতায় একটি সাংগঠনিক কমিটি তৈরি করা হয়েছে যার প্রেসিডেন্ট হলেন ঢাকার মাননীয় নওয়াব বাহাদুর এবং সেক্রেটারি হলেন জনাব সৈয়দ বদরুদ্দোজা এম, এল, এ.। প্রেসিডেন্ট এবং সেক্রেটারিকে সহযােগিতা করার জন্য একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে। তাই আমার বিনীত অনুরােধ, দেরি হয়ে যাওয়ার আগে মুসলিম লীগকে অ-ইসলামিক নেতাদের
১৬৯
কবল থেকে বাঁচান। আর ইহা করার জন্য দরকার সকল ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মুসলিম দলগুলােকে প্রগেসিভ মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত করা। আপনার কাছে আমার আরজি থাকল যেন আপনি ভারতের গ্রাম-গঞ্জে প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগের শাখা দল সংগঠনে এগিয়ে আসেন ; আর এভাবে যেন গ্রাম-লীগ, ইউনিয়ন-লীগ, সাব-ডিভিশনাল লীগ, জেলা-লীগ তৈরি হয়ে প্রভেন্সিয়াল মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে সর্বত্র প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন গড়ে ওঠে। আপনি মুসলিম সম্প্রদায়ের নামকরা নেতা যিনি ইসলামের জন্য সর্বদা নিবেদিত প্রাণ । অতএব আমি আপনার কাছে সাহায্য ও সহযােগিতা বিশেষভাবে কামনা করছি এবং আমি নিশ্চিত যে আমার এ অনুরােধ কখনও বিফলে যাবে না। প্রাথমিক ও জেলা পর্যায়ে যখন পর্যাপ্ত সদস্য পাওয়া যাবে তখন আমি বিভিন্ন স্থানের দলকে একত্রিত করে বড় একটি সভা করব যেখানে প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগের নিয়ম-নীতি নির্ধারণ করা হবে এবং পরবর্তী কর্মসূচিও তখন ঘােষণা করা হবে। প্রাদেশিকভাবে দলকে সুসংগঠিত করার পর আমার ইচ্ছে আছে সমগ্র ভারতে বৃহত্তর আঙ্গিকে এ দলটি প্রতিষ্ঠা করার। যাদের স্বার্থে আঘাত লাগবে, আমরা জানি, তাদের মুখােমুখি আমাদেরকে হতেই হবে। কিন্তু তাদের বিরােধিতাকে উপেক্ষা করেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। আমাদের এগুতেই হবে এবং আমি নিশ্চিত যে আল্লাহর কৃপায় আমরা পরিশেষে সফলতাই পাব।
আপনার উত্তর পেলে আমি খুবই কৃতজ্ঞ থাকব। কারণ, পত্রের প্রতিটি বিষয়ে আপনি সঠিক ধারণা পেয়েছেন কি-না তা আমি জানতে পারব। আমার আশা হল যিনি আমার সাথে দ্বিমত পােষণ করবে তার প্রতি আমি আমার চাওয়া বদলাব এবং সহযােগিতা করতে রাজি না হলেও তা হৃষ্টচিত্তে মেনে নেব এই মনে করে যে হয়ত আমার বক্তব্য আপনার কাছে যথাযােগ্য বলে প্রতীয়মান হয়নি বা আমি আপনাকে বােঝাতে ব্যর্থ হয়েছি।
পরিশেষে আমি একটি বিষয় পরিষ্কার করতে চাই। প্রগ্রেসিভ মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করার আমার প্রচেষ্টায় হয়ত মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ফাটল ধরবে, কিন্তু আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষরা আমার সামনে আর কোন পথ খােলা রাখেনি, আমি অনেক ধৈর্য ধরে অবশেষে দেখলাম আমি আমার রাজনৈতিক নিরাপত্তার রেখা অতিক্রম করতে চলেছি। আমি আর অপেক্ষা করতে পারি না। আমি নয়, ফলাফলের জন্য তারাই দায়ী। কোনরূপ বিচার-বিবেচনা না করেই জনাব জিন্নাহ আমার বহিষ্কারাদেশ জারি করলেন আর বাংলায় তার অনুসারীরা নিজেদের স্বার্থে বা অন্য কোন কারণে আমার
১৭০
রাজনৈতিক জীবন ধ্বংস করার জন্য উঠে-পড়ে লেগে গেল। আমার মনে হয়, বাংলার যে মুসলিম লীগে আমার কোন সংশ্লিষ্টতা নেই সেই জাতীয় মুসলিম লীগের প্রতি এই বাংলার মুসলমানদের কোন আগ্রহ নেই। সকল মুসলিম নেতাই উপলব্ধি করেন, আমারই মুসলিম লীগকে পরিচালনা করার সবচেয়ে বেশি অধিকার রয়েছে। আমিও তেমনটাই করতে চাই এবং মহান সৃষ্টিকর্তার কৃপায় আমার চেষ্টা সফল হবে বলে আমি দৃঢ়চিত্ত।
আপনার বিশ্বস্ত।
স্বাক্ষর
এ. কে. ফজলুল হক

উৎসঃ “হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড” (কলকাতা), ২১ জুন ১৯৪২।
১৭১

পরিশিষ্ট পাঁচ
গভর্নর জন হার্বার্টকে লেখা এ. কে. ফজলুল হকের চিঠির সার-সংক্ষেপ
২ আগস্ট ১৯৪২

কংগ্রেস রেজুলেশনে যখন আমাদের হৃদয় ভারাক্রান্ত, হে মান্যবর ! সে মুহূর্তে আপনাকে এ পত্রখানা লিখতে আমি বাধ্য হচ্ছি। আমাকে যদি এ পত্রখানা না লিখতে হত ! কিন্তু আমাকে খােলাখুলি বলতে হচ্ছে, কম-বেশি আপনারও এ সমস্যা তৈরির পেছনে কিছু অবদান ছিল, আর এ কারণে এ পত্রখানা লেখা ছাড়া আমার অন্য কোন উপায় ছিল না। আপনি প্রদেশের গভর্নর আর আমি আপনার প্রধানমন্ত্রী ও একজন উপদেষ্টা। পারস্পরিক দায়-দায়িত্ব ও মূল্যবােধের ক্ষেত্রে আমরা যে সম্পর্ক বজায় রেখে চলেছি তাতে আমার কর্তব্য হল, বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে আপনার কোন ভুল সিদ্ধান্তকে সঠিক পথ দেখিয়ে দেওয়া। আমি থাকাতে কোন সমস্যা তৈরি হওয়া মানে, আমি আপনার তথা এ প্রদেশের জনগণের জন্য যথাযথ কর্তব্য পালন করছি না । আমার মনে হচ্ছে, বাংলার সাংবিধানিক ধারাকে সমুন্নত রাখার জন্য এ মুহূর্তে আপনার সাথে খােলাখুলি আলাপ করা প্রয়ােজন। একাধিকবার আমি আপনাকে সতর্ক সংকেত পাঠিয়েছি এবং বলেছি, আপনি যে নীতি অনুসরণ করছেন তাতে করে বাস্তবিক পক্ষে বাংলার সংবিধান বাতিল না হয়ে পারে না ……. বাংলার প্রধানমন্ত্রী হিসেবে এ বিষয়টি নিয়ে কথা না বলে আমি থাকতে পারছি না …….. প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমি দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করছি, বিষয়টি নিয়ে গভর্নর হিসেবে আপনার সাথে আমার যদি কোন সাংবিধানিক টানাপােড়েন শুরু হয়, তবুও পরিণামে যাই হােক না কেন, সত্য বলতে আমি কোনরূপ পিছপা হব না।
নির্দিষ্ট করে বলতে গেলে, দু’ ধরনের ঘটনা এখানে ঘটেছে ঃ প্রথম ভাগের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রায় প্রতিটি প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই আপনার সংশ্লিষ্টতা রয়েছে যা কিনা। আইনগত নয়, বিশেষ করে ভারত সরকারের আইনের আওতায় পড়ে না এমন। বিষয়েও আপনার সংশ্লিষ্টতা লক্ষ্য করা গেছে। বর্তমান পরিস্থিতি বলে দিচ্ছে, কিভাবে আপনার এ অতি সংশ্লিষ্টতা সমস্যা তৈরি করছে এবং কিভাবে মন্ত্রিগণ তাদের ক্ষমতার খুবই অল্পমাত্রার প্রয়ােগ ঘটাতে পারছেন। বর্তমান আইনের ধারাতে প্রশাসনিক কর্মকর্তাগণ ক্ষমতাবান না হলেও সকল ক্ষেত্রেই তারা দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। আবার মন্ত্রিগণ সকলেই ক্ষমতাধর হলেও প্রশাসনিক কাজে তাদেরকে ঠিকমত দায়িত্ব
১৭২
পালন করতে দেয়া হচ্ছে না। এখানে সাম্রাজ্যবাদের সেবাই তারা করে চলেছে আর মন্ত্রিগণ নামমাত্র পদবি ধরে বসে রয়েছেন।
দ্বিতীয় ভাগে রয়েছে, আপনার দ্বারা সরাসরি প্রশাসনিক কাজে হস্তক্ষেপ, যেন সকল প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি আপনার আজ্ঞাবহ হয়ে কাজ করে চলেছেন এবং মন্ত্রিদের কর্মকাণ্ডের দিকে তাকালে মনে হচ্ছে যেন এখানে কোন মন্ত্রীই নেই।
এখন আসল ঘটনায় আসি। মন্ত্রিদের দায়-দায়িত্বের উপর আপনার হস্তক্ষেপ। সম্পর্কে আমি দু’-একটি উদাহরণ টানব ঃ
প্রথমটি হল, গত এপ্রিলে, চাল অপসারণ নীতির বিষয়ে বাণিজ্য ও শ্রম মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম-সচিব বরাবরে আপনার নির্দেশ। ঐ আদেশে মনে হচ্ছিল যেন বাংলায় ভারত সরকারের আইন বাতিল হয়ে গিয়েছে আর ৯৩ ধারা মতে আপনিই প্রশাসনের প্রধান হিসেবে কাজ করছেন। লােকজনের খাদ্যদ্রব্য সরবরাহের এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত দেয়ার পূর্বে আপনার উচিত ছিল সেনা কর্তৃপক্ষ এবং কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদার বিষয়ে মন্ত্রিপরিষদের সাথে বিশদ আলােচনা করা। কিন্তু আপনি তেমন কোন কিছুই করেননি। আপনি ঐ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রীকেও পাঠালেন না যদিও সে তখন তৈরি ছিল ; আপনি তার পরিবর্তে যুগ্ম-সচিবকে পাঠিয়ে দিলেন । ঐ এলাকায় ধান-চালের পরিস্থিতি কোন অবস্থায় রয়েছে বা সেগুলাে সরানাের উপায় কি ইত্যাদি মূল্যায়ন না করেই তাকে সেগুলাে সরিয়ে নিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। যুগ্মসচিব বললেন, তিনি যখন আপনার দায়িত্ব পালন করছিলেন তখন আপনি অধৈর্য হয়ে দ্রুততার সাথে তিনটি জেলার অতিরিক্ত চাল সরিয়ে নিতে তাকে ২৪ ঘণ্টা সময় বেঁধে দিয়েছিলেন। আপনি তখনও কোন মন্ত্রীর সাথে কথা বলেননি, হয়ত মন্ত্রিদের উপর আপনার কোন বিশ্বাস নেই। যুগ্ম-সচিব তখন তাড়াহুড়া করে কোন ধরনের শর্ত ছাড়াই এবং জনগণের নিরাপত্তা চিন্তা করা ছাড়াই আপনার আদেশ পালন করতে গিয়ে তার এক বন্ধুকে অগ্রিম ২৪ লক্ষ রুপি দিয়ে কাজ করালেন। বর্তমানে আমরা বাংলাতে খাদ্য সমস্যায় ভুগছি শুধুমাত্র আপনার এ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং যুগ্ম-সচিবের অতি তৎপরতার ফলে।
এখন আমি নৌযান নীতির উপর আলােকপাত করতে চাই। এক্ষেত্রেও মন্ত্রিদের উপর আস্থা না রেখে আপনি প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের অনুরােধ ও পরামর্শের বশবর্তী হয়েছিলেন। আপনি আপনার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তথা প্রধানমন্ত্রীকেই তখন অবহেলা করেছেন। মনে হয় তখন গােপনে মিলিটারী কর্মকর্তাদের সাথে আপনি আলাপ করে ঐ সকল স্থায়ী প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের নিয়ে একটি কর্মপন্থা গ্রহণ করেছিলেন। আপনার সম্মতি ও নির্দেশানুযায়ী সবচেয়ে মারাত্মক যে কাজটি ঐ সকল প্রশাসনিক কর্মকর্তারা
১৭৩
করেছিলেন তাহল বঙ্গোপসাগরের তীরবর্তী দ্বীপে চাষাবাদের জন্য চলাচলকারী সকল নৌকা তারা বন্ধ করে দিয়েছিল। এসব কর্মকাণ্ডে আমরা বুঝেছি, মিলিটারী কর্মকর্তাদের সাথে আলাপ করে প্রশাসন দ্বারা আপনি এ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন যেখানে মন্ত্রিসভা এমনকি প্রধানমন্ত্রীকেও কোনরূপ ইঙ্গিত দেয়া হয়নি।
মন্ত্রিসভার আকার বৃদ্ধি এবং সংসদীয় সচিব নিয়ােগ সম্পর্কে আমার যে উদ্যোগ, সেগুলাের প্রতি আপনার পক্ষ থেকে বাধা দেয়ার বিষয়ে আমি কিছুই বলব না। আইন অনুযায়ী আপনার ক্ষমতা যতটুকুই থাকুক না কেন, মন্ত্রিসভা বৃদ্ধি ও সংসদীয় কর্মকর্তা নিয়ােগের ক্ষেত্রে আমারই চূড়ান্ত রায় প্রদানের ক্ষমতা পরিষ্কারভাবে দেয়া আছে। এ সম্পর্কে আমার অনুরােধগুলাে আপনাকে উপেক্ষা করতে দেখা গেছে। আপনার এমন আচরণ দেখে মনে হচ্ছিল যেন আপনি স্যার নাজিমুদ্দিন ও তাঁর অনুসারিদের মন্ত্রিসভায় আনতে আগ্রহী।
আমি লক্ষ্য করেছি, বেশ কয়েকদিন যাবত সচিবগণ যেসব পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন। তার সবগুলােই প্রায় নিজেদের ইচ্ছামাফিক বা প্রত্যক্ষ ও পরােক্ষভাবে আপনার অনুমতি নিয়ে, মন্ত্রিদের সম্পূর্ণ উপেক্ষা করেই তারা করে চলেছেন। যেমন, কিছুদিন। পূর্বে ইন্ডিয়ার গভর্নমেন্টের কাছে বাংলার সরকার অনুরােধ করল, বাংলার যে সকল কর্মকর্তাকে পাঠানাে হয়েছিল তাদেরকে যেন বাংলাতে পুনরায় ফেরত পাঠানাে হয় ; নির্দেশ অনুমােদন করা হল যে ডিফেন্স অব ইন্ডিয়া এ্যাক্টর অধীনে ৭৬-বি ধারা অনুযায়ী যে ক্ষমতা প্রাদেশিক সরকারের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে তা স্থানীয় কর্মকর্তাগণ করবেন। এসব ক্ষেত্রে আমার সাথে কোন আলােচনাই করা হয়নি যদিও এগুলাে খুবই গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম ছিল।
সংশ্লিষ্ট মন্ত্রিদের উপেক্ষা করে স্থায়ী কর্মকর্তাগণ কিভাবে কাজ করে চলেছেন তা এখন আমি বলছি । নােয়াখালীর সানােয়াতে মেয়েদের নিয়ে যে ঘটনা ঘটেছে আমি তা দিয়েই শুরু করতে চাই। ফেনীর একজন ডেপুটি কালেক্টর যিনি ঐ সময়ে অতিরিক্ত উপ-বিভাগীয় কর্মকর্তা, তিনি নিজে টেলিগ্রাম করে জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে ঘটনা সম্পর্কে জানালেন এবং সেখানে তাঁর নিজের কি করণীয় তা জিজ্ঞেস করলেন। ডেপুটি কালেক্টরের এ কাজে কয়েকজন কর্মকর্তা অসন্তুষ্ট হলেন ; তারা মনে করল, টেলিগ্রাম করাটা ছিল দোষী ব্যক্তির দোষ প্রমাণের বড় একটি প্রমাণ। ঐ অফিসার, যিনি শুধুমাত্র তার কর্তব্য পালন করেছেন, তাকেও ঐ কর্মকর্তাদের সুপারিশে প্রধান। সেক্রেটারি তৎক্ষণাৎ বদলি করে ফেনী থেকে নিয়ে এলেন। আর আমি এখানকার। প্রধানমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আমার সাথে এ বিষয়ে কোন আলােচনাই তিনি
১৭৪
করেননি। অনেকদিন পর যখন ফেনীর ঐ ভয়ঙ্কর অত্যাচারের ঘটনা আমি নিজে অনুসন্ধান করতে যাই তখন ঐ বদলি করার ঘটনা জানতে পারি ..
এক্ষেত্রে আমি আপনাকে স্মরণ করাতে চাই, যখন আমি ফেনী যেতে তৈরি হচ্ছিলাম তখন আপনি আমাকে সেখানে না যেতে পরামর্শ দিয়েছিলেন ; কারণ, আপনি মনে করেছিলেন, যদি আমি সেখানে যাই তাহলে সেখানকার স্থানীয় কর্মকর্তাগণ হতবুদ্ধি হয়ে পড়বেন। আমি আপনাকে পূর্বেই বলেছি, কাউকে কোনরূপ অস্বস্তিতে ফেলার অভিপ্রায় আমার ছিল না, আমি মনে করেছিলাম, দুস্থ লােকদের ভালমন্দ বিষয়ে খোঁজ-খবর করতে আমার সেখানে যাওয়া কর্তব্য। আমি যখন সেখানে গেলাম তখন লক্ষ্য করলাম, ফেনীর ঐ এলাকার ঘটনাস্থলে যাতে আমি না যেতে পারি সেজন্য চট্টগ্রাম বিভাগ থেকে সকল কর্মকর্তারা এসে সেখানে জড় হয়েছেন। ঐ বিভাগের কমিশনার আমাকে স্পষ্ট জানিয়ে দিলেন, আপনার সেক্রেটারি তাকে একটি তারবার্তা পাঠিয়েছেন যেন তিনি আমার যাত্রা বাতিল করার ব্যবস্থা নেন। কর্মকর্তাদের সাথে কোনরূপ বাকবিতণ্ডায় আমি নিজেকে জড়াইনি, তবে যে মহিলারা ঐ ঘটনায় ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন তাদের আত্মীয়-স্বজন এবং যারা মারা গেছেন তাদের আত্মীয়-স্বজনদের সাথে আমি দেখা-সাক্ষাৎ করেছি। আরও কিছু প্রমাণাদি আমার হাতে এসেছে যাতে করে আমি একদম পরিষ্কার ধরতে পেরেছি, ঐখানে কি ঘটনা ঘটেছিল । ফোন করে ডেপুটি কালেক্টরকে বদলি করা, আপনাকে এ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন হতে দেখা আর আমাকে সেখানে যেতে স্থানীয় কর্মকর্তাদের বাধা প্রদান এসবের কারণ আমার কাছে। এখন পরিষ্কার ……..
সাংবিধানিকভাবে নিয়ােগপ্রাপ্ত একজন গভর্নরের মত আচরণই আপনার ক্ষেত্রে শােভা পায়, কোন স্থায়ী কর্মকর্তাদের মুখপাত্র বা কোন দলীয় মুখপাত্রের ভূমিকাতে আপনাকে মানায় না। অন্যভাবে বলতে গেলে, প্রাদেশিক স্বকীয়তার জন্য আপনার উচিত সততার সাথে এর কর্মকাণ্ড পরিচালনা করা, আইনের ৯৩ ধারার মত ছদ্মবেশে স্বৈরাচারী ক্ষমতা প্রয়ােগের মত নয়।
উৎসঃ বেঙ্গল লেজিসলেটিভ এসেম্বলী প্রসিডিংস, ৫ জুলাই, ১৯৪৩, ভলিউম ৬৫,
পৃষ্ঠা ঃ ৪৬-৫৪।
১৭৫

পরিশিষ্ট ছয়
গভর্নর জন হার্বার্টকে লেখা এ. কে. ফজলুল হকের পত্র
তারিখ ১৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ ১১৪-এ নিউপার্ক স্ট্রিট, কলকাতা

শ্রদ্ধেয় স্যার জন,
আপনার ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৪৩ তারিখের পত্রের উত্তর দিতে গিয়ে জানাতে চাই, আপনি যা “সরকারি সিদ্ধান্ত” বলে উল্লেখ করেছেন, সে সম্পর্কে আগে থেকে আপনার সাথে আলােচনা না করায়, আমার ব্যবহার সম্পর্কে আপনাকে ব্যাখ্যা প্রদান করার মত কিছু নেই ; তবে আপনার চিঠিতে যে ধরনের রুচিবিরুদ্ধ ভাষার অবতারণা করা হয়েছে সে সম্পর্কে আপনাকে কিঞ্চিত সতর্কতা প্রদানপূর্বক এ পরামর্শ আমার প্রদান করা কর্তব্য, তাহল, ভবিষ্যতে এ জাতীয় ভাষার প্রয়ােগ গভর্নর ও তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পত্রালাপে এড়িয়ে চলা উচিত।
গত সাক্ষাতে আমি ঠিকভাবে বােঝাতে ব্যর্থ হয়েছি যে, মেদিনীপুরের ঘটনায় কোন তদন্তমূলক ব্যবস্থা গৃহীত হয়নি। সাক্ষাৎটি ১৫-২০ মিনিট স্থায়ী হয়েছিল আর মেদিনীপুর সম্পর্কে ৫ মিনিটের বেশি আলাপ হয়নি। গত পাঁচ মাসের মধ্যে এই প্রথম আমি মেদিনীপুরে গিয়েছিলাম তাও মাত্র ৬ ঘণ্টার জন্য। আমি মাত্র দু’-তিনটি গ্রাম ঘুরেছি, যে গ্রামগুলাে মহিলাদের ঐ ঘটনার কিছুটা দেখেছে। আমি আপনাকে যা জানাতে চেয়েছিলাম তা হল, মূলত ঐ ঘটনায় কোন তদন্ত হয়নি আর তাই ঘটনা বাড়িয়ে বলা হচ্ছে কিনা অথবা আদৌ এর কোন সত্যতা আছে কিনা তা নির্ণয় করা মুশকিল। মেদিনীপুরের বিষয়ে আমার পক্ষে আপনাকে প্রতিবেদন আকারে কোন কিছুই জানানাে সম্ভব নয়। বস্তুত আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে মেদিনীপুরের বিষয়ে সরকারি তথ্য কি আছে তা জানতে চাই। তারা আমাকে প্রতিবেদন বা ঐ জাতীয় কোন তথ্যই দিতে পারেনি ; শুধুমাত্র গতকালের অধিবেশনের সময় জনাব পর্টার অগােছালাে একটি নােট আমার হাতে ধরিয়ে দেন। গত অধিবেশনে যেসব চূড়ান্ত অভিযােগের উপর তর্ক-বিতর্ক হচ্ছিল, মিঃ পর্টারের দেয়া ঐ প্রতিবেদনে তার ছিটেফোঁটাও উল্লেখ ছিল না। তাই ইহা অসত্য যে, আমি আপনাকে কোন প্রতিবেদনই দেইনি। এ জাতীয় মন্তব্যে আপনি কি বুঝাতে চাচ্ছেন তা আমার জানা নেই তবে আমি বলব, মেদিনীপুরে
১৭৬
আসলেই কি ঘটেছিল তা আমার জানা নেই এবং এ বিষয়ে জেলায় কি ঘটছে সে সম্পর্কেও আপনাকে আমি কোন তথ্য দিতে পারব না।
আপনাকে জানাতে চাই, মুলতবী প্রস্তাব ওঠে শুক্রবার, যা স্বরাষ্ট্র দফতরের সবাই জানে, আর আমি নিশ্চিত যে আপনিও বিষয়টি জানতেন যে, মেদিনীপুরের ঘটনায় বড় রকমের অভিযােগ তৈরি হতে যাচ্ছে। অধিবেশনের শুরুতে ডাঃ শামা প্রসাদ মুখার্জী বিস্তারিতভাবে ঐ ঘটনা সম্পর্কে কিছু না বললেও এমন কিছু ইঙ্গিত তিনি তার বক্তব্যে তুলে ধরেছেন যে তার ফলে অধিবেশনে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। অধিবেশনে সবার পক্ষ থেকে তদন্তের দাবি তােলার বিষয়টি যে আপনি বুঝতে পারেননি তা আমার একেবারেই বিশ্বাস হয় না। আপনার কাছে যদি মনে হয়ে থাকে যে, কোন তদন্তের দরকার নেই, তাহলে যে যত জোর দাবি করুক না কেন, আপনি শুধু আমাকে একটিবারের জন্যও যদি বলে পাঠাতেন যে, আপনি তদন্তের পক্ষে নেই তাহলে আমি কিছুতেই সরকারের পক্ষ থেকে এ তদন্ত হতে দিতাম না ; আর সকলকে জানাতাম, আপনি এ তদন্তের বিরুদ্ধে। আমি এর সাথে আরও যােগ করতে চাই, গত শনিবার থেকে আমরা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছাকাছি রয়েছি যারা জানত যে আমরা তদন্তের পক্ষে অবস্থান করছিলাম। এত কিছুর পর কিভাবে আমি বিশ্বাস করব যে তদন্তের বিষয়ে আপনি কিছুই অবগত ছিলেন না ? আপনি আপনার কাজের অবহেলা করেছেন আর আমাকে দোষারােপ করছেন। আমি যখন হাউসে ছিলাম তখন লক্ষ্য করেছি শুধুমাত্র দায়িত্বশীল সদস্যরাই কঠিন অভিযােগ করছিলেন না বরং তদন্তের দাবির বিপক্ষে কোন একজন সদস্যও কথা বললেন না। ইউরােপীয় দলও তখন নিশ্চপ ছিল এবং বিরােধীদল আমাদেরকে দোষারােপ করতে থাকল, কেন আমরা আরও পূর্বে তদন্তের ব্যবস্থা করিনি। এসব কারণে আমি আমার সকল সহকর্মীর সাথে আলাপ করে বুঝতে পেরেছি, যে তদন্তের ব্যবস্থা নেয়া হয়েছিল তার দাবি কোনভাবেই উপেক্ষা করা সম্ভব ছিল না।
আমি অধিবেশনে গতকাল যে বক্তৃতা দিয়েছি তার একটি কপি এই পত্রের সাথে আপনাকে পাঠালাম।
আপনার চিঠিতে আমি পরিষ্কার বুঝতে পেরেছি, তদন্ত কমিশন গঠনে আপনি সম্মতি দিতে মােটেও তৈরি ছিলেন না। যদি তাই হয়, তাহলে আমার একটি পথ খােলা ছিল, তাহল সরকারের পক্ষ থেকে তদন্ত কমিশন গঠনের জন্য আমি গতকাল যে বিবৃতি দিয়েছিলাম তা প্রতিশ্রুতি আকারে না গ্রহণ করার জন্য হাউসে নতুন করে ব্যাখ্যা দেয়া এবং তা করতে আপনার চিঠিটি সবার সামনে তুলে ধরে নিজের অবস্থান
১৭৭
পরিষ্কার করা। অবশ্য আপনার অনুমতি না নিয়ে তা আমি করতে পারি না। আমি এবং আমার সহকর্মিগণ আইন পরিষদের কাছে দায়বদ্ধ এবং তদন্ত কমিশন কেন গঠন করা হয়নি তার যথােপযুক্ত ব্যাখ্যা চাওয়ার অধিকার পরিষদের রয়েছে। আর ব্যাখ্যা দেয়ার মত আপনার পাঠানাে চিঠিটিই শুধু আমার কাছে ছিল ।
আজ সকাল ১০টায় আপনার সাথে আমার একটি সাক্ষাতের সময় ধার্য ছিল। আমি মৌখিকভাবে আপনার সেক্রেটারিকে জানিয়ে দিয়েছি, আমার পক্ষে দেখা-সাক্ষাৎ করা সম্ভব নয়। কারণ, চিঠির উত্তরে আপনি যে ভাষা প্রয়ােগ করেছেন তা সংশােধন না করা হলে এমন সাক্ষাতে কোন ফল পাওয়া যাবে না আর তা রাগের মানসে চলতে থাকবে।
আপনার একান্ত
(স্বাক্ষর) এ. কে. ফজলুল হক

উৎসঃ এ. কে. ফজলুল হক, “বেঙ্গল টুডে” (কলকাতা, ১৯৪৪), পৃষ্ঠা ২৮-৩১।
১৭৮