This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাস
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ
প্রথম অধ্যায়
দেশ ও জনগোষ্ঠীর পরিচয়
‘ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে দেশ এক
সকল দেশের সেরা
ও যে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে যে স্মৃতি দিয়ে ঘেরা।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে
পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে
আমার জন্মভূমি…।’
ক. বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতির বৈশিষ্ট্য ও প্রভাব
অবিভক্ত ভারতের ভূপ্রকৃতি ও নৃতত্ত্ব
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্টের পূর্বে বাংলাদেশ ও পশ্চিম বাংলা ভারতবর্ষের একটি প্রদেশ ছিল। বাংলার প্রাচীনকাল জানতে হলে ভারতের প্রাচীনকাল সম্পর্কে অবহিত হওয়া প্রয়োজন। প্রাচীন ভারতের উত্তরে হিমালয় পর্বতমালা, উত্তরপশ্চিমে সুলেমান ও হিন্দুকুশ পর্বতশ্রেণী, উত্তর-পূর্বে আরাকান পর্বত। অপরদিকে পশ্চিম, দক্ষিণ ও পূর্বে আরব সাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগর। ভারতের উত্তর, পশ্চিম ও পূর্বের পর্বতশ্রেণী ভারতকে এশিয়া হতে বিচ্ছিন্ন রেখেছে। পুরাণে উল্লেখ আছে, ভরত রাজার নামে ভারতের নামকরণ হয়েছে। গ্রীকরা এদেশের নাম দিয়েছে ইন্ডিয়া। সিন্ধু নদের নাম থেকে হিন্দু নামের উৎপত্তি। ভূগঠন অনুসারে ভারত দু’ভাগে বিভক্ত- আর্যবর্ত ও দাক্ষিণাত্য। আর্যবর্ত উত্তরে হিমালয় হতে দক্ষিণে নর্মদা নদী পর্যন্ত। দক্ষিণাত্য তাপ্তি ও কৃষ্ণ নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল পর্যন্ত। বাংলা আর্যবর্তে বা হিমালয় পাদদেশে অবস্থিত।
প্রাগৈতিহাসিক যুগ
ভারতের প্রাচীন কালকে তিনটি ভাগে বিভক্ত করা যায়।
পৃষ্ঠা: ১৭
প্রাচীন প্রস্তর যুগ: খ্রিস্টপূর্ব চার লক্ষ হতে দু’লক্ষ বছরের মধ্যবর্তী কাল। এ যুগের মানুষের হাতিয়ার ছিল অমসৃণ। এ সময়ের মানুষদের প্যালিওলিথিন বলা হয়।
মধ্য প্রস্তর যুগ: খ্রিস্টপূর্ব ১০,০০০ হতে ৬,০০০ বছর কালের মধ্যবর্তী এ যুগের মানুষ পাথরের তৈরি হাতিয়ার ব্যবহার করত। তারা ছিল নেগ্রিটো। গুজরাট, বোম্বাই ও মহীশুরে পাথরের তৈরি নিদর্শন পাওয়া যায়।
নব্য প্রস্তর যুগ: খ্রিস্টপূর্ব ৬ হাজার বছরের পরবর্তী সময়। এ যুগের মানমত পাথর ব্যবহার করত। সিন্ধু, বেলুচিস্তানে এ যুগের নিদর্শন রয়েছে। নব্যপ্রস্তর যুগে বাংলাদেশে মানুষ বাস করত। প্রায় ৫ হাজার বছর বাংলাদেশে মানুষের বাস ছিল।
নব্য প্রস্তর যুগে সিন্ধুর মহেঞ্জোদারো সভ্যতার শুরু হয়। সিন্ধুর সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ২০০০ অব্দ হতে ১৫০০ অব্দ পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। তারা লোহা ও তামার ব্যবহার জানত।
বাংলাদেশে খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ বছর পূর্বের লোহার কুড়াল পাওয়া যায়।
ভারত প্রাচীন দেশ, ভারতের সভ্যতা প্রাচীন। নৃতাত্ত্বিকরা দেহের গঠন ও ভাষার বিচারে ভারতবাসীকে চারটি প্রধান জাতিতে ভাগ করেছে। তারা হলো:
১. দ্রাবিড়: খর্বাকৃতি ও কৃষ্ণকায়। ভাষা তামিল। তারা সিন্ধু সভ্যতা যুগের লোক। আর্য জাতির নিকট পরাজিত হয়ে তারা দক্ষিণাত্যে আশ্রয় নেয়।
২. নেগিটো: আফ্রিকার নিগ্রো জাতি হতে উৎপত্তি। তারা কৃষ্ণকায় ও খর্বাকৃতির। তারা বিহার, বাংলা, কোচিন অঞ্চলে বাস করতো। তারা ভারতের প্রথম জনগোষ্ঠী।
৩. আর্য: তারা মধ্য এশিয়া হতে প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে ভারতে আগমন করে। তারা দীর্ঘাকৃতি, গৌরবর্ণ ও উন্নত নাসিকা। তাদের ভাষা সংস্কৃতি। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আর্যরা বাংলায় আসেনি। মৌর্য ও গুপ্ত আমলে অনেক আর্য বাংলায় বসতি স্থাপন করে।
৪. মোঙ্গলীয় জাতি: তাদের দেহের রং হরিদ্রাভ, চোখ ও নাক চ্যাপ্টা। তারা নেপাল, ভুটান ও বাংলাদেশে বাস করতো। বাংলার আদিবাসী অস্ট্রিক ও বাঙ জনগোষ্ঠী মোঙ্গলীয় জাতি হতে উৎপত্তি।
ভারতের ইতিহাসে বৈচিত্র্য ও বিভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও প্রাচীনকাল হতে। জাতীয় ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য চলছে।
দ্রাবিড় জাতি: ভারতের প্রাচীনতম সভ্য জাতি তামিল, তেলেগু, কানাড়ী, মালায়লাম প্রভৃতি ভাষাভাষী গোষ্ঠী দ্রাবিড় জাতির বংশধর। দ্রাবিড় উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করে। তাদের সমাজ ছিল মাতৃতান্ত্রিক।
পৃষ্ঠা: ১৮
মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় তারা এক উন্নত সভ্যতা গড়ে তোলে।
আর্য জাতি: খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে আর্য জাতি মধ্য এশিয়া হতে ভারতে প্রবেশ করে। তারা দ্রাবিড়দের তাড়িয়ে সিন্ধু জয় করে। বৈদিক সভ্যতার জন্ম ২০০০ বছর পূর্বে।
আর্যদের ভাষা সংস্কৃতি: তাদের সমাজ ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তাদের ধর্মগ্রন্থ ঋগ্বেদ খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১০০০ অব্দে রচিত হতে পারে। বৈদিক সাহিত্যের রচনাকাল খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০-১০০০ অব্দের মধ্যে। বেদ শাস্ত্রের অর্থ জ্ঞান। বেদ হতে বেদ শাস্ত্র। বেদ চার খণ্ডে বিভক্ত- ঋক, সাম, যজু ও অথর্ব। প্রতিটি বেদ চারভাগে বিভক্ত- সংহিতা, ব্রাহ্মণ, আরণ্যক ও উপনিষদ। হিন্দু ধর্মের উৎপত্তিস্থল বেদ। আর্য সভ্যতা দ্রাবিড় সভ্যতার চেয়ে উন্নত ছিল। আর্য সভ্যতা সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। মৌর্য ও গুপ্ত আমলে আর্যদের প্রভাব বাংলায় পৌছে যায়। আর্যদের সময় হিন্দুধর্মের সৃষ্টি হয়। রামায়ণ ও মহাভারত তাদের সময় রচিত হয়েছে। আর্যঅনার্য মিলে হিন্দু জাতি সৃষ্টি আর্যদের অবদান। খ্রিস্টপূর্ব ১০০০ অব্দে লোহা আবিষ্কার হয়। লোহা আবিষ্কার হলে প্রাগৈতিহাসিক যুগের অবসান হয় এবং ঐতিহাসিক যুগের সূচনা হয়। লোহা ব্যবহার করে আর্য জাতি কৃষিক্ষেত্রে বিপ্লব সৃষ্টি করে। লাঙ্গলের চাষের ফলে পশুচারণ ছেড়ে তারা কৃষিজীবী হতে থাকে। ভারতের ইতিহাস ও ভারতবাসীর চরিত্র গঠনে ভৌগোলিক পরিবেশ বিশেষভাবে প্রভাব বিস্তার করেছে। সিন্ধু, গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র প্রভৃতি নদী ঘিরে ভারতীয়দের জীবন গড়ে উঠেছে। ভারতীয় সভ্যতার কেন্দ্র ছিল নদীর তীরে।
বাংলাদেশের ভূপ্রকৃতি
বাংলা ভাষাভাষী জনগোষ্ঠী অধ্যুষিত জনপদের নাম বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তান স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ নামে.পৃথিবীর মানচিত্রে আত্মপ্রকাশ করে। বাংলাদেশের আয়তন ৫৬,৯৭৭ বর্গমাইল বা ১,৪৭,৫৭০ বর্গকিলোমিটার এবং জনসংখ্যা ষোলো কোটি। বাংলাদেশের উত্তরে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, মেঘালয় ও আসাম প্রদেশ, পূর্বে ভারতের আসাম প্রদেশ, ত্রিপুরা রাজ্য ও মিয়ানমার এবং দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। ১৯৪৭ সালে বিভক্ত হওয়ার আগে বাংলার সীমানা ছিলউত্তরে হিমালয়, পূর্বে আসাম, ত্রিপুরা ও মিয়ানমার, পশ্চিমে বিহার, উড়িষ্যা ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর।
বাংলার ইতিহাস রচনা করেছে বাংলার অসংখ্য ছোট-বড়-নদ-নদী। বাংলার সভ্যতা, জনপদ ও রাজধানী গড়ে উঠেছে নদীর তীরে। নদী যুগে যুগে বাংলাকে ‘ গড়েছে। বায়ুমণ্ডলের চাপে হিমালয় পর্বত সাগর থেকে সৃষ্টি হয় এবং হিমালয়
পৃষ্ঠা: ১৯
পাদদেশ পর্যন্ত পানিতে নিমজ্জিত ছিল। তার পর গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদী দ্বারা বাহিত পলিমাটি, বালি প্রভৃতি জমে জমে বাংলাদেশের ভূভাগ সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের বয়স মোটামুটি দু লক্ষ বছর বলে ধরে নেওয়া যেতে পারে। দক্ষিণবঙ্গের ভূগঠন ৫০ হাজার বছরের বেশি হবে না।
গঙ্গা নদীর মোহনায় দ্বীপের সৃষ্টি হয়ে বিরাট ভূখণ্ড সৃষ্টি হয়। দী শতধাবিভক্ত ছিল। দক্ষিণের দ্বীপগুলো সুন্দরবনে আবৃত ছিল। কালক নদীগুলো ভরাট হয়ে দ্বীপগুলো একত্রিত হয়েছে। বাংলার জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ বছরে গড়ে ৭০-৮০ ইঞ্চি বৃষ্টিপাত হয়। বঙ্গোপসাগরে নিম্নচাপের সৃষ্টি হয় উপকূলীয় অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাস দেখা দেয়। ১৫৮৪, ১৭০৭, ১৭৩৭ ১৮৭৬, ১৯৪১, ১৯৬১, ১৯৬৫, ১৯৭০, ১৯৯১ ও ২০০৭ সালে সংঘঠিত ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছাসে লক্ষ লক্ষ মানুষ নিহত হয়।
প্রকৃতির দিক থেকে বাংলাদেশ দুভাগে বিভক্ত
১. উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব পর্বতমালা; ২. পলিমাটির সমতল ভূমি।
পূর্বে সিলেট ঘিরে আছে ছোট বড় পাহাড় টিলা। চট্টগ্রামের উপকূল ঘিরে আছে সীতাকুণ্ড ও চন্দ্রনাথ পাহাড়, পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি, বান্দরবান, রামগড়। পাহাড়ের ওপর অবস্থিত সবচেয়ে উঁচু পাহাড়ের নাম কেওক্রাডংয়ের উচ্চতা ৪০৩৪ ফুট। কুমিল্লা জেলায় ময়নামতি, লালমাই পাহাড়, ময়মনসিংহের গাড়ো পাহাড় আছে।
সমতল ভূমি
ক. পশ্চিম বদ্বীপ সমভূমি- কুষ্টিয়া
খ. পূর্ব বদ্বীপ সমভূমি- ফরিদপুর, বরিশাল
গ. বদ্বীপে মোহনা- সুন্দরবন।
বাংলার জনগোষ্ঠীর মানসিকতা তৈরি হয়েছে ভৌগোলিক অবস্থান এবং প্রাকৃতিক প্রভাবের ফলে। বাংলার ইতিহাস এক হিসাবে বাংলার নদীর ইতিহাস। বাংলাদেশের নদীর অবস্থান ৫ ভাগে বিভক্ত:
১. গঙ্গা-পদ্মা এবং বদ্বীপ
২. মেঘনা এবং সুরমা প্রবাহ
৩. ব্রহ্মপুত্র-যমুনা-শাখা প্রশাখা
৪. উত্তরবঙ্গের নদীসমূহ
৫. পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং সমতলভূমির নদী
পৃষ্ঠা: ২০
গঙ্গা-পদ্মা নদী: গঙ্গা নদীর হিমালয় হতে সৃষ্টি হয়ে উত্তর ভারত হয়ে রাজমহলের নিকট হতে সাঁওতাল পরগনা হয়ে তাম্রলিপির নিকট বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। পরে গঙ্গা নদীর প্রবাহ রাজমহল হতে মহানন্দা, কালিন্দী গতিপথে প্রবাহিত হয়ে গৌড়নগর পশ্চিমে রেখে ত্রিবেণী ও সপ্তগ্রামের নিকট বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। এর বর্তমান নাম ভাগীরথী নদী।
গঙ্গা নদীর গতিপথ প্রাচীনকাল হতে কয়েকবার গতি পরিবর্তন করেছে। গঙ্গা নদীর পূর্বগামী শাখা পদ্মা নামে চাদপুরে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে। গঙ্গা নদীর পলল দ্বারা প্রাচীনকাল হতে বাংলার ভূগঠন হয়েছে। গঙ্গা ও এর শাখা নদীতে দ্বীপের পর দ্বীপ সৃষ্টি হয়ে বাংলাদেশের সৃষ্টি
ব্রহ্মপুত্র নদ: তিব্বতের মানস সরবর হতে উৎপন্ন হয়ে আসাম হয়ে রংপুর ও ময়মনসিংহ হয়ে ভৈরবের নিকট মেঘনায় মিলিত হয়ে মেঘনা নামে বঙ্গোপসাগরে মিলিত হয়েছে। ব্রহ্মপুত্র নদের একটি শাখা যমুনা নামে পাবনা হয়ে ফরিদপুরের পদ্মা নদীর সাথে মিলিত হয়ে পদ্মা নামে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে।
মেঘনা নদী: আসাম-সিলেটের খাসিয়া জয়ন্তিয়া পাহাড় হতে মেঘনা নদীর উৎপত্তি।
গঙ্গা নদী, ব্রহ্মপুত্র ও মেঘনা নদীর প্রবাহিত পলল বাংলার ভূমি সৃষ্টি করেছে। এ ছাড়া করতোয়া, তিস্তা, মহানন্দা, কুশী প্রভৃতি নদী বাংলাদেশকে সমৃদ্ধ করেছে।
বাংলার আবহাওয়া
বাংলার আবহাওয়া নাতিশীতোষ্ণ। এ অঞ্চলে ৬ মাস বর্ষাকাল। প্রচুর বৃষ্টিপাত হয়। বিদেশি অনেকে আবহাওয়ার জন্য একে দুর্যোগপূর্ণ বলেছে। নদ-নদী, খালবিল দ্বারা বেষ্টিত থাকায় প্রাচীনকাল হতে নৌকাই ছিল জনগণের একমাত্র বাহন। বাংলার নদ-নদী জনগোষ্ঠীর জীবন প্রভাবিত করেছে। তারা আবহমানকাল জলের সাথে বাস করে। নদীই তাদের প্রাণ, তাদের জীবন।
বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস শুরু হয়েছে চতুর্থ শতকে মৌর্য শাসন হতে। কিন্তু বাংলার সভ্যতার ইতিহাস আরও প্রাচীন।
সর্বপ্রথম কোন সময় বাংলাদেশে মানুষের বসতি শুরু হয়েছে তার সঠিক ইতিহাস নেই। বাংলায় প্রাপ্ত প্রত্নপ্রস্তর ও নব্যপ্রস্তর যুগের পাথর অস্ত্রের নিদর্শনসমূহ বাংলাদেশের প্রাচীন ভূভাগে মানুষের অস্তিত্ব বহন করে। পরবর্তী সময়ে মানুষ তাম্র ব্যবহার করে বলে এ যুগকে তাম্র প্রস্তর যুগ বলা হয়। তাম্র প্রস্তর যুগের নিদর্শন বাংলাদেশে আবিষ্কৃত হয়েছে। ১৯৬১-৬২ সালে বর্ধমান জেলার অজয় নদীর দক্ষিণ তীরে অবস্থিত পাণ্ডুরাজার ঢিবিতে খ্রিস্টপূর্ব দেড়
পৃষ্ঠা: ২১
হাজার বছর পূর্বের এক উন্নত সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। তারা তাম্র ব্যবহার করত- কৃষি কাজ করত।
বাংলাদেশে নরসিংদী জেলার উয়ারি বটেশ্বরে এক প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন আবিষ্কৃত হয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৫০০ অব্দে উয়ারি বটেশ্বরে এক প্রাচীন সভ্যতা গড়ে উঠে। সিন্ধু নদের মহেঞ্জোদারের সমসাময়িক উয়ারি বটেশ্বর সভ্যতা।
বাংলার প্রাচীন জনপদ: গৌড় বাংলার রাজধানী ছিল। মালদহ জেলায় গৌড় বা লক্ষণাবতী অবস্থিত ছিল।
রাঢ়: ভাগীরথীর পশ্চিম তীরে রাঢ় দেশ অবস্থিত ছিল।
বঙ্গ: দক্ষিণ-পূর্ব বাংলা নিয়ে বাঙ জাতির বাসভূমি ছিল।
সমতট: আসামের দক্ষিণ অঞ্চল সমতট।
হরিকেল: আসাম-সিলেট।
পুণ্ড: বরেন্দ্র অঞ্চল উত্তর বাংলা পুভুক্ত ছিল।
তাম্রলিপ্ত: মেদিনীপুর জেলায়।
ভূ-প্রকৃতির প্রভাব
বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতির প্রভাব পড়েছে দেশ ও জনগোষ্ঠীর ওপর। ভৌগোলিক অবস্থান ও বিশিষ্ট নদ-নদী সমাজ গঠনে প্রভাবিত করেছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায় বলেছেন, “বাংলার এই নদ-নদীগুলো, এই বন ও প্রান্তর, ইহার জলবায়ুর উষ্ণ জলীয়তা, ইহার ঋতু পর্যায়, ইহার বিধৌত নিম্ন ভূমিগুলি, বনময় সমুদ্রোপকূল সমস্তই এই দেশের সমাজ বিন্যাসকে কমবেশি প্রভাবিত করেছে।” বাংলার প্রকৃতি বিভিন্ন শ্রেণীপেশার মানুষ গড়েছে। প্লাবন, বর্ষা, জলোচ্ছাস, নদী ভাঙন সহজ সরল বাঙ্গালীদের সংগ্রামী করে তুলেছে। তাই দেখা যায়, সুলতানী আমলে বাংলা ছিল বিদ্রোহী নগর, মোগল আমলে বারভূঁইয়া, ইংরেজ আমলে কৃষক বিদ্রোহ, নীল বিদ্রোহ, লবণ বিদ্রোহ। পরিশেষে বাঙালিরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠা করেছে।
বাংলার প্রকৃতির প্রভাব রয়েছে সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি, সংস্কৃতি, ধর্ম, ইতিহাস ও নৃতত্ত্বের ক্ষেত্রে।
খ. নৃতাত্ত্বিক গঠন
বাঙালি জাতির উৎপত্তি
নব্য প্রস্তর ও তাম্র প্রস্তর যুগে বাংলায় জনবসতি ছিল। আর্যদের আগমনের পূর্বে। এ অঞ্চলে অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর বাস ছিল। তাদের বংশধর কোল, শরব, চণ্ডাল
পৃষ্ঠা: ২২
প্রভৃতি। দ্রাবিড় ও মোঙ্গল জাতির এ অঞ্চলে আগমন ঘটে। বৈদিক যুগে জনবসতি ছিল। বৈদিক গ্রন্থে এ অঞ্চলের মানুষদের অনার্য ও অসভ্য বলা হয়েছে। আর্যদের বংশধর ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য। বাঙ্গাল জাতি মিশ্র জাতি। একাধিক জনগোষ্ঠীর সংমিশ্রণে বাঙ্গালি জাতির সৃষ্টি। এ কারণে বাঙ্গালিদের সংকর জাতি বলা হয়ে থাকে।
দেহের দৈর্ঘ মাঝারি ও খাটো, নাক লম্বা ও চ্যাপ্টা, গায়ের রং কালো থেকে বাদামী, মাথা লম্বাও নয় গোলও নয়। চোখের রং কালো, চুল সোজা, তরঙ্গায়িত। নবগোষ্ঠীর রক্তধারা মিশ্রিত হয়ে বর্তমান বাঙালি জাতি।
বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতি প্রায় ৫ হাজার বছরের ক্রমবিকাশের তা গড়ে উঠেছে। শত শত নদ-নদী বেষ্টিত ছিল বাংলাদেশ এবং বাস করত বিভিন্ন গোত্রে বা কৌমে। এ জনপদের মানুষের মানসগঠনে এখানকার ভত গভীর প্রভাব ফেলেছে। আবহমান বাংলার প্রকৃতি মনোরম ও উদার; আবার প্রলয়ঙ্করী। গঙ্গা, যমুনা, মেঘনা ও পদ্মার মানুষকে সংগ্রাম করে বাঁচতে সকাছে। নদী ও বঙ্গোপসাগরে আবাদিভূমি ও ছায়াঘেরা জনবহুল গ্রামগুলো বিলীন হয়ে যায়। ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে নিহত হয় লক্ষ লক্ষ মানুষ। অপরদিকে বিজাতীয় শাসন ও শোষণের ফলে তাদের আর্থ-সামাজিক জীবন পঙ্গু হয়ে পড়ে। তব তারা নিজেদের স্বাতন্ত্র্যবোধ বিসর্জন দেয়নি। সংগ্রাম ও প্রতিবাদ বাঙালির সংস্কার ও অহঙ্কার। বাঙালির মানসিকতায় সংগ্রামশীলতা, আত্মকেন্দ্রিকতা ও জীবনমুখিতা সেই প্রাচীনকাল থেকে।
আমরা ভৌগোলিক ভাষা ও সাংস্কৃতিক যে জনগোষ্ঠীকে বাংলাদেশ বলে জানি তা মধ্যযুগের। প্রাচীনকালে বাংলা কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। বসতি ছিল বিরল। তারা চার-পাঁচ হাজার বছর আগে শিকারি বা যাযাবর জীবন পরিহার করে কৃষিকাজ শুরু করে। ভূমি ছিল উর্বর। মাছ-ভাত সহজলভ্য ছিল। জীবিকার জন্য কঠোর পরিশ্রম করতে হতো না। তাই তারা কর্মবিমুখ ও ভোগলিন্দু। জৈন, বৌদ্ধ ও বৈষ্ণব মতবাদ বাঙালিদের আরও কর্মবিমুখ করেছে। ফলে তারা অনেকে ভিক্ষাবৃত্তি, চৌর্যবৃত্তি অবলম্বন করে। বাঙালিদের চরিত্রে একদিকে অকৃতজ্ঞতা, মিথ্যা ভাষণ, প্রবঞ্চনা যেমন দৃষ্ট, অন্যদিকে তেমনি আত্মসম্মানবোধের অভাব ও অদৃষ্টবাদ লক্ষণীয়। শত শত বছর বিদেশি শাসনের ফলে স্বাধীনভাবে আত্মবিকাশের সুযোগ মেলেনি। তারা ছিল বঞ্চিত ও দরিদ্র। শাসকদের লাঠিয়াল বাহিনী ও দালাল হিসেবে অনেককে কাজ করতে হয়েছে। উন্নত জীবন পরিহার করে তারা আধ্যাত্মিক শক্তি লাভের চেষ্টা করত। উদ্যমহীনতা ও নির্ভরশীলতা তাদের পরিচয়ের আরেকটি দিক।
পৃষ্ঠা: ২৩
হাজার হাজার বছর ধরে জনগোষ্ঠীর দ্বন্দ্ব-মিলনের সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ আর বাঙালি জাতি। প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে আধুনিক পর্যন্ত শতাব্দীর পর শতাব্দীব্যাপী অসংখ্য পরিবর্তন ও বিবর্তনের মধ্যদিয়ে আজকের বাঙালি জাতি সৃষ্টি হয়েছে। নৃতত্ত্ব, জাতিতত্ত্ব ও ভাষা বিশ্লেষণ করলে বাঙ্গালি জাতির উৎপত্তি সম্পর্কে জানতে পারা যায়।
নব্য-প্রস্তর যুগে বাংলাদেশে জনবসতির যে নিদর্শন পাওয়া গেছে তাতে মনে হয় আদিম অধিবাসীরা বন্য অবস্থা বা শিকারিজীবন ছেড়ে কৃষিজীবন শুরু করে,কৃষিজীবনের আগে এ দেশের আদিম অধিবাসী ছিল নিগ্রোপ্রতিম নামে এক জাতি এবং তারা অস্ট্রিকদের সাথে বিলীন হয়ে গেছে। নৃতত্ত্ববিদদের মতে, নিগ্রোদের পর বাংলার প্রাচীনতম অধিবাসীরা ছিল অস্ট্রো-এশিয়াটিক জাতি অস্ট্রিকগন, তারা অস্ট্রেলিয়া ও ইন্দোনেশিয়ার মানুষ। প্রাগৈতিহাসিককালে তারা ইন্দোচিন হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করে। নিষাদ জাতি তাদের একটি শাখা। কোল ভিল সাঁওতাল, ভেড়ি প্রভৃতি অস্ট্রিকদের বংশধর। তারা অস্ট্রিক ভাষায় কথা বলত। অস্ট্রিকরা কৃষিকাজ জানত। তারাই এ দেশে কৃষিকাজের প্রচলন করে। অস্ট্রিকরা প্রাগৈতিহাসিক যুগে এ দেশে আগমন করে। তাদের পর মোঙ্গলীয় ও দ্রাবিড়রা বাংলাদেশে আসে। মোঙ্গলীয়রা ভাগ্যের সন্ধানে ৫ হাজার বছর আগে তিব্বত ও ইন্দোচীন থেকে বাংলাদেশে আগমন করে। অস্ট্রিক ও মোঙ্গলীয়দের পরে বাংলাদেশে আলপাইন জনগোষ্ঠী পামির মালভূমি অঞ্চল থেকে এখানে আগমন করে। তাদের সাথে অস্ট্রিক-মোঙ্গলীয়দের রক্তের সংমিশ্রণ ঘটে। আর্যদের কাছে পরাজিত হয়ে দ্রাবিড় জাতির একটি অংশ বঙ্গে আশ্রয় নেয়। তাদের সাথে অস্ট্রিক ও অন্যান্য জনগোষ্ঠীর মিশ্রণ ঘটে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে আর্যরা বঙ্গে আগমন করে। মৌর্য ও গুপ্ত শাসন আমলে বাংলাদেশে ব্রাহ্মণ ও কায়স্থদের প্রভাব দেখা যায়। প্রাচীনকাল থেকে ধীরে ধীরে আর্যরা বাঙালি সমাজজীবনে অনুপ্রবেশ করে। ফলে এক সমন্বিত জন, ধর্ম, সভ্যতা ও সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। জনগোষ্ঠীর রক্তে বিশুদ্ধতা রইল না। তার রক্তে অস্ট্রিক, মোঙ্গলীয়, দ্রাবিড়, আর্য, তুর্কি, পাঠান, মোগল, ইরানি- এ বিচিত্র রক্ত স্রোতধারার মতো মিলিত হলো। এ সমন্বিত জনগোষ্ঠীর নাম বাঙালি। আর্যদের বেদ, ব্রাহ্মণদের ধর্ম ও পূর্বতন ধর্মের আচারঅনুষ্ঠান মিলেমিশে এক নতুন ব্রাহ্মণ ধর্ম সৃষ্টি হলো।
প্রাচীন বঙ্গের জনপ্রবাহে চার মানব জাতি- যথা নিগ্রো, অস্ট্রিক, মোঙ্গলীয় ও আর্যদের মিশ্রণ ঘটে। বাঙালিরা সঙ্কর বা মিশ্রিত জাতি হলেও আদান-প্রদান ও মিশ্রণের ফলে তারা একটা নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ধরে রাখতে সমর্থ হয়। ফলে অধিকাংশ বাঙালি মধ্য আকৃতির, মাথা দীর্ঘও নয়, গোলাকারও নয়। জনপ্রবাহ
পৃষ্ঠা: ২৪
একটি ধারা, তার ইতিহাস কোথাও শেষ হয় না। আর্য জাতির পরে তুর্কি, আফগান, ইরান, ইরাক ও আরবীয় মুসলমানদের প্রভাব বাঙালিদের ওপর দীর্ঘ সাত’শ বছর বয়ে যায়। মিশ্রণের ধারা এখনো প্রবাহমান। জনগোষ্ঠী বিশ্লেষণ করে যা পাওয়া বাংলা ভাষা বিশ্লেষণ করলে তার সমর্থন মেলে। বাঙালিদের জীবনে আস্ট্রিকদের প্রভাব বেশি। কৃষিকাজ অস্ট্রিকদের অবদান। ধান, চাল, কুড়ি, গন্ডা প্রভৃতি অস্ট্রিক শব্দ। অস্ট্রিকদের পরে আর্যদের প্রভাব বেশি। তাদের সংস্কৃতি, ভাষা ও জীবনধারার নিদর্শন বাংলা ভাষা ও জাতীয় জীবনে প্রবহমান। তবে শতকে মুসলমানদের আগমনের ফলে বাঙালি জীবনে এক বিপ্লব দেখা দেয়।আধিকাংশ বাঙালি ছিল বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা সেদিন উচ্চকোটি হিন্দুদের নিপীড়িত তাই নতুন ধর্ম ও নতুন শাসককে তারা সাদরে গ্রহণ করে। বাঙালি সমাজজীবনে ইসলামের প্রভাব সর্বত্র। মধ্য এশিয়ার মুসলমানদের ভাষা, আচারকানঠান বাঙালিদের এক উন্নত জীবনে সন্ধান দেয়। ইতিহাসে ক্রমবিকাশের ধারায় হিন্দু ও মুসলমানদের দ্বন্দ্ব-মিলনে বাঙালির সমাজ বিস্তৃতি লাভ করে।
শতাব্দীর বিরোধ ও মিলনের মধ্য দিয়ে বাংলার অনেক জনপদ গড়ে ওঠে। কৌম বা জনগোষ্ঠীর নামানুসারে জনপদের নামকরণ হয়েছে। যেমন বঙ্গ, গৌড়, রাঢ়, সুষ্ম ও পুণ্ডু। ভাগীরথীর পশ্চিমে রাঢ় ও সুষ্ম, পদ্মার উত্তরে পুণ্ড, গৌড় এবং ভাগীরথীর পূর্বে বঙ্গ জনপদের উল্লেখ মহাভারত ও অন্যান্য প্রাচীন গ্রন্থে পাওয়া যায়। বাঙ বা বঙ্গজাতি কখন প্রথম সৃষ্টি হয়েছে তার কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ নেই। তবে বিভিন্ন তথ্যের ওপর ভিত্তি করে মনে করা হয় যে চার হাজার বছর আগে বাঙ বা বঙ্গ জনপদ গড়ে ওঠে। মহাভারত ঐতরয়ে অরণ্যকে বঙ্গের উল্লেখ আছে। মহাভারতে বলা হয়েছে, দৈত্যরাজ বলিরাজার পত্নী সুদেষ্ণার গর্ভে ও দীর্ঘতমা ঋষির ঔরসে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড্র ও সুষ্ম নামে ৫ পুত্র জন্মগ্রহণ করে এবং তাদের নামে অঙ্গ, বঙ্গ, কলিঙ্গ, পুণ্ড ও সুম্ম রাজ্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কথিত আছে, দীর্ঘতমা ১৬০০ খ্রিষ্টপূর্বে জীবিত ছিলেন। তা হলে ৩৬০০ বছর পূর্বে বাঙ জাতি সৃষ্টি হয়। অনেকের কাছে এ কাহিনী গ্রহণযোগ্য না হলেও, আমরা মহাভারতে বঙ্গের উল্লেখ। দেখে বাঙালি জাতির প্রাচীনত্ব সম্পর্কে ধারণা করতে পারি। অনেকের মতে, বাঙ চীন-তিব্বতীয় মোঙ্গলীয় শব্দ। শব্দটির মৌলিক অর্থ জলাভূমি। জলাভূমিতে যারা বাস করত তাদের বাঙ বা বঙ্গ জনগোষ্ঠী বলা হতো। মহাভারতে বলা হয়েছে যে, বাঙ জাতি স্লেচ্ছ, পক্ষীসদৃশ, তারা অসুর জাতি। তাদের দেশ পাণ্ডব বিবর্জিত। অর্থাৎ পাণ্ডব বা সভ্য জাতি বঙ্গ দেশে বাস করে না। বাঙ জাতি পূর্ব দিক বা ইন্দোচীন থেকে হাঁটতে হাঁটতে গঙ্গার ব-দ্বীপ এলাকায় বসতি স্থাপন করে এবং তাদের নামে জনপদের নাম হয় বঙ্গ। সম্রাট আকবরের সভাসদ আবুল ফজল
পৃষ্ঠা: ২৫
আইন-ই-আকবরীর গ্রন্থে সর্বপ্রথম এ দেশের নাম বাঙ্গাল বলে উল্লেখ করেছেন এবং তিনি বাঙ্গাল শব্দের উৎপত্তি সম্বন্ধে বলেছেন যে, এ দেশের প্রাচীন নাম বঙ্গ এবং এর সাথে জমির সীমা আল বা আইল প্রত্যয় যোগে বাঙ্গাল শব্দ হয়েছে।বাঙ জাতি জমির সীমা ও লবণাক্ততা থেকে রক্ষার জন্য আইল বা বাঁধ নির্মাণ করত। তাই তাদের বাঙ্গাল বলা হতো। বাঙ জাতির সাথে প্রাচীন অস্ট্রিক, আলপাইন, দাবিড় ও আর্যদের সংমিশ্রণ ঘটে এবং চার জনগোষ্ঠী মিলে বাঙ্গাল জাতির সষ্টি।
গ. ভাষা
বাংলার সুপ্রাচীন ভাষা ছিল অস্ট্রিক ভাষা। আর্যরা এ ভাষাকে অসুর, দস্যু ও পাখির ভাষা বলে ঘৃণা করত। মৌর্য ও গুপ্ত আমলে সংস্কৃত ভাষা বাঙালি সমাজকে প্রভাবিত করে।লোকায়ত বাঙালি সমাজের লোকভাষা ছিল মাগধী অপভ্রংশরূপ। এর রূপ পরিবর্তিত হয়ে বাংলা ভাষার সৃষ্টি হয়। প্রাচীন চর্যাগীতি নতুন সৃজমান ভাষার বিবর্তিত রূপ। চর্চাপদ সপ্তম শতক হতে বার শতকে রচিত। এ সময় বাংলা ভাষার সৃষ্টি। বাংলা ভাষার সৃষ্টি বিভিন্ন কৌমের মধ্যে। সমন্বয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
প্রাচীনকাল থেকে সপ্তম শতক পর্যন্ত বাংলাদেশ পুণ্ড, গৌড়, রাঢ়, সুম্ম, তাম্রলিপ্ত, সমতট, চন্দ্রদ্বীপ প্রভৃতি জনপদে বিভক্ত ছিল। এ জনপদগুলোর প্রত্যেকটি স্বতন্ত্র ও পৃথক ছিল। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন ভাষা ছিল। তাদের মধ্যে সামাজিক বন্ধন শিথিল ছিল। এক জনপদের সাথে অন্য জনপদের যোগাযোগ ও সাংস্কৃতিক আদান-প্রদানের পথে ছিল ভাষার অন্তরায়। যেহেতু তাদের কোনো একক ভাষা ছিল না। ভাষা হলো সামাজিক বন্ধন। ঐতিহাসিক কারণে বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে ভাবের বিনিময় চলতে থাকে এবং সপ্তম শতকে বাংলা ভাষার সষ্টি হয়। বাংলা ভাষা সষ্টিতে বাঙ্গাল জাতি উদ্যোগ গ্রহণ করে এবং মনে হয় তাদের ভাষার সাথে অন্য জনগোষ্ঠীর ভাষা মিলে যায়। এ মিশ্রিত ভাষায় বাঙ্গালদের ভাষার প্রাধান্য ছিল। তাই ভাষার নাম হয় বাংলা ভাষা।
বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি
বাংলার সুপ্রাচীন ভাষা ছিল অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর ভাষা। আর্যরা এ ভাষাকে অসুর, দস্যু ও পাখির ভাষা বলে ঘৃণা করত। মৌর্য ও গুপ্ত আমলে সংস্কৃত ভাষা বঙ্গ সমাজকে প্রভাবিত করে। সংস্কৃত ছিল রাজভাষা। সমাজের অনাদৃত নীচ শ্রেণীর জন্য এ ভাষা ছিল নিষিদ্ধ। মৌর্য ও গুপ্ত আমলে বাংলায় বৌদ্ধধর্মের যে প্রসার ঘটে তার মাধ্যম ছিল সংস্কৃত ভাষা।
পৃষ্ঠা: ২৬
সিদ্ধাচার্যগন বৌদ্ধধর্মের তত্ত্বকথা লোকায়ত বাংলা ভাষায় জনগণের নিকট পৌছে দেয়। প্রাচীন চর্যাগীতিগুলো নতুন সৃজ্যমান ভাষার একমাত্র পরিচয়।
চর্যাপদ্গুলো ৭ম থেকে ১১শ শতকে রচিত। ৬৫০ খ্রি. হতে ১১০০ খ্রি. পর্যন্ত সত্যের প্রাচীন যুগ। এ সময় বাংলা ভাষার সৃষ্টি। অপভ্রংশের স্তর পেরিয়ে বাংলা ভাষা আত্মপ্রকাশ করছে। বাংলার রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে এগারো ও বারো শতকে বৌদ্ধ সহজিয়া, নাথ ও মহাযান ধর্মের জয়জয়কার। নাথ ধর্মের জন্মস্থান চন্দ্রদ্বীপ। এখান থেকে নাথধর্ম সারা ভারতে ছড়িয়ে পড়ে। নাথ ধর্মের প্রবর্তক মৎস্যেন্দ্রনাথ বা মীননাথ। মীননাথের জন্ম চন্দ্রদ্বীপে। তিনি বাংলা সাহিত্যের প্রথম কবি। আশ্চর্য চর্যাচয়-বিনিশ্চয়ের টীকায় মীননাথের একটি শ্লোক উদ্ধৃত হয়েছে:
“কহন্তি গুরু পরামর্থের বাট।
কর্ম কুরঙ্গ সমাধিক পাট ॥
কমল বিকসিল কহিহন জমরা।
কমল মধু পিবিবি থোকইন ভমরা ॥”
ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এর আধুনিক বাংলা করেছেন:
“কহেন গুরু পরামর্থের বাট।
কর্মের রঙ্গ সমাধিক পাট ॥
কমল বিকসিল কহিওনা জোংড়াকে (শামুক)।
কমল মধু পান করিতে ভুল করে না ভোমরা ॥”
মীননাথ পাল রাজা রামপালের (১০৭৭ খ্রি.-১১২০ খ্রি.) সমসাময়িক মনে। করা হয়। মীননাথ নাথ ধর্মের গুরু। তিনি সিদ্ধাচার্যদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ। নাথ ও সহজিয়া ধর্ম সপ্তম শতকের পরে প্রবর্তিত হয়। দশম ও এগারো শতকে বৌদ্ধনাথ ধর্ম বাংলার জনপ্রিয় ধর্ম ছিল। সিদ্ধাচার্য বা পদকর্তাগণ বৌদ্ধ দোহা লোকায়ত বাংলা ভাষায় জনগণের চিত্তদুয়ারে পৌঁছে দেন। এগারো বা বারো শতকে সহজিয়া ও নাথ সম্প্রদায়কে আশ্রয় করে বাংলা সাহিত্যের উদ্ভব ও প্রসার ঘটেছিল।
সুলতান হোসেন শাহ ১৪৯৩ সালে বাংলার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার আমলে বাংলা ভাষার সমৃদ্ধি উচ্চ শিখরে পৌছে। সুলতানগণ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বাংলাদেশে আগমন করেন। তারা উপলব্ধি করেছিলেন এ দেশ শাসন করতে হলে বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি গ্রহণ করতে হবে। তাই তারা জনগণকে আপন বলে গ্রহণ করেছিলেন। তারা বাংলা ভাষার পৃষ্ঠপোষকতা করে বাঙালি জাতি গঠনে গৌরবময় অবদান রেখেছেন। বাংলা ভাষাকে দুটি শাখায় ভাগ করা হয়। পূর্বাঞ্চলীয় ও পশ্চিমাঞ্চল। পূর্ব
পৃষ্ঠা-২৭
বাংলার লোকেরা আঞ্চলিক ভাষা ও সাধু ভাষায় কথা বলে। পশ্চিম বাংলার লোকেরা চলতি ভাষায় কথা বলে। বাংলাদেশের কুষ্টিয়া, যশোর, খুলনায় চলতি বাংলা ভাষার প্রভাব আছে।
বাংলা ভাষা সংস্কৃত ও স্থানীয় ভাষা থেকে সৃষ্ট। মাগধী, প্রকত ও অপভ্রংশের রূপ চারটি – রাঢ়ী, বরেন্দ্রী, বাঙ্গালি ও কামরূপী। চারটির মধ্যে প্রধান হলো রাঢ়ী ও বাঙ্গালি। অঞ্চলভেদে বাংলা মৌলিক ভাষার নানারূপ আছে। বাংলাদেশে আঞ্চলিক উপভাষা রয়েছে।
বাংলা ভাষা কয়েকটি ভাগে বিভক্ত- প্রাচীন যুগ ৯০০-১৩৫০ খ্রি., মধ্য যুগ ১৩৫০-১৮০০, আধুনিক যুগ ১৮০০ খ্রিস্টাব্দ পরবর্তী।
পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃত রীতির ওপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল সাধু ভাষা। এর পাশে সৃষ্টি হয়েছে চলতি ভাষা। পূর্ববঙ্গে ভাষার ওপর আঘাত আসে ১৯৪৭ সাল হতে। ভাষার দাবিতে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাঙালিরা রক্ত দেয়। রক্ত দিয়ে বাঙ্গালিরা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে। পশ্চিম বাংলায় বাংলা ভাষা অবহেলিত। ইংরেজি ও হিন্দি ভাষা পশ্চিম বাংলায় প্রভাব ফেলছে।
ঘ. সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা
বাংলাদেশে প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকে সংস্কৃতির সমন্বয়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতা চলে আসছে। ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিন্নতা থাকলেও ধর্মীয় সহনশীলতা অটুট ছিল। বিভিন্ন জনগোষ্ঠী ও অঞ্চলের মধ্যে সংস্কৃতির সমন্বয় চলতে থাকে। সংস্কৃতির সমন্বয় সে অষ্ট্রিক যুগ থেকে চলে আসছে। অষ্ট্রিক জাতি বাংলায় কৃষি কাজের প্রচলন করে। কৃষক সমাজে অষ্ট্রিক শব্দ চাল, কুড়ি, লাঙ্গল, ঈশ এখনও প্রচলিত আছে। অষ্ট্রিকদের আচার অনুষ্ঠান অন্যান্য জনগোষ্ঠীকে প্রভাবিত করেছে। অষ্ট্রিকদের পরে বাঙ জনগোষ্ঠী পূর্ববঙ্গে বসতি স্থাপন করে। তারাও কৃষি কাজ জানত। সমন্বয়বাদিতার কারণে পরবর্তীতে অষ্ট্রিক, বাঙ জনগোষ্ঠী এক সমন্বিত জাতিতে পরিণত হয়। ঐতিহাসিক যুগে বাংলায় আর্যদের আগমনে ঘটে। তারা হিন্দু ধর্মাবলম্বী- সমাজে ব্রাহ্মণদের প্রভাব বেশি ছিল। আর্যরা বাঙ্গালীদের ঘৃণা করত, তাদের ভাষাকে পাখির ভাষা হিসেবে অভিহিত করে। সমাজে উচ্চশ্রেণীর মধ্যে আর্যদের প্রভাব ছিল। আর্য-অনার্যদের দ্বন্দ্ব-মিলনে সমন্বয় চলতে থাকে। প্রাচীনকালে বাঙ জনগোষ্ঠী বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করে। বৌদ্ধ ধর্মের সহনশীলতা ও মানবতা বাঙ জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে। সপ্তম শতকের প্রথম ভাগে রাজা শশাঙ্ক বাংলা দখল করে হিন্দু ধর্ম প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ছিলেন বৌদ্ধ ধর্ম বিদ্বেষী। তার অত্যাচারে বৌদ্ধরা হিন্দু ধর্মে ফিরে যায়। অনেকে বিভিন্ন
পৃষ্ঠা: ২৮
সম্প্রদায়ের আশ্রয় নেয়। পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্ম বিস্তার লাভ করে। এ সময় সাংস্কৃতিক তন্ময়বাদিতা ও ধর্মীয় সহনশীলতার প্রচার ও প্রসার ঘটে। সেন আমলে হিন্দু ধর্মের প্রভাব বৃদ্ধি পায়, সংস্কৃতি ভাষার চর্চা চলে. সমাজে হিন্দু ধর্মে বর্ণ প্রথা চরমে পৌছে। সেন আমলে সমন্বয়বাদিতা ভীষণভাবে বাধাগ্রস্ত হয়। এ স্ময় ধর্মীয় সহনশীলতা অনুপস্থিত ছিল। একই হিন্দু ধর্মের মধ্যে বর্ণ প্রথার কারণে সমন্বয় ও সহনশীলতা গড়ে উঠেনি।
সুলতানী আমলে ও মোগল আমলে সংস্কৃতির সমন্বয় ও ধর্মীয় সহনশীলতা বিরাজমান ছিল। ইসলাম ধর্মের প্রচারকগণ ছিলেন সুফিবাদী- তারা হিন্দু-বৌদ্ধ ভাবে প্রতি সহনশীল ছিলেন। এ কারণে পীর-দরবেশদের খানকা ও মাজার তিন্দ-বৌদ্ধদের জন্য উন্মুক্ত ছিল। তারা পীরের মাজারে মুসলমানদের ন্যায় শ্রদ্ধা জাপন ও মানত করত। তারা পীরের ঝাড়-ফুকে বিশ্বাস করত। মুসলমান শাসন আমলে মধ্যপ্রাচ্য থেকে মুসলমানগণ বাংলায় বসতি স্থাপন করে। তারা স্থানীয় জনগণের সাথে বৈবাহিক সূত্রে আবদ্ধ হয়। ফলে রক্তের মিশ্রণ চলতে থাকে। বাঙ্গালীরা সঙ্কর বা মিশ্র জাতিতে পরিণত হয়।
ধর্ম ও সংস্কার বাঙ্গালি মানস গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ধর্মীয় বলয় থেকে বেরিয়ে আসতে পারেনি। এ কারণে তারা মুক্ত চিন্তার অধিকারী নয়। প্রাচীনকালে বৌদ্ধ ছিল, ছিল অনার্য, জৈন। পরে বৌদ্ধ ধর্ম এ অঞ্চলের জনগোষ্ঠীকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। বাঙ্গালি জীবনে কৌম, আর্যঅনার্য, বৌদ্ধ, ব্রাহ্মণ ধর্মের নানা অনুষ্ঠান বাঙ্গালি সমাজে প্রচলিত ছিল। এ কারণে দেখা যায় বিয়ের অনুষ্ঠানে হলুদ, আলপনা, মাজারের প্রতি ভক্তি হিন্দুমুসলমান সকলে পালন করে। বৈশাখি অনুষ্ঠানকে মৌলবাদিরা হিন্দু অনুষ্ঠান মনে করে, তাই দেখা যায় জঙ্গিরা বৈশাখি অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় চালায়। ধর্ম নিয়ে বিবাদ ছিল। তবে দাঙ্গায় রূপ নেয়নি। বৈষ্ণব শক্তি, জৈব, নাথ প্রভৃতি প্রচলিত ছিল। এর পর ইসলাম ধর্ম সমাজকে আলোকিত করে। সাধারণ মানুষ ইসলামের ছায়াতলে আশ্রয় নেয়। এ দেশের মুসলমানরা ধর্ম-কর্ম করে কিন্তু তারা অসহিষ্ণু নয়। তারা ছিল ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দু-বৌদ্ধ-মুসলমান মিলিতভাবে বাঙ্গালি সমাজকে প্রভাবিত করে। ফলে এক সমন্বিত সমাজ ব্যবস্থা গড়ে উঠে। হিন্দুমুসলমানদের মধ্যে বিভেদ ছিল না। ধর্মীয় সহনশীলতা সমাজের অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল। মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে একটি দ্বন্দ্ব সব সময় ছিল। তারা কি বাঙ্গালি না মুসলমান। মুসলমানদের অনেকে মনে করেন, বাঙ্গালি হলো হিন্দুমুসলমানগণ পৃথক জাতি। এ দ্বন্দ্বের কারণে বাঙ্গালি মুসলমান সমাজ এখনও পুরোপুরি বাঙ্গালি হতে পারেনি। তাই তারা বাংলাদেশী পরিচয় দিতে স্বাচ্ছন্দবোধ
পৃষ্ঠা: ২৯
করে। মুসলিম লীগের দ্বিজাতিতত্ত্ব নির্মূল হয়নি। মুক্ত সত্তা এখনও সৃষ্টি হয়নি।
বাংলাদেশী মুসলমানগণের ধর্মীয় কুসংস্কার থেকে বেরিয়ে আসতে সময় লাগবে। মুসলমান না বাঙ্গালি- এ দ্বন্দ্ব থেকে বেরিয়ে আসতে পারলেই বাঙালি মুসলিম সমাজ সত্যিকারের বাঙ্গালি হতে পারবে।
শত শত বছরের দ্বন্দ্ব ও মিলনে বাঙালি জাতির গঠন। স্মাজ ছিল একান্তভাবে কষিনির্ভর, সমাজের উচ্চশ্রেণা ব্রাহ্মণ্য দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন, সমাজ ভাগ্যনির্ভর, শক্তি ধর্মের প্রতি আকর্ষণ, সমাজের কৃষক সমাজ একান্ত অবহেলিত মানবদেহে জীবনী শক্তির অভাব, চরিত্র শিথিল, বাইরের আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তির অভাব প্রভৃতি। প্রাচীনকালেও একশ্রেণীর মানুষ চৌর্যবৃত্তি, ভিক্ষাভ মিথ্যা ভাষণ, পরশ্রীকাতর ছিল। জাতির দুর্বলতাগুলো রেখে যায় সুলতান ও মোগল যুগের মানুষের জন্য।
একটি জাতি গঠনের উপাদান বাঙালিদের মধ্যে বার শতকে সৃষ্টি হয়েছে। তাদের মধ্যে ভারতের অন্যান্য অঞ্চল হতে স্বাতন্ত্রবোধ দেখা যায়। জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন একই সম্প্রদায়ভুক্ত জনগোষ্ঠী, ভৌগোলিক নৈকট্য, ভাষা-সংস্কৃত ও সার্বভৌমত্ব। নরতত্ত্বের দিক থেকে দেখা যায় বাঙালিরা সংকর জাতি হলেও শত বছরের সমন্বয় ও মিলনে তাদের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় হয়েছে। ভৌগোলিক পরিচয় ও নৈকট্য তখনো পরিচিতি লাভ করেনি। আজকের বাংলা, গৌড়, পুণ্ড, বঙ্গ নামে বিভক্ত ছিল। জাতি গঠনের জন্য প্রয়োজন একটি ভাষা। বাংলা ভাষা সৃষ্টি হলেও তখনো ভাব প্রকাশের জন্য উন্নত হয়নি। তবে বাঙালি জাতি গঠনের পটভূমি সৃষ্টি হয়েছে। এ প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন:
The geographical contiguity, the community of language, and political unity were the forces at work which were destined to bring Gauda and Vanga closer together and ultimately closure, a national life among the people living in the region now known as Bengal.
To sum up, so far as available evidence goes, we can not say that there was a united Bangali nation by the end of 12th century AD, but everything indicates that such a nation was in the making.
ভৌগোলিক নৈকট্য এবং রাজনৈতিক ঐক্য উপাদানগুলো চলমান ছিল, যা গৌড় এবং বঙ্গকে একত্রিত করতে দৃঢ় ছিল এবং যা পরিশেষে এ অঞ্চলে বসবাসকারী মানুষের মধ্যে জাতীয় জীবন সৃষ্টি করে।
পৃষ্ঠা: ৩০
সংক্ষেপে বলা যায় যে সকল তথ্য পাওয়া যায় তার ভিত্তিতে আমরা বলতে পারি না যে,দ্বাদশ শতকের শেষে একটি বাঙালি জাতি ছিল। কিন্তু সবকিছু ইঙ্গিত ইঙ্গিত যে এরূপ জাতি গঠিত হচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় চেতনা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম উন্মেষ ঘটে পাল রাজাদের চারশ বছর রাজত্বকালে। মাৎস্যন্যায়ের পর রাষ্ট্রীয় চেতনা এ যুগে পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। বাঙ্গার স্বতন্ত্রবোধের ভৌগোলিক সত্তা এ যুগেই সৃষ্টি হয় এবং বাঙালির স্বাতন্ত্র্যবোধের জাগরণ পাল যুগের অন্যতম অবদান। পাল শাসন আমলে সার্বভৌম রাজশক্তির আবির্ভাব হয়।
সংস্কতি: পাল রাজাদের রাজ্য বিস্তারের সাথে সাথে বাঙালির নতুন জাতীয় জীবনের সূত্রপাত হয়। বাংলা ভাষা, শিক্ষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য প্রভৃতি ক্ষেত্রে জাতীয় জীবনের আত্মবিকাশ এ আমলেই। এ সময় বিক্রমশীল বিহার ও নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাকেন্দ্র ছিল। এ যুগের লেখক চক্রপাল, সন্ধ্যাকর, চর্যাপদ রচয়িতা লুই ও কাহ্নপাদ পাল রাজাদের সভা অলংকৃত করেন। ভাস্কর্য ও স্থাপত্য শিল্পের চরম বিকাশ ঘটে। পাল রাজাদের পৃষ্ঠপোষকতায় বৌদ্ধধর্মের পুনরুত্থান হয়। অনেক বৌদ্ধ বিহার নির্মিত হয়। তাদের প্রচার তিব্বতেও পৌছে। পাল আমলে বাংলায় সামাজিক সমন্বয় ঘটে। তারা ছিলেন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। তারা হিন্দু ধর্মেরও পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সপ্তম শতকের প্রথম অব্দে গৌড়ের রাজা শশাংক বৌদ্ধ বিদ্বেষী ছিলেন। বৌদ্ধরা নির্যাতিত হয়েছে। সমাজে সমন্বয়বাদিতা ধ্বংস হয়েছে।
অষ্ট্রিক, বাঙ্গাল, আর্য, অনার্য, মুসলমান জনগোষ্ঠী বাংলা ভূমিতে এসেছে এবং আদিবাসীদের সাথে মিশ্রিত হয়ে এক সমন্বয়ধর্মী সংস্কৃতি ও সভ্যতার সৃষ্টি করেছে। তাদের মধ্যে ভাষা, পোশাক, খাদ্য, আচারের মধ্যে ভিন্নতা ছিল কিন্তু অভিন্নতা ও স্বতন্ত্রের মধ্যে ঐক্যবদ্ধ বাঙ্গালী জাতি গড়ে উঠেছে। যাকে বলা হয় Unity in Diversity- বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্য। বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর মধ্যে বিরোধের পরিবর্তে সমন্বয় ও মিশ্রণ ঘটেছে। এ সমন্বয় ঘটেছে সংস্কৃতি, ভাষা, ধর্ম, অর্থনীতি, সমাজ ও রাজনীতির ক্ষেত্রে।
প্রাচীন বাংলায় গোত্র বা কৌমভিত্তিক জনপদ সৃষ্টি হয়। রাঢ়, পুণ্ড্র, গৌড়, বঙ্গ, সমতট প্রভৃতি অঞ্চলে বিভিন্ন সংস্কৃতি ছিল। বিভিন্ন অঞ্চলের সাথে এক সমন্বিত সংস্কৃতির সৃষ্টি হয়। পাল আমলে বৌদ্ধ সংস্কৃতি উন্নত ছিল। স্থাপত্য শিল্প, ভাষা, ধর্ম বিশ্বাস সমাজ জীবন সংস্কৃতিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। ফলে এক সমন্বিত সংস্কৃতিও সমাজ জীবন গড়ে উঠে। সুলতানী আমলে ইসলাম বম বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মকে প্রভাবিত করে এক ঐক্যবদ্ধ ও অভিন্ন বাঙ্গালী সংস্কৃতি গড়ে তোলে।
পৃষ্ঠা: ৩১
ধর্মীয় ক্ষেত্রে সমন্বয়: বাঙ্গালী সমাজ গঠনে ধর্মের ক্ষেত্রে সহনশীলতা বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করে। আর্যদের আচার অনুষ্ঠান প্রাচীন জনগোষ্ঠীকে আকৃষ্ট করে। হিন্দু ধর্ম প্রচারে আর্যদের ভূমিকা মুখ্য ছিল। পাল আমলে বৌদ্ধ ধর্ম পরমসহিষ্ণুতার জন্য খ্যাত ছিল।
মধ্য যুগে সুলতানী ও মোগল আমলে সুফিবাদ বৌদ্ধ ও হিন্দু ধর্মালম্বীদের প্রভাবিত করে। সুফিবাদ ধর্মীয় মৌলবাদে বিশ্বাস করত না। তারা ছিলেন মানবতাবাদী। তাদের কাছে সকল ধর্মের লোক আশ্রয় পায়। সুফিবাদের প্রচারের ফলে হিন্দু, বৌদ্ধ ও ইসলামের মধ্যে এক অপূর্ব ধর্মীয় সহিষ্ণুতা গড়ে উঠে। তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতার স্থান ছিল না।
শাসন: দেশ শাসনে পাল, সেন, সুলতানি ও মোগল আমলে সমন্বয় ও সহিত বিদ্যমান ছিল। সম্রাট অশোক, হর্ষবর্ধন, পাল ও মুলতানি আমলে এক অসাম্প্রদায়িক সমাজ গড়ে উঠে। ধর্মের বিভিন্নতা থাকলে তারা সাম্য ও শান্তি প্রতিষ্ঠা করে এক সুস্থ সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে।
সমাজ: বাঙালির ইতিহাসে সমন্বয়বাদিতা ও সহিষ্ণুতার ধারা প্রাচীনকাল থেকে সমাজ সৃষ্টি করেছে। সেন রাজারা সাম্প্রদায়িক ছিল। কিন্তু তারা সমাজে নিপীড়ন চালায়নি। সুলতানগণ বাংলা সাহিত্য ও সমাজের পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। মুসলমান শাসন আমলে দাঙ্গা হয়নি। হিন্দুর মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মিত হয়নি। ধর্মীয় সহনশীলতা সমাজ শাসন করেছে, বিরোধ সৃষ্টি করেনি। বাঙালির চিন্তায় মানুষের জয়গান প্রবল ছিল। ধর্মীয় চেতনা সমাজে কলহ সৃষ্টি করেনি। বাংলা ছিল সকল ধর্মের মিলনক্ষেত্র। তাই আমরা দেখি, হিন্দু-মুসলমান ইংরেজদের বিরুদ্ধে কৃষক বিদ্রোহ করে। ১৮৫৭ সালে একত্রে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করেছে। কিন্তু পাকিস্তান দাবি বাঙালিদের ঐতিহাসিক সামাজিক বন্ধন ভেঙে ফেলে।
আজ যে অঞ্চল বাংলাদেশ বলে অভিহিত অতীতে তা বিভিন্ন নামে পরিচিত ছিল। বিচিত্র নরগোষ্ঠীর লোক নিয়ে বাঙালি জনগোষ্ঠী গঠিত হয়নি। তারা শত শত বছর কৌম বা গোত্র জীবনে অভ্যস্ত ছিল। এক একটি অঞ্চল নিয়ে এক একটি কৌম স্বতন্ত্র জীবনযাপন করত। ফলে বিভিন্ন গোত্রের মধ্যে বৃহত্তর জনচেতনা গড়ে ওঠার সুযোগ ছিল না। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রীয় ও অর্থনৈতিক কারণে বৃহত্তর কৌম চেতনা গড়ে ওঠে।
প্রাচীনকালে বাঙালিরা নিজেদের আঞ্চলিক জনপদ সত্তাকে বৃহত্তর দেশ সত্তায় মিশিয়ে দিতে শেখেনি। তাদের অর্থনীতি ছিল ভূমি ও কৃষিনির্ভর। জীবন ছিল সামন্ত প্রথায় গ্রথিত। রাষ্ট্র বিন্যাসের সাথে কৌমতন্ত্র ধীরে ধীরে রাজতন্ত্রে বিবর্তিত হয় এবং রাজতন্ত্রের সাথে সামন্ততন্ত্র গড়ে ওঠে। এ সময় সামাজিক-
পৃষ্ঠা: ৩২
সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে ওঠে। পাল-সেন রাজারা নিজেদের গৌড়েশ্বর বলে পরিচয় দিতেন। প্রাচীন বাঙালির জীবন ছিল ধর্মগত। ধর্ম মানব জীবন পরিচালিত করত। হিন্দু ও বৌদ্ধ সমাজের প্রধান ধর্ম ছিল। বৌদ্ধ ধর্ম বিভিন্ন সম্প্রদায় বিশেষ করে সহজিয়া নাথ ও মহাযান মতবাদের কেন্দ্র ছিল বাংলা।
সেন আমলে বাংলার প্রাচীন সভ্যতা ভেঙে পড়ে। বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথা লাভ করে অনেক ব্রাহ্মণ, কায়স্থ, বৈদ্য বাংলায় বসতি স্থাপন করে। পাল আমলে যে সমাজে ধর্মীয় সহনশীলতা, সমন্বয় সৃষ্টি হয়েছিল তা সেন আমলে পবিত্যক্ত হয়। সেনদের সময় কৃষক ভূমিদাসে পরিণত হয়।
গুপ্ত যুগের আগে বাংলার ধারাবাহিক ইতিহাস সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় না। মহাভারতে বাংলাদেশের কয়েকটি রাজ্যের উল্লেখ আছে। পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলায় অজয় নদীর দক্ষিণে পাণ্ডু রাজার ঢিবিতে প্রাপ্ত নদর্শনসমূহ থেকে অনুমান করা হয় যে, সাড়ে তিন হাজার বছর আগে বাংলাদেশে সুসভ্য জাতি বাস করত। খ্রিস্টপূর্ব ৩২৭ অব্দে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের সময়কাল ইতিহাসে বাংলাদেশে গঙ্গারিডি রাজ্যের উল্লেখ আছে। আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণের পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য উত্তর ভারতে রাজত্ব করেন। এ সময় বাংলাদেশ মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত হয়ে পড়ে। সম্রাট অশোকের অধীনে বঙ্গ একটি প্রদেশ ছিল। চতুর্থ শতকে চন্দ্রবর্মা বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করেন। মৌর্যদের পরে বাংলাদেশ গুপ্ত রাজাদের অধীনে ছিল। মনে হয় সমুদ্রগুপ্তের পিতা চন্দ্রগুপ্ত বঙ্গ জয় করেন। গুপ্ত রাজাদের পরে ষষ্ঠ শতকে দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় একটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। সপ্তম শতকে রাজা শশাঙ্ক বঙ্গ, পুণ্ড্র, গৌড় ও রাড় অঞ্চল নিয়ে প্রথমবার স্বাধীন গৌড়রাজ্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেন। তার মৃত্যুর পর হর্ষবর্ধন বাংলাদেশ শাসন করেন। এ সময় বঙ্গ দেশে বৌদ্ধ ধর্মের প্রভাব ছিল। অষ্টম শতকের প্রথম ভাগে বাংলাদেশ অরাজকতায় পূর্ণ ছিল। ৭৫০ সালে জনগণ জনৈক গোপালকে রাজা নির্বাচিত করেন। পাল রাজারা ৭৫০ হতে ১১২৪ সাল পর্যন্ত রাজস্ব করে। পাল বংশের চার শ’ বছরের শাসন বাংলার ইতিহাসে বিশেষ অবদান রেখেছে। বর্তমান বাংলাদেশ, বাঙালি জাতি ও বাংলা ভাষার গোড়াপত্তন পাল আমলে হয়েছে। এ যুগে প্রথম বৃহত্তম সামাজিক সমীকরণ ও সমন্বয় ঘটেছে। পাল রাজাদের রাজধানী ছিল গৌড় এবং উত্তর ভারত নিয়ে তাদের ব্যস্ত থাকতে হতো। দক্ষিণ-পূর্ব বঙ্গের দিকে তারা দৃষ্টি দিতে পারেননি। পাল বংশের পরে সেন বংশ ১০৯৮ সাল থেকে ১২০৩ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে রাজত্ব করে। তাদের সময় বাংলাদেশ রাঢ়, গৌড়, বঙ্গ, বাগড়ি ও নাব্য মণ্ডল- এ ৫টি প্রদেশে
পৃষ্ঠা: ৩৩
বিভক্ত ছিল। সেনদের রাজভাষা ছিল সংস্কৃত। সেনদের আমলে বাঙ্গালিদের ওপর সংস্কৃত ভাষা চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে। এ সময় বাংলা ভাষার চর্চা ব্যাহত হয়। বাংলা ছিল বাঙ জাতির ভাষা। বাঙালিরা তাকে বাংলাকে পরিত্যাগ করে সংস্কৃত ভাষা গ্রহণ করেনি।
ইতিহাস হলো সমাজবিন্যাস এবং সমাজের বিন্যাস হলো শ্রেণী উৎপাদন ব্যবস্থা প্রভৃতি। সভ্যতা ও সংস্কৃতি প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের ইতি কিন্তু প্রাচীনকালে জনগণের ইতিহাস উপেক্ষিত হয়েছে। সমাজ ছিল ধর্মভিত্তিক। মানুষ ছিল ভাগ্যনির্ভর, অত্যধিক ধর্মাশ্রিত ও রক্ষণশীল সমাজের গতি ছিল স্তিমিত। সমাজের উচ্চশ্রেণী ছিল সংস্কৃত ভাষাভাষী বা কায়স্থ; আর বৈদ্যরা ছিল পরজীবী ও জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন।
আমরা প্রাচীনকালের ইতিহাসের প্রেক্ষাপটে দেখতে পাই হাজার বছরের আবর্তন-বিবর্তনে আদিম কৌম বা গোত্র চেতনা পরিত্যাগ করে বাঙালি জাতি গঠনের সংগ্রাম। আর দেখতে পাই সমাজ একান্তভাবে ভাগ্যনির্ভর, বা দৃষ্টিতে আচ্ছন্ন, সমাজ-দেশে বীরপুরুষের অভাব, বিদেশি, আক্রমণ প্রতিহত করার শক্তির অভাব।
১২০৩ সাল তুর্কি বীর ইখতিয়ার উদ্দিন মুহম্মদ বিন বখতিয়ার খলজী বাংলার রাজধানী গৌড় দখল করেন। মুসলমানদের আক্রমণ প্রতিহত করার মতো সাহস ও শক্তি লক্ষ্মন সেন বা তক্কালীন ব্রাহ্মণ সমাজের ছিল না। নিপীড়িত বাঙালি জনগোষ্ঠী মুসলিম শাসনকে সাদরে গ্রহণ করে এবং অনেকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। অনেক তুর্কি, আফগান ও আরব দেশীয় মুসলমান বাংলায় বসতি স্থাপন করে। অসংখ্য পীর-দরবেশ ইসলাম ধর্ম প্রচার করতে আসেন। নিপীড়িত বাঙালিরা মুসলিম শাসনের সংস্পর্শে এসে নতুন জীবনের সন্ধান পায়। তাদের সহায়তায় গৌড়ের সুলতানগণ দিল্লির অধীনতা ছিন্ন করে স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দিল্লির মুসলমানদের শাসনামলে বাংলার সুলতানগণ বার বার বিদ্রোহ করেছেন। তাই ঐতিহাসিকগণ বাংলাকে বিদ্রোহ নগর বলে আখ্যায়িত করেছেন। ১২৭৮ সালে গৌড়ের সুলতান তুঘরিল খাঁ স্বাধীনতা ঘোষণা করলে দিল্লির সম্রাট গিয়াসউদ্দিন বলবন তাঁকে দলবলসহ হত্যা করেন। ১৩৪২ সালে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ লক্ষৌতির বা গৌড়ের সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিন ১৩৫২ সালে উত্তর-পশ্চিম বঙ্গ ও পূর্ব বঙ্গকে একত্র করে সমগ্র বাংলাদেশের অধিপতি হন। তিনি সর্বপ্রথম বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করে ‘শাহ-বাঙ্গাল উপাধি ধারণ করেন। পাল-সেন রাজারা নিজেদের গৌড়েশ্বর বলে পরিচয় দিত। সামাজি কারণে জনগণ ঐক্যবদ্ধ হতে পারেনি। পাল-সেন রাজারা সমগ্র বাঙালি সমাজ
পৃষ্ঠা: ৩৪
দিয়ে একটি রাষ্ট্রীয় ঐক্য গড়ে তোলায় ব্যর্থ হন। বাঙালি জাতিসত্তা ঐক্যবদ্ধ হলো এবং তা ছিল গৌড়েশ্বরের একটি প্রদেশ।
১৫২৬ সালে মোগল সম্রাট বাবর পাঠানদের পরাজিত করে দিল্লি দখল করেন।পাঠানগণ মোগলদের সাথে পাঠানদের রক্তের সংমিশ্রণ হলো। ১৫৭৫ সাল থেকে ১৬১১ সাল পর্যন্ত বার ভূঁইয়ারা স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করে। তাদের মধ্যে ঈশা খান, প্রতাপাদিত্য, রামচন্দ্র, চাদ রায়, কেদার রায় লার স্বাধীনতার জন্য মোগল সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গীরের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন। ১৬১১ সালে সম্রাট জাহাঙ্গীর বার ভূঁইয়াদের পরাজিত করে সমগ্র বাংলা দখল করেন। বাংলাকে বিহার-উড়িষ্যার সাথে যুক্ত করে একটি প্রদেশ বা সুবা গঠন করা হয়। রাজধানী ছিল ঢাকায়। একজন সুবেদার বাংলা শাসন করত। সমাট শাহজাহানের আমলে মগ-পর্তুগিজরা বাংলাদেশ আক্রমণ করে হাজার হাজার মানুষ হত্যা করে এবং সম্পদ লুট করে। তাদের আক্রমণের ফলে দক্ষিণপর্ব বাংলার এক বিস্তীর্ণ অঞ্চল জনবসতি শূন্য হয়ে পড়ে। ১৬৬৬ সালে সুবেদার শায়েস্তা খান মগ-পর্তুগিজদের কঠোর হস্তে দমন করেন। ১৭১৭ সালে মুর্শিদ কলী খা বাংলার নবাব রাজধানী ঢাকা হতে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তর করেন। ১৭৪০ সালে আলিবর্দী খান বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি স্বাধীনভাবে রাজ্য শাসন করতেন। মোগল সম্রাটকে নামমাত্র কর দিতেন। আলিবর্দী খাঁর মৃত্যুর পর তার দৌহিত্র সিরাজউদ্দৌলা ১৭৫৬ সালে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে আরোহণ করেন। সিরাজউদ্দৌলার সেনাপতি মীর জাফর আলী খা, রাজবল্লভ, জগৎ শেঠ, ইয়ার লতিফ ও ঘসেটি বেগম তাঁকে সিংহাসনচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করে। তারা ইংরেজ কোম্পানির লর্ড ক্লাইভের সাথে ষড়যন্ত্র করে সিরাজউদ্দৌলার পরিবর্তে মীর জাফরকে নবাব নিযুক্ত করার চুক্তি করে। এ ষড়যন্ত্রের ফলে ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আম্রকাননে ইংরেজগণ নামমাত্র যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে পরাজিত এবং ২ জুলাই তাকে নির্মমভাবে হত্যা করে। মীর জাফর বাংলার ক্ষমতাহীন নবাব হলেন। প্রকৃতপক্ষে শাসনক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যায়। এভাবে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য পলাশীর আম্রকাননে দুশো বছরের জন্য অস্তমিত হয়ে যায়। আবার ১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল বৈদ্যনাথতলার আম্রকাননে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো। মোগল আমলে বাঙালি জাতি শাসকশ্রেণীর আওতা থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। শাষকশ্রেণী ছিল ১৮ শতকের বিপ্লবের প্রতি উদাসীন। ইউরোপে যখন শিল্প, কৃষি ও বাণিজ্য বিপ্লব চলছে তখন দিল্লির সম্রাট ইংরেজ বণিকদের ভারতে অবাধ বাণিজ্যের সুযোগ সুবিধা প্রদান করে। বাণিজ্যের সুযোগ নিয়ে তারা রাজ্য দখল।
পৃষ্ঠা- ৩৫
করে। সমাজ ছিল পশ্চাদমুখী। ইউরোপ যখন নতুন নতুন আবিষ্কার করে সমাজে বিরাট পরিবর্তন আনছে, তখন বাংলা তথা ভারতবর্ষ ছিল ধর্মাচ্ছন। আমেরিকা যখন স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে তখন বাংলার মুৎসুদ্দিশ্রেণী স্বাধীনতা বিকিয়ে দেওয়ার জন্য ইংরেজ বণিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করছে। বাংলাদেশে ছিল বীরপুরুষের অভাব। সমাজ একবার নেতার অভাবে পিছিয়ে পড়লে সে সমাজে পরিবর্তন আনতে শত শত বছর লাগে।এই ঐতিহাসিক ভুলের জন্য বাঙালিদের আজও মূল্য দিতে হচ্ছে।
১৭৬৫ সালে ইংরেজ গভর্নর লর্ড ক্লাইভ বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার দেওয়ানী লাভ করে এবং বাংলাদেশে দ্বৈতশাসন চালু করে। ইংরেজদের দ্বৈত শাসন আমলে ১১৭৬ বঙ্গাব্দে বাংলাদেশে এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়, যা ছিয়াত্তরের মন্বন্তর নামে পরিচিত। দুর্ভিক্ষ ছিল ইংরেজ সৃষ্ট। বাংলার এক কোটি লোক না খেয়ে মারা গেল অথচ কোনো বাঙালি ইংরেজদের বিরুদ্ধে কোনো প্রতিবাদ করেনি। পথিবীর ইতিহাসে এভাবে নীরবে মরে যাওয়ার দ্বিতীয় উদাহরণ নেই। ১৭৭২ সালে লর্ড হেস্টিংস গভর্নর হয়ে আসেন। তিনি ভারতে ইংরেজ রাজত্ব সুপ্রতিষ্ঠিত করেন। ১৭৯৩ সালে গভর্নর জেনারেল লর্ড কর্নওয়ালিস বাংলাদেশে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত প্রবর্তন করেন। ইংরেজদের অনুগত একদল জমিদার সৃষ্টি হলো। শুরু হলো জমিদারদের সীমাহীন অত্যাচার। অপরদিকে লবণচাষি ও নীলচাষিদের ওপরও ইংরেজদের অত্যাচার চলে। অত্যাচারী জমিদার ও ইংরেজ কুঠিয়ালদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র কৃষকবিদ্রোহ দেখা দেয়। বাংলার সশস্ত্র কৃষকবিদ্রোহ, পলাশীর পর থেকে সিপাহী বিদ্রোহ পর্যন্ত চলে। ফকির বিদ্রোহ, সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, রংপুরের কৃষকবিদ্রোহ, বরিশালের কৃষক বিদ্রোহ, ফরায়েজী আন্দোলন প্রভৃতি ইংরেজ কোম্পানি ও দেশীয় জমিদারদের বিরুদ্ধে প্রধান বৈপ্লবিক ঘটনা। বিদ্রোহীদের মধ্যে বরিশালের বালকী শাহ, উত্তরবঙ্গের মজনু শাহ, ২৪ পরগনার তিতুমীর,ফরিদপুরের দুদু মিয়া ইংরেজদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাঙালি জাতির সংগ্রামের ইতিহাসকে এগিয়ে নিয়ে যান। ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়। তারা প্রথমে ভারতের স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে। তারা মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে ভারতের সম্রাট ঘোষণা করে। ১৮৫৮ সালে বিদ্রোহীরা ইংরেজদের কাছে পরাজয় বরণ করে। বাহাদুর শাহ রেঙ্গনে নির্বাসিত হলেন। ভারতের শাসনভার গ্রহণ করলেন
ইংল্যান্ডের রানী ভিক্টোরিয়া। সিপাহী বিদ্রোহের পর ১৮৬০-৬২ সালে বাংলাদেশে নীলবিদ্রোহ সবচেয়ে শক্তিশালী ইংরেজী বিরোধী আন্দোলন। বাংলার হাজার হাজার নীলচাষি নীল কুঠিয়াল ও ইংরেজি শাসকদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। ইংরেজ সরকার গণবিদ্রোহের কাছে নতিস্বীকার
পৃষ্ঠা: ৩৬
করতে বাধ্য হয় এবং নীল চাষ আস্তে আস্তে বন্ধ হয়ে যায়।
মুলমানদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়। মুসলিম লীগের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে আইনসভায় পৃথক নির্বাচন প্রথা চালু হয়। ১৯২০ সালের খেলাফত আন্দোলন এবং ১৯২১ সালে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হয়। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের রাজনীতি উচ্চশ্রেণীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের কর্মসচির মধ্যে কৃষক-শ্রমিকদের দাবি ছিল উপেক্ষিত। আবুল কাশেম ফজলুল হক নিপীড়িত কৃষক সমাজের মুক্তির লক্ষ্যে ১৯১৪ সালে প্রজা আন্দোলন শুরু করেন। তার আহ্বানে বাংলার কৃষকসমাজ বিপুলভাবে সাড়া দেয়। ১৯৪০ সালে আশ্চমাঞ্চলের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা নিয়ে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব করেন। পরে মুসলিম লীগ তার প্রস্তাবকে পরিবর্তন করে, পাকিস্তান দাবি করে। ১৯৪২ সালে কংগ্রেস মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে ভারত ছাড়’ আন্দোলন শুরু করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনের পর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। তিনি দেখলেন মুসলিম লীগের পাকিস্তান এবং কংগ্রেসের অখণ্ড ভারতের অধীনে বাংলার ভবিষ্যৎ রক্ষিত হবে না। তাই তিনি স্বাধীন বহত্তর বাংলার দাবি করেন। ইংরেজ সরকার স্বাধীন বাংলার দাবি উপেক্ষা করে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ও পাকিস্তান সৃষ্টি করে। বাংলা বিভক্ত হয়ে পূর্ববঙ্গ পাকিস্তানের এবং পশ্চিমবঙ্গ ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই বাঙালিদের ওপর নিড়ীপন শুরু হলো। প্রথমে বাংলা ভাষার ওপর আক্রমণ আসে। বাঙালিরা শেরে বাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধিকার আন্দোলন শুরু করে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের ২১ দফা আন্দোলন, ১৯৬২ ও ১৯৬৪ সালের শিক্ষা আন্দোলন, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনকে ধাপে ধাপে এগিয়ে নিয়ে যায়। পরিশেষে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতি সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করে।
রাজা শশাঙ্ক, পাল রাজা, গৌড়ের সুলতান ও বার ভূঁইয়াগণ স্বাধীন বাংলা মাত্র প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হয়েছিলেন। যে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখেছিলেন আবুল কাশেম ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তাঁদের সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পৃষ্ঠা: ৩৭
ঙ. অভিন্ন বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে তৎকালীন পূর্ববঙ্গ ও বর্তমান বাংলাদেশের স্বকীয়তা
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পর্যন্ত অভিন্ন বাংলা ছিল। আবহমান বাংলা হিন্দু মুসলমানের ঐক্য সুদৃঢ় ছিল। সময় সময় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে মন্দির-মসজিদ, গোহত্যা নিয়ে বিরোধ হলে তা বৃহত্তর বাংলার রাজনীতি সমাজব্যবস্থায় প্রভাব ফেলেনি। হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে ঐক্য ও শান্তি বিরাজমান ছিল। তারা ঐক্যবদ্ধভাবে বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে, খেলাফত ও অসহযোগ আন্দোলন করেছে।
১৯৪৬ সালে দ্বিজাতিত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলিম লীগের পাকিস্তান দাবি হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করে। ফলে ১৯৪৬ সালে কলকাতা, বিহার ও নোয়াখালীতে দাঙ্গা হয়। হাজার হাজার হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়। মুসলমানদের দাবি ছিল- তাদের ধর্ম ও সংস্কৃতি ভিন্ন। তারা ভারত ভাগ চায় না। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ, বাংলা ভাগ হয়। বাঙ্গালির অভিন্ন সংস্কৃতির মৃত্যু হলো। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িকতা দেখা দেয়। পাকিস্তান সরকার ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চায়, উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে। পর্ব বাংলা সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের শিকার হয়।
অভিন্ন বাংলার পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বাংলায় অনেক ক্ষেত্রে নিজস্ব বৈশিষ্ট্য ছিল। উভয় বাংলা ১৯৪৭ পর্যন্ত একই অঞ্চল ও একই জাতীয়তাবোধ থাকা সত্তেও পূর্ব বাংলা প্রাচীনকাল থেকে ভৌগোলিক, সমাজ ব্যবস্থা ও অর্থনীতি ক্ষেত্রে স্বাতন্ত্র ছিল।
পূর্ব বাংলা নদীবহুল। এ অঞ্চল নদী, খাল ও বিলের দেশ। পূর্ব বাংলা সমতল ভূমি। পশ্চিম বাংলা নদীবহুল নয়। নদীর সংখ্যা সীমিত। পূর্ব বাংলায় দ্বীপের সমাহার। নদীর ভাঙনে পূর্ব বাংলার জনপদ বিলীন হয়ে যায়। চর সৃষ্টি ও নতুন জনপদ গড়ে উঠে।
পশ্চিম বাংলায় পাহাড় ও প্রাচীন স্থলভাগ। পূর্ব বাংলার মানুষ কৃষিজীবী। ভাত ও মাছ এদের প্রধান খাদ্য। পূর্ব বাংলায় প্রচুর ইলিশ মাছ পাওয়া যায়। পশ্চিম বাংলায় ইলিশ নেই। পূর্ব বাংলায় প্রাকৃতিক দুর্যোগ লেগেই আছে। পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ আমলে কলকাতার কলোনী ছিল। পূর্ব বাংলার কাঁচামাল দিয়ে। পশ্চিম বাংলায় শিল্প প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। কলকাতাকেন্দ্রিক পাটশিল্প পূর্ব বাংলার পাটের উপর নির্ভরশীল ছিল।
পূর্ব বাংলায় মুসলমানের সংখ্যা বেশি, তারপরও সম্পূর্ণ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি
পৃষ্ঠা: ৩৮
বিরাজমান ছিল। পশ্চিম বাংলার জনগন সর্বভাতীয় জাতীয়তাবাদ ও সংস্কৃতি ধারণ করেছে। পূর্ব বাংলায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে হাজার মেইল দূরে অবস্থিত। তারা বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষার করার জন্য ১৯৫২ সালে রক্ত দিয়েছে। এ অঞ্চলের জনগণ কেন্দ্রের শাসন ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও আন্দোলন করেছে। তারা ৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করে। পরিশেষে বাঙালি জাতি ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করেছে।পূর্ব বাংলার জনগণের স্বাতন্ত্র্যবোধ ও স্বকীয়তা থাকায় তারা একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে সফল হয়েছে। অন্যদিকে পশ্চিম বাংলা ভারতের রাষ্ট্রভাষা হিন্দি ভাষার নিকট আত্মসমর্পণ করেছে। বাংলাদেশের স্বকীয় সত্তার কারনে বাংলাদেশ আজ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র।
পূর্ব বাংলা ব্রিটিশ আমলে অবহেলিত ছিল। পূর্ব বাংলা ছিল পশ্চিম বাংলার কলকাতার পশ্চাতভুমি বা কাঁচামাল সরবরাহকারী। পশ্চিম পাকিস্তানও পূর্ব বাংলাকে তাদের কলোনীতে পরিণত করে। তাই ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ।
পূর্ববঙ্গবাসীর মধ্যে সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ছিল। এর কারন ছিল সমাজ কৃষিভিত্তিক। তাঁদের উৎপাদন পদ্ধতি প্রায় নিশ্চল। নিশ্চলতার কারণে সমাজ বিনাস বহু স্তরে থেকে যায়। সমাজে দ্রুত পরিবর্তন আসেনি। তাছাড়া ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে পূর্ববঙ্গ দূরে থাকায় ভৌগোলিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি হয়। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তান থেকে ১২০০ মাইল দূরে অবস্থিত। দু’অঞ্চলের মধ্যে ঐক্যের চেয়ে অমিল বেশি ছিল। উভয় অঞ্চলের মধ্যে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বৈষম্য প্রকট ছিল। এ সকল কারণে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে।
সহায়ক গ্রন্থ
অতুল চন্দ্র রায়, ভারতের ইতিহাস, কলকাতা
নীহার রঞ্জন রায়, বাঙ্গালির ইতিহাস আদিপর্ব
Dr. R. C. Majumder, History of Bengal, Vol-1
Sir Jadunath Sarker, History of Bengal, Vol-II
ড. হারুন-অর-রশিদ, বাংলাদেশ: রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০০০
পৃষ্ঠা: ৩৯
দ্বিতীয় অধ্যায়
অখণ্ড বাংলা গঠনের প্রয়াস ও উপমহাদেশের বিভক্তি- ১৯৪৭
ক. ঔপনিবেশিক শাসন আমলের সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভব ও বিস্তার
ভারত উপমহাদেশে সাতশ’ বছর মুসলমানের শাসন ছিল। এ দীর্ঘ সময় হিন্দু-মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে বাস করেছে। মুসলমান সুলতানগণ ও মোগল সম্রাটেরা অস্ত্র দিয়ে ইসলাম দিয়ে প্রচার করেনি। ভারতের নির্যাতিত ও শোষিত হিন্দুরা স্বেচ্ছায় ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে। ইসলাম ও হিন্দু ধর্ম মিলিয়ে সম্রাট আকবর দীন-এলাহী ধর্ম প্রচার করেন। তিনি হিন্দু সম্প্রদায়ের সাথে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা করে রাজ্য শাসন করেন। আরব, ইরান, ইরাক থেকে এসে যে সকল আউলিয়া-পীর এ অঞ্চলে ইসলাম প্রচার করেছেন তারা ছিলেন সুফি সাধক। তারা ছিলেন সহনশীল। তারা শান্তির বাণী প্রচার করেছেন। হিন্দু ধর্ম ও ইসলাম ধর্মের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা হয়নি। ইসলাম ধর্ম এক আল্লাহর প্রচার করে; অন্যদিকে হিন্দুরা মূর্তি পূজা করে। ইসলাম ধর্মে মূর্তি পূজা নিষিদ্ধ। তা সত্ত্বেও এদেশে মুসলমানগণ মন্দির ও স্মৃতি ভাঙেনি। শত শত বছরের ইতিহাসে সাম্প্রদায়িকতা ছিল না। ইংরেজ শাসকগণ ভারতে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়। তারা Divide and Rule-এ বিশ্বাস করত। ১৮৩৫ সালে ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেন্টিং ফারসি ভাষার পরিবর্তে ইংরেজি ভাষাকে রাজভাষা করেন।
লর্ড ম্যাকলের পরামর্শে বেনটিং ইংরেজি ভাষাকে দাপ্তরিক ভাষা হিসেবে প্রবর্তন করেন। মুসলমান সম্প্রদায় ইংরেজি ভাষাকে মেনে নেয়নি। তারা ইংরেজি শিক্ষাকে হারাম ঘোষণা করে আত্মহত্যার পরিচয় দেয়। তারা আরবি-ফারসি, উর্দু শিক্ষা টিকিয়ে রাখে। অন্যদিকে হিন্দুরা ইংরেজি ভাষা গ্রহণ করে অফিসআদালতে এককভাবে চাকরি পায়। মুসলমান সম্প্রদায় একশ’ বছর পিছিয়ে
পৃষ্ঠা: ৪০
পড়ে। তারা দেখতে পায়- হিন্দু জমিদার, মহাজন, জজ-ম্যাজিস্ট্রেট, কর্মচারী। ১৯৭৩ সালে জমিদারি প্রথা ও সূর্যাস্ত আইন চালু হলে মুসলমানরা জমিদারি
লখেরাজ সম্পত্তি হারিয়ে গরিব হয়ে পড়ে। তারা কৃষক সম্প্রদায়ের পরিণত হয়। হিন্দুদের শোষকের ভূমিকায় দেখে মুসলমানরা সম্প্রদায়িক হয়ে ওঠে। ১৮৮৫ সালে ভারতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়। কংগ্রেস ছিল হিন্দু নেতাদের দখলে। কংগ্রেসের স্লোগান ছিল- বন্দে মাতরম। মুসলমানরা বন্দে মাতরম প্রত্যাখ্যান করে আল্লাহু আকবার স্লোগান দেয়। আইনসভা নির্বাচনে মুসলমান প্রার্থীরা জয়লাভ করতে পারেননি, তারা সংখ্যায় কম ছিলেন। মুসলমানদের দাবি আদায়ে ভারতের মুসলিম নেতারা ১৯০৬ সালে ঢাকায় অল ইন্ডিয়া মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলমানদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯০৯ সালে আইসভায় পৃথক নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। মুসলমান ও হিন্দুদের আসন ভাগ করে দেওয়া হয়। এভাবে সাম্প্রদায়িকতা বিস্তার লাভ করতে থাকে। হিন্দ-মুসলমানের মধ্যে বিভেদ-দাঙ্গা দেখা দেয়। কংগ্রেসের দাবি ছিল- আইনসভায় যুক্ত নির্বাচন হবে। সাম্প্রদায়িক নির্বাচন হবে না। মুসলিম লীগ পৃথক নির্বাচনের দাবিতে অটল। ফলে শাসনতান্ত্রিক জটিলতা দেখা দেয়।
শাসনতান্ত্রিক সংকট নিরসনের জন্য ব্রিটিশ সরকার ১৯৩০ সালে গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করে। বৈঠক কংগ্রেস প্রত্যাখ্যান করে। ১৯৩১ সালের বৈঠকে মহাত্মা গান্ধী ও কংগ্রেস যোগদান করে। কিন্তু শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে সমঝোতা হয়নি। পরিশেষে ব্রিটিশ সরকার ১৯৩৪ সালে কমিউনাল এওয়ার্ড প্রকাশ করে। কমিউনাল এওয়ার্ডের ভিত্তিতে ব্রিটিশ পার্লামেন্ট ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইন পাস করে। এ আইনে পৃথক নির্বাচনের বিধান রাখা হয়। হিন্দু, মুসলমান, নমশূদ্র ও শিখদের জন্য পৃথক আসন বরাদ্দ করা হয়। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনের অধীনে ১৯৩৭ সালের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ঐক্যবদ্ধ হয়ে মন্ত্রিসভা গঠনে ব্যর্থ হয়। মুসলিম লীগ নেতা জিন্নাহর শর্ত হচ্ছে- কংগ্রেস কোনো মুসলমান মন্ত্রী নিয়োগ করতে পারবে। কংগ্রেস চাচ্ছে তারাও মুসলমানদের মন্ত্রী করবে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের অনৈতিক শর্ত আরোপ করায় প্রদেশে যুক্ত মন্ত্রিসভা হলো না। কংগ্রেস শাসিত প্রদেশে মুসলমানরা নিপীড়িত হচ্ছে। দাঙ্গার শিকার হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা বৃদ্ধি পায়। একে ফজলুল হকের নেতৃত্বে বাংলায় গঠিত মন্ত্রিসভা প্রদেশে সাম্প্রদায়িক সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সফল হয়।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ জিন্নাহর সভাপতিত্বে লাহোরে মুসলিম লীগের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয় এবং ভারতের পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্ব অঞ্চলে মুসলিম
পৃষ্ঠা: ৪১
অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে একাধিক রাষ্ট্র গঠনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। এ প্রস্তাব পরে ‘পাকিস্তান প্রস্তাব’ নামে অভিহিত হয়। জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে দাবি এগিয়ে নিয়ে যান। তিনি বলেন,
We maintain and hold that Muslims and Hindus are two major nations by any definition or test of a nation. We nation of a hundred million, and what is more, we are a nation with our own distinctive culture and civilization, language and literature, art and architecture customs, history and traditions aptitudes and ambitions. In short we have our own distinctiv outlook on life and of life.
আমরা দৃঢ়ভাবে মনে করি, জাতিতত্ত্বের যে কোনো সংজ্ঞার বিচারে ভারতের হিন্দু-মুসলমান দুটি প্রধান ভিন্ন জাতি। ভারতের দশ কোটি মুসলমান জাতির রয়েছে নিজস্ব স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও সভ্যতা, ভাষা, সাহিত্য, শিল্প, স্থাপত্য, রীতিনীতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য এবং এক অভিন্ন জীবন পদ্ধতি। ১৯৪৬ সালের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন পাকিস্তান দাবির ভিত্তিতে অনুষ্ঠিত হয়। গভর্নর জেনারেল অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠন করার জন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে আহ্বান জানান। মুসলিম লীগ অন্তর্বর্তী সরকারে যোগদান না করে ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট ডাইরেক্ট অ্যাকশন দিবস পালন করে। কলকাতায় দাঙ্গায় হাজার হাজার লোক নিহত হয়। কলকাতার পর নোয়াখালী ও বিহারে দাঙ্গা হয়। হত্যা, নারী নির্যাতন চলে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর পাকিস্তান দাবির ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। দেশ ভাগ সাম্প্রদায়িকতা বন্ধ করতে পারেনি। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট থেকে পাঞ্জাব, দিল্লিতে দাঙ্গা হয়। দাঙ্গায় পাঞ্জাবে দশ লক্ষ মুসলমান, হিন্দু, শিখ নিহত হয়।এক সাগর রক্তের বিনিময়ে ভারত বিভক্ত হলো।
সাম্প্রদায়িকতার ফলে ভারত বিভাগ, পাকিস্তান সৃষ্টি। ভারত বিভাগের ফলে ১০ লক্ষ মানব সন্তানকে হত্যা, লক্ষাধিক নারী নির্যাতিত, দুই কোটি মানুষ বাস্তুহারা হয়েছে। দেশ ভাগের পর শত শত দাঙ্গা হয়েছে। দেশ ভাগের পর সাম্প্রদায়িক সমস্যার সমাধান হয়নি। সাম্প্রদায়িকতা আছে এবং থাকবে।
বাঙালিরা ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধ করেছে। পাকবাহিনী ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা করেছে, আড়াই লক্ষ নারী নির্যাতিত হয়েছে। যদি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ বিভক্ত না হতো, জাতীয় ঐক্য থাকত তাহলে। ১৯৪৬ সালে কলকাতা, নোয়াখালী, বিহারে দাঙ্গা হৎতো না। ১৯৭১ সালে
পৃষ্ঠা: ৪২
পাকিস্তান বাহিনী ৩০ লক্ষ বাঙালি হত্যা করতে পারতনা। এ সকল জঘন্য হত্যাকাণ্ড ঘটেছে একমাত্র সাম্প্রদায়িকতার কারণে।
কলকাতা দাঙ্গা
১৯৪৬ সালের ২৪ মার্চ ব্রিটিশ বাণিজ্যমন্ত্রী স্যার স্ট্যাফোর্ড ক্রিপস, ভারত সচিব স্যার প্যাথিক লরেন্স, নৌবাহিনীর সচিব এ. বি. আলেকজান্ডার- এই তিন দলষ্ট কেবিনেট মিশন ভারতে আসেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের পরস্পরবিরোধী কেন্দ্রীয় চিন্তাধারার মধ্যে সংযোগ সাধনের উপায় খুঁজে বের করা। তারা স্বাধীন ভারতে একটি যুক্তরাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা করেন। কেবিনেট মিশন ১৫ মে তাদের সুপারিশ পেশ করেন। তারা ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্রের
অধীনে প্রদেশগুলো তিন ভাগে বিভক্ত করার প্রস্তাব দেন: এ-পাঞ্জাব, সীমান্ত দেশ সিন্ধ ও বেলুচিস্তান, বি-বাংলা ও আসাম, সি-ভারতের অবশিষ্ট দেশসমহ। ভারত যুক্তরাষ্ট্রের অধীনস্থ এই তিনটি বিভাগ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পারে এবং ইচ্ছা করলে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বেরিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ঘোষণা করতে পারবে তাতে এই রকম প্রস্তাব ছিল। কেবিনেট মিশন ভারত বিভাগ ও পাকিস্তান প্রস্তাব সমর্থন করেনি। ১৯৪৬ সালের ৬ জুন দিল্লির ইমপেরিয়াল হোটেলে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে মুসলিম লীগের কার্যনির্বাহী ও কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও তার বোন শায়েস্তা সোহরাওয়ার্দী যোগদান করেন। সভায় কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। কেবিনেট মিশন প্রস্তাব গ্রহণে শহীদ সোহরাওয়ার্দী বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। এ সাফল্যে তিনি খুবই আনন্দিত হন।
১৯৪৬ সালের ৬ জুন লীগ কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব গ্রহণ করে। কারণ মন্ত্রিপরিষদ মিশনে লাহোর প্রস্তাবের স্বীকৃতি ছিল। কিন্তু কংগ্রেস মন্ত্রিপরিষদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে। পণ্ডিত নেহেরুর ১৯৪৬ সালের ১০ জুলাই তারিখের ভাষণ ঐক্যবদ্ধ ভারতের সম্ভাবনা পণ্ড করে দেয়। মওলানা আবুল কালাম আজাদের স্থলে ১৯৪৬ সালের ২৬ এপ্রিল জওয়াহের লাল নেহরুর কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে সম্পর্কের অবনতি হতে থাকে। নেহরু তার ভাষণে বলেছিলেন, কেন্দ্রীয় পরিষদে কংগ্রেস সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। তারা কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করতে পারবে। তারা গণপরিষদে যাবে মুক্ত স্বাধীন সদস্য হিসেবে। ১০ জুলাই তারিখে নেহরুর এই ভাষণ বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। মুসলিম লীগ নেহরুর ঘোষণায় ভীত হয়ে পড়ে এবং ২৮ জুলাই মুসলিম লীগ বোম্বে শহরে কাউন্সিল সভা ডাকে।
পৃষ্ঠা: ৪৩
কেবিনেট মিশন পাকিস্তান প্রস্তাব সুপারিশ না করায় মুসলিম লীগের সভায় তাদের পরিকল্পনা প্রত্যাখ্যান করা হয়।
কায়েদে আজমের রণ হুঙ্কার
বোম্বে কাউন্সিল সভায় কায়েদে আজম স্মরণ করিয়ে দেন যে, We have made a solemn declaration in this August and historic Convention that while we hope for the best, we are prepared for the worst.
দিল্লি কনভেনশনে জিন্নাহ বলেছিলেন, “আমরা সবচেয়ে ভালো আশা করি, আমরা সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত।”
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৬ আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করেন। ১৬ আগস্ট সকাল থেকে দাঙ্গা শুরু হয়। দাঙ্গা ২৪ আগস্ট পর্যন্ত চলে। দাঙ্গায় প্রায় ৫ হাজার হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়, শত শত লোক আহত হয়, ঘরবাড়ি পুড়ে ফেলা হয়, নারীরা নির্যাতিত হয়। কলকাতার দাঙ্গার পরে নোয়াখালী জেলায় দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। এ জেলায় মুসলমান দুবৃত্তরা হিন্দুদের ওপর আক্রমণ, হত্যা, লুট, নারী নির্যাতন করে। শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য মহাত্মা গান্ধী নোয়াখালী জেলায় এক মাস অবস্থান করেন। বিহার প্রদেশে দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে। হত্যা, লুট চলে। কলকাতা, নোয়াখালী ও বিহারে দাঙ্গার জন্য এককভাবে দায়ী মুসলিম লীগ সভাপতি মহম্মদ আলী জিন্না। তিনি দাঙ্গা করার জন্য মুসলমানদের উস্কানি দেন। তিনি যদি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারে যোগ দিতেন তাহলে ১৯৪৬ সালে দাঙ্গায় হাজার হাজার মানুষ নিহত হতো না। প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও মহাত্মা গান্ধী বাংলায় হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।
প্রত্যক্ষ দিবস পালনের জন্য নবাব খাজা নাযিমউদ্দিন, নবাব ইসমাইল ও চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে নিয়ে কমিটি অব অ্যাকশন’ গঠন করা হয়। মুসলিম লীগের স্লোগান ছিল ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান। ১১ ও ১২ আগস্ট খাজা নাযিমউদ্দিন ও পাঞ্জাবের রাজা গজনফর আলী বলেন, তাদের সংগ্রাম। ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে, দিল্লির সরকারের বিরুদ্ধে নয়। ফলে হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে আতঙ্ক সৃষ্টি হয় এবং তারাও প্রত্যক্ষ দিবস মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে।
১৬ আগস্ট পালনের জন্য সারা ভারতে মুসলমান সম্প্রদায় সব রকম প্রস্তুতি নিতে থাকে। কিন্তু একমাত্র বাংলা ছাড়া কোনো প্রদেশের প্রশাসন মুসলমানদের হাতে ছিল না। সিন্ধু, পাঞ্জাব ও সীমান্ত প্রদেশ মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা সত্ত্বেও
পৃষ্ঠা: ৪৪
সেখানে আবহাওয়া ছিল শান্ত। ১৬ আগস্ট ছুটির দিন ঘোষণা করা হলেও এ অঞ্চলে তা পালিত হয়নি। কারণ সিন্ধু সরকারের মুখ্য সচিব প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করার অনুমতি দেননি। দ্বিতীয়ত পাঞ্জাব ছিল ব্রিটিশ গভর্নর ইভান জেনকিসের সুদৃঢ় নিয়ন্ত্রণে। বাংলার প্রশাসন। বাংলা প্রশাসন ছিল মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার হাতে। প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ছিল প্রভাবশালী শাসক। গভর্নর বারোজের ব্যক্তিত্ব তার কাছে ম্লান। বাংলার রাজধানী কলকাতাসহ অন্যান্য অঞ্চলের মুসলমানদের ওপর তার ছিল অপরিসীম প্রতিপত্তি, কলকাতার লোকসংখ্যা ছিল তখন ৬০ লক্ষ। বাংলায় মুসলমানের ছিল তিন কোটি ত্রিশ লক্ষ। পক্ষান্তরে হিন্দু অন্যান্য জাতির লোকসংখ্যা দুই কোটি তিয়াত্তর লক্ষ পনের হাজার। ইংরেজদের সংখ্যা ছিল বিশ হাজার। শান্তি রক্ষার জন্য প্রধানমন্ত্রী ১৬ আগস্ট সাধারণ ছুটি ঘোষণা করেন এবং তা যথাযথভাবে পালিত হয়।
পাঞ্জাবের দাঙ্গা-গণহত্যা এবং দেশ ত্যাগ
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট ভারত বিভাগের সংবাদ শুনে ম্যানচেস্টার গার্ডিয়ান মন্তব্য করে: The Greatest disengagement in the history. ইতিহাসের সবচেয়ে বৃহৎ ব্যবচ্ছেদ। ” ভারত বিভাগের ফলে পৃথিবীর ইতিহাসে সর্ববৃহৎ মানুষের বাস্তুত্যাগ ঘটেছে। তাদের সংখ্যা হতে পারে ৩০ মিলিয়ন এবং ১ মিলিয়ন হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়েছে। অর্ধ মিলিয়ন নারী নির্যাতিত হয়েছে।
যখন ভারত ও পাকিস্তানের অধিকাংশ মানুষ শান্তিতে স্বাধীনতা দিবস উদ্যাপন করছে তখন পাঞ্জাবে চলছিল দাঙ্গা ও ভয়ঙ্কর পরিস্থিতি। স্বাধীনতা দিবসের বিকেলে পূর্ব পাঞ্জাবে একদল শিখ মুসলিম মহিলাকে ধর্ষণ করে তাকে নিয়ে উলঙ্গ মিছিল করে। ১৫ আগস্ট রাতে গুরুগুয়ারায় একদল মুসলমান শিখ মন্দিরে প্রবেশ করে অনেক শিখকে হত্যা করে স্তুপ করে রাখে।
স্বাধীনতার পূর্বে কেউ ভাবেনি যে এত বড় বর্বর দাঙ্গা হবে। দাঙ্গার প্রধান কারণ পাঞ্জাবে বেসামরিক সরকার ভেঙে পড়েছিল। বিশাল গ্রাম এলাকায় হত্যা, লুট, ধর্ষণ, অগ্নিসংযোগ চলে। সেনাবাহিনীর পক্ষে এ দাঙ্গা দমন করা সম্ভব ছিল।
১৯৪৭ সালের মার্চ মাসে স্যার খিজির হায়াত খানের মন্ত্রিসভার পদত্যাগের পর পাঞ্জাবে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়।
সেনাবাহিনীর কমান্ডার লিখেছেন, “১৫ আগস্ট পর্যন্ত সরকারের কাঠামো
পৃষ্ঠা: ৪৫
নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে। পশ্চিম পাঞ্জাবে তা প্রাথমিকভাবে ব্যর্থ হয়ে যায়। পূর্ব পাঞ্জাবে প্রকৃত অর্থে তা অকার্যকর ছিল।
পাঞ্জাবে পুলিশের ৭০-৮০ ভাগ মুসলমান ছিল। তারা দাঙ্গা উৎসাহিত করার অভিযোগে অমুসলমানরা কর্মকর্তারা তাদের নিরস্ত্র করে। ফলে তারা দায়িত্ব পালনে অস্বীকৃতি জানায়। পূর্ব পাঞ্জাবের একই ঘটনা। অমুসলমান পুলিশ পূর্ব পাঞ্জাবে চলে যায়।
১৯৪৭ সালের ১৫ আগস্ট পূর্ব পাঞ্জাবের জলন্ধর বিভাগে ৭০০০ পুলিশ চলে যায়। লাহোর অমুসলমান ও অমৃতসরে মুসলমান হত্যা চলছে। একই সাথে অসংখ্য অমুসলমান ত্যাগ করে ভারতে এবং পূর্ব পাঞ্জাবে মুসলমান সম্প্রদায় পাকিস্তানে আসে। পরিস্থিতি দিন দিন প্রাদেশিক বা কেন্দ্রীয় নেতাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান। জয়েন্ট ডিফেন্স কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মাউন্ট ব্যাটেন পরিস্থিতি শান্ত করার জন্য সৈন্য বৃদ্ধি করছেন। পূর্ব পাঞ্জাবের আম্বালা শহরে কাউন্সিল সভা হল। পদক্ষেপ নেওয়া হয়।
লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন লেখেন:
“দিল্লি থেকে ট্রেনে মুসলমান রিফিউজিদের লাহোর নিয়ে যেত। পথে পূর্ব পাঞ্জাবের দেশীয় করদ রাজ্য হতে শিখ যুবকেরা ট্রেনে হামলা করে মুসলমানদের হত্যা করতো।”
লক্ষ লক্ষ শরণার্থী সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে ও পাকিস্তানে আসছে। ভারতের শরণার্থীদের সেবক লেডি মাউন্টব্যাটেন সেবা করে প্রিয় হয়েছেন। দাঙ্গা দমনের জন্য ভারত ও পাকিস্তানের এমার্জেন্সী কমিটি ছিল। ভারতের জরুরি কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন মাউন্ট ব্যাটেন। দিল্লি ও পূর্ব পাঞ্জাবের সামরিক আইন জারি করার প্রস্তাব হয়। ব্রিটিশ জেনারেল লকহারট যার সামরিক প্রশাসক হবেন। প্রধানমন্ত্রী নেহরু ঘোরতর প্রতিবাদ করেন। সবশেষে তাকে বাদ দেওয়া হয়।
এ সময় ব্রিটিশ অফিসারের অবস্থা আরও দুঃখজনক ছিল। পণ্ডিত নেহরুর প্রতিক্রিয়া ছিল আরও দুঃখজনক। তিনি নিরপেক্ষ ইংরেজ অফিসারদের সামরিক আইন প্রশাসক না করে সাম্প্রদায়িক হিন্দুদের নিয়োগ দেন। ফলে দাঙ্গাকারীরা উৎসাহিত হয়।
নভেম্বরের মাঝামাঝি পায়ে হাঁটা শরণার্থীদের সংখ্যা একেবারে কমে যায়। ডিসেম্বর মাসে ভারত বা পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা, সংঘর্ষ সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে যায়। তবে পাকিস্তানে একটি ভয়াবহ ঘটনা হয়। ১৯৪৮ সালে জানুয়ারি মাসে ১৮৪ জন শিখ নর-নারী সিন্ধু হতে উদ্ধার করে করাচী আনা হয়। দলে দলে উগ্র মানুষ তাদের আক্রমণ করে ৬৪ জনকে হত্যা, অবশিষ্টদের আহত করে। জিন্নাহ
পৃষ্ঠা: ৪৬
এ খবর শুনে সেনাবাহিনীকে দেখামাত্র গুলির নির্দেশ দেন। পরিস্থিতি শান্ত হয়ে the era of large scale massacres and mass migration was virtually at the end . ব্যাপক হত্যাকাণ্ড এবং শরণার্থীদের আগমন প্রকৃতপক্ষে সমাপ্ত হয়েছে। তখন পুনর্বাসনের কাজ শুরু হয়।
১৯৪৭ সালে আগস্ট হতে নভেম্বর মাসে কত মানুষ নিহত হয়েছে তার সঠিক হিসাব পাওয়া অসম্ভব। তথ্য সংগ্রহ করা হয়নি। এক হিসেবে বলা হয়েছে, প্রায় দুই লক্ষ পুরুষ, নারী শিশু নিহত হয়েছে।
মুসলিম লীগ নেতা ও মাউন্ট ব্যাটেনের সাথে আলোচনার জন্য দেখা যায়। ভারতের বিভক্তির জন্য প্রত্যেকের যুক্তি হলো পাঞ্জাবের বিভক্তি। অর্থাৎ পাঞ্জাব ভাগ না হলে ভারত বিভক্তি হবে না। পাঞ্জাব ভাগ হলে ভারত ভাগ হবে। পোকায় খাওয়া পাকিস্তান এবং বিভক্ত পাঞ্জাব ইতিহাসের সবচেয়ে করুণ ট্র্যাজেডি সষ্টি করেছে। ১৯৩৬ সালে প্রাদেশিক নির্বাচনে পাঞ্জাবে মুসলিম লীগ ভালো করেনি। সংখ্যাগুরু আসনে ইউনিউনিস্ট পার্টি জয়লাভ করে। হিন্দু, শিখ ও মুসলমান মিলে ইউনিউনিস্ট পার্টি গঠন করে। স্যার সেকান্দর হায়াত খান মুসলিম লীগের সমর্থন ছাড়া ইউনিউনিস্ট সরকার গঠন করেন। স্যার ফজল হোসাইন ১৯২০ সালে ইউনিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন।
১৯৪২ সালে স্যার সেকান্দার হায়াত মৃত্যুবরণ করেন। স্যার খিজির হায়াত তিওয়ালা প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। স্যার খিজির হায়াত প্রতিরক্ষা কাউন্সিলরের সদস্য হলে জিন্নাহর সাথে তার বিরোধ শুরু হয়। ১৯৪৪ সালে মুসলিম লীগ খিজির হায়াতকে বহিষ্কার করে। ১৯৪৬ সালের নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৮৬টি আসনের মধ্যে ৭৯টি আসনে জয়লাভ করে। পরিশেষে খিজির হায়াত-শিখ আকালী, কংগ্রেস ও ইউনিউনিস্ট পার্টি যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মুসলিম লীগ যুক্ত মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে ব্যাপক আন্দোলন শুরু হয়। সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় ৫০০০ মৃত্যু এবং ৩০০০ গুরুতর আহত হয়। খিজির হায়াত দাঙ্গা পরিহার করার জন্য তিনি তার ইউনিয়নিস্ট সদস্যদের নিয়ে মুসলিম লীগে যোগ দেন এবং মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য গভর্নরের নিকট অনুরোধ জানায়। ভাইসরয় এবং গভর্নর দেখলেন সাম্প্রদায়িক সরকার গঠিত হলে দাঙ্গা বৃদ্ধি পাবে। এ কারণে। ৯৩ ধারা জারি করে গভর্নর পাঞ্জাবের শাসনভার নিজ হস্তে গ্রহণ করে। তিনি পাঞ্জাব বাউন্ডারি ফোর্স দিয়ে শান্তি রক্ষার চেষ্টা করেন।
ভয়ংকর ছয় সপ্তাহ ধরে মধ্যযুগের প্লেগ সংক্রামক ব্যাধির ন্যায় খুনের নয়া উত্তর ভারতের ওপর দিয়ে ঝড়ের ন্যায় বয়ে যায়। এ অভিশাপ থেকে ম্যানিয়া উত্তর ভারতের ওপর দিয়ে ঝড়ের ন্যায় বয়ে যায়। এ অভিশাপ থেকে
পৃষ্ঠা: ৪৭
কোনো পবিত্র স্থান রক্ষা পায়নি। কোনো স্থান এ সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা পায়নি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে চার বছরে যত আমেরিকান নিহত হয়েছে তাঁর অর্ধেক এ সংক্রামিক ব্যাধিতে ভারতে নিহত হতে পারে। কাণ্ডজ্ঞানহীন হত্যাকাণ্ড, ধর্ষণ, লণ্ঠন চলছে দিল্লি, নয়াদিল্লি, চাদনীচক, পূর্ব পাঞ্জাবের অমৃতসর। পশ্চিম পাঞ্জাবের লাহোর, পিণ্ডি সর্বত্র। ভারত বিভাগের দুষ্টচক্র ছিল। পক্ষান্তরে একই মায়ের গর্ভের সন্তান র্যার্ডক্লিফ সার্জারি করে দ্বিখণ্ডিত করেছে পাঞ্জাব। কিন্তু যে টিউমার থেকে গেল তা ক্যান্সারে পিরণত হয়েছে। ক্যাসারের সেল ছড়িয়ে পড়েছে। পাঞ্জাবের উভয় অঞ্চলের মানুষ আক্রান্ত ক্যাম্পারে। একদিকে পঞ্চাশ লক্ষ হিন্দ-শিখ এবং অন্যদিকে পঞ্চাশ লক্ষ মুসলমান। মুসলমানরা ধরে নিয়েছে তারা পশ্চিম পাঞ্জাবের রাজা এবং শিখরা মনে করছে পূর্ব পাঞ্জাবের তাদের শিখ রাজ্য। ১৯৪৭ সালের আগস্ট-ডিসেম্বর শিখ জাতি যে বর্বরতা দেখিয়েছে তা বিশ্ব বিবেককে হতবাক করেছে।
সিমলার অবস্থাও তাই। মাউন্ট ব্যাটেনের প্রেস এটাচির স্ত্রী মিসেস ক্যামবেল জনসনের সামনে অমানুষিক হত্যাকাণ্ড ঘটেছে। তিনি এ দৃশ্য দেখে অসুস্থ হয়ে পড়েন। তিনি দেখলেন খুন হয়ে যাওয়া এক মুসলমানের ফেজ টুপি পরা খুনি। সিমলার সিসিলা হোটেলের বারান্দা থেকে তিনি দেখেন খোলা তরবারি নিয়ে শিখ যুবক বলছে, আমি আরও খুন করব। পাঞ্জাবের এমন কোনো গ্রাম নেই যেখানে সংখ্যালঘুরা নিহত, আহত বা উদ্বাস্তু হয়েছে। তবে যেখানে শিখ বেশি সেখানে। তারা সুশৃঙ্খলভাবে মুসলমান হত্যা করেছে। তেমনি লাহোরে মুসলমান যুবকেরা হত্যা করে, গান গেয়ে শিখদের হত্যা করে। তাদের হত্যার প্রধান অস্ত্র ছিল তরবারি। মোগল আমল থেকে শিখ জাতি মুসলমান বিদ্বেষী। তাই তারা পূর্ব পাঞ্জাব ও ভারতের বিভিন্ন স্থানে মুসলমান হত্যা করে আনন্দ প্রকাশ করে। লাহোরে শেখুপুরা শহরে একটি গুদামে হিন্দু ও শিখ ঢুকিয়ে এক সিপাহি মেশিনগান দিয়ে তাদের হত্যা করে। ইংরেজ অফিসাররা মুসলমান সৈন্যদের বর্বরতায় হতভম্ব হয়ে যায়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে তারা এ রূপ বর্বরতা দেখেনি। নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক রবার্ট টার্নবুল এক প্রতিবেদনে লেখেছেন, “মানুষের এই নীচ হত্যা প্রবৃত্তি দেখে এত বিচলিত হয়ে যাই এরূপ স্থূপাকারে মৃতদেহ কখনও দেখিনি। এ দেশে তখন বৃষ্টির জলের মতো রক্তের বন্যা হয়েছে। আমি এমন হাজার হাজার মানুষের লাশ দেখেছি যাদের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে বা হাত পা কেটে ফেলা হয়েছে। হাতুড়ি বা পাথর দিয়ে কিশোর বা শিশুদের হত্যা করা হয়েছে। তাদের কোনো হিসাব নেই। যারা মারা যায়নি তাদের অর্ধমৃত লাশ রাস্তায় ফেলে রাখা হয়েছে, যাতে তারা রোদে বা মাছির কামড়ে মরে যায়।”
পৃষ্ঠা: ৪৮
দুই জঙ্গি সম্প্রদায়ের মধ্যে পাশবিক অত্যাচারের প্রতিযোগিতা চলছে। পাঞ্জাবে সিমান্ত রক্ষী বাহিনীর একজন ব্রিটিশ অফিসার একদিন আবিষ্কার করলেন, একটি শিখ গ্রামের চারটি মুসলমান শিশুকে শূকরের ছানার ন্যায় আগুনে সেঁকা দিচ্ছে।আর একজন ইংরেজ অফিসার দেখতে পেল যে, হিন্দু পাড়ায় ঢুকে স্তন কেটে হত্যা করছে মুসলমান দুবৃত্তরা। কখনও হত্যা না করে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হতো। লায়ালপুরে ৩০০ হিন্দু চাষি ইমামের নিকট ধর্মান্তরিত ও গো মাংস খেয়ে বেঁচে যায়। কিন্তু তাদের প্রতিবেশী বাহ্মণ ধর্মান্তরিত বা গো মাংস খায়নি। ব্রাহ্মণ ছুরি দিয়ে নিজের স্ত্রী, শিশু কন্যাকে হত্যা করে নিজে আত্মহত্যা করেছে।
শিখ বা হিন্দুদের সম্পত্তি, টাকা, অলঙ্কার দখল করার জন্য মুসলমানরা চড়াও হয়েছে। শিয়ালকোটের নিকটে একটি গ্রামে ধনী সুদখোর মহাজন প্রেম সিং। তিনি সুদের ব্যবসা করতো। মুসলমানরা তাকে ঘৃণা করতো। স্বাধীনতার দ-একদিন পরে মুসলমানরা তার বাড়ি ঘেরাও করে। তিনি সিন্দুক খুলে দোতলায় উঠেন। তিনি বুঝতে পারলেন তারা লুট করতে এসেছে। তার স্ত্রী ধর্ষিত হবার পূর্বে মেয়েকে গায়ে কেরোসিন ঢেলে দিয়ে আত্মহত্যা করে। শিখ এবং স্ত্রীসহ তিন কন্যা পুড়ে মারা যায়। শিখ ভাবতে পারেনি তার স্ত্রী এমন চরম সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে। লাহোরের কুলদীপ দেখেছেন তাদের গ্রামের শিখরা কীভাবে হত্যা করছে। আগুনে পুড়ে মেরেছে। তা তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন। তিনি একটি গাছে পালিয়ে থেকে বীভৎস্য দৃশ্য দেখেছেন। জীবন্ত নারী-পুরুষ শিশুদের আগুনে পুড়িয়ে মেরেছে। তার বাবা-মাকে পুড়িয়ে ফেলছে। দুবৃত্তরা চলে গেলে কুলদীপ সীমান্তে চলে যায়।
ইয়াকুবের একই অভিজ্ঞতা। বালক ইয়াকুব খেলছে। দেখলো কয়েকজন শিখ অস্ত্র নিয়ে তাদের মাটির ঘর আক্রমণ করে। ইয়াকুব পাশে আখ ক্ষেতে আশ্রয় নেয়। তার মা বোনদের টেনে বের করে আনে। মেয়েদের স্তন কেটে দেয়। যন্ত্রণায় তারা ছোটাছুটি করছে। তাদের শিখরা ধর্ষণ করছে। ইয়াকুবের বাবা তরবারি নিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করছে। তার পিছে শিখরা কুকুর লেলিয়ে দেয়। তারা ইয়াকুবের বাবাকে ধরে ফেলে। তাকে গাছের সাথে বেঁধে টুকরা টুকরা করে কেটে কুকুরকে দিয়ে খাওয়ায়। ইয়াকুব টহলদার গাড়িতে উঠে সীমান্ত পাড়ি দেয়।
ব্রিটেনে শ্রমিক সরকারের প্রধানমন্ত্রী মি. এটলী ভারত ছাড়ার নির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে চায়। কিন্তু ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল রাজি নয়। কারণ হিন্দুমুসলমানের মধ্যে সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠা না করে ভারত পরিত্যাগ করা সঠিক হবে না।
পৃষ্ঠা: ৪৯
তাহলে হিন্দু-মুসলমানদের মধ্যে দাঙ্গা হতে পারে। ভারতবাসীর হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ব্রিটেন ভারত ত্যাগ করবে। কিন্তু লর্ড ওয়াভেল একমত নয়।
The Great Divide গ্রন্থে এইচ ভি হডসন লিখেছেন:
Lord Wavell was not convinced. He still argued that if communal difficulties lead to violence history would not forgive the British. The British had governed India for over a hundred years and they would be responsible if unrest, violence and disorder broke out as a result of their withdrwal, when he found that he could not convince Mr. Attle. Lord Wavell offered his resignation.
“লর্ড ওয়াভেল রাজি হলেন না। তিনি এখন যুক্তিতর্ক করছেন যে, সাম্প্রদায়িক কারণে দাঙ্গা শুরু হয় তা হলে ইতিহাস ব্রিটিশকে ক্ষমা করবে না। ব্রিটেন একশ’ বছরের ঊর্ধ্বে ভারত শাসন করেছে। যদি তাদের ভারত ত্যাগের ফলে বিশৃঙ্খলা, সন্ত্রাস এবং দাঙ্গা শুরু হয় তাহলে তারা দায়ী হবে। যখন তিনি দেখলেন যে তিনি লর্ড এটলীকে বাধ্য করতে পারছেন না তখন লর্ড ওয়াভেল পদত্যাগ করেন।”
শরণার্থী শিবির
ভারত থেকে মুসলমান পাকিস্তান থেকে হিন্দু-শিখ বাস্তুত্যাগ করে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। অবর্ণনীয় দুঃখকষ্টে বাস করছে তারা। দেশ বিভাগের ফলে দেড় কোটি মানুষ গৃহহারা হয়ে শিবিরে আশ্রয় নিয়েছে। ধনী গরিব এক হয়েছে। বিশ্বের বৃহত্তম উদ্বাস্তু সমস্যা। আর্তমানুষে সেবায় মহাত্মা গান্ধী এগিয়ে আসেন। তিনি সমস্যা সমাধানের জন্য অনশন পালন করছেন। তিনি আগস্ট মাসে কলকাতায় অবস্থান করে বাংলায় শান্তি টিকিয়ে রাখেন। ১৯৪৭-৪৯ পর্যন্ত উভয় বাংলায় কোনো দাঙ্গা হয়নি। গান্ধী-সোহরাওয়ার্দী শান্তি প্রতিষ্ঠার কারণে বাংলায় দাঙ্গা হয়নি। তবে বিহার প্রদেশে ব্যাপক দাঙ্গা হয়েছে। বিহার থেকে কয়েক লাখ মুসলমান পূর্ব বাংলায় চলে আসে। ভারতের পূর্ব পাঞ্জাব, দিল্লি, মধ্যপ্রদেশ, যুক্ত প্রদেশ বিহার প্রভৃতি প্রদেশে ব্যাপক দাঙ্গা হয়েছে। লাখ লাখ বাস্তত্যাগী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থান নেয়। পাকিস্তান সরকার রিফিউজি পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় চালু করে। তেমনিভাবে পশ্চিম পাঞ্জাব, সীমান্ত ও সিন্ধু প্রদেশ থেকে বাস্তুত্যাগীরা ভারতে বিভিন্ন স্থানে আশ্রয় নেয়। শরণার্থী শিবিরে সেবা করে যে মহীয়সী নারী স্মরণীয় হয়ে আছেন তিনি হলেন মিসেস এডুনা মাউন্ট ব্যাটেন। রাতের কয়েক
পৃষ্ঠা: ৫০
ঘন্টা ঘুম ব্যাতিত তিনি দিনে রাতে উল্কার বেগে এক শিবির থেকে আরও এক শিবিরে ছুটে বেড়িয়েছেন। অন্যদিকে তার স্বামী গভর্নর জেনারেল মাউন্ট ব্যাটেন দাঙ্গা প্রতিরোধ ও শরনার্থীদের দেখাশোনা করে নিজকে উৎসর্গ করেছেন। দেশ বিভাগের কালো দিনগুলিতে বিয়াসা নদীতে ভীষণ বন্যা হয়। এ সময় মার্কিন লেখিকা মার্গারেট বুক হোয়াইট ইরাবতী বা রাভি নদীর তীরে শরণার্থী শিবির পরির্দশন করেছিলেন। বন্যার সময় এক সেনা কর্মকর্তা তাকে উদ্ধার করে নিয়ে জায়।দু দিন পর ফের এসে দেখেন ৪ হাজার উদ্বাস্তুর মধ্যে এক হাজার জীবিত আছে।আর তিন হাজার লোক নিহত হয়েছে। মনে হলো যুদ্ধক্ষেত্রে হাজার হাজার লাশ পরে আছে। এই বিয়োগান্ত দৃশ্য দেখার নয়- ভুলবার নয়। একদিকে মানুষগুলো পশু হয়ে জীব হত্যা করছে। অন্যদিকে প্রকৃতি নির্মম।
১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবে গণহত্যায় শিখ সম্প্রদায় নিকৃষ্ট ও পশুতল্য আচরণ করেছে।মুসলমান সম্প্রদায় ছিল তাদের জাত শত্রু। মোগল শাসন থেকে শিখদের গুরু ও শিখ সম্প্রদায় নির্যাতিত হয়েছে। মোগলদের পতন হলে পাঞ্জাবে শিখ রাজ্য গড়ে ওঠে। ১৮৪৯ সালে ইংরেজদের সাথে শিখরা পরাজিত হলে শিখদের পতন হয়। ১৯৪৭ সালে জুলাই মাসে ভারতের ৬০ লাখ শিখদের মধ্যে ৫০ লাখ পাঞ্জাবে বাস করতো। পাঞ্জাবের লোক সংখ্যার ১৩ ভাগ ছিল শিখ। কিন্তু তারা পাঞ্জাবের ৪০ ভাগ ভূমির মালিক ছিল। তারা পাঞ্জাবের দুই-তৃতীয়াংশ ফসল উৎপাদন করত। ভারতীয় সেনাবাহিনীর এক-তৃতীয়াংশ শিখ প্রথম ও দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পদকপ্রাপ্ত সৈন্যদের মধ্যে অর্ধেক শিখ। পাঞ্জাবের ট্র্যাজেডি হলো শিখ-মুসলমান ইংরেজদের অধীনে বাস করলেও তারা একে অন্যের অধীনে বাস করবে না। শিখ রাজত্বকালে মুসলমানদের ওপর ব্যাপক নির্যাতন হয়েছে। তারা তা ভোলেনি। তেমনি শিখরা মোগল শাসন ভোলেনি। দুই সম্প্রদায় একে অন্যের প্রতি শত্রুভাবাপন্ন ছিল। তাদের মধ্যে পুরাতন শত্রুতা ১৯৪৭ সালে আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে জাগ্রত হল এবং তা গণহত্যার আকার ধারণ করে।
Freedom at Midnight গ্রন্থে ল্যারি কলিন্স এন্ড ডমিনিক লাপিয়ার বলেন:
The tragedies of partition would not have been complete had they not been accompanied as every conflict since the dawn of histrory by an outpouring of sexual savagery. Nearly all of the atrocities cursing the unhappy province were embellished by their orgy of rape. Tens of thousounds of girls and women were seized urom refugee columns, from crowded trains, from isolated village, in the most wide scale kidnapping of modern times.
দেশ বিভাগের করুণ অধ্যায়ের সমাপ্তি হয়েছে নারী নির্যাতন দিয়ে। ইতিহাসের সৃষ্টি থেকে দেখা যায় প্রত্যেকটি যুদ্ধে অসংখ্য ধর্ষণের, বর্বরোচিত ঘটনা ঘটে অসংখ্য প্রদেশে (পাঞ্জাব) যেখানে নির্যাতন হয়েছে – প্রায় সকল ক্ষেত্রে ধর্ষণের উৎসব হয়েছে। হাজার হাজার বালিকা এবং নারী শরণার্থীর শিবির,ট্রেন, গ্রাম থেকে জোর করে ধরে নিয়ে আসতো।
দেশ বিভাগের ফলে নিহতদের সংখ্যা
১৯৪৭ সালের আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে দাঙ্গায় কত লোক নিহত হয়েছে তাঁর কোনো সঠিক হিসেব নেই। যারা দেশত্যাগ করেছে তাদের মধ্যে কতজন পথে বা ট্রেনে নিহত হয়েছে তার পরিসংখ্যান সংগ্রহ করা হয়নি। দেশত্যাগীদের হিসাব নেই। শরণার্থী শিবির থেকে যাদের ধরে নিয়ে গেছে তাদের হিসেব নেই। যারা মারা গেছে তাদের গণকবর দেওয়া হয়েছে। ১৯৪৭ সালে গণহত্যা হয়েছে। যে তথ্য পাওয়া গেছে, তার মধ্যে কিছু অতিরঞ্জিত আছে আবার তথ্য সংগত হয়নি। অনেকে মনে করে পাঞ্জাবের দাঙ্গায় ১০ লাখ লোক নিহত হয়েছে। তবে অনেকই বলেছে, ৫ বা ৬ লাখ হিন্দু-মুসলমান নিহত হয়েছে। আবার অনেকে বলেছেন, ২ বা ৩ লাখ লোক নিহত হয়েছে।
১৯৪৭ সালের দাঙ্গার নির্ভরযোগ্য তথ্য পাওয়া যায় বিচারপতি গোপাল দাশ খোসালা রচিত ইস্টার্ন রেকর্ডিং গ্রন্থে। তিনি প্রথম গণহত্যার একটি সঠিক চিত্র দেবার চেষ্টা করেছেন। বিচারপতি খোশালের মতে, সেদিনের গণহত্যায় নিহতের সংখ্যা পাঁচ লাখ হবে। অবশ্য দুজন ব্রিটিশ ঐতিহাসিক গবেষকের মতে এ সংখ্যা দুই লাখ থেকে আড়াই লাখ হতে পারে। অন্য গবেষক লা ডি হকসন্স তার লেখা দি গ্রেড এড লাইড গ্রন্থে বলেছেন, নিহতদের সংখ্যা আড়াই লাখ। স্বাধীন ভারতের পূর্ব পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার চণ্ডু লাল ত্রিবেদীর হিসেবে গণহত্যার সংখ্যা ২ লাখ ২০ হাজার। নিহত মানুষের সঠিক সংখ্যা জানা না গেলেও শরণার্থী আগমনের সঠিক সংখ্যা অন্তত জানা যায়। শরণার্থীদের স্রোত শরৎকাল ও শীতকালে চলতে থাকে। এক সপ্তাহে ৫ লাখ পরের সপ্তাহে সাড়ে সাত লাখ মানুষ। এ দেশে এসেছে। এভাবে মোট এক কোটি পাঁচ লাখ, বাংলাদেশের দশ লাখ। পাঞ্জাবের এই ভয়াবহ শরণার্থী সমস্যা অনিবার্যভাবেই সর্বশেষ ভাইসরয় এবং ভারতীয় নেতাদের কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ছিল। সারা ইংল্যান্ডে নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। ইংল্যান্ডের সাবেক প্রধানমন্ত্রী উইনস্টন চার্চিল ভারতকে স্বাধীনতা দেবার বিপক্ষে ছিলেন। তিনি জনগণের দৃশ্য দেখে লন্ডন থেকে চাপা সন্তুষ্ট নিয়ে সমালোচনা করে বলেন যে, জনগণ বংশ পরম্পরায় ব্রিটিশের মহান, ধৈর্যশীল, নিরপেক্ষ শাসনাধীনে বসবাস করেছে। তাঁর আজ নর খাদকের শ্ত্রুতা নিয়ে এক অন্যের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছে।
অক্টোবর মাসের প্রথমে ক্লিমেন্ট এটলী লর্ড ইসমেকে জিজ্ঞেসা করলেন- ব্রিটেন কি ভুল সদ্ধান্ত নিয়েছে- তড়িঘড়ি করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। তিনি একটি অসম্ভব প্রশ্ন করছেন। যার উত্তর দেওয়া সম্ভব ছিল না। এটলী বলছেন, কি ঘটেছে, কি ঘটেছে কি ঘটতে পারতো। দুর্যোগ থেকে ভারতকে রক্ষার জন্য দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তর প্রয়োজন ছিল। এ পরিস্থিতি থেকে দেশকে বাঁচাবার জন্য ভাইসরয় এ ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিলেন। একটি বিষয় নিশ্চিত ছিল যে ভারতের নেতৃবৃন্দ একমাত্র মাউন্ট ব্যাটেনকে তার পরিকল্পনা দ্রুত বাস্তবায়ন করতে বলেননি। তারা তাকে এ পদ্ধতি চাপিয়ে দিয়েছিল। অতি দ্রুত ছিল সে চুক্তির সারবস্তু। জিন্নাহ এ পরিকল্পনা পুনরাবৃত্তি করত। স্পীড ছিল প্রধান বক্তব্য। বল্ললভভাই প্যাটেল দর কষাকষি করে যে কংগ্রেস কমনওয়েলথের সদস্য পদ গ্রহণ তবে যদি তৎক্ষণাৎ ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়। নেহরুর সব সময় ভাইসরয়কে হুশিয়ার করে বলতেন, সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিলম্ব হলে ভারত গৃহযুদ্ধের সম্মুখীন হতে পারে। এমনকি গান্ধী যে দেশ বিভাগের বিরোধী ছিলেন তিনিও মাউন্ট ব্যাটেনের নকট দাবি করেন যে অতিসত্ত্বর ভারত ছেড়ে যেতে হবে। মাউন্ট ব্যাটেনের পূর্বসূরি লর্ড ওয়াভেন একইভাবে দ্রুত ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি করছেন। পাগলা ঘরের অস্ত্রোপচার করার জন্য প্রযয়োজন বোধে প্রদেশের পর প্রদেশ হতে ইংরেজদের ভারত ত্যাগের প্রস্তাব দিয়েছিলেন। মাউন্ট ব্যাটেন নিজেও এ পরিকল্পনায় বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি জানতেন যে, ১৯৪৭ সালে ভারতকে দেখেছেন অরাজক ও বিশৃঙ্খল দেশে। বিকল্প কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করলে দেশে গৃহযুদ্ধ ছড়িয়ে পড়বে। সে বিদ্রোহ দমনের জন্য সম্পদ বা ইচ্ছা ব্রিটিশ সরকারের ছিল না। দেশ বিভাগের চুক্তি পাঞ্জাবে যে সহিংসতা সৃষ্টি করেছিল তা মাউন্ট ব্যাটেন বা তার পরামর্শক কল্পনা করতে পারেননি। প্রদেশের আইনশৃঙ্খলা রক্ষার জন্য ৫৫ হাজার সীমান্ত রক্ষী বাহিনী সৃষ্টি করা হয়েছিল। তা নজিরবিহীন ভয়াবহ ঘটনায় সে শক্তি পরাভূত হয়েছিল। যা হোক যত বীভৎস এর বিস্তৃত হোক না কেন তা ভারতের একটি প্রদেশে সীমাবদ্ধ ছিল। সারা ভারতের জনসংখ্যার দশ ভাগের এক ভাগ লোক সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় জড়িত ছিল। এর বিকল্প পদক্ষেপ সর্বভারতকে পাঞ্জাবের ন্যায় দাঙ্গা সৃষ্টি করতে পারতো।
দেশ বিভাগের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত লাখ লাখ শরণার্থীদের পুনর্বাসনের জন্য দীর্ঘস্থায়ী। তারা স্বাধীনতার মূল্য দিয়েছে। আজ অনাগত বছরগুলোর জন্য ছাপ রেখে যাবে। পক্ষান্তরে এক শরণার্থী শিবিরে বন্দি, হতাশাগ্রস্ত মানুষগুলোর।
পৃষ্ঠা: ৫৩
কোনো এক ইংরেজ অফিসার দেখে চিৎকার করে বলছে, ইংরেজ রাজত্ব ফিরিয়ে দাও।
ব্রিটিশ শাসনের মূল স্তম্ভ ছিল ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসের কর্মকর্তাগণ যাদের আইসিএস বলা হয়। ২০০০ ইংরেজ অফিসার এবং ১০০০০ ইংরেজ সেনা অফিসার ভারতের ৩০ কোটি মানুষকে শাসন করত। এ সময় ৬০ হাজার ব্রিটিশ সৈন্য এবং ২০০০০০ ভারতীয় সৈন্য ছিল। ১৮৫৭ সাল হতে এরা ভারত শাসন করছে।
১৯১৮ সাল হতে ভারতীয়দের আইসিএস চাকরিতে প্রবেশের অধিক পায়। ১৯৪৭ সালে ১ জানুয়ারি ভারতে ১০০০ ইংরেজ আইসিএস অফিস ছিল।
১৯৪৭ সালে পাঞ্জাবের জনসংখ্যা ছিল মুসলমান ৬ কোটি, হিন্দু ১ কোটি ৫ লাখ এবং শিখ ৫০ লাখ।
বাংলা
বাংলার হিন্দু-সম্প্রদায় ১৯৪৬ সালে গ্রেট ক্যালকাটা কিলিং ও নোয়াখালীর দাঙ্গার বেদনা ভুলতে পারেনি। তাই তারা বাংলা বিভাগ চায়। সোহরাওয়ার্দী কয়েকজন হিন্দু নেতাদের নিয়ে বৃহত্তর বাংলার স্বাধীনতা দাবি করেন।
সোহরাওয়ার্দী ভাইসরয়কে বলেছিলেন তাকে সময় দেওয়া হলে তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের বাইরে ঐক্যবদ্ধ রাখতে পারবেন। জিন্নাহ অবিভক্ত স্বাধীন বাংলা সমর্থন করেন। গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ স্বাধীন বাংলা সমর্থন করেন। কংগ্রেস নেতা কিরণ শংকর রায় প্রস্তাব দেন যে যুক্ত নির্বাচন হলে হিন্দুরা বৃহত্তর বাংলা মেনে নেবে। কিন্তু যুক্ত নির্বাচনের প্রস্তাব নিয়ে কোনো পক্ষ অঙ্গীকার করেনি। ক্ষমতা হস্তান্তরের মূল পরিকল্পনায় ছিল বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র। হিসেবে সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারবে। কিন্তু পণ্ডিত নেহরুর এই শর্তের ঘোর বিরোধী ছিলেন। তিনি ভারতকে বলকান বানাতে দিবেন না। ভাইসরয় সিমলা থেকে ফিরে এসে দিল্লিতে প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমানের সঙ্গে দেখা করে বলেন, সংশোধিত ক্ষমতা হস্তান্তরের দলিলে প্রদেশের স্বাধীনতার কোনো শর্ত নেই। প্রদেশের সীমানা পরিবর্তনের কিছু উল্লেখ আছে। ভাইসরয় বলেন, যদি বাংলার আইনসভা বাংলার স্বাধীনতার পক্ষে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তাহলে তিনি গভর্নরের সুপারিশের আলোকে বিবেচনা করবেন। স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা নিয়ে সোহরাওয়ার্দী, কিরণ শংকর রায় ও শরশ্চন্দ্র বসুর সাথে আলোচনা করছেন। এ ব্যাপারে অগ্রগতি হয়েছে। সোহরাওয়ার্দী আশান্বিত।
পৃষ্ঠা: ৫৪
তাঁর সোসালিস্ট সাধীন বাংলা দাবি করেন। ভাইসরয় বলেন, তাহলে কমনওয়েলথ সদস্য পদ লাভে জটিলতা হতে পারে। ভাইসরয় সোহরাওয়ার্দীকে হুঁশিয়ার করে দেন যে পণ্ডিত নেহরু চাচ্ছেন যে বাংলা ভারতের সাথে যুক্ত থাকলে তাঁর বিষয়টা দেখবেন। তবে তার ধারণা পূর্ব বাংলা কয়েক বছরের মধ্যে ভারতে ফিরে আসবে। মাউন্ট ব্যাটেন সোহরাওয়ার্দীকে পরামর্শ দেন যে তিনি যদি বাংলায় যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারেন তাহলে তিনি জাতীয় নেতাদের এবং গান্ধীকে স্বাধীন বাংলার পক্ষে বুঝাতে সক্ষম হবেন।
লন্ডন থেকে ফিরে এসে মাউন্টব্যাটেন হোসেন শহীদকে ব্যক্তিগতভাবে ডেকে বাংলার পরিস্থিতি জানতে চাইলেন। ভাইসরয় জেনে বিপর্যস্ত হলেন যে কিরণ শংকর রায় কংগ্রেসকে স্বাধীন বাংলার পক্ষে আনতে পারেননি। সোহরাওয়ার্দী দাবি করেন যে যদি বাংলা বিভক্ত হয় তাহলে কলকাতাকে মুক্ত বন্দর করতে হবে। তা না হলে কলকাতা শহরে দাঙ্গা ও সম্পদের ক্ষতি হবে। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ভিপি মেননকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী প্যাটেলের নিকট প্রেরণ করেন কলকাতাকে ৬ মাসের জন্য যৌথ নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য। প্যাটেলের উত্তর ছিল Not even for six hours-এমনকি ৬ ঘণ্টার জন্য নয়।
১৯৪৭ সালের ৩ জুনের পরিকল্পনায় বাংলার জন্য বিশেষ কোনো ব্যবস্থা ছিল না। পাঞ্জাবের আইনসভা বিভাগ সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করে। ২০ জুন বাংলার আইনসভার নির্বাচনে বৃহত্তর বাংলার পক্ষে ১২৬ ভোট এবং বিপক্ষে ৯৫ ভোট। পশ্চিম বাংলার এমএলদের নিয়ে পৃথক নির্বাচন হয়। সেখানে ৫৮ ভোট বিভাগের পক্ষে এবং বিপক্ষে ২১ ভোট। পূর্ব বাংলায় সংখ্যাগুরুদের ভোটের ফলাফল অকার্যকর হয়। বাংলা ভাগ হবে।
ভি এইচ হডসন বলেন, Thus in the end it was the Hindus and the Congress who decided upon the partition of Bengal which their forebearers had so bitterly opposed.
পরিশেষে বাংলার হিন্দুরা ও কংগ্রেস বাংলা বিভক্তির সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যা তাদের পূর্বপুরুষরা কঠিনভাবে বিরোধিতা করেছিল।
খ. লাহোর প্রস্তাব-১৯৪০
১৯৪০ সালে পাঞ্জাবের রাজধানী লাহোর শহরে নিখিল ভারত মুসলিম লীগের বার্ষিক সম্মেলন মুহম্মদ আলী জিন্নাহর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। পাঞ্জাবের প্রধানমন্ত্রী স্যার সেকান্দার হায়াত খান ও তাঁর সরকার পাঞ্জাবের শহীদগঞ্জের
পৃষ্ঠা: ৫৫
মসজিদ শিখদের ছেড়ে দেয়। শিখেরা এ মসজিদকে ‘গুরুদ্বার বলে দাবি করে এবং তাদের পক্ষে হাই কোর্ট ও প্রিভি কাউন্সিল রায় দেয়। আল্লমা মাশরেকঈর খাকছার দল ১৯৪০ সালের ২১ মার্চ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মসজিদটি দখল করতে যায়। সৈন্যবাহিনী গুলি করে অনেক মুসলমান হত্যা করে। পাঞ্জাবের মুসলমান সম্প্রদায় স্যার সেকান্দার হায়াত সরকারের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে এ রকম বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে মুসলিম লীগের সম্মেলন হওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ে। ফজলুল হক লাহোর পৌছে খাকছারদের সাথে সাক্ষাৎ করেন। খাকছার তাঁকে বিপুলভাবে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে মিয়া আব্দুল আজিজ এমএলএ’র বাড়ি পৌছে দেয়। ফজলুল হক লাহোর সম্মেলনে পৌছলে উপস্থিত জনতা শেরে বাংলা জিন্দাবাদ’ ধ্বনি দিয়ে একযোগে উঠে দাঁড়ায় বক্তৃতারত জিন্নাহ তাঁর বক্তৃতা বন্ধ করতে বাধ্য হন। আধঘণ্টা পর্যন্ত শ্লোগান চলে। তারপর ফজলুল হক গ্রহণ করলে জিন্নাহ বলেন, “বাঘকে খাঁচায় পোরা হয়েছে, এবার শান্ত হোন কাজ আরম্ভ করুন। পুষ্পমাল্য দিয়ে ফজলুল হককে ডুবিয়ে দেওয়া হয়। জিন্নাহ অসমাপ্ত ভাষণ শুরু করলে জনতা শেরে বাংলার বক্তৃতা শুনতে চান। তিনি জনতাকে শান্ত করলে তার দ্বি-জাতিতত্ত্ব উত্থাপন করেন। ভারতে নেতারা যখন একমত হয়ে প্রস্তাব তৈরি করতে ব্যর্থ হন তখন ফজলুল হকই প্রস্তাব তৈরি করেন। ফজলুল হক উত্থাপিত বিখ্যাত ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব নিম্নে উদ্ধৃত হলো।
Resolved that it is the considered view of this session of the All-India Muslim League that no constitutional plan would be workable in this country or acceptable to the Muslims unlese it is designed on the following basic principles view. That geographically contiguous units are demarcates into regions which should be grouped to constitute independent states in which the constituent units shall be autonomous and sovereign: That adequate, effective and mandatory safeguards should be specifically provides in the constitution for minorities in the units and are the regions for the protection of their religious cultural, economic, political, administation and other rights and interests in consultation with them and in other parts of India where the muslims are in a minority adequate, effective and mandatory safeguards shall be specially provided in the constitution for them and other minorities for the protection of their religions, cultural economic, political administrative and other rights and interests in consultation with then.
This session further authorises the working committee to frame a scheme of constitution in accordance with these basic principles, providing for the assumption finally by the respective regions of all powers such as defence, external affairs, communications, customs and such other matters as may be necessary.
“নিখিল ভারত মুসলিম লীগের অত্র অধিবেশন এই মর্মে অত্যন্ত সুচিন্তিত
অভিমত প্রকাশ করছে যে নিমোক্ত মৌলিক আদর্শসমূহকে ভিত্তি হিসেবে না করে অপর যে কোনো নীতি ও আদর্শের ভিত্তিতে প্রণীত শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনা কার্যকরী এবং মুসলমানের জন্য গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হবে না। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ তথা এ দেশের কয়েক কোটি মুসলমান দাবি করছে যে, যেসব এলাকা একান্তভাবেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ, যেমন, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত এলাকা এতে ভারতের পূর্বাঞ্চল; প্রয়োজন অনুযায়ী সীমানার রদবদল করে ঐ সকল এলাকাকে ভৌগোলিক দিক দিয়ে এককভাবে পুনর্গঠন করা হোক, যাতে স্বাধীন ও স্বতন্ত্র স্টেটস হিসেবে সংশ্লিষ্ট অঞ্চলদ্বয় সম্পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত ও সার্বভৌমত্বের মর্যাদা লাভ করতে পারে। এই অধিবেশনে লাহোর প্রস্তাবটি সমর্থন করেছিলেন যুক্ত প্রদেশের চৌধুরী খালেকুজ্জামান। প্রস্তাবটি সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হয়। লাহোর প্রস্তাবই পাকিস্তান প্রস্তাব নামে আখ্যায়িত হয়। লাহোর অধিবেশনে আরও দাবি করা হয় যে, ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনে ফেডারেশনের যে পরিকল্পনা করা হয়েছে তা গ্রহণযোগ্য নয় এবং ভারত শাসন আইন পুনর্বিবেচিত না হলে ভারতীয় মুসলমানদের সম্মতি ছাড়া প্রণীত অপর কোনো পরিকল্পনা মুসলমানের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না।”
লাহোর প্রস্তাবে ভারতের পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ বাংলা-আসাম নিয়ে একটি স্বাধীন দেশ গঠনের পরিকল্পনা ছিল। ১৯৪৬ সালের ৮ এপ্রিল পশ্চিমাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চল রাষ্ট্রসমূহের পরিবর্তে দুই ইউনিট নিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এমনিভাবেই বাঙালিদের বঞ্চিত করার হয়। তারপর লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি দীর্ঘ ২৩ বছর সংগ্রাম করে ১৯৭১ সালে বঙ্গবন্ধু মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের জন্ম দেয়।
লাহোর প্রস্তাবে একাধিক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব ছিল- উত্তর-পশ্চিম
পৃষ্ঠা: ৫৭
অঞ্চলে একটি এবং এবং পূর্ব অঞ্চলে একটি। লাহোর প্রস্তাবে পাকিস্তান শব্দ ব্যবহার করা হয়নি।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালে স্বৈরাচারে ভূমিকায় অবতীর্ন হন। ভাইসরয় ভারতীয় নেতাদের নিয়ে ওয়াল কাউন্সিল গঠন করেন। ভাইসরয়ের আহ্বানে পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী সেকান্দায় হায়াত খান,আসামের মুখ্যমন্ত্রী স্যার সাদুল্লাহ, বাংলার প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল, বেগম শাহনেওয়াজ ওয়ার কাউখলে যোগ দেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ তাদের সকলকে ডিফেন্স কাউন্সিল হতে পদত্যাগ করতে বলেন। আসাম ও পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করেন। ফজলুল হক জিন্নাহর স্বেচ্ছাচারিতার প্রতিবাদ করে ডিফেন্স কাউন্সিল ও মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য পদ ত্যাগ করেন। স্যার সেকান্দার হায়াত পাঞ্জাবের আইন সভায় ঘোষণা করেন।
We do not ask for freedom, that there may be a Muslim Raj here and Hindu Raj elsewhere. If that is what Pakistan means l will have nothing to do with it. If you want real freedom for the Panjab then that Panjab will not be Pakistan, but just Panjab, the land of the five rivers, Panjab is Panjab and will always remain Panjab.
আমরা স্বাধীনতা চাই না। এখানে একটি মুসলিম রাজ্য অন্য স্থানে হিন্দু রাজ্য হবে। তার অর্থ যদি পাকিস্তান হয় তার সাথে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। আপনারা যদি পাঞ্জাবের প্রকৃত স্বাধীনতা চান তাহলে সে পাঞ্জাব পাকিস্তান হবে না। এক মাত্র পাঞ্জাব থাকবে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলার ফজলুল হক মন্ত্রিসভার পতনের জন্য ষড়যন্ত্র করেন। তিনি ফজলুল হককে বিশ্বাস করতেন না।
এ কে ফজলুল হকের দ্বি-জাতিতত্ত্বের বিরোধিতা
ফজলুল হক দ্বি-জাতিতত্ত্ব ভিত্তিক পাকিস্তান দাবির বিরোধী ছিলেন। ১৯৪২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি নয়া দিল্লিতে মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় ফজলুল হকের আচরণের সমালোচনা করে প্রস্তাব গৃহীত হয়। জিন্নাহর পরামর্শ অনুযায়ী বাংলা মুসলিম লীগ ফজলুল হকের বিরুদ্ধে অভিযোগ শুরু করে। স্টেটসম্যান কাগজে শায়েদ নামক একজন লেখক প্রতি সপ্তাহে ‘দারুল ইসলাম’ নামক প্রবন্ধে পাকিস্তান প্রস্তাবের বিরোধিতা করায় ফজলুল হকের সমালোচনা করতেন। ১৯৪৩ সালের ১ জানুয়ারি তারিখেও একটি প্রবন্ধে ফজলুল হকের সমালোচনা করা হয়। ৩ ফেব্রুয়ারি পত্রিকায় ফজলুল হক এই অভিযোগের উত্তর দেন। এ
পৃষ্ঠা: ৫৮
ঐতিহাসিক পত্রে তিনি খুব সতর্কতার সাথে পাকিস্তান প্রস্তাবের মুল উদ্দেশ্যকে আক্রমণ করে বলেন।
“১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ পাকিস্তান প্রস্তাব গ্রহনের পর আমি এই প্রস্তাবের বিরুদ্ধে মন্তব্য করা ত্থেকে বিরত থাকি। আমি তখন থেকে উপলব্ধি করেছিলাম যে, তাত্ত্বিকরা পাকিস্তান প্রস্তাব সম্পর্কে বিভিন্ন সময় এমন সব উদ্ভট চিন্তাধারা প্রচার করেছেন জার ফলে জটিলতা বৃদ্ধি পেয়েছে…আমি অনুভব করছি পাকিস্তান সম্পর্কে অসত্য ধারণা সৃষ্টি করে বাংলার মুসলমানদের প্রতারিত করা হয়েছে। আমি স্বেচ্ছায় মৌনব্রতী হয়েছি। কারন আমার মন্তব্য হয়তো ভুল ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। আমি এমন কিছু বলিনি যাতে পাকিস্তান মতবাদের বিরুদ্ধাচারন বলে অভিহিত করা যায়। তা সাম্প্রতিককালে এ পরিকল্পনা সম্পর্কে যেসব মন্তব্য করা হয়েছে সে বিষয়ে আমি একটি মন্তব্য করতে চাই – আমাদের মনে রাখতে হবে, ভৌগোলিক দিক থেকে বাংলার সংলগ্ন তিনটি প্রদেশ আছে যথাঃ আসাম, বিহার ও উড়িষ্যা। যথাক্রমে আসাম, বিহার ও উড়িষ্যার মুসলমান জনসংখ্যার আনুপাতিক হার হলো ৩৫%, ১০%, ৪%। সুতরাং এটা পরিষ্কার যে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থাকে মেনে নিয়ে ভৌগোলিক দিক থেকে সংলগ্ন প্রদেশগুলোসহ স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা সম্ভব নয়। যদি বাংলাদেশকে দু’ভাগে বিভক্ত করতে হয় তবে তার ফল হবে এই যে, পূর্বাঞ্চল প্রধানত মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা হবে, তাকে এমন চারটি প্রদেশ ঘিরে রাখবে যেখানে হিন্দুরা সংখ্যাগরিষ্ঠ থাকবে। অতএব, বাংলার মুসলমানদের এই বলে ধোঁকা দেওয়ার কোনো অর্থ হয় না যে, এর ফরমুলা পাঞ্জাব ও বাংলা উভয় অঞ্চলের পক্ষে শুভ হবে। বাংলার মুসলমানরা উপলব্ধি করেছে যে, তাদের স্বার্থ সমগ্র ভারতের সঙ্গে যুক্ত। আমরা এই ভেবে কায়দে আজমের ওপর নির্ভর করেছিলাম যে, তিনি পাকিস্তান প্রস্তাব এমনভাবে পরিবর্তন করবেন যাতে বাংলার মুসলমানেরা অন্যান্য প্রদেশের মতো মুসলমানের সঙ্গে আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার অর্জন করতে পারে।’ ফজলুল হক সর্বপ্রথম পাকিস্তান প্রস্তাবের ক্রটি উল্লেখ করে এবং বাঙালি মুসলমানদের দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করেন।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক
মুসলিম লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বদমেজাজী, উন্মাদ ও স্বৈরাচার ছিলেন। তার বিরুদ্ধে কোনো মুসলিম নেতা সমালোচনা করার শক্তি ছিল না একমাত্র বাংলার প্রধানমন্ত্রী জিন্নাহকে প্রকাশ্যে সমালোচনা করেছেন। তার
পৃষ্ঠা: ৫৯
একনায়কতন্ত্রের প্রতিবাদ করে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ১৯৪১ সালে মুসলিম লিগের কার্যকরী কমিটি এবং ওয়ার কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন। তিনি জিন্নাহর মধ্যযুগীয় আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে মুসলিম লীগ ত্যাগ করেন। তিনি ইচ্ছা করলে জিন্নাহর আচরণ মেনে নিয়ে বাংলার প্রধানমন্ত্রী থাকতে পারতেন। তিনি ছিলেন দুর্জয় সাহসী- স্বাধীনচেতা তাই মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত মন্ত্রীসভা পরিত্যাগ করে হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেসের সাথে প্রগতিশীল মন্ত্রীসভা গঠন করেন। শেরেবাংলা ছিলেন মহাত্মা গান্ধীর ভারত ছাড় আন্দোলনের প্রতি সহানুভূতিশীল, তাই তিনি ইংরেজদের কংগ্রেসের প্রতি দমন নীতির সমর্থন করেননি। তিনি ভারতীয়দের স্বাধীনতা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে ইংরেজদের দমননীতির প্রতিবাদ করেন এবং আইনসভায় ইংরেজদের দমননীতির করে প্রধানমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করেন। তার নিকট ইংরেজ গভর্নর হারবাট কৈফি তলব করলে তিনি বলেছিলেন- I owe you no explanation whatsoever আমি আপনার নিকট কোনো ব্যাখা দিতে বাধ্য নই।
তিনি প্রগতিশীল মন্ত্রিসভা গঠন করে ১৯৪৩ সালের ২৯ মার্চ পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিলেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ষড়যন্ত্র করছেন বাংলায় মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা গঠন করবে। জিন্নাহ ইংরেজ সরকারের সাথে ষড়যন্ত্র করে প্রধানমন্ত্রী এ কে ফজলুল হককে কৌশলে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। আইনসভায় তার সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও বাংলার গভর্নর হারবার্ট মুসলিম লীগের খাজা নাজিমউদ্দিনকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আহ্বান জানান। মুসলিম লীগ শাসনে বাংলায় পঞ্চাশের দুর্ভিক্ষ হয়। প্রায় পঞ্চাশ লক্ষ মানুষ দুর্ভিক্ষে মৃত্যুবরণ করেন। বাংলার মন্ত্রিসভা ও জিন্নাহর ভূমিকার কঠোর সমালোচনা করে ফজলুল হক। আইনসভায় ১৯৪৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এক যুগান্তকারী ভাষণ দেন। তিনি আইনসভায় বলেন:
“I have said that there is constitutionally speaking, no Government in Bengal. Apparently, there is a government functioning under the Act of 1935. … But what actually are the facts? According to the Act of 1935 there should be complete democracy, wherever provincial autonomy is functioning, in which there should be government of the people, by the people and for the people. This is, however, not the case in Bengal. Here the ministers are not responsible to the Legislature at all, but are responsible to Mr. Jinnah the head of the Muslim League, So long
পৃষ্ঠা: ৬০
as the ministers have the approval of Mr. Jinnah they need not concern, themselves about the views of the individual men, because they know that the views of the individual members, supporting them do not care for the opinions of their constituencies but are anxious to secure the good opinion of Mr. Jinnah. This may sound surprising but it is nevertheless a fact.”
বলেছি যে, শাসনতান্ত্রিকভাবে বললে বাংলায় কোনো সরকার নেই। আপাতত ১৯৩৫ সালের আইনে একটি সরকার কাজ করছে।… কিন্তু প্রকৃত ঘটনা কই ? ১৯৩৫ সালের আইনে সম্পূর্ণ গণতন্ত্র থাকতে হবে। যেখানে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন চলছে, সেখানে সরকার হবে জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য। কিন্তু বাংলায় তা সত্য নয়। এখানে মন্ত্রীরা আদৌ আইনসভার নিকট দায়ী নয়, তারা মুসলিম লীগ প্রধান জিন্নাহর নিকট দয়ী। মন্ত্রীরা যতক্ষণ জিন্নাহর সমর্থন পাবে, ততক্ষণ নির্বাচনী কেন্দ্রে জনগণের প্রয়োজন হয় না। যারা তাদের সমর্থন করে তাদের নির্বাচনী কেন্দ্রের জনগণের মতামত প্রয়োজন হয় না। তারা জিন্নাহর ভালো মতামত পাওয়ার জন্য উদ্বিগ্ন। এ বিস্ময়কর মনে হতে পারে কিন্তু ইহাই সত্য।”
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ-শেরেবাংলার দ্বন্দ্ব
১৯৩৭ সালে কৃষক-প্রজা পার্টির নেতা কংগ্রেসের সাথে বাংলায় যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনের প্রস্তাব দেন। কিন্তু কংগ্রেসের চিরাচরিত নেতিবাচক রাজনীতির কারণে বাংলায় কংগ্রেস-প্রজা পার্টির যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করা সম্ভব হয়নি। অথচ বাংলায় যদি কংগ্রেস-কৃষক প্রজা পার্টির যুক্ত মন্ত্রিসভা হতো তাহলে বাংলা হতো ভারতের নমস্য। মহাত্মা গান্ধী, নেহেরু ও সর্দার প্যাটেল কংগ্রেস বাংলায় মন্ত্রিসভা গঠন করতে এগিয়ে আসেনি। কংগ্রেসের উচিত ছিল শেরেবাংলার ন্যায় একজন অসাম্প্রদায়িক দক্ষ নেতার সাথে ১৯৩৭ সালে মন্ত্রিসভা গঠন করা। কংগ্রেস ঠেলে দিল শেরেবাংলাকে জিন্নাহর মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা করতে। কংগ্রেস তার ভুল রাজনীতির কারণে ভারতে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি শক্তিশালী হতে থাকে। যেহেতু তিনি মুসলিম লীগের সাথে মন্ত্রিসভা গঠন করেছেন, সে কারণে তিনি ১৯৩৮-৩৯ সালে কংগ্রেস শাসিত ৭টি প্রদেশের কংগ্রেস মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ এনেছেন। কংগ্রেস তাকে সাম্প্রদায়িক বলেছে। মুসলিম লীগ রাজনীতির কারণে দলের পক্ষে তিনি ১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করেন। জিন্নাহ সুকৌশলে বাংলার প্রধানমন্ত্রীকে দিয়ে লাহোর প্রস্তাব বা মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রস্তাব পাঠ করান।এ সময় এ কে ফজলুল হক ছিলেন উপমহাদেশের সবচেয়ে বড় মুসলিম নেতা। সুতরাং জিন্নাহ তাকে ব্যবহার করে তার পাকিস্তান দাবিকে এগিয়ে নিয়ে যান।
পরবর্তীতে ফজলুল হক লাহোর প্রস্তাব থেকে বেরিয়ে আসেন। তিনি যদি লাহোর প্রস্তাবের প্রতি অবিচল থাকতেন তাহলে তিনি জিন্নাহ্র আদেশ অমান্য করে ভাইসরয়ের ওয়ার কাউন্সিলে যোগ দিতেন না। ওয়ার কাউন্সিলে যোগদান নিয়ে মুসলিম লীগ সভাপতি জিন্নাহর সাথে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হতেন না। তিনি ১৯৪১ সালে মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি হতে পদত্যাগ করতেন না। তিনি জিন্নাহর সাম্প্রদায়িক নেতা হতেন তাহলে হিন্দু মহাসভার নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির সাথে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করতেন না। কংগ্রেস এ সময় ফজলুল হকের সাথে ঐক্যমত পোষণ করে তার মন্ত্রিসভায় যোগদান করতে পারত। কিন্তু কংগ্রেসের একগুয়েমী ও অপরিপক্ক রাজনীতির কারণে ফজলুল হক বিচ্ছিন্ন ও একাকী হয়ে পড়েন। কংগ্রেস তাকে দূরে রাখায় পরবর্তীকালে তিনি ভারত কালে বিভাগ কালে তাকে আদৌ মূল্যায়ন করা হয়নি। অথচ তিনি ছিলেন জিনাহর চেয়ে প্রতিভাবান রাজনীতিবিদ। মুসলিম লীগের ভারতের কোনো নেতা জিনাত বিরুদ্ধাচরণ করতে সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেননি। ভারতের প্রায় সকল নেতা জিন্নাহর আজ্ঞাবহ ছিলেন। একমাত্র বাংলার বাঘ, তার স্বৈরাচারী আচরনে তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।
১৯৪১ সালে এ কে ফজলুল হক বড়লাটের জাতীয় প্রতিরক্ষা পরিষদে যোগদান করলে জিন্নাহ তার বিরুদ্ধ প্রতিশোধ নিতে এগিয়ে আসেন। হক-জিন্নাহ বিরোধের মূল কারণ দুই নেতার রাজনৈতিক জীবনের নীতিগত বৈষম্য। ভারতীয় মুসলমানদের স্বার্থ রক্ষার ব্যবস্থা করাই জিন্নাহর একমাত্র লক্ষ্য। তিনি প্রাদেশিক মুসলমানদের স্বার্থের গুরুত্ব দিতেন না। তিনি মুসলিম লীগে একনায়কত্ব প্রতিষ্ঠা করেন। মুসলিম লীগ ছিল মেরুদণ্ডহীন দল, তারা সকল সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল দায়িত্ব জিন্নার ওপর ন্যস্ত করে। ফজলুল হক ভারতীয় মুসলিম জাতীয়তায় বিশ্বাসী হয়েও তিনি বাঙালি জাতীয়তায় বিশ্বাসী ছিলেন। এ অবস্থায় জিন্নাহর সাথে তার বিরোধী অনিবার্য ছিল। ভাইসরয়ের প্রতিরক্ষা পরিষদে নিয়োগের বিষয় নিয়ে জিন্নাহর সাথে বাংলার প্রধানমন্ত্রীর বিরোধ চরমে পৌঁছে। ১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়। যুদ্ধকালে প্রশাসন চালাবার জন্য ভাইসরয় ওয়ার কাউন্সিল গঠন করেন। তিনি প্রাদেশিক প্রধানমন্ত্রীদের ১৯৪১ সালের মে মাসে সদস্য করেন। জিন্নাহ ওয়ার কাউন্সিল পছন্দ করতেন না। তাই তিনি মুসলিম লীগ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর নিয়োগের বিরোধিতা করেন। জিন্নাহ মুসলমান সদস্যদের পদত্যাগের নির্দেশ দেন।ফজলুল হক জিন্নাহর নির্দেশে পদত্যাগ না করে প্রতিবাদ জানায়। জিন্নাহ ফজলুল হককে মুসলিম থেকে বহিষ্কার করেন। ১৯৪১ সালের ১৬ আগস্ট সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে ফজলুল হক বলেন, ‘এ ব্যাপারে আমি পরিষ্কারভাবে বলতে চাই যে, মি. জিন্নাহ কর্তৃক আমার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ সম্পূর্ণ অনিয়মতান্ত্রিক এবং স্বেচ্ছাচারমূলক।“ ১৯৪১ সালের ৮ মুসলিম লীগ সেক্রেটারী নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের নিকট লেখা পত্রে ফজলুল হক বলেন “আমি মুসলিম সংখ্যালঘিষ্ঠ প্রদেশের নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে, তারা যদি সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশের রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করেন তাহলে তা তারা করবেন ভারতের সমগ্র মুসলমানদের স্বার্থ বিপন্ন করে। আমার পক্ষে আমি বলতে পারি, আমি বাংলার ৩৩ মিলিয়ন মুসলমানদের স্বার্থ কখনো বাইরের,তিনি যত শক্তিশালী হোক না কেনো নেতার নেতৃত্বাধীনে নিয়ে যেতে দেব না। “
উপরে বর্ণিত কারণে আমার পক্ষে লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ও কাউন্সিলর সদস্য থাকা সম্ভব নয়। লীগ সভাপতিকে যথেচ্ছ ক্ষমতা প্রয়োগ করার অধিকার দেয়ার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে আমি নিখিল ভারত মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটি ও কাউন্সিলের সদস্য পদ থেকে পদত্যাগ করছি।…
পদত্যাগ করতে যেয়ে আমি বলতে চাই যে, বাঙালি জাতির প্রতিভা চিরদিনই ব্যক্তিবিশেষের স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে আসছে। কাজেই আমিও যখন আমার চিঠিতে দেশের স্বার্থজনিত পরিস্থিতি সম্পর্কে আলোচনা করছি তখন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ প্রধানের (জিন্নাহ) স্বেচ্ছাচারিতার বিরুদ্ধে আপত্তি না জানিয়ে পারিনি। সাম্প্রতিক ঘটনাবলী আমার মনে এ ধারণা সৃষ্টি করেছে যে, মুসলিম ভারতের স্বার্থ নিখিল ভারত মুসলিম লীগের গণতান্ত্রিক ও আত্মনিয়ন্ত্রণের নীতি এমন একজন ব্যক্তির খামখেয়ালির ওপর নির্ভর করছে, যিনি বাংলার তিন কোটি ৩০ লাখ মুসলমানের ভাগ্য নিয়ে একজন অমিত প্রতাপশালী মধ্যযুগীয় খামখেয়ালি বাদশার ন্যায় স্বেচ্ছাচারিতামূলক আচরণ করে ভারতীয় মুসলিম রাজনীতির শীর্ষস্থান দখল করতে চায়, যে বাংলায় চিরদিন ভারতীয় মুসলমানের মধ্যে শীর্ষস্থান দখল করে আসছে। একদিকে বাংলাদেশের মুসলমানদের জীবন রক্ষা করা, যা আমার কাছে ছিল প্রধান কর্তব্য; অন্যদিকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে একতা রক্ষা করা- এ দুটোর মধ্যে প্রথমটাকে শ্রেয় বলে মনে করেছিলাম- এ ছিল আমার অপরাধ।”
মুসলিম লীগ সেক্রেটারী লিয়াকত আলী খানের কাছে লিখিত পত্রের জবাবে ১৯৪১ সালের ১২ সেপ্টেম্বর জিন্নাহ পত্রিকায় বিবৃতি প্রদান করে বলেন,
পৃষ্ঠা: ৬৩
“আমাকেসহ সকলের ওপর তার (ফজলুল হক) অকস্মাৎ আক্রমণ অপ্রত্যাশিত।” ফজলুল হকের চিঠির কারণে মুসলিম লীগ সর্বত্র প্রতিবাদ জানায়। ১৯৪১ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি একটি প্রস্তাব করে ফজলুল হককে ১০ দিনের মধ্যে এসব অভিযোগ প্রত্যাখ্যান ও কুৎসা প্রচারের জন্য দুঃখ প্রকাশ করতে বলে। ১৪ সেপ্টেম্বর ফজলুল হক এক পত্রে লীগ সম্পাদক লিয়াকত আলী খানকে লেখেন:
But before I conclude I wish to record as most emphatic protest against the manner in which the interests of the Moslems of Bengal and the Punjab are being imperilled by Moslems leades of the provinces where the Moslems are in a minority popularly known among Moslems as the minority provinces of India.
For my part, I will never allow the interest of 33 millions of the Moslems of Bengal to be put under the domination of any outside authority, however, eminent it may be.
“সমাপ্তির পূর্বে আমি সংখ্যালঘু প্রদেশের নেতারা যেভাবে মুসলিম বাংলা ও আজ পাঞ্জাবের স্বার্থ জলাঞ্জলি দিচ্ছে আমি তার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি। আমার পক্ষে আমি কখনো বাংলার ৩৩ মিলিয়ন মুসলমানের স্বার্থে অন্য কেনো বহিঃশক্তি তা যত শক্তিশালী হোক না কেন তাদের পদানত হতে দিব না।
” কাউকে আঘাত দেওয়া বা কারও বিরুদ্ধে নিন্দা প্রচার করা তার উদ্দেশ্য ছিল না। তবে জিন্নাহ তাকে বিশ্বাস করতে পারেননি। ফজলুল হকের প্রতি গোপন সতর্ক দৃষ্টি রাখার জন্য জিন্নাহ হাসান ইস্পাহানিকে নিয়োগ করেন। ইস্পাহানি বলেন, ফজলুল হক লীগের প্রতি কেবল মৌখিক সমর্থন করেন। তার পত্রিকা দৈনিক নবযুগ লীগের বিরুদ্ধে প্রচার করছে। জিন্নাহ বুঝতে পেরেছেন যে, ফজলুল হক কোনো প্রকারে তাকে বাংলার রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করতে দেবেন না।এ অবস্থায় বাংলার জিন্নাহপন্থিদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই বিবেচনা করে তিনি। ফজলুল হককে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে এবং মুসলিম লীগ থেকে সরিয়ে দেওয়ার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ফজলুল হক বাধ্য হয়ে ১৯৪১ সালের ১৮ অক্টোবর ওয়ার কাউন্সিল থেকে পদত্যাগ করেন। এভাবে তিনি মহম্মদ আলী জিন্না ও মুসলিম লীগের স্বেচ্ছারিতা থেকে সরে আসেন। শেরে বাংলা একে ফজলুল হক দ্বিজাতিতত্তের ভিত্তিতে রচিত লাহোর প্রস্তাব বা পাকিস্তান দাবি নিয়ে রাজনীতি করেননি।
পৃষ্ঠা: ৬৪
গ অখণ্ড স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গথনের উদ্যোগ -১৯৪৭ ও পরিণতি
স্বাধীন-সার্বভৌম বৃহত্তর বাংলা আন্দোলন
ভারত বিভগের পূর্ব মুহূর্তে শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দুটো অভিযোগের সম্মুখীন হতে হয়। প্রথম অভিযোগ তিনি মহাত্মা গান্ধীর হাতে হাত মিলিয়েছেন। ভারত উপমহাদেশের তথা অবিভক্ত বাংলার হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে দাঙ্গা প্রতিরোধ করে শান্তি স্থাপনের জন্য গান্ধীর সাথে সহজোগিতা করেছেন। তার বিরুদ্ধে দ্বিতীয় অভিযোগ তিনি স্বাধীন বহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা করেছেন। ভারতের অন্যান্য অঞ্চল হতে বাংলার ইতিহাস, ভাষা, কৃষ্টি, সমাজ ও অর্থনীতি স্বতন্ত্র বিধায় তিনি হিন্দু-মুসলমানের ঐক্যের ভিত্তিতে স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র সষ্টি করতে চেয়েছিলেন।
১৯৪৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি ভারতের ভাইসরয় লর্ড ওয়াভেল ব্রিটিশ সম্রাটের পক্ষে ঘোষণা করেন যে, ১৯৪৮ সালের জুন মাসের মধ্যে শাসন ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে অর্পণ করা হবে। ১৯৪৭ সালের ২৪ মার্চ লর্ড উন্টব্যাটেন গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ভারতে ব্রিটিশ সরকারের শেষ ভাইসরয় বা গভর্নর জেনারেল। তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের সাথে আলাপ-আলোচনা করে ভারত বিভক্ত ও পাকিস্তান সৃষ্টির প্রস্তাব মেনে নেন। ইংরেজ সরকার বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তি করার সিদ্ধান্ত নেয়। ১৯৪৭ সালের মে মাসে লর্ড মাউন্টব্যাটেন হিন্দু মহাসভার শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, কংগ্রেসের প্যাটেলের ওপর তার প্রভাব বিস্তার করে পাঞ্জাব ও বাংলাকে বিভক্ত করার ব্রিটিশ সিদ্ধান্ত কার্যে পরিণত করার জন্য তার কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি ১৯৪৭ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে বঙ্গভঙ্গের দাবি জানিয়ে এক বিবৃতি দেন। ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি আচার্য কৃপালিনী ড. শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জির দাবি সমর্থন করেন। কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা মিলিতভাবে বঙ্গভঙ্গের দাবিতে আন্দোলন শুরু করে। বাংলার প্রধানমন্ত্রী কেবিনেট মিশনের প্রস্তাবের আলোকে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা দাবি করেন এবং বঙ্গভঙ্গের প্রবল বিরোধিতা করেন। ১৯৩৭ সাল থেকে ১৯৪৬ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে মুসলমানগণ প্রশাসন যন্ত্র নিয়ন্ত্রণ করে। ফজলুল হক, খাজা নাযিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভায় হিন্দু মন্ত্রী থাকলেও তারা কংগ্রেস থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন। কংগ্রেস কোনো সময়ই কৃষক প্রজা পাটি ও মুসলিম লীগের সাথে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনে রাজি হয় নি। সুতরাং প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্নতা এবং ১৯৪৬ সালের দাঙ্গার জন্য হিন্দু সম্প্রদায় বঙ্গভঙ্গ দাবি এবং
পৃষ্ঠা: ৬৫
পশ্চিম বাংলাকে ভারতের অধীন একটি পৃথক প্রদেশ গঠনের আন্দোলন আরম্ভ করে।
১৯৪০ সালের ২৩ মার্চ তারিখে গৃহীত লাহোর প্রস্তাবে পূর্বাঞ্চলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকা বাংলা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের পরিকল্পনা অন্তর্ভুক্ত ছিল। তার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান রেনেসাঁ সোসাইটি নামে একটি সংগঠন ১৯৪৪ সালে আসাম-বাংলা প্রদেশ নিয়ে ইস্টার্ন পাকিস্তান দাবি করে। পাকিস্তান দাবির সমর্থক করাচির ‘দি ডেইলি ডন’ পত্রিকা ১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট তারিখের সংখ্যায় বাংলা-আসামকে অখণ্ড পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করে মানচিত্র প্রকাশ করে। মূলত ১৯৪০ সাল থেকে আসাম-বাংলা নিয়ে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের প্রচেষ্টা চলে। মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবি করলেও বঙ্গীয় মুসলিম লীগ প্রথমে অবিভক্ত বাংলার স্বাধীনতা আন্দোলন সমর্থন করে। মুসলিম লীগের নেতা মওলানা আকরম খাঁ ও খাজা নাযিমুদ্দিন বিভক্ত ভারতে অবিভক্ত বাংলা দাবি করেন। তারা অবিভক্ত বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। হিন্দু মহাসভা ও কংগ্রেস নেতাদের বঙ্গভঙ্গের দাবির প্রেক্ষিতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ৯ এপ্রিল দিল্লিতে সাংবাদিকদের সাথে আলোচনা প্রসঙ্গে অবিভক্ত স্বাধীন বাঙলার দাবি উত্থাপন করেন। সোহরাওয়ার্দী বঙ্গভঙ্গ দাবির বিরুদ্ধে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, “আমি বরাবরই যুক্ত বাংলা ও বৃহত্তর বাংলার পক্ষে। আমি যথাসময়ে বিষয়টির উপর বিস্তারিত আলোকপাত করে। একটি বিবৃতি দেব এবং তাতে প্রমাণ করব যে বঙ্গ বিভাগ বাঙালি হিন্দু-মুসলিম -তফসিলি সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলের জন্য আত্মহত্যারই শামিল হবে। আমি জানি যে, যারা এ জিগির তুলেছেন তারা মতলবি প্রচারণায় সিদ্ধহস্ত। তারা আন্দোলন গড়ে তুলতে, সে আন্দোলনে গতিবেগ সঞ্চার করতে, এমন কি শুভবুদ্ধিসম্পন্ন হিন্দুদের বিভ্রান্ত করে সে আন্দোলনে তাদের সমর্থন আদায় করতেও কোনো কসুর করবেন না। তবে আমি এখনো আশা করি একদিন-না একদিন শুভবুদ্ধির জয় হবেই, তাই আমি আশা করব, নিজের নাক কেটে পরের যাত্রা ভঙ্গের চেষ্টা করার আগে তারা অবশ্যই একটি সন্তোষজনক মীমাংসায় উপনীত হবার চেষ্টা করবেন এবং সকলের সম্মিলিত প্রয়াসে বাংলাকে একটি মহান দেশ এবং বাঙালিদের একটি মহান জাতিতে পরিণত করার আদর্শে উদ্বুদ্ধ হবেন।”
স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব
এস, এইচ. সোহরাওয়ার্দী বিশ্বাস করতেন বাংলা বিভক্ত হলেও দাঙ্গা আরও বৃদ্ধি পাবে। তাই তিনি হিন্দু-মুসলমানের মিলনের দূত হিসেবে ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন বাংলা
পৃষ্ঠা: ৬৬
দাবি করেন। ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল তিনি প্রকাশ্যে বৃহত্তর বাংলার দাবি করলেও ১৯৪৬ সাল সাল থেকেই অবিভক্ত স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দেখছিলেন। বাংলার গভর্নর স্যার ফ্রেডরিক ব্যারোজ তার সাথে একমত ছিলেন এবং বাংলাকে বিভক্ত না করার জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে বারবার অনুরোধ জানান। প্রথমদিকে – গভর্নর ব্যারোজও শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রস্তাবকে সমর্থন করেছিলেন। পরে কংগ্রেস সভাপতি পণ্ডিত জওয়াহেরলাল নেহেরু, হিন্দু মহাসভা নেতা শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেলের বিরোধিতায় মাউন্ট ব্যাটেন বাংলা বিভক্তির প্রস্তাব বাস্তবায়ন করেন। বাংলা বিভক্ত হলে পূর্ব বাংলার ভবিষ্যৎ কি হবে, সে সম্পর্কে গভর্নর বারোজ বলেছেন, “এটা এত নিশ্চল এবং দরিদ্র হবে যে শেষে এটা পরিণত হবে একটি পল্লী বস্তিতে। অর্থনৈতিক দিক দিয়ে এটা বেঁচে থাকতে পারে না।“ কারণ সকল কয়লার খনি, খনিজদব্য, কলকারখানা, এমন কি দুটো বাদে সকল পাটকল পশ্চিম বাংলায় অবস্থিত। পূর্ব বাংলার খাদ্য ঘাটতি দাড়াবে ২২৫০০০ টন। যদি পূর্ব বাংলাকে সঠিককভাবে খাওয়াতে হয়, তবে কমপক্ষে ৮ লক্ষ টন খাদ্য আমদানি করতে হবে। পর্ব বাংলার একমাত্র ফসল পাট। তারা এখন পাটের পরিবর্তে খাদ্যশস্য উৎপাদনের দিকে যাবে। যদিও তার ফলে কলকাতার পাটকলগুলো ধ্বংস হয়ে যাবে।
প্রথমে গভর্নর জেনারেল মাউন্টব্যাটেন অবিভক্ত বাংলার পক্ষে ছিলেন এবং আশা করেছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টা সফল হবে। এ আশা নিয়ে তিনি গভর্নর বারোজকে লিখেছিলেন, “তার স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা অর্জনের লক্ষ্যে সোহরাওয়ার্দীকে হিন্দুদের সহযোগিতা প্রাপ্তি নিশ্চিত করার জন্য তার চেষ্টা কয়েকগুণ বৃদ্ধি করতে হবে।”
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে বিভক্ত ভারতে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলার দাবি ঘোষণা করেন। এ উদ্দেশ্যে তিনি দিল্লি গমন করেন। এবং মুসলিম লীগ সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে আলোচনা করেন। জিন্নাহর সম্মতি লাভের পর সোহরাওয়ার্দী লর্ড মাউন্টব্যাটেনের সাথে সাক্ষাৎ করেন। মি. জিন্নাহ ও মাউন্টব্যাটেনের সাথে সন্তোষজনক আলোচনার পর ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল তারিখে সন্ধ্যায় দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী ডমিনিয়ন মর্যাদায় স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবি করে বিবৃতি দেন। তিনি স্বাধীন বাংলার পক্ষে বিস্তারিত তথ্য ও পরিসংখ্যানসহ যুক্তি প্রদর্শন করেন।
পৃষ্ঠা: ৬৭
২৭ এপ্রিল তারিখে সাংবাদিক সম্মেলনে সোহরাওয়ার্দী প্রদত্ত বিবৃতি
“বাংলার সমৃদ্ধি ও কল্যাণকামী ব্যক্তিমাত্রই এটা লক্ষ্য করে মর্মাহত হবেন যে, বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য কোনো কোনো মহল থেকে একটা প্রবল আন্দোলনের সূত্রপাত করা হয়েছে। এর একমাত্র কারণ হচ্ছে কিছুসংখ্যাক হিন্দুর চরম হতাশা ও তজ্জনিত ধৈর্যচ্যুতি, কারণ প্রদেশে তাদের সম্প্রদায় জনবহুল, তাদের সম্পদ, প্রভাব, শিক্ষা-দীক্ষা, প্রচারণা ও প্রশাসনযন্ত্রে তাদের প্রাধান্য এবং তাদের অন্তর্নিহিত শক্তি সত্ত্বেও বঙ্গীয় মন্ত্রিসভায় তারা যথোপযুক্ত অংশ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন।
এই নৈরাশ্যের প্রধান কারণ হচ্ছে এই যে, বাংলাদেশ যে ধরনের একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হবে বলে আমি আশা করছি সে ধরনের রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা যে বর্তমান অবস্থায় অব্যাহত থাকতে পারে না, সেটা তারা বুঝতে পারছেন না। আমার আজ ভারতে এমন একটি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চলেছি, যে সংগ্রামে অখিল ভারত পরিধিতে কয়েকটি বিরোধীয় শক্তি একের ওপর অন্যের ইচ্ছাকে চাপিয়ে দেওয়ার মরণপণ চেষ্টায় লিপ্ত, কিন্তু প্রত্যেক পক্ষই নতি স্বীকারের জন্য এমন মুল্য দাবি করছে, যা প্রতিপক্ষ দিতে প্রস্তুত নয়।
“অখণ্ড স্বাধীন রাষ্ট্রের ভবিষ্যৎ কাঠামোতে কি পরিণাম আশা করা যেতে পারে তার নির্দেশক হিসেবে প্রায়ই নোয়াখালীর ঘটনার উল্লেখ করা হয়ে থাকে। আগেই বলেছি, বর্তমান পরিস্থিতিতে উদ্ভূত কোনো ঘটনার নিরিখে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কোনো সিদ্ধান্ত প্রতিপাদনের প্রয়াস হাস্যকর হবে। তবুও ঘটনাটি বিচার করে দেখা যাক। নোয়াখালীতে অনুষ্ঠিত ঘটনাকে কি ভবিষ্যতের মানদণ্ড ও পূর্বগামিনী ছায়া বলে বিবেচনা করা যায়? আরও কি অগণিত জেলা নেই যেখানে মুসলমানেরা বিপুল পরিমাণে সংখ্যাগরিষ্ঠ ? সেসব জেলায় কি শান্তি অব্যাহতরূপে বিরাজমান নেই এবং হিন্দুরা পূর্বের মতোই নিজেদের অধিকার ও প্রতিপত্তিতে প্রতিষ্ঠিত নেই?
“এবার আসুন ভেবে দেখি বাংলা অবিভক্ত থাকলে তার অবস্থান কি হবে। বাংলা হবে একটি মহান দেশ, ভারতের মধ্যে সবচাইতে ধনাঢ্য ও ঋদ্ধশীল রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র তার অঙ্কে লালিত জনগণকে দিতে পারবে এক সমুন্নত জীবনযাত্রার মান, যেখানে এক মহান জাতি তার বিকাশের উন্নততম সোপানে আরোহণ করতে পারবে এবং সত্যিকার অর্থে প্রাচুর্যে ভরা হবে যে দেশ কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে হবে সমৃদ্ধিশালী এবং কালের আবর্তনে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে সেই দেশ। বাংলা যদি অবিভক্ত থাকে, তাহলে তার এই ভবিষ্যৎ কল্পরূপ শুধু স্বপ্ন-বিলাস বা আকাশকুসুম চিন্তা
পৃষ্ঠা: ৬৮
মাত্র পর্যবসিত হবে না। বাংলার অন্তর্নিহিত সম্পদ ও তার উন্নয়নের বর্তমান পর্যায় সম্পর্কে অবহিত ব্যক্তিমাত্রই স্বীকার করবেন যে, এই হবে ভবিষ্যতের বাংলার রুপ,যদি না তার আগেই আমরা স্বখাত সলিলে ডুবে মরি।
“ আমি বারবরই বাংলার ভবিষ্যৎ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে কল্পনা করে এসেছি, কোনোরুপ ভারতীয় রাষ্ট্রসংঘের অংশ হিসেবে নয়। অনুরূপ কোনো রাষ্ট্র একবার সংস্থাপিত হলে. তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার ওপরেই। আমি কখনোই ভুলতে পারবনা ভারত সরকারের কত দীর্ঘদিন লেগেছিল ১৯৪৩ সালের বাংলার মন্বন্তরের গুরুত্ব অনুধাবন করতে, কীভাবে বাংলার চরম দুর্দিনে প্রতিবেশী বিহার প্রদেশ তাঁকে খাদ্য সরবরাহ করতে অস্বীকার করেছিল, কীভাবে ভারতের আর সব কয়টি প্রদেশ বাংলার প্রতি তাদের দ্বার রুদ্ধ করে রেখেছে ও বাংলাকে তারা নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী থেকে বঞ্চিত করে চলেছে, কীভাবে ভারতের দরবারকক্ষে বাংলাকে ঠেলে দেখা হয় মর্যাদার-আলোক-বঞ্চিত এক অখ্যাত কোণে আর অন্য প্রদেশগুলো তাদের আসন দখল করে বসে দোর্দণ্ড প্রতাপে।
“বাংলা যদি মহান হতে চায়, তবে সে শুধু নিজের পায়ে দাড়িয়েই তা হতে পারবে। তাকেই নিজের সম্পদের অধিকারী ও নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হতে হবে। বাংলার ওপর অন্যের শোষণের উচ্ছেদ করতে হবে, ভারতের স্বার্থের যূপকাষ্ঠে বাংলাকে বলি দেওয়া আর চলবে না। শেষ পর্যায়ে বিরোধ বাধবে কলকাতা ও তার অব্যবহিত পরিপার্শ্বকে ঘিরে। কারণ, প্রধানত অন্যান্য প্রদেশ থেকে আগত লোকদের অবদানেই গড়ে উঠেছে কলকাতা; বাংলার মাটিতে তাদের কোনো শেকড় নেই, তারা এখানে এসেছিল শুধু জীবিকার্জন করতে, কিংবা, অন্য দৃষ্টিতে, বাংলাকে শোষণ করতে। কিন্তু বড়ই আফসোসের কথা, ওপরে আলোচিত পরিসংখ্যানের প্রেক্ষিতে, এই যদি হয় বঙ্গ বিভাগ আন্দোলনের প্রধান উদ্দেশ্য, তা হলে এই আন্দোলন শুধু এই উদ্দেশ্যের স্থির বিন্দুতেই সীমিত থাকবে না, অচিরে এই বিভাগের ভ্রণ থেকেই জন্ম নেবে এমন বৈরিতা ও জিঘাংসা, যার শেষ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, কেউ তা জানে না। কাজেই, হিন্দু সমাজের যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক এত হাল্কাভাবে বাংলাকে ভাগ করার কথা বলে. তাদের কাছে আমাদের আবেদন: অশেষ ক্ষতি ও দুর্ভোগের ধাত্রী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করুন। আমরা সকলে একাত্ম হয়ে উদ্যোগী হলে নিশ্চয়ই এমন একটি ভবিষ্যৎ শাষন-প্রকল্প উদ্ভাবন করতে পারব, যা জনগণের সকল অংশের সন্তোষ লাভে সমর্থ হবে ও বাংলার সমদ্ধ সমুজ্জ্বল গৌরবদীপ্ত অতীতকে পুনরুজ্জীবিত করে তুলতে পারবে।”
পৃষ্ঠা: ৬৯
১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল সংবাদ সম্মেলনে উপরোক্ত ভাষণ দোহনকালে তিনি সুসংহত, অবিভক্ত ও সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য উদাত্ব আহ্বান জানান। এই ভাষণ অধিকাংশ দৈনিক পত্রিকায় ঐ দিনের প্রথম খবর হিসেবে ছাপা হয়। তিনি তার ভাষণে বলেন যে, বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করার জন্য মহলবিশেষ থেকে প্রবল আন্দোলনের সূত্রপাত হয়েছে। এর একমাত্র কারণ যে হিন্দুদের একটি শ্রেণী মনে করে, বঙ্গীয় মন্ত্রিসভায় তাদের যথোপযুক্ত অংশ থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। বাংলা বিভাগের দাবিটি হিন্দু সম্প্রদায়ের একাংশের তীব্র হতাশা থেকে উদ্ভূত বলে উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, এমন কি হিন্দু স্বার্থের দষ্টিকোন বঙ্গ-বিভাগ আত্মহত্যার শামিল হবে। তিনি বঙ্গ বিভাগ দাবির বিরুদ্ধে যক্তি প্রদর্শন করে বলেন যে, স্বাধীন বাংলা হবে ভারতের মধ্যে সবচাই ও সমৃদ্ধিশালী দেশ- সেখানে জনগণ উন্নত জীবনযাত্রার মানে প্রতিষ্ঠিত হতে পারবে এবং সেখানে একটি মহান জাতি তার উত্তরে শীর্ষতম সোপানে উপনীত হতে সক্ষম হবে। সত্যিকার অর্থে প্রাচুর্যে-ভরা একটি দেশ হবে এই বাস বাংলা স্বাধীন রাষ্ট্র হয়ে যাবার পর বাঙালি জাতিই হবে বাংলার ভবিষ্যতে নিয়ন্তা। যারা বাংলা বিভাগের ধারণা তুলেছেন তাদের কাছে এ চরম অশুভ দাবিটি প্রত্যাহারের আবেদন জানিয়ে সোহরাওয়ার্দী আরও বলেন, “সবাই মিলে আলোচনার মাধ্যমে নিশ্চয়ই এমন একটি প্রশাসন ব্যবস্থার উদ্ভাবন করা যাবে, যা জনগণের সকল অংশের মনঃপূত হবে এবং বাংলার হারানো গৌরব ফিরে পাবার পথ প্রশস্ত হবে। বাংলার হিন্দুরা শুধু যদি সার্বভৌম অবিভক্ত বাংলার আদর্শটি গ্রহণ করে, তাহলে তিনি তাদের দাবি-দাওয়া পূরণে যথাসাধ্য চেষ্টা করার আশ্বাস দেন। স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা জিন্নাহর আশীর্বাদপুষ্ট কি না- সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “আমার নিজের মনের কথাই বলছি, আমি বাংলার হয়ে বাংলার কথা বলছি। আমি বিভক্ত ভারতে একটি অবিভক্ত, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলছি।”
তিনি স্বাধীন বাংলার ভবিষ্যৎ রূপরেখা দিয়ে বলেন, “বাংলা হবে একটি মহান দেশ, ভারতের মধ্যে সবচাইতে ধনাঢ্য ও সমৃদ্ধশালী রাষ্ট্র, যে রাষ্ট্র তবে বুকে লালিত জনগণকে দিতে পারবে এক সমুন্নত জীবনযাত্রর মান, সেখানে এক মহান জাতি তার বিকাশের উন্নততর সোপানে আরোহণ করতে পারবে এবং সত্যিকার অর্থে প্রাচুর্যে ভরা হবে যে দেশ। কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যে হবে মহাসমৃদ্ধিশালী এবং কালের আবর্তে যে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ও প্রগতিশীল রাষ্ট্ররূপে স্বীয় মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হবে সেই দেশ। বাংলা যদি ঐক্যবদ্ধ থাকে, তবে তা স্বপ্ন বা কল্পনা হবে না।
পৃষ্ঠা: ৭০
“আমি বরাবরই বাংলার ভবিষ্যৎ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে কল্পনা করে আসছি, কোনো রূপ ভারতীয় রাষ্ট্রসংঘের অংশ হিসাবে নয়। অনুরুপ কোনো রাষ্ট্র একবার সংস্থাপিত হলে. তার ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার উপর।… বাংলা যদি মহান হতে চায় তবে সে শুধু নিজের পায়ে দাড়িয়েই তা হতে পারবে। তাকেই নিজেই সম্পদের অধিকারী ও নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা হতে হবে। বাংলার ওপর তবে উচ্ছেদ করতে হবে। ভারতের স্বার্থের যূপকাষ্ঠে বাংলাকে বলি দেওয়া আর চলবে না। কাজেই হিন্দু সমাজের যে মুষ্টিমেয় কয়েকজন লোক হয়ত হাল্কাভাবে বাংলাকে ভাগ করার কথা বলেন তাদের কাছে আমার আবেদন: অশেষ ক্ষতি ও দুর্ভোগের ধাত্রী এই আন্দোলন প্রত্যাহার করুন। আমরা সকলে একাত্ম হয়ে উদ্যোগী হলে নিশ্চয়ই এমন একটি ভবিষ্যৎ শাসন প্রকল্প উদ্ভাবন করতে পারবো।”
২৭ এপ্রিল খাজা নাযিমুদ্দিন বাংলা বিভাগের সমালোচনা করেন এবং স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার পক্ষে দাবি জানান। ঐ দিনই মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বাংলা বিভাগ দাবির নিন্দা করেন। শরৎ বসুর দলভুক্ত কংগ্রেসের একদল যুবক আবুল হাশিমের সঙ্গে বর্ধমানে দেখা করে বলেন যে বাংলা বিভক্ত হতে যাচ্ছে। আবুল হাশিম কলকাতা এলে ২৮ এপ্রিল যুক্তবাংলা পক্ষের এক বিবৃতি দেন, যা ২৯ এপ্রিল প্রকাশ করা হয়। তিনি যুক্তবঙ্গের পক্ষে আবেদন জানিয়ে বলেন, “সময় আসছে সত্যকে দিনের আলোকে উদ্ভাসিত করার, সস্তা জনপ্রিয়তা অর্জনের জন্য সুবিধাবাদী নেতৃত্ব ও বিকৃত চিন্তার নিকট আত্মসমর্পণ করা প্রজ্ঞার ব্যভিচার। … বাংলা আজ তার ভাগ্যের এক ক্রান্তিলগ্নে সমুপস্থিত। তার সামনে দুটি সোজা পথ- একটি স্বাধীনতা ও গৌরবের, অন্যটি অনন্তকালের জন্য দাসত্ব শৃঙ্খল ও অশেষ নির্যাতনের। বাংলাকে এখানেই এখন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। মানুষের জীবনে কখনো কখনো এমন শুভলগ্ন দেখা দেয় যে, লগ্নের মাহেন্দ্রক্ষণে যাত্রা আরম্ভ হলে তা পরম সৌভাগ্যের অব্যর্থ লক্ষ্যেই সমাপ্ত হয়। সুযোগ একবার হারালে আর কখনও নাও আসতে পারে।” তিনি বাঙালিদের হীনম্মন্যবোধ ও পরাজিতের মনোভাব পরিত্যাগ করার আহ্বান জানান। তার বিবৃতি বাংলার ভবিষ্যৎ প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর ভাবাদর্শের পরিপূরক হয়েছিল। স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক সক্রিয় ভূমিকা পালন না করলেও নেতারা তার সাথে যোগাযোগ করতেন এবং তিনি তাদের পরামর্শ দিতেন। লাহোর প্রস্তাব অনুসারে তিনি বাংলা-আসাম নিয়ে স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের সমর্থক ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ২৯ মে তার কৃষক প্রজা পার্টির প্রায় ৪০০ সদস্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রতিবাদ ও কেবিনেট মিশনের প্রস্তাব সমর্থন করেন
পৃষ্ঠা: ৭১
তারা বলেন, মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের দাবিগুলো হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা বাড়াবে এবং ভবিষ্যৎ ভয়ঙ্কর হবে। তারা পাকিস্তান সৃষ্টির বিরোধিতা করে বলেন, মুসলিম লীগ পোকায় খাওয়া ও পঙ্গু পাকিস্তান পাবে। তারা মনে করেন ন্যায় ও গন্তন্ত্রের ভিত্তিতে সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র গঠন দেশের সাম্প্রদায়িক ও অন্যান্য সমাধান করতে পারে। এরূপ রাষ্ট্রে রাজনীতি থেকে ধর্মকে পৃথক রাখতে হবে। পরিশেষে তারা বাংলা ও আসাম প্রদেশ নিয়ে স্বাধীন বঙ্গ প্রতিষ্ঠার দাবি জানান।
১৯৪৭ সালের ৩০ এপ্রিল মওলানা আকরম খার সভাপতিতে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটির সভা হয়। স্পিকার নূরুল আমিনকে আহ্বায়ক, হাবিবুল্লাহ বাহার, ফজলুর রহমান ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সদস্য করে কমিটি গঠন করা হয়। সিদ্ধান্ত হয়, তারা হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে আলোচনা করে অখণ্ড বাংলা সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবেন। ৩০ এপ্রিল কংগ্রেস সভাপতি রাতে প্রসাদ ঘোষণা করেন যে, ভারত ভাগ হলে পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হতে হবে। ঐ দিনই মি. জিন্নাহ প্রদেশ ভাগের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখিয়ে বলেন, ভারত ভাগ হতে হবে এবং ৬টি ইউনিট হবে- বাংলা, আসাম, পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান।
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা সম্পর্কে মুসলিম লীগের মধ্যে দ্বিমত ছিল। মুহাম্মাদ আলী জিন্নাহ ও ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেনের স্বাধীন বাংলার প্রতি সহানুভূতিশীল থাকা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী খুব বিচলিত হয়ে পড়েন। সময় খুবই কম। ২৬ এপ্রিল সাক্ষাতের সময় মাউন্টব্যাটেন সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন যে, ২ জুনের পূর্বে তাকে স্বাধীন বাংলার রূপরেখা দিতে হবে। সোহরাওয়ার্দী দিল্লি থেকে কলকাতায় চলে আসেন এবং শরৎচন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় ও সত্যরঞ্জন বকশীর সাথে স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে আলোচনা শুরু করেন। নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা শরৎচন্দ্র বসু ভারত ও বাংলাদেশ বিভাগের বিরোধী ছিলেন। শরৎচন্দ্র বসু ১৯৪৬ সালের নভেম্বর মাসে অন্তর্বর্তীকালীন মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করে সোস্যালিস্ট রিপাবলিকান পার্টি (আর.এস.পি) গঠন করেন। তিনি ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে নিখিল বঙ্গভঙ্গ-বিরোধী ও বিভক্তি রোধ কমিটি গঠন করেন। তিনি নিজে এই কমিটির সভাপতি ও কামিনী কুমার দত্তকে সম্পাদক নিযুক্ত করেন। কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায় বাংলা বিভাগের বিরোধী ছিলেন। তিনি ৩ মে মাউন্টব্যাটেনের সাথে দেখা করে বলেন, বাংলা এক থাকতে পারে যদি মুসলিম লীগ হিন্দুদের পাওনা মিটিয়ে দিতে সম্মত হয়। ভাইসরয় তাকে কলকাতায় গিয়ে প্রথমে সোহরাওয়ার্দী ও দার্জিলিংয়ে গভর্নর বারোজের সাথে দেখা করতে বলেন। কিরণশঙ্কর রায় তাদের সঙ্গে দেখা করেন। শ্যামাপ্রসাদ মুখার্জি বাংলা বিভাগের
পৃষ্ঠা: ৭২
বিরোধিতা করার জন্য প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর নির্দয় স তার স বলেন, বঙ্গভঙ্গ সমভাবে হিন্দ, মুখার্জিসহ সকল সমালোচক করেন।
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ অবিভা পার্থক্য ছিল। ১৯৪৭ সালের বলেন, তারা অবিভক্ত ভার বাংলার প্রশ্নে দু’দলে বিভক্ত হয়
তসলিম লীগ অবিভক্ত বাংলা দাবি করলেও তাদের মধ্যে মৌলিক ল। ১৯৪৭ সালের ৩ মে বঙ্গীয় কংগ্রেসের সভাপতি সুরেন্দমোহন
অবিভক্ত ভারতে বৃহত্তর বাংলা দাবি করেন। মুসলিম লীগ বৃহত্তর শে দু’দলে বিভক্ত হয়ে পড়ে। বৃহত্তর বাংলার প্রস্তাবক ছিলেন। নী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। অন্যদিকে খাজা নাযিমুদ্দিন ও মওলানা। ম খা প্রথমে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবি করলেও তারা পরে মূল দাবি থেকে
রে যান। খাজা নাযিমুদ্দিন বৃহত্তর অবিভক্ত বাংলা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত তে চান। ৫ মে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আকরম
ভৗগোলিক ও ভাষাভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি দিয়ে। বলেন, “পাকিস্তানের অন্যান্য এলাকা থেকে বিচ্ছিন্নভাবে একটি স্বতন্ত্র স্বাধীন বাংলা রাষ্ট্র গঠনের প্রশ্নই ওঠে না। ভারতের মুসলমানেরা একটি মাত্র সুসংহত জাতির অন্তর্ভুক্ত এবং আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে সকল মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রদেশে সমবায়ে একটি মাত্র সুসংহত রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা।… যারা হিন্দু-মুসলিম সম্মিলি বাঙালি জনতার কথা বলেন এবং সেই ভিত্তিতে স্বতন্ত্র সার্বভৌম বাংলার আওয়া” তোলেন, তারা নিজেদেরকে আমাদের সেইসব শক্তির ক্রীড়নকে পরিণ করেছেন, যারা পূর্ব ও পশ্চিমে হিন্দু প্রদেশের মাঝখানে ফেলে মুসলিম বাংলা পিষে মারার কথা খোলাখুলি বলছে।”।
এদিকে কলকাতার আনন্দবাজার, অমৃত বাজার ও দৈনিক হিন্দুস্তান প সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িক দৃষ্টিকোণ থেকে তীব্র আক্রমণ চালিয়ে থাকে। সোহরাওয়ার্দী সংবাদপত্রের স্বাধীনতায় বিশ্বাসী ছিলেন। কিন্তু সাম্প্র সম্প্রীতি স্থাপনের স্বার্থে সরকারকে পত্রিকাগুলোর বিরুদ্ধে আদালতের শন হতে বাধ্য হতে হয়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী যদিও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও জেনারেল মাউন্টব্যাটেনের সম্মতি নিয়ে স্বাধীন বাংলার আন্দোল করেছিলেন, তবু প্রথম থেকে একমাত্র কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা থেকেই। নিজের দলীয় নেতাদের কাছ থেকেও চরম বাধা পেয়েছেন। তা সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ৮ মে মুসলিম লীগ সেক্রেটারি জেনারেল খানের কাছে একপত্রে লেখেন, “যদি বাংলা বিভক্ত হয় তবে উভয় অংশ দুর্বল ও
পৃষ্ঠা: ৭৩
গুরুত্বহীন হয়ে পড়বে। বেশি হবে আমাদের অংশ, যদিও এর লোকসংখ্যা অনেক বেশি। খাদ্য ঘাটতি এত বেশি যে কোনো প্রকার নিবিড় চাষও প্রয়োজনীয় উৎপাদন করতে পারবে না। আমি কোনো প্রকারে উপলব্ধি করতে পারি না যে, একটি দুর্বল পূর্ব বাংলা মুসলমানের জন্য কি উপকারে আসবে অথবা মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি করবে অথবা সংখ্যালঘু এলাকার মুসলমানের সাহায্য করবে !”
১৯৪৭ সালের ৯ মে বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি বাংলার ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র ও বঙ্গভঙ্গ রোধ সম্পর্কে হিন্দু নেতাদের সাথে আলোচনা রাখার ব্যাপারে সাব-কমিটিকে ক্ষমতা প্রদান করে। সাব-কমিটির ৬ জনের ৪ জনের মধ্যে ছিলেন খাজা গ্রুপের। তারা সোহরাওয়ার্দীর বৃহত্তর বাংলার প্রস্তাব থেকে দূরে সরে যান। সোহরাওয়ার্দী কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে থাকেন। তিনি ১৯৪৭ সালের ১০ মে ও ১২ মে কলকাতার সোদপুরের আশ্রমে মহাত্মা গান্ধীর সাথে বৃহত্তর বাংলার ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করেন। আব্দুল হাশিম, মোহাম্মদ আলী, ফজলুর রহমান ও সোহরাওয়ার্দী গান্ধীর সাথে ভবিষৎ যুক্ত বাংলা নিয়ে সাক্ষাৎ করেন। তারা গান্ধীকে স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব অনুমোদন করার জন্য কংগ্রেসকে রাজি করাতে বলেন। সোহরাওয়ার্দী ও রাজস্ব মন্ত্রী ফজলুর রহমান ১৪ মে ভাইসরয় সাথে আলোচনার জন্য দিল্লি গমন করেন। তারা কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনার প্রেক্ষিতে ১৫ মে জিন্নাহ ও ভাইসরয়ের সাথে দেখা করেন। তারা কলকাতা ফিরে এলেই মওলানা আকরম খাঁ, নূরুল আমিন, হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, ইউসুফ আলী চৌধুরী ও হামিদুল হক চৌধুরী দিল্লি গমন করেন এবং ১৮ মে জিন্নাহর সাথে দেখা করেন। দিল্লি থেকে ফিরে এসে হাবিবুল্লাহ বাহার বলেন, জিন্নাহ তাদের বলেছেন যে, মুসলিম লীগের পক্ষে আলোচনা করার জন্য কাউকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। খাজা গ্রুপের মাহমুদ নুরুল হুদাও সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের ওপর আক্রমণ চালান। ভাইসরয় ক্ষমতা হস্তান্তরের দলিলের খসড়া নেহেরুকে দিয়ে প্রত্যয়ন করান। নেহেরুর সাথে আলোচনার পর মাউন্টব্যাটেন সোহরাওয়ার্দীকে বলেন যে, নেহরু স্বাধীন বাংলা সমর্থন করেন না। ১৬ মে মাউন্টব্যাটেন বাংলার গভর্নর ব্যারোজকে এক পত্রে জানান যে, হিন্দু-মুসলমান নেতারা একমত হয়ে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করতে পারলে তিনি লীগ ও কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রস্তাব গ্রহণ করতে বলবেন এবং শেষ ঘোষণায় বাংলা বিভক্তি অন্তর্ভুক্ত হবে না। বারোজ সোহরাওয়ার্দীকে কোনো শর্তারোপ না করে যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করতে বলেন। তিনি ১৯ মে লন্ডনে এক তারবার্তায় জানান যে, “সম্প্রতি বাংলায় দুটি প্রধান দল। যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠনে সম্মত হয়েছে। ভবিষ্যতের শাসনতন্ত্র রচনার জন্য একটি
পৃষ্ঠা: ৭৪
পৃথক গণপরিষদ নির্বাচিত হবে।” ২০ মে তারিখ অনুষ্ঠিত ইন্ডিয়া কমিটির সভায় বাংলার মাউন্টব্যাটেন বলেন, বাংলার গভর্নর বাংলাকে একত্রিত রাখার ব্যাপারে সফলভাবে অগ্রসর হচ্ছেন। বাংলা যদি স্বাধীন হয় তাহলে তৃতীয় ডমিনিয়ন প্রতিষ্ঠা করার প্রশ্ন অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ যদি ২ জন তারিখের সভায় স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা অনুমোদন করে, তাহলে ভারত বিভাগ পরিকল্পনা সংশোধনের ক্ষমতা ভাইসরয়কে প্রদান করা হবে। ইতিপূর্বে সাক্ষাতের সময় সোহরাওয়ার্দীকে বলেন যে, ভারত বিভাগ পরিকল্পনায় স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব তিনি অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন না। তবে কংগ্রেস ও লীগ সম্মত হলে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলা স্বীকার করে নেওয়া হবে এবং পরিকল্পনার অন্তর্ভুক্ত হবে। ২৯ মে মাউন্টব্যাটেন ব্যারোজকে জানালেন যে, সোহরাওয়ার্দী যেন ডমিনিয়ন দাবি না করেন।
গভর্নর ব্যারোজ বাংলাকে অবিভক্ত রাখার জন্য সচেষ্ট ছিলেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং কিরণশঙ্কর রায়কে বিলম্ব না করে শক্তিশালী যুক্ত মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য উপদেশ দেন। সোহরাওয়ার্দী ও কিরণশঙ্কর গভর্নর বারোজ-এর সহযোগিতায় স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা গঠনের প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে থকেন। সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের একটি স্মারকলিপি গভর্নরকে প্রদান করেন।
স্বাধীন বাংলার রূপরেখা
শরৎচন্দ্র বসুর বাসভবন ১ নম্বর উডবার্ন পার্কে কংগ্রেস এবং মুসলিম লীগের যুক্ত কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। কমিটির কাজ শেষ হয় ১৯৪৭ সালের ১৯ মে। ২০ মে শরৎ বসু তার বাসভবনে মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস নেতাদের এক সম্মেলন আহ্বান করেন এবং সম্মেলনের সদস্যদের রাত্রিতে প্রীতিভোজে আপ্যায়িত করেন। সম্মেলনে মুসলমান প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, আবুল হাশিম এবং এ এম মালিক, অন্যদিকে হিন্দু নেতাদের মধ্যে ছিলেন শরশ্চন্দ্র বসু, কিরণশঙ্কর রায় এবং সত্যরঞ্জন বখশী। উল্লেখ্য, মুসলিম লীগ সাব-কমিটির ৬ জন সদস্যের মধ্যে আহ্বায়ক নূরুল আমিন, সদস্য হাবিবুল্লাহ বাহার, হামিদুল হক চৌধুরী এবং ইউসুফ আলী চৌধুরী সম্মেলনে উপস্থিত হন নি। তারা ছিলেন খাজা নাযিমউদ্দীনের দলের লোক সভায় আলোচনান্তে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। মুসলিম লীগের পক্ষে আবুল হাশিম এবং কংগ্রেসের পক্ষে শরৎচন্দ্র বসু প্রস্তাবিত চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। চুক্তির মূল বিষয় ছিল নিম্নরূপ:
পৃষ্ঠা: ৭৫
১. বাংলা হবে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। স্বাধীন বাংলা অবশিষ্ট ভারতের সাথে তার সম্পর্ক নির্ধারণ করবে।
২. স্বাধীন বাংলার সংবিধানে হিন্দু ও মুসলমানের জনসংখার অনুপাতে আসন সংরক্ষণসমূহ যুক্ত নির্বাচক মণ্ডলী এবং বয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে বঙ্গীয় আইন সভার নির্বাচনের ব্যবস্থা থাকবে। হিন্দু এবং তফসিলি সম্প্রদায়ের আসন তাদের নিজস্ব জনসংখ্যার হার অনুপাতে অথবা নিজেদের মধ্যে বন্টন করা হবে। নির্বাচনী এলাকাগুলো হবে একই সাথে একাধিক আসনের। কিন্তু প্রত্যেকের ভোট হবে একটি করে, একাধিক নয়। একাঞ্চলের প্রার্থী, যিনি নির্বাচনে তার সম্প্রদায় প্রদত্ত অধিকাংশ ভোট এবং অন্য সম্প্রদয়ের পঁচিশ শতাংশ ভোট পাবেন, তাকে নির্বাচিত ঘোষণা করা হবে। এসব শর্ত পূরণ করতে না পারেন, তাহলে সেই প্রার্থীই নির্বাচিত হবেন, যিনি তার সম্প্রদায়ের সর্বাধিক ভোট লাভ করবেন।
৩. ভারত সম্রাটের সরকার স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন এবং বাংলাকে বিভক্ত করা হবে না এই মর্মে ঘোষণা প্রদান করলে বর্তমান মন্ত্রিপরিষদ ভেঙে দেওয়া হবে এবং সব মন্ত্রীকে বাদ দিয়ে সমানসংখ্যাক মুসলমান ও হিন্দু সদস্যদের (তফসিলী সম্প্রদায়ের হিন্দুসহ) নিয়ে একটি অন্তর্বর্তী মন্ত্রিপরিষদ গঠন করা হবে। এ মন্ত্রিপরিষদের প্রধানমন্ত্রী হবেন একজন মুসলমান এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হবেন একজন হিন্দু।
৪. নতুন সংবিধানের অধীনে আইন ও মন্ত্রিপরিষদ চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত হিন্দু (তফসিলি সম্প্রদায়ের হিন্দুসহ) এবং মুসলমানদের সামরিক এবং পুলিশসহ চাকরি ক্ষেত্রে সমান অধিকার থাকবে। এ সকল চাকরিতে নিযুক্ত ব্যক্তিরা হবেন বাঙালি।
৫. ইউরোপীয়দের বাদ দিয়ে আইন সভার মুসলমান এবং অমুসলমান সদস্যরা ১৬ জন মুসলমান এবং ১৪ জন হিন্দু নিয়ে ৩০ জনের গঠিত সংবিধান সভা নির্বাচন করবে।
১নং উডবার্ন পার্ক,
কোলকাতা
২০শে মে, ১৯৪৭ সাল
স্বাক্ষর
শরৎন্দ্র বসু
আব্দুল হাশিম
প্রস্তাবিত চুক্তিটির শর্তগুলো সোহরাওয়ার্দী প্রণীত বাংলার গভর্নরকে প্রদত্ত স্মারকলিপিতে উল্লিখিত শর্তের অনুরূপ। সোহরাওয়ার্দী চুক্তির অনুলিপি
পৃষ্ঠা: ৭৬
নবাবজাদা লিয়াকত আলী খানের কাছে প্রেরণ করেন। কংগ্রেস সংসদীয় দলের নেতা কিরণশংকর রায় ও ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত সোহরাওয়ার্দী-শরৎচন্দ্র বসুর চুক্তিটিকে স্বাগত জানান। মুসলিম লীগের খাজা গ্রুপ চুক্তিকে ভারতের কাছে আত্মসমর্পণ বলে আখ্যায়িত করেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ সভাপতি মওলানা আকরম খা চুক্তির শর্তাবলির কোঠর সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, চুক্তিভুক্ত যুক্ত নির্বাচন প্রথা অসম্ভব। তার সম্পাদিত দৈনিক আজাদ পত্রিকা চুক্তিকে বাঙালি মুসলমানদের মৃত্যু পরোয়ানা বলে অভিহিত করে। অথচ মওলানা আকরম খাঁ একদা বলেছিলেন বাংলার মুসলমানের লাশের ওপর দিয়ে বঙ্গভঙ্গ হবে। আর এখন কংগ্রেসের সঙ্গে আলোচনার ক্ষমতা সোহরাওয়ার্দীকে দেওয়া হয়নি এবং এই প্রস্তাবে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর কোনো সম্মতি নেই। এ কথা শুনে সোহরাওয়ার্দী জিনাহর কাছে চিঠি লেখেন। জিন্নাহ সে চিঠির উত্তর কোনোদিন বঙ্গীয় নিখিল মুসলিম লীগ খাজা গ্রুপের শাহ আজিজুর রহমানের দ্বীন ছাত্রগণ ছিলেন স্বাধীন বাংলার বিপক্ষে। সোহরাওয়ার্দীপন্থি ছাত্রলীগ নেতা মোয়াজ্জেম উদ্দীন ও নুরুদ্দীন চুক্তিকে সমস্যা সমাধানের পথ হিসেবে চিহ্নিত করেন। শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবদুর রহমান চৌধুরী প্রমুখ এই দলে ছিলেন। ২৮ মে বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটির অধিবেশনে প্রস্তাব নেওয়া হয় যে, বাংলার শাসনতান্ত্রিক সমস্যা সমাধানের জন্য সোহরাওয়ার্দী-শরৎ বসু যে প্রস্তাব করেছেন, তার সাথে মুসলিম লীগের কোনো সম্পর্ক নেই। কমিটি আরও সিদ্ধান্ত নেয় যে, ভারতের মুসলমানদের ভবিষ্যৎ শাসনতন্ত্র প্রশ্নে আলোচনা করার অধিকারী একমাত্র মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ। বাংলার মুসলমানেরা তার সিদ্ধান্ত মেনে নেবে। সভা প্রাদেশিক লীগের সাব-কমিটি ভেঙে দেয়। সোহরাওয়ার্দী, আবুল হাশিম এ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন।
১৯৪৭ সালের ২১ মে জিন্নাহ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাংলা পর্যন্ত করিডোর দাবি করেন। কংগ্রেস তার দাবির সমালোচনা করে। ২১ মে সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল কিরণশঙ্কর রায়কে একটি কড়া চিঠি দেন। তিনি তাতে লেখেন, যুক্ত স্বাধীন বাংলা একটি চালমাত্র। হিন্দুরা যদি বাঁচতে চায় তাহলে বাংলাকে ভাগ করতে হবে। তিনি কিরণশঙ্করকে কংগ্রেসের নির্দেশ মেনে চলতে বলেন। তারপর থেকে কিরণশঙ্কর স্বাধীন বাংলা আন্দোলন থেকে দূরে সরে যান। ২৩ মে দেবেন দের মাধ্যমে শরশ্চন্দ্র বসু গান্ধীকে চুক্তির অনুলিপিসহ পাঠিয়ে দেন। তার উত্তরে ২৪ মে গান্ধী পাটনা থেকে বসর কাছে চিঠি লেখেন। ২৬ মে শরৎচন্দ্র বসু পুনরায় গান্ধীর কাছে পত্র দেন। গান্ধী তাকে চক্তির শর্তে আইন পাশের ব্যাপারে হিন্দু
পৃষ্ঠা: ৭৭
সদস্যদের দু-তৃতীয়াংশের সম্মতি, বাংলার যে একটি সাধারন সংস্কৃতি আছে এবং বাংলা যে তার একই মাতৃভাষা, তা অন্তর্ভুক্ত করার পরামর্শ দেন। এ ব্যাপারে শরৎ বসু নেতাদের সাথে আলোচনা চালিয়ে যেতেও বললেন। ৮ জুন গান্ধী শরৎচন্দ্র বসুকে লেখেন, “তোমার খসড়া পড়লাম। আমি এখন পরিকল্পনাটি নিয়ে মোটামুটিভাবে পণ্ডিত নেহরু এবং সরদারের সঙ্গে আলোচনা করছি।দু’জনেই প্রস্তাবটির বিরুদ্ধে অনড় এবং তারা মনে করেন এটা কেবল তফসিলী সম্প্রদায়ের এবং হিন্দু নেতাদের দ্বিধাবিভক্ত করার ফন্দী।“ পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু ও প্যাটেল অভিযোগ করেন যে, যুক্ত বাংলার পক্ষে তফসিলের ভোট সংগ্রহের জন্য অর্থ ব্যয় করা হচ্ছে। গান্ধী তাকে অবহিত করেন যে, ভারতের দু’অংশের বাইরে ক্ষমতা হস্তান্তরের কোনো সম্ভাবনা নেই। তাই গান্ধী শরৎ বসুকে বাংলার অখণ্ডতার জন্য সংগ্রাম পরিত্যাগ করতে বলেন। ১৪ জুন শরৎচন্দ্র বসু গান্ধীকে পত্র লিখে জানান যে, জওহরলাল ও বল্লভ ভাই প্যাটেলের অভিযোগ বা সন্দেহ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। বৃহত্তর বাংলা গঠন একটি চক্রান্ত- এ অভিযোগ শরৎচন্দ্র বসু অস্বীকার করে বলেন, “আমার বিশ্বাস দৃঢ়। আমি আমার ক্ষুদ্র শক্তি দিয়ে বাংলার অখণ্ডতার জন্য কাজ করে যাবার অভিপ্রায় পোষণ করি। বঙ্গভঙ্গের পক্ষে যে প্রচণ্ড উত্তেজনামূলক প্রচারাভিযান চলছে, এতদসত্ত্বেও এ ব্যাপারে আমার লেশমাত্র সন্দেহ নেই। যদি গণভোট দেওয়া হতো তাহলে বাংলার হিন্দুরা বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে অধিক সংখ্যায় ভোট প্রদান করতেন। বাঙলার কণ্ঠকে কিছুকালের জন্য রুদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে, ভবিষ্যতে সে নিজেকে জোরের সঙ্গে প্রকাশ করবে।” তিনি কংগ্রেস নেতাদের বাংলা-বিরোধী কার্যাবলী দেখে কংগ্রেসকে হিন্দুদের একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে অভিযুক্ত করেন।
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কার্যকরী কমিটির প্রস্তাব সম্পর্কে ১ জুন সংখ্যায় মর্নিং নিউজ’-এ “সার্বভৌম বাঙলার জীবন চরিত ও মৃত্যু কাহিনী শীর্ষক সম্পাদকীয় লেখা হয়। সম্পাদকীয়তে বলা হয় যে, যার জন্ম হয়েছিল দিল্লিতে এইচ এস সোহরাওয়ার্দীর সাংবাদিক সম্মেলনে, পাকিস্তানের জাতীয় রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কহীন সেই সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্র নামের শিশুটি স্বাভাবিক মৃত্যুবরণ করে ২৮ মে যখন লীগ ওয়ার্কিং কমিটি সোহরাওয়ার্দী-বসু ফর্মুলা নিন্দার সাথে প্রত্যাখ্যান করে। ১ জুন নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি রাজনৈতিক পরিস্থিতি পর্যালোচনার জন্য নয়া দিল্লিতে এক বৈঠক অনুষ্ঠানে একমত হন। বৈঠকে বাংলা থেকে মওলানা আকরম খাঁ, খাজা নাযিমুদ্দিন এবং এম. এ. ইস্পাহানি উপস্থিত ছিলেন। এ সভায় স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে কোনো আলোচনা হয় নি। জুন মাসের দুই তারিখে দিল্লিতে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের
পৃষ্ঠা: ৭৮
উচ্চ পর্যায়ের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় “বিগ সেভেন” নামে অভিহিত পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, আচার্য কৃপালনী, বলদেব সিংহ, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, লিয়াকত আলী খান, আবদুর রব নিশতার উপস্থিত ছিলেন।বাংলা থেকে কোনো নেতা সভায় উপস্থিত ছিলেন না। তারা ভারত বিভক্ত প্রসঙ্গ নিয়ে আলোচনা করেন। স্বাধীন বাংলা প্রশ্ন আলোচিত হয় নি। তারা লর্ড মাউন্টব্যাটেনের রোয়েদাদ গ্রহণ করেন। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে তার স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব পরিত্যাগ করে বঙ্গ বিভাগ সমর্থন করতে বলেন। লর্ড মাউন্টব্যাটেনের ভারত, বাঙলা ও পাঞ্জাব বিভক্তি চূড়ান্ত করার বিষয়টি বিবেচনার জন্য নিখিল ভারত মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস কমিটির কাউন্সিল অধিবেশন দিল্লির ইম্পিরিয়াল হোটেলে ৩ জুন অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিতে তার পর্বে বাংলার প্রতিনিধিগণ সোহরাওয়ার্দীর বাসভবনে মিলিত হন। তারা সিদ্ধান্ত নেন মুসলিম লীগ যদি ভাইসরয়ের রোয়েদাদ গ্রহণ করেন, তা হলে তারা সে প্রস্তাবের বিরোধিতা করবেন। ১৯৪৭ সালের ৩ জুন সকাল ১০টায় দিল্লির ইম্পিরিয়াল হোটেলে মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভার শুরুতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ প্রস্তাব উত্থাপন করেন। পাঞ্জাবের খাসারগণ বেলচা নিয়ে সভাস্থলে আক্রমণ চালান। লীগের স্বেচ্ছাসেবকগণের সাথে তাদের সংঘর্ষ হয়। হোটেলের মেঝে খাকসারদের রক্তে রঞ্জিত হয়। ১৯৪০ সালে ২৩শে মার্চ যেদিন লাহোর প্রস্তাব উত্থাপন করা হয়, সেদিনও লাহোরের রাজপথ রক্তে লাল হয়েছিল। পাকিস্তানের শুরুই হয় রক্তাক্ত পথে এবং ১৯৭১ সালে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হয় একসাগর রক্তের বিনিময়ে। দিল্লির কাউন্সিল অধিবেশনে মাউন্টব্যাটেন রোয়েদাদ পাশ হয়ে যায়। সোহরাওয়ার্দী দেখলেন জিন্নাহর প্রস্তাবের বিকল্প এক ভয়ানক ব্যাপার। তাই তিনি প্রস্তাবের বিরোধিতা করতে পারেন নি। আবুল হাশিম লীগ সদস্যদের সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করেন। ৩ জুন লর্ড মাউন্টব্যাটেন ব্রিটিশ সরকারের ভারত বিভাগ পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। ঐ দিনই সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিমকে নিয়ে মিসৌরিতে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সাথে সাক্ষাৎ করেন। জিন্নাহ তাদেরকে কংগ্রেস ও হিন্দু নেতাদের সাথে ঐক্যবদ্ধ বাংলা সম্পর্কে আলোচনা করার অনুমতি দেন। ৫ জুন মুসলিম লীগ ব্রিটিশ সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। কাউন্সিলের ৮ জন সদস্য পরিকল্পনা গ্রহণের বিরুদ্ধে ভোট প্রদান করেন। কিন্তু ৪০০ জন সদস্য ভোট দেন এর পক্ষে। ৯ জুন অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কাউন্সিল সভায় জিন্নাহকে বঙ্গভঙ্গ গ্রহণ না করার পরামর্শ দেওয়া হয়। নিখিল ভারত কংগ্রেস কমিটির ১৫ জুনের অধিবেশনে ব্রিটিশ সরকারের পরিকল্পনা গৃহীত হয়।
পৃষ্ঠা: ৭৯
এভাবে ১৯৪০ সালের বিখ্যাত লাহোর প্রস্তাবকে অনাড়ম্বরভাবে আরব সাগরে নিক্ষেপ করা হলো এবং জিন্নাহ এক সময় যাকে কীটদুষ্ট বলে করেছিলেন সেই পাকিস্তানকে দ্বিধাহীন চিত্তে গ্রহণ করে নিলেন। যে নিখিল ভারত কংগ্রেস দৃঢ়ভাবে ভারত বিভাগের বিরোধিতা করেছিল, তারা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত, বাংলা ও পাঞ্জাব বিভাগে সম্মত হলো।
স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য সোহরাওয়ার্দীর হাতে সময় ছিল না। মাউন্টব্যাটেন দ্রুত অগ্রসর হতে থাকেন। স্থির হলো ১৪ আগস্ট পাকিস্তান এবং ১৫ আগস্ট ভারত স্বাধীন হবে। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর হিন্দুদের আক্রশ, আবুল হাশিমের সাময়িকভাবে রাজনীতি থেকে অবসর গ্রহণ, বিভিন্ন স্থানে খাজা গ্রুপের দলের পক্ষে জনমত সৃষ্ট করার সুযোগ এনে দেয়। এ সকল কারনে স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে গেল, বাস্তবায়িত হবার মুখ দেখল না।
ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন কংগ্রেস, বিশেষ করে পণ্ডিত নেহেরুর দ্বারা প্রভাবিত হলেন। মাউন্টব্যাটেনের স্ত্রী লেডি এডুইনার সাথে নেহরুর ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। সে কারণে নেহরু অতি সহজে এডুইনার মাধ্যমে ভাইসরয়কে প্রভাবিত করতে পারতেন। নেহরু বলতেন, তিনি কখনও স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব গ্রহণ করবেন না এবং তার দেশের লোকদের এরূপ প্রস্তাব গ্রহণ করতে দেবেন না। তার মতে বাংলা ভারতভুক্ত হওয়া ব্যতীত তার কোনো ভবিষ্যৎ নেই। ভারত বিভাগের প্রস্তাব নিয়ে লন্ডন গমন করার পূর্বমুহূর্তে মাউন্টব্যাটেন চাননি যে সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব পরিত্যাগ করেন। এ প্রসঙ্গে গভর্নর ব্যারোজ বলেছেন, “ভাইসরয় চূড়ান্ত পরিকল্পনা নিয়ে ৩১ মে ফিরে আসেন। শেষ মুহূর্তে কংগ্রেসের বিরোধিতার ফলে স্বাধীন বাংলা সম্পর্কে তার সকল আশা চিরতরে চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। সুতরাং কংগ্রেসের সম্পূর্ণ পরিকল্পনাটি গ্রহণ না করার অসহযোগিতার ফলে সোহরাওয়ার্দীর মতো মাউন্টব্যাটেনও এ পরিকল্পনা ফলপ্রসূ হবে না ভেবে পরিত্যাগ করেন।”
কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ভারত ও বাংলা বিভাগ মেনে নেওয়ার ফলে স্বাধীন বাংলার আন্দোলন থেমে যায়। শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার কাঙ্ক্ষিত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে ভবিষ্যতে দু’বাংলা এক হতে পারে এ আশা নিয়ে ১৪ জুন এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, “যে সকল ঘটনার প্রেক্ষিতে বাংলা বিভক্ত হচ্ছে। তাতে কেউ খুশি হতে পারে না। সম্ভবত অর্থনৈতিক উন্নতির প্রয়োজনীয়তা পুনরায় দুই অংশকে একত্রিত করতে পারে।”
এখন প্রশ্ন হলো শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবির পেছনে মুসলিম লীগের সভাপতি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর সমর্থন ছিল কি না, এ প্রস্তাবে
পৃষ্ঠা: ৮০
ব্রিটিশ সরকারের অভিমত কি ছিল? জিন্নাহর অনুগত হাসান ইস্পাহানি বলেছেন, সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর সমর্থন পাননি। জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে এ পরিকল্পনা থেকে বিরত থাকতে বলেছিলেন, কারণ তাহলে মুসলমানরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে।হোসেন ইমাম বলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী যখন জিন্নাহর অনুমতি চাইলেন, তখন তিনি তাকে প্রথমে গান্ধী ও কংগ্রেসের সম্মতি নিতে বলেন। তারপরই তিনি তাতে সমর্থন দেবেন। বঙ্গীয় লীগ নেতা মওলানা রাগীব আহসান বলেন যে,জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে সমর্থন দিয়ায়েছিলেন।সোহরাওয়ার্দী তার স্মৃতিচারনে বলেন,“জিন্নাহর মত নিয়ে আমি এ পদক্ষেপ নিয়েছি।” ১৯৪৭ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সোহরাওয়াদী বৃহত্তর বাংলা গঠনের পরিকল্পনা শুরু করে। এপ্রিল-মে মাসে তার নেতৃত্বে বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় দখল করে। লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ প্রকাশ্যে কোনো সময় সোহরাওয়ার্দীকে স্বাধীন বাংলার দাবী পরিত্যাগ করতে বলেননি। অধিকন্তু তিনি সবসময় তার দাবির সম্পর্কে জিন্নাহকে অবহিত করতেন। বঙ্গীয় মুসলিম লীগ প্রথমে তার কে সমর্থন করে বিবৃতি দিয়েছে এবং কংগ্রেস নেতাদের সাথে আলোচনায় বসেছে। মুসলিম লীগ ভেবেছিল স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা গঠিত হলে এক সময় তা পাকিস্তানে যোগ দেবে। জিন্নাহ নিজে বলতেন, কলকাতাকে বাদ দিয়ে পর্ব বাংলা চলতে পারে না। জিন্নাহ শরৎ-সোহরাওয়ার্দী ফর্মুলার বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে কোনো বিবৃতি দেননি। তবে মনে হয় জিন্নাহ তাদের যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি পছন্দ করতেন না; কারণ যুক্ত নির্বাচন ছিল মুসলিম লীগের দ্বি-জাতিতত্ত্বের পরিপন্থি। অনেকে মনে করেন, জিন্নাহর সাথে সোহরাওয়ার্দীর ব্যক্তিগত সম্পর্ক মধুর ছিল। জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে বিশ্বাস করতেন না। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দীও জিন্নাহ সম্পর্কে উচ্চ ধারণা পোষণ করতেন না। স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের সময় তিনি লিয়াকত আলী খানের মাধ্যমে জিন্নাহকে পত্র লিখতেন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালনে তিনি লীগ হাই কমান্ড বা জিন্নাহকে তেমন গুরুত্ব দিতেন না। তখন থেকেই জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি অসন্তুষ্ট হতে থাকেন। যদি কংগ্রেস হাই কমান্ড সোহরাওয়ার্দী-ফরমুলা গ্রহণ করত এবং জিন্নাহ যদি স্বাধীন বাংলার বিরোধিতা করতেন, তবে সোহরাওয়ার্দী জিন্নাহর বিরুদ্ধে কঠিন পদক্ষেপ গ্রহণ করতেন।
সোহরাওয়ার্দী লাহোর প্রস্তাব অনুসারে স্বাধীন বাংলা আন্দোলন শুরু করেন। ১৯৪৭ সালের ২১ মে লিয়াকত আলী খানকে তিনি এক পত্র লিখে হকে স্বাধীন বাংলা প্রস্তাব গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানাতে বলেন। এর
পৃষ্ঠা: ৮১
থেকেই প্রতীয়মান হয় যে, সোহরাওয়ার্দী-বসুর স্বাধীন বাংলা প্রস্তাবের সাথে জিন্নাহ একমত ছিলেন না। অবাঙালি মুসলিম লীগ নেতারা বাঙালি মুসলিম নেতাদের বিশ্বাস করতে পারতেন না। লীগ নেতা চৌধুরী খালেকুজ্জামান মন্তব্য করেছিলেন যে, “বাংলার মুসলিম এমএলএ-দের কোনো চরিত্র নেই। তাদের আদৌ বিশ্বাস করা যায় না। তারা কোন কিছু পরিচালনা করতে সম্ভবত পূর্ব পাকিস্তানকে বিক্রি করে দেবে। এ সকল বাঙালি এমএলএ-দের হিন্দরা ক্রয় করবে এবং মুসলমানেরা পাকিস্তানের বিপক্ষে ভোট দিতে পারে।“ লিয়াকত আলী কোনো সময়ই সোহরাওয়ার্দীর পত্রের উত্তর দেননি। তা মসলিম লীগ নেতারা সব সময় বাংলার মুসলিম নেতাদের অবমূল্যায়ন করতেন। এ কে ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর বাংলা তথা মুসলমানদের উন্নয়নে এত অবদান থাকা সত্ত্বেও তাদেরকে উপযুক্ত সময় দেওয়া হয় নি। অবাঙালি এ সকল মুসলিম নেতার লেজুড়বৃত্তি করতে ঢাকার খাজা গ্রুপ। কেন্দ্রীয় লীগের সিদ্ধান্ত গ্রহণে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের ভূমিকা ছিল খুবই গৌণ। নিখিল ভারত মুসলিম লীগ বাংলার ব্যাপারে গুরুত্ব দেয় নি। স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা আন্দোলন যত তুঙ্গে ওঠে, কেন্দ্রীয় লীগ নেতারা তার প্রতি ততই কম গুরুত্ব দিতে থাকেন।
প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমকে নিখিল ভারত মুসলিম লীগ। ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করা হয়নি। ওয়ার্কিং কমিটির ২৩ জন সদস্যের মধ্যে বাংলা থেকে মাত্র ৩ জন সদস্য ছিলেন। তারা হলেন খাজা নাযিমুদ্দিন, মওলানা আকরম খা এবং অবাঙালি ইস্পাহানি। এ কে ফজলুল হক প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে তাকেও ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য করা হয় নি। অথচ ভারতের মোট মুসলমান জনসংখ্যার ১০ কোটির ৪ কোটি বাস করতো বাংলায়। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের কোনো গুরুত্বপূর্ণ পদ বাঙালিদের দেওয়া হয় নি। ১৯৩৭ থেকে ৪৭ পর্যন্ত জিন্নাহ মুসলিম লীগের সভাপতি, লিয়াকত আলী খান সাধারণ সম্পাদক এবং মাহমুদাবাদের রাজা মোহাম্মদ আমির আহমেদ খান ট্রেজারার ছিলেন। একমাত্র যুগ্ম সচিবের পদ নির্বাচনে দেওয়া হতো। একবার মাত্র বাংলার খান বাহাদুর আবদুল মোমেন যুগ্মসচিব হন। কেন্দ্রীয় ওয়ার্কিং কমিটির সভা ১৯৩৬ থেকে ১৯৪৭ সালের মধ্যে। বাংলায় কোনো দিন অনুষ্ঠিত হয় নি। মুসলিম লীগে বাঙালি মুসলমানের এই করুণ। অবস্থানের জন্য স্বাধীন বৃহত্তর বাংলার দাবির প্রতি কোনোদিন গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বরং এই আন্দোলনকে তারা ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ধ্বংস করে দেয়।
ব্রিটিশ সরকার বাংলাকে বিভক্ত করার বিপক্ষে ছিল। মাউন্টব্যাটন ও গভনর বারোজ প্রস্তাবিত স্বাধীন বাংলার প্রতি সমর্থন দেন। ব্যারোজ সোহরাওয়ার্দী-বসুর
পৃষ্ঠা: ৮২
সাথে সহযাত্রী হিসেবেই কাজ করে গেছেন। তিনি বলেছেন, পূর্বাঞ্চলের পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত হওয়া কোনো ফলদায়ক ব্যাপার হিবে না। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৭০০ মাইল দূরে অবস্থিত কলকাতা ভবিষ্যতে ধংশ হবে। পূর্বাঞ্চলে শিল্প নেই; অঞ্চলটি খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ন নয়। বিভক্ত বাংলা বাচতে পারে না।তিনি ছিলেন স্বাধীন বাংলার সমর্থক। মাউন্টব্যাটেন বৃহত্তর বাংলা সমর্থন করলে তা তিনি অনুমোদন করবেন। কংগ্রেস ও লীগ সমর্থন না করায় ব্রিটিশ সরকার স্বাধীন বাংলার প্রতি শেষ পর্যন্ত তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখতে পারে নি। তবে এ কথা ঠিক ব্রিটিশ সরকার দৃঢ় হলে স্বাধীন অবিভক্ত বাংলার আত্মপ্রকাশ ঘটতো। মাউন্টব্যাটেন্ট পরিশেষে স্বাধীন বাংলা সমর্থন করেননি। তিনি নেহরুর পরামর্শে বিষয়টি পরিকল্পনাভুক্ত করেননি। এভাবে স্বাধীন বাংলার প্রতি জিন্নাহ বা ব্রিটিশ সরকারের সমর্থন না থাকায় প্রস্তাবটি বাস্তবায়িত হয়নি।
ভারত বিভাগের পূর্বে ১৯৪৭ সালে বাংলায় হিন্দু-মুসলমানের আনুপাতিক হার
হিন্দু-মুসলিম
কলকাতা- ৬৮.৭১- ৩১.২৯
২৪ পরগনা- ৬৪.০০- ৩৬.০০
হাওরা- ৭৮.৩- ২১.৭
হুগলী- ৮২.৯৬- ১৭.০৪
বর্ধমান- ৭৮.৬২- ২১.৩৮
বীরভূম- ৬৭.১৭- ৩২.৮৩
বাকুড়া- ৯০.৯০- ৯.১০
মেদিনীপুর- ৮৯.২৩- ১০.৭৭
নদীয়া- ৩৭.৫৩- ৬২.৪৭
মুর্শিদাবাদ- ৪৩.৩২- ৫৬.৬৮
জলপাইগুড়ি- ৬৭.৫০- ৩৩.৫০
দার্জিলিং- ৭১.১২- ২৮.৮৮
দিনাজপুর- ৪৫.২২- ৫৪.৭৮
মালদা- ৫২.১৭- ৪৭.৮৩
যশোর- ৩৩.৫৫- ৬৬.৪৫
খুলনা- ৫০.২২- ৪৯.৭৮
রাজশাহী- ২২.৮১- ৭৭.১৯
বগুড়া- ১৬.৩৬- ৮৩.৬৪
পাবনা- ২২.৯৯- ৭৭.০১
রংপুর- ২২.৭৭- ৭৭.২৩
পার্বত্য চট্টগ্রাম- ১৭.২৭- ৮২.৭৩
ঢাকা- ২৪.১১- ৭৫.৮৬
ময়মনসিংহ- ২০.০০- ৮০.০০
ফরিদপুর- ৩৫.৮০- ৬৪.২০
বাকেরগঞ্জ- ২৬.৪২- ৭৭.৫৮
ত্রিপুরা- ২৪.১৪- ৭৫.৮৬
নোয়াখালী- ২১.৪৭- ৭৮.৫৩
স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা পরিকল্পনার ব্যর্থতার কারণ
স্বাধীন বৃহত্তর বাংলার সংগঠকগণ কংগ্রেস ও মুসলিম লীগকে তাদের প্রস্তাব গ্রহণে বাধ্য করাতে না পারায় স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি।
১৯৩৭-৪৭ সাল পর্যন্ত বাংলার প্রশাসনে মুসলমানের প্রতিপত্তি ছিল। পর পর মুসলিম মন্ত্রিসভা বাংলা শাসন করায় কংগ্রেস ও হিন্দু সম্প্রদায় প্রশাসন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ফলে হিন্দু ও মুসলমানের মধ্যে ঐক্যের বন্ধন শিথিল হয়ে পড়ে।
১৯৪৬ সালের ১৬ আগস্ট তারিখের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম ও নোয়াখালী দাঙ্গার পর বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় শঙ্কিত হয়ে পড়ে এবং হিন্দু-মুসলমানের সম্পর্কে বিরাট ফাটল ধরে। হিন্দু-মুসলমানের এক সাথে বসবাস করা অসম্ভব হয়ে পড়ে।
জনসংখ্যার বিভাজন স্বাধীন বাংলা আন্দোলনের অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। পশ্চিম বাংলায় হিন্দু ও পূর্ব বাংলায় মুসলিম জনবসতি বেশি থাকায় হিন্দুদের মধ্যে বিচ্ছিন্নতা বোধের সৃষ্টি হয়। পশ্চিম বাংলার হিন্দু সম্প্রদায়ের বঙ্গভঙ্গের ফলে তেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবার সম্ভাবনা ছিল না। কারণ কলকাতা ও খনিজ সম্পদ তাদের দখলে থাকবে। কিন্তু কলকাতা ও নোয়াখালীর দাঙ্গা হিন্দুদের মনে ভীতির সঞ্চার করে। ফলে তাদের মনে এই চিন্তা জাগ্রত হয় যে, বাংলা বিভক্ত হলে মুসলমানদের সাথে তাদের ক্ষমতার ভাগাভাগি করতে হবে না এবং পশ্চিমবঙ্গকে তারা নিজেরাই শাসন করার সুযোগ পাবে।
সময়ের স্বল্পতা ব্যর্থতার আর একটি কারণ। আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ ও গভনর বারোজ সময়ের সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন ছিলেন। ১৯৪৮ সালের জুন মালে ভারতকে স্বাধীন করার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু ১৯৪৭ সালের ২ জুনের মধ্যে
পৃষ্ঠা: ৮৪
ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন এ ব্যাপারে সোহরাওয়ার্দীকে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের বলেন সম্মতি সংগ্রহ করতে বলেন। সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলার পরিকল্পনা প্রকাশ করেন ১৯৪৭ সালের ১৭ এপ্রিল। বিলম্বে পরিকল্পনা প্রকাশ করায় কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ পূর্ণাঙ্গ আলোচনা করে ঐকমত্যে পৌছতে পারে নি। ভাইসরয়ের তৃতীয় ডমিনিয়ন প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও সর্বভারতীয় স্বার্থে সেই পরিকল্পনাকে বাদ দিতে হয়েছে।
আন্দোলনের ব্যর্থতার প্রধান কারণ কংগ্রেসের ভেটো প্রদান। প্রথম দিকে আন্দোলনের প্রতি কংগ্রেসের সমর্থন ছিল। কংগ্রেস হাই কমান্ড, বিশেষ করে জওয়াহেরলাল নেহরু এবং সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল সব সময় অবিভক্ত বাংলার বিরোধী ছিলেন। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেসের হাই কমান্ড ভারত বিভাগ পরিকল্পনা গ্রহণ করায় স্বাধীন বাংলার আন্দোলন ব্যর্থ হয়ে যায়।
ব্যার্থতার আর একটি কারণ প্রাদেশিক বঙ্গীয় মুসলিম লীগ ও বঙ্গীয় কংগ্রেস কমিটির মধ্যে ঐকমত্য শূন্যতা। বাংলা বিভাগের ক্ষেত্রে সিলেটের মতো রেফারেন্ডাম দেওয়া হয় নি। বাংলা বিভক্তির ওপর গণভোট দেওয়া হলে স্বাধীন বাংলা আন্দোলন সফল হতো। কিন্তু সময়ের স্বল্পতার জন্য গণভোটের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। অনেকে বলেন যে, বৃহত্তর বাংলা আন্দোলনের উদ্দেশ্য ছিল বাংলার বিভক্তি রদ করা। কিন্তু তা সত্য নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী লাহোর প্রস্তাব অনুসারে স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবি করেছিলেন।
কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভা ভেবেছিল বিভক্ত বাংলা বেশি দিন স্থায়ী হবে না। পূর্ব বাংলা কয়েক বছরের মধ্যে ভারতের সাথে যোগ দিতে বাধ্য হবে। কিন্তু তাদের এ ভবিষ্যদ্বাণী সত্য হয় নি।
বৃহত্তর বাংলা আন্দোলনে বঙ্গীয় মুসলিম লীগের রাজনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই মুসলিম লীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম বাংলা ভিত্তিক মুসলিম লীগ আত্মপ্রকাশ করে। এছাড়া ছিল সার্বিকভাবে খাজা সমর্থক ও সোহরাওয়ার্দী সমর্থক দল। সোহরাওয়ার্দীর সাথে কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের বিরোধ প্রকট হয়ে পড়ে। খাজা নাযিমুদ্দিনের দলের সাথে মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী গ্রুপ অবিভক্ত বাংলা, পূর্ণিয়া ও আসাম নিয়ে একত্রিত বা বৃহত্তর বাংলা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিল। বৃহত্তর বাংলা আন্দোলনের ব্যর্থতার ফলে খাজা নাযিমুদ্দিন গ্রুপের জয় হয়। এই ভয়ঙ্কর পরাজয় একমাত্র সোহরাওয়ার্দীর দলের নয়, এ ছিল বঙ্গীয় মুসলিম লীগের সার্বিক পরাজয়। পূর্ব বাংলা মুসলিম লীগের ভেতরে অন্তর্দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান
পৃষ্ঠা: ৮৫
মুসলিম লীগের ভেতরেও সোহরাওয়ার্দী ও খাজা উপদল ছিল। সোহরাওয়ার্দী পন্থি মুসলিম লীগ থেকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ বাঙালি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করে এবং স্বায়ত্তশাসন আন্দোলনের পথ ধরেই অবশেষে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে।
ঘ. পাকিস্তান সৃষ্টি- ১৯৪৭
১৯৪৭ সালের ভারত বিভাগকালে বিশেষ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা ও ইংরেজ কর্মকর্তা ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের মধ্যে ছিলেন কংগ্রেস নেতা মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জওয়াহের লাল নেহেরু, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, বাংলার শরৎচন্দ্র বসু, মুসলিম লীগের মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ, বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং পাঞ্জাবের বলদেব সিং। ব্রিটিশ সরকারের পক্ষে ছিলেন ভাইসরয় লর মাউন্টব্যাটেন, তার শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ভি. পি. মেনন, স্টাফ অফিসার লর্ড ইজমে, বাংলার গভর্নর বারোজ, পাঞ্জাবের গভর্নর স্যার ইভান জেংকিনস। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যার ক্লড অখিনলেক এবং স্যার সিরিল রেডক্লিফ। লর্ড মাউন্টব্যাটেন ভারত বিভাগের ঐতিহাসিক নাটকের সভাপতিত্ব করেন। পণ্ডিত নেহরু ও সর্দার বল্লভ ভাই প্যাটেল, মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারতের খণ্ড-বিখণ্ডতকরণে ভাইসরয়কে আশাতীত সহযোগিতা করেন। মহাত্মা গান্ধী ও মওলানা আবুল কালাম আজাদ ঐক্যবদ্ধ ভারত প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হন। নেহেরু ও প্যাটেল সুকৌশলে ভারত বিভাগের সময় গান্ধীকে দূরে সরিয়ে রাখেন। পাঞ্জাবের জেংকিনস ও শিখ নেতা বলদেব সিং পাঞ্জাবকে দ্বিখণ্ডিত করার ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। পাঞ্জাব দ্বিখণ্ডিত করার ফলে ৬ লক্ষ মুসলমান, শিখ ও হিন্দু দাঙ্গায় নিহত হয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শরশ্চন্দ্র বসু স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। ভারতে বাংলা নামে একটি স্বাধীন ডমিনিয়ন সৃষ্টির আন্দোলনে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। পাঞ্জাবের মুসলমান ও শিখ সম্প্রদায় প্রদেশের বিভক্ত মেনে নিয়েছিল। কিন্তু বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়, তফসিলি, ও অধিকাংশ হিন্দু ছিলেন বাঙলা দ্বিখণ্ডিতকরণের বিরুদ্ধে। কিন্তু কংগ্রেস ও হিন্দু মহাসভার নেতারা ছিলেন বাংলা ভাগের উদ্যোক্তা। ভি.পি, মেনন ক্ষমতা হস্তান্তর দলিলের প্রণেতা, লর্ড ইজমে ভারত বিভাগ ও সম্পদ বণ্টনে সবিশেষ ভূমিকা পালন করেন। প্রধান সেনাপতি
পৃষ্ঠা: ৮৬
সুশিক্ষিত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দ্বিখণ্ডিত করেন। রেড ক্লিফ পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগের নির্মম দায়িত্ব পালন করেন। আর ভাইসরয় পত্নী লেডি এডুইনা মঞ্চের নেপথ্যে থেকে ভারত বিভাগকে প্রভাবিত করেন।
ইংরেজ সরকার ও কংগ্রেস অখণ্ড ভারতের পক্ষপাতী ছিলেন। মুসলিম লীগ কেবিনেট মিশন প্রস্তাবে পাকিস্তান দাবির স্বীকৃতি থাকায় তারা ফেডারেল সরকার অধীনে গ্রুপ পদ্ধতি গ্রহণ করে। কিন্তু কংগ্রেস প্রথমে কেবিনেট মিশনের সুপারিশ গ্রহণ না করায় সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির অবনতি ঘটে এবং মুসলিম লীগ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার দাবিতে অটল থাকে। ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট শেষবারের মত অবিভক্ত ভারতের জন্য চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তিনি পাঞ্জাব ও বাংলা বিভক্তিরও বিপক্ষে ছিলেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ২ জুন তারিখের মধ্যে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগের কাছ থেকে অবিভক্ত বাংলার পক্ষে সম্মতি আদায় ও সে সম্পর্কে তাকে জানাবার সময় নির্ধারণ করেন। কংগ্রেসের পন্ডীত নেহেরু ও প্যাটেল কোনোক্রমেই বৃহত্তর বাংলা মেনে নিলেন না। ১৯৪৭ এলের ১ জুন মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস তাদের দলীয় সভায় ভারত বিভাগ রোয়েদাদ গ্রহণ করে। ৩ জুন অল ইন্ডিয়া রেডিও থেকে ভারতবাসীর উদ্দেশে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন, পণ্ডিত নেহেরু ও মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ভারত, পাকিস্তান স্বাধীন রাষ্ট্র, বাংলা ও পাঞ্জাব বিভক্তিকে সমর্থন করে ভাষণ দেন। তারা তাদের ভাষণে স্বাধীন ভারত ও স্বাধীন পাকিস্তান রাষ্ট্রের অস্তিত্বের সমর্থনেও বক্তব্য রাখেন। ইংরেজ সরকার কংগ্রেস ও লীগের সমন্বিত সিদ্ধান্ত সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী ৩০ জুলাই পর্যন্ত স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার চেষ্টা অব্যাহত রাখেন।
কথিত আছে, ভারত বিভাগের পরিকল্পনাটি ভাইসরয়ের শাসনতান্ত্রিক উপদেষ্টা ভি.পি. মেনন মাত্র চার ঘণ্টায় রচনা করেছিলেন এবং ব্রিটিশ মন্ত্রিসভা মাত্র ৫ মিনিটের সংক্ষিপ্ত বৈঠকে তা অনুমোদন করেন। সীমান্ত নির্ধারণের জন্য স্যার সিরিল রেড ক্লিফ ৮ জুলাই ভারতে এসে পৌছেন এবং তাকে পাঞ্জাব ও বাংলার সীমান্ত চিহ্নিত করার জন্য মাত্র ৫ সপ্তাহ দেওয়া হয়েছিল। যেখানে সময়ের প্রয়োজন ছিল কয়েক বছর, রেড ক্লিফ মাত্র ৫ সপ্তাহের মধ্যেই সেই কাজ সমাপ্ত করে ৮ আগস্ট সীমান্ত রোয়েদাদ ভাইসরয়ের কাছে প্রদান করেন। কিন্তু ভাইসরয় ১৭ আগস্টে তা প্রকাশ করেন। সীমান্ত নিধারণের জন্য একটি ও বাংলায় একটি কমিশন নিয়োগ করা হয়। বাংলা সংক্রান্ত বোর্ডে ছিলেন কংগ্রেসের বিচারপতি সি, সি, বিশ্বাস ও বি, কে, মুখার্জি, মুসলিম লীগের পক্ষে ছিলেন বিচারপতি মোহাম্মদ আকরম ও এসএ রহমান। ভারতের বৃহত্তর স্বার্থে
পৃষ্ঠা: ৮৭
ইংরেজ সরকার ভারত ও পাকিস্তানের জন্য লর্ড মাউন্টব্যাটেনকে গভর্নর জেনারেল নিয়োগ করতে চেয়েছিল। এ ব্যাপারে মুসলিম লীগের মতামত জানতে চাওয়া হয়। ৩ জুলাই জিন্নাহ ভাইসরয়কে অবহিত করেন যে, তিনি নিজে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল থাকবেন। জিন্নাহর এ সিদ্ধান্ত ছিল একটি মারাত্মক ভুল। ফলে সীমান্ত নির্ধারণ ও সম্পদ বণ্টনের দিক থেকে পাকিস্তান ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পাকিস্তান সংখ্যাগরিষ্ঠ মুর্শিদাবাদ মালদা ও আসামের একাংশ থেকে বঞ্চিত হয়। অন্যদিকে ১৫ আগস্টের পর সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ছড়িয়ে পরে এবং লক্ষ লক্ষ লোক নিহত হয়। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। লিয়াকত আলী খান হলেন প্রধানমন্ত্রী।
বাংলা ভাগ হলো
সোহরাওয়ার্দী স্বাধীন বাংলা ঘোষণার প্রস্তাব উত্থাপন করে বাংলার জনগণ মধ্যে আলোড়ন সৃষ্টি করেন। কিন্তু স্বার্থান্বেষী নেতৃত্ব স্বাধীন বাংলার দাবির পিছে ছুরিকাঘাত করে এবং তারা বাংলা ভাগ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন স্বাধীন বাংলার প্রস্তাব সমর্থন করেন নি। সোহরাওয়ার্দী তার স্বাধীন বাংলার দাবি বাধ্য হয়ে অবশেষে পরিত্যাগ করেন। তার পরও বাংলার সীমানা নির্ধারণ ও কলকাতা নিয়ে সমস্যার সৃষ্টি হয়। বাংলার সীমানা নির্ধারণ ও বঙ্গভঙ্গ সম্পর্কে লিওনার্দ মোজলে তার গ্রন্থে বলেছেন, “বাংলা বিভাগের কাজটি সঙ্কটময় হলেও অসম্ভব ছিল না। বাংলার গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বারোজ এবং মুখ্যমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাঙলাকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে ঘোষণা করার প্রস্তাব করেছিলেন। কিংবা তা না হলে অন্তত কলকাতাকে তারা স্বাধীন নগরী হিসেবে দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ভাইসরয় এবং শ্রমিক সরকার উভয়ই এই অজুহাত দেখিয়ে তাদের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন যে, কংগ্রেস এটা কিছুতেই মেনে নেবেনা। স্যার ফ্রেডরিক ব্যারোজ বাংলা বিভাগ সম্পর্কে স্যার রেড ক্লিফকে বলেছিলেন, “আপনি যখন প্রদেশটি খণ্ডিত করবেন, তখন দুটি ঘটনা ঘটবে। প্রথমত, বাঙলা বিভাগের ফলে এখানে রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা সংঘটিত হবে এবং দ্বিতীয়ত, পূর্ব বাঙলা গ্রাম্য বস্তিতে পরিণত হবে।” স্যার ফেডরিক ব্যারোজের দ্বিতীয় ভবিষ্যদ্বাণীটি সত্যে পরিণত হয়েছিল এবং এটা হওয়ার পেছনে সু কারণও ছিল। পূর্ব বাঙলা ছিল সব সময় কলকাতার পশ্চাদভূমি। এ অঞ্চলটি কলকাতার জন্য খাদ্য ও পাট জন্মাতো। কিন্তু দেশ-বিভাগের ফলে পূর্ব বাঙলা কলকাতার সাবেক বাজার হারিয়ে ফেলে এবং কলকাতা বন্দরের সুযোগ-সুবিধা
পৃষ্ঠা: ৮৮
থেকেও সে চিরদিনের মতে কাজটি দ্রুত সেরে ফেলেন। স্যার রেড ক্লিফ বাংলা বিভাগের কাজটি দ্রুত সেরে ফেলেন।এ কাজে তাকে তেমন বেগ পেতে হয়নি। কারন, বাংলার বেশির ভাগ মুসলমান পূর্বাঞ্চলে এবং বেশির ভাগ হিন্দু পশ্চিমাঞ্চলে কেন্দ্রভুত হয়েছিল। শুধু তাই নয়, “বিভক্ত বাঙলা “ অধিকাংশ বাঙালির কাছে এক অকল্পনীয় ব্যাপার ছিল এবং এটা যে স্থায়ী হবে, সেটাও তারা সত্যি সত্যি বিশ্বাস করতে পারে নি।” (ভিএইচ হডসন)
১৯৪৭ সালের ১১ জুন বাংলার গভর্নর এক ঘোষণায় বাংলা বিভাগ প্রশ্নে সিদ্ধান্ত গ্রহনের জন্য ২০ জুন বাংলার এমএলএ-দের এক বৈঠকের আহ্বান করেন। ১২ জুন খাজা-পন্থি কয়েকজন মুসলিম লীগ নেতা দিল্লী থেকে কলকাতায় আগমন করেন। তাদের বরাত নিয়ে ‘ মর্নিং নিউজ ‘ জানায় যে,পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী হবে ঢাকা। পত্রিকাটি আরও আভাস দেয় যে, নতুন সরকারের কর্নধার হিসাবে খাজা নাযিমুদ্দিনের নাম শুনতে পাওয়া যাচ্ছে।এটা ছিলো বাংলার রাজনীতি থেকে সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের বিদায়ের অশুভ সঙ্কেতস্বরূপ। এ সময় মুসলিম লীগ সম্পাদক আবুল হাশিম ছুটিতে ছিলেন এবং তার জায়গায় হাবিবুল্লাহ বাহার দায়িত্ব পালন করছিলেন।
১৯৪৭ সালের ২৯ জুন শুক্রবার বঙ্গীয় আইন পরিষদের যে অংশ বাংলার মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলাগুলোর প্রতিনিধিত্ব করে, সে অংশের অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন স্পিকার নূরুল আমিন। পরিষদ পূর্ব বাংলার এমএলএ-দের ১০৬-৩৫ ভোটে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে বাংলা বিভাগ করা চলবে না। বর্ধমানের মহারাজা স্যার উদয় চাঁদ মাহতাব-এর সভাপতিত্বে অমুসলিম সংখ্যাগুরু (পশ্চিম বাংলা) অংশ ৫৮-২১ ভোটে প্রস্তাব গ্রহণ করে যে, বাংলা বিভাগ করতে হবে। ব্রিটিশ সরকারের ৩ জুনের ঘোষণার ভিত্তিতে সদস্যদের যুক্ত অধিবেশনে সভাপতিত্ব করেন নূরুল আমিন। উভয় অংশের যুক্ত বৈঠকে ১২৫-৯০ ভোটে বাংলা বিভাগের পক্ষে এবং নতুন গণপরিষদে যোগদানের বিরুদ্ধে প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। মুসলিম সংখ্যাগুরু জেলাগুলোর অংশ ১০৫-৩৬ ভোটে সিলেট জেলার পাকিস্তানভুক্তি কামনা করে প্রস্তাব গ্রহণ করে। ভোটের ফলাফল দেখলেই বোঝা যায় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে জনগণের ভাগ্য নির্ধারণের নামে কি প্রবঞ্চনা আর প্রহসনের অভিনয় করা হয়েছে। জনগণের ভাগ্য নিয়ে যুক্ত আধবেশনে এ. কে. ফজলুল হক অনুপস্থিত ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী এইচ, এস, সোহরাওয়ার্দী, হাসান ইস্পাহানি, খাজা নুরুদ্দীন ও আবুল হাশিম আসন গ্রহণ করেন পশ্চিম বাংলা গ্রুপে। কংগ্রেস নেতা কিরণশঙ্কর রায় আসন গ্রহণ করেন পূর্ব বাংলা গ্রুপে।
পৃষ্ঠা: ৮৯
বাংলা বিভাগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হবার পর সেদিনই প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দী তার প্রতিক্রিয়া জানান সংবাদপত্রে প্রদত্ত এক বিবৃতির মাধ্যমে।বিবৃতিতে তিনি বলেন, “আশা-নিরাশার যন্ত্রণার ইতি হলো অবশেষে। স্বাধীন সার্বভৌম বাংলা রাষ্ট্রের আদর্শের পৃষ্ঠে ছুরিকাঘাত করা হয়েছে। বাংলাকে দ্বিধাবিভক্ত করা হবেই অচিরেই, মুসলিম বাংলার ক্ষোভের বিশেষ কারণ নেই। আমরা অবশ্যই চেয়েছিলাম একটা সুষম ঐক্যের ভিত্তিতে গঠিত রাষ্ট্র, যেখানে আরা স্বনির্ভর হয়ে আমাদের সম্পদকে সদ্ব্যবহার করে বিশ্বের একটি অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধিশালী জাতি গড়ে তুলতে পারতাম। কিন্তু সেই লক্ষের পথে এগিয়ে যাওয়ার সৌভাগ্য থেকে আমরা বঞ্চিত হয়েছি…। আমাদের পথ আলাদা হয়ে গেছে। চলুন আমরা পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বের ভাব বজায় রেখেই পৃথক পথে এগিয়ে যাই এবং প্রতিহিংসার মনোভাব পোষণ ও প্রতিপক্ষকে পদানত করে কৃপা ভিক্ষায় বাধ্য করার হুমকি প্রদর্শন থেকে বিরত হই।”
বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ২১ জুন মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁর সভাপতিত্বে সীমানা নির্ধারণ কমিটি, নূরুল আমিনের সভাপতিতে সম্পদ কমিটি, মওলানা আকরম খাঁর সভাপতিত্বে সিলেট গণভোট কমিটি গঠন করা হয়। সোহরাওয়ার্দীকে একমাত্র সীমানা নির্ধারণ কমিটির সদস্য করা হয়। মুসলিম লীগ তাকে বাংলার নেতৃত্ব থেকে অন্যায়ভাবে অপসারণ করতে থাকে।
২৭ জুন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগ কার্যকরী কমিটি পূর্ব পাকিস্তানের। রাজধানী ঢাকায় স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। চূড়ান্ত ফয়সালা হবার আগেই। কলকাতার ওপর দাবি শিথিলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করায় সোহরাওয়ার্দী তীব্র প্রতিবাদ জানান। তিনি কোলকাতা রাখো’ আন্দোলন শুরু করেন। কলকাতাকে পূর্ব বাংলার অংশে রাখার জন্য তিনি আপ্রাণ চেষ্টা করেন এ. কে. ফজলুল হকও। ‘কোলকাতা রাখো’ আন্দোলন সমর্থন করেন। বাংলার অর্থ, বিশেষ করে পূর্ব বাংলার অর্থ দিয়েই কলকাতা শহরের উন্নতি। যাহোক সোহরাওয়ার্দীর ইচ্ছা ছিল কলকাতা হবে পূর্ব বাংলার রাজধানী। গভর্নর ব্যারোজ কলকাতাকে পূর্ববঙ্গের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে ছিলেন। কিন্তু মাউন্টব্যাটেন তার প্রস্তাবে সম্মত হন নি। খাজা নাযিমুদ্দিন গ্রুপ ছিল ঢাকায় রাজধানী করার পক্ষপাতী। তারা এ আন্দোলনকে মনেপ্রাণে সমর্থন করেন নি। ২৭ জন ঢাকায় রাজধানী স্থাপনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে মুসলিম লীগ ‘কোলকাতা রাখো’ আন্দোলনের পিতে ছুরিকাঘাত করে। হিন্দু-মারোয়াড়ি ব্যবসায়ীরা কলকাতা ছাড়তে নায়ল’ অন্যদিকে অবাঙালি ব্যবসায়ীরা কলকাতার পরিবর্তে ঢাকাকে রাজধানা কম আগ্রহী ছিলেন বেশি। তাদের মধ্যে ছিলেন আদমজি, দাউদ ও ইস্পাহানি। এ
পৃষ্ঠা: ৯০
ব্যাপারের মূলে ছিল এ ধারণা যে, অবাঙালী ব্যাবসায়ীরা পূর্ব বাংলায় তাহলে একচেটিয়া ব্যবসা করতে পারবেন।
বরিশালের যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডলকে জিন্নাহ কেন্দ্রীয় মন্ত্রী পদে নিয়োগের ব্যাবস্থা করেন। জিন্নাহর ষড়যন্ত্রে যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল পা দিলেন।যোগেন্দ্রনাথ মন্ডল নমঃশূদ্রদের নিয়ে পাকিস্তান সমর্থন করেন। অধিকাংশ নমঃশূদ্র ভারত বিভাগ এবং বাংলা বিভাগ সমর্থন করেন। তারা ছিলেন বর্ণ হিন্দুবিরোধী। বর্ণ হিন্দু সম্প্রদায় নমঃশূদ্রদের ঘৃণা করতো। তাই তারা হিন্দুস্থান সর্মথন করে পাকিস্তানের পক্ষে ভোট দেয়। ১৯৪৭ সালে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তানের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। কিন্তু তিনি ১৯৫০ সালে হিন্দু ও নমঃশূদ্রদের দাঙ্গা থেকে রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। ১৯৫০ সালে নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। ১৯৫১ সালে যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল পাকিস্তান ত্যাগ করে কলকাতায় বসবাস করেন। তার ভুল রাজনীতির কারণে পূর্ব বাংলা নমঃশূদ্র সম্প্রদায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়। তাদের মধ্যে অনেকে পশ্চিম বাংলায় চলে যায়। পূর্ব বাংলার নমঃশূদ্র সম্প্রদায় মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়।
১৯৪৭ সালের জুন মাসে সমানসংখ্যক হিন্দু-মুসলমান সদস্য নিয়ে ফ্রাডারিক বারোজকে সভাপতি করে পার্টিশন কাউন্সিল গঠন করা হয়। সোহরাওয়ার্দী কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত হন। কিন্তু পরে মুসলিম লীগ তাকে বাদ দিয়ে হামিদুল হক চৌধুরীকে কাউন্সিলের সদস্য নিযুক্ত করে। খাজা গ্রুপ সোহরাওয়ার্দীকে রাজনীতি ক্ষেত্রে পঙ্গু করার জন্য সবরকম ষড়যন্ত্র করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্য তখন নতুন পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা নির্বাচিত করা হবে। সোহরাওয়ার্দীকে জিন্নাহ বলেছিলেন বাংলার জন্য নতুন করে। পার্লামেন্টারি নেতা নির্বাচন করা হবে না। সোহরাওয়ার্দী বৃহত্তর বাংলা এবং ‘কোলকাতা রাখো’ আন্দোলন ও প্রদেশ বিভাগের দায়িত্ব নিয়ে তখন ব্যস্ত ছিলেন। গণভোটের পর সিলেটের ১৭ জন পরিষদ সদস্য প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর সাথে দেখা করেন এবং মন্ত্রিসভায় ৩ জন মন্ত্রী ও ৩ জন পার্লামেন্টারি সচিবের পদ দাবি করেন। সোহরাওয়ার্দী বলেন, পরবর্তী নির্বাচনের পূর্বে তাদের মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করা সম্ভব নয়। তখন সিলেটের সদস্যগণ খাজা নাযিমুদ্দিনের সাথে সাক্ষাৎ করে তাদেরকে মন্ত্রিত্ব ও পার্লামেন্টারি সচিবের পদ প্রদানের প্রস্তাব করেন। খাজা নাযিমুদ্দিন তাদের দাবি মেনে নেওয়ার আশ্বাস দিলে তারা খাজা গ্রুপে যোগ দেন। কুষ্টিয়ার শামসুদ্দিন আহমেদকেও মন্ত্রিসভায় স্থান দেবার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়।
বাংলার পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণের জন্য ৩০ জুলাই মাউন্টব্যাটেন কলকাতায় আগমন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার স্বাধীন বাংলা গঠনের
পৃষ্ঠা: ৯১
পরিকল্পনা নিয়ে মাউন্টব্যাটেনের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মাউন্টব্যাটেনকে রাজি করানোর জন্য তিনি শেষ প্রচেষ্টা চালালে ভাইসরয় তার পরিকল্পনা নাকচ করে দেন।
বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী অখণ্ড বাংলাকে ধরে রাখতে পারলেন না। তিনি শেষ পর্যন্ত চেয়েছিলেন অন্তত কলকাতাকে যৌথ শাসনে রাখা হোক। তাই তিনি কোলকাতা রাখো’ দাবি উত্থাপন করে। গভর্নর ব্যারোজ কোলকাতা রাখো’ প্রস্তাবে তাকে সমর্থন দেন। শহীদ সোহরাওয়ার্দী সাথে যে আলোচনা হয় গভর্নর ব্যারোজ তা ভাইসরয়কে এই মর্মে পত্র লিখে জানান যে “তারপর কলকাতা সম্পর্কে তার প্রস্তাব পেশ করেন। কলকাতা হল একটি বিশেষ বিষয় এবং অবশ্য তা বিশেষ বিবেচনার দাবি রাখে। প্রধানত ইউরোপীয় বণিকদের ব্যবসার স্বার্থকে কেন্দ্র করে এ শহর গড়ে উঠেছে এবং এর অবস্থান উভয়-পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার ওপর নির্ভরশীল। নিঃসন্দেহে হিন্দুরা সংখ্যাগুরু; মোট জনসংখ্যার তারা প্রায় শতকরা ৭৮ জন। যাহোক তিনি কলকাতার ভবিষ্যৎ উন্নতির জন্য দাবি তুলেছেন। এ শহরকে ধ্বংস হতে দেওয়া যায় না। যদি এ প্রদেশ বিভক্ত হয়ে যায় তবে সম্ভব হলে এ শহরকে সুযোগ দিতে হবে। তিনি (সোহরাওয়ার্দী) বলেন, এটা খুবই অন্যায় হবে যদি সকল রাজস্ব এক এক অঞ্চল পায়। অন্য অঞ্চলও এ শহরের উন্নয়নে অবদান রেখেছে। প্রায় সকল পাট পূর্ব বাংলায় উৎপন্ন হয় – এদিকে তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।”
হিন্দু নেতাদের বিরোধিতার জন্যেই তার ‘কোলকাতা রাখো’ আন্দোলনও ব্যর্থ হয়। তিনি দাবি করেন, কমপক্ষে ৬ মাস কলকাতাকে যৌথ প্রশাসনে রাখা হোক। কিন্তু এ প্রস্তাবের উত্তরে সর্দার প্যাটেল বলেছিলেন, “দুদিনের জন্যও নয়।” মাউন্টব্যাটেনের সাথে সাক্ষাতের পর সোহরাওয়ার্দীর বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। মুসলিম লীগ তার ওপর তখন অসন্তুষ্ট। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খান তাকে বিশ্বাস করতেন না। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর চির অনুগত ও বাধ্যগত খাজা নাযিমুদ্দিনের কলকাতার সাথে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ ছিল না। কিন্তু পূর্ব বাংলার প্রত্যেক জেলায় তার অনুগত নেতা ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকার খাজা শাহাবুদ্দিন, ফজলুর রহমান, ফরিদপুরের ইউসুফ আলী চৌধুরী, এ্যাডভোকেট আবদুস সালাম, ময়মনসিংহের গিয়াসউদ্দীন পাঠান ও অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, চট্টগ্রামের নুরুল হক চৌধুরী, নোয়াখালীর হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী, কুষ্টিয়ার ছাত্রনেতা শাহ আজিজুর রহমান প্রমুখ। শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দলে ছিলেন আবুল হাশিম,
পৃষ্ঠা: ৯২
মোহাম্মাদ আলী, নবাবজাদা হাসান আলী, আবুল মনসুর আহমেদ, মওলানা রাগীব আহাসান, ঢাকার কামরুদ্দীন আহমেদ, টাঙ্গাইলের শামসুল হক, ফরিদপুরের শেখ মুজিবর রহমান, ডা. এ.এম মল্লিক, নুরুদ্দীন আহমেদ প্রমুখ। আবুল হাশিম খাজা নাযিমদ্দিন-সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্ব নিয়ে বিরোধের সময় নীরব ছিলেন। কারন মুসলিম লীগ সভাপতি পদ নিয়ে নির্বাচনের সময় সোহরাওয়ার্দী নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করেন। বঙ্গীয় আইনসভার অধিকাংশ সদস্য খাজা নাযিমুদ্দিন গ্রুপের সমর্থক ছিলেন। খাজা গ্রুপ ছিল জিন্নাহর আশির্বাদপুষ্ট। তাই সযোগ সন্ধানী এমএলএ-গণ সোহরাওয়ার্দীর দল ত্যাগ করতে থাকে। সোহরাওয়ার্দীর সাথে ছিল নিবেদিতপ্রাণ যুবক শ্রেণী ও মুসলিম ছাত্রলীগের নেতা।
সোহরাওয়ার্দীর বহত্তর স্বাধীন বাংলার আন্দোলন তখন ব্যর্থ। কলকাতাকে ধরে রাখতে পারলেন না। মন্ত্রিত্বের লোভে এমএলএ-গণ খাজা নাযিমুদ্দিনের দলে ভির জমায়। খাজা নাযিমুদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হবার জন্য ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। তিনি মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও লিয়াকত আলী খানের পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচিত হওয়ার অনুমতি লাভ করেন। সোহরাওয়ার্দী পূর্ব ও পশ্চিম বাংলার মধ্যে সম্পদ বণ্টন ও হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে শান্তি স্থাপনে যখন ব্যস্ত, তখন খাজা গ্রুপ দলীয় নেতা নির্বাচিত করার জন্য বঙ্গীয় আইন সভার সদস্যদের সভা আহ্বান করে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ সোহরাওয়ার্দীকে বলেছিলেন, পুনরায় বাংলায় দলীয় নেতার নির্বাচন হবে না। তাই তিনি বাউন্ডারি কমিশনের সামনে মুসলিম লীগের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় কাগজপত্র তৈরি করছিলেন। তার সমর্থকগণ দলনেতা নির্বাচনের কথা পূর্বাহে জানালেও তিনি তা বিশ্বাস করেন নি। মুসলিম লীগের জেনারেল সেক্রেটারি লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীকে পছন্দ করতেন না। সোহরাওয়ার্দীর খ্যাতি ও প্রশাসনে তার দক্ষতা লিয়াকত আলী খানকে পরশ্রীকাতর করে তোলে এবং তিনি খাজা নাযিমুদ্দিনের সাথে আঁতাত করেন। লিয়াকত আলী খান ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট দলীয় নেতা নির্বাচনের তারিখ নির্ধারণ করেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতা আই. আই. চুন্দ্রিগড়ের সভাপতিত্বে দুটো সভা অনুষ্ঠিত হয়। খাজা নাযিমুদ্দিনের দলের খাজা শাহাবুদ্দিন ও ফজলুর রহমান নগদ টাকার বিনিময় ভোট সংগ্রহে নামেন। অর্থের ও পদের বিনিময়ে অনেক সদস্য খাজা নাযিমউদ্দিনের পক্ষে চলে আসেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীরও কয়েকজন
ভক্ত অর্থের বিনিময় ভোট সংগ্রহের প্রস্তাব তার কাছে পেশ করেন। আর.পি. সাহা যত টাকা লাগবে তা দিতে তার প্রস্তুতির কথা জানান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী
পৃষ্ঠা: ৯৩
তার প্রস্তাব শুনে তার ব্যক্তিগত সচিব মাহমুদ নুরুল হুদাকে জানালেন যে, তিনি যেন আর.পি, সাহাকে বলেন যে টাকা দিয়ে ভোট ক্রয় করে নেতা হবার শখ সোহরাওয়ার্দীর নেই। শেষে খাজা নাযিমুদ্দিন ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচনের জন্য ভোট হয়। খাজা নাযিমউদ্দিন পান ৭৫ ভোট এবং সোহরাওয়ার্দী পান ৩৯ ভোট। বসিরহাটের আবদুর রহমানের প্রস্তাবে সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিমবঙ্গ মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচন করা হয়। একই সময় পাঞ্জাবের মুসলিম লীগ পার্লামেন্টারি পার্টির নতুন করে নেতা নির্বাচন করা হয় নি। এ ছিল কেন্দ্রীয় লীগ নেতাদের গভীর ষডযন্ত্র। তারা চেয়েছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে একজন একান্ত অনুগত নেতা যিনি বাংলা স্বার্থ নিয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের সাথে বিরোধী ভূমিকায় নামবেন না। নির্বাচনের পর সোহরাওয়ার্দী খাজা নাযিমুদ্দিনের সাথে করমর্দন করে সোজা বাসায় চলে যান এবং সারারাত গভীর নিদ্রায় কাটান। পরাজয়কে তিনি স্বাভাবিকভাবে মেনে নেন। তিনি অসৎ উপায় অবলম্বন করে নেতা নির্বাচিত হতে পারতেন। কিন্তু তা তিনি করেন নি। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ বিভক্ত বাংলা ও পাঞ্জাব নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠনের ইংরেজ সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন এই বলে যে, পোকা খাওয়া ও পঙ্গু পাকিস্তান রাষ্ট্র মুসলিম লীগের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। পরিশেষে তিনি বিভক্ত পাঞ্জাব ও বাংলা গ্রহণ করায় সোহরাওয়ার্দী-শরশ্চন্দ্র বসুর বৃহত্তর বাংলার আন্দোলন স্তিমিত হয়ে পড়ে। ইংরেজ সরকার ১৪ ও ১৫ই আগস্ট তারিখে পাকিস্তান ও ভারত সরকারের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। দেশ বিভাগের প্রাক্কালে প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ওপর তিনটি দায়িত্ব ন্যস্ত করা হয়। প্রথম দায়িত্ব ছিল- প্রদেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করা। প্রায় সকল মুসলিম মন্ত্রী, নেতা, কর্মকর্তা কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে যান। পশ্চিম বাংলা তথা ভারতের মুসলমানদের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য তখন তিনি একমাত্র নেতা। দ্বিতীয় দায়িত্ব ছিল বঙ্গভঙ্গের তত্ত্বাবধান করা সম্পদের সুষম বণ্টন তদারকি ও প্রশাসনের জন্য জনবল নির্ধারণ করা। তিনি পশ্চিম ও পূর্ব বাংলার সরকারের প্রশাসনিক কাঠামোও নির্ধারণ করেন। বিশেষ করে পূর্ব বাংলা সরকারের কোনো প্রশাসনিক কাঠামো, জনবল ও ভবনাদি ছিল না। তিনি অত্যন্ত দক্ষতার সাথে পূর্ব বাংলার প্রশাসনের ভিত্তি স্থাপন করেন। এই প্রসঙ্গে ভাইসরয় মাউন্টব্যাটেন তার ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবেদনে লিখেছেন যে, “ঘোষণার পরে সোহরাওয়ার্দী পুনরায় আমার সাথে দেখা করতে আসেন। একজন মুসলমান নেতা পশ্চিম বাংলায় বসবাস করেও তিনি উপযুক্ত পূর্ব বাংলা গড়ার জন্য আশ্চর্যজনক মানসিকতা ও দৃঢ়তা প্রদর্শন করেছেন। তার কাছে
পৃষ্ঠা: ৯৪
অনেক পরিকল্পনা ছিল যার মধ্যে অন্যতম ছিল- প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রভৃতি সংগ্রহ করে পূর্ব পাকিস্তানকে নিজের পায়ে দাঁড় করানো। তিনি বলেন যে ইতিমধ্যে আমেরিকান ব্যবসায়ীদের ভেতর থেকে অনেক উৎসাহী উদ্যোক্তা সাড়া দিয়েছেন। কিন্তু কোনো ব্রিটিশ এগিয়ে না আসায় তিনি নিরুৎসাহিত হয়েছেন। “শহীদ সোহরাওয়ার্দী নিজে কলকাতা ত্যাগ না করলেও পূর্ব বাংলার শাসন ব্যবস্থা দাড় করিয়ে দেন এবং পূর্ব বাংলায় আসতে আগ্রহী কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সেখানে পাঠাতে থাকেন। ঢাকায় রাজধানী প্রতিষ্ঠার জন্য জমি হুকুন দখল এবং প্রয়োজনীয় নথিপত্র ও সম্পদ ভাগ করেছেন। তার তৃতীয় দায়িত্ব ছিল নিজ দলে তার অবস্থান টিকিয়ে রাখা। তিনি আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা ও দেশ বিভাগ নিয়ে ব্যস্ত থাকায় দলে তার নেতৃত্ব ধরে রাখতে পারেন নি। তিনি হেরে যান খাজা নাযিমুদ্দিনের কাছে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ১৩ আগস্ট পর্যন্ত অবিভক্ত বাংলার প্রধানমস্ত্রী ছিলেন। ১৩ আগস্ট তিনি পশ্চিম বাংলার মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র ঘোষ ও পর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাযিমউদ্দীনকে তার দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন।
১৯৪৭ সালের ৩ জুন দেশ বিভাগের ঘোষণার ৭ দিনের মধ্যে সোহরাওয়ার্দীর সরকার ঢাকাকে রাজধানী ঘোষণা করে এবং ঢাকা শহরের চারদিকে ২০ মাইল এলাকা অধিগ্রহণ করে। এ সত্ত্বেও খাজা নাযিমুদ্দিন সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করতে থাকেন। সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে তখন ‘কোলকাতা রাখো’ আন্দোলন চলছে। এমন কি এ কে ফজলুল হকও এ আন্দোলনের পথ অনুসরণ করেন। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ বাউন্ডারি কমিশনের সামনে এ কে ফজলুল হক এবং শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে প্রতিনিধিত্ব করতে না দিয়ে যুক্ত প্রদেশের জনৈক অবাঙালি ওয়াসিমকে উকিল নিযুক্ত করা হয়। খাজা নাজিমুদ্দিন দলীয় নেতা নির্বাচিত হবার পর তার দল ‘কোলকাতা রাখো আন্দোলন বন্ধ করে দেন। তাদের যুক্তি ছিল কলকাতা হিন্দুপ্রধান শহর এবং কলকাতার দাবি পরিত্যাগ করলে পূর্ব বাংলা নগদ ৩৩ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ পাবে। অন্যদিকে সোহরাওয়ার্দী ও তার পত্রিকা ‘ইত্তেহাদ কলকাতার দাবি করতে থাকে।
প্রাদেশিক বাটোয়ারা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন গভর্নর, পশ্চিম বাংলার পক্ষে প্রতিনিধি ছিলেন নলিনী সরকার ও ধীরেন মুখার্জি, পূর্ব বাংলার পক্ষে ছিলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। কেন্দ্রীয় বাটোয়ারা কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ছিলেন বড়লাট লর্ড মাউন্টব্যাটেন, ভারতের পক্ষে ছিলেন সর্দার এইচ, এম, প্যাটেল, পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন লিয়াকত আলী খান ও চৌধুরী মুহম্মদ আলী। খাজা
পৃষ্ঠা: ৯৫
নাযিমুদ্দিন মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে অক্টোবর মাসে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সে বাদ দিয়ে নিজেই বাটোয়ারা কাউন্সিলের সদস্য হন। প্রাদেশিক কাউন্সিল বিশেষজ্ঞ ছিলেন রাজস্ব সচিব ও পাটিশন কাউন্সিলের সম্পাদক খান বাহাদুর মাহবুবুদ্দিন আহমেদ ও এককালীন সুপারিনটেনডেন্ট অব ইঞ্জিনিয়ার আব্দুর জব্বার। পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিগণ বুকভ্যালু (আদিমূল্যে) সম্পদের দাম ধরতে চান। শহীদ সোহরাওয়ার্দী চেয়েছিলেন বাজার দরে মূল্য নির্ধারন কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানিরা বুক ভ্যালুতে মূল্য ধরতে চায়। তাহলে তাদের ভারতকে ও করাচির জন্য অর্থ প্রদান করতে হবে না। শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে বাদ দেওয়ার পর হামিদুল হক চৌধুরী ও নাযিমদ্দিন বাজার মূল্যে সম্পদের মূল নির্ধারণ করতে ব্যর্থ হন। ১৯৪৭ সালের ২৪ সেলে তারিখে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর স্যার ফ্রেডারিক বোনের সভাপতিতে সম্পদ ভাগের গুরুত্বপূর্ণ সভা হয়। পরবর্তী সভা ৮ নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত হয়। ৯ ডিসেম্বর ভারতের গণপরিষদে সর্দার প্যাটেল ঘোষণা করেন যে, আদি সম্পদের মূল্য নির্ধারণে উভয় সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিগণ সম্মত হয়েছেন। পশি বাংলার প্রতিনিধিগণ হিসেব করে দেখেন যে, পশ্চিম বাংলার পূর্ব বাংলার কাছে পাওনা ৯ কোটি এবং পূর্ব বাংলার পশ্চিম বাংলার কাছে পাওনা ৩ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিল আদি-মূল্য পদ্ধতি গ্রহণ করে নি। এক দেশে দুই নীতি। লাহোরের জন্য পাকিস্তান সরকারহীন পন্থা অবলম্বন করে। কেন্দ্রীয় পার্টিশন কাউন্সিল শুধু কলকাতা ছাড়ে নি। তারা কলকাতার দামে লাহোর ক্রয় করে। খাজা নাযিমুদ্দিনের গ্রুপ পূর্ব বাংলার স্বার্থের কথা বলে জিন্নাহ-লিয়াকত আলী খানের বিরাগভাজন হতে চায় নি। তারা শুধু সম্পদই ছেড়ে দেয়নি, ভূমিও ছেড়ে দিয়েছেন। খুলনা পশ্চিম বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়। কলকাতার বেলভেডিয়ার হাউজে সীমান্ত নির্ধারণী মামলায় এ. কে. ফজলুল হক স্যার রেডক্লিফের নিকট ওকালতি করে খুলনা জেলাকে পূর্ব বাংলার অন্তর্ভুক্ত করেন। লীগ নেতাদের ঔদাসীন্যের জন্য পূর্ব বাংলাকে টাকা, সম্পদ ও ভূমির ব্যাপারে বঞ্চিত করা হয়। কেন্দ্রের এই অবজ্ঞার প্রধান কারণ মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ বুঝতে পারেননি। তারা ভাবতে পারেনি যে, বাংলা বিভাগ হবে এবং পূর্ব বাংলা পাকিস্তানভুক্ত হবে। পূর্ব বাংলা ছিল পাকিস্তানের জন্য অতিরিক্ত লাভস্বরূপ। যে সকল অক্ষর নিয়ে পাকিস্তান শব্দ গঠন করা হয়েছে তার মধ্যে বাংলার স্থান ছিল না। পাঞ্জাবের পি, আফগানিস্তানের এ, কাশ্মীরের কে, বেলুচিস্তানের ‘স্তান’ নিয়ে পাকিস্তান। শব্দসমষ্টির জন্ম। ১৯৩১ সালে লাহোরে মুসলিম লীগ অধিবেশনে কবি ইকবাল মুসলমানদের জন্য যে পৃথক আবাস ভূমি দাবি করা হয় সে প্রস্তাবে বাংলাদেশ
পৃষ্ঠা: ৯৬
অন্তর্ভুক্ত ছিল না। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ নেতৃত্ব প্রথম থেকেই বাংলার প্রতি বৈষম্যমূলক নীতি গ্রহণ করে।
১৯৪৭ সালের ভারত স্বাধীন আইনে ভারতে একটি এবং পাকিস্তানে একটি গণপরিষদ গঠন করা হয়। পাকিস্তানের গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ৮০ জন। পূর্ব বাংলার লোকসংখ্যা ছিল পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার শতকরা ৫৬ ভাগ। অন্যান্য প্রদেশ থেকে জনসংখ্যার অনুপাতে সদস্য নির্ধারিত হয়। জনসংখ্যা বেশি হলেও পর্ব বাংলার ভাগে ৪০ জন সদস্য ছিল। মুসলিম লীগের অনেক নেতা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হতে পারেন নি। তাদের নির্বাচিত করার অনুরোধ করা হলে পূর্ব পাকিস্তানের খাজা নাযিমুদ্দিনের মুসলিম লীগ সরকার সম্মত হয়। নবাবজাদা লিয়াকত আলী খান, আই, এইচ, কোরেশী সীমান্তের আব্দুল কাইয়ম খানসহ মোট ৬ জন গণপরিষদ সদস্য পূর্ব পাকিস্তান থেকে নির্বাচিত হন।সোহরাওয়ার্দীর মামাতো বোন বেগম সায়েস্তা একরামুল্লাহ পূর্ব বাংলা থেকে গণপরিষদের একমাত্র মহিলা সদস্য ছিলেন। ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট পাকিস্তানের রাজধানী করাচিতে জিন্নাহর সভাপতিত্বে পাকিস্তান মুসলিম লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সোহরাওয়ার্দী এ সভায় যোগদান করেন। কিন্তু করাচিতে বসেও তিনি কলকাতার অবস্থা সম্পর্কে অবহিত থাকতেন। ১১ আগস্ট করাচি শহরে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন বসে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ এতে সভাপতিত্ব করেন। তিনি তার ভাষণে ঘোষণা করেন যে, “ এখন থেকে মুসলমান মুসলমান থাকবে না, হিন্দু হিন্দু থাকবে না, খ্রিস্টান খ্রিস্টান থাকবে না, বাঙালি বাঙালি থাকবে না, পাঞ্জাবি পাঞ্জাবি থাকবে না – সকলেই এখন পাকিস্তানি।” তিনি তার ভাষণে দ্বিজাতিতত্ত্ব অস্বীকার করলেন। অধিবেশনে ফরিদপুরের মৌলভী তমিজউদ্দিন খানকে পাকিস্তানের গণপরিষদের স্পিকার নির্বাচিত করা হয়। সোহরাওয়ার্দী এ অধিবেশনে যোগদান করেন।
১৯৪৭ সালের ৭ থেকে ১১ আগস্ট তারিখ পর্যন্ত করাচি অবস্থানকালে সোহরাওয়ার্দীকে কায়েদে আজম মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের ভ্রাম্যমাণ রাষ্ট্রদূত ও ব্যক্তিগত প্রতিনিধি নিয়োগ করার প্রস্তাব দেন। তার প্রধান দায়িত্ব হবে পাকিস্তানকে বিশ্বে পরিচয় করিয়ে দেওয়া। কিন্তু ভারতের ৪ কোটি মুসলমানের কথা চিন্তা করে সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের মন্ত্রিত্ব গ্রহণ করেননি। তখনও মন্ত্রিসভা গঠন করা হয় নি। লিয়াকত আলী খান সোহরাওয়ার্দীকে ভ্রাম্যমাণ দূত ও ব্যক্তিগত প্রতিনিধির পদ প্রদানের কথা শুনে মন্তব্য করেন যে, কে এ রকম পদ প্রদান করা হলে তিনি সেটা আনন্দের সাথে গ্রহণ করতেন।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এর দায়িত্ব গ্রহণের জন্য মুহাম্মদ আলী জিন্না
পৃষ্ঠা: ৯৭
ও তার বোন ফাতেমা জিন্না ডাকোটা বিমানে ১৯৪৭ সালে ৭ আগস্ট করাচী পৌছেন। তাকে বিশাল সম্বর্ধনা দেওয়া হয়। তিনি সিন্ধ প্রদেশের গভর্নরের বাসভবনে ওঠেন। এ ভবনে জিন্নাহ মৃত্যু পর্যন্ত ছিলেন। বাসভবনে প্রবেশকালে তার স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্টট এস এম আহসান কে বলেন, “
Do you know, I never expected to see Pakistan in my life time . we have to be very grateful to God for what we have achieve “ আপনি কি জানেন, আমার জীবদ্দশায় আমি কখনো আশা করিনি যে, পাকিস্তান দেখে যেতে পারব।
সহায়ক গ্রন্থ
হারুন অর রশীদ, বাংলাদেশ: রাজনীতি সরকার ও শাসনতান্ত্রিক উন্নয়ন ১৭৫৭-২০০০
হারুন অর রশীদ, বাঙ্গালির রাষ্ট্রচিন্তা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
সিরাজ উদ্দীন হোসেন, ইতিহাস কথা কয়
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, ভারত বিভাগ- ঐতিহাসিক ভুল
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, শেরে বাংলা একে ফজলুল হক
পৃষ্ঠা: ৯৮
তৃতীয় অধ্যায়
পাকিস্তান রাষ্ট্রীয় কাঠামো ও বৈষম্য
ক. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাঠামো
জাতিততত্বের ভিত্তিতে ব্রিটিশ সরকার ১৯৪৭ সালের ৩ জুন ভারত ভাগ করে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেয়। এ ক্ষেত্রে পাঞ্জাব ও বাংলা ভাগ হবে। ভারত-পাকিস্তানের সীমানা নির্ধারণের জন্য ভারত সরকার ১৯৪৭ সালের ৩০ জুন বাউন্ডারী কমিশন গঠন করে। ইংল্যান্ডের স্যার সিরিল র্যাডক্লিফকে বাউন্ডারি কমিশনের চেয়ারম্যান নিয়োগ করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আবুল হাশিম বৃহত্তর স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠায় ব্যর্থ হলে তারা কলকাতা রাখ আন্দোলন শুরু করেন। একে ফজলুল হক কলকাতার দাবি সমর্থন করেন। স্যার রেডক্লিফ অন্যায়ভাবে মুসলমান প্রধান জেলা মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর, সিলেট ভাগ করে ভারতকে দিয়ে দেয়। সম্পদ বণ্টনে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করা হয়। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এক-চতুর্থাংশ পশ্চিম পাকিস্তানের। প্রথম থেকে সেনাবাহিনী বণ্টনে পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করা হয়। পূর্ব বাংলার অর্থে কলকাতা শহর গড়ে উঠেছে। কলকাতা ভারতকে দেওয়া হয়। পূর্ব বাংলার ভাগে কোনো শিল্প ছিল না। পূর্ব বাংলা হতদরিদ্র। সম্পদ ভাগ করে বেশির ভাগ পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ে যায়। পূর্ব বাংলার বঞ্চনার ইতিহাস ১৯৪৭ সালে বিভাগ থেকে শুরু হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক কাঠামো
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সরকারের কাঠামো প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯৩৫ সালে ভারত শাসন আইনের অধীনে। পাকিস্তান নতুন শাসনতন্ত্র প্রণয়ন না করা পর্যন্ত ১৯৩৫ সালের আইন অনুসরণ করা হবে।
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন
১. যুক্ত রাষ্ট্র ব্যবস্থা
২. দপ্তর বণ্টন- কেন্দ্রের বিষয়- দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র, যোগাযোগ
পৃষ্ঠা: ৯৯
৩. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন
৪. কেন্দ্রে দ্বৈত শাসন- গভর্নর জেনারেলের বিশেষ দায়িত থাকবে। মন্ত্রীসভা থাকবে। গভর্নর জেনারেল গণপরিষদ ও মন্ত্রিসভা ভেঙে দিতে পারবেন। জরুরি অবস্থায় গভর্নর জেনারেল ৯২ক ধারা জারি করে মন্ত্রীসভা ভেঙে দিতে পারবে।
৫. প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন- ১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইনে প্রদান করা- মন্ত্রিসভা থাকবে।
কেন্দ্রীয় গণপরিষদের সদস্য সংখ্যা থাকবে ৮০ জন। পূর্ব বাংলা থেকে ৪০ জন পশ্চিম পাকিস্তানের ৪০ জন। প্রাদেশিক আইনসভায় ২৫০টি আসন থাকবে।
কেন্দ্রীয় সরকার
১৯৩৫ সালের ভারত শাসন আইন অনুসারে ইংল্যান্ডের রানী মুসলিম লীগ নেতা মুহাম্মদ আলী জিন্নাহকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করেন। বিট্রিশ সরকারের ইচ্ছা ছিল লর্ড মাউন্টব্যাটেন এক সাথে ভারত ও পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল থাকবেন। জিন্নাহ সম্মত না হওয়ায় তাকেই পাকিস্তানের গভর জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তিনি ৮ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। তার মধ্যে মাত্র দু’জন পূর্ব বাংলা থেকে ১ জন পশ্চিম পাকিস্তানের। এ সময় পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৫০ লাখ। তার মধ্যে ৫ কোটি বাঙালি এবং পশ্চিম পাকিস্তানি ৪ কোটি ৫০ লাখ। পাকিস্তানের শুরু থেকে সরকার পূর্ব বাংলার প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করতে থাকে এবং বিমাতাসুলভ আচরণ করে।
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট গঠিত পাকিস্তানের মন্ত্রিসভা
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ- গভর্নর জেনারেল
লিয়াকত আলী খান- প্রধানমন্ত্রী, পশ্চিম পাকিস্তান
আই আই চুন্ড্রিগড়- বাণিজ্য-শিল্প, পশ্চিম পাকিস্তান
গোলাম মুহাম্মদ- অর্থ, পশ্চিম পাকিস্তান
সরদার আবদুর রব নিসতার- যাতায়াত, পশ্চিম পাকিস্তান
রাজা গজনফর আলী খান- খাদ্য ও কৃষি, পশ্চিম পাকিস্তান স্যার মুহাম্মদ
জাফরুল্লাহ- পররাষ্ট্র, পশ্চিম পাকিস্তান
যোগেন্দ্রনাথ মণ্ডল- আইন, শ্রম, পূর্ত, পূর্ব পাকিস্তান
ফজলুর রহমান- শিক্ষা, পূর্ব পাকিস্তান।
পৃষ্ঠা: ১০০
পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মৌল্ভী তমিজ উদ্দিন খান গনপরিষদের স্পিকার নির্বাচিত হন।
কেন্দ্রীয় সরকারের মহাসচিব নিযুক্ত হন পশ্চিম পাকিস্তানের চৌধুরী মুহাম্মদ আলী। কেন্দ্রীয় সরকারের সকল সচিব, যুগ্ম সচিব ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানের।
পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভা
স্যার ফেডারিক বোর্ন- গভর্নর
খাজা নাজিমউদ্দিন -মুখ্যামন্ত্রী
নুরুল আমিন- বাণিজ্য শিল্প
আবদুল হামিদ- শিক্ষা
সৈয়দ মুহাম্মদ আফজাল- কৃষি, খাদ্য
হামিদুল হক চৌধুরী- অর্থ
হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী- স্বাস্থ্য
আব্দুল করিম ছিলেন আইনসভার স্পিকার।
পর্ব পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর জিওসি ছিলেন জেনারেল আইয়ুব খান। বাঙালিদের জনপ্রিয় নেতা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে মন্ত্রিত্ব দেওয়া হয়নি। বাঙালিদের বঞ্চিত করার জন্য তাদের দূরে রাখা হয়। পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ লোক পূর্ব পাকিস্তানে বাস করে। তাদের মাতৃভাষা বাংলাকে নির্বাসন দেওয়া হয়। পাকিস্তানের দাপ্তরিক ভাষা ছিল উর্দু এবং ইংরেজি। পোস্টকার্ড, স্ট্যাম্প ও মনিঅর্ডারে বাংলা ভাষা স্থান পায়নি। স্থান দেওয়া হয়েছে উর্দুকে। মুসলিম লীগ সরকার সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য সৃষ্টি করে। তারা বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে। মুসলিম লীগ সরকারের নীতি ছিল দ্বিজাতিতত্ত্ব। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান হয়েছে। তখন তারা ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু করে। বিরোধী দলের প্রতি তারা নির্যাতন শুরু করে। শক্তিশালী বিরোধী দল না থাকায় মুসলিম লীগের সীমাহীন শোষণ চলতে থাকে। পাকিস্তান সৃষ্টির পরই সরকার কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ করে তাদের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার করে।
কেন্দ্রীয় সরকারের বৈষম্য
ক্ষমতার উৎসমূলে ছিল পশ্চিম পাকিস্তান- প্রথম গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পশ্চিম পাকিস্তানের, প্রথম প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান পশ্চিম
পৃষ্ঠা: ১০১
পাকিস্তানের। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যুর পর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানকে আততায়ীরা রাওয়ালপিন্ডিতে হত্যা করে। তার মৃত্যুর পর গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। গভর্নর জেনারেল হলেন অর্থমন্ত্রী গোলাম মুহাম্মদ। তিনি একজন আমলা। তার ক্ষমতা গ্রহণের মাধ্যমে গনতন্ত্র নির্বাসিত হতে থাকে। খাজা নাজিমউদ্দিন পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম হলেও তিনি ছিলেন উর্দুভাষী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের তল্পীবাহক। তিনি কখনো পূর্ব বাংলার পক্ষে কথা বলেননি। বৈষম্য দূর করার জন্য কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ১৯৫৩ সালে গভর্নর জেনারেল গোলাম মহম্মদ প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ক্ষমতাচ্যুত করে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী চৌধুরীকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। মুহাম্মদ আলী বাঙালি হলেও তিনি বাঙালিদের কথা বলেননি। ১৯৫৫ সালে মেজর জেনারেল ইসকান্দার মির্যা পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ইস্কান্দার মির্জা ছিলেন বাঙালি বিদ্বেষী, গণতন্ত্রের শত্রু। তিনি ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তিনি পূর্ব পাকিস্তানে ৯২ক ধারা জারি করে মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর তিনি সামরিক আইন জানি জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত করেন।
জেনারেল আইয়ুব খানের সময় disparity বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পায়। মুসলিম লীগ মন্ত্রীদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা ছিলেন আমলা নির্ভরশীল। অন্যদিকে আমলারা প্রায় সকলে ছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানি সতরাং তারা পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থ দেখেছেন। পূর্বাঞ্চলের প্রতি বৈষম্য বৃদ্ধি পেতে। থাকে। আইয়ুব খানের ১০ বছরে পূর্ব পাকিস্তান শ্মশানে পরিণত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সরকারকে জিজ্ঞেস করলেন- পূর্ব বাংলা শ্মশান। কেন?
১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনে তিনি ঘোষণ করেন- পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব বাংলার প্রতি শোষণ বন্ধ না হলে. স্বায়ত্তশাসন না দিলে পশ্চিম পাকিস্তানকে আস্সালামু আলাইকুম জানাবেন।
কেন্দ্রীয় সরকার ছিল অবাঙালিদের নিয়ন্ত্রণে। কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনিতে পরিণত করে। ঔপনিবেশিক আমলের ন্যায় পাকিস্তানিরা বাঙালিদের শোষণ করে।
১০২
খ. সামরিক ও বেসামরিক আমলাতান্ত্রিক প্রভাব
কেন্দ্র পশ্চিম পাকিস্তানিদের দখলে
১৯৪৭-৭০ সাল পর্যন্ত একবার মাত্র একজন বাঙালি খাজা নাজিমউদ্দিন গভর্নর জেনারেল ছিলেন। তিনি ছিলেন পাকিস্তানিদের আস্থাভাজন। দীর্ঘ ২৪ বছরে মাত্র ১ জন বাঙালি ৩ বছর ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন। ১৯৪৭-৫৮ সাল পাকিস্তানের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ৭ জন। তাদের মধ্যে তিনজন ছিলেন বাঙালি খাজা নাজিমউদ্দিন, বগুরার মোহাম্মদ আলী এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। একমাত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব বাংলার উন্নয়ন ও দু অঞ্চলের বেষম্য দূর করার জন্য সংখ্যাসাম বা প্যারীটি নীতি অনুসরণ করেন। তিনি বাঙালিদের পক্ষে কাজ করার জন্য তাকে প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে বিদায় দেওয়া হয়। এ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিদের ষড়যন্ত্র।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানের অধীনে যারা বাঙালি মন্ত্রী ছিলেন। তারা ছিলেন জন জনবিচ্ছিন্ন ও ঘৃনিত। এমনকি বাঙালিরা নিজ প্রদেশ শাসনের সুজোগ পায়নি। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরদের মধ্যে একমাত্র ফজলুল হক ও সুলতান উদ্দিন বাঙালি ছিলেন। অধিকাংশ জেলা প্রশাসক ও সচিব ছিলেন অবাঙালি। সোহরাওয়ার্দী সংখ্যাসাম্য নীতি প্রবর্তন করার ফলে বাঙালিরা সেনাবাহিনী ও সিভিল সার্ভিসে প্রবেশের সুযোগ পায়। পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশের পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক কোটা এক-পঞ্চমাংশ পেত। সংখ্যাসাম্য নীতি থাকলেও পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ন্যায্য অংশ দেয়নি। বাঙালিরা বঞ্চনার শিকার হয়েছে। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের ৪২০০০ কর্মকর্তা-কর্মচারীর মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যা ছিল মাত্র ২৯০০ এবং তারা ছিলেন নিম্ন পদে।
১৯৬০-এর দশক পর্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে দুই অঞ্চলের তুলনামূলক চিত্র:
পদের নাম | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান |
সচিব (১৯৬৮ পর্যন্ত) | ০ | সকল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি |
অর্থ এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয় সচিব (১৯৬৮ পর্যন্ত) | ০ | সকল পদে পশ্চিম পাকিস্তানি |
চেয়ারম্যান, ডেপুটি চেয়ারম্যান পরিকল্পনা কমিশন | ০ | সকল পদে |
পিআইএ- চেয়ারম্যান, প্রশাসকবৃন্দ | ০ | সকল পদে |
পাকিস্তান স্টেট ব্যাংক গভর্নরবৃন্দ (১৯৬৭ পর্যন্ত) | ০ | সকল পদে |
পাকিস্তানের অর্থমন্ত্রী | ০ | সকল পদে |
উৎস্য: সাফার এ আকন, East Pakistan and Politics of Regionalism
পৃষ্ঠা: ১০৩
পর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে parity বা সাম্য প্রতিষ্ঠার কথা বলা হলেও বাস্তবে তা হয়নি।
১৯৬৬ সালে কেন্দ্রীয় সরকারে গেজেটের কর্মকর্তাদের মধ্যে ৩৭০৮ জন পশ্চিম পাকিস্তানি এবং ১৩৩৮ জন বাঙালি। কর্মচারীদের মধ্যে বাঙালি ছিল ২৬৩১০ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যা ছিল ৮২৯২ জন।
১৯৫৫ এবং ১৯৬৮ সালে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সচিবদের অবস্থা:
পদ | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান |
সচিব | ০ | ১৯ |
যুগ্ম সচিব | ৩ | ৩৮ |
উপসচিব | ১০ | ১২৩ |
সেকশন অফিসার | ৩৮ | ৫১০ |
ফরেন সার্ভিস
ফরেন সার্ভিস ক্যাডা
সময় | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান |
১৯৫৩ | ৩৬ | ৮৩ |
৩১% | ||
১৯৬২ | ৫০ | ১৯০ |
২০.৮% |
প্রতিরক্ষা সার্ভিস
পদ | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান |
লে. জেনারেল | ০ | ৩ |
মেজর জেনারেল | ০ | ২০ |
ব্রিগেডিয়ার | ১ | ৩৪ |
কর্নেল | ২ | ৪৯ |
লে. কর্নেল | ২ | ১৯৮ |
মেজর | ১০ | ৫৯০ |
মোট | ১৪ | ৮৯৪ |
নৌবাহিনী | ১৪ | ৫৯৩ |
বিমান বাহিনী | ৬০ | ৬৪০ |
গ. অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক বৈষম্য
১৯৪৭ সালে ভারত বিভাগ কালে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় স্কুল-কলেজ ও ছাত্রের সংখ্যা বেশি ছিল
প্রতিষ্ঠান | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান | ||
১৯৪৭-৪৮ | ১৯৬৮-৬৯ | ১৯৪৭-৪৮ | ১৯৬৮-৬৯ | |
প্রাথমিক বিদ্যালয় | ৮৪১৩ | ৩৯৪১৮ | ২৯৬৬৩ | ২৮৩০৮ |
মাধ্যমিক বিদ্যালয় | ২৫৯৮ | ৪৪৭২ | ৩৪৮১ | ৩৯৬৪ |
কলেজ | ৪০ | ২৭১ | ৫০ | ১৬২ |
মেডিকেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, কৃষি কলেজ | ৪ | ১৭ | ৩ | ৯ |
বিশ্ববিদ্যালয় | ২ | ৬ | ১ | ৪ |
দেখা যায়, শিক্ষা ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ১৯৪৭ সালের তুলনায় অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তান পিছিয়ে ছিল।
অর্থনীতি ক্ষেত্রে ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগকালে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে ছিল। ১৯৪৮-৪৯ সালে জাতীয় আয়ের ৫৭.৪৯ ভাগ অর্জিত হয় পর্ব পাকিস্তান থেকে। এ সময় পাকিস্তানে রপ্তানি আয়ের উৎস ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পাট, চা, চামড়া। রপ্তানি আয়ের বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয় হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে শিল্প-কলকারখানা প্রতিষ্ঠায়।
১৯৪৭ সালে উভয় অঞ্চলের শিল্প প্রতিষ্ঠান
শিল্প | অবিভক্ত বাংলা | পূর্ব পাকিস্তান | পশ্চিম পাকিস্তান |
পাটকল | ১১৪ | ০ | ০ |
তুলা কল | ৪০৫ | ১০ | ৬ |
চিনিকল | ১৫১ | ৫ | ৪ |
সিমেন্ট | ১৩ | ১ | ৪ |
ম্যাচ ফ্যাক্টরি | – | ২০ | ১৮ |
উৎস: সফর আকন্দ
পৃষ্ঠা: ১০৫
১৯৪৭-৫৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের প্রদেশভিত্তিক ব্যয়ের পরিমান (মিলিয়ন টাকা)
ব্যয়ের খাত | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয়ের শতকরা হার |
আর্থিক সাহায্য | ১০০০০ | ১২৬০ | ১১.২ |
মূলধন ব্যয় | ২১০০ | ৬২০ | ২২.৮ |
অনুদান | ৫৪০ | ১৮০ | ২৫.০ |
শিল্প খাত | ১৫৩০ | ২৪০ | ১৩.৩ |
বৈদেশিক সাহায্য বরাদ্দ | ৭৩০ | ১৫০ | ১৭.০ |
প্রতিরক্ষা খাতে | ৪৬৫০ | ১০০ | ২.১ |
মোট | ১৯৫৫০ | ২৫৫০ | ১০.২ |
এ সময় উন্নয়ন খাতে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে ১৪৯৬.২ মিলিয়ন টাকা। পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয়েছে ৫১৪.৭ মিলিয়ন টাকা। মাথাপিছ আয়ের বৈষম্য বৃদ্ধি পায়। ১৯৫১-৫২ সালে ছিল ১৮%, ১৯৫৪-৫৫ সালে ২৪%।
পাকিস্তানের রাজধানী ছিল প্রথমে করাচী। এ শহর প্রতিষ্ঠায় ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত ব্যয় হয় ৫৭০০ মিলিয়ন টাকা। ১৯৬১ সালে সরকার রাজধানী প্রথমে রাওয়ালপিন্ডি পরে ইসলামাবাদে স্থানান্তর করে। ১৯৬৭ সালে পর্যন্ত ইসলামাবাদ উন্নয়নে ব্যয় হয় ৩০০০ মিলিয়ন টাকা। সেখানে ঢাকায় দ্বিতীয় রাজধানী প্রতিষ্ঠায় ব্যয় হয়েছে ২৫০ মিলিয়ন টাকা।
সেনা, বিমান ও নৌবাহিনীর সদর দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। সকল প্রশাসনিক ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানে। পূর্ব পাকিস্তানে কোনো ব্যয় ছিল না।
পূর্ব পাকিস্তান থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে সম্পদ পাচার হতো। ১৯৪৭-১৯৬৫ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত ছিল ৪৯২৪.১ মিলিয়ন টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানে ঘাটতি ছিল ১৬৬৩৪.৬ মিলিয়ন টাকা। এভাবে পূর্ব পাকিস্তানের উদ্বৃত্ত পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হয়ে যায়।
১৯৪৭-৬৫ সালে পাকিস্তানের মোট রপ্তানিতে পশ্চিম পাকিস্তানের অংশ ছিল ৪২%। অন্যদিকে আমদানির অংশ ছিল ৬৯%। পূর্ব পাকিস্তানে রপ্তানি আয়ের হার ছিল ৫৮%। কিন্তু আমদানির হার ছিল ৩১%।
পাকিস্তানে মোট তফসিলি ব্যাংক ছিল ৩৬টি। ৩৫টি ব্যাংকের মালিক ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। একমাত্র ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক ছিল বাঙালিদের।
পৃষ্ঠা: ১০৬
১৯৭০ সালের নির্বাচন বিষয় নির্বাচনকালে উভয় অঞ্চলে বৈষম্য ছিল:
বিষয় | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
বৈদেশিক মুদ্রা বরাদ্দ | ৮০% | ২০% |
বৈদেশিক সাহায্য | ৯৬% | ৪% |
মার্কিন সাহায্য | ৬৬% | ৩৪% |
পাকিস্তান শিল্প উন্নয়ন করপোরেশন | ৫৮% | ৪২% |
পাকিস্তান শিল্প ঋণ ও বিনিয়োগ করপোরেশন | ৮০% | ২০% |
শিল্প উন্নয়ন ব্যাংক | ৭৬% | ২৪% |
গৃহ নির্মাণ ঋণ | ৮০% | ২০% |
উভয় অঞ্চলের মধ্যে বিশাল বৈষম্যের কারণে ১৯৭১ সালে বাঙালিরা পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম কারণ ছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে বৈষম্য। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য বাঙালিরা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ করেছে।
সহায়ক গ্রন্থ
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, প্রথম খণ্ড মুনতাসীর মামুন-মোঃ মাহবুবুর রহমান, স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদ্বয়ের ইতিহাস সিরাজ উদদীন আহমেদ, একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ- স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়
পৃষ্ঠা: ১০৭
চতুর্থ অধ্যায়
ভাষা আন্দোলন ও বাঙালির আত্মপরিচয় প্রতিষ্ঠা
ক. মুসলিম লীগের শাসন ও গণতান্ত্রিক রাজনীতির সংগ্রাম
১৯৪৬ সালের মার্চ মাসে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক সাধারণ নির্বাচনে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের নেতৃত্বে মুসলিম লীগ বিশাল বিজয় লাভ করে। তারা মুসলমানদের ১১৯টি আসনের মধ্যে ১১৪টি আসনে জয়লাভ করে। ১৯৪৬ সালের ২৫ এপ্রিল হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী বাংলার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হোন। ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে তিনি স্বাধীন বৃহত্তর বাংলা দাবির আন্দোলন শুরু করেন। স্বাধীন বাংলা আন্দোলন কংগ্রেসের বিরোধিতার কারণে ব্যর্থ হয়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ২০ জুন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যগণ বাংলা বিভক্তির গ্রহণ করে। কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ পার্টির নির্দেশে বেআইনিভাবে পূর্ব বাংলা পার্লামেন্টারি দলের নেতা নির্বাচনের ব্যবস্থা করে। ১৯৪৭ সালের ৫ আগস্ট অনষ্ঠিত এ নির্বাচনে ৭৫-৩৯ ভোটে সোহরাওয়ার্দীকে হারিয়ে খালা নাজিমউদ্দিনকে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত করা হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির সাথে সাথে পূর্ব বাংলায় অগণতান্ত্রিক শাসন শুরু হয়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান সৃষ্টি হলে পূর্ব বাংলায় নতুন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। এ মন্ত্রিসভায় সোহরাওয়ার্দীর সমর্থক কোনো মন্ত্রী নেওয়া হয়নি।
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহর মৃত্যুর পর পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান আইনসভার সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের ভোটে সংসদীয় দলের নেতা নির্বাচিত হবেন এবং তিনিই মুখ্যমন্ত্রী হবেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন নুরুল আমিনকে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। এ কারণে অনেক এমএলএ ক্ষুব্ধ হন। মুসলিম লীগ সরকার সংসদীয় পদ্ধতি ধ্বংস করা শুরু করে। মুসলিম লীগ গণতান্ত্রিক রাজনীতি স্বাভাবিক যাত্রা বন্ধ করার ষড়যন্ত্র করে। বিরোধী দলগুলো গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রম শুরু করে। এ সময় পূর্ব বাংলায় নিম্নলিখিত রাজনৈতিক দলসমূহ সক্রিয় ছিল:
পৃষ্ঠা: ১০৮
মুসলিম লীগ: ইসলামপন্থি সরকারি দল।
গণআজাদী লীগ: কামরুদ্দীন আহমেদ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে গণআজাদী লীগ গঠন করে।
পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ: ১৯৪৭ সালের ৬-৭ সেপ্টেম্বর পূর্ব বাংলার তরুণ সমাজ পাকিস্তান গণতান্ত্রিক লীগ গঠন করেন। দলের সভাপতি ছিলেন তসাদ্দুক আহমদ চৌধুরী। তাদের দাবি ছিল গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা। ১৯৪৮ সালের শেষের দিকে সংগঠনটির বিলুপ্তি ঘটে।
তমদ্দুন মজলিস: ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টম্বরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাশেমকে সভাপতি করে তমুদ্দুন মজলিশ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন প্রতিষ্ঠিত হয়। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার আন্দোলনে তমদুন মজলিস অগ্রণী ভুমিকা পালন করে।
কমিউনিস্ট পার্টি; ১৯৪৮ সালের ৬ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি গঠিত হয়। তারা বিটি রনদীভে লাইনে তেভাগা আন্দোলন শুরু করে। মুসলিম লীগ সরকার শত শত কমিউনিস্ট নেতাকর্মীকে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করে।
পাকিস্তান ন্যাশনাল কংগ্রেস: ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তান কংগ্রেস পুনর্গঠন করা হয়।কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন কিরণ শংকর রায়। সরকারি নির্যাতনের ভয়ে তনি পশ্চিম বাংলায় চলে যান। তার স্থলে শীশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায় কংগ্রেসের নেতৃত্ব দেন। মুসলিম লীগ সরকার কংগ্রেসকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে চিহ্নিত করে।
জামায়াতে ইসলামী: ভারতে সৃষ্ট জামায়াতে ইসলামী পাকিস্তানের রাজনীতিতে অশুভ শক্তি হিসেবে ইসলামের নামে রাজনীতি শুরু করে।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ: ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। ছাত্রলীগ গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন, বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি বাস্তবায়নে দেশব্যাপী আন্দোলন শুরু করে।
ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটির সদস্যবৃন্দ
নাম -নিজ জেলা
নইমুদ্দিন আহমদ- আহবায়ক রাজশাহী
আবদুর রহমান চৌধুরী- বরিশাল
শেখ মুজিবুর রহমান -ফরিদপুর
অলি আহাদ -কুমিল্লা
আজিজ আহমদ -নোয়াখালী
পৃষ্ঠা: ১০৯
আবদুল মতিন -পাবনা
শেখ আবদুল আজিজ -খুলনা
নওয়াব আলী- ঢাকা
নুরুল কবির -ঢাকা সিটি
আবদুল আজিজ -কুষ্টিয়া
সৈয়দ নুরুল আলম -ময়মনসিংহ
আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী- চট্টগ্রাম
ছাত্রলীগের প্রধান কর্মসূচি
• প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার
• অবৈতনিক বাধ্যতামূলক শিক্ষা
• জনসংখ্যার ভিত্তিতে ন্যায্য দাবি সুনিশ্চিত করা
• দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ধ্বংস সাধন
• মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা প্রদান
• নারী শিক্ষা প্রসার
• শিক্ষায়তনগুলোতে স্বায়ত্তশাসন
• কারিগরি শিক্ষা
• ছাত্রদের সামরিক ট্রেনিং
• বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সমান অধিকার ও সৌহার্দ্য সুপ্রশস্ত করা
• শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন।
ছাত্র ফেডারেশন: কমিউনিস্ট পার্টির অঙ্গ সংগঠন। দেশ বিভাগের পর দলটি দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের উদ্যোগে ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠিত হয়।
মুসলিম লীগবিরোধী রাজনীতি দমন করার জন্য ১৯৪৮ সালের ৯ জুন। মুসলিম লীগ সরকার জননিরাপত্তা আইন বা কালাকানুন পাস করে। এরপর শুরু হয় কমিউনিস্ট, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার এবং বিনা বিচারে আটক।
পূর্ব পাকিস্তানে বিরোধী দল গঠনে শেরে বাংলা একে ফজলুল হক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ছাত্রসমাজ ১৯৪৯ সালে আরমানিটোলা ময়দানে মুসলিম লীগ স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে ছাত্র র্যালির আহ্বান করে।সভাপতি ছিলেন একে ফজলুল হক। মুসলিম লীগের গুপ্তা বাহিনী সভা ভেঙ্গে দেয়।
পৃষ্ঠা: ১১০
১৯৪৯ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসাম জেল থেকে মুক্তি পেয়ে ঢাকায় ফিরে আসেন। ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ বিরোধী দলের উদ্যোগে বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার দাবিতে হরতাল পালিত হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৯ সালে ঢাকায় এলে তাকে সরকার ঢাকা ত্যাগ করতে বাধ্য করে।
খ . আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা- ১৯৪৯
ছাত্রলীগের জন্ম
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহনের জন্য ১৯৪৭ সালের ৭ আগস্ট করাচীর উদ্দেশ্যে দিল্লি ত্যাগ করেন। ভারতের ভাইসরয় লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন ১৩ আগস্ট করাচী পৌছেন .১৯৪৭ সালের ১৪ বৃটিশ ইউনিয়ন জ্যাক পতাকার পরিবর্তে অর্ধ চাদ ও তারকা খচিত পাকিস্তানি পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে পাকিস্তানের স্বাধীনতা ঘোষণা হয়। ১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করা হয়। ভারতের প্রথম গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্ট ব্যাটেন এবং প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন পণ্ডিত জওহর লাল নেহরু। এভাবে লক্ষ লক্ষ হিন্দুমুসলমানের রক্তের ওপর দিয়ে ভারত বিভক্ত হয়।
পাকিস্তান সরকার গঠনে পূর্ব বাংলাকে প্রথম থেকে বঞ্চিত করা হয়। পূর্ব বাংলা থেকে মাত্র দুজন মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট গঠিত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা –
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ -গভর্নর জেনারেল
লিয়াকত আলী খান- প্রধানমন্ত্রী
আই আই চুন্দ্রিগড়- বাণিজ্য, শিল্প
গোলাম মুহাম্মদ -অর্থ
সরদার আবদুর রব নিশতার -যাতায়াত
রাজা গজনফর আলী খান -খাদ্য ও কৃষি
স্যার মুহাম্মদ জাফরুল্লাহ -পররাষ্ট্র
যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল -আইন, শ্রম ও পূর্ত
ফজলুর রহমান- শিক্ষা
পূর্ব বাংলা থেকে নির্বাচিত গণপরিষদ সদস্য মৌলভী তমিজ উদ্দিন খান। পাকিস্তান গণপরিষদের স্পিকার নির্বাচিত হন। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট গঠিত হয় পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভা।
পৃষ্ঠা: ১১১
পূর্ব বাংলা মন্ত্রিসভা
স্যার ফ্রেডারিক বোর্ন -গভর্নর
খাজা নাজিমউদ্দিন- মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা
নুরুল আমিন- বেসামরিক সরবরাহ, বাণিজ্য, শ্রম ও শিল্প দফতর
আব্দুল হামিদ- শিক্ষা
সৈয়দ মোহাম্মদ আফজাল- কৃষি, সমবায় ও ত্রান
হামিদুল হক চৌধুরী- অর্থ, রাজস্ব
মুহাম্মদ হাবিবুল্লাহ বাহার চৌধুরী -স্বাস্থ্য, স্থানীয় সরকার
মফিজউদ্দিন আহমদ
পূর্ব বাংলা আইন সভার স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন আব্দুল করিম ও নাজমুল হুদা।
১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগ হয়। পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ বাস করতো পূর্ব বাংলায়। তখন বাঙালিদের কোনো নেতা ছিল না। শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়াদী পাকিস্তানে। মুসলিম লীগ সরকার উভয় নেতাকে ক্ষমতা থেকে দূরে রেখেছে।
১৯৪৭ সালে পূর্ব বাংলার জনসংখ্যার ৩৩ ভাগ ছিল হিন্দু। অথচ হিন্দু সম্প্রদায় থেকে পূর্ব বাংলার মন্ত্রিসভায় একজন সংখ্যালঘু নেওয়া হয়নি।
১৯৪৭ সালে ১৪ আগস্ট ভারত বিভাগকালে মহাত্মা গান্ধী কলকাতায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নিয়োজিত ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৪ আগস্ট ঢাকায় না এসে শান্তি মিশনের কর্মী হিসেবে মহাত্মা গান্ধী ও সোহরাওয়ার্দীর সাথে কলকাতায় অবস্থান করেন।
১৯৪৭ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান ও বেগম ফজিলাতুন্নেসার প্রথম সন্তান শেখ হাসিনার জন্ম হয়। শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজ থেকে বিএ পরীক্ষার্থী ছিলেন। তাই ১৯৪৭ সালে পরীক্ষার পর টুঙ্গিপাড়ায় এসে কন্যা সন্তানকে দেখেছেন।
মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও মন্ত্রীদের দেশ পরিচালনায় অভিজ্ঞতা না থাকায় তারা আমলানির্ভরশীল হয়ে পড়েন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারি জেনারেল ছিলেন চৌধুরী মুহাম্মদ আলী। পূর্ব বাংলার মুখ্য সচিব ছিলেন আজিজ আহমদ। পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকে আঞ্চলিক বৈষম্য শুরু হয়। পূর্ব বাংলার লোকসংখ্যা ছিল ৫ কোটি এবং পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৪ কোটি ৫০ লাখ। পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল ৯ কোটি ৫০ লাখ। মুসলিম লীগ সরকার
পৃষ্ঠা: ১১২
শুরু থেকে বাংলা ভাষার প্রতি বৈষম্য সৃষ্টি করে। দ্বিজাতি তত্তের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত। তাই দেশ বিভক্তির পর মুসলিম লীগ সরকারের কোনো মুলনীতি ছিল না। তারা ইসলাম ধর্মভিত্তিক রাজনীতি শুরু করে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট কলকাতা ইসলামিয়া কলেজে ও সিরাজউদ্দৌলা হলে এক গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, পূর্ব বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের অধীনে সত্যিকার স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠিত হবে না। তাই পর্ব বাংলায় একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করতে হবে।
১৯৪৭ সালে তিনি ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞান নিয়ে বিএ পাস করেন। তিনি ১৯৪৭ সালে ডিসেম্বর মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তার রোল নম্বর ছিল ১৬৫ এসএম হল। কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে তিনি ঢাকা কোর্টের পিছনে খাজে দেওয়ান লেনে মোল্লা জালাল উদ্দিন ও আবদুল হামিদ চৌধুরীর সাথে বসবাস শুরু করেন।
১৫০ মোগলটুলির ওয়ার্কার্স ক্যাম্প
১৯৪৪ সালের ১ এপ্রিল ঢাকার মোগলটুলিতে মুসলিম লীগের ওয়ার্কার্স ক্যাম্প প্রতিষ্ঠিত হয়। এ ক্যাম্পের সক্রিয় সদস্য ছিলেন কামরুদ্দিন আহমদ, শামসুল হক, মোহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শওকত আলী প্রমুখ। শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৪৭ সালের নভেম্বর মাসের শেষে এ ক্যাম্পে যোগ দেন। মোগলটুলির ওয়ার্কার্স কাম্প কেন্দ্র করে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও আবুল হাশিমের কর্মী বাহিনী একটি দল গঠনে এগিয়ে আসেন। শেখ মুজিবুর ঢাকায় এসে টাঙ্গাইলের শামসুল হকের সাথে যুবকদের নিয়ে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক লীগ গঠন করেন। আইন বিভাগে পড়ার সময় শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক দল গঠনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। ঢাকার মুসলিম লীগ নেতা কামরুদ্দিন আহমদ ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে। গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠন করে। শেখ মুজিবুর রহমান কামরুদ্দিন আহমদের সাথে দেখা করে তার দলে যোগ দেন। এ সময় কামরুদ্দিন আহমদ পিপলস ফ্রিডম লীগ গঠন করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলের নেতারা মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েছেন। তারা একটি বিরোধী উপদল গঠন করেন। ১৯৪৭ সালের ২০ ডিসেম্বর ঢাকার বলিয়াদি হাউজে পূর্ব বাংলার আইন সভার উপদলের সভা
পৃষ্ঠা: ১১৩
অনষ্ঠিত হয়। এ সভা আয়োজনে শেখ মুজিবুর রহমান মুখ্য ভুমিকা পালন করেন। মুসলিম লীগের দরজা সোহরাওয়ার্দীর অনুসারীদের জন্য নিষিদ্ধ হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ছাত্র সংগঠন নিখিল পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ দল গঠনের প্রস্তুতি গ্রহণ করেন।
শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক দেশ ভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন। খাজা নাজিমউদ্দিন তার ঢাকা আগমনকে সুনজরে দেখেনি। ফজলুল হকের উদ্যোগে ১৯৪৭ সালের ৭ ডিসেম্বর ঢাকার সিরাজউদ্দৌলা পার্কে এক সভা আহ্বান করা হয়। কিন্তু খাজা নাজিমউদ্দিনের লোকেরা সভা পণ্ড করে দেয় এবং মঞ্চ পুড়িয়ে ফেলে। শেরে বাংলা আত্মরক্ষার জন্য কাদের সর্দারের বাসায় আশ্রয় নেয়।
মুসলিম ছাত্রলীগ গঠন
শেখ মুজিবুর রহমান, শামসুল হক, আবদুর রহমান চৌধুরী, নঈমুদ্দিন আহমদ, কাজী আহমদ কামাল, কাজী গোলাম মাহবুব, নুরুদ্দিন আহমদ, মুহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, খালেক নেওয়াজ, আবদুস সামাদ আজাদ, তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ আবদুল আজিজ প্রমুখ ১৫০ নম্বর মোগলটুলি ওয়ার্কার্স ক্যাম্পে মিলিত হয়ে মুসলিম লীগ বিরোধী দল গঠনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সলিমুল্লাহ মুসলিম হল, ফজলুল হক হলে কয়েকটি সভার পর ১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক মিলনায়তনে অধ্যাপক নজমুল করিমের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সভায় পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ প্রতিষ্ঠা সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
মুসলিম ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক কমিটির সদস্যগণ ছিলেন-
নাম- এলাকা- পদ
নইমুদ্দিন আহমদ -রাজশাহী -আহ্বায়ক
আবদুর রহমান চৌধুরী -বরিশাল -সদস্য
শেখ মুজিবুর রহমান -ফরিদপুর -সদস্য
অলি আহাদ -কুমিল্লা -সদস্য
শেখ আবুল আজিজ -খুলনা -সদস্য
শামসুল হক -ঢাকা *সদস্য
খালেক নেওয়াজ -ময়মনসিংহ- সদস্য
আবদুল মতিন -পাবনা -সদস্য
আজিজ আহমদ -নোয়াখালী -সদস্য
মফিজুর রহমান- রংপুর -সদস্য
নওয়াব আলী -ঢাকা -সদস্য
নুরুল কবির ঢাকা শহর সদস্য
আবদুল আজিজ -কুষ্টিয়া- সদস্য
সৈয়দ আব্দুল আলম -ময়মনসিংহ- সদস্য
আব্দুল কুদ্দুস চৌধুরী- চট্টগ্রাম -সদস্য
শেখ মুজিবুর রহমান মূলত এককভাবে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক দায়িত্ব পালন করতেন।
পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ বাংলা ভাষা আন্দোলন ও বাঙালিদের স্বাধীনতা সংগ্রামে অগ্রণী ভূমিকা পালন করে।
১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টম্বর ঢাকায় তমুদ্দিন মজলিশ প্রতিষ্ঠিত হয়। সংগঠনের সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল কাসেম। তমুদ্দিন মজলিশ প্রথম বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি পেশ করেন। বাংলা হবে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার মাধ্যম।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর জন্ম সিরাজগঞ্জে। তিনি আসামে মুসলিম লীগ সভাপতি ও আইন সভার সদস্য ছিলেন। দেশ ভাগের পর তিনি টাঙ্গাইলের সন্তোষে বসতি স্থাপন করেন। তিনি ১৯৪৮ সালের জানুয়ারি মাসে টাঙ্গাইল হতে আইনসভার সদস্য নির্বাচিত হয়। পরে মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন তার সদস্য পদ বাতিল করে দেয়।
১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন
পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের দাপ্তরিক ভাষা ছিল ইংরেজি ও উর্দু। এমন কি গণপরিষদের ভাষা ছিল ইংরেজি ও উর্দু। বাংলা ভাষার কোনো স্থান কেন্দ্রে ছিল না। কুমিল্লা থেকে নির্বাচিত পাকিস্তান গণপরিষদের সদস্য কংগ্রেস নেতা ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি গণপরিষদে উর্দু ও ইংরেজি ভাষার সাথে বাংলা ভাষা অন্তর্ভুক্তির জন্য সংশোধনী প্রস্তাব উত্থাপন করে বলেন
The state language of the state should be language which is used by the majority people of the state and for that I consider that Bengali language is a lingua franca of our state.
I know that I voice the sentiment of the vast millions of our state.
It shuld be treated as the language of state and therefore, Sir I suggest that after the word English, the word Bengali be inserted in
rule 29.
পৃষ্ঠা: ১১৫
ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদে বলেন, মাননীয় স্পিকার, আমি প্রস্তাব করছি যে ২৯ নম্বর বিধির ১ নম্বর উপবিধির দ্বিতীয় লাইনে ইংরেজি শব্দের পর বাংলা শব্দটি অন্তর্ভুক্ত হবে। বাংলা ভাষা দেশের অধিকাংশ লোকের ভাষা। এ রাষ্ট্রের ৬ কোটি ৯০ লাখ লোকের মধ্যে ৪ কোটি ৪০ লক্ষ লোক বাংলা ভাষায় কথা বলে। সুতরাং রাষ্ট্রের রাষ্ট্র ভাষা হবে যে ভাষা রাষ্ট্রের অধিকাংশ লোক ব্যাবহার করে। আমি মনে করি বাংলা রাষ্ট্রে প্রধান ভাষা- রাষ্ট্রভাষা। আমি জানি রাষ্ট্রের অধিকাংশ লোকের মনোভাব আমার কণ্ঠে ধ্বনিত হচ্ছে।
এ ভাষাকে রাষ্ট্রের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করতে হবে। সুতরাং মহোদয়,আমি সুপারিশ করছি যে ইংরেজি শব্দের পর বাংলা শব্দটি অন্তর্ভুক্ত করা হোক “
মহোদয়, ইংরেজি ভাষা যদি ২৯ বিধিতে সম্মানজনক স্থানে থাকে এবং ইংরেজি বা উর্দু ভাষায় যদি সংসদ পরিচালিত হতে পারে তাহলে ৪ কোটি লক্ষ লোকের ভাষা কেন ২৯ বিধিতে মর্যাদার স্থানে থাকবে না। এ ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে গ্রহণ করা উচিত।” কংগ্রেস নেতা প্রেমহরি বর্মা, ভূপেন কুমার দত্ত, গিরিশ চন্দ্র চট্টপাধ্যায় বাংলা ভাষার সমর্থনে ভাষণ দেন। সেদিন পূর্ব বাংলার মুসলমান সদস্যগণ বাংলার পক্ষে কথা বলেননি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের প্রস্তাব বাতিল করে দেন। গণপরিষদের সিদ্ধান্তের খবর ঢাকায় পৌছলে ছাত্র ও বুদ্ধিজীবীরা তীব্র প্রতিবাদ জানাতে থাকেন।
পাকিস্তান সরকার বাংলা ভাষাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসেবে গ্রহণ না করার প্রতিবাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় ধর্মঘট পালিত হয়। ছাত্ররা মিছিল করে শহর প্রদক্ষিণ করে। বিকেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন অধ্যাপক আবুল কাসেম।
ভাষা আন্দোলন পরিচালনার জন্য ১৯৪৮ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। নিম্নলিখিতভাবে কমিটি গঠন করা হয় –
গণআজাদী লীগ- ২ জন প্রতিনিধি
তমদুন মজলিস -একজন প্রতিনিধি
সলিমুল্লাহ হল -২ জন প্রতিনিধি
মুসলিম ছাত্রলীগ -২ জন প্রতিনিধি
শামসুল আলমকে সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক নির্বাচিত করা হয়। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনে তমদুন মজলিস ও ছাত্রলীগ নেতৃত্ব প্রদান করে। ২ মার্চ ফজলুল হক হলে সংগ্রাম কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। শামসুল আলম অনুপস্থিত থাকায় কামরুদ্দিন আহমদকে আহ্বায়ক করা হয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিবুম রহমান, শামসুল হক, মুহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, আবুল কাসেম, রণেশ
পৃষ্ঠা: ১১৬
দাশগুপ্ত, শামসুল হক, অজিত গুহ প্রমুখ। সভায় রাষ্ট্রভাষার দাবিতে ১১ মার্চ সারা দেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহিত হয়।ছাত্রলীগ, ছাত্র ফেডারেশন, কমিউনিস্ট পাটি হরতাল পালনের আয়োজনে হরতালের ভুমিকা পালন করেন। ১০ মার্চ ফজলুল হক হলে সংগ্রাম কমিটির সভা আনুষ্ঠিত হয়। ১১ মার্চ হরতাল পালনে শেখ মুজিবুর রহমান নেতৃত্ব দেন।
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সকালে নিয়ে শেখ মুজিবর রহমান একদল যুবক অ ছাত্র নিয়ে সচিবালয়ে হরতালের সমর্থনে বক্তৃতা অ পিকেটিং শুরু করেন। এ ভাষায় মেজর জেনারেল আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের জিওসি ছিলেন। সচিবালয়ে পিকেটিংরত অবস্থায় ছাত্রদের ওপর পুলিশ লাঠিচার্জ। পুলিশ শেখ মুজিবর রহমান, সর্দার ফজলল করিম, অলি আহাদ, তোয়াহাসহ ৩০০ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ছাত্রদের অনেককে ছেড়ে দেওয়া হয়। পুলিশ শেখ মুজিবুর রহমানসহ ছাত্রদের প্রথমে কোতোয়ালি থানায় এবং পরে ঢাকা জেলে স্থানান্তরিত করে। ১১ মার্চ সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। জিওসি আইয়ুব খান মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের নিরাপত্তার জন্য আইন সভার দিকে যান। পুলিশ ছাত্রদের লাঠি চার্জ করছে। তা দেখে এ কে ফজলুল হক একদল আইনজীবী নিয়ে ছাত্রদের উদ্ধারের জন্য অগ্রসর হন। এ সময় পুলিশের লাঠির আঘাতে তিনি হাঁটুতে ব্যথা পান। আইনজীবীরা তাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যায় এবং চিকিৎসার পর তাকে বাসায় পাঠিয়ে দেন। ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট চলে।
“১১ই মার্চ ভোরবেলা শত শত ছাত্রকর্মী ইডেন বিল্ডিং, জেনারেল পোস্ট অফিস ও অন্যান্য জায়গায় পিকেটিং শুরু করল। বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজে কোনো পিকেটিংয়ের দরকার হয় নাই। সমস্ত ঢাকা শহর পোস্টারে ভরে ফেলা হল। অনেক দোকানপাট বন্ধ ছিল, কিছু খোলাও ছিল। পুরান ঢাকা শহরে পুরোপুরি হরতাল পালন করে নাই। সকাল আটটায় জেনারেল পোস্ট অফিসের সামনে ছাত্রদের উপর ভীষণভাবে লাঠিচার্জ হল। একদল মার খেয়ে স্থান ত্যাগ করার পর আরেকদল হাজির হতে লাগল। ফজলুল হলে আমাদের রিজার্ভ কর্মী ছিল। এইভাবে গোলমাল, মারপিট চলল অনেকক্ষণ। নয়টায় ইডেন বিল্ডিংয়ের সামনের দরজায় লাঠিচার্জ হল। খালেক নেওয়াজ খান, বখতিয়ার (এখন নওগাঁও এডভোকেট), শহর ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক এম. এ. ওয়াদুদ গুরুত্বরূপে আহত হল। তোপখানা রোডে কাজী গোলাম মাহাবুব, শওকত মিয়া ও আর ও অনেক ছাত্র আহত হল। আবদুল গনি রোডের দরজায় তখন আর ছাত্ররা
পৃষ্ঠা: ১১৭
আরে ও লাঠির আঘাত সহ্য করতে পারছে না। অনেক কর গেছে এবং সরে পড়ছে। আমি জেনারেল পোস্ট অফিসের টি নিয়ে ইডেন বিল্ডিংয়ের দিকে ছুটেছি, এর মধ্যে শামসুল হক বিল্ডিংয়ের সামনে পুলিশ ঘিরে ফেলেছে। গেট খালি হয়ে ? কাছে সাইকেল। আমাকে গ্রেফতার করার জন্য সিটি এসপিতি তাড়া করছে, ধরতে পারছে না। এবার দেখলাম উপায় নাই। দাঁড়ান ছিল তার কাছে সাইকেল দিয়ে চার পাঁচজন ছাত্র নি বিল্ডিংয়ের দরজায় আমরা বসে পড়লাম এবং সাইকেল যাকে বললাম শীঘ্রই আরও কিছু ছাত্র পাঠাতে। আমরা খুব অল্প, টিকতে প আমাদের দেখাদেখি আরও কিছু ছাত্র ছুটে এসে আমাদের পাশে আমাদের উপর কিছু উত্তম মাধ্যম পড়ল এবং ধরে নিয়ে জিপে ত (শামসুল) সাহেবকে পূর্বেই জিপে তুলে ফেলেছে। বহু ছাত্র গ্রেফতা হল। কিছু সংখ্যক ছাত্রকে গাড়ি করে ত্রিশ-চল্লিশ মাইল দরে।
কয়েকজন ছাত্রীও মার খেয়েছিল। অলি আহাদও গ্রেফতার হয়ে গেছে। তাজউদ্দীন, তোয়াহা ও অনেককে গ্রেফতার করতে পারে নাই। আমাকে প্রায় সত্তর-পঁচাত্তরজনকে বেঁধে নিয়ে জেলে পাঠিয়ে দিল সন্ধ্যায় সময়। ফলে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠল। জনগণের সমর্থনও আমরা পেলাম।”
ইতোমধ্যে সংবাদ আসে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসবেন। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের। সাথে আলোচনা হয় এবং ৮ দফার ভিত্তিতে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১, ২৯ ফেব্রুয়ারি হতে গ্রেফতারকৃতদের মুক্তি দান; ২. পুলিশের অত্যাচার মুখ্যমন্ত্রী ব্যবস্থা করবেন;
৩, পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার এক বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে।
৪. প্রদেশে সরকারি ভাষা হিসেবে স্বীকৃতি প্রদানের জন্য আগামী এপ্রিলে আইন পরিষদে প্রস্তাব উত্থাপন করা হবে; শিক্ষার মাধ্যম হবে বাংলা;
৫. ভাষা আন্দোলনকারীদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা যাবে না;
৬. সংবাদপত্রের ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হবে।
৭. ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার করা হবে;
৮. ভাষা আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়নি।
এ চুক্তিতে সরকার পক্ষে স্বাক্ষর করেন খাজা নাজিমউদ্দিন এবং সংগ্রাম পারবলেম পক্ষে কামরুদ্দিন আহমদ।
পৃষ্ঠা: ১১৮
১৫ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানসহ সব বন্দিকে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান সভায় সভাপতিত্ব করেন।সভা শেষে তিনি ছাত্রদের মিছিল নিয়ে আইন সভার দিকে অগ্রসর হন। পুলিশ তাদের বাধা দান করে। শওকতসহ অনেকে আহত হয়।
১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ বিকেলে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ও তার বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহ বিমানে ঢাকায় পৌছেন। এ ছিল ঢাকায় জিন্নাহর প্রথম সফর। ২১ মার্চ দেন রমনা রেসকোর্স ময়দানে প্রথম ভাষন দেন। জিন্নাহ তার ভাষণে বলেন, urdu and urdu shall be the only state language of Pakistan. একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা।সভায় উপস্থিত ছাত্ররা না বলে প্রতিবাদ করে।২৪ মার্চ ঢাকার কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে জিন্নাহ পুনরায় বলেন, একমাত্র উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। সভায় উপস্থিত ছাত্ররা জন্নাহর ঘোষণার প্রতিবাদ করে। জিন্নাহ ছাত্র নেতাদের সাথে কয়েক দফা আলোচনা করেন। জিন্নাহর ঢাকা আগমন সম্পর্কে শেখ মজিব লিখেছেন – “জিনাহ পূর্ব পাকিস্তান এসে ঘোড়দৌড় মাঠে বিরাট সভায় ঘোষণা করলেন, ‘উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা হবে।‘ আমরা প্রায় চার পাচশত ছাত্র এক জায়গায় ছিলাম সেই সভায়, অনেকে হাত তুলে দাঁড়িয়ে জানিয়ে দিল ‘মানিনা। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশনে বক্তৃতা করতে উঠে তিনি যখন আবার বললেন, “উর্দুই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে”- তখন ছাত্ররা তার সামনেই বসে চিৎকার করে বলল, ‘না, না, না।’ জিন্নাহ প্রায় পাঁচ মিনিট চুপ করেছিলেন। তারপর বক্তৃতা করেছিলেন। আমার মনে হয় এই প্রথম তাঁর মুখের উপর তার কথায় প্রতিবাদ করল বাংলার ছাত্ররা। এরপর জিন্নাহ যতদিন বেঁচেছিলেন আর কোনোদিন বলেন নাই, উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্র হবে।”
১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর গভর্নর জেনারেল মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ ইন্তেকাল করেন। তার স্থলে পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল নিযুক্ত হন। ১৯৪৮ সালের ১৮ নভেম্বর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও তার স্ত্রী ঢাকা আগমন করেন। ২৭ নভেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খেলার মাঠে লিয়াকত আলী খানকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। ছাত্রলীগের নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী ছাত্রদের পক্ষে শ্রদ্ধাঞ্জলি লেখেন। পাকিস্তানের শতকরা ৬২ ভাগ লোকের মাতৃভাষা বাংলাকে উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানানো হয়।
পৃষ্ঠা: ১১৯
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীদের ধর্মঘট
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নিম্ন বেতনভুক্ত চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারীরা ১৯৪৯ সালের ৩ মার্চ ধর্মঘট আহ্বান করে। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ চতুর্থ শ্রেনী কর্মচারীদের সমর্থনে ৫ মার্চ থেকে ধর্মঘট শুরু করে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করে। ১৯ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্বাহী কাউন্সিল ও মুসলিম লীগ সরকার ২৭ জন ছাত্রদের বিরেদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
• ৬ জন ছাত্রকে ৪ বছরের জন্য বহিষ্কার;
• ১৫ জনকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার;
• ৬ ছাত্রকে জরিমানা করা হয়;
যাদের জরিমানা করা হয় তারা হলেন –
১. শেখ মুজিবুর রহমান, দ্বিতীয় বর্ষ আইন, রোল-১৬৬ এস এম হল;
২. কল্যাণ চন্দ্র দাশগুপ্ত, এমএ, ঢাকা হল;
৩. নৈমুদ্দিন আহমদ, দ্বিতীয় বর্ষ আইন, এস এম হল;
৪. নাদেরা বেগম, প্রথম বর্ষ, এস এম হল;
৫. মুহাম্মদ আবদুল ওয়াদুদ, প্রথম বর্ষ বিএ, এফ এইচ হল;
ছাত্রদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা প্রত্যাহার ও বিশ্ববিদ্যালয় খোলার দাবিতে দেশব্যাপী ধর্মঘট পালিত হয়। ১৯ এপ্রিল অবস্থান ধর্মঘটের সময় শেখ মুজিবুর রহমানসহ কয়েকজন ছাত্র নেতাকে গ্রেফতার করা হয়।
১৭ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয় খুলবে। ১৫০ নম্বর মোগলটুলীতে সভায় সিদ্ধান্ত হয়। ১৭ এপ্রিল থেকে প্রতিবাদ দিবস পালন করা হবে। এদিকে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে শামসুল হক প্রার্থী হয়েছেন ছাত্রলীগ কর্মীরা অনেকে টাঙ্গাইলের নির্বাচনী প্রচারে চলে গেছেন। ১৬ এপ্রিল ছাত্রলীগের কনভেনর নঈম উদ্দিন আহমেদ, ছাত্রলীগ নেতা আবদুর রহমান চৌধুরী ভিপি সলিমুল্লাহ হক, দেওয়ান মাহবুব আলী ও আরও অনেকে গোপনে বন্ড দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থেকে যায়। শেখ মুজিব উদ্যোগ নিয়ে ছাত্রলীগের সভা করে তাদের বহিষ্কার করেন। কাজী গোলাম মাহবুবকে জয়েন্ট কাউন্সিলর করা হয়। ১৭ তারিখ ধর্মঘট শুরু হয়েছে। ১৮ এপ্রিল শেখ মুজিব শোভাযাত্রা করে ছাত্রদের নিয়ে ভিসির বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করেন। ১৯ এপ্রিল জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, পুলিশ নিয়ে হাজির হন। ছাত্ররা চলে যায়, মাত্র শেখ মুজিবসহ ৮ জন থেকে যায়। ছাত্র প্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত হল- শেখ মুজিব গ্রেফতার হলে আন্দে চলবে, পাঁচ মিনিট পরে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট আমাদের গ্রেফতারের হুকুম দিলেন।
পৃষ্ঠা: ১২০
আমাদের গারিতে তুলে একদম জেলগেটে নিয়ে আসল। পরের দিন আন্দোলন শুরু হলো। কিন্তু ছাত্র নেতাদের গ্রেফতার করে সরকার আন্দোলন স্তিমিত করে দেয় – খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহবুব, কে জি মোস্তফা, বাহাউদ্দিন চৌধুরী আরও অনেকে গ্রেফতার হয়।
শেখ মুজিবর রহমান জরিমানা দিতে অস্বীকার করেন। তাকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। তিনি আত্মসমর্পণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসেননি। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ে এসেছেন প্রধানমন্ত্রী হয়ে।
আওয়ামী লীগের জন্ম
২৩ জুন ১৯৪৯
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে শেখ মুজিবর রহমান কলকাতা থেকে ঢাকা আগমন করেন। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন বিভাগে ভর্তি হন। ১৯৪৮ সালে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আসাম থেকে এসে টাঙাইলের সোন্তষে বসতি স্থাপন করেন। ১৯৪৯ সালের ৫ মার্চ অবিভক্ত বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে করাচী চলে আসেন। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে আইন ব্যবসা শুরু করেন।
পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল খাজা নাজিমউদ্দিন এবং প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান। পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনও মুসলিম লীগ নেতা। দেশে কোনো বিরোধী দল নেই বললেই চলে। কংগ্রেস বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করলেও মুসলিম লীগ সোহরাওয়ার্দীকে ভয় করত। তিনি পাকিস্তানের স্থায়ী নাগরিক নয়- এ অজুহাতে ১৯৪৯ সালের ১ মার্চ মুসলিম লীগ সরকার সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের আসন শূন্য ঘোষণা করে।
১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে মওলানা ভাসানী টাঙ্গাইল আসন থেকে এমএলএ নির্বাচিত হন। মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিন মওলানা ভাসানীর আসন শূন্য ঘোষণা করেন। ১৯৪৯ সালের ২৫ এপ্রিল শূন্য আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। বিরোধী দলের শামসুল হক প্রার্থী হন। শেখ মুজিবুর রহমান ১৫০ নম্বর মোগলটুলি লেনে কর্মী শিবিরের নেতাকর্মীদের নিয়ে শামসুল হকের পক্ষে প্রচার চালান। শামসুল হক বিপুল ভোটে মুসলিম লীগ প্রার্থী টাঙ্গাইলের জমিদার কে কে পন্নীকে পরাজিত করেন। এ নির্বাচনের পর মুসলিম লীগ আর উপনির্বাচন দেয়নি। শামসুল হকের বিজয়ে সারা পাকিস্তানকে প্রবল ধাক্কা দেয়। মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনীতি শক্তিশালী হয়। সরকার বিরোধী দল দমনের জন্য কঠোর পদক্ষেপ নেয়। ১৯৪৯ সালের ২৪ এপ্রিল সরকার শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে এবং ২৭
পৃষ্ঠা: ১২১
জুলাইর পূর্বে মুক্তি দেয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাসে ঢাকা আসেন। মওলানা ভাসানীসহ বিরোধী দলের সাথে গোপন আলোচনায় বসেন।তিনি মাওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও শামসুল হককে সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করার নির্দেশ দেন।
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকার রোজ গার্ডেনে আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন
মুসলিম লীগবিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের জন্য ঢাকার স্বামীবাগে রোজ গার্ডেনে কাজী মোহাম্মদ বশির হুমায়ুনের (১৯২১-১৯৮২) বাসভবনে ১৯৪৯ সালের ২৩ ও ২৪ জুন সভা আহ্বান করা হয়। মওলানা ভাসানীকে আহ্বায়ক ও ইয়ার মোহাম্মদ খানকে সম্পাদক করে একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা হয়। সভায় ৩০০ ডেলিগেট যোগ দেয়। সভায় উপস্থিত ছিলেন শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক, আবদুল হামিদ খান ভাসানী, মওলানা আবদুর রশীদ, কামরুদ্দিন আহমদ, মাওলানা রাগীব হাসান, আতাউর রহমান খান, শামসুল হক, ইয়ার মোহাম্মদ খান, খান সাহেব ওসমান, খয়রাত হোসেন এমএলএ, আনয়ারা বেগম এমএলএ, কাজী গোলাম মাহবুব, অলি আহাদ, এম মনসুর আলী সালাম খান, তাজউদ্দীন আহমদ, আরিফ হোসেন চৌধুরী এমএলএ, আবদুল জব্বার খদ্দর, কামাল উদ্দিন চৌধুরী প্রমুখ। সভার মূল ব্যক্তি ছিলেন টাঙ্গাইলের সামসুল হক। তিনি ১৫০ নম্বর মোগলটুলি ওয়ার্কার্স ক্যাম্পের সকল কর্মী ও মওলানা ভাসানীকে নিয়ে সভায় উপস্থিত হন। সভায় সকলে সংক্ষিপ্ত ভাষণ দেন। সভাপতিত্ব করেন মাওলানা রাগীব হাসান। সভায় পূর্বে পাকিস্তান আওয়ামী। মুসলিম লীগ নামে রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। নতুন দল গঠনে তার সম্মতি ছিল। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, শামসুল হককে সম্পাদক এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে যুগ্ম সম্পাদক করে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্যকরী কমিটি গঠন করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সদস্য ছিলেন
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী -সভাপতি
আতাউর রহমান খান -সহ-সভাপতি
আলী আহমদ খান এমএলএ -সহসভাপতি
আলী আমজাদ খান -সহসভাপতি
সাখাওয়াত হোসেন -সহ-সভাপতি
আবদুস সালাম খান -সহ-সভাপতি
শামসুল হক -সাধারণ সম্পাদক
শেখ মুজিবর রহমান -যুগ্ম সম্পাদক
খন্দকার মোশতাক আহমেদ- সহ-সম্পাদক
একে এম রফিকুল ইসলাম- সহ-সম্পাদক
ইয়ার মোহাম্মদ খান- কোষাধ্যক্ষ
১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী মুসলিম লীগের ১২ দফা কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়।
১. পাকিস্তান স্বাধীন ও জনকল্যানমুখী হতে হবে।
২. রাষ্ট্রে দুটি আঞ্চলিক ইউনিট থাকবে।পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তান।
৩. অঞ্চগুলো লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন ভোগ করবে। প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। অবশিষ্ট বিষয় ইউনিটগুলোর হাতে ন্যস্ত থাকবে।
৪. সরকারি পদাধিকারী ব্যক্তিরা কোনো বিশেষ সুবিধা পাবে না।
৫. সরকারি কর্মচারীরা সমালোচিত হবেন। আইনের চোখে তাদের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন করা হবে না।
৬. সকল নাগরিক জাতি ধর্ম নির্বিশেষে সমান অধিকার ভোগ করবে।
৭. সকল নাগরিক যোগ্যতা অনুসারে সমান অধিকার পাবে।
৮. সকল নারী-পুরুষের জন্য শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে।
৯. প্রতিরক্ষা বাহিনীতে সকল নাগরিকের যোগদানের অধিকার থাকবে। একটি বয়স সীমা পর্যন্ত সামরিক শিক্ষা বাধ্যতামূলক হবে।
১০. পূর্ব পাকিস্তানে স্থল, বিমান ও নৌ ইউনিট থাকবে।
১১. বিনা খেসারতে জমিদারি ও অন্য মধ্যস্বত্ব বিলোপ করা হবে।
১২. সকল জমি জাতীয়করণ করতে হবে।
১৯৪৯ সালের ২৪ জুন নারায়ণগঞ্জের খান সাহেব ওসমানের বাসভবনে ৪০ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি ঘোষণা করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২৪ জুন আরমানিটোলা মাঠে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন মওলানা ভাসানী।
জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শেখ মুজিবুর রহমান মওলানা ভাসানী ও শামসুল হকের সাথে জেলা ও মহকুমা সফর করে নতুন কমিটি গঠন করেন।
পৃষ্ঠা: ১২৩
১৯৪৯ সালে জেল থেকে মুক্তির পরে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ গমন করেন। তিনি সালাম সাহেবকে নিয়ে গোপালগঞ্জ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করেন।তিনি আর আইন পড়বেন না শুনে পিতা দুঃখ পেলেন। পিতা তাঁকে ব্যারিস্টারী পড়াতে চান। শেখ মুজিব যাবেন না। তিনি মুসলিম লীগের অন্যায় নির্যাতন, দুর্নীতি ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করবেন। তিনি ছাত্রলীগ ও আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করতে আত্মনিয়োগ করেন।
ঢাকায় এসে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন যাতে তাড়াতাড়ি হয় তার ব্যাবস্থা করলাম। এরপূর্বে আর কাউন্সিল সভা হয় নাই। নির্বাচন হওয়া দরকার আর আমিও বিদায় নিতে চাই। ঢাকার তাজমহল হলে ১৯৪৯ সালের সেপ্টম্বর মাসে কনফারেন্স হল আমার সভাপতিত্বে। আমি আমার বক্তৃতায় বললাম – আজ থেকে আমি আর আপনাদের প্রতিষ্ঠানের সভ্য থাকব না। ছাত্র প্রতিষ্ঠানের সাথে জড়িত থাকার আর আমার কোনো অধিকার নাই। আমি আমাদের কাছ থেকে বিদায় নিচ্ছি। কারণ আমি আর ছাত্র নই।” নির্বাচনে দবিরুল ইসলাম সভাপতি এবং খালেক নেওয়াজ খানকে সাধারণ সম্পাদক করা হয়েছিল। শেখ মজিবর সর্বদা পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগকে পরামর্শ দিতেন। এরাই আমাকে ছাত্রলীগের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে শ্রদ্ধা করেছে। আমরা প্রতিষ্ঠানের কাজে আত্মনিয়োগ করলাম। মওলানা সাহেব, শামসুল হক সাহেব ও আমি ময়মনসিংহ জেলার জামালপুর মহকুমার প্রথম সভা করতে যাই।”
ইত্তেফাক পত্রিকা
ঢাকা থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদসহ সকল পত্রিকা মুসলিম লীগ সরকারের সমর্থক ছিল। সাধারণ মানুষ ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে কথা বলার কোনো পত্রিকা ছিল না। আওয়ামী মুসলিম লীগ সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা সাপ্তাহিক ইত্তেফাক নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করবে। মওলানা ভাসানী, ইয়ার মোহাম্মদ খান ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার নামে ইত্তেফাক প্রকাশের অনুমতি লাভ করে আসগর হোসেন এমএলএর ঢাকার ৭৭ নম্বর মালিটোলার বাসভবনে অবস্থিত ছাপাখানা থেকে সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ১৯৪৯ সালের ১৫ আগস্ট প্রথম প্রকাশিত হয়। সাপ্তাহিক পত্রিকার সভাপতি মওলানা ভাসানী, সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া এবং প্রকাশক ইয়ার মোহাম্মদ খান। সাপ্তাহিক ইত্তেফাক ঢাকার ৯ নম্বর হাটখোলা রোডে অবস্থিত প্যারামাউন্ট থেকে মদিত ও ৯৪ নম্বর নবাবপুর থেকে প্রকাশিত হতে থাকে। আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীরা ইত্তেফাক পত্রিকা প্রকাশক ও প্রচারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
পৃষ্ঠা: ১২৪
নিজ অর্থ দিয়ে ঢাকার হাটখোলায় ভবন নির্মাণের জন্য জমি ও প্রেস ক্রয় করে দেন।
শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেফতার
১৯৪৯ সালের ১১ অক্টোবর আরমানিটোলার জনসভার পর মওলানা ভাসানী, শামসুল হক ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে শোভা যাত্রা বের হল- নাজিরা বাজারে পুলিস মিছিলে আক্রমণ করে। পুলিশ শামসুল হককে গ্রেফতার করে। লাঠির আঘাতে শেখ মুজিবুর রহমান গুরুতর আহত হন। “আমার উপরও অনেক আঘাত পড়ল। এক সময় প্রায় বেহুশ হয়ে একপাশে নর্দমায় পড়ে গেলাম। কাজী গোলাম মাহবুবও আহত হয়েছেন তবে তার হুঁশ ছিল। আমাকে কয়েকজন ধরে রিকশায় উঠিয়ে মোগলটুলী নিয়ে আসল। আমার পা দিয়ে খুব রক্ত পরছিল। তিনি আহত অবস্থায় ১৫০ নম্বর মোগলটুলী পার্টির অফিসে ছিলেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতারের জন্য ভবনে প্রবেশ করে। জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শেখ মুজিব লাফিয়ে তার পাশের ভবনে পড়েন। সেখান থেকে পুলিশকে এড়িয়ে ফুটবল খেলোয়াড় ক্যাপ্টেন শাহজাহানের বাসায় ওঠেন। তার স্ত্রী নূরজাহান তার যত্ন নেন। এখানেও পুলিশের হামলা। তিনি পুলিশকে ফাকি দিয়ে ইয়ার মুহাম্মদ খানের বাসায় মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করে বলেন, “তার সাথে আমার দেখা করা দরকার, তিনি কেন আমাকে গ্রেফতার হতে নিষেধ করেছেন? আমি পালিয়ে থাকার রাজনীতি বিশ্বাস করি না। কারণ আমি গোপন রাজনীতি পছন্দ করি না, আর বিশ্বাসও করি না।” মওলানা সাহেব আমাকে বলেন, তুমি লাহোর যাও। কারণ, সোহরাওয়ার্দী সাহেব লাহোরে আছেন। তার এবং মিয়া ইফতিখার উদ্দিনের সাথে সাক্ষাত কর। তাদের বল, একটি নিখিল পাকিস্তান পার্টি হওয়ার দরকার। পীর মানকি শরীফের সাথে আলোচনা করে সোহরাওয়ার্দী সাহেবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগকে পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠানে করতে পারলে ভালো হয়। সোহরাওয়ার্দী সাহেব ছাড়া আর কেউ এর নেতৃত্ব দিতে পারবে না।
মওলানা ভাসানী তাকে লাহোর যেতে বলেন, সোহরাওয়ার্দীকে সারা পাকিস্তান আওয়ামী লীগের নেতৃত্ব গ্রহণ করতে হবে। আমি অনেক কষ্টে লাহোর পৌছলাম।” তিনি প্রায় লাহোর ছিলেন- হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের সাথে আলোচনা হয়। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের নবাব মামাদাত, খান মোহম্মদ খান লুন্দখোর ও পীর সাহউদ্দিন শহীদ সাহেব প্রমুখের কাছে পূর্ব বাংলার রাজনীতি ও পুলিশি নির্যাতনের কথা অবহিত করেন। তিনি আরও বলেন এখন নির্বাচন হলে মুসলিম লীগ শোচনীয় পরাজয় হবে। ঢাকায়
পৃষ্ঠা: ১২৫
তাকে পলিশ খুঁজিতেছে। তিনি লাহোর ত্যাগ করেন। বিমানে দিল্লি আসেন দিল্লি থেকে ট্রেনে কলকাতা-খুলনা হয়ে ঢাকা আসেন। তিনি খাজা দেওয়ান রোডে আলী আসগার খানের বাসায় অবস্থান করেন- ডিসেম্বরের শেষ দিন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা জেলে পাঠিয়ে দেয়। জেলে মাওলানা ভাসানী, শামসুল হক বন্দি আছে। তারা এক সাথে থাকতেন। শামসুল হক বিয়ে করেছেন। তার স্ত্রী আফিয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পরতেন, একে অন্যকে ভালোবেসে বিয়ে করেছেন।
সাঁওতাল বিদ্রোহ
রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জে কমিউনিস্ট নেত্রী ইলা মিত্রের নেততে ১৯৫০ সালের জানুয়ারি মাসে সাঁওতাল বিদ্রোহ হয়। ১৯৫০ সালের ৫ জানুয়ারি বিদ্রোহী সাঁওতাল আন্দোলনকারীরা নাচোল থানার ৩ জন পুলিশকে হত্যা করে। ৭ জানুয়ারি পুলিশ ইলা মিত্রকে রোহনপুর রেলস্টেশনে গ্রেফতার করে। তাঁকে রাজশাহী জেলে রাখা হয়। পুলিশ তার উপর পাশবিক নির্যাতন চালায়।
১৯৫০ সালের দাঙ্গা
কলকাতা ও বিহারে মুসলিম হত্যার প্রতিবাদে মুসলিম লীগের উদ্যোগে পূর্ব পাকিস্তানে ফেব্রুয়ারি মাসে দাঙ্গা শুরু হয়। বরিশালে দাঙ্গায় হিন্দুরা বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। বরিশালের আগরপুর নিবাসী আলতাফউদ্দিন মিয়া হিন্দুদের বাঁচাতে গিয়ে নিহত হন। অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রতিষ্ঠায় তিনি পূর্ব বাংলার প্রথম শহীদ।
স্বায়ত্তশাসন আন্দোলন
কমরেড মণি সিংহ, ত্রৈলক্যনাথ প্রমুখের নেতৃত্বে তেভাগা আন্দোলন কৃষকদের জনপ্রিয়তা লাভ করে। ১৯৪৮-৫০ সাল মুসলিম লীগ সরকারের নির্যাতনের ফলে পূর্ব বাংলা থেকে হাজার হাজার কমিউনিস্ট পশ্চিম বাংলায় পালিয়ে যায় এবং অনেক গ্রেফতার হন। রাজবন্দিরা সরকারের নির্যাতনের প্রতিবাদ জানাতে থাকে। ১৯৫০ সালের ২৪ এপ্রিল রাজশাহী জেলের খাপড়া ওয়ার্ডে পুলিশ গুলি চালিয়ে কমিউনিস্ট নেতা হালিম শেখ, আনোয়ার হোসেন, সুমেন ভট্টাচার্য, দেলওয়ার, সুধীন ধর, বিজন সেন ও কম্প রায় সিংহকে হত্যা করে এবং অনেকে আহত হন। এ নির্মম হত্যাকাণ্ড পূর্ববাংলায় আলোড়ন সৃষ্টি করে। বিরোধী দল শক্তিশালী হতে থাকে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর আহ্বানে ১৯৫০ সালের ১৮ ও ১৯ ম লাহোরে মুসলিম লীগ ওয়ার্কার্স কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় তিনি মুসলিম
পৃষ্ঠা: ১২৬
লীগের দুঃশাসন তুলে ধরেন এবং একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের প্রস্তাব করেন। ১৯৫১ সালের ১৯ মার্চ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে সভাপতি এবং সিন্ধুর মাহমুদুল হক ওসমানীকে সম্পাদক করে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।
স্বাধীনতার পর ভারত ১৯৪৯ সালে সংবিধান প্রণয়নের করে।কিন্তু পাকিস্তান সংবিধান প্রনয়নের অগ্রগতি নেই। ১৯৫০ সালে প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান গণপরিষদে মূল কমিটির রিপোর্ট পেশ করেন। বিপিসির রিপোর্টটি বাঙালীদের স্বার্থবিরোধী ছিল। আওয়ামী মুসলিম লীগ বিপিসির বিরোধীতা করে। এ সময় শেখ মুজিবুর রহমান বন্দি। ১৯৫১ সালের জানুয়ারি নড় ন্যাশনাল কনভেনশন অনুষ্ঠিত হয় এবং বিপিসি রিপোর্টের সংশোধনী প্রস্তাব করে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাওয়াল পিন্ডিতে আততায়ীর হাতে নিহত হন। তার স্থলে খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। এসব শেখ মুজিবুর রহমান কারাবন্দি ছিলেন।
যুবলীগ গঠন ১৯৫১
১৯৫১ সালের ২৭ মার্চ প্রগতিশীল শক্তি পূর্ব পাকিস্তান যুবলীগ গঠন করে। কমিটির সদস্যরা ছিলেন –
মাহমুদ আলী- সভাপতি
খাজা আহমেদ- সহ-সভাপতি
ইয়ার মোহাম্মদ খান- সহ-সভাপতি
শামসুজ্জোহা- সহ-সভাপতি
আবদুল মজিদ- সহ-সভাপতি
মিসেস দৌলাতুন্নেসা- সহ-সভাপতি
আলি আহাদ- সাধারণ সম্পাদক
আব্দুল মতিন- যুগ্ম সম্পাদক
তোসাদ্দক আহমদ চৌধুরী- কোষাধ্যক্ষ
মুসলিম লীগের নতুন মন্ত্রিসভা ১৯৫১
১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হত্যার পর গণপরিষদের অনুমোদন না নিয়ে অর্থমন্ত্রী গোলাম মুহাম্মদকে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল এবং খাজা নাজিমউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করা হয়। ১৯৫১ সালের
পৃষ্ঠা: ১২৭
১৯ অক্টোবর নতুন মন্ত্রিসভা শপথ গ্রহণ করে:
খাজা নাজিমউদ্দিন -প্রধানমন্ত্রী
জাফর উল্লাহ খান -পররাষ্ট্র
ফজলুর রহমান- বাণিজ্য, শিক্ষা
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী -অর্থ
আবদুস সাত্তার পীরজাদা -খাদ্য, কৃষি ও আইন
খাজা শাহাবুদ্দিন -স্বরাষ্ট্র, তথ্য ও বেতার
এম এ গুরমানি- সীমান্ত ও দেশীয় রাজ্য
সর্দার বাহাদুর খান -যোগাযোগ
ডা. এ এম মালেক- শ্রম, স্বাস্থ্য, পূর্ত
সর্দার আবদুর রব -নিসতার শিল্প
ডা. মোহাম্মদ হোসেন- কাশ্মীর
ড. আই এইচ কোরেশী মোহাম্মদ- মোহাজের পুনর্বাসন
১৯৪৮-১৯৫১ সালে পূর্ব পাকিস্তানে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে শক্তিশালী বিরোধী দলের জন্ম হয় এবং তারাই পরবর্তীতে বাংলাদেশের ইতিহাস রচনা করে।
গ. ভাষা আন্দোলন পটভূমি ও ঘটনাপ্রবাহ
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন
১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ ছাত্রসমাজ রাষ্ট্রভাষার দাবিতে আন্দোলন করে। তখন পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী ছাত্রদের সাথে চুক্তি করেন যে, বাংলা হবে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা। তারপর থেকে ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৯৫১ সালের ১১ মার্চ রাষ্ট্রভাষা দিবস পালিত হয়। রাষ্ট্রভাষার দাবি এগিয়ে যেতে থাকে। ১৯৫২ সালের ২৬ জানুয়ারি মুসলিম লীগ আয়োজিত পল্টন ময়দানের জনসভায় খাজা নাযিমউদ্দিন ঘোষণা করলেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” খাজা নাযিমউদ্দিন ভুলে গেলেন ১৯৪৮ সালের ১৫ মাচের চুক্তির কথা। তিনি সেদিন স্বীকার করেছিলেন বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্র ভাষা হবে। প্রতিবাদে ছাত্রসমাজ প্রচণ্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ফজলুল হক হল এবং ১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মধুর ক্যান্টিন। ১৯৫২ সালে জানুয়ারি ছাত্ররা মধুর ক্যান্টিনে একত্রিত হয়ে খাজা নাযিমউদ্দিনের ঘোষণার
পৃষ্ঠা: ১২৮
প্রতিবাদ করে এবং ৩১ জানুয়ারি হরতাল আহ্বান করে। ৩১ জানুয়ারি সকল স্কুল কলেজে ধর্মঘট পালিত হয়।ছাত্র সমাজের মুখে স্লোগান ছিল ‘ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘আমাদের দাবি মান্তে হবে, নইলে গদি ছাড়তে হবে।নারায়ণগঞ্জে ভাষা আন্দোলন তুঙ্গে উঠেছিল। নারায়নগঞ্জের তরুন নেতা মোস্তফা সারওয়ার এবং সরগাম বালিকা বিদ্যালয়ের শিক্ষয়িত্রী মমতাজ বেগমের নেতৃত্বে নারায়ণগঞ্জ শহরের ছাত্রছাত্রী ও জনতা রাস্তায় বিক্ষোভে বেরিয়ে আসে। পুলিশের নির্যাতনের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল নারায়ণগঞ্জবাসী। বাংলা ভাষাকে কেন্দ্র করে পূর্ব বাংলার সকল জেলা, মহকুমায় আন্দোলন, সভা, মিছিল চলছে। ১৯৫২ সালের ৩১ জানুয়ারি ঢাকা জেলা বার লাইব্রেরি হলে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে প্রতিনিধিদের সম্মেলন অনষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ১৫ নম্বর মোগলটুলি অফিসে ৭ ফেব্রুয়ারি ২৮ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কমিটি গঠন করা হয়।
মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী- সভাপতি- আওয়ামী মুসলিম লীগ
কাজী গোলাম মাহবুব- সদস্য- আওয়ামী মুসলিম লীগ
শামসুল হক- সদস্য- আওয়ামী মুসলিম লীগ
আতাউর রহমান খান- সদস্য- আওয়ামী মুসলিম লীগ
আলমাস আলী- সদস্য- আওয়ামী মুসলিম লীগ
আব্দুল আউয়াল- সদস্য- আওয়ামী মুসলিম লীগ
আবুল হাশিম- সদস্য- খেলাফতে রব্বানী পার্টি
কামরুদ্দিন আহমদ- সদস্য- লেবার ফেডারেশন
খালেক নেওয়াজ- সদস্য- ছাত্রলীগ
সৈয়দ নুরুল আলম- সদস্য- ছাত্রলীগ
অধ্যাপক আবুল কাসেম- সদস্য- তমুদ্দিন মজলিশ
মুহাম্মদ তোয়াহা- সদস্য- যুবলীগ
অলি আহাদ- সদস্য- যুবলীগ
আব্দুল মতিন- সদস্য- আহ্বায়ক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ
মজিবল হক- সদস্য- ভিপি, এসএম হল
শামসুল আলম- সদস্য- ফজলুল হক হল ভিপি
হেদায়েত হোসেন চৌধুরী- সদস্য -সাধারন সম্পাদক,এসএমহল
শওকত আলী- সদস্য -কর্মী শিবির
শামসুল হক চৌধুরী- সদস্য- সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
গোলাম মওলা -সদস্য -ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ
মুহাম্মদ নুরুল হুদা- সদস্য- ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ
সৈয়দ আব্দুর রহিম- সদস্য- রিকশা ইউনিয়ন
খয়রাত হোসেন এমএলএ- সদস্য- আইনসভার প্রতিনিধি
আনোয়ারা বেগম এমএলএ- সদস্য- আইনসভার প্রতিনিধি
আব্দুল গফুর- সদস্য -সম্পাদক, সাপ্তাহিক, সৈনিক
মির্জা গোলাম হাফিজ- সদস্য- সিভিল লিবার্টি পার্টি
আনোয়ারুল হক খান- সদস্য- সাধারন সম্পাদক, ফজলুল হক হল
আখতারউদ্দিন আহমদ- সদস্য- নিখিল পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ
মওলানা ভাসানীকে সভাপতি ও কাজী গোলাম মাহবুবকে আহ্বায়ক করে ২৮ সদস্যবিশিষ্ট সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ ২১ ফেব্রুয়ারি সারা পর্ব বাংলায় সাধারণ ধর্মঘট, মিছিল ও জনসভার আহ্বান করে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল পূর্ববঙ্গ আইন পরিষদের বাজেট অধিবেশন। সংগ্রাম পরিষদের অর্থ সংগ্রহের জন্য ১১-১৩ ফেব্রুয়ারি পতাকা দিবস পালিত হয়। ১৯৫২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি নুরুল আমিন সরকার ঢাকা শহরে এক মাসের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করে। উদ্ভূত পরিস্থিতি আলোচনার জন্য সন্ধ্যা ৭টায় ৯৪ নবাবপুর রোডে আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভা অনুষ্ঠিত হয়। অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার পক্ষে মত দেয়। ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শামসুল হক মুসলিম লীগের নির্যাতনে ক্লান্ত। একদিকে তার স্ত্রী আফিয়া বেগমের অসহযোগিতা; অন্যদিকে দুই শিশুকন্যার জন্য পিছুটান। সুতরাং তার কাছে থেকে সংগ্রামী নেতৃত্ব আশা করা যায়নি। আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিব জেলে অন্তরীণ। তিনি মুক্তা থাকলে তার কাছ থেকে সংগ্রামী নেতৃত্ব আশা করা যেত।
‘৫২র ভাষা আন্দোলনে শেখ মুজিব
১৯৫২ সালে ভাষা আন্দোলনকালে শেখ মুজিব জেলে বন্দি ছিলেন। জেল থেকেও তিনি ভাষা আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ‘৫২র ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তাঁর
পৃষ্ঠা: ১৩০
আত্মজীবনীতে বলেছিলেন: “১৯৪৯ সালের ডিসেম্বর মাসে আমি জেলে আসলাম।
১৯৪৭ সালে পাকিস্তান হযেছে। আমার তিনবার জেলে আসতে হল, এইবার নিয়ে। মাওলানা সাহেবের কাছে সকল কিছুই বললাম।
কয়েকদিন পরেই আমাকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসা হল। চক্ষু দুইটা বেশ যন্ত্রনা দিতেছিল। তাই প্রথমে চোখের চিকিৎসা শুরু করলেন ক্যাপ্টেন লষ্কর, চোখের বিখ্যাত ডাক্তার। কিছুদিনের মধ্যে কিছুটা উপকার হল, আরও কিছুদিন লাগবে। ডা. শামসুদ্দিন সাহেব হার্টের চিকিৎসা শুরু করলেন। বিকেলে অনেক লোক আসত আমাকে দেখতে।
আমি হাসপাতালে আছি। সন্ধ্যায় মোহাম্মদ তোয়াহা ও অলি আহাদ দেখা করতে আসে। আমার কেবিনের একটা জানালা ছিল ওয়ার্ডের দিকে। আমি ওদের রাত একটার পরে আসতে বললাম। আরও বললাম, খালেক নেওয়াজ, কাজী গোলাম মাহাবুব আরও কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাকে খবর দিতে। দরজার বাইরে আইবিরা পাহারা দিত। রাতে অনেকে ঘুমিয়ে পড়েছে। তখন পিছনের ওরা পাঁচ-সাতজন এসেছে। আমি অনেক রাতে একা হাঁটাচলা করতাম। রাতে কেউ আসে না বলে কেউ কিছু বলত না। পুলিশরা চুপচাপ পড়ে থকে কারণ জানে আমি ভাগব না। গোয়েন্দা কর্মচারী একপাশে বসে ঝিমায়। বারান্দায় বসে আলাপ হল এবং আমি বললাম, সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে। আওয়ামী লীগ নেতাদেরও খবর দিয়েছি। ছাত্রলীগই তখন ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র জনপ্রিয় প্রতিষ্ঠান। ছাত্রলীগ নেতারা রাজি হলো। অলি আহাদ ও তোয়াহা বলল, যুবলীগও রাজি হবে। আবার ষড়যন্ত্র চলছে বাংলা ভাষার দাবিকে নস্যাৎ করার। এখন প্রতিবাদ না করলে কেন্দ্রীয় আইনসভায় মুসলিম লীগ উর্দুর পক্ষে প্রস্তাব পাস করে নেবে। নাজিমুদ্দীন সাহেব উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার কথাই বলেন নাই, অনেক নতুন নতুন যুক্তিতর্ক দেখিয়েছেন। অলি আহাদ যদিও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের সদস্য হয় নাই, তবুও আমাকে ব্যক্তিগতভাবে খুবই শ্রদ্ধা করত ও ভালোবাসত। আরও বললাম, “খবর পেয়েছি, আমাকে শীঘ্রই আবার জেলে পাঠিয়ে দিবে, কারণ আমি নাকি হাসপাতালে বসে রাজনীতি করছি। তোমরা আগামীকাল রাতেও আবার এস।” আর দু’একজন ছাত্রলীগ নেতাকে আসতে বললাম। শওকত মিয়া ও কয়েকজন আওয়ামী লীগ কর্মীকেও দেখা করতে বললাম। পরের দিন রাতে এক এক করে অনেকেই আসল। সেখানেই ঠিক হল আগামী ২১শে ফেব্রুয়ারি রাষ্ট্রভাষা দিবস পালন করা হবে এবং সভা করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে। ছাত্রলীগের পক্ষ থেকেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের কনভেনর করতে হবে। ফেব্রুয়ারি থেকেই জনমত
পৃষ্ঠা: ১৩১
সৃষ্টি করা শুরু হবে। আমি আরও বললাম, “আমি ও আমার মুক্তির দাবি করে ১৬ই ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করব। আমার ২৬ মাস জেল হয়ে গেছে।“ আমি একথাও বলেছিলাম, “মহিউদ্দিন জেলে আছে, আমার কাছে থাকে। যদি সে অনশন করতে রাজি হয়, তবে খবর দেব। তার নামটাও আমার নামের সাথে দিয়ে দিবে। আমাদের অনশনের নোটিশ দেওয়ার পরই শওকত মিয়া প্যামপ্লেট ও পোস্টার ছাপিয়ে বিলি করার বন্দোবস্ত করবে।“
হাসপাতালে থেকে শেখ মুজিব রাজনীতি করেন এ কারনে সরকার তাঁকে কারাগারে পাঠিয়ে দেয়। শেখ মুজিব ও মহিউদ্দিন ১৬ ফেব্রুয়ারি থেকে অনশন ধর্মঘট শুরু করবে। এ সংবাদ পেয়ে সরকার তাদের ফরিদপুর জেল পাঠিয়ে দেয়।
ফরিদপুর জেলে তিনি ও মহিউদ্দিন অনশন শুরু করেন। জেলে বসে তারা ঢাকায় ছাত্র হত্যার সংবাদ পায়। তিনি ছাত্রহত্যা সম্পর্কে লিখেছেন, “মুসলিম লীগ সরকার এত বড় অপরিণামদর্শিতার কাজ করল। মাতভাষা আন্দোলনে পথিবীতে এই প্রথম বাঙালিরা রক্ত দিলো। দুনিয়ার কোথাও ভাষা আন্দোলন করার জন্য গুলি করে হত্যা করা হয় নাই।”
শেখ মুজিবুর রহমান ও বরিশালের মহিউদ্দিন আহমেদ ফরিদপুর জেলে তাদের মুক্তির দাবীতে অনশন করছেন। তারা শারীরিকভাবে খুবই দুর্বল হয়ে পড়েন। শেখ মুজিব অনশন সম্পর্কে বলেন,
সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের অধিকাংশ সদস্য ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেও ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র সংগ্রাম কমিটি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রনেতাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুল মতিন, গাজীউল হক, শামসুল আলম, এসএ বারী এটি, এমআর আখতার মুকুল, হাবিবুর রহমান শেলী প্রমুখ। ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরের স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায় সমবেত হয়। সমবেত ছাত্রদের ১৪৪ ধারা ভঙ্গ না করার জন্য আওয়ামী লীগ সম্পাদক শামসুল হক অনুরোধ জানান। অন্যদিকে গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। এ সময় আব্দুস সামাদের মধ্যস্থতায় সিদ্ধান্ত হয় যে, ৫ জন ৫ জন করে ১০ জনের দল ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে আইনসভার দিকে অগ্রসর হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের নিকট পুরাতন আইনসভার ভবন ছিল। প্রথমে নাদিরা বেগমের নেতৃত্বে মেয়েদের দলটি অগ্রসর হয়। পুলিশ তাদের ওপর লাঠিচার্জ করে। তারপর ছেলেদের দলটি অগ্রসর হয়। প্রথম দলে ছিলেন আব্দুল মতিন, গাজীউল হক, হাবিবুর রহমান, শামসুল আলম, এম আর আখতার মুকুল প্রমুখ। শত শত ছাত্র মিছিল করে যাচ্ছে।
পৃষ্ঠা: ১৩২
মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন ও মুখ্য সচিব পাঞ্জাবী আজিজ আহমদ ছাত্রদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহনের নির্দেশ দেন। তখন আইজি পুলিশ জাকির হোসেন, জেলা ম্যাজিস্ট্রেট করায়াশী, ডিআইজি হাফিজুদ্দিন, পুলিশ সুপার ইদ্রিস এবং সিটি এস পি মাসুদ বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় উপস্থিত ছিলেন এবং তার পলিশ দিয়ে হলগুলো ঘিরে ফেলে। তারা গুলির নির্দেশ দেয়। পুলিশের টিয়ারগ্যাস সেল নিক্ষেপ ও লাঠিচার্জের ফলে ছাত্ররা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে সমবেত হয়। ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের ছাত্ররাও মেডিক্যাল কলেজে সমবেত হয়েছে। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ যখন দেখলো ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে তখন তারাও মিচিলে যোগ দেয়। এ কথা সত্যি-সংগ্রাম সংগ্রাম পরিষদ প্রথম ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় মিছিল করে এবং অন্যদিকে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ পিছিয়ে ছিলেন না – তারা এগিয়ে আসেন। আইনসভর অধিবেশন ৩টায় শুরু হবে। এমএলএগণ কড়া পুলিশ প্রহরায় জীপে যাচ্ছে – ছাত্ররা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, নাযিম-আমিন নিপাত যাক, পুলিশ জুলম চলবে না প্রভৃতি স্লোগান দিচ্ছে। বেলা ৩টা ২০ মিনিট মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেলের সামনে সমবেত ছাত্রদের ওপর পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে মেডিক্যাল কলেজ ব্যারাকের পাশে (বর্তমান শহীদ মিনার) দাড়ানো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এমএ ক্লাসের ছাত্র আবদুল জব্বার গুলিবিদ্ধ হন এবং তার মাথার খুলি উড়ে যায়। তারপর রফিক, বরকত, সালাম মেডিক্যাল কলেজের সামনে গুলিবিদ্ধ হন। তাদের ধরাধরি করে হাসপাতালে নেওয়া হয়। মাত্র ৩০ মিনিটে ৩-২০ মিনিটে হতে ৩-৫০ মিনিটের গুলিবর্ষণে বাঙালি জাতিকে প্রবলভাবে কাপিয়ে দেয়। গুলিবিদ্ধ ছাত্ররা মৃত্যুবরণ করেন। জব্বার, রফিক, সালাম ও বরকতের মৃত্যুর খবরে ঢাকার জনতা রাস্তায় বেরিয়ে আসে এবং ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে সমাবেত হয়।
ছাত্র হত্যার সংবাদ আইনসভায় পৌছলে বিরোধী দলের এমএলএগণ এই জঘন্য ছাত্র হত্যার বিচার দাবি করেন। মুখ্যমন্ত্রী উত্তরে বলেন, “এ হলো কল্পনাবিলাসী গল্প।” তিনি আরও বলেন, “পুলিশ ঠিকই করেছে… উচ্ছৃঙ্খলতা দমনের জন্য পুলিশ। এর পিছনে কমিউনিস্টদের উস্কানি আছে। তাদের নিমূল করবই।” পরিষদ সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ জানিয়ে আইনসভা মুলতবির দাবি করেন। ছাত্র হত্যার সংবাদ শুনে শেরে বাংলা এ কে ফজলুল হক তার ভাগিনা সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়াকে নিয়ে মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে উপস্থিত হলেন এবং তীব্র ভাষায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ জানান। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষণা করে ২২ ফেব্রুয়ারি জানাজা অনুষ্ঠিত
পৃষ্ঠা: ১৩৩
হবে। ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে আইনসভার সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ, আনোয়ারা বেগম, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, খয়রাত হোসেন মুসলিম লীগ ত্যাগ করে মেডিক্যাল কলেজে ছুটে আসেন এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ জানান। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতের অন্ধকারে পুলিশ জব্বার, বরকত, রফিকের লাশ নিয়ে যায় এবং সরকারের নির্দেশে তাদের আজিমপুর গোরস্তানে দাফন করা হয়, ২২ ফেব্রুয়ারি ছাত্রজনতা মেডিক্যাল কলেজে সমবেত হয়। কিন্তু লাশ নেই। তারা গায়েবি জানাজা পড়ে মিছিল করে নবাবপুরের দিকে যাচ্ছে। জব্বার, রফিক বরকতের রক্তমাখা কাপড় নিয়ে ছাত্ররা মিছিল করছে। হাইকোর্টের নিকট হঠাৎ পুলিশ গুলিবর্ষণ করলে শফিকুর রহমান গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যায়।২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ১৯ জন নিহত ও অনেকে আহত হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল কলেজে শোকসভা অনুষ্ঠিত হয়। জানাজায় ও শোকসভায় এ এ কে ফজলুল হক উপস্থিত ছিলেন। ২২ ফেব্রুয়ারি রাতে জব্বার, রফিক, বরকত ও শফিকের স্মরণে মেডিক্যাল কলেজের সামনে শহীদ মিনার নির্মিত হয় এবং তা শহীদ শফিকের বাবাকে দিয়ে উন্মোচন করা হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি আন্দোলন, মিছিল, সভা চলে। সারা দেশে আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। পুলিশ শত শত ছাত্র-জনতা গ্রেফতার করে। আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগ, ছাত্রলীগ ও যুবলীগ। কমিউনিস্ট ও তমদুন মজলিস ভাষা আন্দোলনে অংশ নেয়। আইনসভার সদস্য মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, আনোয়ারা বেগম ও কংগ্রেস সদস্যগণ আন্দোলনে অংশ নেন। তাদের অংশগ্রহণ আন্দোলনকে বেগবান করে। নূরুল আমিন সরকারের আইনসভার সদস্য মওলানা তর্কবাগীশ ও খয়রাত হোসেনকে গ্রেফতার করে। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ ধরা পড়েন। আওয়ামী মুসলিম লীগের শামসুল হক, কেজি মাহবুব আত্মগোপন করেন। তোয়াহা, অলি আহাদ, মজিবুল হক, শামসুল আলম গ্রেফতার হন। এ সময় মওলানা ভাসানী সন্তোষে অবস্থান করছিলেন এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তখন সিন্ধু প্রদেশে। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলির সংবাদ পেয়ে সোহরাওয়ার্দী পত্রিকায় বিবৃতি দেন। তাঁর বিবৃতি সমালোচিত হয়। তিনি প্রকৃত অবস্থান জানতেন না। তিনি ঢাকা এসে সব ঘটনা জানতে পারেন। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার জন্য সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা কর্মপরিষদ স্বাক্ষর অভিযান শুরু করে। তাতে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালের ৭ জুন স্বাক্ষর দান করেন। ২১ ফেব্রুয়ারির আন্দোলন ফেব্রুয়ারি মাসেই স্তিমিত হয়ে যায়। সারা বাংলায় মুসলিম লীগ সরকারের নিপীড়ন ও নির্যাতন চলতে থাকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ হয়ে যায়। ছাত্ররা গ্রামে চলে যায়। গ্রামে গ্রামে ভাষা
পৃষ্ঠা: ১৩৪
আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ ফেব্রুয়ারি থেকে ঢাকায় ভাষা আন্দোলন বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গ্রামবাংলায় আন্দোলন চলতে থাকে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ মার্চ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার একটি পরিত্যক্ত বাড়িতে গ্রেফতার হন। অবশিষ্ট নেতারা আত্মগোপন করেন। ভাষা আন্দোলনে যারা গ্রেফতার হয়েছিলেন তাদের মধ্যে ছিলেন আওয়ামী মুসলিম লীগের সভাপতি মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, সাধারন সম্পাদক শামসুল হক, কাজী গোলাম মাহবুব, খেলাফতে রব্বানী পার্টির আবুল হাশিম, যুবলীগের মুহাম্মদ তোয়াহা, অলি আহাদ, ছাত্রনেতা সামসুল আলম, আব্দুল মতিন, গাজীউল হক, এস এম হলের ভিপি মজিবুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক অজিত গুহ প্রমুখ। আইনসভার সদস্য মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ, খয়রাত হোসেন দীর্ঘদিন কারাবন্দি ছিলেন। জেল থেকে কয়েকজন মুক্তিপান; কিন্তু অনেকেই দীর্ঘদিন কারা নির্যাতন ভোগ করেন। শামসুল হক হয়ে পড়লে তার স্ত্রী আফিয়া তার দু’শিশুকন্যাকে নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের সাথে দেখা করে স্বামীর মুক্তি কামনা করেন। কিন্তু নুরুল আমিন তাকে মুক্তি দেননি। আওয়ামী লীগের সম্পাদক সরকারের নির্যাতনের ফলে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলেন। তার মুক্তির জন্য মুখ্যমন্ত্রীর নিকট বার বার অনুরোধ করা হয়। কিন্তু নুরুল আমিন তাকে মুক্তি দিলেন না। তিনি যখন মুক্তি পেলেন, তখন তিনি সম্পূর্ণ অসুস্থ। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী তার চিকিৎসার জন্য চেষ্টা করেন। কিন্তু তিনি আর আরোগ্য লাভ করেননি। ১৯৭০ সালের পর তিনি হারিয়ে যান। তাকে আর দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা শামসুল হক অকালে বাংলার রাজনীতি থেকে বিদায় নিলেন নীরবে, নিভৃতে। মুসলিম লীগ ও মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন তাকে হত্যা করেছে।
১৯৫২ সালে নুরুল আমিন ভাষা আন্দোলনে শুধু ছাত্রদেরই হত্যা করেননি। তিনি বিরোধী রাজনৈতিক দলের অন্যতম স্রষ্টা শামসুল হককেও ধ্বংস করেছেন। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ছাত্রদের ওপর পুলিশের গুলিবর্ষণ ও হত্যা সম্পর্কে তদন্তের জন্য বিচারপতি এলিসকে নিয়োগ করা হয়। জাস্টিস এলিস তদন্তপূর্বক পুলিশের গুলিবর্ষণ সঠিক হয়েছে বলে রিপোর্ট দাখিল করেন।
১৯৫২ সালের শহীদদের স্মরণে অনেক গান, কবিতা, প্রবন্ধ ও গল্প রচিত হয়। এ গানগুলোর মধ্যে বরিশালের আবদুল গাফফার চৌধুরীর লেখা একুশে ফেব্রুয়ারি, আবদুল লতিফের লেখা ‘ওরা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে
পৃষ্ঠা: ১৩৫
চায়’, ওবায়দুল্লাহ খানের কবিতা এবং আশরাফ আলীর লেখা প্রবন্ধ বাঙালার জনজীবনে সাড়া জাগিয়েছিল। আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে যোগ দেন এবং ২১ ফেব্রুয়ারি আহত হন। ২১ ফেব্রুয়ারি পরপরই তিনি একুশের গান রচনা করেন এবং আব্দুল লতিফ তার লেখা গানে প্রথম সুর দেন এবং ১৯৫৩ সালে তার লেখা গানটি প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। মঠবাডিয়ার প্রকৌশলী মোশাররফ উদ্দিনের লেখা একুশের গানটিও ১৯৫৩ সালের প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয়। গাফফার চৌধুরীর ২১ ফেব্রুয়ারি গানটিতে বরিশালের আলতাফ মাহমুদ সুর দেন এবং ১৯৫৭ সালে তা প্রভাতফেরীতে গীত হয়। আলতাফ মাহমুদের সুর দেওয়া একুশের গান জনপ্রিয়তা লাভ করে এবং বর্তমানে আলতাফ মাহমুদের সুর দেওয়া গানটি জাতীয়ভাবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত গান। একুশের গানের সুরকার আলতাফ মাহমুদকে ১৯৭১ সালে পাক বাহিনী নির্মমভাবে হত্যা করে।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন মুসলিম লীগ সরকারকে জনগন থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতীয়তাবাদের আন্দোলনের সূচনা করে এবং পাকিস্তান জন্মের ভিত্তি দ্বিজাতিতত্ত্বকে ভেঙে ফেলে। বায়ানর আন্দোলনের পিচ্ছিল পথ বেয়ে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের বিজয়, ১৯৬২, ১৯৬৪, ১৯৬৬ সালের ৬ দফা ও ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের পথ বেয়ে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয় এবং ১৯৭১ সালের সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টি হয়।
মুসলিম লীগ ভাষা আন্দোলনকে ভারতের ও হিন্দু সম্প্রদায়ের ষড়যন্ত্র বলে আখ্যায়িত করে। ১৯৫২ সালের ২১ ও ২২ ফেব্রুয়ারি মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ এমএলএ পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় দাঁড়িয়ে ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ জানান। তখন সে মুহূর্তে পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিন নিহত ছাত্রদের প্রতি কোনো সহানুভূতি না জানিয়ে ভাষা আন্দোলনকারীদের কমিউনিস্ট, হিন্দু ও ভারতের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করেন। ২৪ ফেব্রুয়ারির পর ভাষা আন্দোলন ঢাকার স্তিমিত হয়ে পড়লেও জেলায়, মহকুমায় ও গ্রামাঞ্চলে ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামেগঞ্জে স্লোগান চলছে- রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই, মুখ্যমন্ত্রী নুরুল আমিনের ফাসি চাই। মুসলিম লীগ সরকার শত শত রাজনৈতিক নেতা ও ছাত্রদের নিরাপত্তা আইনে আটক করে। এ সঙ্কটকালে ভাষা আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্য শেখ মুজিবের উদ্যোগে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ পুনর্গঠন করা হয়। ১৯৫২ সালের ৭ মার্চ আওয়ামী মুসলিম লীগের সহ-সভাপতি আতাউর রহমানকে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক করা হয়। ১৯৫২ সালের ২৭
পৃষ্ঠা: ১৩৬
এপ্রিল ঢাকা বার লাইব্রেরী হলে ভাষা আন্দোলনকারী ৫০০ ভাষাসৈনিকের সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ভাষণ দেন। এখানে উল্লেখ করা যেতে পারে, ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের কৃতিত্ব যুবলীগসহ বামপন্থি দল দাবি করে। তাদের বক্তব্য, আওয়ামা লীগ ও ছাত্রলীগ ভাষা আন্দোলনের ডাক দিলেও তারা ২১ ফেব্রুয়ারির ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করতে অস্বীকার করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক আব্দুল মতিন, গাজিউল হক, হাবিবুর রহমান, শামসুল আলম, এম আর আখতার মুকুল প্রমুখ নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা যখন ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাস্তায় বেড়িয়ে পরেন তখন আওয়ামী মুসলিম লীগ পিছিয়ে ছিল না, তারাও সেদিন মিছিলে যোগ দেয় এবং ছাত্র হত্যার প্রতিবাদ জানায়। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ গ্রেফতারের পর ২৪ ফেব্রুয়ারি হতে আওয়ামী মুসলিম লীগ,ছাত্রলীগ রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন চালিয়ে যায় এবং তাদের নেতৃত্বে ১৯৫৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ঢাকাসহ সারা প্রদেশে ব্যাপকভাবে শহীদ দিবস পালিত হয়।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫০ সালে পাকিস্তান আওয়ামী-মুসলিম লীগ গঠন করেন। কিন্তু ১৯৫১ সালে পাঞ্জাবের প্রাদেশিক নির্বাচনকালে মামদৌতের নওয়াবের জিন্নাহ লীগের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়ে তার দল বিলুপ্ত করে। শেখ মুজিবর রহমানের অনুরোধে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৫২ সালে পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পুনরায় প্রতিষ্ঠা করেন। করাচী সফরকালে শেখমুজিব সোহরাওয়ার্দীকে বলেন, “আপনি জিন্নাহ আওয়ামী লীগ করেছেন, আমরা নাম পরিবর্তন করতে পারব না। কোনো ব্যক্তির নাম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে যোগ করতে চাই না। দ্বিতীয়ত আমাদের ম্যানিফেস্টো আছে, গঠনতন্ত্র আছে, তার পরিবর্তন করা সম্ভবপর নয়। মওলানা ভাসানী সাহেব আমাকে ১৯৪৯ সালে আপনার কাছে পাঠিয়েছিলেন। তখনও তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ গঠনের জন্য অনুরোধ করেছিলেন। তারও কোনো আপত্তি থাকবেনা, যদি আপনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টো ও গঠনতন্ত্র মেনে নেন।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর মুসলিম ছাত্রলীগ বিভক্ত হয়ে পড়ে। বামপন্থি ছাত্রদের সাথে ছাত্র ফেডারেশন যোগ দেয়। কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থক হিসেবে ছাত্র ইউনিয়ন সৃষ্টি হয়। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে মুহাম্মদ সুলতানকে সভাপতি ও মুহাম্মদ ইলিয়াসকে সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন গঠন করা হয়।
১৯৫১ সালে যুবলীগ এবং ১৯৫২ সালে ছাত্র ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠার ফলে। একটি বামপন্থি রাজনৈতিক দল গঠনের পটভূমি সৃষ্টি হয়। ১৯৫৩ সালের ১৭
পৃষ্ঠা: ১৩৭
জানুয়ারি গণতন্ত্রী দল গঠিত হয়। গণতন্ত্রী দলের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হলেন দিনাজপুরের কৃষক নেতা হাজী মুহাম্মদ দানেশ এবং সহ-সভাপতি ছিলেন মহিউদ্দিন আহমদ। সিলেটের মাহমুদ আলীকে সম্পাদক এবং আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকে যুগ্ম সম্পাদক করে কমিটি গঠন করা হয়।মাহমুদ আলীর স্থলে যুবলীগের সভাপতি হলেন মুহাম্মদ তোয়াহা। ১৯৫৩ সালে একুশে ফেব্রুয়ারি ব্যাপকভাবে পালিত হয়। ছাত্র-জনতা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের পাদদেশে সমবেত হয় এবং আব্দুল গাফফার রচিত একুশের গান গাওয়া হয়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে প্রভাতফেরিতে গাওয়া হয় প্রকৌশলী মশাররফ উদ্দিন আহমদ রচিত একুশের গানটি। এ বছরই প্রকাশিত হয় হাফিজর রহমান সম্পাদিত ‘একশে ফেব্রুয়ারি’ সঙ্কলন। ১৯৫৩ সালের ভাষা আন্দোলনকারী অনেককে গ্রেফতার করা হয়।
১৯৫২-৫৩ সালে বিশ্ব ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন ঘটে। ১৯৫২ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের সম্রাট ষষ্ঠ জর্জ প্রাণত্যাগ করেন এবং তার স্থলে জ্যেষ্ঠ কন্যা প্রিন্সেস এলিজাবেথ (দ্বিতীয়) সিংহাসনে আরোহণ করেন। ১৯৫২ সালে মিসরের রাজা ফারুককে সিংহাসনচ্যুত করে জেনারেল নাগিব ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৫৩ সালে জেনারেল নাগিবকে বন্দি করে আব্দুল নাসের মিসরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করেন। সোভিয়েত রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী জোস স্ট্যালিন ১৯৫৩ সালের ৫ মার্চ প্রাণত্যাগ করেন। তার মৃত্যুর পর ক্রুশ্চেভ রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। ১৯৫১ সালে উত্তর কোরিয়া ও দক্ষিণ কোরিয়ার মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয় এবং তা কয়েক বছরব্যাপী চলে। কোরিয়ায় যুদ্ধকালে পাটের দাম বৃদ্ধি পায় এবং পূর্ব বাংলার পাটচাষীরা পাট রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করেন। কিন্তু তা পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প প্রতিষ্ঠায় ব্যয় করা হয়। তাই দেখা যায় ১৯৫২ সালের পর থেকে অর্থনৈতিক উন্নয়নে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি হতে থাকে। বাঙালিদের পাটের পয়সা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বস্ত্রশিল্প প্রতিষ্ঠিত হয় এবং পরবর্তীতে পশ্চিম পাকিস্তানের ২২ পরিবার পাকিস্তানের অর্থনীতিতে একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে। কোরিয়ায় যুদ্ধ বন্ধ হলে পাটের দাম দ্রুত হাস পায় এবং পাটচাষিরা ক্ষতিগ্রস্ত হন। মুসলিম লীগ সরকারের জনপ্রিয়তা পূর্ব পাকিস্তানে হ্রাস পায়।
প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের হত্যার মাধ্যমে পাকিস্তানে যে ষড়যন্ত্রের রাজনীতি শুরু হয় তা আমলাদের নেতৃত্বে চলতে থাকে। ১৯৫১-৫২ সালে পাকিস্তানে খাদ্য সঙ্কট দেখা দেয়। আমেরিকা পাকিস্তানকে খাদ্য ও অস্ত্র সাহায্যে দেয়। বগুড়ার মুহাম্মদ আলী তখন আমেরিকায় পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত
পৃষ্ঠা: ১৩৮
গভর্নর জেনারেল গোলাম মুহাম্মদ, প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান এবং রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আলীর মাধ্যমে পাকিস্তান- আমেরিকা অস্ত্র সাহায্য চুক্তি সম্পাদন করে।গোলাম মুহাম্মদ পাকিস্তানে গনতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ধংশ করার জন্য ষড়যন্ত্র করেন। এদিকে মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় দুর্বল হয়ে পড়ে। বিশেষ করে পূর্বাঞ্চলে খাজা নাযিমাউদ্দিনের জনপ্রিয়তা ছিল না।মুসলিম লীগ জনবিচ্ছিন্ন একটি ঘৃণিত দলে পরিণত হয়।এ সুযোগে ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ খাজা নাজিমুদ্দিঙ্কে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদচ্যুত করেন। গোলাম মোহাম্মদের নেতৃত্বে পাকিস্তানের আমলারা গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রথম ক্যু’ করে খাজা নাজিমউদ্দিনকে সরিয়ে দেন।গোলাম মোহাম্মদের অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপকে বিনা প্রতিবাদে মুসলিম লীগ গ্রহন করে। ১৭ এপ্রিল পাকিস্তানের কোথাও প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনের পদচ্যুতির প্রতিবাদ হয়নি। পূর্ব পাকিস্তানে আনন্দের বন্যা বয়ে যায়। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ খাজা নাযিমউদ্দিনের পতনকে তাদের বিজয় বলে চিহ্নিত করে। ১৯৫৩ সালের এপ্রিল মাসে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে আওয়ামী মুসলিম সভা চলছে। এ সভায় হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও শেখ মুজিব ভাষন দেন এবং খাজা নাযিমউদ্দিনের পদচ্যুতিকে স্বাগত জানায়। খাজা নাজিমউদ্দিন চিরদিন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রতি শত্রুতা করেছেন। খাজা নাযিমউদ্দিনকে পদচ্যুত করার পিছনে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইঙ্গিত ছিল এবং তাদের পরামর্শে রাষ্ট্রদূত মুহাম্মদ আলীকে গভর্নর জেনারেল পাকিস্তানের নতুন প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত এবং তার অধীনে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিসভার সদস্যরা ছিলেন মুহাম্মদ আলী, স্যার জাফরুল্লাহ খান, এম এ গুরমানী, সর্দার বাহাদুর খান, ডা. এ এম মালেক, ডা. এইচ আই কোরেশী, এ কে ব্রোহী, এ কে খান, শোয়েব কোরেশী ও তোফাজ্জল আলী।
১৯৫৩ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের কাউন্সিল অধিবেশনে মুসলিম শব্দ বাদ দিয়ে সংগঠনটির পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নামকরণ করা হয়। অসাম্প্রদায়িক নামকরণ করায় ছাত্রলীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এম কামরুজ্জামানকে সভাপতি এবং এম আবদুল ওয়াদুদকে সাধারণ সম্পাদক করে ১৯৫৩-৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কমিটি গঠন করা হয়।
১৯৫২ সালে শামসুল হক অসুস্থ হয়ে পড়লে মওলানা ভাসানী যুগ্ম সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে সম্পাদকের চলতি দায়িত্ব প্রদান করেন। ১৯৫৩ সালে মওলানা ভাসানী জেল থেকে মুক্তিলাভ করেন। ঢাকার মুকুল সিনেমা হলে আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রথম কাউন্সিল সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায়
পৃষ্ঠা: ১৩৯
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন। সভায় মওলানা ভাসানীকে সভাপতি, মাওলানা তর্কবাগীশ ও আতাউর রহমান খানকে সহ-সভাপতি এবং শেখ মুজিবকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুস্লিম্লীগ গঠন করা হয়। ১৯৫১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান প্রাদেশিক আইনসভার নির্বাচন সমাপ্ত হয়। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক দলগুলো পূর্ব বাংলা আইন পরিষদে নির্বাচন দাবি করে। ১৯৪৯ সালে টাঙ্গাইলের উপনির্বাচনে পরাজয়ের পর মুসলিম লীগ প্রায় ৩৬টি আসনে উপনির্বাচন ও সাধারণ নির্বাচন দিতে ভিত হয়ে পড়ে। শেষ পর্যন্ত মুসলিম লীগ সরকার ঘোষণা দেয় যে, ১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ সাধারন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিব বাংলার সকল জেলায়, মহকুমায় সফর করে আওয়ামী লীগক জনপ্রিয় সংগঠনে পরিণত করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর পুরনো মুসলিম লীগ কর্মী ও নেতারা দলে দলে আওয়ামী লীগে যোগ দিতে থাকে। ১৯৫০ সালের দাঙ্গা ও ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পর বাঙালিদের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় বিপ্লবী পরিবর্তন শুরু হয়। গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সংগঠনগুলো শক্তিশালী হতে থাকে এবং আরও কয়েকটি রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
ঘ. হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দীর যুক্তফ্রন্ট- ১৯৫৪ সালের নির্বাচন ও পরিণতি
১৯৫৩ সালের ২৭ জুলাই একে ফজলুল হক কৃষক শ্রমিক পার্টি কেএসপি গঠন করেন। একে ফজলুল হককে সভাপতি এবং আবদুল লতিফ বিশ্বাসকে সম্পাদক করে কেএসপি গঠিত হয়।
মুসলিম লীগের সাবেক সম্পাদক আবুল হাশিম খেলাফতে রাব্বানী পার্টি গঠন করেন। ১৯৫৩ সালের শেষে কিশোরগঞ্জের মওলানা আতাহার আলী গঠন করেন নিজামে ইসলাম পার্টি। এছাড়া ছিল কংগ্রেস, তফসিলী ফেডারেশন, সোস্যালিস্ট পার্টি, গণতন্ত্রী দল। মুসলিম লীগ কমিউনিস্ট পার্টিকে ১৯৪৮ সালে বেআইনি ঘোষণা করে।
১৯৫৩ সালে ১৪-১৫ নভেম্বর ময়মনসিংহে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আওয়ামী মুসলিম লীগের কাউন্সিল অধিবেশন বসে। এ সভায় শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। ১৯ সালের ২৫ ডিসেম্বর সাপ্তাহিক ইত্তেফাক দৈনিক ইত্তেফাক হিসেবে প্রকাশিত হতে
পৃষ্ঠা: ১৪০
থাকে। সরকার ১৯৫৪ সালে সাধারন নির্বাচন ঘোষনা করে। মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে যুক্তফ্রন্ট গঠনেরপক্ষে ছিলেন না। ছাত্র সমাজের চাপে সকল বিরোধী দল একত্রিত হয় যুক্তফ্রন্ট গঠন করে। একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানী ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর যুক্তফ্রন্ট গঠন করেন। আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি আবুল মনসুর আহমদের প্রণীত ২১ দফায় তিন নেতা সাক্ষর করেন।১৯৫৩ সালের ৫ ডিসেম্বর ২১ দফা প্রকাশিত হয়।
ঐতিহাসিক ২১ দফা
১. লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন।
২. বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে।
৩. নিরাপত্তা আইন বাতিল, সকল রাজবন্দির মুক্তি।
৪. বিচার বিভাগকে প্রশাসন বিভাগ থেকে পৃথক করা।
৫. বিনা ক্ষতিপূরণে জমিদারি-মধ্যস্বত্ব প্রথা উচ্ছেদ।
৬. সমবায় কৃষি খামার ব্যবস্থা প্রবর্তন করা।
৭. এ পূর্ব বাংলাকে শিল্পায়িত করা। খাদ্যে স্বাবলম্বী করা।
৮. সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন। দেশকে বন্যা ও দুর্ভিক্ষ থেকে রক্ষা করা।
৯. পাট ব্যবসা জাতীয়করণ। ন্যায্যমূল্য প্রদান করা।
১০. পূর্ববঙ্গকে লবণ শিল্পে স্বয়ংসম্পূর্ণ করা। মুসলিম লীগ আমলে লবণ কেলেঙ্কারির শাস্তি প্রদান।
১১. অবিলম্বে মোহাজেরদের পুনর্বাসন করা।
১২. বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা প্রবর্তন। শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ভাতার ব্যবস্থা করা।
১৩. সরকারি বেসরকারি বিদ্যালয়সমূহের পার্থক্য দূর করা। শিক্ষা ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস। শিক্ষার মাধ্যম হবে মাতৃভাষা।
১৪. শিক্ষাকে জনসাধারণের নিকট সহজলভ্য করা। ছাত্রদের জন্য অল্প খরচে আবাসের ব্যবস্থা করা।
১৫. দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি নির্মূল করা হবে এবং ব্যবসায়ীদের ১৯৪০ সাল হতে সম্পদের হিসাব গ্রহণ করা হবে। হিসাব বহির্ভূত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা হবে।
১৬. প্রশাসনে ব্যয় হ্রাস করা হবে। নিম্ন বেতনভুক কর্মচারীদের বেতন যৌক্তিক হবে। সর্বোচ্চ বেতন মাসিক এক হাজার টাকার বেশি হবে না।
১৭. মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন বর্ধমান হাউজকে ভাষা সাহিত্যের গবেষণা প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত করা হবে।
১৮. একুশে ফেব্রুয়ারি তারিখে শহীদদের কবরে একটি মিনার নির্মান করা এবং ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারদের ক্ষতিপূরণ দান করা হবে।
১৯. ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও ছুটির দিন ঘোষণা করা হবে।
২০. পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভা আইনসভার আয়ু বৃদ্ধির করতে পারবেনা। নির্বাচনের এক মাস পূর্বে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে।
২১. আইনসভার কোনো আসন শূন্য হলে ৩ মাসের মধ্যে নির্বাচন দিতে হবে। পরপর ৩টি আসনে পরাজিত হলে মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করবে।
২১ দফা ছিল সাড়ে চার কোটি বাঙালির মুক্তি সনদ।
২১ দফার ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে। যুক্তফ্রন্টের প্রতীক ছিল নৌকা এবং মুসলিম লীগের প্রতীক ছিল হারিকেন। শেরেবাংলা, সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীর নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়। ১৯৫৪ সালের ৭-১২ মার্চ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। মোট আসন ছিল ৩০৯ টি। তার মধ্যে ৭২টি হিন্দু ও তফসিলী। ২৩৭টি মুসলমান আসন-৯টি বাদে সব আসনে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করে। পূর্ব বাংলায় ভোটের বিপ্লব হলো। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জয় হলো। ১৯৫৪ সালের ২ এপ্রিল সরকারিভাবে ভোটের ফলাফল প্রকাশিত হয়।
আওয়ামী মুসলিম লীগ- ১৪৩
কৃষক শ্রমিক পার্টি -৪৮
নেজামে ইসল -২৮
গণতন্ত্রী দল- ১৩
খেলাফতে রব্বানিয়া পার্টি- ২
যুক্তফ্রন্ট- ২২৮
মুসলিম লীগ- ৯
মোট -২৩৭
অমুসলিম -৭২
সর্বমোট- ৩০৯
একে ফজলুল হক বরিশাল থেকে ২টি আসনে জয়লাভ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান গোপালগঞ্জ আসন থেকে মুসলিম লীগ প্রার্থী অহিদুজ্জামান ঠাণ্ডা মিয়াকে পরাজিত করে প্রাদেশিক আইনসভার এমএলএ নির্বাচিত হন। গোপালগঞ্জ নির্বাচন সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “নির্বাচনে দেখা গেল।
পৃষ্ঠা: ১৪২
ওয়াহিদুজ্জামান সাহেব প্রায় দশ হাজার ভোটে পরজিত করেছেন। জনসাধারণ আমাকে শুধু ভোটই দেয় নাই, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা নজরানা হিসাবে দিয়েছিল নির্বাচন খরচ চালানোর জন্য। আমার ধারণা হয়েছিল, মানুষকে ভালোবাসলে মানুষও ভালবাসে। যদি সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেন, তবে জনসাধারণ আপনার জন্য জীবনও দিতে পারে। এই নির্বাচনে মুসলিম লীগ শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়। নির্বাচনের কিছুদিন পূর্বে শহীদ সাহেব বিবৃতির মারফতে বলেছিলেন, ‘মুসলিম লীগ নয়টা আসনে পয়েছিল।
দুনিয়ার ইতিহাসে একটা ক্ষমতাসীন দলের এভাবে পরজায়ের খবর মকোনোদিন শোনা যায়নি। বাঙালিরা রাজনীতির জ্ঞান রাখে এবং রাজনৈতিক চেতনাশীল।এবারও তারা তার প্রমাণ দিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর ওপর সাধারণ নির্বাচনেও তারা তা প্রমাণ করেছিল।
এই নির্বাচনে একটা জিনিস লক্ষ্য করা গেছে যে জনগণকে ‘ইসলাম ও মুসলমানের নামে স্লোগান দিয়ে ধোকা দেওয়া যায় না। ধর্মপ্রাণ বাঙালি মুসলমানরা তাদের ধর্মকে ভালোবাসে; কিন্তু ধর্মের নামে ধোকা দিয়ে রাজনৈতিক কর্যসিদ্ধি করতে তারা দেবে না। এ ধারণা অনেকেরই হয়েছিল। জনসাধারণ চায় শোষণহীন সমাজ এবং অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নতি। শেরে বাংলা যুক্তফ্রন্টের নেতা নির্বাচিত হন। মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে যুক্তফ্রন্টে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৪ সালের ৩ এপ্রিল একে ফজলুল হক ৪ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৪ সালের ১৫ মে পূর্ণাঙ্গ যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়।
মন্ত্রিসভা সদস্যবৃন্দ-১৯৫৪
এ কে ফজলুল হক- মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, সংস্থাপন
আবু হোসেন সরকার -অর্থ
আতাউর রহমান খান -বেসামরিক সরবরাহ
আবুল মনসুর আহমদ -জনস্বাস্থ্য
কফিল উদ্দিন চৌধুরী -বিচার ও আইন
সৈয়দ আজিজুল হক -শিক্ষা ও রেজিস্ট্রেশন
আবদুস সালাম খান -শিল্প ও পূর্ত
শেখ মুজিবুর রহমান- কৃষি, ঋণ, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন
আবদুল লতিফ বিশ্বাস -রাজস্ব ও ভূমি সংস্কার
আশরাফ আলী চৌধুরী -সড়ক ও গৃহ নির্মাণ
হাশিম উদ্দিন আহমদ -বাণিজ্য ও বিদ্যুৎ উন্নয়ন
রাজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী- স্বাস্থ্য ও কারা
ইউসুফ আলী চৌধুরী -কৃষি, বন ও পাট
মোয়াজ্জেম উদ্দিন হোসেন- জমিদারি অধিগ্রহণ
মন্ত্রিসভার শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানটি শুরুর আগে অবাঙালিদের ষড়জন্ত্রে আদমজী জুট মিলে দাঙ্গা চলছে। দাঙ্গায় ১৫শ’ নিরপরাধ শ্রমিক নিহত হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদ দিবস ও ছুটি পালন, শহীদ মিনার নির্মাণ, বর্ধমান হাউজকে বাংলা একাডেমিতে রুপান্তর করা হবে।
নিউইয়র্ক টাইমস পত্রিকার সাংবাদিক মি. কালাহান বলেন, মুখ্যমন্ত্রী একে ফজলুল হক বলেছেন, বাংলাকে স্বাধীন করা তার প্রথম কাজ। গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৪ সালের ৩১ মে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে এ কে ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা ভেঙে দিয়ে ৯২ক ধারা জারি করে। গভর্নর শাসন প্রবর্তন করে মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জাকে পূর্ব পাকিস্তানের নিযুক্ত করা হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেফতারের জন্য পুলিশ এসেছিল বাসায়। তিনি বাসায় এসে জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ইয়াহিয়া খান চৌধুরীকে ফোন করে বলেন “আমার বাড়িতে পুলিশ এসেছিল, বোধহয় আমাকে গ্রেফতার করার জন্য। আমি এখন ঘরেই আছি, গাড়ি পাঠিয়ে দেন “। পুলিশ এলো- তাদের গাড়িতে তিনি ঢাকা জেলে চলে যান।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানী দেশের বাইরে- শেখ মুজিব কারাগারে – কোন প্রতিবাদ হলো না। ষড়যন্ত্রকারীরা বুঝতে পারল যে যতই হৈচৈ বাঙালিরা করুক না কেন তাদের দাবিয়ে রাখতে কষ্ট হবে না। বন্দুক লাঠি দেখলে তারা গর্তে ঢুকবে। এ সময় যদি বাধা পেত তবে হাজার বার চিন্তা করত বাঙ্গালিদের ওপর ভবিষ্যতে অত্যাচার করতে। যুক্তফ্রন্টের রাজনীতির কাপুরুষতা দেখে তিনি আত্মজীবনীতে লিখেছেন, “এই দিন থেকে বাঙালিদের দুঃখের দিন শুরু হলো। অযোগ্য নেতৃত্ব, নীতিহীন নেতা ও কাপুরুষ রাজনীতিবিদদের সাথে কোনোদিন একসাথে হয়ে দেশের কাজ করতে নামতে নেই, তাতে দেশসেবার চেয়ে দেশের ও জনগণের সর্বনাশ বেশি হয়।”
১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ পাকিস্তান। গণপরিষদ ভেঙে দেয়। বগুড়ার মহম্মদ আলী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৪ সালের ১৮ ডিসেম্বর মুক্তি লাভ করেন।
১৯৫৪ সালের ২৯ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের
পৃষ্ঠা: ১৪৪
আইনমন্ত্রী নিযুক্ত হন। পাকিস্তানে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য তিনি মন্ত্রিত্ব গ্রহন করেন। গভর্নর মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা মওলানা ভাসানীর দেশে ফিরে আসার প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি করেন। সোহরাওয়ার্দী চেষ্টায় ভাসানী ১৯৫৫ সালের ২৬ এপিল কলকাতা থেকে ঢাকায় ফিরে আসেন।
১৯৫৫ সালের ৩১ মে পশ্চিম পাকিস্তানের মারী শহরে পাকিস্তান গনপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সংখ্যাসাম্যের ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তান ৪০ আসন লাভ করে। এমএলএগণ ভোটার। নির্বাচনের ফলাফল নিম্নরূপ-
কেএসপি -১০
আওয়ামী লীগ- ১৩
আওয়ামী মুসলিম লীগ- ২
নেজামে ইসলাম -২
গণতন্ত্রী দল- ২
মুসলিম লীগ- ১
স্বতন্ত্র- ১
হিন্দু আসনে- ১
মোট- ৪০
একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ গণপরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। কেন্দ্রের ষড়যন্ত্রের ফলে যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যায়। ১৯৫৫ সালের ৩ জুন ৯২ক ধারা প্রত্যাহার করা হয়। কেএসপি নেতা আবু হোসেন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হয়।
১৯৫৫ সালের ৭-১৩ জুলাই মারীতে গণপরিষদের সভা চলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর উদ্যোগে মারীতে ৪ দফা চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
১. পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট;
২. পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন;
৩. দু’অঞ্চলের মধ্যে সংখ্যাসাম্য;
৪. বাংলা ও উর্দু রাষ্ট্রভাষা।
১৯৫৫ সালের ৫ আগস্ট প্রাদেশিক পরিষদের সভায় আবদুল হাকিম স্পিকার ও শাহেদ আলী পাটোয়ারী ডেপুটি স্পিকার নিবাচিত হন।
১৯৫৫ সালের ১০ আগস্ট মুসলিম লীগ নেতা চৌধুরী মোহাম্মদ আলী পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এ মন্ত্রিসভায় একে ফজলুল হক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিযুক্ত হন। যুক্তফ্রন্ট ভেঙে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ বিরোধী দল গঠন করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রথম বিরোধী দলের নেতা।
পৃষ্ঠা: ১৪৫
১৯৫৫ সালের ১২ আগস্ট পাকিস্তান গণপরিষদের স্পিকার ও ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন আবদুল ওহাব খান ও মি. গিবন।
আওয়ামী মুসলিম লীগ হতে আওয়ামী লীগ- ১৯৫৫
১৯৫৫ সালের ২১-২৩ অক্টোবর আওয়ামী লীগের তিনদিনব্যাপী বার্ষিক সম্মেলন সদরঘাট রূপমহল সিনেমা হলে অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় আওয়ামী মুসলিম লীগকে ধর্মনিরপেক্ষতার রূপ দেওয়া হয়। দলের নাম হয় আওয়ামী লীগ। মুসলিম শব্দ বিলুপ্ত করা হয়। আওয়ামী লীগকে সর্বজনীন করায় শেখ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সভায় আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী -সভাপতি
আতাউর রহমান খান- সহ-সভাপতি
আবুল মনসুর আহমদ- সহ-সভাপতি
খয়রাত হোসেন- সহ-সভাপতি
শেখ মুজিবুর রহমান- সাধারণ সম্পাদক
অলি আহাদ- যুগ্ম সম্পাদক
অধ্যাপক আবদুল হাই- প্রচার সম্পাদক
আবদুস সামাদ -শ্রম সম্পাদক
তাজউদ্দীন আহমদ- সংস্কৃতি ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক
সেলিনা বানু- মহিলা সম্পাদক
মুহাম্মদ উল্লাহ- দফতর সম্পাদক
ইয়ার মোহাম্মদ খান- কোষাধ্যক্ষ
৩৬ সদস্যবিশিষ্ট কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান সাংগঠনিক প্রতিভার পরিচয় দেন।
১৯৫৫ সালের ৬ অক্টোবর পশ্চিম পাকিস্তানের ৪টি প্রদেশ নিয়ে এক ইউনিট গঠন করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হলেন মুসতাক আহমদ গুরমানি এবং প্রধানমন্ত্রী হলেন ডা. খান সাহেব।
পাকিস্তান পার্লামেন্টে পূর্ব বাংলার দাবি
১৯৫৫ সালে আগস্ট মাস হতে পাকিস্তান গণপরিষদে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার জন্য বিতর্ক শুরু হয়। শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলার স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য শেখ মুজিবুর রহমান দাবি পেশ করেন। তিনি পূর্ব বাংলাকে বঞ্চিত করার প্রস্তাবের প্রবল
পৃষ্ঠা: ১৪৬
বিরোধিতা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশ নিয়ে এক ইউনিট গঠন করার বিল পেশ করা হয়। ১৯৫৫ সালে ২৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমান এক ইউনিট বিলের বিরোধিতা করেন। তিনি এক ইউনিট বিলের উপর জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব দেন।
কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগ সরকার পূর্ব বাংলার নাম পরিবর্তন করে পূর্ব পাকিস্তান রাখার প্রস্তাব করে এবং তা শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হবে। গনপরিষদের সভায় শেখ মুজিবুর রহমান এ প্রস্তাবের তীব্র বিরোধিতা করে বলেন, that the word to place the word East Pakistan instead of East Bengal . We have demanded so many times that you shold make bengal (Pakistan). The word Bengal have a history, has a tradition of its own “কিন্তু দেখবেন তারা পূর্ব বাংলার নাম পূর্ব পাকিস্তান রাখতে চায়। আমরা বারবার বলেছি যে, আপনাদের বাংলা নামকরণ করতে হবে। বাংলার ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে।”
১৯৯৫ সালে ২৫ আগস্ট একই দিনে শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদে ১৯ বার ভাষণ দেন। এদিন শেখ মুজিবুর রহমানের দিন। ১৯৫৫ সালের ১ অক্টোবর তিনি গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য শাসনতন্ত্র প্রণয়ন, স্বায়ত্তশাসন ও গভর্নর জেনারেলের সীমিত ক্ষমতা প্রদানের প্রস্তাব করেন।
সোহরাওয়ার্দীর নির্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান Parity বা সংখ্যা সাম্য নীতি সমর্থন করেন। তিনি জাতীয় পরিষদে তার ভাষণে বলেন, পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের ৫৬ ভাগ লোক বসবাস করেন। তবু দু’অঞ্চলের মধ্যে সম্পর্ক উন্নয়নের লক্ষ্যে তিনি সংখ্যাসাম্য গ্রহণ করে বলেন, East Pakistan claim parity in all the matters. পূর্ব পাকিস্তান সর্বক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য চায়।
তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি শহীদদের স্মরণে সংসদ মুলতবির দাবি করেন। ১৯৫৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানে দুটি রাজধানী – করাচি ও ঢাকায় দাবি করেন। We have definitely said in accordance with the demand of the people of East Bengal that Capital of Pakistan must be at Karachi and at Dacca.
১৯৫৬ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি তিনি খসড়া শাসনতন্ত্রে মহিলাদের জন্য ১০টি আসন সংরক্ষণের দাবি করেন। উল্লেখ্য, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে মহিলাদের আসন সংরক্ষিত ছিল না।
পার্লামেন্টে মুসলিম লীগ সদস্য ফজলুর রহমান বলেন, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তান ধ্বংস করবেন। উত্তরে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন,
পৃষ্ঠা: ১৪৭
তারাই পাকিস্তান ধ্বংস করছেন। তিনি আরও বলেন, একমাত্র সোহরায়ার্দী পাকিস্তান রক্ষা করতে পারেন।
১৯৫৬ সালের ৬ জানুয়ারি হতে খসড়া শাসনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক শুরু হয়। ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ শাসনতন্ত্র গৃহীত হয়। শেরেবাংলা একে ফজলুল হক ১৯৫৬ সালের ২৪ মার্চ পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন।
১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে খাদ্য অভাব দেখা দেয়। আবু হোসেন সরকার পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী। তিনি খাদ্য সমস্যা সমাধানে ব্যর্থ হন। মাওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্ব ১৯৫৬ সালের ৪ আগস্ট বিক্ষোভ ও ভুখা মিছিল হয়। পুলিশ গুলি চালালে ৩ জনের মৃত্যু হয়। ১৯৫৬ সাল আগস্ট আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভা পদত্যাগ করে।
১৯৫৬ সালের ৫ সেপ্টেম্বর আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিসভায় ৫ জন আওয়ামী লীগ, কংগ্রেস-২, গণতন্ত্রী-১, ইউপিপি-১, তফসিল ফেডারেশন-১, কৃষক শ্রমিক পার্টি-১।
মন্ত্রিসভার সদস্যগণ
১. আতাউর রহমান খান -মুখ্যমন্ত্রী, স্বরাষ্ট্র, পরিকল্পনা
২. আবুল মনসুর আহমদ- শিক্ষা
৩. কফিলউদ্দিন চৌধুরী -যোগাযোগ, পূর্ত ও সেচ
৪. শেখ মুজিবুর রহমান -বাণিজ্য, শিল্প, শ্রম ও দুর্নীতি
৫. মাহমুদ আলী -রাজস্ব বিভাগ ও জেল
৬. মশিউর রহমান -জনসংযোগ, স্থানীয় সরকার
৭. ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত- স্বাস্থ্য
৮. মনোরঞ্জন ধর -অর্থ ও সংখ্যালঘু বিষয়
৯. খয়রাত হোসেন- কৃষি ও পশু
১০. আবদুর রহমান- সমবায়, ঋণ, কৃষি ও বাজার
১১. ক্যাপটেন মনসুর আলী- বিচার ও সংসদীয় বিভাগ
১২. শরৎচন্দ্র মজুমদার -আবগারী, মৎস্য ও লবণ
১৩. গৌরচন্দ্র বালা -বন
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী
কেন্দ্রের রাজনীতিতে পরিবর্তন আসে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী ডা. খান। রিপাবলিকান নামে একটি দল গঠন করেন। মুসলিম লীগের অনেক এমএনএ রিপাবলিকান দলে যোগ দেন। ড. খান মুসলিম লীগ হতে সমর্থন প্রত্যাহার
পৃষ্ঠা: ১৪৮
করলে প্রধানমন্ত্রী চৌধুরী মহম্মদ আলী সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ১৯৫৬ সালের ৮ সেপ্টম্বর তিনি পদত্যাগ করেন।১৯৫৬ সালের ১২ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি, বিরোধী দলের নেতা হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের পঞ্চম প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।
মন্ত্রিসভার সদস্যবৃন্দ
এইচএস সোহরাওয়ার্দী -প্রধানমন্ত্রী, প্রতিরক্ষা, কাশ্মীর, দেশীয় রাজ্য, সীমান্ত, রিফিউজি পুনর্বাসন
মালিক ফিরোজ খান নূন- পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ
আবুল মনসুর আহমদ -বাণিজ্য ও শিল্প
সৈয়দ আমজাদ আলী -অর্থ
এম এ খালেক -শ্রম ও পূর্ত
মীর গোলাম আলী তালপুর -স্বরাষ্ট্র
সরদার আমির আজম খান -আইন, তথ্য ও বেতার
এ এইচ দেলদার আহমদ -খাদ্য ও কৃষি
মিয়া জাফর শাহ -যোগাযোগ
জহির উদ্দিন -শিক্ষা, স্বাস্থ্য
প্রতিমন্ত্রী
রসরাজ মণ্ডল- অর্থ
হাজী মাওলা বকস সুমরো- পুনর্বাসন
আবদুল আলীম -অর্থ
নুরুর রহমান -বাণিজ্য
মন্ত্রীদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, আবুল মনসুর আহমদ, এমএ খালেক, এ এইচ দেলদার আহমদ, জহির উদ্দিন। প্রতিমন্ত্রী ছিলেন রসরাজ মণ্ডল, আবদুল আলীম এবং নুরুর রহমান। কেন্দ্রে ও প্রদেশের আওয়ামী লীগ সরকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ায় বাংলায় নবযুগের সৃষ্টি হয়। বাঙালিরা চাকরি ব্যবসা-বাণিজ্যে সুযোগ পায়। বাঙালি জাতির ঐক্য প্রতিষ্ঠিত হয়।
১৯৫৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্ভিক্ষ অবস্থা সৃষ্টি হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় চলে আসেন এবং খাদ্য সংকট দূর করার জন্য ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
জাতীয় ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রতিষ্ঠার জন্য সোহরাওয়াদী পার্লামেন্টে যুক্ত নির্বাচন প্রবর্তনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন। প্রথমে পূর্ব পাকিস্তান
পৃষ্ঠা: ১৪৯
আইনসভা ১৯৫৬ সালের ২৯ সেপ্টেম্বর মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান যুক্ত নির্বাচন বিল উত্থাপন করে এবং তা ১৫৯-১ ভোটে পাস। বিরোধী দল ভোট দানে বিরত থাকে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ঢাকায় প্রথম ১৯৫৬ সালের ১৪ অক্টোবর জাতীয় সংসদের অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। জাতীয় পরিষদে সোহরাওয়ার্দী যুক্ত নির্বাচনের সমর্থনে দীর্ঘ ভাষণ দেন। যুক্ত নির্বাচন বিল ৪৮-১৯ ভোটে গৃহীত হয়। ইংরেজ আমল হতে ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানে পৃথক নির্বাচন প্রচলিত ছিল।হিন্দুরা হিন্দু প্রতিনিধি এবং মুসলমানরা মুসলমান প্রতিনিধি নির্বাচিত করত। যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তিত হলে দেশে পৃথক নির্বাচন প্রথা থাকবে না। সোহরাওয়ার্দী পথ ধরে ১৯৬২, ১৯৬৪ এবং ১৯৭০ সালে যুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
পররাষ্ট্রনীতি
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পশ্চিমাপন্থি পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন। তিনি সামরিক চুক্তি এবং সেন্টো, সিয়াটো সমর্থন করেন। তিনি চীন ও রাশিয়ার সুসম্পর্ক গড়ে তোলেন। ১৯৫৬ সালের ২২ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ চীন সফরে যান। তিনি চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রধান মাও সে-তুং ও প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইর সাথে বৈঠক করেন। ১৯৫৬ সালের ২৯ ডিসেম্বর চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই ঢাকা সফর করেন। শেখ মুজিবুর রহমান তাকে সংবর্ধনা জানিয়ে ভাষণ দেন।
শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্ব শান্তি সম্মেলনের সদস্য ছিলেন। ১৯৫৬ সালে স্টকহোমে অনুষ্ঠিত শান্তি সম্মেলনে তিনি যোগ দেন। প্রধানমন্ত্রীর সাথে শেখ মুজিব জাপান সফর করেন।
প্রধানমন্ত্রীর দূত হিসেবে শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৫৭ সালের অক্টোবর মাসে রাশিয়ার উদ্দেশে যাত্রা করেন; কিন্তু প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করায় তিনি দেশে ফিরে আসেন।
আঞ্চলিক বৈষম্য
পাকিস্তান সৃষ্টির পর হতে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্য সৃষ্টি শুরু হয়। পশ্চিম পাকিস্তান পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণ করত। পূর্বাঞ্চল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনি। চাকরি ক্ষেত্রে বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে দু’অঞ্চলে বিশাল বৈষম্য ছিল। ১৯৫৬ সালে সেনাবাহিনীতে বিরাজমান বৈষম্য তুলে ধরা হলে-
পৃষ্ঠা: ১৫০
পদবি | পশ্চিম পাকিস্তান | পূর্ব পাকিস্তান |
জেনারেল | ১ | ০ |
লেফটেন্যান্ট জেনারেল | ৩ | ০ |
মেজর জেনারেল | ২০ | ১ |
ব্রিগেডিয়ার | ৩৫ | ০ |
কর্নেল | ৫০ | ২ |
লে. কর্নেল | ১৯৮ | ১০ |
মেজর | ৫৯৩ | ১০ |
নৌবাহিনী অফিসার | ৬১৩ | ০ |
বিমান বাহিনী অফিসার | ৬৪০ | ৬০ |
পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে সর্বক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে পাকিস্তানে ঐক্য গড়ে উঠেনি। ফলে বাঙালি জাতীয়তাবাদ আন্দোলন সুদৃঢ় হতে থাকে।
কাগমারী সম্মেলন
মাওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। ১৯৫৭ সালের ৫-৭ ফেব্রুয়ারি কাগমারীতে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন ও পররাষ্ট্রনীতি সম্মেলনের প্রধান আলোচ্যসূচি ছিল। বিখ্যাত মনীষীদের নামে অনেক গেট ও মঞ্চ নির্মিত হয়েছিল। সভায় প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন। পররাষ্ট্র নীতি নিয়ে আওয়ামী লীগের মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়।
“১৯৫৭ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি কাগমারী সম্মেলনে মাওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন যে, দাবি মানা না হলে ভবিষ্যতে আজ থেকে দশ বছর পর এমন সময় আসতে পারে যখন পূর্ব বাংলা আসসালামু আলাইকুম বলবে।”
কাগমারী সম্মেলনে পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ১৯৫৭ সালের ১৮ মার্চ মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে ইস্তফা দেন।
যুক্তফ্রন্টের একুশ দফার অন্যতম দফা ছিল আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন। ১৯৫৭ পারের ৩ এপ্রিল গণতন্ত্রী দলের এমএলএ মহিউদ্দিন আহমেদ আইনসভায় আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব উত্থাপন করেন। আওয়ামী লীগের সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান স্বায়ত্তশাসন প্রস্তাব সমর্থন করেন। আইন সভায় প্রস্তাবটি অনুমোদিত হয়।
পৃষ্ঠা: ১৫১
আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অলি আহাদের ধারনা ছিল শেখ মুজিবুর রহমান সম্পাদকের পদ ত্যাগ করে মন্ত্রী পদে থাকবেন।তাহলে অলি আহাদ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হবেন। কিন্তু শেখ মজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদক থেকে যান। তখন অলি আহাদ হতাশ। তিনি দলের শৃঙ্খলা ভঙ্গ করলে তাকে বরখাস্ত করা হয়।শেখ মুজিবুর রহমান তাজউদ্দীন আহমদকে দলের সাংগঠনিক সম্পাদক নিযুক্ত হন
১৯৫৭ সালের ১৩ ও ১৪ জুন ঢাকার শাবিস্তান সিনেমা হলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানী ভাষণ দেন। সভায় উপস্থিত ৫০০ কাউন্সিলর সোহরাওয়ার্দী পররাষ্ট্রনীতি সমর্থন করেন। ৩৫ ভোট মওলানা ভাসানীর পক্ষে পড়ে।
ন্যাপ গঠন-১৯৫৭
১৯৫৭ সালে ২৫ জুলাই মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে ঢাকায় আওয়ামী লীগ বামপন্থি, গণতন্ত্রী দল, কমিউনিস্ট পার্টির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সভায় পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি-ন্যাপ গঠন করা হয়। পূর্ব পাকিস্তানের সভাপতি হলেন মওলানা ভাসানী এবং সম্পাদক হলেন মাহমুদ আলী। পাকিস্তান ন্যাপের সভাপতি ও সম্পাদক নির্বাচিত হন মওলানা ভাসানী ও পশ্চিম পাকিস্তানের মাহমুদুল হক ওসমানী। আওয়ামী লীগে বিভক্ত হয়। ফলে প্রদেশে ও কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ দল ভাঙনের সম্মুখীন হয়।
সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভার পদত্যাগ
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ষড়যন্ত্রের কারণে ১৯৫৭ সালের ১১ অক্টোবর সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন। ১৯৫৭ সালের ১২ অক্টোবর মুসলিম লীগের আই আই চুন্দ্রিগড় ১৪ সদস্যবিশিষ্ট মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
এক মাসের মধ্যে প্রধানমন্ত্রী আই আই চুন্দ্রিগড়ের মন্ত্রিসভার পতন হয়। ১৯৫৭ সালের ১০ ডিসেম্বর রিপাবলিকান দলের নেতা ফিরোজ খান নূন মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৭ সালে শেখ মুজিবুর রহমান Under Leadership Exchange Programme-এর অধীনে আমেরিকা সফর করেন। এ সময় তিনি পেটের পীড়ায় ভুগছিলেন। বোস্টন হাসপাতালে তার চিকিৎসা হয়। মুনির চৌধুরী ও মতিউল ইসলাম সিএসপি আমেরিকায় ছিলেন। তাদের সাথে তার সাক্ষাৎ হয়। পরবর্তী সময় মতিউল ইসলাম ও শেখ মুজিবর রহমানের বন্ধুত্ব গভীর হয়।
পৃষ্ঠা: ১৫২
মন্ত্রিত্ব ত্যাগ
১৯৫৭ সালের ৩০ মে শেখ মুজিবুর রহমান মন্ত্রিত্ব ত্যাগ করে দলের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। তাকে টি বোর্ডের চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। তিনি আবদুল গনি রোডের সরকারি বাসা ত্যাগ করে সেগুনবাগিচায় টি বোর্ডের বাসায় ওঠেন। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী লীগের কাজ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে একটি লিমুজিন গাড়ি উপহার দেন।
যুক্তফ্রন্টের ভাঙন
যুক্তফ্রন্টের ভাঙন শুরু হয় এ কে ফজলুল হক ও হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর দ্বন্দ্বের কারণে। ১৯৫৫ সালে কেএসপি কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় যোগ দেওয়ার পর আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট থেকে বের হয়ে আসে। কেএসপি চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মনিসভায় যোগ দেয়। এ সময় আওয়ামী লীগ কেন্দ্রে ও প্রদেশে বিরোধী ভমিকা পালন করে। এ কে ফজলুল হক যুক্তফ্রন্টকে ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন।কিন্তু তার চেষ্টা ব্যর্থ হয়। আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, তেল হোসেন মানিক মিয়া যুক্তফ্রন্ট ভাঙ্গার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানকে দায়ী করেন। শেখ মুজিবুর রহমান যুক্তফ্রন্টকে প্রতিক্রিয়াশীল বলতেন। তিনি আওয়ামী লীগকে এককভাবে শক্তিশালী করায় বিশ্বাসী ছিলেন। ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তাই তিনি এককভাবে দলকে গড়ে তুলতে চেয়েছেন।
গভর্নর এ কে ফজলুল হক ১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ আতাউর রহমানের মন্ত্রিসভা বাতিল করে কেএসপি নেতা আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করার আহ্বান জানালে আওয়ামী লীগ ক্ষুব্ধ হয়ে এ কে ফজলুল হককে পদচ্যুত করে। শুরু হয় পূর্ব বাংলার ভাঙার রাজনীতি।
আইনসভায় দাঙ্গা-১৯৫৮
পূর্ব পাকিস্তানে বার বার মন্ত্রিসভার রদবদল হতে থাকে। একবার আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করে। আবার কেএসপি নেতা আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কংগ্রেস ও ন্যাপ তাদের আনুগত্য পরিবর্তন করে। মন্ত্রিসভা অস্থিতিশীল হয়ে পরে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এ খেলার জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে দায়ী করেন। প্রেসিডেন্ট এমন ঘটনা সৃষ্টি করতে চায়, যার দ্বারা তিনি সামরিক শাসন জারির যুক্তি খুঁজে পান। এ ব্যাপারে তিনি কেএসপিকে ব্যবহার করেন। আওয়ামী লীগ স্পিকার আবদুল
পৃষ্ঠা: ১৫৩
হাকিমের বিরুদ্ধে অনাস্থা দিয়েছে। তারা ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটওয়ারীকে ১৯৫৮-৫৯ সালের বাজেট সেশন চালিয়ে যেতে অনুরোধ করে। তিনি সম্মত হলেন। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর পূর্ব পাকিস্তান আইন পরিষদে তুমুল সংঘর্ষ হয়। কেএসপি তাকে অধিবেশন চালাতে দেবে না। ডেপুটি স্পিকারকে লক্ষ্য করে তারা চেয়ারের হাতল ছুড়ে মারতে থাকে। সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে সংঘর্ষ বাধে। একপর্যায়ে ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটওয়ারী গুরুতর আহত হন। তিনি ছিলেন ডায়াবেটিসের রোগী। তাঁকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। তার অবস্থার অবনতি ঘটে। ১৯৫৮ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর ১-২০ মিনিটে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।২৫ সেপ্টেম্বর গিলোটিন করে বাজেট পাস হয়। ডেপুটি স্পিকার শাহেদ পাটোয়ারীর হত্যাকে কেন্দ্র করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আর খান ক্ষমতা দখলের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন।
আওয়ামী লীগ ভেঙে যাওয়ায় ন্যাপ সৃষ্টি। ন্যাপের এমএলএগণ প্রদেশে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভাকে সমর্থন করছে না। তারা আবু হোসেনকে সমর্থন দেয়। ফলে আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান সংখ্যাগরিষ্ঠতা হারায়। ১৯০৯ সালের ৩১ মার্চ গভর্নর একে ফজলুল হক তার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেয় এবং আর হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠন করার জন্য আহ্বান জানান। আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু সংখ্যাগরিষ্ঠতা না থাকায় তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে পদত্যাগ করতে হয়। এদিকে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী গভর্নরের পদক্ষেপে অসন্তুষ্ট হয়ে প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নূনকে দিয়ে ফজলুল হককে গভর্নরের পদ থেকে অপসারণ করান। ১৯৫৮ সালের ১ এপ্রিল এ কে ফজলুল হক গভর্নর পদ হারান। তার স্থলে চিফ সেক্রেটারি হামিদ আলীকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নরের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
জননায়ক ফজলুল হকের প্রতি অন্যায় আচরণ করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের ধারণা এ কে ফজলুল হক তার নিজস্ব দল কেএসপিকে ক্ষমতাসীন করার জন্য আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা বাতিল করেছে। কিন্তু এ কথা সত্য নয়। ন্যাপ আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে কেএসপিকে সমর্থন করে। আবার তারা কেএসপির প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আবু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার পতন হয়। পুনরায় আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করে এবং ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পর্যন্ত ক্ষমতায় ছিল।
আওয়ামী লীগের সমর্থক রাষ্ট্রদূত মোহাম্মদ সুলতান উদ্দিনকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিয়োগ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৫৪
শেরে বাংলা এ কে ফজলল হক ১৯৫৮ সালের পর রাজনীতিতে ফিরে আসেননি। ঢাকার কে এম দাশ লেনের বাসায় অবসর জীবন যাপন করতেন।
পশ্চিম পাকিস্তান আইনসভা এক ইউনিট বাতিল করে। ন্যাপ তা সমর্থন করে। কিন্তু হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এক ইউনিটের পক্ষে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তান আইন সভার সমালোচনা করেন। আওয়ামী লীগ এক ইউনিট ভাঙার বিরোধিতা করায় ন্যাপ আতাউর রহমান খানের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করে। ১৯৫৮ সালের ১৯ জুন আবু হোসেন সরকার পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ২২ জুন অনাস্থা ভোটে আনু হোসেন সরকারের মন্ত্রিসভার পতন হয়। ২৫ জুন শাসনতন্ত্রের ১৯৩(ক) আনে গভর্নর শাসন জারি হয়। প্রায় দু’মাস রাষ্ট্রপতির শাসন চলতে থাকে। আওয়ামী লীগের সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণিত হওয়ায় ১৯৫৮ সালের আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কেন্দ্রীয় সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯৫৯ সালের মার্চ মাসে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সহায়ক গ্রন্থ
শেখ মুজিবুর রহমান- অসমাপ্ত আত্মজীবনী
সিরাজুল ইসলাম, বাংলাদেশের ইতিহাস, প্রথম খণ্ড
ড, হারুন অর রশীদ, বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী- পুনর্পাঠ
আবু আল সাঈদ, আওয়ামী লীগের ইতিহাস, ১৯৯৬
বশীর আল হেলাল, ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস
বদরুদ্দীন উমর, পূর্ব বাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী
পৃষ্ঠা: ১৫৫
পঞ্চম অধ্যায়
সামরিক শাসক আইয়ুব খান ও ইয়াহিয়া খানেক
শাসন আমল ১৯৫৮-১৯৭১
ক. সামরিক শাসনের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
ভারত উপমহাদেশে সামরিক আইন-মার্শাল ল জারি করা কেউ কোনোদিন শোনেনি। মার্শাল ল অর্থ বেসামরিক শাসন ভেঙে দিয়ে সামরিক শাসন প্রবর্তন। দেশ শাসন হবে সেনা আইনে- গণতন্ত্র থাকবে না, সংসদ থাকবে না, মন্ত্রিসভা থাকবে না, সামরিক আইনে দেশ শাসিত হবে। ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মীর্জা বেসামরিক সরকার বাতিল করে সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক শাসক নিয়োগ করেন। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার বাতিল করা হয়। এ সময় রিপাবলিকান পার্টির ফিরোজ খান নুন প্রধানমন্ত্রী ছিলেন। সামরিক সরকার ফিরোজ খান নুন মন্ত্রিসভা বাতিল করে। প্রাদেশিক মন্ত্রিসভা বাতিল করা হয়। পাকিস্তান জাতীয় সংসদ পশ্চিম পাকিস্তান ও পূর্ব পাকিস্তান মন্ত্রিসভা ও আইনসভা ভেঙে দেওয়া হয়। ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল করা হয়। পাকিস্তানের গণতন্ত্র হত্যা করা হয়। রাজনৈতিক দলসমূহ নিষিদ্ধ করা হয়। সারা পাকিস্তানে রাজনৈতিক সভাসমাবেশ বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগে বাধ্য করে জেনারেল আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। সারা দেশে রাজনৈতিক নেতা গ্রেফতার, সামরিক আইনে মামলা, জেল, বেত্রাঘাত শুরু হয়। সামরিক আইন জারির কারণ হিসেবে বলা হয়- রাজনীতিবিদগণ দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতিতে অভিযুক্ত, দেশে আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে।
সামরিক আইন জারি করে ১৫০ জন সাবেক মন্ত্রী, ৬০০ জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতির অভিযোগ আনা হয়। তাদের বিরুদ্ধে অ্যাবডো ও পোডো প্রয়োগ করে ৬ বছরের জন্য রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৫৬
আইয়ুব খান একমাত্র রাজনীতিবিদদেরই হেয়প্রতিপন্ন করেননি, তিনি সরকারি কর্মচারীদের বিরুদ্ধে public office disqualification order – PODO প্রয়োগ করে তাদের চাকরিচ্যুত করা হয়।পাকিস্তনের ১৩ সিএসপি, ফরেন সার্ভিস ৩, পুলিশ সার্ভি ১৫ এবং প্রাদেশিক সার্ভিসের ১৬৬২ জনকে বাধ্যতামূলক অবসর, চাকুরিচ্যুত করা হয়।
আইয়ুব খান বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি ধংশ করার চেষ্টা চালান। বাংলা ভাষাকে ইসলামী করা শুরু করেন।
১৯৬১ সালে রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালনে সরকার বাধা দেয়। রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী অহিদুল হক ও সনজীদা খাতুন গঠন করেন ছায়ানট। সারা বাংলায় রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী পালিত হয়।
মৌলিক গণতন্ত্র
১৯৫৯ সালে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান গণতন্ত্র হত্যার উদ্দেশ্যে মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করেন। পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার ও পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবে। তারা আইনসভার সদস্য, প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবেন। মৌলিক গণতন্ত্রে ৫টি স্তর ছিল- ইউনিয়ন কাউন্সিল, থানা কাউন্সিল, জেলা কাউন্সিল, বিভাগীয় কাউন্সিল। ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি সারা দেশে মৌলিক গণতন্ত্র নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ৮০ হাজার বিডি মেম্বার নির্বাচিত হয়। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি হা-না ভোটে জেনারেল আইয়ুব খানকে ৫ বছরের জন্য পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করা হয়। মৌলিক গণতন্ত্রীগণ ১৯৬২ সালের এপ্রিল মাসে জাতীয় ও প্রাদেশিক সদস্য নির্বাচিত করেন।
১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর ৩ বছর ৮ মাসে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে কোনো আন্দোলন হয়নি। ১৯৬১ সালে ছাত্রলীগ ছাত্র ইউনিয়নে সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণ করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার আন্দোলনের দ্বার খুলে দেয়।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সামরিক সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে করাচীতে গ্রেফতার করে। এর প্রতিবাদে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৯৬২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হতে আন্দোলন, হরতাল শুরু করে। ৫ ফেব্রুয়ারি সরকার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেয়। সামরিক সরকার শেখ মুজিবুর রহমান, তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ রাজনৈতিক নেতাদের গ্রেফতার করে।
পৃষ্ঠা: ১৫৭
সংবিধানবিরোধী আন্দোলন
১৯৬২ সালের ১ মার্চ আইয়ুব খান প্রণীত সংবিধান ঘোষণা করা হয়। সংবিধানে পূর্ব পাকিস্তানের দাবি উপেক্ষিত হয়। ছাত্রসমাজ সংবিধানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সরকার অনেক ছাত্রকে গ্রেফতার করে। ২৮ এপ্রিল ও ৬ মে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৬২ সালের ৮ জুন সামরিক আইন প্রত্যাহার করা হয়। বেসামরিক সরকার গঠন করা হয়।
সমাবর্তন ১৯৬৪
১৯৬৪ সালে ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনকে কেন্দ্র করে আন্দোলন গড়ে উঠে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর। ছাত্ররা মোনায়েম খানের হাত থেকে সনদ গ্রহণ করবে না। মোনায়েম খান ছাত্রদের দমন করার জন্য একদল ছাত্র দিয়ে এনএসএফ গঠন করেন।ড. এমও গনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর নিয়োগ করা হয়। ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা মোনায়েম খানের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সমাবর্তন অনুষ্ঠান পণ্ড হয়ে যায়। সরকার ছাত্রনেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও আসমত আলী সিকদারের এমএ ডিগ্রি কেড়ে নেয়। অনেক ছাত্রকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে বহিষ্কার ও শাস্তি দেওয়া হয়। ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করলে তার স্থলে ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন। ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা গ্রহণ করে পশ্চিম পাকিস্তানের এক ইউনিট ভেঙে চারটি প্রদেশ পুনর্জীবিত করেন। প্রদেশগুলো হলো- পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান। তিনি এক ব্যক্তি এক ভোট ঘোষণা দেন।
খ, আইয়ুব খানের ক্ষমতা দখল ও শাসনের বৈশিষ্ট্য- রাজনৈতিক নিপীড়ন, মৌলিক গণতন্ত্র, ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার
আইয়ুব খানের সামরিক শাসন
পাকিস্তান সরকার ঘোষণা করে যে, ১৯৫৯ সালের ১৫ মার্চ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। দেশ গণতন্ত্রের পথে যাবে। কিন্তু প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের ষড়যন্ত্র করতে থাকে। তারা
পৃষ্ঠা: ১৫৮
ক্ষমতা দখলের ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছেন। ক্ষেত্রগুলো হলো- পূর্ব পাকিস্তানের আইনসভায় ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী হত্যা এবং কেন্দ্রে সরকার গঠনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করা, আওয়ামী লীগ ও রিপাবলিকান পার্টি কেন্দ্রে সরকার গঠন করা, ফিরোজ খান নুন প্রধানমন্ত্রী এবং কেন্দ্রে মন্ত্রীদের দফতর বণ্টন নিয়ে বিরোধ। সোহরাওয়ার্দী বলেন, তার দল ফিরোজ খান নূনকে সমর্থন করবে। তার মন্ত্রিত্ব গ্রহন করবে না। এমন পরিস্থিতিতে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর রাত ১০.৩০ মিনিটে বেতার ভাষণ দেন এবং দেশে সামরিক আইন জারি করে নিমের পদক্ষেপ গ্রহণ করেন।
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা প্রথম সামরিক শাসন জারি করেন। তিনি গণতান্ত্রিক সরকার ও সংবিধান বাতিল করে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতা প্রদান করেন।
সামরিক শাসনের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য
বিশ শতকের পঞ্চাশ দশক হতে বিশ্বে বিশেষ করে আফ্রিকা ও এশিয়ায় সামরিক বাহিনী কয়েকটি দেশে ক্ষমতা দখল করে। অধিকাংশ দেশে সামরিক শাসন ব্যর্থ হয়েছে এবং গণতন্ত্রের জয় হয়েছে।
সামিরক অভ্যুত্থানকে ক্যু Coupdetat বলা হয়। কুদ্যেতা বা সামরিক অভ্যুত্থান হচ্ছে একটি প্রতিষ্ঠিত সরকারকে সহিংস বা অসাংবিধানিক পথে উৎখাত করে ক্ষমতা দখল। রাজনৈতিক অবস্থার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করে থাকে।
উইকিপিডিয়া সামরিক শাসনের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বলেছেন- A military dictatorship is a form of Government wherin the political power resides with the military. সামরিক শাসন হলো এক প্রকার সরকার যেখানে ক্ষমতা সেনাবাহিনীর নিকট যায়। তৃতীয় বিশ্বে সেনাবাহিনী রাজনীতিতে হস্তক্ষেপ করে থাকে। প্রফেসর ক্লাউড ইওয়েলচ সামরিক শাসনের ৮টি কারণ চিহ্নিত করেছেন। তা হলো-
১. রাজনৈতিক দলগুলোর অবক্ষয়
২. রাজনীতিবিদদের মধ্যে মতভেদ
৩. সামরিক হস্তক্ষেপ বহিঃশত্রুর হস্তক্ষেপের কম সম্ভাবনা
৪. পার্শ্ববর্তী দেশে সামরিক অভ্যুত্থান ঘটলে তার প্রভাব
৫. রাষ্ট্রের সমাজ ব্যবস্থার বহুধা বিভক্তি
৬. অর্থনৈতিক অস্থিরতা
৭. সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর দুর্নীতি ও অদক্ষতা
পৃষ্ঠা: ১৫৯
৮. সামরিক বাহিনী নিজেদের সম্পর্কে উচ্চ ধারণা
রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা ভেঙে পড়লে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে।তৃতীয় বিশ্বে বেসামরিক শাসন দুর্বল, দুর্নীতিপরায়ণ। সামরিক বাহিনী শক্তিশালী তা দ্বারা রাজনীতিবিদদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতির সুযোগ নিয়ে ক্ষমতা দখল করে। তৃতীয় বিশ্বের মিশর, ইরান, ইরাক, আফগানিস্তান, ইন্দোনেশিয়া, পাকিস্তানসহ অফিসার অনেক দেশে সামরিক বাহিনী বেসামরিক সরকার হটিয়ে ক্ষমতা দখল করে।
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসনের প্রেক্ষাপট
১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবরের পূর্বে পাকিস্তানে সাংবিধানিক সরকার ক্ষমতায় ছিল। ১৯৫৮ সালে সেনা অভ্যুত্থানের কয়েকটি কারণ ছিল-
১. সংবিধান প্রণয়নে বিলম্ব পাকিস্তান সৃষ্টির ৯ বছর পরে ১৯৫৬ সালে সংবিধান রচিত হয়।
২. মুসলিম লীগের দুঃশাসন-বিরোধী দল দমন
৩. যুক্তফ্রন্ট সরকার উৎখাত –
পাকিস্তান মুসলিম লীগ- আমলা ও সেনাবাহিনী যুক্তফ্রন্টের বিজয় মেনে নিতে পারেনি। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে গভর্নর জেনারেল অবৈধভাবে পূর্ব পাকিস্তানের যুক্তফ্রন্ট সরকার বাতিল করে ৯২ক ধারা জারি করে।
৪. অর্থনৈতিক সংকট- ১৯৫৫ সালে দেশে খাদ্যাভাব দেখা দেয়।
৫. স্বজনপ্রীতি ও দুনীতি- এক শ্রেণীর রাজনীতিবিদ ও আমলা দুর্নীতিগ্রস্ত হয়ে পরে।
৬. যুক্তফ্রন্টে ভাঙন- ১৯৫৪-৫৮ সালে পূর্ব পাকিস্তানে যুক্তফ্রন্টে অনৈক্য সৃষ্টি হয়। বার বার সরকার পরিবর্তন হয়। একইভাবে কেন্দ্রে বার বার সরকারে পতন হয়।
৭. ১৯৫৯ সালে অনুষ্ঠিতব্য সাধারণ নির্বাচনের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র। ১৯৫৯ সালে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচন বানচাল করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও সোনপতি জেনারেল আইয়ুব খান ষড়যন্ত্র করতে থাকেন।
পাকিস্তানে গণতন্ত্রের যাত্রা ধ্বংস করার জন্য সামরিক ও বেসামরিক আমলারা ঐক্যবদ্ধ হয়। তাদের পিছনে ছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।
যুক্তফ্রন্টে ভাঙনের মুখে পূর্ব পাকিস্তান আইনসভায় স্পিকার নিয়ে কেএসপি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৫৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর আইনসভায় বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় এবং ডেপুটি স্পিকার শাহেদ আলী পাটোয়ারী আহত হন এবং পরে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যু সামরিক সরকারের উত্থানের সুযোগ করে দেয়।
পৃষ্ঠা: ১৬০
রাজনৈতিক দলের অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিয়োগ করেন।
১৯৫৬ সালে সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট
প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা সামরিক আইন জারি করে নিম্নের পদক্ষেপ গ্রহন করেন। তিনি ১৯৫৬ সালে রচিত পাকিস্তানের সংবিধান বাতিল,কেন্দ্র ও প্রদেশের মন্ত্রীসভা ও আইন্সভা বাতিল করে দেন। পাকিস্তানে সামরিক শাসনের বৈশিষ্ট্য-
১. ১৯৫৬ সালের সংবিধান বাতিল
২. কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার বাতিল
৩. জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ বাতিল
৪. রাজনৈতিক দলের সকল কার্যক্রম নিষিদ্ধ
৫. বিকল্প ব্যবস্থা না হওয়া পর্যন্ত দেশে সামরিক শাসন বহাল থাকবে।
ক্ষমতা নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা ও প্রধান সেনাপতি আইয়ুব খানের তথা দ্বন্দ্ব দেখা দেয়। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালের ২৭ অক্টোবর জোর করে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন। জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। তিনি ক্ষমতা দখল করে পাকিস্তানে বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তানে নিপীড়ন ও শোষণ শুরু করেন।
ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার জন্য আইয়ুব খান মুসলিম লীগ ভেঙে কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করেন। অন্যদিকে তিনি বিরোধী দলীয় নেতাদেরকে নিপীড়ন করেন। তিনি রাজনৈতিক নেতাকর্মীদের গ্রেফতার ও সামরিক আদালতে বিচার করে শাস্তি প্রদান করেন।
তিনি পোডো – Public officer Disqualification Order জারি করে ১৯৫৯ সালের জুলাই মাসের মধ্যে ৮১৩ জন কর্মকর্তাকে চাকরিচ্যুত ও ১৯৬২ জনকে শাস্তি দেন।
Elective Bodies Disqualification Order-EBODO জারি করে ১৯৫৯ সালে ৭০০০ নেতাকর্মীকে রাজনীতি থেকে অবসর দেয়।
মৌলিক গণতন্ত্র
গণতন্ত্র ধ্বংস করার জন্য প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তনের ঘোষণা দেন। আইয়ুব খান বিশ্বাস করতেন।
পৃষ্ঠা: ১৬১
সংসদীয় পদ্ধতি সরকার পাকিস্তানে ব্যর্থ, তাই মৌলিক গণতন্ত্রের ভিত্তিতে নতুন নির্বাচন পদ্ধতি চালু করেন।
মৌলিক গণতন্ত্রের ৪টি স্তর থাকবে
১. ইউনিয়ন কাউন্সিল। প্রতিটি ইউনিয়নে প্রত্যক্ষ ভোট ৯ জন সদস্য নিয়ে ইউনিয়ন কাউন্সিল গঠিত হবে। তারা একজন চেয়ারম্যান নির্বাচিত করবে।
২. থানা কাউন্সিল।
৩. জেলা কাউন্সিল।
৪. বিভাগীয় কাউন্সিল।
মৌলিক গণতন্ত্রের অধীনে পূর্ব পাকিস্তানে ৪০ হাজার এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ৪০ হাজার মোট ৮০ হাজার সদস্য জনগণের ভোটে নির্বাচিত হবেন।তারাই প্রেসিডেন্ট, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আইনসভার সদস্য নির্বাচিত করবেন। এভাবে আইয়ুব খান জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেয়।
ধর্মের রাজনৈতিক ব্যবহার
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ইসলাম ধর্মকে ব্যবহার করে তার ক্ষমতা স্থায়ী করতে চেষ্টা করেন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্রকে ইসলামসম্মত বলে প্রচার করেন। মৌলিক গণতন্ত্রের নির্বাচন পদ্ধতির সাথে ইসলামের নির্বাচন পদ্ধতির মিল আছে। ১৯৬১ সালের সংবিধান ইসলামের আলোকে প্রণয়ন করা হয়। তার সংবিধানে পাকিস্তানকে ইসলামী রিপাবলিক বলা হয়েছে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হবেন মুসলমান।
১৯৬৪ সালে বিরোধী দলের প্রেসিডেন্ট প্রার্থী ছিলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। আইয়ুব খান আলেমদের দিয়ে ফতোয়া দিলেন যে রাষ্ট্রপ্রধান নারী হতে পারবে না, রবীন্দ্রসংগীতকে ইসলামবিরোধী বলা হয়। ১৯৬৭ সালে রবীন্দ্রসংগীত নিষিদ্ধ করা হয়। বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে ইসলামকে ব্যবহার করা হয়।
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রাম
১৯৫৯ সালের ২৭ ডিসেম্বর শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি লাভ করেন। সামরিক সরকার তার বিরুদ্ধে একাধিক দুর্নীতির মামলা দায়ের করে। পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী দলীয় নেতাকর্মীদের মামলা পরিচালনা করতেন। তার চেষ্টায় অনেক নেতাকর্মী মুক্তি লাভ করেন।
আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার জন্য সোহরাওয়ার্দী দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার পৃষ্ঠপোষকতা ও শেখ মুজিবুর রহমানকে আর্থিক সচ্ছল অবস্থায় রাখতেন। তার সুপারিশে শেখ মুজিবুর রহমান মাসিক ১৫০০ টাকা বেতনে
পৃষ্ঠা: ১৬২
পাকিস্তান আলফা ইনস্যুরেন্স পূর্ব পাকিস্তানের কন্ট্রোলার নিযুক্ত হন। সোহরাওয়ার্দী তাঁকে একটি লাল রঙের জীপ (নম্বর ১১০০) উপহার দেন। এ কারনে শেখ মুজিবকে সংসার পরিচালনা নিয়ে ভাবতে হয়নি। তিনি সার্বক্ষনিকভাবে দলের সাংগঠনিক কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
১৯৬০ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য আইয়ুব খান পশ্চিম পাকিস্তানের বিচারপতি সাহাবুদ্দিনের নেতৃত্বে শাসনতন্ত্র কমিশন গঠন করেন। কমিশন ১৯৬২ সালের মে মাসে সংসদীয় গণতন্ত্র সুপারিশ করে প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু আইয়ুব খানের নির্দেশে মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসন ব্যবস্থা আনুমোদন করে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী সামরিক শাসন মেনে নেননি। তিনি সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার নির্দেশ দেন। আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি তাকে করাচির বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে জেলে আটক রাখে। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের বিরুদ্ধে পূর্ব পাকিস্তানে আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬২ সালে ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদালয়ের ছাত্র সমাজ তার মুক্তির দতে সামরিক আইন ভঙ্গ করে হরতাল, মিছিল শুরু করে।
আইয়ুব খান ১৯৬০ সালে বিচারপতি হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন গঠন করেন। ছাত্র সমাজ ১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে আন্দোলন শুরু করে। সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতার ও শিক্ষা নীতির বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলা আন্দোলনমুখর হয়ে ওঠে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আন্দোলনের কেন্দ্র ছিল। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদ্ধতির শাসনতন্ত্র ঘোষণা করেন। ১৯৬২ সালের ১৪ এপ্রিল পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের একতরফা শাসনতন্ত্র গ্রহণ ও নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ ও ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেন।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। ২৮ এপ্রিল তাকে ঢাকা হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে সমাহিত করা হয়।
১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ভোটার ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী। কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য সংখ্যা ছিল ১৬৭ জন। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য ছিল ১৫৬ জন।
পূর্ব পাকিস্তানের জনপ্রিয় গভর্নর লে. জেনারেল আজম খানের সাথে আইয়ুব খানের বিরোধ সৃষ্টি হয়। ১৯৬২ সালের ১০ মে আজম খান পদত্যাগ করেন।
পৃষ্ঠা: ১৬৩
তার স্থলে গোলাম ফারুক গভর্নর নিযুক্ত হন। ১৯৬২ সালের ৮ জুন আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন।
১৯৬২ সালের ৮ জুন তমিজউদ্দিন খান স্পিকার, আবুল কাশেম ও আফজাল চিমা ডেপুটি স্পিকার নির্বাচিত হন।
১৯৬২ সালের ১৩ জুন আইয়ুব খান বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে সিনিয়র মন্ত্রী করে মন্ত্রিসভা গঠন করেন। মন্ত্রিসভা হলো –
মুহাম্মদ আলী -পররাষ্ট্র, সিনিয়র মন্ত্রী
বিচারপতি মুহাম্মদ মুনীর- আইন
আবদুল কাদির- অর্থ
আবদুল মোনায়েম খান -স্বাস্থ্য, শ্রম
হাবিবুল্লাহ খান -স্বরাষ্ট্র, কাশ্মীর
ওয়াহেদুজ্জামান- বাণিজ্য
সবুর খান -যোগাযোগ
এ কে এম ফজলুল কাদের চৌধুরী- খাদ্য ও কৃষি
আবদুল ওয়াহেদ খান -তথ্য ও বেতার
এ টি এম মোস্তফা -শিক্ষা
পরে আইন, অর্থ ও স্বাস্থ্যমন্ত্রী পদত্যাগ করলে তাদের স্থলে মন্ত্রী হলেন
শেখ মোহাম্মদ শোয়েব -অর্থ
শেখ খুরশিদ আহমদ -আইন
আবদুল্লাহ জহিরউদ্দিন -স্বাস্থ্য ও শ্রম
১৯৬৩ সালে বগুড়ার মুহাম্মদ আলীর মৃত্যুর পর জুলফিকার আলী ভুট্টো পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং খুলনার সবুর খান সিনিয়র মন্ত্রী নিযুক্ত হন।
৯ নেতার বিবৃতি
১৯৬২ সালের ১৮ জুন আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেন। পূর্ব পাকিস্তানের বিরোধী দলের ৯ জন নেতা ১৯৬২ সালের ২৪ জুন সর্বজনীন ভোটে নির্বাচিত গণপরিষদ কর্তৃক শাসনতন্ত্র প্রণয়নের আহ্বান জানান।
নেতারা হলেন-
নুরুল আমিন, মুসলিম লীগ
আতাউর রহমান খান, আওয়ামী লীগ
শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগ
পৃষ্ঠা: ১৬৪
আবু হোসেন সরকার, কেএসপি
হামিদুল হক চৌধুরী, কেএসপি
এস এম সোলায়মান, কেএসপি
মাহমুদ আলী, ন্যাপ
সৈয়দ আজিজুল হক, কেএসপি
মৌলানা পীর মুহসেনউদ্দিন দুদু মিয়া –নেজামে ইসলাম
নয় নেতার বিবৃতি প্রকাশিত হওয়ার পর ছাত্র ও জনগণের মধ্যে বিপুল সাড়া পরে যায়। প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটের ভিত্তিতে গণপিরষদের নিবাচন এবং শাসনতন্ত্র প্রনয়নের দাবি শক্তিশালী হতে থাকে।
১৯৬২ সালের ১৪ জুলাই আইয়ুব খান দল বিধি প্রণয়ন করে এবং তা সংসদে পাস হয়। যে সকল রাজনৈতিক নেতার বিরুদ্ধে এবডো প্রয়োগ করা হয়েছে, তারা ১৯৬৬ সাল পর্যন্ত কোনো রাজনৈতিক দলের সদস্য হতে পারবে না। তারা রাজনৈতিক কাজে অংশগ্রহণ করতে পারবে না।
সোহরাওয়ার্দীর মুক্তি
তীব্র আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খান পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট মুক্তি দেন। জেলে ৬ মাস ২০ দিন কারাভোগের পর তিনি মুক্তি পেলেন। জেলে থাকায় তিনি জটিল রোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬২ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর করাচী থেকে বিমানযোগে ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণ। করেন। কয়েক লক্ষ জনতা তাকে সংবর্ধনা জানায়।
শিক্ষা আন্দোলন ১৯৬২-৬৪
জেনারেল আইয়ুব খান ক্ষমতা দখল করার পর শিক্ষা ক্ষেত্রে সংস্কারের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর কেন্দ্রীয় শিক্ষা সচিব ড. এসএম শরিফের নেতৃত্বে দশ সদস্যবিশিষ্ট শিক্ষা কমিশন গঠন করা হয়। কমিশন উচ্চ শিক্ষা সংশোধন, ব্যয় বৃদ্ধি, ছাত্র রাজনীতি বন্ধ, ডিগ্রি কোর্স ২ বছরের পরিবর্তে ৩ বছর প্রভৃতি সুপারিশ করে ১৯৬০ সালে রিপোর্ট প্রকাশ করে। কমিশনের রিপোর্টের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও সমালোচনা শুরু হয়। শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন ১৯৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর প্রদেশব্যাপী হরতাল পালন করে। ঢাকায় পুলিশ মিছিলে গুলি করে মোস্তফা, বাবুল ও ওয়াজিউল্লাহকে হত্যা করে। ছাত্র সমাজ ১৭ সেপ্টেম্বর শিক্ষা দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ
পৃষ্ঠা: ১৬৫
করে। ছাত্র আন্দোলনের মুখে সরকার শরীফ কমিশন রিপোর্ট বাস্তবায়ন স্থগিত করে এবং তিন বছরের ডিগ্রি কোর্স পুনরায় দু’বছরে ফিরিয়ে আনে। তৃতীয় বছরের ছাত্র-ছাত্রী অটো প্রমোশন পায়।
হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট
সরকার শরীফ কমিশনের রিপোর্ট পর্যালোচনা ও ছাত্র অসন্তোষ অনুসন্ধানের জন্য পাকিস্তান সরকার ১৯৬৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর সুপ্রিম কোর্টের বিচার হামুদুর রহমানের নেতৃত্বে একটি কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্টে ছাত্রর দাবি উপেক্ষিত হয়। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে হামুদুর রহমান কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ১৯৬৪ সাল হতে ছাত্র আন্দোলন শুরু হয়। ১৯৬৪ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টকে হামুদুর রহমান শিক্ষানীতি বলা হয়ে থাকে। ছাত্র আন্দোলনের ফলে হামুদুর রহমান শিক্ষানীতি বাতিল হয়ে যায়।
শিক্ষা আন্দোলনে ছাত্র নেতাদের মধ্যে ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি আসমত আলী সিকদার, সিরাজুল আলম খান, সওগাতুল আলম সগীর, রাগে খান মেনন, কাজী জাফর আহমদ প্রমুখ।
এনডিএফ গঠন
গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৬২ সালের ৪ অক্টোবর লাহোরে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগ, ন্যাপ, কেএসপি, রিপাবলিকান পার্টি, কাউন্সিল মুসলিম লীগ সভায় যোগ দেয়। সভায় এনডিএফ National Democratic Front গঠন করা হয়। সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত রাজনৈতিক দল পুনরুজ্জীবিত হবে না। ১৯৬২ সালের ৭ অক্টোবর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পল্টন ময়দানে ৫ লাখ লোকের উপস্থিতিতে ভাষণ দেন। তিনি সকল জেলা, মহকুমায় এনডিএফ গঠন করার নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগের ২ জন, ন্যাপের ২ জন, কেএসপির ১-২ জন, মুসলিম লীগের ১-২ জন এবং নেজামে ইসলামের ১ জন নিয়ে থানা, মহকুমা। জেলা এনডিএফ কমিটি গঠনের নির্দেশ দেওয়া হয়।
এনডিএফ নেতাদের নিয়ে হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তানের সকল জেলা, মহকুমা সফর করেন। লক্ষ লক্ষ লোক তার সভায় উপস্থিত হতো। তার আহ্বানে গণজাগরণ সৃষ্টি হয়।
১৯৬২ সালের ৩ নভেম্বর মওলানা ভাসানীর অন্তরীণ আদেশ প্রত্যাহার করা হয়। তিনি মুক্তি লাভ করেন।
পৃষ্ঠা: ১৬৬
কনভেনশন মুসলিম লীগ
আইয়ুব খান রাজনৈতিক দলগুলোর কঠোর সমালোচনা করতেন।কিন্তু শেষ পর্যন্ত ১৯৬২ সালের ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর মুসলিম লীগের কনভেশন আহ্বান করা হয়।
চৌধুরী খালেকুজ্জামাঙ্কে আহবায়ক করে পশ্চিম পাকিস্তানে এবং আবুল হাশিমকে পূর্ব পাকিস্তানে কনভেনশন মুসলিম লীগ গঠন করা হয়।
১৯৬৩ সালের ২৩ জানুয়ারি পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও দল নেতা মুহাম্মদ আলী হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যু: ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩
১৯৬২ সালের ৩১ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। ১৯৬৩ সালের ১৯ মার্চ চিকিৎসার জন্য বৈরুতে গমন করেন। চিকিৎসার পর তিনি লন্ডনে তার পুত্র রাশেদ সোহরাওয়ার্দীর সাথে থাকেন। চিকিৎসার জন্য তিনি পুনরায় বৈরুত গমন করেন। ১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর বৈরুতের হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ৮ ডিসেম্বর তার লাশ ঢাকা ডিমানবন্দরে পৌছলে লাখ লাখ বাঙালি কান্নায় ভেঙে পড়ে। রমনা রেসকোর্স ময়দানে কয়েক লাখ লোক জানাজায় অংশ নেন। তাকে হাইকোর্ট প্রাঙ্গণে শেরে বাংলার মাজারের পাশে সমাহিত করা হয়। তার মৃত্যুতে পাকিস্তানের রাজনীতিতে অপূরণীয় ক্ষতি হয়। তিনি ইতিহাসে গণতন্ত্রের মানসপুত্র হিসেবে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
১৯৬৪ সালের দাঙ্গা
ভারতের কাশ্মীর মসজিদ হতে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর পবিত্র চুল চুরি হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ১৯৬৪ সালে পূর্ব পাকিস্তানে দাঙ্গা ছড়িয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় মন্ত্রী সবুর খান ও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান দাঙ্গার ইন্ধন দেন। খুলনা ও ঢাকায় শত শত হিন্দু নিহত হয়, নারীরা নির্যাতিত হয় ও সম্পদ লুট হয়। দাঙ্গা প্রতিরোধে শেখ মুজিব এগিয়ে এলেন। ১৯৬৪ সালের ১৬ জানুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা অফিসে তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে আহ্বায়ক করে ৯৯ সদস্যবিশিষ্ট দাঙ্গা প্রতিরোধে কমিটি গঠন করা হয়। ৩৩ নম্বর তোপখানা রোডে কমিটির অফিস করা হয়। ১৬ জানুয়ারি কমিটি পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও’ শীর্ষক প্রচারপত্র বিলি করে। প্রচারপত্র বিলির অভিযোগে শেখ মুজিবুর রহমানসহ নেতাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। ১৯৬৪ সালে দাঙ্গার ফলে লাখ লাখ হিন্দু দেশ ত্যাগ করে ভারতে বসতি স্থাপন করে।
পৃষ্ঠা: ১৬৭
আওয়ামী লীগের দায়িত্বভার গ্রহণ
১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগের দায়িত্ব শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর অর্পিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিট করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মওলানা তর্কবাগীশকে সভাপতি ও শেখ মুজিব সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত করা হয়। আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ায় নেতাকর্মীদের মধ্যে উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান, আবুল মনসুর আহমদ, সালাম খান প্রমুখ এনডিএফে থেকে যান। তারা কোনো দিন আওয়ামী লীগে ফিরে আসেননি।
১৯৬৪ সালের জুন মাসে সরকার ঘোষণা করে যে ১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
১৯৬৪ সালের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কনভোকেশন অনুষ্ঠান
১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৩৮তম কনভোকেশন অনুষ্ঠিত হয়। পদাধিকারবলে গভর্নর মোনায়েম খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর হিসে ছাত্রদের ডিগ্রি সনদ প্রদান করবেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রগণ স্বৈরাচারী মোনায়েম খানের নিকট থেকে সনদ গ্রহণ করবে না। সমাবর্তনে পুলিশের সাথে ছাত্রদের সংঘর্ষ হয়। ৩১৩ জন ছাত্র গ্রেফতার হয়। ছাত্রলীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মনি ও আসমত আলী সিকান্দরের এমএ ডিগ্রি বাতিল করা হয়। ৫ বছরের জন্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কৃত হন রাশেদ খান মেনন, সাওগাতুল আলম সগীর, কে এম ওবায়দুর রহমান, একে বদরুল হক বাচ্চু প্রমুখ।
কপ- Combined Opposition Party গঠন-১৯৬৪
সকল বিরোধী দল একতাবদ্ধ করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৬৪ সালের ২২ জুলাই বিরোধী দলের খাজা নাজিমউদ্দিনের বাসভবনে ৩ দিনব্যাপী আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। এনডিএফ ও কেএসপি এ সভায় যোগ দেয়নি। বিরোধী দল ১৯৬৪ সালের ২৬ জুলাই ৯ দফার ভিত্তিতে কপ গঠন করে। কপ গঠনে শেখ মুজিবুর রহমান উদ্যোগী ভূমিকা পালন করেন।
১৯৬৫ সালের নির্বাচন
১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাসে রাষ্ট্রপতি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ১৯৬৪ সালের নভেম্বর মাসে ইউনিয়ন নির্বাচনে উভয় অঞ্চলে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্র।
পৃষ্ঠা: ১৬৮
নির্বাচিত হয়। অধিকাংশ মৌলিক গনতন্ত্রী গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠান অঙ্গীকার করে নির্বাচিত হয়। কনভেনশন মুসলিম লীগ আইয়ুব খানকে এবং কপ পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতা মুহাম্মদ আলী জিনাহর বোন মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেয়।শেখ মুজিবুর রহমান কপ প্রাথী মিস ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষে দেশে ব্যাপক প্রচার অভিযান চালায়। ১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি প্রেসি্ডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সরকারি প্রভাব খাটিয়ে আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ৮০ হাজার ভোটের মাধ্যে আইয়ুব খান ৪৯৯৫১ ভোট এবং ফাতেমা জিন্নাহ ২৮১৯১টি ভোট লাভ করেন। ১৯৬৫ সালের ২১ মার্চ জাতীয় পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব নিজে প্রার্থী না হয়ে বিরোধী দলের পক্ষে প্রচার অভিযান চালান। বিরোধী দল হতে কপ ১০টি আসন এনডিএফ-৫ এবং ৫টি আসনে স্বতন্ত্র প্রার্থী জয় লাভ করে। ২০টি আসনে আইয়ুব খানের মুসলিম লীগ জয় লাভ করে। ১৯৬৫ সালের ২৩ মার্চ আইয়ুব খান প্রেসিডেন্টে হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং মন্ত্রিসভা গঠন করেন। এনডিএফ নেতা নুরুল আমিন বিরোধী নেতা নির্বাচিত হন।
১৯৬৫ সালের ২৫ মার্চ ঢাকা হাইকোর্টে শেখ মুজিবুর রহমানের দেশদ্রোহিতার মামলার রায় দান করে নিম্ন আদালতের ২ বছরের শাস্তি বহাল রাখে। পল্টন ময়দানে দেশদ্রোহিতামূলক ভাষণ দেওয়ায় জজকোর্ট তাকে দু’বছরের জেল দেয়। সুপ্রিমকোর্টে আপিল করলে দু’বছরের শাস্তি বাতিল করে দেয়।
১৯৬৫ সালের ৩ এপ্রিল মওলানা তর্কবাগীশের সভাপতিত্বে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে আন্দোলন চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। এ সময় অনেক নেতা কর্মী গ্রেফতার হয়।
১৯৬৫ সারের ১৬ মে প্রাদেশিক আইন সভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে মুসলিম লীগ ৬৬, বিরোধী দল ২৫ এবং স্বতন্ত্র ৫৮টি আসন জয় লাভ করে। স্বতন্ত্র প্রার্থীরা অনেকে সরকারি দলে যোগ দেয়।
১৯৬৫ সালের ৮ এপ্রিল আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সভায় ১১ দফাভিত্তিক আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধ
কাশ্মীর দখল করার উদ্দেশে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর ভারত আক্রমণ করেন। ১৭ দিন যুদ্ধ চলে। পাকিস্তানের বিরাট অংশ ভারত দখল করে নেয়। পূর্ব পাকিস্তান যুদ্ধকালে সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। জাতিসংঘের নিরাপত্তা
পৃষ্ঠা: ১৬৯
পরিষদ ১৯৬৫ সালের ২০ সেপ্টেম্বর যুদ্ধবিরতির আহ্বান জানায়। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশের শাস্তি প্রতিষ্ঠিত হয়। চুক্তি স্বাক্ষরের পরের দিন ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদূর শাস্ত্রী তাসখন্দে মৃত্যুবরণ করেন।
গ. আইয়ুব খানের পতন ও ইয়াহিয়া খানের শাসন- এক ইউনিট বিলুপ্তি করা, সার্বজনীন ভোটাধিকার এলএফও Legal Framework Order
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারি করে ক্ষমতা দখল করেন। তিনি শাসনতন্ত্র বাতিল, কেন্দ্রে ও প্রদেশে সংসদীয় সরকার বা সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ করেন। তিনি মৌলিক গণতন্ত্র প্রবর্তন করে জনগণের ভোটের অধিকার কেড়ে নেন। সারা দেশে ৮০ হাজার মৌলিক গণতান্ত্রিক ভোটার। ১৯৬২ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানে রাষ্ট্রপতি পদ্ধতির শাসনতন পাস করেন এবং ৮ জুন থেকে কার্যকর হয়। ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল জাতীয় পরিষদ এবং ৬ মে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৬২ সালের ফ্রেব্রুয়ারি মাসে ছাত্রসমাজ হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতার ও হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু করে। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে সরকারের ইঙ্গিতে দাঙ্গা শুরু হয়। পূর্ব পাকিস্তানিরা দাঙ্গার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়।
১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত সমাবর্তনের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন করে। তারা স্বৈরাচারী গভর্নর মোনায়েম খানের নিকট হতে সনদ গ্রহণ করবে না- এ আন্দোলনে প্রায় ১২০০ ছাত্র গ্রেফতার হয়। শেখ ফজলুল হক মনি ও আসমত আলী সিকদারের এমএ ডিগ্রি বাতিল করা হয়।
১৯৬৮ সালে সরকার শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে। ১৯৬৮ সালের অক্টোবর মাসে আইয়ুব-মোনায়েমবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। দাবি ধ্বনিত হলো -জেলের তালা ভাঙব শেখ মুজিবকে আনবো। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি হতে আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে রূপ নেয়।
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি ছাত্র ইউনিয়ন নেতা আসাদুজ্জামান পুলিশের গুলিতে শহীদ হয়। ১৯৬৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের
পৃষ্ঠা: ১৭০
শিক্ষক অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহাকে সেনাবাহিনী গুলি করে হত্যা করে। আন্দোলন সারা পাকিস্তানে বিস্তার লাভ করে। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানে ১০০ জন পূর্ব পাকিস্তানি নিহিত হয়। তাদের মধ্যে ৩৪ জন শ্রমিক, ২০ জন ছাত্র, ১ এ জন সরকারি কর্মচারী, ৫ জন ব্যবসায়ী এবং ১ জন শিক্ষক নিহত হন। ছাত্রদের ১১ দফা এবং আওয়ামী লীগের ৬ দফার ভিত্তিতে গনঅভ্যুত্থান ঘটে। ছাত্র সংগ্রাম কমিটির নেতা ছিলেন –তোফায়েল আহমদ। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি সরকার আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে নেয়। আগরতলা মামলার সকল আসামি মুক্তি লাভ করে। প্রেসিডান্ট আইয়ুব খান রাওয়ালপিন্ডিতে গোলটেবিল বৈঠক ডাকেন। শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা পেশ করেন। বৈঠকে ৬ দফা সমস্যার মীমাংসা না হওয়ায় বৈঠক ভেঙে যায়। ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করেন। তার স্থলে জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক নিযুক্ত হন।
১৯৫৬ সালের সংবিধানে পশ্চিম পাকিস্তানের ৫টি প্রদেশ নিয়ে এক ইউনিট গঠনের ব্যবস্থা করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ এক ইউনিটের বিরুদ্ধে পরল আন্দোলন গড়ে তোলে। ইয়াহিয়া খান এক ইউনিট অবলুপ্ত করেন। প্রদেশগুলো পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে আনেন।
পাঞ্জাব, সিন্ধু, সীমান্ত ও বেলুচিস্তান পৃথক প্রদেশ হিসেবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। তিনি আরো ঘোষণা করেন- এক ব্যক্তি এক ভোট- এ নীতিতে সার্বজনীন ভোটের অধিকার ফিরিয়ে দেয়া হবে। ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ জন্য সরকার Legal Framework Order জারি করে। এ আদেশে সার্বজনীন ভোট হবে প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হবে। গণপরিষদে মোট আসন হবে ৩০০। পূর্ব পাকিস্তান পাবে ১৬৯ জন, পশ্চিম পাকিস্তান পাবে ১৩১ জন। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানে একক বিজয় লাভ করে।
সহায়ক গ্রন্থ
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র, দ্বিতীয় খণ্ড \
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী
সিরাজ উদদীন আহমেদ, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
পৃষ্ঠা: ১৭১
ষষ্ঠ অধ্যায়
জাতীয়তাবাদের বিকাশ ও স্বাধিকার আন্দোলন
ক. সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ও বাঙালি সংস্কৃতির উজ্জীবন
জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা বুঝি একটি সামাজিক অনুভূতি, এক বিশেষ আত্মচেতনার সমষ্টিগত রূপ। বর্ণ, ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, প্রাকৃতিক পরিবেশ। রাজনৈতিক-চেতনা, অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং বহুকাল ধরে একত্রে বসবাসের ফলে একাত্মতাবোধই জাতি গঠনের উপকরণ। জাতি এমন একটি জনসমষ্টি যারা প্রকৃতভাবে ঐক্যসূত্রে আবদ্ধ। এ.কে. ফজলুল হকের মতে, জাতীয়তাবাদ হচ্ছে “জাতির সামগ্রিক কল্যাণে এর চিন্তাধারা অন্যের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার ব্যবস্থা করা।” জাতীয়তাবাদ বলতে পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ বোঝায় এবং তা এদেশে বিশের শতকের আগে অনুপস্থিত ছিল। পশ্চিমা জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল। জাতীয়তাবাদ সামন্ত প্রথাকে ধ্বংস করে নতুন পুঁজিবাদের উদ্ভব ও গণতান্ত্রিক বিপ্লব সৃষ্টি করে।
বাঙালি জাতীয়তাবাদ বুঝতে হলে সামাজিক বিকাশের ধারাকে সামগ্রিকভাবে মূল্যায়ন করে সামনে রাখা প্রয়োজন। আঠারো শতকের প্রথম ভাগে মুঘল সাম্রজ্যের ধ্বংসের ওপর নতুন নতুন রাষ্ট্র গড়ে উঠেছিল। এ সময় ইউরোপীয় বণিকদের সাথে বাণিজ্য করে উপমহাদেশের একটি বণিক শ্রেণীর উদ্ভব হয়। মুঘল আমলের সামন্ততন্ত্র থেকে এই বণিক শ্রেণী। তারা বাংলাদেশে রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের জন্য ইংরেজ বণিকদের সাথে ষড়যন্ত্র করে। বণিকদের আঘাতে পলাশী প্রান্তরে মধ্যযুগের সামন্ততন্ত্র ভেঙ্গে পড়ে। কিন্তু ইংরেজরা ভারতে সামন্ততন্ত্র বিলোপ না করে তা টিকিয়ে রাখে, ফলে ভারতে বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যে সূচনা হয়েছিল, তা চিরতরে নষ্ট হয়ে যায় এবং এদেশে উরোপের মতো কৃষি ও শিল্প বিপ্লব ঘটেনি। সমাজের অর্থনৈতিক কাঠামো ও উৎপাদন পদ্ধতিই জাতীয়তাবাদের চরিত্র-ধর্মকে নিয়ন্ত্রিত করে। কিন্তু ইংরেজ
পৃষ্ঠা: ১৭২
আমলে অর্থনেতিক বিকাশের ধারাটি রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার ফলে জাতীয়বাদের স্বাবাভিক বিকাশ সম্ভব হয়নি। তীয়তাবাদ জন্মলাভ করে। বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে জাতীয়তাবাদ জন্মলাভ করে। বর্জোয়া বিপ্লবে ব্যাপক জনগণের ভূমিকা থাকে এবং সামন্ততান্ত্রিক উৎপাদন ব্যবস্থাকে ধবংস করে পুঁজিবাদের উদ্ভব হয়। ভারতে পুজিবাদ ও ধনতন্ত্র উভয়ের অনুপস্থিতি দেখা যায়। বাঙালিদের ভাষা ছিল, প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল; কিন্তু জাতীয় ঐক্য গড়ে ওঠেনি। জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি যে অনুভুতি ও আত্মচেতনা, বাঙালিদের মধ্যে তা অনুপস্থিত ছিল। সামন্ত প্রথা ও অশিক্ষা তাদের মধ্যে আত্মচেতনার প্রধান অন্তরায় ছিল।
জাতীয়তাবাদ বলতে আমরা বুঝি একটি ভৌগোলিক অঞ্চলের জনগোষ্ঠী যাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ইতিহাস, এক- যারা শত শত বছর ধরে ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপন করে বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে। ফলে তাদের মধ্যে যে চেতনা সৃষ্টি হয়েছে, সে চেতনা অনভূতি, তাদের মধ্যে স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রেরণা জোগায়। একই ভাষা, সংস্কৃতি, ধর্ম, ভূখণ্ড সার্বভৌমত্ব জাতীয়তাবাদের উপকরণ।
প্রাচীন বাংলায় জাতীয়তাবাদের চেতনা অনুপস্থিত ছিল। তখণ ছিল কৌম চতনা। বঙ্গ, রাঢ়, পুণ্ড, সমতট প্রভৃতি নামে পরিচিত ছিল। তাদের প্রধান ভাষা ছিল অষ্ট্রিক। আর্যরা বাঙালিদের ঘৃণা করত। তাদের ভাষাকে পাখির ভাষা বলত। শতাব্দীর পর শতাব্দীর দ্বন্দ্ব-মিলনে তাদের কৌম চেতনা বিলুপ্ত হয়ে তারা বাঙালি হয়েছে। বিভিন্ন কৌম বা গোত্রের মধ্যে ভাবের আদান-প্রদানের ফলে সপ্তম শতকে বাংলা ভাষার উদ্ভব হয়। বাংলা ভাষা সৃষ্টিকাল ৭০০-১২০০ সালের মধ্যে। বাংলা ভাষা প্রসারের মাধ্যমে তাদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা সৃষ্টি হতে থাকে। জাতীয়তাবাদী চেতনা সুলতানি আমলে আরও প্রসারিত হয়। চতুর্দশ শতকে সুলতান শামসুদ্দিন ইলিয়াস শাহ নিজকে শাহ বাঙ্গাল ঘোষণা করেন। তিনি সমগ্র বাংলাকে ঐক্যবদ্ধ করে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেন। মোগল ও ইংরেজ আমলে বাঙালিদের মধ্যে জাতীয়তাবাদী চেতনা থাকলেও পূর্ণতা পায়নি। ইংরেজ সৃষ্ট ভেদনীতি, সাম্প্রদায়িকতা জাতীয়তাবাদকে বাধাগ্রস্ত করে। ১৯০৫ সালে বাংলা ভাগ হলে জাতীয়তাবাদী চেতনা প্রচণ্ড আকার ধারণ করে। এ সময় কবিগুরু লেখেন- ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।
১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ সৃষ্টি। ১৯০৯ সালে ধর্মভিত্তিক নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তন হলে জাতীয়তাবাদী চেতনা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত হয়। মুহম্মদ আলী জিন্নাহ দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমি দাবি করেন। মুহামদ আলী জিন্নাহ ঘোষণা করেন হিন্দু-মুসলমান পৃথক জাতি- তাদের ভাষা, সংস্কৃতি পৃথক। দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টি হয়। শুরু হলো
পৃষ্ঠা: ১৭৩
বাঙালিদের প্রতি পাকিস্তানিদের শোষণ-শাসন। ১৯৭১ সালে জাতীয়বাদী চেতনায় বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করে স্বাধীনতা অর্জন করে। স্বাধীন বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের শ্রেষ্ঠ অর্জন।
পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার প্রথমেই বাংলা ভাষার বিরুদ্ধে আক্রমণ করে। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করতে চায়। বাঙালিরা প্রতিবাদ করে। ১৯৫২ সালে ছাত্ররা ভাষার দাবিতে প্রাণ দেয়। ১৯৫৬ সালে পাকিস্তান বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকতি দেয়। পাকিস্তানিদের বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি আক্রমণ বন্ধ হয়নি।
১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা ঘোষনা করলে বাঙালি সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আগ্রসন শুরু করে। ১৯৬৭ সালে কে তথ্যমন্ত্রী খাজা শাহাবুদ্দিন রেডিও-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ করে দেন। পাকিস্তানি আদর্শের সাথে মিল না থাকায় পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান নতুন করে রবীন্দ্রসঙ্গীত লেখার উদ্যোগ নেয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সরকার হিন্দু-সংস্কৃতির অংশ বলে মন্তব্য করে। ১৯৬৭ সালের জুন মাসে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী, রাজনৈতিক নেতা, ছাত্রসমাজ সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের প্রতিরোধ করতে এগিয়ে আসে। ১৯৬৭ সালের ২৫ জুন ১৮ জন বুদ্ধিজীবী রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধের বিরুদ্ধে বিবৃতি দেন। তারা বলেন, “সরকারি মাধ্যম হতে রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্রচার হ্রাস ও বর্জনের সিদ্ধান্ত প্রকাশ করা হইয়াছে। এই সিদ্ধান্ত আমরা অত্যন্ত দুঃখজনক বলে মনে করি। রবীন্দ্রনাথের সাহিত্য বাংলা ভাষাকে যে ঐশ্বর্য দান করেছে, তার সংগীত আমাদের অনুভূতিকে যে গভীরতা ও ভিন্নতা দান করেছে তা রবীন্দ্রনাথকে বাংলাভাষী পাকিস্তানিদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশে পরিণত করেছে। সরকারি নীতি নির্ধারণের সময় এই সত্যের গুরুত্ব মর্যাদা দান করা অপরিহার্য।”
১৮ জন বুদ্ধিজীবীর এই বিবৃতির বিরুদ্ধে দৈনিক বাংলায় ২৯ জুন পাল্টা বিবৃতি দেয়। এভাবে একশ্রেণীর দালাল বুদ্ধিজীবীর সমর্থনে সরকার ১৯৬৭ সালের আগস্ট মাসে বেতার-টেলিভিশনে রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রচার বন্ধ করে দেয়। উনসত্তরের গণআন্দোলনে এ আদেশ ভেসে যায়। রবীন্দ্রসঙ্গীত বন্ধ হলে ঢাকার ছায়ানট, বুলবুল ললিতকলা একাডেমি রবীন্দ্রসঙ্গীতের অনুষ্ঠান করে সাড়া জাগায়। এ সময় বদরুদ্দীন উমরের লেখা ‘সাংস্কৃতিক সংকট’ ও ‘সাংস্কৃতিক সাম্প্রদায়িকতা’ বই দুটো সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিরোধ আন্দোলনকে অনুপ্রাণিত করে।
পৃষ্ঠা: ১৭৪
আইয়ুব-মোনায়েম চক্র বাংলা ভাষা সংস্কারের ষড়যন্ত্র করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ড. ওসমান গনি, অধ্যাপক কাজী দীন মুহাম্মদের নেতৃত্বে বাংলা ভাষা সংস্কারের একটি কমিটি গঠন করেন। ড. মুহাম্মদ এনামুল হক,অধ্যাপক মুহাম্মাদ আবদুল হাই, অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক গোষ্ঠী ও অপচেষ্টার বিরোধিতা করেন।
খ মজিবুর রহমান ও ছয় দফা আন্দোলনের প্রতিক্রিয়া, গুরুত্ব ও তাৎপর্য
ছয় দফা আন্দোলনের পটভূমি
অবিভক্ত বাংলার দাবি ছিল স্বাধীন বাংলা। বাংলার প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯৪৭ সালের ২৭ এপ্রিল স্বাধীন বাংলা প্রতিষ্ঠার প্রস্তাব উত্থাপন করেন। কংগ্রেস তার দাবি গ্রহণ না করায় ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট বাংলা ভাগ হলো। পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্ত করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তান ও পর্ব পাকিস্তান ১২০০ মাইল দ্বারা বিচ্ছিন্ন ছিল। দু’মাথা বিশিষ্ট পাকিস্তান। একমাত্র ইসলাম ধর্ম ব্যতীত দু’অঞ্চলের মধ্যে কোনো ঐক্য ছিল না। উভয় অঞ্চলের মধ্যে নৃতাত্ত্বিক, ভাষা, সংস্কৃতি ও অর্থনীতির ঐক্য ছিল না। বাঙালিদের জনপ্রিয় নেতা শেরে বাংলা একে ফজলুল হক, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কেন্দ্রীয় বা প্রাদেশিক ক্ষমতা দেয়া হয়নি। বাঙালিদের শাসক হলো পশ্চিম পাকিস্তান। শুরু থেকে পূর্ব বাংলা বা পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের কলোনীতে পরিণত হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকারের অনুগত কয়েকজন বাঙালি মন্ত্রী দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভায় প্রথমে মাত্র দুজন বাঙালি মন্ত্রী ছিল। ১৯৩৫ সালের ভারত শাসনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক সরকার পরিচালিত হতো। প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকারের যে কোনো সময় প্রাদেশিক সরকার বাতিল করার ক্ষমতা ছিল। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করে শেরে বাংলা পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী নিযুক্ত হন। মাত্র দু’মাসের মধ্যে গভর্নর জেনারেল ৯২(ক) ধারা জারি করে শেরে বাংলার মন্ত্রিসভা বাতিল করে দেয়। তার মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। কেন্দ্রীয় সরকার ছিল বাঙালি বিদ্বেষী। ১৯৫৭ সালে বেআইনিভাবে প্রধানমন্ত্রী হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৪৭-১৯৬৬ সাল পর্যন্ত শেখ মুজিব কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক শাসনের বৈষম্য দেখেছেন। ১৯৪৮ সালে কেন্দ্রীয় সরকার
পৃষ্ঠা: ১৭৫
শাসনতন্ত্র সংশোধন করে প্রদেশের ওপর কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। ১৯৪৯ সালে প্রোডা- PRODA- Public and Representative Offices Disqualification Act জারি করে প্রাদেশিক মন্ত্রীদের পরাধীণ করা হয়। কেন্দ্র প্রাদেশিক মন্ত্রীদের অযোগ্য ঘোষণা করতে পারত।
কেন্দ্র ও প্রাদেশিক সরকারের সচিবালয়ে বাঙালি কর্মকর্তা ছিল না।সকল পদে ছিল পশ্চিম পাকিস্তানিরা। সামরিক বাহিনীতে কর্নেলের ওপরে কোনো বাঙালি ছিল না। সেনাবাহিনীতে মাত্র ৫ শতাংশ বাঙালি ছিল। সেনাবাহিনীর সকল দপ্তর ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উভয় অঞ্চলের মধ্যে বিশাল বৈষম্য সৃষ্টি হয়। পূর্ব বাংলার পাট, চা, চামড়া রপ্তানি করে যে বৈদে মুদ্রা অর্জিত হতো তা ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প উন্নয়নে। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অর্থ ব্যয় হতো পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য। বাজেটের অধিকাংশ অর্থ ব্যয় হয়েছে পশ্চিম অঞ্চলে। ১৯৪৭-৪৮ সাল থেকে ১৯৫৪-৫৫ সালে কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করেছে ৭৯০ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। অন্যদিকে পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় করেছে মাত্র ৪২ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যের কারণে বাঙালিরা স্বায়ত্তশাসন দাবি করে।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান সম্পূর্ণ অরক্ষিত ছিল। পূর্ব পাকিস্তানে সেনাবাহিনীর কোনো সদর দপ্তর ছিল না। এ কারণে প্রাদেশিক সরকারের নিজস্ব বাহিনী থাকা প্রয়োজন।
পাকিস্তানে নাগরিকদের কোনো ভোটাধিকার ছিল না। উভয় অঞ্চলে ভোটার ছিল মাত্র ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী। জনগণের ভোটের অধিকার, স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা ও অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে আমাদের বাঁচার ৬ দফা কর্মসূচি পেশ করেন।
১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত। এ অঞ্চলে পাক-ভারত যুদ্ধ হয়নি। ভারত ইচ্ছা করলে পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিতে পারত। পাক-ভারত যুদ্ধের ফলে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তার বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। তিনি পূর্ব পাকিস্তানকে ফেডারেল সরকারের অঙ্গ হিসেবে দেখতে চান। কেন্দ্রের হাতে থাকবে পররাষ্ট্র ও দেশরক্ষা। অন্য সকল বিষয় থাকবে প্রদেশের নিকট। তিনি পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা করার দাবি করছেন। আওয়ামী লীগের উত্থাপিত ১১ দফা থেকে ৬ দফার পথে চলবে। ৬ দফার স্বাপ্নিক শেখ মুজিব, প্রণেতাও তিনি। ৬ দফা প্রণয়নে তাজউদ্দীন আহমদ ও বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদগণ সহায়তা করেছেন।
পৃষ্ঠা: ১৭৬
১৯৬৬ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী চৌধুরীর লাহোরের বাসভবনে বিরোধী দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। পূর্ব বাংলা থেকে ২১ জন এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে২০০ সদস্য সম্মেলনে যোগ দেন। ১৯৬৬ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি লাহোর সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান তার ঐতিহাসিক ৬ দফা পেশ করেন।
আওয়ামী লীগের ঐতিহাসিক ছয়-দফা
১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠকে ৬-দফা অনুমোদিত হয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ঢাকায় ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে ৬-দফা পেশ করা হয়। শেখ মুজিবুর প্রণীত- ‘আমাদের বাঁচার দাবি ৬-দফা’ ১৮ মার্চ অনুমোদিত হয়।
১ নম্বর দফা
এ দফায় বলা হয়েছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়তে হবে। তাতে পার্লামেন্টারী সরকার থাকবে। সকল নির্বাচন সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হবে। আইনসভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকবে।
২ নম্বর দফা
ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ার কেবল দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্র ব্যাপার- এ দুটো বিষয় থাকবে। অবশিষ্ট সকল বিষয় স্টেটসসমূহের (প্রদেশ) হাতে থাকবে।
ফেডারেল বা যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিটকে প্রদেশ না বলে স্টেট বলা হয়েছে। যেমন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ইউনিটকে স্টেট বা রাষ্ট্র বলা হয়।
৩ নম্বর দফা
মুদ্রা সম্পর্কে দুটি বিকল্প প্রস্তাব ছিল। যে কোনো একটি গ্রহণ করলে চলবে।
ক. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য দুটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করতে হবে। এ ব্যবস্থা অনুসারে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে না আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকবে দুটি অঞ্চলের জন্য দুটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকবে।
খ. দু’অঞ্চলের জন্য একই মুদ্রা থাকবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকবে, যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হতে পারে। এ বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে। দু’অঞ্চলের দুটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকবে।
পৃষ্ঠা: ১৭৭
৪ নম্বর দফা
সকল প্রকার ট্যাক্স-খাজনা কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকার আদায়ী রাজস্বের নির্ধারিত অংশ আদায়ের সাথে সাথে ফেডারেল তহবিলে জমা হয়ে যাবে। এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের ওপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসন্তন্ত্রে থাকবে। এভাবে জমাকৃত অর্থ ফেডারেল সরকারের তহবিলে থাকবে।
৫ নম্বর দফা
এ দফায় বৈদেশিক বাণিজ্যের ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধান্ থাকবে-
১. দু’অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখতে হবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়াতে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকবে।
৩. ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশী মুদ্রা অঞ্চল হতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হবে।
৪. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনাশুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি-রপ্তানি চলবে।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্পর্কে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে বাণিজ্য মিশন স্থাপনের এবং আমদানি-রপ্তানি করার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করে শাসনতান্ত্রিক বিধান করতে হবে।
৬ নম্বর দফা
পূর্ব পাকিস্তান মিলিশিয়া বা প্যারা মিলিটারি রক্ষীবাহিনী গঠন করতে পারবে। দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রের হাতে থাকবে। একই সাথে পূর্ব পাকিস্তানে উপযুক্ত পরিমাণে দেশরক্ষা বাহিনী গঠন করতে হবে। অস্ত্র কারখানা স্থাপন করতে হবে। নৌ বাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব পাকিস্তানে স্থানান্তর করতে হবে।
সম্মেলনের সভাপতি চৌধুরী মোহাম্মদ আলী তাৎক্ষণিকভাবে তার ভাষণে বলেন, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন বর্তমান আলোচ্য বিষয় নয়। আলোচ্য বিষয় হলো গণতন্ত্র উদ্ধার ও তাসখন্দ চুক্তি।
শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক উত্থাপিত ছয় দফার বিষয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে। প্রতিক্রিয়া শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমান তার দল নিয়ে করাচি চলে আসেন এবং সোহরাওয়ার্দীর কন্যা আখতার সুলেমানের বাসায় আশ্রয় নেন। তারপর ঢাকায় আসেন।
পৃষ্ঠা: ১৭৮
আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ মুজিবুর রহমান
১৯৬৬ সালের ১৩ মার্চ আওয়ামী লীগের হয় কার্যনির্বাহী কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সভায় ৬ দফা অনুমোদিত হয়।
১৯৬৬ সালের ১৮, ১৯, ২০ মার্চ ঢাকায় ইডেন হোটেল আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়।সভায় ৬ দফা অনুমোদিত হয়।১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান সম্পাদক সভাপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে সাধারণ সম্পাদক করে পূর্ব পাকিস্তান আঅয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির সদস্যরা হলেন –
শেখ মুজিবুর রহমান -সভাপতি
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- সহ-সভাপতি
আবদুস সালাম খান- সহ-সভাপতি
খন্দকার মোশতাক আহমদ- সহ-সভাপতি
এম মনসুর আলি মজিবুর রহমান- সহ-সভাপতি
শাহ আজিজুর রহমান- সহ-সভাপতি
তাজউদ্দীন আহমদ- সাধারণ সম্পাদক
মিজানুর রহমান চৌধুরী- সাংগঠনিক সম্পাদক
জহুর আহমদ চৌধুরী- শ্রম সম্পাদক
ওবায়দুর রহমান -সমাজসেবা সম্পাদক
আবদুল মোমেন -প্রচার সম্পাদক
আমেনা বেগম- মহিলা সম্পাদক
মাহমুদুল্লাহ -দফতর সম্পাদক
হাফেজ মুসা- কোষাধ্যক্ষ
এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ- সদস্য
আবদুর রহমান খান- সদস্য
এম এ রশিদ রওশন আলী -সদস্য
মমিনউদ্দিন আহমদ -সদস্য
আতাউর রহমান -সদস্য
রহিমুদ্দিন আহমদ -সদস্য
সাদ আহমদ -সদস্য
জালাল উদ্দিন আহমেদ -সদস্য
আমজাদ হোসেন- সদস্য
সোহরাব হোসেন- সদস্য
অধ্যাপক ইউসুফ আলী- সদস্য
আবদুল মালেক উকিল- সদস্য
নুরুল হক -সদস্য
বাহাউদ্দিন চৌধুরী- সদস্য
শামসুল হক -সদস্য
শেখ আবদুল আজিজ- সদস্য
আফজাল হোসেন- সদস্য
জাকিরুল হক- সদস্য
আবদুস সামাদ- সদস্য
আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ -সদস্য
মোল্লা জালাল উদ্দিন -সদস্য
১৯৬৬ সালের ১৮ মার্চ ‘আমাদের বাঁচার দাবি- ৬ দফা গৃহীত হয়। ২০ মার্চ কাউন্সিল অধিবেশনে ৬ দফা অনুমোদনের পর বিকেলে পল্টন ময়দানে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় শেখ মুজিবুর রহমান সরকারবিরোধী ভাষণ দেন।
১৯৬৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে ৮ মে পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সকল জেলা ও মহকুমায় ভাষণ দেন এবং জনগণ ৬ দফাকে ব্যাপক সমর্থন প্রদান করে। আইয়ুব-মোনায়েম খানের সরকার ভীত হয়ে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে যশোর, ময়মনসিংহ, সিলেটে কয়েকটি মামলা দায়ের করে। সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তিনি জনসভা চালিয়ে যাচ্ছেন। ৬ দফা জনগণের দাবিতে রূপান্তরিত হয়।
গ্রেফতার: ৮ মে ১৯৬৬
১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জে বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। জনসভা শেষে শেখ মুজিব ঢাকায় ধানমণ্ডির বাভবনে পৌছেন। পুলিশ বাসভবন ঘিরে ফেলে। তিনি ৩০ মিনিটের মধ্যে তৈরি হলেন। পুলিশ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি করে রাখে। একই রাতে পুলিশ তাজউদ্দীন আহমদ, চট্টগ্রামের এম এ আজিজ, জহুর আহম্মদ চৌধুরী, পাবনার এম মনসুর আলী, ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া, রাজশাহীর মুজিবুর রহমান প্রমুখ গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে আন্দোলন মিছিল চলছে। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদে রাজবন্দিদের মুক্তির প্রস্তাব করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১৮০
৭ জুন পালন
শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল বন্দির মুক্তি ও ৬ দফার দাবিতে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন পূর্ব পাকিস্তনে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তেজগাঁও এলাকায় শ্রমিক নেতা মনু মিয়া পুলিশের গুলিতে নিহত হন। নারায়ণগঞ্জে শ্রমিক-পুলিশ সংঘর্ষে ৬ জন শ্রমিক নেতা নিহত হন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা মিছিল করে। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান বাঙালিদের ওপর চরম নির্যাতন চালায়। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ৬ দফার দাবি দমন করার জন্য অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেন। আওয়ামী লীগের শত শত নেতাকর্মী গ্রেফতার হয়। ১৯৬৬ সালের ১৫ জুন সরকার দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করে। ১৬ জুন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকা প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়।
তাজউদ্দীন আহমদের গ্রেফতারের পর মিজানুর রহমান চৌধুরী আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৬ সালের ২২ জুন সরকার মিজানুর রহমান চৌধুরীকে তার চাদপুরের বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে। তিনি ছিলেন জাতীয় পরিষদের এমএনএ। পরিষদে বিরোধী দলে তার গ্রেফতারের প্রতিবাদ জানায়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলীর মধ্যে মতবিরোধ দেখা দেয়। ১৯৬৬ সালের ১৮ জুন ভুট্টো মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগ করেন।
পিডিএম গঠন-১৯৬৬
৬ দফা বিরোধী আওয়ামী লীগ ও এনডিএফ ১৯৬৬ সালের ৩০ এপ্রিল আতাউর রহমান খানের বাসভবনে মিলিত হয়ে পিডিএম গঠনের ঘোষণা দেয়। পিডিএমPakistan Democratic Movement ভুক্ত দল ছিল এনডিএফ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ-নেতা নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান, পাকিস্তান নেজামে ইসলাম। সালাম খান ৬ দফা আওয়ামী লীগ থেকে বেরিয়ে আসেন। ১৯৬৬ সালের ২৩ ও ২৪ জুলাই আওয়ামী লীগের ওয়াকিং কমিটির সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগমকে আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
আওয়ামী লীগ বিভক্ত
আওয়ামী লীগ পিডিএমপন্থি ১৪ জন সদস্যকে কার্যনির্বাহী কমিটি হতে বহিষ্কার করে। পিডিএমপন্থি আওয়ামী লীগ ১৯৬৭ সালের ২৩ আগস্ট এডহক কমিটি গঠন করে।
পৃষ্ঠা: ১৮১
৬ দফা বিরোধী আওয়ামী লীগের কমিটি ছিল নিম্নরূপ:
মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশ -সভাপতি
মশিউর রহমান- সহ-সভাপতি
মজিবর রহমান(রাজশাহী)- সাধারণ সম্পাদক
নূরুল ইসলাম চৌধুরী -কোষাধ্যক্ষ
আবদুস সালাম খান- সদস্য
মিয়া আবদুর রশীদ -সদস্য
আবদুর রহমান- সদস্য
মতিউর রহমান- সদস্য
রওশন আলী -সদস্য
রহিম উদ্দিন আহমদ -সদস্য
সাদ আহমদ -সদস্য
আবদুল রউফ- সদস্য
এস ডব্লিউ লকিতুল্লাহ- সদস্য
মমিন উদ্দিন আহমদ- সদস্য
নুরুল হক- সদস্য
আমজাদ আলী- সদস্য
বিএম ইলিয়াস- সদস্য
জুলমত আলী -সদস্য
ছাত্রলীগ সভাপতি ফেরদৌস আহমদ কোরেশী ১৯৬৭ পিডিএমপন্থি হয়ে যায়।
বন্দিশালায়
শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালের ৮ মে হতে ১৯৬৮ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে বন্দি জীবন যাপন করেন।
১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে আটক রাখা হয়।
ছয় দফার গুরুত্ব ও তাৎপর্য
৬ দফা ছিল বাঙালির মুক্তির সনদ। সকল প্রকার বৈষম্য ও শোষণ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ ৬ দফা প্রণয়ন করে। ৬ দফা ছিল স্বাধিকার আন্দোলনের চূড়ান্ত পর্যায়- হয় ৬ দফা মানতে হবে- নয় স্বাধীনতা। ৬ দফায় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক মুক্তি নিহিত ছিল। পাকিস্তানি শাসক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব
পৃষ্ঠা: ১৮২
খান বুঝতে পারে যে, ৬ দফা অর্থ বাঙালিরা বিচ্ছিন্ন হতে চায়। তাই ৬ দফা আন্দোলন কঠোরহস্তে দমন করেন।তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর অসি-শেখ মুজিবুর রহমান, মসি তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াসহ হাজার হাজার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী গ্রেফতার করে। ৬ দফার দাবিকে স্তব্ধ করার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানসহ ৩৫ জন সামরিক-বেসামরিক ব্যাক্তির বিরেদ্ধে ১৯৬৮ সালে আগরতলা মামলা শুরু হয়।
আওয়ামী লীগ-ছাত্রলীগ সকল বাধা উপেক্ষা করে ৬ দফা ও শেখ মুজিবুর মুক্তি দাবি নিয়ে প্রচণ্ড আন্দোলন চালিয়ে যায়। জনগণ ৬ দফা গ্রহণ করেছে। শ্রমিক-জনতা আন্দোলনে নেমে এসেছে। পশ্চিম পাকিস্তান তাসখন্দ চুক্তির পরে জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে আইয়ুববিরোধী আন্দোলন শুরু হবে। ন্যাপের মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঢাকায় আইয়ুববিরোধী আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৬৯ সালের জানুয়ারি মাসে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠন করা হয়। ছাত্রদের ১১ দফা ও আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন গণঅভ্যুত্থানে পরিণত হয়। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। জেনারেল ইয়াহিয়া খান প্রেসিডেন্ট নিযুক্ত হন। ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিজয় হয়। কিন্তু জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। কারণ তিনি ৬ দফা মেনে নিবেন না। তার নির্দেশে পাকবাহিনী ২৫ মার্চ বাঙালিদের ওপর আক্রমণ ও গণহত্যা শুরু করে। ৬ দফা প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। এবার ৬ দফা নয়, এক দফা- বাংলাদেশের স্বাধীনতা। ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।
গ. আগরতলা মামলা
আগরতলা মামলা বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। বাঙালি সেনাবাহিনী সশস্ত্র যুদ্ধ করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন করার পরিকল্পনা করে। তারা শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সশস্ত্র যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গণতন্ত্রে বিশ্বাসী ছিলেন। তার দাবি ছিল পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা। কিন্তু পাকিস্তান সামরিক সরকার পূর্ব বাংলায় শোষণ ও নির্যাতন চালায়। সাধারণ মানুষের ভোটের অধিকার ছিল না। মাত্র ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর ভোটের অধিকার ছিল। তারা আইনসভার
পৃষ্ঠা: ১৮৩
সদস্য ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করত। ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি সামরিক সরকার আওয়ামী লীগ সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করে করাচিতে ৬ মাস কারাবন্দি করে রাখে। শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক পরিবর্তন আসে। তিনি নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর ন্যায় যুদ্ধ করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জন করতে চান। এ জন্য তার ভারতের সাহায্য ও সহযোগিতা প্রয়োজন। ১৯৬৩ সালে তিনি গোপনে ত্রিপুরা রাজ্যের রাজধানী গমন করেন এবং ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী শ্রী শচীন্দ্র লাল সিংহের সাথে সাক্ষাৎ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন ভারতে অবস্থান করে পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার প্রচার চালাবেন। ত্রিপুরার মুখ্যমন্ত্রী ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহর লাল নেহেরুর সাথে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা করেন। চীনের সঙ্গে যুদ্ধের পর ভারত বিপর্যস্ত। তাই নেহরু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রস্তাবে রাজি হন তাকে দেশে ফিরে যেতে বলেন। আগরতলায় ১৪ দিন অবস্থান করে তিনি ঢাকা ফিরে আসেন।
বিএলএফ গঠন
লেফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে ১৯৬২ সালে গোপনে বাংলাদেশে লিবারেশন ফ্রন্ট গঠিত হয়। বিএলএফ পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রেসিডেন্ট চট্টগ্রামের চন্দ্রঘোনা পেপার মিল পরিদর্শন করবেন। তার বিমান ধ্বংস করে দেওয়ার ষড়যন্ত্র জানতে পেরে চন্দ্রঘোনার সফরসূচি বাতিল করা হয়। পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ প্রেসিডেন্টকে হত্যার দ্বিতীয় পরিকল্পনা উদঘাটন করল। আইয়ুব খান চাঁদপুর আইডব্লিউটিএ উদ্বোধন করবেন। এ সময় লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের নেতৃত্বে বিএলএফও আইয়ুব খানকে হত্যা করবে। আইয়ুব খান চাঁদপুর সফর পরিত্যাগ করেন।
বাঙালি সেনাবাহিনীর গোপন তৎপরতা চলতে থাকে। তাদের পরিকল্পনায় ছিল ভারতের সহায়তায় বিমান ও জলপথ বন্ধ করে দেওয়া। তাহলে বিএলএফএ পূর্ব পাকিস্তানে অবস্থানরত আর্মিকে পরাজিত করে জয়লাভ করতে পারবে। এ উদ্দেশে শেখ মুজিবুর রহমান কমিউনিস্ট পার্টির নেতা বিপ্লবী ত্রৈলক্ষ্য চক্রবর্তীকে ভারতে প্রেরণ করেন। তিনি কলকাতায় অবস্থানকালে মৃত্যুবরণ করেন। এদিকে বাঙালি সেনাদের গোপন তৎপরতা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। জড়িত সৈন্যদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল তারা আগরতলায় ভারতের প্রতিনিধিদের সাথে আলোচনা করে পরিকল্পনা গ্রহণ করে যে, তারা পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করবে। পাকিস্তান
পৃষ্ঠা: ১৮৪
গোয়েন্দা দফতর এ তথ্য জানতে পেরে ১৯৬৭ সালের ডিসেম্বর মাস হতে জড়িত ব্যক্তিদের গ্রেফতার শুরু করে। ২ জন সিএসপিসহ ২৮ জনকে আটক করে। ১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি পাকিস্তান স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে প্রেসনোট প্রকাশিত হয়। গ্রেফতারকৃতদের নির্মমভাবে শারীরিক নির্যাতন করা হয়। নির্যাতনের কারনে কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেনের দাঁত পরে যায়।১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আরও একটি প্রেসনোটে শেখ মুজিবুর রহমানকে এক নম্বর আসামি করে ৩৫ জন আসামির নাম প্রকাশিত হয়।
আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত ৩৫ জন আসামির নাম
১. শেখ মুজিবুর রহমান-টুঙ্গিপাড়া,থানা গোপালগঞ্জ, জেলা-ফরিদপুর। ৬৭৬ ধানমণ্ডি আবাসিক এলাকা, রোড নং-৩২, ঢাকা।
২. ল্যাফটেন্যান্ট কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন-গ্রাম-ডুমুরতলা, থানাপিরোজপুর, জেলা-বরিশাল।
৩. স্টুয়ার্ট মুজিবুর রহমান, গ্রাম-ঘাটিমাঝি, থানা-মাদারীপুর, জেলা-ফরিদপুর।
৪. এলএস সুলতানউদ্দিন আহমদ, গ্রাম-উত্তর খামার, থানা-কাপাসিয়া, জেলা ঢাকা।
৫. এলএস সিডি নূর মোহাম্মদ, গ্রাম-কুমারবাউ, থানা-লৌহজং, জেলা-ঢাকা।
৬. আহম্মদ ফজলুর রহমান সিএসপি, গ্রাম-কচিসার, থানা-দেবীদ্বার, জেলা কুমিল্লা।
৭. সার্জেন্ট মাহফুজুল্লাহ, গ্রাম-মুরাদপুর, থানা-বেগমগঞ্জ, জেলা-নোয়াখালী।
৮. করপোরাল আবুল বাশার মোহাম্মদ আবদুস সামাদ, গ্রাম-মিঠাখালি, থানা মঠবাড়িয়া, জেলা-বরিশাল।
৯. হাবিলদার দলিল উদ্দিন, গ্রাম-শ্যামপুর, থানা-বাকেরগঞ্জ, জেলা-বরিশাল।
১০. রুহুল কুদ্স সিএসপি, গ্রাম-পচারাখি, থানা-সাতক্ষীরা, জেলা-খুলনা।
১১. সার্জেন্ট মোহাম্মদ ফজলুল হক, গ্রাম-সায়েস্তাবাদ, থানা-কোতোয়ালি, জেলা -বরিশাল।
১২. ভূপতি ভূষণ চৌধুরী ওরফে মানিক চৌধুরী, গ্রাম-হাবিলাশ দ্বীপ, থানা-পটিয়া, জেলা-চট্টগ্রাম।
১৩. বিধান কৃষ্ণ সেন, গ্রাম-সারুয়াতলা, থানা-বোয়ালখালী, জেলা-চট্টগ্রাম।
১৪. সুবেদার আবদুর রাজ্জাক-গ্রাম-দক্ষিণ বরষারচর, থানা-মতলব, জেলা-কুমিল্লা।
১৫. হাবিলদার ক্লার্ক মজিবর রহমান, গ্রাম-গোপালপুর, থানা-নবীনগর, জেলা-কুমিল্লা।
১৬. ফ্লাইট সার্জেন্ট মোহাম্মদ আবদুর রাজ্জাক, গ্রাম-বলরামপুর, থানা-দাউদকান্দি, জেলা-কুমিল্লা।
১৭. সার্জেন্ট জহুরুল হক, গ্রাম-সোনাপুর, থানা-সুধারাম, জেলা-নোয়াখালী
১৮. এজি মোহাম্মদ খুরশীদ, সাবের কটেজ, থানা-কোতোয়ালি, ফরিদপুর।
১৯. এম সামসুর রহমান সিএসপি, গ্রাম-লালুবাড়ি, থানা-মানিকগঞ্জ, জেলা- ঢাকা।
২০. রিসালদার এ কে এম শামসুল হক, এসি, গ্রাম-পোতাল, থানা-মানিকগঞ্জ,জেলা-ঢাকা।
২১. হাবিলদার আজিজুল হক, গ্রাম-কচিয়া, থানা-দৌলতখা, জেলা-বরিশাল
২২. এসসি মাহফুজুল বারী, গ্রাম-চর লক্ষ্মী, থানা-ফেনী, জেলা-নোয়াখালী।
২৩. সার্জেন্ট শামসুল হক, গ্রাম-নেয়াজপুর, থানা-ফেনী, জেলা-নোয়াখালী।
২৪. মেজর শামসুল আলম, গ্রাম-খাজে দেওয়ান রোড, জেলা-ঢাকা।
২৫. ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ আবদুল মোতালিব, গ্রাম-দরুদবারিতি, থানা-পূর্বধলা, জেলা-ময়মনসিংহ।
২৬. ক্যাপ্টেন এম শওকত আলী, গ্রাম-চাকদা, থানা-নড়িয়া, জেলা-ফরিদপুর।
২৭. ক্যাপ্টেন খন্দকার নাজমুল হুদা-গ্রাম-পশ্চিম বগুড়া রোড, জেলা-বরিশাল।
২৮. ক্যাপ্টেন এ কে নুরুজ্জামান, গ্রাম-সাহিদাবাদ, থানা-রায়পুর, জেলা-ঢাকা।
২৯. সার্জেন্ট আবদুল জলিল, গ্রাম-সারিয়াবাদ, থানা-নারায়ণপুর, জেলা-ঢাকা।
৩০. মোহাম্মদ মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী-গ্রাম-পাইয়াম, জেলা-সিলেট।
৩১. ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট এম এস এস রহমান, গ্রাম-মাকরাইল, থানা-লোহাগড়া, জেলা-যশোর।
৩২. সুবেদার এ কে এম তাজুল ইসলাম, গ্রাম-শ্রীপুর, থানা-ভাণ্ডারিয়া, জেলা – বরিশাল।
৩৩. মোহাম্মদ আলী রেজা, গ্রাম-লাহিড়ী, থানা-কোতোয়ালি, জেলা-কুষ্টিয়া।
৩৪. ক্যাপ্টেন খুরশিদ উদ্দিন আহমদ, গ্রাম-বাশিয়া, থানা-গফরগাঁও, জেলা-ময়মনসিংহ।
৩৫. ফার্স্ট লেফটেন্যান্ট আবদুর রউফ, পাকিস্তান হাউজ, থানা-ভৈরব, জেলা-ময়মনসিংহ।
উপরোক্ত অভিযুক্ত আসামিদের প্রথম দেশরক্ষা আইনে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাদের ১৯৬৮ সালের ১৮ জানুয়ারি আর্মি, নেভি, এয়ারফোর্স আইনে পুনরায় গ্রেফতার করে কুর্মিটোলা সেনানিবাসে স্থানান্তর করা হয়। শেখ মুজিবুর
পৃষ্ঠা: ১৮৬
রহমানকে একই দিনে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে আর্মি আইনে বন্দি করে কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে স্থানান্তর করা হয়।
আগরতলা মামলায় আরও ১১ জন আসামি রাজসাক্ষী হওয়ায় তাদের ক্ষমা করা হয়। তারা হলেন লে. মোজাম্মেল হোসেন, করপোরাল আমির হোসেন, সার্জেন্ট শামসুদ্দিন আহমদ, ডা. আবদুর রহমান, মির্জা রমিজ, ক্যাপ্টেন আবদুল আলম ভূঁইয়া, করপোরাল কামালউদ্দিন, করপোরাল সিরাজুল ইসলাম, মোঃ গোলাম, মোহাম্মদ ইউসুফ, সার্জেন্ট আবদুল হালিম।
শেখ মুজিবুর রহমানকে আগরতলা মামলায় অভিযুক্ত করায় আওয়ামী লীগ ও ছাত্র সমাজ
মামলার শুনানি
প্রেসিডেন্ট ১৯৬৮ সালের ২১ এপ্রিল ফৌজদারি আইন সংশোধন করে আগরতলা মামলা বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। ১৯৬৮ সালের ২০ জন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার শুনানি শুরু হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান কৌসুলি ছিলেন এডভোকেট আবদুস সালাম খান। সরকার পক্ষের প্রধান কৌসুলি ছিলেন পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী লাহোর হাইকোর্টের বিখ্যাত আইনজীবী মঞ্জুর কাদের। কুর্মিটোলার একটি কক্ষে বিচারকাজ শুরু হয়। মামলার বিচারের প্রধান বিচারক ছিলেন বিচারপতি এস এম রহমান। তার পাশেই বসতেন বিচারপতি এম আর খান এবং মাকসুমুল হাকিম। ১৯৬৮ সালের ২০ জুন হতে ১৩ ডিসেম্বর পর্যন্ত ২০৬ জনের সাক্ষ্যগ্রহণ করা হয়। ১৯৬৯ সালের ২ জানুয়ারি সওয়াল জবাব শুরু হবে। সাংবাদিকরা প্রত্যেক সাক্ষীর জেরা পত্রিকায় প্রকাশ করে সরকারের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করে। ইংল্যান্ডের রানীর কৌসুলি টমাস উইলিয়াম ২৯ জুলাই শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে দেখা করেন। ১৯৬৮ সালের ১৭ নভেম্বর শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে ড, ওয়াজেদ মিয়ার সাথে বিয়ে দেওয়া হয়। শেখ মুজিব তাদের বিয়েতে প্যারোলে উপস্থিত থাকতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাকে অনুমতি দেওয়া হয়নি।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার পাকিস্তান সরকারের আনীত অভিযোগ ছিল-
ভারতীয় অস্ত্রশস্ত্র ও অর্থের সাহায্যে সশস্ত্র বিদ্রোহ ঘটিয়ে পাকিস্তান থেকে একটি অংশ বিচ্ছিন্ন করে সেই অংশে ভারতীয় স্বীকৃত একটি স্বাধীন সরকার গঠন করার এক ষড়যন্ত্রের আভাস গোপন সূত্রে জানা যায়। এই গোপন সূত্র ধরে ১৯৬৭
পৃষ্ঠা: ১৮৭
সালের ডিসেম্বরে পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনে কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়।
সশস্ত্র সংগ্রামের প্রধান পরিকল্পনা ছিল সামরিক ইউনিটগুলোর অস্ত্রাগারগুলো দখল করে সেগুলো পঙ্গু করে দেওয়া। গেরিলা কায়দায় অতর্কিত অভিযান পরিচালনা করা হবে। এ উদ্দেশে সামরিক, প্রাকতন ও বেসামরিক কর্মচারীদের নিয়ে সশস্ত্র দল গঠন হবে।
ভারতের নিকট থেকে অর্থ ও অস্ত্র সাহায্য নিয়ে প্রধান এলাকা চিহ্নিত করে সংগ্রাম দিবসের জন্য অপেক্ষা করা। এ কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য ভারতের আগরতলায় ১৯৬৭ সালের ২৭ জুলাই উভয় দলের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ১৯৬৪ হতে বিদ্রোহের প্রধান নেতা লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেমসহ অন্যান্য আসামিদের সাথে সভা করেছেন এবং ষড়যন্ত্রের নেতৃত্বে দেন।
শেখ মুজিবুর রহমান আদালতে তার বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ অস্বীকার করে এক লিখিত বিবরণ পাঠ করেন।
১৯৬৮ সালের ১৯ অক্টোবর আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। দৈনিক ইত্তেফাকের সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সম্মেলনে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করে গণআন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভায় আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকল আসামির মুক্তি দাবি করা হয়।
১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনের ফলে সরকার ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করে এবং সকল আসামিকে মুক্তি দেয়। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ভিত্তি স্থাপন করে।
সহায়ক গ্রন্থ
হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ, দ্বিতীয় খণ্ড
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
পৃষ্ঠা: ১৮৮
সপ্তম অধ্যায়
১৯৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান ও ১১ দফা আন্দোলন
ক. পটভূমি
১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও তার দল কনভেনশন মুসলিম লীগ উন্নয়ন দশক পালন করে। পূর্ব বাংলার জনগণ তার উন্নয়ন দশক প্রত্যাখ্যন করে। তথাকথিত উন্নয়ন দশক ছিল মূলত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দশক।
শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মিথ্যা আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলছে। প্রত্যেকদিন সরকারি বিবরণ শুনে জনগণ আইয়ুব-মোনায়েম সরকারের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
ছয় দফা দাবি ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারের দাবির প্রেক্ষিতে শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা দ্রুত বৃদ্ধি পায়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে চলে আসে। ১৯৬৮ সালের ৩ নভেম্বর পল্টন ময়দানে এক জনসভায় তিনি আইয়ুব খানকে এই মুহূর্তে পদত্যাগ করতে বলেন। ১৮ নভেম্বর ঢাকার আইনজীবীরা বিক্ষোভ মিছিল করে এবং ছাত্র সমাজ প্রদেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালন করে।
পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলন
জুলফিকার আলী ভুট্টোর পিপলস পার্টি ও অন্যান্য বিরোধী দলের নেতৃত্বে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড আন্দোলন শুরু হয়। রাওয়ালপিন্ডিতে পুলিশ ছাত্রদের ওপর গুলিবর্ষণ করে আবদুল হামিদকে হত্যা করে। আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালের ১৩ নভেম্বর পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান সুশাফকার আলী ভুট্টোকে গ্রেফতার করে। ভুট্টোর গ্রেফতারের প্রতিবাদে পশ্চিম পাকিস্তানে আন্দোলনের ঝড় বয়ে যায়। ৮ ডিসেম্বর পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়।
পৃষ্ঠা: ১৮৯
পিডিএম (Pakistan Democratic Movement)
১৯৬৯ সালের ১ জানুয়ারি ঢাকায় পিডিএম গঠিত হয়। পিডিএমভুক্ত দলগুলে হলো- এনডিএম, ৬-দফা বিরোধী আওয়ামী লীগ, কাউন্সিল মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলাম প্রভৃতি ৫টি দল পিডিএম গঠন করে। ন্যূনতম কর্মসূচির ৫ দল আন্দোলনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। পিডিএম আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন অব্যাহত রাখে। ১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি আইয়ুববিরোধী আন্দোলন পরিচালনার জন্য ৫ দফা ঘোষণা করে। দফাগুলো হলো-
১. সর্বজনীন ভোটের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচন;
২. সরাসরি নির্বাচিত পার্লামেন্ট ও প্রাদেশিক আইনসভাকে পূর্ণ ক্ষমতা প্রদান;
৩. অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার;
৪. অবিলম্বে মৌলিক অধিকার এবং স্বাধীনতা পুনর্বাসন;
৫. অবিলম্বে সকল রাজবন্দির মুক্তি ও তাদের বিরুদ্ধে আনীত সকল মামলা প্রত্যাহার।
পিডিএম-এর নেতা ছিলেন-
নূরুল আমিন, এনডিএফ
আতাউর রহমান খান, এনডিএম
মাহমুদ আলী, এনডিএফ
আবদুস সালাম খান, এনডিএফ
ডাক (Democratic Action Committee-DAC)
১৯৬৯ সালের ৮ জানুয়ারি ঢাকায় ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিতে শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনে অনুষ্ঠিত সভায় পাকিস্তানের সকল বিরোধী দল একনায়কতন্ত্র উৎখাত ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য সম্মিলিত সংগ্রাম কমিটি- ‘ডাক’ গঠন করে।
ডাক ৮ দফার ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন শুরু করে।
১. ফেডারেল পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার।
২. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটাধিকার ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন।
৩. অবিলম্বে জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার।
৪. নাগরিক অধিকার পুনরুদ্ধার, সকল কালো আইন বিশেষ করে বিনা বিচারে আটক ও বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স বাতিল।
৫. শেখ মুজিবুর রহমান, খান আবদুল ওয়ালি খান, জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তি এবং ট্রাইব্যুনালে বিচারাধীন সকল মামলা প্রত্যাহার।
৬. ১৪৪ ধারা মতে জারিকৃত সকল নির্দেশ প্রত্যাহার।
৭. শ্রমিকদের ধর্মঘট করার অধিকার বহাল।
পৃষ্ঠা: ১৯০
৮. সংবাদপত্রের ওপর বিধি নিষেধ প্রত্যাহার। দৈনিক ইত্তেফাক ও উর্দু পত্রিকা চাস্তাসহ যে সকল পত্রিকা ডিক্লারেশন বাতিল করা হয়েছে তা প্রত্যাহার।
ডাকের ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর করেন-
১. আমির হোসেন -ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ন্যাপ
২. চৌধুরী মোহাম্মদ আলী – সভাপতি নেজামে ইসলাম
৩. মুফতি মাহমুদ-সেক্রেটারিতে জেনারেল, জামায়াতে ওলামে-ই-ইসলাম
৪. মমতাজ মোহাম্মদ দৌলতানা- সভাপতি পাকিসান মুসলিম লীগ
৫. নবাব্জাদা নাসরুল্লাহ খান-সভাপতি পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
৬. নুরুল আমীন-সভাপতি এনডিএফ
৭. সৈয়দ নজরুল ইসলাম-ভারপ্রাপ্ত সভাপতি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
৮. তোফায়েল মিয়া-ভারপ্রাপ্ত আমির পাকিস্তান জামায়াতে ইসলাম
এ ঘোষণার সাথে দেশের সর্বত্র ডাকের কর্মসূচি পালিত হয়।
খ. আন্দোলনের কর্মসূচি, গুরুত্ব ও পরিণতি
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-১১ দফা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ও হল নির্বাচনে ছাত্রলীগ একক বিজয় লাভ করে। ১৯৬৯ সালের ৫ জানুয়ারি ১১ দফার ভিত্তিতে কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্যগণ
তোফায়েল আহমদ- ভিপি, ডাকসু, আহ্বায়ক
আবদুর রউফ- সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
সাইফুদ্দিন আহমেদ -সভাপতি, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন মস্কোপন্থি
জামাল হায়দার- সভাপতি, ছাত্র ইউনিয়ন, পিকিংপন্থি
খালেদ মোহাম্মদ আলী -সাধারণ সম্পাদক, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ
মাহবুব উল্ল্যাহ- সাধারণ সম্পাদক, ছাত্র ইউনিয়ন
মাহবুবুল হক দুলন -সভাপতি, এনএসএফ
নাজিম কামরান- সাধারণ সম্পাদক, ডাকসু
ভিপি তোফায়েল আহমদ ছিলেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক
ছাত্রদের এগারো দফা কর্মসূচি
১৯৬৯ সালের ১৪ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ সাধারণ দুটো সভায়
পৃষ্ঠা: ১৯১
আনুষ্ঠানিকভাবে এগারো দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে।
১১ দফা হলো-
১. সকল কলেজসমূহ প্রাদেশিককরণের নীতি পরিত্যাগ করতে হবে। জগন্নাথ কলেজসহ প্রাদেশিককরণ হতে কলেজসমূহ পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হবে। ছাত্রদের বেতন ৫০% হ্রাসকরণ, হোস্টেলে আবাসিক সাবসিডি প্রদান। ছাত্রদের ট্রেন ভাড়া ৫০% হ্রাস। নারী শিক্ষার ব্যাপক প্রসার। অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত শিক্ষা অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করা। মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন। হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল।
২. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, বাক স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা।
৩. পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রতিষ্ঠা।
৪. পশ্চিম পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন দিয়ে সাব ফেডারেশন গঠন।
৫, ব্যাংক, বীমা, বৃহৎশিল্প কারখানা জাতীয়করণ করা।
৬. কৃষকদের খাজনা ও ঋণ মওকুফ।
৭. শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি ও বোনাস প্রদান; ট্রেড ইউনিয়নের অধিকার প্রদান।
৮. পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও জল সম্পদের সঠিক ব্যবহার।
৯. জরুরি আইন প্রত্যাহার, জননিরাপত্তা আইনসহ অন্যান্য নির্যাতনমূলক আইন প্রত্যাহার।
১০. সিয়াটো, সেন্টো পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করে স্বাধীন নিরপেক্ষ পররাষ্ট্র নীতি কায়েম করতে হবে।
১১. আগরতলা মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজনীতিবিদকে মুক্তি ও মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।
আসাদের মৃত্যু- ২০ জানুয়ারি ১৯৬৯
১৯৬৯ সালের ২০ জানুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ঢাকার সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্ররা সমবেত হয়। সভা শেষে তারা মিছিল করে রাস্তা প্রদক্ষিণ করে। পুলিশ, ইপিআর লাঠিচার্জ ও টিয়ার গ্যাস নিক্ষেপ করে। মিছিল চানখারপুলের নিকট পৌছলে পুলিশ ১টা ৫৫ মিনিটে ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজের ছাত্র, ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এএম আসাদুজ্জামানকে(২৫) গুলি করে হত্যা করে। আসাদুজ্জামানের হত্যার প্রতিবাদে ২২, ২৩, ২৪ জানুয়ারি শোক পালিত হয়। আসাদের মৃত্যু গণআন্দোলনের রূপ নেয়। ১৯৬৯ সালের ২৪
পৃষ্ঠা: ১৯২
জানুয়ারি হরতাল চলাকালে পুলিশ মিছিলে গুলি করে ঢাকার নবকুমার ইন্সটিটিউশনের নবম শ্রেণীর ছাত্র কিশোর মতিউর রহমান মল্লিককে হত্যা করে। পুলিশের গুলিতে আরও কযেকজন নিহত হয়। নিহত মকবুল ও রুস্তমের লাশ ছিনিয়ে ছাত্ররা ইকবাল হলে সমবেত হয়। ঢাকার উন্মত্ত জনতা সরকারের প্রেস ট্রাস্টের পত্রিকা দৈনিক পাকিস্তান ও মর্নিং নিউজ পত্রিকায় অগ্নিসংযোগ করে।
ট্রেন,বিমান যাতায়াত বন্ধ হয়ে যায়। সরকার গণঅভ্যুত্থান বন্ধ করার জন্য রাত ৮ টায় ২৪ ঘন্টার জন্য কার্ফু জারি করে। সেনাবাহিনী ছাত্র-জনতার ওপর গুলি বর্ষন করে। ২৫ জানয়ারি কার্ফু ভঙ্গ করে ছাত্ররা জঙ্গী মিছিল বের করে। সেনাবাহিনীর গুলিতে অনেকে নিহত হয়। তেজগাঁও এলাকায় শিশুকে দুগ্ধপানরত অবস্থায় জৈনিক আনোয়ারা গুলিতে নিহত হন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৬ জানুয়ারি হতে ৩ দিনের শোক দিবস পালন করে।
পশ্চিম পাকিস্তানে গণআন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলেন। ডাক ও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতৃত্বে আন্দোলন চরমে পৌছে। প্রশাসন ভেঙে পড়ে। প্রশাসন নিয়ন্ত্রণ করছে ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ-ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদ তখন একচ্ছত্র নেতা। ১৯৬৯ সালের ১ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঘোষণা দিলেন তিনি আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। ৬ ফেব্রুয়ারি তিনি ঢাকায় আসেন। ১৭ ফেব্রুয়ারি আলোচনায় যোগদানের জন্য নেতাদের আহ্বান জানান।
১৯৬৯ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কালোব্যাজ ধারণ ও কালো পতাকা উত্তোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। পরিস্থিতি অনুকূলে আনার জন্য সরকার ৮ ফেব্রুয়ারি দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার ছাপাখানা বাজেয়াপ্ত আদেশ প্রত্যাহার করে। ইত্তেফাক নিয়মিত প্রকাশিত হতে থাকে। ৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় সর্ববৃহত্তম মিছিল বের হয়। সরকারের দমননীতির প্রতিবাদে ভাসানী ন্যাপের জাতীয় পরিষদ সদস্য পাঞ্জাবের আরিফ ইফতেখার এবং পূর্ব পাকিস্তানের মশিউর রহমান পদত্যাগ করেন। আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দিতে হবে। তা না হলে আওয়ামী লীগ ১৭ ফেব্রুয়ারি গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেবে না।
১৯৬৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি ডেমোক্রেটিক অ্যাকশন কমিটিকে অনুরোধ জানায় যে, আগরতলা মামলা প্রত্যাহার করার পর তারা যেন প্রেসিডেন্টের সাথে আলোচনায় বসে। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের এমএনএ এএইচএম কামরুজ্জামান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী, এ বি এম নুরুল ইসলাম জাতীয় পরিষদ হতে পদত্যাগ করেন।
পৃষ্ঠা: ১৯৩
আলোচনার ক্ষেত্র অনুকূলে আনার জন্য সরকার নেতাকে মিক্তি দিতে শুরু করে। ১২ ফেব্রুয়ারি সরকার পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ, নারায়ণগঞ্জের আলী আহমদ, ন্যাপের সিরাজুল ইসলাম খান প্রমুখকে মুক্তি দেয়। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি জরুরি অবস্থা প্রত্যাহার করা হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান জুলফিকার আলীর ভুট্টোকে ১৪ ফেব্রুয়ারি মুক্তি দেয়।
১৪ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও ডাক ১১ দফা ও ৮ জন্য বাস্তবায়নের জন্য দেশব্যাপী হরতাল আহ্বান করে। এদিন পল্টন ময়দানে নরুল আমিনের সভাপতিত্বে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
কুর্মিটোলা সেনানিবাসে শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা ছিল না। তাই তিনি কক্ষের সামনে দুটো জানালা বন্ধ রাখেন।
সার্জেন্ট জহুরুল হকের মৃত্যু- ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
আগরতলা মামলার বিচার চলাকালে পাকিস্তান সেনারা শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যার পরিকল্পনা করে। শেখ মুজিবুর রহমান অফিসার্স মেসে ১৩ জনের সাথে থাকতেন। ১৪ ফেব্রুয়ারি তার পায়চারি করার সময় এক পাঠান ক্যাপ্টেন তাকে কক্ষে যেতে বলেন। তিনি কক্ষে চলে যান। কিন্তু ১৫ ফেব্রুয়ারি বর্বর হত্যাকাণ্ড চলে।
১৯৬৯ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সকালে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট মহম্মদ ফজলুল হক টয়লেটে যাচ্ছিলেন। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হাবিলদার মঞ্জুর হোসেন ঠাণ্ডা মাথায় জহুরুল হক ও ফজলুল হককে হত্যার উদ্দেশে গুলি করে। তাদের মৃত্যু নিশ্চিত করার জন্য হাবিলদার তাদের ওপর বেয়নেট চার্জ করে। এ সময় অন্য সেনারা হাবিলদার মঞ্জুরকে নিয়ে যায়। গুলির একপর্যায়ে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হককে সিএমএইচ নিয়ে যায়। তখন উভয়ের জ্ঞান ফিরে আসে। কর্তব্যরত ডাক্তার ছিলেন ডা. এম এম আলী। গুলিবিদ্ধ দুজনে প্রচণ্ডভাবে দেশপ্রেমিক ও মানবতাবাদী ছিলেন। জহুরুল হক বলেন, তিনি ভালো আছেন। আগে ফজলুল হকের অপারেশন করা হোক। ফজলুল হক বললেন তিনি ভালো আছেন। আগে জহুরুলকে অপারেশন করা হোক। ডাক্তার দেখলেন জহুরুল হকের অবস্থা ভালো নয়। তিনি ফজলুল হকের চিকিৎসার শুরু করেন। নার্স ছিলেন খাওলা বেগম। তার আন্তরিক সেবায় এক মাস চিকিৎসার পর ফজলুল হক ভালো হয়ে যান। জহরুল হক অপারেশন টেবিলে
পৃষ্ঠা: ১৯৪
মৃত্যুবরণ করেন। যদি একসাথে দু’জনকে অপারেশন কর হত, তবে হয়তো সার্জেন্ট জহুরুল হকও বেঁচে যেতেন। কিন্তু কর্তৃপক্ষের অবহেলার কারণে দু’জনকে এক সাথে অপারেশনের ব্যাবস্থা হয়নি। ১৬ ফেব্রুয়ারি ২-৩০ মিনিটে পল্টন ময়দানে জহুরুল হকের জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। ৩-৩০ মিনিটে তাকে আজিমপুরে দাফন করা হয়। দাফনের পর মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে বিশাল শোক মিছিল হয়। জনতা বিক্ষুব্ধ হয়ে বাংলা একাডেমির নিকট গেস্ট হাউজ, কনভেনশন মুসলিম লীগ অফিস, মন্ত্রী খাজা সাহাবুদ্দিন, প্রাদেশিক মন্ত্রী সুলতানের বাসভবনে অগ্নিসংযোগ করা হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি সারাদেশে হরতাল পালিত হয়।
ড. জোহার মৃত্যু- ১৮ ফেব্রুয়ারি
১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল করে। তাদের সাথে সেনাবাহিনীর সংঘর্ষ হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. শামসুজ্জোহা শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের গেটে এসে ছাত্রদের ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন। এ সময় সেনাবাহিনী ড. জোহাকে লক্ষ্য করে গুলি করে। তিনি রাজশাহী মেডিকেল কলেজে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুকে কেন্দ্র করে সমগ্র পাকিস্তানে গণআন্দোলন সৃষ্টি হয়। প্রকৃতপক্ষে সার্জেন্ট জহুরুল হক ও ড. জোহাকে হত্যার পর গণঅভ্যুত্থান চূড়ান্ত বিজয়ে পৌছে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় কার্ফু ভঙ্গ করে ছাত্র-জনতা সেনাবাহিনী, ইপিআর ও পুলিশের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয় এবং গুলিতে ২০৯ জন নিহত হয়। ঢাকার বাইরে কুষ্টিয়ায় ৩, নোয়াখালীতে ৪, বরিশালে ১ জন নিহত হয়। পশ্চিম পাকিস্তানে ড. জোহার হত্যার প্রতিবাদে গণঅভুত্থান হয় এবং অনেকে নিহত হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি গুলিতে ঢাকায় ৮ জন, পাবনায় ২ জন নিহত হয়। শহীদদের রক্ত বৃথা যায় না।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার, শেখ মুজিবুর রহমান মুক্ত- ২২ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান দেখলেন কোনো রাজনৈতিক সমাধান হচ্ছে না। তাই তিনি ২১ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় বেতার ভাষণে ঘোষণা করেন, “I have decided to announce today that I shall not be a candidate in the next election. The decision is final and irrevocable.” আমি আজ ঘোষণা করছি যে, আমি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছি যে, আমি আগামী নির্বাচনে প্রার্থী হবো না। এ সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত এবং অপ্রত্যাহারযোগ্য। তিনি আরও ঘোষণা করলেন যে, আগরতলা মামলা তুলে।
পৃষ্ঠা: ১৯৫
নেওয়া হবে। ১৯৬৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি দুপুরে আগরতলা মামলার আসামি শেখ মুজিবুর রহমানসহ সকলে মুক্তি লাভ করেন। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ মুক্তি লাভ করেন। শেখ মুজিবুর রহমান মুক্তি পেয়ে তার ধানমন্ডি বাসভবনে গমন করেন। সমগ্র পাকিস্তানে বিজয় মিছিল চলছে। গণঅভ্যুথানের ফলে আগরতলা মামলা তুলে নেয়। অভিযুক্তরা মুক্তি পায়। বাংলার জনগণের বিজয় সূচিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমান একদিন বিকেলে মওলানা ভাসানীর সাথে দেখা করেন।
২২ ফেব্রুয়ারি বিকেলে পল্টন ময়দানে আগরতলা মামলা থেকে সদ্য মুক্ত আসামিদের জাতীয় বীরের সংবর্ধনা দেওয়া হয়।
‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি প্রদান- ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯
১৯৬৯ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ শেখ মুজিবুর রহমানকে রমনা রেসকোর্স ময়দানে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়। সভায় দশ লক্ষ লোক উপস্থিত হন। সভায় সভাপতিত্ব করেন ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সভাপতি ডাকসুর ভিপি তোফায়েল আহমদ। তোফায়েল আহমদ বাঙালি জাতির পক্ষে আওয়ামী লীগ সভাপতি বাঙালি জাতির ত্রাণকর্তা শেখ মুজিবুর রহমানকে বঙ্গবন্ধ উপাধিতে ভূষিত করেন। তিনি শুধু বাংলার নয় বাঙালি জাতির বন্ধু। ইতোপর্বে চিত্তরঞ্জন রায়কে দেশবন্ধু, একে ফজলুল হককে শেরে বাংলা এবং সুভাষ চন্দ্র বসুকে নেতাজি উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। শেখ মুজিব জনসভায় ছয় দফা ও ছাত্রদের ১১ দফা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করেন।
বঙ্গবন্ধু একজন মুক্ত মানুষ হিসেবে লাহোরে গোলটেবিল বৈঠকে যোগ দেন।
রাওয়ালপিন্ডি গোলটেবিল বৈঠক
শেখ মুজিবুর রহমানকে প্যারোলে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের আহ্বান করা হয়েছিল। তিনি তা প্রত্যাখ্যান করে একজন মুক্ত প্রতিনিধি হিসেবে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান বাধ্য হলেন তাকে মুক্তি দিয়ে গোলটেবিল বৈঠকে তার সাথে আলোচনায় বসতে।
১৯৬৯ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি রাওয়ালপিন্ডিতে আইয়ুব খান গোলটেবিল বৈঠক আহ্বান করেন। বৈঠকে নিম্নলিখিত দলের নেতৃবৃন্দ যোগদান করেন।
শেখ মুজিবুর রহমান- পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬ দফা
সৈয়দ নজরুল ইসলাম- পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
মমতাজ মোহাম্মদ দৌলাতানা -পাকিস্তান মুসলিম লীগ
খাজা খয়ের উদ্দিন -পাকিস্তান মুসলিম লীগ
পৃষ্ঠা: ১৯৬
নুরুল আমিন- এনডিএফ
হামিদুল হক চৌধুরী -এনডিএফ
নবাবজাদা নসরুল্লাহ খান -পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৮ দফা
আবদুস সালাম খান- পাকিস্তান আওয়ামী লীগ
চৌধুরী মোহাম্মদ আলী -পাকিস্তান নেজামে ইসলাম
মৌলভী ফরিদ আহমেদ -পাকিস্তান নেজামে ইসলাম
মওলানা আবুল আলা মওদুদী- জামায়াতে ইসলাম
অধ্যাপক গোলাম আজম- জামায়েত ইসলাম
ওয়ালি খান- পাকিস্তন ন্যাশনাল পার্টি
অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ- ন্যাপ
মুফতি মহম্মদ- পাকিস্তান জমিয়াতুল ইসলাম
পীর মহসিন উদ্দিন দুদু মিয়া- জমিয়াতুল ইসলাম
বিচারপতি এস এম মোরশেদ
এয়ার মার্শাল আসগর খান
মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও জুলফিকার আলী ভুট্টোকে গালটেবিল বৈঠকে আহ্বান করা হয়। কিন্তু তারা আহ্বান প্রত্যাখ্যান করেন।
২৪ ফেব্রুয়ারি বঙ্গবন্ধু ৯ জন প্রতিনিধি নিয়ে লাহোর যাত্রা করেন। তার সাথে ছিলেন তাজউদ্দীন আহমদ, মিজানুর রহমান চৌধুরী, আবদুল মোমেম, জহুর আহমদ চৌধুরী, আবদুল মালেক উকিল, এম এ আজিজ, ময়েজউদ্দিন ও মতিউর রহমান। লাহোরে তিনি পাকিস্তানের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তির সাথে আলোচনা করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি তিনি পিণ্ডি যাত্রা করেন।
২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০-৩০ মিনিটে প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউজে গোলটেবিল বৈঠক শুরু হয়। ডাকের পক্ষে ১৬ জন, আইয়ুব খানের পক্ষে ১৫ জন মিলিয়ে মোট ৩৩ জন বৈঠকে যোগদান করেন। ৪০ মিনিট আলোচনার পর সভা ১০ মার্চ পর্যন্ত মুলতবি হয়ে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৯ মার্চ দল নিয়ে রাওয়ালপিন্ডি পৌছেন। তারা পিন্ডির ইস্ট পাকিস্তান হাউজে অবস্থান করেন। ১০ মার্চ আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে আরও একটি গোলটেবিল বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা ১৩ মার্চ পর্যন্ত চলে।
গোলটেবিল বৈঠকে উত্থাপিত দাবির মধ্যে ছিল
১. ৬ দফার ভিত্তিতে সংবিধান রচনা।
২. সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে গণতান্ত্রিক পার্লামেন্ট নির্বাচন।
৩. কেন্দ্রীয় আইন পরিষদে জনসংখ্যার ভিত্তিতে নির্বাচন
পৃষ্ঠা: ১৯৭
৪. পূর্ববাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন।
৫. আঞ্চলিক বৈষম্য দূরীকরণ।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সভাপতিত্বে আলোচনা ১৩ মার্চ অমীমাংসিত অবস্থায় শেষ হয়। ডাকের সভাপতি নবাবজাদা নসরুল্লাহ আলোচনায় সন্তোষ প্রকাশ করেন এবং আইয়ুব খানকে ধন্যবাদ, ডাকের ৮ দফাপন্থি আওয়ামী লীগ আলোচনাকে স্বাগত জানান। ৬ দফাপন্থি আওয়ামী লীগের স্বায়ত্তশাসন গোলটেবিল বৈঠকে গৃহীত না হওয়ায় আওয়ামী লীগ গোলটেবিল আলোচনা প্রত্যাখ্যান করে। গোলটেবিল বৈঠকের ফলাফল শূন্য
১৩ মার্চের পর শেখ মুজিবুর রহমান ডাকের সাথে সম্পর্ক ছিল। কারণ ডাক স্বায়ত্তশাসন দাবি মেনে নেয়নি। আলোচনা ভেঙে গেলে খান ক্ষমতায় থাকার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যান। তিনি পূর্ব বাংলার গভর্নর মো খানকে বদলি করে তার স্থলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এম এন হুদা পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত করেন।
মওলানা ভাসানী আলোচনায় না এসে তিনি পূর্ব বাংলায় জ্বালাও পোড়াও কর্মসূচি চালিয়ে যান। আইন-শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। পূর্ব বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ও নেতাদের হাতে।
প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান শেষ পর্যন্ত শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে সমঝোতা করতে চেয়েছিলেন। তিনি তাকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিতে চেয়েছেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা ব্যতীত কোনো মীমাংসায় আসবেন না। অবশেষে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৪ মার্চ পদত্যাগ করেন এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক শাসক নিয়োগ করেন। রিয়াল এডমিরাল এস এ আহসানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর এবং লে. জেনারেল ইয়াকুবকে সামরিক শাসক নিয়োগ করা হয়।
দৈনিক ইত্তেফাক সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার মৃত্যু- ১ জুন ১৯৬৯
১৯৬৯ সালের ৩১ মে রাত ১২-৪০ মিনিটে দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা। সম্পাদক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া রাওয়ালপিন্ডির একটি হোটেলে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। ১ জুন তার মৃত্যুর খবর ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তার মৃত্যুতে বাঙালি জাতি গভীর শোক প্রকাশ করে। বঙ্গবন্ধু তার অকৃত্রিম সংগ্রামী সাথীকে হারিয়ে অসহায় হয়ে পড়েন। তিনি আইয়ুব-মোনায়েম। খানের স্বৈরশাসনে নির্যাতিত। তিনি ১৯১১ সালে বরিশালের ভাণ্ডারিয়ায় জন্মগ্রহণ
পৃষ্ঠা: ১৯৮
করেন। তিনি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী স্নেহধন্য ছিলেন। তিনি ছিলেন ৬ দফা আন্দোলনের অগ্রসেনানি
প্রদেশব্যাপী সফর
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর পূর্ব বাংলার সকল জেলা ও মহকুমা ব্যাপক সফর করেন এবং জনগনকে ৬ দফার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আহ্বান জানান।
পূর্ব পাকিস্তানের নাম বাংলাদেশ ঘোষণা
বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবুর রহমান ১৯৬৯ সালের ৫ ডিসেম্বর হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুবার্ষিকীতে ভাষণে বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের নাম হবে বাংলাদেশ।
সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা
১৯৬৯ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে বেতার ভাষণে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এখন এক ইউনিট বাতিল, এক ব্যক্তি এক ভোটের ভিত্তিতে ১৯৭০ সালের ৫ অক্টোবর দেশব্যাপী নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা করেন।
১৯৭০ সালের ১ জানুয়ারি থেকে রাজনৈতিক তৎপরতা অনুমতি দেওয়া হয়। শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার ভিত্তিতে নির্বাচনী প্রচারণায় দেশব্যাপী অভিযান চালান।
ছাত্রলীগের বার্ষিকী সম্মেলন
১৯৭০ সালের ২০ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে ছাত্রলীগের বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলন ১৯৭০-৭১ সালের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন নুরে আলম সিদ্দিকী এবং শাজাহান সিরাজ। ১৯৬৯-৭০ সালের ছাত্রলীগের সভাপতি ও সেক্রেটারি ছিলেন তোফায়েল আহমদ ও নূরে আলম সিদ্দিকী। ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন ও ডাকসু ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে অনন্য ভূমিকা পালন করে।
সহায়ক গ্রন্থ
মেসবাহ কামাল, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান
সিরাজ উদ্দীন আহমেদ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান