সেক্টর কমান্ডাররা বলছেন মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনা
শাহরিয়ার কবির (সম্পাদক)
৭ নং সেক্টরের অধিনায়ক—লেঃ কর্নেল অবঃ কাজী নূর-উজ্জামান
লেঃ কর্নেল অবঃ কাজী নূর-উজ্জামান একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে ৭ নং সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন কর্নেল নূর-উজ্জামান। মুক্তিযুদ্ধের ৬ বছর আগে সামরিক বাহিনী থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করেও ‘৭১-এ সময়ের প্রয়ােজনে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আবার তিনি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলেন। ঢাকায় ২৫শে মার্চের কালাে রাত্রির। হত্যাযজ্ঞের পরপরই তিনি যুদ্ধের সিদ্ধান্ত নেন। ২৮ শে মার্চ তিনি জানতে পারেন মেজর শফিউল্লাহর নেতৃত্বাধীন বেঙ্গল। রেজিমেন্ট বিদ্রোহ করে জয়দেবপুর থেকে টাঙ্গাইলের দিকে এগিয়েছে। ৩০ শে মার্চ ময়মনসিংহে শফিউল্লাহ ও তাঁর। রেজিমেন্টের সঙ্গে দেখা হয় লেঃ কর্নেল (অবঃ) কাজী নূর-উজ্জামানের। তারপর বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গেই তিনি সীমান্ত অতিক্রম করে চলে আসেন ভারতে। মুজিবনগর সরকার গঠন ও জেনারেল ওসমানীর সিএনসি’র দায়িত্ব গ্রহণের পর জুলাই মাসে তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয় ৭ নং সেক্টরের কমাণ্ডিং অফিসারের। এর আগে জুন মাসে বাংলাদেশ আর্মির প্রথম অফিসার ব্যাচ ট্রেনিং-এর জন্য রিক্রুটমেন্টের দায়িত্ব দেয়া হয় তাঁকে। আর এ কাজের জন্য উইং কমাণ্ডার মির্জার সঙ্গে পূর্বাঞ্চলের প্রত্যেকটি সেক্টরই তিনি ঘুরে দেখেন। রংপুরের কিছুটা অংশ এবং দিনাজপুর, পাবনা, রাজশাহী ও বগুড়ার বিশাল এলাকা নিয়ে গঠিত হয় ৭নং সেক্টর। কাজী নূরউজ্জামানের দায়িত্ব গ্রহণের আগে সেক্টরটির কমাণ্ডিং অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন মেজর নাজমুল হক। কর্নেল জামানের পুরাে পরিবারই। মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিল। ছেলে নাদিম যুদ্ধক্ষেত্রে, আর স্ত্রী ও দুই মেয়ে মালদহের মেহেদীপুরে একটি আর, এ, পি, (রেজিমেন্টাল এইড পােস্ট) হাসপাতালে সেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন। কর্নেল জামানের জন্ম ১৯২৫ সালের ২৪শে মার্চ। ১৯৪৬ সালে বৃটিশ সেনাবাহিনীতে কমিশন পান তিনি। ১৯৬৪ সালে মেজর হিসেবে স্বেচ্ছায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন তিনি। ‘৭১ এর আগস্ট মাসে তাকে লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত করা হয়। ১৯৮১ সালে। তার নেতৃত্বে মুক্তিযােদ্ধা সংসদ সারা দেশ ব্যাপী জামাতে ইসলামীসহ একাত্তরের সকল ঘাতকের বিরুদ্ধে দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তােলেন। তিনি সাপ্তাহিক নয়া পদধ্বনির সম্পাদক প্রকাশকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৮৫ সালে মুক্তিযুদ্ধ চেতনা বিকাশ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মল কমিটি গঠনেরও অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা তিনি। মুক্তিযুদ্ধের স্মরণীয় ঘটনার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে লেঃ কর্নেল | (অবঃ) কাজী নূর-উজ্জামান বলেনঃ আমার সেক্টরের ভৌগােলিক আয়তন ছিল বেশ বড়। সীমান্ত সংলগ্ন এলাকাই ছিল প্রায় ২০০ মাইল লম্বা। সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পর যুদ্ধক্ষেত্রের ব্যস্ততার কারণে মুজিবনগর সরকারের সঙ্গে আমার খুব একটা যােগাযােগ ছিল না বললেই চলে। শুধুমাত্র নির্ধারিত কোন মিটিং-এ অংশগ্রহণের প্রয়ােজন থাকলেই। আমি সাধারণত সল্প সময়ের জন্য মুজিবনগর সরকারের দপ্তরে যেতাম। এতে করে জুলাই-এর পর আমার ৩/৪ বার কোলকাতার ৮নং থিয়েটার ব্লেডে যাওয়া হয়েছিল। তখন সম্ভবত অক্টোবর মাস। একটি বিশেষ প্রয়ােজনে আমি ২ দিনের জন্য মুজিবনগর সরকারের দপ্তরে গেলাম। সেখানে আমার এক ভাগের সঙ্গে দেখা হয়। সে ছিল শেখ মুজিবের ছেলে শেখ কামালের বন্ধু। এক পর্যায়ে সে শেখ কামালকে তার সঙ্গে করে আমার কাছে নিয়ে আসে। আমি কামালকে বললাম, কি করছাে তুমি এখানে? উত্তরে কামাল আমাকে জানালাে কিছু দিন হয় সে ট্রেনিং সেরে এখানে এসেছে। এখনও তার পােস্টিং সে জানে না। অপেক্ষা করছে যুদ্ধক্ষেত্রে যাওয়ার জন্য। তার সঙ্গে কথা বলে বুঝতে পারলাম মুজিবনগর সরকারের একাধিক কর্তাব্যক্তি ও আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ চেষ্টা চালাচ্ছে শেখ কামালকে রণাঙ্গনে না পাঠাতে। কেউ কেউ চাইছেন তাকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী অথবা সর্বাধিনায়কের এডিসি করে যুদ্ধের অনিষ্মতা ও বিপদ থেকে দূরে নিরাপদ অবস্থানে রাখতে। এসব আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ যে করেই হােক কামালকে ৮ নং থিয়েটার রােডেই রেখে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এসব জেনে আমি কামালের উপর রাগ করেই বললাম, তােমার নিজের মতামত নেই? তুমি যা করতে চাও তার সিদ্ধান্ত তাে তােমাকেই নিতে হবে। তুমি কি রণাঙ্গনে যেতে চাও না? দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, প্রতিদিন হাজার হাজার ছেলে যুদ্ধে নাম লেখাচ্ছে, শত শত ছেলে প্রতিদিন দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে অকাতরে শক্রর হাতে জীবন দিচ্ছে আর তুমি যুদ্ধক্ষেত্রে না গিয়ে মুজিবনগরের নিরাপদ অবস্থানেই থাকতে চাচ্ছাে! আমি তাকে বিশ্বের অন্য কয়েকটি দেশের মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার লড়াইয়ের উদাহরণ দিলাম। বললাম মাও সেতুং এর ছেলের কথা। যে উত্তর কোরিয়ার যুদ্ধে নিহত হয়ে পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করে এবং দেশের রাজনৈতিক প্রবাহে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে। আরাে কয়েকটি দেশের কথা বললাম, যেখানে স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতাদের সন্তানরা যুদ্ধে গিয়ে নিজেদের জীবন বিসর্জন দিয়েছে। আমি তাকে আমার ছেলে নাদিম-এর কথাও বললাম। যে ১৯৫৫ সালের ৭ অক্টোবর জন্ম নিয়ে মাত্র ১৬ বছরের যুবক হিসেবে যুদ্ধ করছে। বললাম আমার স্ত্রী ও দুই মেয়ের কথা, যারা একটি হাসপাতালে সেবার দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আরাে অনেক অল্পবয়সী কিশােরের মুক্তিযুদ্ধে অবদানের কথা বললাম। কামালকে আমি বোেঝালাম-ধরেই নিই, তুমি যুদ্ধে মৃত্যুবরণ করেছ। এতেও দেশ ও তােমার পরিবারের জন্য একটি বিরাট অবদান রাখছাে তুমি। কেননা এরকম দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ ছেলেদেরই একসময় এ জাতি তাদের সূর্যসন্তান হিসেবে আখ্যা দেবে। তােমার পরিবার গর্ব করবে তােমার বীরত্বপূর্ণ আত্মত্যাগ নিয়ে। এরপর কামাল কিছুক্ষণ চুপ থেকে উত্তর দিল, আমি যুদ্ধে যাব। সবার সঙ্গে মিলে আমি দেশের মুক্তির জন্য লড়বাে। আমি আপনার সঙ্গে মিলে আমি দেশের মুক্তির জন্য লড়বাে। আমি আপনার সঙ্গেই যাব। আপনার সেক্টরেই যুদ্ধ করবাে। আপনি আমাকে নিয়ে যান। তারপর কামালের সঙ্গে আমার আরাে অনেক কথা। হলাে। আমি পরদিনই সেক্টরে ফিরে আসবাে। তাই পরদিন একটি স্থানের কথা কামালকে বললাম, যেখান থেকে সে আমার সঙ্গে গাড়িতে সেক্টরে যেতে পারবে। নির্ধারিত সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে কামালকে পাওয়া গেল না। আমার হাতেও তেমন সময় ছিল না যে, ওর জন্য অপেক্ষা করবাে। পরবর্তী সময়ে শুনেছিলাম, আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ কামালকে যুদ্ধে অংশগ্রহণে অনুৎসাহী করেছিল এবং কে রণাঙ্গনের বিপদ থেকে কামালকে বাচিয়েছিল তা নিয়ে শেখ মুজিব দেশে আসার পর চাটুকারিতার প্রতিযােগিতা হয়। এতে জ্ঞাণী ভূমিকা ছিল ওসমানীর। ক্যাপ্টেন নূর সর্বাধিনায়কের এডিসি থাকা সত্ত্বেও তিনি কামালকে দ্বিতীয় এডিসি হিসেবে তাঁর সঙ্গে রেখেছিলেন। অথচ কামালের মধ্যে আমি লক্ষ্য করেছিলাম অন্যান্য ছেলেদের মতােই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের তীব্র ইচ্ছা ও ব্যাকুলতা। তার মধ্যে আমি সেদিন কোন দোদুল্যমানতা ও দ্বিধা দেখি নি। তার মধ্যে অন্যান্যদের মতােই উদ্দীপনা আমি সেদিন। দেখেছিলাম। অথচ সেদিন যদি কামাল আমার সঙ্গে যেত, ও যদি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিত, তাহলে শেখ মুজিব দেশে আসার পর অন্যের মুখ থেকে তাকে মুক্তিযুদ্ধ ও যােদ্ধাদের কথা শােনার প্রয়ােজন হতাে না। নিজের ছেলের কাছ থেকেই মুক্তিযুদ্ধের ত্যাগ, তিতিক্ষা ও যন্ত্রণার কথা জেনে তিনি তা হৃদয়ঙ্গম করতে। পারতেন। এছাড়া মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ছেলেদের মধ্যে যে চারিত্রিক সততা ও দেশপ্রেম তখন জনেছিল, তারও অংশীদার হতে শেখ কামাল। আমি মনে করি মুজিবনগরের ষড়যন্ত্রমূলক পরিবেশই শেখ কামালের পরবর্তী পর্যায়ের অধঃপতনের জন্য দায়ী। ‘৭১-এ মুজিবনগরকে এককথায় বলা যায় একটি ষড়যন্ত্রের ঘাঁটি। সেখানে ফিসফাস করে কথাবার্তা, রাজনৈতিক ষড়যন্ত্রের প্রচেষ্টা, ব্যবসায়ী ও যুব সম্প্রদায় যুদ্ধে যাদের অংশ ছিল না)-এর আনাগােনা এবং দেশ স্বাধীনের পর কার কি ভুমিকা হবে এসব নিয়ে শলা-পরামর্শ চলতাে, এসবের মধ্যেই যুদ্ধের মধ্যে সময়টা কাটিয়েছিল শেখ কামাল। ফলে যুদ্ধের নির্মল পরিবেশ তার চরিত্র গঠনে কোন ভূমিকা রাখতে পারে নি। পাশাপাশি আরেকটি ঘটনার কথা বলি। এই ঘটনাটি পুর্ববর্তী ঘটনার সম্পূর্ণ বিপরীত চিত্রের এবং নিঃসন্দেহে তা এদেশের মুক্তির আন্দোলনের গৌরবােজ্জ্বল অধ্যায়। তখন ডিসেম্বর মাস। আমার সেক্টরের প্রতিটি সাব সেক্টর থেকেই তুমুল। লড়াইয়ের সংবাদ আসছে। বিশেষ করে হিলি সাব সেক্টরে তীব্র লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেল। হঠাৎ খবর পেলাম হামজাপুর সেক্টরে (হিলির কাছাকাছি সদ্য। প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত লেঃ সাইফুল্লাহ যুদ্ধে মারাত্মক আহত হয়েছে। তাঁকে রায়গঞ্জের বেস হাসপাতালে অপারেশনের জন্য নেয়া হয়েছে। যুদ্ধের ব্যস্ততায় আমি তাকে দেখতে রায়গঞ্জ হাসপাতালে যেতে পারলাম না। বেশ কিছুদিন পর কোর (Corps) হেডকোয়ার্টার শিলিগুড়িতে যাওয়ার পথে আমি রায়গঞ্জ হাসপাতালে যাই সাইফুল্লাহর অবস্থা দেখতে। হাসপাতালে পৌছতেই কমাণ্ডিং অফিসারে যেন একটু রাগ করেই বললেন না। মুক্তি বাহিনীর ছেলেদের ও অফিসারদের চিকিৎসা আর করা যাবে না। এভাবে নিয়ম শৃঙ্খলা না মানলে চলবে? কোন শৃঙ্খলা নেই। মারাত্মক আহত হয়ে আসে, আর একটু ভাল না হতেই পারে তাে পালিয়ে যায়। আমি তার কাছে রাগের সুনির্দিষ্ট কারণ জানতে চাইলাম। তিনি লেঃ সাইফুল্লাহর। কথা বললেন। এসেছিল গুলিবিদ্ধ হয়ে। অবস্থা একটু ভালাে হতেই কর্তৃপক্ষের কাউকে না জানিয়ে সে হাসপাতাল থেকে পালিয়ে গেছে। আমিও একটু দুশ্চিন্তায় পড়লাম। হাসপাতাল থেকে পালিয়ে সাইফুল্লাহ গেল কোথায়? আর পালালােই-বা কেন? তার কয়েকদিন পর সাইফুল্লাহর সাব সেক্টরে গিয়ে দেখি, এক হাতে ব্যান্ডেজ নিয়ে আমাকে স্যালুট করলাে সাইফুল্লাহ। বললাম, হাসপাতাল থেকে পালালে কেন? ও বললাে স্যার আমি তখনও পুরােপুরি সুস্থ হয়ে উঠি নি। তাই চলে আসার পারমিশন চাইলে কি ওরা আমাকে তা দিত? ওর গুলি লেগেছিল বাম হাতে কাঁধের কাছাকাছি। ও বললাে স্যার একটি মাত্র গুলি লেগেছে হাতে। তাই হাত না হয় কয়েকদিনের জন্য অকেজো হয়েই থাকলাে তাতে আমার কোন অসুবিধা নেই। কিন্তু শক্রর সঙ্গে এখন আমাদের যে মারাত্মক যুদ্ধ চলছে তাতে আমার অনুপস্থিতি ও নেতৃত্বহীনতা আমি মেনে নিতে পারছি না। মনে হচ্ছে এতটুকু আঘাত নিয়ে যুদ্ধের ময়দান ছেড়ে দূরে। থাকাটা ঠিক হচ্ছে না। তাই হাসপাতাল থেকে অনুমতি না নিয়েই আমি চলে। এসেছি। আমার চোখ ছলছল করে উঠলাে। সাইফুল্লাহকে বুকে জড়িয়ে ধরে বললাম ভালই করেছ। সাবধানে থেকো। অসতর্ক হয়াে না। আসলে রণাঙ্গনের প্রতিটি যােদ্ধা সেসময় দেশপ্রেমে ছিল চরম উদ্বুদ্ধ। অনেককেই দেখেছি গুলিবিদ্ধ হয়েও রণাঙ্গনের দায়িত্ব পালনে আপ্রাণ চেষ্টা করেছে। সাইফুল্লাহ ছাড়াও এমন অনেক বীর যােদ্ধার কথা এখানে বলা যায়। যুদ্ধ যে একটি জাতির মানসপটে কি পরিবর্তন আনে, তা দেখার সুযােগ হয়েছিল। ‘৭১-এ। সাধারণ মানুষের মাঝে। মুক্তিযুদ্ধের সময় বাঙ্গালী শরণার্থীদের আশ্রয় দেয়া, তাদের ত্রাণ সাহায্য প্রদান ও যুদ্ধে বাঙালি সৈন্য ও মুক্তিযােদ্ধাদের সাহা সহযােগিতার ক্ষেত্রে ভারতীয় প্রশাসনের কর্মকর্তারা উদার ও সহানুভূতিশীল মনােভাব প্রদর্শন করেছেন। তবে পাশাপাশি এও বলতে হয় যে, ভারতীয়দের এই ভূমিকা ছিল একটি পর্যায় পর্যন্ত সীমাবদ্ধ। তার ওপরে তাদের সকল ভালােবাসা, উদারতা ও সহানুভূতি ছিল ধর্মীয় গোঁড়ামীর বন্ধনে আবদ্ধ। আর তা উচ্চশিক্ষিত, পদস্থ প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের বেলায়ও একইভাবে প্রযােজ্য। একাত্তরের উত্তাল দিনগুলােতেও হিন্দুধর্মীয় সংকীর্ণতা থেকে সৃষ্ট এমনি একটি ঘটনা আমাকে ভীষণ দুঃখ দেয়। আমার সেক্টরের হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুর হলেও, যােগাযােগ সুবিধার কারণে ভারতের পশ্চিম দিনাজপুর শহরই ছিল মুখ্য যােগাযােগ ক্ষেত্র। শিলিগুড়ি কিংবা মুজিবনগরে যেতেও আমাদের এই শহরকে ব্যবহার করতে হতাে। পশ্চিম দিনাজপুর শহরের সার্কিট হাউসটি এককথায় মুক্তিযােদ্ধা ও তাদের ফ্যামিলিদেরই | দখলে ছিল বলা যায়। আর তা সম্ভব ছিল দিনাজপুর শহরের প্রশাসনিক কর্তাদের। | অকুণ্ঠ সহযােগিতায়। সার্কিট হাউসের একপাশে আমাদের দিনাজপুরের জেলা জজ। হান্নান সাহেব তার ফ্যামিলি নিয়ে থাকতেন। মেজর নাজমুল হকের (সাত নং। সেক্টরের প্রথম কমাওরি) পরিবারও যুদ্ধের শুরুর দিকে বেশ কিছুদিন এই সার্কিট হাউসে ছিলেন। তারপর পশ্চিম দিনাজপুর শহরেই ফ্যামিলির জন্য একটি ছােট বাসা নেন নাজমুল। কিন্তু তাঁর অবস্থান ছিল সেক্টর হেডকোয়ার্টারেই। আগেই বলেছি যুদ্ধের ব্যস্ততার কারণে ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গেও আমার মেলামেশার সুযােগ হতাে কম। তাদের কাজ ছিল শরণার্থীদের ত্রাণসামগ্রী সরক্ষণ, বিতরণ ও ক্যাম্প প্রশাসন তদারক করা। আর একাজে আওয়ামী লীগের সাংসদরাই মূলত ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে সম্পর্ক রাখতেন। পশ্চিম দিনাজপুর শহরের ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট-এর বাসা ছিল সার্কিট হাউস সংলগ্ন। আমি প্রয়ােজনে কয়েকবার সার্কিট হাউসে গেলেও তাঁর সঙ্গে আমার কখনােই দেখা হয় নি। তবে বিভিন্ন সময় ম্যাসেজের মাধ্যমে ম্যাজিস্ট্রেটের সঙ্গে। আমার একটি সুন্দর সম্পর্ক গড়ে ওঠে। জেলা জজ হান্নান সাহেবের কাছে। শুনেছিলাম ম্যাজিস্ট্রেট নাকি বাঙালীদের স্বাধীনতার চেতনাকে শ্রদ্ধা করেন এবং আমাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ের ব্যাপারে অত্যন্ত সহানুভূতিশীল মনােভাব পােষণ করেন। তখন লােকটি সম্পর্কে আমার মধ্যেও শ্রদ্ধাবােধ গড়ে ওঠে। কিন্তু পরবর্তী একটি ঘটনা আমার এই বােধে ফাটল ধরায়। তখন অক্টোবর মাস। শিলিগুড়িতে একটি কনফারেন্সে যােগ দিতে জীপে করে যাচ্ছিলেন মেজর নাজমুল হক। উচু-নীচু পাহাড়ী রাস্তায় তিনি নিজেই ডাইভ করছিলেন গাড়িটি। মাঝ পথে এসে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে গাড়িটি পাহাড়ী পথ ছেড়ে কয়েক’শ গজ নিচে পড়ে যায়। মুত্যু ঘটে নাজমুলের। অত্যন্ত পরিশ্রমী অফিসার ছিলেন নাজমুল। তাঁর উপর ভার ছিল প্রশাসন ও ইনডাকসানের। দুটোই খুব কঠিন কাজ। ঘুমাবার পর্যন্ত সময় পেতেন না। হয়তাে ডাইভ করতে করতে ক্লান্তিতে তিনি স্টিয়ারিং-এর উপর ঘুমিয়ে পড়েছিলেন। পরের দিন আমাদের হেডকোয়ার্টার তরঙ্গপুরে এসে পৌছে নাজমুলের মুত্যুর ম্যাসেজ। দুর্ঘটনার সংবাদ পেয়ে কয়েকজন আওয়ামী লীগ সাংসদ নাজমুলের লাশ সমাধির ব্যাপারে আলােচনায় বসেন। তখন আমি সেখানে উপস্থিত হই এবং আমরা সিদ্ধান্ত নিই, মৃতদেহ সরাসরি সার্কিট হাউসে নেয়া হবে। সেখানে গােসল ও অন্যান্য পরিষ্কারপরিচ্ছন্নতা সম্পাদনের পর তার স্ত্রীকে খবর দেব নামজুলের স্ত্রী তখনও মৃত্যুসংবাদ শশানে নি)। তারপর লাশ আমাদের মুক্ত এলাকা সােনা মসজিদের কাছে এনে জানাজা ও দাফনের ব্যবস্থা করবাে। | এ কাজ করতে গিয়েই ভারতীয় প্রশাসনের সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ শুরু হয়। সার্কিট হাউসে নাজমুলের লাশ তারা কিছুতেই আনতে দেবে না। আমি বললাম, দুর্ঘটনার কারণে লাশ মারাত্মক জখম বলেই এখানে একটু গােসলের ব্যবস্থা করতে চাচ্ছি। এতে তারা আপত্তি করলে বললাম, প্রয়ােজনে আমরা সার্কিট হাউসের পেছনের দিকের বাথরুম ব্যবহার করবাে। তবুও তারা সিদ্ধান্তে অনড়। তাদের কথা হচ্ছে, এখানে লাশ গােসল দেয়ালে ভারতীয় কর্মকর্তারা আর এ সার্কিট হাউস ব্যবহার করবে না এবং কর্মচারীদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেবে। আমি বললাম, যে- লােকটিকে জীবিত সময়ে আপনারা এত সমাদর করেছেন, যিনি আপনাদের মাঝে থেকেই যুদ্ধ করেছেন এবং তাঁর পরিবার থাকছে আপনাদের শহরেই, অথচ তার লাশকে আপনারা সার্কিট হাউসে ঢুকতে দিচ্ছেন না এটা কেমন কথা? এতেও প্রশাসনের কর্মকর্তাদের মন গললাে না। ভাবলাম ধর্মীয় কুসংস্কার শুধু নিম্ন পর্যায়েই নয়, একেবারে উচ্চ পর্যায়েও এর ব্যাপক বিস্তার। সার্কিট হাউসের কর্মচারীদের কাছে জিজ্ঞাসা করে জানলাম, লাশের ব্যাপারে এই নির্দেশ এসেছে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে। আমি তখন ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের বাসায় লােক পাঠালাম। ভাবলাম তাঁকে বােঝালে, তিনি হয়তাে পুনঃসিদ্ধান্ত নিতে পারেন। শুনলাম অনুরােধ না করার কথা জানিয়ে, আমার উপস্থিতি টের পেয়ে। উনি দিনাজপুর শহর ত্যাগ করেছেন। এরপর আমি মনঃক্ষুন্ন হয়ে মুক্ত এলাকাতে নামজুলের শবদেহ স্থানান্তরের ব্যবস্থা করলাম। সেইদিনই সন্ধ্যাবেলায় সােনা মসজিদের পাশে তার লাশ দাফনের ব্যবস্থা হলাে। ধর্মনিরপেক্ষ একটি রাষ্ট্রে, হিন্দু ধর্মীয় গােড়ামির কারণে একজন শহীদের এত অমর্যাদা আমাকে সেদিন বিস্মিত করেছিল। শুনেছি শবদেহ যাওয়ার সময় খ্রিস্টানরা নাকি মাথার টুপি খুলে তাকে সম্মান দেখায়। আর একজন উচ্চশিক্ষিত পদস্থ হিন্দু কর্মকর্তাও এতটা ধর্মীয় কুসংস্কারে আচ্ছন্ন! পরে এই প্রসঙ্গ নিয়ে কথা বলি ‘কমিউনাল হারমােনির নেত্রী ও প্রখ্যাত লেখিকা মৈত্রেয়ী দেবীর সঙ্গে। তিনি পুরাে ব্যাপারটি শুনে বিস্মিত হয়ে জানান, হিন্দু ধর্মে এ ধরনের কোন | বিধান আছে বলে তার জানা নেই। তিনি এটাকে কুসংস্কার বলে মন্তব্য করেন। এই ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের আরাে একটি ব্যাপারে আমি দুঃখ পেয়েছিলাম। আমার সেক্টরের চিকিৎসা ব্যবস্থার প্রধান প্রতিবন্ধক ছিল যােগাযােগের দূরবস্থা। তাই যুদ্ধের সময় এই সেক্টরের জন্য একটি মার্সিডিজ বেঞ্জ নির্মিত এম্বুলেন্স বরাদ্দ করা হয়েছিল। আর তা হস্তান্তরের দায়িত্ব ছিল ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেটের হাতে। আমাদের পক্ষ থেকে কয়েকবার তাঁকে এ ব্যাপারে তাগাদা দেয়া হলেও তিনি। যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত গাড়িটি তার নিয়ন্ত্রণেই রেখে দেন। আমাদের কাছে হস্তান্তর করেন নি। ভারতীয় বেসামরিক প্রশাসনের কর্মকর্তাদের সহযােগিতা ও অসহযােগিতার দুই কাপ থাকলেও সাধারণ জনগণের সহানুভূতি, স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা ছিল আমাদের প্রতি। একটি ঘটনা থেকেই এ ব্যাপারে পরিষ্কার চিত্র পাওয়া যাবে। আমাদের সাব-সেক্টরগুলাে ছিল বেশ দুর্গম জায়গায়। স্থান নির্বাচনের সময়ই জনপদ ও প্রধান সড়ক থেকে সাব-সেক্টরগুলােকে দূরে অবস্থান দেয়া হয়। তবে দরিদ্র ভারতীয় জনগণের বাস ছিল সাব-সেক্টরগুলাের আশে পাশে। তারা গভীর। বিস্ময়ের সঙ্গে দেখতে, আমাদের শত শত ছেলে অপারেশনে যাচ্ছে, আহত হয়ে অথবা উল্লাস করতে করতে ফিরে আসছে। তবে তারা আমাদের সঙ্গে এক ধরনের। দূরত্ব বজায় রাখতাে। একদিন আঙ্গিনাবাদ সাব-সেক্টর থেকে আমাদের একটি টপস একটি ছােট অপারেশনে যায়। অপারেশনটি ছােট হলেও এর জন্য বেশ কয়েকদিন পরিকল্পনা করে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়। কিন্তু পাকবাহিনীর কাছে অপারেশনের গােপনীয়তা বজায় থাকে নি। যেভাবেই হােক তারা আমাদের পরিকল্পনার বিস্তারিত জেনে যায়। তাই পাকবাহিনী আমাদের যাওয়ার পথের দু’ধারে প্রচুর এন্টি-পারসােনাল মাইন পুঁতে রাখে। এরপর আমাদের যােদ্ধারা ভাের ৪ টায় অপারেশনে যাওয়ার সময় মধ্যপথেই দু’দিক থেকে পাকবাহিনীর আক্রমণ শুরু হয় এবং মাইনের বিস্ফোরণ হতে থাকে। এই অপারেশনের প্রস্তুতির সময় আমি ছিলাম না। পরিকল্পনা আমার হলেও সে সময় একটি জরুরী কাজে অন্য একটি সাব-সেক্টরে গিয়েছিলাম। সকাল ৯ টার দিকে আঙ্গিনাবাদ সেক্টরে পৌছে দেখি লক্ষ্য অর্জিত হয় নি। আমাদের বাহিনীর হতাহতের সংখ্যাও ব্যাপক। আহত, রক্তাক্ত ছেলেদের কাঁধে করে নিয়ে আসছে সহযােদ্ধারা। জানতে পারলাম, পাকবাহিনীর ফাঁদে পড়েও লেঃ ইদ্রিসের সাহস ও দক্ষতার কারণে পুরাে বাহিনী নিশ্চিহ্নের হাত থেকে রক্ষা পেয়েছে। | ঐ সাব-সেক্টরটির যাওয়া-আসার পথের পাশেই ছিল কতগুলাে কুড়ে ঘরের বসতি। একেবারে দরিদ্র জরাজীর্ণ নিম্নবর্ণের ভারতীয় নাগরিকদের বাস সেখানে। এক চিলতে উঠোন, ভাঙা বেড়া, ভাঙাচাল ও পাতাছোঁড়া হলদে রংয়ের কতগুলাে কলাগাছ-এই ছিল বাড়িগুলাের বৈশিষ্ট। ঐ দিন যখন আমাদের ছেলেরা ব্যর্থ অপারেশনের পর রক্তাক্ত হয়ে সারিবদ্ধভাবে অন্যের কাঁধে দিয়ে ক্যাম্পে ফিরে আসছিলাে, তখন ঐ বাড়িগুলাে থেকে মানুষজন বেরিয়ে আমাদের ছেলেদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কেউ কেউ তাদের কলসি, ঘটি অথবা বাটিতে করে জল আনতে শুরু করলাে, কেউবা আহতদের শরীরে উল ঢেলে রক্ত পরিষ্কার করতে লাগলাে। একজন মহিলা একটি মাটির পাত্রে খই নিয়ে এসে বললাে, বাবারা তােমরা ক্লান্ত। আমার ঘরে এই সামান্য খইটুকুই আছে। তােমরা খাও। আমি এসে আহতদের প্রাথমিক চিকিৎসার তদারক শুরু করি। গামছা ও অন্যান্য টুকরাে কাপড় দিয়ে ছেলেদের রক্ত মুছে দিচ্ছি, বেঁধে দিচ্ছি। এই দৃশ্য। দেখে একজন বুড়ি তার ঘর থেকে দুটো শাড়ি নিয়ে ফিরে এলাে। বললাে, আপনাদের তাে কোন কাপড় নেই। কি করে চিকিৎসা করবেন। আমার আর । আমার ছেলের বউয়ের দুটো তােলা শাশুড়ি ছিল। তা নিয়ে এলাম। পরিষ্কার আছে। এগুলাে বাবা ব্যবহার করতে পারেন। মহিলাটির নিজের গায়ে ছিন্ন বস্ত্র। অথচ সে বারবার অনুপ্রাণিত করছিলাে আহত ছেলেদের জন্য তার তােলা শাড়ি দুটো ব্যবহার করতে। সে বলছিল, ‘আপনারা যে কি কষ্ট করেন বাবা, তা তাে আমরা দেখি। তাদের এই কাজের কৃতজ্ঞতার উত্তর আমি ভাষাতে দিতে পারলাম না। ওঠে দাঁড়িয়ে করজোড়ে হেট হয়ে নমষ্কার করলাম। এতে যেন তারা খুবই বিব্রত হলেন। বললেন, কি করছেন বাবু! লজ্জা দেবেন না। আমরা তাে কিছুই করতে পারি নি। যা ছিল তা-ই নিয়ে এসেছি। সে দৃশ্য আমি আজও ভুলতে পারি না। আগেই বলেছি, ভারতের সাধারণ জনগণ ছিল আমাদের যুদ্ধের ঘাের সমর্থক। মুক্তিযুদ্ধ সফল হােক, এদেশের। যােদ্ধারা জয়ী হােক, এসব অভিব্যক্তি আমি দেখেছি তাদের চোখে মুখে। যুদ্ধ তখন শেষ। আমি আমার মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন সাব-সেক্টর থেকে মেহেদীপুর নবাবগঞ্জ হয়ে রাজশাহী যাওয়ার জন্য নির্দেশ দিলাম। ১৮ ডিসেম্বরের দিকে সকলেই রাজশাহীতে সমবেত হতে লাগলাে। তখন আমি ভারতের দিনাজপুর শহরে গেলাম আমাদের হেডকোয়ার্টারের ব্যাংক একাউন্ট থেকে টাকা। তােলার জন্য। সকাল ১১ টার দিকে ব্যাংকে ঢুকতেই দেখি বেশ লােকজন। একপাশে কপালে চন্দন দেয়া, ধুতি পরা, কালাে টুপি মাথায় কয়েকজন মাড়োয়ারী বসে আছেন। অন্যদিকে আরাে লােকজন। আমাদের অস্ত্রসজ্জিত পােশাক দেখে মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে চিনতে পেরে কয়েকজন জয়বাংলা ধ্বনি দিয়ে বলে উঠলাে “বাঙালি ছেলেরা দেখিয়ে দিল, আমরা যা পারিনি তা-ই ওরা করলাে, এরা যে কি সাহসী!’ একাধিক লােক আমাকে ব্যক্তিগতভাবে অভিনন্দন জানাতে লাগলেন। | হঠাৎ এক ভদ্রলােক আমাকে বলে ওঠেন-দাদা এটা তাে লড়াইয়ে আপনাদের প্রথম জিত। সামনে আরাে অনেক লড়াই আছে। আপনাদের দেশ গড়তে হবে না? আশীর্বাদ করছি তাতেও যেন আপনারা জয়ী হন। তবে ঐ যুদ্ধে জিততে চাইলে এদেরকে (মাড়োয়ারীদের দিকে দেখিয়ে) কিন্তু দেশে ঢুকতে দেবেন না। তাহলেই সব শেষ হয়ে যাবে। | দিনাজপুর শহরে মাড়ােয়ারীদের আধিপত্য ছিল খুবই। ব্যবসা-বাণিজ্য ও অন্যান্য আর্থিক লেনদেনের অধিকাংশই ছিল মাড়োয়ারীদের হাতে। তাই হয়তাে। ঐ লােকটি তার নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলাে বলছিল। আমি অবাক হলাম। ভারতীয় জনগণ আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়েও চিন্তা করছে এবং সতর্কতা দেখাচ্ছে। লােকটিকে তার সতর্কবাণী দেশের উচ্চমহলে বলার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আমি ব্যাংক থেকে বিদায় নিলাম। এবার ৭ নং সেক্টরের ২/১ টি যুদ্ধের ঘটনা বলা যাক। আমার সেক্টরের মেহেদীপুর সাব সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা তুখােড় বাঙ্গালী অফিসার ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। মুক্তিযুদ্ধে তার সাহসিকতা পূর্ণ অবদানের কথা ভুলবার নয়। ১৩ ডিসেম্বর চাঁপাই নবাবগঞ্জে পাকবাহিনীর সঙ্গে এক রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে শহীদ হন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। পরবর্তীতে সরকার। মুক্তিযুদ্ধে তার বীরত্বের কারণে তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ সম্মান প্রদান করে। জাহাঙ্গীরের অংশগ্রহণ ছিল এমন একটি অপারেশনের কথা বলা যাক। মহানন্দা নদীর দু’ পাশে আলী নগর মকরমপুর থেকে শাহপুর গড় পর্যন্ত প্রায় সাত মাইল বিস্তৃত এলাকায় মুক্তিবাহিনীর প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিলাে। অপর পক্ষে নদীর অপর তীরে শিবরামপুর থেকে রােহনপুর হয়ে বিষ্ণুপুর পর্যন্ত পাক সেনাদের কংক্রিট বাঙ্কারসহ সুদৃঢ় প্রতিরক্ষা অবস্থান ছিলাে। একাত্তরের বাইশ নবেম্বর পাকবাহিনীর ২৫ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট মুক্তিবাহিনীর এই প্রতিরক্ষা অবস্থানের উপর ভাের রাতে। হামলা চালায় প্রতরক্ষা অবস্থানের সর্বডান দিকে শাহপুর গড় এলাকা পাকসেনারা আক্রমণ করে। অন্ধকার রাতে এই অতর্কিত আক্রমণে মুক্তিযােদ্ধারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। তারা পশ্চাদপসারণ করে চলে আসে দলদলিতে। বেশ কিছু মুক্তিযােদ্ধা নদী অতিক্রম করে আলী নগর চলে যায়। পাক সেনারা অতি সহজেই দখল করে নেয় শাহপুর গড়। আলমপুর কায়সাবাড়ি প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে পাকবাহিনীকে। প্রতিহত করা হয়। এই দুই অবস্থানে মুক্তিবাহিনীর দু’টি ৮১ মিলিমিটার মর্টার। ছিলাে। শাহপুর গড় থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের পশ্চাদপসরণে আমি অত্যান্ত রাগান্বিত হই এই এবং লেঃ রফিককে অবিলম্বে পাল্টা আক্রমণ করে শাহপুর গড় পুনর্দখলের। আদেশ দেই। পরিকল্পনা অনুযায়ী সেদিনই রাত ১-৩০ মিনিটে পাল্টা আক্রমণ শুরু হয়। আক্রমণ শক্তিশালী করতে ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর মেহেদীপুর। থেকে তাঁর বাহিনী নিয়ে এসে নৌকাযােগে খাল অতিক্রম করে শাহপুর গড়ের পূর্বকোনে অবস্থান নেন। তিনি শিবরামপুর, ব্রেহনপুর ও শাহপুর গড়ে একযােগে কামানের গােলা নিক্ষেপ শুরু করেন। আলীনগর-মকরমপুর প্রতিরক্ষা অবস্থান থেকে মুক্তিবাহিনীর ৮১ মিলিমিটার মর্টার গর্জে উঠে। এখান থেকে শিবরামপুর ব্রীজের অপর প্রান্তে অবস্থিত পাক অবস্থান ও রােহনপুরে অবস্থিত পাকসেনাদের উপর প্রচণ্ড গােলাবর্ষণ অব্যাহত থাকে। মুক্তিবাহিনীর উদ্দেশ্য ছিল পাকবাহিনী। যাতে ধারণা করে, রােহনপুরেই মূল আক্রমণ হয়েছে। আল্পক্ষণ পরে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের বাহিনী পূর্বকোণ থেকে শাহপুর গড় আক্রমণ করে। লেঃ রফিক, নজরুল আলতাফ ও ওয়াশিলকে সঙ্গে করে শাহপুরের সম্মুখ ও পশ্চিম দিক থেকে একযােগে আক্রমণ চালায় সে। প্রায় দেড় ঘন্টা যুদ্ধ চালার পর পাকসেনারা শাহপুর গড় ছেড়ে বিষ্ণুপুর ও কসবা এলাকায় পালিয়ে যায়। ৭নং সেক্টরে বেশিরভাগ অপারেশন হয়েছে সেপ্টেম্বর, অক্টোবর ও নবেম্বরে। এ সময় মেজর গিয়াস, ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ও ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তাদের গেরিলা ইউনিটকে দিয়ে একের পর এক থানা রেইড শুরু করেন। শেষ অবস্থায় পাকিস্তানীরা থানা থেকে টুপ তুলে নিয়ে অন্য কোন বাড়িতে থানা তৈরি করতাে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর ছিল সত্যিকার গণবাহিনীর অধিনায়ক, আদর্শবাদী সৈনিক। সে যুদ্ধের সময় সবরকম বিলাস বসন ত্যাগ করেছিল। দু’টি সস্তা লুঙ্গি ও গেঞ্জী ছিল তার পােশাক। তার জন্য বরাদ্দ বেতনও সে নিত না। ওই। টাকা দিয়ে অ্যাডভান্স ডেসিং সেক্টরে আহত সেনাদের ফলমূল কিনে দেয়া হতাে। শুধু নিজের টাকাই নয় অন্যান্য অফিসারদের কাছ থেকেও সে টাকা চেয়ে এই কাজে ব্যয় করতাে। অসীম সাহসী এই যােদ্ধা যুদ্ধক্ষেত্রে সবার শেষে উইথড্র করতাে। ঘুমাতাে টুপের সঙ্গে। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর ১৩ই ডিসেম্বর চাপাইনবাবগজ্ঞ আক্রমণ করেন। মেজর | গিয়াস অন্যদিক থেকে আরেকটা বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। এখানে পাক বাহিনীর প্রায় এক ব্যাটেক্ষিন শক্তি ছিল। ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর তার টুপস নিয়ে একটি বাঙ্কারে চার্জ করেন। এক সময় তিনি বাঙ্কারের কাছে গিয়ে নীচু থেকে এল এমজির ব্যারেল ধরে টেনে ছিনিয়ে আনেন এবং বাঙ্কারের ভেতরে হ্যান্ড গ্রেনেড চার্জ করেন। ঐ যুদ্ধেই শহীদ হন ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর। জাহাঙ্গীরের লাশ উদ্ধারের জন্য গনবাহিনীর ছেলেরা ২৪ ঘন্টা এক নাগাড়ে যুদ্ধ করেন এবং শহীদের লাশ কাঁধে নিয়ে কবর দেন রাজশাহীর ঐতিহাসিক সােনা মসজিদের পাশে। জাহাঙ্গীর ছিল ইঞ্জিনিয়ারিং কোরের অফিসার। তথাপি বীরত্বের সঙ্গে পরিচালিত করেছে তার। সাব সেক্টরের পদাতিক বাহিনীকে। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস ৭নং সক্টরের অপর এক সাহসী যােদ্ধা। তিনিও আর্মীর লােক ছিলেন না। হিলেন মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। ক্যাপ্টেন ইদ্রিস সবসময় এ্যাসল্ট বা ব্রেইডের নেতৃত্ব দিতেন। পাক আর্মি যদি তাদের কোন অপারেশনে প্রতিপক্ষে ইদ্রিসের অবস্থান জানতাে, তবে আক্রমণে দিধা করতাে। লােকের মুখে ক্যাপ্টেন ইদ্রিসের নাম ছড়িয়ে গিয়েছিল লিজেন্ডের মতাে। মুক্তিযােদ্ধারা এ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। কিন্তু তাদের ব্যবহার করতে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকার ব্যর্থ হয়েছে কিংবা ইচ্ছা করেই করেনি। আমার সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধারা আমাকে বলতাে-‘স্যার, যুদ্ধ শেষে ভাঙ্গা ব্রীজগুলাে আমরা আবার জোড়া লাগাবাে। পােড়া ক্ষেত গুলােতে ফসল গড়ে তুলবাে, কলকারখানা। চালাবাে। দু’বছর না হয় বন্ধই থাকলাে স্কুল কলেজ। এখন যেভাবে যুদ্ধ করছি, এভাবে না হয় দু’বেলা খেয়েই দেশকে গড়ে তুলবাে। তাদের সেইসব অদম্য ইচ্ছাশক্তি আর বাস্তবায়িত হলাে কই?
৪ নং সেক্টরের অধিনায়ক–মেজর জেনারেল (অবঃ) সি আর দত্ত
মেজর জেনারেল (অবঃ) সি, আর, দত্ত। ১৯৭১ সালের রণাঙ্গণের একজন। অকুতােভয় সেনানায়কের নাম। তখন তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। ‘৭১ সালের জানুয়ারি মাসে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৩ মাসের ছুটি কাটাতে সিলেটের হবিগঞ্জে আসেন মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত। পশ্চিম পাকিস্তানে তাঁর। কর্মস্থল ছিল ৬ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টে। ২৫শে মার্চ ঢাকায় পাকবাহিনীর বর্বরােচিত আক্রমণের সংবাদ তিনি ২৬ শে মার্চেই। জানতে পেরে প্রতিরােধ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধে ৪ নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। যুদ্ধে অংশগ্রহণ সম্পকে সি. আর. দত্ত বলেন- আমার ছুটি ছিল ‘৭১-এর মার্চ মাস পর্যন্ত। ২৫ শে মার্চ ঢাকা ও দেশের বড় শহরগুলােতে পাকবাহিনী যে তাণ্ডবলীলা শুরু করে, তা প্রথম জানতে পারলাম মরহুম জেনারেল রব ও মরহুম মানিক চৌধুরীর মুখে। সেটা ছিল ২৬শে মার্চ সকাল। পরের দিন কয়েকজন ছাত্রের মাধ্যমে জেনারেল রব আমাকে খবর পাঠালেন তাঁর বাড়িতে যাওয়ার জন্য। গিয়ে দেখলাম, ঐ বাড়িতে বসে আছেন সামরিক বাহিনী ও আনসারের কয়েকজন সদস্য এবং বেশ কিছু ছাত্র। বাড়ির বাইরের খােলা জায়গায় বেশ ভিড়। দেখলাম হাতিয়ার নিয়ে প্রায় ১৫০ জনের মত দল যুদ্ধে যাবার জন্য প্রস্তুত। যুদ্ধ পরিচালনার ভার দেয়া হলাে আমার হাতে। আমি হাসি মুখে সে দায়িত্ব গ্রহণ করলাম। | সি, আর, দত্তের জন্য শিলং-এ, ১৯২৭ সালের ১লা জানুয়ারি। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে তিনি লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত হন। রণাঙ্গনে বীরত্বপূর্ণ ভূমিকার জন্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর অন্যান্য সেক্টর কমাণ্ডারের ন্যায় তিনি বীর উত্তম” পদকে ভূষিত হন। যুদ্ধের পর ‘৭২-এ রংপুরের ব্রিগেড কমান্ডার এবং ‘৭৩-এ বিডিআর এর ডাইরেক্টর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ থেকে ‘৭৬ সাল পর্যন্ত আমী হেড কোয়ার্টারে চীফ অব লজিস্থিক-এর দায়িত্ব পালনের পর তাঁকে ‘৭৭-এ মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। এরপর ‘৭৯ তে বি.আর.টি.সির চেয়ারম্যান ও পুনরায় ১৯৮২ তে মুক্তিযােদ্ধা কল্যাণ টাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালনের পর ‘৮৪ সালে এল পি আর ছাড়াই তাকে অবসর প্রদান করা হয় বলে তিনি জানান। বর্তমানে তিনি অবসর জীবন যাপন করছেন। এ ছাড়া তিনি হিন্দু-বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি হিসেবেও দায়িত্ব পালন করছেন। ৪ নং সেক্টরের ভৌগােলিক অবস্থান ছিল সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খােয়াইশায়েস্তাগঞ্জ রেললাইন বাদে পুর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট- ডাউকি সড়ক পর্যন্ত বিস্তৃত। ডিসেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে সিলেটের কানাইঘাটে সংঘটিত যুদ্ধকে একাত্তরের। মুক্তিযুদ্ধে সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা বলে জানান সি, আর, দত্ত। এই যুদ্ধের বর্ণনায় তিনি বলেন— ১৯৭১ সালের ৩রা ডিসেম্বর। সেক্টর ট্রপস অগ্রসর হলাে।সৈন্যসংখ্যা ৪০০ জনকে নিয়ে ৪ টি কোম্পানি গঠিত হলাে। একটি কোম্পানিকে লেঃ গিয়াসের নেতৃত্বে দরবস্ত-কানাইঘাট রাস্তার মধ্যে ‘কাট অফ কোম্পানি হিসেবে কাজ করার দায়িত্ব দেয়া হলাে। লেঃ গিয়াসের দায়িত্ব ছিল কোনাে শত্রুসৈন্য যেন দরবস্ত থেকে এসে আমাদের কানাইঘাটে বাধা প্রদান না করতে পারে। লেঃ জহিরকে ১ টি কোম্পানিসহ কানাইঘাট-চুরখাই সড়কের দায়িত্ব দেয়া হলাে, যাতে চুরখাইএর দিকে কোনাে শত্রুসৈন্য পালিয়ে না যেতে পারে। আর দুটো কোম্পানির দায়িত্ব ছিল মেজর রব-এর নেতৃত্বে নদীর পাড় ও মাঝ দিয়ে শত্রুর উপর হামলা চালিয়ে কানাইঘাট জয় করা। রাতের আঁধারে আরম্ভ হলাে কানাইঘাট অভিযান। রাত দেড়টায় গােলাগুলি শুরু হলাে। খবর নিয়ে জানলাম, লেঃ গিয়াসের সঙ্গে। দরবস্ত-কানাইঘাট এলাকায় পাকবাহিনীর সঙ্গে গুলি বিনিময় হচ্ছে। লেঃ গিয়াসের কোম্পানি পাকবাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পর খবর এলাে, ঐ কোম্পানির একটি ছেলে শহীদ হয়েছে। কিন্তু লেঃ গিয়াস গন্তব্যস্থলের অভিমুখে এগিয়ে চলেছে। লেঃ জহিরের কাছ থেকে খবর এলাে যে, ওরা ওদের গন্তব্যস্থলে পৌছতে পারেনি এবং শত্রুরা ওদের গতিরােধ করবার জন্যে মর্টার ও এলএমজির সাহায্যে গােলা নিক্ষেপ করছে। মেজর রবের যাত্রাপথে কোনাে গােলাগুলি হচ্ছিল। না। ওরা এগিয়ে চলেছে। ৪ ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। ভাের আড়াইটার সময় চারদিক থেকে তুমুল যুদ্ধের খবর আসতে আরম্ভ হলাে। লেঃ গিয়াসের গন্তব্যস্থলে পৌছার খবর পেলাম এবং সে তার কাজ আরম্ভ করে দিয়েছে। আরও খবর পেলাম যে, ওদের যাওয়ার পথে ৪ টি বাংকারের ভেতর পাঞ্চাবী সৈন্যদের ওরা ধ্বংস করেছে। লেঃ গিয়াসের কোম্পানি শত্রুদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়লাে। বাংকারের ভেতর থেকে কারা যেন চিৎকার করে বলে ওঠে, ‘আমরা বাঙালি আমাদের। মারবেন না, আমরা আপনাদের সাহায্য করবাে। দুটো পাঞ্জাবী পালিয়ে যাচ্ছে:আপনারা ওদের আক্রমণ করুন। এ পাকিস্তানীদেরকেও গিয়াসের কোম্পানি মেরে ফেলে। এ খবর রাত সাড়ে তিনটায় লেঃ গিয়াসের কাছ থেকে জানলাম। ওকে যে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তা সে পূরণ করেছে এবং প্রতিরােধ গড়ে তুলেছে। চারদিক থেকে গােলাগুলির আওয়াজ আসতে লাগলাে। সকাল ৪টা। লেঃ জহিরের কাছ থেকে জানলাম যে কানাইঘাট-চুরখাইর পথে প্রচন্ড আক্রমণের ফলে সে অগ্রসর হতে পারছে না। তার দুইজন ছেলে গুরুতররূপে আহত হয়েছে। আমি ওকে আহত ব্যক্তিদের পিছনে পাঠিয়ে দিতে বললাম এবং ওকে এগিয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিলাম। যেভাবেই হােক, পাকিস্তানীদের প্রতিহত করতেই হবে। মেজর রবের কাছ থেকে জানলাম, ওখানেও প্রচণ্ড গােলাগুলি চলছে, তবুও ওরা এগিয়ে চলছে। কিছুক্ষণ পর খবর পেলাম মেজর রবের কোম্পানি নদীর পার দিয়ে শত্রুদের ঘিরে ফেলতে সক্ষম হয়েছে এবং শক্রদের কাছ থেকে প্রায় ১৫০ গজ দূরে আছে। ঐ কোম্পানির ৫ টি ছেলে আহত হয়েছে ও পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মেজর রবের কোম্পানির জন্যে গােলাবারুদ অবিলম্বে পাঠানাে দরকার বলে জানালাে। গােলাবারু: পাঠানাে হলাে। বেলা ৬ টার দিকে লেঃ জহিরের কাছ থেকে খবর পেলাম সে তার দায়িত্ব সম্পূর্ণ করতে পারছে না। কারণ মেশিনগান ও মর্টারের গােলাগুলি ভীষণভাবে ওদের উপর এসে পড়ছে। মেজর রবের কাছ থেকে খবর পেলাম ও প্রায় শত্রুদের কাছে এসে পড়েছে। বেশ কিছু আহত হয়েছে। ওকে আরও সৈন্য দিয়ে সাহায্য করতে বলছে। নদীর ওপার থেকে ওদের উপর গােলাগুলি আসছে। নদীর ওপারে বেশ দূরৈ আটগ্রামে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট আছে জানতাম। ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের সঙ্গে বেতার যােগাযােগ ছিল না। আমরা কানাইঘাট আক্রমণ করছি বেঙ্গল রেজিমেন্ট সে খবর জানতে কিনা আমার জানা নেই। আমরা এটাও জানতাম নদীর দু পারেই পাকিস্তানী সৈন্য আছে। কানাইঘাটের নদীর ওপারে শত্রুসৈন্য ও ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট মুখােমুখি বসে আছে জানলাম। ওদের উপর শত্রুসৈন্য হটিয়ে দেবার দায়িত্ব ছিল, তবে সম্ভব হচ্ছিল না তাই পেছনে দিক থেকে কানাইঘাট দখল করা খুবই দরকার হয়ে পড়েছিল। কানাইঘাট দখল করলে নদীর ওপারে পাকিস্তানীদের থাকা অসম্ভব। | লেঃ জহির যখন এগুতে পারছিল না এবং মেজর রবের যখন আরও সৈন্য। দরকার তখন লেঃ জহিরকে বললাম, মেজর রবের সৈন্যদের সাহায্য করতে, যাতে কানাইঘাটের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ হানতে পারে। আমার কাছে ‘ওয়াকিটকি সেট ছিল। যার সাহায্যে যােগাযােগ স্থাপন করছিলাম। ভারতের আর্টিলারী আটগ্রামের পাশে বড় একটা টিলার উপর অবস্থান করছিল। আমাকে বলা হয়েছিল ওদের সাহায্য চাইলে পাওয়া যাবে। খবর পাঠালাম কানাইঘাট বাজারের উপর ও নদীর ওপারে আঘাত হানতে। খুবই সুন্দরভাবে সাহায্য আসতে লাগলাে। সকাল প্রায় ৯ টা। পাকিস্তানী অবস্থান থেকে গােলাগুলির মাত্রা দারুণভাবে। বেড়ে গেল। প্রায় ২০ মিনিট পর বন্ধ হয়ে গেল। বুঝলাম পাকিস্তানীরা হেরে গেছে। মেজর রব ও লেঃ জহিরকে বললাম এগিয়ে যেতে, আজ আমাদের কানাইঘাট দখল করতেই হবে। লেঃ গিয়াসকে আগেই খবর পাঠিয়েছিলাম ওর দুই প্লাটুন দিয়ে লেঃ জহিরকে সাহায্য করার জন্যে কানাইঘাট-চুরখাই রাস্তায় অবরােধ গড়ে তুলতে। বেলা প্রায় ১০ টার সময় খবর পেলাম, নদীর ওপার থেকে পাকস্তানীরা। পালাচ্ছে। হুকুম দিলাম ‘ঝাঁপিয়ে পড়। হাতাহাতি যুদ্ধের খবর পেলাম কিছুক্ষণ। পরেই। মহাবিক্ৰমে মেজর রব, লেঃ জহির ও লেঃ গিয়াসের সৈন্যরা কানাইঘাটের। উপর ঝাপিয়ে পড়লাে। পাকিস্তানীরা দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। ওরা সীতার জানতাে না, তবুও নদীতে ঝাঁপ দিতে আরম্ভ করলাে প্রাণ বাঁচাবার জন্যে। নদীর পারে ওরাই মাইন পুঁতেছিল। তাই নদীর পার দিয়ে দৌড়ে পালিয়ে যাবার সময়। নিজেদের মাইনের বিস্ফোরণে মারা যাচ্ছিল। বেলা ১১ টা—৪ ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল। কানাইঘাট আমাদের দখলে। এলাে—চারধারে জয় বাংলা ধ্বনি, ছেলেদের মুখে হাসি। পেছনে খবর পাঠালাম কানাইঘাট জয়ের কথা। নানা জায়গা থেকে আমাকে অভিনন্দন দেওয়া হােল। কানাইঘাট যুদ্ধে মত পাকিস্তানী সৈন্যের সংখ্যা ছিল প্রায় ৫০ জন। আহত ২০ জনকে গুলি করে মারা হয়েছিল। বাঙালী রাজাকার ছিল ২০ জন। পায়ে ধরে মাফ চাওয়াতে ওদেরকে নিয়ে মুটে-মজুরের কাজ করানাে হত। আমাদের পক্ষের শহীদ হয়েছিল ১১ জন ও আহতের সংখ্যা ছিল ১৫ জন। ওদের প্রাথমিক চিকিৎসার পর পেছনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। লেঃ গিয়াস মেজর হিসেবে ১৯৮১ সালের সামরিক অ্যুথানে অংশ নেয়ার অভিযােগে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হন। লেঃ জহির বর্তমানে (অবসরপ্রাপ্ত। বীর প্রতীক উপাধি প্রাপ্ত) আরেকটি ঘটনা খুব মনে পড়ে। সেটি ছিল চা-বাগান পরিবেষ্টিত ভূমি লাঠিটিলায়। চারপাশের এলাকা থেকে লাঠিটিলা ছিল বেশ উচু। লাঠিটিলার বিপরীতে ভারতের করিমগঞ্জের চা বাগান। পাকিস্তানী বেলুচ রেজিমেন্টের একটি প্লাটুনের অবস্থান ছিল লাঠিটিলায়। কিন্তু আমাদের ছেলেদের ভারতীয় এলাকা থেকে সিলেটের ভিতরে পাঠানাের জন্য লাঠিটিলা শত্রুমুক্ত করা খুব প্রয়ােজন ছিল। মেজর রবের (বর্তমানে ব্রিগেডিয়ার) নেতৃত্বে ১৯ শে জুন লাঠিটিলাকে শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা নেয়া হয় এবং আক্রমণ শুরু হয়। এই আক্রমণে। ভারতের গােলন্দাজ বাহিনী মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করেছিল। দু’দিক থেকে আক্রমণ চালিয়ে লাঠিটিলা পাকবাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করা হয়। সেদিন পাকিস্তান বেলুচ রেজিমেন্টের একজন হাবিলদার ও একজন সিপাহী জীবিত আত্মসমর্পণ করেছিল। খুব বেশি আহত থাকায় ওরা আমাদের সঙ্গে কথাও বলতে পারছিল না। কোন পাকিস্তানী সিপাহীর জীবিত আত্মসমর্পণ সেটাই ছিল প্রথম। নায়েক কুতুব ছিল আমার সেক্টরের একজন বীর যােদ্ধা। আজ সে আমাদের মাঝে নেই। তার সাহসিকতার একটি ঘটনা বলা যাক। তখন সিলেটের সাদামাল নদীতে বেশ পানি। ফেরির সাহায্যে পার হতে হয়। কিন্তু ফেরিটি ছিল পাকিস্তানীদের কজায়। নায়েক কুতুবকে ফেরিটি ধ্বংস করে দেয়ার দায়িত্ব দেয়া হলাে। ওর সঙ্গে দু’জন সিপাহী ও দু’জন ছাত্র সহযােগী। সেদিন সাদামালে বেশ যােত। কচুরীপানা ভেসে যাচ্ছিল বেশ দ্রুত গতিতে। রাতের অন্ধকারে শুরু হল। মিশন। আস্তে আস্তে ওরা সবাই নদীতে নামলাে। ওরা যখন মাঝ নদীতে পৌছলাে তখন বৃষ্টির মতাে গুলি আসতে লাগলাে ওদের উপর। গুলির জন্য ওরা আর এগুতে পারছিল না। সে সময় ওদের সামনে দিয়ে ভেসে যাচ্ছিল কচুরিপানা। সেগুলাে মাথার উপর রেখে আক্রমণে না গিয়ে স্রোতের দিকেই ভেসে গেল ওরা। স্রোতের তীব্রতা ও পাকবাহিনীর অবস্থান বিচার করে এক বিষাদের ছায়া নেমে এলাে সেক্টরে। পরের দিনও ওদের কোন খোঁজ পাওয়া গেল না। দু’দিন পরে এসে আমার পায়ে প্রণাম করলাে নায়েক কুতুব। বললাে ‘বড় বাঁচা বেঁচে গেছি স্যার। আমি ওদেরকে বুকে জড়িয়ে ধরলাম। চোখ দিয়ে আনন্দে জল গড়িয়ে পড়লাে। কেবল বললাম ‘বেঁচে থাকো, জয় বাংলা। | হাবিলদার গােলাম রসুলের কথা কোন দিন ভুলবার নয়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে বীরত্বের জন্য যাদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হতে পারে তাদেরই একজন গােলাম রসুল। সেদিন ছিল ১৪ ই ডিসেম্বর। শুরু হলাে সিলেটের খাদেম নগরের দিকে যাত্রা। খবর পেলাম সেখানে পাকিস্তানীরা বেশ বড় রকমের যুদ্ধের জন্য। প্রস্তুত হচ্ছে। ওটাই ওদের শেষ বৃহ। প্রায় দু’মাইল লার পর আমাদের উপর মর্টারের গােলাগুলি শুরু হলাে। সামনের ঈদগা ও উচুটিলা থেকে মর্টার ও মেশিনগানের গুলি আসছে। ভারতীয় গুর্বা ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে ওরা আমাদের ডাইনে ছিল) ওয়াকিটকির সংযােগ স্থাপনের চেষ্টা করে ব্যর্থ হলাম। আমার দুটো। কোম্পানির বেশিরভাগ ছেলেই একটি খােলা মাঠের মধ্যে এসে গিয়েছিল। তারা। সামনের দিকের কয়েকটি উচু টিলার পিছনে হামাগুড়ি দিয়ে অবস্থান নিল এবং পাকিস্তানীদের গােলাগুলির জবাব দিল। একই সঙ্গে গুৰ্থা ব্যাটেলিয়নের উপরও। পাকবাহিনী গুলিবর্ষণ করছে বলে জানতে পারলাম। অবিরাম গােলাগুলি চলছে। বিকেল পাঁচটার দিকে খবর পেলাম সামনের অবস্থান থেকে সাহসিকতার সঙ্গে শক্রর উপরে হামলা করে হাবিলদার গােলাম রসুল শহীদ হয়েছে। এই নির্ভীক ছেলেটি ছিল বিডিআর-এর। আমি ওকে হাবিলদার পদোন্নতি দিয়েছিলাম আটগ্রাম যুদ্ধের পর। পরে জেনেছি, শক্রর গুলি উপেক্ষা করে সে ঈদগার দিকে এগিয়ে চলেছিল, লক্ষ্য ছিল ঈদগা দখল করা। তারই সাহসিকতায় সন্ধ্যার দিকে আমরা ঈদগা দখল করতে পেরেছিলাম। তার বীরত্বের কথা বিবেচনা করে আমি মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়কের কাছে প্রস্তাব রেখেছিলাম তাকে ‘বীরশ্রেষ্ঠ উপাধি দেয়ার জন্য। মৃত্যুর পরদিন চিকনাগুলে কবর দেয়া হয়েছিল গােলাম রসুলকে। সিলেট দরবস্ত রাস্তার পাশে চিকনাগুলে এখনও তার কবর দেখা যায়। যুদ্ধের সময় সাধারণ মানুষের সাহায্য সহযােগিতা ছিল অতুলনীয়। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে না থাকলেও মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্যে তাদের আপ্রাণ প্রচেষ্টা সব সময়ই ছিল। লক্ষণীয়। একটি ঘটনার কথা বলি। স্থান সিলেটের আটগ্রাম। অনেক মাইল হেঁটে বেশ রাতে আমরা আটগ্রামে পৌছলাম। আমাদের কিছু বলার আগেই গ্রামের মানুষ আমাদের জন্য ভাত, ডাল, তরকারি প্রভৃতির ব্যবস্থা করলাে। এতজন লােকের খাওয়া থাকার সব ব্যবস্থাই তারা কয়েকজন মিলে করে ফেললাে। এ ব্যাপারে প্রশ্ন। করলে জবাবে সেদিন গ্রামের মানুষ বলেছিল, ‘আপনারা এত কষ্ট করে যুদ্ধ করলেন এখন আপনাদের জন্যে আমাদের কিছু করতে দিন। যুদ্ধের শুরুতে আমার প্রথম দায়িত্ব ছিল সিলেটকে মুক্ত করা। আমার সঙ্গে মাত্র ১৫০ জনের একটি বাহিনী। এটা মার্চ মাসের ২৭ তারিখের কথা। ২৮/২৯ মার্চ আমার সৈন্যদের সংগঠিত করে দুই প্লাটুন সাতগা পাহাড়ের দিকে পাঠিয়ে দিলাম। শ্রীমঙ্গল থেকে হবিগঞ্জ ও চুনারুঘাটে যদি শত্রুকে আসতে হয় তাহ সাতগা পাহাড়ের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। কেননা রেল লাইন ও বড় রাস্তা সাতগা। পাহাড়ের মাঝ দিয়েই গেছে। রশীদপুরে আমাদের প্রথম ক্যাম্প ‘বানালাম। এর আশেপাশে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে ছিল চা বাগান। সেসব বাগানের বাঙালী ম্যানেজারদের মুক্তিযুদ্ধে সহযােগিতার কথা কখনাে ভুলবার নয়। সৈন্যদের খাওয়া-দাওয়া, থাকার ব্যবস্থা। এবং টেনিং-এর জায়গা নির্বাচন-সবই তারা করেছেন। বিশেষ করে স্থানীয় চা বাগানের ম্যানেজার মােস্তফা ও আজিজের কথা। অবশ্য আক্রমণের সুবিধার্থে আমরা রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেছি। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি ইয়াকিনগঞ্জে বেশ বড় ধরনের যুদ্ধ হয়েছিল। এ যুদ্ধের একটি ঘটনা বলি। তাতেই বাঙালীদের প্রতি পাকিস্তানীদের প্রেম (?) স্পষ্ট হয়ে উঠবে। এই যুদ্ধে সিলেটের বাঙালী এসপি, যিনি পাকবাহিনীর সহায়কের ভূমিকা পালন করছিলেন, তিনি আমাদের হাতে ধরা পড়েন। পাকিস্তানীরা জানতে , আমরা কত সৈন্য নিয়ে ইয়াকিনগঞ্জ প্রতিরােধ গড়ে তুলেছি। আমাদের স্ট্যাণ্ডি পেটল ইয়াকিনগঞ্জের প্রায় মাইল খানেক আগে ছিল। ইয়াকিনগঞ্জ-সিলেট সড়কে লােক চলাচল তখন একেবারেই বন্ধ। শত্রুরা এটা জানতে যে সিলেট থেকে যদি কেউ গােপালগঞ্জের দিকে যায় তবে সে নিশ্চিতভাবেই আমাদের হাতে পড়বে। আর শক্ত হলে তাে রক্ষা নেই। সিলেটের বাঙালী এস,পি’র পাকবাহিনীকে সহযােগিতার কথা আমরা আগেই জেনেছিলাম। তখন পাকিস্তানিরা একটা অজুহাত দেখিয়ে সিলেটের বাঙালী এসপিকে গােপালগঞ্জের দিকে পাঠালাে। সম্ভবত আমাদের অবস্থান সম্পর্কে ধারণা নেয়ার জন্যই ওদের ঐ প্রচেষ্টা ছিল। এসপি সাহেব স্ট্যান্ডিং পেট্রল পার হয়ে যখন মুল ডিফেন্সের মধ্যে এলাে, তখন চারিদিক থেকে আমাদের ফায়ার খােলা হলাে। তাঁর জীপ দাঁড়িয়ে গেল। দেখালেন সাদা রুমাল। ফায়ার বন্ধ করে আমরা কয়েকজন গেলাম, ভাবলাম বড় শিকার পাব। কিন্তু আশ্চর্য! তিনি বাঙালী এসপি। কি করবাে, গুলি করে মারতে মন চাইলাে না। হেডকোয়ার্টারে নিয়ে এলাম। পরে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য জেনারেল ওসমানী সাহেবের কাছে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল ওকে। ওর জীপটি অবশ্য আমাদের বেশ কাজে লেগেছিল।
৫ নং সেক্টরের অধিনায়ক–লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী
লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী মুক্তিযুদ্ধে ৫নং সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন লেঃ জেনারেল (অবঃ) মীর শওকত আলী। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে তিনি চট্টগ্রামের ষােলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টে মেজর পদে কর্মরত ছিলেন। সেখান থেকেই তিনি বিদ্রোহ ঘােষণা করেন এবং মে মাসের মাঝামাঝি সময়ে আনুষ্ঠানিক ভাবে ৫ নং সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সিলেট | ডাউকি থেকে সিলেট জেলার সমগ্র উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চল নিয়ে এই সেক্টর গঠন করা হয়। মীর শওকতের জন্ম ১৯৩৪ সালের ৯ ডিসেম্বর পুরনাে ঢাকায়। ১৯৫৩ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যােগ দিয়ে ১৯৫৮ সালে তিনি কমিশন লাভ করেন। ১৯৭০-এ মেজর পদে উন্নীত হন। ১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসে তাঁকে কোয়েটা স্টাফ কলেজ থেকে চট্টগ্রামের ৮ম বেঙ্গল।রেজিমেন্টে পােস্টিং দিয়ে পাঠানাে হয়। কিছুদিন ছুটি কাটিয়ে মার্চ মাসের ১৫ তারিখে তিনি ঐ ব্যাটেলিয়নে যােগ দেন। মুক্তিযুদ্ধকালে : লেঃ কর্নেল র্যাঙ্কে উন্নীত হন। ১৯৮১ সালের ৯ই জুন তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ও.এস.ডি করা হয়। পরবর্তী সময়ে মিশর, পশ্চিম জার্মানী, বৃটেন প্রভৃতি দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করেন তিনি। তিনি বলেন, এরশাদ সরকারের আমলে ২ বার রাষ্ট্রদূতের চাকরি ছেড়ে দেশে আসার চেষ্টা করলেও তাকে তা করতে দেয়া হয় | নি।১৯৮৯ সালে বিএনপিতে যােগদানকারী মীর শওকত আলী বর্তমানে জাতীয় সংসদ সদস্য। একজন সেক্টর কমান্ডার হিসেবে | মুক্তিযুদ্ধে তার স্মরণীয় ঘটনা জানতে | চাইলে মীর শওকত বলেন, পুরাে ৯ মাসই আমার কাছে স্মরণীয়। সে সময়ের প্রতিটি দিন, প্রতিটি ঘটনা, প্রতিটি মৃত্যুকে আমি সমান গুরুত্বপূর্ণ ও আত্মত্যাগী বলে মনে করি। চট্টগ্রামের ষােলশহরে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডার ছিলেন অবাঙালী কর্নেল জানজুয়া। মেজর জিয়াউর রহমান ছিলেন এই ব্যাটেলিয়নের সেকেণ্ড -ইনকমাণ্ড। জিয়াউর রহমান ও মীর শওকত ছাড়াও ঐ ব্যাটালিয়নে আরাে কয়েকজন বাঙালী অফিসার ছিলেন। সেনাবাহিনীতে বিদ্রোহ ও মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে মীর শওকত জানান। ২৫শে মার্চ রাত ১১-৩০ মিনিটের সময় টেলিফোনে জানতে পারলাম ঢাকায় হত্যাকাণ্ড শুরু হয়েছে। সে রাতে জিয়াউর রহমান গেছেন ‘ সােয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্র খালাসের জন্য চট্টগ্রাম পাের্টে। ঢাকার সংবাদ শুনে লেঃ খালেকুজ্জামান ও শমশের মবিনকে পাঠিয়ে দেয়া হলাে জিয়াউর রহমানের কাছে। তিনি বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নিলেন এবং ফিরে এসে ব্যাটেলিয়নের সি ও কর্নেল জানজুয়াকে গ্রেফতার করলেন। আমি তাঁর সঙ্গে বিদ্রোহে হাত মেলালাম। এরপর পুরাে ব্যাটেলিয়নকেই আমাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এলাম। | চট্টগ্রামের কালুরঘাট যুদ্ধকেই তার নেতৃত্বাধীন প্রথম ভয়াবহ ও বিপদজনক যুদ্ধ বলে জানালেন মীর শওকত। তিনি বলেন আমরা প্রথম ভয়াবহ যুদ্ধের মখােমুখি হই কালুরঘাটে ১১ এপ্রিল তারিখে। ঐ সময় জিয়াউর রহমান আমাদের সাথে ছিলেন না। তিনি ৩০শে মার্চের দিকে। রামগড় চলে যান। কালুরঘাট যুদ্ধ আমার কমাণ্ডে পরিচালিত হয়। সৈন্য ছিল ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর এবং স্থানীয় কিছু স্বেচ্ছাসেবী। বিপক্ষে ছিল। পাকবাহিনীর দুটি ব্রিগেড। এছাড়া কর্ণফুলিতে তাদের যে নৌ জাহাজ ছিল সেটি | তারা শংখ নদী হয়ে কালুরঘাটের কাছাকাছি নিয়ে এসে ওখান থেকে নেভাল গান। দিয়ে আমাদের এলাকায় বম্বিং শুরু করেছিল। ওদের আর্টিলারীও ১০ এপ্রিল থেকে। বম্বিং শুরু করেছিল। ২৭ মার্চের পর থেকে আমরা কালুরঘাট ব্রীজ দখল করে রাখি। ১১ এপ্রিল ওদের কিছু সৈন্য মহিলার পােশাক এবং কিছু সৈন্য ‘সিভিল’ পােশাকে ‘জয় বাংলা বলতে বলতে আমাদের দিকে অর্থাৎ কালুরঘাট পুলের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। এই অবস্থায় আমাদের লােকজন প্রথমে বুঝতে পারে নি যে তারা পাকিস্তানী। শত্রু যখন ‘জয়বাংলা ধ্বনি দিতে দিতে একেবারে কাছে চলে এলাে, তখন আমাদের পক্ষ ভুল বুঝতে পেরে ফায়ার ওপেন করলাে। প্রচণ্ড যুদ্ধে শত্রুপক্ষের গােলার আঘাতে ক্যাপ্টেন হারুন ও শমশের মবিন আহত হলেন। আমরা পেছনে এসে পটিয়াতে সবাই আবার একত্রিত হলাম। | তারপর বান্দরবান রাঙ্গামাটি হয়ে আমরা মহালছড়িতে ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার স্থাপন করলাম। সেখানেই ছুটি ভােগরত ক্যাপ্টেন আফতাব কাদের। (আর্টিলারী) আমার কাছে আসেন। পরবর্তীতে মহালছড়ির যুদ্ধে এই সাহসী বীরসন্তানের মৃত্যু ঘটে। প্রথমে কাদেরকে ১০০ সৈন্য নিয়ে রাঙ্গামাটির খাগড়াতে রক্ষাব্যুহ গড়ে তােলার দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল। মহালছড়ির যুদ্ধের কথায় পরে। আসছি। আগে বীরশ্রেষ্ঠ মুন্সী আব্দুর রব-এর কথা বলি। মুন্সী আব্দুর রব ছিল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর নেতৃত্বে। খালেককে আমি ১০০ সৈন্য নিয়ে রাঙ্গামাটির মধ্যস্থলে বুড়িঘাটে রক্ষাব্যুহ গড়ে তােলার | দায়িত্ব দিয়েছিলাম। ১৫ এপ্রিল পাকবাহিনী রাঙ্গামাটি শহরে পৌছে। ১৯ এপ্রিল ৩ | টার দিকে পাকসেনাদের একটি বড় দল ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরীর উপর। বুড়িঘাটে আক্রমণ করে। পাকসেনাবাহিনী জীপ থেকে মর্টার ছুঁড়ে অগ্রসর হচ্ছিল। এমনি পরিস্থিতিতে খালেকুজ্জামান তাঁর অবস্থানে কিছুতেই টিকে থাকতে পারছিলেন না। তখন ল্যান্স নায়েক মুন্সী আব্দুর রব অটোমেটিক হাতিয়ার মেশিনগান হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘আমি গুলি চালিয়ে যাচ্ছি। আপনি বাকি সৈন্যদের নিয়ে পিছু হটে যান। বৃষ্টির মত গুলি চালাতে লাগলেন মুন্সী। বাকি সৈন্যদের নিয়ে ক্যাপ্টেন খালেক নিরাপদে পিছু হটে এলেন। কিন্তু পাকবাহিনীর শেলের আঘাতে প্রাণ হারালেন মুন্সী আব্দুর রব। সেদিন মুন্সী যদি এমনি গুলি চালানাে অব্যাহত না রাখতাে তাহলে হয়তাে পুরাে বাহিনীই নিশ্চিহ্ন হতাে। ২০ এপ্রিল লেঃ মাহফুজ ঐ স্থানে যান এবং মুন্সীর ছিন্ন দেহের অংশবিশেষ ও কিছু | গােলাবারুদ নিয়ে আসেন। সে সময় মিজো উপজাতিরা একটি ফ্যাক্টর হয়ে দাঁড়ায়। কেননা তারা পাকবাহিনীকে সহযােগিতা শুরু করে। ২৫ এপ্রিল খবর পেলাম চিঙ্গি নদী ও নানিয়ার চর বাজার হয়ে বিপুল সংখ্যক মিজো সমর্থনপুষ্ট পাকবাহিনী মহালছড়ি অভিমুখে অগ্রসর হচ্ছে। মহালছড়ি ছিল আমাদের ব্যাটেলিয়ন হেড কোয়ার্টার। ২৬শে এপ্রিল ক্যাপ্টেন খালেককে নানিয়ার চর বাজারে বড় পাহাড়ের উপর। ডিফেন্স নিতে বললাম। আফতাব কাদের ও মাহফুজকেও কিছুটা পেছনে অবস্থান নিতে বললাম। ২৭ এপ্রিল সাড়ে ১২টার দিকে ক্যাপ্টেন খালেকের অবস্থানে প্রথম মিজো আক্রমণ শুরু হয়। সংঘর্ষ শুরু হলে ১০ জন সৈন্য দিয়ে লেঃ মাহফুজকে। পাঠালাম খালেককে সাহায্য করার জন্য। মাহফুজ ওখানে পৌছেই ডিফেন্স নিয়ে লক্ষ্যস্থলে আক্রমণ চালাতে থাকে। গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় ক্যাপ্টেন খালেক ভিন্ন। পথে পিছু হটে আসেন। এক পর্যায়ে মিজোরা লেঃ মাহফুজকে চারদিক দিয়ে ঘিরে ফেলে। খবর পেয়ে ক্যাপ্টেন কাদের ও ক্যাপ্টেন খালেক লেঃ মাহফুজকে উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হলেন। আমরা তখন হেড কোয়ার্টারের চারপাশে ডিফেন্স পাকা করছিলাম। এমনি পরিস্থিতিতে ঐ দিন অপরাহু ৩টার দিকে পাকবাহিনীর ১১ রেজিমেন্ট ও পাঞ্জাবের ২টি কোম্পানিসহ প্রায় ১ হাজার মিজো আমাদের উপর আক্রমণ চালায়। পাকবাহিনী ৬টি মর্টার দিয়ে আক্রমণ চালাতে থাকে। আমরা খ্রী নট থ্রী ও হালকা মেশিনগান দিয়ে প্রতি আক্রমণ চালালাম। এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন। কাদের তার এলাকাতে যুদ্ধ করতে করতে শক্রর গুলিতে প্রাণ হারালেন। তখন চারদিকে বৃষ্টির মতাে গুলি চলছিল। এর মধ্য দিয়েই দুজন মুক্তিযােদ্ধা শওকত ও | ফারুক ও সিপাহী ডাইভার আক্কাস গাড়িতে ক্যাপ্টেন কাদেরের লাশ রামগড় নিয়ে। গেল। ‘সহযােদ্ধার জন্য যে কি আকুতি, তা আমি সেদিন দেখেছিলাম শওকত ও ফারুকের মাঝে। গুলি লাগার পর তৎক্ষণাৎ কাদেরের মৃত্যু ঘটলে ও শওকত ও ফারুকের মন তা মানছিল না। ওরা বারবার বলছিল, ‘না। কাদের ভাই মরে। নাই। তাকে হাসপাতালে নিলে সে বাঁচবে। যেভাবেই হােক, তাকে হাসপাতালে নিতে হবে। সেদিন সন্ধ্যা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে রাতের আঁধারে সমস্ত সৈন্য নিয়ে আমরা মহালছড়ি থেকে খাগড়াছড়িতে চলে এলাম। ২৯ এপ্রিল অয়্যারলেসের। মাধ্যমে মেজর জিয়া আমাদের রামগড় চলে আসতে বললেন। সেদিনই রাতের অন্ধকারে আমার সমস্ত সৈন্য নিয়ে চলে এলাম রামগড়ে। সেখানেই জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে আমার প্রথম দেখা। এরপর পাকবাহিনী শুভপুর ব্রীজ, করের হাট ও গুইমারার পথে ৩ দিক দিয়ে রামগড় আক্রমণ করে। ক্যাপ্টেন খালেক, লেঃ মাহফুজ, সুবেদার মুত্তালেবকে হিয়াকুলে পাঠালাম পাকবাহিনীকে প্রতিরােধ করতে। আগে থেকেই সেখানে। ক্যাপ্টেন ওয়ালির অবস্থান ছিল। উভয় পক্ষে তুমুল সংঘর্ষ হয়। ২ মে আমাদের রামগড় হারাতে হয়। ঐ দিনই আমরা ভারতের সাবরুমে আশ্রয় নিতে বাধ্য হলাম। কিছুদিন পর জেনারেল ওসমানী সাহেব আমাকে ডেকে বললেন, সিলেট। এলাকায় আমাদের কোন সেক্টর খােলা হয় নি এবং সিলেটের সুনামগঞ্জ, ছাতক এবং সালুটিকর—এসব এলাকায় অনেক বিডিআর ও সৈন্য বিশৃংঙ্খল অবস্থায়। আছে। তাই তিনি আমাকে অবিলম্বে সিলেট যুদ্ধের প্রস্তুতি সংগঠনের কথা। বললেন। ৫ নং সেক্টরের অধিকাংশ এলাকাই ছিল দুর্গম। গাড়ি চলাচল করতে বেশ অসুবিধা হতাে। সবটাই ছিল হাওড় ও বিল এলাকা। চলাচলের অসুবিধার কারণে সরকারের লােকজনও এদিকে তেমন আসতাে না। একবার একজন কর্মকর্তা। এসেছিলেন। তিনি হলেন নুরুল কাদের খান, যুদ্ধকালীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সংস্থাপন সচিব। জেনারেল ওসমানী দু’বার ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন। আহমদ ১ বার আমার সেক্টর পরিদর্শন করতে এসেছিলেন। তারা দু’জনই পায়ে হেটে সেক্টরের বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শন করেছিলেন। | ৫ নং সেক্টরে পাকবাহিনীর সঙ্গে টেংরাটিলায় আমাদের বেশ বড়ো ধরনের যুদ্ধ হয়েছিল। টেরাটিলা ছিল পাকসেনাদের বিরাট ঘাঁটি। পরিকল্পনা হয় তা আক্রমণের। ২৮শে নভেম্বর টেংরাটিলা রেকী করা হলাে। মুক্তিবাহিনীর ৪টি কোম্পানি ৩০ নম্বের নির্দিষ্ট স্থানে প্রতিরক্ষা অবস্থান নেয়। পরিকানা মত ক্যাপ্টেন মহসিন ডানদিক থেকে ও ক্যাপ্টেন আকবর বামদিক থেকে আক্রমণ করলেন। লেঃ মাহবুব ফ্লাংক গার্ড হিসেবে তৈরি থাকলেন। দীর্ঘ যুদ্ধের পর ৫ ডিসেম্বর টেরাটিলা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে।
৮ নং সেক্টরের অধিনায়ক–লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী
লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান চৌধুরী ‘৭১-এর ২৫শে মার্চ রাতে কুষ্টিয়া সার্কিট হাউসে। অবস্থান করছিলেন। তখন তিনি ছিলেন চুয়াডাঙ্গার ৪নং ইপিআর উইং-এর অধিনায়ক মেজর ওসমান। সেদিন ছিল ৩াঁর বিবাহবার্ষিকী। আগের দিন অফিসের কাজে সপরিবারে তিনি কুষ্টিয়া আসেন। ২৬শে মার্চ সকালে চুয়াডাঙ্গায় ফিরে আসার প্রস্তুতি নিতেই তিনি দেখেন শহরের সড়কগুলােতে সামরিক জীপ টহল দিয়ে সান্ধ্য আইনের ঘােষণা প্রচার করছে। টলিফোনের রিসিভার তুলে বুঝতে পারেন লাইন বিকল। সকাল ৮টায় রেডিওর নব রিয়ে ঢাকা বেতার ধরতেই তার কানে চলে আসে সামরিক আইন বিধির নতুন *তুন ধারা-উপধারা। সন্দেহের আর কোন অবকাশ থাকে না মেজর ওসমানের। শহরের একেবারে দক্ষিণ প্রান্তে কুষ্টিয়া-ঝিনাইদহ সড়কের গা ঘেঁষে। শণ স্থান সার্কিট হাউসটিব। তিনি দেখেন, ২ার ঠিক পেছনের জিলা স্কুলে অবস্থান ‘য়েছে ২৯ বেলুচ রেজিমেন্টের একটি প্রাইন। টহল জীপের সতর্ক প্রহরা এড়িয়ে বেলা ১১টার দিকে ঝিনাইদহের পথে কুষ্টিয়া শহর ছাড়েন মেজর ওসমান। ইতিমধ্যে ঝিনাইদহের রাস্তায় ব্যারিকেড পড়েছে একাধিক। সেসব পার হয়ে চুয়াডাঙ্গার সদর দপ্তরে পৌছেই সমবেত জনসমুদ্রের মাঝে মেজর ওসমান ঘােষুণা করেন স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ সৃষ্টির দৃপ্ত প্রত্যয়। | এভাবে শুরু করে ‘৭১-এর আগস্ট মাস পর্যন্ত ৮নং সেক্টরের সামরিক অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন মেজর ওসমান। মধ্য আগস্টে বাংলাদেশ বাহিনীর সদর দপ্তর মুজিবনগরে এসিসট্যান্ট চীফ অব স্টাফ (লজিস্টিকস) – এর দায়িত্ব দেয়া। হয় তাঁকে। সে দায়িত্বই তিনি পালন করে যান যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত। | আবু ওসমান চৌধুরীর জন্ম ১৯৩৫ সালের ১লা জানুয়ারি। ১৯৫৮ সালে তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। ‘৭১-এর ২৫শে ফেব্রুয়ারী তিনি দায়িত্ব নেন চুয়াডাঙ্গার ইপিআর ৪নং উইং-এর অধিনায়কের। যুদ্ধের পর লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত হয়ে ৩ বছর সেনা সদরে কোর প্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন তিনি। ‘৭৫ সালের নভেম্বরে সামরিক অভুথানের পর তাঁকে সেনাবাহিনী থেকে অবসর প্রদান করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ৮নং সেক্টরের ভৌগােলিক সীমানা ছিল পুরাে কুষ্টিয়া ও যশাের জেলা, ফরিদপুর জেলার অধিকাংশ এলাকা এবং দৌলতপুর-সাতক্ষীরা সড়কের উত্তরাংশ। মুক্তিযুদ্ধে বেশ কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন লেঃ কর্নেল (অবঃ) আবু ওসমান। প্রথমেই তিনি বলেছেন মে মাসের শেষার্ধে ব্রিটিশ এম পি স্টোনহাউস ও চেসওয়ার্থের ‘মুক্তাঞ্চল। পরিদর্শনের জন্য তাঁর সেক্টরে আগমনের ঘটনা। মে মাসের প্রথমার্ধে মুজিবনগরে বাংলাদেশ ফোর্সের হেডকোয়ার্টার স্থাপন করা হয়। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের সময় আমার এক প্লাটুন রণক্লান্ত সৈন্য ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলামকে গার্ড অব অনার প্রদান করে। তার পর দিনই আমার সেক্টরের হেড কোয়ার্টার স্থানান্তর। করি বেনাপােলের সীমান্তবর্তী এলাকায়। যােগাযােগের সুবিধার জন্য সে সময়। অধিকাংশ সাংবাদিকই যুদ্ধের প্রত্যক্ষ রিপাের্ট নিতে আসতেন আমার সেক্টর হেডকোয়ার্টারে। মে মাসের শেষদিকে খবর এলাে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট এম, পি, স্টোনহাউস ও চেসওয়ার্থ মুক্তিবাহিনীর প্রচারিত ‘মুক্তাঞ্চল সত্যি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে কিনা তা যাচাই করতে আসছেন। আর তাদের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থার দায়িত্ব পড়লাে আমার উপর। আমি আমার সেক্টরে প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নিলাম। সিদ্ধান্ত নিলাম বেনাপােলের দক্ষিণের (আমাদের ভূখণ্ডে কাশীনাথপুর) এলাকা দিয়ে তাঁরা প্রবেশ করবেন বাংলাদেশে। সব ব্যবস্থা সম্পন্ন করে আমি নির্দিষ্ট সময়ে বয়রার একটি সীমান্ত পিলারের কাছে মহামান্য অতিথিদের স্বাগত জানিয়ে সীমান্তের একটি খুটি দেখিয়ে বললাম- ‘This is the border survey post, and the moment you have crosed this post, you are on the Bangladesh soil. Sir let us have a photograph here as mark of identification between the two lands.’ ছবি তােলার পর তাঁরা গাছ ও সীমান্ত সংলগ্ন এলাকার বাড়ীর চালের উপর বাংলাদেশের পতাকা দেখতে পেলেন। পরিদর্শন করলেন আমার সেখানকার কোম্পানি হেড কোয়ার্টার। দেখতে পেলেন মুক্তিবাহিনীর অপারেশনে যাওয়া আসা, পাহারা ডিউটি পরিবর্তন ইত্যাদি। সেদিন অন্যান্য দূরবর্তী মুক্ত এলাকা পরিদর্শন করে আমাদের দখলকৃত চীনা হাতিয়ার নিয়ে বাংলাদেশের পতাকার সামনে দাড়িয়ে ছবি তুললেন তাঁরা। সাধারণ জনগণের সঙ্গে কথা বলে ও আমাদের সামরিক অবস্থান দেখে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও প্রচেষ্টার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেন এই দুই ব্রিটিশ এম. পি.। বিদায় নেয়ার আগে স্টোনহাউসের আন্তর্জাতিক পাসপাের্টে আমি আমার স্বাক্ষর ও সিলমােহর লাগিয়ে লিখে দিলাম- ‘Admitted into Bangladesh and allowed to visit liberated area.’ এই বাক্যগুলাে লিখতে গিয়ে তখন। আমার ভেতরটা কেঁপে উঠছিলাে। যুদ্ধে তখনাে ঘাের অনিশ্চয়তা। বিশ্বে বাংলাদেশ নামে কোন নতুন রাষ্ট্রের জন্ম আমরা দিতে পারবাে কি? সেদিন আমার কাছে এ প্রশ্নের উত্তর ছিল না। তবে আশাবাদ ছিল পর্বতপ্রমাণ। | এবার ৭ নং কোম্পানির একটি যুদ্ধক্ষেত্রের বিবরণে চলে আসি। আমার ৭নং কোম্পানির অবস্থান ছিল ভােমরা এলাকায়। এই কোম্পানির নেতৃত্বে ছিলেন। ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিন। কোন জাতির স্বাধিকার ও স্বাধীনতার লড়াই, সে জাতির যােদ্ধাদের যে কি পরিমাণ সাহসী ও মরণজয়ী শক্তিতে রূপান্তরিত করে, তা পাকবাহিনীর সঙ্গে ঐ সংঘর্ষে এই সেক্টরের কয়েকজন সৈনিকের ভূমিকা থেকে স্পষ্ট হবে। সেদিন ছিল মে মাসের ২৭ তারিখ। ভােমরা এলাকার (সীমান্তের কাছাকাছি একটা উচু বাধের উপরে ও তার পেছনে ক্যাপ্টেন সালাউদ্দিনের নেতৃত্বে অবস্থান গ্রহণ করে আমাদের বাহিনী। ভৌগােলিক সুবিধার স্বার্থেই পাকিস্তান সেনাবাহিনী আগেও কয়েকবার আমাদের এই অবস্থান দখলের প্রচেষ্টা চালায়। সেদিন ভাের ৪টার দিকে পাকবাহিনীর দুই কোম্পানি সৈন্য আক্রমণ করে আমাদের অবস্থানে। উচু অবস্থানের সুবিধায় থেকে আমাদের বাহিনী তাদের আক্রমণ প্রতিহত করে। ২ ঘন্টা পর আবারও তাদের হামলা শুরু হয় এবং তা ব্যর্থ হয়। এরপর আরাে এক ব্যাটেলিয়ন সৈন্যের সাহায্যে আলাদা আলাদা অবস্থান। থেকে তীব্র গােলাবর্ষণ শুরু হয় আমাদের দিকে। উভয়পক্ষে শুরু হয় ভয়ঙ্কর যুদ্ধ। এক পর্যায়ে পাক বাহিনীর ছােট একটি দল পাহাড়ের গা ঘেঁষে চলে আসতে থাকে অগ্রসর অবস্থানে। তখনই আমাদের বাহিনী, তাদের দিকে নির্দিষ্ট টার্গেটে গুলিবর্ষণ শুরু করে। এতে ঐ গ্রুপের ১ জন অফিসার ও ২জন জওয়ানের মৃত্যু ঘটে। এই পরিস্থিতিতে অন্য সৈন্যরা সহযােদ্ধার লাশ রেখেই পশ্চাদপসরণ করে। | গােলাবর্ষণের তীব্রতা একটু কমে এলে আমাদের বাহিনীর দু’জন জওয়ান। উৎসাহভরে লাশগুলাে নিয়ে আসতে এগিয়ে যায়। তখনই পাকবাহিনীর গুলিতে মৃত্যু ঘটে ১জন জওয়ানের। পরবর্তী চেষ্টাতে আমাদের বাহিনী ঐ লাশ নিয়ে। আসতে সমর্থ হয়। পরে লাশ গুলাে ভারতীয় ভূখণ্ডে পাঠানাে হয় জনসাধারণকে দেখানাের জন্যে। | সুলতান আলী ও সুবেদার মুজিবুরের কথাই-বা কি করে ভুলি! সুলতান আলী। ছিল আমার সেক্টরের একজন মুক্তিযােদ্ধা। ১৭/১৮ বছর বয়সের এই ছেলেটির পড়াশুনা তেমন ছিল না। কুষ্টিয়া যুদ্ধে তার একটি ঘটনা পরবর্তী সময়ে আমার । সেক্টরের অন্যতম আলােচ্য বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। কারণ ঐ ঘটনাতেই। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সদস্যদের সাহসিকতার চুড়ান্ত পরীক্ষা হয়। কুষ্টিয়া শহরে। অবস্থান ছিল ২৭তম বালুচ ব্যাটেলিয়নের একটি কোম্পানির (প্লাস)। ২৫শে মার্চ রাতে যশাের ক্যান্টনমেন্ট থেকে এসে এই কোম্পানি কুষ্টিয়া শহর অধিকার করে। ২৮শে মার্চ কুষ্টিয়া দখলের পরিকল্পনা নিই আমি। ৩০শে মার্চ ভাের ৪ টায় ক্যাপ্টেন। আযম চৌধুরীর নেতৃত্বে পুলিশ লাইন, জিলা স্কুল ও অয়্যারলেস স্টেশনে একযােগে। আক্রমণ শুরু করে আমাদের বাহিনীর প্রায় ৪০০জন ইপিআর সৈন্য। মুক্তিযােদ্ধা। ও আমাদের আকস্মিক আক্রমণে পাকশিবিরে ব্যাপক ধ্বংসযজ্ঞ শুরু হয় এবং এক। মাত্র জিলা স্কুল অবস্থান থেকে তীব্র প্রতিরােধ গড়ে তুলতে সমর্থ হয় পাকবাহিনী। পুরাে ২দিন দু’পক্ষের মধ্যে গােলাগুলি চলার পর ৩১শে মার্চ রাতে ২টা জীপ ও ১টি ডজ গাড়িতে ঝিনাইদহের দিকে পালাতে শুরু করে ভীত-সন্ত্রস্ত পাকিস্তানীরা। কিন্তু আমার ১ কোম্পানি সৈন্যকে প্রহরায় রাখা হয়েছিল কুষ্টিয়াঝিনাইদহ সড়কে। মুক্তিযােদ্ধাদের সহায়তায় তারা শৈলকুপা সেতু ধ্বংস করে বাঁশের চাটাইয়ে আলকাতরা মেখে তাতে ‘ফাঁদ তৈরি করে দু পাশে ওৎপেতে। বসে ছিল। পাকবাহিনীর গাড়িগুলি দ্রুতগতিতে এসে ফাঁদে পড়ে দুটো জীপই নিচে পড়ে যায় এবং ডজ গাড়িটি থেমে যায়। তখনই মুক্তিবাহিনী গুলিবর্ষণ করে। পাক কোম্পানির কমাণ্ডার মেজর শােয়েব ঘটনাস্থলেই নিহত হন এবং আহত সৈন্যরা। পালিয়ে যেতে থাকে গ্রামের দিকে। এখানেই শুরু সুলতান আলীর ঘটনা। মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থানে থেকে সে দেখতে পায় এল, এম, জি হাতে নিয়ে দৌড়ে । গ্রামের দিকে পালাচ্ছে একজন পাকসেনা। ১৭/১৮ বছরের এই যুবক তখনই তার। একনলা শর্টগান হাতে নিয়ে ধাওয়া করে পাকসেনাটিকে। একপর্যায়ে দৌড়ে সে পাকসেনাটিকে নিজের শর্টগান দিয়ে গুলি করে। গুলিবিদ্ধ হয়ে সেনাটির মৃত্যুর পর দেখা যায় তার সঙ্গে প্রচুর গুলি ছিল। অথচ সে সুলতান আলীকে গুলি করতে পর্যন্ত উদ্যত হয় নাই। সুলতান আলী সৈনিকটির একটি আঙুল কেটে নিয়ে আঙ্গুলসহ এল.এম, জি টি চুয়াডাঙ্গা সদর দপ্তরে জমা দেয়। | এদেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে সাহসিকতার জন্য যেসব বীরসন্তানের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা উচিত; আমি মনে করি নায়েক সুবেদার মুজিবুর রহমান তাদের একজন। যুদ্ধের আগে মুজিবুর ছিল,হাবিলদার মেজর। যুদ্ধে সাহসী ভূমিকার জন্য আমি তাকে নায়েক সুবেদার করেছিলাম। ২৪শে এপ্রিল বেনাপােল যুদ্ধে শহীদ হন বাংলার এই বীরসন্তান। তাঁর মৃত্যু মুক্তিযুদ্ধে আমার অন্যতম স্মরণীয় ঘটনা। ২৫শে মার্চ রাতে আমার কুষ্টিয়ায় অস্থান কালে এই মুজিবুর রহমানই চুয়াডাঙ্গা ইপিআর হেডকোয়ার্টারে সকল অবাঙালী সৈন্যকে বন্দী করে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিরাপদ স্থানে সরিয়ে রেখেছিলেন। | দক্ষিণ-পশ্চিম, রণাঙ্গনের সদর দপ্তর ১৮ই এপ্রিল ইছাখালী থেকে বেনাপােলে স্থানান্তরিত করা হয়। সেদিনই আমি বেনাপােল-যশাের সড়কের বর্তৃত্ব গ্রহণ করে বেনাপােলের পূর্বদিকে কাগজ পুকুরে ইপিআর-এর দু’টি কোম্পানি দিয়ে প্রতিরক্ষাব্যুহ রচনা করি। ২৩শে এপ্রিল বিকাল সাড়ে ৩টায় পাকবাহিনী কাগজ। পুকুর আক্রমণ করে। প্রচণ্ড আক্রমণের ফলে মুক্তিযােদ্ধারা রাতের মধ্যেই কাগজ পুকুরের প্রতিরক্ষা গুটিয়ে পশ্চাদপসরণ করতে বাধ্য হয়। পিছনে এসে মুক্তিযােদ্ধাদের দুই কোম্পানি বেনাপােলের পূর্ব সীমানায় রাস্তার দু’পাশে অবস্থান নেয়। পরদিন ভাের ৪টায় পাকিস্তান বাহিনীর দুই ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ভারি অস্ত্রের সমর্থনে ঝাঁপিয়ে পড়ে মুক্তিযােদ্ধাদের উপর। অবস্থা খারাপ দেখে ও মটারের একটি সাপাের্ট প্লাটুন পাঠানাে হয় মুক্তিযােদ্ধাদের কাছে। তাতেও পাকবাহিনীর অগ্রাভিযান থামানাে সম্ভব হয়নি। আমাদের কাছে কোন ফিল্ড টেলিফোন না থাকায় এক পর্যায়ে দুই কোম্পানির মধ্যে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। তখনই আমি | সৈন্যদের নির্দেশ দেই পশ্চাদপসরণের। ডান দিকের কোম্পানি পিছু হটে থাকলে বাম দিকের কোম্পানি শক্রর ভয়ঙ্কর গােলাবর্ষণের মুখে পড়ে। তখন আমার। নির্দেশ না শুনে একটা সামরিক জীপে অন্য একজন সৈনিককে নিয়ে নতুন অস্ত্র ও গােলাসহ বাম দিকের কোম্পানির দিকে অগ্রসর হন মুজিবুর রহমান। প্রবল। গােলাগুলি ও রকেটবৃষ্টি উপেক্ষা করে প্রতিটি প্রতিরক্ষা পরিখায় নতুন এমুনেশন পৌছে দিতে থাকেন মুজিবুর। অগ্রবর্তী অবস্থানে একটি মেশিনগান পরিখায় গিয়ে দেখেন একজন গানার গুলিবিদ্ধ হয়ে মেশিনগানের পাশে পড়ে আছে। বাকি দু’জন শত্রুর চাপের মুখে টিকতে না পেরে মেশিনগানের লক খুলে নিয়ে পিছনে চলে গেছে। তৎক্ষণাৎ মুজিবুর সঙ্গী সৈনিকটিকে পাশের পরিখা থেকে লক আনার নির্দেশ দিয়ে নিজে মেশিনগানে পজিশন নেন। সৈনিকটির ফিরে আসতে দেরি। দেখে তিনি নিজেই জীবনের ঝুকি নিয়ে পেছন থেকে লক এনে মেশিনগানে ফিট করে একাই শক্রর উপর গুলি চালাতে শুরু করেন (যদিও এ গানটি চালাতে ৩জন। লােকের দরকার)। তাঁর মেশিনগানের সুইপিং ফায়ারে পাকবাহিনীর অগ্রসর হওয়া দুঃসাধ্য হয়ে ওঠে। একসময় তাঁর মেশিনগানের বেল্ট শূন্য হয়ে আসে। চারিদিকে বৃষ্টির মতাে শক্রর গােলা পড়তে থাকায় মুজিবুরকে বলা হলাে, পিছনে সরে আসতে। উত্তর এলাে ‘মুজিবুর পিছনে হটতে জানে না। তখন নিজের কোমরের পিস্তল দিয়ে গুলি করতে থাকে মুজিবুর। পিস্তলের গুলি শেষ হলে শক্র এগিয়ে এসে ঘিরে ফেলে মুজিবুরকে। তখন ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি দিয়ে খালি হাতে লড়ার। জন্যই উঠে দাড়ায় সুবেদার মুজিবুর রহমান। সঙ্গে সঙ্গে এক ঝাক গুলি বিদ্ধ হয় তার বুকে। মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে মুজিবুর। যুদ্ধের পর ‘বীরশ্রেষ্ঠ মনােনয়নের জন্য বীরত্বপূর্ণ অবদানের বর্ণনা দিয়ে আমি সুবেদার মুজিবুরের নাম পাঠিয়েছিলাম। আমি বলা যায় তাঁর বীরশ্রেষ্ঠ হওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিত ছিলাম। কিন্তু তা হয়নি। আমি মনে করি যুদ্ধের পর কিছু কিছু অনার্স অ্যাণ্ড অ্যাওয়ার্ডস দেয়া হয়েছে ব্যক্তিগত সম্পর্ক ও রাজনৈতিক সূত্রের বিবেচনার ভিত্তিতে। এ ছাড়া যুদ্ধের সময় আমাদের প্রয়ােজন ও অন্যান্য বিষয়েও জেনারেল। ওসমানী কোন কোন ক্ষেত্রে পক্ষপাতিত্নের আশ্রয় নিয়ে অবিবেচকের মতাে কাজ। করেছিলেন। আমার সেক্টরের অধিনায়কত্ব বদলের ঘটনাটি বললেই এ ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে। প্রায় ১ সপ্তাহ বিভিন্ন কোম্পানির হেডকোয়ার্টার। পরিদর্শন করে ১৫ আগষ্ট সন্ধ্যা ৬টায় আমার হেডকোয়ার্টারে পৌছে দেখলাম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের মেজর এম. এ. মঞ্জুর আমার অফিসে বসে আছেন। জিজ্ঞেস করে জানলাম, তিনি ‘প্রপার মুভমেন্ট অর্ডার নিয়ে আমার কাছ থেকে সেক্টর-এর কর্মভার গ্রহণ করার জন্য এসেছেন। আমি আশ্চর্য হলাম। আমাকে আগে এ ব্যাপারে একটি খবরও কি মুজিবনগর দপ্তর বা সর্বাধিনায়কের পক্ষ থেকে দেয়া যেতাে না! গত কয়েক মাসের যুদ্ধে আমার ভূমিকা বিবেচনা করে আমি এই কমাণ্ডার পরিবর্তনকে আমার জন্য রীতিমত অপমানজনক বলে মনে করি। সেক্টর কমাণ্ডার-এর গুরু দায়িত্ব থেকে মুজিবনগরে গিয়ে বলা যায় এক প্রকার কর্মহীনতাতেই আমার দিন কেটে ছিল।
৩ নং সেক্টর ও এস ফোর্সের অধিনায়ক–মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহ
মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহ যুদ্ধের শুরুতে ৩নং সেক্টর ও পরে ‘এস ফোর্সের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহ। ‘৭১-এ পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কর্মরত অবস্থায় তিনি ছিলেন একজন মেজর। যুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে ছিলেন জয়দেবপুরস্থ ২য় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সেকেণ্ড-ইন-কমাও। ২৫শে মার্চ ঢাকায় হত্যাযজ্ঞের খবর পেয়ে মেজর শফিউল্লাহ তার রেজিমেন্টের ৬ জন বাঙ্গালী অফিসারসহ পুরাে বাহিনী নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধে। ২৭শে মার্চ ঢাকা থেকে পালিয়ে আসা। একজন সৈনিকের কাছে ২৫শে মার্চের | ধ্বংসযজ্ঞ সম্পর্কে জানতে পারেন মেজর শফিউল্লাহ। তখনই তিনি বিদ্রোহের চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেন। পরিকল্পনা আগেই তৈরি ছিল। পরদিন সকাল ১০টায় দেড় কোম্পানি সৈন্য নিয়ে ৪টা জীপ, ৬টা ট্রাক ও একটি এম্বুলেন্সসহ টাঙ্গাইল হয়ে ময়মনসিংহের পথে রওনা হন। ৩নং সেক্টরের ভৌগােলিক সীমানা ছিল ঢাকা, ময়মনসিংহের একাংশ এবং টাঙ্গাইল, সিলেট ও কুমিল্লার উত্তরাংশ ব্রাহ্মণবাড়ীয়া মহকুমা)। মুক্তিযুদ্ধে বীরােচিত ভূমিকার কারণে ‘৭১ এর আগস্ট মাসেই তিনি লেঃ কর্নেল পদে উন্নীত হন মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লার জন্ম ২ সেপ্টেম্বর ১৯৩৫ সালে। ১৯৫৫ সালে তিনি পাকিস্তান। সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে প্রথমে পাঞ্জাব রেজিমেন্ট ও পরে ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টে যােগ দেন। ‘৬৮ সালে তিনি কোয়েটাতে স্টাফ কলেজ করেন। ‘৭০-এর অক্টোবরে তিনি ২য় বেঙ্গলে সেকেণ্ড ইন্ডকমাণ্ড হিসেবে যােগ দেন। যুদ্ধের পর ‘৭২ এর ৭-এপ্রিল তিনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর চীফ অব স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং ‘৭৫-এর ২৪ আগস্ট সে দায়িত্ব থেকে তাকে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ও এস ডি করা হয়। এরপর কানাডা, বৃটেন, মালয়েশিয়া প্রভৃতি দেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনের পর বর্তমানে তিনি সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ে ও এস. ডি। যুদ্ধের বর্ণনা দিয়েই ‘৭১-এর স্মরণীয় ঘটনা শুরু করেন মেজর জেনারেল (অবঃ) সফিউল্লাহ। তিনি বলেন জয়দেবপুর থেকে আমার ব্যাটেলিয়নকে ময়মনসিংহ নেয়ার পর আমি ঢাকার পূর্বদিক থেকে ৩০শে মার্চ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে প্রথম আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনা নিয়ে সৈন্য পরিচালনা শুরু করেছিলাম। পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে বিভ্রান্ত করার জন্যই আমি ঢাকার পশ্চিম অথবা উত্তর (টঙ্গি, অথবা সাভার) দিক থেকে আক্রমণ না করে ভৈরব, নরসিংদী ও শীতলক্ষ্যা নদী পাড়ি দিয়ে পূর্ব দিক থেকে আক্রমণ চালাবার পরিকল্পনা নিই। ময়মনসিংহ থেকে ট্রেনযােগে আমার সৈন্যদের একটি অংশকে শাটল করে নরসিংদী পাঠাই। তখন আমার মােট সৈন্যসংখ্যা ৬০০ জন। ৩১শে মার্চ থেকে ১লা এপ্রিলের মধ্যে আমার গ্রুপ নরসিংদী থেকে বালু নদী পার হয়ে বাসাবাে পর্যন্ত পৌছে যায়। সে সময়ই ভৈরবে খালেদ মােশাররফের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ হয়। তিনি তখনই আমাকে ঢাকা আক্রমণে নিষেধ করেন এবং সিলেট ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় মুক্তাঞ্চল গঠনের প্রস্তাব রাখেন। পাকবাহিনীর সঙ্গে আমার প্রথম যুদ্ধ হয় ২রা এপ্রিল পাঁচদোনায়।
এটা নরসিংদী ও তারাববার মধ্যবর্তী একটি অঞ্চল। ঐ যুদ্ধে প্রচুর হানাদার সৈন্য হতাহত হয়। পাঁচদোনায় তখন আমার মাত্র এক কোম্পানি সৈন্য (১৫০ জন)। পাকবাহিনী দুর থেকে আমাদের উপর আর্টিলারি শেলিং করে। পরে এই কোম্পানি সরিয়ে আমি ভৈরব নিয়ে আসি। পরদিন ৩রা এপ্রিল মেজর জিয়া আসেন আমার হেডকোয়ার্টারে তার পুরাে টুপ ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়ায় আমি তাকে একটি কোম্পানি দিয়ে সাহায্য করি। এরপর ভৈরবে কিছু টুপ রেখে বাকীদের সিলেট নিয়ে যাই।সিলেটের তেলিয়াপাড়াতে স্থাপন করি সেক্টর হেডকোয়ার্টার। েবাংলাদেশের সীমানা ছেড়ে ভারতের মাটিতে পৌছার আগে পাক-বাহিনীর সঙ্গে দুটি যুদ্ধ সবচে ভয়াবহ ও স্মরণীয় বলে জানান মেজর জেনারেল (অবঃ) শফিউল্লাহ। এর মধ্যে একটি সংগঠিত হয় ১৩/১৪ এপ্রিল আশুগঞ্জ-ভৈরব বাজার এলাকায়। শফিউল্লাহ জানান ঐ যুদ্ধে পাক সেনাবাহিনী তিনটি ব্যাটালিয়ন ও একটি আর্টিলারি রেজিমেন্ট ব্যবহার করে। তা ছাড়া ৬টি এয়ারক্রাফট ভাের সাড়ে ৫টা থেকে দুপুর সাড়ে ১১টা পর্যন্ত একনাগাড়ে ৬ ঘন্টা আমাদের উপর বােমাবর্ষণ চালায়। আমাদের টুপ পজিশন নেয় ভৈরব নদীর উল্টো পাড়ের শাখা নদীতে। কিছু ভৈরবে, কিছু আশুগঞ্জে আর কিছু লালপুরে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর দু ব্যাটেলিয়নের একটি দল রেল লাইন ধরে এগিয়ে আসে ভৈরব বাজারের দিকে। অপর একটি ব্যটোলিয়ন এগিয়ে আসে নৌ জাহাজ যােগে মেঘনা দিয়ে। এখানে সারাদিন যুদ্ধ হয়। আমাদের প্রস্তুতিও ভাল ছিল। কিন্তু এক পর্যায়ে শত্রুবাহিনীর দুটি কমান্ডাে কোম্পানি হেলিকপ্টার যােগে আমাদের পিছনে ‘পজিশন’ নিয়ে। ফেলে। তাদের প্রতিহত করার মতাে অবস্থা তখন আমাদের ছিল না। ফলে বাধ্য হয়ে আমার কোম্পানিকে ওখান থেকে সরিয়ে নিই এবং আরেক বার প্রতিরােধ গড়ে তুলি মাধবপুরে। | ২য় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ন, ও ১১ ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটেলিয়ন-এর সমন্বয়ে সেপ্টেম্বরে গঠন করি এস ফোর্স। এ সময় ৩নং সেক্টরের দায়িত্বভার দেয়া হয় মেজর নূরুজ্জামানের উপর। এস ফোর্স গঠনের পর দু’টি যুদ্ধের ঘটনা এখানে আমি বলবাে। নভেম্বরের ৩০ তারিখ থেকে আমরা আক্রমণ শুরু করি পাকবাহিনীর শক্ত ঘাঁটি আখাউড়ায়। ঐ আক্রমণে ২নং ফোর্সের কমান্ড দেন মেজর মঈন ও ৩নং ফোর্সের ক্যাপ্টেন’ নাসিম। আখাউড়া আক্রমণে মঈনের ব্যাটেলিয়ন (২য় ইস্ট বেঙ্গল) যায়। নাসিমের ১১ বেঙ্গল রেজিমেন্টকে প্রস্তুত রাখা হয় যাতে, সিলেট থেকে মনতলা হয়ে পাকবাহিনীর কোন গ্রুপ পেছন থেকে অগ্রসর দলকে আক্রমণ না করতে পারে এবং প্রয়ােজনে যাতে আক্রমণকারী দ্বিতীয় ইস্ট বেঙ্গলকেও সাহায্য করতে পারে। প্রথম আক্রমণেই আমরা আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত এগিয়ে যাই। ২ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর প্রতিআক্রমণে পিছিয়ে চলে আসি সিঙ্গার বিল এলাকায়, ৩ তারিখে আবার আমরা দখল করি আজমপুর রেলওয়ে স্টেশন। ঐ আক্রমণে আমার বাহিনীর ক্যাপ্টেন বদিউজ্জামান ও দু’জন সৈন্য শহীদ হন। | ৪ ডিসেম্বর আখাউড়া দখলের পর আমি ঢাকার দিকে অগ্রসর হওয়ার পরিকল্পনা করি। প্রথমেই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ব্রাহ্মণবাড়ীয়া আক্রমণের। ৩ ডিসেম্বর ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তান যুদ্ধ ঘােষণা করায় আমাদের সঙ্গে মিত্রবাহিনীও এসময় যুদ্ধে সংযুক্ত হয়। ব্রাহ্মণবাড়ীয়াকে দুদিক থেকেই আক্রমণের সিদ্ধান্ত নিই।
পরিকল্পনা হয় ভারতীয় সেনাবাহিনী আখাউড়া-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া রেল লাইন। দিয়ে এবং আমার ফোর্স সিলেট-সরাইল-ব্রাহ্মণবাড়ীয়া সড়ক দিয়ে অগ্রসর হবে। ৫ ডিসেম্বর আমাদের যাত্রা শুরু হয়। বাহিনীর সামনে থাকে ১১ইস্ট বেঙ্গল। ২য় ইস্ট বেঙ্গল একে অনুসরণ করে। ১১ ইস্ট বেঙ্গলকে দায়িত্ব দেয়া হয় চান্দুরার। উত্তরাংশে একটি রােড ব্লক তৈরি করার, যাতে সিলেট থেকে পশ্চাদপসারণকারী পাকসৈন্যরা এ রাস্তায় না আসতে পারে। তাদের দ্বিতীয় কাজ চান্দুরা থেকে সরাইল পর্যন্ত এলাকা মুক্ত করা। রােড ব্লক তৈরি সম্পূর্ণ হলে ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার নাসিম সবাইকে চান্দুরা হয়ে শাহবাজপুর সরাইল এবং ব্রাহ্মণবাড়ীয়ার | দিকে অগ্রসর হওয়ার আদেশ দেন। বেরা তখন প্রায় ১২টা। অপরেশনের অগ্রগতি দেখার জন্য আমি আমার ‘রানার’ নিয়ে পাইকপাড়া ব্যাটেলিয়ন কমান্ড। হেডকোয়ার্টারে পৌছি। এই হেডকোয়ার্টার অগ্রসর হয়ে যখন ইসলামপুরে পৌছে তখন পেছন থেকে একটি ট্রাককে এগিয়ে আসতে দেখা যায়। ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার নাসিম দূর থেকে ট্রাকটি দেখে বললাে, ‘স্যার, তেলিয়াপাড়া নিশ্চয় আমাদের। দখলে এসেছে। আমার গাড়িও চলে আসছে। চান্দুরা ও মাধবপুরের মাঝামাঝি। রােড ব্লক ছিল বলে আমরা ধরেই নিলাম এটা আমাদের গাড়ি। ধীরে ধীরে গাড়িটা এগিয়ে আসছে সামনের দিকে। খুব কাছে আসতেই ডাইভারকে ইশারা দিয়ে। আসতে বলা হয় এবং গাড়ি থেমে যায়। তখনই সবচে আশ্চর্যজনক ব্যাপারটি ঘটে। পুরাে ট্রাকটি পাকিস্তানী সৈন্যে বােঝাই, তারা বােধহয় তেলিয়াপাড়া থেকে পশ্চাদপসারণ করে আসছিল। পাক সৈন্য দেখে আমরা তাদেরকে অস্ত্রসমর্পণের নির্দেশ দিই। প্রথমে দু’চারজন সৈন্য অস্ত্র রেখে হাত উচু করে দাঁড়িয়ে যায় কিন্তু অন্যরা আমাদের সংখ্যায় কম দেখে ট্রাক থেকে লাফিয়ে পড়ে রাস্তার অপর পাশে। গিয়ে গুলি শুরু করে। গাড়ির দক্ষিণ পাশে ও পেছনের দিকে আমাদের সৈন্যরা | অস্ত্র উঁচিয়ে ধরে। গাড়িটির সামনের সিটে বসা ছিল একজন সুবেদার। সে। | মুহূর্তের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে আমাকে ধরে ফেলে। শুরু হয় তার সঙ্গে ধস্তাধস্তি। েআমাদের দু’জনেরই পিস্তল পাউচ’-এর মধ্যে। আমার এস এম জি ছিল। রানারের কাছে। সুবেদারের সঙ্গে ধস্তাধস্তি চলাতে রানার সুবেদারকে লক্ষ্য করে গুলি করতে পারছিল না। হঠাৎ আমার রানারের পায়ে গুলি লাগলে সে পড়ে যায়। তখনই আমি জোরের সঙ্গে সুবেদারের মুখের চোয়ালে ঘুষি মারি। সে পড়ে গিয়ে ‘রানার’ কে ধরে ফেলে এবং এস এম জি দিয়ে আমাকে লক্ষ্য করে গুলি ছোঁড়ে।।
তার ও আমার মাঝে দুরত্ব ছিল বেশি হলে একগজের। অথচ গুলি আমার শরীরে | কেন ঢুকলাে না? তৎক্ষণাৎ আমাদের একজন সৈন্যের রাইফেল নিয়ে আমি সুবেদারের মাথায় আঘাত করি। ঐ সময়ই আর একটা বাস থেকে নামতে দেখি আরেক দল পাকিস্তানী সৈন্যকে। এটা দেখেই আমি পিস্তল বের করতে চেষ্টা করি। দেখি পিস্তল ভাঙা। তখন বুঝলাম সুবেদারের গুলি লেগেছিল আমার পিস্তলে। এরপর আর কোন উপায় না দেখে লাফিয়ে পড়ি পাশের ডােবায়। এরপর আমার বাহিনী পাকবাহিনীকে দু’দিক থেকে আক্রমণ শুরু করে। এই খন্ডযুদ্ধে প্রায় ১১জন পাকসৈন্যকে জীবিত অবস্থায় ধরা হয়। যুদ্ধের আগে কোন রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সফিউল্লার প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ যােগাযােগ ছিল না। তবে ব্যক্তি হিসেবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি প্রগাঢ় শ্রদ্ধা ছিল বলে জানান তিনি। তিনি বলেন, পাকিস্তানের সময় থেকেই সেনাবাহিনীর মধ্যেও যদি কেউ শেখ মুজিবকে নিয়ে কটাক্ষ করতাে তবে তা আমার সহ্য হতাে না। এই মানুষটির সঙ্গে আমর জীবনে প্রথম সাক্ষাৎ হয় ‘৭২-এর ১০ জানুয়ারি। অথচ ‘৭১-এর ঘটনাবলীর প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে অভিযােগে পাকিস্তান | কর্তৃপক্ষ বলেছিল আমি নাকি পাকিস্তান ভাঙার ব্যাপারে তাঁর সঙ্গে অনেকবার বৈঠক করেছি। যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ও প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের সাহায্য ও সহযােগিতার মনােভাব প্রসঙ্গে সফিউল্লাহ বলেন, সেসময় ভারতীয়রা আমাদের সাহায়ের ব্যাপারে স্বতঃস্ফূর্ত ও উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেছিল। বিশেষ করে আমি একজনের কথাই এখানে বলতে চাই। তিনি তৎকালীন বি, এস, এফ, প্রধান। ব্রিগেডিয়ার বি সি পাডে। আমি জয়দেবপুর থেকে বিদ্রোহ করার পর আমার সঙ্গে বলা যায়, মােট দুই ব্যাটেলিয়নের অস্ত্র ছিল। ‘৭০-এর শেষের দিকে সেনাবাহিনীর জন্য থ্রী নট থ্রী বৃটিশ রাইফেলের পরিবর্তে সেতেন পয়েন্ট সিক্স টু চাইনিজ রাইফেল দেয়া হয়। আমার ব্যাটেলিয়ন চাইনিজ রাইফেল গ্রহণ করে, কিন্তু স্ত্রী নট থ্রী রাইফেলগুলােও তখন পর্যন্ত ফেরৎ দেয়া হয়নি। এ ছাড়া। রাজেন্দ্রপুর অস্ত্রাগারে এবং ময়মনসিংহ পুলিশ ব্যারাক থেকেও আমি অস্ত্র নিই। তৰে হালকা অস্ত্র আমার বহিনীতে যথেষ্ট থাকলেও ভারি অস্ত্রের অভাব ছিল। তাই আমি ব্রিগেডিয়ার পান্ডের কাছে ভারি অস্ত্র চেয়েছিলাম। তিনি আমাকে ২০টি মেশিনগান ও ৬/৭টি মর্টার দিয়েছিলেন। | পরবর্তী পর্যায়ে অস্ত্র সরবরাহের দায়িত্ব ভারতীয় সেনাবাহিনীর হাতে পড়লে এ ব্যাপারে কড়াকড়ি আরােপ করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদেরকে নিয়মিত বাহিনী গড়ে তােলার পরিবর্তে গেরিলা বাহিনী গড়ে তুলতে বেশি উৎসাহিত করতাে। অথচ যুদ্ধের পর দেশরক্ষার দায়িত্ব গ্রহণে নিয়মিত বাহিনী ছিল। অপিরিহার্য। গেরিলাদের যুদ্ধপদ্ধতি হচ্ছে ‘হিট এন্ড রান আর নিয়মিত বাহিনীর লক্ষ্য, কোন যুদ্ধক্ষেত্র জয় করে তা ধরে রাখা। তাই আমার মনে হয়, হয়তাে ভারতীয় সেনাবাহিনী চায়নি যে, আমাদের একটা সুশৃঙখল সেনাবাহিনী গড়ে উঠক। ‘৭১-এ সাধারণ মানুষের মধ্যে যুদ্ধে অংশগ্রহণের যে প্রবল আগ্রহ দেখেছি তা কোনদিন ভােলার নয়। মুক্তিযােদ্ধা হিসেবে ট্রেইনড করার জন্য আমরা যখন | বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে সিলেকশনে যেতাম, সেখানে যুবক ও মধ্যবয়সীরা তাে বটেই এমনকি বৃদ্ধরা পর্যন্ত ট্রেনিং গ্রহণের তীব্র ইচ্ছা প্রকাশ করতাে। একদিন এমনি এক সিলেকশনের জন্য গেলাম মেলাঘরের কাছে একটি শরণার্থী শিবিরে। সেখানে প্রায় ১০ বছর বয়সী একটি বাচ্চা ছেলে জড়িয়ে ধরলাে আমাকে।
সে ট্রেনিং গ্রহণ করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলাে। বয়সের কথা বিবেচনা করে তাকে আমি না করলাম। সম্ভবত সীমান্ত এলাকার কোথাও ছিল তার বাড়ি। সে বললাে অমি অনেক দূর পর হেঁটে এসেছি মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেব। বলে। আপনারা আমাকে কেন সে সুযােগ দিচ্ছেন না? তার কথা শুনে আমি তাকে আমার সঙ্গে করে নিয়ে আসি। অন্যদের সঙ্গে তারও ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা করি। ট্রেনিং শেষে ফন্টে পাঠানাের সময় আমি ছেলেটির ব্যাপারে অনাগ্রহ প্রকাশ করলে সে রীতিমতাে কান্না জুড়লাে। সেদিন যুদ্ধে অংশ নেয়ার এমন প্রচন্ড আগ্রহ আমি তার মধ্যে দেখেছিলাম, যা আমি বলে বােঝাতে পারবাে না। যুদ্ধের শেষের দিকে আমার ব্যাটেলিয়নের সঙ্গে ছেলেটি ঢাকাও এসেছিল। | মান্নান, দৌলামিয়ার কথাই-বা কি করে ভুলি! দৌলামিয়ার বাড়ি ছিল কুমিল্লার শালদা নদীর পাড়ে। একাত্তরের এপ্রিল মাসের দিকে সে আমার সেক্টরে আসে। কুমিল্লায় পাকবাহিনীর হামলার পর যখন মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা বেড়ে যায়, সে সময় দৌলামিয়া মুক্তিযােদ্ধাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে থাকা-খাওয়া ও অন্যান্য সহযােগিতা করতাে। আমি তাকে আমার সেক্টরে ট্রেনিং গ্রহণের সুযােগ দিই। ট্রেনিং-এর পর তাকে আমি আমার একটি ফোর্সের সঙ্গে সিলেটে পাঠাই একটি এমবুশ অপারেশনে। পরিকল্পনা ছিল টার্গেট স্থানের আশেপাশে আগের রাতে অবস্থান করে খুব ভােরের দিকে এমবুশ করবে আমাদের গ্রুপ। কিন্তু নিদিষ্ট রাতে স্বাভাবিক থাকেনি দৌলামিয়া। সম্ভবত চা বাগানের কুলিদের সঙ্গে মদ খেয়েছিল সে। ফলে নিজের উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে সে তার গ্রুপের লােকদের উপরই চড়াও হয়ে অস্ত্র ব্যবহারে উদ্যত হয়। পরে টুপ কমান্ডার মতিন কৌশলে নিরস্ত্র করে। দৌলামিয়াকে হাত বেঁধে নিয়ে আসে আমার কাছে। আমি খুব রাগতঃ স্বরে দৌলামিয়াকে শাসিয়ে বললাম এই বুঝি তােমার যুদ্ধ! কেন তুমি সেখানে গিয়ে হাঙ্গামা করেছ? যাও, আমার সেক্টর এলাকার বাইরে চলে যাও। কোনদিন যেন আর তােমাকে আমি না দেখি। তখন কান্না জুড়ে দিয়ে দৌলামিয়া বললাে, ‘আমাকে আর একবার সুযােগ দেন স্যার। আমি আর ভুল করবে না। এরপর ভুল হইলে আমারে মাইরা ফালাইয়েন? দৌলামিয়ার কান্না দেখে ও অনুশােচনা। উপলব্ধি করে আমি তার কথা পুনর্বিবেচনা করি। তবে যে টপের সঙ্গে সে সিলেট গিয়েছিল তার কমান্ডার মতিন দৌলামিয়াকে আর নিতে রাজি হলাে না। পরে আমি অন্য একজন কমান্ডার লেঃ মােশদের সঙ্গে দৌলামিয়াকে হরসপুর -মনতলাতে পাঠাই। ২১শে জুন হরসপুর-মনতলাতে শুরু হয় ভয়ংকর যুদ্ধ। পাকিস্তানের প্রায় ৪ ব্যাটেলিয়ন সৈন্য ৩ দিক দিয়ে আমাদের অবস্থানের উপর আক্রমণ শুরু করে। কয়েকটি যুদ্ধ বিমান ও হেলিকপ্টার পাক বাহিনীকে সাপাের্ট দিতে থাকে। এক পর্যায়ে হেলিকপ্টার থেকে সৈন্য নেমে ঘিরে ফেলে আমাদের একটি কোম্পানিকে। ঐ কোম্পানিকে উদ্ধার করতে আমি কিছুসংখ্যক সৈন্যকে একত্রিত করে কাউন্টার। এ্যাটাক করি। তখন আমার ডান দিক থেকে একটি মেশিনগান আমাকে অনবরত। ‘সাপাের্ট দিতে থাকে। বলা যায় ঐ মেশিনগানের সার্পোটেই আমার এ্যাটাক সফল। হয় এবং পুরাে একটি কোম্পানি রক্ষা পায় অবরুদ্ধ অবস্থা থেকে। গােলাগুলি। থামলে ঐ মেশিনগানের অবস্থানে গিয়ে আমি দেখতে পাই দৌলামিযা তখনও গুলি ঢুড়ে যাচ্ছে।
সে দু পায়ে গুলিবিদ্ধ এবং গুলি লেগে পেটের একটি অংশ বেরিয়ে যাওয়ায় তা সে বাম হাত দিয়ে চেপে রেখেছে এবং ডান হাত তখনাে মেশিনগানে। তার গায়ের কাপড় সম্পূর্ণ রক্তে লাল। আমাকে দেখেই কেদে উঠলাে দৌলামিয়া। বলল- ‘স্যার, আপনি যে আমাকে যুদ্ধ করার সুযােগ দিয়েছিলেন এজন্য আমি আপনার কাছে ঋণী। এই যে আমার গায়ের কাপড়টি আছে, এটি শেখ মুজিবকে দেখাবেন। তিনি বলেছিলেন, ‘তােমরা রক্ত দেয়ার জন্য তৈয়ার হও।’ স্যার আমি। রক্ত দিয়েছি, আমার তাে মৃত্যু হচ্ছে। আমার মৃত্যুর পর আমার লাশ যেন কবর দেয়া হয় বাংলাদেশের মাটিতে। আমার দু’চোখে পানি চলে এলাে। তখনই একটি জীপে তুলে, আহত দৌলামিয়াকে আমি নিয়ে গেলাম আগরতলা হাসপাতালে। সেখানে চিকিৎসার পর দৌলামিয়া অবশ্য সুস্থ হয়ে উঠেছিল। এদেশের মুক্তিযুদ্ধের এমনি বীরােচিত আত্মত্যাগ ছিল অসংখ্য মুক্তিযােদ্ধার অসংখ্য দৌলামিয়ার। | আমার সেক্টরে বীরের মত মৃত্যু হয়েছিল ল্যান্স নায়েক মান্নানের। ক্যাপ্টেন আজিজের সঙ্গে সে অংশ নেয় খােয়াই অপারেশনে। সে ছিল চার্লি কোম্পানিতে। খােয়াই এলাকার সিন্ধুরখানে শক্রর আগমনের অপেক্ষায় একটি এমবুস পেতেছিল আমাদের বাহিনী। ফাদে পড়ার পর আত্মরক্ষার জন্য শত্রুপক্ষ থেকেও গুলিবর্ষণ শুরু হয়। তখন ফাঁদের মধ্য থেকে একজন জীবিত সৈন্যকে ধরার জন্য মান্নান। নিজের অবস্থান থেকে উঠে দৌড়ে আগে চলে যায়। সে পাকসৈন্যটিকে ধরে ফেলে। এবং চিৎকার করতে থাকে” ধরেছি একটাকে। ক্যাপ্টেন সাহেবকে দেখাবাে একটা পাকিস্তানী ধরেছি। এবার ক্যাপ্টেন সাহেব নিশ্চয়ই আমার গলায় মালা দেবেন। এই কথা শেষ হতে না হতেই কপালে গুলিবিদ্ধ হয়ে তৎক্ষণাৎ মৃত্যু হয় মান্নানের। তার গলায় আর মালা দেয়া হয়নি। ডিসেম্ববের ২ তারিখে আজমপুর রেল স্টেশন অপারেশনে মৃত্যু হয় লেঃ বদিউজ্জামানের। তার অবস্থান ছিল সামনের দিকে। আক্রমণে আমাদের সুবিধা। দেখে পেছনের ছেলেদের সামনে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করার সময়ই শেল বিস্ফোরণে মৃত্যু হয় বদিউজ্জামানের। এপ্রিলের শেষ দিক পর্যন্ত তেলিয়াপাড়া ছিল আমার সেক্টরের হেডকোয়ার্টার। পরে পাকবাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণে আমাদের এই ঘাঁটির পতন ঘটে। েতেলিয়াপাড়া যুদ্ধের একটি কথা মনে করে আমি আজও বিস্মিত হই। ছেলেটির নাম আমার মনে নেই। তখন প্রচন্ড বুদ্ধ চলছে দু’পক্ষে। এক পর্যায়ে নতুন রিক্রুট করা আমাদের একটি দল যুদ্ধে অগ্রগামী অবস্থান গ্রহণ করে। সেই দলেরই পাঁচটি ছেলে একটি বটগাছের নিচে পজিশন নেয়। হঠাৎ করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি শেল এসে পড়ে ঐ গ্রুপের মধ্যে। ১টি ছেলের তৎক্ষণাৎ মৃত্যু ঘটে এবং ৩ জন গুরুতরভাবে আহত হয়। কিন্তু বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, যে ছেলেটির মৃত্যু হয়েছে, তার পাশের ছেলেটি ছিল সম্পূর্ণ অক্ষত। তার গায়ে শেলের কোন আঘাতই লাগেনি। ঘটনাটি আমার কাছে আজও অলৌকিক বলে মনে হয়।
১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক– উইং কমাণ্ডার (অবঃ) হামিদুল্লাহ খান
উইং কমাণ্ডার (অবঃ) হামিদুল্লাহ খান ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শেষদিকে ১১ নং সেক্টরের অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করেন। উইং কমাণ্ডার (অবঃ) হামিদুল্লাহ খান। এই সেক্টরটির প্রথম অধিনায়ক ছিলেন লেঃ কর্নেল আবু তাহের। ১৫ই নবেম্বর কামালপুর যুদ্ধে তিনি আহত হলে হামিদুল্লাহ খান সেক্টরটির সামরিক অধিনায়কত্বের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘৭১-এর যুদ্ধে চিলমারী, কামালপুরসহ বেশ কয়েকটি স্মরণীয় অপারেশন এই সেক্টরে সংঘটিত হয়। এসব যুদ্ধে কর্নেল তাহেরের সহযােগী ছিলেন। হামিদুল্লাহ খান। মােট ৮টি সাবসেক্টরে বিভক্ত ১১নং সেক্টরের ভৌগােলিক সীমানা ছিল কিশােরগঞ্জ মহকুমা বাদে সমগ্র ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং নগরবাড়ী-আরিচা থেকে ফুলছড়ি বাহাদুরাবাদ পর্যন্ত যমুনা নদী ও তীরাঞ্চল। হামিদুল্লাহ খানের জন্ম ১৯৪০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি। তিনি ১৯৬২ সালে পাকিস্তান বিমান বাহিনীতে কমিশন লাভ করেন। মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সময় তার র্যাঙ্ক ছিল ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট। যুদ্ধের মধ্যেই স্কোয়াড্রন লিডার পদে উন্নীত হন। তিনি। ‘৭৩ সালে তিনি উইং কমাণ্ডার পদে উন্নীত হন এবং ‘৭৮-এর শেষভাগে বিমানবাহিনী ত্যাগ করে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আহ্বানে রাজনীতিতে যােগ দেন। বর্তমানে তিনি। বিএনপির কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য এবং মুন্সিগঞ্জ-২ আসন থেকে নির্বাচিত জাতীয় সংসদ সদস্য। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খানের চাকরিস্থল ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। ‘৭০ সালের শেষ দিকে তিনি ৫নং প্রভােস্ট এ্যাও সিকিউরিটি ইউনিটের কমাণ্ডিং অফিসার হিসেবে ঢাকায় বদলি হয়ে আসেন। ২৫শে মার্চের পরের দিনগুলাে সম্পর্কে তিনি বলেন ২দিন কারফিউ-এর পর ২৭শে মার্চ ধানমণ্ডির অফিসে আসি। তখন লক্ষ্য করলাম বাঙালী অফিসারদেরকে যেন অনেকটা দায়িত্বহীন করে রাখার প্রচেষ্টা চলছে। আমার এয়ার অফিসার কমান্ডিং ছিলেন এয়ার কমােডর জাফর মাসুদ। তিনি আমাদের নিরাপত্তার আশ্বাস দিলেন। এছাড়া তখনকার পাক সামরিক বাহিনীর কর্মকাণ্ডের সমালােচনা করতেন তিনি। তার এই মনােভাবের কারণে এক পর্যায়ে তাঁকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলি করে নেয়া হয়। তখনই বুঝলাম দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়েছে পাক শাসকরা। তাই আমাদেরও প্রতিরােধ গড়ে তুলতে হবে। এরই মধ্যে খবর পেলাম এ. কে. খোন্দকার, এম. কে. বাশার ও সুলতান মাহমুদসহ আমার বেশ কয়েকজন উর্ধ্বতন অফিসার পালিয়ে গেছেন যুদ্ধের জন্য। আমিও পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সুযােগ খুজতে থাকলাম। আমার সঙ্গে অনেক আগে থেকেই পরিচয় ছিল কবি সুফিয়া কামাল ও তাঁর পরিবারের। একদিন তাঁর দুই মেয়ে আমার স্ত্রীকে জানাল, ভাইয়া যদি যুদ্ধে যেতে চান, তবে আমাদের কাছে কিছু তথ্য আছে, যা তাকে মুক্তিযুদ্ধে যেতে সহায়তা করবে। এসময় জানতে পারলাম আমার অফিসের একজন সার্জেন্ট, একজন অফিস স্টাফ ও একজন | ডাইভারকে পাকিস্তানী সৈন্যরা হত্যা করেছে। আমার মধ্যে প্রতিশােধের আগুন জ্বলে উঠলাে।
আমি যুদ্ধে যােগ দেয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। সুফিয়া কামালের পরিবারের মাধ্যমে এপ্রিলের মাঝামাঝি যােগাযােগ প্রতিষ্ঠিত হলাে ঢাকা অপারেশনকারী সেক্টর-২-এর কয়েক জন গেরিলার সঙ্গে। তাদের সঙ্গেই ঢাকাকুমিল্লা সড়ক ধরে সােনামুড়া হয়ে মেলাঘরে চলে গেলাম। মেলাঘর থেকে। আগরতলা যাই। কলিকাতার ৮নং থিয়েটার রােডে পৌছলে আমাকে পাঠানাে হলাে। বিহার। সেখানে চাকুলিয়ার একটি পুরনাে এয়ার ফিল্ডে বাংলাদেশ ফোর্সের চীফ | কো-অর্ডিনেটিং কমাণ্ডার হিসেবে ১ মাস দায়িত্ব পালন করি। তারপর মেঘালয়ের তৈলঢালা নামক স্থানে জেড ফোর্সের সদর দপ্তরে যাই। সেখান থেকেই ১১ নং | সেক্টরে যােগ দিই। মুক্তিযুদ্ধের সময়ের বেশ কয়েকটি স্মরণীয় ঘটনা ও কয়েকজন সহযােদ্ধার স্মৃতি জানিয়েছেন হামিদুল্লাহ খান। চিলমারী যুদ্ধের পরের একটি ঘটনা দিয়েই এই বর্ণনা তিনি শুরু করেন এভাবে ে১১ই অক্টোবর আমরা আক্রমণ করি ব্রহ্মপুত্রের পশ্চিম তীরে অবস্থিত পাকিস্তানিদের শক্তিশালী খাঁটি নদী বন্দর চিলমারী। তীব্র যুদ্ধের পর বহু যুদ্ধবন্দী, প্রচুর গােলা ও অস্ত্রসহ মুক্তিবাহিনী ১৩ অক্টোবর রৌমারী ফিরে আসে। ঐ চিলমারী যুদ্ধের ঠিক পরের একটি ঘটনা আমি কই-শত্রুর সঙ্গে গােলা বিনিময়ের এক পর্যায়ে শত্রুর অবস্থান অত্যন্ত নাজুক হয়ে পড়ে এবং জীবিত সৈন্যরা আমাদের হাতে বন্দী হয়। তখন একদল মুক্তিবাহিনী নিয়ে আমি এগিয়ে যাই চিলমারী খাদ্য। গুদামের দিকে। ঐ অঞ্চলে তখন মংগা (অনাহার) চলছে। খাদ্যের অভাবে ও শীতে অনেক জায়গা থেকেই মৃত্যুসংবাদ এলেও পাকবাহিনী খাদ্য গুদাম থেকে কোন প্রকার সাহায্য জনগণকে দেয় নি। খাদ্যগুদাম খুলে দেয়ার পর মুহুর্তের মধ্যে শ’য়ে শ’য়ে অনাহারী মানুষ উপস্থিত হলাে সেখানে। যে যেভাবে পারছে গুদাম থেকে চাল বা গমের বস্তা নিয়ে যাচ্ছে। বস্তাগুলাের আকৃতি বড় থাকায় তা বহন করে নিতেও বেশ কষ্ট হচ্ছিল মানুষের। এমন সময় দেখলাম একটি বড় চালের বস্তা ঠেলে বাইরে আনার চেষ্টা করছেন একজন বৃদ্ধ মহিলা। কিন্তু তিনি কোন ভাবেই তা আনতে পারছেন না। তখনও থেমে থেমে গুলির আওয়াজ আসছে। শেল ও গােলা নিক্ষেপের ফলে এদিক ওদিক থেকে পােড়া গন্ধ ভেসে আসছে। আমি বৃদ্ধা মহিলাটির কাছে গেলাম। সম্ভবত তার কোলে ছিল একটি বাচ্চা। চালের বস্তা নেয়ার জন্য বাচ্চাটিকে সে দেয়ালের দিকে বসিয়ে রেখেছে। বাচ্চাটি উচ্চস্বরে চিৎকার করে কাঁদছে। আমি বৃদ্ধার কাছে পৌছতেই সে আমাকে চালের বস্তাটি তার বাড়ি নিয়ে যাওয়ার কথা বললাে।
কিন্তু সে তা নিতে পারছে না। আশেপাশে এমন কাউকে দেখছি না, যে বদ্ধাকে সাহায্য করতে পারে। আমি তাকে বললাম- চারিদিকে এখনও। বসিয়ে প্রহর গুণতে থাকে। অবশেষে কাংখিত মুহূর্তটি আসে। রেলের বগি নিদিষ্ট স্থানে আসামাত্রই মানের বিস্ফোরণ ঘটে। লেঃ কর্নেল রহমতউল্লাহ খান, মেজর শের খানসহ ১৫/২০ জন সৈন্য তৎক্ষণাৎ মৃত্যুবরণ করেন। অবশিষ্ট সৈন্যদের চট্টগ্রাম, ২৬শে মার্চ। আগের রাতে চট্টগ্রাম ইপিআর হেডকোয়ার্টার ও হালিশহরে পাকিস্তানী অফিসার ও সৈন্যদের গ্রেপ্তার করে সশস্ত্র সংগ্রামের সূচনা ঘটিয়েছেন ক্যাপ্টেন রফিক। এর পরের দিনই তিনি মুখােমুখি হন একটি ষড়যন্ত্রমূলক পরিকল্পনার। যা বাস্তবায়িত হলে হয়তাে মুক্তিযুদ্ধে ক্যাপ্টেন রফিকের অবদানের ইতিহাস অন্যভাবে রচিত হতাে। সেই ঘটনা থেকেই মুক্তিযুদ্ধে ক্যাপ্টেন রফিকের স্মরণীয় অধ্যায়ের শুরু। শােনা যাক তাঁর মুখে’ সেদিন রাত দু’টার দিকে একজন অপরিচিত ব্যক্তি আমার টেকনিক্যাল হেড কোয়ার্টারে এসে উপস্থিত হলেন। বিরাট লম্বা চওড়া লােকটিকে প্রথম দর্শনে বাঙালী বলে মনেই হয় না। ভদ্রলােক বললেন- ‘একটা বিদেশী শক্তি আপনাকে প্রয়ােজনীয় সাহায্য দিতে ইচ্ছুক।’ ‘কি ধরনের সাহায্য? আমি জানতে চাইলাম।—অবশ্যই সামরিক সাহায্য। —আপনার কথার নিস্মতা কি? ইচ্ছা হলে আমার সঙ্গে কক্সবাজারে যেতে পারেন। সেখান থেকেই আপনাকে যথাস্থানে নিয়ে যাওয়া হবে এবং সেখানেই সংশ্লিষ্ট দেশের প্রতিনিধির সঙ্গে আপনি বিস্তারিত আলােচনা করতে পারবেন। রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে কথা না বলে আমার কাছে এসেছেন কেন? সামরিক প্রয়ােজনের বিষয়টি তারা বুঝবেন না।—কিন্তু এ মুহূর্তে আমি তাে এ জায়গা ছাড়তে পারি না। যুদ্ধ পরিচালনা করার মতাে আর কোন অফিসার বর্তমানে এখানে নেই। আপনি গেলেই ভালাে হতাে—লােকটি পীড়াপীড়ি করতে থাকেন।
—দুঃখিত আমার পক্ষে সম্ভব নয়, আপনি বরং রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে দেখা করুন। ভদ্রলােক প্রসঙ্গ পরিবর্তন করলেন—তাহলে বেতার কেন্দ্রে চলুন না। রেডিওতে ভাষণ দেবেন। —আপনি বুঝছেন না কেন? আমি এখানে একমাত্র অফিসার। এই মুহূর্তে এই স্থান ত্যাগ করতে পারি না। ইচ্ছা করলে আপনি একটা টেপ রেকর্ডার আনতে পারেন এবং আমি বক্তৃতা টেপ করে দিলে রেডিওতে প্রচার করতে পারেন। | আগন্তুক লােকটি আমাকে নিয়ে যাবার জন্য আরও পীড়াপীড়ি করলেন। এতে লােকটি সম্পর্কে আমার সন্দেহ ঘনীভূত হলাে। আমি ভাবলাম, এটা পাকিস্তানীদের ফাঁদ হওয়াও বিচিত্র নয়। পরিশেষে লােকটি ব্যর্থ হয়ে চলে যাওয়ার সময় বললেন, রেকর্ডিং যন্ত্রপাতি নিয়ে তিনি আবার আসবেন। কিন্তু তিনি আর আসেননি। পরে সন্দেহজনক তৎপরতার জন্যে লােকটিকে দুলাহাজারার কাছে বাঙ্গালীরা মেরে ফেলে। মৃত্যুর আগে তিনি অবশ্য বাঙ্গালী সৈন্যদের অপর একটি দলকে কক্সবাজার নিয়ে যেতে সমর্থ হয়েছিলেন। ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের একটি ছােট ব্যবসাকেন্দ্রের নাম করের হাট। ২৪শে এপ্রিল এই এলাকাটিতে বিরাজ করছিল মরুভূমির মতাে নির্জনতা। মুক্তিবাহিনীর সদস্যরা ছাড়া পুরাে এলাকাটিতে কোন জনমানুষের চিহ্ন ছিল না। এরই মধ্যে খবর পেলাম মহালছড়িতে আমাদের সৈন্যরা পাকবাহিনীর সঙ্গে তীব্র সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। আমাদের সৈন্যরা প্রায় চারদিক থেকে ঘেরাও হয়ে পড়েছে। তিরিশজন সৈন্যকে পাঠানাে হলাে মহালছড়িতে। অবশিষ্ট ৭০ জনকে নিয়ে আমি প্রধান সড়কে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুললাম। এ সময় করেরহাটের অগ্রবর্তী এলাকা থেকে আমি আধ মাইল পেছনে স্কুল এলাকার দিকে ফিরছিলাম। আশে পাশে তখন থেমে থেমে কামানের গােলা পড়ছিল। তিনটি কুড়েঘর মাটিতে মিশে গেছে। সেগুলাে থেকে তখনাে ধোঁয়া বেরােচ্ছিল। চারদিকে বারুদের গন্ধ। একটি বালককে দেখি রক্তের মধ্যে পড়ে আছে। শেলের টুকরা অংশ পেটের মধ্য দিয়ে ছেলেটিকে একেবারে দু’ভাগ করে ফেলেছে। তার বিস্ফোরিত চোখ দু’টিতে তখনাে আতঙ্কের চিহ্ন লেগেছিল। দেখি দুটি মেয়েলােক ছােটাছুটি করছে। আমি তাদেরকে চিৎকার করে বললাম- দৌড়াদৌড়ি করাে না, শেলিং শেষ না হওয়া। পর্যন্ত এক জায়গায় শুয়ে থাকে। তারা বিভ্রান্তের মতাে আমার দিকে চেয়ে রইলাে। ওদের আর আমার মাঝে শুকনাে একটি নালা। ওদের একজন আমাকে বললাে তুমি কে? ‘আমরা তােমাদের সন্তান জবাব দিয়ে আমি আবার স্কুলের। দিকে পা বাড়ালাম।
যেতে গিয়ে পিছন ফিরে দেখলাম ওদের একজন বাচ্চা ছেলেটির লাশের পাশে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাে। তার পর কাঁপা কাঁপা দু’টি হাত। প্রার্থনার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তুলে ধরে সর্বশক্তিমানের কাছে ফরিয়াদ জানাচ্ছে। ট্যাঙ্কের আওয়াজ ক্রমেই কাছে ঘনিয়ে আসছিলাে। কামান, মর্টার, মেশিনগান আর রাইফেলের গুলির প্রচণ্ড শব্দে তখন চারিদিকে এক ভয়াল পরিবেশ বিরাজ করছিলাে। গােলাগুলির শব্দ কিছুক্ষণের জন্য থামলে ক্লান্ত অবসন্ন দেহে আমি একটি খােলা জায়গায় গা এলিয়ে দিলাম। তখন সেই বৃদ্ধার প্রার্থনা কানে বাজতে থাকলাে —’আল্লাহ আমার ছেলেকে তুমি নিয়ে গেছে। সেই ছেলের জন্য কোন নালিশ নেই। কিন্তু দেশের জন্য আমার যেসব ছেলে যুদ্ধ করছে তুমি তাদেরকে সাহায্য করাে। আবেগে আমার করুদ্ধ হয়ে আসে। মে মাসের মাঝামাঝি শুভপুর সেতুর কাছে পাকবাহিনীর সঙ্গে আমাদের মারাত্মক সংঘর্ষ বাধে। এর আগে ভারতীয় বিত্ৰসএফ-এর সহায়তায় আমরা সেতুর একটি অংশ ধ্বংস করে দিয়েছিলাম। শুভপুর সেতুর যুদ্ধের পরের একটি দৃশ্যের বর্ণনা থেকেই সেসময় মুক্তিযােদ্ধাদের দেশপ্রেম ও দেশমুক্তির লড়াইয়ে নিজেকে অংশীদার করতে পারার তীব্র আনন্দ ফুটে উঠবে। ১২ই মে সকাল থেকে করেরহাটের পাকবাহিনীর কামানগুলাে আমাদের উপর গােলাবর্ষণ শুরু করে। দিনের প্রথম ভাগে প্রতিরােধ গড়ে তুলতে পারলেও, দিনের বাকী সময় আমাদের সেনাদের প্রচণ্ড তম গােলাবর্ষণের মােকাবিলা করতে হয়। সরাসরি আঘাতে বাংকারগুলাে ধসে পড়লে অনেকেরই জীবন্ত সমাধি ঘটে। আমরা হতাহতদের সরাতে পর্যন্ত পারছিলাম না। এক পর্যায়ে হাতাহাতি যুদ্ধ শুরু হয়। আমাদের যেসব সেনা ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি অবস্থানে ছিলাে তার েশেষ পর্যন্ত পশ্চাদপসারণ করতে পেরেছিল। এদের অনেকেই গুরুতর আহত হলেও, মনােবল ভাঙ্গেনি। তখন সন্ধ্যা হয় হয়। শুভপুর সেতুর অদূরে ভারতের শ্রীনগর সীমান্ত ফাঁড়ি। এখান থেকে একটা কাঁচা রাস্তা পাহাড়ের ভেতর দিয়ে আগরতলা অভিমুখী প্রধান সড়কে গিয়ে মিশেছে। ঐ সন্ধ্যায় রাস্তাটিতে অন্য কোন লােক ছিল না শুধু রণাঙ্গন ফেরত কিছু লােক নিঃশব্দে হেঁটে চলেছিল। এদের মধ্যে কেউ হাঁটছিল লাঠিতে ভর দিয়ে, কয়েকজনকে আবার সহযােদ্ধারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল। পথে আমাদের একজন অফিসারের সঙ্গে তাদের দেখা হলে জনৈক মুক্তিযােদ্ধা তার বাম হাত তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। তার ঝুলন্ত ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছিলাে। শেলের বিচ্ছুরিত টকরায় এটি প্রায় দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল শুধু েরণাঙ্গন ফেরত কিছু লােক নিঃশব্দে হেঁটে চলেছিল। এদের মধ্যে কেউ হাঁটছিল। লাঠিতে ভর দিয়ে, কয়েকজনকে আবার সহযােদ্ধারা ধরে নিয়ে যাচ্ছিল।
পথে আমাদের একজন অফিসারের সঙ্গে তাদের দেখা হলে জনৈক মুক্তিযােদ্ধা তার বাম হাত তুলে সামরিক কায়দায় অভিবাদন জানায়। তার ঝুলন্ত ডান হাত থেকে রক্ত ঝরছিলাে। শেলের বিচ্ছুরিত টুকরায় এটি প্রায় দু’ভাগ হয়ে গিয়েছিল। শুধু একফালি চামড়ার সাহায্যে কাঁধের নীচে হাতখানি ঝুলছিল। দুঃসহ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে যাচ্ছিল ছেলেটির মুখ। তবুও সে মুখে একটু হাসির ভাব ফুটিয়ে ‘জয় বাংলা’ বলে শুভেচ্ছা জানালাে অফিসারটিকে। তারপর অন্যদের সঙ্গে আবার অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যায় ছেলেটি……..। ৭নং সেক্টরে ১৭ই আগস্ট মুক্তিযােদ্ধাদের একটি অপারেশন দারুণ চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। ৩২ পাঞ্জাব রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী থাকতাে রাজশাহীর সারদা পুলিশ একাডেমীতে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবলী ৬জনের একটি দল নিয়ে এক কোম্পানী সৈন্যের উপর দুঃসাহসী হামলা চালায়। তার দল ক্রলিং করে শত্রু অবস্থানের একেবারে কাছে চলে যায় এবং শত্রু বাংকারের ভেতরে হ্যাণ্ড গ্রেনেড ছুঁড়তে থাকে। হাত বােমা ছুড়তে ছুঁড়তে বাংকারের পর বাংকার পার হয়ে তারা একাডেমীর একটি বাংলাের মধ্যে ঢুকে পড়ে। এখানেই অবস্থান করছিলাে শত্রু সেনাদের মূল অংশ। ফলে মুক্তিযােদ্ধাদের সঙ্গে শুরু হয় মরণ লড়াই। মুক্তিযােদ্ধারা পরাভূত হওয়া পর্যন্ত ১০ জন শত্রু সেনাকে হত্যা করে। ঐ দলটির একজন মাত্র পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে সমর্থ হয়। শিবলী বন্দী হয়। বাকী ৪ জনকে পাকিস্তানীরা সেই জায়গাতেই হত্যা করে। এরপর মুক্তিযােদ্ধাদের ঠিকানা সংগ্রহের জন্য শিবলীর উপর চলে পাকিস্তানীদের নির্যাতন। পাকিস্তানীরা তার দাঁত-চোখ উপড়ে ফেলে। আঙ্গুলগুলাে কেটে দেয়। চরম দানবীয় নির্যাতনেও এই মুক্তিযােদ্ধার মুখ থেকে একটি তথ্য বেরােয়নি।
আরাে অনেক বীর যােদ্ধার মতাে বাংলার বীর সন্তান শিবলীও আমাদের জাতীয় গর্ব। নভেম্বরের ৪ তারিখ। অন্ধকার শীতের রাত। কনকনে ঠাণ্ডা বাতাসের মধ্যে ক্যাম্প ফেলে বেলুনিয়া অভিযানে এগিয়ে চলেছে মুক্তিসেনাদের দল। ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযােগিতায় বেলুনিয়া পুনর্দখলের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। নিকটবর্তী। শরণার্থী শিবির ও গ্রাম থেকে লােক নিয়ে সাজসরঞ্জাম বহনের ব্যবস্থা করি। যানবাহন চলাচলের জন্য পাহাড় এবং ধান ক্ষেতের ভেতর দিয়ে চার মাইল দীর্ঘ একটি রাস্তার ব্যবস্থা আমাদের করতে হয়। হাজার হাজার লােক দিনরাত স্বতঃস্ফূর্তভাবে কাজ করে চলেছে। দেখি একজন অধ্যাপক বাংকারের জন্য সি আই শীটের বােক্স মাথায় বহন করছেন। ৪ মাইল অতিক্রম করে টিনগুলাে যথাস্থানে নামিয়েই তিনি আবার পেছনে দৌড়ে গেছেন আরেক বােঝা আনতে। ছয় বছরের একটি ছেলে, তাকে দিয়ে কোন কাজ করানাে হবে না বলাতে সেদিন সে কেঁদে ফেলেছিল। প্রত্যক্ষ যুদ্ধে অংশ গ্রহণে যাদের প্রতিবন্ধকতা ছিল, তারা এমনিভাবে। সেদিন মুক্তিযােদ্ধাদের সাহায্য করেছিল। এ রকম আরেক হৃদয়স্পর্শী ঘটনা ঘটে ১৫ সেপ্টেম্বর। ১৪ ডিসেম্বর ভাের রাত ৩টায় আমরা কুমিরা পুরােপুরি শক্রমুক্ত করে ফেলি। চট্টগ্রাম এখন মাত্র ১২ মাইল দূরে। কুমিরা মুক্ত হওয়ার মাত্র তিন ঘন্টার মধ্যে আমাদের যানবাহন ও কামানগুলো ভাঙ্গা সেতু এড়িয়ে খাল পার হতে। শুরু করে। কয়েক হাজার নারী পুরুষ ও শিশু সেদিন ভাঙ্গা সেতুর কাছে জমায়েত হয়ে আমাদের সাহায্য করেছিল। একদল খালের খাড়া পার কেটে ডাইভার্সন রােডের ব্যবস্থা করেছিল। অন্যদল গাছ, পাথর, মাটি যা দিয়ে পারছিলাে তা দিয়েই খাল ভরে ফেলার চেষ্টা করছিলাে। আমি কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে এই দৃশ্য। দেখছিলাম। এই সময় এক বৃদ্ধা আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ‘বাবা চিন্তা। করাে না, এই কাজ আমরাই পারবাে। দ্যাখাে তােমাদের মালপত্র আর গাড়ীগুলাে কিভাবে পার করার বন্দোবস্ত করছি। দরকার হলে আমরা সবাই খালে শুয়ে। পড়বাে। আর তার উপর দিয়ে তােমাদের গাড়ী পার করার ব্যবস্থা করবাে। দেরী করােনা বাবা। প্রত্যেক মুহূর্তে ওরা আমাদের লােক মারছে।
মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের দিন ১৬ ডিসেম্বর যখন একদিকে ঢাকায় জেনারেল নিয়াজী তাঁর সৈন্যবাহিনী নিয়ে জেনারেল অরােরার কাছে আত্মসমর্পণের প্রস্তুতি গ্রহণ করছেন তখনও চট্টগ্রাম শহর দখলের লড়াই চালাচ্ছিল মেজর রফিকের নেতৃত্বাধীন ১নং সেক্টরের সৈন্যরা। সেই শেষ দিনটিতেও রণাঙ্গনের একটি ঘটনায় ১নং সেক্টরে নেমে আসে শােকের ছায়া। তারই বর্ণনা দিচ্ছেন মেজর রফিকুল ইসলাম—ভাটিয়ারীতে ১৫ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় আমরা পাকিস্তানীদের প্রথম। রক্ষাব্যুহের উপর আক্রমণ চালাই। দুটি কোম্পানীর এই আক্রমণ ওরা প্রতিহত করে দেয়, আমাদের পক্ষে হতাহত হয় ২০ জন। ১৬ ডিসেম্বর অগ্রবর্তী দলটি শত্রুর পেছনে ব্যারিকেড সৃষ্টি করার পরই আমাদের আসল আক্রমণ শুরু হবে। তাই আমরা পরের দিন হামলা চালানাের জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি শুরু করি। | ঢাকায় যখন আত্মসমর্পণের আয়ােজন চলছে তখন আমার বিশ্বস্ত সুবেদার আজিজ ও ১৫ বছরের এক কিশাের মুক্তিযােদ্ধা ভাটিয়ারীতে শক্রর বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানীদের একটি খালের অপর পাড়ে হটিয়ে দিয়ে পুনরায় অস্ত্র পরিচালনার জন্য তারা অবস্থান গ্রহণ করছিলাে। অল্প বয়স্ক ছেলেটি কাছেরই এক গ্রামের। ওদের গ্রাম এর আগেই শত্রুমুক্ত হয়েছে। মা-বাবার সঙ্গে দেখা করার। জন্য ১৬ ডিসেম্বর তাকে ১২ ঘন্টার ছুটি দিয়েছিলাম। কিন্তু সে প্রত্যয়দীপ্ত কণ্ঠে জবাব দিয়েছিল, ‘না স্যার। চট্টগ্রাম মুক্ত করার পরই আমি বাড়ী ফিরবাে। ক’দিনই বা আর লাগবে।’ আত্মসমর্পণের জন্য নিয়াজীর নির্দেশ তখনাে তার সকল সেনাদলের কাছে পৌঁছায়নি। আমরা জানতাম না যে, বেলা ৪টা ৩১ মিনিটে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠান সমাপ্ত হচ্ছে। | চট্টগ্রাম শহর থেকে মাত্র ৬ মাইল দূরে মহাসড়কের ওপর ভাটিয়ারী দখলের জন্য আমরা তখন লড়ছি। আক্রমণ চালাচ্ছে মুক্তিবাহিনীর একটি কোম্পানী, ঘড়িতে তখন বেলা ৪টা ৩০ মিনিট। ঢাকায় এবং অন্যান্য জায়গায় অস্ত্রের গর্জন থেমে গেছে। নিয়াজী এবং অরােরা হয়তাে হাতে কলম নিয়ে আত্মসমর্পণের চুক্তিপত্রে স্বাক্ষর করছেন। ঠিক সেই মুহুর্তে পাকিস্তানীদের একটি কামানের গোলা আমার অধীনস্থ মুক্তিযােদ্ধা এই কোম্পানীর মাঝখানে এসে পড়লাে। | সুবেদার আজিজ এবং ১৫ বছরের সেই ছেলেটি দু’ জন গােলার আঘাতে আহত হলাে। আস্তে আস্তে সুর্য পশ্চিম আকাশে ডুবে গেল, সেই সাথে বাতাসে মিলিয়ে গেল তাদের শেষ নিঃশ্বাস। তখন সন্ধ্যার অন্ধকার ঘনিয়ে আসছে ধীরে ধীরে। একজন পাকিস্তানী মেজর ভাটিয়ারীর ভাঙ্গা ব্রীজের মুখে এসে দাঁড়ালাে। হাতে তার সাদা পতাকা। তারা নিয়াজীর নির্দেশ পেয়ে গেছে, এখন আত্মসমর্পণ করতে চায়।
১ নং সেক্টর ও জেড ফোর্সের অধিনায়ক–লেঃ জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমান
লেঃ জেনারেল (অবঃ) জিয়াউর রহমান ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত ১নং সেক্টর ও পরে ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে। দায়িত্বপালন করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ‘৭১ সালের ৭ জুলাই প্রথম। ইস্টবেঙ্গল, তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল, ও অষ্টম ইস্টবেঙ্গলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘জেড’ ফোর্স। এই ফোর্সের হেডকোয়াটার ছিল ভারতের মেঘালয়ে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ৮ম বেঙ্গলের সেকেণ্ড -ইন-কমান্ড হিসেবে মেজর জিয়া। কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামে। ২৫ শে মার্চ রাতে তার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষমান ‘সােয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করা। পথেই তাকে সংবাদ দেয়া হয় ঢাকায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের। তখনই তিনি বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন ও অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের সংঘঠিত করেন। ১৯৭৬ সালের ৭ই নভেম্বর একটি পাল্টা সামরিক অ্যুথানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ শে মে চট্টগ্রামে অপর একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথানে মৃত্যুঘটে তার। একটি জাতির জন্ম” শিরােনামে। তার স্মৃতিকথামূলক একটি লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ৭২ সালে দৈনিক বাংলায়। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে চট্টগ্রাম ও পার্বত্য চট্টগ্রাম নিয়ে গঠিত ১নং সেক্টর ও পরে ‘জেড’ ফোর্সের অধিনায়ক হিসেবে। দায়িত্বপালন করেন মেজর জিয়াউর রহমান। ‘৭১ সালের ৭ জুলাই প্রথম। ইস্টবেঙ্গল, তৃতীয় ইস্টবেঙ্গল, ও অষ্টম ইস্টবেঙ্গলের সমন্বয়ে গঠিত হয় ‘জেড’ ফোর্স। এই ফোর্সের হেডকোয়াটার ছিল ভারতের মেঘালয়ে। ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে ৮ম বেঙ্গলের সেকেণ্ড -ইন-কমান্ড হিসেবে মেজর জিয়া। কর্মরত ছিলেন চট্টগ্রামে। ২৫ শে মার্চ রাতে তার দায়িত্ব ছিল চট্টগ্রাম বন্দরে অপেক্ষমান ‘সােয়াত’ জাহাজ থেকে অস্ত্রশস্ত্র খালাস করা। পথেই তাকে সংবাদ দেয়া হয় ঢাকায় পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের। তখনই তিনি বিদ্রোহের সিদ্ধান্ত নেন ও অন্যান্য বাঙ্গালী অফিসারদের সংঘঠিত করেন। | ১৯৭৬ সালের ৭ই নভেম্বর একটি পাল্টা সামরিক অ্যুথানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রক্ষমতায় আসেন জিয়াউর রহমান। ১৯৮১ সালের ৩০ শে মে চট্টগ্রামে অপর একটি ব্যর্থ সামরিক অভ্যুথানে মৃত্যুঘটে তার। একটি জাতির জন্ম” শিরােনামে। তার স্মৃতিকথামূলক একটি লেখা প্রথম প্রকাশিত হয় ৭২ সালে দৈনিক বাংলায়। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বরে আমাকে নিয়ােগ করা হলাে চট্টগ্রামে। এবার ইস্ট
বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়নের সেকেন্ড ইন কমান্ড। এর কয়েকদিন পর আমাকে ঢাকা যেতে হয়। নির্বাচনের সময়টায় আমি ছিলাম ক্যান্টনমেন্টে। প্রথম থেকেই পাকিস্তানী অফিসাররা মনে করতাে, চূড়ান্ত বিজয় তাদেরই হবে। কিন্তু নির্বাচনের দ্বিতীয় দিনেই তাদের মুখে আমি দেখলাম হতাশার সুস্পষ্ট ছাপ। ঢাকায় অবস্থানকারী পাকিস্তানী সিনিয়র অফিসারদের মুখে দেখলাম আমি আতংকের ছবি। তাদের এই আতংকের করণও আমার অজানা ছিল না। শীঘ্রই জনগণ গণতন্ত্র ফিরে পাবে, এই আশায় আমরা বাঙালী অফিসাররা তখন আনন্দে উৎযু হয়ে উঠেছিলাম। চট্টগ্রামে আমরা ব্যস্ত ছিলাম অষ্টম ব্যাটেলিয়নকে গড়ে তােলার কাজে। এটা রেজিমেন্টের তরুণতম ব্যাটেলিয়ন। এটার ঘাঁটি ছিল ষােলশহর বাজারে। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে এই ব্যাটেলিয়নকে পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। এর জন্য আমাদের সেখানে পাঠাতে হয়েছিল দু’শ জওয়ানের এক অগ্রগামী দল। অন্যেরা ছিল একেবারেই প্রাথমিক পর্যায়ের সৈনিক আমাদের তখন যে সব অস্ত্রশস্ত্র দেওয়া হয়েছিল, তারমধ্যে ছিল তিনশত পুরানাে ৩০৩ রাইফেল, চারটা এলএমজি ও দুটি তিন ইঞ্চি মর্টার। গােলাবারুদের পরিমাণও ছিল নগণ্য। আমাদের এন্টিট্যাংক বা ভারী মেশিনগান ছিল না। ফেব্রুয়ারীর শেষ দিকে বাংলাদেশে যখন রাজনৈতিক পরিস্থিতি বিস্ফোরণ হয়ে উঠছিল, তখন আমি একদিন খবর পেলাম, তৃতীয় কমাণ্ডে। ব্যাটেলিয়নের সৈনিকরা চট্টগ্রাম শহরের বিভিন্ন এলাকায় ছােট ছােট দলে বিভক্ত হয়ে বিহারীদের বাড়ীতে বাস করতে শুরু করেছে। খবর নিয়ে আমি আরাে জানলাম, কমান্ডারা বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র আর গােলাবারুদ নিয়ে বিহারী বাড়ীগুলােতে জমা করেছে। এবং রাতের অন্ধকারে বিপুল সংখ্যায় তরুণ বিহারীদের সামরিক ট্রেনিং দিচ্ছে। এসব কিছু থেকে-এরা যে ভয়ানক রকমের অশুভ একটা কিছু করবে তার সুস্পষ্ট আভাসই আমরা পেলাম। তারপর এলাে ১লা মার্চ।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের উদাত্ত আহবানে সারা দেশে শুরু হলাে ব্যাপক অসহযােগ আন্দোলন। এর পরদিন দাঙ্গা | হলাে। বিহারীরা হামলা করেছিল এক শান্তিপুর্ণ মিছিলে, এর থেকেই ব্যাপক গােলযােগের সূচনা হলাে। এই সময়ে আমার ব্যাটেলিয়নের এনসিওরা আমাকে জানালাে প্রতিদিন সন্ধ্যায় বিংশতিতম বালুচ রেজিমেন্টের জওয়ানরা পােশাক পরে বেসামরিক ট্রাকে করে কোথায় যেন যায়। তারা ফিরে আসে আবার শেষ রাতের দিকে। আমি উৎসুক হলাম। লােক লাগালাম খবর নিতে। খবর নিয়ে জানলাম প্রতি রাতেই তারা যায় কতকগুলাে নির্দিষ্ট বাঙালী পাড়ায়, নির্বিচারে হত্যা করে সেখানে বাঙালীদের। এই সময় প্রতিদিনই ছুরিকাহত বাঙালীকে হাসাপাতালে ভর্তি হতেও শােনা যায়। এই সময়ে আমাদের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল জানজুয়া আমার গতিবিধির উপর লক্ষ্য রাখার জন্যেও লােক লাগায়। মাঝে মাঝেই তার লােকেরা যেয়ে আমার সম্পর্কে খোজ খবর নিতে শুরু করে। আমরা তখন আশংকা করছিলাম, আমাদের হয়ত নিরস্ত্র করা হবে। আমি আমার মনােভাব দমন করে কাজ করে যাই এবং তাদের উদ্যোগ ব্যর্থ করে দেয়ার সম্ভাব্য সব ব্যবস্থা গ্রহণ করি। বাঙালী হত্যা ও বাঙালী দোকানপাটে অগ্নিসংযােগের ঘটনা ক্রমেই বাড়তে থাকে। আমাদের নিরস্ত্র করার চেষ্টা করা হলে আমি কি ব্যবস্থা গ্রহণ করবাে কর্ণেল (তখন মেজর) শওকতও আমার কাছে তা জানতে চান। ক্যাপ্টেন শমসের মবিন এবং মেজর খালেকুজ্জামান আমাকে জানান যে স্বাধীনতার জন্য আমি যদি অস্ত্র তুলে নেই তাহলে তারাও দেশের মুক্তির জন্য প্রাণ দিতে কুণ্ঠাবােধ করবেন না। ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ আমাদের মাঝে খবর আদান প্রদান করতেন। জেসিও এবং এনসিওরাও দলে দলে বিভক্ত হয়ে আমার কাছে বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকলাে। তারাও আমাকে জানায় যে কিছু একটা না করলে বাঙালী জাতি চিরদিনের জন্যে। দাসে পরিণত হবে। আমি নীববে তাদের কথা শুনতাম। কিন্তু আমি ঠিক করে ছিলাম, উপযুক্ত সময় এলেই আমি মুখ খুলবাে। সম্ভবতঃ ৪ঠা মার্চে আমি ক্যাপ্টেন। ওলি আহমদকে ডেকে নেই। আমাদের ছিল সেটা প্রথম বৈঠক। আমি তাকে সােজাসুজি বললাম, সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার সময় দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। ক্যাপ্টেন আহমদও আমার সাথে একমত হন। আমরা পরিকল্পনা তৈরী করি এবং প্রতিদিনই আলােচনা বৈঠকে মিলিত হতে শুরু করি। ৭ই মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ঘােষণা আমাদের কাছে এক গ্রীন সিগন্যাল বলে মনে হলাে আমরা আমাদের পরিকল্পনাকে চূড়ান্ত রূপ। দিলাম।
কিন্তু তৃতীয় কোন ব্যক্তিকে তা জানালাম না। বাঙালী ও পাকিস্তানী সৈনিকদের মাঝেও উত্তেজনা ক্রমেই চরমে উঠেছিল। ১৩ই মার্চ শুরু হলাে বঙ্গবন্ধুর সাথে ইয়াহিয়ার আলােচনা। আমরা সবাই ক্ষণিকের জন্য স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। আমরা আশা করলাম পাকিস্তানী নেতারা। যুক্তি মানবে এবং পরিস্থিতির উন্নতি হবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে পাকিস্তানীদের সামরিক প্রস্তুতি হাস না পেয়ে দিন দিনই বৃদ্ধি পেতে শুরু করলো। প্রতিদিনই পাকিস্তান থেকে সৈন্য আমদানী করা হলাে। বিভিন্ন স্থানে জমা হতে থাকলাে অস্ত্রশস্ত্র আর গােলাবারুদ। সিনিয়র পাকিস্তানী সামরিক অফিসাররা সন্দেহজনকভাবে বিভিন্ন গ্যারিশনে আসা যাওয়া শুরু করলাে। চট্টগ্রামে নৌবাহিনীরও শক্তি বৃদ্ধি করা হলাে। ১৭ই মার্চ স্টেডিয়ামে ইবিআরসির। লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এম আর চৌধুরী, আমি, ক্যাপ্টেন ওলি আহমদ ও মেজর আমিন চৌধুরী এক গােপন বৈঠকে মিলিত হলাম। এক চূড়ান্ত যুক্ত পরিকল্পনা পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। লেঃ কর্ণেল চৌধুরীকে অনুরােধ করলাম নেতৃত্ব দিতে। দুদিন পর ইপিআর-এর ক্যাপ্টেন (এখন মেজর) রফিক আমার বাসায় গেলেন | এবং ইপিআর বাহিনীকে সঙ্গে নেয়ার প্রস্তাব দিলেন। আমরা ইপিআর বাহিনীকে আমাদের পরিকল্পনাভুক্ত করলাম। এরমধ্যে পাকিস্তানী বাহিনীও সামরিক তৎপরতা শুরু করার চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণ করলাে।২১শে মার্চ জেনারেল আবদুল হামিদ খান গেল চট্টগ্রামে ক্যান্টনমেন্টে। চট্টগ্রামে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণের চুড়ান্ত পরিকল্পনা প্রণয়নই তার এই সফরের উদ্দেশ্য। সেদিন ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সেন্টারের ভােজসভায় জেনারেল হামিদ ২০তম বালুচ রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্ণেল ফাতমীকে বললাে— ফাতমি, সংক্ষেপে, ক্ষিপ্রগতিতে আর যত কম সম্ভব লােক ক্ষয় করে কাজ সারতে হবে। আমি এই কথাগুলাে শুনেছিলাম। ২৪ শে মার্চ ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ঢাকা চলে এলেন। সন্ধ্যায় পাকিস্তানী বাহিনী শক্তি প্রয়ােগে চট্টগ্রাম বন্দরে যাওয়ার পথ করে নিল। জাহাজ সােয়াত থেকে অস্ত্র নামানাের জন্যেই বন্দরের দিকে ছিল তাদের এই অভিযান। পথে জনতার সাথে ঘটলাে তাদের কয়েক দফা সংঘর্ষ। এতে নিহত হলাে। বিপুল সংখ্যক বাঙ্গালী। সশস্ত্র সংগ্রাম যে কোন মুহুর্তে শুরু হতে পারে, এ আমরা ধরেই নিয়ে ছিলাম। মানসিক দিক দিয়ে আমরা ছিলাম প্রস্তুত। পরদিন আমরা পথের ব্যারিকেড অপসারণের কাজে ব্যস্ত ছিলাম। তারপর এলাে সেই কালােরাত। ২৫শে ও ২৬শে মার্চের মধ্যবর্তী কালাে রাত। রাত ১টায় আমার কমান্ডিং অফিসার আমাকে নির্দেশ দিলাে নৌবাহিনীর ট্রাকে করে চট্টগ্রাম বন্দরে যেয়ে জেনারেল আনসারীর কাছে রিপাের্ট করতে।
আমার সাথে নৌ-বাহিনীর (পাকিস্তানী) প্রহরী। থাকবে তাও জানানাে হলাে। আমি ইচ্ছা করলে আমার সাথে তিনজন লােক নিয়ে যেতে পারি। তবে আমার সাথে আমারই ব্যাটেলিয়নের একজন পাকিস্তানী অফিসারও থাকবে। অবশ্য কমান্ডিং অফিসারের মতে, সে যাবে আমাকে গার্ড দিতেই। এ আদেশ পালন করা আমার পক্ষে ছিল অসম্ভব। আমি বন্দরে যাচ্ছি কিনা তা দেখার জন্য একজন লােক ছিল। আর বন্দরে প্রতীক্ষায় ছিল জেনারেল আনসারী। হয়তাে বা আমাকে চিরকালের মতােই স্বাগত জানাতে। আমরা বন্দরের পথে বেরােলাম। আগ্রাবাদ আমাদের থামতে হলাে। পথে ছিল ব্যারিকেড। এই সময়ে সেখানে এলাে মেজর খালেকুজ্জামান চৌধুরী। ক্যাপ্টেন অলি আহমদের কাছ থেকে। এক বার্তা এসেছে। আমি রাস্তায় হাঁটছিলাম। খালেক আমাকে একটু দূরে নিয়ে। গেল। কানে কানে বললাে, ‘তারা ক্যান্টনমেন্ট ও শহরে সামরিক তৎপরতা শুরু করেছে। বহু বাঙ্গালীকে ওরা হত্যা করেছে।’ এটা ছিল একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের চূড়ান্ত সময়। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই আমি বললাম-আমরা বিদ্রোহ করলাম। তুমি ষােলশহর বাজারে যাও। পাকিস্তানী। অফিসারদের গ্রেফতার করাে। অলি আহমদকে বলে ব্যাটেলিয়ন তৈরী রাখতে। আমি আসছি। আমি নৌবাহিনীর ট্রাকের কাছে ফিরে গেলাম। পাকিস্তানী অফিসার, নৌবাহিনীর চীফ পােষ্ট অফিসার ও ডাইভারকে জানালাম যে, আমাদের আর বন্দরে যাওয়ার দরকার নেই। এতে তাদের মনে কোন প্রতিক্রিয়া হলাে না দেখে আমি পাঞ্জাবী ডাইভারকে | ট্রাক ঘুরাতে বললাম। ভাগ্য ভালাে, সে আমার আদেশ মানলাে। আমরা আবার ফিরে চললাম। ষােলশহর বাজারে পৌঁছেই আমি গাড়ী থেকে লাফিয়ে নেমে একটা রাইফেল তুলে নিলাম। পাকিস্তানী অফিসারটির দিকে তাক করে বললাম, হাত। তুলল। সে আমার কথা মানলাে।
আমি তােমাকে গ্রেফতার করলাম। নৌবাহিনীর। লােকেরা এতে বিভ্রান্ত হয়ে পড়লাে। এ মুহুর্তেই আমি নৌবাহিনীর অফিসারের দিকে রাইফেল তাঁক করলাম। তারা ছিল আটজন। সবাই আমার নির্দেশ মানলাে। এবং অস্ত্র ফেলে দিল। আমি কমান্ডিং অফিসারের জীপ নিয়ে তার বাসার দিকে রওয়ানা দিলাম। তার বাসায় পৌছে হাত রাখলাম কলিং বেলে। কমান্ডিং অফিসার পাজামা পরেই। বেরিয়ে এলাে। খুলে দিলাে দরজা। ক্ষিপ্রগতিতে আমি ঘরে ঢুকে পড়লাম এবং গলাশুদ্ধ তার কলার টেনে ধরলাম। দ্রুতগতিতে আবার দরজা খুলে কর্ণেলকে আমি বাইরে টেনে আনলাম। বললাম, বন্দরে পাঠিয়ে আমাকে মারতে চেয়েছিলে? এই। আমি তােমাকে গ্রেফতার কবলাম। এখন লক্ষ্মী সােনার মতাে আমার সঙ্গে এসাে। সে আমার কথা মানলাে। আমি তাকে ব্যাটেলিয়নে নিয়ে এলাম। অফিসারদের মেসে যাওয়ার পথে আমি কর্ণেল শওকতকে (তখন মেজর) ডাকলাম। তাকে জানালাম আমরা বিদ্রোহ করেছি। শওকত আমার হাতে হাত মিলালাে। | ব্যাটেলিয়নে ফিরে দেখলাম, সমস্ত পাকিস্তানী অফিসারকে বন্দী করে একটা ঘরে রাখা হয়েছে। আমি অফিসে গেলাম। চেষ্টা করলাম লেফটেন্যান্ট কর্ণেল এম। আর চৌধুরীর সাথে আর মেজর রফিকের সাথে যােগাযােগ করতে। কিন্তু পারলাম। সব চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। তারপর রিং করলাম বেসামরিক বিভাগের টেলিফোন অপারেটরকে। তাকে অনুরােধ জানালাম ডেপুটি কমিশনার, পুলিশ। সুপারিনটেনডেন্ট, কমিশনের ডিআইজী ও আওয়ামী লীগ নেতাদের জানাতে যে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের অষ্টম ব্যাটেলিয়ন বিদ্রোহ করেছে। বাংলাদেশের। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করবে তারা। এদের সবার সাথেই আমি টেলিফোনে যােগাযােগ করার চেষ্টা করেছি। কিন্তু কাউকেই পাইনি। তাই টেলিফোন অপারেটরের মাধ্যমেই আমি তাদের খবর দিতে চেয়েছিলাম। অপারেটর সানন্দে আমার অনুরােধ রক্ষা করতে রাজী হলাে। সময় ছিল অতি মূল্যবান। আমি ব্যাটেলিয়নের অফিসার, জেসিও আর জওয়ানদের ডাকলাম। তাদের উদ্দেশে ভাষণ দিলাম। তারা সবই জানতাে। আমি সংক্ষেপে সব বললাম এবং তাদের নির্দেশ দিলাম সশস্ত্র সংগ্রামে অবতীর্ণ হতে। তারা সর্বসম্মতিক্রমে হৃষ্টচিত্তে এ আদেশ মেনে নিলাে। আমি তাদের একটা সামরিক পরিকল্পনা দিলাম। তখন রাত ২টা বেজে ১৫মিনিট। ২৬শে মার্চ। ১৯৭১ সাল রক্ত আখরে বাঙালীর হৃদয়ে লেখা একটি দিন। বাংলাদেশের জনগণ রৈদিন স্মরণ রাখবে এই দিনটিকে। স্মরণ রাখবে ভালবাসায়।
এই দিনটিকে তারা কোনদিন ভুলবে না। কোনদিন না।” ২৬শে মার্চের পর মেজর জিয়া নিজের জবানীতে কিছু বিবৃত করেন নি। সহযােদ্ধাদের অনেকে তাঁর পরবর্তী কার্যক্রম সম্পর্কে বলেছেন। ক্যাপ্টেন শমসের মুবিন চৌধুরী বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রে নেবম খণ্ড) এক সাক্ষাৎকারে ২৭শে মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়ার সেই ঐতিহাসিক ভাষণের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেছেন ২৭শে মার্চ সন্ধ্যার সময় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রে গেলেন এবং ভাষণ দিলেন। ভাষণে তিনি বললেন যে আমরা স্বাধীনতা যুদ্ধে লিপ্ত আছি। আপনারা যে যেখানে আছেন, সামরিক ও বেসামরিক লােকজন, যেন আমাদের সাথে সহযােগিতা করেন। সবাইকে অস্ত্র নিয়ে পাকিস্তান হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে বললেন। তিনি বিশ্বের শান্তিকামী দেশগুলাের সাহায্য এবং সহযােগিতা কামনা করলেন। দেশবাসীকে স্বাধীনতা যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করতে বললেন। ২৮শে মার্চ সারা দিন আমি ঐ ভাষণ বেতার কেন্দ্র থেকে পড়ি। চট্টেশ্বরী রােডে অপারেশনঃ পাকিস্তান সেনাবাহিনী আমাদের এ্যামবুশ করেছিল। আমরা ১০ জন ছিলাম। আমরা ওদের এ্যামবুশ কাউন্টার করেছিলাম। ২৯শে মার্চ আসকের দীঘি অপারেশনঃ প্রায় ১২ ঘন্টা এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর সাথে আমাদের গােলাগুলি বিনিময় হয়। ৩০শে মার্চ বাকুলীয়া গ্রাম অপারেশনঃ এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর দুটো গেরিলা কমাণ্ডোকে হত্যা করা হয়। | এপ্রিল মাসের ১১ তারিখে কালুরঘাট ব্রীজ অপারেশন চালানাে হয়। এখানে পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আমাদের আক্রমণ করে। এই যুদ্ধে আমি গুরুতররূপে আহত হই। আমি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। তারপর আমাকে ঢাকা নিয়ে এসে বন্দী শিবিরে রাখা হয় এবং অশেষ নির্যাতন চালানাে হয়। প্রত্যেহ আমাকে মারধর করা হত। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে আমাকে রাখা হয়। আমার সাথে আরাে অনেক বন্দী ছিল। এদের কাউকে বাসা থেকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। জুন মাস পর্যন্ত আমার উপর অত্যাচার চলে। নভেম্বর মাসে আমার বিরুদ্ধে চার্জশীট আনা হয়। বলা হয়েছিল আমাকে কোর্ট মার্শাল করা হবে। কিন্তু ডিসেম্বরের ১৬ তারিখে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। আমি মুক্ত হয়ে যাই। এখানে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য যে কালুরঘাটে এসে থামে আমরা শপথ গ্রহণ করলাম। শপথবাক্য পাঠ করেছিলেন মেজর জিয়াউর রহমানঃ বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়া পর্যন্ত আমরা লড়াই চালিয়ে যাব। এমনকি যদি প্রয়ােজন হয় দেশের জন্য আমরা প্রাণ দেব।
২ নং সেক্টর ও কে ফোর্সের–অধিনায়ক মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ
অধিনায়ক মেজর জেনারেল খালেদ মােশাররফ মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে বৃহত্তর নােয়াখালী, ঢাকা, কুমিল্লা ও ফরিদপুর জেলার অংশ নিয়ে গঠিত ২নং সেক্টরের অধিনায়ক ও পরে ‘কে’ ফোর্সের কমাণ্ডার হিসেবে যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ দায়িত্বপালন করেন মেজর খালেদ মােশাররফ। ২৫শে মার্চ ঢাকায় গণহত্যা শুরুর মাত্র কয়েকদিন আগে (১৯ শে মার্চ) খালেদ মােশাররফকে ঢাকা সেনানিবাস থেকে চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের হেড কোয়ার্টারে বদলী করা হয়। ২৪ শে মার্চ একটি টুপসসহ সিলেটের শমসের নগরে। নকশাল’ ও ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী দমনের মিথ্যা, অজুহাতে পাঠানাে হয় তাকে। ২৬ শে মার্চ ঢাকা ও অন্য কয়েকটি স্থানে পাক বাহিনীর হত্যাযজ্ঞের বিবরণ জানতে পেরে সেদিনই প্রতিরােধ যুদ্ধ গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেন খালেদ মােশাররফ। ২২ শে অক্টোবর কসবার যুদ্ধে মেজর খালেদ মােশাররফ গুরুতরভাবে আহত হলে মেজর খালেক ‘কে’ ফোর্স কমাণ্ডার ও মেজর এনটি, এম হায়দার ২নং সেক্টরের কমান্ডার নিযুক্ত হন। মুক্তিযুদ্ধে ঢাকা শহরে অপারেশনকারী গেরিলাদের প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ছিল ২নং সেক্টর। খালেদ মােশাররফের জন্ম ১৯৩৭ সালের নবেম্বর মাসে। ১৯৫৭ সালে সেনাবাহিনীতে কমিশন পান তিনি। ১৯৭৫ সালের ৩ রা নভেম্বর তীর নেতৃত্বে দেশের দ্বিতীয় সামরিক অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। তার ৩দিন পর একটি পাল্টা অভুথানের মুখে সেনা সদস্যদের গুলিতে মাত্র ৩৮ বছর বয়সে নিহত হন মুক্তিযুদ্ধের এই আলােচিত সমর নায়ক। নীচে তার একটি স্মৃতিকথামূলক লেখা সংযুক্ত হলাে। সংগৃহীত হয়েছে সাপ্তাহিক বিচিত্রা থেকে। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারী মাসে আমি বিদেশে ছিলাম। ওখানের টেলিভিশনের পর্দায় দেখেছি ভােটের ছবি। তার আগে ঝড়ের ছবি। দেশে ফিরে দেখলাম আমার দেখা বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে গেছে। চারদিকে দানা বেঁধে উঠেছে সগ্রাম। এবার স্বপ্ন সার্থক হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবার হবেন রাষ্ট্রনায়ক। ক্যান্টনমেন্টে এ নিয়ে আলােচনা হতাে, মৃদু কণ্ঠে। এ আলােচনায় জাতিভেদ স্পষ্ট ছিল। কেউ প্রাণখুলে আলােচনা করতাে না। এ সময় আমার নতুন পদ হলঃ ব্রিগেড মেজর, ৫৭ নং ঢাকা ব্রিগেড মেজর। আমকে ২২শে মার্চ বদলী করে দেয়া হয় (১লা মার্চ থেকে ২২ শে মার্চ পর্যন্ত আর্মি মুভমেন্ট সম্পর্কে আমার কিছুটা ধারণা হয়েছিল। যার জন্যে মার্চ মাসের প্রথম দিকে আমি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করি এবং পরে জেনারেল ওসমানীর সঙ্গেও আলােচনা হয়। ২২শে মার্চ আমার পােস্টিং হয় কুমিল্লায় ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টে।
সেকেন্ড ইন কমান্ড এটা আমার অরিজিন্যাল ব্যাটেলিয়ন। ২৪শে মার্চ আমি ফোর্থ বেঙ্গলের সে সময়কার পাঞ্জাবী কমান্ডার লেঃ কর্নেল খিজির হায়াত খানের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নিলাম। দায়িত্ব নেবার পর মুহূর্তে একটা অর্ডার ইস্যু হলো। আমার নামেঃ আমাকে তখনই রওয়ানা হতে হবে শমশেরনগর, একটা কোম্পানী নিয়ে। কারণ হিসেবে বলা হল ভারত থেকে সশস্ত্র নকশালরা অনুপ্রবেশ করছে। খটকা লাগলাে। প্রশ্ন করেছিলাম, আমি ব্যাটেলিয়নের সেকেন্ড-ইন-কমান্ড, একটা কোম্পানী নিয়ে আমি যাবাে কেন? আমাকে এভাবে হঠাৎ প্রশ্ন করতে দেখে লেঃ কর্নেল খিজির স্পষ্টভাবে চমকে গেলেন। বললেন, ওখানে একটা ইপিআর কোম্পানী আগে থেকেই আছে। সেজন্য একজন সিনিয়র অফিসার যাওয়া প্রয়ােজন। অস্ত্র সংগ্রহ করার সময় আমার মনের সন্দেহটা স্পষ্ট হল। কোম্পানীকে পুরাে অস্ত্রে সজ্জিত করে আমি সেদিনই রওনা হলাম শমশেরনগরের উদ্দেশে। যাবার আগে রেজিমেন্টের বাঙ্গালী অফিসারদের সাবধান থাকতে বলে গেলাম। ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অন্য একটা কোম্পানী ব্রাহ্মণবাড়িয়া গিয়েছিল। আমি যাচ্ছি শমশের নগর। তার মানে কুমিল্লা কেন্টনমেন্ট খালি করা হচ্ছে। বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে দিয়ে বেঙ্গল রেজিমেন্টের শক্তিকে নিউটাল করা হচ্ছে। দেশব্যাপী তখন গণজাগরণের জোয়ার। শমশেরনগর যাবার পথে বাধা • পেলাম হাজার মানুষের কাছ থেকে। তারা আমাদের কিছুতেই যেতে দেবে না। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একজন স্থানীয় লােক আমার গাড়ির সামনে শুয়ে পড়লাে। বুললঃ যেতে হলে আমার উপর দিয়ে যাবেন। আমি আশ্বাস দিলাম যে শেখ সাহেব বললেই আমাদের সগ্রাম শুরু হবে। আমরাও প্রস্তুত। দরকার হলে দেখবে। আমরাও তােমাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। শমশেরনগর যাবার পথে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ফোর্থ বেঙ্গলের অন্য একজন অফিসার, মেজর শাফায়েত জামিলের সঙ্গে এ বিষয়ে আলােচনা করি। কিন্তু শমশেরনগর পৌছে পরদিন খোঁজ নিতে গিয়ে দেখি নকশাল অথবা ইপিআর কোন | কিছুরই পাত্তা নেই। এসেছিলাম পাকা রােড ছেড়ে কাচা ব্লেড দিয়ে। পাকা | রােডের পাশে মৌলভীবাজারে ৩১ পাঞ্জাবের একটি কোম্পানী ওখানে আগেই | পােষ্টেড ছিল।
ওদের খবর পেলাম ২৬শে মার্চ এর আগে চা-বাগানগুলােয় গিয়ে। আশ্চর্য হয়ে দেখি অবাঙ্গালী টি প্ল্যান্টাররা আগেই সরে পড়েছে বা সরিয়ে দেয়া হয়েছে। আমি কুমিল্লার সঙ্গে ওয়ারলেসে যােগাযােগের চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন সাড়া পেলাম না। ২৬শে মার্চ বিকেলে একজন খবর নিয়ে এল ঢাকায় ব্যাপক আকারে গণহত্যা শুরু করেছে আর্মি। এবার যােগাযােগের চেষ্টা করলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সঙ্গে। ওদের পেলাম। শুনলাম ফোর্থ বেঙ্গলের কমান্ডার এখন। ওখানে পুরাে ব্যাটেলিয়ন নিয়ে এসেছে। শাফায়েতকে শুধু বললাম, আমি আসছি। চারদিকের আলাে আঁধারির ভিতর দিয়ে অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ২৬শে মার্চ রাত দশটায় আমি কনভয় নিয়ে রওয়ানা হলাম ব্রাহ্মণবাড়িয়ার পথে। এ সময় প্রতিটি মুহুর্ত আমার পাশে থেকে আমাকে সাহায্য করেছিল তরুণ ক্যাপ্টেন। মাহবুব।পথে বেরিকেড সরিয়ে সরিয়ে অগ্রসর হতে সময় লাগছিল। শাফায়েত আমার সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিল। ভাের ছটা। ২৭শে মার্চ। শাফায়েত জানালাে কমান্ডার সকাল ১০টায় অফিসারদের মিটিং ডেকেছে। বুঝলাম তখনই কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে। বললাম, তুমি তােমার কাজ | শেষ করে ফেল। আমি কাছে এসে পড়েছি। শাফায়েতের নেতৃত্বে ঠিক নটায় ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসাররা পাঞ্জাবী কমান্ডার, অফিসার ও জওয়ানদের বন্দী করে। আমি দুপুরে ওদের সঙ্গে যােগ দিলাম। এ দিন থেকেই শুরু হল প্রতিরােধের যুদ্ধ। মুষ্টিমেয় রেজিমেন্ট তার অস্ত্র কয়েক ভাগে ভাগ করে ডিফেন্স লাইন বসালাম। পুলিশের ওয়ারলেসে চারিদিকে খবর পাঠালাম।। জনতার সঙ্গে চাকরি জীবনে বিচ্ছিন্ন থেকেও তাদের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলাম প্রতিরােধের যুদ্ধে। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভাগ্যের সাথে নিজেদের ভাগ্যকে বেঁধেছিলাম সেদিন। আমি যােদ্ধা, কিন্তু যুদ্ধবাজ নই। শান্তি আমার একমাত্র কাম্যবস্তু। শান্তির জন্যেই অস্ত্র তুলে নিয়েছিলাম শত্রুর বিরুদ্ধে। জয়ী আমাদের হতেই হবে। | ২৬শে মার্চ মেজর জিয়া (এখন মেজর জেনারেল ঘােষণা করেছিলেন স্বাধীনতা শেখ মুজিবুরের পক্ষে। ১৭ই এপ্রিল গঠিত হল বালাদেশ সরকার। এরই মধ্যে আমরা শত্রুর উপর বারবার আঘাত হেনেছি। সে সময়কার বাংলাদেশ বেতার মারফত ব্রাহ্মণবাড়িয়া, আখাউড়া, কসবায় যুদ্ধের কথা শুনেছেন। আমাদের বিরুদ্ধে ওরা সর্বশক্তি নিয়ােগ করেছিল। ভয়ংকরভাবে ওরা, হামলা চালিয়েছিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ার উপর। | ২নং সেক্টর গঠিত হবার পর ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি মতিনগরে একটি পাহাড়ী এলাকায়। কারণ আমি জানতাম এ যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস যদি কেউ লিখতে চান, তবে তাকে এই মতিনগরের কথা। বিশেষভাবে লিখতেই হবে। এখানে দলে দলে তরুণরা এসে যােগ দেয়। তাদের দুবেলা খাবার ছিল না। পরনে কাপড় ছিল না। আমার এ ক্যাম্পে বিদেশী সাহায্য সামগ্রী পৌছাতাে না।
কিন্তু ছেলেরা প্রতিবাদ করেনি। গ্রেনেডের খালি বাজে খেয়েছে, খােলা আকাশের নীচে ঘুমিয়েছে এক মাস। এরা অস্ত্র চাওয়া ছাড়া অন্য কোন অভিযােগ করতাে না। এদের গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হতাে। এবং | আর্মি পুলিশ ইপিআরও এসব গেরিলা যােদ্ধাদের নিয়ে আমি একটা ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকি। আমার প্রথম কাজ হলাে যুদ্ধকে জনসাধারণের মনে জিইয়ে রাখা। মে মাসে। জাতিসংঘ মিশন ঢাকা এল কার্গিলের নেতৃত্বে। আমি মতিনগরের ট্রেনিংরত কয়েকটি ছেলেকে বাছাই করে তাদের হাতে গ্রেনেড দিয়ে ঢাকা পাঠিয়ে দিলাম। এই কয়েকটি সাহসী ছেলে সঠিক সময়মত কার্গিলের গাড়ি উড়িয়ে দিল গ্রেনেড মেরে শহরের প্রাণকেন্দ্র ইন্টারকন্টিনেন্টালের সামনে। এ সময় ঢাকায় ছেলেদের পাঠাতাম। যুদ্ধকে উত্তপ্ত রাখতে। যাকে বলা যায়, সাইকোলজিক্যাল ওয়ার। মানুষ মনে মনে যুদ্ধ উপলব্ধি না করলে বদ্ধ সেদিনই বন্ধ হয়ে যেতাে। আমরা যুদ্ধ করেছি তিন ফন্টে। অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সামরিক। পাকিস্তানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিয়েছিল আমাদের গেরিলা ইউনিট ও ফ্রগম্যানরা। ওরা ব্রীজ উড়িয়েছে, যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে, পাটের গুদামে আগুন লাগিয়েছে, সমুদ্র জাহাজ ডুবিয়েছে। বন্ধ করে দিয়েছে বিদেশী মুদ্রা অর্জনের সমস্ত উপায়। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধ করেছি পাকিস্তানের শাসন কাঠামাে ভেঙ্গে দিয়ে। ইয়াহিয়ার অনুদের হত্যা করেছে আমাদের ছেলেরা। বিশ্ব সংবাদ তৈরী হতে পারে এমন সব টার্গেট বেছে নিয়েছে এরা যেমন ইন্টারকন্টিনেন্টাল, ডিআইটিতে একসপ্লোসিভ বসায়। এই সব ছেলেরা ঢাকা পাওয়ার স্টেশন উড়িয়েছে, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ারের ক্ষতি সাধন করেছে, গ্যাসলাইন। নষ্ট করেছে। এসব কাজে আমি গেরিলাদেরই ব্যবহার করেছি। সামরিক ক্ষেত্রে আমি আরাে দুধনের পদ্ধতি ব্যবহার করেছি। এক-ফ্রন্টাল ফাইট। প্রচলিত প্রথায় ডিফেন্স লাইন বসিয়ে যে যুদ্ধ হয় তাই। দুই- গেরিলা যুদ্ধ। প্রচলিত প্রথায় আমি সীমান্ত এলাকায় মুক্ত সঞ্চলে আমার বেঙ্গল রেজিমেন্ট এবং ইপিআর বাহিনীর পুরনো লােকদের নিয়ােগ করেছি। এরা বাংকার থেকে নমাস ক্লান্তিহীন যুদ্ধ করেছে। সুযােগ পেলেই অগ্রসর হয়েছে, শবুকে প্রতিহত করেছে। আপনারা শালদা নদী, মন্দভাগ, কসবা, বেলােনিয়া, পরশুরাম, আখাউড়া ইত্যাদি নাম বেতারে শুনেছেন। এসব অঞ্চলে আমি যুদ্ধ চালিয়েছি। তার কারণ হচ্ছেঃ পাক সেনাদের সীমান্ত অঞ্চলে কনসেলটেট করা এবং সেখানে পকেট করে ফেলানো। বাস্তবেও তাই হয়েছে। এর ফলে আমার গেরিলা যােদ্ধা দেশের ভেতরে বেশ সহজে কাজ করতে পেরেছে। এই যুদ্ধ পদ্ধতির ফলে পাকিস্তানীদের সঠিক, প্রতিরােধ পদ্ধতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত নিতে অসুবিধা হতাে। প্রচলিত প্রথায় যুদ্ধেও আবার কিছু কিছু মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডাে প্রথায় আক্রমণ চালাতাে যার জন্যে প্রয়োজন অসীম সাহসের। আমার মনে পড়ছে সুবেদার শহীদ বেলায়েতের কথা। শহীদ বেলায়েত একটা প্লাটুন নিয়ে সালদা নদী রেলওয়ে স্টেশনের পাক ডিফেন্সে আক্রমণ চালায়। এ ডিফেন্সে পাক আর্মির সংখ্যা ছিল সাড়ে তিন শ। তারপর ৩৫ জন রাজাকার। মাত্র একচল্লিশজন যােদ্ধা বারাে ঘন্টা যুদ্ধ করে চল্লিশটি বাংকার দখল করে। এখানে আমরা প্রচুর অস্ত্র এবং এ্যামুনিশন পেয়েছিলাম। বেলায়েত শহীদ হয় দুদিন পর র্যাকিতে গিয়ে। জুন মাসে বেলােনিয়ার এক যুদ্ধে দেড় হাজার পাক আর্মি খতম হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে। সীমান্ত অঞ্চলের যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছেন ক্যাপ্টেন গাফফার, ক্যাপ্টেন জাফর ইমাম, মেজর সালেক, মেজর আইনউদ্দীন, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন আশরাফ, লেফটেন্যান্ট হুমায়ুন কবীর। সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট আজিজ শহীদ হয়েছেন কসবায়।। গেরিলা যুদ্ধের দায়িত্ব ছিল মেজর হায়দারের উপর। হায়দার’ ২৭শে মার্চ। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্ট থেকে পালায়। প্রথম দিকে সে দুএকজন ছেলে নিয়ে পাক সৈন্য চলাচলের পথের ব্রীজ উড়িয়ে বেড়াতো। আমি ওকে মতিনগরের টনিং ক্যাম্পের ভার দেই। এরপর আমাদের স্থায়ী ক্যাম্প হয় মেলাঘরে। এখান থেকেই গেরিলাদের পাঠানাে হতাে ঢাকা, ফরিদপুর, নােয়াখালী ও কুমিল্লায়। আমার গেরিলারা এসব অঞ্চলের অধিকাংশ থানা দখল করে নিয়েছিল নবেম্বর মাসেই। কি দুঃসাহসের সঙ্গে এরা লড়েছে তা আপনারাও জানেন। ঢাকায় মতিনগরের টেনিং পাওয়া ছেলেদের দলটা ধরা পড়ে পাক আর্মির হাতে। ধরা পড়ে ২৯শে আগস্ট। এ দলের সঙ্গে যােগ থাকার জন্য গ্রেফতার হন | গায়ক আলতাফ মাহমুদ, রেডিওর হাফিজউদ্দিন। এবং কয়েকজন গেরিলা। এরা। কেউ আর ফিরে আসেনি। এদের দেশপ্রেম, সাহস স্বাধীনতার ইতিহাসে গল্প হয়ে থাকবে। আমি প্রশংসা করি শহীদ মানিকের দলকে। প্রশংসা করি অন্যান্যদের। | সেক্টর ২-এর কমান্ডিং অফিসার হিসেবে, ফোর্সের কমান্ডার হিসেবে আজ লিখছি, আমি বেঁচে আছি আহত হয়েও ।
আমরা বিজয়ী হয়েছি। আমি দেশে ফিরে ন’ মাস আর্মি কাস্টডিতে থাকা আমার দুবছরের মেয়ে রূপনকে ফিরে পেয়েছি। আমি সুখী। কিন্তু একটা কথা বারবার মনে হচ্ছে আমার ফোর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের পুরনাে লােকদের অনেকেই বেচে নেই। দেশের জন্য প্রাণ দিতে পারার মত গৌরবের চেয়ে বড় গৌরব সৈনিকের কাছে আর কিছু হতে পারে না। কিন্তু ওরা প্রিয় মাতৃভূমির মুক্তি দেখে যেতে পারেনি। ক্যাপ্টেন মাহবুবের কাছে একটা। কম্যান্ডাে প্লাটুন ছিল ৩৬ জনের। ওদের মাত্র ৬ জন জীবিত ছিল যুদ্ধের শেষে। | দেশের মুক্তির জন্যে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী যুদ্ধ করেছেন। ভারতে যাওয়া সবার পক্ষে সম্ভব হয়নি, উচিতও না। আমার গেরিলাদের বলতাম, দেশের লােককে বলতে, তারা যেন অপ্রয়ােজনে দেশত্যাগ না করেন। প্রত্যেকেরই লড়তে হবে। গেরিলা যুদ্ধে সবচে যা বেশী প্রয়ােজন, তা হচ্ছে গণ-আবরণ। সাতকোটি মানুষ এই আবরণ সৃষ্টি করে রেখেছিল। আমরা যুদ্ধ করেছি, এটা একান্ত আমাদেরই যুদ্ধ ছিল। আমরা সবাই যােদ্ধা। মনে আছে, ঢাকা থেকে গুটিকতক মেয়ে আমার কাছে গিয়ে যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করতে চেয়েছিল। ওদের কথা শুনে। বুঝেছিলাম, এটা ওদের কথার কথা নয়, সত্যি ওরা যুদ্ধ করতে চায়। ওদের নিয়ে আমি বাংলাদেশের প্রথম হাসপাতাল খুলেছিলাম। ওরা তেরটি মেয়ে ওখানে যুদ্ধে আহতদের নার্সিং করতাে। যুদ্ধ করতে এসেছিলেন ইংল্যান্ড থেকে ডাঃ জাফর উল্লাই ও ডাঃ মােবিন। ঢাকা শহরের এক ফল বিক্রেতা আমার সেক্টরের একজন গেরিলা কমান্ডার হয়েছিলেন। যুদ্ধ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেরা ছাত্র থেকে শুরু করে প্রত্যেকে। বিদেশে নিরাপদ আশ্রয় পেয়েও তাই আমরা তিতের। দালাইলামা হয়ে যাইনি। অন্যের গলগ্রহ হয়ে থাকিনি। আমরা দেশ স্বাধীন করেছি। তার জন্যে আমি প্রতিটি বাঙ্গালীর মতই গর্বিত। গর্ব বােধ করি এজন্যই যে আমরা গণযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছি। জনতার একজন হিসেবে যুদ্ধ করেছি। ২ নং সেক্টরে সংঘটিত যুদ্ধ ও অন্যান্য ঘটনা সম্পর্কে সেক্টর কমান্ডার খালেদ মােশারফের একটি বিস্তারিত সাক্ষাৎকার প্রকাশিত হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্রের নবম খন্ডে। সেই সাক্ষাৎকারের কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো “যখন আমি যুদ্ধ চালাচ্ছিলাম এবং যুদ্ধ আস্তে আস্তে যখন তীব্রতর হচ্ছিল, তখন আমার সেনাদলে আহত এবং নিহতের সংখ্যাও বেড়ে চলছিল। সে সময়ে আমার সৈনিক এবং গণবাহিনীর জন্য চিকিৎসার বন্দোবস্ত ছিল না, শুধু আমার। সঙ্গে সেনাবাহিনীর ১ জন ডাক্তার ক্যাপ্টেন আখতার ছিলেন।
অফিসারের স্বল্পতায় তাঁকেও আমি একটা কোম্পানী কমাণ্ড রি বানিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে নিয়ােগ করেছিলাম এবং যুদ্ধ ক্ষেত্রে ক্যাপ্টেন আখতার ডাক্তার হয়েও একজন যােদ্ধা হিসেবে বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। আমার আহতের সংখ্যা যখন বেশ বেড়ে যায় এবং অনেক সময় দ্রুত চিকিৎসার অভাবে অনেক সৈনিক বা গণবাহিনীর ছেলেরা রক্ত ক্ষয়’ হয়ে মারা যেতে থাকে, তখন আমি বুঝতে পারলাম যে আমার সেক্টরেই চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে ডেকে পাঠাই এবং অতি সত্বর আমার হেডকোয়ার্টার এর নিকট একটি চিকিৎসালয় স্থাপন করার নির্দেশ দিই। ঢাকা থেকে কিছু সংখ্যক ছেলেমেয়ে আমার সেক্টরে এসে আশ্রয় নেয়। এদের মধ্যে দু-একজন চিকিৎসা শিক্ষানবিসও ছিল। তারাও আমাকে ১টি হাসপাতাল গড়ার জন্য অনুরােধ জানায়। এসব ছেলেমেয়ে নিয়ে ক্যাপ্টেন আখতার কয়েকটি তাঁবুতে মতিনগরে আমার হেডকোয়ার্টারের নিকট মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য প্রথম বাংলাদেশ হাসপাতালের ভিত্তি স্থাপন করেন। একটা সুন্দর বাগানের ভিতর উঁচু এবং শান্ত পরিবেশে এ হাসপাতালটি অবস্থিত ছিল। প্রথমে হাসপাতালে ব্যবহারের জন্য আমাদের কাছে ঔষধপত্র বা অস্ত্রোপচারের সরঞ্জাম কিছুই ছিল না। কিন্তু তবুও আমাদের এই নবীন দলটি ক্যাপ্টেন আখতারের নেতৃত্বে সমস্ত বাধাবিপত্তি সত্ত্বেও ধীরে ধীরে হাসপাতালটি গড়ে তুলতে থাকে। এদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য বেগম সুফিয়া কামালের দুই মেয়ে চুল এবং লুলু, মেডিকেল ছাত্রী ডালিয়া, আসমা, রেশমা, ক্যাপ্টেন সিতারা বেগম, সবিতা, শামসুদ্দিন প্রমুখ। এসব ছেলেমেয়ের দল নিজেদের সুখ ও আরাম ত্যাগ করে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আহত সৈনিকদের এবং গণবাহিনীর। ছেলেদের সেবাশুশ্রুষা ও চিকিৎসা করে যাচ্ছিল। এরা রেডক্রস ও বন্ধুরাষ্ট্রের স্থি বিভাগের সঙ্গে যােগাযােগ করে অনেক কষ্টে ঔষধপত্র যােগাড় করত। মাঝে মাঝে আমি যতটুকু টাকা পয়সা সেক্টর ফাণ্ড থেকে দিতে পারতাম, তা দিয়ে ঔষধপত্র যােগাড় করত। জুন মাসের দিকে লণ্ডন থেকে ডাঃ মবিন (প্রবাসী বাঙ্গালী) আমাদের এই হাসপাতালের কথা শুনে এখানে এসে যােগ দেন। এর কিছুদিন পর। ডাঃ মবিনের আর এক বন্ধু ডাঃ জাফরুল্লাহ সংবাদ পেয়ে লণ্ডন থেকে এসে যােগ দেন। এরা দু’জনেই লণ্ডনে এফ-আর-সি-এস পড়ছিলেন। দেশে মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ শুনে তারাও এতে অংশ নেয়ার জন্য আগ্রহী ছিলেন। তারা তাদের লণ্ডনের সব সুখ ও আরাম ত্যাগ করে আমাদের এ হাসপাতালের নাম শুনে ছুটে এসেছিলেন মাতৃভূমিকে শত্রুদের হাত থেকে মুক্ত করার জন্য। তাদের সঙ্গে আমার বিস্তারিত আলাপ হয় এবং আমরা এ হাসপাতালটি গড়ে তােলার জন্য একটি পরিকল্পনা নিই।
ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহ আমাকে আশ্বাস দেন লণ্ডনে। অবস্থিত প্রবাসী বাঙ্গালীরা তাদের মাতৃভূমির জন্য সবকিছু ত্যাগ করতে প্রস্তুত আছে এবং আমরা যদি বাংলাদেশ মেডিকেল এসােসিয়েশনের কাছে আহ্বান জানাই তবে এ হাসপাতালে সরঞ্জামের ব্যবস্থা তারা করতে পারবে। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি ডাঃ মবিন ও ডাঃ জাফরুল্লাহকে বিস্তারিত সরঞ্জামের তালিকা বানানাের নির্দেশ দিই। আর সেই সঙ্গে ক্যাপ্টেন আখতারকে যুদ্ধক্ষেত্র থেকে আর একটু | পিছে বিশ্রামগঞ্জে সুন্দর জায়গায় পাহাড়ের উপর এ অস্থায়ী হাসপাতাল নির্মাণের জন্য পরিকল্পনা নিতে নির্দেশ দিই। আমার সঙ্গে এ ব্যাপারে আমাদের প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম, এ, জি, ওসমানীর (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল) সঙ্গে বিস্তারিত আলােচনা হয়। তাঁকে আমি আমার সেনাদল ও ছেলেদের চিকিৎসার শােচনীয় অবস্থার কথা জানাই। তিনি আমাকে আমার হাসপাতাল তৈরীর পরিকল্পনায় উৎসাহ দেন এবং সঙ্গে সঙ্গে ৩০ হাজার টাকা মঞ্জুরী দেন। এক মাসের মধ্যে বাঁশ, কাঠ ও ছন দিয়ে আমরা বিশ্রামগঞ্জে ২০০ বেডের হাসপাতাল তৈরী করে ফেলি। ডাঃ জাফরুল্লাহ লণ্ডনে চলে যান হাসপাতালের জন্য ঔষধপত্র | ও অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামাদির ব্যবস্থা করতে। আমাদের হাসপাতাল যখন তৈরী হচ্ছিল, তখন আহতের সংখ্যাও দিন দিন বেড়েই যাচ্ছিল। ডাক্তারের যথেষ্ট অভাব ছিল। এছাড়াও ঔষধের অভাব ছিল আমাদের প্রকট। কিন্তু তবুও এসব অসুবিধার মধ্যেও আমাদের ছােট হাসপাতালটি আস্তে আস্তে বেশ পূর্ণাঙ্গ হয়ে উঠেছিল। যদিও এগুলি বাঁশ এবং ছনের ঘর ছিল তবুও উৎসর্গিত ছেলেমেয়েদের প্রচেষ্টায় সমস্ত এলাকাটা শান্তিদায়ক হয়ে উঠেছিল। সকালে উঠেই সমস্ত হাসপাতালের বিভিন্ন কাঁচা ওয়ার্ডগুলি তারা নিজ হাতে লেপতাে এবং পরিষ্কার করত। হাসপাতালের । রােগীদের কাপড় ধােয়া থেকে শুরু করে তাদের রান্নাবান্না, সেবা-শুশ্রুষা সবকিছু এরাই করত। এদের সঙ্গে আরাে ২০ জনের মত ছেলেমেয়ে এসে যােগ দেয়। কিছুদিন পর ডাঃ জাফরুল্লাহ ও ডাঃ মবিনের প্রচেষ্টায় এবং লণ্ডন প্রবাসী বাঙালী ডাক্তারদের সহায়তায় আমরা এ হাসপাতালটির জন্য অস্ত্রোপচারের সরঞ্জামাদিসহ ঔষধপত্র প্রভৃতি পেয়ে যাই।
৯ মাসের যুদ্ধে এ হাসপাতালটি কয়েক হাজার। আহতকে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার করতে সক্ষম হয়। এ হাসপাতালটির আর একটি অবদান ছিল যে এটি স্থাপনের পর আমার সেনাবাহিনীর ছেলেদের ও গণবাহিনীর মনােবল আরাে বেড়ে যায়। তারা বুঝতে পারে যদি তারা যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হয় তবে চিকিৎসার অভাবে মারা যাবে না। যুদ্ধকালীন সময়ে প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এটাকে আরাে উন্নত করার জন্য উৎসাহ দেন। সেপ্টেম্বর মাসে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ হাসপাতালটি পরিদর্শন করেন এবং এর ভূয়সী প্রশংসা করেন। ২৯ শে মে রাতে আমাদের একটা পেট্রোল পার্টি কুমিল্লার বাটপাড়ায় এ্যামবুশ পেতে বসে থাকে। শত্রুদের ২টা গাড়ী রাত ২টার সময় এ্যামবুশ-এর ফাঁদে পড়ে। এ্যামবুশ পার্টি সাফল্যের সাথে ২টা গাড়ী ধ্বংস করে দেয় এবং সেই সঙ্গে ৪ জনকে নিহত করে। শত্রুদের পিছনের গাড়ীটি ফাঁদে পড়ার আগেই পালিয়ে যায়। ২৯শে মে রাত ৯টায় ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিনের নেতৃত্বে ২টি সেকসন কসবার পশ্চিমে টি, আলীর বাড়ীতে শত্রুদের অবস্থানের উপর অকস্মাৎ অনুপ্রবেশ করে এবং আক্রমণ চালায়। সঙ্গে সঙ্গে মর্টারের সাহায্যে আড়াইবাড়ী শক্ত অবস্থানের উপর গােলা চালায়। এ আক্রমণে শত্রুদের ১টা বাংকার ধ্বংস হয়ে যায় এবং তিনজন লােক নিহত ও ২জন শক্রসেনা আহত হয়। এরপর আমাদের সৈন্যরা আক্রমণ শেষ করে নিজ অবস্থানে চলে আসে। ৩১শে মে রাত তিনটায় একটা প্লাটুন লেঃ মাহবুবের নেতৃত্বে কুমিল্লার দক্ষিণে। জগমােহনপুর নামক স্থানে শত্রুঘাঁটির উপর অকস্মাৎ আক্রমণ চালায় এবং শক্রসেনাদের ১২জন হতাহত হয়। পাকসেনারা যখন কসবার দিকে তাদের চাপ বাড়ীতে থাকে, আমি ক্যাডেট হুমায়ুন কবিরকে একটা কোম্পানীসহ সবার উত্তরে লাটুমুরায় অবস্থান নেওয়ার নির্দেশ দিই। ৩০শে মে সন্ধ্যা ৭টায় আমাদের ১টি ছােট গেরিলা দল ইকবালের (বাচ্চু) নেতৃত্বে বিবিরবাজারে শত্রুসেনাদের অবস্থানে আঘাত হানার জন্য পাঠান হয়। পাকসেনারা তখন তাদের অবস্থানের উপর বসে তাদের সান্ধ্যভােজনে ব্যস্ত ছিল এবং এ সময়টি সম্বন্ধে আমাদের স্থানীয় লােল্পে দ্বারা খবর আগে থেকেই সহ করা ছিল। পাকসেনারা যখন খাওয়ায় ব্যস্ত ছিল, সেসময় আমাদের গেরিলা দলটি তাদের উপর হঠাৎ গােমতী বাঁধের উপর থেকে গােলাবর্ষণ করে। এতে শত্রুদের ১০ জন হতাহত হয়।
ঐদিনে সাড়ে ৬ টার সময় আমাদের মর্টার প্লাটুন সিঙ্গারবিল শত্রু-অবস্থানের উপর গােলাবর্ষণ করে। এর ফলে শত্রুদের ৬ জন নিহত এবং ৭ জন আহত হয়। ২৯শে মে চৌদ্দগ্রাম বাবুর্চি রােডে হরিসর্দার বাজারের নিকট রাস্তার ব্রীজ সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়। ২৯শে মে বিকাল ৪টায় ৪র্থ বেঙ্গল-এর পাইওনিয়ার পার্টিকে লাকসাম চাঁদপুর রেলওয়ে লাইনে মাইন পুঁতে রেলগাড়ী লাইনচ্যুত করার জন্য পাঠান হয়। এ দলটি মাইন পুতে লাকসাম এবং নােয়াখালীর মাঝে তিনটি রেলওয়ে বগী। সম্পূর্ণ ভাবে বিধ্বস্ত করে দেয়। ফেরার পথে পাইওনিয়ার পার্টির ছােট দলটি চৌদ্দগ্রাম-চট্টগ্রাম সড়কের উপর একটি সদ্য মেরামত করা ব্রীজের উপর মাইন পুতে দেয়। রাত ৮টায় একটি জীপে ৫ জন পাকসেনাসহ ফেনীর দিক থেকে আসে। জীপটি যখন ব্রীজের উপর পৌছে, তখন মাইন বিস্ফোরিত হওয়াতে ব্রীজটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়ে যায়। এর ফলে ১ জন অফিসারসহ তিনজন পাকসেনা নিহত এবং অন্য ২-জন গুরুতরভাবে আহত হয়। ঐদিনই সন্ধ্যায় তিনজন গেরিলাকে হ্যাণ্ড গ্রেনেডসহ চৌদ্দগ্রাম পাঠান হয়। থানার সন্নিকটে দীঘির নিকট শত্রুদের একটি বাংকার ছিল। গেরিলা দলটি গ্রেনেড ছুঁড়ে বাংকারটি ধ্বংস করে দেয়। ফলে ৩জন শত্রুসেনা নিহত হয় এবং কিছু স্থানীয় লােকও আহত হয়। ৩০শে মে চৌদ্দগ্রামের আধ মাইল উত্তরে চৌদ্দগ্রাম-মিয়াবাজার রােডের উপর ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘বি’ কোম্পানীর একটি প্লাটুন হঠাৎ শত্রুদের ২৭ জনের একটি দলকে দুরে থেকে আসতে দেখতে পেয়ে তাড়াতাড়ি এ্যামবুশ পাতে। শত্রুরা যদিও এ • অতর্কিত আক্রমণে হতচকিত হয়ে যায় কিন্তু তারা ত্বরিতগতিতে রাস্তার পশ্চিম পাশে সরে পড়ে। এ্যামবুশের ফলে শুধু তিনজন শক্রসেনা নিহত হয়। আমাদের গেরিলারা লাকসাম-বাংগােড়া কাঁচা রাস্তার উপর ফেলনা গ্রামের নিকট মাইন পুঁতে রাখে। শত্রুদের একটি ৩ টনের গাড়ী এ মাইনের সাথে সংঘর্ষে সম্পূর্ণ বিধ্বস্ত হয়ে যায়। ২৯শে মে ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘ব্রাভাে কোম্পানীর একটা প্লাটুন ২টি ৩ইঞ্চি মর্টারসহ সন্ধ্যায় চৌদ্দগ্রাম থানার উপর মর্টারের সাহায্যে অতর্কিত আক্রমণ চালায়। অতর্কিত মর্টারের গােলার আঘাতে এবং হালকা মেশিনগানের আঘাতে তাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। জুন মাসের ৪ তারিখে রাত দুটোর সময় ৪র্থ বেঙ্গলের ‘এ’ কোম্পানীর ২টা প্লাটুন মর্টার নিয়ে শত্রুদের অবস্থানে গােপন পথে প্রবেশ করে শালদা নদীর দক্ষিণে বাগড়া বাজার নামক স্থানে অবস্থান নেয়। ভােরবেলায় পাকসেনারা যখন তাদের বাংকারের উপর অসতর্কভাবে ঘােরাফেরা করছিল ঠিক সেসময় আমাদের সৈনিকরা তাদের উপর অতর্কিত মর্টার এবং মেশিনগানের সাহায্যে আক্রমণ চালায়।
পাক সেনারা এ অতর্কিত আক্রমণে সম্পূর্ণ হতচকিত হয়ে যায়। আধ ঘন্টা পর্যন্ত তাদরে পক্ষ থেকে কোন পাল্টা জবাব আসে না। এ আক্রমণের ফলে। শক্রদের প্রায় ১৭ জন নিহত ও ৫ জন আহত হয়। আমাদের একজন সৈন্য বুকে গুলি লেগে গুরুত্বভাবে আহত হয়। এ আক্রমণের তিন ঘন্টা পরে শক্ররা যখন ভেবেছিল, আমাদের সৈন্যরা অবস্থান পরিত্যাগ করেছে এবং তাদের আহতদের পিছনে নিয়ে যাবার যখন ব্যবস্থা করছিল, ঠিক সে সময় আমাদের সৈন্যরা আবার। তাদের উপর দ্বিতীয় দফা আক্রমণ চালায়। এতে শত্রুদের আবারও ৫ জন নিহত হয়। এরপর আমাদের পার্টি অবস্থান ত্যাগ করে চলে আসে। ঐদিন সকাল ৭টার সময় আমার আর একটা পার্টি শক্রদের রাজাপুর অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৬ জন শত্রুকে নিহত করে এবং তিনজনকে আহত করে। আমাদের আরেকটি দল রাত ১টার সময় কুমিল্লার দক্ষিণে সুয়াগাজীতে চট্টগ্রামঢাকা মহাসড়কের ১টা সেতু উড়িয়ে দেয় এবং বাগমারার রেলওয়ে সেতু উড়িয়ে দেয়। ৬ই জুন একটি ডেমােলিশন পার্টিকে লাকসামের দক্ষিণে পাঠান হয়। এই দলটি ‘খিলাতে’ লাকসাম- নােয়াখালী মহাসড়কের উপর ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইন পুতে রাখে। সকাল ৫টায় কুমিল্লা থেকে শত্রুর ২টি জীপ ও একটি ট্রাক নােয়াখালী যাবার পথে মাইনের আঘাতে ধ্বংস হযে যায় এবং সে সঙ্গে ৪জন পাক অফিসার এবং ৭ জন সৈন্য নিহত হয়। পাকসেনাদের ২টি কোম্পানী কুমিল্লা থেকে শালদা নদীর উত্তরে আসে এবং রেলওয়ে লাইনের সাথে সাথে নয়নপুর রেলওয়ে স্টেশনের দিকে অগ্রসর হবার চেষ্টা করে। ৪র্থ বেঙ্গল-এর ‘এ’ কোম্পানী শত্রুদের এ | অগ্রগতিকে বাধা দেয় সকাল ৬টায় পাকসেনাদের আর একটি দল কুমিল্লা থেকে একটি ট্রেনে করে নয়নপুর এবং শালদা নদীর দিকে আসছিল। এ ট্রেনটি নয়নপুর ও শিবপুরের দক্ষিণে আমাদের অবস্থানরত সৈন্যদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। আমাদের গােলাগুলির সামনে শত্রুরা টিকতে না পেরে যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতির পর রাজাপুরে পশ্চাদপসরণ করে। এর ৪/৫ ঘন্টা পরে শত্রুরা কামানের গােলার। সহায়তায় আবার নয়নপুর পর্যন্ত অগ্রসর হতে সক্ষম হয়। কিন্তু নয়নপুর স্টেশনে। যখন তারা বাংকার তৈরীতে ব্যস্ত, সে সময় আমাদের মর্টার তাদের উপর ভীষণ গােলাগুলি চালায় এবং শক্রদের যথেষ্ট ক্ষতি করে।
শত্রুরা কিছু পিছু হটে নয়নপুর গ্রামের ভিতর অবস্থান নিয়ে তাদের বাংকার তৈরী করতে শুরু করে। ঐদিনই শত্রুদের একটি পেট্রোল পার্টি কসবার দিকে অগ্রসর হয়, আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানীর একটা প্লাটুন তাদেরকে অতর্কিত এ্যামবুশ করে। পাক সেনারা এ এ্যামবুশ-এর ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় এবং তাদের অন্ততপক্ষে ২০ জন লােক হতাহত হয়। শত্রুদের দলটি আমাদের এ্যামবুশ পার্টির তাড়া খেয়ে তাদের অবস্থান আড়াইবাড়ির দিকে পালিয়ে যায়। আমাদের একটি দল কুমিল্লার দক্ষিণে ধানপুর বি.ও.পির নিকট পাকসেনাদের জন্য এ্যামবুশ পেতে থাকে। সকাল ৯টায় পাকসেনারা দালালদের মারফতে এ খবর পায়। কুমিল্লা থেকে পাকসেনাদের একজন অফিসারসহ ১টা প্লাটুন গ্রামের ভিতর দিয়ে এসে আমাদের এ্যামবুশ পার্টিকে ঘিরে ফেলার চেষ্টা করে। এ্যামবুশ পার্টি তৎক্ষণাৎ কিছু পিছু হটে গিয়ে শক্রদের সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এ যুদ্ধ ঘন্টাখানেক স্থায়ী হয়। ইতিমধ্যে আমাদের ধানপুরের কোম্পানী খবর পেয়ে লেঃ মাহবুব ও লেঃ কবিরের নেতৃত্বে তৎক্ষণাৎ এ্যামবুশ পাৰ্টিটিকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসে এবং তারা পাকসেনাদের দলটিকে ঘিরে ফেলে। পাকসেনারা দুদিক থেকে আক্রান্ত হয়ে গ্রামের ভিতর | লুকিয়ে পড়ে এবং দালালদের সাহায্যে এ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসতে সমর্থ হয়। এ সংঘর্ষে পাকসেনাদের ৫জন সৈন্য নিহত হয়। ঐদিনই বিকেল তিনটায় পচুয়াতে আমাদের আর একটা এ্যামবুশ পার্টির ফাঁদে শত্রুদের একটি দলের ১০জন হতাহত হয়। ৪ও ৫ই জুন রাতে লাকসামদিপুর রেল লাইনের মাঝে মধু রােডস স্টেশনের নিকটে জমজমা রেলওয়ে সেতুটি সুবেদার পাটোয়ারীর একটি দল উড়িয়ে দেয়। ঐদিনই রাতে আর একটি দল চাঁদপুর-কুমিল্লা সড়কের মহামায়া বাজারের নিকটে একটি পুল ধ্বংস করে দেয়। এর দুইদিন পরে চাঁদপুরের বৈদ্যুতিক ট্রান্সফর্মারটি ধ্বংস করে দেয়া হয়। এর ফলে সমস্ত চাঁদপুরের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। কলকারখানাগুলিও বন্ধ হয়ে যায়। পরে শত্রুরা এসে পাশের গ্রামগুলি জ্বালিয়ে দেয় এবং লুটতরাজ ও মেয়েদের। উপর পাশবিক অত্যাচার করে। আমাদের ৪র্থ বেঙ্গলের ‘ডি’ কোম্পানীর একটা প্লাটুন ১১ই জুন সকাল ৬টায় কসবার উত্তরে চার্নল নামক জায়গায় এ্যামবুশ পেতে রাখে। শত্রুদের একটি কোম্পানী দুপুর ১২টার সময় আমাদের এ্যামবুশ-এর মধ্যে পড়ে যায়। আমাদের গুলীতে তাদের ১২জন সৈন্য নিহত হয়। এতে আমাদের একজন আহত হয় এবং পরে মারা যায়। পাকসেনারা পর্যদস্ত হয়ে ঐ জায়গা থেকে ইয়াকুবপুরের দিকে পলায়ন করে। লায়নের পর শত্রুদেরকে আমাদের আর একটি এ্যামবুশ পার্টি দেখে ফেলে এবং তারাও ইয়াকুবপুরের নিকট তাড়াতাড়ি শক্রদের আক্রমণ করার জন্য এ্যামবুশ পাতে। শত্রুরা এ এ্যামবুশ-এর ফাঁদে পড়ে যায় এবং সম্পূর্ণরূপে পরস্ত হয়। এ এ্যামবুশে শত্রুদের ৮জন লােক নিহত এবং ১৩ জন আহত হয়। এ দুটি এ্যামবুশ-এর পর অনেক অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ আমাদের হস্তগত হয় এবং শত্রুরা এ এলাকা থেকে চলে যায়।
এই সময়ে শালদা নদীর দক্ষিণে রেলওয়ে ব্রীজ, কুটির রাস্তায় ‘বাসারা” গ্রামের সেতু মন্দভাগ গ্রামের সেতু সম্পূর্ণভাবে উড়িয়ে দেয়া হয়। আমাদের হেড কোয়ার্টারের এ খবর আসে যে পাকসেনারা তলুয়াপাড়া ফেরী ঘাট তাদের যাতায়াতের জন্য সাধারণত ব্যবহার করে থাকে। এ সংবাদ পেয়ে। আমাদের একটি প্লাটুনকে ৯ই জুন রাত্রে তলুয়াপাড়াতে পাঠান হয়। এ প্লাটুনটি তলুয়াপাড়া ফেরীঘাটের নিকট শত্রুদের জন্য অ্যামবুশ পাতে। ১০ই জুন রাত ১১টার সময় শত্রুদের একটি দল সেই ফেরীঘাটে আসে এবং নৌকাযােগে পার। হতে থাকে। শত্রুরা যখন নদীর মাঝপথে, এ্যামবুশ দলটি সে সময় তাদের উপর গুলী চালাতে শুরু করে। এর ফলে নৌকাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়। পাকসেনাদের ২০ জন লোক হতাহত হয়। আমাদের একটি প্লাটুন লেঃ মাহবুবুর রহমানের নেতৃত্বে ১০ই জুন রাত্রে মিয়ার বাজারের দক্ষিণে রাজারমার দীঘি ও জগমােহানপুর কাচারীর শত্র অবস্থানের উপর অতর্কিত আক্রমণ চালায়। পাকসেনারা এই সাহসী আক্রমণে সম্পূর্ণরূপে হকচকিয়ে যায়। আমাদের সৈন্যরা পাকসেনাদের বাংকারে গ্রেনেড ছুঁড়ে ৮জন পাকসেনাকে নিহত ও ৫জনকে আহত করে। পাকসেনারা বাধ্য হয়ে তাদের অবস্থান পরিত্যাগ করে। এরপর আমাদের সৈন্যরা অবস্থানটি দখল করে বাংকারগুলি ধ্বংস করে দেয় এবং শত্রুদের পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র হস্তগত হয়। আমাদের ৩টি গেরিলা দল কুমিল্লা ও লাকসামে পাঠানাে হয়। ১১ই জুন। কুমিল্লাতে গেরিলা দলটি শত্রুদের বিভিন্ন অবস্থানের উপর দশটি গ্রেনেড ছোঁড়ে। এতে পাকসেনাদের যথেষ্ট ক্ষয়ক্ষতি হয় এবং সমস্ত কুমিল্লা শহর ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। ঐদিনই চারজন গেরিলার ডেমোলিশন পার্টি জাঙ্গালিয়ার নিকট মাইন পুঁতে একটি ডিজেল ইঞ্জিন লাইনচ্যুত করে। লাকসামে যে গেরিলা দলটি পাঠানাে হয়েছিল, তার নেতৃত্বে ছিল আবদুল মান্নান। পাকসেনাদের একটি গাড়ীর উপর গ্রেনেড ছোঁড়ে এবং এতে ৫জন নিহত হয়। এ দলটি লালমাই-এর নিকট পাকসেনারা যে ঘরে থাকত, তার ভিতর ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতেও পাকসেনাদের যথেষ্ট হতাহত হয়। এর ফলে পাকসেনারা লাকসামে ৭২ ঘন্টার জন্য সান্ধ্য আইন জারী করে এবং অনেক নির্দোষ লােকের উপর অত্যাচার চালায়। আর একটি দল লাকসামে পাকসেনাদের উপর গ্রেনেড ছোঁড়ে। এর ফলে কিছু লােক আহত হয়। আমাদের দুটি এ্যামবুশ পার্টি ফুলতুলি এবং মিয়ার বাজারের নিকট ঐদিনই এ্যামবুশ পেতে রাখে। পাকসেনাদের দুটি গাড়ী রাত সাড়ে চারটার সময় ফুলতলিতে এ্যামবুশ-এর মধ্যে পড়ে যায়।
এ্যামবুশ পার্টি একটা গাড়ীকে ধ্বংস করে দেয় এবং একটা গাড়ীর ক্ষতি সাধন করে। শেষের গাড়ীটির ভিতর এ্যামবুশ পার্টি ২টি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে। এতে শত্রুদের ৬ জন লােক নিহত হয়। মিয়ার বাজারের এ্যামবুশেও পাকসেনাদের ৫জন লােক নিহত হয় এবং আমাদের এ্যামবুশ পার্টি একটি মর্টার দখল করে নেয়। আমাদের কাছে সংবাদ আসে যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম জুন মাসে ঢাকাতে আসছে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি সম্বন্ধে সরেজমিনে ঘটনাবলী অবগত হওয়ার জন্য। ইতােমধ্যে পাকিস্তানের প্রচার যন্ত্র সমস্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বুঝাতে চেষ্টা করছিল যে, বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি স্বাভাবিক। এ খবর পাওয়া মাত্র আমি ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমটির অভ্যর্থনার ব্যবস্থা করি। আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক যদি পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য দেয়, তাহলে সেই আর্থিক সাহায্যে। পাকিস্তানের সমরাস্ত্র কেনার ও যুদ্ধ পরিচালনার পক্ষে যথেষ্ট সুবিধে হবে। যে করেই হােক ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিমকে বুঝিয়ে দিতে হবে যে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি মােটেই স্বাভাবিক নয়। বরঞ্চ বাংলাদেশের অধিকাংশ স্থানই পাকবাহিনীর আয়ত্তাধীনে নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে আমি গেরিলার একটি দলকে ঢাকা শহরে বিভিন্ন জায়গায় বিস্ফোরণ ঘটানাে এবং পাকিস্তানীদের নিহত করার জন্য পাঠিয়ে দিই। এই দলটি ৪ঠা জুন ঢাকায় গােপন পথে রওয়ানা হয়ে যায় এবং পরদিন সকালে পৌঁছে যায়। এ দলেরই ২জন ছেলে ৮ই জুন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার সময় জিন্নাহ। এভিনিউ’র কলেজ সু ষ্টোরের সামনে গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটায়। আর একটি গ্রেনেড ছোঁড়ে পুরানা পল্টনে সন্ধ্যে আটটায়। ঐদিনই আর একটি ছােট দল, ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের ভিতর একজন পাকিস্তানী অফিসারের বাড়ীর ভিতরে দুপুর দুটোর সময় গ্রেনেড ছোঁড়ে। এতে কয়েকজন পাকিস্তানী দালাল নিহত হয়। ইতিমধ্যে দলটি খবরাখবর নেয় যে, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে অবস্থান করছে। এ খবর পাবার পর ২জন গেরিলা ৯ই জুন সন্ধ্যা ৮-১৫ মিনিটে হােটেল। ইন্টারকন্টিনেন্টালে প্রবেশ করে এবং ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম-এর হােটেলে ফেরার। প্রতীক্ষায় থাকে। তাঁরা যখন তাঁদের গাড়ীতে করে আসেন এবং গাড়ী নীচে রেখে। | হােটেলের ভিতরে প্রবেশ করেন, সে সময় গেরিলা দলটি গাড়ী লক্ষ্য করে ৩টি গ্রেনেড ছোঁড়ে। এর ফলে গাড়ীটা সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায় এবং নিকটবর্তী ” একজন পাঞ্জাবী সেনাও নিহত হয়। এ সমস্ত ঘটনাবলীতে বিশ্ব ব্যাংক কর্মকর্তাগণ অতি সহজেই বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল হন। ইন্টারকন্টিনেন্টালের বিক্ষোরণের তাঁরা ছিলেন প্রত্যক্ষদর্শী। তাঁরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের (বাংলাদেশের) বর্তমান অবস্থা স্বাভাবিক নয়। এই ঘটনার পর ওয়ার্ল্ড ব্যাংক টিম | দেশে ফিরে গিয়ে তাদের রিপাের্টে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্বন্ধে সঠিক ঘটনাবলী তুলে ধরেন। তাঁরা তাঁদের রিপাের্টে পাকিস্তানকে আর্থিক সাহায্য না দেয়ার সুপারিশ করেন। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এটা ছিল পাকিস্তানের পক্ষে এক বিরাট পরাজয়।
১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক–লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের
লেঃ কর্ণেল (অবঃ) আবু তাহের। ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধে ময়মনসিংহ ও টাঙ্গাইল জেলা এবং যমুনা নদীর তুন্তীরাঞ্চল নিয়ে। গঠিত ১১ নং সেক্টরের অধিনায়ক ছিলেন পাকিস্তান সেনা বাহিনীর স্পেশাল সার্ভিস গ্রুপের অফিসার মেজর আবু তাহের। পশ্চিম পাকিস্তানের কোয়েটা থেকে পালিয়ে তিনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেন। ১৯৭০ সাল থেকে কোয়েটার স্কুল অব ইনফ্যান্ট্র অ্যান্ড ট্যাকটিক-এ উচ্চতর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করছিলেন তিনি। প্রথমে কাশ্মীরের পাহাড় অঞ্চল দিয়ে পালানাের ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর পাকিস্তানের শিয়ালকোর্ট এলাকা দিয়ে মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর মঞ্জুর ও অন্য দু’জন বাঙালীসহ জুলাই মাসে ভারতে পালিয়ে আসেন তিনি। তারপর আগষ্ট মাসে ১১ নং সেক্টরের ভৌগলিক অবস্থান নির্ধারণ করে সেখানে যুদ্ধ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ‘৭১ সালে ১৪ নভেম্বর কামালপুর যুদ্ধে শত্রুপক্ষের শেলের আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন তিনি। পরবর্তী সময়ে ১১ নং সেক্টরের কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট হামিদুল্লাহ খান। আবু তাহেরের জন্ম ১৯৩৮ সালের ১৪ নভেম্বর। ১৯৬০ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করেন তিনি। ১৯৬৫ তে যােগ দেন স্পেশাল কমাণ্ডে। সার্ভিসে। যুদ্ধের পর ‘৭২ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ কমাণ্ড থেকে সরিয়ে আর্থিক লাভজনক উচ্চপদে প্রমােশন দেয়া হলে, তা গ্রহণ না করে সেনাবাহিনী থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। সেসময় নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাসদের সহ-সভাপতি পদ গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৭৫ সালের ৭ নবেম্বর সংঘটিত সিপাহী জনতার অ্যুত্থানের প্রধান ব্যক্তি ছিলেন আবু তাহের। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই ডাের রাছে এক ষড়যন্ত্রমূলক মিথ্যা মামলার অজুহাতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ফাঁসী দেয়া হয় তাকে। নিচের লেখাটি কর্নেল তাহেরের সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে রচিত। নেয়া হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র থেকে জুলাই মাসের ২৫ তারিখে বাংলাদেশের পথে ভারতে রওনা হই। আমার সঙ্গে মেজর জিয়াউদ্দিন, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, মেজর মঞ্জুর ও তার স্ত্রী-ছেলেমেয়ে এবং * ব্যাটম্যান রওনা হন। পথে নানা বাধাবিপত্তি অতিক্রম করে আমরা ২৭ শে জুলাই দিল্লী এবং আগস্ট মাসের প্রথম সপ্তাহে মুজিবনগর পৌছাই। আগস্ট মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল এম. এ. জি. ওসমানী মেঘালয় ও তৎসংলগ্ন এলাকায় সরেজমিনে যুদ্ধের অবস্থা অবলােকনের জন্য পাঠালেন। পাকিস্তান থেকে আমরা যারা পালিয়ে এলাম তাদের মধ্যে মেজর। জিয়াউদ্দিনকে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের, মেজর মঞ্জুরকে ৮নং সেক্টরের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে ১ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানীর এবং আমাকে ১১নং সেক্টরের পরিচালনার ভার দেওয়া হয়। সেনাবাহিনী প্রধানের নির্দেশে আমি আগস্টের ১২ তারিখে মেঘালয় এসে পৌছাই। এই এলাকার মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা ভারতীয় বাহিনীর কমাণ্ডে ইতিপূর্বেই যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছিলাে। কামালপুর ছিল পাকিস্তানী সেনাদের মস্ত ঘাঁটি। সিদ্ধান্ত নিলাম কামালপুর আক্রমণের।
১৫ই আগষ্ট আমি নিজে মাত্র ১৫০ জন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে সন্ধ্যার দিকে কামালপুর পাক ঘাঁটি আক্রমণ করি। আমাদের অন্ত্র বলতে ছিল এলএমজি, রাইফেল এবং কিছু স্টেনগান। আমাদের আক্রমণ দু’ঘন্টা স্থায়ী হয়। আমাদের আক্রমণে ১৫/১৬ জন পাকিস্তানী নিহত হয়। অপরদিকে মুক্তিযােদ্ধা আহত হলাে ১৫ জন। আমার আক্রমণের পূর্বে এই এলাকা কোন সেক্টরের আওতায় ছিল না। আমি সেনাবাহিনীর সদর দফতরে এই এলাকাকে একটি সেক্টরে পারিণত করার আবেদন করলে আবেদন মঞ্জুর হয়। আমার সেক্টরের নাম হলাে ১১নং সেক্টর। কমাও আমাকেই দেয়া হলাে। ময়মনসিংহ এবং টাংগাইল জেলা নিয়ে আমার সেক্টর গঠিত হয়। সেক্টরের দায়িত্ব নেবার পর সমগ্র এলাকাকে কয়েকটি সাব-সেক্টরে বিভক্ত করি। সাবসেক্টরগুলাে হলােঃ (১) মাকার চর (২) মহেন্দ্রগঞ্জ (৩) পুরাকাশিয়া (৪) ভালু (৫) বাগমারা (৬) শিববাড়ি (৭) রংডা এবং (৮) মহেশখালী। সমগ্র এলাকাতে অফিসারের তীব্র অভাব অনুভব করলাম। সেপ্টেম্বর মাসে। আমাকে দু’ জন অফিসার দেয়া হলাে-(১) স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ এবং (২) লেঃ মান্নান। এই সময় মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর ব্রিগেড নিয়ে সিলেট। এলাকাতে চলে যান। অফিসার দু’জনকে আমি দুটি সাব-সেক্টরের দায়িত্ব। দিলাম। মানকার চর সাব-সেকরের দায়িত্ব দিলাম স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহকে এবং মহেন্দ্রগঞ্জ সাব-সেক্টরের দায়িত্ব দিলাম লেঃ মান্নানকে। সেক্টরের দায়িত্ব নেবার পরপরই প্রাথমিক পর্যায়ে মানকার চর থেকে ডালু। পর্যন্ত সরাসরি আমার নিয়ন্ত্রণে নিয়ে আসি। অবশিষ্ট এলাকা ভারতীয় বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহের কমাতে থাকে। ব্রিগেডিয়ার সান্ত সিংহের হেডকোয়ার্টার ছিল তুরাতে। ট্রেনিং ক্যাম্পের প্রধানও ছিলেন তিনি। সেক্টরে এসে লক্ষ্য করলাম মুক্তিযােদ্ধারা বিভিন্ন পাক পয়েন্টে বি-এস-এফ বাহিনীর নির্দেশে সরাসরি আক্রমণ পরিচালনা করছে। দ্বিতীয়তঃ, বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মুসলিম লীগ এবং অন্যান্যদের হত্যা করে পয়সাকড়ি আদায় করছে। তৃতীয়ত বাহিনী বিশৃঙ্খল, বিপর্যস্ত। মুক্তিবাহিনীকে পুরাপুরি বাহিনী হিসাবে গড়ে তোলার জন্য এবং দীর্ঘস্থায়ী, সংগ্রামের জন্য বাহিনীকে পুনর্গঠিত করতে শুরু করলাম।
সম্মুখসমর বাদ দিয়ে গেরিলা পদ্ধতিতে আক্রমণ চালাবার নির্দেশ দিলাম। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে হত্যা না করে বন্দী করে নিয়ে আসা এবং মুক্তিবাহিনীর বিএসএফ ক্যাম্পে গমন নিষিদ্ধ ঘােষণা করলাম। এবং যুদ্ধনীতির সাথে সাথে ছেলেদেরকে রাজনীতি-সচেতন করে তুলতে শুরু করলাম।| সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আমার সেক্টরে প্রায় বিশ হাজারের মত মুক্তিযােদ্ধা কাজ করছিল। সর্বমােট বাহিনীর মধ্যে তিন হাজার নিয়মিত এবং ১৭ হাজারের মত। যুদ্ধক্ষেত্রে আমি নিয়মিত ও গণবাহিনীকে একত্রে অপারেশনে পাঠিয়েছি। অপারেশনের দৃষ্টিকোণ থেকে আমি মনে করি নিয়মিত এবং গণবাহিনীকে পৃথক, করে ফিল্ড অপারেশনে পাঠানাে ঠিক নয়। যারা দিনের প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত ছিল। তাদেরকে পৃথকভাবে ফিল্ডে পাঠালে, নিয়মিত বাহিনীর সঙ্গে থাকলে যে অভিজ্ঞতা তারা লাভ করতাে সে অভিজ্ঞতা থেকে তারা বঞ্চিত হচ্ছিলো। আমি ঐ সব কারণে একটিমাত্র ফোর্স করলাম। আমি আরও সিদ্ধান্ত নিলাম, নিয়মিত বাহিনী পুরােপুরি গড়ে না ওঠা পর্যন্ত গেরিলা পদ্ধতিতেই যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার। সামরিক দিক থেকে ময়মনসিংহের চেয়ে টাঙ্গাইল, অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ছিল। তাই ময়মনসিংহ রেখে টাঙ্গাইল-জামালপুর হয়ে ঢাকা পৌছানাে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। মনে করলাম। রংপুর এবং বগুড়া ৭নং সেক্টরের অধীনে থাকলেও যােগাযোগের সুবিধার জন্য ঐ সেক্টরের অনেক অপারেশন আমার মাধ্যমেই হয়েছে। আগস্ট মাসেই টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী আমার সঙ্গে যােগাযােগ করেন এবং আমার সেক্টরের অধীনে , আমার কমাণ্ডে থাকেন। ময়মনসিংহের ভালুকা এলাকাতে। অবসরপ্রাপ্ত সৈনিক মেজর আফসার মুক্তিবাহিনীর একটি ব্রিগেড গঠন করে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থেকেই অপারেশন চালাতে থাকেন। মেজর আফসারের দেশপ্রেম, সাহস ও কর্মনিষ্ঠা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণযােগ্য। সেপ্টেম্বর মাসেই ভারতীয় বাহিনীর ৯২ মাউন্টেন ব্রিগেড আমার সাহায্যে আসে। ব্রিগেডের কমাণ্ডার ছিলেন ব্রিগেডিয়ার ক্লেয়ার। এই ব্রিগেডে তিনটি ইনফ্যানটি এবং ২টি . আর্টিলারি রেজিমেন্ট ছিল।
এই বাহিনীতে কর্নেল শ্রোডি একটি ব্যাটালিয়ন কমাও করতেন। এই ব্রিগেডটি ‘আসায় আমার এবং আমার বাহিনীর সাহস, উদ্দীপনা ব্যাপকভাবে। বেড়ে যায়। ভারতীয় অফিসারবৃন্দের সাহস, কর্মতৎপরতা এবং অমায়িক ব্যবহার। আমাকে মুগ্ধ করে। আমার আওতায় রৌমারী থানা বরাবরের জন্য মুক্ত ছিল। এখানে একটি মুক্তিবাহিনীর ট্রেনিং ক্যাম্প খুলি এবং ট্রেনিং দেওয়া শুরু করি। নভেম্বর মাস পর্যন্ত সকলের হাতে অস্ত্র দেওয়া না গেলেও দশ হাজারের মত মুক্তিযােদ্ধা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত হয়েছিল। এই থানাতে প্রশাসন ব্যবস্থা পুরােপুরি চালু হওয়ারও নির্দেশ দিয়েছিলাম। কিন্তু রাজনৈতিক নেতৃবর্গের কাদা ছোড়াছুড়ির ফলে পূর্ণ প্রশাসন ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়নি। | মেজর জিয়াউর রহমান তাঁর ব্রিগেড নিয়ে চলে গেলে রৌমারী থানাকে মুক্ত রাখা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ছিল। কারণ, পাক ঘাঁটি চিলমারী থেকে পাকিস্তানীরা যে কোন সময় এসে রৌমারীর উপর হামলা চালাতে পারে। আর তাই চিলমারী শত্রুমুক্ত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলাম। | সেপ্টেম্বর মাসের শেষের দিকে প্রায় দুই ব্যাটালিয়ন মুক্তিযােদ্ধা এবং ভারতীয় মাউন্টেন ব্রিগেডের একটি সেকশন সঙ্গে নিয়ে অতর্কিতে চিলমারী আক্রমণ করলাম। এখানে পাকিস্তানীদের দুটি কোম্পানী ছিল-একটি বেলুচ রেজিমেন্টের, অপরটি মিলিশিয়া বাহিনীর। ব্যাপকভাবে উভয় পক্ষের সংঘর্ষে উভয় পক্ষের বেশ ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর ৪ জন নিহত এবং বেশকিছু আহত হয়। পাকিস্তানীদের ১০০ জন নিহত হয়। বিশাল ব্রহ্মপুত্রের অপর তীরে অবস্থিত চিলমারীর দুর্ভেদ্য শক্রব্যুহে এক প্রচণ্ড হানা দিয়ে আমরা শত্রুর বিপুল ক্ষতিসাধন করি। এই আক্রমণকে মুক্তিবাহিনীর মূল আক্রমণ ভেবে সে এলাকায় বৃহৎ আকারের শত্রু সমাবেশ ঘটে। এ ধরনের আক্রমণ শুধুমাত্র দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালীন মিত্রবাহিনীর ইংলিশ চ্যানেল অতিক্রমণের কয়েকটি ঘটনার সঙ্গে তুলনীয়। এক্ষেত্রে সুশিক্ষিত কয়েক ডিভিশন ছত্রীসেনা এবং স্পেশাল ফোর্স অংশ গ্রহণ করেছিলেন। সে যুদ্ধের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নে কয়েক ডজন জেনারেল অংশ গ্রহণ করেছিলেন। | যুদ্ধের ইতিহাসে চিলমারী বন্দর আক্রমণ একটি উচ্ছল ঘটনা। এই যুদ্ধ। বাংলার সােনার ছেলেদের নিয়ে গঠিত আমার সেক্টরের প্রাইভেট আর্মি দ্বারা। সংঘটিত হয়। রৌমারীর মুক্তাঞ্চলে মাত্র ১৫ দিনের অনুশীলনপ্রাপ্ত এ সমস্ত ছেলেদের নিয়মিত খাবারের সরবরাহ ছিল না, হাতখরচ ব্যবস্থা ছিল না এবং শুধুমাত্র দখলীকৃত অস্ত্রের উপরই তাদের নির্ভর করতে হতাে।
কোন অনুমােদিত টেনিং ক্যাম্পে অনুশীলনপ্রাপ্ত না হওয়ায় এসমস্ত মুক্তিযােদ্ধারা সেক্টর কমাণ্ডারের। প্রাইভেট আর্মি হিসেবে পরিচিত ছিল। তাদের চিলমারী আক্রমণ পরিকল্পনায় দক্ষতা এবং সাহস ও নৈপূণ্যের সাথে তার বাস্তবায়নের বিষয় যুদ্ধবিদ্যার ছাত্রদের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। ১১ নং সেক্টরের সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে যখন আমি দায়িত্ব গ্রহণ করি তখন বেশ অনেকগুলাে চরের সমন্বয়ে গঠিত বিশাল রেীমারী এলাকা মুক্ত ছিল। এর প্রতিরক্ষা আমাদের জন্য একটা চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছিলো, কারণ মুজিব নগর থেকে অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারকে আমরা সেখানে প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলাম। মেজর জিয়ার (বর্তমানে মেজর জেনারেল) ব্রিগেডের দুটো বেঙ্গল রেজিমেট এই মুক্তাঞ্চল প্রতিরক্ষার কাজে নিয়ােজিত ছিল। শুধুমাত্র কোদালকাঠি চর ছাড়া ব্রহ্মপুত্রের পূর্বপারের সকল এলাকা মুক্ত ছিল। কোদালকাঠিতে শত্রুসৈন্যের অবস্থান স্থানীয় গ্রামবাসীদের জন্য ত্রাসের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলাে। এ সকল শত্রুসৈন্য প্রায়ই পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলােতে ঢুকে পড়ে গ্রামবাসীদের উপর অত্যাচার চালাতাে। ব্রহ্মপুত্রের পূর্বাঞ্চলকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করার জন্য সুবেদার আফতাবের নেতৃত্বে দুই কোম্পানী মুক্তিযােদ্ধা সেপ্টেম্বরের প্রথম দিকের এক রাতে গােপনে কোদালকাঠিতে অনুপ্রবেশ করে এবং শক্রব্যুহের মাত্র কয়েকশত গজ দূরবর্তী ঝাউবনে টেঞ্চ খনন করে তাতে অবস্থান করতে থাকে। মুক্তিযােদ্ধাদের পরিখাগুলাের সামনেই শক্রনিধনের উপযােগী বিস্তৃত খােলা জায়গা ছিল। আমাদের কৌশলের মূল উদ্দেশ্য ছিল, এই মুক্তিযােদ্ধাদের পরিখাগুলােতে উপস্থিতি টের পেয়ে যখন শত্রুসৈন্য তাদেরকে উৎখাত করার জন্য আক্রমণ চালাবে, তখন আক্রমণােদ্যত শত্রুসেনাদেরকে খােলা জায়গায় পেয়ে আমরা তাদের নিশ্চিহ্ন করবাে। পরের দিন ভােরে আমাদের প্রত্যাশা অনুযায়ী শত্রুর প্রচণ্ড আক্রমণ ঘটে এবং তা তড়িৎগতিতে প্রতিহত করা হয়। শীঘ্রই সেনাবাহিনীর দ্বিতীয় এবং তারপর। তৃতীয় আক্রমণ ঘটে- সেগুলােও সাহসের সংগে মােকাবেলা করা হয়। নিধন এলাকা শত্রুসৈন্যের মৃতদেহে ভরে ওঠে। যে ক’জন শত্রুসৈন্য পরিখা পর্যন্ত এগুতে পেরেছিলাে তাদের বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করা হয়। আমাদের অবস্থানের দু’প্রান্তে স্থাপিত মেশিনগান দুটি সেদিন আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেনি। মেশিনগান দুটির আড়াআড়ি গুলিবর্ষণে বেশির ভাগ শত্রুসৈন্য মারা পড়েছিলাে। তৃতীয় আক্রমণ প্রতিহত করার পর মুক্তিযােদ্ধারা তাদের পরিখা থেকে বেরিয়ে আসে এবং শত্রুদের উপর মরণ আঘাত হানার জন্য এগিয়ে যায়। খুব অল্পসংখ্যক শত্রুসৈন্যই অপেক্ষমাণ গানবােটে পালিয়ে যেতে। সক্ষম হয়। কোদালকাঠি আমাদের হস্তগত হলাে।
গ্রামবাসীদের মধ্যে দারুণ উল্লাসের | সৃষ্টি হয় এবং মুক্তিযােদ্ধাদের বীরত্ব এবং দক্ষতার উপর তাদের আস্থা বহুলাংশে বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ পরই বলবাড়ি স্টেশনের অবস্থান থেকে শত্রুসৈন্যরা আমাদের উপর গুলি চালালো। আমরা পিছু হট পুলিশ স্টেশনে অবস্থান নিলাম। সেখানে পাকিস্তানীদের তৈরী পরিখার অভাব ছিল না। দখল করা অস্ত্র এবং গােলাবারুদ গাজীরচরে পাঠানো হলাে। একটি ঘরে আমি দশ বস্তা চাল ও দুই বস্তা গম পেলাম। চেয়েছিলাম এগুলাে গ্রামবাসীরা নিয়ে যাক, কিন্তু নেয়ার মত কেউ সেখানে ছিল না। বেশ কিছুক্ষণ পর আমি একজন বুড়াে লােককে পেলাম। আমি তাকে দরকার থাকলে কিছু চাল নিতে বললাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চারদিকে থেকে লােকজন আসতে লাগলাে। মনে হচ্ছিলাে তারা যেন মাটি ফুড়ে বের হচ্ছে। হট্টগােল শুরু হয়ে গেলাে। ছেলে, বুড়ো, পুরুষ, মেয়েলােক সবাই কাড়াকাড়ি করছে যা পাচ্ছে তুলে নেয়ার জন্য। কয়েক মিনিটের মধ্যেই থানা ও থানার পাশের পুলিশের বাসাগুলো খালি হয়ে গেলো। সে দৃশ্য ভােলার নয়। রাতের অন্ধকার নেমে আসার সাথে সাথে আমি কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা রেখে | প্রধান দলটি নিয়ে গাজীরচরে চলে এলাম। কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা রেখে আসার উদ্দেশ্য ছিলাে যাতে পাকিস্তানীরা আমাদের পিছু নিতে না পারে। যদিও আমরা ওয়াপদা ভবনের বাংকারগুলাে এবং বলবাড়ি রেলওয়ে স্টেশনের অবস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস করতে পারিনি, তবুও পাকিস্তানী সেনাবাহিনী দারুণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। অতি নিকট থেকে সম্পূর্ণভাবে ঘেরাও হয়েও শত্রুসৈন্যরা আত্মসমর্পণ করেনি। সত্যিই তারা বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করছিলাে। আমরা জানতাম আমাদের চলে আসার পর ঐ এলাকার জনসাধারণের উপর পাকিস্তানীরা কি ভয়াবহ অত্যাচার চালাবে। কিন্তু আমাদের উপায় ছিল না। পেছনে ব্রহ্মপুত্র নদীর বিরাট বাধা নিয়ে দখল করা অবস্থান আকড়ে থাকা সম্ভব ছিলাে না। এই আক্রমণের উদ্দেশ্যই ছিলাে শত্রুকে অকস্মাৎ আঘাত হানা, যত বেশী সম্ভব শত্রুসেন খতম। করা, তাদের মনােবল ভেঙ্গে দেওয়া, অস্ত্র ও গােলাবারুদ দখল করা। আমরা সম্পূর্ণ সফল হয়েছিলাম। আমরা চলে আসার দু’দিন পর পাকিস্তানীরা ঐ এলাকার নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর নির্মম অত্যাচার চালায়। নিরস্ত্র জাতি এমনিভাবে অত্যাচার সহ্য করেই বাংলার স্বাধীনতা এনেছে। | ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লার নেতৃত্বে যােগাযােগ বিচ্ছিন্নকারী দলটি অভূতপূর্ব সাফল্যের সাথে তাদের কাজ সম্পন্ন করে। তারা শুধু সড়ক এবং রেলপথের ব্রীজগুলাে ভেঙ্গে দিয়েই ক্ষান্ত হয়নি, জায়গায় জায়গায় রেলওয়ে লাইন এবং রাস্তা কেটে তারা সমান করে দেয়। বেশ কিছুদিনের জন্য এই যোগাযােগ। ব্যবস্থা পাকিস্তানীরা ব্যবহার করতে পারেনি। ১৩ই অক্টোবর। বিপুল সংখ্যক যুদ্ধবন্দী এবং প্রচুর অস্ত্র, গােলাবারুদ নিয়ে আমরা রৌমারী ফিরে এলাম। জনগণের আদালতে ওয়ালী মাহমুদ ও পাচু মিয়ার বিচার হলাে।
দেশপ্রেমিক হত্যা, রাজাকার বাহিনী সংগঠন এবং লুণ্ঠনের অপরাধে তারা দোষী সাব্যস্ত হয় এবং তাদের মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হলাে। বহু সংখ্যক বাঙ্গালী রাজাকার মুক্তিযুদ্ধে যােগদান করে। ওয়ারেন্ট অফিসার সফিকউল্লাহ, নায়েব সুবেদার মান্নান, চাঁদ, দুলু, আলাে, সুলেমান, নজরুল এবং আরাে অনেকের বীরত্ব এবং ত্যাগের কথা কোনদিনই ভােলা যাবে না। এরাই বাংলার সােনার ছেলে। পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে ১১ নং সেক্টরের দায়িত্ব নিয়ে একটা জিনিস দেখে বার বার অবাক হয়েছি। দেখেছি প্রত্যয় আর দৃঢ়তায় সকালের সূর্যের মত। হাজার হাজার তরুণ মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার জন্য নির্বাচিত না হতে পেরে অতৃপ্তির ব্যথা নিয়ে ফিরে গেছে, তারপর যুব শিবিরে অপেক্ষা করেছে দিনের পর দিন, কখন জীবন দেবার ডাক আসে। মহেন্দ্রগঞ্জ, মাইনকারচর, ডালু ও অন্যান্য সীমান্ত এলাকায় ওরা আমাকে ঘিরে ধরেছে। সবারই এক প্রশ্ন, আর কতদিন অপেক্ষা করবাে? একজন সৈনিক হিসেবে আমি বুঝতে পারি কখন মানুষ ভয়াবহ যুদ্ধকে সহজভাবে গ্রহণ করতে পারে। রিক্রুটিং সেন্টারে লাইন দেখে আমি বুঝেছি এ যােদ্ধারা জয়ী হবেই। কারণ পৃথিবীতে এমন স্বতঃস্ফুর্তভাবে যুদ্ধে যােগ দেয়ার দৃষ্টান্ত আর নেই। গণচীন থেকে শুরু করে ইন্দোচীনের স্বাধীনতা যুদ্ধ, কোনটাই বাংলাদেশের মুক্তিযােদ্ধাদের মত এ দৃষ্টান্ত রাখতে পরেনি। চীন, ভিয়েতনাম, কিউবাতে মুক্তিযুদ্ধ সগঠিত হয়েছে, ব্যাপক রাজনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতির সংগে। সম্পূর্ণরূপে রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্ব ছাড়া বাংলার তরুণরা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, যুদ্ধক্ষেত্রে শৌর্য ও আত্মত্যাগের পরিচয় দিয়েছে তার দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোন মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নেই।
মুক্তিযােদ্ধারা এই ইতিহাস সৃষ্টি করেছে। অন্য কেউ নয়। যদি কোন দল বা গােষ্ঠী এককভাবে মুক্তিযােদ্ধা তথা । জনগণের এই বিজয়কে নিজের বলে মনে করে তা হবে অবৈধ, মিথ্যা। পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক শক্তির শােষণ এত তীব্র ছিল যে বাঙ্গালী জাতির জাতীয়তা- বােধ মুক্তিযুদ্ধের প্রধান কারণ হবার প্রখরতা অর্জন করেছিল। জাতীয় শােষণ থেকে মুক্তি পাবার তীব্র আকাঙ্খ এদেশের জনগণ তথা তরুণ সমাজকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার শক্তি যুগিয়েছে। এ কৃতিত্ব জনগণের আর জনগণের যােদ্ধা তরুণ সম্প্রদায়ের নিজ। আগস্ট মাসে ১১নং সেক্টরের কার্যভার গ্রহণ করার পর পাকিস্তানীদের ঘাঁটির উপর আমি কয়েকটি আক্রমণ পরিচালনা করি। এই আক্রমণগুলাে চালাবার ফলে পাকিস্তানী রণনীতি সম্বন্ধে আমাদের একটি সুস্পষ্ট ধারণা জমে এবং সংগে সংগে মুক্তিদ্ধাদের দোষগুণগুলােও প্রকাশ পায়। পাকিস্তানীরা সে সময় মুক্তিযােদ্ধাদের সম্ভাব্য প্রবেশপথগুলাে বন্ধ করার জন্য সীমান্তে শক্তিশালী ঘাঁটি গড়ে তােলে। এই ঘাঁটিগুলােকে সুরক্ষিত করার জন্য তারা ব্যাপকভাবে কাঁটাতারের বেড়া ও মাইন ব্যবহার করে। ঘাঁটিগুলাের ভেতর মজবুত বাংকার তৈরী করা হয়, যা তাদেরকে কামানের গােলা থেকেও বাঁচাতে পারে। ঘাঁটিগুলােতে নিয়মিত পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী ছাড়াও বেশ কিছু সংখ্যক রাজাকার ও আলবদর রাখা হয়। সীমান্তবর্তী এই সুরক্ষিত ঘাঁটিগুলাে ছাড়াও সড়ক ও যােগাযােগ কেন্দ্রগুলােকে রক্ষা করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে। বিভিন্নস্থানে পাকিস্তানী ঘাঁটি গড়ে ওঠে। দেশের অভ্যন্তরে গড়ে ওঠা ঘাঁটিগুলাে ছিলৈ অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত। | কামালপুর ছিল উত্তর সীমান্তে পাকিস্তানীদের একটি সুরক্ষিত ঘাটি। আগষ্ট মাসের মাঝামাঝি এই ঘাঁটির উপর আমরা দু’বার প্রত্যক্ষ আক্রমণ চালাই। দু’বারই মুক্তিযােদ্ধারা ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়, তথাপি তারা। ঘাঁটিটি দখল করতে ব্যর্থ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা যখনই ঘাঁটিতে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে সে সময়ই তাদের উপর পাকিস্তানীদের ব ক ১২০ মিলিমিটার মর্টারের গােলা বর্ষিত হয়েছে। বকশীগঞ্জের পাকিস্তানী অবস্থান থেকে এই মর্টারের গােলা ছোঁড়া হতাে। শত্রুসেনারা মজবুত বাংকারের ভেতরে থাকত বলে এই আক্রমণে তাদের কোন ক্ষতি হত না। এবং অবস্থা বেগতিক দেখলেই তারা নিজ অবস্থানের উপর নিজ মর্টার দ্বারা গােলাবর্ষণ করাতে। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধে পাকিস্তানীরা এই রণনীতির কথা চিন্তা করে এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তা ব্যাপকভাবে কাজে লাগায়। কামালপুর ঘাঁটির উপর এই দু’টি আক্রমণ চালিয়ে আমি মুক্তিযােদ্ধাদের দোষগুলােকে সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করি। আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের দুর্বলতম দিক ছিলাে-রাজনৈতিক ও সামরিক নেতৃত্বের অভাব। যে ওয়াজনৈতিক নেতৃত্ব মুক্তিযােদ্ধাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রয়ােজনীয়তা ও তার মূল লক্ষ্য অ’ * সাহচর্যের মাধ্যমে শিক্ষা দেয় তা কোন সময়ই ছিল না। রাজনৈতিক নেতৃত্বের অভাবে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করে কিভাবে গণসংযােগ করতে হয় তা মুক্তিযােদ্ধারা জানত না। এ জন্য অনেক ক্ষেত্রে দেখা গেছে, মুক্তিযােদ্ধাদের আচরণে তারা জনসমর্থন হারিয়েছে।
দ্বিতীয়তঃ সামরিক নেতৃত্বের দুর্বলতা। কয়েক সপ্তাহের টেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধাদের মধ্য থেকে একজনকে নির্বাচিত করা হতাে নেতা। প্রায় ক্ষেত্রেই সামরিক জ্ঞানের অভাবে সংকট মুহুর্তে সে নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হতাে। অবশ্য এই অল্প সময়ে সামরিক নেতৃত্ব সৃষ্টি করা। সম্ভবপরও ছিলাে না। এই দু’টি প্রধান দুর্বলতা ছাড়াও মুক্তিযােদ্ধারা সে সময়ে, সরবরাহ ও অস্ত্রের দিক থেকে প্রত্যক্ষ আক্রমণের ভূমিকা গ্রহণের উপযুক্ত হ” ওঠেনি। আগষ্ট মাসের শেষের দিকে ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের আমি নির্দেশ দিই “শত্রুর শক্তিশালী ঘাঁটি আক্রমণ থেকে বিরত থাকে। শত্রুকে কৌশলে প্রলুব্ধ করে তার শক্তিশালী ঘাঁটি থেকে নির্ধারিত স্থানে বের করে আনাে এবং হত্যা করে।” ৭ এবং ১০ই সেপ্টেম্বরের অভিযানগুলাে সুরক্ষিত কামালপুর ঘাঁটি থেকে শত্রু সৈন্যদের কৌশলে প্রলুব্ধ করে নির্ধারিত স্থানে বের করে এনে হত্যা করার সুন্দর উদাহরণ। এই অভিযানগুলাে ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযােদ্ধাদের বহুদিন মনে থাকবে। গেরিলা যুদ্ধের ছাত্রদের জন্যেও এগুলো মূল্যবান শিক্ষণীয় বিষয় হয়ে থাকবে। কামালপুর শত্রুঘাঁটি থেকে ৫০০ গজ পশ্চিমে ধানুয়া কামালপুর গ্রাম, দক্ষিণপশ্চিম ও দক্ষিণে ঘাসীরগ্রাম ও উঠানের পাড়া। ধানুয়া কামালপুর, ঘাসীরগ্রাম, আর উঠানের পাড় এই গ্রামের সারি এবং কামালপুরের মাঝে বিস্তীর্ণ জলেমাঠ। শত্রুকে এই জলােমাঠে বের করে আনতে হবে। এই জলােমাঠই হবে তাদের মরণফাঁদ। এই উদ্দেশ্য সম্মুখে রেখে আমি ধানুয়া কামালপুর এবং ঘাসীরগ্রামে। একটি নকল রক্ষাব্যুহ রচনা করি। মুক্তিযােদ্ধা মাহফুজকে এই রক্ষাব্যুহ গড়ে তােলার ভার দেয়া হয়। (বীর মুক্তিযােদ্ধা মাহফুজ পরবর্তীকালে একটি অভিযান পরিচালনা করতে গিয়ে শহীদ হন। মাহফুজ রাতের অন্ধকারে গ্রামবাসীদের। সহায়তায় বাংকার ও ট্রেঞ্চ তৈরী করে ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীরগ্রামে আশ্রয় নেয়। কামালপুর থেকে সােজা দক্ষিণে চলে গেছে গুরুত্বপূর্ণ সড়ক, বকশিগঞ্জ জামালপুর-টাংগাইল সড়ক। ঢাকা দখলের জন্য সর্বাত্মক আক্রমণে এই সড়কটির গুরুত্ব অপরিসীম। পাকিস্তানীরা এই সড়কের গুরুত্ব উপলব্ধি করতাে এবং সেজন্য তারা সড়কটির পাশে বিভিন্ন স্থানে মজবুত ঘাঁটি স্থাপন করেছিলাে। এই সড়ক। ধরেই ১৬ই ডিসেম্বর ১১ নং সেক্টরের বীর মুক্তিযােদ্ধারা সর্বপ্রথম ঢাকা প্রবেশ করে। কামালপুরের শত্রুঘাটিকে তার যােগাযােগ ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন করতে হবে। নকল রক্ষাব্যুহ থেকে কামালপুর ও বকশিগঞ্জের মাঝের সড়কটিতে মুক্তিযােদ্ধারা অনেক এন্টি-ট্যাংক মাইন স্থাপন করে। এই মাইন বিস্ফোরণে পাকিস্তানীদের ব্যাপক ক্ষতি হয়। আগস্ট মাসের শেষের দিকেই পাকিস্তানীদের নয়টি সরবরাহ ও সৈন্য বােঝাই ট্রাক এতে ধ্বংস হয়। ৬ই সেপ্টেম্বর বিকাল বেলা ধানুয়া কামালপুর রক্ষাবহে গিয়ে মুক্তিবাহিনীর একটি দলকে উঠানেরপাড়ার কাছে কামালপুর – বকশিগঞ্জ সড়কের উপর এ্যামবুশ নেবার নির্দেশ দিই। সড়কের খুব কাছে গিয়ে কেমন করে অবস্থান নিতে হবে বার বার তার মহড়া দেয়া হয়।
মাঝরাতে এ দলটি তাদের নির্দিষ্ট স্থানে গিয়ে এ্যামবুশ পাতে। তাদের উপর নিদের্শ ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত এমবুশ স্থলে শক্ত প্রবেশ না করে সে সময় পর্যন্ত তারা অপেক্ষা করবে। রক্ষাব্যুহ থেকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে ফিরে এসে আমি আর একটি কোম্পানীকে অস্ত্র নিয়ে তৈরী থাকার নির্দেশ দিই। রাত দুটোর সময় তাদের নিয়ে যাওয়া হয় কামালপুর ঘাঁটির উত্তর-পূর্ব পাশে অবস্থিত বামুনেরপাড়া গ্রামে। বামুনের পাড়া থেকে বনজংগলে পূর্ণ পথ দিয়ে কামালপুর ঘাটিতে পৌছান যায়। ভাের সাড়ে চারটার সময় এই পথ দিয়ে এগিয়ে কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণ করতে হবে। আমরা জানতাম কামালপুর ঘাঁটি আক্রান্ত হলে ভাের হওয়ার সংগে সংগে পাকিস্তানী একটি সাহায্যকারী দল বকশিগঞ্জ থেকে কামালপুরের দিকে রওনা হবে। উঠানের পাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর দলটি তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। রাতের অন্ধকারে আমাদের চারটি তিন ইঞ্চি মর্টার বান রােডের উত্তর পাশে স্থাপন করি। ভাের চারটা। বান রােডের উপর বসে আছি। আক্রমণকারী দলটি কামালপুরের দিকে এগিয়ে গেছে। সারারাত আমরা কেউ ঘুমাতে পারিনি। আসন্ন সংঘর্ষের উত্তেজনায় আমরা সমস্ত অবসাদ ভুলে গেছি। ভাের হয়ে আসছে।
আক্রমণকারী দলটি কামালপুর ঘাঁটিতে পৌছে গেছে। হঠাৎ তাদের তীব্র আক্রমণ ভােরের নিস্তব্ধতা ভেংগে দিল। আমাদের মর্টারগুলাে কামালপুর ঘাঁটির পশ্চিম অংশে গােলা নিক্ষেপ শুরু করলাে। কিছুক্ষণ পর সকালের আলােতে দেখা গেল বেশকিছু মুক্তিযােদ্ধা কামালপুর ঘাঁটির অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে সক্ষম হয়েছে। ঘাঁটির পূর্ব অংশ তাদের দখলে। ঘাঁটির পশ্চিম অংশের বাংকার থেকে তাদের উপর ক্রমাগত মেশিনগানের গুলি আসতে থাকে এবং সংগে সংগে মর্টারের গােলা।। অল্পক্ষণের মধ্যেই মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। এতে দুজন মুক্তিযােদ্ধা প্রাণ। হারায় ও ১৭ জন আহত হয়। সকাল সাতটায় এ্যামবুশ স্থলে পাকিস্তানী সাহায্যকারী দলটির প্রথম ট্রাকটি এ্যামবুশকারী দলের স্থাপিত মাইন বিস্ফোরণে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়। এতে বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও আহত হয়। ধ্বংসপ্রাপ্ত ট্রাকটির পেছনেই ছিল একটি জীপ ও অপর একটি ট্রাক। এই গাড়ী দুটো থেকে শত্রুসৈন্যরা তুরিত নেমে রাস্তার পাশে অবস্থান নেয় ও এ্যামবুশকারী দলটির সাথে গুলি বিনিময় শুরু হয়। এতে আরাে পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। বেলুচ রেজিমেন্টের মেজর আইয়ুব জীপ থেকে নেমে আসার সময় মুক্তিযােদ্ধাদের গুলিতে নিহত হয়। যখন এই গুলি বিনিময় চলছিল তখন একদল পাকিস্তানী সৈন্য কামালপুর ঘাঁটি থেকে পালিয়ে বকশিগঞ্জ যাচ্ছিল। এই পলাতক দলটি সে সময় এ্যামবুশকারী দলটির পেছনে এসে অবস্থান নেয় ও তাদের উপর গুলি চালায়। এতে ৬ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হন ও ৪ জন পাকিস্তানীদের হাতে ধরা পড়েন। এই আকস্মিক বিপর্যয়ে এ্যামবুশকারী দলটি তাদের এ্যামবুশস্থল পরিত্যাগ করতে বাধ্য। হয়। এই বিপর্যয় না ঘটলে সেদিন একটি পাকিস্তানীও এ্যামবুশস্থল থেকে ফিরে যেতে পারত না। সামগ্রিকভাবে এই অভিযানটি ছিল একটি সফল অভিযান। অভিযান শেষে আনুমানিক ৩৩ জন পাকিস্তান সৈন্য নিহত হয়েছে বলে আমি মুজিব নগরে খবর পাঠাই। রেডিও পাকিস্তান ঢাকা থেকে সেদিনের রাতের খবরে বলা হয় যে, শেষরাতে দুই ব্যাটালিয়ন ভারতীয় সৈন্য পাকিস্তান সীমান্ত ঘাটি কামালপুর আক্রমণ করে। স্বল্প সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য এই আক্রমণ প্রতিহত করে এবং ভারতীয় সৈন্যদের পেছনে হটিয়ে দেয়। এতে ৩০০ ভারতীয় সৈন্য নিহত হয়। ও ৬৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য শহীদ হয়। এ খবর শােনার পর আমরা খুবই উল্লসিত হয়ে উঠি। নিঃসন্দেহে এই অভিযানে আমরা শত্রুকে প্রলুব্ধ করে নির্দিষ্টস্থানে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে সক্ষম হয়েছিলাম। |
১০ই সেপ্টেম্বরের অভিযানটিও শত্রুকে কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের করে। আনার একটি সুন্দর কাহিনী। আমি লক্ষ্য করেছি মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের পরপরই পাকিস্তানী সৈন্যরা বেপরােয়া হয়ে উঠতাে। বাংলাদেশের ভেতর। মুক্তিবাহিনী তাদের কোন ক্ষতিসাধন করতে পারে এই ধারণা তারা স্থানীয় জনসাধারণকে দিতে চাইতাে না। তারা সবসময় এ কথা প্রমাণ করতে চাইত যে, তারা অসীম শক্তির অধিকারী এবং পাকিস্তানকে তারা টিকিয়ে রাখবেই। তাদের এই মানসিকতার জন্য আমি নিশ্চিত ছিলাম যে এবার তারা আমাদের ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীরগ্রাম অবস্থানগুলােয় আক্রমণ করবে। ৭ তারিখ দুপুর থেকে আমরা পাকিস্তানী সৈন্যদের কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কটি ব্যবহারের অবাধ। সুযােগ দিই। এসময় তারা কামালপুরে অবস্থানরত ভীতসন্ত্রস্ত পাকিস্তানী সৈন্যদের সরিয়ে নতুন সৈন্য নিয়ে আসে। আমিও তাই চেয়েছিলাম। ৮ তারিখ বিকাল বেলা মেজর জিয়াউর রহমানের ব্রিগেডের প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একটি কোম্পানী মহেন্দগঞ্জে নিয়ে আসি। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক ছিলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। ৯ তারিখ ভাের বেলা মেজর জিয়াউদ্দিনকে আমি ধানুয়া কামালপুর ও ঘাসীরগ্রামের অবস্থানে নিয়ে যাই। কামালপুর ঘাটি থেকে বের হয়ে এসে পাকিস্তানী সৈন্যরা ঘাসীর গ্রামের অবস্থানের উপর আক্রমণ চালাবে বলে। আমি ধারণা করি। এই অবস্থানকে মজবুত করার জন্যই প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটিকে সেখানে রক্ষাব্যুহ তৈরী করার নির্দেশ দিই। কোম্পানী কমাণ্ড রি ছিলেন ক্যপ্টেন পাটোয়ারী (বর্তমানে মেজর ও প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক)। ৯ ও ১০ তারিখ রাতে কোম্পানীটি নিজ অবস্থান নেয়। সে রাতেই মুক্তিযােদ্ধারা কামালপুর-বকশীগঞ্জ সড়কে ব্যাপকভাবে এন্টি-ট্যাংক ও এন্টিপারসােনাল মাইন স্থাপন করে। সে সময় থেকেই তারা ছােট ছােট দলে সড়কটির পাশে পেট্রোলিংও শুরু করে দেয়। কামালপুরের পূর্ব পাশেও একটি চলমান মুক্তিবাহিনী কোম্পানী নিয়ােজিত করা হয়। তাদেরকে নির্দেশ দেয়া হয় বকশীগঞ্জ থেকে কোন সাহায্যকারী দল আসলে তাদের বাধা দেয়া এবং কামালপুর থেকে যদি কোন সৈন্য বের হয়ে যায় তাদের হত্যা করা। | ১০ তারিখ ভাের বেলা থেকেই আমরা কামালপুর ঘাঁটি সম্পূর্ণরূপে অবরুদ্ধ করে ফেলি। সরবরাহ বন্ধ, সড়ক যােগাযােগ বন্ধ, শক্রর জন্য কেবল দুটো পথ খােলা রয়েছে- হয় রাতের অন্ধকারে ছােট ছােট দলে পলায়ন করা অথবা ।
একত্রিতভাবে আমাদের অবস্থানে আক্রমণ করা। দ্বিতীয় সন্তাবনাটাই ঘটবে বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। এই আক্রমণ আসবে ১০ ও ১১ই সেপ্টেম্বর রাতে। ১০ তারিখ ভাের বেলা আমি ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীর রক্ষাব্যুহ পরিদর্শন করি। রাতারাতি বেশ কতকগুলো বাংকার তৈরী করে তারা তাদের অবস্থানকে মজবুত করে তুলেছে। তাদের অবস্থানের সামনে থেকেই জলােমাঠটির শুরু। পানির গভীরতা। এক ফুট থেকে তিনফুট। শক্র একশত গজের মধ্যে আসলে গুলীবর্ষণ করার নির্দেশ দেয়া হয়। আমি স্থিরনিশ্চিত ছিলাম যে, এবার আমরা বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য নিধন করতে সক্ষম হবাে। এর সাথে সাথে কামালপুর ঘাঁটিও আমাদের দখলে আসতে পারে। শত্রুসৈন্যরা কামালপুর ঘাঁটি থেকে বের হয়ে এসে যখন আক্রমণ চালাবে, তখন সম্পূর্ণ কিংবা আংশিক পরিত্যক্ত কামালপুর ঘাটিটি দখলের জন্য বেশ কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধার প্রয়ােজন হবে। এজন্য আমি এক কোম্পানী মুক্তিযােদ্ধাকে মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পে তৈরী হওয়ার নির্দেশ দিই। নিরাপত্তার খাতিরে এই কোম্পানীকে কি কাজ করতে হবে তা জানতে দিইনি। সে সময় সীমান্ত এলাকায় ছড়িয়ে ছিল বিভিন্ন শ্রেণীর লােক। নিরাপত্তা বজায় রাখা তখন একটি দুরুহ ব্যাপার। সন্ধ্যার পূর্বে কোন আক্রমণ পরিচালিত হবে না বলে আমি ধরে নিয়েছিলাম। আরও বেশ কয়েক ঘন্টা সময় হাতে রয়েছে। তাই দুপুর বেলা মহেন্দ্রগঞ্জ থেকে ১৮ মাইল দূরে মাইনকারচর সাবসেক্টরের দিকে রওনা হয়ে যাই—অপর একটি মুক্তিবাহিনী দলকে তাদের অভিযান সম্পর্কে নির্দেশ দেয়ার জন্য। মাইনকারচরে পৌছার সংগে সংগে আমি খবর পাই যে, ধানুয়া ও ঘাসীরগ্রামে আমাদের অবস্থানগুলোয় পাকিস্তানীরা আক্রমণ করেছে। এখবর পেয়েই আমি মহেন্দ্রগঞ্জে ফিরে আসি। বেলা তখন সাড়ে চারটা। ক্যাম্পে পেীছে যে কোম্পানীটিকে তৈরী থাকার নির্দেশ দিয়েছিলাম তাদের খোঁজ করি। আমাদের অনুপস্থিতিতে পাকিস্তানী আক্রমণের খবর পেয়ে এই কোম্পানীটিকে আমাদের অবস্থানগুলাে সুদৃঢ় করার জন্য প্রেরণ করা হয়। কোম্পানীটিকে এভাবে পাঠাবার ফলে আমার পরিকল্পনা আংশিকভাবে বানচাল হয়ে যায়। সেই সময় কিছু সংখ্যক মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে কামালপুর ঘাটিটি আক্রমণ করলে তা সহজেই দখল করা যেতাে। কামালপুর ঘাঁটি আক্রমণের কোন উপায় না দেখে আমি ধানুয়া কামালপুরের। দিকে রওনা হয়ে যাই। পথে দেখি ছােট ছােট দলে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের জোয়ানরা মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্পের দিকে ফিরে আসছে। তাদেরকে পূর্বস্থানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়ে আমি ঘাসীরগ্রামে পৌছি। তখন প্রায় সন্ধ্যা। পেীছে দেখি বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি বিশৃংখলভাবে তাদের অবস্থান ছেড়ে পালিয়ে গেছে।
ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী একজন সঙ্গীসহ তখনও সেখানে রয়ে গেছেন। জলােমাঠটির মাঝামাঝি জায়গা থেকে তখনও পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের নিহত এবং আহত সৈন্যদেরকে নিয়ে যেতে ব্যস্ত। ধানুয়া কামালপুরের অবস্থানে মুক্তিযােদ্ধারা তখনও অটুট রয়েছে। সেদিন বেলা আড়াইটার সময় আমার মহেন্দ্রগঞ্জ ক্যাম্প ছেড়ে যাওয়ার পর পরই কামালপুর থেকে আনুমানিক দুই কোম্পানী সৈন্য আক্রমণ ধারা রচনা করে ঘাসীরগ্রামের দিকে এগােতে থাকে। প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোম্পানীটি উত্তেজনার বশবর্তী হয়ে নির্দিষ্ট স্থানে শত্রু আসার পূর্বেই গুলিবর্ষণ শুরু করে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এই গুলিবর্ষণ উপেক্ষা করে নানা যুদ্ধাস্ত্র সহকারে বেপরােয়াভাবে এগােতে থাকে। তাদের পাল্টা গুলিতে প্রথম বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন নায়েক সুবেদার ও অপর একজন জোয়ান নিহত হন। সে সময় পেছন দিকে কেউ চিৎকার করে বলে যে, বখশিগঞ্জ থেকেও একটি সৈন্যদল তাদের আক্রমণ করতে আসছে। এতে কোম্পানীটিতে চরম বিশৃংখলা দেখা দেয় এবং তারা নিজ স্থান ছেড়ে পলায়ন করে। এসময় ধানুয়া কামালপুরের দক্ষিণ দিকে ছিল আমাদের একটি এল-এম-জি। এই এল-এম-জি’র কোনাকুনি গােলাবর্ষণে বহুসংখ্যক আক্রমণরত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয় এবং শেষ পর্যায়ে তারা পিছু হটতে বাধ্য হয়। যে মুক্তিযােদ্ধা এল-এম-জি চালাচ্ছিল, উত্তেজনা বশত সে এল-এম-জি’র ব্যারেলটি বাম হাতে চেপে ধরে রাখে। এতে তার হাতের তালু সম্পূর্ণরূপে পুড়ে যায়। বিপুল সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য হত্যা এবং আক্রমণকারী বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দেয়ার কৃতিত্ব তারই। সন্ধ্যার পর ক্যাপ্টেন পাটোয়ারীকে আমি নির্দেশ দিই তার কোম্পানীটিকে পূর্বস্থানে ফিরিয়ে নিয়ে যেতে। রাত ন’টার সময় বােঝা গেল কোম্পানীটির মনােবল ভেংগে গেছে। তাই তাদের ঘাসীরগ্রামে ফিরিয়ে নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। তাদের জায়গায় পাঠানাে হল আর একটি মুক্তিবাহিনী কোম্পানী। এই অভিযানটিতে যদিও আমাদের অনেক ভুল-ত্রুটি হয়েছে তথাপি পরিকল্পনার দিক থেকে এর মূল্য অপরিসীম। এই অভিযানকে একটি সুপরিকল্পিত এ্যামবুশও বলা চলে। শত্রুকে প্রলুব্ধ করে জলে মাঠটিতে এনে বিপুল সংখ্যায় হত্যা করতে আমরা সমর্থ হয়েছিলাম।
এই অভিযানটির পর মুক্তিযােদ্ধাদের সাহস ও আত্মনির্ভরতা বহুগুণে বেড়ে যায়। অক্টোবর মাসের। শেষের দিকে নেত্রকোনা এবং কিশােরগঞ্জের বিস্তীর্ণ হাওড় অঞ্চল আমাদের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। আমি চিন্তা করলাম, যদি মূল লক্ষ্য হিসাবে কামালপুর, জামালপুর, টাঙ্গাইল এবং ঢাকাকে টারগেট করি, তাহলে স্বাভাবিকভাবেই ময়মনসিংহের পতন হতে বাধ্য। তাই ঐ টারগেটকে সামনে রেখে আমার সামরিক তৎপরতা অব্যাহত রাখলাম। অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি থেকে কামালপুর, জামালপুর, বাহাদুরাবাদ ঘাট, বকশিগঞ্জ এবং চিলমারীতে আক্রমণের তীব্রতা বাড়িয়ে দিই। পাকসেনারাও বিভিন্ন স্থান থেকে সৈন্য নিয়ে এসে এসব ঘাঁটিতে মােতায়েন করে প্রতিরক্ষা জোরদার করতে থাকে। নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে আমি বেশ আশাবাদী হলাম। ভারতীয় সেনাবাহিনীও আমাদের তৎপ্রতা দেখে আশ্চর্য্য হয়ে গেল। এই সময়ই সশস্ত্রবাহিনীর একটি অংশকে নিয়মিত বাহিনীর পর্যায়ে নিয়ে আসার সিদ্ধান্ত নিলাম। আমার ভাবনা অনুযায়ী নিয়মিত বাহিনীর একটি ব্রিগেড গঠনের অনুমতি চেয়ে সেনা দফতরে একটি আবেদন পাঠালাম। সেনাবাহিনী প্রধান আমার আবেদন প্রত্যাখ্যান করলেন। অথচ এই সময় গেরিলা বাহিনীকে নিয়মিত বাহিনীতে রূপান্তরিত করার উপযুক্ত সময় এসেছিল। ১৩/১৪ নভেম্বর ৫টি কোম্পানী নিয়ে ভাের ৩টায় কামালপুর আক্রমণ করা হয়। মুক্তিবাহিনীর লেঃ মিজান, ক্যাপ্টেন মান্নান এবং মুক্তিযােদ্ধা সাঈদের তিনটি কোম্পানী এবং ভারতীয় বাহিনীর দুটি কোম্পানী মিলে আক্রমণ পরিচালনা করা হয়। ভারতীয় আর্টিলারী আমাদের সাহায্য করে। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল কামালপুর আক্রমণ করে পাকিস্তানীদের হত্যা করা—কামালপুর দখল নয়। আমাদের তীব্র ।
আক্রমণে পাকসেনাদের ২টি কোম্পানী একজন মেজরসহ নিশ্চিহ্ন হয়। আমরা জয়ের আনন্দে অধীর। তখন সময় সকাল ৯টা। গুলির আঘাতে আমি গুরুতররূপে আহত হই। আমার একটি পা নষ্ট হয়ে যায়। আমাকে সঙ্গে সঙ্গে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। এবং ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে দীর্ঘদিনের চিকিৎসায় আমি সুস্থ হয়ে উঠি। আমার চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের আন্তরিকতা-সাহায্যসহানুভূতি কোনদিন ভুলবার নয়। এমনকি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ভারতরত্ন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী পুন। হাসপাতালে আমাকে দেখে নানা কুশল জিজ্ঞাসা করেন। বাংলাদেশ মুক্ত হওয়া পর্যন্ত আমি সেক্টরে ফিরে যেতে পারিনি। আমার অনুপস্থিতিতে স্কোয়াড্রন লীডার হামিদুল্লাহ সেক্টরের দায়িত্ব হাতে নেন।”
৮ নং সেক্টরের অধিনায়ক–মেজর জেনারেল এম. এ. মঞ্জুর
মেজর জেনারেল এম. এ. মঞ্জুর। মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে আগস্ট মাসে কুষ্টিয়া, যশাের ও ফরিদপুর জেলা নিয়ে গঠিত ৮ নং সেক্টরের কমাণ্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মেজর এম, এ, মঞ্জুর। তার সঙ্গে একই সাথে ঝুকিপূর্ণ অবস্থায় পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসেন মেজর তাহের (৭৬ এ। ফাঁসীতে আত্মদান, মেজর জিয়াউদ্দিন (পরবর্তীতে সর্বহারা পার্টির নেতা ও অন্য কয়েকজন অফিসার। ৮ নং সেক্টরের দায়িত্ব গ্রহণের পর মঞ্জুর যুদ্ধ কৌশল ও নিয়মিত বাহিনীর নতুন বিন্যাস আনেন এবং গেরিলা যুদ্ধের প্রতি নির্ভরতার লক্ষ্যে গণবাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে শিক্ষিত করে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন। ১৯৮১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে চট্টগ্রামে ব্যর্থ সামরিক অভুথানের। প্রচেষ্টা নেয়ার পর পার্বত্য চট্টগ্রামে নিহত হন মেজর জেনারেল এম, এ, মঞ্জুর। নিচের লেখাটি মঞ্জুরের সাক্ষাকারের ভিত্তিতে রচিত। এতে তিনি মুক্তিযুদ্ধে তার অংশগ্রহণ ও সেক্টর কমাণ্ডার হিসেবে তার দায়িত্বের বিভিন্ন দিক তুলে ধরেছেন। লেখাটি নেয়া হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র থেকে। মানসিক দিক থেকে প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যােগ দেবার জন্যে। পালাবার পথ খুজছিলাম। অবশেষে সে সুযােগ হয় ২৬শে জুলাই। ইতােপূর্বে আলাপআলােচনা, পরিকল্পনা করেই রেখেছিলাম। মেজর জিয়াউদ্দীন, মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন পাটোয়ারী, আমার পরিবার এবং আদালীসহ বাংলাদেশের উদ্দেশে বেরিয়ে পড়ি। আরও আগে বেরােবার চেষ্টা করেছি কিন্তু সুযােগ হয় নি, তাছাড়া আমার শিশু সন্তান তখন মাত্র কয়েকদিনের ছিল। অনেক পথ পেরিয়ে ৭ই আগস্ট আমি কলকাতা আসি। তারপর ১১ই আগস্ট আমাকে ৮নং সেক্টরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। ৯নং সেক্টরের কমাণ্ডার ছিলেন। মেজর এম এ জলিল। তবুও যুদ্ধ সংক্রান্ত ব্যাপারে এই সেক্টরের দায়িত্বও আমাকে দেওয়া হয়েছিল। আসার পর পরই পেট্রাপােলে আমার এলাকা পরিদর্শনের জন্যে যাই। সেখানে শুনলাম ছয়জন রাজাকারকে গণবাহিনীরা ধরে নিয়ে এসেছে এবং মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে তাদেরকে মুক্তি দেই এবং গ্রামে ফিরে গিয়ে দেশের জন্যে কাজ করতে বলি। পরে শুনেছিলাম দুইজন অনুশােচনায় অপ্রকৃতিস্থ হয়ে গেছে, অপর চারজন বাংলাদেশের জন্য মরণপণ লড়াই করেছে। ফিরে এসে এ বিষয়ে গভীরভাবে ভাবতে থাকি এবং কতকগুলি অবস্থা লক্ষ্য করলাম। গণবাহিনী নিয়মিত বাহিনী থেকে সম্পূর্ণভাবে পৃথক। তারা অন্য কমাণ্ডের আওতায়, কাজে-চিন্তায় নিয়মিত বাহিনী থেকে আলাদা। বস্তুতঃপক্ষে গণবাহিনী এবং নিয়মিত বাহিনী পৃথক রাজ্যে বাস করতাে। গণবাহিনী বাংলাদেশের অভ্যন্তরে মাঝে মাঝে গেলেও পাকবাহিনী আসছে শুনলে সে গ্রাম বা গৃহ থেকে পালিয়ে যেত। এতে করে মুক্তিবাহিনীর প্রতি জনসাধারণের আস্থা ক্রমশ হারাতে থাকে। অপরদিকে নিয়মিত বাহিনী ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি বিভিন্ন পকেটে থাকতাে। তারা বিস্তৃত পরিসরে ঘুরতাে। বস্তুতঃ তাদের কাজ অত্যন্ত সীমাবদ্ধ ছিল। আরও দেখলাম, গণবাহিনীর প্রধানতঃ কাজ ছিল রাজাকারদের বিরুদ্ধে। গণবাহিনী কোন কোন সময় জোর করেও কোন কোন বাড়িতে থেকেছে, এতেও বিরূপ প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করলাম। “আঘাত কর এবং পালাও” এই নীতির ফলে পরে পাকবাহিনী এসে গ্রামকে গ্রাম জ্বালিয়ে দিত, হত্যা করতাে, লণ্ঠন-সন্ত্রাসও বাদ যেত না। অপরদিকে যেসব রাজাকারদের ধরে সব দিক বিচার না করে হত্যা করতাে সেইসব পরিবারের গােটা লােককে পাকিস্তানের পক্ষে কাজ করতে দেখলাম। এমনিভাবে তারা বাংলার মানুষের সহযােগিতা হারাতে বসেছিল। এ ছাড়া গণবাহিনী মাঝে মাঝে দেশের। অভ্যন্তরে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতাে।
অপরদিকে একজন নিয়মিত বাহিনীর সৈনিক হিসাবে তাদের কাছে যা পাওয়া উচিত তার প্রায় কিছুই পাওয়া যাচ্ছিল না। আমি বুঝলাম গণবাহিনীকে যদি আমার অধীনে নিয়ে আসতে না পারি তাহলে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়বে। শুধু তাই নয়, দেশ মুক্ত করাও পিছিয়ে পড়বে। সমগ্র বাহিনীতে একটা এলােমেলােভাব। তাই এসব ভেবে কতকগুলি সিদ্ধান্ত নেই। (১) সেক্টরটিকে পুরাপুরি পুনঃগঠিত করি। এবং পুনরায় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। করি। (২) গণবাহিনীকে সম্পূর্ণ আমার আওতায় নিয়ে আসি। (৩) আমার এলাকাকে বিভিন্নস্থানে বিশেষ বিশেষ এলাকায় ভাগ করি এবং সেখানকার জন্যে একজন কমাণ্ডার নিযুক্ত করি। সবাই দেশের অভ্যন্তরে থাকবে, যাবতীয় সরবরাহ আমরা করবাে-এ সিদ্ধান্ত নেই। (৪) গণবাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলা, দেশপ্রেমে উথুদ্ধ করবার জন্যে রাজনৈতিক উপদেষ্টা পাঠাই। (৫) রাজাকারদের প্রশ্নেও বিশেষ নির্দেশ দিয়েছিলাম। আমি আসার পর গণবাহিনীতে লােক ভর্তি বাড়িয়ে দেই। ট্রেনিং-এর সময় কমিয়ে তিন সপ্তাহ করি। প্রতিমাসে তিন হাজার করে গণবাহিনী তৈরী করে দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। ভিতরে পাঠাবার সময় প্রত্যেকের। খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি বাবদ রাহাখরচ ৮০ টাকা করে দেবার ব্যবস্থা করেছিলাম। এর আরেকটি দিক ছিল, তা হলাে দেশের ভিতরে এইভাবে সবাই টাকা ব্যয় করলে অন্যেরা প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে উপকৃত হলে আমাদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে। | গণবাহিনী ভিতরে পাঠাবার পর প্রত্যেক গ্রুপের মাত্র একজন। সীমান্ত নিকটবর্তী অথবা তার যে কোন নিকটবর্তী আমাদের স্থায়ী পকেটে এসে সবার জন্যে টাকা, অস্ত্র এবং অন্যান্য জিনিস নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করি। সেপ্টেম্বরের মধ্যে পুনর্গঠনের কাজ হয়ে যায়। পরবর্তী পর্যায়ে নিয়মিত বাহিনী থেকে অফিসারদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠাবার ব্যবস্থা করি। অফিসারদের সাথে সাথে নিয়মিত বাহিনীও ভিতরে এগিয়ে যায়। মােটামুটিভাবে নিয়মিত বাহিনী এবং গণবাহিনীকে একটি বিশেষ ‘ চেইনে নিয়ে আসি। এতে করে ভাল ফল হতে লাগলাে। এই বাহিনী ভিতরে প্রবেশ করলে আমি এদেরকে টাক’ দেই- যেমন রেললাইন উড়িয়ে দেওয়া, সেতু ধ্বংস করা, বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ধ্বংস করা ইত্যাদি। এসব শুরু হলে পাকবাহিনী ভীষণ বিপদের মুখে পড়ে যায়। আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে যাই। শুধু তাই নয়, আওতাভূক্ত এলাকাতে যাতে প্রশাসনযন্ত্র চালু হয় এবং সুষ্ঠুভাবে চলে তার নির্দেশ দেই। এতে করে ভাল ফল পাওয়া গেল। ত্বরিত যােগাযােগের জন্যে বিভিন্ন স্থানে অয়ারলেস সেট পাঠাই এবং এ বিষয়ে একটি দলকে প্রশিক্ষণ দানের ব্যবস্থা করি। দেশের ভিতরে গিয়ে বুদ্ধিমান এবং সাহসী ছেলে বেছে এনে ‘ইনটেলিজেন্স’ বিভাগ খুলি। এর ফলে যাবতীয় খবরাখবর আমরা অতি সহজে পেতে লাগলাম। আমাদের অগ্রগতি এগিয়ে চলে। অপরদিকে আমি লক্ষ্য করেছিলাম যে, শুধুমাত্র পাকবাহিনীকে হত্যা বা। তাড়ানাের ব্যবস্থা করলেই চলবে না, যাতে করে পুরা প্রশাসন ভেঙ্গে পড়ে সেদিকেও নজর দিতে হবে। এ কাজের প্রাথমিক দিক হিসাবে আমি প্রথমে পুলিশ থানাগুলি দখল করতে বলি। অপরদিকে চালনা এবং মঙ্গলা পাের্ট যাতে অকেজো হয়ে যায় তার নির্দেশ দেই। সঙ্গে সঙ্গে কাজ হয়- নৌবাহিনীর একটি দল বিশেষ কৃতিত্বের পরিচয় দেয়। এইভাবে কাজ করে যেয়ে আমরা একের পর এক জয়ের পথে এগিয়ে গেলাম। গণবাহিনী ও নিয়মিত বাহিনী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে কাজ করতে লাগলাে। মুক্তিযুদ্ধের সবচাইতে যেটি প্রয়ােজন, জনসাধারণের সমর্থন, তা পেতে লাগলাম।
আমরা সাফল্যের পথে এগিয়ে গেলাম। এরপর নভেম্বরের ২০ তারিখ থেকে মিত্রবাহিনী আমাদের সাথে আসে। এবং মিত্রবাহিনী ও আমাদের বাহিনী মিলিতভাবে শক্রদের উপর আক্রমণ চালিয়ে একের পর এক এলাকা জয় করে চললাে। অবশেষে ১৬ই ডিসেম্বর সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশ মুক্ত হয়। আলবদর বা আলশামসূদের ক্ষেত্রে অন্য কথা হলেও রাজাকার প্রশ্নে বলা যায় যে, তারা সবাই সমান ছিল না। এদের অনেকেই আমাদের পক্ষে কাজ করেছে, যদিও মানুষ এদের ঘৃণা করতাে। | সত্যিকার অর্থে যশাের সেনানিবাসটাকেই গণ কবরস্থান বলা যেতে পারে। কারণ বিভিন্ন স্থানে ঘটনা বিক্ষিপ্তভাবে যা পাওয়া গেছে, শােনা গেছে, দেখা গেছে, তা অবর্ণনীয়। যাবার পথে পাকবাহিনী সেনানিবাসের বহু ব্যারাক ও স্টোরে আগুন লাগিয়ে দিয়ে গেছে। সেনানিবাসের ভিতরে মডেল প্রাইমারী বিদ্যালয়, দাউদ বিদ্যালয় ইত্যাদি স্থান ছিল চাপ চাপ রক্তে ভরা। অনেক মানুষকে রশি দিয়ে গাছে টাঙ্গিয়ে হত্যা করা হতাে। আরও শুনলাম কিভাবে মেয়েদের উপর অত্যাচার করা হয়েছে। হাজার হাজার মানুষকে হত্যা করেছে নৃশংসভাবে, তার পরিচয় পাওয়া গেল। ডিসেম্বরে পুরামাত্রায় যুদ্ধ বেধে গেলে বাংলার মানুষ আনন্দিত হয়ে উঠে। তারা উন্মুখ হয়ে থাকে মিত্র আর মুক্তিবাহিনীর অপেক্ষায়। মুক্তিবাহিনী এবং মিত্রবাহিনীকে বাংলার মানুষ প্রাণঢালা সংবর্ধনা জানায়। শিশু, বৃদ্ধ, যুবক, নারী, সবাই যে যা পেয়েছে তাই দিয়ে অভ্যর্থনা জানিয়েছে। স্বাধীনতার পর জনমনে সাড়া পড়ে যায়। বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হয়ে ওঠে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে।
৬ নং সেক্টরের অধিনায়ক
উইং কমান্ডার এম কে বাশার। মুক্তির ৬ নং সেরর কমান্ডার ছিলেন উইং কমাণ্ডার এম. কে. বাশার। ‘৭৬ সালের ১লা সেপ্টেম্বর বিমানবাহিনী প্রধান থাকাবস্থায় বিমান দুর্ঘটনায় মৃত্যু ঘটে। তরি। ৬নং সেক্টরের যুদ্ধ ও অন্যান্য প্রসঙ্গে এম কে বাশারের এই বর্ণনাটি নেয়া হয়েছে স্বাধীনতা যুদ্ধের দলিলপত্র (১০ম খণ্ড। থেকে। ১৫-৫-৭৩ সালে তিনি এই সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। ২৫শে মার্চ বিকেল চারটার সময় বিশেষ বােয়িং তার নিজস্ব নিরাপত্তা প্রহরী নিয়ে বিমান বন্দরে অবতরণ করে। বিমান বাহিনীর দু’জন অফিসার (তন্মধ্যে আমিও ছিলাম) এবং একজন টেকনিশিয়ানকে বােয়িংটির কাছে যেতে হয়। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় সেনানিবাস থেকে টেলিফোনে নির্দেশ দেয়া হয় বােয়িং স্টার্ট করার জন্য। রাত আটটায় একটা প্রাইভেট গাড়ীতে করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান (এ গাড়ীর ডাইভার ছিল একজন কর্নেল) ঢাকা সেনানিবাস থেকে বােয়িং-এ উঠে যান এবং সংগে সংগে বিমান চলে যায়। ঐ বিমানে প্রেসিডেন্ট একা যান। প্রেসিডেন্টের এভাবে চলে যাওয়াতে আমার ধারণা হল যে, হয়তাে জেনারেল হামিদ খান ক্ষমতা দখল করেছেন এবং ইয়াহিয়া খানকে বােয়িং-এ করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দিয়েছেন। এখানে উল্লেখযােগ্য যে জেনারেল হামিদ তখন ঢাকাতে ছিলেন। ২৫শে মার্চ রাতে আমি বনানীতে আমার বাসায় ছিলাম। রাত বারটার পরে। ভীষণ গােলাগুলি: আওয়াজ শুনতে পেলাম। ভােররাত থেকে জনসাধারণ বনানীর ঐ পথ দিয়ে গ্রামের দিকে পালাচ্ছে। ২৭শে মার্চ আমি অফিসে আসি। সেই সময়কার বেস কমাণ্ডার ছিলেন এয়ার কমােডর জাফর মাসুদ, যিনি মিঠঠি মাসুদ হিসেবে বিমান বাহিনীতে পরিচিত ছিলেন। আমরা বাঙ্গালী অফিসাররা তাঁর সাথে দেখা করলাম এবং দেশের এই পরিস্থিতিতে আমাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে তার সাথে আলাপ করলাম। তিনি বললেন, ‘নো ওয়ান উইল টাচ মাই মেন অর অফিসারস বিফোর দে কিল মি”। আমরা তাঁকে অনুরােধ করলাম তিনি যেন সবাইকে ডেকে সান্তনা দেন। এর মধ্যে ২৯শে মার্চ সেনাবাহিনী বিমান বাহিনীর কাছে বিমান সাহায্য চেয়ে পাঠায়। তিনি সে সাহায্য দিতে অস্বীকার করেন। ৩০শে মার্চ তিনি বেলের সবাইকে ডেকে ভাষণ দেন। তিনি বললেন ” তােমরা সবাই জান যে সেনাবাহিনী তৎপরতা চালাচ্ছে। আমি বিমান সাহায্য দিতে অস্বীকার করেছি।
কিন্তু আমি কতদিন এটা ঠেকিয়ে রাখতে পারব বলতে। পারছি না। সমস্ত বাঙ্গালী পাইলটকে এসব মিশনে যাওয়া থেকে অব্যাহতি দিচ্ছি এবং যে সমস্ত বাঙ্গালী টেকনিশিয়ান এ সমস্ত বিমানে কাজ করতে চায় না তারা অনির্দিষ্ট কালের জন্য ছুটিতে যেতে পারে।” এপ্রিল মাসের ৩/৪ তারিখে প্রথম বিমান হামলা চালানো হয় পাবনার আশেপাশে। এয়ার কমােডরের নির্দেশ ছিল যদি কোথাও লােক জমায়েত দেখা যায় প্রথমে যেন ওয়ানিং শট করা হয় যাতে করে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। অপরদিকে সেনাবাহিনীর নির্দেশ ছিল ম্যাসাকার করার জন্য। এজন্য এয়ার কমােডর জাফর। মাসুদকে বদলী করে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং পরে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। এর মধ্যে সমস্ত বাঙ্গালী অফিসারকে পশ্চিম পাকিস্তানে বদলী করা হয়। আমরা ছুটি নিলাম। আমরা কারাে সাথে যােগাযােগ করতে পারছিলাম না। জিয়াউর রহমানের ভাষণ আমরা শুনেছিলাম। লােকমুখে শুনলাম যে, ময়মনসিংহ এলাকায় প্রতিরােধ চলছে। তখন ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট মির্জাকে খবর আনার জন্য পাঠানো হয়। সেও ঠিকমত কারাে সাথে যােগাযােগ করতে পারেনি—তবে একটা থমথমে পরিবেশ সে লক্ষ্য করেছিল। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট কাদেরকে আগরতলাতে পাঠানাে হয়। সে ভারতে গিয়েছিল এবং খালেদ মােশাররফের বাহিনীর সাথে যােগাযােগ করতে সক্ষম হয়েছিল। যখন সে ফিরে কুমিল্লা আসে তখন পাক। বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে। পরে তাকে ছেড়ে দেয়া হয়। ১২ই মে আমরা ঢাকা ত্যাগ করলাম। নরসিংদী হয়ে লঞ্চে রওনা হলাম। লঞ্চ থেকে আমরা দেখলাম যে, পাক বাহিনী একটা গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়েছে। পথে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রের সাথে আমাদের দেখা হয়। সে তার গ্রামের বাড়িতে আমাদের আশ্রয় দিয়েছিল। | ১৪ই মে আমরা কুমিল্লা হয়ে সােনামুড়ার নিকটবর্তী শিবেরবাজারে রাত্রি যাপন করি। স্থানীয় জনসাধারণ আমাদের যথেষ্ট আদর-যত্ন করে এবং তারাই পরের দিন আমাদেরকে সােনামুড়ায় পৌছায়। সােনামুড়া বিএসএফ ক্যাম্পে আমরা নিজেদেরকে প্রথমে ব্যবসায়ী বলে পরিচয় দেই। সেখানে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের একজন অফিসার মুক্তিযােদ্ধাদের রিক্রুট করছিলেন।
আমরা তার কাছে গিয়ে নিজেদের পরিচয় দেই। আমার সাথে ছিলেন তৎকালীন গ্রুপ ক্যাপ্টেন খােন্দকার, স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন, ফ্লাইট লেঃ সুলতান, ফ্লাইট লেঃ বদরুল আলম, ফ্লাইট লেঃ কাদের, এক্স ফ্লাইট লেঃ রেজা। এখান থেকে আমাদেরকে মুজিবনগরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জেনারেল ওসমানী আমাদের সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন। আমরা ওনাকে একটা বিমান বাহিনী গঠন করার প্রস্তাব করেছিলাম। কিন্তু সে সময় এটা সম্ভব ছিল না। তারপর আমরা স্থল যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করার সংক জানালাম। সেখানে আমাকে ৬নং সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়ে দেয়া হয়। ৬নং সেক্টরে রংপুরে একটা মুক্তিবাহিনী মেজর নওয়াজেশের অধীনে ভুরুঙ্গামারীর কাছে সংঘবদ্ধ হয়েছিল এবং আর একটা বাহিনী দিনাজপুর-ঠাকুরগাঁ হয়ে মেজর নজমুলের অধীনে ভজনপুরে নদীর উপরে একটা পুল উড়িয়ে নদীর। উত্তর পাড়ে প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরী করে। দুটো জায়গাই বাংলাদেশের ভিতরে ছিল এবং এখান থেকে কখনাে আমরা পিছু হটিনি, বরং এগিয়ে গিয়েছিলাম। মেজর নওয়াজেশের একটা দল সুবেদার বােরহান উদ্দীনের (ইপিআর) নেতৃত্বে রংপুরের রুহুমারী এলাকায় প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করে এবং এ জায়গা বাংলাদেশের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি পর্যন্ত মুক্ত ছিল। এ এলাকা পরবর্তীকালে ১১ নং সেক্টরকে দিয়ে দেয়া হয়। রংপুরের পাটগ্রাম থানাও মুক্ত এলাকা ছিল। এখানেও মেজর নওয়াজেশের একটা দল প্রতিরক্ষা ব্যুহ তৈরি করেছিল। মেজর নওয়াজেশের এবং মেজর নজমুলের দুটো বাহিনী (ই-পি-আর, আনসার, মােজাহেদ, পুলিশ, ছাত্র, শ্রমিক, ড্রাইভার) মিলিয়ে ৭০০ জন ছিল। অস্ত্র বলতে ছিল শুধু মাত্র রাইফেল সামান্য কটা, এলএমজি, মর্টার এবং একটা মেশিনগান। গােলাবারুদও খুব কম ছিল। আমার দুটো সমস্যা ছিল। প্রথমত, আমি বিমান বাহিনীর অফিসার—ঐ এলাকার সৈনিক, অফিসার এবং জনগণ আমাকে ঠিকভাবে গ্রহণ করবে কিনা সে | প্রশ্ন, এবং দ্বিতীয়তঃ সৈনিকদের সংঘবদ্ধ করা এবং সংগঠিত করা। আমাদের।
অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদও কম ছিল। কিভাবে আরাে বেশী অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে সেটাও একটা প্রধান সমস্যা ছিল। ভারত থেকে কিভাবে অস্ত্রশস্ত্র গােলাবারুদ সগ্রহ করতে হবে সেটাও একটা সমস্যা ছিল। রিক্রুটমেন্ট এবং ট্রেনিং-এরও সমস্যা ছিল। তাছাড়া হাসপাতালও ছিল না, ঔষধপত্র ও ডাক্তারের অভাব ছিল। রেশন আমরা ভারতীয় সীমান্ত রক্ষীবাহিনী থেকে পেতাম কিন্তু খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ নিয়মিত ছিল না। যে সমস্ত মুক্তিযােদ্ধা তাদের পরিবার নিয়ে এসেছিল তাদেরকে রেশন সরবরাহ করা কষ্টকর ছিল। মুক্তিযােদ্ধাদের কোন পােশাক ছিল না। লুঙ্গী এবং গেঞ্জী পরেই তারা যুদ্ধ করছিল। তাদের কোন বিছানাপত্র ছিল না। তাদেরকে খােলা মাঠে থাকতে হত। টাকা-পয়সারও যথেষ্ট অভাব ছিল। এখানে বলে রাখা ভাল যে, যে সমস্ত টাকা পয়সা কুড়িগ্রাম এবং ঠাকুরগাঁ ব্যাঙ্ক থেকে মুক্তিযােদ্ধারা নিয়ে এসেছিল সে সমস্ত টাকা সীলমােহর করা বাক্সে মুজিবনগরে বাংলাদেশ সরকারের কাছে অর্পণ করা হয়েছিল। সে টাকা কিভাবে খরচ করা হয়েছে তা বলতে পারছি না। তখন পর্যন্ত ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিবাহিনীতে শরণার্থী শিবির থেকে নিয়ােগ করত এবং ট্রেনিং দিচ্ছিল। শরণার্থী শিবিরগুলােতে অধিকাংশ হিন্দু ছিল। তারা তাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ট্রেনিং-এর জন্য পাঠাত। এ ব্যাপারে আমাদের কোন কর্তৃত্ব ছিল না। কিন্তু সেক্টর কমাণ্ডারের দায়িত্ব গ্রহণ করার পর আমি এ ব্যাপারে ওদের সাথে আলাপ-আলােচনা করি এবং তাদেরকে বলি যে রিক্রুটমেন্ট আমরা করব। আপনারা আমাদেরকে অস্ত্রশস্ত্র এবং ট্রেনিং এর ব্যবস্থা করবেন। অপারেশনে পাঠানাের দায়িত্ব আমাদের থাকবে। অনেক বাকবিতণ্ডার পর ভারতীয় সেনাবাহিনীকে সম্মত করানাে হয়। সৌভাগ্যবশত ভারতে আমাদের যে ট্রেনিং ক্যাম্প ছিল (মুর্তি টি এস্টেট) সেখানকার কমাণ্ডার লেঃ কর্নেল সেনগুপ্ত ছিলেন। একজন বাঙ্গালী হিন্দু। তিনি আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য করেছেন। ব্রিগেডিয়ার জোসীও আমাদেরকে যথেষ্ট সাহায্য এবং সহানুভূতি দেখিয়েছেন। সেনগুপ্ত ট্রেনিং-এর চার্জে ছিলেন। সীমান্ত এলাকায়, যারা বাংলাদেশের ভেতর থেকে উনিং-এর জন্য আসত তাদেরকে প্রথমে হােল্ডিং ক্যাম্পে রাখা হত, তারপর কেন্দ্রীয় একটা ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে ৩ সপ্তাহের গেরিলা ট্রেনিং দেয়া। | হত। পরে এদেরকে আমার কাছে পাঠানাে হত বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানাের জন্য। এবং আমার মনে হয় সমস্ত সেক্টরে এ নিয়ম অনুসরণ করা হয়েছিল। তিন সপ্তাহের ট্রেনিং যথেষ্ট ছিল না।
তাই ঠিক করা হল গেরিলাদের নিয়মিত বাহিনীর সাথে আরাে ১৫ দিন রাখার এবং তাদেরকে যুদ্ধের কলাকৌশল সম্পর্কে ট্রেনিং দেয়ার। এ সময়ের মধ্যে আমরা কাকে কোন দলের নেতৃত্বে দেয়া যায় তা ঠিক করতে পারতাম। তারপর বিভিন্ন এলাকার স্থানীয় ছেলেদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে ভিতরে পাঠিয়ে দেয়া হত শত্রুর অবস্থানের কাছে গিয়ে লক্ষ্য করার জন্য। তারপর তাদেরকে অপারেশন চালানাের নির্দেশ দেয়া হত। শত্রুর অবস্থানের আশেপাশে আমাদের গেরিলা বেইসগুলাে ছিল। আমার। সেক্টরে প্রায় ১২০টার মতাে গেরিলা বেইস ছিল। প্রত্যেকটা গেরিলা বেইস থেকে কুরিয়াররা পতি সপ্তাহে এসে আমাদের কাছে অপারেশন-এর খবর এবং পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিভিন্ন খবরাখবর দিয়ে যেত। কোন কোন সময় নিয়মিত বাহিনী। নিয়েও শত্রুর অবস্থানগুলােতে আক্রমণ চালাতে হত। ভারতীয় সেনাবাহিনী থেকে। আমরা গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নিতাম। মেজর নওয়াজেশ সাব-সেক্টর কমাণ্ডার (রংপুর) ছিলেন— ভুরুঙ্গামারী। থেকে পাটগ্রাম পর্যন্ত। ক্যাপ্টেন দেলােয়ার ছিলেন মােগলহাটে। ক্যাপ্টেন মতিউর | ছিলেন বাউরাতে। চিলাহাটিতে ছিলেন ফ্লাইট লেঃ ইকবাল। ক্যাপ্টেন নজরুল। ছিলেন হলদীবাড়িতে। সুবেদার মেজর ওসমান গনি (ইপিআর), স্কোয়াড্রন | লিডার সদরুদ্দীন ইনডাকশন টেনিং শেষ হবার পর বিভিন্ন অপারেশনে পাঠানাে এদের দায়িত্ব ছিল।
দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগী মহকুমার অমরখান নামক জায়গায় আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। রংপুর জেলার বড়খাতায় আমাদের প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। ভুরুঙ্গামারীর নিকটে আমাদের আর একটা প্রতিরক্ষা ব্যুহ ছিল। এখানে মেজর | নওয়াজেশ ছিলেন। বড়খাতায় ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিউর রহমান। অমরখানে ছিলেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার। আমাদের সেক্টর হেডকোয়ার্টার ছিল পাটগ্রামের কাছে বুড়িমারী নামক জায়গায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরে)। আমাদের নিয়মিত বাহিনী। নিতান্ত নগণ্য ছিল, সুতরাং আমাদেরকে হ্যারাসিং ফায়ার, রেইড, এ্যামবুশ, মাইন পুতে রাখা এগুলাের উপর জোর দিতে হয়েছিল। | প্রধান আক্রমণ যে সমস্ত জায়গায় চালানাে হয়েছিল সেগুলাে হলঃ ভুরুঙ্গামারী (রংপুর), মােগলহাট (রংপুর), অমরখান (দিনাজপুর), বড়খাতা, তেতুলিয়া এবং পাটগ্রাম। আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের পরিবারবর্গের থাকার জন্য দুটো ক্যাম্প তৈরি করা হয়েছিল। আমাদের পরাে সেক্টরের জন্য দুজন এমবিবিএস ডাক্তার। ছিলেন। তেতুলিয়াতে ৫০ বেডের একটা হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। ডাক্তার আতিয়ার রহমান (পচাগড় চিনিকলের ডাক্তার) তেতুলিয়া হাসপাতালের দায়িত্বে ছিলেন। বুড়িমারীতে ২৫ বেডের একটা হাসপাতাল স্থাপন করা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন হােসেন এখানে ছিলেন। দুজন ছাত্র ফ্রন্টে ছিল। আহত মুক্তিযােদ্ধাদের প্রথমত এদের কাছে পাঠানাে হত। এরা ছােটখাট অস্ত্রোপচার করত এবং প্রাথমিক চিকিৎসার পর হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়া হত। রংপুর কলেজের কয়েকজন ছাত্রী হাসপাতালে নার্সিং ডিউটি করার জন্য তাদের ভলান্টিয়ার করে। মারাত্মকভাবে আহত মুক্তিযােদ্ধাদের বাগডােগরা কম্বাইন্ড মিলিটারী হাসপাতালে এবং জলপাইগুড়ি বেসামরিক হাসপাতালে পাঠানাে হত। ঔষধপত্র, যন্ত্রপাতি ভারতীয় সামরিক বাহিনী থেকে পাওয়া গিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকারও বিভিন্ন সূত্রে যােগাড় করেছিলেন। স্থানীয় ভারতীয়রাও সাহায্য করেছিলেন। জুলাই-আগস্ট থেকে খাদ্যদ্রব্য, কাপড় চোপড় ঔষধপত্র, অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ আগের থেকে নিয়মিত | ছিল। যদিও পর্যাপ্ত পরিমাণে ছিল না তবুও মুক্তিযুদ্ধের গতি বৃদ্ধি পেতে থাকল। ট্রেনিং ক্যাম্প থেকেও ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা নিয়মিতভাবে আসতে থাকল। এই সময় বিভিন্ন সেক্টরে অফিসারদের স্বল্পতা দেখা দিয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার। মুর্তিতে অফিসারদের ট্রেনিং-এর জন্য ক্যাম্প স্থাপন করেন।
এখানে প্রথম ব্যাচে প্রায় ৬৪ জন অফিসার ট্রেনিংপ্রাপ্ত হন। এখানে পাসিং আউট প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেছিলেন তৎকালীন অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলাম। অতিথিদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল ওসমানী, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ। এই পাসিং আউট প্যারেড-এর খবর পাকিস্তানে গােয়েন্দা বাহিনীর মাধ্যমে চলে গিয়েছিল। এই সময়ে বাংলাদেশের তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ আমার সেক্টর পরিদর্শনে গিয়েছিলেন, এবং চারদিন পর্যন্ত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আমাদের বিভিন্ন অবস্থান ঘুরে ঘুরে দেখেন। তিনি তেতুলিয়া, ভজনপুর, পাটগ্রামে জনসভায় ভাষণ দিয়েছিলেন এবং বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে আলােচনা করেন। জনাব কামরুজ্জামান যখন আমাদের সেক্টর পরিদর্শনে আসেন তখন তিনি তার মন্ত্রণালয় পাটগ্রামে স্থানান্তরিত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। সমস্ত সেক্টরে নিয়মিত বাহিনীর লােকেরা ৭৫ টাকা করে মাসিক পকেট খরচ এবং খাদ্য, কাপড় চোপড় পেত। অফিসাররা ২০০ টাকা করে পেত এবং গেরিলারা পেত ৫০ টাকা করে পকেট খরচ এবং ফ্রি রেশন অথবা দু’ টাকা করে প্রত্যহ রেশন মানি। অমরখানাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শক্তিশালী ঘাটি ছিল-তাদের ফ্রন্টিয়ার ফোর্স এবং মিলিশিয়া বাহিনী মিলে প্রায় দুই কোম্পানী সৈন্য ছিল। জুলাই মাসে টাস্ক ফোর্স দুই কোম্পানী এবং এক কোম্পানী ফ্রিডম ফাইটার নিয়ে শত্রুঘাটি আক্রমণ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। শত্রুবাহিনীর ঘাটির পেছনে গেরিলাদের অনুপ্রবেশ করানাে হয় ক্যাপ্টেন শাহরিয়ারের নেতৃত্বে। দুই কোম্পানী ইপিআর সৈনিকের সাহায্যে প্রধান আক্রমণ চালানাে হয়। এই আক্রমণে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীরও সাহায্য নেয়া হয়েছিল। যদিও শত্রুঘাটি আমরা দখল করতে সক্ষম হয়েছিলাম কিন্তু পাকিস্তান গােলন্দাজ বাহিনীর আক্রমণের ফলে আমাদেরকে ঐ স্থান ত্যাগ করতে হয়। | এই ব্যর্থতা থেকে আমরা কতগুলাে শিক্ষা গ্রহণ করেছিলাম। আক্রমণের পূর্বে শত্রুবাহিনীর শক্তি সম্পর্কে জানতে হবে। রেডিও বা অয়্যারলেস যােগাযােগের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে যােগাযােগ রক্ষা তে “ব। সৈনিকদেরকেও ভালভাবে প্রশিক্ষণ দিতে হবে। আমরা যদি পূর্বহেই পাকিন গােলন্দাজ বাহিনীর অবস্থান জানতে পারতাম তাহলে ঐ অবস্থানের উপর শেলিং করা যেত।
ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে ইপিআর, এবং আনসার, মুজাহিদ, ছাত্র নিয়ে বড়খাতায় (রংপুর) জুলাই মাসে অপারেশন চালানাে হয়। এখানে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। অবশ্যই এই আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। আমাদের সৈন্যদের। ভাল প্রশিক্ষণ ছিল না। ভারী অস্ত্রশস্ত্র ছিল না। খাওয়া-দাওয়া এবং চিকিৎসার। অভাব ছিল। এই সমস্ত প্রতিকূল অবস্থার মধ্যে আমাদের সৈন্যদের সুশিক্ষিত এবং সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয়েছে। প্রাথমিক পর্যায়ে বিভিন্ন অপারেশনে আমাদের ব্যর্থতা আমাদেরকে অনেক | শিক্ষা দিয়েছিল। আমাদের নিজেদের দোষত্রুটি শশাধরাতে পেরেছিলাম। যার ফলে বিভিন্ন আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলাম। অকটোবর মাস থেকেই আমাদের বিজয় শুরু হয়। অক্টোবর মাসে বড়খাতা, ভুরুঙ্গামারী, অমরখানা আমরা পুরােপুরি দখল করতে সমর্থ হই।
মেজর নওয়াজেশের নৃেতত্বে তিন কোম্পানী সৈন্য নিয়ে ভুরুঙ্গামারীতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঘাটি আক্রমণ করা হয় (জুলাই-আগষ্ট মাসে)। এর আগে ভুরুঙ্গামারীতে রেইড, এ্যামবুশ ইত্যাদি চালিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। কিন্তু এই আক্রমণে আমরা সফলতা অর্জন করতে পারিনি। | এই তিনটি বৃহৎ আক্রমণের ফলে শত্রুবাহিনী বুঝতে পারে যে মুক্তিযােদ্ধারা। যে কোন বড় আক্রমণ করতে পারে। তাই তারা আরাে সৈন্য এবং অস্ত্রশস্ত্র আনতে শুরু করে। এ্যামবুশ, রেইড এতে আরাে বেড়ে যায়। এইসব আক্রমণের ফলে আমরা বুঝতে পারি যে আমাদের সৈন্যদের সংখ্যা বৃদ্ধি করতে হবে। অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ সগ্রহ করতে হবে। সৈন্যদের প্রশিক্ষণ জোরদার করতে হবে এবং তাদের বিশ্রামের ব্যবস্থা করতে হবে।
অটোবরের মাঝামাঝি রুঙ্গামারীর উপর আবার আক্রমণ চালানো হয় মেজর নওয়াজেশের নেতৃত্বে। তিন কোম্পানী সৈন্য দিয়ে এই আক্রমণ চালানাে হয়েছিল। ১৮ ঘন্টা প্রচণ্ড যুদ্ধের পর পাকিস্তান সেনাবাহিনী ভুরুঙ্গামারী ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়। এই আক্রমণে ভারতীয় গােলন্দাজ বাহিনীর সাহায্য নেয়া হয়েছিল। এই যুদ্ধে আমাদের পক্ষে অনেকেই হতাহত হয়। শত্রুবাহিনীকে আমরা পিছু ধাওয়া করি। শত্রুবাহিনীর সাথে আবার যুদ্ধ হয়। এই যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট সামাদসহ অনেকেই শহীদ হন। লেফটেন্যান্ট সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়। জয়মনিরহাটে মসজিদের সামনে তাকে সমাহিত করা হয়। জয়মনিরহাটকে সামাদনগর নামকরণ করা হয়। সামাদের মৃতদেহ উদ্ধার করতে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধা | দু’ভাই মৃত্যুবরণ করেন। এদেরকেও সামাদের সাথে সমাহিত করা হয়। | ভুরুঙ্গামারীতে পাকিস্তানী কোম্পানী-হেডকোয়ার্টার ছিল। ঐ বিল্ডিংয়ের এক কক্ষে ১৫ জন যুবতীকে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। কাছাকাছি এক স্কুলের বিল্ডিংয়ে নারী, পুরুষ এবং ছেলেমেয়ে প্রায় ২০০ জনকে বন্দী অবস্থায় পাওয়া যায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তাদেরকে জোর করে খাটিয়ে নিত। অনেককে ভােগের। সামগ্রী হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর অনেকের মৃতদেহ বিক্ষিপ্ত অবস্থায় পাওয়া যায়। ভুরুঙ্গামারীর আশেপাশের সমস্ত বাড়িঘর সম্পূর্ণরূপে জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল, চাষাবাদ সম্পূর্ণরূপে বন্ধ ছিল। জনমানবের কোন চিহ্নই পাওয়া যায় নাই। চারিদিকে শুধু ধ্বংসের চিহ্ন। সমস্ত এলাকাকে একটা ভূতুড়ে বাড়ির মত মনে হচ্ছিল। ভুরুঙ্গামারীতে বাঙ্কারের মধ্যে অনেক যুবতীয় লাশ পাওয়া যায়। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী বাঙ্কারের মধ্যে এইসব মেয়েদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালিয়েছিল।
এর পর পরই অমরখানা এবং বড়খাতাতে আক্রমণ চালানাে হয়। দুই জায়গা থেকেই পাকিস্তানী সেনাবাহিনী পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। বড়খাতার পতনের পর পাকসেনাবাহিনীর মনােবল একেবারে ভেঙ্গে যায়। তাদের বিভিন্ন ঘাটির দ্রুত পতন ঘটতে থাকে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর মনােবল পুরােপুরিভাবে ভেঙ্গে গিয়েছিল। অমরখানা থেকে মুক্তিযােদ্ধারা পঁচাগড়, বােদা দখল করে ঠাকুরগার। দিকে অগ্রসর হয়। এ দলটার নেতৃত্ব দেন ক্যাপ্টেন শাহরিয়ার ও স্কোয়াড্রন লিডার সদরুদ্দীন। দলটি হাতিবান্ধা আক্রমণ করেছিল। হাতিবান্ধা পতনের পর তারা ক্যাপ্টেন মতিউর রহমানের নেতৃত্বে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হয়। ভুরুঙ্গামারীর পর মেজর নওয়াজেশের এই বাহিনীটি নাগেশ্বরী দখল করে এবং ধরলা নদীর উত্তর পাড়ে পৌছায়। এ ছাড়াও আরাে দুটি গেরিলা বাহিনীর দুটো কলাম ফ্লাইট লেঃ ইকবালের নেতৃত্বে চিলাহাটি দিয়ে ডােমার, ডিমলা এগুলাে দখল করে নিলফামারীর দিকে অগ্রসর হয়। মােগলহাট থেকে আর একটি কলাম ক্যাপ্টেন দেলােয়ারের নেতৃত্বে লালমনিরহাটের দিকে অগ্রসর হয়।
রংপুর, সৈয়দপুর সেনানিবাস ছাড়াও ৬নং সেক্টরের সমস্ত এলাকা ১৬ই ডিসেম্বরের আগে মুক্ত হয়।
৯ নং সেক্টরের অধিনায়ক–মেজর (অবঃ) এম, এ জলিল।
মেজর (অবঃ) এম, এ জলিল। মুক্তিযুদ্ধে বরিশাল, পটুয়াখালী ও খুলনা জেলা নিয়ে গঠিত ৯ নং সেক্টরের কমান্ডার ছিলেন মেজর এম এ জলিল। এপ্রিল মাসে তিনি সুন্দরবনের কাছাকাছি ভারতের হিংগুলগঞ্জ সীমান্ত ফাঁড়ি দিয়ে ইস্টার্ণ কমান্ড হেডকোয়ার্টারে যান এবং সেখান থেকে অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রতিরােধ যুদ্ধ শুরু করেন। এছাড়া ৮ নং সেক্টরের কমাণ্ডার | মেজর ওসমান তাকে গােলাবারুদ ও অস্ত্র দিয়ে সাহায্য করেন। যুদ্ধের পর নবগঠিত জাসদের সহসভাপতি হিসেবে মেজর জলিলের রাজনৈতিক জীবন শুরু হয়। ১৯৮৪ সালের নভেম্বরে তিনি জাসদ থেকে পদত্যাগ করে ইসলামী ভাবধারার রাজনৈতিক দল জাতীয় মুক্তি আন্দোলন গড়ে তােলেন। ১৯৮৯ সালের ১৯ ই নভেম্বর পরলােক গমন করেন তিনি। | ৯ নং সেক্টরে সংঘটিত স্মরণীয় ঘটনা ও যুদ্ধের বিবরণ দিয়ে মেজর জলিল ‘সীমাহীন সমর” নামে একটি বই লিখেছেন। সেখান থেকেই কিছু উল্লেখযােগ্য অংশ এখানে তুলে ধরা হলাে। ১০ই এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুর ও খুলনা এই চারটি জেলার জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে আমাকে সেক্টর কমাণ্ডার ঘােষণা করা হয়। ঘােষণায় আরও উল্লেখ করা হয় যে, যুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর কমাণ্ডার-ইন-চীফ কর্নেল এম, এ. জি. ওসমানীর তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশকে প্রধান ৬টি সেক্টরে ভাগ করা হয়েছে। মিঃ তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী ও সৈয়দ নজরুল ইসলামকে অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট করে চার সদস্যের একটি অস্থায়ী সরকার ‘মুজিব নগরে” গঠন করার কথাও স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘােষণা করা হয়। ব্যাপার যাই হােক না কেন, এই ঘােষণার ফলে বাংলার ‘জনগণ • মুক্তিযােদ্ধারা সশ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য অন্ততঃ একটা ভিত খুজে পেল। শুরু পাকিস্তানী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরােধ। ইতােমধ্যে ১৭ই এপ্রিল।
একজন পাকিস্তানী গােয়েন্দা বরিশালে গ্রেপ্তার হয়। আমাদের অবস্থানগুলাে ও প্রস্তুতির খবরাখবর সংগ্রহ করার জন্য পাক-সামরিকবাহিনীর লেঃ কর্নেল শামস উক্ত গােয়েন্দকে খুলনা থেকে বরিশাল পাঠায়। উক্ত গােয়েন্দাকে যে পুরস্কার দিতে | পেরেছিলাম সেটা হলাে কঠিন মুত্যু। বরিশাল স্টেডিয়ামে জনতার সামনে প্রকাশ্যে তাকে গুলি করে হত্যা করা হল। তার অপরাধ ছিল ক্ষমার অযােগ্য। | বােধ হয় ১৭ই এপ্রিলের ঘটনার ফলশ্রুতিস্বরূপ পাক-বিমান বাহিনীর। দু’খানা স্যাবর- জেট ফাইটারকে বরিশালের আকাশে দেখা গেল। এই প্রথম বারের মত হিংস্র সামরিক জান্তা আমাদের যুদ্ধপ্রস্তুতির উপর আঘাত হানার সাহস পেল। ওই জঙ্গী বিমানগুলােকে ঠেকাবার মত আমাদের হাতে কিছু ছিল না। তবুও আমাদের সাহসী মুক্তিযােদ্ধারা সামান্য রাইফেল দিয়ে গুলি করার অনেক চেষ্টা করলাে। শহরের বিভিন্ন বেসামরিক অবস্থানের উপর নির্বিচারে গােলাবর্ষণ করলাে। বেলস পার্কের উত্তর দিকে ইংরেজ আমলের একটি উচু কাঠের ঘরে আমার হেডকোয়ার্টার। এই ঘর ও বেস পার্কের উপর প্রচণ্ড গােলা এসে পড়তে লাগলাে। এই পার্কের মধ্যেই ছেলেরা ট্রেনিং নিত। ছেলেরা ঐঞ্চের ভিতরে ঢুকে আত্মরক্ষা করলাে। দু’একটি ছােটখাট আঘাত ছাড়া আমাদের তেমন বিশেষ কোন ক্ষতি হয়নি। জঙ্গী বিমান দুটো যখন ঘুরপাক খেয়ে গুলিবর্ষণ করার জন্য নিচে নেমে আসে তখন বেসামরিক লােকজন বাইরে লাফিয়ে এসে মজা দেখতে থাকে। এই সরল মানুষগুলাে এর আগে কখনও ভাবতে পারেনি যে, ওই সুন্দর সুন্দর বিমানগুলাে এমন নির্মমভাবে দংশন করতে পারে। অজ্ঞতা ও সরলতার জন্য ওরা অনেক ভুগেছে। বেসামরিক ডাক্তাররা ভয়ে এদিক-ওদিক ছুটাছুটি করতে লাগলাে। মুহুর্তের ভেতরে গ্রামের দিকে ছুটে চললাে মানুষের কাফেলা। ভয়ে সব ফেলে রেখে শহর খালি করে উন্মাদের মত দৌড়াতে লাগলাে শহরতলীর দিকে। কি মর্মান্তিক দৃশ্য! ১৮ই এপ্রিল রাত্রে বিষাদের কালােছায়া শহরের সারা আকাশটা গুমােট করে ফেললাে। শহরের রাস্তাগুলাে জনমানবশূন্য। ভীষণ নীরব। কোথাও জীবনের স্পন্দন নেই। যেন ঘুমন্ত প্রেতপুরী। রাতে ভয়ানক অস্বস্তিবােধ করলাম। মুক্তিযােদ্ধাদের নিয়ে একটা বেশ বড় বাহিনী তৈরি করেছিলাম। কিন্তু সামান্য কিছু রাইফেল ছাড়া আমার কোন ভারী অস্ত্রপাতি ছিল না। প্রথমাবস্থায় বরিশালের পুলিশ অস্ত্রাগার ভেঙ্গে কিছু রাইফেল জোগাড় করেছিলাম। এসব হালকা অস্ত্র দিয়ে শুধু আত্মরক্ষা করা চলে। যাহােক, এপ্রিল মাসের ২২ তারিখে মিঃ মঞ্জ সুন্দরবনের গােপূর্ণ পথ দিয়ে অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ভারত হতে কিছু অস্ত্রপাতি নিয়ে এলেন। তিনি জানালেন যে, আরাে অস্ত্রপাতির ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমাকে গিয়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীর কাছ থেকে ওগুলাে নিয়ে আসতে হবে। সংবাদটা শুনে খুবই উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। এই সুযােগে সুন্দরবন, বঙ্গোপসাগর হয়ে ভারত থেকে অস্ত্র নিয়ে আসা সম্ভব হবে। এই দুর্যোগময় মুহূর্তেও আমার ছােট্ট মনটি অপার উৎসাহে উজ্জীবিত হলাে। এর চাইতেও বেশি রােমাঞ্চিত হলাম এই কথা ভেবে যে, চতুর গােয়েন্দার মত হানাদারদের চোখ ফাঁকি দিয়ে অস্ত্র নিয়ে আসব। লেফটেন্যান্ট মেহেদী, লেঃ জিয়া এবং লেঃ নাসেরকে যথাক্রমে পটুয়াখালী, বরিশাল ও খুলনায় যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে সাথে নিয়ে ভারত রওনা হলাম। | সুন্দরবন বাংলাদেশের বিখ্যাত অরণ্যানি। এই সুন্দরবনের গােপন পথ ধরেই আমার ভারত যাত্রা শুরু হলাে। রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিতাবাঘ, হরিণ ও অজগরে সুন্দরবন ভরপুর। জানা-অজানা অনেক শংকা ও বিপদের ঝুকি নিয়ে ছােট একটি লঞ্চ, পথের জন্য সপ্তাহের কিছু ব্লেশন ও অন্যান্য জিনিসপত্রসহ আমরা যাত্রা শুরু করলাম। সবাই মিলে লঞ্চে আমরা বিশজন নাবিক ছিলাম। এদের মধ্যে দু’জন বাহিনীতে ছিল। নাম সিদ্দিক ও জব্বার। আমাদের বলা হয়েছিল সুন্দরবনের চারপাশে পাকিস্তানী হানাদাররা গানবােট নিয়ে পাহারা দিচ্ছে। আর বাংলাদেশের নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর বর্বরের মত নির্বিচারে গােলাবর্ষণ করে। ভয়ানক সন্ত্রাসের সৃষ্টি করছে। সন্ধ্যার দিকে অনেক দূরে ‘পশুর’ ও শিন্সা’ নদীর মােহনায় হঠাৎ করে একটা গানবোেট চোখে পড়লাে। এই বিরাট নদী দু’টো অতিক্রম করে আমাদের নিরাপদ জায়গায় যেতে হবে। সামনেই দিগন্তবিস্তৃত। বঙ্গোপসাগর।’পশুর’ ও ‘শিল্পা এই বঙ্গোপসাগরে গিয়ে পড়েছে। অন্ধকারে। বিশাল জলরাশির দৃশ্য ভয়ংকর ও ভীতিপ্রদ। একটা প্রেতপুরীর মত। দলের অধিনায়ক হিসেবে আসন্ন বিপদের ভয়কে চেপে গিয়ে আত্মবিশ্বাসকে ঘা দিয়ে চাঙ্গা করে তুললাম। আমাদের লঞ্চের প্রধান পাইলট কিছুদিন আগেও একজন। কুখ্যাত চোরাচালানী ছিল। জংগলের সব গােপন রাস্তা তার নখদর্পণে। তাকে বললাম যদি কোন বিকল্প পথ থেকে থাকে তাহলে লঞ্চের গতি সেই দিকেই ঘােরাতে। সে আমার আদেশ মানলাে। আমি আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলাম। পরদিন ভারতের সীমান্তবর্তী চৌকি পারগােমতী এসে পৌঁছলাম।
এখানে আমাদের থাকতে বলা হয়েছিল। ভারতীয় সীমান্তরক্ষীরা আগেই আমাদের আসার খবর পেয়েছিল। তারা আমাদের আসার বৈধতা পরীক্ষা করে সামনে এগুবার অনুমতি দিল। ২৪শে এপ্রিল ভােরে ‘পারগােমতি’র একটা জায়গায় ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর ইন্সপেক্টর মিঃ পি. কে. ঘােষ আমাদেরকে বিদায় সম্ভাষণ জানালেন এবং অগ্রবর্তী ঘাঁটিতে যােগাযােগের পর ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর | সতর্ক পাহারায় ক্যাপ্টেন হুদা ও আমাকে সামনে এগুবার অনুমতি দিলেন। এই সময় আমরা ‘হিংগুলগঞ্জ’ নামক অপর একটি ভারতীয় সীমান্ত চৌকির দিকে অগ্রসর হচ্ছিলাম। সিদ্দিকসহ লঞ্চের অন্যান্য সাথীদের লঞ্চসহ এখানেই ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে রেখে গেলাম। নিরাপত্তা স্থানে পৌছার জন্য ভারতের সীমান্ত ধরে আমরা এগুতে লাগলাম। কারণ, নদীর ওপারেই পাকিস্তানী হানাদাররা ওঁৎ পেতে বসেছিল। ওপারের দূরত্ব এক হাজার গজের বেশি নয়। বর্বর পাকিস্তানী হানাদারদের মেশিনগানগুলাে যে কোন সময় গর্জে উঠতে পারে—এই ভয়ে আমরা সতর্ক ও সচেতন ছিলাম। দেখতে পেলাম ওপারে পাকিস্তানী সৈন্যরা টিগারে হাত দিয়ে আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে আছে। আমরা সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম। নদীর ঢেউগুলাে স্পীডবােটের কাঠের দেহটাকে হাপরের মত পিটাচ্ছিল। ভয় হলাে, ওর দেহটা না টুকরাে টুকরাে হয়ে যায়। | ঢেউয়ের বুক চিরে ক্ষুদে দৈত্যের মত স্পীডবােটটা আমাদের নিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে চললাে গন্তব্যস্থানের দিকে। মুখ ঘুরাতেই সামনে দেখতে পেলাম নদীর তীর বরাবর ভারতীয় সীমান্তে বেশ বড় বড় কতগুলাে বাড়ি। উপর দিকটা লাল, এমন কতকগুলাে সেনানিবাস এই বাড়িগুলাে চারদিক দিয়ে ঘিরে রেখেছে। বহু আকাংক্ষিত স্থানে নিরাপদে পৌছতে পেরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়লাম। নতুন করে ইস্পাত কঠিন সংকল্প ও শক্তি সঞ্চয় করলাম। ওই দিনই অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে ফিরে পাকিস্তানী পশুগুলাের উপর বর্বরতার সমুচিৎ জবাব দেবার জন্য মনটা, আমার কঠিন হয়ে উঠলাে। হাজার হাজার মুক্তিযােদ্ধা আমার নিরাপদ। প্রত্যাবর্তনের জন্য অধীর আগ্রহে প্রতীক্ষা করছিল। যাতে করে সাড়ে সাত কোটি অগ্নিদগ্ধ আত্মার শান্তির জন্য হিংস্র জানােয়ারদের উপর চরম আঘাত হানা যায়। আমরা হিংগুলগঞ্জে নামলাম। এবং সীমান্ত নিরাপত্তাবাহিনীর অধিনায়ক ক্যাপ্টেন পাণ্ডের অফিসে হেঁটে গেলাম। তিনি তাঁর অফিসে আমাদেরকে স্বাগত জানাবার জন্য প্রতীক্ষা করছিলেন। ক্যাপ্টেন পাওে সুঠামদেহী, সুন্দর ও বেশ লম্বা।
অত্যন্ত আন্তরিকতার সাথে স্বাগত জানালেন। আমি যা আশা করেছিলাম তার চাইতেও বেশি। এক কাপ গরম কফির পর আমাকে আবার এখনই ছুটতে হবে প্রথমে হাসনাবাদ, পরে ব্যারাকপুর। প্রথম ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী সেখানে। আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের সময় ক্যাপ্টেন পাণ্ডে শরণার্থী হয়ে ভারতে চলে আসেন। আমাকে স্বাগত জানাতে পেরে তিনি খুব আনন্দবােধ করলেন। তাঁর চোখের কোণে আশা ও প্রত্যয়ের ছাপ দেখলাম। আমাদের অনেক রাস্তা সুতরাং সময় নষ্ট না করে ওদের সেনাবাহিনীর পাহারায় আমরা তিনচাকার একটা গাড়ীতে চেপে পড়লাম। এই গাড়ীটির বন্দোবস্ত করেছিলেন মিঃ পাণ্ডে। তিনি হাসনাবাদে আমাদের আগমন-বার্তা অনেক আগেই জানিয়ে দিয়েছিলেন। সহকারী অধিনায়ক ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং সেখানে আমাদের জন্য অপেক্ষায় ছিলেন। হিংগুলগঞ্জ থেকে হাসনাবাদের দূরত্ব ১২ মাইল। কিন্তু মাঝপথে আমাদের দু’টো খেয়া পার হতে হবে। এই তিনচাকার গাড়ীটা দেখতে অদ্ভুত লাগে। এটার নাম ‘টেম্পাে’। | বেশ কষ্টকর ভ্রমণের পর আমরা হাসনাবাদ পৌছে গেলাম। গণপরিষদ সসদ্য। মিঃ নুরুল ইসলাম মঞ্জুর কাছ থেকে ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং আমার সম্বন্ধে অনেক কথা আগেই শুনেছেন। মিঃ মঞ্জুর সাথে আগে থেকেই এদের জানাশুনা হয়েছিল। ক্যাপ্টেন সিং কোমল হৃদয়ের অধিকারী, সুন্দর ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষ। আমাদের সবার কাছেই খুব প্রাণখােলা মনে হলাে। সামনে এসে মিসেস সিংও আমাদের খােশ আমদেদ জানালেন। এই ভদ্রমহিলা আর এক মধুর ব্যক্তিত্ব। দীর্ঘাগী, সুন্দরী। তাঁরা আমাদের সাথে অতি পরিচিত বন্ধুর মত ব্যবহার করলেন। এখান থেকে ব্যারাকপুর প্রায় সত্তর মাইল সামনে। এবার স্বয়ং ক্যাপ্টেন বিশ্রাম সিং-এর পাহারায় রওনা হলাম। হঠাৎ করে ঝড় ও অবিরাম বর্ষণ শুরু হলাে। কিন্তু সামরিক গাড়ীগুলাের আশ্রয় পেয়ে কতকটা নিরাপদ হলাম। দীর্ঘ দু’ঘন্টা ভ্রমণের * পর গাড়ীটা একটা দালানের কাছে থামলাে। ওর গায়ে লেখা ছিল ‘অফিসার মেস, ৭২ নং বি-এস-এফ (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স)। এটাই আমাদের সাময়িক গন্তব্য স্থান। বৃষ্টি থেমে গিয়ে আকাশে তারাগুলাে উকি মারলাে। বাইরে কিছুক্ষণ কাটানাের পর আমাদের নিয়ে যাওয়া হলাে ওদের অফিসার মেসে। আমাদের অফিসার মেসের চাইতে গুণগত দিক দিয়ে এটা অনেক নিচে। কিছু যায় আসে আমরা এখন ভিন্ন দেশের ৭২ নং বি-এস-এফ অফিসার মেসে। পথের ক্লান্তিতে বিশ্রাম নিতে ইচ্ছা করলাম। সুতরাং শীগগীরই পানীয় এলাে। সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসের ধ্বনি ছড়িয়ে এক ঝলক হাসি মুখে নিয়ে উপস্থিত হলেন একজন নতুন যুবক। ইনি হচ্ছেন ক্যাপ্টেন সরকার।
ভাই ও বন্ধুর চেয়েও বেশি অমায়িক। ব্যবহার পেয়েছিলাম এই ভদ্রলােক ও তাঁর স্ত্রীর কাছ থেকে। পরে আমরা আত্মীয়ের চাইতেও বেশি আপন হয়েছিলাম। এই ৭২ বিএসএফ বাহিনীর এডজুট্যান্ট ছিলেন তিনি। মিত্রবাহিনীর বন্ধুদের উল্লাসধ্বনিতে আমি স্বস্তি অনুভব করতে লাগলাম। বাস্তবিক পক্ষে আমরা খুব সুখে ছিলাম। এই সময় অধিনায়ক মিঃ মুখার্জী এসে পৌঁছলেন। অধিনায়কের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেয়া হলাে। বয়সী, লােক। ধূসর চুল, মুখাবয়বে অভিজ্ঞতার ছাপ। আমরা খুব আস্তে আস্তে কথা বললাম। ভেতরটা তাঁর বড় নরম, বড় কোমল। পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তিযুদ্ধে যে সফলতা এসেছে সেটা সম্ভব হয়েছিল তাঁর সুষ্ঠু নির্দেশনা ও ব্যক্তিত্বের জন্য। তাঁকে ভুলব না। কোন কোন লােকের কতকগুলাে অদ্ভুত চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য আছে। যেমন, আমি দেখেছি যখনই তারা তাদের ইপ্সিত কোন কিছু সমাধা করতে ব্যর্থ হয়েছে, তখনই বশ্যতা স্বীকার বা মাথা নােয়াবার পরিবর্তে ওই কাজটাকে সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার জন্য দ্বিগুণ উৎসাহে বার বার চেষ্টা করেছে। নিরাশ হয়নি বা আশা ছেড়ে দেয়নি। এইসব লােকদের আমি ঈর্ষা করতাম, তাদের পদাংক অণুসরণ করার জন্য স্থিরপ্রতিজ্ঞ হতাম। একবার দৃঢ় আত্মপ্রত্যয়ে বলীয়ান হলে পরাজয়ের গ্লানিটুকু অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। বাংলাদেশের সীমান্ত অতিক্রম করে যখন আমি ভারতে আসি, তখন মুক্তিসংগ্রাম চলাকালে এ রকম একটা অবস্থার সম্মুখীন হয়েছিলাম। শেষবারের মত আমি ৭২ নং ভারতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর অধিনায়ক মিঃ মুখার্জীর বাসভবনে থামলাম। অস্ত্রশস্ত্র যােগাতে তিনি আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন। নৈশভােজের পর তিনি আমাকে গাড়ীতে করে কোলকাতায় নিয়ে গিয়ে তার উর্ধ্বতন কর্মকর্তা নিরাপত্তা বাহিনীর ডেপুটি ইনস্পেক্টর জেনারেল মিঃ মজুমদারের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাঁকে জানালেন যে, অধিনায়ক হিসেবে। মুক্তি সগ্রামে অংশ গ্রহণ করে দেশের জন্য আমি অনেক কাজ করতে পারবাে। আমার কি কি অস্ত্রশস্ত্র প্রয়ােজন মিঃ মজুমদারকে জানালাম। তিনি বেশ ধৈর্যের সাথে কথাগুলাে শুনে আমাকে আশ্বাস দিয়ে ভদ্রভাবে বললেন যে, তার সামর্থমত প্রয়ােজনীয় অস্ত্রশস্ত্র যুগিয়ে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করবেন না। মিঃ মজুমদারের। ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। বেশী আশ্চর্য হলাম তাঁর সুন্দর ভদ্রতা-বােধ দেখে এবং আশ্বাস বাণী শুনে। | ওই দিনই সন্ধ্যায় কোলকাতার ‘আসাম হাউসে’নিরাপত্তা বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মিঃ রুস্তমজীর সাথে সাক্ষাৎ করতে হলাে। মিঃ মুখার্জীকে নিয়ে তার সাথে দেখা করলাম। আমার প্রতি যে আন্তরিকতা ও ভদ্রতা দেখিয়ে তিনি আমাকে সাদরে গ্রহণ করেছিলেন তাতে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছিলাম। বেশ আকর্ষণীয় চেহারার অধিকারী সিনিয়র অফিসার। তাঁর সাথে কথাবার্তায় আমার দৃঢ়বিশ্বাস হলাে যে, বেশ অল্পদিনের ভেতরেই আমরা অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাব। অস্ত্র যােগাড় করাটাই আমার আসল উদ্দেশ্য। আমার চলাফেরার সময় মিঃ মুখার্জী ও তার অফিসের কর্মচারীরা। আমাকে যথেষ্ট সাহায্য করেছিলেন।
তাঁদের ব্যবহার অত্যন্ত অমায়িক ও বন্ধুসুলভ। ১৯৭১ সালের ২৪শে এপ্রিল মিঃ মুখার্জী গাড়ীতে করে আমাকে মেজর উসমানের কাছে নিয়ে গেলেন। তিনি মুক্তিসংগ্রামের আর একজন অধিনায়ক। পাক দখলদার বাহিনীর সাথে তাঁর ক্ষুদ্র শক্তি নিয়ে পর পর কয়েকটা যুদ্ধ করে উত্তর বাংলার পট্রাপােলে তিনি ঘাটি গেড়েছেন। মেজর উসমান পাক-আমলে ইপিআর’এ চাকরি করতেন। তিনি অনেক হালকা অস্ত্রশস্ত্র যোগাড় করে রেখেছিলেন তার ঘাঁটিতে। প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র জমা দেখে আমার লােভ হলাে। কারণ, পৃথিবীর যে কোন জিনিসের চাইতে এই প্রয়ােজনের সময় যুদ্ধক্ষেত্রে একজন। সৈনিকের কাছে একটি মাত্র রাইফেল সবচেয়ে বেশী মুল্যবান। কেননা, অস্ত্র ছাড়া একজন সৈনিকের গর্ব ভূলুণ্ঠিত হতে বাধ্য। যাহােক, অনেক কষ্টে অনেক বলাকওয়ার পর মেজর উসমানকে বােঝাতে সক্ষম হলাম যে আমিও তার মত দেশের জন্য যুদ্ধ করতে যাচ্ছি। কিছুটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেজর উসমান রাজী হলেন। অন্ধকারের ভিতর আশার আলাে দেখতে পেলাম। সমস্ত কৃতিত্বই অধিনায়ক মিঃ। মুখার্জীর। তিনি নিজে মেজর উসমানকে ব্যাপারটার গুরুত্ব বুঝিয়ে রাজী। করিয়েছিলেন। সুতরাং এক ট্রাক বােঝাই হালকা অস্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম নিয়ে আমি হাসনাবাদ ফিরে এলাম। এখানে এগুলাে লঞ্চে বোেঝাই করার বন্দোবস্ত করতে হবে। মেজর উসমানের সাথে আলাপ-আলােচনার সময় আমার সহকারী ক্যাপ্টেন হুদা বেশ ধৈর্য ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিয়েছিল। তার উপরে প্রশাসনিক দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে আমি মিঃ মুখার্জীর সাথে ফোর্ট উইলিয়াম ও পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সদর দপ্তরে রওয়ানা হয়ে গেলাম। প্রথমে ইস্টার্ন কমাণ্ডের ইনটেলিজেন্স অফিসার কর্নেল খেরার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলাম। তিনি আমাকে অনেক প্রশ্ন করলেন পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীতে থাকাকালীন আমি কোথায় কোথায় ছিলাম, কি কি করেছি ইত্যাদি। তিনি যা প্রশ্ন করলেন সবগুলােরই উত্তর দিতে হলাে আমাকে। একটা লােক তার কানে কানে কি বলতেই আমাকে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হলাে। সেখানে পূর্বাঞ্চলীয় কমাণ্ডের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল জগৃজিৎ সিং অরােরার সাক্ষাৎ পেলাম। তার স্মিত হাসি ও আন্তরিক ভদ্রতা আমাদের ভেতর ‘পদের বাধা মুছে ফেললাে। আমার মনে সা এলাে। তাই কোন সংশয় না করে বা কোন কথা গােপন না করে তার কাছে মনের কথা সব কিছু খুলে বললাম। এর ফলে আমার উদ্দেশ্য পুরােপুরি সফল হলাে। একটা মানচিত্র তুলে ধরে বাংলাদেশের কোথায় কোথায় আমার গেরিলা ঘাঁটি আছে—তাঁকে দেখালাম। দেখে মৃদু হাসলেন এবং বললেন, ‘খুব ভাল। সাথে কর্নেল খেরাকে নির্দেশ দিলেন আমাকে প্রয়ােজনীয় সব রকম সাহায্য করতে।
এখানে কর্নেল খেরার সাথে আমাকে পুরাে তিনটা দিন থাকতে হয়। সামরিক বাহিনীতে অন্যান্য গােয়েন্দা অফিসারের মত তার অনুসন্ধিৎসু মনটা আমার সম্বন্ধে খুব উৎসুক হয়ে উঠলাে। বিশেষ গােয়েন্দা বিভাগের লােক হিসেবে খুব সতর্কতার সাথে কথা বললেন, নানা রকম প্রশ্ন করে | নিশ্চিত হতে চাইলেন যে, আমি সত্যিকারের মুক্তিযােদ্ধা কিনা। আমার পরিকল্পিত | কাজের বিলম্ব হওয়াতে এই কয়টা দিন আমি ভয়ানক অস্থিরতার ভেতর। কাটিয়েছিলাম। যাহােক, আমার বিরক্তি সত্ত্বেও, তাঁর ধৈর্য, বুদ্ধিমত্তা ও দেশের জন্য নিরাপত্তা বােধের আন্তরিক প্রশংসা না করে পারছি না। এখানেই তার কাছে প্রথম শুনলাম, ২৫শে এপ্রিল পাকিস্তানী দস্যুদের হাতে বরিশাল-ফরিদপুরের পতন হয়েছে। হতাশায় মনটা ভেঙে পড়লাে। এই জেলাগুলিকে রক্ষা করার পূর্ব পরিকল্পনা আমার সাময়িকভাবে ব্যাহত হওয়া সত্ত্বেও কঠিন সংকা নিলাম যে, যেভাবেই হােক এইসব অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই হবে। অস্ত্র তুলে দিতে হবে মুক্তিসংগ্রামীদের হাতে। আমার আশায় অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে ওরা। আমার বিলম্ব হবার আরও একটা কারণ হলােঃ সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে খবর পেয়েছিলাম যে, কর্নেল এম, এ, জি, ওসমানী যেভাবেই হােক আমার সাথে কোলকাতায় সাক্ষাৎ করতে চান। | ৫ই মে পর্যন্ত আমি তার অপেক্ষায় ছিলাম। কিন্তু তার ফিরে আসার কোন লক্ষণই দেখলাম না। কেউ বলতে পারলাে না কখন তিনি ফিরে আসবেন। তিনি তখন সীমান্তবর্তী অন্যান্য সেক্টর কমাণ্ডারদের সাথে যােগাযােগ করার জন্য কঠোর চেষ্টা করছিলেন। এই বিলম্বে ভয়ানক চিন্তান্বিত হয়ে স্থির করলাম আরদ্ধ কাজ সমাধা করার জন্য আমাকে এখনই রওয়ানা হয়ে যেতে হবে। ঠিক এই সময় মিঃ নুরুল ইসলাম মঞ্জ, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদা পরিবার-পরিজন নিয়ে হাসানাবাদে পৌছলাে। বরিশালের পতন হওয়াতে তারা চলে এসেছে। ক্যাপ্টেন হুদাকে নির্দেশ দিলাম যে, যখন আমি বাংলাদেশের অভ্যন্তরে থাকবে, তখন যেন বাহকের মাধ্যমে আমার সঙ্গে যােগাযােগ করা হয়। পরিস্থিতি অনুকল মনে হলে সরবরাহ ব্যবস্থা যেন অব্যাহত রাখে। আমাদের ক্যাম্পের দিকেও লক্ষ্য রাখতে বললাম। এই ক্যাম্পে মিঃ মঞ্জু, লেঃ নাসের ও ক্যাপ্টেন হুদার পরিবার-পরিজনও থাকতাে। সবাই মিলে মােট চল্লিশজন লােক দুটো লঞ্চে করে যাত্রা করলাম। আমাদের ভেতর চারজন নিয়মিত সেনাবাহিনীর লােক ছিল। বাকী সব ছাত্র। আমাদের গন্তব্যস্থানের রাস্তাঘাট আমার নিজেরও জানা ছিল না। লঞ্চে এরকম একটা দুঃসাহসিক যাত্রায় মােটেই ভরসা পাচ্ছিলাম না। যে কোন সময় বিপর্যয় আসতে।
পারে। যেহেতু যাওয়ার পথে শত্রুরা চারদিকে ওৎ পেতে বসে ছিল, আমরা সবাই লঞ্চের পাইলটের উপর নির্ভ করলাম। পাইলটরা তাদের অনেক বছরের অভিজ্ঞতার বড়াই করে আশ্বাস দিল যে, তারা আমাদের নিরাপদে পৌঁছে দেবে। ওদের দুঃসাহসিক কথাবার্তা ও আত্মবিশ্বাসের জোর দেখে স্বভাবতঃই • আমি আদেশ করা থেকে বিরত রইলাম, যেহেতু যাওয়ার প্রকৃত রাস্তাঘাট সম্বন্ধে আমি সম্পূর্ণ অপরিচিত। রাস্তা সম্পর্কে আমার ম্যাপ দেখা অস্পষ্ট ধারণা ছিল মাত্র। তৎসত্ত্বেও একটা সংক্ষিপ্ত ‘অপারেশন প্ল্যান তৈরী করলাম। প্রাথমিক পর্যায়ে বুঝিয়ে বললাম কি ভাবে দুটো লঞ্চে অস্ত্রশস্ত্র ভাগাভাগি করে নিতে হবে এবং শত্রুর সাক্ষাৎ পেলে নাগরিকরা কি করবে। যাত্রা শুরু করার হুকুম দিলাম। একটা লঞ্চে মঞ্জু, লেঃ নাসের এবং আরও কয়েকজন লােক আগে আগে চললাে। আমার লঞ্চটা আগেরটার পিছু পিছু রওয়ানা হলাে। কারণ, আমার লঞ্চে প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র ও অনেক অস্ত্রশস্ত্র বােঝাই ছিল। সামনের লঞ্চটায় মিঃ মঞ্জু ও লেঃ নাসেরকে অধিনায়কের দায়িত্ব পালন করার ভার দিলাম। পথের নিরাপত্তা সম্বন্ধে তারা দুজনেই বেশ আশ্বস্ত ছিলেন। কারণ, মাত্র দু’দিন আগেই তারা এই পথে হাসনাবাদ এসেছেন। ভারতের সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর পেটোল বােট ‘চিত্রাংগদা আমাদেরকে শামশেরনগর পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে গেল। এখান থেকে আমরা যাত্রা শুরু করবাে। শামশেরনগর ভারতের শেষ সীমান্তা ঘাটি। রাত ন’টা। শুরু হলাে যাত্রা। আশা-নিরাশার দোদুল দোলায় সারা দেহ মনে চাপা উত্তেজনা। যাত্রার লগে দূরে বহু দূরে দেখতে পেলাম গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির সাথে আকাশটার চমকানি। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি ছাড়াও রাত্রের গুমােট অন্ধকার। গত কয়েক দিনের ক্লান্তিতে আমার চোখ দুটো জড়িয়ে এলাে। ঘুম পেল আমার। ইঞ্জিনের কর্কশ শব্দের মাঝেও আমি গভীর ঘুমে গা এলিয়ে দিলাম। হঠাৎ একটা ধাক্কা খেয়ে ঘুম থেকে লাফিয়ে উঠে দেখি, কে যেন চাপা গলায় ডাকছেঃ ‘গানবােট, গানবােট স্যার। হ্যাঁ, সত্যিই তাে গানবােট!
ভূত দেখার মত উপরতলার ক্যাবিন থেকে ঝড়ের বেগে চীনা ‘কার্বাইনটা হাতে নিয়ে বেরিয়ে এলাম। ইঞ্জিন কক্ষে ঢােকা মাত্রই দু’দিক থেকে প্রচণ্ড সার্চলাইটের আলাে আর মেশিনগানের গুলি আসতে লাগলাে। ভেতরটা আমার অসম্ভব রকমের বকুনি দিয়ে উঠলাে। বুঝতে পারলাম, পাকিস্তানী গানবোেট ওৎ পেতে আমাদের ঘিরে ফেলেছে। রাতটা ভয়ানক বিক্ষুব্ধ। ঝড়ের দাপাদাপি। তার উপর চারিদিকে সূচীতেদ্য অন্ধকার আর মেশিনগানের অবিরাম গুলিবর্ষণ। সার্চলাইট দিয়ে এই বষ্টির মধ্যে হানাদাররা তন্নতন করে আমাদেরকে খোঁজ করতে লাগলাে। একটা গুলি এসে লঞ্চের পিছন দিকটায় আঘাত করলাে। শত্রুপক্ষকে বিভ্রান্ত করার জন্য আমার সাথের চার জন্য সৈনিক সিদ্দিক, হাবিলদার জব্বার, মােকছেদ ও ইউসুফকে প্রথমে রাইফেলের গুলি কতে বললাম। যেন শত্রুপক্ষ মনে করে আমাদের শক্তি খুব কম। আশ্চর্যজনক ভাবে আমার এই পরিকল্পনাটা কাজে এলাে। দেখতে পেলাম আমাদের বাঁ দিকের গানবােটটা পুরাে সার্চলাইট জ্বালিয়ে বৃষ্টি ও বিক্ষিপ্ত ঢেউগুলোর ভেতর দিয়ে। এগিয়ে আসছে। আমাদের লঞ্চটার পিছন দিকটায় আরও কয়েকটি গুলি এসে। লাগলাে। বাইরের প্রবল বৃষ্টিপাত ও বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দে গুলির আওয়াজ অস্পষ্টভাবে ভেসে আসছিল। সার্চলাইটের আলােকিত পথটুকুই শুধু চোখে পড়লাে। পৃথিবীর আর সব কিছুই দৃষ্টির বাইরে। কোন পথই খুঁজে পাচ্ছিলাম না। সমস্ত ব্যাপারটা এলােমেলাে হওয়া সত্ত্বেও অল্প সময়ের ভেতর পাল্টা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিলাম। ইতিমধ্যে যে গানবােট আমাদের দিকে এগিয়ে আসছিল, সেটা প্রায় লঞ্চের কাছাকাছি এসে গেল। বলতে ভুলে গিয়েছি যে, আমাদের লঞ্চটা স্থির হয়ে দাড়িয়ে ছিল। কিন্তু এটা নদীর তীরে, না মাঝখানে অন্ধকারে ঠিক বুঝে। উঠতে পারলাম না। দু’জনকে মেশিনগান, দু’জনকে ‘এনারগা গ্রেনেড’ সজ্জিত রাইফেল নিয়ে বাম দিকে বসিয়ে দিলাম। আমি নিজে একটা মেশিনগান নিয়ে ডানদিকের গানবােটটাকে লক্ষ্য করে প্রস্তুত হয়ে রইলাম। নির্দেশ দেয়ার সাথে সাথেই চারজনে ওই গানবােটটাকে লক্ষ্য করে প্রচণ্ড ভাবে গােলা বর্ষণ শুরু করলাে। এই সময় গানবােটটা আমাদের বেশ আওতার মধ্যে এসে গিয়েছিল। এই অতর্কিত আক্রমণে শত্রুরা ভয়ানক ঘাবড়ে গেল এবং ওদের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হলাে। ওদের হৈ-চৈ শুরু হলে এবং গানবােট থেকে বিরাট একটা আগুনের গােলা ছিটকে পড়লে বুঝতে পারলাম, আমাদের নিক্ষিপ্ত রকেট ঠিক জায়গায় আঘাত করেছে। বামদিকের গানবােটটাকে চিরদিনের জন্য নিস্তব্ধ করে দিয়ে ডানদিকের গানবােটটাকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ঘুরে বসলাম। কিন্তু ওটা বিপদের আশংকা করে মেশিনগানের আওতার বাইরে পালিয়ে গেল। যাহােক, শত্রুপক্ষকে ভীত সন্ত্রস্ত রাখার জন্য গুলিবর্ষণ অব্যাহত রইলাে। এই সুযােগে অন্য দু’জন লােককে আমাদের আগের লঞ্চটার খোঁজ নিতে বললাম। কিন্তু মনটা ভীষণভাবে দমে গেল যখন দেখলাম আগের লঞ্চটা ঠিক আমাদের বামদিকে চড়ার উপর বিধ্বস্ত অবস্থায় পড়ে আছে এবং ওর ভেতরের লােকজন আগেই পালিয়ে গিয়েছে। | সাথের বেশীর ভাগ লােকজন পালিয়ে গিয়েছে দেখে মনটা ভয়ানক দুর্বল হয়ে পড়লাে। এমন সময় পালিয়ে গেল যখন তাদের প্রয়ােজন ছিল সবচেয়ে বেশী। ভাগ্য ভাল আমরা তীরের কাছাকাছি ছিলাম। অনিশ্চয়তা, নিরাশা ও ভয়ের আশংকা। আমরা তাড়াতাড়ি লঞ্চ থেকে লাফিয়ে পড়লাম। পায়ের নিচে আঠালাে কাদা।
কোমর পরিমাণ জলের ভেতর দিয়ে অনেক কষ্টে নদীর তীরে পৌছলাম। তীরটা আমার কাছে উচু বাধের মত লাগলাে। নদী থেকে অনেক উঁচুতে বাধের উপর তাড়াতাড়ি ঘাটি গেড়ে বসলাম। সামনে থেকে যত আক্রমণই করা হােক না কেন আমরা এখানে পুরােপুরি নিরাপদ। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম। অচেনা, অজানা পথ। জীবনে কোনদিন এখানে আসিনি। এসব চিন্তা করে নিজেকে বড় অসহায় মনে হলাে। শত্রুর উপস্থিতি, ঝড়ের বিলাপ, কুচকুচে কালাে আধাঁর সব মিলে। | রাতটাকে একটা প্রেতাত্মার ছায়ার মত মনে হলাে। হঠাৎ দেখতে পেলাম বারে। পিছন দিকে মানুষের একটা অস্পষ্ট ছায়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শংকিত পদে ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটা লােক পালাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এত ভীত যে মনে হলাে পৃথিবীটা খুঁড়ে তার ভেতর গিয়ে লুকাবে। মৃদুভাবে তাকে স্পর্শ করতেই এমন জোরে চিৎকার শুরু প্রলাে যে, ভয়ে আমার শরীর কপিতে লাগলাে। তাকে সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও সে এমন বিলাপ করে চিৎকার আরম্ভ করলাে। যে, উপর দিকে একবার চাইবারও সাহস পেল না। গরীব বেচারা। প্রায় বিকারগ্রস্ত। অনেক চেষ্টার পর সে শান্ত হলাে। এই লােকটা হচ্ছে সেইসব পাইলটদের একজন যারা লম্বা লম্বা গালত্যা কথা বলেছিল। অবশ্য তার কোন দোষ নেই। কারণ, সে কোনদিন গুলির শব্দ শােনেনি। যাহােক এই লােকটা আমার। অনেক উপকারে এলাে। আমি কোন্ জায়গায় আছি এটা সে নির্ভুলভাবে বলে দিল। এসব ব্যাপারে এই ক্ষুদে ‘সাহসী’ লােকটির স্মৃতিশক্তির বেশ জোর আছে। এই জায়গাটার নাম ‘গাবুরা। জায়গাটার পরিবেশ ও অবস্থানের কথা চিন্তা করে সংশয় জাগলাে যে, ভাের হওয়া পর্যন্ত যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে শত্রুপক্ষ হয়তাে বা আমাদের মত লােভনীয় বস্তুগুলাের উপর হাওয়াই হামলা চালিয়ে ওদের। মেশিনগানের ক্ষুধা মেটাতে পারে। তাছাড়া আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শত্রুপক্ষ যদি স্থলপথে আক্রমণ করেই বসে তাহলে কিছুতেই রুখতে পারবাে না। এই অত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কোন রকমে ‘ক্রলিং’ করে গ্রামের অভ্যন্তরে চলে যাওয়া।
আমাদের পিছন দিকে এই গ্রামগুলাে প্রায় এক মাইল দূরে। ইতিমধ্যে। শত্রুপক্ষের গানবােটটা অনেক দূরে পিছিয়ে গিয়ে বাধের উপর আমাদের অবস্থান | ও নদীর তীরে পরিত্যক্ত লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে ভীষণভাবে মেশিনগান ও রকেটের গােলাবর্ষণ শুরু করলাে। ওদের অবিরাম গােলাবর্ষণে আমাদের দুটো লঞ্চেই আগুন ধরে গেল। বর্তমান অবস্থানে থাকাটা অযৌক্তিক ভেবে আমরা ক্রলিং করে কোন রকমে বাধের নিচের দিকে চলে গেলাম আর খােদাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কারণ, এই দুঃসময়ে এক খােদা ছাড়া আর কেউ শত্রুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গােলাবারুদ ছিল না। ঠিক এই সময় আমার সঙ্গের চারজন সৈনিক এদিক-ওদিক সরে পড়লাে। সম্ভবতঃ তারা গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পাইলট ছাড়া আর কাউকে আমার চারপাশে দেখলাম না। মেশিনগানের গর্জন আর রকেটের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে। পিছন দিকে মানুষের একটা অস্পষ্ট ছায়া মুখ থুবড়ে পড়ে আছে। শংকিত পদে ভয়ে ভয়ে কাছে গিয়ে দেখলাম একটা লােক পালাবার জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে। এত ভীত যে মনে হলাে পৃথিবীটা খুঁড়ে তার ভেতর গিয়ে লুকাবে। মৃদুভাবে তাকে স্পর্শ করতেই এমন জোরে চিৎকার শুরু প্রলাে যে, ভয়ে আমার শরীর কপিতে লাগলাে। তাকে সান্ত্বনা দেয়া সত্ত্বেও সে এমন বিলাপ করে চিৎকার আরম্ভ করলাে। যে, উপর দিকে একবার চাইবারও সাহস পেল না। গরীব বেচারা। প্রায় বিকারগ্রস্ত। অনেক চেষ্টার পর সে শান্ত হলাে। এই লােকটা হচ্ছে সেইসব পাইলটদের একজন যারা লম্বা লম্বা গালত্যা কথা বলেছিল। অবশ্য তার কোন দোষ নেই। কারণ, সে কোনদিন গুলির শব্দ শােনেনি। যাহােক এই লােকটা আমার। অনেক উপকারে এলাে। আমি কোন্ জায়গায় আছি এটা সে নির্ভুলভাবে বলে দিল। এসব ব্যাপারে এই ক্ষুদে ‘সাহসী’ লােকটির স্মৃতিশক্তির বেশ জোর আছে। এই জায়গাটার নাম ‘গাবুরা। জায়গাটার পরিবেশ ও অবস্থানের কথা চিন্তা করে সংশয় জাগলাে যে, ভাের হওয়া পর্যন্ত যদি আমরা এখানে থাকি তাহলে শত্রুপক্ষ হয়তাে বা আমাদের মত লােভনীয় বস্তুগুলাের উপর হাওয়াই হামলা চালিয়ে ওদের। মেশিনগানের ক্ষুধা মেটাতে পারে। তাছাড়া আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলাম। শত্রুপক্ষ যদি স্থলপথে আক্রমণ করেই বসে তাহলে কিছুতেই রুখতে পারবাে না। এই অত্যাসন্ন মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, কোন রকমে ‘ক্রলিং’ করে গ্রামের অভ্যন্তরে চলে যাওয়া।
আমাদের পিছন দিকে এই গ্রামগুলাে প্রায় এক মাইল দূরে। ইতিমধ্যে। শত্রুপক্ষের গানবােটটা অনেক দূরে পিছিয়ে গিয়ে বাধের উপর আমাদের অবস্থান | ও নদীর তীরে পরিত্যক্ত লঞ্চ দুটোকে লক্ষ্য করে ভীষণভাবে মেশিনগান ও রকেটের গােলাবর্ষণ শুরু করলাে। ওদের অবিরাম গােলাবর্ষণে আমাদের দুটো লঞ্চেই আগুন ধরে গেল। বর্তমান অবস্থানে থাকাটা অযৌক্তিক ভেবে আমরা ক্রলিং করে কোন রকমে বাধের নিচের দিকে চলে গেলাম আর খােদাকে স্মরণ করতে লাগলাম। কারণ, এই দুঃসময়ে এক খােদা ছাড়া আর কেউ শত্রুর হাত থেকে আমাদের বাঁচাতে পারবে না। কারণ, আমাদের কাছে পর্যাপ্ত গােলাবারুদ ছিল না। ঠিক এই সময় আমার সঙ্গের চারজন সৈনিক এদিক-ওদিক সরে পড়লাে। সম্ভবতঃ তারা গ্রামের দিকে পালিয়ে যাচ্ছিল। পাইলট ছাড়া আর কাউকে আমার চারপাশে দেখলাম না। মেশিনগানের গর্জন আর রকেটের প্রচণ্ড আওয়াজ শুনে। পাইলট আধমরার মত আমার কাছে পড়ে রইল। গােলার ভয়ংকর আগুন আমাদের। লঞ্চ দুটোকে নির্দয়ভাবে গ্রাস করলাে। পরাজিত মন ও ক্লান্ত দেহটা বাধের পিছন দিকে এলিয়ে দিয়ে হতাশার গ্লানি নিয়ে চেয়ে রইলাম লেলিহান বহ্নিশিখার দিকে। গােলার প্রচণ্ড শব্দ, রকেট বিস্ফোরণের বিকট আওয়াজ। উৎকট গন্ধে ভরপুর সমস্ত আকাশটা ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন—পরাজয়ের কালিমায় কিছুটা মলিন। পূর্ব দিকটা সামান্য হালকা হতেই পাইলটকে টেনে নিয়ে কোন রকমে গ্রামের ভেতরে ঢুকে সাহস করে। সেখানে এক হাজী সাহেবের বাড়িতে আশ্রয় নিলাম। আমাদের প্রতি সহৃদয় হবার জন্য ইঙ্গিতে তাকে অনুরােধ জানালাম। যখন তাকে খােদার চাইতেও জেনারেল ইয়াহিয়ার উপর বেশী অনুগত দেখলাম তখন যুগপৎ ভয় ও বিস্ময়ে মনটা বিচলিত হলাে। গ্রামের অধিকাংশ লােককেই দেখালাম বর্বর ইয়াহিয়ার প্রতি অনুগত ও ভক্ত।
আমাদের প্রতি ভয়ানক বিরূপ মনােভাবাপন্ন মনে হলাে। প্রকৃতপক্ষে এখানকার স্থানীয় লােকজনই আমাদের সাথের লেঃ নাসের, গণপরিষদ সদস্য মিঃ মহিউদ্দীন ও আরাে ছাব্বিশজন লােককে ধরে তাদের উপর অকথ্য অত্যাচার চালায় এবং সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। আমিও এই রকম একটা গন্ধ পেলাম যে হাজী সাহেব আমাদেরকেও পাকিস্তানী হানাদারদের হাতে তুলে দেবার জন্য গােপনে প্রস্তুতি নিচ্ছে। আমাদের চারদিকে অনেক লােকের ভীড়। তারা আমাদেরকে উৎসুক দৃষ্টিতে দেখছে। আমরা দু’টি যেন অদ্ভুত জীব। আমাদের এরকম দুরবস্থা দেখে ওদের মধ্যে কেউ কেউ দুঃখও প্রকাশ করলাে। এ অবস্থা দেখে হাজী সাহেবেরও বােধ হয় দয়া হলাে। তিনি আমাদের কিছু ভাত ও মধু দিলেন। এটা সুন্দরবনের বনাঞ্চলের লােকদের একটা বিশেষ খাদ্য। খাবার দেখা মাত্র আমার চোখ দুটো বড় হতে লাগলাে। কেননা আমি ও আমার সঙ্গী পাইলট উভয়েই ভয়ানক ক্ষুধার্ত ও ক্লান্ত ছিলাম। গত রাতের ভয়ংকর পরিবেশে আমি ওর সাথে বড় একাত্ম ও আপন হয়ে গিয়েছিলাম। যখন এই অনির্ধারিত খাবার শেষ করে ফেলেছি, ঠিক সেই সময় হাজী সাহেব হাতে করে রাইফেলের “ছেরেফ’ একটা বােন্ট নিয়ে হাজির হলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন যে, এটা কি? কেননা তাঁর ধারণা ছিলাে এটা কোন কাজে আসে না। তার চোখের কোণে ভীতির চিহ্নএই দালাল শিরােমণিকে নিয়ে কিছু মজা করবাে স্থির করলাম। তার হাতে বােল্টটা দেখেই ভীতিজড়িত কণ্ঠে চিৎকার দিয়ে উঠলাম এবং হাজী সাহেবকে বললাম যে, তাঁর হাতের জিনিসটা খুব মারাত্মক ডিনামাইট। মাটিতে যেন কোনরকমে না পড়ে তাহলে সবাই মারা যাবে। শুনে হাজী সাহেব ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে গেলেন। এইবার হাজী সাহেবকে হাতের মুঠোয় পেলাম। আমার কথায় তাঁর কাপন শুরু হলাে।
তাঁর চক্ষু স্থির, রক্তহীনের মত বিবর্ণ। আপাদমস্তক ভয়ে কাপতে লাগলাে। আমার হুশিয়ারী স্মরণ করে তিনি বােল্টটাকে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়ার মত সৎসাহসও দেখাতে পারছিলেন না। তার শােচনীয় অবস্থা দেখে আমি। বললাম যে, ডিনামাইটের হাত থেকে রক্ষা পাবার একমাত্র উপায় হচ্ছে, ওটাকে পানির মধ্যে ফেলে দেয়া। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলাে আমার কথা মত খুব আস্তে আস্তে আঙ্গুল টিপে টিপে বােন্টটার দিকে অপলক দৃষ্টি মেলে হাজী সাহেব পুকুরের দিকে রওনা হলেন। এই দুরবস্থার মধ্যেও আমার ভয়ানক হাসি পেল। যখনই এই মজার ব্যাপারটা ঘটছিল, তখন হঠাৎ গানবােট থেকে হাজী সাহেবের বাড়ির দিকে আবার গােলাবর্ষণ শুরু হলাে। হাজী সাহেবের বাড়িটা বড় একটা দালান। বহু দূর। থেকে দেখা যায়। এই আকস্মিক ঘটনায় গ্রামের লােকজন যে যেদিকে পারলাে ছিটকে পড়লাে। এটা আমাদের পালানাের জন্য আশীর্বাদস্বরূপ দেখা দিল। আমার সথের পাইলটটি মাত্র নদীর পথ সম্বন্ধে ওয়াকিবহাল ছিল। সে সাহচর্য ছাড়া আর কোন প্রয়ােজনে আসলাে না। যাহােক, একটা গর্তের মধ্যে লুকিয়ে থেকে দিনটা | কোন রকমে কাটিয়ে দিলাম। সন্ধ্যার সাথে সাথে আরম্ভ হলাে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি এবং সেই সঙ্গে বাতাসের শশা শোঁ শব্দ। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের প্রতি খুব সদয় ছিল। হাজী সাহেবের ব্যবহারে আশ্বাস ও স্বস্তির রেশটুকু খুঁজে না পেলেও আমাদের প্রতি তার ছেলের মমত্ববােধ দেখে এই দুঃসময়েও বাচার ক্ষীণ আশায় | বুক বাধলাম। হাজী সাহেবের ছেলে আমাদের খুঁজে বের করলাে। তাঁকে দেখে ভরসা পেলাম। সে আমাদের আশ্বাস দিল যে খুব ভােরে একটা নিরাপদ জায়গায়। | পৌছে দেবে। তাঁর সহানুভূতিশীল মনের পরিচয় পেয়ে যেখান থেকে পালিয়ে এসেছিলাম—আবার সেখানে ফিরে গিয়ে সযত্ন প্রহরায় নির্বিঘ্নে রাত কাটিয়ে। দিলাম। প্রতিশ্রুতি মত হাজী সাহেবের ছেলে রাস্তার সব খবরাখবর আমাদেরকে খুলে বললাে। এবং খুব ভােরে একটা নিরাপদ জায়গায় পৌছিয়ে দিয়ে গেল। খেয়া পার হবার জন্য সে আমাদের কিছু টাকা পয়সাও দিল। কেননা, রাস্তায় অনেক নদী। ও খাল পার হতে হবে। পথটা অত্যন্ত বিপদসংকুল। তাছাড়া সমস্ত অঞ্চলটা পাকদালালে ভর্তি। প্রাণটা হাতে নিয়ে অনেক কষ্টে আমরা প্রায় আধ মাইল পথ অতিক্রম করলাম। কখনো হেটে, কখনাে নৌকায়—এইভাবে ভারতের সীমান্তবর্তী ঘাঁটি হিংগলগঞ্জ এসে পৌছলাম। হিংগলগঞ্জের ঠিক উল্টোদিকে পাকিস্তানী সীমান্ত ঘাটি বসন্তপুর। পাকিস্তানী সৈন্যরা আমাদের ফেরার খাবার আগে থেকে পেয়েই ও পেতে আমাদের ধরার জন্য প্রস্তুত হয়ে ছিল। কিন্তু ওদের চোখে ধুলাে দিয়ে আমরা নিরাপদ জায়গায় পৌছে গেলাম।
২৬ জন ছাড়া সঙ্গের অন্যান্য সবাইও পৌঁছে গেল। আমরা যে বেঁচে গিয়েছি এটা ভাগ্য নয়। এটা একটা চরম পরাজয়। আর এজন্য আমিই দায়ী। কেননা, অধিনায়ক হিসেবে রাস্তাঘাটের সাথে পরিচিতি ছিলাম না। তারপর অধীনস্থ লােকদের উপর নির্ভরশীল হয়ে নিজের বিবেককে করেছিলাম খর্ব, তাই হারিয়ে ফেলেছিলাম নির্দেশ দেয়ার শক্তি। কিন্তু এক অর্থে এই পরাজয়ের গ্লানি একটা বিরাট বিজয়। কেননা, এটা একটা সাহসী পদক্ষেপ মাত্র। ভবিষ্যতে যাতে চরমভাবে আঘাত হানতে পারি তার জন্য নতুন করে শপথ। নিলাম। যদিও কোন করুণ দৃশ্যে আমি খুবই বিচলিত হয়ে পড়তাম এবং আমার উপরে এর প্রভাব ছিল ভয়ানক প্রবল, তবুও নৃশংস পাক-হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে আমার মনে জমা হতে লাগলাে চরম প্রতিহিংসা ও জিঘাংসার আগুন। বর্বর। পশু গুলাে হাজার হাজার বিরীহ নিরপরাধ বাঙালীকে গরু-ছাগলের মত ঘরছাড়া করে নিক্ষেপ করেছে দুঃখের অথৈ সাগরে। এক মুহূর্ত সময় নষ্ট না করে আমাদের যা কিছু সৈন্য ও অস্ত্রশস্ত্র ছিলাে, তাই নিয়ে ক্যাপ্টেন হুদাকে হিংগলগঞ্জে একটা আক্রমণ ঘটি স্থাপন করার জন্য নির্দেশ দিলাম। হিংগলগত হাসনাবাদ থেকে বারাে মাইল দক্ষিণে। পথের মাঝখানে দুটো নদী। ১৯৭১ সালের জুন মাসের প্রথম সপ্তাহে ক্যাপ্টেন হুদা ৩৫ জন মুক্তিযােদ্ধা ও ২০টি রাইফেল নিয়ে হিংগলগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করেন। হাসনাবাদ ও হিংগলগঞ্জের মধ্যে যাতায়াতের ব্যবস্থা ছিল তিন চাকা বিশিষ্ট ‘টেম্পাে’ নামে এক প্রকার গাড়ী আর নৌকা। ইছামতী নদী নৌকায় করে পার হতে হতাে।
কিন্তু এই নদীটা পার হওয়া খুব একটা নিরাপদ ছিল না। কারণ, ওপারে নদীর তীর বরাবর পাকবাহিনী অসংখ্য বাঙ্কার ও ট্রেঞ্চ খনন করে ওদের ঘাটি সুদৃঢ় করে নিয়েছিল। এই ঘাঁটিগুলাে ভারতের সীমান্তবর্তী অঞ্চল থেকে একজন পথিকেরও চোখে পড়তাে। হিংগলগঞ্জে ভারতের ৭২ নং সীমান্ত নিরাপত্তা বাহিনীর একটা স্থায়ী ফাড়ি আছে। ক্যাপ্টেন পাণ্ডে এর অধিনায়ক। তিনি তাঁর ফাঁড়ির এক মাইল দক্ষিণে একটি ঘটি বানাতে ক্যাপ্টেন হুদাকে সবরকম সাহায্য করলেন। এ ঘাটিটা ইছামতী নদীর তীর থেকে আধ মাইল ভিতরে। এর ঠিক উল্টো পারে পাক-হানাদারের সুদৃঢ় পর্যবেক্ষণ ফড়ি। এখানে ঘাটি স্থাপন করা কত কষ্টসাধ্য ক্যাপ্টেন হুদার তা ভালভাবেই জানা ছিল। আমারও ভাবনার অন্ত ছিল না। কেননা, অধিনায়ক হিসাবে তার চাহিদা মত তাবু, খাদ্য, অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, টাকা-পয়সা এবং যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী সৈন্যবাহিনীর মঙ্গলামঙ্গল ও অগ্রগতির জন্য অত্যাবশ্যকীয় জিনিসপত্র পাঠাতে ব্যর্থ হয়েছিলাম। কারণ, তাদের জন্য গভীর সহানুভূতি ছাড়া আমার কাছে তহবিল ছিল না। এর জন্য দুয়ারে দুয়ারে আমি পাগলের মত ঘুরেছি। শিগগিরই আমরা জীবনকে কঠিনভাবে উপলব্ধি করতে শিখলাম এবং গভীর পারস্পরিক সমঝোতার মাধ্যমে সব বিপদ, সব প্রতিকূল অবস্থানে রুখে দাড়াবার নতুন শক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলাম। বসন্তপুর ইছামতী নদীর পূর্ব তীরে। কেউ শুনে বা বইয়ে পড়ে দুঃখের কাহিনী হৃদয়ঙ্গম করতে পারবে না। ভারতের সীমান্তে হিংগলগঞ্জে দাড়িয়ে দৃষ্টি মেলে দিলে দেখা যাবে বসন্তপুর। মাঝখানে ছােট ইছামতী। দুর্নিবার ইচ্ছ, ভালবাসা ও আসক্তি সত্ত্বেও ওই রূপসী বাংলার কোলে ফিরে যাওয়া আমার পক্ষে। ভয়ানক কষ্টসাধ্য। কেননা, ওপারে মারণাস্ত্র নিয়ে অপেক্ষা করছিল মানবতার জঘন্যতম শত্রু। আমি আর স্থির থাকতে পারলাম না। ওই অসভ্য বর্বরদের হাত থেকে আমার মা-বােনদের বাঁচিয়ে আনার উদগ্র বাসনায় উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। ছটফট করতে লাগলাম। কিন্তু কি দিয়ে আমি তাদের বাচাবাে? মাত্র ৩৫ জন। মুক্তিযােদ্ধা আর ২০টা রাইফেল নিয়ে? হ্যা, এই অসম্ভব কাজেও আমরা জীবনকে বাজী রেখে ঝাপিয়ে পড়েছিলাম এবং সফল হয়েছিলমা। ১৯৭১ সালের জুন মাসের ১২ তারিখ।
সকাল থেকে ভয়ানক ঝড়। ভিতরে আমার ভয়ানক অস্বস্তি। কারণ, আমি জানতাম যে, ক্যাপ্টেন হুদার সাথের ছেলেরা এই ঝড়ের মধ্যে ছোঁড়া তাবুতে বসে বৃষ্টির জলে অসহায়ের মত ভিজছে। তা। ছাড়াও আমি ভাবলাম শক্রর উপর অতর্কিত আঘাত আনার এটাই সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। ভাবনাটা মাথায় আসতেই আমি উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। বলিষ্ঠ যুবক ডাক্তার শাহজাহানকে তাড়াতাড়ি তৈরী হয়ে আমার সাথে আসতে বললাম। প্রাণপ্রাচুর্যে জীবন্ত এই ডাক্তার সাহেব। সকাল ৮টায় আমরা দুজনে ওভারকোট নিয়ে হাসনাবাদ থেকে বেরিয়ে পড়লাম। ইছামতী পার হতে পুরাে এক ঘন্টা সময়। লাগলাে। হিংগলগঞ্জে যাওয়ার পথে এটাই প্রথম নদী। বাত্যাবিক্ষুব্ধ ছােট্ট ইছামতী আজ ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। এছাড়া খেয়ার মাঝি এই দুর্যোগময় মুহূর্তে খেয়া ছাড়তেও অস্বীকার করলাে। টাকায় সবকিছু সম্ভব। তাই সেই হাড্ডিসার রােগা খেয়াঘাটের মাঝি টাকার লােভ সংবরণ করে আমাদের প্রস্তাব উপেক্ষা করতে। পারলাে না। খুব কষ্টে নদী পার হলাম। কিন্তু বড় বিপদে পড়লাম। কেননা কোন । টেম্পাে গাড়ীওয়ালা এই দুর্যোগে ঝড়ের মধ্যে গাড়ী ছাড়তে সাহস পেল না। এই দুঃসাহসিক কাজে ওদের রাজী করাবার জন্য বেশ খানিকটা সময় কেটে গেল। শেষ পর্যন্ত তিনগুণ ভাড়ায় পৌঁছে দিতে ওরা সম্মত হলাে। বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে। আমরা বরুনহাট নামক একটা জায়গায় নদীর পাড়ে পৌছালাম। খুলনা জিলার। সাতক্ষীরা মহকুমার সাথে দুটো প্রধান স্থলপথে বসন্তপুরের যোগাযােগ ব্যবস্থা—একটা পারুলিয়া হতে কালিগঞ্জ ও নাজিমগঞ্জ হয়ে, অন্যটা সাতক্ষীরাশ্যামনগর রােড। পারুলিয়া থেকে যে রাস্তাটা গিয়েছে সেটা বেশ প্রশস্ত। সি-এও – বি’র রাস্তা। ভারী সামরিক যানবাহন এর উপর দিয়ে অনায়াসে যাতায়াত করতে পারে। কিন্তু পরেরটা বিশেষ সুবিধাজনক নয়। তবুও পাকিস্তানী শত্রুবাহিনী প্রায়ই এই রাস্তায় চলাফেরা করত। তাই সৈন্য চলাচল ও আক্রমণ পরিচালনার জন্য । সামরিক দিক দিয়ে বসন্তপুর ভয়ানক গুরুত্বপূর্ণ।
বসন্তপুর অধিকার করে। উপরােক্ত রাস্তা দুটোর উপর প্রভাব বিস্তার করার অর্থ একশ’ বর্গমাইল মুক্ত এলাকা হাতের মধ্যে আসা। এবং এই সংকটময় দিনগুলােতে এটা একটা সাংঘাতিক। ব্যাপার। | ইছামতী নদীর চাইতে বরুনহাটের এই নদীটি পাশে ছােট। কিন্তু দেখতে ভয়ংকর দৈত্যের মত। এই অবস্থায় খেয়া পার হওয়া সাংঘাতিক বিপজ্জনক। অযথা সময় নষ্ট না করে সুযােগসন্ধানী এক নৌকার মাঝিকে বেশী টাকা দিয়ে নদী। পার হলাম। কোন যানবাহন ছিল না। দীর্ঘ পাঁচ মাইল রাস্তা হেঁটে হিংগলগ। ক্যাপ্টেন হুদার আস্তানায় পৌছতে হবে। ভয়ানক শীত। তার উপরে বৃষ্টিতে সারা। শরীর ভিজে গিয়েছিল। হাঁটু পরিমাণ কাদা ভেঙে ক্যাপ্টেন হুদার ঘাটিতে। পৌছলাম। সামান্য একটু উঁচু জায়গায় তাবু খাটিয়ে ক্যাপ্টেন হুদা আস্তানা গেড়েছিল। তাঁবু ভেদ করে বৃষ্টির পানি পড়ছে। ক্যাপ্টেন হুদাকে বড় বিষন্ন মনে হলাে। উচু জায়গাটার চারদিকে বৃষ্টির পানি জমে সমুদ্রের মত মনে হলাে। প্রবল। বৃষ্টির মধ্যে আমাকে আসতে দেখে হুদা যেন নতুন প্রাণ ফিরে পেল। মুখে তার। দৃঢ়প্রত্যয়ের হাসি। কাছে গিয়ে কুশলাদি জিজ্ঞেস করলাম। ‘জয় বাংলা’ বলতেই সবাই বৃষ্টির মধ্যে লাফিয়ে পড়ে জয় বাংলা’ শেখ মুজিব জিন্দাবাদ’ ধ্বনি। তুলে আমাদের স্বাগত জানালাে। এই দৃশ্য অভূতপূর্ব। এত প্রাণচাঞ্চল্য আমি আর আগে কখনও দেখিনি। ওদের সেই প্রাণচাঞ্চল্যে খুঁজে পেলাম আগামী দিনের। বিজয়ােৎসবের গােপন সংকেত। ওদের মনােভাবের উত্তাপ লক্ষ্য করে আমি চিৎকার করে প্রশ্ন করলামঃ ‘আজ রাতেই তােমরা কি সবাই যুদ্ধ করতে রাজী আছ?’ ৩৫ জন মুক্তিযােদ্ধা ৩৫ শত লােকের মত চিৎকার দিয়ে উত্তর দিলঃ ‘হ্যা স্যার, আমরা সবাই প্রস্তুত। ওদের উচু মানসিক শক্তির পরিচয় পেয়ে আমি খুব ভরসা পেলাম। আগ্রহী কণ্ঠে বললাম, ও-কে। এই বলে ওদের বিদায় দিয়ে হুদার তাঁবুতে ফিরে গেলাম এবং আমরা ম্যাপের উপর ঝুকে পড়ে কোথায় আক্রমণ চালাতে হবে সবাইকে বুঝিয়ে দিলাম। এ ব্যাপারে সােবহান নামে একজন হাবিলদার অনেক সাহায্য করেছিল। পাকিস্তানী আক্রমণের আগে সােবহান বসন্তপুরে গােয়েন্দার কাজ করেছে। কাজেই সেখানকার সব খবরই তার জানা ছিল। ক্যাপ্টেন হুদার নেতৃত্বে এই অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে সে অত্যন্ত বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছিল।
রাত একটায় শত্রুপক্ষের বাঙ্কারে ঝটিকা আক্রমণের পরিকল্পনা। উদ্দেশ্য, ওদের বাঙ্কারে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে কাবু করা এবং পরিত্যক্ত অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাড়াতাড়ি পালিয়ে আসা। পরিকল্পনাটা শুনতে মধুর ও উত্তেজনাকর লাগলেও—এই ঝড়ের রাতে এই দুঃসাহসিক কাজটা সমাধা করা ছেলেখেলা নয়। তবু তারা, বা প্রথম অভিযানের অধিনায়ক ক্যাপ্টেন হুদা, মােটেই দমলাে না। খুব জোরে ঝড় বইলি। একবার ভাবলাম ঝড়ের রাতে এই বিক্ষুব্ধ নদীটা পার হওয়া সম্ভব হবে না। কিন্তু মন থেকে এই নৈরাশ্যকে দূরীভূত করলাম। কেননা আমাদের বিজয় সম্বন্ধে আমি খুবই আশাবাদী ছিলাম। জানতাম, সবাইকে বিস্মিত করে অভিযান সফল হবেই। ব্যস্তসমস্ত হয়ে সবাই সামান্য খাবার খেয়ে নিলাম। সৌখিন পাচকেরা এসব পাক করেছিল। তারাও অভিযানে শরিক হলাে। যখন আমি হুদার কাছে আমার উদ্দেশ্যের কারণ ব্যাখ্যা করছিলাম, তখন হঠাৎ করে আমার মাথায় একটা ধারণা এলাে যে, একই সঙ্গে টাউন শ্রীপুরে পাক-হানাদারের অপর একটি ঘটি আক্রমণ করব। ভারতের সীমান্তবর্তী শহর ‘টাকির অপর দিকেই টাউন শ্রীপুর। সেখানে শাজাহান নামে একটা স্কুল শিক্ষকের অধীনে অনেক টেও মােজাহিদ আছে। মিঃ শাজাহান বুদ্ধিমান, হাসিখুশী এবং উৎসর্গীকৃত প্রাণ। তিনি টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা ছিলেন এবং প্রশিক্ষণ দিয়ে হালকা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত একটি মােজাহিদ বাহিনীও গড়ে তুলেছিলেন। তারা টাউন শ্রীপুরের বাসিন্দা। হওয়ায় ওখানকার পাকিস্তানী ঘাটির সঠিক অবস্থান, রাস্তাঘাট ও অন্যান্য খুটিনাটি সম্বন্ধে বেশ ওয়াকেবহাল ছিল।
সুতরাং দুর্যোগময় রাতটার তাৎপর্য আমার কাছে দ্বিগুণ হয়ে উঠলাে। ক্যাপ্টেন হুদাকে বিদায় জানিয়ে আমি ও ডাক্তার শাজাহান দু’মাইল রাস্তা হেটে ‘টাকি’ এলাম এবং মিঃ শাজাহানের সাথে আলাপ-আলোচনা করলাম। তিনি সন্তুষ্টচিত্তে আমার অধীনে কাজ করতে রাজী হলেন। মিঃ শাজাহানের অধীনে লেঃ মুখার্জী নামে একজন অসম সাহসী যুবক কাজ করতাে। সে পূর্বে যশােরের অধিবাসী ছিল এবং দাবী করতাে যে, সে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর একজন ভূতপূর্ব অফিসার। বয়স পঁচিশের কাছাকাছি। বেশ শক্তিশালী। অন্য দু’জন মােজাহিদ সেসান লিডার মিঃ মণ্ডল ও সােবহানের সাথে লেঃ মুখার্জী একত্রে টনিং নিয়েছে। টাউন শ্রীপুরে পাক-হানাদারদের ঘাটি আক্রমণ করবাে শুনে মুখার্জী উত্তেজিত হয়ে উঠলাে। বসন্তপুর অভিযানের মত এখানেও এদের ইছামতী পার হয়ে যেতে হবে। ইছামতী আরও উত্তরে গােজাডাংগা পর্যন্ত গিয়ে গঙ্গায় পড়েছে। ভারতীয় সীমান্তবর্তী ঘটিগুলাের ঠিক অপর দিকে পাকিস্তানী পর্যবেক্ষণ ঘাটি। আমার সেক্টরে ইছামতী নদীর তীর বরাবর দু’তিন মাইল অন্তর পাকিস্তানী ঘটিগুলাের অবস্থান। সর্ব উত্তরে শংকরা। সেখান থেকে দক্ষিণ দিকে টাউন শ্রীপুর, দেবহাটা, খানজী, বসন্তপুর, উসা ও সর্বশেষ কৈখালি। এ সমস্ত পাকিস্তানী ঘাঁটিগুলাের শক্তি বিভিন্ন রকমের। ভাবলাম, আমার প্রথম কাজ হলাে। রাতের অন্ধকারে এবং গােপনে ক্রমাগত আক্রমণ চালিয়ে এই বিক্ষিপ্ত পাকিস্তানী। ঘাঁটিগুলাে অধিকার করা। এতে করে গেরিলাদের জন্য কতকগুলাে গােপন অবস্থানের পরিকল্পনা রা আমার পক্ষে সুবিধাজনক হবে। যার ফলে একটি মুক্তাঞ্চল গড়ে তােলা যায়। বাস্তবিকপক্ষে প্রথম অবস্থায় আমার পরিকল্পনা ছিল ভারতীয় সীমান্তে টাকি, হিংগলগঞ্জ ও শমসেরনগর এই তিন জায়গায় আক্রমণ ঘাটি করে এর ঠিক বিপরীত দিকে পাকিস্তানী ঘাঁটি টাউন শ্রীপুর, বসন্তপুর ও কৈখালি অধিকার করা।
কিন্তু অস্ত্রশস্ত্র ও অন্যান্য প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্রের অপ্রতুলতা হেতু আমার আশা সফল হয় নি। তবুও আমার কল্পনার উদ্দাম গতি থামে নি। যারা নিজেদের ভাগ্য গড়তে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ, আল্লাহ তাদের সাহায্যে এগিয়ে | আসেন। এ কথার সত্যতা প্রমাণিত হলাে ১৩ই জুন-যখন ক্যাপ্টেন হুদা বাহকের মারফত খবর পাঠালাে যে, সেই দুর্যোগময় রাত্রে মুক্তিযােদ্ধারা পাকিস্তানী ঘাঁটি আক্রমণ করে ২০ জন হানাদারকে খতম এবং ৫০টি রাইফেল, দু’টি এল-এমজি, অনেক অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ, গ্রেনেড ও বিস্ফোরক দ্রব্য হস্তগত করেছে। মুক্তিযােদ্ধারা ঘুমন্ত শক্রদের উপর হামলা চালিয়েছিল। শত্রুপক্ষের স্বয়ংক্রিয়। অন্ত্রের গুলিতে আমাদের একজন যুবক সামান্য আহত হয় মাত্র। শত দুঃখের মাঝেও বিজয়গর্বে বুক ফুলে উঠলাে। লেঃ মুখার্জী, মিঃ মণ্ডল, সােবহান ও মিঃ শাহাজান আমার সদর দপ্তরে এসে খবর দিল যে, তাদের আক্রমণও সফল হয়েছে। ওদের সবার মুখেই বিজয়ের হাসি। বিজয়ােল্লাসে মিঃ শাজাহান আমাকে অভিনন্দন জানালাে। আমিও আন্তরিকভাবে ওদেরকে স্বাগত জানালাম। আমার সুন্দরবনের ব্যর্থতার গ্লানি আজ যেন কিছুটা লাঘব হলাে। পরক্ষণেই প্রতিহিংসার দাবানল আমার ভেতরে আবার দ্বিগুণভাবে জ্বলে উঠলাে। মিঃ শাজাহানের নেতৃত্বাধীন মুক্তিযােদ্ধারা ৩৫টি রাইফেল ও প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র অধিকার করেছিল। এই বাড়তি অস্ত্রশস্ত্র হাতে আসায় আমার আক্রমণ পরিচালনা ঘাঁটির। পরিধি আরও প্রসারিত করতে মনস্থ করলাম। ওই দিনই মিঃ শাজাহানের। সহায়তায় টাকিতে আমার অন্তর্বর্তীকালীন ঘাঁটি স্থাপিত হলাে। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পাকিস্তানী দক্ষ সৈন্যের উপর দুর্যোগের মধ্যে হামলা চালিয়ে এই বিরাট সফলতা অর্জন করার জন্য আমি ক্যাপ্টেন হুদা, মিঃ শাজাহান, লেঃ মুখার্জী ও মিঃ মণ্ডলকে অভিনন্দন জানালাম। একই সঙ্গে খুব অল্প সময়ের ভেতর সীমান্তবর্তী সমস্ত পাকিস্তানী ঘাটিগুলাে আক্রমণ করার ইচ্ছা ওদের কাছে প্রকাশ করলাম। এ ছাড়াও আর একটা জিনিসের উপর জোর দিলাম যে, সীমান্তের ওপারের ছেলেদের যােগাড় করে এই মুহুর্তেই ওদের ট্রেনিং দেবার ব্যবস্থা করতে হবে। এইজন্য টাকি থেকে দুই মাইল দূরে ‘টকিপুরে একটি যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র খােলার পরিকল্পনা নিলাম। সীমান্তের ওপার থেকে ছেলে যােগাড় করার দায়িত্ব মিঃ শাজাহানকে দিলাম। বসন্তপুর ও টাউন শ্রীপুরে আমাদের সফলতার খবর সর্বাধিনায়কের কানে শীগগীরই পৌঁছে গেল। ভবিষ্যতে আরও এরকম সফলতা আশা করে তিনি স্বাগত জানালেন। ইতিমধ্যে সামরিক বাহিনীর অনেক লােক ও স্কুল-কলেজের ছাত্র সীমান্ত পার হয়ে এপারে চলে এলাে। ছাত্রদের টাকিপুর যুবকেন্দ্র ট্রেনিং এর জন্য এর সামরিক বাহিনীর লােকদের হদার ঘাটিতে পাঠিয়ে দিলাম। ওদের সাথে বরিশাল থেকে এম, এ, বেগ নামে একজন লােক এসে পৌছলাে। যুবক, শিক্ষিত ও চটপটে।
গায়ের রং কালাে, সারা মুখমণ্ডলে প্রতিভা ও চাঞ্চল্যের স্বাক্ষর। সে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীতে একজন দক্ষ প্যারাস্যুট সৈনিক ও একজন যুগম্যান হিসেবে। অনেক দুঃসাহসিক কাজে নিযুক্ত ছিল। এইসব কাজে ওর মতুল্য বড় একট। কেউ ছিল না। পশ্চিম পাকিস্তানের চেরাটে দীর্ঘ আট বছরের অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ে! পর পাকিস্তান নৌবাহিনীতে ‘মিডশীপম্যান’ হিসেবে প্রশিক্ষণ নেয়। ওখান থেকে ১৯৭১সালের মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে সে বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ রােমাঞ্চকর জীবন ছেড়ে পালিয়ে আসার কারণ জিজ্ঞাসা করায় সে উত্তর দিলঃ “বাংলাদেশ। | আরও দুটো সাহসী ছেলেকে সাথে নিয়ে বেগ জুন মাসের তৃতীয় সপ্তাহে হাসনাবাদ পৌছলাে। বরিশাল জিলার স্বরূপকাঠি থানার কুড়িগ্রাম নামক একটা গ্রামে পাকহানাদারদের সাথে সংঘর্ষের এক চমকপ্রদ কাহিনী শুনালাে সে। জায়গাটা স্বরূপকাঠি থানার অনেক ভেতরে। এখানে সারি সারি অনেক পেয়ারা বাগান আছে। দুটো সারির মাঝখানটা নালার মত। সেখানে যে-কেউ অনায়াসে আত্মগােপন করে থাকতে পারে। বেগ প্রায় একশ’ ঝানু মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে দিনের বেলায় এই নালার মধ্যে লুকিয়ে থাকতাে এবং রাতের অন্ধকারে ওখান থেকে বেরিয়ে এসে হানাদারদের উপর আঘাত হানতাে। সবার কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ছিল না। কারাে কারাে কাছে মান্ধাতার আমলের তীর-ধনুক, বর্শা ইত্যাদি থাকতাে। বেগ-এর বাহিনীর অবিরাম আক্রমণে বিধ্বস্ত ও বিপর্যস্ত পাক হানাদাররা। একদিন এক দালালের কাছে খবর পেয়ে দিনের বেলায়ই ওদের উপর আক্রমণ চালাবার জন্য অগ্রসর হলাে। বেগও ঠিক সময়মত বাহকের মারফত হানাদারদের অগ্রসর হবার সংবাদ জেনে গেল। এবং হাতের কাছে যে সমস্ত আগ্নেয়াস্ত্র ও পুরানাে আমলের তীর-ধনুক পাওয়া গেল তাই নিয়েই ওর লােকজনের প্রধান প্রধান জায়গায় বসিয়ে দিল। একদিকে নগণ্য অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত বাংলার দুর্জয়। মুক্তিবাহিনী, অন্যদিকে আধুনিকতম অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত পৃথিবীর অন্যতম দুর্ধর্ষ পাকিস্তানী সৈন্য। সবাই প্রস্তুত। কিন্তু প্রাচীন রােমনগরী বা অন্য কোন ইতিহাসপ্রসিদ্ধ যুদ্ধের মত এখানে বেজে উঠলো না কোন রণদামামা। উত্তেজনা চরমে উঠলাে যখন দালালরা প্রায় ৫০ জন হানাদারকে সাথে নিয়ে এসে পেয়ারা বাগানের ভেতর তল্লাশী চালাতে বললাে। হানাদাররা বাগানে ঢুকে খুব সতর্কতার সাথে বাগানের গভীর অভ্যন্তরে প্রবেশ করলাে।
দক্ষ শিকারীর মত বেগ তার দুঃসাহসিক মুক্তিবাহিনী নিয়ে অসম্ভব রকমের চুপচাপ। কোন সাড়াশব্দ নেই। ওরা অপেক্ষায় ছিল কতক্ষণে শত্রুপক্ষ বন্দুকের নলের আওতায় আসবে। পাকহানাদাররা মুক্তিযােদ্ধাদের ‘মুক্তি’ বলে ডাকতাে। অনেক তল্লাশী চালিয়েও কোন ‘মুক্তি’র খোঁজ না পেয়ে হানাদাররা পাকা পেয়ারায় ভর্তি একটা গাছের উপর বিশ্রাম নিতে লাগলাে। আর কি! চতুর্দিক থেকে আচমকা ছুটে আসতে লাগলাে বন্দুকের গুলি, তীর, বর্শা ইত্যাদি। হতভম্ভ হয়ে হানাদাবরা চিৎকার করতে করতে এদিক ওদিক ছুট দিল। ঘটনাস্থলেই ২০ জন হানাদার খতম হলাে। বাদবাকিগুলাে জীবনের মায়ায় পেয়ারা গাছে ভেতর দিয়ে দৌড়াতে লাগলো। ওদের পলায়নের পালাটাও খুব আরামে কাটলাে না। বাগানের বােলতা ও মৌমাছি ভয়ানকভাবে ওদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে হাতেমুখে হুল ফুটাতে লাগলাে।
পরে শুনেছি, পেয়ারা বাগানের এই পরাজয় হানাদারদের মনােবল ভেঙে দিয়েছিল। এই বােকাগুলাে শেষ পর্যন্ত স্থানীয় লােকজন দ্বারা সম্পূর্ণ পেয়ারা বাগান কেটে ফেলে আগুন ধরিয়ে দেয় যাতে করে ভবিষ্যতে ওরা নিরাপদ হতে পারে। এ ঘটনার পর বেগ তার গােপন আড়া ছেড়ে দিয়ে অন্য আর একটি জায়গায় গিয়ে ‘যাদু’ দেখাবার আয়ােজন করছিল। ঠিক এই সময় গোলাগুলির অভাব দেখা দিল। তাই ওকে বাধ্য হয়ে সুন্দরবনের গােপন পথ ধরে হাসনাবাদ আসতে হয়েছে। এই সময় বেগের মত কজন দক্ষ লােকের সাহায্য ও সহযােগিতার খুবই প্রয়ােজন ছিল। কেননা, সে নতুন মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা পদ্ধতি ও কলাকৌশল সম্বন্ধে প্রশিক্ষণ দিতে পারবে। তার ইচ্ছা ছিল বাংলাদেশের অভ্যন্তরে গিয়ে শক্রদের উপর আঘাত হানবে। কিন্তু ওকে আমি যেতে দিলাম না। প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিয়ে ওকে ক্যাপ্টেন হুদার কাছে পাঠালাম। বেগকে পেয়ে ক্যাপ্টেন হুদা ওর কাঁধেও কিছুটা দায়িত্ব চাপিয়ে দিল। | বসন্তপুর ঘাঁটি ও তার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আক্রমণ পরিচালনা করার দায়িত্ব ওদের একলার উপর ছেড়ে দিয়ে আমার দৃষ্টি আরও দক্ষিণে শমসেরনগরের দিকে নিবদ্ধ করলাম। হানাবাদ থেকে শমসেরনগরের দূরত্ব চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ মাইল। আক্রমণ পরিচালনার জন্য কৌশলগত কতকগুলাে মূল অসুবিধা ছিল। প্রথমতঃ জায়গাটা আমাদের আওতা থেকে অনেক দূরে। যাতায়াত ব্যবস্থা একমা। নদীপথ। দ্বিতীয়তঃ যদিও ভারতীয় সীমান্তবর্তী ফাঁড়িতে একটা বেতারব্যবস্থা। ছিল, তবুও আমাদের নিজস্ব কোন বেতারযন্ত্র না থাকায় এতদুর নিয়ন্ত্রণ রক্ষা করা আমাদের পক্ষে ছিল কষ্টসাধ্য। তাছাড়াও নতুন আক্রমণ ঘাঁটি স্থাপন করার আগে জনশক্তি ও প্রয়ােজনীয় উপকরণ-সামগ্রীর স্বল্পতার কথা চিন্তা করতে হবে। এই সমস্ত সমস্যা বিদ্যমান থাকা সত্ত্বেও নতুন করে কোন কিছু করতে যাব কিনা এ বিষয়ে নিজে নিজে ভাবছিলাম। সৌভাগ্যবশত একদিন ভােরে ২০০ ট্রনিংগ্রও মুক্তিযােদ্ধা বিহার প্রদেশের চাকুলিয়া থেকে এসে হাজির হলাে। এইসব যুবক মুক্তিযােদ্ধারা বাংলাদেশ সরকারের অনুরােধে ভারতীয় সামরিক বাহিনীর। তত্ত্বাবধানে ‘ ক্রোশ প্রােগ্রাম ট্রেনিং লাভ করে। প্রয়ােজনের সময় ওদের পেয়ে খুব স্বস্তি অনুভব করলাম। সংবাদ বাহকের মাধ্যমে আমাদের সর্বাধিনায়কের কাছ থেকে একখানা চিঠি পেয়ে আরও খুশী হলাম। তাতে লেখা ছিলঃ ”ব্যারাকপুরে চার্লি সেক্টর থেকে এই দু’শাে মুক্তিযােদ্ধার জন্য শীগগীরই অস্ত্রশস্ত্র পেয়ে যাবেন।” সংবাদটা দ্বিগুণ জোরে আমার কানে বাজতে লাগলাে।
দুশাে রাইফেল। সংবাদটা পাওয়ার পরেই মােজাহিদ ক্যাপ্টেন মিঃ শাজাহানকে ডেকে টাকির কাছাকাছি কোথাও একটা ঘাঁটি স্থাপন করার জন্যে স্থান নির্বাচন করতে বললাম। নিরাপত্তার খাতিরে আমি চাই নি যে, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধারা অদক্ষ মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে টাকিপুর যুদ্ধক্ষেত্রে এক হয়ে মিশে থাক। আমার দপ্তরে প্রয়ােজনীয় নির্দেশ দিয়ে মিঃ খুরশিদকে নিয়ে জীপে চাপলাম। খুরশীদ তথাকথিত আগরতলা মামলার একজন আসামীও ছিলাে। সে সাধারণত লেঃ খুরশীদ নামেই। পরিচিত। জীবনের মূল্যবান অংশটা সে পাকিস্তান নৌ বাহিনীতে কাটিয়েছে। একথা সে আমাকে প্রায়ই স্মরণ করিয়ে দিত। মিঃ খুরশীদ খুব সরল, সৎ ও দেশপ্রেমিক। মুখে সবসময় হাসি। এই ভদ্রলােকটি বন্ধুবান্ধবের জন্য যে কোন সময় নিজের জীবনকে বিলিয়ে দিতে পারতাে। একমুখ দাড়ি, প্রশস্ত দৃষ্টিভংগী। খুরশীদকে একজন পাক্কা গােয়েন্দার মত লাগতাে। জন্ম থেকেই সে আশাবাদী। ভয়ানক দুঃসময়ে ওকে আমি হাসতে দেখেছি। তার সাহচর্য পেয়ে খুব আশ্বস্ত হলাম এবং তাকে নিয়ে আমাদের সর্বাধিনায়কের সাথে দেখা করার জন্য তার সদর দপ্তরে রওনা হলাম। কি আর বলবাে-তিনি এমন একটা জায়গায় সদর দপ্তর স্থাপন করেছিলেন, যার নাম নিরাপত্তার (!) খাতিরে প্রকাশ করা যায় না। যাহােক, কিছুক্ষণ কথাবার্তা বলে তাঁর সাথে সাক্ষাৎপর্ব শেষ করলাম। কারণ, তিনি স্বল্পভাষী। বেশি কথাবার্তা পছন্দ করতেন না। কোলকাতাতেই মিঃ খুরশীদ, সুলতান আহমেদ নামে চটপটে এক ভদ্রলােককে আমার সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। অল্প পরিচয়ে বুঝতে পারলাম মিঃ সুলতান আহমেদ বেগের একজন প্রশিক্ষণ-গুরু। এই সংবাদে শুধু সাহসই পেলাম না, রীতিমত উত্তেজিত হয়ে উঠলাম। কেননা, এতে করে আমার নতুন আখড়ায় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ছেলেদের আরও উন্নত প্রণালীতে শিক্ষা দেওয়ার সুযােগ এসে গেল। আর এজন্য মিঃ সুলতানের। তত্ত্বাবধানে কাজ করার জন্য বেগকে নির্দেশও দিলাম। সুলতান ও খুরশীদকে সংগে করে কর্মচঞ্চল কোলকাতার রাস্তা দিয়ে ব্যারাক। পুরের দিকে ছুটলাম। চার্লি সেক্টর খুঁজে বের করতে বেশ সময় লেগে গেল। কেননা, এটা একটা নতুন সংস্থা। আমার ও মেজর ওসমানের সেক্টর থেকে আক্রমণ পরিচালনায় সমন্বয় সাধনের জন্য ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনী এই সংস্থা স্থাপন। করেছে। সংক্ষেপে চার্লি সেক্টরের পরিচয় হলাে- এর অধিনায়ক একজন।
ব্রিগেডিয়ার, তাঁর অধীনে দু’জনে মেজর, দু’জন ক্যাপ্টেন এবং কয়েকজন। কেরানী। ব্রিগেডিয়ার জানালেন যে, ভবিষ্যৎ আক্রমণ পরিচালনার জন্য সম্ভাব্য সব রকমের সাহায্যের জন্য তিনিই দায়ী। সব সময় তার ও স্টাফের সক্রিয় সহযােগিতা পাব বলে আশ্বাস দিলেন। দুর্যোগময় চারটি মাসের ব্যথাবেদনা, হতাশা ও অনিশ্চয়তার মাঝে এই প্রথমবারের মত সক্রিয় আশ্বাসের বাণী শুনলাম। এই প্রতিশ্রুতি আমাকে ভরসা দিল, সাহস যােগালাে। আমার ঝিমিয়ে পড়া মনটাকে আবার আশা-আনন্দের নতুন উদ্দীপনায় সজীব করে আরও কঠিনভাবে শত্রুপক্ষের উপর আঘাত হানার জন্য ফিরে এলাম আমার সদর দপ্তর হাসনাবাদে। এক এক দলে ছ’জন করে মােট ষাটজন মুক্তিযােদ্ধাকে জুলাই মাসের দ্বিতীয়। সপ্তাহে খুলনা পাঠিয়ে দিলাম। উদ্দেশ্য, শহরের ভেতরে ও চতুর্দিকে গেরিলা ঘাটি স্থাপন করা। মুক্তিযােদ্ধাদের বলে দিলাম, প্রাথমিক কাজ সমাধা করার পর যারা পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে, তাদেরকে আমার ঘাটিতে ফেরৎ পাঠিয়ে দিতে যাতে করে ওরা চেনা গােপন পথ ধরে ধরে পর পর গেরিলা দলকে বাংলাদেশের ভেতরে নিয়ে যেতে পারে। এই গেরিলা পদ্ধতি প্রবর্তন করার প্রথম উদ্দেশ্য হলাে বিকল্প গােপন পথ খুঁজে বের করা। দ্বিতীয়তঃ নির্ভরযােগ্য স্থানীয় লােকদের সহায়তায় শহরের ভেতরে ও তার চতুর্দিকে গােপন ঘাঁটি স্থাপন করা। তৃতীয়তঃ পথপ্রদর্শকদের ফেরত পাঠিয়ে খবরাখবর আদান-প্রদান করা। তখনকার দিনে এই কাজগুলো সমাধা করা খুবই কষ্টসাধ্য ছিল। কেননা, পাকিস্তানী পশুগুলাের হিংস্র থাবা গ্রামবাংলার সব জায়গায় তখন ছড়িয়ে পড়েছে। তবুও অকুতােভয় মুক্তিযােদ্ধারা কঠিন আত্মবিশ্বাসে বলীয়ান। ওদের ভেতরে কোন রকম অনিচ্ছা বা বিষাদের ভাব খুজে পেলাম না। এমন কি ওদের তীর চোখেমুখে দেখতে পেলাম চরম উত্তেজনা ও প্রতিহিংসার দুর্বার আগুন। ওদের এই আত্মবিশ্বাসের দু’টো কারণ হতে পারে। প্রথমতঃ খুলনার অধিবাসী, দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানী হানাদাররা নারকীয় ধ্বংসযজ্ঞে মেতে উঠলেও ভেতরের জনসাধারণের আওয়ামী লীগের উপর আস্থা ছিল। গেরিলাদের কাছে ছিল স্টেনগান, গ্রেনেড ও চাকু। ওদের নিরাপত্তা ও পথে যদি ওরা হঠৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে অথবা শত্রুর সামনে পড়ে তাহলে ওদের মােকাবেলা করার জন্য কিছু হালকা প্রনের বিস্ফোরক দ্রব্যও সাথে দিয়ে দিলাম। প্রাণঢালা আশীর্বাদ করে আগের নির্দেশানুযায়ী ওদের বিভিন্ন রাস্তায় পাঠিয়ে দিলাম।
সময়টা ছিল ১৪ই জুলাইয়ের রাত্রি। শত্রুপক্ষের সামরিক যন্ত্রটাকে স্তব্ধ করার জন্য শিল্প এলাকায় আমার দ্বিতীয় পর্বের আক্রমণ শুরু হলাে। শিল্প এলাকাগুলাের কার্যক্ষমতা অচল করে দিতে পারলে সামরিক যন্ত্রটাকে বাচিয়ে রাখার মত হানাদারদের অর্থের অনটন ঘটবে। এই কাজটা খুবই মর্মান্তিক। কেউই চায় না তার নিজের দেশের শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলাে ক্ষতিসাধন বা ধ্বংসপ্রাপ্ত হােক। এছাড়া কোন উপায় ছিল না। কেননা, আমাদের সামগ্রিক সাফল্য অর্জনের জন্য এ কাজটা ভয়ানক প্রভাব বিস্তার করবে এবং সেই সঙ্গে শত্রুপক্ষের আক্রমণধারাও পঙ্গু করে। দেবে। ইতিমধ্যে ক্যাপ্টেন হুদাও তার ঘাটি থেকে আক্রমণের গতি বেশ সন্তোষজনকভাবে বাড়িয়ে দিল। জুলাই মাসের শেষ নাগাদ ৩৫ জনের ছােট্ট বাহিনীটি বাড়তে বাড়তে ৩৩০ জনে এসে দাঁড়ালাে। শত্রুপক্ষের উপর রীতিমত আক্রমণ চালিয়ে তারা বেশ কিছুটা সাফল্য অর্জন করলাে। বেগের অক্লান্ত সহযােগিতায় হদা পাক-বাহিনীর তিনটি সীমান্ত ঘাটি ধ্বংস করে দেয়। এর । ভেতর ছিল দক্ষিণে উত্স, বসন্তপুরের উত্তরে দেবহাটা ও খানজী সীমান্ত ফাঁড়ি। মাইন, ডিনামাইট ও গ্রেনেড বিস্ফোরণে ওই ফাড়িগুলাে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল।
উত্স অঞ্চলে পাকিস্তানী সৈন্যরা পাহারায় বেরুলে মুক্তিযােদ্ধারা কিভাবে ওদের কাবু করেছিল, সে সম্বন্ধে হুদা আমাকে একটি চমকপ্রদ কাহিনী। শােনালাে। ওঁৎ পেতে পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর আঘাত হানার জন্য জুলাই মাসের ২৮ তারিখ রাত্রে ক্যাপ্টেন হুদা ১৫ জন মুক্তিযােদ্ধার একটি দল নিয়ে ইছামতি পার হলাে। পাকিস্তানী সৈন্যরা উত্স ঘাটিতে খুব ভােরে পাহারায়। বেরুতে। হদা ও তার সাথের লােকেরা একটা খুঁটির সাথে ‘জয় বাংলা পতাকা লটকিয়ে তার চারিদিকে ‘এন্টিপারসনাল’ মাইন পুঁতে রেখে নিকটবর্তী একটা। ধানক্ষেতের মধ্যে লুকিয়ে থাকে। হঠাৎ করে ওরা ফিস ফিস শব্দ শুনতে পেল। পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের দিকে এগিয়ে আসছে। তখনও গাছের ফাঁকে ফাঁকে কিছু কিছু আবৃছা অন্ধকার। হুদা ও তার সাথের লােকজন জল-ভর্তি ধানক্ষেতের মধ্যে চুপচাপ প্রস্তুত হয়ে রইলাে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত হানাদাররা এদিকে আসলো না। উড়ন্ত ‘জয় বাংলা পতাকাটা চোখে পড়তেই মাথাভারী কুত্তার দল তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলাে এবং ওটাকে নামিয়ে পুড়িয়ে ফেলার জন্য বিশ্রী ভাষায় গালিগালাজ করতে করতে ছুটে আসলাে। আর যায় কোথায়? সমস্ত পৃথিবীটাকে কাপিয়ে প্রচণ্ড বিস্ফোরণ। হাতির মত পাকিস্তানী দৈত্যগুলাে টুকরাে টুকরাে হয়ে ছিটকে পড়লো এবং হুদা তার লােকজন ও শত্রুদের পরিত্যক্ত অস্ত্র নিয়ে নিরাপদে ঘাটিতে ফিরে এলাে। আমার মনে পড়ে ‘ভট্টাচার্য’ নামক দশ বছরের একটি ছেলে বেগের বিশেষ ‘বাহিনীতে যােগ দেয়। এই বিশেষ বাহিনীটির নাম ‘হার্ড কোর অব সার্জেন্টস’। এর বিশেষত্ব ছিল বারাে বছরের ঊর্ধ্বে কোন বালককে এই বাহিনীতে নেয়া হতাে। না। নতুন এসেও, ভট্টাচার্য কঠিন পরিশ্রমের বলে সার্জেন্ট মেজরের পদে উন্নীত হলাে। সে নিজে অনেক যুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছে। উপরন্তু, চারদিকে শত্র থাকা সত্ত্বেও তাদের অবস্থান, শক্তি, সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ রাস্তায় পারুলিয়া ব্রীজের খুটিনাটি-সব মূল্যবান সংবাদ সহের জন্য তার ক্ষুদে বাহিনীকে যােগ্যতার সাথে পরিচালনা করেছে। পারুলিয়া ব্রীজটা লম্বায় প্রায় ১৫০ ফুট। এই ব্রীজের উপর দিয়েই হানাদাররা তাদের রসদসম্ভার, অস্ত্রশস্ত্র কালিগঞ্জ ও বসন্তপুরে নিয়ে যেত। ব্রীজটার উপর হামলা চালানাের দিন ভট্টাচার্য রাতের অন্ধকারের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে ব্রীজের এক প্রান্তে পাহারারত সান্ত্রীদের কয়েক গজের মধ্যে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাে।
আর এদিকে বেগ ব্রীজের নিচে বিস্ফোরক দ্রব্য রেখে দিল। সংকেত দিতেই এই দশ বছরের সার্জেন্ট মেজরটি ঝােপের আড়াল থেকে শক্রর দিকে গ্রেনেড ছুঁড়ে মারলাে। কোনদিক থেকে গ্রেনেট ছুঁড়েছে টের পাবার আগেই সান্ত্রীরা মাটিতে লুটিয়ে পড়লাে। তারপর সার্জেন্ট মেজরটি তার ছােট। কনুইয়ের উপর ভর করে হামাগুড়ি দিয়ে পূর্বনির্ধারিত স্থানে এসে মিলিত হলাে | এবং নীরবে অপেক্ষা করতে লাগলাে কখন বিস্ফোরণের ভয়ানক গর্জনটা কানে ভেসে আসবে। দীর্ঘমেয়াদী বিস্ফোরক দ্রব্য বুকে নিয়ে ব্রীজটা অসম্ভব রকমের নীরব ও শান্ত। মগজহীন হানাদার সান্ত্রীরা ভারী বুট পায়ে ব্রীজের অপর প্রান্তে। পায়চারি করছিল। বেগ হাতঘড়িটার দিকে তাকালাে। সময় আসন্ন। উহ! কি ভয়ানক উত্তেজনা। প্রচণ্ড শব্দ করে ব্রীজের বেশীর ভাগ অংশ উড়ে গেল। আর পােশাক পরা পাকিস্তানী পশুগুলাে চিরদিনের জন্য ভেসে গেল ষােতের জলে।”