This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
সত্তরের নির্বাচন
শেখ মুহম্মদ ইব্রাহীম
ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের স্বাধীনতার ইতিহাসে এক অনন্য মাইলফলক। উনসত্তরের গণজোয়ার সারা বাংলা মাতিয়ে তােলে। প্রতিটি বাঙালি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠে নিজেদের স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে। এ সময়কার নানা ঘটনা পরম্পরায় স্বাধিকারের আন্দোলন মােড় নেয় স্বাধীনতা অর্জনে। বিপ্লবী ছাত্র-জনতা আন্দোলনকে এগিয়ে নিয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বলিষ্ঠ নেতৃত্বে তা আরাে তেজোদীপ্ত রূপলাভ করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার ঘােষণা অনুযায়ী ১৯৭০-এর ১ জানুয়ারির মধ্যরাত থেকে রাজনৈতিক সভা-সমিতি, মিটিং-মিছিলের অনুমতি মিলে। রাত ১২টার পর থেকে মিছিলে মিছিলে মুখরিত হয়ে ওঠে সারা বাংলার আনাচে-কানাচে। এতে ছাত্র সংগঠনগুলাে সক্রিয় হয়ে ওঠে। ১ জানুয়ারি শ্রমিক লীগের উদ্যোগে নুরুল হকের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভা হয়। সভায় বক্তব্য প্রদান করেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, মােহাম্মদ শাহজাহান, কেএম ওবায়দুর রহমান, সিরাজুল আলম খান, আবদুল মান্নান, রুহুল আমীন ভূইয়া, তােফায়েল আহমদ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, আবদুল কুদুস মাখনসহ বিভিন্ন নেতৃবৃন্দ। সভায় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং পশ্চিমাগােষ্ঠীর শােষণের অবসানকল্পে দৃঢ় শপথ নেয়া হয়।
সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের অবস্থান আগের মতাে ঐক্যবদ্ধ থাকলাে না সত্তরে এসে। সারা দেশে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক ভিত এতই শক্তিশালী হয়ে উঠলাে তারা একাই যে কোনাে আন্দোলন গড়ে তুলতে সক্ষম হলাে। ছাত্রলীগের এই বিকাশ শুরু হয় ছয়দফা আন্দোলনের পর থেকে। উনসত্তরে ছাত্রলীগ একক সংগঠনে পরিগণিত হয়। তাই সত্তরে বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ বিপুল ভােটে
জয়লাভ করে। একটা প্রমাণ থেকে বােঝা যায়, ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা কতখানি ছিল। ১৯৭০-৭১ সালে চট্টগ্রাম কমার্স কলেজ ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ দুটো প্যানেলে নির্বাচন করে। একটি সরাসরি ছাত্রলীগ, অপরটি নির্বাচনী দল ‘দিশারী’ নাম দিয়ে। দ্বিধাবিভক্তির পেছনে নেতৃত্বের কোন্দল এবং আদর্শগত মতদ্বৈততা ছিল। কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের এই বিভক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টির পর জাসদ ছাত্রলীগের জন্মের পূর্বাভাস পাওয়া যায়। কমার্স কলেজে ছাত্রলীগের দুটো প্যানেল সত্ত্বেও নির্বাচনী দল ‘দিশারী’ সমর্থিত মােস্তফা ইকবাল-জাহেদ পরিষদ বিপুল ভােটে জয়লাভ করে। দ্বিতীয় হয় ছাত্রলীগ-সমর্থিত আহাদ-আমিন পরিষদ। এতে প্রমাণিত হয় ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা কতখানি তুঙ্গে ছিল। কমার্স কলেজের ছাত্র সংসদ নির্বাচনের দ্বিধাবিভক্তিই বাংলাদেশ পরবর্তী মুজিববাদী ও জাসদ ছাত্রলীগের জন্ম হয়।
১৯৭০-এর ১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বরে তােফায়েল আহমদের নেতৃত্বে ছাত্রলীগের এবং সামসুদ্দোহার নেতৃত্বে ছাত্র ইউনিয়ন ও এনএসএফ (দোলন)-এর যৌথ সভা হয়। আইয়ুবের বিদায়ে ফজলুল কাদের চৌধুরী কনভেনশন মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট হন।
বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের দলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে নানা দাবি উত্থাপন করে। ন্যাপের দাবি ছিল ১১ দফার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ নির্বাচন, প্রগ্রেসিভ লীগ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার এবং জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার আবেদন জানায়। আওয়ামী লীগ ঘােষণা করে নির্বাচনে তারা করাচির সকল আসনে প্রার্থী মনােনয়ন দেবে। পশ্চিম পাকিস্তানে লুখােরের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের একাংশ মমতাজ দৌলতানার কাউন্সিল মুসলিম লীগের সাথে নির্বাচনী মাের্চা গঠন করে। পূর্ব ও পশ্চিমের আওয়ামী লীগের চরিত্র ভিন্নতর। পশ্চিমের আওয়ামী নেতৃবৃন্দ পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়ার প্রতি সবসময় অনীহা প্রকাশ করতেন। সােহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগের স্রষ্টা শেখ মুজিবুর রহমান নিজেই। এ ব্যাপারে ওয়াকিবহাল ছিলেন। ৩ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চট্টগ্রাম সফরে এলে ঘােষণা দেন, নির্বাচন যথাসময়ে অনুষ্ঠিত হবে- এতে কেউ বাধা দিলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। নূরুল আমিন বলেন, নির্বাচনের প্রাক্কালে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা উচিত।
৪ জানুয়ারি ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তার বক্তব্যের মাধ্যমে ন্যাপসহ অন্যান্য দলের সাথে ঐক্যজোট গঠনের প্রস্তাব নাকচ করে দেন। বঙ্গবন্ধু এককভাবে নির্বাচনী প্রস্তুতি নিতে থাকেন। ৫ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের প্রাক্কালে বিমানবন্দরে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সত্যিকার অর্থে দেশপ্রেমিক।’ ৬ জানুয়ারি মওলানা ভাসানী টঙ্গীতে এক বিতর্কিত বক্তব্যে বলেন, ‘স্বায়ত্তশাসন নির্বাচনী ইস্যু হলে জনগণের মাঝে তিক্ততা বৃদ্ধি পাবে। নির্বাচনের আগে তিনি স্বায়ত্তশাসনের মীমাংসা চান। স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি ৬ দফা সম্বলিত ১১ দফার ভিত্তিতে হবে কিনা তাও তিনি উল্লেখ করেননি। ছাত্রলীগ ১১ দফা পালন সপ্তাহ শুরু করে আন্দোলনকে চাঙ্গা করে তােলে। এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান। পিডিপি থেকে সরে গিয়ে বলেন, তিনি নিরপেক্ষ ব্যক্তি হিসেবে রাজনীতিতে অবদান রাখতে চান। প্রাদেশিক কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা। শফিকুল ইসলাম পাকিস্তানের রাজধানী ইসলামাবাদ থেকে ঢাকায় স্থানান্ত রের আবেদন জানান। মওদূদী স্বায়ত্তশাসন ও সমাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে। কঠোর বিরােধিতা করে বক্তব্য দেন। ঢাকা শহরে আওয়ামী লীগ বিশাল মশাল মিছিল বের করে। | ১১ জানুয়ারি পল্টনে আওয়ামী লীগের জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ‘৫৪ সালের নির্বাচনী জোট এবং পরবর্তী অসুবিধার বর্ণনা দিয়ে কোনাে ধরনের নির্বাচনী ঐক্যের সম্ভাবনাকে বাতিল করে দেন। তিনি বলেন, আমরা নেতা বা দলের ঐক্য চাই না। আমরা চাই জনগণের ঐক্য। বাঙালিদের শােষণকারীরাই আজ ৬ দফার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে। তিনি অবশ্য পূর্বে সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে সংখ্যাসাম্য নীতি মেনে নেয়ার জন্য অনুশােচনা করেন। তিনি বাঙালি জাতিকে অধিকার আদায়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান। এ জনসভায় গগনবিদারী স্লোগান ওঠে। জাগাে জাগাে বাঙালি জাগাে। আমার নেতা, তােমার নেতা শেখ মুজিব শেখ মুজিব । আমার দেশ, তােমার দেশ বাংলাদেশ বাংলাদেশ। জাতীয়তাবাদী এসব স্লোগান শুধু পল্টনে নয়, ছড়িয়ে পড়ে সারা বাংলার আনাচে-কানাচে। পল্টনের এক সভায় ঢাকার দ্বিতীয় রাজধানী আইয়ুব নগরের নাম ‘শেরেবাংলা নগর’, ‘আইয়ুব এভিনিউ’-এর নাম মানিক মিয়া
এভিনিউ’ এবং রেসকোর্স ময়দানের নাম ‘সােহরাওয়ার্দী উদ্যান’ রাখা হয়। জনগণের অকুণ্ঠ সমর্থনের মাধ্যমে। ন্যাপের কাউন্সিল অধিবেশনে ওয়ালীখান ঘােষণা দেন, শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠাকল্পে তার দল আগামী নির্বাচনে অংশ নেবে। মওদূদা বলেন, পাকিস্তান দুটি মারাত্বক চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন- একটি হলাে সমাজতন্ত্র, অন্যটি হলাে শেখ মুজিবের ৬ দফা। প্রাদেশিক জামায়াতের আমির গােলাম আযমও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে শেখ মুজিবকে দোষারােপ করেন। জামায়াত জাতির সামনে ৩ দফা পেশ করে : ইসলামিক শাসনতন্ত্র, গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও পাকিস্তানের অখণ্ডতাকে সংহত করা। তারা। বঙ্গবন্ধুকে বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে আখ্যায়িত করে। এর প্রত্যুত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন, স্বায়ত্তশাসন মানে আলাদা হওয়া নয়। শক্তিশালী কেন্দ্রের তুলনায়, শক্তিশালী পাকিস্তান আরাে বেশি প্রয়ােজন। ইসলাম টিকে থাকবেই। ইসলামকে কায়েমী স্বার্থের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ইসলাম চায় সামাজিক ন্যায়বিচার । ইসলামের নাম ব্যবহার করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার চেষ্টা করা উচিত নয় । মওদূদীর ইসলাম আর নবী করিম (সা:)-এর প্রদর্শিত ইসলামে অনেক ফারাক। আমরা আমাদের প্রিয় নবী (সা:)-এর প্রবর্তিত ইসলামের একান্ত অনুসারী। কারাে ন্যায্য দাবির কথা ইসলামের পরিপন্থি নয় । জামায়াতে ইসলামীর মনগড়া ইসলামের জন্য সমগ্র আলেম সমাজকে অহেতুক দোষারােপ না করার জন্য অনুরােধ জানিয়ে এই সময় বিবৃতি দেন, পূর্ব পাকিস্তান জমিয়তে ওলামায়ে ইসলামের সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা সামসুদ্দীন কাজেমীসহ আরাে অনেক ওলামায়ে কেরাম। তারা বলেন, মওদূদীর সমর্থকদের সাথে দেশের প্রকৃত ইসলামপন্থিদের কোনাে সম্পর্ক নেই। গােলাম আযমরা যে ইসলামের নামে জিহাদে অবতীর্ণ হয়েছেন তা মদিনার ইসলাম নয়। বরং তা আমেরিকার ইসলাম তথা মওদূদী মতবাদ ও সরাসরি গােমরাহি। এ কথা দেশের বিজ্ঞ আলেম সমাজ অনেক আগেই স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিয়েছেন। (দৈনিক পাকিস্তান, ২০ জানুয়ারি ১৯৭০] ১২ জানুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানি ন্যাপ নেতা মাহমুদুল হক ওসমানা আওয়ামী লীগ ও ন্যাপকে তাদের সাথে নির্বাচনী মাের্চা গঠনের আহ্বান জানান। তা না হলে জনগণ ঐক্য গঠনে বাধ্য করবেন- এ হুমকি দেন।
বঙ্গবন্ধুর ঘােষণার পরও ন্যাপের বারবার ঐক্যের আহ্বান তাদের দৈন্যদশা প্রমাণ করে। ভাসানী জানান, তার দল হয়তাে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে পারে। নির্বাচনকে লক্ষ্য রেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রদেশব্যাপী সফর শুরু করেন। প্রথমে ময়মনসিংহে রফিক ভূইয়ার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, আবদুল মান্নান, আবদুল মােমেন, ব্যারিস্টার শওকত আলী খানসহ অনেকেই বক্তব্য দেন। তারা ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র ও শােষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করেন। এ সময় চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠের জনসভায় অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি জানান। ১৫ জানুয়ারি সমগ্র পাকিস্তানে ভােটার সংখ্যা ৫ কোটি ৬০ লাখ বলে সরকারি প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানাে হয়। | ১৯৭০-এর ১৭ জানুয়ারি সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলন আরেক দিকে বাঁক নেয়। ছাত্রলীগ ও ডাকসু কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করে। এর প্রতিবাদে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া ও মেনন গ্রুপ) এনএসএফ (দোলন) বাংলা ছাত্রলীগ বিবৃতি দেয়। সারা দেশে আন্দোলনের ক্ষেত্র ও বিভিন্ন ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় অন্য সব ছাত্র প্রতিষ্ঠানের বিরােধিতা সত্ত্বেও ছাত্রলীগ ডাকসুর সমন্বয়ে গঠিত কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের হাতে নেতৃত্ব চলে আসে। ছাত্রলীগ ৬ দফা ও ১১ দফার সপক্ষে আন্দোলন চালিয়ে যায়। সারা প্রদেশে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কালাে পতাকা উত্তোলন করা হয় । ১৭ জানুয়ারি ইসলামী ছাত্রসংঘের প্রাদেশিক সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে মাওলানা আবুল আলা মওদূদী আগমন করেন। ১৮ জানুয়ারি। পল্টনের জনসভায় তার বক্তৃতা দেয়ার কথা থাকলেও কোনাে এক অদৃশ্য কারণে তিনি উপস্থিত হননি। সভায় চট্টগ্রাম জামায়াতের আমির ওসমান রমজ ৬ দফা ও ১১ দফার বিরুদ্ধে বিষােদগার করলে সাথে সাথে জনতা তীব্র প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে এবং প্রচণ্ড গােলমাল শুরু হয়। জামায়াত সভামঞ্চের পাশে চাঁদোয়া ও পর্দা দিয়ে ঘেরা এক কক্ষ তৈরি করেছিল। সংঘর্ষের শুরুতে জামায়াত কর্মীদের হুইসেলের সাথে সাথে এই কক্ষ ও মঞ্চের নিচ থেকে লাঠিসোটা, হকিস্টিক নিয়ে নিরীহ জনতাকে আক্রমণ শুরু করে। ক্রুদ্ধ জনতাও তাদের লাঠিসোটা নিয়ে মারমুখী পাল্টা আক্রমণ। শুরু করে। বিক্ষুব্ধ জনতা জামায়াত কর্মীদের হটিয়ে দিয়ে সভামঞ্চ ও প্যান্ডেলে আগুন ধরিয়ে দেয়। মতিঝিলের হােটেল ইডেনের ইসলামী ছাত্রসংঘের (বর্তমান ছাত্র শিবির) সম্মেলন মঞ্চও ভেঙে দেয়। সংঘর্ষে জামায়াতের দু’জন কর্মী নিহত এবং উভয় পক্ষে অনেকেই আহত হয়। সংবাদপত্রের ফটোগ্রাফারেরা জঙ্গি জামায়াত কর্মীদের হাতে লাঞ্ছিত হন। জামায়াতের এই ন্যক্কারজনক ঘটনার প্রতিবাদে সর্বদলীয় ছাত্রসমাজ তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯ জানুয়ারি সারা দেশে কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে হরতাল পালিত হয়। ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামীর সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা হয়। ভাসানীসহ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ নিন্দা জ্ঞাপন করেন জামায়াতের বিরুদ্ধে। এদিন ঢাকায় তােফায়েল আহমদের সভাপতিত্বে ছাত্রসভায় পবিত্র ধর্মের নামে মিথ্যার রাজনীতি না করার জন্য জামায়াত ও ছাত্র সংঘকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন। এতে নূরে আলম সিদ্দিকী, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, আবদুল কুদুস মাখনসহ আরাে কয়েকজন বক্তব্য দেন। ছাত্রলীগের এ সভায় আইয়ুব পার্কের নাম পরিবর্তন করে মতিউর রহমান পার্ক, আইয়ুব গেটের নাম ‘আসাদ গেট’, ফার্মগেটের নাম ‘আনােয়ারা গেট’, এলিফ্যান্ট রােডের নাম ‘সার্জেন্ট জহুর রােড’, বকশিবাজার রােডকে ‘আবদুল লতিফ রােড’ নামকরণের প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। ছাত্রলীগ মশাল মিছিল বের করে। অন্যান্য ছাত্র সংগঠন ১১ দফা আন্দোলনকে ব্যাপকতর করার শপথ নেন। টাঙ্গাইলের সন্তোষে মওলানা ভাসানী কৃষক সম্মেলনে চাষীমজদুরদের মুক্তি সংগ্রামে আপস নেই বলে জানান। হঠাৎ করে তিনি বলে বসেন, ভােটের আগে ভাত চাই।’ সাথে সাথে নির্বাচন বিরােধী স্লোগান উঠে যায় সমাবেশে। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন ড. আলিম আল রাজী, আতাউর রহমান খান, শাহ আজিজুর রহমান, ওয়ালী ন্যাপের মহীউদ্দিন আহমদ প্রমুখ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এক ভাষণে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার আহ্বান জানিয়ে বলেন, শক্তির প্রয়ােগ গণতন্ত্রে আস্থাহীনতার পরিচায়ক। | ২০ জানুয়ারি আসাদ দিবস উপলক্ষে ভাসানী ন্যাপ আবার ঘােষণা করে
নির্বাচন নয়, বিরামহীন সংগ্রামই মুক্তির একমাত্র পথ। ২১ জানুয়ারি ১১ দফার সমর্থনে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে এক মহিলা সমাবেশ হয়। তাতে বক্তব্য রাখেন আমেনা বেগম, সাজেদা চৌধুরী, রাফিয়া আখতার ডলি, মমতাজ বেগমসহ আরাে কয়েকজন। ২৩ জানুয়ারি মওদূদী ঢাকা থেকে লাহাের ফিরে যান অনেকটা অপাংতেয় হয়ে। বাংলার বুকে মওদূদীর জনসভা করা সম্ভব হলাে না। জনতার রুদ্ররােষে। এজন্য মওদূদী ইসলামবিরােধী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের দায়ী করেন। ঢাকায় উত্তেজনাকর পরিস্থিতির কথা বলেন। রাজনৈতিক গতিধারা থেকে আওয়ামী লীগ বিচ্ছিন্ন হচ্ছে এ অভিযােগ এনে আমেনা বেগম আওয়ামী লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন। আসলে কেন জানি মিজানুর রহমান চৌধুরীর আওয়ামী লীগে অবস্থান তার সহ্য হচ্ছিল না। বহুদিনের পরীক্ষিত নেতা মিজান চৌধুরীকে বাদ না দেয়ায় আমেনা বেগমের আওয়ামী লীগ থেকে প্রস্থান। বঙ্গবন্ধু এদিন কুমিল্লায় মিজান চৌধুরীদের নিয়ে এক বিশাল জনসভা করেন। ( ২৪ জানুয়ারি অন্য ছাত্র সংগঠনগুলাে যৌথভাবে গণঅভ্যুত্থান দিবস পালন করে পল্টনে জনসভার মাধ্যমে। ছাত্রলীগ সমাবেশ করে বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে । সভায় ১১ দফার সপক্ষে বলিষ্ঠ জনমত গঠনের আহ্বান জানানাে হয়। এ সময় ছাত্রলীগ কেন অন্যান্য ছাত্র সংগঠন নিয়ে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন করছে না- এ প্রশ্নের জবাবে ছাত্রলীগের বক্তব্য ছিল। এরূপ- ‘অন্য ছাত্র সংগঠনগুলাের রাজনৈতিক সহযােগী সংগঠনগুলাে ৬ দফা ও ১১ দফার ব্যাপারে দৃঢ় মত পােষণ করছে না। অথচ এই ব্যাপারে আওয়ামী লীগের মতামত খুবই সুদৃঢ়। যেমন এনএসএফ (দোলন)-এর। কোনাে রাজনৈতিক সংগঠন নেই। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন ভাসানী ন্যাপের সাথে সম্পৃক্ত তারা নির্বাচন চায় না এবং ৬ দফা ও ১১ দফাকে দৃঢ় সমর্থনও দেইনি। ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া ওয়ালী ন্যাপের সাথে সংযুক্ত। পশ্চিমা নেতা হিসেবে এ ব্যাপারে ওয়ালী খানের মতামত পরিষ্কার নয়। আর বাংলা ছাত্রলীগ আতাউর রহমান খানের বাংলা জাতীয় লীগের সাথে যারা ৬ দফাকে সহ্য করতে পারে না। এমতাবস্থায় ৬ দফা ও ১১ দফাকে সামনে নিয়ে এগুতে হলে এভাবে জগাখিচুড়ি দিয়ে সম্ভব নয়। সামনে জাতীয় নির্বাচন। জনগণের কাছ থেকে এ দফাগুলাের ভিত্তিতে ম্যান্ডেট
নিতে হবে। তাছাড়া বাংলার আপামর ছাত্র-জনতার অধিকাংশই ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আবদ্ধ। এ বিচারে ‘একলা চলাে নীতি’ গ্রহণ করে জনতার রায় আদায় করতে হবে। ২৫ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তােফায়েল আহমদের নেতৃত্বে পল্টনে জনসভা করে। ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র
রচনার দাবি জানিয়ে বক্তব্য দেন শেখ ফজলুল হক মনি, আবদুর রাজ্জাক, আবদুর রউফ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদুস মাখন, রাফিয়া আখতার ডলিসহ আরাে কয়েকজন নেতৃবৃন্দ। এ সভায় বঙ্গবন্ধুর প্রতি হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, তিনি যদি ৬ দফা ও ১১ দফা দাবি থেকে বিচ্যুত হন তাহলে তাকে ক্ষমা করা হবে না। রাজনৈতিক দলগুলাের পাকিস্তানজুড়ে ভিত্তি থাকলাে না। দল ও নেতারা পূর্ব ও পশ্চিমমুখী হয়ে পড়ে এবং রাজনৈতিক ধারা দু’ধারায় প্রবাহিত হতে থাকে। পাকিস্তানভিত্তিক দলের শূন্যতা সৃষ্টি হয়। পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগ, পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে ভুট্টোর পিপিপি এবং সীমান্ত প্রদেশে কাইয়ুম লীগ ও সীমান্ত বেলুচিস্তানে ওয়ালী ন্যাপের প্রভাব বেড়ে যায়। বামপন্থী নেতৃত্বের মধ্যেও আঞ্চলিক মনােভাব গড়ে ওঠে। যেমন ন্যাপ-এর প্রাদেশিক নেতা অধ্যাপক মােজাফফর ১১ দফার ডাক দিলেও পশ্চিম পাকিস্তানের ওয়ালী খান এ ব্যাপারে নিচুপ ছিলেন। ১৯৭০-এর ১ ফেব্রুয়ারি পল্টনে ৬ দফা ও ১১ দফার বিরুদ্ধাচারণ করায় পিডিপির সভা ভঙ্গ হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধু টাঙ্গাইলের বিশাল জনসভায় ৬ দফার ভিত্তিতে দলীয় ঐক্য নয়, জনগণের সর্বজনীন ঐক্য কামনা করেন। ৩ ফেব্রুয়ারি সিলেটে দেওয়ান ফরিদ গাজীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। ৫ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে মুফতি মাহমুদ বলেন, ইসলামের নামে একশ্রেণীর লােক গণতন্ত্র নস্যাৎ করতে চাইছে। ৬ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের লালদীঘি ময়দানে জহুর আহমদ চৌধুরীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বঙ্গবন্ধু দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন, ‘এবার করেছি। পণ, হতে হবে নির্বাচন। এ সভায় এমএ আজিজ, অধ্যাপক মােহাম্মদ খালেদ, এমএ হান্নান, আবদুল্লাহ আল হারুন, আবু সালেহ, অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী, এমএ মান্নান, এমএ ওহাব, কফিলউদ্দিন, এম ইদ্রিস প্রমুখ রাজনীতিবিদ এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যে আশরাফ খান, মৌলভী ছৈয়দ, এসএম ইউসুফ, এবিএম মহীউদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ বক্তৃতা করেন। সভা শেষে এক বিশাল মিছিল বের করা হয়। ১১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ স্বাধীন পূর্ববাংলা প্রতিষ্ঠার কথা ঘােষণা করার পরিপ্রেক্ষিতে কাজী জাফর ও মেননকে ৭ বছর, মােস্ত ফা জামাল হায়দার ও মাহবুব উল্লাহকে ১ বছর কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
ড. আহমদ শরীফের সভাপতিত্বে ‘লেখক স্বাধিকার সংরক্ষণ কমিটি’ প্রেস অর্ডিন্যান্স বাতিলের দাবিতে সভা করে। তাতে অংশ নেন প্রফেসর কবীর চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহীম, কবি শামসুর রাহমান, আলাউদ্দিন আল । আজাদ, শহীদুল্লাহ কায়সার, সন্তোষ গুপ্তসহ আরাে অনেকে। ১৫ ফেব্রুয়ারি সার্জেন্ট জহুরের মৃত্যু স্মরণে সর্বপ্রথম ‘জয়বাংলা বাহিনী। সালাউদ্দিন ইউসুফের নেতৃত্বে মার্চ ফাস্ট করে । ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া যৌথভাবে পল্টনে ছাত্র জনসভা করে ১১ দফার দাবি আদায়ের জন্য। এদিকে পশ্চিম পাকিস্তানে মওদূদী, দৌলতানা, কাইয়ুম খান ভুট্টোসহ পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠীর প্রতিভূরা ৬ দফা ও শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিষােদগার করতে থাকে । লাহােরে আসগর খান শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে আপসের মনােভাব প্রদর্শনের আহ্বান জানান। ২৭ ফেব্রুয়ারি। চট্টগ্রামের লালদীঘি মাঠে নুরুল আমিনের জনসভায় পচা ডিম, জুতা নিক্ষিপ্ত হয় এবং সভা পণ্ড হয়ে যায়। ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপে নেতৃত্বের কোন্দল মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যশাের, খুলনা, ফরিদপুর, রংপুর, পাবনা, কুষ্টিয়া, দিনাজপুর, বরিশাল, ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, পটুয়াখালী, ভােলা, রাজশাহী, বগুড়া, চাঁদপুর, ফেনী, নােয়াখালীসহ প্রত্যন্ত অঞ্চলে ৬ দফা ও ১১ দফার সমর্থনে এবং নির্বাচনী প্রচারণা অভিযানে ঝাপিয়ে পড়েন। এ সময় তিনি বাংলার স্বাধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ঘােষণা করেন। তার সভা-সমিতিতে মানুষের ঢল নামা শুরু করে। নেতাকে একনজর দেখার। জন্য এবং নেতার কথা শুনতে আপামর জনগণ দূর-দূরান্ত থেকে তার সভায় হাজির হতে থাকে। তিনি হয়ে ওঠেন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ মার্চ মাদারীপুরের এক জনসভায় তার ভাষণে প্রতিটি ঘরকে শােষণবিরােধী দুর্গ হিসেবে গড়ে তােলার আহ্বান জানান। করাচিতে ‘জিয়ে সিন্ধ’ নেতা জিএম সৈয়দ ৬ দফাকে সমর্থন দেন। এবং সিন্ধুর জন্য ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু মেহেরপুরের জনসভায় বলেন, নির্বাচন না হলে আন্দোলনের মাধ্যমে। স্বায়ত্তশাসন আদায় করা হবে এবং বলেন, আমার দল নির্বাচিত হলে। কৃষকদের খাজনা মওকুফ এবং শ্রমিকদের লভ্যাংশ দেয়া হবে। নীলফামারীতে বলেন, ৬ দফার ভিত্তিতে জনগণকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য।
সৈয়দপুরে বলেন, স্বায়ত্তশাসনবিরােধীদের প্রতিহত করার শক্তি আমাদের আছে। সুনামগঞ্জে বলেন, অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে। মুন্সীগঞ্জে বলেন, আগামী নির্বাচন হবে ৬ দফার প্রশ্নে গণভােট। প্রাদেশিক ন্যাপ প্রধান অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ জামালপুরের এক জনসভায় বলেন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য গণতান্ত্রিক সকল শক্তির এক হওয়া প্রয়ােজন। মুন্সীগঞ্জে ন্যাপ নেতা সৈয়দ আলতাফ হােসেন বলেন, শােষক ও অত্যাচারীর কবল থেকে গণমানুষকে মুক্ত করাই ইসলামের শিক্ষা।
অপরদিকে, মওলানা ভাসানী কৃষক-শ্রমিকের সমস্যার সমাধানে এবং আল্লাহর নামে সকল কলকারখানা রাষ্ট্রায়াত্ব করার আহ্বান জানান। দেশবাসীর দাবি উপেক্ষা করলে ঘেরাও, জ্বালাও-পােড়াও অভিযান শুরু করার আদেশ দেন। আমেনা বেগম আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বাধীন জাতীয় প্রগ্রেসিভ লীগে যােগ দেন। ফেরদৌস আহমদ কোরেশীও এ রাজনৈতিক দলের সাথে সম্পৃক্ত ছিলেন।
| আসগর খান গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য একটি ফোরাম গঠন করেন তেহরিক-এ-ইসতেকলাল’ নাম দিয়ে। পশ্চিম পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান শেখ মুজিবকে দায়ী করেন পাকিস্তানকে ভাগ করতে চাচ্ছেন বলে। পশ্চিমা জামায়াত নেতা চৌধুরী রহমত আলী ৬ দফাকে ইসলামের পরিপন্থী বলে ফতােয়া দেন। নুরুল আমিনও বিভিন্ন জনসভায় ৬ দফার বিরুদ্ধে কথা বলেন এবং বিদেশী শক্তির পাঁয়তারা বলে আখ্যায়িত করেন। জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম হাজারভী গ্রুপ ছাড়া বাকি সব ইসলামপন্থী দল আওয়ামী লীগ ও পিপিপির বিরুদ্ধে উঠেপড়ে লেগে যায়।
কনভেনশন মুসলিম লীগ ফজলুল কাদের চৌধুরীর নেতৃত্বে, কাউন্সিল মুসলিম লীগ খাজা খয়েরউদ্দিনের নেতৃত্বে এবং কায়েদে আযম মুসলিম লীগ সবুর খানের নেতৃত্বে কার্যকলাপ চালাতে থাকে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশে এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি নেয়। এসব দলের মূল সমালােচনা ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। | ২০ মার্চ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের বিশাল চত্বরে (ইকবাল হল) পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন হয়। প্রধান অতিথি ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এ সময় ছাত্রলীগের মধ্যে দুটি গ্রুপ আবির্ভূত হয়
একটি চরমপন্থী, আরেকটি কিছুটা নরমপন্থী। চরমপন্থীরা শ্লোগান তােলে বীর বাঙালি অস্ত্র ধরাে, বাংলাদেশ স্বাধীন করাে; তােমার আমার ঠিকানাপদ্মা, মেঘনা, যমুনা, জয়বাংলা। এ সময় অতিবিপ্লবী শ্লোগানধারীদের। কিছুটা সংযমের পরিচয় দিতে বঙ্গবন্ধু নির্দেশ দেন এবং দেখেশুনে এগিয়ে। যেতে বলেন। এ সম্মেলনে নূরে আলম সিদ্দিকী সভাপতি, শাজাহান সিরাজ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এতে সমন্বয় সাধন করা হয় নরমপন্থী নূরে আলম সিদ্দিকী ও চরমপন্থী শাজাহান সিরাজকে নিয়ে।
একই দিন বাংলা ছাত্রলীগের সম্মেলনে ভাষণ দেন আতাউর রহমান খান, আমেনা বেগম এবং ফেরদৌস কোরেশী।
এ সময় ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দেন, কোনাে শক্তিই পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করতে পারবে না। ৩১ মার্চ হায়দরাবাদে ভুট্টোর মিছিলে সিন্ধুর ধর্মীয় নেতা পীর পাগারাের সমর্থকরা আক্রমণ করলে কয়েকজন নিহত ও অনেকেই আহত হয়।
২৮ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শাসনতন্ত্রের মূলনীতি ঘােষণা করেন- তাহলাে- (১) শাসনতন্ত্রে ইসলামী আদর্শকে অবশ্যই রক্ষা করতে হবে, (২) ফেডারেল ইউনিয়ন হবে এবং ইসলামী প্রজাতন্ত্র হতে হবে, (৩) গণতন্ত্র, জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্ত বয়স্কদের ভােটাধিকার থাকবে, (৪) ফেডারেল শাসনতন্ত্র অনুযায়ী কেন্দ্র ও প্রদেশের ক্ষমতা। ভাগাভাগি হবে ও (৫) অর্থনৈতিক বৈষম্য দূরীকরণের ব্যবস্থা থাকবে।
| তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা ৩১৩ জন নির্ধারিত হয়, তন্মধ্যে সংরক্ষিত মহিলা আসনে ১৩ জন। ২২ অক্টোবরের মধ্যে প্রাদেশিক নির্বাচন দেয়া হবে। ১ জুলাই থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট প্রথা বাতিল ঘােষণা করা হবে। এই এক ইউনিট প্রথায় আইয়ুব খান পাঞ্জাব, | সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান প্রদেশ গঠন
২৯ মার্চ ইয়াহিয়া খান এলএফও (Legal Frame-Work Order) আইনগত কাঠামাে আদেশের ঘােষণা দেন। এতে সন্নিবেশিত ছিল : | নির্বাচিত জাতীয় পরিষদ যে শাসনতন্ত্র দিক না কেন তা প্রেসিডেন্ট কর্তৃক
অনুমােদিত হতে হবে। প্রেসিডেন্ট অনুমােদন না করলে জাতীয় পরিষদ বিলুপ্ত হবে। ১২০ দিনের মধ্যে নির্বাচিত জাতীয় পরিষদে শাসনতন্ত্র রচনা
করতে হবে। শাসনতন্ত্রের মূল চাবিকাঠি প্রেসিডেন্ট তার হাতে রেখে
দেন।
প্রেসিডেন্টের আইনগত কাঠামাের প্রশ্নে আওয়ামী লীগ কিছু সংশােধনী উত্থাপন করে। তবে ৬ দফা ও ১১ দফার ভিত্তিতে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করে এবং সকল রাজবন্দীর মুক্তির দাবি করে। আইনগত কাঠামাের পক্ষে-বিপক্ষে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল তাদের মতামত পেশ করে। ইসলামপন্থী দলগুলাে স্বায়ত্তশাসন, সমাজতন্ত্র এবং ‘জয়বাংলা’ স্লোগানের বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়। ফজলুল কাদের চৌধুরী লালদীঘির মাঠের সভায় বলেন, ‘জয়বাংলা’ শ্লোগান ভারতীয় হিন্দুদের থেকে আমদানি এবং এই শ্লোগান দিলে পূর্ব পাকিস্তানের মুসলমানদের ‘লুঙ্গি’ ছেড়ে ‘ধূতি’ পরতে হবে। এ সময় এ ধরনের নানা অশােভন কথাবার্তা চলতে থাকে। তবে সবারই সমালােচনার টার্গেট হলাে আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিব । মস্কোপন্থী ন্যাপ বারবার ঐক্যের কথা বললেও ঐক্যজোট গঠনে ব্যর্থ হয়। পরে একলা চলাে’ নীতি অনুসরণ করে । মওলানা ভাসানী নির্বাচনী ইস্যুকে এড়িয়ে কৃষক-শ্রমিকদের সংগ্রামের কথা বলে মাতিয়ে তােলেন।
আইনগত কাঠামাের সমালােচনার জবাবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বলেন, জনপ্রতিনিধিদের সার্বভৌমত্বকে খর্ব করার অভিপ্রায় তার সরকারের নেই। নির্বাচন বর্জনের কথা কোনাে দল বলেনি এবং মূলনীতি অনুযায়ী শাসনতন্ত্র হলে তা অনুমােদন না করার কোনাে কারণ নেই।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এপ্রিল মাসে ব্যাপক সফরে বের হন। ৪ | এপ্রিল ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কিশােরগঞ্জে, ৭ এপ্রিল ঢাকা শহরে, ৯ এপ্রিল বাগেরহাটে, ১১ এপ্রিল বরিশালে, ২৭ এপ্রিল কক্সবাজারে, ২৮ এপ্রিল চট্টগ্রামের রাউজানে জনসভা করেন। (রাউজানের সভা থেকে ফেরত আসার সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চট্টগ্রাম সিটি কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি হারুন-আর রশীদ নিহত হয়। বঙ্গবন্ধু সদলবলে তার মাদারবাড়ীর বাসায় গিয়ে সমবেদনা জ্ঞাপন করেন)। অন্যান্য দিন চট্টগ্রামের বিভিন্ন হানে সভা করেন। বঙ্গবন্ধুর বাসভবন ৩২নং ধানমণ্ডি থেকে সকল প্ল্যান| প্রোগ্রাম চলতে থাকে আন্দোলনে এগিয়ে যাওয়ার জন্য এবং নির্বাচনের প্রস্তুতি গ্রহণের। তাই এই বাড়িটি সারাক্ষণ সরগরম থাকে। বাংলার
মানুষের আলােকবর্তিকা হয়ে বিরাজ করতে থাকে। এ সময় বঙ্গবন্ধু বিভিন্ন সভা-সমিতিতে ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার অঙ্গীকার করেন। বাংলার জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেন পশ্চিমাগােষ্ঠীর শােষণের যাতাকল থেকে মুক্তির জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যেতে এবং ইসলাম ও সংহতির নামে ভাওতাবাজি থেকে দূরে সরে থাকতে। ভাওতাবাজদের লেবেল আটা ইসলামে বিশ্বাস না করে প্রকৃত ইসলামের মর্মকথা উপলব্ধি করে নিজেদের জীবন গড়ে তােলার আহ্বান জানান। পুরাে বাঙালি জাতিকে তার অনলবর্ষী বক্তৃতার মাধ্যমে জাতীয়তাবাদের ধারায় উদ্বুদ্ধ। করেন, এনে দেন নবজাগরণ।।
প্রেসিডেন্টের ঘােষিত আইনগত কাঠামাে নিয়ে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ছাত্রলীগের মধ্যেও এ নিয়ে সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী কিছুটা নীরব ভূমিকা পালন করলেও সাধারণ সম্পাদক শাজাহান। সিরাজ প্রতিবাদমুখর হয়ে ওঠে। ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া গ্রুপও আইনগত কাঠামাের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানায়। প্রেসিডেন্টের এলএফওর ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান খুব সতর্কভাবে এগিয়ে যান। বেশি। বাক-বিতণ্ডায় না গিয়ে তিনি নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকেন। এতে অনেকেই তার সমালােচনা করেন। কিন্তু তাতে তিনি কর্ণপাত না করে অভিষ্ঠ লক্ষ্যের দিকে এগিয়ে চলেন একজন পটু, বিচক্ষণ রাজনীতিবিদ হিসেবে। নির্বাচনের মাধ্যমে সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থন আদায় করাই তার উদ্দেশ্য। দেশ ও বিদেশের কাছে প্রমাণ করা তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযােগ্যতা। তিনি যে আপামর বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা তা জনসমক্ষে এবং বিশ্বের কাছে তুলে ধরা— এটাই তার স্থির লক্ষ্য ছিল। এভাবে পুরাে বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে মুক্তির সােপানে পৌছে। দেয়া। ৬ দফার মধ্যে শ্রমিকদের দাবি সন্নিবেশিত না থাকলেও শ্রমিকরা | বাঙালি জাতীয়তাবাদের মন্ত্রে উদ্বুদ্ধ হয়ে বিপুলভাবে শ্রমিক লীগের
পতাকাতলে সমবেত হয়। বঙ্গবন্ধুর বলিষ্ঠ নেতৃত্বের ফলে শ্রমিক সমাজে | বিপুলভাবে সাড়া জাগে এবং শ্রমিক লীগ অনেক শক্তিশালী হয়।
১৯৭০-এর মে মাসের প্রথমদিকে বঙ্গবন্ধু সন্দ্বীপের এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন, বিশ্বাসঘাতকদের ভােটের বাক্স যেন খালি যায়। এ সভায় শফি বাঙালির গান সভাকে মাতিয়ে তােলে। উল্লেখ্য, চট্টগ্রামে
বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের প্রতিটি সভায় শফির গান জনগণকে জাগিয়ে তুলতাে। সন্দ্বীপের এ সভায় এমআর সিদ্দিকী, এমএ আজিজ, এমএ হান্নান এমএ মান্নান, ফজলুল হক বিএসসি, ইঞ্জিনিয়ার ওবায়দুল হক, রিজওয়ানুল বারীসহ আরাে কিছু নেতা বক্তব্য দেন। ঢাকায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গিয়ে ড. কামাল হােসেন আওয়ামী লীগে যােগ দেন। আলেমওলামাদের একটি অংশ আওয়ামী লীগের প্রতি সমর্থন দেন তাদের ন্যায্য
দাবি-দাওয়ার জন্য। মাওলানা আবদুল আউয়াল, মাওলানা অলিউর রহমান, মাওলানা যশােরী, মাওলানা জালালবাদীসহ বেশ কয়েকজন আলেম আওয়ামী লীগের প্রতি হাত প্রসারিত করেন। মাওলানা আবদুল আউয়ালের নেতৃত্বে আওয়ামী ওলেমা পাটি গঠিত হয়। ইসলামপন্থী। দলগুলাে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন ও স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি তীব্র অনীহা প্রকাশ করে। এরূপ প্রতিকূল পরিবেশে সত্য ও ন্যায়ের খাতিরে যে আলেমসমাজ এগিয়ে আসে তা সত্যিই প্রশংসনীয়। এক জনসভায় জামায়াতের প্রাদেশিক আমির গােলাম আযম বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রীর পদ না নিয়ে শেখ মুজিব ৬ দফার প্রতি অনড়। অথচ গােলটেবিলে তাদের দেয়া ৮ দফা শেখ মুজিব মেনে নিলে তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হতাে।’
ছাত্র ইউনিয়ন মেনন গ্রুপ অন্তঃকোন্দলে তিনভাগে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এক গ্রুপে রাশেদ খান মেনন, আবদুল মান্নান ভূইয়া, মােস্তফা জামাল হায়দার ও হায়দার আকবর খান রনাে। আরেক গ্রুপে মাহবুব উল্লাহ ও তার সমর্থকরা এবং তৃতীয় গ্রুপে কাজী জাফরের সমর্থকরা। এ সময় বিভিন্ন কারণে মােহাম্মদ তােয়াহা ভাসানী ন্যাপ থেকে পদত্যাগ করে সাম্যবাদী দল গঠন করেন।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ এবং অঙ্গসংগঠনগুলাে নির্বাচনী হাওয়া। তৈরিতে সচেষ্ট হয়। নির্বাচন বানচালকারীদের বিরুদ্ধে তারা যথাযথ কঠোর ব্যবস্থা নেয়। ২২ মে পােস্তগােলা শিল্পাঞ্চলে পুলিশ-শ্রমিক সংঘর্ষে পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালালে ১১ জন শ্রমিক ও ১ জন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়। নির্বাচনের পূর্বে এ ধরনের ঘটনা পরিলক্ষিত করে বঙ্গবন্ধু বলেন, নির্বাচন বানচালের জন্য এটা এক গভীর ষড়যন্ত্র। এই হত্যার প্রতিবাদে ২৩ মে ঢাকায় হরতাল পালন করা হয়। এ সময় ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগের আ স ম আবদুর রব সহ-সভাপতি এবং আবদুল কুদুস মাখন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
বাংলার জনগণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে নির্বাচনের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে। জনগণের সমর্থন না থাকায় নির্বাচন বিরােধীদের ষড়যন্ত্র বিফল হয়। ডাকসু নির্বাচনের পর সারা প্রদেশের বিভিন্ন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়েও ছাত্রলীগের প্যানেল বিপুল ভােটে জয়লাভ
করে। এতে সাধারণ ছাত্রসমাজের আস্থা ছাত্রলীগের প্রতি বৃদ্ধি পায় তাদের। আপসহীন সংগ্রামী মনােভাবের জন্য।
১৯৭০ সালের জুন মাসের প্রথমদিকে এক সাক্ষাঙ্কারে বঙ্গবন্ধু বলেন, অক্টোবরের সাধারণ নির্বাচন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জন্য মহাপরীক্ষা। মওলানা ভাসানী হুমকি দিলেন নিয়মতান্ত্রিকভাবে না হলে দাবি আদায়ে শ্রমিকরা ভিন্ন পথ অবলম্বন করবে। ২ জুন ছাত্রনেতা তােফায়েল আহমদ আওয়ামী লীগ যােগ দেন। | ৪ জুন ঢাকার ইডেন হােটেলে আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনের প্রধান আকর্ষণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই নীতি-নির্ধারণী বক্তৃতা দেন এবং দলীয় কর্মীদের এভাবে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন— দাবি আদায়ের জন্য যারা প্রাণ দিলাে তাদের ত্যাগের কথা ভুললে চলবে না। আপনারা ব্যক্তিস্বার্থের জন্য দলাদলি ও আত্মকলহে লিপ্ত হবেন না। ক্ষমতার লিপ্সায় মন্ত্রী, এমএনএ, এমপিএ হওয়ার খায়েশ নিয়ে কেউ পার্টি করলে তারা ভুল করবেন। এরূপ মনােভাব নিয়ে যারা ঘাপটি মেরে আছেন তারা সসম্মানে দল ছেড়ে যেতে পারেন। দলের মাঝে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা নিয়ে গ্রুপিং সৃষ্টির প্রয়াস দেখে তিনি দৃঢ়কণ্ঠে বলেন, হাতের ১০ আঙ্গুলের মাঝে ৯টিকে রক্ষা করতে প্রয়ােজনে ১টি আঙ্গুল কেটে ফেলতে দ্বিধা করবেন না। এ সম্মেলনে তাজউদ্দিন আহমদ ঘােষণা করেন, আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ঐক্যে যাবে না। কাউন্সিলে ২৫ জন সদস্য কো-অপ্ট করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযােগ্য মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ, সৈয়দ আবদুস সুলতান, জানে আলম দোভাষ, আবদুল মান্নান (শ্রমিক লীগ) সিরাজুল আলম খান প্রমুখ। আগের কমিটি বহাল থাকে। কাউন্সিলে আইনগত কাঠামাের নিন্দা করে বলা হয়, নির্বাচিত সংসদ সার্বভৌম হবে, এতে কাউকে হস্ত ক্ষেপ করতে দেয়া যাবে না। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান এবং সম্পাদক এএইচএম কামরুজ্জামান নির্বাচিত হন। উভয় প্রদেশের কাউন্সিলে এই নির্বাচন হয়। কাউন্সিলে ঘােষণা দেয়া হয়, একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, জমিদারি, জোতদারি, মহাজনি প্রথা বিলােপ সাধন করে গণতান্ত্রিক কাঠামাের মধ্যে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করে মানুষের মধ্যে সাম্যনীতি কায়েম
করা হবে। এই সম্মেলন থেকে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী অভিযান শুরু হয়। ৭ জুন রেসকোর্স ময়দানে এক বিশাল জনসমুদ্রে বঙ্গবন্ধু সদর্পে। ঘােষণা করেন, ‘জেল-জুলুম, অত্যাচার আর বেঈমানীর অবসান ঘটিয়ে যদি মানুষের মতাে বাঁচতে চান তবে আগামী নির্বাচনে ভােটের মাধ্যমে ধােকাবাজ আর মীর জাফরদের খতম করে ৬ দফার পক্ষে রায় দিন। আমি ইনশাআল্লাহ আপনাদের দাবি আদায় করে ছাড়বাে আর প্রয়ােজনে আমি রক্ত দিতে প্রস্তুত আছি।’ ফতােয়াবাজদের উদ্দেশ্যে বলেন, ‘৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টকে ভােট দিলে বিবি তালাক হয়ে যাবে বলেছিল। যুক্তফ্রন্ট জিতেছে কিন্তু বিবি তালাক হয়নি। ‘৫৬ সালে বলেছিল, যুক্ত নির্বাচন করলে ইসলাম বরবাদ হয়ে যাবে। যুক্ত নির্বাচন হয়েছে, ইসলাম বরবাদ হয়নি। নারী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া নাজায়েজ বলেছিল। আবার ‘৬৫ সালের নির্বাচনে মুহতারমা ফাতিমা জিন্নাহর পক্ষে পূর্ণ সমর্থন দিয়েছিল, কই, তখন তাে নাজায়েজ হয়নি। এবার বলছে ৬ দফা হলে পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে যাবে। আমি তােমাদের বলে দিতে চাই ৬ দফা হলে পাকিস্তান টিকবে, অন্যথায় নয়। তােমাদের এসব ভাওতাবাজি ফতােয়া কেউ বিশ্বাস করে না। বাংলার মানুষ জেগেছে, তােমাদের দূরভিসন্ধি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। এবার আর ধোঁকা দেয়া চলবে না।
রেসকোর্সের সমাবেশের পর আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে ‘জয়বাংলা। স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী’ মিছিল করে ঢাকার প্রধান সড়কসমূহ প্রদক্ষিণ করে। মিছিলের শ্লোগান ছিল ৬ দফা ও ১১ দফা এবং স্বাধীনতার ওপর। এ বাহিনীর জঙ্গি মিছিল জাতীয়তাবাদী চেতনাকে তীব্রতর করে। জয়বাংলা। বাহিনীর পক্ষ থেকে একটি পতাকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে উপহার দেয়া হয়, যা পরবর্তীতে রূপান্তরিত হয় স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলার পতাকায়।
পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা ডান-বাম যে গােত্রেরই হােক না কেন তারা বাঙালির দাবি-দাওয়া ও স্বায়ত্তশাসনের অধিকারকে অস্বীকৃতি জানায় এবং এর বিরুদ্ধাচারণ করে। ৬ দফার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান ন্যাপ মােজাফফর একমত থাকলেও পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপ বিরােধিতা করে।
মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বের আড়ালে চীনপন্থী উপদলগুলাে নির্বাচনের বিরুদ্ধে পূর্বের ভূমিকা বহাল রাখে। যে কোনাে কৃষক-শ্রমিক সমাবেশে তারা নির্বাচনবিরােধী বক্তব্য দিতে থাকে।
আদমজীর শ্রমিক বস্তিতে আগুন লাগিয়ে স্থানীয়-অস্থানীয় দাঙ্গা বাধানাের প্রচেষ্টা চালানাে হয় । আদমজী তখন আওয়ামী লীগপন্থীদের দখলে। সাধারণ শ্রমিকরা আওয়ামী লীগের কর্মপন্থার সাথে একাত্মতা ঘােষণা করে। এ দাঙ্গা বাধানাের উদ্দেশ্য ছিল আওয়ামী লীগকে দুর্বল করে নির্বাচন বানচাল করা। আদমজীর অজুহাত ধরে ছাত্রলীগের মন্টু, খসরু ও সেলিমকে গ্রেপ্তার করে। এরা তিনজন ছাত্রলীগের মিলিট্যান্ট বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন। আসলে এরা তিনজনই মােনায়েমের গুণ্ডাবাহিনী এনএসএফকে প্রবলভাবে প্রতিহত করে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক ধারার ছাত্র রাজনীতিকে রাজধানী ঢাকার বুকে টিকিয়ে রাখেন। তাদেরকেসহ অন্য বন্দিদের মুক্তির জন্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ গভর্নর আহসানের সাথে সাক্ষাৎ করেন। নির্বাচন যাতে বানচাল না হয় আওয়ামী লীগ কৌশল। অবলম্বন করে, সংঘর্ষে না গিয়ে। নির্বাচন বানচালকারীদের নমনীয়ভাবে প্রতিহত করে।
| ১ জুলাই ভাসানী ন্যাপ কাজী জাফর, মেননসহ সকল রাজবন্দীর দণ্ডাদেশ মওকুফ ও মুক্তির দাবি করেন। সামরিক আইনের বিরােধিতা করায় অনেকে কারাগারে ছিলেন। ওয়ালী খান কাইয়ুম খানকে দায়ী করেন। নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা চালাচ্ছে বলে। অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ শেখ মুজিবকে দায়ী করেন আইনগত কাঠামাের বিরুদ্ধে আন্দোলন না। করায়। অথচ তিনি নিজেও আন্দোলন শুরু করেননি। বায়তুল মােকাররমে বেগম সুফিয়া কামালের সভানেত্রীত্বে এক সভায় মােজাফফর আহমদ ও আতাউর রহমান খান বাঙালির দাবি প্রতিষ্ঠা এবং নির্যাতন মােকাবিলায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। ১৪ জুলাই চাঁপাইনবাবগঞ্জের এক সভায় মতিয়া চৌধুরী কঠোরভাবে শেখ মুজিবের সমালােচনা করে ১১ দফার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। আসলে বামপন্থী * দলগুলাে যুগােপযােগী কোনাে কর্মপন্থা নির্ধারণ করতে পারছিল না তখন।
ইসলামপন্থী দলগুলাের কার্যক্রম অব্যাহত থাকে আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। নেজামে ইসলামের মৌলভী ফরিদ আহমদ বলেন, ৬ দফা পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করবে। তার দল ২২ দফা দাবির ভিত্তিতে ইসলামী শাসনতন্ত্র কায়েমের অঙ্গীকার করে। নির্বাচনকে সামনে রেখে একেক দল একেক রকম দাবি-দাওয়া শুরু করে । জামায়াত ঘােষণা দেয়, একজন
মুসলমান বেচে থাকতে সমাজতন্ত্র কায়েম হতে পারবে না এবং ৬ দফার স্রোতে ভেসে না যাওয়ার জন্য জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। গােলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানিরা বাঙালি নয়, বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাক্তন গভর্নর এয়ার মার্শাল (অব.) নূর খান কাউন্সিল মুসলিম লীগে যােগ দেন। কাউন্সিল মুসলিম লীগের নেতা রংপুরের মাইনকার চরের আবুল কাসেম এক উদ্ভট দাবি করে বসেন এভাবে যে, পাকিস্তানের রাজধানী উত্তরবঙ্গে স্থাপন করার জন্য। পিডিপি, জামায়াত, নেজামে ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ নির্বাচনী ঐক্যের ঘােষণা দেয় । এ সময় ইসলামপন্থী দলগুলাে অনেকটা সরগরম হয় নির্বাচনের ব্যাপারে। নির্বাচনে অবস্থা বেগতিক দেখে তারা নির্বাচন পেছানাের দাবিতে সােচ্চার হয়। তাদের বাঙালি বিরােধী কার্যকলাপ ও নানা বক্তব্য বাংলার মানুষকে সজাগ করে তােলে এবং আওয়ামী লীগের পতাকাতলে আরাে গভীরভাবে সমবেত করে তােলে। অপরদিকে ইসলামপন্থী আরেক অংশ জামায়াতি ঐক্যের বিরােধিতা করে বলেন, মওদূদীদের ভােট দিলে ইসলাম ধ্বংস হবে। মওদূদীর ইসলাম প্রকৃত ইসলাম নয়। তারা মার্কিনি-ইহুদিদের দালাল। পূর্বে ও পশ্চিমে আলেম-ওলামাদের একাংশ শেখ মুজিব ও ভুট্টোর সমর্থনে কথা বলতে থাকেন।
জুলাইয়ের দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনী সফরে গিয়ে বলেন, ৬ দফার ব্যাপারে কোনাে আপস করা হবে
। ৬ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র হলে পাকিস্তানের সব প্রদেশের ফায়দা হবে এবং শক্তিশালী পাকিস্তান হবে, ভুল বুঝাবুঝির অবসান হবে। ২৩ বছরে একটি গােষ্ঠীর শােষণ ও ষড়যন্ত্র পাকিস্তানকে পঙ্গু করেছে।
পাকিস্তান থেকে ফেরত এসে ১১ জুলাই ঢাকার ধুপখােলা মাঠে, ১৫ জুলাই ভােলায়, ১৭ জুলাই বরগুনায় এবং ২০ জুলাই গৌরনদীতে নির্বাচনী সভা করেন। এ মাসে ইঞ্জিনিয়ারিং বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংসদ নির্বাচনে ছাত্রলীগ পুরাে প্যানেলে জয়লাভ করে। তাছাড়া জেলা, মহকুমা, থানা, ইউনিয়ন, গ্রাম পর্যায়ে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, কৃষকলীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ এবং কলকারখানায় শ্রমিক লীগ নির্বাচন উপলক্ষে জনসমর্থন আদায়ে প্রচার অভিযান শুরু করে। পূর্ববাংলার শােষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস, পাকিস্তানি শােষকগােষ্ঠীর আসল রূপ জনসমক্ষে তুলে
ধরে। বাঙালির মুক্তিসনদ ৬ দফার ব্যাখ্যা প্রদান করতে থাকে। ৬ দফা। দাবি মেনে না নিলে একদফা আন্দোলনের যৌক্তিকতা ব্যাখ্যা করে।
১৮ জুলাই চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এমএ আজিজ গ্রেপ্তার হন চট্টগ্রামের মিরেশ্বরাইয়ে আপত্তিমূলক বক্তব্য প্রদানের জন্য। এ সভায় তিনি দ্ব্যর্থকণ্ঠে ঘােষণা করেন ৬ দফা আদায় না হলে। জাতি এক দফার আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়বে। আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে তিনিই প্রথম এক দফা দাবি উত্থাপন করেন। ২৭ জুলাই চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ ‘আজিজ দিবস’ পালনের মাধ্যমে সারাদিন হরতাল পালন করে। ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় কমিটি ৩১ জুলাইয়ের মধ্যে এমএ আজিজ, মন্টু, খসরু, সেলিমসহ সব রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করে। আন্দোলনের মুখে সরকার অনেক আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ কর্মীদের গ্রেপ্তার করে। লালদীঘি। মাঠে আবদুল্লাহ খান হারুনের সভাপতিত্বে এক প্রতিবাদ সভা হয়। সভায় বক্তব্য রাখেন এমএ ওহাব, এমএ হান্নান, ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ, আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, আবু সালেহ, ডাঃ মান্নান, ডাঃ ফয়েজ প্রমুখ। এ সভায় মিজানুর রহমান চৌধুরী দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করেন, ‘এমএ আজিজকে কারাগারে রেখে নির্বাচনে যােগদান হবে অর্থহীন।’ সভায় ৬ দফার বদলে ১ দফার গােনে মুখরিত হয়ে ওঠে। চট্টগ্রাম এক দফা। আন্দোলনের ঘাটিতে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের বিপুল জনপ্রিয়তা দেখে জুজুর ভয় দেখিয়ে আইয়ুবের এক সাবেক মন্ত্রী বলে উঠেন, আগতরলা মামলা এখনাে বহাল আছে। যে কোনাে সময় তার কার্যকারিতা শুরু হতে পারে।
পূর্ববাংলার পুরাে রাজনীতি শেখ মুজিবের হাতের মুঠোয় এসে পড়ে। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। পুরােপুরি নির্বাচনী প্রস্তুতি নেয়ার জন্য ভুট্টো নির্বাচন ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত করার আহবান জানান। নির্বাচনে ভরাডুবির আশঙ্কা টের পেয়ে প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী দলগুলাে নির্বাচনের আগে প্রেসিডেন্টকে শাসনতন্ত্র ঘােষণার দাবি জানান। আবার অনেকে নির্বাচনের পূর্বে স্বায়ত্তশাসনের দাবির মীমাংসা করতে বলেন। পশ্চিমে ৬ দফার বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনা চলতে থাকে ।
১ আগস্ট মওলানা ভাসানী খুলনাতে এক জনসভায় ঘােষণা দেন, অব্যাহতভাবে সংগ্রামের মাধ্যমে দাবি আদায় হবে। তিনি শ্রেণীভিত্তিক
নির্বাচনের দাবি করেন। নির্বাচনের ব্যাপারে মওলানা সুনির্দিষ্ট কোনাে বক্তব্য দেয়া থেকে বিরত থাকেন এবং নির্বাচনী ইস্যুটি অনেকটা এড়িয়ে যান। চীনপন্থী দলগুলাে নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্তে অটল ছিল। তাদের শ্লোগান হলাে ‘ভােটের আগে ভাত চাই’। নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের কাক্ষিত মুক্তি আদায় হবে না। নির্বাচন বানচালের জন্য পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থবাদীরা আদমজী পাটকলে শ্রমিক সংঘর্ষ লাগিয়ে মারামারি সৃষ্টি করে। বিক্ষুব্ধ শ্রমিক-জনতার রােষ থামাতে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। এতে ৬ জন নিহত ও শতাধিক আহত হয়। নানা ধরনের অজুহাত এবং কিছু রাজনৈতিক দলের দাবির মুখে নির্বাচন পিছিয়ে যায়। জাতীয় পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ঠিক হয় ৭ ডিসেম্বর ১৯৭০ এবং প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের তারিখ ১৯ ডিসেম্বর ১৯৭০। নির্বাচন পেছানাের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু বলেন, আওয়ামী লীগের দলগত অবস্থান এতে ক্ষুন্ন হবে না। যারা নির্বাচন পেছানােতে আওয়ামী লীগের ক্ষতি হবে ভাবছেন তারা বেকুফের স্বর্গে বাস করছেন।
কাউন্সিল মুসলিম লীগ আবার নির্বাচনের আগে ইসলামভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি জানান। আইয়ুব খানের বড়ভাই কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা সরদার বাহাদুর খানও একই সুরে সুর মেলালেন। পিন্ডিতে নূর খানের সভায় গােলযােগ হয়। ৩০ আগস্ট ঢাকায় এনএসএফ দোলন গ্রুপের সভায় কায়েদে আজম মুসলিম লীগের নেতা সরদার কাইয়ুম খান বক্তৃতা দিতে উঠলে মারপিট শুরু হয়। ইব্রাহীম খলিলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এ সভার মাঝে গুলিবর্ষণে কিছু লােক হতাহত হয়।
চট্টগ্রামের পলােগ্রাউন্ডের এক বিশাল জনসভায় বঙ্গবন্ধু ভাষণ দেন। চট্টগ্রামের জনসভা অনুষ্ঠানের ইতিহাসে এত বিশাল সমাবেশ এখনাে পর্যন্ত হয়নি। এ বিশাল সভায় সভাপতিত্ব করেন জহুর আহমদ চৌধুরী। জোরালাে বক্তব্য প্রদান করেন এম আর সিদ্দিকী, এম এ আজিজ, এম এ ওহাব, এম এ হান্নান, এম ইদ্রিস, এম এ মান্নান প্রমুখ । পুরাে জনসভায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রতীক নৌকার প্রতিচ্ছবি শােভা পেতে থাকে। নৌকার পালে নির্বাচনী হাওয়া বইতে থাকে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে এ বিশাল জনসভায় যােগদান করে। এত বিশাল পলােগ্রাউন্ডে স্থান না হওায় চতুর্পাশ্বে মানুষের ঢল উপচিয়ে পড়ে। অনেকে
বঙ্গবন্ধুকে একনজর দেখার জন্য বিন্ডিংয়ের ছাদে ও গাছের আগডালে উঠে পড়ে। অবশ্য এ জনসভায় তিনি বন্যার কারণে নির্বাচন পিছিয়ে না দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি বলেন, এই দেশে বন্যা প্রতি বছরই হয়। ২৩ বছর ধরে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোনাে ব্যবস্থা হয়নি। বন্যা প্রতিরােধের ব্যাপারে ক্রুগমিশন রিপাের্ট বাস্তবায়ন করেনি
পশ্চিমা শাসকগােষ্ঠী।
এই সময়ে বাংলার সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সত্তরের নির্বাচনে ভােট গ্রহণ রাজনৈতিক তৎপরতা পর্যবেক্ষক মহলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তার জীবনের এক অভাবনীয় পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়। তিনি পূর্ব বাংলার স্বাধিকারের সাথে সমাজতন্ত্রের কথাও বলতে শুরু করেন। সমসাময়িক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের কিছু নেতা বঙ্গবন্ধুর চিন্তার ক্ষেত্রে সাধিত এই পরিবর্তনকে ব্যঙ্গ করতে থাকেন। বিশেষ করে তকালীন পাকিস্তানে যারা সমাজতন্ত্রের ‘সােল এজেন্ট হিসেবে ভাবতেন বঙ্গবন্ধু প্রধানত তাদেরই আক্রমণের শিকার হন। এনায়েত উল্লাহ খান সম্পাদিত সাপ্তাহিক হলিডেতে বঙ্গবন্ধুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাকে ব্যঙ্গ করে কাটুনও প্রকাশ করে। অথচ এই এনায়েত উল্লাহ জিয়াউর রহমানের সামরিক সরকারের মন্ত্রী হয়ে সমাজতন্ত্র তথা প্রগতিশীল রাজনীতির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল কার্যকলাপ, বক্তৃতা, বিবৃতি দিতে থাকেন। এতে করে এনায়েত উল্লাহ খান
নিজেকে ‘হলিডে ক্যুনিস্ট’ হিসেবে প্রমাণ করেন। ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনী ঘােষণায় সমাজতন্ত্র’ শব্দটি যােগ করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেন। এ সময়ে তার বক্তৃতা-বিবৃতি এবং বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে নতুন রাজনৈতি গতিধারার ভাব লক্ষ্য করা যায় ।
ইয়াহিয়া খানের এলএফওর আওতায় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পটভূমিকায়। ন্যাশনাল প্রগ্রেসিভ লীগের মহাসম্মেলনে দলীয় গঠনতন্ত্র ও ঘোষণাপত্র। অনুমােদিত হয়। আতাউর রহমান খান ও শাহ আজিজুর রহমান পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল লীগের সভাপতি আতাউর রহমান খান এবং সাধারণ সম্পাদক অলি আহাদ নির্বাচিত হন। আতাউর রহমান খানের দুই কমিটিতে প্রধান থাকা নিয়ে মতদ্বৈধতা দেখা দেয়। এখানে আতাউর রহমান খান একজন। প্রাজ্ঞ ও বিচক্ষণ রাজনীতিবিদের পরিচয় দেননি। যার ফলে পরবর্তীতে জাতীয় লীগ দ্বিধাবিভক্ত হয়ে যায়।
| আমরা বাঙালি। পরশ্রীকাতরতা আমাদের বাঙালি চরিত্রের অন্যতম ভূষণ। আমরা সবাই ব্যক্তি নেতৃত্ব, ব্যক্তি প্রাধান্য ও ব্যক্তি পূজার আকাক্ষী। ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে কোন্দলই আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। তাই নীতিগত ও আদর্শভিত্তিক রাজনীতি আমাদের আন্তরিক প্রয়াস নয়। ব্যক্তি স্বার্থের কাছে আমরা সমষ্টিগত স্বার্থকে জলাঞ্জলি দেই। ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ। করার মানসে আমরা জাতীয় স্বার্থকে বিকিয়ে দিতে দ্বিধাবােধ করি না। নীতি ও আদর্শ শুধু মুখে, অন্তরে নয়। এই জঘন্য মনমানসিকতার জন্য আমাদের রাজনীতি আজ কলুষিত, রাজনীতিবিদরা জনগণের কাছে অপাংতেয় ।।
নির্বাচনের পূর্বে ওয়ালী-মােজাফফরের নেতৃত্বাধীন ন্যাপ বার বার আওয়ামী লীগের প্রতি ঐক্যের আহ্বান জানিয়েছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ তা প্রত্যাখ্যান করে। এতে করে বঙ্গবন্ধুর কিছুটা দাম্ভিক মনােভাব প্রকাশ পেলেও পূর্বাংলার অধিকার আদায়ের দাবির প্রতি ওয়ালী খানের আন্তরিকতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। ওয়ালী ন্যাপ ছিল তকালীন পাকিস্ত েিনর একমাত্র প্রগতিশীল দল, যার দেশের দুই অংশে কিছুটা প্রভাব ছিল। অথচ আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে খুবই শক্তিশালী ছিল, কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে তার ভিত্তি ছিল না। যদি আওয়ামী লীগ ওয়ালী ন্যাপের সাথে।
জোট করতাে তাহলে উভয় পাকিস্তানে তারা শক্তিশালী সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করতাে। কারণ নির্বাচনের পর দেখা গেছে ওয়ালী ন্যাপ বেলুচিস্তানে। সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেছিল। সীমান্ত প্রদেশেও বেশ কিছু আসন। পেয়েছিল।
নির্বাচন ডিসেম্বরে পিছিয়ে যাওয়ার পরপরই পাকিস্তানজুড়ে নির্বাচনী তৎপরতা শুরু হয়ে যায়। এই সময় কাইয়ুমপন্থী মুসলিম লীগ নেতা ফরিদপুরের ওয়াহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়া এবং রংপুরের কাজী কাদের। আওয়ামী লীগ ও শেখ মুজিবের প্রতি অহেতুক চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়ে বলেন, যদি আওয়ামী লীগ নেতারা আসন্ন নির্বাচনে জিততে পারেন তাহলে তারা হাতের কজি থেকে কনুই পর্যন্ত মেয়েদের চুড়ি পরে বেড়াবেন এবং রাজনীতি চিরতরে ছেড়ে দেবেন। শেখ মুজিব কোনাে এলাকা থেকে নির্বাচিত হতে পারবেন না। ১৯৭০-এর নির্বাচনে তারা এবং তাদের অনুসারীদের চরম ভরাডুবি হয়েছিল এবং প্রায় সকলের জামানত বাজেয়াপ্ত হয়েছিল। অতি উৎসাহী এসব চ্যালেঞ্জ প্রদানকারীর জন্য নির্বাচনের পরে বেলােয়াড়ি চুরি এবং শাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল, যাতে তারা প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে। তবে তারা প্রতিশ্রুতি মােতাবেক কাজ করেনি বরং ওয়াদা ভঙ্গকারীর কালাে তালিকাভুক্ত হয়েছিল। আপামর জনগণের কাছে ঘৃণিত ও লাঞ্ছিত হয়েছিল।
আগস্টের শেষের দিক থেকে পূর্ব পাকিস্তান প্রদেশের স্কুল ছাত্ররা তাদের পাঠ্য তালিকায় ছাপিয়ে দেয়া পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি” বইটি বাতিলের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। সেপ্টেম্বরে এসে স্কুল ছাত্রের এই বই বাতিলের দাবিতে স্কুল ছাত্রসংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে ছাত্র আন্দোলন শুরু করে। পাকিস্তান কৃষ্টি, তাহজীব-তমুদ্দন ও জাতীয়তাবাদ তৈরির পশ্চিমা পরিকল্পনা স্কুল ছাত্রদের সৃষ্ট আন্দোলনের মুখে বাধাগ্রস্ত হয়। ৮ সেপ্টেম্বর সারা প্রদেশে ‘পাকিস্তান দেশ ও কৃষ্টি’ বই বাতিলের জন্য ধর্মঘট ও মিছিল হয়। সত্তরে এসে এভাবে স্কুলের ছাত্রদের মাঝেও পাকিস্তানবিরােধী মনােভাব উজ্জীবিত হতে থাকে।
১৯৭০-এর সেপ্টেম্বরে আওয়ামী লীগ তার কর্মীবাহিনী নিয়ে পূর্ণোদ্যমে নির্বাচনী প্রচারে মেতে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১ সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়া, ২ সেপ্টেম্বর চুয়াডাঙ্গা, ৪ সেপ্টেম্বর নড়াইল, ৫
সেপ্টেম্বর মাগুরা, ২০ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় জনসভা করার পাশাপাশি প্রার্থী নির্বাচনের কাজও চূড়ান্ত করেন। তিনি বিভিন্ন এলাকা, থানা, মহকুমা ও জেলা সফরকালে কর্মিসভায় যাচাই করতেন তারা কাকে চায় এবং জনসভায় দেখে নিতেন কার পক্ষে জনগণ সমর্থন। যােগাচ্ছে বেশি। এ সময় বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযােগ্যতা বাংলার মানুষের কাছে এত বেশি, তিনি যে কোনাে কাউকে নমিনেশন দিলে জিতে যেতাে। লােকে যেমন বলেন, বঙ্গবন্ধু কলাগাছ দাড় করিয়ে দিলেও হয়ে যাবে।। এরকম অবস্থার মাঝেও তিনি কর্মী ও জনগণের মতামতকে মূল্যায়ন করেছেন বেশি এবং দেখেছেন এলাকার মাঝে প্রার্থীর জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযােগ্যতা। তাই নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়নের ব্যাপারে পুরােপুরি বাস্ত বতার নিরিখে কৌশলীপন্থা অবলম্বন করেছেন, যা পরে নির্বাচনী ফলাফলে প্রমাণিত হয়েছে।
১৯৭০-এর ২৪ সেপ্টেম্বর বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিব ঢাকায় তার দলের মনােনীত প্রার্থীদের নাম ঘােষণা করেন। তিনি । নির্বাচনের পূর্বে সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাবি করেন। তিনি বলেন, একমাত্র সিন্ধুর ‘জিয়ে সিন্ধ” নেতা জিএম সৈয়দের যুক্তফ্রন্ট ব্যতীত আর কারাে সাথে নির্বাচনী জোট করবেন না। অবশ্য এই জোট গঠন কোনাে কাজে আসেনি। কারণ পশ্চিম পাকিস্তানি জনগণের কাছে শেখ মুজিব ও আওয়ামী লীগের কোনাে গ্রহণযােগ্যতা ছিল না। আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সকল আসনেই প্রার্থী দেয়। আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিটেফোটা কয়েকটি আসনে প্রার্থী মনােনয়ন দেয়—যাদের কোনাে স্থানীয় ভিত্তি ছিল না।
ভাসানী ন্যাপ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা-না করার দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকে। | দলে অবস্থিত চরম বামপন্থীদের একটি উপদল নির্বাচনে অংশগ্রহণ না
করার জন্য চাপ দিতে থাকলে জরুরি কাউন্সিল তলব করা হয়। দু’দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত কাউন্সিলে ভীষণভাবে তর্ক-বিতর্ক চলে। শেষপও জুন মাসে লাহােরে অনুষ্ঠিত দলের বৈঠকে গৃহীত নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত বহাল থাকে। দলের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক মশিউর রহমান যাদু মিয়া আরেকটি প্রস্তাব এনে বলেন, ভাসানী ন্যাপ নিবাচনে শুধূ
টোকেন হিসেবে অংশগ্রহণ করবে। কিন্তু পরে ভােটে এটা বাতিল হয়ে যায়।।
ডানপন্থী দলগুলাে দেশের বিভিন্ন স্থানে ইসলামী শাসনতন্ত্রের দাবিতে, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের সমালােচনা করে অসংখ্য সভা-সমিতি করে। একই সাথে তারা একটা ঐক্যজোট গঠনের প্রচেষ্টা চালায়। ফজলুল কাদের চৌধুরী তার কনভেনশন মুসলিম লীগকে ইসলামী ঐক্যের প্রতি একাত্মতা বলে ঘােষণা করেন। এসব দলের সভাগুলাে সাধারণ মানুষের স্বার্থের পরিপন্থী বলে জনগণ বানচাল করে দিতে প্রায় সময়। তারা অবশ্য এসবের জন্য পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগকে এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টিকে দায়ী করতে থাকে।
সেপ্টেম্বর মাসে মওলানা ভাসানী আন্দোলনের ডাক দিলেও নির্বাচনের ব্যাপারে নিচুপ থাকেন। ১৩ সেপ্টেম্বর সাটুরিয়াতে এক জনসভায় বলেন, ধনীকশ্রেণীর বিরুদ্ধে অচিরেই উৎখাত আন্দোলন শুরু হবে। পিন্ডিতে তিনি সামাজিক অবিচার দূরীকরণের আহ্বান জানান। ঢাকার যাত্রাবাড়ীর এক সমাবেশে তিনি বলেন, দেশে আল্লাহর হুকুমত কায়েম না হলে গরিবের দুঃখ ঘুচবে না। পাবনায় বলেন, জনগণের দাবি আদায়ে প্রত্যক্ষ সংগ্রাম শুরু করতে হবে। দাবি আদায়ের জন্য প্রয়ােজনে জিহাদ করতে হবে। তার বক্তব্যে কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের কথা বললেও কৌশলে তিনি ৬ দফা ও ১১ দফার বক্তব্যকে এড়িয়ে যান।
১৯৭০-এর ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস’ উপলক্ষে ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন (উভয়) এনএসএফ দোলন যৌথভাবে এই দিবসটি পালন করে। এইদিন ছাত্রলীগ কেন্দ্রীয় সংসদ এক সার্কুলারের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল ডানপন্থী এবং অতি বিপ্লবী বামপন্থীদের নির্বাচন বানচালের ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জনগণকে সজাগ করে দেন।
নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে ভবিষ্যৎ বাণী করতে গিয়ে লন্ডনে পাকিস্তান সােসাইটিতে ভাষণদান কালে তৎকালীন কেন্দ্রীয় যােগাযােগমন্ত্রী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, বঙ্গসন্তান জি ডব্লিউ চৌধুরী বলেন, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে কোনাে দলই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারবে না। এ ছিল তখনকার পাক সরকারের
নির্বাচনী প্রতিক্রিয়া। এ সময় আমলা এমএম আহমদ প্রেসিডেন্টের। অর্থনৈতিক উপদেষ্টা নিযুক্ত হন। অক্টোবরের শুরু থেকে আওয়ামী লীগ ও সহযােগী সংগঠনগুলাে তুমুল নির্বাচনী প্রচারণার সাথে সাথে নির্বাচনবিরােধী চক্রের বিরুদ্ধে অত্যন্ত সক্রিয় হয়ে ওঠে।
১ অক্টোবর পল্টনে শ্রমিক লীগের এক বিশাল শ্রমিক জনসভায় শ্রমিক লীগ নেতা আবদুল মান্নান বলেন, শ্রমিক লীগের কর্মীদের উপর সামরিক নানা বিধি প্রয়ােগ করা হচ্ছে। অথচ যারা জ্বালাও-পােড়াও, ঘেরাও আন্দোলন করছে তাদের বিরুদ্ধে সরকার নীরব ভূমিকা পালন করছে। তিনি আরাে বলেন, জনগণের দাবি-দাওয়া আদায়ে যদি ছিনিমিনি খেলা হয়, বাংলার স্বাধিকার আন্দোলন ও নির্বাচন বানচাল হয়, ৬ দফা ও ১১ দফা আদায়ে বাধা সৃষ্টি করা হয়, তাহলে বাংলার জাগরিত জনগণ তা কখনাে ক্ষমা করবে না। পটুয়াখালীতে তাজউদ্দিন আহমদ এক জনসভায় বলেন, নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টা যে কোনাে কিছুর বিনিময়ে রুখে দাঁড়াতে হবে।
অক্টোবরে বঙ্গবন্ধু তার কিছু দলবল নিয়ে সারা বাংলায় নির্বাচনী প্রচারে নেমে পড়েন। ২ অক্টোবর চাঁদপুরে ছাত্রলীগের সম্মেলনে বঙ্গবন্ধু নির্বাচনবিরােধী তৎপরতার ব্যাপারে হুঁশিয়ার করে দেন এবং বলেন, যারা প্রতিক্রিয়াশীল স্বার্থান্বেষীদের সাথে হাত মিলিয়ে অতি বিপ্লবীরা নির্বাচন বানচালের প্রচেষ্টায় লিপ্ত তাদের সম্পর্কে সজাগ থাকতে হবে। সুনামগঞ্জের এক সভায় বলেন, বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধভাবে আওয়ামী লীগকে ভােট দিলে কোনাে শক্তিই বাংলার মানুষের অধিকারকে দাবিয়ে রাখতে। পারবে না।
১০ অক্টোবর ধর্মপাশায় তিনি বলেন, শাসনতন্ত্রে বাঙালির দাবি| দাওয়া স্বীকৃতি পেলে আর আন্দোলনের প্রয়ােজন নেই। তবে তা বাস্তবায়নও করতে হবে। ১৩ অক্টোবর মােহনগঞ্জে এক সভায় বলেন, পশ্চিমাদের পূর্বাংলা থেকে লুষ্ঠিত সম্পদ ফেরত দিতে হবে। ১৮
অক্টোবর কালীগঞ্জে বলেন, ‘কারাে কলােনি হয়ে, গােলাম হয়ে, বাজার। | হয়ে, শোষণ ও বঞ্চনার শিকার হয়ে বসে থাকার জন্য বাঙালির জন্ম হয়নি। ২০ অক্টোবর ঝিনাইদহে বলেন, ৬ দফা ও ১১ দফার পক্ষে আপনারা স্পষ্ট রায় প্রদান করুন। ২১ অক্টোবর লালবাগে বলেন,
আমাদের সংগ্রাম পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠীর বিরুদ্ধে। ২৩ অক্টোবর ঠাকুরগাঁওয়ে বলেন, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস শােষণ ও বঞ্চনার ইতিহাস। পশ্চিমা শােষকরা ২৩ বছরে বাংলার সম্পদ যেভাবে লুণ্ঠন করেছে ২শ’ বছরে ব্রিটিশ বেনিয়ারা তা করতে পারেনি। ২৪ অক্টোবর
সৈয়দপুরে এক জনসভায় বলেন, এবার নির্বাচনের রায়ের মাধ্যমে শােষকগােষ্ঠী নির্মূল করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।
এর মধ্যে নির্বাচন কমিশন পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের জন্য ৮৭০ জন প্রার্থী মনােনয়নপত্র দাখিল করেছেন বলে এক প্রেসবিজ্ঞপ্তিতে জানান। তন্মধ্যে ৩ জন মহিলা প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন- জাতীয় লীগের আমেনা বেগম, মস্কো ন্যাপের সেলিনা বানু ও প্রাক্তন পরিষদ সদস্য খালেদা এদিব খানম।
মওলানা ভাসানী রেসকোর্সের এক সভায় বলেন, আমি নির্বাচন বিরােধী নই। তবে নির্বাচনের পর নির্বাচিত প্রতিনিধিরা ওয়াদার বরখেলাপ। করলে তাদের গলায় গামছা বেঁধে ভােট ফেরত নেয়া হবে। ভােট হলাে জনগণের আমানত। তার দল এ সময় নির্বাচনে অংশগ্রহণের ঘােষণা দেয়। মনােনীত প্রার্থীদের উপদেশ দেন ভােটের জন্য নয়, দুর্গত মানুষের। সেবায় অর্থ ব্যয় করুন। আবার লাহােরে গিয়ে তার উল্টোটা বলেন। তিনি বলেন, ব্যক্তিগতভাবে আমি নির্বাচনে বিশ্বাস করি না। ভাসানী ন্যাপ জাতীয় পরিষদে মাত্র ১৭ জন এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৩৫ জন প্রার্থীর নাম ঘােষণা করেন। ভাসানী হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, সাম্রাজ্যবাদের এজেন্টরা এদেশে গৃহযুদ্ধের পাঁয়তারা করছে। নির্বাচনকে তিনি বিলাসিতা বলে আখ্যায়িত করেন। এর মধ্যে ভাসানীপন্থী শ্রমিক ফেডারেশন দ্বিধাবিভক্ত হয়ে একভাগ সিরাজুল হােসেন খানের নেতৃত্বে এবং অপরভাগ কাজী জাফর আহমদের নেতৃত্বে বিভক্ত হয়ে যায়। কাজী জাফরের নেতৃত্বাধীন ফেডারেশন ভাসানীর পক্ষে এবং অপরপক্ষ বিপক্ষে চলে যায়। ওয়ালী ন্যাপ নির্বাচনী ঐক্য না করার জন্য বিভিন্ন সভায় আওয়ামী লীগকে বিষােদগার করে এবং অভিযােগ করে আওয়ামী লীগ দলীয় স্বার্থের উর্ধ্বে জনগণের স্বার্থকে স্থান দিতে পারেনি।
ইসলামপন্থী দলগুলাে নির্বাচনে প্রার্থী মনােনয়নে হিমশিম খাচ্ছিল। যৌথভাবে জোট প্রার্থী দিতে তারা ব্যর্থ হয়। তফসিলি ফেডারেশন অবস্থা বেগতিক দেখে আইনগত কাঠামাের বিরােধিতা করে নির্বাচন বর্জন করে। | এই দলের নেতা ছিলেন রসরাজ মণ্ডল।
নেজামে ইসলাম ও জমিয়তে তালাবায়ে ইসলাম যৌথভাবে উভয়। পারষদে ৫৬ জন প্রার্থীর নাম ঘােষণা করে। নেজামে ইসলামের নেতা
ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদ। পিডিপি মাত্র ৮ জন প্রার্থীর নাম ঘােষণা করতে সমর্থ হয়। জামায়াত প্রাদেশিক পরিষদে ১৮৩ জন ও জাতীয় পরিষদে ৫৮ জন প্রার্থরি মনােনয়ন দেয়। কনভেনশন মুসলিম লীগ ১০৬ জন প্রার্থী দেয়। জাতীয় লীগের প্রার্থী ছিল ১৭ জন। কাইয়ুম মুসলিম লীগ প্রাদেশিক পরিষদে ১৩৩ জন প্রার্থী মনােনয়ন করে। যদিওবা তারা বলেছিল পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সমান প্রার্থী দাঁড় করাতে তারা। সক্ষম। কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের দাবি জানালেও এই দলের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা এর প্রবল বিরােধিতা করেন। এভাবে এসব দল বাংলার মানুষের। আস্থা হারাতে বসে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নও নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয় । নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের পশ্চিমাদের দালাল বলে আখ্যায়িত করে। অথচ এ সময় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে বাংলার আপামর জনগণ সম্পৃক্ত। হয়ে পড়ে।
অনেক বাধাবিপত্তি এবং নির্বাচনবিরােধী কিছুটা প্রচার সত্ত্বেও সারা দেশে নির্বাচনের জোয়ার বয়ে চলে এবং প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর দলের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা দেখে অন্য দলগুলাে ভিমরি খেয়ে যায়। ন্যাপ উভয় গ্রুপ, জাতীয় লীগ, পিডিপি, জামায়াত, নেজাম এবং সমস্ত মুসলিম লীগের নির্বাচনী আক্রমণের মূল শিকার হলাে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু।
নির্বাচন উপলক্ষে ইয়াহিয়ায় সরকার এক প্রথা চালু করেন বেতার ও টেলিভিশন মারফত একযােগে দলীয়প্রধানদের জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদানের সুযােগ করে দেয়া। এতে করে রাজনৈতিক দলের প্রধানরা তাদের দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রচারে সক্ষম হয়।
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একযােগে বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে তার নির্বাচনী ভাষণ দেন। বস্তুত শেখ মুজিবের ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে রাজনৈতিক নেতাদের সিরিজ বক্তৃতা শুরু হয়। আধ ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। বাংলার মানুষের অধিকার স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ে এবং পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠীর নিষ্পেষণের যাতাকল থেকে
ছিলেন মৌলভী ফরিদ আহমদ। পিডিপি মাত্র ৮ জন প্রার্থীর নাম ঘােষণা করতে সমর্থ হয়। জামায়াত প্রাদেশিক পরিষদে ১৮৩ জন ও জাতীয় পরিষদে ৫৮ জন প্রার্থরি মনােনয়ন দেয়। কনভেনশন মুসলিম লীগ ১০৬ জন প্রার্থী দেয়। জাতীয় লীগের প্রার্থী ছিল ১৭ জন। কাইয়ুম মুসলিম লীগ প্রাদেশিক পরিষদে ১৩৩ জন প্রার্থী মনােনয়ন করে। যদিওবা তারা বলেছিল পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের সমান প্রার্থী দাঁড় করাতে তারা। সক্ষম। কাউন্সিল মুসলিম লীগের পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা কেন্দ্রীয় রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরের দাবি জানালেও এই দলের পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা এর প্রবল বিরােধিতা করেন। এভাবে এসব দল বাংলার মানুষের। আস্থা হারাতে বসে। বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়নও নির্বাচন বর্জনের ডাক দেয় । নির্বাচনে অংশগ্রহণকারীদের পশ্চিমাদের দালাল বলে আখ্যায়িত করে। অথচ এ সময় নির্বাচনী প্রক্রিয়ার সাথে বাংলার আপামর জনগণ সম্পৃক্ত। হয়ে পড়ে।
অনেক বাধাবিপত্তি এবং নির্বাচনবিরােধী কিছুটা প্রচার সত্ত্বেও সারা দেশে নির্বাচনের জোয়ার বয়ে চলে এবং প্রচারণা তুঙ্গে ওঠে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধুর দলের অভূতপূর্ব জনপ্রিয়তা দেখে অন্য দলগুলাে ভিমরি খেয়ে যায়। ন্যাপ উভয় গ্রুপ, জাতীয় লীগ, পিডিপি, জামায়াত, নেজাম এবং সমস্ত মুসলিম লীগের নির্বাচনী আক্রমণের মূল শিকার হলাে আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু।
নির্বাচন উপলক্ষে ইয়াহিয়ায় সরকার এক প্রথা চালু করেন বেতার ও টেলিভিশন মারফত একযােগে দলীয়প্রধানদের জাতির উদ্দেশ্যে বক্তব্য প্রদানের সুযােগ করে দেয়া। এতে করে রাজনৈতিক দলের প্রধানরা তাদের দলের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রচারে সক্ষম হয়।
১৯৭০ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী লীগ প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একযােগে বেতার ও টেলিভিশনে জাতির উদ্দেশ্যে তার নির্বাচনী ভাষণ দেন। বস্তুত শেখ মুজিবের ভাষণের মধ্য দিয়ে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশনে রাজনৈতিক নেতাদের সিরিজ বক্তৃতা শুরু হয়। আধ ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ও ১১ দফার প্রতি তার পূর্ণ সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেন। বাংলার মানুষের অধিকার স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ে এবং পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠীর নিষ্পেষণের যাতাকল থেকে
সর্বত্র নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়ে মিছিল, সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ এবং পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন মাহবুব উল্লাহর নেতৃত্বে নির্বাচনবিরােধী কার্যক্রম শুরু করে। তাদের এই অপচেষ্টা জনগণের কাছে ধােপে টেকেনি।
এককালের আওয়ামী লীগ নেত্রী তখনকার জাতীয় লীগ নেত্রী আমেনা বেগম বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবতীর্ণ হন এবং বলেন, বঙ্গবন্ধুর সস্তা শ্লোগানে জনগণ যেন ধোঁকা না খায়। ন্যাপের মহীউদ্দিন বলেন, ৬ দফা কায়েম হলে বাঙালি ২২ পরিবার সৃষ্টি হবে। তিনি বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা শ্লোগানের সমালােচনা করেন। রাজশাহীতে এক জনসভায় মতিয়া চৌধুরী বলেন, সংখ্যাসাম্যের জন্য মুজিবই দায়ী। মুজিব বলেছিলেন, ওয়ালী খান অবাঙালি, তার দলকে ভােট দিও না। অথচ তিনি অবাঙালি ইউসুফ হারুনের আলফা ইস্যুরেন্সে কিভাবে চাকরি করেন। তার দল কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কথা বলে না কখনাে। আমাদের ঐক্যের ডাকে আওয়ামী লীগ সাড়া দেয়নি। আমরাও দেখবাে আওয়ামী লীগ কিভাবে ক্ষমতায় যায়।।
খাজা খয়েরউদ্দিনও গণতন্ত্রের হত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন। ভাসানী ন্যাপের মশিউর রহমান যাদুমিয়া ৬ দফা ও আওয়ামী লীগের তীব্র সমালােচনা করেন। ওয়ালী ন্যাপ ৬ দফা ও জয়বাংলা। স্লোগানের প্রতি বিষােদগার করলেও ততদিন তা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির মুক্তি সনদে পরিণত হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনাে নির্বাচনী আঁতাত না করে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।
মওলানা ভাসানী আবার বলা শুরু করেন, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র | এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে সংহতি বজায় থাকে । আল্লাহর কাছে
পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য মােনাজাত করেন। তিনি দুনীতি উচ্ছেদের | কথা বলেন এবং শাসনতন্ত্রে কৃষক-শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণের দাবি | জানান। মওলানার রাজনৈতিক অভ্যাসে পরিণত হয় একেক সময় একেক | ধরনের কথা বলা।
সারা দেশে যখন নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে তখন হঠাৎ করে পূর্ববাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে বয়ে যায় মহাপ্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও
সর্বত্র নির্বাচন বয়কটের আহ্বান জানিয়ে মিছিল, সভা-সমাবেশ করতে থাকেন। মতিন-আলাউদ্দিন গ্রুপ এবং পূর্ববাংলা ছাত্র ইউনিয়ন মাহবুব উল্লাহর নেতৃত্বে নির্বাচনবিরােধী কার্যক্রম শুরু করে। তাদের এই অপচেষ্টা জনগণের কাছে ধােপে টেকেনি।
এককালের আওয়ামী লীগ নেত্রী তখনকার জাতীয় লীগ নেত্রী আমেনা বেগম বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে নির্বাচনে অবতীর্ণ হন এবং বলেন, বঙ্গবন্ধুর সস্তা শ্লোগানে জনগণ যেন ধোঁকা না খায়। ন্যাপের মহীউদ্দিন বলেন, ৬ দফা কায়েম হলে বাঙালি ২২ পরিবার সৃষ্টি হবে। তিনি বঙ্গবন্ধু ও জয়বাংলা শ্লোগানের সমালােচনা করেন। রাজশাহীতে এক জনসভায় মতিয়া চৌধুরী বলেন, সংখ্যাসাম্যের জন্য মুজিবই দায়ী। মুজিব বলেছিলেন, ওয়ালী খান অবাঙালি, তার দলকে ভােট দিও না। অথচ তিনি অবাঙালি ইউসুফ হারুনের আলফা ইস্যুরেন্সে কিভাবে চাকরি করেন। তার দল কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের কথা বলে না কখনাে। আমাদের ঐক্যের ডাকে আওয়ামী লীগ সাড়া দেয়নি। আমরাও দেখবাে আওয়ামী লীগ কিভাবে ক্ষমতায় যায়।।
খাজা খয়েরউদ্দিনও গণতন্ত্রের হত্যার জন্য আওয়ামী লীগকে দায়ী করেন। ভাসানী ন্যাপের মশিউর রহমান যাদুমিয়া ৬ দফা ও আওয়ামী লীগের তীব্র সমালােচনা করেন। ওয়ালী ন্যাপ ৬ দফা ও জয়বাংলা। স্লোগানের প্রতি বিষােদগার করলেও ততদিন তা বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও বাঙালির মুক্তি সনদে পরিণত হয়। এ সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কোনাে নির্বাচনী আঁতাত না করে বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন।
মওলানা ভাসানী আবার বলা শুরু করেন, পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র | এমনভাবে তৈরি করতে হবে যাতে সংহতি বজায় থাকে । আল্লাহর কাছে
পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার জন্য মােনাজাত করেন। তিনি দুনীতি উচ্ছেদের | কথা বলেন এবং শাসনতন্ত্রে কৃষক-শ্রমিকের অধিকার নিশ্চিতকরণের দাবি | জানান। মওলানার রাজনৈতিক অভ্যাসে পরিণত হয় একেক সময় একেক | ধরনের কথা বলা।
সারা দেশে যখন নির্বাচনী প্রচারণা তুঙ্গে তখন হঠাৎ করে পূর্ববাংলার সমুদ্র উপকূলবর্তী অঞ্চলসমূহে বয়ে যায় মহাপ্রলঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ও
জলােচ্ছাস। এতে জানমালের অনেক ক্ষতি হয়। সারা দেশের জনজীবন স্তব্ধ হয়ে পড়ে। প্রায় ১০ লাখ আদম সন্তান অসহায়ভাবে মৃত্যুবরণ করে। ঘরবাড়ি, গাছপালা, গবাদি পশু এবং অসংখ্য জীবজন্তুর অস্তিত্ব বিলােপ হয়ে যায়। মানুষের পচা লাশ এবং জীবজন্তুর মৃতদেহের গন্ধে বাংলার আকাশ-বাতাস বিষাক্ত হয়ে উঠে। পূতিময় দুর্গন্ধ, খাদ্যের অভাব ও বিশুদ্ধ পানি না পাওয়ায় নানা রােগ ও মহামারি দেখা দেয়। বেচে যাওয়া মানুষ ও পশুপাখি খােলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সাথে সাথে ঘূর্ণি উপদ্রুত এলাকায় সাহায্য সামগ্রী নিয়ে ছুটে চলেন এবং দুর্গত মানুষের সেবায় নিজেকে এবং কর্মীবাহিনীকে আত্মনিয়ােগ করেন। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকায় জরুরি অবস্থা ঘােষণার দাবি জানান। পূর্ববাংলার এই স্মরণাতীত কালের মহাপ্রলয়ের পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া চীন সফর শেষে পশ্চিম পাকিস্তান যাওয়ার পথে ঢাকায় ক্ষণিকের বিশ্রাম নেন। অথচ দেশের প্রধান হিসেবে অসহায় মানুষকে দেখার জন্য এক কদমও এগিয়ে আসেননি। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এসএম আহসানকে কতিপয় নির্দেশ দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান। এ মহাপ্রলঙ্করী দুর্যোগের পর নির্বাচন হবে কি হবে না অথবা পিছিয়ে যাবে কিনা- এ নিয়ে নানা তর্ক-বিতর্ক ও সংশয়ের সৃষ্টি হয়। ওয়ালী ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আলতাফ হােসেন এক বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন কিছুদিন পিছিয়ে দেয়ার জন্য আহ্বান জানান।
ঘূর্ণিঝড় উপদ্রুত এলাকা পশ্চিমে পটুয়াখালী থেকে পূর্বের সন্দ্বীপকক্সবাজারের দ্বীপাঞ্চল, বরিশাল, পিরােজপুর, ঝালকাঠি, ভােলা, বরগুনা, হাতিয়া, রামগতি, লক্ষ্মীপুর, নােয়াখালী ও চট্টগ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকার উপকূল মানুষ, পশুপাখি, গাছগাছালি বিহীন এক বিরান ভূমিতে পরিণত হয়। এসব দুর্গত এলাকার দুর্যোগপূর্ণ অবস্থার জন্য নির্বাচন শুধু অত্র এলাকায় পিছিয়ে দেয়া হয়। মূলত সারা দেশে নির্বাচনী আবহাওয়ায় স্থবিরতা নেমে আসে, সৃষ্টি হয় এক শােকবিহ্বল করুণ পরিবেশ। সারা দেশের ছাত্র-শিক্ষক, যুবক-কিশাের, ধনী-গরিব, রাজনৈতিক ও সংস্কৃতিক কর্মীরা দুর্যোগ মােকাবিলায় এগিয়ে আসে। সারা দেশের জনগণ সাহায্যের হস্ত সম্প্রসারিত করে। রিলিফ কর্মীরা প্রতিকূল পরিবেশে কাজ চালিয়ে
যায়। বাঙালির এই মহাদুর্যোগের সময় কোনাে পশ্চিম পাকিস্তানি এগিয়ে আসেনি।
সরকারি অবহেলা, অদূরদর্শিতা ও কাণ্ডজ্ঞানহীনতায় ধ্বংসলীলা আরাে ব্যাপক আকার ধারণ করে। বাংলাদেশের ইতিহাসে সাইক্লোনে এতাে লােক আর কখনাে মরেনি। প্রাকৃতিক দুর্যোগ পূর্ববাংলার মানুষের জন্য নিত্যনৈমত্তিক ব্যাপার। কিন্তু তখনকার সাইক্লোনে অসহায় মানুষ পূর্বে রেডিও বা টেলিভিশন মারফত কোনাে সংকেত পায়নি। এই সংকেত না পাওয়ার পেছনে কাজ করেছিল পূর্ব পাকিস্তানের আবহাওয়া বিভাগে আঞ্চলিক পরিচালক হিসেবে এক পশ্চিম পাকিস্তানি ভদ্রলােকের চরম অবহেলা ও গাফলতি। কারণ তিনি সাইক্লোনের পূর্বে এক নির্দেশ জারি করেন আবহাওয়া সংকেত রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারের জন্য না পাঠিয়ে সরাসরি সমুদ্র ও নদীবন্দর কর্তৃপক্ষের কাজে পাঠানাের জন্য। তার এই কাণ্ডজ্ঞানহীনতার জন্য উপকূলবাসী দুর্যোগের পূর্বে সতর্কতা অবলম্বন করতে পারেনি। রেডিও-টেলিভিশনে প্রচারিত না হওয়ায় ঘনীভূত নিমচাপ যে সাইক্লোন আকারে মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে তা কেউ জানতাে না। তাই মধ্যরাতে ছােবল আনা এই সাইক্লোন ঘুমন্ত আদম সন্তানদের আত্মরক্ষার সুযােগই দিলাে না। ঘুমের ঘােরে অসহায় অবস্থায় লাখ লাখ মানুষ ভেসে যায় ভয়াবহ জলােচ্ছাসের প্রবল তােড়ে। অধিকাংশ মৃত লাশ সমুদ্রে ভেসে যায় আর সামান্য যারা বেঁচে ছিল তারাও পড়ে অসহায়ভাবে সমুদ্রের কোলে মৃত্যুবরণ করে।
সরকারি ত্রাণ তৎপরতা ও উদ্ধার কাজ শুরু হয় অনেক বিলম্বে । শুধু কিছু নেতাকর্মী সমাজের দানশীল ব্যক্তিরা সাহায্য-সহযােগিতার জন্য এগিয়ে আসে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার নির্বাচনী প্রচারণা বাদ দিয়ে দুর্গত মানবতার সেবায় আত্মনিয়ােগ করেন। মওলানা ভাসানী শারীরিক অসুস্থতা নিয়ে হাতিয়ার দুর্গত এলাকা সফর করেন। পূর্ববাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন বেতার ও টেলিভিশনে যথাসময়ে বিপদ সংকেত প্রচার না করার জন্য সরকারকে দায়ী করে মিছিল বের করে। এই মিছিলেও পুলিশ লাঠিচার্জ করে এবং কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে।
কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী-বুদ্ধিজীবী ও সাংবাদিকরা যৌথভাবে ঢাকা নগরীতে কবি সুফিয়া কামালের নেতৃত্বে এক মৌনমিছিল বের করে।
উদাসীনতা এবং খবর চাপা দেয়ার প্রচেষ্টাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তীব্র। নিন্দা করছে। যে কাজের জন্য সরকার অথবা কোনাে মানুষ দায়ী নয়সেই মর্মান্তিক ঘটনা সরকার কেন ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাচ্ছেন না। বােধগম্য নয়। কোনাে মন্ত্রী এখানে নেই। এখন পর্যন্ত মানুষ ও পশুর লাশ
মিছিলে ‘কাদো দেশবাসী কাঁদো’ শীর্ষক এক ব্যানার বহন করা হয়। এ মিছিল শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করার সময় সাধারণ মানুষ শােকে বিহ্বল হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের উদ্যোগে আরমানিটোলা ময়দানে হাফেজ মােবারক হােসেনের ইমামতিতে দুর্গত এলাকার মৃতদের উদ্দেশ্যে গায়েবানা নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। জামায়াতে ইসলামী বায়তুল মােকাররমে গায়েবানা জানাজা আদায় করে। মওলানা ভাসানী ২১ নভেম্বর সারা দেশে শােক দিবস ও গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠিত করে।
এর মধ্যে পাকিস্তান সরকারের বােধােদয় হলে ২০ নভেম্বরকে জাতীয় শােক দিবস হিসেবে ঘােষণা করে এবং দুর্গত এলাকা’ ঘােষণা করে বিদেশী সাহায্যের আবেদন জানায়। পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া এবং ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্র বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে দুর্গত এলাকার প্রকৃত চিত্র ও তথ্য তুলে ধরার জন্য সরকারের। প্রতি দাবি জানায়। বিপদ সংকেত প্রদানে অবহেলা প্রদর্শনের জন্য প্রকৃত ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তির দাবি করে। বিলম্বে হলেও সরকার সশস্ত্রবাহিনীকে দুর্যোগপূর্ণ এলাকায় নিয়ােগ করে এবং রিলিফ সামগ্রী বিতরণের জন্য হেলিকপ্টার ব্যবহার করে। | বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সমস্ত নির্বাচনী কার্যকলাপ বাতিল করে তার দলবল ও কর্মীবাহিনী নিয়ে দুঃস্থ মানবতার সেবায় ঝাপিয়ে পড়েন। তিনি ও তার কর্মীবাহিনী বিভিন্ন দুর্গত এলাকায় রিলিফ সামগ্রী বণ্টন শুরু করেন । সাহায্য ও অর্থ সংগ্রহের জন্য আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় রিলিফ ফান্ড গঠন করে। শেখ মুজিবের মতাে কোনাে নেতা দুর্গত এলাকা সফর। করেননি এবং দুঃস্থ মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। পূর্ববাংলার এই ভয়াবহ দুর্যোগের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের অনীহা দেখে বাংলার মানুষ স্তম্ভিত হয়ে যায়। কেউ এসে দুর্গত মানুষের পাশে দাঁড়ায়নি। একমাত্র ব্যতিক্রমী ছিলেন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আবদুল ওয়ালী খান। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে তার নির্বাচনী প্রচার স্থগিত রেখে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্গত এলাকার মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান।
এ সময় ১১ জন নেতা প্রেসিডেন্টের কাছে তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় বলা হয়, পূর্ব পাকিস্তানের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকায় সংঘটিত মানবসভ্যতার বৃহত্তম ধ্বংসলীলার প্রতি সরকারের ক্ষমাহীন অবহেলা,
উদাসীনতা এবং খবর চাপা দেয়ার প্রচেষ্টাকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ তীব্র নিন্দা করছে। যে কাজের জন্য সরকার অথবা কোনাে মানুষ দায়ী নয়সেই মর্মান্তিক ঘটনা সরকার কেন ধামাচাপা দিয়ে রাখতে চাচ্ছেন না। বােধগম্য নয়। কোনাে মন্ত্রী এখানে নেই। এখন পর্যন্ত মানুষ ও পশুর লাশ
ইতস্ততঃ ছড়িয়ে আছে। অতিসত্তর দুর্যোগ মােকাবিলায় সরকারকে এগিয়ে আসার আহবান জানান। তারবার্তায় স্বাক্ষর করেন মওলানা ভাসানী, নূরুল আমীন, আতাউর রহমান খান, অধ্যাপক মােজাফফর আহমদ, খাজা খয়েরউদ্দিন, অধ্যাপক গােলাম আযম, খান এ সবুর, এএসএম সােলায়মান, মাওলানা সিদ্দিক আহমদ, পীর মােহসেন উদ্দিন দুদুমিয়া ও গরীব নেওয়াজ।
মাওলানা মওদূদী এক বিবৃতিতে দুর্গত এলাকায় আসতে না পারার জন্য তার মারাত্মক অসুস্থতার কথা উল্লেখ করেন। দৈনিক পূর্বদেশ এ সময় পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের ছবি প্রথম পৃষ্ঠায় বড় বড় করে ছেপে শিরােনাম দেয় ‘ওরা কেউ আসেনি’। এই শিরােনামটি বাংলার মানুষের মাঝে আলােড়ন সৃষ্টি করে। বাংলার জনগণ ব্যালটের মাধ্যমে এর চরম প্রতিশােধ নেয়। বিবৃতি প্রদানকারী ১১ জন নেতার নির্বাচনের ব্যাপারে। ভালাে অবস্থান ছিল না।
রিলিফ বণ্টনে সরকারি গড়িমসির তীব্র সমালােচনা করেন বঙ্গবন্ধু । তিনি বাংলার মানুষের কাছে পাকিস্তান সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের মুখােশ খুলে দেন। বাংলার মানুষকে তারা কত অবহেলা করে তার চিত্র তুলে ধরেন।
পূর্ববাংলার মানুষের বিশেষ করে উপকূলীয় অঞ্চলের লােকদের দূরাবস্থার সুযােগে কিছু রাজনৈতিক দল পুরা নির্বাচনটা পিছিয়ে নেয়ার পাঁয়তারা শুরু করে। এতে করে তাদের কিছুটা দুরভিসন্ধি লুকিয়ে ছিল। বঙ্গবন্ধু দুর্গত এলাকা ছাড়া দেশের অন্যান্য অংশে নির্বাচনের আহ্বান জানান। যারা নির্বাচন স্থগিতের দাবি জানান তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, খারাপ ছাত্ররা সবসময় পরীক্ষা পেছানাের দাবি তাে করবেই তাতে কর্তৃপক্ষ কর্ণপাত করলে চলবে না। তিনি জানতেন নির্বাচন স্থগিত হলে সামরিক সরকার আর নির্বাচন অনুষ্ঠিত করে কিনা সন্দেহ ছিল। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা পশ্চিমাদের ভাবিয়ে তুলেছিল । তিনি স্পষ্ট ভাষায় ঘােষণা করেন নির্বাচন বন্ধ হলে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের। পথ রুদ্ধ হবে। তখন জনগণ অনিয়মতান্ত্রিক পথে যেতে বাধ্য হবে। কোনাে কিছুকেই এখন থেকে বিনা চ্যালেঞ্জে ছেড়ে দেয়া হবে না। বাঙালিদের ঠকানাের খেলা যারা খেলছে তারা আগুন নিয়ে খেলছে। তিন
আবারাে ঘূণি উদ্ৰত এলাকার মানুষকে যথাযথ সাহায্য ও পুনর্বাসনের আহ্বান জানান। সাথে সাথে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবি করেন।
ভাসানী ন্যাপের জরুরি বর্ধিত সভায় নির্বাচনে তাদের ১৪ জন জাতীয় পরিষদ প্রার্থী এবং ২৫ জন প্রাদেশিক পরিষদ প্রার্থীদের নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানাের আহ্বান জানান। এএসএম সােলায়মানসহ কিছু নেতা ঘূর্ণিঝড়ের অজুহাত দেখিয়ে প্রার্থিতা প্রত্যাহার করেন। এসব নির্বাচন বর্জনের ফলাফল আওয়ামী লীগের আরাে অনুকূলে গেল। পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে দল বলতে বাঙালিরা আওয়ামী লীগকে বুঝতাে। | ১৯৭০ সালের ২৭ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট আগা মােহাম্মদ ইয়াহিয়া খান ঘােষণা দেন নির্ধারিত সময়ে সারা দেশে নির্বাচন হবে, শুধু ঘূর্ণি উদ্রুত এলাকা ছাড়া। এসব এলাকায় পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এতে প্রতিবাদ করে জাতীয় লীগও নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ায়। দলের কিছু কিছু নেতা দলীয় আদেশ অমান্য করে নির্বাচনে থেকে যায়। এ ঘূর্ণিঝড়ে সরকারের সীমাহীন উদাসীনতা ও বিভিন্ন নেতার প্রতিবাদী বক্তব্য নির্বাচনী হাওয়াকে আরাে আওয়ামী লীগের অনুকূলে নিয়ে আসে।
নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সরকার বিচারপতি আবদুস সাত্তারের নেতৃত্বে (পরবর্তীতে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট) শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। নির্বাচন কমিশন বিভিন্ন দলের প্রার্থীদের মনােনয়নপত্র জমা নিতে থাকে। পরে তা যাচাই-বাছাই করে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করেন। বিভিন্ন দলকে প্রতীক বরাদ্দ করা হয় নির্বাচনের জন্য। আওয়ামী লীগকে ‘নৌকা’, ওয়ালী ন্যাপ কুঁড়েঘর’, ভাসানী ন্যাপ ‘ধানের শীষ’, জামায়াতে ইসলামী ‘দাড়িপাল্লা’, নেজামে ইসলামী ‘কিতাব’, কনভেনশন মুসলিম লীগ ‘গােলাপ ফুল’, কাউন্সিল মুসলিম হারিকেন’এভাবে প্রতীক বরাদ্দ পায়। প্রতিটি দল তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো তৈরি করে জাতির সামনে তুলে ধরে।
১৯৭০ সালের ১ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ও ১১ | দফার উপর সরাসরি নির্বাচনী ম্যান্ডেট আহ্বান করে। তিনি বলেন, সংখ্যাসাম্য চলে যাওয়ায় আমরা নির্বাচনে বেশি সিট পেয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করবাে ইনশাআল্লাহ। নির্বাচনী প্রচারকালে আওয়ামী লীগের একটি পােস্টার অর্থনৈতিক বৈষম্যের উপর ‘সােনার বাংলা শ্মশান কেন?’
নির্বাচন-পূর্ববর্তী তল্কালীন পাকিস্তানের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থায় প্রতীয়মান হয় পূর্ববাংলার করুণ অবস্থা। এতে করে মুক্তিযুদ্ধের ঘটনাবলীর একটা ক্রমধারা খুঁজে পাওয়া যায়। নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক পরিস্থিতিই মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি তৈরি করেছিল ।
| পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত হয় মানুষের প্রত্যক্ষ ভােটে। পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেছিল হকসােহরাওয়ার্দী-ভাসানীর নেতৃত্বে। ১৯৬৫ সালে আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহর নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হলেও জনগণ প্রত্যক্ষ ভােটার ছিল না। সে সময় ভােট দিয়েছিল ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী। সুতরাং ১৯৭০ সালের নির্বাচনই ছিল পাকিস্তানের ইতিহাসে অবাধ, নিরপেক্ষ, সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে আপামর জনসাধারণ। স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করে।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোর মাধ্যমে দেশের সামাজিক, অথনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, সামরিক, বৈদেশিক বাণিজ্য সবগুলো
সমাধানে তার ভবিষ্যৎ কর্মসূচি জনগণের সামনে তুলে ধরে। অন্যান্য । দলও তাদের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো প্রচার করে।
আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে বলা হয়, একশ্রেণীর লােক স্বীয় স্বার্থসিদ্ধির জন্য ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাধারণ মেহনতি মানুষকে শােষণ করছে। এ শাসক ও শােষকশ্রেণীকে উত্থাত করা প্রয়ােজন। দেশের দু’প্রদেশের বৈষম্য নিরসনে শাসনতান্ত্রিক ব্যবস্থার প্রয়ােজন। পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন প্রদান একান্ত জরুরি। সমাজের অন্যায়, অত্যাচার, নিপীড়ন দূর করার জন্য রাজনৈতিক ও সামাজিক শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনা করতে হবে। নৌবাহিনী ও নৌ একাডেমি সদর দপ্তর করাচি থেকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরের প্রস্তাব দেয়া হয়। কৃষির উন্নয়ন সাধনে কৃষি ব্যবস্থার উপর জোর দেয়া হয়। কৃষকদের সামন্তবাদী-পুঁজিপতিদের খপ্পর থেকে মুক্তির জন্য আইন প্রণয়নের সুপারিশ করা হয়। কৃষকদের ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফের আবেদন করা হয়।
ম্যানিফেস্টোতে আওয়ামী লীগের ভবিষ্যৎ অর্থনৈতিক কর্মসূচি তুলে ধরে ন্যায়সঙ্গত সমান অধিকারভিত্তিক শােষণমুক্ত সমাজ গঠনের অঙ্গীকার করা হয়। ভারি শিল্প, ব্যাংক-বীমা, বৈদেশিক বাণিজ্য ও যােগাযােগ ব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করণের সুপারিশ করা হয়। মানুষের চাহিদাভিত্তিক শিল্প স্থাপনের উপর জোর দেয়া হয়। নতুন শিল্প-কলকারখানা স্থাপন করে কর্মসংস্থানের সুযােগ সৃষ্টির আবেদন করা হয়। বিলাসসামগ্রী আমদানি বন্ধ করে আমদানি-রপ্তানির ব্যাপারে কতকগুলাে নিষেধাজ্ঞা আরােপ করার প্রস্তাব করা হয়। নিরক্ষরতা দূরীকরণে প্রাথমিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক ও বয়স্ক শিক্ষার ব্যবস্থা করা, বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে সকল দেশের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ। সহঅবস্থান এবং সিয়াটো-সেন্টো জোট থেকে সরে আসার প্রস্তাব দেয়া হয়। | শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের সুব্যবস্থার জন্য করণীয় উদ্যোগ ও বাস্তবায়নের প্রস্তাব করা হয়। মােটামুটি আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ম্যানিফেস্টোতে সকল কিছু তুলে ধরা হয়। পূর্ববাংলার গণমানুষের। অধিকারের প্রতি লক্ষ্য রেখে এই ম্যানিফেস্টো প্রণয়ন করা হয়।
আওয়ামী লীগের প্রতিটি প্রার্থীর সপক্ষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশ্যে ছােট্ট একটি আবেদন করেন, তাহলাে এই :
“জাতি-ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে কেবল সর্বশক্তিমান স্রষ্টার নিকট প্রার্থনা করেই ক্ষান্ত হননি বরং বুলেট, বেয়ােনেট, কালাকানুন অগ্রাহ্য করে আমাকে বন্দীশালা হতে ছিনিয়ে এনেছে এদেশের সংগ্রামী জনগণ। আমি তাদের সে ঋণ কখনাে শােধ করতে পারব না। আগামী সাধারণ নির্বাচনেও আপনাদের আন্তরিক সহযােগিতার মাধ্যমে আমাদের মনােনীত প্রার্থীদেরকে ‘নৌকা মার্কায় ভােট দিয়ে এ দেশের অবহেলিত মানুষের দাবি-দাওয়া আদায়ের পথকে সুগম করুন। আমরা দৃঢ় প্রতিজ্ঞ আপনাদের দাবি আদায়ের সংগ্রামকে এগিয়ে নিতে বিন্দুমাত্র পিছপা হবাে না।।
আপনাদের উপর আমার দৃঢ় আস্থা আছে। আপনারাই আমার সাহস ও শক্তি। জাতীয় জীবনের এ ক্রান্তিলগ্নে আমি আপনাদের নিকট সকল প্রকার সাহায্য পাব বলে আশা রাখি।
আমরা সত্য ও ন্যায়ের জন্য সংগ্রাম করছি। নিশ্চয় আল্লাহ আমাদের সহায় হবেন।
আপনাদেরই শেখ মুজিবুর রহমান”
১৯৭০ সালের ৪ ডিসেম্বর পল্টনে এক জনসভায় মওলানা ভাসানী স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান গঠনের আহ্বান জানান। নির্বাচনের ঘােরবিরােধিতা করে তিনি বলেন, লাখ লাখ লাশের উপর যারা নির্বাচনী প্রচারণার জন্য লাখ লাখ টাকা ব্যয় করছে তারা জনগণের শত্রু না মিত্র তা জনগণকে ভাবতে হবে। যারা বলে নির্বাচনে ১০০ ভাগ আসনে জয়ী হয়ে প্রমাণ করৰে জনতা তাদের পেছনে আছে, তাদের সাথে আমার মতের মিল নেই। তারা সাম্রাজ্যবাদ মার্কিনি ও স্বৈরাচারের তল্পিবাহক। জয়বাংলা শ্লোগানের কোনাে ভিত্তি নেই। স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তানের জন্য কোনাে বিদেশী সৈন্য ত্রাণ তৎপরতায় অংশগ্রহণের সুযােগ দিলে মনে করতে হবে তার পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র আছে। এ সময় ভাসানীর আবােল-তাবােল কথাবার্তার সাথে সুর মিলিয়ে ঐকমত্য পােষণ করেন আতাউর রহমান খান ও এএসএম সােলায়মান প্রমুখ নেতা।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর পূর্ববাংলার ইতিহাসে ঐতিহাসিক দিবস। এ নির্বাচনে বাংলার মানুষ অভূতপূর্ব সাড়া দেয়। জাতি-ধর্ম-বর্ণ, দল-মত
নির্বিশেষে আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে নিজেদের ভােটাধিকার প্রয়ােগ করে। নির্বাচনে অংশগ্রহণের এরূপ স্বতঃস্ফূর্ততা বাংলার ইতিহাসে আর কখনাে পরিলক্ষিত হয়নি। ভােটাররা। স্বেচ্ছাপ্রণােদিত হয়ে ভােট কেন্দ্রে যায় তাদের পছন্দমাফিক উপযুক্ত প্রার্থীকে ভােট প্রদান করে। সত্তরের নির্বাচনের মতাে এদেশে আরেকটি নির্বাচনও সংঘটিত হয়নি। পূর্ববাংলার স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের প্রশ্নে বাংলার আপামর জনগণ দিনাজপুরের তেতুলিয়া থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ পর্যন্ত একই স্রোতধারায় প্রবাহিত হয় এবং ঐকমত্য পােষণ করে । সত্তরের নির্বাচন সম্পূর্ণ অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। কারণ ইয়াহিয়া সরকারের কোনাে নির্বাচনী দল ছিল না। তাই সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করে। এখনকার মতাে নির্বাচনী প্রচারণায় ছিল না কালাে টাকার ছড়াছড়ি, প্রভাব ছিল না মাফিয়া ও মাসলম্যানদের। সৎ, শিক্ষিত, নিষ্ঠাবান, জনদরদী নেতারাই নির্বাচনে প্রার্থী হন এবং অংশগ্রহণ করেন। তাদের ছিল না আর্থিক লােভ-লালসা ও ব্যক্তিস্বার্থের প্রতি। তাদের উদ্দেশ্য ছিল দেশ ও জাতির কল্যাণ সাধন করা এবং দেশকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। দেশ ও জনগণের সেবাই ছিল তাদের মহাত। তাই তারা দেশবাসীর কাছে অত্যন্ত শ্রদ্ধার পাত্র ছিল এবং যথাযথ সম্মান পেতাে। এমনকি তখনকার ছাত্র নেতৃবৃন্দের মধ্যেও এরূপ সৎ গুণ বিরাজিত ছিল। জাতি ও দেশ তাদেরকে শ্রদ্ধার চোখে দেখতাে ও তাদের কথায় বিশ্বাস করে প্রতিটি আন্দোলন ও নির্বাচনে শরিক হতাে। সত্তরের নির্বাচনে ছাত্রসমাজের ভূমিকা অবিস্মরণীয়।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদের নির্বাচনে জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। আওয়ামী লীগ এ নির্বাচনে ধস নামান বিজয় অর্জন করে। দু’দফা নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদের ১৬২টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পায় ১৬০টি আসন। পশ্চিমে আওয়ামী লীগ কোনাে আসন পায়নি। মহিলা ৭টি আসনসহ ৩১৩ সদস্যবিশিষ্ট জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসন পেয়ে সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠী ও তাদের দোসররা এবং দেশী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা হতভম্ব হয়ে যান নির্বাচনী ফলাফলে। পশ্চিম পাকিস্তানের
১৪৮টি আসনের মধ্যে ভুট্টোর পিপিপি ৮৩টি আসন পায়। পরে মহিলা ৫টি আসনসহ ৮৮টি আসন পেয়ে তার দল পশ্চিম পাকিস্তানে বৃহত্তম দল হিসেবে আবির্ভূত হয়। তবে পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশে ভুট্টোর পিপিপির সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। নির্বাচনে জাতীয় পরিষদের আসনে প্রদেশওয়ারী বিভিন্ন দল এভাবে জয়লাভ করে :
পূর্ব পাকিস্তান
আওয়ামী লীগ ১৬০টি, পিডিপি ১টি ও স্বতন্ত্র ১টি আসন লাভ করে। মােট আসন সংখ্যা = ১৬২টি।
পাঞ্জাব (পশ্চিম)।
পিপিপি ৬৪টি, কাইয়ুম মুসলীম লীগ ১টি, কাউন্সিল মুসলীম লীগ ৭টি, জমিয়তে ওলেমা (থানভী রহ.) ৪টি, জামায়াত ১টি, কনভেনশন মুসলিম লীগ ২টি এবং স্বতন্ত্র ৩টি আসন লাভ করে। মােট আসন সংখ্যা = ৮২টি।
সিন্ধু প্রদেশ
পিপিপি ১৮টি, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ১টি, জমিয়তে ওলেমা (থানভী রহ.) ৩টি, জামায়াত ২টি এবং স্বতন্ত্র ৩টি আসনে সাফল্য লাভ করে। মােট আসন সংখ্যা = ২৭টি।
উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ
পিপিপি ১টি, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ৭টি, জমিয়তে ওলেমা (থানভী রহ.) ৬টি, ন্যাপ ওয়ালী ৩টি, জামায়াত ১টি। মােট আসন সংখ্যা = ১৮টি।
বেলুচিস্তান প্রদেশ
ন্যাপ ওয়ালী ৩টি, জমিয়তে ওলেমা (হাজারভী) ১টি। মােট আসন সংখ্যা = ৪টি।
উপরােক্ত ফলাফলে প্রমাণ হয় আওয়ামী লীগ একচ্ছত্রভাবে পূর্ব পাকিস্তানে ভুট্টোর পিপলস পার্টি সিন্ধু ও পাঞ্জাবে, সীমান্ত প্রদেশে কাইয়ুম মুসলিম লীগ, জমিয়তে ওলেমা (থানভী রহ.) এবং বেলুচিস্তান ওয়ালী ন্যাপ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। উভয় পাকিস্তানে আওয়ামী লীগ ক্ষুদ্র সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিসেবে আওয়ামী লীগেরই পাকিস্তানে সরকার গঠনের কথা। আওয়ামী লীগের এই অসম্ভব বিজয়কে
পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠী ও তাদের পূর্ব পাকিস্তানি দোসররা মেনে নিতে পারেনি। তাই তারা পর্দার অন্তরালে নানা কূটচালে লিপ্ত হয় যাতে আওয়ামী লীগ এবং শেখ মুজিবুর রহমান ক্ষমতায় যেতে না পারে।
| জাতীয় সংসদের ২টি আসনে আওয়ামী লীগ পরাজিত হয়। একটি পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটির চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে, আরেকটিতে ময়মনসিংহ থেকে পিডিপি প্রার্থী নূরুল আমিন জয়লাভ করেন।
পূর্ববাংলায় আওয়ামী লীগের বিপুল ভােটের জয়ের পেছনে আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনসমূহের নিরবচ্ছিন্ন কর্মকাণ্ড ও আন্তরিক প্রচেষ্টা এবং বঙ্গবন্ধুর বিশাল জনপ্রিয়তা কাজ করে। বঙ্গবন্ধুর ৬ দফা দাবি উত্থাপনের পর থেকে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান এবং আগরতলা ষড়যন্ত্র। মামলা বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগকে বাংলার মানুষের অতি কাছে নিয়ে যায়। এবং আপন করে তােলে। যার ফলশ্রুতি সত্তরের নির্বাচনে বিপুল বিজয়।
১৯৭০ সালের ১৮ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনেও ৭টি আসন ছাড়া বাকি সব আসনে আওয়ামী লীগ বিপুল ভােটে জয়ী হয়। উল্লেখ্য, বিরােধী আসনের ৭টিতে জয়ী হলেন ন্যাপের সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত এবং চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে শাহজাদা আহমদ সগীরসহ আরাে ৫ জন।
জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট নেতৃবৃন্দের মধ্যে যারা জয়লাভ করেন তারা হলেন- তকালীন জেলাওয়ারী ঢাকায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন আহমদ (জাতীয় চারনেতার অন্যতম), এডভােকেট ময়েজউদ্দিন, সামসুল হক, কোরবান আলী, এডভােকেট রহমত আলী, কফিলউদ্দিন চৌধুরী (প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পিতা), গাজী গােলাম মােস্তফা, এডভােকেট জহির উদ্দিন (মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন পাকিস্তানি বাহিনীর কাছে বশ্যতা স্বীকারকারী ও মন্ত্রিসভার সদস্য), আশরাফ আলী চৌধুরী, শাহ মােয়াজ্জেম হােসেন, শামসুজ্জোহা এবং ড. কামাল হােসেন (বঙ্গবন্ধুর ছেড়ে দেয়া ঢাকার একটি আসন থেকে উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন)। ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলায় সৈয়দ নজরুল ইসলাম (জাতীয় চারনেতার অন্যতম), আবদুল মােমেন, রফিকউদ্দিন ভূইয়া, আবদুল মান্নান, আবদুল মুমিন খান (বিএনপি মন্ত্রী ড. মঈন খানের পিতা), সৈয়দ আবদুস সুলতান, ব্যারিস্টার
শওকত আলী খান, এডভােকেট আবদুল হামিদ, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, আসাদুজ্জামান খান, মােসলেম উদ্দিন খান, জিল্লুর রহমান, শামসুর রহমান খান, এডভােকেট জুবেদ আলী, আবদুল হাকিম, আনিসুর রহমান, আফতাব উদ্দিন ভূইয়া (বিএনপি মন্ত্রী মান্নান ভূইয়ার আত্মীয়), রিয়াজউদ্দিন আহমদ (ভােলা মিয়া)। ফরিদপুর জেলায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (বঙ্গবন্ধু ঢাকার দু’টি এবং ফরিদপুরের একটি এলাকা থেকে নির্বাচিত হন), মােল্লা জালালউদ্দিন, মােল্লা শামসুদ্দিন আহমদ, ফণীভূষণ মজুমদার, গৌরচন্দ্র বালা, কেএম ওবায়দুর রহমান, মােহাম্মদ বায়তুল্লাহ, আবদুর রাজ্জাক, আবদুল ওয়াজেদ চৌধুরী, আবেদুর রেজা খান। বরিশাল ও পটুয়াখালীতে আবদুর রব সেরনিয়াবাত (বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি, ১৫ আগস্ট ১৯৭৫-এ নিহত), এ কে ফায়জুল হক (শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হকের একমাত্র ছেলে), কাজী ফিরােজ রশীদ, কাজী গােলাম মাহবুব (ভাষাসৈনিক), এনায়েতুর রহমান, এবিএম নূরুল ইসলাম, তােফায়েল আহমদ, হরনাথ বাইন, মহীউদ্দিন আহমদ, কাজী আবুল কাসেম, চিত্তরঞ্জন সুতার, এনায়েত হােসেন খান, শাহজাদা আবদুল। মালেক খান, আবদুল হাদি তালুকদার (ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন রেজিস্ট্রার)। খুলনা জেলায় শেখ আবদুল আজিজ, সালাহউদ্দিন ইউসুফ, খয়রাত হােসেন, আবদুল লতিফ খান, মােমেন উদ্দিন আহমদ, দিলদার আহমদ। পাবনায় ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী (জাতীয় চারনেতার অন্যতম), হােসেন মনসুর, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ, মির্জা সুলতান রেজা, আহমেদ রফিক (নির্বাচনের পর পরই আততায়ীর হাতে নিহত)। যশােরের এডভােকেট মশিহুর রহমান (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), সােহরাব হােসেন, ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, সুবােধ কুমার মিত্র, রওশন আলী, খােন্দকার আবদুল হাফিজ, কে এম এ আজিজ, নূরে আলম সিদ্দিকী। রংপুরের নূরুল হক মিয়া (মুক্তিযুদ্ধে শহীদ), মতিউর রহমান, আবদুর রউফ, আবদুল আউয়াল, লুঙ্কর রহমান, শামসুল হক । দিনাজপুরের অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এস ফজলুল করিম, এডভােকেট আবদুর রহিম। কুষ্টিয়ার ব্যারিস্টার আমীরুল ইসলাম, আজিজুর রহমান আক্কাস, ডাঃ আশহাবুল হক, মহীউদ্দিন। আহমদ। রাজশাহীর এএইচএম কামরুজ্জামান (জাতীয় চারনেতার অন্যতম), সরদার আমজাদ হােসেন, আবদুল জলিল, ডাঃ আলাউদ্দিন
আহমদ, শংকর গােবিন্দ চৌধুরী, আবদুল মমিন তালুকদার, আতাউর রহমান, ডাঃ মিসবাহুল হক। বগুড়ার এ কে মুজিবুর রহমান, ড. মফিজউদ্দিন চৌধুরী, কাসিমউদ্দিন আহমদ। সিলেটের দেওয়ান ফরিদ গাজী, কর্নেল এমএজি ওসমানী, কর্নেল এমএ রব, আবদুস সামাদ
আজাদ, কম্যান্ড্যান্ট মানিক চৌধুরী, মােস্তফা আলী, আবদুল হাকিম চৌধুরী, দেওয়ান তৈমুর রেজা। কুমিল্লার মিজানুর রহমান চৌধুরী, খোন্দকার মােশতাক আহমদ, ক্যাপ্টেন সুজাত আলী, অধ্যাপক খােরশেদ আলম, লুফুল হাই সাচ্চু, কাজী জহিরুল কাইউম, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, আবদুল কুদ্স মাখন, এডভােকেট সিরাজুল হক, অধ্যাপক আলী আজম। নােয়াখালীর আবদুল মালেক উকিল, নুরুল হক, অধ্যাপক মােহাম্মদ। হানিফ, মােহাম্মদ উল্লাহ, খালেদ মােহাম্মদ আলী, খাজা আহমদ, এবিএম তালেব আলী, আবদুর রশীদ।
বৃহত্তর চট্টগ্রামের নির্বাচিত প্রতিনিধি সম্পর্কে পরে উল্লেখ করা । হয়েছে। বাকি ১৭টি জেলার নির্বাচিত নামকরা নেতাদের নাম বর্ণিত হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তিনটি এলাকা থেকে নির্বাচিত হন। ঢাকার একটি আসন ড. কামাল হােসেনকে এবং ফরিদপুরের আসনটি ফণীভূষণ মজুমদারকে ছেড়ে দেন এবং তাঁরা দুজন উপনির্বাচনে নির্বাচিত হন। সবচেয়ে বেশি ভােট পান বদরুদ্দোজা চৌধুরীর পিতা কফিলউদ্দিন চৌধুরী।
সমগ্র পাকিস্তানে মহিলাদের সংরক্ষিত আসন ১৩টি, তন্মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ৭টি আসন নির্ধারিত হয়। এই ৭টি আসনে মহিলা সদস্য নির্বাচিত হন বেগম সাজেদা চৌধুরী, বেগম তসলিমা-আবেদ, বদরুন্নেসা আহমদ, নূরজাহান মাের্শেদ, আইভি রহমান, সৈয়দা রাজিয়া বানু ও রাফিয়া আখতার ডলি। | বৃহত্তর চট্টগ্রাম, কক্সবাজারসহ সারা দেশে আওয়ামী লীগের মনােনীত প্রার্থীরা জয়লাভ করে। এ প্রসঙ্গে একটা ব্যাপার উল্লেখ না করলে নয়। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের মনােনয়ন বাের্ডের মেম্বার ছিলেন চট্টগ্রামের এম এ আজিজ। মনােনয়নের ব্যাপারে তিনি একটা কৌশল অবলম্বন করেন। কারণ চট্টগ্রাম ছিল মুসলিম লীগের শক্ত ঘাঁটি। মুসলিম লীগের নেতাদের ছেলেদেরকে ধরে এনে কয়েকটি জায়গায় নমিনেশন দেন। এতে জহুর আহমদ চৌধুরী গ্রুপের শহর ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ ক্ষেপে গিয়ে লালদীঘি মাঠে প্রতিবাদসভা করে। এই প্রতিবাদসভায় ছাত্রলা নেতা এস এম ইউসুফ মুসলিম লীগের সন্তানদের অর্থাৎ নব্য আওয়ামী লীগারদের ‘নীল বর্ণের শৃগাল বলে আখ্যায়িত করেন, যা স্থানীয় পত্রিকায়
হেডিং হয়ে আসে। এসব মনােনীত প্রার্থী হলেন- আনােয়ারায় এয়ার আলী খানের (ফেচু মিয়া) ছেলে আতাউর রহমান খান কায়সার, আনােয়ারা জুট মিলের মালিকের মেয়েজামাই আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু (অবশ্য তার বড়ভাই বশীরুজ্জামান চৌধুরী চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন), সাতকানিয়ার আহমদ কবির মিয়ার ছেলে সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ফটিকছড়ির মির্জা আবুর ছেলে মির্জা মনসুর, মিরসরাইয়ের ছৈয়দুর রহমানের ছেলে ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ হােসেন। নির্বাচনের পর এদের জয়লাভে প্রমাণ হলাে এম এ আজিজের সিদ্ধান্তই সঠিক এবং তিনি দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন। এতে করে মুসলিম লীগের এসব নেতারা নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত ছিলেন। তদুপরি এসব নব্য তরুণ আওয়ামী লীগার এখনাে পর্যন্ত আওয়ামী রাজনীতির সাথে জড়িত, শুধু মির্জা মনসুর ছাড়া। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী প্রয়াত।
চট্টগ্রামের জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ প্রার্থী নির্বাচিত হন। মিরসরাই-ফটিকছড়ি- ফজলুল হক বিএসসি, সীতাকুণ্ড-সন্দ্বীপ : এম আর সিদ্দিকী, হাটহাজারী-রাউজান : অধ্যাপক মুহম্মদ খালেদ, রাঙ্গুনিয়াবােয়ালখালী : এম ইদ্রিস, চট্টগ্রাম শহর : এম এ আজিজ, আনােয়ারাবাঁশখালী : আতাউর রহমান খান কায়সার, পটিয়া-সাতকানিয়ার অংশ অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, সাতকানিয়া অংশ-চকরিয়া : আবু সালেহ, কক্সবাজার (চকরিয়া থানা ছাড়া) : এডভােকেট নূর আহমদ।
| প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচিত হন : মিরসরাই ইঞ্জিনিয়ার মােশাররফ হােসেন, সন্দ্বীপ ইঞ্জিনিয়ার ওবায়দুল হক, সীতাকুণ্ড অধ্যাপক সামসুল হক, ফটিকছড়ি- মির্জা আবু মনসুর, হাটহাজারি— এম এ ওহাব, রাউজান আবদুল্লাহ আল হারুন চৌধুরী, রাঙ্গুনিয়া- ডা. ক্যাপ্টেন আবুল কাসেম, বােয়ালখালী- ডা. এম এ মান্নান, আনােয়ারা- আখতারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, পটিয়া সুলতান আহমদ কুসুমপুরী, সাতকানিয়া- সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, চকরিয়াডা. সামসুদ্দীন আহমদ, রামু-উখিয়া- ওসমান সরওয়ার আলম চৌধুরী, কক্সবাজার-টেকনাফ- মােশতাক আহমদ চৌধুরী, কুতুবদিয়ামহেশখালী- এডভােকেট জহুরুল ইসলাম, চট্টগ্রাম শহর জহুর আহমদ চৌধুরী। আর বাঁশখালীতে আওয়ামী লীগের প্রবীণ
পার্লামেন্টারিয়ান জাকেরুল হক চৌধুরী শাহজাদা মুহম্মদ সগীর (নেজামে ইসলামী দল)-এর কাছে পরাজয় বরণ করেন। ফজলুল কাদের চৌধুরী
অধ্যাপক খালেদের কাছে এবং এ কে খান, এম ইদ্রিসের কাছে, মৌলভী | ফরিদ আহমদ, এডভােকেট নুর আহমদের কাছে বিপুল ভােটে পরাজিত।
| ১৯৭০-এর নির্বাচনে এটাই প্রমাণিত হলাে পাকিস্তানের দু’অঞ্চলের জনগণ একে অপর থেকে ভিন্ন। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ একচেটিয়াভাবে ভােট দেয় আওয়ামী লীগকে। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে। পিপলস পার্টি, সীমান্ত প্রদেশে জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম (হাজারভী) ও কাউন্সিল মুসলীম দুটি মিলে সংখ্যাগরিষ্ঠ, বেলুচিস্তানে অনেকটা জনমানবশূন্য প্রদেশের ৪ আসনের ৩টিতে ওয়ালী ন্যাপ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়। তাই পশ্চিম পাকিস্তানের সব প্রদেশে ভুট্টোর একক নেতৃত্ব ছিল না। সবকটি দল পাকিস্তানব্যাপী না হয়ে অঞ্চলভিত্তিক দল হিসেবে রূপলাভ
বস্তুত, পাকিস্তানের সাধারণ নির্বাচনের ফলাফল ছিল অভাবিত। পূর্ব পাকিস্তানে পশ্চিম পাকিস্তানভিত্তিক স্বরাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও গােয়েন্দা বিভাগের নির্বাচন সংক্রান্ত যে রিপাের্ট ছিল তার সাথে নির্বাচনী ফলাফলের শুধু গরমিলই হলাে না, হলাে সম্পূর্ণ বিপরীত। আসলে এই গােয়েন্দা সংস্থার রিপাের্টের উপর ভিত্তি করেই পাকিস্তান সরকার অবাধ-নিরপেক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করেছিল। তাদের ধারণা ছিল দক্ষিণপন্থী দলগুলাে নির্বাচনে জয়লাভ করবে। সত্যিকার অর্থে তারা নির্বাচনের ফলাফলে এতাে ফারাক হবে কল্পনাই করেনি। বঙ্গবন্ধু পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ৯০% আসন লাভের কথা ব্যক্ত করলেও তিনি পেয়েছিলেন প্রায় ৯৯.৯৯% আসন। নির্বাচনের এই অভাবিত এবং অসাধারণ ফলাফল পাকিস্তানের রাজনীতিতে বৈপ্লবিক। | পরিবর্তনের সম্ভাবনার সূচনা করে। | ডাকসু ও পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের নেতৃবৃন্দ এক যৌথ বিবৃতিতে। আওয়ামী লীগের এই বিরাট সাফল্যকে অভিনন্দিত করে। বিবৃতিতে তারা। বলেন, বাংলার মানুষ ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে ৬ দফা ও ১১ দফার সামান্য রদবদলও সহ্য করবে না। পিডিপি নেতা নির্বাচিত নুরুল আমিন এক বিবৃতিতে বলেন, আমি জনগণের রায়কে শ্রদ্ধা করি।
মওলানা ভাসানী আবার বেঁকে বসলেন, তিনি দাবি করলেন স্বাধীনসার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে বাঙালির রায় যাচাইয়ের জন্য একটি গণভােট অনুষ্ঠান করা উচিত। তিনি আরাে বললেন, দু’দিন আগে নির্বাচনে জনগণ যে রায় দিয়েছিল তা কোনাে ব্যক্তি, পার্টি বা দফার জয় নয়। তিনি এ নির্বাচনের রায়কে ৬ দফা, ১১ দফা ও স্বায়ত্তশাসনের প্রশ্নে জনগণের সুচিন্তিত রায় বলে শেখ মুজিব যে ঘােষণা দেন তা নাকচ করে দেন। মওলানা ভাসানীর এই উদ্ভট দাবি বাংলার মানুষকে বিস্মিত করে। মানুষের মনে প্রশ্ন জাগে- হঠাৎ করে নির্বাচন থেকে ভাসানীর সটকে পড়াটা একটা তেলেসমাতি। নির্বাচন-পরবর্তী এ ধরনের কথাবার্তা রাজনৈতিক বিশেষজ্ঞরা অসুস্থ, ঘােলাটে রাজনৈতিক পরিস্থিতি সৃষ্টির পূর্বাভাস বলে মনে করতে থাকেন।
ঠিক একই সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানি আওয়ামী লীগ নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান পশ্চিম পাকিস্তানে এক বিবৃতিতে বলেন, নির্বাচনে জনগণ বিভ্রান্ত হয়ে ভুল রায় দিয়েছে এবং আবেগের বশবর্তী হয়ে জনগণ ভােট প্রদান করে।
জামায়াতের অধ্যাপক গােলাম আযম নির্বাচনী ফলাফলকে মেনে নিতে পারেননি এবং বলেন, নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়নি। অথচ কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা মিয়া মমতাজ দৌলতানা ও তাহরিক-প্রধান এয়ার মার্শাল (অব.) আসগর খান নির্বাচনী ফলাফল মেনে নেন এবং বিজয়ীদের অভিনন্দন জ্ঞাপন করেন।
| পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্নে ১৫ ডিসেম্বর দুটি পরস্পর বিরােধী ঘটনা ঘটে। পাকিস্তানের নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের। | নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এই বলে
আশ্বাস দেন, ৬ দফা ও ১১ দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র অঞ্চলে অঞ্চলে ও মানুষে মানুষে ন্যায়বিচারের নিশ্চয়তা দিতে পারবে বলে তার দৃঢ় বিশ্বাস। | অন্যদিকে, ৪টি প্রদেশের মধ্যে দুটি প্রদেশে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ৭ সদস্যবিশিষ্ট একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করে এ দেশবাসীকে বিস্মিত করে। দেন। পিডিপি নেতা নুরুল আমিন ভুট্টোর এই অপপ্রয়াসকে অভিনন্দিত করেন। তিনি আওয়ামী লীগ ও পিপলস পার্টিকে শাসনতন্ত্রের প্রশ্নে একটা
সমঝােতায় আসতে আহ্বান করেন। ভুট্টো উল্টোভাবে আওয়ামী লীগের সাথে সমান অংশীদারিত্ব দাবি করে বসেন।
পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) নির্বাচনে দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে পরাজিত করার জন্য অভিনন্দন জানান জনগণকে। নির্বাচনের সাফল্যকে যাতে গণবিরােধী চক্র নস্যাৎ করে দিতে না পারে সে জন্য সবাই সতর্ক থাকার আহ্বান জানান। কমিউনিস্ট পার্টির একটি মুখপত্র এই বলে সতর্ক করে দেন, জনগণের সুস্পষ্ট রায় সত্ত্বেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে প্রকৃত শাসন ক্ষমতা হস্তান্তর হওয়ার সম্ভাবনা কম। | নানা রকম দূরভিসন্ধি এবং গণবিরােধী চক্রের পাঁয়তারা দেখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে সারা দেশে সফরে বের হন জনগণকে, তার দল ও নির্বাচিত সদস্যদের ৬ দফার প্রশ্নে আরাে ঐক্যবদ্ধ করতে । কারণ সে সময় সুযােগ ছিল দলীয় নির্বাচিত সদস্যরা ইচ্ছা করলে দলীয় নীতি ও অবস্থান পরিবর্তন করতে পারেন। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর বেশ কিছু আওয়ামী লীগ সদস্য এরূপ ডিগবাজি খাওয়ায় আওয়ামী লীগ বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়। অতীতের তিক্ত অভিজ্ঞতার আলােকে বঙ্গবন্ধু তার দলীয় সাংসদদের ঐক্যবদ্ধ করার এবং এভাবে যাতে পরিবর্তন না করতে পারে সে ব্যাপারে সতর্ক করে দেন। বঙ্গবন্ধু এক বিশাল জনসমাবেশে দলীয় নির্বাচিত প্রার্থীদের শপথবাক্য পাঠ করান- যাতে নীতি ও আদর্শ থেকে বিচ্যুত না হয়। তিনি দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা দেন ৬ দফা ও ১১ দফার প্রশ্নে কোনাে আপস হবে না। জনগণের অধিকার আদায়ে প্রয়ােজনে শেষ রক্তবিন্দু বিসর্জন দিতে তিনি প্রস্তুত আছেন। ২৩ ডিসেম্বর পাবনায় চরমপন্থীদের হাতে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সাংসদ আহমেদ রফিক নিহত হন। এ নিয়ে অনেক উত্তেজনা বিরাজ করে।
মওলানা ভাসানী স্বাধীন-সার্বভৌম পূর্ব পাকিস্তান গঠনের আহ্বান জানিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান ন্যাপের সাথে সম্পর্কচ্ছেদ করেন। তিনি বঙ্গবন্ধুকে হুঁশিয়ার করে দেন যাতে ক্ষমতার মােহে বিভাের না হন এবং বলেন, শীঘ্রই মুক্তির সংগ্রাম শুরু হবে। মওলানা ভাসানীর এসব ঢাকঢোলে জনতা তেমন সাড়া দিলাে না। কারণ বাংলার জনগণের অবিসংবাদিত নির্বাচিত নেতা হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। এদিকে শাসনতন্ত্র রচনার প্রশ্নে পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠী ভুট্টোর পেছনে এক হতে থাকে অবস্থা
দেখে আওয়ামী লীগের তাজউদ্দিন আহমদ ঘােষণা করেন আওয়ামী লীগ একাই শাসনতন্ত্র রচনা করতে পারে। এমনই পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘােষণা করেন জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় বসবে।
বঙ্গবন্ধু বলেন, আমাদের জাতীয় সংস্কৃতি ধ্বংসের জন্য জাতীয় পুনর্গঠন ব্যুরাে গঠন করা হয়েছে। অনতিবিলম্বে এটা বন্ধের দাবি জানান।
সত্তরের নির্বাচন ছিল বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকাশের সর্বশ্রেষ্ঠ মাধ্যম। এ নির্বাচনে পশ্চিমা শােষকগােষ্ঠীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বঞ্চনার চিত্র বাংলার জনগণের সম্মুখে বার বার তুলে ধরা হয়। এতে করে তাদের মন-মানসিকতা প্রবল পশ্চিমাবিরােধী হয়ে ওঠে, যা পরবর্তীতে মুক্তি সংগ্রামে রূপ নেয়। বাংলার জনগণ এই নির্বাচনের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ হয় বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের পেছনে। এই নির্বাচনের মাধ্যমে বাংলার অধিকাংশ মানুষ বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়। বঙ্গবন্ধুর কর্মীবাহিনী এ চেতনা বাংলার ঘরে ঘরে পৌছে দেয়।
| নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ জয়লাভের পেছনে কারণ ছিল— বঙ্গবন্ধু ও আওয়ামী লীগের মধ্যে নিহিত পূর্ববাংলার মানুষের স্বার্থ ও স্বাধিকার। বাংলার মানুষের মনে এই বদ্ধমূল ধারণা জন্মায় পশ্চিমা শােষণ ও বঞ্চনার হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে বঙ্গবন্ধুর মহান নেতৃত্বে আগামী দিনের মুক্তির জন্য এগিয়ে যেতে হবে। আওয়ামী লীগ ও বঙ্গবন্ধু সদা কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি জনতার দাবি আদায়ের মাধ্যমে শােষণমুক্ত সমৃদ্ধশালী সমাজব্যবস্থা কায়েমের জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগ আরাে বাংলার জনগণের কাছে এসে যায় এবং নিজেদের প্রমাণ করে তারা জনগণের প্রতিনিধিত্ব করার উপযুক্ত।
১৯৭০ সালের পাকিস্তানের অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন বাঙালি জাতির স্বাধীনতার ইতিহাসের অন্যতম মাইলফলক। ভাষা আন্দোলনের পর ‘৬৬এর ৬ দফা আন্দোলন, ‘৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান— এ সবেরই ফলশ্রুতি ‘৭০-এর নির্বাচন। ‘৭০-এর নির্বাচন মানে ঐক্যবদ্ধ বাঙালির মূর্তপ্রয়াস। ‘৭০-এর নির্বাচনের পথ ধরেই শুরু হয় স্বাধিকার আন্দোলন, অসহযােগ আন্দোলন। এই আন্দোলনের পথ ধরেই আমাদের সশস্ত্র মুক্তিসংগ্রাম। মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে রচিত বাংলার স্বাধীনতা।
সত্তরের নির্বাচনের পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী অবস্থা বিশ্লেষণ করলে আমরা লক্ষ্য করি, এই নির্বাচন অনুষ্ঠিত করার জন্য অনেক চড়াই-উত্রাই। পার হতে হয়। বারবার প্রতিহত করতে হয় নির্বাচন বানচালকারীদের। এই কুচক্রিগােষ্ঠী কিছুতেই কামনা করে না বাংলার মানুষ ভােটের মাধ্যমে ঐক্যবদ্ধ রায় প্রদান করুক। এতে করে তাদের নেতৃত্ব বেহাত হয়ে যাবে।। প্রতিষ্ঠিত হবে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নেতৃত্ব।
| সত্তরের নির্বাচনকে বাস্তবে রূপ দিতে বঙ্গবন্ধু, তার সহকর্মী ও । কর্মীবাহিনী জীবন-মরণ সংগ্রাম করে। প্রতিহত করে নির্বাচন বানচালকারীদের। বাংলার মানুষের সামনে তুলে ধরে ‘গাঁয়ে মানে না আপনি মােড়ল’ নেতাদের ভাবমূর্তি। সত্তরের নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সুস্পষ্ট রায় না পেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের একক নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হতাে না এবং স্বীকৃতি পেতাে না বহির্বিশ্বে ও আন্তর্জাতিক মহলে। নির্বাচনের মাধ্যমে প্রমাণ হলাে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। এই নির্বাচন না হলে বঙ্গবন্ধু-আওয়ামী লীগ বৈধতা পেতাে না এবং বৈধ সরকার গঠনে সমর্থ হতাে না। সবাই দাবি করে। বসতাে বাঙালির প্রতিনিধি ও নেতা হিসেবে। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে প্রবাসী সরকার এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বেকায়দায় পড়তে হতাে। জনগণের ভােটে নির্বাচিত হওয়ায় ভারতসহ অন্যান্য বন্ধুপ্রতীম রাষ্ট্র, প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকার এবং মুক্তিযােদ্ধাদের সমর্থনে এগিয়ে আসে। আন্তর্জাতিক বিশ্বেও নির্বাচিত সরকার ও প্রতিনিধি হিসেবে স্বীকৃতি মিলে। স্বাধীনতার পক্ষে জোরালাে বক্তব্য রাখা সম্ভব হয় যেহেতু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে পশ্চিমারা ক্ষমতা হস্তান্তর না করে সশস্ত্র আঘাত হানে নিরীহ জনগণের ওপর। এতে করে বিশ্ববাসীর সমর্থন ও সহানুভূতি পাওয়া যায়। যুদ্ধকালীন সময়ে আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব সবাই মেনে নেয়, যেহেতু তারা নির্বাচিত প্রতিনিধি। সত্তরের নির্বাচনে নির্বাচিত হওয়ার দরুন স্বাধীনতা-পরবর্তী দেশকে একটি শাসনতন্ত্র দিতে সমর্থ হয়। একক নেতৃত্বের ফলে গােটা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। তাই এসব আলােকে আমরা সুস্পষ্টভাবে বলতে পারি সত্তরের নির্বাচন আমাদের মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার অন্যতম সমুজ্জ্বল মাইলফলক। মুক্তিযুদ্ধের অনন্য পটভূমি।