You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামীলীগের ভূমিকা
মেজর রফিকুল ইসলাম পিএসসি

প্রথম অধ্যায়

প্রারম্ভ
বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ভারতীয় উপমহাদেশে জাতীয়তাবাদী চেতনার বিকাশ ঘটে এবং সামাজিক রাজনৈতিক শক্তিসমূহ নতুন আঙ্গিকে আত্মপ্রকাশ করে। ত্রিশ দশকের মধ্যভাগে সংখ্যালঘু মুসলমানরা নিখিল ভারত মুসলিম লীগের মাধ্যমে ব্রিটিশ বিরোধী রাজনীতিকে বিপুলভাবে প্রভাবান্বিত করে। ভারতীয় মুসলমানরা ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয় এবং ফলশ্রুতিতে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকা সমন্বয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি হয়। পাকিস্তান সৃষ্টির পর পূর্ব বাংলার বঞ্চিত জনগণ সীমাহীন অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হওয়ার ফলে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ক্রমশ আন্দোলন দানা বেঁধে উঠে। মুসলমান জাতীয়তাবাদের স্থলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনার উন্মেষ ও বিকাশ ঘটতে থাকে। সমগ্র বাঙালি জাতি পূর্ববাংলার আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিতে প্রবল গণআন্দোলন শুরু করে। ১৯৭১ সালে দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রীয় কাঠামোর ভিতরে বাংলাদেশের জন্ম হয়। এবং শক্তির ভারসাম্য নতুনভাবে নির্ধারিত হয়। এভাবেই শতাব্দীর শেষার্ধে এ রাজনৈতিক নাটকের অবসান ঘটে।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর মুহম্মদ আলী জিন্নাহর নেতৃত্বে মুসলিম লীগ ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়। কিন্তু সরকার পরিচালনায় ও দেশ গঠনে কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় মুসলিম লীগ সরকার ক্রমান্বয়ে আমলা নির্ভর হয়ে পড়ে এবং পাকিস্তানের। বিদ্যমান সমাজ শক্তিগুলোকে একীভূত করে রাষ্ট্র গঠনের দিকে ধাবিত করতে চরমভাবে ব্যর্থ হয়। স্মরণযোগ্য যে মুহম্মদ আলী জিন্নাহর আহ্বানে বাঙালি মুসলমানরা পাকিস্তান সৃষ্টিতে অংশগ্রহণ করলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পর তাদের আশা-আকাক্ষার প্রতিফলন না ঘটায় পাকিস্তান সৃষ্টির পশ্চাতে যে দর্শন কাজ। করেছিল তার অসারতা দৃশ্যমান হয়ে উঠে। মুসলিম লীগ পরিত্যাগ করে বিভিন্ন নেতা কর্মী বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনে সচেষ্ট হয়। এভাবে ১৯৪৯ সালের শেষ দিকে প্রায় ২০টি বিরোধী দল আত্মপ্রকাশ করে। একমাত্র পাঞ্জাবেই ১৩টি বিরোধী রাজনৈতিক দলের আবির্ভাব হয়। ১৯৪৭ সালের জুলাই মাসে
পৃষ্ঠা-১১

হাশিম গ্রুপ সমর্থক মুসলিম লীগ কর্মীরা ঢাকায় গণ আজাদী লীগ গঠন করে। ঐ বছরেই সেপ্টেম্বর মাসে মুসলিম লীগের তরুণ প্রগতিশীল কর্মীদের প্রচেষ্টায় গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ডিসেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের করাচি অধিবেশনে সোহরাওয়ার্দী অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি প্রচলনের প্রস্তাব করেন। যদিও সোহরাওয়ার্দী ও মিয়া ইফতেখার উদ্দিনসহ মাত্র ১০ জন সদস্য এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দেয়। তবুও একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, এ প্রস্তাবের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে গণ আজাদী লীগ , গণতান্ত্রিক যুবলীগ ও ঢাকার বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ কর্মীদের অসাম্প্রদায়িক চেতনার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এসব প্রচেষ্টার পেছনে মুসলিম লীগের ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পরিবর্তে অসাম্প্রদায়িক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতি প্রবর্তনের ইচ্ছার অভিব্যক্তি ঘটে। পরে ১৯৪৮ সালের মার্চ মাসে সোহরাওয়ার্দী একটি দলমত নির্বিশেষে ধর্মনিরপেক্ষ জাতীয় রাজনৈতিক দল প্রবর্তনের উদ্দেশ্যে পাকিস্তান। ন্যাশনাল লীগ গঠনের প্রস্তাব করেন যে দলে সকল ধর্মের পাকিস্তানি নাগরিক সদস্য হতে পারবেন। ১৯৪৯ সালে মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে অন্তর্দলীয় কোন্দল চরমে উঠে। প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচনে টাঙ্গাইল আসনে মুসলিম লীগ পদপ্রার্থী খুররম খান পন্নীর বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ কর্মী শামসুল হক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। এ নির্বাচনে খুররম খান পন্নীর শোচনীয় পরাজয় মুসলিম লীগের রাজনীতির ভবিষ্যৎ ভরাডুবির দিক নির্দেশ করে। এ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে মুসলিম লীগের অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ও হতাশাগ্রস্ত কর্মীরা ১৯৪৯ সালে ঢাকায় ২ দিনের অধিবেশনে মিলিত হয়। এ অধিবেশনে পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে এবং পূর্ব বাংলার মানুষের ন্যায়সঙ্গত দাবি সম্বলিত শামসুল হক রচিত মূল দাবি শিরোনামে একটি প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়। ২৩ জুন সর্বসম্মতিক্রমে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠন করা হয় এবং ৪০ সদস্য বিশিষ্ট কমিটি আত্মপ্রকাশ করে।
পাকিস্তানের বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আর একটি মুসলিম লীগ। বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠন তেমন উল্লেখযোগ্য বিষয় ছিল না। কিন্তু তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল সমগ্র পাকিস্তানের রাজনীতিতে নতুন গতি সঞ্চার করে। নবগঠিত পূর্ব পাকিস্তান। আওয়ামী মুসলিম লীগের যে খসড়া মেনিফেস্টো রচিত হয় তাতে ১৯৪০ সালে। রচিত বেঙ্গল প্রাদেশিক মুসলিম লীগের মেনিফেস্টোর প্রতিফলন ঘটে। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের তরুণ সংগঠকরা সকলেই ছিলেন ১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগের সদস্য, যা মুসলিম লীগের অঙ্গ ছাত্র সংগঠনের বিরুদ্ধে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। এসব তরুণ প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ভাষা
পৃষ্ঠা-১২

আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির চূড়ান্ত পরিণতিতে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের জন্ম হয়।
নব সৃষ্ট পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চল অর্থনৈতিকভাবে পঙ্গু হয়ে পড়ে। ১৯৪৭ থেকে ১৯৪৯ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে প্রবল দুর্ভিক্ষ দেখা দেয়। ১৯৪৯ সালের ১৮, ১৯ এবং ২০ জুন তারিখে অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের দ্বিতীয় কাউন্সিল অধিবেশনে দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি মোকাবেলার ক্ষেত্রে মুসলিম লীগ সরকারের ব্যর্থতা স্বীকৃত হয়।
আওয়ামী লীগের প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় ২৪ জুন ১৯৪৯ মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। ১৯৪৯ সালের অক্টোবর মাসে আর্মানিটোলা ময়দানে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। সারা পূর্ব বাংলায় চরম দুর্ভিক্ষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ জনসভায় বক্তৃতা করার অভিযোগে মওলানা ভাসানীসহ অনেক নেতাকর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। কৃষকের পাটের দাম হ্রাস পায় এবং অর্থনৈতিক সংকটময় পরিস্থিতির উদ্ভব হয়। লক্ষণীয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে গঠিত হলেও দলের নামকরণে মুসলিম শব্দটি বর্জন করতে সমর্থ হয়নি। বস্তুত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগও মুসলিম লীগের মতই একটি সাম্প্রদায়িক দল হিসাবে আত্মপ্রকাশ করে। ইতিহাসের নিরিখে এটা কিছুতেই অস্বীকার করা যাবে না যে, বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে আওয়ামী মুসলিম লীগ আর একটি সাম্প্রদায়িক ছাড়া আর কিছুই ছিল না। এ কারণে এ নতুন রাজনৈতিক দলে, তাজউদ্দিন, কমরুদ্দিন আহম্মদ, তোয়াহা ও অন্যান্য প্রগতিশীল কর্মীরা প্রথমদিকে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। শাসক মুসলিম লীগ তখন ধর্মকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করছিল। পূর্ব বাংলার জনগণও ধর্মীয় চেতনা থেকে সম্পূর্ণ পৃথক ছিল না। এ পরিস্থিতিতে সম্পূর্ণ ধর্ম নিরপেক্ষ দল যেমন গঠন সম্ভব ছিল না, ঠিক তেমনি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের একটি ধর্মভিত্তিক দল হিসাবে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করার ক্ষেত্রে ব্যর্থতার আশঙ্কাই ছিল বেশি।
যদিও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা লাভ করে, তবুও বেঙ্গল মুসলিম লীগের খাজা নাজিমুদ্দিন বিরোধী সোহরাওয়ার্দী-হাশিম গ্রুপের সমর্থকরাই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। বিক্ষুব্ধ তরুণ কর্মীরা প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ সোহরাওয়ার্দী কর্তৃক অনুপ্রাণিত হয়। সোহরাওয়ার্দী মুসলিম লীগকে জাতীয় রাজনৈতিক দল হিসেবে ঢেলে সাজাতে চেয়েছিলেন। তিনি ১৯৪৯ সালের নভেম্বরে পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি চৌধুরী খালেকুজ্জামানকে এক পত্রে ইচ্ছুক ব্যক্তিদের মুসলিম লীগের সদস্যপদে
পৃষ্ঠা-১৩

অন্তর্ভুক্ত করার আহ্বান জানান এবং তা না করলে তারা পৃথক দল গঠন করতে পারে এ মর্মে সতর্ক করে দেন। মুসলিম লীগকে ঢেলে সাজাতে ব্যর্থ হয়ে সোহরাওয়াদী বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনে সচেষ্ট হন। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগকে ক্ষমতা থেকে অপসারণ করাই ছিল বিরোধী রাজনৈতিক দল গঠনের উদ্দেশ্য। ১৯৫০ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে লাহোরে এক রাজনৈতিক কর্মী সমাবেশে তিনি নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের কথা ঘোষণা করেন এবং তিনি নিজেই এ দলের সভাপতি হন কিন্তু বিশেষভাবে লক্ষণীয় যে, মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে গঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ তখন পর্যন্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের অংশ ছিল না। পরে ১৯৫১ সালে সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হলে তখনও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এর অংশ ছিল না। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রকৃতঅর্থে একটি প্রাদেশিক দল হিসেবেই গড়ে উঠেছিল। ১৯৫১ সালের নভেম্বর-ডিস্বের মাসে অনুষ্ঠিত উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে প্রাদেশিক নির্বাচনের পরে সোহরাওয়ার্দী পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের সঙ্গে একীভূত হওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ততদিনে প্রাদেশিক গণপরিষদে বৃহত্তম বিরোধী দল হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে এবং ভাষা আন্দোলন ও বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের জন্য সোচ্চার হওয়ার কারণে একটি জনপ্রিয় দল হিসেবে পরিগণিত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে শর্ত সাপেক্ষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ লাহোরে এক রাজনৈতিক সমাবেশে একীভূত হয়। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ দলের নাম, মেনিফেস্টো এবং কর্মসূচি অপরিবর্তন রাখে। এ দুই দলের একীভূত হওয়ার বিষয়টি পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কার্য নির্বাহী কমিটির ১৯৫৩ সালের ২১ এপ্রিল অনুষ্ঠিত সভায় অনুমোদন লাভ করে। এর এক বছর পরে কাউন্সিল অধিবেশনে মওলানা ভাসানী ঘোষণা করেন যে, যখন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ একীভূত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় তখন তিনি জেলে ছিলেন। এ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয় পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের কর্মসূচি ও মেনিফেস্টো চূড়ান্ত করার পর। সুতরাং কর্মসূচি ও মেনিফেস্টোর ক্ষেত্রে দ্বিমত দেখা দিলে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ একাই এগিয়ে যাবে। তিনি আরো ঘোষণা করেন যে, কেউ যদি আমাদের কর্মসূচির মধ্যে হস্তক্ষেপ করে তা হলে কেন্দ্রীয় দলের সঙ্গে একীভূত হওয়ার বিষয় পুনর্বিবেচনা করতে বাধ্য হবে।
পৃষ্ঠা-১৪

মওলানা ভাসানী বলেন যে, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের সমস্যা আলাদা এবং পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ে বদ্ধপরিকর। এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ ও জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ একীভূত হওয়ার পরও পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের গঠনতন্ত্র অবিকল ছিল এবং স্বায়ত্তশাসনের দাবি আদায়ের সংগ্রাম সব সময়েই অব্যাহত ছিল। এমনকি ষাটের দশকে সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর শেখ মুজিবের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পরও আওয়ামী লীগ এ আদর্শ থেকে বিচ্যুত হয়নি। মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হিসেবে স্বায়ত্তশাসন আদায়ের যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, পরবর্তীকালে সেই সংগ্রাম অব্যাহত থাকে। কিন্তু মওলানা ভাসানী তখন আর আওয়ামী লীগে ছিলেন না। তিনি তখন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির সভাপতি। আওয়ামী লীগ শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ৬ দফাভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন আদায়ের জন্য মরণপণ সংগ্রাম শুরু করে। আওয়ামী লীগের পূর্ব ও পশ্চিম অংশ কখনই এক ও অভিন্ন মেনিফেস্টো অনুযায়ী পরিচালিত হয়নি। স্বভাবত পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ ৬ দফা প্রশ্নে বিরোধিতা শুরু করার ফলে আওয়ামী লীগ বিভক্ত হয়। আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের ২৩ বছরের শাসনকালে বাঙালিদের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ে সোচ্চার থাকার ফলে প্রাদেশিক দল হিসেবেই সমধিক পরিচিত লাভ করে।
পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাক্তন সদস্যরা, বিক্ষুব্ধ মুসলিম লীগ সদস্যরা, তরুণ। আইনজীবী, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, জমিদার শ্রেণি ও অন্যান্য প্রভাবশালী ব্যক্তি যারা সোহরাওয়ার্দীকে সমীহ করতেন, তাঁরা আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগ দেন। সীমান্ত প্রদেশের মানকীর পীর ও পাঞ্জাবের মামদোতের খান সাহেব এবং অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরোধিতা করার জন্য সোহরাওয়ার্দীকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করেন। অপরদিকে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ এবং নিখিল পাকিস্তান জিন্নাহ আওয়ামী মুসলিম লীগ একীভূত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনো বাধা ছিল না। এমতাবস্থায় মুসলিম লীগের ধর্মাশ্রয়ী, ধর্মনিরপেক্ষ, ডানপন্থি, বামপন্থি, জাতীয়তাবাদী, আঞ্চলিকতাবাদী ও অন্যান্য উচ্চাভিলাসী মুসলিম লীগ বিরোধী ব্যক্তিরা সকলেই আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করে।
সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর মার্কিন ঘেঁষা পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেন। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সেন্টো-সিয়াটো সামরিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র গৃহীত হওয়ার পর সোহরাওয়ার্দী বলেন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন শতকরা ৯৮ ভাগ দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান জোট
পৃষ্ঠা-১৫

নিরপেক্ষ গ্রুপের সদস্য হওয়া সত্ত্বেও মিশর ব্রিটেন কর্তৃক আক্রান্ত হওয়াযর পরও পাকিস্তান বৃটেনের নিন্দা জ্ঞাপন করতে অসমর্থ হয়। বিশেষ করে দীর্ঘকালব্যাপি বাঙালির প্রাণের দাবি স্বায়ত্তশাসন সম্পর্কে সোহরাওয়াদী-ভাসানী দ্বন্দ অনিবার্য হয়ে পড়ে। ১৯৫৭ সালে কাগমারী সম্মেলনের পর মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগের সভাপতি পদ থেকে পদত্যাগ করেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, ১৯৫৩ সালের জুলাই মাসের কাউন্সিল অধিবেশনে আওয়ামী মুসলিম লীগকে একটি অসাম্প্রদায়িক দল হিসাবে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে আওয়ামী মুসলিম লীগে মুসলিম শব্দটি বর্জন করার প্রস্তাব উত্থাপিত হয় এবং ১৯৫৫ সালের অক্টোবর মাসে অনুষ্ঠিত কাউন্সিল অধিবেশনে আনুষ্ঠানিকভাবে মুসলিম শব্দটি বর্জন করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। আওয়ামী লীগ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল হিসেবে গড়ে উঠে।
আওয়ামী লীগ পূর্ব বাংলার পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও জনগণের ন্যায় সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আপোষহীন ভূমিকা রাখে। আওয়ামী লীগের অনমনীয় ও দৃঢ় মনোভাবের কারণে বাঙালি জাতি ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত এ দীর্ঘ পথ পরিক্রমায় নানা ঘাত-প্রতিঘাতে এগিয়ে চলে এবং স্বাধীনতার অবিনাশী চেতনার দিকে ধাবিত হয়। ষাটের দশকে শেখ মুজিব কর্তৃক ৬ দফা ঘোষণার ফলে স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সংগ্রাম অধিকতর বেগবান হয়। সত্তরের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ পাকিস্তান গণপরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু পাকিস্তানের কুচক্রী সামরিক শাসকেরা ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে নির্বাচনী রায় বানচাল করার হীন উদ্দেশ্যে সামরিক বাহিনী লেলিয়ে দেয় এবং ভয়াবহ গণহত্যা শুরু করে। বাঙালি জাতি স্বাধীনতা লাভের আকাঙ্ক্ষায় ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
পৃষ্ঠা-১৬

দ্বিতীয় অধ্যায়
আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠা ও উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি
২৪৭ সালে ব্রিটিশ শাসনের অবসানের পর পাক-ভারত উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। ১৪ আগস্টে পাকিস্তান নামক যে রাষ্ট্রটির সৃষ্টি হলো তার শাসনভার পড়লো মুসলিম লীগের ওপর। মুহাম্মদ আলী জিন্নাহ পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেলের আসন গ্রহণ করলেন এবং লিয়াকত আলী খান হলেন প্রধানমন্ত্রী। মুসলিম লীগের দেশ পরিচালনার কোনো পূর্ব অভিজ্ঞতা না থাকায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত হলো আমলাদের হাতে। আর মি. জিন্নাহ একনায়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হলেন।
শেখ মুজিব পাকিস্তান অর্জনের জন্য আন্দোলন করেছিলেন। ছাত্র-যুবকদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন। তিনি তখন থেকেই উপলব্ধি করেন যে, পাকিস্তানে বাঙালিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকার অর্জিত হবে না। বাঙালি জাতিসত্তা পাকিস্তানে মুসলিম লীগের রাজনীতিতে নিরাপদ নয়। বাঙালি জাতি পাকিস্তানের বিশেষ করে পাঞ্জাবিদের শাসন-শোষণের যাঁতাকলে নিপতিত হয়েছে। জনগণকে পাঞ্জাবিদের হাত থেকে রক্ষা করতে হবে।
শেখ মুজিব ১৯৪৭ সালে বি. এ. পরীক্ষার কারণে কলকাতায় থেকে যান। ঢাকায় আসতে তাঁর বেশ কিছু দেরি হয়। ১৯৪৭ সালের সেপ্টেম্বরে তিনি ঢাকায় আসেন এবং ১৫০ মোগলটুলীতে ওঠেন। তাঁর পিতার ইচ্ছা ছিল পুত্র হবে একজন আইনজীবী। সে অনুযায়ী ১৯৪৭ সালে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইন বিভাগে ভর্তি হন।
এ বছরেই টাঙ্গাইলের যুবনেতা শামসুল হকের নেতৃত্বে ঢাকায় গঠিত হয়। গণতান্ত্রিক যুবলীগ এবং শেখ মুজিব হন প্রতিষ্ঠাতা সদস্য। ঢাকা আগমনের আগে শেখ মুজিব ইসলামিয়া কলেজের সিরাজদ্দৌলা হলে ছাত্র, যুবক ও রাজনেতিক কর্মীদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নেন। এ সমাবেশে তিনি ঘোষণা করেন ‘মুসলিম লীগ’ আসলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি চায় না। মুসলিম লীগ ধর্মকে হাতিয়ার করে রাজনৈতিক স্বার্থ চরিতার্থ করতে চায়।’ তিনি বলেন, ‘এ
পৃষ্ঠা-১৭

স্বাধীনতা সত্যিকারের স্বাধীনতা নয়। বাংলার মাটিতে নতুন করে আবার আমাদের সংগ্রাম করতে হবে।’
রাজনৈতিক দিক থেকে শেখ মুজিব যে কতো দূরদর্শী ছিলেন তা তাঁর এ বক্তব্য থেকে বোঝা যায়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর বড় নেতারাও কলকাতা ছেড়ে ঢাকায় চলে এলেন। পর্ব পাকিস্তানের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন এবং প্রাদেশিক মুসলিম লীগের কতিপয় নেতা মুসলিম লীগকে পকেট প্রতিষ্ঠানে পরিণত করে ফেললেন। শেখ মুজিব প্রতিবাদী হয়ে উঠলেন। এসব নেতাদের প্রতিক্রিয়াশীল আবরণের বিরুদ্ধে ফজলুল কাদের চৌধুরী, জহিরউদ্দীন, নূরুদ্দীন আহমেদ, আবদুর রহমান প্রমুখদের নিয়ে সংগ্রামে অবতীর্ণ হলেন।
১৯৪৭ সালের ডিসেম্বরে প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনয়নের লক্ষ্যে আইনসভায় কতিপয় সদস্য বৈঠকে বসেন। শেখ মুজিব এ বৈঠকে নেতৃত্ব দেন। এ সময় শাহ আজিজুর রহমানের নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ খাজা নাজিমউদ্দীনের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করলে শেখ মুজিব এর বিরুদ্ধাচরণ করেন।
১৯৪৮ সালের মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীরা বিভিন্ন দাবির পরিপ্রেক্ষিতে ধর্মঘট পালন করে। শেখ মুজিব এসব ধর্মঘট পালনকারী কর্মচারীদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করেন এবং নেতৃত্ব দেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
মুসলিম লীগ সরকারের ইঙ্গিতে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ শেখ মুজিবসহ ২৭ জন ছাত্রনেতাকে বহিষ্কার ও জরিমানা করে। পরে পরিস্থিতি শান্ত হলে এ মর্মে জানানো হয় যে, শাস্তিপ্রাপ্ত ছাত্ররা ভুল স্বীকারপূর্বক দুঃখ প্রকাশ করে। অঙ্গীকারনামা প্রদান করলে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করা হবে।
অন্যান্য ছাত্রনেতারা আত্মসমর্পণমূলক মুচলেকা প্রদান করলেও শেখ মুজিব এ ধরনের অপমানজনক মুচলেকা দিতে অস্বীকার করেন। প্রতিবাদী শেখ মুজিব বলেন যে, চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের ন্যায্য দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে তিনি কোনো অপরাধ করেননি, কাজেই মুচলেকা দেওয়ার কোনো প্রশ্নই ওঠে না।
শেখ মুজিবের চরিত্রে এ অনমনীয় দৃঢ়তা সারাজীবন প্রতিফলিত হয়েছে। তিনি কখনোই মাথা নত করেননি। বন্দুকের নলের মুখেও তিনি অমিততেজ আর অসীম সাহসে গর্জে উঠেছেন। মাথা নত না করে বুক ফুলিয়ে অসীম সাহসে জনগণের পাশে তিনি দাঁড়িয়েছেন। শেখ মুজিবের এ মাথা নত না করা থেকে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম শিক্ষাগ্রহণ করতে পারে।
শেখ মুজিব বহিষ্কৃত হওয়ার পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে এলেন। তিনি বললেন, “আমি আবার একদিন এ বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে আসব। তবে
পৃষ্ঠা-১৮

হয়তো ছাত্র হিসাবে নয়, সসম্মানেই আসব।” তিনি তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করেছিলেন। দীর্ঘ ২৪ বছর পর ১৯৭২ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ও ডাকসু সম্মিলিতভাবে এক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে এবং তাঁর উপস্থিতিতে ১৯৪৯ সালের বহিষ্কার আদেশের কপি ছিড়ে ফেলা হয় এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আজীবন সদস্য পদ দিয়ে তাঁকে সম্মানিত করা হয়। শেখ মুজিব তখন ‘জাতির পিতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে মেনে নেবে বলে ঘোষণা দিলে তৎক্ষণাৎ শেখ মুজিব এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। কুমিল্লার ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত উর্দু ও ইংরেজি ভাষার পাশাপাশি বাংলাকে গণপরিষদের অন্যতম ভাষা হিসাবে দাবি করেন। ধীরেন্দ্রনাথ দত্তের এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান ও পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দীন। খাজা নাজিমউদ্দীনের বক্তব্যে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। শেখ মুজিব মুসলিম লীগের এ হীন পরিকল্পনার বিরুদ্ধে আন্দোলনের প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য কর্ম তৎপরতা শুরু করেন। শেখ মুজিব ছাত্র ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে যোগাযোগ করেন।
১৯৪৮ সালের ২ মার্চ ভাষা প্রশ্নে মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে সংগঠিত করার লক্ষ্যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মীদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এ বৈঠকে শেখ মুজিবের প্রস্তাব অনুযায়ী সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। সংগ্রাম পরিষদ বাংলা ভাষা নিয়ে মুসলিম লীগের ষড়যন্ত্রের প্রতিবাদে ১১ মার্চ সাধারণ ধর্মঘট আহ্বান করে।
ধর্মঘট চলাকালে শেখ মুজিব সহকর্মীদের সাথে সচিবালয়ের সামনে বিক্ষোভরত অবস্থায় গ্রেফতার হন। শেখ মুজিবকে গ্রেফতারের প্রতিবাদে সারা দেশে ছাত্রসমাজ প্রতিবাদে ফেটে পড়ে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার ছাত্রদের আন্দোলনের চাপে শেখ মুজিবসহ গ্রেফতারকৃত সকল ছাত্র নেতৃবৃন্দকে মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। শেখ মুজিব ১৫ মার্চ মুক্তি লাভ করেন। ১৬ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে সভার আয়োজন করা হয়। শেখ মুজিব এ সভায় সভাপতিত্ব করেন। পুলিশ এ সভায় হামলা চালায়। পুলিশের হামলার প্রতিবাদে শেখ মুজিবের আহ্বানে ১৭ মার্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ১১ সেপ্টেম্বর তাকে পুনরায় গ্রেফতার করা হয়।
১৯৪৯ সালের ২১ জানুয়ারি শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান। ২৬ এপ্রিল অনুষ্ঠিত টাঙ্গাইল উপ-নির্বাচনে মুসলিম লীগ বিরোধী প্রার্থী শামসুল হককে সমর্থন করেন এবং তার পক্ষে প্রচারণা চালান। উপাচার্যের বাসভবনের সামনে অবস্থান ধর্মঘটের কারণে তিনি আবার গ্রেফতার হন।
পৃষ্ঠা-১৯

একই বছরের জুন মাসের শেষ দিকে তিনি মুক্তি লাভ করেন। জেল থেকে বেরিয়েই দেশে বিরাজমান খাদ্য সংকটের কারণে আন্দোলন সংগঠিত করেন। সেপ্টেম্বরে ১৪৪ ধারা ভঙ্গের দায়ে গ্রেফতার হন এবং পরে মুক্তি লাভ করেন। অক্টোবরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী মুসলিম লীগের সভায় নূরুল আমিনের পদত্যাগ দাবি করেন। এর অব্যবহিত পরেই অক্টোবরের শেষ দিকে মওলানা ভাসানীসহ লিয়াকত আলী খানের নিকট একটি প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য শেখ মুজিব পুনরায় গ্রেফতার হন।
বিরাজমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে পাকিস্তান সৃষ্টির মাত্র ২১ মাসের মাথায় ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ বিরোধী রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠিত হয় ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন। তখন পাকিস্তানের উভয় অংশেই মুসলিম লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। মুসলিম লীগের অন্যায় অত্যাচার থেকে দেশবাসীকে রক্ষা করার জন্য মুসলিম লীগেরই অভ্যন্তরে একদল তরুণ রাজনৈতিক কর্মী প্রতিবাদী হয়ে উঠেছিল। মুসলিম লীগের কুশাসন ও রাষ্ট্রপরিচালনায় ব্যর্থতার বিরুদ্ধে এরা প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। ১৯৪৭ সালের ৬ ও ৭ সেপ্টেম্বর ঢাকা পৌরসভার ভাইস-চেয়ারম্যান খান সাহেব আবুল হাসনাতের বেচারাম দেউড়িস্থ বাসভবনে এক যুব সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে পাকিস্তান গণতান্ত্রিক যুবলীগ গঠিত হয়। কফিলউদ্দিন চৌধুরী ও শামসুল হক যথাক্রমে সম্মেলনের অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। তছাদুক আহমেদ চৌধুরী ২৫ সদস্য বিশিষ্ট জাতীয় কমিটির সভাপতি মনোনীত হন।
মুসলিম লীগ সরকার এদেরকে ভারতীয় চর অভিহিত করে বলে যে, এরা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। এ সময়েই কমরুদ্দীন আহমদকে আহ্বায়ক করে ‘গণ আজাদী লীগ’ গঠিত হয়। লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন ছিল গণ আজাদী লীগের লক্ষ্য। এ ছাড়া কম্যুনিস্ট পার্টি এবং তাদের সমর্থিত ছাত্র ফেডারেশনও তৎপর ছিল।
১৯৪৮ সালের ৪ জানুয়ারি ফজলুল হক হলে অনুষ্ঠিত এক ছাত্র সভায় ‘পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ’ গঠিত হয়। মঈনউদ্দীন আহমেদ এ কমিটির আহ্বায়ক এবং অলি আহাদ ঢাকা শহর কমিটির আহ্বায়ক মনোনীত হন। পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের সাংগঠনিক কমিটিতে ছিলেন : নঈমুদ্দিন আহমেদ, আব্দুর রহমান চৌধুরী, শেখ মুজিবুর রহমান, অলি আহাদ, আজিজ আহমেদ, আবদুল মতিন, দবিরুল ইসলাম, মফিজুর রহমান, শেখ আব্দুল আজিজ, সৈয়দ নূরুল আলম ও আবদুল কুদ্দুস চৌধুরী।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পরই এর দুই অংশের মধ্যে রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব শুরু হয়। বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে বিরাজমান অর্থনৈতিক
পৃষ্ঠা-২০

বৈষম্যের কারণে সচেতন বাঙালিরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। সংঘাতের প্রথম কারণই সৃষ্টি হয় রাষ্ট্রভাষা নিয়ে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আগেই হায়দ্রাবাদ অধিবেশনে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের ঘোষণা ছিল যে, পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু ।
সুতরাং ভাষা-সংস্কৃতির প্রশ্নে বাংলা ভাষাভাষী জনগণের সঙ্গে মুসলিম এগর সংঘাত অনিবার্য হয়ে ওঠে। ১৯৪৯ সালের মে মাসে মুসলিম লীগের বিক্ষুদ্ধ তরুণ রাজনৈতিক কর্মীদের একটি সম্মেলনের আয়োজন চলছিল। আবুল হাশিমপন্থী তরুণ মুসলিম লীগ কর্মীদের দপ্তর ছিল ১৫০ মোগলটুলী, ঢাকা। টাঙ্গাইলের শামসুল হক সার্বক্ষণিকভাবে ১৫০ মোগলটুলীস্থ দপ্তরের তত্ত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন। ১৯৪৯ সালের মধ্য জুনে এ কর্মী সম্মেলনের প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও ইয়ার মোহাম্মদ যথাক্রমে এ অভ্যর্থনা কমিটির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। মওলানা আকরম খাঁ তখন পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম লীগের সভাপতি। বিক্ষুব্ধ তরুণদের এ ধরনের রাজনৈতিক তৎপরতা ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং বিক্ষুব্ধ তরুণেরা ক্ষমতাসীনদের রোষানলে পতিত হয়। বিক্ষুব্ধ তরুণদের মধ্যে ছিলেন শামসুল হক, শেখ মুজিব, ফজলুল কাদের চৌধুরী, আবদুর সবুর খান, কমরুদ্দীন আহমেদ, আনোয়ারা খাতুন প্রমুখ। এসব তরুণ কর্মীরা মওলানা আকরম খাঁর কাছে সংগঠনের প্রাথমিক সদস্য সংগ্রহের জন্য রশীদ বই চাইতে গেলে তাদেরকে প্রত্যাখ্যান করা হয়। এর ফলে প্রকাশ্য দ্বন্দ্ব শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জের রহমতুল্লাহ ইনস্টিটিউটে বিক্ষুদ্ধ তরুণ কর্মীরা এক সম্মেলনের আয়োজন করে। ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার সভাস্থলে ১৪৪ ধারা জারি করে। পরিবর্তিত অবস্থায় খান সাহেব এম ওসমান আলী এম. এল. এ-কে সভাপতি মনোনীত করা হয় এবং নারায়ণগঞ্জের পরিবর্তে পাইকপাড়ায় এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সভায় সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, কেন্দ্রীয় মুসলিম লীগের সভাপতি খালেকুজ্জামানের কাছে একটি প্রতিনিধিদল প্রেরণ করা হবে এবং এ ব্যাপারে অভিযোগ উত্থাপন করা হবে। একটি বড় প্রতিনিধিদল যথারীতি করাচিতে উপস্থিত হয়ে খালেকুজ্জামানের কাছে নাজিমউদ্দীন-আকরম খাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উত্থাপন করে। খালেকুজ্জামান ছাত্র প্রতিনিধিদের কোনো কথাই কর্ণপাত না করে নাজিমউদ্দীন-আকরম খাঁকে সমর্থন করলেন।
আর এভাবেই মুসলিম লীগের পাল্টা একটি রাজনৈতিক দল আওয়ামী মুসলিম লীগ জন্ম নেয়। ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন ঢাকায় কে এম দাস লেনস্থ। রোজ গার্ডেনের হলো ঘরে সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ সম্মেলনে ৩০০ থেকে ৩৫০ জন প্রতিনিধি উপস্থিত ছিলেন। এতে উদ্বোধনী ভাষণ দেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও সভাপতিত্ব করেন আতাউর রহমান খান। প্রসঙ্গত
পৃষ্ঠা-২১

উল্লেখ্য যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন পূর্ব পাকিস্তান সরকারের এটর্নি জেনারেল ছিলেন। প্রথম যে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয় তা নিম্নরূপঃ
সভাপতি : মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। সহ-সভাপতি ৫ জন যথাক্রমে আতাউর রহমান খান, সাখাওয়াত হোসেন, আলী আহম্মদ, এম এল এ. আলী আমজাদ খান, আবদুস সালাম খান। শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক মনোনীত হন। শেখ মুজিবুর রহমান যুগ্ম সম্পাদক এবং সহ-সম্পাদক পদে খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও এ, কে. এম রফিকুল হোসেন মনোনীত হন। ইয়ার মোহাম্মদ খান কোষাধ্যক্ষের দায়িত্ব নেন। অলি আহাদ রচিত ‘জাতীয় রাজনীতি ১৯৪৫-৭৫’ গ্রন্থে উপরিউক্ত কমিটির উল্লেখ রয়েছে।
১৯৪৯ সালের ২৪ জুন অর্থাৎ আওয়ামী মুসলিম লীগ গঠনের পরদিন ঢাকার আরমানীটোলা ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয় মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে। ইয়ার মোহাম্মদ খান, আবদুল জব্বার খদ্দর, খয়রাত হোসেন, শামসুল হক ও মওলানা ভাসানী এ জনসভায় বক্তৃতা করেন। শেখ মুজিব তখন জেলে। জেলে থাকাকালীন অবস্থাতেই তিনি দলের যুগ্ম সম্পাদক পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৫০ সালের ১ জানুয়ারি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খানের ঢাকা আগমন উপলক্ষে আওয়ামী মুসলিম লীগ ভুখা মিছিল বের করে। এ মিছিলে নেতৃত্বদান কালে শেখ মুজিব গ্রেফতার হন এবং প্রায় দু’বছর তাঁকে জেলে আটক রাখা হয়।
পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ জন অধিবাসী বাঙালির মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকার উর্দুকে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার চক্রান্তে লিপ্ত হয়। বাঙালি লেখক, বুদ্ধিজীবী, ছাত্র ও জনগণ নীরব থাকেননি। এ অশুভ ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে তাঁরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। তকালীন প্রকাশিত দৈনিক ইত্তেহাদ, মাসিক ও সাপ্তাহিক পত্রিকাগুলো জোরালো প্রবন্ধ প্রকাশ করে। বিশেষ করে দৈনিক ইত্তেহাদ ও দৈনিক আজাদে অগ্নিঝরা লেখনী প্রকাশিত হতে থাকে। পাকিস্তানের শতকরা ৭ ভাগ লোক উর্দুতে কথা বলে। তাছাড়া বাংলা ভাষার মতো তা আন্তর্জাতিক খ্যাতি অর্জন করেনি। তথাপি তারা বাংলা ভাষার প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। এ পটভূমিতে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রথম ধাপ হিসাবে বাংলা ভাষার প্রশ্নে ১৯৪৮ সালে ঢাকায় আন্দোলন শুরু হয়। আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সপক্ষে তার অভিমত ব্যক্ত করার সাথে সাথেই বাঙালি বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এক প্রবন্ধে ১৫৪ বঙ্গাব্দের ১২ শ্রাবণ সংখ্যায় দৈনিক আজাদে
পৃষ্ঠা-২২

প্রকাশিত পাকিস্তান রাষ্ট্রভাষা শীর্ষক এক প্রবন্ধে বলেন, “বাংলাদেশের কোর্ট, আদালত ও বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাভাষার পরিবর্তে উর্দু, হিন্দি অথবা অন্যকোনো ভাষা গ্রহণ করা হইলে ইহা রাজনৈতিক পরাধীনতারই নামান্তর হইবে। ড. জিয়াউদ্দীন আহমেদ পাকিস্তানের প্রদেশসমূহের বিদ্যালয়ে শিক্ষার বাহনরূপে প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে উর্দু ভাষার সপক্ষে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন আমি একজন শিক্ষাবিদ রূপে উহার তীব্র প্রতিবাদ জানাইতেছি। ইহা কেবলমাত্র রাজনৈতিক শিক্ষা ও নীতি বিরোধীই নয়, প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের নীতি বিগর্হিত বটে।” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৪৭ সালের ১ সেপ্টেম্বর ‘তমুদুন মজলিস’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন গঠিত হয়। ১৯৪৭ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর এ মজলিস কর্তৃক প্রকাশিত ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি পুস্তিকায় কাজী মোতাহার হোসেন, আবুল মনসুর আহমদ ও আবুল কাশেম বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার পক্ষে তীব্র ভাষায় বক্তব্য রাখেন এবং প্রয়োজন বোধে সারা দেশব্যাপী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান।
ইতোপূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ পূর্ব বাংলার জনগণ রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে বাংলার সপক্ষে ধর্মঘট পালন করে। সেক্রেটারিয়েট ও অন্যান্য সরকারি অফিস ও রেল কর্মচারীরা এ ধর্মঘটে যোগ দেয়। পুলিশ বহু সংখ্যক লোককে গ্রেফতার করে এবং মিছিল ছত্রভঙ্গ করার জন্য ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালের গেটের সামনে কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে।
এর কিছুদিন পরেই পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মহাম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকায় আসবার কথা। জিন্নাহর ঢাকায় সফর কালে গোলমালের আশংকায় খাজা নাজিমউদ্দীন আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। জিন্নাহ নাজিমউদ্দীনকে ভাষার প্রশ্নে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা করে মীমাংসা করার নির্দেশ দেন।
নাজিমউদ্দীন সংগ্রাম পরিষদের কাছে এ মর্মে একটি অনুরোধ পত্র পাঠান যে, সরকার ছাত্রদের দাবি মেনে নিতে রাজি আছে। এ জন্যে সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে খাজা নাজিমউদ্দীন আলোচনা করতে চান। সংগ্রাম পরিষদ ১৫ মার্চ দুটো বৈঠকে খাজা নাজিমউদ্দীনের সজ্ঞে মিলিত হয়। সংগ্রাম পরিষদের পক্ষ থেকে আবুল কাশেম, কমরুদ্দীন আহমেদ, মোহাম্মদ তোয়াহা ও নঈমুদ্দীন আহমেদ প্রমুখেরা উপস্থিত ছিলেন। নাজিমউদ্দীনের সঙ্গে এ বৈঠকে ছাত্র নেতাদের তুমুল বাক-বিতন্ডা হয়। ছাত্র নেতৃবৃন্দ দাবি মেনে নেওয়ার জন্য চাপ প্রয়োগ অব্যাহত রাখলেও নাজিমউদ্দিন সবগুলো দাবি মেনে নিতে রাজি ছিলেন না। প্রথম দফা বৈঠক ব্যর্থ হওয়ার পর পুনরায় বৈঠক বসে। ছাত্রদের ৮ দফা দাবির পরিপ্রেক্ষিতে নাজিমউদ্দীন ও রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের মধ্যে এক চুক্তি
পৃষ্ঠা-২৩

সম্পাদিত হয়। এ চুক্তি ঐতিহাসিক ‘ভাষা চুক্তি’ নামে পরিচিত। এ চুক্তি সরকারের পক্ষে সই করেছেন স্বয়ং নাজিমউদ্দীন এবং সংগ্রাম পরিষদের পক্ষে কমরুদ্দীন আহমেদ। শেখ মুজিব তখন জেলে। ছাত্র নেতৃবৃন্দ এ চুক্তি স্বাক্ষরের আগে জেলে গিয়ে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে শেখ মুজিবের অনুমোদন গ্রহণ করেন।

ঐতিহাসিক সেই ভাষা চুক্তিটি ছিল নিম্নরূপঃ
১. ২৯ ফেব্রুয়ারি, ১৯৪৮ সাল হতে বাংলা ভাষার প্রশ্নে যাহাদেরকে গ্রেফতার করা হইয়াছে, তাহাদেরকে অবিলম্বে মুক্তিদান করা হইবে।
২. পুলিশ কর্তৃক অত্যাচারের অভিযোগ সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং তদন্ত করিয়া এক মাসের মধ্যে এ বিষয়ে একটি বিবৃতি প্রদান করিবেন।
৩. ১৯৪৮ সালের এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে পূর্ব বাংলা সরকারের ব্যবস্থাপক সভায় বেসরকারি আলোচনার জন্য যে দিন নির্ধারিত হইয়াছে, সেইদিন বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করিবার এবং তাহাকে পাকিস্তান গণপরিষদে এবং কেন্দ্রীয় সরকারের পরীক্ষা দিতে সমমর্যাদা দানের জন্য একটি বিশেষ প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে।
৪. এপ্রিল মাসে ব্যবস্থাপক সভায় এ মর্মে একটি প্রস্তাব উত্থাপন করা হইবে যে, প্রদেশের সরকারি ভাষা হিসাবে ইংরেজি উঠিয়া যাওয়ার পরই বাংলা তাহার স্থলে সরকারি ভাষারূপে স্বীকৃত হইবে। ইহা ছাড়া শিক্ষার মাধ্যমও হইবে বাংলা। তবে সাধারণভাবে স্কুল-কলেজগুলিতে অধিকাংশ ছাত্রের মাতৃভাষার মাধ্যমেই শিক্ষাদান করা হইবে।
৫. আন্দোলনে যাঁহারা অংশগ্রহণ করিয়াছেন, তাঁহাদের কাহারো বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করা হইবে না।
৬. সংবাদপত্রের ওপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হইবে।
৭. ২৯ ফেব্রুয়ারি হইতে পূর্ব বাংলার যে সকল স্থানে ভাষা আন্দোলনের জন্য ১৪৪ ধারা জারি করা হইয়াছে সেখান হইতে তাহা প্রত্যাহার করা হইবে।
৮. সংগ্রাম পরিষদের সাথে আলোচনার পর আমি এ ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হইয়াছি যে, এ আন্দোলন রাষ্ট্রের দুশমনদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয় নাই(এ দফাটি নাজিমুদ্দিন নিজের হাতে লেখেন)।
শেখ মুজিব ১৫ মার্চ জেল থেকে মুক্তি পেয়ে শওকত আলীকে সঙ্গে নিয়ে ফজলুল হক হলো থেকে ১৫০ মোগলটুলীতে গিয়ে রাত্রিযাপন করেন। পরদিন ভোরে তিনি ফজলুল হক হলে ফিরে আসেন এবং একটি প্রতিবাদ সভার
পৃষ্ঠা-২৪

আয়োজন করার জন্য ছাত্রদের একত্রিত করেন। ১৬ মার্চ বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে যে সভা অনুষ্ঠিত হয় শেখ মুজিব সেই সভায় সভাপতিত্ব করেন এবং সভাশেষে মিছিল সহকারে গণপরিষদের দিকে যাত্রা শুরু করেন।
এ মিছিলে সন্ধ্যার দিকে পুলিশের লাঠিচার্জ শুরু হয়। ১৯ জন ছাত্র গুরুতরভাবে আহত হয়। রাতে ফজলুল হক মুসলিম হলে সংগ্রাম পরিষদের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এবং এ বৈঠকে ১৭ মার্চে দেশব্যাপী সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
শেখ মুজিব ইতোমধ্যেই একজন সাহসী যুবনেতা হিসাবে স্বীকৃতি লাভ করেন। শেখ মুজিব, তাজউদ্দীন আহমদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, নঈমুদ্দীন আহমেদ, শওকত আলী, শামসুল হক ও আবদুল মতিন প্রমুখ ছাত্রনেতৃবৃন্দের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ডের ফলে সারা দেশে এ আন্দোলন লেলিহান শিখার মতো ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের এ সময়ে শেখ মুজিব নিরলস পরিশ্রম করেন।
এ বিক্ষোভ-সংক্ষুব্ধ পরিস্থিতিতে জিন্নাহ তাঁর প্রথম ও শেষ ঢাকা সফরে আসেন ১৯ মার্চ বিকেলে। ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে অনুষ্ঠিত জনসভায় জিন্নাহ ঘোষণা করেন, “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা।” সভার একপ্রান্ত থেকে প্রতিবাদী কণ্ঠ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। শেখ মুজিব, তাজউদ্দিন আহমদ ও আব্দুল মতিন এ প্রতিবাদে নেতৃত্ব দেন। জিন্নাহ সাহেব এ ধারণা পোষণ করতেন যে, তার কথার প্রতিবাদ করবে এমন সাহস পাকিস্তানের কারো নেই। যদিও এ প্রতিবাদের সুর ছিল খুবই ক্ষীণ, তবুও মি. জিন্নাহর কাছে ছিল একটি নিতান্তই অপ্রত্যাশিত। তিনদিন পর ঢাকা কার্জন হলে বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে মি. জিন্নাহ ভাষণদান কালে পুনরায় একই বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করেন। এবার হলের একপ্রান্ত থেকে অপরপ্রান্ত পর্যন্ত সোচ্চার প্রতিবাদের ধ্বনিতে জিন্নাহর কণ্ঠস্বর মিলিয়ে যায়্ জিন্নাহ কিছুক্ষণ চুপ করে দাড়িয়ে থাকেন। তারপর অপেক্ষাকৃত নরম সুরে তিনি পুনরায় তার ভাষণ শুরু করেন। এবারে তিনি বলেন যে, “পাকিস্তান রাষ্ট্রের বিভিন্ন অংশগুলি একত্রে এগিয়ে যাওয়ার জন্য প্রয়োজন একটি মাত্র রাষ্ট্র ভাষার এবং আমার মতে একমাত্র উর্দুই হতে পারে সে ভাষা।” এবারও মৃদু প্রতিবাদ ও গুঞ্জন শোনা যায়।
হোসেন শহিদ সোহাওয়ার্দী দেশ বিভাগের পর ভারতে অবস্থানরত মুসলমানদের রক্ষার জন্য কলকাতায় থেকে যান। ১৯৪৮ সালে তিনি প্রথম ঢাকায় আসেন কিন্তু নারায়ণগঞ্জ স্টিমার ঘাটে অবতরণ করতে না দিয়ে তাঁকে কলকাতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তীতে ১৯৪৯ সালে সোহরাওয়ার্দী কলকাতা থেকে তার শ্বশুর স্যার আবদুর রহিমের করাচি’র বাসভবনে আসেন।
পৃষ্ঠা-২৫
তৎকালীন মুসলিম লীগ সরকার সোহরাওয়ার্দীর গণপরিষদের সদস্য পদ বাতিল করে দেয়।সোহরাওয়ার্দী বিরোধী দলীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন।
রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন তখন চরমরূপ পরিগ্রহ করেছে। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত খান নিহত হলে খাজা নাজিমুদ্দিন তার স্থলাভিষিক্ত হন। প্রধানমন্ত্রী নাজিমুদ্দিন তার প্রথম ঢাকা সফরকালে ১৯৫১ সালের ২৬ জানুয়ারি পল্টন ময়দানের বিশাল জনসভায় বলেন যে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু অন্য কোনো ভাষা নয়। অথচ ইনিই (নাজিমুদ্দিন) বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার অঙ্গীকারে ঐতিহাসিক ভাষা চুক্তিতে স্বাক্ষর দান। করেছিলেন। মৃত জিন্নাহর প্রেতাত্মা হয়ে নাজিমুদ্দিন জিন্নাহর বক্তব্যের পুনরাবৃত্তি করলে ঝিমিয়ে পড়া রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনে হঠাৎ করে বিদ্রোহের আগুন জ্বলে ওঠে।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ডাকসু’র নেতৃবৃন্দ মধুর ক্যান্টিনে এক ছাত্র সমাবেশের আয়োজন করে। ছাত্রনেতা গাজীউল হক এ সভায় অগ্নিময়ী ভাষণ দেন। সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৩০ জানুয়ারি দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকা ডিস্টিক্ট বার লাইব্রেরি হলে সর্বদলীয় প্রতিনিধিদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলা ভাষাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে পূর্ব বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এ সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়ে। ৩০ জানুয়ারি সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, খেলাফতে রাব্বানী পার্টি, ছাত্রলীগ ও বিশ্ববিদ্যালয় সংগ্রাম কমিটি থেকে দু’জন করে নেওয়া প্রতিনিধির সমন্বয়ে একই কমিটি গঠিত হয়। এ প্রতিনিধিদের মধ্যে ছিলেন-আবুল হাশিম, আতাউর রহমান খান, কমরুদ্দীন আহমেদ, অলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, আব্দুল মতিন, খালেক নেওয়াজ খান ও শামসুল হক প্রমুখ। শেখ মুজিব তখন কারাগারে আটক। ছাত্রসমাজ পরদিন ১৪৪ ধারা ভেঙে পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য বদ্ধপরিকর হয়ে ওঠে। ২১ ফেব্রুয়ারি ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জমায়েত হতে শুরু করে। এদিকে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। রাজপথে যানবাহন চলাচল ছিল না, দোকানপাট বন্ধ ছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে পুলিশের গাড়ি। বেলা ১২টার সময় সভা শুরু হলো। বিশ্ববিদ্যালয়ের বটতলায় গাজীউল হকের সভাপতিত্বে ছাত্রনেতারা বক্তব্য রাখেন। বিশ্ববিদ্যালয় ভাষা কমিটির আহ্বায়ক আবুদল মতিন উপস্থিত ছাত্রসমাজকে লক্ষ্য করে বললেন, “মায়ের অপমান সহ্য করা যায় না। মাতা এ অপমানের প্রতিশোধ নিতে ডাক দিয়েছেন। বলুন আপনারা সে ডাকে সাড়া দিয়ে। ১৪৪ ধারা ভাঙ্গবেন, না ঘরে ফিরে যাবেন।” শ্লোগানে শ্লোগানে আকাশ বাতাস বিদীর্ণ হতে লাগলো। রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ১৪৪ ধারা মানব না, মানব না, ‘নাজিম-নূরুল নিপাত যাক’, ‘চলো চলো অ্যাসেম্বিলিতে চলো।‘
পৃষ্ঠা-২৬

প্রসঙ্গত উলেখ্য শেখ মুজিব জেলের অভ্যন্তর থেকে গাজীউল হককে এক ঐতিহাসিক চিঠি লেখেন। এ চিঠিতে শেখ মুজিব ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে বাংলাকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য ছাত্রসমাজকে আহ্বান জানান। ছাত্ররা দসজন দশজন করে মিছিল বের করে। বেলা ৩টায় পুলিশের গুলিবর্ষণে সালাম, বরকত ,রফিক , জব্বার, শফিকুর ও অজ্ঞাতনামা অনেকে শহিদ হন। শেখ মজিব জেল থেকে এক বিবৃতিতে ছাত্র মিছিলে পুলিশের গুলিবর্ষণের তীব্র প্রতিবাদ ও নিন্দা জানান এবং এক টানা ১৭ দিন অনশন অব্যাহত রাখেন। জেল থেকে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে যোগাযোগের অপরাধে তাকে ঢাকা থেকে ফরিদপুর কালে স্থানান্তর করা হয়। ২৬ ফেব্রুয়ারি ফরিদপুর জেল থেকে তিনি মুক্তি লাভ করেন ।ঢাকায় হত্যা তখন পাকিস্তান গনপরিশদের বৈঠক ছলছিল ।পুলিশের গুলি বর্ষণে ছাত্র হত্যার সংবাদ পৌঁছানো মাত্র গণপরিষদ সদস্য মাওলানা আবদূর রাশিদ তর্কবাগীশ তুমুল প্রতিবাদ করেন।মাওলানা তর্কবাগীশ বলেন,” আমাদের ছাত্ররা শাহাদাৎ বরন করেছেন ,আমরা আরামে পাখার হাওয়া খেতে থাকবো এটা বরদাস্ত করা যায় না । আগে চলুন কথায় হত্যাকাণ্ড হয়েছে দেখে আসি। তারপর অ্যাসেম্বলি চলবে। আর আগে আমরা এ্যাসেম্বলি চলতে দেব না।” তুমুল বাকবিতণ্ডার মাঝে অ্যাসেম্বলি মূলতবি ঘোষণা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি ছিল প্রাদেশিক ব্যবস্থাপক সভার বাজেট অধিবেশন। রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ সারা বাংলায় ধর্মঘট পালনের আহ্বান জানায়। সরকারিভাবে ২০ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা জারি করে সভা, শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ মিছিল নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়। ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা ২০ ফেব্রুয়ারির মধ্যরাতে ফজলুল হক হলো ও ঢাকা হলের মাঝখানে অবস্থিত পুকুরের পূর্ব পাশে উত্তরধারের সিড়িতে এক সভায় মিলিত হন। ছাত্রনেতা গাজীউল হক, মোহাম্মদ হাবিবুর রহামন (শেলী), মোহাম্মদ সুলতান, জিল্লুর রহমান, আব্দুল মোমিন, এম. আর, আখতার মুকুল, এস. এ. বারী, এ.টি. কামরুদ্দিন আহমদ, আনোয়ারুল হক খান, আনোয়ার হোসেন ও মঞ্জুর হোসেন। উপস্থিত ছিলেন। সভায় পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়।
পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিপুল সংখ্যক পুলিশ মোতায়েন করা হয়। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে নির্ধারিত কর্মসূচি অনুযায়ী পরিষদ ভবনের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে পুলিশ কর্তৃক বাধাপ্রাপ্ত হয়। শহিদের রক্তে ঢাকার রাজপথ রঞ্জিত হয়। গুলির শব্দে ব্যবস্থাপক পরিষদ উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। কোনো কোনো সদস্য বাইরে এসে দাঁড়ান। পরিষদের ভিতরে বিক্ষুদ্ধ সদস্যরা তীব্র প্রতিবাদে ফেটে পড়েন। অধিবেশন স্থগিত রাখার দাবি জানান।
পৃষ্ঠা-২৭

মওলানা আব্দুর রশীদ তর্কবাগীশ। ২১ ফেব্রুয়ারির ভাষা আন্দোলন ২২ ফেব্রুয়ারি গণ-আন্দোলনে পরিণত হয়। ২১ তারিখ থেকে ২৫ তারিখ পর্যন্ত হরতাল পালিত হয়। উপায়ান্তর না দেখে বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য পাকিস্তান গণপরিষদে একটি বিল আনয়নের প্রস্তাব প্রাদেশিক গণপরিষদ কর্তৃক গৃহীত হয়। ১৯৫৬ সালের ২৯ ফেব্রুয়ারি গৃহীত পাকিস্তানের প্রথম সংবিধানের ২১৪ নং অনুচ্ছেদে উর্দু ও বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
২১ ফেব্রুয়ারি কতিপয় ছাত্রসহ অন্যান্যদের নিহত হওয়ার খবরে সমগ্র ঢাকা নগরী বিক্ষুব্ধ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এ ভূখণ্ডের জনপদ শঙ্কিত হয়ে পড়ে। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে মিছিলরত সংগ্রামী ছাত্রদের প্রতি গুলিবর্ষণের ফলে তাৎক্ষণিকভাবে পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের স্থলে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উন্মেষ ঘটে। বস্তুত সেদিন থেকেই বাঙালির স্বতন্ত্র স্বাধীন চিন্তার সূত্রপাত হয়। শহিদের রক্তে রাজপথ রঞ্জিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাঙালির মোহমুক্তি ঘটে।
এ উত্তপ্ত রাজনৈতিক পটভূমিতে বাংলার জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের অঙ্গীকার নিয়ে ১৯৪৯ সালে আওয়ামী মুসলিম লীগ যাত্রা শুরু করে। মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে অব্যাহত থাকে অধিকার আদায়ের অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম। পরবর্তীকালে একটি অসাম্প্রদায়িক সংগঠন গড়ে তোলার স্বার্থে আওয়ামী মুসলিম লীগের ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করা হয়। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনার প্রদীপ জ্বলে ওঠে এদেশের ঘরে ঘরে।
ফেব্রুয়ারি ২১ ও ২২ তারিখ রাতে প্রায় ১ ফুট উঁচু শহিদ মিনার নির্মাণ করা হয়। মেডিকেল কলেজের ছাত্র আজমল, ইয়াহিয়া, বদরুল আলম, হায়দার, শরফুল আলম প্রমুখ প্রথম শহিদ মিনার নির্মাণে প্রচুর পরিশ্রম করেছিলেন। শহিদ শফিকুর রহমানের (পুলিশের গুলিতে যার মাথার গুলি উড়ে গিয়েছিল) বৃদ্ধ বাবা শহিদ মিনার উদ্বোধন করেন। এ শহিদ মিনার দ্বিতীয়বার উদ্বোধন করেন। আজাদ পত্রিকার সম্পাদক আবুল কালাম শামসুদ্দিন। কিন্তু ২৬ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় পাকিস্তানি সৈন্যরা শহিদ মিনারটি ভেঙে ধুলিস্মাৎ করে দেয়। পাকিস্তানি শাসক চক্র বুঝতে পেরেছিল শহিদ মিনারের অলংঘনীয় প্রত্যয়ী ভূমিকা। তাই একাত্তরের পঁচিশে মার্চের কালো রাতে হিংস্র হায়েনার মতো তারা ছুটে গিয়েছিল শহিদ মিনারে। বিজাতীয় আক্রোশে, পশু শক্তিতে শহিদ মিনার ভেঙে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল এবং সেখানে একটি মসজিদ নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু একুশে ফেব্রুয়ারি পরাজিত হয়নি। বায়ান্নোর রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের শহিদের রক্তে অমর স্মৃতি বিজড়িত শহিদ মিনার এমনই অবিনাশী শক্তির অধিকারী যে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে নতুন কলেবরে বলিষ্ঠ চেতনায় গড়ে উঠেছে আবার অপরাজেয় শহিদ মিনার।
পৃষ্ঠা-২৮

বায়ান্নোর একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের পূর্বপুরুষেরা রক্তদান করে বাঙালি তীয়তাবাদের যে বীজ বপন করেছিল, ধাপে ধাপে জনগণের মহান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সেই বীজ কালক্রমে বিশাল মহীরূহে পরিণত হয়। ইতিহাসের ধারাবাহিকতায় অনিবার্যভাবে আমাদের ঘরে ঘরে এসেছে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
বাংলাদেশের অনাগত প্রজন্মকে একুশের অমৃত বৃক্ষ করবে নিশ্চিত চায়াদান, অন্যায়ের কাছে মাথা নত না করার সংগ্রামী চেতনা আর দুর্জয় আক্রোশ রুখে দাঁড়ানোর অমিত তেজ ও দুর্বার সাহস। আত্মদানের মহিমাময় ইতিহাস প্রজন্মের পর প্রজন্মকে বাঙালি সংস্কৃতিজাত নিজস্ব পরিচয় ও জাতিসত্তা সঞ্চারিত করবে, সমৃদ্ধ করবে সংগ্রামী চেতনায় অনাগত কাল ধরে। একুশের অন্তর্নিহিত শক্তি বাঙালিকে আত্মপরিচয়ের সন্ধান দেবে যুগে যুগে।
১৯৫৩ সালে রাজনৈতিক ঘটনাবলি দ্রুত প্রবাহিত হতে থাকে। ভাষা আন্দোলনের পর ১৯৫২ সালের ডিসেম্বর মাসে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের জন্ম হয়। প্রতিটি জেলা থেকে একটি অসাম্প্রদাযিক ছাত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য চাপ অব্যাহত থাকে। এ পরিস্থিতিতে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগ ‘মুসলিম’ শব্দটি বর্জন করে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ নাম ধারণ করে। কামরুজ্জামান এর সভাপতি নির্বাচিত হন। ক্ষমতাসীন সরকারের বিরোধিতা সত্ত্বেও ১৯৫৩ সালে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বার্ষিকী উদযাপিত হয়। সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা পরিষদের আহ্বায়ক অলি আহাদ ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ জেলে থাকায় পুনরায় সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পষিদ গঠিত হয়। এর সভাপতি নির্বাচিত হন আতাউর রহমান খান। ১৯ ও ২০ ফেব্রুয়ারি শহিদের রূহের মাগফিরাত কামনা করা হয়। ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলায় হরতাল পালিত হয়। ঐ দিন আরমানীটোলা মাঠে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
১৯৫৩ সালের ৯ মার্চ পাকিস্তান কেন্দ্রীয় সরকার এক আদেশবলে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের কার্যমেয়াদ ১৯৫৪ সালের ১৪ মার্চ পর্যন্ত বৃদ্ধি করেন। পাকিস্তান গণ-পরিষদে এ ধরনের একটি বিল পাস হয়। ১৯৫৩ সালের ১ এপ্রিল চৌধুরী খালেকুজ্জামান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হয়ে আসেন। ১৯৪৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর জিন্নাহর মৃত্যুর পর চৌধুরী খালেকুজ্জামান নিখিল পাকিস্তান। মুসলিম লীগের সভাপতি নিযুক্ত হন।
সোহরাওয়ার্দী করাচিতে অবস্থানকালে মিস্ ফাতেমা জিন্নাহর সমর্থনে ‘জিন্নাহ আওয়ামী লীগ’ গঠন করেন। ১৯৫১ সালের ১৬ অক্টোবর লিয়াকত আলী নিহত হলে খাজা নাজিমউদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং গোলাম মোহাম্মদ গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। গোলাম মোহাম্মদ ১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমউদ্দিনকে বরখাস্ত করেন এবং
পৃষ্ঠা-২৯

ওয়াশিংটনে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত হিসাবে কর্মরত বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। সোহরাওয়াদী জিন্নাহ আওয়ামী লীগের বিলুপ্ত ঘটিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগের বিলুপ্ত ঘটিয়ে নিখিল পাকিস্তান সংগঠন গড়ে তোলেন। তিনি নিজে সভাপতি এবং মাহমুদুল হক ওসমানী সাধারণ সম্পাদক হন। খাজা নাজিমউদ্দিন মন্ত্রিসভার সদস্য ছিলেন : স্যার জাফরুল্লাহ খান, ফজলুর রহমান, মোহাম্মদ আলী, এ, এস, পীরজাদা, খাজা শাহাবুদ্দীন, এম. এ. গুরমানী, সরদার বাহাদুর খান, ডা, এ. এম. মালিক, সরদার আবদুর রব নিশতার, ডা. মাহমুদ হোসেন ও আই, এইচ, কোরাইশী। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী মন্ত্রিসভায় স্থান প্রাপ্তরা। হলেন—স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান, মোহাম্মদ আলী, এম. এ. ব্রোহী, খান। আবদুর কাইউম খান, শোয়েব কোরাইশী ও তোফাজ্জল আলী। ১৯৫৩ সালের ৯ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব দলের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং আসন্ন নির্বাচনে মুসলিম লীগকে পরাজিত করার লক্ষ্যে মওলানা ভাসানী, শেরে বাংলা ফজলুল হক ও সোহরাওয়ার্দীর মধ্যে ঐক্য প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট হন।
১৯৫৩ সালের ১৭ এপ্রিল পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় সোহরাওয়ার্দী ঘোষণা করেন যে, “রাজবন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি না দিলে আওয়ামী লীগ প্রবল গণ-আন্দোলন শুরু করবে।” তিনি এ জনসভায় মুসলিম লীগ সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন। শেখ মুজিব এ জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, “মুসলিম লীগ সরকার আমাদের স্বাধীনতা বিরোধী সাম্রাজ্যবাদী শক্তির কাছে বিক্রি করে দিয়েছে। আমাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ধ্বংসের মুখে! কৃষকের মুখের হাসি মিলিয়ে গেছে। অভাবে ও ঋণে জর্জরিত কৃষকরা আজ দিশেহারা। শ্রমিকদের অধিকার হরণ করা হয়েছে। সারাদেশে পুলিশ আর মুসলিম লীগ গুণ্ডাবাহিনীর নির্যাতনের মানুষ আজ অতিষ্ঠ।‘ শেরে বাংলা ফজলুল হকও অতিথি বক্তা হিসাবে এ জনসভায় ভাষণ দেন।
১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবস্থাপক পরিষদের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘোষণা দেওয়া হয়। এ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই রাজনৈতিক মহলে তুমুল উত্তেজনা শুরু হয়। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে আলোচনা ও মেরুকরণ প্রক্রিয়া শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের পরে ১৯৫৩ সালে শেরে বাংলা ফজলুল হক সরকারের এটর্নি জেনারেলের দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করেন এবং জনসভায় তার লুপ্ত কৃষক শ্রমিক পার্টিকে পুনরুজ্জীবিত ঘোষণা করেন। রংপুরের আবু হোসেন সরকার, ঢাকার আবদুল লতিফ বিশ্বাস, ফরিদপুরের ইউসুফ আলী চৌধুরী, কুমিল্লার আশরাফ উদ্দীন চৌধুরী, বরিশালের আবদুল ওহাব খান (পরবর্তীকালে স্পীকার), চট্টগ্রামের নূরুল হক চৌধুরী, নোয়াখালীর হামিদুল হক
পৃষ্ঠা-৩০

চৌধুরী, রাজশাহীর লুৎফর রহমান খান, সৈয়দ আজিজুল হক নান্না মিয়া, আবদুস সাত্তার(পরবর্তীকালে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি) এ. এস. এম. সলায়ামান নবগঠিত ‘কৃষক-শ্রমিক’ পার্টিতে যোগ দেন।
শেরে বাংলা ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠেয় সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের প্রতি নির্বাচনী ঐক্যের আহ্বান জানান। আওয়ামী লীগও তাতে সমর্থন জ্ঞাপন করে। এ নির্বাচনী ঐক্যে অন্যান্য দলের মধ্যে নেজামে ইসলামও অন্তর্ভুক্ত হয়। হক-ভাসানী-সোহরাওয়ার্দী এক ও অভিন্ন কর্মসূচির ভিত্তিতে এক রাজনৈতিক মোর্চায় মিলিত হন। ১৯৫৩ সালের ৪ ডিসেম্বর শুক্রবার একুশ দফা দাবির ভিত্তিতে যুক্তফ্রন্ট গঠিত হয়। আবুল মনসুর আহমেদ যুক্তফ্রন্ট নামকরণ করেছিলেন। আওয়ামী লীগের পক্ষে মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং কৃষক-শ্রমিক পার্টির পক্ষে শেরে বাংলা ফলজুল হক এ ঐহিতাসিক দলিলে স্বাক্ষর করেন।
যুক্তফ্রন্টের ২১ দফা কর্মসূচি ছিল নিম্নরূপঃ
১। বাংলা ভাষা হবে পাকিস্তানের অন্যতম একটি রাষ্ট্রভাষা।
২। ক্ষতিপূরণ ব্যতিরেকে যে কোনো প্রকারের জমিদারী বিলুপ্তিকরণ এবং উদ্বৃত্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের বন্টন করের পরিমাণ হ্রাস।
৩। পাট শিল্পকে জাতীয়করণ, পাট উৎপাদকের জন্য উপযুক্ত মূল্য নির্ধারণ। মুসলিম লীগ আমলের পাট শিল্পের দালালদের অনুসন্ধান করে তাদের সম্পত্তি বাজেয়াপ্তকরণ।
৪। সমবায় শিল্প প্রথা প্রতিষ্ঠা দ্বারা কুটির শিল্প ও শ্রমশিল্পের উন্নতি।
৫। লবণ শিল্পে পূর্ব পাকিস্তানের স্বনির্ভরতার জন্য এ শিল্পের পত্তন এবং পাট-দালালদের মত লবণ শিল্পের দালালদের সম্বন্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ।
৬। সর্বপ্রকার উদ্বাস্তু-বিশেষত কারিগর ও শিল্প-শ্রমিকদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ।
৭। বন্যা ও দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য সেচ-পরিকল্পনা।
৮। পূর্ববঙ্গে শিল্প প্রতিষ্ঠার দ্বারা শিল্প শ্রমিকদের আর্থিক ও সামাজিক নিরাপত্তা বিধান।
৯। বাধ্যতামূলক অবৈতনিক প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং শিক্ষকদের উপযুক্ত বেতন ও ভাতার ব্যবস্থা।
১০। সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থা বিলোপের দ্বারা প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা পুনর্বিন্যাস এবং মাতৃভাষার মাধ্যমে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রবর্তন।
পৃষ্ঠা-৩১

১১। ঢাকা ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত কালাকানুন বাতিল করে তাদের স্বাধীন বিশ্ববিদ্যালয় রূপান্তরকরণ।
১২। প্রশাসনিক ব্যয় সংকোচন, উচ্চ ও নিম্ন পর্যায়ের কর্মচারীদের বেতনে সমতা আনয়ন। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রীরা ১,০০০ টাকার বেশি বেতন গ্রহণ করবেন না।
১৩। সর্বপ্রকার দুর্নীতি, আত্মীয় পোষণ, উৎকোচের অবসান এবং এ উদ্দেশ্যে ১৯৪০ সালের পরের সময়ের প্রত্যেক সরকারি অফিসার ও বাণিজ্যপতিদের সম্পত্তির হিসাব গ্রহণ।
১৪। বিভিন্ন জননিরাপত্তা আইন ও অর্ডিন্যান্স কর্তৃক ধৃত সকল বন্দীর মুক্তি এবং সভাসমিতি, প্রেস ও বাক-স্বাধীনতা দান।
১৫। বিচারব্যবস্থা ও প্রশাসনব্যবস্থা পৃথকীকরণ।
১৬। বর্ধমান ভবনকে প্রথমে ছাত্রাবাস এবং পরে বাংলাভাষা ও সাহিত্যের গবেষণাগারে পরিণতকরণ।
১৭। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি বাংলা ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মৃতিতে একটি শহিদ স্তম্ভ নির্মাণ ও ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারবর্গের ক্ষতিপূরণ।
১৮। ২১ ফেব্রুয়ারি ‘শহিদ দিবস’ এবং ছুটির দিন ঘোষণা।
১৯। ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রতিরক্ষা, বৈদেশিক সম্পর্ক এবং মুদ্রাব্যবস্থা ছাড়া অন্য সকল বিষয়ে পূর্ববঙ্গের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা । প্রতিরক্ষা বিষয়েও পূর্ববঙ্গে যেমন থাকবে ‘নেভি হেড কোয়ার্টাস’, পূর্ববঙ্গকে অস্ত্র ব্যাপারে স্বনির্ভর করার জন্য তেমনি পূর্ববঙ্গে হবে ‘অস্ত্র কারখানা প্রতিষ্ঠা। আনসারদের পুরোপুরি সৈনিকরূপে স্বীকৃতি।
২০। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা কোনো কারণেই আইনসভা বা মন্ত্রিসভা কার্যকাল বৃদ্ধি করবে না এবং যাতে নির্বাচন কমিশনারের মাধ্যমে স্বাধীন পক্ষপাতহীন নির্বাচন হতে পারে তার জন্য তারা নির্বাচনের দুমাস পূর্বে পদত্যাগ করবে।
২১। প্রত্যেকটি আইনসভা সদস্যদের শূন্যপদ শূন্য হওয়ার তিনমাসের মধ্যে উপ-নির্বাচন দ্বারা পূর্ণ করা হবে এবং যদি যুক্তফ্রন্ট মনোনীত প্রার্থী পর পর তিনটি উপনির্বাচনে পরাজিত হন তবে মন্ত্রিসভা স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করবে।
আবুল মনসুর আহমদ মওলানা ভাসানীর রূপরেখা অনুযায়ী এ ঐতিহাসিক ২১ দফার মূল খসড়া প্রণয়ন করেন। এডভোকেট কমরুদ্দীন আহমেদ আবুল
পৃষ্ঠা-৩২

মনসুর আহমদকে সক্রিয়ভাবে সহযোগিতা করেন এবং হক-ভাসানীর বৈঠকে চড়ান্তভাবে উপস্থাপিত হবার পূর্বে সোহরাওয়াদী এর চূড়ান্ত রূপদান করেন। উল্লেখ্য ১৯৫৩ সালের ১৫ নভেম্বর নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে যে ৪২ দফা কর্মসূচি গৃহীত হয়েছিল তার ওপর ভিত্তি করেই ২১ ফেব্রুয়ারির সঙ্গে সাদৃশ্য রেখে ২১ দফা প্রণীত হয়।
সোহরাওয়ার্দী ভবিষ্যদ্বাণী করেন যে, মুসলিম লীগ সরকার মাত্র ৯টি আসনে জয়ী হতে পারবে। তার এ ভবিষ্যদ্বাণী অক্ষরে অক্ষরে প্রতিফলিত হয়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিব গোপালগঞ্জ নির্বাচনী এলাকায় ওয়াহিদুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং ১৩ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন। পূর্ব বাংলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিন যুক্তফ্রন্ট প্রার্থী ২৫ বছর বয়স্ক খালেক নওয়াজের কাছে পরাজিত হন। ১৯৫৪ সালের ১১ মার্চ এ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ২ এপ্রিল সরকারিভাবে এ নির্বাচনের ফলাফল প্রকাশ করা হয়।
ঢাকা সদরঘাটে ৫৬ সিমসন রোডে যুক্তফ্রন্টের সদর দপ্তর স্থাপিত হয়। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায়, সোহরাওয়ার্দীর ভবিষ্যদ্বাণী অনুযায়ী মুসলিম লীগ মাত্র ৯টি আসন লাভ করেছে। নির্বাচনী ফলাফলে দেখা যায় ২৩৭টি আসনের মধ্যে যুক্তফ্রন্ট ২২২টি আসনে জয়লাভ করেছে। স্বতন্ত্র ৫ জন প্রার্থী ও খেলাফতে রাব্বানীর ১ জন প্রার্থী জয়লাভ করেছে।
অবশ্য পরে চট্টগ্রাম থেকে স্বতন্ত্রপ্রার্থী ফজলুল কাদের চৌধুরী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। ফলে এরা পরিষদে গ্রুপ তৈরি করতে সক্ষম হয় এবং মুসলিম লীগ গ্রুপের নেতা নির্বাচিত হন রংপুরের পনিরউদ্দীন। অমুসলিম আসনে কংগ্রেস-২৪, তফসিলী ফেডারেশন-২৯, সংখ্যালঘু যুক্তফ্রন্ট-৯, কমিউনিস্ট-৫, গণতন্ত্রী দল-২, বৌদ্ধ-২ ও খ্রিষ্টান-১টি আসনে জয়লাভ করে। যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে অভূতপূর্ব সাংগঠনিক দক্ষতা প্রদর্শন করেন মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেখ মুজিবুর রহমান। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে ময়মনসিংহের নান্দাইল এলাকা ছিল পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী নূরুল আমিনের এলাকা। নির্বাচন স্ট্রাটেজি হিসাবে নান্দাইলের এক ঐতিহাসিক জনসভায় তিন নেতা শেরে বাংলা ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী ভাষণ দেন। পর্বেই উল্লেখ করা হয়েছে যে নূরুল আমিন এ নির্বাচনে নিদারুণভাবে পরাজিত হন। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনের পর শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা নির্বাচিত হন। শেরে বাংলা ফজলুল হককে মন্ত্রিসভা গঠনের সুযোগ দেওয়া হয়। যদিও আওয়ামী লীগ ১৪ টি আসন লাভ করেছিল তবুও শেরে বাংলার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও বয়সের কথা বিবেচনা করে
পৃষ্ঠা-৩৩

তাঁকে পার্লামেন্টারী পার্টির নেতা মনোনীত করা হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করলেন। মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হক যে মন্ত্রিসভা গঠন করেন তাতে বৃহৎ দল আওয়ামী লীগের কোনো প্রতিনিধিকে স্থান না দেওয়ায় যুক্তফ্রন্টে ভাঙনের সূত্রপাত হয়। যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরে আওয়ামী লীগ ও কৃষক-শ্রমিক পার্টির অন্তদ্বন্দ্ব চরমে উঠে। অবশ্য অল্পদিন পরে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হক আওয়ামী লীগ থেকে কয়েকজন সদস্যকে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। শেখ মুজিব এ সময় প্রাদেশিক মন্ত্রিসভার কনিষ্ঠ সদস্য (কৃষি ও বনমন্ত্রী) হিসাবে শপথ গ্রহণ করেন। এ সময়েই বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের। অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয় এবং পরে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্টের এ অভূতপূর্ব বিজয় কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগ সরকারকে দারুণভাবে আতঙ্কিত করে তোলে। পূর্ব বাংলায় শেরে বাংলা ফজলুল হকের নেতৃত্বে সরকার গঠনের ফলে পাকিস্তানিরা চক্রান্তে লিপ্ত হয়। শুরু হয় জঘন্য ষড়যন্ত্র।
গোলাম মোহাম্মদ তখন পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল। ইতিহাসে গোলাম মোহাম্মদ কুখ্যাত ষড়যন্ত্রের নায়ক হিসাবে সর্বজনবিদিত। যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে অকার্যকর করার জন্য সরকারি উস্কানিতে আদমজী জুট মিলে বাঙালি অবাঙালি শ্রমিকদের ভয়াবহ দাঙ্গা বেধে যায়। এ দাঙ্গায় সহস্রাধিক বাঙালি শ্রমিক নিহত হয়। আদমজী জুট মিলের শ্রমিক ইউনিয়ের সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী। বাঙালি শ্রমিকেরা স্বাভাবিকভাবেই যুক্তফ্রন্টে ভোট দেয়। বাঙালি-বিহারী দাঙ্গাজনিত কারণে বিরাজমান অশান্ত রাজনৈতিক পরিবেশের জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যুক্তফ্রন্ট সরকারকে দায়ী করে। শেরে বাংলাকে জরুরিভাবে পশ্চিম পাকিস্তানে তলব করা হয়।
যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের ২৭ দিন পরে মুখ্যমন্ত্রী শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতা সফরে যান। দীর্ঘদিন পরে পুরাতন বান্ধবদের সঙ্গে সাক্ষাত করা এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল। ভাষা আন্দোলনের সময় তিনি পুলিশের লাঠিচার্জে আঘাত প্রাপ্ত হন। তাঁর এককালীন বন্ধু ডা. বিধানচন্দ্র রায়ের কাছে চিকিৎসা কাজেও তিনি কলকাতা যান। ১৯৫৪ সালের ৩০ এপ্রিল বেলা সাড়ে তিনটায়। অরিয়েন্ট এয়ার ওয়েজে শেরে বাংলা ফজলুল হক ‘দমদম এয়ারপোর্টে অবতরণ করেন। তাঁর পত্নী ও দশ বছর বয়স্ক পুত্র তার সঙ্গে ছিলেন। বিপুল জনতা শেরে বাংলাকে অভ্যর্থনা জানায়। সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেরে বাংলা বলেন, “এখানে আমি পুরোনো বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে দেখা করতে এসেছি। আমি কলকাতা শহরে ষাট বছরেরও বেশি সময় আমার সেরা আনন্দময় দিনগুলি
পৃষ্ঠা-৩৪

কাটিয়েছি। সে সব পুরোনো স্মৃতি পুনরুদ্ধার করতে এবং সম্ভব হলে নতুন প্রেরণার সঞ্চার করতে আমি কলকাতা এসেছি। ভবিষ্যতেও আবার আসব।”
পরদিন সকালে শেরে বাংলা রাইটার্স বিল্ডিং-এ যান এবং ডা. বিধান চন্দ্র রায়ের সঙ্গে দেখা করেন। বহু পুরোনো বন্ধু-বান্ধবের সঙ্গে আন্তরিক হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনাসহ তিনি স্বাস্থ্য পরীক্ষা করেন। স্বাস্থ্য পরীক্ষা ছাড়াও দুই বাংলার মধ্যে বিরাজমান সমস্যাবলি নিয়েও আলোচনা হয়। দুই বাংলার মধ্যে ভিসা প্রথা বিলোপ, বাণিজ্য ও যোগাযোগ ব্যবস্থা প্রবর্তন, সীমান্ত সংক্রান্ত বিধি-নিষেধ শিথিলকরণ, বাস্তুহারাদের দেশে ফিরিয়ে নেওয়ার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় আলোচনায় স্থান পায়।
কলকাতাস্থ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শেরে বাংলাকে সংবর্ধনা জানায়। খিদিরপুরে এমনি এক সংবর্ধনার জবাবে শেরে বাংলা বলেন, “বাংলাকে রাজনৈতিক দিক থেকে দু’ভাগ করা হয়েছে সত্যি কিন্তু ভাষা, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যে উভয় বাংলার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই। রাজনীতিকরা বাংলাকে দু’ভাগ করে এ সংস্কৃতির ঐক্যের ফাটল ধরাতে পারেনি, ভবিষ্যতেও পারবে না।“কলকাতা থেকে বিদায়ের আগে শেরে বাংলা বলেন যে, “একদল লোক বিশেষ করে প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সম্পাদক আমার কথার বিরূপ মন্তব্য করেছেন। আমি তাদের কোনো সমালোচনার জবাব দিতে চাই না, শুধু বলতে চাই নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়ে তাদের পক্ষে জনসাধারণের প্রতিনিধি হয়ে কথা বলা সাজে না।” তিনি আরও বলেন, “আমি অবশ্যই একজন পাকিস্তানি এবং আমি নিঃসন্দেহে মুসলিম লীগ পন্থী থেকে উৎকৃষ্ট পাকিস্তানি। কিন্তু আমি একজন পাকিস্তানি হওয়া সত্ত্বেও পূর্ব পশ্চিম বাংলার জনসাধারণে মধ্যে কোনো রাজনৈতিক বিচ্ছেদ হয়নি এমন ভেবে তাদের সম্পর্ক উন্নত ও সৌহার্দ করার চেষ্টায় কোনো দোষ দেখতে পাই না। আমি পুনর্বার কলকাতাবাসীদের তাদের সাদর ও আন্তরিক অভ্যর্থনার জন্য ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা জানাই। আমি আশা রাখি ও বিশ্বাস করি যে, দুই বাংলা মিলেমিশে কাজ করে তাদের যুগ্ম প্রচেষ্টায় সমৃদ্ধি ও সুখের পথে উত্তরোত্তর এগিয়ে যাবে।”
শেরে বাংলা ফজলুল হকের এ কলকাতা ভ্রমণ নিয়ে কুচক্রীমহল ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠে। পাকিস্তানের তৎকালীন সরকার যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার মাত্র ৫৭ দিনের মাথায় পূর্ব বাংলায় ৯২ (ক) ধারায় গভর্নরের শাসন জারি করে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভাকে ক্ষমতাচ্যুত করে। ১৯৫৪ সালের ৩১ মে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী বগুড়ার মোহাম্মদ আলী জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার ভাষণে শেরে বাংলা এ. কে. ফজলুল হককে রাষ্ট্রদোহী আখ্যায়িত করেন। শের বাংলা ফজলুল
পৃষ্ঠা-৩৫

হককে তাঁর কে, এম, দাস লেনের বাসায় অন্তরীণ করা হয়। শেখ মুজিবর রহমানসহ হাজার হাজার রাজনৈতিক কর্মী ও নেতৃবৃন্দকে নিরাপত্তা আইন গ্রেফতার করা হয়। এ সময় মওলানা ভাসানী ইউরোপে হেলসিংকি শহরে বিশ্ব শান্তি সম্মেলনে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে দেশের বাইরে ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর ইস্কান্দার মির্জা ঘোষণা করেন যে, “এদেশে মওলানা ভাসানীর মতো রাষ্ট্রদোহীদের স্থান নাই এবং মওলানা ভাসানী দেশে ফেরার পরপরই তাকে একজন হাবিলদার দিয়ে গুলি করা হবে।”
উল্লেখ্য যে, শেরে বাংলা ফজলুল হক কলকাতা থেকে ঢাকা ফিরে আসার পর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এবং প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী তাঁকে করাচিতে ডেকে পাঠান। শেরে বাংলা ২১ মে, শুক্রবার করাচি পৌঁছান। সেখানে গভর্নর জেনারেল ও শেরে বাংলার মধ্যে তর্ক-বিতর্ক চলে। শেরে বাংলা পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন দাবি করেন। পশ্চিমা শাসকরা শেরে বাংলার প্রতি এ মর্মে দোষারোপ করে যে, ভারতের সঙ্গে হক সাহেবের যোগসাজোস রয়েছে। মার্কিন সংবাদপত্র ‘নিউইয়র্ক টাইমস’-এর জন, ডি, কালাহান নামক এক সাংবাদিক কর্তৃক প্রেরিত রিপোর্টের ভিত্তিতে শেরে বাংলার প্রতি এ দোষারোপ করা হয়। স্বাক্ষী হিসাবে মি, কালাহানকে সেখানে উপস্থিতও করা হয়। মি. কালাহানের এ রিপোর্ট পাকিস্তান অবজারভারেও প্রকাশিত হয়। মি. কালাহানের রিপোর্টটি নিম্নরূপঃ “নিউইয়র্ক ২৩ মে নিউইয়র্ক টাইমস্ পত্রিকা আজ পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. জফলুল হকের এক সাক্ষাৎকার ছাপিয়েছে। এতে তাঁর বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, পূর্ব বাংলা একটি স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে।” পত্রিকাটি করাচিস্থ সংবাদদাতা প্রেরিত এ রিপোর্টটি প্রথম পৃষ্ঠায় ফলাও করে ছাপা হয় এবং ফজলুল হকের বক্তব্য হিসাবে বলা হয়, তার মন্ত্রী সভার অন্যতম কাজ হবে স্বাধীনতার ব্যবস্থা করা। ডেসপাসে উল্লেখ করা হয় যে, পাকিস্তানের সর্ববৃহৎ প্রদেশ পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ বলেছেন তারা স্বাধীন হতে আগ্রহী। নিউইয়র্ক টাইমসে এ ধরনের খবর প্রকাশিত হওয়ায় রাজনৈতিক অঙ্গনে তুমুল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। ২৪ মে করাচি থেকে শেরে বাংলা বলেন যে, “উল্লিখিত রিপোর্টটি ইচ্ছাকৃত, মিথ্যার বেসাতি ও প্রকৃত তথ্যের বিকৃতি।”
তিনি একবিবৃতিতে বলেন যে, আসলে আমি মার্কিন সাংবাদিককে সাক্ষাৎকার দানকালে যা বলেছি তা হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে পক্ষে পাকিস্তানের একটি স্বায়ত্তশাসিত ইউনিট হওয়া প্রয়োজন—এ হচ্ছে আমাদের দর্শন এবং আমরা এজন্য সংগ্রাম করবো। আমি ঘুণাক্ষরেও বলিনি যে, আমাদের আদর্শ স্বাধীনতা। অপরদিকে কালাহান বলেন যে, ফজলুল হক এ মর্মে সাক্ষাতকার প্রদান করেন যে, সহস্রাধিক মাইল ভারতীয় এলাকা দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম
পৃষ্ঠা-৩৬

পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে পৃথক থাকার কারণেই বিয়াল্লিশ মিলিয়ন বাঙালি স্বাধীনতা দাবি করছে। এসোসিয়েটেড প্রেস অব পাকিস্তান এর এক রিপোর্টে বলা হয় যে, প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া), শেরে বাংলা ও কালাহানকে একত্রিত করেন এবং উক্ত রিপোর্ট সম্বলিত পত্রিকাটি উপস্থাপন করেন। শেরে বাংলা এ প্রকাশিত বিবৃতি অস্বীকার করেন এবং সাংবাদিক কালাহান প্রকাশিত রিপোর্ট প্রত্যাহারে অস্বীকৃতি জানান।
ফজলুল হক করাচি থেকে ঢাকা ফেরার পথে কলকাতায় দমদম বিমান বন্দরে একঘণ্টা অবস্থান করেন। মন্ত্রিসভার তিনজন সদস্য-আজিজুল হক, আতাউর রহমান খান ও শেখ মুজিবুর রহমান তার সঙ্গে ছিলেন।
১৯৫৪ সালের ২৩ জুলাই কমিউনিস্ট পার্টি নিষিদ্ধ ঘোষণা হয়। ২৭ জুলাই প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়া বলেন, “পূর্ব বাংলার মুখ্যমন্ত্রী এ. কে. ফজলুল হকের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে না কারণ তিনি কলকাতা প্রদত্ত বক্তব্যের জন্য অনুতপ্ত। আওয়ামী লীগ মুসলিম লীগের নেতৃবৃন্দ ২ (ক) ধারা উঠে যাবে।” পূর্ব বাংলায় তিনি গণতন্ত্রের সরকার দেখতে চান। কিন্তু মোহাম্মদ আলী করাচিতে ফিরে গিয়ে ১ আগস্ট বলেন যে, পূর্ব বাংলার গভর্নর শাসন ব্যবস্থা বলবৎ রাখা প্রয়োজন। যতোদিন পর্যন্ত পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা না হয় ততোদিন গভর্নরের শাসন ব্যবস্থা বলবৎ থাকবে। এর কিছুদিন পর গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ এক বিবৃতিতে বলেন যে, হক সাহেব দেশদ্রোহী নন বরং তাকে পাকিস্তানের বন্ধু বলেই মনে করেন।” ফলে কৃতজ্ঞতাবশত হক সাহেব গোলাম মোহাম্মদের ঢাকা সফর কালে তার গলায় ফুলের মালা পরিয়ে দেন। একই সাথে আওয়ামী লীগের অন্যতম নেতা আতাউর রহমান খানও ফুলের মালা দিয়ে গভর্নর জেনারেলকে বরণ করেন। কার্জন হলে গোলাম মোহাম্মদকে অভিনন্দন জানানো হয়। ১৯৫৫ সালের জুন করাচি থেকে এক ঘোষণা বলে পূর্ব বাংলা থেকে গভর্নর শাসন ব্যবস্থা প্রত্যাহার করা হয়।
শেরে বাংলা ফজলুল হককে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানানো হয়। শেরে বাংলা ফজলুল হক নিজে মন্ত্রিসভা গঠন না করে আবু হোসেন সরকারকে মন্ত্রিসভা গঠনের দায়িত্ব প্রদান করেন। আবু হোসেন সরকার আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে নেজামে ইসলাম পার্টির সঙ্গে কোয়ালিশনে সরকার গঠন করেন।
মওলানা ভাসানী তখন ইউরোপে। সোহরাওয়ার্দী ডায়াবেটিকস ও লিভারের জটিলতায় অসুস্থ। শেরে বাংলা ফজলুল হক তার বাসভবনে। এ সময় বগুড়ার মোহাম্মদ আলী গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা হ্রাস করে সংবিধানে গণ-পরিষদের চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য পেশ করে আমেরিকায় যান।
পৃষ্ঠা-৩৭

গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ টের পেয়ে জেনারেল আইয়ুব খানের সহায়তায় সমগ্র পাকিস্তানের জরুরি অবস্থা জারি করেন, গণপরিষদ বাতিল করেন এবং মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। ১৯৫৪ সালের ২২শে সেপ্টেম্বর প্রধানমনী। গভর্নর জেনারেলের ক্ষমতা খর্ব করার জন্য সচেষ্ট হন আর গভর্নর জেনারেল ১৯৫৪ সালের ২০ সেপ্টেম্বর দৈনিক ইত্তেফাককে জন নিরাপত্তা আইনে নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিউইয়র্কে ব্যস্ততম দিন কাটাচ্ছেন এমন সময় জেনারেল আইয়ুব খান লন্ডন হয়ে সেখানে উপস্থিত হন এবং ৭ অক্টোবর, মোহাম্মদ আলীর সঙ্গে সাক্ষাত করেন। এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী চিকিৎসার জন্য জুরিখে অবস্থান করেছিলেন। আতাউর রহমান খান মওলানা ভাসানীর নির্দেশে লন্ডন রওনা হন। ১৯৫৪ সালের ১৬ অক্টোবর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে দেখা করে তিনি জুরিখে যান।
বগুড়ার মোহাম্মদ আলী ১৯৫৪ সালের ২৩ অক্টোবর নিউইয়র্ক থেকে করাচি ফেরেন। এরপর ২৪ অক্টোবরে গণপরিষদ মন্ত্রিসভা বাতিল করে জরুরি অবস্থা জারি করা হয় ।এদিনই ৮ সদস্য বিশিষ্ট এক নতুন মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়। এ মন্ত্রিসভাতেও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আইয়ুব খান প্রতিরক্ষামন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৫৪ সালের নভেম্বরে গণপরিষদের স্পীকার তমিজউদ্দীন খান গণপরিষদ ভেঙে দেওয়া সম্বলিত গভর্নর জেনারেলের ঘোষণার বিরুদ্ধে আদালতে আর্জি পেশ করেন।
এদিকে ১৯৫৪ সালের ১২ নভেম্বর সোহরাওয়ার্দী জুরিখ থেকে লন্ডনে এসে এক সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর জেনারেল গোলাম মোহাম্মদ গৃহীত পদক্ষেপগুলো সঠিক হয়েছে বলে মতামত প্রকাশ করেন। ১৯৫৪ সালের ২ ডিসেম্বর মাহমুদুল হক ওসমানী সাংবাদিকদের বলেন যে, আগামী ১১ ডিসেম্বরের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী দেশে ফিরবেন। সোহরাওয়ার্দী করাচি এসে পৌছলেন ১৯৫৪ সালের ১২ ডিসেম্বর। বিমান বন্দরে তাঁকে উষ্ণ সংবর্ধনা জানানো হয়। সোহরাওয়ার্দী সাংবাদিকদের কিছুই বললেন না। বিমান বন্দর থেকে বেরিয়ে আসার সময় শুধু বললেন যে, “গভর্নর জেনারেল অচিরেই রাজবন্দীদের মুক্তি দেবেন।”
১৯৫৪ সালের ১৮ ডিম্বের সোহরাওয়ার্দীর চেষ্টায় শেখ মুজিব জেল থেকে মুক্তি পেলেন। ১৯৫৪ সালের ৩০ মে ৯২ (ক) ধারা জারির পরে তিনি গ্রেফতার হয়েছিলেন।
বায়ান্নোর ভাষা আন্দোলনে বাঙালি তরুণদের আত্মদানের ফলে সুপ্ত বাঙালি জাতীয়বাদী চেতনা দ্রুত বিকাশ লাভ করতে থাকে। রাজনৈতিক চেতনার এ
পৃষ্ঠা-৩৮

পটভূমিতে ১৯৫৩ সালে ডাকসু নির্বাচনে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন কর্তৃক গঠিত গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট পরিষদ জয়লাভ করে। ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনকে কেন্দ্র করে স্বৈরাচার ও প্রতিক্রিয়াশীল চক্রকে পরাজিত করার আকাক্ষা দুর্বার হতে থাকে। পূর্ব বাংলার ছাত্রসমাজ পূর্ব বাংলার মাটি থেকে মুসলিম লীগকে উৎখাত করার লক্ষ্যে সমস্ত বিরোধী দলের সমন্বয়ে একটি যুক্তফ্রন্ট গঠনের ঐতিহাসিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ছাত্রদের গণতান্ত্রিক যুক্তফ্রন্ট বিরাজমান রাজনৈতিক অনৈক্য ও বিভেদের মাঝখানে পথ প্রদর্শকের ভূমিকা পালন করে।
নেতাজী ভবনে এক সংবর্ধনার জবাবে বিরাশি বছর বয়স্ক শেরেবাংলা ফজলুল হক আবেগ আপ্লুত কণ্ঠে বলেন, বাঙালি এক অখণ্ড জাতি। তারা এক ভাষায় কথা বলে এবং একই সুসংহত দেশে বাস করে। তাদের আদর্শ এক এবং জীবনধারণের প্রণালিও এক। বাংলা অনেক বিষয়ে সারা ভারতকে পথ প্রদর্শন করেছে এবং দেশ বিভাগ সত্ত্বেও জনসাধারণ তথাকথিত নেতৃবৃন্দের উর্ধ্বে থেকে কাজ করতে পারে।…আজ আমাকে ভারতের ভবিষ্যৎ ইতিহাস গঠনে অংশগ্রহণ করতে হচ্ছে। আশা করি ভারত কথাটি ব্যবহার করায় আমাকে আপনারা ক্ষমা করবেন। আমি এর দ্বারা পাকিস্তান ও ভারত উভয়কে বুঝিয়েছি। এ বিভাগকে আমি কৃত্রিম বিভাগ বলে মনে করতে চেষ্টা করব। আমি ভারতের সেবা করব।’ ৪ মে গ্রান্ড হোটেলে অনুরূপ এক সংবর্ধনার জবাবে তিনি বলেন, পশ্চিম বঙ্গের চেয়ে পূর্ব বঙ্গে বঙ্গভাষার জন্য উৎসাহ বেশি। এমনকি বঙ্গভাষাকে রাষ্ট্রীয় ভাষায় পরিণত করার জন্য পূর্ববঙ্গে একটি ক্ষুদ্র শিশুও প্রাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। আসুন, আমরা রাজনীতি ভুলে আমাদের মহান সংহতির ধারক শ্রেষ্ঠ ভাষার ঐতিহ্যের কথা চিন্তা করি। বাংলার মঙ্গল, বাংলা ভাষার সেবা, বাঙালি জাতির উন্নতি, হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে জনসাধারণের সেবায় জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলো নিয়োজিত করাই জীবনের একমাত্র আকাঙ্ক্ষা। জীবনের প্রান্ত সীমায় পৌছে আমার আর কোনো আশা বা আকাঙক্ষা নেই। উভয় বঙ্গের মধ্যে যে মিথ্যার প্রাচীর রচিত হয়েছে, তা অপসারিত করার কাজ আমি যদি আরম্ভ করে যেতে পারি, তাহলেই নিজেকে ধন্য মনে করব। দুই বাংলার মধ্যে যে ব্যবধান আছে তা একটি স্বপ্ন ও ধোকা মাত্র। করুণাময় খোদাতালার দরবারে আমার একটি প্রার্থনা তিনি যেন এ ব্যবধান দূর করেন। আমার এ আকাঙ্ক্ষা যেন পূর্ণ হয়। সে জন্যে আপনারা আমাকে দোয়া করুন।”
সোহরাওয়ার্দী ২০ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার অধীনে আইনমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। অথচ ১৯৪৬ সালে যুক্ত বাংলায় সোহরাওয়ার্দীর অধীনে বগুড়ার মোহাম্মদ আলী অর্থমন্ত্রী ছিলেন। সোহরাওয়ার্দী আইনমন্ত্রী হওয়ার পর এক ইউনিট প্রথা ও সংখ্যাসাম্য নীতি সমর্থন করেন,
পৃষ্ঠা-৩৯

এবং গণ পরিষদের পরিবর্তে কনভেনশনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র প্রণয়ন উত্থাপন করেন। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে তুমুল বিতর্কের সূত্রপাত হয় ।
জুন মাসে নতুন গণপরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ।পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হন জেনারেল ইসকান্দার মির্জা। কৃষক-শমিক পার্টির সমর্থনে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠিত হয়।
১৯৫৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী কলকাতায় তাঁর স্বেচ্ছা নির্বাসন শেষে ঢাকা ফিরে এলেন এবং শেখ মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পেলেন। যুক্তফ্রন্টে আওয়ামী লীগের সদস্য সংখ্যা ছিল সর্বাধিক। তবুও আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে যুক্তফ্রন্টের মন্ত্রিসভা গঠন করার ফলে ভাঙন অবশ্যম্ভাবী হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।।
পাঞ্জাব, সীমান্ত প্রদেশ, বেলুচিস্তান ও সিন্ধু—এ চারটি প্রদেশের সমন্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে একটি প্রদেশে পরিণত করা হয়। সংখ্যাসাম্য নীতির অর্থ ছিল জনসংখ্যার ভিত্তিতে গণ পরিষদ সদস্যের সংখ্যা নির্ধারণ না করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪০ জন (এর মধ্যে মুসলমান আসন ৩১ এবং অমুসলমান আসন ৯) এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৪০ জন গণপরিষদ সদস্য নির্বাচিত হবেন। সারা দেশে এর বিরুদ্ধে জনগণ প্রতিবাদে সোচ্চার হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও রাজনৈতিক নেতারা জনসংখ্যার ভিত্তিতে গণপরিষদে প্রতিনিধিত্ব করার দাবি উত্থাপন করেন। ১৯৫৬ সালে ৯ জানুয়ারি গণপরিষদে নতুন শাসনতন্ত্র রচনার কাজ শুরু হয়। নতুন শাসনতন্ত্রে এক ইউনিট ও সংখ্যাসাম্য নীতি গৃহীত হয়। এর ফলে আবহমান পূর্ব বাংলা সরকারিভাবে পূর্ব পাকিস্তানে পরিণত হয় এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ পূর্ব বাংলা প্রকৃতপক্ষে সংখ্যালঘিষ্ঠে পরিণত হয়।
এদিকে মাত্র ৯ মাস মন্ত্রী থাকার পর ১৯৫৫ সালের আগস্ট মাসে সোহরাওয়ার্দী মন্ত্রিসভা থেকে বাদ পড়েন। সর্বস্তরের জনগণের এক সমাবেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তোলার লক্ষ্যে সর্বদলীয় কর্মপরিষদ গঠিত হয়। আওয়ামী লীগ, গণতন্ত্রী দল, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, ছাত্র ইউনিয়ন এবং ছাত্রী সংসদ সমম্বয়ে এ পরিষদ গঠিত হয়। মওলানা ভাসানী এ পরিষদের চেয়ারম্যান এবং অলি আহাদ সম্পাদক নির্বাচিত হন।
এ পরিষদের আহ্বানে ২৯ জানুয়ারি (১৯৫৬) দেশব্যাপী প্রতিরোধ দিবস পালিত হয় এবং ৮ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত সংবিধানের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সপ্তাহ পালিত হয়।
১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে নতুন শাসনতন্ত্র চালু করা হলো। ঐ দিনটিকে সারাদেশে মহা আড়ম্বরে পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে উদ্যাপন করা
পৃষ্ঠা-৪০

হলো। শেরে বাংলা ফজলুল হক তখন পূর্ব বাংলা গভর্নর ছিলেন। নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে তিনি আবার আবু হোসেন সরকারকে নেতৃত্বে মন্ত্রিসভাকে শপথ গ্রহণ করালেন।
ইস্কান্দার মির্জা গোলাম মোহাম্মদের পরে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল হন এবং চৌধুরী মোহাম্মদ আলীকে পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আগে গোলাম মোহাম্মদের আমলে চৌধুরী মোহাম্মদ আলী বগুড়ার মোহাম্মদ আলীকে অপসারণ করে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন।
আর হোসেন সরকার ক্ষমতাসীন থাকাকালে পূর্ব বাংলায় প্রচণ্ড খাদ্যাভাব দেয়। খাদ্যের দাবিতে ভুখা-মিছিলের ওপর গুলিবর্ষণের ফলে আবু হোসেন সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ অনাস্থা প্রস্তাব আনে। গভর্নর ফজলুল হক ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান আনন। ১২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করেন। ১৯৫৭ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে পাকিস্তানি শাসকচক্রের বিরুদ্ধে চরম হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন যে, পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন আদায় না হলে পূর্ব বাংলা পশ্চিম পাকিস্তানকে আসসালামু আলাইকুম জানাবে। এ মঞ্চে তখন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শহীদ সোহরাওয়ার্দী উপবিষ্ট ছিলেন। বর্ষীয়ান জননেতা মওলানা ভাসানী সরাসরি স্বাধীনতার কথা না বললেও তিনি তাঁর ভাষণের মাধ্যমে স্বাধীনতার বীজ বপন করেছিলেন।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশনে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি উত্থাপন করেন আওয়ামী লীগ নেতা মহিউদ্দিন আহমদ। অধ্যপক মোজাফফর আহমদ, আসহাব উদ্দিন আহমদ ও শেখ মুজিব এ দাবির সমর্থনে বক্তৃতা করেন।
বৈদেশিক নীতির প্রশ্নে সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে মতপার্থক্যের কারণে মওলানা ভাসানী আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করেন এবং ১৯৫৭ সালের ২৭ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। গভর্নর জেনারেল ইসকান্দার মির্জা ও চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর মধ্যে দ্বন্দ্ব দেখা দিলে ইসকান্দার মির্জা কর্তৃক রাতারাতি গঠিত রিপাবলিকান পার্টি ও আওয়ামী লীগের কোয়ালিশন মন্ত্রিসভা গঠিত হয়। ১২ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। ইসকান্দার মির্জা সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের সমর্থন নেই এ অজুহাতে ১১ অক্টোবর (১৯৫৭) সোহরাওয়ার্দীকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করেন এবং মুসলিম লীগ নেতা আই আই চুন্দ্রীগড়কে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন। ৫৯
পৃষ্ঠা-৪১

দিন পরে ১৬ ডিসেম্বর ফিরোজ খান নুন প্রধানমন্ত্রী হন। ফিরোজ খান নুন ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী ১৯৫৯ সালে ১৬ ফেব্রুয়ারি সাধারণ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করেন। ১৯৫৮ সালের ১ মার্চ গভর্নর ফজলুল হক আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান খানের মন্ত্রিসভা বাতিল করেন। সোহরাওয়াদী প্রতিশোধমূলক ব্যবস্থা হিসেবে প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুনকে দিয়ে ফজলুল হককে পদচ্যুত করাতে সক্ষম হন। আবু হোসেন সরকার পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠন করেন, কিন্তু ১২ ঘন্টা পরে তার মন্ত্রিসভা বরখাস্ত হয়। পুনরায় আতাউর রহমান খান মন্ত্রিসভা গঠন করেন। কিন্তু ১৯ জুন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি সমর্থন প্রত্যাহার করার ফলে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। আওয়ামী লীগ-ন্যাপ সমঝোতা হলে আতাউর রহমান খান ২২ জুলাই পুনরায় মুখ্যমন্ত্রী হন।
১৯৫৮ সালের সেপ্টেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের অধিবেশন আহবান করা হয়। আওয়ামী লীগ স্পীকার আব্দুল হাকিমকে পাগল আখ্যায়িত করে স্পীকারের। বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনলে ২১ সেপ্টেম্বর পরিষদ কক্ষে ভীষণ বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী এ ঘটনায় গুরুতরভাবে আহত হন এবং হাসপাতালে প্রাণত্যাগ করেন। দেশের এ নাজুক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের ভাগ্যাকাশে শুরু হয় দুর্যোগের ঘনঘটা। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট তথা বাঙালির বিজয় পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থায় বাঙালিদের অংশগ্রহণের পথ প্রশস্ত করেছিল, কিন্তু পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক আমলাদের কাছে তা মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিল না। তারা অজুহাত খুঁজছিলেন ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করে একনায়কতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করার। ডেপুটি স্পীকার শাহেদ আলী হত্যাকাণ্ড ও রাজনীতিকদের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণ একটা অজুহাত খাড়া করে দিল। পাঞ্জাবি সামরিক-বেসামরিক চক্র সামরিক শাসন জারির পায়তারা শুরু করে দিল।
চরম রাজনৈতিক অস্থিরতা ক্ষমতা, রদবদল, ব্যক্তিগত আক্রোশ ও কুৎসা রটনা, ক্ষমতার দ্বন্দ্ব, রাজনৈতিক দলগুলোর অনৈক্য ও ভাঙনের ফলে পাকিস্তানে রাজনীতিতে নেমে এল ঘোর অমানিশা। ১৯৫৮ সালের মে মাসে জেনারেল আইয়ুব খান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে যান। আইয়ুব পেন্টাগনের জেনারেল নাথান টুইনিং, জেনারেল ওমর ব্রাডলী, পররাষ্ট্র সচিব জন ফস্টার ডালেস ও সিআইএ’র এ্যালান ডালেসের সঙ্গে সলা-পরামর্শ করে ১৮ মে দেশে ফিরে আসেন। এ বছরের ৭ অক্টোবর ইসকান্দার মির্জা সারাদেশে সামরিক আইন জারি করলেন, নুন-মন্ত্রিসভা ভেঙে দিলেন এবং ‘৫৬ সালের সংবিধান বাতিল ঘোষণা করলেন। পাকিস্তানে সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা চিরতরে বিলুপ্ত হলো। শুরু হলো
পৃষ্ঠা-৪২

পাকিস্তানের ইতিহাসে এক অন্ধকারময় অধ্যায়। জেনারেল আইয়ুব খানকে প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ করেন। আর ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান রাতের অন্ধকারে ইসকান্দার মির্জাকে ক্ষমতাচ্যুত করেন এবং দেশত্যাগে বাধ্য করেন। এভাবেই আইয়ুব খানের বহুদিনের উচ্চাভিলাষ পূর্ণ হলো । সর্বময় ক্ষমতা দখল করে আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে আবির্ভূত হলেন। শেখ মুজিব ৮ অক্টোবর সকালে সামরিক আইন জারির কথা জানতে পারেন। মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিব , আবুল মনসুর আহমদ ও অন্যান্য নেতাকে গ্রেফতার করা হয়। দেশের রাজনৈতিক দলগুলকে বিলুপ্ত করে দেওয়া হলো এবং সকল রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ করে দেওয়া হলো। ১৯৫৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর আইয়ুব খান পাকিস্তানের সব ভাষার জন্যে রোমান হরফ এবং একটি সাধারণ ভাষা সষ্টির প্রস্তাব করেন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা থেকে এর প্রতিবাদ করা হয়। অধ্যাপক মুহম্মদ আবদুল হাই ও অপ্যাপক মুনীর চৌদুরী এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা ভবিষ্যতের দুর্যোগময় দিনগুলোর কথা চিন্তা করে শিউরে উঠলেন।
আইয়ব খান তখন তার জাল ফেলতে শুরু করেছেন। ১৯৫৯ সালের ৭ আগস্ট তিনি দুটো আইন জারি করলেন। এর একটি হলো পোডো (পাবলিক অফিস ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার) এবং অপরটি এবডো (ইলেকটিভ বডি ডিসকোয়ালিফিকেশন অর্ডার)। ১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর আইয়ুব খান নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে ঘোষণা করলেন এবং পরদিন ২৭ অক্টোবর তিনি পালন করলেন তাঁর বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী। ক্ষমতা দখলের প্রথম বার্ষিকী উদযাপন উপলক্ষে তিনি বেসিক ডেমোক্রেসি বা বুনিয়াদী গণতন্ত্র নামে একটি পরিকল্পনা ঘোষণা করেন। আইয়ুব খানের আসল উদ্দেশ্য জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। পোডো এবং এবডো দিয়ে সোহরাওয়ার্দী, মওলানা ভাসানীসহ সকল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে রাজনীতি থেকে দূরে রাখার আইন প্রণয়ন ও বুনিয়াদী গণতন্ত্র চালুর ফলে সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে সংসদীয় গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অন্ধকারময় হলো। বুনিয়াদী গণতন্ত্র প্রবর্তনের ফলে উভয় প্রদেশে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হতে পারবেন এবং ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য দেশের প্রেসিডেন্ট, জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত করেন।
ময়মনসিংহের ছাত্ররা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারির সঙ্গে সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে। প্রাক্তন ছাত্রনেতা কাজী আবদুল বারির নেতৃত্বে ছাত্ররা প্রাতবাদ মিছিল বের করে। এ অপরাধে কাজী আব্দুল বারিকে গ্রেফতার করা হয়।
পৃষ্ঠা-৪৩

এবং সামরিক আদালতে ১০টি বেত্ৰদণ্ড প্রদানের শাস্তি দেওয়া হয়। এমনভাবে এ দণ্ড কার্যকর করা হয় যে, তিনি সারা জীবনের জন্যে বধির হয়ে যান।
১৯৬১ সালে যখন রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপিত হচ্ছিল, তখন পূর্বপাকিস্তানে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী যেন উদযাপিত না হতে পারে সেই লক্ষ্যে ষড়যন্ত্র চালানো হয়। খাজা শাহাবউদ্দিনের জামাতা মুসা আহম্মদ তখন পূর্ব পাকিস্তানের তথ্য সচিব। বাংলা একাডেমিতে এ বছর রবীন্দ্র জন্ম-শতবার্ষিকী উপলক্ষে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়নি। কিন্তু বিচারপতি মাহবুব মোর্শেদ ও অধ্যাপক খান সরওয়ার মুরশিদ-এর নেতৃত্বে গঠিত রবীন্দ্র জন্মশতবার্ষিকী কমিটি সপ্তাহকালব্যাপী অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এভাবেই আইয়ুব বিরোধী আন্দোলনের প্রথম প্রকাশ ঘটে। এ সময় পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদদের আলোচনা মধ্য দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অর্থনেতিক বৈষম্য ও পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের স্বরূপ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। পূর্ব বাংলার অর্থনীতিবিদরা পাকিস্তানের দুই অংশের জন্য। পৃথক অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রয়োজনীয়তার কথা প্রচার করতে থাকেন। বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক রেহমান সোবহান ‘টু ইকোনোমি থিউরি’ প্রচার করেন। ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি আইয়ুব খানের পরিকল্পনা অনুযায়ী মৌলিক গণতন্ত্রী সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। এ নির্বাচনে ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী নির্বাচিত হলেন। নিন্দুকেরা বলল ৮০ হাজার ফেরেশতা পয়দা করা হলো। ১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। আইয়ুব খান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী। এ নির্বাচনের তাঁর কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন না। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রীর ‘হ্যা অথবা না’ সূচক ভোটের মাধ্যমে প্রহসনমূলক নির্বাচনের শতকরা ৯৫ ভাগ ভোট পেলেন আইয়ুব খান। ১৭ ফেব্রুয়ারি তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন।
১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি করাচিতে সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ঢাকা আসেন। সোহরাওয়ার্দী গ্রেফতারের খবরে ঢাকায় ছাত্র-জনতার মধ্যে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে রাজপথে মিছিল বের করে। দীর্ঘ কয়েক বছরের জোরপূর্বক স্তব্ধ করে দেওয়া রাজনৈতিক চেতনা। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে ও রমনার রাজপথে বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
২৭ এপ্রিল শেরে বাংলা ফজলুল হক পরলোকগমন করেন। সোহরাওয়ার্দী ৬ মাস ২০ দিন কারাগারে থাকার পর ১৬ সেপ্টেম্বর ঢাকায় আসেন। ঢাকাবাসী সোহরাওয়ার্দীকে এক অভূতপূর্ব সংবর্ধনা জানায়। প্রকৃতপক্ষে মরহুম ফজলুল
পৃষ্ঠা-৪৪

হকের শোভাযাত্রা ও সোহরাওয়ার্দীকে নিয়ে যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল,তার মধ্য দিয়ে বাঙালি জাতির মনোভাব স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
১৯৬২ সালে হামুদুর রহমান শিক্ষা কমিশন রিপোর্টের বিরুদ্ধে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্রসমাজ প্রবল আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ‘৬২ সালের ১৭ সেপ্টেম্বরকে শিক্ষা দিবস হিসেবে পালন করে। আইয়ুব খান চরম দমন নীতির আশ্রয় গ্রহণ করেন। বিক্ষোভরত মিছিলের গুলিবর্ষণের ফলে ওয়াজিউল্লাহ, বাবুল ও মুস্তাফিজ শহিদ হন। ‘৬২-৬৩ সালে ছাত্র-বিক্ষোভ ও আন্দোলনের ফলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২৭ দিনের বেশি ক্লাশ হয়নি।
কথিত আছে প্রেসিডেন্ট ইসকান্দার মির্জার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সভায় আইয়ুব খান প্রধান বিচারপতি মোহাম্মদ মুনীরকে এক নতুন সংবিধান কীভাবে সমর্থিত করা যায় সে বিষয়ে পরামর্শ দিতে বলেন। বিচারপতি মনীরের জবাব ছিল চমকপ্রদ ও হাস্যকর। তিনি বলেন, এটি অতি সামান্য ব্যাপার। প্রাচীন কালে গ্রিক রাষ্ট্রগুলোতে গণকণ্ঠের সমর্থনেই সংবিধান গৃহীত হতো। এখন পাকিস্তানেও সেভাবে করা যেতে পারে। আইয়ুব খান বিচারপতি মুনীরকে গণকণ্ঠের সমর্থন কথাটি বিশ্লেষণ করতে অনুরোধ করলে বিচারপতি মুনীর বলেন খসড়া সংবিধান তৈরি হলে তা প্রথমে সংবাদপত্রে প্রকাশ করতে হবে। তারপর আইয়ুব খান করাচির নিশতার পার্কে, ঢাকার পল্টন ময়দানে, লাহোরের মুচিগেটে এবং পেশোয়ারের চক ইয়াদগারে জনসভা করে সংবাদপত্রে প্রকাশিত সংবিধানের উপর জনসমর্থন চাইবেন। বিচারপতি আরো বললেন, এক্ষেত্রে অবশ্যই জনগণ তাদের সমর্থন সোচ্চারে ঘোষণা করবে আইউব খানের অট্টহাসিটি ছিল সর্বোচ্চ গ্রামে। পরবর্তীকালে আইয়ুব খান সংবিধান অনুমোদনের এ পথ অনুসরণ না করলেও প্রধান বিচারপতি গুরুত্ব সহকারেই এ পরামর্শ দিয়েছিলেন।
১৯৬২ সালের আইয়ুব খান যে সংবিধান দিলেন, তার ফলে আইয়ুব খানের আজীবন প্রেসিডেন্ট থাকার পথ পরিষ্কার হয়ে গেল। কারণ এ সংবিধান অনুযায়ী ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্য রাষ্ট্রপতি নির্বাচন করবেন। আর নানা সুযোগ-সুবিধা, আর্থিক আনুকূল্যে ও সামাজিক আধিপত্য প্রদানের মাধ্যমে এসব সুযোগসন্ধানী মৌলিক গণতন্ত্রী সদস্যদের মাথা ক্রয় করা ছিল পানির মতো সহজ।
একথা অনস্বীকার্য যে, ভাষা আন্দোলনই বাঙালি রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও বুদ্ধিজীবীদের চোখ খুলে দিয়েছিল। ১৯৫৪ সালের নির্বাচনে বাঙালির জয়লাভের
পৃষ্ঠা-৪৫

মূল কারণ ছিল বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির মর্যাদা রক্ষা ও পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের দাবি। ‘পূর্ব বাংলার উপরে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণের অবসান চাই’-এর ধ্বনি মূর্ত হয়েছিল নির্বাচন রায়ের মাধ্যমে। পশ্চিম পাকিস্তানের এ উপনিবেশবাদ থেকে মুক্তির উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের মাধ্যমে ব্যাপক গণআন্দোলন শুরু করেন। জনমতকে জাগ্রত করার উদ্দেশ্যে সে সময় আওয়ামী লীগ একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেছিল। এ পুস্তিকাটির নাম ছিল ‘কেন পূর্ববঙ্গের অটোনমি চাই।’ এ পুস্তিকার খসড়া তৈরি করেছিলেন স্বয়ং শেখ মুজিব। এ পুস্তিকার আংশিক উদ্ধৃতি এখানে প্রণিধানযোগ্য।… “পাকিস্তান একটি অখণ্ড ভৌগোলিক অঞ্চল নয়। এ রাষ্ট্রের দুটি অঞ্চল বিমানপথে এক হাজার মাইল এবং জলপথে তিন হাজার মাইল ব্যবধানে অবস্থিত। কানাডা ও ব্রিটেনের মধ্যে যে ব্যবধান, পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবধান তার চেয়েও বেশি। ….. পূর্ববঙ্গ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন। এক হাজার মাইল দূরে প্রতিষ্ঠিত সরকারি সিদ্ধান্তে তাই অবিচার হতে বাধ্য। পাকিস্তানের দু ভূখণ্ডের অর্থনীতির ভিত্তি সম্পূর্ণ পৃথক।… প্রায় সমস্ত জিনিসই প্রথমে করাচিতে আমদানি করা হয়। তারপরে আবার রফতানি করা হয় পূর্ব পাকিস্তানে। তার ফলে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাল রফতানি করার জন্য অতিরিক্ত দাম ধার্য করে। সেজন্য বিদেশি জিনিসপত্র পূর্ববঙ্গের বাজারে অত্যন্ত চড়া দামে বিক্রি হয়।… জোর-জুলুম করে অথবা পিস্তল দেখিয়ে কোনো দেশে ঐক্য স্থাপন করা সম্ভব নয়।… পাকিস্তানে দুই ভূখণ্ডে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আমদানির ক্ষেত্রে যে পক্ষপাতিত্ব করা হচ্ছে তার ফলে পূর্ববঙ্গের জনজীবন গুরুতরভাবে বিপন্ন হচ্ছে।”
ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, ঐতিহাসিক কাগমারী সম্মেলনে স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও পশ্চিম-পাকিস্তানকে আস্সালামু আলাইকুম জানিয়ে মওলানা ভাসানীর চরম সতর্কবাণী উচ্চারণ ও শেরে বাংলার কলকাতা সফরকালীন বক্তৃতা বাংলাদেশের স্বাধীনতা চিন্তার বহিঃপ্রকাশ। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবুর রহমান, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ও শেরে বাংলা ফজলুল হককে বাঙালি জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনরত্ন। হিসেবে অভিহিত করা যায়।
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পূর্ব বাংলা নামের বিলুপ্তি ঘটানোর প্রতিবাদে গণপরিষদের শেখ মুজিব দীর্ঘ জোরালো ভাষণ দিয়েছিলেন। এর আগে করাচিতে শেখ মুজিব আওয়ামী লীগ সদস্যদের এক ঘরোয়া বৈঠকে বলেন, ভারত বিভাগের ফলে পাঞ্জাব ও বাংলাকে ভাগ করা হয়েছে। পাকিস্তানের পাঞ্জাব নাম ছাড়েনি। অথচ আমাদের নাম বদলে পূর্ব পাকিস্তান রাখা হয়েছে। বাঙালি
পৃষ্ঠা-৪৬

জাতীয়তাবাদের আন্দোলনকে আমাদেরকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে । (এম,আর, আখতার মুকুলঃ আমরাই বাঙালি)।
বিদেশি সাহায্য হিসেবে প্রাপ্ত রফতানি ও কর বাবদ থেকে কোটি কোটি টাকা পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের জন্য ব্যয় করা হয়। রাজধানী থেকে শুরু করে সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তর ও অন্যান্য সামরিক প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয় পশ্চিম পাকিস্তানে।
১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ৩০ কোটি টাকা করে মোট ১৮০ কোটি টাকা পূর্ব বাংলা থেকে নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নের কাজে ব্যায় করা হয়েছে। ১৯৪৮ ও ১৯৪৯ এ দুই বছরে প্রাদেশিক সরকারের উন্নয়ন খাতে সরকার প্রদত্ত ঋণের ২৪ কোটি টাকার মধ্যে এক পাঞ্জাবেই বরাদ্দ হয় ১০ কোটি টাকা আর পূর্ব বাংলায় মাত্র ৮ কোটি টাকা।
১৯৪৯-৫০ ও ১৯৫০-৫১ সালের উন্নয়ন খাতে বরাদ্দকৃত অর্থের শতকরা ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত পূর্ব বাংলা যে বৈদেশিক মুদ্রা আয় করেছিল তার সবটাই ব্যয় করা হয় পশ্চিম পাকিস্তানে। পঞ্চাশের দশকের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও অর্থনৈতিক শোষণের পরিপ্রেক্ষিতে স্বাধীনতার চিন্তা-চেতনার জন্ম হয়। এ পটভূমিতে ষাটের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি চলে।
ইতোমধ্যে ১৪ মাস কারাভোগের পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু শেখ মুজিবকে মিথ্যা হয়রানিমূলক মামলায় আবার জড়ানো হয়। তাঁকে ক্ষমতা অপব্যবহারের অভিযোগে পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা সহ দু’বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। শেখ মুজিব আপীল সাপেক্ষে জামিনের আবেদন জানালে বিচারপতি ইদ্রিস আবেদন মঞ্জুর করেন।
পৃষ্ঠা-৪৭

তৃতীয় অধ্যায়
আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবন ও সামরিক শাসন বিরোধী আন্দোলন।
হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বিরুদ্ধে এবডো’ আরোপের মাধ্যমে রাজনৈতিক তৎপরতা নিষিদ্ধ ছিল। তথাপি তাঁর পক্ষে আর নিষ্ক্রিয় থাকা সম্ভব ছিল না। পরিস্থিতি তাঁকে বাধ্য করে রাজনীতিতে উপস্থিত হতে। তিনি আসন্ন রাজনৈতিক পটভূমিকায় ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা নির্ধারণের পরিপ্রেক্ষিতে পূর্ব বঙ্গের নেতাদেরকে এক গোপন বৈঠকের আহ্বান জানান। এ আহ্বানের ফলে আতাউর রহমান খানের বাসভবনে ১৯৬২ সালের ২৪ জানুয়ারি রাত্রে শেখ মুজিব, হামিদুল হক চৌধুরী, তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া), আর হোসেন সরকার, মোহাম্মদ আলী, ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) প্রমুখ উপস্থিত হয়ে আলোচনা শুরু করেন। সোহরাওয়ার্দী দলমত নির্বিশেষে সব বিভেদ-বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে এক আদর্শের ভিত্তিতে সংগ্রাম করার আহ্বান জানালে সকল নেতাই তা সমর্থন করেন। এ বৈঠকে গোপনে তাঁদের আদর্শ ও উদ্দেশ্য প্রচার করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। বৈঠকের পরদিন সোহরাওয়ার্দী করাচি যান। কথা ছিল, সাতদিন পর তিনি ঢাকায় ফিরে এসে এ ব্যাপারে সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তার আগেই ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি তাঁকে নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। সোহরাওয়ার্দীকে গ্রেফতারের সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে আগুন জ্বলে উঠল। সরকারের টনক নড়ে গেল। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান তখন ঢাকায়। তার উপস্থিতিতেই ছাত্ররা বিক্ষোভে ফেটে পড়ল। তরুণ ছাত্রসমাজ রাস্তায় নেমে পড়ল। এ প্রথম আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন গড়ে উঠলো এবং আন্দোলনের নেতৃত্বে ছিলেন সোহরাওয়ার্দীর যোগ্য শিষ্য অকুতোভয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সমস্ত বাধা নিষেধ উপেক্ষা করে বীর দর্পে রাজপথে নেমে পড়লেন শেখ মুজিব। আন্দোলন যাতে বেগবান না হয় সেজন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নির্দিষ্ট সময়ের এক মাস আগেই বন্ধ ঘোষণা করা হয়। ফেব্রুয়ারি ৬ তারিখে ছাত্ররা এক সভা করে এর প্রতিবাদ জানান। প্রতিবাদ সভার পর ছাত্ররা সোহরাওয়ার্দীসহ অন্যান্য রাজবন্দীর মুক্তির দাবিতে শ্লোগান দিতে দিতে মিছিল
পৃষ্ঠা-৪৮

সহকারে ঢাকা শহর পদক্ষিণ করে। শুধু তাই নয়, বিক্ষুদ্ধ ছাত্র জনতা প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের ছবিকেও পদদলিত করে ও তাতে অগ্নি সংযোগ করে। পরদিনই ৭ ফেব্রুয়ারি গোটা দেশে পূর্ণ হরতাল পালনের আহবান জানানো হয়। শেখ মুজিব হরতালে নেতৃত্ব দিতে পারলেন না। তার আগেই অর্থাৎ ৬ ফেব্রুয়ারি গভির রাতে ‘পাকিস্তান জননিরাপত্তা অর্ডিন্যান্সে ‘ তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। শেখ মুজিবের সাথে আর যাঁদের গ্রেফতার করা হয় তাঁরা হলেন – আবুল মনসুর আহমদ, সৈয়দ আলতাফ হোসেন, (পরে মোজাফফর ন্যাপের ভাইস প্রেসিডেন্ট),তাজউদ্দিন আহমদ, তফাজ্জল হোসেন ,কোরআন আলী , ফণীভূষণ মজমদ , আব্দুর রব সেরনিয়াবাত প্রমুখ
৭ ফেব্রুয়ারি গণবিক্ষোভ দানা বেঁধে উঠলসা । হলি ফ্যামিলি হাসপাতালের সামনে এক বিরাট জঙ্গী মিছিলের ওপর পুলিশ-মিলিটারী কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ ও ব্যাপক লাঠিচার্জ করে। বিক্ষোভকারীরা এর ফলে আরও বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।তেজগাঁও এয়ারপোর্টের সামনে আইয়ুবের সম্মানে নির্মিত একটি তোরণ জনতা ভেঙ্গে ফেলে ।
১৯৬২ সালের ১ মার্চ পাকিস্তানের নয়া শাসনতন্ত্র পেশ করা হয়। আতাউর বহমান খান লিখেছেন : “এক হাজার নয়শ বাষট্টি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পয়লা মার্চের হিজরী মোতাবেক এক হাজার তিনশ’ একাশি সালের তেইশে রমজান আইয়ুব খান প্রণীত শাসনতন্ত্র ভূমিষ্ঠ হলো।” [স্বৈরাচারের ১০ বছর : আতাউর রহমান খান; পৃ. ১৯৮]
আল্লাহর নামে শুরু করে ও নিজের নামে শেষ করে আইয়ুব ভূমিকা দান করেনঃ “এক হাজার নয়শ বাষট্টি সালের ফেব্রুয়ারি মাসের পয়লা মার্চ তারিখে পাকিস্তানের জনগণ আমাকে যে ম্যান্ডেট দিয়েছে তারই বলে বলীয়ান হয়ে পাকিস্তানের উত্তরোত্তর অগ্রগতি লাভ, বিশ্ব দরবারে মর্যাদার আসন গ্রহণ, আন্তর্জাতিক শান্তি, মানবতার কল্যাণ সাধনে পাকিস্তানের জনগণের যথাযোগ্য সহায়তা প্রদান ইত্যাদি শুভ ইচ্ছায় প্রণোদিত হয়ে আমি মোহাম্মদ আইউব খান, হিলারে পাকিস্তান, হিলারে জুরাত, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট অদ্য তারিখে এ শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিলাম।”
এক ব্যক্তির দেওয়া শাসনতন্ত্র! পাকিস্তানের জনগণের উল্লেখ অবান্তর। তারা কোনো ম্যান্ডেট দেয় নাই। [স্বৈরাচারের ১০ বছর ও পৃ. ১৯৮]
এ শাসনতন্ত্রের প্রধান দুটো বৈশিষ্ট্য ছিল :
১। সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত। দেশের সর্বময়কর্তা প্রেসিডেন্ট। তিনি সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী।
পৃষ্ঠা-৪৯

২। জনগণের ওপর পূর্ণ অনাস্থা। তাদের প্রত্যক্ষ ভোটে দেশের সর্বসময় ক্ষমতাধিকারী প্রেসিডেন্টকে নির্বাচনের অধিকার জনগণের নেই। সরকার কতিপয় দালাল সৃষ্টি করে দেবে–তারাই প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবে।
আইয়ুবের এ শাসনতন্ত্রের বর্ণনা দিতে গিয়ে আতাউর রহমান খান যথার্থী। লিখেছেনঃ “গণতন্ত্রের বহির্বাস বহাল করা হয়েছে অন্তর অসার কেন্দ্রে ও প্রদেশে পরিষদ হবে। তাদের অধিবেশনও হবে। সেখানে বক্তৃতা, তর্কবিতর্ক প্রশ্নোত্তর সবই হবে। তার জন্য আইন কানুনও প্রণীত হবে। অর্থাৎ সংবাদপত্রের খাদ্য পুরোপুরি থাকবে। পরিষদে সব বিষয়ের আলোচনা হবে। এমনকি রাষ্ট্রেরও। কিন্তু তার ওপর ভোটাভোটি চলবে না। স্থিতিশীলতা নষ্ট হয়ে যাবে । অর্থাৎ পরিষদ রবার স্ট্যাম্প, পঙ্গু ও ক্লীব। তবুও সদস্যের মান মর্যাদা আছে। পদাধিকার আছে। মন্ত্রীমন্ডলির থাকারও ব্যবস্থা আছে।…তাদের গাড়ি বাড়ি থাকবে। আরদালী চাররাশিও থাকবে। থাকবে না শুধু ক্ষমতা। ক্ষমতা থাকবে প্রেসিডেন্টের হাতে এবং তারই হুকুমে গভর্নর ও কর্মচারীরা ক্ষমতার অধিকারী হবেন।” [পূর্বোক্ত : পৃ. ১৯৮-১৯৯]।
পূর্ব বাংলার জনগণ স্বৈরাচার আইয়ুবের এ শাসনতন্ত্র মেনে নিতে পারেনি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রসমাজ ১৫ মার্চ এ শাসনতন্ত্রের প্রতিবাদে ধর্মঘট আহ্বান করে। মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ শাসনতন্ত্রের। দুটি কপি ভস্মিভূত করা হয়। আইয়ুব খান সরকার ও শাসনতন্ত্র বিরোধী কার্যকলাপে বাঙালিদের ওপর ভীষণ ক্ষেপে যান।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ২৪ মার্চ ৩-দফা দাবির ভিত্তিতে পুনরায় অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট শুরু করে।
১। নয়া শাসনতন্ত্র অবিলম্বে বাতিল কর।
২। দেশে পূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম কর।
৩। সোহরাওয়ার্দী ও মুজিব সহ সকল রাজবন্দীর মুক্তি দাও।

১২ দিন ধর্মঘট পালনের পর ছাত্ররা ৪ এপ্রিল তা সাময়িকভাবে তুলে নেন। এরই মধ্যে ঘোষণা করা হয়েছিল যে, নয়া শাসনতন্ত্রের অধীনে ১৯৬২ সালের ২৮ এপ্রিল পাকিস্তান প্রথম জাতীয় পরিষদের সদস্য নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। কিন্তু ছাত্রসমাজ এ শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে ক্রমাগত বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দও এ নির্বাচন থেকে বিরত থাকার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু প্রাক্তন মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ আইয়ুব খানের এ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন। কোনো রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দিতা না থাকায় মুসলিম লীগ প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করেন। বগুড়ার মোহাম্মদ আলী,
পৃষ্ঠা-৫০

হাবিবুর রহমান, ফজলুল কাদের চৌধুরী, মুনেম খান ও সবুর খান প্রমুখ ব্যক্তিরা নির্বাচনে জয়লাভ করে পরবর্তীকালে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সুযোগ পান।
১৯৬২ সালের ২৭ এপ্রিল শুক্রবার শেরে বাংলা ফজলুল হক ৮৮ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ইন্তেকাল করেন। সারা বাংলার মানুষ শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। ৮ জুন আইয়ুব খান সামরিক আইন প্রত্যাহার করেন এবং একই দিনে জাতীয় পরিষদের সদস্যরা নতুন শাসনতন্ত্রের অধীনে শপথ গ্রহণ করেন। আইয়ুব খানের নতুন মন্ত্রিসভায় যারা স্থান পেলেন তারা হলেন : সবুর খান, ফজলুর কাদের চৌধুরী, ওয়াহিদুজ্জামান ও বগুড়ার মোহাম্মদ আলী। প্রসঙ্গত উল্লেখ যে, সামরিক শাসন প্রত্যাহার হওয়ার পর ছাত্রদের ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর জোরদার আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে আইয়ুব খান ১৯৬২ সালের ১০ মে The oplitical organization (Prohibition of unregulated activities ordinance of 1962. নামে এক অধ্যাদেশ জারি করেন। এ অধ্যাদেশের বলে আসন্ন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনের পূর্ব পর্যন্ত রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়।
শেখ মুজিব ১৯৬২ সালের ১৮ জুন ভোরে মুক্তিলাভ করেন। এর কয়েকদিন আগে তাজউদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদসহ কয়েকজন রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিক মুক্তি পান। শেখ মুজিব জেল থেকে বেরিয়ে এসে তুমুলভাবে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সূত্রপাত করেন। বাঙালি জাতিকে পশ্চিমা শোষণ থেকে রক্ষা করার জন্য আতাউর রহমান খান ও অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলোচনা অব্যাহত রাখেন। এক কয়েকদিন পরে ২৪ জুন পূর্ব বাংলার শীর্ষস্থানীয় ৯ জন রাজনৈতিক নেতা বিবৃতি দেন যা ২৫ জুন খবরের কাগজগুলোতে প্রকাশিত হয়। এ বিবৃতি ইতিহাসে ৯ নেতার বিবৃতি নামে পরিচিত। এ বিবৃতিতে স্বাক্ষর করেন শেখ মুজিবুর রহমান, আতাউর রহমান খান, হামিদুল হক চৌধুরী, আবু হোসেন সরকার, সৈয়দ আজিজুল হক, পীর মহসিন উদ্দিন আহম্মেদ, ইউসুফ আলী চৌধুরী মোহন মিয়া, নূরুল আমিন ও মোহাম্মদ আলী। বিবৃতিটি নিম্নরূপ : “সত্যিকার গণপ্রতিনিধি ছাড়া কোনো ব্যক্তির শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার অধিকার নাই। করলে তা স্থায়ী, সহজ ও কার্যকরী হতে পারে না। জনগণ সাবভৌম-এ হচ্ছে গণতন্ত্রে সার কথা। জনগণই সমস্ত ক্ষমতার উৎস। তাদের ইচ্ছানুযায়ী সকল ক্ষমতা প্রয়োগ করতে হবে। এ ইচ্ছার স্বতঃস্ফূর্ত বাধা-বিঘ্নমুক্ত ও অবাধ বিকাশের একান্ত প্রয়োজন। শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় গণ প্রতিনিধির লক্ষ্য থাকে যাতে কালের ঘাতপ্রতিঘাত সহ্য করে শাসনতন্ত্র টিকে থাকতে পারে এবং সম্ভাব্য বাধা বিপত্তি ও সংকট মুক্ত হয়ে নিজের অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে।
পৃষ্ঠা-৫১

শাসনতন্ত্রকে স্থায়িত্বের বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত গুণসম্পন্ন হতে হলে সমগ্র জাতিত ইচ্ছা ও বিচার বুদ্ধির প্রতিফলন অবশ্যই থাকতে হবে। এ পদ্ধতিতে প্রণীত বিধানগুলোই বর্তমান ও ভবিষ্যতে ভাবি বংশধরদের মনে অকৃত্রিম আনুগত্য ও আবেগের প্রেরণা দিতে পারে। এ আনুগত্য ও আবেগই শাসনতন্ত্রের প্রধান অবলম্বন এবং দুর্ভেদ্য বর্মবিশেষ। জনমতের ওপর নির্ভর না করে বাইরে থেকে চাপানো শাসনতন্ত্র বিপর্যয়ের মুখে জনসমর্থন লাভ করতে পারে না।
বর্তমানে শাসনতন্ত্রে এ গুণাবলির না থাকায় এটা অন্তঃসার শূন্য। যতই প্রচার করা হোক না কেন জনমতের প্রতি উপেক্ষা ও অনাস্থাই এ নয়া শাসতন্ত্রের ভিত্তিভূমি। আট কোটি (তখন যা ছিল) জনসংখ্যার মধ্যে মাত্র আশি হাজারকে দেওয়া হয়েছে ভোটের অধিকার। আবার এ অতি কম সংখ্যক ভোটারের ভোটে নির্বাচত যে পরিষদ তাকেও সত্যিকার কোনো ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। মাত্র তিন সপ্তাহের অভিজ্ঞতা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, আমূল পরিবর্তন না করলে এ শাসনতন্ত্র কাজের অনুপযোগী।
সরকারি নীতি ও কার্যকলাপ নির্ধারণ বা নিয়ন্ত্রণের কোনো ক্ষমতা সদস্যদের না থাকার ফলে শুধু মাত্র সরকারের তীব্র ও চরম সমালোচনার মাধ্যমে সদস্যরা নিজেদের যোগ্যতা প্রমাণ করতে প্রলুব্ধ হবে। যোগ্য ও স্বাধীনচেতা ব্যক্তি এ ধরনের সরকারে যোগ দিতে কোনো আগ্রহ বোধ করবে না। ফলে শাসন ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ আমলাতন্ত্রের হাতের মুঠোর মধ্যে গিয়ে পড়বে।
যথাসম্ভব দ্রুত নির্বাচনের মাধ্যমে একটি বিশেষ সংস্থা গঠন করে দেশবাসী বিনা দ্বিধায় গ্রহণ করতে পারে এমন একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করার আহ্বান আমরা জানাই। ছয় মাসের মধ্যে একটি সুষ্ঠু শাসনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব বলে আমরা মনে করি। শাসনতন্ত্র প্রেসিডেন্সিয়াল না পার্লামেন্টারি হওয়া উচিত, সে প্রশ্নের জবাব আমরা এখন দিতে চাই না। তবে দেশের জনসংখ্যগরিষ্ঠ অংশ পার্লামেন্টারি ধরনের সরকার কায়েমের পক্ষপাতি; কেননা বহুকাল ধরে ঐ ধরনের শাসন পদ্ধতির সাথে আমাদের পরিচয় ঘটেছে এবং তার অভিজ্ঞতা অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। শাসনতন্ত্র ফেডারেল বা ইউনিটারী হবে, এ প্রশ্নের জবাবের প্রয়োজন হবে না বিচিত্র ভৌগোলিক অবস্থানের পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেল শাসনতন্ত্রই গ্রহণ যোগ্য হবে; এতে সন্দেহের অবকাশ নেই। একটি জ্বলন্ত সমস্যার সমাধান করা একান্ত কর্তব্য-সেটা দুই অংশের মধ্যে ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক উন্নয়নমূলক বৈষম্য। উভয় অংশের জনগণের সদিচ্ছার অভাব নেই। তাই আমরা মনে করি গণপ্রতিনিধিদের সত্যিকার দায়িত্ব দিলে, তারা সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে, দেশের সামগ্রিক উন্নয়নে কাজে মনযোগ দেবে আর অনুন্নত অঞ্চলগুলোর দিকে অধিক দৃষ্টি নিবদ্ধ করবে, এটা সুনিশ্চিত।
পৃষ্ঠা-৫২

এতকাল ধরে রাষ্ট্রের নীতি নির্ধারণের ব্যাপারে জনগণের কোনো কথা বলার সুযোগ না থাকায় সংকীর্ণমনা ও শ্রেণি স্বার্থের রক্ষকদের হাতে পড়ে দুই অংশের ভেতর উন্নয়নের ক্ষেত্রে পর্বত প্রমাণ বৈষম্য সৃষ্টি হয়ে পড়েছে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে একবার যদি রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমত প্রতিষ্ঠা লাভ করতে পারে তাহলে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির কায়েমী স্বার্থের দিন শেষ হয়ে যাবে। পূর্ব পাকিস্তান অর্থনৈতিক ব্যাপারে সত্যিকার রাজনৈতিক ক্ষমতার অংশীদার হওয়ার সুযোগ পাই নাই বললেই চলে। কারণ দুই অঞ্চলের বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছে। আজাদী লাভের পর সমস্ত রাজনৈতিক ক্ষমতার সমাবেশ হয়েছিল মুষ্টিমেয় সরকারি অফিসারদের হাতে। তার ওপর দেশে একটিও সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান না হওয়ার ফলে জনগণ রাষ্ট্র পরিচালনার ব্যাপারে কথা বলার সুযোগ পায় নাই। এমতাবস্থায় অন্তর্বর্তীকালে কি করণীয় সেইটাই হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচ্য বিষয়। সামরিক শাসন উঠে যাওয়ার ফলে দেশে যে সদিচ্ছার উদ্ভব হয়েছে, তাকে জোরদার করে তোলার জন্য প্রয়োজন হচ্ছে গভীর রাজনৈতিক প্রবক্তার জনসাধারণ ও সরকারি শাসনতন্ত্রের মধ্যে ব্যবধানের প্রাচীর আর গড়ে উঠতে দেওয়া হবে না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের দায়িত্ব অপরিসীম। আমরা আশা করি তিনি এটা বুঝতে অক্ষম নন।
আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতি মনে একটি স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়া সাপেক্ষে দেশের সরকার পরিচালনার কাজ চালিয়ে যেতে হবে। তাই আমাদের প্রস্তাব ওনিশ শ ছাপ্পান্ন সালের শাসনতন্ত্রের মৌলিক অধিকার সংক্রান্ত অধ্যায়গুলো নয়া শাসনতন্ত্রে সন্নিবেশিত করে জনসাধারণের মৌলিক অধিকার আদালতের এক্তিয়ার করতে হবে।
যে পরিষদ বর্তমান বিধান অনুযায়ী গঠিত হয়েছে তার ওপর সরকারের আস্থা ও বিশ্বাস স্থাপন করতে হবে। লাভজনক পদ বণ্টন করে ভাগ্যবান সদস্যদের নিয়ে পরিষদ গৃহ ভর্তি করার আসক্তি বর্জন করতে হবে। তা না হলে যে ক্ষীণমাত্রা স্বাধীনতা পরিষদের আছে তাও বিলুপ্ত হয়ে যাবে। একথা ভুললে চলবে না যে, বিশ্বাসেই বিশ্বাস বৃদ্ধি পায়। সরকারের ওপর জনগণের আস্থা যাতে ফিরে আসে তার জন্য বিনা বিচারে আটক সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। তাদের বিরুদ্ধে গৃহীত যাবতীয় শাস্তিমূলক ব্যবস্থা বাতিল করে দিতে হবে। রাজনৈতিক দল গড়ে ওঠার পর পথে যতকিছু বাধা অন্তরায় আছে তার অবসান ঘটাতে হবে। দেশের সকলকে সমবেতভাবে এসব সমস্যার সমাধানের কাজে এগিয়ে আসতে হবে। দেশ একটি বিরাট পরীক্ষার মুখে। এক অস্থির অবস্থায় দেশ সম্মুখের দিকে অগ্রসর হচ্ছে।
পৃষ্ঠা-৫৩

আমাদের শেষ আহ্বান আসুন, সকলে মিলে যতশীঘ্র সম্ভব শাসনত প্রণয়ন করে সমস্ত বিতর্ক বন্ধ করে দেশকে অভীষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যাবার এক দুর্জয় সংকল্প নিয়ে ঐক্যবদ্ধ হয়ে গঠনমুলক কাজে আত্মনিযয়োগ করি।”
৯ নেতার বিবৃতি বাংলাদেশে এক অভূতপূর্ব সাড়া জাগায়। জনতা গণতন্ত্র আদায়ের লক্ষ্যে নতুন করে ঐক্যবদ্ধ হয়। বিরোধী দলের এ নতুন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে আইয়ুব খান ও তাঁর সহযোগিরা ভীষণভাবে ক্ষুব্ধ হলেন। সবুর খান এ বিবৃতিকে ব্যবিলনের ৯ জন জ্ঞানীর বিবৃতি বলে ব্যাঙ্গ করলেন। আইয়ুব খান রাজনীতিকদের গণধিকৃত আখ্যায়িত করলেন। এতদসত্ত্বেও চট্টগ্রাম, বরিশাল , টাংগাইল, সিলেট ও অন্যান্য জায়গায় সরকার বিরোধী জনসভা হতে লাগলো। পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হলো। সোহরাওয়ার্দী তখন করাচি জেলে বন্দী। অতঃপর ৩০ জুন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে রাজনৈতিক দল গঠন সম্পর্কে পলিটিক্যাল পার্টিস বিল-১৯৬২ নামে একটি বিল উত্থাপিত হয়। এ বিলে বলা হয় ইসলামি আদর্শ পাকিস্তানের সংহতি বিরোধী মতামত প্রচারের জন্য এবং এবডো প্রোডো আইনে অযোগ্য ঘোষিত রাজনীতিবিদেরা কোনো দল গঠন বা কোনো দলের সদস্য হতে পারবে না।
১৯৬২ সালের ৮ জুলাই পল্টন ময়দানে নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব জ্বালাময়ী ভাষায় বলেন যে স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় যারা ইংরেজ প্রভুদের গোলামি করেছিল তারাই আজ দেশের বিধাতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দী ও ভাসানীসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করেন। তিনি এবডোসহ সকল কালাকানুন বাতিল করার দাবি তুলেন। আতাউর রহমান খান ভাষণ দিতে গিয়ে বলেন যে, “এ শাসনতন্ত্র চাই না। এ শাসনতন্ত্র পুড়িয়ে ফেলতে হবে। চাঁড়ালের হাত দিয়া পোড়াও পুস্তিকা ভস্মরাশি ফেলে দাও কীর্তিনাশা জলে।”
শহীদ সোহরাওয়ার্দী ১৯ আগস্ট ১৯৬২ করাচি সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন। প্রায় ৪ মাস করাচিতে বিশ্রামের পর ১৬ সেপ্টেম্বর বেলা ১টা ৪৫ মিনিটে তিনি ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। ঢাকা বিমানবন্দরে সর্বস্তরের জনগণ তাঁকে এক অভূতপূর্ব সম্বোধন জানায়। লক্ষ লক্ষ মানুষের শ্লোগান শ্লোগানে বাংলার আকাশ বাতাস মুখরিত হলো। সোহরাওয়ার্দী হেসে বললেন, আমিও ৯ জন নেতার সামিল আমার নম্বর ১০।
পরদিন ১৭ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে এক ঐতিহাসিক স্মৃতি বিজড়িত দিন। শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের দাবিতে ছাত্রসমাজ এদিন হরতাল আহ্বান করেছিল। আইয়ুব খান তখন ঢাকায় উপস্থিত।
পৃষ্ঠা-৫৪

ছিলেন । তিনি ঐদিন কার্জন হলে ভাষণ দিতে গিয়েছিলেন। ছাত্র নেতা রাশেদ খান মেনন-এর নেতৃত্বে ছাত্ররা শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিল ও অন্যান্য দবির জন্য বিক্ষোভ মিছিল বের করেন। আইয়ুব খান বক্তৃতা না দিয়েই কার্জন হলো ত্যাগ করেন এবং পুলিশ বাহিনীকে ছাত্রদের শায়েস্তা করার জন্য নির্দেশ দিলেন। পুলিশ বাহিনী ও ছাত্রদের মধ্যে তুমুল সংঘর্ষ শুরু হলো। ফলে ৩ জন নিহত ও ২০০ ছাত্র জনতা আহত হলেন। বহু ছাত্র জনতাকে গ্রেফতার করা হলো এবং ঢাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হলো। সরকারের এ নির্যাতনের প্রতিবাদে ২৯ সপ্টেম্বর সারা দেশে সাধারণ ধর্মঘট ও দমন নীতি দিবস পালিত হলো। সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব ও অন্য ৮ নেতা এ হত্যাকাণ্ড ও গ্রেফতারের নিন্দা করে বিবৃতি দিলেন। শেখ মুজিব স্বয়ং অন্যান্য নেতাকে সঙ্গে করে তৎকালীন গভর্নর গোলাম ফারুকের সঙ্গে দেখা করে এর প্রতিবাদ করলেন।
শেখ মুজিব ২৪ সেপ্টেম্বর (১৯৬২) আতাউর রহমান খান সহ পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জন নেতা লাহোরে গেলেন। ২৫ সেপ্টেম্বর সোহরাওয়ার্দী গণতন্ত্র পুনরুজ্জীবনের লক্ষ্যে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট সংক্ষেপে এ. ডি. এফ, গঠনের কথা ঘোষণা করেন। ৪ অক্টোবর এন, ডি. এফ.-এর ৫৪ নেতার নাম ঘোষণা করা হয়। এদের মধ্যে উল্লেখ্য হলেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, আতাউর রহমান খান, মোহাম্মদ আলী, সৈয়দ আজিজুল হক প্রমুখ। দুদিন পর নুরুল আমিন এতে যোগ দেন। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মওলানা মওদুদী, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, আইয়ুব খুরো, জেড এইচ প্রসারী প্রমুখ যোগদান করেন। সোহরাওয়াদী এর পরে অক্টোবরের ৬ তারিখে ঢাকায় এলেন। পরদিন নূরুল আমিনের সভাপতিত্বে পল্টন ময়দানে ভাষণ দিতে গিয়ে সোহরাওয়াদী জনগণকে জিজ্ঞাসা করেন আপনারা গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চান কি না। উপস্থিত লক্ষ লক্ষ মানুষ হাত তুলে জবাব দেন চাই চাই। পরবর্তীকালে খাজা নাজিমউদ্দিন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, ফরিদ আহমেদ, মিয়া তোফায়েল, গোলাম আযম, খান ওয়ালী খান, হাজী দানেশ, আব্দুস সামাদ আচাচাই গণতন্ত্র আদায়ের জন্য এনডিএফ-এ যোগদান করেন।
১৯৬৩ সালের ৩ সেপ্টেম্বর সারা দেশে কুখ্যাত প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অডিন্যান্স জারি করা হয়। ঢাকা প্রেস ক্লাবে বিক্ষুব্ধ সাংবাদিকেরা এক প্রতিবাদ সভা বের করেন। এ সভায় সভাপতিত্ব করেন (১৮ সেপ্টেম্বর) ইত্তেফাকের মরহুম সিরাজ উদ্দিন হোসেন। বর্ষীয়ান সাংবাদিক রাজনীতিক মওলানা আকরম খাঁ, বিচারপতি মোহাম্মদ ইব্রাহিম, অবজারভার সম্পাদক আবদুস সালাম, ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া প্রমুখ ব্যক্তিগণ তেজোদীপ্ত ভাষণ দেন।
পৃষ্ঠা-৫৫

শেখ মুজিবের নেতত্বে বিরোধীদলীয় রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ঢাকা প্রেসক্লাবে সমবেত হন। এ সভায় পূর্ব পাকিস্তান দাংগা প্রতিরোধ কমিটি গঠিত হয়। সভায় সাংবাদিকদের সহযোগিতা কামনা করা হয় এবং একটি সর্বসম্মত প্রচারপত্র প্রণয়নের দায়িত্ব প্রদান করা হয় শেখ মুজিবুর রহমানকে। শেখ মুজিব তাৎক্ষিণকভাবে ১টি প্রচারপত্র তৈরি করলেন এবং সকল সংবাদপত্রে ছাপানোর অনুরোধ করলেন। ১৯৬৪ সালের ১৭ জানুয়ারি ঢাকার সকল সংবাদপত্রে এ ঐতিহাসিক প্রচারপত্রটি ছাপা হলো। এ প্রচারপত্রটির শিরোনাম ছিল ‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও।’
‘পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও
সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তের ঘৃণ্য ছুরি আজ ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ ও অন্যান্য স্থানেও শান্ত ও পবিত্র পরিবেশ কলুষিত করিয়া তুলিয়াছে। ঘাতকদের ছুরি হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে পূর্ব বাংলার মানুষের রক্তে লাল হইয়া উঠিয়াছে। দুবৃত্তদের হামলায় ঢাকায় প্রতিটি পরিবারের শান্তি ও নিরাপত্তা আজ বিপন্ন। হিন্দু মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের নিরীহ মানুষের ঘরবাড়ি পোড়ান হইতেছে, সম্পত্তি বিনষ্ট করা হইতেছে, এমন কি জনাব আমির হোসেন চৌধুরীর মতো শান্তিকামী মানুষদেরও দুবৃত্তের হাতে জীবন দিতে হইতেছে। তাদের অপরাধ কি ছিল একবার চিন্তা করিয়া দেখুন। গুণ্ডারা মুসলমান ছাত্রী নিবাসে হামলা করিয়াছে এবং হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে আমাদের মা-বোনের সম্ভ্রম আজ মুষ্টিমেয় গুণ্ডার কলুষ স্পর্শে লাঞ্ছিত হইতে চলিয়াছে। এসর্বনাশা জাতীয় দুর্দিনে আমরা মানবতার নামে, পূর্ব পাকিস্তানের সম্মান ও মর্যাদার নামে দেশবাসীর নিকট আকুল আবেদন জানাইতেছি, আসুন সর্বশক্তি লইয়া গুণ্ডাদের রুখিয়া দাঁড়াই, শহরে শান্তি ও পবিত্র পরিবেশ ফিরাইয়া আনি।
পূর্ব বাংলার মানুষের জীবনের ওপর এ পরিকল্পিত হামলার বিরুদ্ধে রুখিয়া দাঁড়াইতে আমরা পূর্ব বাংলার সকল মানুষকে আহ্বান জানাইতেছি।।
* প্রতি মহল্লায় দাংগা প্রতিরোধ কমিটি গঠন করুন।
* গুণ্ডাদের শায়েস্তা করুন, নির্মূল করুন।
* পূর্ব পাকিস্তানের মা-বোনের ইজ্জত ও নিজেদের ভবিষ্যৎকে রক্ষা করুন। দাংগা প্রতিরোধ কমিটি পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক প্রচারিত।
১৯৬২ সালের ১০ মে আজম খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর পদ থেকে অপসারণ করা হয়। গোলাম ফারুক তার স্থলাভিষিক্ত হলেন। তিনি বাঙালির ন্যায় সংগত দাবির প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন। কিন্তু বেশিদিন তিনি গভর্নর হিসাবে থাকতে পারেননি।
পৃষ্ঠা-৫৬

১৯৬২ সালের ২৮ অক্টোবর আবদুল মুনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসাবে শপথগ্রহণ করেন।
এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী হৃদরোগে আক্রান্ত হন। করাচির জিন্নাহ সেন্ট্রাল হাসপাতালে তাকে ভর্তি করা হয়। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে অক্লান্তভাবে অংশগ্রহনের ফলে তিনি আকস্মিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। চিকিৎসকরা তাকে পূর্ণ বিশ্রামের পরামর্শ দেন। সোহরাওয়ার্দী ১৯৬৩ সালের ১৯ মার্চ সুচিকিৎসা ও বিশ্রামের জন্য বৈরুতে যান।
মওলানা ভাসানীকে এসময় মুক্তি দেওয়া হয়। ১৯৬৩ সালের ৩১ মার্চ করাচিতে মওলানা ভাসানী এক জনসভায় এনডিএফ-কে সমর্থন করেন। কিন্ত ২ এপ্রিল ঢাকায় এসে তিনি এনডিএফ-কে কয়েকটি শর্ত সাপেক্ষে সমর্থন করতে পারেন বলে জানালেন। তিনি পূর্ণগণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এবং সিয়াটো সেন্টো বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতির দাবি তুলেন। মওলানা ভাসানী এনডিএফ-কে Nothing Doing Front হিসাবে আখ্যায়িত করলেন। শহিদ সাহেব তখন বৈরুতে চিকিৎসাধীন। শেখ মুজিবের প্রবল আপত্তি থাকা সত্ত্বেও নূরুল আমিনকে সোহরাওয়ার্দী এনডিএফ-এর পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান মনোনীত করেছিলেন। ভাষা আন্দোলনে নূরুল আমিনের বিতর্কিত ভূমিকার ফলে মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পেরে উঠছিলেন না। এনডিএফ-এর এ অচল অবস্থায় শেখ মুজিব আলাপ আললাচনার জন্য সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন। সোহরাওয়ার্দী তখন বৈরুতে থেকে কিছু সময়ের জন্য লন্ডনে যান। ১৯৬৩ সালের ৮ আগস্ট রাতে শেখ মুজিব লণ্ডন যাত্রা করেন এবং ২৮ আগস্ট নেতার সঙ্গে আলোচনা শেষে দেশে ফিরে আসেন।
এ সময়ে জাতীয় পরিষদে কয়েকজন সদস্যের পদ মন্ত্রী হওয়ার ফলে শূন্য হয়ে পড়ে। এ শূন্য পদে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে শেখ মুজিব এনডিএফ প্রার্থীদের জন্য নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেন। বিভিন্ন এলাকায় জনসভায় যোগ দেওয়ার পর ১৮ অক্টোবর শেখ মুজিব ঢাকায় ফিরে আসেন এবং ২০ অক্টোবর তাঁর ৩২ নম্বর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভাষণ দেন। তিনি সরকারি কর্মচারীদের পক্ষপাতমূলক আচরণের জন্য কঠোর নিন্দা করে সাংবাদিকদের সুস্পষ্টভাবে বলেন যে পূর্ব বাংলার মানুষেরা পিণ্ডির উপনিবেশে পরিণত হয়েছে।
১৯৬৩ সালের ৫ ডিসেম্বর রাত ৩-২০ মিনিটে সোহরাওয়ার্দী বৈরুতে কন্টিনেন্টাল হোটেলে ৭০ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। এ নেতার মৃত্যুতে সমগ্র বাঙালি জাতি শোকাভিভূত হয়ে পড়ে। ৮ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দীর মরদেহ
পৃষ্ঠা-৫৭

বৈরুত থেকে করাচি হয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। বিমানবন্দরে শোকে মুহ্যমান জনতা কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং এক অভূতপূর্ব দৃশ্যের অবতারণা হয়। শেখ মজিবের ইচ্ছা অনুযায়ী রেসকোর্স ময়দানের এক প্রান্তে শেরে বাংলা ফজলুল হকের পাশে সমাহিত করা হয়। উল্লেখ্য যে, শেখ মুজিব সোহরাওয়ার্দি এ মৃত্যুকে হত্যাকাণ্ড হিসাবে অভিহিত করেন ১৫ ডিসেম্বর এনডিএফ-এর সভায় শেখ মুজিব বলেন যে, আমি জানি না সোহরাওয়ার্দী মারা গিয়েছেন কিনা। কিন্তু আমি মনে করি আমার নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। আমার বাঙালি ভাইয়েরা ঐক্যবদ্ধ হউন এবং প্রতিশোধ নিন। গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে পড়ুন। যারা আমাদের নেতাকে হত্যা করেছে, তাদের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিশোধ নিতে হবে।’
এ বক্তৃতার জন্য পরবর্তীতে শেখ মুজিবকে বহু মামলায় জড়িয়ে ফেলা হয় এবং অযথা হয়রানি করা হয়।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসে কাশ্মীরের এক মসজিদে রক্ষিত হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর কেশ চুরি হয়ে যাওয়ার ফলে প্রথমে ভারতে ও পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাংগা শুরু হয়। পূর্ব বাংলায় খুলনা থেকে ঢাকা পর্যন্ত সাম্প্রদায়িক দাংগা ছড়িয়ে পড়ে। এ দাংগা প্রতিরোধে শেখ মুজিব উজ্জ্বল ভূমিকা রাখেন। পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শীর্ষক প্রচারপত্র ছাপার অভিযোগে শেখ মুজিব ও তাজউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হয়। পরে উভয়কেই জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়। কিন্তু প্রেস এন্ড পাবলিকেশন্স অর্ডিন্যান্স ও পাকিস্তান দণ্ডবিধির বিভিন্ন অভিযোগে অভিযুক্ত করে মামলা দায়ের করা হয়।
শেখ মুজিব এ সময় আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার লক্ষ্যে সচেষ্ট হন। এনডিএফ-এর কর্মকাণ্ড স্তিমিত হয়ে পড়ে। এনডিএফকে দিয়ে দাবি আদায় সম্ভবপর নয় বলে শেখ মুজিব মনে করেন। তাই তিনি পুরাতন সহকর্মীদের নিয়ে আওয়ামী লীগকে পুনরুজ্জীবিত করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ১৯৬৪ সালের ২৫ জানুয়ারি মওলানা আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ-এর সভাপতিত্বে ৩২ নম্বর ধানমণ্ডি বাসভবনে সাবেক আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। আতাউর রহমান খান ও আবুল মনসুর আহমদ আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের বিরুদ্ধে ছিলেন বিধায় তারা এ সভায় অনুপস্থিত ছিলেন। পরদিন সংবাদপত্রে আওয়ামী লীগের পুনরুজ্জীবনের খবর প্রকাশিত হয়। ঐ সভায় দেশে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন, আঞ্চলিক সার্বভৌমত্ব, পূর্ব পাকিস্তানকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করা,। পাকিস্তানের নৌবাহিনীর সদর দপ্তর চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করা ও রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করা হয়।
পৃষ্ঠা-৫৮
৬ মার্চ (১৯৬৪) গ্রীন রোডে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ৩ দিনব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশন শুরু হয়। এ কাউন্সিল অধিবেশনে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের সদস্যসহ প্রায় এক হাজার কাউন্সিলার অংশগ্রহণ করেন। এ অধিবেশনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক হিসাবে শেখ মুজিব মর্মস্পর্শী ভাষণ দেন। তিনি বলেন : আওয়ামী লীগের ইতিহাস আপনাদের সুগামের ইতিহাস। আপনারা জানেন, কোনো অবস্থায় কোনো পরিপ্রেক্ষিতে এভাবে এ প্রতিষ্ঠানের সৃষ্টি হয়েছিল। আপনারা জানেন, সৃষ্টি থেকে আরম্ভ করে এ পর্যন্ত কত রকম প্রতিকূল অবস্থা ও বাধা-বিপত্তির মধ্যদিয়ে আপনারা আওয়ামী লীগকে দেশের সেরা ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পেরেছেন। কিন্তু দুঃখের বিষয়, গণতন্ত্রের মূলনীতি যে দেশ থেকে যখন তখন মুষ্টিমেয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট ক্ষমতাসীন মহলের ইঙ্গিতে নির্বাসন দেওয়া হয়, যে দেশে কথায় কথায় বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলির নেতা ও কর্মীদের জেলে আটক করা হয় সে দেশে গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য সৃষ্টি করা এক বিরাট কাজ, সুকঠিন দায়িত্ব। আসুন আজ আমরা এ শপথগ্রহণ করি যে, যতদিন না পাকিস্তানের বুক থেকে স্বার্থান্বেষী মহলের পরাজয় ঘটবে যতদিন না এদেশে গণতান্ত্রিক সরকার কায়েম করতে পারব, যতদিন না দেশকে একটি জনকল্যাণকর রাষ্ট্র হিসেবে গঠন করতে পারব, যতদিন না সমাজ থেকে শোষণের মূলোৎপাটন হবে, যতদিন না দেশের প্রত্যেক নাগরিক দল-মত-ধর্ম নির্বিশেষে অর্থনৈতিক মুক্তি ও আর্থিক প্রাচুর্যের আস্বাদ গ্রহণ করতে পারবে, যতদিন না শ্রেণিবিশেষের অত্যাচার থেকে সমগ্র দেশ ও জাতিকে মুক্তি দেওয়া হবে ততদিন আমরা সংগ্রাম চালিয়ে যাব। ন্যায় আমাদের নীতি, আমাদের আদর্শ। জয় আমাদের অনিবার্য।’
১৮ই মার্চ দাবি দিবস পালনকালে তাজউদ্দিন ও কোরবান আলীকে গ্রেফতার করা হয়। পরদিন পুলিশের নির্যাতনের প্রতিবাদে ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। বিকেলে পলন্টন ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব তাঁর ভাষণে বললেন, ‘ফেরাউন মানুষের জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি, হিটলার পারেনি, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও পারবে না। একদিন দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালি তাদের জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে আনবেই আনবে। পূর্ব বাংলা কখনোই পিণ্ডির উপনিবেশ হয়ে থাকবে না। আর মওলানা ভাসানী বললেন, ‘বাঙালি সম্রাট অশোককে মানেনি, মোগল-পাঠানেরও অনুগত হয়নি, ইংরেজের আনুগত্য স্বীকার করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়ায় মুসলিম লীগ আজ কবরে শায়িত। এবারো সরকার যদি ভোটাধিকারের
পৃষ্ঠা-৫৯

দাবি মেনে না নেয়, তবে দেশে আর এক রাষ্ট্রভাষার ঘটনা ঘটবে। জনসভা শেষে বিশাল মিছিল ঢাকার রাজপথ প্রদক্ষিণ করে ।
ষাটের দশকের প্রথমার্ধে অনেকেই সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখেন। যতদূর জানা যায়, আইয়ুব খানের সামরিক আইন জারির পর নভেম্বরে ময়মনসিংহে ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন পার্টি নামে একটি সশস্ত্র দল গঠিত হয়। সশস্ত্র যুদ্ধের মাধ্যমে পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করা এ দলের মুল উদ্দেশ্য ছিল। আওয়ামী লীগ সমর্থক আব্দুর রহমান সিদ্দিকী, খন্দকার ফজলুর রহমান ও ন্যাপ সমর্থক এ এম সাঈদ এ দলের নেতৃস্থানীয় সদস্য ছিলেন। সে সময়েই স্থানীয় ন্যাপনেতা তাসিরউদ্দিনের পুত্র আলী আসাদের নেতৃত্বে জামালপুরে এবং ডিসেম্বরের প্রথম দিকে নেত্রকোনায় এবং ডিসেম্বরের মাঝামাঝি টাঙ্গাইলে এ দলের শাখা খোলা হয়। ১৯৫৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকায় এ দলের শাখা প্রতিষ্ঠা করা হয়।
১৯৫৯ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ব্রহ্মপুত্র নদীবক্ষে একটি বড় নৌকার ওপরে এ দলের সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এ দলের নেতৃস্থানীয় কর্মীরা ভারতে চলে যান। অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যের আশায়। ভারত থেকে কিছু পোস্টার ও প্রচারপত্র ছাপিয়ে এনে তারা গোপনে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ ও পূর্ব বাংলার বিভিন্ন বার ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠাতে শুরু করেন। শেরে বাংলা ফজলুল হক ও শহীদ সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ এ দলের গোপন তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। শেখ মুজিব এদের শুধু সমর্থনই করেননি, এ দলের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন এবং অর্থ সাহায্য করতেন। ১৯৮৮ সালের ২১ জানুয়ারি ও ৮ এপ্রিল সাপ্তাহিক বিচিত্রায় প্রকাশিত নিবন্ধে এ বিষয়ে নূরুউদ্দিন আহমদ, আশরাফ হোসেন, আব্দুর রহমান সিদ্দিকীর চিঠি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। স্বাধীনতাযুদ্ধের ইতিহাস, দলিলপত্র, অষ্টম খণ্ড, পৃষ্ঠা-৩১ এ বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যাবে।
১৯৬১ সালের নভেম্বর ও ডিসেম্বরে আওয়ামী লীগ ও কমিউনিস্ট পার্টির মধ্যে ঢাকায় এক গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে অভিন্ন সংগ্রামের কর্মসূচি প্রণয়নই ছিল এ গোপন বৈঠকের উদ্দেশ্য। এ বৈঠকে আওয়ামী লীগের পক্ষে শেখ মুজিব ও মানিক মিয়া এবং কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে মনি সিংহ ও খোকা রায় উপস্থিত ছিলেন। লিয়াজোঁ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী। সোহরাওয়ার্দী তখন ঢাকায় অবস্থান করছিলেন এবং চার দফা আলোচনায় তিনিও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। এ বৈঠকে শেখ মুজিব পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার দাবি উত্থাপন করেন এবং তা যৌথ কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানান। শেখ মুজিব বলেন, আমার বিশ্বাস, গণতন্ত্র, স্বায়ত্তশাসন এসব কোনো দাবিই পাঞ্জাবিরা মানবে না। কাজেই
পৃষ্ঠা-৬০

স্বাধীনতা ছাড়া বাংলার মুক্তি নেই। স্বাধীনতার দাবিটা আন্দোলনের কর্মসূচিতে রাখা দরকার ।‘ সোহরাওয়ার্দীর হস্তক্ষেপের ফলে শেষ অবধি স্বাধীনতার দাবি কর্মসূচি থেকে বাদ দেওয়া হয়। স্বাধীনতা সম্পর্কে কমিউনিস্ট পার্টির মল্যায়ন ছিল স্বাধীন পূর্ব বাংলা দাবি উত্থাপন করার সময় এখনও আসেনি।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ছাত্রসমাজের রয়েছে এক বিশাল ঐতিহাসিক ভূমিকা ।১৯৪৯ সালের ৪ জানুয়ারি আওয়ামী মুসলিম ছাত্রলীগ গঠিত হয়। নঈমুদ্দিন আহমদ ছাত্রলীগের প্রথম আহ্বায়ক হন। ১৯৪৯ সালের এপ্রিল মাস পর্যন্ত নঈমুদ্দীন আহমদ ছাত্রলীগের আহ্বায়ক ছিলেন। এর পরে ছাত্রলীগের সভাপতি হন দবিরুল ইসলাম (দিনাজপুর, এডভোকেট, পরবর্তীতে ন্যাপ সদস্য) ও নঈমুদ্দীন আহমদ সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ১৯৪৯ সালে সেপ্টেম্বরে ছাত্রলীগের প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে ১৯৪৯-৫০ সালের জন্য দবিরুল ইসলাম সভাপতি ও খালেক নেওয়াজ খান (ময়মনসিংহ) সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৫০-৫২ সাল পর্যন্ত সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খালেক নেওয়াজ খান ও কামরুজ্জামান। ১৯৫২ সালে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন যথাক্রমে কারুজ্জামান ও আব্দুল ওয়াদুদ (ইত্তেহাদ কর্পোরেশনের প্রাক্তন জেনারেল ম্যানেজার, বর্তমানে মৃত)। ১৯৫৪ সালে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্রলীগের মুসলিম শব্দটি বর্জন করে ছাত্রলীগ একটি অসাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়।
১৯৫৩-৫৪ সালে ছাত্রলীগ সভাপতি হন আব্দুল মোমিন তালুকদার। তিনি সুপ্রীম কোর্টের এডভোকেট, বাড়ি সিরাজগঞ্জ, আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার প্রাক্তন প্রতিমন্ত্রী। সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আব্দুল আওয়াল, ইত্তেফাকের প্রাক্তন রিপোর্টার ও আদমজী জুট মিলের জেনারেল ম্যানেজার ও জাসদ নেতা। সাভারে মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন।
১৯৫৭-৫৮ সালে রফিকুল্লাহ চৌধুরী ছাত্রলীগ সভাপতি হন। রফিকুল্লাহ চৌধুরী পরবর্তীতে পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন ও পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও শাহ আজিজুর রহমান উভয়েরই সচিব হিসাবে কাজ করেন। এ সময় সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন আজহার আলী। আজহার আলী লন্ডন চলে গেলে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের ফলে সমস্ত রাজনৈতিক কার্যকলাপ বন্ধ হয়ে যায়। এ সময় অর্থাৎ ১৯৬২ সাল পর্যন্ত এ কমিটিই বহাল ছিল। ১৯৬২-৬৩ সালে শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন শেখ ফজলুল হক মনি।
পৃষ্ঠা-৬১

১৯৬২ সালে শিক্ষা কমিশনের রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলনকালে ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন বদরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন এনায়াতুর রহমান। সে সময় পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন কাজী জাফর আহমদ।
আইয়ুব খানের সামরিক শাসনের দীর্ঘ ৪ বছর পর রাজনৈতিক দলগুলো সংগঠিত হতে শুরু করে। ১৯৬১ সালের ৩০ ডিসেম্বর ইস্কাটনের একটি বাড়িতে ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মোহাম্মদ ফরহাদ-এর উদ্যোগে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের একটি গোপন সভা অনুষ্ঠিত হয়। উল্লেখ্য যে, ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের মধ্যে মতাদর্শগত দ্বন্দ্ব বিরাজমান ছিল। ছাত্রলীগ আওয়ামী লীগের অঙ্গ সংগঠন আর ছাত্র ইউনিয়ন ন্যাপ-এর অঙ্গ সংগঠন। এ মতাদর্শিক ভেদাভেদ থাকা সত্ত্বেও এ গোপন বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে একুশে ফেব্রুয়ারি (১৯৬২) থেকেই তীব্র আন্দোলন শুরু করা হবে। কিন্তু ৩০ জানুয়ারি সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের খবরে ঢাকায় দাবানলের মতো বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে।
১৯৬২ সালের ৩১ জানুয়ারি রাতে মধুর ক্যান্টিনে সকল ছাত্র সংগঠনের এক অনির্ধারিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্রলীগ থেকে উপস্থিত ছিলেন শেখ ফজলুল হক মনি, আব্দুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান ও মাহবুব (ব্যারিস্টার) ছাত্র ইউনিয়ন। থেকে মোহাম্মদ ফরহাদ, বদরুল হক (এডভোকেট, পটুয়াখালী), জয়নাল আবেদীন, হায়দার আকবর খান রনো, রহিম আজাদ ও আহমেদ জামাল। (ডাক্তার) ছাত্রশক্তির পক্ষ থেকে মওদুদ আহমদ এবং এনএস এফ-এর পক্ষে আবুল হাসনাত। সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে সর্বদলীয় কর্মসূচি গ্রহণ করা ছিল এ সভার মূল উদ্দেশ্য। প্রকৃতপক্ষে এনএসএফ এ কর্মসূচি বানচালের উদ্দেশ্যেই সভায় যোগদান করে। কারণ তার পরদিনই আইয়ুব খানের ঢাকজ আসার কথা।
রাত দুটো পর্যন্ত কোনো সমঝোতা ছাড়াই সভা শেষ হয়। সমাপ্তি ঘোষণা করেন। এনএসএফ ও ছাত্রশক্তির নেতৃবৃন্দ চলে যাওয়ার পর ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দ পুনরায় বৈঠক বসে এবং পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি ধর্মঘটের প্রস্তাব গ্রহণ করে।
পরদিন ১ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় শহীদ সোহরাওয়র্দীর গ্রেফতারের প্রতিবাদে ছাত্রসভা অনুষ্ঠিত হলো। কিন্তু ২ ফেব্রুয়ারি ছাত্র ধর্মঘটের কোনো সংবাদ খবরের কাগজে ছাপা হলো না। বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা মিছিল সহকারে প্রেসক্লাবে সমবেত হলো। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে এটাই ছিল প্রথম বিক্ষোভ। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ আইয়ুব বিরোধী পোস্টারে ছেয়ে গেল।
পৃষ্ঠা-৬২

পরদিন ৩ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব-এর পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জুর কাদের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আসেন। পুরাতন কলাভবনের ১০৪ নং কক্ষে পূর্ব নির্ধারিত বক্তৃতা দেওয়ার জন্য উপাচার্যের সঙ্গে প্রবেশ করতেই ছাত্ররা উত্তেজিত হয়ে পড়ে।মঞ্জুর কাদেরকে সংবাদপত্রের স্বাধীনতা , আঞ্চলিক বৈষম্য ইত্যাদি প্রশ্নের সম্মুখীন হন । এক পর্যায়ে ছাত্ররা তাঁর কলার চেপে ধরলো। একদল ছাত্র তার গায়ে থুথু ছিটিয়ে দিল। মঞ্জুর কাদেরকে সরিয়ে দিয়ে তার মাইক কেড়ে নিয়ে ছাত্ররা বক্তৃতা শুরু করে দিল। এ নাজেহাল অবস্থা থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে শেষ পর্যন্ত পুলিশ রক্ষা করে। পরদিন ঢাকা শহরে দেখা গেল পোস্টার ‘সামরিক শাসন নিপাত যাক’ আইয়ুবশাহী ধ্বংস হোক’, সাম্রাজ্যবাদ ধ্বংস হোক’ পূর্ব বাংলাকে শোষণ করা চলবে না’।
৫ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। এর প্রতিবাদে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কয়েক হাজার কর্মী কার্জন হলো প্রাঙ্গণে সমবেত হয়। ছাত্রদের বিক্ষোভ মিছিল নগরীর রাজপথ প্রকম্পিত করে। এ সময় সেনাবাহিনীর জিওসি এ পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন। ছাত্ররা তাকে ধাওয়া করে ও তাঁর জীপ লক্ষ্য করে ইট পাটকেল ছোড়ে। ফলে তার ড্রাইভার আহত হয়। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পুলিশের বাস পুড়িয়ে দেয়।
৭ ফেব্রুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী আইয়ুব বিরোধী কর্মসূচি নেওয়া হয়। এক বিশাল ছাত্র সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সেনাবাহিনী ও পুলিশ রাস্তায় টহল দিতে থাকে। সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা এমনভাবে ঘিরে ফেলা হয় যেন ছাত্ররা মিছিল সহকারে বের হতে না পারে। হাইকোর্ট ও কার্জন হলের সামনে দুটি গোলন্দাজ কামান বসানো হয়েছিল। কিন্তু ছাত্ররা শেষ পর্যন্ত কার্জন হলো থেকে মিছিল সহকারে ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হলো) ক্যান্টিনের পাশ দিয়ে প্রথমে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে প্রবেশ করে এবং পরে মেডিক্যাল কলেজ। হাসপাতালের ভিতর দিয়ে পুরাতন ঢাকার রাজপথে নেমে পড়ে। মিছিল যখন হাটখোলা রোডে এসে পৌছায় তখন পুলিশ লাঠিচার্জ করে।
সেদিন ঢাকা হলে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের বৈঠক অধিক রাত পর্যন্ত চলায় ছাত্র নেতৃবৃন্দ ঢাকা হলো ও ফজলুল হক হলে রাত্রি যাপন করেন। আর ঐ রাতেই পুলিশ ও সেনাবাহিনী সমস্ত হলো ঘেরাও করে একটা মাত্র গেট দিয়ে ছাত্রদের হলো ত্যাগে বাধ্য করে। কিন্তু অনেকেই হলো ত্যাগে অস্বীকার করে। কোনো কোনো ছাত্র বলে, তাদের কাছে বাড়ি যাওয়ার টাকা নেই। অনেক ছাত্রকে টাকা দিয়ে হলো ত্যাগে বাধ্য করা হলো। এ ৭ দিন সার্বক্ষণিকভাবে পুলিশ ছাত্র নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতার করার প্রহরায় নিয়োজিত ছিল। কারণ তাদের
পৃষ্ঠা-৬৩
ধারণা ছিল, ছাত্রনেতারা এ হলেই আছে, বের হওয়ার কো্নো পথ নেই। সপ্তম দিবসে প্রচণ্ড ঝড়-বৃষ্টি শুরু হলে পুলিশ স্থান ত্যাগ করে শেখ ফজলুল হক মনি, মোহাম্মদ ফরহাদ ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ পুলিশের চোখকে ফাকি দিয়ে বাইরে চলে যান।
বহুসংখ্যক ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকায় ৭ ফেব্রুয়ারি থেকে ১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ২২৯ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ঢাকার বাইরে বরিশাল, পিরোজপুর, সিলেট, খুলনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রামে ছাত্র আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খুলে দেওয়া হয় এবং ১৫ মার্চ থেকে অবিরাম ছাত্র ধর্মঘট চলতে থাকে। ডাকসু’র সহ-সভাপতি রফিকুল হক ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা হায়দার আকবর খান রনোসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রকে মিছিল করার অপরাধে গ্রেফতার করা হয় ও ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে জিজ্ঞাসাবাদের পর তাঁদেরকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। এসব নির্যাতনমূলক গ্রেফতারের ফলে ছাত্র আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লেও ‘৬২ সালের সংবিধানের বিরুদ্ধে পুনরায় তারা সংগঠিত হয়। এপ্রিলের মাঝামাঝি ছাত্ররা শপথ দিবস পালন করে। ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলন উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। এ সময় বুদ্ধিজীবী, শিক্ষক ও রাজনীতিবিদদের মধ্য থেকেও ছাত্রদের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করা হয়। ছাত্ররা নির্বাচনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুললে আওয়ামী লীগ ও ন্যাপ নির্বাচনে অংশ নেওয়া থেকে বিরত থাকে। ছাত্রনেতাদের মুক্তি, হুলিয়া প্রত্যাহার, বাক স্বাধীনতা ও মৌলিক অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার দাবিতে পরিস্থিতি আরো উত্তপ্ত হয়ে উঠলে ৩১ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পুনরায় বন্ধ করে দেওয়া হয়।
নির্বাচনের পর যারা নির্বাচন বয়কটের আন্দোলনে কর্ণপাত না করে পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন, আন্দোলনের অংশ হিসেবে ছাত্ররা তাঁদের কাছে যাওয়া শুরু করে। উদ্দেশ্য ছিল পার্লামেন্টে পূর্ব পাকিস্তানের সমস্যার কথা বলার প্রতিশ্রুতি আদায় করা। এক পর্যায়ে ছাত্ররা সবুর খানের কাছে যায়। সবুর খান অবাক হওয়ার ভাব দেখিয়ে ছাত্রদের বলেন, তোমরা কি পাগল হয়েছ! আইয়ুব মন্ত্রিসভায় ভুট্টো ও অন্যান্যদের সঙ্গে আমি মন্ত্রী হব! অথচ আশ্চর্য ঘটনা হলো এ যে এর ৮-১০ দিন পরই সবুর খান আইয়ুবের যোগাযোগমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করলেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, আইয়ুবের সামরিক শাসন জারির পরপরই সবুর খান সামরিক আদালতে অভিযুক্ত হন এবং শাস্তি হিসেবে তাকে ৪টি বেত্রদণ্ড মারা হয়।
ছাত্ররা ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে সকল সদস্যকে খুঁজে বেড়াচ্ছিলেন। ছাত্ররা যাকে সবচেয়ে বেশি করে খুঁজছিলেন, তিনি হচ্ছেন মোনেম খান।
পৃষ্ঠা-৬৪

মোনেম খান ময়মনসিংহ থেকে গণপরিষদ সদস্য হিসেবে জয়লাভ করে এক বিবৃতিতে রাজবন্দিদের দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করেন এবং সরকারের কাছে তাঁদের মুক্তি না দেওয়ার জন্য আবেদন করেন। সুতরাং তাকে দিয়েই গণ পরিষদের রাজবন্দিদের মুক্তি দাবি উত্থাপনের প্রতিশ্রুতি আদায়ের জন্য ছাত্ররা মানেম খানের বাসভবনে যায়। কিন্তু মোনেম খান দেখা না করার ফলে অধিক রাত পর্যন্ত অপেক্ষা করার পর ছাত্ররা ফিরে আসে। বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা মোনেম খানকে বিমানবন্দরে ধরার সিদ্ধান্ত নেন। করাচিতে অনুষ্ঠিতব্য গণ পরিষদের আধিবেশনে যোগদানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগের জন্য মোনেম খান যখন বিমানবন্দরে আসেন, তখন উত্তেজিত ছাত্ররা তাকে নাজেহাল করে। ছাত্র ইউনিয়ন নেতা কাজী জাফর মোনেম খানের শেরওয়ানির কলার চেপে ধরে এক লম্বা বক্তৃতা দেওয়া শুরু করেন। ধস্তাধস্তির ফলে তার মাথার টুপি মাটিতে পড়ে যায়। এ নাজেহাল অবস্থা থেকে মোনেম খানকে রক্ষা করেন তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া ও জহুর হোসেন চৌধুরী। এর কয়েকদিন পরেই বাঙালি বিরেধিতার পুরস্কার স্বরূপ মোনেম খান স্বাস্থ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন এবং এর দু’মাস পরেই মোনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন।
১৯৬২ সালে আগস্ট মাসে শুরু হয় ছাত্র আন্দোলনের নতুন দিগন্ত। শিক্ষানীতির ক্ষেত্রে শরীফ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের বিরুদ্ধে ছাত্ররা আন্দোলন শুরু করে। আইয়ুব খান ক্ষমতা দখলের পরপরই শিক্ষানীতি প্রণয়নের জন্য ১৯৫৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর ঘোষণা দেন এবং ৫ জানুয়ারি (১৯৫৯) কমিশনের কার্যক্রম উদ্বোধন করেন। এ কমিশনের চেয়ারম্যান নিযুক্ত হন পশ্চিম পাকিস্তান শিক্ষা বিভাগের সচিব এবং আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইয়ুব খানের প্রাক্তন শিক্ষক এস এম শরীফ। এ কমিশনে সদস্য হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৬ জন ও পূর্ব পাকিস্তান থেকে ৪ জন সদস্য নিয়োগ করা হয়। পূর্ব পাকিস্তান থেকে সদস্য ছিলেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মোমতাজউদ্দিন, ঢাকা মাধ্যমিক বোর্ডের চেয়ারম্যান আবদুল হক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আততায়ার হোসেন ও ঢাকা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের অধ্যক্ষ ড. এ রশীদ। ১৯৫৯ সালে ২৬ আগস্ট কমিশনের সুপারিশ প্রেসিডেন্টের কাছে পেশ করা হয় এবং ১৯৬২ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। শরীফ কমিশন ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে ডিগ্রি পর্যন্ত ইংরেজিকে বাধ্যতামূলক করা, উর্দুকে মুষ্টিমেয় লোকের পরিবর্তে জনগণের ভাষায় পরিণত করাও পাকিস্তানের জন্য একটি অভিন্ন বর্ণমালার সুপারিশ করে। স্নাতক কোর্সকে সম্প্রসারণ করে তিন বছর মেয়াদী করার সুপারিশও করা হয়। এ শিক্ষা কমিশনের রিপোর্টে সুস্পষ্টভাবে শিক্ষা সঙ্কোচন নীতির সুপারিশ করা হয়। যে সন্তানের পিতার টাকা আছে তার
পৃষ্ঠা-৬৫

জন্যই শিক্ষার দ্বার খোলা রাখার প্রস্তাব করা হয় এবং দরিদ্র পিতার মেধাবী সন্তানের শিক্ষালাভকে বিলাসিতা হিসেবে গণ্য করা হয়।
ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে স্বাভাবিকভাবেই এ ধরনের গণবিরোধী শিক্ষানীতি গ্রহণযোগ্য ছিল না। বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা শরীফ কমিশন রিপোর্ট বাতিলের জন্য আন্দোলন শুরু করে। সারাদেশে যখন সামরিক শাসন বিরোধী চেতনা দানা বেঁধে উঠছিল, তখন শরীফ কমিশনের সুপারিশ বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা ছিল প্রকৃতপক্ষে ভীমরুলের চাকে ঢিল মারা।
শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট বাতিলের আন্দোলন শুরু হয় ঢাকা কলেজ থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এতে অংশ নেয়। সারাদেশের মেডিকেল স্কুল ও। ন্যাশনাল মেডিকেল ইনস্টিটিউটের ছাত্ররা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করে, এমনকি অনশন ধর্মঘটের আশ্রয় নেয়। ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদী করার বিষয়ে। প্রথম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে ঢাকা কলেজের ছাত্ররা। ডিগ্রির ছাত্র জনৈক এম এ চৌধুরী এ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। জুলাই মাস পর্যন্ত ক্লাস বর্জনের মধ্যেই এ আন্দোলন সীমাবদ্ধ ছিল। ‘ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম’ ও পরে ‘ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম’ নামে দুটি সংগঠনের সৃষ্টি হয়। জগন্নাথ কলেজ, কায়েদে আযম (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী) কলেজ ও ইডেন মহিলা কলেজের ছাত্র-ছাত্রীরাও আন্দোলনে এগিয়ে আসে।
১০ আগস্ট আন্দোলনের গুণগত পরিবর্তন হয়। এদিন বিকেলে ঢাকা কলেজ ক্যান্টিনে স্নাতক ও উচ্চ মাধ্যমিক শ্রেণির ছাত্ররা এক সমাবেশে মিলিত হয়। ঢাকা কলেজ ছাত্র সংসদের সাধারণ সম্পাদক কাজী ফারুক আহমদ তার বক্তৃতায় ছাত্রদের বোঝাতে সক্ষম হন যে, শিক্ষার আন্দোলন ও গণতন্ত্রের আন্দোলন এক সূত্রে গাঁথা। এ সভায় ১৫ আগস্ট সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। সারা দেশব্যাপী ছাত্রসমাজের মধ্যে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়। ১০ সেপ্টেম্বর সচিবালয়ের সামনে ছাত্রদের অবস্থান ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ১৫ আগস্ট থেকে সভা, সমিতি, মিছিল, বিক্ষোভ নিত্যদিনের দৃশ্য হয়ে উঠে। এ পটভূমিতে ডিগ্রি স্টুডেন্টস ফোরাম ও ইস্ট পাকিস্তান স্টুডেন্টস ফোরাম পরিণত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদে।।
আন্দোলন চলে আসে বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে। বিশ্ববিদ্যালয় আমতলায় বিরাট ছাত্র সমাবেশে বক্তৃতা করেন শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কাজী জাফর। জ্বালাময়ী বক্তৃতার তাৎক্ষণিক ফল হলো প্রায় পঁচিশ হাজার ছাত্র-ছাত্রী মিছিল সহকারে রাজপথে বেরিয়ে পড়ে। আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে গ্রামে-গঞ্জে। সারাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে অবিরাম ধর্মঘটের কর্মসূচি নেওয়া হয়। নয় দশ বছরের বালক বালিকারা পর্যন্ত মিছিলে সামিল হতে থাকে।
পৃষ্ঠা-৬৬

ঢাকার ১৪৪ ধারা জারি করা হয় এবং অবস্থান ধর্মঘট থেকে বিরত থাকার জন্য ছাত্রদের প্রতি চরম হুমকি দেওয়া। কৌশলগত কারণে ১০ সেপ্টেম্বর কর্মসূচি প্রত্যাহার করা হলেও ১৭ সেপ্টেম্বর খুব ভোর থেকেই ছাত্ররা রাস্তায় রাস্তায় পিকেটিং শুরু করে। পিকেটিং কালে মোনেম খান মন্ত্রিসভার সদস্য হাসান আসকারীর মার্সিডিজ গাড়িটি ভস্মীভূত হয়। দুই-তিনটি পুলিশের গাড়িও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সকাল ৯টার মধ্যেই বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা লোকে লোকারণ্য হয়ে যায়। এমন সময় খবর আসে, নবাবপুরে পুলিশের গুলিবর্ষণে কয়েকজন নিহত হয়েছে। সকাল দশটায় ছাত্র-জনতার জঙ্গী মিছিল বের হয়। এ মিছিলে নেতত্ব দেন সিরাজুল আলম খান, মহিউদ্দিন আহমদ, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, আইউব রেজা চৌধুরী, রেজা আলি প্রমুখ। মিছিল যখন হাইকোর্ট অতিক্রম করে আবদুল গণি রোডে প্রবেশ করে তখন পিছন থেকে পুলিশ গুলিবর্ষণ করে। নিহত হয় বাবুল ও ইপিআরটিসি বাসের কন্ট্রাক্টর গোলাম মোস্তফা এবং আহত হয় গৃহভৃত্য ওয়াজিউল্লাহ। পরদিন হাসপাতালে ওয়াজিউল্লাহ মারা যায়। সিরাজুল আলম খান অন্যান্য ছাত্রকর্মীদের নিয়ে আহতদের হাসপাতালে পাঠানোর ব্যবস্থা করেন। এলোপাথাড়ি গুলি ও টিয়ার গ্যাসে অসংখ্য আহত হয়। প্রায় ১৫০ জনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ঢাকার শতকরা ৯৫ জন মেহনতি মানুষ এদিনের বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করে, এমনকি বুড়িগঙ্গা নদীর ওপার থেকে নৌকার মাঝিরা পর্যন্ত বৈঠা হাতে মিছিলে যোগদান করে।
আইয়ুব খান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে ছাত্র অসন্তোষের মূল কারণ বের করার জন্য নিযুক্ত করেন। হামুদুর রহমান ছাত্র আন্দোলন সম্পর্কে অপমানজনক মন্তব্য করেন। ছাত্র সংগঠনগুলো সম্পর্কে হামুদুর রহমানের রিপোর্টে বলা হয় যে, এদের কোনো নিজস্ব ঘোষণাপত্র বা আদর্শ নেই। রাজনৈতিক কলকাঠিতে এরা নড়ে। ডিগ্রি কোর্সকে তিন বছর মেয়াদী করাটাকেই মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। স্বভাবতই ছাত্ররা ঘৃণাভরে হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট প্রত্যাখ্যান করে এবং নতুন করে ছাত্ররা আবার রাজপথে নামে কিন্তু হামুদুর রহমান কমিশনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ দানা বেঁধে ওঠার আগেই ১৯৬৫ সালে নতুন সমস্যার আবির্ভাব ঘটে। ৬ সেপ্টেম্বর ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয় আর সে বছরই অনুষ্ঠিত হয় প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে সম্মিলিত বিরোধী দলের প্রার্থী হলেন মিস ফাতেমা জিন্নাহ। ছাত্রসমাজ আইয়ুব বিরোধী নির্বাচনী আন্দোলনে মেতে ওঠে। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, প্রকৃতপক্ষে হামুদুর রহমান কমিশন কোনো শিক্ষা কমিশন ছিল না। নতুন শিক্ষানীতি প্রণয়ন এর উদ্দেশ্য ছিল না। ছাত্রবিক্ষোভের কারণসমূহ অনুসন্ধান এবং শরীফ কমিশন রিপোর্টের
পৃষ্ঠা-৬৭

পর্যালোচনার জন্য আইয়ুব খান হামুদুর রহমান কমিশন গঠন করেন। এ কমিশনের অন্যান্য সদস্য ছিলেন বিচারপতি এম এ মাহমুদ, কাজী আনোয়ারুল হক কেন্দ্রীয় পাবলিক সার্ভিস কমিশন) ও নাসির আহমদ (চেয়ারম্যান, পশ্চিম পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন)। ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব বিরোধী জনগণ সম্মিলিত বিরোধী দলের পতাকাতলে একতাবদ্ধ হন। প্রবলভাবে গণজাগরণের সৃষ্টি হলেও সাধারণ মানুষের হতাশ হওয়া ছাড়া করার কিছু ছিল না। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী ছিল ভোটার, যাদেরকে সুযোগ দিয়জ কিনে ফেলা হলো। চরম দুর্নীতি ও ভয় ভীতি দেখিয়ে আইয়ুব খান নির্বাচনে জয়লাভ করেন। কিন্তু শত চেষ্টা করেও আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তান থেকে মাত্র আড়াই হাজার ভোট বেশি পান। আইয়ুব খান ২১,০১২ ভোট এবং ফাতেমা জিন্নাহ ১৮,৪৩৪ ভোট পান।
১৯৫৮ সালে সামরিক আইন জারির পর থেকে লে. জেনালের আজম খান। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তিনি ঢাকায় শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয় হয়ে পড়েছিলেন। আইয়ুব খানের সঙ্গে মত বিরোধের কারণে আজম খান অপসারিত হন এবং ৬২’র এপ্রিল মাসে গোলাম ফারুক নতুন গভর্নর নিযুক্ত হন। এর ছয় মাস পরে ২৮শে অক্টোবর আইয়ুব খানের সেবাদাস কেন্দ্রীয় স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুল মোনেম খান পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্ত হন। মোনেম খান গভর্নর হয়েই পরিচিত ও বিশ্বস্ত ড. ওসমান গনিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য নিয়োগ করেন। ছাত্র আন্দোলন দমন করার জন্য পেশীশক্তি সম্পন্ন ছাত্রদের সমন্বয়ে একটি ছাত্রদল গঠন করেন। এ ছাত্র সংগঠনের নাম ন্যাশনাল স্টুডেন্টস ফেডারেশন বা সংক্ষেপে এন এস এফ। এ বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সন্ত্রাসের এক কলঙ্কময় অধ্যায় রচনা করে। ছাত্র নামধারী মোনম খানের গুণ্ডারা শুধু ছাত্রদের ওপরই নয়, শিক্ষকদের ওপরেও চরম বর্বরতা চালায়। মোনেম খান গভর্নর হিসেব পদাধিকারবলে বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের চ্যান্সেলর ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে তুমুল হট্টগোলের মধ্যে সমাবর্তন অনুষ্ঠান সম্পন্ন হলেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা মোনেম খানের কাছ থেকে সার্টিফিকেট নিতে অস্বীকার করেন।
১৯৬৪ সালের ২২ মার্চ কার্জন হলে সমাবর্তন অনুষ্ঠানটি হওয়ার কথা ছিল। এ সময় ডাকসুর সহ-সভাপতি ছিলেন রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী। ডাকুসর ভিপি, জিএস, ইকবাল হলের (বর্তমান। জহুরুল হক হলো) ভিপি ও জিএস যথাক্রমে মুঈদ চৌধুরী ও আলী হায়দার খান, সলিমুল্লাহ হলের ভিপি ও জিএস যথাক্রমে ফরাসউদ্দিন ও মোহাম্মদউল্লাহ ভুইয়া, ঢাকা হলের (বর্তমান শহীদুল্লাহ হলো) ভিপি ও জিএস যথাক্রমে ফজলুল।
পৃষ্ঠা-৬৮

হক ও আবদুর রাজ্জাক এক যুক্ত বিবৃতিতে ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতিকে চ্যান্সেলর নিয়োগের দাবি জানান।
১১ মার্চ ডাকসু অফিসে ২২ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য সমাবর্তন অনুষ্ঠান বর্জনের সময়ে আলোচনার জন্য বৈঠক বসে। সর্বদলীয় ছাত্রনেতাদের এ বৈঠক ভন্ডুল করার হীন উদ্দেশ্যে এন এস এফ-এর গুন্ডা বাহিনী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টরের অফিস থেকে হকিস্টিক ও রড সংগ্রহ করে আক্রমণ চালায়।
এ ঘটনার জের হিসাবে পরদিন পরিস্থিতি চরম আকার ধারণ করে। ছাত্র-পুলিশ উভয়ই মারাত্মক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চালে গেলে মোনেম খান সভা কক্ষ ত্যাগ করেন। বহু ছাত্র গ্রেফতার ও আহত হন। রাতের অন্ধকারে প্রায় ৫০ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হয়।
ডাকসুর সহ-সভাপতি রাশেদ খান মেনন ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন বেগম মতিয়া চৌধুরী সরকারের নির্যাতনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য নিন্দা করে বিবৃতি দেন। ৩০ মার্চ রাশেদ খান মেনন, হায়দার আকবর খান রনো, গিয়াস কামাল, এ কে বদরুল হক, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, এন এম সিরাজুল আলম প্রমুখের নামে হুলিয়া জারি করা হয় এবং আত্মসর্পণের নির্দেশ দেওয়া হয়। এতে আন্দোলন আরও দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। সরকার উপায়ান্তর না দেখে পূর্ব পাকিস্তানের ৭৪টি কলেজ, ১৪০০টি উচ্চবিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। সারাদেশে প্রায় ১২০০ ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। ছাত্রনেতা আজিজুর রহমানসহ ঢাকা কলেজ ও ঢাকা আর্ট কলেজের ১২ জন ছাত্রকে বহিষ্কার করা হয়। ছাত্রলীগ নেতা কে এম ওবায়দুর রহমান ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা এ কে বদরুল হক, রাশেদ খান মেনন এবং সওগাত আলমকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাঁচ বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। গিয়াসউদ্দিন আহমদ চৌধুরী, মনসুরউদ্দিন আহমদ, জাকির হোসেন, আবদুল করিম, সৈয়দ মতিউর রহমান, আবদুর রাজ্জাক, সিরাজুল আলম খান, কাজী মোজাম্মেল, আরিফুর রহমান, হুমায়ুন কবির ও কামাল সিদ্দিকীকে দুই বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়। ২০ জনকে সদাচারের মুচলেকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। ফেরদৌস আহমেদ কোরেশী (ছাত্রলীগ) তা দিতে অস্বীকার করলে তাকেও এক বছরের জন্য বহিষ্কার করা হয়।
ফেরদৌস আহমদে কোরেশী উপাচার্যের কাছে এক দীর্ঘ প্রতিবাদপত্র লেখেন, যা সংবাদপত্রে ছাপা হয়েছিল। এ সময় সংবাদপত্র যাতে আন্দোলনের সঠিক খবর পরিবেশন না করতে পারে সেজন্য বিধি-নিষেধ জারি করা হয়।
পৃষ্ঠা-৬৯

ইতিপূর্বে পরিবেশনের দায়ে আজাদ, সংবাদ ও ইত্তেফাক-এর বিরুদ্ধে কারণ দর্শাও নোটিশ প্রদান করা হয় এবং প্রত্যেক সংবাদপত্রের কাছে ত্রিশ হাজার টাকা জামানত তলব করে সমন জারি করা হয়। ছাত্ররা এ অন্যায় বহিষ্কারের নির্দেশের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে মামলা দায়ের করে। হাইকোর্টের বিশেষ বেঞ্চ ৮ জুলাই এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করে। এ রায়ে ছাত্রদের বহিষ্কারের আদেশকে অবৈধ ঘোষণা করা হয়। অপরদিকে পত্রিকাগুলো বিচারপতি মোর্শেদের এজলাসে মামলা দায়ের করে। মামলায় জয়লাভ করার পর ২৮ এপ্রিল (১৯৬৪) সংবাপত্রগুলো ছাত্র নির্যাতনের ৩০ দিনের এক দীর্ঘ প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
মামলায় জিতে ছাত্ররা আনন্দ মিছিল বের করলে পুলিশ লাঠিচার্জ করে। ৮ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় খোলার ঘোষণা দেওয়া হলে ৪মে ছাত্র নেতৃবৃন্দ ড, ওসমান গণির পদত্যাগ দাবি করে। এ সময় ছাত্র আন্দোলন দমনের উদ্দেশ্যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়।
১৯৬৪ সালের ৬ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ছাত্র সংগঠনের নেতৃবৃন্দ মধুর ক্যান্টিনে এক বৈঠকে মিলিত হয় এবং আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন সুস্পষ্ট হয়ে উঠলে পরদিন ১৮ সেপ্টেম্বর প্রদেশের সকল স্কুল-কলেজ এবং ১৯ সেপ্টেম্বর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং পত্রিকাগুলোর ওপর পুনরায় সেন্সরশীপ জারি করা হয়।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর তারিখে ভারত-পাকিস্তান সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। ১৭ দিন স্থায়ী এ যুদ্ধ চলাকালে বাঙালি এক চরম অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়। আইয়ুব খান ও তার পাঞ্জাবি সহচররা বলত পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে নিহিত আছে। অর্থাৎ পূর্ব পাকিস্তানকে ভারত দখল করবে পশ্চিম পাকিস্তান ভারত ভূখণ্ড দখল করে নেবে। কি অদ্ভুত থিওরি! এ উদ্ভূত তত্ত্বের ফলে পাঞ্জাবিরা বাঙালিদের সেনাবাহিনীতে নিত না। কিন্তু ১৭ দিনের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ বাঙালিদের চোখ খুলে দিয়েছিল। এ যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত।
১৯৬৬ সালের জানুয়ারি মাসে অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু মাহমুদ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরুদ্ধে একটি মামলায় জয়লাভ করার কারণে এন এস এফ-এর গুণ্ডারা তাকে প্রচণ্ডভাবে প্রহার করে। ড. আবু মাহমুদ গুরুতর ভাবে আহত হন। এসব ছাত্র নামধারী গুণ্ডারা গভর্নর হাউসে আশ্রয় লাভ করে এবং এদের বিরুদ্ধে কোনো আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
পৃষ্ঠা-৭০

১৯৬২ সালে রাকসুর সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন শেখ রুস্তম আলী ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন বজলুল করিম। এঁরা কোনো কেন্দ্রীয় রাজনৈতিক দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। রাজশাহী কলেজ ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি চিলেন আবু আলম। আবু আলম পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন, বাড়ি রংপুরে, বর্তমানে ঢাকায় ভাসানীপন্থী ন্যাপের রাজনীতির সঙ্গে সক্রিয়ভাবে জডিত। উপ-সহসভাপতি (প্রোভিপি) ছিলেন ছাত্র ইউনিয়নের মোহাম্মদ রফিক। সাধারণ সম্পাদক ছিলেন মোজাম্মেল হক (ছাত্র ইউনিয়ন)।
রাজশাহীতে উপযুক্ত নেতৃবৃন্দের নেতৃত্বে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় (১৯৬২) আইয়ুব খান রাজশাহী সফরে আসেন। রাজশাহী কলেজের সংগ্রামী ছাত্ররা আইয়ুব খানকে কালো পতাকা দেখান এবং উচ্চস্বরে শ্লোগান দিতে থাকেন, “আইয়ুব খান ফিরে যাও”। কড়া পুলিশ প্রহরায় যখন আইয়ুব খানের মোটর শোভাযাত্রা রাজশাহী কলেজ হোস্টেলের সম্মুখে দিয়ে অগ্রসর হচ্ছিল, তখন বিক্ষুদ্ধ ছাত্ররা আইয়ুব খানের গাড়ির ওপরে ইট নিক্ষেপ করে। নিক্ষিপ্ত ইট আইয়ুবের গাড়ির ওপরে সশব্দে পড়ে। আইয়ুব আহত না হলেও ক্রোধে অগ্নিমূর্তি ধারণ করেন এবং জেলা প্রশাসক পাঞ্জাবি জামিলুর রহমান খান ছাত্রদের শায়েস্তা করার আদেশ দেন। পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আইয়ুব যখন পদ্মার তীরে সার্কিট হাউসে বসে ঝাউন বনের বাতাস খাচ্ছিলেন, শহরে তখন ছাত্র-জনতা টিয়ার গ্যাসে প্রবল ভাবে আক্রান্ত। গুলি, লাঠিচার্জ ও টিয়ারগ্যাস নিক্ষেপ করে তাণ্ডবলীলা শুরু হয়। জেলা প্রশাসকের নেতৃত্বে পুলিশ বাহিনী সমগ্র কলেজ হোস্টেলে ঢুকে ছাত্রদের যাকে সামনে পায় তাকেই নিদারুণ ভাবে পেটাতে শুরু করে। এভাবে ছাত্রদের নির্যাতন-নিগৃহীত করে পাঞ্জাবি জেলা প্রশাসক প্রভু আইয়ুবের সন্তুষ্টি অর্জন করেন।
এ আইয়ুব বিরোধী বিক্ষোভের ফলে রাজশাহী ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি আবু আলম, উপ-সহসভাপতি মোহাম্মদ রফিক ও সাধারণ সম্পাদক মোজাম্মেল হক কলেজ থেকে বহিষ্কৃত হন। ছাত্র সংসদ বাতিল করে ছাত্র সংসদের নির্বাচন অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়। নির্বাচন ছাড়াই অঘোষিতভাবে ছাত্র সংসদের দায়িত্ব চলে যায় আইয়ুবের গুণ্ডা ছাত্র সংগঠন এন এস এফ-এর হাতে। রাজশাহী কলেজের তৎকালীন অধ্যক্ষ মুহাম্মদ আব্দুল হাই-এর প্রত্যক্ষ সমর্থন ও পৃষ্ঠপোষকতায় রাজশাহীতে গড়ে ওঠে এনএসএফ বাহিনী। তৌফিকুর রহমান শেলী, মুইদ ও শাকুর খান এর নেতৃত্বে এনএসএফ-এর অভ্যুদয় ঘটে। পরবর্তীকালে হেতমখানের প্রখ্যাত গুণ্ডা মতিন খান, মন্টু, সিং, ইউনুস খান,
পৃষ্ঠা-৭১

পাঠান পাড়ার সন্টু সিং ও দরগা পাড়ার ছাত্র নামধারী এনএসএফ-এর গুন্ডাদের দৌরাত্ম রাজশাহী কলেজে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করে।
১৯৬৩ সালে মোনেম খান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে যোগদানের উদ্দেশে রাজশাহী আসেন। এ সময়ে রাকসু’র সহ-সভাপতি ছিলেন ছাত্রলীগের মোজহারুল হক বাকি ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন আব্দুর রউফ। এস এম হলের সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ছাত্রলীগের সরদার আমজাদ হোসেন। ছাত্ররা মোনম খানের কাছ থেকে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সার্টিফেকেট নিতে অস্বীকার করে। ফলে প্রবল হাঙ্গামার সৃষ্টি হয়। শুরু হয় ছাত্রদের ওপর পলিশী নির্যাতন। মজহারুল হক বাকিকে স্থায়ী ভাবে বহিষ্কার করা হয়। আবদুর রউফ (ছাত্রলীগ), সরদার আমজাদ (ছাত্রলীগ) ও জাকারিয়া (ছাত্র ইউনিয়ন) কেও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার করা হয়। ১৯৬৪ সালে আওয়ামী লীগ পুনরুজ্জীবিত হওয়ার পর শেখ মুজিব রাজশাহীতে জনসভা করতে আসেন। ভুবনমহন পার্কটি রাজশাহী শহরের কেন্দ্রস্থলে সাহেব বাজার এলাকায় অবস্থিত। পার্কের এক কোণে শান-বাঁধানো স্টেজ। রাজশাহীর আওয়ামী লীগ নেতা কামরুজ্জামানের বক্তৃতার পরে শেখ মুজিব বক্তৃতা শুরু করলেন।
শেখ মুজিব সাধারণ বাঙালির চেয়ে লম্বা ছিলেন,চমৎকার দোহারা গড়ন। ব্যাক ব্রাশ করা চুল দু’পাশে শৈল্পিকভাবে ফুলে আছে। শেখ মুজিব যখন উঠে পঁড়িয়ে বক্তৃতা দিতে শুরু করলেন, তখন তাকে প্রকৃতই একজন বীরপুরুষের মতো মনে হচ্ছিল। ঠিক তখনই এ জনসমাবেশে গণ্ডগোলের সূত্রপাত করা হয়। সরকারি মহল শেখ মুজিবের জনসভা পণ্ড করার জন্য গুণ্ডা লেলিয়ে দেয়। কুখ্যাত গুণ্ডা হাত কাটা হেকিম (এর হাত কাটা ছিল), দরগাপাড়ার এতিম গুণ্ডা ডালমন্ত্রী আমজাদ (ইনি কোনো মন্ত্রী ছিলেন না; ডালের ব্যবসা করতেন বলে অনেকে ঠাট্টা করে এ নামে তাকে ডাকত) ও শাহ আলম গুণ্ডা রামদা ও লাঠি নিয়ে আক্রমণ করে। এ আকস্মিক আক্রমণে লাঠির আঘাতে আওয়ামী লীগ কর্মী মাতবরের মাথা ফেটে যায়। ফলে জনসভা থেমে গেল, ভীত-সন্ত্রস্ত লোকজন তখন দৌড় দিতে শুরু করেছে, অনেকেই চিৎকার করছে। মাত্র কয়েক মিনিট… শেখ মুজিব তাঁর পরিহিত পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে মঞ্চ থেকে নিচে লাফিয়ে পড়ে গর্জন করে উঠলেন, কে আছিস আয়, আয় আমার সামনে, তোদের গুণ্ডামি কেমন করে শায়েস্তা করতে হয় তা মজিবুর রহমানের জানা আছে।” শেখ মুজিবের এ তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া ও সাহসী পদক্ষেপের ফলে সরকারি গুণ্ডারা দ্রুত পলায়ন করল। শেখ মুজিব পুনরায় মঞ্চে উঠলেন এবং স্বভাবসিদ্ধ জ্বালাময়ী বক্তৃতা শুরু করলেন।
পৃষ্ঠা-৭২

১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে রাজশাহী স্টেডিয়ামে আইয়ুব খান ও ফাতেমা জিন্নাহর পরিচিতি অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। আইয়ুব খানের গাড়ি যখন সফুরা রেলওয়ে গেট অতিক্রম করছিল, তখন উত্তেজিত জনতা গাড়ি লক্ষ্য করে ইট-পাটকেল নিক্ষেপ করে। পুলিশ তৎক্ষণাৎ লাঠিচার্জ করে । ফলে অনেকের মধ্যে পাবনার নব নির্বাচিত সংসদ সদস্য সৈয়দ হোসেন মনসুর তারা মিয়া আহত হন।
রাজশাহী রেলওয়ে স্টেশনে রেলওয়ে সেলুনে নেতৃবৃন্দের থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এখানে সেলুনে অবস্থান করছিলেন ফাতেমা জিন্নাহর পক্ষাবলম্বনকারী কাশ্মীরের সাবেক প্রেসিডেন্ট মুহম্মদ খুরশীদ, কবি ইকবালের পুত্র জাভেদ ইকবাল, রংপুরের মাইনকারচরের আবুল কাশেম শেখ মুজিব ও আজম খান একই সেলুনে ছিলেন।
রাজশাহী জেলা প্রশাসক ছিলেন পাঞ্জাবি জামিলুর রহমান খান ও এডিসি চিলেন আসফউদ্দৌলা এবং এসপি ছিলেন গোলাম কিবরিয়া। নেতৃবৃন্দের থাকার অব্যবস্থার জন্য শেখ মুজিব জেলা প্রশাসককে ডেকে পাঠান এবং এক পর্যায়ে ধমকের সুরে তাঁকে বলেন ইলেকশনের পরে আমার সঙ্গে দেখা করবেন। এডিসি আসফউদ্দৌলা ও এসপি গোলাম কিবরিয়া নানাভাবে ছাত্রদের সেই সময় সাহায্য সহযোগিতা করেছেন।
বিকেলে আহত সৈয়দ হোসেন মনসুরকে দেখার জন্য শেখ মুজিব আজম খানকে সঙ্গে করে রাজশাহী সদর হাসপাতালে রওনা হন। শেখ মুজিবের গাড়ি যখন রাজশাহী কলেজের সামনে দিয়ে যাচ্ছিল, তখন কতিপয় ছাত্র হাত তুলে গাড়ি থামায়। শেখ মুজিব ঐ ছাত্রদের তার পক্ষের লোক ভেবে গাড়ি থামিয়ে নেমে পড়েন। এসব ছাত্ররা ছিল আইয়ুব-মোনায়েম সমর্থক এনএসএফ দলভুক্ত। এরা শ্লোগান দেয়ঃ ‘মুজিব আজম ফিরে যাও, ফিরে যাও’। শেখ মুজিব উচ্চস্বরে বললেন, তোমাদের দেখে নেব’। এরপর শেখ মুজিব ও আজম খান হাসপাতালে যান। সেইদিনই সন্ধ্যার পর রাজশাহী ছাত্র নেতৃবৃন্দ নূরুল আলম, সাইফুল ইসলাম ও নুরুল ইসলাম ঠাণ্ড সেলুনে শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করেন। শেখ মুজিব এনএসএফ এর ছাত্রদের এ ধৃষ্টতার জন্য খুবই রাগান্বিত ছিলেন। শেখ মুজিবের আত্মবিশ্বাস ছিল গগণচুম্বি। তিনি বললেন নির্বাচনের পরে ওদের শায়েস্তা করবেন। নূরুল ইসলাম ঠান্ডু এক পর্যায়ে বললেন, আপনি তো পূর্ব পাকিস্তানের মুখ্যমন্ত্রী হবেন এবং তখন সবাইকে ক্ষমা করেন দেবেন। শেখ মুজিব জবাবে বললেন, সবাইকে ক্ষমা করে দেব, শুধু মোনেম খান ক্ষমা পাবে না । উপস্থিত সবাই উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।
পৃষ্ঠা-৭৩

১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের পরে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয় । তাসখন্দ চুক্তিকে কেন্দ্র করে পশ্চিম পাকিস্তানি রাজনীতিবিদরা ১৯৬৬ সালের ফেব্রুয়ারি লাহোরে সকল রাজনৈতিক দল সমন্বয়ে একটি জাতীয় সম্মেলন আহবান করেন। এসময় নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি নসরুলাহ খান ও সাধারণ সম্পাদক ছিলেন জহিরুদ্দিন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন আবদুর রশিদ তর্কবাগীশ আর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান। শেখ মুজিব প্রথম দিকে লাহোর কনফারেন্সে যেতে অস্বীকার করেন। এ খবর পেয়ে নসরুল্লাহ খান ছুটে এলেন ঢাকায়। শাহ আজিজ তখন আওয়ামী লীগে। শেখ মুজিব তাকেই লাহোরে পাঠানোর কথা ভেবে ছিলেন, কিন্তু ইত্তেফাক সম্পাদক মানিক মিয়া বলেন, মুজিবুর মিয়া যদি যেতেই হয়, আপনি যান। আপনার মনে এতকাল যে কথাগুলো আছে সেগুলো লিখে নিয়ে যান। ওরা শুনুক, এতে কাজ হবে। শেখ মুজিব লাহোর কনফারেন্সে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিলেন।
অতঃপর তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে আলফা ইনসিওরেন্সের কক্ষে বসে। ছয় দফার একটি খসড়া প্রণয়ন করেন। এভাবেই প্রণয়ন করা হলো বাঙালির মুক্তিসনদ ঐতিহাসিক ছয় দফা। পূর্ব বাংলার বুদ্ধিজীবী ও অর্থনীতিবিদদের কাছে থেকে ছয় দফার ধারণা ও শোষণের চিত্র পাওয়া গেলেও ছয় দফা মূলত শেখ মুজিবের সুদীর্ঘ কালের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা ও প্রজ্ঞার ফসল। পূর্ব বাংলাকে নব্য উপনিবেশবাদ থেকে রক্ষা করার জন্য ও অর্থনৈতিক শোষণ চিরতরে বন্ধ করার লক্ষ্যে শেখ মুজিব দীর্ঘকাল ধরে যে মুক্তির পথ খুঁজছিলেন, ছয় দফা তারই প্রতিফলন।
৪ ফেব্রুয়ারি লাহোর কনফারেন্সে যোগদানের জন্য তাজউদ্দিন আহমদ ও নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ শেখ মুজিব লাহোরে যান। ছয় দফা প্রণয়নের সময় আলফা ইনসিওরেন্সের কক্ষে উপস্থিত ছিলেন সাংবাদিক আবদুল গাফফার চৌধুরী। আবদুল গাফফার চৌধুরী ছয় দফার একটি কপি হস্তগত করেন এবং তা কাগজে প্রকাশ করে দেন। ৩৪২ শরৎগুপ্ত রোডস্থ অনুপম মুদ্রণালয় থেকে সদ্য প্রকাশিত দৈনিক আওয়াজ-এ প্রথম ছয় দফা প্রকাশিত হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ কর্তৃক ছয় দফা জনসমক্ষে উপস্থাপনের পূর্বেই পূর্ব বাংলায় এর ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়।
ফেব্রুয়ারির ৫ তারিখে চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর বাসভবনে কাউন্সিল মুসলিম লীগ সভাপতি সৈয়দ মোহাম্মদ আফজলের সভাপতিত্বে সভা শুরু হয়। সাবজেক্ট কমিটির মিটিং-এ শেখ মুজিব তার ছয় দফা দাবি পেশ করেন। কিন্তু উপস্থিত পশ্চিম পাকিস্তানি কয়েকটি পত্রিকায় শেখ মুজিবকে বিচ্ছিন্নতাবাদী
পৃষ্ঠা-৭৪

হিসেবে অপবাদ দেওয়া হয়। শেখ মুজিব এরপর কনফারেন্সে যোগদান থেকে বিরত থাকেন। কাগজে বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে শেখ মুজিবকে চিহ্নিত করে খবর প্রকাশিত হওয়ার ফলে লাহোরে শেখ মুজিব ও তার সঙ্গীদের জীবন বিপন্ন হয়ে পড়ে। তারা গোপনে করাচি গিয়ে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর বাসায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। ১১ ফেব্রুয়রি শেখ মুজিব তার সঙ্গীদের নিয়ে ঢাকা ফিরে আসেন এবং বিমান বন্দরেই সাংবাদিকদের কাছে ছয় দফা ব্যাখ্যা করেন।
শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ছয় দফা কর্মসূচি আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটিতে পেশ করেন এবং যথারীতি সর্বসম্মতিক্রমে তা অনুমোদন লাভ করে। ১৮ মার্চ (১৯৬৬) ইডেন হোটেলে অনুষ্ঠিত পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিন ব্যাপী কাউন্সিল অধিবেশনে ছয় দফার বিস্তারিত ব্যাখ্যাসহ আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা কর্মসূচি পুস্তিকা বিতরণ করা হয়।
শেখ মুজিবর এরপর ছয় দফা জনগণের কাছে পৌছে দেবার জন্যে গণসংযোগ সফর শুরু করেন। তিনি সারাদেশে সভা সমাবেশ করে ছয় দফার পক্ষে জনমত গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। চট্টগ্রামের লালদিঘি ময়দানে ২৫ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) এক বিশাল জনসভায় জনতা ছয় দফা আদায়ের জন্য যে কোনো ত্যাগ স্বীকারে শপথ গ্রহণ করে। ছয় দফার পক্ষে এখানেই প্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি নোয়াখালির মাইজদী কোর্টে জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে শেখ মুজিব ছয় দফা দাবিতে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান।
১৬ মার্চ (১৯৬৬) রাজশাহীতে আইয়ুব খান প্রকাশ্যে ছয় দফার সমালোচনা করে বলেন,এটা বৃহত্তর বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি পরিকল্পনা। আইয়ুব সাবধানবাণী উচ্চারণ করে বলেন, এ জঘন্য স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তানবাসী গোলামে পরিণত হবে এবং তিনি তা সফল হতে দেবেন না।
ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাকিস্তান কনভেনশন মুসলিম লীগের অধিবেশনে সভাপতির ভাষণদান কালে আইয়ুব খান শেখ মুজিব ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে গৃহযুদ্ধের হুমকি দেন (১৯ অথবা ২০ মার্চ ১৯৬৬)। আর এদিনই শেখ মুজিব আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনের সমাপ্তি দিবসে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় ঘোষণা করলেন, কোনো হুমকিই বাংলার মানুষকে ছয় দফা দাবি থেকে বিবৃত্ত করতে পারবে না।
ইডেন হোটেলে ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কাউন্সিল অধিবেশনে শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান লীগের সভাপতি হন ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন তাজউদ্দিন আহমদ। সহ-সভাপতি নির্বাচিত হন যথাক্রমে সৈয়দ
পৃষ্ঠা-৭৫

নজরুল ইসলাম, হাফেজ হাবিবুর রহমান ও মজিবুর রহমান (রাজশাহী) । অন্যরা হলেন; সাংগঠনিক সম্পাদক আব্দুল মোমেন, মহিলা সম্পাদিকা আমেনা বেগম , দপ্তর সম্পাদক মোহাম্মদুল্লাহ, সমাজকল্যাণ সম্পাদক কে এম ওবায়দুর রহমান ও কোষাধ্যক্ষ নূরুল ইসলাম চৌধুরী।
এ সময় আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফা প্রশে প্রকাশ্য জনসভায় শেখ মুজিবের প্রতি বাকযুদ্ধের আহবান জানান। শেখ মুজিবের পক্ষে তাজউদ্দিন ২১ মার্চ উক্ত চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পল্টন ময়দান বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। ১৭ এপ্রিল এ বাকযুদ্ধের দিন ধার্য হয়। কিন্ত ইতোমধ্যেই ছয় দফার সপক্ষে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছে। জনগণ প্রবলভাবে সাড়া দিয়েছে। এ জনসমর্থন দেখে ভুট্টো দর্শকদের নিরাশ করে রণে ভঙ্গ দেন। ভুট্টো বলেন, গণচীনের নেতা লিউ শাও চী’র সংবর্ধনায় ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি বাকযুদ্ধে উপস্থিত থাকতে পারবেন না। ভুট্টো পশ্চাদপসরণে শেখ মুজিব বলেন, ছয় দফা নৈতিক বিজয় সূচিত হয়েছে।
শেখ মুজিব ৭ এপ্রিল বগুড়া, ৯ এপ্রিল রংপুর, ১০ এপ্রিল দিনাজপুর, ১১ এপ্রিল রাজশাহী, ১৪ এপ্রিল যশোর ও ১৭ এপ্রিল খুলনায় জনসভায় ভাষণদান করার পর ঢাকা ফেরার পথে যশোরে তাকে ঢাকার রমনা থানা জারিকৃত ওয়ারেন্ট অনুযায়ী পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারাবলে পুলিশ গ্রেফতার করে। যশোর সদর দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের এজলাস থেকে জামিনে মুক্তলাভ করে সদলবলে শেখ মুজিব ঢাকা ফিরে আসেন। যশোরের মহকুমা হাকিমের নির্দেশক্রমে শেখ মুজিব ২১ এপ্রিল (১৯৬৬) ঢাকার দক্ষিণ মহকুমা হাকিমের আদালতে হাজির হলে তার জামিন নাকচ করে দেন। পরে সেশন জজের কাছে জামিনের আবেদন জানালে তিনি আবেদন মঞ্জুর করেন এবং শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। কিন্তু সেদিন রাতেই সিলেট এসডিও আদালতের এক পরোয়ানাবলে ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপারের নেতৃত্বাধীন একটি পুলিশ দল তাঁর ধানমণ্ডিস্থ বাসভবনে থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে ঢাকার মহকুমা হাকিমের (দক্ষিণ) এজলাসে হাজির করে। তিনি জামিনের আবেদন করলে তা নাকচ করে দিয়ে হাকিম তাকে জেল হাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন।
২৩ এপ্রিল সিলেটের দায়রা জজ শেখ মুজিবকে জামিনে মুক্তিলাভের নির্দেশ দেন। কিন্তু সে দিনই ময়মনসিংহ থেকে পাঠানো গ্রেফতারি পরোয়ানা বলে পুলিশ সিলেট কারাগার থেকে তাঁকে গ্রেফতার করে ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ নিয়ে যায়। ২৪ এপ্রিল শেখ মুজিবকে ময়মনসিংহ সদর মহকুমা হাকিমের বাসভবনে হাজির করা হয়। কিন্তু এসডিও শেখ মুজিবকে জামিন দিতে অস্বীকৃতি জানান। পরদিন ২৫ এপ্রিল ময়মনসিংহ জেলা ও দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করেন।
পৃষ্ঠা-৭৬

১৯৬৬ সালের ৮ মে শেখ মুজিব নারায়ণগঞ্জের চাষাড়ায় মে দিবস স্মরণে এক বিরাট জনসমাবেশে ভাষণদান শেষে বাসায় ফিরে আসেন। রাত ১টায় পাকিস্তান দেশরক্ষা আইনের ৩২ (১) ক ধারাবলে তাকে গ্রেফতার করা হয়। একই সঙ্গে খন্দকার মোশতাক, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবর রহমান (রাজশাহী) ও এম এ আজিজকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে পাঠানো হয়।
৮ মে তারিখের নারায়ণগঞ্জের জনসভায় সর্বপ্রথম শেখ মুজিকে ছয় দফার প্রতীক স্বর্ণপদক দেওয়া হয়। এ জনসভায় আইয়ুব খানের অস্ত্রের ভাষার প্রতিবাদ করে শেখ মুজিব জনগণকে অস্ত্রের ভাষার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানান।
গগণবিদারী শ্লোগানের মধ্যে সংগ্রামী জনতা শেখ মুজিবের অবর্তমানে ছয় দফার সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার শপথ গ্রহণ করে। শেখ মুজিব ও অন্যান্যের গ্রেফতারের কয়েকদিন পর পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, আবদুর রব বগা মিয়া ও ময়মনসিংহের রফিকউদ্দিন ভূঁইয়া গ্রেফতার হন।
শেখ মুজিবসহ সব রাজনৈতিক নেতার মুক্তির দাবিতে ঢাকাসহ অন্যান্য অঞ্চলে জনগণের চরম বিক্ষোভ প্রদর্শন অব্যাহত থাকে। ১৩ মে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয় এবং ৭ জুন সারাদেশে হরতাল পালিত হয়। কলকারখানা, গাড়ি চলাচল, দোকনাপাট সম্পূর্ণ বন্ধ থাকে। নাগরিক জীবন সম্পূর্ণ স্তব্দ হয়ে যায়। ধর্মঘটের জনতাকে ছত্রভঙ্গ করার লক্ষ্যে পুলিশ নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে। মনু মিয়া, মুজিবুর হকসহ মোট ১১ জন শহিদ হন এবং ৮০০ লোককে গ্রেফতার করা হয়। হরতালের খবর পর্যন্ত পরদিন সংবাদপত্রে ছাপাতে দেওয়া হলো না। সরকারি প্রেসনোট বড় হরফে প্রথম পাতায় ছাপা হলো। এ প্রেসনোট ১০ জনের মৃত্যুর কথা স্বীকার করা হলো। প্রেসনোটে বলা হলো : পুলিশের কোনো দোষ নেই। আইন-শৃংখলা রক্ষার জন্য পুলিশ গুলিবর্ষণে বাধ্য হয়েছে, যার ফলে কয়েকজন গুণ্ডা নিহত হয়েছে। ১৬ জুন (১৯৬৬) দেশবরেণ্য সাংবাদিক তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে গ্রেফতার করা হয় এবং ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ করে দেওয়া হয়।
তাজউদ্দিনকে এর আগে গ্রেফতারের ফলে মিজানুর রহমান চৌধুরী ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছিলেন। ২২ জুন মিজানুর রহমান চৌধুরীর গ্রেফতার করা হলে সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব নেন মোল্লা জালালউদ্দিন। মোল্লা জালালউদ্দিনকে গ্রেফতার করা হলে আমেনা বেগমকে ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম শেখ মুজিবের
পৃষ্ঠা-৭৭

অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন। এ সময় শেখ ফজল হক মনি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন ও ছাত্রনেতা শেখ শহীদুল ইসলাম গ্রেফতার করা হয়।
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত একের পর এক মামলার বিচার চলতে থাকে। ১৯৬৭ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকার অতিরিক্ত ম্যাজিস্ট্রেট এম এস খানের আদালতে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা বিচার শুরু করা হয়। ১৯৬৬ সালের ২০ মার্চ বক্তৃতাদানের মামলায় রায় ১৯৬৭ সালের ১৮ এপ্রিল প্রদান করা হয়। এ রায়ে শেখ মুজিবকে ১ মাস বিনাশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া। হয়।
গণদাবি আদায়ের সংগ্রামে এনডিএফ নিষ্ক্রিয় হয়ে যাওয়ার ১৯৬৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি পাঁচটি বিরোধী দল ৮ দফার ভিত্তিতে পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট বা পিডিএম নামে একটি ঐক্যজোট গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। আন্দোলনের কর্মসূচিতে ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, প্রাপ্তবয়স্কদের প্রত্যক্ষ ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত পার্লামেন্টারি ও ফেডারেল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা লাভ করে। দেশরক্ষা, পররাষ্ট্র বিষয়, মুদ্রা, ফেডারেল ফাইন্যান্স, সেন্ট্রাল ব্যাংক, বাণিজ্য ও যোগাযোগ বাদে অবশিষ্ট সব বিষয় আঞ্চলিক সরকারের হাতে অর্পণ, দেশরক্ষার ব্যাপারে উভয় অংশকে সমপর্যায়ে উন্নীত করা নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব বাংলায় স্থানান্তর আন্দোলনের কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
পৃষ্ঠা-৭৮

চতুর্থ অধ্যায়
স্বায়ত্তশাসন অর্জনের সংগ্রাম
যুক্তফ্রন্টের অভ্যন্তরীণ কোন্দল ও দেশ পরিচালনায় মুসলিম লীগের ব্যর্থতা পূর্ব বাংলার রাজনৈতিক অঙ্গনে হতাশা সৃষ্টি করে। দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান উর্ধ্বগতি রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে বিরূপ ধারণা সৃষ্টি করে। রাজনীতিবিদরাই এ পরিস্থিতির জন্য দায়ী, এ ছিল নিত্যনৈমিত্তিক আলোচনা। আওয়ামী মুসলিম লীগ ও যুক্তফ্রন্টের মধ্যে তীব্র মতবিরোধ সৃষ্টি হয়। সামনে পাকিস্তান গণ পরিষদের নির্বাচন। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রাদেশিক ইউনিটগুলো ভেঙে দিয়ে ১৯৫৫ সালের ২৭ মার্চ তারিখে এক ইউনিট ঘোষণার ফলে গভর্নর জেনারেল বিপুল ক্ষমতার অধিকারী হয়। ইতোমধ্যে মওলানা ভাসানী এপ্রিলের প্রথম দিকে কলকাতা আসেন।
১৯৫৫ সালের ২১ এপ্রিল আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক বসে। যুক্তফ্রন্টের ঐক্য সম্পর্কে তর্ক-বিতর্ক চলে। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও মওলানা ভাসানীর পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের ফলে আওয়ামী মুসলিম লীগ ও কেএসপি-এর বিরোধ সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। ১৯৫৫ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব আতাউর রহমান খান ও মওলানা তর্কবাগীশকে নিয়ে যুক্তফ্রন্ট পার্লামেন্টারি সভায় শেরে বাংলার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১৯৫৫ সালের ২১ এপ্রিল যে সভা হয় তার সভাপতি ছিলেন হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী। এ সভায় মারী কনভেনশন নিয়ে নতুনভাবে বিতর্ক সৃষ্টি হয়। সংবিধান, গণ পরিষদ ও এক ইউনিট প্রশ্নে সকল রাজনৈতিক দলের কনভেনশন নিয়ে আলোচনা হয়। সালাম খান এর বিরোধিতা করেন। মওলানা ভাসানীও বিরোধিতা করেন। এতদসত্ত্বেও ওয়ার্কিং কমিটির সভায় মারী কনভেনশনে যোগদানের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়। এ সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সালাম খানসহ ৯জনকে আওয়ামী লীগ থেকে বহিষ্কার করা হয়। বহিষ্কৃতরা হচ্ছেন ? খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, খালেক নেওয়াজ, আনোয়ারা খাতুন, আবদুল আওয়াল, আলমাস আলী, হাশিমউদ্দিন, জহিরুল হক ও আবুল হোসেন। এ ছাড়াও আব্দুর রহিম ও এমদাদ আলীর প্রতি কেন বহিষ্কার করা হবে না এ মর্মে কারণ দর্শাও নোটিশ দেওয়া হয়।
পৃষ্ঠা-৭৯

মওলানা ভাসানী কলকাতা থেকে মারী কনভেনশন বিরোধী বিবৃতি দেন, তিনি বলেন যে, পূর্ব বাংলায় পার্লামেন্টারি শাসন ও রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া না হলে আওয়ামী মুসলিম লীগ মারী কনভেনশন যোগ দেবে না।মওলানা ভাসানীর এ বিবৃতির ফলে ওয়ার্কিং কমিটি সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে মওলানা ভাসানীর মত পরিবর্তনের জন্য তাঁকে কলকাতা থেকে করাচি নিয়ে যেতে হবে এবং শেখ মুজিব, ইয়ার মোহাম্মদ ও আতাউর রহমান খানকে এ ব্যাপরে দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৫৫ সালের ২৪ এপ্রিল সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় মওলানা ভাসানীর ওপর থেকে বিধিনিষেধ উঠে গেলে ২৫ এপ্রিল মওলানা ভাসানী ঢাকায় এসে পৌঁছান। ২৬ এপ্রিল ওয়ার্কিং কমিটির যে সভা চলে তাতে মওলানা ভাসানী মারী কনভেনশন যোগদানের পক্ষেই রায় দেন। কিন্তু মে মাসের শুরুতেই আবার সোহরাওয়ার্দী-ভাসানী দ্বন্দ্ব শুরু হয়ে যায়। আওয়ামী মুসলিম লীগের পার্লামেন্টারি সদস্যদের সমর্থন আদায়ের জন্য সোহরাওয়ার্দী অব্যাহত চেষ্টষ চালিয়ে যেতে লাগলেন। সমর্থন আদায়ের উদ্দেশ্য হলো কেন্দ্রের গণ পরিষদে দল ভারি করা। কিন্তু ভাসানী অবিলম্বে ৯২-ক ধারার প্রত্যাহার চাইছিলেন এবং শেরে বাংলার নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভা গঠনের দিকে ঝুঁকে পড়লেন। ১৯৫৫ সালের ২৬ মে প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলীর জরুরি আমন্ত্রণে ইউসফ আলী চৌধুরী, সৈয়দ আজিজুল হক এবং আবদুস সালাম খান করাচি চলে যান। এ সময় অনেকেরই ধারণা হচ্ছিল যে, শেরে বাংলাই আবার পূর্ব বাংলার চীফ মিনিস্টার হতে যাচ্ছেন।
এ সময় কয়েকজন তরুণকে নিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান আপোসহীনভাবে শেরে বাংলার বিরোধিতা করে যাচ্ছিলেন। শেখ মুজিবের এ আপোসহীন এবং দৃঢ়চিত্ত মনোভাব পরিবর্তনের জন্য তাঁকে বিভিন্ন প্রলোভন দেখানো হয়। তাঁকে বলা হয় মন্ত্রিসভায় তিনি যে পদ চাইবেন সেই পদই দেওয়া হবে তাঁকে। কয়েক দফা বৈঠক করে সৈয়দ আজিজুল হককে দায়িত্ব দেওয়া হয় শেখ মুজিব যেন শেরে বাংলা বিরোধী কার্যক্রম থেকে বিরত থাকেন। কিন্তু কোনো প্রলোভন বা অনুরোধে শেখ মুজিব দমে যাননি। আব্দুস সালাম খান যেদিন প্রধানমন্ত্রীর আমন্ত্রণে করাচি যান, শেখ মুজিব সেদিন কুমিল্লা ও চাঁদপুরে সাংগঠনিক সফরে বেরিয়ে পড়েন। ১৯৫৫ সালের ২৯ মে চাঁদপুরের জনসভায় শেখ মুজিব যে বক্তব্য প্রদান করেন তা এক অর্থে ঐতিহাসিক বটে। অসাম্প্রদায়িক চেতনার উন্মেষ ঘটে তাঁর এ বক্তব্যের মাধ্যমে। তিনি বলেন, আওয়ামী মুসলিম লীগ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল রাজনৈতিক সংগঠন। হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান সকল ধর্মের প্রতি এ সংগঠন সমআচরণ প্রকাশ করবে। প্রয়োজনে
পৃষ্ঠা-৮০

সংগঠনের নামও বদল হতে পারে। তার এ বক্তব্যের মাধ্যমে তার ভবিষ্যৎ বাজনৈতিক জীবন কোনো ধারায় প্রবাহিত হবে তার একটা সুস্পষ্ট ইঙ্গিত পাওয়া যায়। আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগ এ ঐতিহাসিক উত্তরণের পিছনে শেখ মুজিব পঞ্চাশ দশকের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ধারাবাহিকভাবে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করছিলেন তারই বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে।
১৯৫৫ সালের ২ জুন গভীর রাতে প্রধানমন্ত্রী পূর্ব বাংলা থেকে ৯২-ক ধারা প্রত্যাহারের ঘোষণা দেন। ৩ জুলাই আওয়ামী মুসলিম লীগের নেতৃত্বে ঢাকায় আনন্দ মিছিল বের করা হয়। যুক্তফ্রন্টের ব্যাপারে আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রায় চুড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলে। এ সময় কেন্দ্রীয় আইনসভার নির্বাচন সম্পর্কেও সরকারি ঘোষণা প্রদান করা হয়। তবে মুসলিম লীগ তখনও কেন্দ্রীয় আইনসভায় যোগদানের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি।
১৯৫৫ সালের ৪ জুন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা আইন পরিষদের সদস্য হিসেবে মনোনয়নের জন্য মুসলিম লীগে যোগ দেন। ঐদিন করাচি থেকে কেন্দ্রের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার শেরে বাংলা মনোনীত পূর্ব বাংলা সরকারকে অস্থায়ী সরকার বলে বক্তব্য দেন। ১৯৫৫ সালের ৫ জুন পূর্ব বাংলার গভর্নর ৯২-ক ধারা আলোচনার পর শেরে বাংলা এ মর্মে গভর্নরকে আশ্বাস দেন যে, যদি তিনি (শেরে বাংলা) সরকার গঠন করেন তাহলে কোনো সমস্যা হবে না সালাম খানসহ বিপুল সংখ্যক নির্বাচিত সদস্য তাকে সমর্থন দিবে। তবে তিনি চিফ মিনিস্টার না হয়ে আবু হোসেন সরকারকে চিফ মিনিস্টার মনোনীত করেন। ১৯৫৫ সালের ৬ জুন আবু হোসেন সরকারের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভার শপথ অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। ৭ জুন বন্দী এম, এন, এ দের মুক্তি দেওয়া হয়। ৮ জুন সোহরাওয়ার্দী বিবৃতি দেন যে, আওয়ামী মুসলিম লীগ পূর্ব বাংলায় শেরে বাংলা সরকারের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করবে। আওয়ামী মুসলিম লীগ পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠ।
আব্দুস সালাম খান ছাত্রলীগকে দ্বিখণ্ডিত করে ফেলেন এবং মওলানা ভাসানী ও সোহরাওয়ার্দী আওয়ামী মুসলিম লীগের মনোনয়ন নিয়ে মুখোমুখি ঝগড়া ফ্যাসাদে উপনীত হন। ইতোমধ্যে যাঁরা জেল থেকে মুক্তি পান তারা হলেন-পাকিস্তান গণতন্ত্রী দলের মাহমুদ আলী (সিলেট), দিনাজপুরের হাজী মোহাম্মদ দানেশ, ফেনীর খাজা আহমেদ, রাজশাহী আতাউর রহমান, ত্রিপুরার দেওয়ান মাহবুর আলী, রংপুরের আজিজুল হক, ঢাকার বি. সি. চ্যাটার্জি, রংপুরের অভয় বর্মণ (কমিউনিস্ট), চট্টগ্রামের দস্তিদার (কমিউনিস্ট), সংখ্যালঘু দলের ফনীভূষণ মজুমদার ও প্রসন্ন কুমার রায়। প্রসন্ন কুমার রায় ১৯৪৮ সালে বন্দী হন এবং জেলে বসেই এম. এল. এ নির্বাচিত হন। ১৯৫৫ সালের ১৪ জুন
পৃষ্ঠা-৮১

ঢাকা হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি আমির উদ্দিন আহমেদ অস্থায়ী গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।
১৯৫৫ সালের ২১ জুন আইসভার নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং ঐদিন রাতেই নির্বাচনের ফলাফল বেরোয়। যারা নির্বাচতি হন তারা হলেন : যুক্তফ্রন্ট থেকে এ. কে. ফজলুল হক, ২. মওলানা আতাহর আলী (নেজামে ইসলাম), ৩. হামিদুল হক চৌধুরী (কে, এস, পি), ৪. ইউসুফ আলী চৌধুরী (কে, এস ৫. আবদুল লতিফ বিশ্বাস (কে. এস. পি), ৬. নূরুল হক চৌধুরী (কে, এস পি), ৭, আব্দুল করিম (কে. এস. পি), ৮. আব্দুল ওহাব খান (কে. এস, পি)। ৯. আব্দুস সাত্তার (কে. এস. পি), ১০. লুৎফুর রহমান খান (কে. এস. পি), ১১। মোফাজ্জল হক (কে, এস, পি), ১২. মোহাম্মদ আলী (কে, এস, পি), ১৩। সৈয়দ মেজবাহ উদ্দিন হোসেন (কে. এস. পি), ১৪. আদেল উদ্দিন (কে. এস, পি), ১৫. ফরিদ আহমেদ (কে. এস. পি)।
আওয়ামী মুসলিম লীগ : ১. হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী, ২. আতাউর রহমান খান, ৩, আবুল মনসুর আহমদ, ৪. জহিরুদ্দিন, ৫. শেখ মুজিবুর রহমান ৬. নূরুল রহমান, ৭. দেলদার আহমেদ, ৮. আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, ৯. এ. রহমান খান, ১০. মোজাফফর আহমদ, ১১. মোসলেম আলী মোল্লা ও ১২. এ. খালেক।
মুসলিম লীগ : মোহাম্মদ আলি
কমিউনিস্ট পার্টি : সরদার ফজলুল করিম
সবচেয়ে বেশি ১০৪ ভোট পান এ. কে. ফজলুল হক। সোহরাওয়ার্দী পান ৯৩টি ভোট। এ থেকে সহজেই অনুমেয় শেরে বাংলা আওয়ামী মুসলিম লীগের কতজন নির্বাচিত সদস্যের সমর্থন পেয়েছিলেন।
১৯৫৫ সালের ১০ জুলাই তারিখে মারীর গভর্নর হাউসে এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। হামিদুল হক চৌধুরী ও ইউসুফ আলী চৌধুরী (মোহন মিয়া) এ সভায় কে. এস, পি-র প্রতিনিধিত্ব করেন। এ সভায় সংখ্যা সাম্য নীতি মেনে নেওয়া হয়। ফলে জনসংখ্যা অনুসারে পশ্চিম পাকিস্তান ৪৪ শতাংশ এবং পূর্ব বাংলা ৫৬ শতাংশ হলেও সর্বক্ষেত্রে ৫০৪৬০ দাঁড়ালো। তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান খান গণপরিষদে খসড়া শাসনতন্ত্র বিল সম্পর্কে আলোচনাকালে এ চুক্তির কথা ফাঁস করে দেন। এ চুক্তির শর্তগুলো ছিল নিম্নরূপ :
১। পূর্ববঙ্গীয় সদস্যরা সর্বক্ষেত্রে সংখ্যা সাম্য নীতি মেনে নেবে।
২। পূর্ববঙ্গীয় সদস্যরা পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোকে ভেঙে এক ইউনিট করার প্রচেষ্টা সমর্থন করবে।
৩। পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা যুক্ত নির্বাচন সমর্থন করবে।
পৃষ্ঠা-৮২

৪। পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা স্বায়ত্তশাসন সমর্থন করবে।
৫। একই সঙ্গে উর্দু এবং বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার বিষয়টি পূর্ব বাংলা ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যরা মেনে নেবে। ১৯৫৫ সালের ৭ আগস্ট গোলাম মোহাম্মদকে জীবনের বাকি দিনগুলো কাটানোর জন্য মক্কা শরীফে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মাত্র ৪ দিন পরে ১১ আগস্ট ইস্কান্দার মির্জা প্রধানমন্ত্রী মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)কে পদচ্যুত করেন। পাঞ্জাবি অবসরপ্রাপ্ত আই. সি. এস চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)-কে পুনরায় যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত হিসেবে নিয়োগ দান করা হয়। সোহরাওয়ার্দী পুনরায় বিরোধী দলের নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। শেখ মুজিব এ সময় গ্রামে গঞ্জে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জয়দেবপুরের এক জনসভায় ভাষণ দানকালে তিনি বলেন : “আমরা সাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করি না। সংখ্যালঘু বলে কোনো শব্দ আমরা বিশ্বাস করি না। এ দেশ থেকে সংখ্যালঘু শব্দটি আমরা ঘুচিয়ে দেবো। সুতরাং আওয়ামী মুসলিম লীগকে প্রয়োজনে ঢেলে সাজাতে হবে। শেখ মুজিব পরবর্তীকালে বলেন-আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে মুসলিম’ শব্দটি বাদ দেওয়ার চিন্তা প্রথম তার মাথায় আসে ১৯৫৩ সালে যখন তিনি ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে সব ধরনের মানুষকে নিয়ে সংগঠন করতে হবে। আমাদের দুঃখদুর্দশার অনেক কারণের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা অন্যতম কারণ। ১৯৫৫ সালের শেষের দিকে আওয়ামী মুসলিম লীগের দ্বিবার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশন বসার কথা ছিল। অক্টোবর মাসের ২১, ২২ ও ২৩ তারিখে এ কাউন্সিল অধিবেশন বসার তারিখ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। যথাসময়ে মওলানা ভাসানীর সভাপতিত্বে সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে অধিবেশন বসে। এ অধিবেশনে প্রায় ৭০০ ডেলিগেটের উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগের সংবিধান পরিবর্তন করে মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার বিষয়টি অনুমোদিত হয়। ফলে আওয়ামী লীগ একটি অসাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী এবং সাধারণ সম্পাদক মাহমুদুল হক ওসমানী এ অধিবেশনে যোগদান করেন।
১৯৫৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান আইনসভার অধিবেশন বসে। জানুয়ারি মাসে রচিত খসড়া শাসনতন্ত্রটি পাস করার জন্যেই এ অধিবেশনের আয়োজন। এ শাসনতন্ত্রের কতগুলো মারাত্মক ধারা হলো —
১। পাকিস্তান হবে ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ নামে পরিচিত।
২। কোনো হিন্দু রাষ্ট্রপ্রধানের পদে স্থান পাবে না।
৩। পাকিস্তানের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করা হবে কেন্দ্রে।
পৃষ্ঠা-৮৩

বিরোধী দল জাতীয় পরিষদে এ নতুন শাসনতন্ত্রের কঠোর ভাষায় সমালোচনা করেন। তাঁরা বলেন, “রাষ্ট্রের সঙ্গে ধর্মকে জুড়ে দেওয়া হয়েছে এর দ্বারা বুঝা যাচ্ছে যে, পাক নেতারা মধ্যযুগের অন্ধকারে এবং গড়ামির রাজত্বে বাস করছেন। আর সেই কারণে তারা অগণতান্ত্রিকভাবে পাকিস্থান রাষ্ট্রপ্রধানের পদটি কেবলমাত্র মুসলমানদের জন্য নির্দিষ্ট করে রেখেছেন। তার ওপর পাকিস্তানের সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করার ব্যবস্থা হয়েছে কেন্দ্রে। এ সম্পূর্ণ অগণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র। এর দ্বারা প্রকারান্তরে স্বৈরতন্ত্রেরই জন্ম দেওয়া হচ্ছে।”
নতুন শাসনতন্ত্রের খসড়াকে কেন্দ্র করে ঐদিনই আইনসভায় দারুণ হৈ চৈ পড়ে। বিরোধীদলের সদস্যরা একসময় সভাকক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে গেলে শাসকগোষ্ঠী সেই সুযোগে শাসনতন্ত্রের ৫০ ধারা পাস করিয়ে নেয়। পরবর্তী ২৯ ফেব্রুয়ারি পুনরায় অধিবেশন বসে এবং সেদিনও বিরোধী দলকে বাদ দিয়েই সমস্ত খসড়া শাসনতন্ত্রটি গৃহীত হয়। শুধু তাই নয় পূর্ব বাংলার বিরোধী দলের নেতৃবৃন্দের তীব্র প্রতিবাদ সত্ত্বেও পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের দাবি প্রত্যাখ্যাত হয়। এমনকি ‘পূর্ব বাংলা’ নামটি পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান’ নামে রূপান্তরিত করা হয়।
‘পূর্ব বাংলা নাম পরিবর্তনের সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় পরিষদে শেখ মুজিব তীব্র প্রতিবাদ করে ভাষণ দেন।
পূর্ব বাংলার প্রশ্নে জাতীয় পরিষদে একদিন শেখ মুজিবকে কটাক্ষ করেছিলেন মোহাম্মদ আলী (বগুড়া)। তার জবাবে শেখ মুজিব বলেছিলেন : “পূর্ব বাংলার জন্য কথা বলবার অধিকার আপনার আছে না আমার আছে তার প্রমাণ দিতে হলে পূর্ব বাংলায় এসে আমার সাথে আপনার জনপ্রিয়তা যাচাই করুন। পূর্ব বাংলার যে কোনো অঞ্চল থেকে, এমনকি বগুড়া থেকে আমার সাথে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারেন। যদি আপনাকে না হারাতে পারি, আমি জীবনে আর কোনো দিন রাজনীতি করবো না। আশা করি প্রধানমন্ত্রী আমার এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করবেন।”
মেজর জেনারেল মির্জা ‘ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান’ এর প্রথম প্রেসিডেন্ট হন। তিনি এর আগে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল পদে বহাল ছিলেন। গুরুতর অসুস্থতার কারণে গোলাম মোহাম্মদ চিকিৎসার্থে ইউরোপ গেলে তার অবর্তমানে ইস্কান্দার মির্জা অস্থায়ী গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করছিলেন, কিন্তু ইউরোপ থেকে ফিরে আসার পর গোলাম মোহাম্মদ তার পদ ফিরে পেলেন না। এমনকি চিরদিনের জন্য তাঁকে রাজনীতি থেকে বিদায় নিতে হলো ।
পৃষ্ঠা-৮৪

নতুন প্রবর্তিত শাসনতন্ত্রটি ১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ থেকে চালু হয় এবং ঐদিন সারাদেশে ‘পাকিস্তান দিবস’ হিসেবে উদযাপিত হয়। ইতিমধ্যে শেরে বাংলা পূর্ব বাংলার গভর্নর নিযুক্ত হয়েছেন। ইসলামি রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান ঘোষিত হওয়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায় যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসেন। আওয়ামীলীগ প্রমাণের জন্য বারবার চাপ দিতে থাকলেও সরকার প্রতিবারই তা এড়িয়ে যেতে থাকেন।
পাকিস্তানের কেন্দ্রে তখন চৌধুরী মোহাম্মদ আলী প্রধানমন্ত্রী। আর পূর্ব বাংলায় মুখ্যমন্ত্রী আবু হোসেন সরকার। এ সময় পূর্ব বাংলায় তীব্র খাদ্য সংকট দেখা দেয়। আবু হোসেন মন্ত্রিসভা এ খাদ্য সংকট সমাধান করতে পারলেন না। দিকে দিকে শ্লোগান উঠলো- ‘এ জালিম সরকার জাহান্নামে যাক, গরিব মারার এ আসন বরবাদ হোক।‘ সরকার পরিস্থিতি মোকাবিলার জন্য সেনাবাহিনী তলব করলেন। আওয়ামী লীগ সেনাবাহিনী তলবের প্রতিবাদ করে। শেখ মুজিব ১৯৫৬ সালের জুলাই মাসে এক সভায় প্রশাসনে সেনাবাহিনীর উপস্থিতির বিরোধিতা করেন এবং আবু হোসেন সরকার মন্ত্রিসভার পদত্যাগ দাবি করেন। কিন্তু গভর্নর জেনারেল শেরে বাংলা ফজলুল হক এতদসত্ত্বেও আবু হোসেন সরকারকে বরখাস্ত করলেন না। খাদ্য দপ্তরের দায়িত্ব সেনাবাহিনীর ওপর অর্পণ করা হলো। আওয়ামী লীগ খাদ্যের দাবিতে গণঅনশন শুরু করলো শেখ মুজিবের নেতৃত্বে।
১৯৫৬ সালের ৪ আগস্ট তারিখে খাদ্যের দাবিতে ঢাকা শহরে নিরন্ন মানুষের মিছিল হয়। ক্ষুধার্ত, দারিদ্রের কষাঘাতে নির্যাতিত জনগণ শেখ মুজিবের আহ্বানে সরকারি বাধা সত্ত্বেও ঢাকা শহর অভিমুখে দলে দলে এসে মিছিলে যোগ দেয়। সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে। এতদসত্ত্বেও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে জনগণ মিছিল করে। চকবাজারে পুলিশ জনতাকে বাধা দেয়। প্রথমে কাঁদানে গ্যাস, লাঠি চার্জ ও পরে গুলি চলে। ৩ জন বুভুক্ষু গ্রামবাসী নিহত হয়। শেখ মুজিব ১ জনের মৃতদেহ তুলে নিয়ে মিছিল সহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করেন। রক্তে রঞ্জিত হয় তার পরিধেয় জামা কাপড়। দুর্ভিক্ষ, নিপীড়ন ও গুলি বর্ষণের ফলে পূর্ব বাংলার জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
ফজলুল হকের যুক্তফ্রন্ট সরকার ব্যাপক সমালোচনার সম্মুখীন হয়। শেখ মুজিব দাবি জানালেন-অবিলম্বে আইনসভার অধিবেশন ডেকে পরিস্থিতির পর্যালোচনা করা হোক। ফজলুল হক যখন বুঝতে পারলেন অধিবেশন আইনসঙ্গতভাবে চললে তার দলের সরকার সংখ্যা লঘিষ্ঠতার দরুণ বাতিল হয়ে যেতে পারে তখন তিনি কৌশলের আশ্রয় গ্রহণ করলেন। স্পীকারকে ডেকে নির্দেশ দিলেন-‘আপনি ছোটখাটো এক অধিবেশনের আয়োজন করুন। সেখানে
পৃষ্ঠা-৮৫

যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কোনো বক্তৃতা করা চলবে না। মন্ত্রিসভার বিরুদ্ধে কোনো অনাস্থা প্রস্তাবও আনা যাবে না। শুধু মাত্র বাজেট পাস করিয়ে হবে।”
১৯৫৬ সালের ২২ মে আইনসভার অধিবেশনে স্পীকার গভর্নরের নির্দেশে কাউকে মুখ খুলতে দেননি। সেদিন মুলতবির পর ১৩ আগস্ট আবার অধিবেশন ডাকা হয়। সেদিন মন্ত্রীদের আসনগুলো ছিল শূন্য। অধিবেশনের শুরুতে গভর্নরের একটি নয়া আদেশে পুনরায় আদেশ না দেওয়া পর্যন্ত আইনসভার অধিবেশন বন্ধ রাখা হয়। স্পীকারের বক্তব্য শেষ হতে না হতেই শেখ মুজিব উত্তেজিত হয়ে বলেন-“আমরা বিরোধী দলের সদস্যরা এ অপদার্থ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনছি।” তর্ক-বিতর্কের এক পর্যায়ে সরকারি ও বিরোধী দলের মধ্যে হাতাহাতি শুরু হয়ে যায়।
এ সময় শহীদ সোহরাওয়ার্দী ঢাকায় ছিলেন। তিনি ১৯৫৬ সালের ১৭ আগস্ট সংবাদপত্রে এক বিবৃতি প্রদান করেন। তাতে বলেন-“আবু হোসেন সুনিশ্চিত পতন রোধ করার জন্য এবং আওয়ামী লীগ যাতে ক্ষমতায় না বসতে পারে সে উদ্দেশ্যে আইনসভা বসবার কয়েকঘণ্টা আগে গভর্নর অধিবেশন স্থগিত রাখার আদেশ জারি করেছেন। পরিস্থিতি ভয়াবহ দেখে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার টনক নড়লো। গভর্নর ফজলুল হকসহ আওয়ামী লীগ ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দকে তিনি করাচিতে ডেকে পাঠালেন। অবস্থা বেগতিক দেখে যুক্তফ্রন্টের অনেক সদস্য আওয়ামী লীগে যোগ দিতে লাগলেন। আবু হোসেন সরকার বাধ্য হয়ে গভর্নরের কাছে তার মন্ত্রিসভার পদত্যাগপত্র পেশ করলে ফজলুল হক আওয়ামী লীগের প্রাদেশিক নেতা জনাব আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানিয়ে চিঠি দেন। যেদিন মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানিয়ে আতাউর রহমান খানকে আমন্ত্রণলিপি পাঠানো হয়, সেদিন ৪ সেপ্টেম্বর খাদ্যের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল চলছিল। ঢাকা জেলা প্রশাসক ১৪৪ ধারা জারি করলে বিক্ষোভকারীরা তা মানলো না। ফলে বিক্ষোভকারীদের ওপর চলে লাঠি, গুলি, টিয়ার গ্যাস। ৪ জন নিহত ও শত শত লোক আহত হয়।
পরদিন মওলানা ভাসানী ও শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বিরাট শোক মিছিল বেরোয়। ঐ সময় কেন্দ্রীয় খাদ্যমন্ত্রী আব্দুল লতিফ গাড়িসহ উত্তেজিত জনতার সামনে পড়ে যান। উত্তেজিত জনতা তাকে মোটরগাড়ি থেকে টেনে বের করে মুখে গোবর মাখিয়ে দেয়।
যথারীতি ১৯৫৬ সালের ৬ সেপ্টেম্বর আতাউর রহমান খানকে মুখ্যমন্ত্রী করে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা ফজলুল হকের কাছে শপথ গ্রহণ করে। শেখ মুজিবের
পৃষ্ঠা-৮৬

প্রভাব দলের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বেশি থাকলেও প্রবীণ রাজনীতিবিদ হিসেবে আতাউর রহমান খানকেই আওয়ামী লীগ মুখ্যমন্ত্রী মনোনীত করে। উক্ত মন্ত্রিসভায় শেখ মুজিব শিল্প-বাণিজ্য-শ্ৰম-দুর্নীতি দমন ও ভিলেজ এইড দফতরের দায়িত্ব পালন করেন।
শেখ মুজিব মন্ত্রিত্ব পেয়ে নিজেকে জনগণের সেবায় আত্মনিয়োগ করেন। পূর্ব বাংলার ওপর এতোদিন ধরে যে অসমতাপূর্ণ আচরণ করা হয়ে আসছিল, তিনি অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে তার মোকাবিলা করতে সচেষ্ট হন। সমগ্র দেশে শাসন ব্যবস্থার অরাজকতার সুযোগে দুর্নীতিতে ছেয়ে গিয়েছিল। শেখ মুজিব দুর্নীতি দমন বিভাগের দায়িত্ব পেয়েই দেশকে দুর্নীতির কবল থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তার পরিকল্পনা প্রাদেশিক পরিষদে গৃহীত হলেও কেন্দ্রীয় সরকার তা অনুমোদন করেনি। শেখ মুজিব এতে বিন্দুমাত্র নিরুৎসাহিত না হয়ে দুর্নীতি দমন বিভাগ খুলে সরকারি ও বেসরকারি সদস্যগণের সমম্বয়ে তাঁর কার্যক্রম পরিচালনা করেন। কিন্তু গোটা দেশ আমলাতান্ত্রিক নাগপাশে আষ্টেপৃষ্ঠে বন্দী হওয়ায় তার কার্যক্রম সফল হতে পারল না।
পাকিস্তানের বৈদেশিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবের ভূমিকা ছিল অত্যন্ত বলিষ্ঠ ও দ্ব্যর্থহীন। বিশেষ করে রাশিয়া ও চীন প্রভৃতি সমাজতান্ত্রিক দেশগুলো সম্পর্কে বৈরী মনোভাব পোষণ করতে পাকিস্তান। ১৯৫৭ সালের আগস্ট মাসে ১১ জন প্রতিনিধি নিয়ে এক শুভেচ্ছা সফরে শেখ মুজিব নয়া চীনে যান। প্রকৃতপক্ষে শেখ মুজিবের মাধ্যমেই পাকিস্তানের সাথে চীনের বন্ধুত্বের ক্ষেত্র প্রস্তুত হয়েছিল। চীনে যাবার কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়ার্দীর বিশেষ দূত হিসেবে শেষ মুজিব রাশিয়াসহ কয়েকটি দেশে শুভেচ্ছা সফরে যান।
সোহরাওয়ার্দী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর আওয়ামী লীগের মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দেয়। মওলানা ভাসানী বিভিন্ন সভা-সমিতিতে সোহরাওয়ার্দীর কঠোর সমালোচনা করতে লাগলেন। পররাষ্ট্রনীতির প্রশ্নে দু’জনের মধ্যে বিরোধ দেখা দেয়। ভাসানী পাক-মার্কিন যুদ্ধ জোটের বিরোধী। তাই তিনি চাপ দিতে থাকেন আমেরিকার আস্তানা থেকে পাকিস্তানকে সরিয়ে আনার জন্য।
ঠিক এ সময় পূর্ব বাংলা থেকে একদল বাণিজ্য প্রতিনিধিদল যান ভারতে। এঁদের মধ্যে ছিলেন প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খান, প্রাদেশিক শিল্প ও বাণিজ্যমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এবং কেন্দ্রীয় বাণিজ্যমন্ত্রী আবুল মনসুর আহমদ।
এদিকে মওলানা ভাসানী একুশ দফার পক্ষে জোর আন্দোলন শুরু করেন। সোহররাওয়ার্দী এতে বিরক্ত হচ্ছিলেন সন্দেহ নেই। কিন্তু বর্ষিয়ান এ জননেতার
পৃষ্ঠা-৮৭

জনপ্রিয়তাকে তিনি উপেক্ষা করতে পারলেন না। ভাসানী প্রধানমন্ত্রী সোহরাওয়াদীকে মোকাবিলা করার উদ্দেশ্যে ১৯৫৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে টাঙ্গাইলের কাগমারীতে এক সম্মেলন আহ্বান করেন। আওয়ামী লীগের ৮৯৬ জন কাউন্সিল সদস্য উক্ত সম্মেলনে উপস্থিত হয়েছিলেন। কাগমারী সম্মেলনের মতো এরূপ ঐতিহাসিক সম্মেলন আর হয়নি। টাঙ্গাইল থেকে কাগমারী পর্যন্ত তৈরি হয়েছিল অনেকগুলো তোরণ। তোরণগুলোর নাম রাখা হয়েছিল ইতিহাস প্রসিদ্ধ লোকদের নামে। শহীদ সোহরাওয়াদী কাগমারী সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন এবং কৌশলে নিজের সম্মান অক্ষুন্ন রাখতে সমর্থ হন।
সোহরাওয়ার্দী সেদিন ভাসানীকে জব্দ করার জন্য একটি চিরকুট আর একটি টেলিগ্রাম নিয়ে গিয়েছিলেন। পাকিস্তান গুপ্তচর বিভাগ ভাসানীর বিরুদ্ধে এ দুটো অস্ত্র তৈরি করেছিল। সোহরাওয়ার্দী নিকটেই বসা ছিলেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি সোহরাওয়ার্দীর উদ্দেশ্যে বলেন-“স্যার আপনাকে আমরা ছাড়বোনা, ছাড়তে পারি না। বাংলাদেশের স্বার্থেই আপনার কেন্দ্রে থাকবার প্রয়োজন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।”
যদিও মওলানা ভাসানী এ সম্মেলন ডেকেছিলেন, কিন্তু এ সম্মেলনের মাধ্যমে উদীয়মান নেতা শেখ মুজিব এক অনন্য পুরুষ হিসেবে আবির্ভূত হন। শেখ মুজিবের এহেন বলিষ্ঠ নেতৃত্বের কারণে এ সম্মেলনের কিছুদিন পর ভাসানী আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে অন্য দল গঠন করলেও আওয়ামী লীগের তাতে বিন্দুমাত্র ক্ষতি হয়নি। কাগমারী সম্মেলনে কিছু কিছু তোরণ ভারতীয় নেতাদের নামে নামকরণ করা হয়েছিল এবং ভারতীয় কবি সাহিত্যিকদের নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল, ফলে প্রতিক্রিয়াশীল চক্র ভাসানীর বিরুদ্ধে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগ আনে।
ভাসানীর তীব্র সমালোচনা সত্ত্বেও সোহরাওয়ার্দী জাতীয় পরিষদে তাঁর বৈদেশিক নীতি অনুমোদন করিয়ে নিতে সমর্থ হয়েছিলেন। এখনে উল্লেখ্য যে, সোহরাওয়ার্দীর প্রতি শেখ মুজিবের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা সত্ত্বেও তিনি পরিষদে ভোটদানে বিরত থাকেন।
১৯৫৭ সালের ৩ এপ্রিল শেখ মুজিবের সাথে আলোচনাক্রমে অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ প্রাদেশিক আইনসভায় এক প্রস্তাব আনেন। এতে বলা হয় যে, প্রাদেশিক সরকার একমাত্র অর্থ, বৈদেশিক দফতর ও প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ছাড়া আর সব বিষয়ে পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে ।
এ প্রস্তাবটি যাতে গৃহীত হয় তার জন্য শেখ মুজিব অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিলেন এবং প্রস্তাবটি অধ্যাপক মোজাফফর আহমদ উত্থাপন করলেও শেখ মুজিবের অবদানই ছিল বেশি।
পৃষ্ঠা-৮৮

এতে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতারা। মুসলিম লীগের সংবাদপত্রগুলো এর বিরোধিতা করতে লাগলেন কড়া ভাষায়। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী কম পাকিস্তানি মীর গোলাম আলী খান তালপুর হুমকি দিয়ে বললেন : “পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তান থেকে ছিনিয়ে নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের লেজুড় বানানোর যে কোনো প্রচেষ্টাকে কেন্দ্রীয় সরকার তার লৌহমুষ্টির আঘাতে গুড়ো গুড়ো করে দেবে।”
তালপুরের বিবৃতির তীব্র সমালোচনা করে কেন্দ্রীয় শ্রমমন্ত্রী পূর্ব বাংলার এম, এ খালেক বলেন যে, পূর্ব বাংলার পাঁচ কোটি মানুষের প্রতিনিধিদের সর্বসম্মত প্রস্তাবের প্রতি হস্তক্ষেপ করার অধিকার তালপুর সাহেবের নেই। শেখ মজিবও কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন : বাঙালিদের ব্যাপারে মাথা গলাতে আসবেন না। বাঙালিরা জানে কীভাবে অধিকার আদায় করতে হয়। আপনাদের কামান-বন্দুকের পরোয়া তারা করে না।” অথচ আশ্চর্য পূর্ব বাংলার প্রতিনিধিদের এ প্রস্তাবকে সেদিন সোহরাওয়ার্দী খুব সুনজরে দেখতে পারেননি। পরবর্তীকালে প্রধানমন্ত্রীত্ব হারিয়ে এবং আইয়ুব খানের শিকারে পরিণত হয়ে তিনি অবশ্য তাঁর মত পরিবর্তন করেছিলেন এবং পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনকে তিনি স্বীকার করে নিয়েছিলেন। ভাসানী শেষ পর্যন্ত সোহরাওয়ার্দীর সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক ছিন্ন করেছিলেন। দল থেকে পদত্যাগের অভিপ্রায় জানিয়ে দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবের কাছে ভাসানী এক পত্র লিখেন-‘কেন্দ্র ও পূর্ববঙ্গে সমতার আসনে বসে আওয়ামী লীগের নায়কগণ, বিশেষ করে জনাব সোহরাওয়ার্দী দলের মূলনীতির প্রতি ও বহু প্রস্তাবের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে দেশকে ধীরে ধীরে বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর জোয়ালের সঙ্গে বেঁধে দিচ্ছেন। কাজেই আমি আর এ দলের সদস্যও থাকতে চাই না।”
অবশ্য এ পদত্যাগ ও দলত্যাগের পশ্চাতে রহস্য ছিল অন্যরূপ। আবুল মনসুর আহমদ ও প্রসঙ্গে অতীতের স্মৃতিচারণ করতে যেয়ে লিখেছেনঃ “আগেই তিনি মিয়া ইফতিয়ারউদ্দিন ও জি, এম, সৈয়দ প্রভৃতি বামপন্থী পশ্চিম পাকিস্তানি নেতৃবৃন্দ ও শহিদ সাহেব কর্তক বিতাড়িত আওয়ামী লীগ সেক্রেটারী মাহমুদুল হক ওসমানীর সাথে গোপন পরামর্শ করিতে থাকেন-ইতিমধ্যে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতারা বন্ধ দরজায় মওলানা ভাসানীর সাথে পরামর্শ করিয়া গিয়াছেন। এটা চলে পর পর কয়েকদিন। তবুও কাউন্সিল মওলানাকে ইস্তফা প্রত্যাহারের অনুরোধ করেন। মওলানা তদুত্তরে ন্যাপ গঠন করেন। ন্যাপ গঠনে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার হাত ছিল এতে আমার কোনো সন্দেহ নাই।”
(আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর : আবুল মনসুর আহমদ, পৃষ্ঠা ৪৯২]
পশ্চিমা গোষ্ঠী স্পষ্ট উপলব্ধি করতে লাগলেন—আওয়ামী লীগের মধ্যে বিরোধ সৃষ্টি করতে না পারলে তাদের উদ্দেশ্য চরিতার্থ হবে না। আর সেজন্যই
পৃষ্ঠা-৮৯

সোহরাওয়ার্দীকে ক্ষমতা দানের মাধ্যমে অথবা তোষামোদ করে পূর্ব বাংলা স্বার্থের বিরুদ্ধে সচেতন রাখতে চেষ্টা করা হয়, আর যাতে করে আওয়ামী লিগের মধ্যে ভাঙন ধরানো যায় সেই চেষ্টা পুরোপুরি চলতে থাকে।।
মাওলানা ভাসানীর উদ্যোগে ১৯৫৭ সালের ২৫ জুলাই ঢাকার সদর অবস্থিত একটি সিনেমা হলে পাকিস্তান গণতন্ত্রী সম্মেলন আহ্বান করে এ আহ্বানে যোগ দিয়েছিলেন (আবুল মনসুর আহমদের মতে আগে থেকেই এ বিষয়ে কথাবার্তা ছিল) সীমান্ত গান্ধী আব্দুল গাফফার খান, আব্দুস সামাদ খান , জি এম সৈয়দ, আব্দুল মজিদ সিন্ধি, রাজস্বমন্ত্রী মাহমুদ আলী প্রমুখ বিশিষ্ট নেতবর্গ। সম্মেলনে প্রায় ১২০০ কর্মী যোগ দিয়েছিলেন। জন্ম হলো এক নতন সংগঠন, নাম ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি। সংক্ষেপে ‘ন্যাপ’।
সেন্টো সিয়াটো চুক্তির বিরোধিতা করে, শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে প্রগতির আন্দোলনকে বেগবান করার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এ নতুন সংগঠন ‘ন্যাপএর জন্ম। মওলানা ভাসানী হলেন এ সংগঠনের সভাপতি। ন্যাপ-এর জন্ম এ উপমহাদেশের প্রগতিশীল বাম রাজনৈতিক ইতিহাসে একটি উল্লেখ্য অধ্যায়। আওয়ামী লীগের মধ্যে যারা প্রগতিশীল এবং বিশেষ করে সমাজতন্ত্রে আদর্শের। অনুসারী তাঁদের নিয়েই মূলত ন্যাপ পার্টির গোড়াপত্তন।
ন্যাপ গঠিত হওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভীত অনেকাংশে দুর্বল হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের ধস থেকে সংগঠনকে শক্তিশালী অবস্থানে টিকিয়ে রাখার জন্য শেখ মুজিব বলিষ্ঠ পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। ইতোমধ্যে পার্টির ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণও উপলব্ধি করলেন যে, ভাসানীর চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে যদি আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখতে হয় ও জনপ্রিয় করে তুলতে হয় তবে শেখ মুজিব ছাড়া গত্যন্তর নেই।
শেখ মুজিবের ছিল অপরিসীম সাংগঠনিক শক্তি। মন্ত্রিত্বের আসনের চেয়ে জনগণের মিছিলে সামিল হওয়াটাকেই তিনি অধিকতর শ্রেয় বলে মনে করলেন। তিনি আরও উপলব্ধি করলেন যে, ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকার ফলে তিনি জনগণের কাছ থেকে অনেকটা দূরে সরে গিয়েছিলেন। এর ফলে তিনি বেদনাবোধে তাড়িত হতেন। রাজপথের শেখ মুজিব আবার ফিরে এলেন রাজপথে। তার বলিষ্ঠ নেতৃত্নের ফলে আওয়ামী লীগ তার প্রাণস্পন্দন ফিরে পেল। অপূর্ব গতিতে আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বাড়তে লাগল। বর্ষিয়ান নেতা ভাসানী, আতাউর রহমান খানের সাথে পাল্লা দিয়ে শেখ মুজিবের জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে এগিয়ে যেতে থাকল।
পৃষ্ঠা-৯০
১৯৫৮ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক গভর্নর ফজলুল হক মুখ্যমন্ত্রী আতাউর রহমান খানকে ও তার মন্ত্রিসভাকে বরখাস্ত করে তার দলকেই আবার ক্ষমতায় বসালেন। মুখ্যমন্ত্রী করা হলো আবুল হোসেন সরকারকে।
আওয়ামী লীগকে ক্ষমতাচ্যুত করায় সোহরাওয়ার্দী ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন। পাকিস্তানের সপ্তম প্রধানমন্ত্রী মালিক ফিরোজ খান নুন সোহরাওয়ার্দীর সমর্থন প্রত্যাহারের ভয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব হারাবার আশংকায় ৪ ঘণ্টার মধ্যে ফজলুল হককে বরখাস্ত করে পূর্ব বাংলার চীফ সেক্রেটারী হামিদ আলীকে প্রাদেশিক গভর্নর নিযুক্ত করেন। প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে পরদিনই অর্থাৎ ১ এপ্রিল, ১৯৫৮ তারিখে হামিদ আলী আবু হোসেন সরকারকে বরখাস্ত করেন। ৩১ মার্চ রাত্রিবেলা ১২ ঘণ্টা রাজ্য শাসন করে আবু হোসেনকে বিদায় নিতে হলো। আবার আতাউর রহমান খানকে মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য আহ্বান জানালেন গভর্নর। ২৪ ঘণ্টারও কম সময়ের মধ্যে আওয়ামী লীগ প্রদেশে ক্ষমতা ফিরে পেল ।
কিন্তু ইস্কান্দার মির্জা গোপনে কৃষক-প্রজা পার্টির সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হওয়ার ফলে আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভা আবার সংকটের সম্মুখীন হয়। ১৯৫৮ সালের ১৮ জুন অতর্কিতভাবে প্রাদেশিক আইনসভায় হেরে যাওয়ার ফলে আতাউর রহমান মন্ত্রিসভাকে পদত্যাগ করতে হয়। ইতোমধ্যে হামিদ আলীর স্থলে সুলতান উদ্দিন আহমদ পূর্ব বাংলার স্থায়ী গভর্নর নিযুক্ত হন। আতাউর রহমান মন্ত্রিসভার পতনের ফলে তিনি আবু হোসেন সরকারকে পুনরায় মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানান। ১৯৫৮ সালের ২০ জুন গভর্নর সুলতান আহমদের নিকট শপথ গ্রহণ করেন। আবু হোসেন সরকার এ নিয়ে তিনবার মুখ্যমন্ত্রী হন। কিন্তু দুর্ভাগ্য, এ বারেও তিনি তিন দিনের বেশি মন্ত্রিত্ব করতে পারলেন না।
বারবার এরকম দুর্বলতা ও বিশৃঙ্খলার সুযোগের ইস্কান্দার মির্জা দেশে একনায়কত্ব চালু করে মহাপরাক্রমশালী দেশনায়ক হওয়ার খায়েশ পোষণ করেন। পূর্ব বাংলার আইনসভা সাময়িকভাবে বাতিল করে তিনি চালু করেন প্রেসিডেন্টের শাসন। কিন্তু পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অঞ্চলেই তখন সাধারণ নির্বাচনের দাবিতে জনগণ সরকারকে ব্যতিব্যস্ত করে তুলে। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগ নেতা আব্দুল কাইয়ুম খান মির্জাকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন যে, অবিলম্বে দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত না হলে একটা রক্তাক্ত কাণ্ড ঘটে যাবে।
উভয় প্রদেশের দাবির পরিপ্রেক্ষিতে মির্জা পূর্ব বাংলা থেকে প্রেসিডেন্টের শাসন তুলে নিতে বাধ্য হন। আওয়ামী লীগকে আবার মন্ত্রিসভা গঠনের আহ্বান জানানো হলে আতাউর রহমান খান ১৯৫৮ সালের ২৫ আগস্ট পূর্ব বাংলার নবম মন্ত্রিসভা গঠন করেন।
পৃষ্ঠা-৯১

অচিরেই প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার ভাগ্য বিপর্যয় ঘটতে থাকল । ১৯৫৮ সালের ৭ অক্টোবর পাকিস্তানের মালিক ফিরোজ খান নুন তাঁর মন্ত্রীপরিষদের সদস্য নির্বাচন ও দফতর বণ্টনে ঝামেলায় পড়ে যান। কিছুতেই তিনি শেষ মীমাংসায় উপনীত হতে পারছিলেন না। তাকে মন্ত্রিসভা গঠন করতে হয়েছিলো যুক্তফ্রন্টের অধীনে। কোয়ালিশন দলের প্রতিটি সদস্যই মন্ত্রী হতে চায় । নুন সাহেব কাউকেই অসন্তুষ্ট করতে পারছিলেন না।
সকালে মন্ত্রিসভা গঠন করে বাধ্য হয়ে সেদিন সন্ধ্যা বেলায়ই দফতরগুলো আবার রদবদল করতে হয়। এবারেও আওয়ামী লীগের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। অবশ্য এবার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে গণতন্ত্রের স্থায়িত্বের স্বার্থে। আওয়ামী লীগ নুন মন্ত্রিসভার বিরোধিতা করলো না। কারণ তারা আশংকা করছিলেন নুন মন্ত্রিসভার যদি পতন ঘটে তাহলে পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্রের ভাগ্য বিপর্যয় ঘটবে। এ সংকটপূর্ণ মুহূর্তে আওয়ামী লীগের কর্ণধার শেখ মুজিবুর রহমান সেদিন করাচিতে বলেছিলেন ?
“পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসী মন্ত্রীদের মধ্যে দফতর বণ্টন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী ফিরোজ খান নুন তার নিজেদের দলের মধ্যে প্রচণ্ড বাধা ও চাপের সম্মুখীন হচ্ছেন। এ বাধা এত প্রবল এবং এমনই ধরনের যে, এ পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগের আর মন্ত্রিসভায় থাকা নিরর্থক। কিন্তু এ সত্ত্বেও আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের আগে নুন সরকার থেকে আমাদের সমর্থন প্রত্যাহার করে নিয়ে আমরা দেশে গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কোনো সুযোগ প্রতিক্রিয়াশীলদের দেবো না।”
এতদসত্বেও নুন সাহেবের শেষ রক্ষা হলো না। প্রধানমন্ত্রী থাকার দুর্বার লোভ তাঁর ধ্বসে গেল। কারণ প্রেসিডেন্ট মির্জা সমগ্র পাকিস্তানে সামরিক আইন জারি করে তার মন্ত্রিসভা ভেঙে দেন। পাকিস্তানের সংসদীয় গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা বিলুপ্ত হলো। পাকিস্তানের ইতিহাসে অন্ধকাময় যুগের সূচনা হলো।
এ অধ্যায়ের প্রেক্ষাপটে মঞ্চস্থ নাটকেরও একটি নেপথ্য কাহিনী রয়েছে, যার কেন্দ্রীয় চরিত্রে রূপদান করেছিলেন পাকিস্তানের কালো দশকের একচ্ছত্র অধিপতি জেনালের মোহাম্মদ আইয়ুব খান। নেপথ্যে থেকে আইয়ুব খান ধীরে ধীরে কীভাবে এ নাটকের সঙ্গে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেছিলেন তার ব্যাখ্যা তিনি আত্মজীবনীতেই দিয়েছেনঃ
“দিনটি ছিল ৪ অক্টোবর, ১৯৫৮ সাল। আমি আমার রেলগাড়ির সেলুনের মধ্যে যখন অবস্থান করছিলাম, তখন জানতাম যে, শীঘ্রই দেশে একটা যুগ শেষ হয়ে আসছে। আমি করাচি যাচ্ছিলাম। সেখানে একটি মর্মন্তুদ সুদীর্ঘ রাজনৈতিক প্রহসন ধীরে ধীরে শেষ হচ্ছিল। মাত্র কয়েক দিন পূর্বে প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জা আমাকে জানিয়েছিলেন যে, পরিস্থিতি অসহ্য হয়ে উঠেছে এবং তিনি
পৃষ্ঠা-৯২

কর্মপন্থা গ্রহণ করা স্থির করেছেন। বহু বছর ধরে আমরা সবাই আশা করেছিলাম যে , রাজনইটিক নেতারা তাদের গুরুদায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন হবেন। তাদের মধ্যে দেশপ্রিমিক লোক ছিলেন, গুণবান এবং দক্ষ ব্যক্তিও ছিলেন এবং কায়েদে আয়মের সেই সব নিকট সহচররাও ছিলেন যারা দূরদৃষ্টি, রাজনৈতিক বিচক্ষণতা এবং অনড় সংকল্প নিয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য সংগ্রাম করেছিলেন। পরবর্তীতেও তারা দেখেছিলেন, কি করে লিয়াকত আলী খান দৃঢ়তা এবং সাহসিকতার সাথে রাষ্ট্রীয় অর্নবপোতকে অশান্ত স্রোতের মধ্য দিয়ে পরিচালনা করার চেষ্টা করেছিলেন। সার্কাসের দড়াবাজদের মতো এক এক সময় এক একজন লাফ দিয়ে মধ্যের দোলনার আড়টিকে ধরে ফেলে একটু ঝুলে উজ্জ্বল বাতির আলোকের মধ্যে এসে উপস্থিত হচ্ছিলেন, আবার পর মুহূর্তে ষড়যন্ত্র ও সামর্থ্যহীনতার জালের মধ্যে উৎক্ষিপ্ত হয়ে অন্ধকারে তলিয়ে যাচ্ছিলেন।
[সৈয়দ আলী আহসান অনূদিত ‘প্রভু নয় বন্ধু ঢাকা ১৯৬৮, পৃ. ১০]
আইয়ুব খান যে ভবিষ্যতের এক উজ্জ্বল পরিকল্পনার ছবি মনে মনে আঁকছিলেন, সরাসরি তা না বললেও মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণে তা পড়ে। সেই পরিকল্পনাকে বাস্তবে রূপ দেবার গোপন উদ্দেশ্য নিয়েই পরদিন অর্থাৎ ৪ অক্টোবর তিনি গিয়েছিলেন প্রেসিডেন্ট ইস্কান্দার মির্জার কাছে।
আইয়ুব এবং মির্জা অনেক শলাপরামর্শ করে দেশকে রক্ষার খাতিরে ৭ অক্টোবর রাত আটটায় নাটকীয়ভাবে পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করেন। প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে নিযুক্ত হন আইয়ুব খান। পূর্বাঞ্চলের সামরিক আইন প্রশাসক হলো তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের জি. ও. সি. মেজর জেনারেল ওমরাও খান।
গণতন্ত্রের নামে কি নিষ্ঠুর পরিহাস। সেদিন সামরিক আইন জারির কিছু পূর্বে সন্ধ্যা বেলায় ইস্কান্দার মির্জা ফিরোজ খান নুনের মন্ত্রিসভার সদস্যদের আপ্যায়নের জন্য তাঁর করাচি বাসভবনে একটি রঙিন তরল পানীয়ের পার্টির আয়োজন করেছিলেন।
সম্পূর্ণ আটঘাট বেঁধেই আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকের দায়িত্ব নিয়েছিলেন যাতে করে কোনো প্রকার সমালোচনার সম্মুখীন হতে না হয় তাঁকে। ধুরন্ধর আইয়ব মির্জা সাহেবের কাছ থেকে লিখিতভাবে কয়েকটি শর্তও আদায় করে নেন। শর্তের মূল বিষয় হলো, সমস্ত ঘটনা যেন মির্জা সাহেবের একক সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতি বলে ঘোষণা করা হয়। এবং এ ঘটনায় আইয়ুবের কোনো ভূমিকা নেই এরূপ স্বীকারোক্তিমূলক বক্তব্যও আইয়ুব খান ফিরোজ খান নুনের কাছে ইস্কান্দার মির্জাকে দিয়ে একটি চিঠিও লেখিয়ে নেন।
পৃষ্ঠা-৯৩

পর্ব বাংলার জনপ্রিয় নেতাদের অধিকাংশই সেদিন ছিলেন করাচিতে । আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের মধ্যে সোহরাওয়ার্দী, শেখ মুজিব, ইত্তেফাক সম্পাদক তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) প্রমুখ নুন মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচনে আলোচনা বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশ্যে সেখানে গিয়েছিলেন। আতাউর রহমান খানও কয়েকদিন পূর্ব থেকেই করাচিতে অবস্থান করছিলেন।
শেখ মুজিব ৭ অক্টোবর রাতে ঢাকার পথে বিমানে আসছিলেন। তিনি ৮ তারিখ ভর বেলা সামরিক আইন জারির কথা জানতে পান। ভোরবেলা তেজগাঁও বিমান বন্দরে নামতেই সহকর্মী বন্ধুরা সেদিনের প্রভাতী সংবাদপত্র তাঁর সামনে তুলে ধরেন। খবর দেখে হতচকিত হয়ে যান তিনি।
এমন পরিস্থিতিতে কি ঘটতে পারে শেখ মুজিবের তা অজানা ছিল না। অচিরেই তাঁকে গ্রেফতার করা হবে এটা তিনি বুঝতে পারলেন। পৃথিবীর কোনো দেশেই রাজনৈতিক নেতাদের জেলখানার বাইরে রেখে নিশ্চিত মিলিটারী ডিক্টেটরশীপ চালানো সম্ভব নয়। অতএব তাঁকেও কারাগারে যেতে হবে। সুতরাং বাবা-মা-আত্মীয়-স্বজনদের সাথে দেখা করা দরকার। কারণ এবার কতদিনের জন্য সমাজ সংসারের বাইরে তাঁকে কাটাতে হবে তা কে জানে?
প্রাদেশিক গভর্নর সুলতানউদ্দিন আহমদের ভাগ্যের পতন ঘটল যথাসময়ে। নতুন গভর্নর হলেন জাকির হোসেন। জাকির হোসেন যখন পুলিশের আই, জি, ছিলেন তখন আইয়ুব খানও ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জি. ও. সি.। তখন থেকেই এ দুই ব্যক্তির নেতার মধ্যে দহরম-মহরম গড়ে উঠেছিল। আইয়ুব খান প্রধান সামরিক প্রশাসক হয়েই পুরনো বন্ধুর কথা স্মরণ করলেন।
জাকির হোসেন গভর্নর হয়েই পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দকে গ্রেফতারের নির্দেশ দিলেন। পাইকারিভাবে গ্রেফতার কার্যক্রম চলল ঢাকায়। ৮ অক্টোবর নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয় বর্ষীয়ান নেতা মওলানা ভাসানীকে। গ্রেফতারকৃত অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন-শেখ মুজিব, আবুল মনসুর আহমদ, হামিদুল হক চৌধুরী, সোহরাওয়ার্দী ক্যাবিনেটের শ্রমমন্ত্রী আবদুল খালেক, শিল্প দফতরের সেক্রেটারী আসগর আলী পি, ডব্লু ডি,’র চীফ ইঞ্জিনিয়ার মোঃ আব্দুল জব্বার, বাণিজ্য দফতরের আন্ডার সেক্রেটারী আমিনুল ইসলাম প্রমুখ। সবাইকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের পুরোনো হাজতে বন্দী করে রাখা হয়।
সামরিক শাসন জারির প্রতিক্রিয়া সম্বন্ধে অবহিত হওয়ার জন্য আইয়ুব খান কয়েকদিন পরেই ঢাকা এলেন। তাঁর সম্মানে হোটেল শাহবাগে একটি নাগরিক সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়েছিল।
আইয়ুব খান প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হবার পর সব কিছুতেই হুকুমদারি শুরু করে দেন। ইস্কান্দার মির্জা ভেবেছিলেন আইয়ুবকে অনুগত রেখে
পৃষ্ঠা-৯৪

পাকিস্তানের একচ্ছত্র অধিপতি হবেন তিনি। কিন্তু আইয়বের কার্যকলাপে মির্জার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয়, তার চোখের ঘুম ছুটে যায়। বাধ্য হয়ে আইয়ুব খানকে সরাবার মতলব আটলেন তিনি। মতলবটা আইয়ুব অগোচরে থাকল না। তিনি ঢাকা থেকে তড়িঘড়ি ছুটে এলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। সামরিক বাহিনীর অফিসাররাও মির্জা সাহেবের বিরুদ্ধে আইয়ুব খানকে উসকিয়ে দিলেন। ইস্কান্দার মির্জার কাছে গিয়ে এ ব্যাপারে ভবিষ্যতের জন্য সতর্ক করে দিয়ে আসেন আইয়ুব।
মির্জার তখন মরণপণ অবস্থা। অবস্থা বেগতিক দেখে মির্জা তাঁর শেষ চাল চাললেন। সামরিক বাহিনীর উচ্চপদস্থ অফিসারদের হাত করার উদ্দেশ্যে তাদেরকে মন্ত্রিত্বের পদের উৎকোচ দিয়ে ২৫ অক্টোবর, ১৯৫৮ সালে একটি মন্ত্রিসভা গঠন করেন মির্জা। তিনি নিজে প্রেসিডেন্ট পদে আসীন থেকে প্রধানমন্ত্রী করলেন জেনারেল আইয়ুবকে। অন্যান্য মন্ত্রীরা হলেন : লে. জেঃ আজম খান পুনর্বাসনমন্ত্রী, লে. জে. এ. বাকি স্বাস্থ্য ও সমাজকল্যাণ মন্ত্রী, লে. জেঃ কে, এম, শেখ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আবুল কাশেম খান শিল্প ও পূর্তমন্ত্রী, হাবিবুর রহমান শিক্ষা ও তথ্যমন্ত্রী, মনজুর কাদির পররাষ্ট্রমন্ত্রী, বিচারপতি মুহম্মদ ইব্রাহিম আইনমন্ত্রী, মোহাম্মদ শোয়েব অর্থমন্ত্রী, এফ, এ, খান যোগাযোগমন্ত্রী, হাফিজুর রহমান কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো বাণিজ্যমন্ত্রী।
কিন্তু সামরিক অফিসারদের তৃপ্ত করার পরও ইস্কান্দার মির্জা শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। পারলেন না তার প্রেসিডেন্টের পদটিকে টিকিয়ে রাখতে। ২৭ অক্টোবর ইস্কান্দার মির্জা আইয়ুব খান ও তার মন্ত্রিসভাকে শপথ গ্রহণ করান। শপথ অনুষ্ঠানের মাত্র দুই ঘণ্টা পর আইয়ুব খানের তিন সৈনিক দূত ইস্কান্দার মির্জার সামনে এসে দাঁড়ায়। ইস্কান্দার মির্জাকে ক্ষমতা ছাড়তে হলো। তিনি স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেছেন—এ মর্মে দাসখত লিখে দিতে হলো তাকে। আরও বলতে হলো দেশের বৃহত্তর স্বার্থে আইয়ুব খানের হাতে তিনি ক্ষমতা অর্পণ করেছেন। শুধু পদত্যাগেই সীমাবদ্ধ রইল না, আইয়ুবের নির্দেশে সপরিবারে তিনি দেশ ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হলেন।
আইয়ুব খান তাঁর ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করার জন্য সারাদেশে সামরিক অবস্থান মজবুত করলেন। ২৭ অক্টোবর মধ্যরাত থেকে নিজেকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করলেন এবং সামরিক বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হয়ে থাকলেন। ক্ষমতায় গিয়েই রাজনৈতিক নেতাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার শুরু করলেন তিনি। সমস্ত দুর্নীতি এবং ধ্বংসের জন্য রাজনৈতিক নেতাদের দায়ী করে তাদের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করলেন। রাজনৈতিক নেতাদের নির্মূল করা ছাড়া দেশের উন্নয়ন নয়—এমন সব কথা যত্রতত্র চিৎকার করে বলতে শুরু করলেন।
পৃষ্ঠা-৯৫

ক্ষমতাকে টিকিয়ে রাখার স্বার্থে এসবই ছিল তার চালাকি। জনগনের সমর্থন আদায়ের জন্য এ মহাধুরন্ধর ব্যক্তিটি কতিপয় পদক্ষেপ গ্রহণ। ব্যবসায়ীদের ভীতসন্ত্রস্ত করে দ্রব্যমূল্য স্বাভাবিক অবস্থায় আনা, দুর্নীতি দমন জন্য গ্রেফতার করা, এমনকি দেশের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলে প্রতিষ্ঠিত করে তিনি পুনরায় সেনাবাহিনীতে ফিরে যাবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।
পর্ব বাংলার রাজনৈতিক কোন্দল এদেশের জনগণকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ফলে আইয়ুব খানের প্রাথমিক কিছু পদক্ষেপ পূর্ব বাংলায় বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে।
১৯৫৯ সালের ২৬ অক্টোবর আইয়ুব খান নিজেকে ফিল্ড মার্শাল হিসেবে ঘোষণা করলেন। ২৭ অক্টোবর তিনি পালন করলেন তাঁর ‘বিপ্লবের প্রথম বার্ষিকী।‘
আইয়ুব খান ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সময় ঘোষণা করেছিলেন তিনি দেশে গণতন্ত্র দেবেন। কিন্তু সেটা কোনো পদ্ধতির কিংবা কেমন গণতন্ত্র তা বলেননি। এক্ষণে তিনি সত্যি সত্যি তার প্রতিশ্রুত গণতন্ত্র প্রদান করলেন।
তিনি ওয়াদা করেছিলেন, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হলে জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। এ উদ্দেশ্যে ১৯৬০ সালের ১১ জানুয়ারি তিনি একটি সাধারণ নির্বাচনও দেন। ৮০ হাজার মৌলিক গণতন্ত্রী এ নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত হলো। নিন্দুকেরা বলতে শুরু করল ৮০ হাজার ফেরেশতা পয়দা করা হলো। এ আশি হাজার গণতন্ত্রী নির্বাচিত করবেন কে প্রেসিডেন্ট হবে। আইয়ুব সবিনয়ে বললেন, “যদি আপত্তি না থাকে তাহলে আমিই ‘জনপ্রতিনিধিত্বশীল সরকারের প্রেসিডেন্ট হতে পারি।” অর্থাৎ তাঁর প্রতি আস্থা আছে কিনা তা জনপ্রতিনিধিদের কাছে জানতে চাইলেন।
১৯৬০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট নির্বাচন হলো। আইয়ুব খানের কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল না। কারণ সেরকম সুযোগ তিনি কাউকেই দেননি। মৌলিক গণতন্ত্রীদের প্রতি নির্দেশ ছিল শুধুমাত্র তাঁর প্রতি আস্থা আছে কিনা তা ‘হ্যা অথবা ‘না’ সূচক ব্যালটের মাধ্যমে বক্তব্য রাখতে হবে। মৌলিক গণতন্ত্রীরা জানতো ‘না’ এর বাক্সে ভোট দিলেও আইয়ুব খানই প্রেসিডেন্ট হবেন। কারণ তাকে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা থেকে সরাবার সাহস কারো হবে না। উপরন্তু তারা অনেক সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত হতে পারেন। এ নির্বাচন প্রহসনে আইয়ুব খান শতকরা ৯৫ ভাগ ভোট পান
ইতোমধ্যে ১৪ মাস কারভোগের পর ১৯৫৯ সালের ডিসেম্বরে শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি দেওয়ার সময় তাঁর বিরুদ্ধে কতগুলো বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছিল। যেমন ঢাকা ত্যাগ করলে তাঁকে গন্তব্য সম্পর্কে
পৃষ্ঠা-৯৬

লিখিতভাবে স্পেশাল ব্রাঞ্চকে জানাতে হবে এবং প্রত্যাবর্তনের পরেও একইভাবে সে বিষয়ে কর্তৃপক্ষকে অবহিত করতে হবে। গোয়েন্দা বিভাগের পুলিশ তার পেছনে সবসময় ছায়ারমত থাকত। শেখ মুজিব এগুলোর কোনো তোয়াক্কা করতো না। সরকার জনগণের কাছে শেখ মুজিবকে হেয় করার উদ্দেশ্যে তাঁর বিরুদ্ধে অপমানজনক কয়েকটি মামলাও দাঁড় করালেন।
শেখ মুজিব মন্ত্রী হিসেবে সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার ও নিজের পদমর্যাদার বলে আর্থিক সুবিধা অর্জন করেছেন এ অভিযোগের ভিত্তিতে আনীত মামলা থেকে ঢাকা বিভাগের স্পেশাল জজ এ, এস, এম, রাশেদ তাঁকে অব্যাহতি দেন। সোহরাওয়ার্দী এ মামলায় শেখ মুজিবের পক্ষ নিয়েছিলেন।
শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে আনীত দুর্নীতিতে সহায়তা করার মামলায় মিথ্যা সাক্ষ্য দেবার অভিযোগে ১৯৫৯ সালের ১২ জুলাই লে. কর্নেল আই, এ, শামিমের সভাপতিত্বে গঠিত চার নাম্বার স্পেশাল মিলিটারী কোর্ট ঐ মামলার অন্যতম সাক্ষী আল-আমিন ইন্ডাষ্ট্রির পার্টনার আনোয়ার আলী ও মুজিবর রহমান চৌধুরীকে যথাক্রমে চার ও দুবছরের সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করলে আসামীর স্বীকার করেন যে, পুলিশের প্রচণ্ড প্যাচে পড়ে তারা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মিথ্যা বিবৃতি দিয়েছেন।
এভাবে মুজিবের বিরুদ্ধে একর পর এক মামলা দায়ের হতে থাকল। ১৯৫৯ সালের ২২ আগস্ট ঢাকা জেলার ডিস্ট্রিক্ট এবং সেশন জজ আব্দুল মওদুদের আদালতে তাঁর বিরুদ্ধে সরকারি পদমর্যাদা অপব্যবহারের মামলা হয় এবং এ মামলায় ১২ সেপ্টেম্বর তাঁকে দু’বছর বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও পাঁচ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে আরও ছয় মাস জেল) দণ্ডিত করেন। এ রায়ের পরিপ্রেক্ষিতে শেখ মুজিব হাইকোর্টে আপীল পেশ সাপেক্ষে অন্তবর্তীকালীন জামিনের আবেদন জানালে হাইকোর্টের বিচারপতি জনাব ইদ্রিস অবকাশকালীন বেঞ্চে তাঁর আবেদন মঞ্জুর করেন। এরপর ঢাকা হাইকোর্টে বিচারপতি আমির ও বিচারপতি আলীকে নিয়ে গঠিত এ মামলার শুনানী ডিভিশন বেঞ্চে আরম্ভ হয়।
প্ৰসংগত উল্লেখ্য যে ১৯৬৩ সালের প্রথম দিকে মওলানা ভাসানী অল্প সময়ের জন্য কায়রো যান। প্রেসিডেন্ট নাসেরের সঙ্গে তিনি দেখা করেন। এ সফর শেষে দেশে প্রত্যাবর্তনের পর আইয়ুব খান বিশেষ দূত মারফত রাওয়ালপিণ্ডিতে তাঁর সঙ্গে দেখা করার জন্য আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬৩ সালের মার্চ মাসে পিণ্ডিতে ঐতিহাসিক ভাসানী-আইয়ুব বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকের পরপরই মওলানা ভাসানী এক সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হিসেবে ৭ সপ্তাহ ব্যাপী চীন সফরে যান। চীনে তিনি মাওসেতুং ও চৌ এন লাই-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। কথিত আছে যে, মাওসেতুং মওলানা ভাসানীকে আইয়ুব বিরোধী
পৃষ্ঠা-৯৭

আন্দোলন জোরদার না করার অনুরোধ করেন। মওলানা ভাসানী Dont Disturb Ayub নীতি গ্রহণের প্রতিশ্রুতি দেন। ভাসানী গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর রচিত ভাসানী গ্রন্থে লিখেছেন, ‘তখন অন্যান্য দলের মতো ন্যাপের খুব মন্থর গতিতে এগোতে থাকে। ১৯৬৩-এর মার্চে ভাসানী প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের আমন্ত্রণে রাওয়ালপিণ্ডিতে তার সঙ্গে দেখা করেন। পশ্চিম পাকিস্তানের গভর্নরের সঙ্গেও তাঁর সাক্ষাত হয়। তারপর অক্টোবরে গণচীনের বিপ্লব দিবসে যোগ দেবার জন্য পাকিস্তানি সরকারি প্রতিনিধিদলের অন্যতম সদস্যরূপে তিনি পিকিং যান এবং মাওসেতুং ও চৌ এন লাই-এর সঙ্গে মত বিনিময় করেন । ভাসানীর আইয়ুবের সঙ্গে দেখা করা ও তার পরপরই চীনে যাওয়ার ব্যাপার নিয়ে দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। আইয়ুবের সঙ্গে ন্যাপ এবং ভাসানী সহযোগিতা করছেন বলে অভিযোগ উথিত হয় নানা পত্রপত্রিকায়। আইয়ুব সম্পর্কে ন্যাপ এবং ভাসানী সে সময় কেন কিছুটা নমনীয় মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন সে ব্যাপারে প্রাদেশিক কাউন্সিল অধিবেশনে (২৪, ২৫ জুলাই) হাজী দানেশের রিপোর্টেই চমৎকার ব্যাখ্যা দেওয়া হয়েছে।…
দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে বিদগ্ধ বামপন্থী নেতা হাজী দানেশের এ রিপোর্টে ন্যাপের তৎকালীন নীতি সুস্পষ্টভাবে উত্থাপিত হয়েছে। বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে আইয়ুবকে কিছুটা সমর্থন দিলেও অভ্যন্তরীণ নীতির বিরোধিতা করেছে সুস্পষ্ট ভাষায়ই।’
১৯৬৪ সালের ১১ মার্চ প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি আদায়ের জন্য সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়। আওয়ামী লীগের পক্ষে এ সংগ্রাম কমিটির ঘোষণাপত্রে স্বাক্ষর দান করেন। ১৮ ও ১৯ মার্চ সারা পূর্ব বাংলায় প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটাধিকার ও প্রত্যক্ষ নির্বাচন দিবস পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ছাত্র জনতার প্রতিবাদ মিছিলের উপর পুলিশ লাঠিচার্জ করে ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে। পরদিন ঢাকায় হরতাল পালিত হয়। বিকেলে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভা শেষে ঢাকার রাজপথ জনসমুদ্রের মিছিলে পরিণত হয়। এ মিছিলে নেতৃত্ব দেন মওলানা ভাষানী ও শেখ মুজিব। শেখ মুজিব তার অনলবর্ষী ভাষণে বলেন : “সভ্যতার কোনো পর্যায়েই জন্মগত অধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেনি, হিটলার পারেনি। আজ পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীও পারবে না। একদিন দেশবাসী দুর্বার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে তাদের জন্মগত অধিকার ছিনিয়ে আনবেই আনবে। আজ জাতি যখন তার দাবি নিয়ে সংগ্রামে নেমেছে তখন ঢাকা শহর পুলিশে পুলিশে ছেয়ে দেওয়া হয়েছে। অথচ এ সেদিন যখন দাঙ্গাবাজদের উচ্ছঙ্খলতা চরমে পৌছেছিল, তখন এ পুলিশ পুংগুবরা কোথায় ছিল? তিনি আরও বলেন : বাংলার ভায়েরা আমরা স্পষ্ট করে আজ
পৃষ্ঠা-৯৮

আপনাদের থেকে জেনে যেতে চাই আমরা যদি জেলে চলে যাই পারবেন কি আপনারা হৃত অধিকার ছিনিয়ে আনার জন্য গ্রামে গ্রামে দুর্বার আন্দোলন চালিয়ে যেতে? জেল-জুলুমের মুখে আপনাদের ছেলেরা আজ যেমন বুক পেতে দিয়েছে, পারবেন কি আপনারা তেমনি করে ত্যাগ ও সাধনার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষা নিতে? পারবেন কি আপনারা হাজারে হাজারে আইয়ুব কারাগার ভরে তুলতে?
মওলানা ভাসানী তার বক্তৃতায় বলেন : “বাঙালি সম্রাট অশোককে মানেনি। মোগল-পাঠানেরও অনুগত হয়নি। ইংরাজের আনুগত্য স্বীকার করেনি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদা না দেওয়ায় জনতার রুদ্ররোষে প্রবল ক্ষমতাশীল মুসলিম লীগ আজ কবরে শায়িত। এবারো সরকার যদি ভোটাধিকারের দাবি মেনে না নেন, তবে দেশে আর এক রাষ্ট্রভাষার ঘটনা ঘটবে।”
১৬ মার্চ (১৯৬৪) রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্ররা প্রবল বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। ২২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাবর্তন উৎসব অনুষ্ঠানকালে পদাধিকার বলে চ্যানচেলার মোনেম খান বক্তৃতা দিতে উঠলে ছাত্ররা হলের অভ্যন্তরে শ্লোগান দিতে থাকে। পুলিশ নিরস্ত্র ছাত্রদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। ৩ জন সাংবাদিকসহ ৩১৩ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ ফজলুল হক মনি ও ক্যাপ্টেন মুনসুর আলী এদের অন্যতম। ২৯ মার্চ (১৯৬৪) সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটির উদ্যোগে প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এইদিন পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব বলেন যে, ভোটাধিকার না দিলে সরকারকে ট্যাক্স দেওয়া হবে না।
শেখ মুজিব এপ্রিল ও মে মাসে আওয়ামী লীগকে শক্তিশালী করার উদ্দেশ্যে বিভিন্ন জেলায় গণসংযোগ সফরে যান। ৩১ মে বিকেলে মুজিবকে তার বাসভবন থেকে পূর্ব পাকিস্তান জন নিরাপত্তা আইনে ৭ (৩) ধারায় এবং পাকিস্তান দণ্ডবিধির ১২৪ (ক) ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়। ৫ জুলাই আসন্ন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের কর্তব্য সম্পর্কে
বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে আগামী প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কাকে প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হবে সে ব্যাপারে শেখ মুজিবুর রহমান, নবাবজাদা নাসেরুল্লাহ খান ও আবুদস সালাম খানের উপর দায়িত্ব দেওয়া হয়। ১৯৬৪ সালে ১২ জুলাই সমগ্র পূর্ব বাংলায় জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিব অনলবর্ষী ভাষণ দেন।
১৯৬৪ মালের মার্চ মাসে জাতীয় পরিষদে নির্বাচনী বিল পাস হয়। ১৯৬৫ সালে ২ জানুয়ারি ৮০ হাজার মৌলিক গণতান্ত্রিক ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ঘোষণা দেওয়া হয়। ২১ জুলাই কাউন্সিল মুসলিম লীগ নেতা খাজা নাজিমউদ্দিনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত সর্বদলীয় সভায় সম্মিলিত বিরোধী দল
পৃষ্ঠা-৯৯

(Combined Opposition Party or COP) গঠিত হয়। ৫টি বিরোধী দল ৪ দিনব্যাপী সভায় মিলিত হয়। আওয়ামী লীগ, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি , জামায়াত ইসলাম, কাউন্সিল মুসলিম লীগ ও নেজামী ইসলাম পার্টি ২৪ জুলাই ৯ দফা নির্বাচনী কর্মসূচি স্বাক্ষর করে।
সম্মিলিত বিরোধী দলের পক্ষ থেকে মহাতেরামা মিস্ ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট পদে মনোনয়ন দেওয়া হয়।
ইতিমধ্যে আইয়ুব খান পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন বলে ঘোষণা করে। এর আগে ১৯৬২ সালের ৪ ও ৫ সেপ্টেম্বর মুসলিম লীগের এক বিরাট অংশকে নিয়ে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এ দলের নাম কনভেনশন মুসলিম লীগ। আইয়ুব খান নিজেই সেই দলের সভাপতির পদ দখল করলেন। ১৭ সেপ্টেম্বর মিস ফাতেমা জিন্নাহ সম্মিলিত বিরোধী দলের এ প্রস্তাবে সম্মতি জ্ঞাপন করেন। বিরোধী দলের ৫ নেতা খাজা নাজিমউদ্দিন, মওলানা ভাসানী, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, নওয়াবজাদা নাসেরুল্লাহ খান ও শেখ মুজিবুর রহমান মিস ফাতেমা জিন্নাহর বাসভবনে গিয়ে বিরোধী দলের সিদ্ধান্ত জানান।
১৯৬৪ সালের ৭ নভেম্বর শেখ মুজিবকে পুনরায় তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করা হয় এবং পাকিস্তান দণ্ড বিধি ১২৪ (ক) ধারা অনুযায়ী শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়। পরে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
আসন্ন প্রেসিডেন্ট নির্বাচন উপলক্ষে জোর নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়। আইয়ুব খান ও তার বসংবাদরা নির্বাচনী প্রচার চালাতে থাকেন। অন্যদিকে সম্মিলিত বিরোধী দল কর্তৃক আয়োজিত দেশের বিভিন্ন স্থানে জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিটি জনসভায় শেখ মুজিব অনলবর্ষী ভাষণ দেন। ২২ নভেম্বর শেখ মুজিব ফাতেমা জিন্নাহর সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্য করাচি যান। ছয়দিন পর ঢাকা ফিরে তাঁর বক্তৃতায় পাঠান, বেলুচ ও সিন্ধিদের আইয়ুব বিরোধিতার কথা উল্লেখ করেন। ৩ ডিসেম্বর শেখ মুজিবকে পুনরায় পূর্ব পাকিস্তান জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। পরে তাকে জামিনে মুক্তি দেওয়া হয়।
১৯৬৫ সালের ২ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আইয়ুব খান ৪৯৯৫১ ভোট এবং মিস জিন্নাহ্ ২৮১৯১ ভোট লাভ করেন। আইয়ুব খান এ নির্বাচনে জয়লাভ করে পুনরায় প্রেসিডেন্ট পদে অধিষ্ঠিত হন।
১৯৬৫ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাক-ভারত যুদ্ধ শুরু হয়। এ যুদ্ধ ১৭ দিন স্থায়ী হয়। কাশ্মীর ও কচ্ছের রান সীমান্তে পাক বাহিনী ভারতীয় এলাকায় গুলি বর্ষণের ফলে সীমান্ত এলাকায় সংষর্ঘ বাঁধে। এছাড়া পাকিস্তান দীর্ঘদিন ধরে। কাশ্মীরে সশস্ত্র গেরিলা পাঠিয়ে ভারতকে নাস্তানাবুদ করছিল। ভারত ৬ সেপ্টেম্বর
পৃষ্ঠা-১০০

লাহোর আক্রমণ করার ফলে প্রকাশ্য যুদ্ধ শুরু হয়। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল ২০ সেপ্টেম্বর যুদ্ধ বিরতি ঘোষণা করে। পাকিস্তান ও ভারত উভয় দেশই যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত হয়। পরে সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধানমন্ত্রী কোসিকিন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী লাল বাহাদুর শাস্ত্রীকে শান্তিপূর্ণ মীমাংসার লক্ষ্যে তাসখন্দে মিলিত হওয়ার আমন্ত্রণ জানান। ১৯৬৬ সালের ১০ জানুয়ারি তাসখন্দ চুক্তি সম্পাদিত হয়।
মাত্র ১৭ দিন স্থায়ী পাক-ভারত যুদ্ধ বাঙালি জাতির চোখ খুলে দেয়। এ যুদ্ধের সময় পূর্ব বাংলা ছিল সম্পূর্ণভাবে অরক্ষিত ও নিরাপত্তাহীন। পাকিস্তানের মুল সামরিক শক্তি অবস্থিত ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে। আইয়ুব খান বলতেন, পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা নিহিত রয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তির ওপর। এ ধরনের অযৌক্তিক অজুহাত খাড়া করার ফলে বাঙালি সংগত কারণেই ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে।
তাসখন্দ যাওয়ার আগে আইয়ুব খান পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ-আলোচনার জন্য ঢাকায় আসেন। সরকার নূরুল আমিন, হামিদুল হক চৌধুরী, ফরিদ আহমদ, শেখ মুজিব, সালাম খান, তাজউদ্দিন আহমদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী ও জহিরউদ্দিনকে বৈঠকে আমন্ত্রণ জানান। ২৫ ডিসেম্বর এ বৈঠক বসলে আইয়ুব খান সবাইকে হতবাক করে দিয়ে জিজ্ঞাসা করেন, ‘বলুন আপনারা কেন এসেছেন? কি আপনাদের বক্তব্য?’ শেখ মুজিব উঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের মন্তব্যের প্রতিবাদ করে বলেন, “আমরা তো নিজে থেকে আসিনি। আপনার আমন্ত্রণে এসেছি। আমাদেরকে ডেকে নিয়ে এসে এভাবে অপমান করার অধিকার আপনার নেই।’ সালাম খান মাঝখানে বক্তব্য রেখে বিষয়টা সহজ করে দেন। নূরুল আমিনও বক্তব্য রাখেন। ১৯৬৬ সালে ৪ জানুয়ারি বৈঠক বসে এবং ১০ জানুয়ারি ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিন্তু এ ঐতিহাসিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার মাত্র কয়েক ঘণ্টা পর ১১ জানুয়ারি গভীর রাতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী ইন্তেকাল করেন।
এদিকে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে হয়রানিমূলক মামলা অব্যাহত থাকে। পূর্ব পাকিস্তান রুখিয়া দাঁড়াও শীর্ষক প্রচারপত্র ছাপানোর মামলার শুনানি ৫ ফেব্রুয়ারি নির্ধারিত ছিল। ২৪ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তা মুলতবি করা হয়।
আমাদের বাঁচার দাবি ছয়দফা কর্মসূচি নামে তাজউদ্দিন আহমেদ কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের পক্ষে ‘অনুপম’ পুরানা পল্টন ঢাকা থেকে একটি পুস্তিকা প্রকাশিত হয়। এ পুস্তকটি একটি ঐতিহাসিক দলিল। এ বিবেচনায় নিম্নে উদ্ধৃত করা হলো :
পৃষ্ঠা-১০১

আমাদের বাঁচার দাবি
ছয় দফা কর্মসূচি
আমার প্রিয় দেশবাসী ভাই বোনেরা,
আমি পূর্ব পাকিস্তানবাসীর বাঁচার দাবিরূপে ছয়দফা কর্মসূচি দেশবাসী ও ক্ষমতাসীন দলের বিবেচনার জন্য পেশ করিয়াছি। শান্তভাবে উহার সমালোচনা করার পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থবাদীদের দালালরা আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটনা শুরু করিয়াছেন। জনগণের দুশমনের এ চেহারা ও গালাগালির সহিত দেশবাসী সুপরিচিত। অতীতে পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিতান্ত সহজ ও ন্যায্য দাবি যখন উঠিয়াছে, তখনই এ দালালরা এমনিভাবে হৈ চৈ করিয়া উঠিয়াছেন। আমাদের মাতৃভাষাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবি, পূর্ব পাক জনগণের মুক্তি সনদ একুশ দফা দাবিযুক্ত নির্বাচন প্রথার দাবি, ছাত্র তরুণদের সহজ স্বল্পব্যয়ে শিক্ষালাভের মাধ্যম করার দাবি ইত্যাদি সকল প্রকার দাবির মধ্যেই এ শোষকের দল ও তাহাদের দালালরা ইসলাম ও পাকিস্তান ধ্বংসের ষড়যন্ত্র আবিষ্কার করিয়াছেন।
আমার প্রস্তাবিত ছয় দফা দাবিতেও এরা তেমনিভাবে পাকিস্তানকে দুই টুকরা করিবার দুরভিসন্ধি আরোপ করিতেছে। আমার প্রস্তাবিত ছয় দফা দাবিতে যে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে সাত কোটি শোষিত বঞ্চিত আদম সন্তানের অন্তরের কথাই প্রতিধ্বনিত হইয়াছে তাহাতে আমার কোনো সন্দেহ নাই। খবরের কাগজের লেখায়, সংবাদে ও সভা-সমিতির বিবরণে, সকল শ্রেণির সুধীজনের বিবৃতিতে আমি গোটা দেশবাসীর উৎসাহ উদ্দীপনার সাড়া দেখিতেছি। তাতে আমার প্রাণে সাহস ও বুকে বল আসিয়াছে। সর্বোপরি পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগ আমার ছয় দফা দাবি অনুমোদন করিয়াছে। ফলে ছয় দফা দাবি আজ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের জাতীয় দাবিতে পরিণত হইয়াছে। এ অবস্থায় কায়েমী স্বার্থবাদী শোষকদের প্রচারণায় জনগণ বিভ্রান্ত হইবেন না, সে বিশ্বাস আমার আছে।
কিন্তু এও জানি, জনগণের দুশমনদের ক্ষমতা অসীম ও তাঁদের বিত্ত প্রচুর, হাতিয়ার এদের অফুরন্ত, মুখ এদের দশটা, গলার সুর এদের শতাধিক। এরা বহুরূপী। ঈমান, ঐক্য ও সংহতির নামে এঁরা আছেন সরকারি দলে। কিন্তু পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দুশমনির বেলায় এঁরা সকলে একজোট। এঁরা নানা ছলাকলায় জনগণকে বিভ্রান্ত করিবার চেষ্টা করিবেন। সে চেষ্টা শুরুও হইয়া গিয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানবাসীর নিষ্কাম সেবার জন্য এঁরা ইতিমধ্যেই বাহির হইয়া পড়িয়াছেন। এঁদের হাজার চেষ্টাতেও আমার অধিকার সচেতন দেশবাসী যে বিভ্রান্ত হইবেন না, তাতেও আমার কোনো সন্দেহ নাই। তথাপি ছয় দফা দাবির তাৎপর্য ও উহার অপরিহার্যতা জনগণের মধ্যে প্রচার করা সমস্ত গণতন্ত্রী
পৃষ্ঠা-১০২

বিশেষত আওয়ামী লীগ কর্মীদের অবশ্য কর্তব্য। আশা করি তাঁরা সকলে অবিলম্বে ছয় দফা ব্যাখ্যায় দেশময় ছড়াইয়া পড়িবেন। কর্মী ভাইদের সুবিধা জন্য ও দেশবাসী জনসাধারণের কাছে সহজবোধ্য করার উদ্দেশ্যে আমি ছয় দফার প্রতিটি দফার দফাওয়ার সহজ সরল ও সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা ও যুক্তিসহ এ পস্তিকা প্রচার করিলাম। আওয়ামী লীগের তরফ হইতেও এ বিষয়ে আরো পস্তিকা ও প্রচারপত্র প্রকাশ করা হইবে। আশা করি সাধারণভাবে সকল গণতন্ত্রী বিশেষভাবে আওয়ামী লীগের কর্মিগণ ছাড়াও শিক্ষিত পূর্ব পাকিস্তানি মাত্রই এসব পুস্তিকার সদ্ব্যবহার করিবেন।
১ নং দফা
এ দফায় হইয়াছে যে, ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনা করতঃ পাকিস্তানকে একটি সত্যিকার ফেডারেশনরূপে গড়িতে হইবে। তাহাতে পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্ত বয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইন সভাসমূহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে। ইহাতে আপত্তি কি আছে? লাহোর প্রস্তাব পাকিস্তানের জনগণের নিকট কায়েদে আয়মসহ সকল নেতার দেওয়া নির্বাচনী ওয়াদা। ১৯৪৬ সালের সাধারণ নির্বাচন এ প্রস্তাবের ভিত্তিতেই হইয়াছিল। মুসলিম বাংলার জনগণ একবাক্যে পাকিস্তানের বাক্সে ভোট দিয়াছিলেন, এ প্রস্তাবের দরুনই। ১৯৫৪ সালের সাধারণ নির্বাচনে পূর্ব বাংলার মুসলিম আসালের শতকরা সাড়ে ৯৭টি একুশ দফার পক্ষে আসিয়াছিল। লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র রচনার দাবি ছিল তার অন্যতম প্রধান দাবি। মুসলিম লীগ তখন কেন্দ্রের ও প্রদেশের সরকারি ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত। সরকারি সমস্ত শক্তি ও ক্ষমতা লইয়া তাহারা এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করিয়াছিলেন। এ প্রস্তাবের পক্ষে ভোট দিলেই ইসলাম বিপন্ন ও পাকিস্তান ধ্বংস হইবে, এসব যুক্তি তখনও দেওয়া হইয়াছিল। বলিতে গেলে এ প্রশ্ন চূড়ান্তভাবে গণতান্ত্রিক উপায়ে মীমাংসিত হইয়াই ঘিয়াছে। কাজেই আজ লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার দাবি করিয়া আমি কোনো নতুন দাবি তুলি নাই, পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পুরান দাবিরই পুরুল্লেখ করিয়াছি মাত্র। তথাপি লাহোর প্রস্তাবের নাম শুনিলেই যাঁহারা আঁৎকিয়া উঠেন, তাহারা হয় পাকিস্তান সংগ্রামে আগ্রহী ছিলেন না, অথবা তাহারা পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের দাবি দাওয়ার বিরোধিতা ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের দালালী করিয়া পাকিস্তানের অনিস্ট সাধন করিতে চান।
এ দফায় পার্লামেন্টারী পদ্ধতির সরকার সার্বজনীন ভোটে সরাসরি নির্বাচন ও আইন সভার সার্বভৌমত্বের যে দাবি করা হইয়াছে তাহাতে আপত্তির কারণ।
পৃষ্ঠা-১০৩

কি? আমার প্রস্তাবই ভালো, না প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার ও পরোক্ষ নির্বাচন এবং ক্ষমতাহীন আইনসভাই ভালো এ বিচারের ভার জনগনের উপর ছাড়িয়া দেওয়াই কি উচিত নয়? তবে পাকিস্তানের ঐক্য সংহতির তরফদারেরা এসব প্রশ্নে রেফারেণ্ডামের মাধ্যমে জনমত যাচাইয়ের প্রস্তাব না দিয়া আমার বিরুদ্ধে গালাগালি বর্ষণ করিতেছেন কেন? তাঁহার যদি নিজেদের মতে এতই আস্থাবান, তবে আসুন এ প্রশ্নের উপরই গণভোট হইয়া যাক।
২নং দফা
এ দফায় আমি প্রস্তাব করিয়াছি যে, ফেডারেশন সরকারের এখতিয়ার কেবলমাত্র দেশরক্ষা ও পররাষ্ট্রীয় ব্যাপার এ দুইটি বিষয় থাকিবে। অবশিষ্ট সমস্ত বিষয় স্ট্রেটসমূহের (বর্তমান ব্যবস্থায় যাকে প্রদেশ বলা হয়) হাতে থাকিবে। এ প্রস্তাবের দরুনই কায়েমী স্বার্থের দালালরা আমার উপর সর্বাপেক্ষা বেশি চটিয়াছেন। আমি নাকি পাকিস্তানকে দুই টুকরা করতঃ ধ্বংস করিবার প্রস্তাব দিয়াছি। সংকীর্ণ স্বার্থবুদ্ধি ইহাদের এতই অন্ধ করিয়া ফেলিয়াছে যে, ইহারা রাষ্ট্র বিভাগের মূল সূত্রগুলি পর্যন্ত ভুলিয়া গিয়াছে। ইহারা ভুলিয়া যাইতেছে যে, ব্রিটিশ সরকারের ক্যাবিনেট মিশন ১৯৪৬ সালে যে প্ল্যান দিয়াছিলেন এবং যে ‘প্ল্যান কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়ই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতে কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে দেশরক্ষা পররাষ্ট্রও ও যোগাযোগ ব্যবস্থা এ তিনটি মাত্র বিষয় ছিল এবং বাকি সব বিষয়ই প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল। ইহা হইতে এটাই নিঃসেন্দেহে প্রমাণিত হইয়াছে যে, ব্রিটিশ সরকার, কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলের মত এ যে, এ তিনটি মাত্র বিষয় কেন্দ্রের হাতে থাকিলেই কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে পারে। অন্য কারণে কংগ্রেস চুক্তি ভঙ্গ করায় ক্যাবিনেট প্ল্যান পরিত্যক্ত হয়। তাহা না হইলে এ তিন বিষয় লইয়াই আজো ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার চলিতে থাকিত। আমি আমার প্রস্তাবে ক্যাবিনেট প্ল্যানেরই অনুসরণ করিয়াছি। যোগাযোগ ব্যবস্থা আমি বাদ দিয়াছি সত্য, কিন্তু তাহার যুক্তিসংগত কারণও আছে। অখণ্ড ভারতের বেলায় যোগাযোগ ব্যবস্থারও অখণ্ডতা ছিল। ফেডারেশন রাষ্ট্র গঠনের বৈজ্ঞানিক মূলনীতি এ যে, যে যে বিষয়ে ফেডারেটিং স্ট্রেটসমূহের স্বার্থ এক ও অবিভাজ্য, কেবল সেই সেই বিষয়ই ফেডারেশনের এখতিয়ারে দেওয়া হয়। এ মূলনীতি অনুসারে অখণ্ড ভারতে যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য ছিল। পেশোয়ার হইতে চাটগা পর্যন্ত একই রেল চলিতে পারিত। কিন্তু পাকিস্তানে তা নয়। দুই অঞ্চলের যোগাযোগ ব্যবস্থা এক ও অবিভাজ্য তো নয়ই, বরঞ্চ সম্পূর্ণ পৃথক। রেলওয়েকে প্রাদেশিক সরকারের
পৃষ্ঠা-১০৪

হাতে ট্রান্সফার করিয়া বর্তমান সরকারও তা-ই স্বীকার করিয়াছেন। টেলিফোন, টেলিগ্রাম,পোস্ট অফিসের ব্যাপারেও এ সত্য স্বীকার করিতেই হইবে।
তবে বলা যাইতে পারে যে, একশ দফায় যখন কেন্দ্রকে তিনটি বিষয় দেবার সুপারিশ ছিল, তখন আমি আমার বর্তমান প্রস্তাবে মাত্র দুইটি বিষয় দিলাম কেন? এ প্রশ্নের জবাব আমি তিন নম্বর দফার ব্যাখ্যা দিয়াছি। এখানে আর পুনরুক্তি করিলাম না। আর একটি ব্যাপারে ভুল ধারণা সৃষ্টি হইতে পারে, আমার প্রস্তাবে ফেডারেটিং ইউনিটকে প্রদেশ না বলিয়া স্টেট বলিয়াছি। ইহাতে কায়েমী স্বার্থী শোষকরা জনগণকে এ বলিয়া ধোকা দিতে পারে এবং দিতেও শুরু করিয়াছে যে, স্টেট অর্থে আমি ইন্ডিপেনডেন্ট স্টেট বা স্বাধীন রাষ্ট্র বুঝাইয়াছি। কিন্তু তাহা সত্য নয়। ফেডারেটিং ইউনিটকে দুনিয়ার সর্বত্র সব বড় বড় ফেডারেশন অথবা ইউনিয়ন বলা হয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফেডারেল জার্মানি, এমনকি আমাদের প্রতিবেশী ভারত রাষ্ট্র সকলেই তাহাদের প্রদেশসমূহকে স্টেটস ও কেন্দ্রকে ইউনিয়ন বা ফেডারেশন বলিয়া থাকে। আমাদের পার্শ্ববর্তী আসাম ও পশ্চিম বাংলা প্রদেশয় নয়- স্টেট। এরা যদি ভারত ইউনিয়নের প্রদেশ হইয়া স্টেট হওয়ার সম্মান পাইতে পারে, তবে পূর্ব পাকিস্তানকে এইটুকু নামের মর্যাদা দিতেই বা কর্তাদের এত এলার্জি কেন?
৩নং দফা
এ দফায় আমি মুদ্রা সম্পর্কে দুইটি বিকল্প বা অলটারনেটিভ প্রস্তাব দিয়াছি। এ দুইটি প্রস্তাবের যে কোনো একটি গ্রহণ করিলেই চলিবে।
(ক) পূর্ব ও পশ্চিম , পাকিস্তানের জন্য দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক অথচ সহজে বিনিময়যোগ্য মুদ্রার প্রচলন করিতে হইবে। এ ব্যবস্থা অনুসারে কারেন্সী কেন্দ্রের হাতে থাকে না, আঞ্চলিক সরকারের হাতে থাকিবে। দুই অঞ্চলের জন্য দুইটি স্বতন্ত্র স্টেট ব্যাংক থাকিবে।
(খ) দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে। এ ব্যবস্থায় মুদ্রা কেন্দ্রের হাতে থাকিবে। কিন্তু এ অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে। যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে। এ বিধানে পাকিস্তানের একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে, দুই অঞ্চলে দুইটি পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। এ দুইটি বিকল্প প্রস্তাব হইতে দেখা যাইবে যে, মুদ্রাকে সরাসরি কেন্দ্রের হাত হইতে প্রদেশের হাতে আনিবার প্রস্তাব আমি করি নাই। যদি আমার দ্বিতীয় অল্টারনেটিভ গৃহীত হয়, তবে মুদ্রা কেন্দ্রের হাতেই থাকিয়া যাইবে। এ অবস্থায় আমি একুশ দফা প্রস্তাবের খেলাফে কোনো সুপারিশ করিয়াছি, এইকথা বলা চলে না।
পৃষ্ঠা-১০৫

পাকিস্তানি ভাইরা আমার এ প্রস্তাবে রাজি হন, তবেই শুধ প্রথম বিকল্প অর্থাৎ কেন্দ্রের হাত হইতে মুদ্রাকে প্রদেশের হাতে আনিতে হইবে । আমার দৃঢ়বিশ্বাস আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ভুল বুঝাবুঝির অবসান হইবে এবং উভয় অঞ্চলের সুবিধার খাতিরে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এ প্রস্তাবে রজি হইবেন । আমরা তাঁদের খাতিরে সংখ্যা গরিষ্ঠতা ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসাম্য মানিয়া লইয়াছি। তারা কি আমাদের খাতিরে এইটুকু করিবেন না।
আর যদি অবস্থাগতিকে মুদ্রাকে প্রদেশের এলাকায় আনিতেও হয় তবু তাহাতে কেন্দ্র দুর্বল হইবে না। পাকিস্তানের কোনোও অনিষ্টও হইবে । ‘ক্যানিনেট প্ল্যান’ নিখিল ভারতীয় কেন্দ্রের যে প্রস্তাব ছিল তাহাতে মুদ্রা কেন্দ্রীয় বিষয় ছিল না। এ প্রস্তাব পেশ করিয়া ব্রিটিশ সরকার এবং এ প্রস্তাব গ্রহণ করিয়া কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ সকলেই স্বীকার করিয়াছেন যে, মুদ্রাকে কেন্দ্রীয় বিষয় না করিয়াও কেন্দ্র চলিতে পারে। কথাটা সত্য। রাষ্ট্রীয় অর্থ বিভাগে এ ব্যবস্থার স্বীকতি আছে। কেন্দ্রের বদলে প্রদেশের হাতে অর্থনীতি রাখা এবং একই দেশে পৃথক পৃথক রিজার্ভ ব্যাংক থাকার নজির দুনিয়ার বড় বড় শক্তিশালী রাষ্ট্রেও আছে। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলে ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমের মাধ্যমে, পৃথক পৃথক স্টেট ব্যাংকের দ্বারা। এতে যুক্তরাষ্ট ধ্বংস হয় নাই, তাহাদের আর্থিক বুনিয়াদও ভাঙ্গিয়া পড়ে নাই। অত যে শক্তিশালী দোর্দণ্ড প্রতাপ সোভিয়েত ইউনিয়ন তাহাদেরও কেন্দ্রীয় সরকারের কোনো অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর আছে। কেন্দ্রীয় সরকারের আর্থিক প্রয়োজন ঐসব প্রাদেশিক মন্ত্রী ও অর্থ দফতরই মিটাইয়া থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশেও আঞ্চলিক সুবিধার খাতিরে দুইটি পৃথক ও স্বতন্ত্র রিজার্ভ ব্যাংক বহুদিন আগে হইতেই চালু আছে।
আমার প্রস্তাব মর্ম এ যে, উপরিউক্ত দুই বিকল্পের দ্বিতীয়টি গৃহীত হইলে মুদ্রা কেন্দ্রের তত্ত্বাবধানে থাকিবে। সেই অবস্থায় উভয় অঞ্চলের একই নকশার মুদ্রা বর্তমানে যেমন আছে তেমন থাকিবে। পার্থক্য শুধু এ হইবে যে, পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাহাতে পূর্ব পাকিস্তান বা সংক্ষেপে ঢাকা লিখা থাকিবে। পশ্চিম পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে রিজার্ভ ব্যাংক হইতে ইস্যু হইবে এবং তাহাতে পশ্চিম পাকিস্তান বা সংক্ষেপে ‘লাহোর লিখা থাকিবে। পক্ষান্তরে, আমার প্রস্তাবের দ্বিতীয় বিকল্প না হইয়া যদি প্রথম বিকল্প গৃহীত হয়, সেই অবস্থাতেও উভয় অঞ্চলের মুদ্রা সহজে বিনিময়যোগ্য থাকিবে এবং পাকিস্তানের ঐক্যের প্রতীক ও নিদর্শনস্বরূপ উভয় আঞ্চলিক সরকারের সহযোগিতায় একই নকশার মুদ্রা প্রচলন করা যাইবে।
পৃষ্ঠা-১০৬

একট তলাইয়া চিন্তা করিলেই বুঝা যাইবে যে, এ দুই ব্যবস্থার একটি গ্রহণ করা ছাড়া পর্ব পাকিস্তানকে নিশ্চিত অর্থনৈতিক মৃত্যুর হাত হইতে রক্ষা করার অন্য কোনো উপায় নাই। সারা পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা হওয়ায় ও দুই অঞ্চলের মুদ্রার মধ্যে কোনো পৃথক চিহ্ন না থাকায় আঞ্চলিক কারেন্সি সার্কুলেশনে কোনোও বিধিনিষেধ ও নির্ভুল হিসাব নাই। মুদ্রা ও অর্থনীতি কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকায় অতি সহজেই পূর্ব পাকিস্তানের আয় পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে, সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, শিল্প-বাণিজ্য, ব্যাংকিং ইনসিওরেন্স ও বৈদেশিক মিশনসমূহের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায় প্রতি মিনিটে এ পাচারের কাজ অবিরাম গতিতে চলিতেছে। সকলেই জানেন সরকারি স্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকসহ সমস্ত ব্যাংকের হেড অফিস পশ্চিম পাকিস্তানে। এ সেইদিন মাত্র প্রতিষ্ঠিত ছোট দুই একখানি ব্যাংক ইহার সাম্প্রতিক ব্যতিক্রম মাত্র। এসব ব্যাংকের ডিপোজিটের টাকা, শেয়ার মানি, সিকিউরিটি মানি, শিল্প বাণিজ্যের আয় ও মুনাফা এককথায় পূর্ব পাকিস্তানে অনুষ্ঠিত সমস্ত আর্থিক লেনদেনের টাকা বালুচরে ঢাকা পানির মত একটানে তলদেশ হেড অফিসে অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানে চলিয়া যাইতেছে। পূর্ব পাকিস্তান শুকনা বালুচর হইয়া থাকিতেছে। বালুচরে পানির দরকার হইলে টিউবওয়েল পুতিয়া তলদেশ হইতে পানি তুলিতে হয়। অবশিষ্ট পানি তলদেশে জমা থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের প্রয়োজনীয় অর্থও তেমনি চেকের টিউব অয়েলের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তান হইতে আনিতে হয়। উদ্ধৃত্ত আর্থিক সেভিং তলদেশেই অর্থাৎ পশ্চিম পাকিস্তানেই জমা থাকে। এ কারণেই পূর্ব পাকিস্তানে ক্যাপিটেল ফর্মেশন হইতে পারে নাই। সব ক্যাপিটেল ফর্মেশন পশ্চিমে হইয়াছে। বর্তমান ব্যবস্থা চলিতে থাকিলে কোনোদিন পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গঠন হইবে না। কারণ সেভিং মানেই ক্যাপিটেল ফর্মেশন।
শুধু ফ্লাইট অব ক্যাপিটেল বা মুদ্রা পাচারই নয়, মুদ্রাস্ফীতিও পূর্ব পাকিস্তানের নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসের দুর্মূল্যতা, জনগণের বিশেষত পাট চাষীদের দুর্দশা এ সমস্তের জন্য দায়ী এ মুদ্রা ব্যবস্থা ও অর্থনীতি। আমি পাঁচ নং দফার ব্যাখ্যায় এ ব্যাপারে আরো বিস্তারিতভাবে আলোচনা করিয়াছি। এখানে শুধু এইটুকু বলিয়া রাখিতেছি যে, এ ফ্লাইট অব ক্যাপিটেল বন্ধ করিতে না পারিলে পূর্ব পাকিস্তানিরা নিজেরা শিল্প বাণিজ্যে এক পাও অগ্রসর হইতে পারিবে না। কারণ এ অবস্থায় মূলধন গড়িয়া উঠিতে পারে না।
৪নং দফা।
এ দফায় আমি প্রস্তাব দিয়াছি যে, সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা, কর ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের সে
পৃষ্ঠা-১০৭

ক্ষমতা থাকিবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায়ের সঙ্গে সঙ্গে ফেডারেল তহবিলে অটোমেটিক্যালি জমা হইয়া যাবে । এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকসমূহের উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রেই থাকিবে । এইভাবে জমাকৃত টাখান ফেডারেল সরকারের তহবিল হইবে।
আমার এ প্রস্তাবেই কায়েমী স্বার্থের কালোবাজারি ও মুনাফাখোর শোষকরা সবচেয়ে বেশি চমকিয়া উঠিয়াছে। তাহারা বলিতেছে, ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে না থাকিলে সে সরকার চলিবে কিরূপে? সে সরকার তাহাতে যে একেবারে খয়রাতি প্রতিষ্ঠানে পরিণত হইবে। খয়্রারাতের ওপর নির্ভর করিয়া কেন্দ্রীয় সরকার দেশরক্ষা করিবেন কেমনে? পররাষ্ট্র নীতিই বা চালাইবেন কি দিয়া? প্রয়োজনের সময় চাদা না দিলে কেন্দ্রীয় সরকার তো অনাহারে মারা যাইবেন। অতএব এ নিশ্চয়ই পাকিস্তান ধ্বংসেরই ষড়যন্ত্র । কায়েমী স্বার্থীরা এ ধরনের কত কথাই না বলিতেছেন তাহার একমাত্র কারণ তাঁহাদের ব্যক্তিগত ও শ্রেণিগত স্বার্থ। সেই স্বার্থ পূর্ব পাকিস্তানের জনগণকে অবাধে শোষণ ও লুণ্ঠন করিবার অধিকার। তাহারা জানেন যে, আমার এ প্রস্তাবে কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের দায়িত্ব দেওয়া না হইলেও কেন্দ্রীয় সরকার নির্বিঘ্নে চলার মত যথেষ্ট অর্থের ব্যবস্থা করা হইয়াছে। সেই ব্যবস্থা নিখুঁত করিবার শাগণতান্ত্রিক বিধান রচনার সুপারিশ করা হইয়াছে। ইহাই সরকারি তহবিলের সবচেয়ে অমোঘ, অব্যর্থ ও সর্বাপেক্ষা নিরাপদ উপায়। তাঁহারা ইহাও জানেন যে, কেন্দ্রকে ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা না দিয়াও ফেডারেশন চলার বিধান রাষ্ট্রবিভাগে স্বীকৃত। তাঁহারা এ খবরও রাখেন না যে, ক্যাবিনেট মিশনের যে প্ল্যান ব্রিটিশ সরকার রচনা করিয়াছিলেন এবং কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয়েই গ্রহণ করিয়াছিলেন, তাহাতেও সমস্ত ট্যাক্স ধার্যের ক্ষমতা প্রদেশের হাতে দেওয়া হইয়াছিল, কেন্দ্রকে সেই ক্ষমতা দেওয়া হয় নাই। ৩ নং দফার ব্যাখ্যায় আমি দেখায়েছি যে, অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর ছাড়াও দুনিয়ার অনেক ফেডারেশন চলিতেছে। তাহার মধ্যে দুনিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিশালী ফেডারেশন সোভিয়েত ইউনিয়নের কথাও আমি বলিয়াছি। তথায় কেন্দ্রের অর্থমন্ত্রী ও অর্থ দফতর বলিয়া কোনো বস্তুর অস্তিত্বই নাই। তাহাতে কি অর্থাভাবে সোভিয়েত ইউনিয়ন ধ্বংস হইয়া গিয়াছে। আর দেশরক্ষা বাহিনীই পররাষ্ট্র দফতর কি সেজন্য দুর্বল হইয়া পড়িয়াছে? পড়ে নাই। আমার প্রস্তাব কেন্দ্রীয় তহবিলের নিরাপত্তার জন্য শাগণতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করা হইয়াছে। সেই অবস্থায়। শাসনতন্ত্রে এমন এমন বিধান থাকিবে যে, আঞ্চলিক সরকার যেখানে যখন, সেইখানে যেই টাকা ট্যাক্স ধার্য ও আদায় করুন না কেন, শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত সেই টাকার হারের অংশ রিজার্ভ ব্যাংকের কেন্দ্রীয় তহবিলে জমা হইয়া যাইবে।
পৃষ্ঠা-১০৮

সেই টাকায় আঞ্চলিক সরকারের কোনোও হাতও থাকিবে না। এ ব্যবস্থায় অনেক সুবিধা হইবে। প্রথমত কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্যাক্স আদায়ের ঝামেলা পোহাইতে হইবে না। দ্বিতীয়ত ট্যাক্স ধার্য ও আদায়ের জন্য কোনোও দফতর বা আদায়ের মধ্যে ডুপ্লিকেশন হইবে না। তাহাতে আদায়ী খরচায় অপব্যয় ও অপচয় বন্ধ হইবে। ঐভাবে সঞ্চিত টাকা দ্বারা গঠন ও উন্নয়নমূলক অনেক কাজ করা যাইবে। অফিসার বাহিনীকেও উন্নততর সকাজে নিয়োজিত করা যাইবে। সতীয়ত, ট্যাক্স ধার্য ও আদায় একীকরণ-সহজতর হইবে। সকলেই জানেন, অর্থ বিজ্ঞানীরা এখন ক্রমেই সিঙ্গল ট্যাক্সেশনের দিকে আকৃষ্ট হইতেছেন। সিঙ্গল টাক্কশনের নীতিকে সকলেই অধিকতর বৈজ্ঞানিক ও ফলপ্রসূ বলিয়া অভিহিত করিতেছেন। ট্যাক্সেশনকে ফেডারেশনের এলাকা হইতে অঞ্চলের এখতিয়ারভুক্ত করা সর্বোত্তম ও সর্বশেষ আর্থিক নীত গ্রহণের প্রথম পদক্ষেপ বলা যাইতে পারে।
৫ম দফা
এ দফায় আমি বৈদেশিক বাণিজ্য ব্যাপারে নিম্নরূপ শাসনতান্ত্রিক বিধানের সুপারিশ করিয়াছি :
১. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে।
২. পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পূর্ব পাকিস্তানের এখতিয়ারে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানের এখতিয়ারে থাকিবে।
৩. ফেডারেশনের প্রয়োজনীয় বিদেশি মুদ্রা দুই অঞ্চল হইতে সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রে নির্ধারিত হারাহারি মতে আদায় হইবে।
৪. দেশজাত দ্রব্যাদি বিনা শুল্কে উভয় অঞ্চলের মধ্যে আমদানি ও রপ্তানি চলিবে।
৫. ব্যবসা-বাণিজ্য সম্বন্ধে বিদেশের সঙ্গে চুক্তি সম্পাদনের, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপনের এবং আমদানি রপ্তানি করিবার অধিকার আঞ্চলিক সরকারের হাতে ন্যস্ত করিয়া শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে।
পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক নিশ্চিত মৃত্যু হইতে রক্ষা করিবার জন্য এ ব্যবস্থা তিন নম্বর দফার মতই অত্যাবশ্যক। পাকিস্তানের আঠারো বছরের আর্থিক ইতিহাসের দিকে একটু নজর বুলাইলেই দেখা যাইবে যে-
পৃষ্ঠা-১০৯

(ক) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়া পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প গড়িয়া তোলা হইয়াছে এবং হইতেছে। সেই সকল শিল্পজাত দ্রব্যের অর্জিত বিদেশি মুদ্রাকে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা বলা হইতেছে।
(খ) পূর্ব পাকিস্তানে মূলধন গড়িয়া না উঠায় পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশী মুদ্রা ব্যবহারের ক্ষমতা নাই। পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হইতেছে। এইভাবেই পূর্ব পাকিস্তান শিল্পায়িত হইতে পারিতেছে না।
(গ) পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণে আয় করে সেই পরিমাণে ব্যয় করিতে পারে না । সকলেই জানেন, পূর্ব পাকিস্তান যে পরিমাণ রপ্তানি করে, আমদানি করে সাধারণত তার অর্ধেকেরও কম। ফলে, অর্থনীতির অমোঘ নিয়ম অনুসারেই পূর্ব পাকিস্তানে ইনফ্রেশন বা মুদ্রাস্ফীতি ম্যালেরিয়া জ্বরের মত লাগিয়াই আছে। তার ফলে আমাদের নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির দাম এত বেশি। বিদেশ হইতে আমদানিকরা একই জিনিসের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি দামের তুলনা করলেই ইহা বুঝা যাইবে। বিদেশি মুদ্রা বণ্টনের দায়িত্ব এবং অর্থনৈতিক অন্যান্য সমস্ত ক্ষমতা কেন্দ্রীয় সরকারের এখতিয়ারে থাকার ফলেই আমাদের এ দুর্দশা।
(ঘ) পাকিস্তানে বিদেশি মুদ্রার তিন ভাগের দুই ভাগই অর্জিত হয় পাট হইতে। অথচ পাট চাষীকে ন্যায্যমূল্য তো দূরের কথা, আবাদী খরচটাও দেওয়া হয় না। ফলে পাট চাষীদের ভাগ্য আজ শিল্পপতি ও ব্যবসায়ীদের খেলার জিনিসে পরিণত হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তান সরকার পাটের চাষ নিয়ন্ত্রণ করেন। কিন্তু চাষীকে পাটের ন্যায্য দাম দিতে পারেন না। এমন অদ্ভুত অর্থনীতি দুনিয়ার আর কোনো দেশে নাই। যতদিন পাট থাকে চাষীর ঘরে, ততদিন পাটের দাম থাকে পনর বিশ টাকা। ব্যবসায়ীর গুদামে চলিয়া যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার দাম হয় পঞ্চাশ। এ খেলা গরিব পাট চাষী চিরকাল দেখিয়া আসিতেছে। পাট ব্যবসা জাতীয়করণ করিয়া পাট রপ্তানিকে সরকারি আয়ত্তে আনা ছাড়া এর কোনো প্রতিকার নাই, এ কথা আমরা বলিয়াছি। এ উদ্দেশ্যে আমরা আওয়ামী লীগ মন্ত্রিসভার আমলে জুট মার্কেট কর্পোরেশন গঠন করিয়াছিলাম। পরে কেন্দ্রীয় সরকারের সাহায্যে পুঁজিপতিরা আমাদের সেই আরদ্ধ কাজ ব্যর্থ করিয়া দিয়াছেন।
(ঙ) পূর্ব পাকিস্তানের অর্জিত বিদেশি মুদ্রাই যে শুধু পশ্চিম পাকিস্তানে খরচ হইতেছে তাহা নহে; আমাদের অর্জিত বিদেশি মুদ্রার জোরে যে বিপুল পরিমাণ বিদেশি লোন ও এইড আসিতেছে, তাহাও পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় হইতেছে। কিন্তু সেই লোনের সুদ বহন করিতে হইতেছে পূর্ব পাকিস্তানকেই। এ অবস্থার প্রতিকার করিয়া পাট চাষীকে পাটের ন্যায্যমূল্য দিতে হইলে, আমদানি-রপ্তানি সমান করিয়া জনসাধারণকে সস্তা দামে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্য সরবরাহ করিয়া
পৃষ্ঠা-১১০

তাদের জীবন সুখময় করিতে হইলে এবং সর্বোপরি আমাদের অর্জিত বিদেশি মুদ্রা দিয়া পূর্ব পাকিস্তানির খাতে পূর্ব পাকিস্তানকে শিল্পায়িত করিতে হইলে আমার প্রস্তাবিত এ ব্যবস্থা ছাড়া উপায়ান্তর নাই।
৬নং দফা
এ দফায় আমি পূর্ব পাকিস্তানে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষী বাহিনী গঠনের সুপারিশ করিয়াছি। এ দাবি অন্যায়ও নয়, নতুনও নয়। একুশ দফার দাবিতে আমরা আনসার বাহিনীকে ইউনিফর্মধারী সশস্ত্র বাহিনীতে রূপান্তরিত করার দাবি করিয়াছিলাম, তাহাতো করা হয় নাই, বরঞ্চ পূর্ব পাকিস্তান সরকারের অধীনস্থ ই. পি. আর, বাহিনীকে এখন কেন্দ্রের অধীনে নেওয়া হইয়াছে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা ও নৌ-বাহিনীর হেড কোয়ার্টার স্থাপন করতঃ এ অঞ্চলকে আত্মরক্ষায় আত্মনির্ভর করার দাবি একুশ দফার দাবি। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার বার বছরেও আমাদের একটি দাবিও পূরণ করেন নাই। পূর্ব পাকিস্তান অধিকাংশ পাকিস্তানির বাসস্থান। এটাকে রক্ষা করা কেন্দ্রীয় সরকারেরই নৈতিক ও রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব। সেই দায়িত্ব পালনে আমাদের দাবি করিতে হইবে কেন? সরকার নিজে হইতে সেই দায়িত্ব পালন করেন না কেন? পশ্চিম পাকিস্তান আগে বাঁচাইয়া সময় ও সুযোগ থাকিলে পরে পূর্ব পাকিস্তান বাঁচান হইবে, এটা কি কেন্দ্রীয় সরকারের অভিমত? পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষা ব্যবস্থা পশ্চিম পাকিস্তানেরই রহিয়াছে। এমন সাংঘাতিক কথা শাসনকর্তারা বলেন কোনো মুখে? মাত্র সতের দিনের পাক-ভারত যুদ্ধই কি প্রমাণ করে নাই, আমরা কত নিরুপায়? শত্রুর দয়া ও মর্জির উপরতো আমরা বাঁচিয়া থাকিতে পারি না। কেন্দ্রীয় সরকারের দেশরক্ষা নীতি কার্যতঃ আমাদের তাই করিয়া রাখিয়াছে।
তবু আমরা পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির খাতিরে দেশরক্ষা ব্যবস্থা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে রাখিতে চাই। সঙ্গে সঙ্গে এও চাই যে, কেন্দ্রীয় সরকার পূর্ব পাকিস্তানকে এ ব্যাপারে আত্মনির্ভর করিবার জন্য এখানে উপযুক্ত পরিমাণ দেশরক্ষা বাহিনী গঠন করুন। অস্ত্র কারখানা স্থাপন করুন। নৌ-বাহিনীর দফতর এখানে নিয়া আসুন। এসব কাজ সরকার কবে করিবেন জানি না। কিন্তু ইতিমধ্যে আমরা অল্প খরচে ছোটখাট অস্ত্রশস্ত্র দিয়া আধা-সামরিক বাহিনী গঠন করিলেও পশ্চিমা ভাইদের এত আপত্তি কেন? পূর্ব পাকিস্তান রক্ষার উদ্দেশ্যে স্বতন্ত্র যুদ্ধ তহবিলে চাদা উঠিল তাহাও কেন্দ্রীয় রক্ষা তহবিলে নিয়ে যাওয়া হয় কেন? এসব প্রশ্নের উত্তর নাই। তবু কেন্দ্রীয় ব্যাপারে অঞ্চলের হস্তক্ষেপ করিবার অধিকার আমরাও চাই না। এ অবস্থায় পূর্ব পাকিস্তান যেমন করিয়া পারে গরিবী হালেই আত্মরক্ষার ব্যবস্থা করিবে, এমন দাবি কি অন্যায়? এ দাবি করিলেই
পৃষ্ঠা-১১১

সেটা হইবে দেশদ্রোহিতা? এ প্রসঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানি ভাই-বোনদের খেদমতে আমার কয়েকটি আরজ আছেঃ
এক
তাঁহারা মনে করিবেন না যে, আমি শুধু পূর্ব পাকিস্তানিদের অধিকার দাবি করিতেছি। আমার ৬ দফা কর্মসূচিতে পশ্চিম পাকিস্তানিদের দাবিও সমভাবেই রহিয়াছে। এ দাবি স্বীকৃত হইলে পশ্চিম পাকিস্তানিরাও সমভাবে উপকৃত হইবেন।
দুই
আমি যখন বলি, পূর্ব পাকিস্তানের সম্পদ পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার ও স্তুপীকৃত হইতেছে, তখন আমি আঞ্চলিক বৈষম্যের কথাই বলি, ব্যক্তিগত বৈষম্যের কথা বলি না। আমি জানি, এ বৈষম্য সৃষ্টির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিরা দায়ী নয়। আমি এত জানি যে, আমাদের মতো দারিদ্র পশ্চিম পাকিস্তানেও অনেক আছে। যতদিন ধনতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার অবসান না হইবে, ততদিন ব্যক্তিতে ব্যক্তিতে এত অসাম্য দূল হইবে না। কিন্তু তার আগে আঞ্চলিক শোষণও বন্ধ করিতে হইবে। এ আঞ্চলিক শোষণের জন্য দায়ি আমাদের ভৌগোলিক অবস্থান এবং সেই অবস্থানকে অগ্রাহ্য করিয়া যে অস্বাভাবিক ব্যবস্থা চালাইবার চেষ্টা চলিতেছে। ধরুন, যদি পাকিস্তানের রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া পূর্ব পাকিস্তানে হইত, পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর তিনটি দফতরই যদি পূর্ব পাকিস্তানে হইত, তবে কার কি অসুবিধা-সুবিধা হইত একটু বিচার করুন। পাকিস্তানের মোট রাজস্বের শতকরা ৬২/= টাকা খরচ হয় দেশরক্ষা বাহিনীতে এবং শতকরা বত্রিশ টাকা খরচ হয় কেন্দ্রীয় সরকারের পরিচালনায়। এ একুনে শতকরা চুরানব্বই টাকা পশ্চিম পাকিস্তানে না হইয়া তখন খরচ হইত পূর্ব পাকিস্তানে। আপনারা জানেন বিজ্ঞানের কথা ও সরকারি আয় জনগণের ব্যয় এবং সরকারি ব্যয় জনগণের আয়, এ নিয়মে বর্তমান ব্যবস্থায় সরকারের গোটা আয়ের অর্ধেক পূর্ব পাকিস্তানে ব্যয় হয় ঠিকই, কিন্তু সরকারি ব্যয়ের সবটুকু পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। রাজধানী পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত থাকায়, সরকারি, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ এবং বিদেশি মিশনসমূহ, তাহাদের সমস্ত ব্যয় পশ্চিম পাকিস্তানেই করিতে বাধ্য হইতেছেন। এ ব্যয়ের সাকুল্যই পশ্চিম পাকিস্তানের আয়। ফলে প্রতি বছর পশ্চিম পাকিস্তানের আয় ঐ অনুপাতে বাড়িতেছে এবং পূর্ব পাকিস্তান তার মোকাবিলায় ঐ পরিমাণ গরিব হইতেছে। যদি পশ্চিম পাকিস্তানের বদলে পূর্ব পাকিস্তানে আমাদের রাজধানী হইত, তবে এসব খরচ পূর্ব পাকিস্তানে হইত। আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা এ পরিমাণে ধনী
পৃষ্ঠা-১১২

হইতাম। আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানিরা ঐ পরিমাণে গরিব হইতেন। তখন আপনারা কি করিতেন? যেইসব দাবি করার জন্য আমাকে প্রাদেশিক সংকীর্ণতার মতামত দিতেছেন, সেইসব দাবি আপনারা নিজেরাই করিতেন। আমাদের চেয়ে জোরেই করিতেন। অনেক আগেই করিতেন। আমাদের মত আঠার বছর বসিয়া থাকিতেন না। তাহা করা আপনাদের অন্যায়ও হইত না।
তিন
আপনারা এসব দাবি করিলে আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা কি করিতাম জানে? আপনাদের সব দাবি মানিয়া লইতাম। আপনাদেরকে প্রাদেশিকতাবাদী বলিয়া গালি দিতাম না। কারণ আমরা জানি এবং বিশ্বাস করি যে, ঐ সব আপনাদের হক পাওনা। নিজের হক পাওনা দাবি করা অন্যায় নয়, কর্তব্য। এ বিশ্বাস আমাদের এতই আন্তরিক যে, সেই অবস্থা হইলে আপনাদের দাবি করিতে হইত না। আপনাদের দাবি করার আগেই আপনাদের হক আপনাদেরকে বুঝাইয়া দিতাম। আমরা নিজেদের হক দাবি করিতেছি বলিয়া আমাদের স্বার্থপর বলিতেছেন। কিন্তু আপনারা যে নিজেদের হকের সাথে সাথে আমাদের হকটাও খাইয়া ফেলিতেছেন, আপনাদের লোকে কি বলিবে? আমরা শুধু নিজদের হকটাই চাই। আপনাদের হকটা আত্মসাৎ করিতে চাই না। আমাদের দিবার আওকাত থাকিলে বরঞ্চ অপরকে কিছু দিয়াও দেই। দৃষ্টান্ত চান? শুনন তবে :
(১) প্রথম গণ-পরিষদে আমাদের মেম্বার ছিল ৪৪; আর আপনাদের ছিল ২৮। আমরা ইচ্ছা করিলে গণতান্ত্রিক শক্তিতে ভোটের জোরে রাজধানী ও দেশরক্ষার সদর দফতর পূর্ব পাকিস্তানে আনিতে পারিতাম তাহা করি নাই।
(২) পশ্চিম পাকিস্তানিদের সংখ্যাল্পতা দেখিয়া ভাইয়ের দরদ লইয়া আমাদের ৪৪টা আসালের মধ্যে ৬টা পূর্ব পাকিস্তানির ভোটে পশ্চিম পাকিস্তানি মেম্বার নির্বাচন করিয়াছিল।
(৩) ইচ্ছা করিলে ভটের জোরে শুধু বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করিতে পারিতাম। তাহা না করিয়া বাংলার সাথে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষার দাবি করিয়াছিলাম।
(৪) ইচ্ছা করিলে ভটের জোরে পূর্ব পাকিস্তানের সুবিধাজনক শাসনতন্ত্র রচনা করিতে পারিতাম।
(৫) আপনাদের মন হইতে মেজরিটি ভয় দূর করিয়া সে স্থলে ভ্রাতৃত্ব ও সমতাবোধ সৃষ্টির উভয় অঞ্চল সকল বিষয়ে সমতা বিধানের আশ্বাসে আমরা সংখ্যাগুরুত্ব ত্যাগ করিয়া সংখ্যাসাম্য গ্রহণ করিয়াছিলাম।
পৃষ্ঠা-১১৩

সুতরাং পশ্চিম পাকিস্তানের ভাই সাহেবান আপনারা দেখিতেছেন যেখানে আমাদের দান করিবার আওকাৎ ছিল আমরা দান করিয়াছি । আর কিছুই নাই দান করিবার! থাকিলে নিশ্চয়ই দিতাম। যদি পূর্ব পাকিস্তান রাজধানী হইত তবে আপনাদের দাবি করিবার আগেই আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে সত্য সত্যই দ্বিতীয় রাজধানী স্থাপন করিতাম। দ্বিতীয় রাজধানীর নামে ধোঁকা দিতাম না। সে অবস্থায় কেন্দ্রীয় সরকারের সকল প্রকার ব্যয় যাতে উভয় অঞ্চলে সমান হয় তার নিখুঁত ব্যবস্থা করিতাম। সকল ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানকে সামগ্রিকভাবে এবং প্রদেশসমূহকে পৃথকভাবে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতাম। আমরা দেখাতাম , পূর্ব পাকিস্তানিরা মেজরিটি বলিয়াই পাকিস্তান শুধু পাকিস্তানিদের নয়, ছোট-বড় নির্বিশেষে তা সকল পাকিস্তানির। পূর্ব পাকিস্তানে রাজধানী হইলে তাহার সুযোগ লইয়া আমরা পূর্ব পাকিস্তানিরা সব অধিকার ও চাকরি গ্রাস করিতাম না। পশ্চিম পাকিস্তানিদের শাসনভার পশ্চিম পাকিস্তানিদের হাতেই দিতাম। আপনাদের কটন ব্বোর্ডে আমরা চেয়ারম্যান হইতে যাইতাম না। আপনাদের প্রদেশে আমরা গভর্নর হইতেও চাইতাম না। আপনাদের পি, আই, ডি, সি, আপনাদের ওয়াপদা, চেয়ারম্যান আমরা দখল করিতাম না। আপনাদেরই করিতে দিতাম। সমস্ত অল-পাকিস্তানি প্রতিষ্ঠানকে পূর্ব পাকিস্তানে কেন্দ্রীভূত করিতাম না। ফলতঃ পূর্ব পাকিস্তানকে অর্থনীতিতে মোটা ও পশ্চিম পাকিস্তানকে সরু করিতাম না। দুই অঞ্চলের মধ্যে এ মারাত্মক ডিসপ্যারিটি সৃষ্টি হইতে দিতাম না।
এমনি উদারতার, এমন নিরপেক্ষতার, পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে এমন ইনসাফবোধই পাকিস্তানি দেশপ্রেমের বুনিয়াদ। এটা যার মধ্যে আছে, কেবল তিনিই দেশপ্রেমিক। যে নেতার মধ্যে এ প্রেম আছে, কেবল তিনিই পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলের উপর নেতৃত্বের যোগ্য। যে নেতা বিশ্বাস করেন দুটি অঞ্চল আসলে পাকিস্তান রাষ্ট্রের রাষ্ট্রীয় দেহের দুই চোখ, দুই কান, দুই নাসিকা, দুই পাটি দাঁত, দুই হাত, দুই পা, যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানকে শক্তিশালী করিতে হইলে এসব জোড়ার দুইটিকেই সমান সুস্থ ও শক্তিশালী করিতে হইবে। যে নেতা বিশ্বাস করেন পাকিস্তানে এক অংগ দুর্বল হইলে গোটা পাকিস্তানই দুর্বল হইয়া পড়ে; যে নেতা বিশ্বাস করেন ইচ্ছা করিয়া বা জানিয়া-শুনিয়া যাহারা পাকিস্তানের একাংশকে দুর্বল করিতে চায়, যাহারা পাকিস্তানের দুশমনদের শায়েস্তা করিতে প্রস্তুত আছেন কেবল তিনিই পাকিস্তানের জাতীয় নেতা হইবার অধিকারী। কেবল তাঁরই নেতৃত্বে পাকিস্তানের ঐক্য অটুট ও শক্তি অপরাজেয় হইবে। পাকিস্তানের মতো বিশাল ও অসাধারণ-রাষ্ট্রের নায়ক হইতে হইলে নায়কের চরিত্র ও হইতে হইবে বিশাল ও অসাধারণ। আশা করি আমার পশ্চিম পাকিস্তানি ভাইরা এ মাপকাঠিতে আমার ৬ দফা কর্মসূচি বিচার করিবেন । তা
পৃষ্ঠা-১১৪

যদি তাহারা করেন তবে দেখিতে পাইবেন, আমার এ ৬ দফা শুধু পূর্ব পাকিস্তানিদের বাঁচার দাবি নয় গোটা পাকিস্তানেই বাঁচার দাবি।
আমার প্রিয়-ভাই বোনেরা, আপনারা দেখিতেছেন যে, আমার ৬ দফা দাবিতে একটিও অন্যায়, অসংগত, পশ্চিম পাকিস্তান-বিরোধী বা পাকিস্তান ধ্বংসকারী প্রস্তাব করি নাই। বরঞ্চ আমি যুক্তিতর্ক সহকারে দেখালাম, আমার সুপারিশ গ্রহণ করিলে পাকিস্তান আরো অনেক বেশি শক্তিশালী হইবে। তথাপি কায়েমী স্বার্থে মুখপাত্ররা আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার এলজাম লাগাইতেছেন। এটা নতুনও নয়, বিস্ময়ের কথাও নয়। পূর্ব পাকিস্তানের মজলুম জনগণের পক্ষে কথা বলিতে গিয়া আমার বাপ-দাদার মতো মুরুব্বীরাই এদেশের কাছ গাল খাইয়াছেন, এদের হাতে লাঞ্ছনা ভোগ করিয়াছেন, আর আমি কোনো ছার? দেশবাসীর মনে আছে আমাদের নয়নমণি শেরে বাংলা ফজলুল হককে এঁরা দেশদ্রোহী বলিয়াছিলেন। দেশবাসী এও দেখিয়াছেন যে, পাকিস্তানের অন্যতম শ্ৰষ্টা, পাকিস্তানের সর্বজনমান্য জাতীয় নেতা শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে দেশদ্রোহিতার অভিযোগে কারাবরণ করিতে হইয়াছিল এদেরই হাতে। অতএব দেখা গেল, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবির কথা বলিতে গেলে দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল-জুলুম ভুগিবার তকদির আমার হইয়াছে। মুরুব্বীদের দোয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তা এবং দেশবাসীর সমর্থনে সে সব সহ্য করিবার মতো মনের বল আল্লাহ আমাদের দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালবাসাকে সফল করিয়া আমি এ কাজে যে-কোনো ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি। আমার দেশবাসীর কল্যাণের কাছে আমার মত নগণ্য ব্যক্তির জীবনের মূল্যই বা কতটুকু? মজলুম দেশবাসীর বাঁচার দাবির জন্য সংগ্রাম করার চেয়ে মহৎ কাজ আর কিছু আছে বলিয়া আমি মনে করি না। মরহুম জনাব শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ন্যায় যোগ্য নেতার কাছেই আমি এ জ্ঞান লাভ করিয়াছি। তাঁহার পায়ের তলে বসিয়াই এতকাল দেশবাসীর খেদমত করিবার চেষ্টা করিয়াছি। তিনিও আজ বাঁচিয়া নাই। আমিও আজ যৌবনের কোঠা বহু পিছনে ফেলিয়া প্রৌঢ়ত্বে পৌছিয়াছি।
আমার দেশের প্রিয় ভাই-বোনেরা, আল্লাহর দরগায় শুধু এ দোয়া করিবেন। বাকি জীবনটুকু আমি যেন আপনাদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক মুক্তির সাধনায় নিয়োজিত করিতে পারি।”
ক্ষমতাসীন সরকার শেখ মুজিবের ছয় দফা ঘোষণাকে দেশদ্রোহিতার নামান্তর হিসাবে চিহ্নিত করে এবং এ নিয়ে শাসকগোষ্ঠিক মধ্যে প্রবল প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। শেখ মুজিব ১৭ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৬) আওয়ামী লীগের ৫১,
পৃষ্ঠা-১১৫

পুরানা পল্টনস্থ অফিসে অনুষ্ঠিত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ছয় দফার ব্যাখ্যা করেন। তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন যে দেশের বৃহত্তর কল্যাণের কথা ভেবেই দফা পেশ করা হয়েছে। ছয় দফার সাথে পাকিস্তানের শতকরা ৫৬ ভাগ মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন জড়িত। শেখ মুজিব বলেন, ১৯৪০ সালের লাহার প্রস্তাবে পাকিস্তানের ভিত্তি। ১৯৪৬ সালে দিল্লিতে মুসলিম লীগের উদ্যোগে কনভেনশন হয় তার পূর্বেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং সেই নির্বাচনে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক পাকিস্তানের পক্ষে রায় দান করে। সুতরাং মুসলিম লীগ কাউন্সিলের গৃহীত সিদ্ধান্ত এবং জনগণ কর্তৃক নির্বাচনের মাধ্যমে স্বীকৃত সত্যকে বানচাল করার কোনো এখতিয়ার দিল্লি কনভেনশনের ছিল না। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, লাহোর সম্মেলনের সাথে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সম্পর্ক ছিন্ন করার গণতান্ত্রিক অধিকার প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের আছে। তিনি দাবি করেন যে, জনগণ ছয় দফার পক্ষে আছে। তিনি ছয় দফা প্রশ্নে গণভোটের দাবি করেন। যারা ছয় দফার বিরুদ্ধাচরণ করছেন শেখ মুজিব তাদের উদ্দেশ্যে বলেন যে, ১৯৫৪ সালের ২১ দফার মধ্যে লাহোর প্রস্তাবভিত্তিক প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অন্যতম প্রধান দাবি ছিল। শেখ মুজিব দলমত নির্বিশেষে ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রশ্ন বিবেচনা করার জন্য সকলকে আহ্বান জানান। বিগত যুদ্ধের সময় পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত, নিতান্তই দয়া করে ভারতীয় বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের উপরে সর্বাত্মক হামলা করেনি। যদি ভারত পূর্ব পাকিস্তান আক্রমণ করতো তাহলে এ চরম বিপাকের সময় কেন্দ্রীর সরকার এবং পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শক্তি কীভাবে পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা করতো। তিনি শক্তিশালী কেন্দ্রের বিশ্বাসীদের এ প্রশ্ন করেন।
শেখ মুজিব জনগণের কাছে ছয় দফা ব্যাখ্যা করার জন্য সারাদেশে জনসভা শুরু করেন। ২৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ চট্টগ্রামে লালদিঘির ময়দানে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় শেখ মুজিব ছয় দফা ব্যাখ্যা করেন এবং যেকোনো ত্যাগ স্বীকারে জনগণকে আহ্বান জানান। ২৭ ফেব্রুয়ারি ননায়াখালীর মাইজদী কোর্ট জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলনে ছয় দফার পক্ষে বক্তব্য রাখে। শেখ মুজিব প্রত্যেক জেলা শহরে জনসভা শুরু করেন। ১৬ মার্চ (১৯৬৬) তারিখে আইয়ুব খান রাজশাহীতে প্রকাশ্য জনসভায় ছয় দফার সমালোচনা করেন বলেন : এটা বৃহত্তর স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি পরিকল্পনা। এ জঘন্য স্বপ্ন বাস্তবায়িত হলে পূর্ব পাকিস্তানবাসী গোলামে পরিণত হবে এবং তিনি তা কখনই হতে দেবেন না। ১৯ মার্চ (১৯৬৬) অনুষ্ঠিত মুসলিম লীগের কনভেনশনের সমাপ্তি অধিবেশনে আইয়ুব খান অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করে গৃহ যুদ্ধের হুমকি
পৃষ্ঠা-১১৬

দেন। সেদিনই শেখ মুজিব পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশনে পল্টন ময়দানে এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতাকালে বলেন, কোনো হুমকি বাংলার মানষকে ছয় দফার দাবি থেকে নিবৃত্ত করতে পারবে না। ১৮, ১৯ ও ২০ মার্চ (১৯৬৬) মতিঝিলের ইডেন হোটেলে আওয়ামী লীগের কাউন্সিল অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। শেখ মুজিব সর্বসম্মতিক্রমে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। তাজউদ্দিন আহমেদকে সাধারণ সম্পাদক নির্বচিত করা হয়। সৈয়দ নজরুল ইসলাম, হাফেজ হাবিবুর রহমান, মুজিবুর রহমানকে সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মিজানুর রহমান চৌধুরী, শ্রম সম্পাদক পদে জহুর আহমেদ চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক পদে আবদুল মোমেন, মহিলা সম্পাদিকা পদে আমিনা বেগম, দপ্তর সম্পাদক পদে মোহাম্মদ উল্লাহ, সমাজ কল্যাণ সম্পাদক পদে কে, এম, ওবায়দুর রহমান ও কোষাধ্যক্ষ পদে নূরুল ইসলাম চৌধুরীকে নির্বাচিত করা হয়।
দেশের বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবী ও রাজনীতিকেরা আইয়ুব খানের অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগের জন্য নিন্দা জানান। আইয়ুবের পররাষ্ট্রমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো ছয় দফা প্রশ্নে প্রকাশ্য বাক-যুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার জন্য শেখ মুজিবকে চ্যালেঞ্জ করেন। শেখ মুজিব এ চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে পল্টন ময়দানে অথবা ভুট্টোর পছন্দ মতো যে কোনো স্থানে বিতর্ক অনুষ্ঠানে অংশ গ্রহণের আহ্বান জানান। শেখ মুজিব ১৭ এপ্রিল (১৯৬৬) এ বিতর্ক অনুষ্ঠানের দিন ধার্য করেন ভুট্টোকে আহ্বান জানান। তাজউদ্দিন আহমেদ ছয় দফা প্রশ্নে গণভোটের আহ্বান জানান। ছয় দফা প্রশ্নে জনগণের বিপুল সমর্থন দেখে ভুট্টো শেষ পর্যন্ত এ বাকযুদ্ধে অবতীর্ণ হলেন না। ভুট্টো জানান যে গণচীনের চেয়ারম্যান লিও শাও চির সংবর্ধনার জন্য ব্যস্ত থাকার কারণে তিনি ঐ সভায় উপস্থিত থাকতে পারবেন । এসময়ে মওলানা ভাসানী ছয় দফা কর্মসূচি সমর্থন করা থেকে বিরত থাকেন। মওলানা ভাসানী বলেন ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাব অনুযায়ী প্রদেশসমূহের স্বায়ত্তশাসনের দাবি তিনি সমর্থন করেন। তবে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের প্রতিফলন থাকতে হবে।
ক্রমান্বয়ে ছয় দফা আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। আইয়ুব খান বেসামাল হয়ে দমন নীতি প্রয়োগ শুরু করেন। প্রত্যেক জেলায় অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিবের আপত্তিকর বক্তব্যের অজুহাতে মামলা দায়ের করা হতে থাকে। ১৭ এপ্রিল (১৯৬৬) রাত ৪ টায় খুলনার একটা জনসভায় ভাষণ দিয়ে ঢাকা ফেরার পথে যশোরে শেখ মুজিবকে ঢাকার রমনা থানা থেকে দেওয়া ওয়ারেন্ট অনুযায়ী প্রতিরক্ষা আইনের ৪৭ (৫) ধারা অনুযায়ী গ্রেফতার করা হয়। যশোরে সদর মহকুমা হাকিম জামিনে মুক্তি দিলে স্বদলবলে তিনি ঢাকায় ফিরেন। যশোরের
পৃষ্ঠা-১১৭

মহকুমা হাকিমের নির্দেশ অনুযায়ী শেখ মুজিব ২১ এপ্রিল (১৯৬৬) ঢাকার দক্ষিন মহকুমার আদালতে উপস্থিত হন। মহকুমা হাকিম তার জামিনের আবেদন নাকচ করে দেন। পরে ঢাকায় সেশন জজ জামিনের আবেদন মঞ্জুর করেন । ঐদিনই রাত ৯টায় সিলেট এস ডি ও আদালতে এক গ্রেফতারী পরওয়ানা বলে পুলিশ তার ধানমন্ডিস্থ বাসভবন থেকে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকার মহকুমা হাকিম দক্ষিণ-এর বাসভবনে হাজির করেন। মহকুমা হাকিমের নির্দেশ অনুযায়ী পুলিশ প্রহরায় শেখ মুজিবকে সিলেটে পাঠানো হয়। পরদিন সিলেট মহকুমা হাকিমের এজলাসে শেখ মুজিব জামিনের আবেদন করলে মহকুমা হাকিম তা নাকচ করে শেখ মুজিবকে জেলহাজতে পাঠানোর নির্দেশ দেন। পরদিন ২৩ (১৯৬৬) সিলেটের দায়রা জজ জামিন মঞ্জুর করেন। কিন্তু সে দিনেই ময়মনসিংহ থেকে পাঠানো এক গ্রেফতারী পরওয়ানাবলে পুলিশ সিলেট জেলা থেকে গ্রেফতার করে সরাসরি রেলস্টেশনে যায় এবং আখাউড়াগামী ট্রেনযোগে ময়মনসিংহ মহকুমা হাকিমের বাসভবনে হাজির করা হয়। মহকুমা হাকিম তাঁর জামিনের আবেদন বাতিল করে দেন। ২৫ এপ্রিল (১৯৬৬) অর্থাৎ পরদিন ময়মনসিংহের জেলা ও দায়রা জজ গোলাম মওলা জামিনের আবেদন মঞ্জুর করলে শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করেন। ময়মনসিংহের জনগণ শেখ মুজিবকে প্রাণঢালা অভ্যর্থনা জানান। ১৯৬৬ সালের ৮ মে নারায়ণগঞ্জের চাষারায় মে দিবস উপলক্ষে আয়োজিত এক বিশাল সমাবেশে শেখ মুজিব ভাষণ দেন। রাত ১টায় যখন তিনি ৩২ নম্বর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে ফেরেন তখন তাঁকে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবের সঙ্গে খন্দকার মোশতাক আহমেদ, নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জহুর আহমেদ চৌধুরী, মুজিবর রহমান (রাজশাহী), ও এম. এ. আজিজ (চট্টগ্রাম) গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিবর ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের গ্রেফতারে রাজনৈতিক অঙ্গনে চরম ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। নূরুল আমিন, শাহ আজিজ, ফরিদ আহমেদ এ গ্রেফতারের প্রতিবাদ করে বিবৃতি দেন। আওয়ামী লীগ ১৩ মে প্রতিবাদ দিবস পালন করে। তাজউদ্দিন আহমেদ গ্রেফতার হলে মিজানুর রহমান চৌধুরী সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব সাময়িকভাবে গ্রহণ করেন। ২০ মে আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ বৈঠকে ৭ জুন সারাদেশে হরতাল পালনের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। ২ জুন তারিখে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ আবদুল মোমেন, ওবায়দুর রহমান, হাফেজ মোহাম্মদ মুসা, শাহাবুদ্দিন চৌধুরী, হারুন অর রশিদ, রাশেদ মোশারফ ও পত্রিকা হকার জাকির হোসেন ও মোস্তফা সরওয়ারকে গ্রেফতার করা হয়। এ রাজনৈতিক পটভূমিতে সারা পূর্ব বাংলার অসন্তোষ ধূমায়িত হতে থাকে। জনগণের মধ্যে এ বিশ্বাস ঘনীভূত হয় যে, পূর্ব বাংলার ন্যায়সংগত দাবি স্তব্ধ করে দেওয়ার জন্য আইয়ুব-মোনেম চক্র অত্যাচারের স্টীম রুলার শুরু করেছে।
পৃষ্ঠা-১১৮

ইত্তেফাক সম্পদক তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়াকে ১৬ জুন (১৯৬৬) গ্রেফতার করা হয় এবং ৫২(২) ধারা অনুযায়ী ইত্তেফাক প্রকাশনা নিষিদ্ধ করা হয় এবং নিউনেশন প্রিন্টিং প্রেস বাজেয়াপ্ত করা হয়।
১৮ জন (১৯৬৬) জুলফিকার আলী ভুট্টোকে মন্ত্রিত্ব থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়। ১২ জুন তারিখে মিজানুর রহমান চৌধুরীকে চাঁদপুর থেকে গ্রেফতার করা হয়। এর আগে শেখ ফজলুল হক মনি, শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, মোল্লা জালাল উদ্দিন, ক্যাপটেন মুনসুর আলী ও শেখ সহিদুল ইসলামকে গ্রেফতার করা হয়।
এ সময় ভাসানীর ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি দ্বিধা বিভক্ত হয়। একদল চীনপন্থী।’ অপরদল মস্কোপন্থী। মস্কোপন্থীদের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ওয়ালি খান। ৯ আগস্ট (১৯৬৬) তারিখে শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দিন, খন্দকার মোশতাক আহমদ ও তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার আটক আদেশ চ্যালেঞ্জ করে রীট পিটিশন করা হয়। হাইকোর্ট তাদের আটক আদেশ আইনসঙ্গত বলে রায় দেন এবং আবেদন নাকচ করে দেন। ঐদিনই বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকীর নেতৃত্বে গঠিত এক বিশেষ বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে রায় প্রদান করেন যে ইত্তেফাকের নিউন্যাশন প্রিন্টি প্রেস বাজেয়াপ্ত করা অবৈধ। তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়ার ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের ভিতরে ১০ অক্টোবর বিচার শুরু হয়। ২৪ অক্টোবর (১৯৬৬) শেখ মুজিবকে নিরাপত্তার জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপের অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।
আইয়ুব খানও এ সময়ে পূর্ব বাংলা সফরে আসেন। ১৭ ডিসেম্বর (১৯৬৬) ঠাকুরগাঁও-এ এক জনসভায় বক্তৃতাকালে জনগণের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, সরকারের বিরুদ্ধে যে কোনো প্রচেষ্টা তিনি প্রতিহত করবেন। শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে দায়েরকৃত মামলা একের পর এক চলতে থাকে। সারাদেশের বিভিন্ন স্থানে আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়ার অভিযোগে একাধিক মামলা চালু হয়। ১৯৬৭ সালে ২৮ এপ্রিল এক মামলার রায়ে শেখ মুজিবকে একমাস বিনাশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।
ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট ভেঙে দেওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ২৮ শে ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান ডেমোক্রেটিক মুভমেন্ট সংক্ষেপে পি, ডি, এম, নামে ৮-দফার ভিত্তিতে একটি মোর্চা গঠন করা হয়। ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবন, প্রাপ্ত বয়স্ক ভোটারের ভোটাধিকারে পার্লামেন্টের শাসন ব্যবস্থা কায়েম, দেশ রক্ষা ও পররাষ্ট্র, মুদ্রা, ফেডারেল ফাইনেন্স, সেন্ট্রাল ব্যাংক, বৈদেশিক বাণিজ্য ও আন্তঃআঞ্চলিক যোগাযোগ ইত্যাদি বিষয় ছাড়া সকল বিষয় আঞ্চলিক সরকারের হাতে ছেড়ে দেওয়ার দেশ রক্ষার ব্যাপারে পাকিস্তানের উভয় অঞ্চলকে সমানভাবে শক্তিশালী করা এবং নৌবাহিনীর সদর দপ্তর পূর্ব বাংলায় স্থানান্তরিত
পৃষ্ঠা-১১৯

করা ৮-দফায় মধ্যে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। শেখ মুজিবকে ১৯৬৬ সালের ৮ মে গ্রেফতার হওয়ায় পর থেকে পরবর্তী ১৭ মাস ঢাকার সেন্ট্রাল জেলে নিঃসঙ্গভাবে অন্তরীণ রাখা হয়। অবশেষে একজন মানুষকে সঙ্গী হিসাবে সেলে থাকার অনুমতি প্রাপ্তির পর শেখ মুজিবের পরম বন্ধু আবদুল মোমেন ১৯৬৭ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ১৯৬৮ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত অথাৎ আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসাবে শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে ঢাকা সেনানিবাসে নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আবদুল মোমেন শেখ মুজিবসহ এক সেলে থাকতেন। এ সময় শেখ মুজিব জেলে বসে বই পড়তেন ও দেশাত্মবোধক গান শুনতেন, “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ ‘ও আমার দেশের মাটি তোমার পরে ঠেকাই মাথা,’ ‘এমন দেশটি কোথাও তুমি খুঁজে পাবে নাকো’-এসব ছিল শেখ মুজিবের প্রিয় গান। ১৯৬৮ সালের ১৭ জানুয়ারি রাত একটায় শেখ মজিবকে বেকসুর মুক্তি দেওয়া হয়। জেল গেট থেকে বেরেনোর সঙ্গে সঙ্গে শেখ মুজিবকে একটা মিলিটারী গাড়িতে উঠান হয় এবং ঢাকা সেনানিবাসে নিয়ে যাওয়া হয়।
১৯৬৮ সালের ৬ জানুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামী হিসেবে ৩ জন সি এস পি অফিসারসহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করা হয়। সরকারি প্রেসানোটে বলা হয় যে, জাতীয় স্বার্থ বিরোধী এক ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে এসব ব্যক্তিদের গ্রেফতার করা হয়েছে। গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিরা ঢাকাস্থ ভারতীয় হাই কমিশনারদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে আসছিল এবং পূর্ব পাকিস্তান বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যে সংঘবদ্ধ প্রচেষ্টা চালাচ্ছিল। প্রেসনোটে আরও বলা হয়, আটক ব্যক্তিদের কয়েকজন ভারতীয় এলাকা সফর করে এবং লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিশ্র, মেজর মেনন প্রমুখ ভারতীয় সামরিক অফিসারের সাথে তাদের পরিকল্পনা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা করেন। তাদের উদ্দেশ্য ছিল নিজেদের পরিকল্পনা সফল করে তোলার জন্য প্রচুর অর্থ ও অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ করা। এ মর্মে সাক্ষ্য প্রমাণ পাওয়া গেছে যে, মানিক চৌধুরীসহ আটক ব্যক্তিদের কয়েকজনের মাধ্যমে তারা ইতিমধ্যেই উল্লেখ্য পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ করেছে। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় তদন্ত অনুষ্ঠান সমাপ্ত প্রায়। শীঘ্রই মামলার শুনানী হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। সরকারি প্রেসনোটে দাবি করা হয় যে তদন্তকালে আটক ব্যক্তিদের অধিকাংশই স্ব-স্ব ভূমিকা সম্পর্কে স্বীকারোক্তি করেছেন। আগরতলায় আলোচনার ফলশ্রুতি হিসাবে অস্ত্রশস্ত্রের একটি তালিকাসহ বহু সংখ্যক দলিলপত্র আটক করা হয়েছে। এসব লোক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির যে প্রচেষ্টা চালিয়ে আসছিলেন তা নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। এর কয়েকদিন পর ১৮ জানুয়ারি অপর একটি প্রেস নোটে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র পরিকল্পনা ও পরিচালনার অভিযোগ আনা হয়। ইতিহাসে এ মামলা আগরতলায় ষড়যন্ত্র মামলা হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। আগরতলায় ষড়যন্ত্র মামলায় যাদেরকে
পৃষ্ঠা-১২০

গ্রেফতারকরা হয় তারা হলেন : (১) শেখ মুজিবুর রহমান, (২) লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, (৩) স্টুয়ার্ড মুজিব, (৪) প্রাক্তন এল এস সুলতান উদ্দিন আহমদ, (৫) এল. এস নুরু মোহাম্মদ, (৬) আহমেদ ফজলুর রহমান সিএসপি, (৭) ফ্লাইট সার্জেন্ট মফিজুল্লাহ্ (৮) প্রাক্তন কর্পোরাল এ বি সামাদ, (৯) প্রাক্তন সাবিলদার দলিল উদ্দিন, (১০) রুহুল কুদ্দুস সি, এস, পি, (১১) ফ্লাইট সার্জেন্ট ফজলুল হক, (১২) ভূপতি ভূষণ চৌধুরী (মানিক), (১৩) বিধান কৃষ্ণ সেন, (১৪) সুবেদার আবদুর রাজ্জাক, (১৫) মজিবুর রহমান (পিআরটিসি ক্লার্ক), (১৬) ফ্লাইট সার্জেন্ট আবদুর রাজ্জাক, (১৭) সার্জেন্ট জহুরুল হক, (১৮) মোহাম্মদ খুরশিদ, (১৯) কে. এম শামসুর রহমান সি, এস, পি, (২০) রেসালদার শামসুল হক, (২১) হাবিলদার আজিজুর হক, (২২) এস এস সি মাহফুজুল বারী, (২৩) সার্জেন্ট শামসুল হক, (২৪) মেজর শামসুল আলম, (২৫) ক্যাপ্টেন মোত্তালিব, (২৬) ক্যাপ্টেন শওকত আলী, (২৭) ক্যাপ্টেন নজমুল হুদা, (২৮) ক্যাপ্টেন নুরুজ্জামান, (২৯) সার্জেন্ট আবদুল জলিল, (৩০) মাহবুব উদ্দিন চৌধুরী, (৩১) লে, এম, এম, এম. রহমান, (৩২) প্রাক্তন সুবেদার তাজুল ইসলাম, (৩৩) মোহাম্মদ আলী রেজা, (৩৪) ক্যাপ্টেন খুরশিদ, (৩৫) লে, আবদুল রউফ।
আগরতলায় ষড়যন্ত্র মামলায় আরও ১১ জনকে অভিযুক্ত করা হয় যারা পরে রাজসাক্ষীতে রাজি হওয়ায় ক্ষমা প্রাপ্ত হন। এর হলেন : (১) লে. মোজাম্মেল হোসেন, (২) প্রাক্তন কর্পোরাল আমির হোসেন মিয়া, (৩) সার্জেন্ট সামসুদ্দিন আহমেদ, (৪) ডা. সাইদুর রহমান, (৫) মির্জা রমিজ, (৬) ক্যাপ্টেন আবদুল আলীম ভূঁইয়া, (৭) কর্পোরাল কামাল উদ্দিন (৮) কর্পোরাল সিরাজুল ইসলাম, (৯) মোঃ গোলাম আহমদ, (১০) মোহাম্মদ ইউসুফ, (১১) সার্জেন্ট আবদুল হালিম।
১৯৬৮ সালের ১৯ জুন বহু দেশ-বিদেশি সাংবাদিকের উপস্থিতিতে ঢাকা সেনানিবাসে ভারতীয় অস্ত্র ও অর্থ সাহায্যে পূর্ব পাকিস্তানকে বিচ্ছিন্ন করার অভিযোগে আনীত রাষ্ট্র বনাম শেখ মুজিবুর রহমান ও অন্যান্য মামলার শুনানী শুরু হয়। সুপ্রীম কোর্টের সাবেক বিচারপতি এস, এ. রহমানের নেতৃত্বে বিচারপতি মজিবর রহমান খান ও বিচারপতি মকসুমুল হাকিম সমন্বয়ে গঠিত বিশেষ ট্রাইবুনালে বিচার শুরু হয়। পাকিস্তানের সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মঞ্জর কাদিরসহ বেশ কিছু সংখ্যক আইনজীবী সরকার পক্ষে মামলা পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অপরদিকে ড, আলীম আল রাজি, আবদুস সালাম খান, আতাউর রহমান খান, জহিরউদ্দিন, জুলমত আলী, মোল্লা জালালউদ্দিন ও ব্রিটিশ আইজীবী টমাস উইলিয়াম আসামীদের পক্ষ অবলম্বন করেন। এ মামলায় মোট ২৫০ জন সাক্ষীর সাক্ষ্য গ্রহণ করা হয়।
পৃষ্ঠা-১২১

আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা শুরু হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সারা দেশে বিক্ষোভের দাবানল জলে উঠে । জনগন এ মামলার সত্যতা বিশ্বাস করে না। জনগণের এ মর্মে দঢ় বিশ্বাস ঘনীভূত হয় যে বাংলার জনগণের ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের লক্ষ্যে সোচ্চার, আপোসহীন সংগ্রামী জননেতা শেখ মুজিবকে ফাঁসী কাষ্ঠে ঝুলিয়ে হত্যা করার উদ্দেশ্যে আইয়ুব-মোনেম খান এ মিথ্যা মামলার করেছেন। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ধারা বিবরণী খবরের কাগজে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হতে লাগল। যতই দিন গেলো জনগণ ততই বিক্ষুব্ধ হতে লাগল। ছাত্র, জনতা, রাজনীতিক, পেশাজীবী, কৃষক-শ্রমিক সর্বস্ততের জনগণ শেখ মুজিব ও অন্যান্যদের মুক্তির দাবিতে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে লাগল। সারাদেশে এক অভূতপূর্ব গণআন্দোলন প্রত্যক্ষ করা গেল। শেখ মুজিবের মুক্তি চাই , মিথ্যা মামলা তুলে নাও। আইয়ুব শাহী ধ্বংস হউক ইত্যাদি শ্লোগানে সারা দেশের আকাশ বাতাস মুখরিত হতে লাগল।
১৯৬৮ সালের ২৭ অক্টোবর আইয়ুব খান তার উন্নয়নের এক দশক বা ডিকেড অব রিফর্মস পালন করেন। আইয়ুব খানের সেবাদাস মোনেম খান মহাআড়ম্বরে উন্নয়নের দশক উপলক্ষে বিভিন্ন অনুষ্ঠান, সভা, সমিতির আয়োজন করেন। অপরদিকের পূর্ব বাংলার পত্রপত্রিকা পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে গত ১০ বছরের সৃষ্ট আঞ্চলিক বৈষম্যের খতিয়ান বের করে।
নিচের ছক থেকে আঞ্চলিক বৈষম্যের চিত্র সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে : কেন্দ্রীয় সরকারের বিভিন্ন বিভাগের চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে বৈষম্য পদ
পূর্ব পাকিস্তানি পশ্চিম পাকিস্তানি
পশ্চিম পাকিস্তানি প্রেসিডেন্টের সেক্রেটারিয়েট ১৯ ৮১
দেশরক্ষা ৮.১ ৯১.৯
স্বরাষ্ট্র ২২.৭ ৭৭.৩
শিল্প ২৫.৭ ৭৪.৩
শিক্ষা ২৭ ৭২.৭
তথ্য ২০.১ ৭৯.৯
স্বাস্থ্য ১৯ ৮১
কৃষি ২১ ৭৯
আইন ৩৫ ৬৫

পৃষ্ঠা-১২২

বৈষম্যের কয়েকটি দিকঃ
বেসরকারি খাতে পুঁজি বিনিয়োগ তফসীল
পূর্ব পাকিস্তানের পুঁজি বিনিয়োগ শতকরা ২২ ভাগ
পশ্চিম পাকিস্তানে শতকরা ৭৮ ভাগ
পূর্ব পাকিস্তান ১৯৬৫-৬৬ ও ১৯৬৬-৬৭ শতকরা ৩৩ ভাগ

বিদেশি ঋণ ১৯৬৫-৬৬ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২২.২০ ভাগ

পশ্চিম পাকিস্তানে উক্ত সময়ে শতকরা ৭৭.৮০ ভাগ
শিল্প ব্যাংকের ঋণ ১৯৬৫-৬৬ সালে পূর্ব পাকিস্তানে শতকরা ২৪ ভাগ

উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রে ব্যয় বরাদ্দ (শতকরা হারে) :
বিষয় পঃ পাক পৃঃ পাক
বিভিন্ন উন্নয়নের জন্য বৈদেশিক মুদ্রা ৮০% ২০%
বৈদেশিক সাহায্য (মার্কিন সাহায্য ছাড়া) ৯৬% ৪%
মার্কিন সাহায্য ৬৬% ৩৪%
পাকিস্তান শিল্পোন্নয়ন কর্পোরেশন ৫৮% ৪২%
পাকিস্তান শিল্পঋণ ও বিনিয়োগ করপয়রেশন ৮০% ২০%
শিল্পোন্নয়ন ব্যাংক ৭৬% ২৪%
গৃহ নির্মাণ ৮৮% ১২%
মোট গড়পড়তা ব্যয় ৭৭% ২৩%

(why bangladesh – By A Group of Scholars in Viena Bangladesh Documents P. 16)
৩ নভেম্বর ১৯৬৮। পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসালের দাবি করেন। তিনি দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন স্বায়ত্তশাসনসহ রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও জরুরি আইন প্রত্যাহার করতে হবে। ছাত্র, জনতা, বুদ্ধিজীবী সর্বস্তরের জনগণ ১৮ নভেম্বর রাজপথে মিছিল বের করেন। এ সময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন শুরু হয়। ভুট্টো ‘পিপলস পার্টি’ নামে একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেন। আইয়ুব খানের নির্দেশে ভুট্টো ও তাঁর সহকর্মীদের গ্রেফতার করা হলো।
২৯ নভেম্বর ১৯৬৮। পশ্চিম পাকিস্তানে ছাত্র-জনতার উপরে গুলি বর্ষণের প্রতিবাদে ছাত্ররা বিক্ষোভ মিছিল বের করে। ভাসানী ন্যাপের উদ্যোগে পল্টন ময়দানে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা ভাসানী এ জনসভায় বক্তৃতাকালে
পৃষ্ঠা-১২৩

দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন দাবি মানতে হবে। যদিও দাবি উপেক্ষা করা হয় তাহলে পূর্ব পাকিস্তানবাসি বিচ্ছিনত বাংলা গঠন করবে। এ সভায় অটো-রিক্সা চালকের উপর পলিশী প্রতিবাদ করা হয়। অটোরিক্সা চালকেরা মওলানা ভাসানীকে পরদিন পালনের অনুরোধ করলে মওলানা ভাসানী সম্মত হন।
মওলানা ভাসানীর আহ্বানে ৭ ডিসেম্বর পূর্ণ হরতাল পালিত হয়। এ হরতাল পালনকালে সরকারের নির্দেশে পুলিশ বাহিনী লাঠিচার্জ ও কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং ৪০ জনকে গ্রেফতার করে। আবদুল মজিদ নামক এক ব্যক্তি গুলিবর্ষণের ফলে নিহত হয়। গুলিস্তানের কাছে একজন বালক ঘটনাস্থলেই মারা যায়। পুলিশের গুলিবর্ষণের কমপক্ষে ৩ জন নিহত, ৩০ আহত ও ৩০০ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করা হয়। সাংবাদিকদের ওপরও পুলিশের গুলিবর্ষণ চলে। এর প্রতিবাদে ৯ ডিসেম্বর সারা দেশে সাংবাদিকগণ ধর্মঘট পালন করেন। এ দিন ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ সহ প্রায় অর্ধ শতাধিক আইনজীবী ১৩ ডিসেম্বর আওয়ামী লীগ আহুত দমননীতি প্রতিরোধ দিবস পালনের সমর্থন করেন। সরকার সারা প্রদেশে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল সহকারে ঢাকা শহর প্রদক্ষিণ করে। পুলিশের গুলিবর্ষণে ১২ জন আহত এবং সহস্রাধিক ব্যক্তি গ্রেফতার বরণ করেন।
জনগণের মৌলিক অধিকার আদায়ের লক্ষ্যে ৮ জানুয়ারি ১৯৬৯ গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। ৮টি বিরোধী দলের ঐক্যফ্রন্ট ৮ দফা কর্মসূচির ভিত্তিতে একতাবদ্ধ হয়। শেখ মুজিবের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে এবং সাংবাদিক সম্মেলনে স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশের জনগণের মৌলিক অধিকার। আদায়ের দাবি ঘোষণা করা হয়। ফেডারেল পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকার, প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে প্রত্যক্ষ নির্বাচন, অবিলম্বে জরুরি আইন প্রত্যাহার, নাগরিক স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার ও সকল কালাকানুন বাতিল, শেখ মুজিব, ওয়ালি খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তিদান, আদালত ও ট্রাইবুনালে বিচারাধীন সকল মামলা প্রত্যাহার, ১৪৪ ধারা প্রত্যাহার ও সংবাদপত্রের উপরে বিধিনিষেধ প্রত্যাহার ঘোষণাপত্রে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
১৭ জানুয়ারি ১৯৬৯ সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদের আহবানের দাবি দিবস পালিত হয়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা গগণবিদারী শ্লোগান দিতে দিতে রাজপথে নেমে পড়ে। পুলিশ লাঠিচার্জ কাঁদুনে গ্যাস নিক্ষেপ করে ও ২৫ জন ছাত্রকে গ্রেফতার করে। এ নির্যাতনের প্রতিবাদে সর্বদলীয় ছাত্রসমাজ পরদিন দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘটের আহবান করে।
পৃষ্ঠা-১২৪

দেশের এ ক্রান্তি লগ্নে পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ, পূর্ব পাকিস্তানের ছাত্র ইউনিয়ন (মস্কো ও পিকিংপন্থী) এবং জাতীয় ছাত্র ফেডারেশনের একটি অংশের সমন্বয়ে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হয়। নির্যাতিত জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ কর্তৃক ১১ দফা কর্মসূচি প্রণীত হয়।
ঐতিহাসিক ১১ দফা দাবি ছিল নিম্নরূপঃ
১। (ক) আত্মনির্ভর কলেজগুলোকে প্রাদেশিকীকরণের নীতি ছাড়তে হবে। জগন্নাথ এবং অন্যান্য যেসব কলেজকে এ আইনের আওতায় আনা হয়েছিল, তাদের সাবেক অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে হবে।
(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসার যদি সত্যিই সরকারের কাম্য হয়, তবে গ্রামাঞ্চলে আরও অনেক স্কুল-কলেজ খুলতে হবে। যেসব স্কুলকলেজ ইতিমধ্যে খুলেছে তাদের অনুমোদন দিতে হবে। কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব আমাদের দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতেই খুব বেশি, কাজেই সরকারের উচিত আরো বেশি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক, টেকনিক্যাল ও কমার্শিয়াল স্কুল খোলা।
(গ) কলেজের সংখ্যা না বাড়ার দরুন ছাত্র-ছাত্রীদের বিশেষ ক্ষতি হচ্ছে।কাজেই প্রতিটি কলেজেই নৈশ বিভাগ খোলা উচিত।
(ঘ) ছাত্র-ছাত্রীদের স্কুল-কলেজের আইনে অন্তত শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কমাতে হবে। স্কলারশীপ এবং স্টাইপেন্ডের পরিমাণ বাড়াতে হবে। আন্দোলন করার অপরাধে ছাত্র-ছাত্রীদের এসব সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা চলবে না।
(ঙ) হোস্টেলে খাওয়া খরচের শতকরা পঞ্চাশ ভাগ সরকারকে দিতে হবে সাবসিডি হিসেবে।
(চ)হল, হোস্টেল এবং অন্যান্য ছাত্রাবাসের বিভিন্ন অসুবিধা দূর করতে হবে।
(ছ)মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে বিদ্যা দানের ব্যবস্থা করতে হবে।
(জ) অধিকাংশ স্কুল-কলেজেই অভিজ্ঞ ও যোগ্য শিক্ষকের সংখ্যা খুব কম। সরকারকে এর মোকাবেলা করতে হবে এবং শিক্ষকদের বাক স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করা চলবে না।
(ঝ) অষ্টম শ্রেণি শিক্ষাকে অবৈতনিক এবং বাধ্যতামূলক করতে হবে।
(ঞ) মেডিকেল ইউনিভারসিটি খুলতে হবে। মেডিকেল কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স এবং নমিনেশন ভর্তির ব্যবস্থা বাতিল করতে হবে। নার্স ছাত্রীদের সমস্ত দাবি মেনে নিতে হবে।
পৃষ্ঠা-১২৫

(ট) প্রকৌশল শিক্ষার অটোমেশন প্রথা এবং অন্যান্য ব্যবস্থা বিলোপ করতে হবে।
(ঠ) পলিটেকনিক ছাত্রদের ‘কনডেন্স কোর্স’-এর সুযোগ দিতে হবে এবং ডিপ্লোমা দানের ভিত্তি হবে ‘সেমিস্টার পরীক্ষা।
(ড) কষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের ন্যায্য দাবি মেনে নিতে হবে।
(ঢ) রেলপথে যাতায়াতের জন্য ছাত্র-ছাত্রীরা তাদের আইডেনটিটি কার্ড দেখালে শতকরা পঞ্চাশ ভাগ কনসেশনে টিকিট পাবে। বাসে দূরবর্তী অঞ্চলে যাতায়াতের জন্য এ একই সুবিধা ছাত্র-ছাত্রীদের দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের মত পূর্ব পাকিস্তানের শহরের ভেতরে বাসভাড়া দশ পয়সা করতে হবে। যাতে শহরের যে কোনো জায়গায় সহজেই যাওয়া যায়। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাওয়ার জন্যে আরও অনেক বাস চালু করতে হবে।
(ণ) চাকরির নিশ্চয়তা দিতে হবে।
(ত) কুখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয় অর্ডিন্যান্স সম্পূর্ণ বাতিল করতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে।
(থ) শাসক গোষ্ঠীর শিক্ষা সংকোচন নীতির প্রামাণ্য দলিল, জাতীয় শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট ও হামুদুর রহমান কমিশন রিপোর্ট বাতিল করতে হবে। শিক্ষা ব্যবস্থাকে গণমুখী এবং বিজ্ঞানভিত্তিক করতে হবে।
(২) প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারী গণতন্ত্র কায়েম করতে হবে। বাক-স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ক্ষুন্ন করা চলবে না।
(৩) পূর্ব পাকিস্তানের মেহনতি মানুষ চায় পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন। এ পূর্ণ স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তি হিসাবে তারা দাবি করে যে –
(ক) দেশের শাসনতান্ত্রিক কাঠামো হবে ফেডারেল ব্যবস্থাভিত্তিক। এ যুক্তরাষ্ট্রের আইন পরিষদের ক্ষমতা হবে সার্বভৌম।
(খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্রা এ কয়টি বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকবে। অন্যান্য বিষয়ে প্রদেশগুলোকে ক্ষমতা হবে নিরংকুশ।
(গ) পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য একই মুদ্রা থাকবে এবং কেন্দ্রই হবে। মুদ্রা ব্যবস্থার পরিচালক। কিন্তু শাসনতন্ত্রে এমন একটা সুনির্দিষ্ট বিধান রাখতে হবে-যাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্রা পশ্চিম পাকিস্তানে
পৃষ্ঠা-১২৬

পাচার হতে না পারে। একই কারণে দেশে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক এবং দুই অঞ্চলে দুটি আলাদা রিজার্ভ ব্যাংক বসাতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে একটা আলাদা অর্থনীতি চালু করতে হবে।
(ঘ) সকল রকমের কর, খাজনা ইত্যাদি ধার্য এবং আদায় করার ক্ষমতা থাকবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। ফেডারেল সরকারের কোনো কর ধার্য করার ক্ষমতা থাকবে না। আঞ্চলিক সরকারের আদায়ী রেভিনিউ-এর নির্ধারিত অংশ আদায় হওয়া মাত্রই ফেডারেল তহবিলে জমা হবে-এ মর্মে রিজার্ভ ব্যাংকগুলির উপর বাধ্যতামূলক বিধান শাসনতন্ত্রে থাকবে।
(ঙ) ফেডারেশনের প্রতিটি অংগরাজ্যে বহির্বাণিজ্যের আলাদা হিসাব রাখবে এবং বহির্বাণিজ্যের মাধ্যমে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা তাদের অধীনেই থাকবে। ফেডারেল সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা অংগরাজ্যগুলো সমানভাবে অথবা শাসনতন্ত্রের নির্ধারিত হার অনুযায়ী সরবরাহ করবে। দেশে প্রস্তুত যে কোনো জিনিস অংগরাজ্যগুলোতে আমদানি বা রপ্তানি করা চলবে। এর জন্য কোনো শুল্ক থাকবে না। ব্যবসা-বাণিজ্যের ব্যাপারে বিদেশি রাষ্ট্রগুলোর সাথে চুক্তি করার বা বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন করার অধিকার অংগরাজ্যগুলোর থাকবে।
(চ) পূর্ব পাকিস্তানকে মিলিশিয়া বা প্যারামিলিটারী রক্ষী বাহিনী গঠনের ক্ষমতা দিতে হবে। পূর্ব পাকিস্তানে অস্ত্র কারখানা নির্মাণ এবং নৌবাহিনীর সদর দফতর করতে হবে।
৪। পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ সিন্ধুসহ সমস্ত রাজ্যকেই স্বায়ত্তশাসন দিতে হবে এবং এদের নিয়ে একটা সাব-ফেডারেশন গঠন করতে হবে।
৫। ব্যাংক, ইস্যুরেন্স, পাটের ব্যবসা এবং অন্যান্য বড় শিল্পের জাতীয়করণ চাই।
৬। কৃসখদের খাজনা ও ট্যাক্সের হার কমাতে হবে। বকেয়া খাজনা ও ঋণ মওকুফ করতে হবে। সার্টিফিকেট প্রথা বাতিল করতে হবে। পার্টের সর্বনিম্ন মূল্য মণ প্রতি চল্লিশ টাকা ধরতে হবে এবং আখের ন্যায্যমূল্য দিতে হবে।
৭। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, বোনাস, উপযুক্ত শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থান দিতে হবে। ধর্মঘট ও ট্রেড ইউনিয়ন করার অধিকার স্বীকার করে নিতে হবে।
পৃষ্ঠা-১২৭

৮। পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং জন-সম্পর্কের সার্বিক ব্যাবহারের ব্যবস্থা করতে হবে।
৯। জরুরি আইন, নিরাপত্তা আইন এবং নির্যাতনমূলক আইন তুলে নিতে হবে।
১০। সিয়াটো, সেন্টো, পার্ক-মার্কিন সামরিক চুক্তি বাতিল করে জোট বহির্ভূত স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি চালু করতে হবে।
১১। দেশের বিভিন্ন জেলখানায় আটক সমস্ত ছাত্র, শ্রমিক, কৃষক , রাজনৈতিক কর্মী ও নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি দিতে হবে। যাবতীয় গ্রেফতারী পরোয়ানা, হুলিয়া ও মামলা ফিরিয়ে নিতে হবে।
সারা দেশে আগরতলার ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ ১১-দফা দাবিতে আন্দোলন দাবানলের মতো ছড়িয়ে পড়ে। ২৪ জানুয়ারির পর থেকে শহরে বন্দরে-গ্রামে-গঞ্জে বিক্ষোভ আন্দোলন তুঙ্গে উঠে। সর্বত্র শ্লোগান ওঠে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা মানি না মানবো না, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো। ছয় দফা, ১১-দফা মানতে হবে, মানতে হবে, আইয়ুব-মোনেমের গদিতে আগুন জ্বালাও একসাথে। ২৫ জানুয়ারি সান্ধ্য আইন ভঙ্গের সময় সেনাবাহিনীর গুলিতে ঢাকা পলিকেনিকের ২ জন ছাত্র নিহত হয় ও ১২ জন আহত হয়। ২৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জে সেনাবাহিনীর গুলিতে ৪ জন নিহত হয়। ময়মনসিংহে ৮৫ জন গ্রেফতার হয়। ২৭ ও ২৮ জানুয়ারি বিভিন্ন শহরে হরতাল পালিত হয়। ২৮ জানুয়ারি বরিশালে গণমিছিলে গুলিবর্ষণ করা হয়। ২৯ জানুয়ারি ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্টাফ কোয়ার্টারস থেকে ৪৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ৩০ জানুয়ারি মাদারীপুরের জাজিরায় পুলিশের গুলিবর্ষণের ফলে একজন নিহত ও ৩ জন আহত হয়। ৩১ জানুয়ারি গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটি (ডাক) হত্যা নির্যাতনের প্রতিবাদে শোক দিবস পালন করে।
দেশের বিরাজমান রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রেক্ষাপটে আইয়ুব খান ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে রাওয়ালপিণ্ডিতে এক গোল টেবিল বৈঠকের আহ্বান করেন। ৫ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঘোষণা করেন যে ১৭ ফেব্রুয়ারি গোল টেবিল বৈঠক বসবে।
ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ছয় দফা বাস্তবায়ন ও আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান না করার জন্য গণতান্ত্রিক কমিটির নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ জানান। ৬ ফেব্রুয়ারি আইয়ুব খান ঢাকায় আসেন। ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের আহবানে হাজার হাজার ছাত্র-জনতা আইয়ুব খানকে কালো পতাকা প্রদর্শন করে। ৯ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের আহবানে পল্টনে এক জনসভায় ছাত্র নেতা তোফায়েল আহমেদ অবিলম্বে
পৃষ্ঠা-১২৮

আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহারসহ সকল রাজবন্দীদের মুক্তি দাবি করেন। ১১ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে শেখ মুজিবের মুক্তির দাবি দিবস পালিত হয়। ১২ ফেব্রুয়ারি তাজউদ্দিন ও ১৩ ফেব্রুয়ারি ক্যাপ্টেন মনসুর আলী এ খন্দকার মুশতাকসহ ৬৫ জন রাজবন্দীকে মুক্তি দেওয়া হয়। ১৪ ফেব্রুয়ারি পল্টন ময়দানে অনুষ্ঠিত এক বিশাল জনসভায় গণতান্ত্রিক সংগ্রাম কমিটির পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে বাদ দিয়ে গোল টেবিলে বৈঠকে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। ১৫ ফেব্রুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার ও শেখ মুজিবের মুক্তির দাবিতে হরতাল পালিত হয়। এ দিন রাতে ঢাকা সেনানিবাসে আটক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা করা হয়। এ সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর ১৬ ফেব্রুয়ারি ছাত্র-শ্রমিক-জনতা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। গগণবিদারী শ্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত হয়। ১৭ ফেব্রুয়ারি ডাক নেতৃবৃন্দ গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশে রাওয়ালপিণ্ডি যান। আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মুশতাক, কামরুজ্জামান ও ময়েজউদ্দিন আহমেদ প্রমুখ নেতৃবৃন্দ রাওয়ালপিণ্ডি পৌছান। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিব ছাড়া বৈঠকে যোগদানে অস্বীকৃতি জানান। এ পরিস্থিতিতে আইয়ুব খান গোল টেবিল বৈঠকে ২৬ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত স্থগিত ঘোষণা করেন। এ সময়ে আভাস পাওয়া যায় যে, গোল টেবিল বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশে শেখ মুজিবকে প্যারোলে মুক্তি দেওয়া হতে পারে। বেগম ফজিলাতুননেছা এ সময়ে ক্যান্টনমেন্ট যান এবং শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে। প্যারোলে না যাওয়ার জন্য বলেন। অতঃপর শেখ মুজিব আগরতলার মামলা প্রত্যাহার না করা পর্যন্ত গোল টেবিল বৈঠকে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। এখানে উল্লেখ করা যায় যে, তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া, সাংবাদিক জহুর হোসেন চৌধুরী, খন্দকার মুশতাক ও মিজানুর রহমান চৌধুরী শেখ মুজিবকে প্যারোলে রাওয়ালপিণ্ডি যাওয়ার পক্ষে মত প্রকাশ করেন। অপরদিকে তাজউদ্দিন আহমেদ, ময়েজউদ্দিন আহমেদ ও ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ প্যারোলে মুক্তির তীব্র বিরোধিতা করেন। ১৮ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে এক মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে মিছিল বের করে। এ সময়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. জোহা সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ফলে নিহত হন। ফলে সারা দেশে ছাত্র-জনতা জঙ্গিরূপ ধারণ করে। ‘জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’ শ্লোগানে সারা দেশে প্রকম্পিত হতে থাকে। দিনাজপুর, নোয়াখালী, কুষ্টিয়া, ঢাকায় সেনাবাহিনীর গুলিবর্ষণের ফলে ৭ জন নিহত ও ২৬ জন আহত হয়। বিক্ষুব্ধ জনতা আইয়ুব খানের মন্ত্রী সবুর খানের
পৃষ্ঠা-১২৯

বাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে। ২২ ফেব্রুয়ারি তথাকথিত আগরতলা ষ্য প্রত্যাহার করা হয় এবং শেখ মুজিবসহ সকল আসামীদের নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়।
২৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৬৯) রবিবার রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে শেখ মুজিবকে গণসংবর্ধনা দেওয়া হয়। লক্ষ লক্ষ মানুষের সমাবেশের ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ বাঙ্গালি জাতীর পক্ষ থেকে শেখ মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দিয়ে ভূষিত করেন।
প্ৰসংগত উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৬৩ সালে ১০ জুন তারিখে শেখ মজিন ভারতীয় সাহায্যে বাংলাদেশ স্বাধীন করার লক্ষ্যে সীমান্ত অতিক্রম করে প্রায় ১৮ মাইল পায়ে হেঁটে আগরতলা যান। ড. মাজাহারুল ইসলাম ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মজিব গ্রন্থের ৮৬১ পাতায় উল্লেখ করেছেন যে, ‘সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়াস বা প্রচেষ্টা যে শেখ মুজিবের ১৯৭১ সালের পূর্বেও ছিল না, একথা সত্য নয়। ১৯৬৫ সালের ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধের সময় তিনি তার নিকটতম বন্ধু-বান্ধবকে দুঃখ করে বলতেন, ‘বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি অপূর্ব সুযোগ আমরা নষ্ট করলাম। ভারতের সাথে আগে থেকেই যোগাযোগ করলে এবং কিছু অস্ত্র সংগ্রহ করতে পারলে এইবার বাংলাদেশ পশ্চিমা শক্তির হাত থেকে মুক্ত করা যেত। শুধু একথা উচ্চারণ করেই তিনি ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয়, গোপনে চেষ্টাও করেছেন। আগরতলা মামলায় তার মূল আসামী হবার পেছনে সত্যতা যে ছিল না এমন নয়। তিনি ভারত থেকে অস্ত্র এনে দেশ স্বাধীন করার প্রয়াসে বিশেষভাবে জড়িত ছিলেন। কিন্তু শাসকের সতর্ক চক্ষু তার ওপর এমন কঠোরভাবে নিবদ্ধ ছিল যে, তার পক্ষে স্বল্প সময়ে এ প্রচেষ্টাকে একটি সংগ্রামে রূপ দেওয়া সম্ভব হয়নি। অনুরূপ আর্তি ও ব্যাকুলতা তাঁকে উদ্বুদ্ধ করেছিল ১৯৬২ সালে শহীদ সোহরাওয়ার্দীর গ্রেফতারের পরবর্তীতে। সোহরাওয়ার্দী ১৯৬২ সালের ৩০ জানুয়ারি তারিখে জননিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার করা হয়। শেখ মুজিব ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দের প্রচেষ্টায় গণআন্দোলন শুরু হয়। অতঃপর শেখ মুজিবকে আটক করা হয় ৬ ফেব্রুয়ারি তারিখে। ১৭ জুন পর্যন্ত কারাগারে আবদ্ধ থাকেন এবং ১৮ জুন ছাড়া পান। সোহরাওয়ার্দী মুক্তিলাভ করেন ১৯৬২ সালের ১৯ আগস্ট। ১৬ সেপ্টেম্বর তিনি ঢাকায় এলে বিমানবন্দরে তাঁকে বিপুল সংবর্ধনা জানানো হয়। কিন্তু সোহরাওয়ার্দী জেলে থাকা কালে শেখ মুজিব একবার ভেবেছিলেন যে, বোধ করি নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে স্বৈরাচারী আইয়বের আমলে সাফল্য অর্জন করা যাবে না। তাই তিনি পদব্রজে পূর্ব বাংলার সীমান্ত পার হয়ে আগরতলা গমন করেন এবং স্থানীয় ভারতীয় নেতৃবৃন্দের সাথে সশস্ত্র সংগ্রামে সাহায্যের ব্যাপারে আলোচনা করেন। কিন্তু আগরতলার গোয়েন্দা
পৃষ্ঠা-১৩০

বিভাগ তাকে বিশ্বাস করতে পারেনি। ফলে তাঁকে গ্রেফতার করে কারাগারে নিয়ে যাওয়া হয়। বঙ্গবন্ধু তখন স্থানীয় নেতৃবৃন্দের নিকট আবেদন জানান যে, অস্ত্র দেওয়া অথবা বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করা যদি সম্ভব না হয়, তবে অযথা তাকে কারাগারে রেখে বাংলাদেশের নিয়মতান্ত্রিক সংগ্রামকে ব্যাহত করে লাভ নেই। তাঁকে মুক্তি দিয়ে বাংলার সীমান্তে রেখে আসা হোক। অবশেষে তাই করা হয় ।
শেখ মুজিবকে মুক্তি দিয়ে বাংলার সীমান্তে এনে ছেড়ে দেওয়া হয়। সুদীর্ঘ ৩০/৩৫ মাইল পথ পায়ে হেঁটে গোপনে এসে তাকে দেশের এক পরিচিত বাড়িতে পরিশ্রান্ত অবস্থায় বিশ্রাম নিতে হয়। তার পা দুটো ফুলে গিয়েছিল এবং একদিন তিনি যন্ত্রণায় খুবই কষ্ট পেয়েছিলেন। ৩ ফেব্রুয়ারি (১৯৭৪) তাঁর ৩২ নং ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে একটি অনির্ধারিত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু আমার নিকট এ ঘটনা সংক্ষেপে বিবৃত করেন। আমার সাথে পাশে উপবিষ্ট ছিলেন সাংবাদিক সাহিত্যিক রাহাত খান। বাংলা একাডেমির সংস্কৃতি বিভাগের শামসুজ্জামান খান ও জিল্লুর রহমান।”
আব্দুল ওয়াদুর ভূঞা (Emergence of Bangladesh and Role of Awami League) গ্রন্থের ১০৮-১০৯ পৃষ্ঠায় মাজাহারুল ইসলাম প্রদত্ত উপরিউক্ত একই তথ্যের পুনরাবৃত্তি করেছেন। প্রকৃত পক্ষে এটি ১৯৬২ সাল না হয়ে ১৯৬৩ সাল হবে। ফয়েজ আহমেদ রচিত ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ও বাংলার বিদ্রোহ’ গ্রন্থে উপস্থাপিত হয়েছে আগরতলার তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী শচীন্দ্র লালের স্বহস্ত লিখিত পত্র। এ পত্রে শচীন্দ্র লাল জানাচ্ছেন যে ১৯৬৩ সালের ১০ জুন তারিখে শেখ মুজিব তার বাড়িতে পৌঁছান। এছাড়া উল্লেখ করা যায় যে, ১৯৬২ সালের ১৮ জুন শেখ মুজিব মুক্তি লাভ করেন। তার আগ পর্যন্ত শেখ মুজিব জেলে ছিলেন। সুতরাং ১৯৬২ সালের ১০ জুন তাঁর পক্ষে আগরতলা যাওয়া অসম্ভব। ৩০ জানুয়ারি (১৯৬২) সোহরওয়ার্দী গ্রেফতার হন এবং ১৯ আগস্ট (১৯৬২) করাচির সেন্ট্রাল জেল থেকে মুক্তি লাভ করেন অর্থাৎ এ সময়ে সোহরাওয়ার্দী জেলে ছিলেন। শেখ মুজিব ১৯৬৩ সালের ৮ আগস্ট লন্ডন যান। ১৯৬৩ সালের জুন মাসে ছিলেন মুক্ত এবং সোহরাওয়ার্দী ১৯ মার্চ (১৯৬৩) বৈরুতে যান চিকিৎসার জন্য এবং সেখানে ৫ ডিসেম্বর ১৯৬৩ তিনি মৃত্যুবরণ করেন। এতে প্রতীয়মান হয় যে, শেখ মুজিব ১৯৬৩ সালের জুন মাসে নেতৃত্বহীন অবস্থায় হতাশাগ্রস্ত হন এবং তার ফলে নিয়মতান্ত্রিক পথে স্বৈরাচারী সরকারের পতন ঘটানো তার কাছে অসম্ভব মনে হওয়ায় ভারতীয় সাহায্যের জন্য তিনি আগরতলায় যান। এ বিষয়ে শেখ হাসিনার বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য।
পৃষ্ঠা-১৩১

ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউট-এ বক্তৃতাকালে শেখ হাসিনা ১৯৯৩ সালে বলেন যে , আমার পিতা ১৯৬৩ সালের ভারতীয় সহায়তার জন্য আগরতলা যান।
ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলনের পটভূমিতে পূর্বোল্লিখিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করার পর আওয়ামী লীগ দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করে । বাংলাদেশের স্বাধীন সংগ্রামের ইতিহাসে ছয় দফা সবচেয়ে গুরুতুপর্ণ বিষয় । ছয় দফা কোথা থেকে এসেছিল, কে তার রচয়িতা এ বিতর্কের শেষ নেই । তৎকালীন ভাসানী ন্যাপ, চীনপন্থী কমিউনিস্ট গ্রুপ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)- এর মতে ছয় দফা প্রণয়ন করেছিল আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ । আইয়ুব খানকে বিপদে ফেলে আরো সুবিধা আদায় করাই সিআই’র উদ্দেশ্য ছিল। তবে ছয় দফার সৃষ্টি সম্পর্কে এ ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা কারো কাছে গ্রহণজোগ্য হয়নি। অনেকের মতে, প্রকৃতপক্ষে কয়েকজন বাঙালি সিএসপি, অফিসার রুহুল কুদ্দুস, শামসুর রহমান খান, আহমদ ফজলুর রহমান ছয় দফা সম্পর্কে ধ্যান-ধারণার সৃষ্টি করেন। অনেকে মনে করেন ছয় দফা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপকসহ অন্যান্য বুদ্ধিজীবীদের সৃষ্টি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক রেহমান সোবহান, ড. মাহমুদ হোসেন প্রমুখ পূর্ব অঞ্চলের সঙ্গে পশ্চিম অঞ্চলের বৈষম্যের পরিসংখ্যান প্রকাশ করে দেশবাসীর কাছে তুলে ধরেন। এর পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতিবিদদের কাছে অর্থনৈতিক বৈষম্যের অবনতিশীল চিত্রটি ধরা পড়ে এবং রেহমান সোবহান কর্তৃক প্রচারিত দুই অর্থনীতি তত্ত্বের যৌক্তিক বিশ্বাসের প্রসার ঘটে। এ চিন্তার প্রসারের কারণ ছিল। প্রথম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার কার্যকাল পূর্ব পাকিস্তানের উন্নয়নের মাথাপিছু ব্যয়ের পরিমাণ ছিল ৮০ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে ছিল ২০৫ টাকা। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় মাথাপিছু পূর্ব পাকিস্তানের ১৯০ টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানের ২৯২ টাকা। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়নে ব্যয় হয়েছিল ৯৭০ কোটি টাকা আর পশ্চিম পাকিস্তানে ২,১৫০ কোটি টাকা। অথচ ব্যয়ের ক্ষেত্রে দু’অঞ্চলের চিত্র ছিল সম্পূর্ণ বিপরীত। বহির্বাণিজ্যের ক্ষেত্রে প্রথম ১০ বছরে পশ্চিম পাকিস্তানে যেখানে ৪,০৭৬ কোটি টাকা ঋণাত্মক ভারসাম্য ছিল, পূর্ব পাকিস্তানে সেখানে ৪,৬৮৯ কোটি টাকা ঋণাত্মক ভারসাম্য বজায় ছিল। কেন্দ্রীয় সরকারের ট্রেজারিতে পশ্চিম পাকিস্তানের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তান ২০০ কোটি টাকা বৈদেশিক মুদ্রা জমা দেয়। এর পুরস্কারস্বরূপ’ কেন্দ্রীয় সরকার প্রায় ৪০ কোটি টাকার বিদেশি দ্রব্য আমদানির ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে বঞ্চিত করে। ক্রমশ এসব কারণে বাঙালিদের কাছে এটা পরিষ্কার হয়ে ওঠে যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ঋণের বোঝা মেটানো হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের আয় থেকে। পশ্চিম পাকিস্তানের বাজার হিসাবে পূর্ব পাকিস্তান ব্যবহৃত হচ্ছে।
পৃষ্ঠা-১৩২

এ পরিস্থিতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক ড. দানী এক সেমিনারে ‘স্বাধীন বাংলাদেশের সম্ভাবনা’ শীর্ষক একটি আলোচনা উপস্থাপন করেন। এ আলোচনার ফলে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে প্রবল উত্তেজনার সৃষ্টি হয়। বছরের পর বছর সৃষ্ট পর্বতপ্রমাণ আঞ্চলিক বৈষম্যের শিকার হয়ে বাঙালি জনগণের মনে ক্ষোভ ধূমায়িত হতে থাকে। আর এ রাজনৈতিক পটভূমিতে শেখ মজিব ১৯৬৬ সালে লাহোরে ছয় দফা পেশ করেন। ছয় দফা প্রকৃতপক্ষেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রথম কার্যকর পদক্ষেপ। ছয় দফা সত্যিকার অর্থে বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্মারক, যা বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হতে অনুপ্রাণিত করে। প্রকৃত সত্য হচ্ছে এ যে, ছয় দফা পাকিস্তানকে ঐক্যবদ্ধ রাখার জন্য প্রণয়ন করা হয়নি। লক্ষণীয় যে, ছয় দফায় শেখ মুজিব এক পাকিস্তানে দুটি স্বতন্ত্র মুদ্রা ব্যবস্থার দাবি করেছিলেন। এটা আর কিছু নয়, লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা। পাকিস্তানের পরিধির মধ্য থেকে যখন সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণার করা যাচ্ছিল না, তখন ছয় দফা আন্দোলনকে শেখ মুজিব কৌশলগত হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন। পাকিস্তানিরা কখনোই ছয় দফা মেনে নিতে পারতেন না, আর মেনে নিলেও পাকিস্তান অখণ্ড থাকতে পারতো না । শেখ মুজিবের ছয় দফা তাই একটি চকমপ্রদ রাজনৈতিক কৌশল। ছয় দফা ঘোষণার ফলে পাকিস্তানি শাসকচক্র প্রবলভাবে শংকিত হয়। একদিকে শেখ মুজিব ছয় দফা আন্দোলনকে বাঙালির গণতান্ত্রিক আন্দোলন হিসেবে প্রচার করেন, অন্যদিকে এক পাকিস্তানে ছয় দফাভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণয়ন প্রায় অসম্ভব ছিল। সুতরাং শাসকচক্র প্রচণ্ড বিপদে পড়লেন, না পারলেন ছয় দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করতে, না পারলেন ছয়দফাকে আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার হিসেবে মেনে নিতে। ফলে সারা দেশব্যাপী এক বিক্ষুব্ধ পরিস্থিতির সৃষ্টি হলো।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার ধারাবিবরণী খবরের কাগজে প্রকাশিত হওয়ার ফলে সাধারণ মানুষও বুঝতে পারে যে, তথাকথিত ষড়যন্ত্র মামলাটি ছিল মিথ্যা, সাজানো ও বানোয়াট। যদিও আজ এ কথা সর্বজনবিদিত যে, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ছিল না। প্রকৃতই কিছুসংখ্যক সামরিক-বেসামরিক ব্যক্তিবর্গ ভারতের সাহায্যে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করার পরিকল্পনা করেন। লে. কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন শেখ মুজিবের সাথে দেখা করে। রাজনৈতিক সমর্থন চাইলে শেখ মুজিব তাতে সম্মত হন। কিন্তু মোনেম খানের লম্পঝম্প, সরকারি অপপ্রচার ও শেখ মুজিবকে ১নং আসামী হিসেবে অন্তর্ভুক্ত ফলে জনগণের কাছে এ মামলাটি বিশ্বাসযোগ্য মনে হয়নি। সর্বসাধারণ এ কথা মনে করতে শুরু করে যে, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবিদাওয়ার পক্ষে সবচেয়ে সোচ্চার কণ্ঠ শেখ মুজিবকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করার জন্যই আগরতলা ষড়যন্ত্র
পৃষ্ঠা-১৩৩

মামলা শুরু করা হয়েছে। এর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া হিসেবে সমগ্র বাঙ্গালিআ জাতি আইয়ুব বিরোধী গণবিক্ষোভে ফেটে পড়ে।
সম্মিলিতভাবে আন্দোলনের কর্মসূচি গ্রহণের ক্ষেত্রে দুটি বড় ধনের সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমত, পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগ ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের কর্মসূচিতে ছয় দফা অন্তর্ভুক্ত করার জন্য সচেষ্ট ছিল। ডাকসু’র পক্ষ থেকেও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের ডাক দেওয়া সম্ভব ছিল না। কারণ এ সময় ডাকসু’র সহ-সভা ছিলেন তোফায়েল আহমদ (ছাত্রলীগ) এবং সাধারণ সম্পাদক নাজিম কা চৌধুরী (এনএসএফ)। উল্লেখ্য যে, এ সময় হলোভিত্তিক নির্বাচনে চক্রাকার ডাকস’র সহ-সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হতেন। পরবর্তী উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এ প্রথার পরিবর্তন করে সাধারণ নির্বাচনের বিধি প্রচলন করেন। দ্বিতীয়ত, পিডিএম-এর ৮-দফাভিত্তিক আন্দোলন ও আওয়ামী লীগের ছয় দফাভিত্তিক আন্দোলনের কর্মসূচির ফলে এক্যবদ্ধ কর্মসূচি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সঙ্কট দেখা দিচ্ছিল। শেখ মুজিব তখন জেলের অভ্যন্তরে। এছাড়াও অব্যাহত নির্যাতন ও ধর পাকড়ে ছাত্রলীগের সাংগঠনিক অবস্থা ছিল সংকটাপন্ন। ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) গ্রুপের সভাপতি সাইফুউদ্দিন আহমদ মানিক ও মেনন গ্রুপের সভাপতি মাহবুবউল্লার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি থাকায় তারা আত্মগোপন করেছিলেন।
এতদসত্ত্বেও ঐতিহাসিক প্রয়োজনে ১৯৬৮ সালের ডিসেম্বরের মাঝামাঝি ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের জন্য আলোচনার সূত্রপাত হয়। দিনের পর দিন ইকবাল হলের ক্যান্টিনের নিচতলায় সিঁড়ি কামরায় আলোচনা চলতে থাকে। এ সময় ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন)-এর একতাবদ্ধ হওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) সাহায্য করে। মতিয়া গ্রুপ ছয় দফার বিরোধী ছিল না। তারা শুধু বলত, ছয় দফায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বক্তব্য নেই। অবশেষে ছাত্র ইউনিয়ন (মতিয়া) ছয় দফাকে সামনে রেখেই সরকার বিরোধী কর্মসূচি ও শিক্ষাবিষয়ক দাবিনামা পেশ করে। ছাত্রলীগ নেতা আব্দুর রউফ ও ছাত্র ইউনিয়ন নেতা শামসুদ্দোহা শিক্ষাবিষয়ক দাবিগুলোর খসড়া তৈরি করেন। দীর্ঘ বিতর্ক, সংযোজন ও সংশোধনের পর ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) সম্মত হয় এবং এভাবেই দীর্ঘ প্রতীক্ষার পর ঐতিহাসিক ১১-দফা প্রণীত হয়। গঠিত হয় সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ। যে ১০ জন ছাত্র এ পরিষদের সদস্য ছিলেন তাঁরা হলেন আব্দুর বুউক ও খালেদ মোহাম্মদ আলী (ছাত্রলীগ), সাইফুদ্দিন আহমদ মানিক ও সামনদোহা (ছাত্র ইউনিয়ন মতিয়া), মোস্তফা জামাল হায়দার ও মাহবব উল্লাহ (ছাত্র ইউনিয়ন-মেনন), মাহবুবুল হক দোলন ও ইব্রাহিম খলিল (এনএসএফ) এবং তার সহ-সভাপতি তোফায়েল আহমদ ও সাধারণ সম্পাদক নাজিম
পৃষ্ঠা-১৩৪

কামরান চৌধুরী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, মাহবুবুল হক দোলন ও ইব্রাহিম খলিল মোনেম খান বিরোধী এনএসএফ-গ্রুপের নেতৃত্ব দেন। এনএফএফ-এর এ অংশ এসময় মোনেম খান বিরোধী ও সবুর খান সমর্থক ছিলেন। ১১-দফার ভিত্তিতে সংগ্রামী ছাত্রসমাজ এক অভূতপূর্ব ও ইতিহাসে তুলনাহীন ঐক্যবদ্ধ মরণপণ গণআন্দোলন গড়ে তুলে।
ছাত্রদের এ কর্মসূচি ঘোষণার তিনদিন পর ৮ জানুয়ারি (১৯৬৯) রাজনৈতিক দলগুলো ৮-দফা দাবি পেশ করে। এতে স্বাক্ষর করেন আওয়ামী লীগের সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আমির হোসেন শাহ, জামাতে ইসলামির মিয়া তোফায়েল, নেজামে ইসলাম পার্টির মোহাম্মদ আলী, জামাতে উলামায়ে ইসলাম-এর মুফতী মাহমুদ, পাকিস্তান মুসলিম লীগ (কাউন্সিল)-এর মমতাজ দৌলতানা, পাকিস্তান আওয়ামী লীগ (পিডিএমপন্থী)-এর নসরুল্লাহ খান ও জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট-এর নূরুল আমিন। গণতান্ত্রিক সংগ্রাম পরিষদ জোটের নাম রাখা হয় Democratic Action Committee বা ডাক। ভাসানী ন্যাপ ও পিপলস পার্টিকে যোগদানের আমন্ত্রণ করা হয়েছিল, কিন্তু তারা এ জোটে অংশগ্রহণ করতে অস্বীকার করে। এর আগে ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ফ্রন্ট বা এনডিএফ নেতৃবৃন্দ হোটেল শাহবাগে মিলিত হয়ে ৭ দফা দাবিনামা প্রণয়ন করে। বিরোধী দলীয় নেতা নসরুল্লাহ খান, মিয়া মমতাজ উদ্দিন দৌলতানা, মাইকারচরের আবুল কাসেম, সরদার বাহাদুর খান (আইয়ুব খানের ভাই ও গণপরিষদের বিরোধী দলেল নেতা), ইউসুফ খটক, খাজা তোফায়েল, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী ও ফরিদ আহমদ এ বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের মিজানুর রহমান চৌধুরী, ন্যাপ-এর মহিউদ্দিন (ইনি ১৯৭২ সালে আওয়ামী লীগে যোগদান করেন এবং ১৯৭৩ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন, কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর, নূরুল আমিন, এ এস এম সোলায়মান, আব্দুস সামাদ আজাদ ও মোহাম্মদ আলীও এ বৈঠকে যোগদান করেন।
শেখ মুজিব ১৯৬৬ সালে ছয় দফা পেশ করার পর নবাবজাদা নসরুল্লা খান (তৎকালীন পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় কমিটি ছয় দফার বিরোধিতা করে এবং প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ কমিটি বাতিল ঘোষণা করে। শেখ মুজিব পাল্টা সম্মেলন আহবান করে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রতি অনাস্থা এনে নতুন নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করেন। এ কমিটি মোতাবেক শেখ মুজিব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কামরুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। এ সময় স্থানীয় নেতৃবৃন্দ ছিলেন রাজশাহীতে মজিবর রহমান ও কামরুজ্জামান, পাবনায় আমজাদ হোসেন ও বগা মিয়া, বগুড়ায় মাহমুদুল হাসান ও এ কে মজিবর, রংপুরে আব্দুল আউয়াল ও নুরুল
পৃষ্ঠা-১৩৫

হক , দিনাজপুরে আজিজুর রহমান ও ইউসুফ আলী, কুষ্টিয়ায় আজিজুর রহমান আক্কাস ও সাদ আহমেদ (ইনি পরে পিডিএম এ পরে জামায়াতে ইসলামে যোগ দেন ),যশোরে মশিউর রহমান (শহিদ) ও রওশন আলী, খুলনায় শেখ আব্দুল আজিজ ও এডভোকেট মনসুর আলী, নোয়াখালীতে মালেক উকিল ও নক ঢাকায় শামসুল হক (ইনি পরে বিএনপি’র মন্ত্রী ছিলেন এরশাদ আমলে পাট ও সমবায় মন্ত্রী ও মুজিবুর আমলে মস্কোয় বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন। জহিরউদ্দিন (১৯৭০-এর নির্বাচনে ইনি মিরপুর-মোহাম্মদপুর আসনে গোল। আয়মকে বিপুল ভোটে পরাজিত করে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন), কুমিল্লায় খন্দকার মোশতাক আহমেদ ও জহিরুল কাইউম, চট্টগ্রাম এম আর সিদ্দিকী ও এ এম এ আজিজ এবং চট্টগ্রাম শহরে জহুর আহম্মদ চৌধুরী ও আব্দুল মান্নান।
ছাত্ররা ১১-দফা প্রণয়নের পর ডাক-এর নেতৃবৃন্দের কাছে যায়। কিন্তু। সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী ও পূর্ব পাকিস্তানের আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের এ দাবিনামা দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক দলগুলো মানতে অস্বীকার করে। আওয়ামী লীগ ও ওয়ালী ন্যাপ নেতৃবৃন্দ ছাত্রদের সাথে একাত্মতা ঘোষণা করে। এরপর ছাত্ররা দল বেঁধে মওলানা ভাসানীর কাছে যায়; কিন্তু মওলানা ভাসানী ১১-দফায় প্রতি সমর্থন জানাতে অস্বীকার করেন। তিনি বলেন যে, সামনের মাসে ন্যাপের সম্মেলনে এ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি ১১-দফা সমর্থন করে বিবৃতি দিতে পারবেন না।
এ সময় আওয়ামী লীগ পিডিএম-এর ৮ দফাপন্থী ও শেখ মুজিবের ছয় দফাপন্থী এ দুই দলে বিভক্ত হয়। মুষ্টিমেয় কয়েকজন, যেমন জহির উদ্দিন, সালাম খান, মশিউর রহমান, রওশন আলী, আব্দুর রশিদ তর্কবাগীশ, মজিবর রহমান (রাজশাহী) ও মতিউর রহমান (রংপুর) পিডিএম-এর ৮-দফায় স্বাক্ষর করেন। এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে শেখ মুজিবের ছয় দফাপন্থী আওয়ামী লীগের ফিরে আসেন। কিন্তু রাজশাহীর মজিবর রহমান ফিরে আসেননি। তিনি পূর্ব পাকিস্তান পিডিএম-এর সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং হাফেজ হাবিবুর রহমান পদত্যাগ করেন। ফলে আওয়ামী লীগের দুইজন সহসভাপতির পদ শূন্য হয়। ঐ শূন্য পদে পাবনার ক্যাপ্টেন মনসুর আলী (তখন জেলে) ও কুমিল্লার খন্দকার মোশতাক আহমেদকে সহ-সভাপতির দায়িত্ব দেওয়া হয়। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির বিরুদ্ধে অনাস্থা জ্ঞাপন করে যে পাল্টা কমিটি গঠন করা হয়, তাতে শেখ মুজিব সভাপতি, কামরুজ্জামান সাধারণ সম্পাদক, মাস্টার খান গুল (সীমান্ত প্রদেশ) সহ-সভাপতি, খলিল আহম্মদ তিরমিজি সাংগঠনিক সম্পাদক, টাঙ্গাইলের আব্দুল মান্নান প্রচার সম্পাদক, মোস্তফা সরওয়ার সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও এ আর এস দোহাকে (এরশাদের
পৃষ্ঠা-১৩৬
মন্ত্রী ) পিণ্ডি আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত করা হয়। এ সময় তর্কবাগীশ, রওশন আলী, মশিউর রহমান নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৭ নভেম্বর ন্যাপ (ওয়ালী) পল্টন ময়দানে জনসভা করে। ২৬ নভেম্বর এলানা ভাসানী ও আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান চৌধুরীর মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।
২৯ নভেম্বর সরকারের পুলিশি নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঢাকা হাইকোর্টের আইনজীবীরা মিছিল করে। ১ ডিসেম্বর ঢাকায় সাংবাদিকরা সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ও রাজবন্দিদের মুক্তির দাবিতে রাজপথে নামে। ৬ ডিসেম্বর ভাসানী ন্যাপের পক্ষ থেকে জুলুম প্রতিরোধ দিবস পালিত হয়। পল্টনের জনসভা শেষ করে জনতা গভর্নর হাউস ঘেরাও করে। এদিন স্কুটার ড্রাইভারদের আন্দোলনে পলিশের নির্যাতনের ফলে বিক্ষুদ্ধ ড্রাইভাররা মওলানা ভাসানীকে ৭ ডিসেম্বর হরতাল আহবানের অনুরোধ জানান। স্বতঃস্ফূর্তভাবে ৭ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়। এদিন পুলিশের গুলিবর্ষণে তিনজন নিহত হন। এ হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ৮ ডিসেম্বর পুনরায় হরতাল পালিত হয়। ৯ ডিসেম্বর বায়তুল মোকাররমে গায়েবানা জানাজা অনুষ্ঠানে প্রায় ২০০ জন গ্রেফতার বরণ করেন।
এরপর সকল বিরোধী দলের ডাকে ১৩ ডিসেম্বর হরতাল পালিত হয়। পুলিশের গুলিতে এদিন চট্টগ্রামে ২৬ জন আহত এবং ১৫৭ জনকে বন্দী করা হয়। ২৯ ডিসেম্বর মওলানা ভাসানী পাবনার জেলা প্রশাসকের অফিস ঘেরাও করেন। আন্দোলনে নতুন গতি সঞ্চার হয়। সারাদেশে ঘেরাও আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। চারদিকে ধ্বনি ওঠে ‘জাগো জাগো বাঙালি জাগো, বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো বাংলাদেশ স্বাধীন করো’। এ আন্দোলনের চরম পর্যায়ে জাতীয়তাবাদী চেতনার চরম অভিব্যক্তি ঘটে। জনতা শ্লোগান দিতে থাকে ‘জয়বাংলা’, ‘তোমার দেশ আমার দেশ, বাংলাদেশ, জেলের তালা ভাঙ্গবো, শেখ মুজিবকে আনবো।
১৭ জানুয়ারি ছাত্র সংগাম পরিষদের ডাকে হরতাল পালিত হয়। সরকার কর্তৃক জারিকৃত ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ছাত্ররা রাজপথে মিছিল করে। পরদিন ৮ জানুয়ারি ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ডাকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ধর্মঘট পালিত হয়। ধর্মঘট চলাকালে পুলিশ ও ছাত্রদের মধ্যে খণ্ডযুদ্ধ শুরু হয়।
২০ জানুয়ারি পুলিশের গুলিতে ছাত্র ইউনিয়ন (মেনন) গ্রুপের নেতা আসাদ নিহত হলে আন্দোলনে প্রচণ্ড ঝড় ওঠে। তিনদিনব্যাপী শোক পালন, ২১ জানুয়ারি হরতাল, ২২ জানুয়ারি শোক দিবস ও ২ জানুয়ারি সন্ধ্যা মশাল মিছিল বের করা হয়।
এভাবে আন্দোলন এগিয়ে চলে। ১২ ফেব্রুয়ারি বিরোধী দলের কতিপয় সংসদ সদস্য পদত্যাগ করেন। এ দিনই পল্টনে তিন লক্ষাধিক জনতা ১১-দফা
পৃষ্ঠা-১৩৭

আদায়ের দৃপ্ত শপথ ঘোষণা করে। ১৫ ফেব্রুয়ারি আগরতলা মামলার অন্যতম বিচারাধীন আসামী সার্জেন্ট জহুরুল হককে সেনাবাহিনীর একজন প্রহরী গুলি করে হত্যা করে। পরদিন ১৬ ফেব্রুয়ারি প্রতিবাদে হরতাল পালিত । ২০ ফেব্রুয়ারি পুলিশের গুলিতে ৮ জন নিহত হয়। সেদিন আইয়র ঘোষণা করেন তিনি আর প্রেসিডেন্ট পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করবেন না।
আইয়ুব খান সকল বিরোধী দলের নেতাদের গোলটেবিল বৈঠকে বসে আহবান জানান। শেখ মুজিবকে প্রথমে প্যারোলে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করা হয়। শেখ মুজিব প্যারোলে যেতে অস্বীকার করলে ২২ ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা প্রত্যাহার করে শেখ মুজিবসহ সকল আসামীকে মুক্তি দেওয়া হয়।
শেখ মজিব মুক্তিলাভের পর মওলানা ভাসানীর সঙ্গে পৌনে এক ঘণ্টব্যাপী এক আলোচনা অনুষ্ঠানে মিলিত হন। তিনি আতাউর রহমান খানের বাসভবনেও যান।
শেখ মুজিব সরকার প্রস্তাবিত গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করেন। মওলানা ভাসানী ও ভুট্টো যোগাদন থেকে বিরত থাকেন। শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে ছয় দপা ও ১১-দফা ব্যাখ্যা করে ভাষণ দেন। আইয়ুব খান জিজ্ঞাসা করেন, এসব দাবি মানার পরে পাকিস্তান কি ফেডারেশন থাকবে, না কনফেডারেশনে পরিণত হবে? শেখ দৃঢ়কণ্ঠে উত্তর দেন ফেডারেশন তবে সুবিচারের সাথে (Federation with justice)। শেখ মুজিবের জবাব শুনে আইয়ুব খান প্রমাদ গুনলেন। গোলটেবিল বৈঠক ব্যর্থতাই পর্যবসিত হলো। ১৪ মার্চ (১৯৬৯) শেখ মুজিব ঢাকা ফিরে আসেন। আওয়ামী লীগ ডাক-এর সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করে। ২১ মার্চ মোনেম খান পশ্চিম পাকিস্তানে পালিয়ে যান সপরিবারে। গভর্নরের দায়িত্ব গ্রহণ করেন ড. এম এন হুদা। আইয়ুব খান ২৪ মার্চ প্রধান সেনাপতি ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করে ক্ষমতার মঞ্চ থেকে চিরবিদায় নিলেন।
পৃষ্ঠা-১৩৮

পঞ্চম অধ্যায়
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা
২৪ মার্চ, ১৯৬৯
প্রিয় জেনারেল ইয়াহিয়া,
অতীব দুঃখের সহিত আমাকে এ সিদ্ধান্তে আসিতে হইয়াছে যে, দেশের সমুদয় বেসামরিক প্রশাসন ব্যবস্থা ও নিয়মতান্ত্রিক কর্তৃপক্ষ সম্পূর্ণ অচল হইয়া পড়িয়াছে। বর্তমান উদ্বেগজনক মাত্রায় অবস্থার যদি অবনতি ঘটিতে থাকে, তাহা হইলে দেশের অর্থনৈতিক জীবনধারা তথা সভ্য জীবনের অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্পূর্ণ অসম্ভব হইয়া পড়িবে। এমতাবস্থায়, ক্ষমতার আসন হইতে নামিয়া যাওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর দেখিতেছি না। তাই আমি পাকিস্তানের দেশরক্ষা বাহিনীর হস্তে দেশের পূর্ণ কর্তৃপক্ষ ন্যস্ত করিয়া যাওয়ার সাব্যস্ত করিয়াছি। কেননা, সামরিক বাহিনীই দেশের আজিকার একমাত্র কর্মময় ও আইনানুগ যন্ত্র।
আল্লাহর মেহেরবানীতে আমাদের সেনাবাহিনী পরিস্থিতির মোকাবিলা করিয়া দেশকে চরম বিশৃক্ষলা ও সর্বাত্মক ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিতে সক্ষম। কেবল তাহারাই দেশে বুকে শুভবুদ্ধির উন্মেষ ঘটাইয়া বেসামরিক ও নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে পুনরায় অগ্রগতির পথে আগাইয়া যাইতে সাহায্য করিতে পারে।
কতিপয় লোক আমার নিকট প্রস্তাব করেন যে, যদি তাহাদের সমুদয় দাবি মানিয়া নেওয়া হয়, তাহা হইলে দেশে শান্তি ফিরিয়া আসিবে। আমি তাহাদের জিজ্ঞাসা করিয়াছিলাম, কোনো দেশে এ সকল দাবি মানিয়া নেওয়া হইলে পাকিস্তান ধ্বংস হইয়া যাইত। আমি সর্বদা আপনাকে বলিয়াছি যে, শক্তিশালী কেন্দ্রের মধ্যেই পাকিস্তানের মুক্তি নিহিত রহিয়াছে। আমি এ জন্য পার্লামেন্টারী শাসন-ব্যবস্থা মানিয়া লইয়াছিলাম যে, এ পদ্ধতিতে শক্তিশালী কেন্দ্র বজায় রাখার সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু এক্ষণে বলা হইতেছে যে, দেশ দুইটি অংশে বিভক্ত হইবে এবং কেন্দ্র ক্ষমতাহীন সংস্থায় পরিণত হইবে।
পৃষ্ঠা-১৩৯
প্রতিরক্ষা বাহিনী পঙ্গু হইয়া উঠিবে এবং পশ্চিম-পাকিস্তানের রাজনইতিক সত্তা বিলোপ করা হবে। আমাদের দেশ ধ্বংস করিয়া দেওয়ার ক্ষেত্রে, পৌরোহিত্য করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।
আমার জীবনের বিরাট আশা বাস্তবায়িত হইতে পারিল না দেখিয়া আমি ব্যথিত। নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ক্ষমতা হস্তান্তর অব্যাহত রাখার ঐতিহ্য প্রতিষ্ঠা করাই ছিল আমার কামনা।
দেশের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভাঙ্গিয়া পড়িয়াছে। শ্রমিকদের উস্কানি দেওয়া হইতেছে এবং অরাজকতাপূর্ণ ও নিষ্ঠুর কাজ করার জন্য বলা হইতেছে। এ দিকে হিংসাত্মক হুমকি প্রদর্শন করিয়া অধিক বেতন, মজুরি ও সুবিধার দাবি আদায় করা হইতেছে। উৎপাদন হ্রাস পাইতেছে এবং রফতানি গুরুতরভাবে কমিয়া যাইতেছে। শীঘ্রই দেশে গুরুতর মুদ্রাস্ফীতি দেখা দিতে পারে বলিয়া আমার আশঙ্কা হয়। যাহারা গণআন্দোলনের আড়ালে থাকিয়া গত কয়েকমাস যাবৎ দেশের মূলে আঘাতের পর আঘাত হানিয়াছেন, তাহাদের বেপরোয়া আচরণের দরুণই এ অবস্থার সৃষ্টি হয়। দুঃখের বিষয়, বহু সংখ্যক লোক তাহাদের দূরভিসন্ধির শিকারে পরিণত হয়।
সকল অবস্থায় সাধ্যমত আমি জনসাধারণের খেদমত করিয়াছি। নিশ্চয়ই কিছু কিছু ভুলত্রুটি হইয়াছে, তবে সাফল্যও নেহায়েত কম নয়। আমি যাহা কিছু সম্পাদন করিয়াছি, এমনকি আমার পূর্বেকার সরকারসমূহের মর্মান্তিক ও হৃদয়বিদারক ব্যাপার এই যে, কতিপয় ব্যক্তি কায়েদে আযমের কীর্তি পাকিস্তানকেও বিনষ্ট করিতে ইচ্ছুক। বর্তমান সংকটের নিরসনের জন্য আমি সম্ভাব্য সর্বপ্রকার বেসামরিক ও প্রশাসনতান্ত্রিক পদ্ধতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করিয়াছি।
জনগণের নেতা বলিয়া গণ্য সকলের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হওয়ার জন্য আমি প্রস্তাব দেই। তাহাদের মধ্যে অনেকে সম্প্রতি সম্মেলনে যোগাদন করেন, তবে তাহাদের পূর্বশর্ত মানিয়া লওয়ার পরই তাঁহারা উহাতে যোগদান করেন। অনেকে সম্মেলনে যোগদান করিতে অসম্মত হন।
কেন, উহা তাঁহারাই ভাল জানেন। একটি সর্বসম্মত ফর্মুলা উদ্ভাবনের জন্য আমি তাহাদের অনুরোধ জানাই। কিন্তু কয়েকদিন আললাচনার পরও তাঁহারা এই ব্যাপারে ব্যর্থ হন। অবশেষে তাঁহারা দুইটি প্রশ্নে একমত হন এবং আমিও উহার দুইটিই মানিয়া লই। প্রত্যক্ষ সার্বজনীন ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত হওয়ার পর জনপ্রতিনিধিদের নিকট অমীমাংসিত প্রশ্নসমূহ পেশ করার জন্য অতঃপর আমি প্রস্তাব দেই। আমার যুক্তি ছিল যে, সম্মেলনে যোগদানকারী প্রতিনিধিবর্গ জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত হন নাই বলিয়া যে সকল প্রশ্নে তাহারা একমত নন,
পৃষ্ঠা-১৪০

যে সকল বিষয়সহ সমুদয় বেসামরিক ও শাসনতান্ত্রিক প্রশ্ন সম্পর্কে তাহারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতে পারেন না।
দুইটি সর্বসম্মত প্রশ্ন বিবেচনার জন্য জাতীয় পরিষদের বৈঠক আহবান করার কথা আমি চিন্তা করি। কিন্তু শীঘ্রই সুস্পষ্টভাবে বুঝা যায় যে, উহা নিরর্থক হইবে। পরিষদের সদস্যরা আর স্বাধীন প্রতিনিধি থাকিতেছেন না এবং দুইটি সর্বসম্মত প্রশ্ন গৃহীত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা যাইতেছেনা। বস্তুত, সদস্যদের প্রতি হুমকি দেওয়া হইতেছে এবং অধিবেশন বর্জন অথবা তাহাদের এমন সব সংশোধনী উত্থাপনের জন্য বাধ্য করা হইতেছে, যাহার ফলে কেন্দ্রীয় সরকার বিলুপ্ত হইবে, সশস্ত্র বাহিনী বজায় রাখা অসম্ভব হইবে। দেশের অর্থনীতি বিভক্ত এবং পাকিস্তান ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে ছিন্ন ভিন্ন হইয়া যাইত। এই ধরনের বিশৃঙ্খল অবস্থায় পরিষদ আহ্বান করা হইলে পরিস্থিতি অধিকতর খারাপ হইয়া উঠিত। ক্রমাগত হিংসাত্মক কাজের হুমকির মধ্যে কাহারো পক্ষে কি মৌলিক সমস্যা সম্পর্কে শান্তভাবে আলোচনা করা সম্ভব? বর্তমান জটিল পরিস্থিতির মোকাবিলা করা বেসামরিক সরকারের সাধ্যাতীত। কাজেই প্রতিরক্ষা বাহিনীকে অবশ্যই অগ্রসর হইতে হইবে।
শুধু বাহিরের আক্রমণই নয়, অভ্যন্তরীণ আক্রমণ হইতে দেশকে রক্ষা করাও আপনাদের আইনগত ও শাসনতান্ত্রিক দায়িত্ব। দেমের নিরাপত্তা ও অখণ্ডতা রক্ষা এবং স্বাভাবিক সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক জীবন পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য আপনি এই দায়িত্ব পালন করিবেন বলিয়া জাতি আশা করে। ১২ কোটি মানুষের এই দুঃখের রাজ্যেও সমৃদ্ধি ফিরিয়া আসুক।
আমি বিশ্বাস করি যে, দেশের বিরাট সমস্যা মোকাবিলা করার মতো সামর্থ দেশপ্রেম, শিক্ষা ও কল্পনাশক্তি আপনার রহিয়াছে। আপনি এমন এক বাহিনীর নেতা, যে বাহিনী গোটা বিশ্বের সম্মান ও প্রশংসা অর্জন করিয়াছে। পাকিস্তান বিমান বাহিনী এবং পাকিস্তান নৌ-বাহিনীতে আপনার সহকর্মীরা সম্মানের অধিকারী এবং আমি জানি যে, আপনি সর্বদা তাহাদের পূর্ণ সমর্থন লাভ করিবেন। পাকিস্তানের সশন্ত্র বাহিনীকে অবশ্যই পাকিস্তানকে ধ্বংসের হাত হইতে রক্ষা করিতে হইবে।
আপনি যদি প্রত্যেক সৈনিক, নাবিক ও বৈমানিককে জানান যে, এক কালে তাহাদের সর্বাধিনায়ক হিসাবে থাকার জন্য আমি গর্ববোধ করি, তাহা হইলে আপনার নিকট কৃতজ্ঞ থাকিব। তাহাদের মনে রাখিতে হইবে যে, এই সঙ্কটজনক মুহূর্তে তাহাদেরকে পাকিস্তানের রক্ষকের ভূমিকা গ্রহণ করিতে হইবে। ইসলামের নীতি অনুযায়ী তাহাদের আচরণ করিতে হইবে।
পৃষ্ঠা-১৪১
এত দীর্ঘকাল, সাহসী পাকিস্তানবাসীর সেবা করা একটি সম্মান। অকৃত্রিম আনুগত্যের জন্য আমি অবশ্যই প্রশংসা করিব। আমি জানি, দেশপ্রেম সর্বদা আপনার জীবনের উৎস ছিল। আপনার সাফল্য এবং আমার দেশের কে কল্যাণ ও সুখ-সমৃদ্ধির জন্য আমি প্রার্থনা করি।
খোদা হাফেজ
আপনার বিশ্বস্ত
এম, এ. খান।
উনসত্তরের প্রচণ্ড গণবিক্ষোভের ফলে স্ব-ঘোষিত লৌহমানব ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান তার বরপুত্র সেনাপ্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে মার্চ মাসের পঁচিশ তারিখ রাত্রে ক্ষমতা হস্তান্তর করে পাকিস্তানের শাসন মঞ্চ থেকে চিরবিদায় নেন। সেই প্রসঙ্গে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সেনা প্রধান জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানকে উপরিউক্ত পত্র লেখেন।
২৫ মার্চ রাত ৮ টায় প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া। এক বেতার ভাষণের পর পরই জেনারেল ইয়াহিয়া খান পাকিস্তানের শাসন পদে আবির্ভূত হন।
১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাত্রি সোয়া নয়টার পর সারা পাকিস্তানে দ্বিতীয় বারের মতো সামরিক শাসন জারি করা হয়।
প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ আইয়ুব খান পাকিস্তান বেতারে দেওয়া তাঁর অনির্ধারিত বক্তৃতায় স্বীয় ক্ষমতা ত্যাগের ঘোষণা করে জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের হাতে শাসনভার অর্পণ করেন। প্রধান সামরিক প্রশাসক জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন পূর্বপাকিস্তান সময় রাত সোয়া নয়টায় পাকিস্তান বেতার থেকে সরাসরি শাসন সংক্রান্ত নির্দেশমালা পাঠে শাসতন্ত্র বাতিল, পরিষদসমূহের বিলুপ্তি এবং প্রেসিডেন্ট, গভর্নর ও মন্ত্রীপদে সমাসীন ব্যক্তিবর্গ স্ব-স্ব পদে বহাল থাকবেন না বলে ঘোষণা দেয়।
ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান বেতারে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত তার সংক্ষিপ্ত ভাষণে সামরিক শাসন প্রবর্তনের পটভূমি এবং লক্ষ্য বিশ্লেষণ করেন জনগণের সামনে। সামরিক শাসনের বিধি-বিধান ঘোষণা করেন।
পাকিস্তানের শাসনভার গ্রহণ করার পর জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান জাতির উদ্দেশ্যে দেওয়া এক বেতার ভাষণে বলেন :
“অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় আমি আপনাদেরকে জানাইয়া দিতে চাই যে, দেশে একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার উপযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করা ছাড়া অন্য কোনো অভিলাষ আমার নাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সুষ্ঠু, গলদমুক্ত, সততাপরায়ণ প্রশাসন ব্যবস্থাই সুস্থ বিবেক বুদ্ধিসম্পন্ন গঠনমূলক রাজনৈতিক জীবনধারার একটি অনিবার্য পূর্বশর্ত।
পৃষ্ঠা-১৪২
… প্রাপ্তবয়স্ক ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচিত এসব জনপ্রতিনিধিদের কাজই হইবে দেশকে একটি সরল শাসনতন্ত্র প্রদান করা। এবং যেসব বাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সতস্যা প্রতিনিয়ত জনমনকে বিব্রত করিতেছে, তাহার একটি সমাধান নির্দেশ করা।
ছাত্র , শ্রমিক ও কৃষক সম্প্রদায়সহ সমাজের বিভিন্ন স্তরের মানুষের সত্যিকার অভাব অভিযোগ সম্পর্কে আমি সম্পূর্ণ সচেতন আছি। এ প্রসঙ্গে আমি আপনাদেরকে এই আশ্বাসই দিতে চাই যে, আমার সরকার তাহাদের অভাব অভিযোগের প্রতিকারের জন্য কোনো চেষ্টারই ত্রুটি করিবে না’।
… পরিস্থিতির এমন অবনতি ঘটে যে, স্বাভাবিক আইন প্রয়োগ পদ্ধতিসমূহ সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ও অচল হইয়া পড়ে। দেশে জানমালের গুরুতর ক্ষতি হয় এবং বাসের ভাব জাতীয় জীবন বিপর্যস্ত করিয়া ফেলে। উৎপাদন বিপজ্জনকভাবে নিম্নতর পর্যায়ে হাস পাইয়াছে এবং অর্থনীতিকে সাধারণভাবে একটি নজিরবিহীন ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হইতে হইয়াছে। ধর্মঘট আর হিংসাত্মক কার্যকলাপ দৈনন্দিন বিষয়ে পরিণত হইয়াছে এবং দেশকে একটি অতল গহ্বরে ধ্বংসের প্রান্তে লইয়া যাওয়া হইয়াছে। দেশকে তাই নিরাপদ ও স্বাভাবিক পরিবেশের মধ্যে ফিরাইয়া আনা জরুরি কর্তব্যরূপে দেখা দেয়। সশস্ত্র বাহিনী এইরূপ একটি নৈরাজ্যপ্রায় অবস্থায় নীরব দর্শক হইয়া থাকিতে পারে না। এই জন্যই তাহাদেরকে দেশকে চরম বিপর্যয়ের কবল হইতে রক্ষার দায়িত্ব গ্রহণ করিতে হয়। এই জন্যই আমি উপরিউক্ত কর্মপন্থা গ্রহণ করিয়াছি।
জনসাধারণের জানমাল আর স্বাধীনতার নিরাপত্তা বিধান এবং প্রশাসনযন্ত্রকে পূর্বাবস্থায় পুনঃপ্রতিষ্ঠাই আমার সামরিক আইন জারি করার মুখ্য উদ্দেশ্য। অতএব, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসাবে আমার প্রথম ও প্রধানতম কর্তব্য হইতেছে সুস্থ বিবেকবোধ পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং শাসনযন্ত্র যাহাতে জনগণের সন্তোষ অনুযায়ী স্বাভাবিক কাজকর্ম পুনরারম্ভ করিতে পারে উহার নিশ্চয়তা বিধান করা। আমাদের প্রশাসনযন্ত্রে যথেষ্ট শৈথিল্য ও বিশৃঙ্খলা দেখা দিয়াছে। কিন্তু আমি দেখিতে চাই, যে কোনো প্রকারে যে কোনো পদ্ধতিতেই যেন ইহার পুনরাবৃত্তি না ঘটে, প্রশাসনযন্ত্রের প্রত্যেকেই এই হুঁশিয়ারিকে গুরুত্ব সহকারে গ্রহণ করুক।
আমি আপনাদেরকে স্পষ্ট করিয়া জানাইতে চাই যে, একটি নিয়মতান্ত্রিক সরকার কায়েমের জন্য অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি ব্যতীত আমার আর কোনো অভিলাষ নাই। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এই যে, দেশে একটি সুস্থ ও গঠনমুখী রাজনৈতিক জীবনধারার প্রতিষ্ঠা এবং ভোটাধিকারের ভিত্তিতে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে নির্ধাচিত জনপ্রতিনিধিদের নিকট নির্বিঘ্নে ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য।
পৃষ্ঠা-১৪৩

প্রথমে একটি সুষ্ঠ ও স্বচ্ছ প্রশাসনযন্ত্র আবশ্যক। অতঃপর দেশবাসীকে একটি কর্মোপযোগী শাসনতন্ত্র প্রদান এবং জনসাধারণের অন্তরে বিক্ষোভ যাবতীয় রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক সমস্যার সমাধান বাহির করা এই সমস্ত জনপ্রতিনিধিরই কর্তব্য হইবে।”
প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে জেনারেল ইয়াহিয়া খান ঘোষণা করলেও ক’দিন পর নিজের আসনকে আরও পাকাপোক্ত করার জন্যে ৩১ মার্চ জাতির উদ্দেশ্যে এক বেতার বিবৃতিতে বললেন : ‘যেহেতু পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ফিল্ড মার্শাল মোহাম্মদ আইয়ুব খান ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ রাত্রি ৯টা ১৫ মিনিটের সময় তাহার প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার ত্যাগ করিয়াছেন এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ও পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক হিসাবে আমি জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান এর নিকট সকল ক্ষমতা হস্তান্তর করিয়াছেন, আমি ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চের উক্ত রাত্রে সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান ইসলামিক প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার এবং উল্লিখিত ক্ষমতাসমূহ ও এইভাবে অন্য যে সকল ক্ষমতা আমার উপর ন্যস্ত হইয়াছে, তাহা প্রয়োগের দায়িত্বভার গ্রহণ করিয়াছি।”
ইয়াহিয়ার কার্যকলাপে জনমনে নির্বাচন সম্পর্কে আস্থা ফিরে এলো। তিনি তার মন্ত্রিপরিষদের ক’জন বেসামরিক ব্যক্তিকেও গ্রহণ করেন। মন্ত্রিপরিষদে যোগ দেয় পূর্ববাংলা থেকে ডাঃ এ, এম, মালিক, এ, কে, এম, হাফিজুদ্দিন, শামস-উল-হক এবং আহসানুল হক। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সরদার আব্দুর রশিদ খান, নবাব মুজাফফর আলী কিজিলবাশ ও মেজর জেনারেল শের আলী, খান। ১৯৬৯ সালের ৪ আগস্ট এই সাত সদস্যের মন্ত্রিপরিষদ তার নিকট শপথ গ্রহণ করেন।
যে গণ-আন্দোলনের মুখে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব ইয়াহিয়ার কাছে দেশের শাসনক্ষমতা হস্তান্তর করেন – সামরিক শাসন জারি থাকা সত্ত্বেও সে আন্দোলন অব্যাহত থাকলো। সভা, মিছিল, হরতাল, লাঠিচার্জ, গুলি চালানো ইত্যাদি হলো নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। তাই শেষ পর্যন্ত রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের দাবির মুখে সরকার রাজনৈতিক দলগুলোর উপর আরোপিত বিধি-নিষেধ প্রত্যাহার করে নির্বাচনী প্রচারণা চালাবার সুযোগ দেয়। ১৯৭০ এর ৫ অক্টোবর ঘোষিত হলো সাধারণ নির্বাচনের তারিখ। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান জনসংখ্যা ভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে এক ইউনিট বিলোপের দাবি জানিয়ে বিভিন্ন স্থানের সভা সমাবেশে বক্তব্য রেখে জনমত সৃষ্টি করতে লাগলেন।
পৃষ্ঠা-১৪৪

ইয়াহিয়া খান পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা ও প্রাপ্ত বয়স্কদের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনসংখ্যাভিত্তিক প্রতিনিধিত্ব মেনে নেন এবং এক ইউনিট প্রথা বাতিল করেন । তিনি ৩০ মার্চ লিগাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডার (এল, এল, ও) ঘোষণা করেন । এল, এফ, ও প্রেসিডেন্টকে এই মর্মে ক্ষমতা প্রদান করে যে নির্বাচিত গনপরিষদ কর্তৃক পাসকৃত শাসনতন্ত্র যদি পাকিস্তানের সংহতি ও ইসলামি তলার পরিপন্থী হয় তাহলে তিনি তা অনুমোদন না করে গণ পরিষদ বাতিল ঘোষণা করতে পারবেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এল, এফ, ও-এর অধীনে নির্বাচন করতে সম্মত হন। এ প্রসঙ্গে তিনি সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘আগে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নেই, তারপর আমি এল, এফ, ও টুকরো টুকরো করে ছিড়ে ফেলে দেব।’
‘ইতোমধ্যে সারাদেশ হলো বন্যায় প্লাবিত। মাত্র আওয়ামী লীগ ছাড়া প্রায় অন্য সব রাজনৈতিক দলই প্রাকৃতিক দুর্যোগের অজুহাতে নির্বাচন পিছানোর দাবি জানালো। নতুন তারিখ ধার্য হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং বন্যাপ্লাবিত দুর্গত এলাকার জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩০ টি আসনের জন্যে নির্বাচনের তারিখ হয় ১৯৭১ এর ১৭ জানুয়ারি।
এ দিকে ১২ নভেম্বর এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে খুলনা, বরিশাল, পটুয়াখালী, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রাম জেলায় সমুদ্র উপকূলবর্তী বিস্তীর্ণ এলাকার লক্ষ লক্ষ মানুষ প্রাণ হারায়। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান ঘূর্ণিদুর্গত এলাকা সফর করলেন। বৃদ্ধ জননেতা মওলানা ভাসানী বাকরুদ্ধ কণ্ঠে বললেন, “হযরত নুহের জামানার পর এত বড় প্রলয় কাণ্ড মানুষের ইতিহাসে ঘটেনি। পূর্ব বাংলার উপকূলের ১০ থেকে ১২ লক্ষ লাশ পড়ে আছে—ওদের দাফনের কোনো ব্যবস্থা নেই। গলিত লাশ ও মরা পশুর দুর্গন্ধের মধ্যে যারা এখনও আর্তনাদ করছে আল্লাহর কুদরতেই তারা বেঁচে আছে।”
সত্তরে ঘূর্ণিঝড় ও এক শ্রেণি মানুষের উথলতাকে মূলধন করে প্রতিক্রিয়াশীল কুচক্রীদল নির্বাচন বানচালের সকল প্রকার চেষ্টা চালালেও শেষ পর্যন্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনের ফল দেখে পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী চমকে ওঠে। আওয়ামী লীগ সৃষ্টি করলো পার্লামেন্টারী গণতন্ত্রের এক নজীর বিহীন ইতিহাস। নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হবার পর ৯ ডিসেম্বর শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বললেন : আমাদের জনগণ এক ঐতিহাসিক রায় প্রদান করিয়াছে। তাহারা এক অবিরাম সংগ্রামের মধ্য দিয়া আমাদের এই রায় প্রদানের অধিকার অর্জন করিয়াছে আর সেই সংগ্রামে হাজার হাজার মানুষ জীবন উৎসর্গ করিয়াছে। অগণিত মানুষ বছরের পর বছর ধরিয়া সহ্য করিয়াছে। জনগণের সগ্রামকে উহার প্রথম বিরাট বিজয় মণ্ডিত করার জন্য আমরা
পৃষ্ঠা-১৪৫

সর্বশক্তিমান আল্লাহর নিকট কৃতজ্ঞ। আমরা আমাদের শহিদের প্রতি সালাম জানাইতেছি—যাহারা নির্মম নিপীড়নের মুখেও এইকারণে সংগ্রাম করিয়া গিয়াছে যে, একদিন যেন আমরা প্রকৃত স্বাধীনতায় বসবাস করিতে পারি । আওয়ামী লীগের বিরাট বিজয় প্রকৃত পক্ষে লক্ষ লক্ষ নিপীড়িত মানুষের বিজয় । আমরা আমাদের জনগণ, আমাদের ছাত্র, আমাদের শ্রমিক ও কৃষকদের ভালবাসায় অভিভূত হইয়াছি। তাহারা ইহা যথার্থভাবেই ব্যক্ত করিয়াছে যে আওয়ামী লীগ তাহাদেরই পার্টি। আমরা নিশ্চিত যে, তাহারা ১৭ ডিসেম্বরে প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও অবিরাম কাজ করিয়াছে, তাহারা নিজেদের যথার্থ পুরস্কৃত মনে করিয়াছে। যে সাধারণ নির্বাচন, সর্বোপরি ৬ দফা ভিত্তিক পর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনসহ গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে বাংলাদেশের মানুষের এক গণভোট, সেই নির্বাচনের শান্তিপূর্ণ ও সুশৃংখলভাবে একটি পরিষ্কার রায় প্রদানের ব্যাপারে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে জনসাধারণ ঐক্য ও শৃংখলার যে পরাকাষ্ঠা দেখাইয়াছে, উহা হইল তাহাদের পুরস্কার।
‘যাহা হউক, আমাদের লক্ষ্য এখনও সম্মুখে বিদ্যমান, এ লক্ষ্য বাস্তবায়িত না হওয়া পর্যন্ত সংগ্রাম অব্যাহত থাকিবে। ৬-দফা ফমূলাভিত্তিক পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন সম্মিলিত একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন এবং উহার পূর্ণ বাস্তবায়ন করিতে হইবে এবং প্রকৃতির ধ্বংসলীলা ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের হাত হইতে বাংলাদেশ ও উহার মেহনতি জনতাকে অবশ্যই রক্ষা করিতে হইবে। হাজার সমস্যার মধ্যে ক্ষুধা, বেকারত্ব, রোগ, বন্যা, দুর্ভিক্ষ ও নিরক্ষতার সমস্যার আশু সমাধানের তাগিদ দিতেছে। ঘূর্ণিদুর্গত উপকূলবর্তী এলাকা সমূহে যে দশ লক্ষ লোক প্রাণ দিয়াছে এবং যে তিরিশ লক্ষ লোক টিকিয়া থাকার সগ্রাম করিতেছে উহাই আমাদের স্মরণ করাইয়া দেয় যে, অতীতে কি রূপ শোষণ ও অবহেলা চলিয়াছষ এবং সম্মুখে আমাদের দায়িত্ব কত বিরাট।
‘আমরা মনে করি যে, কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ ও প্রকৃতির ধ্বংসলীলা হইতে আমাদের জনগণকে রক্ষার জন্য আমাদের সকল শক্তি ও সম্পদ নিয়োগ করার শপথ লইতে হইবে। পাকিস্তানের জনসাধারণের প্রথম ইশারাকে আমরা স্বাগত জানাই। আমরা তাহাদের বাঙালি ভাইদের অন্তরের অন্তঃস্থলের আকাক্ষা বাস্তবায়নের আমাদেরকে সমর্থন করার জন্য পশ্চিম-পাকিস্তানের জাগ্রত জনতাকে আহ্বান জানাইতেছি। আমাদের পক্ষ হইতে আমরা তাহাদেরকে ভূস্বামী ও কায়েমী স্বার্থবাদীদের শোষণ হইতে মুক্তির সংগ্রামে আমাদের সমর্থন প্রদানের নিশ্চয়তা দিতেছি। আমরা বিশ্বাস করি যে, একমাত্র জনগণের যৌথ প্রচেষ্টার মাধ্যমেই আমরা আমাদের সম্মুখের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করিতে পারি। আমরা এই সত্য হইতে আমাদের আশা ও শক্তি সঞ্চয় করি যে, আমাদের
পৃষ্ঠা-১৪৬

জনগণ তাহাদের ভবিষ্যৎ বংশধরদের প্রতি দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। একমাত্র জনগণের ঐক্যের উপরই সমাজকে পুনর্গঠনে এবং অঞ্চলেও মানুষের অবিচার দুর করার কার্যকরী কর্মসূচির ভিত্তি দাঁড়াইতে পারে। কাজেই আমরা সকলের প্রতি অতীতের মতানৈক্য ও বিদ্বেষ পরিহার করার আবেদন জানাইতেছি যাহাতে আমাদের লক্ষ লক্ষ মেহনতি জনতার মুক্তি ও সমৃদ্ধি লক্ষ্যে ঐক্যবদ্ধভাবে অগ্রসর হইতে পারি। জয় বাংলা।”
১৯৭০ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনেও পূর্ব বাংলার মানুষ আওয়ামী লীগ-এর পক্ষে চূড়ান্ত রায় দেয়। জাতীয় পরিষদের ৩১৩টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭, পিপলস পার্টি ৮৮, কাইয়ুম মুসলিম লীগ ৭, জমিয়তউল-উলেমাই-ইসলাম (হাজারী গ্রুপ) ৭, মারকাজি জমিয়তউল উলেমা (থানভি গ্রুপ) ৭, জামাতে ইসলাম ৪, ন্যাপ (ওয়ালীপন্থী) ৭, পি, ডি. পি ১, নির্দলীয় প্রার্থী ১৪ এবং কনভেনশন মুসলিম লীগ ১৫টি আসন লাভ করে।
প্রাদেশিক পরিষদের আসন সংখ্যা ৩১০ এর মধ্যে আওয়ামী লীগ ২৯৮টি, পি.ডি. পি ২, ন্যাপ (ওয়ালী পন্থী) ১, নিজামে ইসলাম ১, জামাতে ইসলাম ১ ও নির্দলীয় প্রার্থী ৭ টি আসন লাভ করে।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যে জনগণকে ধন্যবাদ জানিয়ে ১১ ডিসেম্বর এক বিবৃতি প্রচার করে। তিনি বললেন : “জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের যে পরিকল্পনা সামরিক সরকারের রয়েছে নির্বাচন হচ্ছে তার প্রথম পর্যায় মাত্র। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে একটি শাসনতন্ত্র প্রণয়ন। এ জন্যেই নব নির্বাচতি প্রার্থীদের আমি স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যে, জনগণ তাদের ভোট দিয়ে তাদের উপর বিরাট আস্থা স্থাপন করেছে। দেওয়া নেওয়া ও সহনশীলতার ভিত্তিতে এখনই তারা শাসনতন্ত্র প্রণয়নের কাজে লেগে যান, জাতি এখন তাদের কাছে তাই চাচ্ছে। জাতি তাদের উপর যে আস্থা স্থাপন করেছে তারা তা রক্ষা করবেন, এ বিশ্বাস আমার আছে। তাদের প্রচেষ্টা সফল হোক, এটাই কামনা করি।’
এদিকে পিপলস পার্টি প্রধান প্রধান জুলফিকার আলী ভুট্টো লাহোরের এক জনসভায় বলেন, তার দলের সহযোগিতা ছাড়া কোনো কেন্দ্রীয় সরকারই কাজ চালাতে পারে না। তিনি আরো বলেন, জাতীয় পরিষদের বিরোধি দলে বসে ক্ষমতায় যাওয়ার জন্যে আরো পাঁচ বছর অপেক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। কারণ, তিনি যদি ক্ষমতায় না যান তাহলে জনগণের মঙ্গলের জন্যে কাজ করার কেউ থাকবে না। এবং ক্ষমতায় না গিয়ে জনগণের জন্য কাজ করা সম্ভব নয়। সর্বোপরি তিনি বলেন, পাঞ্জাব ও সিন্ধুই হলো পাকিস্তানের ক্ষমতার উৎস এবং
পৃষ্ঠা-১৪৭

কেন্দ্রস্থল আর এই দুই প্রদেশেই তার দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা রয়েছে অতএব , তাঁকে ক্ষমতায় যেতেই হবে।
১৯৭১ এর ৩ জানুয়ারি ঢাকায় রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) এক ঐতিহাসিক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচন-বিজয়ী আওয়া লীগের জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের নবনির্বাচিত সদস্যরা এই সভায় বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন দাবিতে অটল থাকার শপথ গ্রহণ করেন। শপথ গ্রহন অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন স্বয়ং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। তিনি ঘোষণা করেন , ছয় দফার ভিত্তিতে দেশের শাসনতন্ত্র অবশ্যই রচিত হবে। ঠিক এর তিন দিন পর ৭ জানুয়ারি এক অভাবনীয় ঘটনা ঘটে। শেখ মুজিবের বাসভবনে ধৃত হলো ছোরাসহ এক যুবক। পুলিশী জেরায় সে স্বীকার করে, শেখ সাহেবকে হত্যার জন্য তার উপর নির্দেশ ছিল। এই নির্দেশ কাদের তা জানা যায়নি। একদিন পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের জীবন রক্ষা পাওয়ায় স্বস্তি প্রকাশ করে বাণী পাঠান ঢাকায়। আর একদিন পর তিনি এলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য, শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা। ১১ জানুয়ারি বসল মুজিব-ইয়াহিয়া রুদ্ধদ্বার বৈঠক। ১৩ জানুয়ারি হল তিনঘণ্টা ব্যাপী মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। এই বৈঠকে শেখ মুজিবের সঙ্গী ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, খন্দকার মোশতাক আহমদ, মনসুর আলী ও কামরুজ্জামান। পরদিন ১৪ জানুয়ারি করাচি প্রত্যাবর্তনের প্রাক্কালে ঢাকা বিমান বন্দরে ইয়াহিয়া বললেন, ‘শেখ মুজিব দেশের ভাবী প্রধানমন্ত্রী আরও বললেন, ‘শেখ মুজিবের সরকার শীঘ্রই ক্ষমতা গ্রহণ করতে যাচ্ছে।’ তিনি (শেখ মুজিব) যখন ক্ষমতা গ্রহণ করবেন, তখন আমি ক্ষমতায় থাকবো না। দেশের এক বিপর্যস্ত অর্থনৈতিক কাঠামো আমি তার জন্য উত্তরাধিকার হিসেবে রেখে যাব। ১৭ জানুয়ারি বাংলাদেশের ঘূর্ণিঝড় প্রবাহিত এলাকায় স্থগিত রাখা জাতীয় পরিষদের ন’টি এবং প্রাদেশিক পরিষদের একুশটি আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এবং সব কয়টি আসনেই আওয়ামী লীগ প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। ২২ জানুয়ারি পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তানে একটি প্রকৃত ফেডারেশন গঠনের প্রশ্নে তিনি শেখ মুজিবের সঙ্গে একমত।’ ২৭ জানুয়ারিতে ভুট্টো এলেন ঢাকায়। উদ্দেশ্য শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনা। ঢাকা বিমান বন্দরে বললেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ অভিমতের প্রতি তার শ্রদ্ধা রয়েছে। শেখ মুজিবের বাসভবনে তারা এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে মিলিত হলেন। ৭৫ মিনিটের জন্য। আলোচনা শেষে ভুট্টো বললেন, এই বৈঠক দ্বারা তিনি সুখি ও সম্মানিত বোধ করছেন। ২৮ জানুয়ারিতে ভুট্টোর হোটেল কক্ষে আবার আলোচনা, ৭০ মিনিটের জন্য দলীয় নেতারা আলাদা-আলাদাভাবে শাসনতন্ত্র সম্পর্কে আলোচনায় বসেন। পরদিন তৃতায় দফা মুজিব-ভুট্টোর বৈঠক। বৈঠক শেষে ভুট্টো বললেন, একটি জনকল্যাণমূলক
পৃষ্ঠা-১৪৮
শাসনতন্ত্র প্রণয়নের জন্য তিনি সব রকমের সহায়তা দেবেন,৩০ জানুয়ারী এম, এল, নাবিক জাহাজ যোগে মুজিব-ভুট্টোর নৌবিহার পাঁচঘণ্টা ব্যাপী। সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো শেখ মুজিবের সঙ্গে তার আলোচনা সফল হয়েছে কিনা এ প্রশ্ন এড়িয়ে গিয়ে বলেন, আমরা দু’নেতাই আলোচনায় সন্তুষ্ট। তবে আলোচনার দ্বার খোলা রইল। পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্যান্য নেতাদের মতামত জেনে অমীমাংসিত বিষয়গুলো আলোচনার জন্য আবার বৈঠকে বসব। কিন্তু ভুট্টো নতুন চেহারা ধারণ করলেন ঢাকা থেকে লাহোর পৌছেই। ভুট্টো ঢাকা থেকে লাহোর পৌছবার আগেই ৩০ জানুয়ারি সারা দেশের মানুষ স্তম্ভিত হয়ে শুনল, কাশ্মীরি মুক্তিযোদ্ধা নামধারী দু’জন বিমান-ছিনতাইকারী ভারতীয় বিমান ‘গঙ্গা’ জোর করে লাহোরে অবতরণ করায়। ৩১ জানুয়ারিতে ভুট্টো নামলেন লাহোর বিমানবন্দরে। পাকিস্তানের সামরিক কর্তৃপক্ষ তাকে অবাধে বিমান দস্যুদের সঙ্গে দেখা করার সুযোগ দেয়। তাদের গলায় হাত রেখে ভুট্টো অন্তরঙ্গভাবে অনেকক্ষণ আলাপ করলেন, তাদের কাজের যথেষ্ট প্রশংসা করলেন। ভুট্টোর প্রশংসায় উৎসাহিত বিমান দস্যুরা ২ ফেব্রুয়ারি অপহৃত ভারতীয় বিমান ‘গংঙ্গা’ বিনা বাধায় পাকিস্তানি প্রহরীদের চোখের সামনে ধ্বংস করে। পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ক্ষমতা হস্তান্তর না করার জন্য শেষ চাল হিসেবে ভারতের সঙ্গে বিবাদ ও উত্তেজনা সৃষ্টি এবং সেই বিবাদের অজুহাতে নব-নির্বাচিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন না ডাকা ছিল এই ষড়যন্ত্রের উদ্দেশ্যে। তাদের এই চক্রান্তে প্রধান সহযোগীর ভূমিকা নিয়েছেন ভুট্টো। ৩ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে ভারতীয় বিমান অপরহণে দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, “ক্ষমতা হস্তান্তর বিঘ্নিত করার জন্য এটা পাকিস্তানের স্বার্থান্বেষী মহলের একটা বড় চক্রান্ত।” ভারত সরকার ভারতীয় এলাকার উপর দিয়ে পাকিস্তানের সামরিক বিমান চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। পরে সামরিক বিমান চলাচলের উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ছুটে যান করাচিতে। সাংবাদিকদের কাছে ইয়াহিয়া বললেন, তিনি অবসর বিনোদন ও শিকারের জন্য করাচি এসেছেন। রাজনৈতিক আলোচনা মুখ্য উদ্দেশ্য নয়। ৯ ফেব্রুয়ারি শেখ মুজিব এক বিবৃতিতে বলেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন এখনও আহুত না হওয়ায় তিনি সামরিক জান্তার উদ্দেশ্য সম্পর্কে উদ্বিগ্ন। ভুট্টো ১০ ফেব্রুয়ারি মুলতানে এক বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, তারও অভিযোগ, সরকার ক্ষমতা হস্তান্তরে বিলম্ব করছে। তিনি আরও বলেন, যদি ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণীত হয়, তাহলে তিনি আন্দোলন শুরু করবেন। পরদিনই ভুট্টো আগের দিনে বক্তব্য অস্বীকার করে। বলেন, এমন কথা তিনি বলেননি। কতিপয় দেশি ও বিদেশি শক্তি দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝি সৃষ্টির চেষ্টা করছে। এই প্রথম ভুট্টো প্রকাশ্যে এক দেশে দুই সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের কথা ঘোষণা করে।
প্রিস্থা-১৪৯
ফেব্রুয়ারিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ঘোষণা করেন, মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন বসবে। একই দিনে পাকিস্তানে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদুত মুজিবের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং ভুট্টো সীমান্ত প্রদেশের মুসলিম লীগ নেতা কাইয়ুম খানের এক আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। এই বৈঠকের পর ফেব্রুয়ারি পেশোয়ারে এক সাংবাদিক বৈঠকে ভুট্টো নাটকীয়ভাবে ঘোষণা , ছয় দফা প্রশ্নে কোনো আপোষ মীমাংসার সম্ভাবনা না থাকায় তার দলের পক্ষে ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদান করা সম্ভব হবে না। তবে ছয় দফায় কোনো রদবদল বা আপোষের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হলে তারা যে কোনো দিন ঢাকা যাবেন। ‘ভুট্টোর এই হুমকি সম্পর্কে শেখ মুজিব কোনো মন্তব্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানান। ১৭ ফেব্রুয়ারি তারিখে বালুচ নেতা নবাব আকবর খান বুগতি ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বানচাল করার জন্য ভুট্টো যে সিদ্ধান্ত তা পাকিস্তানের দু’অংশকে বিচ্ছিন্ন করার উদ্দেশ্যেই নেওয়া হয়েছে। ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার জরুরি তলব পেয়ে ভুট্টো পিণ্ডিতে যায়। ঢাকায় জাতীয় পুনর্গঠন সংস্থার অফিসে একদল অজ্ঞাতনামা ব্যক্তি বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ঢাকায় নির্ধারিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন না বসে, তার অজুহাত সৃষ্টির জন্যই স্বার্থান্বেষী মহলের চক্রান্ত। ভারতীয় বিমান অপহরণ ও ধ্বংস এবং ঢাকায় এই বোমা বিস্ফোরণ এসবই ছিল চক্রান্তমূলক।
২১ ফেব্রুয়ারি শহিদ দিবসে শেখ মুজিব পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানালেন, ‘আসুন, জাতীয় পরিষদের অধিবেশনের আগেই আমরা ৬ দফা সম্পর্কে খোলাখুলি ও বিস্তারিত ভাবে আলোচনা করি। কিন্তু মঞ্চের নাটক ও নেপথ্যের মহড়া তখন অনেক দূর এগিয়ে। একুশে ফেব্রুয়ারির পরই শুরু হল, পাকিস্তানের রাজনীতিতে দ্রুত ও নাটকীয় পট পরিবর্তন।
২২ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার সামরিক মন্ত্রিপরিষদ বাতিল করে দিয়ে বিভিন্ন প্রদেশের গভর্নর ও সামরিক আইন প্রশাসকদের নিয়ে বিশেষ বৈঠকে বসেন। একই দিন কাইয়ুম খান ঘোষণা করেন, তার দলও ভুট্টোর দলের। পদাঙ্ক অনুসরণ করে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যাবে না। ২৪ ফেব্রুয়ারি মুজিব ঘোষণা করলেন,“জনসাধারণের নির্বাচনী বিজয় বানচাল করার প্রকাশ্য ষড়যন্ত্র শুরু হয়েছে। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য জনসাধারণের সতর্ক ও সজাগ হওয়া দরকার।’ ওই তারিখেই কাইয়ুম-পন্থী মুসলিম লীগের মত কাউন্সিল মুসলিম লীগও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে যে, তারা জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ঢাকায় আসবেনা। ২৬ ফেব্রুয়ারি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সঙ্গে ভুট্টোর গোপন বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্যান্য ৬টি দলের ৩৩ জন সদস্য জাতীয়
পৃষ্ঠা-১৫০

পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেন। ২৮ ফেব্রুয়ারি ভুট্টো ঘোষণা করলেন পিপলস পার্টির সদস্যদের উপস্থিতি ছাড়া পরিষদের অধিবেশন বসলে তিনি খাইবার থেকে করাচি পর্যন্ত আন্দোলন শুরু করবেন। পিপলস পার্টির অংশ গ্রহণ ছাড়া জাতীয় পরিষদে পশ্চিম-পাকিস্তানের মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি পদেশেই পূর্ণ হরতাল পালনের আহ্বান জানাবেন। তিনি আরও বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ ৬ দফার বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছে। ওই রাতেই পাকিস্তানের নির্বাচন কমিশন ঘোষণা করেন, জাতীয় পরিষদের পশ্চিম পাকিস্তনের মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত ৬টি আসনে আপাতত নির্বাচন স্থগিত রাখা হল। বাংলাদেশের মানুষের আর কিছু বুঝতে বাকি রইল না। ১ মার্চ সোমবার ১৯৭১। স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা চলছে। প্রায় ত্রিশ তাহার দর্শক খেলা দেখতে উপস্থিত। খেলা দেখার মাঝেও চলছে উত্তেজিত রাজনৈতিক আলোচনা। সেদিন ঢাকার সংবাদপত্রে দুটি গুরুত্বপূর্ণ খবর প্রকাশিত হয়। এক : আগের দিন (রবিবার) পি. আই. এ. বিমানযোগে পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন জাতীয় পরিষদ সদস্য ঢাকা এসে পৌঁছেছেন। তাদের অধিকাংশই ওয়ালীমুজাফফর ন্যাপের। দুই : রবিবার বিকেলে ঢাকার শিল্প ও বণিক সমিতির সংবর্ধনা-সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেন, “ভুট্টো তাঁর দলের ৮৩ জন সদস্য নিয়ে ঢাকা আসতে চান না। আমি যদি বলি, ১৬০ জন সদস্য নিয়ে আমরা পশ্চিম পাকিস্তানে যাব না, তাহলে পরিস্থিতি কি দাঁড়ায়? পরিষদে আলোচনায় না বসে আগে কি করে আমরা প্রতিশ্রুতি দেব, যে ছয় দফা সংশোধন করা হবে? ৬ দফা এক্ষণে জনগণের সম্পত্তি, তাদের নির্বাচনী রায়। ব্যক্তিগতভাবে এটা সংশোধন বা পরিবর্তনের অধিকার আমার নেই। আসলে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর বানচাল করার ষড়যন্ত্র চলছে। এই চক্রান্ত অব্যাহত থাকলে পরিণামে যা ঘটবে, তজ্জন্য চক্রান্তকারীরাই দায়ী হবেন।” পশ্চিম পাকিস্তানের কোনো কোনো সদস্য ও নেতা শাসনতন্ত্র প্রণয়নে তাদের প্রস্তাব গ্রহণের আশ্বাস দেওয়া হলে তারা অধিবেশনে যোগ দেবেন বলে যে উক্তি করেছেন, তার উল্লেখ করে শেখ মুজিব বলেছেন “যদি একজন সদস্যও কোনো ন্যায়সংগত প্রস্তাব দেন, তা গ্রহণ করা হবে। আমরা আমাদের সংখ্যাগরিষ্ঠতার সুযোগ নিয়ে অন্যায় কিছু করবো না।”
এর দুদিন পরেই ঢাকায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন। বাংলাদেশের সকলের মনেই তখন উদ্বেল প্রতীক্ষা। আশা ও আশংকার মিশ্র অনুভূতি। শেষ পর্যন্ত ভুট্টো তাঁর মত পাল্টাবেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তার প্রতিশ্রুতি রাখবেন, এটাই বাংলাদেশের মানুষের একমাত্র আশা। সোমবার সকল দশটার আগেই
পৃষ্ঠা-১৫১

জানাজানি হয়ে গেল, দুপুর একটায় প্রেডিসেন্ট ইয়াহিয়ার বেতার ভাষা । কি নতুন কথা বলবেন তিনি? শংকিত বুকে সকলেই অপেক্ষমান। বেলা একটায় বেতার ঘোষক বলেন, ‘এবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেতার ভাষণ দেবেন। কিন্তু না , ইয়াহিয়ার কণ্ঠ নয়। প্রেসিডেন্টের ঘোষণা পাঠ করলেন অপর এক কণ্ঠ-জাতীয় পরিষদের বৈঠক ৩ মার্চ বসবে না। অনির্দিষ্ট কালের জন্য স্থগিত করা হলো।‘ আশা ভংগের বেদনায় প্রথমে সকলেই স্তম্ভিত হলো। তারপরই গর্জে উঠল সারা ঢাকা। স্টেডিয়ামের খেলা ভেঙে, তাবুতে আগুন ধরিয়ে হাজার হাজার বিক্ষুব্ধ দর্শক বেরিয়ে এলো রাস্তায়। ঢাকা হাইকোর্টের সামনে একটি বা অগ্নিদগ্ধ হল। লাখো বিক্ষুব্ধ মানুষ সমবেত হলো হোটেল পূর্বাণীর সামনে, বিকেল চারটে শেখ মুজিবের সাংবাদিক সভা। শেখ মুজিব সাংবাদিক সভা শেষ করে সমবেত জনতার উদ্দেশ্যে বললেন, জাতীয় পরিষদের বৈঠক স্থগিত রাখা। একটি চক্রান্তের পরিণতি ছাড়া আর কিছু নয়। সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মতামত উপেক্ষা করে সংখ্যালগিষ্ঠ দলের নেতার প্রতিটি দাবি মেনে নেওয়া হচ্ছে। এটা গণতন্ত্র নয়, স্বৈরতন্ত্র। এর প্রতিবাদে প্রথম কর্মসূচি হিসাবে পরদিন ঢাকায় এবং তারপরের দিন সারা বাংলাদেশে হরতাল পালিত হবে এবং ৭ রেসকোর্সে জনসভা হবে। এ সভায় ঘোষিত হবে আন্দোলনের পূর্ণাঙ্গ কর্মসূচি। শেখ মুজিব আরও বলেন, “আগামী ৭ মার্চের মধ্যে যদি বর্তমান পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন ঘটানো না হয়, তা হলে ভবিষ্যতে যা ঘটবে, তজ্জন্য তিনি দায়ী থাকবেন না।”
১ মার্চ আরও দুটো ঘটনা ঘটল। বাংলাদেশের গভর্নর ভাইস এডমিরাল আহসান এর স্থলে সামরিক প্রশাসক লেফটেনেন্ট জেনারেল সাহেবজাদা ইয়াকুব খানের সামরিক প্রশাসনের দায়িত্ব গ্রহণ। শেখ মুজিবের আহ্বানে যে আন্দোলনের শুরু তার খবর ও ছবি সংবাদপত্রে ছাপানো সামরিক আদেশ বলে নিষিদ্ধ করা হলো।
প্রেসিডেন্টের ঘোষণার পরপরই ঢাকাসহ প্রদেশের অন্যান্য শহরের উত্তাল জনতা ক্রোধে ক্ষোভে ফেটে পড়ে। স্থানীয় দৈনিক ইত্তেফাকের ভাষায় সেদিনের ঢাকার অবস্থা ছিল নিম্নরূপঃ
“বহু প্রতীক্ষিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনুষ্ঠানের মাত্র দুই দিন পূর্বে গতকাল (সোমবার) বেলা ১-০৫ মিনিটের সময় আকস্মিকভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘোষণা করিয়া পাকিস্তান বেতারে প্রেসিডেন্টের এই বিবৃতি প্রচারে দলমত নির্বিশেষে সকল শ্রেণির বিক্ষোভে দাবানলের মতো ছড়াইয়া পড়ে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে শহরের সকৎ দোকানপাট বন্ধ হইয়া যায়। সরকারি-বেসরকারি অফিস এবং ব্যবসায়
পৃষ্ঠা-১৫২

প্রতিষ্ঠানের কর্মসুচি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-শিক্ষক, কল-কারখানার শ্রমিক এবং আদালতের আইনজীবীগণ রাস্তায় নামিয়া আসেন। গোটা শহর বিগত ১৯৬৯ গণঅভ্যুত্থানের ন্যায় স্বতঃস্ফূর্ত মিছিলের নগরীতে পরিণত হয়। শিল্প এলাকা , কল-কারখানা, অফিস-আদালত এবং বিভিন্ন মহল্লা হইতে অসংখ্য স্বতঃস্ফূর্ত মিছিল বাহির হয়। মিছিলকারীদের চোখে-মুখে ক্ষোভানল পরিলক্ষিত সইতেছিল। বজ্র কণ্ঠে তাহারা সেদিন প্রকম্পিত করিয়া ভুট্টো ও শোষণ বিরোধি শ্লোগান দান করেন। এই সময় ঢাকা স্টেডিয়ামের বি, সি, সি, পি, টিম এবং ইন্টারন্যাশনাল একাদশ টিমের মধ্যে অনুষ্ঠানরত খেলা স্বতঃস্ফূর্তভাবে ভাংগিয়া যায়। স্টেডিয়াম হতে অগ্নিস্ফুলিংগের মতো বর্ষিত ক্রীড়ামোদেরণও রণপ্রস্তুত সৈনিকের ন্যায় লাঠি-সোটাসহ মিছিলে শামিল হইয়া যান। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় মিছিলগুলো আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের মুখ হইতে নির্দেশ লাভের উদ্দেশ্যে মতিঝিলস্থ হোটেল পূর্বাণীর দিকে অগ্রসর হইতে থাকে। বেলা ৩টার দিকে হোটেল পূর্বাণীর সম্মুখভাগ লোকে লোকারণ্য হইয়া যায়।
উল্লেখযোগ্য যে, বেলা সাড়ে তিনটায় হোটেল পূর্বাণীতে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির বৈঠক অনুষ্ঠানের কথা ছিল। বৈঠক শুরু হওয়ার পূর্বেই পূর্বাণী হোটেল এলাকায় তিল ধারণের ঠাই থাকে না। যে মতিঝিল এলাকার বিভিন্ন ভবনের ছাদে দাঁড়াইয়া হাজার হাজার মানুষ শেখ মুজিবের নির্দেশ লাভের আশায় প্রতীক্ষা করিতে থাকে। বৈঠক শেষে সংগ্রামের কর্মসূচি ঘোষণা না করা পর্যন্ত জনতা পূর্বাণী হোটেল এলাকায় দাঁড়াইয়া থাকে।
ইতিমধ্যে পল্টন ময়দান এক স্বতঃস্ফূর্ত জনসমুদ্রে পরিণত হয়। এ সময় রাজধানীর বিভিন্ন মহল্লা এবং শহরতলী এলাকা হইতে একের পর এক মিছিল পল্টনের দিকে আসিতে থাকে। পল্টনের স্বতঃস্ফূর্ত জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে পূর্বপাকিস্তান ছাত্রলীগের সভাপতি নূরে আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্রসংসদের সহ-সভাপতি আ.স.ম. আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদুস মাখন, উনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের নায়ক জাতীয় পরিষদ সদস্য তোফায়েল আহমদ, জাতীয় শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান প্রমুখ ভাষণ দান করেন। এ বিশাল জনসমুদ্রে জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিত ঘোষণার তীব্র প্রতিবাদ জ্ঞাপন করেন।
সমাবেশে আওয়ামী লীগ প্রদান শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃপক্ষ ঘোষিত কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করা হয়। বিশাল জনসমুদ্র জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য বজ্রশপথ গ্রহণ করে। ইহার পূর্বে ঢাকা বারের আইনজীবীগণ মিছিল করিয়া বায়তুল মোকাররম প্রাঙ্গণে শাহ আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে এক সভা অনুষ্ঠান করেন।”
পৃষ্ঠা-১৫৩

দৈনিক সংবাদে বলা হয় : “গতকাল (সোমবার) বিকালে পূর্বাণী হোটেলে , আওয়ামী লীগের পার্লামেন্টারী পার্টির সংক্ষিপ্ত সভাশেষে আকস্মিকভাবে আহূতএক সাংবাদিক সম্মেলনে আওয়ামী লীগ প্রধান আজ (মঙ্গলবার) ঢাকায় এবং বুধবার ৩ মার্চ সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালনের আহ্বান জানান। সর্বাত্তক হরতাল পালনের পরবর্তী কর্মসূচি হিসেবে আগামী ৭ মার্চ রমনা রেসকোর্স ময়দানে জনসভা অনুষ্ঠিত হইবে। শেখ মুজিব বলেন, এই জনসভায় তিনি পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করিবেন।”
পাকিস্তানি লেখক বিগ্রেডিয়ার সিদ্দিক মালিক ‘Witness to Surrender গ্রন্থে পরিস্থিতির বর্ণনা করেছেন এ ভাবে
Lieutenant-General S.G.M. Peerzada, Principal Staff Officer to President Yahya Khan, made an ominous phone call to Governor Ahsan on 28 February to break the news that the President had decided to postpone the Assembly session to allow more time to the political parties to hammer on an agreement on the draft constitution outside the Assembly Chambers.
As desired by Peerzada, Mujib was summoned to Government House at 7 p. m. the same evening and after a long preparatory talk, Ahasn apprised him to the President’s decision. Surprisingly, Mujib did not let fly. He retained his sweet reasonableness and said, ‘I will not make an issue out of it provided I am given a fresh date, It is very hard for me to handle the extremists within the part. If the new date is some next month (March), I will be able to control the situation. If it is an April, it will be rather difficult, But if it is an indefinite postponement, it will be impossible. Before leaving Government House, he said to Major General Farman. ‘I am between two fires. I will be killed either by the Army or extremist elements in my party. Why don’t you arrest me. Just give me a ring and I will come over.’
The same evening Rawalpindi was informed of Mujib’s reaction. It was followed up by earnemt entreaties to Rawalpindi to include the new date in postponement announcement. Rawalindi cabled back of cold reply, Your message fully understood.
Dacca interpreted this message as a tacit acceptance of its proposal and hopefully waited for the fresh date. The announcement was broadcast on Marh at 13.05 hours (East Pakistan Standard
পৃষ্ঠা-১৫৪
Time). Anticipation and emotion kept us glued to our radio sets. I sat in the monitoring section so that I didn’t miss a word. To our surprise, and horror, the announcement said nothing of the new date. Many ugly scene began to hover before my eyes.
What surporsed me, besides the omission of the date, was the absence of the President’s voice which had jarred our ears several times before to announce relatively unimportant developments.Did this mean that he was not a party to the announcement? This, at least, is What Processor G. W. Chaudhury wants us to believe. He says, ‘Yahya was only a signatory to it. Who is the author? When I checked up details of this important development with MajorGeneral T who was on Yahya’s personal staff, he said “The President was in Karachi then, We were all downstairs., Major General! ‘H’ and Major General ‘O’ were going up and down. They painted such a picture to the President that he had to agree to the draft already prorated. Is this a sufficient defence of General. Mujib from his extremists and Bhutto from the electorate! Who was then a free agent? How much one yields to such pressures and how much freedom of acton one retains, gives the measure for a man who seeks the responsibility of a national leader.
…Bamboo sticks and iron roads thumped the city streets spitting anger warped in abusive slogans. The city seethen with fury. The cricket match between the BCCP (Board for control of Cricket in Pakistan) XI and an International XI was wrecked at the City Stadium and the payers narrowly saved, were shushed away to the M.N.A.’S Hostel.
… It was widely anticipated the Sheikh Mujibur Rahaman would make a unilateral declaration of independence (U.D.I) for Bangladesh. Many people thought that it would only formalise a de facto situation. But others felt that it would mean the outright beak up of Pakistan which the armed forces would not allow,
The Awami league was also aware of the grave consequences of such a declaration. It extremist elements still pressed for it but the
পৃষ্ঠা-১৫৫

moderates pleaded against it Mujib is said to have oscillated between the two weighing the pros and cons of this extreme step.
The Awami league went into session on 6 March. All eyes of the Government were focussed on the meeting. The headquarters of the Chief Martial law Administrator was also informed of the anticipated bomshell. The meeting was adjournmed at midnigh without a decision. It was to meet again early next morning.
Meanwhile, two important developments look place. President Yahya had a long telepone conversation with Mujib on 6 March persuading him not to take a step from which there would be no return, Later, he sent a teleprinter message for Mujib. It arrived in the Martial Law Headquarters Dacca at about midnight in my presence. I read it briefly before it was passed on Later I recorded its contains from memory, in my diary.
Please do not take any hasty decision, I will soon come to Dacca and discuss the details with you. I assure you that your aspirations and commitments to the people can be fully honoured I have a scheme in mind which will more than satisfy your Six Points I urge you not to take hasty decision.’
২ মার্চ ঢাকায় পালিত হয় সর্বাত্মক হরতাল। রাত পৌনে আটটায় ঢাকা। বেতারের মাধ্যমে সান্ধ্য আইন ঘোষণা প্রচারিত হয়। ঘোষণায় বলা হয়-‘প্রতিদিন সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত পুনরাদেশ না দেওয়া পর্যন্ত সান্ধ্য আইন বলবৎ থাকবে। জনতা সান্ধ্য আইনের তোয়াক্কা না করে মিছিল বের করে। ঢাকা নগরী বিক্ষোভে ফেটে পড়ে, পথে নামে জনতার ঢল। শ্লোগানে শ্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে ঢাকার রাজপথ। জনতার গর্জনে আকাশ-বাতাস। প্রকম্পিত হলো ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধর, বাংলাদেশ স্বাধীন করো’।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তাগুলো চালালো জনতার ওপর। হাসপাতাল ভরে উঠলো নিহতের লাশে ও আহতদের আর্তনাদে নিমিষেই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লো বাংলার সর্বত্র। শেখ মুজিব গুলিবর্ষণের তীব্র নিন্দা করে নিম্নবর্ণিত বিবৃতি দিলেন ?
* ৩ মার্চ হইতে ৬ মার্চ পর্যন্ত প্রতিদিন ৬ টা হইতে দুপুর ২টা পর্যন্ত সমগ্র প্রদেশে হরতাল পালন করুন। সরকারি অফিসসমূহে, সেক্রেটারিয়েট, হাইকোর্ট ও অন্যান্য-কাচারী, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা পি.
পৃষ্ঠা-১৫৬
আই. এ, রেলওয়ে ও অন্যান্য পরিবহন মাধ্যম, যানবাহন, করকারখানা, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান, হাট-বাজার সহ সর্বত্র এই হরতাল পালন করিতে হইবে। শুধু এম্বুলেন্স (হাসপাতালের গাড়ি), সাংবাদিকদের গাড়ি, ঔষধের দোকান, বিজলী ও পানি সরবরাহের ক্ষেত্রে হরতালের নির্দেশ প্রযোজ্য হইবে না।
* রেডিও, টেলিভিশন বা সংবাদপত্রে আমাদের কর্মতৎপরতার বিবরণী বা আমাদের বিবৃতি প্রকাশ করিতে দেওয়া না হইলে এসব প্রতিষ্ঠানের বাঙালি কর্মচারিদের বাংলাদেশের ৭ কোটি মানুষের কণ্ঠরোধের প্রচেষ্টা নাকচ করিয়া দিতে হইবে।
* আগামী ৭ মার্চ বিকাল ২ টায় রেসকোর্স ময়দানে আমি এক গণ সমাবেশে ভাষণ দান করিব সেই খানে আমি পরবর্তী নির্দেশ প্রদান করিব। জনগণের প্রতি আমার আহ্বান সংগ্রাম সুশৃংখল ও শান্তিপূর্ণ উপায়ে চালাইতে হইবে, উচ্ছংখলতা আমাদের আন্দোলনের স্বার্থ ক্ষুন্ন করিবে এবং গণবিরোধি শক্তি ও তাহাদের ভাড়াটিয়ে চরদের স্বার্থে দ্ধার করিবে।”
২ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলাভবনের সামনে বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতা সমবেত হন। এখানেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, আব্দুল কুদুস মাখন ও নূরে আলম সিদ্দিকী এই অনুষ্ঠানে নেতৃত্ব দেন।
৩ মার্চ ইতিহাসের আরেকটি অবিস্মরণীয় যুগান্তকারী অধ্যায়ের সূচনা ঘটে। পল্টন ময়দানে বিশাল জনসমুদ্রের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিতে গিয়ে শেখ মুজিব অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ডাক দিলেন।
স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য ৩ মার্চ জনসভায় একটি ইশতেহার পঠিত হয়। শাজাহান সিরাজ স্বাধীনতার এই ইশতেহারটি পাঠ করেন। এ ইশতেহারে বাঙালি জাতির জন্য স্বাধীন, সাবভৌম ও সমাজতান্ত্রিক দেশ গঠনের কথা ঘোষিত হয়। নতুন রাষ্ট্রের শাসন ব্যবস্থা ও স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালনার রূপরেখা ও প্রয়োজনীয় দিক-নির্দেশনা এই ইশতেহারে ঘোষিত হয়।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া এক সংক্ষিপ্ত বেতার ভাষণে ১০ মার্চ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের এক সম্মেলন আহবান করেন। প্রেসিডেন্টের আমন্ত্রণ শেখ মুজিব অবজ্ঞাভরে প্রত্যাখ্যান করলে সে দিন বিকেলেই পল্টন ময়দানে শ্রমিক লীগ ও
পৃষ্ঠা-১৫৭

ছাত্র লীগের উদ্যোগে এক বিরাট জনসভা হয়। সভার প্রধান অতিথি মুজিবুর রহমান বিশাল জনসমূদ্রে বললেন : “বাংলার গণ-প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে না নিলে বাংলার মানুষ সরকারকে সহযোগিতা করবে না, কর-খাজনা দেবে না। পুনরাদেশ না পর্যন্ত অফিস আদালতে যাবে না। তিনি আরও বলেন-যদি আমাদের বহন বিবৃতি প্রচারের উপর নিষেধ আরোপ করা হয়—সে নির্দেশ লংঘন করুন। যে মুহর্তে বীর শহিদদের রক্তের দাগ রাজপথ থেকে শুকিয়ে যায়নি-যখন বল শহিদের নশ্বর দেহ দাফনের প্রতীক্ষায় পড়ে আছে, যখন শত শত বুলেট বিদ্ধ মানুষ হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে, সেই মুহূর্তে এ সম্মেলন বন্দুকের নলের মুখে নিষ্ঠুর তামাসা।”
৪ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাকের এক প্রতিবেদনে জানা যায় ও সেনাবাহিনীর গুলিতে ঢাকায় এবং চট্টগ্রামে ৭৫ জন নিহত হয়। চট্টগ্রামে হাঙ্গামা সম্পর্কে পত্রিকায় বলা হয়-“৩ মার্চ ফিরোজশাহ কলোনি, অয়্যারলেস কলোনি, আমবাগান, পাহাড়তলী, জুট ফ্যাক্টরি এবং সন্নিহিত অন্যান্য এলাকায় আজ সকাল হইতে অপরাহ্র পর্যন্ত অগ্নিকাণ্ড, হামলা, প্রতি হামলা, প্রাইভেট বন্দুকের গুলিবর্ষণ, সংঘর্ষ এবং আইন-শৃংখলা রক্ষাবাহিনীর গুলিবর্ষণ ইত্যাদি ঘটনায় অন্যূন অর্ধশতাধিক লোক প্রাণ হারাইয়াছে এবং কয়েকশত লোক আহত হইয়াছে। চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় আড়াইশত হতাহতকে আনয়ন করা হয়। তন্মধ্যে নিহতের সংখ্যা ৪৭ বলিয়া জানা যায়, প্রকাশ জনৈক প্রশাসনিক কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে একটি ট্রাকে করিয়া ২০টি মৃতদেহ আনয়ন করা হইলে চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ কর্তৃপক্ষ মৃত দেহগুলোকে সরাসরি মর্গে পাঠাইয়া দেন। নিহতের আঘাত প্রায় বুলেট ও বন্দুকের গুলিজনিত বলিয়া জানা যায়। অধিকাংশ মৃতদেহ তৎক্ষণাৎ শনাক্ত করা না গেলেও উহাদের মধ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের কয়েক জন কারখানার শ্রমিক, পথচারী, অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালক এবং পলিটেকনিক ইন্সটিটিউট সহ অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের কয়েকজন ছাত্র রহিয়াছে বলিয়া আশংকা করা হইতেছে। হাসপাতাল সূত্রের বরাত দিয়া গভীর রাতে প্রাপ্ত খবরে নিহতের সংখ্যা ৭৫ জানা গিয়াছে এবং আজ রাত্রির মধ্যে হাসপাতালে আনীত মৃতদেহের সংখ্যা শতের কোঠায় উন্নীত হইতে পারে বলিয়া আশংকা করা যাইতেছে।”
প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস মার্চ সম্পর্কে বলেছেনঃ
“There was serious trouble in Chittagong that night when the authorities tried to unload the M. V.swat which arrived with troops
পৃষ্ঠা-১৫৮

and a cargo of ammounition. Dock workers spread the news. Soon thousands of people were locked in battle with West Pakistani solidiers and sailors. The trouble gained a new dimension when a unit of the East pakistan rifiles refused to fire on Bangali demonstrators. Seven men were court martialled and it is learnt, subsequently shot. This action gave a sharper edge to Bangali resentment.”
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবের আহ্বানে মার্চ হরতালের সাফল্য সম্পর্কে সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস বলেন :
On 3 march Mujibur Rahman called a provinecewide strike and lanuched a non-violent non-co-operation movement. Everywhere the people responded to Sheikh Mujib’s appeal and the movement became more orderly and effective. Restoration of oder in Dacca was assisted by the withdarwal of troops after it was found they could not enforce the carfiew. The troops also began to feel the pinch of hunger as supplies, including foodstuffs were denied on the orders of the Awami League.”
এ সম্পর্কে শ্রী সুব্রত রায় চৌধুরী তার গ্রন্থে বলেন
“The response of the entire people in East Bengal to the call of their leader was spontaneous, complete and overwhelming. Since in contemporary international law theeffectiveness of an authority is to be measuerd by the popular support it commends, the authority of Mujib and his Awami League in East Bangal was conclusively proved by the success of the movement between 7 and 25 March.”
৪ মার্চ পদচ্যুত গভর্নর ভাইস-অ্যাডমিরাল এস. এম. আহসান বিমানযোগে করাচির উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঐ একই তারিখ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান আওয়ামী লীগের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানালেন। ৫ মার্চের দৈনিক ইত্তেফাকে লেখা হলো…“একটি মাত্র ব্যতীত বাংলার প্রকৃতির একটি স্তবকও যেন আর আন্দোলিত হইতে জানে না। সংগ্রামী বাংলার আপামর মানুষের কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়া পুলিশ, ও ই. পি. আর, বাহিনীর বাঙালির জওয়ানদের কণ্ঠও উচ্চকিত হইয়াছে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগানে। আর সে সুরের অনুসরণ জাগিয়েছে সরকারি প্রচার মাধ্যমেও। এককালে যে বেতার টেলিভিশন ছিল জনগণের নাগালের বাহিরে, গত বুধবার হইতে সে দুইটি মাধ্যমও জয়
পৃষ্ঠা-১৫৯

বাংলা জয়গানে মুখরিত। গতকাল হইতে রেডিও পাকিস্তান, ঢাকা কেবল ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র; আর পাকিস্তান টেলিভিশন কেবল ‘ঢাকা টেলিভিশন’ বলিয়া শ্রোতামণ্ডলীর খেদমতে হাজির হইতেছে। বাংলা ও বাঙালির বর্ণনা গীতিই এখন তাহাদের উপজীব্য সব কিছু মিলিয়া বিচার করিলে দেখা যায় যে, গত তিনদিনের আন্দোলন রাজনৈতিক অঙ্গনে বাংলার মন ও মানসকে এতদিন একসুত্রে গ্রথিত করিতে সক্ষম হইয়াছে। জুজুর ভয়’ বা ‘অস্ত্রের ভাষায়’ অতীতে যে কণ্ঠ দাবাইয়া দেওয়া সম্ভব হইয়াছে, সে কণ্ঠ এবার একটি মাত্র শ্লোগানে মুখরিত-‘জয় বাংলা’।”
৫ মার্চ বেশ কিছু ঘটনা ঘটে। টংগী শিল্প এলাকায় উত্তাল জনতার ওপর সশস্ত্র বাহিনী গুলি চালিয়ে ৪ জনকে হত্যা করে ও ২৫ জনকে আহত করে। এই হতাহতের প্রতিবাদে ঢাকা শহরে নামে জনতার ঢল। তারা সমবেত হয় শহিদ মিনারে। শহিদ মিনারে ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার থেকে রিলে করার আহ্বান জানান। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে স্টেট ব্যাংক এবং অন্যান্য বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো বিকেল আড়াইটা থেকে ৪টা পর্যন্ত চালু রইলো। ওই দিনই এয়ার মার্শাল আসগর খান (অবসর প্রাপ্ত) শেখ মুজিবের ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে তাঁর সঙ্গে দেখা করলেন।
৬ মার্চ দুপুর ১টা ৫ মিনিটে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান বেতার যোগে ২৫ মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবার ঘোষণা দেন। এই দিন লে, জেনারেল টিক্কা খানকে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর নিযুক্তির কথাও ঘোষণা করা হয়। এদিকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের গেট ভেঙে ৩৫০ জন কয়েদী পলায়ন করে। নিরাপত্তা বাহনী তাদের ওপর গুলি চালালে ৭ জন নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়, ধরা পড়লো ১৬ জন।
ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। বিকালে রেসকোর্স ময়দানে দশ লক্ষাধিক বিক্ষুব্ধ জনতার সমাবেশে বাঙালি জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ঐতিহাসিক ভাষণ দেন। ৭ মার্চের সভার বর্ণনা দিতে গিয়ে পত্রিকায় বলা হলোঃ মুহুর্মুহু গর্জনে ফেটে পড়েছে জনসমুদ্রের উত্তাল কণ্ঠ। শ্লোগানের ঢেউ একের পর এক আছড়ে পড়েছে। লক্ষ কণ্ঠে এক আওয়াজ। বাঁধ না মানা দামাল হাওয়ার সওয়ার লক্ষ কণ্ঠের বজ্রশপথ। হাওয়ায় পতপত করে উড়ছে পূর্ব-বাংলার মানচিত্র অংকিত সবুজ জমিনের উপর লাল সূর্যের পতাকা। লক্ষ হস্তে শপথের বজ্রমুষ্ঠি মুহুর্মুহু উথিত হচ্ছে আকাশে। জাগ্রত বীর বাঙালির সার্বিক সংগ্রামের প্রত্যয়ে প্রতীক সাত কোটি মানুষের সংগ্রামী হাতিয়ারের প্রতীক। বাঁশের লাঠি মুহুর্মুহু শ্লোগানের সাথে সাথে উখিত হচ্ছে আকাশের দিকে। এই ছিল গত কাল রোববার রমনা রেসকোর্স ময়দানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের
পৃষ্ঠা-১৬০

ঐতিহাসিক সভার দৃশ্য। বঙ্গবন্ধু মঞ্চে আহোরন করলেন ৩টা ২০ মিনিটে। কিন্তু ফারুনের সূর্য মাথার উপর ওঠার আগে থেকে এই শ্লোগান চলছে। মঞ্চে মাইকে এসে শ্লোগান দিচ্ছেন ছাত্রলীগ নেতা আ. স. ম. আব্দুর রব, নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ ও আবদুল কুদুস মাখন। শ্লোগানের ফাকে ফাকে নেতবৃন্দ দিচ্ছেন টুকরো টুকরো বক্তৃতা। মঞ্চ থেকে শ্লোগান শেষ হলে শ্লোগান উঠছে মাঠের বিভিন্ন স্থান থেকে, শ্লোগান দিচ্ছে ছাত্র-শ্রমিক, কৃষক-মজুর, মেহনতি জনতা, শ্লোগান দিচ্ছে মহিলারা।
এ শ্লোগানে শ্লোগানে সভাস্থলে ক্রমে বেড়ে যায় সংগ্রামের উদ্দীপনা। শপথের প্রাণবহ্নি। শ্লোগানের ভাষা ছিল “জয় বাংলা জয় বাংলা, আপোষ না সংগ্রাম, সংগ্রাম সংগ্রাম, আমার দেশ তোমার দেশ, বাংলাদেশ” পরিষদ না রাজপথ, রাজপথ, ষড়যন্ত্রের পরিষদে-বঙ্গবন্ধু যাবেনা। ঘরে ঘরে দুর্গগড় ইত্যাদি।”
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ৭ মার্চের জনসমুদ্রে ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন,
“ভাইয়েরা আমার!
আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত মন নিয়ে আপনাদের সামনে হাজির হয়েছি। আপনারা সবাই জানেন ও বুঝেন। আমরা আমাদের জীবন দিয়ে চেষ্টা করেছি কিন্তু ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রংপুর ও যশোরের রাজপথ আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। আজ বাংলার মানুষ মুক্তি চায়-তারা বাঁচতে চায়। তারা অধিকার পেতে চায়। নির্বাচনে আপনারা ভোট দিয়ে আওয়ামী লীগকে জয়ী করে ছিলেন, শাসনতন্ত্র রচনার জন্য। আশা ছিল জাতীয় পরিষদ বসবে-আমরা শাসনতন্ত্র তৈরি করবো এবং এই শাসনতন্ত্রে মানুষ তাদের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তি লাভ করবে। কিন্তু ২৩ বছরের ইতিহাস বাংলার মানুষের মুমূর্ষ আর্তনাদের ইতিহাস, রক্তদানের করুণ ইতিহাস, নির্যাতিত মানুষের কান্নার ইতিহাস।
১৯৫২ সালে আমরা রক্ত দিয়েছি। ১৯৫৪ সালে নির্বাচনে জয়লাভ করেও গদিতে বসতে পারিনি। ১৯৫৮ সালে দেশে সামরিক আইনজারি করে আইয়ুব খান দশ বছর আমাদের গোলাম করে রাখলো। ১৯৬৬ সালে ৬ দফা দেওয়া হল এবং এরপর এ অপরাধে আমার বহু ভাইকে হত্যা করা হল। ১৯৬৯ সালে গণআন্দোলনের মুখে আইয়বের পতনের পর ইয়াহিয়া খান এলেন। তিনি বললেন, তিনি জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেবেন। শাসনতন্ত্র দেবেন—আমরা মেনে নিলাম। তার পরের ঘটনা সকলেই জানেন। ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা হল—আমরা তাঁকে ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডাকার অনুরোধ করলাম। কিন্তু মেজরটি পার্টির নেতা হওয়া সত্ত্বেও তিনি আমার কথা শুনলেন
পৃষ্ঠা-১৬১

না । শুনলেন সংখ্যালঘু দলের ভুট্টো সাহেবের কথা। আমি শুধু বাংলার মেজরিটি পার্টির নেতা নই—সমগ্র পাকিস্তানের মেজরিটি পার্টির নেতা। ভুট্টূ সাহেব বললেন মার্চের প্রথম সপ্তাহে অধিবেশন ডাকতে। তিনি মার্চের ৩ তারিখে অধিবেশন ডাকলেন। আমি বললাম, তবুও আমরা জাতীয় পরিষদের অধিবেশন যাব এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হওয়া সত্ত্বেও কেউ যদি ন্যায্য কথা বলে আমরা তা মেনে নেব। এমন কি তিনি যদি একজনও হন। ভুট্টো ঢাকা এসেছিলেন তার সঙ্গে আলোচনা হলো ভুট্টো সাহেব বলে গেছেন, আলোচনার দরজা বন্ধ নয়। আরো আলোচনা হবে। মওলানা নূরানী, মওলানা মুফতী সহ পশ্চিম-পাকিস্তানের অন্যান্য পার্লামেন্টারী নেতা এলেন, তাদের সঙ্গে আলোচনা হল-উদ্দেশ্য ছিল আলাপ আলোচনা করে শাসনতন্ত্র রচনা করবো। তবে তাদের আমি জানিয়ে দিয়েছি যে, ৬-দফা পরিবর্তনের কোনো অধিকার নেই, এটা জনগণের সম্পদ।
কিন্তু ভুট্টো হুমকি দিলেন। তিনি বললেন, এখানে এসে ডবল জিম্মী হতে পারবেন না। পরিষদ কসাইখানায় পরিণত হবে। তিনি পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যদের প্রতি হুমকি দিলেন যে, পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিলে রক্তপাত করা হবে, তাদের মাথা ভেঙে দেওয়া হবে, হত্যা করা হবে। আন্দোলন শুরু হবে পেশোয়ার থেকে করাচি পর্যন্ত। একটি দোকানও খুলতে দেওয়া হবে না।
তা সত্ত্বেও পঁয়ত্রিশজন পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্য এলেন। কিন্তু পয়লা মার্চ ইয়াহিয়া খান পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন। দোষ দেওয়া হলো বাংলার মানুষকে, দোষ দেওয়া হলো আমার। অনমনীয় মনোভাবের জন্যই কিছু করা হয়নি।
এর পর বাংলার মানুষ প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলো। আমি শান্তিপূর্ণ সংগ্রাম চালিয়ে যাবার জন্য হরতাল ডাকলাম। জনগণ আপন ইচ্ছায় পথে নেমে এলো, কিন্তু কি পেলাম আমরা? বাংলার নিরস্ত্র জনগণের উপর অস্ত্র ব্যবহার করা হলো, আমাদের হাতে অস্ত্র নাই। কিন্তু আমরা পয়সা দিয়ে যে অস্ত্র কিনে দিয়েছি দেশকে রক্ষা করার জন্য আজ সে অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে আমার নিরীহ মানুষকে হত্যা করার জন্য। আমার দুঃখী জনতার উপর চলছে গুলি। আমরা বাংলার সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ, যখনই দেশের শাসনভার গ্রহণ করতে চেয়েছি। তখনই ষড়যন্ত্র চলেছে—আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে।
ইয়াহিয়া খান বলেছেন, আমি নাকি দশই মার্চ গোলটেবিল বৈঠকে যোগদান করতে চেয়েছি, তার সাথে টেলিফোনে আমার আলাপ হয়েছে। আমি তাকে বলেছি-আপনি দেশের প্রেসিডেন্ট। ঢাকায় আসুন, দেখুন আমার গরিব জনসাধারণকে কী ভাবে হত্যা করা হয়েছে। আমার মায়ের কোল কীভাবে খালি করা হয়েছে। আমি আগেই বলে দিয়েছি। কোনো গোলটেবিল বৈঠক হবে না,
পৃষ্ঠা-১৬২

কিসের গোলটেবিল বৈঠক? কার গোলটেবিল বৈঠক? যারা আমার মা-বোনের কোল শূন্য করেছে, তাদের সাথে বসবো আমি গোলটেবিল বৈঠকে। ৩ মার্চ পল্টনে আমি অসহযোগের আহ্বান জানালাম। বললাম, অফিস-আদালত, খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ করুন। আপনারা মেনে নিলেন। হঠাৎ আমার সঙ্গে বা আমার দলের সঙ্গে আলোচনা না করে একজনের সঙ্গে পাঁচ ঘণ্টা বৈঠকের পর ইয়াহিয়া খান যে বক্তৃতা করেছেন, তাতে সমস্ত দোষ আমার ও বাংলার উপর চাপিয়ে দিয়েছেন। দোষ কররেন ভুট্টো, কিন্তু গুলি করা হল আমার বাংলার মানুষকেআমরা গুলি খাই, দোষ আমাদের, আমরা বুলেট খাই, দোষ আমাদের।
ইয়াহিয়া সাহেব অধিবেশন ডেকেছেন। কিন্তু আমার দাবি, সামরিক আইন প্রত্যাহার করতে হবে, সেনাবাহিনীকে ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে, হত্যার তদন্ত করতে হবে, আর জনগণের প্রতিনিধির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে-তারপর বিবেচনা করে দেখবো পরিষদে বসবো কি বসবো না। এ দাবি মানার আগে পরিষদে বসার কোনো প্রশ্নই ওঠে না, জনগণ আমাকে সে অধিকার দেয়নি। রক্তের দাগ এখনো শুকায়নি, শহিদের রক্ত মাড়িয়ে ২৫ মার্চ পরিষদে যোগ দিতে যাব না।
ভাইয়েরা আমার, আমার উপর বিশ্বাস আছে, (লাখো জনতা হাত উঠিয়ে ‘হ্যা’ বলে) আমি প্রধানমন্ত্রীত্ব চাই না; মানুষের অধিকার চাই। প্রধানমন্ত্রীত্বের লোভ দেখিয়ে আমাকে নিতে পারেনি। ফাঁসির কাষ্ঠে ঝুলিয়ে নিতে পারেনি। আপনারা রক্ত দিয়ে আমাকে ষড়যন্ত্র-মামলা থেকে মুক্ত করে এনেছিলেন। সেদিন এই রেসকোর্সে আমি বলেছিলাম, রক্তের ঋণ আমি রক্ত দিয়ে শোধ করবো। মনে আছে? আজো আমি রক্ত দিয়েই রক্তের ঋণ শোধ করতে প্রস্তুত।
আমি বলে দিতে চাই, আজ থেকে কোর্ট কাচারী, হাইকোর্ট, সুপ্রীম কোর্ট, অফিস আদালত, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ থাকবে। কোনো কর্মচারি অফিসে যাবে না। এ আমার নির্দেশ।
গরিবের যাতে কষ্ট না হয়, তার জন্য রিক্সা চলবে, ট্রেন চলবে আর সব চলবে। তবে সেনাবাহিনী আনা নেওয়া করা যাবে না। যদি কোনো দুর্ঘটনা ঘটে তার জন্য আমি দায়ী থাকব না।
সেক্রেটারিয়েট, সুপ্রীম কোট, হাইকোর্ট, সরকারি-আধাসরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত সংস্থাগুলো বন্ধ থাকবে। শুধু পূর্ব বাংলা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে টাকা যেতে পারবে না। বাঙালিরা বুঝে-শুনে চলবেন। টেলিগ্রাফ, বাংলাদেশের মধ্যে চালু থাকবে, তবে সাংবাদিকরা বহির্বিশ্বে সংবাদ পাঠাতে পারবেন।
এদেশের মানুষকে খতম করা হচ্ছে, বুঝে শুনে চলবেন, দরকার হলে সমস্ত চাকা বন্ধ করে দেওয়া হবে। আপনারা নির্ধারিত সময়ে বেতন নিয়ে আসবেন এরপর বেতন যদি না দেওয়া হয় তোমাদের প্রতি নির্দেশ রইলো যদি একটি
পৃষ্ঠা-১৬৩
গুলি চলে, তাহলে বাংলার ঘরে দুর্গ গড়ে তোল। যার যা আছে তা নিয়েই শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে। রাস্তাঘাট বন্ধ করে দিবে। আমরা তাঁদের ভাতে মারবো, পানিতে মারবো। আমি যদি হুকুম দেবার না পারি, যদি আমার সহকর্মীরা না থাকেন, আপনারা সংগ্রাম চালিয়ে যাবেন।
তোমরা আমার ভাই, তোমার ব্যারাকে থাকো, কেউ কিছু বলবে না। চালালে আর ভালো হবে না। সাত কোটি মানুষকে আর দাবাতে পারবে না। বাঙালিরা যখন মরতে শিখেছে-তখন কেউ তাদের দাবাতে পারবে না।
শহিদের ও আহতদের পরিবারের জন্য আওয়ামী লীগ সাহায্য কমিটি করেছে। আমরা সাহায্যের চেষ্টা করবো। আপনারা যে যা পারেন—দিয়ে যাবেন। সাত দিনের হরতালে যেসব শ্রমিক অংশগ্রহণ করেছেন, কারফিউর জন্য কাজ করতে পারেননি—শিল্প মালিকেরা তাদের পুরো বেতন দিয়ে দিবেন।
সরকারি কর্মচারিদের বলি, আমি যা বলি তা মানতে হবে। কাউকে যেন অফিসে দেখা না যায়। এদেশের মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ থাকবে। আপনারা আমার উপরে ছেড়ে দেন-আন্দোলন কীভাবে করতে হয়, তা আমি জানি। কিন্তু হুশিয়ার, একটা কথা রাখবেন। আমাদের মধ্যে শত্ৰু ঢুকেছে, ছদ্মবেশে তারা আত্ম-কলহের সৃষ্টি করতে চায়। বাঙালি-অবাঙালি, হিন্দুমুসলমান সবাই আমাদের ভাই, তাদের রক্ষা করার দায়িত্ব আমাদের। রেডিও, টেলিভিশন ও সংবাদপত্র যদি আমাদের আন্দোলনের খবর প্রচার না করে তবে কোনো বাঙালি রেডিও এবং টেলিভিশনে যাবেন না।
শান্তিপূর্ণভাবে ফয়সালা করতে পারলে ভাই-ভাই হিসেবে বাস করার সম্ভাবনা আছে, তা না হলে নেই। বাড়াবাড়ি করবেন না, মুখ দেখাদেখিও বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
আমার অনুরোধ, প্রত্যেক গ্রামে, মহল্লায়, ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে সংগ্রাম কমিটি গড়ে তুলুন। হাতে যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকুন। মনে রাখবেন-রক্ত যখন দিয়েছি রক্ত আরো দেব, তবু এদেশের মানুষকে মুক্ত করে ছাড়বো ইনশাআল্লাহ। এবারে সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম। প্রস্তত থাকবেন, ঠাণ্ডা হলে চলবে না। আন্দোলন ও বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়লে তারা আমাদের উপর ঝাপিয়ে পড়বে। শৃংখলা বজায় রাখুন। কারণ, শৃংঙ্খলা ছাড়া কোনো জাতি সংগ্রামে জয় লাভকরতে পারে না। জয় বাংলা।”
অহিংস অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকলো। জনতা সেনাবাহিনীর রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আহ্বানে সাড়া দিয়ে চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছুবার সিদ্ধান্তে তখন অটল।
পৃষ্ঠা-১৬৪
৮ মার্চ এক সপ্তাহের জন্যে দশটি নির্দেশ ঘোষণা করা হলো :
১. খাজনা-ট্যাক্স বর্জন আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।
২. সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিস, হাইকোর্ট ও বাংলাদেশে অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। মাঝে মাঝে প্রয়োজনবোধে এ ব্যাপারে কোনো কোনো অংশকে হরতালের আওতামুক্ত ঘোষণা করা হবে।
৩. রেলওয়ে ও বন্দরগুলো চালু থাকতে পারে। কিন্তু যদি সৈন্য সমাবেশের জন্য রেলওয়ে বন্দরগুলোকে ব্যবহার করা হয় তাহলে বন্ধ থাকবে। বেতার, টেলিভিশন ও সংবাদপত্রগুলোকে আমাদের বিবৃতিসমূহের পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে এবং তারা জনগণের আন্দোলনের সম্পর্কে খবর গোপন করতে পারবে না। অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানের চাকরিতে বাঙালিরা সহযোগিতা করবেন না।
৫. কেবল স্থানীয় ও আন্তঃজেলা ট্র্যাংক টেলিফোন যোগাযোগ চালু থাকবে।
৬. সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
৭. ব্যাংকগুলো স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে অথবা অন্য কোনো উপায়ে দেশের পশ্চিম অংশে অর্থ পাচার করতে পারবে না।
৮ প্রতিদিন সকল ভবনে কালো পতকা উত্তোলন করতে হবে।
৯. অন্যসকল ক্ষেত্রে হরতাল প্রত্যাহার করা হয়েছে। কিন্তু অবস্থান বিশেষে যে কোনো সময় উপরিউক্ত ক্ষেত্রে পূর্ণাঙ্গ অথবা আংশিক হরতাল ঘোষণা করা হতে পারে।
১০. প্রতি ইউনিয়ন, মহল্লা, থানা, মহকুমা ও জেলায় আওয়ামী লীগ ইউনিটের নেতৃত্বে একটি করে সংগ্রাম পরিষদ গঠন করতে হবে।”
দেশের সার্বিক পরিস্থিতিতে ক্রমশ রদবদল ঘটতে থাকে। পাকিস্তানি সামরিক জান্তা তাদের প্রস্তুতি নিতে থাকে। সামরিক কর্তৃপক্ষ শুধু মাত্র নিজেদের প্রস্তুতির জন্যই যে পঁচিশে মার্চের সন্ধ্যা পর্যন্ত অপেক্ষা করেছিল তা আজ আর নতুন করে বলবার অপেক্ষা রাখে না। বাঙালি জাতির হত্যাযজ্ঞের নীল নকশা বেশ আগেই প্রস্তুত করা হয়। রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সামরিক সরকারের প্রস্তুতির খবর কতটুকু পেয়েছিলেন জানা না গেলেও সামরিক এবং আধা সামরিক বিভাগের বাঙালি কর্মচারিবৃন্দ অনেকটা টের পেয়ে যায়। ফলে বেঙ্গল রেজিমেন্টের অনেক তরুণ অফিসার এবং ই. পি. আর. বাহিনরি বহু সদস্য
পৃষ্ঠা-১৬৫
আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য নেতবর্গের সঙ্গে যোগাযোগ করলো।
এ সময় পরিলক্ষিত হয়, সমস্ত অবাঙালি ই. পি, আর, সৈন্যদের সীমান্ত থেকে সরিয়ে উইং হেড কোয়াটার অথবা সেক্টর হেড কোয়ার্টারে নিয়ে তা হচ্ছে। কোয়ার্টার গার্ডগুলিতে বাঙালি সরিয়ে অবাঙালিকে নিয়োগ অভ্যন্তরী নিরাপত্তার কাজে অপ্রয়োজনে বাঙালিদের সঙ্গে সমসংখ্যক এবং কোথাও কোথাও বেশি সংখ্যক অবাঙালি ই. পি. আর. সদস্যকে রাখা হচ্ছে। যেখানে অবাঙালি সৈনিক কম সেখানে অবাঙালি গার্ড কমান্ডারকে নিয়োগ করা হচ্ছে। পিলখানাতে অবস্থানরত ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের তৎপরতা বেড়ে যায়। ঢাকা সেনানিবাস থেকে পিলখানায় হেলিকপ্টারে করে উর্ধ্বতন সামরিক কর্তপক্ষের আগমন ও গোপন বৈঠক, সর্বত্র অবাঙালিদের ফিসফিসানি দেখে বাঙালিদের মনে সন্দেহের উদ্রেক হলো।
বেঙ্গল রেজিমেন্টের ক্ষেত্রেও এমনটি ঘটে। পরিকল্পিতভাবে ৮ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানে পাঠানোর অংশ হিসেবে একটি কোম্পানিকে মার্চের প্রথম সপ্তাহেই পাকিস্তানের খাখিয়ান সেনানিবাসে পাঠানো হয়। ইতোমধ্যে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষ সম্ভবত মেজর জিয়াউর রহমান, ক্যাপ্টেন অলি, ক্যাপ্টেন আমীন আহমেদ চৌধুরী, ই, বি আর. সি.র কর্নেল এম, আর, চৌধুরী প্রমুখের মনোভাব আঁচ করে নেয়। তখন ষোলশহর নামক স্থানে অবস্থিত ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পাকিস্তানিদের পক্ষে প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণে রাখা মুশকিল ছিল। অবস্থার পরিবর্তনের ফলে ৮ম বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবশিষ্ট সৈন্যদের আর পাকিস্তানে পাঠানো সম্ভব হয়নি। তবে ই. পি. আর এবং বেঙ্গল রেজিমেন্টের কোনো কোনো দলকে পরস্পর থেকে বিচ্ছিন রাখা ।
৭ মার্চের সম্পর্কে প্রখ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস লিখেছেন : “জনগণের একজন বিপ্লবী নেতা হিসাবে আওয়ামী লীগ প্রধান যে সুনাম অর্জন করেছিলেন, তার প্রতি আস্থা থাকলে তিনি টিক্কা খানের আত্মসমর্পণের দাবি করে তাকে হাতের মুঠোয় পাওয়ার জন্য দৃঢ় ভাবাপন্ন লাখ লাভ বাঙালিকে চার মাইল দূরে অবস্থিত পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান সেনানিবাসে পাঠাতেন তারা তা করার জন্যও প্রস্তুত ছিল, উপরন্তু সেনাবাহিনীকে পর্যুদস্ত করার জন্য সানন্দে কয়েক শ লোক জীবন বিসর্জন দিতো। তখন ন্যূনতম রক্তপাতে বাংলাদেশ বাস্তবে রূপ নিত। ফলে পরবর্তীতে কিছুতেই লাখ লাখ নিহত হতো না এবং সেনাবাহিনীর বর্বরতার শিকার হয়ে অগণিত লোক দেশত্যাগ করতো না।
বিষয়টি তর্ক সাপেক্ষ, তবুও নির্দ্বিধায় বলা যায় যে রেসকোর্স ময়দানে সমবেত কয়েক লক্ষ নিরস্ত্র জনতাকে ঢাকা সেনানিবাসের দিকে লেলিয়ে দিলে
পৃষ্ঠা-১৬৬
অনর্থক প্রচুর রক্ত ক্ষয় হতো। এটা হতো উত্তেজনার বশবর্তী অদুরদর্শী রাজনীতির এক চূড়ান্ত হঠকারী সিদ্ধান্ত। লক্ষ লক্ষ জনতা তো নিশ্চিহ্ন হতোই উপরন্ত শেখ মুজিব চিহ্নিত হতেন বিচ্ছিন্নতাবাদী হিসেবে। তিনি মীমাংসার পথ খোলা রেখে, অপরদিকে তিনি ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার মৃত্যুঞ্জয়ী প্রেরণার সঞ্চার ঘটান। সেনাবাহিনীকে নির্বিচারে গণহত্যার সুযোগ না দেবার জন্যই সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না করে বজ্রকণ্ঠে বলেছেন এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।
অপরদিকে ৮ মার্চে ব্রিটেনবাসী দশ হাজার বাঙালি বাংলার স্বাধীনতার দাবিতে লন্ডস্থ পাকিস্তানি হাই কমিশনের সামনে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। অবসরপ্রাপ্ত এয়ার মার্শাল আসগর খান বিকেলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করলেন।
৯ মার্চ পল্টনের জনসভায় ভাসানী ১৪-দফা কর্মসূচি দেন। ৮ মার্চ হাইকোর্টের প্রধান বিচারপতি বি. এ. সিদ্দিকী লে. জেনারেল টিক্কা খানকে গভর্নর হিসাবে শপথবাক্য পাঠ করাতে অস্বীকৃতি জানান। ফলে ৯ মার্চ তাঁকে বাংলাদেশের সামরিক শাসনকর্তা নিযুক্তির ঘোষণা দেয় সরকার। রাজশাহীতে সান্ধ্য আইন জারি হয়। নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এ. এইচ. এম. কামরুজ্জামান এর তীব্র প্রতিবাদ করেন। ঢাকাস্থ জাতিসংঘের কর্মকর্তা ও স্টাফদের পরিবার্গকে সরিয়ে নেওয়ার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মিঃ উথান্ট ঢাকাস্থ উপ-আবাসিক প্রতিনিধিকে ক্ষমতা দেন। জাপান এবং পশ্চিম জার্মান সরকারও তাদের নাগরিক নিরাপদ স্থানে নেওয়ার জন্যে চার্টার্ড বিমান পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেয়। ঐ দিনই ঢাকাস্থ সায়েন্স ল্যাবরেটারী থেকে বেশ কিছু এসিড ও বিস্ফোরক দ্রব্য চুরি হয়।
১০ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান সংবাদপত্রে এক বিবৃতিতে বললেন, “শুধুমাত্র জাতিসংঘ কর্মচারিদের সরিয়ে নিলেই তার দায়িত্ব শেষ হয়ে যায় না। বাংলাদেশের জনগণ মুক্তির লক্ষ্য অর্জনের যে কোনো ত্যাগ স্বীকার এবং স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বসবাসের অধিকার আদায়ের জন্য শেষ পর্যন্ত সংগ্রাম চালিয়ে যেতে দৃঢ়সংকল্পবদ্ধ। সারা বিশ্বের স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের কাছে তাদের উচ্চ মনোবল প্রেরণা যোগাবে, বাংলাদেশের জনগণ জানে যে ইতিহাস। তাদের পক্ষে আছে এবং ধ্বংসকারী অস্ত্র যতই সংগ্রহ করা হোক না কেন, জনতার শক্তিই তাদের চূড়ান্ত বিজয় রুখতে পারবে।”
ওই দিনই নারায়ণগঞ্জ জেলখানার ৪০ জন কয়েদী জেল ভেঙে পালায়। পলায়নকালে নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে ১ জন নিহত এবং ২৫ জন আহত হয়। দেশের সিভিল সার্ভিসের দ্বিতীয় শ্রেণির কর্মচারিরা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মেনে চলবার
পৃষ্ঠা-১৬৭

প্রতিশ্রুতি দেয়। ওয়ালি খান ১৩ মার্চ ঢাকায় এসে বঙ্গবন্ধুর সাথে আলোচনা করার ঘোষণা দেয়।
১১ মার্চ বরিশাল জেল ভেঙে ৪০ জন কয়েদী পালিয়ে যাওয়ার সময় নিরাপত্তা বাহিনীর গুলিতে কয়েদীদের ২ জন নিহত এবং ২০ জন আহত হয় । এই সময় শোনা যায়, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া শীঘ্রই বাংলাদেশ সফরে আসছেন । স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ এক বিবৃতিতে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে সাক্ষাতের আগে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে তার ৬ মার্চের বেতার ভাষণ প্রত্যাহরের দাবি জানায়। ওয়ালীপন্থী ন্যাপ নেতৃবর্গ, মওলানা ভাসানী ও আতাউর রহমান খান এ সময় বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে সভা করে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে জোরদার করার জন্য জনতার প্রতি উপযুপরী আহ্বান করে। শিল্পী, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বুদ্ধিজীবীরাও চুপ করে বসে থাকলেন না। তারাও স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা করে দেশব্যাপী নানা অনুষ্ঠান করতে থাকেন।
১২ মার্চ অবসরপ্রাপ্ত এয়ার-মার্শাল আসগর খান এক জনসভায় বলেন, আমাদের অদূরদর্শিতার জন্য বাংলাদেশ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান ৫ বছরও টিকে থাকতে পারবে না।
এদিকে সি. এস. পি. ও. ই. সি. অফিসার সমিতি বঙ্গবন্ধু আহূত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করে এবং আওয়ামী লীগের সাহায্য তহবিলে সি এস. পি, ও প্রথম শ্রেণির ই. পি. সি. এস কর্মচারিবৃন্দ তাদের একদিনের বেতন দানের ঘোষণা দেন।
১৩ মার্চ সামরিক কর্তৃপক্ষ প্রতিরক্ষা বাজেট থেকে বেতন গ্রহণকারী বেসামরিক কর্মচারিদের ১৫ মার্চ সকাল ১০ টায় কাজে যোগ দিতে বলে। আদেশ অমান্যকারীর সর্বাধিক দশ বছর সশ্রম কারাদণ্ডের কথাও ঘোষিত হলো।
১৪ মার্চ বাংলার সামরিক আইন প্রমাসক লে. জেনারেল টিক্কা খানের ১১৫ নং নির্দেশকে অগ্রাহ্য করে দেশরক্ষা বিভাগে চাকরিরত বেসামরিক কর্মচারিরা ঢাকার রাজপথে বিক্ষোভ মিছিল করে। ন্যাপ প্রধান ওয়ালী খান বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডিস্থ বাসভবনে ৮৫ মিনিট কাল স্থায়ী এক বৈঠকে মিলিত হন। আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী দলের নেতা মনসুর আলী চট্টগ্রাম বন্দর থেকে খাদ্যবাহী জাহাজের গতি পরিবর্তনের জন্য গভীর ক্ষোভ প্রকাশ করে এ ব্যাপারে পূর্ণ তদন্তের দাবি জানান।
১৪ মার্চে শেখ মুজিবুর রহমান এক বিবৃতিতে বলেন, “বাংলাদেশের মুক্তির উদ্দীপনা নিভিয়ে দেওয়া যাবে না। যাবে না আমাদের পরাজিত করা। কারণ আমাদের ভবিষৎ বংশধররা যাতে স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হয়ে মর্যাদার
পৃষ্ঠা-১৬৮
সাথে বাস করতে পারে, তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য আমরা প্রত্যেকে প্রয়োজন হলে মরতেও কৃতসংকল্প। অতএব, আমাদের মুক্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত আমরা নতুন উৎসাহ উদ্দীপনা নিয়ে আমাদের সংগ্রাম চালিয়ে যাবো। যে কোনো ত্যাগের জন্য তৈরি হয়ে থাকতে এবং তাদের বিরুদ্ধে শক্তি প্রয়োগ করা হলে সম্ভাব্য সর্বোপায়ে তা প্রতিহত করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আমি আবেদন জানাচ্ছি।”
এ সময় ভারতীয় জুজুর অজুহাতে পাকিস্তান থেকে নানাপথে ব্যাপক সৈন্য আনয়ন অব্যাহত থাকে। অথচ ভারতীয় সীমান্তে তেমন কোনো সামরিক তৎপরতা পরিলক্ষিত হয়নি।
মেজর রফিক লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে গ্রন্থে বলেন
Our sources confirmed this excuse to be a blatant lie. Moreover, the troops that were arriving from the west by C-130 transport air craft and the PIA Boeings were not moved to take-up any defence along the borders.
১৫ মার্চ প্রেসিডেন্ট আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান বেশ ক’জন জেনারেল সঙ্গে নিয়ে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে ঢাকায় আসেন। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া তেজগাঁও বিমানবন্দর থেকে সরাসরি প্রেসিডেন্ট ভবনে যান।।
ওই দিনই জুলফিকার আলী ভুট্টো দাবি জানান-সংশ্লিষ্ট প্রদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে এবং কেন্দ্রের ক্ষমতা দুটি গরিষ্ঠ দলের হাতে দিতে হবে। দাবির কথা শুনে ভুট্টোর নিজের দলীয় লােক ছাড়া অন্য প্রায় সব দলই হলো প্রতিবাদমুখর।
শেখ মুজিব প্রশাসন ব্যবস্থা চালু রাখার জন্যে নিচের ৩৫টি বিধি জারি করলেন ।
নির্দেশ ১ : ১৪ কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক
সেক্রেটারিয়েট, সরকারি ও আধা-সরকারি অফিসমূহ, স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা সমূহ, হাইকোর্ট ও সমগ্র বাংলাদেশের অন্যান্য আদালত হরতাল পালন করবে। নিচে যে বিশেষ নির্দেশাবলি হরতালের আওতামুক্ত তার ব্যাখ্যা প্রদান করা হলো, তার এবং বিভিন্ন সময়ে যে সব নির্দেশাবলি ও ব্যাখ্যা দেওয়া তার পরিপ্রেক্ষিতে এই হরতাল পালন করতে হবে।
নির্দেশ ২ : বাংলাদেশের সমস্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।
নির্দেশ ৩ : আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাঃ
(ক) ডেপুটি কমিশনার ও সাবডিভিশনাল অফিসারগণ অফিস না খুলে, আইন-শৃংখলা রক্ষার ব্যাপারে তাদের যে দায়িত্ব রয়েছে, তা পালন করবেন এবং
পৃষ্ঠা-১৬৯
উন্নয়ন কর্মসূচিসহ বর্ণিত নির্দেশাবলি বাস্তবায়নের জন্য যা যা দরকার , সব দায়িত্ব দায়িত পালন করবেন। নিজ নিজ দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনে সংশ্লিষ্ঠ কর্তৃপক্ষ তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সংগ্রাম পরিষদের সাথে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষা করবেন ও পরিষদের সহযোগিতায় কাজ করবেন।
(খ) পুলিশ আইন শৃংখলা রক্ষার দায়িত্ব পালন করবে এবং প্রয়োজন হলে আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর সহায়তা গ্রহণ করবে।
(গ) জেলা ওয়ার্ডার ও জেলের অফিসমূহে কাজ চলবে।
(ঘ) আনসার বাহিনী তাদের দায়িত্ব পালন করে যাবে।
নির্দেশ ৪ : বন্দরসমূহ
অভ্যন্তরীণ নৌ-বন্দরসহ, নৌ-যান চলাচল অব্যাহত রাখাসহ বন্দর কর্তৃপক্ষ সকল পর্যায়েই কাজ চালু রাখবে। তবে জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর জন্য ব্যবহৃত হতে পারে এমন সব দ্রব্যাদি বা সেনাবাহিনী মোতায়েনের কাজে সহযোগিতা-সম্প্রসারণ ব্যতীত জাহাজসমূহের বন্দরে ভিড়া ও বন্দর ছাড়ার কাজ সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজন, বন্দর কর্তৃপক্ষের অফিসের শুধু তেমন বিভাগই চালু থাকবে। সকল জাহাজ; বিশেষ করে বাংলাদেশের জনগণের জন্য যে সকল জাহাজ খাদ্যশস্য বহন করে আনছে, সে সব দ্রুত খালাস করতে সার্বিক চেষ্টা রাখতে হবে। বন্দর কর্তৃপক্ষ বন্দরের ন্যায্য পাওনা ও মাল খালাস চার্জ করবে। অভ্যন্তরীণ নৌ-বন্দরসমূহও অপরাপর চার্জ আদায় করবে।
নির্দেশ ৫: মাল আমদানি
আমদানিকৃত সকল মাল খালাস করতে হবে। সকল বিভাগের প্রয়োজনীয় সেকশন সমূহ কাজ চালু রাখতে এবং নিরূপিত শুল্কর পুরো অর্থজমা দেওয়া হলে। তার ভিত্তিতে মাল-খালাসের অনুমোদন দান করবে। এতদুদ্দেশ্যে ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন লিমিটেডকে শুল্ক কালেক্টর কর্তৃক পরিচালিত বিশেষ একাউন্টে উক্ত অর্থ জমা দিতে হবে। শুল্ক আওয়ামী লীগের নির্দেশ মোতাবেক। এসব একাউন্ট পরিচালনা করবে।
আওয়ামী লীগ সময়ে সময়ে এ সম্পর্কে নির্দেশ দেবে। এভাবে সংগৃহীত অর্থ কেন্দ্রীয় সরকারের হিসাবে জমা হবে না।
নির্দেশ ৬ : রেলওয়ে চালু থাকবে, তবে রেলওয়ে চালু রাখার জন্য রেলওয়ে কর্তৃপক্ষের যে যে সেকশন খোলা থাকা দরকার কেবল মাত্র সেই সেকশনই কাজ করবে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ওপর নির্যাতন চালানোর কাজে ব্যবহৃত হতে পারে এমন সব ক্ষেত্রে সৈন্য ময়তায়ন কিংবা রসদ পরিবহনের কাজে সহযোগিতা করা যাবে না। বন্দরসমূহ থেকে অভ্যন্তরে খাদ্যশস্য পরিবহনের
পৃষ্ঠা-১৭০

বেলায় অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষকে ওয়াগনসমূহ বরাদ্দ করতে হবে।
নির্দেশ ৭: সড়ক পরিবহন
বাংলাদেশের সর্বত্র ই. পি. আর টি সি. চলাচল করবে।
নির্দেশ ৮ : অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহনে
অভ্যন্তরীণ নদীবন্দরগুলোর সঠিকভাবে কাজ চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় আই, ডবলিউ, টি-এর স্বল্প সংখ্যক কর্মচারি ই, পি, এস, সি, এবং অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কাজ করবে। কিন্তু জনগণের ওপর নির্যাতন চালানোর কাজে ব্যবহৃত হতে এ রূপ বাহিনী অথবা সরঞ্জামাদি সমাবেশ করার ব্যাপারে কোনো রূপ সহযোগিতা করা যাবে না।
নির্দেশ ৯ ও ডাক ও টেলিগ্রাফ
বাংলাদেশের মধ্যে চিঠি, টেলিগ্রাম ও মানি-অর্ডার পাঠানোর জন্যই কেবল ডাক ও টেলিগ্রাফ অফিস কাজ করবে। তবে সকল শ্রেণির বিদেশি মেইলসার্ভিস ও বিদেশি টেলিগ্রাফ সরাসরি সংশ্লিষ্ট দেশগুলোতে প্রেরণ করা যেতে পারে। ২৫ নং নির্দেশে যে সমস্ত বার্তা আদান-প্রদানের অনুমতি দেওয়া হয়েছে ব্যাংকগুলোকে কোনো সে ধরনের বার্তা টেলিপ্রিন্টারে আদান-প্রদান করতে দেওয়ার জন্য সোমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার বিকাল ৩ টা থেকে ৪টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার জন্য আন্তঃপ্রাদেশিক টেলিপ্রিন্টার চ্যানেল খোলা থাকবে।
নির্দেশ ১০ : টেলিফোন
বাংলাদেশের মধ্যে স্থানীয় আন্তঃজেলা ট্রাংক টেলিফোন চালু থাকবে। টেলিফোন ব্যবস্থা রক্ষণাবেক্ষণ ও মেরামতের জন্য প্রয়োজনীয় সেকশনগুলো কাজ করবে।
নির্দেশ ১১ : বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র।
বেতার, টেলিভিশন এবং সংবাদপত্র চালু থাকবে এবং এগুলোতে জনগণের আন্দোলন সংক্রান্ত সকল খবর ও বিবৃতির পূর্ণ বিবরণ প্রচার করতে হবে। অন্যথায় এ সমস্ত প্রতিষ্ঠানে চাকরিরত ব্যক্তিরা সহযোগিতা করবেন না।
নির্দেশ ১২ : স্বাস্থ্য ও সেনিটেসন সার্ভিসেস
জেলা হাসপাতাল, যক্ষ্মা ক্লিনিক ও কলেরা গবেষণা কেন্দ্রসহ সকল হাসপাতাল, স্বাস্থ্য কেন্দ্র এবং স্বাস্থ্য ও সেনিটেসন সার্ভিস চালু থাকবে। সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর্স থাকবে এবং সকল হাসপাতাল, মফস্বল শহরের হাসপাতাল, গ্রামাঞ্চলের হাসপাতাল এবং স্বাস্থ্য কেন্দ্রে ওষুধপত্র ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি সরবরাহ অব্যাহত থাকবে।
পৃষ্ঠা-১৭১

নির্দেশ : ১৩ : বিজলী সরবরাহ
মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ বিভাগসহ বিদ্যুৎ সরবরাহ অব্যাহিত রাখার কাজের সাথে সম্পর্কিত ইপি ওয়াপদার সমস্ত বিভাগ কাজ করবে।
নির্দেশ ১৪ ও পানি ও গ্যাস
পানি ও গ্যাস সরবরাহ চালু থাকবে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ ব্যবস্থাও চালু থাকবে।
নির্দেশ ১৫ ও খাদ্য সরবরাহ
খাদ্য সরবরাহ সর্বোচ্চ অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে খাদ্যশস্যের আমদানি বণ্টন গুদামজাতকরণ ও স্থানান্তরে চালান অব্যাহত থাকবে। এ কাজের জন্য ওয়াগন বার্জ, ট্রাক ইত্যাদি সহ সব রকম যান বাহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
নির্দেশ ১৬ : কৃষি তৎপরতা
(ক) ধান ও পাটের বীজ, সার এবং কীটনাশক ওষুধ সংগ্রহ, চলাচল এবং বন্টন অব্যাহত থাকবে। কৃষি খামার, চাল গবেষণা ইন্সটিটিউট এবং এগুলোর সকল প্রকল্পের কাজ চলবে।
(খ) পাওয়ার পাম্প এবং অন্যান্য যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জামের চলাচল, বন্টন, স্থাপন (ফিল্ডিং) এবং চালানোর কাজ চলবে। এগুলোর জন্য প্রয়োজনীয় তেল-জ্বালানি, যন্ত্রপাতির সরবরাহ অব্যাহত থাকবে। এগুলোর মেরামত রক্ষণাবেক্ষণের ব্যবস্থাও রাখতে হবে।
(গ) নলকূপ খনন, পরিচালনা এবং খালের সেচসহ সব রকম পানি সেচ ব্যবস্থা চালু থাকবে।
(ঘ) পূর্ব-পাকিস্তান সমবায় ব্যাংক, সেন্ট্রাল সমবায় ব্যাংক ও এদের অনুমোদিত সংস্থা, থানা কেন্দ্রীয় সমবায় সমিতি ও অন্যান্য সব সমবায় প্রতিষ্ঠান চালু থাকবে।
(ঙ) এতদুদ্দেশ্যে ই, পি, আর, ডি. সির প্রয়োজনীয় সেকশন চালু থাকতে পারে।
(চ) কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক ও অন্যান্য ব্যাংক কর্তৃক ঘূর্ণিঝড় দুর্গত এলাকাসমূহে সুদমুক্ত-ঋণ প্রদান অব্যাহত থাকবে।
নির্দেশ ১৭: বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও শহর সংরক্ষণ।
বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ, শহর সংরক্ষণ এবং নদী খনন ও যন্ত্রপাতি স্থাপন সহ ইপিওয়াপদা ও অন্যান্য সংস্থার পানি উন্নয়ন কাজ, মালপত্র খালাস ও চলাচল এবং সংশ্লিষ্ট অন্যান্য সংস্থার জরুরি কাজ সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া হবে। সরকারি সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা স্বাভাবিক নিয়মে কন্ট্রাক্টরদের পাওনা মিটিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে।
পৃষ্ঠা-১৭২

নির্দেশ ১৮ : উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজ
বৈদেশিক সাহায্যে তৈরি সড়ক ও সেতু প্রকল্প সহ সরকারি স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা ও আধা-সরকারি সংস্থার সব উন্নয়ন ও নির্মাণ কাজের বাস্তবায়ন সুচারুরূপে চলবে। সরকারি সংস্থা বা সংশ্লিষ্ট স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা যথারীতি কন্টাকটরদের পাওনা মিটিয়ে দেবে। চুক্তি অনুযায়ী প্রয়োজনীয় মাল-মসলা সরবরাহের নিশ্চয়তাও বিধান করবে।
নির্দেশ ১৯ : সাহায্য ও পুনর্বাসন।
ঘূর্ণিদুর্গত এলাকাগুলোতে বাঁধ নির্মাণ ও উন্নয়ন কাজ সহ সব রকম সাহায্য পুনর্বাসন ও পুনঃনির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকবে। সরকারি সংস্থা কন্ট্রাক্টরদের পাওনা যথারীতি মিটিয়ে দেবে।
নির্দেশ ২০ : ই. পি, আই, ডি, সি, ইপসিক কারখানা ও ইস্টার্ণ রিফাইনারি।
ই পি, আই, ডি, সি, ইপসিক-এর সব কারখানায় কাজ চলবে এবং যত বেশি সম্ভব উৎপাদন বাড়ানোর চেষ্টা করবে। এসব কারখানা চালু রাখার জন্য অর্থ সরবরাহ ও ক্রয়ের জন্য ই. পি. আই. ডি. সি. ইপসিকের যে সব বিভাগ খোলা রাখা দরকার হবে সেগুলোতে কাজ চলবে। ইস্টার্ন রিফাইনারি লিমিটেডেও যথারীতি কাজ চলবে।
নির্দেশ ২১ : পেনশন
সামরিক বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারি ও শ্রমিক এবং প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষকদের বেতন তা দৈনিক, মাসিক, সাপ্তাহিক, পাক্ষিক যে ভিত্তিতে দেওয়া হোক না কেন, তা তাদের পাওনা হলে সেভাবেই দিতে হবে। যে সব সরকারি কর্মচারির বন্যা সাহায্য মুঞ্জুর করা হয়েছে এবং বকেয়া বেতন রয়েছে তা দিতে হবে। বেতনের বিল তৈরি ও বেতন দানের জন্য সরকারি ও আধা-সরকারি অফিসের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোতে কাজ চলবে।
নির্দেশ ২২ : সামরিক বিভাগে অবসরপ্রাপ্ত কর্মচারিদের সহ সব পেনশন প্রাপ্তদের নির্ধারিত পেনশন দিতে হবে।
নির্দেশ ২৩ : এজিইপি ও ট্রেজারী ও বেতনের বিল তৈরি এবং এসব নির্দেশ অনুমোদিত লেনদেনের জন্য এজিপিও ট্রেজারীতে সামান্য সংখ্যক কর্মচারি কাজ চালিয়ে যাবে।
নির্দেশ ২৪ : ব্যাংক
(ক) ব্যাংকিং কাজের জন্য সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২ টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য বিকেল ৪টা পর্যন্ত (বিরতির সময়সহ) সব ব্যাংক খোলা থাকবে। তবে শুক্র ও শনিবার দিন ব্যাংকগুলো ব্যাংকিং কাজের জন্য সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত এবং প্রশাসনিক কাজের জন্য দুপুর সাড়ে ১২ টা পর্যন্ত খোলা থাকবে।
পৃষ্ঠা-১৭৩

(খ) নিম্নলিখিত বিধি-নিষেধ ছাড়া ব্যাংকগুলো যে কোনো পরিমান জমা গ্রহণ, বাংলাদেশের ভেতর যে কোনো পরিমাণ আন্তব্যাংক কিয়ারেন্স, বাংলাদেশের ভেতর আন্তঃব্যাংক ট্রান্সফার এবং পশ্চিম পাকিস্তান থেকে টিটি বা মেইল ট্রান্সফার ব্যবস্থার মাধ্যমে অর্থ কড়ি’র করার কাজ চালিয়ে যাবে।
বিধি-নিষেধগুলো হচ্ছে :
(১) চেকের সাথে যদি সংশ্লিষ্ট শ্রমিক সংস্থার প্রতিনিধির বা বেতন রেজিস্টারের সার্টিফিকেট থাকে তা হলে বেতন মঞ্জুর ও পরিশোধ করা।
(২) সপ্তাহে ১ হাজার টাকা পর্যন্ত বোনাফাইড ব্যক্তিগত উইংস।
(৩) চিনিকল, পাটকল ইত্যাদির জন্য আঁখ ও পাটসহ, শিল্পের কাঁচামাল ক্রয়ের জন্য অর্থদান।
(৪) বাংলাদেশের ক্রেতাদের প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র ক্রয়সহ যে কোনো বোনাফাইড প্রয়োজনে সপ্তাহে ১০ হাজার টাকা পর্যন্ত প্রদান। এই অর্থ নগদ অর্থে বা ক্যাশ ড্রাফট মারফত উঠানো যাবে। তবে উপরে উল্লিখিত ৩ ও ৪ নম্বর শর্তে কোনো অর্থ দেওয়ার পূর্বে অতীত রেকর্ড দেখে ব্যাংককে সন্তুষ্ট হতে হবে যে, অর্থ গ্রহণকারী একজন বোনাইফাইড শিল্প অথবা বাণিজ্যিক সংস্থা বা ব্যবসায়ী এবং যে পরিমাণ অর্থ উঠানো হচ্ছে তা এক বছরে সপ্তাহে গড়ে উঠানো অর্থের চেয়ে বেশি।
(৫) উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নের কাজে নিযুক্ত তালিকাভুক্ত কন্ট্রাক্টরদের অর্থদান। তবে যে কর্তৃপক্ষক্ষের অধীনে প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। তার কাছ থেকে একটি সার্টিফিকেট আনতে হবে যে, যে টাকা উঠানো হচ্ছে তা উল্লিখিত কাজের জন্য প্রয়োজন
(ক) বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যে কোনো একাউন্টে ক্রস চেক ও ডিমান্ড ডাফট প্রদান করা ও জামা নেওয়া যাবে।
(খ) স্টেট ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক থেকে অর্থ প্রদানের ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে চিঠি পাঠাতে পারবে। যে সব ব্যাংকের সদর দপ্তর পশ্চিম পাকিস্তানে অবস্থিত সেগুলো ঢাকাস্থ ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংকের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় পাওয়া গ্রহণ করবে।
(গ) অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে নিম্নলিখিত বিষয়ের জন্য সঅমবার, মঙ্গলবার, বুধবার ও বৃহস্পতিবার, বিকেল ৩টা থেকে ৪টা পর্যন্ত আন্তঃশাখা টেলিপ্রিন্টার সার্ভিস চালু থাকবে।
পৃষ্ঠা-১৭৪
(১) প্রত্যেকটি বাণিজ্যিক ব্যাক সোমবার ও বুধবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যের একটি খবর পাঠাতে পারে।
(২) প্রত্যেকটি ব্যাংক অর্থ পাঠানোর ব্যাপারে মঙ্গল ও বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে খবর পেতে পারে।
(ঘ) বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ পদ্ধতির জন্য টেলিপ্রিন্টার সার্ভিসেস কাজ অব্যাহত থাকবে।
(ঙ) বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ বিল সংগ্রহের অনুমতি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ক্রস চেক বা ক্রস ডাফটের মাধ্যমে অর্থ প্রদান করতে হবে।
(চ) অনুমোদিত ডিলারের সাহায্যে ফরেন ট্র্যাভেলার্স চেক ভাংগানো যাবে।
(ছ) কূটনীতিকরা অবাধে তাদের একাউন্টের কাজ পরিচালনা করতে পারেন। এবং বিদেশি নাগরিকরা বৈদেশিক মুদ্রা একাউন্ট পরিচালনা করতে পারবেন এবং বৈদেশিক মুদ্রা গ্রহণ করতে পারবেন।
(জ) লকার্স পরিচালনার কাজ বন্ধ থাকবে।
(ঝ) স্টেট ব্যাংকের মাধ্যমে বা অন্য কোনো উপায়ে বাংলাদেশের বাইরে টাকা পাঠানো যাবে না।
(ঞ) বিদেশি রাষ্ট্র থেকে লাইসেন্সের মাধ্যমে দ্রব্যাদি আমদানির জন্য ঋণপত্র খোলা যাবে।
(ট) পণ্য বিনিময়ের চুক্তি (যে সব দ্রব্য ইতোমধ্যেই পাঠানো হয়েছে) অনুযায়ী প্রেরিত দ্রব্যাদি ছাড় করতে হবে।
(ঠ) ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক লিমিটেড ও ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশন এর মারফত বকেয়া রপ্তানি বিল সংগ্রহ করতে হবে। এ ব্যাপারে ব্যাংকগুলোর প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী কাজ পরিচালিত হবে।
নির্দেশ ২৬ : স্টেট ব্যাংক অন্যান্য ব্যাংকের মতই কাজ করবে এবং সেখানে একই অফিস সময় চলবে। বাংলাদেশের ব্যাংকিং পদ্ধতি কাজ করার উদ্দেশ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্যও অনুরূপভাবে ভোলা থাকবে। উল্লিখিত কাঠামো ও বিধি-নিষেধও এ ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে। ‘পি’ ফর্ম বরাদ্দ করা যেতে পারে এবং বিদেশে অবস্থানরত ছাত্র ও অন্যান্য অনুমোদিত প্রাপকের জন্য বিদেশে প্রেরণের টাকাও গৃহীত হতে পারবে।
নির্দেশ ২৭ : আমদানি ও রফতানি কন্ট্রোলার
বাংলাদেশের জন্য আমদানি লাইসেন্স ইস্যুকরণ ও আমদানিকৃত দ্রব্যাদি চলাচলের বিধি ব্যবস্থা নিশ্চিত করার জন্য আমদানি-রফতানি কন্ট্রোলারের অফিস নিয়মিত ভাবে চলবে।
পৃষ্ঠা-১৭৫

নির্দেশ ২৮ : ট্র্যাভেল এজেন্ট ও বিদেশি এয়ার লাইন্স।
সব ট্র্যাভেল এজেন্ট ও অফিস ও বিদেশি বিমান পরিবহন অফিস চালু থাকতে পারে। তবে তাদের বিক্রয়লব্ধ অর্থ বাংলাদেশের ব্যাংকে জমা রাখতে হবে।
নির্দেশ ২৯ : ফায়ার সার্ভিস বাংলাদেশের সব অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা চালু থাকবে।
নির্দেশ ৩০ : পৌরসভা ময়লাবাহী ট্রাক, রাস্তায় বাতি জ্বালানো সুইপার সার্ভিস এবং জনস্বাস্থ্য সংক্রান্ত অন্যান্য ব্যবস্থা চালু থাকবে।
নির্দেশ ৩১ : কর দান বন্ধ রাখা অভিযান
(ক) পুনরায় নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত-(১) সব ভূমি রাজস্ব আদায় বন্ধ থাকবে, (২) বাংলাদেশের কোথাও কোনো লবণ কর আদায় করা যাবে না (৩) বাংলাদেশের কোথাও কোনো তামাক কর আদায় হবে না এবং (৪) তাঁতিরা আবগারী শুল্ক ছাড়াই বাংলার সুতা কিনবেন। মিল-মালিক ও ডিলাররা তাদের কাছ থেকে কোনো আবগারী শুল্ক আদায় করতে পারবে না।
(খ) এ ছাড়া প্রাদেশিক সরকারের সব কর, যেমন—প্রমোদ কর, হাটবাজার, সেতু ও পুকুরের ওপর ধার্যকৃত কর আদায় করা যাবে এবং বাংলাদেশের সরকারের একাউন্টে জমা দিতে হবে।
(গ) অক্টয়সহ সব স্থানীয় কর আদায় করা যাবে।
(ঘ) কেন্দ্রীয় সরকারের সব পরোক্ষ কর, যেমন—আবগারী শুল্ক কর, বিক্রয় কর এখন থেকে আদায়কারী প্রতিষ্ঠান দ্বারা আদায় হবে। তবে তা কেন্দ্রীয় খাতে জমা করা যাবে না বা কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে হস্তান্তর করা যাবে না। এসব আদায়কৃত কর ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক বা ইস্টার্ন ব্যাংকিং কর্পোরেশনে বিশেষ একাউন্ট খুলে জমা রাখতে হবে। এবং ব্যাংক দুটিও তাদের প্রতি প্রদত্ত নির্দেশ অনুযায়ী এগুলো গ্রহণ করবে, আদায়কারী প্রতিষ্ঠানকে এ নির্দেশ ও বিভিন্ন সময় তাদের প্রতি যে নির্দেশ দেওয়া হবে তা মানতে হবে।
(ঙ) কেন্দ্রীয় সরকারের সব প্রত্যক্ষ কর, যেমন-আয়কর, আদায়কর ইত্যাদি পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত বন্ধ থাকবে।
নির্দেশ ৩২ : পাকিস্তান বিমা কর্পোরেশন চালু থাকবে এবং পোস্টাল লাইফ ইস্যুরেন্সসহ সব বিমা কোম্পানিতে কাজ চলবে।
পৃষ্ঠা-১৭৬

নির্দেশ ৩৩ : সব ব্যবসা ও শিল্প প্রতিষ্ঠান এবং দোকান পাট নিয়মিতভাবে চলবে।
নির্দেশ ৩৪ : সব বাড়ির উপর কালো পতাকা উড়া অব্যাহত থাকবে ।
নির্দেশ ৩৫ : সংগ্রাম পরিষদগুলো সর্বস্তরে তাদের কাজ চালু রাখবে এবং এ সব নির্দেশ যথাযথভাবে বাস্তবায়িত করে যাবে।
স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদের নেতৃবৃন্দ বায়তুল মোকাররমে এক জনসমাবেশে বক্তৃতাকালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার উদ্দেশ্যে অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকার জন্য সকল শ্রেণির বাঙালিদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন, গত ১ মার্চ আমরা বাংলাদেশের মুক্তির কথা ঘোষণা করেছি। তারপর এক পক্ষকাল অতিক্রান্ত হয়েছে। ইতিমধ্যেই প্রতিপক্ষের সাথে আমাদের সংঘর্ষ শুরু হয়েছে। তাই মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য আমাদের দীর্ঘ সংগ্রামে লিপ্ত থাকতে হবে। এই সার্বিক যুদ্ধের মমোকাবিলায় গণবাহিনী গঠন করার জন্য নেতৃবৃন্দ জনগণের প্রতি আহ্বান জানান। আ, স, ম, আব্দুর রব বলেন-বাংলাদেশ আজ স্বাধীন, আমাদের ওপর সামরিক বিধি জারি করার ক্ষমতা কারো নেই। বাংলাদেশের জনগণ একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নির্দেশই মেনে চলবে। স্বাধীনতা রক্ষার জন্য গণবাহিনী গঠন করার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের সকল নর-নারী ও যুবক-যুবতীকে সৈনিক হতে হবে। গণশত্রুরা আমাদের দেশকে ভিয়েতনাম ও হিরোশিমার মতো বোমা মেরে উড়িয়ে দেওয়ার পাঁয়তারা করছে। এই সার্বাত্মক যুদ্ধকে প্রতিরোধ করতে হবে। আব্দুল কুদ্দুস মাখন বলেন, বাংলাদেশে যদি কোনো আইন জারী করতে হয়, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানই তা করবেন। শাহজাহান সিরাজ বলেন, প্রতিপক্ষ এখনও নিশ্ৰুপ রয়েছে, কিন্তু চরম আঘাত হানার জন্য তারা হয়তো অপেক্ষা করছে। তাদেরকে প্রতিহত করতে না পারলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষা করা যাবে না। সভাপতির ভাষণে নূরে আলম সিদ্দিকী বলেন, ২৩ বছর যারা সোনার বাংলাকে শ্মশানে পরিণত করেছে তাদের সাথে আমাদের আপোষ নেই। তিনি বলেন, ৬-দফা ও ১১ দফা দিয়ে সংহতির ফুটো কলসিতে আমরা সিমেন্ট লাগাতে চেয়েছিলাম। কিন্তু তারা আমাদের সে প্রচেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়েছে তাই বাংলার মানুষ সে কলসীকে ভেঙে দিয়েছে পৃথিবীর কোনো শক্তিই আমাদের স্বাধীনতাকে নস্যাৎ করতে পারবে না।”
মার্চ মাসের শুরুতেই ক্রমবর্ধমান গণ-আন্দোলন ও বিক্ষোভের অগ্নিগর্ভ সূচনা হয়েছিল তা অব্যাহত রইলো। শেখ মুজিব শান্তিপূর্ণ ভাবে অসহযোগ আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার জন্যে জনগণের প্রতি আহ্বান জানান
পৃষ্ঠা-১৭৭

১৬ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক চললো আড়াই ঘণ্টাকাল বাংলাদেষেড় মানুষ তথা বিশ্ববাসীর নিবদ্ধ দৃষ্টি ছিল বৈঠকের প্রতি। পরদিন সংবাদে বলা হয় : “আলোচনা শেষে বাংলার নায়ক প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগ করা দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদেরকে জানান যে রাজনৈতিক ও অন্যান্য পরিস্থিতি নিয়ে তারা উভয়ে আলোচনা করেছেন। জনৈক বিদেশি সাংবাদিক আলোচনার অগ্রগতি হয়েছে কিনা জানতে চাইলে শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, আলোচনা চলছে এবং আরো চলবে। এর বেশি আমার কিছু বলার নেই। আরেক দিক সাংবাদিক প্রশ্ন করেন যে, তাদের উভয়ের আলোচনা যে পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়েছে তাঁকে বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশ বলা চলে কিনা? শেখ সাহেব মুহূর্তকাল থেমে স্পষ্ট জবাবে বলেন, ‘সাংবাদিকদের কাছে যতটুকু বলেছি তার বেশি কিছু আর বলা নেই। এ সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন করবেন না। পরে তিনি বলেন, ‘আলোচনা অব্যাহত থাকবে এবং এ ব্যাপারে বেশ সময়ের প্রয়োজন। বিষয়টি এক-দুই মিনিটের নয়। আরেক সাংবাদিক তার ৬-দফা শর্ত ছাড়াও আলোচনায় অন্য কোনো প্রশ্নও তিনি তুলেছেন কিনা, প্রশ্ন করলে শেখ সাহেব আর কোনো মন্তব্য করতে অসম্মতি জানান।
ঐ দিনই স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম-পরিষদও সংবাদপত্রে বিবৃতি প্রদান করলে ছাপা হয় পত্রিকায়। “স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের সদস্য চতুষ্টয় এক বিবৃতিতে অভিযোগ করেন যে, সেনাবাহিনী রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হোস্টেল, জোহা হল, মন্নুজান হল, যশোর রংপুর ক্যান্টনমেন্ট এলাকায়-খুলনা, চট্টগ্রাম, ঢাকা, ই. পি, আর, ক্যাম্প, ফার্মগেট, দ্বিতীয় রাজধানী রায়পুরা ও কচুক্ষেতে স্বাধীনতাকামী জনগণ ও অন্যদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে। তারা অভিযোগ করেন যে, বহু লোককে এ পর্যন্ত হত্যা করা হয়েছে, এ ছাড়া গত সোমবার রাতে ঢাকার ড্রাম ফ্যাক্টরি ও দ্বিতীয় রাজধানীতে দু’জনকে গাড়ি থেকে নামিয়ে মারপিট করা হয়েছে মা-বোনদের ওপর জুলুম চালিয়ে যাওয়ারও অভিযোগ করা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে এ সব সৈন্যদের ফিরিয়ে নিতে বলেন।”
১৭ মার্চ ইয়াহিয়া-মুজিব দ্বিতীয় দফা বৈঠক। মাত্র এক ঘণ্টাকাল স্থায়ী হয়। শেখ মুজিব সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের জবাব এড়িয়ে গিয়ে শুধু বললেন, ‘আলোচনা চলবে’। মিছিল-শোভা যাত্রার জনতা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে আকাশবাতাস মুখরিত করে তুললো।
এই দিনটি ছিল শেখ মুজিবের জন্মদিন। সাংবাদিকরা তাকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানালে তিনি দুঃখ ভারাক্রান্ত কণ্ঠে বলেন আমি আমার জন্মদিনের উৎসব করি না। এই দুখিনী বাংলায় আমার জন্ম দিনই বা কি আর মৃত্যু দিনই
পৃষ্ঠা-১৭৮

বা কি? পশ্চিমাদের ইচ্ছামত আমাদের প্রাণ দিতে হয়। এ দেশের জনগণের কাছে জন্মের আজ নেই মহিমা।
শেখ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক সম্পর্কে সিদ্দিক সালিক তাঁর ‘Witness to Surrender’ গ্রন্থে বলেনঃ
He met Mujib at the President’s House next day. There were no aides on either side. It was understood to be an informal attempt to re-establish the broken contact. It didn’t take Yahya long to discover that Mujib had something up his sleeve and he didn’t respond to the President’s overtures as openly as he had done in preelection days. The President was dismayed. Amazingly, he had (apparently) failed to see the snake in the grass for one full year, although it is said that leaders should be sensitive enough to hear the grass grow.
Yahya and Mujib held full-dress talks on 17 March. It was a tough session. Both sides presented their views with no discernible areas of compromise. The Awami League had briefed its team well but it could not convince the President’s advisers of its standpoint.
After, the meeting, when Mujib emerged from the President’s House flying a black flag on his white car, he was stopped by the waiting journalists at the gate. I was present but Mujib took no notice of my uniform. He seemed obsesse, and highly agitated. I stood close to his left shoulder looking at his face. It was ashen. His entire frame quivered and his lips trembled with excitement. He dismissed all questions with a snappy ‘yes’ or ‘on’ and drove off rapidly to his Dhanmandi residence. The journalists followed him. I stood bemused under the sprawling banyan tree. The Iron gate of the President House had clanked shout. Only the bayonet of the guard could be seen from outside.
Back in the cantonment, I learnt that G.O.C. had gone to General Tikka Khan to learn the outcome of the Day’s talks, General Tikka Khan said, ‘Khadim, I know as little as you do.’ But, sir, it is your right, as the man on the spot, to keep in touch with developments so that you are not caught unawares, ‘The same evening, General Tikka Khan’s staff car entered the President’s House. Yahya Khan reportedly told him, ‘the bastard is not behaving. You get ready.
পৃষ্ঠা-১৭৯
“Tikka Khan rang up the G.O.C. at 10 p.m. to day, “Khadim, you can go ahead.’ It was taken to mean that planning and paper preparations for army action could start as the army always readies itself for all contingencies but that the action would depend on the progress of political talks. The Army in Dacca was not forcing the President’s hand for a crack down. It still longed for the political settlement which was being attempted at the president’s House. Preparations, it should be emphasised, do not necessarily indicate intentions. If one digs out the military files of any country, one will find offensive as well as defensive plans against plan.
On 18 March (morning), Major-General Khadim Raja and Major-General Rao Farman Ali met in the G.O.C.’s office to draft the basic operation plan. Both of them agreed that the basis of operation ‘BLITZ (that is, the people’s co-operation) was no longer relevant, as had been amply demonstrated since I March. They also agreed that the aim of operation ‘BLITZ’ (to enforce martial law in its classical role), had likewise been superseded by events. Now, if and hen any actions was taken, it would have to aim at overthrowing Mujib’s de facto rule and re-establishing government authority.
In the same sitting, General Farman wrote down the new plan on a light blue pad, using an ordinary school pencil. I saw the original plan in General Farman’s immaculate hand. General Khadim wrote its second part, which dealt with distribution of resources and the allocation of task to brigades and units.
The plan, christened ‘Operation SEARCHLIGHT; consisted of sixteen paragraphs spread over five pages. It presumed that all Bengali troops. including regular East Bengal battalions would revolt in reaction to its execution. they should therefore, be disarmed. Secondly, the ‘non co-operation movement launched by Mujib should be deprived of its leadership by arresting all the prominent Awami League leaders while they were in conference with the President. The plan also listed, as an annex, sisteen prominent persons whose houses were to be visited for their arrest.
পৃষ্ঠা-১৮০

The hand-written plan was read out to General Hamid and Lieutenant-General Tikka Khan at his falag staff House on the afternoon of 20 March. Both of them approved the main contents of the plan but General Hamid struck out the clause pertaining to disarming the Benggli troops as ‘it would destroy one of the finest armies in the world.’ He, however, approved the disarming of paramilitary forces like the East Pakistan Fifles and the police. He asked only one question. After distribution of these troops for various tasks, are you left with any reserves? No, sir,’ was the prompt reply from the G.O.C.
Later, the resident also deprived the plan of one of its fundamental features. He refused to agree that the Awami League leaders should be arrested, on the appointed day, while they were in conference with the President, ‘I don’t want to kill the people’s confidence in political negotiation. I don’t want to go down in history as a traitor to democracy. “These were his very words, reported to me by an eye witness. What was eventually left in the plan was only the allocation of tasks and areas of responsibility to various brigades and battalions.
১৭ মার্চ সামরিক আইন প্রশাসকের পক্ষ থেকে এক ঘোষণায় বলা হলো, ‘২রা মার্চ থেকে ৯ মার্চ পর্যন্ত বেসামরিক কর্তৃপক্ষকে সাহায্য করার জন্য কোনো পরিস্থিতিতে সেনাবাহিনী তলব করা হয়েছিল তা তদন্ত করে দেখার জন্য একটি তদন্ত কমিশন গঠন করা হয়েছে’। সামরিক কর্তৃপক্ষের এই ঘোষণা জনতা মেনে নিলো না। তদন্ত কমিশনের নামে প্রহসন হবে বলে তারা মনে করলো। শেখ মুজিব দুঃখ করে বললেন, “আমি দুঃখের সাথে বলছি যে, জনগণের পক্ষ থেকে আমি যে দাবি জানিয়েছি, ঘোষিত তদন্তকমিশন যে তা পূরণ করতে পারবে না, কমিশনের প্রকৃতি দেখেই তা বোঝা যায়। সামরিক আদেশবলে এর গঠন এবং সামরিক কর্তৃপক্ষের কাছে এর রিপোর্ট পেশের ব্যবস্থা দুই-ই অত্যন্ত আপত্তিকর।”
১৮ মার্চ মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠকের বিরতি ছিল, ফলে জনগণের মনে দেখা দিলো নানান সংশয়। জনতার মিছিল এসে জমতে থাকে শেখ মুজিবের ধানমন্ডিসহ বাসভবনে।
পৃষ্ঠা-১৮১

এ সমযয়ে পুরোদমে চলছিল পাকিস্তানিদের প্রস্তুতি। এন্থনি ম্যাসকারেনহাস বলেন : ‘PIA Boeing and Pakistan Air force C-130s were flying in round the clock with their cargoes of with machine gun nests and anti-aircraft batteries. Tanks were brought in from outlying boarder districts and converted to soft belts for use in the cities.There was a constant movement of troops. Bengali officers and men of the east Pakistan Rifles and the East Bengal Regiment were systematically broken up into smaller groups. Some were disarmed.”
১৯ মার্চ সকাল ১১টায় বসlলো পুনরায় মুজিব-ইয়াহিয়া বৈঠক। এক ঘন্টা স্থানী এই বৈঠকে আলোচনার অগ্রগতি সম্পর্কে শেখ মুজিব সাংবাদিকদের কিছু জানাতে অস্বীকৃতি জানান। ওই দিনই সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের ৩ জন উপদেষ্টা তাজউদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং ড. কামাল হোসেনের সাথে জেনারেল ইয়াহিয়ার উপদেষ্টার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দু’ঘণ্টাব্যাপী আলোচনা। হয়।
১৯ মার্চ ঢাকার জয়দেবপুরে সেনাবাহিনীর গুলি চালনায় ২০ জনেরও বেশি বাঙালি নিহত ও বেশ কিছু আহত হয়। এ সম্পর্কে সাংবাদিক এন্থনি ম্যাসকারেনহাস লেখেন ।
“On 19 March there was a serious clash between West Pakistan military men and the people in Joydevpur 22 miles north of Dacca, when attempts were made to disarm a contingent of the East pakistan Rifles guarding the Chinese buit ordnance factory. The official estimates put the casualties at two dead and five injured. The Awami League’s own estimate is that 120 people dead as a result of the army firing.”
এই ঘটনা সম্পর্কে মেজর সফিউল্লাহ (বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল) Bangladesh at war গ্রন্থে লিখেছেন, ঢাকা ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকে জয়দেবপুরে অবস্থানরত দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টকে জানানো হয় :
“The commander with his escort is coming to have lunch with you. He would also visit Gazipur ordnance Factory.
বেলা ১২টার সময় পুনরায় বার্তা আসে :
I had cleared some barricade, now, I am at chowrasta, I am using the civilians to open the barricade, you also clear the barricade from your side and meet me enroute. If there is any opposition use maximum force.
পৃষ্ঠা-১৮২
ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আলবাবের সঙ্গে ৭০ জন সশন্ত্র জোয়ান, ৩ জন ক্যাপ্টেন, একজন মেজর এবং একজন লে. কর্নেল জয়দেবপুরের দিকে আসছিলেন। তাদের আগমনের খবর জনতার মধ্যে দারুণ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে । শোনা যাচ্ছিলো দ্বিতীয় বেঙ্গল রেজিমেন্টকে নিরস্ত্র করা হবে।
জনতা সঙ্গে সঙ্গে ব্যারিকেড তৈরি করে পাকিস্তানিদের প্রতি মারমুখি হয়। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব অত্যন্ত ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ঠিক এই সময়েই টাংগাইল থেকে একটি বেডফোর্ড গাড়িতে কয়েকজন বেঙ্গল-রেজিমেন্টের সৈন্য জয়দেবপুর আসছিল। জনতা গাড়ি থামিয়ে বেঙ্গল-রেজিমেন্ট সৈন্যদের কাছ থেকে ৪টি চাইনিজ রাইফেল এবং একটি চাইনিজ এস-এম-জি ছিনিয়ে নিয়ে পাঁচজনকে বন্দী করে। ড্রাইভার এবং অপর একজন সৈন্য পালিয়ে ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে পৌছে ঘটনা অবগত করলে ব্রিগেডিয়ার জনতাকে লক্ষ্য করে গুলি চালাবার নির্দেশ দেন। ব্যাটালিয়ন কমান্ডার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসান শেষ পর্যন্ত মেজর মঈনকে নির্দেশ দেয় উপরের দিকে গুলি ছুঁড়তে। মেজর মঈন বস্তুত দু’বার ফাঁকা গুলি করে। কিন্তু এতে ব্রিগেডিয়ার অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হয়ে বললেনঃ ।
‘I want one dead body per bullet. If you cannot handle the situation, I will employ my troops.’
শেষ পর্যন্ত মেজর মঈন গুলি ছুঁড়তে বাধ্য হয়। কয়েক রাউন্ড গুলিতে কয়েকজন লোক নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হলে জনতা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব ব্যারিকেড পরিষ্কার করে ঢাকা ফিরে যান। তার উদ্দেশ্য কি ছিল জানা না গেলেও, উদ্দেশ্য যে মহৎ ছিল না সে কথা বলাই বাহুল্য।’
এ ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকার ৫৭তম ব্রিগেড হেড কোয়ার্টার থেকে ব্রিগেড কমান্ডার দ্বিতীয় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ব্যাটালিয়ন কম্যান্ডার লে. কর্নেল মাসুদুল হাসানের নামে কারণ দর্শাবার নোটিশ পাঠায়। ফলে লে, কর্নেল মাসুদুল হাসানকে ঢাকা ডেকে পাঠানাে হয় এবং সেখানেই তাঁকে বন্দী করা হয়।
এ ঘটনা সম্পর্কে জয়দেবপুর থেকে প্রকাশিত ‘স্বাধীনতা সংকলন পুস্তিকায় লেখা হয়, “১৯৭১ এর ১৯ মার্চ সেকেন্ড বেঙ্গল রেজিমেন্টের বাঙালি সৈনিকদেরকে নিরস্ত্র করার জন্য ব্রিগেডিয়ার জাহানজেবের নেতৃত্বে প্রায় শতাধিক পাকিস্তানি সৈন্যের কনভয় জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে আসে। অসুস্থ এক শ্রমিক ভাইয়ের চিকিৎসার উদ্দেশ্যে আমি আমার দু’জন সহকর্মী হেলালুজ্জামান ও ওয়াহিদ সাহেবকে নিয়ে জয়দেবপুর যাই বেলা দুটার দিকে।
“হঠাৎ গোলাগুলির আওয়াজ শুনি। গাড়ি ঘুরিয়ে সরিয়ে, আমরা তখন ম্যালেরিয়া অফিসের কাছে রাখি। ঠিক এই সময়ে বেশ কিছু সংখ্যক রাইফেল
পৃষ্ঠা-১৮৩

নিয়ে আক্রান্ত শ্রমিককর্মী, মুক্তিপাগল যুবক, চৌধুরী গিয়াসউদ্দিন ,ডিজেল প্লান্টের জনৈক টেকনিশিয়ান ও আরও দুটি ছেলে উর্ধ্বশ্বাসে এসে গাড়ির কাছে উপস্থিত হলে পরম আগ্রহে টেনে নিলাম গাড়ির ভেতর। ফিরে গেলাম গোপন স্থানে অস্ত্র রাখার জন্য। শুনলাম বহুলোক হতাহত হয়েছে। অ্যাম্বুলেন্স পাঠিয়ে দিলাম। কিছুক্ষণ পরে নেওয়ামত নামে এক কিশোরকে বুকে গুলি বিদ্ধ অবস্থায় আমাদের মেডিক্যাল সেন্টারে আনা হলো। বহু যত্ন এবং প্রচেষ্টায়ও তাকে বাঁচানো গেল না।… নেওয়ামত, মনু খলিফা ও আরো কয়েকজনের আত্যাগে মধ্য দিয়ে বস্তুত এ দিনেই শুরু হয় বাংলাদেশের সশস্ত্র স্বাধীনতা সংগ্রাম। কড্ডার কালু মিয়া বাঁশ হাতে পাঞ্জাবিদের ধাওয়া করে। ফুটবল খেলোয়াড় দুঃসাহসী হুরমত আলী এক সিপাহীর অস্ত্র কেড়ে নিলে পাকসৈন্যরা দূর থেকে গুলি করে। হুরমত ও কালু মিয়া গুরুতরভাবে আহত হন।
শেখ মুজিব এই ঘটনায় মর্মাহত হয়ে বললেন, “বাঙালির ফিনকি দেওয়া রক্তের দাগ শহরে-বন্দরে ছড়িয়ে আছে। জয়দেবপুরের মাটিও আমার ভাইয়ের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে। বুলেট আর বেয়নেট দিয়ে বাঙালির মুক্তির আন্দোলন স্তব্ধ করা কোনো শক্তির পক্ষে সম্ভব নয়। যারা এ ধরনের দুরাশা মনে মনে পোষণ করেন, তাঁরা বেওকুফের স্বর্গেই বাস করছেন।”
২০ মার্চ উপদেষ্টাসহ শেখ মুজিব ইয়াহিয়ার সাথে ৯০ মিনিটব্যাপী ৩য় দফা বৈঠকে মিলিত হন। বঙ্গবন্ধুর উপদেষ্টার মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, তাজউদ্দিন আহমেদ, কামারুজ্জামান, খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও ড. কামাল হোসেন। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু মুজিব সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করে বৈঠকের ফলাফল সম্পর্কে এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আমি সর্বদা ভাললাটা আশা করি, কিন্তু আবার খারাপের জন্য প্রস্তুত হয়েই থাকি। আমার ভূমিকা বিশ্ববাসীর কাছে সুস্পষ্ট রয়েছে।” সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব আরও বললেন, “আমি শুধু এটুকুই। বলতে পারি আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে।” অপর একজন সাংবাদিকের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, “আমি নরকের মধ্যে বসেও পুষ্পের হাসি হাসতে পারি।”
একই দিনে শেখ মুজিবের ৩ জন উপদেষ্টার সঙ্গে ইয়াহিয়া খানের ৩ জন উপদেষ্টারও দু’ঘণ্টাব্যাপী এক বৈঠক হয়। ইতোমধ্যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াঅ জুলফিকার আলী ভুট্টো ও সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি হামুদুর রহমানকে ঢাকায় আসার জন্য এক জরুরি তারবার্তা পাঠায়। জবাবে করাচিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টো সে আবেদন প্রত্যাখ্যান করে। ভুট্টো বলেন যে, তিনি ১৬ মার্চে শাসনতান্ত্রিক প্রশ্নে গোপন আলোচনার জন্য প্রেসিডেন্টের কাছে
পৃষ্ঠা-১৮৪

কয়েকটি বিষয়ে ব্যাখ্যা পাঠিয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়ার দিক থেকে সম্পূর্ণ ব্যাখ্যা না পাওয়ায় তিনি ঢাকা যাওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন। অবশেষে, মার্চের ২০ প্রেসিডেন্টের আরেকটি আমন্ত্রণের পরিপ্রেক্ষিতে ভুট্টো সদলবলে ঢাকায় যাবার ঘোষণা দেন।
ভুট্টো এবং ইয়াহিয়ার সওয়াল-জবাবের বিষয় অজ্ঞাত থাকলেও তা অনুমান করতে আমাদের কষ্ট হয় না। পরবর্তীকালে তাদের কার্যকলাপ থেকে আমরা এ কথা খুব জোরের সঙ্গেই বলতে পারি যে, ২৫ মার্চের ঘটনার বীজ ঐ ‘সন্তোষজনক জবাবের মধ্যেই নিহিত ছিল। ইয়াহিয়ার সাথে পূর্বে পাঁচঘণ্টার এক বৈঠকে দু’জন ভবিষ্যৎ কর্মপন্থা প্রায় একরূপ ঠিকঠাক করেই রেখেছিলেন। বঙ্গবন্ধু তার ৭ মার্চের ভাষণে এ সম্পর্কে আভাস দিয়েছেন।
মার্চের ২১ তারিখে ভুট্টো সাহেব ১৩ জনের এক প্রতিনিধি দল নিয়ে ঢাকায় এসে পৌছা মাত্রই তুমুল বিক্ষোভের মুখোমুখি হন। কড়া সামরিক নিরাপত্তায় তিনি হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল পৌছেন। হোটেল প্রাঙ্গণে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে কয়েক’শ লোক ভুট্টো-বিরোধি শ্লোগান দিয়ে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
সামরিক বাহিনীর লোকজন ভুট্টোকে চারদিক ঘিরে হোটেলের অভ্যন্তরে নিয়ে যায়। হোটেলের অভ্যন্তরেও ক্ষুদ্র একটি দল প্ল্যাকার্ডসহ তার প্রতি বিক্ষোভ জানায়। এ সময় সাংবাদিকদেরও ভুট্টোর কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। ভুট্টোর গাড়ির সামনে ও পিছনে সাব-মেশিনগান ও অন্যান্য অস্ত্রশস্ত্র সজ্জিত সামরিক বাহিনীর কয়েকটি গাড়ি ছিল। ভুট্টোর গাড়িতেও তার দুপাশে সাদা পোশাক পরিহিত স্বয়ংক্রিয় রাইফেলধারী দু’ব্যক্তি আসীন ছিল। তারা গাড়ির জানালা দিয়ে দুদিকে রাইফেল তাক করে বসে ছিল। ভুট্টোকে এ সময় অত্যন্ত বিমর্ষ ও চিন্তাক্লিষ্ট দেখাচ্ছিল।”
ভুট্টো বরাবরই নিজেকে জাতীয় নেতা হিসাবে জাহির করে আসছেন। অথচ সেই জাতির প্রায় শতকরা ষাটজন বাঙালি এবং তথা এই বৃহত্তর জনগোষ্ঠর যিনি একচ্ছত্র নায়ক ভুট্টো তাঁকে নিদারুণ ভয় পান। কেননা ভুট্টোর উচ্চাকাঙ্ক্ষা বড়ই গগণচুম্বি-তিনি প্রধানমন্ত্রী হতে চান। অথচ সংখ্যাগরিষ্ঠ শতকরা ষাটজন তাকে সমর্থন করেন না। এ কারণেই জনগণের সেই শক্তি ও তাদের মহানায়কের গর্ব নির্মূল করতে চান ভুট্টো।
ঢাকায় পৌছেই ভুট্টো প্রথমে ইয়াহিয়া খানের সাথে দেখা করেন। উভয়ের এক গোপন বৈঠক হয়। বৈঠক শেষে ভুট্টো বলেন, সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।’
ঠিক হয়ে যাবে, কারণ ইয়াহিয়া খানের গণহত্যা পরিকল্পনায় তার সমর্থন আছে। দু’জন দু’জনকে প্রয়োজনের তাগিদেই আবিষ্কার করেছে, উভয়ে সুহৃদ
পৃষ্ঠা-১৮৫

হয়েছে। কিন্তু পরবর্তী ইতিহাসে প্রমাণিত হয় ইয়াহিয়া ভুট্টোকে খুব বেশি দিন ব্যবহার করতে পারেনি। বরং তিনিই ব্যবহৃত ও পরাজিত হন।
একই দিনে মুজিব-ইয়াহিয়ার মধ্যেও ৭০ মিনিট ব্যাপী এক অনি বৈঠক বসে। বৈঠক শেষে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশের হওয়া পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন অব্যাহত থাকবে।’ ‘ইয়াহিয়ার অনুষ্ঠিত বৈঠকের ফলাফল জানাতে তিনি অস্বীকৃতি জানান।
অথচ এর পূর্ব দিন অর্থাৎ ২০ মার্চ প্রেসিডেন্টের সঙ্গে প্রায় দুই ঘণ্টা ধরে আলোচনার পর বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদেরকে বলেছিলেন যে, আলোচনায় অগ্রগতি হয়েছে। তবে বঙ্গবন্ধুর উক্তিতে একথা সুস্পষ্ট হয়েছিল যে, ধমজাল কাটেনি-কাটাবার সম্ভাবনাও খুব উজ্জ্বল নয়।
২২ শে মার্চ ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে শেখ মুজিবের ৭৫ মিনিটব্যাপী এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। ৭ ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচন হবার পর এই প্রথমবারের মতো এই তিন জনের ত্রি-পক্ষীয় বৈঠক বসে।
ত্রি-পক্ষীয় বৈঠক শেষে বাসভবনে ফিরে বঙ্গবন্ধু সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, “আলোচনায় অগ্রগতি সাধিত না হলে আমি আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছি কেন?” অবশ্য তিনি একথাও বলেন, বাংলাদেশে এখনো বিপজ্জনক পরিস্থিতি বিদ্যমান। এ দেশবাসীকে তাই সাবধানতা অবলম্বন করতেই হবে।
মুজিব-ইয়াহিয়া-ভুট্টোর মধ্যকার বৈঠকের পর সবাই এর সফলতা নিয়ে আশাবাদী হন। বাংলাদেশের বিভিন্ন সংবাদপত্র এ দিন ‘বাংলার স্বাধিকার’ শীর্ষক ক্রোড়পত্র প্রকাশ করে। পরদিন ইত্তেফাকের সম্পাদকীয়তে লেখা হয় ?
সোমবার ঢাকায় এই মর্মে আভাস পাওয়া গিয়াছে, রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পন্থা চূড়ান্ত করার পদক্ষেপ হিসাবে প্রেসিডেন্ট দুই একদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের নেতাদের এক যৌথ বৈঠকে মিলিত করার চেষ্টা করিতে পারেন। সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই তিনি কাইয়ুম খানকে তলব করিয়া আনেন। অন্য পশ্চিমাঞ্চলীয় গণপ্রতিনিধিত্বশীল নেতারা বর্তমানে ঢাকায় রহিয়াছেন। এদিকে গতকাল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং ভুট্টো আলোচনায় অগ্রগতি হইতেছে বলিয়া মন্তব্য করিয়াছেন। ছয় দফা পূর্বশর্ত পূরণ না হইলে সংখ্যাগরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদে যোগ দিবে না বলিয়া ঘোষণা করিয়াও এ ব্যাপারে শেখ সাহেব যে আপোসহীন ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন, ইয়াহিয়া ও ভুট্টো উহার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হইয়াছেন বলিয়া অনুমিত হইতেছে। সম্ভবত সেই কারণেই অর্থাৎ সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং গণপ্রতিনিধিদের নিকট ক্ষমতা হস্তান্তরসহ বঙ্গবন্ধুর দাবি পূরণের ব্যবস্থা গ্রহণের নিমিত্তেই ভুট্টোর উপস্থিতিতে শেখ সাহেবের বৈঠক চলাকালেই প্রেসিডেন্ট
পৃষ্ঠা-১৮৬

জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আবার স্থগিত ঘোষণা করিয়াছেন। যদি শেষ মুহূর্তে ব্যক্তিবিশেষের কারণে অতিনাটকীয় কিছু না ঘটে তবে অচিরেই সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং সংশ্লিষ্ট অপরাপর ব্যবস্থা গৃহীত হইতে যাইতেছে। আরো জানা গিয়াছে যে, শেখ মুজিবের দাবি অনুসারে সামরিক আইন প্রত্যাহারের পরই নয়া সরকারের রূপরেখা নির্দিষ্ট হইবে। ইতিমধ্যে শেখ সাহেব সোমবার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলিয়াছেন যে, আমাদের আন্দোলন চলিতেছে। লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই আন্দোলন অব্যাহত থাকিবে। তিনি আরো বলিয়াছেন, বাংলার মানুষ শান্তিপূর্ণভাবে সমস্যার সমাধান চায়। কিন্তু উহা না হইলে সংগ্রামের মাধ্যমেই তাহারা লক্ষ্যে গিয়া পৌছিবে।”
প্রেসিডেন্টের সাথে ভুট্টোর যে একটি গভীর সংযোগ ছিল, তাও আজ বিশ্ববাসীর কাছে অত্যন্ত সুস্পষ্ট। ২২ মার্চ ভুট্টো বলেন, তিনি শেখ মুজিব ও প্রেসিডেন্টের মধ্যে যে সমঝোতা হয়েছে তিনি তা পরীক্ষা করেছেন এবং তিনি অত্যন্ত আশাবাদী। তার ভাষায়ঃ
I had a fruitful and satisfactory meetig with Sheikh Mujibur Rahman this morning. I would welcome another meeting. (Dawn, Karachi, March 2, 1971)
২৪ ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সুদীর্ঘ আলাপ শেষে ভুট্টো বলেন :
We are making some progress.
২৫ মার্চ-এ ভুট্টো এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন :
“While I supported in principle the four point preconditions of Sheickh Mujibur Rahman, my party is trying to come close to six points (The Pakistan Times, March 26, 1971) শুধু ভুট্টোই নন, পশ্চিমা স্বার্থবাদী মহলের আর এক নায়ক মিয়া মমতাজ দৌলতানাও এক উজ্জ্বল আশার কথা প্রকাশ করে বলেন :
I an hopeful about the talk. (The morning News, March 25, 1971)
মুজিব এবং ইয়াহিয়ার আলোচনায় যে একটি আপোষ হতে যাচ্ছে, সে সম্পর্কে লাহোরে পাকিস্তান টাইমস্ লেখে ।
To Mujib, he (President) indicated that there were no serious objectons to four point proposale and that an interim constitutions could be worked out by the respective advisers accordingly. The base points on which and transfer of power to a civilian government by a presidential proclamation, (ii) transfer of power in the provinces
পৃষ্ঠা-১৮৭

to the majority parties. (iii) Yahya to remain the President and in control of the Central Governemtn and (iv) separate sitting of the National Assembly members from East and West prespartory to a joint session of the houses to finalise the constitution. The last suggestion in fact came from yahya to accommodate Bhutto.
[The Pakistan Times, March 23, 1971]
সুতরাং এটা স্পষ্ট যে, চার দাবির স্বীকৃতির ভিত্তিতে মুজিব ও ইয়াহিয়ার আলোচনা রাজনৈতিক অচলাবস্থা নিরসনের পথে এগুচ্ছে : (১) সামরিক শাসন তুলে নিয়ে প্রেসিডেন্টের ঘোষণার মাধ্যমে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হবে, (২) প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের হাতে ক্ষমতা দেওয়া হবে। (৩) কেন্দ্রীয় সরকার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার হাতেই আপাতত থাকবে, (৪) প্রদেশ দুটোতে পৃথক পৃথক ভাবে গণপরিষদের সদস্যগণ বসবেন এবং পরবর্তীকালে যাতে দুই প্রদেশ থেকে সমগ্র সকল সদস্য একত্রে বসে অনুমোদন করতে পারে এমন একটি সংবিধানের খসড়া প্রস্তুত করা হবে।
দেশের বৃহত্তর স্বার্থের দিকে চেয়ে বঙ্গবন্ধু এই শর্তগুলোয় সম্মত হন। এ ছাড়াও বঙ্গবন্ধু দৃঢ় বিশ্বাসী ছিলেন যে, এভাবে শান্তিপূর্ণ পথে, নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই একদিন না একদিন বাস্তব বাংলাদেশের স্বাধীনতা রূপ পরিগ্রহ করবেই। আজীবন নিয়মতান্ত্রিক পথে সংগ্রাম করা বঙ্গবন্ধু রাতারাতি সশস্ত্র সংগ্রামে যেতে চাননি। কিন্তু আসলে ইয়াহিয়া-ভুট্টো চক্র সমস্ত নিয়মতান্ত্রিক পথকে ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে ঠেলে গিয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রামের পথে। অনন্যোপায় মুজিব সেই পথেই শেষ পর্যন্ত দৃপ্ত পদক্ষেপে এগিয়েছেন।
নিয়মতান্ত্রিক উপায়ের অনুসারী হয়েও শেখ মুজিব ভেতরে ভেতরে নির্দেশ যা দেবার তার সবই তিনি দিয়েছেন। যদিও ৭ মার্চ-এর ঐতিহাসিক ভাষণে। তিনি প্রকাশ্যেই বলেছেন এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’। তবু শেষ অবধি নিয়মাতান্ত্রিক পথে এই শান্তিকামী, মানবতাবাদী, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি তিনি শ্রদ্ধাশীল মহানায়কের ছিলেন।
এমন কি, প্রেসিডেন্ট ও শেখ মুজিবের মধ্যে সম্পন্ন যে চারটি সিদ্ধান্তের সমঝোতা বাস্তবায়নে অস্বাভাবিক বিলম্ব সন্দেহের উদ্রেক করলেও বঙ্গবন্ধু তখনো আশা হারাননি। বর্বর সামরিক বাহিনীর এ দেশবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বার পূর্ব পর্যন্ত প্রদত্ত সর্বশেষ বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ উদ্ধৃত হলো :
The arrival of the President in Dacca and his subsequent talks led the people to expect that there was realisation that this grave
পৃষ্ঠা-১৮৮

crisis engulfing the country could only be resolved politically. It was for this reason that I met the President. The President affirmed that there could only be a political solution of the crisis. Upon that promise, certain fundamental principles on which such a situation would be be based were accepted by the President, subsequently my colleagues sat with the president’s advisers to work out those principles. We have thus done our duty and contributed our utmost efforts towards that attainment of a political solution. There is no reason or justification for any delay. If a political solution is desired by those concerned, they should realise that it is for them to take matters immediately to a conclusion, and that to delay this would expose that country and its people to grave hazards. It is., therefore, unfortunate that there is a regrettable delay in resolving the crisis politically. Indeed, the critical situation already prevailing is being aggravated by renewed military activities the pace of which, according to reports from different parts ob Bangladesh is being stepped up, This is all the more regrettable at a time when the President is in Dacca for the declared purpose of resolving the crisis politically. After last week’s firing at Joydevpur, reports of atrocities are pouring in form Rangapur, Dinajpur, where curefew has been imposed From Chittagong, there are reports of heavy firing on the civilian population (Emphasis added)
Dawn, Karachi, March 26, 1971
এ সম্পর্কে সুব্রত রায় চৌধুরী লেখেন: While Awami leaders were anxiously awaiting a call from General President for the final session, which never materialised, It was learnt that M M Ahmed had suddenly left for Karachi on the morning of 25 March without any warning to the Awami league. No one knew what transpired in the private meeting between Yahya and Bhutto at Dacca, but a consensus between the two must have been reached.
দুজনের এই ঐকমত্য যে কি ব্যাপারে, বিশ্ববাসীর কাছে তা অবিদিত নেই। গণহত্যা, রক্তপাত, লুণ্ঠন, ধর্ষণ, ধ্বংস, বর্বরতা এ সবই ঐকমত্যের ফসল। এক কোটি মানুষের স্বদেশ ত্যাগ, ত্রিশ লক্ষ মানুষের জীবনাবসান, অসংখ্য
পৃষ্ঠা-১৮৯

নির্যাতন সব-ই সেই ষড়যন্ত্রেরই ফলশ্রুতি। বিখ্যাত সংবাদিক Peter Hazelhurst এ সম্পর্কে চমৎকার তথ্য প্রদান করেছেন : Yahya and mujib had agreed to an interim settlement Providing (i) immediate withdrawal of martial law by a presidential proclamation (ii) imediate restoration of power at the proclamation (ii) immediate restoration of power at the provincial level. and (iii) the interim Central Government to be administered by the President until the constitution was framed. Bhutto opposed the scheme stating that if martial law was withdrawn. and power transferred to the provinces Pakistan would be broken up into five sovereign states It was Bhutto who finally brought the President to take the decision whichset East Bengal on fire. Taking events to their logical conclusion there is no doubt that the present holocaust was precipitated by President Yahya Khan when he postponed that assembly without consulting the Bengalis, but even more so by Mr Bhutto’s deliberate decision to boycott the Assembly on 3 March.
The Manila Chronicle, July. 1, 1971
সুতরাং ঘটনাপ্রবাহের বিশ্লেষণে এটা সুস্পষ্টভাবেই প্রতীয়মান যে, ভুট্টো ও ইয়াহিয়ার মিলিত ষড়যন্ত্র ও সম্মতিতেই পূর্ব-বাংলায় গণহত্যা, লুণ্ঠন ও উম্মত ধ্বংসযজ্ঞ সাধিত হয়। এ বাংলার মাটিতে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রটির কবর রচিত হয়। সুদক্ষ রাজনীতিবিদ বঙ্গবন্ধু এই ষড়যন্ত্র সম্পর্কে অবহিত ছিলেন। সতর্ক ও দূরদর্শী ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু ৭ মার্চ ঐতিহসিক ভাষণে মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম বলে জনগণকে সজাগ করে দিয়ে সম্পূর্ণ তৈরি থাকার নির্দেশ দেন। অতঃপর প্রায় প্রতি দিনই তিনি জনগণকে সংগ্রামের ও প্রস্তুতির ডাক দেন। ২৩ মার্চ তিনি বলেন, বাংলার মানুষ কারো করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতার বলেই তারা মুক্তি ছিনিয়ে নিয়ে আনবে। আজীবন নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রনায়ক বঙ্গবন্ধু বহু ভাষণ ও বিবৃতিতে বলেছেন, অনিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনে তিনি আদৌ বিশ্বাসী নন। তাই বিশ্ববাসী দেখেছে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিয়মতান্ত্রিক পথেই অগ্রসর হতে বঙ্গবন্ধুর সর্বশক্তি ও সাধনা। কিন্তু বর্বর পশুশক্তি যখনই আঘাত হানে তখনই নিয়মতান্ত্রিক সমস্তপথ রুদ্ধ হয়, অনন্যোপায় বঙ্গবন্ধু তখনই তিনি সশস্ত্র সংগ্রামের পথে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন ২৫ মার্চ রাত্রি বারোটার পর আনুষ্ঠানিকভাবে দেশবাসীকে সশস্ত্র যুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়তে আহ্বান করেন। সেই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাড়ে সাত কোটি
পৃষ্ঠা-১৯০

মানুষ বাধ ভাঙ্গা সমুদ্রের ন্যায় ছুটে এসেছে। যুদ্ধ করেছে, জীবন দিয়েছে এবং দেশকে স্বাধীন করে তবে ক্ষান্ত হয়েছে। সুতরাং বঙ্গবন্ধুর গণনায় ভুল হয়নি। ইয়াহিয়ার ওপর আপাত দৃশ্যমান আস্থা রেখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত আলোচনা যাবার অর্থ এই নয় যে ইয়াহিয়া-ভুট্টো ষড়যন্ত্র এবং সম্ভাব্য পণিতি ধরতে না পারা-তবুও এই ভূমিকার কারণ এই যে, নিয়মতান্ত্রিক পথের শেষ প্রান্ত পর্যন্ত যেতে তিনি প্রস্তুত বোঝাতে, সে পথে বিপদ ও বাধা যত বড় ও গুরুতরই হোক না কেন বঙ্গবন্ধু তা পেরেছেন, কেননা, তার প্রত্যয় ছিল জনগণের শক্তির ওপর এবং ন্যায়ের সুনিশ্চিত বিজয় সম্পর্কে তার ছিল অসাধারণ আস্থা। যারা উপরিউক্ত বিষয় বিশ্লেষণে বলেন মুজিব ভুল করছেন, বস্তুত তা নয় বরং তাদেরই হিসেব ভুল প্রমাণিত হয়েছে ইতিহাসে। আমার উল্লিখিত বিশ্লেষণের প্রশ্ন বহু ঘটনায়, বহু বিবৃতিতে ছড়িয়ে রয়েছে বেশি দূরে যেতে হবে না, ২৩ মার্চ তিনি যে সব কথা বলেছেন তার মধ্যেই এই সত্যজাজ্বল্যমান। তিনি বলেন, ‘মনে রাখবেন সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তিনিই সেরা সিপাহসালার। আবার বলেছেন, মুক্তির লক্ষ্যে আমরা পৌছবই, বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করিয়া রাখা যাইবে না।’
বস্তুত ঘটনাগুলো ভাসাভাসাভাবে বিচার করলে মনে হতে পারে যে বঙ্গবন্ধু সশস্ত্র সংগ্রামে প্রস্তুতি না নিয়ে সমগ্র দেশকে সংঘাতের দিকে ঠেলে দেন। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, দু’জন জাদরেল সেনানায়কের শাসনামলেই বাংলাদেশের সমগ্র সংগ্রামের প্রস্তুতি পূর্ণ সাফল্যের পর্যায়ে অতিক্রান্ত হয়। আর দু’জন সেনানায়কেরই দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল এই একজন গণনায়কের ওপর। তাকে সশস্ত্র মামলার শিকার হতে হয়েছে। সুতরাং যে পথ তিনি বেছে নেন, তার চেয়ে প্রকৃষ্ট অন্য কোনো পথ বেছে নেওয়া সমীচিন ছিল না। সমীচিন হতও না।
অবশ্য একাত্তরের মার্চ মাসের শুরু থেকেই বঙ্গবন্ধুর যাত্রাপথে দুটো গতি সঞ্চারিত হয়। একদিকে অহিংস অসহযোগ আন্দোলন, অন্যদিকে ভেতরে ভেতরে সংগ্রামের প্রস্তুতি। পঁচিশ দিনের ঘটনাপঞ্জী বিচার কলে দেখা যায় যে তিনি সমগ্র দেশকে একটি পুঞ্জীভূত আগ্নেয়গিরিতে রূপান্তরিত করে যে কোনো সময় আহ্বান করলেই যেন অগ্নৎপাত ঘটতে পারে। তার সুদীর্ঘ কালের নিয়মতান্ত্রিক অথচ সংগ্রাম সচেতন সাধানর ফলশ্রুতি ঘটেছে সত্তরের নির্বাচনের পর থেকে সামগ্রিক ঘটনারাশিতে বিশেষ করে মার্চ মাসের পঁচিশ দিন। এজন্যে ২৫ই মার্চ মধ্যরাত্রির পর বঙ্গবন্ধু যখন স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধের ডাক দেন সে ডাক বৃথা যায়নি। ক্ষেত্র ছিল প্রস্তুত। এই ক্ষেত্র প্রস্তুতিতে মুজিবের অবদান বিস্ময়কর। আগ্নেয়গিরি তিনিই নির্মাণ করেন অগ্নৎপাতও ঘটান তিনিই।
পৃষ্ঠা-১৯১

ইতোমধ্যে নানারূপে নাটকীয় পরিবর্তনের ঘটনার শুরু-বাংলার মীরজাফরেরা তাদের পোশাক বদল করতে আরম্ভ করে দেয়। পূর্ববর্তী কার্যকলাপের পরিসমাপ্তি ঘটিয়ে ছদ্ম আবেশে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রতি তা প্রকাশ করে বাংলাকে মুক্ত করার সংকল্প জ্ঞাপন করতে থাকে। এলো ২৩ মার্চ । এই দিনটি বরাবর পাকিস্তানের জাতীয় দিবস হিসেবে পালিত হয়। কিন এবারের ২৩ মার্চ নতুন এক তাৎপর্যমণ্ডিত। বঙ্গবন্ধু আগে এক ঘোষণায় এই দিনটিতে ছুটি এবং প্রতিরোধ দিবস হিসেবে পালনের আহ্বান জানান। অন্যদিকে স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ ও স্বাধীন বাংলাদেশ। কেন্দ্রীয় শ্রমিক সংগ্রাম পরিষদের ডাকে এ দিনটিতে বাংলাদেশ ব্যাপী প্রতিরোধ। দিবস পালিত হয়।
এ দিন বাংলাদেশের সর্বত্র সরকারি ও বেসরকারি অফিস ভবন, বাড়িঘর ও যানবাহনে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন করা হয়।
ঢাকায় পল্টন ময়দানে ছাত্রলীগের সদস্যরা আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ রবীন্দ্রনাথের এই গানটি গাওয়ার পর আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে এবং গানটি জাতীয় সঙ্গীত হিসেবে গৃহীত হয়। এ বিষয়ে পরদিন প্রকাশিত খবরে বলা হয়, গতকাল প্রতিরোধ দিবস পালন উপলক্ষে রাজধানী ঢাকায় গণজীবনে গণ আন্দোলনের সাগরের ভরা কোটালের জোয়ার দেখা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ব্যবস্থাপনায় আউটার স্টেডিয়ামের স্বাধীনতা আন্দোলনে অগ্রসৈনিক ছাত্র-ছাত্রীরা যে বীরোচিত কুচকাওয়াজ পরিবেশন করে, স্বাধিকার পিপাসু হাজার হাজার নর-নারী আনন্দ উজ্জ্বল কিন্তু বজ্রকঠোর দীপ্ত এক অপূর্ব পরিবেশে তা অবলোকন করে। বাংলার তরুণদের এই কুচকাওয়াজের মধ্য দিয়া গতকাল আকাশে বাতাসে বাঙালি মানুষের মত মরিবার ও বাঁচিবার আত্মপ্রত্যয়ের যে অনির্বাণ স্বাক্ষর রচনা করা। হইয়াছে তাহা অতুলনীয়, অদৃষ্টপূর্ব, অশ্রুত পূর্ব সকাল হইতে রাত পর্যন্ত ঢাকার রাস্তায় বীর বাঙালির অগণিত মিছিল শুধু কামনা বাসনা ও আকাংখার ধ্বনিকে প্রতিধ্বনিত করিয়া গিয়াছে অবিশ্রান্ত জলধারার মতো।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বাসভবন প্রাঙ্গনেও আনুষ্ঠানিকভাবে সকাল বেলায় বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। সন্ধ্যায় তা, আবার আনুষ্ঠানিকভাবে নামিয়ে ফেলা হয়। পতাকা উত্তোলনের সময় গান গাওয়া হয়-‘জয় বাংলা জয় বাংলা মাতৃভূমি বাংলার জয়।’
বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ছাত্রলীগ বাহিনী তাকে অভিবাদন জানায়। অভিবাদন গ্রহণকালে তিনি ঘোষণা করেন যে, মূল সমস্যার প্রশ্নে কে আপোষ নেই। সংবাদে বলা হয়, বিক্ষুব্ধ বাংলার দশ দিগন্তে সর্বাত্মক মুক্তির
পৃষ্ঠা-১৯২
আন্দোলনের পটভূমিকায় নয়া আংগিকে আবির্ভূত তেইশে মার্চের অবিস্মরণীয় দিন। (মঙ্গলবার) বন্যার স্রোতের মতো সমাগত জনতার উদ্দেশ্যে স্বীয় বাসভবনে ভাষণ দান কালে স্বাধিকার আন্দোলনের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মজিবর রহমান পুনরায় বলেন, ‘এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম’। যতদিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির সার্বিক মুক্তি অর্জিত না হইবে, যত দিন একজন বাঙালি বাচিয়া থাকিবে, এই সংগ্রাম থাকিবে, এই সংগ্রাম আমাদের চলিবেই। মনে রাখিবেন, সর্বাপেক্ষা কম রক্তপাতের মাধ্যমে যিনি চড়ান্ত লক্ষ্য অর্জন করতে পারেন, তিনি সেরা সিপাহসালার। তাই বাংলার জনগণের প্রতি আমার নির্দেশ, সংগ্রাম চালাইয়া যান। শৃংখলা বজায় রাখুন। সংগ্রামের কর্মপন্থা নির্ধারণের ভার আমার উপর ছাড়িয়া দিন। শেখ সাহেব তাঁহার ভাষণে বলেন, বাংলার দাবির প্রশ্নে কোনো আপোষ নাই। বহু রক্ত দিয়াছি, প্রয়োজন বোধে আরও রক্ত দিব, কিন্তু মুক্তির লক্ষ্যে… বাংলার মানুষকে আর পরাধীন করিয়া রাখা যাইবে না।’ তিনি বলেন আমরা সমস্যার শান্তিপূর্ণ সমাধান চাই। কিন্তু যদি তা সম্ভব না হয়, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসাবে বাঁচিয়া থাকার লক্ষ্য অর্জনের সংগ্রাম আমাদের চলিতেই থাকিবে। এই সংগ্রামের পন্থা কি হইবে উহা আমিই করিয়া দিব, সে ভার আমার উপর ছাড়িয়া দিন। শোষক কায়েমী স্বার্থবাদীদের কিভাবে পর্যুদস্ত করিতে হয়, আমি জানি।’ তিনি বলেন, ‘অতুলনীয় ঐক্য নজির বিহীন সংগ্রামী চেতনা আর প্রসংসনীয় শৃঙ্খলাবোধের পরিচয়ে বাংলার মানুষ প্রমাণ করিয়া দিয়াছে যে, শক্তির জোরে তাহাকে আর দাবাইয়া রাখা যাইবে না।’
কাকডাকা ভোর হইতে রাজপথ প্লাবিত করিয়া শহর, শহরতলীর বিভিন্ন দিক হইতে দশ ঘন্টা সময়ে ৬টি মহিলা সহ অন্ততঃ ৫৫টি ছোট-বড় মিছিল শেখ সাহেবের বাসভবনে আগমন করিয়া মহান জাতির মাহন নেতার প্রতি অকুণ্ঠ আস্থার পুনরাবৃত্তি ও সংগ্রামের দুর্জয় শপথের স্বাক্ষর রাখিয়া যায়। সেই মিছিলসমুদ্রের হাতে হাতে লাঠি বল্লম, বন্দুক, চোখে মুখে মুক্তির দীপ্ত তারুণ্য আর কণ্ঠে কণ্ঠে নয়া দিনের সব জাতির, নতুন দেশের বিজয় গাথা, কোটি প্রাণের অমোঘ সঙ্গীত ‘জয় বাংলা’ সাধন মন্ত্রে গর্জিয়া উঠিতে থাকে। তেইশ বছর ধরিয়া বাংলার দশদিগন্তে যে পাকিস্তানি পতাকা উড়িয়াছে, যে পাকিস্তান দিবস পালিত হইয়াছে, যে ভাবে সরকারি ব্যবস্থাপনায় সভা সমিতি হইয়াছে, আর সেই সব অনুষ্ঠানে রাজপথে অধিকার বঞ্চিত গণ-মানুষ ক্ষেপা পাগলের মতো পাকিস্তানে তাদের স্বাধীনতা খুঁজিয়া বেড়াইয়াছে। গত কালের দিনটি তাহার তমসাবসানের সূচনা করিয়া জনতাকে নব সূর্যের নব আলোকে নয়া পতাকার দিকনির্দেশে প্রাণের টানে টানিয়া নিয়াছে জাতির ভাগ্যনিয়ন্তা বঙ্গবন্ধুর
পৃষ্ঠা-১৯৩

বাসভবনে। আর বাম হাতে বাংলাদেশের পতাকা উর্ধ্বে তুলিয়া ডান হাত জনতার দিকে বাড়াইয়া দিয়া বাংলার মুকুটহীন সম্রাট সাড়ে সাত কোটি মান আত্মার স্পন্দনকে একত্রে জড়ো করিয়া গর্জিয়া উঠিয়াছে ‘বাংলার মানুষ কাহারো করুণার পাত্র নয়। আপন শক্তির দুর্জয় ক্ষমতা বলেই তাহারা এ ছিনাইয়া আনিবে। জয় বাংলা, বাংলার জয় অনিবার্য।
(দৈনিক ইত্তেফাক, ২৩ মার্চ ১৯৭১)।
প্রকৃতপক্ষে ১৯৭১ সালের ২৩ মার্চ আনুষ্ঠানিক ভাবে পাকিস্তানের সমাধি রচিত হয়। পাকিস্তান দিবসের নাম ইতিহাসের পাতা থেকে চিরদিনের জন্য মুছে যায়। বাংলার জনগণ নিজেদের অস্তিত্বের স্পন্দন অনুভব করে। উপলব্ধি করে এ আরেক দেশ পাকিস্তানের কবরের ওপর নতুন দেশের উত্থান ঘটেছে। এ দেশের নাম বাংলাদেশ।
বঙ্গবন্ধু তখনো আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেননি; কিন্তু তার বক্তব্য এ কথা কারো আর বুঝতে বাকি ছিল না। বাংলার মানুষ যে শোষক ও প্রবঞ্চক শক্তিচালিত দেশ পাকিস্তানের সঙ্গে আর সম্পর্ক রাখতে পারে না, একথা তিনি প্রকারান্তরে শাসক গোষ্ঠীকে জানিয়ে দিয়েছেন। আর এ জন্যই তিনি বলেছেন, যে নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে যদি ক্ষমতা হস্তান্তর না করা হয়, তা হলে বাংলাদেশের মুক্তি কীভাবে আনতে হয়, তা তিনি দেখিয়ে দিবেন।
বঙ্গবন্ধু তা সত্যি দেখিয়ে দিয়েছিলেন। বিশ্ববাসী-ই জানে যে, তিনি নিজে হানাদারের হাতে ধরা দিয়েও শুধু ব্যক্তিত্বের অসাধারণ শক্তিতে কিভাবে সাড়ে সাত কোটি মানুষকে পরিচালিত করে পশুদের কবল থেকে বাংলাদেশের শোষিত মানুষকে মুক্ত করেছে।
২৩ মার্চের পাকিস্তান দিবস উপলক্ষে ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ দেবার কথা থাকলেও অজ্ঞাত কারণবশত তা বাতিল হয়। তবে এক বাণীতে জানান যে, শাসনতান্ত্রিক অচলাবস্থা দূর করার জন্যে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের এক সঙ্গে কাজ করার পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, এ দিন আওয়ামী লীগ নেতবৃন্দ ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের। মধ্যে দুদফা বৈঠকও হয়। সেখানেও সমঝোতার কথাই বিশেষভাবে আলোচনা হয়। আসলেও এও ইয়াহিয়ার এক ধরনের চাল এবং তিনি সার্থকভাবেই এসব চাল চেলে এগোচ্ছিলেন। ভুট্টোও আরো কিছু সময় নিচ্ছিলেন। তার অভিষ্ট সময়ের জন্য। ইয়াহিয়াও জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত করে আলোচনার পথ প্রশস্ত করতে চেয়েছেন। লোক দেখানো এই চাওয়ার পশ্চাতে ছিল বিরাট ষড়যন্ত্র। আমরা জানি, সে প্রশস্ত পথ বেয়ে শান্তিপূর্ণ মীমাংসা আসেনি, এসেছে ট্যাংক আর কামানের গর্জন। সে চাওয়ার পথে কামনায় স্নিগ্ধ পুষ্প ঝরেনি।
পৃষ্ঠা-১৯৪

ঝরেছে রক্তের প্রবাহ, অশ্রুর বন্যা। পূর্বেই বলা হয়েছে যে, আসন্ন ২৫ মার্চের ঘটনার প্রতি ভুট্টোর ছিল অকুণ্ঠ সমর্থন। ভুট্টোর এই সমর্থন নীরবতার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলনা; বরং কূটবুদ্ধির আশ্রয়ে সক্রিয় ভূমিকা নিয়ে ভুট্টো-ইয়াহিয়ার কার্যকলাপকে উৎসাহ যুগিয়ে যান। সেই জন্যেই দেখা যায় যে, এক মহানায়কের প্রকাশ্য নির্দেশে স্বাধীনতা অর্জনের জন্য বাংলার জনগণের মরণপণ সংগ্রাম প্রত্যক্ষ করা সত্ত্বেও ভুট্টো তিনি আওয়ামী লীগের সঙ্গে আপোষেঅনীহা প্রকাশের স্পর্ধা দেখায়। শেখ মুজিব ৬-দফার একটি দফাও যে ছেড়ে দেবেন না, তা ভুট্টোর ভাল করেই জানা, তবু আলোচনার অজুহাতে রাজনীতিবিদ হিসেবে তার বিশ্বাসঘাতকতার নজীর বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। ইয়াহিয়া সৈনিক, তার এমন আচরণ অপ্রত্যাশিত ছিল না। কিন্তু রজানীতিবিদ ভুট্টো যা কররেন তা ছিল অচিন্তনীয়। এদিকে সেনাবাহিনীও প্রস্তুতির যথেষ্ট সময় পেয়েছে। উপযুক্ত সময়ে আঘাত হানার পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা নিজেদের অনুচরদের উস্কানি দিতে থাকে। ফলে বিভিন্ন জায়গায় বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধে। চট্টগ্রামের সংঘর্ষের কথা আগেই বলা হয়েছে, সেখানে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের অবস্থা স্বাভাবিক রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা ছিল।
২৩ মার্চ, রাতে রংপুর জেলার সৈয়দপুর ও ঢাকার মিরপুরে বাঙালিঅবাঙালির মধ্যে বাধে সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষ। সামরিক সরকারের অনুচরেরা মিরপুরে লুটতরাজ, অগ্নিকাণ্ড ও হত্যাকাণ্ড চালায়। সৈয়দপুরের অবাঙালিরা নিরীহ বাঙালির ওপর আক্রমণ চালালে বাঙালিরা রুখে দাঁড়ায় তখন বিনা তলবে নেপথ্য থেকে সেনাবাহিনী এগিয়ে আবির্ভূত হয় এবং গুলিবর্ষণ করে। এতে কমপক্ষে ৫০ জন বাঙালি নিহত এবং কয়েক শ’জন আহত হয়।
বঙ্গবন্ধু জনগণকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বলেন, আন্দোলন নস্যাতের চক্রান্ত চলছে’। সেদিন তার বাসভবনের সামনে সমাগত মিছিলকারীদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতায় তিনি বলেন যে, কিছু সংখ্যক লোক আমাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু এসব ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে বলেন, ‘তাদের বহু কিছু আছে এবং তারা বানরের পিঠা ভাগের মত আবার এসে বসার জন্য বাংলাদেশে গোলমাল বাধাবার চেষ্টা করছে। বঙ্গবন্ধু সামগ্রিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সচেতন ছিলেন এবং বারবার সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন। এ প্রসঙ্গে সৈয়দপুরের ঘটনার উল্লেখ করে বঙ্গবন্ধু এই অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাবার জন্য বাংলার জনগণের প্রতি নির্দেশ দেন। জনগণকে আশ্বাস দিয়ে বলেন, “আমার মাথা কেনার শক্তি কারো নেই। বাংলার মানুষের সাথে, শহিদদের রক্তের সাথে আমি বেঈমানী করতে পারবো না।”
(দৈনিক পাকিস্তান, ২৪ মার্চ ১৯৭১)।
পৃষ্ঠা-১৯৫

তিনি দৃঢ়কণ্ঠে ঘোষণা করেন-“জয় বাংলাই থাকবে, আর কেউ ক্ষয় বাংলার করতে পারবে না।’ ঐদিনই অর্থাৎ ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগের তিন জন নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ ও ডক্টর কামাল হোসেন এবং প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার উপদেষ্টা বিচারপতি মি. কর্নেলিয়াস, লে. জেঃ পীরজাদা , কর্নেল হাসান ও পরিকল্পনাবিদ এম. এম. আহমদ সমবেতভাবে দু’ঘণ্টা স্থায়ী এক বৈঠকে মিলিত হন। তাদের মধ্যে মূলনীতি সংক্রান্ত যে সমঝো হয় তদনুযায়ী বিশদ পরিকল্পনা রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য বঙ্গবন্ধ শেখ মুজিবর রহমান ও প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কথা সুস্পষ্টভাবে পেশ করেন।
২৪ মার্চ সর্বশেষ সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিব বলেন, ক্ষমতা হস্তান্তরে ব্যাপারে আমরা মতৈক্যে পৌছেছি। আমি আশাকরি প্রেসিডেন্ট এখন তা ঘোষণা করবেন। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায় যে, নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে শাসনতন্ত্র ব্যতিরেকে কেন্দ্রীয় সরকারের সঙ্গে বাংলাদেশের কি সম্পর্ক হবে এই প্রশ্ন ওঠে। শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়া নিম্নলিখিত বিষয়ে ঐকমত্যে পৌছেন-
এক : সামরিক আইন প্রত্যাহার ও প্রেসিডেন্টের ঘোষণা অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর।
দুই : প্রদেশগুলোর নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতা হস্তান্তর।
তিন : ইয়াহিয়া খান অন্তর্বর্তীকালীন প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার তার নিয়ন্ত্রণে থাকবে।
চার : পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের সংসদ সদস্যদের পৃথক অধিবেশন বসবে শাসনতান্ত্রিক আলোচনার জন্য। পরবর্তীকালে একত্রে বসে জাতীয় সংসদে সংবিধানের খসড়া তৈরি করবেন।
ভুট্টো স্বয়ং চতুর্থ প্রস্তাবটি দেন এবং ইয়াহিয়া সম্মত হন। পরবর্তীকালে ১৭ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদ ভুট্টোকে ক্ষমতার অংশীদার করা ও পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশগুলোতে ছয়দফা কতটুকু প্রয়োগ করা যেতে পারে তার পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখার জন্য ইয়াহিয়া এই ব্যবস্থা করেছিলেন। শেখ মুজিব ভেবে দেখলেন সেনাবাহিনী ও ভুট্টোর বিরোধিতার মুখে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে পারছেনা। উপরে উল্লেখিত প্রস্তাবে সম্মত হলে ভুট্টো আপাত দৃষ্টিতে খুশি হবে। জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসতে বাধা থাকবে না এবং বাংলাদেশে ছয়দফা ভিত্তিক প্রাদেশিক সরকার গঠন সম্ভব হবে। এতে জনগণকে শান্তকরা যেত এবং পরবর্তীতে পরিস্থিতি শান্ত হলে জাতীয় পরিষদের পূর্ণাঙ্গ অধিবেশন বসতে অসুবিধে ছিল না। শেখ মুজিবের কাছে জাতীয় পরিষদ একদলে বা দুইদলে বসবে এটা বড় বিষয় ছিল না কারণ উভয় ক্ষেত্রেই তার দল সংখ্যাগরিষ্ট ছিল।
পৃষ্ঠা-১৯৬

প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৭ ও ১৮ মার্চের বৈঠকে ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাগণ ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের পুনরুজ্জীবনের প্রস্তাব করলে শেখ মুজিবের উপদেষ্টাগণ সরাসরি এর বিরোধিতা করেন। ফলে ইয়াহিয়া তখন প্রস্তাব করেন যে সামরিক আইনবিধি ঘোষণা বলে ক্ষমতা হস্তান্তর করা যেতে পারে। আওয়ামী লীগ এর বিরোধিতা করে, কারণ সামরিক আইন প্রত্যাহারই ছিল তাদের প্রথম দাবি। ফলশ্রুতিতে স্থির হয় যে, প্রেসিডেন্ট একটি ঘোষণা দিয়ে সামরিক আইন প্রত্যাহার করবেন এবং পূর্ব-পাকিস্তান ছয় দফাভিত্তিক ক্ষমতা লাভ করবে। সর্বসম্মতি ক্রমে শেখ মুজিব ও ইয়াহিয়ার উপদেষ্টাগণ প্রেসিডেন্টের ঘোষণার খসড়া প্রস্তুত করেন। প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা এম এম আহমেদের খসড়াটি পরীক্ষা করে চূড়ান্ত রূপ দেওয়ার কথা ছিল। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে এম এম আহমেদ ঢাকা ত্যাগ করেন এবং ভুট্টোর ২৫ মার্চ সকাল ৯টার মুজিব-ইয়াহিয়ার শাসনতান্ত্রিক পরিকল্পনার প্রতি অসম্মতি প্রকাশ করেন। সুতরাং প্রেসিডেন্টের প্রত্যাশিত ঘোষণা আসেনি।
ঐদিন ঢাকা টেলিভিশন কেন্দ্রের প্রচার বন্ধ থাকে। টেলিভিশন কেন্দ্র প্রহরারতদের; এর কর্মচারিদের সাথে দুর্ব্যবহারের অভিযোগে কাজে যোগদানে বিরত থাকে। এখানে উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, অসহযোগ আন্দোলনে অন্যান্য প্রতিষ্ঠানের মত ঢাকা বেতার ও টেলিভিশন কেন্দ্রও শেখ মুজিবের নির্দেশাবলি পালন করতে থাকে। আন্দোলনের সমর্থন ও অনুষ্ঠান-সূচি প্রচার করা হয়। এমনকি রেডিও পাকিস্তান এর পরিবর্তে ‘ঢাকা বেতার কেন্দ্র’ বলেও ঘোষণা করা হতে থাকে।
২৫ মার্চ প্রেসিডেন্টের ‘জাতির উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণ দেবার কথা। বাংলাদেশের জনগণের মনে একটা আশা ও উকি মারলো যে, হয়তো ইয়াহিয়া তার ওয়াদা পালন করবেন-সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতা শেখ মুজিবের হাতে ক্ষমতা তুলে দেবেন। বিশেষ করে পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের উক্তি সে ধারণাকে উজ্জীবিত করল। ২৪ মার্চে মিয়া মমতাজ দৌলতানা নেতৃবৃন্দের বৈঠকের ফলাফলে আশাবাদ প্রকাশ করেন। একই দিনে ভুট্টো প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনার পর বলেন- ‘We are making some progress’ ফলে সেদিনকার মত আন্দোলন কিছুটা স্তিমিত হয়ে পড়ে। কিন্তু হঠাৎ দেখা গেল খান আব্দুল ওয়ালী খান, আব্দুল কাউয়ুম খান, সর্দার শওকত হায়াৎ খান, মিয়া মমতাজ দৌলতানা, মওলানা মুফতী মাহমুদ প্রমুখ পশ্চিমা নেতৃবৃন্দ পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করতে থাকেন। এই নেতবৃন্দ রাজনৈতিক সংকট নিরসনের পন্থা উদ্ভাবনে সহায়তার জন্য ঢাকায় এসেছিলেন। এদের কেউ কেউ দফায় দফায় শেখ মুজিবের সঙ্গে আলোচনাতেও মিলিত হয়েছিল, ভুট্টো-ইয়াহিয়ার
পৃষ্ঠা-১৯৭

কার্যকলাপের সমালোচনা করে তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা প্রদানের জন্য জোর সুপারিশও করেন। তথাপি আসল কাজ সমাধা না হতেই আস্মিকভাবে তাদের ঢাকা ত্যাগকে জনগণ সহজভাবে গ্রহণ করতে পারল না ।
২৫ মার্চ ভোর থেকেই মিছিলের পর মিছিল সারা শহর প্রদক্ষিন করতে লাগলো। প্রতিটি মিছিলেই জনতা অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত ছিল। শ্লোগানে তারা প্রত্যেক বাঙালি নেতাকে বার বার হুশিয়ার করে দিতে লাগলো। ঐদিন জনগণকে ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সতর্ক থাকার জন্য পুনরায় বঙ্গবন্ধু আনুরোধ জানান। তিনি বলেন যে, শহিদের রক্ত যেন বৃথা না যায়, সেদিকে সকলকে দৃষ্ঠি রাখতে হবে।
সেদিন সকালেও ভুট্টো-ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৪৫ মিনিট কথা বলেন। পরে ভুট্টো সাংবাদিকদেরকে বলেন, ‘শেখ মুজিবের ৪ দফা দাবির ব্যাপারে তার দলের নীতিগতভাবে কোনো আপত্তি নেই। দেশের উভয় অংশেই ক্ষমতা হস্তান্তর করা হোক, এটাই তাদের কাম্য। তিনি আরো বলেন যে, ‘শেখ মুজিব যে স্বাধিকার দাবি তুলেছেন, তা স্বাধীনতারই নামান্তর। তিনি সরাসরি শেখ সাহেবের সাথে আলোচনা করতে চেয়েছেন, অথচ শেখ মুজিব তাতে রাজি হননি বলে ভুট্টো মন্তব্য করেন।
ক্ষমতালোভী ভুট্টো নির্লজ্জভাবে আপন দুর্বলতা প্রকাশ করেন। গণতান্ত্রিক আইনে পৃথিবীতে কোথাও সংখ্যালঘিষ্ঠ দল ক্ষমতার অধিকারী হয়—এ ধরনের দৃষ্টান্ত পাওয়া যায় না। কিন্তু ভুট্টো অবৈধভাবেই তা পাওয়ার জন্য যে অস্বাভাবিক অস্থিরতা প্রকাশ করে, যার ফলে হয়েছে দেশের জন্য ভয়াবহ। ভুট্টোর উক্তিতে শেখ মুজিব তার ৬-দফা দাবি থেকে একচুলও নড়বেন না এবং তাতে ব্যর্থ হলে যে পাকিস্তান দ্বিখণ্ডিত হবে জেনেও ভুট্টো শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত। ক্ষমতার লোভে শেখ মুজিবের কাছ থেকে অন্যরূপ বিবেচনার প্রত্যাশা করতে থাকেন। তা নির্লজ্জভাবে প্রকাশ করতেও ভুট্টো দ্বিধাবোধ হয়নি।
প্রেসিডেন্ট তার বেতার ভাষণে এ ব্যাপারে একটা সুস্পষ্ট সিদ্ধান্ত ঘোষণা করবেন এ আশায় সবাই তখন উম্মুখ। কিন্তু সামরিক বাহিনীকে আবার হঠাৎ তৎপর হতে দেখা গেল বিশেষ করে রংপুর, চট্টগ্রাম প্রভৃতি স্থানে তারা নির্বিচারে গুলি বর্ষণ এতে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হবার সংবাদ পাওয়া যায়। এই সংবাদে বঙ্গবন্ধু ক্ষোভে ফেটে পড়েন। তিনি এর প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সারা দেশে হরতাল আহ্বান করেন। কিন্তু সে হরতাল আর পালন করা সম্ভব হয়নি। তার আগেই শুরু হয়ে গেল মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চে ইয়াহিয়া খান বেতার ভাষণ দিতে চেয়েছিলেন। তিনি ঘোষণা করলেন বাঙালিদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র যুদ্ধ, বাংলার নিরস্ত্র নিরাপরাধ মানুষের ওপর চালানো হলো মানবেতিহাসের নিষ্ঠুর ও
পৃষ্ঠা-১৯৮

ভয়াবহতম গণহত্যা। পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দের আকস্মিক ঢাকা ত্যাগের কারণ এখন আর কারো নিকট অজ্ঞাত থাকলো না। নেমে এলো ২৫ মার্চের কালোরাত্রি।
জেনারেল ফজল মুকম খান তাঁর রচিত Pakistans Crisis in Leadership গ্রন্থে বলেন : ২৩ মার্চ দুপুরে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া-টিক্কা খানের বাসভবন ফ্লাগ স্টাফ হাউসে এলেন এবং জরুরি অপারেশনের জন্য প্রস্তুত হতে আদেশ দেন। স্থির হলো যে,২৬ মার্চ রাত ১টায় অপারেশন শুরু হবে। ২৪ মার্চ সিনিয়র অফিসারদের বিভিন্ন সেনানিবাসে পাঠানো হলো কমান্ডারদের হাতে আদেশ (Operational order) পৌছে দেবার জন্য। এভাইে জনগণের অহিংস অসহযোগ আন্দোলন শেষ হয় এবং শুরু হলো জনগণের বিপ্লবী যুদ্ধ প্রকৃত অর্থেই, নির্বাচনী ফলাফল প্রেসিডেন্টকে ভীষণ বিপদে ফেলে। নির্বাচনের আগে তার ভাবনা ছিল আওয়ামী লীগ সংখ্যাগিরষ্ঠতা পাবে না। কিন্তু ছয় দফার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে এবং ছয় দফার ভিত্তিতে শাসনতন্ত্র প্রণয়নে বদ্ধপরিকর। সুতরাং প্রেসিডেন্টকে নতুন পরিকল্পনা নিতে হয়। তার সামরিক-বেসামরিক উপদেষ্টারা তাকে বোঝান যে, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে জয়লাভ করলেও তাদের প্রতি জনগণের নিরঙ্কুশ সমর্থন নেই। দীর্ঘদিন সংগ্রাম চালানোর মানসিক শক্তিও বাঙালিদের নেই। কয়েকদিনের সামরিক অ্যাকশনেই পরিস্থিতি ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। উপরন্ত রাজনীতিবিদদের মাথা থেকে জাতীয়তাবাদের ভূত নেমে যাবে। দেশের বৃহত্তম স্বার্থে এবং পাকিস্তান ও ইসলামের সংহতি রক্ষার জন্য কয়েক হাজার জীবন এমন বেশি কিছু নয়। এটা না করে মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে জাতি ইয়াহিয়াকে ক্ষমা করবে । প্রেসিডেন্টের পরিকল্পনার সাথে এই উপদেশ চমৎকার ভাবে মিলে গেল।
২৫ মার্চ অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘোষণা করা হলো :
“In consultation with leaders of both the wings of Pakistan and with a view to facilitating the process of enlarging areas of agreement among the political parties the Presdident has decided to postpone the meeting of the National Assembly called on March 25.”
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ২২ মার্চ ও আলোচনা সম্পর্কে অত্যন্ত আশাবাদী বলে মত প্রকাশ করেন। পত্রিকায় বলা হয় ? That the stage is now set for our elected representatives to work together for the common goal which would accommodate both East and West wings in a smoothly
পৃষ্ঠা.-১৯৯

working harmonious system. I have no doubt that in dissolving the current political crisis .”
এ সময় ইয়াহিয়া বাংলাদেশে মুজিব-ইয়াহিয়া একটা সমঝোওতায় আসছেন। সর্বত্রই এমন খবর পাওয়া যাচ্ছিলো, ফলে সবাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া আশাবাদী মনোভাব পোষণ করে।
২৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন এমন খবরও শোনা গেলো। বাংলার মানুষ ধরে নেয় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দাবি প্রেসিডেন্ট মেনে নিচ্ছেন। একটি আপোষ যে হতে যাচ্ছে, এ সম্পর্কে সবাই প্রায় নিশ্চিত ছিল। সংবাদে লেখা হয় :
ইতিমধ্যে ২৩ মার্চ ‘প্রতিরোধ দিবস’ হিসেবে পালনের জন্যে সারা বাংলায় তোড়জোর লক্ষ্য করা গেলো। আতাউর রহমান খান বললেন, ‘শোষণহীন, স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের পতাকা উর্ধ্বে তুলে ধরার প্রকৃষ্ট সময় হচ্ছে ২৩ মার্চ।’… ২২ মার্চের সংবাদপত্রে স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ঘোষিত স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকার প্রতিকৃতি সংবাদপত্রে ছাপা হয়। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ ২৩ মার্চ ভোরে ঘরে ঘরে এই পতাকা উত্তোলনের আহ্বান জানায়।
২৩ মার্চ স্বাধীন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহ্বানে সারা দেশে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। প্রতি ঘরের শীর্ষে কালো পতাকার পাশাপাশি স্বাধীনবাংলার সবুজ জমিনে লাল সূর্যের মাঝে সোনালি রংয়ের বাংলাদেশের মানচিত্র অংকিত নতুন পতাকাও উড়তে থাকে। সরকারি অফিস, হাইকোর্ট, হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল, বিদেশি দূতাবাস সর্বত্রই স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়তে দেখা গেলো। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাসভবনেও আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হলো। ছাত্রলীগের জংগী কর্মী নিয়ে গঠিত জয়বাংলা বাহিনী এই দিন পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে পতাকা উত্তোলন করে কুচকাওয়াজ প্রদর্শন করে। সংবাদে বলা হয় : “রৌদ্রকরোজ্জ্বল পল্টন ময়দানে সকাল ৯টা ২০ মিনিটে স্বাধীন। বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে কুচকাওয়াজ শুরু হয়। কালচে সবুজ রঙের পটভূমিতে মাঝখানে লাল বৃত্তের মাঝে সোনালি রঙে পূর্ব-বাংলার মানচিত্র খচিত। স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন কালে হাজার, হাজার দর্শক বিপুল করতালিতে ফেটে পড়েন। স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারজন সদস্য নূরে আলম সিদ্দিকী, শাজাহান সিরাজ, আ.স.ম. আব্দুর রব ও আব্দুল কুদুস মাখন অভিবাদন গ্রহণ করেন। রেকর্ডে ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালবাসি’ বাজানো হয়। দশ প্লাটুন জয় বাংলাবাহিনী সামরিক কায়দায় পতাকা উত্তোলনকালে অভিবাদন করেন। পতাকা উত্তোলনের পর
পৃষ্ঠা-২০০

স্বাধীন বাংলাদেশ কেন্দ্রীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের চারনেতা জয় বাংলা বাহিনী পরিদর্শন করেন। দশ প্লাটুনের মধ্যে এক প্লাটুন ছাত্রী, এক প্লাটুন কিশোর, এক প্রাটুন প্রাক্তন সেনাবাহিনী ছিল। এদের মধ্যে ছাত্রী, প্রাক্তন সেনাবাহিনী ও তিন প্লাটুন যুবকের হাতে ডামি রাইফেল ছিল। এ ছাড়া ব্যান্ড প্লাটুন দল একটি। এক প্লাটুনের হাতে ছিল লাঠি।”
এদিন পূর্বপাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন শহিদ মিনারে এক সভার আয়োজন করে। পরদিন সংবাদে বলা হলো…“৪ দফা সম্পর্কে আলাপ আলোচনা এতদিন পর্যন্ত চলার কোনো মানে থাকতে পারে না। ন্যায্য দাবি মেনে নেওয়ার জন্য আলোচনা অনির্দিষ্ট কালের জন্য চলতে পারে না। তারা অভিযোগ করেন যে, একদিকে দাবি মেনে নেওয়া বিলম্বিত হচ্ছে এবং এই অবসরে পূর্ব-বাংলার সামরিক বাহিনী অধিকতর তৎপরতা ও প্রস্তুতি চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের নির্যাতনও বন্ধ হয়নি।”
২৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার নির্ধারিত বেতার ভাষণ বাতিল করা হয়। ইয়াহিয়া উপদেষ্টার সাথে আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতৃবর্গের এদিন দু-দফা বৈঠক বসে।
ই.পি.আর-দের সেক্টর হেড কোয়ার্টারে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন সম্পর্কে ‘দৈনিক পাকিস্তান’ বাংলাদেশের পতাকা যশোরের ই. পি, আর দফতরে উড়ছে’ শিরোনামায় লিখলো :
“যশোর ২৪ মার্চ, গতকাল এখানে ভোলা ট্যাংক রোডস্থ পূর্ব-পাকিস্তান। রাইফেলস এর হেডকোয়ার্টারসে প্রথম বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়। ই.পি.আর জোয়ানরা জয় বাংলা গান গেয়ে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে পতাকাকে গার্ড অব অনার দেয় ও অভিবাদন করে। এ ছাড়া এখানে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে সকল সরকারি বেসরকারি ভবনে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করা হয়। বিভিন্ন ছাত্র দল, জনতা, স্বেচ্ছাসেবক দল বিভিন্ন স্থানে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করে। বিভিন্ন সংস্থা ও দলের উদ্যোগে মার্চ পাস্ট ও গণজমায়েত অনুষ্ঠিত হয়।”
এ ঐতিহাসিক ঘটনায় সকল বাঙালি ই.পি.আর. এর প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সমর্থন ছিল। পতাকা উত্তোলনকে কেন্দ্র ঢাকা সদর দফতরসহ সারা দেশের ই.পি.আর, সেক্টর উইং এবং বি.ও. পিতে গুরুতর প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। পরবর্তীকালে পতাকা উত্তোলনের জন্য ই. পি. আর. বাহিনীর সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির কয়েকজনকে পাকিস্তানিদের নির্মম বুলেট বেয়নেটেরর শিকার হতে হয়।
পৃষ্ঠা-২০১

ভাবতে বিস্ময় জাগে, সেদিন কোনো যাদু মন্ত্রে, কোনো শক্তির বলে ই. পি. আর বাহিনীর নিয়মিত বাহিনীর নিয়ম-শৃংখলা ভঙ্গের চরম অবস্থার কথা জেনেও পতাকা উত্তোলন করেছিল। দীর্ঘ দিনের পশ্চিমা শোষণ আর নিস্পেশনে জর্জরিত, বাঙালি জাতীয়তাবাদে উজ্জীবিত হয়েই সেদিন বাঙালি ই. পি. আর. ও অগ্রসর হয়েছে। অথচ দুঃখের বিষয়, স্বাধীনতার অগ্রসৈনিক সেই ই. পি. আর. বাহিনীর অবদানকে স্বাধীনতা-উত্তোরকালে অনেকেই অস্বীকার করায় ব্যর্থ প্রয়াস পান।
স্বাধীন যুদ্ধে বাঙালি সৈনিকদের সম্পর্কে সাংবাদিক অ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস Rape of Bangladesh গ্রন্থে লিখেছেন ?
Spectaculars as it was the Awami league’s Civil disobedience camping lacked the essential ingredient of success. Maximum pressure and monimum preparedness was a costly error. Only the incredible valour and determination of virtually and handful officers and men of the East Bengal Regiment and the East Pakistan rifles prevented the West Pakistan military men sweeping the board. They saved the day. Brave men every where will salute them.
২৩ মার্চ সেনাবাহিনী পুনরায় গুলি চালায়। সৈয়দপুর, মিরপুর, পাহাড়তলী প্রভৃতি এলাকাতে সেনাবাহিনীর সমর্থন পুষ্ট হয়ে অবাঙালিরা বাঙালিদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে। বাঙালিরা রুখে দাঁড়ালে সেনাবাহিনী ত্বরিত ঘটনাস্থলে এসে গুলি চালায়। ফলে কমপক্ষে ৫০ জন নিহত এবং কয়েকজন বাঙালি আহত হয়। তবুও জনতার দুর্বার আন্দোলন অব্যাহত থাকে। দেশের অন্যান্য জায়গায় মতো রংপুরেও এই দিন আরো কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা ঘটে।
২৩ মার্চ সেনাবাহিনীর পাঞ্জাবি অফিসার লে. আব্বাস তার কিছু সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে রংপুর শহরের পার্শ্ববর্তী এক গ্রামে হাঁস-মুরগি কিনতে যায়। গৃহস্থও বিক্রি করতে রাজি নয়। লে, আব্বাস শেষ পর্যন্ত বলপ্রয়োগ করে তার কাছে হাঁস-মুরগি বিক্রি করতে বাধ্য করার চেষ্টা করে। এমতাবস্থায় গ্রামবাসী ক্ষিপ্ত হয়ে তার উপর ঝাপিয়ে পড়ে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয় এবং তাঁকে ও একজন সৈন্যকে হত্যা করে। অবশিষ্ট সৈন্য পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই অঞ্চলে উত্তেজনা আরও বৃদ্ধি পায়।
২৪ মার্চ ভুট্টোর সঙ্গীগণ এবং অন্যান্য নেতৃবর্গের মধ্যে খান আব্দুল ওয়ালী খান, সরদার শওকত হায়াত খান, খান আব্দুল কাইয়ুম খান, মিয়া মমতাজ
পৃষ্ঠা-২০২

মোহাম্মদ খান দৌলতাতানা, মওলানা মুফতী মাহমুদ প্রমুখ পশ্চিম পাকিস্তানে পাড়ি জমান।
এদিকে ২৪ মার্চ সেনা প্রধান জেনারেল হামিদ ব্রিগেডিয়ার আনসারীকে সঙ্গে নিয়ে হেলিকপ্টার যোগে চট্টগ্রাম পৌছে জেনারেল হামিদ ২০তম বেলুচ রেজিমেন্ট প্রধান কর্নেল ফাতমীকে বললেন, দেখ ফাতমী, এ্যাকশন খুব দ্রুত ও কম সময়ের মধ্যে সারতে হবে। আমাদের পক্ষের কেউ যেন হতাহত না হয়। গোপন সলা-পরামর্শ শেষ করে জেনারেল হামিদ বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে সঙ্গে নিয়ে ঢাকা ফিরে যায়। চট্টগ্রাম নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রেখে যান বিগ্রেডিয়ার আনসারীকে। জনতা বুঝে বাঙালি অফিসার বিগ্রেডিয়ার মজুমদারকে কেন সরানো হয়েছে। এই তারিখেই এম ভি সোয়াত থেকে গোলাবারুদ খালাস করাকে কেন্দ্র করে জনতার সঙ্গে সেনাবাহিনীর এক সংঘর্ষ ঘটে। সেনাবাহিনীর গুলিতে বেশ হতাহত হয়।
২৫ মার্চ সকালে ভুট্টো ইয়াহিয়ার সঙ্গে ৪৫ মিনিটব্যাপী এক বৈঠকে মিলিত হন। জনতার উত্তাল তরঙ্গ সারা দেশে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠলে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা নির্দ্বিধায় গুলি চালায় রংপুর, চট্টগ্রাম, ঢাকা প্রভৃতি স্থানে কমপক্ষে ১১০ জন নিহত হয় বলে খবরে জানা যায়। ২৪ মার্চ ১১ টায় সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার যোগে মেজর জেনারেল জানজুয়া, মেজর জেনারেল টিক্কা খান, মেজর জেনারেল নজর হোসেন শাহ্, মেজর জেনারেল খাদেম হোসেন রাজা, লে. জেনারেল খোদাদাদ খান প্রমুখ সেনানায়ক রংপুর সেনানিবাসে পৌঁছেন। রংপুর সেনানিবাসে বিগ্রেডিয়ার আব্দুল্লাহ মালিক তাদেরকে স্বাগত জানিয়ে সরাসরি নিজ বাস ভবনে নিয়ে যান। জেনারেলদের সঙ্গে হেড কোয়ার্টার ৪৩তম ডিভিশনের কর্নেল স্টাফকে একটি কাগজের প্যাকেট বহন করতে দেখা যায়। জেনারেলরা কিছুক্ষণ আলোচনা শেষে আবার হেলিকপ্টারে ওঠেন। হেলিকপ্টারটি রংপুর থেকে রাজশাহী, যশোর, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা ঘুরে সন্ধ্যায় ঢাকা সেনানিবাসে পৌছে। ৪তম ডিভিশনের কর্নেল স্টাফ যখন বিগ্রেডিয়ার মালিকের বাসা থেকে হেলিপ্যাডে রওয়ানা হন, তখন তার হাতে কাগজের প্যাকটেটি আর দেখা যায়নি। আসলে প্যাকেটটি ছিল গণহত্যার নীলনকশা, যা বিগ্রেডিয়ার মালিককে হস্তান্তর করা হয়। রংপুর থেকে জেনারেলগণ চলে যাওয়ার পরপরই বিগ্রেডিয়ার মালিক সামরিক কর্মকর্তাদের নিয়ে এক বৈঠকে বসেন। এই বৈঠকে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুসারে ১০ নং ই.পি. আর, উইং এর সহকারী কমান্ডার ক্যাপ্টেন নওয়াজেশ উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও ব্রিগেডিয়ার মালিক তাঁকে সে বৈঠকে উপস্থিত থাকতে দেননি।
পৃষ্ঠা-২০৩

২৫ মার্চ দুপুরের দিকে পিলখানায় অবস্থানরত ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টের সৈন্যরা পি, পি ডেসে সারা পিলখানায় ঘুরে বেড়াতে থাকে। পিলখানার বাইরে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার কাজে কর্তব্যরত অধিকাংশই ই, পি, আর ট্রুপসকে পিলখানার ভিতরে নিয়ে আসা হলো। হাতিয়ার জমা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হলো। ই.পি.আর হাই কমান্ড-এর পক্ষ থেকে বলা হলো ‘শেখ মুজিবের সব দাবি মেনে নেওয়া হয়েছে। আই. এস (ইন্টারন্যাল সিকিউরিটি) ডিউটির আর প্রয়োজন নেই। সব আরাম করো’ রাত ৯টার দিকে পিলখানার ২২তম বেলুচ রেজিমেন্টকে মুভ করতে দেখা যায়।
সারা দেশে ই.পি.আর বাহিনী, আওয়ামী লীগ নেতৃবর্গ ও ছাত্র নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে নিজেদের সদা প্রস্তুত রাখা। অপেক্ষায় থাকে হাই কমান্ডের নির্দেশের জন্য চরম মুহূর্ত এলো, কিন্তু অজান্তে যখন সবাই নিদ্রার কোলে ঢুলুঢুলু। পাকিস্তানিরা চরম আঘাত হানে বাঙালিদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য। ই.পি.আর বাহিনী এগিয়ে এলো দৃপ্ত পদক্ষেপে, হাতিয়ার হাতে। সেই সঙ্গে এগিয়ে এলো পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক ও ছাত্র-জনতা। শুরু হলো মুক্তির সশস্ত্র সংগ্রাম।
পঁচিশে মার্চ বিকেলে শেখ মুজিব জানতে পারলেন, প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলোচনা ব্যর্থ হয়েছে এবং সেনাবাহিনী আক্রমণের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে। খবর পান ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করেছে। শেখ মুজিব শত অনুরোধ সত্ত্বেও আত্মগোপন করতে অস্বীকার করেন এবং তার প্রবীণ সহকর্মীদের শহর ছেড়ে চলে যাবার নির্দেশ দেন। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে শেখ মুজিব বলেছেন চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমেদ চৌধুরীর কাছে নিম্ন বর্ণিত বার্তা পাঠান :
TO THE PEOPLE OF BANGLADESH AND ALSO OF THE WORLD.
Pakistan armed Forces suddenly attacked the EPR. base at Peelhana and police line at Rajarbag of 00 Hrs of 26.0.71. killing tots and lots of people Still battle is going on with EPR & Police Forces in the streets of Dacca People are fighting gallantly with the enemy forces for the cause of freedom of Bangladesh. May, Allah bless you and hel you in your struggle for freedom Joy Bangla Sd/Sk. Mujibur Rahman.
২৬ মার্চ সকালের মধ্যেই শেখ মুজিবের এই স্বাধীনতার বাণী হ্যান্ডবিল আকারে ছাপিয়ে বিলি করার ব্যবস্থা করে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এই
পৃষ্ঠা-২০৪

হ্যান্ডবিলে ২৬ মার্চ ১-৩০ মিনিটে পাকবাহিনীর হাতে বন্দী হওয়ার আগেই বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। শামসুল হুদা চৌধুরী বাংলা বেতার কেন্দ্রের পরিচালক ছিলেন। তিনি লিখেছেন কালুরঘাটে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্র চালু হয়েছিল ২৬ মার্চ। সূচনা পর্বের অধিবেশনে বর্ষীয়ান গীতিকার আব্দুস সালাম স্বাধীনতা যুদ্ধে দেশবাসীকে ঝাপিয়ে পড়ার উদাত্ত আহবান জানান। এর আগে বেলা ১২-৩০ মিনিটে আওয়ামী লীগ নেতা মরহুম আব্দুল হান্নান এক অনলবর্ষী ভাষণে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা পাঠ করেন। পরে ২৭ মার্চ সন্ধ্যা ৭-০ মিনিটে মেজর জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা সম্বলিত নিম্নলিখিত ভাষণ পাঠ করেন ও Major Zia, hereby proclaim, on behalf of great political leader Sheikh Mujibur Rahman. I also declare, we have already formed a sovereign legal government under Sheikh Mujibur Rahman which pledges to function as per law and the constitution.
The new democratic governemtn is committed to a policy of a non-alignment in international relations. It will seek friendship with all nations and public opinion in their respective countries against the brutal genocide in Bangladesh.
The government under Sheikh Mujibur Rahman is sovereign legal governemin of Bangladesh and is entitled to recognition from all democratic nations of the world.
বাঙালি সৈন্যরা ও বিদ্রোহী জনতা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রসমূহ জানতে পারে যে এ ভূখণ্ডে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়েছে। ২৫ মার্চের রাতে হানাদার বাহিনী যে মুহূর্তে অতর্কিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাঙালি জাতির ওপর, সেই মুহূর্তে মহান মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হলো। যে সব লক্ষ লক্ষ মুক্তিযোদ্ধারা নিজ প্রাণ তুচ্ছজ্ঞান করে বীরবিক্রমে সেদিন যুদ্ধ করেছেন ইতিহাসে তারা চিরস্মরণীয়।
পৃষ্ঠা-২০৫

ষষ্ঠ অধ্যায়
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার
পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তানি বাহিনী পাশবিক হত্যাযজ্ঞে মেতে উঠলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিরাপদ স্থানে সরে যেতে অস্বীকার করেন এবং পাকিস্তানিদের হাতে গ্রেফতার হন। তাজউদ্দিন আহমদ ২৭ মার্চ পর্যন্ত ঢাকা শহরে আত্মগোপন করে থাকার পর ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে ফরিদপুর ও কুষ্টিয়া। যাত্রা শুরু করেন এবং ২৯ মার্চ সন্ধ্যায় নানা জনপদ ঘুরে ঝিনাইদহে এসে উপস্থিত হন। ৩০ মার্চ ঝিনাইদহের পুলিশ সুপার মাহবুর উদ্দিনসহ একটি জীপে চড়ে চুয়াডাঙ্গা আসেন। ঐ দিনই বিকেলে তাজউদ্দিন ও ব্যারিস্টার ইসলাম মহকুমা প্রশাসক তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী ও মাহবুর উদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে সীমান্তের দিকে অগ্রসর হন। প্রকৃত পক্ষে ভারতীয় কর্তৃপক্ষের সঙ্গে পঁচিশে মার্চের পর এটাই প্রথম যোগাযোগ। ভারতীয় বি.এস.এফ -এর উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা গোলক মজুমদারের সহায়তায় তাজউদ্দিন ও ব্যারিস্টার ইসলাম সীমান্ত অতিক্রম করে কোলকাতা যান এবং ঐ রাতেই সেখান থেকে একটি সামরিক বিমানে করে তাঁরা দিল্লি চলে যান।
পাকিস্তানি সামরিক জান্তা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে গণহত্যা শুরু করলে সম্ভাব্য সহায়তা দানের বিষয়ে ভারতের কি করা প্রয়োজন, তা নিয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। মঈদুল হাসান ‘মূল ধারা ৭১ গ্রন্থে এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করেছেন, শেখ মুজিবের নির্দেশে ৬ মার্চ তাজউদ্দিন ঢাকার ভারতীয় ডেপুটি হাইকমিশনার কে. সি. সেন গুপ্তের সঙ্গে দেখা করেন। দুর্যোগে পড়লে ভারত কিভাবে সাহায্য করতে পারে তাই ছিল এই দেখা করার উদ্দেশ্য। কে, সি, সেনগুপ্ত ভারত সরকারকে অবহিত করার জন্য দিল্লি যান এবং ঢাকা ফিরে ১৭ মার্চ তাজউদ্দিনকে এই আশ্বাস দেন যে, যদি পাকিস্তানিরা সামরিক আঘাত করে তাহলে সেই অবস্থায় ভারত যথাসম্ভব সাহায্য করবে। কিন্তু ভারতীয় সাহায্যের রূপরেখা কি হবে, সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার জন্য ২৪ মার্চ মিলিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে এই নির্ধারিত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। সুতরাং এই অসমাপ্ত সংলাপের
পৃষ্ঠা-২০৬

কারণে মুক্তিবাহিনীকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ সরবরাহ ও ভারতের মাটিতে মুক্তিবাহিনীর নিরাপদ বেস গঠনের বিষয়টি স্থির করা যায়নি।
তাজউদ্দিন ৩ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করেন। প্রথমেই ইন্দিরা গান্ধী জিজ্ঞাসা করেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে কি না। তাজউদ্দিন এই প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার সময় উপস্থিত বুদ্ধি প্রয়োগ করেন। তিনি ভারতের প্রধানমন্ত্রীকে জানান, ২৬ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন। নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে উপস্থাপন করে জানান, শেখ মুজিব স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং অন্যান্য সহকর্মীরা মন্ত্রিসভার সদস্য। তাজউদ্দিন ভারতের সাহায্যের আবেদন জানালে ইন্দিরা গান্ধী সব ধরনের সাহায্য সহযোগিতা দানের আশ্বাস দেন।
তাজউদ্দিন একটি ডাকোটা প্লেনে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও আব্দুল মান্নানসহ ১১ এপ্রিল আগরতলা যান। খোন্দকার মোশতাক আহমেদ ও কর্নেল ওসমানী এই সময় আগরতলায় অবস্থান করছিলেন। খোন্দকার মোশতাক ৩০ মার্চ পর্যন্ত ঢাকায় হক নাসিং হোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। এপ্রিলের প্রথম দিকে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে তিনি আগরতলা যান এবং ওমরাহ পালনের জন্য মক্কা গমনের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেন। পরে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাহায্য প্রদানের সম্মতি এবং তাঁকে মন্ত্রিসভায় নিতে তাজউদ্দিনের আগ্রহের কথা জানতে পেরে তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে চান।
বাঙালির জীবনে দুঃস্বপ্নের নিকষকালো মর্মান্তিক রাত উনিশ শ একাত্তরের ২৫ মার্চের রাত। পাকিস্তানিরা অত্যাচার, উৎপীড়নে পাশবিকতা, নৃশংসতা আর হিংস্রতার বিষাক্ত ফণা বিস্তার করেছিল। নিরীহ বাঙালিদের উপর সেই ভয়াবহ রাতে। পূর্ব পরিকল্পিত সিদ্ধান্ত মাফিক পরিপূর্ণ সামরিক সরঞ্জাম নিয়ে বিজাতীয় ঘৃণা ও আক্রোশবশত পাকিস্তান সেনাবাহিনী গোটা বাংলাদেশ জুড়ে সেই রাতেই শুরু করলো পৃথিবীর ইতিহাসের এক জঘন্যতম গণহত্যা ও ধ্বংসলীলা। মেশিন গান, মর্টার আর ট্যাংক নিয়ে রাতের অন্ধকারে যুদ্ধের সকল নিয়ম-কানুন উপেক্ষা করে বর্বরের মতো তারা নিরস্ত্র বাঙালির রক্তে বাংলাদেশকে এক শোনিত সাগরে পরিণত করতে তৎপর হয়ে উঠলো।
শেখ মুজিবুর রহমানের ঢাকার ৩২ নম্বর ধানমন্ডীর বাসভবনটি একাত্তরে আহুত অহিংস আন্দোলনের সময় স্বাধীনতাকামী লক্ষ বাঙালির সংগ্রামের মূল ঘাঁটি হয়ে উঠেছিল। ২৫ মার্চ ৭১ বিকেলে ওখানে জরুরি সাংবাদিক সম্মেলনের। ডাকার কথা ভাবছিলেন শেখ মুজিব। পুরোদিনটিই কেটেছে তার চরম উদ্বেগের মধ্যে। তখনও তিনি জানতে পারেননি তাঁকে এবং বাঙালি জাতিকে চোখে ধুলা
পৃষ্ঠা-২০৭

দিয়ে ইয়াহিয়া খানের করাচি পালিয়ে যাবার খরব। যখন জানলেন, তখন বিকেল চারটে। তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্ত নিতে নিতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলো। সিদ্ধান্তের জন্য প্রতিক্ষারত আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ শুরু করলেন পীড়াপীড়ি। কর্নেল ওসমানী (পরে জেনারেল) ৭টা নাগাদ বাড়ির ভেতরের একটা ঘরে বঙ্গবন্ধুকে ডেকে নিয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর মুভমেন্টের সংবাদটা জানালেন। রাত নয়টা অবধি শেখন মুজিবের সাথে ওই সংকট মুহূর্তে কর্নেল ওসমানীসহ অন্যান্যদের মধ্যে ছিলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ডক্টর কামাল হোসেন, আব্দুস সামাদ আজাদ, কাজী জহিরুল কাউইম ও আরো বেশ কিছু বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা। সবাই মিলিতভাবে বঙ্গবন্ধুকে তার বাড়ি ছেড়ে তাঁদের সঙ্গে সরে পড়তে অনুরোধ করলেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু তাঁদের সবাইকে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নেবার নির্দেশ দিয়ে নিজে থেকে গেলেন তাঁর বাস ভবনে। বর্বর পাকবাহিনী ২৫ মার্চ দিবাগত রাত ১-৩০ মিনিটে শেখ মুজিবকে বন্দী করে ঢাকার কুর্মিটোলায় নিয়ে যায়। তারপর সেখানে অতি সঙ্গোপনে ৩০ মার্চ নিয়ে যায় করাচিতে। পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে বন্দি হবার কিছুক্ষণ আগে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামের আওয়ামী লীগ নেতা জহুর আহমদ চৌধুরীসহ এদেশের নানান অঞ্চলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাবাণী ওয়ারলেসে পাঠানোর ব্যবস্থা করে যান।। ওই বার্তাটির মুদ্রিত হ্যান্ডবিলই ২৬ মার্চ, ‘৭১ ভোরের মধ্যে চট্টগ্রাম এবং সিলেটসহ দেশের কয়েকটি এলাকায় পৌঁছে যায়। হ্যান্ডবিলটি ছিল ইংরেজিতে। চট্টগ্রামের ডাক্তার মঞ্জুলা আনোয়ার তার অনুবাদ করেছেন এভাবে : “বাঙালি ভাই বোনদের কাছে এবং বিশ্ববাসীর কাছে আমার আবেদন রাজারবাগ পুলিশ ক্যাম্প ও পিলখানা ই. পি. আর ক্যাম্পে রাত ১২ টায় পাকিস্তানি সৈন্যরা অতর্কিত হামলা চালিয়ে হাজার হাজার লোককে হত্যা করেছে। হানাদার পাকিস্তানি সৈন্যদের সঙ্গে আমরা লড়ে যাচ্ছি। আমাদের সাহায্য প্রয়োজন এবং পৃথিবীর যে কোনও স্থান থেকেই হোক। এমতাবস্থায় আমি বাংলাদেশকে স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র বলে ঘোষণা করছি। তোমরা তোমাদের সমস্ত শক্তি দিয়ে মাতৃভূমিকে রক্ষা কর। আল্লাহ তোমাদের সহায় হউন।” -শেখ মুজিবুর রহমান
প্রবাসী সরকার গঠনের পর কোলকাতাস্থ ডেপুটি হাই কমিশনার হোসেন আলী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন এবং পাকিস্তান সরকারের কলকাতাস্থ মিশন দখল করে নেন। পাকিস্তান সরকার স্বাভাবিকভাবেই দিশাহারা হয়ে যায়। পাকিস্তান সরকার জনাব হোসেন আলীকে পদচ্যুত করে মি. মাসুদকে কলকাতা মিশন প্রধান হিসেবে পাঠায়। কিন্তু মাসুদকে ৯নং পার্ক সার্কাস এভিনিউর অফিসে কিছুতেই ঢুকতে দেয় না বাংলার মানুষ। শেষ পর্যন্ত
পৃষ্ঠা-২০৮

নাজেহাল হয়ে মাসুদ সার্কাস এভিনিউর কাছে পার্ক হোটেলে গিয়ে ঠাই দেয়। কিন্তু বাংলাদেশি নাগরিকরা সেই হোটেলে আক্রমণ করে ইট পাটকেল মেরে হোটেলের জানালা দরজা ভেঙে দেয়। বাধ্য হয়ে মাসুদকে কলকাতা ছেড়ে পালাতে হয়।
এ অবস্থায় বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় সরকার গঠনের জায়গা খোঁজা হচ্ছিল। এই সময় কুষ্টিয়ার সদস্য এবং আওয়ামী লীগ নেতারা জানালেন যে, মেহেরপুরে পাক বাহিনী তখনও ঢুকতে পারেনি। তাই শেষ পর্যন্ত সাব্যস্ত হলো যে, কুষ্টিয়া জেলাধীন মেহেরপুর মহকুমার বৈদ্যনাথ তলার আমবাগানে। বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান পরিচালিত হবে। তৎকালীন মেহেরপুরের এস. ডি. ও. জনাব তওফিক এলাহী চৌধুরী এবং মেজর ওসমানের সক্রিয় সাহায্যে প্রথম ঐ এলাকাটি ই. পি. আর, আনসার, পুলিশ, বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যদের দিয়ে ঘিরে ফেলা হয়। তাদের সহযোগিতার জন্য ভারতীয় বি. এস, এফ-এর সদস্যরাও ছদ্মবেশে তাদের সঙ্গে যোগ দেয়।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ঘোষিত হলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি ছিলেন পাক হানাদার বাহিনীর হাতে বন্দী। কাজেই তাঁর অনুপস্থিতিতে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হলেন সৈয়দ নজরুল ইসলাম। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আনুষ্ঠানিক অনুমোদন পেলেন তাজউদ্দিন আহমদ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী, অর্থমন্ত্রী এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পেলেন যথাক্রমে খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। কর্নেল আতাউল গণি ওসামানীর ওপর প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব প্রদান করা হলো।
১০ এপ্রিল গঠিত বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার ১৭ এপ্রিল দেশি বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে প্রথম আত্মপ্রকাশ মেহেরপুরের আমবাগানে। আশপাশের গ্রামের লোকদের কাছ থেকে কয়েকখানা চেয়ার টেবিল এনে খোলা মাঠের এক কোণে গাছ তলায় সাজিয়ে একটি সভামঞ্চ তৈরি হলো। সামসুল হুদা চৌধুরী এ প্রসঙ্গে লিখেছেন : ঐ দিন বেলা পূর্বাহ্নে ১১ টা ১০ মিনিট সময়ে কুষ্টিয়া বৈদ্যনাথ তলায় আয়োজিত ঐ সভামঞ্চের পশ্চিম দিক থেকে এলেন নেতৃবৃন্দ। উপস্থিত জনতা মুহুর্মুহু করতালী দিয়ে নেতৃবৃন্দকে স্বাগত জানালেন। সদ্য গঠিত সশস্ত্র বাহিনীর একটি দল অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিবাদন জানালেন। এর পর নেতৃবৃন্দ একে একে নির্ধারিত আসনে বসলেন। প্রথমে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তারপর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ, তারপর মন্ত্রী খোন্দকার মোশতাক আহমেদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, জনাব কামারুজ্জামান এবং প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানী। স্বেচ্ছাসেবকগণ পুষ্প দিয়ে তাদের অভিবাদন জানালেন।
পৃষ্ঠা-২০৯

বৈদ্যনাথতলায় আয়োজিত ঐতিহাসিক অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান। পবিত্র কোরআন শরীফ থেকে তের করা হলো। নতুন রাষ্ট্রের ঐতিহাসিক ঘোষণা পাঠ করলেন তৎকালীন লীগের চীফ হুইপ অধ্যাপক ইউসুফ আলী। নবগঠিত স্বাধীন সার বাংলাদেশের নাম হলো ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ’।
পুলিশ সুপার মাহবুব উদ্দিনের নেতৃত্বে একদল ইপিআর সৈন্য। মুক্তিযোদ্ধারা নবগঠিত মন্ত্রিসভা ও অস্থায়ী রাষ্ট্রপতিকে সামরিক অভিবাদন জানায়।
চারটি ছেলে প্রাণ ভরে গাইলো ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালাবাসি।’ এরপর দাঁড়ালেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী পদে তাজউদ্দিন আহমদ এবং তাঁর পরামর্শে আরো তিন জনের নাম ঘোষণা করেছেন তিনি। অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি একে একে পরিচয় করিয়ে দিলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সহকর্মীকে। তিনি নতুন রাষ্ট্রের সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে কর্নেল (পরে জেনারেল) আতাউল গণি ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর চীফ অফ স্টাফ পদে লে. কর্নেল আব্দুর রবের নাম ঘোষণা করলেন। মেহেরপুরের নতুন নামকরণ করা হলো ‘মুজিব নগর’। এই মুজিব নগরেই ঘোষিত হলো অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে। অবশ্য নতুন বিপ্লবী সরকারের আত্মপ্রকাশের মাত্র দু’ঘণ্টার মধ্যেই হানাদার বাহিনী পুনর্দখল করে নিয়েছিল। তাই বাধ্য হয়ে মুজিবনগর প্রশাসনকে সুবিধামত মুক্তাঞ্চলে নিয়ে যেতে হয়েছিল। কিন্তু অস্থায়ী রাজধানী হিসেবে মুজিব নগর নামের আর পরিবর্তন হয়নি।
মুজিব নগরে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তাঁর ভাষণে বলেন :
‘আজ এই আম্রকাননে একটি নতুন জাতি জন্ম নিলো। বিগত বহু বছর যাবৎ বাংলায় মানুষ তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি নিজস্ব ঐতিহ্য, নিজস্ব নেতাদের নিয়ে এগুতে চেয়েছেন। কিন্তু পাকিস্তানি কায়েমী স্বার্থ কখনওই তা হতে দিল না ওরা আমাদের ওপর আক্রমণ চালিয়েছে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম, ওরা তা দিল না। ওরা আমাদের ওপর বর্বর আক্রমণ চালালো। তাই আজ আমরা লড়াইয়ে নেমেছি। এ লড়াইয়ে জয় অনিবার্য। আমরা পাকিস্তানি হানাদারকে বিতাড়িত করবোই। আজ না জিতি কাল জিতবো। কাল না জতি পরশু জিতবোই। আমরা বিশ্বের সব রাষ্ট্রের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ সহঅবস্থান চাই। পরস্পরের ভাই হিসেবে বসবাস করতে চাই। মানবতার, গণতন্ত্রের এবং স্বাধীনতার জয় চাই।
পৃষ্ঠা-২১০
আপনারা জানেন, পাকিস্তানের শোষণ এবং শাসন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য গত ২৩ বছর ধরে বঙ্গবন্ধু সব স্বার্থ পরিত্যাগ করে আন্দোলন করেছেন। তিনি চেয়েছিলেন রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক অধিকার। আমি জোর দিয়ে বলছি তিনি আমাদের মধ্যে আছেন। জাতির সংকটের সময় আমরা তার নেতৃত্ব পেয়েছি। তাই বলছি পৃথিবীর মানচিত্রে আজকে যে নতুন রাষ্ট্রের সূচনা হল তা চিরদিন থাকবে। পৃথিবীর কোনো শক্তি মুছে দিতে পারবে না। আপনারা জেনে রাখুন, গত ২৩ বছর ধরে বাংলার সংগ্রামকে পদে পদে আঘাত করেছে পাকিস্তানের স্বার্থবাদী, শিল্পপতি, পুঁজিবাদী ও সামরিক কুচক্রিরা। আমরা চেয়েছিলাম শান্তিপূর্ণভাবে আমাদের অধিকার আদায় করতে। লজ্জার কথা, দুঃখের কথা ঐ পশ্চিমারা শেরে বাংলাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে কারাগারে পাঠিয়েছিল। তাই ওদের সঙ্গে আপোষ নেই, ক্ষমা নেই।
আমাদের রাষ্ট্রপতি জন-গণ-নন্দিত ক্ষণজন্মা মহাপুরুষ, নির্যাতিত মানুষের মূর্ত প্রতীক শেখ মুজিব বাংলার মানুষের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের জন্য সংগ্রাম করে আজ বন্দী। তাঁর নেতৃত্বে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম জয়ী হবেই।’
স্বাধীনতার ঘোষণা পত্র :
১৭ এপ্রিল ৭১ কুষ্টিয়ার আমবাগানে গঠিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোণাপত্র ছিল নিম্নরূপঃ
“যেহেতু ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচিত করা হয়েছিল এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন প্রতিনিধি নির্বাচিত করিয়াছিলেন, এবং
যেহেতু জেনারেল ইয়াহিয়া খান ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে শাসনতন্ত্র রচনার উদ্দেশ্যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের অধিবেশন আহ্বান করেন এবং
যেহেতু আহুত এই পরিষদ স্বেচ্ছাচার এবং বেআইনীভাবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয় এবং
যেহেতু পাকিস্তান কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি পালন করিবার পরিবর্তে বাংলাদেশের গণ প্রতিনিধিদের সহিত পারস্পরিক আলোচনা চলাকালে হঠাৎ ন্যায় নীতির বহির্ভূত এবং বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করেন এবং
যেহেত উল্লিখিত বিশ্বাসঘাতকতামূলক কাজের জন্য উদ্ভূত পরিস্থিতির। পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু
পৃষ্ঠা-২১১
শেখ মুজিবর রহমান জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জনের আইনানুগ। প্রতিষ্ঠার জন্য ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতা। করেন এবং বাংলাদেশের অখণ্ডতা ও মর্যাদা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগন প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান এবং
যেহেতু পাকিস্তান সরকার অন্যায় যুদ্ধ, গণহত্যা নানাবিধ নৃশংস অত্যাচাষ পরিচালনা দ্বারা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিদের একত্রিত হইয়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করিয়া জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠা অসম্ভব করিয়া তুলিয়াছে, এবং
যেহেতু বাংলাদেশের জনগণ তাহাদের বীরত্ব, সাহসিকতা ও বিপ্লবী। কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলাদেশের উপর তাহাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করিয়াছে এবং। যেহেতু সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী বাংলাদেশের জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রতি যে ম্যান্ডেট দিয়াছে সেই ম্যান্ডেট মোতাবেক আমরা নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আমাদের সমম্বয়ে গণপরিষদ গঠন করিয়া পারস্পরিক আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করা আমাদের পবিত্র কর্তব্য মনে করি, সেইহেতু আমরা বাংলাদেশকে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশে রূপান্তরিত করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি এবং উহার দ্বারা পূর্বাহ্নে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বাধীনতা ঘোষণা অনুমোদন করিতেছি।
এতদ্বারা আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, শাসনতন্ত্র প্রণীত না হওয়া পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রপ্রধান এবং সৈয়দ নজরুল ইসলাম উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পদে অধিষ্ঠিত থাকিবেন।
রাষ্ট্রপ্রধান প্রজাতন্ত্রের বাহিনীর সর্বাধিনায়ক পদেও অধিষ্ঠিত থাকিবেন। রাষ্ট্রপ্রধানই সর্বপ্রকার প্রশাসন ও আইন প্রণয়নের অধিকারী। রাষ্ট্রপ্রধানের প্রধানমন্ত্রী ও মন্ত্রিসভার সদস্যদের নিয়োগের ক্ষমতা থাকিবে। তাহার কর ধার্য ও অর্থ ব্যয়ের ক্ষমতা থাকিবে। তাঁহার গণপরিষদের অধিবেশন আহ্বান ও উহার অধিবেশন মূলতবী ঘোষণার ক্ষমতা থাকিবে। উহা ছাড়া বাংলাদেশের জন সাধারণের জন্য আইনানুগ ও নিয়মতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য অন্যান্য প্রয়োজনীয় সকল ক্ষমতায়ও তিনি অধিকারী হইবেন। বাংলাদেশের জনগণের দ্বারা নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসেবে আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে কোনো কারণে রাষ্ট্রপ্রধান যদি অনুপস্থিত থাকেন, অথবা রাষ্ট্রপ্রধান যদি কাজে যোগদান করিতে না পারেন অথবা তাহার কর্তব্য ও দায়িত্ব পালনে যদি অক্ষম হন তাহা হইলে রাষ্ট্রপ্রধানের প্রদত্ত ক্ষমতা ও দায়িত্ব উপ-রাষ্ট্রপ্রধান পালন করিবেন।
আমরা আরো সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের এই স্বাধীনতা ঘোষণা ১৯৭১ সনের ২৬ মার্চ হইতে কার্যকর বলিয়া গণ্য হইবে। আমরা আরো
পৃষ্ঠা-২১২

সিদ্ধান্ত ঘোষণা করিতেছি যে, আমাদের সিদ্ধান্ত কার্যকর করার জন্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীকে যথাযথভাবে রাষ্ট্রপ্রধান ও উপ-রাষ্ট্রপ্রধানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য দায়িত্ব অর্পন ও নিযুক্ত করিলাম।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ নিম্নলিখিত ভাষণ দেন :
“বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে লিপ্ত। পাকিস্তানের উপনিবেশবাদী নিপীড়নের বিরুদ্ধে জাতীয় স্বাধীনতা যুদ্ধের মাধ্যমে আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার অর্জন ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো বিকল্প নেই।
বাংলাদেশের গণহত্যার আসল ঘটনাকে ধামাপাচা দেওয়ার লক্ষ্যে পাকিস্তান সরকারের অপপ্রচারের মুখে বিশ্ববাসীকে অবশ্যই জানাতে হবে কীভাবে বাংলার শান্তিকামী মানুষ সশস্ত্র সংগ্রামের পরিবর্তে সংসদীয় পদ্ধতিকেই বেছে নিয়েছিল। তবেই তারা বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত আশা আকাক্ষ্যাকে সত্যিকারভাবে উপলব্ধি করতে পারবেন।
পাকিস্তানের জাতীয় সংহতি রক্ষার শেষ চেষ্টা হিসেবে আওয়ামী লীগ পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে ছয়দফার আলোকে বাংলাদেশের জন্য স্বায়ত্তশাসন চেয়েছিলেন। ১৯৭০-এ আওয়ামী লীগ এই ছয়দফা নির্বাচনী ইশতেহারের ভিত্তিতেই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের মোট ৩১৩টি আসনের মধ্যে বাংলাদেশের জন্য বরাদ্দ ১৬৯টি আসনের স্থলে মোট ১৬৭টি আসন লাভ করেছিলেন। নির্বাচনী বিজয় এতোই চূড়ান্ত ছিল যে আওয়ামী লীগ মোট শতকরা আশিটি ভোট পেয়েছিল। এই বিজয়ের চুড়ান্ত রায়েই আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল।
স্বভাবতই নির্বাচন পরবর্তী সময়টি ছিল আমাদের জন্য এক আশাময় দিন। কারণ সংসদীয় গণতন্ত্রে জনগণের এমনি চুড়ান্ত রায় ছিল অভূতপূর্ব। দুই প্রদেশের জনগণই বিশ্বাস করেছিলেন যে, এবার ছয়দফার ভিত্তিতে উভয় প্রদেশের জন্য একটি গ্রহণযোগ্য গঠনতন্ত্র প্রণয়ন সম্ভব হবে। তবে সিন্ধু পাঞ্জাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন লাভকারী পাকিস্তান পিপলস পার্টি তাদের নির্বাচন অভিযানে ছয়দফাকে জনগণের কাছে এই দলের জবাবদিহি করার ছিল না। বেলুচিস্তানের নেতৃস্থানীয় দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি ছিল ছয়দফার পূর্ণ সমর্থক। উত্তরপশ্চিম সীমান্তের প্রদেশের প্রভাবশালী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও ছয়দফার আলোকে পূর্ণ প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাসী ছিল। কাজেই প্রতিক্রিয়াশীলদের পরাজয় সূচনাকারী ৭০-এর নির্বাচনে পাকিস্তান গণতন্ত্রের আশাপ্রদ ভবিষ্যতেরই ইঙ্গিত বহন করেছিল।
আশা করা গিয়েছিল যে জাতীয় পরিষদ আহ্বানের প্রস্তুতি হিসেবে প্রধান প্রধান রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনায় বসবে। এমনি আলোচনার প্রস্তাব এবং
পৃষ্ঠা-২১৩

পাল্টা প্রস্তাবের উপর গঠনতন্ত্রের ব্যাখ্যা উপস্থাপনের জন্য আওয়ামী লীগ সর্ব সময়ই সম্মত ছিল। তবে এই দল বিশ্বাস করেছে যে যথার্থ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধকে জাগ্রত রাখার জন্য গোপনীয় সম্মেলনের পরিবর্তে জাতীয় পরিষদের গঠনতন্ত্রের ওপর বিতর্ক হওয়া উচিত। এরই প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ চেয়েছিল যথাসত্বর জাতীয় পরিষদ আহ্বানের জন্য। আওয়ামী লীগ আসন জাতীয় পরিষদ অধিবেশনে উপস্থাপনের পক্ষে একটি খসড়া গঠনতন্ত্র প্রণয়ন কাজে লেগে গেলো এবং এ ধরনের একটি গঠনতন্ত্র প্রণয়নের সব আইনগত এবং বাস্তব দিকও তারা পরীক্ষা করে দেখলো।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক ভবিষ্যতের ওপর আলোচনার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া খান এবং শেখ মুজিবের প্রথম গুরুত্বপূর্ণ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় জানুয়ারি ৭১ মাঝামাঝি সময়ে। এ বৈঠকে জেনারেল ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগের ছয়দফাভিত্তিক কর্মসূচিকে বিশ্লেষণ করলেন এবং ফলে কি হতে পারে তারও। নিশ্চিত ভরসা নিলেন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে। কিন্তু প্রস্তাবিত গঠনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশে বিরত থাকলেন। তিনি এমন এক ভাব দেখালেন যে ছয়দফায় সাংঘাতিক আপত্তিজনক কিছুই তিনি খুঁজে পাননি। তবে পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির সাথে একটি সমঝোতায় আসার ওপর তিনি জোর দিলেন।
পরবর্তী আলোচনা অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তান পিপলস পার্টি এবং আওয়ামী লীগের সাথে। গঠনতন্ত্রের উপর আলোচনার জন্য এ সময়ে কয়েকটি বৈঠকে মিলিত হয়। ইয়াহিয়ার ন্যায় ভুট্টোও গঠনতন্ত্রের অবকাঠামো সম্পর্কে কোনোও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব আনয়ন করেননি। বরং তিনি এবং তার দল ছয়দফায় বাস্তব ফল কি হতে পারে সে সম্পর্কে আলোচনার প্রতি অধিক ইচ্ছুক ছিলেন। যেহেতু এ ব্যাপারে তাদের প্রতিক্রিয়া ছিল না সূচক এবং যেহেতু এ নিয়ে তাদের কোনোও তৈরি বক্তব্যও ছিল না, সেহেতু এ ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ আপোষ ফরমূলায় আসাও সম্ভব ছিল না। অথচ দুই দলের মধ্যে মতানৈক্য দূর করার জন্য প্রচেষ্টার দুয়ার সব সময়ই খোলা ছিল। এই আলোচনা বৈঠক থেকে এটাই স্পষ্ট হয়ে গেলো যে কোনো পর্যায় থেকে আপোষ ফরমূলায় আসা সম্ভব সে সম্পর্কেও জনাব ভুট্টোর নিজস্ব কোনো বক্তব্য ছিল না।
এখানে একটি কথা আরো পরিষ্কারভাবে বলে রাখা দরকার যে আওয়ামী লীগের সাথে আলোচনায় অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছে এ ধরনের কোনোও আভাসও পাকিস্তান পিপলস পার্টি ঢাকা ত্যাগের আগে দিয়ে যাননি। উপরন্তু তারা নিশ্চয়তা দিয়ে গেলেন যে, আলোচনার জন্য সব দরজাই খোলা রয়েছে এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য নেতৃবৃন্দের সাথে আলাপ আলোচনার পর পাকিস্তান
পৃষ্ঠা-২১৪

পিপলস পার্টি আওয়ামী লীগের সাথে দ্বিতীয় দফায় আরো অধিক ফলপ্রসূ আলোচনায় বসবেন, অথবা জাতীয় পরিষদেও তারা ভিন্নভাবে আলোচনায় বসার জন্যও অনেক সুযোগ পাবেন।
পরবর্তী পর্যায়ে জনাব ভুট্টোর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বয়কটের সিদ্ধান্ত সবাইকে বিস্মিত ও হতবাক করে। তার এ সিদ্ধান্ত এ জন্যই সবাইকে আরো বেশি বিস্মিত করে যে শেখ মুজিবের দাবি মোতাবেক ১৫ ফেব্রুয়ারি জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বান না করে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ভুট্টোর কথামতই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন ডেকেছিলেন। পরিষদ বয়কটের সিদ্ধান্ত ঘোষণার পর ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য সমস্ত দলের সদস্যদের বিরুদ্ধে ভীতি প্রদর্শনের অভিযান শুরু করেন। এ অভিযানের উদ্দেশ্য ছিল তাদেরকে পরিষদের অধিবেশনে যোগদান থেকে বিরত রাখা। এ কাজে ভুট্টোর হাতকে শক্তিশালী করার জন্য জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের চেয়ারম্যানও ইয়াহিয়া ঘনিষ্ঠ সহচর লে. জেনারেল ওমর ব্যক্তিগতভাবে পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের সঙ্গে দেখা দিতে থাকেন। জনাব ভুট্টো ও লে. জেনারেল ওমরের চাপ সত্ত্বেও পি.পি.পি ও কাইয়ুম লীগের সদস্যগণ ব্যতীত অপরাপর দলের সমস্ত সদস্যই ৩রা মার্চ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের জন্য বিমানে পূর্ব বাংলায় গমনের টিকিট বুক করেন। এমন কি কাইয়ুম লীগের অর্ধেক সংখ্যক সদস্য তাদের আসন বুক করেন। এমনও আশ্বাস পাওয়া যাচ্ছিল যে পি.পি.পির বহু সদস্য দলীয় সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে ঢাকায় আসতে পারেন। বাংলাদেশের বিরুদ্ধে এভাবে যুক্তফ্রন্ট গঠন করেও যখন কোনো কূলকিনারা পাওয়া যাচ্ছিল না, তখন ১লা মার্চ অনির্দিষ্টকালের জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতবী ঘোষণা করেন জেনারেল ইয়াহিয়া। তার দোস্ত ভুট্টোকে খুশী করার জন্য শুধু তাই নয়, জেনারেল ইয়াহিয়া পূর্ব বাংলার গভর্নর আহসানকেও বরখাস্ত করলেন। গভর্নর আহসান ইয়াহিয়া প্রশাসনে বুদ্ধিজীবী বলে পরিচিত ছিলেন। বাঙালিদের সংমিশ্রণে কেন্দ্রে যে সভা গঠিত হয়েছিল তাও বাতিল করে সরকারের সমস্ত ক্ষমতা পশ্চিম পাকিস্তানি মিলিটারী জান্তার হাতে তুলে দেওয়া হলো।
এমতাবস্থায় ইয়াহিয়ার সমস্ত কার্যক্রমকে কোনো ক্রমেই ভুট্টোর সাথে চক্রান্তে লিপ্ত হয়ে বাংলাদেশের গণ-রায় বানচাল করার প্রয়াস ছাড়া আর কিছু ভাবা যায় না। জাতীয় পরিষদই ছিল একমাত্র স্থান যেখানে বাংলাদেশ তার বক্তব্য কার্যকর করতে পারতো এবং রাজনৈতিক শক্তি প্রদর্শন করতে পারতো। এটাকে বানচাল করার চেষ্টা চলতে থাকে। চলতে থাকে জাতীয় পরিষদকে সত্যিকার ক্ষমতার উৎস না করে একটা ঠুটো জগন্নাথে’ পরিণত করার।
পৃষ্ঠা-২১৫

জাতীয় পরিষদ অধিবেশন স্থগিতের প্রতিক্রিয়া যা হবে বলে আশংকা হয়েছিল তাই হয়েছে। ইয়াহিয়ার এই স্বৈরাচারী কাজের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের জন্য সারা বাংলাদেশের মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে রাস্তায় নেমে পড়ে। কেননা বাংলাদেশের মানুষ বুঝতে পেরেছিল যে ক্ষমতা হস্তান্তরের কনো ইচ্ছা ইয়াহিয়া খানের নেই এবং তিনি পার্লামেন্টারী রাজনীতির নামে তামাশা করছেন। বাংলাদেশের জনগণ এটা স্পষ্টভাবে বুঝতে পেরেছিলেন যে এক পাকিস্তানের কাঠামোতে বাংলাদেশের ন্যায়সঙ্গত অধিকার আদায়ের কোনো সম্ভাবনা নেই। ইয়াহিয়া নিজেই আহ্বান করে আবার নিজেই যেভাবে জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দিলেন তা থেকেই বাঙালি শিক্ষা গ্রহণ করেছে। তাই তারা একবাক্যে পূর্ণ স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর চাপ দিতে থাকেন।
শেখ মুজিব এতদ্সত্ত্বেও সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য চেষ্টা করতে থাকেন। ৩রা মার্চ অসহযোগ কর্মসূচির আহ্বান জানাতে গিয়ে তিনি দখলদার বাহিনীকে মোকাবেলার জন্য শান্তি অস্ত্রই বেছে নিয়েছিলেন। তখনো তিনি আশা করেছিলেন যে সামরিক চক্র তাদের জ্ঞান বুদ্ধি ফিরে পাবে। গত ২রা ও ৩রা মার্চ ঠাণ্ডা মাথায় সামরিক চক্র কর্তৃক হাজার হাজার নিরস্ত্র নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করার মুখে বঙ্গবন্ধুর অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
শেখ সাহেবের অসহযোগ আন্দোলন আজ ইতিহাসের অন্তর্গত। অসহযোগ আন্দোলনের ক্ষেত্রে তিনি সৃষ্টি করলেন এক নতুন ইতিহাস। বাংলাদেশে ১লা মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত অসহযোগ আন্দোলন যেভাবে এগিয়ে গেছে মুক্তি। আন্দোলনের ইতিহাসে তার নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না। এত কার্যকরী অসহযোগ আন্দোলন কোথাও সাফল্য লাভ করেনি। পূর্ণ অসহযোগ আন্দোলন চলেছে দেশের সর্বত্র। নতুন গভর্নর লে. জেনারেল টিক্কা খানের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য পাওয়া গেলো না হাইকোর্টের কোনো বিচারপতি। পুলিশ এবং পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসসহ গণপ্রশাসন বিভাগের কর্মচারিগণ কাজে যোগ দিতে অস্বীকার করেন। জনগণ সেনাবাহিনীর সরবরাহ বন্ধ করে দিলো। এমনকি সামরিক দপ্তরের অসামরিক কর্মচারিগণ তাদের অফিস বয়কট করলেন। কেবল কাজে যোগদান থেকে বিরত থেকেই তারা ক্ষান্ত হলেন না। অসামরিক প্রশাসন ও পুলিশ বিভাগের লোকের সক্রিয় সমর্থন ও নিজেদের আনুগত্য প্রকাশ করলেন। শেখ সাহেবের প্রতি। তাঁরা স্পষ্ট ঘোষণা করলেন যে আওয়ামী লীগ প্রশাসনের নির্দেশ ছাড়া তারা অন্য কারো নির্দেশ মেনে চলবেন না।
পৃষ্ঠা-২১৬

এ অবস্থায় মুখোমুখি হয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমতাসীন না হয়েও অসহজোগের মধ্যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থার দায়িত্ব স্বহস্তে গ্রহণে আওয়ামী লীগ বাধ্য হলো। এ ব্যাপারে শুধু আপামর জনগণই নয়, বাংলাদেশের প্রশাসনও ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের দ্বার্থহীন সমর্থন লাভ তারা করেছিলেন। তারা আওয়ামী লীগের নির্দেশাবলি সর্বান্তকরণে মাথা পেতে নিলেন এবং সমস্যাবলির সমাধানে আওয়ামী লীগকে একমাত্র কর্তৃপক্ষ বলে গ্রহণ করলেন। অসহযোগ আন্দোলনের ফলে বাংলাদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ফাটল ধরলে দেখা দেয় নানাবিধ দুরুহ সমস্যা। কিন্তু এসব সমস্যাবলির মধ্যেও বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে দেশের অর্থনৈতিক ও প্রশাসনিক দপ্তরের কাজ যথারীতি এগিয়ে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের কোনো আইনানুগ কর্তৃপক্ষ না থাকা সত্ত্বেও পুলিশের সহযোগিতায় আওয়ামী লীগ স্বেচ্ছাসেবকগণ আইন শৃংখলা রক্ষার যে আদর্শ স্থাপন করেছিলেন, তা স্বাভাবিক সময়েও অন্যদের অনুকরণীয় হওয়া উচিত। আওয়ামী লীগও ঐতিহাসিক অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি জনগণের সর্বাধিক সমর্থন দৃষ্টে জেনারেল ইয়াহিয়া তার কৌশল পাল্টালেন। ৬ মার্চ একটা কনফ্রন্টেশনের জন্য উত্তেজনা সৃষ্টিতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ বলে মনে হলো। কেননা তার ঐদিনের প্ররোচনামূলক বেতার বক্তৃতায় সংকটের সম্পূর্ণ দায়িত্ব চাপাইলেন আওয়ামী লীগের উপর। অথচ যিনি ছিলেন সংকটের স্থপতি সেই ভুট্টো সম্পর্কে তিনি একটি কথাও বললেন না। মনে হয় তিনি ধারণা করেছিলেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। অনুরূপ উদ্যোগ গ্রহণ করা হলে তা নির্মূল করার জন্য ঢাকায় সেনাবাহিনীকে করা হয় পূর্ণ সতর্কীকরণ। লে. জেনারেল টিক্কা খানের তাই রদবদল থেকে প্রমাণ পাওয়া যায় সামরিক জান্তার ঘৃণ্য মনোভাবের পরিচয়।
কিন্তু ইতিমধ্যে মুক্তিপাগল মানুষ স্বাধীনতা লাভের জন্য পাগল হয়ে ওঠে। এ সত্ত্বেও শেখ মুজিব রাজনৈতিক সমাধানের পথে অটল থাকেন। জাতীয় পরিষদে যোগদানের ব্যাপারে তিনি যে ৪ দফা প্রস্তাব পেশ করেন তাতে যেমন একদিকে প্রতিফলিত হয়েছে জনগণের ইচ্ছা, অপরদিকে শান্তিপূর্ণ সমাধানে পৌছানোর জন্য ইয়াহিয়াকে দেওয়া হয় তার শেষ সুযোগ।
বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এটি অবশ্যই সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, শান্তিপূর্ণ উপায়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট নিরসনের বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ইয়াহিয়া এবং তার জেনারেলদের ছিল না। তাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল। বাংলাদেশে সামরিক শক্তিকে জোরদার করার জন্য কালক্ষেপণ করা। ইয়াহিয়ার ঢাকা সফর ছিল আসলে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ
পৃষ্ঠা-২১৭

করা। এটা আজ পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে যে অনুরূপ একটি সংকট সৃষ্টির পরিকলন বেশ আগেভাগেই নেওয়া হয়েছিল।
১ মার্চের ঘটনার সামান্য কিছু আগে রংপুর থেকে সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োজিত ট্যাংকারগুলো ফেরত আনা হয়। ১ মার্চ থেকে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পশ্চিম পাকিস্তানি কোটিপতি ব্যবসায়ী পরিবারসমূহের সাথে সেনাবাহিনীর লোকদের পরিবার পরিজনদেরকেও পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হতে থাকে।
১ মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের সামরিক শক্তি গড়ে তোলার কাজ ত্বরান্বিত করা হয় এবং তা ২৫ মার্চ পর্যন্ত অব্যাহত গতিতে চলে। সিংহলের পথে পি, আই-এর কমার্শিয়াল ফ্লাইটে সাদা পোশাকে সশস্ত্র বাহিনীর লোকদের বাংলাদেশ আনা হলো। সি-১৩০ পরিবহন বিমানগুলোর সাহায্যে অস্ত্র এবং রশদ এনে বাংলাদেশে স্থাপিকৃত করা হয়।
হিসাব নিয়ে জানা গিয়েছে ১ মার্চ থেকে ২৫ মার্চের মধ্যে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামসহ অতিরিক্ত এক ডিভিশন সৈন্য বাংলাদেশে আমদানি করা হয়। ব্যাপারটা নিরাপদ করার জন্য ঢাকা বিমানবন্দরকে বিমান বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। সমগ্র বিমান বন্দর এলাকায় আর্টিলারী ও মেশিনগানের জাল বিস্তার করা হয়। যাত্রীদের আগমন নির্গমণের ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ ও হত্যাকাণ্ড সংগঠনে ট্রেনিং প্রাপ্ত এস এম জি কমান্ডো গ্রুপ বাংলাদেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্রে ছেড়ে দেওয়া হয়। ২৫ মার্চের পূর্ববর্তী দুই দিনে ঢাকা ও সৈয়দপুরে যে সব কুকাণ্ড ঘটে এরাই সেগুলো সংগঠন করেছিল। সামরিক হস্তক্ষেপের অজুহাত সৃষ্টির উদ্দেশ্যে স্থানীয় ও অস্থানীয়দের মধ্যে সংঘর্ষ সৃষ্টির মাধ্যমে একটা উত্তেজনার পরিবেশ খাড়া করাই ছিল এসবের উদ্দেশ্য।
প্রতারণা ও ভণ্ডামির এই স্টাটেজি গোপন করার অংশ হিসেবেই ইয়াহিয়া শেখ মুজিবের সাথে তার আলোচানয় আপোষমূলক মনোভাব গ্রহণ করেছিলেন। ১৬ মার্চ আলোচনা শুরু হলো ইয়াহিয়া তৎপূর্বে যা ঘটেছে তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেন এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানের জন্য আন্তরিক আগ্রহ প্রকাশ করেন। শেখ মুজিবের সাথে আলোচনা এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে ইয়াহিয়ার কাছে জানতে চাওয়া হয়েছিল আওয়ামী লীগের ক্ষমতা হস্তান্তরের ৪ দফা শর্তের প্রতি সামরিক জান্তার মনোভাব কি? জবাবে ইয়াহিয়া জানান যে, এ ব্যাপারে তাদের তেমন কোনো আপত্তি নেই। তিনি আশা করেন যে ৪ দফা শর্ত পূরণ ভিত্তিতে উভয়পক্ষের উপদেষ্টাগণ একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণয়নে সক্ষম হবেন। আললাচনাকালে যে সব মৌলিক প্রশ্নে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয় সেগুলো হলো :
পৃষ্ঠা-২১৮

১. মার্শাল ল বা সামরিক আইন প্রত্যাহার করে প্রেসিডেন্টের একটি ঘোষণার মাধ্যমে একটা বেসামরিক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
২. প্রদেশগুলোতে সংখ্যাগরিষ্ঠ দলসমূহের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর।
৩. ইয়াহিয়া প্রেসিডেন্ট থাকবেন এবং কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করবেন।
৪. জাতীয় পরিষদের পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানি সদস্যগণ পৃথক পৃথকভাবে বৈঠকে মিলিত হবেন।
আজ ইয়াহিয়া ও ভুট্টো জাতীয় পরিষদের পৃথক পৃথক অধিবেশনের প্রস্তাবের বিকৃত ব্যাখ্যা দিচ্ছেন। অথচ ইয়াহিয়া নিজেই ভুট্টোর মনোরঞ্জনের জন্য এ প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এ প্রস্তাবের সুবিধা ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সেদিন নিজেই বলেছিলেন যে, ৬-দফা হলো বাংলাদেশের এবং কেন্দ্রের মধ্যকার সম্পর্ক নির্ণয়ের এক নির্ভরযোগ্য নীল নকশা। পক্ষান্তরে এটার প্রয়োগ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য সৃষ্টি করতে নানারূপ অসুবিধা। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানি এম, এন, এ-দের পৃথকভাবে বসে ৬-দফার ভিত্তিতে রচিত শাসনতন্ত্র এবং এক ইউনিট ব্যবস্থা বিলোপের আলোকে একটা নতুন ধরনের ব্যবস্থা গড়ে তোলার সুযোগ অবশ্যই দিতে হবে।
শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়ার মধ্যকার এ নীতিগত মতৈক্যের পর একটি মাত্র প্রশ্ন থেকে যায় তা হলো অন্তর্বর্তী পর্যায়ে কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বন্টন। এ ক্ষেত্রেও উভয় পক্ষই এই মর্মে একমত হয়েছিলেন যে, ৬-দফার ভিত্তিতে অদূর ভবিষ্যতে যে শাসনতন্ত্র রচিত হতে যাচ্ছে মোটামুটি তার আলোকেই কেন্দ্র ও বাংলাদেশের মধ্যে ক্ষমতা বণ্টন হবে।
অন্তর্বর্তীকালীন মীমাংসার এই সম্পর্কে একটা পরিকল্পনা তৈরির উদ্দেশ্যে প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এম. এম, আহমদকে বিমানে করে ঢাকা আনা হয়। আওয়ামী লীগ উপদেষ্টার সাথে আলাপ আলোচনায় তিনি স্পষ্টভাবে এ কথা বলেন যে রাজনৈতিক মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ৬-দফা কার্যকরী করার প্রশ্নে দুর্লজ্জ সমস্যা দেখা দেবে না। এমনকি অন্তর্বর্তী পর্যায়েও না।
আওয়ামী লীগের খসড়ার ওপর তিনি যে তিনটি সংশোধনী পেশ করেছিলেন। তাতে একথাই প্রমাণিত হয়েছিল যে সরকার এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে যখন যে ব্যবধানটুকু ছিল তা নীতিগত নয়, বরং কোথায় কোনো শব্দ বসবে তাই নিয়ে। ২৪ মার্চের বৈঠকে ভাষায় সামান্য রদবদলসহ সংশোধনীগুলি আওয়ামী লীগ গ্রহণ করে। অতঃপর অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র চূড়ান্ত করণের উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া ও মুজিবের উপদেষ্টাদের শেষ দফা বৈঠকে মিলিত হওয়ার পথে আর কোনো বাধাই ছিল না।
পৃষ্ঠা-২১৯

এ প্রসঙ্গে একটা জিনিস পরিষ্কার করে বলতে হয় , কোনো পর্যায়েই আলোচনা অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়নি। অথচ ইয়াহিয়া বা তাঁর উপদেষ্টারা আভাস-ইঙ্গিতেও এমন কোনো কথা বলেননি যে তাদের এমন একটা বক্তব্য আছে যা থেকে তারা নড়চড় করতে পারেন না।
গণহত্যাকে ধামাচাপা দেওয়া জন্য ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তরে আইনগত ছত্রছায়ার প্রশ্নেও আজ জোচ্চুরির আশ্রয় নিয়েছেন। আলোচনায় তিনি এবং তাঁর দলবল একমত হয়েছিলেন যে ১৯৪৭ সালে ভারতীয় স্বাধীনতা আইনের মাধ্যমে যেভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করা হয়েছিল তিনিও সেভাবে একটা ঘোষনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন। ক্ষমতা হস্তান্তরের আইনগত ছত্রছায়ার ব্যাপারে ভুট্টো পরবর্তীকালে যে ফ্যাকরা তুলেছেন ইয়াহিয়া তাই অনুমোদন করেছেন। আশ্চর্যের ব্যাপার, ইয়াহিয়া ঘূণাক্ষরেও মুজিবকে এ সম্পর্কে কিছু জানাননি। ক্ষমতা হস্তান্তরের জন্য জাতীয় পরিষদের একটা অধিবেশন বসা দরকার ইয়াহিয়া যদি আভাস-ইঙ্গিতেও এ কথা বলতেন তা হলে আওয়ামী লীগ নিশ্চয়ই তাতে আপত্তি করতো না। কেননা এমন একটা সামান্য ব্যাপারকে উপেক্ষা করে আলোচনা বানচাল করতে দেওয়া যায় না। তাছাড়া জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু দল হিসেবে আওয়ামী লীগের ভয় করার কিছুই ছিল না। দেশের দুই অংশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের পৃথক পৃথক বৈঠকের যে প্রস্তাবে আওয়ামী লীগ সম্মতি দিয়েছিল, তা শুধু ভুট্টোকে খুশী করার জন্য করা হয়েছিল। এটা কোনো সময়েই আওয়ামী লীগের মৌলিক নীতি ছিল না।
২৪ মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম, এম, আহমদ তার সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোনো চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং জনাব এম, এম, আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ মার্চ করাচি চলে যান।
২৫ মার্চ রাত ১১ টা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী। শহরে পজিশন গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নাগাদ ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগণের ওপর পরিচালনা করা হলো গণত্যার এক পর্ব নির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরুপ ‘ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাস কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোনো চরমপত্র। অথবা মেশিনগাল আটিলারী সুসজ্জিত ট্যাংকসমূহ যখন মানুষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লো ও ধ্বংসলীলা শুরু করে দিলো তার আগে জারী করা হয়নি কোনো কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লে. জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ
পৃষ্ঠা-২২০
জারী করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার লোক তার আগেই প্রাণ হারিয়েছেন বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশই ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরককুণ্ডে, প্রতিটি অলিগলি ও আনাচে-কানাচে চলতে লাগলো নির্বিচারে গুলি। সামরিক বাহিনীর লোকদের নির্বিচারে অগ্নিসংযোগের মুখে অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যেসব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করলো তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো মেশিনগানের গুলিতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখেও পুলিশ ও ই.পি.আর, বীরের মটো লড়ে গেলো। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোনো প্রতিরোধ দিতে পারল না। তারা মারা গেল হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ করব। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যে সব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা তার সব কিছুকে ম্লান করে দিয়েছে।
পাকিস্তান সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে ২৫ মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেননা তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন পরদিন রাত ৮টার সময় বিশ্ববাসীকে জানানো হলো এর কৈফিয়ত। এ বিবৃতিতে তিনি ধ্বংসযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পর বিড়োধি এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা চালাচ্ছিলেন, সে দলের লোকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ আলোচনায় কোনো সংগতি খুঁজে পেলো না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদে সংখাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেঈমান ঘোষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির অবাধ মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না ।তার বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রতিভাত হলো যে ইয়াহিয়া আর যক্তি বা নৈতিকতার ছত্রছায়ায় আশ্রয় চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মল করার জন্য জঙ্গি আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর।
পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার করব রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার
পৃষ্ঠা-২২১

লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের ওপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা কোনো মতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূলে ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপর ওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লংঘন করেছে তাতে সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারী পশুর মতো। তারা চালিয়ে হত্যাযজ্ঞ, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচারে ধ্বংসলীলা বিশ্বসভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এ সব কার্যকলাপ থেকে এ কথরই আভাস মেলে যে ইয়াহিয়া খান তাঁর সাঙ্গপাঙ্গদের মনে দুই পাকিস্তানের প্রায় দৃঢ়ভাবে প্রথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের উপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারতো না। ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণত আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়। তার এ কাজ পাকিস্তানের বিয়োগান্ত এই মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়, যা ইয়াহিয়া রচনা করেছেন। বাঙালির রক্ত দিয়ে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হওয়া বা নিমূল হওয়ার আগে তারা গণহত্যা ও পোড়ামাটি নীতির মাধ্যমে বাঙালি জাতিকে শেষ করে দিতে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হলো আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবীমহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলোকে ধূলিস্মাৎ করা, যাতে একটি জাতি হিসেবে কোনোদিনই আমরা মাথা তুলে দাঁড়াতে না পারি।
ইতিমধ্যে এ লক্ষ্য পথে সেনাবাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শোষণ করেছে, তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পাকিস্তান থেকে ৫০ বছর পিছিয়ে পড়ল।
আসউজিরে পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা ঘটেনি। অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যাপারে উটপাখির নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে এতদ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করেছেন, তাহলে তারা ভুল করেছেন। কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান নিজেও মোহমুক্ত। তাদের বোঝা উচিত যে পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালি অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালি সন্তান রক্ত দিয়ে এই নতুন রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন। দুনিয়ার কোনো জাতি এ নতুন শক্তিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক
পৃষ্ঠা-২২২

কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকে গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্রপুঞ্জে।
সুতরাং রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিত ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমরা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো। গণচীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেট ব্রিটেন ও অন্যান্য দেশের কাছ থেকেও আমরা অনুরূপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাবো। প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা। এবং তারা যদি তা করেন তাহলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট ভষ্ম ধ্বংসস্তুপের ওপর একটা নতুন দেশ গড়ে তোলা। এ একটা দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতিসমূহের অন্যতম। এছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্য মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামের লিপ্ত হয়েছে। তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে। সুতরাং তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারি না। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জ্বল করতেই হবে।
আমার বিশ্বাস, যে জাতি প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না। এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোনো বাধা-বিপত্তি টিকতে পারে না।
আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোনো শক্তি, ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না—আমরা আশা করি শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসংকোচে আমাদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসবেন কারো তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এতো রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছে না।
আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং বৈষয়িক ও নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যাপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহস্র মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের ফুল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কাল বিলম্ব করবেন না। এই মুহূর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।
পৃষ্ঠা-২২৩

বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম, বিশ্বের আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকতির বেশি দাবিদার হতে পারে না। কেননা, আর কোনো জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি। অধিকতর ত্যাগ স্বীকার করেনি।”
১৮ এপ্রিল মন্ত্রী পরিষদের জরুরি অধিবেশন বসে। এতে বাংলাদেশ থেকে লাগত তরুণদের প্রশিক্ষণ দেওয়ার মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি নেওয়ার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় এবং প্রথম সরকারি নির্দেশ জারী করা হয়। এসব নির্দেশাবলি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছিল।
নির্দেশাবলি
“স্বাধীন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি সন্তান আজ চূড়ান্ত সংগ্রামে নিয়োজিত। এ সংগ্রামের সফলতার ওপর নির্ভর করছে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আপনার, আমার সন্তানদের ভবিষ্যৎ। আমাদের সংগ্রামে জয়লাভ করতেই হবে এবং আমরা যে জয়লাভ করবো তা অবধারিত।
মনে রাখবেন আমরা এ যুদ্ধ চাইনি। বাঙালির মহান নায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান চেয়েছিলেন গণতান্ত্রিক উপায়ে বিরোধের মীমাংসা করতে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতি, শোষক শ্রেণি ও রক্তপিপাসু শক্তির মুখপাত্র ইয়াহিয়া হামিদ টিক্কা সে পথে না বাড়িয়ে বাঙালির পাট বেচা টাকায় গড়ে তোলা সেনাবাহিনী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে আমাদের ওপর সর্বশক্তি নিয়ে। তারা নির্বিচারে খুন করেছে আমাদের সন্তানদের, মা বাপদের, ইজ্জত নষ্ট করেছে মা-বোনদের, আর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে শহরের পর শহর, গ্রামের পর গ্রাম। তাই আমরা আজ পাল্টা হামলায় নিয়োজিত হয়েছি। গঠন হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। সরকারের প্রধানতম লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে শত্রু কবল হতে মুক্ত করা। বাংলাদেশের এই মুক্তি সংগ্রামে ধর্ম, মত, শ্রেণি বা দল নেই। বাংলার মাটি, পানি ও আলো বাতাসে লালিত-পালিত প্রতিটি মানুষের একমাত্র পরিচয় আমরা বাঙালি। আমাদের শত্রুপক্ষ আমাদের সেই ভাবেই গ্রহণ করেছে। তাই তারা যখন কোথাও গুলি চালায়, শহর পোড়ায় বা গ্রাম ধ্বংস করে, তখন তারা আমাদের ধর্ম দেখে না, মতাদর্শ দেখে না, বাঙালি হিসেবেই আমাদেরকে মারে।
স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার সকল রকমের অত্যাচার, অবিচার, অন্যায় ও শোষণের অবসান ঘটিয়ে এক সুখী সমৃদ্ধ, সুন্দর সমাজতান্ত্রিক ও শোষণহীন সমাজ কায়েমে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই জাতির এই মহাসংকট মুহূর্তে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হিসাবে আপনাদের প্রতি আমার আবেদন
পৃষ্ঠা-২২৪

১.কোনো বাঙালি কর্মচারি শত্রুপক্ষের সাথে সহজোগিতা করবেন না। ছোট বড় প্রতিটি কর্মচারি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ মোতাবেক কাজ করবেন। শত্রু কবলিত এলাকায় তারা জনপ্রতিনিধিদের এবং অবস্থা বিশেষে নিজেদের বিচার-বুদ্ধি খাটিয়ে কাজ করবেন।
২. সরকারি, আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহের যে সমস্ত কর্মচারি অন্যত্র গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁরা স্ব-স্ব পদে বহাল থাকবেন এবং নিজ ক্ষমতা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকার ও মুক্তিবাহিনীকে সাহায্য করবেন।
৩. সকল সামরিক, আধাসামরিক লোক কর্মরত বা অবসরপ্রাপ্ত অবিলম্বে নিকটতম মুক্তিসেনা শিবিরে যোগ দেবেন। কোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে পড়বেন না বা শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না।
৪. স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারো বাংলাদেশ থেকে খাজনা, ট্যাক্স, শুল্ক আদায়ের অধিকার নেই। মনে রাখবেন, আপনার কাছ থেকে শত্রুপক্ষের এভাবে সংগৃহীত প্রতিটি পয়সা আপনাকে ও আপনার সন্তানদের হত্যা করার কাজে ব্যবহার করা হবে। তাই যে কেউ শত্রুপক্ষকে খাজনা, ট্যাক্স দেবে অথবা এ ব্যাপারে সাহায্য করবে বাংলাদেশ সরকারও মুক্তি বাহিনী তাদেরকে জাতীয় দুশমন বলে চিহ্নিত করবে এবং তাদের দেশদ্রোহের দায়ে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।
৫. যোগাযোগ ব্যবস্থা, বিশেষ করে নৌ-চলাচল সংস্থার কর্মচারিরা কোনো অবস্থাতেই শত্রুর সাথে সহযোগিতা করবেন না। সুযোগ পাওয়া মাত্র তারা যানবাহনাদি নিয়ে শত্রু কবলিত এলাকার বাইরে চলে যাবেন।
৬. নিজ নিজ এলাকার খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির চাহিদার প্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে। আর এ চাহিদা মিটানোর জন্য খাদ্যশস্য উৎপাদন বুদ্ধির ব্যাপারে জনগণকে উৎসাহিত করতে হবে। মনে রাখবেন, বর্তমান অবস্থায় বিদেশি খাদ্যদ্রব্য ও জিনিসপত্রের ওপর নির্ভর করলে তা আমাদের জন্য আত্মহত্যার শামিল হবে। নিজেদের ক্ষমতানুযায়ী কৃষি উৎপাদনের চেষ্টা করতে হবে। স্থানীয় কুটির শিল্প, বিশেষ করে তাঁত শিল্পের ওপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে। কালোবাজারী, মুনাফাখখারী, মজুদদারী, চুরি, ডাকাতি বন্ধ করতে এদের প্রতি কঠোর নজর রাখতে হবে। জাতির এ সংকট সময়ে এরা
পৃষ্ঠা-২২৫

আমাদের এক নম্বর দুশমন। প্রয়োজনবোধে এদের কঠোর শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
৮. আর এক শ্রেণির সমাজ বিরোধি ও দুষ্কৃতকারী সম্পর্কেও সদা সচেতন থাকতে হবে। এদের কার্যকলাপ দেশদ্রোহমূলক। একবার এদের খপ্পরে পড়লে আর নিস্তার নেই।
৯. গ্রামে গ্রামে রক্ষী বাহিনী গড়ে তুলতে হবে। মুক্তিবাহিনীর নিকটতম শিক্ষা শিবিরে রক্ষী বাহিনী স্বেচ্ছাসেবকদের পাঠাতে হবে। গ্রামের শান্তি ও শৃংখলা রক্ষা ছাড়াও এরা প্রয়োজনবোধে মুক্তিবাহিনীর সাথে প্রতিরোধ সংগ্রামে অংশগ্রহণ করবে। আমাদের কোনো স্বেচ্ছাসেবক বা কর্মী যাতে কোনো অবস্থাতেই শত্রুর হাতে না পড়ে, সে দিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।
১০. শত্রু পক্ষের গতিবিধির সমস্ত খবরাখবর অবিলম্বে মুক্তি বাহিনীর কেন্দ্রে জানাতে হবে।
১১. স্বাধীন বাংলা মুক্তি বাহিনীর যাতায়াত ও যুদ্ধের জন্য চাওয়ামাত্র সমস্ত যানবাহন (সরকারি বেসরকারি) মুক্তি বাহিনীর হাতে ন্যস্ত করতে হবে।
১২. বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনী অথবা বাংলাদেশ সরকার ছাড়া অন্য কারো।কাছে পেট্রোল, ডিজেল, মবিল ইত্যাদি বিক্রি করা চলবে না।
১৩. কোনো ব্যক্তি পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী অথবা তাদের এজেন্টদের কোনো প্রকারের সুযোগ-সুবিধার সংবাদ সরবরাহ অথবা পথ নির্দেশ করবেন না, যে করবে তাকে আমাদের দুশমন হিসেবে চিহ্নিত করতে হবে এবং প্রয়োজনবোধে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।
১৪. কোনো প্রকার মিথ্যা গুজবে কান দেবেন না বা চূড়ান্ত সাফল্য সম্পর্কে নিরাশ হবেন না। মনে রাখবেন, যুদ্ধে অগ্রাভিযান ও পশ্চাদপসরণ দুটোই সমান গুরুত্বপূর্ণ এক স্থান থেকে মুক্তিবাহিনী সরে গেছে দেখলেই মনে করবেন না যে আমরা সংগ্রামে বিরতি দিয়েছি।
১৫. বাংলাদেশের সকল সুস্থ ও সবল ব্যক্তিকে নিজ নিজ আগ্নেয়াস্ত্রসহ নিকটস্থ মুক্তিবাহিনী শিবিরে রিপোর্ট করতে হবে। এ নির্দেশ সকল আনসার, মুজাহিদ ও প্রাক্তন সৈনিকদের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
১৬. শত্রুবাহিনীর ধরাপড়া সমস্ত সৈন্যকে মুক্তিবাহিনীর কাছে সোপর্দ করতে হবে। কেননা, জিজ্ঞাসাবাদের পর তাদের কাছ থেকে অনেক মূল্যবান তথ্য সংগৃহীত হতে পারে।
পৃষ্ঠা-২২৬
১৭. বর্বর ও খুনী পশ্চিমা সেনাবাহিনীর সকল প্রকার যোগাযোগ ও সরবরাহ ব্যবস্থা যাতে পুনঃ প্রতিষ্ঠিত না হতে পারে তৎপ্রতি লক্ষ্য রাখতে হবে।
নিম্নবর্ণিতভাবে প্রবাসী সরকারের মন্ত্রিসভা গঠিত হয় ?
রাষ্ট্রপতি : বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান
উপ-রাষ্ট্রপতি : সৈয়দ নজরুল ইসলাম
প্রধানমন্ত্রী : তাজউদ্দিন আহমদ
পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী : খন্দকার মোশতাক আহমদ
অর্থমন্ত্রী : মনসুর আলী
স্বরাষ্ট্র, ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রী : এ. এইচ. এম কামরুজ্জামান
প্রধান সেনাপতি : কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী
প্রেস, তথ্য, বেতার ও ফিল্ম এর ভারপ্রাপ্ত : আবদুল মান্নান
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ সীমান্ত অতিক্রমকারী আওয়ামী লীগ সংসদ সদস্যদের গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক দায়িত্ব অর্পণ করেন। আগরতলা, শিলং, তুরাগ, কুচবিহার, গঙ্গারামপুর, কৃষ্ণনগর এবং বারাসতে সংসদ সদস্যদেরকে আঞ্চলিক প্রশাসক নিয়োগ করেন। স্থানীয় সেক্টর কমান্ডারদের সঙ্গে যোগাযোগ, যুব শিবির পরিদর্শন, মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, খাদ্য ওষুধপত্র সরবরাহের তদারকি করার দায়িত্ব দেওয়া হয়। জনগণের মনোবল অবিচল রাখার জন্য ও পাকিস্তানি প্রপাগাণ্ডা থেকে সৃষ্ট বিভ্রান্তি থেকে মুক্ত রাখার জন্য প্রবাসী সরকার কর্তৃক প্রচারিত পুস্তিকা ও পোস্টার বিতরণের দায়িত্ব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং ভারতের বিভিন্ন স্থানে, নেপাল ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া এবং মধ্যপ্রাচ্যে সংসদ সদস্যদের সমন্বয়ে প্রতিনিধি দল প্রেরণ করেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলাই ছিল এর উদ্দেশ্য।
মুজিব নগর প্রশাসনকে কয়েকটি জোনে ভাগ করা হয়েছিল। যারা এসব জোনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেছেন, তাঁরা ছিলেন :
১. সাউথ ইস্ট জোন : (১) অধ্যাপক নূরুল ইসলাম চৌধুরী এম.এন.এ.
২. (২) জহুর আহমদ চৌধুরী এম. এন. এ.
৩. নর্থ ইস্ট জোন : (১) দেওয়ান ফরিদ গাজী, এম. এন. এ.
৪. (২) শামসুর রহমান খান
৫. ইস্ট জোন : লেফটেন্যান্ট কর্নেল এম.এ. রব, এম.এন.এ.
৬. নর্থ জোন : মতিউর রহমান
৭. ওয়েস্ট জোন : (১) আজিজুর রহমান
পৃষ্ঠা-২২৭

৮. ঐ (২) আশরাফুল ইসলাম, এম. এন. এ.
৯. সাউথ ওয়েস্ট জোনঃ (১) এম. এ. রউফ চৌধুরী, এম. এন এ
১০. ঐ (২) শ্রী ফণিভূষণ মজুমদার, এম. এন. এ
সাহায্য ও পুনর্বাসন, যুব শিবির, বিদেশের জন্য মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত প্রকাশনা প্রভৃতি বিভাগ একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে সহায়ক শক্তি হিসেবে কায করেছে । অধ্যাপক ইউসুফ আলী (এম. এন. এ) কিছুকাল বাংলাদেশের মুক্ত এলাকাযর পূর্বাঞ্চলে প্রশাসনিক দায়িত্ব পালন করেন। তার সঙ্গে ছিলেন সামসুজ্জোহা (এম, এন, এ) ও জহুর আহমদ চৌধুরী প্রমুখ। এছাড়া মুজিব নগরে গঠিত বাংলাদেষ সাংবাদিক সমিতি, বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবী সমিতি, বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী – কুশলী সমিতি, ভলান্টিয়ার্স কোর প্রভৃতি বেসরকারি সংগঠনও মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজ করেছে। ভলান্টিয়ার্স কোরের পরিচালক ছিলেন ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম (এম, এন, এ)। মুক্তিযোদ্ধাদের শুশ্রুষার জন্য স্থাপিত বাংলাদেশ নার্সিং প্রশিক্ষণ কেন্দ্রের আবাসিক পরিচালিকা ছিলেন বেগম সাজেদা চৌধুরী (এম, এন, এ) ও মমতাজ বেগম, বেগম আইভি রহমান, বেগম হোসনে আরা মান্নান, বেগম জাহানারা হক ও বেগম হাসিনা আহমদ প্রমুখ মুক্তি বাহিনী শিবির ও শরণার্থী শিবিরে সাহায্য সামগ্রী বিতরণে বিভিন্নভাবে সহযোগিতা প্রদান করেছেন।
সমগ্র মুজিব নগর প্রশাসন পরিচালিত হয়েছে একটি পূর্ণাংগ সেক্রেটারীয়েটের মাধ্যমে। এই সেক্রেটারিয়েটের প্রধান সচিবের দায়িত্ব পালন করেছেন রুহুল কুদ্দুস। মুজিব নগরে সংগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের সচিবালয় এবং সংশ্লিষ্ট সচিবগণের পূর্ণ বিবরণী নিচে সন্নিবেশিত হলো :
সংস্থাপন সচিব : নুরুল কাদের খান
আভ্যন্তরীণ সচিব : আবদুল খালেক প্রতিরক্ষা সচিব
প্রতিরক্ষা সচিব : আবদুস সামাদ
তথ্য সচিব : আনোয়ারুল হক খান
বৈদেশিক সচিব : মাহবুবুল আলম চাষী
কেবিনেট সচিব : হোসেন তওফিক ইমাম
অর্থ সচিব : খন্দকার আসাদুজ্জামান
প্রধামন্ত্রীর মুখ্য সচিব : রুহুল কুদ্দুস
পরিকল্পনা কমিশনের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন ডক্টর মুজাফফর আহমদ চৌধুরী। রিলিফ কমিশনার : শ্রী জে. জি. ভৌমিক এবং ইয়ুথ ক্যাম্প-এর পরিচালক ছিলেন উইং কমান্ডার মির্জা ।
পৃষ্ঠা-২২৮
মওলানা ভাসানী ২৪ মার্চ রাতে সন্তোষ ত্যাগ করেন এবং সিরাজগঞ্জে চলে যান। ২৫ মার্চ গণহত্যা শুরু হলে সাইফুল ইসলামকে সঙ্গে করে একটি বড় বজরা নৌকায় চড়ে যমুনা নদী পথে আসামে ধুবড়ি সীমান্তে উপস্থিত হন। ভারত বিভাগের আগে মওলানা ভাসানী দীর্ঘকাল আসামে ছিলেন এবং আসাম মুসলিম লীগের সভাপতি ছিলেন। তাজউদ্দিন আহমদের অনুরোধে মওলানা ভাসানী কলকাতা যান। এ সময় বাঙালি শরণার্থীদের ছদ্মবেশে অনেক পাকিস্তানি গুপ্তচর ভারতে অনুপ্রবেশ করে। ভারতীয় সরকার বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের মন্ত্রীদের নিরাপত্তা বিধান ছাড়াও মওলানা ভাসানীর জন্য বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করে। মওলানা ভাসানী কলকাতার হাজরা রোডের একটি বাড়িতে থাকতেন। পরে তিনি দেরাদুনে চলে যান এবং সেখানেও তার জন্য সুদৃঢ় নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনের পর মওলানা ভাসানী পুনরায় আসামে যান এবং ভাসানীর চরে তার মুরিদদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। মওলানা ভাসানী এই সময় অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং বিশ্রামের জন্য আসাম থেকে দেরাদুনে শৈত্যাবাশে যান। ৬/৭ সপ্তাহ তিনি দেরাদুনে অবস্থান করেন। এসময় তিনি চীনের চেয়ারম্যান মাও সেতুং এর কাছে একটি তারবার্তা পাঠান। এই তারবার্তায় মওলানা ভাসানী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করার জন্য চেয়ারম্যান মাওকে অনুরোধ করেন।
১৯৭১ এর সেপ্টেম্বর মাসে মওলানা ভাসানী সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির বৈঠকে যোগদানের উদ্দেশ্যে কলকাতা আসেন। বৈঠক শেষে তিনি আবার দেরাদুনে ফিরে যান। দেরাদুনে তার শারীরিক অবস্থার অবনতি ঘটলে মওলানা ভাসানী তাজউদ্দিন ও মোজাফফর আহমদকে টেলিগ্রাম করেন। মওলানা ভাসানীর সুচিকিৎসার ব্যবস্থা করার জন্য ভারত সরকারকে অনুরোধ করা হয়।
পৃষ্ঠা-২২৯
সপ্তম অধ্যায় অভ্যন্তরীণ
কোন্দল ও আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া
বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনের ফলে পাকিস্তান সরকার ও তাদের সমর্থক বিদেশি শক্তিগুলো বেকায়দায় পড়ে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, গণচীন, সৌদি আরবসত মধ্য প্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলো প্রকাশ্যেই পাকিস্তানকে সমর্থন করে যাচ্ছিল। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে জামাতে ইসলামি, মুসলিম লীগ ও অন্যান্য ইসলাম পন্থী দলগুলো পাকিস্তানি দখলদার বাহিনীর গণহত্যাকে শুধু সমর্থনই করলো না, পরবর্তীকালে রাজাকার বাহিনী, আলবদর, আলশামস বাহিনী গঠন করে। পাকিস্তানির সহযোগী শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলো এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, স্বাধীনতার বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হলো। দেশের বাইরে বৃহৎশক্তির বৈরীতা ও পাকবাহিনীকে সহায়তাদান, দেশের অভ্যন্তরে রাজাকার বাহিনী গঠনের পাশাপাশি মুজিব নগর প্রবাসী সরকারের ভেতরেও অন্তর্দ্বন্দ্বমূলক কলহ শুরু হলো।
তাজউদ্দিন নিজেকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে পরিচয় দিয়ে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর প্রতিশ্রুতি আদায় করে নেওয়ার ফলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে প্রবল গতি সঞ্চারিত হয় এবং মুক্তিসংগ্রাম এক নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করে। কিন্তু আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরে এর ফলে দলীয় কোন্দল বেড়ে যায়। দিল্লি থেকে কোলকাতা ফিরে ৮ এপ্রিল ভবানীপুরের একটি বাড়িতে উপস্থিত আওয়ালী লীগ ও যুব। নেতাদের কাছে তার দিল্লি সফর ও ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সফল আলোচনার কথা সবিস্তারে বলেন। শেখ ফজলুল হক মনি তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রীত্ব গ্রহণের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিরোধিতা করেন। এবং প্রবাসী সরকার গঠন সংক্রান্ত তাজউদ্দিনের বেতার ভাষণ প্রচার বন্ধ করার জন্য ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, অসহযোগ আন্দোলন চলাকালে ৯ মার্চ শেখ মুজিব তার এক সময়ের বান্ধব ভারতীয় বিধান সভার সদস্য শ্রী সমরগুহকে ভারতীয় সাহায্যের ব্যাপারে শ্রীমতি গান্ধীকে প্রভাবিত করার জন্য একটি পত্র লিখেন এবং
পৃষ্ঠা-২৩০
এই পত্রটি পৌছে দেওয়ার জন্য শেখ মনিকে নিযুক্ত করেন। (শ্রদ্ধেয় গাজীউল হক আমাদের জানিয়েছেন, লাল কালিতে শেখ মুজিবের স্বহস্তে লেখা এই পত্র তিনি স্বচক্ষে দেখেছেন)। অজ্ঞাত কারণে শেখ মনি এই পত্র সমর গুপ্তের কাছে না পাঠিয়ে নিজের কাছেই রেখে দেন এবং পরে ইন্দিরা গান্ধীকে এই পত্র হস্তান্তর করেন এবং এই পত্রের জোরেই শেখ মনি দাবি করেন, তিনিই শেখ মুজিবের উত্তরাধিকারী এবং শেখ মুজিবের অনুপস্থিতিতে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একচ্ছত্র ক্ষমতা শেখ মুজিব তাকে দিয়েছেন। সম্ভবত এই কারণে শেখ মনি তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে মন্ত্রিসভা গঠনে প্রবল বিরোধিতা করেন।
তাজউদ্দিন আহমদ এর প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার গঠন এবং মন্ত্রী পরিষদের পরবর্তী সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ থেকে আগত যুবনেতাগণ সন্তুষ্ট হতে পারলেন না। শেখ ফজলুল হক মনি, সিরাজুল আলম খান, আব্দুর রাজ্জাক, তোফায়েল আহমদ, আসম আব্দুর রব, শাহজাহান সিরাজ, নুরে আলম সিদ্দিকী এবং আব্দুর কুদুস মাখন কলকাতায় একত্রিত হয়ে তাজউদ্দিন আহমদের সরকারকে উৎখাত করার জন্য সচেষ্ট হন। এই যুব নেতাদের সহায়তা করেছেন। খন্দকার মোশতাক আহমদ, আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আব্দুল আজিজ ও অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ। এ সম্পর্কে বদরুদ্দিন আহমদ তার স্বাধীনতা সংগ্রামের নেপথ্যে কাহিনী’ গ্রন্থে লিখেছেন (পৃষ্ঠা ১০৭-১১৩) :
“যুবনেতারাসহ অনেকেই সেদিন ভেবেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর জীবীত নেই। ইয়াহিয়া খান এতো দিনে তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকর করে থাকবেন। বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে তাদের কোনো দাবিই তাজউদ্দিন পূরণ করবেন না। অথচ বঙ্গবন্ধু বরাবরই তাদের সংগ্রামী ভূমিকার প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কোনো সিদ্ধান্ত তাদের সঙ্গে পরামর্শ না করে গ্রহণ করতেন না। এমনকি ৭ মার্চের ভাষণে বঙ্গবন্ধু তাদের কথা সংযোজন করেছেন। ইয়াহিয়া ও ভুট্টোর সঙ্গে আলোচনার সময়ও তিনি তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেছেন। বঙ্গবন্ধু যে শুধু যুবনেতাদের গুরুত্ব অনুধাবন করতেন তাই নয়, তিনি তাদের ওপর অনেক ক্ষেত্রেই নির্ভর করতেন। তিনি কাছে থাকলে স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিচালনার ক্ষেত্রে যুবনেতাদের ওপর দায়িত্ব অর্পণ করতেন। কিন্তু তাজউদ্দিনের দুঃসাহসের অন্ত নেই। তিনি যুবনেতাদের সঙ্গে ধমকের শুরে কথা বলেন। তাদের সংগ্রামী ভূমিকার স্বীকৃতি দিতে তিনি নারাজ। স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে যুবনেতাদের মতামত তিনি সম্পূর্ণ উপক্ষো করেছেন। তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বে থাকলে তারা সব রকম সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হবেন। তাজউদ্দিনের ধৃষ্টতার শেষ নেই। তিনি বঙ্গবন্ধুর আত্মীয় আব্দুর রব সেরনিয়াবাতকেও উপেক্ষা করে চলেছেন। বঙ্গবন্ধু নিজে যেকোন জটিল
পৃষ্ঠা-২৩১

ব্যাপারে তাঁর পরামর্শ গ্রহণ করতেন। বঙ্গবন্ধুর আত্মীয়কে উপেক্ষা করা, পরোক্ষভাবে বঙ্গবন্ধুকে উপেক্ষা করা। অতএব যে কোনো মূল্যে তাজউদ্দিনকে অপসারণ করতে হবে।
যুবনেতারা মনে করেন যে, বঙ্গবন্ধুর ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে তাঁর নিকট আত্মীয় তরুণ শেখ মনিকে নেতৃত্ব বরণ করে নিলে বাংলাদেশ থেকে আগত তরুণদের প্রভাবিত করা সহজ হবে। ঐ তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যদি তাদের মাধ্যমে হয়, তাহলেই তারা প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণদের সহায়তায় তাজউদ্দিন সরকারকে উৎখাত করতে সক্ষম হবেন। যুবনেতারা শেখ মনির প্রতি পূর্ণ আনুগত্য স্বীকার করে তাদের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে প্রচেষ্টা চালাতে লাগলেন।
তাদের পরিকল্পনা কাজে পরিণত করার প্রথম পর্যায়ে কয়েকজন যুবনেতা দিল্লি গিয়ে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করে তাঁকে জানান যে, তারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত বিশ্বাসভাজন। বঙ্গবন্ধু পাকহানাদার বাহিনী কর্তৃক ধৃত হওয়ার পূর্বে তাদেরকে ভারত সরকারের সহায়তায় স্বাধীনতা সংগ্রাম পরিচালনা করার নির্দেশ দিয়ে যান। তাজউদ্দিন আহমদের প্রতি বাংলাদেশ থেকে আগত জাতীয় এবং প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের সমর্থন নেই। এ অবস্থায় বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীত্ব করার কোনো অধিকার তাজউদ্দিন সাহেবের নেই। তাদের কথার সমর্থনে তারা বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আব্দুর রব সেরনিয়াবাতের একটি পত্র শ্রীমতি গান্ধীকে প্রদান করেন এবং বঙ্গবন্ধুর জ্যৈষ্ঠ পুত্র শেখ কামালকে তাঁর নিকট উপস্থিত করেন। বাংলাদেশ থেকে আগত তাদের অনুগত তরুণদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার জন্য শ্রীমতি গান্ধীর নিকট অনুরোধও জানান। ইন্দিরা গান্ধী তাদের অনুরোধ রক্ষা করেন। ঐসব তরুণদের প্রশিক্ষণের দায়িত্ব অর্পণ করা হয় মেজর জেনারেল ওবানের উপর।
এভাবে ভারত সরকারের অনুগ্রহ লাভ করে ঐ যুবনেতারা তাদের দুরভিসন্ধি চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সে দিন যে মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন তা বাংলাদেশের যুব সমাজের মাথা নত করে দিয়েছে। আর এই ষড়যন্ত্রের ফসল হিসেবে সেদিন সৃষ্টি হয়েছিল মুজিব বাহিনীর। যখন মুক্ত বাহিনীর তরুণরা অনাহারে অর্ধাহারে নিদারুণ কষ্টের মধ্যে থেকে ট্রেনিং গ্রহণ করেছে, তখন মুজিব বাহিনীর তরুণরা দেরাদুনের সামরিক একাডেমির অত্যন্ত মনোরম পরিবেশে ভারতীয় সেনাবাহিনীর অফিসারদের সমস্ত সুখ বাগডোগরায় গণপ্রতিনিধিদের একক
পৃষ্ঠা-২৩২
সমর্থন প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের ভিতকে আরো মজবুত করে। সেই সঙ্গে ভারত সরকারের কাছে যুব নেতৃবৃন্দের ষড়ষন্ত্রও ফাঁস হয়ে যায়।
ঐ সময় পর্যন্ত উল্লিখিত যুবনেতারা চার হাজার তরুণকে তাদের নিজস্ব সংগঠন মুজিব বাহিনীতে তালিকাভুক্ত করে দেরাদুনের সামরিক একাডেমিতে ট্রেনিং-এর জন্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু বাগডোগরার সমাবেশে পত্র ভারত সরকার মুজিব বাহিনীতে রিক্রুট বন্ধ করিয়া দিতে বাধ্য হয়। তবে ঐ সময় পর্যন্ত দেরাদুনে যারা প্রশিক্ষণে রত ছিল সেই তরুণদের ট্রেনিং সম্পন্ন করার নির্দেশ দেওয়া হয়। উক্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত তরুণরা তাদের নির্ধারিত ট্রেনিং সম্পন্ন করে দেরাদুন থেকে বেরিয়ে এসে প্রবাসী বাংলাদেশ সরকাতরের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে অস্বীকার করে। উল্লিখিত যুবনেতারা ঐ সময় থেকে মুজিব বাহিনীর উক্ত প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণদের দেশের অভ্যন্তরে পাঠাতে চেষ্টা করলে বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে তাদের বাধা দেওয়া হয়। এ সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের বক্তব্য ছিল যে, প্রবাসী সরকারের কমান্ডে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হচ্ছে। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন না করলে অস্ত্রসহ কাউকে দেশের অভ্যন্তরে প্রবেশ করতে দেওয়া হবে না। ফলে সাময়িকভাবে উক্ত তম নেতারা কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েন।
১৯৭১ সালের সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আজিজ মন্ত্রিপরিষদের সদস্য খন্দকার মোশতাক আহমদসহ মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচারণায় লিপ্ত ছিলেন। তারা বলতেন, তাজউদ্দিনের মুক্তিযুদ্ধের নীতি সম্পূর্ণ ভ্রান্ত, ভারতের ভূমিকা অস্পষ্ট এবং সোভিয়েত রাশিয়ার ভূমিকা মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি। তাজউদ্দিন সর্বদলীয় উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করে আওয়ামী লীগের স্বার্থের ক্ষতি করেছেন এবং বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শের প্রতি চরম উপেক্ষা প্রদর্শন করে। আওয়ামী লীগ নেতা এবং পরিষদ সদস্যদের তারা প্রভাবিত করতে ব্যর্থ হন। কিন্তু এ সত্ত্বেও মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দ তাজউদ্দিনকে অপসারণের জন্য বেপরোয়া হয়ে উঠেন। তারা তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে আবার প্রচারণা শুরু করেন যে, তাজউদ্দিন বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের কারণ। তিনি যতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন ততদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেবে না। তাজউদ্দিন যতদিন প্রধানমন্ত্রী থাকবেন ততদিন বাংলাদেশের মুক্তি অসম্ভব।
এই বিদ্বেষপূর্ণ প্রচারণার ফলে আওয়ামী লীগের বৃহত্তর অংশের সঙ্গে তাদের সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠে। মুক্তি বাহিনীর কোনো কোনো ইউনিটের সঙ্গে মুজিব বাহিনীর বিক্ষিপ্ত সংঘর্ষ ঘটে। নৌ কমান্ডোদের বিরুদ্ধে তাদের তৎপরতার খবর ছড়িয়ে পড়ায় মুজিব বাহিনী দারুণ অপ্রিয় হয়ে উঠে।
পৃষ্ঠা-২৩৩
এই সময় ভারত সরকার বাংলাদেশ সরকারকে জানান, মুজিব বাহিনীর ৪ নেতাকে তাজউদ্দিন সরকারের বিরুদ্ধে প্রচারণা বন্ধ করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
শেখ মনি এই সময় মরিয়া হয়ে উঠেন। তাজউদ্দিনই তার একমাত্র পথের কাঁটা। তাঁকে সরিয়ে দিতে পারলেই বাংলাদেশের শাসন ক্ষমতা তার হাতের মুঠিতে এসে পড়বে। তাজউদ্দিনকে হত্যা করার পরিকল্পনা করেন তিনি।
এই সময় মুজিব বাহিনীর সদস্য হিসাবে পরিচয়দানকারী এক যুবক আগ্নেয়াস্ত্রসহ হঠাৎ একদিন তাজউদ্দিন আহমদের অফিসে এসে উপস্থিত হয়।
নতজানু হয়ে অস্ত্র তাজউদ্দিন সাহেবের সামনে টেবিলে রেখে বলে ? আপনার প্রাণনাশের কথা উল্লেখ করার সঙ্গে সঙ্গে আমি স্বেচ্ছায় দায়িত্বভার গ্রহণ করে আপনার কাছে এসেছি যাতে আপনার জীবন রক্ষা করা সম্ভব হয়। তাজউদ্দিন তখন অফিসে একা ছিলেন। তিনি এ অবস্থায় কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েন। যুবকটি বলল, আমি স্বীকারোক্তি করতে প্রস্তুত। আমার এই গর্হিত কাজের জন্য যে শাস্তি দেবেন, আমি মাথা পেতে নেব। তাজউদ্দিন কিছু প্রয়োজনীয় জিজ্ঞাসাবাদের পর যুবকটিকে চলে যেতে বলেন।
তাজউদ্দিন ঘটনাটি গোপন রাখেন, কেননা একথা প্রচার হলে মুজিব বাহিনী এবং মুক্তি বাহিনীর মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম শুরুর সম্ভাবনা ছিল।
এই ঘটনার পর তাজউদ্দিন শ্রীমতি গান্ধীকে মুজিব বাহিনী নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করার অনুড়োধ জানান। ইন্দিরা গান্ধী এবার মুজিব বাহিনীর নেতৃবৃন্দের প্রতি তাজউদ্দিন সরকারের বিরদ্ধে কোনো রূপ প্রচারণা থেকে বিরত থাকার কড়া নির্দেশ দেন।
বাগডোগরায় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের মোকাবিলায় গিয়ে ব্যর্থ হয়ে এবার তারা অন্যভাবে বাংলাদেশ সরকারকে ঘায়েল করার প্রচেষ্টা চালায়। আওয়ামী লীগ ওয়ার্ক কমিটির সদস্যদের ওপর প্রভাব বিস্তার করতে সচেষ্ট হয়। উদ্দেশ্য, ওয়ার্ক কমিটির সদস্যদের দ্বারা প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করা।
১৯৭১ সনের নভেম্বর মাস। আওয়ামী লীগ ওয়ার্ক কমিটির এক জরুরি সভা অনুষ্ঠিত হয় কলকাতার সি. আই. টি রোডের কোনো এক ভবনে। এখানেও যুব নেতৃবৃন্দের প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার বিরোধি সকল হীন প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে গেল। ওয়ার্ক কমিটি প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপন করলো। এই সভা মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি এম. এ. জি ওসমানীর নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধকে ব্যাপকতর করার নির্দেশ প্রদান করে। এ সময় প্রবাসী
পৃষ্ঠা-২৩৪

বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ অমান্য করে মুজিব বাহিনীর কিছু তরুণ মেঘালয় থেকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে প্রবেশের চেষ্টা করে। মুক্তিবাহিনীর সেক্টর কমান্ডোরের নির্দেশে তাদের গ্রেফতার করা হয়। এ সব তরুণদের কাছ থেকে অনেক তথ্য সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। পাক হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কোনো পরিকল্পনা ঐ বাহিনীর ছিল না। দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে তাদের নিজস্ব সংগঠনকে জোরদার করে বাংলাদেশ সরকারের বিরুদ্ধে সক্রিয় করে তোলাই ছিল তাদের মূল লক্ষ্য। পরে ঐ বাহিনীর নেতৃবৃন্দকেও গ্রেফতার করা হয়। সে দিন ঐ যুব নেতৃবৃন্দ তাদের কৃতকর্মের জন্য অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে এবং সরকারকে পূর্ণ সহযোগিতাদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। বাংলাদেশ সরকার তাদের ক্ষমা করে দেন।
এই সময় পাকহানাদার বাহিনীর অত্যাচার সকল সীমা ছাড়িয়ে যায়। কোনো গ্রামে মুক্তিবাহিনীর আগমনের কথা শুনলে সেই গ্রাম পাকহানাদার বাহিনী ভস্মীভূত করে দিতো। কোনো ছেলে মুক্তিবাহিনীতে যোগদান করেছে, এমন সংবাদ পেয়ে তারা সত্যি ঘটনা যাচাই না করে ঐ ছেলের পিতাকে গুলি করে হত্যা করতো, বাড়ি ঘর জ্বালিয়ে দিতো। মেয়েদের ধর্ষণ করতো। সুপরিকল্পিতভাবে এই সময় আলবদর বাহিনী বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী ও তরুণদের হত্যা করার পরিকল্পনা করে। বাংলাদেশের মানুষ বর্বর পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের সহযোগিদের অত্যাচারের কথা কোনো দিন ভুলতে পারবে না। নিদারুণ অপমান, লাঞ্ছনা এবং সর্বক্ষণ মৃত্যুকে সহচর করে তখন বাংলার মানুষের দিন কেটেছে।
খোন্দকার মোশতাক ছিলেন পররাষ্ট্র ও আইনমন্ত্রী। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে ১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মোশতাক নমিনেশন পেতে ব্যর্থ হন। মোশতাকে নির্বাচনী এলাকায় আব্দুল জব্বার খদ্দরকে নমিনেশন দেওয়া হলে ক্ষুদ্ধ মোশতাক স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন এবং জয়লাভ করেন। এরপর প্রায় দশ বছর মোশতাক আওয়ামী লীগে ছিলেন না। ষাটের দশকের মাঝামাঝি মোশতাক পুনরায় আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। প্রথম দিকে কুমিল্লা জেলা সভাপতি হিসেবে এবং পরে আওয়ামী লীগের ৬-দফা ও পিডিএম পন্থীদের ৮-দফা সমর্থনকে কেন্দ্র করে যে রাজনৈতিক টানাপোড়নের সৃষ্টি হয় তাতে কেন্দ্রীয় নেতা হোসেন মনসুর আওয়ামী লীগ ছেড়ে যান। মোশতাককে আওয়ামী লীগের জুনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে স্থান দেওয়া হয়।
পঁচিশে মার্চ রাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী যখন গণহত্যা শুরু করে তখন মোশতাক হক নার্সিং হোমে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ৪ এপ্রিল পর্যন্ত মোশতাক হক
পৃষ্ঠা-২৩৫
নার্সিং হোমে ছিলেন। পরে কুমিল্লা সীমান্ত অতিক্রম করে তিনি আগরতলায় জান এবং পবিত্র হজ্জব্রত পালনের জন্য মক্কা যাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের লোকসভায় প্রয়াত প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী পাকিস্তানি গণহত্যার নিন্দা জানালে এবং বাঙালি জাতির স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তাদানের আশ্বাস দিলে এবং সর্বোপরি তাজউদ্দিন মোশতাককে মন্ত্রিসভায় স্থান দিতে আগ্রহ প্রকাশ করলে ধূৰ্ত মোশতাক মক্কা যাওয়ার ইচ্ছা ত্যাগ করেন এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী হতে সম্মত হন।
মেহেরপুরের আম্রকাননে নবগঠিত বাংলাদেশ সরকার শপথ গ্রহণের পরপরই মোশতাক ষড়যন্ত্র মেতে ওঠেন। তার সমর্থক উপদলের সমর্থনে তিনি তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। মোশতাক সমর্থকগণ কোলকাতার পার্কসার্কাসে অবস্থিত বাংলাদেশ মিশনে গোপন বৈঠক করতে শুরু করেন। জহিরুল কাইউম, আব্দুল মোমেন, শাহ মোয়াজ্জেম, কে, এম, ওবায়েদ, তাহেরুদ্দিন ঠাকুর, অধ্যাপক আব্দুল খালেক প্রমুখ মোশতাকের সমর্থক হিসেবে আবির্ভূত হন। প্রধান সেনাপতি কর্নেল আতাউল গণি ওসমানী ও বাংলাদেশ মিশন প্রধান হোসেন আলী এ গ্রুপের সমর্থক ছিলেন বলে জানা যায়।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের অজান্তে মোশতাক গ্রুপের উদ্দেশ্য ছিল তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করে মোশতাককে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ এবং যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনে ইরানের শাহের মধ্যস্থতায় পাকিস্তানের সঙ্গে সমঝোতায় পৌছানো। ছয়দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন লাভ ও পাকিস্তানের পরিধির মধ্যে কনফেডারেশন গঠন করা ছিল এদের মূল উদ্দেশ্য। এতে মুক্তিযুদ্ধের অস্বভাবিক ইতি টানা এবং পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষা করা সম্ভব হতো। বাংলাদেশের মাঠে-ঘাটে প্রত্যন্ত অঞ্চলে যখন লক্ষ লক্ষ অকুতোভয় মৃত্যুঞ্জয়ী তরুণ মুক্তিযুদ্ধে নিয়োজিত, তখন মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি ষড়যন্ত্রে মোশতাক গ্রুপ লিপ্ত ছিলেন। ব্যারিস্টার আমির-উল-ইসলাম তার মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি’ গ্রন্থে লিখেছেন –
“তাজউদ্দিন ভাই আমাকে খন্দকার মোশতাকের সঙ্গে দেখা করতে পাঠান। মোশতাক সাহেব তাঁর পরিবার নিয়ে একটি ফ্ল্যাটে থাকতেন। দেখা করার জন্যে সেখানে গিয়ে আমাকে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো। সেখানে আরো কিছু লোক তার সঙ্গে গল্প-গুজবে ব্যস্ত ছিলেন। সবাই চলে যাবার পর আমার ডাক পড়লো। মোশতাক ম্যাকগাইভের লেখা মতামত না পড়েই একটা মন্তব্য করেন। তার এই বক্তব্য আমি কোনো দিন ভুলতে পারবো না। তিনি বললেন :
পৃষ্ঠা-২৩৬
must decide whether you want Sheikh Mujibor idence. You cant have both. (আপনাদের সিদ্ধান্ত নিতে হবে- আপনারা শেখ মুজিবকে চান অথবা স্বাধীনতা চান। আপনারা দুটো পেতে পারেন না।)
আমি একথা শুনে একেবারে স্তম্ভিত হয়ে পড়ি। সঙ্গে সঙ্গে উত্তর দিলাম, We want both, Sheikh wothout independence or independence without Sheikh both are incomplete. (আমরা দু’টাই চাই। স্বাধীনতা ছাড়া শেখ অথবা শেখকে ছাড়া স্বাধীনতা-দুটাই অসম্পূর্ণ)।”
“আমি বুঝলাম, তার মন্তব্য আকস্মিক নয়। এর পেছনে একটা যোগসূত্র কাজ করছে। শেখ মুজিবকে আনতে হলে (মোশতাকের কথা হচ্ছে) স্বাধীনতার প্রশ্নে আমাদের আপোস প্রয়োজন। এটাও এক ধরনের ব্ল্যাক মেইল বলে আমার কাছে মনে হলো। আমি যে উদ্দেশ্যে গেছি মোশতাক সুকৌশলে যে তা এড়িয়ে গেলেন, তা বুঝতে আর বাকি রইলো না। খুব বিরক্ত হয়ে ভগ্ন হৃদয়ে সেখান থেকে ফিরে এসে তাজউদ্দিন ভাইকে সব জানালাম।
এ সম্পর্কে মার্কিন সাংবাদিক লরেঞ্চ লিফসুইজ পুরো ব্যাপারটাকে ‘ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে লিখেছেন, “কোনো কোনো সূত্র মনে করেন যে, সময় হিসেবে ১৯৭১-এর অক্টোবরকে বাছাই করা হয়েছিল। সে সময় পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে মোশতাকের নিউইয়র্কে এসে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের কাছে। বাংলাদেশের বক্তব্য তুলে ধরার কথা । সে সময় এককভাবে কোনো পূর্ব ইঙ্গিত ছাড়াই নিউইয়র্কে মোশতাক এমন একটা আপোস রফার ঘোষণা দিয়ে ফেলতেন, যেখানে পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত হতো না এবং যে ব্যাপারটা তাজউদ্দিন নেতৃত্বের কাছে বিশ্বাসঘাতকতার সামিল হতো। এ ক্ষেত্রে কোলকাতায় আওয়ামী লীগের বাকি নেতৃত্বের ওপর মোশতাক নিঃসন্দেহে টেক্কা দিতে পারতেন। বাংলাদেশের ইতিহাসও অন্যরকম হতো।
ইরানের শাহ-এর মধ্যস্থতায় তেহরানে এই বৈঠকে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। পরবর্তীকালে যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে এই বৈঠকের কথা উল্লেখ করেন। বাংলাদেশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ছিল মোশতাকের এবং কর্নেল ওসমানীকে প্রতিনিধি দলের অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি, বাংলাদেশের পূর্ণস্বায়ত্তশাসন ও কনফেডারেশন গঠন ছিল এই প্রস্তাবের মূল লক্ষ্য। কর্নেল ওসমানী মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি হিসেবে প্রস্তাবিত বৈঠকে অংশগ্রহণ করলে এবং ফর্মূলা অনুযায়ী ছয়দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন ও কনফেডারেশনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা
পৃষ্ঠা-২৩৭

টিকিয়ে রেখে শেখ মুজিবকে মুক্তি দিলে মুক্তযোদ্ধাদের দ্বিধা বিভক্ত করা ও বিভ্রান্ত করা সহজ হতো। জনগণকে বলা হতো বঙ্গবন্ধুর প্রাণ রক্ষার জন্য বাধ্য হয়ে রাজনৈতিক সমাধানে সম্মত হতে হয়েছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তিলাভ করলে তাজউদ্দিনকে প্রধানমন্ত্রীর পদ হারাতে হবে এই ভয়ে তাজউদ্দিন শেখ মুজিবের প্রাণ রক্ষার জন্য রাজনৈতিক সমাধান চান না এই ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়। এমন কি ‘স্বাধীনতা না বঙ্গবন্ধু’ এই প্রচারপত্র বিলি করা হয়।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন আহমদ ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ও ভারত সরকারের কাছে থেকে এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পারেন। স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে উভয় নেতাই এই মর্মে ভাষণ দেন যে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন না হওয়া পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ চলবে। ২৭ নভেম্বর তারিখে পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষী প্রধানমন্ত্রী কর্তৃক বরখাস্ত হন। প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত আব্দুল মোমেনকে নতুন পররাষ্ট্র সচিব নিযুক্ত করা হয়। খন্দকার মোশতাকের জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে নিউইয়র্ক যাত্রা বাতিল করা হয়। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দান করেন বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী।
একাত্তরের ১১ জুলাই কোলকাতার ৮ থিয়েটার রোডে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের সভাপতিত্বে সেক্টর কমান্ডারদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। যুদ্ধের সার্বিক রণকৌশল নির্ধারণই এই বৈঠকের অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল। মেজর জিয়াউর রহমান এসময় প্রস্তাব করেন যে অবিলম্বে একটি যুদ্ধ কাউন্সিল গঠন করতে হবে। এই প্রস্তাবে কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির কাজ থেকে অব্যাহতি দিয়ে প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়। স্পষ্টতই এটা ছিল যুদ্ধ পরিচালনার ব্যাপারে সামরিক কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রয়াস এবং কর্নেল ওসমানীকে প্রধান সেনাপতির পদ থেকে অপসারণের চেষ্টা। কর্নেল ওসমানী এটা আঁচ করতে পেরে প্রথম দিন বৈঠকে উপস্থিত হওয়ার থেকে বিরত থাকেন। শোনা যায় কর্নেল ওসমানী প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিনের কাছে পদত্যাগ করলে প্রবাসী সরকারের তথা মুক্তিযুদ্ধের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হবে এই ভেবে তাজউদ্দিন ওসমানীকে পদত্যাগ থেকে বিরত করেন। এদিকে মেজর শফিউল্লাহ ও মেজর খালেদ যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। কারণ ওসমানী অপসারিত হলে চাকরিরত অফিসারদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র মেজর জিয়াই প্রধান সেনাপতির দায়িত্ব লাভ করতেন। শফিউল্লাহ ও খালেদের বিরোধিতার ফলে যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব অনুমোদন লাভে ব্যর্থ হয় এবং ওসমানী পদত্যাগ পত্র প্রত্যাহার করেন। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে মেজর জিয়ার সঙ্গে কর্নেল ওসমানীর সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটে।
পৃষ্ঠা-২৩৮

১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ যখন দুর্বার গতিলাভ করেছে তখন প্রবাসী সরকারের অজান্তে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ ‘মুজিব বাহিনী’ নামে আলাদা একটা বাহিনী গড়ে তোলে। ৮ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর মঞ্জুর মুজিব বাহিনীর সদস্যদের গ্রেফতার করেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের ছেড়ে দেওয়ার জন্য মেজর মঞ্জুরকে অনুরোধ করেন। বিষয়টি তাজউদ্দিন ও কর্নেল ওসমানীরও অজানা ছিল। মুক্তিযুদ্ধ প্রলম্বিত হলে বাঙালি জাতীয়তাবাদী শক্তি আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব ধরে রাখতে অসমর্থ হতে পারে এবং উগ্রবামপন্থীদের হাতে নেতৃত্ব চলে যেতে পারে এই আশঙ্কায় ভারতীয় কর্তৃপক্ষ মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দানের জন্য অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ওভানকে নিয়োজিত করেন। মুজিব বাহিনী গঠন সম্পর্কে মুক্তিবাহিনী অজ্ঞতার ফলে সীমান্ত অতিক্রমকালে সশস্ত্র মুজিব বাহিনীর সদস্যদের সাথে মুক্তিবাহিনীর বেশ কয়েকটি সংঘর্ষ হয়।
মুজিব বাহিনী গঠনের প্রেক্ষাপট সম্পর্কে বিশিষ্ট ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের বক্তব্য বিশেষভাবে লক্ষণীয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ দলিরপত্রের পঞ্চদশ খণ্ডে তার লিখিত বক্তব্য হচ্ছে- “ভারতের দুটি স্থানে মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জেনারেল ওবান এই প্রশিক্ষণের দায়িত্বে ছিলেন। আজ পর্যন্ত আমি বুঝে উঠতে পারছি না মুজিব বাহিনী নামে এই আলাদা বাহিনীর কোনো প্রয়োজন ছিল কি না। তবে যদ্দুর জেনেছি, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থার সাথে শেখ মনির লৰি ছিল। তাকে বুঝানো হয়, যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে বর্তমান আওয়ামী লীগ সে সময় নেতৃত্ব দিতে অসমর্থ হবে। অথবা এই নেতৃত্ব কোনো প্রকার আপোষ করতে পারে। তাকে আরো বুঝানো হয়, যে যুব শক্তি স্বাধীনতার উন্মেষ ঘটিয়েছে, তারাই কেবলমাত্র সঠিক নেতৃত্ব দিতে সক্ষম হবে। প্রয়োজনে এই নেতৃত্ব আওয়ামী লীগের বিকল্প হিসেবে কাজ করতে পারবে। তাছাড়া বাংলাদেশ স্বাধীন হলো এই নবশক্তি চীন বা নকশাল পন্থীদের বিরুদ্ধে স্বাধীন ও সার্বভৌম সরকার প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা করবে। পরে আরো জেনেছি, ভারত সরকার এই সিদ্ধান্ত নেয়, যার অর্থ হলোঃ এক বাক্সে সব ডিম না রাখা। বি এস এফ এর (বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স) রুস্তমজী মুজিব বাহিনী গঠনের তীব্র প্রতিবাদ করেন। কিন্তু তার প্রতিবাদ শেষ পর্যন্ত গ্রাহ্য হয়নি। সবচেয়ে আশ্চর্য ব্যাপার হলো, ভারত সরকার মুজিব বাহিনী গঠন সংক্রান্ত এই সিদ্ধান্ত মুজিবনগর সরকারের কাছে গোপন রাখে। তাজউদ্দিন ভাইসহ আমাদের অনেককেই এই সিদ্ধান্ত পীড়া দেয়।”
মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রশ্ন তোলেন যে, তাজউদ্দিন আহমদ প্রধানমন্ত্রী এবং দলের সাধারণ সম্পাদক উভয় পদই দখল করে রয়েছেন। মিজান চৌধুরী, জহিরুল কাউইম প্রমুখ ব্যক্তিরা তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন
পৃষ্ঠা-২৩৯

করেন । এক্ষেত্রে মন্ত্রী পরিষদকে সম্প্রসারণ করার জন্য চাপ সৃষ্টি করা হয়। মশিউর রহমান যাদু মিয়া কলকাতায় উপস্থিত হয়ে প্রবাসী সরকারের ৪ হওয়ার জন্য চাপ সৃষ্টি করেন। আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারাও মন্ত্রী হওয়ার অভিলাসে ষড়যন্ত্রে মেতে ওঠেন। খন্দকার মোশতাক, মনসুর আলী, কামারুজ্জামান স্ব-স্ব উপদলের নেতৃত্বে থাকেন এবং প্রধানমন্ত্রীত্বের দাবিদার হিসাবে প্রচারণা চালাতে থাকেন। তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে এই অনাস্থা প্রস্তর শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। তাজউদ্দিন পূর্ণস্বাধীনতার লক্ষ্যে অসীম ধৈৰ্য্য সহকারে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের প্রশ্নে অবিচল থাকেন।
যে সব বামপন্থী দল মুক্তি যুদ্ধকে সমর্থন করেছিল এবং বামপন্থী নেতবৃন্দ সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে গিয়েছিলেন তারাও মন্ত্রী হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন । তাজউদ্দিন আহমদ পড়লেন মহাবিভ্রাটে। যেহেতু আওয়ামী লীগ জনগণ কর্তক নির্বাচিত সেহেতু আওয়ামী লীগের অধিকাংশ নেতাই বামপন্থীদের সরকারে অন্তর্ভুক্ত করার বিরোধিতা করেন। এ কারণে বামপন্থী নেতাদের মন্ত্রী করা যেমন একদিকে সম্ভব ছিল না, অপরদিকে স্বাধীনতার এক ও অভিন্ন লক্ষ্যে। মুক্তিযুদ্ধকে পরিচালনা করার জন্য বামপন্থীদের নাখোশ করাও সম্ভবপর ছিলনা আবার সোভিয়েত রাশিয়াসহ বিভিন্ন সমাজতান্ত্রিক দেশগুলোর সমর্থন লাভের জন্য বামপন্থী দলগুলোর সহায়তা অত্যাবশ্যক ছিল। অপর দিক বিবেচনা করেই মোশতাকের বিরোধিতা সত্ত্বেও মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। মওলানা ভাসানীকে সভাপতি হিসেবে মনোনীত করা হয়। ন্যাপ, জাতীয় কংগ্রেস এবং কমুনিস্ট পার্টি থেকে একজন করে সদস্য যথাক্রমে অপধ্যাক মোজাফফর আহমেদ, মনোরঞ্জন ধর ও মনি সিংহকে কমিটির অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আওয়ামী লীগ থেকে দুইজন সদস্য যথাক্রমে মোশতাক ও তাজউদ্দিন সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটির সদস্য হন।
সর্বদলীয় উপদেষ্টা কমিটি গঠনকে কেন্দ্র করে আওয়ামী লীগের উপদলীয়। কোন্দল চরমে ওঠে। একদল বিদ্রোহীগণ পরিষদ সদস্য তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হন এবং ৫ সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার বারাসত শহরে প্রায় ৪০ জন। গণপরিষদ সদস্য মিলিত হন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, শেখ আব্দুর আজিজ ও শাহ মোয়াজ্জেম এই বৈঠকে বেশ তৎপরতা দেখান। ৫ সেপ্টেম্বরের অসমাপ্ত বৈঠক ১১ সেপ্টেম্বর গণপরিষদ সদস্য এনায়েত হোসেন খানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তা ছিল নিম্নরূপঃ
“Awami League has got the mandate from the people to shape the destiny of the country, as such, it is Awami League alone which is eligible and competent to conduct the present war…
পৃষ্ঠা-২৪০

“While we have observed that planned and systematic efforts are being made to wipe out the image of Bangabandhu Sheikh Mujibur Rahman, to destory Awami League and its ideals to help set up new ideology in Bangladesh in derogation to our parly’s airms and object and help introduce authoritative (sic) and totalitarian system of state machinery to the great detriment of the election result of the people, we have been compelled to take the present move with the intention to see things in order….”
“Needless to say that all tiers of the present liberation fight have been shockingly infiltrated by forces and elements opposed to Awami league, its ideals aims and objects and they have been very much active to drag the fight to their respective destination. As a result the genuine and devoted Awami League workers and leaders of different tiers have been deprived of their due prarticipation in the struggle and privilages thereof. The mystry should be immediatley unerthed and positive and suitable steps to be taken for a saferetrn Inaction on our part would be disastrous…
“We all are aware the taking NAP (2 groups), Communist Party and Congress along with Awami League, a joint front infact has been formed naming a consultative committee for the liberation struggle against the avowed policy of our leader Sk. Mujibur Rahman. On such vital matter even no opinion was taken from Awami League…
এই ধরনের প্রস্তাব গ্রহণ প্রকৃতপক্ষে প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা আনয়নের শামিল ছিল। তাজউদ্দিন আহমদের গুরুত্ব উপলব্ধি করে রংপুর সীমান্তে আওয়ামী লীগ কার্যকরী সংসদের এক জরুরি বৈঠক ডাকেন। এই বর্ধিত সভায় মুক্তিযুদ্ধের নানাদিক তুলে ধরে জাতির দুর্যোগকালের দলীয় ঐক্য, রণাঙ্গনের সাফল্য ও বিশ্ব জনমত সৃষ্টির ক্ষেত্রে প্রবাসী সরকারের কর্মকাণ্ড এবং উপদলীয় কোন্দল পরিহার করার জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক অবিস্মরণীয় ভাষণ দান করেন। তাজউদ্দিনের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব গৃহীত হওয়ার আগেই সভার পরিসমাপ্তি ঘটে।
আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ উপদলীয় কোন্দলের ফলে তাজউদ্দিন আহমদ যখন বিভ্রাটে পড়েছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধ বিরোধি ষড়যন্ত্র হচ্ছিল তখন মওলানা
পৃষ্ঠা-২৪১

ভাসানী তাজউদ্দিনের পাশে দাঁড়ান এবং ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে প্রবাসী সরকারকে সকল চক্রান্ত থেকে রক্ষা করার সময়োপযোগী ভূমিকা পালন করেন । সত্তরের নির্বাচনে পরাজিত কমুনিস্ট পাটি, কংগ্রেস, ন্যাপ ও অন্যান্য বামপন্থী দলগুলো যখন সর্বদলীয় সরকার গঠনের জন্য চাপ প্রয়োগ করেন তখন মওলানা ভাসানী এর বিরোধিতা করে এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন সেক্রেটারী অব স্টেট হেনরি কিসিঞ্জার তাঁর ‘দি হোয়াইট হাউজ ইয়ার্স’ গ্রন্থের (The White House Years by Dr. Henry Kissinger) একবিংশতিতম অধ্যায়ে The India-Pakistan Crisis of 1971 ‘শিরোনামে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ প্রসঙ্গে এক বিস্তারিত তথ্য সংযোজন করেছেন। এই অধ্যায়ে তিনি ‘Contacts with the Bangladesh Exiles উপশিরোনামে ইয়াহিয়া খানের কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত করে আনার জন্য কাজী জহিরুল কাউইম-এর ভূমিকা সম্পর্কে লিখেছেন :
On July 30, a Mr. Qaiyum, an elected member of the Awami League closely associated with the Bangladesh government in exile, approached our Consulate in Calcutta to say he had been designated to establish contact with the United States. He would return in two weeks for an answer. The Consulate reported this approach in State channels.
We recognized that this contact would be explosive if it surfaced in Islamabad-and we had to assume that India would have every incentive to publicize it. Nevertheless, after checking with the President, I approved a State suggestion that our Consulate receive Qaiyum and probe for the readiness of the Awami League to negotiate with the Pakistani government. (The instructions for this initiative were prepared in State’s Near East Bureau and cleared in the White House.) Quiyum appeared on schedule on August 14. He affirmed that if Mujib were allowed to participate in these negotations, his group might settle for less than total independence so long as Islamabad accepted the Awami Leaguc’s xix points. He hoped the United States would encourge such an evolution. In a second meeting few days later, Qaiyum observed that once India formally recognized Bangladesh, even this essentially face-saving proposal would no longer be possible.
পৃষ্ঠা-২৪২

We did not think we could proceed further without informing Yahya; at the same time the Calcutta contacts might be an opportunity to budge Islamabad toward a political soulution. State instructed Ambassador Joseph Farland tell Yahya about contacts in Calcutta and of the possibility of a settlement based on the six points.
Yaha’s reaction was surprisingly favorable. Recognizing that he had trapped himself, he was groping for a way out, he welcomed our contacts in Calcutta, asking only to be kept informed. He even accepted Farland’s suggestion that we use our good offices to arrage secret contacts between his govbernment and the Bengali exiles.
When on August 27 Quiyum shoowed interest in expediting contacts, we went one step further. On September 4 Farland suggested to Yahya that we cantact the Bangladesh ‘foreign minister’, ostensibly to check out Qaiym’s bonafdes; we would tell him of Yahya’s willingness to engage in secret talks. It was an extraordinary proposal to make to the President of a friendly country that we would approach the “foreign minister” of a movement he has banned as seditious, an official whose very title implied at a minimum a consttutional change if not treason. Such was Yahya’s quandary that he agreed.
Yahya accepted our suggestions in other fields as well. On September I he appointed a civillian governor for East Pakistan replacing the hated martial-law administrator. On September 5 Yahya extended the ammesty previsously offered to refugees to cover all citizens except those against whom criminal proceedings had already been instituted. (This excluded Mujib, however.) Around the same time, Yahya assrued Maury Williams, our aid coordinator, that a death sentence against Mujib would not be carried out. On October I Nixon announced that he would ask for $250 million in additional funds for refugee relief, bringion our contribution to nearly twice that of the rest of the world combined.
পৃষ্ঠা-২৪৩
The surest way to intensify a crisis is to reject all the other side’s initiatives without offering an alternative. Thiswas India’s course .No governemtn offers its ultimate concessions at the outset, and it may not even know far it is prepared to go until there is some process of negotiation. This was paricularly true of the harassed military leaders of Pakistan in 1971. They knew by now that their brutal suppression of East Pakistan beginning on March 25 had been in Talleyrand’s pharase. worse than a crime; it was a blunder, Yet they had stood for a united Pakistan all their lives; it was impossible for them to accept the secession of half their country, Yahya feared both a war caused by his inflexibility and an overthrow based on the accusation that he made too many concessions. Faced with this dilemma, he sought to turn over authority to a civilian goverment as rapidly as possible, shifting to it the responsibility for the ultimate debacle. In the meatime he hoped to stave off a confict by making some conscessions while avoiding West Pakistani unrest.
Mrs. Gandhi, however, had no intention of permitting Pakistan’s leaders to escape their dilemma so easily. She knew that once discussions between pakistan and the Awami League started, some sort of compromise might emerge; India might then lose control of events. Mrs. Gandhi was not willing to risk this. she would not soon again have pakistan at such a disadvantage, China in the throes of domestic upheaval (the Lin Piao affair), the United State devided by Vietnam, and the Sovier Union almost unconditionally on India’s dide. On Septmeber I we learned that Indian armed forces had been put on general alert. Predictably Pakistan reacted on September 4 by moving additional forces into forward positions near the West Pakistan reacted on September 4 by moving additional forces into forward positions near the West pakistan-India border. On September 9 units of India’s only armored division and an independent armord brigade move toward the West Pakistan frontier On September 16 there was a report that India planned to infiltrate some 9,000 more Muktibahini guerrillas into East Pakistan starti in early October
পৃষ্ঠা-২৪৪
At the same time our contacts with the bangladesh representatives in Calcutta began to dry up. On September 9 our Consul met with Qaiyum to arrage the meeting with the Bangladesh ‘foreign minister’. but Qaiym now demanded nto only the imediate release of Mjib, but the immediate departure of the pakistani army from East Pakistan and a guarantee for Bangladesh Security by the United Nations-in short, immediate independence. On September 14 Qaiyum told us that his ‘foreign minister’ saw little point m a meeting. He ascribed this reluctance to surveillance by the Indian government, which he said was skittish about any contacts with the Uniited States. On September 21 Yahya revealed his anxiety by asking Farland about ou contacts in Calcutta. He hoped Farland would keep him informed of any new development. Farland was suficiently enocourged to recommend our consul be permitted to meet the Acting President of Bangladesh government in exile if the foreign minister remained unavailable.
But in Calcutta all signals were now pointing in the opposite direction. On September 23 Qaiyum sent a messenger to tell our Consul that the India government had become aware of his contacts with us and had formally warned against them. We responded by proposing a meeting with the “acting president”. Qaiyum presented himself shortly afterward and confirmed what his messenger had said : India wanted all contacts handled through New Delhi.
At the same time, the Indians were telling us exactly the opposite-at least about refugees. Whenever we proposed joint USIndian relief prorgams we were given the stock reply that this should be taken up with Bangladesh representatives in Calcutta. We could be excused for suspecting that we were being given the run around: the Indians urged us to talk to the Bengali exiles, who then avoided high-level contact under the pretext of Indian displeasure.
On September 27 Joe Sisco sought to straighten out the mess by
proposing to Jha diret negotiations between representavtives of Pakistan and Bangladesh without conditions. Jha was negative. He
পৃষ্ঠা-২৪৫
professed not to see any advance in this offer (even though such talks implied a recognition of Bangaldesh and could hardly lead to any result other than autonomy and eventually independence). He fell back on the stock demand, which he knew could not be immediately fulfilled : that any talks with Bangladesh representatives include Mujib at the outset and be aimed at immediately fulfilled: that any talks with Bangladesh representatives include Mujib at the outset and be aimed at immediately fulfilled : and be aimed at immediate independence. (At this point the release of Mujib was essentially a problem of face. the military government could not bring itself to commence negotiations with so humiliating a reversal. On the other hand, it must have been clear to it that any negotiations it initated with the Awami League could not go far unless its leader was eventually released form Jail.)
The next day the Bangladesh ‘foreign minister’ finally met with our Consul in Calcutta: he said talks were useless unless the United State used its influence to bring about Bengali ‘desires,’ which included full independence, freedom for Mujib, US aid, and normal relations, Let there be any temptaions to yield, Qaiyum returned on October 3 with an escalation of Bangladesh’s ‘desires.’ He wanted the Soviet Union to participate in the talks. He saw no need for concessions since the Indian army would keep Pakistani forces busy at the border freeing the guerrillas for eventual control of the country. On October 16 Qaiyum ruled out a meeing between our Consul and the “acting president” of Bangladesh, citing Indian objections. On October 20 another senior Bangladesh official Hossain Ali, told our Consul that his organization was not interested in passing messages to Yahya; the ‘obvious solution’ was Mujib’s release and immediate independence for Bangladesh. By the end of October, the Indian press was publicly warning against Bengali negotiations with ‘foreign representative.’ In short, the effort to encourage negotiations between the government of Pakistan and the Bangladesh government in exile was finished.
পৃষ্ঠা-২৪৬

অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল ওবানের সার্বিক তত্ত্বাবধানের মুজিব বাহিনীর সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। জেনারেল ওবান বিশেষ গেরিলা বাহিনী গড়ে তোলার ক্ষেত্রে পারদর্শী ছিলেন। বাংলাদেশের অস্থায়ী সরকার মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক যোগাযোগ ও সহায়তা দানের বিষয়টি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ভারত সরকার তিনটি কমিটি গঠন করে। প্রথমটি হচ্ছে রাজনৈতিক কমিটি এর প্রধান ছিলেন ডি. পি. ধর। দ্বিতীয়টি হচ্ছে যুদ্ধ কাউন্সিল। জেনারেল মানেকশ ছিলেন যুদ্ধ কাউন্সিলের প্রধান। সেনাবাহিনীর উপ-প্রধানকে চেয়ারম্যান মনোনীত করে গোয়েন্দা কমিটিও গঠন করা হয়। এই গোয়েন্দা কমিটি ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’ কে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। স্বাধীনসংগ্রামী তরুণদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ বাহিনী গড়ে তোলার পরিকল্পনা প্রণয়ন করে গোয়েন্দা কমিটি। এই বিশেষ বাহিনীর নামকরণ করা হয় মুজিব বাহিনী। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে বামপন্থীরা যেন ক্ষমতা দখল করতে না পারে এবং মুক্তিযুদ্ধে প্রলম্বিত হলে আওয়ামী লীগের নেতত্ব যেন নিরাপদ থেকে সেই উদ্দেশ্যেই সম্ভবত মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের মে মাসের চূড়ান্ত হয় মুজিব বাহিনী গঠনের সিদ্ধান্ত। জেনারেল ওবান এই বিক্ষুদ্ধ তাজউদ্দিন বিরোধি চার নেতাকে মুজিব বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত করেন। জেনারেল ওবান তার রচিত ‘ফ্যান্টমস অব চিটাগাং : ফিফথ আর্মি ইন বাংলাদেশ’ গ্রন্থে কি উদ্দেশ্যে এবং কাদের সমন্বয়ে মুজিব বাহিনী গঠিত হয়েছিল তা বর্ণনা করেছেন। চার যুবনেতার সঙ্গে জেনারেল ওবানের প্রথম সাক্ষাৎ ঘটে চিত্তরঞ্জন সুতারের বাসায়। তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে চার যুবনেতা ঐক্যবদ্ধ হন। চার যুবনেতা মনে করতেন মুক্তিযুদ্ধে তাঁদেরই নেতৃত্ব দেবার কথা। বিক্ষুদ্ধ চার যুবনেতা যুদ্ধ কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেন। তারা বলেন যুদ্ধে বামপন্থী ও নক্সাল পন্থী আওয়ামী লীগ বিরোধিরা ঢুকে পড়েছে, যুদ্ধ কাউন্সিলই মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা করবে। প্রবাসী সরকার যুবনেতাদের এই দাবি অগ্রাহ্য করলে তারা মুক্তিবাহিনীর সমান্তরাল মুজিব বাহিনী গড়ে তোলার ব্যাপারে আগ্রহী হন। তাজউদ্দিনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার বঙ্গবন্ধু কর্তৃক ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রদত্ত নির্দেশ পরিপন্থী বলে আব্দুর রাজ্জাক দাবি করেছেন। বঙ্গবন্ধু তাজউদ্দিনের উপস্থিতিতে চার যুবনেতাকে বলেছিলেন কমান্ড কাউন্সিল হবে এবং কমান্ড কাউন্সিলের মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধ পরিচালিত হবে। তিনি বলেছিলেন যে স্বাধীনতার পরেও এই কমান্ড কাউন্সিলের মাধ্যমে দেশ পরিচালিত হবে পাঁচ বছর পর্যন্ত। পাঁচ বছর পর গণতন্ত্র এবং বহুল ব্যবস্থা চালু হবে। পাঁচ বছরের মধ্যে নির্বাচন হবে না। কারণ অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে সশস্ত্র বিপ্লবের পর দেশে অস্ত্র থাকে বিভিন্ন
পৃষ্ঠা-২৪৭

বয়সের লোকের কাছে। রাজ্জাক বলেন বঙ্গবন্ধু যা বলেছিলেন সে অনুযায়ী কাজ হলো না। প্রধানমন্ত্রী যদি কেউ হন বঙ্গবন্ধুই হবেন। বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রী করে তিনি উপ-প্রধান মন্ত্রী হতে পারেন। আর উপ-প্রধানমন্ত্রী তা সৈয়দ নজ ইসলাম হবেন। কেননা বঙ্গবন্ধু ছিলেন পার্লামেন্টের নেতা আর সৈয়দ ছিলেন উপনেতা। তাজউদ্দিন ছিলেন তৃতীয় ব্যক্তি। তিনি কমান্ড কাউন্সিল গঠন না করে নিজেকে প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করলেন।
তাজউদ্দিনের সঙ্গে চার যুবনেতার বিরোধের সূত্রপাত এখানেই। তাজউদ্দিনের সঙ্গে কথা ছিল ভারতে গিয়ে চিত্তরঞ্জন সুতারের ২১ রাজেন ড়োডের বাসায় দেখা হবে কিন্তু তাজউদ্দিন সেই ঠিকানায় না গিয়ে দিল্লি চলে যান।
মঈদুল হাসান তাঁর মূলধারা’ গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন যে চার যুবনেতারা। প্রচারণা চালিয়েছেন যে তাজউদ্দিন অস্থায়ী সরকারের প্রধানমন্ত্রী থাকলে দেশ স্বাধীন হবে না। তাজউদ্দিনই শেখ মুজিবের গ্রেফতারের কারণ, তাজউদ্দিনকে হত্যার জন্য ঘাতক নিয়োগ করা হয়েছিল। রাজ্জাক এক কথায় এসব নাকোচ করে দিয়ে বলেছেন যে এসব বানোয়াট কল্পিত ষড়যন্ত্র।
পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে তাজউদ্দিন আহমদ ৫-৬ জুলাই শিলিগুড়িতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশের প্রায় তিনশত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সম্মেলনে এসব অপপ্রচারের মোকাবিলা করেন। তাজউদ্দিন অবৈধভাবে নিজেকে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন এবং প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা তাজউদ্দিনের নেই, দুর্বল নেতৃত্বের কারণে মুক্তিযুদ্ধ ঝিমিয়ে পড়েছে এসব অপপ্রচার চালাতে থাকেন। খোন্দকার মমোশতাক আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা মিজান চৌধুরী অধিবেশনে প্রদত্ত ভাষণে দলীয় সম্পাদকের পদ থেকে তাজউদ্দিনের অপসারণ দাবি করেন এবং মুক্তিযুদ্ধের নৈরাশ্যজনক চিত্র উপস্থাপিত করেন। তাজউদ্দিন বিরোধি সদস্যরা প্রধান সেনাপতি কর্নেল ওসমানীর যোগ্যতা ও ভারত সরকারের আন্তরিক সদিচ্ছার প্রশ্নে সন্দেহ প্রকাশ করে প্রচারণা শুরু করেন। এতদসত্ত্বেও সংখ্যাগিরষ্ঠ নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ তাজউদ্দিনের স্বপক্ষে ভোট দেন। তাজউদ্দিন প্রতিকূল অবস্থার মুখেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আস্থা অর্জন করেন এবং খোন্দকার মোশতাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার নিদারুণ আশাভঙ্গ ঘটে।
জুলাই-এর প্রথম সপ্তাহে কিসিঞ্জার নয়াদিল্লি আসেন। কিসিঞ্জার এরপরে ইসলামাবাদ যান এবং গোপনে পিকিং সফর করেন। কিসিঞ্জারের এই ঝটিকা সফল সংশ্লিষ্ট মহলে সন্দেহের উদ্রেক করে। ১৭ জুলাই কিসিঞ্জার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে চীনের সম্ভাব্য আক্রমণের মুখে ১৯৬২ সালে স্বাক্ষরিত চুক্তি মোতাবেক ভারতকে সাহায্য করতে অক্ষমতা প্রকাশ করেন । বাংলাদেশের
পৃষ্ঠা-২৪৮

মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাদানের বিরুদ্ধে চাপসৃষ্টির কৌশল হিসেবেই এটা করা হয়েছিল সন্দেহ নেই।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের সাথে বন্ধুসুলভ সম্পর্ক গড়ে তোলার আগ্রহের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের কাছে অখণ্ড পাকিস্তানই কাম্য ছিল। পাকিস্তানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড শেখ মুজিবের সঙ্গে দেখা করে এই মর্মে সতর্ক করে দেন যে, বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রচেষ্টা যুক্তরাষ্ট্র সমর্থন করবে না। ঢাকাস্থ কনসার জেনারেল আর্চার ব্লাড ছিলেন বাঙালিদের আন্দোলনের প্রতি সমেবদনাশীল। তিনি সেই সময় ওয়াশিংটনে যে রিপোর্ট পাঠান সেক্রেটারী অব স্টেট উইলিয়াম রজার্স সে সম্পর্কে মন্তব্য করেন-Our deplomat at Dacca is sending petitions instead of sending peports.এপ্রিল মাসের প্রথম দিকেই আর্চার ব্লাডকে প্রত্যাহার করা হয়।
কিসিঞ্জার ভারতের ওপর চাপ প্রয়োগ করেই ক্ষান্ত হননি। কিসিঞ্জার SRG (Senior Review Group) NSC (National Security Council) WSAG (Washington Special Action Group) এর একাধিক জরুরি বৈঠকে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার নিমিত্তে নব নব কৌশল উদ্ভাবন করে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ বানচাল করতে সচেষ্ট হন।
১৯৭১ সালের ৯ আগস্ট ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। কিসিঞ্জার এই চুক্তিকে (Bambshel) নামে অভিহিত করেছেন। প্রকৃতপক্ষে এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার ফলে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের হস্তক্ষেপের সম্ভাবনা ক্ষীণতর হয়। চুক্তির নবম অধ্যায়ে উল্লেখ আছে যে উভয় দেশের কারো বিরুদ্ধে যদি বহিঃআক্রমণের বিপদ দেখা দেয়, তাহলে এই বিপদ অপসারণের জন্য উভয় দেশ অবিলম্বে পারস্পরিক আলোচনায় বসবে এবং তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। এই সময় বাংলাদেশের মস্কোপন্থী রাজনৈতিক দলগুলোসহ স্বাধীনতার স্বপক্ষে অন্যান্য দল সমন্বয়ে জাতীয় মুক্তি ফ্রন্ট বা ঐক্য ফ্রন্ট গঠিত হলে রাশিয়ার সমর্থন আরও কার্যকরী হতে পারে এই ধারণার বশবর্তী হয়ে একটি ফ্রন্ট গঠনের উদ্যোগ নেয় নয়। খোন্দকার মোশতাককে এই ফ্রন্ট গঠনে সমর্থন জানাতে অনুরোধ করা হলে তিনি আসন্ন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ অধিবেশনে বাংলাদেশের নেতৃত্ব করার জন্য নিউইয়র্ক যাওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ভারত সরকারের সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আলম চাষীকে তিনি ৫ সেপ্টেম্বর দিল্লি পাঠান।
এই সময় সিনেটর কেনেডি প্রকাশ করেন যে ভিয়েতনামে ও ব্রাজিলের মতো পুলিশ বিশেষজ্ঞ বরার্ট জ্যাকসনকে ঢাকাস্থ US AID কর্তৃক নিয়োগ করা হয়েছে ।টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানা যায় যে, ৮ সেপ্টেম্বর
পৃষ্ঠা-২৪৯

ইসলামাবাদে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত জোসেফ ফারল্যান্ড ইয়াহিয়াকে এই প্রস্তাব করেন যে, বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাককে জানিয়ে রাখতে চান যে, মোশতাকের সঙ্গে ইয়াহিয়া গোপন আলোচনা শুরু করতে সম্মত রয়েছেন। মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের আন্ডার সেক্রেটারী জন আউইন, ডেপটি এসিস্টেন্ট সেক্রেটারী ভ্যান হোলেন এবং US AID-এর মরিস উইলিয়াম ভারতের রাষ্ট্রদূত এল, কে, ঝাকে জানান যে, যুক্তরাষ্ট্রে কনস্যূলেট সদস্যরা বাংলাদেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করেছে বাংলাদেশ পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার পন্থা উদ্ভাবন করেছেন। বাংলাদেশের জাতীয় পরিষদের সদস্যদের একাংশ প্রভাবান্বিত করে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে পাকিস্তানের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য একটি রাজনৈতিক আপোষ ফর্মুলা তৈরিই এই যোগাযোগের উদ্দেশ্য ছিল।
২০ সেপ্টেম্বর অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট জানতে পারেন যে দুজন জাতীয় পরিষদের সদস্য মার্কিন কনস্যুলেট জেনারেলের সঙ্গে দেখা করেছেন। ভারত ও বাংলাদেশ সরকার নিশ্চিত হন যে খন্দকার মোশতাক ও মাহবুবুল আলম চাষী এবং কতিপয় সদস্য অত্যন্ত গোপনে মার্কিন কূটনৈতিকদের সঙ্গে যোগযোগ করে চলেছেন। এ প্রসঙ্গে কিসিঞ্জার নিজেই স্বীকার করেছেন-
We established contact with the Bangladesh people in Calcutta during August, September and October of this year, no fewer than eight such contacts took place. We approached President Yahya Khan three times on order to begin negotiation with the Bangladesh people in Calcutta. (Congressional Records, December, 9, 1971) মার্কিনদের সঙ্গে এই গোপন যোগাযোগের খবর জানাজানি হয়ে যাওয়ার ফলে। খন্দকার মোশতাকের নিউইয়র্ক যাত্রা বাতিল করে দেওয়া হয়। কারণ যুক্তরাষ্ট্রে গিয়ে তিনি যদি অখন্ড পাকিস্তানের মধ্যেই ছয় দফা ভিত্তিক স্বায়ত্তশাসন লাভের মাধ্যমে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে বক্তৃতা করতেন তাহলে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া ব্যাহত হতো। আট সদস্য বিশিষ্ট বাংলাদেশের প্রতিনিধি দল ২১ সেপ্টেম্বর নিউইয়র্ক যাত্রা করেন এবং যুক্তরাজ্যে অবস্থানরত বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী এই প্রতিনিধি দলের নেতৃত্ব দেন।
তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভার তীব্র বিরোধিতা করেন উচ্চাভিলাসি শেখ মনি। খন্দকার মোশতাক ও শেখ মনির উদ্দেশ্য ছিল অভিন্ন। তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভা মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনায় চরমভাবে ব্যর্থ ও তাজউদ্দিন যতদিন ক্ষমতায় থাকেন। ততদিন ভারত বাংলাদেশকে স্বীকতি দেবে না এমন ধরনের অপপ্রচার চালানো হয়। শেখ মনি তাজউদ্দিন মন্ত্রিসভা বাতিল করার দাবি করেন এবং সেস্থলে চার
পৃষ্ঠা-২৫০

ছাত্রনেতা কর্তৃক যুদ্ধ পরিচালনার দাবি তোলা হয়। কামারুজ্জামান, ইউসুফ আলী গ্রুপটিও বেশ তৎপর হয়ে ওঠে। প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার ভারতের টীড়ানক হয়ে পড়ায় স্বাধীনতা অর্জন অসম্ভব এ ধারণায় কামারুজ্জামানের নেতৃত্বে সরকার গঠনে চেষ্টা করা হয়। ২৫ সেপ্টেম্বর দেবেন শিকদারের সভাপতিত্বে কোলকাতায় এক সভায় কামারুজ্জামান-ইউসুফ আলী বিদ্রোহ গ্রুপের সঙ্গে দেবেন শিকদার শর্তহীনভাবে হাত মেলান।
খোন্দকার মোশতাকের সমর্থকরা এই প্রচার চালাতে থাকে যে, স্বাধীনতা ও শেখ মুজিবের মুক্তি দুটো এক সাথে সম্ভব নয়। শেখ মুজিবকে জীবীত মুক্তি দিয়ে তারা এক পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসনের ভিত্তিতে থাকতে সম্মত ছিলেন। ১১ সেপ্টেম্বর এনায়েত হোসেন খানের নেতৃত্বে ৪০ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব পেশ করেন। আব্দুর রব সেরনিয়াবাত ও শেখ আব্দুল আজিজ এই গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। তাজউদ্দিন ২০ অক্টোবর আওয়ামী লীগ ওয়ার্ক কমিটির বৈঠক ডাকেন। ২০ ও ২১ অক্টোবর বৈঠক চলার পর সৈয়দ নজরুল ও তাজউদ্দিন ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে জরুরি আলোচনার জন্য দিল্লি যান এবং ২৭ ও ২৮ অক্টোবর পুনরায় বৈঠকে বসেন। সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য তাজউদ্দিনের পক্ষে থাকায় বিরোধি সদস্যরা তাজউদ্দিনের পদত্যাগ দাবি উত্থাপন করা থেকে বিরত থাকেন।
ইন্দিরা গান্ধী ২৪ অক্টোবর থেকে ১৯ দিনের জন্য পশ্চিম ইউরোপ এবং যুক্তরাষ্ট্র সফর করেন। বাংলাদেশের পক্ষে জনমত সৃষ্টি ও ভারতের শরণার্থী সমস্যা প্রভাবশালী করার জন্য রাষ্ট্র প্রধানদের অবহিত করাই এ সফরের উদ্দেশ্য ছিল। এদিকে কিসিঞ্জার ২৬ অক্টোবর চীন থেকে ফিরে ইয়াহিয়া জান্তার পক্ষে কর্মব্যস্ত হয়ে পড়েন। একটি পাকিস্তানি প্রতিনিধিদল জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বে চীন সফর করেন। চীন ভারতের নিন্দা জ্ঞাপন ছাড়া প্রত্যক্ষভাবে যুদ্ধে জড়িত হওয়ার কোনো অংগীকার করা থেকে সুকৌশলে বিরত থাকে।
পৃষ্ঠা-২৫১

অষ্টম অধ্যায়
বাঙালির স্বাধীনতা অর্জন
৩ ডিসেম্বর পাকিস্তান বিমান বাহিনীর বোমারু বিমানগুলো ভারতের কয়েকটি বিমান ঘাঁটির উপর বোমা বর্ষণের ফলে সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়। মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যখন পলায়নপর পাকিস্তানিদের পরাজিত করে ঢাকার পথে বিজয় অভিযানে ব্যস্ত, তখন ৯ ডিসেম্বর ভিয়েতনাম ও ফিলিপিন উপকলে অবস্থিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সপ্তম নৌবহরকে বঙ্গোপসাগরের অভিমুখে ধাবিত করা হয়। পাকিস্তান ১৯৫৯ সালের মার্চ সাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি (SEATO) মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ সামরিক হস্তক্ষেপ দাবি করে।
৩ ডিসেম্বর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হওয়ায় ৬ ঘন্টার মধ্যে পাকিস্তান দ্বিপাক্ষিক চুক্তি মোতাবেক যুক্তরাষ্ট্রের দায়বদ্ধতার কথা উল্লেখ করে। মার্কিন প্রতিনিধি জর্জ বুশ ৪ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ও ভারত এবং পাকিস্তানের সৈন্য নিজ নিজ সীমান্তে প্রত্যাহারের দাবি জানান। অপর পক্ষে রাশিয়া ৫ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদে পাকবাহিনী সহিংসতা রোধ করে বর্তমান সংঘর্ষের অবসানের প্রস্তাব করে। ৬ ডিসেম্বর ভারত বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। তারপর ভুটান বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে। ঐ দিন WASAG-এর বৈঠক সিপি আই এ প্রধান রিচার্ড হেলম জানান। যে আগামী দশ দিনের মধ্যে ভারত পূর্ব পাকিস্তানে এক তরফা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দিতে সমর্থ হবে। ৬ ডিসেম্বর WASAG-এর বৈঠকে ভারতের যুদ্ধ বিরতি মেনে নেওয়ার জন্য সোভিয়েতের উপর চাপ প্রয়োগের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।
সপ্তম নৌবহর ফিলিস্তিন উপকূল থেকে বঙ্গোপসাগরে পৌছাতে চার পাঁচ দিন সময় লাগে। পাকিস্তানিরা তখন পশ্চাদপসারণে ব্যস্ত। হতোদমারাও ফরমান আলী ঢাকাস্থ জাতিসংঘের মহাসচিব পলমার্ক হেনরিকে অবিলম্বে যুদ্ধ বিরতি ও পাকিস্তানি সৈন্যদের সরিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করার অনুরোধ করেন। পলক হেনরি যথারীতি ঢাকাস্থ আমেরিকান রাশিয়ান, ব্রিটিশ ও ফরাসী দূতাবাসকে অবাহিত করেন। নিরাপত্তা পরিষদের যখন এই প্রস্তাব নিয়ে আলোচনা হচ্ছিল, তখন সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর অভিমুখে ধাবমান। ইয়াহিয়া যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপের প্রত্যাশা উপরিউক্ত প্রস্তাব বাতিল করে দেয়া হয় ।
পৃষ্ঠা-২৫২

সপ্তম নৌবহর বঙ্গোপসাগর উপকূলে পৌছানোর সময় দেবার জন্য যে অবস্থায় আছে সেই অবস্থায় যুদ্ধ বিরতি কার্যকর করার জন্য ভারতকে রাজি করানোর জন্য রাশিয়ার ওপরে সর্বাধিক চাপ প্রয়োগ করা হয়। ১০ ডিসেম্বর মার্কিন সপ্তম নৌবহর মালাক্কা প্রণালি পৌছে যায়। কিসিঞ্জার এই মর্মে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন যে ভারতকে যুদ্ধ বিরতিতে সম্মত করতে রাশিয়া ব্যর্থ হলে যুক্তরাষ্ট্র এককভাবে সামরিক ব্যবস্থা নেবে। এ সময় প্রখ্যাত মার্কিন কলামিস্ট জ্যাক এনডারসন জানান যে, পূর্ব উপকূল থেকে রাশিয়া পাঁচটি সাবমেরিনসহ ষোলটি যুদ্ধ জাহাজ ভারত মহাসাগরে সমাবেশ করেছে এবং সপ্তম নৌবহরকে পর্যবেক্ষণ করার জন্য রাশিয়া কসমস ৪৬৪ উপগ্রহ উৎক্ষেপণ করেছে।
১১ ডিসেম্বর ডি পি ধর ভারত-সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি মোতাবেক আলোচনার জন্য মস্কো যান। ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর অগ্রাভিযান আরও দ্রুত করা হয় এবং ভারতীয় নৌবাহিনীর যুদ্ধ জাহাজগুলো সতর্কাবস্থায় মোতায়েন করা হয়। ১২ ডিসেম্বর কিসিঞ্জার সোভিয়েত প্রতিনিধি রেন্টসকে চুড়ান্তভাবে সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে ভারত যদি যুদ্ধ বিরতি না করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র সমুচিত শিক্ষা দেওয়ার জন্য সামরিক হস্তক্ষেপ করবে। পরদিন ১৩ ডিসেম্বর দুপুরে লে. জেনারেল গুল হাসান নিয়াজীকে জানান যে উত্তর ও দক্ষিণ দিক থেকে বন্ধুরা এসে পড়বে। সিকিম ও ভুটানের উত্তর সীমান্তে চীনা সৈন্য সমাবেশ সামরিক দৃষ্টিকোণ থেকে এক নাজুক পরিস্থিতির সৃষ্টি করে। ইন্দিরা গান্ধী চরম সাহসিকতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে এসব পরিস্থিতি মোকাবিলা করেন এবং সোভিয়েত রাশিয়া যুক্তরাষ্ট্রের এসব উপর্যপুরি হুমকি অগ্রাহ্য করার সিদ্ধান্ত নেন।
নিকসন ও কিসিঞ্জার আশা করেছিলেন পাকিস্তানকে সাহায্য করার জন্য চীন যে কোনো সময় ভারত আক্রমণ করবে। সে ক্ষেত্রে রাশিয়া যদি চীন আক্রমণ করে তাহলে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়াকে পারমাণবিক আঘাত করবে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে নিরাপত্তা পরিষদে বক্তৃতা প্রদান ছাড়া সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে চীনের কোনো ইতিবাচক ভূমিকা ছিল না। চৌদ্দ বছর পরে নিকসন টাইমস পত্রিকার কাছে স্বীকার করেন যে, চীনকে এই বলে প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে রাশিয়া যদি চীন আক্রমণ করে সেক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার বিরুদ্ধে পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করবে।
হুয়াংহুয়া নিউইয়র্কে ১২ ডিসেম্বর আলেকজান্ডার হেগকে জানান যে চীন শুধুমাত্র আরেকবার নিরাপত্তা পরিষদে যুদ্ধ বিরতি আলোচনা চায়, সামরিক হস্তক্ষেপের বিষয়ে নয় । সপ্তম নৌবহর তখন মালাক্কা প্রণালি অতিক্রম করেছে। সামরিক হস্তক্ষেপ চীনের এই অনাগ্রহে চব্বিশ ঘণ্টা পথের দূরত্বে সপ্তম নৌবহবকে নিশ্চল করে দেওয়া হয়। ১৩ ডিসেম্বর নিয়াজীকে জানানো হয় বন্ধুদের সাহায্য আটচল্লিশ ঘণ্টা পিছিয়ে দেওয়া হয়েছে। পাকিস্তান ও
পৃষ্ঠা-২৫৩

যুক্তরাষ্ট্র এ সময় চীনকে সামরিক হস্তক্ষেপে রাজি করানোর জন্য সর্বাত্নক চেষ্টা চালায়।
এ সময় সবচেয়ে চমকপ্রদ ঘটনা হচ্ছে প্রায় এক মাস অব্যাহতিপ্রাপ্ত পররাষ্ট্র সচিব মাহবুবুল আমল চাষী বিশেষ তৎপর হয়ে ওঠেন । বাংলাদেশে এককভাবে যুদ্ধ বিরতিতে রাজি এই মর্মে একটি বিবৃতিতে স্বাক্ষর গ্রহণের জন্য মাহবুব আলম চাষী অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের সঙ্গে দেখা করেন । বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী যখন যৌথ কমান্ডের অধীনে ভারতীয় বাহিনীর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করে চলেছে সে সময় যদি বাংলাদেশ এতরফাভাবে যুদ্ধ বিরতিতে রাজি হতো, তাহলে ভারতীয় বাহিনীর পক্ষে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পেছনে কোনো নৈতিক ভিত্তি থাকতো না। সৈয়দ নজরুল এ বিবৃতিতে স্বাক্ষরদানে অস্বীকৃতি জানান।
১৩ ডিসেম্বর নিরাপত্তা পরিষদের মূলতবি বৈঠক পুনরায় বসে। যুদ্ধ বিরতি প্রসঙ্গে রাশিয়ার তৃতীয় বার ভেটো প্রয়োগ করলে প্রস্তাবটি বাতিল হয়ে যায়।
যুক্তরাষ্ট্র এ সময় চীনা হস্তক্ষেপের আশায় মরিয়া হয়ে নিশ্চল সপ্তম নৌবহরকে পুনরায় সচল করে বঙ্গোপাগরে ধাবিত করে। ১৪ ডিসেম্বর ভোর তিনটায় ভারতীয় বিমানবাহিনী ঢাকাস্থ গভর্নর হাউসের উপর বোমা বর্ষণ করে। তখন রেডিওতে জেনারেল মানেকশ কর্তৃক পাকিস্তান বাহিনীকে আত্মসমর্পণের আহ্বান প্রচারিত হতে থাকে। সপ্তম নৌবহর যখন অজানা বিপদ নিয়ে বঙ্গোপসারের দিকে ছুটে আসছে তখন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী বিজয় উল্লাসে ঢাকার উপকণ্ঠে এসে পৌঁছেছে। গভর্নর মালেক মধ্যাহ্নে গভর্নর হাউসে যখন মন্ত্রিসভার বৈঠকে পদত্যাগের সিদ্ধান্ত নিচ্ছিলেন, তখন ভারতীয় বোমারু বিমানগুলো বোমা বর্ষণ শুরু করে। নিয়াজী কয়েকটি শর্তসাপেক্ষে বিরতির প্রস্তাবসহ মার্কিন কনসাল জেনারেল স্পিভাককে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন। শর্তের বিষয়বস্তু ছিল পাকিস্তানি বাহিনী ও বিহারীদের পূর্ব উপকূলে সমাবেশ করতে দিতে হবে। নিয়াজী সম্ভবতঃ আশা করেছিলেন সত্তম নৌবহর উপকূলে পৌছানোর পরে পাকিস্তানিদের স্থানান্তর করবে। সপ্তম নৌবহরের ভূমিকা সম্পর্কে কোনো স্পষ্ট ঘোষণা ছিল না। জেনারেল মানেকশ এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ দাবি করেন। ১৫ ডিসেম্বর ভারত ও বাংলাদেশের সম্মিলিত বাহিনী ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে এসে পড়ে এবং সপ্তম নৌবহরের সম্ভাব্য সংযোগস্থান চট্টগ্রাম উপকলও তাদের দখলে আসে। নিয়াজা ১৫ ডিসেম্বর বিকেল সাড়ে পাঁচটা থেকে পরদিন সাড়ে নয়টা পর্যন্ত বিমান আক্রমণ স্থগিত রাখার অনুরোধ করেন।
পরদিন ১৬ ডিসেম্বর মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী জাতিসংঘের প্রাতানধি জন কেলীর মাধ্যমে ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে যুদ্ধ বিরতির সময়সীমা আরো
পৃষ্ঠা-২৫৪

ছয় ঘণ্টা বৃদ্ধি করে একজন স্টাফ অফিসার পাঠাতে অনুরোধ করেন। বিকেল ৫টা ১ মিনিটে রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) লে. জেনারেল নিয়াজী ভারত বাংলাদেশের যৌথ কমান্ডের অধিনায়ক লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরোরার কাছে আত্মসমর্পণের দলিলে স্বাক্ষর দেন। বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করে বাংলাদেশ বাহিনীর ডেপুটি চীফ অব স্টাফ গ্রুপ ক্যাপ্টেন (বর্তমানে অবসর প্রাপ্ত এয়ার ভাইস মার্শাল) এ কে খোন্দকার। বিজয়ের আনন্দে সমগ্র বাংলাদেশ মুখরিত। সপ্তম নৌবহর তখন বঙ্গোপসাগরের দক্ষিণ প্রান্তে বহু মাইল সমুদ্র ভ্রমণের পরে ক্লান্ত পরিশ্রান্ত বিশ্রামরত। যুক্তরাষ্ট্রের নিকসন প্রশাসন পরাজয়ে এবং তাদের প্রকাশ্য বিরোধিতার মুখে বাংলাদেশের অভ্যুদয় পরবর্তী রাজনৈতিক পট পরিবর্তনে যুক্তরাষ্ট্রের নেপথ্য ভূমিকা আজ সর্বজনবিদিত। প্রবাসী সরকারের মধ্যে এই অন্তর্ঘাতি বিরোধ খোন্দকার মোশতাক ও শেখ মনির উচ্চাভিলাষ ও যুক্তরাষ্ট্র সরাসরি বিরোধিতা স্বাধীনতা উত্তরকালের রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের যে প্রভাব বিস্তার করে তা যে কোনো রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকের কাছে আজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য ২৫ মার্চ রাত ১-৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে গ্রেফতার করে পাক বাহিনী প্রথমে আদমজী ক্যান্টনমেন্ট কলেজে রাখেন। সেখানে এক পাঞ্জাবি সৈন্য শেখ মুজিবকে গুলি করলে তা লক্ষভ্রষ্ট হয়। এর পর শেখ মুজিবকে ফ্লাগ স্টাফ ভবনে নিরাপদ স্থানে (বর্তমানে সেনাভবন) সরিয়ে নেওয়া হয়। শেখ মুজিবকে ৩০ মার্চ করাচি স্থানান্তর করা হয়।
২৬ মার্চ ইয়াহিয়া বেতার ভাষণে বলেন Shikh Mujib is a traitor and will not to Unpunished. ইয়াহিয়া খান দেশদ্রোহিতার অভিযোগ এনে শেখ মুজিবকে বিচারের নামে প্রহসন করে হত্যা করতে চেয়েছিলেন। এ সংবাদে প্রবাসী সরকার উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। তাজউদ্দিন, সৈয়দ নজরুল ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে চরম সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধী শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষার জন্য বৃহৎ রাষ্ট্রসমূহের রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে আবেদন জানান।
শেখ মুজিবকে মিয়ানওয়ালী জেলে রাখা হয়েছিল। ১১ আগস্ট সামরিক আদালতে লোকচক্ষুর অগোচরে শেখ মুজিবের বিচার শুরু হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি অভযোগ আনা হয়। এক, দেশদ্রোহিতা দুই. পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা।
শেখ মুজিবের এ গোপন বিচার প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জুরিস্ট কমিশন তীব্র প্রতিবাদ জানায় এবং শেখ মুজিবকে হত্যার এ ষড়যন্ত্র বন্ধের আহ্বান জানান। প্রখ্যাত আইজীবী এ, কে, ব্রোহি শেখ মুজিবের পক্ষে কৌসুলী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব জার্মান সরকার, আন্তর্জাতিক বিশ্ব শান্তি সংস্থা ও অন্যান্য রাষ্ট্র প্রধানেরা ইয়াহিয়া খানকে নিবৃত্ত করার জন্য সচেষ্ট হন। শেখ
পৃষ্ঠা-২৫৫

মুজিবকে বিচারে মৃত্যদণ্ড দেওয়া হয়। কিন্তু তা কার্যকর করার আগেই ১৬ ডিসেম্বর পাকবাহিনী আত্মসমর্পণ করে। ভুট্টো তখন জাতিসংঘে পাকিস্তানে পক্ষে বক্তৃতা করতে গেছেন। তিনি পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কয়েকজন জাদরেল জেনারেলের সাহায্যে ইয়াহিয়া খানকে গৃহবন্দী করে ক্ষমতা দখল করেন।
ভুট্টোকে ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা হস্তান্তরের আগে শেখ মুজিবের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার সময় চেয়েছিলেন। ভুট্টো বুঝেছিলেন মুজিবকে হত্যা করলে ৯৮,০০০ হাজার পাকসেনার জীবন বিপন্ন হবে। তাই ২৫ ডিসেম্বর জেল গভর্নর শেখ মুজিবকে নিরাপত্তার কারণে জেলখানা থেকে তার বাসভবনে স্থানান্তর করেন। এর কয়েক দিন পরে তাকে পুনরায় একটি ইংলিশ টাইপের বাংলাতে নিয়ে যাওয়া হয়।
এখানে ভুট্টো শেখ মুজিবের সাথে দেখা করেন। ভুট্টো নিজেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক হিসেবে পরিচয় দিলে বঙ্গবন্ধু হেসে ফেলেন। শেখ মুজিবকে বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনী ও মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে অবহিত করেন। শেখ মুজিব জিজ্ঞাসা করেন তিনি মুক্ত কি না। ভুট্টো মুক্তি দেবার আগে মুজিব পাকিস্তানের সঙ্গে একটা কনফেডারেশন সম্পর্ক রাখার অনুরোধ করলে শেখ মুজিব বলেন আমার জনগণের কাছে জিজ্ঞাসা না করে আমি কিছুই বলতে পারবো না।
৮ জানুয়ারি ১৯৭২, রাত ১১ টার সময় ভুট্টো রানওয়েতে দাঁড়িয়ে শেখ মুজিবকে বিদায় জানায়। অপেক্ষমান বিমানে শেখ মুজিব উঠলে বিমান অনির্দিষ্ট পথে যাত্রা শুরু করে। পরদিন ৯ জানুয়ারি ৬-৩৬ মিনিটে লন্ডন হিথ্রো ঘাঁটিতে বিমানটি বন্দরে অবতরণ করে।
শেখ মুজিবের মুক্তির খবর স্বাধীন বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকায় ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা হর্ষধ্বনিতে ফেটে পড়ে। শেখ মুজিব লন্ডন থেকে বেগম মুজিবের সাথে কথা বলেন। এরপর সৈয়দ নজরুলের সঙ্গে কথা বলেন। শেখ মুজিব ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি গান্ধীর সঙ্গেও ফোনে আলাপ করেন এবং মুক্তিযুদ্ধে সাহায্য করার জন্য কৃতজ্ঞতা জানান। ৯ জানুয়ারি রাতে শেখ মুজিবকে নিয়ে বিশেষ বিমান আর এফ রুটে ঢাকার উদ্দেশ্যে লন্ডন ত্যাগ করে। বিমানটি সাইপ্রাসের রাজধানী নিকোশিয়ায় জ্বালানি সংগ্রহের জন্য যাত্রা বিরতি করে। দিল্লিতে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎকারের জন্য শেখ মুজিব যাত্রা বিরতি করেন। পরদিন ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ শতাব্দীর মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বিজয়ীর বেশে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে ফিরে এলেন। সমগ্র ঢাকা তখন ‘জয়বাংলা’ শ্লোগানের গগণবিদারি জয়ধ্বনি আর হর্ষোৎফুল্ল জনতার উল্লাসে মুখরিত।
পৃষ্ঠা-২৫৬

নবম অধ্যায়
উপসংহার
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের ভূমিকা অপরিসীম। ১৯৪৭ সালে হিন্দু-মুসলিম বিদ্বেষের কারণে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল মুসলিম লীগের নেতৃত্বে মুসলমান অধ্যুষিত এলাকা নিয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হলেও পাকিস্তান সৃষ্টির পরে ধর্মভিত্তিক দর্শন যথার্থতা হারিয়ে ফেলে । ভৌগলিক দিক দিয়ে দুই অংশের জনগণ প্রায় এক হাজার মাইল বিচ্ছিন্ন ছিল। এছাড়া পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে ভাষা, সংস্কৃতির কোনো সাদৃশ্য ছিল না। বিদ্যমান বৈপরিত্য পাকিস্তানে জনগণের একীভূত জাতীয় পরিচয় দিতে অসমর্থ হয়। কেবলমাত্র ধর্ম ব্যতীত দুই অংশের জনগণের মধ্যে কোনো মিলই ছিল না। পাকিস্তানের ২৩ বছরের ইতিহাস প্রমাণ করে যে, ধর্ম দুই অংশের জনগণকে একাত্ম করতে পারেনি। নব সৃষ্ট পাকিস্তানে পূর্ব বাংলার জনগণের জীবন যাত্রার মান উন্নয়নের আকাক্ষা এতোই প্রবল ছিল যে শুধুমাত্র ইসলামি চেতনা ও ভ্রাতৃত্বের শ্লোগান দিয়ে তা অবদমিত করা সম্ভব হয়নি। অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক বঞ্চনার ফলে কেবল ইসলামের দোহাই দিয়ে বাঙালি জাতিকে তার ন্যায়সঙ্গত দাবি আদায়ের সংগ্রাম থেকে বিরত রাখা যায়নি। ১৯৪০ সালের লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসিত রাষ্ট্রসমূহ গঠন করা হলে একাত্তরের ভয়াবহ মর্মান্তিক অধ্যায় এড়ানো হয়তো সম্ভব হতো। সত্তরের নির্বাচনে বাঙালি জাতি বিপুল ভোটে শেখ মুজিবের নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগকে জয়ী করার ফলে পাকিস্তান গণ পরিষদে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসাবে আবির্ভূত হয়। গণতন্ত্রের চিরাচরিত নিয়মানুযায়ী পাকিস্তানি শাসকেরা সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে অর্থাৎ জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধির হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে হয়তো পাকিস্তান রক্ষা পেত। কিন্তু বাস্তবে তা ঘটেনি। কারণ বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করলে সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে বাঙালি চিরকালই পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা ভোগ করতে যা পশ্চিম পাকিস্তানের জমিদার, ব্যবসায়ী ও সুবিধাবাদী রাজনৈতিক নেতাদের কাম্য ছিল না।
পৃষ্ঠা-২৫৭
পাকিস্তান সৃষ্টির পর পশ্চিম পাকিস্তানের সিভিল ও সেনাবাহিনীর উর্ধতন আমলারা প্রশাসনিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভ করে। প্রকৃত অর্থে পূর্ব পাকিস্তান পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশে পরিণত হয় এবং বাঙ্গালিরা পাকিস্তানের দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিকে পরিণত হয়। পাকিস্তানের, সংখ্যাগরিষ্ঠ শতকরা ছাপান্ন ভাগ জনগণ বাঙালি হওয়া সত্ত্বেও উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার অপচেষ্টা চালানো হয়। বাঙালি বুদ্ধিজীবী ছাত্র-জনতা এ হীন চক্রান্তের প্রবল বিরোধিতা করে। বাঙালিদের পদানত করার ক্ষেত্রে এটাই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের প্রথম উদ্যোগ, যা বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্ম দেয়। ভাষা আন্দোলন তাই বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের মাইল ফলক। পর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ এবং আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে। দূর্বার আন্দোলন গড়ে তোলে। পূর্ব বাংলার পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন ও অন্যান্য ন্যাযৎ সঙ্গত অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আওয়ামী লীগ অগ্রণী ভূমিকা পালন করার ফলে ক্রমশ সুসংগঠিত ও জনপ্রিয় রাজনৈতিক দলে পরিণত হয়।
১৯৫৪ সালে অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে যুক্তফষ্ট্রের বিজয় সূচিত হয় এবং মুসলিম লীগের ভরাডুবি হয়। কিন্তু যুক্তফ্রন্ট সরকারের বিরুদ্ধে পশ্চিমা শাসকদের চক্রান্ত অব্যাহত থাকে।
এক সময় আওয়ামী লীগ যুক্তফ্রন্ট থেকে বেরিয়ে আসে এবং পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন অব্যাহত রাখে। আইয়ুব খানের সামরিক শাসনামলে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের সর্বাধিক জেল জুলুম অত্যাচার সহ্য করতে হয়। শত নির্যাতন ও প্রতিকূল অবস্থা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেতে থাকে। শেখ মুজিব এ সময় ভেবেছিলেন নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে। আন্দোলন চালিয়ে ক্ষমতাসীন আইয়ুব সরকারকে হটানো সম্ভব হবে না। এ পরিস্থিতিতে বিকল্প হিসাবে ভারতীয় সাহায্যে মুক্তিযুদ্ধ করে স্বৈরশাসক বিতাড়িত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়। তিনি ১৯৬৩ সালে ভারত সরকারের সহায়তা লাভের জন্য আগরতলা গমন করেন কিন্তু আশানুরূপ সাড়া না পেয়ে হতাশাগ্রস্ত হন।
শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন শুরু করেন। এর মধ্যে ১৯৬৫ সালে ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ সংঘটিত হয়। ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ বাঙালিদের কাছে স্পষ্ট করে দেয় যে, যুদ্ধকালে পূর্ব পাকিস্তান ছিল সম্পূর্ণ অরক্ষিত। বাঙালি জাতি পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাঠামো সম্পর্কে সন্দিহান হয়ে পড়ে। এ পটভূমিতে আওয়ামী লীগ ৬ দফা কর্মসূচি ঘোষণা করে। পাকিস্তানি শাসকচক্র ৬ দফার বিরুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ে। আইয়ুব খান শুধু অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করেই ক্ষান্ত হলেন না।
পৃষ্ঠা-২৫৮
আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের ব্যাপক ধরপাকড় শুরু করলেন। অত্যাচার নির্যাতনের স্টীম রোলার চালালেন। বাঙালি জাতি ৬ দফা কর্মসূচিকে বাঁচার দাবি হিসাবে গ্রহণ করে। প্রকৃত অর্থে বাঙালির রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি সুবিধাবাদী পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের শংকিত করে তোলে। ৬ দফার বিরুদ্ধে যতই নির্যাতন চলতে লাগলো আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তা ততই বুদ্ধি পেতে লাগলো। ১৯৬৮ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক শেখ মুজিবকে ১ নং আসামী করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করার পর বাঙালি বুদ্ধিজীবী ও মধ্যবিত্ত শ্রেণির কাছে স্পষ্টই প্রতিভাত হয় যে, বাঙালির স্বায়ত্তশাসনের দাবি ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারকে নস্যাৎ করার ষড়যন্ত্রে পাকিস্তান সরকার আগরতলা মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলা শুরু করেছে। উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের তোড়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ভেসে যায় এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বাঙালির একচ্ছত্র নেতা হিসাবে আবির্ভূত হন।
সত্তরে নির্বাচনে জনগণ ৬ দফার পক্ষে ম্যান্ডেট প্রদান করে এবং আওয়ামী লীগকে বিপুল ভোটে জয়ী করে। কিন্তু গণতন্ত্রের নিয়ম অনুসারে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে সামরিক শাসকচক্র গণহত্যায় মেতে ওঠে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় শান্তিপূর্ণ সমঝোতা চেয়েছিলেন। কিন্তু পাকিস্তান সেনাবাহিনী নির্বিচারে হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করলে তিনি বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হওয়ার আহ্বান জানান। ২৬ মার্চ গভীর রাতে ওয়ারলেসের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্তৃক স্বাধীনতা ঘোষণার বাণী দেশের জেলা সদর ও প্রত্যন্ত থানা অঞ্চলে পৌছে যায়। এখানে উল্লেখ্য যে জাতীয় পরিষদ পূর্ব পাকিস্তান এবং পশ্চিম পাকিস্তানে আলাদাভাবে বসার যে প্রস্তাব ইয়াহিয়া খান ও ভুট্টো করেছিলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাতে সম্মত হয়েছিলেন কারণ ভুট্টোকে গণপরিষদ অধিবেশনে যোগদানে সম্মত করে অচল অবস্থা নিরসনপূর্বক ক্ষমতা হস্তান্তরে বাধা অপসারণ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর এই উদারতাকে ইয়াহিয়া খানের ২৬ মার্চের ভাষণে অপরাধ হিসাবে ঘোষণা করা হয়। প্রকৃতপক্ষে ছয় দফা মেনে নেওয়া পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। কারণ ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র প্রণীত হলে পাকিস্তান এক ও অখণ্ড থাকে না। ঐতিহাসিক বিশ্লেষণে এটা স্পষ্টই প্রতীয়মান হয় যে, ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিব ঘোষিত ছয় দফা স্বাধীনতা অর্জনের এক চমকপ্রদ রাজনৈতিক কৌশল। পাকিস্তানি শাসকেরা ছয়দফা আন্দোলনকে নস্যাৎ করার জন্য দেশদ্রোহিতার অভিযোগ আনতে পারলেন না। আবার ছয় দফা মেনে নেওয়াও তাদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। আর নির্বাচনের পর ৩ জানুয়ারি ১৯৭১ রেসকোর্স ময়দানে নব নির্বাচিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের যে শপথ গ্রহণ
পৃষ্ঠা-২৫৯
অনুষ্ঠান পরিচালিত হয় তাতে শেখ মুজিব ঘোষণা করেন : ছয় দফা এ জনগণের সম্পত্তি। ছয় দফার প্রশ্নে আপোষ করার ক্ষমতা নাই, জনগন সে অধিকার আমাকে দেয় নাই। বন্দুকের নলের মুখে দাঁড়িয়েও আমরা ছয় আদায় করবো।’ এমতাবস্থায় ছয় দফা দাবি সম্পর্কে আপোষ করার সকল পথ রুদ্ধ হয়ে গেল। আর পাকিস্তানিদের সঙ্গে সংঘাত অনিবার্য হয়ে উঠলো। মুজিব ৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণে ঘোষণা করলেন “এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।” ৭ মার্চের ভাষণে শেখ মুজিব বাংলাদেশের আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতা না করলেও যুদ্ধের রূপরেখা ও পাকিস্তানিদের প্রতিরোধ করার জন্য জনগণকে ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তুলে শত্রুর মোকাবেলা করতে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এতদসত্ত্বেও নিয়মতান্ত্রিক পন্থায় ছয় দফা আদায়ের লক্ষ্যে শেখ মুজিব ১৬ মার্চ থেকে ২৫ মার্চ পর্যন্ত ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে মিলিত হন। আজ এটা সর্বজন বিদিত যে, এই প্রহসনমূলক আলোচনা করে কালক্ষেপণ করাই ছিল সামরিক শাসকদের উদ্দেশ্য। কালক্ষেপণ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সমাবেশ করা হয়। অপর দিকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ছাত্র নেতৃবৃন্দ সমগ্র জাতিকে যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত করতে সচেষ্ট হন।
২৫ মার্চের ভয়াবহ রাতে পাকবাহিনী গণহত্যা শুরু করলে শেখ মুজিব স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। ইতোপূর্বে তিনি তাঁর সহকর্মীদের ভারতে গিয়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু করার নির্দেশ প্রদান করেন। তাঁর নির্দেশ অনুযায়ী বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং পূর্ব নির্ধারিত ভারতীয় সহায়তায় মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবর্তমানে তাজউদ্দিনের নেতৃত্বে প্রবাসী সরকার গঠিত হয়। প্রবাসী সরকারের অন্তর্দলীয় কোন্দল চরমে ওঠে। তাজউদ্দিন বিরোধিদের মোকাবেলা করেন এবং সমগ্র জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত সাফল্যের দিকে ধাবিত করতে সক্ষম হন। অন্যান্য রাজনৈতিক প্রতিনিধি সমন্বয়ে মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে উপদেষ্টা কমিটি গঠিত হয়। উপদেষ্টা কমিটির প্রধান কাজ ছিল প্রবাসী সরকারকে রাজনৈতিক পরামর্শ প্রদান করা। এই কমিটির কোনো প্রশাসনিক ক্ষমতা ছিল না। উপদেষ্টা পরিষদ গঠনের ফলে সোভিয়েত রাশিয়া ও অন্যান্য দেশের সমর্থন ত্বরান্বিত হয় এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে ওঠে।
বাঙালি জাতি সুদীর্ঘকাল ধরে স্বাধীনতা সংগ্রাম করেছে। এ অনতিসুদুর সময়ের অব্যাহত স্বাধীনতা সংগ্রামে ছোট বড় সকল রাজনৈতিক দলের অবদান আছে। অগণিত মানুষ অধিকার আদায়ের সংগ্রামে আত্মদান করেছেন। দলমত
পৃষ্ঠা-২৬০

নির্বিশেষে ৩০ লক্ষ মানুষ শহিদ হয়েছেন। কিন্তু এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আওয়ামী লীগের অবদান সবচেয়ে বেশি ছিল। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অসীম সাহস, অমিত তেজ ও বিরল সাংগঠনিক ক্ষমতার ফলে আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতার ক্ষেত্রে যে অবদান রাখতে সক্ষম হয় তা গগণচুম্বী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সমগ্র বাঙালি জাতির কাছে স্বাধীনতার প্রতীকে পরিণত হন এবং তাঁর নামেই লক্ষ লক্ষ মানুষ নিজ প্রাণ তুচ্ছ জ্ঞান করে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠিত হয় এবং প্রবাসী সরকারের নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগ বাঙালির পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে যাত্রা শুরু করে, নানা ঘাত প্রতিঘাতে সীমাহীন অত্যাচার নির্যাতনের শিকার হয়। ষাটের দশকে জনগণের দাবি আদায়ের ক্ষেত্রে ছয় দফা ভিত্তিক সংগ্রামে আপোষহীন ভূমিকায় ফলে আওয়ামী লীগ প্রবল জনপ্রিয়তা লাভ করে। পরিশেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনী ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে গণহত্যা শুরু করলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়। বাঙালি জাতি দীর্ঘ ন’মাসব্যাপী রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে স্বাধীনতা অর্জন করে।
পৃষ্ঠা-২৬১