You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

অষ্টম অধ্যায়
১৯৭০ সালের নির্বাচন, অসহযোগ আন্দোলন ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা

ক. নির্বাচনের ফলাফল এবং তা মেনে নিতে কেন্দ্রের অস্বীকৃতি
১৯৭০ সালের ২৮ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান Legal Framework order. আইনি কাঠামোর ঘোষণা দেন।
এলএফও-এর প্রধান দিকগুলো-
১. জাতীয় পরিষদে ৩১৩ জন সদস্য নিয়ে গঠিত হবে। এর মধ্যে ১৩ জন মহিলা থাকবেন।
২. শাসনতন্ত্র গণতান্ত্রিক হবে। জনসংখ্যার ভিত্তিতে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার থাকবে।
৩. শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য ১২০ দিন সময় দেওয়া হবে। ১৯৭০ সালের ১ জুলাই থেকে এক ইউনিট বিলুপ্ত হবে।
৪. ১ জুলাই হতে চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকীর কাজ শুরু হবে।
৫. ১৯৭০ সালের ৩০ মার্চ এলএফও জারি হবে। শাসনতন্ত্র হবে ইসলামী শাসনতন্ত্র।
পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশে আসন সংখ্যা নিমরূপ হবে-
জাতীয় পরিষদ
পূর্ব পাকিস্তান- ১৬৯
পুরুষ- ১৬২
মহিলা- ৭
পশ্চিম পাকিস্তান -১৪৪
পুরুষ- ৮২
মহিলা- ৩
সিন্ধু -২৭
পৃষ্ঠা: ২০০

মহিলা- ২
বেলুচিস্তান- ৪
মহিলা- ১
সীমান্ত প্রদেশ -১৮
উপজাতি- ৭
মহিলা- ১
প্রাদেশিক আসন
পূর্ব পাকিস্তান- ৩০০
পশ্চিম পাকিস্তান- ৩১৩
১৯৭০ সালে ৫ অক্টোবর জাতীয় পরিষদ এবং ২২ অক্টোবর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন হবে।

ডাকসু নির্বাচন
১৯৭০ সালের ১৭ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদ- ডাকসুর নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আ স ম আবদুর রব ডাকসুর সহ-সভাপতি ও আবদুল কুদুস মাখন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। বিশ্ববিদ্যালয় ৮টি হলের মধ্যে ৬টি হলে ছাত্রলীগ বিজয়ী হয়। ১৪২টি কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় ও হল নির্বাচনে ১৩২টিতে। ছাত্রলীগ জয়লাভ করে। ছাত্রলীগের বিজয়ে স্বাধীনতা অর্জনের পথ সুদৃঢ় করে। তারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব প্রদান করে।

আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন,৪ জুন ১৯৭০
১৯৭০ সালের ৪ জুন আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক কাউন্সিল অধিবেশন ঢাকার হোটেল ইডেনে অনুষ্ঠিত হয়। ১১৩৮ জন কাউন্সিলর অধিবেশনে যোগ দেন।
১৯৭০ সালের ৪ জুন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কমিটি নিমের সদস্যদের নিয়ে গঠিত হয়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান -সভাপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- সহ-সভাপতি
ক্যাপটেন মনসুর আলী খন্দকার- সহ-সভাপতি
মোশতাক আহমেদ- সহ-সভাপতি
তাজউদ্দীন আহমদ- সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান চৌধুরী- সাংগঠনিক সম্পাদক
আবদুল মোমিন- প্রচার সম্পাদক
পৃষ্ঠা: ২০১

মোহাম্মদ উল্লাহ- দপ্তর সম্পাদক
জহুর আহমেদ চৌধুরী- শ্রম সম্পাদক
বেগম বদরুন্নেসা- সমাজসেবা ও সংস্কৃতি
মোহাম্মদ মোহসিন- কোষাধ্যক্ষ

৬ জুন হোটেল ইডেনে পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কমিটি গঠিত হয়।
সভাপতি- বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমান
সম্পাদক- এ এইচ এম কামরুজ্জামান
শেখ মুজিবুর রহমান ২৭ জুন হতে ৬ জুলাই পশ্চিম পাকিস্তান সফর করেন। তিনি পূর্ব বাংলায় সকল জেলা, মহকুমা ও থানায় নির্বাচনী সফর করেন।
নির্বাচনের তারিখ পরিবর্তন করে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ও ১৬ ডিসেম্বর করা হয়। নির্বাচন কমিশন ১৯৭০ সালের ৮ অক্টোবর দলীয় প্রতীক বরাদ্দ করে।
১. পাকিস্তান আওয়ামী লীগ -নৌকা
২. পিডিপি -ছাতা
৩. পিপলস পার্টি- তরবারি
৪. জামায়াতে ইসলামী- দাঁড়িপাল্লা
৫. মুসলিম লীগ কাইয়ুম- বাঘ
৬. কনভেনশন মুসলিম লীগ- বাইসাইকেল
৭. ন্যাপ ওয়ালী- কুঁড়েঘর
৮. ন্যাপ ভাসানী- ধানের শীষ
৯. জমিয়তে ওলামায়ে ইসলাম -খেজুর গাছ

১৯৭০ সালে ২৮ অক্টোবর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বেতার-টিভিতে নির্বাচনী ভাষণ দেন। তিনি নির্বাচনে জয়লাভের জন্য নিম্নলিখিত ইশতেহার দেন।
১. ৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান;
২. বাঙালিদের প্রতি বৈষম্য দূর করতে হবে;
৩. শাসনতান্ত্রিকভাবে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে;
৪. স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনের স্পষ্ট রূপরেখা;
৫. অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর;
৬. দুর্নীতি দমন;
৭. ভূমি সংস্কার-২৫ বিঘা পর্যন্ত ভূমি খাজনা মাফ;
৮. উভয় অঞ্চলে দ্রব্যমূল্যের সমতা। বর্তমান করাচীতে সোনা প্রতিভরি ১৩৫ টাকা, ঢাকায় ১৫০ টাকা। ঢাকায় চালের মণ ৫০ টাকা, পশ্চিম পাকিস্তানে ২৫ টাকা;
পৃষ্ঠা: ২০২

৯. পাটের ন্যায্যমূল্য প্রদান;
১০. গ্যাসের সদ্ব্যবহার;
১১. যমুনা, বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষার ওপর সেতু নির্মা;
১২. জনসংখ্যার ভিত্তিতে চাকরিতে নিয়োগ;
১৩. প্যারামিলিটারি বাহিনী গঠন;
১৪. চাষীদের বহুমুখী সমবায় সমিতি প্রতিষ্ঠা, ভূমিহীনদের ভূমি বণ্টন;
১৫. ৫ বছর বয়স্ক শিশুদের বাধ্যতামূলক অবৈতনিক শিক্ষা প্রদান;
১৬. প্রতি ইউনিয়নে একটি পল্লী চিকিৎসা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা, হাসপাতাল প্রতিষ্ঠা।
১৭. উপজাতীয় এলাকায় সর্বাত্মক উন্নয়ন;
১৮ . সর্বনাশা ফারাক্কা বাঁধের ফলে যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সর্বনাশ হবে তা মোকাবেলা করা।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার জনগণের মধ্যে সাড়া জাগায়। তারা আওয়ামী লীগের পতাকাতলে ঐক্যবদ্ধ হয়।
১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর ভোলো, পটুয়াখালী ও নোয়াখালীর ওপর দিয়ে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় বয়ে যায়। ১০ লাখ লোক নিহত হয়। বঙ্গবন্ধু তার দল নিয়ে ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্তদের পাশে দাঁড়ান। তিনি এলাকায় ছুটে যান এবং ত্রাণ বিতরণ করেন।
১৯৭০ সালে নির্বাচনকালে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য –

বৈষম্যের বিষয় পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তান
রাজস্ব খাতে ব্যয় ১৬০০ কোটি টাকা ৫০০০ কোটি টাকা
উন্নয়ন খাতে ব্যয় ৩০০০ কোটি টাকা ৬০০০ কোটি টাকা
বৈদেশিক সাহায্য ২০% ৮০%
বৈদেশিক দ্রব্য আমদানি ২৫% ৭৫%
কেন্দ্র সরকারের চাকরি ১৫% ৮৫%
সামরিক বিভাগে চাকরি ১০% ৯০%
চাল মণপ্রতি ৫০ টাকা ২৫ টাকা
আটা মণপ্রতি ৩০ টাকা ১৫ টাকা
সরিষার তেল সেরপ্রতি ৫ টাকা ২.৫০ টাকা
স্বর্ণ প্রতিভরি ১৭০ টাকা ১৩৫ টাকা

পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর ৯টি বাদে ১৫৩টি আসনে নির্বাচন

পৃষ্ঠা: ২০৩

অনুষ্ঠিত হয়। দুটি ব্যতীত সকল আসনে আওয়ামী লীগ জয়লাভ করে। দুটির একটি আসনে পিডিপির নুরুল আমিন এবং পার্বত্য চট্টগ্রাম হতে চাকমা রাজা ত্রিদিব রায় নির্বাচিত হন। ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৭১ সালের ১৭ জানুয়ারি বরিশাল, পটুয়াখালী নোয়াখালী চট্টগ্রামের ক্ষতিগ্রস্থ এলাকায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
জাতীয় পরিষদে নির্বাচনের বিজয়ীদের ফলাফল নিম্নরূপ ছিল-
জাতীয় পরিষদের আসন- ৩১৩
পাকিস্তান আওয়ামী লীগ -১৬৭
পাকিস্তান পিপলস পার্টি -৮৮
কাইয়ুম মুসলিম লীগ -৯
কাউন্সিল মুসলিম লীগ -৭
কনভেনশন মুসলিম লীগ -২
ন্যাপ ওয়ালী- ৭
জামায়াতে ইসলাম- ১
মারকাজ জমিয়াতুল ইসলাম- ৭
হাজারভি গ্রুপ—
থানভি গ্রুপ -১৪
নির্দলীয় -১৪
মোট- ৩১৩

প্রাদেশিক পরিষদে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৮৮ আসনে জয় লাভ করে। অবশিষ্ট আসনে পিডিপি ২, নেজামে ইসলাম ১, জামায়াতে ইসলামী ১, ন্যাপ-১, স্বতন্ত্র-৭। স্বতন্ত্র সদস্যগণ আওয়ামী লীগে যোগ দেয়। আওয়ামী লীগের আসন দাঁড়ায় ২৯৫টি।
ভাসানী ন্যাপ নির্বাচন বর্জন করে। পরোক্ষভাবে মওলানা ভাসানী বঙ্গবন্ধুকে সমর্থন দেন।
আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় পরিষদে মোট ভোটের ৭৫.১০%। এবং প্রাদেশিক পরিষদে ৭০.৪৮% ভোট লাভ করে।
শেখ মুজিবুর রহমান তখন ঘনিষ্ঠজনদের বলতেন, My aim is to establish Bangladesh. I will tear the LFO into pieces as soon as the elections are over.
আমার লক্ষ্য হলো বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা। নির্বাচন শেষ হলে আমি এলএফও
পৃষ্ঠা: ২০৪

ছিড়ে ফেলব। শেখ মুজিব ধীরগতিতে চলেছেন। তিনি আইয়ুব খানের গোলটেবিলের বৈঠকে যোগ দিয়েছেন। এর পরেও নিজে নির্বাচন করেছেন। তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে গ্রহন করবেন না। ১৯৭০ সাল আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক বিজয়কে মেনে নিতে কেন্দ্র অস্বীকার করে।

নির্বাচিত সদস্যদের শপথ ৩ জানুয়ারি-১৯৭১
১৯৭১ সালের ৩ জানুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সকল এমএনএ ও এমপিদের শপথ পড়ান। সদস্যরা ৬ দফা বাস্তবায়নের জন্য অঙ্গীকার করেন।

ইয়াহিয়া-শেখ মুজিব আলোচনা
নির্বাচনের পর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ১১ জানয়ারি ঢাকায় আগমন করেন। তিনি প্রেসিডেন্ট হাউজে (সুগন্ধা) শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ১২ ও ১৩ জানুয়ারি গোপন বৈঠক করেন। বৈঠকে মূল সমস্যা ৬ দফার সমঝোতা হয়নি। ১৪ জানুয়ারি ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। এ সময় ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবুর রহমানকে পাকিস্তানের ভবিষ্যত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সম্বোধন করেন।
১৭ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ভুট্টোর অতিথি হিসেবে লারকানা গমন করেন। লারকানায় ভুট্টোর সাথে গোপন আলোচনা হয়।
১৯৭১ সালের ৩০ জানুয়ারি কাশ্মীরের দু’জন স্বাধীনতা সংগ্রামী ভারতের গঙ্গা নামে একটি বিমান ভারত থেকে ছিনতাই করে পাকিস্তানের লাহোরে নিয়ে আসেন। এ ঘটনায় ভারত আকাশপথে পাকিস্তান বিমান চলাচলের জন্য বন্ধ করে দেয়। তারপর পাকিস্তানি বিমান শ্রীলংকা ও রেঙ্গুন হয়ে ঢাকা যাতায়াত করতে বাধ্য হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ ফেব্রুয়ারির মধ্যে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান জানান। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ বুধবার সকাল ৯টায় ঢাকায় প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করেন। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপিপি ও কাউন্সিলর মুসলিম লীগ কাইয়ুম ব্যতিত সকল দল ঢাকায় অধিবেশন যোগ দেবে। ১৪ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো পেশোয়ারে ঘোষণা করেন যে, পাকিস্তানে তার দলের যারা ঢাকায় ৩ মার্চের অধিবেশনে যোগ দেবে তাদের পা ভেঙে দেওয়া হবে।
পৃষ্ঠা: ২০৫

১৯৭১ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ইঞ্জিনিয়ারিং ইনস্টিটিউশনে আওয়ামী লীগের এমপিদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে দলের নেতা, সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপনেতা ও অধ্যাপক ইউসুফ আলী চিফ হুইপ নির্বাচিত হন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এবং আব্দুল মান্নান হুইপ নির্বাচিত হন। এএইচএম কামরুজ্জামানকে পার্লামেন্টারি দলের সচিব নিযুক্ত করা হয়।
রাওয়ালপিন্ডিতে জুলফিকার আলী ভুট্টো ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়া ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করেন।
১৯৭১ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে গিয়ে কয়েকজন উপদেষ্টা নিয়োগ করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট গভর্নরদের সম্মেলন আহ্বান করেন।
২৫ ফেব্রুয়ারি গভর্নর এসএম আহসান শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন।
২৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো করাচির জনসভায় বলেন, বর্তমান সংকট নিরসনে জন্য দুটো প্রস্তাব পেশ করেন। একটি হল ৩ মার্চের অধিবেশন বন্ধ। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের ১২০ দিন সময়সীমা বাতিল করতে হবে।
পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে আওয়ামী লীগের বিশাল বিজয়কে মেনে নিতে পারেনি। প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও পাকিস্তান পিপলস পার্টির সভাপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা না দেয়ার ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা বাঙালিদের বাঁচার দাবি ৬ দফা মেনে নেননি। ইয়াহিয়া খান গণতন্ত্রের পথে না চলে বাঙালি নিধনের পথে অগ্রসর হন। তিনি সংসদ অধিবেশন স্থগিত করে বাঙালি জাতিকে সংগ্রামের পথে যেতে বাধ্য করেন। তাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়।
খ. অসহযোগ আন্দোলন, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ, অপারেশন সার্চ লাইট
জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত হবে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ২৫ জন এমএনএ ঢাকায় পৌঁছেছেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ঢাকায় শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন।
পৃষ্ঠা: ২০৬

১৯৭১ সালের ১ মার্চ হঠাৎ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশে এক ভাষণে ৩ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করেন। তিনি রাজনৈতিক মতবিরোধ ও শাসনতন্ত্র প্রণয়নে জটিলতা নিরসনে ব্যর্থতাকে দায়ী করেন।
১ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সভাপতিত্বে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন কমিটির সভা চলছিল। অধিবেশন স্থগিতে বাঙালির মুক্তির জন্য তিনি ঘোষণা করেন, ৭ কোটি বাঙ্গালির মুক্তির জন্য তিনি সকল প্রকার সকল প্রকার উৎসর্গ করবেন। তিনি ঘোষণা দেন যে – ২ মার্চ ঢাকায় অর্ধদিবস হরতাল, ৩ মার্চ সারা বাংলায় হরতাল এবং ৭ মার্চ জনসভায় তিনি চূড়ান্ত কর্মসূচি দেবেন।
১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের ভাষণ শুনে লাখ লাখ লোক রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। ঢাকার পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমাগম হয়। ছাত্রনেতা আ স ম রব, আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী ভাষণ দেন।
২ মার্চ ঢাকার সর্বত্র মিছিল চলছে। সেনাবাহিনী মালিবাগের আবুজর গিফারী কলেজের ছাত্র ফারুককে গুলি করে হত্যা করে। তাকে রামপুরা সড়কের আইল্যান্ডে দাফন করা হয়।
১ মার্চ সকাল ১০-৪৫ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কলা ভবনে বিশাল ছাত্র সমাবেশ। ছাত্রনেতা আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ, নূরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দস মাখন বাংলাদেশের উদীয়মান লাল সূর্য ও পূর্ব বাংলার মানচিত্র খচিত পতাকা উত্তোলন করেন। ছাত্র সমাবেশে ছাত্রনেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তোফায়েল আহমেদের নেতৃত্বে মিছিল করে ছাত্ররা পল্টনের জনসভায় যোগ দেয়। ৩ মার্চ প্রদেশব্যাপী হরতাল। শেখ মুজিবুর রহমান পল্টন ময়দানে ভাষণ দেন। ৩ মার্চের জনসভায় বঙ্গবন্ধু নিমের নির্দেশ প্রদান করেন-
• অবিলম্বে জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা প্রদান;
অফিস-আদালত বন্ধ থাকবে;
•বেতার টিভিতে আন্দোলনের খবর প্রকাশ নিষেধ থাকলে তা প্রত্যাখ্যান করা হবে।
• আন্দোলনে লুটপাট অগ্নিসংযোগ করলে তা প্রতিহত করতে হবে। ৩ মার্চ সেনাবাহিনীর গুলিতে ১৫ জন নিহত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানে প্রচণ্ড গণরোষ দেখে ৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকায় ১০ মার্চ সর্বদলীয় সম্মেলন আহ্বান করেন। আমন্ত্রিত অতিথিদের মধ্যে ছিলেন
শেখ মুজিবুর রহমান -আওয়ামী লীগ
জুলফিকার আলী ভুট্টো- পিপিপি
পৃষ্ঠা: ২০৭

আব্দুল কাইয়ুম খান- মুসলিম লীগ কাইয়ুম
মিয়া মোহাম্মদ দৌলতানা- কাউন্সিল মুসলিম লীগ
মৌলানা মুফতি মাহমুদ- জমিয়াতুল ওলামায়ে ইসলামী জামায়াত
গফুর আহমদ- জামায়াতে ইসলাম
নুরুল আমিন- পিডিপি
মওলানা শাহ আহম্মদ নুরানী- জমিয়াতুল ওলামায়ে ইসলাম
আমন্ত্রণ পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান তা ঘৃণাভাবে প্রত্যাখ্যান করেন।
৪ মার্চ আওয়ামী লীগের নির্দেশে পাকিস্তান রেডিওর নাম বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান টিভির নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ টিভি। ৩ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা, ৪ মার্চ বেতার টিভির নামকরণ ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনা।
৪ মার্চ এয়ার ভাইস মার্শাল আসগর খান ইয়াহিয়া খানকে আওয়ামী লীগের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের অনুরোধ জানান।
ডাকসু ও ছাত্রলীগ প্রত্যেক জেলা, থানা, ইউনিয়নে ১১ সদস্যবিশিষ্ট সংগ্রা কমিটি গঠনের নির্দেশ দেয়।
৩ ও ৪ মার্চ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গুলিতে ১১১ জন নিহত হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এডমিরাল এম এস আহসান দমননীতি পরিচালনা করতে অস্বীকার করায় তাকে ১৯৭১ সালের ১ মার্চ বদলি করা হয়। তার স্থলে লে. জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুবকে গভর্নর নিয়োগ করা হয়। জেনারেল ইয়াকুব সামরিক সরকারের কঠোর নীতি অনুসরণ করতে অস্বীকৃতি জানান। তিনি ৫ মার্চ পদত্যাগ করেন। এ অপরাধে সামরিক সরকার তাকে শাস্তি প্রদান করে। তার স্থলে সরকার ৭ মার্চ লে. জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর নিয়োগ করে। প্রধান বিচারপতি বিএ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেন।
শেখ মুজিবুর রহমানের আহ্বানে ৫ ও ৬ মার্চ সকাল ৮টা থেকে ২টা পর্যন্ত। হরতাল চলে।
৩ হতে ৬ মার্চ পর্যন্ত সেনাবাহিনীর গুলিতে ৩০০ লোক নিহত হয়েছে।
৬ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, সংসদের অধিবেশন ২৫ মার্চ অনুষ্ঠিত হবে।

জয় বাংলা স্লোগান: স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা
ছাত্রলীগ ১৯৭১ সালের ২ মার্চের সভায় পতাকা ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করে। ৩ মার্চ ইস্তেহার নাম্বার এক- স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ ঘোষণা ও কর্মসূচি নামের ঘোষণাপত্র বিতরণ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ২০৮

২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। নুরে আরম সিদ্দিকী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন। পাকিস্তানি পতাকা পুড়িয়ে ফেলে আ স ম আব্দুর রব অন্যান্য ছাত্রনেতাদের নিয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।

৭ মার্চের ভাষণ- ১৯৭১
১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। সকাল হতে জনতা লাঠি, বৈঠা নিয়ে জনসভায় সমবেত হতে থাকেন। বঙ্গবন্ধ ২টায় ভাষণ দেবেন। কিন্তু তিনি ২টা ৪৫ মিনিট পূর্বে জনসভায় পৌঁছতে পারেননি। তিনি মাত্র ১৮ মিনিটে নিমোক্ত ভাষণ দেন।
“ভাইয়েরা আমার!
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবই জানেন এবং বোঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় আজ ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা, রাজশাহী, রংপুরে আমার ভাইয়ের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়- বাংলার মানুষ বাঁচতে চায়। বাংলার মানুষ তার অধিকার চায়।
কি অন্যায় করেছিলাম! নির্বাচনের পরে বাংলাদেশের মানুষ সম্পূর্ণভাবে আমাকে, আওয়ামী লীগকে ভোট দেন। আমাদের ন্যাশনাল এসেম্বলি বসবে, আমরা সেখানে শাসনতন্ত্র তৈয়ার করব এবং এ দেশকে আমরা গড়ে তুলব। এ দেশের মানুষ অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তি পাবে। কিন্তু দুঃখের বিষয়, আজ দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ২৩ বছরের করুণ ইতিহাস বাংলার অত্যাচারের, বাংলার মানুষের রক্তের ইতিহাস। ২৩ বছরের ইতিহাস, মুমূর্ষ নর-নারীর আর্তনাদের ইতিহাস। বাংলার ইতিহাস এ দেশের মানুষের রক্ত দিয়ে রাজপথ রঞ্জিত করার ইতিহাস। ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছি, ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও আমরা গদিতে বসতে পারি নাই। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান মার্শাল ল জারি করে দশ বছর পর্যন্ত আমাদের গোলাম করে রেখেছে। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা আন্দোলনে, ৭ জুনে আমার ছেলেদের গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ১৯৬৯ সালের আন্দোলনে আইয়ুব খানের পতন হওয়ার পরে যখন ইয়াহিয়া খান সাহেব সরকার দায়িত্বভার নিলেন, তিনি বললেন, দেশে
পৃষ্ঠা: ২০৯

শাসনতন্ত্র দেবেন, গণতন্ত্র দেবেন, আমরা মেনে নিলাম। তারপর অনেক ইতিহাস হয়ে গেল, নির্বাচন হলো। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে দেখা করেছি। আমি শুধু বাংলার নয়, পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা হিসাবে তাকে অনুরোধ করলাম, ১৫ ফেব্রুয়ারি তারিখে আপনি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন দেন। তিনি আমার কথা রাখলেন না, তিনি রাখলেন ভুট্টো সাহেবের কথা। তিনি বললেন প্রথম সপ্তাহের মার্চ মাসে হবে। আমরা বললাম ঠিক আছে, আমরা এসেম্বলিতে বসব। আমি বললাম, এসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করব। এমনকি আমি এ পর্যন্ত বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে. আমরা সংখ্যা বেশি হলেও একজন যদিও, সে হয় তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেব।
জনাব ভুট্টো সাহেব এখানে এসেছিলেন, আলোচনা করলেন, বলে গেলেন যে, আলোচনার দরজা বন্ধ না, আরও আলোচনা হবে। তারপরে অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলাপ করলাম: আপনারা আসুন বসুন, আমরা আলাপ করে শাসনতন্ত্র তৈরি করি। তিনি বললেন পশ্চিম পাকিস্তানের মেম্বাররা যদি এখানে আসে তাহলে কসাইখানা হবে এসেম্বলি। তিনি বললেন, যে যাবে তাকে মেরে ফেলে দেওয়া হবে। যদি কেউ এসেম্বলিতে আসে তাহলে পেশোয়ার থেকে করাচী পর্যন্ত দোকান জোর করে বন্ধ করা হবে। আমি বললাম এসেম্বলি চলবে। তারপরে হঠাৎ এক তারিখে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি বন্ধ করে দেওয়া হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব প্রেসিডেন্ট হিসেবে এসেম্বলি ডেকেছিলেন, আমি বললাম যে আমি যাব। ভুট্টো সাহেব বললেন, তিনি যাবেন না। পঁয়ত্রিশ জন সদস্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে এখানে আসলেন। তারপরে হঠাৎ বন্ধ করে দেওয়া হলো। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমাকে। বন্ধ করে দেওয়ার পর এ দেশের মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠল।
আমি বললাম, আপনারা কলকারখানা সবকিছু বন্ধ করে দেন। জনগণ সাড়া দিল। আপন ইচ্ছায় জনগণ রাস্তায় বেরিয়ে পড়লো। তারা শান্তিপূর্ণভাবে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার জন্য স্থির প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলো। কী পেলাম আমরা? যে আমরা পয়সা দিয়ে অস্ত্র কিনেছি
পৃষ্ঠা: ২১০

বহিঃশত্রু আক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য, আজ সেই অস্ত্র সেই অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার দেশের গরিব-দুঃখী-আর্তমানুষের বিরুদ্ধে। তার বুকের উপর হচ্ছে গুলি। আমরা পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু, আমরা বাঙালিরা যখনই ক্ষমতায় যাবার চেষ্টা করেছি, তখনই তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
টেলিফোনে আমার সঙ্গে তার কথা হয়। তাকে আমি বলেছিলাম জবাব ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট, দেখে যান কীভাবে আমার গরিবের ওপরে, আমার বাংলার মানুষের বুকের উপরে গুলি করা হয়েছে। কী করে আমার মায়ের কোল খালি করা হয়েছে। কী করে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে, আপনি আসুন, দেখুন বিচার করুন। তিনি বললেন, আমি নাকি স্বীকার করেছি যে, ১০ তারিখে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স হবে। আমি তো অনেক আগেই বলেছি, কিসের আরটিসি? কার সঙ্গে বসব? যারা আমার মানুষের বুকের রক্ত নিয়েছে তাদের সঙ্গে বসব? হঠাৎ আমার সঙ্গে পরামর্শ না করে পাঁচ ঘণ্টা গোপনে বৈঠক করে যে বক্তৃতা তিনি করেছেন, সমস্ত দোষ তিনি আমার উপর দিয়েছেন। বাংলার মানুষের উপরে দিয়েছেন।
ভাইয়েরা আমার!
পঁচিশ তারিখে এসেম্বলি কল করেছে। রক্তের দাগ শুকায় নাই। আমি দশ তারিখে বলে দিয়েছি যে, ঐ শহীদের রক্তের উপর পাড়া দিয়ে আরটিসিতে মুজিবুর রহমান যোগদান করতে পারে না। এসেম্বলি কল করেছেন আমার দাবি মানতে হবে প্রথম। সামরিক আইন মার্শাল ল উইথড্র করতে হবে। সমস্ত সামরিক বাহিনীর লোকদের ব্যারাকে ফেরত নিতে হবে। যেভাবে হত্যা করা হয়েছে তার তদন্ত করতে হবে। আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। তারপরে বিবেচনা করে দেখব আমরা এসেম্বলিতে বসতে পারব কি পারব না। এর পূর্বে এসেম্বলিতে বসতে আমরা পারি না।
আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না। আমরা এ দেশের মানুষের অধিকার চাই। আমি পরিষ্কার অক্ষরে বলে দেবার চাই যে, আজ থেকে এই বাংলাদেশে কোর্ট, কাছারি, আদালত, ফৌজদারি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ থাকবে। গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, যাতে
পৃষ্ঠা: ২১১

আমার মানুষ কষ্ট না করে, সে জন্য সমস্ত অন্যান্য জিনিসগুলো সেগুলির হরতাল কাল থেকে চলবে না। রিকশা, ঘোড়ার গাড়ি চলবে, রেল চলবে, লঞ্চ চলবে। শুধু সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীমকোর্ট জজকোর্ট, হাইকোর্ট, সেমি-গভর্নমেন্ট দফতরগুলো- ওয়াপদা, কোনো কিছু চলবে না। ২৮ তারিখে কর্মচারীরা গিয়ে বেতন নিয়ে আসবেন। এর পর যদি বেতন দেওয়া না হয়, আর যদি একটা গুলি চলে. আর যদি আমার লোককে হত্যা করা হয়, তোমাদের উপর আমার অনুরোধ রইল প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলো। তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে এবং জীবনের তরে রাস্তাঘাট যা যা আছে সব কিছু আমি যদি হুকুম দেবার নাও পারি তোমরা বন্ধ করে দেবে।
আমরা ভাতে মারব। আমরা পানিতে মারব। তোমরা আমার ভাই তোমরা ব্যারাকে থাকো, কেউ তোমাদের কিছু বলবে না। কিন্তু আর আমার বুকের উপর গুলি চালাবার চেষ্টা করো না। সাত কোটি মানুষকে দাবায়ে রাখতে পারবা না। আমরা যখন মরতে শিখেছি, তখন কেউ আমাদের দাবাতে পারবে না। আর যে সমস্ত লোক শহীদ হয়েছে, আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, আমরা আওয়ামী লীগ থেকে যতদুর পারি তাদের সাহায্য করতে চেষ্টা করব। যারা পারেন আমার রিলিফ কমিটিতে সামান্য টাকা-পয়সা পৌছিয়ে দেবেন। আর এই সাতদিন হরতালে যে সমস্ত শ্রমিক ভাইরা যোগদান করেছেন প্রত্যেকটা শিল্পের মালিক তাদের বেতন পৌছিয়ে দেবেন। সরকারি কর্মচারীদের বলি: আমি যা বলি তা মানতে হবে। যে পর্যন্ত আমার এ দেশের মুক্তি না হবে, খাজনা, ট্যাক্স বন্ধ করে দেওয়া হলো। কেউ দেবে না। শোনেন- মনে রাখবেন শত্রু বাহিনী ঢুকেছে নিজেদের মধ্যে। আত্মকলহ সৃষ্টি করবে, লুটতরাজ করবে। এই বাংলায় হিন্দু-মুসলমান, বাঙালি-নন-বাঙালি যারা আছে তারা আমাদের ভাই। তাদের রক্ষার দায়িত্ব আপনাদের উপরে, আমাদের যেন বদনাম না হয়। মনে রাখবেন, রেডিও-টেলিভিশনের কর্মচারীরা, যদি রেডিওতে আমাদের কথা না শোনে তাহলে কোনো বাঙালি রেডিও স্টেশনে যাবেন না। যদি টেলিভিশন আমার নিউজ না দেয় কোনো বাঙালি টেলিভিশনে যাবেন না, দুই ঘণ্টা ব্যাংক খোলা থাকবে- যাতে মানুষ তাদের মায়নাপত্র নেবার পারে। কিন্তু পূর্ববাংলা থেকে পশ্চিম
পৃষ্ঠা: ২১২

পাকিস্তানে এক পয়সাও চালান হতে পারবে না। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ আমাদের এই পূর্ব বাংলায় চলবে এবং বিদেশের সঙ্গে নিউজ পাঠাতে হলে আপনারা চালাবেন। কিন্তু যদি এ দেশের মানুষকে খতম করার চেষ্টা করা হয়, বাঙালিরা বুঝেশুনে কাজ করবেন।
প্রত্যেক গ্রামে, প্রত্যেক মহল্লায়, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলো এবং তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাক। মনে রাখবা রক্ত যখন দিয়েছি, রক্ত আরও দেব- এ দেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়ব ইনশাআল্লাহ।
এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম-এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। জয় বাংলা।”

৭ মার্চের ভাষণ বেতার ও টিভিতে প্রচারের কথা ছিল। কিন্তু সামরিক সরকার তা বন্ধ রাখে। ৮ মার্চ ঢাকা বেতার বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ প্রচার করে। ৭ মার্চের ভাষণ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ। ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ৭ মার্চের পর হতে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়।

অসহযোগ আন্দোলন
৮ মার্চ বঙ্গবন্ধু সপ্তাহব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা দেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, যতক্ষণ জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হবে ততক্ষণ অহিংস ও অসহযোগ আন্দোলন চলবে।
কর্মসূচি
* কর প্রদান বন্ধ;
* সকল অফিস হরতাল পালন করবে;
* সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে;
* বেতার টিভি আওয়ামী লীগের সংবাদ প্রচার করবে;
* পরিবহন চালু থাকবে- ট্রেন চলবে;
* ব্যাংক ২টা পর্যন্ত খোলা থাকবে;
* প্রত্যেক ভবনে কালো পতাকা উড়বে;
* ব্যাংকসমূহ পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থ প্রেরণ করবে না।
৮ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ তাদের দলের নাম করে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ।
পৃষ্ঠা: ২১৩

তাদের দপ্তর ইকবাল হলে স্থানান্তর করা হয়। ৩ মার্চ ইকবাল হলের নাম রাখা হয় সার্জেন্ট জহুরুল হক হল। ছাত্র ইউনিয়নের দপ্তর ছিল জগন্নাথ হলে।
ন্যাপ সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৯ মার্চ পল্টন ময়দানে স্বাধীন বাংলাদেশ দাবি করেন। তিনি ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশে বলেন, ২৫ মার্চের মধ্যে এ দাবি মেনে না নিলে তিনি শেখ মুজিবর রহমানের সাথে এক হয়ে ১৯৫২ সালের ন্যায় বাঙালিদের স্বাধীনতার জন্য সর্বাত্মক সংগ্রাম শুরু করবেন।
৯ মার্চ জহুরুল হক হলে ছাত্রলীগের সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা স্বাধীন বাংলাদেশ অনুমোদন করে এবং আন্দোলন পরিচালনার জন্য সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। আন্দোলনের ভার চার ছাত্র নেতার ওপর অর্পণ করা হয়। তারা হলেন, আ স ম আবদুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ এবং আবদুল কুদ্দুস মাখন। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির স্লোগান ছিল-
স্বাধীন বাংলাদেশ দীর্ঘজীবী হোক
স্বাধীন কর স্বাধীন কর বাংলাদেশ
মহান জাতির মহান নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব
বীর বাঙ্গালী অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর
৯ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দেন, তিনি সঙ্কট নিরসনের জন্য ঢাকা আসবেন।
৯ মার্চ ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন-প্রশাসক নিয়োগ করেন। টিক্কা খান শপথ গ্রহণে ব্যর্থ হলে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করা হয়।
১৯৭১ সালের ১১ মার্চ ভারতে কংগ্রেস নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকার গঠন করে। ইন্দিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে ইন্দিরা গান্ধী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন।
১২ মার্চ অসহযোগ আন্দোলন এগিয়ে যায়।
১৩ মার্চ ন্যাপ নেতা ওয়ালি খান ঢাকা পৌঁছেন এবং ১৪ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা করেন।
১৪ মার্চ সকল রাজনৈতিক দল ও জনগণের অনুরোধে শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা স্বহস্তে গ্রহণ করেন।
১৫ মার্চ বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ অসহযোগ আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৩৫টি বিধি প্রণয়ন করেন এবং তা বঙ্গবন্ধু ১৫ মার্চ ঘোষণা করেন।
পৃষ্ঠা: ২১৪

৩৫টি বিধি
১. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিসসমূহ, হাইকোর্ট ও দেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। তবে অতিপ্রয়োজনীয় ও আন্দোলনের স্বার্থে নির্দিষ্ট অফিস, দপ্তর ও সংস্থা হরতালের আওতা বহির্ভূত থাকবে।
২. বাংলাদেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৩. আইনশৃঙ্খলা রক্ষা- ডেপুটি কমিশনার, সাব-ডিভিশনাল অফিসার, আওয়ামী লীগ সংগ্রাম কমিটির সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা ও উন্নয়ন কর্মসূচিসহ দায়িত্ব পালন করবে। পুলিশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করবে।
৪. বন্দরসমূহ- অভ্যন্তরীণ নৌযান চলাচল অব্যাহত থাকবে। তবে সৈন্যদের সযোগিতা করবে না। বন্দরের কাজ চলবে।
৫. মাল আমদানি-আমদানিকৃত সকল মালামাল খালাস করতে হবে। সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হিসেবে জমা হবে না।
৬ রেলওয়ে চলবে- তবে সৈন্য চলাচল বা তাদের রসদ বহন করতে পারবে না।
৭. সড়ক পরিবহন- ইপিআরটিসি চলাচল করবে।
৮. অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরের কাজ চলবে।
৯. ডাক ও টেলিগ্রাফ বাংলাদেশের মধ্যে কাজ করবে- বিদেশে মেল সার্ভিস ও টেলিগ্রাফ করা যেতে পারে।
১০. টেলিফোন বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে।
১১. বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র- এগুলো চালু থাকবে এবং জনগণের আন্দোলনের সংবাদ প্রচার করতে হবে।
১২. হাসপাতালসমূহ চালু থাকবে।
১৩. বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৪. পানি, গ্যাস সরবরাহ চালু থাকবে।
১৫. কয়লা সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
১৬. খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। খাদ্য আমদানি চালু থাকবে।
১৭. কৃষি তৎপরতা-ধান ও পাটের বীজ, সার ও কীটনাশক ওষুধ সংগ্রহ ও বণ্টন অব্যাহত থাকবে। পাওয়ার পাম্প ও যন্ত্রপাতি সরবরাহ চালু থাকবে। কৃষি ব্যাংকের কাজ চালু থাকবে।
১৮. বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণের কাজ অব্যাহত থাকবে।
পৃষ্ঠা: ২১৫

১৯. উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ চলবে।
২০. সাহায্য ও পুনর্বাসন- ঘূর্ণিদুর্গত এলাকায় বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজসহ পুনর্বাসনের কাজ চলতে থাকবে।
২১. ইপিআইডিসি, ইস্টার্ন রিফাইনারি ও সকল কারখানার কাজ চলবে।
২২. সকল সরকারি ও আধা-সরকারি সংস্থার কর্মচারী ও শ্রমিকদের বেতন নিয়মিতভাবে প্রদান করতে হবে।
২৩. পেনশন- নিয়মিতভাবে সরকারি-বেসরকারি অবসরপ্রপ্ত কর্মচারীদের দেওয়া হবে।
২৪. এজি ও ট্রেজারি- বেতন-ভাতা প্রদানের জন্য নির্দিষ্টসংখ্যক কর্মচারী কাজ চালিয়ে যাবে।
২৫. ব্যাংক সকাল ৯টা হতে ১২টা পর্যন্ত ব্যাংকিং কাজ করবে। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে লেনদেন চলবে না। বিদেশের সাথে ব্যবসা-বাণিজ্য চলবে। ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনকে নির্দিষ্ট দায়িত্ব দেওয়া হবে।
২৬. স্টেট ব্যাংক- অন্যান্য ব্যাংকের মতোই কাজ করবে।
২৭. আমদানি ও রপ্তানি কন্ট্রোলার- আমদানি-রপ্তানি নিশ্চিত করবে এবং কাজ চালিয়ে যাবে।
২৮. ট্রাভেল এজেন্ট ও বিদেশি এয়ারলাইন্স চালু থাকবে।
২৯. ফায়ার সার্ভিস ব্যবস্থা চালু থাকবে।
৩০. পৌরসভার কাজ চালু থাকবে।
৩১. ভূমি রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে। লবণ ও তামাক কর আদায় হবে না। আয়কর আদায় বন্ধ থাকবে। এছাড়া প্রাদেশিক কর আদায় হবে এবং বাংলাদেশ সরকারের এ্যাকাউন্টে জমা দিতে হবে। কেন্দ্রীয় সরকারের কর আবগারী শুল্ক কর, বিক্রয় কর আদায় করে কেন্দ্রীয় সরকারের খাতে জমা না দিয়ে ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল বা ইস্টার্ন ব্যাংকিং করপোরেশনে জমা দিতে হবে।
৩২. পাকিস্তান বীমা কর্পোরেশন, পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স চালু থাকবে।
৩৩. সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠানের সেবাদান নিয়মিতভাবে চলবে।
৩৪. সকল বাড়ির ওপর কালো পতাকা উড়বে।
৩৫. সংগ্রাম পরিষদগুলো সর্বস্তরে তাদের কাজ চালু রাখবে এবং এসব নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করে যাবে।
পৃষ্ঠা: ২১৬

ইয়াহিয়া-বঙ্গবন্ধুর আলোচনা
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আলোচনার জন্য ১৫ মার্চ ঢাকা পৌঁছেন। তার সাথে ছিলেন বিচারপতি এ আর কর্নেলিয়াস, লে. জেনারেল পীরজাদা, কর্নেল হাসান, পরিকল্পনা কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম আহমদ।
১৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট ভবনে গভর্নর ও উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে চলমান পরিস্থিতি আলোচনা করেন।
১৬ ও ১৭ মার্চ ইয়াহিয়া-শেখ মুজিবুর রহমান কোনো সাহায্যকারী ব্যতীত একক আলোচনা চলে।
১৬ মার্চ সকালে শেখ মুজিবুর রহমান তার বাসভবনে নেতাদের সাথে আলোচনা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান, ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে সকাল ১০টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে গমন করেন। ইয়াহিয়া খানের সাথে বঙ্গবন্ধুর ১৫ মিনিট একক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। তিনি তার সঙ্গীদের নিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করেন। শত শত দেশি-বিদেশি সাংবাদিক সমবেত। তারা তাকে প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি বলেন, আলোচনা চলবে।
১৭ মার্চ সকালে মুজিব-ইয়াহিয়া একক আলোচনা চলে। বিকেলে প্রেসিডেন্টের দলের সাথে আওয়ামী লীগ নেতাদের আলোচনা হয়। রাষ্ট্রপতির দল বলে যে, সামরিক আইনের জন্য সংসদ কর্তৃক অনুমোদিত বিধি প্রয়োজন। আওয়ামী লীগ নেতারা প্রস্তাবিত পদ্ধতি প্রত্যাখ্যান করেন।
১৬ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো সভায় যোগ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তিনি এ প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। ১৭ মার্চ পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ নেতা ওয়ালি খান। প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করেন।
১৭ মার্চ ছিল বঙ্গবন্ধুর ৫১তম জন্মবার্ষিকী। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের জুলুমের প্রতিবাদে তিনি জন্মদিন পালন করেননি।
১৭ মার্চ মার্কেন্টাইল ব্যাংক কেন্দ্রীয় সরকারের দেওয়া রাজস্ব ও কর জমা নেওয়া শুরু করে। ১৭ মার্চ অস্ত্র বোঝাই সোয়াত জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরে পৌছে। সেখানে শ্রমিকরা অস্ত্র নামাতে অস্বীকার করে।
১৯ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিবের মধ্যে এক ঘণ্টা একান্ত আলোচনা চলে। বিকেলে প্রেসিডেন্টের বিশেষজ্ঞ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পদ্ধতি নিয়ে আলোচনা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন
পৃষ্ঠা: ২১৭

‘আমি সব সময় ভালোই আশা করি এবং খারাপের জন্য প্রস্তুত থাকি। ২০ মার্চ ইয়াহিয়া ভুট্টোকে ঢাকায় আসার জন্য আহ্বান জানান। ২১মার্চ ভুট্টো ঢাকা পৌছেন।

জয়দেবপুরে প্রথম মুক্তিযুদ্ধ ১৯ মার্চ
জয়দেবপুরের রাজবাড়িতে এক ব্যাটালিয়ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট ছিল। সামরিক সরকার তাদের অস্ত্রহীন করতে চায়। এ সংবাদ শুনে স্থানীয় জনগণ রাজবাটি ঘিরে ফেলে। পাক বাহিনী জনতার ওপর গুলিবর্ষণ করে ২০ জনকে হত্যা করে এবং ১৫ জন আহত হয়। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ প্রথম জয়দেবপুরে শুরু হয়।
২০ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের পূর্ণ আলোচনা হয়। উভয় দলের সাহায্যকারীরা আলোচনায় উপস্থিত ছিলেন। বিচারপতি কর্নেলিয়াস বলেন, সামরিক আইন প্রত্যাহারের জন্য জাতীয় সংসদের অনুমতি ও শূন্যতা পূরণের জন্য আইনের প্রয়োজন। তাজউদ্দীন আহমদ এ প্রস্তাবের সাথে দ্বিমত পোষণ করেন। শেখ মুজিব প্রস্তাব করেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি কমিটি গঠন করা যেতে পারে। উভয় কমিটি শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়ন করে সংসদে পেশ করবে।
২১ মার্চ ইয়াহিয়া খানের সাথে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দীন আহমদের এক অনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়।
আওয়ামী লীগ নিম্নলিখিত প্রস্তাব আলোচনায় পেশ করে।
* অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে বেসামরিক সরকার গঠন এবং আওয়ামী লীগের সুপারিশে গভর্নর নিয়োগ।
* গভর্নর দায়িত্ব গ্রহণের সাথে সাথে সামরিক আইন সম্পূর্ণভাবে তুলে নিতে হবে।
* ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের ভিত্তিতে অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র যাতে পূর্ব পাকিস্তানের সংশ্লিষ্ট ৬ দফা অন্তর্ভুক্ত থাকবে।
* প্রেসিডেন্ট তার পদে এবং প্রধান সেনাপতি হিসেবে স্বপদে সকল দলের সর্বসম্মত চুক্তির অধীনে বহাল থাকবে।
২১ মার্চ জুলফিকার আলী ভুট্টো ১১ সদস্যবিশিষ্ট দল নিয়ে ঢাকা পৌঁছেন এবং হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন।
২১ মার্চ ইয়াহিয়া-ভুট্টো ৭০ মিনিটব্যাপী আলোচনা করেন। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যান।
ইয়াহিয়া খান আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করছেন। তার নির্দেশে
পৃষ্ঠা: ২১৮

প্রত্যেকদিন পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানে হাজার হাজার সৈন্য পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসতে থাকে।
২১ মার্চ বিকেলে ইয়াহিয়া খানের সাথে ভুট্টোর আলোচনা হয়। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের প্রস্তাব নিয়ে তার সাথে আলোচনা করেন। উত্তরে ভুট্টো বলেন, The scheme was fraught with danger- প্রস্তাবটি ভয়ঙ্করভাবে শঠতাপূর্ণ।
২২ মার্চ সকাল ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে ইয়াহিয়া খান-শেখ মুজিবুর রহমান ও ভুট্টোর সাথে আলোচনায় বসেন।
২২ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্টের দল সামরিক আইন প্রত্যাহারের একটি খসড়া তাজউদ্দীন আহমদ ও ভুট্টোকে প্রদান করে। ভুট্টোর দল পার্লামেন্টের অনুমতি ব্যতীত সামরিক আইন প্রত্যাহারের বিরোধিতা করে। ভুট্টোর দলে ছিলেন জে এ রহিম, মাহমুদ আলী কাসুরী এবং মোবাশ্বের হাসান।

২৩ মার্চ একটি নতুন জাতির জন্ম
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। আওয়ামী লীগ ২৩ মার্চ প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালন করে। ২৩ মার্চ সারাদেশে বাংলাদেশের নতুন পতাকা উত্তোলন করা হয়।
২৩ মার্চ বিভিন্ন সংগঠন-ছাত্র জনতা দলে দলে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গমন করে। ছাত্রলীগ ও শ্রমিক লীগ আনুষ্ঠানিকভাবে উত্তোলনের জন্য বাংলাদেশের পতাকা বঙ্গবন্ধুর হাতে দেন। বঙ্গবন্ধু তার বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের সাথে সাথে অখণ্ড পাকিস্তানের সমাপ্তি হলো। একমাত্র সেনানিবাস ব্যতীত বাংলাদেশের কোথাও পাকিস্তানের পতাকা ছিল না।
২৪ মার্চ ভুট্টো ইয়াহিয়া খান ও জেনারেল পীরজাদার সাথে দেখা করেন। ২৪ মার্চ এ কে ব্রোহী ঢাকা আসেন। তিনি বলেন, জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো বাধা নেই।
২৫ মার্চ হরতাল-মিছিল চলে। ২৫ মার্চ সেনাবাহিনী ১১০ জনকে হত্যা করেছে। আওয়ামী লীগ ২৭ মার্চ দেশব্যাপী হরতাল পালনের আহ্বান করে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন যে আওয়ামী লীগ যদি তার প্রস্তাব মেনে না নেয় তাহলে সেনাবাহিনী বাঙালিদের আক্রমণ করবে।
২৫ মার্চ সন্ধ্যায় গোপনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করেন। এদিন রাত ১১টায় অপারেশন সার্চলাইট শুরু হয়।
অপারেশন সার্চলাইট পাকিস্তানের জেনারেলরা ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনা করে অপারেশন
পৃষ্ঠা: ২১৯

সার্চলাইট ২৫ মার্চ রাতে শুরু করেন। অপারেশন ব্রিজ পরিবর্তন করে অপারেশন সার্চলাইট করা হয়েছে। পরিকল্পনা ছিল বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ নিরস্ত্র করা হবে। রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ, কর্নেল ওসমানী, মতিয়া চৌধুরী, তোফায়েল আহমেদ, সিরাজুল আলম প্রমুখকে গ্রেফতার করা হবে।
১৯৭১ সালের ২০ মার্চ ঢাকায় স্টাফ হাউজের সভায় জেনারেল হাবিব এবং লে. জেনারেল টিক্কা খান অপারেশন সার্চলাইট অনুমোদ করেন। জেনারেল হামিদ বাঙালি সৈনিকদের নিরস্ত্র করার প্রস্তাব বাদ দিয়ে ইপিআর পুলিশ নিরস্ত্র করার প্রস্তাব করেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান প্রস্তাব অনুমোদন করেন
২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগের সিদ্ধান্ত নেয়। এ জন্য তিনি নাটক করেন। প্রেসিডেন্ট বিকেলে ফ্লাগ স্টাফ হাউজে চা পান করার জন্য চলে যান। সন্ধ্যা হওয়ার পূর্বে প্রেসিডেন্ট গাড়িতে বিউগল বাজিয়ে প্রেসিডেন্ট ভবনে আসেন। কিন্তু প্রেসিডেন্ট গাড়িতে ছিলেন না। যখন ইয়াহিয়া খান পিএএফ গেটে প্রবেশ করেন তখন উইং কমান্ডার এ কে খন্দকার এ দৃশ্যে দেখে ফেলেন। তিনি এ সংবাদ সাথে সাথে শেখ মুজিবকে জানিয়ে দেন।
অপারেশন সার্চলাইটের দুটো হেডকোয়ার্টার ছিল। ব্রিগেডিয়ার আরবারের অধীনে ৫৭ ব্রিগেডসহ, মেজর জেনারেল ফরমান অপারেশন-১, ঢাকা শহর এবং পার্শ্ববর্তী এলাকার দায়িত্বে ছিলেন। প্রদেশে অবশিষ্ট এলাকার দায়িত্বে ছিলেন মেজর জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা। অপারেশনের অগ্রগতি পর্যবেক্ষণের জন্য লে. জেনারেল টিক্কা খান মার্শাল ল হেডকোয়ার্টারে রাত কাটান। সিদ্ধান্ত ছিল রাত ১১-৩০ মিনিটে বাঙালিদের ওপর আক্রমণ শুরু করা হবে। ইয়াহিয়া খান করাচীতে অবতরণ করার পর অপারেশন শুরু হবে। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বিমানে থাকাকালে ব্রিগেডিয়ার আরবার ঢাকার বিভিন্ন স্থানে আক্রমণ করে।
পাক বাহিনীর ২২ বেলুচ পিলখানার ৫০০০ ইপিআরকে নিরস্ত্র করবে। ৩২ পাঞ্জাব রাজারবাগ পুলিশ লাইনের ১০০০০ পুলিশকে নিরস্ত্র করবে। ২২ বেলুচ ও ৩২ পাঞ্জাব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিদ্রোহীদের শক্ত ঘাঁটি ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল ধ্বংস করবে। এক প্লাটুন বিশেষ বাহিনী (কমান্ডাে) শেখ মুজিবুর রহমানের বাড়ি আক্রমণ করে তাকে গ্রেফতার করবে।
ইপিআর ও পুলিশ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অভিযান প্রতিহত করার জন্য চট্টগ্রাম, যশোর, দিনাজপুর, রাজশাহী প্রভৃতি স্থানে প্রস্তুত ছিল। চট্টগ্রামে মেজর রফিকুল ইসলামের নেতৃত্বে ২৫ মার্চ রাত ৮-৩০ মিনিটে বিদ্রোহ করে ও পাকিস্তানিদের বন্দি করে।
পৃষ্ঠা: ২২০

গ. বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা ও গ্রেফতার
ইয়াহিয়া খানের ঢাকা ত্যাগের সংবাদ পেয়ে বঙ্গবন্ধু আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেন। তিনি জানালেন যে, পাকবাহিনী বাঙালিদের আক্রমন করবে। তারা যেন আত্মগোপন করে প্রতিরোধ গড়ে তুলে। নেতৃবৃন্দ বঙ্গবন্ধুকে তার বাসভবন ত্যাগ করে আত্মগোপন করার অনুরোধ করেন। তিনি তাদের জানালেন যে কোনো অবস্থায় তিনি পালাবেন না। তিনি ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে নিজ বাসভবনে অবস্থান করবেন। রাত ১২টায় জামাতা ড. ওয়াজেদ, কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা বঙ্গবন্ধুর নিকট বিদায় নিয়ে ওয়াজেদ মিয়ার বাসায় চলে যান। বঙ্গবন্ধু সংবাদ পেলেন পাকবাহিনী পিলখানা, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আক্রমণ করেছে। বাঙালিরা আক্রান্ত। পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। ২৬ মার্চ রাত ১২-৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু তাৎক্ষণিক বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের আদেশ দেন। স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীর নিকট পৌছে দেন। মগবাজার ওয়্যারলেস ও পিলখানা ওয়ারলেস বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা পেয়ে তা প্রত্যেক জেলা, মহকুমা, থানায় ছড়িয়ে দেয়।

DECLARATION OF WAR OF INDEPENDENCE
PAK-ARMY SUDDENLY ATTACKED EPR BASE AT PILKHANA, RAJARBAG POLICE LINE AND KILLING CITIZENS STOP STREET BATTLE ARE GOING ON IN EVERY STREET OF DHAKACHITTAGONG STOP I APPEAL TO THE NATIONS OF THE WORLD FOR HELP STOP OUR FREEDOM FIGHTERS ARE GALLANTLY FIGHTING WITH THE ENEMIES TO FREE THE MOTHERLAND STOP I APPEAL AND ORDER YOU ALL IN THE NAME OF ALMIGHTY ALLAH TO FIGHT TO THE LAST DROP OF BLOOD TO LIBERATE THE COUNTRY STOP ASK POLICE, EPR, BENGAL REGIMENT AND ANSAR TO STANDBY YOU AND TO FIGHT STOP NO COMPROMISE STOP VICTORY IS OURS STOP DRIVE OUT THE LAST ENEMY FROM THE HOLY SOIL OF MOTHERLAND STOP CONVEY THIS MESSAGE TO ALL AWAMI LEAGUE LEADERS, WORKERS AND OTHER PATRIOTS AND LOVERS OF FREEDOM STOP MAY ALLAH BLESS YOU STOP JOY BANGLA STOP-SHEIKH MUJIBUR RAHMAN STOP.
পৃষ্ঠা: ২২১

পাকিস্তান সেনাবাহিনী অতর্কিতভাবে পিলখানা, ইপিআর ঘাঁটি, রাজার বাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করেছে এবং শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ চলছে। আমি বিশ্বের জাতিসমূহের কাছে সাহায্যের আবেদন করেছি। আমাদের মুক্তিযোদ্ধারা বীরত্বের সঙ্গে মাতৃভূমি মুক্ত করার জন্য শত্রুদের সঙ্গে যুদ্ধ করছে। সর্বশক্তিমান আল্লাহর নামে আপনাদের কাছে আমার আবেদন ও আদেশ দেশকে স্বাধীন করার জন্য শেষ রক্তবিন্দ থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যান। আপনাদের পাশে এসে যুদ্ধ করার জন্য পুলিশ, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্ট ও আনসারদের সাহায্য চান। কোন আপস নাই। জয় আমাদের হবেই। পবিত্র মাতৃভূমি থেকে শেষ শত্রুকে বিতাড়িত করুন। সকল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী এবং অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রিয় লোকদের কাছে এ সংবাদ পৌঁছে দিন। আল্লাহ আপনাদের মঙ্গল করুন। জয় বাংলা।”
একই রাতে বঙ্গবন্ধু আরও একটি স্বাধীনতার ঘোষণাবার্তা ইপিআর ওয়ারলেসের মাধ্যমে চট্টগ্রামে প্রেরণ করেন। দ্বিতীয় বার্তাটি নিয়ে নিম্নে উদ্ধৃত হলো
“This may be my last message. From today Bangladesh is independent. I call upon the people of Bangladesh wherever you might be and with whatever you have, to resist the army of occupation to the last. Your fight must go on until the last soldier of Pakistan occupation army is expelled from the soil of Bangladesh and final victory is achieved.”
“এ আমার শেষ বাণী। আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন। বাংলাদেশের জনগণ তোমরা যে যেখানে থাকো; তোমাদের কাছে যা কিছু আছে তা নিয়ে শেষ পর্যন্ত দখলদার বাহিনীর প্রতিরোধ করো। বাংলাদেশ হতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শেষ ব্যক্তিকে না তাড়ানো এবং চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তোমরা যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।”
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা পেয়ে চট্টগ্রাম সেলিমপুর ওয়্যারলেস অফিস, চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ওয়্যারলেস তা বৈদেশিক জাহান, বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় প্রেরণ করে। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান ২৬ মার্চ কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র খুলে তা প্রচার করেন।

চট্টগ্রামে প্রতিরোধ
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে চট্টগ্রাম অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু চট্টগ্রাম নেতাদের চট্টগ্রামের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে কুমিল্লায় অগ্রসর হতে বলেন। সংবাদ পেয়ে ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম ২৫ মার্চ রাত ৮-৩০ মিনিটে বিদ্রোহ
পৃষ্ঠা: ২২২

করেন। তার অধীনে ১০০০ ইপিআর ছিল। তার মধ্যে ৩০০ অবাঙালি ছিল। তিনি অবাঙালী ইপিআরদের বন্দি করেন।
২৫ মার্চ রাত ১১টায় মেজর জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম বন্দরে পাকিস্তানি অস্ত্র বোঝাই সোয়াত জাহাজ হতে অস্ত্র খালাস করার জন্য যাত্রা করেন। পথে তিনি জানতে পারেন চট্টগ্রাম সেনানিবাসে পাকবাহিনী বাঙালি সেনাদের হত্যা করছে। তখন ফেরত চলে যান এবং বিদ্রোহ করেন। ২৬ মার্চ সকালে তিনি সৈন্যদের নিয়ে নিরাপদ স্থানে চলে যান। তিনি পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ ও বাঙালি সেনাদের উদ্ধারের কোনো উদ্যোগ না নিয়ে চট্টগ্রাম শহর ত্যাগ করেন।
২৬ মার্চ কুমিল্লা হতে পাক বাহিনী চট্টগ্রামের পাক সেনাদের সাথে যোগ দেওয়ার জন্য হতে থাকে। ১০২ জন ইবিআর ও ইপিআর কমিরায় পাক সেনাদের পরাজিত করে। পাক বাহিনীর ১৫২ জন সৈন্যসহ অধিনায়ক নিহত হয়। এ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের প্রথম বিজয়।

চট্টগ্রাম কালুর ঘাটে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্র নিরাপদ না থাকায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বেতারের কলাকুশলীদের নিয়ে ২৬ মার্চ দুপুরের মধ্যে কালুরঘাট স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র চালু করে। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসেন কাস্টম অফিসার এম এ হালিম, বেলাল মোহাম্মদ, ইঞ্জিনিয়ার নাসিরউদ্দিন, আবদুস সোবহান, দেলওয়ার হোসেন। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা প্রথম পাঠ করেন।
২৭ মার্চ মেজর খালেদ মোশাররফ, ক্যাপটেন শাফায়াত জামিল ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় বিদ্রোহ করে এবং অবাঙালি অফিসারদের বন্দি করে। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম পর্যায় কুষ্টিয়ার যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সফলতা ছিল অপূর্ব। ২৯ ও ৩০ মার্চ পাকবাহিনীর সাথে তাদের যুদ্ধ চলে। যুদ্ধে ৮৫ জন পাকিস্তানি সৈন্য নিহত হয়। ইপিআর অধিনায়ক মেজর ওসমান চৌধুরী কুষ্টিয়ার যুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। সাথে ছিল হাজার হাজার জনতা। কুষ্টিয়া থেকে অবশিষ্ট সৈন্য নিয়ে মেজর শোয়েব যশোর সেনানিবাসে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ঝিনাইদহে পৌছলে এসডিপিও মাহবুব ভাদন আহমেদ পুলিশ, ইপিআর ও জনতা নিয়ে বার বার আক্রমণ করে মেজর শোয়েবসহ ৫৬ জন সৈন্যকে হত্যা করে।
পাবনার ডিসি নুরুল কাদের খানের নেতৃত্বে ২৭ মার্চ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধে পাক বাহিনীর মেজর আসলামসহ ৮০ জন সৈন্য নিহত হয়।
পৃষ্ঠা: ২২৩

২৬ মার্চ পাকবাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হল ও জগন্নাথ হল আক্রমণ করে অনেক শিক্ষক-ছাত্রদের হত্যা করেছে।
২৬ মার্চ নিহত শিক্ষকগণ হলেন-
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব-দর্শন বিভাগ
ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা-ইংরেজি
ড. ফজলুর রহমান-মৃত্তিকা বিভাগ
ড. এন এম মনিরুজ্জামান-পরিসংখ্যান বিভাগ
অদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য-পদার্থ বিভাগ
আতাউর রহমান খান পদার্থ বিভাগ
ড. সাফাত আলী-শিক্ষা ও গবেষণা ইনস্টিটিউট
শারাফত আলী-গণিত বিভাগ
আগরতলা মামলার ২ নম্বর আসামি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে ২৬ মার্চ ভোরে সেনাবাহিনী তাকে তার এলিফ্যান্ট রোডের বাসভবনের সামনে নির্মমভাবে হত্যা করে। তার লাশ জীপের সাথে বেধে সেনানিবাসে নিয়ে যায়। তার লাশের সন্ধান পাওয়া যায়নি। ১৯৩৬ সালে মোয়াজ্জেম হোসেন পিরোজপুরে ডুমুরতলায় জন্মগ্রহণ করেন।
২৬ মার্চ দিন রাত ঢাকায় গণহত্যা চলে। ২৭ মার্চ কিছুক্ষণের জন্য কার্ফ তুলে নেওয়া হয়। এ সময় হাজার হাজার মানুষ ঢাকা শহর ত্যাগ করে। নেতাকর্মীরা পালিয়ে যায়। ২৭-৩১ মার্চ ঢাকায় হত্যাকাণ্ড চলে। পাক সেনারা শহীদ মিনার ধ্বংস করে। জগন্নাথ হলে ছাত্র শিক্ষকদের হত্যার পর তাদের মাঠে গণকবর দেওয়া হয়। রাজারবাগ ও পিলখানা ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদের বাড়ি আক্রমণ করে। তার স্ত্রী জোহরা তাজউদ্দীন প্রাণে বেঁচে যান। কর্নেল ওসমানী গোপ কেটে ঢাকা থেকে পালিয়ে যান। এমনিভাবে অনেক নেতা আত্মগোপন করতে সক্ষম হয়। তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ২৭ মার্চ ঢাকা তাগ করে মেহেরপুর হয়ে ভারতে চলে যান।

শেখ মুজিবের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কে মেজর সিদ্দিক সালিক
শেখ মুজিব যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সে সম্পর্কে পাকিস্তানি মেজর সিদ্দিক সালিক তার Witness to Surrender গ্রন্থে লিখেছেন: “When the first shot had been fired the voice of Sheikh Mujibur Rahman
পৃষ্ঠা: ২২৪

came faintly through an wave length close to that of official Pakistan Radio. In whay must have been, and sounded like a pre-recorded message. The Sheikh proclaimed East Pakistan to the peoples Republic of Bangladesh.”
“যখন প্রথম গুলিবর্ষণ তখন রেডিও পাকিস্তানে ক্ষীণভাবে শেখ মুজিবের কন্ঠ শোনা যায়। মনে হলো পূর্বে রেকর্ডকৃত বাণী। শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ ঘোষণা করছেন।”

২৭ মার্চ রাত ১-৩০ মিনিট: বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার
২৬ মার্চ রাতে একদল কমান্ডো বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাসভবন ঘিরে ফেল। তারা গোলাগুলি শুরু করে। লে. কর্নেল জেড এ খান এবং কোম্পানি কমান্ডার মেজর বেলালের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে অভিযান চলে। বঙ্গবন্ধু প্রচণ্ড গুলির শব্দ শুনে নিচে নেমে আসে এবং চিৎকার করে নিজের পরিচয় দেন। সিপাইরা তাকে হত্যা করতে উদ্যত্ত হলে কর্নেল জেড এ খান তাদের বাধা দেন। বঙ্গবন্ধু উপরে উঠে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে আসেন। কমান্ডােরা তাকে রাত ১-৩০ মিনিটে ৯জীপে তুলে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে চলে যায়। রাতে তাকে ক্যান্টনমেন্টে আদমজী স্কুলে আটক রাখে। ২৬ মার্চ দিনে তাকে ফ্ল্যাগ স্টাফ হাউজে স্থানান্তর করা হয়। তিন দিন পর বঙ্গবন্ধুকে বিমানে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়। তাকে পাঞ্জাবের মিয়ানওয়ালি জেলে বন্দি করে রাখা হয়।
বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের পর বেগম ফজিলাতুন্নেসা পুত্র জামাল ও রাসেলকে নিয়ে পাশের বাড়িতে আশ্রয় নেন।
বঙ্গবন্ধু যখন বন্দি অবস্থায় আদমজী স্কুলে তখন ঢাকা শহর জ্বলছে। বস্তিতে অগ্নিসংযোগ করে জীবন্ত মানুষসহ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। ডেইলি পিপলস পত্রিকা অফিস আগুন দিয়ে পুড়ে ফেলে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা যেভাবে প্রচারিত হয়েছে।
১. ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা বঙ্গবন্ধু টেলিফোনে চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহম্মেদ চৌধুরীর স্ত্রী ড. নুরুন্নাহারের নিকট জানিয়ে দেন। ড. নুরুন্নাহার বার্তাটি লিপিবদ্ধ করে চট্টগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ অফিসে এবং সলিমপুর ওয়ারলেস স্টেশনে প্রেরণ করেন।
২. সলিমপুর ওয়ারলেস অফিসের সহকারী প্রকৌশলী এম হাকিম তার
পৃষ্ঠা: ২২৫

কর্মচারীদের দ্বারা ঘোষণা বার্তা দেশে বিদেশে প্রেরণ করেন। চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজের মাধ্যমে বার্তাটি দিল্লিসহ বিদেশি প্রেরণ করেন।
৩. বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তাটি প্রচারের জন্য চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান চট্টগ্রাম বেতারের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে ২৬ মার্চ সকালে কালুঘাটে ট্রান্স মিশনে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। এমএ হান্নান স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা কালুর ঘাট থেকে ২৬ মার্চ দুপুর ২ টা ৩০ মিনিট এবং সন্ধ্যার পর প্রচার করেন। ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা বারবার প্রচারিত হয়েছে।
৪. ঢাকার মগবাজারসহ ডিএএস ওয়ারলেসের সুপারভাইজার মেজবাহউদ্দিন ২৬ মার্চ সকাল ৬টায় বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা চট্টগ্রামের সলিমপুর অফিসে প্রেরণ করেন।
৫. চট্টগ্রাম ফৌজদারহাট ক্যাডেট ওয়ারলেস অফিস ঢাকার মগবাজার ওয়ারলেস থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা পেয়ে তা প্রচার করে।
৬. বুয়েটের অধ্যাপক ড. নূরুল উল্লাহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে বেতারযন্ত্র স্থাপন করেন এবং তা থেকে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা প্রচারিত হয়েছে।
৭. ঐতিহাসিক বলধা গার্ডেন হতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা প্রচারিত হয়েছিল।
৮. পিলখানার ইপিআর সিগন্যাল উইংয়ের সুবেদার শহীদ শওকত তার ট্রান্সমিটার থেকে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বার্তা বাংলাদেশের বিভিন্নস্থানে প্রেরণ করেন। পাকবাহিনী এ সংবাদ জানতে পেরে নির্যাতন করে তাঁকে হত্যা করে।
৯. ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে স্বাধীনতা ঘোষণা দিয়েছেন তা আমেরিকার ডিফেন্স ইনটেলিজেন্স এজেন্সির (American Defence Intelligence Agency-DIA) রিপোর্টে লিপিবদ্ধ আছে। তা উদ্ধৃত হলোD/A Spot Report
Date-26 March 1971
Time-14-30
Subject: Civil war in Pakistan
Pakistan was thrust into Civil war to day when Sheikh Mujibur Rahman proclaimed the east wing of the two Country to be the Soverein independent peoples Republic of Bangladesh. Fighting 15 reported heavy Dacca and other eastern cities where the 10,000 men paramilitary East Pakistan Rifels have joined Police and Private citizen in Conflict with an estimated 23000 West Pakistan regular army troops.
ডিআই এ রিপোর্ট
তারিখ: ২৬ মার্চ ১৯৭১
সময়: ১৪-৩০টা
বিষয়: পাকিস্তানে গৃহযুদ্ধ
পাকিস্থানে আজ গৃহযুদ্ধ শুরু হয়েছে। শেখ মুজিবুর রহমান দেশের দুই অংশে পূর্ব অঞ্চলকে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ হিসেবে ঘোষণা দেন। ঢাকা ও পূর্বাঞ্চলের অন্যান্য শহরে ভীষণ যুদ্ধ চলছে। এ অঞ্চলে ১০০০০ ইপিআর পুলিশ এবং জনগণ সাথে যোগ দিয়ে পাকিস্তানের ২৩০০০ সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লিপ্ত আছে।
Department of State
TEL & RAM
A clandestine Radio began to broadcast resistance message, one of first of these was a declaration of the sovereign and independent Peoples republic of Bangladesh made in the name of Mujib.
On March 27 the Clandestine radio announced the formation of a revolutionay army and a provisional government under the leadership of a mijor Zia Khan.
একটি গোপন বেতার থেকে প্রতিরোধের সংবাদ পাওয়া যায়। তার মধ্যে প্রথমটি ছিল মুজিবের নামে সার্বভৌম স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের ঘোষণা। ২৭ মার্চ গোপন বেতারে মেজর জিয়ার নেতৃত্বে বিপ্লবী সেনাবাহিনী ও অস্থায়ী সরকার গঠনের ঘোষণা দেওয়া হয়। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা নিয়ে বিএনপি বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে এবং ইতিহাস বিকৃত করেছে। আমেরিকার হোয়াইট হাউজে রক্ষিত নথিতে দেখা যায় বঙ্গবন্ধু ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং তার পক্ষে মেজর জিয়াউর রহমান ২৭ মার্চ ঘোষণা পাঠ করেন।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা উল্লিখিত উৎস থেকে সারা বাংলায় হাড়য়ে পড়ে এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু হয়। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ব্যতীত অন্য কোনো ব্যক্তি স্বাধীনতা ঘোষণা দেয়নি। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার বার্তা বরিশাল পৌছে ২৬ মার্চ। একই দিনে সেখানে অস্থায়ী সচিবালয় গঠন করা হয়। লেখক
পৃষ্ঠা: ২২৭

এ সময় বরগুনা ম্যাজিস্ট্রেট। বরগুনা মহকুমার তৎকালীন এসডিও সৈয়দ আনোয়ার হোসেন এবং লেখক বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তা পেয়েছেন।
সেলিমপুর/ভিএইচএফ সহকারী স্টেশনের প্রকৌশলী হাকিম, জালাল আহমদ টিটিআর, জুলহাস উদ্দিন টিটিআর, ইএসও শফিকুল ইসলাম টিটিআরএ কাশেম, ক্যাশিয়ার আব্দুল ফজল, মাহফুজ আলী এবং ঢাকার ঢাকার মগবাজার সহ ভিআইএফ-এর সুপারভাইজার মেজবাহ উদ্দিন স্বাধীনতা ঘোষণার বার্তাটি দেশে বিদেশে প্রেরণ করে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঐতিহাসিক অবদান রেখেছেন। তাঁদের এই দুঃসাহসিক অবদানের তেমন কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি।
১৯৭২ সালের মাঝামাঝি সময় আবদুল হাকিম, শফিকুল ইসলাম, জালাল আহমেদ, জুলহাস উদ্দিন, আবুল কাশেম গণভবনে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার একটি অনুলিপি বাইন্ডিং করে বঙ্গবন্ধুকে দেন এবং তার একটি অনুলিপি বঙ্গবন্ধু সত্যায়িত করে দেন। বঙ্গবন্ধু প্রশংসা করে বলেছিলেন, এরাই আমার বাংলার মানুষ, প্রকৃত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা, জাতি তাদের চিরদিন শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবে। এই বাণীবদ্ধ স্মৃতি জাতীয় জাদুঘরে সংরক্ষিত থাকবে। তোমাদের সরকারিভাবে মূল্যায়নের ব্যবস্থা করা হবে।” গণভবনে বাণীটি সংরক্ষিত আছে। নিম্নে তা উদ্ধৃত করা হলো:
চট্টগ্রামে ২৬ মার্চ প্রত্যুষে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণার বার্তাটি দেশবাসীর নিকট ওয়্যারলেসের মাধ্যমে যারা পৌঁছে দেন তাদের নাম ঠিকানা ঘোষণাপত্রে আছে। গণভবনে রক্ষিত ইংরেজিতে লিখিত উক্ত ঘোষণাপত্রে যেভাবে তাদের নাম-ঠিকানা লিখিত আছে, তার অনুলিপি নিন্মে দেওয়া হলো।
1. Management and Guidance by AKSM A Hakim HEW
2. Received and Transmitted by Md. Jalal Ahmed (TTR) ESW
3. Aided by Gulhasuddin Ex-EPR TTR
4. Aided by Md. Shifiqul Islam ESW
5. Aided by Abul Kasem Khan TTR
6. Aided by Abul Fazal, Cashier
এই ৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা সলিমপুর ওয়্যারলেস স্টেশন থেকে দেশে-বিদেশে প্রচার করেছিলেন। আজ তাদের মধ্যে অনেকেই জীবিত নেই। জাতির উচিত ছিল এই বীর সন্তানদের জবানবন্দি বাণীবদ্ধ করে রাখা। এখনো অনেক কর্মচারী জীবিত আছেন। সরকারের উচিত তাদের সাক্ষাৎকার লিপিবদ্ধ করে সংরক্ষণ করা। চট্টগ্রামের সেলিমপুরের স্বাধীনতার ঘোষণা বার্তাটি যথাযথভাবে সংরক্ষিত থাকলে পরবর্তীতে মুক্তিযুদ্ধ বিরোধী সরকার
পৃষ্ঠা: ২২৮

ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতারঘোষণা বিতর্কিত করতে পারতো না।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা পাবনা জেলার সিরাজগঞ্জ মহকুমার শাহজাদপুর থানায় ২৬ মার্চ সকালে পৌঁছে এবং তা এখনো সংরক্ষিত আছে। বাংলাদেশে এই সংরক্ষিত বার্তাটি এক ঐতিহাসিক দলিল। বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা বাংলাদেশ সরকারের সাবেক যুগ্ম সচিব জনাব আবদুল হাই উদ্যোগ গ্রহণ করে বার্তাটি উদ্ধার করেন।
শাহজাদপুর থানার ওসি আবদুল হামিদ ২৬ মার্চ প্রত্যুষে ‘পাকিস্তান টেলিগ্রাফ এন্ড টেলিফোনস ডিপার্টমেন্ট, ঢাকা থেকে প্রেরিত বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতার ঘোষণাটির বার্তাটি পান। বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা বাংলাদেশের সকল জেলা, মহকুমা ও থানায় ইপিআর ও ওয়্যারলেস-এর মাধ্যমে পৌছে যায়। এ সময় টেলিগ্রাম অপারেটরগণ হাতে বার্তা লিখতেন এ কারণে ভাষার কিছুটা পার্থক্য দেখা দেয়। তবে বার্তার মূল বিষয় একই ছিল।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ৮ ঘটিকায় শাহাজাদপুর থানার ওসি আবদুল হামিদ ইপিআর ওয়ারলেসের স্বাধীনতার ঘোষণার বার্তা পেয়ে শহরে প্রচার করেন। তিনি থানা ত্যাগ করার সময় মূল বার্তা নিয়ে যান। তিনি ঢাকায় অবসর জীবন যাপন করতেন। কিছুদিন পূর্বে তিনি মৃত্যুবরণ করেছেন। তিনি ২৬ মার্চ যে বার্তা পেয়েছেন তা নিম্নরূপ:
From Dacca
Receive on
Sd: 26/3
at 0-8 am
To
Peoples of Bangladesh and all of the World.
Pakistan arms forces suddenly attacked E.P.R of Peelkhana and Police forces at Rajarbag from 00 hours of 26th March killing laks of unarmed people fierce battle going on with EPR and Police forces in the street of Dacca and people are fighting gallantly for the freedom of Bangladesh. Every section of people of Bangladesh asked attack enemy force at any cost of Bangladesh. May Allah bless you and Help in your struggle of freedom.
Joy Bngla
S. K Mujib
পৃষ্ঠা: ২২৯

ঢাকা হতে
গ্রহণের সময়
এসডি: ২৬/৩
সকাল: ০৮টা
বাংলাদেশসহ পৃথিবীর সকল জনগণ।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনী হঠাৎ পিলখানার ইপিআর, রাজারবাগের পুলিশ ২৬ মার্চ ১২টায় আক্রমণ করেছে। তারা লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষ হত্যা করেছে। ঢাকার রাস্তায় ইপিআর, পুলিশ ও জনগণের সাথে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ চলছে। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষকে যে কোনো মূল্যে শত্রুর সাথে যুদ্ধ করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হলো। স্বাধীনতা যুদ্ধে আল্লাহ আপনাদের সহায়তা করুন।
জয় বাংলা
শেখ মুজিব

তেলিয়াপাড়া সেনা সম্মেলন-৪ এপ্রিল
চতুর্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের অধিনায়ক মেজর খালেদ মোশাররফ সিলেটের তেলিয়াপাড়া চা বাগানে ১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সেনা সম্মেলন আহ্বান করেন। এ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী, কর্নেল আবদুর রব এমএনএ, মেজর সফিউল্লাহ, মেজর জিয়াউর রহমান, লে. কর্নেল সালাউদ্দিন, মেজর মইনুল হোসেন চৌধুরী, মেজর নুরুজ্জামান, মেজর খালেদ মোশাররফ, কর্নেল ওসমানী এমএনএ সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভায় মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়।

সহায়ক গ্রন্থ
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
পৃষ্ঠা: ২৩০

নবম অধ্যায়
মুক্তিযুদ্ধ ১৯৭১

ক.গণহত্যা, নারী নির্যাতন, শরণার্থী
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে পাকবাহিনীর গণহত্যা মানব ইতিহাসকে কলঙ্কিত করেছে। ৯ মাসে তারা ৩০ লক্ষ নরনারী হত্যা ও ২ লক্ষ ৫০ হাজার নারীকে নির্যাতন করেছে। তাদের অত্যাচারে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে। পাকবাহিনীকে সহায়তা করেছে জামায়াতে ইসলামী, মুসলিম লীগ, ছাত্রশিবির, শান্তি কমিটি, রাজাকার-আলবদর। তাদের সংখ্যা ছিল- এক লক্ষ শান্তি কমিটির সদস্য এবং ৫০ হাজার রাজাকার-আলবদর।
ইসলাম ধর্মের মূল আবেদন শান্তি। ইসলাম ধর্মে হত্যা, নারী নির্যাতন মহাপাপ, দোযখে তাদের বাস। অথচ ইসলামের নামে পাকবাহিনী বাংলাদেশে ৯ মাস গণহত্যা চালিয়েছে। তাদের নির্যাতনের ভয়ে দু’কোটি মানুষ ঘরবাড়ি ছেড়ে দেশের ভেতরে জঙ্গলে. গুপ্তস্থানে পালিয়ে বেড়িয়েছে। এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। সকল ধর্মে জীবহত্যা মহাপাপ। সকল ধর্ম মানবপ্রেমের কথা বলেছে মহামতি বুদ্ধ, কনফুসিয়াস, হযরত মুহাম্মদ (দ.)। তারা শান্তির আহ্বান জানিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের শান্তির বাণীর প্রতি শ্রদ্ধা না রেখে বিশ্বের ইতিহাসে কয়েকটি জঘন্যতম গণহত্যা হয়েছে। সবচেয়ে করুণ, নিষ্ঠুর গণহত্যা ঘটেছে বাংলাদেশে, আর এ হত্যাকাণ্ডের নায়ক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান, জুলফিকার আলী ভুট্টো, জেনারেল হামিদ, লে. জে. নিয়াজী প্রমুখ এবং তাদের সহযোগী প্রফেসর গোলাম আযম, মওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ দালাল ও রাজাকার-আলবদররা।
১৯৪৬ সালের দাঙ্গায় কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীতে হাজার হাজার লোক নিহত ও নারীরা নির্যাতিত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগের পর হিন্দু-মুসলমানদের দাঙ্গায় প্রায় দশ লক্ষ লোক নিহত, লক্ষাধিক নারী ধর্ষিত হয় এবং কয়েক কোটি লোক বাস্তুহারা হয়। বাংলাদেশে কয়েক হাজার বধ্যভূমি ছিল
পৃষ্ঠা: ২৩১

যেখানে পাকসেনারা বাঙালিদের হত্যা করে গণকবর দিয়েছে, অনেক সময় লাশ খাল, বিল ও নদীতে ফেলে দিয়েছে, কুকুর ও শকুনের মহোৎসব ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান সামরিক সরকার তাদের দোসর জামায়াতে ইসলামী, ছাত্র সংগঠন, ছাত্র সংঘ, রাজাকার আলবদর ৯ মাস ধরে গণহত্যা চালায়। নিহতদের কোনো জানাজা পড়ানো হতো না, ধর্মের নির্দেশ অনুসারে কবর দেওয়া হতো না। হিন্দু, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিফৌজ হত্যা করাকে জায়েজ করে নেয়। নারীদের মালেগনিমত হিসেবে পাশবিক নির্যাতন চালায়। জীবনের ভয়ে সীমাহীন কষ্ট ও মৃত্যু ভয়ের শিকার হয়ে ভারতে পালিয়ে যায়। যাওয়ার পথে অনেকে ধরা পড়ে নিহত হয়। ভারতে শরণার্থী শিবিরে হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছে। এ দুঃসময়ে পশ্চিম বাংলা এবং আগরতলার জনগণ এগিয়ে আসে। বিশেষ করে পূর্ববাংলা থেকে, যারা পশ্চিম বাংলায় স্থায়ী বাসিন্দা ছিল তারা মানবতার সেবায় এগিয়ে আসে। বিদেশি অনেক এনজিও ও রেডক্রস শরণার্থীদের মধ্যে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ, সুচিকিৎসা ও শিক্ষার ব্যবস্থা করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা
বাঙালীদের ৬ দফা দাবি ধ্বংস করার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান, জেনারেল টিক্কা খান ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে গণহত্যা শুরু করে। তাদের ষড়যন্ত্রের সাথে পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর সহযোগিতা ছিল। ভুট্টো ছিলেন ৬ দফা ও আওয়ামী লীগ বিরোধী। তিনি বঙ্গবন্ধুর বিজয়কে মেনে নিতে পারেননি। তার কারণে ঢাকার আলোচনা ভেঙে যায়। পূর্ব বাংলার জনগণের দাবি স্বাধীন বাংলাদেশ ইয়াহিয়া ভুট্টো গ্রহণ করবে না। বাঙালিদের ওপর আক্রমণের নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা থেকে গোপনে চলে যান। পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক প্রশাসক লে. জেনারেল টিক্কা খান ২৫ মার্চ রাত ১১টায় বাঙালীদের বিরুদ্ধে অপারেশন সার্চলাইট শুরু করেন। একই সময় পাক বাহিনী ঢাকার পিলখানা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজারবাগ পুলিশ লাইন, বস্তি এলাকা আক্রমণ করে এবং ঢাকায় প্রথম রাতে ৭ হাজার লোক হত্যা করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করে। ২৬ মার্চ ভোরে পাক বাহিনী আগরতলা মামলার ২ নম্বর আসামি লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনকে এলিফ্যান্ট রোডে তার বাসভবনের সামনে হত্যা করে লাশ নিয়ে যায়। ২৫ মার্চ রাতে পাক বাহিনী চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, সিলেট, খুলনা প্রভৃতি স্থানে আক্রমণ চালায়। তারা প্রথমেই বাঙালী সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশদের
পৃষ্ঠা: ২৩২

নিরস্ত্র করে। পাকসেনারা বাঙালি সেনা অফিসার, বেসামরিক কর্মকর্তাদের হত্যা করে। তারা কার্ফু জারী করে হত্যা, অগ্নিসংযোগ, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। ২৫ মার্চ রাতে ঢাকা জ্বলছে। হাজার হাজার বাড়ি ঘর ও বস্তিতে আগুন দিয়ে পুড়ে আতংক সৃষ্টি করে। মনে হল চেঙ্গিস খান, হালাকু খান আবার ফিরে এসেছে। ঢাকা মৃতনগরীতে পরিণত হয়। টিক্কা খানের ধ্বংসলীলা এত ভয়ঙ্কর ছিল যে, যুদ্ধকালীন পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তানি কমান্ডার লে. জেনারেল এ কে কে নিয়াজী বলেন, ২৯৭১ সালের ২৫ ও ২৬ মার্চ মধ্যরাতে জেনারেল টিক্কা খান আক্রমণ করেন। সমস্ত রাত আর্তনাদ, চিৎকার ও জ্বলন্ত রাতে পরিণত হলো। জেনারেল টিক্কা খান তার অধীনে যা কিছু ছিল সব মুক্ত করে দেন। মনে হলো তিনি শত্রুদের ওপর অভিযান চালিয়েছেন। নিজের বিভ্রান্ত বিপদগামী জনগণের সঙ্গে যেভাবে করা উচিত ছিল তা তিনি করেন নি। তার সামরিক অভিযান ছিল নির্মম নিষ্ঠুরতার প্রদর্শন। চেঙ্গিস খান এবং হালাকু খান বোখারা ও বাগদাদ অথবা ব্রিটিশ জেনারেল ডায়ার জালিয়ানওয়ালাবাগে যে নিষ্ঠুর গণহত্যা চালিয়েছিল তার চেয়েও ভয়ঙ্কর ও নিষ্ঠুর ছিল টিক্কা খানের সামরিক আক্রমণ।”
জেনারেল নিয়াজী আরও বলেছেন যে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান টিক্কা খানকে নির্দেশ দিয়েছিলেন বাঙালী সেনাবাহিনীকে নিরস্ত্র করতে। কিন্তু তিনি তা না করে সাধারণ নাগরিকদের হত্যা এবং পোড়ামাটিনীতি গ্রহণ করেন। সেনাবাহিনীর প্রতি জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশ ছিল, I want the land, not the People.’ আমি মানুষ চাই না। ভূমি চাই।’ গণহত্যার আর একজন সমর নায়ক মেজর জেনারেল রাওফরমান বলেছেন, “Green Land of East Pakistan will be painted red.” পূর্ব পাকিস্তানের সবুজ ভূমি রক্তাক্ত করা হবে। জুলফিকার আলী ভুট্টো ২৫ মার্চ ঢাকায় থেকে স্টেনগানের গুলির শব্দ শুনেছেন। জ্বলন্ত ঢাকা দেখেছেন। আনন্দিত হয়েছেন। তিনি পরের দিন সকালে টিক্কা খান, রাওফরমান ও আরবারকে ধন্যবাদ জানালেন।
জেনারেল নিয়াজী টিক্কা খানের পর পূর্ব বাংলায় গণহত্যা অব্যাহত রেখেছেন। নিয়াজী আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সমালোচনা করে লিখেছেন যে, মার্চ মাসের প্রথম ১৪ দিনে অবাঙালিদের হত্যা করেছে এবং নারী নির্যাতন করেছে। নিয়াজীর বক্তব্য সত্য নয়। ২৫ মার্চের পূর্বে অবাঙালিদের হত্যা করা হয়নি। ২৬ মার্চ হতে যুদ্ধ শুরু হয়। এ সময় অবাঙালি নিহত হয়েছে। এ জন্য কিছুসংখ্যক লোক দায়ী ছিল। বঙ্গবন্ধু বা মুজিবনগর সরকার অবাঙালীদের নিরাপত্তা বিধানে অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন। পূর্ব বাংলায় সামরিক আইন প্রশাসক জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে
পৃষ্ঠা: ২৩৩

গণহত্যা চলতে থাকে। তার নিষ্ঠুরতা ও গণহত্যা কাহিনী সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়ে। ইয়াহিয়া খান জেনারেল টিক্কার স্থলে অভিজ্ঞ লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজীকে পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার নিয়োগ করেন। ৪ এপ্রিল নিয়াজী ঢাকায় পৌঁছে এবং ১০ এপ্রিল কমান্ডের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১১ এপ্রিল টিক্কা খানকে গভর্ণর নিযুক্ত করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী গভর্নরের উপদেষ্টা ছিলেন। ব্রিগেডিয়ার বাকির মুহাম্মদ ছিলেন চিফ অব স্টাফ। ১৪ ডিভিশনের কমান্ডিং অফিসার মেজর জেনারেল খাদিম রাজার স্থলে মেজর জেনারেল আবদুর রহিমকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়।
জেনারেল টিক্কা খান সামরিক ও বেসামরিক ক্ষমতা প্রয়োগ করেন। সতরাং তার নির্দেশে সারা বাংলায় গণহত্যা, লুণ্ঠন ও নারী নির্যাতন চলছে। মেজর জেনারেল নাজির হোসেন শাহ ১৬ ডিভিশনের জিওসি ছিলেন। মেজর জেনারেল জামসেদকে ইস্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সেস ECAF- এর মহাপরিচালক নিয়োগ করা হয়। বাঙালি ইপিআর মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। এ কারণে পাকিস্তান সরকার অবাঙালি ইপিআর ও বিহারীদের নিয়ে ইক্যাপ গঠন করে। EPCAF বাঙালিদের হত্যা করে।
মেজর জেনারেল মিঠা খান টিক্কা খানের সহকারী ছিলেন। জেনারেল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর থাকার ফলে লক্ষ লক্ষ বাঙালীকে হত্যা করে এবং এক কোটি বাঙালি বাধ্য হয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। দুই কোটি নর-নারী দেশের অভ্যন্তরে পালিয়ে বেড়াত। অবশিষ্ট ৪ কোটি মানুষ ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে রাত কাটাত। বাঙালিদের হত্যার জন্য টিক্কা খানকে দায়ী করা হয়। তাই টিক্কা খানকে কসাই বলা হয়। ইতিপূর্বে তিনি বেলুচিস্তানে গণহত্যা চালিয়ে কসাই উপাধি পেয়েছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর জামায়াত, মুসলিম লীগের নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষার নামে শান্তি কমিটি Peace Committee গঠন করে। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা খয়ের উদ্দিনকে আহ্বায়ক করে ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটি গঠন করা হয়। শান্তি কমিটির নেতৃবৃন্দ-
খাজা খয়ের উদ্দিন- আহ্বায়ক
খান এ সবুর খান – মুসলিম লীগ
প্রফেসর গোলাম আযম- জামায়াত
এডভোকেট ফরিদউদ্দিন আহমদ- নেজামে ইসলাম
মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী- জামায়াত
পৃষ্ঠা: ২৩৪

মাওলানা আব্বাস আলী- জামায়াত
এএস এম সোলায়মান- কৃষক-শ্রমিক পার্টি
পীর মোহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া
মাওলানা মাসুম
পূর্ব পাকিস্তানের জামায়াত, মুসলিম লীগ, পিডিপি, নেজামে ইসলাম পাকিস্তানকে সমর্থন এবং মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জামায়াত গণহত্যায় মুখ্য ভূমিকা পালন করে।
১৯৭১ সালের মে মাসে খুলনার জামায়াত নেতা এ কেএম ইউসুফ প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করে। পাক বাহিনীর সহায়তাকারী পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়। ১৯৭১ সালে রাজাকার বাহিনী গণহত্যায় কলঙ্কময় ইতিহাস সৃষ্টি হয়। তারা জামায়াতও পাক সেনাদের সহায়তা করে। তারা হিন্দু নারী-পরুষ, আওয়ামী লীগ ও মুক্তিযোদ্ধাদের ধরে এনে পাকবাহিনীর নিকট হস্তান্তর করতো। রাজাকাররা পাক বাহিনীকে পথ দেখিয়ে গ্রামে গ্রামে নিয়ে যায়। তারা নিজেরাই পাক বাহিনীর ভূমিকা পালন করে এবং মানুষ হত্যা করেছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন শিক্ষক পাক বাহিনীর দালালী করে।
কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির উদ্যোগে প্রত্যেক জেলা, মহকুমা, থানা ও ইউনিয়ন শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। রাজাকার বাহিনীকে মাসিক বেতন ও অস্ত্র প্রদান করে। পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিশিয়ারা পূর্ব বাংলায় গণহত্যা চালায়। পাক সেনারা সকল জেলা, মহকুমা ও থানায় ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ ও লুণ্ঠন চালায় এবং তারা লাখ লাখ বাঙালি হত্যা করেছে। গ্রামবাংলা পুড়ে কোটি মানুষকে আশ্রয়হীন করেছে। তাদের নির্যাতনে এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারতে পালিয়ে যাওয়ার সময় তাদের অনেককে হত্যা করা হয়। ভারতের আশ্রয় কেন্দ্রে শরণার্থীরা অবর্ণনীয় কষ্টে দিন যাপন করেছে। জাতিসংঘ শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যার নায়ক ছিলেন গভর্নর ও সামরিক শাসক জেনারেল টিক্কা খান। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল জেনারেল টিক্কা খান গভর্নর হিসেবে বিচারপতি বি এ সিদ্দিকীর নিকট শপথ গ্রহণ করেন। ইতিপূর্বে বিচারপতি বি এ সিদ্দিকী টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেছিলেন। সারা বিশ্ব গণহত্যার কারণে বর্বর টিক্কা খানকে ঘৃণা করতো। জেনারেল নিয়াজীর সাথে তার সম্পর্ক ভালো ছিল না। ৪ সেপ্টেম্বর টিক্কা খানের সামরিক আইন প্রশাসকের ক্ষমতা জেনারেল নিয়াজীকে দেওয়া হয়।
পৃষ্ঠা: ২৩৫

রাজাকার মন্ত্রিসভা
লক্ষ লক্ষ বাঙালি হত্যার নায়ক জেনারেল টিক্কা খানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত সৃষ্টি হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ও পাকিস্তানের ভাবমূর্তি বিশ্বে ধ্বংস হয়েছে। তাই ইয়াহিয়া খান বাধ্য হয়ে জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণের সিদ্ধান্ত নেন।
১৯৭১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর সাবেক মন্ত্রী ডা. আবদুল মোত্তালিবকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়। বিচারপতি বিএ সিদ্দিক তাকে শপথ পড়ান। ১১ সেপ্টেম্বর শপথ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সাবেক গভর্নর মোনায়েম খান, অধ্যাপক গোলাম আযম, ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর খান, ইউসুফ চৌধুরী মোহন মিয়া, এ এমএস সোলায়মান, হাসান আসকারী, পীর মোহসীন উদ্দিন দুদু মিয়া, আবদুল জব্বার খান, ইস্পাহানী, এ আর এস দোহা প্রমুখ।
১৯৭১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ডা. এএম মালেক জামায়াত মুসলিম লীগ ও দলছুটদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রীরা হলেন-
ডা. এ এম মালিক- গভর্নর
আবুল কাসেম- কাউন্সিল মুসলিম লীগ-অর্থ
এডভোকেট নওয়াজেস আহমেদ- কাউন্সিল মুসলিম লীগ খাদ্য ও কৃষি
আব্বাস আলী খান-জামায়াত- শিক্ষা
মওলানা এ কে এম ইউসুফ- জামায়াত ইসলাম- রাজস্ব পূর্ত, বিদ্যুৎ, সেচ
ওবায়দুল্লাহ মজুমদার- আওয়ামী লীগ থেকে দলছুট- স্বাস্থ্য ও তথ্য
এ এম এস সোলায়মান- কৃষক শ্রমিক পার্টি, সমাজকল্যাণ ও পরিবার পরিকল্পনা
মওলানা মোহাম্মদ ইসাহাক- নেজামে ইসলাম, স্থানীয় সরকার
ব্যারিস্টার আখতার উদ্দিন আহমদ- কনভেনশন মুসলিম লীগ, শিল্প, বাণিজ্যও আইন
অং সু প্রু- পার্বত্য চট্টগ্রাম, বন সমবায় মৎস্য।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বেসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করে প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। কিন্তু ডা. মালিক মন্ত্রিসভা ছিল পুতুল সরকার। সামরিক সরকারের নির্দেশে তারা দায়িত্ব পালন করতো। গভর্নরের উপদেষ্টা ছিল মেজর জেনারেল রাওফরমান আলী। তিনি পূর্ব
পৃষ্ঠা: ২৩৬

পাকিস্তানে গণহত্যার নীল নকশা বাস্তবায়িত করেছিলেন।
বাংলাদেশে গণহত্যার পাকিস্তানি সমরনায়কগণ
জেনারেল ইয়াহিয়া খান- প্রেসিডেন্ট
জেনারেল আবদুল হামিদ খান- সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফ
এয়ার ভাইস মার্শাল এ রহিম খান- পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রধান
মেজর জেনারেল পীরজাদা -প্রেসিডেন্টের পিএসও
লে. জেনারেল টিক্কা খান- পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসক
মে. জেনারেল খাদেম হােসেন রাজা- জিওসি পূর্ব পাকিস্তান
লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ খান নিয়াজী- ইস্টার্ন কমান্ডার- সামরিক আইন প্রশাসক
মেজর জেনারেল রাওফরমান আলী- গভর্নরের পরামর্শদাতা
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী, মিলিশিয়া ও রাজাকার, আল বদর ৩০ লাখ বাঙালি হত্যা করে এবং দুই লক্ষ পঞ্চাশ হাজার নারী ধর্ষণ করেছে। প্রত্যেক জেলা, মহকুমা ও থানায় গণহত্যার পর মৃতদেহ গণকবর দেওয়া হয়। ঢাকা শহরে মিরপুর বধ্যভূমিতে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে। বাংলাদেশে শত শত গণকবর আবিষ্কার হয়েছে। অনেক গণকবর অবহেলায় পড়ে রয়েছে।
বাংলাদেশে হাজার হাজার বধ্যভূমির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখ করা হলাে :
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার নির্দেশে জেনারেল টিক্কা খান বাঙালিদের ওপর বর্বরােচিত আক্রমণ চালায়। প্রথমে রাতে পাকবাহিনী ঢাকায় ৭০০০ লােক হত্যা করে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র-শিক্ষকদের হত্যা করে জগন্নাথ হলের মাঠে মাটি চাপা দেয়। তারা সারা বাংলায় গণহত্যা ও নারী নির্যাতন শুরু করে।
১৯৭১ সালের ৩ এপ্রিল টাঙ্গাইলের গােড়ান-সাটিয়াপাড়া গ্রামে কাদের সিদ্দিকী বাহিনীর সাথে পাকবাহিনীর যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে ৩০ জন মুক্তিযােদ্ধা শহীদ হয়। মুক্তিযােদ্ধারা পিছু হটে গেলে পাকিবাহিনী প্রায় ৩০০ গ্রামবাসীকে হত্যা করে। তারা শহরে কাদের সিদ্দিকী, খন্দকার আসাদুজ্জামানের বাসগৃহ পুড়িয়ে ফেলে. তারা জীবন্ত মানুষকে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। টাঙ্গাইলে পাকবাহিনী ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও নারী নির্যাতন চালায়, হাজার হাজার লােক নিহত হয়। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সৈন্যরা অসংখ্য ভিয়েতনামিকে হত্যা করেছে এবং শত শত মাইলাই সৃষ্টি করেছে।
পৃষ্ঠা: ২৩৭

১৯৭১ সালে বাংলাদেশে পাকিস্তান সমরনায়ক এবং তাদের সহচর জামায়াতে ইসলামী গণহত্যা চালায়। বাংলাদেশের ৮০ হাজার গ্রামের প্রত্যেকটিতে মাইলাই সৃষ্টি করেছে। তারা ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করেছে, আড়াই লক্ষ নারীকে ধর্ষণ করেছে। তাদের নির্যাতনের ফলে এক কোটি মানুষ ভারতে আশ্রয় নিয়েছিল। নিমে পাকবাহিনীর গণহত্যার কয়েকটি স্থানের নাম উল্লেখ করা হলো।
২৫ মার্চ পাকবাহিনী অতর্কিতে ঢাকার ইপিআর হেডকোয়ার্ট ও রাজারবাগ পুলিশ লাইন আক্রমণ করে শত শত ইপিআর ও পুলিশকে হত্যা করে। ২৫ মার্চ- ৩০ মার্চ পাকসেনারা যশোর, কুমিল্লা ও চট্টগ্রাম সেনানিবাসে বেঙ্গল রেজিমেন্টের শত শত সেনা কর্মকর্তা ও সৈন্যকে হত্যা করে গণকবর দেয়। স্বাধীনতার পর কুমিল্লা সেনানিবাসে কয়েকটি গণকবরের সন্ধান পাওয়া যায়।
২৭ মার্চ তারা রাজশাহীর পুলিশ লাইন আক্রমণ করে পাকসেনারা অনেক পুলিশকে হত্যা করে।
পাকবাহিনী মুক্তিবাহিনীর দখল থেকে জেলা, মহকুমা ও থানায় সদর দখল করার পর সে সকল অঞ্চলে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নি সংযোগ চালায়। তারা মুক্তিফৌজ আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও হিন্দুদের খোঁজে গ্রামে গ্রামে যায়। নিরস্ত্র মানুষকে লাইন দিয়ে দাঁড় করিয়ে হত্যা করে। কিশোরী, যুবতী, এমনকি বয়স্ক নারীদের ধরে নিয়ে তাদের ক্যাম্পে আটক রেখে দিনের পর দিন নির্যাতন চালায়। অনেক নারী গর্ভবতী হয়-স্বাধীনতার পর অনেক শিশু বিদেশে দত্তক দেওয়া হয়।
পাকবাহিনী বরিশালের শর্শিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ ও শান্তি কমিটির সহযোগিতায় পিরোজপুর মহকুমায় হাজার হাজার লোক হত্যা করে, নারী নির্যাতন চালায় এবং হিন্দুদের মালামাল মালেগনিমত হিসেবে লুণ্ঠন করে। আটঘর কুড়িয়ানায় একটি ডোবায় ৩০০ লোককে হত্যা করে চাপা দেওয়া হয়। নারীদের নির্যাতন করা হয়। গভীর পেয়ারা বাগানে মানুষ পালিয়ে থাকত; তাদের জোঁকে ধরত। পাক সেনাবাহিনীর গানবোটে এক যুবক দালালকে দেখা যেত। পরবর্তীকালে সে দু’বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের পরে ৫শ’ রাজাকার আলবদর নিয়ে শর্শিনার পীর আত্মসমর্পণ করে। তাকে ১৯৭২ সালের ১ জানুয়ারি পর্যন্ত বরিশালের জেলে আটক রাখা হয়। শর্শিনার পীর আবু জাফর মোহাম্মদকে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ১৯৮০ সালে একুশে পদক এবং জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালে স্বাধীনতা পদক দিয়েছেন। বরিশালসহ শহরে ত্রিশ গোডাউন, ওয়াপদা অফিসের পিছনে ছিল বধ্যভূমি,
পৃষ্ঠা: ২৩৮

ভোলার ডাকবাংলো ও ওয়াপদা অফিসের নিকট শত শত লোক হত্যা করা হয়। বরগুনা জেলে দু’শতাধিক লোককে হত্যা করে ওয়াপদা বেড়িবাঁধের পাশে গণকবর দেওয়া হয়। স্বাধীনত করা কবর থেকে মানুষের মাথা ও হাড় উদ্ধার করা হয়।
বরগুনার এসডিওর লঞ্চঘাট, পাথরঘাটা, পটুয়াখালী, জেলখানা, পিরোজপুরের হুলারহাট, বলেশ্বর খেয়াঘাট, ঝালকাঠি শ্মশানঘাট, উজিরপুরের গুঠিয়া ইউনিয়ন, গৌরনদী কলেজ শত শত লোককে হত্যা করা হয়।
১১ এপ্রিল পাবনা দখলের পর পাকসেনারা স্থানীয় দালালদের সহযোগিতায় শত শত লোককে হত্যা, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠন চালায়। পাবনা শহর, চাটমোহর, পাকশী, নগরবাড়ি, বাঘাবাড়ি, ঈশ্বরদী পাকসেনাদের হত্যাকাণ্ডের ঘাঁটি ছিল। তাদের সাথে সহযোগিতায় ছিল-জামায়াত নেতা মওলানা মতিউর রহমান নিজামী ও মওলানা ছোবহানসহ অনেকে। মওলানা মতিউর রহমান নিজামী সাঁথিয়া-বেড়া থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিল এবং বিএনপিসহ ৪ দলীয় জোটের প্রথমে কৃষিমন্ত্রী, পরে শিল্পমন্ত্রী হয়। এই মতিউর রহমান নিমাজী ১৯৭১ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসায় বদর বাহিনীর অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী’ বলে আখ্যায়িত করেছিল। এভাবে গণহত্যার নায়করা জেনারেল জিয়া ও বেগম খালেদা জিয়ার আমলে পুনর্বাসিত হয়েছে। এ হলো জাতির ও মুক্তিযোদ্ধাদের দুর্ভাগ্য। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সমাজকল্যাণ মন্ত্রী আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ১৯৭১ সালে ছাত্র সংঘ (ছাত্রশিবির)-এর সভাপতি ছিল এবং আলবদর বাহিনীর ঢাকা মহানগরের সভাপতি ছিল। সে ১৯৭১ সালে নারায়ণগঞ্জ মহকুমার সর্বত্র হত্যাকাণ্ড চালায়। ১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর ফতুল্লা থানার বক্তাবলী এলাকায় পাকবাহিনী ১৭০ জনকে হত্যা করে। ঢাকা শহরের বধ্যভূমির মধ্যে রায়েরবাজার ও মিরপুর অন্যতম। বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে রায়েরবাজার ও মিরপুরে ফেলে দেওয়া হয়। ১৬ ডিসেম্বরের পর বুদ্ধিজীবীদের অনেক লাশ উদ্ধার করা হয়। শহীদদের স্মরণে রায়েরবাজার ও মিরপুর গোরস্তানে শহীদ স্মৃতি নির্মাণ করা হয়েছে।
রমনা কালীবাড়িতে শতাধিক ইপিআরকে হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়। শাখারী বাজারে কয়েক শ হিন্দুদের ২৬ মার্চ হতে হত্যা করা হয়।
বগুড়ার জয়পুরহাটের মুসলিম লীগ নেতা আবদুল আলীম ৩০ জন মুক্তিযোদ্ধাকে ধরিয়ে দেয় এবং তাদের সকলকে হত্যা করা হয়। ১৯৭১ সালের অন্যতম ঘাতক আবদুল আলীম জিয়াউর রহমানের রেলমন্ত্রী ছিল। ময়নামতি ক্যান্টনমেন্টে ২৬ মার্চ হতে ৩১ মার্চ এক নারকী হত্যাকাণ্ড
পৃষ্ঠা: ২৩৯

চালানো হয়। পাকিস্তানি লে. কর্নেল ইয়াকুবের নির্দেশে অনেক বাঙালি অফিসার ও সৈন্যদের হত্যা করা হয়।
কুমিল্লা শহরে ৩০ মার্চ বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ও ভাষাসৈনিক ধীরেন্দ্রনাথ দত্তকে হত্যা করা হয়। ২৯ ও ৩০ মে মেজর নাদের পারভেজ ও ক্যাপ্টেন শওকতের নির্দেশে বরগুনা জেলা থানায় প্রায় দু’শ লোককে হত্যা করা হয়। তারা প্রায় সকলে হিন্দু ছিল। ১০ জুন বরিশালে উজিরপুর থানার গুঠিয়া ইউনিয়নে ৩০০ লোককে হত্যা করা হয়।
শর্শিনার পীর মওলানা আবু জাফর সালেহ তার মাদ্রাসার বদর বাহিনী নিয়ে পাকসেনাদের সাথে পিরোজপুর, ঝালকাঠিতে গণহত্যা চালায়। ঝালকাঠি, আটঘরকুড়িয়া থানা, স্বরূপকাঠি, ইন্দুরহাটে হাজার হাজার লোক হত্যা করে গণকবর দেওয়া হয়েছে আটঘর কুড়িয়ায় মেজর নাদের পারভেজের নেতৃত্বে পাকসেনারা এক মাস অভিযান চালায়। দক্ষিণ বাংলার হিন্দুরা ও মুক্তিফৌজ কুড়িয়ানা পেয়ারা বাগানে আশ্রয় নিয়েছিল। ১৯৭১ সারের ২৪ নভেম্বর শেরপুরের সূর্যদী গ্রামে ৬২ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে পাকবাহিনী। নওগাঁ মহকুমার মান্দা থানায় পাকুড়িয়ায় ২৮ আগস্ট বর্বর বাহিনীর ১২৮ জন গ্রামবাসীকে হত্যা করেছে।
২৬ মে সিলেটের বালাগঞ্জে বরুঙ্গায় শতাধিক হিন্দুদের লাইন করে হত্যা করে।
নরসিংদীতে অনেক বুদ্ধিজীবী ও গ্রামবাসীকের হত্যা করা হয়।
খুলনার গল্লামারীতে প্রতিদিন পাকসেনারা হিন্দু ও মুক্তিযোদ্ধাদের হত্যা করত। বাগেরহাটে রাজাকার রজব আলীর সহায়তায় পাকসেনারা অনেককে হত্যা করেছে। সাতক্ষীরা, খালিশপুর, দৌলতপুরে বধ্যভূমি রয়েছে। আরও রয়েছে মুসলিম লীগ নেতা খান এ সবুর, জামায়াত নেতা মৌলানা ইউসুফ। খুলনার অধিবাসী মওলানা ইউসুফ প্রথমে খুলনার খালিশপুরে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তারা অনেককে হত্যা করে। খালিশপুরে অনেক বিহারী পাকবাহিনীর দালাল ছিল। স্বাধীনতার পর অনেক নির্দোষ বিহারীকে হত্যা করা হয়। এ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যর্থতা। ফরিদপুর, মাদারীপুর, গোয়ালন্দ, যশোর, ঝিনাইদহ, মাগুরা, কুষ্টিয়া, চুয়াডাঙ্গায়, সান্তাহার, রাজশাহী, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, দিনাজপুর, ময়মনসিংহ, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, সুনামগঞ্জ, কুমিল্লা, চাঁদপুর, ফেনী, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে হত্যাযজ্ঞের কেন্দ্র ছিল।
১৯৭১ সালে অনেক মুক্তিযোদ্ধা, বুদ্ধিজীবীকে পাকবাহিনী গ্রেফতার করে কারাগারে আটক রাখে। তাদের ওপর দিনের পর দিন নির্যাতন চালানো হতো
পৃষ্ঠা: ২৪০

ঢাকা, যশোর, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহী, রংপুর, সিলেট সেনানিবাসগুলো বাঙালিদের নির্যাতনকেন্দ্র ছিল। জেলে অনেককে সামরিক আদালতে বিচার করে শাস্তি দেওয়া হয়। আওয়ামী
নেতা সংসদ সদস্যদের অনুপস্থিতিতে বিচাত করে তাদের শাস্তি ও সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হয়।
যারা কারাবরণ করেন তাদের মধ্যে ছিলেন প্রাদেশিক সংসদ সদস্য মহিউদ্দিন বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ, সাবেক রাষ্ট্রদূত কামরুদ্দীন আহমদ, বরিশালের জেলা প্রশাসক আইয়ুবুর রহমান, ফরিদপুরের জেলা প্রশাসক অ ন ম ইউসুফ, নুর ইপিসি, টিএন্ডটি বোর্ডের চেয়ারম্যান লোকমান হোসেন, বরিশাল আওয়ামী লীগ নেতা জালাল সর্দার প্রমুখ। সামরিক আদালতে বিচার হয়ে এমপি মহিউদ্দিন আহমদের ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, কিন্তু ইতোমধ্যে দেশ স্বাধীন হওয়ায় তিনি বেঁচে যান।
রবার্ট পেইন বাংলাদেশের গণহত্যা সম্পর্কে লিখেছেন: Massacre- The Tragedy at Bangladesh and the Phenomenon of Mass Slaughter Throughout History. তিনি বাংলাদেশের গণহত্যার ইতিহাসে ভয়ঙ্কর অধ্যায় নামক গ্রন্থ রচনা করেছেন। রবার্ট পেইন স্বাধীনতার পর পর বাংলাদেশে এসেছিলেন। তার লেখা গ্রন্থ থেকে অংশবিশেষ উদ্ধৃত করা হলো:
‘২৫ মার্চ ১৯৭১, রাত ১১টা বেজে পঁচিশ মিনিটে শুরু হলো হত্যাযজ্ঞ। এক প্লাটুন পাঞ্জাবী এবং বালুচ সৈন্য চারটি আমেরিকার তৈরি এম-২৪ ট্যাঙ্ককে অনুসরণ করে এসে গাঁড়ালো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটো ছাত্রাবাসের সামনে। ছাত্রাবাস দুটো ছিল ইকবাল হল আর জগন্নাথ হল। এক নাগাড়ে পাঁচ মিনিট ধরে চলল প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ। মাত্র পনেরো মিনিটের মধ্যে হত্যা করা হলো প্রাণবন্ত ১০৯ জন ছাত্রকে। সৈন্যদের আদেশ দেওয়া হয়েছিল দুটো ছাত্রবাসের একটি প্রাণীও যেন বেঁচে না থাকে এবং ঘটলও তাই।’
মাসের পর মাস পূর্ব পাকিস্তানের সব অঞ্চলেই এই হত্যালীলা চলতে থাকল। অত্যন্ত পরিকল্পিত ছিল পাকবাহিনী সেনাবাহিনীদের এ হত্যাযজ্ঞ। নিরীহ মুসলমান কৃষকদের প্রতিনিয়ত হত্যা করে চলছিল এ সকল মুসলমান সৈন্যরা। প্রতিরোধহীন সকল মানুষকে হত্যা করা তাদের সিগারেট, মদ পানের অভ্যাসের মতো হয়ে দাঁড়িয়েছিল। যুদ্ধ শেষ হবার আগ পর্যন্ত এই অভ্যাস যে ফলাফল নিয়ে এসেছিল তা হচ্ছে ৩০ লক্ষ মানুষের মৃত্যু।
নয় মাস ধরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে যে নজিরবিহীন হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে সাম্প্রতিক ইতিহাসে তার উদাহরণ খুব একটা নেই। জাপান ১৯৩০ সালে চীনে যে হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়েছিল কিংবা ১৯৪০-এ রাশিয়ায় জার্মানি যে
পৃষ্ঠা: ২৪১

আক্রমণ চালিয়েছিল তার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের এ ঘটনার তুলনা হতে পারে বটে। কিন্তু অতিক্রম করতে পারে না। পূর্ব পাকিস্তানিদের হত্যার ব্যাপারে পাকিস্তানি শাসকরা ছিল স্থির সংকল্প। প্রতিটি পদক্ষেপই তারা নিয়েছে সামরিক কৌশলের ভিত্তিতে। ব্যাপক হত্যাযজ্ঞের এই অমোঘ আদেশ এসেছিল ইসলামাবাদ থেকে।
পূর্ব পাকিস্তানে এই দ্বিতীয় পর্যায়ের হত্যাযজ্ঞের শুরু হয়েছিল- ‘৭১ এর এপ্রিলের শেষ দিক থেকে। প্রথম অভিযানে এর আগে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ ট্যাঙ্ক আর সাঁজোয়া যান, পদাতিক সৈন্য নিয়োগ করেছিল। এবার সেনাদল একেবারে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে চলে গেল; সাথে সাথে সাহায্য দিল যুদ্ধ জাহাজ, গানবোট আর যুদ্ধ বিমান। হত্যাযজ্ঞকে স্মৃতিতে রাখার জন্য ভিয়েতনামের মাইলাই গ্রামে স্মরণ অনুষ্ঠান হয়েছিল। অথচ এই একটি গ্রামেই তো আর ব্যাপক গণহত্যা হয়নি। হয়েছে প্রতি বর্গইঞ্চি ভূমিতে। ভিয়েতনাম হত্যা আর মৃত্যুর দেশ হয়ে গিয়েছিল। এই হত্যাযজ্ঞ ঘটেছে চীন, রাশিয়া, পূর্ব পাকিস্তানে অথচ কি অবাক বিভ্রমে আমাদের স্মৃতির এলবাম থেকে আমরা সেগুলো মুছে দিচ্ছি প্রতিদিন।
হত্যার কালো আঁধার শেষ হয়ে গিয়েছিল, শোষকের ওপর শোষিতের বিজয়ও অর্জিত হয়েছে, নতুন আশার প্রাণ সঞ্চার হচ্ছিল জীবনে। উজ্জল স্বর্ণাভার সেই দিনে খুব স্বল্পপরিচিত একটি শহরের রেসকোর্সে দাড়িয়ে দীর্ঘদেহের ঋজু এই মানুষটি (শেখ মুজিব), আশার বাণী ছড়িয়ে দিয়েছিলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এ রকম স্মরণযোগ্য দিন সচরাচর ঘটেনি।
আমাদের এই অসুস্থ সময়ে একজন আশোকের আর সম্ভাবনা নেই। যতদিন সামরিক বাহিনী থাকবে ততদিন চলবে এই ব্যাপক গণহত্যা ধ্বংসযজ্ঞ- না কোনো সম্ভাবনা নেই যে তারা মৃত্যুতে আহত হবেন। অপরাধবোধ কখনো তাদের তাড়িয়ে বেড়ায় না। এই বিশ্ব এখন উদ্যম উদ্যোগহীন। আমরা এখন সময় এবং মানবতার কাছে নিজেদেরকে সোপর্দ করা ছাড়া কিইবা আমরা করতে পারি। আশায় আমাদের বসবাস। বিশ্ব একদিন গণহত্যাযজ্ঞের হাত থেকে রক্ষা পাবে। অথবা আওরঙ্গজেবের মতো পাপবোধ হয়তো আমাদেরকে তার দিকে নিয়ে যাবে। গোঁড়াধার্মিক আওরঙ্গজেব লিখেছিলেন আমার মতো পাপীর জন্য সৃষ্টিকর্তার কাছে কোনো স্থান নেই। তোমরা আমার মাথা মুড়িয়ে কবর দিও, শুনেছি এভাবে গেলে তার ক্ষমা পাওয়া যাবে। কিন্তু দ্বিধা হয় মনে। তিনি তবুও আমার দিকে তাকাবেন না। জার্মানির ইহুদি হত্যার উদাহরণ দিয়ে তার লেখার সমাপ্ত করে বলেন- পৃথিবীর জানা-অজানা জায়গায় এ রকম ঘটনা ঘটেছে। বাংলাদেশে তার ব্যতিক্রম ঘটেনি। অন্তর্জাত কান্নায় মানবাত্মা আকুল হয়েছে।
পৃষ্ঠা: ২৪২

কিন্তু কোন ব্যবস্থা নিতে পারেনি। সব জায়গাতেই এসএফ গার্ড বা সৈন্যরা একই রকমের নির্বিকার নৃশংসতা দেখিয়েছে। আর সেই নিশ্চিত মরণযাত্রার মানুষগুলোর সব সময়ই পরস্পর হাত উঠেছে। পরস্পরকে বলেছে বিশ্বজনীন মানবাত্মার শেষ বিজয়ের কথা, বলেছে আমাদের রক্তপাতেই পৃথিবীতে শস্যময় দিন আসবে।

মুক্তিযুদ্ধকালে বঙ্গবন্ধুর পরিবার
বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতারের পর শেখ কামাল বাসা থেকে পালিয়ে যান। বেগম মুজিব শেখ জামাল ও শেখ রাসেলকে নিয়ে পাশে মোশাররফ হোসেনের বাসায় আশ্রয় নেন। তিনি স্বামী ও পুত্র কামালের জন্য ব্যাকুল।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ফুফাত ভাই মমিনুল হক খোকা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় এসে বেগম মুজিবকে খুঁজে পান। তিনি বেগম মুজিব, দুই পুত্রকে নিয়ে মগবাজার এসেছেন। তখন কারফিউ ও গুলিবর্ষণ শুরু হয়েছে। কাছেই ছিল মমিনুল হকের বন্ধু ইঞ্জিনিয়ার আলীর বাসা। কোনো রকমে তারা একটি কামরায় রাত কাটান। ২৭ মার্চ কারফিউ শিথিল করা হয়। মমিনুল হক বেগম মজিব ও তার সন্তানদের নিয়ে ওয়ারীতে তার শ্বশুরের বাসায় পৌছেন। কিন্তু পাড়া-প্রতিবেশীরা বঙ্গবন্ধুর পরিবারের অবস্থান মেনে নিতে পারেনি।
মমিনুল হক মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় তার এক পরিচিত মহিলার বাসা ভাড়া নেন। বেগম মুজিব সন্তানদের নিয়ে আসেন। বেগম মুজিব কন্যা হাসিনা ও ওয়াজেদ মিয়ার জন্য চিন্তিত। মমিনুল হক শেখ হাসিনা, রেহানা ও ড. ওয়াজেদের সংবাদ নিয়ে আসেন। মালিবাগ চৌধুরীপাড়ায় ড. ওয়াজেদ তার এক সহকারীর বাসায় অবস্থান করছেন। এক সময় শেখ কামাল বাসায় আসেন। মা-ছেলে জড়িয়ে কান্নাকাটি করেন। তারপর শেখ কামাল ভারতে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন।
চৌধুরীপাড়ার বাসায় দিন কাটছে, স্বাধীন বাংলা বেতারের সংবাদ শুনছেন। হঠাৎ একদিন বেগম মুজিবের বোনের ছেলে শেখ শহীদ চৌধুরীপাড়ায় বেগম মুজিবের কাছে বিদায় নিতে আসেন। পাশের বাসার এক ডিএসপির স্ত্রী শেখ শহীদকে চিনতেন। তিনি বাড়ির মালিক মহিলাকে বলেন, শেখ পরিবার এখানে থাকলে তারা ধ্বংস হয়ে যাবেন। মমিনুল বাসা খোঁজ করছেন। কিন্তু শেখ পরিবারকে কেউ বাসা ভাড়া দিতে চায় না। বেগম মুজিব বঙ্গবন্ধুর ভাগ্য নিয়ে চিন্তিত। এপ্রিল মাসের প্রথম সপ্তাহে সকল দৈনিক পত্রিকায় বন্দী অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে সবাই জানতে পারে তিনি জীবিত আছেন। ছবিটি করাচীর
পৃষ্ঠা: ২৪৩

বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে তোলা হয়েছে। একদিকে পাক মিলিশিয়া মোমিনুল হকের খোঁজ করছে। বেগম মুজিব অবিলম্বে বাসা ত্যাগ করেন। মগবাজারে এক বাসার মালিক এক ভদ্রমহিলা শেখ পরিবারের পরিচয় পেয়ে সাহসের সাথে তাদের আশ্রয় দেন। নতুন বাসায় দিন কাটে।
একদিন ড. ওয়াজেদ আসন্ন প্রসবা শেখ হাসিনাকে নিয়ে বেগম মুজিবের বাসায় চলে আসেন। ড. ওয়াজেদ নিয়মিত অফিসে যাচ্ছেন। বেগম মুজিবের নির্দেশে মমিনুল হক বেগম তফাজ্জল হোসেনের বাসায় যান। বেগম তফাজ্জল হোসেন পুত্র আনোয়ার হোসেনকে নিয়ে ধানমণ্ডির বাসায় থাকেন। একদিন আর্মি মঞ্জুকে ধরে নিয়ে যায়। তিনি বাসায় ফিরে এসে বলেন, আর্মি বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে খুঁজছে। বেগম তোফাজ্জল হোসেন ও আনোয়ার হোসেন বেগম মুজিবের সাথে দেখা করেন। আনোয়ার হোসেন বেগম মুজিব ও মমিনুল হককে বাসার সংবাদ দেন। বেগম মুজিব ও মোমিনুল হক আনোয়ার হোসেন মঞ্জুর বাসায় পৌছে মেজর জেনারেল ওমরকে বসা দেখেন। জেনারেল ওমর বেগম মুজিবকে পশ্চিম পাকিস্তানে অথবা সেনানিবাসে থাকার প্রস্তাব দেন। বেগম মুজিব বাংলাদেশ থেকে কোথাও যাবেন না। জেনারেল ওমর ও মমিনুল হক ধানমণ্ডিত ১৮ নম্বরে একটি বাসা ঠিক করেন। বেগম মুজিব প্রথমে ৩২ নম্বরের বাসায় যান। বাসার সব কিছু তছনছ, অনেক মূল্যবান জিনিস চুরি হয়েছে। তিনি এক কাপড়ে বাড়ি ছেড়েছেন। ৩২ নম্বর থেকে বেগম মুজিব মগবাজার যান। এবার তিনি বেঁকে বসলেন। কিছুতেই তিনি ধরা দেবেন না। ইতোমধ্যে সেনাবাহিনী বাসা ঘিরে ফেলে এবং তাদের ধানমণ্ডি ১৮ নম্বরে নিয়ে যায়। সেখানে তারা পাক সেনাদের পাহারায় থাকেন। বাসায় হাঁড়ি পাতিল ফার্নিচার কিছুই ছিল না। অনেক কষ্টে তারা দিন যাপন করেন। সেনাবাহিনীর নির্দেশ ছাড়া কোথাও যাওয়া যায না।
টুঙ্গিপাড়ায় সেনাবাহিনী বঙ্গবন্ধু বাবা-মাকে বের করে দিয়ে আগুন দিয়ে ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ফেলে। বাড়ির কয়েকজনকে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর বাবা-মা ঢাকায় চলে আসেন। তারা বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ বোন লিলির বাসায় ওঠেন। তারা অসুস্থ হলে ডা. নুরুল ইসলাম তাদের পিজি হাসপাতালে ভর্তি করেন। শেখ হাসিনার সন্তান হবে। তাকে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়। বেগম মুজিব মেয়ের সাথে থাকতে চান। কিন্তু সেনাবাহিনী তাকে অনুমতি দেয়নি। তখন শেখ মুজিবের ছোট বোন লিলি আয়া সেজে শেখ হাসিনার দেখাশুনা করেন। ১৯৭১ সালের ২৯ জুলাই শেখ হাসিনা পুত্র সন্তান লাভ করেন। কয়েকদিন পর শেখ হাসিনা ১৮ নম্বর ধানমণ্ডি চলে আসেন। পুত্রের নাম রাখা
পৃষ্ঠা: ২৪৪

হয় জয়। শেখ জামাল মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবেন। একদিন জামাল এক সৈনিকের সাহায্যে বাসা থেকে পালিয়ে যায়। এ ঘটনা নিয়ে সেনাবাহিনী পরিবারে আতঙ্ক সৃষ্টি করে। এ সময় বেগম মুজিব ড. ওয়াজেদকে নিয়ে মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাথে দেখা করেন। তাদের ওপর সেনাবাহিনীর চাপ কমে যায়। কিন্তু সেনাবাহিনী মমিনুল হককে ধরে নিয়ে যায়। মেজর হাসান তাকে রক্ষা করেন।
দীর্ঘ ৯ মাস গৃহবন্দীর পর ১৯৭১ সালের ১৭ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ভারতীয় বাহিনীর মেজর তারা তাদের উদ্ধার করেন।

পাকবাহিনীর বন্দিশালায়
পাকবাহিনী তাদের সেনানিবাসে হাজার হাজার নর-নারী গ্রেফতার করে নির্মম নির্যাতন চালাত। বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যদের গৃহবন্দি করে রাখে। ১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর বন্দিশালায় যারা ছিলেন:
১. বেগম ফজিলাতুন্নেসা মুজিব, গৃহবন্দি, ধানমণ্ডি
২. শেখ হাসিনা, গৃহবন্দি, ধানমণ্ডি
৩. শেখ রেহানা, গৃহবন্দি, ধানমণ্ডি
৪. শেখ রাসেল, গৃহবন্দি, ধানমণ্ডি
৫. বেগম খালেদা জিয়া, সেনানিবাসে বন্দি, কুর্মিটোলা
৬. কামরুদ্দিন আহমেদ
বিশিষ্ট লেখক ও সাবেক রাষ্ট্রদূত, ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার
৭. মহিউদ্দিন আহমেদ, এমপিএ, বরিশাল, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার
৮. আহমাদুল কবির, দৈনিক সংবাদের সম্পাদক
৯. অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম, অধ্যাপক বাংলা বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
১০. এএনএম ইউসুফ সিএসপি, ডিসি, ফরিদপুর
১১. নূরুল মোমেন খান এসপি, ফরিদপুর
১২. আইয়ুবুর রহমান, ডিসি, বরিশাল
১৩. সৈয়দ রেজাউল হায়াত, এসডিও, মাদারীপুর
১৪. এম এ নূর ইপিসিএ, ম্যাজিস্ট্রেট, মাদারীপুর
১৫. স্কোয়াড্রন লিডার মঞ্জুরুল হক, ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার
১৬. লোকমান হোসেন, চেয়ারম্যান, টিএন্ডটি বোর্ড
১৭. মকসুদ আলী, টিএন্ডটি বোর্ড
১৮. জালাল সর্দার, আওয়ামী লীগ নেতা, বরিশাল, ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার
পৃষ্ঠা: ২৪৫

১৯. মিহির লাল দত্ত, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, বরিশাল
২০. লে. নাসির, নবম সেক্টরের অফিসার, ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগার
এছাড়া হাজার হাজার স্বাধীনতাকামী বাঙালি বিভিন্ন জেলে ও পাকবাহিনীর ক্যাম্পে আটক ছিল। পাক বাহিনী অধিকাংশ বন্দিদের হত্যা করেছে।

পাকিস্তানে আটক সেনাবাহিনী
পশ্চিম পাকিস্তানে বাঙালি কয়েক হাজার সৈন্য ও কয়েক শ’ অফিসার আটক ছিল। তাদের মধ্যে কয়েকজন সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন। যারা পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছেন তাদের মধ্যে ছিল মেজর এম মঞ্জুর, মেজর তাহের, ক্যাপ্টেন শাহজাহান, ক্যাপ্টেন দেলওয়ার হোসেন, ক্যাপ্টেন জয়নাল আবেদীন, ক্যাপ্টেন নুরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন নূর চৌধুরী, ক্যাপ্টেন ফারুকুর রহমান, ক্যাপ্টেন খন্দকার আ. রশিদ, ক্যাপ্টেন শরিফুল হক ডালিম, ক্যাপ্টেন রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন ল্যান্সার, ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন। উল্লেখ্য, পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসা অফিসারদের মধ্যে অনেকেই ছাত্রজীবনে ছিলেন এনএসএফ (মুসলিম লীগের ছাত্র সংগঠন) এবং তারা ১৯০৪ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে। ক্যাপ্টেন (কর্নেল) নূর চৌধুরী বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছে। হত্যার মূল ষড়যন্ত্রকারী ছিলেন কর্নেল ফারুক, রশীদ ও শরিফুল হক ডালিম।

নারী নির্যাতন
১৯৭১ সালে ২৫০০০০ নারী পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতিত ও ধর্ষিত হয়েছে। সেনাবাহিনীর উচ্চপর্যায় থেকে শুরু করে সিপাহী ও রাজাকার, শান্তি কমিটির অনেকে নারী ধর্ষণ করেছে। নির্যাতিত মহিলাদের পুনর্বাসনের জন্য স্বাধীনতার পর প্রত্যেক মহকুমায় বঙ্গবন্ধু নারী পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। বাংলাদেশে এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে নারী নির্যাতিত হয়নি। অনেক নারী নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করেছে। এ পশুদের হাত থেকে গর্ভবতী নারী, বৃদ্ধা ও শিশুরাও রেহাই পায়নি।
নোয়াখালী জেলার সোনাগাজী ও মতিগঞ্জ ক্যাম্পে মেয়েদের ধরে এনে ধর্ষণ করা হতো।
পিরোজপুরের পাকসেনারা অনেক নারীকে ধর্ষণ করে। কলেজছাত্রী ফুলু রানী বিশ্বাস নির্যাতনের ফলে মৃত্যুবরণ করেছে। ঝালকাঠির সঞ্জীবের বোনদের নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে। চাঁদপুরে হাজিগঞ্জে বালিকা ধর্ষণে বাধা দিলে
পৃষ্ঠা: ২৪৬

এক বাড়িতে ৭ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। শান্তি কমিটি ও রাজাকার পরিবারের মেয়েরাও নির্যাতন থেকে রক্ষা পায়নি।
বগুড়া জেলার সরিয়াকান্দি, গাবতলী, সান্তাহারে অনেক নারী নির্যাতনের শিকার হয়। রংপুর সেনা সদরে বিভিন্ন গ্রাম থেকে যুবতী মেয়েদের ধরে এনে
ক্যাম্পে নির্যাতন করা হতো। সিরাজগঞ্জে বিভিন্ন স্থান থেকে ধরে এনে ৭০০ মেয়েকে ধর্ষণের পর যমুনা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়। অনেকে ডুবে মারা যায়।
দিনাজপুর চিনিরবন্দর থানায় একটি মেয়েকে ৭/৮জন সেনা ধর্ষণ করে।
রোকেয়া হলে নির্যাতন করে অনেক ছাত্রীকে হত্যা করা হয়। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের সম্পাদিকা মালেকা বেগম জাতিসংঘের প্রতি এক আহ্বানে বলেন, পাকসেনারা ক্যাম্পে হাজার নারী বন্দি করে রাখে। ঢাকার রায়পুরা, ঘোড়াশাল, হালুয়াঘাট, করিমগঞ্জ, ভুরুঙ্গামারী, বালীয়া, চাপাইনবাবগঞ্জে অবাধে নারী নির্যাতন চলে।
অনেক পরিবার আত্মসম্মান ও সামাজিক কারণে নারী নির্যাতনের কথা গোপন রেখেছে। অনেক নারীর গর্ভপাত করানো হয়েছে। প্রসবের অনেক সন্তান বিদেশিদের নিকট পালনের জন্য দেওয়া হয়। অনেক নির্যাতিত হিন্দু মেয়ে ভারতে থেকে যায়।
নির্যাতিত নারীদের নিয়ে ডা. নীলিমা ইব্রাহিম গ্রন্থ রচনা করেছেন।
১৯৭১ সালের শহীদদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রণয়ন করা হয়নি। হয়নি রাজাকারদের তালিকা, মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা। এক সরকার প্রণয়ন করে, আর এক সরকার ক্ষমতায় এসে তা বাতিল করে নতুন তালিকা করে। সুতরাং মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যে এখনো স্থায়ী সনদ জোটেনি। কিন্তু রাজাকার আলবদররাও সমাজে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার ভাগীদার হয়েছে। জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল এরশাদ ও বেগম খালেদা জিয়ার পৃষ্ঠপোষকতায় জামায়াত-মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
শহীদদের স্মরণে বিচ্ছিন্নভাবে দেশের বিভিন্ন স্থানে স্মৃতিসৌধ নির্মাণ, স্মৃতিফলক স্থাপন করা হয়েছে। জাতীয়ভাবে এখনও জেলা, উপজেলায় স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়নি। কেন্দ্রিয়ভাবে সাভারে শহীদদের স্মরণে স্মৃতিসৌধ নির্মিত হয়। স্মৃতিসৌধের ভিত্তি স্থাপন করেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রায়েরবাজার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধ নির্মাণ সমাপ্ত করেছেন। সাভার স্মৃতিসৌধের সামনে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শহীদদের দেহাবশেষ এনে সমাহিত করা হয়েছে। সাভার স্মৃতিসৌধ ১৯৭১ সালের ৩০
পৃষ্ঠা: ২৪৭

লক্ষ শহীদদের স্মৃতি বহন করছে। জাতি তাদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে। বিদেশি রাষ্ট্রপ্রধান বা বিশিষ্ট অতিথিরা সাভার স্মৃতিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের মধ্যে আলোচনা ব্যর্থ হয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তিনি বাঙালিদের স্বাধীকার দাবি ধ্বংস করার জন্য ঢাকায় অপারেশন সার্চ লাইটের নির্দেশ দিয়ে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় ঢাকা ত্যাগ করেন। লে. জেনারেল টিক্কা খান অপারেশন সার্চ লাইট পরিচালনা করেন। রাত ১১টায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন, পিলখানা, ইপিআর, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল, ইকবাল হল, শহীদ মিনারে একযোগে আক্রমণ করে এবং গণহত্যা শুরু করে। ঢাকা শহরের শাঁখারীবাজার, তাঁতীবাজার, নয়াবাজার, বস্তি এলাকা পুড়িয়ে দেয়। ২৫ ও ২৬ মার্চ পাকবাহিনী ঢাকা শহরে প্রায় ৭ হাজার লোক হত্যা করেছে। ঢাকায় অবস্থানরত বিদেশী সাংবাদিকগণ সেনাবাহিনীর জঘন্য গণহত্যার সংবাদ বিশ্ব মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেয়। বিশ্ববাসী ঢাকার ধ্বংসলীলার সংবাদ শুনে শোকাহত হয়। লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডেইলি টেলিগ্রাম ১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ সংখ্যায় এক প্রতিবেদনে বলে-
“আল্লাহ এবং পাকিস্তানের ঐক্যের নামে ঢাকা আজ এক বিধ্বস্ত ও সন্ত্রস্ত নগরী। দীর্ঘ ২৪ ঘণ্টার নৃশংস অভিযান, ঠাণ্ডা মাথায় বোমা বর্ষণ এবং গোলাগুলি চালিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনী কমপক্ষে সাত হাজার মানুষ হত্যা করেছে। তারা বিশাল এলাকা মাটির সাথে মিছিয়ে দিয়েছে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতার স্পৃহা শুরুতেই স্তব্ধ হয়ে যায়।…”
পাকিস্তানের বর্বর হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ২৬ মার্চ রাত ১২টা ৩০ মিনিটে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার নির্দেশ দেন।
পাকিস্তান বাহিনী চট্টগ্রাম, রংপুর, রাজশাহী, যশোর, খুলনা, কুমিল্লাসহ প্রত্যেক জেলায় আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। গণহত্যাকে জেনোসাইড বলা হয়। জেনোস অর্থ জাতি, সেনোসাইড ছিল বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করা। জেনোসাইড ১৯৪৪ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্যবহার করা হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় জার্মানি ইহুদী ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর ওপর হত্যাকাণ্ড চালায়। এ গণহত্যার বিচার হয় নুরেমবার্গ ট্রায়ালে। ১৯৭১ সালের পাকবাহিনী, রাজাকার, জামায়াতে ইসলাম ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা করেছিল। তারা সারা বাংলায় গণহত্যা চালায়। হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে তাদের গণকবর দেওয়া হয়। গণকবরগুলো বধ্যভূমি নামে পরিচিত। রায়েরবাজার, খুলনার চুকনগর গণহত্যা
পৃষ্ঠা: ২৪৮

হিসেবে পরিচিত। চুকনগরে গণহত্যার পর অনেক লাশ ভদ্রা নদীতে ফেলে দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালে পাকবাহিনী হত্যা, নারী নির্যাতন, ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ধ্বংস করে।
ধ্বংসপ্রাপ্ত ঘরবাড়ির সংখ্যা-
নোয়াখালী- ৭১ হাজার
নওগাঁও – ৫০ হাজার
জামালপুর- ৭৫ হাজার
বগুড়া- ৮০ হাজার
নরসিংদী- ৯০%
শান্তাহার- ৫ হাজার
টাঙ্গাইল- ২১৩৪৮
টুঙ্গিড়াপাড়ায় বঙ্গবন্ধুর বসতবাড়ি পাকসেনারা পুড়িয়ে দেয়।
ধ্বংসপ্রাপ্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা-
সাতক্ষীরা- ১৪৬০
কুমিল্লা- ৭৫%
চট্টগ্রামে মাধ্যমিক স্কুলসমূহে ২৫ কোটি টাকা ক্ষতি হয়।
বাংলাদেশে মোট ৩৪৫৭টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়েছিল। ক্ষতির পরিমাণ ছিল ১৩৫ কোটি টাকা।
১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী তাদের সহযোগী জামায়াত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ৩০ লক্ষ বাঙালিকে হত্যা করে। নিম্নে কয়েক অঞ্চলের সংখ্যা দেওয়া হলো:
অঞ্চল- নিহতের সংখ্যা
দিনাজপুর- ৭৫০০০
কুষ্টিয়া- ৪০০০০
বরিশাল- ২৫০০০
ঝালকাঠী- ১০০০০
পটুয়াখালী- ২৫০০০
রংপুর- ৬০০০০
আখাউড়া- ২০০০০
নওগাঁ- ২০০০০
নড়াইল- ১০০০০
ঠাকুরগাঁও- ৩০০০০
পৃষ্ঠা: ২৪৯

চট্টগ্রাম- ১০০০০০
সেতাবগঞ্জ- ৭০০০
পার্বতীপুর- ১০০০০
সৈয়দপুর- ১০০০০
কুড়িগ্রাম- ১০০০০
হাজীগঞ্জ- ৩০০০০
বগুড়া- ২৫০০০
জামালপুর- ১০০০০
চৌদ্দগ্রাম- ১০০০
স্বরূপকাঠী-বানারীপাড়া- ৫০০০
মানিকগঞ্জ- ১০০০
নরসিংদী- ১০১৯
হরিরামপুরের একটি পুকুরে ১০ হাজার নরমুণ্ড, কুমিল্লায় ৫০০, জয়পুরহাটে ৫০০, দিনাজপুরে ৩৭০০০, শেরপুরে ২০০০, বরগুনা ও পটুয়াখালী জেলে নিহত ৫০০ লোকের কংকাল পাওয়া যায়।
পাকবাহিনীর পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল নিয়াজী বলেছেন, ১৫ লক্ষ মানুষকে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীসমাজ। পাকবাহিনী ২ লক্ষ ৫০ হাজার নারী ধর্ষণ ও নির্যাতন করেছে। অনেকে বলছেন, এ সংখ্যা ৫ লক্ষ হতে পারে। যুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর সরকার প্রত্যেক মহকুমায় নির্যাতিত নারীদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে।

শরণার্থী
পাকিস্তান বাহিনী, শান্তি কমিটি ও রাজাকারদের গণহত্যা, নারী নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ, লুটপটের কারণে এক কোটি বাঙালি ভারতের পশ্চিম বাংলা, ত্রিপুরা, মেঘালয়, আসাম ও বিহারে আশ্রয় নেয়। শরণার্থীর সংখ্যা নিমে দেয়া হলো:

রাজ্য ক্যাম্প সংখ্যা ক্যাম্পে শরণার্থী ক্যাম্পের বাইরে সংখ্যা মোট
পশ্চিম বাংলা ৪৯২ ৪৮৪৯৭৮৬ ২৩৮৬১৩০ ৭২৩৫৯১৬
ত্রিপুরা-আগরতলা ২৭৬ ৮৩৪০৯৮ ৫৪৭৫৫১ ১৩৯১৬৮৯
মেঘালয় ১৭ ৫৯১৫২০ ৭৬৪৬৬ ৬৬৭৯৮৬
আসাম ২৮ ২৫৫৬৪২ ৯১৯১৩ ৩৪৭৫৫৫
বিহার ৩৬৭৩২ ৩৬৭৩২
মধ্যপ্রদেশ ২১৯২৯৮ ২১৯২৯৮
উত্তর প্রদেশ ১০১৬৯ ১০১৬৯
মোট ৮২৫ ৬৭৯৭২৪৫ ৩১০২০৬০ ৯৮৯৯৩০৫

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, তার সরকার ও ভারতের জনগণ বাংলাদেশের এক কোটি শরর্থীর আশ্রয় ও খাওয়ার দায়িত্ব গ্রহণ করে। ভারতের কেন্দ্রিয় সরকার ও পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী-মন্ত্রীরা শরণার্থীদের সার্বিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করেন। ভারত সরকারের কেন্দ্রিয় সচিব এ কে দত্ত চৌধুরী শরণার্থী ক্যাম্পের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি পাকিস্তানের সিএসপি ক্যাডারের কর্মকর্তা ছিলেন। ১৯৫৮ সালে পালিয়ে এসে ভারত সরকারের অধীনে চাকরি গ্রহণ করেন।
বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে ছিলেন। ভারত সরকারের সহায়তায় বাংলাদেশ সরকার ত্রাণ শিবির ও যুব অভ্যর্থনা দপ্তর পরিচালনা করে। ত্রাণ দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন রিলিফ কমিশনের জি জি ভৌমিক।
ভারতের প্রত্যেক রাজ্যে ছাত্র, শিক্ষক, রাজনৈতিক দল চাঁদা আদায় করে শরণার্থীদের প্রদান করত। প্রবাসী বাঙালিরা শরণার্থীদের জন্য অর্থ প্রেরণ করেন। বিশ্বের অনেক দেশ শরণার্থীদের জন্য সাহায্য পাঠায়।
জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট সদস্য রাষ্ট্রসমূহকে পূর্ব পাকিস্তানে ক্ষতিগ্রস্ত ও ভারতে শরণার্থীদের জরুরি সাহায্য প্রেরণের আহ্বান জানান। অনেক সদস্য রাষ্ট্র জাতিসংঘের আহ্বানে শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে।
জাতিসংঘ প্রিন্স সদরউদ্দিনকে শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার নিয়োগ করে। ভারত ও পাকিস্তানে জাতিসংঘের আবাসিক প্রতিনিধি ছিল। ভারতে অবস্থানরত শরণার্থীদের জন্য জাতিসংঘ খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণ সাহায্য প্রেরণ করে। জন কেলিকে ঢাকায় UNHCR-এর প্রতিনিধি নিয়োগ করা হয়। এক কোটি শরণার্থীর থাকা খাওয়ার ব্যয় বেশি অংশ ভারত সরকার নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করে। ভারতে শরণার্থীদের জন্য ব্যয় হয়েছে ৩৬৭ মিলিয়ন ডলার। তার মধ্যে ভারত ১৯৭ মিলিয়ন ডলার এবং জাতিসংঘ ১৭০ মিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে। শরণার্থীরা ক্যাম্পে অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্টে জীবন যাপন করেন। কলেরা ও অন্যান্য রোগে শত শত শরণার্থী মৃত্যুবরণ করে। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় লাভের পর শরণার্থীরা বাংলাদেশে চলে আসে।
পৃষ্ঠা: ২৫১

খ. বাংলাদেশ সরকার গঠন ও স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র
২৫ মার্চ রাত ১১টায় তাজউদ্দীন আহমদ, ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বঙ্গবন্ধুর সাথে শেষ সাক্ষাৎ করে তার বাসভবন ত্যসগ করেন। তিনি তাদের নিরাপদ স্থানে যেতে বলেন। তাজউদ্দীন, ড কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ২৫ মার্চ রাতে একত্রে নিরাপদ স্থানে চলে যান। কামাল হোসেন তার বাসায় যান এবং সেখানে তিনি গ্রেফতার হন। ২৭ মার্চ নিঃস্ব অবস্থায় তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ঢাকা ত্যাগ করেন। তারা পদ্মা পাড়ি দিয়ে ২৯ মার্চ ঝিনাইদহ পৌঁছেন। ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমেদ, ইপিআর কমান্ডার মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ও মেহেরপুরের এসডিও তৌফিক এলাহী চৌধুরী সীমান্তের ওপারে যোগাযোগ করে তাজউদ্দীন ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের ভারত গমনের ব্যবস্থা করেন। ৩০ মার্চ তারা সীমান্ত অতিক্রম করেন। বিএসএফ-এর আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার তাদের সংবর্ধনা জানায়। বিএসএফ প্রধান ছিলেন কেএফ রুস্তমজী। রুস্তমজী ও গোলক মজুমদার প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে তাজউদ্দীন আহমদের সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন। তাজউদ্দীন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ১ এপ্রিল দিল্লি পৌছেন। তাজউদ্দীন আহমদ প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে ৪ ও ৫ এপ্রিল বিস্তারিত আলোচনা করে নিম্নের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
* স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে ভারতে অবস্থান অনুমতি দেওয়া;
* সরকার পরিচালনায় সহায়তা প্রদান;
* মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান;
* বাংলাদেশের জন্য আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়;
* বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করা;
* যোগাযোগের জন্য একটি বিমান প্রদান;
* মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ প্রচারের জন্য বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা;
* মুক্তিযোদ্ধাদের পর্যাপ্ত অস্ত্র সরবরাহ।
৭ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমদ ও ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম কলকাতায় ফিরে আসেন। তারা একই কক্ষে থাকতেন। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণাপত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন এবং তাজউদ্দীন আহমদ তা অনুমোদন করেন। কলকাতা হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী সুব্রত রায় চৌধুরী খসড়ার সাথে একমত পোষণ করেন। ১০ এপ্রিল খসড়া স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র চূড়ান্ত করা হয়।
পৃষ্ঠা: ২৫২

১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল এমএনএ ও এমপিএগণ স্বাধীন বাংলাদেশে সরকার গঠন করেন।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- রাষ্ট্রপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
তাজউদ্দীন আহমদ- প্রধানমন্ত্রী
খন্দকার মোশতাক আহমদ- মন্ত্রী
এম মনসুর আলী- মন্ত্রী
এ এইচ এম কামরুজ্জামান- মন্ত্রী
১১ এপ্রিল কর্নেল এম এ জি ওসমানীকে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি নিয়োগ করা হয়।

আগরতলায় সংসদীয় দলের প্রথম সভা।
১৯৭১ সালের ১১ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদ আগরতলা গমন করেন। আগরতলায় অনুষ্ঠিত সংসদীয় দলের সভায় নিম্নলিখিত সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
* বাংলাদেশ সরকারের নাম হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার;
* সংসদীয় পদ্ধতি সরকার হবে। রাষ্ট্রপতি হবেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হবেন তাজউদ্দীন আহমদ;
* ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করা হয়;
* স্বাধীনতা ঘোষণা ১০ এপ্রিল ১৯৭১ অনুমোদন;
* অধ্যাপক ইউসুফ আলী মন্ত্রিসভার শপথ পড়াবেন;
* মুক্তিফৌজকে মুক্তিবাহিনী নামকরণ;
* বাংলাদেশের রাজধানীর নাম হবে মুজিবনগর;
* বাংলাদেশকে ৫টি সেক্টর ও কমান্ডার নিয়োগ অনুমোদন।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল বাংলাদেশ বেতার হতে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা দেন। বেতার ভাষণে তিনি বলেন, We are at war আমরা যুদ্ধরত। তার ভাষণে নিমোক্ত সেক্টর ও কমান্ডার নিয়োগের কথা বলেন।
অঞ্চল- কমান্ডার
চট্টগ্রাম-নোয়াখালী: মেজর জিয়াউর রহমান
সিলেট-কুমিল্লা: মেজর খালেদ মোশাররফ
ময়মনসিংহ-টাঙ্গাইল: মেজর সফিউল্লাহ
কুষ্টিয়া-যশোর: মেজর আবু ওসমান চৌধুরী
রাজশাহী: মেজর আহমদ
দিনাজপুর-রংপুর: মেজর নজমুল হক
পাবনা-বগুড়া: মেজর নওয়াজিশ

মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল কুষ্টিয়া জেলার মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথতলায় আম্রকাননে শপথ গ্রহণ করে। শপথ অনষ্ঠানে দেশি-বিদেশি সাংবাদিক উপস্থিত ছিলেন।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রিসভা
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- রাষ্ট্রপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি- ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি
তাজউদ্দীন আহমদ- প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, সংস্থাপন
ক্যাপটেন মনসুর আলী- অর্থ
খন্দকার মোশতাক আহমেদ- পররাষ্ট্র
এ এইচ এম কামরুজ্জামান- স্বরাষ্ট্র
কর্নেল এম এ জি ওসমানী এমএনএ- প্রধান সেনাপতি
প্রধান হুইফ অধ্যাপক ইউসুফ আলী মন্ত্রিসভার শপথ পড়ান।
মন্ত্রিসভাকে গার্ড অব অনার জ্ঞাপন করেন ঝিনাইদহের এসডিপিও মাহবুব উদ্দিন আহমদ। ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম অভিবাদন গ্রহণ করেন।
শপথ অনুষ্ঠানে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী বেতার ভাষণ দেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র শপথ অনুষ্ঠান প্রচার করে। বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের পর বাংলাদেশ সরকার দেশে ও বিদেশে স্বীকৃতি পায়। বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকে।
অধ্যাপক ইউসুফ আলী স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র পাঠ করেন। স্বাধীনতা ঘোষণাপত্র নিম্নে উদ্ধৃত হলো:

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র
মুজিবনগর, তারিখ: ১০ এপ্রিল, ১৯৭১; শনিবার, ২৭ চৈত্র ১৩৭৭
“যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হইয়াছিল।”
এবং
“যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিল।”
এবং
“যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন।”
এবং
“যেহেতু আহূত এই পরিষদ স্বেচ্ছায় এবং বেআইনিভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করেন।”
এবং
“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাংলাদেশের জনপ্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনাকালে পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ ন্যায়নীতি বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন।”
এবং
“যেহেতু উল্লেখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।”
এবং
“যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ বর্বর নৃশংস যুদ্ধ পরিচালনা করিয়াছে এবং এখনও বাংলাদেশের সামরিক ও নিরস্ত্র জনগণের বিরুদ্ধে নজিরবিহীন গণহত্যা ও নির্যাতন চালাইতেছেন।”
এবং
“যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ ও গণহত্যা ও নানাবিধ নৃশংস অত্যাচার পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে।”
এবং
“যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কার্যকরী কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা কারয়াছে। সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকার বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছেন সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমবায়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য- সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে রূপায়িত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহা দ্বারা, পূর্বাহ্নে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদ করিতেছি।”
এতদ্বারা আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের সশস্ত্র বাহিনীসমূহের সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসনিক ও আইন প্রণয়নের ক্ষমতার অধিকারী।
রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী এবং মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা থাকিবে। তাহার কর ধার্য ও অর্থব্যয়ের ক্ষমতা থাকিবে। তাঁহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহার অধিবেশন মুলতবি ঘোষণার ক্ষমতা থাকিবে। উহা দ্বারা বাংলাদেশের জনসাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতারও তিনি অধিকারী হইবেন।
বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, কোনো কারণে যদি রাষ্ট্রপ্রধান না থাকেন অথবা যদি রাষ্ট্রপ্রধান কাজে যোগদান করিতে না পারেন তাহার কর্তব্য ও প্রদত্ত সকল ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, বিশ্বের একটি জাতি হিসেবে এবং জাতিসংঘের সনদ মোতাবেক আমাদের যে দায়িত্ব ও কর্তব্য বর্তাইয়াছে উহা যথাযথভাবে আমরা পালন করিব।
আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতার ঘোষণা ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। আমরা আরও সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য আমরা অধ্যাপক এম. ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পণ ও নিযুক্ত করিলাম।”
স্বাক্ষর
এম. ইউসুফ আলী
বাংলাদেশ গণপরিষদের পক্ষ থেকে
পৃষ্ঠা: ২৫৬

ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল অব্যাহত কার্যকর আদেশ জারি করেন। আদেশে বলা হয় যে, ১৯৭১ সালে ২৫ মার্চ যে সকল আইন কার্যকর ছিল তা কার্যকর থাকবে। তবে জনগণের ইচ্ছানুযায়ী আইন পরিবর্তন করা যাবে।
শপথ অনুষ্ঠানের পর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৭ এপ্রিল প্রেসে বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, Bangladesh is at War. It has been given no choice but to secure its right of self-determination, through a national liberation struggle against the colonial oppression of West Pakistan.
বাংলাদেশ যুদ্ধ করছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক নির্যাতনের বিরুদ্ধে। আতনিয়ন্ত্রণের অধিকার আদায়ের জন্য জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ ব্যতীত বিকল্প কোনো পথ ছিল না।

বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশনাবলি
১৯৭১ সালের ১৮ এপ্রিল কলকাতায় পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার এম হোসেন আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন। তার সাথে ৫ জন অফিসার এবং ৭০ জন বাঙালি কর্মচারী ছিল। কলকাতার হাইকমিশনার দপ্তরে বাংলাদেশ সরকারের অফিসে রূপান্তরিত হয়।
২০ এপ্রিল দিল্লির পাকিস্তান হাইকমিশনের অফিসে কূটনীতিবিদ কেএম শাহাবুদ্দিন ও আমজাদুল হক বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে লন্ডনে বিশেষ দূত নিয়োগ করে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মুক্তিফৌজ গঠিত হয়। জুলাই মাসে মুক্তিফৌজের নামকরণ হয় মুক্তিবাহিনী।
কর্নেল এমএ রব এমএনএকে মুক্তিবাহিনীর চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়। গ্রুপ ক্যাপ্টেন আবদুল করিম খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়।
বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় ছিল কলকাতার পার্ক সার্কাসে। প্রধানমন্ত্রীর অফিস ছিল পার্ক সার্কাস সোহরাওয়ার্দী ভবনে।
বিশেষ দায়িত্বে নেতৃবৃন্দ
এম এ মান্নান এমএনএ- তথ্য ও স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র
অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ- মুক্তিবাহিনী ট্রেনিং ক্যাম্প
পৃষ্ঠা: ২৫৭

জহুর আহমদ চৌধুরী এমএনএ- রাজনৈতিক
বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয়ের দায়িত্বে ছিলেন সাবেক সিএস্পি ও ইপিসিএস কর্মকর্তাগণ;
হোসেন তৌফিক ইমাম সিএসপি- মন্ত্রীপরিষদ সচিব
নুরুল কাদের খান সিএসপি- সংস্থাপন সচিব
খন্দকার আসাদুজ্জামান সিএসপি- অর্থ সিচিব
এম এ সামাদ সিএসপি- প্রতিরক্ষা সচিব
মাহবুব আলম চাষী- পররাষ্ট্র সচিব
এমএ হান্নান, জেলা জজ, দিনাজপুর- সচিব, আইন
এমএ খালেক, আইজি পুলিশ- সচিব, স্বরাষ্ট্র
আনোয়ারুল হক খান- সচিব, তথ্য
নূরুদ্দিন- সচিব, কৃষি
ডা. টি হোসেন- স্বাস্থ্য
২৯ মে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের ৭৫ মিলিয়ন বাঙালির জন্য স্বাধীনতা ঘোষণা ব্যতীত আমাদের অন্য কোনো উপায় ছিল না।
১৯৭১ সালের ৬ জুন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম নিম্নের চার দফার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধানের প্রস্তাব দেন।
১. বঙ্গবন্ধুসহ সকল রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দান।
২. বাংলর মাটি থেকে হানাদার বাহিনীকে ফিরিয়ে নেওয়া।
৩. স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান।
৪. বাংলাদেশ থেকে লুণ্ঠিত সম্পদ ও বিগত আড়াই মাসে ক্ষতিপূরণ প্রদানের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে।

প্রবাসী বাঙালিদের ভূমিকা
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ শুনে প্রবাসী বাঙালিরা স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পরে, অর্থ সাহায্য ও জনমত সৃষ্টি করে। বাংলাদেশ সরকার ২১ এপ্রিল বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীকে আন্তর্জাতিক দূত নিয়োগ করে। লন্ডনে তার দূতাবাস ছিল। লন্ডন, আমেরিকারসহ প্রায় দেশে বাঙালিদের আন্দোলন চলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধে তাদের ভূমিকা স্মরণীয় হয়ে আছে।
পৃষ্ঠা: ২৫৮

গ. স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক প্রতিরোধ ও সংগঠিত প্রতিরোধ (মুক্তিফৌজ, মুক্তিবাহিনী, গেরিলা ও সম্মুখ যুদ্ধ)
১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে কয়েকটি পর্যায়ে বিভক্ত করা যায়-
* ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর সংগ্রাম কমিটি গঠন ও প্রশিক্ষণ।
* ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হতে স্বতঃস্ফূর্ত প্রাথমিক সশস্ত্র প্রতিরোধ ও সংগঠিত প্রতিরোধ
* মুক্তিফৌজ, মুক্তিবাহিনী, গেরিলা ও সম্মুখযুদ্ধ
* যৌথ বা মিত্রবাহিনী গঠন, যুদ্ধ ও বিজয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যা ও বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলায় ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্র, জনতা, সেনাবাহিনী, পুলিশ, ইপিআর, আনসার আর বাহিনীর বিরুদ্ধে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলে। চট্টগ্রামে মেজর রফিকুল ইসলাম সর্বপ্রথম তার ইপিআর বাহিনী নিয়ে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করেন। সেনাবাহিনীর মেজর জিয়াউর রহমান বিদ্রোহ করেন এবং ২৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।
জয়দেবপুরে ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চ হতে মেজর সফিউল্লাহ ও জয়দেবপুরের জনগণ স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ করে। পাকিস্তান বাহিনীর সাথে জনতার সংঘর্ষে অনেকে শহীদ হয়েছেন। জয়দেবপুরে স্বাধীনতা যুদ্ধ সর্বপ্রথম শুরু হয় আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্য, নেতা, ছাত্র, বাঙালি সৈন্যদের নিয়ে সম্মুখযুদ্ধ করে। এ সময় মুক্তিফৌজ গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের জুলাই মাস হতে মুক্তিফৌজের নাম মুক্তিবাহিনী করা হয়।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় মেজর খালেদ মোশাররফ আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মী ও জনগণকে নিয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করেন।
কুষ্টিয়ায় মেজর আবু ওসমান চৌধুরী ইপিআর ও জনগণ নিয়ে প্রতিরোধ করেন।
পাবনায় জেলা প্রশাসক নুরুল কাদের, সিরাজগঞ্জে এসডিও শামসুদ্দিন সংগ্রাম কমিটির সাথে প্রতিরোধ করেন। দিনাজপুরে ইপিআর পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।
বরিশালে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সরকার গঠন করে যুদ্ধ প্রস্তুতি গ্রহণ করে। মেজর এমএ জলিলকে প্রতিরক্ষা প্রধান করে মুক্তিফৌজ গঠন করা হয়।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল সিলেটের তেলিয়াপাড়ায় কর্নেল এমএজি ওসমানীর সভাপতিত্বে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সেনা কর্মকর্তাদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। তারা
পৃষ্ঠা: ২৫৯

কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতি করে মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের পর যুদ্ধ পরিচালনার জন্য দেশকে ১১টি সেক্টর ও বিভিন্ন সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়।
মুক্তিফৌজ নিয়মিত ও অনিয়মিত দুটি ভাগে বিভক্ত ছিল। সেনাবাহিনী ইপিআর নিয়ে নিয়মিত এবং ছাত্র, যুবক, আনসার, পুলিশ নিয়ে অনিয়মিত বা গণবাহিনী গঠন করা হয়।
ভারতে প্রশিক্ষণের পর তারা গণবাহিনী ও গেরিলা বাহিনী গঠন করে। স্থানীয় প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনগণ গেরিলা বাহিনীতে যোগ দেয়। দেশের অভ্যন্তরে কয়েকটি স্থানীয় মুক্তিবাহিনী সৃষ্টি হয়। টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী, গোপালগঞ্জে হেমায়েত বাহিনী প্রভৃতি।
১৯৭১ সালে একদল যুবক প্রশিক্ষণ নিয়ে নৌ কমান্ডাে গঠন করেন। তারা অপারেশন জ্যাকপট নামে পাকিস্তানের নৌশক্তি ও জাহাজ ধ্বংস করে।
১৯৭১ সালের ২৮ অক্টোবর একে খন্দকারের নেতৃত্বে বিমান বাহিনী গঠন করা হয়।
১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী ও মুক্তিবাহিনী যৌথবাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। যুদ্ধে জয়লাভ করার পর ৯৩ হাজার পাকসেনা আত্মসমর্পণ করলে ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।

মুক্তিযুদ্ধ- সেক্টর ও আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন
আওয়ামী লীগ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে এবং মুক্তিযুদ্ধের সহায়তা ও বেসামরিক শাসন পরিচালনার জন্য বাংলাদেশে ১০টি আঞ্চলিক কাউন্সিল গঠন করে।

 

 

 

 

সেক্টরের নাম এলাকা সেক্টর প্রধানের নাম
সেক্টর-১ চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম, নোয়াখালীর একাংশ মেজর জিয়াউর রহমান

পরে মেজর রফিকুল ইসলাম

সেক্টর-২ নোয়াখালী, কুমিল্লা, ফরিদপুর ও ঢাকার একাংশ মেজর খালেদ মোশাররফ
সেক্টর-৩ কুমিল্লা, ঢাকা ও সিলেটের একাংশ মেজর কাজী সফিউল্লাহ
সেক্টর-৪ সিলেট, হবিগঞ্জ মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত
সেক্টর-৫ উত্তর সিলেট মেজর মীর শওকত আলী
সেক্টর-৬ রংপুর, দিনাজপুরের একাংশ  
সেক্টর-৭ দিনাজপুরের একাংশ, রাজশাহী, পাবনা ও বগুড়া কর্নেল নুরুজ্জামান
সেক্টর-৮ কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনার একাংশ মেজর ওসমান চৌধুরী ও পরে মেজর মঞ্জুর
সেক্টর-৯ খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, ফরিদপুরের একাংশ মেজর এম এ জলিল
সেক্টর-১০ সমগ্র বাংলাদেশের নদী বন্দর ও সমুদ্র উপকূল নৌবাহিনীর নৌ কমান্ডাে
সেক্টর- ১১ ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল মেজর আবু তাহের,

উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ

 

প্রত্যেক সেক্টরকে সাব-সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। সাব-সেক্টরের দায়িত্বে ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন কমিশন্ড অফিসার, লে. অথবা ক্যাপ্টেন। পুনরায় সাব-সেক্টর বেইজ বা থানায় বিভক্ত করা হয়। প্রত্যেক থানা/বেইজে একজন ননকমিশন্ড কর্মকর্তাকে কমান্ডার নিয়োগ করা হয়। মুক্তিবাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত ছিল। নিয়মিত বাহিনী ও গেরিলা বাহিনী। নিয়মিত বাহিনী সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করে। গেরিলা বাহিনী দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী ও রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে।

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ ১৯৭১ সালের ১১-১৭ জুলাই কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে সেক্টর কমান্ডারদের সম্মেলন আহ্বান করেন। সম্মেলনে মুক্তিযুদ্ধ শক্তিশালী করার লক্ষ্যে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সম্মেলনে কর্নেল রব এমএনএ চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধকে পাঁচটি পর্বে বিভক্ত করা হয়:

১. ২৫ মার্চ থেকে মে পর্যন্ত স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিরোধ, সমন্বয়ের অভাবে প্রতিরোধ ভেঙে পড়ে।

২. জুন-জুলাই, মুক্তিবাহিনী গঠন;

৩. আগস্ট-সেপ্টেম্বর, সমগ্র বাংলাদেশে নিয়মিত ও গেরিলা যুদ্ধ;

৪. অক্টোবর-নভেম্বর, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড যুদ্ধ ও সফলতা অর্জন।

৫. শেষ পর্ব ৩ ডিসেম্বর ১৬ ডিসেম্বর, পাক-ভারত যুদ্ধ, মুক্তিবাহিনী ও

পৃষ্ঠা: ২৬১

 

 

ভারতীয় বাহিনী নিয়ে মিত্র বাহিনী গঠন; যুদ্ধে বিজয় ও ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর ৯০ হাজার সৈন্যের মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ।  

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল নির্বাচিত সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে জনযুদ্ধ।  মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার সার্বিক সহযোগিতা, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, শরণার্থীদের  আশ্রয়, খাদ্য ও মুক্ত এলাকার প্রশাসন এবং দেশের অভ্যন্তরে মুক্তিযুদ্ধের সমন্বয়ের লক্ষ্যে সংসদ সদস্যদের নেতৃত্বে সমগ্র বাংলাদেশকে ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়:

আঞ্চলিক কাউন্সিলের নাম আঞ্চলিক কাউন্সিলের চেয়ারম্যান
১. পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল-১

চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও ফেনী মহকুমা

নুরুল ইসলাম চৌধুরী, এমএনএ
২. পূর্ব-দক্ষিণ অঞ্চল-২

ঢাকা, কুমিল্লা ও নোয়াখালী

জহুর আহমদ চৌধুরী, এমএনএ
৩. পূর্ব অঞ্চল

হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার

কর্নেল এম এ রব এমএনএ
৪. উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-১

সিলেট, সুনামগঞ্জ

দেওয়ান ফরিদ গাজী এমএনএ
৫. উত্তর-পূর্ব অঞ্চল-২

ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল

শামসুর রহমান খান এমএনএ
৬. উত্তর অঞ্চল-রংপুর মতিয়ুর রহমান এমএনএ
৭. পশ্চিম অঞ্চল-১-দিনাজপুর আব্দুর রহিম এমএনএ
৮. পশ্চিম অঞ্চল-২ রাজশাহী আশরাফুল ইসলাম এমপিএ
৯, দক্ষিণ পশ্চিম অঞ্চল-১

কুষ্টিয়া

আব্দুর রউফ চৌধুরী এমপিএ
১০. দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চল-১ যশোর, ফরিদপুর ফণীভূষণ মজুমদার এমপিএ
১১. দক্ষিণ অঞ্চল

খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী

আব্দুর রব সেরনিয়াবাত এমএনএ

 

সকল এমএনএ ও এমপিএ স্ব স্ব আঞ্চলিক কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন। প্রত্যেক অঞ্চলে আঞ্চলিক দপ্তর ছিল এবং দপ্তরে একজন সিএসপি বা ইপিসিএস কর্মকর্তা প্রশাসনিক কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করতেন। আঞ্চলিক কাউন্সিলের দপ্তরগুলো ভারতের সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত ছিল।

পৃষ্ঠা: ২৬২

 

 

মুক্ত এলাজা বৃদ্ধি ও রিফিউজির সংখ্যা দ্রুত বেড়ে যাওয়ায় বেসামরিক প্রশাসনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। জুন মাসে সীমান্ত এলাকায় প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা হয়। মুজিবনগর সরকার গঠনের পর জুন মাসে ৫টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদ গঠন করা হয়। তাদের দায়িত্ব নির্ধারণ করা হয়। জুলাই মাসে ৯টি এবং আগাস্ট মাসে ১১টি আঞ্চলিক প্রশাসনিক পরিষদে উন্নীত হয়। প্রত্যেক অঞ্চলের নির্বাচিত সদস্যগণ চেয়ারম্যান নির্বাচন করতেন এবং প্রত্যেক অঞ্চলে একজন প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয়। পরিষদের কার্য পরিচালনার জন্য আরও কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ করা হয় এবং মুজিবনগর সরকার তাদের ভাতা প্রদান করে। মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে নিয়মিত বাহিনীর অফিসার ও জওয়ানরা ভাতা পেতেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে মেজর জিয়াসহ সকল কমান্ডার মুজিবনগর সরকারের কর্মকর্তা ছিলেন। রাজনৈতিক নেতা, কর্মী ও আমলারা আঞ্চলিক প্রশাসন পরিচালনায় দক্ষতার পরিচয় দেন। চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা এম এ হান্নান আগরতলায় প্রশাসন প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভমিকা পালন করেন। মুজিবনগর সরকার পরিচালনায় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম এমএনএ প্রধানমন্ত্রীর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বিদেশিদের দেখাশুনা করতেন। প্রধানমন্ত্রীর আরেকজন সহায়তাকারী ছিলেন মজিদুল হাসান। আব্দুস সামাদ আজাদ এমএনএ প্রচার ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ আজিজুর রহমান মল্লিক এবং সৈয়দ আব্দুস সুলতান এমএনএ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে সহায়তা করতেন। রাষ্ট্রদূত আবুল ফাত্তাহ এবং আবদুল মোমেন পাকিস্তান দূতাবাস ত্যাগ করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেন এবং তারা অস্থায়ী রাষ্ট্রের উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতেন। এমআর আখতার মুকুল, আব্দুল গাফফার চৌধুরী, আলমগীর কবির, কবি আসাদ চৌধুরী পাকিস্তান সামরিক সরকার ও দালালদের বিরুদ্ধে প্রচার অভিযান চালান। এম আর আখতার মুকুল প্রত্যেক দিন বাংলাদেশ বেতার থেকে চরমপত্র পাঠ করে যুদ্ধরত জাতিকে প্রেরণা যুগিয়েছেন। জহির রায়হান, শিল্পী কামরুল হাসান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাধ্যক্ষ মাজহারুল ইসলাম, সৈয়দ আলী হাসান প্রমুখ স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের দায়িত্ব পালনের মধ্য দিয়ে বিশেষ অবদান রাখেন।

কলকাতায় পার্ক সার্কাস মন্ত্রিসভার সদর দপ্তর ও সেনাবাহিনীর দপ্তর অবস্থিত ছিল। অনেক বেসামরিক কর্মকর্তা-কর্মচারী পূর্ব পাকিস্তান সরকারি দপ্তর পরিত্যাগ করে সীমান্ত অতিক্রম করে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অনেক কর্মকর্তা পালিয়ে এসে মুজিবনগর সরকারে যোগ দেন।

পৃষ্ঠা: ২৬৩

 

 

২৫ মার্চ রাতে পাকবাহিনী রাজারবাগ পুলিশ লাইন এবং পিলখানা ইপিআর ক্যাম্প আক্রমণ করে। তখন বাংলাদেশের ১৫ হাজার ইপিআর ও চল্লিশ হাজার পুলিশ ছিল। ইপিআর ও পুলিশ পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রাথমিক প্রতিরোধ গড়ে তোলে। এ সময় ইপিআরের ভূমিকা ছিল দুঃসাহসিক। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সাড়া দেশের ইপিআর মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পুলিশ প্রাথমিক প্রতিরোধের পরে অনেকে পুনরায় চাকরিতে যোগ দেয় এবং একাংশ মুক্তিযযুদ্ধে অংশ নেয়। বাংলাদেশের সকল থানায় বাঙালি পুলিশদের দিয়ে সামরিক সরকার আংশিক হলেও প্রত্যেক থানায় কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়। তাদের সহায়তায় সামরিক সরকার রাজাকার বাহিনী গঠন করে। আনসার ও মুজাহিদ বাহিনী অসীম সাহসের পরিচয় দেয়।

পাক সেনারা প্রথমে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করার চেষ্টা করলে তারা বিদ্রোহ করে। বাংলাদেশে তাদের ছয়টি নিয়মিত ব্যাটালিয়ন ছিল অসহযোগ আন্দোলনকালে পাকবাহিনী অনেক নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। এ সময় বাঙালি সৈন্যদের মধ্যে বিদ্রোহের ভাব সৃষ্টি হতে থাকে। ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট শুরু করলে তাৎক্ষণিকভাবে বাঙালি সৈন্যরা চট্টগ্রাম ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, কুষ্টিয়া ও রংপুরে বিদ্রোহ করে এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।

ঢাকা সেনানিবাসে পাকিস্তান বাহিনীর ১৪তম ডিভিশন অবস্থান করছিল। ১৫ এপ্রিলের মধ্যে নবম ও ষোলোতম ডিভিশনকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসে। ঢাকায় ৪৭ ব্রিগেড, রংপুরে ২৩ ব্রিগেড ও কুমিল্লায় ৫৩ ব্রিগেডের অবস্থান ছিল। এ সকল ডিভিশনে মোট ১২টি ইনফ্যান্ট্রি ব্যাটালিয়ন, ১টি আর্মড রেজিমেন্ট, একটি কমান্ডাে ব্যাটালিয়ন, ৫টি ফিল্ড রেজিমেন্ট আর্টিলারি ও ১টি ১২০ মিলিমিটার মর্টার রেজিমেন্ট ছিল। ৯ম ডিভিশনকে কুমিল্লা-সিলেট এলাকায় এবং ১৬ ডিভিশনকে উত্তর বাংলায় নিয়োগ করা হয়। ১৪তম ডিভিশনকে ঢাকা, ময়মনসিংহ, ফরিদপুর, যশোর ও খুলনার দায়িত্বে দেওয়া হয়। পরে পাকবাহিনী ৩৬ ও ৩৯ ডিভিশন গঠন করে। এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তান পুলিশ দেশীয় রাজাকার, আলবদর, আল শামস মিলিয়ে প্রায় ৫০ হাজার আধা সামরিক বাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের সাথে ছিল।

মুক্তিবাহিনী প্রাথমিক বিপর্যয়ের পরে পুনরায় অস্ত্রে সজ্জিত হয়ে পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে সর্বাত্মক আক্রমণের জন্য সীমান্ত এলাকায় ঘাঁটি স্থাপন করে। ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় স্বাধীন বাংলাদেশ গঠন করার পর মুক্তিযুদ্ধ আরও তীব্র হতে থাকে। প্রথম পর্যায়ে বাংলাদেশকে চারটি সেক্টরে

পৃষ্ঠা: ২৬৪

 

 

বিভক্ত করা হয়। চট্টগ্রাম সেক্টরে কমান্ডার মেজর জিয়া, কুমিল্লা সেক্টরে মেজর আবু ওসমান চৌধুরীকে দায়িত্ব প্রদান করা হয়। মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তর স্থাপিত হয় কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোডে। লে. কর্নেল রবকে চিফ অব স্টাফ এবং গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ডেপুটি চিফ অব স্টাফ নিয়োগ করা হয়।

১৯৭১ সালের ১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং রাজনৈতিক বেসামরিক সহায়তার জন্য নির্বাচিত সদস্যদের নেতৃত্বে ১০টি অঞ্চলে বিভক্ত করা হয়। এ সভায় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের নিয়ে তিনটি ব্রিগেড গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্রিগেড ৭ জুলাই মেজর জিয়ার নেতৃত্বে গঠিত হয়। তার নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে ব্রিগেডের নামকরণ হয় জেড ফোর্স। প্রথম, ততীয় ও অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের সমন্বয়ে জেড ফোর্স ব্রিগেড গঠিত হয়। পরে মেজর জিয়াউদ্দিন পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে প্রথম বেঙ্গলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। প্রথম বেঙ্গলের অন্যান্য অফিসারের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন বজলুল গনি পাটওয়ারী, ফ্লাইয়াত লে. লিয়াকত আলী খান, ক্যাপ্টেন মাহবুব, ক্যাপ্টেন হাফিজ, ক্যাপ্টেন কাইয়ুম, লে. আনিস ও লে. ওয়াকার। তৃতীয় ইস্ট বেঙ্গল ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক ছিলেন মেজর শাফায়াত জামিল। অন্যান্য অফিসার ছিলেন ক্যাপ্টেন মহসিন, ক্যাপ্টেন আনোয়ার, ক্যাপ্টেন আকবর, লে. নুরুন্নবী, লে. মঞ্জুর, লে. ফজলে হোসেন, ফ্লাইট লে. আশরাফুল আলম। মেজর আমিনুল হক অষ্টম ইস্ট বেঙ্গলের অধিনায়ক ছিলেন। অফিসারদের মধ্যে ছিলেন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান চৌধুরী, লে. মাহবুব, লে. এমদাদ, লে. মুনির, লে. ওয়ালী, লে. বাকের। জেড ফোর্স কামালপুর, বাহাদুরাবাদ, চিলমারী, গোবিন্দগঞ্জ ও নকশী বিওপি আক্রমণে বিশেষ সাফল্য অর্জন করে।

নবম, দশম ও চতুর্থ বেঙ্গল নিয়ে ৭ অক্টোবর গঠিত হয় কে ফোর্স’। কে ফোর্সের অধিনায়ক খালেদ মোশাররফের নামের প্রথম অক্ষর দিয়ে এ ব্রিগেডের নামকরণ করা হয়। ক্যাপ্টেন আইনউদ্দিন, ক্যাপ্টেন মাহবুব, লে. হারুন, লে. কবীর, ক্যাপ্টেন গাফফার, মেজর সালেক চৌধুরী, লে. দিদার, ক্যাপ্টেন আকবর, ক্যাপ্টেন ইমাম, ক্যাপ্টেন শহীদ, লে. ইমামুজ্জামান, মেজর মতিন, মেজর হায়দার, লে. মিজান, লে. দিদারুল আলম ‘কে’ ফোর্সে যুদ্ধ করেছেন। বেলোনিয়া, মন্দাভাগ, শালদা ও কসবা যুদ্ধে ‘কে’ ফোর্স বীরত্বের পরিচয় দেয়।

অক্টোবর মাসে ‘এস ফোর্স গঠন করা হয়। মেজর শফিউল্লাহ এস ফোর্সের সাধনায়ক নিযুক্ত হন। তার নামের প্রথম অক্ষর অনুসারে এস ফোর্সের নামকরণ।

পৃষ্ঠা: ২৬৫

 

 

করা হয়। এস ফোর্সের অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর মইনুল হাসান চৌধুরী, লে. সাইদ, লে. আবুল হোসেন, মেজর মতিয়ুর রহমান, লে. আমিনুল ইসলাম,  লে. বদিউজ্জামান, লে. সেলিম, লে. ইব্রাহিম, মেজর নাসিম, ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভূঁইয়া, লে. নজরুল, লে. নাসের ও মেজর নুরুল হান্নান।

‘জেড ফোর্স’, ‘এস ফোর্স’, ‘কে ফোর্স’ ছিল নিয়মিত বাহিন। মেজর জিয়া ‘জেড’ ফোর্সের দায়িত্বে ছিলেন। এ ছাড়া হাজার হাজার প্রশিক্ষনপ্রাপ্ত ছাত্র, যুবক কৃষককে নিয়ে গেরিলা বাহিনী বা অনিয়মিত বাহিনী গঠন করা হয়। তারা দেশের অভ্যন্তরে যুদ্ধ করে পাকসেনা ও রাজাকারদের পর্যুদস্ত করে।

 

আঞ্চলিক বাহিনী

দেশের অভ্যন্তরে টাঙ্গাইলে কাদের সিদ্দিকীর নেতৃত্বে, হাবিলদার হেমায়েতের নেতৃত্বে গোপালগঞ্জে, মির্জা লতিফের নেতৃত্বে সিরাজগঞ্জে মুক্তিবাহিনী পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে কৃতিত্বের পরিচয় দেয়।

 

বাংলাদেশ নৌবাহিনী

১০ নম্বর সেক্টরের অধীনে ছিল নৌ কমান্ডাে-অভ্যন্তরীণ নৌপথ ও সমুদ্র উপকুলীয় অঞ্চল। দশম সেক্টরের অধীনে বাঙালি পদস্থ কর্মকর্তা না থাকায় এ সেক্টরের অধিনায়ক ছিল না। নিজ নিজ সেক্টর কমান্ডারগণ অপারেশন পরিচালনা করেন। নৌবাহিনী অফিসারদের মধ্যে ছিলেন এ জি খুরশীদ, রহমতুল্লাহ, বি আলম, আসাদুল্লাহ, সলিমুল্লাহ, রফিকুল ইসলাম। নবম সেক্টরে প্রথম বঙ্গবন্ধুর নামে নৌবাহিনী গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের আগস্ট মাসে মন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান দশম সেক্টরে প্রথম নৌবাহিনীর শুভ উদ্বোধন করেন। মংলা, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি স্থানে নৌ কমান্ডােরা হামলা চালিয়ে অনেক জাহাজ ডুবিয়ে দেয়।

ফ্রান্স থেকে পাকিস্তান নৌবাহিনীর ৮ জন নাবিক পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। তাদের নিয়ে মুজিবনগর সরকার প্রথম নৌবাহিনী গঠন করে। নৌবাহিনীতে বাঙালি কোনো অফিসার না থাকায় ভারতীয় নৌবাহিনীর কমান্ডার এম এন সামন্ত বাংলাদেশ নৌবাহিনীর গঠন ও প্রশিক্ষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুর্শিদাবাদের পলাশীতে মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডােদের প্রশিক্ষণ শুরু হয়। পলাশীতে ৩০০ নৌ-কমান্ডাে প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। রহমতুল্লাহ, জালালউদ্দিন, লে. সেলিম, বজলুর রহমান প্রমুখ পলাশীতে প্রশিক্ষণ প্রদানে কঠোর পরিশ্রম  করেন।

পৃষ্ঠা: ২৬৬

 

 

বাংলাদেশ বিমানবহিনী

১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের নাগাল্যান্ডের ডিমাপুরে গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ. কে খোন্দকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর জন্ম হয়। মাত্র কয়েকটি  ডাকোটা, অটার এলুভেট হেলিকপ্টার নিয়ে প্রশিক্ষণ শুরু হয়। বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর অফিসারদের মধ্যে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলম, ক্যাপ্টেন আকরম, ফ্ল্যাইট লে. বদরুল আলম, ক্যাপ্টেন শাহাবুদ্দিন, ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন, মুক্তি ও সারওয়ারসহ ৬৭ জন। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু হলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনী আকাশযুদ্ধে দক্ষতার পরিচয় দেয়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ নৌবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে তিন পর্যায়ে ভাগ করা যায়;

প্রথম পর্যায়: ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২০ জুন। এ সময় বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার আহ্বানে সাড়া দিয়ে জনগণ, ছাত্র-যুবক, বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইউআর, পুলিশ, আনসার স্বতঃস্ফূর্তভাবে পাকবাহিনীর আক্রমণ প্রতিহত করে। যুদ্ধপ্রস্তুতি অবশ্য ছিল। কিন্তু সমন্বয়ের অভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের বিচ্ছিন্নভাবে আক্রমণ প্রতিহত করতে হয়েছে। এ সময়কাল ছিল প্রকৃতপক্ষে অপরিকল্পিত জনযুদ্ধ। অস্ত্র ও গোলাবারুদের অভাব ছিল। যার যা আছে তা নিয়ে বাংলার মানুষ জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু শ্লোগান দিয়ে পাক বাহিনীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে।

দ্বিতীয় পর্যায়: ১৯৭১ সালের জুনের তৃতীয় সপ্তাহ হতে সেপ্টেম্বর। এ সময় মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন করা হয় এবং সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। ছাত্র, যুবক, কৃষক সংক্ষিপ্ত সামরিক প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে এবং দেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনী, রাজাকার ও দালালদের বিরুদ্ধে অভিযান চালায়। মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়মিত বাহিনী ‘কনভেনশন’ যুদ্ধ শুরু করে।

তৃতীয় পর্যায়: অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহ হতে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত। এ সময় বাংলাদেশে গেরিলা যুদ্ধ চলে। সীমান্ত এলাকায় পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনীর নিয়মিত সৈন্যদের যুদ্ধ চলে এবং বাংলাদেশের বিস্তৃত এলাকা আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে চলে আসে। নভেম্বর মাসের শেষ দিকে পাকিস্তানি বাহিনী পর্যদস্তু হয়। নৌ-কমান্ডাের আক্রমণে চালনা ও চট্টগ্রাম বন্দর অচল হয়ে পড়ে।

চতুর্থ ও শেষ পর্যায়: ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী একত্রিত করে মিত্রবাহিনী গঠন করা হয়। ৩ ডিসেম্বর হতে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত মিত্রবাহিনীর সাথে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর যুদ্ধ। ১৬ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনীর বিজয়।

পৃষ্ঠা: ২৬৭

 

 

 

ঘ. মুক্তিযুদ্ধের প্রচারমাধ্যম (স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্র, বিদেশি প্রচারমাধ্যম ও জনমত গঠন)

 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র মুক্তিযুদ্ধকালে দ্বিতীয় ফ্রন্ট হিসেবে কাজ করেছে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের সাথে ভারতের আকাশবাণী, লন্ডনের বিবিসি, ভয়েজ অব আমেরিকাসহ বিদেশি বেতার-টিভি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে জনমত গঠন করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে দ্বিতীয় শক্তির ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ অফিসে রাতেই পৌঁছে। চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর ঘোষণা চট্টগ্রাম রেডিও থেকে প্রচারের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এম  এ হান্নান ও আতাউর রহমান খান কায়সার এমএনএ সকালে চট্টগ্রাম রেডিও অফিসে যান। রেডিও অফিস বন্ধ থাকায় কাস্টম কর্মকর্তা এমএ হালিম রেডিও কর্মকর্তা ও কুশলীদের নিয়ে আসেন। আগ্রাবাদের রেডিও অফিস নিরাপদ নয়, তাই এম এ হান্নান উপস্থিত সকলকে নিয়ে কালুরঘাট রেডিও অফিসে যান। আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা কয়েকবার পাঠ করেন। এমএ হান্নান রেডিও চালু করেছে শুনে রেডিও কর্মকর্তা বেলাল মোহাম্মদ, প্রকৌশলী নাসিরউদ্দিন, আবদুস ছোবহান, আবদুল্লাহ আল ফারুক, উপাধ্যক্ষ আবুল কাশেম প্রমুখ কালুরঘাট ট্রান্সমিটার সন্ধ্যা ৭-৩০ দ্বিতীয় অধিবেশন চালু করেন।

বেলাল মোহাম্মদ দ্বিতীয় ও তৃতীয় অধিবেশন পরিচালনা করেন। বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণা বাংলায় অনুবাদ করে বার বার পাঠ করা হয়। একই রাত ১০টায় চতুর্থ অধিবেশন শুরু হয়। এ অধিবেশনে লন্ডন প্রবাসী মাহমুদ হাসান বিশ্ববাসীর সমর্থন ও সাহায্য চেয়ে ইংরেজি ভাষায় আবেদন জানান। এ দিন রেডিওর সংগঠকগণ কালুরঘাট কেন্দ্রের নামকরণ করেন বিপ্লবী বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র। আওয়ামী লীগ নেতা এমএ হান্নান কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযুদ্ধের নবযাত্রা শুরু করেন। ২৭ মার্চ সন্ধ্যায় কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে মেজর জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। তার ঘোষণা মুক্তিযুদ্ধকে অনুপ্রাণিত করে। লন্ডন প্রবাসী হাসান মাহমুদ মেজর জিয়ার পত্র নিয়ে ভারতের সাহায্যের জন্য যাত্রা করেন। সীমান্তে হারভাঙ্গা নামক স্থানে সিআইএর দালাল আখ্যায়িত করে একদল উউচ্ছৃঙ্খল  ইপিআর তাকে হত্যা করে। তিনি বাঙালি হলেও দেখতে ছিলেন অবাঙালিদের ন্যায়- মাথায় লম্বা চুল ছিল।

পৃষ্ঠা: ২৬৮

 

 

কালুরঘাটে বিপ্লবী বাংলাদেশ বেতার কেন্দ্র থেকে বিপ্লবী শব্দ বাদ দিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ বেতার নামকরণ করা হয়। ৩০ মার্চ পাকিস্তান আর্মি বোমা বর্ষণ করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র ধ্বংস করে দেয়। তারা চট্টগ্রাম দখল করে নেয়। বেতার কর্মকর্তা, কুশলী ও মুক্তিবাহিনী কালুরঘাট থেকে এক কিলোওয়াট ট্রান্সমিটারটি নিয়ে রামগড় হয়ে ত্রিপুরা রাজ্যের সাবরু যায়। আগরতলা থেকে ৪ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রচার পুনরায় শুরু হয়। ২৪ মে পর্যন্ত আগরতলা থেকে স্বাধীন বাংলা বেতারের প্রচার চলে।

১৯৭১ সালের ২৫ মে কলকাতা থেকে ৫০ কিলোওয়াট ট্রান্সমিটার থেকে অনুষ্ঠান প্রচার শুরু হয়। আগরতলায় অবস্থানরত বেতারকর্মীরা কলকাতা স্বাধীন বেতার কেন্দ্রে যোগ দেন। কলকাতার বালুহাক্কাক লেনে বেতার কেন্দ্র অফিস ছিল। বালুহাক্কাক লেনে সাপ্তাহিক জয় বাংলা পত্রিকার অফিস ছিল। এনএ আবদুল মান্নান পত্রিকার সম্পাদক ও বেতারের দায়িত্বে ছিলেন। বেতার কেন্দ্র কলকাতার ৫৭/৮ বালিগঞ্জ সার্কুলার রোডে অবস্থিত ছিল। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র পরিচালনার দায়িত্বে ছিলেন-

শামসুল হুদা চৌধুরী- সিনিয়র প্রােগ্রাম সংগঠক

আশফাকুর রহমান- প্রোগ্রাম অর্গানাইজার

টিএইচ সিকদার- প্রােগ্রাম প্রডিউসার

তাহের সুলতান- প্রোগ্রাম প্রডিউসার

মোস্তফা আনোয়ার- প্রােগ্রাম প্রডিউসার

আলমগীর কবীর- ইংরেজি অনুষ্ঠান

আলী যাকের- ইংরেজি অনুষ্ঠান

সমর দাশ- সঙ্গীত পরিচালক

সৈয়দ হাসান ইমাম- নাট্য পরিচালক

কামাল লোহানী- বার্তা বিভাগ

বেগম পারভীন হোসেন- ইংরেজি সংবাদ পাঠক

সৈয়দ আবদুস শাকের- প্রকৌশলী

আলী রেজা ছৌধুরী- সংবাদ পাঠক

নুরুল ইসলাম সরদার- সংবাদ পাঠক

আশরাফুর আলম- সংবাদ পাঠক

বাবুল আখতার- সংবাদ পাঠক

আবদুল জব্বার- মিউজিক প্রডিউসার

আপেল মাহমুদ- বেতার শিল্পী

রথীন্দ্রনাথ রায়- বেতার শিল্পী

বেলাল মোহাম্মদ- প্রােগ্রাম অর্গানাইজার

বেতার কেন্দ্র থেকে নিয়মিত কোরআন পাঠ, মুক্তিযুদ্ধের খবর, মুক্তিযুদ্ধের গান, রণাঙ্গন, সংবাদ বুলেটিন, এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্র, বজ্রকণ্ঠ, নাটক- জল্লাদের দরবার, আলোচনা, কবিতা পাঠ, সাহিত্য আলোচনা,  কথিকা পাঠ হতো। বেতার শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন- সমর দাশ, মলয় ঘোষ, হরলাল রায়, আবদুল জব্বার, অজিত রায়, আপেল মাহমুদ, রথীন্দ্রনাথ রায়, সানজিদা খাতুন, কল্যাণী ঘোষ, কাদেরী কিবরিয়া, শেফালী ঘোষ, স্বপ্না রায়, মালা খান,  ফকির আলমগীর, লাকি আখন্দ প্রমুখ।

বেতারের বিশিষ্ট আলোচক ছিলেন, ড. আনিসুজ্জামান, আব্দুল গফফার  চৌধুরী, আসাদ চৌধুরী, সন্তোষ গুপ্ত, কবি নির্মলেন্দু গুণ, এডভোকেট গাজীউল হক, সৈয়দ আলী আহসান, ডা. বি, চৌধুরী এবং এমএনএ, এমপিএ মন্ত্রীগণ। বাংলাদেশ শিল্পী গোষ্ঠী ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে গান গেয়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে এবং তা মুক্তিযুদ্ধের ফান্ডে জমা দেয়। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জনপ্রিয় গান:

কথা রচনা শিল্পী
আমার সোনার বাংলা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঢাকায় সৃষ্ট
আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো গাফফার চৌধুরী আলতাফ মাহমুদ
শোনো একটি মুজিবুরের থেকে গৌরিপ্রসন্ন মজুমদার অংশুমান রায়
জয় বাংলা বাংলার জয় গাজী মাজহারুল আনোয়ার অধিবেশনের সূচনা সঙ্গীত
কারার ঐ লৌহ কপাট কাজী নজরুল ইসলাম রেকর্ড
একটি ফুলকে বাঁচাবো বলে গোবিন্দ হালদার আপেল মাহমুদ
এক সাগর রক্তের বিনিময়ে গোবিন্দ হালদার স্বপ্না রায়
সোনা সোনা আবদুল লতিফ রেকর্ড
সালাম সালাম হাজার সালাম ফজল এ খোদা রেকর্ড
পূর্ব দিগন্তে সূর্য উঠেছে গোবিন্দ হালদার রেকর্ড

 

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের গান, চরমপত্র, জল্লাদের দরবার নাটক, রণাঙ্গনের সংবাদ দীর্ঘ ৯ মাস বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে মাতিয়ে রেখেছে। দেশের অভ্যন্তরে দিনরাত মানুষ গোপনে বেতার বাংলা শুনতো। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রেরণা ছিল বেতার। এপার বাংলা ও ওপার বাংলার মানুষের প্রিয় অনুষ্ঠান ছিল বেতার বাংলার। বাংলাদেশ বেতার বিরতিহীন প্রচার মাধ্যমে জনগণের মতামত

পৃষ্ঠা: ২৭০

 

 

দারুণভাবে প্রভাবিত করে।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র, ভারতের আকাশবাণী, লন্ডনের বিবিসি আমেরিকার ভয়েজ অব আমেরিকা- ভারত, বাংলাদেশ, প্রবাসী ও বিশ্ব জনমত গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আকাশবাণীর দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের কণ্ঠে সকলকে মাতিয়ে রাখতেন। এমআর আখতার মুকুলের চরমপত্র, জল্লাদের দরবার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের প্রেরণা যুগিয়েছে।

থেকে সরকার জয় বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করতো।

মুজিবনগর থেকে সরকার জয় বাংলা সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত করতো। এমএনএ আবদুল মান্নান ছদ্মনামে আহম্মদ রফিক নামে পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন। সহকারী সম্পাদক ছিলেন আবদুল গাফফার চৌধুরী, কবি আসাদ চৌধুরী। বেসরকারি পত্রিকা ছিল বাংলার বাণী, দেশ বাংলা, দাবানল, মুক্তিযুদ্ধ, জন্মভূমি, বিপ্লবী বাংলাদেশ, নতুন বাংলা প্রভৃতি।

বিশ্বের বিভিন্ন পত্রিকা ও সাংবাদিকগণ বাংলাদেশের গণহত্যা, যুদ্ধের সংবাদ প্রচার করে বিশ্ব মতামত গঠন করে। বিশ্বের জনগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে। ২৫ মার্চ ঢাকায় কয়েকজন বিদেশী সাংবাদিক অবরুদ্ধ ছিলেন। তারা ছবি সংবাদ সংগ্রহ করে গোপনে তা বিশ্বে ছড়িয়ে দেয়। লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের সাংবাদিক সাইমন ড্রিংক ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলেন। তিনি ঢাকার গণহত্যার চিত্র ও সংবাদ সংগ্রহ করে গোপনে পাঠিয়ে দেন। তারপর ঢাকা ত্যাগ করেন। বিশ্বের মানুষ তার পাঠানো গণহত্যার সংবাদ জানতে পারে।

পাকিস্তানি সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস ঢাকার গণহত্যার সংবাদ সংগ্রহ করে লন্ডনে চলে যান। তার প্রতিবেদনের পর সারা বিশ্ব পাকবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ শুরু করে। বিশ্বের সকল দেশে বাংলাদেশের গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধের সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে। অনেক সময় সরকার পাকিস্তানের পক্ষে থাকলেও জনগণ বাংলাদেশের পক্ষ নেয়। বিবিসির মার্ক টালির প্রতিবেদন বিশেষ ভূমিকা রাখে। তার প্রতিবেদন বাঙালিদের উজ্জীবিত রাখে। এভাবে প্রচার মাধ্যম বিশ্বে জনমত সৃষ্টি করে। জনগণ তাদের সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করে বাংলাদেশকে সমর্থন করার পক্ষে।

 

আকাশবাণী কলকাতা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে আকাশবাণী কলকাতা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আকাশবাণীর সংবাদ পাঠক দেবদুলাল বন্দোপাধ্যায় বাঙালি জাতি ও মুক্তিযোদ্ধাদের অনুপ্রেরণা দেন। তার কণ্ঠ এবং সংবাদপাঠ মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে থাকবে।

পৃষ্ঠা: ২৭১

 

 

বিবিসির ভূমিকা

১৯৭১ সালে বিবিসি স্বাধীনতা আন্দোলনে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন কর। বিবিসি পাকিস্তানের বর্বরতা বিশ্বের সামনে তুলে ধরে। বাংলা ভাষার অনুষ্ঠান সংগঠক সিরাজুর রহমান, শ্যামল লোধ, কমল বোস  বাংলাদেশে গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য প্রচার করে খ্যাতি অর্জন করেন। খ্যাতিমান সাংবাদিক পিল রজার ডেইলি মিররের সাংবাদিক ছিলেন। তার বিখ্যাত গ্রন্থ- ‘ডেথ অব এ নেশন’-এ পাকিস্তানিদের বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন। বাংলাদেশ এ্যাকশন কমিটির সভাপতির স্ত্রী এলন কনেট মুজিবনগর হয়ে ত্রাণসামগ্রী নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। পাকবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে জেলে প্রেরণ করে। স্বাধীনতার পর তিনি মুক্তি লাভ করেন।

 

বাংলাদেশ সরকারের কার্যাবলি

বাংলাদেশ সরকারের প্রধান দায়িত্ব ছিল মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার জন্য ভারত সরকারের সহায়তায় ট্রেনিং ক্যাম্প প্রতিষ্ঠা করা হয়। নিয়মিত বাহিনী ব্যতীত এক লাখ মুক্তিযোেদ্ধাকে প্রশিক্ষণ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরে প্রেরণ করা হয়। তারা দীর্ঘ ৯ মাস যুদ্ধ করে পাকিস্তানিদের পর্যুদস্ত করে। মুক্তিযুদ্ধের দায়িত্ব ছিল প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ১১টি সেক্টর গঠন করে যুদ্ধ পরিচালনায় অপূর্ব রণকুশলীর পরিচয় দেন।

 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনী

তাজউদ্দীন আহমদ- প্রতিরক্ষামন্ত্রী

কর্নেল এএম এ জি ওসমানী- প্রধান সেনাপতি

কর্নেল আবদুর রব এমএনএ- চিফ অব স্টাফ

গ্রুপ ক্যাপটেন এ কে খন্দকার- ডেপুটি চিফ অব স্টাফ

মেজর ওসমান চৌধুরী

মেজর নুরুল ইসলাম

মেজর হাবিবুল্লাহ

মেজর এ টি এম সালাউদ্দিন

স্কোয়াড্রন লিডার শামসুল আলম

মেজর এনামুল হক লে.

শেখ কামাল

পৃষ্ঠা: ২৭২

 

 

ত্রাণ ও পুনর্বাসন দফতর

পাক বাহিনীর অত্যাচারে এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। সরকার ভারতের সহায়তায় ত্রাণ ও পুনর্বাসন  মন্ত্রণালয়ের অধীনে ত্রাণ শিবির ও যুব অভ্যর্থনা দপ্তর পরিচালনা করে। ত্রাণ পুনর্বাসন মন্ত্রী ছিলেন এএইচএম কামরুজ্জামান।

 

যুব অভ্যর্থনা দপ্তরের দায়িত্বে ছিলেন:

অধ্যাপক ইউসুফ আলী এমএনএ, সচিব

আবদুল মালেক উকিল এমএনএ, সদস্য

মোঃ শামসুল হক এমএনএ

সোহরাব হোসেন এমএনএ

আক্তারুজ্জামান চৌধুরী এমপিএ

 

ত্রাণ ও পুনর্বাসন দপ্তর

জিজি ভৌমিক, রিলিফ কমিশনার

মামুনুর রশীদ সিএসপি, উপ-রিলিফ কমিশনার

 

মুজিবনগর সরকারের সচিবালয়

প্রধানমন্ত্রীর দপ্তর-৮ নম্বর থিয়েটার রোড

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপন প্রতিরক্ষা, তথ্য ও বেতার, পরিকল্পনা

উপদেষ্টা, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম

মন্ত্রী পরিষদ সচিব, এইচটি ইমাম

সংস্থাপন সচিব, নুরুল কাদের খান

 

অর্থ মন্ত্রণালয়

মন্ত্রী, ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী

সচিব, খন্দকার আসাদুজ্জামান

আইন মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ মিশন

মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ

সচিব, এমএ হান্নান চৌধুরী

 

কৃষি

মন্ত্রী, এএইচএম কামরুজ্জামান

সচিব, নুরুদ্দিন আহমদ

 

স্বরাষ্ট্র

মন্ত্রী, এ এইচ এম কামরুজ্জামান

সচিব, এম এ খালেক

পৃষ্ঠা: ২৭৩

 

 

পররাষ্ট্র

মন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমদ

সচিব, মাহবুবুল আলম চাষী

 

পরিকল্পনা বিভাগ

ড. মোজাফফর আহমেদ চৌধুরী, চেয়ারম্যান

ড. স্বদেশ বসু, সদস্য

ড. মোশাররফ হোসেন, সদস্য

ড. নুরুল ইসলাম, সদস্য

অধ্যাপক সারওয়ার মোর্শেদ, সদস্য

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, সদস্য

 

বেতার ও তথ্য

আবদুল মান্নান এমএনএ

 

মুজিবনগর থেকে বেসরকারিভাবে কয়েকটি পত্রিকা প্রকাশিত হতো।

শিল্পী কামরুল হাসান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যঙ্গচিত্র- এ জানোয়ারদের হত্যা করতে হবে, অংকন করে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছেন।

 

এক কোটি শরণার্থীর ভারতে আশ্রয় গ্রহণ

১৯৭১ সালে ৯১ লাখ ৮৮ হাজার ৫৩২ জন ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আগরতলা, মেঘালয় আসাম ও বিহারে ৯৩৫টি শরণার্থী শিবিরে অবস্থান করে।

প্রদেশের নাম-  আশ্রয় শিবিরের সংখ্যা

পশ্চিমবঙ্গ- ৬১৫

ত্রিপুরা রাজ্য- ২৭৪

মেঘালয়- ১৭

আসাম- ২৭

বিহার- ৩

মোট- ৯৩৫

দখলদার বাহিনীর নির্যাতনে বাধ্য হয়ে এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী শিবির ব্যতীত অনেকে আত্মীয়-স্বজনের আশ্রয়ে ছিল। অনেকে চাকরিস্থলে ভাড়া বাসায় থেকেছেন।

 

বাংলাদেশ ফুটবল টিম

বাংলাদেশ সরকারের উদ্যোগে ফুটবল টিম গঠিত হয়। তারা ভারতের বিভিন্ন

পৃষ্ঠা: ২৭৪

 

 

স্থানে ফুটবল খেলা প্রদর্শন করে অর্থ সংগ্রহ ও জনমত সৃষ্টি করেন।

 

বাংলাদেশ মিশন

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত বাঙালি কূটনীতিবিদগণ ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের, পর বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

বাঙালি কূটনীতিবিদদের নাম কর্মরত দেশ

এম হোসেন আলী- কলকাতা, ভারত

হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী- দিল্লি

কে এম শাহাবুদ্দিন- দিল্লি

আমজাদুল হক- দিল্লি

এ এইচ মাহমুদ আলী- নিউইয়র্ক

এস এ করিম- নিউইয়র্ক

এনায়েত করিম- ওয়াশিংটন

এম এ এস এম কিবরিয়া- ওয়াশিংটন

এ এম এ মুহিদ- ওয়াশিংটন

সৈয়দ মোয়াজ্জেম আলী- ওয়াশিংন

মহিউদ্দিন আহমেদ- লন্ডন

এ লুৎফুল মতিন- লন্ডন

রেজাউল করিম- লন্ডন

ওয়ালি উর রহমান- সুইজারল্যান্ড

এ এম এস ফাত্তাহ-রাষ্ট্রদূত- ইরাক

কে কে পন্নী-রাষ্ট্রদূত- ফিলিপাইন

এ রহিম- জাপান

মোস্তাফিজুর রহমান- নেপাল

এস এ জায়গীরদার- লাওস

মহিউদ্দিন আহমদ- হংকং

 

বাংলাদেশ সরকার লন্ডন, ওয়াশিংটন, নিউইয়র্ক, ভারত প্রভৃতি স্থানে মিশন প্রতিষ্ঠা করে। বাঙালি কূটনীতিবিদগণ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জনমত গঠন ও অর্থ সাহায্য করে।

 

মুজিব বাহিনী গঠন

ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা (RAW- Research and Analysis Wing) বিশেষ

পৃষ্ঠা: ২৭৫

 

 

প্রশিক্ষণ দিয়ে Bangladesh Liberation Front-BLF গঠন করে। বিএলএফ-এর জনপ্রিয় নাম মুজিব বাহিনী। মুজিব বাহিনীর প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর মেজর জেনারেল ওবান। মুজিব বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক এবং তোফায়েল আহমদ। মুজিব বাহিনীর সংখ্যা ছিল প্রায় পাঁচ হাজার।  

 

ভারতে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী

মওলানা ভাসানী ২৫ মার্চের পর আসামে আশ্রয় নেন। মে মাসে তিনি কলকাতায় অবস্থান করে মুজিবনগর সরকারকে পরামর্শ দিতেন। ভারতে তিনি দেরাদুনে বসবাস করতেন।

১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশ সরকার সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠন করে।

উপদেষ্টা কমিটির সদস্যগণ

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- চেয়ারম্যান, ভাসানী ন্যাপ

তাজউদ্দীন আহমদ- সদস্য, আওয়ামী লীগ

খন্দকার মোশতাক আহমদ- সদস্য, আওয়ামী লীগ

কমরেড মণি সিং- সদস, কমিউনিস্ট পার্টি

শ্রী মনোরঞ্জন ধর- সদস্য, কংগ্রেস

অধ্যাপক মোজাফফর আহমেদ- সদস্য, ন্যাপ

 

জাতিসংঘে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল

১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন বসবে। বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘে জনমত সৃষ্টির জন্য সেপ্টেম্বর মাসে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধি দল নিউইয়র্কে প্রেরণ করে।

প্রতিনিধি দলে ছিলেন-

বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী- দলনেতা

আব্দুস সামাদ আজাদ এমএনএ- সদস্য

ফনীভূষণ মজুমদার এমপিএ- সদস্য

সৈয়দ আবদুস সুলতান এমএনএ- সদস্য

ড. মফিজ চৌধুরী-এমএনএ- সদস্য

ডা. আহসাবুল হক-এমপিএ-  সদস্য

ফকির সাহাবুদ্দিন-এমপিএ- সদস্য

এম আর সিদ্দিকী-এমএনএ- সদস্য

ড. আজিজুর রহমান মল্লিক- সদস্য

মোজাফফার আহমেদ ন্যাপ- সদস্য

অধ্যাপক রেহমান সোবহান- সদস্য

আবুল ফাত্তাহ – সদস্য

কে কে পন্নী- সদস্য

এস এ করিম- সদস্য

এম এ মুহিত- সদস্য

অন্যদিকে পাকিস্তান বাঙালি মাহমুদ আলীর নেতৃত্বে একটি দল প্রেরণ করে। এ দলে বাঙালি ছিলেন শাহ আজিজুর রহমান, এ টি সাদী, জুলমত আলী, রাজিয়া ফয়েজ- তারা জাতিসংঘে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা শান্ত, ভারত অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করছে।

 

ঙ. ছাত্র-নারী ও সাধারণ মানুষের অবদান (গণযুদ্ধ)

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ। জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত জাতীয় সংসদ ও প্রাদেশিক আইনসভার নেতৃত্বে সাড়ে সাত কোটি বাঙালি ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনীর গণহত্যার প্রতিবাদে বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে জনগণ যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। এক দেশ এক নেতা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র জাতি ঐক্যবদ্ধ। বাঙালি জাতীয়তাবাদে অনুপ্রাণিত হয়ে তারা যুদ্ধ করেছে। ১৯৭০ সালে বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ নির্বাচনে ছাত্রলীগ জয়লাভ করে। জাতীয় সংসদের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭ আসন লাভ করে। জনগণ মুক্তি লাভের জন্য আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়। ছাত্র-যুবক, নারী সকলে দেশমাতৃকার মুক্তির জন্য প্রাণ বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। ছাত্রনেতারা ১৯৭১ সালের ২ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করে। ৩ মার্চ তারা বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। ২৫ মার্চের পর হাজার হাজার ছাত্র মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে তারা পাকবাহিনী, রাজাকারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে। অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। ছাত্রনেতা নুরে আলম সিদ্দিকী, আবদুল কুদ্দুস মাখন, আ স ম আবদুর রব, শাজাহান সিরাজ মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দেন। তারা মুজিব বাহিনী গঠন করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে নারীসমাজের অবদান সর্বশ্রেষ্ঠ। তারা সশস্ত্র যুদ্ধে

পৃষ্ঠা: ২৭৭

 

 

অংশ নিয়েছে। ২৫ মার্চের পূর্বেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। তারা গেরিলা বাহিনীতে অংশ নেয়। পুরুষরা যুদ্ধ করেছে, মেয়েরা অস্ত্র- গোলাবারুদ এগিয়ে দিয়েছে। নারী ঘরে অস্ত্র গোপন রেখে সময়মতো যোদ্ধাদের হাতে তুলে দিত। নারী মুক্তিবাহিনী খাবার রান্না করেছে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের ৯ মাস খাইয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের খাবার দেওয়ার অভিযোগে  অনেক নারী লাঞ্ছিত ও ধর্ষিত হয়েছেন। ঘরের পুরুষদের পাকবাহিনী রাজাকাররা  হত্যা করেছে, বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ ছিল গণযুদ্ধ। সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, জেলে যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ৭০ ভাগ ছিল কৃষক। গ্রামের মানুষ বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকসেনাদের প্রতিহত করেছে। ১৯৭১ সালের যুদ্ধ হলো গণযুদ্ধ- জয় বাংলা স্লোগানে তারা ঐক্যবদ্ধ। জয় বাংলা- জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগান সাধারণ মানুষকে অনুপ্রাণিত করেছে। নির্বাচিত পার্লামেন্টের অধীনে ৯ মাস গণযুদ্ধ চলে। পরিশেষে মুক্তি বাহিনী ও ভারতীয় বাহিনী পাকিস্তান বাহিনীকে পরাজিত করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে।

 

চ. মুক্তিযুদ্ধে বৃহৎ শক্তিসমূহের ভূমিকা

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বাঙালিদের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকবাহিনীর সাথে মুক্তিবাহিনী সম্মুখযুদ্ধ আন্তর্জাতিক রূপ নেয়। এ যুদ্ধ কেন্দ্র ও বিচ্ছিন্ন প্রদেশের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। প্রথমে ভারত, রাশিয়া এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এ সমস্যায় জড়িয়ে পড়ে। ভারতকে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়তে হয়। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে দলে দলে শরণার্থী, রাজনৈতিক নেতা-কর্মী ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ভারতীয় রাজ্যসভা পাকসেনাদের বর্বরোচিত হামলায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এবং বাঙালিদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে এবং তারা দৃঢ় আশা ব্যক্ত করে বলেন, ৭৫ মিলিয়ন জনগণের গণতান্ত্রিক জীবনযাত্রার সংগ্রামে তারা অবশ্যই জয়ী হবে। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি পূর্ব পাকিস্তানরে পরিস্থিতি সম্পর্কে ‘Note verbale’ নোট জাতিসংঘে প্রেরণ করেন। বাংলাদেশে পাকবাহিনীর আক্রমণ ও গণহত্যার ঘটনা পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যম ব্যাপক প্রচার করে। ২৭ মার্চ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বলেন, পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কটে অংশ নেবে না। ব্রিটিশ বিদেশ সচিব একই কথা পুনর্ব্যক্ত করেন। ২ এপ্রিল আমেরিকার স্টেট ডিপার্টমেন্ট ব্রিটেনের মতো বলে যে, যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে জড়িত হবে না।

পৃষ্ঠা: ২৭৮

 

 

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে  ভারত-রাশিয়া বাংলাদেশের পক্ষে ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা শুরু করলে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার প্রতিবাদ করেন। ভারতীয় পার্লামেন্ট পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধান চায়। ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট পত্র লেখেন। রাশিয়া পূর্ব পাকিস্তানে রাজনৈতিক সমাধান চায়।

চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট পত্র প্রেরণ করে বলেন, ‘চীনের সরকার ও জনগণ সকল সময় পাস্তিান সরকার ও জনগণের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষায় জনগণকে সমর্থন হানাবে।’

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর ভারত বিএসএফের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে আসছে। কিন্তু ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হলে চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে। তাই ভারতের রাশিয়ার সমর্থন একান্ত প্রয়োজন। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লিতে সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারতের মধ্যে একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে। রাশিয়ার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দে গ্রোমিকো এবং ভারতের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তির ফলে ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে প্রয়োজনে যুদ্ধ করতে পারবে এবং চীন-আমেরিকা যদি পাকিস্তানের পক্ষে এগিয়ে আসে তাহলে সোভিয়েত রাশিয়া ভারতের সহায়তায় এগিয়ে আসবে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নকল্পে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে সোভিয়েত রাশিয়াও তার নৌবহর পাঠিয়ে দেয়। ফলে সপ্তম নৌবহর পিছু হটে যায়। এভাবে ভারত ও রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে চীন-আমেরিকাকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখে।

 

মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে আমেরিকার ষড়যন্ত্র

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকা বাংলাদেশের বিরোধিতা ও পাকিস্তানের পক্ষ অবলম্বন করে। মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে আমেরিকা অস্ত্র দিয়ে পাকিস্তানকে সাহায্য করে। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ও জাতিসংঘে আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী ভূমিকা পালন করে। এমনকি আমেরিকার সরকার মুজিবনগর সরকারের ভিতরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ ও পররাষ্ট্র সচিব মাহবুব আলম চাষীর সাথে ষড়যন্ত্র করে মুক্তিযুদ্ধ পর্যদস্তু করার ষড়যন্ত্র করেছিল। কলকাতায় অবস্থিত

পৃষ্ঠা: ২৭৯

 

 

আমেরিকার কনসাল এ ব্যাপারে উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলোচনা করতে উৎসাহী ছিলেন না। সে কারণে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সহকারী হেনরি কিসিঞ্জার আলোচনার ক্ষেত্র তৈরির সূচনা করেন। কিসিঞ্জারের বিবরণে দেখা যায়, কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত আওয়ামী লীগের নেতা কাজী জহিরুল কাইয়ুম একদলের পক্ষে কলকাতায় আমেরিকার কনস্যুলেটরের সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তানের সাথে সমঝোতার প্রস্তাব দেন।

প্রস্তাবের শর্ত ছিল, শেখ মুজিবকে আলোচনায় উপস্থিত থাকতে হবে এবং ৬ দফা গ্রহণ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রদান করতে হবে। আগস্ট মাসের মাঝামাঝি পাকিস্তানে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত ফারল্যান্ড ইয়াহিয়া খানের নিকট সমঝোতার প্রস্তাব দিলে তিনি সাথে সাথে রাজি হয়ে যান এবং  ফারল্যান্ডকে প্রবাসী সরকারের সাথে গোপন বৈঠক করতে বলেন। মধ্য সেপ্টেম্বরে আমেরিকান কনস্যুলেট জহিরুল কাইয়ুমকে বাংলাদেশ সরকার থেকে আয়োজন করতে বলেন। জহিরুল কাইয়ুম জানালেন যে, যেহেতু ভারতের এ ব্যাপারে আপত্তি আছে সে কারণে তার পক্ষে আলোচনার আয়োজন করা সম্ভব নয়।

১৯৭১ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ইয়াহিয়া খান ফারল্যান্ডের নিকট আলোচনা আয়োজনের অগ্রগতি সম্পর্কে জানতে চান। ২৩ সেপ্টেম্বর জহিরুল কাইযয়ুম আমেরিকার কনসালকে হুঁশিয়ার করে বলেন, ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে দিল্লির মাধ্যমে সকল যোগাযোগ করার নির্দেশ দিয়েছে। ২৭ সেপ্টেম্বর আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে ভারতীয় রাষ্ট্রদূতের নিকট পাকিস্তান ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের মধ্যে এক শর্তহীন আলোচনার প্রস্তাব দেন। ভারতের রাষ্ট্রদূত শেখ মুজিবের আশু মুক্তি ও বাংলাদেশের স্বাধীনতার দাবি জানান।

২৮ সেপ্টেম্বর আমেরিকার কনসালের সাথে বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদের এক বৈঠক হয়। ভারত সরকার খন্দকার মোশতাকের গতিবিধির ওপর নজর রাখতেন। এ কারণে তিনি অনেক শর্তের সাথে আলোচনায় সোভিয়েত রাশিয়ার শর্ত জুড়ে দেয়। ১৬ অক্টোবর জহিরুল কাইয়ুম ভারতের আপত্তির কারণে ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি পর্যায়ে আলোচনার কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়ে দেয়। কিসিঞ্জার বলেন, অক্টোবর শেষে বাংলাদেশ নেতাদের সাথে আলোচনার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে যায়।

লরেন্স লিফশুলজ তার গ্রন্থে বলেন, মোশতাকের দলের সাথে আমিেরকার কর্মকর্তাদের কলকাতা ও অন্যান্য স্থানে ৮টি গোপন বৈঠক হয়েছে। ১৯৭১ সালে জাতিসংঘে পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ বাংলাদেশ বিষয়ে বক্তব্য

পৃষ্ঠা: ২৮০

 

পেশ করতে যাবেন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ খন্দকার মোশতাকের ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে তার স্থলে বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরীকে বাংলাদেশ দলের নেতা নির্বাচিত করেন এবং তার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দল নিউইয়র্ক গমন করেন। এভাবে খন্দকার মোশতাক আহমদের ষড়যন্ত্র থেকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বেঁচে যায়।

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিদেশ সফর

বিশ্ব জনমত ভারতের অনুকূলে আনার জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর হতে ৬টি দেশ ভ্রমণের জন্য দিল্লি ত্যাগ করেন। তিনি বেলজিয়াম, অস্টিয়া, আমেরিকা, ফ্রান্স, বৃটেন, জার্মানি সফর করে ১২ নভেম্বর তিনি দেশে ফেরেন। ইন্দিরা গান্ধী বিদেশ সফর করেছেন কিছু পাওয়ার জন্য নয়। তাদের উপমিহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা। সফরকালে একপর্যায়ে ইন্দিরা গান্ধী বলেছেন, “I feel I am sitting on a Volcano. আমি অনুভব করি যে, আমি আগ্নেগিরির ওপর বসে আছি।”

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা এবং পাকবাহিনীর সাথে মক্তিবাহিনীর যুদ্ধ আন্তর্জাতিকরূপ লাভ করে। এ যুদ্ধ পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও বিচ্ছিন্ন পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারত, রাশিয়া ও আমেরিকা এ সময় জড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধ শুরু হওয়ার সাথে সাথে শরণার্থী নেতাকর্মীরা ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ ভারতের রাজ্যসভা পাক সেনাদের বর্বরোচিত হামলায় উদ্বেগ প্রকাশ এবং বাঙালিদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে।

১৯৭১ সালের ২৮ মে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে পত্র লিখে তাদের ধৈর্য ধারণের অনুরোধ জানান।

২ এপ্রিল সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী আলেক্সি কোসিগিন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের নিকট পত্র লিখে তার সরকারের রক্তপাত, হত্যার জন্য দায়ী করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধানের উপদেশ দেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান উদ্যত ভাষায় কোসিগিনের পত্রের উত্তর দেন। রাশিয়া পাকিস্তানকে সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য অপেক্ষা করে।

২৪ জুন কোসিগিন ভারতে শরণার্থী ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের আহ্বান জানান। পাকিস্তান এ সকল উপদেশের প্রতি কোনো কর্ণপাত না করে সামরিক শক্তি দিয়ে বাঙালিদের দমনের পথ বেছে নেয়। ১৯৭১ সালের

পৃষ্ঠা: ২৮১

 

৯ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের পত্রের জবাব দেন। তিনি আশ্বাস দেন যে, পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে চীন তার পাশে থাকবে।

আমেরিকার বিশেষ দূত হেনরি কিসিঞ্জার পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের রাজধানী বেজিং সফর করেন। ১৫ জুলাই কিসিঞ্জার ঘোষণা করেন যে, তিনি বেজিং সফর করছেন। এ সংবাদে বিশ্ব হতবাক হয়ে যায়। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপন হওয়ায় বিশ্ব পরিবর্তন শুরু হয়।

১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দে গ্রোমিকো ১২ সদস্য নিয়ে দিল্লি আসেন এবং ৯ আগস্ট ইন্দো-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১২ আগস্ট তারা উভয়ে যুক্ত বিবৃতি প্রদান করেন।

৭ অক্টোবর কেসিগিন ইয়াহিয়া খানকে হুঁশিয়ারি পত্র লেখেন। ২৩ নভেম্বর রাশিয়া পুনরায় উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য দায়ী করে পাকিস্তানের নিকট পত্র পাঠান। যুদ্ধ শুরুর ৪ দিন পর রাশিয়া আবার পত্র লিখে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের অনুরোধ করে। পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করলে রাশিয়া স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

২৫ মার্চের পূর্ব থেকে আমেরিকা পূর্ব পাকিস্তান সঙ্কট নিয়ে আলোচনা করে। ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে কি-না সে সম্পর্কে কিসিঞ্জারের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি তার মতামত ২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে অবহিত করেন। তিনি বলেন, শেখ মুজিব তাঁর স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে অটল থাকবে; যদি ব্যর্থ হন তাহলে তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। ২৫ মার্চের সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপের পর আমেরিকার নীতিনির্ধারকগণ মনে করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা এখন অবশ্যম্ভাবী।

২৮মে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পত্র লিখে তাদের ধৈর্য ধারণের জন্য আবেদন জানান। ইয়াহিয়া খানের জাতিসংঘের ত্রাণ গ্রহণ, সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা, ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা এবং টিক্কা খানের পরিবর্তে ডা. এ.এম. মালিককে গভর্নর নিয়োগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে তিনি আমেরিকার দ্বারা প্রভাবিত হয়েছেন।

২৮ মার্চ সোভিয়েত কনসাল জেনারেল রাশিয়ার পদগরনির মৌখিক বার্তা পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে অবহিত করেন। মার্চ মাসের শেষে ইয়াহিয়া খান

পৃষ্ঠা: ২৮২

 

 

সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের নিকট পত্র লিখ সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ সম্পর্কে অবহিত করেন। ২ এপ্রিল কোসিগিন ইয়াহিয়াকে পত্র লিখে  তার সরকারের রক্তপাত, হত্যার জন্য দায়ী করে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের উপদেশ দেন। এ সময় সোভিয়েত রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী দেশ। উদ্ধত ভাষায় ইয়াহিয়া খান কোসিগিনের পত্রের জবাব দেন। সোভিয়েত রাশিয়া পাকিস্তানকে সমুচিত জবাব দেওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকে। ২৪ জন কোসিগিন ভারতে শরণার্থী ও পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান। পাকিস্তান এ সকল উপদেশের ও আবেদনের প্রতি কর্ণপাত না করে সামরিক শক্তি দিয়ে বাঙালিদের দমনের পথ বেছে নেয়।

চীন প্রথম থেকে পাকিস্তানের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। ১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানের পত্রের জবাব দেন এবং আলোচনার মাধ্যমে তিনি সমস্যার সমাধানের উপদেশ দেন। আরও আশ্বাস দেন যে পাকিস্তানের সার্বভৌমত্ব রক্ষার সংগ্রামে চীন তার পাশে থাকবে। কিন্তু চীনের সমর্থনের ভাষা ছিল দুর্বল। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তানের গণহত্যা, নারী নির্যাতনের ব্যাপক প্রচারের কারণে পাকিস্তান বিশ্বে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। জাতিসংঘে পাকিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি আগা শাহী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের পাকসেনাদের গণহত্যার প্রশ্নের উত্তর দিতে সক্ষম হয়নি। পাকিস্তানের কার্যাবলী সম্পর্কে পশ্চিমা দেশগুলোকে অবহিত করার জন্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী আরশাদ হোসেন, প্লানিং কমিশনের ডেপুটি চেয়ারম্যান এম.এম. আহমেদ রাশিয়া, আমেরিকা সফর করেন। এম.এম. আহমেদ বিদেশ থেকে ফিরে এসে প্রেসিডেন্টকে প্রতিবেদন দেন। তিনি বলেন- ‘On my return, I briefed the President on my impressions that Pakistan was totally isolated because of the atrocities reported in the western press and unless the refugees influx in India was controlled, India was likely to take violent action.’

“আমি ফিরে প্রেসিডেন্টকে আমার অভিজ্ঞতা সম্পর্কে অবহিত করে বলি যে, পশ্চিমের প্রচার মাধ্যমে নির্যাতনের সংবাদ প্রচারের ফলে পাকিস্তান একেবারে একঘরে হয়ে পড়েছে এবং ভারতে শরণার্থী সমস্যা বন্ধ না করে ভারত ভয়ানক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে।

বাংলাদেশ সম্পর্কে ব্রিটেনে বিরোধী দল ও গণমাধ্যমে ব্রিটিশ সরকারের ওপর প্রবল চাপ সৃষ্টি করে এবং ৮ ও ৯ জুন ব্রিটিশ পররাষ্ট্র সচিব স্যার আলেক্স

পৃষ্ঠা: ২৮৩

 

 

শরণার্থী সমস্যার জন্য রাজনৈতিক কাঠামোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে ভাষণ দেন। ১৫ জুন ব্রিটিশ পার্লামেন্টে শ্রমিক দলের ১২০ এমপি পাকিস্তান সরকারকে গণহত্যার জন্য দায়ী করে হাউজ অব কমন্সে প্রস্তাব উত্থাপন করে এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি প্রদানের দাবি জানায়। ব্রিটিশ সরকার ও বিরোধী দলের পার্লামেন্ট সদস্য নিয়ে গঠিত দুটি দল পূর্ব পাকিস্তানে প্রেরে করে। তারা  পরিদর্শন করে পাকবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের কথা তুলে ধরে। শেখ মুজিবের নেতৃত্বে নির্বাচিত প্রতিনিধির সাথে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য তারা সুপারিশ করেন।

জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্টের অনুরোধে ওআইনসির (Organisation of Islamic Countries) মহাসচিব টিংকু আব্দুর রহমান ইরান, কুয়েত ও সৌদি আরবের প্রতিনিধি নিয়ে জুলাই-আগস্ট মাসে করাচী ও  দিল্লি গমন করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো। ইন্দিরা গান্ধী তাদের শেখ মজিবের মুক্তি ও গণহত্যার নিন্দা জ্ঞাপন করতে বলেন। এ বিষয়ে তারা উদ্যোগ না  নেওয়ায় ওআইসির প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। কমনওয়েলথের মহাসচিব ও শীলংকার প্রধানমন্ত্রী মিসেস শ্রীমাভো বন্দরনায়েক শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করে ব্যর্থ হন।

আমেরিকার হোয়াইট হাউজ এবং স্টেট ডিপার্টমেন্ট পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট নিয়ে কূটনীতির ক্ষেত্রে একমত ছিল না। নিক্সন ও কিসিঞ্জারের সাথে কংগ্রেসের মতের অমিল ছিল। আমেরিকার জনগণ ও মিডিয়া বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। হোয়াইট হাউজ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আশ্বাস দিয়েছিল যে, যদি ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় সেক্ষেত্রে আমেরিকা পাকিস্তানকে সাহায্য করবে। ইয়াহিয়া অনুধাবন করতে পারেননি যে, ঐকমত্যে পৌছতে না পারলে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট তাকে সহায়তা করতে পারবে না।

জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের বিশেষ দূত কিসিঞ্জার পাকিস্তান ও ভারত সফর করেন। তিনি ৮ জুলাই ইসলামাবাদ পৌঁছেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ খানের সাথে আলোচনা করেন। দিল্লি অবস্থানকালে তিনি বুঝতে পারলেন যে, শরণার্থী সমস্যা সমাধানের জন্য ভারত সামরিক হস্তক্ষেপের আশ্রয় নেবে। কিসিঞ্জারের উপমহাদেশের আগমনের প্রধান লক্ষ্য ছিল তার বেজিং সফর। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান চীনের কূটনীতিবিদদের সাথে আলোচনার জন্য কিসিঞ্জারের সাথে বেজিংয়ে তারা গোপন বৈঠকের আয়োজন করেন। কিসিঞ্জার চীনের সাথে আলোচনা করে চীন-আমিেরকার

পৃষ্ঠা: ২৮৪

 

 

সম্পর্ক স্বাভাবিক করেন। কমিউনিস্ট চীনের সাথে আমেরিকার দীর্ঘ বৈরি ভাব দূর হলো। ১৫ জুলাই প্রেসিডেন্ট নিক্সন ঘোষণা করলেন যে, কিসিঞ্জার বেজিং সফর করেছেন এবং তিনি ১৯৭২ সালের মে মাসে চীন সফরে যাবেন। চীন-আমেরিকার কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় বিশ্ব রাজনীতির ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন শুরু হয়। অন্যদিকে কিসিঞ্জারের চীন সফরের সংবাদে সারা পশ্চিম পাকিস্তানে উৎসব পালিত হয়। তারা ভাবলো চীন-মার্কিন পাকিস্তানের পক্ষে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৮ জুন ভাষণে বলেন, কয়েক দিনের মধ্যে তিনি জনপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। আওয়ামী লীগ ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। জাতিসংঘের মহাসচিব ১৯ জুলাই ভারত-পাকিস্তানের নিকট ত্রাণ কাজ তত্ত্বাবধানের জন্য জাতিসংঘের হাইকমিশনার (UNHCR)  নিয়োগের প্রস্তাব পেশ করেন। পাকিস্তান ২১ জুলাই জাতিসংঘের প্রস্তাব গ্রহণ করে এবং ২২ জুলাই ভারত জাতিসংঘের প্রস্তাব নাকচ করে। জাতিসংঘের মহাসচিব বিষয়টি নিরাপত্তা পরিষদের প্রেসিডেন্টকে জানান। নিরাপত্তা পরিষদের ২৫ জন সদস্য আলোচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, নিরাপত্তা পরিষদের সভা ডেকে কোনো উদ্দেশ্য সাধিত হবে না। বেজিং-ওয়াশিংটন নতুন সম্পর্ক প্রতিষ্ঠার পর ভারত-বাংলাদেশের সীমান্তে জাতিসংঘের নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষক এবং গেরিলা যুদ্ধ বন্ধের জন্য ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করা হয়। এ সময় আগস্টের প্রথম সপ্তাহে ভারতের বিশেষ দূত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত ডিপি ধর গোপনে মস্তো গমন করেন।

১৯৭১ সালের ৮ আগস্ট সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী আন্দ্রে গ্রোমিকো ১২ সদস্য নিয়ে দিল্লি আগমন করেন এবং ৯ আগস্ট ইন্দো-সোভিয়েত শান্তি, বন্ধুত্ব এবং সহযোগিতা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তিতে গ্রোমিকো ও শরণ সিংহ স্বাক্ষর করেন। ১২ আগস্ট তারা উভয় এক যুক্তি বিবৃতিতে প্রদান করেন। ভারত-রাশিয়া চুক্তি সম্পর্কে মিশ্র প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করা হয়। কিসিঞ্জার এই চুক্তিকে ‘বমশেল’ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। পাকিস্তানের উন্মত্ত জনগণ ও যুদ্ধবাজ জেনারেলরা নিস্তেজ হয়ে পড়ে।

ভারত-বাংলাদেশ-পাকিস্তানের বিদ্যমান পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ৯ আগস্ট ঘোষণা করেন বিশেষ সামরিক আদালতে ক্যামেরায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অপরাধে ১১ আগস্ট শেখ মুজিবের বিচার শুরু হবে। এ ঘোষণার ফলে শান্তি প্রতিষ্ঠার যে ক্ষীণ আশা ছিল তা শেষ হয়ে যায়। বিশ্ব হতভাগ, জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট ১০ আগস্ট পাকিস্তানকে জানিয়ে

পৃষ্ঠা: ২৮৫

 

 

দেন যে, এ বিচারের ফলে সীমান্তে অবশ্যম্ভাবী প্রতিক্রিয়া হবে। পাকিস্তান মহাসচিবকে তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপের জন্য প্রতিবাদ পেশ কতে। হেনরি কিসিঞ্জার শেখ মুজিবের বিচারকে একজন অদম্য সাহসী মানুষের বিরুদ্ধে ‘Truculent move’ নিষ্ঠুর পদক্ষেপ হিসেবে আখ্যায়িত করেন। আমেরিকার ১১ জন সিনেট ও কংগ্রেসের ৫৮ জন সদস্য শেখ মুজিবের বিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানান। আমেরিকার সেক্রেটারি অব স্টেট রজার পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের নিকট আমেরিকার প্রতিক্রিয়া অবহিত করেন। কিন্তু নিক্সন সমস্যা সমাধানের জন্য কোনো বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণে সম্মত হননি। ১৭ আগস্ট সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন পাকিস্তানে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে শেখ মুজিবের বিচারের প্রতিবাদ করেন এবং তাকে কঠিন শাস্তি প্রদান করলে তার ফল শুভ হবে না বলে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন।

এ সময় বিদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূতের সাথে তেহরান ও জেনেভায় আগস্ট মাসের শেষ সপ্তাহে সভা অনুষ্ঠিত হয় এবং সভায় পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মোহাম্মদ, তথ্য সচিব রোয়েদান খান এবং আগা শাহী ভাষণ দেন। তারা বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের বেশ কিছু অংশ তাদের নিয়ন্ত্রণে। পাকিস্তানের দূতাবাসগুলো বাংলাদেশে কি ঘটছে তা তারা জানে না। এবং অন্যান্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের প্রশ্নের জবাব দিতে পারছেন না। রাষ্ট্রদূতদের সভা নিছক তামাশা বলে প্রমাণিত হয়।

সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম সপ্তাহে পাকিস্তানের পররাষ্ট্র সচিব সুলতান মাহমুদ মস্কো সফর করেন এবং তার সাথে ৫ সেপ্টেম্বর আলোচনাকালে কোসিগিন পাকিস্তানকে নির্যাতন বন্ধ এবং পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন। ২৮ সেপ্টেম্বর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মস্কো গমন করেন। আলোচনান্তে ভারত-সোভিয়েত রাশিয়া এক যুক্ত বিবৃতিতে, শরণার্থীদের দেশে প্রত্যাবর্তনের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্য রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের আহ্বান জানান।

সোভিয়েত ইউনিয়ন কূটনীতি ও প্রচার মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য হুশিয়ারি অব্যাহত রাখে। ৭ অক্টোবর এক পত্রে কোসিগিন ইয়াহিয়া খানকে জানান, সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশ্বাস করে যে, ভারত সরকার শান্তি প্রতিষ্ঠায় আগ্রহী, কিন্তু পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ আক্রমণাত্মক বিবৃতি প্রদান করে যাচ্ছে। তিনি অভিযোগ করেন যে, পাকিস্তানের সামরিক সরকার তাদের অভ্যন্তরীণ সংঘর্ষের দায়িত্ব ভারতের ওপর চাপাতে চায় এবং পার্শ্ববর্তী দেশের বিরুদ্ধে সামরিক অভিযান শুরু করার কারণ সৃষ্টি করছে। কোসিগিন ইয়াহিয়া খানকে

পৃষ্ঠা: ২৮৬

 

 

হুশিয়ার করে বলেন, পাকিস্তান যদি ভারতের বিরুদ্ধে অভিযান চালায় তাহলে ভারতের বন্ধু হিসেবে সোভিয়েত ইউনিয়ন চরম ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।

পারস্যের রাজতন্ত্রের ২৫০০তম বার্ষিকী উদ্‌যাপন উপলক্ষে ইরানের শাহ ১৯৭১ সালের ১৫ অক্টোবর পার্সিপালিসে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগরনির এক বৈঠকের আয়োজন করেন। ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানে কেন সামরিক ব্যবস্থা নিয়েছেন তার কারণগুলো তুলে ধরেন। পদগরনি বলেন, বিদ্রোহ দমন করার অধিকার সরকারের থাকলেও  ৭ কোটি বাঙালির প্রতিনিধি শেখ মুজিবকে তিনি কেন বন্দি করলেন; তাকে রাজনৈতিক সমাধানের জন্য মুক্তি দেওয়ার জন্য অনুরোধ জানান। ইয়াহিয়া উত্তরে বলেন মুজিবকে মুক্তি দেওয়া অসম্ভব; তিনি দেশদ্রোহী। অক্টোবর মাসের শেষে সোভিয়েত ডেপুটি বিদেশমন্ত্রী নিকোলাই ফাইরুবিন দিল্লি আগমন করেন এবং ভারত-সোভিয়েত চুক্তি ৯ নম্বর অনুচ্ছেদ অনুসারে পারস্পরিক আলোচনা করেন। চুক্তিভুক্ত দেশ দুটোর কোনো একটির আক্রমণের সম্ভাবনা থাকলে আলোচনা করার পরামর্শ দেন। এ সফরের পরে রাশিয়া ভারতকে প্রচুর অস্ত্র সরবরাহ করে।

সোভিয়েত ইউনিয়ন বার বার পাকিস্তানকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করেছে, কিন্তু ইয়াহিয়া খান অনড়। সুতরাং সোভিয়েত ইউনিয়ন কঠোর হতে থাকে। ২৩ নভেম্বর সোভিয়েত রাশিয়া পুনরায় উপমহাদেশের শান্তি বিঘ্নিত করার জন্য দায়ী করে পাকিস্তানের নিকট পত্র পাঠালেন। চার দিন পরে যখন যুদ্ধ চলছে তখনো কোসিগিন ইয়াহিয়া খানের নিকট পত্র পাঠিয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমাধানের আবেদন জানান। এ প্রসঙ্গে হাসান জহির বলেন, ‘Perhaps the Russian genuinely wanted to avert a war in the Subcontinent and did not subscribe to the Indian commitment to the creating of Independent Bangladesh. This was the denial view of western media…’

ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরুর পূর্ব পর্যন্ত রাশিয়া পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক মীমাংসা চেয়েছিল; কিন্তু পাকিস্তান যুদ্ধ ঘোষণা করলে সোভিয়েত ইউনিয়ন স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী সোভিয়েত রাশিয়ার শান্তি চুক্তি সম্পাদনে ভারতের অবস্থান সুদৃঢ় করেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা ২৫ অক্টোবর পশ্চিমের দেশগুলোর রাজধানী সফর শুরু করেন। তার সফরের পর ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ ইয়াহিয়া খানকে লিখেছেন, ‘We must take this very seriously….

পৃষ্ঠা: ২৮৭

 

 

following my talks with the Indian Prime Minister, I renain deeply apprehensive.’

 

পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়া

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাক সেনাদের বাঙালিদের ওপর আক্রমণ, গণহত্যা, নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে সারা বিশ্ব প্রতিবাদ জানালেও পশ্চিম পাকিস্তানের বুদ্ধিজীবী, ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক এমনকি সাধারণ মানুষ একটি কথাও বলেনি। মনে হলো তারা পাকিস্তানের ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের একমাত্র অভিভাবক। হাসান জহির পশ্চিম পাকিস্তান সম্পর্কে বলেছেন “The Military and civil bureaucracies, big business, urban middle classes, elected representatives and the independent press welcomed the army operation’ ২৬ মার্চ ভুট্টোর প্রতিক্রিয়া এবং ইয়াহিয়া ভাষণে পশ্চিম পাকিস্তানিদের মনমানসিকতা ফুটে ওঠে। তবে পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের নেতাকর্মিগণ আর্মি অপারেশন সমর্থন করেননি। তারা উৎফুল হয়নি বলে ন্যাপ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের গ্রেফতার করে জেলে অন্তরীণ রাখে। এয়ার মার্শাল (অব.) আজগর খন এবং বিখ্যাত উর্দু কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার হন। লাহোরে উর্দু দৈনিক পত্রিকা নওয়া-ই-ওকত, করাচীর উর্দু দৈনিক জং এবং ইংরেজি দৈনিক ডন পত্রিকাসহ সকল পত্রিকা ২৫ মার্চের সেনাবাহিনীর পদক্ষেপকে সমর্থন দেয়। এ পত্রিকায় প্রথম পৃষ্ঠায় নিয়মিত সংবাদ ছাপা হতো যে, পূর্ব পাকিস্তানে সব ঠিক আছে। কোনো সময় পত্রিকাগুলো প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে জনগণকে জানতে দেয়নি। তারা পশ্চিম পাকিস্তানে ‘War Histeria’ সৃষ্টি করেছে।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নতুন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য বিচারপতি কর্নেলিয়াস, এম.এম আহমেদ, জেনারেল পীরজাদা, কর্নেল হাসান এবং বাঙালি জি.ডব্লিউ. চৌধুরীকে নিয়ে কমিটি গঠন করেন। তিনি নিম্নলিখিত বিষয়ের ওপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রণয়নের নির্দেশ দেন।

১. শাসনতন্ত্রে ইসলামী বিষয় থাকতে হবে। তিনি বলেন যে, শেখ মুজিব পাকিস্তানকে ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ও মুসলমান রাষ্ট্রপ্রধান হবে তা চায় না।

২. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন আওয়ামী লীগের দাবি অনুসারে হবে না।

৩. তিন বাহিনীর প্রধানগণ শাসনতন্ত্র সংরক্ষণ করবে।

৪. প্রেসিডেন্ট তদন্ত করে জাতীয় পরিষদ বা প্রাদেশিক পরিষদের যে কোনো সদস্যের ৬ বছরের জন্য বাতিল করতে পারবেন।

পৃষ্ঠা: ২৮৮

 

 

৫. দেশে ৩টির বেশি রাজনৈতিক দল থাকবে না।

৬. কোনো সাধারণ ক্ষমা করা হবে না।

৭. ঘোষণার মাধ্যমে শাসনতন্ত্র জারি করা হবে।

 

জুলাই মাসে খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করা হয়। প্রেসিডেন্ট রাজনৈতিক নেতাদের সাথে শাসনতন্ত্র  নিয়ে আলোচনা করেন। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। তিনি ১৯৭১ সালের ২৮ জুন রেডিও ও টিভির মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ২৮ জুন পরিকল্পনার প্রধান বিষয় ছিল আওয়ামী লীগের যে সকল সদস্য রাষ্ট্রবিরোধী কাজে অংশ নিয়েছিল তাদের সদস্যপদ বাতিল করে তাদের আসনে উপনির্বাচন হবে। উপনির্বাচন এবং শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্পূর্ণ হলে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান করা হবে এবং কেন্দ্রে ও প্রদেশে সরকার গঠন করা হবে। জাতীয় পরিষদের আওয়ামী লীগের ৭৮টি এবং পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার আওয়ামী লীগের ১৮৮ আসনের মধ্যে ১৯৩টি আসন শূন্য ঘোষণা করা হয়। ২৯ ও ৩০ সেপ্টেম্বর উপনির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা হয়। শূন্য আসনগুলো মুসলিম লীগ, পিডিএম, পিপি, জামায়াত প্রভৃতি দলের মধ্যে ভাগাভাগি করা হয়। মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী আসন বণ্টনে প্রধান ভূমিকা পালন করেন। ইয়াহিয়া খান তার জেনারেলদের নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সঙ্কটের জন্য যে সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তার সাথে পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট সমাধানের কোনো সম্পর্ক ছিল না। সারা বিশ্ব চায় পূর্ব পাকিস্তানিদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে সমঝোতা করে শরণার্থীদের দেশে ফেরত নিতে হবে সে সম্পর্কে তিনি কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। অধিকন্তু শেখ মুজিবের বিচার শুরু করে তিনি পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তুলেছেন।

 

ছ. দখলদার বাহিনী, শান্তি কমিটি, আলবদর, আলশামস, রাজাকার বাহিনী, রাজনৈতিক দল ও দেশীয় অন্যান্য সহযোগীর স্বাধীনতাবিরোধী কর্মকাণ্ড ও বুদ্ধিজীবী হত্যা

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, সামে ইসলাম, পিডিপি, ভাসানী ন্যাপ, জাতীয় লীগ অংশ নেয়। আওয়ামী লীগ

বিজয় লাভ করে। ন্যাপ মোজাফফর, ন্যাপ ভাসানী, কমিউনিস্ট পার্টি

পৃষ্ঠা: ২৮৯

 

 

জাতীয় মুক্তির প্রশ্নে আওয়ামী লীগের ছয় দফা সমর্থন করে। তারা ছিল বাঙালির স্বাধীনতার পক্ষে। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ, পিডিপি এক পাকিস্তান ও দ্বিজাতিতত্ত্বে বিশ্বাসী।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ দখলদার বাহিনী বাঙালিদের  আক্রমণ করে গণহত্যা শুরু করে। ২৬ এপ্রিলের মধ্যে দখলদার বাহিনী বাংলাদেশ দখল করে নেয়। মুক্তিফৌজ, আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ভারতে আশ্রয় নেয়। দখলদার বাহিনী, জামায়াতে ইসলাম, মুসলিম লীগ মনে করতো আওয়ামী লীগ ভারতের চর ও ইসলামের শত্রু।

দখলদার বাহিনীকে সহায়তা করার জন্য মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দলগুলো শান্তি কমিটি, রাজাকার বাহিনী, আলবদর, আল শামস গঠন করতে এগিয়ে আসে। আলবদর, আল শামস দলে জামায়াতের নেতাকর্মী বেশি ছিল। জামায়াতের মুখপত্র ছিল দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকা।

১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল পাকিস্তান ও ইসলামপন্থি নেতারা পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করেন। তারা হলেন জামায়াতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম, পিডিপি নেতা নুরুল আমিন, মুসলিম লীগের খাজা খায়ের উদ্দিন, একিউএম শফিকুল ইসলাম, মওলানা আবদুল মান্নান, নেজামে ইসলাম নেতা মৌলভী ফরিদ আহমদ মাওলান নুরুজ্জামান, পীর মহসীন উদ্দিন, এডভোকেট সাদ প্রমুখ। তারা অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সামরিক আইন প্রশাসনকে সম্পূর্ণ সহযোগিতার আশ্বাস এবং জনগণের মন থেকে ভিত্তিহীন ভয় দূর করার উদ্দেশ্যে ঢাকায় নাগরিক কমিটি গঠনের প্রস্তাব দেয়। টিক্কা খান দুষ্কৃতকারী ও ভারতের চরদের ধরিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান। পিডিপি নেতা হামিদুল হক চৌধুরীও সামরিক আইন প্রশাসকের সাথে দেখা করেন।

১৯৭১ সালের ৯ এপ্রিল টিক্কা খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। পরপরই ১৪০ সদস্যবিশিষ্ট নাগরিক শান্তি কমিটি গঠিত হয়। এ কমিটিতে ছিলেন- আহ্বায়ক খাজা খায়ের উদ্দিন, সদস্য একিউএম শফিকুল ইসলাম, মৌলভী ফরিদ আহমদ, অধ্যাপক গোলাম আযম, পীর মোহসেন ডান্দল, মাহমুদ আলী, এএসএম সোলায়মান, আবুল কাসেম, আতাউল হক প্রমুখ। পরবর্তীকালে মৌলভী ফরিদ আহমদের নেততে শান্তি ও কল্যাণ কমিটি গঠিত হয়। শান্তি কমিটি দখলদার পাকবাহিনীকে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করে।

শান্তি কমিটির পরে দখলদার বাহিনীর প্রধান শক্তি ছিল রাজাকার বা ১৯৪৭ সালে হায়দারাবাদের নিজাম রেজাকার বাহিনী গঠন করে আত্মরক্ষার

পৃষ্ঠা: ২৯০

 

 

জন্য। রেজা অর্থ স্বেচ্ছাসেবক, কার অর্থ কর্মী- স্বেচ্ছাসেবী। খুলনার জামায়াতে ইসলাম নেতা খুলনার খালিশপুরে ৯৬ জন জামায়াত কর্মী নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করে। তারা পাকিস্তান ও ইসলাম রক্ষায় পাকিস্তান দখলদার বাহিনীকে সশস্ত্র সহযোগিতা করে। ১৯৫৮ সালে আনসার বাহিনী গঠন করা হয়। অধিকাংশ আনসার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়। সে কারণে ১৯৭১ সালের জুন মাসে আনসার বাহিনী বিলুপ্ত করে অর্ডিন্যান্স ১৯৭১ জারি করে রাজাকার বাহিনী গঠন করা হয়। সারা দেশে গরিব শ্রেণীর লোকদের নিয়োগ দিয়ে অস্ত্র ট্রেনিং দেওয়া হয়। রাজাকারদের পাহারা, লুট, মুক্তিবাহিনী গ্রেফতার, হত্যা, নারী নির্যাতনে নিয়োগ করা হয়। তারা কৃষকদের গরু, ছাগল, হাঁস-মুরগি লুট করে এনে সেনাবাহিনীকে সরবরাহ করত। পাকিস্তান সরকার ৫৫ হাজার রাজাকার নিয়োগ করে মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করতে চায়। রাজাকার বাহিনীর পর আলবদর বাহিনী গঠন করা হয়। ১৯৭১ সালের ৭ নভেম্বর আল বদর দিবস ঢাকায় পালিত হয়। ইসলামী ছাত্রসংঘ ঢাকায় মিছিল করে। ছাত্রসংঘ নেতারা ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র সংঘের সভাপতি আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সম্পাদক মীর কাসেম আলী, শামসুল হক প্রমুখ। ১৯৭১ সালের মে মাসে জামায়াতে ইসলামী আলবদর বাহিনী গঠন করে। তারা ছিল হিংস্র, বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী। বদরবাহিনী ১৯৭১ সালের ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে। আলবদর বাহিনীর প্রধান ছিলেন মতিউর রহমান নিজামী। আরও ছিলেন জামায়াতের আলী আহসান মুহাম্মদ মজাহিদ, মীর কাসেম আলী, মোহাম্মদ ইউসুফ, মোহাম্মদ কামারুজ্জামান, আশরাফ হোসাইন, শামসুল হক, আ স ম রুহুল কুদুস, সরদার আবদুস সালাম, জাহের নাসের প্রমুখ। আরও ছিলেন খালেক মজুমদার, মওলানা মান্নান, আবদুল আলীম, চৌধুরী মঈনুদ্দিন প্রমুখ। আলবদর বাহিনী ১৪ ডিসেম্বর দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী, অধ্যাপক, লেখক, চিকিৎসক, শিল্পী, চলচ্চিত্রকার প্রমুখকে হত্যা করে। রায়েরবাজার বধ্যভূমি তাদের নৃশংসতার নিদর্শন। আওয়ামী লীগ সরকার বুদ্ধিজীবী হত্যাকারীদের আন্তর্জাতিক ট্রাইব্যুনালে বিচার করে কয়েকজনকে ফাঁসি দিয়েছে।

 

জ. পাকিস্তানে বন্দি অবস্থায় বঙ্গবন্ধুর বিচার ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়া

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তান বাহিনী গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি রাখে। প্রথমে সকলের ধারণা ছিল বঙ্গবন্ধু জীবিত নেই। পাকিস্তানের সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি দেখে জানতে পারে তিনি।

পৃষ্ঠা: ২৯১

 

 

পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি আছেন। বাংলার ৭ কোটি মানুষ ও বিশ্ববাসী তার মুক্তি চায়। জুলাই মাসে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন, শেখ মুজিবুর রহমান জীবিত এবং পাকিস্তানের যে কোনো কারাগারে আছেন। খুব শীঘ্রই সামরিক আদালতে তার বিচার শুরু হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দায়িত্ব গ্রহণ করেই বঙ্গবন্ধুর মুক্তির জন্য দাবি জানায়। প্রবাসী বাঙালিরা বিভিন্ন দেশের সরকারের নিকট বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা ও মুক্তির জন্য আন্দোলন করে।

১৯৭১ সালের ২ আগস্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করেন যে, ১১ আগস্ট শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার শুরু হবে। তিনি বলেন ‘শেখ মুজিবের বিচার করা হবে এবং রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে রাষ্ট্রের আইন অনুসারে তার বিচার হবে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা শুনে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্র ও জনগণ শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করেন। ১৯৭১ সালের ৭ সেপ্টেম্বর থেকে ৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিচারের নামে প্রহসন চলে। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী জাতিসংঘ ও বিশ্বের বিভিন্ন  রাষ্ট্রপ্রধানের নিকট বঙ্গবন্ধুর জীবন বাঁচানোর জন্য পত্র লেখেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যা সমাধানের জন্য বারবার পত্র লেখেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিশ্বজনমত সৃষ্টি ও শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর হতে ১২ নভেম্বর পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপ ও আমেরিকা সফর করেন। সারা বিশ্ব শেখ মুজিবের মুক্তি দাবি করে। জাতিসংঘের মহাসচিব উথান্ট বঙ্গবন্ধুর বিচারে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যে যা ঘটবে তা অবধারিতভাবেই পাকিস্তানের সীমানার বাইরেও প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে।’

বঙ্গবন্ধু সামরিক আদালতকে জানিয়ে দেন যে, তাকে বিচার করার অধিকার তাদের নেই। আমেরিকা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ছিল না, তবে তারা শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখার পক্ষে ছিল।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনার পর ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে পত্র লিখে উদ্বেগ প্রকাশ করেন।

১৯৭১ সালের ৩ নভেম্বর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে বাংলাদেশ নিয়ে আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণ রক্ষা ও মুক্তির ব্যাপারে হস্তক্ষেপ কামনা করেন।

পাকিস্তান বাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে ১৯৭১ সালের

পৃষ্ঠা: ২৯২

 

 

৩১ মার্চ করাচী নিয়ে আসে। তাকে ফয়সালাবাদ জেলে বন্দি করে রাখা হয়। জেলে তাকে সুযোগ- সুবিধা দেওয়া হয়নি। তাকে সংবাদপত্র দেওয়া হতো না। ফলে বাংলাদেশে গণহত্যা ও মুক্তিযুদ্ধ চলছে সে সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন না।

পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে তার বিচার হবে পাকিস্তান আর্মি অ্যাক্টের অধীনে। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক সিএমএলএ ফিল্ড মার্শাল কোর্টের ক্ষমতা দিয়ে গঠিত বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। কোর্টের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন বিগেডিয়ার। সদস্য ছিলেন একজন নৌবাহিনী ও একজন বাহিনীর অফিসার এবং পাঞ্জাবের একজন জেলা জজ ছিলেন। তার বিরুদ্ধে ১২টি অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনটি অভিযোগ পাকিস্তাম দণ্ডবিধির এবং অন্যান্য অভিযোগ ছিল সামরিক আইনে। অধিকাংশ অভিযোগের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। যদিও শেখ মুজিবুর রহমানের অনুমতি নিয়ে এ কে ব্রোহিকে তার আইনজীবী নিয়োগ করা হয়। কিন্তু যখন তাকে ২৬ মার্চের ইয়াহিয়া খানের দেওয়া ভাষণের টেপ শোনানো হয়, তখন বঙ্গবন্ধু আত্মপক্ষ সমর্থনের অস্বীকার করেন এবং ব্রোহিকে অব্যাহতি দেন। শেখ মুজিব বলেন, তার ভাগ্য পূর্বনির্ধারিত। শেখ মুজিবের আপত্তি সত্ত্বেও সরকার ব্রোহিকে তার আইনজীবী হিসেবে মামলা চালিয়ে যেতে বলে। সরকার ১০৫ জন সাক্ষীর তালিকা পেশ করে। মাত্র অর্ধেক সাক্ষ্য জানানো হয়। সাক্ষী ছিলেন মূলত বাঙালি অফিসারগণ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার কথা তারা স্বীকার করেন। সেনাবাহিনীর হেফাজতে থেকে পুলিশ তাদের স্বীকারোক্তি আদায় করে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর বিশেষ সামরিক আদালত জেলা জজ ব্যতীত সকল সদস্য শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় প্রদান করেন এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এ রায় কার্যকর করার জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমতি প্রয়োজন। শেখ মুজিবের বিচার সম্পর্কে কেন্দ্রের তথ্য সচিব রোয়েদাদ খান একটি ঘটনা বলেন। একদিন জেনারেল গুল হাসান প্রেসিডেন্টের নিকট শেখ মুজিবের ভবিষ্যত সম্পর্কে জানতে চান। ইয়াহিয়া খান টেবিলে ঘুরে ঘুরে প্রশ্ন করলেন, বিচার করে মৃত্যু বা বিচার ছাড়া মৃত্যু? তিনি liquidation শব্দ ব্যবহার করেন। তার অর্থ হতে পারে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। দু’জন বেসামরিকসহ কয়েকজন বলেন, তার বিচার করা হোক। জেনারেলরা তাকে বিচার ছাড়া হত্যার পক্ষে মত দেন। এ ছিল উন্মত্ততা। কয়েকজন দঃখ করে বলেন, এ বদমাইশকে (মুজিব)

পৃষ্ঠা: ২৯৩

 

 

অভিযানের প্রথম প্রহরে খতম করা উচিত ছিল। আগস্ট মাসে বিশ্ব বিষয়টি হালকাভাবে নেবে না। আমেরিকা নিশ্চয়তা আদায় করে যে, তার মৃত্যুদণ্ড হবে না। ইয়াহিয়া খান তার মতের বিরুদ্ধে শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখেন। কিন্তু তিনি অভিযোগ প্রত্যাহার বা মুক্তি দিতে নারাজ ছিলেন। যুদ্ধে যদি ইয়াহিয়া খান জয়লাভ করতেন তাহলে ইয়াহিয়া খান তাকে মৃত্যুদণ্ড দিতেন।

১৯৭১ সালের ৩১ মার্চ শেখ মুজিবকে করাচী নিয়ে আসা হয় এবং তাকে ফসসালাবাদ জেলে বন্দি করে রাখা হয়। যুদ্ধ শুরু হলে তাকে মিয়ানওয়ালী জেলে স্থানান্তর করা হয়। প্রশ্ন হলো পশ্চিম পাকিস্তানের নির্জন স্থানে কেন ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে পুনরায় আলোচনা শুরু করলেন না? বিশ্ব জনমত চাচ্ছিল তার সাথে ইয়াহিয়া খান আলোচনা করুক।

 

 

 

 

ইয়াহিয়া খানের বাঙালি উপদেষ্টা জি.ডব্লিউ. চৌধুরী বলেন, ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবের বিচারের ব্যাপারে তত আগ্রহী ছিলেন না। এমনকি বিচারকালে শেখ মুজিবের আইনজীবী এ.কে. ব্রোহীর মাধ্যমে আলোচনা শুরু করা হয় এবং এ ব্যাপারে আমেরিকার কর্মকর্তাগণ অবহিত ছিলেন। চৌধুরী বলেছেন, “ইয়াহিয়া খান মুজিবকে মুক্তি দিতে রাজি ছিলেন। কিসিঞ্জার এ বিষয়টি জানেন। কিন্তু সেপ্টেম্বর মাসে শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া বস্তুত মুখ রক্ষার জন্য অসম্ভব ছিল। জ্যাকসন বলেন, বিচারটি ছিল, A trade off to pacify the hawkish। generals before introducing various political measures.’ যুদ্ধবাজ জেনারেলদের শান্ত করার জন্য ইয়াহিয়া খানকে বিচার শুরু করতে হয়। ১৯৭০ সালের নির্বাচনের পূর্বে জেনারেলদের ঘোরতর আপত্তি সত্ত্বেও ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে অনেক ছাড় দিয়েছিলেন। পরবর্তীতে ইয়াহিয়া খানের বার বার অনুরোধ সত্ত্বেও শেখ মুজিব ইয়াহিয়া খানের সাথে আলোচনার লক্ষ্যে পশ্চিম পাকিস্তান যায়নি এবং ঢাকায় তার সাথে আলোচনাকালে ৬ দফা থেকে একটুও সরে দাঁড়াতে চাননি। এ কারণে ইয়াহিয়া খানের মধ্যে Ego বা আত্মাভিমান কাজ করে। সে কারণে যারা শেখ মুজিবকে বিশ্বাস না করতে বলেছেন তাদের নিকট তিনি অপমানিত ও হেয়প্রতিপন্ন হলেন। সর্বশেষ ২৬ মার্চের ভাষণে তিনি শেখ মুজিবকে বিশ্বাসঘাতক বলে উভয়ের মধ্যে সকল প্রকার আলোচনার দ্বার বন্ধ করে দেন। এ প্রসঙ্গে জেনারেল ওমর বলেন, As far as Mujib was concerned! the President mind was completely closed. Peerzada, who was dealing with the case, would not allow any body to meet Muto except Brohi (Who was his defense counsel). The suggestion that Yahaya wanted to negotiate with Mujib through Brohi is

পৃষ্ঠা: ২৯৪

 

not correct… But once or twice when if they had ever thought at all of any understanding with Mujub to save the situation and wanted serious negotiations with him, the President would have turned to move. But once or twice put some questions regarding Mujib, Peerzada said, ‘don’t interfere in this.’ ওমরের মতে ইয়াহিয়া খান পুনরায় শেখ মুজিবের সাথে কোনো আলোচনা করতে চাননি। তাহলে তার যুদ্ধবাজ জেনারেল পীরজাদার সাথে আলোচনা করতেন।

শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে বিচারে সামরিক জান্তার আন্তরিকতা ছিল না, তা ঠিক নয়। পাকিস্তান আর্মি এক্টের অধীনে প্রধান সামরিক আইন প্রসাশক- সিএমএলএ ফিল্ড জেনারেল কোর্টের ক্ষমতা দিয়ে বিশেষ সামরিক আদালতে বিচার করা হয়। কোর্টের চেয়ারম্যান ছিলেন একজন ব্রিগেডিয়ার। কোর্টের আরও ২ জন আর্মি অফিসার, একজন নৌবাহিনী ও একজন বিমান বাহিনী কর্মকর্তা এবং পাঞ্জাবের একজন জেলা জজ ছিলেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ১২ টি অভিযোগ আনা হয়। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তিনি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন। তিনটি অভিযোগ পাকিস্তান দণ্ডবিধির এবং অন্যান্য অভিযোগ ছিল সামরিক আইনে। অধিকাংশ অভিযোগের শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড। যদিও শেখ মুজিবের অনুমতি নিয়ে এ.কে. ব্রোহিকে তার আইনজীবী নিয়োগ করা হয়; কিন্তু শেখ মুজিবকে যখন ২৬ মার্চের ইয়াহিয়া খানের দেওয়া ভাষণের টেপ শোনানো হলো, তখন তিনি আত্মপক্ষ সমর্থনে অস্বীকার করেন এবং ব্রোহিকে অব্যাহতি দেন। শেখ মুজিব বলেন, তার ভাগ্য পূর্ব নির্ধারিত। তা সত্ত্বেও ব্রোহিকে সরকার শেখ মুজিবের পক্ষে মামলা চালিয়ে যেতে বলে। সরকার ১০৫ জন সাক্ষীর তালিকা পেশ করে। কিন্তু অর্ধেক সাক্ষীকে জানানো হয়। সাক্ষী মূলত বাঙালি সেনা কর্মকর্তাগণ। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার কথা তারা স্বীকার করে। অবশ্য সেনাবাহিনী পুলিশের হেফাজতে রেখে তাদের স্বীকারোক্তি আদায় করা হয়। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরে বিচার কাজ সমাপ্ত হয়। ৪ ডিসেম্বর বিশেষ সামরিক আদালত জেলা জজ ব্যতিত সকল সদস্য মুজিবের বিরুদ্ধে আনিত আভযোগ প্রমাণিত হয়েছে বলে রায় প্রদান করে এবং তাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়। এ রায় কার্যকর করার জন্য প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের অনুমতি প্রয়োজন হবে।

শেখ মুজিবের ভাগ্য সম্পর্কে কেন্দ্রিয় তথ্য সচিব রোয়েদান খান একটি ঘটনার উল্লেখ করেন। রাওয়ালপিণ্ডির সেনাবাহিনীর জিএইচকিউতে নিয়মিত

পৃষ্ঠা: ২৯৫

 

 

সভা হতো। এক সভায় জেনারেল গুল হাসান প্রেসিডেন্টের নিকট শেখ মুজিবের ভবিষ্যত সম্পর্কে রাখেন। ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় সে সম্পর্কে একটি প্রশ্ন জেনারেলদের নিকট জানতে চায়। ইয়াহিয়া খান টেবিলের বাম দিকে ঘুরে প্রত্যেককে মুজিব সম্পর্কে মতামত ব্যক্ত করতে বলেন। তিনি প্রত্যেককে প্রশ্ন করলেন- বিচার করে মৃত্যু, না বিচার ছাড়া মৃত্যু। তিনি Liquidation শব্দ ব্যবহার করেন। তার অর্থ হতে পারে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যু। দুজন বেসামরিক সদস্যসহ কয়েকজন  সদস্য বলেন তার বিচার করা হোক। জেনারেল গুল হাসানসহ অন্য জেনারেলরা বিচার ছাড়াই তার হত্যার পক্ষে মত দেয়। এটা ছিল উন্মাদনার বিষয়। সরকারের অনেক দায়িত্বশীল ব্যক্তি দুঃখ প্রকাশ করে বলেন যে, সেনা অভিযানের প্রথম প্রহরে এ শয়তানকে (মুজিব) খতম করা উচিত ছিল। আগস্ট মাসে বিশ্ব শেখ মুজিবের বিষয়টি হাল্কাভাবে গ্রহণ করবে না। আমেরিকা দাবি করে এবং নিশ্চয়তা পেলেন যে, শেখ মুজিবকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হবে না। ইয়াহিয়া খান তার মতের বিরুদ্ধে বাধ্য হয়ে শেখ মুজিবকে বাঁচিয়ে রাখলেন। কিন্তু তিনি তার অভিযোগ প্রত্যাহার বা মুক্তি দিতে সম্মত হননি। যদি যুদ্ধে তিনি জয় লাভ করতেন; ইয়াহিয়া ক্ষমতায় টিকে থাকতেন; তাহলে তিনি অবশ্যই তাকে শাস্তি দিতেন।

 

ঝ. প্রবাসী বাঙালি, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিক সমাজের ভূমিকা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে ব্রিটেন, আমেরিকা, ভারত, কানাডা. জার্মানি, ফ্রান্স, জাপানসহ বিশ্বের সকল প্রবাসী বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে এগিয়ে আসে। তারা রাতের ঘুম, দিনের সুখ বিসর্জন দিয়ে বিদেশের মাটিতে বসে স্বাধীন বাংলার মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ে। মনে হতো তারা বাংলার মাটিতে থেকে যুদ্ধ করছে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। প্রবাসীরা বিদেশে থেকে আন্দোলন, মিছিল করেছে, গণহত্যার তীব্র প্রতিবাদ করেছে, বিদেশি সরকারগুলোকে বাংলাদেশকে সহায়তা ও স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য অবিরাম দাবি জানাতে থাকে। তারা অর্থ সংগ্রহ করে মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্রের যোগান দিয়েছে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর জন্য ত্রাণ প্রেরণ করেছে। বিদেশে চাকরিজীবী অধিকাংশ বাঙালিকে পাকিস্তানের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় এগিয়ে আসে। তাদের নিয়ে লন্ডন ও নিউইয়র্কে বাংলাদেশ দূতাবাস প্রতিষ্ঠা করা হয়।

পৃষ্ঠা: ২৯৬

 

 

লন্ডনে প্রবাসীদের ভূমিকা

১৯৭১ সালে লন্ডনে প্রায় এক লক্ষ ত্রিশ হাজার বাঙালি বাস করত। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে প্রবাসী বাঙালিরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ব্রিটিশ সরকার, লন্ডনে অবস্থিত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, ব্রিটিশ সাংবাদিক, বিবিসি ও ইংরেজ জাতিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য দীর্ঘ নয় মাস অবিরাম প্রচেষ্টা চালিয়েছে। বস্তুত ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে প্রবাসী বাঙালিদের অবদান ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।

জেনারেল আইয়ুব খানের সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে লন্ডনে বাঙালিরা ১৯৬০ সাল থেকে আন্দোলন শুরু করে। একদল বাঙালি তরুণের উদ্যোগে ১৯৬২ সাল থেকে ইস্ট পাকিস্তান হাউজ প্রতিষ্ঠিত হয়। ইস্ট পাকিস্তান হাউজে বাঙালি ছাত্রদের  আশ্রয়স্থল ছিল। একই সালে তারা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা করে। ১৯৬২ সালে তারা স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার চিন্তাভাবনা করে। উনসত্তরের গণআন্দোলনকে কেন্দ্র করে লন্ডনে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের নির্দেশে ১৯৭০ সালে লন্ডনে আওয়ামী লীগ কমিটি গঠন করা হয়। দলের সভাপতি ছিলেন গাউস খান এবং সম্পাদক ছিলেন সুলতান মাহমুদ শরীফ। ১৯৬৯ ও ১৯৭০ সালে বঙ্গবন্ধু লন্ডন গমন করেন এবং তার আহ্বানে লন্ডনে আওয়ামী লীগ শক্তিশালী হতে থাকে। লন্ডনে ভাসানী ন্যাপ ও মোজাফফর ন্যাপের শাখা ছিল। এ ছাড়া লন্ডনে বাঙালিদের অনেকগুলো সংগঠন ছিল। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে লন্ডনের সকল সংগঠন একত্রিত হয়ে বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয়। অ্যাকশন কমিটির স্টিয়ারিং কমিটি ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা আন্দোলন পরিচালনা করেন।

১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর বাঙালিদের প্রতি মুসলিম লীগ সরকারের বৈষম্যমূলক আচরণ ও শোষণের ফলে পূর্ব পাকিস্তান বিরোধী দল শক্তিশালী হয়। ১৯৫২-এর আন্দোলনের পথ ধরে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলন চলতে থাকে। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় লাভ করে। পরবর্তীতে যুক্তফ্রন্ট মুসলিম লীগের প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের শিকার হতে থাকে। লন্ডনে মওলানা ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিবুর রহমানের আগমনকে কেন্দ্র করে লন্ডনে বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হতে থাকে। এ সময় লন্ডনে আব্দুল মান্নান, মিনহাজ উদ্দিন, হরমুজ আলী, আইয়ুব আলী প্রমুখ নেতৃত্ব দেন। আব্দুল মান্নান ছিলেন গ্রীন মাস্ক রেস্তোরার মালিক। নেতৃবৃন্দ তার অভ্যর্থনা লাভ করেন। প্রবাসী পাকিস্তান ছাত্ররা ষাটের দশকের প্রথম দিকে ছাত্র ফেডারেশনের এবং প্রবাসীরা পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন গঠন করেন। প্রবাসী বাঙালিরা উভয়

পৃষ্ঠা: ২৯৭ 

 

 

সংগঠনের নেতৃত্ব দখল করে। মাহমুদুর রহমান, আমিরুল ইসলাম, শরফুল ইসলাম খান, সুবিদ আলী টিপু, একরামুল হক প্রমুখ বাঙালি ছাত্র ফেডারেশনের সভাপতি পদ দখল করেন। বাঙালিদের দাবি আদায়ের আন্দোলনে পাকিস্তান ওয়েলফেয়ার এসোসিয়েশন অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

১৯৬২ সালে লন্ডনে হাইবারি এলাকায় পূর্ব পাকিস্তান ভবন প্রতিষ্ঠিত হয়। এ প্রতিষ্ঠান বাঙালিদের লন্ডনভিত্তিক রাজনীতির কেন্দে পরিণত হয়। লন্ডনে ছাত্রলীগের শাখা ও পৃথক যুব ফেডারেশন ছিল। যুব ফেডাবেশনের সভাপতি ছিলেন বরিশালের সুলতান মাহমুদ শরীফ। ছাত্র ফেডারেশনে সভাপতি সুবিদ আলী টিপু এবং যুব ফেডারেশনের পরবর্তী প্রেসিডেন্ট আফতাব উদ্দিন শাহ বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করেন।

১৯৬৮ সালে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার বিরুদ্ধে এবং শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির দাবিতে প্রবাসী বাঙালিরা হাইড পার্কে সমবেত হয়। ১৯৬৯ সালে আন্দোলনের ফলে প্রবাসীরা পাকিস্তান হাইকমিশন অফিস দখল করে। সুলতান মাহমুদ শরীফ হাইকমিশন অফিসের পাকিস্তানি পতাকা সরিয়ে ফেলে কালো পতাকা উত্তোলন করেন। এই কালো পতাকার ফটো ও প্রতিবাদ মিছিলের ছবি ১৯৬৯ সালের ৩ ফেব্রুয়ারি দি টাইমস পত্রিকায় ছাপানো হয়। আগরতলা মামলা পরিচালনার জন্য তহবিল খোলা হয়। তাদের অর্থে শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষে মামলা পরিচালনার জন্য কুইন্স কাউন্সিল ও শ্রমিকদলীয় পার্লামেন্ট সদস্য স্যার টমাস উইলিয়ামসকে ঢাকায় প্রেরণ করা হয়।

আগরতলা মামলা থেকে মুক্তি পাওয়ার পর ১৯৬৯ সালের ২৬ অক্টোবর শেখ মুজিবুর রহমান লন্ডন আসেন। এখানে তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য গাউস খানকে সভাপতি করে একটি কমিটি করা হয়। ৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু লন্ডন ত্যাগ করার পর গাউস খানকে সভাপতি এবং বিএইচ তালুকদারকে সম্পাদক করে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগ গঠন করা হয়। ১৯৭০ সালে মিনহাজউদ্দিনকে সভাপতি এবং সুলতান মাহমুদ শরীফকে যুক্তরাজ্য আওয়ামী লীগের সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৭১ সালের মার্চের অসহযোগ আন্দোলনকালে প্রবাসী বাঙালিরা একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলন শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী বাঙালিদের আক্রমণ করে এবং গণহত্যা শুরু করে। লন্ডনের সকল পত্রিকায় ঢাকার গণহত্যার সংবাদ প্রকাশিত হয়। ২৭ মার্চ দি টাইমস, দি গার্ডিয়ান পত্রিকায় পাকবাহিনীর আক্রমণ ও শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ গুরুত্ব সহকারে প্রকাশিত হয়। ২৮ মার্চ আওয়ামী লীগের উদ্যোগে লন্ডনের ট্রাফালগার স্কোয়ারে প্রবাসীদের এক বিরাট সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় গাউস খান

পৃষ্ঠা: ২৯৮

 

 

আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। ২৮ মার্চ লেডবেরি রোডে জেবুন্নেসা বখতের বাড়িতে তাকে সভাপতি করে লন্ডন মহিলা সমিতি গঠন করা হয়। সমিতির নেতৃস্থানীয় ছিলেন লুলু বিলকিস, ফেরদৌসী রহনান (শিল্পী), আনোয়ারা জাহান, মুন্নী রহমান প্রমুখ। লন্ডনে লক্ষাধিক বাঙালি স্বাধীনতা সংগ্রামে সদা প্রস্তুত। কিন্তু তাদের মধ্যে ছিল একাধিক সংগঠন। ঐক্যের অভাব। এ সময় লন্ডনে এসেছিলেন ঢাকা হাইকোর্টের বিচারপতি ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী। তার নেতৃত্বে লন্ডন প্রবাসী বাঙালিরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে পাকহানাদার বাহিনীর আক্রমণের প্রতিবাদে প্রচণ্ড আন্দোলন অব্যাহত রাখে। তারা অর্থ ও অস্ত্র দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্মেলনে যোগ দেওয়ার জন্য সুইজারল্যান্ডের রাজধানী জেনেভায় ছিলেন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সকালে বিবিসির সংবাদ শুনে স্তম্ভিত হলেন। তিনি সম্মেলন থেকে বিদায় নিয়ে ২৬ মার্চ বিমানে লন্ডন পৌছেন। লন্ডনে তার স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ছিলেন। ইতোপূর্বে তিনি ১৫ মার্চ ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর পদ ত্যাগ করেন। আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে পৌছার কিছুক্ষণ পর সুলতান মাহমুদ শরীফ কয়েকজন বাঙালিসহ তার সাথে দেখা করেন এবং লন্ডনের পরিস্থিতি অবহিত করেন।

২৭ মার্চ লন্ডনে প্রকাশিত প্রায় সব সংবাদপত্রে বঙ্গবন্ধুর ছবি ছাপা হয়। সকালে বিচারপতি চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা সাদারল্যান্ডের সাথে দেখা করেন। ২৭ মার্চ বিকেলে তার সাথে শিল্পী আব্দুর রউফ, মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু, আব্দুল হাকিম, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, মোশাররফ হোসেন জোয়ারদারের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।

৩০ মার্চ বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ভাইস চ্যান্সেলরের সাথে ৬ এপ্রিল তিনি ইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসির সাথে, এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কমনওয়েলথের সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথের সাথে দেখা করে দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করেন।

তিনি জনমত সম্পাদক ছাত্রনেতা ওয়ালী আশরাফ, ছাত্রনেতা মোশাররফ হোসেন, মানিক চৌধুরী, রাজিউল হাসান রঞ্জ, এনামুল হক প্রমুখের সাথে কর্মপদ্ধতি নিয়ে আলোচনা করেন।

৩০ মার্চ ডেইলি টেলিগ্রাফে সাংবাদিক সায়মন ড্রিংয়ের ঢাকা থেকে ২৫ মার্চের পাকবাহিনীর পৈশাচিক হত্যাকাণ্ডের সংবাদ প্রকাশ করা হয়। এই প্রথম

পৃষ্ঠা: ২৯৯

 

 

একজন সাংবাদিকের প্রত্যক্ষ বিবরণ দেখে প্রবাসীরা ভেঙে পড়েন। ২৫ মার্চ সায়মন ড্রিং ঢাকার হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ছিলেন। তিনি কিছু ধ্বংসলীলার ছবি তোলেন। সামরিক সরকার সকল বিদেশি সাংবাদিককে ঢাকা থেক্র বিতাড়িত করে। সায়মন ড্রিংয়ের বিবরণ প্রবাসীরা প্রচার করে বিদেশি সরকার ও প্রায় জনগণের সহানুভূতি লাভ করে।

এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী স্যার আলেক ডগলাস হিউমের সাথে দেখা করে আবু সাঈদ বঙ্গবন্ধুর মুক্তিও বাংলাদেশের রক্তক্ষয় বন্ধের অনুরোধ জানান। তিনি বিবিসিতে বাংলাদেশের ওপর সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। সিরাজর রহমান ও শ্যামল লোথ তার সাক্ষাৎকার গ্রহণ করে তা প্রচার করে। এ সময় অবরুদ্ধ বাঙালিরা বিবিসি সংবাদ শোনার জন্য প্রতিদিন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করতো।

বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানি দূতাবাসে কর্মরত বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীগণ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সাহসী অবদান রেখেছে। তারা অনেকে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে প্রত্যক্ষ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯৭১ সালের ৬ এপ্রিল দিল্লিতে অবস্থিত পাকিস্তানি দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব মোহাম্মদ শিহাবউদ্দিন এবং প্রেস এটাচি আমজাদুল হক পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেন।

এপ্রিলের দ্বিতীয় সপ্তাহে কলকাতা থেকে ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম এমএনএ আবু সাঈদ চৌধুরীকে ফোন করে বলেন, শীঘ্রই বাংলাদেশ সরকার গঠিত হবে; ভাবি প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাকে বিদেশে বিশেষ প্রতিনিধি নিযুক্ত করতে চান। তিনি সম্মত হলেন। এ সময়ই পাকিস্তান সরকার আবু সাঈদ চৌধুরীকে অপহরণ করে পাকিস্তানে নিয়ে যেতে অথবা জীবননাশ করার উদ্যোগ গ্রহণ করে। ব্রিটিশ নিরাপত্তা বিভাগ এ ষড়যন্ত্রের আভাস পেয়ে তার নিরাপত্তার ব্যবস্থা করে। তিনি কয়েকজন বাঙালি নেতা নিয়ে প্রায়ই ব্রিটিশ পার্লামেন্ট হাউজে যেতেন এবং পার্লামেন্ট সদস্য পিটার শোর, স্টোন হাউজ, লর্ড সেলকারক, ফ্রেস জন ডগলাসম্যান, মাইকেল বার্নসের সাথে ঘনিষ্ঠতা হয়। তারা বাংলাদেশ বিষয়টি সমর্থন করেন।

তিনি ১৫ এপ্রিল লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগ নেতা গাউস খান, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হোসেন, শেখ আব্দুল মান্নান, ড. হারুন, আমির আলী এবং অন্যান্য দলের নেতৃবৃন্দের সাথে আলোচনা করেন। তিনি কোনো দলে যোগদান না করে সকলকে একত্রিত করার চেষ্টা করেন। ১৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয় এবং ২১ এপ্রিল বাংলাদেশ

পৃষ্ঠা: ৩০০

 

 

সরকার আবু সাঈদ চৌধুরীকে বহির্বিশ্বের প্রতিনিধি নিয়োগ করে। ২৩ এপ্রিল কভেন্ট্রির সভায় রকিব উদ্দিন তাকে নিয়োগপত্র প্রদান করেন। ২৪ এপ্রিল লন্ডনে কভেন্ট্রি শহরে সকল দলের মিলিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন শেরে বাংলা এ.কে. ফজলুল হকের নাতনি ঢাকার বিখ্যাত বুদ্ধিজীবী সৈয়দ তৈফুরের কন্যা বেগম লুলু বিলকিস বানু। তিনি ইংল্যান্ডে বাস করেন এবং একটি স্কুলের শিক্ষয়িত্রী। চলিশের দশকে তিনি পাকিস্তান আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। সে যুগে মুসলিম নারীদের মধ্যে যারা রাজনীতিতে এগিয়ে এসেছেন তাদের মধ্যে লুলু বিলকিস অন্যতম। এ মহীয়সী নারী আজ আমাদের মাঝে বেঁচে নেয়। তিনি ইংরেজি ও বাংলায় সুবক্তা ছিলেন। তার সভাপতিত্ব কভেন্ট্রির সভায় যুক্তরাজ্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটি গঠন করা হয় এবং সংগ্রাম পরিচালনার জন্য ৫ সদস্যবিশিষ্ট একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির সদস্যরা হলেন: আজিজুল হক ভুইয়া, কবীর চৌধুরী, মনোয়ার হোসেন, শেখ আব্দুল মান্নান এবং শামসুল রাহমান। ২৫ এপ্রিল লন্ডনে স্টিয়ারিং কমিটির শাখা গঠিত হয়। কমিটির সদস্যগণ ছিলেন- গাউস খান-সভাপতি মিনহাজ উদ্দিন-সহসভাপতি, ব্যারিস্টার সাখাওয়াত হোসেন- সাধারণ সম্পাদক।

লন্ডনে স্বাধীনতা সংগ্রামে আরও যারা নেতৃত্ব দেন তারা হলেন- ডা. মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার, জাকারিয়া চৌধুরী, সুলতান শরীফ, শেখ মকসুদ আলী, মুসাব্বির তরফদার, আব্দুস সোবহান মাস্টার, আব্দুল কাদের, বদরুজ্জামান, ডা. শামসুদ্দিন, মাহমুদুল হক, মীর্জা লুৎফর রহমান, এ.কে.এম এনায়েত উল্লাহ প্রমুখ। ১৪ মে হাউজ অব কমন্সে একটি পূর্ণাঙ্গ আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। জন স্টোন হাউজ, পিটার শোর, ব্রুস ডগলাসম্যান বাংলাদেশকে সমর্থন করার জন্য রক্ষণশীল দলের সরকারের প্রতি চাপ প্রয়োগ করেন এবং পাকিস্তানের সকল সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড বন্ধের আবেদন জানান। তখন এডওয়ার্ড হীথ ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী। এ সময় আবু সাঈদ চৌধুরী অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন এপনালসের সাথে দেখা করেন।

 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন

১৯৭১ সালে জুন মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সোলায়মান করাচী থেকে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারকে সমর্থন দেওয়ার ফলে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হয় এবং আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা মর্মাহত হন। এ

পৃষ্ঠা: ৩০১

 

 

সময় রাশেদ সোহরাওয়ার্দী বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন জানিয়ে মুজিবনগর সরকারের নিকট পত্র লেখেন। মুক্তিযুদ্ধকালে তার ভূমিকা মুক্তিযোদ্ধা ও মজিবনগর সরকারকে অনুপ্রাণিত করে। লন্ডনপ্রবাসী বাঙালিদের সাথে রাশেদ সোহরাওয়ার্দী স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন।

‘পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর গণহত্যার সংবাদ শোনার সাথে সাথে আমি বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামকে পূর্ণ সমর্থন ও সহানুভূতি দিয়েছি। আমি রাজনীতিতে নেই। তাই ব্যক্তিগতভাবে আমার বক্তব্য দেওয়া প্রয়োজন ছিল না। যেহেতু আমার পরিবারের একজন সদস্যের সাম্প্রতিক বিবৃতির সঙ্গে আমার শ্রদ্ধেয় পিতার হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাবমূর্তি এবং স্মৃতি বিনষ্ট হচ্ছে দেখে আমার জন্য বিবৃতি দেওয়া জরুরী হয়ে পড়েছে।

আমি দ্ব্যর্থহীন ভাষায় বলতে চাই যে, আমি বাংলাদেশের জনগযণের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিজয় কামনা করছি। বিগত ২৪ বছর ধরে পশ্চিম পাকিস্তান তাদের অর্থনৈতিকভাবে শোষণ এবং রাজনৈতিকভাবে শাসন করেছে এবং পশ্চিম পাকিস্তান সেনাবাহিনী যে গণহত্যা এবং অন্যান্য জঘন্য অপরাধ করেছে বা করে, তার প্রতিহত করার জন্য তারা অস্ত্র ধরতে বাধ্য হয়েছে। আমার মনে কোনো সন্দেহ নেই যে, দুঃসাহসী মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণকারী সেনাবাহিনীকে বিতাড়িত করে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন করতে সফল হবে। একটি স্বাধীন সার্বভৌম দেশে সকল ধর্মের এবং সকল রাজনৈতিক দলের মানুষ শান্তিতে এবং মিলেমিশে বাস করছে তা দেখার জন্য অদূর ভবিষ্যতে বাংলাদেশে যাওয়ার জন্য আমি গভীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি।’

 

আমেরিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন

 আমেরিকায় বিভিন্ন অঙ্গরাজ্য ও শহরে বসবাসরত বাঙালিরা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পূর্বে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের জন্য আন্দোলন করেছে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের ভয়াল রাতের পর থেকে তারা বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি আস্থা রেখে স্বাধীনা সংগ্রাম শুরু করে। তারা মার্কিন কংগ্রেস ও সিনেট সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশে পাকিস্তানিদের গণহত্যার চিত্র তুলে ধরেন। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধবিরোধী হলেও আমেরিকার জনগণ বাংলাদেশের স্বাধীনতা দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। আগে থেকে নিউইয়র্কে বাঙালিদের পূর্ব পাকিস্তান লীগ অব আমেরিকা নামে প্রতিষ্ঠান ছিল। সংগঠনের প্রেসিডেন্ট ছিলেন কাজী শামসুদ্দিন আহমদ। মুজিবনগর সরকারের নির্দেশ ছিল তারা বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীরর নির্দেশে কাজ করবেন। বাংলাদেশ

পৃষ্ঠা: ৩০২

 

 

আন্দোলনে আমেরিকায় অবস্থানরত বাঙালিদের মধ্যে ছিলেন: এফ আর খান (ফজলুর রহমান খান বিশ্বখ্যাত স্থপতি), ড. মোহাম্মদ ইউনূস, কে এস আলমগীর এবং তার স্ত্রী ডা. রোকেয়া, প্রকৌশলী মাহবুবুল আলম এবং তার স্ত্রী সালমা আলম,  ডা. ফজলে বারী মালিক, ডা. রেজাউর রহমান, প্রকৌশলী কাজী রেজাউল হাসান, মাহবুব হোসেন, ফররুকুল ইসলাম, কাজী শহীদুল হাসান ছাত্রনেতা এএকেএম হোসেন, আব্দুল মান্নান, শিকাগোর মোজাম্মেল হক শহীদুল আলম খোরশেদ, প্রকৌশলী রেজাউল করিম ভুইয়া, আমিনুল ইসলাম, ছাত্রনেতা মবিন উদ্দীন, ডা. এম আহমেদ প্রমুখ। তারা নিজেদের অর্থ, শ্রম ব্যয় করেছেন। বাংলাদেশ ও মানষের মুক্তি সংগ্রামে তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের ফলে কংগ্রেস, সিনেটের অনেক সদস্য ও আমেরিকার জনগণ বাংলাদেশ প্রশ্নে এগিয়ে আসেন। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি আমেরিকার নিক্সন প্রশাসনের বিরুদ্ধে প্রকাশে বিদ্রোহ করেন। তিনি মার্কিন সরকারের পাকিস্তান সমর্থন করার জন্য কঠোর সমালোচনা করেন। তিনি অবিলম্বে পাকিস্তানে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করার আহ্বান জানান। তিনি ভারতে এসে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে লক্ষ লক্ষ মানুষের অবর্ণনীয় দুর্দশা দেখে যান। ১৯৭১ সালে তার ভূমিকা বাংলাদেশের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।

আমেরিকায় অবস্থানরত ভারতীয় প্রবাসীরা বাংলাদেশের আন্দোলন সমর্থন করে সাহায্য-সহযোগিতা করেন। বিখ্যাত শিল্পী রবি শংকর আমেরিকার জন হ্যারিসন কনসার্ট পরিবেশন করে অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশকে সহায়তা করেছেন।

কৃটনৈতিক মাহমুদ আলী ২১ এপ্রিল বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। আমেরিকার পাকিস্তান দূতাবাসের কর্মকর্তা এএমএ মুহিত, হারুন অর রশীদ ২৫ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশ আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তারা আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ না করে পরোক্ষে সর্বপ্রকার সহযোগিতা করতে থাকেন। আগস্ট মাসে তারা ঘোষণা দিয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

মুজিবনগর সরকারের নির্দেশে বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭১ সালের ২৪ মে নিউইয়র্কে আগমন করেন। তার সাথে ছিলেন এনামুল হক (পরে ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন এবং জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক হয়েছিলেন)। বিমানবন্দরে কূটনীতিবিদ মাহমুদ আলীসহ অনেক বাঙালি তাকে অভ্যর্থনা জানান। ২৫ মে শিকাগো থেকে বিখ্যাত আর্কিটেক্ট ফজলুর রহমান খান (এফআর খান) হোটেলে তার সাথে সাক্ষাৎ করে কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করেন।

পৃষ্ঠা: ৩০৩

 

 

ইতোপূর্বে তিনি লন্ডন গিয়ে আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করে এসেছেন। এফ আর খান একটি বিমানে শিকাগো থেকে আসতেন এবং নিউইয়র্কে তার সব আলোচনা শেষ করে আবার ফিরে যেতেন। তিনি আমেরিকায় বিভিন্ন রাজ্যের বসবাসরত বাঙালিদের সাথে যোগাযোগ করতেন। মূলত তিনি প্রধান সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করতেন। জনাব চৌধুরী রাষ্ট্রদূতের সাথে আলোচনা করে তাকে বাংলাদেশ সমস্যা বোঝাতেন। নিউইয়র্কে বসবাসরত বাঙালিরা পাকিস্তানের কনসাল জেনারেলের অফিসটি দখল করে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এবং তারা সে অফিসে অবস্থান নেয়। কসনাল জেনারেল বাঙালি হলেও তিনি বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা না করায় পুলিশ অফিসটি পাকিস্তানের বলে গণ্য করে। বিচারপতি চৌধুরী নিউইয়র্কে কর্মব্যস্ত দিনগুলো কাটিয়ে ২৯ মে লন্ডন পৌঁছেন।

 

The Concert for Bangladesh

১৯৭১ সালের ১ আগস্ট নিউইয়র্ক ম্যাডিসন স্কোয়ার গার্ডেনে এক অবিস্মরনী, সঙ্গীতসন্ধ্যা অনুষ্ঠিত হয়। বব ডিলান, রিঙ্গো স্টার, রবিশঙ্কর, বিলি প্রেস্টল লিওন রাসেল, এরিখ ক্লাপ্টনসহ ৭৫ জন বিদেশি শিল্পীর সমন্বয়ের ‘The Concert for Bangladesh’ নামক এই অনুষ্ঠান থেকে উদ্যোক্তরা ২৪,৩৪,১৮৫ মার্কিন ডলার অর্থ সংগ্রহ করে বাংলাদেশের তহবিলে দান করেন। জনবেজ লিখেছেন একটি হৃদয় নিংড়ানো সঙ্গীতালেখ্য।

Bangladesh, Bangladesh, Bangladesh, Bangladesh

when the sun sinks in the west die a million people of Bangladesh…

সূর্য অস্ত যায় পশ্চিম আকাশে। বাংলাদেশের লক্ষ মানুষের চিতা জ্বলে।

আরেক শিল্পী George Harrison নিজের সুরে গেয়ে ওঠেন-

My Friend came to me…

…..………………………………….

We get to release Bangladesh

Now Please let your hand

Please the people of Bangladesh…

এ গানগুলো মূলে ছিল বাংলাদেশ ও শেখ মুজিব।

৩০ মার্চ শ্রদ্ধেয় নেতা আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে ম্যানচেস্টারে সভা অনুষ্ঠিত

পৃষ্ঠা: ৩০৪

 

 

হয়। তাকে সহায়তা করেন ম্যানচেস্টারে অবস্থানরত বাঙালি  ছাত্রদের সভাপতি মহিউদ্দিন আহমেদ। সভায় বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী বিস্তারিত ভাষণ দেন। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চে ভাষণ বাজিয়ে শোনানো হয়। বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্র প্রেরণের বিষয়টি আলোচনার জন্য স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভুঁইয়াকে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের নিকট প্রেরণ করা হয়। এ সময় ভারতের সর্বদলীয় নেতা জয় প্রকাশ নারায়ণ লন্ডনে আগমন করেন এবং বিচারপতি আবু সাঈদের সাথে আলোচনা করেন। এরপর নেতৃবৃন্দ লীডিসে সভা করেন। লীডসের বাংলাদেশ এসোসিয়েশনের সভাপতি ছিলেন মিয়া মোহাম্মদ মোস্তাফিজুর রহমান। লীডসে বাঙালিরা জয়বাংলা নামে একটি পত্রিকা বের করে। এখানের বাঙালি মহিলারাও আন্দোলনের যোগ দেয়।

লন্ডনস্থ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি বাংলাদেশ আন্দোলনে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত আন্তরিকতার সাথে সংগ্রাম চালিয়ে গেছেন। এই প্রতিষ্ঠানই ইস্ট পাকিস্তান হাউজ প্রতিষ্ঠা করে। বিভিন্ন সময় এর নেতৃত্বে ছিলেন আমীর-উল-ইসলাম, সুলতান শরীফ, এটিএম ওয়ালী আশরাফ, বাদল রসিদ, আলমগীর কবির, মওদুদ আহমদ,  মিনহাজ উদ্দিন আহমেদ, শেখ আব্দুল মান্নান, আমির আলী, জাকারিয়া চৌধুরী, জগলুল হোসেন, তোজাম্মেল হক, সুরাইয়া খানম, মানিক চৌধুরী, আমিনুল হক, খন্দকার মোশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ ইসহাক, একরামুল হকসহ অনেকে। তারা লন্ডনে বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করেছেন। লন্ডনে বাঙালিদের নেতা সুলতান শরীফের সাথে আবু সাঈদ চৌধুরীর মার্চ মাসের মাঝামাঝি প্রথম সাক্ষাৎ হয়। তার কাছে তিনি লন্ডনের পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে পারেন।

মুজিবনগর সরকার থেকে মাওলানা ভাসানীর দস্তখত করা কয়েকটি চিঠি আবু সাঈদ চৌধুরীর কাছে প্রেরণ করা হয়। তিনি চিঠিগুলো মাও সে-তুঙ, চৌ এন লাই, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।

 একুশে জুন আবু সাঈদ চৌধুরী নেদারল্যান্ডস গমন করেন এবং আমস্টারডামে বাঙালিদের সাথে আলোচনা করে ২৩ জুন তিনি লন্ডনে ফিরে আসেন। স্টিয়ারিং কমিটির সভায় বাংলাদেশ টুডে নামে একটি সাপ্তাহিক ইংরেজি বুলেটিন প্রকাশ করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। লন্ডনে বেজ ওয়াটার অঞ্চলে বাঙালিদের সভায় লেবার পার্টি ও নিজের পক্ষ থেকে পিটার শোর বাঙালিদের আন্দোলনে পূর্ণ সহানুভূতি জ্ঞাপন করেন। ১৬ জুলাই বাঙালিরা চীনা দূতাবাসের সামনের বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।

১৯৭১ সালের ৬ আগস্ট আবু সাঈদ চৌধুরী জেনেভা গমন করেন এবং

পৃষ্ঠা: ৩০৫

 

 

সেখানে তিনি বঙ্গবন্ধু নিরাপত্তা নিয়ে আইসিআরসির প্রধান কার্যালয়ের সাথে আলোচনা করেন।

বঙ্গবন্ধু পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে দুঃসহ বন্দি জীবন যাপন করছেন। শোনা যাচ্ছে সামরিক আদালতে বিচার হবে। জুলাই মাসের শেষের দিকে বাঙালিরা আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইনজীবী শোন ম্যাট ব্রাইডকে পাকিস্তান প্রেরণ করে। তার সাথে আরও একজন সলিসিটর ছিলেন। তারা ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া খানের আইন উপদেষ্টা কর্নেলিয়াসের সাথে দেখা করেন। কর্নেলিয়াস তাদের জানিয়ে দেন যে, কোনো বিদেশি শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ বা পক্ষ অবলম্বন করতে পারবে না। তিনি কয়েকদিন পর লন্ডন ফিরে আসেন। ১১ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রতিবাদে লন্ডনে হাইড পার্কে এক বিরাট সভা হয়। সভাশেষে এক বিরাট শোভাযাত্রা দশ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে যায়। ১২ আগস্ট টাইমস পত্রিকায় এক সম্পাদকীয়তে শেখ মুজিবের তথাকথিত বিচার করা হয়।

লন্ডনে স্বাধীনতা আন্দোলনের পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু কোনো ব্যাংক বাংলাদেশ ফান্ড নামে একাউন্ট খুলতে রাজি হয়নি। পরিশেষে গোরিং স্ট্রিটে হ্যামব্রুজ ব্যাংক একাউন্ট খুলতে রাজি হয়। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী, ইংরেজি স্টোন হাউজ ও ডোনাল্ড চেজওয়ার্থকে ট্রাস্টি বোর্ডের করা হয়। একাউন্ট খোলার পর বিভিন্ন শহরে কমিটিগুলো অর্থ জমা দিতে থাকে। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন কমিটির কাছে ১ লক্ষ পাউন্ড পাওনা ছিল। অবশ্য পরে তারা এ অর্থ জমা দেয় এবং তা বাংলাদেশ সরকারকে প্রদান করা হয়। এ ফান্ডের মোট ৪ লক্ষ ১২ হাজার ৮৩ পাউন্ড বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রণালয়ের জমা দেওয়া হয়। স্বাধীনতার পর এ টাকাই ছিল সরকারের প্রথম বৈদেশিক মুদ্রা। বাংলাদেশ ফান্ড নিয়ে ১৯৭৪ সালে স্টোন হাউজের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনি বাংলাদেশ ফান্ডের কোনো অর্থ আত্মসাত করেননি। অন্য একটি বিষয়ে স্টোন হাউজ অভিযুক্ত হয়েছিলেন।

আগস্ট মাসে ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে বাঙালি কর্মকর্তা এএমএ  মুহিত, এসএ করিম, এনায়েত করিম, এসএমএ কিবরিয়া, এআর চৌধুরী, আবু রুশদ, মতিন উদ্দিন, এসএম আলী প্রমুখ পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন।

ইংল্যান্ডে ইংরেজ তরুণ-তরুণীরা গঠন করলেন ‘অ্যাকশন বাংলাদেশ’। এ কমিটির প্রধান ছিলেন পল কনেট। ১ আগস্ট একশন বাংলা কমিটির উদ্যোগে ট্রাফালগার স্কোয়ারে এক বিরাট জনসমাবেশ হয়। এ সভায় পাকিস্তান দূতাবাসের

পৃষ্ঠা: ৩০৬

 

 

দ্বিতীয় সচিব মহিউদ্দিন আহমদ পাকিস্তানের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য  প্রকাশ করেন। এ খবর শুনে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ তাকে শুভেচ্ছা জানালেন। এ সভায় ভারতের আশোক সেন, ব্রুস ডগলাসম্যান, পিটার শোর, জন স্টোন হাউজ, লুলু  বিলকিস জোরালো ভাষায় বক্তৃতা দেন।

 

লন্ডনে মহিলা সমিতি

বাংলাদেশে ২৫ মার্চের পর থেকে গণহত্যা, নারী নির্যাতনের প্রতিবাদে এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে আন্দোলন পরিচালনার জন্য ইংল্যান্ডে বসবাসরত বাঙালি নারীরা মহিলা সমিতি গঠন করে। ২৮ মার্চ লেডবেরি রোডে জেবুন্নেসা বখতের বাড়িতে মহিলারা সমবেত হয়ে মহিলা সমিতি গঠন করে। সভাপতিও হলেন জেবুন্নেসা বখত।   সমিতির সদস্যদের মধ্যে ছিলেন: ফেরদৌসী রহমাম, আনোয়ারা জাহান, মুন্নী রহমান, সবিতা চৌধুরী, কুলসুম উল্লাহ, তাহেরা কাজী, শেফালী হক, বেগম রকিব প্রমুখ। তারা জনসংযোগ, পোস্টারিং এবং হাউজ অব কমন্সে গিয়ে সদস্যদের সাথে সাক্ষাৎ করতেন। তারা সমাবেশে উপস্থিত থাকতেন। দীর্ঘ ৯ মাস তারা জনমত সৃষ্টি, অর্থ সংগ্রহে কাজ করেছেন।

ইন্টারন্যাশনাল ফ্রেন্ডশিপ এসোসিয়েশনের পক্ষে পুলিন বিহারী শীল ও গিয়াস উদ্দিন মিয়া আগস্ট মাসে একটি সভার আয়োজন করেন। এ সভায় অনেক বিদেশি রাষ্ট্রদূত উপস্থিত ছিলেন। আবু সাঈদ চৌধুরী ও পিবি শীল মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। মরিশাসের প্রধানমন্ত্রী স্যার সিউ সাগার লন্ডনে এলে আবু সাঈদ চৌধুরী তার সাথে দেখা করেন। সুইডেনস্থ পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত আব্দুর রাজ্জাক, আর্জেন্টিনার রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেন পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। তারা লন্ডনে এসে আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে দেখা করে লন্ডনস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগ দেন। ইরাকের রাষ্ট্রদূত আবুল ফতেহ ২৫ হাজার পাউন্ড ভারতীয় দূতাবাসের মাধ্যমে মুজিবনগরে প্রেরণ করেন। তিনি লন্ডনে এসে বাংলাদেশের দূতাবাসে যোগ দেন। অর্থের জন্য পাকিস্তান সরকার তাকে ইসলামাবাদ পাঠাতে অনুরোধ করতে পারে তাই তিনি কয়েকদিনের মধ্যে মজিবনগর চলে যান।

আগস্ট মাসে শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার জন্য লন্ডনে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। বিশ্বের বিভিন্ন স্থান থেকে বঙ্গবন্ধর বিচার বন্ধের জন্য দাবি জানানো হয়। এ সময় কমনওয়েলথ সেক্রেটারি জেনারেল আর্নল্ড স্মিথ পাকিস্তান এবং ভারত ভ্রমণ করেন।

পৃষ্ঠা: ৩০৭

 

 

১৯৭১ সালের ২৬ জুলাই ব্রিটিশ পার্লামেন্টের হাউজ অব কমন্সের হারকোট কক্ষে বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে ডাকটিকেট প্রকাশনা উৎসব অনুষ্ঠিত হয়। ডাকটিকেটে ডিজাইন করেন শিল্পী বিমান মল্লিক। এ টিকেট উৎসবে পিটার শোর, জন স্টোন হাউজ ভাষণ দেন। জন স্টোন হাউজ ‘ওয়ার ওন ওয়াল’- এর পক্ষ থেকে কয়েকবার ভারতে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন।

আগস্ট মাসে ভারতীয় রাজনীতিবিদ কৃষ্ণ মেনন লন্ডনে আসেন। তার সাথে আবু সাঈদ চৌধুরী আলোচনা করেন। লন্ডনস্থ আওয়ামী লীগের নেতা গাউস খান কৃষ্ণ মেননের সম্মানে একটি ঘরোয়া ভোজের আয়োজন করেন। কৃষ্ণ মেনন বাংলাদেশ স্বাধীনতা সংগ্রামকে আন্তরিকভাবে সমর্থন করেন।

আগস্ট মাসেই লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশন স্থাপিত হয়। গোরিং স্ট্রিটে কেন্দ্রিয় অফিস ছিল। সব সময় অফিস পূর্ণ থাকত। হাইকমিশন অফিস পরিচালনার জন্য অর্থের প্রয়োজন ছিল। সিদ্ধান্ত হয় যে, বাংলাদেশ ফান্ডের অর্থ অস্ত্র ক্রয় ব্যতীত অন্য খাতে ব্যয় হবে না।

ওয়ার অন ওয়ান্ট-এর চেয়ারম্যান ডোনাল্ড চেজওয়ার্থ বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনে এপ্রিল থেকে সাহায্য করে আসছেন। তিনি কয়েকবার কলকাতা এসে শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এবং মুজিবনগর সরকারের সাথে দেখা করেন। চেজ ওয়ার্থ একটি ব্রিটিশ ট্রাস্ট কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত হোস্টেলের ওয়াডেন হিসেবে কাজ করতেন। তিনি নামমাত্র ১০০ পাউন্ড মাসিক ভাড়ায় হোস্টেলের কয়েকটি কক্ষ বাংলাদেশ দূতাবাসের জন্য বরাদ্দ করেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের ঠিকানা ছিল ২৪ নম্বর পেমব্রিজ গার্ডেন। বাঙালি যুবক জহুরুল ইসলাম পাকবাহিনীর হাতে নির্যাতিত হয়ে চিকিৎসার জন্য লন্ডনে চলে আসেন। তিনি স্বেচ্ছায় দূতাবাসের খরচ বাবদ আড়াই হাজার পাউন্ড প্রদান করতে রাজি হলেন। এমনকি বিচারপতির মাসিক খরচের জন্য ৩ হাজার পাউন্ড দেন। পরে তিনি সে অর্থ জহুরুল ইসলামকে ফেরত দেন। দূতাবাসের ফিন্যান্স ডাইরেক্টর ছিলেন লুৎফুল মতিন।

১৯৭১ সালের ২৭ আগস্ট বাঙালি সাংবাদিক ও ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্যদের উপস্থিতিতে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ সরকারের হাইকমিশনার আবু সাঈদ চৌধুরী বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন। এ সংবাদ ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়। পাকিস্তানি রাষ্ট্রদূত বাংলাদেশ দূতাবাস বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। বাংলাদেশ দূতাবাসের সদস্য আবুল ফতেহ, মহিউদ্দিন আহমদ, লুৎফুল মতিন, শিল্পী আবদুর রউফ, মহিউদ্দীন চৌধুরী, আবদুস সামাদ, একেএম নুরুল হুদা ও ফজলুল হক চৌধুরী সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশ দূতাবাস

পৃষ্ঠা: ৩০৮

 

 

মুজিবনগর সরকার আনন্দিত হয়ে আবু সাঈদ চৌধুরীকে ধন্যবাদ জানায়।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকারের বৈদেশিক দূত আবু সাঈদ চৌধুরী ১ সেপ্টেম্বর রাজিউল হাসান রঞ্জুকে নিয়ে নরওয়ে গমন করেন। বিমানবন্দরে রফিকুজ্জামান, হামিদুল ইসলাম ও আরও কয়েকজন যুবক তাকে অভ্যর্থনা জানায়। তারা নরওয়েতে বাংলাদেশের জন্য আন্দোলন ও প্রচার কাজ চালান। নরওয়েত রানধানী অসলোতে পৌঁছে আবু সাঈদ চৌধুরী টিভিতে সাক্ষাৎকার দেন। প্রধান বিচারপতি ও পার্লামেন্ট সদস্যদের সাথে দেখা করে পাকবাহিনীর নির্যাতন ও বাংলাদেশের মক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে আলোচনা করেন। ৭ সেপ্টেম্বর তিনি সুইডেনে পৌঁছেন। স্টকহোম বিমানবন্দরে রাষ্ট্রদূত আব্দুর রাজ্জাক তাকে অভ্যর্থনা জানান। তিনি আগস্ট মাসে অনুগত্য প্রকাশ করেন।  তিনি বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণ করে বাংলাদেশের তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের সমর্থন দেন।

আবু সাঈদ চৌধুরী সুইডেনে বিভিন্ন স্তরের প্রতিনিধি এবং প্রবাসীদের সাথে আলোচনা সমাপ্ত করে ১৩ সেপ্টেম্বর ফিনল্যান্ডের রাজধানী হেলসিংকিতে পৌঁছেন। ব্রিটিশ কনসাল জেনারেল রয়কক্স তাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপন করেন। ফিনল্যান্ডের জনসংযোগ সমাপ্ত করে ১৪ সেপ্টেম্বর ডেনমার্কের রাজধানী কোপেনহেগেনে পৌঁছেন। বিমানবন্দরে মতিউর রহমান এবং লিয়াকতসহ কয়েকজন স্বাগত জানান। তিনি ডেনমার্ক পার্লামেন্টের স্পিকার, পত্রিকার সম্পাদকদের সাথে দেখা করেন। তিনি টিভিতে সাক্ষাৎকার দেন। ডেনমার্কে ৬৭ জন বাঙালি সেখানকার নাগরিকদের নিয়ে অ্যাকশন কমিটি গঠন করেন। কমিটির সভাপতি বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ ফিস্টেন ওস্টেগার্ড। এ মহিলা ২৫ মার্চ ঢাকায় ছিলেন। অ্যাকশন কমিটি একটি বুলেটিন বের করত। ১৬ সেপ্টেম্বর আবু সাঈদ চৌধুরী লন্ডনে ফিরে আসেন। তার অবর্তমানে শেখ আবদুল মান্নান স্টিয়ারিং অফিসের কার্য দক্ষতা পরিচালনা করেন। স্টিয়ারিং কমিটির আহ্বায়ক আজিজুল হক ভূঁইয়া মুজিবনগর থেকে ফিরে এসে কমিটির কাজ শুরু করেন। কমিটির অফিস সেক্রেটারি নিযুক্ত হলেন শামসুল আলম চৌধুরী।

কলকাতায় অবস্থিত পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলী ১৮ এপ্রিল তার অফিসের সকল কর্মকর্তা ও কর্মচারীসহ স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন। ২৬ এপ্রিল লন্ডন টাইমস পত্রিকায় এ সংবাদ প্রকাশিত হলে প্রবাসী বাঙালিরা খুবই উৎসাহিত হয়। তার কলকাতার অফিসে মুজিবনগর

পৃষ্ঠা: ৩০৯

 

 

সরকারের প্রধান কার্যালয় স্থাপিত হয়। ফলে বহির্বিশ্বে যোগাযোগের সুবিধা হয়।

শিল্পী এ কে এম আব্দুর রউফ আগস্টের প্রথম থেকে নিয়মিত কাজ করেন। তিনি বিজ্ঞপ্তি লেখা, প্রচ্ছদ অঙ্কন করতেন। স্বাধীনতা অর্জনের পর থেকে তিনি বাংলাদেশের সংবিধান হাতে লেখেন এবং তাতে সদস্যগণ স্বাক্ষর করেন। আফরোজ চৌধুরী সম্পাদিত বাংলার রণাঙ্গন পত্রিকা গোরিংটন থেকে প্রকাশিত  হতো। স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালে পিআইএ’র কর্মচারী মহিউদ্দিন আহমদ চৌধুরী এবং রিয়াজুল আলম পাকিস্তানের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে লন্ডনে চলে আসেন।

লন্ডনে স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করার পর অনেক নিবেদিত কর্মী নিরলসভাবে কাজ করেছেন। কাজী মুজিবুর রহমান চার্টার্ড একাউন্ট্যান্ট, লুৎফুল মতিন বাংলাদেশ ফান্ডের হিসাব সংরক্ষণ ও পরীক্ষা করতেন। তাসাদ্দুক আহমেদ লন্ডনে একজন প্রভাবশালী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি গ্যালজম রেস্টুরেন্টের মালিক ছিলেন। তিনি বিটিশ পার্লামেন্টের অনেক সদস্যের সাথে সুপরিচিত ছিলেন এবং তাদের শরণার্থী শিবির পরিদর্শনে প্রভাবিত করেন। তিনি বাংলাদেশের ফ্রিডম মুভমেন্ট নামে সংগঠন প্রতিষ্ঠা করেন। বিএইচ তালুকদার, নুরুল হক চৌধুরী কূটনীতিবিদ মহিউদ্দিন আহমদ, সুলতান মাহমুদ শরীফ, আমির আলী, ড. কবির আহমদ, মিম্বার আলী, আরব আলী, রাশেদ সোহরাওয়ার্দী, মোশাররফ হোসেন জোয়ারদার প্রমুখ লন্ডনে স্বাধীনতা আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

লন্ডনে পাকিস্তানের হাইকমিশনার সালমান আলী প্রবাসী বাঙালিদের বিরুদ্ধে প্রায়ই ব্রিটিশ সরকারের নিকট অভিযোগ করতেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকার বাঙালিদের স্বাধীনতা আন্দোলনে বাধা দেয়নি।

লন্ডনে বিভিন্ন অঞ্চলে স্টিয়ারিং কমিটি গঠিত হয় এবং তারা আন্দোলনকে বেগবান করে। বার্মিংহাম কমিটির জগলুল পাশা, তোজাম্মল হক, মেডিক্যাল এসোসিয়েশনের সভাপতি আবদুল হাকিম, জাফরুল্লাহ চৌধুরী, গ্লাসগোর কাজী এনামুল হক নিবেদিত কর্মী ছিলেন। স্বাধীনতার পর কাজী এনামুল হক ঢাকায় ইন্তেকাল করেন।

বাংলাদেশ সরকার প্রতিষ্ঠার পর অনেক নেতা, সংসদ সদস্য লন্ডনে আগমন করেন। জুন মাসে শ্রমিক লীগের সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মান্নান লন্ডনে আসেন। তারা সাংবাদিক সম্মেলন করেন এবং কয়েকটি জনসভায় ভাষণ দেন। সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে প্যারিসে আন্তর্জাতিক পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। লন্ডনস্থ স্টুডেন্ট অ্যাকশন। কমিটির একটি প্রতিনিধি দল প্যারিসে প্রেরণ করা হয়। প্রতিনিধি দলে ছিলেন

পৃষ্ঠা: ৩১০

 

 

নজরুল ইসলাম, এএইচএ প্রামাণিক, ওয়ালি আশরাফ, খোন্দকার মোশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ হোসেন মঞ্জু।

এনামুল হক বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন। তার রচিত ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ নৃত্যনাট্যটি লন্ডনে কয়েক স্থানে পরিবেশিত হয়। এ সংসদের সম্পাদিকা ছিলেন মুন্নী রহমান। এ সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বাঙালিদের মধ্যে প্রেরণা সৃষ্টি করা হয়।

ওয়ালি আশরাফ সম্পাদিত সাপ্তাহিক জনমত পত্রিকা স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছে। মিনহাজ উদ্দিন ব্রিটেনে বাঙালি মহলে প্রভাবশালী ব্যক্তিত্ব। তিনি লন্ডনস্থ বাঙালিদের ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা আন্দোলনে অবদান রেখেছেন।

সুলতান মাহমুদ শরীফ লন্ডনের আওয়ামী লীগের সম্পাদক ছিলেন। বরিশালে  তার জন্ম। ষাটের দশকে তিনি লন্ডনে উচ্চ শিক্ষার জন্য আসেন। তিনি ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের মাঝামাঝি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর সাথে সাক্ষাৎ এবং ২৫ মার্চ পুনরায় দেখা করে লন্ডনে নেতৃত্ব গ্রহণে তাকে অনুরোধ জানান।

বাংলাদেশ স্টুডেন্ট অ্যাকশন কমিটি, বাংলাদেশ মহিলা সমিতি দীর্ঘ ১ মাস স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।

 

ঞ. মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী অতর্কিতে নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর আক্রমণ, হত্যা, নারী ধর্ষণ এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতারে সোভিয়েত রাশিয়া উদ্বেগ প্রকাশ করে। এ কারণে ১৯৭১ সালের ২ এপ্রিল সোভিয়েত রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নিকট পত্র লেখেন। পত্রে তিনি জানান, পাকিস্তানের উল্লিখিত সমস্যা রাজনৈতিকভাবে সমাধান করা উচিত। তিনি আশা করেন যে, পূর্ব পাকিস্তানে অতিশীঘ্র শান্তি, ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠিত হবে। ১৩ এপ্রিল চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টকে লিখেছেন, চীনের সরকার ও জনগণ সকল সময় পাকিস্তান সরকার ও জনগণের রাষ্ট্রীয় সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামকে সমর্থন জানাবে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ হতে মুক্তিযুদ্ধাদের সাথে পাকবাহিনীর তীব্র লড়াই চলতে থাকে। অভ্যন্তরে গেরিলা যুদ্ধ এবং সীমান্তে নিয়মিত যুদ্ধ চলছে। কিন্তু দ্রুত বিজয় লাভ করতে হলে বিদেশি রাষ্ট্রের সক্রিয় সহযোগিতা প্রয়োজন।

পৃষ্ঠা: ৩১১

 

 

বাঙালি জাতির অস্তিত্বের লড়াইয়ে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়া সর্বাগ্রে এগিয়ে আসে। ভারত প্রথমে সীমান্ত বাহিনী (Border security Force) দিয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করে। কিন্তু পাকিস্তান আর্মির ন্যায় একটি শক্তিশালী বর্বর বাহিনীর বিরুদ্ধে অব্যাহত যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হলে ভারতীয় সেনাবাহিনীর সহযোগিতা প্রয়োজন। কিন্তু যখন ভারতের সেনাবাহিনী এগিয়ে আসবে তখনই চীন ও আমেরিকা পাকিস্তানের পক্ষে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে পারে- Yellow from the north and White from the south will come. সে ক্ষেত্রে রাশিয়ার সক্রিয় সমর্থন প্রয়োজন। তাই ভারত রাশিয়ার সাথে পারস্পরিক আলোচনা করে ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লিতে সোভিয়েত রাশিয়া ও ভারত একটি সামরিক চুক্তি স্বাক্ষর করে-রাশিয়ার পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এ গ্রোমিকা এবং ভারতের পক্ষে পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহ এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। শান্তি চুক্তির ৯ নম্বর অনুচ্ছেদে উল্লেখ আছে-১ ‘Each High Contracting Party  undertakes to abstain from providing any assistance to any third country engages in armed conflict with other party, In the event of either being subjected to an attack of a threat thereof the High Contracting Parties shall immediately enter into mutual consultations in order to remove such threat and to take appropriate effective measures to ensure peace and the security of their countries.’ চুক্তিবদ্ধ দেশগুলোর মধ্যে কেউ তৃতীয় দেশ দ্বারা আক্রান্ত হলে সেক্ষেত্রে অন্য দেশটির তৃতীয় দেশকে কোনো সহায়তা করবে না। যদি চুক্তিবদ্ধ দেশের মধ্যে কোনো দেশ আক্রান্ত হয় তাহলে তারা তাৎক্ষণিকভাবে এরূপ ভীতি দূর করার জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারবে তাদের নিরাপত্তা ও শান্তি নিশ্চিত করার জন্য। এ চুক্তির ফলে ভারত পাকিস্তানের প্রয়োজনবোধে যুদ্ধ করতে পারবে এবং চীন-আমেরিকা যদি পাকিস্তানের পক্ষে এগিয়ে আসে তাহলে রাশিয়া ভারতের সহায়তায় এগিয়ে আসবে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আমেরিকা যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়নকল্পে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ করলে সোভিয়েত রাশিয়াও তার নৌবহর পাঠিয়ে দেয়। ফলে সপ্তম নৌবহর পিছু হটে যায়। এভাবে ভারত-রাশিয়া মৈত্রী চুক্তি ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকালে চীন-আমেরিকাকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখে।

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিদেশ সফর

পাকিস্তানের একগুঁয়েমির ফলে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কটের কোনো সমাধান

পৃষ্ঠা: ৩১২

 

 

হচ্ছে না। তারা অভ্যাহতভাবে গণহত্যা চালিয়ে যায়। ইয়াহিয়া খান ৯ আগস্ট ঘোষণা করেন যে,  রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধে শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার হবে এবং ১১ আগস্ট থেকে বিচার শুরু হয়। অন্যদিকে ভারতকে এক কোটি লোকের আশ্রয় ও ত্রাণ দিতে হচ্ছে। ভারত-রাশিয়া ব্যতিত অন্য কোনো দেশ সরাসরি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করছে না। এমন পরিস্থিতিতে ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পড়তে হবে। সেক্ষেত্রে বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্রের সমর্থন ভারতের পক্ষে থাকা প্রয়োজন। তাই ১৯৭১ সালের ৫ জুন হতে ২২ জুন পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং মস্কো, প্যারিস, অটোয়া, নিউইয়র্ক, ওয়াশিংটন সফর করেন এবং বাংলাদেশ পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের অবহিত করেন।  নিউইয়র্কে তিনি জাতিসংঘের মহাসচিব উত্থান্টের সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশে শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত করেন। বিশ্ব মতামত ভারতের অনুকূলে নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রী মিসেস ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭১ এলের ১৪ অক্টোবর ৬টি দেশ ভ্রমণের জন্য দিল্লি ত্যাগ করেন। বেলজিয়াম, অস্ট্রিয়া,  আমেরিকা, ফ্রান্স, ব্রিটেন এবং পশ্চিম জার্মানি সফর করে ১২ নভেম্বর তনি দেশে ফেরেন। ইন্দিরা গান্ধী তাঁর অনুসৃত কূটনীতির মাধ্যমে বিশ্বের সহানুভূতি ও সমর্থন বাংলাদেশের সঙ্কট নিরসনের পক্ষে নিয়ে আসার জন্য আন্তরিকভাবে চেষ্টা করেন এবং এ ক্ষেত্রে সফলতা অর্জন করেন।

মিসেস গান্ধীর বিদেশ সফরের উদ্দেশ্য ছিল বিদেশের কাছ থেকে কিছু পাওয়ার জন্য নয়, তাদেরকে উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করা- এ সম্পর্কে মিসেস গান্ধীর বলেছেন, She was not going to ask for anything but only to inform the world leaders of the real situation in the Indian subcontinent and to acquaint the host countries with the Indian point of view.’ দ্বিতীয় কারণ ছিল তারা বাংলাদেশ সম্পর্কে কি ভাবছে এবং কি করতে বলেন, তৃতীয় কারণ হলো সময় দ্রুত চলে যাচ্ছে। উপমহাদেশের শান্তি রক্ষার এই শেষ মুহূর্ত যদি যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তাহলে ভারতের ভাবমূর্তি বিনষ্ট হবে।

১৯৭১ সালের ২৪ অক্টোবর ইন্দিরা গান্ধী ব্রাসেলসের উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন। ব্রাসেলস কমন মার্কেটের কেন্দ্র এবং বেলজিয়াম নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য ছিল। বেলজিয়ামের প্রধানমন্ত্রী গ্যাসটান আইসকেনসের সাথে প্রধানমন্ত্রীর আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। বেলজিয়াম সরকার পাকিস্তানকে সাহায্য বন্ধ, রিফিউজিদের ফেরত ও পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক সঙ্কট আলোচনার মাধ্যমে সুষ্ঠু সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করেন। ব্রাসেলস থেকে মিসেস গান্ধী অস্ট্রিয়ার

পৃষ্ঠা: ৩১৩

 

 

রাজধানী ভিয়েনায় পৌঁছেন এবং অস্ট্রিয়ার চ্যান্সেলর ড. ব্রুনো ত্রিসকির এবং প্রিসেন্ট জোলাসের সাথে আলোচনা করেন। তারা বিশ্বাস করেন যে, ভারত পাকিস্তান উভয় রাষ্ট্রে শান্তি প্রতিষ্ঠিত হোক। মিসেস গান্ধী ২৯ অক্টোবর ৫ দিনের সফরে লন্ডন পৌছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হিথের সাথে গোপনীয় আলাপ করেন। আলোচনার প্রেক্ষিতে ব্রিটেনে ভারতের যুক্তি ও বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতিশীত হতে থাকে। কোনো কোনো সংস্থা মিসেস গান্ধীকে ইয়াহিয়া খানের  আলোচনার উপদেশ দেয়। তিনি ব্যাখ্যা করে বলেন, কার সাথে কথা বলব? কী কথা বলব? ইয়াহিয়া খানকে তিনি হিটলারের সাথে তুলনা করেন। অনেক দেশের উপদেশ ছিল ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে তার সাথে কথা বলুক। ৩ নভেম্বর ইন্দিরা গান্ধী নিউইয়র্ক পৌঁছেন। ইন্দিরা আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাথে তিন ঘন্টা আলোচনা করেন। ভারতীয় দল জোর দিয়ে বলে যে, বাংলাদেশের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধানে আসতে হবে। আমেরিকাও বিশ্বাস করে আলোচনায় অবশ্য শেখ মুজিবকে থাকতে হবে। আলোচনাকালে আমেরিকা পক্ষ বলে যে, তাদের দেশের জন্য গুরুত্বপূর্ণ হলো পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা রক্ষা করা; কারণ তার বিভক্তি উপমহাদেশের যুদ্ধ বাধিয়ে দিতে পারে। নিক্সন প্রশাসন মিসেস গান্ধীর প্রতি যথাযথ মর্যাদা প্রদর্শন করেনি। এমনকি তিনি নিউইয়র্ক পৌঁছলে নিক্সনের পক্ষ থেকে বিমানবন্দরে কেউ ছিল না। ভারতে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কিটিংস উপস্থিত ছিলেন। ইন্দিরা কোনো বিষয়েই আমেরিকাকে বাধ্য করতে পারেননি। শেখ মুজিবের মুক্তির ব্যাপারে আমেরিকা কোনো উৎসাহ দেখায়নি।

মিসেস গান্ধী ৭ নভেম্বর প্যারিস পৌঁছেন এবং ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করেন। ইন্দিরা গান্ধী এক পর্যায়ে বলেছিলেন, ‘I Feel, I am sitting on a volcano.’ আমি অনুভব করি যে, আমি আগ্নেয়গিরির ওপর বসে আছি। ১০ নভেম্বর মিসেস গান্ধী বন গমন করেন এবং পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ডটের সাথে আলোচনা করেন। মিসেস গান্ধী যে সকল দেশে যান তার মধ্যে আমেরিকা ব্যতীত সকল দেশ ভারতের প্রতি মৌখিক সহানুভূতি দেখিয়েছিল। কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশের সমস্যা সমাধানে তেমন কোনো উৎসাহ দেখায়নি। আমেরিকা পাকিস্তান সমর্থন করে যাচ্ছে; তার মধ্যে কোনো পরিবর্তন হয়নি। কিন্তু মিসেস গান্ধী তাঁর সফরকালে আমেরিকার জনগণের সমর্থন অর্জনে সফল হয়েছেন। বাংলাদেশ সম্পর্কে মার্কিন সরকার এবং জনগণের মধ্যে বিশেষ পার্থক্য ছিল। আমেরিকার প্রখ্যাত বুদ্ধিজীবী, সিনেট সদস্য, সাংবাদিকগণ সম্পূর্ণভাবে বাংলাদেশের দুঃখ-কষ্টের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করেন এ

পৃষ্ঠা: ৩১৪

 

 

প্রশাসনবিরোধী অবস্থান গ্রহণ করেন। আমেরিকার ৩৫০ জন বুদ্ধিজীবী এক  স্বাক্ষরিত বিবৃতিতে বলেন, শেখ মুজিবুর রহমানের দলের সাথে শান্তি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানের সকল সাহায্য বন্ধ রাখতে হবে। স্বাক্ষরকারীদের জন ছিলেন নোবেল পুরস্কার বিজয়ী।

 

আশ্রয় শিবির

১৯৭১ সালে পাকবাহিনীর গণহত্যা ও নির্যাতনের ফলে এক কোটি বাঙালি ভারতের আশ্রয় নেয়। তাদের মধ্যে পশ্চিম বাংলা ও ত্রিপুরা রাজ্যে অধিকাংশ আশ্রয় নেয়। পূর্ব পাকিস্তানের ঢাকা, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম ও সিলেটের জনসাধারণ ত্রিপুরা রাজ্যে চলে যায়। কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেট সীমান্ত আগরতলা-ত্রিপুরা। ত্রিপুরার স্থানীয় অধিবাসীদের চেয়ে শরণার্থীর সংখ্যা বেশি ছিল। ত্রিপুরা রাজ্য সরকার ও জনগণ বাঙালিদের প্রতি যে আন্তরিক সাহায্য- সহযোগিতা করেছে বাংলাদেশের জনগণ তা কোনোদিন ভুলতে পারে না। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের দ্বিতীয় রাজধানী ছিল আগরতলায়। কলকাতার পরেই আগরতলায় সরকারের অবস্থান ছিল। পশ্চিম বাংলায় বেশি শরণার্থী ছিল। বরিশাল, খুলনা, যশোর, কুষ্টিয়া, ফরিদপুর, পাবনা, রাজশাহী, দিনাজপুর, রংপুরের হিন্দু সম্প্রদায়, আওয়ামী লীগ পরিবারগুলো আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার, পশ্চিম বাংলা রাজ্য সরকার তাদের সর্বশক্তি দিয়ে শরণার্থীদের সাহায্য করেছে। পশ্চিম বাংলার জনগণ শরণার্থীদের জন্য অপূর্ব ত্যাগ স্বীকার করে। তাদের নিজেদের ঘরবাড়ি পর্যন্ত শরণার্থীদের ছেড়ে দেয়।

পশ্চিম বাংলার পক্ষে ত্রাণ কাজ সমন্বয় করতেন কেন্দ্রিয় সরকারের সচিব অশোক কুমার দত্ত চৌধুরী। তিনি পূর্ব বাংলায় একে দত্ত চৌধুরী নামে পরিচিত। তিনি সিলেটের অধিবাসী। বরিশালের জেলা প্রশাসক ছিলেন। ১৯৫৮ সালে সামরিক শাসন আমলে তিনি ভারতে পালিয়ে যান এবং ভারত সরকারের অধীনে চাকরি করতেন। বাংলাদেশ থেকে যে সকল হিন্দু পশ্চিম বাংলায় বসতি স্থাপন করেন তারা তাদের এককালের প্রতিবেশীদের সাহায্যে এগিয়ে আসেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী শরণার্থী শিবির ঘুরে তাদের অবর্ণনীয় দুঃখ-কষ্ট দেখেন। ভারত সরকারসহ ভারতের সকল রাজ্য মুক্তহস্তে শরণার্থীদের সেবা করেছে। ভারতের ও বিদেশী সাংবাদিক গণমাধ্যমে শরণার্থীদের করুণ কাহিনী বিশ্বে তুলে ধরে, বিশ্ববাসী শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। জাতিসংঘ শরণার্থীদের সাহায্যে প্রচুর বরাদ্দ দেয়। ভারতে তাদের দপ্তর ছিল। পশ্চিম বাংলাসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বিভিন্ন সংস্থা, শিক্ষক, ছাত্রছাত্রী চাঁদা তুলে শরণার্থীদের সাহায্য

পৃষ্ঠা: ৩১৫

 

 

করে। ভারতের বিখ্যাত যাদুকর পিসি সরকার জুনিয়র যাদু প্রদর্শন করে শরণার্থীদের ফান্ডে জমা দেন। বিখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী উদয় শংকর নিউইয়র্কে অনুষ্ঠান করে মুক্তিযুদ্ধে সহায়তা করেন।

পশ্চিম বাংলার বিখ্যাত লেখক তারাশংকর বন্দোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, গায়ক হেমন্ত মুখার্জি, সন্ধ্যা মুখার্জি, চিত্র তারকা উত্তম কুমার,  সুচিত্রা সেন, শিক্ষাবিদ রমা গুহঠাকুরতা ভারতের বিভিন্ন স্থানে অনুষ্ঠান করে বাংলাদেশের জন্য অর্থ সাহায্য করেন।

পশ্চিমবঙ্গসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সহায়ক সমিতি গঠন করে মুক্তিযুদ্ধে ও শরণার্থীদের সাহায্য প্রদান করে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় সহায়ক সমিতি শরণার্থী শিবিরের ছেলেমেয়েদের লেখাপড়ার জন্য ৭০০ শিক্ষক নিয়োগ করে। এ ব্যাপারে ভারতের শিক্ষামন্ত্রী ড. ত্রিগুতা সেন বাংলাদেশের ড. এ আর মল্লিক, কামরুজ্জামান এমএনএ, ড. আনিসুজ্জামান, ড. সরওয়ার মোর্শেদ প্রমুখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

 

ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি

ভারতের আবেদন, ইন্দিরা গান্ধীর বিশ্ব সফরে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে কেউ এগিয়ে না আসায় ভারত বাংলার সমস্যা সমাধানে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।

ভারতের প্রধানমন্ত্রী পূর্বেই বুঝতে পেরেছিলেন যে, ভারতের প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ ব্যতীত বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান হবে না। ২৫ মার্চের পর লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সীমান্ত অতিক্রম করে ত্রিপুরা, আসাম ও পশ্চিম বাংলায় প্রবেশ করতে থাকে। রাজ্য সরকারগুলো কেন্দ্রিয় সরকারকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের অনুরোধ জানালো। মিসেস গান্ধী এপ্রিল মাসে মন্ত্রিপরিষদের সভা আহ্বান করেন। সভায় জেনারেল শ্যাম মানেকশাকে উপস্থিত থাকার জন্য বলা হয়। সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিংহ, অর্থমন্ত্রী ওয়াইবি চবন এবং প্রতিরক্ষামন্ত্রী জগজীবন রাম উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল শ্যাম মানেকশাকে শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করার জন্য বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের নির্দেশ দেন। মানেকশা বলেন, তার অর্থ যুদ্ধ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধ হলেও অভিযান চালাতে মানেকশা বলেন, এ মুহূর্তে যুদ্ধ করার জন্য তার সেনাবাহিনী প্রস্তুত নয়। তাকে বাংলাদেশ আক্রমণ করতে হলে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সময় দিতে হবে। কারণ এ মুহূর্তে ত্রিপুরায় মাত্র এক ব্যাটালিয়ান সৈন্য রয়েছে। তাকে সৈন্য মোতায়েন ও অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা সেরে সৈন্য প্রেরণ ও প্রস্তুতির

পৃষ্ঠা: ৩১৬

 

 

জন্য কয়েক মাস সময় লাগবে। এ মুহূর্তে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে আক্রমণ চালালে পরাজয় বরণ করতে হবে। শ্যাম মানেকশা বলেন, Prime Minister, I guarantee you 100 percent defeat’ কিন্তু তাকে সময় দিলে নিশ্চিত জয় লাভ করবেন- – ‘I guarantee you 100 percent success.’২

জেনারেল মানেকশা এবং জেনারেল জ্যাকোবের মন্তব্য থেকে জানা যায় পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত সেনাবাহিনী সম্পর্কে তাদের নিকট সঠিক তথ্য ছিল না। ইস্টার্ন কমান্ডে তাদের যে সেনাবাহিনী ছিল তা পুনর্গঠন করলে মে-জুন মাসেই মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে  আক্রমণ চালালে পাকবাহিনী অবশ্যই পরাজয় বরণ করত। পাকিস্তানিদের বিমান ও নৌবাহিনী ছিল না বললেই চলে। পদাতিক বাহিনীর অস্ত্র ছিল দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত অস্ত্র। অবশ্য ভারতীয় জেনারেলদের তাৎক্ষণিকভাবে যুদ্ধ শুরু না করার আরেকটা বড় কারণ ছিল বর্ষাকাল। বর্ষাকালে বাংলাদেশে সেনাবাহিনী চলাচলে অনেক বাধার সম্মুখীন হতো।

লে জেনারেল জে.এফ.আর জ্যাকোব ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার ছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে যোগ দেন। ১৯৬২ সালে চীন-ভারত যুদ্ধকালে তিনি ভারতীয় সেনাপ্রধান জেনারেল বি.এম কাউলের ব্যর্থতা দেখেছেন। ১৯৬৯ সালে লে. জেনারেল মানেকশার নিকট থেকে ইস্টার্ন কমান্ডের চিফ অব স্টাফ হিসেবে জেনারেল জ্যাকব দায়িত্ব গ্রহণ করেন এবং মানেকশা ভারতের সেনাবাহিনী প্রধান নিযুক্ত হন। ইস্টার্ন কমান্ডের প্রধান কার্যালয় কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ামে অবস্থিত ছিল। জ্যাকবের জন্মস্থান কলকাতা এবং কলকাতায় তিনি লালিতপালিত। ১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে জেনারেল এস.এইচ.এফ.জে মানেকশা ফোনে জ্যাকবকে নির্দেশ দেন তাকে তখনই পূর্ব পাকিস্তানে অভিযান চালাতে হবে। তার মাত্র এক ডিভিশন সৈন্য আছে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই। আসছে ১৫ নভেম্বরের পূর্বে তাদের পক্ষে যুদ্ধ শুরু করার সময় নেন। তাকে ব্যাপক প্রস্তুতি নিতে হবে। এপ্রিল পর্যন্ত পশ্চিম বাংলার বিএসএফ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে সীমান্ত যুদ্ধ চালিয়ে ছিল। বিএসএফের মহাপরিচালক কে রুস্তমজি বিএসএফ সঠিকভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সহযোগিতা করতে পারছে না। তাই ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল ভারতের সেনাবাহিনী সরকারিভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্যের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। মুজিবনগর সরকার গঠন, স্বাধীনতা ঘোষণা এবং কলকাতায় পাকিস্তানি দূতাবাসের বাঙালি ডেপুটি হাইকমিশনার হোসেন আলীও তার সহকর্মীদের বাংলাদেশের পক্ষে আনুগত্য স্বীকার করার ব্যাপারে জেনারেল জ্যাকব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। জেনারেল মানেকশা ১৯৭১ সালের মে হতে অক্টোবর

পৃষ্ঠা: ৩১৭

 

 

মাসের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। একই সাথে মে হতে নভেম্বর পর্যন্ত মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সহায়তা করেন।

ভারতীয় বাহিনীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র সরবরাহ এবং পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধকালে পিছন থেকে সকল প্রকার সহায়তা প্রদান করে। ভারতীয় বাহিনী ১১টি সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তিশালী করার সকল ব্যবস্থা গ্রহণ করে। সেপ্টেম্বর মাস হতে মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সুদক্ষ যুদ্ধ পরিচালনা করে সফলতা অর্জন করে। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের ৩টি নিয়মিত এবং একটি কমিউনিকেশন জোন ছিল। তারা বাংলাদেশকে ৫টি সেক্টরে বিভক্ত করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করে। কমান্ডার ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

 

যুদ্ধের পূর্বে ভারতীয় বাহিনীর অবস্থান

উত্তর সেক্টর-ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা। সদর দপ্তর: পশ্চিম বাংলার শিলিগুড়ি।  সেনাবাহিনীর অবস্থান-সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরুবক্স সিং। এ বাহিনীর  সাথে ছিল মুক্তিবাহিনীর ১১ সেক্টর কমান্ডার স্কোয়াড্রন লিডার হামিদুল্লাহ এবং টাঙ্গাইলের  কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী। পাকবাহিনীর অবস্থান- ব্রিগেডিয়ার আব্দুল কাদের, ৯৩ ব্রিগেড, ৩১ বেলুচ ও ৩৩ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট।

উত্তর-পশ্চিম সেক্টর- রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী,  পাবনা। সদর দপ্তর: শিলিগুড়ি।  সেনাবাহিনীর অবস্থান- ৩৩ কোর কমান্ডার মেজর জেনারেল থাপ্পা, ৬ নং মাউন্টেন ডিভিশন- মেজর জেনারেল পিসি রেড্ডি, ৯ম মাউন্টেন ডিভিশন- মেজর জেনারেল লচমানসিংহ, মুক্তিবাহিনীর ৬ নম্বর ও ৭ নম্বর সেক্টরের ১২ হাজার মুক্তিযোদ্ধা ভারতীয় কোর কমান্ডের সাথে অভিযানে অংশগ্রহণ।

পাকবাহিনীর অবস্থান- ১৬ ডিভিশন মেজর জেনারেল নজর হুসাইনশা, ব্রিগেডিয়ার তোজাম্মেল- হিলি, দিনাজপুর। ব্রিগেডিয়ার-নঈম নাটোর, রাজশাহী।

পৃষ্ঠা: ৩১৮

 

 

পশ্চিম সেক্টর: কুষ্টিয়া, যশোর ফরিদপুর, যশোর, খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, সদর দপ্তর: পশ্চিম বাংলার নদীয় জেলার কৃষ্ণনগর ভারতীয় বাহিনীর ২-কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিএন রায়না। নবম ডিভিশন- মেজর জেনারেল দলবীর সিংহ, চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশন অধিনায়ক মেজর জেনারেল মহিন্দর সিং বারা। অষ্টম ও নবম সেক্টরের ১৬ হাজার মুক্তিবাহিনী সদস্য অভিযানে অংশগ্রহণ করে। পাকবাহিনীর অবস্থান: অধিনায়ক মেজর জেনারেল আনসারী, ৯ম ডিভিশন।

পূর্ব সেক্টর: সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম। সদর দপ্তর: আগরতলা

ভারতীয় বাহিনীর ৪র্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সগত সিং। ৮ম মাউন্টেন মেজর জেনারেল কৃষ্ণ রায়, ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল গঞ্জালেস এবং ২৩ নং মাউন্টেন ডিভিশন- মেজর জেনারেল আরটি হীরা ডিভিশনের অধিনায়ক ছিলেন। মুক্তিবাহিনীর ১, ২, ৩, ৪ ও ৫ সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধারা ভারতীয় বাহিনীর সাথে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। পাকবাহিনীর অবস্থান: মেজর জেনারেল আব্দুল মজিদ ১৪ ডিভিশন, মেজর জেনারেল রহিম খানের অধীনে ৩৯ পদাতিক ডিভিশন।

পূর্বাঞ্চল: সদর দপ্তর: আসামের গৌহাটি।

১০১ কমিউনিকেশন জোন- ৯৫ এবং ৬৩ ব্রিগেড, অধিনায়ক মেজর জেনারেল জিএম গিল, তিনি যুদ্ধে আহত হলে মেজর জেনারেল নাগরা কমান্ডার নিযুক্ত হন।

ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পিসি লাল কলকাতায় অবস্থিত সেনাবাহিনীর অধিনায়কের সাথে সমন্বয় করতেন।

পৃষ্ঠা: ৩১৯ 

 

 

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর উপপ্রধান এয়ার কমোডর এ.কে খন্দকারের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর আসামের ডিমাপুরে বাংলাদেশ বিমান বাহিনী গঠিত হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ইংরেজ সেনাবাহিনী ডিমাপুরে বিমানবন্দর নির্মাণ করেছিল। বিমান বাহিনীর অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে ছিলেন স্কোয়াড্রন লিডার এম.কে. বাশার, গ্রুপ ক্যাপ্টেন সদরুদ্দিন, গ্রুও ক্যাপ্টেন সুলতান মাহমুদ, গ্রুপ ক্যাপ্টেন লিয়াকত, গ্রুপ ক্যপ্টেন বদরুল আলম, গ্রুও ক্যাপ্টেন শামসুল আলম, গ্রুপ ক্যাপ্টেন শরফুদ্দিন প্রমুখ।

বাংলাদেশ নৌবাহিনী ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা করে। ক্যাপ্টেন সামন্তের তত্ত্বাবধানে পলাশীতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত এবং পাকিস্তাম নৌবাহিনী থেকে আগত বাঙালি নৌসেনারা মুক্তিবাহিনীর অপারেশন জ্যাকপট নামে নোয়াউ কমান্ডাে বাহিনী লিমপেট মাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম ও মংলা সমুদ্র বন্দরে অনেক বিদেশি জাহাজ ধ্বংস করে ফেলে। ১৯৭১ সালের ১৪ আগষ্ট নৌ কমান্ডো সফলতার সাথে মংলা বন্দরে জাহাজ ধ্বংস করে বিদেশি ও পাক সরকারকে ভীত করে ফেলে। চট্টগ্রামে নৌ কমান্ডাে ফ্রিগেট  ও সমুদ্রগামী জাহাজ মাইন দিয়ে ডুবিয়ে দেয়। অভ্যন্তরীণ নৌবন্দর চাঁদপুর, বরিশাল, নারায়ণগঞ্জ প্রভৃতি বন্দরের ছোটখাটো নৌযান ধ্বংস করে ফেলে। বীরশ্রেষ্ঠ মোঃ রুহুল আমিন, নজরুল ইসলাম, রহমত উল্লাহ, আব্দুল হাকিম, এজি খুরশিদ, আব্দুল আউয়াল, শাহ আলম, জালাল উদ্দিন, মেজাহের উল্লাহ, মোফাজ্জল হোসেন, আহসানউলাহ, আউয়াল সরকার, মতিয়ুর রহমান, সৈয়দ আবুল বাশার প্রমুখ অপারেশন জ্যাকপট পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করেন। অপারেশন জ্যাকপটের ফলে পাকিস্তান নৌবাহিনী বিদেশি জাহাজ বাংলাদেশে আসা বন্ধ করে দেয়। ৩ ডিসেম্বর যুদ্ধ শুরু করার পূর্বেই বাংলাদেশ নৌবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের সমুদ্রপথে পলায়ন অসম্ভব করে তোলে।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে আশ্রয়ের জন্য প্রবেশ করতে থাকে। ভারতের আবেদনে কোনো দেশ বাংলার রাজনৈতিক সমাধানে এগিয়ে আসেনি। তাই বাংলার সমস্যা সমাধানে ভারতকে এগিয়ে আসতে হয়েছে।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী মন্ত্রিপরিষদের সভা আহ্বান করেন। সভায় জেনারেল মানেকশ উপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা জেনারেল মানেকশকে শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশের নির্দেশ দেন। মানেকশ বলেন, এ মুহূর্তে আক্রমণ করলে পরাজয় বরণ করতে হবে। লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ইস্টার্ন কমান্ডার

পৃষ্ঠা: ৩২০

 

 

জেনারেল মানেকশকে শরণার্থীদের আগমন বন্ধ করার জন্য পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে প্রবেশের নির্দেশ দেন। মানেকশ বলেন, এ মুহূর্তে আক্রমণ করলে পরাজয় বরণ করতে হবে। লে. জেনারেল জে এফ আর জ্যাকব ইস্টার্ন কমান্ডার ছিলেন।  তার মাত্র এক ডিভিশন সেনা আছে। ১৫ নভেম্বরের পূর্বে তাদের পক্ষে যুদ্ধ করা সম্ভব নয়। পশ্চিম বাংলার বিএসএফ মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করছে। বিএসএফের মহাপরিচালক কে রুস্তমজি এবং উপমহাপরিচালক ছিলেন গোলক মজুমদার। ১৯৭১ সালের ২৯ এপ্রিল ভারতের সেনাবাহিনী সরকারিভাবে দ্ধোদের সাহায্যের দায়িত্ব গ্রহণ করে।

জেনারেল মানেকশ ১৯৭১ সালের মে হতে অক্টোবর মাসের মধ্যে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সাথে যুদ্ধ করার সকল প্রস্তুতি গ্রহণ করেন। একই সময় মুক্তিযোদ্ধাদের  আক্রমণে সহায়তা করেন। তারা মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদান করে।

পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য ভারতের ইস্টার্ন কমান্ডের ৩টি নিয়মিত এবং একটি কমিউনিকেশন জোন ছিল। তারা বাংলাদেশকে ৫টি সেক্টরে বিভক্ত করে সেনাবাহিনী মোতায়েন করেন। কমান্ডার ছিলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা।

 

ভারতীয় সেনাবাহিনীর অবস্থান-নভেম্বর ১৯৭১

উত্তর সেক্টর:  ময়মনসিংহ, টাঙ্গাইল, ঢাকা। সদর দফতর: শিলিগুড়ি।  অধিনায়ক মেজর জেনারেল গুরুক্স সিং

উত্তর পশ্চিম সেক্টর: রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া, রাজশাহী, পাবনা। সদর দফতর: শিলিগুড়ি।

৩৩ কোর কমান্ডার মেজর জেনারেল থাপ্পা ৬ নম্বর মাউন্টেন ডিভিশন মেজর জেনারেল পিপি রেড্ডি ৯ম মাউন্টেন ডিভিশন মেজর জেনারেল লচমন সিংহ।

পশ্চিমাঞ্চল সেক্টর: কুষ্টিয়া, যশোর, ফরিদপুর, খুলনা, বরিশাল-পটুয়াখালী। সদর দফতর নদীয়া জেলার কৃষ্ণনগর।

ভারতীয় বাহিনীর ২ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টি এন রায়না, নবম ডিভিশন মেজর জেনারেল দলবীর সিংহ, চতুর্থ মাউন্টেন ডিভিশন অধিনায়ক মেজর জেনারেল মহিন্দর সিং বারা।

পৃষ্ঠা: ৩২১

 

 

পূর্ব সেক্টর: সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী, চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম। সদির দফতর: আগরতলা।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৪র্থ কোর কমান্ডার লে. জেনারেল সাগত সিং, ৮ম মাউন্টেন  মেজর জেনারেল কৃষ্ণ রায়, ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশনের মেজর জেনারেল আরটি  হীরা ১০১ কমিউনিকেশন জোন-৯৫, ৬৩ ব্রিগেড-অধিনায়ক মেজর জেনারেল জি এম গিল, মেজর জেনারেল নাগরা

ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল পি সি লাল কলকাতায় অবস্থিত অধিনায়কের স্থান সমন্বয় করতেন।

 

ট. যৌথ বাহিনী গঠন ও বিজয়

ভারতের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের যুদ্ধ ঘোষণা

১৯৭১ সালের ২৯ নভেম্বর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান, জেনারেল হামিদ বিমান ও নৌবাহিনী প্রধানদের সাথে আলোচনা করে ৩ ডিসেম্বর ভারত আক্রমণ এবং পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধের ফ্রন্ট খোলার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেল ৪টা ২০ মিনিটে পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভারত আক্রমণ করে। পাকিস্তানের বিমান ভারতের বিমান বন্দর অমৃতসর, পাঠানকোটে বোমা বর্ষণ করে। একই দিনে ভারতও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ৪ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান বাহিনী তেজগাঁও ও কুর্মিটোলা বিমানবন্দর আক্রমণ করে ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে। পাকিস্তান বিমান বাহিনীর পূর্বাঞ্চলে মাত্র ১৪টি স্যাবর জেট ছিল। এগুলো রাতে কোনো অভিযান পরিচালনা করতে পারত না।

 

যৌথ বাহিনী গঠন

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর বিকেলে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতা জনসভায় ভাষণ দিচ্ছিলেন। এ সময় তাকে পাকিস্তানিদের আক্রমণের কথা বলা হয়। তিনি সন্ধ্যায় দিল্লি ফিরে এসে মন্ত্রিসভার আহ্বান করেন। সভায় পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর ভারত সরকার ও বাংলাদেশ সরকার মিত্র বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। মিত্র বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হলেন পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল

পৃষ্ঠা: ৩২২

 

 

জগজিৎ সিং অরোরা।

যুদ্ধ শুরুর সময় পূর্বাঞ্চলে ভারত-পাকিস্তান সেনাবাহিনীর অবস্থান নিম্মরূপ ছিল:

ভারত পাকিস্তান
৮,২৩,৫৭০ তিন ডিভিশন নিয়ে গঠিত ৪ নম্বর করপস মাঝে ছিল ৩টি আর্মার্ড স্কোয়াড্রন ১৪,৩৯ ডিভিশন ১৯ক ৫৩ক ব্রিগেড
যশোর সেক্টর
৪ এবং ৯ম ডিভিশন নিয়ে গঠিত ২ করপস। এ ছাড়া ছিল একটি ব্রিগেড এবং ২ আর্মার্ড রেজিমেন্ট ২ ব্রিগেড নিয়ে ৯ম ডিভিশন একটি আর্মার্ড স্কোয়াড্রন-৮টি ট্যাংক
ঢাকা ময়মনসিংহ
১০১ কমিউনিকিশেন জোন

৯৫, ৬৩ ব্রিগেড

৯৩ ব্রিগেড, ৩১৪ ব্রিগেড

নিয়ে গঠিত ৩৩৬ এ ডিভিশন

রাজশাহী সেক্টর
২০, ৬ মাউন্টেন ডিভিশন নিয়ে ৩৩ করপস-এর সাথে ছিল একটি পৃথক ব্রিগেড। ১৬ নম্বর ডিভিশন এবং ২৯ ক্যাভালরি
ভারতীয় বিমান বাহিনীর ১৭ স্কোয়াড্রন এম ইউ-৭ এবং মিগ-২১ ৫টি বিমান বন্দর ভিক্রান্তসহ ভারতীয় নৌবাহিনীর স্কোয়াড্রন পিএএফ-এক স্কোয়াড্রন

একটি বিমানবন্দর

 ৪টি গানবোট

 

১৯৭১ সালে ডিসেম্বর মাসে ভারত ও পাকিস্তানের সামরিক শক্তির তুলনামূলক সংখ্যা নিম্নে উল্লেখ করা হলো-

  ভারত পাকিস্তান
মোট সৈন্য ৮ লাখ ২৮ হাজার  মূল বাহিনী ৩ লাখ ৫০ হাজার মূল বাহিনী
সাঁজোয়া ডিভিশন ১টি ২টি
সাঁজোয়া ব্রিগেড ১টি
পদাতিক ডিভিশন ১৩ ১২
সাবিস্টেন ব্রিগেড ১০
প্যাটন ট্যাংক ৪০০
চীনা ট্যাংক ২০০
টি ৪৪-৫৫ রুশ ৪৫০ ২৫০
বৈজয়ন্তী ট্যাংক ৩০০
বিমান বাহিনী
বিমান লোকবল ৯০০০০ ১৫০০০
জঙ্গী বিমান ৬২৫ ১৭০
ক্যানবেরা বোমারু ৫০ ১১
বি ৫৭ ৫০ ১১
মিগ-১৯ ৫ স্কোয়াড্রন
মিগ-২১ ১২০
এফ ৮৫ ৭ স্কোয়াড্রন
৩৩ মিজার ৮০
ন্যাট ১৫০
এম ইউ ১৪০
নৌবাহিনী
নৌ সৈন্য ৪০০০০ ৯৫০০
ক্রুজার
ডেস্ট্রয়ার
সাবমেরি
বিমানবাহিনী জাহাজ

 

যুদ্ধ পরিচালনার জন্য মিত্র বাহিনী বাংলাদেশকে নিমোক্ত সেক্টরে বিভক্ত করে।

৩ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনীর অবস্থান

  মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার
পশ্চিম সেক্টর ৮ম সেক্টর মেজর মঞ্জুর
৯ম সেক্টর মেজর এম এ জলিল
পশ্চিম উত্তর সেক্টর ৭ম সেক্টর কর্নেল নুরুজ্জামান
৬ষ্ঠ সেক্টর গ্রুপ ক্যাপ্টেন এম কে বাশার
পূর্ব দক্ষিণাঞ্চল ১১তম সেক্টর উইং কমান্ডার হামিদুজ্জামান
  ৫ম সেক্টর মেজর মীর শওকত আলী
  ৪র্থ সেক্টর মেজর সি আর দত্ত
  ৩য় সেক্টর ব্রিগেড কমান্ডার
  ২য় সেক্টর মেজর সফিউল্লাহ

এ টি এম হায়দার

  ১ম সেক্টর মেজর রফিকুল ইসলাম

ব্রিগেড কমান্ডার মেজর জিয়াউর রহমান

 

পশ্চিম অঞ্চলের রণাঙ্গন

পশ্চিমাঞ্চলে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার ছিলেন লে. জেনারেল রায়না। তার সাথে ছিলেন মেজর জেনারেল এস বারার, মেজর জেনারেল দলবীর সিংহ, মুক্তিবাহিনীর মেজর মঞ্জুর, মেজর জলিল। ৪ ডিসেম্বর পশ্চিমাঞ্চলে যুদ্ধ শুরু হয়। যশোরের বয়রা ও চৌগাছা যুদ্ধে পাকবাহিনী পরাজয় বরণ করে পিছু হটে যায়। ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী সকাল ৮টায় যশোর ক্যান্টনমেন্ট আক্রমণ করে এবং ৭ ডিসেম্বর দুপুরের মধ্যে মিত্র বাহিনী যশোর দখল করে। পাকবাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত হয়ে ফরিদপুর ও খুলনার দিকে পালিয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর বিজয়ীর বেশে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী যশোর শহরে প্রবেশ করেন। যশোর দুর্গের পতনের পর পাকবাহিনী সকল সেক্টরে পরাজিত হতে থাকে। ৮ ডিসেম্বর বরিশাল, পটুয়াখালী জেলা মুক্ত হয়।

১৪ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ফরিদপুর দখল করে। ১৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ঢাকার সন্নিকটে পৌঁছে।

 

উত্তর-পশ্চিম সেক্টর

মিত্র বাহিনী ৩ ডিসেম্বর ঠাকুরগাঁও, ১০ ডিসেম্বর গাইবান্ধা, ১১ ডিসেম্বর হিলি এবং ১৬ ডিসেম্বর বগুড়া দখল করে। মিত্র বাহিনী দিনাজপুর ও রংপুর বিচ্ছিন্ন করে ফেলে।

 

উত্তর অঞ্চল

ময়মনসিংহ, জামালপুর, টাঙ্গাইল

মিত্র বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল গুরবক্স সিং। ৯ ডিসেম্বর মিত্রবাহিনী জামালপুর দখল করে। টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকী মিত্রবাহিনীর সহায়তায়

পৃষ্ঠা: ৩২৫

 

 

এগিয়ে আসেন। যুদ্ধকালে গুরুবক্স আহত হলে তার স্থলে মেজর জেনারেল নাগরা কমান্ডার নিযুক্ত হন। পাকবাহিনীর সঙ্গে মিত্র বাহিনীর ভয়াবহ যুদ্ধ চলে। মিত্রবাহিনী ঢাকা ঘিরে ফেলে। ১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ও জামায়াত-রাজাকার আলবদর বাহিনী শতাধিক বুদ্ধিজীবী হত্যা করে। হত্যাকাণ্ডের নায়ক ছিল মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী।

 

দক্ষিণ-পূর্ব সেক্টর

মিত্র বাহিনী সিলেট, ব্রাহ্মণবাড়িয়া ও কুমিল্লায় অবস্থানরত পাক বাহিনীর বিরুদ্ধে দুর্ধর্ষ আক্রমণ চালায়। মিত্র বাহিনীর অধীনে ভারতীয় বাহিনীর ৮ ও ৫৭ মাউন্টেন ডিভিশন এবং ৩, ৪, ৫ নম্বর সেক্টরের মুক্তিবাহিনী। পাক বাহিনীর মেজর জেনারেল কাজী আবদুল মজিদ ১৪ ডিভিশন নিয়ে যুদ্ধে পরাজয় বরণ করেন। পাক বাহিনী ঢাকা পালিয়ে যাওয়ার পথে ভৈরব ব্রিজ উড়িয়ে দেয়। মিত্র বাহিনী মেঘনা নদী অতিক্রম করে ঢাকার উপকণ্ঠে পৌঁছে।

 

কুমিল্লা-ময়নামতি

ভারতীয় বাহিনীর ৬১ মাউন্টেন ব্রিগেড আগরতলা হতে অভিযান চালায়। তাদের সঙ্গে ছিল মুক্তিবাহিনীর ২ নম্বর সেক্টর। পাক বাহিনীর ব্রিগেডিয়ার হকি খেলোয়ার আতিক সম্মুখ যুদ্ধে পরাজিত হয়ে ময়নামতি সেনানিবাসে আশ্রয় নেয়। ৯ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী কুমিল্লা শহর দখল করে। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনীর চার হাজার সৈন্য মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে।

 

লাকসাম-চাঁদপুর

মিত্র বাহিনীর নিকট পরাজিত হয়ে পাকবাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল রহিম চাঁদপুর হতে নদী পথে নারায়ণগঞ্জে পালিয়ে যান। তার বাহিনী ময়নামতি সেনানিবাসে পালিয়ে যায়। জেনারেল রহিম নারায়ণগঞ্জ যাওয়ার পথে মেঘনায় বিমান হামলায় আহত হন। তিনি হেলিকপ্টারে রেঙ্গুন যায় এবং সেখান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যান।

 

চট্টগ্রাম-পার্বত্য চট্টগ্রাম

ভারতীয় বাহিনীর ৯৭ পদাতিক ব্রিগেডে এবং মুক্তিবাহিনীর ১ নম্বর সেক্টর পাকবাহিনীকে শুভাপুর, সীতাকুণ্ড যুদ্ধে পরাজিত করে চট্টগ্রামের দিকে অগ্রসর হতে থাকে। ১৬ ডিসেম্বর পাক বাহিনী চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে আত্মসমর্পণ করে।

পৃষ্ঠা: ৩২৬

 

 

২৭ ডিসেম্বর ১ নম্বর সেক্টরের কমান্ডার মেজর রফিকুল ইসলাম বিজয় বেশে চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করেন।

 

বিমান যুদ্ধ

১৯৭১ সালে ৪ ডিসেম্বর, ২.৪০ মিনিটে ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকা বিমানবন্দর আক্রমণ করে। ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় বিমান ঢাকা বিমানবন্দর সম্পূর্ণ ধ্বংস করে দেয়। পাকিস্তান বিমানবাহিনী সৈন্যদের বিমান সহায়তা দিতে না পারায় তাদের পরাজয় ত্বরান্বিত হয়।

 

নৌযুদ্ধ

পাকিস্তানের নৌশক্তির গর্ব সাবমেরিন গাজী ২১ নভেম্বর ভারতের যুদ্ধজাহাজ রাজপুত টাস্কফোর্স বিশাখাপট্টমে গাজীর সন্ধান পায়। ৪ ডিসেম্বর গাজীকে ডেপথ চার্জ করে ধ্বংস করে দেয়। ৭ ডিসেম্বর খবর পাওয়া যায় গাজী চূর্ণবিচর্ণ হয়ে সমুদ্রে তলিয়ে যায়।

ভারতের নৌবাহিনী প্রধান এডমিরাল এন কৃষ্ণার পরামর্শে ৭ খানা যুদ্ধজাহাজ নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। ১৩ নভেম্বর তারা আন্দামান যাত্রা করে। তাদের উদ্দেশ্য হলো পাকিস্তানি নৌবাহিনীকে বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করতে না দেওয়া।

ভারতীয় যুদ্ধজাহাজ ভিক্রান্ত ৪টি ফ্রিগেট এবং একটি সাবমেরিন পরিবেষ্টিত হয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার যাত্রা করে ও ভিক্রান্তের ফ্রিগেট থেকে বিমান উপকূলীয় অঞ্চলে বিমান হামলা চালায়। ১০ ডিসেম্বর ভুল ক্রমে ভিক্রান্তের সি-হক বিমান মুক্তিবাহিনীর পদ্মা ও পলাশ ডুবিয়ে দেয়। এ আক্রমণে নৌসেনা রুহুল আমিন শহীদ হন। পূর্ব পাকিস্তানে পাক বাহিনীর নৌশক্তি ছিল না। মিত্র বাহিনীকে প্রতিহত করতে তারা সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়। বঙ্গোপসাগর মিত্র বাহিনী পূর্ণ দখলে চলে আসে।

 

১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা

পাক বাহিনী সকল সেক্টরে মিত্রবাহিনীর নিকট চরমভাবে পরাজিত হচ্ছে। এ মুহূর্তে পাকবাহিনী ও জামায়াত ইসলাম ১৪ ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করে। তারা বুদ্ধিজীবীর বাসায় বাসায় বদর বাহিনী প্রেরণ করে। পাকিস্তানি মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জামায়াত নেতাদের নিয়ে হত্যার জন্য তালিকা প্রণয়ন করেন।

পৃষ্ঠা: ৩২৭

 

 

১৪ ডিসেম্বর রাতে তারা নিম্নলিখিত বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে:

১. অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী-ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

২. অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৩. ডা. মুহাম্মদ মুর্তজা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

৪. অধ্যাপক আনোয়ার পাশা- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৫. অধ্যাপক ড. আবুল খায়ের- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ইতিহাস

৬. অধ্যাপক গিয়াস উদ্দিন আহমদ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,  ইতিহাস

৭. অধ্যাপক সন্তোষ ভট্টাচার্য- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ইতিহাস।

৮. অধ্যাপক রশিদুল হাসান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রবিজ্ঞান

৯. শহিদুল্লা কায়সার-সাংবাদিক-সাহিত্যিক

১০. সিরাজউদ্দিন হোসেন-বার্তা সম্পাদক, দৈনিক ইত্তেফাক

১১. ডা. ফজলে রাব্বী-অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

১২. মুহাম্মদ ইয়াকুব মিয়া-আওয়ামী লীগ নেতা।

পূর্ব পাকিস্তান সামরিক সরকার উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের ১৪ ডিসেম্বর হত্যার পরিকল্পনা করে এবং তারা গভর্নর হাউজে এক বৈঠকের আহ্বান করে। ১৪ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজে একটানা বোমাবর্ষণ করলে হত্যার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়।

 

নৌ-কূটনীতি- সপ্তম নৌবহর

আমেরিকা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করার জন্য যে সকল পদক্ষেপ নিয়েছিল তার মধ্যে ভয়ঙ্কর ছিল বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণ। নৌবহর প্রেরণের উদ্দেশ্য ছিল-

* ভারতকে যুদ্ধবিরতি মানতে বাধ্য করা।

* মুক্তিযুদ্ধকে স্তব্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের মূলোৎপাটন করা।

* বাংলাদেশে যুদ্ধবিরতি স্থায়ী করে পাকিস্তানি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করা।

১৯৭১ সালে ৮ ডিসেম্বর আমেরিকার হোয়াইট হাউজে স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপের গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। ৯ ডিসেম্বর আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিক্সন বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আমেরিকার টাস্কফোর্স সপ্তম নৌবহর ভিয়েতনামের টনকিন উপসাগরে অবস্থান করছিল। সপ্তম নৌবহরে ৮টি জাহাজ ছিল। দলপতি জাহাজের নাম ছিল এন্টারপ্রাইজ। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের নির্দেশে সপ্তম নৌবহর ৯ ডিসেম্বর যাত্রা শুরু করে। ১০

পৃষ্ঠা: ৩২৮

 

ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালিতে একত্রিত হয়। ১২ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ করে এবং ২০ ডিসেম্বর পৌঁছবে।

ভারতের আন্দামান নিকোবর কমিউনিকেশন সেন্টারের রাডার সপ্তম নৌবহরের বঙ্গোপসাগরে প্রবেশ ধরে ফেলে। সাথে সাথে ভারত সরকার সোভিয়েত ইউনিয়নকে জানিয়ে দেয়। সংবাদ পেয়েই রাশিয়ার নৌবাহিনীর ২০টি জাহাজের নৌবহর বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে অবস্থান নেয়। বঙ্গোপসাগরের দিকে সোভিয়েত রাশিয়ার টাস্কফোর্স আসতে দেখে আধঘণ্টার মধ্যে আমেরিকা সপ্তম নৌবহর গতি পরিবর্তনের নির্দেশ দেয়। সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরের যাওয়ার গতিপথ পরিবর্তন করে শ্রীলঙ্কার দিকে যাত্রা করে। একটি আসন্ন তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ হতে পৃথিবী রক্ষা পায়।

রাশিয়া সপ্তম নৌবহরকে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে হস্তক্ষেপ করতে দেবে না। যদি চীন ভারতের উত্তর সীমান্তে আক্রমণ চালায় তাহলে রাশিয়া চীনের সিংকিয়াম আক্রমণ করবে।

বৃটিশ সাংবাদিক এন্ডারসন বলেন, This is how the big powers danced precariouslyon the edge of the brink just before christmas as people song about peace on earth and good will toward men. যখন ক্রিসমাস সমাগত প্রায়, যখন মানুষ পৃথিবীর শান্তি এবং মানুষের জন্য ভালোবাসার গান করবে- তার পূর্ব মুহূর্তে বৃহৎ শক্তি যুদ্ধে নগ্নভাবে নৃত্য করছে।’

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধকে ধ্বংস করার লক্ষ্যে আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. হেনরি কিসিঞ্জারের পরামর্শে প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিমানবাহী পারমাণবিক জাহাজ এন্টারপ্রাইজের নেতৃত্বে ৮টি জাহাজ সজ্জিত টাস্কফোর্স বঙ্গোপসাগরে পাঠাবার নির্দেশ দিয়েছেন। ৯ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর সিঙ্গাপুর হয়ে ভারত মহাসাগরে পৌঁছে। ১২ ডিসেম্বর নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে চলছে। কিন্তু হঠাৎ হোয়াইট হাউজের নির্দেশে সপ্তম নৌবহর শ্রীলঙ্কার দিকে গতি পরিবর্তন করে। ১৬ ডিসেম্বর সপ্তম নৌবহর শ্রীলঙ্কার উত্তর-পূর্ব কোণে সমুদ্রে এসে নোঙ্গর করে। গতি পরিবর্তনের কারণ যে, ভারত মহাসাগরে রাশিয়ার নৌবহরের উপস্থিতি। সমগ্র বঙ্গোপসাগর মুক্ত। ভারতীয় নৌবাহিনীর বিমানবাহী জাহাজ ভিক্রান্ত এককভাবে বঙ্গোপসাগরে তৎপর ছিল। এভাবে আমেরিকা নৌ-কূটনীতিতে পরাজয় বরণ করে।

 

জাতিসংঘ

১৯৭১ সালে জাতিসংঘের সবচেয়ে আলোচ্য বিষয় ছিল নিরাপত্তা পরিষদে চীনের

পৃষ্ঠা: ৩২৯

 

 

সদস্য পদ লাভ এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগ্রাম দমনের জন্য পাকিস্তান বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। নারীরা নির্যাতিত হয়েছে। এক কোটি মানুষ পাকবাহিনীর নিষ্ঠুর নির্যাতনের কারণে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘন ও শরণার্থী সমস্যার কারণে বাংলাদেশের সমস্যা আর অভ্যন্তরীণ বিষয় ছিল না। তা আন্তর্জাতিক সমস্যা হয়ে দাঁড়ায়।  জাতিসংঘ শরণার্থীদের জন্য প্রিন্স সদর উদ্দিনকে ভারতে হাইকমিশনার নিয়োগ করে। জাতিসংঘ খাদ্য ও অন্যান্য ত্রাণসামগ্রী শরণার্থীদের জন্য প্রেরণ করে। জন কেলিকে ঢাকায় UNHER-এর প্রতিনিধি নিয়োগ করে।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান আক্রমণ এবং ৪ ডিসেম্বর ভারত পাকিস্তান আক্রমণ করলে আমেরিকার অনুরোধে জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের সভা বসে। ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের সভা অভিলম্বে যুদ্ধবিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব পেশ করা হয়। নিরাপত্তা পরিষদের ১৫ জন সদস্যের মধ্যে ১১ জন সদস্য প্রস্তাবের পক্ষে ভোট প্রদান করে এবং বৃটেন ও গ্রীস ভোটদানে বিরত থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পোল্যান্ড প্রস্তাবের বিরোধিতা করে। সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রদান করে। ফলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

৫ ডিসেম্বর ৮ শক্তি পুনরায় নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধবিরতির প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভেটো প্রয়োগ করলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।

৭ ডিসেম্বর সাধারণ পরিষদের সভায় ৮ শক্তির প্রস্তাব আলোচনা করা হয়। যুদ্ধবিরতির পক্ষে ১০৪ ভোট এবং বিপক্ষে ১১ ভোট এবং ১০টি দেশ ভোটদানে বিরত থাকে। একই দিনে সাধারণ পরিষদ বিবেচনার জন্য নিরাপত্তা পরিষদে প্রেরণ করে। নিরাপত্তা পরিষদের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৩ ডিসেম্বর ভেটো প্রদান করে। পূর্বের ন্যায় পক্ষে ১১ ভোট, বিপক্ষে ২ ভোট এবং ২ সদস্য ভোট দানে বিরত থাকে। সোভিয়েত ইউনিয়ন তৃতীয়বারের মতো ভেটো প্রয়োগ করলে যুদ্ধবিরতি প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়।

১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২-০৫ মিনিটে নিরাপত্তা পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিনিধি অনুপস্থিত। ভারতের প্রতিনিধি ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর একক যুদ্ধবিরতির ঘোষণা পাঠ করে শোনান।

 

ভারত কর্তৃক স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান

১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারতীয় পার্লামেন্ট বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে

পৃষ্ঠা: ৩৩০

 

 

স্বীকৃতি প্রদান অনুমোদন  করে এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তা ঘোষণা দেন। ভারতের ঘোষণার ফলে বাংলাদেশের শরণার্থী ক্যাম্প ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে  আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং তাজউদ্দীন আহমদ ভারতকে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে ভাষণ দেন।

 

যশোরের পতন

১৯৭১ সালের ৭ ৭ ডিসেম্বর যশোর পতনের পর পাকবাহিনী সম্মুখযুদ্ধ পরিহার করে ঢাকার দিকে পালিয়ে যেতে থাকে। অনেক স্থানে মিত্রবাহিনী তাদের ঘেরাও করে রাখে। পাক বাহিনীর বিমান নেই। নৌবাহিনী নেই। তারা প্রতিরোধ করার শক্তি হারিয়ে ফেলেছে।

৭ ডিসেম্বর সকাল ১১টায় লে. জেনারেল নিয়াজী গভর্নর এ এম মালিককে পূর্ব পাকিস্তানের যুদ্ধ পরিস্থিতি সম্পর্কে অবহিত করেন। একই দিন ১২টায় গভর্নর প্রসিডেন্টের নিকট বার্তা প্রেরণ করেন। বার্তায় তিনি বলেন ৪৮ ঘন্টার মধ্যে সাহায্য আসতে হবে। তা না হলে সন্ধি করতে হবে। প্রাণহানি বন্ধ করে মধ্যে সাহায্য আসতে হবে। তা না হলে সন্ধি করতে হবে। প্রাণহানি বন্ধ করে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে।

৯ ডিসেম্বর ৯-৩০ মিনিটে জেনারেল নিয়াজী পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর চিফ অব স্টাফের নিকট বার্তা প্রেরণ করেন। তিনি জানান যে, অবস্থা খুবই সংকটময়। বিমানে সৈন্য পাঠাতে অনুরোধ করেন।

 

১০ ডিসেম্বর

১৩ দিনের পৃথিবী কাঁপানো যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটে ১০ ডিসেম্বর। মিত্র বাহিনী ঢাকা শহর ঘিরে ফেলেছে। ভারতের প্রধান সেনাপতি জেনারেল শ্যাম মানেকশ ৮ ডিসেম্বর থেকে পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিচ্ছেন। পাকবাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ছে। এমনি পরিস্থিতিতে ১০ ডিসেম্বর গভর্নর হাউজে গভর্নর এ এম মালেক, জেনারেল নিয়াজী, বেসামরিক প্রধান রাও ফরমান আলী এবং চিফ সেক্রেটারি মোজাফফর হোসেন উপস্থিত হন। ফরমান আলী ও মোজাফফর হোসেন প্রেসিডেন্ট ও জাতিসংঘে প্রেরণের জন্য পত্রের খসড়া প্রণয়ন করেন এবং চারজন তা অনুমোদন করেন। গভর্নর এ এম মালিক বার্তাটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং ঢাকার জাতিসংঘের সহকারী মহাসচিব মি. পল মার্কের নিকট প্রেরণ করেন। বার্তায় প্রস্তাব করা হয়-

এক. অবিলম্বে যুদ্ধবিরতি।

পৃষ্ঠা: ৩৩১

 

 

দুই. সম্মানের সাথে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে পশ্চিম পাকিস্তানে প্রেরণ।

তিন. পূর্ব পাকিস্তানের নাগরিক যারা পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরে যেতে চায় তাদের প্রেরণ করতে হবে।

চার. ১৯৪৭ সাল থেকে যারা বসতি স্থাপন করেছে তাদের নিরাপত্তা।

পাঁচ. পূর্ব পাকিস্তানে কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে প্রতিহিংসামূলক ব্যবস্থা না নেওয়ার নিশ্চয়তা।

বার্তায় গভর্নর জাতিসংঘকে শান্তিপূর্ণভাবে ক্ষমতা হস্তান্তরের আহ্বান জানান।

জাতিসংঘের প্রতিনিধি বার্তাটি পেয়ে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিকট প্রেরণ করেন। মহাসচিব তার অনুলিপি নিরাপত্তা পরিষদের প্রত্যেক সদস্যকে দেন।

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গভর্নরের বার্তাটি সংশোধন করে জাতিসংঘে প্রেরণ করেন।

১১ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী, রাওফরমান আলী পিন্ডিতে চিফ অব স্টাফকে জানান। “সকল সেক্টরে আমাদের সৈন্য প্রচণ্ড চাপের মুখে। দুর্গে তারা বিচ্ছিন্ন এবং শত্রু দ্বারা বেষ্টিত। শত্রুরা আকাশে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। স্থানীয় জনগণ ও বিদ্রোহীরাও আমাদের সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য বদ্ধপরিকর।

 

জেনারেল মানেকশর আত্মসমর্পণের বার্তা

৮ ডিসেম্বর আকাশবাণী থেকে ইংরেজি, হিন্দী এবং বাংলায় জেনারেল মানেকশর পাক সৈন্যদের উদ্দেশে তার নির্দেশ প্রদান শুরু করেন এবং ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে। বার্তায় বলা হয়, ‘হাতিয়ার ডালদো। মিত্র বাহিনী আপনার সৈন্যদের চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে। আপনার বিমানবাহিনী সম্পূর্ণ ধ্বংস। আপনি অস্ত্র সমর্পণ করুন।’ এ বার্তায় আরও বলা হয়, বিজয়ী সৈন্যদের কাছে আত্মসমর্পণের ঘোষণায় কোনো লজ্জা নেই। ১৪ ডিসেম্বর এ সম্পর্কে ছাপানো প্রচারপত্র বিমান থেকে পাক সেনা ছাউনিতে ফেলা হয়।

 

১৩ ডিসেম্বর

জেনারেল নিয়াজী রাওয়ালপিন্ডিতে নিম্নের বার্তা প্রেরণ করেন, “সকল সেনা ছাউনি চাপের মুখে। কোনো সরবরাহ নেই। এমনকি অস্ত্রের শূন্যতা পূরণ হচ্ছে না। বিদ্রোহীরা ইতোমধ্যে শহর ঘিরে ফেলেছে। ভারতীয়রা অগ্রসর হচ্ছে। অবস্থা খুবই সংকটময়। ১৪ ডিসেম্বরের মধ্যে প্রতিশ্রুতি অনুসারে সাহায্য আসতে হবে। শিলিগুড়ি নয় নেফায় আক্রমণ চালাতে হবে। শত্রুর বিমান ঘাঁটি ব্যস্ত রাখতে হবে।

পৃষ্ঠা: ৩৩২

 

 

১৩ ডিসেম্বর ভারতের বিমান গভর্নর হাউজে বোমাবর্ষণ করে।

১৩ ডিসেম্বর ১২-৩০ মিনিটে গভর্নর পদত্যাগ করেন। কারণ প্রেসিডেন্ট তার কথা শুনছেন না। গভর্নর, মন্ত্রী,রাও ফরমান আলী রেডক্রসের সঙ্গে আলোচনা করে সবাই হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আশ্রয় নেয়।

 

১৪ ডিসেম্বর

১৪ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় জেনারেল নিয়াজী ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান শ্যাম মানেকশর নিকট আত্মসমর্পণের বার্তা ঢাকার আমেরিকার কনসাল জেনারেল মি. সিপব্যাকের নিকট হস্তান্তর করেন। মি. সিপ্যাক বার্তার একটি অনুলিপি ওয়াশিংটনে প্রেরণ করেন। নিয়াজী তার সেনাবাহিনী, পাকিস্তানি নাগরিকদের পশ্চিম পাকিস্তানে নিরাপদ প্রত্যাবর্তনের শর্তে যুদ্ধবিরতিতে সম্মত হন। তিনি আরও বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রশাসন জাতিসংঘের ব্যবস্থাপনায় হস্তান্তর করা হবে।

১৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল হামিদ নিয়াজীকে ভারতের প্রধান সেনাপতির নির্দেশ অনুসারে যুদ্ধবিরতি গ্রহণের উপদেশ দেন।

ভারতের প্রধান সেনাপতি মানেকশা জেনারেল নিয়াজীর বার্তার উত্তর প্রেরণ করেন ১৫ ডিসেম্বর রাত ২০-৩০ মিনিটে।

১৬ ডিসেম্বর বিকেল ৩টায় ভারতীয় সেনাপতির দেওয়া শর্ত গ্রহণ করার জন্য পাকিস্তান সেনাপ্রধান নির্দেশ প্রদান করেন।

 

পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

১৪ ডিসেম্বর গভর্নর ৯-৩০ মিনিটে গভর্নর হাউজে একটি উচ্চ পর্যায়ে জরুরি সভা আহ্বান করেন। এ সংবাদ মিত্র বাহিনী জানতে পেরে গভর্নর হাউজে বিমানে বোমা বর্ষণ করে। ফলে সভা বন্ধ হয়ে যায়। ভয়ে গভর্নর ট্রেঞ্জে আশ্রয় নেন। তিনি পদত্যাগ করে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে ওঠেন।

১৫ ডিসেম্বর জেনারেল নিয়াজী জেনারেল মানেকশাকে যুদ্ধবিরতির বার্তা পাঠান। নিয়াজীর উত্তর পেয়ে উভয় পক্ষ যুদ্ধবিরতি মেনে নেয়। ১৫ ডিসেম্বর ১৭০০ ঘণ্টা থেকে ১৬ ডিসেম্বর সকাল ৯টা পর্যন্ত যুদ্ধবিরতি পালন করবে। নিয়াজীর অনুরোধে যুদ্ধবিরতির সময় ১৬ ডিসেম্বর ৩টা পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়।

পৃষ্ঠা: ৩৩৩

 

 

১৫ ডিসেম্বর রাতে ১০১ কমিউনিকেশন্স বাহিনীর কমান্ডার মেজর জেনারেল নাগরা, টাঙ্গাইলের কাদের সিদ্দিকীর বাহিনী কালিয়াকৈর হয়ে তুরাগ নদীর পূর্ব পারে পৌঁছে। ১৬ ডিসেম্বর ৬টায় তারা দেখলেন গোলাবর্ষণ হচ্ছে। জেনারেল নিয়াজী সকল সেনা ছাউনিতে যুদ্ধবিরতির বার্তা পাঠিয়েছে। নাগরা সিদ্ধান্ত নিলেন এই মুহূর্তে নিয়াজীর নিকট দূত পাঠাবেন। সকাল ৯টায় নাগরা বার্তা নিয়ে দূত নিয়াজীর নিকট পৌঁছে। পাকবাহিনীর ঢাকা জিওসি মেজর জেনারেল মোহাম্মদ জামসেদ নাগরাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের জন্য মিরপুর ব্রিজের পশ্চিম পাশে যান। জেনারেল নাগরা ও কাদের সিদ্দিকী সাদা ফ্লাগ উড়িয়ে মিরপুর ব্রিজের পশ্চিম পার এলেন। জামসেদ তাদের অভ্যর্থনা জানায়। তারা ইস্টার্ন আর্মির হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেন। নিয়াজী সকলের সাথে করমর্দন করেন। এ সময় কাদের সিদ্দিকী নিয়াজীর সাথে হাত মিলাতে অস্বীকার করেন। কারণ যারা নারী নির্যাতন করেছে তাদের সাথে তিনি হাত মিলাবেন না।

১৬ ডিসেম্বর দুপুর ১২টায় কলকাতায় থিয়েটার রোডে খবর এল পাক বাহিনী বিকেল তিনটায় আত্মসমর্পণ করবে। ভারতীয় বাহিনী চাচ্ছে মুক্তিবাহিনী প্রধান কর্নেল এম এ জি ওসমানী বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করবেন। কিন্তু ওসমানী যেতে অস্বীকার করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তি বাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকারকে ঢাকার আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে প্রেরণ করেন। মিত্র বাহিনীর লে. জেনারেল জ্যাকব ও এ কে খন্দকার দুপুর ১টায় ঢাকা আর্মি হেডকোয়ার্টারে পৌঁছেন এবং আত্মসমর্পণের আয়োজন করেন। বিকেল ৪-৩০ মিনিটে মিত্রবাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা বিমানে ঢাকা পৌঁছেন। জেনারেল আরোরা, জেনারেল নিয়াজী, জেনারেল জ্যাকব, গ্রুপ ক্যাপ্টেন এ কে খন্দকার প্রমুখ রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছেন। প্রথমে মিত্র বাহিনীর প্রধান লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করেন এবং তারপর পাকিস্তান বাহিনী লে. জেনারেল আমির আবদুল্লাহ নিয়াজী দলিলে স্বাক্ষর করেন। স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণ দলিল নিম্নে উদ্ধৃত হলো:

ইংরেজি ভাষায় স্বাক্ষরিত আত্মসমর্পণ দলিলের বঙ্গানুবাদ

“পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি বাংলাদেশে অবস্থিত সকল সশস্ত্র সেনাবাহিনী নিয়ে পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতি লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার নিকট আত্মসমর্পণ করতে সম্মত হয়। পাকিস্তানের সকল স্থল, বিমান ও নৌবাহিনী, প্যারামিলিটারি এবং বেসামরিক সশস্ত্র সেনাবাহিনী এ আত্মসমর্পণের অন্তর্ভুক্ত হবে। এ সকল সৈন্য

পৃষ্ঠা: ৩৩৪

 

তাদের অস্ত্র পরিত্যাগ করবে এবং লে. জেনারেল জগজিৎ সিংহের অধীনস্থ নিকটস্থ নিয়মিত বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করবে।

এ দলিল সাক্ষরের সাথে সাথে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাবাহিনী লে. জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরার অধীনে চলে আসবে। নির্দেশ ভঙ্গ করলে তা  শর্ত ভঙ্গকরণ হিসেবে বিবেচিত হবে এবং তা যুদ্ধের রীতি ও আইন অনুসারে বিচার করা হবে। যদি আত্মসমর্পণের শর্তের সম্পর্কে কোনো সন্দেহ অথবা ব্যাখ্যার প্রয়োজন দেখা দেয় তাহলে জগজিৎ সিংহ অরোরার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত বলে বিবেচিত হবে।

লে. জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরা নিশ্চিত আশ্বাস দেন, যে সকল সৈন্য আত্মসমর্পণ করবে তাদের সাথে জেনেভা কনভেনশনের বিধির অধীনে সেনাবাহিনীর প্রাপ্যতা অনুসারে পূর্ণ মর্যাদা ও সম্মানের সাথে ব্যবহার করা হবে এবং পাকিস্তানের সৈন্য এবং প্যারামিলিটারি যারা আত্মসমর্পণ করছে তাদের নিরাপত্তা ও মঙ্গলের নিশ্চয়তা প্রদান করবে। লে. জেনারেল জগজিৎ সিংহ অরোরার অধীনের সেনাবাহিনী বিদেশি নাগরিক, জাতিগত সংখ্যালঘু এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নাগরিকদের নিরাপত্তা প্রদান করবে।”

জগজিৎ সিংহ অরোরা

লে. জেনারেল

পূর্বাঞ্চলীয় ভারতীয় এবং বাংলাদেশ

বাহিনীর প্রধান সেনাপতি

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী

লে. জেনারেল

সামরিক প্রশাসক জোন-খ এবং

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি

১৬ ডিসেম্বর, ১৯৭১

 

পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় সেনাপতি লে. জেনারেল আমীর আবদুল্লাহ নিয়াজী পাকিস্তানের ৯৩ হাজার সৈন্য নিয়ে মিত্র বাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করেন। তিনি তার বেল্ট ও ব্যাজ দুটো খুলে এবং ৩৮ বোরের রিভলভার অরোরার হাতে সমর্পণ করেন। তখন নিয়াজী নীরবে কাঁদছিলেন। সন্ধ্যা হয়ে আসছে। রেসকোর্স ময়দানে ১০ লাখ লোক উপস্থিত। তারা নিয়াজী ও পাক বাহিনী বিরোধী স্লোগান দিচ্ছে।

১৭ ডিসেম্বর ভারতীয় বাহিনীর মেজর তারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে মুক্ত করেন।

২০ ডিসেম্বর সকালে লে. জেনারেল এ এ কে নিয়াজী, মেজর জেনারেল রাওফরমান আলী, এডমিরাল শরীফ, এয়ার কমোডোর ইনামুল হক, ব্রিগেডিয়ার বাকের সিদ্দিকী, জনসংযোগ কর্মকর্তা সিদ্দিক সালিককে যুদ্ধবন্দি হিসেবে ঢাকা থেকে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে আটক রাখা হয়। পরে মেজর জেনারেল নজর

পৃষ্ঠা: ৩৩৫

 

 

হোসেন আনসারী, কাজী মজিদ, মেজর জেনারেল জামসেদকে কলকাতায় পাঠানো হয়।

 

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর ঘোষণা

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ভারতীয় পার্লামেন্টে বলেন, “আজ আমি একটি ঘোষণা দিচ্ছি। ঢাকায় ১৬-১৩ ঘণ্টায় আত্মসমর্পণ দলিল স্বাক্ষরিত হয়েছে।

ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রয়োজনের চেয়ে বেশি সময় বাংলায় অবস্থান করবে না।

আমরা বিশ্বাস করি নতুন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগণের মধ্যে সঠিক স্থান পাবেন এবং বাংলাদেশকে শান্তি, প্রগতি ও সমৃদ্ধির পথে পরিচালিত করবেন।”

 

প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিদায়

১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ ও সেনাবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে ক্ষুব্ধ হয়। তার পদত্যাগের জন্য চাপ দিতে থাকে। জনগণের দাবি- জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন। জুলফিকার আলী ভুট্টো নিউইয়র্ক থেকে পাকিস্তানে ফিরে আসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২০ ডিসেম্বর পদত্যাগ করেন। একই দিনে জুলফিকার আলী পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নিযুক্ত হন।

 

বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় স্থানান্তরিত

১৭ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন।

১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশে বেসামরিক প্রশাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়।

১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর রাজধানী কলকাতার ৮ নম্বর থিয়েটার রোড হতে ঢাকায় স্থানান্তরিত হয়। মুজিবনগর সরকারে মন্ত্রিসভা ২২ ডিসেম্বর ঢাকায় ফিরে আসেন।

 

বাংলাদেশ সচিবালয়

২৩ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সরকারের প্রথম মন্ত্রিসভার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম।

পৃষ্ঠা: ৩৩৬

 

 

শহীদ বুদ্ধিজীবী

১৯৭১ সালে পাকবাহিনী লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করে। লক্ষ লক্ষ শহীদদের মধ্যে বদ্ধিজীবীর নাম নিম্নে স্মরণ করা হলো। এ তালিকায় সম্মুখযুদ্ধে শহীদদের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়নি।

নাম পরিচয় হত্যার তারিখ
লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ২নং আসামী ২৬ মার্চ ১৯৭১
ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেব অধ্যাপক, দর্শন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ মার্চ ১৯৭১
অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য অধ্যাপক, দর্শন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ মার্চ
অমল কৃষ্ণ সোম অভিনেতা, যশোর ২৬ মার্চ
ডাঃ আজহারুল হক ফ্রী স্কুল রোড ১৫ নভেম্বর
আব্দুর রউফ সরকার পরিচালক, নিপা, ঢাকা ৮ ডিসেম্বর
আতাউর রহমান খান খাদিম অধ্যাপক, পদার্থ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ মার্চ
আ স ম গোলাম মোস্তফা সাংবাদিক, দৈনিক আজাদ ১১ ডিসেম্বর
আনোয়ার পাশা অধ্যাপক, বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
আনোয়ারুল আজীম গোপালপুর, সুগার মিল ৫ মে
আব্দুল আহাদ এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট ১৯ মে
সৈয়দ আলমগীর ছাত্রলীগ নেতা, বরিশাল নভেম্বর
আব্দুল আলিম অধ্যাপক, ঝিনাইদহ ক্যাডেট কলেজ সেপ্টেম্বর
আলতাফ মাহমুদ একুশে গানের সুরকার এপ্রিল
আবুল কালাম আজাদ অধ্যাপক ১৫ ডিসেম্বর
আবুল কালাম মোঃ শাহাবুদ্দিন প্রকৌশলী, ওয়াপদা ১৫ এপ্রিল
আমিন উদ্দীন এমপি, পাবনা ২৯ মার্চ
আবুল খায়ের অধ্যাপক, ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১০ ডিসেম্বর
আব্দুর রাজ্জাক এসডিও, পিরোজপুর মে
আতিকুল্লাহ সার্কেল অফিসার, পাথরঘাটা মে
এএনএম মনিরুজ্জামান অধ্যাপক, পরিসংখ্যান, ঢা.বি ২৫ মার্চ
ডাঃ এএফ জিয়াউর রহমান প্রাক্তন অধ্যক্ষ, সিলেট মেডিকেল কলেজ ১৫ এপ্রিল
এএফএম লুৎফর রহমান অধ্যাপক, ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজ ১৪ ডিসেম্বর
এ কে শামসুদ্দিন সিএসপি এসডিও, সিরাজগঞ্জ ৬ ডিসেম্বর
এ এম সাদেক শিক্ষক, ল্যাবরেটরী স্কুল, ঢাকা মার্চ
এটিএম জাফর আলম ছাত্র, ইকবাল হল ২৬ মার্চ
এসএএম ফয়জুল মহী অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
এমএ মান্নান লাডু ভাই ক্রীড়া ব্যক্তিত্ব ১৯৭১
কছিম উদ্দিন আহমেদ পাবনা জেলা স্কুল ৪ জুন
কাজী আজিজুল ইসলাম অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক, বরিশাল মে
ডাঃ কাজী ওবায়দুল হক যশোর ৫ এপ্রিল
কাজী শামসুল হক আওয়ামী লীগ নেতা, স্বরূপকাঠি, পিরোজপুর জুন
কামিনী কুমার ঘোষ আইনজীবী ও সমাজ সেবক, চট্টগ্রাম ২৫ এপ্রিল
খালেদ রশীদ অধ্যাপক, সুন্দরবন কলেজ ১৪ আগস্ট
গিয়াস উদ্দিন আহমদ অধ্যাপক, ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
গণপতি হালদার ছাত্র, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মে
গোলাম হোসেন অতিরিক্ত এসপি, বরিশাল ৩ মে
জহির রায়হান সাহিত্যিক, চলচ্চিত্রকার ৩০ জানুয়ারি
জিকরুল হক সংসদ সদস্য, পাবনা ২৬ মার্চ
জিতেন্দ্র লাল দত্ত এডভোকেট, বরিশাল বার ১৪ আগস্ট
জোতির্ময় গুহঠাকুরতা অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢা.বি ৩০ মার্চ
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সাবেক সংসদ সদস্য, এডভোকেট কুমিল্লা ২৭ মার্চ
নজরুল ইসলাম প্রকৌশলী, ওয়াপদা ২২ জুলাই
নিজামুদ্দীন আহমদ সাংবাদিক, বিবিসি ১২ ডিসেম্বর
নজরুল ইসলাম ছাত্রনেতা, বরিশাল নভেম্বর
নূতন চন্দ্র সিংহ কুণ্ডেশ্বরী ঔষধালয় ১৩ মে
মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন চিফ পার্সোনাল অফিসার, রেলওয়ে, চট্টগ্রাম ১১ মে
নুরুল আমিন সিএসপি সাবেক ডিসি, বরিশাল ২০ মে
ফয়জুর রহমান ডিএসপি পিরোজপুর মে
বীরেন্দ্রনাথ সরকার আইনজীবী, রাজশাহী ৩ এপ্রিল
মশিউর রহমান এমএনএ, যশোর ৩০ মার্চ
মামুন মাহমুদ পিএসপি ডিআইজি পুলিশ রাজশাহী ২৬ মার্চ
মিজানুর রহমান ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট পিরোজপুর মে
মজিবর রহমান কাঞ্চন আওয়ামী লীগ নেতা, বরিশাল মে
মোহাম্মদ শাহজাহান পাথরঘাটা অক্টোবর
মুজিবর রহমান কনক পাথরঘাটা অক্টোবর
মীর আব্দুল কাইয়ুম অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ২৫ নভেম্বর
মুনীর চৌধুরী অধ্যাপক, বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
মুহাম্মদ আব্দুল মুকতাদির ওয়াপদা ২৬ মার্চ
মেহেরুন্নেসা লেখিকা ২৬ মার্চ
মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী অধ্যাপক, বাংলা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
ডাঃ মোহাম্মদ ফজলে রাব্বি অধ্যাপক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ ১৫ ডিসেম্বর
ডাঃ মোহাম্মদ মোর্তজা চিকিৎসক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
ডাঃ এম শফী চিকিৎসক, চট্টগ্রাম ৭ এপ্রিল
ডাঃ যোগেশ চন্দ্র ঘোষ সাধনা ঔষধালয় ৪ এপ্রিল
রণদা প্রসাদ সাহা দানবীর, মির্জাপুর ১৭ মে
কবি রফিকুল ইসলাম অধ্যাপক, দর্শনা কলেজ ২৯ জুলাই
ডাঃ রাখাল চন্দ্র দাস চিকিৎসক ময়মনসিংহ জেলা কাউন্সিল ১২ মে
রামকৃষ্ণ অধিকারী অধ্যাপক, বাংলা, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর ৩০ মে
রাশিদুল হাসান অধ্যাপক, ইংরেজি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
ডাঃ রেবতী কান্ত স্যানাল নওগাঁ ৪ এপ্রিল
ললিত কুমার বল আইনজীবী, সাবেক এমএলএ বরিশাল ৭ জুন
লুৎফুন্নাহার হেলেন শিক্ষিকা, মাগুরা উচ্চ বালিকা বিদ্যালয় ৫ অক্টোবর
শহীদ সাবের সাংবাদিক, দৈনিক সংবাদ ৩১ মার্চ
ডঃ শরাফত আলী অধ্যাপক, গণিত, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ২৬ মার্চ
শহীদুল্লাহ কায়সার সাংবাদিক, লেখক ১৪ ডিসেম্বর
শামসুদ্দিন ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট, রাজশাহী এপ্রিল
শামসুল হক পিএসপি পুলিশ সুপার, চট্টগ্রাম এপ্রিল
শামসুল হক খান সিএসপি জেলা প্রশাসক, কুমিল্লা এপ্রিল
শহিদুল ইসলাম খোকন ছাত্র, পিরোজপুর ডিসেম্বর
শাহ আবদুল মজিদ পিএসপি পুলিশ সুপার, রাজশাহী ৩১ মার্চ
শফিকুল মান্নান অধ্যাপক পাতারহাট কলেজ, বরিশাল নভেম্বর
সন্তোষ চন্দ্র ভট্টাচার্য অধ্যাপক, ইতিহাস, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
সৈয়দ নুরুল হুদা অধ্যাপক, ইতিহাস, বিএম কলেজ জুন
অধ্যক্ষ সুলতান উদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট ১১ এপ্রিল
সায়ীদুল ইসলাম ভাসানী ন্যাপ নেতা, ঢাকা ১৮ মে
ডঃ সাদাত আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, গবেষণা ইনস্টিটিউট ২৬ মার্চ
এডভোকেট সুধীর চক্রবর্তী বরিশাল অক্টোবর
সুনীল বরণ চক্রবর্তী অধ্যাপক, দর্শন, কারমাইকেল কলেজ, রংপুর ৩০ মে
একেএম নুরুল হক প্রকৌশলী টিএন্ডটি ১৪ এপ্রিল
সিরাজুল হক খান অধ্যাপক, শিক্ষা গবেষণা ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ ডিসেম্বর
এডভোকেট সুনাহার আলী আইনজীবী, সুনামগঞ্জ ১৯৭১
সিরাজ উদ্দীন হোসেন সাংবাদিক ১০ ডিসেম্বর
সুখরঞ্জন সমাদ্দার অধ্যাপক, সংস্কৃতি, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ১৪ এপ্রিল
সৈয়দ নজমুল হক সাংবাদিক ১১ ডিসেম্বর
সেলিনা পারভীন লেখিকা ১৪ ডিসেম্বর
কর্নেল ডা. সৈয়দ আব্দুল হাই যশোর সেনানিবাস ৩০ মার্চ
হরিণাথ দে শিক্ষাবিদ, ঢাকা ২৭ মার্চ
ডা. হাসিময় হাজরা ঢাকা মেডিকেল কলেজ মে
লে. কর্নেল জাহাঙ্গীর কুমিল্লা সেনানিবাস মার্চ

 

 

যুদ্ধাপরাধীদের তালিকা

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বাংলাদেশের মাটিতে বিচারের জন্য তালিকা প্রণয়ন করা হয়। ভারতে যারা বন্দি ছিল তাদের তালিকা করা হয়েছিল। কিন্তু যারা যুদ্ধকালে পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়, তাদের বিচারে তালিকাভুক্ত করা হয়নি। ১৯৫ জনের মধ্যে নিম্নে উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নামের তালিকা দেওয়া হলো-

কর্মকর্তাদের নাম ও পদবি-                   ১৯৭১ সালে অবস্থান

১. লে. জে. আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী-  পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার

২. মেজর জে. নজর হুসেন শাহ- জিওসি, ১৬ ডিভিশন

৩. মেজর জে. মুহাম্মদ হুসেইন আনসারী- জিওসি, ৯ম ডিভিশন

৪. মেজর জে. মোহাম্মদ জামসেদ- ডিজি, ইপকাফ

৫. মেজর জে. কাজী আব্দুল মজিদ খান- জিওসি, ১৪ ডিসেম্বর

৬. মেজর জে. রাও ফরমান আলী খান- গভর্নরের বেসামরিক উপদেষ্টা

৭. ব্রি. আব্দুল কাদির খান- ৯৩, বিডিই

৮. ব্রি. আরিফ রাজা- হেডকোয়ার্টার সিগন্যাল

৯. বি. আতা মুহাম্মদ খান মালিক- ৭ বিডিই

১০. ব্রি রশির আহমেদ- কাফ

১১. ব্রি. ফাহিম আহমেদ খান- হেডকোয়ার্টার ইসি

১২. ব্রি. মঞ্জুর আহমেদ- ৫৭ হেডকোয়ার্টার বিডিই

১৩. ব্রি. মঞ্জুর হুসেইন আতিক- ১৭৭ বিডিই

১৪. ব্রি. মিয়া মনসুর মুহাম্মদ- ৩৯ ডিভিশন

১৫. ব্রি. তাসকিনউদ্দিন- ৯১ বিডিই

১৬. ব্রি. মীর আব্দুল নাইম-  ৩৪ হেডকোয়ার্টার বিডিই

১৭. ব্রি. মুহাম্মদ আসলাম- ৫৩ বিডিই

১৮. ব্রি. মুহাম্মদ হায়াত- ১০৭/৪০৭ বিডিই

১৯. ব্রি. মুহাম্মদ শফি-  ২৩ হেডকোয়ার্টার বিডিই

২০. ব্রি. এমএ আশরাফ- সিএসডি নাটোর জিআরসি

রংপুর জিআরসি

২১. ব্রি. এম এ আনসারী- রংপুর জিআরসি

২২. ব্রি. সাদউল্লাহ খান এসজে- ২৭ বিডিই

২৩. ব্রি. সৈয়দ আবীর হাসান- সিলেট ফোর্স

২৪. ব্রি. শাহ আব্দুল কাসেম- সিসিএটিওয়াই ইসিও

২৫. ব্রি. তোজমাল হুসেইন মালিক- ২০৫ হেডকোয়ার্টার বিডিই

২৬. এয়ার কমোডর এনামুল হক খান- পিএফ-ঢাকা

২৭. কর্নেল ফজলে হামিদ- ৩১৪ হেডকোয়ার্টার বিডিআই

২৮. কর্নেল কে. কে. আফ্রিদী- ৯ম ডিভিশন

২৯. কর্নেল মোহাম্মদ খান- আইএসআই

৩০. মুহাম্মদ মুশাররফ আলী- ১৪ এডিএমএস ডিভিশন

৩১. রিয়ার এডমিরাল মুহাম্মদ শরীফ- নৌবাহনী

এছাড়া যুদ্ধাপরাধীদের তালিকায় ছিল ৪৫ জন লে. কর্নেল, ৮০ জন মেজর, ৪৩ জন ক্যাপ্টেন। যুদ্ধকালে লে. জে, টিক্কা খান, লেঃ জেঃ খাদেম হোসেন রাজা, মেজর জেনারেল রহিম পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যাওয়ায় তাদের তালিকাভুক্ত করা হয়নি। সিমলা চুক্তির আলোকে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙালিদের ফেরত আনার জন্য পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি বাংলাদেশ সরকারকে পরিত্যাগ করতে হয়।

উল্লেখ্য, ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও লুণ্ঠনে ৯৩ হাজার পাকবাহিনী, জামায়াত, রাজাকার, শান্তি কমিটি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ

পৃষ্ঠা: ৩৪১

 

 

করে। তারা সকলে যুদ্ধাপরাধী। তাদের বিচার দাবি অব্যাহত রয়েছে। শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গঠিত ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গণআদালত প্রতিষ্ঠা করে জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের বিচার করে ফাঁসির আদেশ দেয়।

 

পাকবাহিনীর দালালদের তালিকা

১. খাজা খায়েরউদ্দিন- মুসলিম লীগ

২. একিউএম শফিকুল ইসলাম- মুসলিম লীগ

৩. অধ্যাপক গোলাম আযম- জামায়াতে ইসলামী

৪. মতিউর রহমান নিজামী- জামায়াত, বদরবাহনী প্রধান

৫. নুরুল আমিন- প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, পিডিপি নেতা

৬. মাহমুদ আলী- পিডিপি

৭. শাহ আজিজুর রহমান- কাউন্সিল মুসলিম লীগ

৮. মওলানা সৈয়দ মোহাম্মদ মাসুম- পিডিপি

৯. পীর মোহসেন উদ্দিন দুধু মিয়া- পিডিপি

১০. এ এস এম সোলায়মান- ডাঃ মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য

১১. গোলাম সারওয়ার- দাওয়াতুল ইসলাম

১২. আবুল কাসেম- মুসলিম লীগ

১৩. ফজলুল কাদের চৌধুরী- মুসলিম লীগ

১৪. রাজিয়া ফয়েজ- মুসলিম লীগ

১৫. এডভোকেট এটি সাদী- নেজামে ইসলাম

১৬. আব্দুল মতিন- মুসলিম লীগ

১৭. ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিন- মুসলিম লীগ

১৮. এডভোকেট আতাউল হক খান- মুসলিম লীগ

১৯. মওলানা ইউসুফ আলী- জামায়াত

২০. মওলানা আব্বাসউদ্দিন- জামায়াত

২১. মৌলভী ফরিদ আহমেদ- নেজামে ইসলাম

২২. নওয়াজেশ আহমেদ- মুসলিম লীগ

২৩. মওলানা আব্দুল মান্নান- আলবদর

২৪. জুলমত আলী খান- মুসলিম লীগ

২৫. হামিদুল হক চৌধুরী- পিডিপি

২৬. ওবায়দুল্লাহ মজুমদার- মালেক মন্ত্রিসভার সদস্য।

২৭. ড. সাজ্জাদ হোসেন- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২৮. ড. হাসান জামান- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

২৯. ড. মহর আলী- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

৩০. অধ্যাপক আব্দুল বারী- রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

৩১. আশরাফুজ্জামান খান- আলবদর

৩২. এ বি এম খালেক মজুমদার- আলবদর

৩৩. চৌধুরী মঈনুদ্দিন- আলবদর

৩৪. এ জি এম সফিকুজ্জামান- মুসলিম লীগ

৩৫. মুহাম্মদ সিরাজউদদীন- মুসলিম লীগ

৩৬. মওলানা সিদ্দিক আহমেদ- ইত্তেহাদুল উষ্মা

উপরের কয়েকজন নেতৃস্থানীয় দালালের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া আরও কয়েক হাজার দালাল তালিকাভুক্ত আছে।

 

ঠ. স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্ব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের স্থাপতি। তিনি বাংলার মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করে বাঙালি জাতীয়তাবাদ সুদৃঢ় করেন। বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি বাঙালি জাতির জনক। তার নেতৃত্বে ৯ মাস যুদ্ধের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণ করে এবং স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় হয়।

বাংলাদেশের অপর নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাষায় বলতে হয়, ‘মুজিব তুমি সুরের আগুন ছড়িয়ে দিলে সবখানে। এবং ‘আমি তোমাদেরই লোক।’ বঙ্গবন্ধু চিরঞ্জীব। তার মৃত্যু হয়নি। তিনি মরতে পারেন না।

“যতদিন রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান

ততদিন রবে কীর্তি তোমার শেখ মুজিবুর রহমান”

-অন্নদা শংকর রায়।

ইতিহাসের মূল লক্ষ্য একটি সমাজ ও জাতি। কিন্তু কোনো সমাজে এমন একজন ব্যক্তির আবির্ভাব ঘটে যার কার্যকলাপ সে সমাজ ও জাতিকে নবজন্ম দেয়। তবে যে কোনো ব্যক্তির ব্যক্তিত্বও একটি সমাজে প্রতিবিম্বিত হয়। সমাজে ব্যথা-বেদনা ও আশা-আকাঙ্ক্ষা তার ব্যক্তিত্বে লালিত হয় বলে তিনি সমাজের প্রতিভূ। বাংলার ইতিহাস ও শেখ মুজিব অবিচ্ছিন্ন সত্তা। এ

পৃষ্ঠা: ৩৪৩

 

কথা সত্য যে, কোনো নেতা এককভাবে একটি জাতি বা দেশকে গড়তে পারে না। তার পিছনে শত শত নেতা, হাজার হাজার কর্মী লক্ষ কোটি জনতার অবদান থাকে। তেমনি বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান হলেও তার সাথে রয়েছে আমাদের বহু নেতা, কবি, সাহিত্যিক, মুক্তিযোদ্ধা ও বুদ্ধিজীবী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে যখন জাতির জনক বলা হয় তখন স্বাধীনতা সংগ্রামে উৎসর্গীকৃত সকল রাজনৈতিক দল, নেতা, কর্মী, মুক্তিযোদ্ধা ও ৩০ লাখ শহীদ ও তিন লাখ নির্যাতিত মা-বোনের অবদানের কথাও শ্রদ্ধার সাথে স্বীকার করি। তাদের অবদানের ফলেই শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির মুক্তি সংগ্রামে জয়ী হয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যক্তিচরিত্র একটি অখণ্ড সংগ্রামের ইতিহাস। তার রাজনৈতিক জীবন, ব্যক্তিগত জীবন ও ধারাবাহিক জীবন ছিল একটি দর্শন।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বোচ্চ কৃতিত্ব বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধান স্তম্ভ জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ বলতে বোঝায় সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিবর্তনের মাধ্যমে ধীরে ধীরে কৌম থেকে গোত্র, গোত্র থেকে গোষ্ঠী এবং গোষ্ঠী থেকে একটি জাতির সৃষ্টি। জাতি অভিন্ন চেতনার ফল। একটি নির্দিষ্ট ভৌগোলিক সীমার সহাবস্থান, একই ভাষা, সাংস্কৃতিক, সমাজ ও রাজনৈতিক চেতনা প্রভৃতির ঐক্য জাতীয়তাবাদের ভিত্তি। পরাধীন থাকলে স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম ও জাতীয় সংগ্রামী চেতনার প্রয়োজন। জাতীয়তাবাদের সবগুলো বৈশিষ্ট্য বাংলাদেশে ছিল এবং জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম অগ্রনায়ক দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ ও এ কে ফজলুল হক। জাতীয়তাবাদী চেতনা বিকশিত হয় মওলানা ভাসানী ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। একটি জাতি গঠনের উপকরণ বাংলাদেশে ছিল, তারা এক ভূখণ্ডের অধিবাসী, এক ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী এবং অভিন্ন জাতীয় চেতনার। আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী জাতীয় চেতনা সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু তারা জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে যেতে পারেননি।

বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম রাজা শশাঙ্কর আমল থেকে শুরু হয়। কিন্তু এ সংগ্রামে তারা সফল হতে পারেনি। কারণ তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে ব্যর্থ হয়। পাল রাজারা রাষ্ট্র গঠন করতে পারেনি।

পৃষ্ঠা: ৩৪৪

 

 

গৌড়ের সুলতানগণ বাঙালি জাতিকে একটি রূপ দিতে সক্ষম হয়। কিন্তু তখনও পুরোপুরি একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারেনি। মোগল সম্রাটগণ বাঙালিদের ওপর ফার্সি ও ইংরেজগণ ইংরেজি ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। বিদ্রোহী বাঙালিরা যেমন সেনদের সংস্কৃত ভাষা গ্রহণ করেনি, তেমনিভাবে তারা ফার্সি ও ইংরেজি ভাষাকেও গ্রহণ করেনি। ইতিহাসের গতি থেমে থাকেনি। আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রাম শশাঙ্ক থেকে পলাশী, পলাশী থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত চলে। জাতি হিসেবে আত্মপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে আমাদের মহান নেতা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। শেরে বাংলা বাঙালিদের শিক্ষার আলো ঘরে ঘরে পৌঁছে দিয়ে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটান। সামাজিক-অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যে ভূমি সংস্কার করেন। তিনি একটি স্বাধীন দেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৪০ সালে লাহোর প্রস্তাবের মাধ্যমে পূর্বাঞ্চলে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রের প্রস্তাব পেশ করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলাদেশ দাবি করেন। ১৯৫৪ সালে ২১ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মাওলানা ভাসানী বাঙালি জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করেন। বাংলা ভাষা রাষ্ট্র ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। জাতীয় চেতনা উদ্বুদ্ধ যুক্তফ্রন্ট ও আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা দখল করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সংখ্যাসাম্য নীতি সমর্থন করে বাঙালিদের চাকরি, ব্যবসা ও শিল্পায়নে সুযোগ করে দেন। সংখ্যাসাম্যনীতির ভিত্তিতে হাজার হাজার বাঙালি; সেনাবাহিনী ও কেন্দ্রীয় চাকরিতে সুযোগ লাভ করেন এবং তারা অনেকে ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন।

আমাদের মহান তিন নেতার সৃষ্ট জাতীয় আন্দোলনে পরিপূর্ণতা এনেছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফা দাবির মাধ্যমে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফার আন্দোলন ছিল মূলত বাঙালি জাতির স্বাধীনতার দাবি। বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলার একদল দামাল ছেলে সেনাবাহিনীর মধ্যে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স গঠন করে। পাকিস্তান সরকার তাদের বিরুদ্ধে তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ৬ দফা ও আগরতলা মামলাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৯ সালে গণঅভ্যুত্থান সূচিত হয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাঙালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে ৫০ বছর এগিয়ে নিয়ে যায়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের শহীদের রক্তের পিচ্ছিল পথ অতিক্রম করে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা,

পৃষ্ঠা: ৩৪৫

 

 

১৯৬৯ সালের আগরতলা মামলা এবং গণঅভ্যুত্থান শেখ মুজিবের বাঙালি জাতীয়তাবাদের সফল ও সার্থক পরিণতির পথ প্রস্তুত করে।

১৯৭০ সালে জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ৬ দফা মেনে ও ক্ষমতা হস্তান্তর করতে অস্বীকার করেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা সংগ্রামের ডাক দেন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকিস্তান বাহিনী বাঙালিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা ও গণহত্যা শুরু করে। ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন এবং জনগণকে পাকবাহিনীকে প্রতিরোধ করার নির্দেশ দেন। পাকবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি করে রাখে। ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রপতি করে মুজিবনগর স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। সরকার মুক্তিবাহিনী গঠন করে ৯ মাস যুদ্ধ করে। ভারত রাশিয়া বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিক সহায়তা করে। ১৯৭১ সালের ১৯ ডিসেম্বর পাকবাহিনী ঢাকায় আত্মসমর্পণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বে আত্মপ্রকাশ করে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে বঙ্গবন্ধ ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন। বঙ্গবন্ধ জাতির জনক। তার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ৯ মাস যুদ্ধ করে। ভারত-রাশিয়ার সহযোগিতায় স্বাধীনতা অর্জন করে। তিনি বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠাতা।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর জাতি ও দেশ হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে। এ জাতীয়তাবাদ শেখ মুজিবের চিন্তা ও চেতনার ফল। জাতীয় ঐক্য দৃঢ় করার জন্য তিনি স্বাধীনতা অর্জনের পরও শাসনতন্ত্রের ৪টি মূল নীতির মধ্যে জাতীয়তাবাদকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তার স্লোগান ছিল, “পদ্মা-মেঘনা-যমুনা তোমার আমার ঠিকানা।” তাঁর চার মূলনীতিকে মুজিববাদ বলা হতো।

বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রেরণা যোগাচ্ছে সমাজতান্ত্রিক কর্মসূচি। জনগণ যদি তাদের অর্থনৈতিক মুক্তির সূচনা না দেখে তবে তারা জাতীয়তাবাদী আন্দোলন অংশ নেয় না। জনগণের সার্বিক উন্নয়নে সমাজতন্ত্র কর্মসূচি। জনগণের সার্বিক উন্নয়নে সমাজতন্ত্র হলো একটি সহজ দ্রুত পথ; তাই শাসনতন্ত্রে সমাজতন্ত্র অন্তর্ভুক্ত করা হয়। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য অর্জনের জন্য তিনি পরিকল্পনা কমিশন গঠন ও পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। ব্যাংক, বীমা, পাটকল, বস্ত্রকল ও ভারী শিল্প রাষ্ট্রায়ত্ত করা হয়। ২৫ বিঘা ভূমির খাজনা মওকুফসহ অনেক গণমুখী কর্মসূচি নেওয়া হয়। হাজার বছর ধরে অবহেলিত বাঙালির সমাজ জীবনে ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে পুঁজিবাদ গড়ে

পৃষ্ঠা: ৩৪৬

 

 

ওঠে। ধনী আরও ধনী হয়, গরিব আরও গরিব হয়। তাই বঙ্গবন্ধু ঘুণে ধরা সমাজ ব্যবস্থা ভেঙে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য দ্বিতীয় বিপ্লবের ডাক দেন। দ্বিতীয় বিপ্লবের উদ্দেশ্য ছিল দুর্নীতি দমন, কৃষি-শিল্প উৎপাদন বৃদ্ধি, জনসংখ্যা রোধ, নিরক্ষরতা দূরীকরণ ও অর্থনীতির সুষম বণ্টন।

বাংলাদেশের চতুর্থ মূলনীতি- গণতন্ত্র। বাংলার মানুষ দীর্ঘ ২৪ বছর ধরে গণতন্ত্রের জন্য সংগ্রাম করেছে। শোষণ ও অর্থনেতিক নিপীড়নের হাত হতে মুক্তি পাওয়ার পথ গণতন্ত্র। জনগণের প্রতিনিধি তাদের মঙ্গলের জন্য দেশ শাসন করবে। তাই গণতন্ত্র শাসনতন্ত্রের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। জনগণ সকল ক্ষমতার উৎস- জনগণ তাদের নির্বাচিত পালামেন্টের মাধ্যমে দেশ পরিচালনা করবে- এ মলনীতি শাসনতন্ত্রের ৭ নম্বর অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত আছে।

একদল ঘাতক ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করেছে। কিন্তু তার মৃত্যু নেই। তার আদর্শ জাতিকে পথ দেখাচ্ছে। তার কন্যা শেখ হাসিনা পিতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করছেন। পিতার জনপ্রিয়তা তাকে তৃতীয়বার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর পদে অধিষ্ঠিত করেছে।

১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান তথা পূর্ব বাংলার ঘটনাপ্রবাহ একজন ব্যক্তিকে কেন্দ্র করে একটি সুষ্ঠু পরিণতির পথে এমনভাবে অগ্রসর হয়েছে, তার যদি ইতিহাস লেখা হয় তবে যে মহানায়ককে পাওয়া যায় তিনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। অনেক কবি, সাহিত্যিক, নেতার অবদানেও বাংলাদেশ গৌরবময়। বাংলার জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, কাজী নজরুল ইসলাম, এ কে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেছেন। কিন্তু এ দেশ যার অবদানে জন্মলাভ করেছে তিনি বঙ্গবন্ধু। তার সাথে কারো তুলনা হয় না। তাই তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বলা হয়। ভবিষ্যতে অনেকে আসবেন, তবে জন্মদাতা একজনই থাকবেন- তিনি বাংলার সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মানব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

 

স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হলো

১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। বাংলা ভাগ হয়ে পূর্ব বাংলা পাকিস্তান ভূক্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের দূরত্ব এক হাজার মাইলের বেশি। দুই মাথা বিশিষ্ট পাকিস্তান টিকে থাকতে পারে না

পৃষ্ঠা: ৩৪৭

 

 

এ ভবিষ্যদ্বাণী অনেকেই করেছিলেন।

পূর্ব বাংলার নামকরণ হলো পূর্ব পাকিস্তান। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ পূর্ব পাকিস্তানে বাস করে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় পূর্ব বাংলার জনপ্রিয় নেতাদের বাদ দেওয়া হয়। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। মুসলিম লীগ সরকার তাদের কোনো স্থান দিল না। তাদের প্রতি মুসলিম লীগ সরকার বৈরী ভাব পোষণ করত। তারা পাকিস্তানে বিশ্বাস করেনি। ১৯৪৮ সালে প্রগতিশীল ছাত্রদের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। পাকিস্তানে প্রথম বিরোধী দল গঠিত হয়।

১৯৪৮ সালে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি ওঠে। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ মাসে ভাষা দিবস পালিত হয়। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকা সফরে এসে ঘোষণা দিলেন যে, উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা। ছাত্র-জনতা তার ঘোষণার প্রতিবাদ করে। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মৃত্যুবরণ করেন। নতুন গভর্নর জেনারেল হলেন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন। পাকিস্তানের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা আমলা ও সেনাবাহিনীর দখলে চলে যায়। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পিণ্ডির এক জনসভায় আততায়ীর গুলিতে নিহত হন। গণতন্ত্রের পথরুদ্ধ হলো। ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলছে।

ভারত ১৯৪৯ সালে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করেছে। কিন্তু পাকিস্তান শাসনতন্ত্র প্রণয়নে ব্যর্থ হয়েছে। বাংলা থেকে রাষ্ট্রভাষার দাবি পূর্ব বাংলায় জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে। পুলিশ গুলিবর্ষণ করে অনেক ছাত্র-জনতাকে হত্যা করে। ভাষার দাবিতে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেরেবাংলা, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী ২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। ৯টি বাদে সকল আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। ভোটের বিপ্লব হলো। শেরে বাংলার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হলেন। কেন্দ্রীয় সরকার তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী আখ্যা দিয়ে পদচ্যুত করে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের শাসনতন্ত্র রচিত হয়। ১৯৫৬ সালের ১১ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের ফলে তাকে পদত্যাগ করতে হয়। বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের বিরুদ্ধে

পৃষ্ঠা: ৩৪৮

 

 

আন্দোলন করতে থাকে। দুই অঞ্চলের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। সোহরাওয়ার্দীর সংখ্যাসাম্য নীতি বাস্তবায়িত হয়নি। বিদেশি সাহায্যের মাত্র ২০ ভাগ ব্যয় হয় পূর্ব বাংলায়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে মাত্র ১০ ভাগ সৈন্য বাঙালি। কেন্দ্রীয় সরকারের চাকরিতে বিশাল বৈষম্য। পূর্ব পাকিস্তানে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-কারখানা গড়ে উঠেছে। বাঙালিদের কন্ঠরোধ করার জন্য ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর জেনারেল আইয়ুব খান সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি দীর্ঘ ১০ বছর পাকিস্তান শাসন করেন।১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা একে ফজলুল হক মৃত্যুবরণ করেন। আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে গ্রেফতার করে ৬ মাস বন্দি রাখে। মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানকে বন্দি করে রাখে। মুক্তি লাভ করে সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্র উদ্ধারের  জন্য আন্দোলন করেন। তার নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ঢাকার হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে শেরে বাংলার মাজারের পাশে দাফন করা হয়।

সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব গ্রহণ করেন শেখ মুজিবর রহমান। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি তিনি লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে ৬ দফা দাবি পেশ করে। ৬ দফার অন্যতম প্রস্তাব ছিল- কেন্দ্রের নিকট থাকবে দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, কর আরোপ ক্ষমতা থাকবে প্রদেশের নিকট। পূর্ব বাংলায় প্যারা-মিলিটারি থাকবে। পৃথক মুদ্রা থাকবে। ৬ দফার দাবিতে শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়। ৬ দফা বন্ধ করার জন্য আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামী লীগের নেতাদের গ্রেফতার করে। ৬ দফা ও বন্দিদের মুক্তির দাবিতে ৬ জুন পালিত হয়। এদিন পুলিশ অনেক শ্রমিককে হত্যা করে।

১৯৬৮ সালে সরকার আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। সেনাবাহিনীর বাঙালি একদল সৈন্য শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলাকে বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ভারতের আগরতলায় ষড়যন্ত্র করে। শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চালু করে। ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়। পুলিশ ও আর্মির গুলিতে অনেকে প্রাণ হারায়। শহীদ হলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা, সার্জেন্ট জহুরুল হক, আসাদ প্রমুখ। ২২ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান আগরতলা মামলা হত্যাহার করে নেয়। রেসকোর্স ময়দানের জনসভায় ২৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধু উপাধি দেওয়া হয়। অবশেষে ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ আইয়ুব

পৃষ্ঠা: ৩৪৯

 

 

খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। সেনাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করেন। তিনি ঘোষণা দেন যে, ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর নির্বাচন হবে।

১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলায় ১৬৯ টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জয়লাভ করে। পশ্চিম পাকিস্তানে জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি জয়লাভ করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হন। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তর না করে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী পূর্ব বাংলায় গণহত্যা শুরু করে। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। তাকে গ্রেফতার করে পশ্চিম পাকিস্তানের জেলে আটক রাখা  হয়।

১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইট চালিয়ে একমাত্র ঢাকা শহরে ৭ হাজার লোক হত্যা করা হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আক্রমণ চালিয়ে শিক্ষক- ছাত্রদের হত্যা করে। আওয়ামী লীগ সম্পাদক তাজউদ্দী আহমদ এমপি ও ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারত গমন করেন। বিএসএফ মহাপরিচালক রুস্তমজি এবং উপমহাপরিচালক গোলক মজুমদারের সহায়তায় তাজউদ্দীন আহমদ ৫ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রিরা গান্ধীর সাথে দেখা করেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনা করে তাজউদ্দীন আহমদ ১০ এপ্রিল স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করেন। সরকার প্রধান হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদ তার অবর্তমানে, সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি নিযুক্ত হন। প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন কর্নেল এমএজি ওসমানী এমএনএ। রাজধানীর নাম রাখা হয় মুজিবনগর। পূর্ব বাংলায় সর্বত্র গণহত্যা চলছে। বিশেষ করে হিন্দুদের হত্যা করা হচ্ছে। পাকবাহিনীর নির্যাতনের ফলে এক কোটি মুক্তিকামী মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। ভারত সরকার তাদের শরণার্থীদের আশ্রয় ও খাদ্য প্রদান করে। জাতিসংঘও শরণার্থীর সেবায় এগিয়ে আসে।

পূর্ব বাংলায় গণহত্যা ও নারী নির্যাতন চলছে। লাখ লাখ লোক নিহত হয়। তাদের বাড়িঘর পুড়ে ফেলে। মালামাল লুট করে, নারী ধর্ষণ চলে।

বাঙালি সৈন্য, ইবিআর, ইপিআর, পুলিশ, আনসার পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলে। পাকসেনাদের ভারী অস্ত্রের নিকট টিকতে না পেরে সীমান্তে অবস্থান নেয়। ভারতের অস্ত্র সাহায্যে মুক্তিবাহিনী গড়ে ওঠে। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ দিয়ে অভ্যন্তরে প্রবেশ করে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যেতে। বাংলাদেশ সরকার মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করে। সেক্টরের অধীনে সাব-সেক্টর ছিল। ১০ নম্বর সেক্টর ছিল নৌ-বাহিনী।

পৃষ্ঠা: ৩৫০

 

 

গঠিত। বাঙালি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়। দূতাবাসে চাকরিরত কর্মকর্তারা বাংলাদেশ সরকারের পক্ষে আনুগত্য প্রকাশ করে। দেশের অভ্যন্তরে পাক বাহিনী জামায়াতে ইসলামের সহযোগিতায় রাজাকার, শান্তি কমিটি, বদর বাহিনী গঠন করে। মুক্তিবাহিনী রাজাকার, শান্তি কমিটির সমর্থকদের হত্যা করে করে পাকবাহিনীকে দুর্বল করে।  গেরিলা যুদ্ধে পাকসেনারা পরাজিত হতে থাকে। মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে পাকবাহিনী শহরে অবরুদ্ধ হয়ে পরে। ভারত সরকার বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সর্বপ্রকার সহায়তা করে। পাকিস্তান বাহিনী বাঙালি হত্যার শুরু থেকে সোভিয়েত রাশিয়া মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে। ১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট দিল্লিতে সোভিয়েত রাশিয়া-ভারত শান্তি-মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ভারত কোনো পরাশক্তির দ্বারা আক্রান্ত হলে রাশিয়া ভারতের সাহায্যে এগিয়ে আসবে। ইন্দিরা গান্ধী বিশ্ব জনমত সৃষ্টির জন্য ২৪ অক্টোবর থেকে ১১ নভেম্বর ইউরোপ আমেরিকা সফর করে।

১১ আগস্ট পাকিস্তানি কারাগারে বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার অভিযোগে বিচার শুরু হয়। বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু ভারতের সাথে যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ফাঁসির রায় কার্যকর করা হয়নি।

১৯৭১ সালের ৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করে। ৪ ডিসেম্বর মুক্তিবাহিনী নিয়ে ভারত মিত্র বাহিনী গঠন করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে।

পূর্বাঞ্চলে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার নিযুক্ত হলেন লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অবোরা। ভারতীয় বাহিনীর প্রধান ছিলেন জেনারেল শ্যাম মানেকশা। প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ছিলেন জগজীবন রাম। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ছিলেন শরণ শিং। পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন সিদ্ধার্থ শংকর রায়। ভারতের বেতার, টিভি, পত্রপত্রিকা, শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী সকলে মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করেন। ভারতীয় জনগণ শরণার্থী ও মুক্তিযুদ্ধে অর্থ, শ্রম ও ভালোবাসা দিয়ে সমর্থন দেয়। তারা এক কোটি শরণার্থীকে আশ্রয় ও সাহায্য দেয়।

ভারতীয় সেনাবাহিনীর সংখ্যা ছিল ৮ লাখ ২৮ হাজার, বিমান ছিল এক হাজারের উর্ধ্বে, ক্রুজার ৪টি, ডেস্ট্রয়ার ৪টি, সাবমেরিন ৪টি, বিমানবাহী জাহাজ ১টি। পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ছিল ৩ লাখ ৫০ হাজার, বিমান প্রায় ৪শ’, ডেস্ট্রয়ার ১টি, ক্রুজার ১টি, সাবমেরিন ৫টি, পূর্ব পাকিস্তানে ৯০ হাজার সেনাবাহিনী ছিল। যুদ্ধ শুরুর ৩ দিনের মধ্যে পূর্ব বাংলায় পাকবাহিনী সম্পূর্ণ বিমান শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। পশ্চিম পাকিস্তানে বিমান শক্তি ধ্বংস হয়ে যায়। সম্মুখ যুদ্ধে পাকিস্তান একের পর এক পরাজয় বরণ করে। ১৯৭১ সালের ৭

পৃষ্ঠা: ৩৫১

 

 

ডিসেম্বর পূর্ব বাংলার যশোর ক্যান্টনমেন্টের পতন হয়। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর প্রথমম থেকে আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানের পক্ষাবলম্বন করে। মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করার জন্য আমেরিকা নৌ-কূটনীতিক ও জাতিসংঘে যুদ্ধ বিরতির চেষ্টা করে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর আমেরিকা নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতি ও সৈন্য প্রত্যাহারের প্রস্তাব করে। সোভিয়েত রাশিয়া ভেটো প্রয়োগ করায় যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নাকচ হয়ে যায়। আমেরিকা পুনরায় যুদ্ধ বিরতির প্রস্তাব নিরাপত্তা পরিষদে পেশ করে। সোভিয়েত রাশিয়া এবারও ভেটো প্রয়োগ করে যুদ্ধ বিরতি নাকচ করে দেয়। একই সাথে মুক্তিযুদ্ধ ধ্বংস করার জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নিকসন ১৯৭১ সালের ৯ ডিসেম্বর বঙ্গোপসাগরে সপ্তম নৌবহর প্রেরণের নির্দেশ দেয়। সপ্তম নৌবহর ভিয়েতনামের টমকিন উপসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছে। ভারতের আন্দামান-নিকোবর কমিউনিকেশন সেন্টারের রাডার সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগরে প্রবেশের সংবাদ পায়। ভারত সরকার সাথে সাথে এ সংবাদ সোভিয়েত রাশিয়াকে জানিয়ে দেয়। তৎক্ষণাৎ সোভিয়েত নৌবহর বঙ্গোপসাগরের দিকে যাত্রা করে। আমেরিকা এ সংবাদ পেয়ে সপ্তম নৌবহনের গতিপথ পরিবর্তন করে শ্রীলংকার দিকে যেতে বলে। এমনিভাবে বিশ্ব তৃতীয় মহাযুদ্ধ থেকে রক্ষা পায়।

১৪ ডিসেম্বর পাকবাহিনী রাজাকার-জামায়াতের সহযোগিতায় ঢাকায় বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে।

পাকিস্তান বাহিনী পশ্চিম রণাঙ্গনে পরাজয় বরণ করছে। পূর্ব রণাঙ্গনে জেলার পর জেলার পতন হচ্ছে। ১৫ ডিসেম্বর মিত্র বাহিনী ঢাকার উপকণ্ঠে পৌছে যায়। জেনারেল শ্যাম মানেকশ পাকবাহিনীকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করার সিদ্ধান্ত নেয়।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে ৪টায় পাকিস্তানের ৯০ হাজার সৈন্য মিত্রবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে। সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করে মিত্র বাহিনীর কমান্ডার লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরা, পাকিস্তানের পক্ষে পূর্বাঞ্চলের কমান্ডার লে. জেনারেল এ কে কে নিয়াজী।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশ বিশ্বের বুকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ভারত-রাশিয়ার প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সাথে যুদ্ধে ভারতের কয়েক হাজার সৈন্য নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের ৩০ লাখ শহীদের সাথে তাদের রক্ত মিশে আছে। আমরা যেন তাদের ভুলে না যাই।

পৃষ্ঠা: ৩৫২

 

When you go home

Tell them of us and say

For your tomorrow

We gave our today.

তোমরা যখন গৃহে ফিরে যাবে

আমাদের কথা বলবে

তাদের আগামী কালের জন্য

আমরা আমাদের আজকের দিনটি উৎসর্গ করেছি।

 

প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ দক্ষতার সাথে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেছেন। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ১৯৭১ সালের ২২ ডিসেম্বর বাংলাদেশের রাজধানী কলকাতা থেকে ঢাকায় স্থানান্তর করা হয়। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়। তিনি লন্ডন হয়ে ১০ জানুয়ারি দিল্লি আসেন। ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিপি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। একই দিনে বঙ্গবন্ধু ঢাকা পৌঁছেন এবং বাংলাদেশের শাসনভার গ্রহণ করেন।

পাকিস্তান সৃষ্টির ২৩ বছরের মধ্যে লর্ড মাউন্ট ব্যাটেনের ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হলো- The traumatic experience of the 1971 Bangladesh War, which realised Louis Mountbatten’s prophecy that the union between the two halves of Pakistan would not last a quater of a century.

লুইস মাউন্টব্যাটেন যে ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে, পাকিস্তানের দুটি অংশের ঐক্য এক-চতুর্থ শতকের বেশি টিকবে না- তা ১৯৭১ সালের ভয়াবহ যুদ্ধের ফলে বাস্তবায়িত হয়েছে।

বঙ্গবন্ধু ভারতের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি বন্ধুত্ব চুক্তি স্বাক্ষর করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী একদল সেনা সদস্য বন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে। তার কন্যা শেখ হাসিনা তিনবার বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়েছেন।

 

সহায়ক গ্রন্থ

হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের দালিলপত্র

মেজর রফিকুল ইসলাম, লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে

পৃষ্ঠা: ৩৫৩

 

 

এম আর আখতার মুকুল, আমি বিজয় দেখেছি

হারুন অর রশীদ, বাঙ্গালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, স্বাধীনতা ঘোষণা- বিজয় অতঃপর

Lt. Gen. JFR Jacob, Surrander at Dacca, Birth of a nation

Lt. Gen. A AK Niazi, The Betrayat of East Pakista

Robert Payne, Massacre

Lachhman Sing Major Gen. Victory in Bangladesh

পৃষ্ঠা: ৩৫৪

 

 

 

 

 

 

দশম অধ্যায়

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকাল ১৯৭২-১৯৭৫

 

ক. স্বদেশ প্রত্যাবর্তন

১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের মিয়ানওয়ালী জেলে আটক ছিলেন। ২৬ ডিসেম্বর তাকে রাওয়ালপিন্ডির সামরিক বিমানবন্দরের নিকট একটি ঘরে আটক রাখা হয়। ২৭ ডিসেম্বর এবং ১৯৭২ সালের ৭ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করেন। ভুট্টো পাকিস্তানের সাথে। বাংলাদেশের একটি সম্পর্ক রাখার অনুরোধ জানান। শেখ মুজিবুর রহমান জানেন না যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করেছে। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে বলেন, তিনি তার জনগণের সাথে আলাপ না করে কিছু বলতে পারবেন না। পাকিস্তান থেকে মুক্তিলাভ করে তিনি ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি পিআইএ বিমানে লন্ডন যাত্রা করেন। সাথে ড. কামাল হোসেন। তারা হিথ্রো বিমানবন্দরে অবতরণ করেন এবং হোটেল ক্লারিজে ওঠেন। ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ তাকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানান। ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ও ড. কামাল হোসেন ব্রিটিশ রয়াল এয়ার ফোর্সের কমেট বিমানযোগে দিল্লি হয়ে ঢাকা যাত্রা করেন।

১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি সকালে দিল্লির পালাম বিমানবন্দরে ভারতের প্রেসিডেন্ট ভিপি গিরি ও প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করেন। বিকেল ১টা ৪১ মিনিটে বিমান ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করলে লক্ষ লক্ষ জনতা বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা জানায়। বিমানবন্দর থেকে রমনা রেসকোর্স ময়দানে তার যেতে ৪ ঘণ্টা সময় লাগে। সেদিন তিনি ১০ লাখ মানুষের উদ্দেশে কান্নাজড়িত কণ্ঠে ভাষণ দেন।

ভাষণের এক পর্যায়ে বলেন, “ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা আমার দেশ। বাংলা আমার ভাষা।” তিনি লক্ষ লক্ষ শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানান। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য বিশ্বকে আহ্বান

পৃষ্ঠা: ৩৫৫

 

 

জানান। ভাষণের পর তিনি তার পরিবারের সদস্যদের সাথে ৯ মাস পর মিলিত হন।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১০ জানয়ারি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের সাময়িক শাসনতন্ত্র জারি করেন। তিনি রাষ্ট্রপতি পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করেন। ১২ জানুয়ারি তিনি বাংলাদেশে সরকারের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী হলেন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রীসভার সদস্যরা হলেন-

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপন, প্রতিরক্ষা, পরিকল্পনা 

সৈয়দ নজরুল ইসলাম- শিল্প

তাজউদ্দীন আহমদ- অর্থ, পাট

এম মনসুর আলী- যোগাযোগ

খন্দকার মোশতাক আহমদ- পানিসম্পদ ও বিদ্যুৎ

আবদুস সামাদ আজাদ- পররাষ্ট্র

এ এইচ এম কামরুজ্জামান- বাণিজ্য

শেখ আবদুল আজিজ- কৃষি

অধ্যাপক ইউসুফ আলী- শিক্ষা

আবদুল মালেক উকিল- স্বরাষ্ট্র

জহুর আহমদ চৌধুরী- শ্রম ও সমাজকল্যাণ

ফণী ভূষণ মজুমদার- খাদ্য

ড. কামাল হোসেন- আইন

আব্দুর রব সেরনিয়াবাত- ভূমি প্রশাসন

 

১৯৭২ সালের ১৩ জানুয়ারি মন্ত্রিসভার বৈঠকে গৃহীত সিদ্ধান্ত:

* সুদসহ সকল ঋণ মওকুফ

* জাতীয় পতাকায় বাংলাদেশের মানচিত্র থাকবে না, লাল সূর্য থাকবে।

* বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি- কবিতার প্রথম ১০ লাইন জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়।

* কুচকাওয়াজের সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয় বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের চল চল চল গানটি।

* জাতীয় ফুল শাপলা, জাতীয় পশু বাঘ, জাতীয় পাখি-দোয়েল। বাংলা

পৃষ্ঠা: ৩৫৬

 

 

সালের ১ বৈশাখ, ২১ ফেব্রুয়ারি ছুটির দিন, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

* ১৭ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু মুক্তিযোদ্ধাদের অস্ত্র জমা দেওয়ার নির্দেশ দেন।

১৯৭২ সালের ২২ জানুয়ারি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী ভারত থেকে টাঙ্গাইলে আসেন।

রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর সুপ্রিমকোর্ট উদ্বোধন করেন।

বঙ্গবন্ধু সাংবাদিক ডেভিড ফ্স্টের সাথে সাক্ষাৎকার দেন এবং তা ১৯৬২ সালের ১৮ জানুয়ারি নিউইয়র্ক টেলিভিশন থেকে প্রচারিত হয়।

১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ভারতের আহ্বানে রাষ্ট্রীয় সফরে কলকাতা গমন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ব্রিগেড প্যারেড গ্রাউন্ড মাঠে অনুষ্ঠিত স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দেন।

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুর অনুরোধে ভারতীয় সেনাবাহিনী ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ বাংলাদেশ ত্যাগ করে।

১৯৭২ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু রাশিয়া সফর করেন।

১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশে আসেন এবং বিকেলে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। ১৭ মার্চ উভয় দেশের মধ্যে ২৫ বছর মেয়াদি মৈত্রী সমঝোতা ও শান্তির এক ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এ চুক্তি নিয়ে বঙ্গবন্ধুকে সমালোচনা করা হয়েছে। এ চুক্তি ছিল বন্ধুত্বের চুক্তি মাত্র। চুক্তিটি আর নবায়ন করা হয়নি।

 

খ. সংবিধান প্রণয়ন

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সর্বশ্রেষ্ঠ কৃতিত্ব স্বাধীন বাংলাদেশ, দ্বিতীয় কৃতিত্ব ১৯৭২ সালের বাংলাদেশের সংবিধান।

অস্থায়ী সংবিধান আদেশ বলে ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ হতে ১৫ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ পরিচালিত হয়।

১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ গণপরিষদ আদেশ ও বাংলাদেশ গণপরিষদ সদস্য আদেশ নামে ২টি আদেশ জারি হয়। প্রথম আদেশের মাধ্যমে ১৯৭১ সালে  তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচিত জাতীয় (এমএনএ) ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য এমপিএগণকে নিয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। সকল এমএনএ ও এমপিএগণ এমসি (Member of Constituent Assembly) নামে

পৃষ্ঠা: ৩৫৭

 

অভিহিত হয়। এমএনএ ও এমপিদের নিয়ে মোট সদস্য ছিল ৪১৪ জন। সংবিধানের খসড়া প্রণয়নে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ৩৪ সদস্যবিশিষ্ট কমিটি করা হয়। কমিটির আহ্বায়ক ছিলেন ড. কামাল হোসেন। ১৯৭২ সালের ১১ অক্টোবর সংবিধানের খসড়া চূড়ান্তভাবে প্রণয়ন করা হয়। ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদ সংবিধান বিল পাস করে। সংবিধান ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর কার্যকর হয়। সকল রাজনৈতিক দল সংবিধানকে স্বাগত জানায়।

১৯৭২ সালের সংবিধান একটি লিখিত দলিল। সংবিধানে একটি প্রস্তাবনা, ১১ টি ভাগ ও ৪টি তফসিল আছে।

প্রথম ভাগ- প্রস্তাবনা

দ্বিতীয় ভাগ- রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিসমূহ

তৃতীয় ভাগ- মৌলিক অধিকার

চতুর্থ ভাগ- নির্বাহী বিভাগ

পঞ্চম ভাগ- জাতীয় সংসদ

ষষ্ঠ ভাগ- বিচার বিভাগ

সপ্তম ভাগ- নির্বাচন কমিশন

অষ্টম ভাগ- মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রক

নবম ভাগ- কর্মকমিশন

দশম ভাগ- সংবিধান সংশোধন

একাদশ ভাগ- বিবিধ বিষয়াবলী

বাংলাদেশ হবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ হবে মন্ত্রিপরিষদ শাসিত সরকার। ৩০০ আসনবিশিষ্ট জাতীয় সংসদ থাকবে। মহিলাদের জন্য ১৫টি আসন সংরক্ষিত থাকবে। সংবিধানে স্বাধীন নিরপেক্ষ বিচার ব্যবস্থা থাকবে। বাংলাদেশ কর্মকমিশন প্রজাতন্ত্রের কর্মকর্তাদের নিয়োগের সুপারিশ করবে। সংবিধান বাংলা ভাষাকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা ও রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘আমার সোনার বাংলা’ গানের প্রথম ১০ চরণ বাংলাদেশের জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গ্রহণ করা হয়।

জাতীয় সংসদের সময়কাল ৫ বছর। সংসদ সদস্যগণ ৫ বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত করবেন।

সংবিধানে সার্বজনীন ভোটের অধিকার ও গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। এককেন্দ্রিক রাষ্ট্র ও এক কক্ষবিশিষ্ট বাংলাদেশের সংসদ। বাংলাদেশের সরকার হবে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার। সংবিধানে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা ছিল।

পৃষ্ঠা: ৩৫৮

 

 

সংবিধানের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ ধারা নিম্নে উদ্বৃত হলো:

প্রস্তাবনা

১৯৭২ সালে রচিত সংবিধানে বলা হয়েছে, বাংলাদেশের জনগণ স্বাধীনতার ঘোষক। সংবিধানের প্রস্তাবনায় লিখিত আছে-

“আমরা বাংলাদেশের জনগণ, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণা করি, জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন ও সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত করিয়াছি।

আমরা অঙ্গীকার করিতেছি যে, যে সকল মহান আদর্শ আমাদের বীর জনগণকে জাতীয় স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধে আত্মনিয়োগ ও বীর শহীদদিগকে প্রানোৎসর্গ করিতে উদ্বদ্ধ করিয়াছিল- জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা সে সকল আদর্শ এই সংবিধানের মূল নীতি হইবে।

আমরা আরও অঙ্গীকার করিতেছি যে, আমাদের রাষ্ট্রের অন্যতম মূল লক্ষ্য হইবে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে এমন এক শোষণমুক্ত সমাজতান্ত্রিক সমাজের প্রতিষ্ঠা- যেখানে সকল নাগরিকের জন্য আইনের শাসন, মৌলিক মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক সাম্য, স্বাধীনতা ও সুবিচার নিশ্চিত হইবে।”

 

প্রজাতন্ত্র

অনুচ্ছেদ-১: বাংলাদেশ একটি একক, স্বাধীন ও সার্বভৌম প্রজাতন্ত্র, যাহা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ নামে পরিচিত হইবে।

অনুচ্ছেদ-২: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রীয় সীমানার অন্তর্ভুক্ত হইবে- ১৯৭১ সালের মার্চ মাসের ২৬ তারিখে স্বাধীনতা ঘোষণার অব্যবহিত পূর্বে যে সকল এলাকা লইয়া পূর্ব পাকিস্তান গঠিত ছিল।

অনুচ্ছেদ-৩: প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্র ভাষা বাংলা।

অনুচ্ছেদ-৪: প্রজাতন্ত্রের জাতীয় সঙ্গীত ‘আমার সোনা বাংলার প্রথম দশ চরণ।

অনুচ্ছেদ-৫: প্রজাতন্ত্রের রাজধানী ঢাকা।

অনুচ্ছেদ-৬: বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙ্গালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।

অনুচ্ছেদ-৭: প্রজাতন্ত্রের সকল ক্ষমতার মালিক জনগণ এবং জনগণের পক্ষে সেই ক্ষমতার প্রয়োগ কেবল এই সংবিধানের অধীন ও কর্তৃত্বে কার্যকর হইবে।

 

রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি

অনুচ্ছেদ-৮: জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা- এই

পৃষ্ঠা: ৩৫৯

 

নীতিসমূহ এবং তৎসহ এইনীতি সমূহ হইতে উদ্ভূত এইভাবে বর্ণিত অন্য সকল নীতি রাষ্ট্র পরিচালনার মীলনীতি বলিয়া পরিগণিত হইবে।

অনুচ্ছেদ-৯: জাতীয়তাবাদ- বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি সম্পর্কে বলা হয়- ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্তাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছিল, সেই বাঙ্গালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।

অনুচ্ছেদ-১০: সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি। সমাজতন্ত্র সম্পর্কে বলা হয়েছে- মানুষের ওপর মানুষের শোষণবিহীন ন্যায়ভিত্তিক সমাজব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে একটি সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।

অনুচ্ছেদ-১১: গণতন্ত্র। প্রজাতন্ত্র হবে একটি গণতন্ত্র। যেখানে মৌলিক মানবাধিকার ও স্বাধীনতার নিশ্চয়তা থাকবে। মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শদ্ধাবোধ নিশ্চিত হবে এবং প্রশাসনের সকল পর্যায়ে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণের কার্যকর অংশগ্রহণ নিশ্চিত হবে।

অনুচ্ছেদ-১২: ধর্মনিরপেক্ষতা। ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য

ক. সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা

খ. রাষ্ট্র কর্তৃক কোনো ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান

গ. রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মের অপব্যবহার

ঘ. কোনো বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ন বিলোপ করা হইবে।

অনুচ্ছেদ-১৪: রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে মেহনতি মানুষকে, কৃষক ও শ্রমিককে এবং জনগণের অনগ্রসর অংশসমূহকে সকল প্রকার শোষণ হইতে মুক্তি দান করা।

অনুচ্ছেদ-১৫: রাষ্ট্রের অন্যতম মৌলিক দায়িত্ব হইবে-

ক. অন্ন, বস্ত্র, আশ্রয়, শিক্ষা ও চিকিৎসা জীবন ধারণের মৌলিক উপকরণের ব্যবস্থা

খ. কর্মের অধিকার

পৃষ্ঠা: ৩৬০

 

 

গ. সামাজিক নিরাপত্তার অধিকার।

অনুচ্ছেদ-১৭:  রাষ্ট্র একই পদ্ধতির গণমুখী ও সার্বজনীন শিক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য এবং আইনের দ্বারা নির্ধারিত স্তর পর্যন্ত সকল বালক-বালিকাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষা দান।

অনুচ্ছেদ-২২: রাষ্টের নির্বাহী অঙ্গসমূহ হইতে বিচার বিভাগের পৃথককরণ রাষ্ট্র নিশ্চিত করিবেন।

 

তৃতীয় ভাগে- মৌলিক অধিকার

অনুচ্ছেদ-২৭: সকল নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয়  লাভের অধিকারী।

অনুচ্ছেদ-৩৯: চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দান করা হইল।

আওয়ামী লীগ সরকার ২০০৯ সালে ক্ষমতায় এসে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন প্রণয়ন করে এবং তাদের বিচার চলছে।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান সামরিক আইনের বলে ১৯৭২ সালের সংবিধানে কয়েকটি মৌলিক ধারা সংশোধন করে ইসলাম ধর্ম অন্তর্ভুক্ত করে পাকিস্তানি ভাবধারায় ফিরে যায়। বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট জিয়াউর রহমানের সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী ১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিলের আইন বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়। জাতীয় সংসদ অধিকাংশ সংশোধনী বাতিল করে ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনর্জীবিত করে।

১৯৭২ সালের সংবিধানে ১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যবস্থা ছিল। প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন বাতিল করে তাদের ক্ষমা করে দেন।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বঙ্গবন্ধুর সরকার নিম্নোক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ করে-

* ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ দালাল আইন জারি করে- Po No VIII 1972.

* ১৯৭২ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ নাগরিকত্ব আইন জারি করা হয় এবং অনেক দালালিদের নাগরিকত্ব বাতিল করা হয়।

* ১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর সংবিধানের ১২ ও ৩৮ অনুচ্ছেদে ধর্ম নিয়ে রাজনীতি করা রহিত করা হয়।

* ৬৬ ও ১২২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দালালদের ভোটাধিকার ও সংসদ নির্বাচনে

পৃষ্ঠা: ৩৬১

 

 

অংশগ্রহণের অধিকার বাতিল করা হয়।

* The International Crimes (Tribunals) Act. 1973.

* ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন।

* যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৫  সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করেন। ১৯৭৬ সালে Second Proclamation জারি করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার লক্ষ্যে সংবিধানের ৩৮ অনুচ্ছেদের শর্তাদি তুলে দেওয়া হয়। তিনি সংবিধান সংশোধন করে দালালদের রাজনীতি করা, ভোট প্রদানের অধিকার ও নাগরিকত্ব ফেরত পাবার অধিকার প্রদান করেন।

 

গ. যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠন

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশে ফিরে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশ পুনর্গঠনের দায়িত্ব পালন করেন। পাকিস্তান বাহিনী ১৯৭১ সালের ৯ মাসে বাংলাদেশকে ধ্বংসস্তুপে পরিণত করেছিল। প্রশাসন ভেঙে পড়েছে, যাতায়াত ব্যবস্থা অচল। রেললাইন, জনপথ ক্ষতিগ্রস্ত লঞ্চ-স্টিমার ডুবিয়ে দিয়েছে, বিদ্যুৎ নেই, পানি সরবরাহ নেই, ব্যাংকের টাকা পুড়িয়ে দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ ঘরবাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে। শীতবস্ত্র নেই, ঘরে খাদ্য নেই, সাড়ে সাত কোটি মানুষ অসহায়। তাদের ঘুরে দাঁড়াতে হবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমেই ভারত থেকে ফিরে আসা এক কোটি মানুষকে পুনর্বাসন করেন। প্রশাসন পুনর্গঠন করেন। পাকিস্তানি আমলের ইউনিয়ন পরিষদ ভেঙে দিয়ে প্রত্যেক ইউনিয়নে রিলিফ কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির মাধ্যমে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করা হয়। ১৯৭৩ সালের এক তথ্য বিবরণীতে জানা যায় যে, সরকার ধ্বংসপ্রাপ্ত ৯ লক্ষ ঘরবাড়ি পুনঃনির্মাণ করেছে। এ সময় পুনর্গঠনে ব্যয় হয়েছে ৭২ কোটি ৭৫ লাখ টাকা। তিনি ৩০ লক্ষ শহীদ পরিবারকে আর্থিক সাহায্য এবং নিজ স্বাক্ষরে সমবেদনা পত্র দেন। ৩ লক্ষ নির্যাতিতা মা-বোনের পুনর্বাসন করেন। প্রত্যেক জেলায় সরকারের তত্ত্বাবধানে পুনর্বাসন কেন্দ্র পরিচালনা করা হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত রেল, সড়ক, সেতু, বিদ্যুৎ কেন্দ্র, টেলিফোন এক্সচেঞ্জ পুনঃনির্মাণ করা হয়। পাকবাহিনী কর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত ভৈরব ও হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পুনঃনির্মাণ করা হয়। ৪৬৭টি সেতু নির্মাণ ও মেরামত করা হয়। ৭টি ফেরি, ১৮৫১টি রেলওয়ে ওয়াগন, ৬০৫টি স্টেশন ও তিন পুরাতন বিমান মেরামত করে অভ্যন্তরীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু করেন।

পৃষ্ঠা: ৩৬২

 

ক্ষতিগ্রস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পুনরায় চালু করা হয়। অধিকাংশ শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিল অবাঙালিরা, তারা যুদ্ধকালে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। সরকার পরিত্যক্ত শিল্প প্রতিষ্ঠানের ভার গ্রহণ করে। পাক সেনারা আত্মসমর্পণের পূর্বে ব্যাংক নোট জ্বালিয়ে দিয়ে যায়। দেশের ভৌত অবকাঠামো পুনরুদ্ধার করা হয়। বিভিন্ন দেশ বাংলাদেশকে আর্থিক, খাদ্য ও প্রয়োজনীয় দ্রব্য দিয়ে সাহায্য করেছে। যুদ্ধের পর দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়। ১৯৭১ সালে কৃষকরা ফসল ফলাতে পারেনি। সরকার গ্রামাঞ্চলে ৪ কোটি ৭৫ লাখ মণ চাল-আটা বিনামূল্যে বিতরণ করে। সরকার পশ্চিম পাকিস্তানিদের ৫০০ শিল্প প্রতিষ্ঠান জাতীয়করয়ান ও উৎপাদনক্ষম করে শ্রমিকদের কর্মসংস্থান করে। যুদ্ধের ফলে চট্টগ্রাম ও মংলা সামুদ্রিক বন্দর অচল হয়ে পড়ে। জাতিসংঘ ও রাশিয়া বন্দর থেকে মাইন সরিয়ে বন্দর আবার চালু করে।  সরকারের নির্দেশে মুক্তিযোদ্ধারা অস্ত্র জমা দেয়। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে ভারত ১৯৭২ সালের ১২ মার্চ তাদের সেনাবাহিনী নিয়ে যায়।  পাকিস্তানি ৯৩ হাজার সৈন্যকে ভারতের বিভিন্ন ক্যাম্পে বন্দি করে রাখা হয়।

সরকার ইজারা প্রথা বাতিল করে জলমহল জেলের নিকট বন্দোবস্ত দেয়। ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির মালিকদের খাজনা বাতিল করা হয়। খাজনা বকেয়ার কারণে কৃষকের জমি নিলাম হবে না, বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে আটক ৫ লক্ষ বাঙালিকে দেশে ফেরত নিয়ে আসে। বিশ্বের ১১১টি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে।

কৃষি পুনর্বাসন: ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে কৃষিক্ষেত্র বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষি পুনর্বাসনে নিন্মের কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়-

* জমির বকেয়া খাজনাসহ ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ করা হয়। (২৬.৩.১৯৭২)।

* পরিবারপ্রতি ১০০ বিঘা জমি নির্ধারণ করা হয়।

* কৃষকদের বিরুদ্ধে বকেয়া খাজনা আদায়ের জন্য দায়ের করা ১০ লাখ সার্টিফিকেট মামলা বাতিল করা হয়। সুদসহ কৃষিঋণ মাফ করা হয়।

* সারা দেশে ৪০ হাজার পাওয়ার পাম্প, ২৯০০ গভীর নলকূপ, বিনামূলে সার-সেচের ব্যবস্থা করা হয়।

* কৃষি গবেষণা উন্নত করা হয়।

* ফারাক্কা বাঁধের ফলে সৃষ্ট সমস্যা সমাধান করা হয়। ৪৪০০০ কিউসেক পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হয়।

শিক্ষা সংস্কার: শিক্ষা সংস্কারের জন্য ড. কুদরত-ই-খুদা কমিশন নিয়োগ করা

পৃষ্ঠা: ৩৬৩

 

 

হয়। কমিশন ১৯৭৪ সালে সুপারিশ পেশ করে। শিক্ষক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধু জরুরিভিত্তিতে নিম্নের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন-

* ছাত্রদের বকেয়া বেতন মাফ করা হয়। শিক্ষকদের বকেয়া বেতন পরিশোধ করা হয়।

* অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক করা হয়। পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত ছাত্রদের বিনামূল্যে বই সরবরাহ করা হয়।

* ৩৬ হাজার প্রাথমিক বিদ্যালয়কে সরকারি করা হয়। ১ লাখ ৬০ হাজার শিক্ষকের চাকরি সরকারি করা হয়।

 

অর্থনৈতিক উন্নয়ন

* অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তিনি প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ১৯৭৩-৭৮ গ্রহণ করেন। পরিকল্পনার প্রধান লক্ষ্য দারিদ্রদূরকরণ, জাতীয়প্রবৃদ্ধি ৫.৬ ভাগ অর্জন।

* ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ ও সরবরাহ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত কনজিউমার স্টোর প্রতিষ্ঠা করেন।

* জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের জন্য পরিবার পরিকল্পনার উপর গুরুত্ব প্রদান।

* ব্যাংক-বীমা জাতীয়করণ করা।

* সরকারি কর্মচারীদের বেতন স্কেল দেয়া।

* বিমান ব্যবস্থা উন্নত করা হয়।

* বিদ্যুৎ ব্যবস্থার উন্নয়ন করা হয়।

* প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা সুদৃঢ় করা হয়।

* মদ, জুয়া বন্ধ করা হয়।

 

পররাষ্ট্র নীতিতে সফলতা অর্জন

* ভারত-বাংলাদেশ মৈত্রী চুক্তি- ১৯৭২

* রাশিয়ার সাথে বন্ধুত্ব।

* বাংলাদেশ বিশ্বের ১১১টি রাষ্ট্রের স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭৪ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর প্রথম বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দেন। সর্বোপরি তিনি ১৯৭২ সালে বাংলাদেশকে একটি উন্নতমানের সংবিধান উপহার দেন। জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা হলো রাষ্ট্রের মূলনীতি।

পৃষ্ঠা: ৩৬৪

 

১৯৭৩ সালের সাধারণ নির্বাচন ও মন্ত্রিসভা

১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। আওয়ামী লীগ নৌকা, প্রতীক নিয়ে ৩০০ আসনের মধ্যে ২৯৫ টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৭৩ সালের ১৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে ২১ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। মন্ত্রীরা হলেন:

শেখ মুজিবুর রহমান- প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রিপরিষদ, সংস্থাপন, প্রতিরক্ষা ও পরিকল্পনা

সৈয়দ নজরুল ইসলাম- শিল্প

তাজউদ্দীন আহমদ- অর্থ, পাট

এম মনসুর আলী- যোগাযোগ

খন্দকার মোশতাক আহমিদ- পানিসম্পদ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও বিদ্যুৎ

এ এইচ এম কামরুজ্জামান- বাণিজ্য

আবদুস সামাদ আজাদ- কৃষি

শেখ আবদুল আজিজ- তথ্য ও বেতার

অধ্যাপক ইউসুফ আলী- শিক্ষা, সংস্কৃতি ও ক্রীড়া

জহুর আহমেদ চৌধুরী- শ্রম ও সমাজকল্যাণ

শ্রী ফনী ভূষণ মজুমদার- খাদ্য

ড. কামাল হোসেন- পররাষ্ট্র

আবদুল মালেক উকিল- স্বরাষ্ট্র

এম মতিয়ুর রহমান- স্থানীয় সরকার, সমবায় পল্লী উন্নয়ন

মিজানুর রহমান চৌধুরী- ত্রাণ পুনর্বাসন

সোহরাব হোসেন- পূর্ত

আবদুল মান্নান- স্বাস্থ্য পরিবার পরিকল্পনা

আবদুর রব সেরনিয়াবাত- ভূমি প্রশাসন, ভূমি সংস্কার,

বন, মৎস্য ও পশু পালন

জেনারেল মোঃ আতাউল গনি ওসমানী- নৌপরিবহন, ডাক ও তার

ড. মফিজ চৌধুরী- বিজ্ঞান, কারিগরি ও আণবিক শক্তি

শ্রী মনোরঞ্জন ধর- আইন ও সংসদবিষয়ক

মন্ত্রিসভা মুক্তিযুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত ও শহীদ পরিবারের পুনর্বাসনের সিদ্ধান্ত নেয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এক কোটি লোক ভারতে আশ্রয় নেয়, ৩০ লাখ শহীদ, ২ লাখ পঞ্চাশ হাজার নারী নির্যাতিত হয়।

পৃষ্ঠা: ৩৬৫

 

 

মুক্তিযোদ্ধাদের সম্মানিত করা

১৯৭৩ সালের ১৬ ডিসেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে যারা মৃত্যু নিশ্চিত জেনে সম্মুখযুদ্ধে শহীদ হয়েছেন এবং অপূর্ব সাহসিকতা প্রদর্শন করেছেন তাদের বিশেষ খেতাবে ভূষিত করেন। খেতাবপ্রাপ্তদের মধ্যে ৭ জন বীরশ্রেষ্ঠ, ৬৮ জন বীরউত্তম, ১৭৫ জন বীরবিক্রম, ৪২৬ জন বীরপ্রতীক ছিলেন।

বীরশ্রেষ্ঠরা হলেন:

শহীদ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর

শহীদ ফ্লাইট লে. মতিয়ুর রহমান

শহীদ ল্যান্সনায়েক মুন্সী আবদুর রব

শহীদ সিপাহী হামিদুর রহমান

শহীদ সিপাহী মোস্তফা কামাল

শহীদ ল্যান্স নায়েক নূর মোহাম্মদ

শহীদ মোহাম্মদ রুহুল আমিন

 

সরকারের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কর্মসূচি

১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি সরকার পাকবাহিনীর দালালদের বিচারের জন্য ট্রাইব্যুনাল গঠন করে।

১৯৭২ সালের ৮ এপ্রিল পৃথক সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও নৌবাহিনী গঠন করা হয়। ১৯৭২ সালের ১০ এপ্রিল শাহ আবদুল হামিদ ও মোহাম্মদ উল্লাহ যথাক্রমে গণপরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।

১৯৭২ সালের ১৩ জুলাই সচিব আবদুর রবকে চেয়ারম্যান করে ১৫ সদস্যবিশিষ্ট পে-কমিশন গঠন করা হয়।

১৯৭২ সালের ১০ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানীকে সভাপতি এবং কাজী জাফরকে মহাসচিব করে ভাসানী ন্যাপ গঠন করা হয়।

সরকার ১৯৭৩ সালের ১০ জুলাই বেতন বৈষম্য দূর করে দশটি জাতীয় স্কেল ঘোষণা করে।

 

সংবিধানের প্রথম সংশোধন

বঙ্গবন্ধুর জীবিতকালে সংবিধানের চারবার সংশোধন করা হয়।

১৯৫ জন পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার জন্য ১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই জাতীয় সংসদ সংবিধানের প্রথম সংশোধন করে। সংবিধানের ৪৭ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে বলা হয় যে, মৌলিক অধিকারের ৩৫ ও ৪৪ ধারা আটক যুদ্ধাপরাধীদের জন্য প্রযোজ্য হবে না। তারা আটকাদেশ চ্যালেঞ্জ করে

পৃষ্ঠা: ৩৬৬

 

আদালতের আশ্রয় নিতে  পারবে না। ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের জন্য জাতীয় সংসদে The International Crimes (Tribunals) Act 1973 পাস হয়।

 

সংবিধানের দ্বিতীয় সংশোধনী

১৯৭৩ সালের ১৫ জুলাই সংবিধানের ২৫ ও ৩৩ ধারা সংশোধন করে রাষ্ট্রপতিকে জরুরি অবস্থা ঘোষণার ক্ষমতা প্রদান করা হয়।

জাসদ, সর্বহারা পার্টি ও ভাসানী ন্যাপ দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। ব্যাংক ও থানা লুট, পাঁচজন সংসদ সদস্য নিহত হয়। বাধ্য হয়ে রাষ্ট্রপতি ১৯৭৪ সালের ২৮ ডিসেম্বর জরুরি অবস্থা ঘোষণা করেন।

 

সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী

১৯৭৪ সালের ১৬ মে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান দিল্লি গমন করেন এবং উভয় দেশের মধ্যে সীমান্ত চুক্তি স্বাক্ষর করেন। এ চুক্তি অনুসারে ১৯৭৪ সালের ২৮ নভেম্বর সংবিধানের তৃতীয় সংশোধনী আনা হয়।

 

সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী

১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি শাসনতন্ত্রে চতুর্থ সংশোধনী আনয়ন করা হয় এবং রাষ্ট্রপতি ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করা হয়।

 

আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন- ২০ জানুয়ারি ১৯৭৪

আওয়ামী লীগের গঠনতন্ত্র অনুসারে যারা মন্ত্রী থাকবেন তারা দলের সাংগঠনিক পদে থাকবেন না। বঙ্গবন্ধু ইতোপূর্বেই সভাপতির পদ ত্যাগ করার ঘোষণা দেন। ১৯৭৪ সালের ২০ জানুয়ারি ঢাকায় আওয়ামী লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্থলে এএইচএম কামরুজ্জামান সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদের স্থলে জিল্লুর রহমান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

 

উন্নয়ন ভাবনা

বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন সম্পর্কে বলেন, “আমার সরকার অভ্যন্তরীণ সমাজ বিপ্লবে বিশ্বাস করে। এটা কোনো অগণতান্ত্রিক কথা মাত্র নয়- আমার সরকার ও পার্টি বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রতিষ্ঠা করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। একটি নতুন ব্যবস্থার ভিত রচনার জন্য পুরনো সমাজ ব্যবস্থা

পৃষ্ঠা: ৩৬৭

 

 

উপড়ে ফেলতে হবে। আমরা শোষণমুক্ত সমাজ গড়ব।” সমাজতান্ত্রিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু ব্যাংক, বীমা, পাট, বস্ত্র প্রভৃতি জাতীয়করণ করেন। ১৯৭২ সালের ২৬ মার্চ পিও ১৬ আদেশে সকল ব্যাংক জাতীয়করণ করে ৬টি ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পাট, বস্ত্র, ভারি শিল্প জাতীয়করণ করা হয়। সরকার কনজিউমার সাপ্লাই কপারেশন প্রতিষ্ঠা করে গ্রাম পর্যায় ন্যায্যমূল্যে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহের ব্যবস্থা করে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার জন্য বাজেট প্রণয়ন করা হয়। তখন বাজেটের আকার ছোট ছিল।

 

সাল।

রাজস্ব আয় ১৯৭২-৭৩ ২১৮.১৫ কোটি

৫০১ কোটি ১৯৭৩-৭৪। ৫৫৯.৩৭ কোটি

৫২৫ কোটি ১৯৭৪-১৯৭৫ ১৪৫৯.৩৭ কোটি

৫২৫ কোটি

জাতীয়করণ করে ৬টি করণ করা হয়। সরকার

পর্যায় ন্যায্যমূল্যে বাংলাদেশকে গড়ার

উন্নয়ন ব্যয়

 

 

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা

প্রধানমন্ত্রী ১৯৭২ সালের ২১ জানুয়ারি বাংলাদেশ প্লানিং কমিশন গঠন করেন। কমিশনে ছিলেন-

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- চেয়ারম্যান

ড. নুরুল ইসলাম- ভাইস চেয়ারম্যান

ড. রেহমান সোবহান- সদস্য

ড. আনিসুর রহমান- সদস্য

ড. মোশাররফ হোসেন- সদস্য

গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে প্রথম পঞ্চবার্ষিকী ১৯৭৩-৭৮ প্রণয়ন করা হয়। মোট ব্যয় ধরা হয় ৪৪৫৫ কোটি টাকা।

প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার লক্ষ্য ছিল:

  • দারিদ্র দূরীকরণ-জাতীয় উৎপাদন বৃদ্ধি;
  • সার্বিক জিডিপি ৫.৫ শতাংশ বৃদ্ধি;
  • জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ৩.৩ থেকে ২.৮ হ্রাস করা;
  • বেকারত্ব দূর করে চাকরির সংস্থান;
  • খাদ্যশস্যের উৎপাদনে আত্মনির্ভরশীলতা অর্জন;
  • মাথাপিছু আয় ২.৫ শতাংশ বৃদ্ধি করা;
  • মুক্তিযোদ্ধাদের পুনর্বাসন;
  • মানব সম্পদ উন্নয়ন;
  • দেশে সমহারে আয় ও কর্মের সুযোগ সৃষ্টি করা।

পৃষ্ঠা: ৩৬৮

 

 

অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের পদত্যাগ

২৬ অক্টোবর ১৯৭৪

তাজউদ্দীন আহমদ মুক্তিযুদ্ধকালে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। তিনি ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করেন। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে তার অবদান উজ্জ্বল হয়ে থাকবে। একটি মহল বঙ্গবন্ধু ও তাজউদ্দীন আহমদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টি করে। অন্যদিকে আমেরিকা তাজউদ্দীন আহমদের বিরোধিতা করত। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর পদত্যাগ করেন। তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা বঙ্গবন্ধুর ভুল সিদ্ধান্ত ছিল।

 

শিক্ষানীতি-১৯৭৪

বঙ্গবন্ধু সরকার ১৯৭২ সালের ২৬ জুলাই ড. মুহম্মদ কুদরত-এ-খুদাকে সভাপতি করে ১৫ সদস্য বিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করে। ১৯৭৪ সালের মে মাসে পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট প্রণয়ন করা হয়।

জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও গণতন্ত্রের ভিত্তিতে শিক্ষানীতি প্রণয়ন করা হয়।

কমিশনের অগ্রাধিকার বিষয়

১. শিক্ষার সর্বস্তরে জাতীয়করণ, মূলনীতি চতুষ্টয়ের সার্থক প্রতিফলন সুনিশ্চিত করতে হবে।

২. সর্বস্তরে বাংলাকে শিক্ষার মাধ্যম রূপে ব্যবহার করতে হবে।

৩. প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করতে হবে।

৪. প্রাথমিক স্তর থেকে বিজ্ঞান এবং কৃষি শিক্ষা বিশেষ স্থান দিতে হবে।

৫. মাধ্যমিক স্তরে নবম শ্রেণী পর্যন্ত বৃত্তিমূলক শিক্ষার ব্যাপক সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে।

৬. ১৯৮০ সালের মধ্যে দেশকে নিরক্ষরতা দূর করতে হবে।

৭. সরকারি ও বেসরকারি শিক্ষায়তনগুলোর মধ্যে বিরাজমান বৈষম্য দূর করতে হবে।

৮. শিক্ষাকে সম্পদ সৃষ্টির উপায় হিসেবে গণ্য করতে হবে।

 

শিক্ষার লক্ষ্য

১. শিক্ষা ব্যবস্থা একটি জাতির আশা-আকাক্ষা রূপায়ণ এবং ভবিষ্যত সমাজ নির্মাণে হাতিয়ার।

পৃষ্ঠা: ৩৬৯

 

 

২. দেশের সকল শ্রেণীর জনগণের জীবনে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রয়োজনের উপলব্ধি জাগানো।

৩. নানাবিধ সমস্যা সমাধানের যোগ্যতা অর্জন।

৪. সমাজতান্ত্রিক সমাজ সৃষ্টির প্রেরণা সঞ্চার।

৫. শিক্ষার মাধ্যমে জাতীয় নীতি চতুষ্টয়ের সার্বিক প্রতিফল সুনিশ্চিত  করতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর ড. কুদরত-এ-খুদা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত হয়ে যায়।

 

প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ

প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি জাতীয়করণ করে সরকার প্রাথমিক শিক্ষকদের চাকরি সরকারিকরণ  এবং বেতন বৃদ্ধি করে। সরকার ৩৬১৬৬টি প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ এবং ১৫৬৭৪২ শিক্ষককের চাকরি সরকারি করেছে। অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা নিশ্চিত করার অধিকার সংবিধানের ১৭ অনুচ্ছেদে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।

 

বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা আইন-১৯৭৩

বিশ্ববিদ্যালয়ের কালাকানুন বাতিল করে ১৯৭৩ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স জারি করা হয়।

ফারাক্কা বাঁধ ও গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি-১৯৭৫

ভারত সরকার গঙ্গা নদীতে ১৯৭৫ সালে ফারাক্কা বাঁধ নির্মাণ সমাপ্ত করে। ১৯৭৫ সালের ১৮ এপ্রিল বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে গঙ্গা নদীর পানি বণ্টন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ সর্বনিম্ন ৪৪ হাজার কিউসেক পানি পাবে।

 

ইসলামিক ফাউন্ডেশন-১৯৭৫

ইসলাম ধর্মের প্রচার ও প্রসারের জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২২ মার্চ এক অধ্যাদেশবলে ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি টঙ্গী ইস্তেমা ও কাকরাইল মসজিদকে জমি বরাদ্দ করেন।

 

পররাষ্ট্রনীতি

১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা চালায়। পাকিস্তানের

পৃষ্ঠা: ৩৭০

 

 

গণহত্যা সারা বিশ্বে ঘৃণার সৃষ্টি করে। বিশ্বের অধিকাংশ দেশ মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন করে। বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত-রাশিয়ার অবদান অবিস্মরণীয়।

স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে।

১৯৭২ সালের সংবিধানের মূলনীতির ২৫ নম্বর অনুচ্ছেদে পররাষ্ট্রনীতির উল্লেখ আছে।

জাতীয় সার্বভৌমত্ব ও সমতার প্রতি শ্রদ্ধা, অন্য রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয় হস্তক্ষেপ না করা, আন্তর্জাতিক বিরোধের শান্তিপূর্ণ সমাধান, আন্তর্জাতিক আইন ও জাতিসংঘের সনদের প্রতি শ্রদ্ধা- এ সকল নীতি হবে আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ভিত্তি- এ সকল নীতির ভিত্তিতে রাষ্ট্র-

(ক) আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে শক্তি প্রয়োগ পরিহার এবং সাধারণ ও শান্তিপূর্ণ নিরস্ত্রীকরণের চেষ্টা করবেন।

(খ) প্রত্যেক জাতির অভিপ্রায় অনুযায়ী পথ ও পন্থার মাধ্যমে অবাধে নিজস্ব সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা নির্ধারণ ও গঠনের অধিকার সমর্থন করবেন এবং

(গ) সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকবাদ ও বর্ণ বৈষম্যবাদের বিরুদ্ধে, বিশ্বের সর্বত্র নিপীড়িত জনগণের ন্যায়সঙ্গত সংগ্রামকে সমর্থন করবে।

বঙ্গবন্ধুর পররাষ্ট্রনীতির মূল ভিত্তি ছিল সকলের প্রতি ভালোবাসা, কারও প্রতি ঘৃণা পোষণ না করা। জাতীয় স্বার্থে পররাষ্ট্রনীতি পরিচালিত হবে।

 

ভারত সফর

১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়ক শক্তি হিসেবে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করে। ভারত এক কোটি বাঙালিকে আশ্রয় দেয়। ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে একত্রিত হয়ে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে বিজয় ছিনিয়ে আনে। ভারত সরকার ও জনগণের প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপনের জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ২ দিনের সফরে কলকাতা গমন করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তাকে অভ্যর্থনা জানান। সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেন, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষতা অনুসরণ করবে। ধর্মনিরপেক্ষতা চার মূলনীতির অন্যতম।

 

রাশিয়া সফর

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সোভিয়েত রাশিয়ার অবদান অতুলনীয়। রাশিয়ার প্রতি

পৃষ্ঠা: ৩৭১

 

 

কৃতজ্ঞতা জানাবার জন্য বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১ মার্চ হতে ৫ মার্চ সোভিয়েত রাশিয়া সফর করেন।

 

ভারতের সাথে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি

ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ১৯৭২ সালের ১৭ মার্চ বাংলাদেশ সফর করেন। সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে উভয় নেতা ভাষণ দেন। তারা ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তি স্বাক্ষর করেন।

 

সিমলা চুক্তি ও বন্দি বিনিময়

১৯৭২ সালের ২৮ জুন হতে ২ জুলাই ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টো বন্দি বিনিময়ের জন্য সিমলা চুক্তি স্বাক্ষর করেন এবং ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী ফেরত দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। বাংলাদেশ-সিমলা চুক্তি সমর্থন দেয়। কারণ এ চুক্তির ফলে পাকিস্তানে আটক ৫ লাখ বাঙালি দেশে ফিরে আসতে পারবে। চুক্তি অনুসারে ১৯৭৩ সালের ১৯ এপ্রিল হতে ব্যাপক প্রত্যাবাসন চলে। এ ব্যাপারে জাতিসংঘ সহায়তা করে।

১৯৭৩ সালের ২৩ মে ঢাকায় এশীয় শান্তি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু এ সম্মেলন উদ্বোধন করেন।

 

জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন-১৯৭৩

১৯৭৩ সালের ৫-৬ সেপ্টেম্বর আলজিরিয়ার রাজধানী আলজিয়ার্সে জোট নিরপেক্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বঙ্গবন্ধু এ সম্মেলনে যোগদান করেন এবং বিশ্ব নেতাদের সাথে আলোচনায় মিলিত হন।

 

পাকিস্তানে ইসলামী সম্মেলন-১৯৭৪

পাকিস্তানের লাহোরে ১৯৭৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ইসলামী সম্মেলন- ওআইসি অনুষ্ঠিত হয়। ওআইসি বাংলাদেশকে সম্মেলনে যোগদানের জন্য আহ্বান জানায়। বঙ্গবন্ধু জানালেন যে, পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিলে তিনি সম্মেলনে যাবেন না। তখন মুসলিম দেশসমূহ পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টোকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য চাপ দেয়। ১৯৭৪ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু লাহোরে গমন করেন এবং সম্মেলনে যোগ দেন। মুসলিম বিশ্বে বাংলাদেশের সম্মান বৃদ্ধি পায়। ইরাক ও তুরস্ক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়।

পৃষ্ঠা: ৩৭২

 

 

১৯৭৪ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি মিশরের প্রেসিডেন্ট আনোয়ার সাদাত বাংলাদেশ সফর করেন।

 

বঙ্গবন্ধুর জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার লাভ-১৯৭৩

১৯৭২ সালের অক্টোবর মাসে চিলির রাজধানী সান্তিয়াগোতে শান্তি পরিষদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের প্রতিনিধি আলি আকসাদ বিশ্ব পরিষদের সভায় যোগ দেন। বাঙালি জাতির মুক্তিআন্দোলন ও বিশ্ব শান্তি প্রতিষ্ঠায় বঙ্গবন্ধুর অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক প্রদানের প্রস্তাব উত্থাপন করে। ১৪০টি দেশের ২০০ প্রতিনিধির উপস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পুরস্কার পদক প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।

১৯৭৩ সালের ২২-২৩ মে বাংলাদেশ জাতীয় সংসদের উত্তর প্রাজায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৩ মে সভায় বিশ্ব শান্তি পরিষদের মহাসচিব  রমেশ চন্দ বঙ্গবন্ধুকে জুলিও কুরি শান্তি পদক পরিয়ে দিয়ে বলেন, শেখ মুজিব শুধু বঙ্গবন্ধু নন আজ থেকে তিনি বিশ্ববন্ধু বটে।

 

জাপান সফর ১৯৭৩

১৯৭৩ সালের ১৯ অক্টোবর ৭ দিনের সফরে বঙ্গবন্ধু জাপান গমন করেন। সাথে ছিলেন শেখ রেহানা ও শেখ রাসেল। জাপান সফরকালে তিনি জাপান সরকারের সাথে যমুনা সেতু নির্মাণের জন্য আলোচনা করেন। আলোচনা অনুসারে জাপানি বিশেষজ্ঞ দল ঢাকা আসে এবং যমুনা সেতু নির্মাণের সম্ভাব্যতা পরীক্ষা শুরু করে। বঙ্গবন্ধুর জাপান সফরের পর যমুনা সেতুর কার্যক্রম শুরু হয়। যমুনা সেতু নির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়।

 

কমনওয়েলথ সম্মেলন

প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যুগোস্লাভিয়া ও কানাডা সফরের জন্য ১৯৭৩ সালের ২৬ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৮ জুলাই তিনি যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটোর সাথে বৈঠকে মিলিত হন এবং জোট নিরপেক্ষ আন্দোলন সম্পর্কে আলোচনা করেন।

১৯৭৩ সালের ৩ আগস্ট বঙ্গবন্ধু কানাডায় অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন এবং ৭ আগস্ট সম্মেলনে ভাষণ দেন। তিনি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য পদ লাভের প্রতি সমর্থন প্রদানের জন্য সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানান।

পৃষ্ঠা: ৩৭৩

 

 

১৯৭৫ সালে ২৬ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু জ্যামাইকার রাজধানী কিংস্টনে অনুষ্ঠিত কমনওয়েলথ সম্মেলনে যোগ দেন।

 

জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭৪

বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি প্রদান করে। কিন্তু চীনের ভেটোর কারণে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভ করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুর ব্যক্তিত্ব ও কূটনীতির কারণে ১৯৭৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ বাংলাদেশের সদস্য পদ গ্রহণ করে। বাংলাদেশ জাতিসংঘের ১৩৬তম সদস্য নির্বাচিত হয়।

 

জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ

২৫ সেপ্টেম্বর-১৯৭৪

১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব রহমান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ২৯তম অধিবেশনে যোগ দেন। তিনি প্রথম বাংলা ভাষায় জাতিসংঘে ভাষণ দেন। তার পূর্বে কোনো বাঙালি জাতিসংঘে বাংলা ভাষায় ভাষণ দেওয়ার সুযোগ লাভ করেনি। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থা, আন্তর্জাতিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি, শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান, উপসাগর বিবাদ নিষ্পত্তি, জাতিসংঘের ভূমিকা প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করে তিনি ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে নোবেল পুরস্কার পেয়ে বাংলা ভাষাকে বিশ্বে পরিচয় করে দেন। এ ঘটনার ৫০ বছর পর বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে বিশ্বের বুকে তুলে ধরেন।

 

বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন

বাকশাল-১৯৭৫

দ্বিতীয় বিপ্লব

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ, রাষ্ট্রপতি পদ্ধতি ও একদলীয় শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭৫ সালের ১৬ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী আনয়ন করেন।

সংশোধন আইনের কয়েকটি ধারা:

অনুচ্ছেদ-১৮: বাংলাদেশে একজন রাষ্ট্রপতি থাকবেন।

অনুচ্ছেদ-৪৯: একজন উপরাষ্ট্রপতি থাকবে। তিনি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হবেন।

পৃষ্ঠা: ৩৭৪

 

 

অনুচ্ছেদ-৫৮: মন্ত্রিপরিষদ থাকবে

অনুচ্ছেদ-১১৭ক: জাতীয় দল থাকবে। রাষ্ট্রপতি জাতীয় দল গঠন করবেন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি তিনি জাতীয় পরিষদের ভাষণ দেন।

১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু ১৭ জন মন্ত্রী ও ৯ জন প্রতিমন্ত্রী নিয়ে রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিসভা গঠন করেন।

রাষ্ট্রপতির মন্ত্রিসভা: ২৬ জানুয়ারি ১৯৭৫

শেখ মুজিবুর রহমান- রাষ্ট্রপতি

সৈয়দ নজরুল ইসলাম- উপরাষ্ট্রপতি

এম মনসুর আলী- প্রধানমন্ত্রী 

খন্দকার মোশতাক আহমদ- বাণিজ্য

এ এইচ এম কামরুজ্জামান- শিল্প

অধ্যাপক মহম্মদ ইউসুফ আলী- শ্রম সমাজ কল্যাণ

শ্রী মনোরঞ্জন ধর- আইন

ফণীভূষণ মজুমদার- স্থানীয় সরকার

আবদুস সামাদ আজাদ- কৃষি

আবদুর রব সেরনিয়াবাত- পানি সম্পদ, বিদ্যুৎ

ড. এ আর মল্লিক

ম- অর্থ ও পরিকল্পনা

ড. কামাল হোসেন- পররাষ্ট্র

ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী- শিক্ষা

এম কোরবান আলী- তথ্য

আবদুল মোমেন- খাদ্য ও ত্রাণ

মোহাম্মদ উল্লাহ- ভূমি সংস্কার

আসাদুজ্জামান খান- পাট

মোহাম্মদ সোহরাব হোসেন- গণপূর্ত

আবদুল মান্নান- স্বাস্থ্য

আবু সাঈদ চৌধুরী- নৌ ও জাহাজ চলাচল

প্রতিমন্ত্রী

আবদুল মমিন তালুকদার- সমবায়

দেওয়ান ফরিদ গাজী- বাণিজ্য

নুরুল ইসলাম চৌধুরী- প্রতিরক্ষা

তাহের উদ্দিন ঠাকুর- তথ্য ও বেতার

পৃষ্ঠা: ৩৭৫

 

 

মোসলেম উদ্দিন খান- পাট

নুরুল ইসলাম মঞ্জুর- যোগাযোগ

কে এম ওবায়দুর রহমান- ডাক ও তার

ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল- ত্রাণ

রিয়াজ উদ্দিন আহমদ- বন মৎস্য ও পশু পালন

আবদুল মালেক উকিল- স্পিকার

এম বায়তুল্লাহ- ডেপুটি স্পিকার

শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন- চিফ হুইপ

তোফায়েল আহমেদ- রাষ্ট্রপতির বিশেষ সহকারী

১৯৭৫ সালে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে ঐতিহাসিক ভাষণ দেন এবং দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি ঘোষণা দেন। কর্মসূচি ছিল দুর্নীতি দমন,  জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, সমবায় খামার প্রতিষ্ঠা।

বঙ্গবন্ধু সমাপ্তিতে বলেন,

“ভাইয়েরা

আবার দেখা হবে, কি বলেন ইনশাআল্লাহ আবার দেখা হবে। আপনারা বহুদূর থেকে কষ্ট করে এসেছেন। গ্রামে গ্রামে ফিরে যান। যেয়ে বলেন, দুর্নীতিবাজদের খতম করতে হবে। ক্ষেতে খামারে, কল-কারখানায় প্রডাকশন বাড়াতে হবে। সরকারি কর্মচারী ভাইরা আপনারাও কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগের সদস্য হবেন। আপনারা প্রাণ দিয়ে কাজ করেন। ইনশাআল্লাহ বাংলাদেশ এসেছে, বাংলাদেশ থাকবে।”

 

বাকশাল কমিটি গঠন

১৯৭৫ সালের ৭ জুন বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ গঠন করেন। তিনি বাকশালের ১৫ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী এবং ১১৫ জন সদস্যবিশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটি গঠন করেন।

বাকশালের কার্যনির্বাহী কমিটি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান- চেয়ারম্যান

সৈয়দ নজরুল ইসলাম

এম মনসুর আলী- সাধারণ সম্পাদক

খন্দকার মোশতাক আহমদ

এ এইচ এম কামরুজ্জামান

আবদুল মালেক উকিল

পৃষ্ঠা: ৩৭৬

 

 

অধ্যাপক মোহাম্মদ ইউসুফ আলী

শ্রী মনোরঞ্জন দে

ড. মোজাফফর আহমদ চৌধুরী

শেখ আবদুল আজিজ

মহিউদ্দিন আহমেদ

গাজী গোলাম মোস্তফা

জিল্লুর রহমান – সম্পাদক

শেখ ফজলুল হক মনি- সম্পাদক

আবদুর রাজ্জাক- সম্পাদক

 

বাকশালের অঙ্গ সংগঠন

জাতীয় কৃষক লীগ, সাধারণ সম্পাদক, ফণিভূষণ মজুমদার

জাতীয় শ্রমিক লীগ, সাধারণ সম্পাদক, অধ্যাপক মোঃ ইউসুফ আলী

মহিলা লীগ, সাধারণ সম্পাদক, বেগম সাজেদা চৌধুরী

যুবলীগ, সাধারণ সম্পাদক, শেখ ফজলুল হক মণি

ছাত্রলীগ, সাধারণ সম্পাদক, শেখ শহীদুল ইসলাম

১৯৭৫ সালের ২৩ জুন সকল মহকুমা জেলায় উন্নীত করে ৬১টি জেলা সষ্টি করা হয়।

১৬ জুলাই ৬১ জন গভর্নর নিয়োগ করা হয়।

২১ জুলাই বঙ্গবন্ধু গভর্নদের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উদ্বোধন করেন।

জুলাই মাসে বঙ্গভবনে বঙ্গবন্ধু বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রথম সভায় ভাষণ দেন।

তিনি ভাষণে বলেন,

“আমাদের আদর্শ হলো বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসেবে ইজ্জত সহকারে দুনিয়াতে বাঁচিয়ে রাখা। সেখানে অন্যায় অবিচার জুলুম থাকবে না। দুর্নীতি থাকবে না। Let us try for that, আসুন আমরা চেষ্টা করি সে সম্পর্কে সকলে মিলে।

 

বাকশাল গঠনের উদ্দেশ:

* সকলকে নিয়ে জাতীয় ঐক্য গঠন করা হবে;

* দেশের মঙ্গলের জন্য কাজ করতে হবে;

* প্রত্যেক নির্বাচনী এলাকা থেকে ৩ বা ৪ জন বাছাই করে একজন নির্বাচিত হবে;

পৃষ্ঠা: ৩৭৭

 

* প্রত্যেক জেলায় একজন গভর্নর, ম্যাজিস্ট্রেট থাকবেন।

* শাসন ব্যবস্থা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে;

* সমাজে আমূল পরিবর্তন Revolution আসবে;

& আত্মসমালোচনা থাকতে হবে। তা না হলে আত্মশুদ্ধি করা যায় না;

* ইতিবাচক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

 

ঘ. সপরিবারে বঙ্গবন্ধু হত্যা ও আদর্শিক পটপরিবর্তন

দেশী-বিদেশি শত্রুরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে। দেশে বাকশাল কায়েম হলে তার সরকারকে উৎখাত করা যাবে না। তাই তারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৫ আগস্ট বেছে নেয়।

খন্দকার মোশতাক আহমদ ও মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের সমর্থনে সেনাবাহিনীর একটি অংশ বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

জুলাই মাসে বঙ্গবন্ধুর দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা জার্মানির উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করেন। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিক্ষকদের উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রস্তুতি চলছে। অন্যদিকে ষড়যন্ত্রকারীরা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে।

 

পনেরোই আগস্টের ষড়যন্ত্রকারীরা

খন্দকার মোশতাক আহমদ- বঙ্গবন্ধু মন্ত্রিসভার সদস্য

তাহের উদ্দিন ঠাকুর- তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী

মাহবুব আলম চাষী- কুমিল্লা পল্লী উন্নয়ন একাডেমির মহাপরিচালক। তিনি একাডেমিতে ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ে সভা করেছেন।

মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমান- সেনাবাহিনীর ডেপুটি চিফ অব স্টাফ

মেজর ফারুকুর রহমান

মেজর খন্দকার আবদুর রশীদ

মেজর নূর চৌধুরী- সে বঙ্গবন্ধুকে গুলি করে হত্যা করেছে।

মেজর রাশেদ চৌধুরী- মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিবায়াত ও তার পরিবারকে হত্যা করেছে।

রিসালদার মোসলেম উদ্দিন- শেখ ফজলুল হক মণি ও তার স্ত্রী আরজু মনিকে হত্যা করেছে।

পৃষ্ঠা: ৩৭৮

 

 

মেজর শরিফুল হক ডালিম- বেতার-টিভিতে বঙ্গবন্ধুর হত্যার ঘোষণা দেয়।

মেজর বজলুল হুদা- শেখ কামাল, কর্নেল জামিলসহ পরিবারের অনেককে হত্যা করে।

 

১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট রাতে মেজর ফারুক এবং মেজর রশীদ প্রথম বেঙ্গল ল্যান্সার এবং দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারি ঢাকা সেনানিবাস থেকে বহর নিয়ে যায়। রাতের কুচকাওয়াজের নামে বেঙ্গল ল্যান্সার এবং ফিল্ড আর্টিলারির ৬০০ সৈন্যদের একত্রিত করে। মেজর ফারুক অপারেশনের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি সৈন্যদের তিন ভাগে বিভক্ত করেন। এক ভাগে ৭৫ থেকে ১৫০ সৈন্য ছিল। তাদের লক্ষ্য ছিল তিনটি বাসা। ৩২ নম্বরের ধানমণ্ডি-বঙ্গবন্ধুর বাসভবন, রাষ্ট্রপতি হয়েও তিনি বঙ্গভবনে না থেকে ধানমণ্ডিতে নিজের বাসায় থাকতেন। দ্বিতীয় শেখ মনির বাসভবন এবং তৃতীয় মিন্টো রোডে আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসভবন।

মেজর নুর চৌধুরী, মেজর বজলুল হুদা ও মেজর মহিউদ্দিন একদল ল্যান্সার সৈন্য নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সকাল ৫-১৫ মিনিটে পৌঁছে। সৈন্যরা বঙ্গবন্ধুর বাসভবন লক্ষ্য করে গোলাবর্ষণ করতে থাকে। বঙ্গবন্ধু ও বাসার সবার ঘুম ভেঙে যায়। তারা ভেবেছিল দুষ্কৃতকারীরা বাসা আক্রমণ করেছে। ৫টি ট্রাকে ১২০ জন্য সৈন্য বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করে। পাহারারত পুলিশরা কালো পোশাকধারী সৈন্য দেখে আত্মসমর্পণ করে। তারা দেহরক্ষীকে হত্যা করে। সৈন্যদের দেখে শেখ কামাল নিচে নেমে আসে। তিনি ভাবছিলেন সৈন্যরা তাদের সাহায্যে এসেছে। শেখ কামালকে দেখে মেজর বজলুল হুদা তাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি মাটিতে লুটিয়ে পড়ে মৃত্যুবরণ করেন। বঙ্গবন্ধু তার জ্যেষ্ঠ পুত্র শেখ কামালের লাশ দেখতে পান। তিনি জেনারেল সফিউল্লাহকে ফোন করে তার বাসভবন আক্রমণের কথা তাকে জানান। তিনি তার মিলিটারি সেক্রেটারি কর্নেল জামিলউদ্দিনকে জানান।

বঙ্গবন্ধু দোতলায় ছিলেন। তিনি সিড়ির ওপরে দাঁড়িয়ে আছেন। তার পরনে ছিল ধূসর রঙের চেক লুঙ্গি, গায়ে ছিল পাঞ্জাবি এবং হাতে ছিল পাইপ। মেজর মহিউদ্দিন তাকে হত্যার জন্য এগিয়ে যান। বঙ্গবন্ধু তাকে জিজ্ঞেস করেন, তোমরা কী চাও। তোমরা কি আমাকে হত্যা করতে এসেছ? তা ভুলে যাও। পাকিস্তান সেনাবাহিনী তা করতে পারেনি। তোমরা কে যে তা পারবে?” মেজর মহিউদ্দিন মুখোমুখি হয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ সময় পাষণ্ড মেজর নুর চৌধুরী তার

পৃষ্ঠা: ৩৭৯

 

 

স্টেনগান দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে গুলিবর্ষণ করে। গুলি তার ডান পাশে গর্ত করে বেরিয়ে যায়। গুলিতে তার শরীর ঝাঁঝরা হয়ে যায়। তার দেহ কাত সিঁড়িতে  পড়ে যায়। মুখ ছিল নিচে। তখনও তার ডান হাতে পাইপ। সময় তখন ভোর ৫ টা ৪০ মিনিট। বাঙালি জাতির মহান নেতার করুণ মৃত্যু হলো। বঙ্গবন্ধকে যখন গুলি করে তখন বেগম মুজিব তাকে অনুসরণ করে। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর মেজর বজলুল হুদা, মেজর মহিউদ্দিন, মেজর আজিজ পাশা ওপরে ওঠে। বেগম মুজিবকে তার শয়নকক্ষে দরজায় দেখে মেজর বজলুল হুদা তাকে গুলি করে হত্যা করে। তারপর গণহত্যা চলে। লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বড় কক্ষে নিয়ে আসে। অফিসার ও সৈন্যরা স্টেনগান দিয়ে গুলি করে বন্ধ দরজা ভেঙে ফেলে। অতি নিকট থেকে মেজররা গুলি করে শেখ জামালকে হত্যা করে। শেখ কামালের নববিবাহিত বধূ সুলতানা ও শেখ জামালের বধু রোজীকে গুলি করে হত্যা করে। ১০ বছরের শিশু শেখ রাসেল ফার্নিচারের মধ্যে পালিয়ে ছিল। তাকেও ধরে ফেলে। রাসেল খুনিদের অনুরোধ করে, ‘আমাকে মেরো না, আমাকে মায়ের নিকট যেতে দাও।’ শেখ রাসেলের কান্নায় খুনিদের হৃদয় গলেনি। তারা রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর কনিষ্ঠ ভ্রাতা শেখ নাসের পাশের বাথরুমে পালিয়ে ছিলেন। তাকেও তারা হত্যা করে। রক্তের স্রোত সিঁড়ি দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে। বিশ্বে ভয়াবহ নারকীয় হত্যা। বিশ্ব অবাক হয়ে জানতে পারে স্বাধীন দেশের প্রতিষ্ঠাকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে।

খুনিদের একটি দল বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাতের বাসা আক্রমণ করে। খুনিরা আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও পরিবারের সদস্যদের বাইরে লাইন করে দাঁড় করায়। মেজর রাশেদ চৌধুরী প্রথম আবদুর রব সেরনিয়াবাতকে গুলি করে। তার কোলে ছিল ৫ বছরের নাতি সুকান্ত বাবু। আবদুর রব সেরনিয়াবাত কোলে নাতিসহ গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। খুনিরা আবদুর রব সেরনিয়াবাতের ১১ বছরের শিশুপুত্র আরিফ, ১০ বছরের কন্যা বেবী, ভ্রাতুস্পুত্র শহীদ সেরনিয়াবাত ও আত্মীয় রেন্টুকে হত্যা করে। খুনিরা সেরনিয়াবাতের দুই কন্যা, স্ত্রী আমেনা বেগম এবং পুত্রবধূ শাহানা আবদুল্লাহ, পুত্র খোকাকে গুলি করে গুরুতর আহত করে। তার জ্যেষ্ঠ পুত্র আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ ছাদে পালিয়েছিলেন। খুনিরা বাসা ত্যাগ করলে তিনি আহতদের হাসপাতালে পাঠাবার ব্যবস্থা করে পালিয়ে যান। খুনিরা চেয়েছিল হাসানাতকে হত্যা করতে।

একই সময় খুনিরা রিসালদার মোসলেহ উদ্দিনের নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনির বাসা আক্রমণ করে। রিসালদার মোসলেহউদ্দিন শেখ

পৃষ্ঠা: ৩৮০

 

 

মনি ও তার স্ত্রী গর্বরতী আরজু মনিকে হত্যা করে। তারা দুই শিশুপুত্র রেখে যান। শেখ সেলিম ও আরজুকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেন।  শেখ মনি তখনও জীবিত ছিলেন। তিনি হাসপাতালে মারা যান। উল্লেখ্য, শেখ মনির দ্বিতীয় পুত্র  ব্যারিস্টার ফজলে নূর তাপস ঢাকা-১২ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

খুনিরা খন্দকার মোশতাককে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করে। মোশতাক ১৫ আগস্ট ১১টা ১৫ মিনিটে রেডিওতে ভাষণ দেন। তিনি বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার মন্ত্রীদের নিয়ে মন্ত্রীসভা গঠন করেন। একমাত্র ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দীন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এএইচএম কামরুজ্জামান খুনিদের মন্ত্রিসভায়  যোগদানে অস্বীকতি জানান। ফলে তাদের গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখা হয়।

ঢাকার সেনানিবাসের নবম ডিভিশনের ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল সাফায়াত জামিল বঙ্গবন্ধু হত্যার সংবাদ শুনে মেজর জেনারেল সফিউল্লাহর সাথে কথা বলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানের বাসভবনে যান। তিনি জিয়াকে জিজ্ঞেস করেন, প্রেসিডেন্টকে হত্যা করা হয়েছে। আপনার নির্দেশ কি? জিয়া উত্তর দিলেন যদি প্রেসিডেন্ট না থাকে ভাইস প্রেসিডেন্ট আছেন। জিয়া এ সময় দাডি কামাচ্ছিলেন। তিনি শান্ত। তাকে শোকাভিভূত দেখা যায়নি। সেনাবাহিনীর তিন প্রধানকে রেডিও অফিসে আনা হয়। তারা মোশতাকের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন। জেনারেল সফিউল্লাহর স্থলে মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করা হয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যার পর খন্দকার মোশতাক ও জিয়াউর রহমান ক্ষমতাসীন হয়েছেন। তাদের সমর্থনে খুনিরা বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেছে।

১৫ আগস্ট সারাদিন বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের লাশ ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসায় অযত্নে পরে ছিল। ১৫ আগস্ট গভীর রাতে বঙ্গবন্ধু ব্যতীত সবার লাশ বনানী কবরস্থানে গণকবর দেওয়া হয়। তাদের গোসল ও জানাজা পড়ানো হয়নি। বনানী গোরস্তানে বঙ্গবন্ধুর তিন পুত্র, দুই পুত্রবধূ, স্ত্রী, কনিষ্ঠ ভ্রাতা, ভাগিনা শেখ মনি, তার স্ত্রী, ভগ্নিপতি মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও তার পরিবারের সদস্য সর্বমোট ১৮ জনকে মাটিচাপা দেওয়া হয়।

 

বঙ্গবন্ধুকে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন

শখর ধানমণ্ডি সড়কের বাসভবনে বঙ্গবন্ধুর মতদেহ ১৫ আগস্ট সকাল থেকে ১৬ আগস্ট দুপুর ২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত অবহেলিত অবস্থায় ছিল। তাকে ঢাকায়

পৃষ্ঠা: ৩৮১

 

 

দাফন না করে টুঙ্গিপাড়ায় দাফন করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৬ আগস্ট বিকেলে দু’জন মেজর বঙ্গবন্ধুর লাশ হেলিকপ্টারে টুঙ্গিপাড়ায় নিয়ে যান। তাকে গোসল ও দাফনের জন্য অল্প সময় দেওয়া হয়। লোকজন ভয়ে পালিয়ে যায়। হাসপাতালের সাবান দিয়ে গোসল করানো হয়। রেড ক্রিসেন্টের কাপড় পরানো হয়। কয়েকজন লোক জানাজায় উপস্থিত ছিল। বঙ্গবন্ধুর শরীরে ২৯টি ক্ষত ছিল- বুকে ২৪টি গুলির আঘাত এবং একটি বুলেট পিছন দিয়ে ঢুকে বের হয়ে যায়। বঙ্গবন্ধুকে তার পিতামাতার পাশে চিরশায়িত করা হয়।

 

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুর পরিবারে যারা নিহত হয়েছেন:

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (৫৫)

বেগম ফজিলাতুন্নেসা-স্ত্রী (৪৫)

শেখ নাসের-ভাই (৪৭)

শেখ কামাল-জ্যেষ্ঠ পুত্র (২৭)

শেখ জামাল-দ্বিতীয় পুত্র (২১)

শেখ রাসেল-কনিষ্ঠ পুত্র (১০)

সুলতানা কামাল-কামালের স্ত্রী (২২)

রোজী-জামালের স্ত্রী (১৮)

আবদুর রব সেরনিয়াবাত-মন্ত্রী-ভগ্নিপতি (৫৪)

শেখ ফজলুল হক মনি-ভাগ্নে (৩৬)

আরজু মনি-শেখ মনির স্ত্রী (২৬)

নুরুন্নেসা বেবী-সেরনিয়াবাতের কন্যা (১৩)

আরিফ-সেরনিয়াবাতের পুত্র (১২)

কর্নেল জামিল উদ্দিন আহমদ (৪২)

সুকান্ত বাবু-সেরনিয়াবাতের নাতি (৫)

শহীদ সেরনিয়াবাত-মন্ত্রী আবদুর রব-এর ভ্রাতুস্পুত্র (৩৫)

আবু নঈম রেন্টু-আত্মীয়। বরিশাল অপসোনিনের মালিক ক্যাপ্টেন সবুরের কনিষ্ঠ ভ্রাতা। (২০)

 

বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যাকারী

লে. কর্নেল বরখাস্ত সৈয়দ ফারুকুর রহমান

লে. কর্নেল অব্যাহতিপ্রাপ্ত খন্দকার আবদুর রশীদ

লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) শাহরিয়ার রশীদ খান

পৃষ্ঠা: ৩৮২

 

 

মেজর (অব) বজলুল হুদা

লে. কর্নেল (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমদ

লে. কর্নেল এস এইচ এস বি নূর চৌধুরী

লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমদ

লে. কর্নেল অব্যাহতিপ্রাপ্ত শরিফুল হক ডালিম

লে. কর্নেল অব্যাহতিপ্রাপ্ত এ এম রাশেদ চৌধুরী

লে. কর্নেল (অব্যাহতিপ্রাপ্ত) আবদুল আজিজ পাশা

ক্যাপ্টেন অনারারি (অব) আবদুল ওহাব জোয়ারদার

রিসালদার মোসলেম উদ্দিন

মেজর অব্যাহতিপ্রাপ্ত আহমদ শরফুল হাসান

ক্যাপটেন (অব) কিসমত হাশেম

ক্যাপটেন অনারারি (অব) নাজমুল হোসেন আনসারী

ক্যাপেটন (অব) আবদুল মাজেদ

দফাদার মারফত আলী শাহ

এ্যাসিস্ট্যান্ট ল্যান্স দফাদার আবুল হাশেম মৃধা

রিসালদার সৈয়দ সারওয়ার হোসেন

ক্যাপ্টেন এম মোস্তফা আহমেদ

 

কেন্দ্রীয় কারাগারে জাতীয় চার নেতার হত্যা

জেনারেল খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ক্যু

 বাংলাদেশের ইতিহাসে করুণ ঘটনা ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার জাতীয় চার নেতাকে নির্মমভাবে হত্যা। তারা হলেন মুজিবনগর সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, মন্ত্রী এম মনসুর আলী, মন্ত্রী কামরুজ্জামান। তারা মোশতাক সরকারে যোগদানে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করলে তাদেরকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আটক রাখা হয়।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট হতে সেনাবাহিনীর শৃঙ্খলা ভেঙে পড়ে। সেনা কর্মকর্তাগণ জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার জন্য অনুরোধ জানান। কিন্তু কৌশলে তিনি বিরত থাকেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ, কর্নেল নুরুজ্জামান ও নবম ডিভিশনের জিওসি কর্নেল সাফায়াত জামিল সামরিক অভ্যুত্থানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ২ নভেম্বর রাতে খালেদ মোশারফের নেতৃত্বে ক্যু হয়। ৩ নভেম্বর ভোরে জেনারেল জিয়াকে

পৃষ্ঠা: ৩৮৩

 

 

তার বাসভবনে গ্রেফতার করে আটক করা হয়। খালেদ মোশাররফ দেশের কতৃত্ব গ্রহণ করেন। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমদ ৩ নভেম্বর সকালে গ্রেফতার করা হয়। খালেদ মোশাররফ মেজর জেনারেল পদে উন্নীত হন। তিনি সেনবাহিনী প্রধান হন। খালেদ মোশাররফ সমঝোতা করে ১৭ খুনি মেজরকে ব্যাঙ্ককে নির্বাসনে প্রেরণ করেন। খুনি মেজররা দেশত্যাগের পূর্বে জেলখানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করে।

 

কীভাবে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয়

ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান এবং ডিআইজি প্রিজন আউয়ালকে ৩ নভেম্বর রাত ৩টায় বঙ্গভবনের নির্দেশে জেলে আসতে হয়। বঙ্গভবন থেকে লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদের নির্দেশে তারা রিসালদার মোসলেহউদ্দিন, দফাদার মারফত আলীসহ এলডি আবুল হাশেম মৃধাকে জেলে প্রবেশ করতে দেন। তারা ৩ নভেম্বর ভোর ৪টায় জেলগেটে স্বাক্ষর করে প্রবেশ করে। তারা বন্দি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে দেখিয়ে দিতে বলে। এ সময় আইজি প্রিজন নুরুজ্জামান প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাকের সাথে কথা বলতে চান। তিনি মোশতাকে  সাথে কথা বলেন। মোশতাক তাকে কর্নেল রশীদের নির্দেশমতো কাজ করতে বলেন। কয়েক মিনিটের মধ্যে রিসালদার মোসলেহউদ্দিনসহ ৪ জন সেনা সদস্য অফিসে ঢুকে পড়ে। তারা বন্দিদের নিকট চলে যায়। চার নেতাকে এক কক্ষে আনা হয়। রিসালদার মোসলেমউদ্দিন ও তার সাথীরা চার নেতাকে গুলি করে হত্যা করে।

৩ নভেম্বর সকাল ১০টায় খালেদ মোশাররফ জেল হত্যার সংবাদ পেয়ে শঙ্কিত হয়ে পড়েন। চার নেতার লাশের ময়না তদন্ত করা হয় এবং ৪ নভেম্বর রাতে লাশ আত্মীয়স্বজনের নিকট ফেরত দেওয়া হয়। ৫ নভেম্বর সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এম মনসুর আলীর লাশ বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ এইচ এম কামরুজ্জামানের লাশ হেলিকপ্টারে রাজশাহী পাঠিয়ে দেয় এবং তাকে পারিবারিক গোরস্তানে দাফন করা হয়।

১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর হতে ৬ নভেম্বর বাংলাদেশে কোনো সরকার ছিল না। মেজর জেনারেল খালেদ মোশাররফ অপরিকল্পিত ক্যু করেছেন। তিনি বেতার টিভিতে এসে দেশবাসীকে ক্যু সম্পর্কে অবহিত করেননি। তিনি ক্ষমতালিপ্সু ছিলেন না। এ সুযোগে তার বিরুদ্ধে মিথ্যা গুজব ছড়ানো হয়। কর্নেল তাহের সিপাহী ও জাসদ নেতাকর্মীদের সংগঠিত করেন।

পৃষ্ঠা: ৩৮৪

 

 

৪ নভেম্বর বাকশাল নেতাকর্মী ও ছাত্রলীগ জাতির জনকের হত্যার প্রতিবাদে শোক দিবস পালন করেন।

৬ নভেম্বর সকালে খন্দকার মোশতাক আহম্মদের স্থলে প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নিয়োগ করা হয়।

১৯৭৫ সালের ৬ নভেম্বর মধ্যরাতে সাধারণ সৈন্যরা লে. কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বে উচ্ছৃঙ্খল হয়ে পড়ে। তারা গৃহবন্দি মেজর জেনারেল জিয়াউর রহমানকে মুক্ত করে। জিয়াউর রহমান নিজেকে প্রধান সামরিক শাসক ঘোষণা করেন। তার প্রেরিত সৈন্যরা জেনারেল খালেদ মোশাররফ, কর্নেল এ টি এম হায়দার ও কর্নেল কেএন হুদাকে শেরে বাংলানগরে ধরে ফেলে। তাদেরকে এক লাইনে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করা হয়।  তিন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে সেনানিবাসে দাফন করা হয়।

 

জেল হত্যা মামলা

১৯৯৭-২০০১ সালে জেল হত্যা মামলা শুরু হলেও বিভিন্ন অজুহাতে বিচার বিলম্বিত হয়।

২০০৪ সালের প্রথম দিকে ঢাকা জেলা জজ মতিয়ুর রহমান নাজিমউদ্দিন বাড়ে একটি ভবনে বিচার কাজ সমাপ্ত করেন। ২০০৪ সালের ২০ অক্টোবর জেল হত্যা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়। রায়ে ৩ জনের মৃত্যুদণ্ড, ১২ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং ৫ জনকে খালাস দেওয়া হয়।

 

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তরা হলো:

রিসালদার মোসলেহউদ্দিন

দফাদার মারফত আলী শাহ

এলডি আবুল হাশেম মৃধা

যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্তরা হলেন:

লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুকুর রহমান

লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ

লে. কর্নেল খন্দকার আবদুর রশীদ

মেজর বজলুল হুদা

লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমদ

পৃষ্ঠা: ৩৮৫

 

 

লে. কর্নেল এম এইচ এমবি নুর চৌধুরী

লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী

মেজর শরিফুল হোসেন

ক্যাপ্টেন কিসমত হাশেম

খালাসপ্রাপ্তরা হলো: শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, তাহের উদ্দিন ঠাকুর, কে এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, মেজর শামসুজ্জোহা।

এ রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্ট আপীল করা হলে একজন ব্যতীত সবাই খালাস পায়। একমাত্র রিসালদার মোসলেম উদ্দিনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। দেশবাসী এ রায় প্রত্যাখ্যান করেছে। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এসে জেলহত্যার রায়ের বিরুদ্ধে আপীল করেছে। জেলহত্যা মামলা বিচারাধীন আছে।

 

বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের হত্যার বিচার

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর খন্দকার মোশতাক আহমেদ বেআইনিভাবে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য ১৯৭৫ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করেন। ২১ বছরে বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার হয়নি।

১৯৯৬ সালের ১২ জুন নির্বাচনে জয়লাভ করে শেখ হাসিনা ২৩ জুন সরকার গঠন করেন। তিনি ক্ষমতায় এসে বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের হত্যার বিচার কাজ শুরু করেন। ১৯৯৬ সালের ১২ নভেম্বর জাতীয় সংসদে ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স বাতিল বিল গৃহীত হয়। ১৪ নভেম্বর রহিতকরণ বিল রাষ্ট্রপতির সম্মতি লাভ করে।

ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ ১৯৭৫-এর রহিতকরণ আইন ১৯৯৬ বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচারের দ্বার খুলে দেয়।

১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর ধানমণ্ডি থানায় বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সাবেক পিএ আ ফ ম মহিতুল ইসলাম বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের সদস্যদের হত্যা মামলা দায়ের করে। ১৯৯৭ সালের ১৫ জানুয়ারি পুলিশ মামলার অভিযোগনামা দায়ের করে। আসামিদের মধ্যে ছিল ৭ জন গ্রেফতারকৃত এবং পলাতক ১৩ জন। মোট ২০ জন আসামির বিরুদ্ধে আদালতে সাক্ষ্য-প্রমাণের মাধ্যমে বিচারকার্য অনুষ্ঠিত হয়।

গ্রেফতারকৃত আসামিরা হলো:

লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুকুর রহমান

লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশীদ খান

তাহের উদ্দিন ঠাকুর

পৃষ্ঠা: ৩৮৬

 

 

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ-আর্টিলারী

অনারারি ক্যাপ্টেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার

জোবায়দা রশীদ

মেজর বজলুল হুদা

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় ৭৩ জনকে সাক্ষী হিসেবে নাম অন্তর্ভুক্ত ছিল।

ঢাকা জেলা জজ কাজী গোলাম রসুল প্রাপ্ত সাক্ষ্য পর্যালোচনা করে ১৯৯৮ সালের ৮ নভেম্বর ১৫ জন আসামিকে ফায়ারিং স্কোয়াডে অথবা ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেন। ৪ জনকে খালাস দেওয়ার নির্দেশ দেয়।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলো:

লে. কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান

লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান

লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ আর্টিলারি

লে. কর্নেল আবদুর রশীদ

মেজর বজলুল হুদা

লে. কর্নেল শরিফুল হক ডালিম

মেজর শরিফুল হোসেন ওরফে শরিফুল হোসেন

কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী

কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ লান্সার

লে. কর্নেল এমএইচএসবি নুর চৌধুরী

লে. কর্নেল আজিজ পাশা

ক্যাপ্টেন মোঃ কিসমত হাশেম

ক্যাপ্টেন নাজমুল হোসেন

ক্যাপ্টেন আবদুল মাজেদ

রিসালদার মোসলেম উদ্দিন

আসামিরা ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আনুমানিক ভোর ৫টায় ধানমণ্ডির নিজ ৬৭৭ নম্বর বাসভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু, তার পরিবারবর্গকে ষড়যন্ত্র ও পূর্বপরিকল্পনা মোতাবেক গুলি করে হত্যা করার অপরাধে তাদের বিরুদ্ধে দণ্ডবিধি ৩০২/৩৪ এবং দণ্ডবিধি ১২০ক ধারায় অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হওয়ায় উপরোক্ত ১৫ জন আসামিকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করা হয়।

আসামি তাহের উদ্দিন ঠাকুর, অনারারি ক্যাপটেন আবদুল ওহাব জোয়ারদার ও মারফত আলী, এলডি আবুল হাশেম মৃধার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় তাদেরকে খালাস দেওয়া হয়।

পৃষ্ঠা: ৩৮৭

 

 

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আপীল বিভাগে বিচারাধীন ছিল। জোট সরকারের আমলে আপীল শুনানি বিলম্বিত হয়। ২০০৯ সালে মহাজোট সরকার ক্ষমতায় এলে বিচার কাজ সমাপ্ত হয়।

সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি তফাজ্জল ইসলাম হাইকোর্টের দেওয়া ১২ জন আসামির মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখে। মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিদের মধ্যে ৫ জনের ২০১০ সালের ২৭ জানুয়ারি ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

তারা হলো:

কর্নেল (অব) সৈয়দ ফারুক রহমান

লে. কর্নেল সুলতান শাহরিয়ার রশীদ খান

মেজর (অব) বজলুল হুদা

মেজর (অব) একেএম মহিউদ্দিন আহমেদ

মেজর (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ  আর্টিলারি

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত আসামি মেজর মোহাম্মদ আজিজ পাশা জিম্বাবুয়েতে মৃত্যু হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ৬ জন আসামি বিদেশে পলাতক আছে।

তারা হলো:

কর্নেল (অব) খন্দকার রশীদ-লিবিয়া

লে. কর্নেল (অব) শরিফুল হক ডালিম-কানাডা

লে. কর্নেল এ এম রাশেদ চৌধুরী-দক্ষিণ আফ্রিকা

মেজর (অব) এম এইচ বি এস নুর চৌধুরী-আমেরিকা

রিসালদার মোসলেমউদ্দিন-আমেরিকা

ক্যাপটেন (অব) আবদুল মাজেদ-কেনিয়া

সুপ্রিমকোর্টের রায়ের ফলে ৩৪ বছর পর জাতি কলঙ্কমুক্ত হলো।

সুপ্রিমকোর্টের আপীল বিভাগের বিচারপতি ছিলেন-

তফাজ্জুল ইসলাম-প্রধান বিচারপতি

বিচারপতি মোঃ আবদুল আজিজ

বিচারপতি মোকাম্মেল হোসেন

বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা

এ মামলায় সরকার পক্ষে কৌঁসুলি ছিলেন আনিছুল হক। তার পিতা মরহুম এডভোকেট সিরাজুল হক জজকোর্টে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা পরিচালনা করেন। পিতাপুত্র এ মামলা পরিচালনা করে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছেন।

পৃষ্ঠা: ৩৮৮

 

 

আদর্শিক পটপরিবর্তন

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। স্বাধীনতাবিরোধী চক্র ক্ষমতায় এসে বাংলাদেশকে ইসলামী রাষ্ট্র করার উদ্যোগ নেয়। রাষ্ট্রের শ্লোগান- ‘জয় বাংলা’ বাতিল করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ প্রবর্তন করে।

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বন্ধু ভারত-রাশিয়ার বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালায়। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর দেশকে নেতৃত্বহীন করার জন্য ঢাকা জেলে চারনেতাকে হত্যা করা হয়।

মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় ইতিহাস বিকৃত করা হয়। স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে অবমূল্যায়ন করা হয় এবং মেজর জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘোষক করা হয়।

জাতীয় দিবসে বঙ্গবন্ধুর নাম উচ্চারণ করা হতো না। সকল অফিস-আদালত থেকে বঙ্গবন্ধুর ছবি অপসারণ করা হয়।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালে সামরিক আইনবলে ১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন করে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোধ ধ্বংস করে দেয়। ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে ইসলাম ধর্ম অন্তর্ভুক্ত করে। বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি ছিল। সংবিধান পরিবর্তন করে বাঙালির পরিবর্তে বাংলাদেশী করা হয়। দালালী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আইন বাতিল করা হয়।

মুসলিম লীগ, জামায়াত-শিবিরের উত্থান ঘটে। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগপন্থিদের জয়- পাকিস্তানি দালাল মুসলিম লীগ নেতা শাহ আজিজুর রহমান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, যুদ্ধাপরাধী আবদুল আলিম জিয়া সরকারের মন্ত্রী ছিলেন। খালেদা জিয়া সরকারের মন্ত্রী ছিলেন জামায়াতে ইসলামীর আমির মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ।

বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের রক্ষার জন্য খন্দকার মোশতাক ইনডেমনিটি আইন করে- খুনিদের বিচার করা যাবে না। ১৯৭৯ সালে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস করে মোশতাক-জিয়াউর রহমানের সকল অবৈধ কাজ বৈধ করা হয়। ১৯৭৫-১৯৯৬ সাল- দীর্ঘ একুশ বছরে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শকে বিসর্জন দেয়া হয়। স্বাধীনতার ইতিহাসকে বিকৃত করা হয়। জাতির জনকের অবমূল্যায়ন করা হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জয় লাভ করে শেখ হাসিনা স্বাধীনতার ইতিহাস পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন। বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফাঁসি দিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করান। বাংলাদেশের সমৃদ্ধির পথে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন।

পৃষ্ঠা: ৩৮৯

 

 

১৯৭২ সালের সংবিধান সংশোধন মুক্তিযুদ্ধের ওপর আঘাত

প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউর রহমান সামরিক আইনের বলে ১৯৭৭-৭৮ সালে ১৯৭২ সালের সংবিধানের কয়েকটি ধারা সংশোধন করে সংবিধানকে পাকিস্তানের ভাবধারায় ফিরিয়ে নিয়ে যান।

প্রেসিডেন্ট জিয়াউ রহমান ১৯৭২ সালের সংবিধানের প্রস্তাবনা সংশোধন করেন। প্রস্তাবনায় ছিল ‘জাতীয় মুক্তি’ তা সংশোধন করে লেখা হয় ‘জাতীয় স্বাধীনতা’। প্রস্তাবনায় ‘সর্বশক্তিমান আল্লাহর উপর বিশ্বাস’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

সংবিধানের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদের ধর্মনিরপেক্ষতার পরিবর্তে ‘মহান আল্লাহর প্রতি পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

৯ নম্বর অনুচ্ছেদের বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ সম্পর্কীয় বিষয় বাতিল করে স্থানীয় সরকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১০ নম্বর অনুচ্ছেদের সমাজতান্ত্রিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বাতিল করে জাতীয় জীবনের সকল ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিতকরণ অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

১২ নম্বর অনুচ্ছেদে ধর্মনিরপেক্ষতা বাস্তবায়নের বিষয় উল্লেখ ছিল। জিয়াউর রহমান ধর্মনিরপেক্ষতা বাতিল করে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি করার অনুমতি দেন।

রাষ্ট্রপতি হুসাইন মোহাম্মদ এরশাদ ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম সংবিধানের ২ অনুচ্ছেদ ২ক ধারা অন্তর্ভুক্ত করেন।

জেনারেল জিয়াউর রহমান ১৯৭৮ সালের ৫ এপ্রিল নাগরিকত্ব আইন সংশোধন করে ১৯৭১ সালের দালালদের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেন। ফলে জামায়াতের আমীর অধ্যাপক গোলাম আযমসহ অনেকে নাগরিকত্ব ফিরে পায় এবং বাংলাদেশে ফিরে আসে।

১৯৭৯ সালের ৫ এপ্রিল সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী পাস করে সংবিধানের সংশোধন বৈধ করে নেয়।

 

বঙ্গবন্ধু সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কৃতিত্ব তিনি একটি ভাষাভিত্তিক অসম্প্রদায়িক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছেন। পৃথিবীর ইতিহাসে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় যারা নেতৃত্বে দিয়েছেন তাঁরা হলেন- ইটালিতে ম্যাটসিনি, গ্যারিবল্ডি, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে জর্জ ওয়াশিংটন, ভারতের মহাত্মা গান্ধী, ইন্দোনেশিয়ার সুকর্ন প্রমুখ। তারা সকলে বিশ্বের মহানায়ক। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে ৩০ লাখ

পৃষ্ঠা: ৩৯০

 

লোক প্রাণ দিয়েছেন। এত রক্ত প্রতি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্র বা জাতিকে দিতে হয়নি।

এ দিক দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাস অনন্য।

২০০৪ সালের লন্ডনস্থ বিবিসি শ্রেষ্ঠ বাঙালিদের এক সমীক্ষা পরিচালনা করে। তাদের জরিপে প্রথম ১০ জন সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি হলেন:

সর্বশেষ্ঠ বাঙালির নাম-                              ঘোষণার তারিখ

১. সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি-বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান: ১৪-৪-২০০৪

২. দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর: ১৩-৪-২০০৪

৩. তৃতীয় শ্রেষ্ঠ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম: ১২-৪-২০০৪

৪. চতুর্থ শেষ্ঠ বাঙালি শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক: ১১-৪-২০০৪

৫. পঞ্চম শ্রেষ্ঠ নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু: ১০-৪-২০০৪

৬. ষষ্ঠ শ্রেষ্ঠ বেগম রোকেয়া: ৯-৪-২০০৪

৭. সপ্তম শ্রেষ্ঠ স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু: ৮-৪-২০০৪

৮. অষ্টম শ্রেষ্ঠ ঈশ্বর চন্দ্র বিদ্যাসাগর: ৭-৪-২০০৪

৯.  নবম শ্রেষ্ঠ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী: ৬-৪-২০০৪

১০. দশম শ্রেষ্ঠ অতীশ দীপংকর: ৫-৪-২০০৪

১৯২০ সালের ১৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার রাজনৈতিক জীবন বিস্ময়কর। তিনি রাজনীতি শুরু করেছেন মুসলিম লীগের পতাকাতলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার রাজনৈতিক আদর্শ। ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার পর সোহরাওয়ার্দী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি থেকে সরে আসতে থাকেন। ১৯৪৭ সালে সোহরাওয়ার্দী বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবি করেন। এ সময় শেখ মুজিবুর সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ত্যাগ করে ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির আদর্শ গ্রহণ করে ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগ গঠনে আত্মনিয়োগ করেন।

১৯৫৪ সালে পাকিস্তান সরকার পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে কেন্দ্রীয় সরকারের শাসন প্রবর্তন করে। মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্জা শেখ মুজিবুর রহমানসহ শত শত রাজনৈতিক নেতাদের বন্দি করে। পাকিস্তান সরকার শেখ মুজিবকে ভীষণ ভয় করত। তাই তাকে ১২ বছর জেলে বন্দি রেখেছে।

একজন মানুষ হিসেবে তার মহত্ত্ব হলো তিনি বাঙালি জাতির মুক্তির জন্য সংগ্রাম করেছেন। তিনি বাংলা ভাষাভিত্তিক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি চেয়েছিলেন বাংলার মানুষ যেন খেয়ে পরে সুখে-শান্তিতে থাকতে পারে। বঙ্গবন্ধুর মনের ঐশ্বর্য, চিত্তের উদারতা, নিরহংকারিতা, এসব বৈশিষ্ট্য

পৃষ্ঠা: ৩৯১

 

 

তুলনাহীন। তাঁর চরিত্রের দৃঢ়তা, ব্যক্তিত্ব অতুলনীয়। তিনি সকলের উর্ধ্বে ছিলেন। কি উচ্চতার, কি চিত্তের বৈভবের বিপুলতায়। একাধারে তিনি সাহসী বিনয়ী মানুষ ছিলেন। তিনি সর্বযুগের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি। তিনি হলেন বিরাট মাপের মানবতাবাদী। তিনি বিশ শতাব্দীর একজন শ্রেষ্ঠ রাজনীতিবিদ ও রাষ্ট্রনায়ক।

চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দেকে সোভিয়েত রাশিয়া রক্ষা করতে পারেনি। বঙ্গবন্ধুকেও রাশিয়া ভারত নিরাপত্তা দিতে পারেনি।

বঙ্গবন্ধু ছিলেন- ‘মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক

আমি তোমাদের লোক।’

 

সহায়ক গ্রন্থ

এইচটি ইমাম, বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২-৭৫

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ

সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, স্বাধীনতা ঘোষণা- বিজয় অতঃপর।

পৃষ্ঠা: ৩৯২

 

 

 

 

পরিশিষ্ট

জাতীয় নেতৃবৃন্দের পরিচিতি

 

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ১৮৭৩-১৯৬২

একে ফজলুল হক অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী, পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর, কৃষক প্রজা আন্দোলনের নেতা এবং বাঙালি জাতীয়তাবাদের স্থপতি ছিলেন। তিনি ১৮৭৩ সালের ২৬ অক্টোবর বরিশালে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মৌলভী মোহাম্মদ ওয়াজেদ, মাতা সায়েদুন্নেসা। তার পৈতৃক বাসভূমি চাখার এবং মাতার বাড়ি রাজাপুর উপজেলার সাতুরিয়ায়। বরিশাল শহরে পিতার বাসভবন ফ্লোরা সাউজে ফজলুল হক লালিত-পালিত হন। তিনি ১৮৮৯ সালে বরিশাল জিলা স্কুল থেকে এন্ট্রাস, ১৮৯১ সালে কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে এফএ এবং ১৮৯৪ সালে রসায়ন, পদার্থ ও অংকে বিএ অনার্স পাস করেন। তিনি ১৮৯৫ সালে অংকে এমএ পাস করেন। তিনি ১৮৯৭ সালে কলকাতা রিপন কলেজ থেকে বিএ পাস করে কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯০৬ সালে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেটের চাকরি গ্রহণ করেন। ১৯১১ সালে সরকারি চাকরি ত্যাগ করে পুনরায় কলকাতা হাইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। ১৯১৩ সালে তিনি বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯১৪ সালে তিনি কৃষক প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। তিনি একই সাথে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতা ছিলেন। হিন্দু-মুসলমানের মিলনের জন্য ১৯১৬ সালে লখনৌ চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ চুক্তি সম্পাদনে ফজলুল হক অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। তিনি ১৯১৯ সালে খেলাফত ও ১৯২০ সালে অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেন। ১৯২৪ সালে একে ফজলুল হক বাংলার শিক্ষা ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। তিনি ১৯১৩ থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৩০-৩১ সালে তিনি লন্ডনে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন। ১৯৩৫ সালে তিনি কলকাতা করপোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন। ১৯৩৭ সালে তিনি বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৩৭ সালের ১৬ অক্টোবর লখনৌ শহরে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগে অধিবেশনে তাকে ‘শেরে বাংলা’ উপাধি দেওয়া হয়। ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ

পৃষ্ঠা: ৩৯৩

 

 

তিনি ‘লাহোর প্রস্তাব’ উত্থাপন করেন। ১৯৪৩ সালের ২৮ মার্চ তিনি মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।

১৯৫৩ সালে তার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের বিজয় এবং পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫৬ সালে তাকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি ইন্তেকাল করেন। তাকে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে কবর দেওয়া হয়।

শেরে বাংলা একে ফজলুল হক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি প্রজাস্বত্ব ও চাষি খাতক, মহাজনী আইন পাস করে বাংলার নির্যাতিত কৃষক-শ্রমিক সমাজকে মুক্ত করেন। তিনি অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন করে গ্রামে গ্রামে শিক্ষার আলো পৌঁছে দেন। তিনি কৃষকদের মুক্তিদাতা। তিনি বাংলার দরিদ্র মানুষের জন্য ডাল-ভাতের রাজনীতি করেছেন।

 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২-১৯৬৩

আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৮৯২ সালের ১ সেপ্টেম্বর কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক নিবাস মেদিনীপুর। তার পিতা ব্যারিস্টার জাহিদুর রহিম এবং মাতা খুজিস্তা আখতার বানু। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএ পাস করে ১৯১৩ সালে লন্ডন গমন করেন। তিনি লন্ডনের অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিসিএল, ইংরেজি, অর্থনীতি, রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এমএ ডিগ্রি লাভ করেন। তিনি লন্ডনের গ্রেস ইন থেকে বার এট ল’ পাস করে ১৯২০ সালে কলকাতা সইকোর্টে আইন ব্যবসা শুরু করেন। তিনি কংগ্রেস রাজনীতিতে যোগ দেন। তিনি ১৯২১-১৯৪৭ সাল পর্যন্ত বঙ্গীয় আইনসভার সদস্য ছিলেন। তিনি ১৯৩৬ সালে মুসলিম লীগে যোগ দেন। ১৯৩৭ সালে তিনি ফজলুল হক মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে তার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ জয়লাভ করে এবং বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালে তিনি বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা দাবি করেন। ১৯৪৯ সালে তার উদ্যোগে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৫৩ সালে হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন এবং ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে ঐতিহাসিক বিজয় লাভ করেন। ১৯৫৬ সালে তিনি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তাকে গ্রেফতার করে করাচী জেলে বন্দি রাখে। মুক্তি লাভ করে তিনি গণতন্ত্র উদ্ধারের জন্য এনডিএফ গঠন করেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর তিনি বৈরুতে একটি হোটেলে মৃত্যুবরণ করেন। তাকে ৮ ডিসেম্বর ঢাকায় হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে সমাধিস্থ করা হয়।

পৃষ্ঠা: ৩৯৪

 

 

মৃত্যুকালে তিনি কন্যা আখতার সুলেমান এবং পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দীকে রেখে যান।

 

আবুল হাশিম ১৯০৫-১৯৭৪

আবুল হাশিম ১৯০৫ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলার কাশিয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা বিখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল কাসেম এবং মাতা মোকাররমা খাতুন। তিনি ১৯২৮ সালে বর্ধমান কলেজ থেকে বিএ এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৩২ সালে আইন পাস করেন। তিনি মুসলিম লীগ হতে ১৯৩৭ সালে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে মুসলিম লীগকে সংগঠিত করেন। ১৯৪৭ সালে তিনি স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫০ সালে তিনি পশ্চিম বাংলা ত্যাগ করে ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৫২ সালে তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন এবং কারাবরণ করেন। ১৯৫৩ সালে তিনি খেলাফত এ রব্বানী পার্টি গঠন করেন। ১৯৭৪ সালের ৫ অক্টোবর তিনি ঢাকায় মত্যুবরণ করেন। তাকে জুরাইনে দাফন করা হয়। তিনি ইসলামী একাডেমির প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ইসলামের ওপর কয়েকখানি গ্রন্থ ও নিজের আত্মজীবনী রচনা করেন। তার পুত্র বিখ্যাত চিন্তাবিদ বদরুদ্দীন ওমর।

 

মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০-১৯৭৬

আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৮৮০ সালের ১২ ডিসেম্বর সিরাজগঞ্জ মহকুমার ধানগড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ শরাফত আলী খান এবং মাতা মজিরন বিবি। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে টাঙ্গাইলের কাগমারী বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেন। তিনি আসামে চলে যান এবং কৃষকদের অধিকার আদায়ের জন্য আন্দোলন শুরু করেন। ১৯২৬ সালে আসামের ভাসানচরে কৃষক সম্মেলন করেন। এ সময় থেকে তিনি ভাসানী নামে পরিচিত হন। তিনি আসাম প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি ও আইনসভার সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালের পর তিনি টাঙ্গাইলে চলে আসেন। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন তাকে সভাপতি করে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালে তিনি রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি ছিলেন। ১৯৫৩ সালে হক-ভাসানীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট গঠন করা হয়। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে জয়লাভ করেন। ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে ন্যাপ গঠন করেন। ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে তিনি নেতৃত্ব দেন। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি ভারতে অবস্থান করে মুজিবনগর

পৃষ্ঠা: ৩৯৫

 

সরকারের উপদেষ্টার দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর তিনি ঢাকায় মৃত্যুবরণ করেন। তাকে টাঙ্গাইলের সন্তোষে কবর দেওয়া হয়। তিনি সন্তোষ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাতা।

 

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০-১৯৭৫

শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ ফরিদপুরের গোপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা শেখ লুৎফর রহমান এবং মাতা সায়েরা খাতুন। তিনি ১৯৪২ সালে গোপালগঞ্জ হতে মেট্রিক পাস করে কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হন। তিনি একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা ও মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালে বিএ পাস করে তিনি ঢাকায় চলে আসেন। ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি তার নেতৃত্বে মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। ১৯৫০-৫২ সালে তিনি কারাবন্দি ছিলেন। ১৯৪৯ সালে তিনি আওয়ামী মুসলিম লীগের যুগ্ম এবং ১৯৫৩ সালে সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৪ সালে তিনি গোপালগঞ্জ  হতে আইনসভার সদস্য এবং মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৬৬ সালে তিনি জনগণের মুক্তির সনদ ৬ দফা দেন। তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি রাখা হয়। ১৯৬৮ সালে তাকে আগরতলা মামলার আসামি করা হয়। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের ফলে তিনি মুক্তি লাভ করেন। ১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনতা তাকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেন। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ তিনি রেসকোর্স ময়দানে ভাষণ দেন এবং ঘোষণা করলেন- এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। তাকে পাকিস্তান বাহিনী বন্দি করে পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যায়। মুজিবনগর সরকার ৯ মাস মুক্তিযুদ্ধ করে বাংলাদেশ স্বাধীন করে। পাকিস্তানি কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে বঙ্গবন্ধু ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি ঢাকা পৌছেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশকে পুনর্গঠন করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতক দল তাকে সপরিবারে হত্যা করে।

 

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫-১৯৭৫

স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ ১৯২৫ সালের ২৩ জুলাই বৃহত্তর ঢাকা জেলার গাজীপুরের কাপাসিয়া উপজেলার দরদরিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ ইয়াসিন খান, মাতা মেহেরুন্নেসা খানম। তাজউদ্দীনের চার ভাই এবং ৬ বোন।

পৃষ্ঠা: ৩৯৬

 

 

তাজউদ্দীন আহমদের প্রাথমিক প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় দরদরিয়া মক্তবে। তিনি মেধাবী ছাত্র ছিলেন। তিনি কয়েক পারা কোরআন শরীফ মুখস্থ করে ফেলেন। এ কারণে তাকে কোরআনে হাফেজ বলা হয়। তিনি পার্শ্ববর্তী গ্রামে ভুলেশ্বর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। তিনি এ স্কুলে তৃতীয় শ্রেণী সমাপ্ত করে কাপাসিয়া এমই স্কুলে ভর্তি হন। কাপাসিয়ায় তিন রাজবন্দর পরামর্শে তাজউদ্দীন কালিগঞ্জ নাগরী সেন্ট নিকোলাস ইনস্টিটিউটে ষষ্ঠ শ্রেণীতে ভর্তি হন।

১৯৪০ সালে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার মুসলিম বয়েজ হাইস্কুলে অষ্টম শ্রেণীতে ভর্তি হন। ১৯৪৩ সালে তিনি ঢাকার সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৪ সালে তিনি দ্বাদশ স্থান দখল করে সেন্ট গ্রেগরিজ স্কুল থেকে মেট্রিক পাস করেন। ১৯৪৪ সালে তিনি ঢাকা কলেজে ভর্তি হন। এ সময় তিনি মুসলিম লীগ ও মুসলিম ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত ছিলেন। এ কারণে তিনি সঠিক সময়ে পরীক্ষা দিতে পারেননি। ১৯৪৭ সালের ৫ জুন তিনি দিল্লিতে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যোগ দেন।

১৯৪৮ সালে তাজউদ্দীন ঢাকার সলিমুল্লাহ কলেজ থেকে চতুর্থ স্থান দখল করে আইএ পাস করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে অনার্সে ভর্তি হন। ১৯৫৩ সালে বিএ অনার্স পাস করে এমএ ভর্তি হন। তিনি এফএইচ হলের ছাত্র ছিলেন। তিনি মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্টের প্রার্থী হিসেবে কাপাসিয়া থানা থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। রাজনৈতিক কারণে তার এমএ পাস করা হয়নি। ১৯৬৪ সালে তিনি এলএলবি পাস করেন।

তাজউদ্দীন আহমদ ১৯৫৫ সালে আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৭ সালে তিনি আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫৯ সালের ২৬ এপ্রিল সৈয়দা জোহরা খাতুনের সাথে তাজউদ্দীনের বিয়ে হয়। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমান তার বিখ্যাত ৬ দফা দাবি পেশ করেন।

১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানকে সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করা হয়। ১৯৬৬ সালের ৮ মে সরকার শেখ মুজিবুর রহমান ও তাজউদ্দীন আহমদকে গ্রেফতার করে। ১৯৬৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে গণঅভ্যুত্থান শুরু হয়। সরকার বাধ্য হয়ে ১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে মুক্তি দেয়।

১৯৭০ সালের ৪ জুন তাজউদ্দীন আহমদ পুনরায় আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন।

পৃষ্ঠা: ৩৯৭

১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে তাজউদ্দীন আহমদ ঢাকার কাপাসিয়া-কালিগঞ্জ নিয়ে গঠিত ঢাকা-৫ আসন হতে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা দেন। তাজউদ্দীন আহমদ ২৯ মার্চ সীমান্ত অতিক্রম করে কলকাতায় পৌছেন। তিনি ৫ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে আলোচনা করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী করে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়। ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করে। তাজউদ্দীন ৯ মাসব্যাপী মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করে অতুলনীয় প্রতিভার পরিচয় দেন। ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী যৌথবাহিনীর নিকট আত্মসমর্পণ করে স্বাধীন বাংলাদেশ বিশ্বে স্বীকৃতি লাভ করে। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি লাভ করে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তাজউদ্দীন আহমদ সরকারের অর্থমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৭৪ সালের ২৬ অক্টোবর তাজউদ্দীন আহমদ পদত্যাগ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হন। ১৯৭৫ সালের ২৩ আগস্ট সেনাবাহিনী তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রিয় কারাগারে বন্দি রাখে। ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর কয়েকজন সেনা সদস্য ঢাকা কারাগারে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, এম মনসুর আলী ও এএইচএম কামরুজ্জামানসহ তাজউদ্দীন আহমদকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর সকালে তাজউদ্দীন আহমদকে বনানী কবরস্থানে দাফন করা হয়। মৃত্যুকালে তিনি স্ত্রী সৈয়দা জোহরা, ৩ কন্যা, এক পুত্র রেখে যান।

পৃষ্ঠা: ৩৯৮

———X———

Previous