প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে খালেদা জিয়ার সরকারের পাশে সেনা পরিষদ
বিএনপি জোট সরকার গঠনের পরপরই এক প্রলংকারি ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত হয়ে পরলো উপকূলীয় বিস্তীর্ণ অঞ্চল। বিশেষ ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হল উড়ির চর অঞ্চল। টেলিযোগাযোগ সহ সারাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পরেছে। ঢাকার সাথে বহির্বিশ্বের কোনও যোগাযোগ নেই। বাংলাদেশের সরকারের কাছে ত্রাণকার্য পরিচালনা করার মতো কোনও সঙ্গতিও নেই। অগুন্তি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে, বাস্তুহারা অবস্থায় জলবন্দী হয়ে পরেছে হাজার হাজার নারী-পুরুষ, শিশুসহ আবাল বৃদ্ধ বণিতা। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করা নবগঠিত সরকারের পক্ষে অসম্ভব হয়ে দেখা দিলো। দিশাহারা সরকার! এই বিপর্যয়ের হাত থেকে দুর্গতদের উদ্ধার করতে না পারলে পতন অবধারিত। খালেদা সরকারের অবস্থা টালমাটাল, আতংকগ্রস্ত সমগ্র দেশবাসী। অপ্রত্যাশিত ভাবে কামাল সিদ্দিকি আমাদের বাসায় সশরীরে এসে উপস্থিত হয়ে জানালো প্রধানমন্ত্রী আমাকে সাথে করে নিয়ে যেতে পাঠিয়েছেন বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে। যেহেতু টেলিফোন কাজ করছে না তাই তাকে এভাবে নিজেকেই আসতে হয়েছে। কোথায় যেতে হবে?
সুগন্ধায় তার কার্যালয়ে, তিনি অধীর অপেক্ষায় রয়েছেন।
এত জরুরী তলব কেনো, বিষয়টা কি? সেটা তার মুখ থেকেই শুনবি, চল। তা না হয় শুনবো, কিন্তু সুগন্ধায় মৌমাছির মতো ভনভন করা নানা বর্ণের নানা ধরণের লোকজনদের ভিড় ঠেলে সেখানে প্রধানমন্ত্রীর সাথে কথা বলতে যেতে কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছি।
অস্বস্তির কারণটা ঠিক বুঝতে পারছিনা। সেটা তুই বুঝবিও না, চল।
পৌঁছালাম সুগন্ধায়। রানী এলিজাবেথ যখন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসেছিলেন তখনএই মনোরম ভবনটি রাণীর থাকার জন্য বিশেষ ভাবে বানানো হয়েছিলো মানুষে গিজগিজ করছে সুগন্ধা।কামালের গাড়ী গিয়ে থামলো পোর্টিকোতে। গাড়ী থেকে নেমে ত্বরিত ঢুকে পড়লাম সুগন্ধার ভেতরে। কামাল আমাকে নিয়ে একটি ঘরে গিয়ে ঢুকল, পথে অনেকেই সালাম ঠুকল। ঘরে অপেক্ষায় ছিল সাব্বিহউদ্দিন। ম্যাডামকে খবর দাও। তিনি অপেক্ষাতেই আছেন। চলুন।বলে সাব্বি আমাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল যেখানে খালেদা জিয়া অবস্থান করছিলেন। আমরা প্রবেশ করতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। সালাম জানাতেই তিনি একটা সোফায় বসে ইশারায় আমাকে পাশের সোফাটাতে বসতে বললেন। পাশেই রাখা দু’টি ভিক্টোরিয়ান চেয়ারে বসল কামাল ও সাব্বি। গুরুগম্ভীর পরিবেশ। ছুটিতে ভাগ্যিস আপনি ঢাকার বাইরে যাননি, তাহলে তো আপনার সাথে যোগাযোগই করা সম্ভব হতো না। ভূমিকার পর আসল বক্তব্য শুরু করলেন প্রধানমন্ত্রী সর্বনাশা ঘূর্ণিঝড় সরকারের জন্য এমন এক সমস্যার সৃষ্টি করেছে যার সমাধানের সামর্থ সরকারের নেই। পুরো দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙ্গে পরেছে। এই অবস্থায় সরকার যদি ত্রাণকাজ এবং ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনে ব্যর্থ হয় তাহলে সরকারের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পরবে। আমাদের বিমান বাহিনী এবং সেনা বাহিনীর কাছে যেসব হেলিকপ্টার রয়েছে সেগুলো বিধ্বস্ত এলাকায় যেতেই পারছে না। এই অবস্থায় কামাল আর সাব্বির পরামর্শ অনুযায়ী আপনাকে ডেকে এনেছি। ভাই, আমি আকুল আবেদন জানাচ্ছি আপনি যথাসাধ্য চেষ্টা করে দেখুন যদি কোনও উপায় বের করা যায়।
আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে সমস্যার সমাধানের পথ খুঁজে পাচ্ছেন না, সেইক্ষেত্রে আমার মতো একজন অতি সাধারণ মানুষের পক্ষে কি করা সম্ভব সেটা ঠিক বুঝতে পারছিনা ভাবী!
আমি জানতে পেরেছি বিদেশে আপনার অনেক ক্ষমতাশালী বন্ধুবান্ধব আছেন, তাদের মাধ্যমে কোনও রাস্তা বের করা সম্ভব নয় কি? আমি চুপ করে আছি দেখে বেগম জিয়া আবারও অনুরোধ জানালেন প্লিজ ভাই, চেষ্টা করে দেখুন। শুধু সরকারের জন্য নয়, অসহায় ক্ষতিগ্রস্তদের স্বার্থে! কিন্তু ভাবী, দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে অকেজো হয়ে পরেছে সেক্ষেত্রে এখান থেকে বিদেশে যোগাযোগ করাও তো সম্ভব নয়। আপনার সুবিধা মতো বাইরে যেকোনো দেশে গিয়ে যোগাযোগ করুন। আজই বেরিয়ে পড়ুন। কামাল, আপনি সব বন্দোবস্ত করে দিন।
আপনার অনুরোধ রক্ষা করে আমি আমার সাধ্যমত সর্বাত্মক চেষ্টা করবো, কিন্তু ফলাফল কি হবে সে সম্পর্কে আমি কিছুই বলতে পারছি না। তবে আপনাকে কথা দিতে হবে, আপনি যে আমাকে এমন একটি স্পর্শকাতর গুরু দায়িত্ব দিচ্ছেন এই কথাটা আমাদের চারজন ছাড়া অন্য কেউ কখনো জানতে পারবে না। ফলাফল যাই হউক না কেনো।
কথা দিলাম। ধন্যবাদ। এবার তাহলে আসি। যদি সম্ভব হয় চেষ্টা করবো আজই বেরিয়ে পড়তে।
বিদায় নিয়ে তিনজনই এসে বসলাম কামালের ঘরে। আচ্ছা কামাল, এ সমস্তের মানে কি? প্রধানমন্ত্রীর কাছে কি প্রমাণ করতে চাচ্ছিস তোরা, সারা বিশ্ব আমার ইচ্ছামত চলছে? প্রধানমন্ত্রীকে এ ধরনের পড়া পড়িয়ে আমাকে বিব্রত করে বন্ধুত্বের ভালোই প্রতিদান দিচ্ছিস কিছুটা রেগেই বললাম। সাব্বি মাথা নিচু করে এমন ভাবে নিশ্চুপ বসেছিল যেনো চোর ধরা পড়ে গেছে। ইতিমধ্যে বেয়ারা এসে চা-নাস্তা পরিবেশন কোরল। সাব্বি বললো
কামাল ভাই, আমার এক বন্ধুর ট্রাভেল এজেন্সি আছে। তার কাছে লোক পাঠালে হয়তো আজই ব্যাংকক পৌঁছানোর ব্যবস্থা করা যেতে পারে। সেখান থেকে তিনি যেখানে ইচ্ছে যেতে পারবেন।
হ্যাঁ, তুমি নিজেই যাও। সাব্বি বেরিয়ে যাবার আগে জানতে চাইল টিকেটটা কি সঙ্গে করেই নিয়ে আসবো? অবশ্যই, যদি সম্ভব হয়। সাব্বি চলে যাবার পর ঘরে রইলাম শুধু আমরা দু’জন। কামাল ইন্টারকমে কাকে যেন হুকুম দিল যতক্ষণ তার রুমে গেস্ট রয়েছেন ততক্ষণ তার রুমে কাউকে যেন ঢুকতে না দেয়া হয়। বন্ধু, এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের সময় থেকে নির্বাচন পর্যন্ত পর্দার অন্তরালে তুই যে ভূমিকা রেখেছিস সে সম্পর্কে ম্যাডাম ছাড়া অন্য কেউই অবগত নয়। তবে তার কিছুটা আমি আন্দাজ করতে পেরেছি। রসিকতা করে বললাম
পিটার কুস্টার কানে কানে কিছু বলেছে নাকি? দু’জনেই হেসে উঠলাম।
কত টাকার দরকার?
কিছু ক্যাশ ডলার দিয়ে দে, তাতে না কুলোলে Credit Card ব্যবহার করবো। ফিরে এসে সব হিসাব তোকে কড়ায়-গণ্ডায় বুঝিয়ে দেবো। That’s not important really. To be honest, আমাকে তোরা বিশেষ করে তুই বিস্মিত করেছিস।
কেনও?
১৫ই আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও তোদের প্রতি যে ধরনের নিষ্ঠুর অবিচার এবং বিশ্বাসঘাতকতা জিয়া করেছেন এরপরও তোরা জাতির প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নিঃস্বার্থ ভাবে সাধ্যমতো ইতিবাচক অবদান রেখে যাচ্ছিস কোনও প্রতিদানের প্রত্যাশা ছাড়াই। এই নিঃস্বার্থ ত্যাগের সঠিক মূল্যায়ন কি এই দুর্ভাগা জাতি করবে কখনো!
ভুল বললি। প্রতিদানের প্রত্যাশা অবশ্যই আছে। সেটা হল, মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের যে শপথ আমরা নিয়েছিলাম সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। সেই সংগ্রামে নিজেকে আহূতি দিতে কুণ্ঠিত হব না যতদিন বেঁচে থাকবো। সংঘটিত ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর-এর ঐতিহাসিক সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর সেনা পরিষদের নেতৃত্ব জেনারেল জিয়াকে পরিকল্পনা অনুযায়ী ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করে। সেই জিয়াই পরে সামরিক বাহিনীতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার ধুয়া তুলে সেনা পরিষদের নিবেদিতপ্রাণ,পরীক্ষিত তিন হাজারেরও বেশী দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যকে ষড়যন্ত্রমূলক নারকীয় হত্যাযজ্ঞে যেভাবে হত্যা করেন সেটাই আমার বক্তব্যের পক্ষে সবচেয়ে বড় প্রমাণ নয় কি? সেনা পরিষদের সাথে যে অন্যায় জিয়া করেছিলেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লক্ষে তার শাস্তি তো তিনি এড়াতে পারেননি যদিও পরকালের বিচারটা এখনও বাকি রয়েছে। আর একটা কথা তোকে বলতে চাই,
আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি মোনাফেকি, প্রতিহিংসা পরায়ণতা এবং মিথ্যাচারের উপর ভিত্তি করে কোনও রাজনীতিই বেশিদিন টিকে থাকতে পারে না। মিথ্যার বেসাতি সাময়িক চমক সৃষ্টি করতে পারে বটে, কিন্তু অল্প সময়েই সেটা ফিকে হয়ে যায়। অন্যদিকে সত্য চিরভাস্বর।
ডালিম, তুই তো সব সময় বলে থাকিস অতীতের দিকে না চেয়ে ভবিষ্যতের দিকে দেখা উচিৎ। তাহলে চীন সফরকালে জিয়া চাচার(আমার আব্বা) উপস্থিতিতে তোকে জড়িয়ে ধরে বলেছিলেন, ‘Let us forget and forgive and start afresh’ তার সেই প্রস্তাব তোরা প্রত্যাখ্যান করলি কেনো?
অতীত নিয়ে বুঁদ হয়ে থাকা আমাদের অভ্যাস নয় ঠিকই, তবে অতীতের ভুলভ্রান্তি থেকে শিক্ষা না নিলে ভবিষ্যতে সঠিক পথে এগুনো কিভাবে সম্ভব? তার উক্তি ‘Let us forget and forgive and start afresh’, ছিল বর্ণচোরার আর একটা কুটিল চাল আমাদের ফাঁদে ফেলার। আগস্ট আর নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর জাতীয়শত্রু আওয়ামী-বাকশালী চক্র যখন বিলুপ্তির পথে তখন ভারতের সাথে সমঝোতার পর তাদের মানসকন্যা হাসিনাকে ভারত থেকে সসম্মানে ফিরিয়ে এনে তার নেতৃত্বে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করে জাতীয় রাজনীতিতে মৃতপ্রায় আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করে সহ-অবস্থানের রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন জেনারেল জিয়া। সেই বাস্তবতার নিরিখে আমাদের পক্ষে তার সাথে নতুন করে কি শুরু করা সম্ভব হতো? কিছু মনে করিসনে, তুইও একজন দেশপ্রেমিক তবে তোর আর আমাদের মধ্যে একটু ফারাক আছে দোস্ত। তুই হলি চোখ-কান খোলা রেখে চলায় অভ্যস্ত একজন দেশপ্রেমিক, আর আমরা হচ্ছি ‘৭১-এরস্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আপোষহীন নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। আমার কথায় কামাল বিব্রত বোধ করছিলো। তাই সান্ত্বনা দিতে বললাম এটাও আমাদের জানা আছে তুই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন, বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত একজন চৌকস আমলা। তাই তুই দেশি-বিদেশী বিভিন্ন মহলের সুনজরে রয়েছিস।
আমাদের তোর মতো Credentials নাই ভাই। তাই আমাদের একমাত্র নিজেদের সীমিত বুদ্ধিমত্তার উপর নির্ভর করেই বাঁচতে হচ্ছে এবং হবে। Actually, Zia was highly ambitious but had over estimated himself at times. His offer was a very foolish bait to allure us within his fold and crush at his will. Because, he had been under continuous threat and fear that it is only we and no one else who could unmask his dirty face and duality of his character to the people if need be. Therefore, how could we offer ourselves to be entrapped? Hope, I have made myself clear. You are smart enough to fathom the rest. তাহলে খালেদা জিয়াকে সাহায্য করছিস কেনো? জবাবটা তো তোর ম্যাডামই দিয়ে দিয়েছিলেন আজকের আলাপ কালে, দেশ এবং দেশবাসীর স্বার্থে। মন দিয়ে শুনিসনি বোধহয়। হাসতে হাসতে আরও বললাম, খালেদার প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি যখন হতে পেরেছিস তখন ভেতরের খেলার অনেক কিছুই সময়মতো জানতে পারবি। But, I must say it’s a very smart move. This has removed many misgivings all around. At the same time this would also give you the opportunity to be one of Khaleda’s most close trusted confidant. With time you would also become a sought for blue eyed boy in the capitals of may powerful countries particularly in the West due to your credentials, character traits and brilliant track record. পক্ষান্তরে আমরা তো বর্তমানে সবক্ষেত্রেই অপাংক্তেয়। কোথাও তেমন একটা গ্রহণযোগ্যতাও নেই। সবখানেই বর্জনীয়। কামাল আমার কথাগুলো খুবই মনোযোগের সাথে শুনে বললো
তোর প্রতিটি কথা গুরুত্বপূর্ণ। তোদের সাথে আমার এবং আমার মতো অন্য কারো কোনও তুলনাই হয় না। একসময় একজন স্টাফ এসে কামালকে একটা এনভেলাপ দিলো, সেটা কামাল আমাকে দিয়ে বলল এখানে পথে খরচের জন্য কিছু বৈদেশিক মুদ্রা আছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই সাব্বি ফিরে এসে জানালো-আজ রাতেই থাই এর ফ্লাইটে আমার ব্যাংকক যাবার সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। টিকেটটা আমাকে দিয়ে কামাল বললো
তুই বাসায় চলে যা, সময়মত আমার এক অফিসার তোকে বাসা থেকে নিয়ে ফ্লাইটে তুলে দিয়ে আসবে। চল, তোকে গাড়ীঅব্দি পৌঁছে দিয়ে আসি। বাসায় ফিরে নিম্মিকে জানালাম, কয়েকদিনের জন্য দেশের বাইরে যেতে হবে সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর অফিসে বৈঠকে। আজ রাতেই যাবার ব্যবস্থা হয়েছে। আমার স্যুট ক্যারিয়ার আর হ্যান্ডব্যাগটাতে প্রয়োজনীয় সবকিছু গোছগাছ করে দাও। সময় মতো কামালের প্রটোকল অফিসার এসে আমাকে নিয়ে যাবে। কোথায় যাচ্ছো? নিম্মি খানিকটা উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলো।
প্রথমে ব্যাংকক। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করো, বেশি সময় নেই, তাই ঝটপট তৈরি হয়ে নিতে হবে।
সময়মত প্রটোকল অফিসার গাড়ী নিয়ে উপস্থিত হলেন। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে জিয়া ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। সাথে নিম্মি এবং মহুয়া এসেছে।গাড়ী থেকে নামতেই দেখি এয়ারপোর্ট-এর সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য অপেক্ষা করছেন। বুঝতে পারলাম, প্রাইম মিনিস্টারের অফিস থেকে নির্দেশ পাঠান হয়েছে। তারা আমাদের VIP Lounge-এর একটা কামরায় নিয়ে গেলেন। খাতির যত্নের আতিশয্য চোখে পরার মতো। প্রটোকল অফিসার জানালেন, Flight on time. তিনি আমার মালপত্র, টিকেট আর পাসপোর্ট নিয়ে এয়ারপোর্টের কর্মকর্তাদের সাথে বেরিয়ে গেলেন। একজন তদারককারিকে রেখে গেলেন যাতে আমাদের কোনও অসুবিধে না হয়। আমরা চা নাস্তা খেতে খেতে নিজেদের মধ্যে টুকটাক কথা বলছিলাম। এরই মধ্যে একজন উর্দি পরা অফিসার এসে কাঁচুমাচু হয়ে আমাকে অনুরোধ করলেন স্যার, আমার একজন সিনিয়র অফিসার বিশেষভাবে আমাকে পাঠিয়েছেন, তিনি আপনার সাথে সাক্ষাত করে সালাম জানাতে ইচ্ছুক।
বেশতো, নিয়ে আসুন তাকে। সম্মতি পেয়ে অফিসার ছুটে বেরিয়ে গেলেন। ভদ্রলোক বেরিয়ে যাবার পর আমি নিম্মি এবং মহুয়াকে লক্ষ্য করে বললাম কি ব্যাপার বল তো? জানা ছিল অদ্ভুত জীবজন্তু দেখার জন্য উৎসুক লোকজন চিড়িয়াখানায় যায়, আমিও কি সেই পর্যায়ে পরলাম নাকি! মহুয়া জবাব দিল ভাইয়া, তোমার উপস্থিতিটা জানাজানি হলে এয়ারপোর্টের পাবলিক হুমড়ি খেয়ে পরতো মেজর ডালিমকে এক নজর দেখার জন্য। তোমাকে নিয়ে সব মহলেই এত বেশি কৌতূহল যা দেখে আমরাও হতবাক হয়ে যাই। তুমি বাংলাদেশের মানুষের কাছে কিংবদন্তির এক রহস্য নায়ক। তাই নাকি, ভাববার কথা! ভদ্রলোকটি একজন বয়স্ক ব্যক্তিকে সাথে নিয়ে হাজির হলেন। জানলাম, পদবীতে তিনি সিভিল এভিয়েশনের ডেপুটি ডিরেক্টর এয়ারপোর্ট ইন চার্জ। সালাম ও কুশলাদি বিনিময়ের পর তিনি জানালেন প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে বিশেষ নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনার উপস্থিতিটা যাতে গোপন রাখা হয়। সেক্ষেত্রে আপনার সাথে দেখা করার অনুরোধ জানানোটা আপনি কিভাবে গ্রহণ করবেন সেটা বিবেচনায় না এনেই আবেগের তাড়নায় অনুরোধটা করেই ফেললাম। আপনি কিছু মনে করেননি তো, স্যার? আরে না না এতে মনে করার কিছুই নেই আপনি বসুন।
পাশের একটা সোফায় বসলেন ভদ্রলোক।চাচলবে?বলেই ইশারায় পরিচারককে চা পরিবেশন করতে বললাম। স্যার, সারা দেশবাসী বুড়ো থেকে বাচ্চারাও আপনার নাম জানে। কিন্তু স্বচক্ষে দেখার সৌভাগ্য খুব অল্পজনেরই হয়েছে। ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর আমি আপনার ঘোষণা শুনে দুই রাকাত নফল নামাজ পড়ে আপনাদের জন্য দোয়া করেছি। আপনারা সবাই জাতীয় বীর। তখন থেকেই চাক্ষুষ আপনাকে দেখার একটা বাসনা মনে মনে লালন করে এসেছি, আল্লাহ্পাক আজ আমার সেই মনোবাসনা পূরণ করলেন। আমি মন থেকে দোয়া করছি, আপনি দীর্ঘজীবী হউন। আপনাদের মতো কৃতী নির্ভীক সন্তানরাই দেশকে প্রগতি এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যতের পথে নিয়ে যেতে পারে। এটা শুধু আমার বিশ্বাসই নয়, দেশের অধিকাংশ মানুষেরও কথা। ভদ্রলোকের চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ছিল কথা বলতে বলতে। বয়স্ক একজন ইমানদার নামাজি ভদ্রলোক নিজের আবেগকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারছিলেন না। সব শুনে আমি বললাম আপনার দোয়াতে আমাদের স্মরণ রাখবেন। আপনাদের দোয়াই আমাদের মনোবল, প্রত্যয় আরও সবল করে তুলবে বৃহত্তর দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কাজ করে যাবার জন্য। আমি আসি স্যার, সাক্ষাৎ দিতে সম্মত হওয়ায় অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম আপনার মতো একজন বুজুর্গ-এর সাথে মিলিত হয়ে দোয়া নিতে পেরে আমি নিজেকেই ধন্য মনে করছি। সালাম জানিয়ে বেরিয়ে গেলেন দু’জনই। ভাইয়া,দেখলেতো? চিড়িয়াখানায় অদ্ভুত জন্তু-জানোয়ার দেখে আবেগ বিহ্বলতায় কারো চোখ থেকে পানি গড়িয়ে পড়ে না নিশ্চয়ই! আমি আগে যা বলেছিলাম, সেটাই প্রমাণ করে গেলেন এক বর্ষীয়ান পরহেজগার ভদ্রলোক। মহুয়ার কথার কোনও জবাব না দিয়ে মনে মনে আল্লাহ্পাকের হাজার শুক্রিয়া আদায় করছিলাম। এত অপপ্রচার ও নিষ্পেষণের পরও এখনো দেশবাসীর মনে আমাদের জন্য দোয়া এবং ভালোবাসা রয়েছে! রয়েছে অনেক প্রত্যাশা! একসময় এনাউন্সমেন্ট হল বোর্ডিং শুরু হয়েছে। এরপরও ১০-১৫ মিনিট অপেক্ষা করতে হবে। কারণ, প্রথা অনুযায়ী সব যাত্রী প্লেনে ওঠার পরই VIP Passengers are taken for boarding যাতে তাদের লাইন-এ দাঁড়িয়ে সময় নষ্ট করতে না হয়। যথাসময়ে প্রটোকল অফিসার এসে বললেন
চলুন স্যার, ভাবী, আপা আপনারাও চলুন।
নিম্মি, মহুয়াসহ আমরা প্লেনের ভেতর ঢুকতেই স্মিতহাস্যে এক বিমানবালা আমাদের সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে আমাকে আমার নির্দিষ্ট আসনে বসিয়ে দিলো। VIP কোনও যাত্রী থাকলে নিয়ম অনুযায়ী এয়ারপোর্ট অথরিটি আগেই ককপিট এবং ক্যাবিন ক্রুদের জানিয়ে দেয় Special handling-এর জন্য। নিম্মি বলল যেখানেই থাকো টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ঠিক হলে ফোন কোরো। নিশ্চয়ই। প্রটোকল অফিসারকে বললাম, আপনি অনেক কষ্ট করলেন ভাই তার জন্য ধন্যবাদ। মোটেও নয়, স্যার। আমারই সৌভাগ্য আপনাকে এত কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেলাম কামাল স্যারের সৌজন্যে। আমি ভাবীদের বাসায় পৌঁছে দিয়ে ফিরবো। তারা সবাই বিদায় নিয়ে চলে গেল। সাথে সাথেই প্লেনের দরজা বন্ধ করে দেয়া হল। এক সময় প্লেন আকাশে উড়াল দিলো। আমি ব্যাগ থেকে নেলসন ম্যান্ডেলার জীবনের উপর সদ্য প্রকাশিত বইটি বের করে তাতে মনঃসংযোগ করলাম। এক সময় বিমানবালা খাবারের মেন্যু রেখে গেলো। মিয়ানমার থেকে ফিলিপিনস পর্যন্ত খাবারের মধ্যে ফ্লেভারে বেশ কিছুটা মিল রয়েছে। থাইফুড এর মেন্যু থেকে পছন্দের খাবারের কয়েকটা আইটেম বেছে নিলাম। সিট বেল্ট খোলার ঘোষণা হতেই কেবিন ক্রুরা খাবার পরিবেশনায় ব্যস্ত হয়ে পরলো।
নেলসন ম্যান্ডেলা, রবার্ট মুগাবে, জমু কেনিয়াটা, জুলিয়াস নায়ারে, আরাপ মই, ইদি আমিন, আল বশির, তোরাবি, মুসেবেনি, জর্জ গারাং, মোহাম্মদ আবদুল্লাহ, আইদিত, মোয়াম্মর গাদ্দাফি, নুরি মিজরি, আয়াতুল্লাহ খোমেনি, লি কুয়ান ইউ, মাহাথির মোহাম্মাদ, দেং শিয়াও পিং, হুয়ো গুয়ো ফেং, প্রিন্স সিহানুক,মারকোস, কোরাজন আকিনো,ইয়াসির আরাফাত ছাড়াও অনেক সংগ্রামী নেতার সাথে পরিচিত হওয়ার সৌভাগ্য আমার হয়েছে বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে।
বইটাতে ডুবে ছিলাম। খাবারের ট্রলি নিয়ে হাসি মুখে একজন বিমানবালা খাবার পরিবেশন করে ড্রিংকসের ট্রলির দিকে দৃষ্টি ফিরিয়ে জিজ্ঞেস করল What would you like, Sir?
Just a glass of plain water please. বিমানবালা গ্লাসে পানি ঢেলে দিলো। Thanks. You are most welcome, বলে চলে গেলো বিমানবালা। খাবারের সাথে বই পড়তে পড়তেই সময় কেটে গেলো, পৌঁছে গেলাম ব্যাংকক। এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল দুসিথানীতে একটা রুমের বুকিং দিয়ে হোটেলের ট্যাক্সি নিয়েই পৌঁছালাম দুসিথানীতে। ওটাই তখনকার দিনে ব্যাংককের সবচেয়ে আধুনিক এবং নামিদামি হোটেল।
রিসেপশন-এচেক-ইন করে কামরায় ঢুকলাম। মধ্যরাত পেরিয়ে গেছে। ফজরের পরই সাধারণত আমি শুয়ে থাকি। ছোটকাল থেকেই রাত জাগার অভ্যাস। শাওয়ার নিয়ে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ঘুম ভাঙল সকাল এগারোটার দিকে। ওয়াশিংটনে তখন সাতসকাল। এই সময়টাতেই গঙ্গাভাইকে সহজে পাওয়া যায়। অতি প্রত্যুষে জেগে ওঠার অভ্যাস তার। রাত জাগার অভ্যাস নেই। প্রাতঃক্রিয়া শেষে ঘরেই নাস্তা সেরে ফোন করলাম।
হ্যালো।
অপর প্রান্তে গঙ্গাভাই।
কোথা থেকে বলছেন?
আমি ব্যাংকক থেকে বলছি, গত রাতে ঢাকা থেকে এসে পৌঁছেছি। প্রলয়ংকরী সাইক্লোনের খবর এখানের টিভিতে দেখেই নাইরোবিতে ফোন করে জানলাম, ভয়ংকর ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত বাংলাদেশ। আপনি তখনো সপরিবারে ঢাকায়। সেখানে যোগাযোগের চেষ্টা করে জানলাম টেলিকম্যুনিকেশন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে ভেঙ্গে পড়েছে, তাই যোগাযোগ সম্ভব নয়। ঝড়ের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখে ভীষণভাবে চিন্তিত হয়েই আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করার জন্য উতলা হয়ে পরেছিলাম।
সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ভাই, টিভিতে যা দেখেছেন বা শুনেছেন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ তার চেয়ে হাজারগুণ বেশি। বাংলাদেশ সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত হয়ে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে বাকি দুনিয়া থেকে। হাজার হাজার লোক মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ লোক জলবন্দী হয়ে অসহায় অবস্থায় দিন কাটাচ্ছে উপদ্রুত এলাকায়। অনাহারে, মহামারী, রোগে, শোকে খোলা আকাশের নিচে মৃত্যুর দিন গুনছে। এই ভয়াবহ প্রাকৃতিক দুর্যোগের মোকাবেলা করার সামর্থ নেই বাংলাদেশের সরকারের।পরিবহন ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ভাবে বিধ্বস্ত হয়ে পরায় উপদ্রুত এলাকাতে যাওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। আপনি তো অবগত আছেন বিগত নির্বাচনে অপ্রত্যাশিত পরাজয়ের পর রোষ সামলাতে না পেরে হাসিনা প্রেস কনফারেন্স করে দাবি করেছে, নির্বাচনে সূক্ষ্ম কারচুপি হয়েছে বিধায় খালেদা সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যও স্বস্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত এবং জলবন্দী মানুষের জীবন বাঁচাতে না পারলে সরকারের পতন অনিবার্য! এর সাথে আমাদের বিগত দিনের সব শ্রমও পণ্ড হয়ে যাবে। রুশ-ভারত চক্রের গোলামির শেকলে বাধা পরবে দেশ ও জাতি। সাহায্যের জন্য পশ্চিমা দেশগুলোর দূতাবাসগুলোতে সরকার পক্ষ থেকে আকুল আবেদন জানানো হয়েছে অফিসিয়াল চ্যানেলের মাধ্যমে। কিন্তু তেমন কোনও আশাপ্রদ সাড়া মেলেনি। মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে জবাব দিয়েছেন, তিনি স্টেট ডিপার্টমেন্টে আবেদন লিপি পাঠিয়ে দেবেন জরুরী ভিত্তিতে। ব্যস এতটুকুই।
এই বেসামাল অবস্থায় প্রধানমন্ত্রীর সদ্য নিয়োগপ্রাপ্ত প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আমার ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডঃ কামাল সিদ্দিকি এবং পিএস সাব্বিউদ্দিন আহমেদ যে আমার সাথে হংকং এ তিন বছর প্রথম সচিব হিসাবে কাজ করেছে তারা একত্রে খালেদা জিয়াকে বুঝিয়েছে অফিসিয়াল চ্যানেলে কোনও দেশ থেকেই সাহায্য সহযোগিতার ত্বরিত প্রতিক্রিয়ায় প্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড়ে বিধ্বস্ত অবস্থা সামাল দেবার সঙ্গতি পাওয়া সম্ভব নয়। আমরা জানি, রাষ্ট্রদূত হক পৃথিবীর অনেক ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের ক্ষমতাবলয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে অদৃশ্য শক্তিধর ব্যক্তিবর্গের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বসুলভ ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছেন বিগত ২০ বছরের দীর্ঘ কূটনৈতিক কর্মজীবনে। তিনি তো এখনো দেশেই রয়েছেন, আপনি তাকে ডেকে অনুরোধ করে দেখুন ব্যক্তিগত উদ্যোগে তিনি কিছু কোরতে পারেন কিনা। দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে তিনি আপনার অনুরোধ মেনে নিলেও নিতে পারেন। আমরাও তাকে বিশেষ ভাবে বুঝিয়ে বলবো।
তাদের পরামর্শে প্রধানমন্ত্রী আমাকে ডেকে ব্যক্তিগত চেষ্টায় কোনও কিছু করা সম্ভব হয় কিনা সেই প্রচেষ্টা করার জন্য ব্যাংককে প্রায় জোর করেই পাঠিয়ে দিলেন। আপনি এবং আমেরিকান ক্ষমতাশালী বন্ধুরা কি এই সরকারকে বাঁচানোর জন্য আমলাতান্ত্রিক জটিলতাকে পাশ কাটিয়ে কোনও কিছু করতে পারবেন? উদ্ধারকার্য, ত্রাণ এবং একই সাথে ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য স্পেসিফিক কি ধরনের সাহায্য সহযোগিতা চাচ্ছেন সেটা আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন। গঙ্গাভাই, স্থলভিত্তিক কোনও কিছুই বর্তমান অবস্থায় করা সম্ভব নয়। কারণ, স্থলপথে উপদ্রুত এলাকায় যাবার কোনো উপায় নেই। একমাত্র নৌবহর ভিত্তিক অপারেশন-এর মাধ্যমেই ফলপ্রসূ উদ্ধার কাজ এবং পুনর্বাসন তৎপরতা চালানো সম্ভব।এধরনের ‘Sea Born Operation’ 7th Fleet-এর মতো শক্তিশালী নৌবহরের পক্ষেইকরা সম্ভব। আমার জানা মতে, বর্তমানে 7th Fleet প্যাসিফিক-এর পথে রয়েছে। যদি সম্ভব হয় 7th Fleet-কেই চট্টগ্রাম সংলগ্ন উপকূলে ডাইভার্ট করে উড়িরচরসহ বিধ্বস্ত অন্যান্য এলাকায় উদ্ধার, ত্রাণকার্য্ এবং পুনর্বাসন একই সাথে করা সম্ভব।এ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প নেই।
বন্ধুরা যদি এই যাত্রায় খালেদার সরকারকে বাঁচিয়ে দেন, তাহলে খালেদা জিয়াই শুধু কৃতার্থই হবেন তাই নয়, বাংলাদেশের জনগণের কাছে ‘৭১-এর শেষ পর্যায়ে আমেরিকান সরকারের সিদ্ধান্তে 7th Fleet সম্পর্কে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছিল যার রাজনৈতিক ফায়দা রুশ-ভারত চক্র নিয়ে চলেছে আজ অবধি সেই ধারণা শুধু মুছেই যাবে না জনগণের মন থেকে, আমেরিকা সম্পর্কে অভিমত পাল্টে যাবে সম্পূর্ণভাবে। ত্রাণকর্তা এবং বন্ধুরাষ্ট্র হিসেবে আমেরিকার ভাবমূর্তি উজ্জ্বলতর হয়ে উঠবে দেশবাসীর কাছে। তবে গঙ্গাভাই, সময়টাই এখানে সবচেয়ে প্রণিধানযোগ্য বিষয়। ঠিক আছে, আমি সবকিছুই পরিষ্কার ভাবে বুঝে নিয়েছি। এখনি আমি Capitol Hill এ যাচ্ছি জিমের কাছে। তাকে সব বুঝিয়ে তাকে সঙ্গে নিয়েই অন্য সবার সাথে আলোচনা করবো। এই বিষয়ে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত সরাসরি ভাবে আদায় করার যোগ্যতা আছে শুধু একজনেরই, বন্ধুবর জেসির।
ঠিক বলেছেন। গঙ্গাভাই, আমাদের সবার স্বার্থে যে করেই হউক এই অনুমতিটা আপনাকে জেসির মাধ্যমে আদায় করে নিতেই হবে। চেষ্টার ত্রুটি হবে না।
আপনি কিন্তু আগামী ২-৩ দিন টেলিফোনের কাছেই থাকবেন।আমার বিশ্বাস, এর মধ্যেই সিদ্ধান্ত একটা হয়েই যাবে। আমাদের দায়িত্ব সাধ্যমতো চেষ্টা করা, ফল দেবার মালিক রব। ফোন ছাড়ার আগে গঙ্গাভাইকে জানালাম, আমি অধীর অপেক্ষায় থাকবো। সময় সময় আমাকে জানাবেন কি ডেভেলপমেন্ট হচ্ছে।
অবশ্যই জানাবো। একটা পরামর্শ দিচ্ছি, আপনিও স্বয়ং এখনই জিমকে ফোন করে সবকিছু বুঝিয়ে বলে ওকেও জানিয়ে দিন বিস্তারিত ভাবে বাস্তব অবস্থা এবং করণীয় সম্পর্কে। একই সাথে বলবেন, আপনিই আমাকে তার সাথে দেখা করার অনুরোধ জানিয়েছেন এবং আমি খুব শীঘ্রই হিলে এসে পৌঁছাচ্ছি। ঠিক আছে, আমি এক্ষুনি জিমের সাথে যোগাযোগ করছি।
জিমকে ফোনে সবকিছু বুঝিয়ে দিলাম। তাকে বললাম, শুধু দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কই নয় হাজারো মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যই এই প্ল্যানটা যেভাবেই হউক কার্যকরী করতে হবে। মানবিকতা এবং নিপীড়নের ঘোর বিরোধী ব্যক্তি হিসাবে জিম Capitol Hill এ বিশেষ ভাবে পরিচিত। দীর্ঘ ৪০ বছরের বেশি সময় তিনি কংগ্রেস সদস্য হিসাবে তার এলাকাবাসীর প্রতিনিধিত্ব করেছেন অপ্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী হয়ে নিজস্ব চারিত্রিক গুণাবলীর মহিমাতেই। তার কাছে জাতি, গোষ্ঠী, ধর্ম কিংবা বর্ণ কোনও মানে রাখে না। সবাইকে তিনি একই মানদণ্ডে বিচার করেন। মানবতাবাদী জনাব জিম করম্যান ন্যায় এবং সত্যের প্রতীক। তাই ক্ষমতা বলয়ে একজন বিশেষভাবে শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি।এই সম্মান তিনি অর্জন করেছেন দীর্ঘ কর্মজীবনে সততা, দক্ষতা এবং জনস্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ এক কর্মী হিসেবে। শুরু হল এক অসম্ভবকে সম্ভব করে তোলার প্রক্রিয়া। আমাকে দু’তিনদিন ফোনের পাশেই বসে থাকতে হবে, সেই সময় আমার সঙ্গী হিসাবে থাকবে ম্যান্ডেলার উপর বইটি। Lunch brake-এরসময় জিম ফোন করলো।
জরুরী ভিত্তিতে আমরা একত্রিত হয়েছি। গঙ্গাভাইও সাথে রয়েছেন। বিভিন্ন সংশ্লিষ্ট সূত্র থেকে প্রয়োজনীয় সব তথ্য সংগ্রহ করা হচ্ছে। সব তথ্যের চুলচেরা বিচার বিশ্লেষণের পর প্রতিবেদন তৈরি করে সেটা সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারকের কাছে উত্থাপন করতে রাজি হয়েছেন জেসি। যুক্তিসঙ্গত কারণেই আশা করা যায়, তার উদ্যোগ ব্যর্থ হবে না। আজ-কালের মধ্যেই সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে। আশাব্যঞ্জক খবর পেয়ে জিমকে ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম, আমি ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জানার অপেক্ষায় থাকবো। মধ্যরাতের কিছু পূর্বে জিম আবার ফোন করলো
আন্তরিক অভিনন্দন বন্ধু, তোমার প্রস্তাবে রাজি হয়েছেন রাষ্ট্রপতি। সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান থেকে Pacific Command-কে হুকুম দেয়া হয়েছে 7th Fleet কে চট্টগ্রাম উপকূলে Divert করে উদ্ধার, ত্রাণকার্য এবং গৃহহীনদের পুনর্বাসনে বাংলাদেশের সরকারকে সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতাকরার জন্য। আনুষঙ্গিক সব রিলিফ সামগ্রীর ব্যবস্থাও করবে আমেরিকা অগ্রণী হয়ে। এই অপারেশনের নাম হবে ‘Operation Sea Angels’. নামটা আমরা সবাই মিলে ঠিক করেছি, কেমন হয়েছে? তুমি ফিরে গিয়ে এই সিদ্ধান্তের সুখবরটা প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়ে দিতে পারো। প্রোটোকল অনুযায়ী এই সিদ্ধান্তের খবর ঢাকায় নিযুক্ত আমেরিকার রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে যথাসময়ে প্রধানমন্ত্রীকে জানাবেন।
অসম্ভবকে সম্ভব করে তুলেছেন প্রিয় বন্ধুরা যৌথ প্রচেষ্টায়। জিমকে জানালাম তাদের এই অবদানের জন্য যত সত্বর সম্ভব প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে আমি আসবো কৃতজ্ঞতা জানাতে। সেই সফরকালে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থে আরও কিছু বিষয় নিয়ে আলাপ করবো। ব্যক্তিগত সম্পর্ক ক্ষেত্রবিশেষে অসাধ্য সাধন কোরতে পারে এই শিক্ষাই পেলাম এই সফরে। You are always most welcome. গঙ্গাভাই এর সাথেও আলাপ হল। তাকে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে বললাম, Next Flight -এই আমি ফিরে যাচ্ছি।
Reception এ খবর নিয়ে জানতে পারলাম ঢাকার সাথে টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা ইতিমধ্যেই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়েছে।পরদিন সকালে থাই-এর ফ্লাইটে সিট Confirm করে কামালকে ফোন করে Flight details জানিয়ে অনুরোধ করলাম আমার পৌঁছানোর সংবাদটা নিম্মিকে জানিয়ে দিতে।
অবশ্যই সেটা জানাবো।এয়ারপোর্টে আমার লোক থাকবে তোকে রিসিভ করার জন্য। এয়ারপোর্ট থেকে সোজা চলে আসবি মইনুল রোডের বাড়ীতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করার জন্য। আমি সেখানেই থাকবো। ঠিক আছে। Flight was on time. যথাসময় ঢাকায় পৌঁছে গেলাম। দরজা খুলতেই পূর্বপরিচিত সেই প্রটোকল অফিসার হাসি মুখে ভেতরে এলেন আমাকে স্বাগত জানাতে। প্রধানমন্ত্রীর বাসায় পৌঁছানোর পর কামাল আমাকে জড়িয়ে ধরে আস্তে জিজ্ঞেস করল সফরের ফলাফল কি?
এতো উতলা হচ্ছিস কেনো? প্রধানমন্ত্রীর সামনেই সবশুনবি। তবে এতটুকু বলতে পারি এ যাত্রায় তোর ম্যাডাম বেঁচে গেলেন! হেসে কামাল বলল তুই সারা জীবন রহস্য পুরুষ হয়েই থাকবি! মনে আছে, টার্মশেষে বেইজিং থেকে ফেরার সময় দূতাবাসের Economic Minister হওয়া সত্ত্বেও তুইই আমাদের সপরিবারে চীন সফরের ব্যবস্থা করে দিয়েছিলি তোর বন্ধুদের মাধ্যমে। এমন বিলাসবহুল ভ্রমণের সুযোগ ও ব্যবস্থা বোধ করি কনও VIP-এর ভাগ্যেও জোটে না। সেই সফরের কথা জীবনে ভোলার নয়। সফরকালে চৈনিক বন্ধুরা যেভাবে তোর প্রশংসা করছিল তাতে মনে হচ্ছিল তোর কাছে কোনও জিয়নকাঠি আছে যার পরশে তুই সবাইকেই বশ করে নিতে সক্ষম!
কেনো বন্ধু! বশীকরণ বিদ্যায় তুইতো আমার চেয়ে আরও বেশি পারদর্শী। তানাহলে এতো আমলা থাকতে খালেদা জিয়া তোকেই তার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসেবে বেছে নিলেন জানার পরও যে ৭ই নভেম্বর বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় তার স্বামী জেনারেল জিয়া তোকে জেলবন্দী করে রেখেছিলেন? সাথে করে পরিবারের সবার প্রিয় ম্যাঙ্গস্টিন, রাম্বুথান আর সফেদার তিনটি ক্রেট নিয়ে এসেছি। কামাল নিম্মিকে ফোন করে জানাল ডালিম পৌঁছে গেছে। ঘণ্টা দু’একের মধ্যেই প্রধানমন্ত্রীর সাথে মিটিং, এরপর বাসায় আসছে।ইতিমধ্যে তোমাদের প্রিয় ফলের তিনটি ক্রেট আমি পাঠিয়ে দিচ্ছি। কিন্তু আমার ভাগটার কি হইবো বইন? সেটা, আপনার গাড়ীতেই থাকবে। চিন্তার কোনও কারণ নেই। কিন্তু বদ্দা, আপনার ব্যাপার-স্যাপার খুব একটা সুবিধাজনক লাগতাছে না। আপনিও শেষকালে আপনার বন্ধুরে সিঁড়ি হিসাবে ব্যবহার করতাছেন, এটা কিন্তু কখনোই আমি ভাবতে পারি নাই। যাক, আপনাদের ব্যাপার আপনারাই ভাল বুঝবেন। বলে নিম্মি ফোন রেখে দিলো। কামাল নিম্মির কথা শুনে কিছুটা ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গেলো।
কিছুক্ষণ পর বেগম জিয়া এসে উপস্থিত হলেন আমাদের কামরায়। আমরা উঠে দাঁড়িয়ে সালাম ও কুশল বিনিময় করলাম। তার সাজ পোশাক দেখে মনে হচ্ছিলো তিনি বেরুবার জন্যই তৈরি হয়ে এসেছেন।আমাদের ইঙ্গিতে বসতে বলে জিজ্ঞেস করলেন
বলুন, কেমন আছেন? সফর কেমন হল?দু‘দিন কিছুটা টেনশনে কেটেছে, তবে সুখবর নিয়েই ফিরেছি। আমেরিকার প্রেসিডেন্টের হুকুমে 7th Fleet প্যাসিফিক থেকে চট্টগ্রাম উপকূলে Divert করা হয়েছে উড়ির চর এবং অন্যান্য উপদ্রুত এলাকাতে উদ্ধার, ত্রাণকার্য এবং পুনর্বাসনের কাজে আপনার সরকারকে সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য।7th Fleet will be launching sea born operation. এর জন্য প্রয়োজনীয় সব ত্রাণসামগ্রীও আমেরিকা সরকারই অগ্রণী হয়ে সরবরাহ করার ব্যবস্থা করবে। আগামী ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই পৌঁছে যাবে 7th Fleet চট্টগ্রামের উপকূলে।পৌঁছামাত্রইশুরু হবে ‘Operation Sea Angels’.যথাসময়ে আমেরিকার রাষ্ট্রদূত formally পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে আপনার সাথে দেখা করে সিদ্ধান্তটি আপনাকে জানিয়ে যাবেন।
বিস্ময়ে হতবাক হয়ে গেলেন বেগম খালেদা জিয়া এবং কামাল সিদ্দিকি! তারা যেন বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না আমার বক্তব্যকে। আমি কিছুটা ক্লান্ত, তাই যদি অনুমতি দেন তবে আজকের মতো উঠতে চাই। তবে ভাবী, আমি আপনাকে আবারও স্মরণ করিয়ে দিচ্ছি যতক্ষণ পর্যন্ত রাষ্ট্রদূত আনুষ্ঠানিকভাবে খবরটা আপনাকে না দিচ্ছেন, সেই সময় পর্যন্ত এই ব্যাপারে আপনি নিশ্চুপ থাকবেন। আপনি কথা দিয়েছিলেন যাবার প্রাক্কালে কে কি করলো, কি ভাবে, কি করে সব হল সেই বিষয়টিও গোপন রাখবেন। আমি তাহলে চলি। বলে উঠে দাড়ালাম।
দু‘দিনের ধকলে সত্যি ক্লান্ত এবং পরিশ্রান্ত বোধ করছিলাম।
হ্যাঁ নিশ্চয়ই, আপনাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আপনার বিশ্রাম দরকার। রাষ্ট্রদূতের সাথে সাক্ষাতের পর আমি কিন্তু আপনাকে আবার সাক্ষাতের জন্য ডেকে পাঠাবো ভাই। একান্তে কিছু আলাপ আছে।অবশ্যই ডেকে পাঠাবেন তবে বৈঠকটা সুগন্ধায় না হয়ে এখানে বাসায় হলে আমার পক্ষে সুবিধা হয়।
তাই হবে। আপনাকে ধন্যবাদ জানিয়ে এবারও ছোট করবো না। দরজা পর্যন্ত এগিয়ে দিলেন খালেদা জিয়া। কামালের গাড়ী ইতিমধ্যেই বাসায় ফলের ক্রেট এবং আমার লাগেজ পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসেছে। কামাল বেগম জিয়াকে বলল ডালিমকে বাসায় নামিয়ে দিয়েই আমি সুগন্ধায় আসছি। পথে নিশ্চুপ ছিল কামাল। হয়তো নিজেকে ধাতস্থ করে নিচ্ছিলো। বাসায় পৌঁছে গাড়ী থেকে নেমে আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল Incredible! Simply incredible!
গাড়ীর শব্দে নিম্মিরা সবাই বেরিয়ে এসে কামালকে ভেতরে যাবার অনুরোধ জানালো কিন্তু কামাল সবাইকে সস্নেহে বুঝিয়ে বললো, ম্যাডাম অফিসে চলে গেছেন। তাই তাকেও এক্ষুনি চলে যেতে হবে। নিম্মিকে ইশারায় কাছে ডেকে নিচু স্বরে বললো আদরের বইন তুমিতো জানোনা, কি অবিশ্বাস্য অসাধারণ কাজ বিগত দুইদিনে ও করে এসেছে। ডালিমের এই অবদানের স্বীকৃতি দেশবাসী একদিন দেবেই। বেচারা ভীষণ ক্লান্ত। বিগত দুইদিন দুইরাত্রি ভীষণ টেনশনে থাকতে হয়েছে ওকে। জানি, সবাই আসবে কিন্তু তুমি ওকে জোর করে ঘুম পাড়িয়ে দেবে। প্রয়োজনে ঘুমের ঔষধ খাইয়ে। চলে গেলো কামাল বিদায় নিয়ে।
নিম্মি বললো ফ্রেশ হয়ে নাও সবাই আসার আগে। হ্যাঁ, বলে শাওয়ার নিয়ে কাপড়-চোপড় বদলে ফ্রেশ হয়ে এসে বসলাম। ফিরে এসেছি শুনে ভাইবোনেরা বাচ্চাদের নিয়ে উপস্থিত হলো।
মিনু ফুপ্পু সবার জন্য রান্না করেই রাখেন। আমরা এলে বাড়িটা সবসময় গমগম করতে থাকে। দুপুরের খাওয়া শেষে ভেতরের বারান্দায় শীতের মিষ্টি রোদের আমেজে পানের আসর উপভোগ করছিলাম। একটুখানি ঝিমুনি এসেছিল রোদের আমেজে। ঝিমুতে দেখে নিম্মি বললো
চলো ঘরে, একটু ঘুমিয়ে নাও। এরা কেউই চলে যাবে না। নিম্মির কথায় সবাই সায় দিয়ে বলল হ্যাঁ ভাইয়া, একটু ঘুমিয়ে নাও। তা নাহলে রাতের আড্ডাটা মাটি হয়ে যাবে। আজ রাতে Royal Orchid-এ ডিনারে যাবো আমরা। মহুয়া বললো। ঠিক আছে, বলে শোবার ঘরে চলে এলাম। নিম্মি এলো সাথে। পর্দা টেনে দিয়ে বললো তুমি শুয়ে পর, আমিও একটু গড়িয়ে নেই। দুপুরে একটু গড়িয়ে নেবার অভ্যাস নিম্মির। নিমেষেই গভীর ঘুমের অতলে তলিয়ে গেলাম। নিম্মি কখন উঠে গেছে টেরও পাইনি। মাগরিবের আজানে ঘুম ভাঙল। নামাজ পড়ে বসার ঘরে পৌঁছাতেই মানু, সফু, কেয়া চা নাস্তা পরিবেশনে ব্যস্ত হয়ে পরল। মোস্তাফিজ কাকু ইতিমধ্যেই অফিস থেকে ফিরে জাঁকিয়ে বসে রসের হাঁড়ি ভেঙ্গে সবাইকে হাসিয়ে চলেছেন। আমাকে দেখেই বলে উঠলেন কি মিয়া লম্বা ঘুম দিয়া উঠলা, এইডা কি ব্যাংককের আছর নাকি? ঐখানে তো রাইতে ঘুমানোর রেওয়াজ নাই। ঠিকই কইছেন কাকু, তবে এই যাত্রায় দুই দিন দুই রাত কাজের চাপে নাভিশ্বাস উঠে গেছে। টেনশনে কিছুই উপভোগ করতে পারি নাই। পুরা সময়টাই ফোনের পাশে বইসা কাটাইতে হইছে। হোটেলে বন্দী হইয়া থাকলে কি আর রাতের ব্যাংককের মজা ভোগ করা যায়! কাজ কেমন হইলো?
উদ্দেশ্য সফল হইছে। রাত ৮ তার দিকে কামাল ফোনে জানালো, আজ বিকেলেই আমেরিকান রাষ্ট্রদূত খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তিনি আমার কথাগুলোই ফরমালি জানিয়ে গিয়েছেন। খালেদা জিয়া আমেরিকান সরকারের এই সিদ্ধান্তের তারিফ করে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে 7th Fleet-এর আগমনকে স্বাগতমও জানিয়েছেন। ভালো খবর। আমাকেতো বেচে চলেছিস। এবার শোন, মহুয়া আমাদের সবাইকে নিয়ে যাচ্ছে Royal Orchid-এতোকেও সপরিবারে দাওয়াত দিচ্ছে। চলে আয়। বইনরে ক আমারে মনে রাখায় খুবই খুশি হইছি, কিন্তু একটু পরেই একটা জরুরী ক্যাবিনেট মিটিং শুরু হইবো। বুঝলাম, ঠিক আছে তার পেটিকোটের নীচেই বইয়া থাকো তুমি শালা নকরিবাজ! আমরা চললাম। আল্লাহ্ হাফেজ।
ফোন রেখে বসার ঘরে ফিরে আসতেই টিভিতে এলান হল একটি বিশেষ ঘোষণার।
দেখলাম, আমেরিকার রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সাথে সাক্ষাৎ করে উপদ্রুত এলাকায় উদ্ধার এবং ত্রাণকার্য পরিচালনার জন্য 7th Fleet-কে পাঠাবার আমেরিকান সরকারের সিদ্ধান্তের সংবাদটাই দেশবাসীকে জানান দেয়া হচ্ছে। উপস্থিত সবাই খবরটা শুনে উল্লসিত হয়ে মত প্রকাশ করলো, এটা খালেদা জিয়া সরকারের একটা বিরাট কূটনৈতিক সাফল্য। এর ফলে সরকারের নড়বড়ে অবস্থা আবার পোক্ত হয়ে উঠবে। এই ‘Operation Sea Angels’ এর ব্যবস্থা না হলে সহজেই হাসিনা সরকারকে ফেলে দিতো। সবাই খালেদা সরকারের এই সাফল্যের ভূয়সী প্রশংসা করতে লাগলো। আমি নীরবে সব উপভোগ করছিলাম। মহুয়া এসে জানালো, হোটেলে সবাই আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ও জানালো লিটুর আম্মা, সঙ্গিতা, দীপ্তি, সুপ্তি, মিঠু, কাপ্পা, অ্যান্টি, কামাল শাহ বাচ্চাদেরসহ সবাই পৌঁছে গেছে। খালাম্মা, চাচা, মোস্তাফিজ কাক্কু এবং মিনু ফুপ্পু রয়েছেন আমাদের সাথেই। নান্নু, কেয়া, মিলন, মানু, প্রিন্স, সফু, এসে গেল বাচ্চাদের নিয়ে। অল্প সময়ে পৌঁছাল স্বপন, রোজি বাচ্চাদেরসহ সাথে বাপ্পি ও তার পরিবার। মহুয়ার ফোন পেয়ে আমার Illustrated brother in law লিটুও এসে যোগ দিলো। It turned into a splendid get together of all immediate family members আনন্দঘন পরিবেশে পছন্দের থাই ফুড খেয়ে সবাই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে যার যার বাড়িতে ফিরে গেলো। আমরাও ফিরে এলাম মহুয়া আর লিটুকে ধন্যবাদ জানিয়ে।
পরিবারের প্রায় সবাই কমবেশি নিশাচর। সুতরাং ঘুম থেকে দেরি করে ওঠার অভ্যাস সবারই। তবে আমার আর নিম্মির রুটিনে কিছুটা ফারাক আছে। আমি ফজরের আজান শুনে উঠে নামাজ পড়ে আবার শুয়ে পড়ি। উঠি ১০-১১ টায়। নিম্মি ফজরের পর আর শোয় না। নামাজের পর ও কোরআন তেলাওয়াত করে আর কিছু ওজিফাও পড়ে। তারপর সময় মতো সস্তিকে উঠিয়ে স্কুলে পাঠিয়ে দিয়ে সংসারের তদারকিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। আমি উঠে আমার workout সেরে অফিসে চলে যাই। দুপুরের খাওয়ার পর সস্তিকে সাথে নিয়ে নিম্মি এক-দেড় ঘণ্টার জন্য ঘুমায়। দিনের বেলায় আমি ঘুমোতে পারি না। তাই ওরা যখন ঘুমোয় তখন আমি গুরুত্বপূর্ণ ফাইলস দেখি কিংবা লেখালেখি করি অথবা পড়ি স্টাডি রুমের শান্ত পরিবেশে। বাসার পরিচারক-পরিচারিকারাও সেই সময় বিশ্রাম নেয়। এর ব্যতিক্রম ঘটে দেশে এলে। তখন সবাই মিলে প্রতিটি মুহূর্ত প্রাণভরে উপভোগ করি।
বাসার পরিচারক-পরিচারিকারাও সেই সময় বিশ্রাম নেয়। এর ব্যতিক্রম ঘটে দেশে এলে। তখন সবাই মিলে প্রতিটি মুহূর্ত প্রাণভরে উপভোগ করি।
বাংলাদেশ সামরিকবাহিনী আর 7th Fleet-এর মেরিনসদের যৌথ অভিযান ‘Operation Sea Angels’ শুরু হয়ে গেছে। হতবাক হয়ে দেখলো দেশবাসী অবিশ্বাস্য বিস্ময়ে কি নিপুণভাবে আধুনিক প্রযুক্তির প্রয়োগে অকুতোভয় আমেরিকান মেরিনস এবং জাতীয় সেনা সদস্যরা ফেরেশতা হয়ে বাঁচিয়ে দিলো হাজারো জলবন্দী মানুষের জীবন! উদ্ধার কাজের পাশাপাশি ত্রাণএবং পুনর্বাসনের কাজও শুরু হয়ে গেলো দ্রুতগতিতে। সারা দুনিয়া থেকে এলো প্রচুর ত্রাণসামগ্রী। জনগণ প্রচার মাধ্যমে দেখলো প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষতিগ্রস্ত, পীড়িত জনগণের মাঝে। খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তা প্রায় আকাশচুম্বী হয়ে উঠলো। যুদ্ধের জন্য তৈরি পারমাণবিক শক্তিসম্পন্ন এক বিশাল এবং অপরিমেয় শক্তিশালি নৌবহরকেও যে মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করা সম্ভব তার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত রাখতে সক্ষম হলোSea Borne ‘Operation Sea Angels’. কৃতজ্ঞতার সাথে দুঃস্থ জনগণ আল্লাহ্ পাকের দরবারে দোয়া জানালেন জানবাজ নিঃস্বার্থ মানবতাবাদী দু’দেশের সেনা সদস্যদের কল্যাণ কামনায়।
ক্ষমতা গ্রহণের পর পরই চরম বিপর্যয়ের সফল মোকাবেলার সবটুকু কৃতিত্ব, প্রশংসা ও রাজনৈতিক ফায়দা পেলেন প্রধানমন্ত্রী এবং তার সরকার। কাদের প্রচেষ্টায় ‘Operation Sea Angels’ এর সব কৃতিত্বের দাবিদার হতে পারলেন খালেদা জিয়া এবং তার সরকার সেটা অজানা রয়ে গেলো শুধু দেশবাসীর কাছেই নয়, বিশ্ববাসীর কাছেও।
এরপর থেকে দিনগুলো কাটছিল আনন্দে। প্রতিদিন রাতেই কনও না কনও বন্ধুর বাসায় ঘরোয়া পার্টি দেয়া হচ্ছে নিম্মি ও আমাকে আপ্যায়ণ করার জন্য। সব কমন বন্ধুরা সস্ত্রীক সেই সব পার্টিতে উপস্থিত থাকছে। সাথে গানের জলসারও বন্দোবস্ত থাকছে। গান আমরা দুই জনই ভালবাসি। আমরা বিশেষ ভাবে কাউকে নিমন্ত্রণ করতে চাই কিনা সেটাও জেনে নেয়া হচ্ছে একরাতে স্বপনের বাসায় চলছে জমজমাট পার্টি। হঠাৎআজিজ মোহাম্মাদ ভাই এসে বসলো আমার আর নিম্মির পাশে।ডালিম, আমার একটা অভিযোগ আছে তোমাদের দু’জনের বিরুদ্ধে। কি রকম?
আমারবাড়ীতে যেকোনো পার্টিতে কূটনৈতিকপাড়াথেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ এবংসমাজের ক্ষমতাশালী রুই কাতলা যাদেরই নিমন্ত্রণ করি তারা সবাই সাগ্রহে এসে উপস্থিত হন। কিন্তু আমার একটা দুঃখ, বন্ধু হওয়া সত্ত্বেও তোমরা আজঅব্দি আমার কনও নিমন্ত্রণই গ্রহণ করনি। এর কারণ কি? আমাদের অনুপস্থিতিতে তোমার পার্টির আমেজে কনও ভাটা পরেছে সেটা বিশ্বাসযোগ্য নয়। না, তা হয়তো পরেনি, তবে ব্যাক্তিগতভাবে আমি পীড়িত হয়েছি।
তা কেনো? তোমার সাথে তো অন্যান্য জায়গাতে দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছেই। নেশায় রং ধরলে মনের কথা বেরিয়ে আসে। তাকে হাল্কা করার জন্য বললাম দেখো আজিজ, তোমার পার্টিগুলো ঠিক ঘরোয়া প্রকৃতির নয়-বরং সেগুলোকেবলাচলে বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন মানসিকতার লোকজনদের মিলনকেন্দ্র। সেখানে আমরা দু’জনই নিজেদের কিছুটা বেমানান মনে করি। আমরা কেবল সেই সমস্ত পার্টিতেই আনন্দ পাই যেখানে থাকবে অতি ঘনিষ্ঠরা, যাদের সাথে প্রাণ খুলে কথা বলা যায়, হাসি তামাশা করা যায়, অতীতেরস্মৃতি রোমন্থন করে হাসি-কান্না শেয়ার করা চলে।সেই ধরনের পরিবেশ তোমার পার্টিগুলোতে থাকে না। এটাই আমাদের অনুপস্থিতির প্রধান কারণ। অন্য কনও কারণ নেই। আজকের এই পার্টি এবং তোমার পার্টিগুলোর মাঝে যে পার্থক্য রয়েছে সেটা বুঝতে পারছো নিশ্চয়ই?
নিশ্চুপ বসেছিল আজিজ কিছুটা বিষণ্ণ চিত্তে। শাহনাজ তখন মেহেদি হাসানের একটা প্রিয় গজল গাইছিল সঙ্গে তবলা বাজাচ্ছিলো বাচ্চু। চলো, গান শুনি গিয়ে বলে অন্য সবার সাথে গিয়ে যোগ দিলাম। বুফে ডিনার পরিবেশনার পর রোজি এসে পথ দেখিয়ে সবাইকে নিয়ে গেল ডাইনিং রুমে। টেবিলে গরম কেসারলের উপর পরিবেশিত হয়েছে হরেক রকমের খাবার। সবাই পছন্দসই খাবার প্লেটে তুলে নিয়ে ছোট ছোট জটলায় বিভক্তহয়ে খাবারে মন দিলো।
এক সময় কামাল সিদ্দিকি আমাকে আর নিম্মিকে বলল চল, একটু নিরিবিলি জায়গায় গিয়ে বসি। বুঝতে পারলাম একান্তে আলাপের জন্যই কামাল প্রস্তাবটা দিচ্ছে। ডাইনিং রুম থেকে বেরিয়ে উপরে একটা সিটিং রুমে আমরা বসলাম তিনজন। একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তোদের সাথে আলাপ করতে চাই। আমি সব কিছু না জানলেও অনেকের চেয়ে কিছুটা বেশি জানি কি করে কোন শক্তির বলে জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট হতে পেরেছিল। কিন্তু ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার পরমুহূর্ত থেকেই তোদের একজন হয়েও জিয়া তোদেরকেই তার সবচেয়ে শক্তিশালী প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে চিহ্নিত করে সেনা পরিষদ এবং সেই সংগঠনের নেতাদের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা করে। জিয়া যে ১৫ই আগস্ট বিপ্লবের সাথে তার সম্পৃক্ততা অস্বীকারই করেছিল শুধু তাই নয়, তোদের শক্তিকে সমূলে নির্মূল করার জন্য নিষ্ঠুরভাবে হাজারো বিপ্লবীকে হত্যা করেছিলো এবং অনেককেই বিনাবিচারে জেলে পুরেছিলো। এক সময় এক ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় তোকে এবং অন্যান্যদের জড়িত করে চরম শাস্তি দেবার উদ্যোগও নিয়েছিল। বন্দীদের অনেকেই এখন পর্যন্ত কারাগারে অমানবিক পরিবেশে দিন কাটাচ্ছে। তাদের কয়েকজনের সাথে আমার কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো আমি নিজেও যখন বন্দী ছিলাম।
তাদের এবং তোদের নিখাদ ও নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের নজির পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ চিন্তা করে তোরা সবকিছুই নীরবে মেনে নিয়েছিস যদিও আমি জানি, যদি ইচ্ছে করতিস তবে যেকোনো মুহূর্তে জিয়াকে গদিচ্যুত করার মতো শক্তি তোদের ছিল। কিন্তু আগ্রাসী ভারতের অনুপ্রবেশের কথা চিন্তা করেই সেটা তোরা করিসনি। আত্মত্যাগের এক অভাবনীয় নিদর্শন তোরা প্রত্যেকেই! আমি এটাও জানি, তুইসহ তোদের সবাই চাকুরি ছেড়ে সমাজে স্বাধীনভাবে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হতে আগ্রহী। এই পরিপ্রেক্ষিতে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের কাল থেকে নির্বাচন পর্যন্ত এবং নির্বাচনের পর আজঅব্দি তোদের পক্ষ থেকে তুই পর্দার অন্তরালে যে অসাধারণ অবদান দেশ ও জাতীয় স্বার্থে করে এসেছিস সেসব কিছুর সবচেয়ে বড় Beneficiary হচ্ছে খালেদা জিয়া। এই বাস্তবতায় কারাবন্দী সহযোদ্ধাদের মুক্তি এবং তোদের স্বীকৃতি প্রদান করে যথাযথ মর্যাদায় সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার দাবি খালেদার কাছে উত্থাপন করাটা কি যুক্তিসঙ্গত নয়? অবশ্যই যুক্তিসঙ্গত।
তুই হয়তো ঠিকই বলছিস তবে তোকে বুঝতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে আজ পর্যন্ত আমরা যাই করেছি সেটা করেছি বৃহত্তর দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে, কোনও ব্যক্তি স্বার্থে নয়। আমাদের নিঃস্বার্থ অবদানে ব্যক্তিগতভাবে কেউ যদি উপকৃত হয়ে থাকে সেটা তার ভাগ্য। এর জন্য প্রতিদানে কিছু চেয়ে নেয়াটা আমরা যুক্তিসঙ্গত মনে করি না। তুই শুধু বিশ্বস্ত বন্ধুই নস, ভাইও বটে। নিম্মিরা তোকে বদ্দা বলে সম্বোধন করে, খালাম্মা আর চাচা তোকে বাপ্পির চেয়ে কম ভালবাসেন না তাই তোকে জানাচ্ছি, নির্বাচনের আগেই খালেদা জিয়া নিজে থেকেই কথা দিয়েছেন নির্বাচনে জয়ী হলে আমাদের প্রতি জিয়ার সময় থেকে যে অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিকার তিনি অগ্রাধিকার ভিত্তিতে করবেন। এর অনেক সাক্ষী রয়েছে দশে বিদেশে।
যদি সেটাই তিনি করেন তাহলে আমরা বুঝবো, ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সফল অভ্যুত্থান যে একই সূত্রে গাঁথা, এই দুইটি সফল বিপ্লবের নেতৃত্ব দিয়েছিল সেনা পরিষদ সেটা তিনি বুঝতে পেরেছেন। সেই সত্যকেই স্বীকৃতি দিয়েই ভারতের রক্ত চক্ষুকে উপেখ্যা করেই তিনি আমাদের সমাজে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে রাজনীতির মূলধারায় কাজ করার সুযোগ করে দিলেন। তেমনটি হলে আমরাও অতীত থেকে শিক্ষা নিয়ে ভাববো, ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতির শিকড় বাংলাদেশের মাটিতে কি করে দৃঢ়ভাবে প্রোথিত করার প্রক্রিয়ায় বিএনপির সাথে কি ধরনের সম্পর্ক বজায় রেখে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব। কূয়োর ব্যাঙের রাজনীতিতে আমরা বিশ্বাস করি না।আমাদের রয়েছে সুদূরপ্রসারী সুচিন্তিত স্বচ্ছ দৃষ্টিভঙ্গি। নির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য সেনা পরিষদের রয়েছে নীতি-আদর্শ ভিত্তিক একটি কর্মসূচি। এ সমস্ত বিষয়ে যুদ্ধকালীন সময় থেকেই তুই অনেক কিছুই জানিস। এখন শোন, তুই অনুমতি দিলে আমি এই দুইটি বিষয়ে ম্যাডামকে অতিসত্বর পদক্ষেপ নেবার জন্য বোঝাতে চেষ্টা করতে পারি। এই বিষয়ে আমার কিছুই বলার নেই, তুই তোর ইচ্ছে অনুযায়ী যা করতে চাস করতে পারিস। স্বল্পভাষী নিম্মি সব শুনে বললো
বদ্দা, আপনার কোনও প্রচেষ্টাই কার্যকর হবে না, কারণ খালেদা জিয়া জেনারেল জিয়ার পথেই হাঁটবেন। বরং আমার মনে হয়, খালেদা জিয়া যতটুকু সম্ভব তার স্বার্থ হাসিল করে নেবার পর অতি সহজেই তার দেয়া কথাটা ভুলে যাবেন। ডালিমদের রাজনীতিতে আলাদাভাবে কিছুতেই দাঁড়াতে দেয়া আপনাদের ম্যাডামের পক্ষে সম্ভব হবে না। এর অনেক যুক্তি রয়েছে। Sooner or later তিনিও জিয়ার মতোই বিশ্বাসঘাতকতার নজিরবিহীন আর একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন। চলুন নিচে যাওয়া যাক। নামতে নামতে কামাল বললো
চেষ্টা করতে দোষ কি বইন? নিম্মি কনও জবাব দিলো না। তিনজনই নিচে নেমে অন্যদের সাথে যোগ দিলাম। খাওয়ার পর চা, কফির সাথে পানের সরঞ্জাম পরিবেশিত হল। গানের আসরও জমে উঠেছে। এক কোণে নিম্মি, কামাল আর আমি একটা জায়গা বেছে নিলাম। আরামদায়ক কুশনে ঠেস দিয়ে গান শুনছিলাম আর নিজেদের মধ্যে নিচু স্বরে আলাপ করছিলাম। কামাল নিম্মিকে লক্ষ্য করে বললো
তুমি খালেদা সম্পর্কে এতটা নেতিবাচক ধারণা পোষণ করছো কেন বইন? আঁতে ঘা লাগছে মনে হয়! তাহলে একটু বুঝাইয়া কই শুনেন, যদিও এর অনেক কিছুই হয়তো আপনার জানা থাকলেও থাকতে পারে। ডালিমদের সাথে তথাকথিত ষড়যন্ত্রের দায়ে জড়িয়ে নবি ভাইয়েরও কোর্টমার্শাল শুরু করেছিলেন জেনারেল জিয়া। কর্নেল নুরুন্নবি খান বীরবিক্রম তখন ঢাকার ইএমই ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক। শুধু তাই নয়, জিয়ার সাথেই নবিভাই শুরু থেকে সহযোদ্ধা হিসাবে যুদ্ধ করেছিলেন। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনায় ঝুনুর(কর্নেল নবির স্ত্রী)মাথায় আকাশ ভেঙ্গে পড়! ঝুনুকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে তার সরকারি বাসভবন ত্যাগ করতে বাধ্য করা হয়। ছোট ছোট বাচ্চাদের নিয়ে ঝুনু বাস্তুহারা হয়ে অসহায় হয়ে পরে। এম এ পাশ ঝুনুর পক্ষে একটা চাকুরিও যোগাড় করা সম্ভব হয়নি যোগ্যতা থাকলেও। কারণ, জিয়ার রোষানলে পরার ভয়ে সবাই তখন বহুলভাবে পরিচিত একজন বীরবিক্রম মুক্তিযোদ্ধার স্ত্রীকে এড়িয়ে গেছে। তখন নিরুপায় ঝুনু এলিফেন্ট রোডের বস্তিসংলগ্ন একটা গলিতে দুই রুমের বাসায় বাচ্চাদের নিয়ে মাথা গোঁজার ঠাই করে নেয়। একটা অখ্যাত স্কুলে সামান্য বেতনের একটা চাকরিও ভাগ্যক্রমে জুটে যায় আল্লাহ্র অসীম করুণায়। সংসারের ন্যূনতম খরচা যোগাতে ঝুনু বিপর্যস্ত হয়ে পরে।
দেশের বড় বড় বুলি কপচানো মহারথীদের কেউই এতটুকু সাহায্যের হাত বারিয়ে দেয়নি তখন।
জনগণ আর দেশের কথা বলতে বলতে আপনারা সব সময় মুখে ফেনা তুলে ফেলেন, জীবনের ঝুঁকিও নিয়ে ফেলেন আগপিছ কিছু না ভেবেই যার দুর্ভোগ পোহাতে হয় আমাদের।
এই বিষয়টা কখনও ভেবে দেখার প্রয়োজন আছে বলে আপনারা মনে করেন না। আমরাও আপনাদের সততায় সব কিছু মুখ বুঁজে মেনে নেইগর্বের সাথেই। আমরা তখন নির্বাসনে। আমি লন্ডনে একটি দোকানে কাজ করি। কারণ আমাদের স্থাবর অস্থাবর সহায় সম্পত্তি সবই বাজেয়াপ্ত করে লুটপাট করে নেয়া হয়েছিল তাই টাকা থেকে ঝুনুকে মাসিক কিছু টাকা পাঠাতাম আমার চাকুরির বেতন থেকে। একবার ঢাকায় এলে ঝুনু আমার সাথে দেখা করতে আসে। তখন জোর গুজব নবি ভাইকে ফাঁসি দেয়া হবে। ওর অবস্থা দেখে চোখের পানি ধরে রাখতে পারিনি। বুকটা ফেটে গিয়েছিলো। তাই নিজেকে সামলে নিয়ে ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, নবি ভাইকে না জানিয়ে তুমি একবার খালেদা জিয়ার সাথে দেখা করে তার সাহায্য চাও। আমার কথাতেই ঝুনু একদিন অতি কষ্টে খালেদার সাথে দেখা করতে সমর্থ হয়। অশ্রুর বন্যায় ভেসে ঝুনু তার দুর্বিষহ জীবনের কথা তাকে শোনায় এবং নবিভাইয়ের জীবন ভিক্ষা চায়। সব শুনে একজন অসহায় দুঃস্থ মহিলাকে কিজবাব য়েছিলেন আপনার ম্যাডাম গর্বের সাথে, জানেন? বলেছিলেন এসমস্ত কান্নাকাটি বন্ধ করুন।আমার স্বামী কতজনকে ফাঁসিতে লটকিয়েছেন, কতজনকে ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মেরেছেন সেটা আপনি জানেন? তবুওতো ভালো আপনার স্বামী এখনও জীবিতই আছেন। তার যা হবার সেটা আইনি ভাবেই হবে। এরপর তাকে বিদায় করে দেন খালেদা জিয়া।
যার মধ্যে সভ্যতা, সহমর্মিতা, মায়া-মমতা এবং সহানুভূতি দেখাবার মতো ন্যূনতম জ্ঞানটুকু নেই সেই মহিলাকে কি বলা উচিৎ? মানুষ নাকি অমানুষ? এভাবে অপমানিত হয়ে ঝুনু ফিরে এসে আমার বুকে ঝাঁপিয়ে পরেছিলো। সেই দিন ঝুনুকে বুকে ধারণ করে নিজেকে খুবই দোষী মনে হচ্ছিলো। নবি ভাইয়ের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েও সরকারের এজেন্সিরা কোনও স্বীকারোক্তি আদায় করতে সক্ষম হয়নি। পরে আদালতে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় নবি ভাই মুক্তি পান। কিন্তু তার মুক্তির অল্প কিছুদিনের মধ্যেই দুর্বিষহ অবস্থার সাথে লড়াই করতে করতে ঝুনু অকালে মারা যায়। নিম্মির কথা শুনে লজ্জায় মাথা হেঁট করে একদম চুপ হয়ে গেলো কামাল। ঝুনুর মুখটা মনে ভেসে ওঠায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠেছিলো আমার মন। অতি নিষ্পাপ সরল হাসি হেসে সর্বদাই আপ্যায়ন করত ঝুনু যখনই গেছি তাদের বাসায়। এরপর আর পার্টিতে থাকতে মন চাইছিলো না। তাই বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম কোনও মতে নিজেকে সামলে নিয়ে বাকরুদ্ধ অবস্থায়। আমি এসবের কিছুই জানতাম না। স্বপন জানিয়েছিল সে নিজে গিয়ে নবিকে নিমন্ত্রণ করে এসেছিল কিন্তু সে রাতে তার সাইট এ যেতে হওয়ায় ক্ষমা চেয়ে নিয়েছিল নবি। বলেছিলো, আমার আর নিম্মির সাথে পরে দেখা করবে। পরদিনই নবি ফোন করলো। আমি তাকে মিনু ফুপ্পুর বাড়ীতে আসতে বললাম। জবাবে নবি বললো বন্ধু জেল থেকে বেরিয়ে শপথ নিয়েছি ক্যান্টনমেন্টের গেটপেরিয়ে বেঁচে থাকার শেষদিন পর্যন্ত কোনোক্রমেই ভেতরে প্রবেশ কোরব না। তাই দয়া করে তুই ভাবীকে নিয়ে আমার অফিসে চলে আয়। অফিস থেকে তোদের বাসায় নিয়ে যাবো।
এলিফেন্ট রোডে নবির বিরাট অফিস! নবির তখন রমরমা ব্যবসা। জেল থেকে বের হয়ে নবি একটি কনস্ট্রাকশন ফার্ম খুলে বসে। সে এখন শুধু একজন সফল ব্যবসায়ীই নয়, দেশের বিত্তবানদের শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে নিজের মেধা ও পরিশ্রমের বদৌলতে।ওর চেম্বারে নিয়ে গিয়ে তার বিরাট গ্লাসটপ টেবিলের সামনে আমাদের দু‘জনকে বসিয়ে নিজে গিয়ে অপর প্রান্তে তার রিভলভিং চেয়ারে বসলো নবি। অসাধারণ সাফল্যের পরও নবির মধ্যে কোনও পরিবর্তন দেখতে পেলাম না। ঠিক আগের মতই রয়ে গেছে নবি! অফিসে আসতে বলেছি কেনও জানিস? কেনও? একটা জিনিস দেখাতে। বলেই তার সামনে টেবিলের গ্লাসের নিচে একটা ১০০ টাকার নোটের দিকে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে বললো এটা দেখাতে। এটা তো ১০০ টাকার একটা নোট নবি ভাই!কিছুটা বিস্মিত হয়ে নবির দিকে তাকালো নিম্মি।
না ভাবী, এটা শুধুমাত্র একটা নোট নয়। এটাই আমার উন্নতির চাবিকাঠি, আর এটা আপনার দান। জেল থেকে বেরুবার পর ঝুনুর কাছ থেকে আমি আপনার সম্পর্কে বিস্তারিত সব কিছুই জানতে পারি। যখন ঝুনু ছিল সবার কাছেই বর্জনীয় তখন একমাত্র আপনিই তাকে বড়বোনের মতো বুকে টেনে নিয়ে যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করে গেছেন গোপনে। আপনিই হয়ে উঠেছিলেন ঝুনুর সংগ্রামী জীবনের একমাত্র অনুপ্রেরণা। যখন কোম্পানি গঠন করে ব্যবসা শুরু করার সিদ্ধান্ত নিই তখন আপনার পাঠানো টাকা থেকেই ঝুনু কোম্পানি রেজিস্ট্রেশন করার জন্য প্রয়োজনীয় টাকা আমার হাতে তুলে দিয়ে বলেছিলো, দেবীতুল্য ভাবীর টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করো।এতে আল্লাহ্পাক বরকত দেবেন। সেই টাকা থেকে এই নোটটা বাঁচিয়ে টেবিলের কাঁচের নিচে চোখের সামনে রেখে এগুচ্ছি। প্রতিটি সাফল্যের পর এই নোটটার মধ্যে আমি ঝুনুকে দেখতে পাই। শুনতে পাই ঝুনু বলছে বলেছিলাম না, পুত-পবিত্র ভাবীর টাকায় ব্যবসা শুরু করলে আল্লাহ্পাক তোমার উপর তার রহমত উজাড় করে দেবেন। কথাগুলো বলতে বলতে নবির দুই চোখে প্লাবন বইছিলো। আমাদের চোখ ও ঝাপসা হয়ে উঠেছিলো। কারণ, নবির স্বচ্ছলতা ঝুনু বেশিদিন উপভোগ করতে পারেনি। হঠাৎ করেই অপ্রত্যাশিত ভাবে ঝুনু সবাইকে ফাঁকি দিয়ে পৃথিবী ছেড়ে অনন্তলোকের পথে যাত্রা করে। নবি উঠে দাঁড়িয়ে বললো চল, বাসায় বাচ্চারা তোদের জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে। সেকেন্ড ক্যাপিটালে চারতলা বিশাল একটা বাড়ি বানিয়েছে নবি। তিন বাচ্চার জন্য তিনতলা আর নিজের জন্য নিচের তলা। বাসার গেট খোলার আওয়াজ পেয়েই তার দুই মেয়ে আর ছেলে দৌড়ে এসে সালাম জানিয়ে নিম্মিকে জড়িয়ে ধরলো। নিম্মি ওদের জন্য কিছু উপহার আর চকলেট নিয়ে এসেছিলো। সেগুলো হাতে তুলে দিলো। রুচিশীল ছিমছাম ভাবে সাজানো বিশাল অট্টালিকায় কোনও কিছুরই অভাব নেই, শুধু ঝুনুর সদাহাস্য মুখের সাদর স্বাগতম ছাড়া! বাচ্চারা নিম্মিকে নিয়ে উপরে চলে গেলো, নিচে থেকে গেলাম আমি আর নবি। বিশ্বাস কর নবি, আমি কিন্তু এ সবের কিছুই জানতাম না! সেটাই স্বাভাবিক। ভাবী যা কিছুই করেছেন সেটা তিনি তার কর্তব্য মনে করে করেছেন সবার অগোচরে। এখানেই তিনি অনন্যা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বড় মেয়ে এসে আমাদের নিয়ে গেলো খাবার ঘরে। পরিবেশিত হয়েছে আমার প্রিয় ছোট মাছের ব্যঞ্জন, শাক আর ডাল। অবাক হলাম, এ যেনো ঝুনুর হাতেরই রান্না! মা, এগুলো কে রান্না করলো?
কেনো, ভালো হয়নি বুঝি? আমিই রেঁধেছি। অপূর্ব হয়েছে, মনে হচ্ছে ঝুনুর হাতের রান্নাই খাচ্ছি! বেঁচে থাকো মা, তোমার মার রান্নার হাতটাই পেয়েছো তুমি মা শা আল্লাহ্।
বিকেল পর্যন্ত নবিদের সাথে কাটাবার পর বিদায় নেবার প্রাক্কালে নবি বললো
কাল বৃহস্পতিবার, তোদের আর মিনু ফুপ্পুকে নিয়ে যাবো নরসিংদী আমার আধ্যাত্মিক গুরুর কাছে, তিনি একজন সিদ্ধ কামেল সূফি সাধক। তুই আবার এই দিকে ঝুঁকলি কবে?
আমিতো ফরজ হজ্জও করে ফেলেছি। বলিস কিরে! সুইন্ডনের কার্ল মার্কসের প্রতিভূ হজ্জ করে ফেলেছে! এতো অবিশ্বাস্য পরিবর্তন! তাই হয় বন্ধু, আল্লাহ্র মর্জিতে মুহূর্তে মানুষ বদলে যায়। ঝুনুর অপ্রত্যাশিত ভাবে চলে যাবার পর আল্লাহ্র ইচ্ছায় আমিও বদলে গেছি। তবে আমাকে কাঠ মোল্লা ভাবিসনে যেনো! বাবার সাথে আলাপ করলে তোদেরও ভাল লাগবে। পল্লীগ্রামের পরিবেশটাও নির্মল। কাল সকাল ১১ টায় তোরা ক্যান্টনমেন্ট এর মেইন গেটের সামনে পৌঁছাবি।ওখানেই আমি তোদের জন্য অপেক্ষা কোরব। ঠিক আছে। ভালোই হবে শহর থেকে দূরে একটা দিন একজন বুজুর্গের সান্নিধ্যে কাটিয়ে আসতে পারলে মনটা কিছুটা হলেও আবর্জনামুক্ত হবে। বাসায় ফিরে মিনু ফুপ্পুকে নবির দাওয়াতের কথাটা জানাতেই তিনি সাদরে সেটা গ্রহণ করলেন। বেনু ফুপ্পুও সেখানে উপস্থিত ছিলেন।তিনি ইচ্ছা প্রকাশ করলেন তিনিও যাবেন আমাদের সাথে। মোস্তাফিজ কাক্কুর বাবাও একজন খ্যাতিমান সূফিসাধক ছিলেন। এই জ্ঞান তাপসরা এই জগতের বাইরে যে বিশাল সৃষ্টি জগত রয়েছে সেই সম্পর্কে এবং আল্লাহ্তায়ালা কি করে এই বিশ্বভুবনে নিজের নিজাম কায়েম রেখে চলেছেন সেই রহস্য জানার সাধনার মাধ্যমে আল্লাহ্র নৈকট্য পাবার একাগ্র বাসনায় নিজেদের তরিকায় চিরন্তন নিমগ্ন থাকেন।
মিনু ফুপ্পু, বেনু ফুপ্পু এবং নিম্মি তিনজনই ভীষণভাবে ধার্মিক। মানুষের প্রতি তাদের ভালোবাসা আর দুঃখীজনের কষ্টে যে ভাবে তারা কাতর হয়ে ছুটে যায় সাহায্য-সহযোগিতা এবং সমবেদনা জানাবার জন্য নিঃস্বার্থভাবে, সেটা সচরাচর আজকের দুনিয়ায় দৃষ্টিগোচর হয় না। একই ভাবে উদারপ্রাণ পুরুষ মোস্তাফিজ কাক্কু। একই সাথে BJMC এবং BJIC এই দুইটি প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান জনাব মোস্তাফিজুর রহমানকে একজন দূরদর্শী, সৎ,পাট বিষয়ে অগাধ জ্ঞান সম্পন্ন অভিজ্ঞ এবং বিচক্ষণ পরিচালক হিসেবেই জানেন তার সহকর্মী এবং পাট ব্যবসায়ীরা। সম্ভ্রান্ত পরিবারের এই ব্যক্তির বাইরের আবরণটা কঠিন হলেও তার মনটা ছিল শিশুর মতোই কোমল। তাদের জুটিটা ছিল একটা আদর্শ জুটি।আমাকে দু’জনেই নিজের সন্তানের মতোই স্নেহ-ভালোবাসা উজাড় করে দিয়েছেন মৃত্যুর আগ পর্যন্ত। সব বিপদ-আপদে ঢাল হয়ে রক্ষা করেছেন। কিন্তু প্রতিদানে আমি কিছুই করতে পারিনি। পিতৃস্নেহ আর মাতৃমমতার ঋণ পরিশোধ করাও সম্ভব নয়। মায়া-মমতা একতরফা ভাবে নিম্নগামী চিরকাল। এটাও হয়তো একটি প্রাকৃতিক নিয়ম।
রুহানী জগতের আর এক সূফি সাধকের সান্নিধ্যে
পরদিন যথাসময়ে গিয়ে পৌঁছালাম ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেইটে। আমি গিয়ে বসলাম নবির পাশে। নবির গাড়ী থেকে এক ভদ্রলোক নেমে আমার গাড়ীর ড্রাইভার-এর পাশে গিয়ে বসলেন গাইড হিসাবে। মিনু আর বেনু ফুপ্পুকে দেখে নবি ত্রস্তে নেমে গিয়ে সালাম করে বললো
এতো আমার সৌভাগ্য দুই ফুপুই এসেছেন। কেয়া আর মানুও রয়েছে দেখছি! বড়লোক হয়েছো শুনেছি, তাই বলে গরীব ফুফুকে ভুলে গেলে কি করে? মিনু ফুপ্পুর প্রশ্ন।আসতে পারিনি কোনও এক বিশেষ কারণে। কিন্তু ফুপ্পু, ঝুনু তো আপনাদের খোঁজ খবর সব সময়েই নিতো। তাছাড়া আমিও তো ফোনে খবরা-খবর নিতাম মাঝে মধ্যে। তা নিতে, তবে মায়ের মন তো তাতে ভরে না বাবা। অশ্রুসিক্ত নবি আবেগে ধরা গলায় বললো
ফুপ্পু, দুঃসময়ে আপনি যেভাবে ঝুনু আর বাচ্চাদের দেখে রেখেছিলেন, সেটা আপনার এই ছেলের পক্ষে কি করে ভুলে যাওয়া সম্ভব? ঝুনুকে পাঠাতাম, কিন্তু নিজেকে অতিকষ্টে সামলে নিতাম। কারণ, জেল থেকে বেরিয়ে নিজেদের হাতে গড়া এই ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে কোনোদিন ঢুকবো না প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। আপনাদের কাছ থেকেই শিক্ষা পেয়েছি শপথ নিলে তার মর্যাদা প্রাণ দিয়ে হলেও রক্ষা করতে হয়। কাক্কু আর আপনি সেটা প্রায়ই আমাদের বলতেন। তাই আজ আমরা মিলিত হচ্ছি গেটের বাইরে। আপনাদের আসার আগে MP Check Post এর Duty Commander আমাকে গাড়ীতে দেখে ছুটে এসে সাল্যুট করে বলল
স্যার, আপনি এখানে থেমে পড়লেন? প্রতিজ্ঞা না ভাঙ্গার জন্য। কিছুক্ষণের মধ্যেই সে এক কাপ গরম চা নিয়ে এসে অতি শ্রদ্ধার সাথে বলল স্যার, এটা আমাদের সবার তরফ থেকে শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে গ্রহণ করতেই হবে। চৌকি থেকে সবাই তখন বেরিয়ে এসে লাইন করে দাঁড়িয়ে স্যালুট করে আমার দিকে মিনতি ভরা চোখে তাকিয়ে। সেই আন্তরিকতা আমাকে চায়ের কাপটা হাতে তুলে নিতে বাধ্য করলো। ঠিক সেই সময় ঝাণ্ডা উড়িয়ে কোনও এক পদস্থ সেনা অফিসারের গাড়ী বেরিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু কেউ সেদিকে ভ্রুক্ষেপই করলো না।
সেটাই স্বাভাবিক বাবা, অফিসার হিসেবে তোমাদের মর্যাদা সৈনিকদের অন্তরে আর অন্যান্যদের শুধুমাত্র পদমর্যাদায়। সম্মান আল্লাহ্র দান। আমরা সবাই তোমাদের জন্য গর্বিত।
নবি ফেরার পর আমাদের দুই গাড়ীর কাফেলা যাত্রা শুরু করল।পাক মটরস এ আসার পর নবি গাড়িী থামালো। পেছনের গাড়ীটাও থেমে পড়লো। নবির ইশারায় পেছনের গাড়ী থেকে ভদ্রলোক ও ড্রাইভার নেমে আমাদের কাছে এলেন। নবি নির্দেশ দিলো, যাত্রীদের সবাইকে তার গাড়ীতে বসিয়ে আমার গাড়ীটা ফিরে যাবে। বিচক্ষণ নবি, আমি সবি বুঝতে পারছিলাম। সব কিছুই করা হচ্ছে নিরাপত্তার কথা ভেবে। ড্রাইভারকে আমি বললাম, ভদ্রলোককে যেখানে যেতে চান নামিয়ে দিয়ে বাসায় ফিরে যেতে। সবাই এসে নবির নতুন রেঞ্জরোভারে উঠে বসলাম। নবি চালক আর আমি পাশে সাথে রয়েছে দুইটি পিস্তল আর নবির SMG. সবগুলোই লাইসেন্সড। তাছাড়াও নবির কাছে রয়েছে তার ওয়ারলেস টেলিহ্যান্ড সেট। এপথ ওপথ ঘুরে যাত্রাবাড়ি হয়ে গাড়ী এগুচ্ছে নরসিংদীর দিকে। আচ্ছা নবি, আব্বা হুজুরের কোনো নাম আছে নাকি? হ্যাঁ, মাস্তান শাহ্। মনে পড়ে গেল হযরতজীর মুখচ্ছবি। তার নাম মান শাহ্। নবি জানালো তিনি কখন কোথা থেকে এসেছেন, কত বয়স সেটা স্পষ্ট করে কেউ কিছুই বলতে পারে না। তার খানকার পরিবেশটাও একটা গৃহস্থবাড়ির মতো। সংসারী মানুষ। ক্ষেত-খামার করেই উপার্জন করেন জীবিকা। দিনে কতবার গোসল করেন তার হিসেব নেই। আশ্চর্য! অদ্ভুত মিল রয়েছে দু’জনের মধ্যেই! অতিথিদের আপ্যায়ন করেন নিজের ক্ষেতের চাল, পুকুরের মাছ, গৃহপালিত হাঁস-মুরগি, বাগানের শাক-সবজি দিয়ে। প্রয়োজনে পালিত গরু, খাসিও জবাই করা হয়। কথা বলতে বলতে পৌঁছালাম নরসংদীর শহরতলীতে সবুজে ঘেরা শান্ত পরিবেশে এক মসজিদের গাড়ী রাখার জায়গায়। মসজিদের সামনে বিশাল চত্বর। পাশেই একটি একতলা দালান। তাতে রয়েছে বড় একটি হল ঘর আর বেশ কয়েকটি থাকার ছোট ছোট ঘর। নবি জানালো, বড় ইস্তেমায় হল ঘরটাও লোকে ভরে যায়। মূলত মসজিদ, চত্বর আর পাকা বাড়িটা নিয়েই বাবার খানকা এক নির্মল সবুজ শান্ত পরিবেশে। মসজিদের পেছনে দুইদিকে প্রশস্ত বিশাল জায়গা নিয়ে বাবার বসত বাড়ি। পুরো জায়গাটাই প্রাচীর দিয়ে ঘেরা। বাইরে থেকে উঁচু উঁচু গাছের মগডালগুলো ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না। মসজিদ থেকে একটু দূরে রয়েছে একটি গেট।নবি আমাদের ঐ ফটকের সামনেই নিয়ে গেলো। বুঝতে পারলাম, দেয়াল ঘেরা জায়গাতে ঢোকার ফটক সেটা। বেল টিপতেই এক তরুণ সহাস্যে ফটক খুলে দাঁড়ালো সাদর অভ্যর্থনা জানাতে। উঠানে বিভিন্ন মৌসুমি ফুলের কেয়ারি। টিনের ছাদের ইটের বেশ কয়েকটি বিল্ডিং নিয়ে বাবার বসত বাড়িটি ঘিরে রয়েছে মনে পড়ার মতো সব রকমের দেশি এবং নাতিশীতোষ্ণ অঞ্চলের ফলের গাছ ও গুচ্ছের আচ্ছাদন।একটা বিল্ডিং এর বারান্দায় পাটি বিছানো। সেখানেই আমাদের বসিয়ে তরুণ ছেলেটি অন্দর মহলে চলে গেলো। চারিদিকে শান্ত পরিবেশ, লনের এক কোণে রাখা দানা আর পানির পাত্র ঘিরে এক ঝাঁক পায়রা, বুলবুলি খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দানা খাচ্ছে নির্বিকারে। সাথে রয়েছে বেশ কয়েকটি শালিক, চড়ুই আর ঘুঘু পাখিও।
আমরা মৌসুমি ফুলের গন্ধ পাচ্ছিলাম। বাবা বেরিয়ে এলেন তার স্ত্রী আর দুই তরুণী কন্যাকে সাথে নিয়ে। তার পরনে একটা লুঙ্গি। মাঝারি আকৃতির বাবার গায়ে কোনও কাপড় নেই কাঁধে একটা গামছা। কাঁচাপাকা ঘাড়অব্দি বাবড়ি চুল, মুখে মানানসই দাড়ি গোঁফ। মুখে স্মিতহাসি। তার স্ত্রীর পরনে আটপৌরে একটা তাঁতের শাড়ি, মেয়েদের পরনে সালওয়ার কামিজ। মাথায় রয়েছে দোপাট্টা। বাবার চোখ দুটো জ্যোতির্ময়। ঝকঝকে এক পাটি দাঁত। শ্যামবর্ণের সাধককে সুদর্শনই বলা চলে। সবাই আমাদের আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালো। পরিচয় এবং সালাম-দোয়া পর্বের পর তিনি আমাদের সাথে নিয়ে বসলেন। ইতিমধ্যে একটি মেয়ে কখন উঠে গিয়ে একটা মোটা বেলি ফুলের মালা এনে নিম্মির সুদীর্ঘ বেণীতে ক্লিপের সাহায্যে আটকে দিয়ে বললো দেখো আম্মু, বুবুর চুল কি সুন্দর, আর মালাটা কেমন মানিয়েছে, দেখো দেখো বাবা! বাবা নিম্মির দিকে চেয়ে বললেন মেয়ে আমার রাজকুমারী।
আর একটা ধাক্কা খেলাম! বিস্ময়! হযরতজীও একই কথা বলেছিলেন নিম্মিকে দেখে!মেয়েটি বললো বুবু, মালাটা কিন্তু আমি নিজ হাতে সকালে ফুল কুড়িয়ে গেঁথেছি, বাজার থেকে কেনা নয়।
নিম্মি মেয়েটিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে জিজ্ঞেস করলো বেলিফুলের মালা চুলে বাঁধতে আমার খুব ভালো লাগে, সেটা তুমি বুঝলে কি করে বলতো? আমি প্রতিদিন মালা গেঁথে বাবার গলায় পরিয়ে দিই। আজ যখন তাকে মালা পরাতে গিয়েছিলাম তখন তিনি বললেন
ওটা আজ একজন বিশেষ অতিথির জন্য পানিতে রেখে দে, ওটা তাকেই বেশি মানাবে। আপনাকে দেখে বুঝতে কষ্ট হয়নি বাবা আপনার জন্যই ওটা রেখে দিতে বলেছিলেন।
ইতিমধ্যে ধুমায়িত চা, সাথে চিঁড়েভাজা আর কয়েক রকমের পিঠা পরিবেশিত হয়েছে।
বাবা নিম্মিকে ইশারায় তার পাশে বসতে আহ্বান জানালেন, বসতেই নিম্মির মাথায় হাত রেখে বললেন আমার এই মেয়ে কোনও সাধারণ মেয়ে নয়, এই মেয়ে আমার অসাধারণ! আমরা সবাই নিশ্চুপ। মিনু ফুপ্পুর চোখ দিয়ে পানি গড়িয়ে পড়ছে, নিম্মি বাবার স্নেহাশিষে অভিভূত হয়ে পড়েছিল বোধকরি। এরপর আমার দিকে চেয়ে বললেন তুমি অতি ভাগ্যবান, আল্লাহ্ তোমাকে আমার মেয়েকে দান করেছেন। নবি, তুইতো অনেককেই আমার এখানে নিয়ে এসেছিস। কিন্তু আজকের মতো আমি আর কাউকেই পাইনি, পাবো কিনা সেটাও জানিনা।
গৃহিণী বললেন তোমরা কথাবার্তা বলো আমি আসছি, বলে তিনি অন্দর মহলে চলে গেলেন। মিনু ফুপ্পু সজল চোখে মিনতি জানালেন বাবা, ওদের উপর বিপদের কালো মেঘ সব সময়েই ছেয়ে থাকে। আপনি ডালিম আর নিম্মির জন্য খাস দোয়া করবেন। বাবা হেসে বললেন বোন! দোয়া তো না চাইলেও করবো, তবে আমার দোয়ার প্রয়োজন নেই। আমার মেয়ের দোয়াই যথেষ্ট। বলে আবার নিম্মির মাথায় সস্নেহে তিনি হাত রাখলেন। ইশারাটা বুঝতে কারো কোনও অসুবিধে হল না। কিছুক্ষণের জন্য মনে হল বাবা চোখ বুঁজে ধ্যানমগ্ন হয়ে অন্য জগতে চলে গেলেন। আমরা সবাই নিশ্চুপ বসে ছিলাম। চোখ খুলে স্বাভাবিক হয়ে বাবা বললেন দেখে শুনে, বিদ্যা-বুদ্ধি দিয়ে কতটুকুই বা বোঝা যায়? সৃষ্টিরহস্য অতি জটিল। সীমাহীন এর পরিব্যাপ্তি। হঠাৎ সরাসরি নিম্মির দিকে চেয়ে বাবা অনুরোধ জানালেন, তুমি যদি তোমার বুড়ো ছেলেকে অনুমতি দাও তবে আমি একটা সিগারেট খেতে চাই। নিম্মি হতবাক হয়ে মুখ তুলে বাবার দিকে চেয়ে বললো আমি অনুমতি দেবো! ওর দু’চোখও তখন অশ্রুসিক্ত। হ্যাঁ, তোমার অনুমতিই আমার প্রয়োজন। নিম্মি আর নিজেকে সামলাতে পারলো না। তার চোখ থেকে অশ্রুবন্যা গড়িয়ে পড়ছে, সমস্ত শরীর কাঁপছে এক অদ্ভুত শিহরণে। বাবা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বললেন কাঁদছো কেনও? বলোখাবো কি খাবোনা? মুখে কিছুই বলতে পারলো না নিম্মি, মাথা ঝুঁকিয়ে সম্মতি জানালো। তাকে বেসামাল অবস্থা থেকে পরিত্রাণ দেবার জন্য মেয়েরা নিম্মিকে বললো
বুবু, চলুন আপনাদেরকে ভেতরে নিয়ে যাই। তারপর আপনাদেরকে দেখাবো আমাদের বাগান, দীঘি, হাঁস-মুরগির খোঁয়াড়। সস্তিসহ নিম্মি, মিনু ফুপ্পু, বেনু ফুপ্পু, কেয়া আর মানুকে সঙ্গে নিয়ে তারা ভেতরে চলে গেলো। তারা চলে যাবার পর বাবা নবির কাছ থেকে একটা সিগারেট চেয়ে ধরিয়ে নবিকেও বললেন একটা ধরাতে। আমার দিকে চাইতেই নবি জানান দিলো আমার ধূমপানের অভ্যাস নেই। ভালো ভালো, এই বদ অভ্যাসটা থেকে দূরে থাকা সহজ নয়। নিম্মিরা চলে যাওয়ায় পরিবেশটা হাল্কা হয়ে উঠল। প্রসঙ্গ পালটে আমি জিজ্ঞেস করলাম বাবা, মানবকুল মানেই তো আল্লাহ্র খলিফা, তাহলে বিশ্বজোড়া এত হিংস্রতা, মারামারি, কাটাকাটি, হানাহানি কেনও? বাবা হেসে বললেন এটাও একটা রহস্য! সোজা কথায়, এই জাগতিক জীবনটা পরীক্ষার হলে বসে থাকা কিছুটা সময়। এই পরীক্ষার ফলের উপরেই নির্ভর করছে ইহকাল এবং অনন্ত পরকালের জীবনের পরিণাম। তাই প্রতিটি মানুষকে চেষ্টা করতে হবে যাতে পরীক্ষাটা যতটুকু সম্ভব ভাল দেয়া যায়। এর জন্য সৃষ্টিকর্তার রহমত এবং করুণা ভিক্ষা করতে হবে যাতে তার প্রদত্ত সিলেবাসটা ভালো করে বুঝে নিয়ে পরীক্ষার জন্য প্রস্তুত হওয়া যায়। জাগতিক জীবনের পরীক্ষার যেমন বিভিন্ন স্তর আছে তেমনই আধ্যাত্মিক জীবনেও বিভিন্ন স্তর রয়েছে। জাগতিক এবং আধ্যাতিক জিবনের সব চাওয়া পাওয়ার হিসেব আন্তরিক একাগ্রতা, প্রশ্নাতীত বিশ্বাস এবং নিরলস সাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে সৃষ্টিকর্তা ইচ্ছে করলে তার পূর্ব নির্ধারিত নিয়তি বদলেও দিতে পারেন যে কোনও সময়।
তার পক্ষে সবকিছুই করা সম্ভব। প্রতিটি মানুষকে নিজেকে আল্লাহ্র প্রতিনিধি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে। যেদিন কোনও ব্যক্তি নিঃস্বার্থ ভাবে আল্লাহ্র গুণাবলীর বাহ্যিক বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে সেই দিনই মানুষ হিসাবে তার ন্যূনতম দায়িত্ব পালনে সে সক্ষম হয়েছে বলে ধরে নেয়া হবে। তবে এই কাজটা সহজ নয়। শয়তানের প্রলোভন রয়েছে প্রতি মুহূর্তে, সত্যের পথ থেকে ভ্রান্ত পথে বিপথগামী করার।
এই টানাপড়েনের মধ্যে সত্যকে বেছে নেয়াটাই হচ্ছে আসল পরীক্ষা। নিজস্ব চেষ্টা এবং সাধনার মাধ্যমে যকোনো মানুষ নিজেকে শারীরিক এবং মানসিক ভাবে উচ্চ থেকে উচ্চতর স্তরে নিতে সক্ষম জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক দুই ক্ষেত্রেই। তবে যতই উপরে উঠবে তার জন্য কঠিনতর হয়ে উঠবে জাগতিক কিংবা আধ্যাত্মিক জীবনের পরীক্ষা। হঠাৎ করে বাবা আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দিয়ে বললেন চলো, তোমাদের আমার ছোট্ট দুনিয়াটা দেখাই। তিনি আমাদের ফলের বাগান, ধানক্ষেত, গরু ও ছাগলের খামার, হাঁসের খামার, মুরগির খামার, শাক-সবজির বাগান, মাছের পুকুর সব কিছুই ঘুরে ঘুরে দেখালেন। সবখানেই সুপরিকল্পিত পরিচালনার ছাপ। ফিরে এলাম। ইতিমধ্যে মেয়েরাও ফিরে এসেছে। তখন আমরা সবাই স্বাভাবিক। দুপুরে অতি সাধারণ কিন্তু সুস্বাদু ব্যঞ্জনের সাথে খাওয়ার পাট চুকিয়ে পানের বাটা ঘিরে বসলাম সবাই। হাল্কা কথাবার্তায়, হাসি ঠাট্টায় এক আনন্দঘন পরিবেশের মাঝে আমরা ডুবে গেলাম। ফুরফুরে হাওয়ায় গাছের পাতার টুপটাপ ঝরে পড়ার শব্দ, নাম জানা এবং নাম না জানা পাখিদের কলকাকলি, হাঁস-মুরগীর চির পরিচিত আওয়াজ পরিবেশকে আরও মনোরম করে তুলেছিল। আচমকা একঝাঁক সবুজ টিয়া উড়ে এসে বসলো ইউক্যালিপটাস গাছে। ওয়াক্তের নামাজ আদায় করছিলাম সংলগ্ন মসজিদে জামায়াতের সাথে। সন্ধ্যার আগেই ফেরার কথা। হঠাৎবাবা বললেন আজ তোমরা রাতটা এখানেই থেকে যাও।
এই সুন্দর মনোরম পরিবেশে থাকতে কারোই আপত্তি থাকার কথা নয় কিন্তু আমার ও নিম্মির রাতে একটা দাওয়াত রয়েছে। তাই কিছুটা ইতস্তত ভাবেই বললাম
বাবা, রাতে আজ আমাদের একটা পূর্বনির্ধারিত দাওয়াতে যেতে হবে। তাই ইচ্ছে থাকলেও আজ থাকা সম্ভব নয়। তবে আল্লাহ্র মর্জি হলে আবার আসবো হাতে বেশি সময় নিয়ে। অল্পদিনের ছুটি, তাই সবদিক রক্ষা করে চলতে কিছুটা সময়ের ঘাটতি পোহাতে হচ্ছে। দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই আকাশে কালো মেঘ জমে উঠছিলো। বিদ্যুৎ চমকাতে শুরু করেছে। ঝড়ের পূর্বাভাস। বাবা আবারও বললেন বিশেষ প্রয়োজন না থাকলে থেকেই যাও। আবহাওয়ার অবস্থা তো ভাল ঠেকছে না। আমি বললাম এক-দেড় ঘন্টার পথ ঝড়ের আগেই পৌঁছে যাবো। বাড়ির সবাই জোর আবদার করছিলো থেকে যাবার জন্য। কিন্তু নিতান্ত অপারগ অবস্থায় বিদায় নিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম। নবি গাড়ী চালাতে চালাতে বলছিলো বাড়ির সবাই যখন এতো করে অনুরোধ করছিলো থেকে যাবার জন্য তখন থেকে গেলেও পারতিস। দীর্ঘদিন যাবত আমি বাবার এখানে আসছি, তিনি আমাকে অত্যধিক স্নেহ করেন। কিন্তু আমাকেও এভাবে তিনি কখনই রাতে থাকতে অনুরোধ করেননি। আধ্যাত্মিক সাধনায় ব্রতী সাধকদের বোঝা মুশকিল। তাদের প্রকাশ ভঙ্গিতে কেমন যেন একটা কুহেলিকা থেকে যায়।বাবাই বলেছিলেন, কোনো কিছু অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে গেলে লোকে বলে দুর্ঘটনা। কিন্তু কার ইশারায় কিংবা ইচ্ছায় সেটা ঘটলো তার কোনও হদিস মানুষ আজ অব্দি পেতে অক্ষম। ইন্দ্রিয়লব্ধ জাগতিক জ্ঞানের যেখানে ইতি সেখান থেকেই আধ্যাত্মিক পথের যাত্রা। বৈজ্ঞানিকরাই বলে, কর্ম ও প্রতিফলের বৃত্তেই ঘটছে সবকিছু। এই যুক্তিটা দুর্ঘটনার বেলায় খাটে কি?প্রতিটি মানুষ এই পৃথিবীতে ভূমিষ্ঠ হয় কোনও বিশেষ উদ্দেশ্যে কিন্তু সেটা কারো পক্ষেই জানা সম্ভব নয়। একমাত্র সৃষ্টিকর্তাই জানেন, কে কি উদ্দেশ্যে জন্ম নিলো। উদ্দেশ্য পূরণ হয়ে গেলেই তার প্রত্যাবর্তন ঘটে এক অজানা ঠিকানায়।আমরা বোকার মতো গর্ব করে বলি আমি এটা করেছি, আমি সেটা করেছি, কিন্তু আমরা মানতে নারাজ যে আমাদের হাতে কিছু করার কোনোও ক্ষমতাই নেই। যা কিছুই করি সেটাও ঘটে তারই ইচ্ছায়। কোথা থেকে এলো, কোথায় যাবে সেটা জানতে পেরেছে কি মানুষ এখনও? এক্সিডেন্ট হয় কেনও? অপ্রত্যাশিত ঘটনা ঘটে কেনও? যা হবার তা হয় না, আবার যা হবার নয় তা হয়ে যায় কেনও? এই সব কেনোর উত্তর যখন মানুষ পায় না তখন সেটাকেই বলা হয় ভবিতব্য! কিন্তু ভবিতব্যটা বানালো কে? এর জবাব নেই মানুষের।
অবিমিশ্র এই বক্তব্যগুলো আধ্যাত্মিক লোকের অসীম গভীরতার ইঙ্গিতই বহন করে। বাবার কথা-বার্তায় আর হযরতজীর কথাবার্তায় একটা অদ্ভুত মিল স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছিলো আমার মনে।
যাত্রার কিছুক্ষণের মধ্যেই ঝড়ের তীব্রতা বৃদ্ধি পেলো অস্বাভাবিক ভাবে। সাথে শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। বৃষ্টির আচ্ছাদন ভেদ করে অল্পদূরেও কিছুই দেখা যাচ্ছে না। হেডলাইট অকেজো হয়ে পড়েছে। মাঝে মধ্যে বিদ্যুতের চমকের সাথে কান ফাটানো বাজের শব্দ। প্রবল ঝড়ের মধ্যে পড়ে সবাই আতংকিত। আমি নবিকে বললাম কিছুই তো দেখা যাচ্ছে না, গাড়ী চালিয়ে নিতে পারবি তো? জবাব না দিয়ে দক্ষচালক নবি অতি সতর্কতার সাথে গাড়ী ধীরগতিতে এগিয়ে নিয়ে চলছিলো। অকস্মাৎ তুমুল বৃষ্টির সাথে শিলপড়া শুরু হল। ফলে ভিজিবিলিটি আরও কমে গেলো। এই দুর্যোগের মধ্যেই ডেমরা ব্রিজ মাত্র পেরিয়েছি, তখন হঠাৎ নবির ব্র্যান্ড নিউ রেঞ্জরোভার থেমে গেলো! সবাই প্রায় এক সাথেই বলে উঠলাম
নবি গাড়ীর কি হল! নবি কয়েকবার সেলফ এর চাবি ঘোরালো থেমে যাওয়া গাড়ী স্টার্ট করার চেষ্টায়, কিন্তু গাড়ী স্টার্ট নিলো না। পথঘাট জনশূন্য। দুই দিকেই কোনও যানবাহনের নিশানাও নেই। নবি নিজেই একজন চৌকস ইলেকট্রিক্যাল এবং মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার। থমথমে গলায় নবি বললো বলেছিলাম না, বাবা এতো করে বললেন থেকে যাবার জন্য, কিন্তু শুনলিনা। যাক, তুই স্টিয়ারিং ধরে বস, আমি নেমে দেখছি কি হল বলে গাড়ীর বনেট খুলে হাতে একটা পাঁচ ব্যাটারির টর্চ নিয়ে নেমে গেলো নবি।
পেছনে মহিলারা সবাই দোয়া-দরূদ পড়ছেন আল্লাহ্র করুণা ভিক্ষা করে। শিলাবৃষ্টির তীব্রতা তখন কিছুটা কমেছে। অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে নবি আমাকে ইশারায় সেলফ স্টার্টার অন করতে বললো। দু’ তিন বার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গাড়ী স্টার্ট নিলো না। নবির পরিধেয় কাপড় ইতিমধ্যেই ভিজে চুপসে গেছে। বনেট বন্ধ করে নবি আমার কাছে এসে দাড়ালো। কাঁচ নামিয়ে জিজ্ঞেস কোরলাম কি ব্যাপার?কিছুই বুঝতে পারছিনা, আপাতদৃষ্টিতে সবতো ঠিকই আছে দেখলাম। তাহলে এখন কি হবে? যাত্রাবাড়ী বেশি দূরে নয়। তোরা গাড়ীতেই অপেক্ষা কর, আমি দেখি ওখান থেকে কনও মেকানিক ধরে আনতে পারি কিনা।
মাথা খারাপ নাকি, এই বৃষ্টির মাঝে তুমি এতদূর যাবে পায়ে হেঁটে!অন্য কোনও উপায় নেই মিনু ফুপ্পু। না, এই বৃষ্টিতে তোমাকে যেতে হবে না, বৃষ্টি থামলে যাবে তুমি। এখন ভেতরে এসে বসো। এরপর নিম্মির ওড়না আর নিজের চাদরটা এগিয়ে দিয়ে বললেন
ভেতরে এসে ওড়না দিয়ে মাথা আর শরীর ভাল করে মুছে কাপড় ছেড়ে চাদরটা গায়ে জড়িয়ে নাও। সুবোধ বালকের মতো তাই করলো নবি। বৃষ্টি ধরে এলো কিন্তু কোনও মানুষজনের চিহ্ন নেই।যতদূর রাস্তা দেখা যায় দুইদিকেই ফাঁকা। বৃষ্টি তখনো গুঁড়ি গুঁড়ি পড়ছে।আমি যাই ফুপ্পু, বৃষ্টি যতটুকু পড়ছে তাতে অসুবিধে হবে না। আর একটু সবুর করো। কথোপকথনের মধ্যেই আচমকা একজন জটাধারী মানুষের ছায়া ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে আমাদের গাড়ির কাছে এগিয়ে এলো। খালি গা, পরনে লুঙ্গি আর হাতে একটা লাঠি। গলায় ঝুলছে রং বেরঙের পুঁতির একটা মালা আর কালো সুতোয় বাঁধা একটা রুপোর তাবিজ। ঘাড় অব্দি যত্নহীন বাবড়ি চুল। সারা মুখ ঢেকে আছে দাড়ি-গোঁফে। শরীর, দাড়ি-গোঁফ থেকে তখনও বৃষ্টির পানি ঝরছে। সব মিলিয়ে মাজারে যে সমস্ত সাধু-সন্ন্যাসী দেখা যায় তাদের মতই একজন।
নবির দিকের উইন্ডোতে টোকা দিলো লোকটা, গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি ঝরে চলেছে। নবি কাচ নামাতেই লোকটা বলল গাড়ী বিকল হইয়া পড়ছে মনে হয়! নবি জবাব দিলো জি, তাই। ইঞ্জিনের কিছু খারাপ হয়ে গেছে। লোকটার চোখ দুটো জ্যোতির্ময়। সে বলল যাত্রাবাড়ী ছাড়া কোথাও মেকানিক পাওন যাইবো না। কথার সাথে সাথে বনেটে হাতের লাঠিটা ঠুকছিলো লোকটা। লোকটার উপস্থিতিতে সবাই কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলো। তাই লোকটার দিকে তাকিয়ে মিনু ফুপ্পু ব্যাগ থেকে ১০০ টাকার একটা নোট বের করে নবিকে দিয়ে বললেন
এটা ওকে দিয়ে বিদেয় করো। গাড়ির জানালা দিয়ে নোটটা নবি লোকটার দিকে বাড়িয়ে দিতেই আগন্তুক অবজ্ঞাভরে বনেটে সশব্দে একটা বাড়ী মেরে রাগত ভাবে বলে উঠলো
টাকা দিয়া সব হয় না, জানোস না গাধার বাচ্চা? আমারে ফকির মনে কইরা টাকা দিতে চাইলি ক্যান, আমি কি ভিক্ষা চাইছি? গাড়ী স্টার্ট কর বলেই পেছনের দিকে পা বাড়ালো জটাধারী লোকটা টাকাটা না নিয়েই। আমি বললাম সেলফটা অন করতো। নবি সেলফ ঘোরালো আর সাথে সাথেই গাড়ী স্টার্ট নিয়ে গর্জে উঠল সবাইকে বিস্মিত করে দিয়ে।
সবাই পেছনে তাকিয়ে দেখলাম সেই লোকটির কোনও হদিস নেই। জলজ্যান্ত লোকটা এভাবে বেমালুম হাওয়া হয়ে গেলো! এটা কি তবে একটি অলৌকিক ঘটনা! সবাই স্তম্ভিত হয়ে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে একে অপরের দিকে চেয়ে বলে উঠলাম সুবহান আল্লাহ্! সত্য লৌকিকতাকেও হার মানিয়ে দিলো! নবি নীরবে গাড়ী চালাচ্ছিল। এই অপ্রত্যাশিত ঘটনার পর পথে তেমন আর কথাবার্তা জমলো না। ক্যান্টনমেন্টের মেইন গেটের কাছে পৌঁছেই নবি তার ওয়ারলেস ফোন থেকে মোস্তাফিজ কাক্কুকে ফোন করতেই আমার গাড়ী এসে পৌঁছে গেলো কয়েক মিনিটের মধ্যে। মিনু ফুপ্পু নবিকে অনেক করে অনুরোধ করেছিলেন রাতের খাবার তার বাসায় খেয়ে যেতে। কিন্তু নবি তার প্রতিজ্ঞায় অটল থেকে ফুপ্পুর কাছ থেকে মাফ চেয়ে এবং সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে চলে গেলো। বীর মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল নুরুন্নবি খান বীরবিক্রমের সাথে সারাদিনের আধ্যাত্মিক জগতের যে অদ্ভুত অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরেছিলাম সেদিন তা সারাজীবনে কখনোই ভুলবার নয়।
আমাকে আবার খালেদা জিয়ার জরুরী তলব
বাসায় ঢুকতেই মোস্তাফিজ কাকু যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। আমাকে বললেন দুপুর থেকেই কামাল ঘনঘন ফোন করছে, প্রধানমন্ত্রী বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে তোমার সাথে কথা বলার জন্য অপেক্ষা করছেন। কামাল জানতে চাইছে তুমি কোথায় এবং তোমার সাথে কি করে যোগাযোগ সম্ভব। আমি বলেছি
তুমি তোমার বন্ধুকে চেনো না? ও কি কাউকে কিছু বলে কোথায় যায়, কার সাথে দেখা করে, কি করে? ওরা সকালেই বেরিয়ে গেছে, আমি দুপুরে ফিরেছি অফিস থেকে। বাসার কেউ জানে না ওরা কোথায় গেছে। তোমার ফুপ্পুও গেছেন সাথে। এরপর থেকে তুমি ফিরলে কিনা সেটা জানার জন্য বারবার ফোন আসছে। তার বক্তব্য শেষ না হতেই আবার ফোন বেজে উঠলো। কাকু বললেন
ঐ যে আবার ফোন এসেছে। আমিই ফোন ধরলাম, কামাল অপর প্রান্তে। আশ্চর্য! কোথায় উধাও হয়ে গিয়ে এতো দেরিতে ফিরলি?
এই বিষয় বাদ দিয়ে বল, কেনো গো খোঁজা খুঁজছিস?
জরুরী ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রী তোর সাথে সুগন্ধায় দেখা করতে সারাদিন অপেক্ষায় রয়েছেন। কিন্ত সারাদিন তোর হদিস পাইনি। এখনি চলে আয়। কামাল, তোদের সুগন্ধার গন্ধটা আমার ঠিক সহ্য হয় না। সেটা আমি আগেই ব্যক্ত করেছি। তাছাড়া একটা দাওয়াতেও যেতে হবে আমাকে আর নিম্মিকে। আমাকে কথা শেষ করতে না দিয়েই কামাল বলে উঠল
শিলাবৃষ্টির কারণে এখন কোনও ভিড় নেই, আমি গাড়ী পাঠাচ্ছি, তুই চলে আয়। ছোট্ট মিটিং, তাই তাড়াতাড়ি ফিরে যেতে পারবি। চাকুরি যখন করছি তখন হুকুম তো মানতেই হবে! ঠিক আছে গাড়ী পাঠিয়ে দে মিনুফুপ্পুর বাসায়, আমি আসছি। সবাই শুনছিলো আমাদের বাক্যালাপ। আমি তৈরি হয়ে নিলাম। গাড়ী পৌছে গেছে। সুগন্ধায় কামালের অফিসে ঢুকে দেখি কামাল আর সাব্বি একসাথে বসে আমার অপেক্ষায়। কামাল ও সাব্বি আমাকে একটা ছোট বসার ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরটি ছিমছাম করে সাজানো। দুটো সিঙ্গেল সোফার মাঝখানে সাইড টেবিলে ম্যাচিং টেবিল ল্যাম্প ও ফুলদানি। দু’পাশে কয়েকটি ভিক্টোরিয়ান চেয়ার এবং সাইড টেবিল। দেয়ালে রুচিসম্পন্ন পেইন্টিংস।
আচ্ছা কামাল, এভাবে জরুরী তলব করে পাঠালেন কেনো তোদের ম্যাডাম?
সেটা তিনি নিজেই বলবেন। আলাপ কি শুধু আমার সাথে একাই হবে? না, আমি থাকবো, পরে প্রয়োজনে ফরেন মিনিস্টারকেও ডেকে পাঠানো হতে পারে। বুঝলাম, কিন্তু যদি মুস্তাফিজুর রহমানকে ডাকতেই হয় তাহলে তিনি বসবেন কোথায়? সাব্বি জবাবটা দিলো
ডালিম ভাই, এই বিশেষ মিটিং রুমে ম্যাডামের পাশে সোফাতে কোনো মন্ত্রী বা আমলার বসার নিয়ম নেই। সোফায় বসেন শুধু অভ্যাগত অতিথি। কামাল, তোরা আমাকে চাকুরিচ্যুত করার ষড়যন্ত্র করছিস নাতো? দু’জনই হেসে উঠলো আমার কথা শুনে। কামাল সাব্বিকে বললো ম্যাডামকে নিয়ে আসতে। এলেন খালেদা জিয়া। সালাম বিনিময় করলাম। তিনি একটা সোফায় বসে পাশের সোফাটায় আমাকে বসতে বললেন। কামাল নোট প্যাড হাতে বসলো তার জন্য নির্ধারিত চেয়ারে। কেমন আছেন, কোথায় ছিলেন সারাদিন?
শহর থেকে দূরে, সন্ধ্যায় ফিরেছি।
বিশেষ একটা প্রয়োজনে আবার আপনাকে ডেকে পাঠাতে হলো।
আমি একজন সরকারী চাকুরে। আপনি দেশের প্রধানমন্ত্রী, আপনি অবশ্যই যেকোনো সময় অবশ্যই ডেকে পাঠাতে পারেন। অনুগ্রহ করে বলুন, আমি আপনার জন্য কি করতে পারি?
ইতিমধ্যেই চা-নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে। আমার জবাবে কিছুটা বিব্রত হয়ে চা পরিবেশনার আড়ালে কি যেনো ভেবে নিলেন প্রধানমন্ত্রী। জিজ্ঞেস করলেন-কতো চামচ চিনি?
বললাম, এক। তিনি একটি পেয়ালাতে চা বানিয়ে আমার হাতে তুলে দিলেন। তিনি তখনও ভাবছেন।
ভাই, আমি এক মহাসঙ্কটে পড়েছি। নওয়াজ শরিফ আপনার সামনেই আমাকে দাওয়াত করেছেন পাকিস্তান সফরের। তার আগেই ভারতের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসাবে সে দেশের পররাষ্ট্র সচিব স্বয়ং এসে আমাকে নিমন্ত্রণ করে গেছেন। রাজনৈতিক কারণেই এই দুই দেশের কোনও একটা দিয়েই প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আমার রাষ্ট্রীয় সফর শুরু হউক সেটা আমি চাই না। আমি তৃতীয় কোনও দেশ দিয়ে আমার রাষ্ট্রীয় সফর শুরু করতে চাই।
বুঝলাম। সে ক্ষেত্রে আপনার পররাষ্ট্র মন্ত্রীকে বলুন যেকোনো বন্ধুরাষ্ট্র থেকে আপনার জন্য একটা রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ যোগাড় করে ফেলতে। বলা হয়, শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়া SAARC-এর স্বপ্নদ্রষ্টা। বলা হয়ে থাকে OIC-এর তরফ থেকে ইরান-ইরাক যুদ্ধ বন্ধ করার চেষ্টায় দূতিয়ালি করার সময় অনেক মুসলিম দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানদের সাথেও নাকি তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছিলো। উপরন্তু দেশবাসীকে অহরহ জানান দেয়া হচ্ছে, বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কের বুনিয়াদও জেনারেল জিয়াই স্থাপন করেছেন। সেই প্রেক্ষাপটে তার সহধর্মিণী এবং বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সৌদি আরব, চীনে কিংবা অন্য যেকোনো দেশে একটা রাষ্ট্রীয় সফরের ব্যবস্থা করাটা খুব একটা কঠিন সমস্যা হবে বলে মনে হয় না। চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু কোনও দেশ থেকেই তেমন ইতিবাচক সাড়া পাওয়া যাচ্ছেনা। আমেরিকান রাষ্ট্রদূত তো বলেই দিলেন যেকোনো তৃতীয় বিশ্বের সরকার প্রধানের পক্ষ থেকে রাষ্ট্রীয় সফরের আবেদনের পূর্বশর্ত হচ্ছে, সরকার প্রধানকে ন্যূনতম ২-৩ বছর ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত থাকতে হবে।
তা ঠিক, এটাই সাধারণ মাপকাঠি পশ্চিমা দেশগুলোতে। তবে এর ব্যতিক্রমও হয়ে থাকে দ্বিপাক্ষিক স্বার্থের নিরিখে। সৌদি আরবের প্রতিক্রিয়া কি?
তারাও তেমন আগ্রহ প্রকাশ করেনি। অস্বাভাবিক নয়। তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশে হঠাৎকরে কখন কি ঘটে যায় সেই অনিশ্চয়তার জন্যই সবাই সময় নিতে চায়। বিশেষ কোনও স্বার্থ থাকলে অবশ্য ভিন্ন কথা। বিশেষ করে সৌদি আরব মুসলিম জাহানে আমেরিকার সবচেয়ে নির্ভরশীল ক্রিয়ানক বিধায় প্রতিটি মুসলিম দেশের সাথে তাদের সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের সম্পূরক হয়ে থাকে। যুক্তরাজ্যসহ ইউরোপীয় অন্যান্য শক্তিধর দেশগুলোর ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম হয় না।গণচীনের প্রতিক্রিয়া কি? চীনা রাষ্ট্রদূতের কাছে আবেদন করা হলে তিনি জবাব দিয়েছেন, জরুরী ভিত্তিতে তিনি আবেদনটি বেইজিং-এ পাঠিয়ে দেবেন এবং জবাব এলেই সেটা তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে জানিয়ে দেবেন। কিন্তু আজ অবধি কোনও জবাব বেইজিং থেকে আসেনি। এই অবস্থায় আমার অনুরোধ আপনি যদি আমার বিশেষ দূত হয়ে বেইজিং যান, তাহলে হয়তো একটা ফলপ্রসূ ইতিবাচক কিছু করতে পারবেন, এটা আমার আর কামালের দৃঢ় বিশ্বাস। এই বিশ্বাসের কারণটা বোধগম্য হচ্ছে না। আমরা জানি, গণচীনের ক্ষমতা বলয়ে অনেকের সাথেই আপনার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব রয়েছে ব্যক্তিগত পর্যায়। তারা আপনাকে বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবেই মনে করেন। সেখানে থাকা কালেই এই সম্পর্ক আপনি গড়ে তুলতে সমর্থ হন।
এটাই যদি যুক্তি হয়, তবে বিনয়ের সাথেই বলছি সেই সম্পর্ক নিতান্তই ব্যক্তিগত। এর সাথে রাষ্ট্রীয় নীতি নির্ধারণের কোনও সম্পর্ক নেই। কামাল নিজেও বেইজিং-এর দূতাবাসে তিন বছর কাটিয়ে এসেছে ইকনোমিক মিনিস্টার হিসাবে। এখন সে আপনার বিশ্বস্ত মুখ্যসচিব হিসেবে সবচেয়ে ওজনদার প্রভাবশালী আমলা। চীনা কর্তৃপক্ষের কাছে কামালও সুপরিচিত। তাই আমার মনে হয়, আপনি তাকেই পাঠান। এর অন্য আরেকটি কারণ আছে, সেটা সম্পর্কে আপনি ভালোভাবেই অবগত আছেন।
গণচীনে দ্বিতীয় সফরকালে রাষ্ট্রপতি জিয়া অতীতের সব কিছুকে ক্ষমা সুন্দর চোখে দেখে এবং ভুলে গিয়ে তার সাথে আবার একত্রে রাজনীতি করার যে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সেটা আমাদের পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হয়নি। এই প্রত্যাখ্যান জেনারেল জিয়া মেনে নিতে পারেননি। যার ফলে সরকার উৎখাতের এক ভুয়া ষড়যন্ত্রমূলক মামলায় আমাকে এবং আরও কয়েকজন সহকর্মী যারা বিদেশে কূটনীতিক হিসাবে পোস্টেড ছিলো, তাদের জড়িয়ে তিনি তদানীন্তন DGFI তার কোর্সমেট জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে বেইজিং-এ পাঠিয়েছিলেন যাতে চীনা কর্তৃপক্ষের সাহায্যে তিনি আমাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে পারেন। কিন্তু সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। পরে ঐ ষড়যন্ত্রের দায়ে আমরাসহ দেশে অনেককেই চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিলো। অনেকের কোর্ট মার্শাল এবং সামারি ট্রায়ালও হয়েছিলো। বিচার ছাড়া কারাবন্দী করে ফেলে রাখা হয়েছিলো অনেককেই। এই পরিপ্রেক্ষিতে, আমি যদি আপনার বিশেষ দূত হিসাবে ওকালতির জন্য যাই তবে তা অনেক প্রশ্নের জন্ম দেবে। কি বলিস কামাল, আমার কথাগুলো যুক্তিসঙ্গত নয় কি?
হ্যাঁ, যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু এই দায়িত্ব নিয়ে আমি গেলে কিছুই হবে না। বলতে দ্বিধা নেই, যে যাই বলুক না কেনও, চীনা কর্তৃপক্ষের উপর তোর প্রভাব যতটুকু সেটা বর্তমানে বাংলাদেশে অন্য কোনও দ্বিতীয় ব্যক্তির নেই। এই সত্যিটা আমি চীনে অবস্থান কালেই পরিষ্কার বুঝেছি। আমি নিজেও বিশ্বাস করি তুই গেলে অনেক প্রশ্নের জন্ম হবে ঠিকই, কিন্তু তার উপযুক্ত জবাব দেবার যোগ্যতাও তোর আছে।
কামালের বক্তব্যের প্রতি জোর সমর্থন জানিয়ে বেগম জিয়া বলে উঠলেন
এখন পর্যন্ত আপনি যাই করে এসেছেন তা আপনি করেছেন দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে। এই কাজটা কিছুটা আমার নিজের স্বার্থে। তাই আপনার মনে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব থাকতেই পারে। কিন্তু তারপরও আমি আপনাকে অনুরোধ করছি আপনি একটু চেষ্টা করে দেখুন ভাই। তার এই আকুল আবেদনে দোটানায় পড়ে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বললাম
এতোই যখন চাপ দিচ্ছেন, আমি যাবো। তবে এই সফরের গোপনীয়তাটাও আপনাকে রক্ষা করতে হবে আগের মতোই। আপনার তরফ থেকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে একটা চিঠি লিখে দেবেন। ড্রাফটটা আমিই করে দেবো, মন্ত্রী মহোদয় শুধু সই করে দিবেন। বাকি আনুষঙ্গিক ব্যবস্থাও তাকেই করতে হবে। ভাবী, একটা কথা বলি যদি কিছু মনে না করেন, কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট বিধায় নিশ্চয় আপনার অতি বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন সহকর্মী, তাই না?
এ কথা বলছেন কেনও? না, মানে উনাকেও বলবেন কথাটা যাতে গোপন রাখেন।
অবশ্যই। কামাল, মুস্তাফিজকে ডেকে পাঠাও। ইন্টারকমে কামাল সাব্বিকে বলতেই মুস্তাফিজ সাহেবকে সাথে নিয়ে ঢুকে ম্যাডামের সামনে তাকে দাড় করিয়ে বেরিয়ে গেলো সাব্বি। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী, আমি একজন রাষ্ট্রদূত। আমি বসে আছি সোফায় আর মন্ত্রী দাড়িয়ে আছেন সামনে। দৃশ্যটা দৃষ্টিকটুই নয়, অস্বস্তিকরও বটে। তার উপর বেচারা ডায়াবেটিক। তাই রাত একটু বেশি হয়ে যাওয়ায় ইতিমধ্যেই ঝিমুচ্ছিলেন। শোনো মুস্তাফিজ, কর্নেল ডালিম আমার বিশেষ দূত হয়ে গণচীনে যাবেন। তার প্রয়োজন মতো সব বন্দোবস্ত তোমাকেই করতে হবে। তবে বিশেষ গোপনীয়তার সাথে। জি ম্যাডাম, ঠিক তেমনটিই হবে। তাহলে আজ রাতেই মুস্তাফিজের সাথে বসে আপনি সব ব্যবস্থা ঠিক করে নিয়ে আগামীকালই রওনা দেন।
আমরা তাহলে আসি। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। কামালের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে কর্নেল মুস্তাফিজের সাথে পৌঁছালাম পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তার অফিসে। বলুন আপনার কি কি প্রয়োজন?
বিশেষ কিছু না। আমি একটা নোট ভারবাল ড্রাফট করে দেবো, আর সেটা প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে আপনি সই করে দেবেন। তাছাড়া চীনের ভিসা, টিকিটের ব্যবস্থা করতে হবে। সাথে কিছু বৈদেশিক মুদ্রা। ফিরে এসে হিসেব বুঝিয়ে দেবো। মন্ত্রী সাহেব বেল টিপলেন। ত্বরিত তার পি এ প্যাড হাতে এসে উপস্থিত হল। এ যে সাখাওয়াত! বেইজিং মিশনে আমরা একসাথে কাজ করেছি। অনেকদিন পর আমাকে দেখে হাসি মুখে সালাম জানিয়ে সাখাওয়াত বললো স্যার, কেমন আছেন? আমি এগিয়ে গিয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে বললাম
আমি ভালোই আছি।তুমি ও তোমার বৌ-বাচ্চারা কেমন আছ তাই বলো? আবেগাপ্লুত সাখাওয়াত বললো আল্লাহ্র মেহেরবানী আর আপনাদের দোয়ায় সবাই ভালোই আছে, স্যার।
মন্ত্রীসাহেব কিছুটা বিস্মিত হয়েই আমাদের দিকে চেয়ে ছিলেন। সালাম-দোয়া শেষে জনাব মুস্তাফিজ সাখাওয়াতকে বললেন
কর্নেল সাহেব তোমাকে একটা নোট ভারবালের ডিক্টেশন দিবেন, তুমি আমার এই ঘরেই টাইপ মেশিনটা নিয়ে এসে সেটা টাইপ করবে। তবে বিষয়টি তোমাকে গোপন রাখতে হবে। কথা শেষ হতেই ছুটে বেরিয়ে গিয়ে মেশিন নিয়ে ফিরে এলো সাখাওয়াত। অতি অল্পক্ষণেই অভিজ্ঞ সাঁটলিপিকার সাখাওয়াত নোট ভারবালটা তৈরি করে ফেললো আর পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাতে সই করে দিলেন। সেটা নিয়ে সাখাওয়াত চলে গেলো তার রুমে সিল দেয়ার জন্য। মিনিটেই ফিরে এসে সাখাওয়াত আমার হাতে চিঠিটা দিয়ে বেরিয়ে গেলো।
স্যার, অনেক রাত হঅয়েছে, কাল কামালের মাধ্যমে পাসপোর্ট, টিকেট আর টাকাটা আমার বাসায় পৌঁছে দেবার ব্যবস্থা করলে বাধিত হবো। কারণ, দিনের বেলায় আমি এখানে আসতে চাই না।
এক সময় ক্যাপ্টেন হিসাবে জেনারেল জিয়ার সাথেই জনাব মুস্তাফিজ পাকিস্তান আর্মির গোয়েন্দা সংস্থা ISI তে চাকুরি করেছেন। আমার ইশারা বুঝতে তার অসুবিধে হবার কথা নয়। বললেন তাই হবে। চলুন আপনাকে এগিয়ে দিয়ে আসি।
না স্যার, এর প্রয়োজন নেই। এরপর সাখাওয়াতকে ডেকে তিনি বললেন কর্নেল সাহেবকে এগিয়ে দিয়ে ড্রাইভারকে বলবে, তিনি যেখানে যেতে চান তাকে পৌঁছে দিতে। Duty Room ছাড়া কোথাও কেউ নেই। সাখাওয়াতকে জিজ্ঞেস করলাম
বাচ্চারা সব নিশ্চয় বড় হয়ে গেছে?
জি, স্যার। বাকি পুরনো লোকজন কে কোথায় সেই খবরও নিলাম। বললাম সবাইকে আমার সালাম জানিও।
পকেট থেকে একটা খাম বের করে আমাকে দিয়ে সাখাওয়াত বললো এটা আপনার কপি স্যার।
ধন্যবাদ।
কেনও লজ্জা দিচ্ছেন স্যার। আপনার জন্য আমাদের মনে যে কতটুকু শ্রদ্ধা সেটা ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। আমিও তোমাদের কম ভালবাসিনা। আমরা সেটা জানি। ভাবী কেমন আছেন স্যার? আপনাদের সাথে যে অন্যায় হচ্ছে সেটা আমরা সবাই বুঝি। তাই সবাই দোয়া করি আপনারা যেখানেই থাকেন, আল্লাহ্ যেন আপনাদের সহায় হন।
ওর চোখে পানি জমে উঠেছিলো। বিদায় নিয়ে চলে আসার আগে বললাম তোমরাও সবাই ভালো থেকো। আল্লাহ্ হাফেজ। বাসায় ফিরে দেখি সবাই আমার অপেক্ষায় বসে আছে।
কি ব্যাপার এত রাত হলো যে? নিম্মির প্রশ্ন।
কাল আমাকে সন্ধ্যার থাই ফ্লাইটে পিকিং-এর পথে যাত্রা করতে হবে। তার সব বন্দোবস্ত করে ফিরতেই রাত হল। সকালেই ফরেন মিনিস্টার পাসপোর্ট, টিকেট আর, পথ খরচা পৌঁছে দেবেন কামালের মাধ্যমে। তুমি রাতেই আমার স্যুট ক্যারিয়ার আর ট্র্যাভেল ব্যাগটা গুছিয়ে রেখো। কেনও অযথা গাধার খাটুনি খাটছো? আজকের বৈঠকের পর নিম্মির এই প্রশ্নটা অত্যন্ত যুক্তিসঙ্গত মনে হচ্ছিলো এবং একই সাথে নির্বাচনের আগে তার অভিমতটাই নতুন করে মনে পরে গেলো। নিম্মি বলেছিলো,‘খালেদা জিয়া তার মৃত স্বামীর মতো সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতার রাজনীতিই করবে। তোমাদের ব্যবহার করবে নিজের স্বার্থে কিন্তু জাতীয় রাজনীতিতে আলাদাভাবে কখনই প্রতিষ্ঠিত হতে দেবে না।’
হতাশাগ্রস্ত মন।তাই কোনও জবাব না দিয়ে সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বিছানায় আশ্রয় নিলাম।
রাজনীতির চোরাগলি! ভারতে যাবার রাস্তা করার জন্য লোক দেখানো চীনে রাষ্ট্রীয় সফর শুরু করার চেষ্টা করছেন খালেদা জিয়া। সেখানে তাকে যেতেই হবে ভারতবান্ধব হওয়ার জন্য। জেনারেল জিয়াও একই কাজ করেছিলেন। একদিকে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামী মূল্যবোধ ভিত্তিক রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন অন্যদিকে ভারতের আনুকূল্য এবং সহযোগিতা পাবার প্রচেষ্টা! এক অদ্ভুত সমীকরণ! জেনারেল জিয়ার ওই বালখিল্য উদ্যোগের ফলে অপূরণীয় ক্ষতি হয়েছে দেশ ও জাতির। শেষ পর্যন্ত জীবন দিয়ে ভুলের মাশুল গুণতে হয়েছে তাকে। খালেদা জিয়াকেও একই পথে টেনে নিয়ে যাচ্ছে তার আস্থাভাজন পরামর্শদাতারা। ভবিষ্যতে এই ভুলের জন্য তাকে এবং দেশ ও জাতিকে কি মাশুল গুণতে হয় সেটা উপলব্ধি করতে খুব বেশি সময় লাগবে না দেশবাসীর।
বাংলাদেশ স্বনির্ভর, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধশালী একটি দেশ হিসাবে প্রতিষ্ঠা পাবার পথে বিভিন্ন কারণে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে প্রতিবেশী ‘বন্ধু’ রাষ্ট্র আগ্রাসী ভারত। সেক্ষেত্রে সুখী-সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পারে শুধুমাত্র সেই ধরনের একটি আপোষহীন নেতৃত্ব যারা ভারতীয় জুজুর ভয়ে ভীত না হয়ে দেশপ্রেমিক জনগণকে সাথে নিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার মতো সাহস রাখবে ১৪ কোটি দেশবাসীর ঐক্যবদ্ধ শক্তি, মেধা এবং সৃজনশক্তির উপর আস্থা রেখে নির্ভীক ভাবে আগ্রাসী ভারতের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে এগিয়ে যেতে হবে তাদের।
তেমন নিঃস্বার্থ, সাহসী এবং ত্যাগী নেতৃত্বের উদ্ভব না হোলে রক্তক্ষয়ী সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে জনগণের ন্যায়সঙ্গত অর্থনৈতিক এবং সামাজিক অধিকার এবং সার্বিক মুক্তির প্রত্যাশা হয়ে উঠবে সুদূর পরাহত মরীচিকা। শুধু তাই নয়, ক্রমান্নয়ে দেশ পরিণত হবে ভারত নির্ভর একটি করদ রাজ্যে আর জাতি মূলত পরিণত হবে দাসে।
এভাবেই আগামীতে বাস্তবায়িত হয়ে যাবে চাণক্যদের বাংলাদেশকে গিলে খাওয়ার নীলনকশা তাদের দেশীয় পদলেহিদের সহযোগিতায়!
প্রিয় দেশের স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য সচেতন বীরের জাতি কি গর্জে উঠবে না আর একবার একাত্তরের মতো? আত্মপরিচিতি সমুন্নত রাখার সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়বে না কি বর্তমান ও ভবিষ্যতের তরুণ প্রজন্ম তাদেরই পূর্বসূরিদের পদাঙ্ক অনুসরণ করে যারা তাদের এনে দিয়েছিলো স্বাধীনতা? এই সব অসংলগ্ন ভাবনার দোলাচলে দুলতে দুলতেএকসময় ঘুমের দেশে পৌঁছে গেলাম।
সকাল ১১টার দিকে কামালের সেই ভদ্রলোক এলেন টাকা, টিকেট, পাসপোর্ট নিয়ে। আমরা তখন নাস্তা করছিলাম। তাই তাকে খাবার ঘরেই ডেকে পাঠালাম। তিনি ঢুকতেই বললাম নাস্তায় শরিক হন, পরে কথা হবে। স্যার, আমি কিন্তু নাস্তা করেই বাসা থেকে অফিসে এসেছিলাম। আরে ভাই সেতো কোন সকালে, এখন প্রায় দুপুর হতে চলেছে! বয়সে তরুণ আপনি, একটু জলপানিতে কি এমন সমস্যা হবে? নিন শুরু করুন। ভদ্রলোক কিছুটা অস্বস্তি বোধ করছিলেন দেখে বললাম বড়ো ভাইয়ের সাথে নাস্তা করতে এতো লজ্জার কি আছে! আমার কথায় পরিবেশ স্বাভাবিক হয়ে উঠলো। চা নাস্তা করতে করতে তিনি জানালেন, সন্ধ্যার থাই ফ্লাইটে ব্যাংকক অব্দি বুকিং কনফারম করা হয়েছে। চীনের ভিসাও লাগানো হয়ে গেছে। এরপর টিকেট, পাসপোর্ট আর ডলারের প্যাকেটটা আমকে দিয়ে তিনি বললেন, যথাসময়ে তিনি এসে আমাকে এয়ারপোর্ট নিয়ে যাবেন। ঠিক আছে, আপনি আসার ঘণ্টা খানেক আগে আমাকে একটা ফোন করে দেবেন, যাতে আমি তৈরি হয়ে থাকতে পারি।
অবশ্যই স্যার, বলে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ভদ্রলোক। যথাসময়ে ভদ্রলোক এসে আমাকে প্লেনে তুলে দিয়ে ফিরে গেলেন। সময় মতোই পৌঁছে গেলাম ব্যাংকক। দেড় ঘণ্টা পর হংকং-এর ফ্লাইট। ট্রানজিট লাউঞ্জের ভিআইপি রুমেই সময়টা কাটাতে হবে!
ব্যাংকক ট্রানজিট লাউঞ্জে
ব্যাংকক এয়ারপোর্টে ট্রানজিট লাউঞ্জে রুমে বসে বই পড়ে সময় কাটাচ্ছিলাম। হঠাৎ মনে হল, থাইল্যান্ডের ডেপুটি ফরেন মিনিস্টার রাজপরিবারের সদস্য জনাব শ্রী কাসম শ্রী এবং তার স্ত্রীর সাথে কুশল বিনিময় করি। আমরা একসাথে পিকিং-এ ছিলাম। সেই সময় গণচীনে আমেরিকান এম্ব্যাসেডর ছিলেন সিনিয়র জর্জ বুশ, ব্রিটিশ এম্ব্যাসেডর ছিলেন স্যার এডওয়ার্ড ইয়্যুদ, ভারতের রাষ্ট্রদূত ছিলেন দাক্ষিণাত্যের একজন দার্শনিক গোছের চিন্তাবিদ। নামটা সঠিক মনে পরছে নয়া তবে রামা স্বামী ভেংকট রমন হতে পারে। এই ভদ্রলোক ছিলেন তামিল বংশোদ্ভূত নিম্নবর্ণের হিন্দু তবে তিনি ছিলেন অত্যন্ত জ্ঞানী, উদার প্রকৃতির লেখক, দার্শনিক এবং রাজনীতি বিশারদ। একবার চৈনিক পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আয়োজিত বাৎসরিক ভ্রমণে আমরা প্রায় ১০/১২ দিন একসাথে কাটিয়েছিলাম। সেই সময় এই বিদ্বান মানুষটির সাথে ভারতের ইতিহাস, আর্থ-সামাজিক অবস্থা, রাজনীতি, জাতিগত সংঘাত, সংস্কৃতি, ধর্মীয় অসহিষ্ণুতা ইত্যাদি বিষয়ে খোলামেলা আলাপ-আলোচনার সুযোগ হয়েছিলো। এ ছাড়া ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো আমেরিকান দূতাবাসের Covered Job এ নিয়োজিত বিল গিলিল্যান্ড, ব্রিটিশ এমব্যাসির পলিটিকাল উইং-এর হেড রিচার্ড, পাকিস্তান এমব্যাসির মিলিটারি এটাচি গ্রুপ ক্যাপ্টেন সানি, এবং কূটনীতিক নিজামী ও বাসারত-এর সাথে। নিজামী পরে বাংলাদেশেও এসেছিলেন পোস্টেড হয়ে। আমরা সবাই ছিলাম টেনিস পাগল, তাই প্রতিদিন বিকেলে ডিপ্লোমেটিক ক্লাবে একত্রিত হতাম। খেলার সাথে চলতো সব রকম বিষয়েই আলাপ-আলোচনা। পরবর্তী পর্যায়ে জর্জ বুশ এবং ভেংকট রমন যার যার দেশের রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। স্যার এডওয়ার্ড ইয়্যুদ নিয়োগ প্রাপ্ত হন হংকং এর শেষ গভর্নর এবং একই সাথে ব্রিটিশ এবং চীন সরকারের মধ্যে হংকং-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার চীফ নেগোশিয়েটর হিসাবে। আমিও তখন হংকং-এই পোস্টেড ছিলাম।
লিজ শেষ হবার পর ইতিমধ্যেই ম্যাকাওকে পর্তুগিজ সরকার চীনকে ফিরিয়ে দিয়েছে। কারণ, চীন লিজ বাড়াতে রাজি হয়নি। কিন্তু হংকং-এর বিষয়টি বেশ জটিল। ৯৯ বছরের লিজের আওতায় ব্রিটিশ এবং তার পশ্চিমা মিত্ররা হংকং-এ গড়ে তোলে পুঁজিবাদী এক আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। ফলে হংকং-এর বিত্তবান এবং সাধারণ চৈনিকদের মধ্যে কম্যুনিজম সম্পর্কে রয়েছে স্বাভাবিক, দ্বিধা দ্বন্দ্ব ভয় ভীতি। এই ভয়-ভীতির অজুহাতে ব্রিটিশ সরকার চাচ্ছে, হয় লিজ বাড়িয়ে দেয়া হউক কিংবা হংকংকে পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হউক। এর দুটোর কোনটাই গণচীন সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। তাদের অবস্থান হচ্ছে, লিজ শেষে গণচীনের সার্বভৌমত্ব কায়েম করা হবে হংকং-এর উপর এবং সেখানে চালু করা হবে ‘One Country Two System’. এই দর-কষাকষির সময় ঘটে যায় ‘ফকল্যান্ড ওয়ার’।
ঐ যুদ্ধে আর্জেন্টিনা পরাজিত হয় ব্রিটেনের কাছে। এই অসম যুদ্ধে বিজয়িনী রানী এলিজাবেথ পিকিং সফরে এসেছিলেন শেষবারের মতো চেষ্টা করে দেখতে, আধুনিক গণচীনের রূপকার এবং শীর্ষ নেতা দেং শিয়াও পিং এবং অন্যদেরকে হংকং-এর বিষয়ে তাদের অবস্থান থেকে সরানো যায় কিনা সেই প্রচেষ্টায়। ‘গ্রেট হল অফ দি পিপলস’-এ বৈঠক বসেছে। একদিকে রানী ও তার সফর সঙ্গীরা অন্যদিকে দেং শিয়াও পিং এবং তার সাথীরা। বিজয়িনী রানী কিছুটা গর্বের সাথেই তার বক্তব্য শুরু করলেন। প্রায় একনাগাড়ে তিনি ২০-২৫ মিনিট বলে গেলেন। কিন্তু দেং শিয়াও পিং-এর কাছ থেকে তিনি কোনও প্রতিক্রিয়াই পেলেন না। তিনি তার অভ্যাস মতো একটার পর একটা সিগারেট ফুঁকছিলেন। সার্বিক বিবেচনায় বিষয়টা কিছুটা একতরফা এবং দৃষ্টিকটু দেখাচ্ছিলো বিধায় চৈনিক দোভাষী দেং শিয়াও পিং-এর কানের কাছে মুখ নিয়ে আস্তে বলেছিল নেতা, আপনার কিছু বলা উচিত। এর জবাবে দেং দোভাষীকে বলেছিলেন
আমি কি বলবো? ইতিহাস সম্পর্কে মূর্খ মহিলা ভুল সবক দিচ্ছেন।
তাদের কথোপকথন রানীর দৃষ্টি আকর্ষণ করায় পাশে বসা চীনা ভাষায় রপ্ত স্যার ইয়্যুদ থেকে তিনি জানতে চান, দোভাষী এবং দেং শিয়াও পিং-এর মধ্যে নিচু স্বরে কি কথা হচ্ছিলো। জবাবটা সেই মুহূর্তে চেপে যান স্যার ইয়্যুদ। যাই হোক, সেই একপেশে বৈঠক ও নৈশভোজের পর বিদায় লগ্নে রানী পুনরায় সেই প্রসঙ্গে স্যার ইয়্যুদের কাছে জানতে চাইলে, অনেকটা অনিচ্ছাকৃত ভাবেই স্যার ইয়্যুদ সত্য কথাটাই রানীকে বলেছিলেন। স্যার ইয়্যুদের বয়ান শুনে রানী নাকি সিঁড়িতেই ভিরমি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিলেন। কেউ একজন ধরে ফেলায় তিনি সেই যাত্রায় রক্ষে পান। একান্ত এক ডিনারে স্যার ইয়্যুদ নিজেই আমাকে এবং নিম্মিকে এই কাহিনীটি শুনিয়েছিলেন। দর-কষাকষির শেষপ্রান্তে একদিন সকালে অফিসে যাচ্ছি, হঠাৎ গাড়ীর রেডিওতে শুনলাম, কিছুক্ষণ আগে হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছেন বন্ধুপ্রতিম গভর্নর স্যার ইয়্যুদ। অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনেই মর্মাহত অবস্থায় ড্রাইভার মিস্টার চেনকে বললাম বাসায় ফিরে যেতে। সেখান থেকে নিম্মিকে সাথে নিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম গভর্নর হাউসে। আমার গাড়ীটি গভর্নর হাউসের স্টাফদের কাছে বিশেষ ভাবে পরিচিত। কারণ প্রায়ই তিনি পুরনো বন্ধু হিসাবে আমাকে ডেকে পাঠাতেন কিংবা যুগলে আমাকে আর নিম্মিকে দাওয়াত করতেন।
ভেতরে পৌঁছে দেখি মিডিয়া থেকে আগত সাংবাদিক এবং ভাষ্যকারদের একটা জটলা। গাড়ী থেকে নামতেই এক তরুণী সাংবাদিক এগিয়ে এসে নিজের পরিচয় দিয়ে বলল তার জানা আছে, স্যার ইয়্যুদ পরিবারের সাথে আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুত্বের কথা। তাই গভর্নর স্যার ইয়্যুদের আকস্মিক মৃত্যুতে ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে আমার তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া কি? সংক্ষেপে জবাব দিলাম
গভর্নর স্যার ইয়্যুদের আকস্মিক মৃত্যুতে আমি এবং আমার স্ত্রী একজন আন্তরিক বন্ধুকে হারালাম! স্যার ইয়্যুদ দম্পতির বৈশিষ্ট্য হল তারা অকৃত্রিম, অমায়িক এবং আন্তরিকভাবে বন্ধুবৎসল। স্যার ইয়্যুদ ছিলেন একজন দূরদৃষ্টি সম্পন্ন জ্ঞানী এবং ঝানু কূটনীতিক।
ভেতরে নিয়ে গেলো অতি পরিচিত কম্পত্রোলার। আমরা স্যার ইয়্যুদ পরিবারের ব্যক্তিগত বন্ধুই শুধু ছিলাম তা নয় আমি তখন হংকং এর ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডয়ানও বটে।
শোক বইতে সাক্ষর দান করে তার স্ত্রীকে সমবেদনা জানিয়ে ফিরে এলাম আমি ও নিম্মি।
ক্ষণিকের এই পার্থিব জীবনে অনেক সম্পর্কই গড়ে ওঠে কিন্তু তার বেশিরভাগই হারিয়ে যায়। তবে কিছু সম্পর্ক অম্লান হয়ে থাকে, স্যার ইয়্যুদ এবং লেডি ইয়্যুদ আমাদের জন্য ছিলেন তেমনই এক দম্পতি।
ফিরে চলি ব্যাংকক এয়ারপোর্টের ভি আই পি রুমে। বাসায় ফোন করতেই পেয়ে গেলাম শ্রী কাসম শ্রীকে। অনেকদিন পর অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার ফোন পেয়ে আনন্দিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন কেমন আছ তুমি? কোথা থেকে বলছো? ব্যাংকক এয়ারপোর্টের ভিআইপি রুম থেকে। কোথায় চলেছো? গণচীনের পথে,বর্তমান প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে। এতো খুবই সুখবর! ওখানে পুরনো বন্ধুদের কারো সাথে দেখা হলে আমার শুভেচ্ছা জানিও। স্যার ইয়্যুদের আকস্মিক মৃত্যুর পর তোমার ছোট্ট একটি প্রতিক্রিয়া দেখেছিলাম TV-তে। যেভাবে তোমরা বেইজিং ত্যাগ করেছিলে, তাতে প্রথমে সবাই আমরা অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। পরে সব জানার পর তোমাদের নিয়ে আমরা সবাই বিশেষ ভাবে চিন্তিত ছিলাম। সেনা অভ্যুত্থানে প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর পর আমরা মানে Common Friends রা তোমাদের নিয়ে আরও বেশি উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছিলাম। পরে তুমি হংকং এ পোস্টেড হয়ে আসাতে আমরা সবাই দুঃশ্চিন্তামুক্ত হই। কতদিনের সফর? অনেক দিন দেখা সাক্ষাত নেই। তাই অনুরোধ করছি, সম্ভব হলে ফেরার পথে দেখা করে গেলে আমরা খুবই খুশি হবো। দু’চারদিনের মধ্যেই ফিরে আসতে পারবো আশা করছি। আসার আগে আমাকে একটা ফোন করে দিয়ো। তাহলে এখানে আমার মেহমান হয়ে থাকার সব ব্যবস্থা করে রাখবো। আর পিচাইকে বলবো তোমাকে এয়ারপোর্টে রিসিভ করার জন্য। সাথে নিম্মি আছে নাকি? না এক্সেলেন্সি, ওকে ঢাকায় রেখে এসেছি।No problem, there can always be a next time. Wish you all the best and success in your mission. Thanks a lot Your Excellency, do convey our warm regards and best of wishes to Madame. Its boarding time now, so must say good bye. বলেই ফোন রেখে দিলাম।
হংকং হয়ে বেইজিং
যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম হংকং, থাই-এরই একটি ফ্লাইটে। হংকং অতি পরিচিত শহর। পরদিন দুপুরের পর CAAC এর একটি ফ্লাইটে গুয়াংজুয়ো বুকিং দিলাম। পেনিনসুলায় গিয়ে উঠলাম।
কয়েক বছর হংকংএ ‘Doyen of the Diplomatic Corps’ হিসেবে কাটিয়ে গেছি বিধায় এখানকার সব কয়টি নামীদামী হোটেলের ম্যানেজমেন্ট-এর সাথে ব্যক্তিগতভাবে পরিচিত ছিলাম। সুতরাং আগাম বুকিং ছারাও রুম পেতে অসুবিধে হল না। পেনিনসুর একটা লিমুজিন করেই কাইট্যাক বিমানবন্দর থেকে হোটেলে গিয়ে পৌঁছালাম। রুমে ঢুকেই শাওয়ার নিয়ে সটান বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সকালে উঠে প্রথমেই কমরেড লামকে ফোন করলাম। চৈনিক বন্ধুরাই হংকং-এর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী কমরেড লামের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো। এরপর চলার পথে লামের সাথে পারিবারিক পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে ওঠে। লামকে ডেকে পাঠালাম হোটেলে। এরপর কয়েকজন পুরনো বন্ধু-বান্ধবীকে ফোন করলাম। সবাই দেখা করে পুরনো বন্ধুকে আপ্যায়ন করতে চায়। তাদের বললাম
আমি বিশেষ কাজে বেইজিং যাচ্ছি। ফেরার পথে লিন্ডাকে বলবো, Hong Kong Country Club -এ সব ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবীদের একটা Get-together-এর আয়োজন করতে। বেইজিং ছাড়ার আগেই লিন্ডাকে ফোনে আমি যোগাযোগ করে সুবিধে মতো দিনক্ষণ ঠিক করে দেবো। লিন্ডাই তোমাদের সাথে এই ব্যাপারে যোগাযোগ কোরবে। এতে সবাই একমত হল।
লিন্ডাকে ফোন করলাম। অনেক দিন পর হঠাৎ আমার ফোন পেয়ে কিছুটা অবাক হল লিন্ডা।
কখন এলে? গতরাতে। শোনো, আজ বিশেষ কাজে বেইজিং যাচ্ছি। বেইজিং থেকে ফোনে বিস্তারিত আলাপ করবো।ফিরতি পথে দেখা করতে চাই পুরনো ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের সাথে, বিশেষ করে তোমার সাথে। তোমাকেই সব ব্যবস্থা করতে হবে প্রিয়ে! একটা জরুরী মিটিং আছে। তাই মন না চাইলেও ফোন রাখতে হচ্ছে।
আমি বেইজিং থেকে তোমার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো। চমৎকার! বলে ফোন রেখে দিলাম। কথা শেষে অপেক্ষা করছিলাম লামের আগমনের। অল্পসময়ের মধ্যেই লাম এসে উপস্থিত হল।সংক্ষেপে তাকে আমার সফরের উদ্দেশ্য বয়ান করতেই লাম পরামর্শ দিলো ক্যান্টনে কমরেড লাই-এর সাথে ফোনে কথা বলতে। ফোন করলাম কমরেড লাইকে। তাকে বললাম, সময়ের অভাবে আগাম কোনও খবর না দিয়ে আজই বিকেলে পৌঁছাচ্ছি ক্যান্টন। লাম আমার পাশেই রয়েছে।
কোনও সমস্যা নেই, কমরেড উ স্বয়ং তোমাকে এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানাবে। লাম তোমাকে CAAC এর ফ্লাইটে বসিয়ে দেবে। তুমি লামকে ফোনটা দাও, আমি ওকে সব বুঝিয়ে দিচ্ছি।
লাম কমরেড লাইকে আমার ফ্লাইট ডিটেলস জানিয়ে দিয়ে কিছু প্রয়োজনীয় কথা সেরে ফোন রেখে বললো
আমি তাহলে এখন যাই। সব ব্যবস্থা করে সময়মত তোমাকে হোটেল থেকে নিয়ে প্লেনে তুলে দিয়ে আসবো। তুমি তৈরি থেকো। চলে গেলো বিদায় নিয়ে পুরনো বন্ধু কমরেড লাম। আমিও বেরুলাম টুকটাক কিছু কেনাকাটার জন্য। যথাসময়ে লাম এসে আমাকে নিয়ে গিয়ে প্লেনে তুলে দিয়ে বিদায় নিলো। সময়মত আকাশে উড়াল দিলো প্লেন।
গুওয়াংচাও (ক্যান্টন) পৌঁছার পর প্লেনের দরজা খুলতেই দেখি সহাস্য বদনে ভেতরে এসে ঢুকলো কমরেড উ ও সাথে তার দুই সহচর। সহাস্যে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে বললো
চলো।
আমরা সিঁড়ি দিয়ে নেমে একটা গাড়িতে করে VIP Room-এ এসে পৌঁছালাম। অল্পক্ষণের মধ্যেই সব ফরমালিটিজ শেষ করে লাগেজ নিয়ে ফিরে এলো উর একজন সহকর্মী। আমরা বেরিয়ে এলাম এয়ারপোর্ট থেকে। একটা মারসিডিজ-৬০০ এ বসলাম আমি এবং উ। পেছনে আরেকটা একই রকমের গাড়িতে উঠে বসলো উ-র দুইজন সহকর্মী আমার লাগেজ নিয়ে।
উ বেইজিং ল্যাঙ্গুয়েজ ইন্সিটিউট থেকে ইংরেজি ভাষায় দোভাষীর ডিগ্রী নিয়েছে। তাই Fluent in English both in speaking and writing. উচ্চপদস্থ নেতাদের সাথে বিদেশী নেতাদের মিটিং-এ কমরেড উ প্রায়ই দোভাষীর ভূমিকা পালন করে। অল্পক্ষণেই পৌঁছে গেলাম অতি পরিচিত স্টেট গেস্টহাউসে। সেখানে কমরেড ইউ ই এবং কমরেড লাই আমাকে অভ্যর্থনা জানাবার জন্য অপেক্ষা করছিলেন। বেশ অনেকদিন পর পুরানো বন্ধুদের মিলন মেলা। কমরেড মা’কে দেখতে না পেয়ে কিছুটা বিস্মিত হয়ে লাইকে জিজ্ঞেস করলাম কমরেড মা কোথায়? জবাব দিলো পরম বন্ধু ইউ ই
কমরেড মা বর্তমানে কম্যুনিস্ট পার্টির সেন্ট্রাল এক্সিকিউটিভ কমিটির মেম্বর পদে নির্বাচিত হয়ে বেইজিং-এ চলে গেছেন। খুবই খুশি হলাম সুখবরটা শুনে। রাতের খাবারের পর সবাই বসলাম আলোচনায়। এবারের সফরের উদ্দেশ্য এবং এজেন্ডা সম্পর্কে সবকিছু খুলে বললাম। এজেন্ডাটা কামাল সিদ্দিকিই খালেদা জিয়ার সাথে আলাপ করে চূড়ান্ত করে আমাকে ধরিয়ে দিয়েছিলো আসার আগে। সব শুনে কমরেড ইউ ই এবং কমরেড লাই অভিমত প্রকাশ করলো আগামীকাল কমরেড উকে সাথে করে আমাকে বেইজিং যেতে হবে। সেখানে কমরেড মা আমাকে জানাবেন কোন পথে এগুতে হবে এবং তিনি স্বয়ং সচেষ্ট থাকবেন যাতে আমার সফর ফলপ্রসূ হয়। আমরা আজই তাকে তোমার আসার উদ্দেশ্য সম্পর্কে সব জানিয়ে দেবো।তুমি উ কে সঙ্গে করে আগামীকাল সকালে বেইজিং পৌঁছাচ্ছো। এরপর উ বলল তুমি একটু বিশ্রাম করো। আমরা ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসছি। বুঝতে পারলাম কমরেড মা’র সাথে আলাপ করে সব ব্যবস্থা করার জন্য তারা চলে যেতে চাচ্ছে।
গণচীনের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সাথে আমি দীর্ঘদিন যাবত অন্তরঙ্গভাবে মেলামেশা করে আসছি। পুরো জাতির চারিত্রিক গুণাবলির মধ্যে যেগুলো আমাকে বিশেষভাবে অভিভূত করেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তাদের শৃঙ্খলাবোধ, আন্তরিকতা, একাগ্রতা, কর্মনিষ্ঠা, সময়জ্ঞান এবং বন্ধু-বাৎসল্য। প্রচলিত একটা প্রবাদ আছে, ‘চৈনিকদের বন্ধু হওয়া খুবই কষ্টসাধ্য, কিন্তু কাউকে বন্ধু হিসাবে গ্রহণ করলে চৈনিকরা সেই বন্ধুত্বকে প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম বজায় রাখার চেষ্টা করে থাকে।’ আমার বিশ্বাস, এই চারিত্রিক গুণাবলী ছাড়া কোনও জাতিই আত্মমর্যাদা বজায় রেখে প্রগতির পথে এগুতে পারে না। কমরেডরা সবাই ফিরে এলো। লাই বললো
সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে। কমরেড মা নিজে তোমাকে বেইজিং-এ অভ্যর্থনা জানাতে এয়ারপোর্টে আসবেন। আমরা মনে করি এই যাত্রা তোমার শুভ এবং সার্থক হবে। কারণ কমরেড মা’র বিশেষ বন্ধু ও অতিথি হিসাবেই এবার তুমি বেইজিং যাচ্ছো। কথাচ্ছলে লাই জানতে চাইলো তোমার অনুরোধে আমরা তোমার বন্ধু ডঃ কামাল সিদ্দিকি এবং তার পরিবারের জন্য একটা ভ্রমণের ব্যবস্থা করেছিলাম পিকিং দূতাবাসে তার চাকুরি শেষে দেশে ফেরার আগে। ও কেমন আছে?
কামাল ও তার পরিবার অত্যন্ত খুশি হয়েছিল তোমাদের আয়োজিত সেই বিলাসবহুল ভ্রমণের সুযোগ পেয়ে। ওতো এখন প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব। মানে সরকারের মধ্যে সবচাইতে ক্ষমতাধর আমলা। আসার আগে ও আমাকে বিশেষ ভাবে নুরোধ করেছে যাতে আমি ওদের তরফ থেকে আবারও তোমাদের সবাইকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই। তাই নাকি? এত খুবই সুখবর! হংকং এ আমার সাথে ৩ বছর দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসাবে কাজ করা অফিসার সাব্বিহউদ্দিন এখন খালেদা জিয়ার পিএস।
এতো দেখছি অদ্ভুত সংযোগ! বলে উঠল উ। কমরেড উ সাব্বিকে হংকং মিশনে দেখেছে, কথাবার্তাও হয়েছে উর সাথে। তবে উর আসল পরিচয়টি জানতে পারেনি সাব্বি। সাব্বি জানতো, উ ছিল আমার ব্যক্তিগত বন্ধু, হংকং-এর একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। লামের পরিচয়টাও ছিল একজন ব্যবসায়ী বন্ধু হিসেবে। বন্ধুরা সবাই কিছুটা মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছিল কেনও আমি নিম্মি এবং সস্তিকে সাথে আনিনি। আমি বন্ধুদের বুঝিয়ে বলেছিলাম, এবারের সফরটা গোপন রাখা হয়েছে আমার অনুরোধেই। সে জন্য তাদের ঢাকাতেই রেখে আসতে হয়েছে।
পরদিন সময় মতো বন্ধুরা আমাদের প্লেনে তুলে দিলো। আমি ও উ বেইজিং এর উদ্দেশে আকাশে উড়লাম। আমরা বেইজিং পৌঁছে গেলাম। কমরেড মা ও তার সাথীরা প্লেন থেকে আমাদের উষ্ণ আন্তরিক অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গেল ভি আই পি রুমে। বিদ্যুৎ গতিতে সব ফর্মালিটিজ শেষ করে আমরা বেরিয়ে এলাম। নতুন বিশাল অত্যাধুনিক আন্তর্জাতিক মানের এয়ারপোর্ট দেখে হতবাক হলাম! যাত্রা পথে রাস্তাঘাট এবং মহাসড়কের ব্যাপকতা এবং দুই পাশের আধুনিক আকাশচুম্বী দালানকোঠা আমাকে বিস্মিত করল। আমার জানা পুরানো শহর বেইজিংকে চিনতেই পারছিলাম না। আমাদের কাফেলা স্টেট গেস্টহাউসের একটি অট্টালিকার সামনে এসে থামলো। এই অভিজাত ঐতিহ্যবাহী এলাকাটাতে তেমন কোনও পরিবর্তন করা হয়নি। সুপ্রাচীন ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্যই এই এলাকাটাকে ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে যেমন ছিল ঠিক তেমনই রাখা হয়েছে। সেখানে পরিচারক-পরিচারিকারা সবাই আমাদের আগমনের প্রতীক্ষায় ছিল। পৌঁছানো মাত্র তারা সব মালপত্র নিয়ে গেলো। কমরেড মা আমাকে আর উ কে একটা বসার ঘরে নিয়ে গেলেন।
বলো বন্ধু, তুমি কেমন আছো? নিম্মি এবং সস্তি কেমন আছে? ওদের নিয়ে না আসার যুক্তিসঙ্গত কারণটা লাই জানিয়েছে। অনেকদিন ওদের এখানে আসা হয়নি। তাই যখনই সম্ভব হবে তাদের নিয়ে একবার ঘুরে যাবে সেটাই প্রত্যাশা করবো।
নিশ্চয়ই নিয়ে আসবো।
সব কিছুই লাই এবং ইউ ই আমাকে বুঝিয়ে বলেছে। তাই তোমাকে আর কিছু বলতে হবে না। তুমি শুধু লিখিত এজেন্ডাটা দাও। আমি নোট ভারবাল আর এজেন্ডাটার লেফাফাটা মা’র হাতে তুলে দিয়ে বললাম
বন্ধু, তোমাদের সিদ্ধান্ত যাই হউক না কেনও, সেটা যত সত্বর সম্ভব আমি জেনে ফিরে যেতে চাই। পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে চৈনিক রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সফরের আবেদন জানিয়ে আশাপ্রদ সাড়া না পাওয়ায় প্রধানমন্ত্রীর একান্ত অনুরোধেই আমাকে আসতে হয়েছে অনেকটা অপারগ হয়েই। বন্ধু ডঃ কামাল সিদ্দিকি বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্যসচিব। আমার বিশ্বাস কামালই প্রধানমন্ত্রীকে বলে থাকবে যদি তিনি আমাকে রাজি করিয়ে তার বিশেষ দূত হিসাবে চীনে পাঠাতে পারেন তবে রাষ্ট্রীয় সফরের ব্যবস্থাটা হলেও হতে পারে। এখন সবকিছুই তোমাদের হাতে। বিষয়টি কিছুটা বিব্রতকর। ঠিক যেমনটি হয়েছিল জিয়ার সময়। তাকে তোমরা বাঁচিয়েছিলে CMLA হিসাবেই চীন সফরে আমন্ত্রণ করে। এবার তারই স্ত্রীকে সম্ভব হলে বাঁচাতে হবে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে নিমন্ত্রণ করে যাতে তাকে ভারত যাত্রা দিয়ে বিদেশ ভ্রমণ শুরু করতে না হয়।
জানিনা সব বিবেচনায় এত অল্প সময়ে তাকে নিমন্ত্রণ জানানো সম্ভব হবে কিনা। তবে কমরেড, আমার মনে হয় খালেদার বর্তমান সমস্যাটার একটা ইতিবাচক সমাধান করা যদি সম্ভব হয় তবে এই বিষয়টি বাংলাদেশ গণচীন সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে অবশ্যই একটা সুদূর প্রসারী প্রভাব ফেলবে। স্মিত হেসে বন্ধু মা বলল তুমি আমাদের বিশ্বস্ত পরীক্ষিত বন্ধু। তোমার উপস্থাপনা সর্বপর্যায়ে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে বিবেচিত হবে এই বিষয়ে তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আগামী কাল সকাল ১১ টায় তোমার সাথে সাক্ষাত করবেন কমরেড শু শিং। তিনি একই সাথে সেন্ট্রাল কমিটি এবং মিলিটারি কমিশন-এর সদস্য। বর্তমানে জাতীয় গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং Foreign Relation Department of PLA এর নেতৃত্বও দিচ্ছেন তিনি। আমি নোট ভারবাল আর এজেন্ডাটা নিয়ে যাচ্ছি।সময়ের স্বল্পতার কারণে চেষ্টা করবো কমরেড শু শিং-ই যাতে সাক্ষাতের সময় তোমাকে সিদ্ধান্তটা জানিয়ে দিতে পারেন।
তিনি মিটিং-এর পর তোমাকে এক মধ্যাহ্ন প্রীতিভোজে আপ্যায়ন করবেন। সব পাট চুকিয়ে কালই তুমি যাতে গুওয়াংচাও ফিরে যেতে পারো সেই চেষ্টাই আন্তরিকভাবে করা হবে সর্বস্তরে। আমাকে বিশ্রাম করার পরামর্শ দিয়ে যেতে যেতে কমরেড মা বললেন, আগামীকাল তোমার এক পুরনো বন্ধু আসবে দেখা করতে। সে কিছুদিন আগে বাংলাদেশ ঘুরে এসেছে। আরও কয়েকজন পুরানো বন্ধু প্রীতিভোজে আমন্ত্রিত হয়ে আসবেন তাদের প্রিয় বন্ধু জনাব হকের সাথে দেখা করতে।
চলে গেলেন কমরেড মা কমরেড উ কে সাথে নিয়ে।আমিও রাতের খাবার খেয়ে বিছানা নিলাম। একজন পরিচারিকাকে অনুরোধ জানালাম যাতে আমাকে সকাল ৭ টায় জাগিয়ে দেয়া হয়। কঠিন থেকে কঠিনতর সমস্যার নিরসনের গৃহীত সিদ্ধান্ত ত্বরিতগতিতে কার্যকর করার উপযুক্ত ব্যবস্থাও এই বিশাল দেশ জুড়ে গড়ে তোলা হয়েছে যা শুধু বিস্ময়করই নয়, অভাবনীয়ও বটে। অবাক হতে হয় প্রশাসনের দক্ষতা এবং স্বচ্ছতা দেখে। এখানে লালফিতার দৌরাত্মের বালাই নেই, যেমনটি তৃতীয় বিশ্বে তো বটেই উন্নত দেশগুলোতেও পরিলক্ষিত হয়। এখানে পদভারে বোঝা যায় না শক্তির পরিমাপ। তৃণমূল থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দু কোথায়, কারা প্রকৃত অর্থে ক্ষমতাবান- সেটা এক কুহেলিকা যার রহস্য আজঅব্দি ভেদ করা সম্ভব হয়নি কারো পক্ষে।
ঐতিহাসিক তিয়ান আন মেন স্কোয়ারের ঘটনার সময় আমি হংকং-এ। মূলত হংকং থেকেই আমেরিকা, ব্রিটিশসহ তাদের সহযোগী পশ্চিমা শক্তিগুলো একযোগে বহু সময় ধরে প্রচুর টাকাকড়ি খরচ করে গণচীনের ভেতরে শহর ভিত্তিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজের ছাত্র-ছাত্রীদের সংগঠিত করে মানবাধিকার এবং অবাধ গণতন্ত্রের দাবিতে প্রায় হাজার পনেরো-বিশেক তরুণ-তরুণীকে সমবেত করে পৃথিবীর সর্ববৃহৎ শানবাধানো স্কোয়ার ‘তিয়ান আন মেন স্কোয়ার’-এ এক বিক্ষোভ ধর্মঘটের আদলে। এই ধর্মঘটে চীনের শীর্ষস্থানীয় অনেক নেতা-নেত্রীর সন্তান-সন্ততিও অংশগ্রহণ করেছিল। প্রথমে সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাদের স্কোয়ার ছেড়ে চলে যাবার আবেদন জানানো হয় সময় বেধে দিয়ে। সরকারী সেই সিদ্ধান্তে কর্ণপাত না করায় বেধে দেয়া সময় শেষে একরাতে প্রায় বারো হাজার অবাধ্য তরুণ-তরুণীকে মেরে ফেলা হয় এক ঝটিকা অপারেশন চালিয়ে রাজধানীতে অরাজকতা সৃষ্টির দায়ে।
যেমনটি করেছিলেন সিঙ্গাপুরের বিপ্লবী নেতা লি কুয়ান ইউ স্বাধীন সিঙ্গাপুরের ক্ষমতা গ্রহণের পর যখন উপনিবেশবাদী পরাজিত ব্রিটিশ সরকার সিঙ্গাপুরে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার চেষ্টা করে এক রক্তাক্ত নৃতাত্ত্বিক দাঙ্গা বাধিয়ে। মুক্তিযোদ্ধা লি কুয়ান ইউ কঠোর হস্তে এক রাতে সেই দাঙ্গার সাথে জড়িত প্রায় ১৫ হাজারেরও বেশি দাঙ্গাকারীকে নিধন করে সিঙ্গাপুরের স্থিতিশীলতা বজায় রেখেছিলেন। দাঙ্গা বন্ধ করে তিনি ঘোষণা দেন, স্বাধীন সিঙ্গাপুরে প্রতিটি নাগরিকের একমাত্র পরিচয় হবে সিঙ্গাপুরী, অন্য কিছু নয়। যারা এটা মেনে নিতে পারবে না তাদের ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া হল সিঙ্গাপুর ত্যাগ করার জন্য। এরপরও চক্রান্তকারীদের কেউ যদি থেকে যাবার চেষ্টা করে তবে তাদেরকেও একই ভাবে সমূলে উৎপাটন করা হবে। এ ধরনের দৃঢ়চেতা সাহসী নেতৃত্ব ছাড়া তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের পক্ষেই প্রগতি এবং সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। ঘটনার পর দিনই বেইজিংসহ সারা দেশে জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। গণচীনে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করার এই ব্যর্থ অপচেষ্টার পর একদিন আমি আমেরিকার একজন বিশিষ্ট চিন্তাবীদ এবং নীতি নির্ধারক মহলে একজন প্রতিষ্ঠিত চীনা বিশারদ হিসাবে স্বীকৃত বন্ধুবর বার্ট লেভিনকে জিজ্ঞেস করেছিলাম দীর্ঘদিন ধরে অনেক টাকা খরচ করে এবং গোপন তৎপরতা চালিয়ে অসন্তোষের চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটানো হল তিয়ান আন মেন স্কোয়ারে বিক্ষোভকারীদের জমায়েত করে। কিন্তু এক রাতেই সেই বিক্ষোভকারীদের কঠোর হস্তে দমন করে পরদিন থেকেই সারাদেশের জীবনযাত্রাকে স্বাভাবিক করে তুলতে সমর্থ হলো চৈনিক নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, বৈদেশিক সাহায্য সহযোগিতায় তৈরি করা চিহ্নিত নাটের গুরু এবং ক্রিয়ানকদের তাদের বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দিয়ে তাদের নিয়ে যেতে বাধ্য করা হল অতি অনায়াসেই! সোভিয়েত ইউনিয়নের মতো একটা পরাশক্তিকে তোমরা ভেঙ্গে টুকরো টুকরো করে দিতে সক্ষম হলে, কিন্তু তার চেয়ে অনেক কম শক্তিধর চীনের ক্ষেত্রে প্রায় সব চালই ব্যর্থ হচ্ছ কেনও? এর মূল কারণটা কি বলো তো বন্ধু?
বার্ট লেভিন জবাবে বলেছিলো
আজঅব্দি চীনে একজন গর্বাচভ খুঁজে পাওয়া সম্ভব হয়নি। গণচীনের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলয়, পিএলএ এবং পার্টির সংগঠনে ক্ষমতার স্তম্ভগুলো এতোই সুরক্ষিত যে সেই লৌহকঠিন বর্ম ভেদ করা সম্ভব হচ্ছে না। আগামী কাল কমরেড শু শিং বৈঠকে আমাকে চীন সরকারের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেবেন, অথচ আমার নিজের দেশে সামান্য কোনও বিষয়েও সময় মতো সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হয় না কোনও পর্যায়েই। এর প্রধান কারণ ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রণীত রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রশাসনিক ব্যবস্থা, আইন ব্যবস্থা কোনও স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্য কার্যকর হতে পারে না। এই ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছিল ঔপনিবেশিক দেশগুলোর স্বার্থ রক্ষার্থে, দাসদের প্রগতি কিংবা আর্থ-সামাজিক অগ্রগতির জন্য নয়। প্রথম এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর যখন সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো ধ্বসে পড়ে তখন ওই সমস্ত অপশক্তি তাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বেশিরভাগ উপনিবেশকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয়। বোঝাপড়ার মাধ্যমে সামন্তবাদের অবশেষ এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর সমন্বয়ে তাদেরই গড়ে তোলা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীকে বসিয়ে দেয়া হয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। তারা ঔপনিবেশিক প্রভুদের বরকন্দাজ হয়ে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে প্রভুদের সুতোর টানেই দেশ শাসন করে চলেছে স্বাধীনতার পরও ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আইন বিভাগ, প্রশাসনিক যন্ত্র, আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এবং জাতীয় রাজনীতি নিজেদের মুঠোয় কুক্ষিগত করে। যার ফলে, বেশির ভাগ সদ্য স্বাধীন দেশগুলোতে বদলায়নি কিছুই, বদলিয়েছে শুধু শোষক এবং শাসকগোষ্ঠীর খোলস। সাদা সাহেবদের জায়গাতে আসীন হয়েছে তাদেরই লালিত পালিত ব্রাউন সাহেবরা। এই পরভৃত শ্রেণি প্রয়োজন মতো কখনো স্বৈরশাসন কখনো গণতন্ত্রের ছদ্মাবরণে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা তাদের হাতেই ধরে রাখছে জনস্বার্থের বিরুদ্ধে। জনগণের ১-২ শতাংশ এই শ্রেণিই নিয়ন্ত্রণ করছে রাষ্ট্র ও সমাজ। কব্জা করে নিয়েছে জাতীয় সম্পদের ৮০ শতাংশের উপর। জনশক্তির ৯৮-৯৯ শতাংশ মূলত ঐ ১-২ শতাংশের অপশাসন এবং শোষণের স্টিম রোলারের নিচে পিষ্ট দাসে পরিণত হয়ে আছে। তাদের জন্য স্বাধীনতার মানে হচ্ছে একটি জাতীয় পতাকা এবং একটি জাতীয় সঙ্গীত। তৃতীয় বিশ্বের এই ধরনের তথাকথিত স্বাধীন দেশগুলোর বাস্তবতা বর্ণনা করতে গিয়ে মুক্তিকামী নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলেন-অনুন্নত এবং পশ্চাদপদ বেশিরভাগ তথাকথিত স্বাধীন রাষ্ট্রগুলোতে তিনি শুধু রাজনীতিবিদই দেখতে পান, কিন্তু নেতা দেখতে পান না। তার এই মন্তব্য শুনে সাংবাদিকরা তাকে রাজনীতিবিদ এবং নেতার মধ্যে পার্থক্য কি তার ব্যাখ্যা জানতে চাইলেম্যান্ডেলা বলেছিলেন রাজনীতিবিদরা শুধুমাত্র নিজেদের কায়েমী স্বার্থের খাতিরেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অংশীদার হতে আগ্রহী। ঔপনিবেশিক প্রভুদের প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অবকাঠামো বজায় রেখে তারা শুধু নিজেদের কায়েমী স্বার্থ বৃদ্ধি করায় ব্রতী হয়। তাদের দৃষ্টির পরিসীমা শুধুমাত্র নির্বাচন অব্দি। আর নেতারা হচ্ছে দূরদৃষ্টি সম্পন্ন এমন ব্যক্তিবর্গ যাদের রয়েছে দেশের জনগণের প্রত্যাশার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে পর্যায়ক্রমে নির্ধারিত সময়সীমার মধ্যে কোনও লক্ষে পৌঁছানো হবে সে সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা। একইসাথে সেই লক্ষে পৌঁছানোর জন্য যে পথকেই বাস্তবতার নিরিখে সর্ব-উৎকৃষ্ট বলে বিবেচিত হবে, সেই পথে এগিয়ে চলার মতো দৃঢ় প্রত্যয়, সাহস এবং আপোষহীন কমিটমেন্ট থাকবে তাদের। বর্তমান আর আগামী প্রজন্মের সাহসী মুক্তিযোদ্ধা যারা জনগণের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে দেশ এবং জাতিকে পংকিল চোরাবালিতে নিমজ্জিত অবস্থা থেকে উদ্ধার করার সংগ্রামে ব্রতী তাদের জন্য নেলসন ম্যান্ডেলার এই অভিমত সঠিক পথের সন্ধানে আলোকবর্তিকা হিসাবে কাজ করবে বলেই আমার বিশ্বাস। অভিজ্ঞ এই বর্ষীয়ান নেতার বক্তব্যের আলোকে বলা চলে, বর্তমান বিশ্বব্যবস্থায় বেশিরভাগ অনুন্নত দেশগুলোর প্রগতির পথে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে সে সমস্ত দেশের ঘুণেধরা ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা যাকে বলা হয়ে থাকে ‘Status Quo’. প্রকৃত স্বাধীনতা এবং স্বনির্ভর উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির জন্য বর্তমান ব্যবস্থার ত্বরিত আমূল পরিবর্তন করে দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে গড়ে তুলতে হবে দেশবাসীর প্রত্যাশার নিরিখে যুগোপযোগী নতুন এক প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয়, আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা। এ ধরনের পদক্ষেপকে যদি বিপ্লব বলা হয় তবে তাতে সমস্যা হবার কথা নয়। কিন্তু এ ধরনের আমূল পরিবর্তন ছাড়া বিদেশীদের দ্বারা সৃষ্ট কায়েমী স্বার্থবাদী ক্ষমতাধর ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠীর হাত থেকে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুক্তির কোনও সম্ভাবনাই নেই। তাছাড়া বৃহত্তর জনগণের মেধা, সৃজনশীল কর্মক্ষমতা এবং পেশাগত দক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার সমসুযোগ যেই সমাজে অবর্তমান সেই সমাজ কখনোই প্রগতির পথে এগুতে পারে না। সেই জাতির ভাগ্যোন্নয়নও সম্ভব নয়।
অনেক রাজনৈতিক নেতা প্রচলিত ‘Status Quo’ বজায় রেখে Evolutionary Process-এর মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে প্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাবার কথা প্রচার করে থাকেন। এমন প্রচারণা বিভ্রান্তিকর এবং অযৌক্তিক। ইতিহাস সেই সাক্ষ্যই বহন করে।
পৃথিবীর সব জাতিরই রয়েছে নিজস্ব জীবন ধারা, ঐতিহ্য, মূল্যবোধ, সংস্কৃতি, আশা এবং আকাঙ্ক্ষার উপর গড়ে ওঠা পৃথক পরিচিতি। এই বাস্তবতাকে অস্বীকার করে ধার করে আনা কোনও দর্শন বলপূর্বক কোনও জাতির উপর চাপিয়ে দিলে সেটা কখনোই সুফল বয়ে আনতে পারে না বরং এ ধরণের প্রচেষ্টা হয়ে ওঠে আত্মঘাতী। একমাত্র নিজস্ব মূল্যবোধ সংস্কৃতি, ঐতিহ্য, সম্পদ এবং জনগণের মেধা ও সৃজনশীল কর্মক্ষমতার উপর নির্ভর করেই গড়ে তোলা সম্ভব একটি আত্মনির্ভরশীল স্বাধীন রাষ্ট্র আর আত্মমর্যাদাশীল গর্বিত জাতি।কমরেড শু শিং একজন ক্ষমতাধর ব্যক্তি হলেও খালেদা জিয়ার সফর সংক্রান্ত সিদ্ধান্তের পেছনে আরো অদৃশ্য শক্তিধর নীতি নির্ধারকরা রয়েছেন সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহের অবকাশ নেই। বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিভিন্ন স্তরের চৈনিক নেতৃবৃন্দের সাথে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা আমাকে সেই শিক্ষাই দিয়েছে। এই সমস্ত ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকালে বেড সাইড টেবিলে রাখা ফোনটা বেজে ওঠায় ঘুম ভেঙ্গে গেলো। অপরপ্রান্ত থেকে মিষ্টি গলায় এক তরুণী জানালো, সকাল ৭ টা বাজে। দেয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখলাম নির্ধারিত সময়েই জাগিয়ে তোলা হয়েছে। বেড টি নিয়ে দরজায় টোকা দিয়ে ঘরে প্রবেশ করলো এক সুদর্শনা তরুণী। টেবিলের উপর সযত্নে ট্রে টা রেখে বললো স্যার, আপনার বেড টি, ভালো ঘুম হয়েছে তো? কয় চামচ চিনি জেনে নিয়ে চা বানাতে বানাতে মেয়েটি জানতে চাইলো নাস্তা কখন নিয়ে আসবে। বললাম, ৯ টায়। চলে গেলো মৃদু হেসে প্রিয়দর্শিনী পরিচারিকা। বেড টি শেষে প্রাতঃক্রিয়া সেরে তৈরি হয়ে নিলাম। টেবিলের উপর থেকে দৈনিক পিপলস ডেইলিটা তুলে চোখ বুলাচ্ছিলাম। ঠিক ৯ টায় তরুণী নাস্তার ট্রলি নিয়ে ঘরে ঢুকলো এবং নাস্তা পরিবেশন করলো। খবরের কাগজ পড়তে পড়তে আস্তে ধীরে নাস্তা পর্ব শেষ করলাম। ঠিক পৌনে ১১ টায় এলো কমরেড উ। কুশলাদি বিনিময়ের পর জিজ্ঞেস করলো, ঘুম ভালো হয়েছে কিনা। জানতে চাইলো অন্য কোনও অসুবিধে হয়েছে কিনা। জবাবে বললাম
যেই রাজকীয় অবস্থায় রেখেছো তাতে কোনও অসুবিধে হবার কারণ থাকতে পারে কি? আরামের সাথে একটা লম্বা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে উঠেছি। আমার রসিকতায় হেসে উঠল পুরনো বন্ধু উ। আমাকে মিটিং রুমে নিয়ে গিয়ে উ জানালো, মিটিং-এ শুধুমাত্র কমরেড শু শিং এবং কমরেড মা থাকবেন। সে থাকবে দোভাষী হিসাবে।
ঠিক ১১ টায় উপস্থিত হলেন কমরেড শু শিং কমরেড মাকে সঙ্গে নিয়ে। ঘরে ঢুকে বন্ধুবর মা আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্বের শেষে কমরেড শু শিং আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে বললেন
আমাদের পরীক্ষিত বন্ধুকে চৈনিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে স্বাগতম জানাচ্ছি। আপনার সাথে আগে দেখা না হলেও আপনি আমার কাছে অপরিচিত নন। তার এই ছোট্ট মন্তব্যটা অর্থবহ। এরপর আমরা নিজেদের নির্ধারিত আসনে বসলাম। মিটিং শুরু হল। পুরনো বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে আমাদের আলোচনা হবে খোলাখুলিভাবে কোনও রাখঢাক না রেখেই, এতে আপনার কোনও আপত্তি নেইতো?
এক্সেলেন্সি, আপনার এই ধরনের প্রস্তাবনা শুধু প্রশংসনীয়ই নয়, হৃদয়স্পর্শীও বটে। আপনার এবারের সফরের লক্ষ এবং এজেন্ডা নিয়ে যথাযথ আলোচনার পর চীন সরকারের সিদ্ধান্তটা আপনাকে জানিয়ে দেবার দায়িত্ব আমার উপর অর্পিত হয়েছে। সেটা জানানোর আগে চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ক কিছু কথা আমি বলতে চাই।
চীন-বাংলাদেশের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে সুপ্রাচীন। বহু যুগ আগে শ্রী অতীশ দীপংকর নামের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু প্রাচীন বঙ্গ থেকে চীনে এসে বৌদ্ধ ধর্মের প্রচার শুরু করেন। এই ধর্মের বাণীকে গ্রহণ করে লক্ষকোটি চীনাবাসী। এরপর ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্য ২৯ জন ধর্ম প্রচারককে চীনে পাঠিয়েছিলেন হযরত শাহজালাল(রঃ) আদিবঙ্গ থেকেই। ইসলাম ধর্মের জীবন দর্শন এবং মূল্যবোধে আকৃষ্ট হয়ে এদেশের কোটি কোটি মানুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়ে মুসলমান হয়েছিলো। আমাদের পরিসংখ্যান অনুযায়ী ৪০ কোটিরও বেশি চীনের বিভিন্ন প্রদেশের নারী-পুরুষ ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিলো। শ্রী অতীশ দীপংকরের দেহাবশেষ অতি শ্রদ্ধার সাথেই তিব্বতের পোতলা প্যালেস-এ সংরক্ষিত রাখা হয়েছিল। বর্তমানের বাংলাদেশকে গণচীন একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫-এর সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পরই স্বীকৃতি প্রদান করে। এরপর বাংলাদেশের সরকারের অনুরোধে জেনারেল জিয়ার শাসনকালে সেই সংরক্ষিত দেহাবশেষ বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দেয়া হয়। এই বিষয়ে আপনিও অবদান রেখেছেন। ২৯ জন মুসলিম প্রচারকের সমাধিগুলো ক্যান্টনের মসজিদের পরিসীমার মধ্যে সুরক্ষিত রয়েছে সেটা আপনি স্বচক্ষে পরিদর্শন করেছেন। বেইজিং-এ অবস্থান কালে আপনার উদ্দগে বেইজিং-এ অবস্থিত সব মুসলিম দেশগুলোর দূতাবাসের কূটনীতিকদের সমন্বয়ে গঠিত একটি প্রতিনিধি দল চৈনিক কর্তৃপক্ষের সাথে সাক্ষাৎ করে প্রস্তাব করেছিলেন, বেইজিং-এর জামে মসজিদসহ দেশের সব মসজিদে নামাজ আদায়ের অনুমতি প্রদান এবং নামাজের জন্য আজান দেবার রীতি পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে। আপনাদের সেই প্রস্তাব গণচীন সরকার মেনে নিয়ে সবরকম কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করেছিল আপনার বেইজিং এ থাকাকালীন সময়েই। এই মহৎ উদ্দগের পেছনে আপনার ব্যক্তিগত অবদান কতটুকু সেটাও আমাদের অজানা নয়। প্রকৃত বন্ধুত্ব গড়ে তোলার ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয়ে বিশেষ গুরুত্ব দেবার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে মনে করে গণচীন।
যথা, একে অপরের প্রতি সমতা ভিত্তিক আচরণ, ধর্মীয় বিশাস, মূল্যবোধ, জীবনধারা এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। এ ছাড়াও বন্ধুত্বের সম্পর্ককে দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে তোলার জন্য তিন পর্যায়ে বন্ধুত্বের শেকড় প্রোথিত করা অত্যন্ত আবশ্যকীয়।
প্রথমতঃ জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্ক। দ্বিতীয়তঃ সমমনা রাজনৈতিক দল, সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিজ্ঞজন এবং বুদ্ধিজীবীদের সাথে সম্পর্ক। তৃতীয়তঃ সরকারের সাথে সম্পর্ক। চার হাজার বছরের বেশি সময়ের চৈনিক জাতির সুরক্ষিত লিখিত ইতিহাস আমাদের সেই শিক্ষাই দেয়। এই তিন পর্যায়ে বন্ধুপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য সমপরিমাণ গুরুত্ব দিয়ে থাকেন চৈনিক নেতৃবৃন্দ। বন্ধুপ্রতিম বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই নীতি মেনে চলেছে গণচীন। সরকারের রদবদলে এই মৌলিক নীতিতে হেরফের হয় না কখনোই। ঐতিহাসিক ভাবে প্রমাণিত, চীন সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাসী নয়। বৈদেশিক সম্পর্ক, বিশেষ করে বন্ধুপ্রতিম কোনও রাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে সরকার বদল বা অন্য যেকোনো কারণে কোনরূপ প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হলে সেই প্রতিকূল অবস্থাকে অনুকূলে কি করে আনা সম্ভব সেই প্রজ্ঞাও আমরা রপ্ত করেছি আমাদের ইতিহাস থেকেই। পাকিস্তানে যখন কম্যুনিস্ট পার্টির উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়, তখনও চীন তার নীতিতে অটল থেকে বন্ধুত্বের সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে চলে।
‘৬৯-এর গণ অভ্যুত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনের পর ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয় নিয়ে পাকিস্তানের রাজনৈতিক অবস্থা জটিল হয়ে ওঠে। বিশেষ করে মুজিবের অসহযোগের ডাক দেবার পর সেই জটিলতা আরও ঘনীভূত হয়।
সেই সংকট কালে জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সামরিক জান্তা প্রধান প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের বিশেষ দূত হিসাবে এক প্রতিনিধি দলের নেতা হয়ে গণচীনে এসেছিলেন পাকিস্তানের চলমান সংকট নিয়ে আলোচনা করার জন্য। বৈঠকে তিনি রাজনৈতিক সংকটের বিস্তারিত বিবরণ দিয়ে বলেছিলেন
পূর্ব পাকিস্তানের একছত্র নেতা শেখ মুজিবর রহমান এবং তার দল আওয়ামীলীগের রাজনৈতিক এজেন্ডা হচ্ছে মূলত বিচ্ছিন্নতাবাদ, আর এইএজেন্ডা বাস্তবায়নে ইন্ধন যোগাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারত। এই বাস্তবতায় রাষ্ট্রীয় অখণ্ডতা বজায় রাখার স্বার্থে দেশের সামরিক জান্তা এবং পাকিস্তানের অন্যান্য দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং দলগুলোর মধ্যে ঐক্যমত্য হয়েছে, যেকোনো পদক্ষেপের মাধ্যমেই হউক না কেনও বর্তমানের অভ্যন্তরীণ সমস্যার সমাধান করে দেশের অখণ্ডতা বজায় রাখতে হবে। সমস্যা মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে সোভিয়েত সমর্থিত ভারতীয় যেকোনো প্রকার হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে বন্ধুপ্রতিম দেশ গণচীন পাশে থাকবে এটাই পাকিস্তান সরকারের প্রত্যাশা। এ বিষয়ে চীনা নেতৃবৃন্দের পূর্ণ সমর্থনের অঙ্গীকার নিয়ে ফিরে যেতে চান জনাব ভুট্টো। তার এই বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অভিমত তাকে পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো। আমাদের তরফ থেকে তাকে বলা হয়-
পাকিস্তানকে বন্ধুরাষ্ট্র হিসাবেই গণ্য করে গণচীন। বিধায়, পাকিস্তানের বর্তমান রাজনৈতিক সংকট নিয়ে গণচীনও উদ্বিগ্ন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে উপমহাদেশকে খণ্ডিত করে পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান নামের দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্রের সৃষ্টি করে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারত ছাড়তে বাধ্য হয়। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকেই হিন্দুস্তানের কর্ণধারেরা ভারতমাতার এই বিভক্তি মেনে নিতে পারেনি। আজ অবধি সেটা স্পষ্টভাবে লিখিত হয়ে আছে ‘নেহরু ডক্ট্রিন’-এর পাতায়। তাই যেকোনো সুযোগের সদ্ব্যবহার করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব বিলীন করায় ব্রতী হবে ভারত, এটা একটা বাস্তবতা। এই বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই। তবে দুঃখজনক হলেও আমরা মনে করি, বহুজাতিক রাষ্ট্র পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদ দৃঢ় ভিত্তির উপর গড়ে তুলতে ব্যর্থ হয়েছেন সামন্তবাদী এবং মুৎসুদ্দি শ্রেণীর প্রতিভূ বেসামরিক-সামরিক শাসকগোষ্ঠী যারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে আছেন জন্মলগ্ন থেকে বিগত ২৫ বছর ধরে। অপশাসন, শোষণ, বঞ্চনা এবং আর্থ-সামাজিক বৈষম্য প্রকট হয়ে ওঠার ফলেই জাতীয়তাবাদ দুর্বল হয়ে পড়ে, আর আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতাবাদ সমাজে শিকড় গাড়ে। এ দু’টি সর্বনাশা আলামত কম-বেশি পাকিস্তানের প্রায় সব কয়টি প্রদেশেই বিরাজমান। বর্তমানের সংকট হচ্ছে কেন্দ্রের সাথে পূর্ব পাকিস্তানের দীর্ঘদিনের পুঞ্জিভূত দ্বন্দ্বগুলোর রাজনৈতিক বহিঃপ্রকাশ। বন্ধুরাষ্ট্র পাকিস্তানের স্বার্থেই আমাদের অভিমত হচ্ছে, পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান সমস্যাটা সার্বিক বিবেচনায় একটি রাজনৈতিক সমস্যা হিসাবে গ্রহণ করতে হবে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান একমাত্র রাজনৈতিক ভাবেই বের করার উদ্দগ নিতে হবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আশা-প্রত্যাশার আলোকে। অস্ত্রবলে বর্তমান সংকটের সমাধান করার যেকোনো প্রয়াস হবে আত্মঘাতী। আমরা দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি, আলোচনার মাধ্যমে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের সময় এখনও পেরিয়ে যায়নি। আমাদের অভিমত শুনে ফিরে গিয়ে জনাব ভুট্টো জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে আমাদের বক্তব্যের ঠিক উল্টোটাই বলেছিলেন। তিনি তাকে বুঝিয়েছিলেন অভ্যন্তরীণ অরাজকতা এবং অস্থিতিশীলতার হাত থেকে পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচানোর জন্য কেন্দ্রীয় সরকার যদি কঠিন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে তবে তার প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানাবে গণচীন সরকার। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেন, কঠিন কোনও পদক্ষেপ গ্রহণের পরিপ্রেক্ষিতে ভারত যদি পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে প্রত্যক্ষভাবে জড়িয়ে পড়ে সেই সময় গণচীন পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষার জন্য প্রয়োজনে ভারতের বিরুদ্ধ্বে যুদ্ধ করতেও প্রস্তুত থাকবে সেই অঙ্গীকারও আদায় করে ফিরেছেন তিনি।
এ ধরনের মিথ্যাচার কোনও জাতীয় পর্যায়ের নেতার পক্ষে করা সম্ভব এমন দৃষ্টান্ত ইতিহাসে বিরল। ভুট্টোর এহেন মিথ্যাচারে প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক জান্তা রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান সামরিক শ্বেত-সন্ত্রাসের মাধ্যমে নিরসন করার জন্য বিশেষভাবে অনুপ্রাণিত হয়ে ওঠেন। তারা ভেবেছিলেন,পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান চালালে যদি সেই সুযোগে রুশ-ভারত অক্ষশক্তি পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হয় সেই ক্ষেত্রে গণচীন সহ আমেরিকা, তাদের দোসর ইউরোপীয় শক্তিগুলো এবং সারা মুসলিম জাহান পাকিস্তানের পক্ষে সোভিয়েত ইউনিয়ন ও ভারতের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবে। এই ধরনের সমীকরণের যুদ্ধে শোচনীয় পরাজয় ঘটবে রুশ-ভারত অক্ষশক্তির। পরাজিত এবং যুদ্ধবিধ্বস্ত ভারতকে খণ্ডিত করে কাশ্মীর দখলসহ ভারতীয় ইউনিয়নকে খণ্ডিত করে এর বিলুপ্তি ঘটানো যাবে। এতে চাণক্যদের ‘অখণ্ড ভারত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার স্বপ্ন চিরতরে নস্যাৎ করাও সম্ভব হবে। একই সাথে পাকিস্তান বিশ্বপরিসরে স্বীকৃতি লাভ করবে দক্ষিণ এশিয়ার একচ্ছত্র আঞ্চলিক শক্তি হিসাবে।
এ ধরনের চিন্তা-ভাবনাকে দিবাস্বপ্নই বলা চলে! জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সম্পর্কে চৈনিক নেতৃবৃন্দের একজন ক্ষমতাধর প্রবীণ নেতার বিবরণ শুনে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম! কেনও এই প্রসঙ্গে এত বিশদভাবে ব্যাখ্যা করলেন ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী ক্ষমতাধর প্রবীণ এই নেতা! কারণটা সুস্পষ্ট। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণচীনের ভূমিকা সম্পর্কে অনেক মিথ্যা অপ-প্রচার চালানো হয়েছে আওয়ামী-বাকশালী আমলে এবং যুদ্ধকালীন সময় থেকেই। ঐ সমস্ত বিরূপ প্রচারণা বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে কিছুটা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে সক্ষমও হয়েছে। সেই বিভ্রান্তি দূর করার প্রয়াসেই এই প্রসঙ্গটা তুলেছিলেন কমরেড শু শিং চৈনিক নেতৃবৃন্দের তরফ থেকে। এরপর খালেদা জিয়ার চীন সফর এবং তার এজেন্ডা সম্পর্কে ফিরে এলেন কমরেড শু শিং। তিনি জানালেন
খালেদা জিয়াকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ জানাবার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সর্বোচ্চ পর্যায়ে। তিনি নিজের সুবিধা মতো যেকোনো দিন চীন সফরে আসতে পারেন। দিনক্ষণ ঠিক করে ঢাকায় অবস্থানকারী রাষ্ট্রদূতকে জানালেই রাষ্ট্রীয় সফরের সব আয়োজন করা হবে এই প্রান্তে। এজেন্ডা সম্পর্কে তিনি জানালেন, সফরকালে খালেদা জিয়াকে এজেন্ডার বিষয়গুলো সম্পর্কে ইতিবাচক সিদ্ধান্তই জানানো হবে চীন সরকারের পক্ষ থেকে। এভাবেই মিটিং শেষে মধ্যাহ্ন ভোজের নিমন্ত্রণ জানিয়ে চলে গেলেন লং মার্চ ভেটারান কমরেড শু শিং বন্ধু মা-কে সঙ্গে নিয়ে। উ-কে সঙ্গে নিয়ে আমার ঘরে ফিরে এলাম আমি।
কিছুটা টেনশনে ছিলাম, কিন্তু বৈঠক সফল হওয়ায় সব টেনশন কেটে গেলো। রিল্যাক্সড মুডে বসলাম দুই বন্ধু। আমি দুইটি কাপে জেসমিন সবুজ চা ঢেলে একটি কাপ উ-র হাতে তুলে দিয়ে নিজেরটা হাতে নিয়ে বসলাম মুখোমুখি। উ হঠাৎবলে উঠলো প্রিয়বন্ধু, তুমি জানো না, আমরা সবাই তোমাকে কতটুকু ভালোবাসি আর শ্রদ্ধা করি। কারণটা কি শুনবে নও?
কেনো?
সারা বিশ্বের প্রতিপ্রান্তে আমাদের অনেক বন্ধু ছড়িয়ে আছে। কিন্তু তুমি তাদেরই একজন হয়েও কিছুটা ভিন্ন। তোমার মধ্যে আমরা খুঁজে পেয়েছি কিছু দুর্লভ বৈশিষ্ট্য। তুমি একজন নিঃস্বার্থ জনদরদী সাচ্চা দেশপ্রেমিক। তোমার রাজনৈতিক সচেতনতা, দূরদর্শী বিচক্ষণতা এবং বর্তমান বিশ্বের চলমান ধারা সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি বিস্ময়কর! তুমি স্পষ্টবাদী, নির্ভীক এক সত্য সন্ধানী। জাগতিক সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে তুমি এক বিরল ব্যক্তিত্ব। বৃহত্তর মানবতার স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ এক যোদ্ধা তুমি। জেসমিন টি পান করতে করতে অতি আন্তরিকতার সাথেই কথাগুলো বলছিল পুরনো বন্ধু উ। আমি নিঃশব্দে চা পান করছিলাম আর তার বক্তব্য শুনছিলাম।
পয়গাম নিয়ে হাসি মুখে তরুণী পরিচারিকা এসে জানালো খাবারের সময় হয়েছে। আমাদের পথ দেখিয়ে খাবারের ঘরে নিয়ে গেলো পরিচারিকা। ঘরে প্রবেশ করার দরজায় দেখি কমরেড শু শিং এবং কমরেড মা আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য দাড়িয়ে। তাদের পেছনে দাড়িয়ে আছে PLA এর পুরনো বন্ধু কমিসার কমরেড ফু এবং উর্দি পরিহিত সুদর্শন যুবক কমরেড হং।
আমি যখন বেইজিং-এ ছিলাম তখন হং PLA এর Foreign Relation Department এ দোভাষীর দায়িত্ব পালন করতো উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকগুলোতে। তার কাধে দেখলাম ফুল কর্নেলের ব্যাজ। উ জানালো, ইতিমধ্যে হং বাংলাদেশ সফর করে এসেছে। আমি এসেছি জানতে পেরে ফু এবং হং তাদের পুরনো বন্ধুর সাথে মিলিত হবার ইচ্ছা প্রকাশ করায় তাদেরকেও আজকের মধ্যাহ্ন ভোজে নিমন্ত্রণ করা হয়েছে। নিখুঁতভাবে সাজানো রিভলভিং গোল টেবিল। প্রতিটি নির্ধারিত চেয়ারের সামনে মেনুর সাথে নামের কার্ড। সবাই যার যার আসনে বসে পড়লাম। মেনুটা হাতে নিয়ে চোখ বুলিয়েই বুঝতে পারলাম বিখ্যাত ‘পিকিং ডাক’ ভিত্তিক খাবার পরিবেশিত হবে। এই খাবারের বৈশিষ্ট হল শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত সব কয়টি ব্যঞ্জন তৈরি করা হবে পিকিং ডাকের বিভিন্ন অঙ্গ প্রত্যঙ্গ দিয়ে। খাবার পরিবেশনার অনুমতি নিয়ে প্রশিক্ষিত চৌকস পরিচারিকারা হসিমুখে পরিচর্যা এবং পরিবেশনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লো। খাবারের সাথে টুকটাক কথাবার্তা এবং রসিকতাও চলছিল। এক সময় কমরেড শু শিং বললেন
যদিও তোমার একান্ত সাথী এবং সহযোদ্ধাদের কারও সাথেই আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠতা গড়ে তোলার সুযোগ হয়নি তবে তাদের প্রতিও আমাদের যথেষ্ট শ্রদ্ধা রয়েছে। আমার নিজের জীবনের অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি, পংকিলতার মাঝেও পদ্মফুল যেভাবে উদ্ভাসিত হয়ে উঠে ঠিক তেমনি সত্যিও সব অপচেষ্টা বাধা-বিপত্তি উৎরে দেশবাসীর কাছে উন্মোচিত হবেই একদিন। আর তখনই তোমার মতো নেতাদের জনগণ খুঁজে নেবে জাতীয়মুক্তিসংগ্রামে নেতৃত্ব দান করার জন্য। আমরাও সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকবো। আত্মবিশ্বাস আর দৃঢ় প্রত্যয়ী হয়ে ধৈর্য ধরে থাকো বন্ধু, ডাক একদিন আসবেই।
কমরেড, আপনি বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ একজন নেতা। আপনার মতো একজন বিচক্ষণ এবং প্রাজ্ঞ নেতার মূল্যায়ন আমাদের জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে। জেনে রাখুন শ্রদ্ধেয় কমরেড, জীবদ্দশায় সেই ডাক যদি নাও আসে তবুও আমাদের লাখো শহীদ এবং মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের ইতিকথা রেখে যাবো বর্তমান আর ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য, যাতে সেই স্বপ্নকে একদিন তারা বাংলাদেশে বাস্তবে পরিণত করতে সক্ষম হয়। কাজটি দুষ্কর হলেও অসম্ভব নয়, সেই শিক্ষাই গণচীনের ইতিহাস থেকে আমি পেয়েছি। প্রথা অনুযায়ী খাওয়া শেষে হোস্ট কমরেড শু শিং চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন ছোট্ট করে তার বক্তব্য পেশ করার জন্য।
বন্ধুবর হকের সম্মানে আয়োজিত আজকের ভোজসভায় উপস্থিত সবাইকে অভিনন্দন জানিয়ে আমি আমার বক্তব্য শুরু করছি। তিনি উপস্থিত সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত। তার নিজ দেশে তিনি একজন বহুল পরিচিত বিপ্লবী নেতা এবং বীর মুক্তিযোদ্ধাই শুধু নন, চীন-বাংলাদেশ সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য নিবেদিতপ্রাণ বিশ্বস্ত কর্মীও বটে। এর স্বাক্ষর চীন-বাংলাদেশ সম্পর্কের ইতিহাস বহন করবে। তিনি এবার দেশের নব নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে এক গোপন সফরে এসেছেন একটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য এবং এজেন্ডা নিয়ে। আজ আমরা সবাই খুশি, আমাদের পরমবন্ধু আজই ফিরে যাচ্ছেন সফলতা অর্জন করে। ভবিষ্যতে তিনি এবং তার সাথী ভাইরা জাতীয় মুক্তিসংগ্রামে আরও বড় অবদান রাখবেন সেই প্রত্যাশায় তার সুস্বাস্থ্য কামনা করে আমি উপস্থিত সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছি এক টোষ্টে আমার সাথে যোগদান করুন। তার কথা শেষে সবাই পানীয়র গ্লাস হাতে উঠে দাড়ালেন, আমিও তাই করলাম। কমরেড শু উচ্চস্বরে বলে উঠলেন, ‘কাম্বে’ এবং গ্লাসটা খালি করলেন, আমরা সবাই তাঁর অনুকরণ করলাম। এবার গেস্ট অফ অনার হিসাবে তার বক্তব্যের জবাবে আমাকে কিছু বলতে হবে তাই চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম।
মাননীয় কমরেড শু শিং এবং উপস্থিত বন্ধুগণ, অনেকদিন পর আপনাদের সাথে মিলিত হতে পেরে আমি আনন্দিত। কমরেড শু, আপনি গণচীনের একজন বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ এবং বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ নেতা হয়েও আমার মতো একজন অতি সাধারণ ব্যক্তির জন্য আজকের এই ভোজসভার আয়োজন করে আমাকে যে সম্মান প্রদর্শন করলেন সেটা আমার মনে থাকবে চিরদিন। আজকের ভোজসভায় এমন কয়েকজন পুরনো বন্ধুদের একত্রিত করেছেন যাদের মুখচ্ছবি চীন ছেড়ে যাবার পরও আমার স্মৃতির পর্দায় জাগরূক হয়ে আছে। এর জন্য আপনাকে বিশেষভাবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি। মাননীয় কমরেড বলেছেন, আজ আমি সফলতার সাথে ফিরে যাচ্ছি। কিন্তু আমি জানি, এই সফলতা অর্জনের পেছনে আমার বন্ধুদের প্রচেষ্টাটাই মুখ্য। তাদের আন্তরিক প্রচেষ্টা ছাড়া এই সাফল্য আমার একক প্রচেষ্টায় কিছুতেই অর্জন করা সম্ভব হতো না। তাই কমরেড শু শিং-এর সাথে আমি বন্ধুদের সুস্বাস্থ্য কামনা করে একটি টোস্টে আপনাদের সবাইকে যোগদান করার আবেদন জানাচ্ছি, এরপর ‘কাম্বে’ বলে পানীয়র গ্লাসটি খালি করলাম। সাথে সবাই আমার অনুকরণ করলো। ভোজসভা শেষ হল। এরপর কমরেড শু শিং সহ সবাই একে একে চলে গেলেন।
কমরেড মা উর কাছ থেকে জানতে চাইলেন ফিরতি যাত্রার সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে কিনা।
হ্যাঁ, অপরাহ্ণের একটি ফ্লাইটে ফিরে যাবেন হক। হংকং-এ রাত্রি যাপনের সব ব্যবস্থা করে ফেলেছেন কমরেড লাম। আগামীকালই তার দেশে ফেরার সব ব্যবস্থাও করা হয়েছে। সময় মতো আমি নিজেই তাকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানিয়ে আসবো। অতি উত্তম। এরপর মা আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল বন্ধু, বিশেষ জরুরী কিছু কাজে আটকে পড়ায় আমি এয়ারপোর্টে তোমাকে বিদায় জানাতে যেতে পারছি না। তবে তাতে তোমার কোনও অসুবিধে হবে না। কমরেড উ তো রয়েছেই। তোমার, আমাদের প্রিয় ভাবী নিম্মি এবং সস্তির জন্য সামান্য কিছু উপহার তোমার ঘরে পাঠিয়ে দিয়েছেন কমরেড শু শিং আমাদের তরফ থেকে। তাদের আমাদের আশির্বাদ ও শুভেচ্ছা জানাবে। পরের বার ওদের অবশ্যই সাথে নিয়ে আসবে। তুমি ভাল থেকো, আসি এবার। আমি সবকিছুর জন্য তাকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মা। যাবার আগে ফিসফিসিয়ে জানিয়ে গেলেন চোখ টিপে, এজেন্ডার সব কয়টি প্রস্তাবই অনুমোদিত হয়েছে অর্থের সংকুলান সহ।
ঘরে ফিরলাম উকে সঙ্গে নিয়ে। লিন্ডাকে ফোন করে জানালাম বিকেলে ফিরছি। আজ রাতটাই হাতে আছে, কাল ঢাকার পথে রওনা হতে হবে। তাই সম্ভব হলে বন্ধু-বান্ধবদের যাদেরকেই পাওয়া যায় তাদের জড়ো করতে পারলে মিলন মেলাটা বসাতে পারো কান্ট্রি ক্লাবে। আমি পেনিনসুলাতেই থাকবো। পৌঁছেই তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।
হংকং হয়ে ফিরলাম ঢাকায়
ঠিক আছে আমি সব ব্যবস্থা করছি। তুমি হোটেলে পৌছে আমাকে ফোন দিও। এর মধ্যেই আমি সব ব্যবস্থা করে নেবো। যথাসময়ে উ আমাকে প্লেনে বসিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। CAAC এর ফ্লাইট- তাই সময়ের তারতম্য হয় না।যথাসময়ে পৌঁছে গেলাম হংকং-এর কাইট্যাক এয়ারপোর্টে। লাম প্লেনের দোরগোড়া থেকেই অভ্যর্থনা জানিয়ে নিয়ে গিয়ে বসালো VIP Room-এ। পাসপোর্ট, টিকেট এবং লাগেজট্যাগ নিয়ে বেরিয়ে গেলেন তার সাথের ভদ্রলোক।
বলো, তোমার সফর কেমন হল? তোমাদের সবার প্রচেষ্টা ব্যর্থ হতে পারে না বন্ধু।
জবাব শুনে হেসে উঠল সুদর্শন লাম। অল্পক্ষণ পরই ভদ্রলোক ফিরে এসে সব কিছু ফিরিয়ে দিয়ে বললেন, মালপত্র গাড়িতে তোলা হয়ে গেছে। চলো, হোটেলে যাওয়া যাক। আমাকে হোটেলে পৌছে দিয়ে লাম বলল আগামীকাল সময়মতো আমি তোমাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে গিয়ে প্লেনে তুলে দিয়ে আসবো। চলে গেলো পরম বন্ধু লাম।লাম চলে যাবার পর ফোন করলাম লিন্ডাকে। লিন্ডা জানাল ঠিক হয়েছে আজ রাত ৮টায় সবাই একত্রে রাতের খাবার খাবো। আমি নিজেই এসে তোমাকে নিয়ে যাবো সাড়ে সাতটার দিকে ক্লাবে। তৈরি থাকবে।
দেখতে মিষ্টি প্রাণোচ্ছল মাঝবয়সী লিন্ডা পরম বন্ধু রবিনের স্ত্রী। চীনাদের বয়স বোঝা দুষ্কর।
চৈনিক একটা প্রবাদ আছে, ৪০ বছর না পেরোলে কোনও নারী কিংবা পুরুষকে চীনারা প্রাপ্তবয়স্ক মনে করে না। চীনা নারী-পুরুষের গড় আয়ু হচ্ছে যথাক্রমে ৯৭ এবং ৯৩ বছর। এর কারণ তাদের শরীরচর্চা এবং খাদ্যাভাস। চীনারা বাসী কোনও জিনিষ খাওয়ায় অভ্যস্ত নয়। শিশুকাল থেকেই কঠিন নিয়মানুবর্তিতায় জীবনযাপন করে থাকে চৈনিকরা। দীর্ঘ আয়ুষ্কালের মূলমন্ত্র এটাই। ঠিক সোয়া সাতটায় লিন্ডা এসে পৌঁছালো। সুঠামদেহিনী লিন্ডা এমনিতেই সুন্দরী। কিন্তু আজ কালো শিফনের পার্টি ড্রেসে লিন্ডাকে একটু বেশি সুন্দরী দেখাচ্ছিলো। ঘরে ঢুকেই খুশিতে তার পুরনো টেনিস পার্টনারকে জড়িয়ে ধরলো লিন্ডা।
অনেক দিন বে-খবর থাকার পর হঠাৎ তোমার আগমনে বন্ধুরা সবাই ভীষণ খুশি। হংকং এ অবস্থিত সবাই অতি আগ্রহের সাথেই তোমার সাথে দেখা করার জন্য পূর্ব নির্ধারিত অন্য সব এ্যাপয়েন্টমেন্ট নাকচ করে আমার দাওয়াতে আসছে। চশমার পরিবর্তে ম্যাচিং লেন্স পড়েছে লিন্ডা। ওকে সোফায় বসিয়ে মুখোমুখি বসলাম। স্থিরদৃষ্টিতে আমার দিকে কয়েক লক তাকিয়ে মৃদু হেসে লিন্ডা বলল তোমার তো কোনও পরিবর্তন দেখছিনা! তোমারও কি কোনও পরিবর্তন হয়েছে মক্ষিরাণী? বরং আজকে তো তোমাকে পরীর মতোই লাগছে!
আশ্চর্য! তোমার কথাবার্তার ধরনটাও ঠিক আগের মতোই আছে। জানো, তুমি চলে যাবার পরও অনেকেই তোমাকে বিশেষভাবে মনে রেখেছে। প্রায়ই তোমাকে নিয়ে আমাদের মধ্যে কথা হয়। আমিও কি তোমাদের ভুলতে পেরেছি! পারিনি বলেই অতি অল্প সময়ের যাত্রা বিরতির মাঝখানে তোমাকে ফোন করেছি সবার সাথে দেখা করার জন্য।
তা বটে। কিন্তু লিন্ডা আজকে তোমাকে যেমন সুন্দরী আর মোহময়ী দেখাচ্ছে, ভাবছি নিজেকে সংযমের আওতায় রাখতে পারবো তো?
দুষ্ট কোথাকার! কাছে এসে হাত ধরে উঠিয়ে বললো
যথেষ্ট হয়েছে দুষ্ট হৃদয়হরণ। এবার যাওয়া যাক। দু’জনই নিচে নেমে এলাম। চাবি নিয়ে ভ্যালে চলে গেলো গাড়ী পোর্চে নিয়ে আসার জন্য। ত্বরিত ফিরে এল একটা সিলভার কালারের চকচকে মার্সিডিজ ৬০০ কনভার্টেবল স্পোর্টস কার নিয়ে। কি ব্যাপার? ইতিমধ্যেই গাড়ী বদলিয়ে ফেলেছো দেখছি! দুই তিন বছরের মধ্যে গাড়ী বদলানোটা আমার অভ্যেস।
শুনে বিরবিরিয়ে স্বগতোক্তি করলাম।
কি বললে? না কিছু না, বুঝতে চাচ্ছিলাম বন্ধু বদলানোর সময়সূচিটা কি? লিন্ডা বললো
অন্যদের সাথে তুমি নিজেকে তুলনা করবে না, তুমি আমার চিরকালের বন্ধু।
তাই বুঝি? হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। অল্প সময়েই রিপালস বেতে সমুদ্র সৈকত ঘেঁষে অবস্থিত হংকং-এর সবচেয়ে অভিজাত মিলনস্থল কান্ট্রি ক্লাবে পৌঁছে গেলাম। এই ক্লাবের বিশেষত্ব হল, শুধু ‘রিচ এন্ড ফেমাস’ হলেই এই ক্লাবের মেম্বার হওয়া যায় না। বংশের আভিজাত্যও সাথে থাকতে হবে। তাই ক্লাবের সদস্য সংখ্যা সর্বমোট দুই শত পরিবারের অধিক নয়। একমাত্র ব্যতিক্রম হচ্ছে হংকং-এ নিয়োগপ্রাপ্ত মিশন প্রধানগণ। ইচ্ছে করলে, শুধুমাত্র তারাই এর সদস্য হতে পারেন। সেই সুবাদেই এই ঐতিহ্যবাহী ক্লাবের মেম্বারশিপ লাভ করার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। এর ফলে হংকং-এর বিভিন্ন ক্ষেত্রের শীর্ষস্থানীয় প্রায় সবার সাথেই পরিচিত হতে পেরেছিলাম। ক্লাবের কর্মচারীদের সবাই আমাকে ভালোভাবে চেনে। কারণ হচ্ছে, বাৎসরিক ইন্টার ক্লাব টেনিস প্রতিযোগিতায় ক্লাবের টিমে আমি নিয়মিত অংশগ্রহণ করেছি যতদিন হংকং-এ ছিলাম। গাড়ী পার্কিং এ রেখে মেইন বিল্ডিং এর দিকে এগুচ্ছিলাম, পথে দেখা হলো টেনিস কোচ ওয়াং-এর সাথে। সহাস্যমুখে আমাদের দেখে এগিয়ে এসে ওয়াং জিজ্ঞস করলো
কেমন আছো তুমি? অনেকদিন পর তোমাকে দেখে অনেক খুশি হলাম। নিম্মি আর সস্তি কেমন আছে, সস্তি টেনিস খেলছে তো? ওয়াং-এর কাছেই সস্তির টেনিস খেলার হাতে খড়ি। জবাবে বললাম
ওরা সবাই ভাল আছে, সস্তি টেনিস খেলছে। জবাব শুনে খুশি হল ওয়াং। এরপর আমরা গিয়ে ঢুকলাম চিনিজ রেস্তোরাঁয়। বিশাল আয়োজন! দেখলাম ঘনিষ্ঠ বন্ধু-বান্ধবদের প্রায় সবাই উপস্থিত। দরজায় ক্লাব ম্যানেজমেন্ট-এর তরফ থেকে ম্যানেজার একটি সুন্দর ফুলের বুকে উপহার দিয়ে সবার সাথে স্বাগত জানালেন। খাওয়ার সাথে সবাই চুটিয়ে ঘণ্টা দুয়েক আড্ডা দিলাম।এক ফাঁকে জর্জকে প্রস্তাব দিলাম তোমার নিজস্ব জেটে করে সবাইকে নিয়ে আসো নাইরোবিতে সাফারি ট্রিপে আমার মেহমান হয়ে। সিসিল বললো অতি উত্তম প্রস্তাব! জর্জ, তোমার বদৌলতে আশেপাশের সব দেখার মতো জায়গাগুলোতো প্রায় সবই দেখা হয়ে গেছে, এবার আফ্রিকায় VIP সাফারি ট্রিপের দাওয়াতটা হেলায় হারানোটা ঠিক হবে না, কি বলো তোমরা সবাই?
সবাই একসাথে বিশেষ করে বারট লেভিনের স্ত্রী লিলি জর্জকে ধরে বসলো, ঠিকই বলেছে সিসিল।
হংকং-এর বিশিষ্ট ধনকুবের এবং সৌখিন পাইলট জর্জ আমাকে নিমন্ত্রণের জন্য সবার তরফ থেকে ধন্যবাদ জানিয়ে জানতে চাইলো, বছরের কন সময়টা নাইরোবিতে সাফারি ট্রিপে যাবার জন্য সর্বোত্তম? জবাবে বললাম কেনিয়া চির বসন্তের দেশ। তাই যেকোনো সময়ই উত্তম সময়। তবে আগস্টে এলে মাইগ্রেশনটা দেখতে পারবে। এটা সৃষ্টিকর্তার এক অভাবনীয় বিস্ময়! তাহলে আমরা সবাই সদলবলে আগামী আগস্টেই আসছি তোমার নিমন্ত্রণ রক্ষা করে।
লিন্ডা তোমার সাথে এ ব্যাপারে যোগাযোগ করবে সমন্বয়কারী হিসাবে। বললো, জর্জ।
হ্যাঁ, নিশ্চয়। সমস্বরে বলে উঠল উপস্থিত সবাই। লিন্ডাই সবাইকে জানালো আমি এবার দেশের প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ দূত হিসেবে বেইজিং সফরে গিয়েছিলাম এবং কালই দেশে ফিরে যাচ্ছি। বার্ট কাছে এসে শুধালো কেমন হল সফর? সংক্ষেপে ফলদায়ক। কালই হক ফিরে যাচ্ছে। তাই এবার আমাদের ওঠা উচিৎ। সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বললো পলিন
হ্যাঁ, সেটাই করা উচিৎ। যদিও এতদিন পর হককে পেয়ে ছাড়তে ইচ্ছে হচ্ছে না বলল বন্ধু লোউই। আমারও তোমাদের ছেড়ে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে না, তবু যেতে হচ্ছে। সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে লিন্ডার সাথে বেরিয়ে আসলাম। চাঁদের আলোয় উদ্ভাসিত রাত। পরিষ্কার নীল আকাশ ভরা তারা। নিঃশব্দ চারিধার। লিন্ডা প্রস্তাব রাখলো তুমি যদি ক্লান্ত না থাকো, তবে চলো স্ট্যানলি বিচ অব্দি ঘুরে হোটেলে ফিরি। এমন সুন্দর চাঁদনী রাতে তোমার মতো সুন্দরী যদি এমন ইচ্ছে প্রকাশ করে তখন ‘আমায় ক্ষমা করো প্রভু’ বলে মৃত যেকোনো ব্যক্তিই চাঙ্গা হয়ে উঠবে প্রিয়ে, তাই উপেক্ষা করার প্রশ্নই ওঠে না! চলো। লিন্ডা আমার কথা শুনে বলে উঠলো জানো, তোমার এমন দুষ্টুমি ভরা চটুল রসিকতাগুলো প্রায়ই মনে পড়ে। Then I really miss you a lot. লক্ষণটা ভালো নয় প্রিয়ে, রবিন ডাক্তারকে জানান দিতে হয় যাতে এই রোগের উপযুক্ত চিকিৎসার একটা ব্যবস্থা ও করতে পারে। কি বলবো নাকি?
তুমি ভালো করেই জানো আমি কারও পরওয়া করিনা। তা অবশ্য ঠিক। দু’জনই হেসে উঠলাম। স্ট্যানলি সৈকতের অপূর্ব নৈসর্গিক শান্ত পরিবেশে কিছুক্ষণ কাটিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। বিদায়ের আগে লিন্ডাকে বললাম নাইরোবি আসার ব্যাপারে তোমাকেই উদ্দগ নিতে হবে। আসবে কিন্তু, আমি আর নিম্মি অপেক্ষায় থাকবো। বলে আমার ব্যক্তিগত টেলিফোন নম্বরসহ একটা ভিজিটিং কার্ড ওর হাতে তুলে দিলাম। এরপর আলতো জড়িয়ে ধরে বললাম
আজকের এই সুন্দর রাতের জন্য ধন্যবাদ তোমাকে জানাবো না, ভাল থেকো। এবার এসো রাত অনেক হল, তোমার তো আবার রাত জাগার অভ্যেস নেই। হ্যাঁ তাই। তুমিও ভালো থেকো আর নিম্মি ও স্বস্তিকে আমার আদর দিয়ো। বিদায় দুষ্টু রিদয়হরণ বলে গালে চুমু দিয়ে হাত নাড়িয়ে গাড়ী চালিয়ে বাড়ী ফিরে গেলো লিন্ডা।
পরদিন যথাসময়ে লাম এসে থাই-এর একটা ব্যাংককগামী ফ্লাইটে তুলে দিলো আমাকে। ট্রানজিটে দেড়ঘণ্টা তারপর ঢাকার ফ্লাইট।VIP Lounge থেকে শ্রী কাসম শ্রীকে ফোন করে জানালাম
এক্সেলেন্সি, বিশেষ তাড়াহুড়োয় ফিরতে হচ্ছে। তাই এবার দেখা হল না ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও। এর জন্য ক্ষমাপ্রার্থী। তবে শীঘ্রই দেখা হবে কথা দিলাম। সময় মতই থাই বিমান পৌঁছে দিলো ঢাকায়। কামালের প্রেরিত প্রোটোকল অফিসার আমাকে বাসায় পৌঁছে দিলেন। কামাল বাসাতে ফোন করলো পৌঁছে গেছিস? হ্যাঁ। ঠিক আছে, আমি ম্যাডামের সাথে আলাপ করে তোকে জানাচ্ছি কোথায় কখন সাক্ষাত হবে।তুই বিশ্রাম কর। নিম্মি জানতে চাইলো সফর কেমন হল আর বন্ধু-বান্ধবীদের কে কেমন আছে? সফর ফলপ্রসূ হয়েছে, আর সবাই কুশলেই আছে। চীনাবন্ধুরা দাওয়াত করেছে তোমাকে আর সস্তিকে নিয়ে বেড়াতে যেতে সুবিধে মতো। লিন্ডারা সদলবলে আসবে নাইরোবিতে আগামি আগস্টে জর্জের ব্যক্তিগত প্লেনে করে আমাদের অতিথি হয়ে। পড়ন্ত দুপুরে আবার কামালের ফোন এলো। ম্যাডাম রাত ১০টায় ক্যান্টনমেন্ট-এর বাসায় একান্তে আমার সাথে সাক্ষাতের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
তোর ম্যাডাম তার প্রয়াত স্বামীর কাছ থেকে রাজনীতির কূটকৌশলগুলো ভালোই রপ্ত করেছেন দেখছি। তোর আর সাব্বির বদৌলতে সবকিছু হল, আর তোদের বাদ দিয়েই তিনি সফরের ফলাফলটা আমার কাছ থেকে একান্তে জেনে নিতে চাচ্ছেন! অনুরোধ করার সময় কিন্তু তোদের উপস্থিতির প্রয়োজন হয়েছিলো। এমনটি কেনও ব্রাদার?
তাতো বলতে পারছিনা, জানিও না।
জেনে রাখ। তিনি কোনও সাক্ষী মৌজুদ রাখতে চাচ্ছেন না। অনুরোধ কালে তোমাদের সঙ্গে রেখেছিলেন যাতে আমি তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে না পারি। আমার কথা শুনে একটু চুপ থেকে কামাল জিজ্ঞেস করলো, সফর কেমন হয়েছে?
ভালোই বলতে পারিস। তোদের মনোবাঞ্জা পূর্ণ হয়েছে, সেই বিচারে সফলই বলতে হবে।
জানতাম সাফল্য ছাড়া তুই ফিরবি না।
তুই অনেক কিছুই জানিস। তাই আমাকে বেচে নিজের ক্রেডেন্সিয়াল বাড়িয়ে নিচ্ছিস। যাক সে কথা, যে সমস্ত বন্ধুদের সাথে দেশে ফিরে আসার আগে তোর পরিচয় হয়েছিল তারা সবাই তোকে অভিনন্দন আর তোর পরিবারের সবাইকে শুভেচ্ছা জানিয়েছে।
তাই নাকি? সত্যি তোর অনুরোধে ওরা আমাদের জন্য আন্তরিকভাবে যা করেছে তাতে আমরা হতবাক হয়ে গিয়েছিলাম।
হবারই কথা। কারণ, তাদের বন্ধুত্বের অভিধানে শঠতা এবং নিমকহারামী শব্দ দুটো নেই। শোন কামাল, একটা বিশেষ অনুরোধ জানাচ্ছি। ভবিষ্যতে কিন্তু এভাবে আমাকে আর এমন কোনও বিষয়ে জড়িয়ে বিব্রত করবি না, যতক্ষণ না তোর ম্যাডাম তার দেয়া ওয়াদা পূরণ না করেন। মানে, তিনি আমাদের স্বাধীন ভাবে দেশে ফিরে বসবাসের সুযোগ না করে দেন।
এখন পর্যন্ত তুই তার জন্য যা করেছিস তারপরও কি তুই মনে করিস, তিনি তার কথার বরখেলাপ করবেন?
আমাদের মতো দেশে যারা ক্ষমতার রাজনীতি করেন তাদের বেশিরভাগই মনে করেন তারা হচ্ছেন জিয়ল মাছ। তাদের একমাত্র উদ্দেশ্য হল ক্ষমতার বলয়ে বেঁচে থাকা। এই স্বার্থে এবং নিজেদের সব অপকর্ম এবং মিথ্যাচারকে বৈধতা দানের জন্য দুইটি বহুল প্রচলিত প্রবাদে তারা খুবই আস্থাশীল।
প্রথমটি হল, ‘কাজের বেলায় কাজি কাজ ফুরালেই পাজি’। আর দ্বিতীয়টি হল, ‘রাজনীতিতে কোন শেষ কথা নেই’। তোমাদের ম্যাডাম তো মাত্র ক্ষমতার গদিতে আসীন হয়েছেন। ক্ষমতার শক্তি কি সেটা তাকে বুঝতে দাও। তারপরই তার স্বরূপটা প্রকাশ পাবে। আমি কি মনে করি সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। তবে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল, ঘনিষ্ঠ চৈনিক বন্ধুদের মনে খালেদার প্রতিজ্ঞার বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। তারা মনে করেন, খালেদা জিয়া ঠিক তার স্বামী জেনারেল জিয়ার মতোই ১৫ই আগস্টের সাথে তার কোনও রকমের সম্পৃক্ততা স্বীকার করবেন না এবং আমাদের দেশে ফিরে স্বাধীনভাবে জাতীয় রাজনীতিও করতে দেবেন না। তাহলে তার নিজের এবং বিএনপির রাজনীতি শেষ হয়ে যাবে কর্নেল রশিদ এবং কর্নেল ফারুককে নিয়ে এরশাদের মতো খালেদারও তেমন মাথাব্যথা নেই। কারণ, তিনি ভালো করেই জানেন যে, সেনা পরিষদের মূল সংগঠক হচ্ছি আমরা। সেনা পরিষদের সাথে রাজনৈতিক ভাবে ফারুক ও রশিদ জড়িত নয়। মুজিব বিরোধী অভ্যুত্থানে তাদের সাথে সেনা পরিষদ একটি কৌশলগত ঐক্য গড়ে তুলেছিল মাত্র। খালেদা জিয়া আরও জানেন, যুদ্ধকালীন সময় যেই সংগঠন অতি গোপনে গড়ে তোলা হয়েছিল সেটাই স্বাধীনতার পর সেনা পরিষদে পরিণত হয়। সেই সংগঠনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হবার জন্য আমিই জিয়াকে রাজি করিয়েছিলাম সেটাও তার অজানা নয়। তাই আমাদেরকে তিনি নিজের আওতার বাইরে কখনোই রাজনৈতিক অঙ্গনে বিচরণ করতে দিতে পারেন না। তিনি অবশ্যই মনে করবেন সেটা হবে তার এবং তার দলের জন্য আত্মঘাতী। এটা চৈনিকদেরও আশংকা। তাদের এই আশংকা ঠিক হতেও পারে আবার নাও হতে পারে, সময়েতেই সেটা নির্ধারিত হবে। চৈনিক বন্ধুদের আশংকাটাকে অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায় না। এ নিয়ে পরে কোনোদিন যদি বিশদ আলোচনার ইচ্ছে রাখিস তবে করবো। রেখে দিলাম ফোন।
রাত দশটা বাজার পাঁচ মিনিট আগে খালেদা জিয়ার বাড়ীর গেইটে গিয়ে পৌঁছালাম। মিনু ফুপ্পুর বাসা থেকে কাছেই শহীদ মইনুল রোড, তাই নিজেই গাড়ী চালিয়ে এসেছি। গেটের রক্ষীদের কমান্ডার এগিয়ে এলো পরিচয় জানতে। আমি ড্রাইভিং সিটে বসেই সাইড উইন্ডোর কাঁচটা নামাচ্ছিলাম হঠাৎ কমান্ডার উচ্চস্বরে কমান্ড দিল রক্ষীদের- ‘গার্ডস পিজেন্ট আর্মস।’ মুহূর্তে কমান্ডারসহ পুরো চৌকস কন্টিনজেন্ট সাল্যুট করে দাড়াল। আমি কিছুটা বিস্মিত হয়ে তাদের সাল্যুট গ্রহণ করলাম। এরপর রক্ষীরা গেইট খুলে দিলো। আমি গাড়ীতে বসেই গার্ড কমান্ডারকে কাছে ডেকে জিজ্ঞেস করলাম
আপনি আমাকে ‘পিজেন্ট আর্মস’ এর সম্মান দিলেন কেনও? আমিতো সাধারণ পোশাকে গাড়ী নিজেই চালিয়ে এসেছি। আপনি আমাকে চিনলেন কি করে? আগে দেখেছেন নাকি? একসাথে চাকুরি করেছি বলেও তো মনে হচ্ছে না!
হ্যাঁ স্যার, আপনাকে চীনে দেখেছি। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী থেকে সর্বপ্রথম যে দলটি ‘লাইট উইপনস অ্যান্ড ট্যাকটিক্স’ কোর্সের জন্য পাঠfনো হয়েছিল ক্যাপ্টেনসৈয়দ ইস্কান্দারের নেতৃতে তাতে আমিও ছিলাম। আপনি বেইজিং থেকে এসেছিলেন আমাদের অভ্যর্থনা জানাতে। এরপর অনেক বারই প্রশিক্ষণকালে এসেছেন আমাদের খোঁজ-খবর নিতে। আমাদের সুবিধা-অসুবিধা এবং অন্যান্য সমস্যাদি নিয়ে আপনি আমাদের সবার সাথে যে আন্তরিকতার সাথে আলাপ-আলোচনা করতেন আর সেই সমস্ত সমস্যাদি দূর করার জন্য সাধ্যমতো চেষ্টা করতেন, বিদেশের মাটিতে আপনার মতো এতো উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তার কাছ থেকে এমন আন্তরিক ব্যবহার পাওয়ায় আপনি আমাদের সবার কাছেই বিশেষভাবে শ্রদ্ধাভাজন হয়ে উঠেছিলেন। অতি সহজ সরলভাবে যেভাবে আপনি বিভিন্ন জ্ঞানগর্ভ কথাগুলো আমাদের বোঝাতেন সে সমস্ত কথা আমাদের কেউই ভুলে যায়নি। আবেগপ্লুত সুবেদার আন্তরিকভাবেই কথাগুলো বলেছিলো।
আমাদের হাতে বানানো এই আর্মিতে আপনার মতো চরিত্রের লোকেরা বিশ্বপরিসরে আর্মির সম্মান বৃদ্ধি করুক, বলে গাড়ী বারান্দায় গিয়ে গাড়ী থেকে নামলাম। একজন ড্রাইভার গাড়ী পার্কিং-এ নিয়ে গেলো। জনাব ফালুকেই অভ্যর্থনা জানানোর জন্য দাড়িয়ে থাকতে দেখলাম। সে আমাকে একটি বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে আমাকে বসিয়ে জানতে চাইলো, আমি কি পছন্দ করবো চা, কফি না কোল্ড ড্রিংস।
কিছু না আপনি বেগম জিয়াকে খবর দিন। বেরিয়ে গেলো ফালু।
এলেন খালেদা জিয়া, পান মশলা চিবুতে চিবুতে। কুশলাদি বিনিময়ের পর দু’জনই বসলাম সোফায়। তিনি ইন্টারকমে ফালুকেই বোধকরি হুকুম দিলেন যতক্ষণ আমি তার সাথে বৈঠকে আছি ততক্ষণ তাকে কোনও ইনকামিং ফোনকল না দিতে, সাক্ষাৎও নয়। একই সাথে চা-নাস্তা পাঠিয়ে দিতে বললেন। চা-নাস্তার প্রয়োজন ছিল না ভাবী, আমি রাতের খাবার খেয়েই এসেছি।
কোথায় থাকছেন?
ডেরা ফেলেছি মিনু ফুপ্পুর বাসায়। সেখান থেকেই আত্মীয়-স্বজন আর বন্ধুদের বাসায় বাসায় ঘুরে বেড়াচ্ছি।
স্বাভাবিক, আপনারা খাস ঢাকাইয়া, তাই নিকট আত্মীয়-স্বজন ছাড়াও আপনার পরিচিত জন এবং বন্ধু-বান্ধবদের বলয়ের পরিসীমাটা অস্বাভাবিক ভাবে ব্যাপক শুনেছি। বলুন, কেমন হল আপনার সফর? ফলাফলটা কি ইতিবাচক? আসল বিষয় উত্থাপন করলেন প্রধানমন্ত্রী।
ইতিবাচকই বলা চলে। চীনা নেতৃবৃন্দ আপনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ জানাতে রাজি হয়েছেন। আপনার সুবিধামতো যেকোনো দিন আপনি চীন সফরের প্রস্তাব জানালে চীন সরকার সেটাই গ্রহণ করবেন। আমার মনে হয় চীনা রাষ্ট্রদূত ইতিমধ্যেই জরুরী ভিত্তিতে নির্দেশ পেয়ে থাকবেন আপনার সাথে একান্তে সাক্ষাৎ করে এই সফরের বিষয়ে সবকিছু জেনে নিতে। আর এজেন্ডার প্রস্তাবগুলোও মেনে নিয়েছেন চীনা কর্তৃপক্ষ। শুধু প্রযুক্তি, কারিগরি তদারকি এবং রসদই চীন প্রদান করবে না, প্রতিটি প্রোজেক্টের জন্য আর্থিক সংকুলানও করবে গণচীন সরকার। আপনার সফরকালেই চুক্তিগুলো স্বাক্ষরিত হবে। খুশিতে তার চোখে চমক দেখা দিলো। নিজের অজান্তেই তার মুখ থেকে বেফাঁস বেরিয়ে পড়লো কামালের কথাই ঠিক হল!
কিছু বললেন? না, আপনাকে কি বলে ধন্যবাদ দেবো সেটাই ভাবছি।
একজন সরকারি চাকুরে হিসাবে আমি আমার সাধ্যমতো দেশ ও জাতীয় স্বার্থে প্রধানমন্ত্রীর অর্পিত দায়িত্ব পালন করেছি মাত্র। এর জন্য প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে ধন্যবাদ আমার প্রাপ্য নয়। জবাবটা শুনে এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন
আপনার আত্মমর্যাদাবোধ এবং বাচনভঙ্গি খুবই তীক্ষ্ণ বলে, এক কাপ চা নিজ হাতে বানিয়ে জিয়ার মতোই আমার হাতে তুলে দিলেন। ভাই, আপনি সিনিয়র মিনিস্টার হিসাবে আমার পাশে দাড়ান। অস্বস্তিকর আবার সেই একই পুরনো কাসুন্দি! চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম আর ভাবছিলাম কি জবাব দেবো। একটু ভেবে নিয়ে চায়ের কাপটা টেবিলে রেখে তার দিকে দৃষ্টি মেলে দেখি, একরাশ প্রত্যাশা নিয়ে তিনি আমার দিকে চেয়ে আছেন জবাবের প্রতীক্ষায়। তার সেই চাহনি আমাকে আরও বিব্রত করে তুললো।
ভাবী, কিছু মনে করবেন না, এই অনুরোধটা আপনি আগেও করেছেন, জবাবটাও যতটুকু সম্ভব পরিষ্কার করে আমি দিয়েছি। এটা অবাস্তব প্রস্তাবনা। এতে হিতে বিপরীত হবে দুই পক্ষের জন্যই। বরং আপনি স্বেচ্ছায় যে ওয়াদা করেছেন, আমাদের স্বাধীনভাবে দেশে ফিরে নিজেদের মতো রাজনীতি করার সুযোগ করে দেবেন তার বাস্তবায়ন কোরলে তাতে দুই পক্ষেরই মঙ্গল হবে। দেশপ্রেম, বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ এবং প্রগতিশীল ইসলামী মূল্যবোধ ভিত্তিক রাজনৈতিক ধারাকে চিরন্তন রাখার অন্য কোনও বিকল্প নেই।
আমার জবাবে উনার মুখাবয়বে হতাশার একটা ছাপ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে দেখতে পেলাম। তাই প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম, যদি অনুমতি দেন তবে একটা পরামর্শ দিতে চাই যদিও জানি বিজ্ঞ পরামর্শদাতার অভাব আপনার নেই।
বলুন।
ভাবী, সব ক্ষেত্রেই ব্যক্তিগত সম্পর্ক অনেক সময় আশ্চর্যজনক ঘটনা ঘটাতে পারে যেটা ফরমাল সম্পর্কের মাধ্যমে সম্ভব হয় না।
সরকার প্রধান হিসেবে আপনারও উচিৎ হবে পৃথিবীর শক্তিশালী রাষ্ট্রগুলোর ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যক্তিবর্গের সাথে ব্যক্তিগত পর্যায়ে সম্পর্ক গড়ে তোলা। এর জন্য যা খরচ হবে সেটার শতগুণ আপনাকে পাইয়ে দেবে বন্ধুরাই। কারণ, কি করে কন পথে সেই অর্থ অর্জন করা সম্ভব সেটা কোনও রাষ্ট্রদূত, পররাষ্ট্রমন্ত্রী এমনকি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পররাষ্ট্র বিশারদের পক্ষেও জানা সম্ভব নয়। এইসব চোরাগলিগুলো ঐ সমস্ত অদৃশ্য ক্ষমতাধর ব্যক্তিদের নখদর্পণে। তাছাড়া আমেরিকাতেও রাষ্ট্রীয় এবং প্রশাসনিক নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে ব্যাতিক্রম যে একেবারেই হয় না সেটাও ঠিক নয়। যেমন ধরুন, আপনার আমেরিকা সফরের আবেদন জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয় রাষ্ট্রদূতের কাছ থেকে যে জবাব নিয়ে ফিরে এসেছেন সেটা প্রচলিত প্রথা বটে, তবে ক্ষেত্র বিশেষে এর ব্যতিক্রম যে একেবারেই অসম্ভব সেটাও ঠিক নয়। তাই যদি হয়, তাহলে কোথা থেকে কি ভাবে এই উদ্দগ শুরু করা যেতে পারে বলে আপনি মনে করেন? আমার মতে পশ্চিমা জগতের বর্তমান মোড়ল আমেরিকা থেকেই শুরু করার উদ্দগ নিলে ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকার রাজধানীগুলোতে সেই ধরনের ফলপ্রসূ সম্পর্ক গড়ে তুলতে সুবিধে হবে। তবে দূরদর্শী নেত্রী হিসাবে চীনের ক্ষমতাশালী নেতাদের সাথে আপনার সম্পর্ককে প্রাধান্য দিতে হবে সব সময় বাংলাদেশের স্বার্থেই।
আপনি আমাকে এই ব্যাপারে ব্যক্তিগত ভাবে সাহায্য করতে রাজি আছেন কি? যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমেরিকাতে একটা রাষ্ট্রীয় সফরের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করা যেতে পারে কি? নিজের ফাঁদে আটকা পড়ে গেলাম। বিপাকে পড়ে গেলাম নিজের বক্তব্যের জন্যই। কিছুটা ভেবে নিয়ে বলতে বাধ্য হোলাম দেশের স্বার্থে আমি চেষ্টা করতে পারি, তবে ফলাফল কি হবে সেটা একান্তভাবে আমার উপর নির্ভর করছে না, তাই বলাও সম্ভব নয়।
খুবই স্বাভাবিক। তাহলে ফিরে গিয়ে আপনি এই বিষয়ে যা কিছু করার তাই করবেন। প্রয়োজন বোধ করলে, আমি আপনাকে আমেরিকাতে রাষ্ট্রদূত হিসাবেও পাঠাতে পারি।
না ভাবী, রাষ্ট্রদূত হিসাবে সেখানে গিয়ে এ ধরনের কোনও কাজ করা সম্ভব হবে না। কারণ, যেকোনো রাষ্ট্রদূতকেই একটা সীমিত গণ্ডির মধ্যে থেকে তার দায়িত্ব পালন করতে হয়। এ ধরনের কাজ বাঁধাধরা গণ্ডিতে বন্দী হয়ে করা সম্ভব নয়। এ ধরনের সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গোপনীয়তা একটি অপরিহার্য শর্ত। তাহলে আপনি আপনার মতোই এগিয়ে যান। এর জন্য আনুষঙ্গিক সবকিছুর যোগান আমিই আপনাকে দেবো গোপনীয়তা রক্ষা করেই।
ঠিক আছে, তাহলে ফিরে গিয়ে আমি গোপনে আমেরিকা সফরে যাবো। ফিরে যাবার আগে আমাকে আপনার বিশেষ দূত হিসাবে উল্লেখ করে একটা নোট ভারবাল সই করে দিতে হবে আর কিছু ফান্ডের ব্যবস্থা করতে হবে। খরচাপাতির হিসেব আপনি পাবেন। এ ছাড়া, কয়েকটা Letter of thanks-ও আপনাকে সই করে দিতে হবে। নোট ভারবাল এবং Letter of thanks গুলো আমিই নিজে লিখে নিয়ে আসবো। এর জন্য আপনার অফিসিয়াল প্যাডের কয়েকটা পৃষ্ঠা এবং এনভেলপ আমাকে দিয়ে দিন। দু’দিন পর আপনি আমাকে ডেকে পাঠাতে পারেন। তখন আমি ঐ চিঠিগুলোতে সই করিয়ে আপনার সামনেই সিল করে টাকা সহ চলে যাবো।
তাহলে দু’দিন পর আপনি রাত দশটায় বাসাতেই আসবেন। আমি অপেক্ষায় থাকবো।
এবার আমি তাহলে আসি।
রহস্যময় হাসি হেসে তিনি বললেন আসুন। এখন থেকে কোনও কিছুর জন্যই আপনাকে ধন্যবাদ জানাবার ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে তাই না?
কিছু না বলে বেরিয়ে এলাম। ফিরে এলাম বাসায়। পরদিন রাতেই কামাল ফোন করে জানালো
চীনা রাষ্ট্রদূত জরুরী ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করে সফর সংক্রান্ত সব তথ্য নিয়ে গেছেন। ভালোই তো মুখ্য সচিব হিসেবে গণচীনে VVIP Delegation-এর মেম্বার হয়ে যেতে পারবি।
ভাবছি, পুরানো বন্ধুদের সাথে দেখা করার চেষ্টা করবো।
না, সেটা করবি না। করলেও দেখা পাবি না। রহস্য পুরুষরা পর্দার আড়ালেই থাকতে পছন্দ করেন। হাই প্রোফাইল রাষ্ট্রীয় সফরে তাদের হদিসও পাবি না। বুঝলাম। কামালের সাথে আলাপ করে ঠিক বুঝলাম না আমাকে দেয়া আগামী দায়িত্ব সম্পর্কে প্রধানমন্ত্রী কামালকে অবহিত করেছেন কি করেননি। দু’দিন পর যথা সময়ে মইনুল রোডের বাড়িতে গিয়ে সব কাগজ-পত্রে খালেদা জিয়ার সই করিয়ে, টাকা নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। এই বিষয়ে বাসায় কারো সাথে কোনও আলাপ করলাম না।
নাইরোবি ফেরার প্রাক্কালে কামালের সেকেন্ড ক্যাপিটালের বাসায় ভোজে যেতে হয়েছিল নিম্মিকে নিয়ে। মাত্র আমরা দুইজনই অতিথি। একান্ত ঘরোয়া পরিবেশ। নিম্মিকে কথা বলার জন্য কামালের স্ত্রী অন্য একটি ঘরে নিয়ে গেলো। এতে দুই বন্ধু প্রাণ খুলে আলাপ করার সুযোগ পেয়েছিলাম। আচ্ছা ডালিম, একটা কথা জিজ্ঞেস করছি। তুই কিছু মনে করবি নাতো?
হঠাৎ এতো বিনয় কেনও বন্ধু, বল। ‘৭১-এর যুদ্ধকালীন সময় থেকে তোর আর নিম্মিদের পরিবারের সাথে এত ঘনিষ্ঠভাবে মিশেও কেনো জানি মনে হয়, তোকে সঠিক ভাবে চিনতে পারিনি।
কেনো? আমার কোনও কিছুই তো তোর অজানা না। তা ঠিক, বরং বলবো আমার সব সুখে-দুঃখে আপনজন হিসাবে আমার পাশেই থেকেছিস। খালাম্মাতো আমাকে ছেলের মতোই ভালবাসেন আর বাপ্পি, নিম্মি এবং মানুতো আমাকে বদ্দা বলেই ডাকে। আমিও নিজেকে তাদের পরিবারেরই একজন বলে মনে করি। নিজের বাবা-মার কাছ থেকে জীবনে যতটুকু স্নেহ-ভালবাসা পেয়েছি তার চেয়ে হাজার গুণ বেশি নিঃস্বার্থ স্নেহ ও ভালবাসা পেয়েছি এদের কাছ থেকে এটা আমি গর্বের সাথেই স্বীকার করতে পারি। যুদ্ধের পর তোর পরিবারের সাথেও একই রকমের ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে এটাও স্বীকার করবো নিঃসঙ্কোচে।
মুক্তিযুদ্ধের সময় দেখেছি সর্বমহলে তুই ছিলি আলোচিত বিশেষ এক ব্যক্তিত্ব। তোর স্পষ্টবাদিতা, অসীম সাহস আর বীরত্বের কারণে রণক্ষেত্রে তুই নিজেকে সহজেই পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলি এক কিংবদন্তিতে। যুদ্ধের পর দেখলাম দেশের সর্বমহলেই তুই বহুলভাবে পরিচিত। রাজনৈতিক মহলের ডানপন্থী, বামপন্থী, মধ্যপন্থী সবক্ষেত্রেই নেতা-কর্মীদের সাথে তোর রয়েছে বিস্ময়কর অন্তরঙ্গ সখ্যতা। সামরিক বাহিনীর একজন সদস্য হিসাবে দেশের রাজনীতিবিদ, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, শিক্ষক মহল এমনকি ঝানু ঝানু আমলাদের সাথেও দেখেছি তোর ঘনিষ্ঠতা। দেশজুড়ে এমন ব্যাপক পরিচিতি ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আমার কিংবা অন্য কারো পক্ষেই অর্জন করা সম্ভব বলে মনে হয়না। এর কারণ কি?
কারণ তোর মতো সচেতন দেশপ্রেমিকরা বরাবরই নিজেকে সীমিত করে রাখে একটা নির্দিষ্ট গণ্ডির মধ্যে। সেই গণ্ডির মধ্যে থেকে যতটুকু ঝুঁকি নেয়া সম্ভব ততটুকু ঝুঁকি নিয়েই দেশ এবং জনগণের সেবা করার চেষ্টা করে থাকিস তোরা। বিপরীতে, আমি এবং আমার সঙ্গী-সাথীরা কোনও গণ্ডির পরোয়া করি না। এটাই প্রধান কারণ। নিজস্ব নিরাপত্তা এবং ক্ষয়ক্ষতির হিসাব করে চলিস তোরা, আর আমরা এ সমস্তের ঊর্ধ্বে বাধন ছাড়া পাখি। পরিণাম যাই হউক না কেনও, নীতি আদর্শের প্রশ্নে কনও আপোষ করতে আমরা জানি না, বুঝিলে কি সুজন?
হ্যা। এবার অন্য বিষয়ে আর একটি প্রশ্ন। যুদ্ধকালীন সময় যখন জিয়াকে সেক্টর থেকে সরিয়ে হেড কোয়ার্টারে এনে ডাম্প করা হয়েছিলো, তখন থেকে দেখে এসেছি তোরা তার বর্ম হয়ে তাকে আগলে রেখেছিলি স্বাধীনতাত্তোর কালেও।
১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে তোরাই ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত করেছিলি সেটাও আমি জানি। কিন্তু সেই জিয়াই তোদের সাথে নিষ্ঠুর প্রতারণা করল কেন?
কথায় বলে মানুষের মন না মতি। যেকোনো মানুষের মনেই পরিবর্তন আসতে পারে যেকোনো সময়, চোখও পাল্টাতে পারে মুহূর্তে। তোকেই জিজ্ঞেস করি এক সময়ের ভার্সিটির চৌকস ছাত্র, কট্টর বামপন্থী কামাল সিদ্দিকি পরে হয়ে গেলো ক্যারিয়ারিস্ট CSP officer! তারপর মুক্তিযুদ্ধের সময় এক বিপ্লবী মুক্তিযোদ্ধা, স্বাধীনতার পর আবার বাংলাদেশের ডাকসাইটে একজন উজ্জ্বল ভবিষ্যতের অধিকারী আমলা, এসবই তো মনের পরিবর্তন, তাই নয় কি? জাস্টিস সায়েমকে প্রেসিডেন্ট-এর পদ থেকে হটিয়ে দেশের সব ক্ষমতা করায়ত্ত করে জেনারেল জিয়া কেনও পিটার কুস্টার নামের ডেনিশ সাংবাদিকের সাথে জড়িয়ে তোকে ফেরারি হতে বাধ্য করেছিলো? গণেশ উল্টে দেবার মতো মানুষ তো তুই না, তবে কেনও জিয়ার রোষানল থেকে বাঁচার তাগিদে হক ভাইয়ের শেল্টারে তোকে পালিয়ে থাকতে বাধ্য করেছিল জেনারেল জিয়া।
পরে অনেক ধরপাকড় করে মাফটাফ চেয়ে কিছুদিন শ্রীঘর বাসের পর আবার চাকুরিতে পুনর্বাসিত হয়ে সেই জিয়ারও খেদমত করলি, এখন খালেদার খেদমত করছিস।
এগুলোর সবই তো মনেরই পরিবর্তন। আশ্চর্য! এত কিছুর পরও জিয়ার মোনাফেকি এবং সন্দেহপ্রবণ মন সম্পর্কে তোর ধারণা এখনো অস্বচ্ছ, এটা বিশ্বাস করতে পারছিনা বন্ধু!
যাই হউক, এখন অতি উৎসাহে চেষ্টা তদবির করে খালেদা জিয়ার মুখ্যসচিব হয়েছিস দেশ উদ্ধার করার জন্য। বিপরীতে বাকশালী রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবর রহমান যখন আমাদের কালো আইন PO-9 এর আওতায় চাকুরিচ্যুত করে স্বয়ং নানা ধরনের আকর্ষণীয় অফার দিয়ে আমাদের কেনার চেষ্টা করেন, আমরা সেগুলো সবিনয়ে প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।
এটাও তোর আর আমাদের মধ্যে একটা তফাৎ। ‘৭১-এর লালিত স্বপ্নের বাস্তবায়ন তোদের ম্যাডাম কতটুকু কি করবেন সেটা সময়ই বলবে। তবে যে পদটি তুই করায়ত্ত করেছিস তাতে বিশ্ব আমলাদের হাটে তোর চাহিদা এবং দাম দুটোই বাড়বে। প্রয়োজনে চড়াদামে নিজেকে বিক্রি করতে পারবি যেকোনোও সময় সেটা তুই নিজেও ভালোই জানিস। এটাও তোদের ক্যালকুলেটেড পদক্ষেপের একটি। আমরা মনে করি খালেদা জিয়া জেনারেল জিয়ার পদাংকই অনুসরণ করে চলবেন। তাই তার মাধ্যমে আমাদের ‘৭১-এর স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। জিয়া আমাদের একজন হয়েও ভারতের সাথে সমঝোতা করে জাতীয় স্বার্থ জলাঞ্জলি দিয়ে সেনা পরিষদের সদস্য এবং আমাদেরকেই আখ্যায়িত করলেন ষড়যন্ত্রকারী এবং দেশদ্রোহী হিসাবে, তোর ম্যাডামের কাছ থেকেও কোনোদিন তেমনই কোনও অপবাদ নিয়ে চাকুরিচ্যুত হলে বিস্মিত হবার কিছুই থাকবে না বন্ধু। সেইক্ষণে ভাই তুইও আমার সাথে একটা দূরত্ব বজায় রাখবি। তাহলে খালেদার জন্য এতকিছু করে যাচ্ছিস কেন?
আমাদের বিবেচনায় দেশ ও জাতির মঙ্গল আর আমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়নের সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়ার জন্য যা প্রয়োজন আমরা সেটাই করে চলেছি। এতে জিয়া, এরশাদ কিংবা তোদের ম্যাডাম যদি ব্যক্তিগতভাবে উপকৃত হয়ে থাকেন সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। তাই বলতে পারিস যা কিছুই আজঅব্দি করেছি বা করে চলেছি সেটা আমাদেরই স্বার্থে।
তোর বাহ্যিক রূপ দেখে তোর গভীরতা কারো পক্ষেই বোঝা সম্ভব নয়। তাই বুঝি! উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম দুইজনই। শোন, একটা গোপন কথা তোকে জানাচ্ছি, যদি তোর কোনও উপকারে লাগে ভবিষ্যতে তাই। তোর ম্যাডাম আমাকে আকুতি জানিয়ে বললেন, আমেরিকা আর পশ্চিম ইউরোপের ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য শক্তিধর স্তম্ভদের সাথে তার ব্যক্তিগত একটা যোগসূত্র স্থাপন এবং তার আমেরিকা সফরের একটা ব্যবস্থা করে দেবার চেষ্টা করতে। এবারের ভেঞ্চারে তোকে এখনঅব্দি অন্ধকারে রাখা হল! শুধু তাই নয়, তিনি বিশেষভাবে বললেন, বিষয়টি শুধুমাত্র তার আর আমার মধ্যেই যেনো গোপন রাখা হয়।
তাই নাকি? আশ্চর্য তো! তা তুই কি বললি? বললাম, চেষ্টা করে দেখবো। তাই বলছি, যাই করিস না কেনো সাধু সাবধান! একটা শেষ ঔৎসুক্যের জবাব দিবি কি?
বল, কি জানতে চাস? মনজুর জিয়ার বিরুদ্ধে এমন একটা পদক্ষেপ নিতে যাচ্ছে সে সম্পর্কে তোর কোনও পূর্ব ধারণা ছিল কি? কার হয়ে গোয়েন্দাগিরি করছিস জানি না। তবে মিথ্যাকে আমি ঘৃণা করি। তাই চুপ থাকতে হচ্ছে। এটাই আমার জবাব। আমি কিন্তু জানি, এই ব্যাপারে তুই বেশ কিছুটা অবগত ছিলি। সারগোদিয়ান বিধায় এটাই কি খালেদার প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হওয়ার একটা কারণ নাকি? ইচ্ছে হলে বলতে পারিস আমার অনুমানটা সঠিক কিনা।
তবে ভয়ের কিছু নেই বন্ধু, আমি তোমার ম্যাডামের কাছে এই বিষয়ে কিছুই কখনো ফাঁস করে দেবো না, আশা করি এতটুকু বিশ্বাস আমার উপর তোর আছে। জবাবে কোনও কিছুই বললো না কামাল। বুঝলাম। এখন যাবার আগে তোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিয়ে যেতে চাই জিয়া পরিবারকে বোঝার জন্য। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদ জিয়া পরিবারের সবার ব্যক্তিগত এবং পার্টির সব একাউন্ট জব্দ করে দেয়ার হুকুম জারি করে, পরিণামে জিয়া পরিবারে আর্থিক সংকট দেখা দেয়। এর প্রধান কারণ জিয়া অত্যন্ত সতর্কতার সাথে ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই নিজেকে ব্যক্তিগতভাবে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রাখেন কিন্তু তিনি তার দলীয় নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি করার জন্য খোলা ছুট দিয়ে রেখেছিলেন। এভাবেই চতুরতার সাথে তিনি তার পার্টি ফান্ডের ব্যবস্থা করতেন এবং একি সাথে DGFI-এর মাধ্যমে প্রত্যেকের নামে একটা ফাইল বানিয়ে নিজের কাছে রাখতেন। এই ভাবে অতি সহজেই দলের শীর্ষ পর্যায়ের সব নেতাকে তার পালিত কুকুরের মত অনুগত রাখার ব্যবস্থাটাও পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন ধূর্ত জিয়া। জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের আচরণের কারনে অর্থ সংকটে পরেজিয়া পরিবার।
পারিবারিক আর্থিক সংকটের সুযোগে নিয়ে RAW sponsored হংকং এবং সিঙ্গাপুর ভিত্তিক দুইটি কোম্পানির ঢাকাস্থ গার্মেন্টস Buying house মোটা অংকের মাসোহারা এবং শেয়ার হোল্ডার ডিরেক্টর হিসাবে সাঈদ ইস্কান্দার এবং তারেক জিয়াকে নিয়োগ দান করে।
এ ছাড়া তোদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী কর্নেল মুস্তাফিজুর রাহমান পাকিস্তান আমলে একই সময় ক্যাপ্টেন হিসাবে জিয়ার সাথে ISI-তে চাকুরি করেছিলেন বছর দুই-তিন।
তিনি জিয়ার কোর্সমেট, তাই তাকে বিশ্বাসভাজন মনে করে তোর ম্যাডাম তাকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বানিয়েছেন। কিন্তু তিনি অবগত নন কর্নেল মুস্তাফিজ এখন রুশ-ভারত অক্ষের স্বার্থে RAW- এর পে-রোলে কাজ করছেন। মওদুদও এখন RAW-এর চর। ইন্টেলিজেন্স-এর রীতি অনুযায়ী খবরের সূত্র সম্পর্কে প্রশ্ন করার বিধান নেই, তবে খবরের সত্যতা যাচাই করার অধিকার অবশ্যই তোর আছে। সম্ভব হলে RAW-এর অনুপ্রবেশকারীদের খপ্পর থেকে তোর ম্যাডামকে বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করিস দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। ‘ছেঁড়া গেঞ্জি আর ভাঙ্গা স্যুটকেস’ অনেক আগেই আঁস্তাকুড়ে কবর দেয়া হয়েছে। দুর্নীতির রাহুর গ্রাস ক্রমশ জিয়া পরিবারকে গিলে ফেলছে অতি দ্রুত, বুঝিলে বন্ধু। বড় বড় চোখে কামাল আমার কথাগুলো গিলছিলো।
ঠিক সেই মুহূর্তে কামাল বোধ করি আমার কথাগুলো পুরোপরি হজম করতে পারছিল না।
কিন্তু সময়ের সাথে সংগৃহীত তথ্য প্রমাণের ভিত্তিতে আমার কথার সত্যতার প্রমাণ পেতে সক্ষম হয়েছিল কামাল। অনেক রাত হয়ে গিয়েছিল তাই বিদায় নিয়ে আমরা বাসায় ফিরলাম।
এর কিছুদিনের মধ্যেই লন্ডন হয়ে আমরা নাইরোবি ফিরে এলাম। এটাই ছিল ঢাকায় কামালের সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎ।
গোপনে আমেরিকা সফর
বেশ কিছুদিন বাইরে থাকার কারণে অনেক কাজ জমে গিয়েছিল। সে সব শেষ করতে কয়েক দিন বেশ ব্যস্ততায় কাটল। ইতিমধ্যে গঙ্গাভাই আমার মেহমান হয়ে কেনিয়া, তানজানিয়া, উগান্ডা, জাম্বিয়া ঘুরে গেলেন তাদের মুভমেন্টের জন্য এক সফল ফান্ড রেইজিং মিশনের পর সপরিবারে। নাইরোবিতেই গঙ্গা ভাইয়ের সাথে আমেরিকার মিশন নিয়ে প্রাথমিক আলাপের পর সিদ্ধান্ত নেয়া হল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাকে আমেরিকাতে যেতে হবে এই বিষয়ে বন্ধুদের সাথে বিস্তারিত আলোচনার জন্য। একদিন তানজানিয়া সফরের কথা বলে আমেরিকার পথে রওনা দিলাম। দারুসসালাম থেকে লন্ডন হয়ে আমেরিকায় যাবো। প্ল্যানটা গঙ্গাভাইকে জানিয়ে দিলাম সাথে এটাও জানিয়ে দিলাম, গোপনীয়তার স্বার্থে এবারের ভিজিট সম্পর্কে নিম্মি কিংবা লন্ডনে আমার আত্মীয়-স্বজনদেরও কিছুই জানাবো না আমি।লন্ডনে থাকবো হোটেলে। গঙ্গাভাই সব বুঝে নিয়ে বললেন, লন্ডন ছাড়ার আগে শুধু ফ্লাইট ডিটেলসটা জানিয়ে দিতে। তিনি ইতিমধ্যে জিমের সাথে প্রাথমিক আলাপ সেরে রাখবেন।
লন্ডনে কয়েকজন বিশিষ্ট বন্ধুর সাথে দেখা-সাক্ষাত করে পৌঁছালাম নিউইয়র্ক হয়ে ওয়াশিংটন-এ। গোপনীয়তার স্বার্থেইতার বাড়ীর পরিবর্তে হিলটনে এবার থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। গঙ্গাভাই নিজেই এয়ারপোর্ট থেকে আমাকে রিসিভ করেলেন এবং আমরা হোটেলে পৌঁছালাম। হোটেল স্যুইটে গঙ্গাভাই জানালেন-সন্ধ্যায় জিমকে সঙ্গে নিয়ে তিনি আসবেন। আমার সাথে বিস্তারিত আলাপের পরই ঠিক করা হবে আমরা কোন পথে এগুবো। লম্বা ফ্লাইট এর ধকলে কিছুটা ক্লান্তি স্বাভাবিক। তাই আপনিও এর মধ্যে বিশ্রাম করে ফ্রেশ হয়ে নিন। চলে গেলেন গঙ্গাভাই। ওয়াশিংটন ডিসি শহরটাকে দ্বিখণ্ডিত করে বয়ে চলেছে পটোম্যাক স্রোতস্বিনী। এক পাড় ঘেঁষে ভার্জিনিয়া অন্য কিনারা ঘেঁষে মেরিল্যান্ড। গঙ্গাভাইয়ের বাড়ি ভার্জিনিয়াতে। এক শান্ত সবুজ মনোরম পরিবেশে প্রাসাদোপম এক ট্টালিকা। বেড়াতে এলে তার বাসাতেই থাকতে হতো। সন্ধ্যার আগেই এসে পৌছালেন গঙ্গাভাই বন্ধু জিমকে সাথে নিয়ে আমার স্যুইটে। জিম হাসিমুখে আমাকে উষ্ণ আলিঙ্গনে স্বাগতম জানালেন।
এক নাগাড়ে তিন দশকের বেশি সময় তিনি একজন কংগ্রেসম্যান হিসেবে তার এলাকার প্রতিনিধিত্ব করেছেন। রাজনীতির সাথে জড়িত জিম ক্ষুরধার বুদ্ধিমত্তা, দূরদর্শী, জ্ঞানী এবং অভিজ্ঞ একজন বিশেষ প্রভাবশালী ক্ষমতাধর ব্যাক্তি আমেরিকার ক্ষমতা বলয়ে। সরকার আসে যায়, কিন্তু তার প্রভাবে এতে কোনও তারতম্য ঘটে না। কারণ, নীতি নির্ধারকদের সাথে তার রয়েছে দীর্ঘ দিনের ঘনিষ্ঠতা। তাই রিপাবলিকানই হউক কিংবা ডেমোক্র্যাট সবাই তাকে বিশেষ সমীহ ও শ্রদ্ধার সাথে তোয়াজ করে চলে সেটাই দেখে এসেছি। চা-নাস্তার অর্ডার দিয়ে বসলাম তিন বন্ধু। প্রথমেই আমি জিম এবং তার মাধ্যমে অন্যান্য বন্ধুদের ব্যক্তিগত ভাবে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানালাম প্রাকৃতিক ঘূর্ণিঝড়ে বিপর্যস্ত জনগণের ত্রাণ এবং পুনর্বাসনের স্বার্থে যে মানবিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছিলো তার জন্য। প্রধানমন্ত্রীও তাদের অবদানের জন্য লিখিত ধন্যবাদ জানিয়ে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেছেন, বলেই খালেদা জিয়ার সই করা আমারই লেখা চিঠিগুলো জিমের হাতে তুলে দিলাম, সাথে তিনি যে আমাকে তার বিশেষ দূত হিসেবে পাঠিয়েছেন সেই চিঠিটাও। এবার বলো, ‘অপারেশন সি এঞ্জেলস’ এর ফলাফল কেমন হচ্ছে এবং বাংলাদেশী জনগণের প্রতিক্রিয়া কি?
লাখো কোটি মানুষের জীবন রক্ষা করেছে 7th Fleet-এর মেরিনরা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর সদস্যদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। দেশবাসী হতবাক হয়ে দেখছে কি অভাবনীয় সাহসিকতার সাথে জীবন বাজী রেখে তারা এক দুঃসাধ্য অপারেশন করে চলেছে জলবন্দী অসহায় মানুষকে যমদূতের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য। পুনর্বাসনের কাজ এবং একই সাথে পানিতে আটকে পড়া অসহায় মানুষদের উদ্ধারের কাজ অতি ক্ষিপ্রতার সাথে এগিয়ে চলেছে। পুরো দেশবাসী দু’হাত তুলে মার্কিন সেনাদের জন্য আল্লাহ্র দরবারে দোয়া করছে তাদের মঙ্গল কামনায়, এটা আমি নিজে স্বচক্ষে দেখে এসেছি। ক্ষতিগ্রস্ত আবাল বৃদ্ধ বণিতার কাছে আজ প্রতিটি সৈনিক যেন ঈশ্বর প্রেরিত ফেরেশতা। আমি তোমাকে খুশি করার জন্য একবর্ণও বাড়িয়ে বলছি না। দেশ-বিদেশের প্রচার মাধ্যমে সবকিছুই দেখানো হচ্ছে। বাংলাদেশী জনগণের স্মৃতিতে এই দুঃসাহসিক অভিযানের কথা চির জাগরূক হয়ে থাকবে। আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি, আমেরিকার এই মানবিক সিদ্ধান্ত দেশের জনগণের মানসে যে ইতিবাচক মনোভাবের সৃষ্টি করেছে তার ফলে ‘৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় আমেরিকার ভূমিকা মানুষের মনে যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল সেটা অনেকটাই মুছে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, আগামীতে দু’দেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জোরদার করতে এই মানবিক সিদ্ধান্ত অবশ্যই সুদূর প্রসারী ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তবে দৃঢ় ভিত্তির উপর সম্পর্ক গড়ে তোলার ক্ষেত্রে একটি বিষয়কে আমেরিকার নীতি-নির্ধারকদের মনে রাখতে হবে।
বাংলাদেশের অগ্রগতির পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে আগ্রাসী ভারত, এই বাস্তবতাটা আজ প্রতিটি বাংলাদেশীকে চরমভাবে ভারত বিদ্বেষী করে তুলেছে। তাই আমেরিকার স্বার্থেই ভারতের স্বার্থ মাথায় না রেখে সরাসরি আমেরিকাকে বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে শুধুমাত্র দ্বিপাক্ষিক স্বার্থকে মাথায় রেখে। এ ছাড়া আমেরিকা বাংলাদেশ সম্পর্ক টেকসই হবে না কখনোই।
জিম আমার বক্তব্য মনোযোগের সাথে শুনছিল নীরবে। গঙ্গা ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পেরেছিলাম, অভ্যন্তরীণ নির্বাচনের জন্য বন্ধুদের প্রায় সবাই এখন ফান্ড রেইজিং-এ ব্যস্ত। প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া কথাটা আমার কাছ থেকে জেনে বলেছেন, তার তরফ থেকে সামান্য অংকের কিছু টাকা তোমাদের নির্বাচনী ফান্ড-এ দান করতে। বলে একটা এনভেলপ জিমের হাতে তুলে দিলাম। ধন্যবাদ জানিয়ে এনভেলপটা গ্রহণ করে জিম বলল টাকার অংকটা যাই হউক না কেনও সেটা বিবেচ্য নয়। আমি সবার পক্ষ থেকে তার আন্তরিকতার প্রশংসা করে এই অনুদান গ্রহণ করলাম শ্রদ্ধার সাথেই। তোমার এই কথা আমি অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীকে জানাবো। এবার দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ আলোচ্য বিষয়টি তোমাকে বিশদ ভাবে অবগত করতে চাই। বলো, কি বলতে চাও তুমি।
‘৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণার আগেই সুচিন্তিতভাবে স্বাক্ষরিত হয়েছিল সোভিয়েত-ভারতের মধ্যে ‘মৈত্রী এবং শান্তি’ চুক্তি এবং পাকিস্তানের পরাজয়ের পর সেই চুক্তির আদলে ২৫ বছর মেয়াদি মুজিব এবং ইন্দিরার মধ্যেও স্বাক্ষরিত হয় এক অসম ‘মৈত্রী এবং শান্তি’ চুক্তি। এর সুদূর প্রসারী উদ্দেশ্য বাংলাদেশকে ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। এই নীলনকশা প্রণীত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সময়েই এবং এই দাসখত মেনে নেয় শেখ মুজিব সরকার এককভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করার লালসায়। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে ১৯৭৫ এর ১৫ আগস্টের জনসমর্থিত সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে স্বৈরশাসক শেখ মুজিবের তিরোধানের মাধ্যমে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ফলে সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত ভারতীয় নীলনকশা ভেস্তে যায়। জনপ্রিয় ১৫ই আগস্ট বিপ্লবকে পরাস্ত করার জন্য ভারতীয় অক্ষশক্তি এবং আওয়ামী-বাকশালী জোট ব্রিগেডিয়ার খালেদের মাধ্যমে ২-৩রা নভেম্বর এক প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ঘটায়। কিন্তু তাদের গণবিচ্ছিন্ন এই প্রয়াসকে ব্যর্থ করে দেয়া হয় ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার সমন্বয়ে আর একটি সফল সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই অভ্যুত্থানেও অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে ১৫ই আগস্টের বিপ্লবীরাই। এই পরাজয়ের পরও চক্রান্ত থেমে থাকেনি। বাংলাদেশে ঘটে যায় কয়েকটা অশুভ উত্থান পতনের ঘটনা। এর মধ্য দিয়েই অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯০-এর নির্বাচন। রুশ-ভারত চক্রের মদদ পুষ্ট তাবেদার রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ নিশ্চিত ছিল, তাদের মিত্র এবং ভারত সমর্থিত সামরিক শাসক জেনারেল এরশাদের ৮ বছর শাসনকালে পিষ্ট, নিপীড়িত, সম্বলহীন, সাংগঠনিকভাবে দুর্বল বিএনপি জোটকে অতি সহজেই পরাজিত করতে পারবে। কিন্তু অপ্রত্যাশিতভাবে তাদের সেই গুড়ে বালি পড়ে। নির্বাচনে জিতে যায় খালেদার জোট। গণতান্ত্রিক প্রথা অনুযায়ী এই পরাজয়কে মেনে নিতে পারেনি রুশ-ভারত অক্ষশক্তি সমর্থিত আওয়ামী লীগ। তাই নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পরমুহূর্তেই হাসিনা হুংকার দিয়ে বলে, খালেদার সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না।
শুধু হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেই ক্ষান্ত হয়নি হাসিনা, ইতিমধ্যেই RAW-এর পরামর্শ অনুযায়ী বহুমুখী চক্রান্তের মাধ্যমে খালেদার সরকারকে অস্থিতিশীল করে তোলার চেষ্টা করছে বিরোধী দলীয় নেত্রী এবং তার দল। সঙ্গে রয়েছে জেনারেল এরশাদ, এমনকি জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশকেও খালেদা বিরোধী চক্রান্তে দলে ভেড়াবার চেষ্টা করা হচ্ছে। এই অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া চাইছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমেরিকায় রাষ্ট্রীয় সফরে এসে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে আরও মজবুত করে তুলতে। শুধু তাই নয়, তিনি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন আমেরিকা সহ ইউরোপ এবং নর্থ আমেরিকার শক্তিশালী দেশের ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য ক্ষমতাধর নীতি নির্ধারকদের সাথে দুই দেশের স্বার্থে ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার।
তোমার পরামর্শেই তিনি এই সিদ্ধান্তগুলো গ্রহণ করেছেন সেটা তুমি উল্লেখ না করলেও আমি ঠিকই বুঝতে পারছি বন্ধু। প্রধানমন্ত্রী তোমার পরামর্শ গ্রহণ করে নিয়ে সঠিক পথেই এগুতে চাচ্ছেন সেটা প্রশংসনীয় এবং তার এই প্রচেষ্টা যাতে ফলপ্রসূ হয় তার জন্য তোমার বন্ধু হিসাবে আমরা তাকে আন্তরিকভাবে যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা অবশ্যই করবো। কাল সকালে গঙ্গা তোমাকে নিয়ে ক্যাপিটল হিলে আসবে। সেখানে তোমার সাথে আমাদের বৈঠক হবে। সেখানে বন্ধুদের মধ্যে জেসি, বব, হেমিলটন এবং হ্যারি থাকবে। সেখানে তোমার বক্তব্যের উপর বিস্তারিত আলোচনা হবে। তারপর তোমাকে আমাদের তরফ থেকে সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে। একই সাথে সেই সিদ্ধান্ত কি করে বাস্তবায়িত করা হবে সেটাও তোমাকে বুঝিয়ে দেয়া হবে দুই-তিন দিনের মধ্যে। আমি বৈঠকের আগেই তাদের সংক্ষেপে তোমার মিশন সম্পর্কে অবগত করে রাখবো আলোচনার সুবিধার্থে। বন্ধুদের মধ্যে অনেকেই ইহুদী। কিন্তু তাদের মানবিক এবং চারিত্রিক গুণাবলী জানার পর তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা না করে পারা যায় না। এ থেকেই প্রমাণিত হয় ভালমন্দ সব ধর্মাবলম্বীদের মধ্যেই বর্তমান। ধর্মীয় গোঁড়ামি কিংবা বিদ্বেষ আমাদের বন্ধুত্বে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করে কলুষিত করতে সক্ষম হয়নি আজঅব্দি। বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের প্রতি আমেরিকার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে খোলাখুলি আলোচনা হল আমার এজেন্ডা ছাড়াও। বিশেষ উৎসাহের সাথেই বন্ধুরা আমার সাথে আলোচনা করেছিলেন। আলোচনাকালে, তারা খালেদা জিয়ার কৃতজ্ঞতা প্রকাশে খুশি হয়েছিলেন। আমার পরামর্শে আমেরিকা-বাংলাদেশ সম্পর্ক জোরদার করার তার সঠিক চিন্তাভাবনা ও উদ্যোগের প্রয়াসেও তারা সন্তুষ্টি প্রকাশ করে জানালেন, ব্যক্তিগত সম্পর্ক গড়ে তোলার প্রচেষ্টা চালনো হবে জিমের মাধ্যমেই তাই আমার দায়িত্ব হবে প্রধানমন্ত্রীর সাথে জিমকে প্রাথমিক সৌজন্য সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করে দেয়া। এরপর থেকে তাদের প্রতিনিধি হিসাবে খালেদা জিয়ার সাথে সর্ব বিষয়ে যোগাযোগ রক্ষা করে চলবে জিম দুই পক্ষের মধ্যে। বৈঠক শেষ হওয়ার আগে জেসি বললেন, জিমই তাদের লিখিত সিদ্ধান্ত আমাকে জানিয়ে দেবে। এভাবেই শেষ হল আমাদের বৈঠক। একটি এক্সক্লুসিভ ক্লাবে দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত করলেন জেসি বন্ধুদের তরফ থেকে আমাকে এবং গঙ্গা ভাইকে। সেখানে কয়েকজন নতুন বন্ধুর সাথেও আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলো জিম। খাবার পর্ব শেষে গঙ্গাভাই আমাকে হোটেলে নামিয়ে দিতে এলেন। হোটেলে পৌঁছে দুই বন্ধু বসলাম সারাদিনের কার্যকলাপের সম্পর্কে উপসংহার টানার জন্য। গঙ্গাভাই বললেন আপনার সাবলীল, স্পষ্ট , সারগর্ভ উপস্থাপনা এবং সওয়াল-জবাব বন্ধুদের সন্তুষ্ট করতে সক্ষম হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস। তাই ধরে নেয়া যায় তাদের সিদ্ধান্ত হবে ইতিবাচক, আর আপনার সফরও হবে ফলপ্রসূ। এর একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত জেসির বক্তব্যেই রয়েছে। তিনি বলেছেন, তাদের সিদ্ধান্ত লিখিতভাবে আপনাকে জানানো হবে জিমের মাধ্যমে। সিদ্ধান্ত জানাতে জিম কখন আসবে সেটা আমাকে জানালেই আমি তাকে নিয়ে আপনার কাছে চলে আসবো।
বিদায় নিয়ে চলে গেলেন গঙ্গা ভাই। এখন সব কাজ শেষে ফলাফলের অপেক্ষার পালা।
হোটেল থেকে ফোন করলাম আমার ছোট খালা খুকুকে নিউ জার্সিতে। হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার ফোনে খুশি হয়ে অনুরোধ করল, ফেরার পথে তাদের ওখানে যেনো অবশ্যই হয়ে যাই। জবাবে বললাম, এবার সময়ের স্বল্পতার জন্য সম্ভব নয়। শুনে খুকু বললো, তাহলে ও নিজেই ওয়াশিংটনে আসছে দেখা করার জন্য সাপ্তাহিক ছুটিতে। বলতে বাধ্য হলাম, সেটাও সম্ভব নয় এইবার। কারণ, দুই-তিন দিনের মধ্যেই আমাকে ফিরে যেতে হবে কাজ শেষে। আমার জবাবে বেচারি বলল খুবই হতাশ করলে! তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম
পরের বার নিম্মি আর সস্তিকে সঙ্গে করে সময় হাতে নিয়ে আসবো। তখন নিশ্চয় তোমাদের ওখানে বেরাব। খুকুর সাথে কথোপকথন শেষ করে ফোন করলাম খসরু মামা (ডঃ আকবর আলি খান) কে। তিনি তখন যুক্তরাষ্ট্রের বাংলাদেশ দূতাবাসে ইকনোমিক মিনিস্টার হিসাবে পোস্টেড ছিলেন। অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার ফোন পেয়ে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন
তুমি কোথেকে? ওয়াশিংটন থেকেই বলছি মামা। বলা নেই কওয়া নেই হঠাৎ ধূমকেতুর মতো আবির্ভাব। ব্যাপার কি? নিম্মিও এসেছে নাকি? না, এবারের সফরটা সংক্ষিপ্ত তাই অকে আনিনি, এসেছি একটা বিশেষ কাজে। তাহলে ব্যস্ত না থাকলে আমি এসে তোমাকে বাসায় নিয়ে আসতে চাই, কোথায় উঠেছো? হিলটনে। আপনাকে আসতে হবে না, আমি ট্যাক্সি করে নিজেই আসবো। আপনি ঠিকানাটা দিন। মেরিল্যান্ডে থাকেন মামা, ঠিকানাটা জেনে নিয়ে গিয়ে পৌঁছালাম তাদের বাড়ীতে। পটোম্যাক নদী পার হয়ে মেরিল্যান্ডে খসরু মামার বাসায় পৌঁছাতে বেশি সময় লাগলো না। দরজায় বেল টিপতেই মামা নিজেই হাসি মুখে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলেন। মামী এলেন, মামা তাকে খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বললেন, চলে গেলেন মামী কিচেনে। তাদের একটি মাত্র কন্যা সন্তান, ও তখনও খুবই ছোট। তাই ঘুমিয়ে পড়েছে। কি মামু এমন চুপিসারে ওয়াশিংটন সফরে কেনও? খালেদা কি এজেন্ডা দিয়ে পাঠালেন এবার? হেসে হাল্কাভাবে বললাম প্রধানমন্ত্রীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য তো আপনারাই রয়েছেন মামা। মামা আমাকে বিশেষ ভাবে স্নেহ করতেন। তিনি শুধু কালিনারায়ণ স্কলারই নন, জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার এবং সবার কাছেই সমাদৃত একজন নিষ্কলুষ, বিচক্ষণ এবং জাঁদরেল আমলা। স্পষ্টবাদিতা এবং সততার এক বিরল উদাহরণ। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা একই সাথে ছিলাম। বলিষ্ঠ চরিত্রের এই ব্যক্তিটিকে দলমত নির্বিশেষে সবাই শ্রদ্ধার সাথে সমীহ করে থাকে। বললাম 7th Fleet-এর diversion এবং উড়ির চরে ‘Operation Sea Angels’ কার্যক্রমে আমার কিছু বন্ধু-বান্ধব যারা এই সিদ্ধান্ত নিতে আমেরিকার প্রেসিডেন্টকে প্রভাবিত করেছিলেন, তাদের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে ধন্যবাদ জানানোর জন্য গোপনে আমাকে তার বিশেষ দূত হিসাবে আসতে হল। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যুক্তরাষ্ট্রে তার একটা রাষ্ট্রীয় সফরের চেষ্টাও করতে অনুরোধ করেছেন বেগম সাহেবা।
মামু, কেনও এইসব রদ্দিমালের জন্য অযথা বেগার খাটছো? জিয়ার পরও তোমাদের শিক্ষা হয়নি? এখন যে সমস্ত নেতা-নেত্রী মাঠ গরম করে জমিয়ে বসেছে তাদের লক্ষ্য শুধু একটাই। সেটা হচ্ছে কে কাকে ধরাশায়ী করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করবে। দেশ এবং জনগণের স্বার্থে রাষ্ট্রকে কি করে ব্যবহার করতে হয়, সে সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই নেই। সেই জ্ঞান অর্জনে তাদের কারও বিন্দুমাত্র আগ্রহ অথবা উৎসাহ ও নেই। এইসব স্বার্থান্বেষীদের একমাত্র উদ্দেশ্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে দেশ বেঁচে নিজেদের আখের গোছানো। ‘৭১ থেকে আমাদের লালিত স্বপ্ন এদের দ্বারা বাস্তবায়ন কিছুতেই সম্ভব নয়। তার চেয়ে সম্ভব হলে কিছু টাকাকড়ির ব্যবস্থা করো, তাহলে নিজেরাই দেশটার চেহারা বদলানোর জন্য আর একটা যুদ্ধ করার চেষ্টা করে দেখি। স্বল্প কথার মানুষ। গুটিকতক বাক্যে একটা ইতিহাসের সারবস্তু বয়ান করে ফেলার মতো জ্ঞান ও দক্ষতার অধিকারী খসরু মামা। নিঃশব্দে শুনে একসময় বিদায় নেবার প্রাক্কালে অনুরোধ জানালাম মামা, আমার এবারের সফরটা খুবই গোপনীয়। হেসে তিনি বিদায় দিয়ে বললেন নিশ্চিন্ত থাকো মামু, আমি তোমার এই গোপন সফরের নীরব একজন সাক্ষী হয়েই থাকবো। মামাকে ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। পরদিন বিকেলেই আগমনী বার্তা জানিয়ে এসে পৌঁছালেন গঙ্গাভাই জিমকে সঙ্গে করে। দু’জনকেই বেশ উৎফুল্ল দেখাচ্ছিলো। ঘরে ঢুকেই গঙ্গাভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে পিঠ চাপড়ে বললেন আপনার সফরের লক্ষ্য অর্জনে আপনি সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছেন।
জিমও একই ভাবে জড়িয়ে ধরে বললো Hearty congratulation my dear friend, your mission has achieved great success. তাদের উচ্ছ্বাসে আমি কিছুটা হতবাক হলাম! সোফায় বসলাম তিন বন্ধু। এমব্যাসাডর হক, তোমার প্রেজেন্টেশন এবং সওয়াল-জবাব এতটাই সাবলীল এবং যুক্তিসঙ্গত ছিলো যার ফলে বিশেষ গুরুত্বের সাথে সার্বিক বিবেচনার পর তোমার দু’টি প্রস্তাবই গ্রহণযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন বন্ধুরা এবং এর আশু বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুই জরুরী ভিত্তিতে করার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে সর্বসম্মতিক্রমে। তবে এর চেয়েও বড় একটা সারপ্রাইজ এর উল্লেখ রয়েছে চিঠিগুলোতে যা প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া এবং তোমার প্রত্যাশার বাইরে, বলেই জিম তিনটি সিলড লেফাফা আমার হাতে দিলো। একই সাথে একটা খোলা লেফাফা। ওটার মধ্যে চিঠি তিনটির কপি রয়েছে তোমার জন্য। তিনটি চিঠিই প্রধানমন্ত্রীর নামে। উপরে লেখা রয়েছে CONFIDENTIAL. চিঠি তিনটি লিখেছেন, Senate Foreign Relations Committee Chairman, Leader of the Congress এবং Senate Endowment Committee Chairman. আমি চিঠিগুলোর কপি বের করে পড়লাম। তিনটি চিঠির সারবস্তু প্রায় একই।
অতিসত্বর খালেদা জিয়ার রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ জানানোর ব্যবস্থার চেষ্টা করা হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষমতা বলয়ে ব্যক্তিগত সুসম্পর্ক গড়ে তোলার ইচ্ছা পূরণের জন্য সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করা হবে। শুধু তাই নয়, সফরকালে তাকে Joint Session of the Senate and the Congress এ ভাষণ দেবার আমন্ত্রণও জানানো হবে বাংলাদেশের নির্বাচিত সরকার প্রধান হিসেবে। এ ধরনের সুযোগ অতি দুর্লভ। পৃথিবীর হাতে গোণা কয়েকজন রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানই আজঅব্দি এই সুযোগ লাভ করতে সক্ষম হয়েছেন। তাদের কাতারে সামিল হওয়ার সৌভাগ্য শুধু খালেদা জিয়ার ভাবমূর্তিকেই বিশ্বপরিসরে সমুজ্জ্বল করবে তাই নয়, এতে বাংলাদেশ ও দেশবাসী একইভাবে গৌরবান্বিত একটি দেশ ও জাতি হিসাবে সুপরিচিত হয়ে উঠবে জগৎ জুড়ে। এটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি। তাই সত্যই স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। আমার সম্পর্কে তিনজনই মন্তব্য করেছেন যার সারবস্তু হল, আমার মতো জ্ঞানী, দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ একজন রাষ্ট্রদূত যেকোনো দেশ, জাতি এবং সরকারের গর্ব। এই বিষয়ে আমি কিছুটা বিব্রত হয়ে জিমকে বলেছিলাম আমার সম্পর্কে মন্তব্যগুলোতে বিব্রত বোধ করছি। না লিখলেই আমি স্বস্তি বোধ করতাম। তোমার সম্পর্কে মন্তব্যগুলো কেউই পত্র লেখকদের ডিক্টেট করিনি। তারা নিজেরাই যা বুঝেছেন সেটাই লিখেছেন। তাই এতে তোমার বিব্রত হবার কোনও কারণ আমি দেখতে পাচ্ছিনা বন্ধু।
ইতিমধ্যে চা-নাস্তা পরিবেশিত হয়েছে। তাই বন্ধুদের চিঠিগুলোর জন্য জিমের মাধ্যমে তাদের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে প্রসঙ্গ পাল্টে বললাম এবার এসো, পেট পূজাতে মনোসংযোগ করা যাক। চা-নাস্তা খাওয়ার ফাঁকে জিম জানতে চাইলো কবে ফিরে যাচ্ছি। জবাবে বললাম, সম্ভব হলে আজ রাতেই লন্ডন হয়ে তানজানিয়া। সেখান থেকে নাইরোবি। তারপর ঢাকায়।
প্রয়োজন বোধে তুমি যেকোন সময় আমাকে ফোন করতে পারো। ধন্যবাদ। এরপর কিছুক্ষণ হাল্কা আলাপ করে বিদায় নিয়ে চলে গেলো জিম।
গঙ্গাভাই হোটেল থেকেই রাতের ফ্লাইটে লন্ডন আর তার একদিন পর লন্ডন থেকে তানজানিয়ার ফ্লাইট কনফার্ম করে ফেললেন। যথাসময়ে তিনি আমাকে প্লেনে তুলে দিয়ে বিদায় নিলেন। লন্ডন পৌঁছে কারো সাথে যোগাযোগ করলাম না। হোটেলেই এক রাত কাটিয়ে পৌঁছালাম তানজানিয়া। সেখান থেকে নাইরোবি। সবাই জানলো তানজানিয়ার ট্যুর শেষে ফিরে এসেছি।
আবার ঢাকায়
এক সপ্তাহের মধ্যেই ঢাকায় যাওয়া ঠিক। সপরিবারে ঢাকা পৌঁছে মিনি ফুপ্পুর বাসাতেই ডেরা বাঁধলাম। কিন্তু স্বপন আর রোজির জোরাজুরিতে প্রথম দুই-তিন দিন ওদের বাসায় থাকতে হল।
কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রম আমার একমাত্র ছোটভাই। বয়সে আমার চেয়ে বছর চারেকের ছোট একজন বহুল পরিচিত মুক্তিযোদ্ধা এবং প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী। ‘৬০-এর দশকে ফৌজদার হাট ক্যাডেট কলেজ থেকে পাশ করে স্কলারশিপ নিয়ে বৈরুত আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে চলে যায়। সেখানকার পড়াশুনা শেষে উচ্চশিক্ষার্থে চলে যায় জার্মানিতে। সেখান থেকে ডিগ্রী নিয়ে দেশে ফিরে নিজের ব্যবসা শুরু করে। একই সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটির IBA Department এ ভর্তি হয় MBA করার জন্য। কিন্তু ডিগ্রীলাভের আগেই শুরু হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধ। যুদ্ধের প্রারম্ভেই স্বপন, বদি, কাজি, সাচো, জুয়েল, আজাদ, বাদল, আলম, চুল্লু, সামাদ, মেওয়া, রুমি, ফাজলে, ফতেহ আলি, উলফাত, মোখতার, তৈয়ব আলি এবং তাদের আরও কয়েকজন বন্ধু ও পরিচিতজন ২নম্বর সেক্টরের অধীন ত্রিপুরার মেলাঘর ক্যাম্পে গিয়ে গেরিলা হয়ে যোগদান করে ট্রেনিং-এর জন্য। ট্রেনিং শেষে তাদের ঢাকায় পাঠানো হয় খানসেনাদের বিরুদ্ধে অপারেশন করার জন্য। এদের সবাই আমার অতিপ্রিয় আপনজন। এই গেরিলাগ্রুপটি ঢাকা শহরে অবিশ্বাস্য দুঃসাহসিক অপারেশন করে খানসেনাদের মনে ত্রাসের সঞ্চার করে। ঢাকা শহরের প্রায় সবকয়টি দুঃসাহসিকঅপারেশনের হোতা ছিল স্বপনদের দুর্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপটিই। তাদের দুঃসাহসিক অপারেশনের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের অপারেশন, ফার্মগেট অপারেশন, সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার প্লান্ট অপারেশন, ডেমরা অপারেশন, গুলবাগ পাওয়ার হাউস অপারেশন, ধানমণ্ডি অপারেশন, যাত্রাবাড়ী অপারেশন। এই অমিত সাহসী গ্রুপটি নিজেদের জীবন বাজী রেখে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পরিবার এবং বাচ্চাদের খান সেনাদের হাতে বন্দী অবস্থা থেকে উদ্ধার করে সাফল্যের সাথে তাদের সহি সালামতে সীমান্তের ওপারে পৌঁছে দেয়।এই জানবাজ বিচ্ছু দলটির তৎপরতায়ভয় এবং আতংকে তটস্থ হয়ে উঠেছিলো হানাদার বাহিনী এবং ঢাকার হেডকোয়ার্টার-এ অবস্থিত তাদের কমান্ডাররা। কিন্তু যুদ্ধের এক পর্যায়ে আওয়ামীলীগের মনোনীত প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জনাব জিল্লুর রহমানেরপত্নী আওয়ামীলীগের পরলোকগত নেত্রী আইভি রহমানের কনিষ্ঠ ভ্রাতা ফরিদের বিশ্বাসঘাতকতায় একই রাতে হানাদার বাহিনী এক আচমকা ঝটিকা অপারেশন চালিয়ে আমার আব্বা, বাসায় সেই রাতে অবস্থানরত সব আত্মীয়-স্বজন, কাজের লোকজনসহ গেরিলা দলটির বেশীরভাগ সদস্যদের শহরের বিভিন্ন অবস্থান থেকে বন্দী করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়। গুলিবিদ্ধ হয়েও প্রাণে বেঁচে যেতে সক্ষম হয় মাত্র দুইজন, স্বপন ও কাজি কামালুদ্দিন। বেঁচে যায় এই বিচ্ছুদলের আরও কয়েকজন, যারা সেই কালরাত্রিতে ঢাকার বাইরে অবস্থান করছিলো।
মীরজাফরের অবতার ফরিদের বিশ্বাসঘাতকতায় বন্দী মুক্তিযোদ্ধাদের কেউই জীবিত ফিরে আসতে পারেনি ক্যান্টনমেন্ট থেকে। মুক্তিযোদ্ধাদের উপর বন্দী অবস্থায় অকথ্য নির্যাতন চালনোর পর তাদের সবাইকে হত্যা করা হয়। কিন্তু যেকোনো কারণেই হউক নিরীহ সাধারণ নাগরিকদের উপর অসহনীয় অত্যাচার করা হলেও তাদের মেরে ফেলা হয়নি। তাই আমার আব্বা, বন্দী পুরুষ আত্মীয়-স্বজন এবং বাসার কাজের লোকজনসহ আরও অনেককে মুক্ত করা হয় পাকবাহিনীর আত্মসমর্পণের পর আধমরা অবস্থায় আল্লাহ্তায়ালার অসীম করুণায়।
অকুতোভয়য় এইসব মুক্তিযোদ্ধাদের সবাই ছিলো ভার্সিটির কৃতি ছাত্র, উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ ছিল তাদের সামনে। কিন্তু দেশপ্রেম এবং বিবেকের তাড়নায় অন্যায়ের বিরুদ্ধে এই সূর্য সন্তানরা গর্জে উঠে সব কিছুর আকর্ষণ এবং মায়া ত্যাগ করে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলো স্বাধীনতা সংগ্রামে।
কিন্তু জাতি আজঅব্দি এইসব বীরদের সঠিক মূল্যায়ন করে যথাযোগ্য সম্মান দিতে পেরেছে কি? এদের বীরগাথা নিয়ে লেখেনা কেউ, এদের নিয়ে হয় না কনও সেমিনার কিংবা স্মরণ সভা। কিন্তু পরিলক্ষিত হয়, যে দুইটি পরিবার বাংলাদেশকে তাদের পৈত্রিক সম্পত্তিতে পরিণত করার জন্য পশুদের চেয়েও হিংস্রতার সাথে লড়াই এবং চুল টানাটানি করছে জনগণের কাঁধে ভর করে, তাদের নিয়ে হরহামেশা সেমিনার, জনসভা, পদযাত্রা, গাড়ির শোভাযাত্রার কমতি নেই। কমতি নেই দেশের সবচেয়ে বড় চোর, দুর্নীতিবাজ, চরিত্রহীন, লম্পট কুসন্তানদের যুবরাজ বানানোর জঘন্য প্রতিযোগিতার।
সত্যি বিচিত্র এ দেশ সেলুকাস! এই উক্তি খণ্ডানোর মতো সাহসী মানুষ কি নেই এই প্রজন্মে? প্রত্যাশা করা যায় কি আগামী প্রজন্মে? যে জাতি প্রকৃত দেশপ্রেমিক বীরদের মর্যাদা দিতে পারে না বা জানে না, তারা কখনোই আত্মসম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার দাবিদার হতে পারে না। ইতিহাসের এই শিক্ষা না নিলে থাকবে না সম্ভাবনাময় বাংলাদেশের স্বাধীন অস্তিত্ব। ফলে ভবিষ্যৎবলেও কিছুই থাকবে না ১৮ কোটি বাংলাদেশীর তথা সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান জনগোষ্ঠীর।কি করে ঘটেছিল এই ন্যক্কারজনক ঘটনা সেটা বিশদভাবে জানার ইচ্ছে যাদের আছে তারা আমার লেখা এবং প্রকাশিত ‘কিছু কথা কিছু ব্যথা’ বইটি পড়তে পারেন। বইটি সংগ্রহ করতে না পারলে ওয়েবসাইট www.majordalimbubangla.com থেকেও বইটি পড়তে পারেন কিংবা ডাউন লোড করে নিতে পারেন। বইটিতে আমি শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেছি কয়েকটি সত্যি ঘটনা তুলে ধরার মাধ্যমে আমার কয়েকজন অবহেলিত সাথী মুক্তিযোদ্ধা যাদের বীরগাথা উপেক্ষিত হয়েছে এবং অনেককেই দেয়া হয়নি কোনও স্বীকৃতি পদক, Guerilla Advisor to the Sector Commanders এবং একজন Commander হিসেবে আমার আপ্রাণ চেষ্টা সত্ত্বেও।
এই অক্ষমতার যাতনা বুকে নিয়েই লিখেছি ঐ সমস্ত উপেক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ নিঃস্বার্থ মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা ‘কিছু কথা কিছু ব্যথা’ বইটিতে। মুক্তিযোদ্ধাদের এমন হাজারও বীরগাথাকে প্রকাশ না করে ধামাচাপা দেয়া হয়েছে সুপরিকল্পিত চক্রান্তের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান দেশ ও বিদেশবাসীর কাছে গৌণ প্রমাণ করার জন্য বিশেষ করে ভারতের স্বার্থে। ‘৭১-এ শ্রেণী বিভেদ নির্বিশেষে প্রকৃত নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক সংখ্যাগরিষ্ঠ মুক্তিযোদ্ধাদের চেতনা এবং কি ছিলো তাদের মন-মানসিকতা সেটা বর্তমান এবং ভবিষ্যৎপ্রজন্মের বোঝার সুবিধার্থে দু’জন মুক্তিযোদ্ধার উদাহরণ তুলে ধরা হল।
জার্মানিতে চিকিৎসার পর দেশে ফেরার কিছুদিন আগে স্বপন এবং কাজি দেরাদুন মিলিটারি একাডেমী থেকে কৃতিত্বের সাথে কমিশন লাভ করে দেশে ফিরে দুইজনই সেনাবাহিনীতে যোগদানে অনীহা প্রকাশ করে। স্বপন তার নিজ ব্যবসাকে নতুন করে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার উদ্যোগের সাথে সাথে তার লেখাপড়া শেষ করায় ব্রতী হয়। কাজি ভার্সিটিতে পড়াশুনা করার সময়েই পাকিস্তানের ন্যাশনাল বাস্কেট বল টিমে খেলতো। পড়াশুনা শেষে যোগ্যতার ভিত্তিতে তাকে পাকিস্তান সরকার জার্মানিতে পাঠায় কোচ হিসাবে ট্রেনিং নেবার জন্য। ফিরে আসার পর জাতীয় কোচ হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের স্পোর্টস ফেডারেশনের একজন কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হয় কাজি কামালুদ্দিন। যুদ্ধের পর কাজি বাংলাদেশের স্পোর্টস ফেডারেশনের কর্মকর্তার পদেই যোগদানের সিদ্ধান্ত নেয়, সাথে নিজস্ব ব্যবসাও শুরু করে।
তাদেরকে সেনাবাহিনীতে যোগদান করানোর জন্য অনেক করে বুঝিয়েছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়াউর রহমান, জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু এবং ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ। কিন্তু তারা সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে নিজেদের সিদ্ধান্তে অটল থাকে। যুক্তি হিসাবে তারা বলেছিলো মুক্তিযুদ্ধটা স্বাভাবিক পথে এগুলে প্রলম্বিত হতে পারে, আর সেই ক্ষেত্রে IMA এর ট্রেনিংটা কাজে লাগবে বিবেচনা করেই তারা দেরাদুনে ক্যাডেট হিসাবে যোগদান করেছিলো। কিন্তু সেখানে প্রশিক্ষণরত অবস্থাতেই মুক্তিযুদ্ধটাকে স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগুতে না দিয়ে সেটাকে হাইজ্যাক করে ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের আত্মত্যাগ এবং রক্তের বিনিময়ে অক্লেশে বিজয় হাসিল করে পাকিস্তানকে পরাস্ত করে এবং স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশকে তাদের বিজয়ের দান হিসাবে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ এবং বিশ্বপরিসরে প্রতীয়মান করতে সমর্থ হয়। দাক্ষিণ্যের এই স্বাধীনতা অদূর ভবিষ্যতে অরক্ষিত হয়ে পরাধীনতায় পরিণত হতে পারে। তার হেফাজতের জন্য আপনাদের মতো পেশাদার দক্ষ সেনা অফিসাররা তো রইলেন। আমরা যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম নিজেদের লড়াই নিজেরা লড়ে দেশকে স্বাধীন করার জন্য, চাকুরির প্রত্যাশায় নয়। অরক্ষিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করার জন্য যদি জীবিত অবস্থায় আবার একটি মুক্তিসংগ্রামের প্রয়োজন হয় তাহলে আবার আমরা অস্ত্র হাতে তুলে নেবো মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে।
স্বপন ও কাজির এই দৃঢ় আত্মবিশ্বাস এবং প্রচণ্ড আত্মপ্রত্যয় ছিলো হাজার হাজার দেশপ্রেমিক জনদরদী মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মনোভাব এবং বুকে লালিত স্বপ্নের প্রতিফলন।
সেই স্বপ্ন স্বাধীনতার চার দশকের পরেও আজঅব্দি বাস্তবায়িত হয়নি ক্ষমতায় থাকা নেতা-নেত্রীদের বিশ্বাসঘাতকতা, অপশাসন, দুর্নীতি এবং বিদেশী প্রভুদের সেবাদাসত্বের কারণে।
এই ব্যর্থতার জন্য দায়ী কে সেটাও ভেবে দেখতে হবে বর্তমান ও আগামী প্রজন্মকে।
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ তখনকার প্রজন্মকে উদ্দীপ্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো নির্ভেজাল জাতীয়তাবাদী চেতনায়। সাধারণ জনগণের সাথে এক কাতারে মিশে শাণিত হয়েছিলো তাদের দেশাত্মবোধ, সামাজিক এবং রাজনৈতিক চেতনা। বয়সের তুলনায় মুক্তিযোদ্ধারা হয়ে উঠেছিলো অনেক বেশি পরিপক্ব। এর ফলে, তারা হয়ে উঠেছিলো যুগযুগ ধরে নিগৃহীত, লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, আর্থ-সামাজিকভাবে সম অধিকার থেকে বঞ্চিত এবং শোষিত দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর পক্ষের প্রতিবাদী শক্তি।
এই নবশক্তির জাগরণে কেঁপে উঠেছিলো ঘুণেধরা কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর ভিত তাই তারা হয়েছিলো প্রতারণা এবং নিগ্রহের শিকার। দাবড়ে দেয়া হয়েছিলো তাদের উপর রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসের লাল ঘোড়া। কিন্তু সাময়িকভাবে সেই চেতনাকে দাবিয়ে দিলেও সংগ্রামের মাধ্যমে দেশ এবং জনস্বার্থের আদর্শভিত্তিক যে অপরাজেয় ঐক্যবদ্ধ শক্তির জন্ম হয়, তার কাছে সব অপশক্তিকেই পরাজয় বরণ করতে হয় দেরিতে হলেও, এটাই ইতিহাসের শিক্ষা। একমাত্র এই শক্তিই হতে পারে কোনও একটি দেশ এবং জাতির মূল রক্ষাকবচ।
ঢাকায় পৌঁছানোর সংবাদ পেয়ে প্রধানমন্ত্রী আমাকে পরদিন রাত ৯ টায় তার বাসভবনে দেখা করার পয়গাম পাঠালেন। পরদিন নির্ধারিত সময়ে তার বাসায় পৌঁছালাম, আমাকে স্বাগত জানিয়ে বসার ঘরে নিয়ে গিয়ে বসালো দন্ত বিকশিত সেই ফালু। কিছুক্ষণের মধ্যেই মিসেস জিয়া এলেন মশলা চিবুতে চিবুতে। বুঝতে পারলাম, তিনি অধীর হয়েই আমার প্রতীক্ষায় ছিলেন। তার আগমনে উঠে সালাম জানাতেই প্রতিউত্তর দিয়ে ইশারায় বসতে বলে নিজেও বসে পড়লেন পাশের সোফায়।কেমন আছেন, কোথায় উঠেছেন, রাতের খাবার খেয়েছেন? ভালই, দেশে আসলে যাযাবরের মতো কোনোও একখানে ডেরা ফেলে সব নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতে ঘুরে ঘুরে থাকতে হয়। এখন এসেছি স্বপনের বাসা থেকে। চা খেতে আপত্তি নেই নিশ্চয়, বলেই চা-নাস্তার ফরমায়েশ দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন
কেমন হল আপনার আমেরিকা সফর? কিছু না বলে সিলড চিঠি তিনটি তার হাতে দিয়ে অনুরোধ জানালাম খুলে পড়তে। তিনি তার রিডিং গ্লাস আনিয়ে চিঠিগুলো মনোযোগ দিয়ে পড়লেন। পড়া শেষে প্রথমতো তিনি কিছুটা স্তম্ভিত হয়ে গেলেন! পরে উচ্ছ্বসিত হয়ে জিজ্ঞেস করলেন এটা কি করে সম্ভব হল?
সঠিক জবাবটা আমার নিজেরও জানা নেই।
আপনাকে যতই বোঝার চেষ্টা করছি ততই হতবাক হচ্ছি। অসম্ভব কাজগুলো কি করে এতো সহজেই সম্ভব করে তোলেন আপনি! আমি শুধু সাধ্যমতো আন্তরিকভাবে চেষ্টা করি। ফল দেবার মালিক আল্লাহ্ সোবহানওয়াতালা।
তা অবশ্য ঠিকই বলেছেন। এবার বলুন, আমার করণীয় কি?
আমাদের এক বন্ধু আছেন তার নাম জিম। তিনি লাগাতার তিন দশকের বেশি সময় তার এলাকা থেকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নির্বাচিত কংগ্রেস সদস্য হিসাবে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করেছেন। ক্ষমতা বলয়ে সব মহলে তিনি একজন অভিজ্ঞ এবং প্রভাবশালী ব্যক্তি হিসাবে বিশেষভাবে সমাদৃত। তিনিই সমন্বয়কারী হিসাবে আপনার এবং বন্ধুদের মধ্যে সর্ব ব্যাপারে যোগাযোগ রক্ষা করবেন। আপনার সফর, ব্যক্তিগত সম্পর্ক মজবুত ভিত্তিতে কি করে গড়ে তোলা যায় এবং বিভিন্ন জটিল সমস্যাগুলো কি করে সমাধান করা সম্ভব তার মূল পরামর্শদাতাও হবেন তিনিই। আপনার আমন্ত্রণে তাকে ডাকিয়ে এনে প্রাথমিক পরিচয়টা আমিই করিয়ে দেবো। তাহলে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে তার সুবিধা অনুযায়ী আসার নিমন্ত্রণপত্র পাঠিয়ে দেই আমার তরফ থেকে, কি বলেন? হ্যাঁ, তাই করতে হবে। তবে আমার অভিমত, প্রথম পরিচয়টা ঢাকায় না হওয়াটাই শ্রেয়। গোপনীয়তার স্বার্থে কোনও তৃতীয় দেশে সাক্ষাতটা হলেই ভাল হয়। পরিচয়ের পর পূর্বপরিচিত কাউকে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে আপনি ঢাকায় ডেকে পাঠালে সেটা হবে একটা সাধারণ ব্যাপার। তাই সন্দেহের অবকাশও কম থাকবে। আপনার যুক্তিটা বুঝতে পেরেছি। কিন্তু এরমধ্যে জিম্বাবুইতে কমনওয়েলথ-এর সামিট কনফারেন্স ছাড়া অন্য কথাও যাবার শিডিউল তো নেই।
এই অবস্থায় আপনি একটা কাজ করতে পারেন। ঐ সামিট কনফারেন্সে আমাকে দলভুক্ত সদস্য হিসেবে যোগদানের নির্দেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়কে বলবেন পাঠিয়ে দিতে। এর আগেই জিমের নিমন্ত্রণ পত্রটা আমার কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে। আমি সেটা জিমের কাছে পাঠিয়ে দিয়ে তাকে যথাসময়ে হারারেতে চলে আসতে বলবো। তারপর কনফারেন্স কালে কোনও এক ফাঁকে তার সাথে আপনার গোপন সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে নেবো।
কথার ফাঁকে চায়ের সাথে পরিবেশন করা হলো দেশীয় পিঠা। প্রধানমন্ত্রীর অনুরোধে খেলাম খানিকটা।
ঠিক আছে, আপনার পরামর্শ অনুযায়ী সব করবো আমি। এবার অন্য দুটো প্রসঙ্গে আপনার মতামত কি সেটা জানতে চাইবো। বলুন।
সরকার গঠনের পরমুহূর্ত থেকেই প্রেসিডেন্সিয়াল সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করে ওয়েস্টমিনস্টার এর আদলে সংসদীয় গণতন্ত্র কায়েমের দাবি তুলেছে আওয়ামীলীগ ও এরশাদের জাতীয় পার্টি। অন্যদিকে জামায়াতের তরফ থেকে আগামীতে ‘কেয়ার টেকার সরকারে’ এর অধীন নির্বাচনের একটা দাবি তোলা হবে। এই দুইটি ইস্যুতে তারা যুগপৎ আন্দোলনে যাবে সংসদ এবং সংসদের বাইরে শুনতে পাচ্ছি। এই দুইটি ইস্যু সম্পর্কে আপনার মতামত কি?
এই বিষয়ে বিশদভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করবেন এবং সিদ্ধান্তও নেবেন আপনারা। তবে আমার ব্যক্তিগত মত হচ্ছে দুটোই সুদূর প্রসারী রাজনৈতিক কূটচাল যাতে বাংলাদেশে কখনোই কোনও স্থিতিশীল সরকার কায়েম না থাকতে পারে। এর বিস্তারিত যুক্তিভিত্তিক তর্ক অবশ্যই হতে পারে। আমি সে ধরনের কোনও বিশদ আলোচনায় না গিয়ে শুধু বলবো ‘প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্ম অফ গভর্নমেন্ট’ দেশে প্রথম জারি করেছিলেন কালুর ঘাট থেকে মেজর জিয়া পরে শেখ মুজিবর রহমানের মতো একজন ব্যক্তি যার কথাই ছিল আইন। তারপরও তিনি এই পদ্ধতির সরকার প্রবর্তন করতে বাধ্য হয়েছিলেন কেনও? আর রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা হাতে নিয়ে প্রয়াত শহীদ প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া এবং পতিত প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ সেই পদ্ধতিটি বলবৎরেখেছিলেন কেনও?
এই দুইটি ইস্যুতে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেবার আগে এই প্রশ্ন দুটোর কারণ বিশ্লেষণ করে দেখা বিশেষভাবে প্রাসঙ্গিক বলেই মনে করি। অবশ্যই এর পেছনে এই তিনজনেরই যুক্তি ছিল। সেটাই খতিয়ে দেখতে হবে। নির্দলীয় ‘কেয়ার টেকার গভর্নমেন্ট’ এর অধীনে নির্বাচনের নজির বিশ্বের কোনও দেশেই পাওয়া যায় না। আমার ধারণা পৃথিবীতে নির্দলীয় দুই ধরনের মানুষই পাওয়া যায়, পাগল আর মৃত ব্যক্তি। সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মতো একটা অনুন্নত দেশ যার দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি জনগোষ্ঠী দারিদ্রসীমার নিচে মানবেতর জীবন কাটায়, যে দেশে আজঅব্দি যতগুলো সরকার আসলো গেলো তারা মানুষের বাঁচার ন্যূনতম প্রয়োজন মেটাতে ব্যর্থ হয়েছে, সেখানে এইসব এক্সপেরিমেন্টকে প্রাধান্য দেয়ার বিলাসিতা যুক্তিসঙ্গত নয়।
১৮ টি সিটের অধিকারী জামায়াতের দাবির চেয়ে জনগণের দাবিগুলোকেই আপনার প্রাধান্য দেয়া উচিৎ। তাছাড়া এই দুইটি দাবির কোনোটাই আপনার নির্বাচনী ইশতেহারে ছিল না বিধায় জনগণের কাছে এর কোনও দায়বদ্ধতাও আপনার নেই। সেই ক্ষেত্রে এই দায়ভার আপনি কিংবা আপনার সরকার নেবে কেন? এটাই আপনাকে পরিষ্কার করে জনগণকে বোঝাতে হবে। অনেকেই বলছেন, আমি রাষ্ট্রপতির নির্বাচনে হাসিনাকে পরাস্ত করতে পারবো না।
অনুমানটার সাথে একমত হতে পারলাম না। সাংগঠনিকভাবে আপনার দল আওয়ামীলীগের চেয়ে দুর্বল, তারপরও আপনি নির্বাচনে জিতেছেন। সেটা কি আপনার দলীয় শক্তির বলে? মোটেও না। শহীদ জিয়ার স্ত্রী হিসেবে দেশবাসী আপনাকে একজন ধর্মপ্রাণ, স্বৈরাচার বিরোধী এবং ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী আপোষহীন নেত্রী হিসাবেই নির্বাচনে জয়ী করেছে। আপনার দলীয় প্রার্থীদের যোগ্যতার বাছ-বিচার তেমন একটা করেনি সাধারণ ভোটাররা। তারা ভোট দিয়েছে ধানের শীষে। এই বাস্তবতার আলোকে যারা আপনাকে বলার চেষ্টা করছেন যে ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার প্রতিযোগিতায় আপনি হাসিনার কাছে ভোটে হেরে যাবেন, তাদের এ বক্তব্য যুক্তির ধোপে টেকে না।
সেক্ষেত্রে দুঃখজনক হলেও বলতেই হবে, তাদের এমন বক্তব্যের উদ্দেশ্য হল আপনার নিজস্ব শক্তিকে খর্ব করা। নির্বাচনের সরকারি ফলাফল বের হওয়ার সাথে সাথেই হাসিনা সংবাদ সম্মেলন করে পরিষ্কার ভাষায় দোষারোপ করেছেন যে নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। তিনি একই সাথে দম্ভোক্তি করেছেন, এক মুহূর্তের জন্যও বর্তমান সরকারকে শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। সেক্ষেত্রে তাদের ফাঁদে পা দিয়ে নিজেকে দুর্বল করে তোলার জন্য আপনিই যদি রাস্তা করে দেন সমঝোতার মাধ্যমে সেটা ভিন্ন কথা। তাছাড়া আপনার আশেপাশের অনেকেই আপনার প্রতি আন্তরিকভাবে অনুগত নয়, তারা সুযোগ সন্ধানী বাস্তুঘুঘু। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের প্রতিই তাদের সব আনুগত্য। ভুলে যাবেন না, অনেক কারণের মধ্যে প্রকৃত মিত্র আর শত্রু চেনার ক্ষেত্রে ব্যর্থতা ছিলো জেনারেল জিয়ার মর্মান্তিক অপমৃত্যুর একটা প্রধান কারণ।
স্তব্ধ নিথর হয়ে বেগম জিয়া শুনছিলেন আমার কথাগুলো। কথা শেষে উঠবো ভাবছি, ঠিক তখনই তিনি বলে উঠলেন
ভাই, আমি আপনাকে আবারও অনুরোধ করছি, আপনি সিনিয়র মন্ত্রী হিসাবে আমার পাশে এসে দাড়ান। ভাবী, আপনার আন্তরিকতার প্রতি শ্রদ্ধা রেখে আবারও বিব্রত হয়েই বলতে হচ্ছে, আমার কিংবা আমাদের কারও পক্ষেই বিএনপিতে যোগ দিয়ে রাজনীতি করা এখন আর বাস্তবসম্মত নয়। তার চেয়ে আপনি নিজের তরফ থেকেই নির্বাচনের আগে বলেছিলেন, নির্বাচনে জয়ী হয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হতে পারলে আপনি এতদিন আমাদের প্রতি যে অন্যায়-অবিচার করা হয়েছে তার প্রতিবিধান করে আমাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সমাজে পুনর্বাসিত করবেন। সেটাই করুন, তাতেই উভয় পক্ষের মঙ্গল হবে।
বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম বাসায়। আজকের কথোপকথনের মাধ্যমে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো,সংবাদ সম্মেলনে হাসিনার দাম্ভিক বক্তব্য নিছক হুমকি ছিল না। খালেদা সরকারকে অস্থিতিশীল করার জন্য ইতিমধ্যেই ষড়যন্ত্র শুরু হয়ে গেছে RAW এবং ভারতীয় চাণক্যপুরির যোগসাজশে। ভারত কখনোই চাইবে না বাংলাদেশ তাদের প্রভাব বলয় থেকে বেরিয়ে এসে স্বাধীন একটা পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করুক। ভারত বেষ্টিত বাংলাদেশকে নিজস্ব সত্তা বজায় রেখে সমৃদ্ধির পথে এগুতে হলে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি অবশ্যই হতে হবে চীনকেন্দ্রীক। একই সাথে আমেরিকাসহ ইউরোপীয় শক্তিসমূহ এবং মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর সাথে গড়ে তুলতে হবে যতটুকু সম্ভব সমতাভিত্তিক সম্পর্ক। তবে বিশেষভাবে খেয়াল রাখতে হবে, বাংলাদেশের অন্য যেকোনো দেশের সাথে গড়া সম্পর্ক যাতে বাংলাদেশ-চীন সম্পর্কে কোনও প্রকার টানাপড়েন সৃষ্টি না করে। এ ছাড়া ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অস্তিত্ব টিকিয়ে রেখে স্বনির্ভরতা অর্জন এবং অগ্রগতি কোনোটাই সম্ভব হবে না। উজ্জ্বল সম্ভাবনার দেশটি বিলীন হয়ে যাবে হতাশার অন্ধকারে ব্যর্থরাষ্ট্র হিসাবে। তাই প্রথম থেকেই বিশেষ সতর্কতার সাথে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলতে হবে। কারণ, মজবুত ভিত্তি তৈরি হওয়ার আগেই ঘুণাক্ষরে টের পেলে ভারতের মতো একটি শক্তি অতি সহজেই সক্ষম হবে সেই প্রচেষ্টাকে অংকুরেই বিনাশ করে দিতে।
নাইরোবিতে প্রত্যাবর্তন
ফিরে এলাম নাইরোবিতে। ফিরেই গঙ্গাভাই এবং জিমকে জানালাম সবকিছু বিস্তারিতভাবে। সাথে এটাও জানিয়ে দিলাম প্রথম পরিচয়টা হবে হারারেতে। যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলাম কেনও এই সাক্ষাত ঢাকায় না হয়ে হবে হারারেতে। এরপর শঙ্কা এবং খানিকটা অস্বস্তি নিয়ে সময় গড়িয়ে যাচ্ছিল। এরই মধ্যে একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আমাকে ফোন করে অভিযোগ জানালেন আপনি ঢাকা ঘুরে গেলেন আমার সাথে সালাম দোয়া না করেই!
তার এমন খোঁচায় কিছুটা চমকে উঠলাম! বেগম জিয়া কি তবে জনাব মুস্তাফিজুর রহমানকে বিশ্বাস করে সবকিছুই বলে দিয়েছেন!
যদি তেমনটি করে থাকেন তবে সব পরিকল্পনার কথা ইতিমধ্যে সাউথ ব্লকে পৌঁছে গিয়ে থাকবে। ফলে আমাদের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যাবে। শুধু তাই নয়, এই সুবর্ণ সুযোগ হারালে অপূরণীয় ক্ষতি হবে দেশ ও জাতির। ব্যক্তিগতভাবে প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কি ক্ষতি হবে সেটা মুখ্য বিষয় নয়। পররাষ্ট্রমন্ত্রীর ফোনের পর উল্টো বাতাস বইতে শুরু করল।
দেখলাম, মওদুদের মতো বাস্তুঘুঘুরা, যারা শহীদ জিয়ার রক্ত মাড়িয়ে জেনারেল এরশাদের ছত্রছায়ায় গিয়ে ভিড়েছিল তারা আবার অক্লেশে খালেদার আঁচলের নিচে তাদের অবস্থান পাকাপোক্ত করে নিতে পারল অদৃশ্য শক্তির ইশারায় এবং বদরুদ্দোজা চৌধুরী, কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমানদের মতো ক্ষমতাশালী পার্টি নেতাদের আশীর্বাদ পুষ্ট হয়ে।
ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্-এর মধ্যস্থতায় দেশদ্রোহিতার অভিযোগে জেনারেল জিয়ার আমলে মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কাদের সিদ্দিকি এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গ সন্ত্রাসীদেরকেও ভারত থেকে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা হল। শুধু কি তাই? কাদের সিদ্দিকিকে একটি দৈনিক প্রকাশনার লাইসেন্স এবং একটি অত্যাধুনিক প্রেস স্থাপনের জন্য মোটা অংকের অনুদানের বন্দোবস্ত ব্যাংক থেকে করে দেয়া হলো সরকারের তরফ থেকে। অন্যদিকে জনাব গোলাম আজমকে জামায়াতের আমীর বানিয়ে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেবার জন্য জোটের শরিক দল জামায়াত খালেদা জিয়ার উপর ক্রমান্বয়ে চাপ বাড়িয়ে চলল। খালেদা জিয়া জামায়াতকে বোঝাবার চেষ্টা করেন, সরকারি হুকুমে তার নাগরিকত্ব ফিরিয়ে না দিয়ে কাজটি আদালতের মাধ্যমে করাটাই হবে শ্রেয়। তার এ ধরনের অভিমত জামায়াতের কাছে গ্রহণযোগ্য হলো না। জামায়াত নেতৃত্ব মনে করলো খালেদা জিয়া নির্বাচনী বৈতরণী পার হবার পর তার ওয়াদার বরখেলাপ করছেন। শুরু হলো বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে টানাপড়েন। এই সুযোগ গ্রহণ করে বিএনপি ও জামায়াতের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দিতে চাণক্যপুরির কর্ণধারদের এবং হাসিনার ইশারা এবং সমর্থনে হঠাৎ করেই বেগম জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে গজিয়ে উঠল ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি।’ যুগ্ম আহবায়ক হিসাবে তাতে যোগদান করলেন মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার কর্নেল কাজি নুরুজ্জামান বীরউত্তম। তাদের দুই জনই ছিলেন শিখণ্ডি মাত্র। এর পেছনে মুখ্য খেলোয়াড়রা ছিলেন শাহরিয়ার কবির, সি আর দত্ত (হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান পরিষদের কর্ণধার), কর্নেল ওসমান, কর্নেল শওকত আলী, মুনতাসীর মামুন, হাসান ইমাম, লেখক শওকত ওসমান, শামসুর রাহমান, নীলিমা ইব্রাহিম, কামাল লোহানী, নাসিরুদ্দিন বাচ্চু, এমআর আখতার মুকুল, সুফিয়া কামাল, এবিএম মুসা, আসাদ্দুজ্জামান নূর, কবির চৌধুরী, ইকবাল সোবহান চৌধুরী, গফফার চৌধুরী, তুহিন আফরোজ, নির্মলেন্দু গুণ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম প্রমুখ। তারা প্রকাশ্যে গণআদালত গঠন করে জনাব গোলাম আজমের বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসির রায়ে দণ্ডিত করে তার কুশপুত্তলিকার ফাঁসির নাটক মঞ্চস্থ করে। এই ঘটনার পর আস্থার এবং বিশ্বাসের অভাবে বিএনপি-জামায়াত আঁতাত ভেঙ্গে যায়। সময় বুঝে টোপ ফেলে আওয়ামীলীগ আর সেই টোপ গলাধঃকরণ করে জামায়াত চরম সুবিধাবাদিতার প্রমাণ দেয়। হাসিনাসহ আওয়ামীলীগের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে কয়েকটি গোপন বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, জামায়াত ‘নির্দলীয় তত্বাবধায়ক সরকারের অধীন নির্বাচন’ এবং আওয়ামী লীগ ‘সংসদীয় গণতান্ত্রিক সরকার’ পুনঃপ্রতিষ্ঠার ইস্যু নিয়ে খালেদা জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে সংসদে এবং সংসদের বাইরে ঐক্যবদ্ধ আন্দোলন গড়ে তুলবে সরকার পতনের লক্ষে। সাথে থাকবে জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টি।
এই সমঝোতা পচনশীল সমাজের নীতি-আদর্শ বিবর্জিত অপরাজনীতির এক কদর্য হিঃপ্রকাশ। এই আঁতাতের পর হঠাৎ করেই ভাঁটা পড়ে ‘ঘা দা নির্মূল কমিটি’-এর কর্মতৎপরতায়। দেরিতে হলেও জাহানারা ইমাম এবং কর্নেল নুরুজ্জামান বুঝতে পারেন রাজনৈতিক ফায়দার জন্য আওয়ামী লীগ তাদের ব্যবহার করেছে মাত্র।এই মনোকষ্ট নিয়ে ক্যন্সার আক্রান্ত জাহানারা ইমাম যুক্তরাষ্ট্রে স্বেচ্ছা নির্বাসনে ছেলের কাছে পাড়ি জমান এবং সেখানে ক্যান্সার অপারেশনের পর মারা যান। কর্নেল নুরুজ্জামান নিজের ভুল বুঝে চিরতরে সক্রিয় রাজনীতি থেকে অব্যহতি গ্রহণ করেন। এরপরের ঘটনা আরও হতাশাব্যঞ্জক। ভারতপন্থীদের সমর্থনে বলীয়ান হয়ে কর্নেল মুস্তাফিজুর রহমান খালেদা জিয়াকে হুঁশিয়ার করে দিয়ে বোঝালেন যে সেনা পরিষদের নেতাদের বিশেষ করে আমার সাথে তার ঘনিষ্ঠতা নাকি তার জন্য কাল হয়ে দাড়াবে। এক সময় আমি নাকি তাকে ব্ল্যাকমেইল করে ১৫ আগস্টের স্বীকৃতি আদায় করে নেবো এবং আগস্ট বিপ্লবের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের সাথে জেনারেল জিয়া প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন সেটাও বিশ্বপরিসরে প্রমাণ করিয়ে ছাড়বো! ফলে প্রতিবেশী ভারতের রোষানলে পড়ে তার সরকারের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকাই অসম্ভব হয়ে দাড়াবে!
কিছু সমমনা আমলা, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক ও পার্টিনেতা একই সুরে ঐক্যতান তুলে খালেদাকে নসিহত করেছিলেন প্রয়াত শহীদ জিয়ার ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর-এর ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সাথে কোনও প্রকার সম্পৃক্ততা ছিল না সেটা প্রকাশ্যে স্বীকার করে নিয়েই রাজনীতি শুরু করেছিলেন। এরপর থেকে তারই নির্দেশে বিএনপির পার্টি পজিশন হচ্ছে, জেনারেল জিয়া ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন সেনাবাহিনী এবং দেশবাসীর মধ্যে তার জনপ্রিয়তার কারণেই। এই ভিত্তিতে মুজিবের পতনের কোনও দায়দায়িত্ব না নিয়েই তিনি ১৯ দফার রাজনীতিকে এগিয়ে নিয়ে একজন জনপ্রিয় নেতা হিসেবে নিজের ভাবমূর্তি গড়ে তুলতে সক্ষম হয়েছিলেন। ঠিক একই ভাবে তিনি প্রতিবেশী বিশাল দেশ ভারতের সাথেও সমঝোতা করতে সমর্থ হয়েছিলেন তাদের স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়ে যে, ‘মুজিব হত্যার’ সাথে তার কোনও সম্পৃক্ততা কখনোই ছিল না। আর সেটার প্রমাণ স্বরূপ তিনি শেখ হাসিনাকে ভারতের নির্বাসিত জীবন থেকে দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতিতে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার মাধ্যমে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করে সহ-অবস্থানের রাজনীতি করার অঙ্গীকার করেছিলেন। সেই ক্ষেত্রে আমাদের সাথে খালেদা জিয়ার যেকোনো সম্পর্ক তার প্রয়াত স্বামীর প্রণীত রাজনীতিকেই বিপন্ন করে তুলবে। শুধু তাই নয়, এখন যদি খালেদা জিয়া তার স্বামীর রাজনৈতিক সমীকরণ এবং পররাষ্ট্র নীতিতে কোনও পরিবর্তন আনতে চান তাহলে তার সরকারই অচল হয়ে পড়বে এবং তার নিজের জীবনও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে ভারতের রোষের কারণে। অতএব সর্ব বিবেচনায় এখন থেকে সেনা পরিষদ, আগস্ট বিপ্লবী কিংবা বিপ্লবের নেতাদের সাথে কোনোরূপ যোগাযোগ রাখা যুক্তিসঙ্গত হবে না। ভারতের পোষা এই দালালগোষ্ঠী কিন্তু তাদের উপস্থাপনার সময় অতি প্রাসঙ্গিক প্রণিধানযোগ্য বিষয়গুলো কৌশলে এড়িয়ে গেলেন! ভারতের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে হাসিনাকে সসম্মানে দেশে ফিরিয়ে আনার মাত্র ১৩/১৪ দিনের মাথায় এক ষড়যন্ত্রে জেনারেল জিয়াকে অপমৃত্যুর সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। এটাও জ্ঞানপাপীরা বললেন না যে, ভারতের চিরলালিত স্বপ্ন হলো নিজেকে বিশ্বের একটি পরাশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করা। আর এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত হচ্ছে এই উপমহাদেশে তার একছত্র আধিপত্য কায়েম করা।
ভারতীয় পররাষ্ট্রনীতির দর্শন ‘নেহেরু ডকট্রিন’ অনুযায়ী ‘অখণ্ড ভারত’ পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যেই প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে সাউথ ব্লকের কুশিলবরা এবং ক্ষমতাসীন প্রতিটি সরকার ভারত বিভক্তির পর থেকেই। ব্রিটিশদের সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ যতদিন টিকে থাকবে ততদিন ভারতের শাসকগোষ্ঠী তাদের এই স্বপ্ন বাস্তবায়নের প্রয়াস থেকে এক চুলও নড়বে না প্রতিবেশী দেশগুলো যতই ছাড় দিক না কেনও। কাশ্মীর, হায়দ্রাবাদ, গোয়া, দমন, দিউ এবং সিকিমকে অস্ত্রবলে গিলে তাদের অঙ্গরাজ্যে পরিণত করা এবং স্বাধীনতাকামী রাজ্যগুলোকে কেন্দ্রীয় শাসনের অধীনস্থ করে আজঅব্দি অস্ত্রবলে দাবিয়ে রাখার প্রক্রিয়া এই বাস্তবতাকেই প্রমাণিত করে।
সুতরাং যুক্তিসঙ্গতভাবেই বলা চলে, যতদিন না কৃত্রিমভাবে বিদেশী আগ্রাসী ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর স্বার্থে এই উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর কাছ থেকে অস্ত্রের জোরে তাদের স্বাধীনতা এবং আবাসভূমি ছিনিয়ে নিয়ে সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’-এর বিলুপ্তি না ঘটবে ততদিন এই অঞ্চলে স্থায়ী স্থিতিশীলতা কখনোই কায়েম হবে না। যার ফলে, বিশ্বের এক-তৃতীয়াংশ জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নয়নও কখনোই সম্ভব হবে না। যেহেতু স্থিতিশীলতা আর্থ-সামাজিক উন্নতির একটি আবশ্যকীয় পূর্বশর্ত।
ঐতিহাসিকভাবে ভারত কখনোই একটি দেশ ছিল না যার প্রমাণ ব্রিটিশদের প্রত্যাবর্তনের পর থেকেই স্বাধীন হিন্দুস্তানের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের হারানো স্বাধীনতা এবং রাষ্ট্র নরুদ্ধারের জন্য সশস্ত্র সংগ্রামে আজঅব্দি লিপ্ত রয়েছে। এ সমস্ত সংগ্রাম ক্রমশ তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। ছড়িয়ে পড়ছে বিভিন্ন অঞ্চলে কেন্দ্র কর্তৃক কঠোর সামরিক শাসন, অভিযান এবং নির্মম পাশবিক অত্যাচার, জুলুম ও নিষ্পেষণের মুখেও। কোনও জাতির স্বাধীনতার জন্য রক্তের আহূতি বৃথা যায় না। স্বাধীনতার সংগ্রাম প্রলম্বিত হতে পারে, সাময়িকভাবে পশুশক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে দাবিয়ে রাখা যায়, মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করা যায়, কিন্তু স্বাধীনতার চেতনাকে পরাজিত করা কখনোই সম্ভব হয় না।
অধুনাকালে ভিয়েতনাম এবং বাংলাদেশ তার জলজ্যান্ত দৃষ্টান্ত। মানুষ স্বাধীনভাবেই জন্ম নেয়, তাই স্বাধীনভাবে বাঁচা প্রতিটি মানুষের জন্মগত অধিকার। এই প্রাকৃতিক বিধানকে বর্তমান উদীয়মান পরাশক্তি গণচীন মেনে চলেছে এবং অন্যান্য শক্তিগুলোকেও মেনে নিতে হবে তাদেরই স্বার্থে বিশ্বশান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্যই। বিধাতার এই নিয়মটিকে মেনে না নিলে বিশ্বের বর্তমান সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যাবে অচিরেই অতীতের অনেক সভ্যতার মতোই।
বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক অপরিপক্বতা, অদূরদর্শী ক্ষমতাকেন্দ্রিক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে জিমের আমন্ত্রণপত্র এবং আমার হারারে যাবার নির্দেশ এলো না। পরিণামে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং উজ্জ্বল ভবিষ্যৎকে বিকশিত করার জন্য ভারতের চাপের মুখে ভারসাম্যতা বজায় রাখার প্রয়োজনে অত্যাবশ্যকীয় স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি প্রণয়ন করার একটি সুবর্ণ সুযোগ হারিয়ে গেলো।
দুর্ভাগা দেশ ও জাতির অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ভেবে অত্যন্ত কষ্ট পেয়েছিলাম। জিমকে ফোন করে সবকিছু বিস্তারিত জানিয়ে বলেছিলাম জিম, আমাদের সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়ে গেলো! জবাবে জিম বলেছিলো ভালোই তো হয়েছে, শুরুতেই আমরা খালেদা জিয়ার যোগ্যতা এবং চরিত্রটা বুঝে নিতে পারলাম। দুঃখ পাচ্ছ কেনও? খালেদা কিংবা হাসিনা তো অবিনশ্বর নয়, তারাও একদিন দৃশ্যপট থেকে অদৃশ্য হয়ে যাবে, কিন্তু থেকে যাবে বাংলাদেশ।
তবে একটি কথা তোমার জ্ঞাতার্থে বলছি, নেতা-নেত্রীদের চারিত্রিক গুণাবলী, দূরদর্শিতা এবং বিচক্ষণতা যেকোনো দেশ ও জাতির অগ্রবর্তী কিংবা পশ্চাদপদতার জন্য মূলত দায়ী হয়ে থাকে।
কিছুদিন পর জানতে পারলাম, মিলিয়ন ডলার খরচ করে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াশিংটনে বসবাসকারী তার ভাগ্নের মাধ্যমে আমেরিকাতে RAW-এর বিশিষ্ট এজেন্ট ‘কাঞ্জু’ নামে পরিচিত এক ধনাঢ্য ব্যাবসায়ীর সহযোগিতায় খালেদা জিয়ার জন্য আমেরিকান প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে আয়োজিত বাৎসরিক ‘ব্রেকফাস্ট প্রেয়ার’ অনুষ্ঠানে যোগদানের নিমন্ত্রণ জোগাড় করেছিলেন।
প্রতিবছর এই অনুষ্ঠানে যোগদানের জন্য বিশ্বের প্রায় শ’খানেক রাষ্ট্রপ্রধান কিংবা সরকার প্রধান এবং বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ থেকে বাছাই করে নিমন্ত্রণ করা হয়। প্রেয়ার শেষে প্রাতঃরাশের পর প্রত্যেকের সাথে প্রেসিডেন্টের একটা সৌজন্যমূলক ফটো সেশনের শেষে অভ্যাগতদের বিদায় জানানো হয়। প্রথা অনুযায়ী এই মিলনমেলায় ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য শক্তিধর ব্যক্তিরা উপস্থিত থাকেন না। এই সফরকালে বেগম খালেদা জিয়াকে এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানায় স্টেট ডিপার্টমেন্টের একজন ডেপুটি এসিস্ট্যান্ট আন্ডার সেক্রেটারি। মোটা অংক খরচ করে ওয়াশিংটন পোস্টে তার সফর সংক্রান্ত কয়েক লাইনের একটা খবর ছাপানোর ব্যবস্থা করেছিল বাংলাদেশের দূতাবাস।
দেশে ফেরার আগে খালেদা জিয়া তার হোটেলে এক প্রাতঃরাশে নিমন্ত্রণ করেছিলেন বন্ধুদের। তার সেই নিমন্ত্রণে সাড়া দেননি কেউই। মনোকষ্ট আর হতাশাগ্রস্ত হয়ে ফিরে আসতে হয়েছিল খালেদা জিয়াকে। খবরটা জিমই আমাকে ফোন করে জানিয়েছিলো। নিয়তির পরিহাস!
চক্রান্তকারী ভারতীয় দালালদের প্রভাবে বিরল সুযোগ পেয়েও তার সদ্ব্যবহার করতে পারলেন না বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধারক-বাহকের দাবিদার দেশনেত্রী প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া! এরপর আমি আমার গতানুগতিক রাষ্ট্রদূতের দায়িত্বই পালন করে চলেছিলাম। ডিপ্লোম্যাটিক কোরের ডিন হিসেবে অনান্য রাষ্ট্রদূতদের তুলনায় আমাকে ব্যতিক্রমী বিভিন্ন দায়িত্ব পালনে কিছুটা বেশি ব্যস্ত থাকতে হয়। একই সাথেপর্যবেক্ষণ করছিলাম জাতীয় শত্রুদের সাথে আপোষের রাজনীতির তামাশা।
সমঝোতা মোতাবেক পরিকল্পিতভাবে আওয়ামীলীগ, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির ঐক্যবদ্ধ খালেদা সরকার বিরোধী আন্দোলনে প্রতিদিন নতুন মাত্রা যোগ হতে থাকে। একই সাথে ‘হাওয়া ভবন’ কেন্দ্রিক তারেক জিয়ার দাম্ভিক আচরণ, দুর্নীতি ও সরকারি এবং দলীয় সিদ্ধান্তে ‘হাওয়া ভবনের’ অযাচিত হস্তক্ষেপ, অভ্যন্তরীণ কোন্দল খালেদা জিয়াকে কোণঠাসা অবস্থায় অসহায় করে তোলে।
এই অবস্থায় পরিবারতন্ত্র কায়েমের লক্ষ্যে আচমকা তারেক জিয়াকে দলের অনেক সিনিয়র নেতাদের মাথা ডিঙ্গিয়ে পার্টির সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দলের অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জ্বলন্ত লাভায় ঘি ঢাললেন খালেদা জিয়া। শুরু হলো মনকষাকষি এবং দলীয় কার্যক্রমের প্রতি ত্যাগী নেতাদের অনীহা। এর প্রভাব পড়লো কর্মীদের মধ্যেও।
নিবেদিতপ্রাণ কর্মীদের যথাযথ মূল্যায়ন না হওয়ায় তারাও নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ল। অন্যদিকে ‘হাওয়া ভবন’থেকে তারেক জিয়া কর্তৃক সরকারি এবং পার্টি সিদ্ধান্তে কলকাঠি নাড়ার ফলে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে সৃষ্টি হয় অরাজকতা। এই অসহায় অবস্থায় মিত্রহীন খালেদা উপায়হীন হয়ে রাষ্ট্রপতি শাসন ব্যবস্থার জায়গায় সাংবিধানিক পরিবর্তন এনে সংসদীয় শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তন করে আওয়ামীলীগের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হন। কিন্তু কেয়ার টেকার গভর্নমেন্ট-এর অধীনে নির্বাচনের দাবিটি মানতে রাজি না হওয়ায় তার সরকারের বিরুদ্ধে যুগপৎ আন্দোলন আরও দুর্বার করে তোলে আওয়ামী-জামায়াত জোট। সেই বেসামাল অবস্থায় ঘরের শত্রুরাও বিভীষণ হয়ে ওঠে। বিশেষ করে তার সুপুত্র তারেক জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গ এবং ‘হাওয়া ভবনের’ চামচারা, কোকো, সাঈদ ইস্কান্দার, চকলেট আপা শহীদ জিয়ার গর্ব ‘ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জির’ কাহিনীকে বিসর্জন দিয়ে জড়িত হয়ে পড়ে অবাধ দুর্নীতিতে। দুর্নীতির মাধ্যমে জিয়া পরিবার রাতারাতি কোটিপতি হয়ে ওঠে, খালেদা জিয়া উটপাখির মতো বালির ঢিবিতে মাথা গুঁজে সব দেখেও না দেখার ভান করে মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ থাকেন।
বয়স বেড়ে চলেছে, কিন্তু সেই অনুপাতে শিফন শাড়ির বাহার, দামি অলংকার আর পরচুলার চাকচিক্য কমার পরিবর্তে বরং মাত্রাহীন ভাবে বেড়ে চলেছে। নির্বাচনী ওয়াদা পূরণের ব্যর্থতায় জনসমর্থনও দ্রুত কমতে থাকে। সময়ের সাথে যতই খালেদা সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছিল ততোই আওয়ামী জোট তাদের চাপ বৃদ্ধি করতে থাকে সংসদে এবং রাজপথে।
এমতাবস্থায় সরকারের মেয়াদ শেষে তিনি বিগত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের মতোই নির্বাচনের ঘোষণা দেন দলীয় সরকারের অধীনে। সেই নির্বাচন বর্জন করে আওয়ামী জোট, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টি।ফলে নির্বাচন এক প্রহসনে পরিণত হয়। এই ধরনের অপরিপক্ব হঠকারী পদক্ষেপের পর খালেদা জিয়ার অবস্থা আরও সঙ্গীন হয়ে পড়ে। শেষরক্ষার জন্য নিরুপায় খালেদা জিয়ার সরকার জাময়াতের ‘কেয়ার টেকার’ সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিটি মেনে নিয়ে এর জন্য প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংশোধনী সংসদে পাশ করিয়ে তার দলের মনোনীত রাষ্ট্রপতি জনাব আব্দুর রহমান বিশ্বাসের হাতে ক্ষমতা দিয়ে সংসদ বিলুপ্ত করে দেন। রাষ্ট্রপতি একটি ‘কেয়ার টেকার’ সরকার মনোনীত করেন। তাতে খুশি হতে পারেনি আওয়ামী জোট এবং তাদের দোসররা। সেই জন্য হাসিনা ও তার প্রভু ভারতের ইঙ্গিতে তৎকালীন সাঈদ ইস্কান্দারের পরামর্শে খালেদা জিয়ার নিয়োজিত সেনাপ্রধান জেনারেল নাসিমের মাধ্যমে প্রেসিডেন্টেকে উৎখাতের জন্য একটা সামরিক ক্যু’দাতা ঘটানোর চেষ্টা চালানো হয়। নড়বড়ে সরকারের রাষ্ট্রপতির বিরুদ্ধে জেনারেল নাসিমের ক্যু সফল হবে সেটা অবধারিত মনে করে হাসিনা প্রকাশ্যে জেনারেল নাসিমের ক্যু’দেতাকে সমর্থন জানান যেমনটি জানিয়েছিলেন বেআইনী ভাবে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ যখন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বন্দুকের জোরে পদত্যাগে বাধ্য করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কব্জা করে নেন। জনাব বিশ্বাসের বিরুদ্ধে সামরিক অভ্যুত্থানের পেছনে মুল ক্রিয়ানক ছিল ভারত সমর্থিত জেনারেল নাসিম আর্মি চিফ, জেনারেল হেলাল মোরশেদ, ব্রিগেডিয়ার মিরণ এবং জেনারেল ইব্রাহিম বীর প্রতিক।
কিন্তু কয়েকজন সাচ্চা জাতীয়তাবাদী কমান্ডারদের প্রতিরোধের মুখে নাসিমের অপচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়। কমান্ডারদের মধ্যে জেনারেল ইমামুজ্জামান, জেনারেল ভুঁইয়া, জেনারেল মাহবুব এবং জেনারেল মতিনের নাম বিশেষ ভাবে উল্লেখযোগ্য। এরপর রাষ্ট্রপতির পরিবর্তে একজন নির্দলীয় ব্যক্তির নেতৃত্বে একটি তথাকথিত ‘কেয়ার টেকার’ সরকার গঠিত হয় আওয়ামী জোট, তাদের দোসর জামায়াত, জাতীয় পার্টি এবং বিএনপির গ্রহণযোগ্যতার পরিপ্রেক্ষিতে।
অনুষ্ঠিত হয় ১৯৯৬ সালের নির্বাচন। এই নির্বাচনে কোনও দলের পক্ষেই একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করা সম্ভব হয়নি। খালেদা জিয়া শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে সরকার গঠন করার জন্য সব নীতি-আদর্শ জলাঞ্জলি দিয়ে তার স্বামী শহীদ জিয়াউর রহমানের করুণ মৃত্যুর পেছনে ধূর্ত চক্রান্তকারী স্বৈরশাসক এবং ভারতের পোষ্যপুত্র জেনারেল এরশাদের সমর্থন আদায় করার জন্য তাকে প্রধান মন্ত্রীর পদ দেবার অঙ্গীকার করে অনেক আকুতি মিনতি করেও ব্যর্থ হন। আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ হাসিনা পক্ষান্তরে খালেদার আদিখ্যেতা দেখে ক্রূর হাসি হেসে জামায়াত এবং এরশাদের সমর্থন নিয়ে সরকার গঠন করে নিজে প্রধানমন্ত্রীর পদে আসীন হন। এই নির্বাচনে খালেদা জিয়ার দল ১১৬ টি আসন লাভ করে সংসদে বিরোধীদলীয় নেত্রীর আসন অলংকৃত করে। জামায়াতের সিটের সংখ্যা ১৮ থেকে কমে এলেও আওয়ামী লীগের কৃপায় জনাব গোলাম আজমের নাগরিকত্ব লাভ করতে জামায়েত ইসলামী সমর্থ হয়। এরশাদ জেল থেকে মুক্তি পেতে সক্ষম হন। ব্যর্থ ক্যু’দাতার শিরোমণি জেনারেল নাসিম এবং তার দোসরদের কোর্টমার্শালে প্রাপ্ত সাজা মওকুফ করে দেয় শেখ হাসিনা সরকার। শুধু তাই নয়, তাদের চাকুরি থেকে বরখাস্তের কোর্টের রায় বাতিল করে তাদের সৌজন্যে অবসর প্রদানের আদশ জারি করা হয় যাতে পেনশনসহ অন্যান্য সব সুবিধাই তারা উপভোগ করতে পারেন।
ফিরে যাই ১৯৯৬- এর নির্বাচনের পূর্বে নাইরোবিতে থাকাকালিন অবস্থায় আমার চাকুরি জীবনে আর একবার যবনিকাপাত কি করে ঘটেছিলো সেই পর্বে। ১৯৯৩ সালে চাচা, খালাম্মাকে সাথে নিয়ে যুগলে ফরজ হজ্ব করে নাইরোবিতে ফেরার পর অপ্রত্যাশিতভাবে ঘটে এক দুর্ঘটনা! একদিন প্রত্যুষে ফজরের আযানের পর অজু করার জন্য বিছানা থেকে উঠতে গিয়ে নিম্মির স্লিপডিস্ক হওয়ায় ও চিৎকার করে মাটিতে পড়ে যায়। পড়ে যাবার পর নিম্মি একদম নড়াচড়া করতে পারছিলো না, শুধু যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছিলো। জরুরী ভিত্তিতে এ্যাম্বুলেন্স আনিয়ে তাকে নাইরোবি হাসপাতালে নিয়ে গেলাম। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর ডাক্তাররা জানালেন, লোয়ার লাম্বারে একটা ডিস্ক কলাপ্স করেছে বাজে ভাবে ডিজেনারেটেড অবস্থায়। হতবাক হয়ে গেলাম। নিম্মি বরাবর তার খাদ্যাভ্যাস এবং শরীরচর্চার বিষয় খুবই সচেতন!
প্রেসিডেন্ট জেনারেল আইয়ুব খানের আমলে সারা পাকিস্তান ব্যাপী কথক নাচে ও সর্বপ্রথম স্থান অধিকার করে গোল্ড মেডেল পেয়েছিলো কলেজে পড়ুয়া ছাত্রী অবস্থায়। সেই নিম্মিকেই হাসপাতালে বিশেষ চিকিৎসার অধীনে ঘাড়ে-কোমরে-পায়ে ট্র্যাকশন নিয়ে বিছানায় শয্যাশায়ী করে রাখা হয়েছিলো দীর্ঘ দেড় মাস। দেড় মাস পর নিম্মি লাঠির উপর ভর দিয়ে কিছুক্ষণের জন্য উঠে দাঁড়াতে সক্ষম হয় অতি কষ্টে। ঐ অবস্থাতেই তার ইচ্ছায় বাসায় নিয়ে আসলাম। চিকিৎসা চলতে থাকলো। বাসায় নিয়মিত আসছে ডাক্তার এবং ফিজিওথেরাপিস্ট। নিম্মির অসুস্থতার সংবাদ জানা মাত্রই নিকট আত্মীয়-স্বজন সবাই ছুটে এলো নাইরোবিতে।
স্বপন ও কেয়া দু’জনেরই ব্যাক প্রবলেম ছিলো। দু’জনই প্রায় পঙ্গু হয়ে যাচ্ছিলো। সেই সময় তাদের এক বন্ধুর পরামর্শে দুইজনই সিঙ্গাপুরের একজন বিখ্যাত অর্থপেডিক সার্জন ডঃ ফ্রেডি চু-এর কাছে যায়। তিনি তাদের পরিষ্কার বলেন স্পাইন এর অপারেশন-এ সাফল্যের সম্ভাবনা কম। তাই তিনি অপারেশনের পক্ষে নন। তবে তারা রাজি থাকলে তিনি চৈনিক ট্র্যাডিশনাল পন্থায় তাদের চিকিৎসাকরতে পারেন। তারা রাজি হওয়ায় তিনি চিকিৎসা করেন এবং দু’জনই ধীরে ধীরে সুস্থ হয়ে ওঠে। কেয়া ও স্বপনের জোরাজুরিতেই নিম্মিকে ডঃ ফ্রেডি চু-এর কাছে নিয়ে গেলাম। স্বপনই সব ব্যবস্থা করে দিল। নিম্মিকে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ডঃ ফ্রেডি চু বললেন, নিম্মির কেসটা কেয়া এবং স্বপনের চেয়ে জটিল বিধায় প্রতি তিনমাস অন্তর তাকে সিঙ্গাপুর আসতে হবে দুই সপ্তাহের জন্য। ওই দুই সপ্তাহের মধ্যে মেরুদণ্ডে ইনজেকশনের সাথে কিছু বিশেষ ফিজিওথেরাপিও গ্রহণ করতে হবে অভিজ্ঞ চৈনিক ফিজিওথেরাপিস্টের কাছ থেকে। এভাবেই চিকিৎসাচলবে এক বছর। এরপর অবস্থার উন্নতি দেখে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। শুরু হলো চিকিৎসা। সময়ের সাথে অভূতপূর্ব উন্নতি পরিলক্ষিত হলো আল্লাহ্র রহমতে। এক বছরের মধ্যেই নিম্মি অনেকখানি সুস্থ হয়ে উঠলো। সেই পরিপ্রেক্ষিতে ডঃ ফ্রেডি চু ঠিক করলেন দ্বিতীয় বছর তিন মাসের পরিবর্তে ছয় মাস অন্তর সিঙ্গাপুরে আসার। দ্বিতীয় বছরের শুরুতেই নিম্মি প্রায় স্বাভাবিক হয়ে উঠল, চার্ট মোতাবেক ব্যায়াম করছে, হাঁটছে নিয়মিতো, ফলো করছে ডায়েট চার্ট। কিন্তু হাতে ছড়িটা রাখতে হচ্ছে কোনও প্রকার দুর্ঘটনা থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য।
সেই সন্ধিক্ষণে নাইরোবিতে আমার টেনিওর প্রায় শেষ হয়ে আসছিলো। তাই পোস্টিং অর্ডার আসার আগেই আমি পররাষ্ট্রমন্ত্রী মহোদয়ের মাধ্যমে লিখিতভাবে প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে আবেদন জানালাম, মানবিক কারণে নিম্মির চিকিৎসার সুবিধার্থে আমাকে যাতে সিঙ্গাপুর কিংবা তার নিকটবর্তী কোনও দেশে পোস্টিং দেয়া হয়। সেই আবেদনের জবাবে পেলাম পোস্টিং অর্ডার সুদূর ব্রাজিলে রাষ্ট্রদূত হিসাবে। এই পোস্টিং অর্ডার পেয়ে কিছুটা হতবাক হয়ে প্রধানমন্ত্রীকে আর একটি চিঠি লিখে পাঠালাম। তাতে জানালাম, সুদুর ব্রাজিল থেকে সিঙ্গাপুরে নিম্মির চিকিৎসা চালিয়ে যাওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ এবং ব্যয়সাপেক্ষ। সার্বিক বিবেচনায় তিনি যাতে আমার পোস্টিং অর্ডারটা পুনর্বিবেচনা করেন। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে জবাব এলো। আমাকে জানানো হল, আদেশ অমান্য করার জন্য সরকার আমাকে চাকুরি থেকে অবসরে পাঠাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। আমার রিপ্লেসমেন্ট পাঠানো হচ্ছে, তার কাছে চার্জ বুঝিয়ে দিয়ে আমি যাতে সরকারি সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে অবসর গ্রহণ করি। জবাব পাওয়ার দুই-তিনদিনের মধ্যেই এসে উপস্থিত হলেন আমার স্থলাভিষিক্ত হয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন আমলা জনাব মোমেন। সরকারের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে তার কাছে চার্জ বুঝিয়ে দেয়ার মাধ্যমে দীর্ঘ ২০ বছরের কূটনৈতিক জীবনের ইতি ঘটল কিছুটা অস্বাভাবিক ভাবেই।
১১ই এপ্রিল ১৯৯৫ সালে আমার স্থলাভিষিক্ত হলেন নবাগত রাষ্ট্রদূত। আচমকা এ ধরনের সরকারি সিদ্ধান্তে অস্বস্তিকর অবস্থায় নিজেরাও কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে পড়েছিলাম।
সেই সন্ধিক্ষণে দেবদূতের মতই পাশে এসে দাড়াল বিশ্বস্ত পরম বন্ধু রব্বানি খান। আমাকে হতোদ্যম হতে না দিয়ে বললো চাকুরিচ্যুতি এবং চাকুরি ছাড়ার ঘটনা তোমার বর্ণিল জীবনে কোনও নতুন ঘটনা নয়। সাক্ষাৎমৃত্যুর হাত থেকেও পাঁচবার বেঁচে গেছো তুমি। এ সমস্ত কিছুর মধ্য দিয়েই মহান সৃষ্টিকর্তা ও প্রতিপালক তোমাকে তার অসীম করুণায় এগিয়ে চলার পথ দেখিয়েছেন অতীতে, ভবিষ্যতেও অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিল করার জন্য তার রহমত তোমার উপর থাকবে এবং তিনিই ভবিষ্যতে সঠিক পথের সন্ধান দেবেন ইন শা আল্লাহ্ এটা আমার দৃঢ় বিশ্বাস। তুমি অবিচল হয়ে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে যাও সাহসী একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে। রাব্বুল আলামিন সব কিছুই জানেন এবং দেখছেন। তুমি যেভাবে ইমানের সাথে তার কাছে সম্পূর্ণভাবে আত্মসমর্পণ করে তারই সৃষ্ট বিশ্বমানবতা এবং নিপীড়িত মুসলিম উম্মাহর স্বার্থে জাগতিক সব প্রলোভন উপেক্ষা করে একমাত্র তাকেই খুশি করার জন্য নিজেকে উৎসর্গ করার শপথ নিয়ে তার রহমতের উপর ভরসা করে বহু দুর্গম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে চলেছো, তাতে তিনি নিশ্চয়ই তোমার নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের জন্য পুরস্কৃত করবেন এটা আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি। সব অন্যায়-অবিচারের বিচার তিনি অবশ্যই করবেন।
অদ্ভুত আমার বন্ধু এই রব্বানি খান! কোহিনূরের চেয়েও দুর্লভ এক হীরের টুকরো। আধ্যাত্মিক এবং জাগতিক জ্ঞানের এক বিশাল ভাণ্ডার। জাগতিক মানদণ্ডে একজন ঈর্ষণীয় ধন ও যশের অধিকারী হয়েও অন্তরে একজন সাধক ফকির। উম্মতে মোহাম্মদ(সাঃ) রব্বানি খান জাগতিক জীবনের সব দায়িত্ব পালন করার সাথে সাথে দৃঢ় ইমানের ভিত্তিতে আন্তরিক একাগ্রতার সাথে আল্লাহ্তায়ালার নৈকট্য পাবার জন্য লোকচক্ষুর অন্তরালে কঠোর সাধনা করে চলেছে। তার উদার আর অতি স্বচ্ছ মনের গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাকে বারবার অভিভূত করেছে তার নৈকট্যে আসার পর থেকেই। এ জগতের মানুষ হয়েও রব্বানি যেন অদৃশ্যলোকের কেউ ! বিভিন্ন ঘটনায় তেমনটিই মনে হয়েছে আমার। হটাৎ করেই বছর তিনেক হল পরম একান্ত প্রিয় বন্ধু এবং সাথী রব্বানি কিছুটা আকস্মিকভাবেই আমাদের ফাঁকি দিয়ে ফিরে গেছে না ফেরার দেশে। আল্লাহ পাক তাকে জান্নাতুল ফিরদউসে স্থান দিন সেই দোয়াই করে চলেছি।
দেশে ফিরলাম
ফিরে এলাম দেশে। সুদীর্ঘ সময় প্রবাস জীবন কাটিয়ে দেশে ফিরে নিজেকে পুনরায় পুনর্বাসিত করার চেষ্টার সাথে সাথে দেশের চলমান সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করতে থাকলাম। সম্মানের সাথে সাধারণভাবে বেঁচে থাকার আর্থিক সঙ্গতি অর্জনের জন্য কারো দ্বারস্থ না হয়ে স্বাধীনভাবে কিছু একটা করার সিদ্ধান্ত নিলাম। শুভাকাঙ্ক্ষীদের অনেকেই যথাসম্ভব সাহায্য-সহযোগিতার প্রতিশ্রুতি দিলেন। আমার একমাত্র শ্যালক বাপ্পি বছর খানেক আগেই গুলশান দুই নম্বরে আমার একটা প্লটে ‘সোনা ঝরা’ নামে একটি মাল্টি স্টোরিড ফ্ল্যাট বানানোর কাজ শুরু করেছিল। আমি তার সাথেই যোগ দিলাম। উদ্দেশ্য ছিল যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব প্রজেক্টটা শেষ করে ৮টি ফ্ল্যাটের ৬টি ভাড়া দিয়ে সংসারের খরচ মেটাবো আর ২টা ফ্ল্যাটকে একত্রিত করে একটা ডুপ্লেক্স বানিয়ে সেখানে সপরিবারে নিজে থাকবো। প্লটটির অবস্থান ছিল বিশেষ পছন্দের। পেছনে লেক আর সামনে গুলশানের সর্ববৃহৎ আজাদ মসজিদ।
ইচ্ছে ছিল ধানমণ্ডির পৈতৃক বাড়িটাকে একটি ট্রাস্টের অধীনে পরিণত করবো বাংলাদেশের ইতিহাস এবং মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক একটা গবেষণাগারে, সাথে থাকবে একটা পাঠাগার। আমার নিজের কালেকশনে বিভিন্ন বিষয়ের উপর দুর্লভ প্রায় ৩০০০-এরও বেশি বই ছিল। তার সাথে যোগ করা হবে পারিবারিক সূত্রে সংগ্রহীত পুরনো আরও প্রায় ১০০০ বই। সেই আশা অপূর্ণই রয়ে গেলো আজঅব্দি প্রতিকূল অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে! রাব্বুল আলামিনের কাছে আমার সেই সময়কার পরিকল্পনা সঠিক বিবেচিত হয়নি তাই শুকরিয়ার সাথেই তার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি।
দেশের মাটিতে পা দিয়েই আঁচ করতে পেরেছিলাম ঝড়ের পূর্বাভাস। দেখলাম রাজনৈতিক আকাশের ঈশানকোণে জমে উঠেছে কালো মেঘ। ক্রমান্বয়ে খালেদার সরকার দুর্বল হয়ে পড়ছে। একই মাত্রায় খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তায় ধস এবং রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে যোগ্যতা ও স্বচ্ছতার ব্যাপারে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। হতাশাগ্রস্ত দেশবাসী!
আওয়ামী জোট, জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির মূল দুইটি ইস্যু ছাড়াও সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নেতা-নেত্রী এবং জিয়া পরিবারের দুর্নীতি, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন এবং বিচার বিভাগে অবাধ দলীয়করণ, যুবদল-ছাত্রদলের লাগামহীন হারমাদি, চাঁদাবাজি ও বিরোধী দলসমূহের উপর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর নির্যাতন সরকার বিরোধী আন্দোলনকে তীব্র থেকে তীব্রতর করে তুলছে। এরই মধ্যে ম খা আলমগীরের নেতৃত্বে সরকারি আমলা এবং পেশাজীবীদের নিয়ে গঠিত ‘জনতার মঞ্চ’ সরকার বিরোধী আন্দোলনে নতুন মাত্রা সৃষ্টি করায় টালমাটাল হয়ে পড়েছে খালেদা সরকারের প্রশাসন। ‘জিয়ার ভাঙ্গা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জির’ প্রচারণা লজ্জাকর তামাশায় রূপান্তরিত হয়ে গেছে ইতিমধ্যেই তারই পরিবারের সদস্যদের এবং প্রতিষ্ঠিত দলের নেতা-নেত্রীদের দুর্নীতি ও অপকর্মকাণ্ডের ফলে।
দলীয় কোন্দল এবং ‘হাওয়া ভবনের’ দোর্দণ্ডপ্রতাপ এবং একচোখা পক্ষপাতিত্বের কারণে তৃণমূল পর্যায়ের কর্মীরা ক্ষোভে এবং হতাশায় নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ছে। গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছেন মন্ত্রীরা নির্বাচনী ওয়াদা পূরণে ব্যর্থ হয়ে। জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী নিশ্চুপ সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ যাদের ভোটে বিএনপি-জামায়াতের চারদলীয় জোট নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসতে সক্ষম হয়েছিল তাদের বৃহদংশই মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে খালেদা জিয়ার জোটের তরফ থেকে ক্ষমতাসীনদের ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী এবং দলীয় স্বার্থে অস্বচ্ছ রাষ্ট্রপরিচালনা এবং শাসন ব্যবস্থা পরিচালিত হওয়ার কারণে। তাদের সব প্রত্যাশাই ধূলিসাৎ হয়ে গেছে শাসকগোষ্ঠীর লোভ লালসা এবং অপশাসনের যাঁতাকলে। বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে তাদের জীবন। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রীর ক্রমবর্ধমান মূল্য পেশাদার চাকুরিজীবী এবং মেহনতি মানুষের ক্রয়সীমার বাইরে চলে যাওয়ায় তারা দিশেহারা। এই অবস্থায়, আগামী নির্বাচনে খালেদার জোট ক্ষমতায় ফিরে আসতে পারবে না, সেটা ছিল নিশ্চিত ভবিতব্য। হয়েছিলো তাই। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, সবকিছুই ঘটছিলো খালেদার নাকের নিচেই, কিন্তু ঝড়ের পূর্বাভাস আঁচ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলেন খালেদা জিয়া! পরিবার পরিজন ও চাটুকারদের বলয়ে তখন ক্ষমতা উপভোগ করে চলেছিলেন তিনি নির্বোধ উটপাখির মতো অন্ধ সেজে।
নিরুদ্দেশে যাত্রা
নির্বাচনের সরকারি ফলাফল প্রকাশের পরই বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেলাম, ক্ষমতায় আসীন হয়েই হাসিনা তার জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য সফল আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে বিচার শুরু করবেন যে ভাবেই হউক না কেনো অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে। তাই আমি এবং আরও কয়েকজন দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হই পরিবার পরিজনদের দেশে রেখেই অজানা ঠিকানার উদ্দেশ্যে। প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করে সরকার গঠনের পরপরই শেখ হাসিনা সংসদে একটি সাধারন বিল উত্থাপন করে সাংগঠনিক বিধি লঙ্ঘন করে দুই-তৃতীয়াংশের পরিবর্তে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় পঞ্চম সংশোধনীর অবিচ্ছেদ্য অংশ ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি বাতিল করিয়ে নিলেন বেআইনি ভাবে। বিলটি যখন পাশ করানো হয় তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়া এবং তার জোটের সদস্যরা এর প্রতিবাদে টু শব্দটি না করে সংসদ থেকে ওয়াক আউট করলেন। ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণং’ প্রমাণিত হওয়ার পরই হাসিনার ব্যক্তিগত উদ্যোগে প্রয়াত শেখ মুজিবের একজন একান্ত সচিব মোহিতুল ইসলামের দ্বারা ১৫ই আগস্ট সফল সামরিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে ধানমণ্ডি থানায় একটি জিডি দারিজ করিয়ে গোলাম রসুলের জজকোর্টে ‘মুজিব হত্যা’ নামে একটা সাধারণ ক্রিমিনাল খুনের মামলা শুরু করে দেয়া হয়। ঐ মামলায় প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং জেনারেল জিয়াউর রাহমান ছিলেন যথাক্রমে ১নংএবং ২নং আসামী। নুরুল ইসলাম মঞ্জু সহ অভ্যুত্থানের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সব সামরিক অফিসার যারা বিভিন্ন দেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছিল অথবা দেশে কিংবা বিদেশে এবং সেনা পরিষদের বিপ্লবী কয়েকজন JCO এবং NCO কে আসামী করা হয়। জারি করা হয় সবার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরওয়ানা।
একই সাথে, লালবাগ থানায় দারিজ করানো একটি জিডির ভিত্তিতে ‘জেল হত্যা’ নামে আর একটি বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়। এই মামলাতেও প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি খোন্দকার মোশতাক আহমদ, প্রয়াত সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াউর রহমান সহ আগস্ট বিপ্লবের সব শীর্ষ নেতাদের আসামি করা হয়। অতি ক্ষিপ্রতার সাথে ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্টও জারি করাতে সক্ষম হয় হাসিনা সরকার। সব কিছুই ঘটছিল অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। পরবর্তী সময়ে মৃত বিবেচনায় খোন্দকার মোশতাক আহমদ ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের নাম আসামীদের এই লিস্ট দুটো থেকে বাদ দেয়া হয়। ক্যাঙ্গারু আদালতে বিচারের প্রহসনের পর শেখ হাসিনাকে খুশি করার জন্য নিয়োজিত বিচারক গোপালগঞ্জের গোলাম রসুল দম্ভভরে উদ্ভট রায় দিলো, ‘আসামীদের ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মারতে হবে’ যদিও পিনাল কোডে এমন কোনও বিধান নেই। খালেদা জিয়ার জোট এই ধরনের রায়ের পরও নিশ্চুপ থাকে।
নির্বাচনের দিন বিকালেই বিএনপির ভরাডুবি অনুধাবন করে মেজর হুদা তার নির্বাচনী এলাকা থেকে ঢাকা ফেরত আসে এবং দেশত্যাগ করে অস্ট্রেলিয়া যাওয়ার পথে ব্যাংকক আগমন করে। আমি হুদার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বলি, ব্যাংকক তার জন্য মোটেও নিরাপদ স্থান নয়, সুতরাং দ্রুত তাকে ব্যাংকক ত্যাগ করতে হবে’। জবাবে হুদা বলেছিল,ব্যাংককে কিছু কাজ আছে। শেষ হলেই সে ব্যাংকক ছাড়বে। হুদা ব্যাংকক পৌঁছানোর পরপরই বাংলাদেশ দূতাবাসের বিএনপিপন্থী রাষ্ট্রদূত জুলমত আলী খান তার বাসায় হুদাকে নিমন্ত্রণ করেন। অতীতে হুদা জনপ্রিয় সংসদ সদস্য ছিল বিধায় অনেকের কাছেই হুদা এক অতি পরিচিত মুখ। সম্ভবত রাষ্ট্রদূতের বাসা থেকেই হুদার ব্যাংকক অবস্থানের কথা জানাজানি হয়ে যায়। কোনও এক অজানা কারণে হুদারও ব্যাংকক ছাড়তে দেরী হয়ে যায়। সবই নিয়তি! ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসের আমলারা হুদাকে অনুসরণ করতে থাকে। এক বৃষ্টির দিনে একটি দোকানের মধ্যে মিথ্যে নাটক সাজিয়ে হুদাকে ষড়যন্ত্র করে গ্রেফতার করা হয়। টাকা-পয়সা খরচ করতে পারলে ব্যাংককের মতো জায়গায় অসম্ভব বলে কিছু নেই। সে দিনটি ছিল শুক্রবার। শনি-রবি সাপ্তাহিক বন্ধ বিধায় হুদাকে দুইদিন ডিটেনশন সেন্টারে কাটাতে হয়। সোমবার তার বিরুদ্ধে আনিত অভিযোগ প্রমাণিত না হওয়ায় ব্যাংকক পুলিশ হুদাকে ছেড়ে দেয়। হুদা হোটেলে এসে জানতে পারে তার পাসপোর্ট দূতাবাসের কর্নেল হানিফ ইকবাল নামের এক প্রভাবশালী কর্মকর্তা (প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসার) বাজেয়াপ্ত করে নিয়ে গেছে। কর্নেল হানিফ ইকবাল প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে তৎপর হয়ে হুদাকে তার কাছে হস্তান্তর করার জন্য চাপ দিতে থাকে। কিন্তু আইনি জটিলতার কারণে হুদাকে বন্দী অবস্থায় ডিটেনশন সেন্টারে পাঠিয়ে দেয় ব্যাংকক পুলিশ কর্তৃপক্ষ।
হুদার ছোটবোন প্রয়াত রাষ্ট্রদূত কর্নেল পাশার স্ত্রী জিম্বাবুয়ের রাজধানী হারারেতে ছিল সেই সময়।
হুদার কোনও খোঁজ না পেয়ে উদ্বিগ্ন বোন রেডক্রসে জরুরী ই-মেল পাঠালে ব্যাংককের রেডক্রস অফিস হুদার বোনের ইমেলটি ব্যাংককে অবস্থিত UNHCR কে প্রদান করে। এ ভাবেই এই কেসের সাথে UNHCR জড়িত হয়ে পড়ায় প্রায় আড়াই বছর হাসিনা সরকার তাদের সর্বশক্তি নিয়োগ করেও হুদাকে বাংলাদেশে নিয়ে যেতে সক্ষম হয়নি। পরে তড়িঘড়ি করে বাংলাদেশ সরকার থাইল্যান্ড সরকারের সাথে বন্দী বিনিময় চুক্তি সাক্ষরের কৌশল গ্রহন করে। বন্দী বিনিময় চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পরই হুদাকে বাংলাদেশে ফেরত পাঠিয়ে দেয় থাইল্যান্ড সরকার।
সংবিধান লঙ্ঘন করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় একটি বিল পাশ করিয়ে এই দুইটি ক্রিমিনাল খুনের মামলা দায়ের করা হয়। বিচার দুইটি শুরু করার প্রক্রিয়ায় আইনি বৈধতার ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দেয়। কারণ, কোনও সফল সামরিক অভ্যুত্থানের বিচারের নজির দুনিয়ার কোনও দশেই নেই। কোনও ব্যর্থ অভ্যুথানেও যেখানে চাকুরিরত অফিসার কিংবা সৈনিক জড়িত থাকে তাদের বিচার করা সম্ভব একমাত্র সামরিক আইনের আওতায় কোর্টমার্শালের মাধ্যমে, বেসামরিক আইনী আদালতের মাধ্যমে নয়। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আর একটি ন্যক্কারজনক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। তিনি তার ফুফা অবসরপ্রাপ্ত জেনারেল মোস্তাফিজুর রহমানকে কন্ট্রাক্ট বেসিসে পুনরায় সেনাপ্রধান বানিয়ে তার মাধ্যমে সেনাসদর থেকে একটি সনদ জারি করিয়ে নেন যাতে বলা হয়, বর্তমান সরকার ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ নামক যে দুইটি বিচার কার্যকর বেসামরিক আদালতে শুরু করেছে তার সাথে চাকুরিতে বহালরত সেনা অফিসার এবং সৈনিকরা জড়িত থাকলেও সেই বিচার প্রক্রিয়ার পথে কোনও প্রতিবন্ধকতা সেনাসদরের তরফ থেকে নেই। ইতিমধ্যে মুজিব হত্যা মামলা শুরু করিয়ে দেয়া হয়েছে, আমাদের নামে জারি করা হয়েছে গ্রেফতারি পরোয়ানা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট। মেজর হুদার এই পরিণতিতে আমরা সবাই ভীষণভাবে মর্মাহত হয়ে পড়েছিলাম। কিন্তু আমাদের কিছুই করার ছিল না। সিদ্ধান্ত গৃহীত হল যারা তখনও কূটনৈতিক হিসাবে চাকুরিতে বহাল রয়েছে তাদের সবাইকে চাকুরীরত অবস্থাতেই গোপনে যার যার সুবিধা মতো নিরাপদ আশ্রয় ঠিক করে নিতে হবে কালবিলম্ব না করে জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরার নির্দেশ আসার আগেই। বাহ্যিকভাবে প্রত্যেকেই দৈনন্দিন দায়িত্ব পালন করে চলবে স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায়। ফেরত যাবার ডাক এলে মিশনের সবাইকে এমন ভাব দেখাতে হবে যে দেশেই ফিরে যাচ্ছে সবাই। প্রস্তুতিও নিতে হবে সেইভাবেই প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী যাতে করে কোনও সন্দেহের উদ্রেক না হয়। সব নিয়ম মেনেই প্রত্যেককে কর্মস্থল ত্যাগ করে পথিমধ্যে পাড়ি জমাতে হবে নিরাপদ আশ্রয়ে যাতে পরিকল্পনার পথে কোনও বাধার সৃষ্টি না হয়। হুদার দুর্ভাগ্যজনক পরিণামের বিষয়টিও সবাইকে জানিয়ে দেয়া হল। হাসিনা সরকার এবং ভারতীয় RAW-এর জালে আটকে পড়ায় হুদার পক্ষে ব্যাংকক থেকে বের হওয়া সম্ভব হয়নি।
কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিনকে(যে বন্দী জিয়াকে ৭ই নভেম্বর মুক্ত করেছিল) আরও অনেকের সাথে বন্দী করে কারাগারের কন্ডেম সেলে নিক্ষিপ্ত করা হল বেআইনি ভাবে।
প্রায় আড়াই বছর যাবত আপ্রাণ চেষ্টা ও মিলিয়ন ডলার খরচ করে ১৯৯৮ সালের ৮ই নভেম্বর প্রহসনের বিচারের প্রহসনের রায় দেয়ার দিন সকালে ব্যাংককে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাস নোংরা কৌশলের মাধ্যমে হুদাকে থাই কর্তৃপক্ষের নিকট হতে নিজেদের হেফাজতে বাংলাদেশ দূতাবাসে নিয়ে যায় এবং সন্ধ্যায় একটি বিশেষ ফ্লাইটে ঢাকায় ফেরত নিয়ে আসে।
মেজর হুদাকেও দেশে ফিরিয়ে এনে ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হল কন্ডেম সেলে। একমাত্র মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত আসামীদেরকেই রাখা হয় জেল কোড অনুযায়ী কন্ডেম সেলে। উচ্চ আদালত তাদের বেইল পিটিশন নাকচ করে দিলেও রাজনৈতিক বন্দী হিসাবে তাদের ক্লাস দেবার রায় দিয়েছিলেন। কিন্তু জিঘাংসা পরায়ণ অগ্নিশর্মা হাসিনার রোষ থেকে বাঁচার তাগিদে প্রশাসন এবং জেল কর্তৃপক্ষ আদালতের সেই রায় বাস্তবায়িত করা থেকে বিরত থাকে শেষদিন পর্যন্ত।
নির্বাহী সরকারের প্রশাসন কর্তৃক আদালতের রায় কার্যকরী না করা স্বাধীন বিচার বিভাগের পরাধীনতারই চরম বহিঃপ্রকাশ!
বৈপ্লবিক জীবনের উত্থান-পতনের এক চরম দৃষ্টান্ত!
দীর্ঘ তিনদশক পার হবার পরও ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের সব শীর্ষস্থানীয় নেতারাই হাসিনার সৌজন্যে ‘খুনের আসামী’ হিসাবে আসামীর কাঠগড়ায়!
কোথাও নেই কোনও প্রতিবাদ! জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধ্বজাধারী রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং জামায়াত জোট কোনও প্রতিবাদ কিংবা উচ্চবাচ্য না করে নিশ্চুপ হয়ে ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের প্রহসন দেখছিল উপভোগও করে থাকবেন। সত্যিই বিচিত্র এইসব দল, তাদের নীতি-আদর্শ এবং দলীয় নেতৃত্বের চরম মোনাফেকি এবং সুবিধাবাদিতার রাজনীতি। তাদের জন্য রাজনীতি শুধুই ধর্মপ্রাণ নিরীহ জনগণকে চটকদার কথায় ভুলিয়ে নিজেদের স্বার্থ এবং ভাগ্য উন্নয়নের পন্থা মাত্র।
বীর মুক্তিযোদ্ধা যারা জীবনবাজি রেখে দেশ স্বাধীন করলো, পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আওয়ামী-বাকশালী স্বৈরশাসনের যূপকাষ্ঠের নিগড় থেকে নিজেদের প্রাণের মায়া তুচ্ছ করে শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা থেকে দেশ ও জাতিকে সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে উদ্ধার করে ফিরিয়ে দিয়েছিল মানবিক অধিকার, গণতন্ত্র এবং বাক স্বাধীনতা, যারা যুদ্ধকালীন সময় থেকেই একনিষ্ঠ নিরলস সংগ্রামে ব্রতী হয়েছিল স্বাধীনতার পর জনগণের মনে লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের মাধ্যমে গড়ে তুলতে প্রগতিশীল এবং আত্মসম্মানে বলীয়ান সুখী, সমৃদ্ধশালী এক নতুন বাংলাদেশ এবং ন্যায়ভিত্তিক সুষম সমাজব্যবস্থা যেখানে থাকবে প্রতিটি নাগরিকের নিজস্ব মেধা, প্রতিভা, যোগ্যতা এবং সৃজনশীলতা প্রকাশের সমঅধিকার। যেখানে থাকবে না শোষকের পৈশাচিক অট্টহাসি আর শোষিতের হাহাকার। এইসব মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যরা স্বাধীনতার পর সব প্রলোভন পদদলিত করে নিজেদের ব্রতে অটল থেকে ভারতের পুতুল সরকারের বরকন্দাজ না হয়ে প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে নির্ভীক ভাবে জনস্বার্থের সাথেই একাত্মতা প্রকাশ করে নিজেদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের স্বাক্ষর রেখে এসেছে, সেই ইতিহাস মুছে যাবার নয়। তারপরও তাদেরকেই দেশবাসী দেখলো সাজানো মামলার আসামি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে বিশেষ আদালতের কাঠগড়ায়!
যখন ভারতের পদলেহি এবং নব্য পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী একজোটে ক্ষমতার স্বার্থে সংবিধান লঙ্ঘন করে আইনকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে চক্রান্ত মূলক বিচারের প্রহসনের স্পর্ধা দেখাচ্ছিলো তখন জনগণের বৃহদাংশের ভোটে জেতা বিরোধীদলগুলোর সাংসদরা উটপাখি সেজে নীরব থেকেছিলেন আওয়ামীলীগ ও ভারতকে খুশি রাখার জন্যই, এই বিশ্বাসঘাতকতা যে একদিন তাদের জন্যই কাল হয়ে উঠবে সেটা না বুঝেই। সম্প্রসারণবাদী ভারত-প্রীতিতে আওয়ামী-বাকশালী সরকারকে পরোক্ষ সমর্থন প্রদান জনগণের সার্বিক মুক্তির স্বপ্নকেই শুধু বিলীন করেই দিয়েছিল তাই নয়, এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বও হুমকির মুখে পড়বে সেটাই হয়ে উঠল হতাশা বেঞ্জক বাস্তবতা! জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর গড়ে ওঠা স্বকীয় ঐতিহ্যকে সমূলে বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলে দেশটাকে রূপান্তরিত করা হবে ভারতের সুদূরপ্রসারী নীলনকশা অনুযায়ী একটি করদ রাজ্যে কিংবা অঙ্গরাজ্যে, দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে এই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করেই আমাদের পক্ষে যা কিছু করা সম্ভব সেটাই আমরা অতিতের মতই ভবিষ্যতেও করবো সব প্রতিকূলতার মকাবেলা করেই সেই সিদ্ধান্তই গৃহীত হল।
সর্বসম্মতি সাপেক্ষে, আমি বিদেশ থেকেই নিম্মির সাথে যোগাযোগ করে তাকে বললাম, ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন-এর সাথে দেখা করে আইনি সাহায্য চাইতে। নিম্মি তার সাথে দেখা করেছিল পারিবারিক ভাবে ঘনিষ্ঠতার কারণে। ন্যায়নিষ্ঠ প্রখ্যাত এই আইনজীবী নিম্মিকে অকপটে জানিয়েছিলেন এটা কোনও মামলাই নয়, বিচারের প্রহসন মাত্র। হাসিনার জালে হাসিনাকে জড়িত করে অনায়াসেই তার সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব। এর জন্য তারাও প্রস্তুত। কিন্তু পথের কাঁটা হয়ে দাড়িয়েছেন স্বয়ং খালেদা জিয়া। তিনি চাচ্ছেন না, এই বিচার প্রক্রিয়ার সাথে বিএনপির কোনও প্রকার সম্পৃক্ততা কিংবা বিরোধী জোটের প্রতি সহানুভূতিশীল আইনজীবীরা এই বিচারে আসামী পক্ষে ওকালতি করুক। সব শুনে নিম্মি প্রশ্ন তুলেছিল মইনুল ভাই, আপনারা তো পেশাদার আইনজীবী। সেই সুবাদে এই কেসটা গ্রহণ করে আসামী পক্ষে আইনি লড়াই লড়তে পারেন না কি? ভাবী, আপনাকে বলতে বাধা নেই, সংসদে যখন সাংবিধানিক বিধি-বিধানের তোয়াক্কা না করে হাসিনার সরকার একক সংখ্যা গরিষ্ঠতায় ইনডেমনিটি এ্যাক্ট বাতিল করে মামলা দায়ের করে, তখনই আমরা খালেদা জিয়াকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম সরকারের পতন ঘটানোর এই মোক্ষম সুযোগটা হাতছাড়া করা উচিৎ হবে না। তিনি আমাদের পরামর্শে কর্ণপাত না করে শুধু বললেন
আপনারা এই মামলা থেকে দূরে থাকবেন। পার্টিপ্রধানের এহেন নির্দেশে হতবাক হয়ে বিবেক বিসর্জন দিয়ে নিরুপায় হয়ে পড়েছি আমরা। যদি সম্ভব হয়, আপনি তার তরফ থেকে একটি ইশারার ব্যবস্থা করুন, তাহলে আমি কথা দিচ্ছি, বিনা খরচায় আমি ও সমমনা দেশের বিশিষ্ট আইনজীবীদের অনেকেই স্বেচ্ছায় আসামীদের পক্ষে এই কেস লড়তে রাজি হবেন।
তার সাথে সাক্ষাতের পর নিম্মি বিশ্বস্তজনদের সাথেও এই প্রসঙ্গে আলাপ করে জানাতে পেরেছিল খালেদা জিয়া কাঁটা দিয়ে কাঁটা তুলতে চাচ্ছেন, তাই সবাইকে নির্দেশ দিয়েছেন কেসটা থেকে দূরে থাকতে। অতএব বিএনপি-জামায়াত জোট থেকে কোনও রকম সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়া যাবে না আইনি লড়াই লড়তে। রাজনৈতিক ভাবেও আগস্ট বিপ্লবীদের বিচারের পক্ষে দাড়াবে না তারা। খালেদা জিয়া আরও ভাবছেন, তাদের এই মৌন সমর্থনে হাসিনা সরকার এবং ভারত তাদের পক্ষে নমনীয় থাকবে। লেনদেনের এক অভাবনীয় সমীকরণ!
ইতিমধ্যে, অন্যান্য সাথী ভাইদের কাছে দেশে ফিরে যাবার নির্দেশ পৌঁছালো। নির্দেশ পাবার পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী সবাই গোপনে যার যার নিরাপদ আশ্রয়ে চলে গেলো।
জানতে পারলাম, দেশে অবস্থানরত আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের বন্দী করার সাথে সাথেই বিদেশ থেকে কূটনৈতিক দায়িত্বে নিয়োজিত নেতারা দেশে না ফেরায় তাদেরকে চাকুরি থেকে বরখাস্ত করে তাদের নামেও গ্রেফতারি পরওয়ানা এবং ইন্টারপোলের মাধ্যমে রেড এলার্ট জারি করেছে হাসিনা সরকার। ডিবি-এর আওয়ামী লীগ অনুগত সাবেক কর্মকর্তা আবদুল কাহহার আকন্দের নেতৃত্বে তল্লাশির নামে সবার বাড়িঘর তছনচ করে ফেলা হয়েছে। আমার বইগুলোও রেহাই পায়নি। নিম্মি আর সস্তির পাসপোর্ট জব্দ করে তাদের গৃহবন্দী করে রাখা হল।
নিকট আত্মীয়-স্বজনদের বাড়িতেও চালানো হয় একই তাণ্ডব। বাজেয়াপ্ত করার সমন জারি করা হল সরকারের তরফ থেকে আমাদের নামে স্থাবর-অস্থাবর সব সম্পত্তি এবং ব্যাংক একাউন্ট।
ছোটভাই স্বপনকে বন্দী করে নিক্ষেপ করা হল কারাগারে এই সন্দেহে, যে স্বপন আমাকে এবং আমার পরিবারকে আর্থিকভাবে সাহায্য করে থাকে। রিমান্ডে নিয়ে তার উপর চালানো হয় পাশবিক অত্যাচার। দীর্ঘ দু’ বছর আইনি লড়াইয়ের মাধ্যমে বেইল পেলে, স্বপন সপরিবারে আমেরিকাতে পালিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় গ্রহণ করতে বাধ্য হয়। তার ব্যবসা-বাণিজ্য লুটপাট করে নেয় সরকারী দলের ক্ষমতাশালী লুটেরারা, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হয় তার সবগুলো গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। রাজনৈতিক অঙ্গনে তখন শুরু হয়েছে নতুন এক তামাশা।
সংরক্ষিত মহিলা আসনের ভাগ-বাটোয়ারার পর আওয়ামী লীগের কাছে জামায়াত এবং জাতীয় পার্টির প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়া মাত্র তাদের ব্যবহৃত টিস্যু পেপারের মত ছুঁড়ে ফেলে দেয়া হয় আঁস্তাকুড়ে।
১৯৯৬-এর নির্বাচনে জামায়াতের সিটের সংখ্যা ১৭ থেকে উদ্দেগজনক ভাবে কমে আসায় জামায়াত বুঝতে পারে বাংলাদেশে ভারত ঘেঁষা রাজনীতি করে কোনও দলের পক্ষেই জনপ্রিয়তা লাভ করা সম্ভব নয়।তাই দল হিসাবে রাজনীতির ব্যবসা চালিয়ে যেতে হলে স্বর্ণলতিকার মতো বাহ্যিক ভাবে ‘ভারত বিরধি’ বিএনপিকেই অবলম্বন করা ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প তাদের নেই। অন্যদিকে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে পরাজয়ের পর বিএনপিও বুঝতে পারে সমঝোতা ও সুবিধাবাদের রাজনীতিতে একগুয়েমি এবং স্বেচ্ছাচারিতা বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে গেলো হিসাব। তাই আবার বিএনপিএবং জামায়াতের গাঁটছড়ার উদয় হল দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে।
বাংলাদেশের জনগণের সত্তায় মিশে আছে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের চেতনা। প্রাচীনকাল থেকেই এই দু’টি চেতনার সংমিশ্রণে গড়ে উঠেছে আমাদের স্বকীয় পরিচিতি। ১৯৪৭ সালেও ভারত বিভক্ত করে দুইটি স্বাধীন রাষ্ট্র পাকিস্তান এবং হিন্দুস্তান নামের রাষ্ট্রের বাস্তবতাকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তিকেও মেনে নিতে হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জাতীয় সত্তার সাথে সামঞ্জস্যহীন ভারতের সংবিধানের চার নীতির উপর দেশের সংবিধান গড়ে জাতিকে বিভক্ত করার চক্রান্ত করা হল শুরুতেই আওয়ামী লীগ সরকারের মাধ্যমে। পরিণতিতে সৃষ্টি হল রাজনীতির মূলধারায় দুইটি তথাকথিত বিপরীতমুখী রাজনৈতিক ধারা। কিন্তু আশ্চর্যজনক বিষয় হল, বিগত চার দশকের বেশি সময় ধরে এই দুইটি শক্তিকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় দেখার পরই দেশবাসী বুঝতে পারলেন কাগুজে ভাবে এদের নীতি-আদর্শে ব্যবধান থাকলেও এদের চরিত্র এক। দুইটি রাজনৈতিক শক্তিই একই গোষ্ঠীস্বার্থের প্রতিভূ। জনগণের প্রত্যাশার বিরুদ্ধেই তাদের অবস্থান। অন্যদিকে তথাকথিত যারা ধর্মের ঠিকাদার, তাদের চেহারাতেও কোনও ব্যতিক্রম পরিলক্ষিত হল না।
তাই আজ হয়তো জনগণ বুঝতে পারছে পরীক্ষিত বিকল্প নেতৃত্ব ছাড়া দেশের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।
কিন্তু জাতীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুরা তৃতীয় বিশ্বের সম্পদশালী সম্ভাবনাময় কোনও দেশেই চায় না সেখানে জাতীয় স্বার্থে দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের অধীনে ঐক্যবদ্ধ হউক দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী। তাই সে ধরনের যেকোনো প্রচেষ্টাকে অংকুরেই বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে এবং বিভ্রান্তিকর প্রচারণা চালিয়ে বিনাশ করে দেয়া হয় ছলেবলে কৌশলে।
এই পরিপ্রেক্ষিতে, সেই ধরণের প্রকৃত অর্থে ঐক্যবদ্ধ ধর্মীয় এবং জাতীয়তাবাদী চেতনায় শাণিত শক্তি এবং নেতৃত্ব শুধুমাত্র গড়ে তোলা সম্ভব আপোষহীন অন্যায়, অপশাসন ও শোষণ বিরোধী কঠোর সংগ্রামের মাধ্যমেই। এর জন্য চাই সাহসী এবং সচেতন মানুষ।
যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই সংগ্রামে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করতে হবে দেশের তরুণ প্রজন্মকেই সব প্রলোভন এবং ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে। তারাই হচ্ছে যেকোনো দেশের দুর্বার এবং নির্ভীক চালিকা শক্তি। যেকোনো দেশ এবং জাতির ইতিহাস সৃষ্টির মুখ্য উপাদান এবং মেরুদণ্ড এই টগবগে তারুণ্য। এদের সংঘবদ্ধ জাগরণে হৃৎকম্পনের সৃষ্টি হয় দেশীয় ও কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী শক্তিধর মুরুব্বীদের। তখনই সুযোগ হয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নতুন সমীকরণ সৃষ্টির।
নিম্ন আদালতে গোপালগঞ্জের জজ গোলাম রসুল তার ক্যাঙ্গারু কোর্টে বিচারের নামে তামাশা করে হাসিনার দয়াও করুণা পাবার জন্য আইনে কনও বিধি না থাকা সত্ত্বেও সদর্পে অপরাধীদের ‘ফায়ারিং স্কোয়াডে’ গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার রায় দেয়ার স্পর্ধা দেখিয়েছিলেন। এই রায় দেবার পরও খালেদা জিয়ার জোট মুখে কুলুপ এঁটে নিশ্চুপ থাকে।
এরপর বিবাদী পক্ষের সব রিট এবং রিভিউ পিটিশনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্ট এবং সুপ্রিমকোর্টে দায়সারা গোছের বিচার প্রক্রিয়া পরিচালিত হয় সরকারি প্রশাসনের তীক্ষ্ণ নজরদারিতে।
স্মরণ রাখতে হবে, এই মামলা চলাকালে উচ্চ আদালতের ৮ জন বিবেকবান বিচারক বিব্রতবোধ করে বিচার কার্যক্রম থেকে সরে এসেছিলেন। সুপ্রিমকোর্টের তিনজন বিচারপতি বিবেকের তাড়নায় এই বিচারের রিভিউ বেঞ্চে বসতে বিব্রত বোধ করেছিলেন।
এই পুরোটা সময় উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের সরকারি চাপ, ক্ষমতাসীন দলের তরফ থেকে প্রাণনাশসহ বিভিন্ন ধরনের ধমক-ধামকি এবং হেনস্থার সম্মুখীন হতে হয়েছিল। তৎকালীনস্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিম এবং মায়ার নেতৃত্বে লাঠি ও চাপাতি মিছিল বের করা হয়েছিলো। সেই মিছিলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী স্বয়ং সদম্ভে বিচারকদের উদ্দেশ্যে বলেছিলেন বিচারের রায় যদি জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী না হয় তবে সেই প্রত্যাশিত রায় কি করে আদায় করতে হয় সেটা আওয়ামীলীগের ভাল করেই জানা আছে। এরপরও হাসিনা সরকারের পক্ষে সেই টার্মে বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি।
২০০১ সালের নির্বাচনী নাগরদোলায় স্বজনপ্রীতি, পুকুরচুরি, জাতীয় সম্পদের হরিলুট, মানুষ খুন, অন্যায়-অবিচার, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্যের আকাশচুম্বী ঊর্ধ্বগতি, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস, দলীয় মাস্তানি, গুমখুন, জবরদখল, চাঁদাবাজির প্রচণ্ডতায় শাসরুদ্ধকর অবস্থা, একই সাথে ভারত তোষণ নীতিতে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণ নিরুপায় হয়ে আবার খালেদা জিয়ার জোটকেই ভোটের মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনে। নিজেদের ভুল-ভ্রান্তি স্বীকার করে নিয়ে জনগণের ভোট প্রার্থনা করায় জনগণ তাদের বিশ্বাস করেছিল অতীতের ভুলভ্রান্তিগুলোর পুনরাবৃত্তি ঘটাবে না এবারের জোট সরকার। আমরাও ভেবেছিলাম এবার হয়তো খালেদা জিয়ার জোট সরকার অন্যায়ভাবে বাতিলকৃত ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি আবার সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে পুনর্বহাল করবে এবং আইনগত ভাবেই আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের বিরুদ্ধে দায়ের করা‘খুনের মামলা’ দুটো খারিজ হয়ে যাবে, মুক্তি পাবে সবাই মানবেতর বন্দী অবস্থা থেকে। নির্বাসিত নেতারাও স্বাধীনভাবে দেশে ফিরতে পারবে। কিন্তু জনগণ হতবাক হয়ে দেখলো, নবনির্বাচিত খালেদা জিয়ার সরকার সেই পথে এগুলো না সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও। যদিও সংবিধান লঙ্ঘিত বেআইনি ভাবে ক্যাঙ্গারু কোর্টের প্রহসন মূলক এই বিচারের বিরুদ্ধে তখন বিশ্বজনমত তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন, কানাডা, অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, যুক্তরাজ্য, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ছাড়া বিশ্বের আরও অনেক দেশ ও মানবাধিকার সংস্থা এই বিচার প্রক্রিয়ার তীব্র সমালোচনা করে সরকারকে ইনডেমনিটি এ্যাক্ট পুনর্বহাল করে এই বিচার বন্ধের আবেদনও জানিয়েছিল।
বিশেষভাবে অনুরোধ জানিয়েছিল কয়েকটি ভাতৃপ্রতিম দেশ, যাদের বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতা খালেদা জিয়ার জোটকে ২০০১ সালের নির্বাচনী বৈতরণী পার করাতে বিশেষ অবদান রেখেছিল ১৯৯১ সালের নির্বাচনের মতোই। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তাদের আশ্বস্ত করেছিলেন তিনি যথাসময়ে সেই উদ্দগ গ্রহণ করবেন। কিন্তু তার পাঁচ বছরের শাসনকালের মেয়াদপূর্তি পর্যন্ত সেই উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে তিনি রহস্যজনকভাবে বিরত থাকেন। শুধু তাই নয়, কারাবন্দীদের ‘কন্ডেম সেল’-এর মানবেতর অবস্থা থেকে ক্লাস দেবার উচ্চ আদালতের রায়ের বাস্তবায়নের ক্ষেত্রেও কোনও প্রশাসনিক উদ্যোগ গ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে খালেদা জিয়ার জোট সরকার।
এভাবেই স্বীয় স্বার্থ এবং ভারতের চাণক্যপুরি এবং তাদের প্রতিভু আওয়ামীলীগকে খুশি করার লক্ষেই আগামিতে আসামীদের মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করার পথটি অতি নিষ্ঠুরতার সাথে খোলা রেখেই ক্ষমতা ছেড়েছিলেন খালেদা জিয়া এবং তার জোট সরকার। এই সুযোগের পূর্ণ দ্ব্যবহার করতে সক্ষম হয় আওয়ামীলীগ।
২০০৮ সালের নির্বাচনে জরুরী অবস্থায় ‘উদ্দিনদের’ সরকারের সহযোগিতায় ডিজিটাল কারচুপির মাধ্যমে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যা গরিষ্ঠতায় আওয়ামীলীগকে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসায় ইন্দো-আমেরিকান বলয়। তাদের বিশেষ এজেন্ডা বাস্তবায়নের স্বার্থে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার জন্যই দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতায় জেতানো হয়েছিল আওয়ামীলীগ জোটকে। অতি চতুরতার সাথে বিদেশী দূতিয়ালির মাধ্যমে নির্বাচনী ফাঁদে ফেলা হয়েছিলো খালেদার জোটকে। দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক ভারতের হাতের পুতুল আশিত্তোর এরশাদ বুড়ো বয়সে জেলের ভাত না গেলার স্বার্থে ভারতের সুতোর টানে হাসিনার পেটিকোটের নিচে আশ্রয় নিতে বাধ্য হন। ক্ষমতাসীন হয়েই তড়িঘড়ি করে জ্যেষ্ঠতার রীতি উপেক্ষা করে পছন্দমতো বিচারকদের সুপ্রিমকোর্টে নিয়োগদান করে ৫ সদস্যের মনপছন্দ একটি বেঞ্চ গঠন করে হাসিনার আওয়ামীলীগ মহাজোট সরকার। বেঞ্চের দুইজনই ছিলেন সদ্য পদোন্নতি প্রাপ্ত হিন্দু সম্প্রদায়ের বিচারপতি। তাদেরই একজন ছিলেন সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। সেই বেঞ্চ ফাঁসির চূড়ান্ত রায় দান করে বন্দী পাঁচজন বীর মুক্তিযোদ্ধা জনদরদী সেনা অফিসারের বিরুদ্ধে তাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমের প্রতিদানে। সুপ্রিম কোর্টের রায় প্রদান এবং মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার মধ্যে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য আইনগতভাবে যে সময় দেবার রীতি সেটা থেকেও বঞ্চিত করা হয়েছিলো জাতীয় বীরদের। যদিও বীরদের সবাই ক্ষমা প্রার্থনা না করার সিদ্ধান্তই গ্রহণ করেছিলেন স্বেচ্ছায় তবুও আইন অনুযায়ী সময় না দেয়াটা ছিল বেআইনি হঠকারিতা। প্রধানমন্ত্রীর অঙ্গুলি হেলনে জেলকর্তৃপক্ষ রায় ঘোষিত হবার পর, তাড়াহুড়ো করে জাতীয় বীরদের নিকট আত্মীয়-স্বজনকে কড়া নিরাপত্তার সাথে কারাগারে এনে তাদের সাথে শেষ সাক্ষাৎকরিয়ে প্রত্যুষে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং মেজর হুদার গলায় ছুরি চালিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় নির্ভীক, নিঃস্বার্থ, দেশপ্রেমিক বীরদের।
২৮শে জানুয়ারি ২০১০ সালে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের নৃশংস হত্যাযজ্ঞ
‘৭১ সালে সেনা বাহিনীর চৌকস অফিসার এবং বীরমুক্তিযোদ্ধা, ’৭৫ সালের ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে শেখ মুজিবের একদলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনে পিষ্টশ্বাসরুদ্ধ অবস্থা থেকে জাতিকে মুক্ত করা এবং প্রতিক্রিয়াশীল খালেদ-চক্রেরচক্রান্তকে পরাস্ত করার মূলশক্তি সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদের সংবিধান বিরোধী ‘মুজিব হত্যা’ বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে দীর্ঘ ১৪ বছরেরও বেশি সময় কারাপ্রকোষ্ঠের মৃত্যুগুহায় রাখার পর দেশপ্রেমিক সূর্য-সন্তানদের মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করে ফাঁসির হুকুম জারি করানো হয়। সেই অবৈধ রায় কার্যকর করা হয় ২৮শে জানুয়ারি সুবহে সাদেকে ২০১০ সালে। সেইদিনই খবরে প্রকাশিত হয়, ‘‘লে.কর্নেল সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল মহিউদ্দিন আহমেদ যিনি ৭ই নভেম্বর ৭৫ সালে সিপাহী জনতার সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর জেনারল জিয়াউর রহমানকে বন্দি অবস্থা থেকে মুক্ত করে ২য়ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারসে নিয়ে এসেছিলেন, ল্যান্সারের মেজর মহিউদ্দিন আহমেদ এবং মেজর বজলুল হুদাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মৃত্যুদণ্ডকার্যকর করা হয়েছে। বাকিরা রয়েছেন পলাতক।’’
কিন্তু উপস্থিত প্রত্যক্ষদর্শী, বিভিন্ন মাধ্যম এবং বিদেশের কয়েকটি সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের সূত্রে জানা যায় সেই দিন প্রত্যুষে ৪ জনেরফাঁসি কার্যকর করা হলেও মেজর হুদাকে কিন্তু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়নি। হাসিনার হুকুমে মেজর বজলুল হুদার বুকের উপর পা চেপে ধরে রেখে জবাই করে তাকে হত্যা করেছিল জল্লাদ। হঠাৎ এমন কথা শুনে অনেকেই চমকে উঠবেন! আজ আপনাদেরকে জানাবো সেই অপ্রকাশিত সত্য। অনেক কিছু লেখার ইচ্ছা ছিল, তবে সংক্ষেপেই জানাচ্ছি সেই লোমহর্ষক হত্যার উপাখ্যান।মেজর বজলুল হুদাকে ফাঁসি দেওয়া হয়নি। যার কথা লিখছি সেই মহান বীর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হওয়ার পর পাকিস্তান থেকে যে কয়জন সেনা অফিসার পালিয়ে এসে অসীম সাহসিকতার সাথে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন তাদের অন্যতম মেজর বজলুল হুদা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট একদল বীর সেনানী জাতিকে দিয়েছিল এক ‘ডিভাইন জাস্টিস’। জাতিকে মুক্ত করেছিল এক রাহুগ্রাস থেকে। ’৭৫ -এর ২৬ সেপ্টেম্বর তৎকালীন খন্দকার মোশতাক সরকার একটি ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্স (দায়মুক্তি অধ্যাদেশ) জারি করেছিলো জানবাজ মুক্তিদাতাদের কার্যক্রমকে বৈধতা দান করে। (এই মোশতাক সরকারকে শপথ বাক্য পাঠ করিয়েছিলো হাসিনার বর্তমান উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম)। পরবর্তীকালে জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক দল বিএনপি সরকার গঠনের পর সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি ভোটে পাশ হওয়ায় মোশতাক সরকার প্রদত্ত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি ইনডেমনিটি অ্যাক্ট হিসেবে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর অংশে পরিণত হয়। ১৯৯৬ সালের ২৩ জুন ক্ষমতায় এসে আওয়ামী লীগসরকার সংবিধান পরিবর্তনের জন্য অতি আবশ্যকীয় দুই-তৃতীয়াংশ ভোট ছাড়াই দায়মুক্তি অধ্যাদেশটি বাতিল করে ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানকে একটি ‘সাধারণ হত্যাকান্ড’ হিসেবে পরিগণিত করে ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ নামের দুটি বিচারের প্রহসন শুরু করে। প্রায় দীর্ঘ ১৪ বছরেরও বেশি সময় এই বিচার কার্যক্রমের তামাশা চলে। রাষ্ট্রপতি মোশতাক, জেনারেল জিয়াউর রহমান সহ বিশ জনকে ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ মামলার আসামি করা হয়েছিল। পরে মৃত বিধায় রাষ্ট্রপতি মোশতাক এবং জেনারেল জিয়া এই দুই আসামীর নাম অভিযুক্তদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। বিচারকালে রাজনৈতিক বন্দী হিসেবে ক্লাস চেয়ে উচ্চ আদালতে রিট পিটিশন করলে আদালত অভিযুক্তদের ক্লাস দেবার রায় দিয়ে প্রশাসনকে সেই রায় কার্যকরকরার নির্দেশ প্রদান করেন। কিন্তু খালেদা জিয়া কিংবা হাসিনা সরকার সেই রায় বাস্তবায়ন করেনি। এরই মধ্যে সাবেক মন্ত্রী শাহ মোয়াজ্জেম হোসেন, কে এম ওবায়দুর রহমান, নুরুল ইসলাম মঞ্জুর, তাহের উদ্দিন ঠাকুর ও মেজর (অব) খায়রুজ্জামানসহ পাঁচজনকে খালাস দেন আদালত। শেষঅব্দি ১৫ জনকে ফাঁসিরআদেশ দিলেও রিভিউতে তিন জনের ফাঁসির আদেশ বাতিল করে উচ্চ আদালত। বাকি বারোজন হচ্ছেনঃ মেজর (অব) বজলুল হুদা, মেজর (অব) এ কে এম মহিউদ্দিন আহমেদ (ল্যান্সার), লে. কর্নেল (অব) সুলতান শাহরিয়ার রশিদ খান, লে. কর্নেল (বরখাস্ত) সৈয়দ ফারুক রহমান, লে. কর্নেল (অব) মহিউদ্দিন আহমেদ (আর্টিলারি), লে. কর্নেল (অব) আব্দুর রশিদ, লে. কর্নেল (অব) শরিফুল হক ডালিম, লে.কর্নেল (অব) এস এইচ এম বি নূর চৌধুরী, রিসালদার (অব) মোসলেম উদ্দিন, মেজর (অব)রাশেদ চৌধুরী, ক্যাপ্টেন (অব) আব্দুল মাজেদ, লে. কর্নেল (অব) আব্দুল আজিজ পাশা। শেষের ছয় জন বিদেশে নির্বাসনে আছেন। তাদের গ্রেপ্তারে ইন্টারপোলের পরোয়ানা রয়েছে। দণ্ডিত অবস্থায় জিম্বাবুয়েতে নির্বাসনে মারা যান কর্নেল আব্দুল আজিজ পাশা।
১৯৯৬-তে মেজর বজলুল হুদাকে গ্রেফতারের পর তার বৃদ্ধামাকে আওয়ামীলীগের পাণ্ডারা লাঞ্ছিত করে ঘর থেকে রাস্তায় টেনে এনে ফেলে। তখন থেকেই বৃদ্ধা মহিলা অসুস্থ হয়ে যান।
২০০০ সালের ১৫ই মার্চ বজলুল হুদারবৃদ্ধা মা ইহজগৎ ছেড়ে চলে যান। মায়ের জানাজায় অংশ নিতে বজলুল হুদার প্যারোলে মুক্তির আবেদন জানায় তার পরিবার। কিন্তু মায়ের জানাজায় অংশ নিতেঅনুমতি পায়নি হুদা। অতপর তার মায়ের লাশ জেল গেটে দেখার আবেদন করেন পরিবারের সদস্যরা। জেল গেটে ৭ ঘন্টা তার মায়ের লাশ রেখে অনেক তালবাহানা ও নাটক করে বজলুল হুদাকে ১ মিনিটের জন্য তার মায়ের লাশ দেখতে দেয় জেল প্রশাসন। ২০১০ সালের ২৮শে জানুয়ারী প্রত্যুষে মেজর (অব) বজলুল হুদা সহ মোট ৫ জনেরমৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়। এরই মধ্যে আরেকটা লোমহর্ষক কথা বলি।
২৭জানুয়ারী লে. কর্নেল (অব.) মহিউদ্দিন আহমেদের কারাবন্দি দুই ছেলে নাজমুল হাসান সোহেল ও মাহাবুবুল হাসান ইমুকে কাশিমপুর কারাগার থেকে ঢাকা জেলে আনাহয় যাদের আওয়ামীলীগ সংসদ সদস্য ফজলে নূর তাপস ‘হত্যা চেষ্টা’ র সাজানো অভিযোগে আটক করা হয়েছিল। তাদেরকে যে প্রিজন ভ্যানে আনা হচ্ছিল সেই একই ভ্যানে আনা হয়েছিল এক হিন্দু জল্লাদকে যে কিনা তাদের বাবাকে পরেরদিন ফাঁসিতে ঝুলাবে। প্রিয় পাঠকগণ! এই ধরনের লোমহর্ষক ব্যপার ভাবতে পারেন কি! এই জল্লাদের কথা পরে বলছি।
সে আওয়ামী লীগেরই সমর্থক যার স্বল্পমেয়াদি সাজা হয়েছিলো। ধরে নেয়া যাক তাদের বাবা ফাঁসির আসামি। তাই বলে একই ভ্যানে তার বাবার জল্লাদকেও সাথে করে আনতে হবে! একবার চোখ বন্ধ করে ভেবে দেখুন তো ঐ দুই ছেলের কি মানসিক অবস্থা ছিল তখন!
একই অভিযোগে বন্দী করে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয়েছিল আমার ছোট ভাই কামরুল হক স্বপন বীর বিক্রমকেও। ২৭শে জানুয়ারী,২০১০ রাত ১১টায় কারাগারে তৎকালীন স্বরাষ্ট্র সচিব আব্দুস সোবহান শিকদার, কারামহাপরিদর্শক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আশরাফুল ইসলাম খান, ঢাকার জেলা প্রশাসকজিল্লার রহমান, অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট অমিতাভ সরকার, ডিএমপি কমিশনার একে এম শহীদুল হক, ঢাকার সিভিল সার্জন ডা. মুশফিকুর রহমানসহ স্বরাষ্ট্রমন্ত্রণালয়, পুলিশ এবং র্যাহবের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।১১টা২০ মিনিটে পাঁচটি কফিন বক্স কারাগারের ভেতরে ঢোকানো হয়। (এদের নাম ও পদবি উল্লেখ করে রাখলাম। বিশেষ কারণে র্যাবের কর্মকর্তাদের নাম উল্লেখ করলাম না যাতে করে এদেরকে যেকোনো এক সময় সাক্ষী হিসাবে ডাকা যেতে পারে)। জেল কোডে “হিংসা-বিদ্বেষ বা আবেগের বশবর্তী হয়েকোনো কাজ করবো না” কিংবা এর কাছাকাছি ভাষায় এটাই লেখা থাকে যেটা মেনে চলতে বাধ্য থাকেন জেল কর্তৃপক্ষ। কিছুক্ষণের মধ্যে দুইটি একই রকম টিনটেড গ্লাস লাগানো ল্যানডক্রুজার দ্রুতগতিতে জেলের ভেতর ঢুকে পড়ে। একটিতে ছিলেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারার আগেই মেজর হুদাকে জেলের একটি কামরায় গোপনে নিয়ে এসে তাকে ফ্লোরের উপর চিত করে ফেলে দেয়া হয় হাত পা বাঁধা অবস্থায়। এরপর হাসিনার নির্দেশে তার গলাটা যখন ছুরি চালিয়ে অতি নিষ্ঠুর ভাবে কেটে দিচ্ছিল কাশিমপুর থেকে আনা হিন্দু জল্লাদ তখন স্বয়ং শেখ হাসিনা জিঘাংসায় উন্মত্ত হয়ে পেত্নির মতো মেজর হুদার বুকে পা রেখে তৃপ্তির হাসি হাসছিলেন। ফিনকি দিয়ে বেরিয়ে আসা রক্তে হাসিনার শাড়ি ভিজে যায়। এভাবেই, শেখ হাসিনা তার প্রতিজ্ঞা অনুযায়ী রক্তপিপাসু জিঘাংসা চিরতার্থ করেছিলেন। একটি সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নায়কদের যখন বেআইনি ভাবে সাধারণ খুনের আসামী হিসাবে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিকাঠে ঝুলিয়ে তৃপ্তি পাচ্ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তখন হয়তো তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে সত্য চিরকাল লুকায়িত থাকে না। মেজর হুদার গলা কেটে খুন করার অভিযোগে খুনি হিসাবে হাসিনার বিচার বাংলাদেশের আইনি আদালতেই একদিন হবে নিয়তির বিধান মতোই ইন শা আল্লাহ।
যখন জাতীয় বীরদের এক এক করে ফাঁসির মঞ্চে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল ডেথসেল থেকে, তখন দু’পাশের সেলগুলোতে বন্দী কয়েদীরা সবাই ডুকরে কেঁদে উঠে দু’হাত উপরে তুলে আল্লাহ্র দরবারে চিৎকারকরে ফরিয়াদ জানাচ্ছিল হে রাব্বুল আলামিন, এ তোমার কেমন বিচার! দেশের স্বাধীনতা রক্ষা আর দুঃখী বঞ্চিত দেশবাসীর হক প্রতিষ্ঠা করতে, জালিমের হাত থেকে মুক্ত করার অপরাধে কেনও অন্যায়ভাবে অবিচারের রায়ে তাদের মতো বীরদের ফাঁসিতে ঝোলানো হচ্ছে? দেশকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে স্বাধীন করার জন্য জানবাজি রাখা পরীক্ষিত বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং স্বাধীনতা উত্তরকালে জনস্বার্থে সব অন্যায়ের বিরুদ্ধে আপোষহীন সংগ্রামী দেশপ্রেমিক সেনাসদস্য ছিলেন এরা সবাই! আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য জনাব মালেক উকিলের লন্ডনে উচ্চারিত উক্তি অনুযায়ী, ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে বাংলাদেশে ফেরাউন শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী বাকশাল সরকারের পতন ঘটানোর মাধ্যমে শ্বাসরুদ্ধকর একনায়কত্বের স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জনগণ নাজাত লাভ করেছিলো। নাজাত দানকারী দেশ মাতৃকার এই অগ্রণী বীরদের ‘সাধারণ খুনি’ হিসেবে কোন আইনে বিচার করলো শেখের বেটি হাসিনা? জিয়ার বউ খালেদাই বা কেনোও এই অন্যায় বিচারের প্রতিবাদ করলো না? ২০০১ সালে বিপুল ভোটে জিতে ক্ষমতায় এসে খালেদা জিয়া আর তার জোটের শরিক জামায়াত এবং অন্যরা কেনও এই বীরদের মিথ্যা মামলার হাত থেকে মুক্তি দিলো না? তাদের এই বিশ্বাসঘাতকতার বিচার আল্লাহ্পাক নিশ্চয় করবেন, ছাড় পাবেনা এইসব জাতীয় বেঈমানদের কেউই। সবাই ডুকরে ডুকরে কাঁদছিল আর এইসব খেদোক্তি করছিল অন্তর থেকে। নিগৃহীত মানুষের ফরিয়াদে আল্লাহর আরশও কেঁপে ওঠে। বীররা সবাই ঐশ্বরিক শক্তিবলে ছিলেন শান্ত এবং জ্যোতির্ময়। কারও মুখে ভয়-ভীতি কিংবা কোনও উৎকন্ঠার লেশমাত্র ছিল না। দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সূত্রে এবং ফাঁসির সময় যে সমস্ত কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন তাদের কয়েকজনের কাছ থেকেই হৃদয় বিদারক এইসব তথ্য পরে জানা সম্ভব হয়েছে। দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়াতের প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে প্রশ্ন করলে বিএনপি জোটের নেতাদের ন্যক্কারজনক উত্তর দেশবাসীর অজানা নয়। কিন্তু যাদের জানা নেই তাদের জ্ঞাতার্থে বলছি।
বিএনপি বলে, ‘‘মওদুদ ম্যাডামকে বিভ্রান্ত করে বীরদের মুক্ত করতে দেয়নি।’’ আর জামাত দায় এড়ায় এই বলে আমরা জোটের জুনিয়ার পার্টনার হিসেবে ম্যাডামকে অনুরোধ করেছিলাম বীরদের ফাঁসি বন্ধ করতে। কিন্তু ম্যাডাম জবাবে বলেছিলেন, ‘‘এইবিষয়ে সিদ্ধান্তের দায়িত্বটা তার।’’ ম্যাডাম এখনও শিশু, বোতলে দুধ পান করেন!দেশের সংবিধান অনুযায়ী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় ঢাকায় সংরক্ষিত কবরস্থানে তাদের অন্তিম শয়ানে শায়িত করার কথা। কিন্তু জিঘাংসার বশবর্তী হয়ে হাসিনা ও তার সরকার জাতীয় বীরদের সেই ন্যায্য অধিকার থেকেও বঞ্চিত করে। সব কয়টি শহীদের লাশ কড়া নিরাপত্তার সাথে তাদের গ্রামের বাড়িতে পাঠিয়ে দেয়া হয় নিকট আত্মীয়-স্বজন এবং প্রিয়জনদের আপত্তির কোনও তোয়াক্কা না করেই। এতেও সন্তুষ্ট হতে পারেনি প্রতিহিংসা পরায়ণ শেখ হাসিনা।
স্থানীয় প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহ এবং দলীয় নেতাকর্মীদের প্রতি আদেশ জারি করা হয়, যাতে শহীদদের জানাজায় লোকসমাগম না ঘটতে পারে। কিন্তু সচেতন মানুষের বাঁধ ভাঙ্গা জোয়ার ঠেকাতে ব্যর্থ হয় প্রশাসন, সরকারী বাহিনী এবং দলীয় ক্যাডাররা। প্রতিটি শহীদের জানাজায় সব বাধা উপেক্ষা করে দেশের হাজার হাজার আবাল বৃদ্ধ বণিতা শরিক হয়েছিল তাদের প্রিয় নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, নির্ভীক, প্রতিবাদী বীর মুক্তিযোদ্ধাদের বুক ভরা দোয়ার সাথে শেষ বিদায় জানাতে।
নির্ভরযোগ্য সুত্রে জানা যায়, কয়েকশত সরকারী অস্ত্রধারীদের হুমকি-ধামকিকে বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন পূর্বক মেজর হুদার গ্রামের বাড়িতে হুদার জানাজায় পাঁচ লক্ষেরও অধিক জনসমাগম হয়। ঠিক এমন ভাবেই লক্ষ জনতার ঢল নেমে ছিল সব বাধা অতিক্রম করে অন্যদের জানাজায়ও।
শহীদের মৃত্যু নেই। তারা বেঁচে থাকে চিরজাগরূক হয়ে জন্ম-জন্মান্তরের প্রজন্মের চেতনায় সত্যপথের দিশারী হয়ে। তাদের মহত্ত্ব এবং আত্মত্যাগের বীরগাথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে সৃষ্টি হয় লক্ষ কোটি সাহসী বীর, যারা লড়ে চলে ন্যায় ও সত্যের জন্য যুগে যুগে। স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের প্রত্যেকেই হচ্ছে তিতুমীর, হাজি শরিয়তুল্লাহ, মাস্টারদা, ক্ষুদিরাম, তোরাব আলি, ভগত সিং-এর মতোই বিপ্লবী।
ইতিহাসের পাতায় স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে এদের বীরত্বগাথা, দেশবাসী গাইবে তাদের জয়গান। তাই নশ্বর এই পৃথিবীতে মরেও তারা হয়ে থাকবে অমর আগামীদিনের প্রজন্মের মধ্যেই।
দেশের সূর্যসন্তান বীরদের ফাঁসিতে বিএনপি এবং জামায়াতের প্রতিক্রিয়া
যাই হউক, বাস্তবে কি বলা হয়েছিলো এইদু’টি দলের তরফ থেকে সেটা নিচে তুলে ধরলাম।
খালেদা জিয়া’র নির্দেশে মওদুদের বিবৃতি স্টাফ রিপোর্টারঃ দৈনিক আমার দেশঃ ২৯/১/২০১০
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান হত্যা মামলার রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন সাবেকআইনমন্ত্রী ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। রায়ঘোষণার পর মতিঝিলের অফিসে এক প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, এ রায়জাতিকে স্বস্তি দিয়েছে। এর মাধ্যমে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পেল। সর্বোচ্চআদালতের রায় আমাদের সবার মেনে নিতে হবে।
ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদবলেন, এ রায়কে দলীয়ভাবে নয়, আইনের শাসনের দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে হবে। এ রায়েরমাধ্যমে শুধু আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা পায়নি, এটা জাতিকে স্বস্তি দিয়েছে। এধরনের হত্যাকাণ্ড আমরা দেখতে চাই না। রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডেরঘটনায়ও খুনিদের বিচার হয়েছে। প্রচলিত বিধিতে না হলেও হত্যাকারীদের বিচারহয়েছে। সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ বলেন, ৫ জন আসামি আপিল করেছিলো। যারা আপিল করেনি, তাদের বেলায়ও এখন ফাঁসি কার্যকরের রায় প্রযোজ্য হবে। সংবিধানের বিধি উল্লেখ করে প্রবীণ এ আইনজীবী বলেন, ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী৩০ দিনের মধ্যে রিভিউর জন্য আবেদন করতে পারবে। নতুন কোনো তথ্য-উপাত্ত থাকলেরিভিউ পিটিশন দায়ের করা যায়। ৯৯১ জেল কোড অনুযায়ী সুপ্রিমকোর্টের আদেশ জেলকর্তৃপক্ষের কাছে গেলে ২১ দিন পর ও ২৮ দিনের মধ্যে রায় কার্যকর করতে হবে।এজন্য রিভিউ পিটিশন ২১ দিনের মধ্যেই করাটা আসামিদের জন্য ভালো হবে। তিনি বলেন, রিভিউ পিটিশনে সাধারণত রায় বহাল থাকে। আর রায় বহাল থাকলে ৪৩অনুচ্ছেদ অনুযায়ী আসামিরা ক্ষমার জন্য রাষ্ট্রপতির কাছে আবেদন করতে পারবে।ওই আবেদন আইন মন্ত্রণালয় ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে যাবে। ক্ষমার আবেদনরাষ্ট্রপতি প্রত্যাখ্যান করলে তখন জেল কর্তৃপক্ষ রায় কার্যকর করবে।
বিএনপির এই আইনজীবী নেতা কিন্তু বললেন না যে তারই কথিত আইনি অনুচ্ছেদগুলো সূর্যসন্তানদের ফাঁসির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয়নি। আসামিদের রিভিউ পিটিশনও সরকারের পদানত আদালত গ্রহণ করেনি। তিনি কিন্তু একবারও উল্লেখ করলেন না যে, বিশ্বের সভ্য কোনও দেশ এবং মানবাধিকার প্রতিষ্ঠায় ব্রতী কোনও প্রতিষ্ঠানই ক্যাঙ্গারু কোর্টের সাজানো মামলা এবং প্রহসনমূলক বিচারের রায় মেনে নেয়নি।তারাএই রায়কে আখ্যায়িতকরেছিল, “Hasina ’s political trial, miscarriage of justice and Judicial Murder” হিসাবে।
আদালতের রায়ের প্রতি আমরা শ্রদ্ধাশীল- জামায়াতের আমীরের নির্দেশেমোহাম্মদ মুজাহিদের বিবৃতি স্টাফ রিপোর্টারঃ দৈনিক আমার দেশঃ ২৯/১/২০১০ মোহাম্মদ মুজাহিদ বলেছেন, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী আইনের শাসনে বিশ্বাসী।দীর্ঘ শুনানির পর সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছেন তার প্রতি আমরাশ্রদ্ধাশীল। গতকাল বিভিন্ন সংবাদপত্র ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকরাস্বাধীনতার স্থপতি মরহুম শেখ মুজিবুর রহমান হত্যার বিচারের রায় সম্পর্কে প্রতিক্রিয়া জানতে চাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে জনাব মুজাহিদ এই প্রতিক্রিয়াব্যক্ত করেন।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আওয়ামীলীগকে ক্ষমতাসীন করিয়েছিলো জেনারেল মইনুদ্দিন এবং ফখরুদ্দিন সরকার দেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে মাইনাস ওয়ান ফর্মুলা কার্যকর করার জন্য। ক্ষমতায় আসীন হয়েই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শেখ রেহানার স্বামীর অনুজ জেনারেল (অবঃ) তারেককে তার সামরিক উপদেষ্টা হিসাবে নিয়োগ দান করেন। চক্রান্তমূলক বিডিআর এর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, নির্বাচনী বিজয়, এবং বিডিআর হত্যাযজ্ঞে ‘উদ্দিন’ সরকারের সহযোগিতার পুরস্কার হিসাবে তাদের সব অবৈধ কার্যক্রমকে বৈধতা দান করে আওয়ামীলীগের মহাজোট সরকার এবং পরিশেষে সব কুশীলবদের আমেরিকায় পাড়ি জমাবার সুযোগ করে দেয়া হয়।
চক্রান্তমূলকনির্বাচনী বিজয়, বিডিআর-এর নির্মম হত্যাযজ্ঞ, জাতীয় বীরদের ফাঁসি, এই সবকিছুই ছিলো পূর্বপরিকল্পিত। বিডিআরের নির্মম, ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞে অসহায় অবস্থায় মেরে ফেলা হয়েছিল ৫৭ জন সেনাবাহিনীর চৌকস অফিসারকে ভাড়াটিয়া বিদেশী কমান্ডো এনে।
লাঞ্ছিত হয়েছিলেন তাদের পরিবার পরিজনেরা। এ ছাড়াও অকল্পনীয় শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে বন্দী অবস্থায় মেরে ফেলা হয়েছিল কয়েক’শ সেনা সদস্যকে। বিডিআর বিদ্রোহের দিন পিলখানার অভ্যন্তরে যখন হত্যাযজ্ঞ চলছিলো ভাড়া করা কমান্ডোদের দ্বারা তখন শেখ হাসিনার ইশারায় নিষ্ক্রিয় হয়ে বসেছিল তদানীন্তন সেনাপ্রধান। যদিও বারবার সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছিলো পিলখানার বিডিআর ছাউনি থেকে হত্যাযজ্ঞ শুরু হওয়ার আভাস পাওয়ার পরমুহূর্ত থেকেই। এই নির্মম হত্যাযজ্ঞের পর সেনাকুঞ্জে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাক্ষাতে শোকার্ত,আবেগাপ্লুত সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক অফিসার এবং সৈনিকরা ক্ষোভ এবং উষ্মায় ফেটে পড়ায় প্রধানমন্ত্রী বিচারের আশ্বাস দিয়ে পদোন্নতি দিয়ে অবসরে পাঠানো তার অতি বিশ্বস্ত এ এস পি আকন্দকেই ডাকিয়ে এনে তদন্তের জন্য IO হিসাবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এই একই ব্যক্তিআকন্দের মাধ্যমেই ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ মামলার তদন্তও করানো হয়েছিল। সেই রিপোর্ট আজঅব্দি প্রকাশিত হয়নি। তবে তদন্ত সাপেক্ষে বিচারের আগেই সেনাবাহিনী থেকে বেছে বেছে আরও প্রায় দুইশ’ অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হয় অন্যায় ভাবে। জেলবন্দী করা হয় প্রায় ৪০০০০ সেনা সদস্যকে। পরে বিজিবি গঠনের পর একটা দায়সারা গোছের বিচারের প্রহসন করে অসংখ্য সেনা সদস্যকে ফাঁসি কিংবা কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। অগুণতি সেনা সদস্যকে কারাবন্দী অবস্থায় হার্ট অ্যাটাকের নাটক সাজিয়ে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। এই ন্যক্কারজনক সাজানো নির্মম পরিকল্পনার মূল দু’টি উদ্দেশ্য ছিলো।
১। ঐতিহ্যবাহী একটি সশস্ত্রবাহিনীর বিলুপ্তি ঘটিয়ে তার স্থলে মুজিবের কুখ্যাত রক্ষীবাহিনীর আদলে হাসিনা সরকারের দলীয় ক্যাডারদের সমন্বয়ে বিশেষভাবে বিশ্বস্ত এবং অনুগত একটি বাহিনী বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ(BGB) গড়ে তুলে সরকারের নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ এবং ভারতীয় বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সম্পূরক হিসাবে বর্ডার সংরক্ষণের দায়িত্ব পালন করানোই ছিল ঐ নৃশংস হত্যাযজ্ঞের উদ্দেশ্য। এর পরিণামেই অহরহ মৃত ফেলানিদের সীমান্তের কাঁটাতারে ঝুলতে দেখতে পাচ্ছেন দেশবাসী। প্রায় প্রতিদিনই ভারতীয় BSF নির্দ্বিধায় গুলি করে মারছে বর্ডার সংলগ্ন গ্রামবাসীদের মনগড়া মিথ্যে অজুহাতে পাখির মতো।
২। অফিসার নিধনের মাধ্যমে দেশের মেরুদণ্ড সেনাবাহিনীকে মানসিক ও নৈতিকভাবে হীনবল এবং সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল করে তোলাও ছিল পরিকল্পনার অংশ।
বিডিআর-এর প্রতি আওয়ামীলীগ এবং ভারতের আক্রোশের কারণ রয়েছে। ১৯৭১ সালে পাক আর্মির ক্র্যাকডাউনের পর জেনারেল জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণা প্রচার করার আগেই চট্টগ্রামের বিডিআর-এর বাঙ্গালী সদস্যরা বিভিন্ন বিওপিতে অবস্থানরত অবাঙ্গালী অফিসার এবং সৈন্যদের নিরস্ত্র করে দখল করে নিয়েছিলো চট্টগ্রামের বিডিআর উইঙ্গের এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলামের নির্দেশে। এরপর থেকে মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতার পর এই ঐতিহ্যবাহী বাহিনীর অগুণতি দেশপ্রেমের সাক্ষর রয়েছে জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে।বীর মুক্তিযোদ্ধা বিডিআর প্রধান মেজর জেনারেল ফজলুর রহমানের নেতৃত্বে পদুয়ার ভারতীয় বিএসএফ এর দাম্ভিক স্পর্ধার জবাবে দুঃসাহসিক পুশব্যাক অপারেশন তারই একটি জ্বলন্ত নিদর্শন।
বিডিআর এর হত্যাযজ্ঞের পর নিহত অফিসারদের পরিবার এবং এই নৃশংসতার প্রতিবাদ করায় চাকুরিচ্যুত সেনা সদস্যরা সবাই বিরোধী জোট নেত্রীর শরণাপন্ন হয়ে এই সুপরিকল্পিত চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে জনগণকে সাথে নিয়ে ভারতের সেবাদাস সরকার বিরোধী জোরদার আন্দোলন গড়ে তোলার আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়ার জোট সে ধরনের কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ না করে নিষ্ক্রিয় থাকে। ফলে, সেনাবাহিনীতে জিয়া পত্নী খালেদার জনপ্রিয়তায় ধ্বস নামে। এরই প্রতিফলন দেখা গিয়েছিল যখন খালেদা জিয়াকে হেস্তনেস্ত করে অত্যন্ত আপত্তিকর অবস্থায় হাসিনা সরকার তাকে টেনে হিঁচড়ে এক কাপড়ে অপমান করে শহীদ মইনুল রোডের বাড়ী থেকে বের করে দেয়।তখন সেনাবাহিনীতে কোনও বিরূপ প্রতিক্রিয়াই পরিলক্ষিত হয়নি। উল্টো আই এস পিআর থেকে বিজ্ঞপ্তি জারি করা হয়েছিল, আদালতের রায় অনুযায়ী তাকে বাড়ী থেকে উচ্ছেদ করে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়েছে। অদৃষ্টের পরিহাস!
সদা পরিবর্তনশীল মানবসভ্যতার চলমান ধারায় পৃথিবী বর্তমানে এক ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। পুরনো ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ছে। ক্ষয়িষ্ণু বিশ্ব শক্তিগুলো এবং তাদের আঞ্চলিক মোড়লদের মধ্যে দখলদারিত্ব এবং প্রভাব বলয় সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন নতুন ফন্দি ও কৌশল উদ্ভাবন এবং সেগুলো তুলনামূলক অনগ্রসর পশ্চাৎপদ দেশ এবং জাতিগোষ্ঠীর উপর ছলে বলে চাপিয়ে দেবার প্রবল সহিংস প্রতিযোগিতা চলেছে বিশ্বপরিসরে। অন্যদিকে এর বিরোধিতায় পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে সমমাত্রায় জনগণের প্রতিবাদী সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠছে। কারণ, বিশ্ব শক্তিগুলো ও তাদের স্থানীয় সেবাদাসদের বিভিন্ন প্রকার সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসনের মূল লক্ষ্য হচ্ছে মানব এবং প্রাকৃতিক সম্পদের উপর নিয়ন্ত্রণ কায়েম করার অমানবিক প্রতিযোগিতা। ক্ষয়িষ্ণু পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার জন্য পরের ধনসম্পদ কুক্ষিগত করার চেতনা এবং লোভ লালসা পৃথিবীর প্রতিটি দেশের আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে সৃষ্টি করছে সংঘাতমূলক দ্বন্দ্বের। জনগণের মধ্যে বেড়ে চলেছে সহিংসতা এবং দ্বিধাবিভক্তি। ফলে আজকের পৃথিবীর প্রতিটি দেশই হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল। একদিকে ক্ষয়িষ্ণু বিশ্বব্যবস্থাকে টিকিয়ে রাখার হিংস্র আগ্রাসী প্রচেষ্টা আর এরই বিপরিতে প্রতিবাদী সংগ্রাম। এর ফলেই চারদিকে বইছে রক্তগঙ্গা। অনুন্নত বিশ্বের প্রতিটি দেশে বিশ্ব শক্তিগুলোর লালিত পালিত শাসক এবং শোষকগোষ্ঠী এবং তাদেরই অনুগত তথাকথিত সুশীল সমাজের অন্যায়, অবিচার, বঞ্চনা, শোষণ এবং অপশাসনের যাঁতাকলের নিচে পিষ্ট নিপীড়িত বৃহত্তর জনগোষ্ঠী বাঁচার তাগিদে ও অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় পুঞ্জিভূত ক্ষোভ আর উষ্মায় ঘুরে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। জনগণের সেই প্রচেষ্টাকে দমনের জন্য প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় কাঠামোধীন প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, প্রতিরক্ষা বাহিনী, বিচার বিভাগকে লেলিয়ে দেয়া হচ্ছে কায়েমীগোষ্ঠীস্বার্থে।
অনুন্নত দেশগুলোতে সামরিক কিংবা বেসামরিক সরকারের মধ্যে গুণগত কোনও তফাৎ নেই। গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মধ্যেও কোনও পার্থক্য নেই। কারণ, জাতীয় পরিসরে সব তন্ত্রকেই নিয়ন্ত্রণ করছে গণবিচ্ছিন্ন জাতীয় স্বার্থ বিরোধী মানসিকতার একই কায়েমী গোষ্ঠী।
গণ-জাগরণকে পরাস্ত করার জন্য বিভিন্ন খোলসে এই একই গোষ্ঠীর অনুচররা ঢুকে পড়ে জনতার সংগ্রামে, তারপর অতি চতুরতা এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে নিজেদের অর্থবল এবং পেশীশক্তির সাহায্যে হাইজ্যাক করে নেবার চেষ্টা করে থাকে আমজনতার সংগ্রাম তাদেরই কায়েমী স্বার্থে। এভাবেই যুগে যুগে মানব সভ্যতার ইতিহাসে পরাজিত হয়েছে হাজারো বিপ্লব এবং মুক্তি অর্জনের লক্ষ্যে গণঅভ্যুত্থান ভেড়ার ছালের আবরণে আচ্ছাদিত হায়েনা চরিত্রের নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতায়। বর্তমানের বাংলাদেশেও জনগণের সার্বিক মুক্তির সংগ্রাম বিশ্বাসঘাতকতার অন্ধ গলিতে হারিয়ে গিয়েছে তিন বার।
প্রথমতঃ ১৯৭১ সালে আমাদের মুক্তিসংগ্রামকে মাঝপথেই হাইজ্যাক করে নেয় ভারত প্রবাসী আওয়ামীলীগ সরকারের মাধ্যমে দাসখত লিখিয়ে নিয়ে। প্রতিদানে আওয়ামী-বাকশালীদেরকে সেবাদাস হিসাবে সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণের ঘাড়ের উপর জগদ্দল তল্পিবাহকদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হয়।
দ্বিতীয়তঃ ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের সাথে জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় যুদ্ধকালীন সময় থেকে সেনা পরিষদের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের সব প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়ে যায়।
তৃতীয়তঃ স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে গণ-আন্দোলনের সাথে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের বিশ্বাসঘাতকতায় কক্ষচ্যুত হয়ে যায় সেই আশা!
অতীতের এই ব্যর্থতা থেকে শিক্ষা নিয়েই এগিয়ে যেতে হবে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে দেশের ঘুণেধরা ঔপনিবেশিক আর্থ-মাজিক এবং রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোতে যুগোপযোগী আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধন করে ’৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্নজনগণের সার্বিক মুক্তিসংগ্রামের বিজয় অর্জনের লক্ষ্যে। আমাদের ঐতিহ্য, স্বাধীন সত্তা, ভাষা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উপরই গড়ে উঠেছে আমাদের আলাদা নিজস্ব স্বকীয়তা। যেকোনো জাতীয় সত্তা গড়ে ওঠার জন্য ভাষাই একমাত্র উপাদান নয়। এটা আমাদের ভুললে চলবে না। আজকের বাংলাদেশে ৬০ শতাংশের উপর মানুষ মানবেতর জীবনের বোঝার ভারে ন্যুব্জ হয়ে দারিদ্রসীমার নিচে জীবন্মৃত অবস্থায় কালযাপন করছে। জাতীয় সম্পদের ৮০ শতাংশ আজ ১-২ শতাংশ কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর হাতের মুঠোয়। জাতীয় সম্পদের এ ধরনের অসম বণ্টনের ফলে আর্থ-সামাজিক এবং রাজনৈতিক ভাবে দেশের ৯৮ শতাংশ জনগণ মূলত জিম্মি হয়ে পড়েছে ঐ ১-২ শতাংশের হাতে। এই পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে জাতির বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মুক্ত করে তাদের প্রাণশক্তি, মেধা, সৃজনশীলতা ও কর্মক্ষমতাকে সঠিক নেতৃত্বের অধীনে সুপরিকল্পিত ভাবে কাজে লাগাতে না পারলে দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বকে সুসংহত করা এবং একই সাথে অপরিমেয় সম্ভাবনার দেশটিকে আত্মমর্যাদাশীল, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল ও সমৃদ্ধশালী করে গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব নয়। বাংলাদেশ মানে চকমকে কয়েকটা শহর নয়, আসল বাংলাদেশ হল ৬৮ হাজার গ্রাম ও সেখানে বসবাসকারী জনগোষ্ঠী। গ্রামাঞ্চল এবং সেখানকার জনগোষ্ঠীর মানবাধিকার, বাক-স্বাধীনতা, আইনি অধিকার, স্বায়ত্তশাসন, রাজনৈতিক অধিকার এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে অধিকারের মাত্রা কতটুকু সেটার উপরেই নির্ভর করে বাংলাদেশের উন্নতি যাচাইয়ের মানদণ্ড।
নীতি-আদর্শ বিবর্জিত দুর্নীতিগ্রস্ত শহর ভিত্তিক দালাল ও মুৎসুদ্দিশ্রেণীর শিক্ষিত কুলাঙ্গাররা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অবাধ লুটতরাজের মাধ্যমে বর্তমানে তথাকথিত সুশীল সমাজের ঠিকাদার এবং রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী বনে বংশপরিক্রমায় দেশটাকে তাদের জমিদারি আর জনগণকে তাদের অনুগত প্রজা মনে করে রক্ত চুষে চলেছে। এই রক্তচোষাদের চিহ্নিত করে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে আঁস্তাকুড়ে। চিরতরের জন্য গুঁড়িয়ে দিতে হবে তাদের পেশীশক্তি এবং ছিনিয়ে নিতে হবে দুর্নীতি ও অসৎউপায়ে স্তূপীকৃত ধনবল।ভুইফোঁড় এইসব মধ্যস্বত্বভোগী পরগাছাগুলোকে সমাজের প্রতিক্ষেত্র থেকে কোনও প্রকার পক্ষপাতিত্ব না করে সমূলে উপড়ে ফেলার সাথে সাথে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে এমন একটি রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রশাসন, আইনি এবং রাজনৈতিক ব্যবস্থা যেখানে থাকবে না কোনও ফাঁক-ফোকর যার মাধ্যমে সময়ে আবার ওই ধরনের চীনেজোঁক শ্রেণী জন্মাতে পারে।একই সাথে নিয়মিত শুদ্ধি অভিযানের মাধ্যমে অংকুরেই নস্যাৎকরে দিতে হবে এ ধরনের যেকোনো প্রবণতা বা সমীকরণের উদ্দগ। এই ধরনের পরিবর্তন আনার প্রক্রিয়ায় পরামর্শ এবং সাহায্য-সহযোগিতা নেয়া যেতে পারে পরীক্ষিত ভ্রাতৃসুলভ রাষ্ট্রগুলোর অভিজ্ঞতা এবং শিক্ষা থেকে। কিন্তু কোনও ফর্মুলাই ধার করে এনে অবশ্যই হুবহু চাপিয়ে দেয়া চলবে না জনগণের উপর। এই ধরনের প্রয়াস কখনই কার্যকরী হয় না। প্রয়োগ করতে হবে নিজেদের বাস্তবতার নিরিখে লব্ধ অভিজ্ঞতার আলোকে প্রণীত কার্যক্রম। এ ছাড়া কোনও ভাবেই আত্মমর্যাদাশীল, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী দেশ এবং জাতি হিসাবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাড়ানো সম্ভব হবে না।
মানবিক আধিকার, বাকস্বাধীনতা, আইনের শাসন, ন্যায়সঙ্গত সুষম সমাজ ব্যবস্থা প্রতিটি নাগরিকের মেধা এবং সৃজনশীল কর্মদক্ষতার বহিঃপ্রকাশের পূর্ণসুযোগ, ঐতিহ্যবাহী নৈতিক, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের উপর জাতীয় চরিত্র গঠন যদি নিশ্চিত করা সম্ভব না হয় তবে স্বকীয়তা এবং স্বাধীনতা টিকিয়ে রাখা দুষ্কর হয়ে ওঠে। ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য এবং দীর্ঘমেয়াদি স্থিতিশীলতা প্রগতি এবং উন্নয়নের দু’টি পূর্বশর্ত। শৃংখলাবোধের সাথে জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের কর্তব্য এবং রাষ্ট্রের প্রতি জনগণের কর্তব্য সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা না থাকলে স্থায়ী জাতীয় ঐক্য এবং স্থিতিশীলতার কোনোটাই অর্জন সম্ভব নয়। যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগপ্রাপ্ত পেশাজীবীদের প্রত্যেককেই হতে হবে সততার সাথে আন্তরিক এবং নিষ্ঠাবান।
পেশার ভিত্তিতে কোনও নাগরিকের সামাজিক অবস্থান নির্ধারণ অসুস্থ এবং বিকৃত মানসিকতার বহিঃপ্রকাশ। একটি ন্যায়সঙ্গত সুষম সমাজে প্রতিটি মানুষের চারিত্রিক উৎকর্ষতা,স্বচ্ছতা, গুণাবলী, দেশপ্রেম, কর্মনিষ্ঠা, সত্যকহন, স্পষ্টবাদিতা, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, দায়িত্ববোধ,বিশ্বাসযোগ্যতা, প্রজ্ঞা, অভিজ্ঞতা, সমাজ সচেতনতা, নির্লোভ আত্মত্যাগের মূল্যায়নের উপরই নির্ভর করবে ব্যক্তি বিশেষের সামাজিক অবস্থান।বর্তমানে অর্থসম্পদ এবং পেশীশক্তির বলে সমাজপতি হওয়ার যে অপসংস্কৃতির ঘৃণ্য প্রতিযোগিতা চলছে তার অবসান ঘটাতে হবে। কারণ, পচন শুরু হয় মাথা থেকেই। একটি সমাজের মাথা হচ্ছে সরকার। যতদিন না দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণকে আর্থ-সামাজিকভাবে অতিক্ষুদ্র কিন্তু অভাবনীয় ভাবে বিদেশী মদদপুষ্ট ক্ষমতাবান কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর নিগড় থেকে স্বাধীন করা না যাবে ততদিন তারা স্ব-ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যোগ্য ব্যক্তিদের রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করতে সক্ষম হবে না নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় কিংবা বৈপ্লবিক গণ-আন্দোলনের মাধ্যমেও। ফলে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কোনও জবাবদিহি প্রতিষ্ঠানই গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর প্রণীত রাষ্ট্রীয় কাঠামো, প্রশাসনিক এবং আইনী ব্যবস্থা, বিভিন্ন সশস্ত্র বাহিনী, গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ এবং দেশের রাজনীতি যতদিন বিদেশী শক্তিগুলোর পদলেহি তল্পিবাহকরা কুক্ষিগত করে রাখবে ততদিন ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন সত্ত্বেও কোনক্ষেত্রেই যুগোপযোগী মৌলিক পরিবর্তন আনা সম্ভব হবে না। যুক্তিটা অনুধাবন করা কষ্টকর নয়। যারা বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর থেকেই অতীতের মানসিকতা বজায় রেখে বর্তমানের ঘুণেধরা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো এবং রাজনৈতিক অপসংস্কৃতির সাহায্যে চীনেজোঁকের মতো জাতীয় সম্পদ ও জনগণকে চুষে চলেছে, তারই ‘সোনার ডিম’ দেয়া হাঁসটাকে বর্জন করবে তেমনটি কখনোই হবার নয়। আরও সাদামাটা ভাবে বলতে গেলে বলতে হয়, ঔপনিবেশিক বিজাতীয়রা তাদের জবরদখল, শাসন, শোষণ, নিপীড়ন বলবত রাখার জন্যই এই ধরনের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আইনি ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং বিভিন্ন সামরিক এবং বেসামরিক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠিত করেছিলো স্থানীয় তল্পিবাহকদের সহযোগিতায়। প্রচলন করেছিলো অপসংস্কৃতি এবং অপরাজনীতির,সেইসব দেশের জনগণের উন্নয়ন কিংবা সমৃদ্ধির জন্য নয়। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর অন্তর্দ্বন্দ্বের ফলেই দু’টি ধ্বংসাত্মক বিশ্বযুদ্ধ ঘটে যার ফলে অর্থনৈতিক এবং সামরিক ভাবে তারা বিধ্বস্ত ও দুর্বল হয়ে পড়ে। তাদের দুর্বলতার সুযোগে সারাবিশ্বের নিপীড়িত জনগণ গড়ে তোলে দুর্বার জাতীয় স্বাধীনতা ও মুক্তিসংগ্রাম, যার মোকাবেলা করতে অসমর্থ হয়ে তাদের অধীনস্থ ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রগুলোকে স্বাধীনতা দিতে বাধ্য হয় ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলো। কিন্তু উপনিবেশগুলো ত্যাগ করার আগে অতিকৌশলে এবং চাতুর্যের সাথে তাদের সৃষ্ট এবং পালিত সেবাদাসদের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতা বানিয়ে তাদেরকেই স্বাধীনতার পর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হয়। প্রতিদানে ঐসব তল্পিবাহক শাসকগোষ্ঠী নিজেদের গোষ্ঠীস্বার্থ এবং ঔপনিবেশিক প্রভুদের স্বার্থ রক্ষার জন্যই জাতীয় স্বার্থ এবং গণবিরোধী ঔপনিবেশিক অবকাঠামোকেই অটুট রেখে সাদা চামড়ার সাহেবদের জায়গাতে নিজেরাই ‘ব্রাউন সাহেব’ সেজে বসে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং দুর্নীতির মাধ্যমে সার্বিকভাবে বলিয়ান হয়ে ওঠে। ফলে দেশ ও জনগণের উন্নতির পরিবর্তে অবনতিরই ক্রমবিকাশ ঘটতে থাকে।
‘৭১-এর মুক্তি সংগ্রামকালে প্রবাসীসরকার সম্প্রসারণবাদী ভারতের ইচ্ছা অনুযায়ী দাসখত লিখে দিয়ে খয়রাতি স্বাধীনতা লাভ করার সিদ্ধান্ত নেয়। প্রতিদানে স্বাধীনতার পর আওয়ামী লীগকেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে দেয় ভারত জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বের একচ্ছত্র অধিকারী হিসাবে। আঁতাতের মাধ্যমে শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তান থেকে ফিরে এসে নিজেই দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ২৫ বছরের গোলামির চুক্তি সাক্ষর করে বাংলাদেশকে মূলত ভারতের একটি করদ রাষ্ট্রে পরিণত করেন। এরই সাথে ধূলিসাৎ হয়ে যায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত সংগ্রামী দেশবাসীর স্বপ্ন। এভাবেই স্বাধীনতার প্রথম লগ্ন থেকেই শুরু হয় বিদেশী প্রভুদের প্রতিভূ দেশ ভারত এবংকায়েমী গোষ্ঠীস্বার্থে নেতৃত্বের প্রতারণা, অপশাসন, শোষণ, দুর্নীতি ও দলীয়করণের ধারাবাহিক ইতিকথা। সময়ের সাথে পরনির্ভরতা, লেজুড়বৃত্তি, অপশাসন, লুটতরাজ, দুর্নীতি, ক্ষমতাদখলের সহিংস প্রতিযোগিতার ফলে জাতীয় জীবন হয়ে পড়ে বিপর্যস্ত। কেন এই পরিণাম সেটা জানতে হলে ফিরে তাকাতে হবে মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট এবং রণাঙ্গনের বাস্তব পরিস্থিতির দিকে। তারই সারসংক্ষেপ পাঠকদের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। ষাটের দশকের মাঝামাঝি স্বাধিকার আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ করে পাকিস্তানের সামরিক জান্তার উপর জাতীয় নির্বাচন করানোর চাপ সৃষ্টি করার লক্ষে শেখ মুজিব তার ৬দফা নির্বাচনী দাবি উত্থাপন করেন। কিন্তু তার সেই ৬দফাতে সামরিক জান্তা বিচ্ছিন্নবাদের গন্ধ খুঁজে পায়। এই অবস্থায় পাকিস্তান গোয়েন্দা সংস্থা উদ্ঘাটন করে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা। এর প্রধান পরিকল্পনাকারীদের মধ্যে ছিলেন পাকিস্তান সেনাবাহিনী, বিমানবাহিনী, নৌবাহিনী এবং সরকারি আমলাদের কিছু তরুণ সদস্য। তাদের উদ্দেশ্য ছিল সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে স্বাধীন করা। এই ষড়যন্ত্রের প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন নৌবাহিনীর কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন। তিনি শেখ মুজিবের রাজনৈতিক সমর্থন চেয়ে বিফল হয়ে ভারতের সাহায্য চেয়ে আশাপ্রদ সমর্থন লাভে ব্যর্থ হন। সেই পর্যায়ে পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ষড়যন্ত্রটি জনগণের সম্মুখে প্রকাশ করে একটি মামলা দায়ের করে ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামে। এতে শেখ মুজিবুর রহমান, কমান্ডার মোয়াজ্জেম হোসেন, ফ্লাইট সার্জেন্ট জহুরুল হক,স্টুয়ার্ড মুজিব, সিএসপি অফিসার রুহুল কুদ্দুস, ক্যাপ্টেন নাজমুল হুদা, ক্যাপ্টেন খুরশিদ, ক্যাপ্টেন শওকত আলী প্রমুখকে আসামী হিসেবে কারাবন্দী করা হয়।
এতে পূর্ব পাকিস্তানে মুজিবের ৬ দফা ভিত্তিক স্বাধিকার আন্দোলনে ভাটা পড়ে। সেই সন্ধিক্ষণে মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানী ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবী নিয়ে দেশব্যাপী দুর্বার গণ-আন্দোলন গড়ে তুলে ‘আগরতলা মামলা’কে সাজানো মামলা অভিহিত করে মুজিবসহ সব আসামির মুক্তি দাবি করেন। তার নেতৃতে ঝিমিয়ে পড়া আন্দোলন পুনরায় প্রাণ ফিরে পায়। বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতিতে সামরিক জান্তা শেখ মুজিবসহ অন্যদের প্যারোলে মুক্তি দিয়ে মুজিবকে পিণ্ডিতে গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের আহ্বান জানায়। অভিযুক্তদের মুক্তির পর মাওলানা ভাসানী শারীরিক অসুস্থতার কারণে মুজিবের হাতে নেতৃত্ব তুলে দিয়ে স্বাধিকারের সংগ্রামকে আপোষহীনভাবে স্বাধীনতা পর্যন্ত এগিয়ে নিতে পরামর্শ দেন। কিন্তু শেখ মুজিব গোলটেবিল বৈঠকে যোগদানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন তীব্র গণআন্দোলনের ফলেই রাতারাতি মুজিব কারামুক্তির পর হয়ে ওঠেন পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির কিংবদন্তির নায়ক। ১১দফা এবং ৬ দফা আন্দোলনকে গণজোয়ারে পরিণত করার ক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিল তরুণরা এবং ছাত্র সমাজ। তারাই ছিল অগ্রণীর ভূমিকায়। এরপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের প্রণীত LFO এর আওতায় সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। কিন্তু জনাব ভুট্টোর কারসাজিতে মুজিবের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে দেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান বলপ্রয়োগের মাধ্যমে করার আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত নেয় সামরিক জান্তা। ফলে, ২৫-২৬ মার্চ কালরাতে বর্বরোচিত সামরিক শ্বেত সন্ত্রাসের পরিপ্রেক্ষিতে সশস্ত্র বাহিনীগুলোর বাঙ্গালী সদস্যরা বিদ্রোহ করে। তাদের কেন্দ্র করেই দেশব্যাপি স্বতঃস্ফূর্ত ভাবেই শুরু হয় সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। সেই সংগ্রামই পরে পরিণত হয় স্বাধীনতার সংগ্রামে। এখানেও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সচেতন তরুণ প্রজন্ম।
প্রচারিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী যুদ্ধকালীন সময়ে ১ কোটি শরণার্থী পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রাণের দায়ে ভারতে পাড়ি জমিয়ে শরণার্থী ক্যাম্প এবং যুব ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। তাদের থেকেই গড়ে তোলা হয় মুক্তিবাহিনী জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে। ভারতে হিজরতকারী সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারদের বেশির ভাগই ওপারে তাদের জ্ঞাতি-গোষ্ঠীর সহযোগিতায় নিরাপদেই থাকার সুযোগ পেয়েছিলো। আওয়ামী ঘরানার রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদেরও জামাই আদরে নিরাপদ আশ্রয় করে দিয়েছিলো ভারত সরকার জনাব নজরুল ইসলাম এবং জনাব তাজুদ্দিনের অধীনস্থ প্রবাসী সরকারের সাথে ভারত সরকারের ৭ দফা চুক্তি সাক্ষরিত হবার পর।
বগুড়ার স্টেট ব্যাঙ্কের শাখা এবং প্রায় সব জিলা এবং মহকুমার ট্রেজারি এবং ব্যাংকে গচ্ছিত সব টাকাই স্থানীয় প্রশাসন এবং আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী এবং দলীয় মাস্তানরা লুট করে নিয়ে আসে ভারতে। সেই অর্থের কিয়দংশই জমা পড়েছিলো প্রবাসী সরকারের খাজানায়। সিংহভাগই থেকে যায় লুণ্ঠনকারীদের পকেটে। তাই তাদের নির্বাসন জীবন ছিল হাওয়া বদলের নিরাপদ বিলাসী জীবন। এদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের কোনও সম্পর্ক না থাকলেও প্রবাসী সরকারের পীঠস্থান ৮নং থিয়েটার রোড এবং ১৯ নং সার্কাস এভেন্যুর সং সেজে তারা অপেক্ষায় ছিলেন কখন একটা স্বাধীন দেশ পাওয়া যাবে আর তারা ফিরে গিয়ে ক্ষমতায় জেঁকে বসে লুটের অর্থসম্পদ উপভোগ করবেন। তবে ব্যতিক্রমও ছিলো। এদের মধ্যে স্বল্পসংখ্যক ব্যক্তি নিরাপদ আয়েশি জীবনের প্রলোভন ত্যাগ করে মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিলেন।এ সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে হলে আমার লেখা বই, ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইটি পড়ে দেখতে পারেন কিংবা www.majordalimbu.com অথবা www.majordalimbubangla.com থেকে ডাউন লোড করে নিতে পারেন।
এ কথা অস্বীকার করার কোনও অবকাশ নেই, বেশিরভাগ রণাঙ্গনের মুক্তিযোদ্ধারা শ্রেণী এবং পেশার প্রাচীর ভেঙ্গে সাধারণ জনগণের কাতারে মিশে গিয়েছিলো দেশমাতৃকাকে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করে এক নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে।
সেই স্বপ্নের মূলে ছিল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম এবং যুগ যুগ ধরে অন্যায়, জুলুম এবং নিষ্পেষণে মথিত জনগণের সার্বিক মুক্তির চেতনা। সমাজের বিত্তবান শ্রেণি থেকে আগত শিক্ষিত তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা সাধারণ জনগণের সাথে এক হয়ে বুঝেছিল কি করে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে তাদের রক্ত চুষে বিত্তবান হয়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে উঠতে সক্ষম হয় তাদের বিদেশী প্রভুদের সাহায্য-সহযোগিতায়। তাদের কায়েমী স্বার্থ এবং শাসন ও শোষণ প্রক্রিয়া কি করে বজায় রাখা হয় ঔপনিবেশিক শক্তির নিগড় থেকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে সেটাও তারা বুঝতে পারে। বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম এবং পরাজয়ের করুণ গাথা তরুণ মুক্তিযোদ্ধা বিশেষ করে শিক্ষিত বর্ধিষ্ণু পরিবার থেকে আগত শিক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে রাষ্ট্র, সমাজ এবং রাজনৈতিক সচেতনতা শাণিত করে তোলে। তারা বুঝতে পারে স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে এই সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত এবং ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ভাগ্যোন্নতি নিশ্চিত না করলে সুখী সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা কিছুতেই সম্ভব হবে না। এ ভাবেই স্বাধীনতার স্পৃহার সাথে গণমুক্তির বৈপ্লবিক সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে উঠেছিল বেশিরভাগ মুক্তিযোদ্ধা। এই চেতনার পরিপ্রেক্ষিতেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন কিছু মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে অতি সতর্কতার সাথে গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিল নীতি-আদর্শ এবং সুচিন্তিত কর্মসূচি ভিত্তিক একটি গোপন সংগঠন, যার নাম স্বাধীনতার পর দেশের সামরিক বাহিনী গঠন কালে দেয়া হয়েছিলো ‘সেনা পরিষদ।’ সেনা পরিষদের লক্ষ্য শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জনের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। সেই সংগঠনের লক্ষ্য ছিল সুদূরপ্রসারী। স্বাধীনতার পর আপামর জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার ও আর্থ-সামাজিক মুক্তি অর্জনের মাধ্যমে ইস্পাত কঠিন জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠিত করে এমন একটা সম্ভাবনার সুযোগ সৃষ্টি করা যাতে করে পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলা সম্ভব হয়। একই সাথে বিশ্বপরিসরে দেশবাসীর পরিচিতি ঘটে আত্মমর্যাদাশীল জাতি হিসাবে একই সাথে ভারতের আগ্রাসী নীল নকশার মোকাবেলা করা। বলা হয়ে থাকে, মানুষের মন- মানসিকতায় কিংবা চিন্তা চেতনায় ত্বরিত পরিবর্তন ঘটে না। কিন্তু ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ আমাকে এই শিক্ষাই দিয়েছে, বিশেষ প্রেক্ষাপটে আচমকা ঘটে যাওয়া ঘটনা মানুষকে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি জ্ঞানী এবং পরিপক্ব করে তুলতে পারে। চিন্তার ক্ষেত্রে এবং মন-মানসিকতায় ঘটাতে পারে অবিশ্বাস্য পরিবর্তন।
যেকোনো দেশে সমাজ বদলের বিপ্লব একটি সংঘাত সংকুল জটিল এবং কঠিন কাজ। ব্যক্তিগত আধিপত্য, মালিকানা, ভোগ-বিলাসের অদম্য স্পৃহা থেকে সৃষ্ট বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা মানুষকে যেভাবে বংশ পরিক্রমায় আত্ম এবং গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল এবং কুক্ষিগত করার বাসনাকে একটি সহজাত প্রবৃত্তিতে পরিণত করে মানুষকে আবিষ্ট করে ফেলেছে সেখানে নৈতিক মানবিক চেতনাকে শাণিত করে সাহসী মানুষ তৈরির মাধ্যমে সাংগঠনিক শক্তি সঞ্চয় করা ছাড়া এই ধরনের সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করা কিছুতেই সম্ভব হবে না।সমাজ বদলের বিপ্লব একটি চিরন্তন প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ার ধারায় সৃষ্টি হয় অনেক দ্বন্দ্ব। নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল বিশ্বাস, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নিরলস পরিশ্রম এবং আত্মত্যাগের সাথে বাস্তবধর্মী পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমেই এইসব দ্বন্দ্বের নিরসন করে ধাপে ধাপে বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জন এবং বিপ্লবের জয়কে সুসংহত করা সম্ভব। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ জনগণের বিশেষ করে তরুণ সচেতন শিক্ষীত মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রণীত গণবিরোধী অপশাসন ও শোষণ থেকে স্বাধীনতা এবং জাতীয় মুক্তির জন্য এক অদম্য বাসনা ও শক্তির স্ফূরনের সম্ভাবনার সুযোগ এনে দিয়েছিল। সেই শক্তিকে গঠনমূলক ভাবে দেশের পুনর্গঠনের স্বার্থে কাজে লাগাবার কোনও উদ্দগই নিলো না জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় চাপিয়ে দেয়া আওয়ামীলীগের সরকার। এরপরও দেশবাসী আশায় বুক বেঁধেছিল। তারা প্রত্যাশা করেছিল, শেখ মুজিব দেশে ফিরে এর প্রতিকার করবেন। কিন্তু তাদের সেই প্রত্যাশায় বালি পড়ে। পাকিস্তান থেকে বোঝাপড়ার মাধ্যমে শেখ মুজিব দেশে ফিরে রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হয়ে ভুলে গেলেন, ‘ব্যক্তির চেয়ে দল বড় দলের চেয়ে বড় দেশ’। সদ্য স্বাধীন একটি দেশকে গড়ে তোলার জন্য উপযুক্ত একটি জাতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি করতে ব্যর্থতার পরিচয় দিলেন শেখ মুজিব। তার প্রশাসন প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি, গোষ্ঠী এবং দলীয় স্বার্থই প্রাধান্য পেলো। এরপর সেনা পরিষদের নেতৃত্বে সংগঠিত ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর-এর সফল বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের পর সৃষ্টি হয়েছিল আর একটি সুযোগ। কিন্তু ক্ষমতার কেন্দ্রে জেনারেল জিয়াকে বসানোর পর সেই সুযোগ তিনি ব্যর্থ করে দেন। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে ক্ষমতালিপ্সু বিশ্বাসঘাতক শেখ মুজিব এবং জেনারেল জিয়া এই ব্যর্থতার দায় কিছুতেই এড়াতে পারবেন না। তাদের প্ররোচনায় ক্ষমতালোভীদের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্রের যূপকাষ্ঠে আত্মনির্ভশীল, সমৃদ্ধশালী, সুখী, আত্মমর্যাদাশীল এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার অপার সম্ভাবনা মরীচিকায় পরিণত হয়। বর্তমান প্রজন্মের এক অংশের নীতি-আদর্শ বিহীন অমানবিক আচরণ, অপসংস্কৃতির চর্চা, চারিত্রিক স্খলন এবং নৈতিকতার অবক্ষয় সেই ব্যর্থতারই বহিঃপ্রকাশ। ক্যান্সারগ্রস্ত এই পচনশীলতার হাত থেকে পরিত্রাণের কোনও উপায় কি তবে আর খোলা নেই! নিশ্চয় আছে। সাময়িকভাবে বিপ্লবকে দাবিয়ে দেয়া সম্ভব, কিন্তু বৈপ্লবিক চেতনা চিরভাস্বর। ঠিক সেভাবেই আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের চেতনা যার সাথে মিশে ছিল স্বাধীনতার পর দেশের রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক আমূল পরিবর্তন এনে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মুক্তির অদম্য সুপ্ত বাসনা, তাকে নতুন করে শাণিত করে তার আলোকেই খুঁজে নিতে হবে সার্বিক মুক্তির সঠিক পথ। পড়ন্ত বেলায় মনে হয়েছিলো দেশের বর্তমান ও ভবিষ্যৎতরুণ প্রজন্ম যাদেরকে প্রভাত সূর্যের সাথে তুলনা করা চলে তারা দেশ ও জাতি সম্পর্কে ভাবলেশহীন হয়ে পড়েছে কিংবা পড়বে, কিন্তু অধুনা বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতে তারা অপ্রত্যাশিতভাবেই দেশবাসীকে হতচকিত করে দিয়ে গা ঝাড়া দিয়ে উঠেছে। তাদের দাবি এবং প্রতিবাদের ধরন নিয়ে বিতর্কের অবকাশ থাকলে থাকতেও পারে। তা সত্ত্বেও তাদের এই প্রতিবাদী সংগ্রামের ইতিবাচক দিকটি হল, তারা সক্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের এই সক্রিয়তা অবশ্যই প্রশংসাযোগ্য। তরুণ সমাজের এই অঙ্গার থেকে হঠাৎ করে দাবানল সৃষ্টির ঘটনা ’৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ’৬০-’৭০-এর দশকে স্বাধিকার আন্দোলন এবং মুক্তিযুদ্ধ কালে দেশবাসী দেখেছে।
১৯৬৮ সালের মে মাসে ফ্রান্সের প্রবল প্রতাপশালী প্রেসিডেন্ট দ্য’গলের সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রদের নেতৃত্বে এক গণঅভ্যুত্থানের সৃষ্টি হয়েছিল। এই অভ্যুত্থানের ফলে দ্য’গলের সরকারের অবস্থা এমনই সঙ্গিন হয়ে পড়েছিল যে এক পর্যায়ে প্রেসিডেন্ট দ্য’গলের পক্ষে ফ্রান্সে থাকা অসম্ভব হয়ে ওঠে। সুতরাং প্রাণ বাঁচানোর জন্য তাকে দেশত্যাগ করে জার্মানির এক সামরিক ঘাঁটিতে আশ্রয় নিতে হয়। সেই অভ্যুত্থানের সূত্রপাত ঘটেছিল একটি অতি সাধারণ ঘটনা থেকে।
ঘটনার শুরু সবর্ণ ভার্সিটিতে। সেখানে ছাত্র-ছাত্রীরা একটি ডরমেটরিতে বসবাসের অধিকার চাইলো। কিন্তু কর্তৃপক্ষ তাদের দাবি মানতে রাজি হল না। শুরু হল প্রতিবাদ বিক্ষোভ। ক্রমশ সেই বিক্ষোভ আর সেই ক্ষুদ্র দাবির মধ্যে সীমাবদ্ধ রইলো না। ছড়িয়ে পড়লো প্যারিসের ল্যাটিন কোয়ার্টারসে। শ্রমজীবী মানুষের বস্তি ল্যাটিন কোয়ার্টারস পরিণত হল বিপ্লবের ঘাঁটিতে। ফ্রান্সের বেশিরভাগ মানুষ মেহনতি শ্রমিক। তাদের মধ্যেও বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ায় অতিদ্রুত এই প্রতিবাদী আন্দোলন সুষম সমাজ ব্যবস্থার গণ-অভ্যুত্থানের রূপ ধারণ করলো। আন্দোলনের বহ্নিশিখা গ্রাস করে ফেললো পুরো ফ্রান্সকে। কিন্তু কায়েমী স্বার্থের প্রতিভূ ফ্রান্সের শক্তিশালী ট্রেড ইউনিয়নের নেতারা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে এই সর্বজনীন অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করায় দ্য’গল তাদের সহায়তায় সেই যাত্রায় চরম বিপর্যয়ের হাত থেকে রক্ষা পান। এই ঘটনাই প্রমাণ করে সময়ে একটি তুচ্ছ ঘটনা থেকেও অকল্পনীয়ভাবে আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মতো দুনিয়া কাঁপানো ঘটনা ঘটে যেতে পারে। তাই হতাশাগ্রস্ত হবার কারণ নেই। বাংলাদেশে বিগত চার দশকেরও বেশি সময়ের অপশাসনের ফলে মানুষের মনে পুঞ্জিভূত ক্ষোভ যেভাবে দেশকে অগ্নিগর্ভ করে তুলেছে তাকে প্রশমিত করার যোগ্যতা বর্তমানের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রীদের নেই। সেক্ষেত্রে দেশ জুড়ে যেকোনো সময় এমন একটা বিস্ফোরণ ঘটতে পারে যাতে কায়েমী স্বার্থবাদী ও তথাকথিত গণতন্ত্রের ধ্বজাধারী সব বর্ণচোরা রাজনৈতিক দলগুলোর আম ও গাছ দুটোই হাত ছাড়া হয়ে যাবে। কেনও এমনটি হবে তার বাস্তব সম্মত যুক্তি রয়েছে। বর্তমানের জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন আদর্শের ঠিকাদার বনে পাতানো খেলার রাজনীতিতে রত সবকয়টি রাজনৈতিক দলের চরিত্র যে একই, সেটা আজ জনগণের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে। তারা বুঝতে পারছে, এরা সবাই মুদ্রার এ পিঠ ওপিঠ। ক্ষমতার লড়াইয়ে জনসম্মুখে চলে ‘নুরা কুস্তি’ অন্যদিকে আড়ালে চলে সহবাস। তারা ধরে ফেলেছে শুভংকরের ফাঁকি। জন্মলগ্ন থেকেই উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ। দেশবাসী বুঝতে পারছে বিগত চার দশকে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর প্রতিভূ ক্ষমতালোভী রাজনৈতিক দলগুলোর মতলবি কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসের জোরে দেশটাকে নিজেদের পৈতৃক সম্পত্তিতে পরিণত করে চুষে ফোকলা করে ১৮ কোটি জনগণের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তুলেছে। তারা নিজেরাই সমস্ত দেশটাকেই সন্ত্রাস সংকুল করে তুলেছে নিজেদের স্বার্থেই। শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্যই ক্ষমতার রাজনীতি তাদের। নিজেদের পেটপূর্তির জন্য রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল, ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকা, লাগামহীন দুর্নীতি, লুটপাট, সর্বক্ষেত্রে দলীয়করণ করার জন্য গণতন্ত্রের নামাবলি গায়ে জড়িয়ে ফ্যাসিবাদই তাদের হাতিয়ার। তাদের সব বিচার-বিবেচনা আর সিদ্ধান্তের কষ্টিপাথর হল নিজস্ব, পারিবারিক, গোষ্ঠী এবং দলীয় স্বার্থ। দেশ ও জনগণের সমস্যা নিয়ে ভাবছে না কেউই। ক্ষমতার জন্য সবকিছুই তাদের পক্ষে করা সম্ভব। স্বৈরাচারের সাথে আঁতাত, সামরিক শাসন কায়েম, জরুরী অবস্থা ঘোষণার ক্ষেত্রে ইন্ধন যোগানো এমনকি প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতাকেও সমর্থন করতে কুণ্ঠিত হয় না তারা। ক্ষমতালাভের জন্য আন্দোলনের নামে হরতাল, জ্বালাও-পোড়াও, অবরোধ-ঘেরাও করে নিরীহ মানুষের জীবন বিঘ্নিত করতে এবং নিজেদের স্বার্থে তাদের সাধারণ নিরীহ মানুষের রক্ত ঝরাতেও বিবেকে বাধে না তাদের। বোমা ফাটিয়ে, গায়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে মানুষ খুন গুম করতেও দ্বিধাবোধ করেনা তারা। প্রশাসনযন্ত্র এবং সরকারী আমলাদের দলীয়করণের মাধ্যমে উসকে দিয়ে গোটা শাসন ব্যবস্থাকেই স্থবির এবং অকেজো করে তুলেছে তারাই। আইন বিভাগকে দলীয়করণের মাধ্যমে বিচারের নামে এক তামাশার নাটকই মঞ্চস্থ করে চলেছে তারাই। পেশাধারীদের গুণগত মানে ধ্বস নামাচ্ছে তারাই। নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ ধর্ষিত হচ্ছে তাদেরই স্বার্থে। ক্ষমতার স্বার্থে রাজাকারদের বানানো হচ্ছে মুক্তিযোদ্ধা আবার প্রয়োজনে মুক্তিযোদ্ধাদের বানানো হচ্ছে রাজাকার। জামায়াতে ইসলামীর সাথে এক টেবিলে বসে আলোচনার পর জোট বেঁধে আন্দোলন করেছে বিএনপি এবং আওয়ামীলীগ। এই দু’টি দল এবং তাদের সাথে জোটবদ্ধ সব কয়টি শরিক লেজুড় দলগুলো আবার প্রয়োজনে জামায়াতকে এড়িয়ে চলেছে রাজনৈতিক সুবিধার্থে নির্দ্বিধায়! পাকিস্তান আমলে ১ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট থেকে আইন ভঙ্গের দায়ে চাকুরিচ্যুত ল্যান্স নায়েক কাদের সিদ্দিকি যে নাকি ন্যক্কারজনক ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক জেনারেলওসমানীর ‘বঙ্গবীর’ খেতাবটি হাইজ্যাক করে তার নামের প্রথমে যোগ দিয়ে শোভাবর্ধন করতে লজ্জিত না হয়ে দেশবাসীর নাকের ডগার উপর দিয়ে জাতীয় নেতা হিসাবে গজিয়ে উঠলেন আর সবাই সেটা আপাতদৃষ্টিতে মেনেও নিলেন। সেই নির্লজ্জ ব্যক্তিকেই তার সাঙ্গোপাঙ্গসহ ভারতের নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে তাদের সাজা মওকুফ করিয়ে দেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করলেন বেগম খালেদা জিয়া ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর প্রধানমন্ত্রী হয়ে আওয়ামীলীগে ভাঙ্গন ধরানোর ভুয়া কৌশলের অজুহাতে। তাকে একটি দৈনিক কাগজ প্রকাশনার অনুমতি এবং অত্যাধুনিক একটি প্রেস কেনার জন্য প্রায় ২০ কোটি টাকার ব্যবস্থাও করে দেয়া হয় খালেদা জিয়ার জোট সরকারের আমলেই। ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ সহ কিছু বিএনপি নেতা যারা ছিলেন সাঈদ ইস্কান্দারের বিশেষ ঘনিষ্ঠ জন, তারাই ছিলেন এই বিষয়ে মূল উদ্যোগ গ্রহণকারী। প্রেসিডেন্ট জিয়ার আমলে রাষ্ট্রদ্রোহিতার বিচারে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এই কাদের সিদ্দিকিই বর্তমানে নিজের একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কব্জা করার কিংবা ভাগ বসাবার সুযোগের অপেক্ষায় দিন গুণছেন ফাঁসির রজ্জুর বদলে গলায় গামছা ঝুলিয়ে।
আপোষের মাধ্যমে ভারতীয় খুঁটিঁর জোরে বেঁচে থাকা ১৫ই আগস্ট বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের পর বাংলাদেশের সীমান্তে সেনাবাহিনীর দুইজন অফিসার আর তিনজন সৈনিক হত্যার দায়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত এই ব্যক্তিকে যদি ভবিষ্যতেক্ষমতার পীঠস্থানের আরামদায়ক কেদারার পরিবর্তে জনতার দাবির মুখে আদালতের রায় অনুযায়ী রাষ্ট্রদ্রোহিতা এবং খুনের আসামী হয়ে ফাঁসির মঞ্চে যেতে হয় তখন যারা তার সব সাজা মাফ করিয়ে দিয়ে নির্বাসন থেকে ফিরিয়ে এনে গলায় গামছা ঝুলিয়ে রাজনৈতিক খেলোয়াড় হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন তারা দায়মুক্ত হবেন কোন সমঝোতা কিংবা যুক্তির ভিত্তিতে? এই স্পর্শকাতর বিষয়টি নিয়েও ভাবছে জনগণ। কারণ, ঘটনাটিকে সাময়িকভাবে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হলেও ভুলে যাওয়া কিংবা এড়ানো সম্ভব হবে না কখনোই। পাকিস্তান থেকে ভুট্টো এবং ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বোঝাপড়ার পর দেশে ফিরে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসীন হয়ে শেখ মুজিব আইন করে চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সহ ৯৭ হাজার পরাজিত আত্মসমর্পণকারী খানসেনা ও তাদের সহোদরদেরকে ক্ষমা করে দিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর হাতে তুলে দিয়েছিলেন ত্রিপক্ষীয় ‘সিমলা চুক্তির’ আওতায় বাংলাদেশের জনগণের তীব্র প্রতিবাদের মুখে। ২০০১ সালে ‘উদ্দিন’ কুশীলবদের কারসাজিতে ক্ষমতায় এসে তারই সুপুত্রী হাসিনার সরকার বিষাক্তসাপের ফেলে যাওয়া খোলসের বিচার নিয়ে মেতে উঠেছেন যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে। এটাকে তামাশা ছাড়া আর কি বলা চলে? তবে অনেক আঁতেলই এই বিচারের প্রহসনকে রাজনীতির একটি কূটচাল বলেই অবহিত করছেন। অনেকেই আবার এর বিরোধিতা করছেন। বর্তমানের পাতানো খেলার রাজনীতিতে সবকয়টি দলই যার যার স্বার্থে যা কিছুই করছে সবকিছুই তাদের জন্য বেশ্যাবৃত্তির মতোই হালাল করা হচ্ছে এই সত্যটা আজ জনগণের কাছে দিবালোকের মতোই স্পষ্ট লেখকের ধারণা।বন্দুকের নলের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া জাস্টিস সায়েমকে ক্ষমতাচ্যুত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেন। ১৯৮২ সালে একই কায়দায় তারই নিয়োজিত তাবেদার সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি সাত্তারকে বঙ্গভবন থেকে বন্দুকের জোরে আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে অবৈধ ভাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেন। যেমন গুরু তেমন শিষ্যই বটে! তার এই অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল সম্পর্কে আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের কাছে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘I am not unhappy’. এক পর্যায়ে তার স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণআন্দোলন শুরু হয়। কিন্তু চতুর এরশাদ নির্বাচনী খেলা খেলে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হন। ১৯৮৬ সালে এরশাদ একটা নির্বাচনের আয়োজন করেন। এই নির্বাচনের বিরুদ্ধে হাসিনা হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেছিলেন, ‘যারা নির্বাচনে যাবে তারা জাতীয় বেঈমান’। কিন্তু এরপরই খবরে প্রকাশ পেল, এরশাদের আমন্ত্রণে এক মধুচন্দ্রিমা রাতে হাসিনা চুপিসারে প্রেসিডেন্ট এরশাদের সাথে এক লং ড্রাইভে গেলেন এবং ফিরে এসে ২৪ ঘণ্টা না পেরুতেই দেশবাসীকে হতবাক করে হাসিনা নির্বাচনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে আন্দোলন থেকে সরে আসেন। এরশাদের এই নির্বাচনে শরিক হয়েছিল আওয়ামীলীগের তৎকালীনলেজুড় এবং সহযোগী দল জামায়াতে ইসলামী। দুষ্ট লোকেরা বলে, ঐ রাতে লং ড্রাইভে মধ্যরাতের জোছনাময় রোমাঞ্চকর পরিবেশে হাওয়া খেতে খেতে হাসিনা দুর্নীতি পরায়ণ এরশাদের নিকট থেকে ১৭ কোটি টাকাও হাতিয়ে নিতে সমর্থ হন। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপি জামায়াত এর সাথে জোট বেঁধে ক্ষমতায় আসে। কিন্তু অতি অল্পসময়ের মধ্যেই গোলাম আজমের নাগরিকত্ব প্রদানের তরিকা নিয়ে জামায়াত ও জোট সরকারের প্রধানমন্ত্রী খালেদার মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত আসনের ভাগ-বাটোয়ারার পর জামায়াতের ১৭ টি সিটের প্রয়োজন ফুরিয়ে যাওয়ায় বিএনপি প্রশাসনিক বিধানে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দেয়ার দাবিটি অগ্রাহ্য করায় শুরু হয় টানাপড়েন। এই সুযোগ থেকে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার জন্য হাসিনা আওয়ামীলীগের মনোনীত রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী বিচারপতি বদরুল হায়দার চৌধুরী নির্বাচনে জয়ী হবার জন্য তৎকালীন জামায়াতের আমীর ২০০৮ সালের পর যুদ্ধাপরাধী বিচারের আসামী গোলাম আজমের দোয়া ও সমর্থন চাইতে অক্টোবর মাসে তার বাসভবনে গিয়েছিলেন। একই সাথে বিএনপি এবং জামায়াতের মধ্যে ব্যবধান বাড়ানোর কৌশল হিসাবে হাসিনার ইশারায় ‘একাত্তরের ঘাতক দালাল কমিটি’ সৃষ্টি করা হয় জাহানারা ইমাম এবং কর্নেল (অব) কাজি নুরুজ্জামানের নেতৃতে। এই সংগঠন প্রকাশ্যে গণআদালতে গোলাম আজমের বিচারের নাটক মঞ্চস্থ করে ফাঁসির রায় দিয়ে তার কুশপুত্তলিকার ফাঁসি কার্যকর করে জামায়াতের উপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হয় আওয়ামী লীগ। উপায়হীন জামায়াত বিএনপিজোট থেকে বেরিয়ে এসে আওয়ামীলীগের সাথে গাঁটছড়া বাধে। জামায়াতকে আওয়ামী খোঁয়াড়ে ঢুকানোর পর ভোজবাজির মত ‘ঘা দা কমিটির’ কার্যক্রমে ভাটা পড়ে। এ ভাবেই শুরু হল বিএনপি সরকারের বিরুদ্ধে আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত-এর যুগপৎ আন্দোলন। জামায়াতের আন্দোলন শুরু হল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে। আওয়ামী লীগ শুরু করে প্রেসিডেন্সিয়াল ধাঁচের সরকারের পরিবর্তে ওয়েস্টমিনস্টার টাইপের সংসদীয় সরকার কায়েমের দাবিতে। শেখ হাসিনার আহ্বানে ১৯৯৪ সালের ২৪শে ফেব্রুয়ারী সংসদে জাতীয় পার্টি, জামায়াতে ইসলামী এবং এনডিপির একটি বৈঠক হয়। ঐ বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দলগুলো এই দুইটি দাবি আদায়ে সরকারকে বাধ্য করার জন্য ২৬শে এপ্রিল ১৯৯৪ থেকে হরতাল, অবরোধ, মশাল মিছিল, পদযাত্রা, জনসভাসহ পুরো দেশে বিভিন্ন রকম লাগাতার সহিংস কর্মসূচি পালন করতে থাকে। ২৭শে জুনেই জোট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা প্রকাশ করে। সংসদ ভবনে বিরোধী দলীয় নেত্রীর সম্মেলন কক্ষে এক যৌথ সাংবাদিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সেই প্রেস ব্রিফিংয়ে শেখ হাসিনার সাথে এক টেবিলে বসেছিলেন জামায়াতের তৎকালীনসেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, জাতীয় পার্টির ব্যারিস্টার মওদুদ আহমেদ, এনডিপির সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও গণতান্ত্রিক পার্টির সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। তখন জামায়াতের আমীর ছিলেন গোলাম আজম।
নিয়তির নিষ্ঠুর পরিহাস, ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ের পর হাসিনা সরকার জামায়াতের এই দুই নেতা এবং এনডিপি পরে বিএনপি নেতা সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করায়। নীতি-আদর্শ বিবর্জিত স্বার্থ ও সুবিধাবাদী রাজনীতির করুণ অবশ্যম্ভাবী পরিণতি! ২৮শে ডিসেম্বর আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে জামায়াত ইসলামী, জাতীয় পার্টি ও এনডিপির ১৪৭ জন সাংসদ সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। সেই সময় রাশেদ খান মেনন তথাকথিত বামপন্থী নেতা যিনি ২০০৮ সালে আওয়ামী মহাজোটের শরিক হয়ে নৌকা প্রতীক নিয়ে সাংসদ হওয়ার যোগ্যতা অর্জন করেছিলেন। তিনি এই ধরণের অশুভ আঁতাতের সমালোচনা করে বলেছিলেন জামায়াত চায় মধ্যযুগীয় ব্লাসফেমি আইন, জাতীয় পার্টি চায় এরশাদের মুক্তি আর আওয়ামী লীগ চায় যে কোনো ভাবে ক্ষমতায় যেতে। অর্থাৎক্ষমতায় যেতে জামায়াত ইসলামীকে মুক্তিযোদ্ধাদের সমমর্যাদায় একই গাঁটছড়ায় বাঁধতে শেখ হাসিনা এবং আওয়ামীলীগের কোনও সমস্যা হয়নি। সমস্যা হয়নি স্বৈরশাসক এরশাদ এবং যুদ্ধাপরাধীদের মিত্র হিসেবে গ্রহণ করতে। বর্তমানে সেই আওয়ামীলীগই আজ নতুন খেলায় নেমেছে। এখন আওয়ামীলীগ তাদের মুরব্বি ভারতের মতোই জামায়াতকে আর পছন্দ করছে না। তাদের মধ্যে ইসলামী জঙ্গিবাদের জীবাণু আবিষ্কার করেছে আওয়ামীলীগ ভারত ও তাদের আঞ্চলিক স্ট্র্যাটেজিক মিত্র বিশ্বমোড়ল আমেরিকা এবং তাদের পশ্চিমা দোসরদের অনুকম্পা অর্জনের প্রত্যাশায়। এছাড়া একটি রাজনৈতিক কারণও রয়েছে। জামায়াত বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় ঐক্যজোটে রয়েছে। এই ঐক্য আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগের জন্য সুখকর নয়। এই কথা স্মরণে রেখে বর্তমানের আওয়ামীলীগ সরকার জামায়াতের ব্রেইন চাইল্ড তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আইনটি সংবিধান থেকে খারিজ করে দিয়েছে। তাতেও স্বস্তি পাচ্ছেন না হাসিনা। জামায়াত-এর উপর চাপ সৃষ্টি করে তাদের ১৮ দলীয় জোট থেকে বের করে এনে আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণে বাধ্য করে নির্বাচনের বৈধতা অর্জন এবং একই সাথে বিএনপিএবং জামায়াতকে আলাদা করে দুটো দলকেই দুর্বল করে তোলার জন্য বিভিন্ন কূটকৌশলের মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালানো হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধী বিচারের নামে পাইকারিভাবে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ সব নেতাদের আসামী হিসাবে কারাগারে বন্দী করে বিশেষ ট্রাইব্যুনালে ফাঁসি, যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় জারি করানো হচ্ছে দেশী এবং বিদেশের মানবাধিকার সংগঠনগুলোর বিচার প্রক্রিয়ার বৈধতা নিয়ে কড়া সমালোচনার তোয়াক্কা না করেই। সবপর্যায়ের নেতা-কর্মীদের পাইকারি হারে জেলবন্দী, জুলুম, হয়রানি, পাশবিক নির্যাতন, গুমহত্যা চলছে নির্বিচারে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। অবশেষে দলটির নিবন্ধনও বাতিল করে তাদের আর্থিক সঙ্গতির মেরুদণ্ডও ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে। শেখ হাসিনার একসময়ের মিত্র সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীকেও জেলে ঢুকানো হয়েছে জামায়াতের নেতাদের মতোই যুদ্ধাপরাধের বিচারে তারও ফাঁসির রায় দেয়া হয়েছে। এই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীই কোনও এক সময় সংসদে বড় গলায় গর্বের সাথে জানান দিতেন, শেখ পরিবারের সাথে তার ঘনিষ্ঠতার। তিনি হাসিনাকে সম্বোধন করতেন ‘বুবুজান’ বলে। এই বোনের জন্য নিয়মিত ধনকুবের এই সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী বড় বড় রুই, কাতলা, পাঙ্গাশ, গলদা চিংড়ি পাঠাতেন সেই কাহিনীও শুনিয়েছেন অনেকবারই। কিন্তু ক্ষমতার সমীকরণে এখন ‘বুবুজান’ ভাইকে ত্যাজ্য করে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফাঁসির রায় শোনালেন! কারণ, এখন তার প্রয়োজন ফুরিয়েছে। নীতি-আদর্শহীন নৈতিকতা বিবর্জিত রাজনীতিবিদের কাছে কোন সম্পর্কেরই কোনওমূল্য নেই।সব সম্পর্কই মাপা হয় ক্ষমতার সমীকরণের মানদণ্ডে। এই রাষ্ট্রীয় ও দলীয় সন্ত্রাসের শিকার বিএনপিও যদিও আওয়ামীলীগকে ছাড় দেয়ার ক্ষেত্রে তাদের কমতি কখনই ছিল না। ১৯৮১ সালে জেনারেল জিয়াউর রহমান বসন্তের কোকিল ডঃ কামাল হোসেন গং এর দূতিয়ালির মাধ্যমে ভারতের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে জাতীয় ঐক্যের নামে শেখ হাসিনা এবং রেহানাকে ভারতে ৮ বছরের বেশি সময়ের নির্বাসিত জীবনের অবসান ঘটিয়ে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের চেতনার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে দেশে ফিরিয়ে আনার ১৩/১৪ দিনের মাথায় তার ভুলের মাশুল গুণে এক ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে প্রাণ হারান। বিস্ময়ের ব্যাপার হলোজাতীয় শত্রুদের সাথে জাতীয়তাবাদীদের ঐক্য হওয়াটা কি করে যুক্তিসঙ্গত হতে পারে!জিয়ার করুণ মৃত্যুতে দেশে সামরিক শাসন জারি এবং চক্রান্তের নাটের গুরু স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখলকে স্বাগত জানিয়ে আওয়ামীলীগের মুখপাত্র বাংলার বাণী একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছিল। শেখ হাসিনাও বিবিসিতে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করে বলেছিলেন, ‘তিনি অখুশি নন’। ১৯৯৬ সালে জেনারেল নাসিমের ব্যর্থ ক্যুদেতার প্রতিও প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন হাসিনা গণমাধ্যমে বিবৃতি দিয়ে। জেনারেল নাসিম এবং তার সাথী ভাইরা পরবর্তীতে খালেদা এবং হাসিনার রাজত্বকালেই শুধু নয়, আজঅব্দি সবরকম সরকারি সুখ-সুবিধাসহ বহাল তবিয়তে আয়েশি জীবনযাপন করছেন। পাঠকদের অবগতির জন্য বলছি, খালেদা জিয়া নাসিমকে সেনাপ্রধান হিসেবে নিয়োজিত করেছিলেন তার ভাই বিএনপির ক্ষমতাধর নেতা ক্যাপ্টেন (অব) সাঈদ ইস্কান্দারের মনোনয়নের উপর ভিত্তি করে। ১৯৯৬-এর নির্বাচনের পর জেনারেল খালেদের সহযোগী এবংজেনারেল নাসিমের অতি বিশ্বাসভাজন ক্যাপ্টেন তাজ হাসিনার বদান্যতায় প্রতিমন্ত্রীর পদটিও অলঙ্কৃত করতে সক্ষম হয়েছিলেন জেনারেল নাসিমের পরামর্শেই। বর্তমানে খালেদ এবং নাসিমের আস্থাভাজন অনুগত ওবায়দুল কাদের আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক। কি অদ্ভুত চলমান রাজনীতি বাংলাদেশে!
শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য ২০০৬ সালে লগি-বৈঠা দিয়ে নির্মম ভাবে মানুষ পিটিয়ে হত্যা করে, আগুনে জ্যান্ত নিরীহ শহরবাসীদের জ্বালিয়ে গণতন্ত্রের মানসকন্যা যে রাজনীতির তাণ্ডব সৃষ্টি করেছিলেন তার কথা বোধকরি বর্তমানের প্রজন্ম ভুলে যায়নি এখনো। ঐ নৈরাজ্য সৃষ্টি করেই জাতির ঘাড়ে জরুরী অবস্থা চাপিয়ে ‘উদ্দিনদের’ ক্ষমতা গ্রহণের রাস্তা করে দিয়ে হাসিনা তৃপ্তির সাথেই সদম্ভে বলেছিলেন, মইন-ফখরুদ্দিনের সরকার তাদের আন্দোলনেরই ফসল। পরে তাদের বৈধতা দেবার অঙ্গিকার করেই ক্ষমতার মসনদ অর্জনের ব্যবস্থাও তিনি পাকাপোক্ত করে নিয়েছিলেন বিদেশী মোড়লদের সাহচর্যে। যে নেত্রী একটি লাশের পরিবর্তে দশটি লাশ নেতা-কর্মীদের কাছ থেকে চাইতে পারেন তার জন্যএমন আচরণ অতি স্বাভাবিক। ক্ষমতায় আসীন হয়ে ‘উদ্দিন’ সরকারের সব কার্যক্রমের বৈধতা প্রদান করে তাদের বিদেশের নিরাপদ আশ্রয়ে পাড়ি দেবার ব্যবস্থাও করে দেয় হাসিনা সরকার।
এক-এগারোর ঘটনার নেপথ্যের একটি প্রাসঙ্গিক গুরুত্বপূর্ণ বিষয় পাঠকদের অবগতির জন্য তুলে ধরা হল কায়েমী শাসক গোষ্ঠীর চরিত্র বোঝার স্বার্থে। আওয়ামীলীগ জোটের লগি-বৈঠা ও লাশের প্রকোপে রাষ্ট্রপতি ইয়াজুদ্দিনের অধীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার যখন দিশেহারা তখন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন প্রেসিডেন্টের অফিসে গিয়ে জাতিসঙ্ঘের মহাসচিবের দফতর থেকে জারিকৃত একটি ভুয়া চিঠি তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বলে, তার অধীনস্থ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে দেশে নির্বাচন হলে ভবিষ্যতে জাতিসঙ্ঘ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীসহ অন্যান্য বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কোনও সদস্যকে শান্তিরক্ষী কিংবা শান্তিস্থাপনের দায়িত্ব পালনের জন্য নেবে না এবং বর্তমানে নিয়োজিত সবাইকে দেশে ফেরত পাঠানো হবে। এর ফলে শুধু সামরিক বাহিনীরই নয়, দেশেরও চরম আর্থিক ক্ষতি হবে। সেজন্য তার সরকারকে পদত্যাগ করতেই হবে। এভাবে হুমকির মুখেই প্রেসিডেন্ট ইয়াজুদ্দিনের সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা হয়েছিলো। কাকতালীয় ভাবে সেই সময় জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্ব পালন করছিলেন হাসিনার পররাষ্ট্র বিষয়ক উপদেষ্টা প্রাক্তন পররাষ্ট্রসচিব ফারুক চৌধুরীর ছোটভাই ইফতেখার চৌধুরী। তিনিই ঐ চিঠিটি জেনারেল মইনকে পাঠিয়েছিলেন। পরে অবশ্য জাতিসঙ্ঘের মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র এক সাংবাদিক সম্মেলনে স্পষ্ট করে বিবৃতি দিয়ে ঐ ধরনের কোনও চিঠি তার অফিস থেকে জারি করা হয়েছিল সেটা অস্বীকার করেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সবচেয়ে বিস্ময়কর বিষয় হল রহস্যজনক এই ভুয়া চিঠি কি ভাবে, কোন পথে জেনারেল মইনের কাছে এলো এই বিষয়ে কিন্তু আজঅব্দি কোনও পক্ষ থেকেই কোনও উচ্চবাচ্য করা হচ্ছে না! হাসিনার মহাজোট সরকারের পর্বতসম দুর্নীতির মাধ্যমে দেশ ও জাতিকে ধ্বংস করার তৎপরতা এবং ভারতের সাথে নির্দ্বিধায় জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী একের পর এক অসম দাসত্বমূলক চুক্তি গোপনে করা নিয়েও কিন্তু বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে কোনও উচ্চবাচ্য শোনা যাচ্ছে না। ফলে মনে হচ্ছে, ‘মৌনং সম্মতি লক্ষণং।’ ‘৭৫-এর নিঃস্বার্থ বীরদের প্রায় ১৪ বছর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের কন্ডেম সেলের মৃত্যুগুহায় রেখে ফাঁসিতে ঝোলানো হল সরকারী ও বিরোধী জোটের আঁতাতের মাধ্যমে, ঘটে গেলো বিডিআর-এর লোমহর্ষক হত্যাযজ্ঞ যার লক্ষ্য ছিল জাতির মেরুদণ্ডে পঙ্গুত্বের এক চরম আঘাত। কিন্তু বিষয়টির সুদূরপ্রসারী পরিণতি কি হতে পারে, সেই সম্পর্কেও তথাকথিত জাতীয়তাবাদ ও ইসলামের ধ্বজাধারীদের মনোভাব ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। অতীতে দেশের সামরিক বাহিনীকে দুর্বল করে রেখে ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার চক্রান্তের সাথে এই বিশেষ দুইটি ঘটনাকে দেখতে হবে। বর্তমানের সামরিক বাহিনীর বঙ্গশার্দুলদের মন-মানসিকতায় ভোগ বিলাসের লালসা উস্কে দিয়ে তাদের দেশপ্রেম এবং ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও স্বপ্নকে অস্বচ্ছ করে তুলে, তাদেরকে শুধুমাত্র সরকারের অনুগত চাকুরেতে পরিণত করা হচ্ছে। প্রকৃত যেকোনো একজন মুক্তিযোদ্ধার জন্য এই অবক্ষয় অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক! শুধু তাই নয়, বিভিন্ন চুক্তির মাধ্যমে দেশের গোয়েন্দা সংস্থাসমূহ, প্রতিরক্ষা, সীমান্তরক্ষী, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোকে সুপরিকল্পিতভাবে ভারত নির্ভর করে তোলা হচ্ছে। ফলে, নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে অদূর ভবিষ্যতে দেশটিকে পরিণত হতে হবে ভারতের একটি করদ কিংবা অঙ্গরাজ্যে আর ১৮ কোটি জনগোষ্ঠী পরিণত হবে দাসে। এই সমস্ত জাতীয় স্বার্থ বিরোধী চুক্তিগুলো ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে যারা সই করেছেন সেগুলোকে কার্যকর করার জন্যই তুলনামূলকভাবে বিএনপি জোটের চেয়ে হাসিনার মহাজোটকেই আর একবার ৫ বছরের জন্য ক্ষমতায় বসানোর নীলনকশাই বাস্তবায়ন হতে চলেছে। ব্যর্থ মহাজোট সরকারের অপশাসন, শোষণ, নির্যাতন, রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাস, গুম খুন, পদ্মা সেতু কেলেঙ্কারি, ডেস্টিনির জালিয়াতি, শেয়ার কেলেঙ্কারির মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ পরিবারকে সর্বস্বান্ত করা, ব্যাংকের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা লোপাট, দণ্ডিত সন্ত্রাসী এবং দলীয় খুনিদের রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে মুক্তি দেয়া, গণমাধ্যমের উপর খড়গ, বিদ্যুৎবিভ্রাট, নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিষ পত্রের আকাশচুম্বী মূল্যবৃদ্ধি, গণতন্ত্রের লেবাসে স্বৈরতন্ত্র কায়েম, মানবিক অধিকার লঙ্ঘন, বাকস্বাধীনতা হরণ, সবকিছু দেখে এবং জেনেও স্বার্থের খাতিরে আওয়ামী লীগকেই ক্ষমতায় ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছে ইন্দো-আমেরিকান বলয়। বর্তমানে দেশের জনগণ জিম্মি হয়ে বিভক্ত হয়ে পড়ছে চলমান রাজনৈতিক ধারার মূল দু’টি নীতি-আদর্শ বিবর্জিত জোটের নাগপাশে। এ দু’টি জোটই ক্ষমতা উপভোগ করে এসেছে তিন দশকের বেশি সময় যার পরিণাম দেশবাসী আজ হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। তমসাচ্ছন্ন দেশের ভবিষ্যৎহয়ে পড়েছে অনিশ্চিত। এই করুণ পরিণতির দায় দেশের সবগুলো রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রীকে একইভাবে বহন করতে হবে। কারণ, পাতানো খেলার রাজনীতিতে এক তরফাভাবে কাউকেই দোষারোপ করার কোনও অবকাশ নেই। এই হতাশা ব্যঞ্জক অবস্থার হাত থেকে বাঁচার একমাত্র উপায় যুগোপযোগী প্রজ্ঞাবান, দূরদর্শী, অভিজ্ঞ ত্যাগী নেতৃত্বের অধীন নীতি-আদর্শ ভিত্তিক প্রগতিশীল সুস্থ রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করা। এই অঙ্গিকার নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে তরুণ প্রজন্মকেই। এ ছাড়া বর্তমানের অধোগতি থেকে পরিত্রাণের কোন বিকল্প নেই। চেনা বামুনদের নেতৃত্বে জাতির ইস্পিত লক্ষ্য অর্জন কখনই সম্ভব হবে না। এই প্রসঙ্গে তরুণ প্রজন্মকে জানতে হবে, যতক্ষণ না কোন দেশের সমাজপতি এবং শাসকগোষ্ঠীর মধ্যে দালাল শ্রেণী সৃষ্টি করা সম্ভব না হয়ততদিন কোনও বিদেশী শক্তির পক্ষেই সে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ করা সম্ভব হয় না। বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতসহ বিশ্বের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার অগুণতি চর দেশের সর্বস্তরে নিজেদের অবস্থান সুসংহত করে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত করে তোলার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। কিন্তু এই সব পশক্তির সকল ষড়যন্ত্র নস্যাৎ করে দিতে পারে একমাত্র সচেতন সংগ্রামী জনতা। ঐতিহাসিক পরিপ্রেক্ষিতে ব্রহ্মপুত্র, পদ্মা, যমুনা, মেঘনা, বুড়িগঙ্গা বিধৌত পলিমাটি দ্বারা গঠিত আদি বাংলা আজকের বাংলাদেশের মানুষ কখনো কোনও প্রতিকূলতার মোকাবেলায় নতশির না হয়ে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের মাধ্যমে সব প্রতিকূলতা দূর করে নিজস্ব স্বকীয়তা বজায় রেখে এগিয়ে চলার স্বাক্ষর রেখেছে যুগে যুগে। বাংলাদেশের মানুষ পামির মালভূমি থেকে নেমে আসা যাযাবর আর্যদের আগ্রাসী নখর এই দেশের মাটিতে বসাতে দেয়নি। বিদেশী আগ্রাসী শক্তিসমুহ ভারতবর্ষের অন্যান্য অঞ্চলে তাদের বিজয় নিশান ওড়াতে সক্ষম হলেও বাংলার মাটিতে সেটা সম্ভব হয়নি। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বাংলা বিজয় সম্ভব হয়েছিল, বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজ উদ্দৌলার অনুগত মীরজাফর, মিত্রবেশী বিত্তশালী হিন্দু সম্প্রদায়ের উমিচাঁদ, রাজবল্লভ প্রমুখ রাজন্যবর্গ, জমিদার এবং বণিক শ্রেণীর বিশ্বাসঘাতকতায়। তবে ইংরেজদেরও বাংলাদেশীদের সংগ্রামী চেতনাকে উপলব্ধি করতে হয়েছে প্রতিমুহূর্তে। এর ফলেই, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে গান্ধীকে আমদানি করে স্যার ডগলাস হিউম এবং এ্যানি বেসান্তের মাধ্যমে কংগ্রেস পার্টি সৃষ্টি করে নেতার পদে অধিষ্ঠিত করা হয়েছিল আপোষকামী গান্ধীকে। বাংলাদেশীরাই বিশ্বের একমাত্র গর্বিত জাতি যারা রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষার মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত করে ২১শে ফেব্রুয়ারি ‘রাষ্ট্রভাষা দিবস’ হিসাবে জাতিসংঘের স্বীকৃতি লাভ করতে সক্ষম হয়েছে। ‘৭১-এ হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে দেশের ৭ কোটি আবাল, বৃদ্ধ, বণিতা, ছাত্র ও যুব সমাজ এক কাতারে সামিল হয়ে জানবাজি রেখে লাখো প্রাণের আহুতি দিয়ে একটি জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে ছিনিয়ে এনেছে স্বাধীনতার সূর্য। স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশে একদলীয় স্বৈরশাসক শেখ মুজিব আগ্রাসী ভারতের সাথে ২৫ বছরের গোলামির চুক্তি স্বাক্ষর কোরে যখন দেশকে ভারতের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করতে চেয়েছিল তখন গর্জে ওঠে বাংলাদেশের জাগ্রত সিপাহী-জনতা। ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট সেনা পরিষদের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক সেনা অভ্যুত্থানে পতন ঘটেছিল মুজিবের বাকশালী এক নায়কত্বের। ২-৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ ভারত ও আওয়ামী-বাকশালীদের মদতে ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিলের নেতৃত্বে দেশটাকে আগস্ট বিপ্লবের পূর্ব অবস্থায় নিয়ে যাবার জন্য প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতাকেও পরাজিত করেছিল সেনা পরিষদ এবং কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যৌথ নেতৃত্বে সংগঠিত ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক সিপাহী-জনতার মহান বিপ্লব।
বাংলাদেশের নিকট ইতিহাসে ১৯৫২, ১৯৬৯, ১৯৭১, ১৯৭৫, ১৯৯০ সাল অন্যায়-অবিচার বিরোধী ন্যায্য অধিকার আদায়ের দেশবাসীর শাণিত সংগ্রামী চেতনার স্বাক্ষর বহন করে। এইসব প্রতিটি গণজাগরণ সামাজিক ক্ষেত্রে এবং মন-মানসিকতায় এনেছে পরিবর্তন। আকণ্ঠ দুরাচার, অপশাসন, যুগের পরিপন্থী দুর্নীতিপরায়ণ পরিবারতান্ত্রিক অসুস্থ রাজনৈতিক কালচার, দলীয়করণের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাস, জাতীয় সম্পদের অবাধ লুটপাট, ব্যাঙ্ক, বীমা, শেয়ার মার্কেট এবং সিন্ডিকেটেড কালো কারবারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার এবং পেশীশক্তির বলে জনগণের রক্ত চুষে নেয়ার জঘন্য প্রতিযোগিতা, মিথ্যাচারের মাধ্যমে ভারতের স্বার্থে দেশকে বিকিয়ে দেয়া এবং ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে একটি মহা গণজাগরণের প্রয়োজনীয়তা অবশ্যম্ভাবী হয়ে উঠেছে দেশ এবং আপামর জনগণের স্বার্থেই। একমাত্র মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা এবং স্বপ্নের আলোকেই সম্ভব তেমন একটি গণজাগরণ এবং আর একটি সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ। বর্তমানের তমসাচ্ছন্ন বাংলাদেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব এবং স্বকীয়তা বজায় রেখে অনিশ্চিত ভবিষ্যৎকে সম্ভাবনাময় করে তোলার অন্য আর কোনও বিকল্প নেই। কিন্তু বর্তমান তরুণ প্রজন্ম সঠিক পথ এবং নেতৃত্বের সন্ধান তখনই পাবে, যখন তারা বুঝতে সক্ষম হবে স্বাধীনতার চার দশকেরও বেশি সময়ের সংগ্রামী পথে অনেক চড়াই-উৎরাইপেরিয়ে আত্মাহুতি দিয়েও কেনও আজো ‘৭১-এর স্বপ্ন বাস্তবায়িত হল না!
বিশ্বায়নের মোজেজা, রাষ্ট্র ও ধর্ম
অতীতের সাম্রাজ্যবাদ এবং ঔপনিবেশিকবাদ বর্তমানে বিশ্বায়নের নামে এক নতুন রূপধারণ করেছে। এর জন্য শক্তিধর দেশগুলোর প্রণীত বিভিন্ন অসম চুক্তিতে আবদ্ধ হতে বাধ্য করা হচ্ছে পশ্চাদপদ অনুন্নত সদস্য দেশগুলোকে তাদের অনুগত জাতিসংঘ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক লগ্নিপুঁজি প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে। তাদের এই চক্রান্তের নাগপাশে দেশ ও জাতিকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাধার জন্য বিশ্বের অনুন্নত প্রতিটি দেশের তাদেরই সৃষ্ট সেবাদাস কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী নিজেদের স্বার্থে। তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য অগ্রগতিও ঘটানো হয়েছে তাদের এই চক্রান্তকে সফল করার জন্যই। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে এই অগ্রগতির কোনও সুফলই সমভাবে ভোগ করার অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হচ্ছে অতি সতর্কতা এবং কৌশলে অনুন্নত দেশগুলোর অগ্রগতি ও সমৃদ্ধির স্বার্থে। তাদের চক্রান্তের ইস্পিত লক্ষ্য অর্জনে প্রচার মাধ্যম বিশেষ অবদান রাখছে। আধুনিকতার নামে নিজস্ব ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধকে বিসর্জন দিয়ে মিথ্যা এবং ভ্রান্ত প্রচারণার মরীচিকার পেছনে ছুটে চলেছে তরুণ প্রজন্ম। একই সাথে সেবাদাসরা জনগণকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছেন না তাদের সংঘাত, সংশয়, ত্রাস ও অমানবিক আর্থ-সামাজিক অবস্থা সৃষ্টি করে ন্যূনতম বাঁচার অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। বিভিন্ন নামের তত্ত্ব এবং গণতন্ত্রের নামে কেড়ে নেয়া হচ্ছে তাদের মৌলিক অধিকার। শাসকগোষ্ঠী এবং সমাজপতিদের একটাই লক্ষ্য দেশের জনগোষ্ঠীকে তাদের মুখাপেক্ষী করে তুলে ক্ষমতার কুক্ষিগতকরণ। এর জন্যই, গড়ে তোলা হয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর অনুকূলে গণবিরোধী রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, প্রশাসন, আইন বিভাগ এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। প্রণীত হয় দেশের সংবিধান প্রয়োজনে যার কাটছাঁট করা হয়ে থাকে তাদেরই স্বার্থে। যেকোনো অনুন্নত দেশের প্রচার মাধ্যমগুলোর নিয়ন্ত্রণ থাকে জাতীয় ক্ষমতাশালী সেবাদাস এবং তাদের বিদেশী মোড়লদের হাতে। ফলে সঠিক তথ্য জনগণঅব্দি পৌছায় না। সত্য উদ্ঘাটনের প্রচেষ্টাও হারিয়ে যায় মিথ্যা প্রচারণার দাপটে। এর ফলে সবচেয়ে মারাত্মক যে অবস্থার উদ্ভব হয়, তা হলো অপ্রতিহত মিথ্যার রাজত্ব।
বাংলাদেশে বর্তমানে ওয়েস্টমিনস্টারের আদলের গণতান্ত্রিক রাজনীতির চর্চা চলছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পরিভাষায় ‘গণতন্ত্র‘ শব্দটির মানে হচ্ছে, জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাষ্ট্র পরিচালনা এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং রাষ্ট্রীয় আইন প্রণয়নের সব সিদ্ধান্তে জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলনের নিশ্চিতকরণ। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থা কায়েম করার কতগুলো পূর্বশর্ত রয়েছে। যেমন সহনশীলতা, ভিন্ন মতাদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন, সব দ্বন্দ্বের সমাধান যুক্তিতর্ক এবং আলোচনার মাধ্যমে করা, প্রশাসন এবং আইন বিভাগ এবং নির্বাচন কমিশনকে সম্পূর্ণ ভাবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং স্বচ্ছ রাখা, সংঘাত কিংবা প্রতিহিংসা পরায়ণতা পরিহার করা, সর্বসম্মতি সাপেক্ষে গৃহীত সংবিধানের প্রতি অনুগত থাকার বাধ্যবাধকতা, সংবিধানে কোনও পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে সরকারি এবং বিরোধী দলের মধ্যে কোনও বিষয়ে মতপার্থক্য সংসদে নিরসন করা অসম্ভব হলে গণভোটের মাধ্যমে সেই মতপার্থক্যের নিরসন করা, সর্বোপরি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে গণতান্ত্রিক সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠিত করা, এইসমস্ত পূর্বশর্তগুলো যেসব সমাজে বর্তমান সেখানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা অবশ্যই সফল হবে। কিন্তু এই পূর্বশর্তগুলো যে সমস্ত সমাজে অবর্তমান সেখানে স্বচ্ছ এবং সত্যিকারের গণতন্ত্র কখনই কার্যকর হতে পারেনা। সেখানে গণতন্ত্রের নামে চলে স্বৈরাচার এবং সেটা ক্রমান্বয়ে পরিণত হয় পরিবারতন্ত্রে।
জনাব উসলেন, প্রখ্যাত রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানীর রিসার্চে দেখা গেছে শক্তিশালী উন্নত দেশগুলোতে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি স্বচ্ছ এবং ক্রিয়াশীল। তাই সেখানে নির্যাতন ও দুর্নীতি নেই বললেই চলে। এর প্রধান কারণ হিসাবে জনাব উসলেন বলেছেন বিশ্বের উন্নত দেশগুলো এবং তৃতীয় বিশ্বের পশ্চাদপদ এবং অনুন্নত দেশগুলোর বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর শিক্ষা এবং জীবনযাত্রার মানে রয়েছে বিশাল ব্যবধান। এই ব্যবধান রাজনীতিবিদদের মননশীলতায় প্রভাব ফেলে। উন্নত দেশগুলোতে সমাজপতি এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় উপবিষ্ট রাজনীতিবিদরা বৃহত্তর সাধারণ জনগোষ্ঠী যাতে আত্মমর্যাদার সাথে সার্বিকভাবে স্বচ্ছল জীবনযাত্রার মান ও অধিকার সুনিশ্চিত হয় সেই দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই রাষ্ট্র এবং সমাজ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করে থাকেন।
পক্ষান্তরে, অনুন্নত দেশগুলোর সমাজপতি এবং রাজনীতিবিদরা জনসংখ্যার অতিক্ষুদ্র একটি অংশ হয়েও জাতীয় সম্পদের সিংহভাগ সামাজিক প্রতিষ্ঠা এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে নিজেদের হাতে কুক্ষিগত করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে মানবেতর জীবন যাপনে বাধ্য করে তাদেরকে মূলত শাসককুলের দাসে পরিণত করে রাখে। জনগণের মেধা, উদ্যম, সৃজনশীলতা, কর্মক্ষমতাকে সুদূর প্রসারী পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজে লাগিয়ে সুখী, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল জাতি এবং দেশ গড়ার পরিবর্তে শুধুমাত্র ক্ষমতাবানদের ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীস্বার্থে তাদের জীবনী শক্তিকে ব্যবহার করে ক্রমশ তাদের বোধশক্তিহীন নিস্তেজ জিন্দা লাশে পরিণত করে রাখার লক্ষ্যেই রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে থাকে। প্রায়ই সংবাদ মাধ্যমে প্রচারিত হয়, বাংলাদেশের জনগণ নিজেদের সুখীই মনে করেন! স্তম্ভিত হতে হয় এই ধরনের বিবেক বর্জিত মিথ্যা প্রচারণায়! বর্তমান বৈষম্যমূলক সমাজ ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার স্বার্থেই অভিজাত শ্রেণী থেকে আগত কবি-সাহিত্যিকরা ‘দারিদ্রকে খৃস্টের সম্মান’ দিয়ে থাকবেন। এই প্রেক্ষিতে একটি ঘটনা পাঠকদের কাছে তুলে ধরছি। ঘটনাটি সাধারণ হলেও এর তাৎপর্য অনুধাবন করা প্রয়োজন আমাদের সমাজের মোড়লদের চরিত্র এবং মন মানসিকতা বোঝার জন্য।
ছোটবেলায় দেখলাম, পাড়ার এক বহুল পরিচিত ধনাট্য ব্যক্তি আমাদের বাড়িতে ভিক্ষে করতে এসেছেন সবাইকে হতবাক করে দিয়ে। জানা গেলো, তিনি নিজেকে ‘ফকির’ ঘোষণা দিয়ে তাঁর সব ধনদৌলত, স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি তার উত্তরসুরিদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারা করে দিয়ে একটি থলে হাতে বেরিয়ে পড়েছেন। এতেই নাকি তিনি পরম ঐশ্বরিক সুখ অনুভব করছেন! নিজে ‘ফকির’ হলেন বটে, কিন্তু ধনসম্পদ রয়ে গেলও তারই প্রজন্মের কাছে।
বাংলাদেশের মানুষের রক্তে মিশে আছে গণতান্ত্রিক অধিকার। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনায়ও মিশে ছিলো গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রত্যাশা। কিন্তু বিদেশী শক্তিসমুহের সৃষ্ট পরভৃততথাকথিত সুশীল সমাজের মাথা এবং শাসকগোষ্ঠীর মন-মানসিকতা গড়ে তোলা হয়েছে স্বৈরতান্ত্রিক ধ্যান-ধারণার ভিত্তিতে। এই বৈপরীত্যের ফলেই আজঅব্দি নানা কৌশলে গণতন্ত্রের র্বশর্তগুলো পূরণ না করে জনগণকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছে প্রকৃত গণতান্ত্রিক অধিকার থেকে। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্রের লেবাসে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচার।
জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য শাসক-শোষকগোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণাধীন মিডিয়ার মাধ্যমে জোর মিথ্যা প্রচারণাও চালানো হচ্ছে যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীয় ব্যাবস্থাতে রাষ্ট্রধর্ম এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের একই সাথে কোনও স্থান পাওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু এই জঘন্য অপপ্রচারের বরখেলাপে ঐতিহাসিক সত্য হলো, কালের আবর্তে প্রতিটি সভ্যতাকেই প্রভাবিত করেছে বা করছে ধর্ম ও ধর্মীয় মূল্যবোধ। বিশ্বের অনেক উন্নত এবং অনুন্নত গণতান্ত্রিক দেশেই রাষ্ট্রধর্ম আছে এবং ধর্ম ভিত্তিক রাজনৈতিক দলও আছে। আমাদের নিকটেই অবস্থিত গণতান্ত্রিক দেশ মালয়েশিয়ার রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম। রাষ্ট্রধর্ম আছে ইংল্যান্ড, নরওয়ে, সুইডেন ও ডেনমার্কের মতো গণতান্ত্রিক দেশে। এসব দেশের মানুয বাংলাদেশীদের মতোই ধর্মান্ধ নয়। কিন্তু এদের মাঝে কাজ করে চলেছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। যেকোনো দেশের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, সংবিধান এবং আইনসমূহ প্রতিষ্ঠিত হয় জনগণের মূল্যবোধের ভিত্তিতে। আর বিশ্ব পরিসরে ধর্মবিশ্বাস হল এখনও মানুষের মূল্যবোধের অন্যতম প্রধান উৎস। উল্লেখিত এইসব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কেও গভীরভাবে ভাবতে হবে বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সঠিক মুক্তির পথের ন্ধানে। বিশ্বায়নের দাপটে স্বকীয় ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধ আজ বিলীয়মান প্রায় সব জাতিগোষ্ঠীর। বিশেষকরে শোষণ এবং অপশাসন জীবন ব্যবস্থাকে এমন পর্যায় নিয়ে এসেছে যেখানে বাঁচার তাগিদে শাসক-শোষক গোষ্ঠীর মিথ্যাকেও সত্য হিসাবে মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে সাধারণ জনগণ। তাদের অপকর্মের বোঝা না বয়ে সাধারণ ভাবে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়েছে। সর্বক্ষেত্রে পশুশক্তির শাসনই আজ আইনি শাসন আমজনতার জন্য। চারিদিকের ঘটনাপ্রবাহ প্রতিটি দিনকে ক্রমেই অর্থহীন করে তুলছে বোদ্ধাজনদের কাছেও। এমন একটি দিন নেই যেদিন হৃদয় বিদারক, অমানবিক, অনৈতিক ঘটনা ঘটছে না। গুম, খুন, সহিংসতা, সংঘর্ষ, ধর্ষণ, জবর দখল, অন্যায়-অবিচার, মিথ্যাকহন, অপপ্রচার, ব্যভিচার, মাদকাসক্তিসহ এমন কোনো বর্বরতা নেই যা ঘটছে না অহরহ। এই সমস্ত অঘটনের প্রণেতা সমাজের চিহ্নিত স্বল্পসংখ্যক মানুষ নামের অমানুষ। এরা এমনটি করতে পারছে কারণ তারা বিত্তবান এবং ক্ষমতাবান। তাদের নেই কারো কাছে জবাবদিহিতার কোনোও দায়বদ্ধতা। এই সমস্ত লোমহর্ষক ঘটনাবলী নিরীহ দেশবাসীদের শুধু ভীত সন্ত্রস্তই করছে তা নয়, তাদের চেতনা ও বোধ শক্তিরও বিলুপ্তি ঘটাচ্ছে। ফলে প্রতিবাদী না হয়ে সব কিছুকেই নিয়তির বিধান হিসেবেই মেনে নেয়া হচ্ছে। সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা যাতে হাতছাড়া না হয়ে যায়, তার জন্য একদিকে জনগণকে বিভিন্নভাবে বিভক্ত করে রাখা হচ্ছে, অন্যদিকে তাদেরকে ব্যস্ত রাখা হচ্ছে নাভিশ্বাস অবস্থায় দৈনন্দিন জীবনের চাহিদা মেটাতে যাতে তারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে কোন প্রতিরোধ সংগ্রাম সংগঠিত করতে না পারে।
এই স্বল্পসংখ্যক কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর একটাই লক্ষ্য, তা হচ্ছে সীমাহীন সম্পদ এবং বৈভব অর্জন। আর এর জন্যই প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা। একি সাথে তারা বিশেষভাবে সচেতন থাকে যাতে করে সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বিশাল জনগোষ্ঠী কোনক্রমেই অন্যায়-অবিচার ও তাদের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে সচেতন হয়ে হক আদায়ের লক্ষ্যে কোনও প্রকার সংগ্রাম কিংবা আন্দোলন সংগঠিত করতে না পারে। অঙ্কুরেই তেমন কোনও উদ্যোগকে বর্বরোচিত নিষ্ঠুরতার সাথে উপড়ে ফেলা হয় মিথ্যা প্রচারণার আড়ালে রাষ্ট্রীয় এবং দলীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে। আদিকাল থেকে সমাজ এবং রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল মানুষের কল্যাণের জন্যই। তাদের জীবনধারণ করার প্রক্রিয়া সহজ ও নিরাপদ করে তোলার জন্য। কিন্তু একবিংশ শতাব্দীতে আমরা কি দেখছি? লোভী, মুনাফাখোরী শাসকগোষ্ঠী অনুধাবন করছে সমাজ এবং রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রণের অধিকারটাই হল তাদের শোষণ ও অপশাসনের মূল হাতিয়ার। তাই বিশ্ববাসীর নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণের ভাওতার আড়ালে সারা দুনিয়ায় সৃষ্টি করা হচ্ছে ত্রাসের রাজত্ব। কারণ, তারা জানে, ভীতসন্ত্রস্ত এবং যন্ত্রণাক্লিষ্ট জনগণ অতি সহজেই আত্মসমর্পণ করে। মার্কিন সমাজ বিজ্ঞানী করি রবিন নিউইয়র্কের জ্যাকবিন সাহিত্য ম্যাগাজিনে ‘ল্যাঙ্গুয়েজ অফ ফিয়ার, সিকিউরিটি এন্ড মডার্ন পলিটিক্স’ নিবন্ধে এইসব মুনাফাখোরদের সম্পর্কে একটি চমৎকারবর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন এরা অনেকটাই আন্তর্জাতিক, নানাবর্ণে বিস্তৃত এবং একে অপরকে এই বিষয়ে সহায়তা করে থাকে। এদের কাছে সবচেয়ে ফায়দা দায়ক উপাত্তটি হল ‘নিরাপত্তা’ কেন্দ্রিক। এরা রাষ্ট্রের নিরাপত্তা, সমাজের নিরাপত্তা অথবা জাতীয় নিরাপত্তার নামে অভাবনীয় সব ঘটনা বিশ্বপরিসরে ঘটিয়ে চলেছে। এর মূল উদ্দেশ্য হলো প্রতিপক্ষের যেন কোনও অধিকারই বলবত না থাকে। তারা গণতন্ত্র, মানবাধিকারসহ যেকোনো নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী হউক না কেনও। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো‘নিরাপত্তার’ বিষয়টি তারাই নির্ধারণ করছে। এর সংজ্ঞা নিরুপণে জনগণ এমনকি বোদ্ধাজনদেরও কোনও সম্পৃক্ততা নেই। তারাই একতরফাভাবে ঠিক করছে কোন বক্তব্য কিংবা ঘটনা ‘নিরাপত্তার’ প্রতি হুমকি! জনগণ সেই সমস্ত বক্তব্য এবং ঘটনাকে হুমকি কিংবা বিপদজনক মনে করছে কিনা তাদের কাছে সেটা একেবারেই গৌণ এবং ধর্তব্যের বিষয় নয়। এই লোভী এবং স্বার্থপর মুনাফাখোররা কখনো শাসক রূপে কখনও তাদের দোসর হয়ে এই ‘নিরাপত্তার’ নামে বিশ্বের সর্বপ্রান্তে জনজীবনকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। করি রবিন এদের মানসিকতা সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আরও বলেছেন
এরা ‘নিরাপত্তা’ বলতে বোঝে তাদের শাসন ও শোষণের সুরক্ষিত স্থায়িত্ব। তাই তাদের কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে যারাই সোচ্চার হবে বা প্রতিবাদী হবে তাদেরকেই চিহ্নিত করা হবে তাদের সংজ্ঞায়িত ‘নিরাপত্তার’ প্রতি হুমকি হিসাবে এবং এদের নির্মূল করার জন্য প্রয়োগ করা হয় রাষ্ট্রীয়, দলীয় এবং গোষ্ঠী সন্ত্রাস। প্রয়োজনে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধারীরা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থে প্রণীত করে উদ্ভট আইন কানুন। সাম্প্রতিক কালের খণ্ডিত সোভিয়েত ইউনিয়ন, রেজা শাহ পেহলভির ইরান, সাদ্দামের ইরাক, গাদ্দাফির লিবিয়া, মোবারকের মিশর, আসাদের সিরিয়া তার এই বিশ্লেষণের জ্বলন্ত উদাহরণ। তবে তিনি বলেছেন
বাস্তবতার নিরিখে বিভিন্ন দেশে এই সন্ত্রাসের রূপ হয় ভিন্ন প্রকৃতির। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোর তুলনায় অনুন্নত দেশগুলোতে এই সন্ত্রাসের রূপ হয় ক্রূর এবং বর্বরোচিত যেমন, গুমখুন বা বহুল আলোচিত ‘এনকাউন্টারে’ বন্দী অবস্থায় বিরোধীদের হত্যা করা। অনেক সময় সংঘাত এবং সংঘর্ষের সৃষ্টি করে নির্বিবাদে শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে প্রকাশ্যে হত্যাযজ্ঞ চালানো হয় প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে। করি রবিন তার অনুসন্ধানে দেখিয়েছেন, এই ‘নিরাপত্তার’ অজুহাতে পৃথিবীব্যাপী নৈরাজ্য, ধ্বংস, বিনাশ ক্রমে বেড়েই চলেছে। এই মাত্রার ধ্বংসযজ্ঞের নজির মতাদর্শের ভিন্নতা এবং ধর্মীয় কারণে অতীতের মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুঁজে পাওয়া যায় না। বিখ্যাত রাজনৈতিক তাত্ত্বিক জন ড্যান এবং বার্নার্ড উইলিয়ামস বলেছেন
যেহেতু জনগণের সার্বিক নিরাপত্তার দায়িত্ব রাষ্ট্রের, তাই ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী মুনাফার জন্য এই ‘নিরাপত্তা’ বিষয়টি জনগণকে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে ধোঁকা দিয়ে নিজেদের স্বার্থ হাসিল করার লক্ষ্যে প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার সবচেয়ে সহজপন্থা হিসাবে ব্যবহার করে থাকে। সুপরিকল্পিতভাবে বিদেশী প্রভুদের সাহায্যে প্রতিপক্ষকে ‘নিরাপত্তার’ হুমকি হিসাবে চিহ্নিত করে তাদের অতি নিষ্ঠুর ভাবে নির্মূল করার উদ্যোগ গ্রহণ করে বিভিন্ন দেশের ক্ষমতাধর স্থানীয় তল্পিবাহক দালালরা। প্রকাশ্যেই তারা ‘নির্মূল’ শব্দটি প্রচার করার ধৃষ্টতাও প্রদর্শন করে। ‘নিরাপত্তার’ নামে অতিকৌশলে তারা লোমহর্ষক ত্রাস এবং ভীতির রাজত্ব কায়েম করে জনগণের মানবিক অধিকার হরণ ও প্রতিপক্ষকে নির্মূল করে চলেছে যেই শুভংকরের ফাঁকিটা বেশিরভাগ ক্ষেত্রে সহজ সরল জনগণের পক্ষে ধরাটা সম্ভব হয় না। সবদেশেই জনগণের যেকোনো দাবি ভিত্তিক আন্দোলনের চরম পর্যায়েই এই হাতিয়ারটি বিশেষ বর্বরোচিত ভাবে ব্যবহার করা হয় শেষরক্ষার জন্য। যখন ক্ষমতাবানরা বুঝতে পারে জনগণ তাদের তথাকথিত দেশভক্তি মূলক খিস্তি-খেউড় আর ‘নিরাপত্তার’ কপচানো বুলিকে সন্দেহ করছে তখন তারা বিচারের প্রহসনের মাধ্যমেও প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেয় তাদের সহচর এবং অনুগত বিচার বিভাগের সহায়তায়। সরকার নিয়ন্ত্রিত বিচারবিভাগের মাধ্যমে প্রতিপক্ষকে বিশেষ করে যারা আপোষহীনভাবে সত্য, নৈতিকতা, মানবিক এবং সামাজিক অধিকারের জন্য কথা বলে, জানবাজি রেখে লড়ার মত চারিত্রিক দৃঢ়তা প্রদর্শন করে তাঁদের ফাঁসির মঞ্চে চড়িয়ে, কারাগারে ‘ডেথ সেল’-এ দীর্ঘকাল নারকীয় মানবেতর পরিস্থিতিতে আধমরা করে ফেলে রেখে একদিকে ভীতির রাজ্য কায়েম এবং অন্যদিকে কায়েমী স্বার্থের পথের কাঁটা সরানোর এই ন্যক্কারজনক কর্মকাণ্ড ঘটানো হচ্ছে সর্বত্র। বাংলাদেশেও স্বাধীনতার পরপরই মুজিবের আওয়ামীলীগ সরকারের অঙ্গুলি হেলনে দেশদ্রোহী কাদের সিদ্দিকীর ‘কাদেরিয়া বাহিনীর’ সদস্যরা ঢাকা স্টেডিয়ামে প্রকাশ্য দিবালোকে একইভাবে বাংলা এবং উর্দুভাষী শতশত বাংলাদেশী নাগরিককে দালাল অভিহিত করে বিনা বিচারে বেয়নেট দিয়ে ক্ষমতাসীনদের প্রতিপক্ষকে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা করেছিল। দেশ-বিদেশের নামিদামি পত্র-পত্রিকায় এই বিভৎস হত্যাযজ্ঞের ছবিসহ প্রতিবাদী প্রতিবেদন লিখেছিলেন সাহসী সাংবাদিকরা। তাদের অনেককেই পরিণামে সরকারের রোষানলে পড়তে হয়েছিল। এ ধরণের বর্বরতায় সমর্থন দিয়ে একটি বীরের জাতির মুখে কালিমাই লেপন করেছিলেন তদানীন্তন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব।
২০১০ সালের ২৭/২৮ জানুয়ারি একদলীয় স্বৈরশাসন বিরোধী ঐতিহাসিক ‘৭৫-এর ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা এবং সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদেরকে শেখ মুজিবের কন্যা শেখ হাসিনা তার জিঘাংসা চরিতার্থ করার জন্য অসাংবিধানিক ও বেআইনিভাবে সাজানো মামলার মাধ্যমে জাতির এবং বিশ্বজনমতের কোনও তোয়াক্কা না করেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে বিরোধী জোটের নেত্রী খালেদা জিয়ার মৌন সম্মতি সাপেক্ষে। এরপরও কি বলা যুক্তিসঙ্গত নয় যে মুজিব এবং হাসিনার মতো জেনারেল জিয়া এবং খালেদা জিয়াও ভারতের সাথে আঁতাতের মাধ্যমেই রাজনীতি কর চলেছেন। তবে অবশ্যই বলতে হবে পদলেহি হিসেবে বরাবরই যুক্তিসঙ্গত কারণেই অগ্রাধিকার পেয়ে এসেছেন মুজিব ও হাসিনা। এর আগের বছর ২০০৯ সালের ২৫-২৬ ফেব্রুয়ারি প্রত্যক্ষ সরকারী চক্রান্তের ফলে ঘটে তথাকথিত বিডিআর বিদ্রোহের নাটক যার ফলে ঐতিহ্যধারী এবং ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে অগ্রণী ভূমিকা পালনকারী এই সশস্ত্র বাহিনীটিকে বিলুপ্তই করা হয়। শুধু তাই নয়, সরকারের নিযুক্ত আইও অবসরপ্রাপ্ত এ এস পি আখন্দ এবং সেনাবাহিনীর তদন্ত রিপোর্ট প্রকাশ না করেই আরও কয়টা বিচারের সাজানো নাটকের মাধ্যমে ভারতের পালিত এবং পদলেহি হাসিনা সরকার ভারতের স্বার্থেই ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে শত শত বিডিআর সৈনিককে। কারাগারে নিক্ষিপ্ত করা হয় অসংখ্য বিডিআর সৈনিককে। এর জের ধরে সেনাবাহিনীতে ত্রাস সৃষ্টি করে সেনা সদস্যদের সচেতনাকে অবচেতন করে ফেলার লক্ষ্যে এবং প্রতিবাদী কণ্ঠকে স্তব্ধ করে দেবার জন্য চাকুরিচ্যুত করা হয় বিবেকবান বিভিন্ন র্যাং কের প্রায় ২০০ অফিসারকে। জার্মানির হিটলার, ইতালির মুসোলিনি, সোভিয়েত ইউনিয়নের স্ট্যালিন, জায়েরের মবুতু, ইরানের শাহ্, ইরাকের সাদ্দাম, মিশরের হোসনি মোবারক, সিরিয়ার আসাদ প্রমুখ স্বৈরশাসকরা একই নীতি প্রয়োগ করেছেন ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য। সংবাদ মাধ্যম, রাষ্ট্রীয় প্রশাসন, আইন বিভাগ, শিক্ষাঙ্গনকে সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণাধীন করে সব স্বৈরশাসক তা সে যে লেবাসেই হউক না কেনো তাদের স্বেচ্ছাচারিতা চালিয়ে থাকেন। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহারের দৃষ্টান্ত মেলে প্রচার মাধ্যম, বিচার বিভাগ, গোয়েন্দা প্রতিষ্ঠানসমূহ, প্রতিরক্ষা ও শান্তি রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর গোষ্ঠীস্বার্থে অপপ্রয়োগের ধারাবাহিকতায়।
ক্ষমতাসীনরা অতি সহজেই তাদের সব বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডকে বৈধ করে নেয় তাদেরই প্রণীত সংবিধান এবং পদানত আইন বিভাগের মাধ্যমে। এ ভাবেই ক্ষমতাসীনদের পক্ষে সর্বযুগেই সম্ভব হয়ে এসেছে সব অন্যায়, সংঘর্ষ এবং অরাজকতার দায় প্রতিপক্ষের উপর চাপিয়ে দিয়ে নির্বিবাদে তাদের স্বার্থ হাসিল করা। এই ঘৃণ্য কারসাজির ফলেই বর্তমান পৃথিবীতে নিষ্ঠুরতা এবং সন্ত্রাস প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পেতে সক্ষম হচ্ছে। বর্তমানে তথ্য প্রযুক্তির ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক বিস্ফোরণ ঘটলেও এখনও ক্ষমতাধর শাসকশোষক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই ক্ষমতাবানদের নিষ্ঠুরতা লাগামহীন ভাবে বেড়েই চলেছে বিশ্বজুড়ে।
ক্ষমতা মানুষকে অন্ধ এবং বধির করে তোলে। ইতিহাস থেকেও ক্ষমতাবানরা শিক্ষাগ্রহণ করে না। ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়, সেই সত্যটাকেও অস্বীকার করে থাকে তারা। তাই ভবিষ্যতের পরিণাম সম্পর্কে ক্ষমতাবানরা থাকে নির্লিপ্ত। বর্তমান পৃথিবীতে ক্ষমতাবানরা মুখে স্বৈরচারের বিরুদ্ধে যতই খিস্তি-খেউড়ই করুক না কেনও অন্তরে তারা সবাই স্বৈরচারের পূজারী। একেই বোধকরি প্রবাদে বলা হয়, ‘চোরের মার বড় গলা’। উল্লেখিত বিষয়গুলোর উপর মন্তব্য করতে গিয়ে লিখেছেন মার্কিন সহকারি অর্থমন্ত্রী পল ক্রেইগ রবার্টস। তার প্রতিবেদনটি যদিও যুক্তরাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে লেখা তবুও তার প্রতিবেদন বিশ্বের অন্যান্য দেশ বিশেষ করে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর জন্য তাৎপর্য বহন করে।তিনি লিখেছেন
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে সত্যের কি কনও ভবিষ্যৎ আছে? এমনটি তিনি লিখেছিলেন কয়েকজন সত্য কথকদের সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে। তিনি লেখেন যারা উইকিলিক্স এর মাধ্যমে সারা দুনিয়ায় মার্কিন অপকর্মের অনেক গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয় এদের উপর পরিণামে অত্যাচারের যে খড়গ নেমে আসে তা অকল্পনীয়। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে সরকারের বিশ্বস্তজনদের কেউও যদি কোনো সত্য বলেন তাকেও ছাড় দেয়া হয় না। যেমন মেজর জেনারেল আন্তনিয় তাগুবার কথাই ধরা যাক। বিশ্ব সমালোচনার প্রেক্ষিতে তাকে দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আবু গ্রাইব জেলে কয়েদীদের উপর অত্যাচার করা হয় কিনা সেই বিষয়ে তদন্ত করে মার্কিন সরকারের কাছে রিপোর্ট পেশ করার। সরকার আশা করেছিল জেনারেল হিসেবে তিনি সেখানে ঘটিত সব অপকর্মের কাহিনী চেপে যাবেন। কিন্তু সত্যনিষ্ঠ জেনারেল তাগুবা একটি চমৎকার বস্তুনিষ্ঠ রিপোর্ট দেন। রবার্টস অনুশোচনা করে লিখেছেন, এমন ভালো কাজের জন্য তাগুবাকে পদোন্নতি না দিয়ে তাকে পদত্যাগে বাধ্য করা হয়। এমনটি বর্তমানে অহরহ ঘটছে। এভাবে প্রতিভাবান মানব সম্পদ ধ্বংস করা হচ্ছে। এ ধরনের সত্যকহনে মানবতা ও রাষ্ট্র উপকৃত হয় এবং সুন্দর ভবিষ্যতের দিকে এগিয়ে চলে। কারণ, মানব সম্পদ সত্যের উপর প্রতিষ্ঠিত এবং সত্য বলতে অভ্যস্ত। রবার্টস আরও লিখেছেন এই ধরণের অনৈতিক আচরণের ফলে সব সরকারের আমলেই সত্য বলার লোক কমে যাচ্ছে। কারণ, সত্য বললে পদ, যোগাযোগ, সামাজিক জীবন এমনকি বেঁচে থাকার অধিকারটুকু হারিয়ে ফেলার ভয় থাকে। আল জাজিরার উল্লেখ করে তিনি লিখেছেন, এর শুরু হয়েছিল সত্যকহনের মাধ্যমে, বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষয় নিয়ে। পশ্চিমা বিশ্বের সংবাদ মাধ্যমগুলো মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্ব নিয়ে যে সমস্ত গল্প ফাঁদে সেগুলোর অসত্যতা উন্মোচিত করার লক্ষ্যে। দেখা গেলো অতি অল্পসময়ে সেই দেশের সরকার এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর তল্পিবাহক সরকারগুলো আল জাজিরাকে ধমকাচ্ছে, সেন্সর করছে এবং এক পর্যায়ে এর কাবুল ও বাগদাদের দফতরে হামলা চালানো হয় এবং তাদের সাংবাদিকদের টার্গেট কিলিং-এর মাধ্যমে হত্যা করা হতে থাকে। এ ভাবেই আল জাজিরাকে পশ্চিমা সংবাদ মাধ্যমগুলোর বিকৃতিকে অনুসরণ করে চলতে বাধ্য করা হয়েছিল। রবার্টস তার প্রতিবেদনে স্পষ্ট করে দেখিয়েছেন, কেমন ভাবে সত্য অনুসন্ধানী তথ্যভিত্তিক রিপোর্টগুলো সরকার বস্তাবন্দী করে অনাচারের রাজ্য কায়েম রাখে। তিনি আর একটা উদাহরণ দিয়েছেন। যখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থিত হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনকে বন্ধ করার জন্য মামলা করা হয়, তখন দেখা যায় এই চ্যারিটিটি ইউ এস এইড এবং জাতিসংঘের অনুমোদিত হয়েই মানবিক কারণে প্যালেস্টাইনের দুস্থ মানুষের সাহায্য করছে, এমনকি স্টেট ডিপার্টমেন্টেরও সম্মতি ছিল সেই কর্মকাণ্ডে। তাই প্রথম বারের মামলায় সরকার পক্ষ হেরে যায়। ইসরাইলের চাপে মামলাটি পুনরায় আদালতে উত্থাপন করা হয়। এবার কোর্ট এই সংস্থার বিরুদ্ধে গোপন এবং অজ্ঞাত এক বিশেষ ব্যক্তির ‘এক্সপার্ট আইনজ্ঞের অভিমত’ গ্রহণ করার অনুমোদন দিলো। একইসাথে কোর্ট রায় দিলো, সেই ‘বিজ্ঞ ব্যক্তি’কে কোর্টের সামনে পেশ হতে হবে না! তেমনই একজন ‘এক্সপার্ট আইনজ্ঞের’ জমাকৃত ‘সাক্ষ্য প্রমাণের’ ভিত্তিতে কোর্ট হলিল্যান্ড ফাউন্ডেশনের সব কার্যক্রম বন্ধ করে দেবার হুকুম জারি করে। রবার্টস লিখেছেন, এভাবেই মানবিক উদ্যোগের মৃত্যু ঘটিয়ে ক্ষমতাশালী গোষ্ঠীস্বার্থে মিথ্যা বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে নিষ্ঠুরতার প্রাতিষ্ঠানিকতার অগ্রযাত্রা অব্যাহত রাখা হলো। এই চিত্রগুলো যেন একান্তভাবে বাংলাদেশেরই নিজস্ব ঘটনাসমূহ, হিসাবেই প্রতিফলিত হচ্ছে রাষ্ট্র এবং সমাজের সর্বক্ষেত্রে! বিশেষভাবে নির্বাহী সরকারের পদানত আইন বিভাগের শোচনীয় অবয়ব বাংলাদেশে জন্মলগ্ন থেকেই স্পষ্টভাবে প্রতিভাত। আমেরিকার মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘গভর্নমেন্ট এন্ড পলিটিক্স’-এর অধ্যাপক এরিক এম উসলেনার তার এক রিসার্চ পেপারে দেখিয়েছেন আধুনিক বিশ্বে গণতন্ত্রের ব্যাপক অপব্যবহারে শুধুই স্বৈরাচারের জন্ম হচ্ছে, বিশেষ করে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোতে। এই স্বৈরশাসন শুধু দুর্নীতি এবং তার থেকে সৃষ্ট পেশিশক্তির উপর নির্ভরশীল। দুর্নীতিমুক্ত গণতন্ত্রে স্বৈরাচার, অসাধু ও পক্ষপাতপুষ্ট বিচার বিভাগ, অসম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, পরাধীন, বিশৃঙ্খল সংবাদ মাধ্যম এবং নির্বাচন ব্যবস্থা থাকতে পারে না। উসলেনার আরও দেখিয়েছেন, অসম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা টিকিয়ে রেখে কখনোই দুর্নীতিকে নির্মূল করা সম্ভব নয়। তিনি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের জন্য দুইটি বিষয়ের উপর বিশেষ জোর দিয়েছেন।
গণতান্ত্রিক মানসিকতা, ব্যবহার এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানসমূহ। যখনই নির্বাচিত সরকার গণতান্ত্রিক ব্যবহার থেকে সরে এসে স্বৈরচারী শাসন পদ্ধতির আশ্রয় নেয় তখনই গণতন্ত্রের মৃত্যু ঘটে। তখনই রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পর্যায়ে দুর্নীতিসহ নানা রকম অগণতান্ত্রিক কার্যক্রমের উদ্ভাবন ঘটে। শুরু হয় ত্রাসের রাজত্ব এবং সংঘাত। উসলেনার অভিমত প্রকাশ করে বলেছেন, সত্যিকার অর্থে স্বৈরাচারের চেয়ে গণতান্ত্রিক স্বৈরাচার অধিক ভয়াবহ। এর প্রধান কারণ হল, গণপ্রতিনিধিত্বশীল সরকার হিসেবে ক্ষমতাগ্রহণের পরমুহূর্তেই বিচার বিভাগ এবং প্রচার মাধ্যমকে কুক্ষিগত করে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন করে ফেলে। ফলে আইন বিভাগের পক্ষে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত ক্ষমতাসীন দলীয় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কোনোও আইনী পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হয় না। গ্রহণকরলেও আদালতের রায় কার্যকর করা হয় না। এমনকি অসহায় বিচার বিভাগের সহায়তায় আইনী ফাঁক-ফোকরের মাধ্যমে অনায়াসে সাজাপ্রাপ্ত ক্রিমিনালদের সাজাও মওকুফ করিয়ে নেয় ক্ষমতাসীনরা। এ ভাবেই অন্যায় অবিচারের ক্যান্সার ছড়িয়ে দেয়া হয় রাষ্ট্র ও সমাজের সর্বক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় গণতন্ত্রের খোলসে। উসলেনার তার অনুসন্ধান মূলক প্রতিবেদনের উপসংহারে লিখেছেন
শুধু একটিমাত্র উপায়েই দুর্নীতিসহ সব অন্যায়, অনাচার, অপশাসন এবং সংঘাতের পরিসমাপ্তি ঘটতে পারে, যদি রাষ্ট্র প্রতিটি নাগরিককে সমভাবে দেখে। সামান্যতম পক্ষপাতিত্ব হলেও এইসব অনাচার এবং দুর্নীতির মূল উৎপাটনসম্ভব নয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ তিনি একদা চরম দুর্নীতিগ্রস্ত সিঙ্গাপুর এবং আফ্রিকার বোতসোয়ানা রাষ্ট্রের উল্লেখ করে বলেন, জাতীয় নেতৃবৃন্দের দূরদর্শিতা এবং কঠোর নীত-আদর্শ ভিত্তিক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার প্রয়োগের মাধ্যমে নাগরিকদের সমঅধিকার প্রতিষ্ঠিত করার ফলে দেশ দু’টি স্বাধীনতার পর মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই দুর্নীতিমুক্ত হয়ে বর্তমানের উন্নত বিশ্বের কাছে অভূতপূর্ব বিস্ময়কর আদর্শ রাষ্ট্রের নিদর্শন হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে। উসলেনারের মতে, সত্যিকারের গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে প্রথম শর্ত হচ্ছেরাজনৈতিক দলগুলোকে বিশেষ করে ক্ষমতাসীন দলকে গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার চর্চা করতে হবে। উসলেনারের অনুসন্ধানমূলক প্রতিবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের চলমান অবস্থার দিকে সামান্য দৃষ্টিপাত করলেই বোঝা যায় গণতন্ত্রের কি করুণ হাল। জনগণের সমঅধিকার এবং গণতান্ত্রিক সহিষ্ণুতার কোনও তোয়াক্কা না করে দেশের সব কয়টি রাজনৈতিক দল, সুশীল সমাজের মাথা এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেরক্রিয়ানকগণ শুধুমাত্র ব্যক্তি, পরিবার, গোষ্ঠী, দলীয় স্বার্থে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার অভিপ্রায়ে বিভিন্ন স্লোগানের ঢালের আড়ালে যেভাবে ঘৃণ্য প্রতিযোগিতায় পালাবদলের রাজনীতির বেসাতি করে চলেছে তাতে জিঘাংসা পরায়ণ সহিংস সঙ্ঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে জাতি জীবনীশক্তি হারিয়ে নির্জীব হয়ে পড়ছে। এ ভাবেই সময়ে দেশ এবং জাতিকে পরিণত হতে হবে বলির পাঁঠায়। ক্ষমতাবানদের এই বিষয়ে কোনোই ভাবনা নেই। তাদের একমাত্র লক্ষ্য হলো ক্ষমতা এবং সেই ক্ষমতা ব্যবহারের সুযোগ। এর জন্য শেষ অস্ত্র হিসাবে তারা ঘৃণাকেও ব্যবহার করে সামাজিক অস্থিরতা সৃষ্টি করতে কুণ্ঠিত হয় না। কারণ, যুগে যুগে এই ঘৃণাকে ছড়িয়ে দিয়ে সামাজিক উন্মাদনা সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছে। অবশ্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘ম্যাটা সেন্টার ফর ননভায়োলেন্স’-এর প্রেসিডেন্ট অধ্যাপক মাইকেল নেগলার স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন ঘৃণা সম্মোহনী উন্মাদনা সৃষ্টির ক্ষেত্রে একটি প্রচণ্ড শক্তি তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবেএই ঘৃণাই বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সাম্রাজ্যকেও ভেতর থেকেই ধ্বংস করেছে। তিনি দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, বর্তমান বিশ্বের মুনাফাখোর ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী একজোটে তাৎক্ষণিক ফায়দার জন্য এই ঘৃণাকেই অতি অমানবিক ভাবে ব্যবহার করছে মাত্রা ছাড়িয়ে। প্রাচীন গ্রীকপ্রবাদ এখন সবাই ভুলতে চাইছে, ‘কোনো সাম্রাজ্য বা শক্তি যদি তাদের শেষ সময়ে পৌছায় তখন সবাই পাগল হয়ে যায়। গোষ্ঠীগতভাবে ক্ষমতাবানরা এই পাগলামিতে মাতলে সাধারণ জনগোষ্ঠী ভুক্তভোগী হয় ঠিকই, কিন্তু প্রাকৃতিক বিধানে ক্ষমতাবানদের পতন অবধারিত হয়ে ওঠে।’
দার্শনিক এবং সমাজবিজ্ঞানীরা অভিমত পোষণ করেন, ধর্ম, গোত্র, এবং ভাষা এই তিনটি স্পর্শকাতর বিষয়কে রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের জন্য ব্যবহার করা হলে যেকোনো রাষ্ট্র এবং জাতিকে দিতে হয় চরম মূল্য। কারণ, যেকোনো দেশের ভৌগোলিক সীমানার মধ্যে বসবাস করে বহু জাতি, বিভিন্ন ধর্মমতে বিশ্বাসী এবং বিভিন্ন ভাষায় কথা বলা জনগোষ্ঠী। সেইক্ষেত্রে এই তিনটি বিষয়কে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করলে জাতীয় ঐক্যের বিপরীতে বিভাজনই সৃষ্টি হয়। জাতীয় ঐক্য ছাড়া কনও দেশ বা জাতি দৃঢ় ভিত্তির উপর স্থায়ী হয়ে প্রগতির পথে কখনোই এগুতে পারে না।
কিন্তু দুঃখজনক হলেও দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকেই এই তিনটি বিষয়কে মূলধন করেই ক্ষমতাশালী গোষ্ঠী দলমত নির্বিশেষে রাজনৈতিক ফায়দা নেবার জন্য ব্যবহার করে চলেছে যার পরিণতিতে ‘৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্ন ভিত্তিক যে জাতীয় ঐক্য গড়ে উঠেছিল সেই ঐক্যকে নস্যাৎকরে জাতিকে বিভক্ত করে ফেলা হয়েছে। এই বিভক্তির ফলেই ক্রমান্বয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে বিদেশী হস্তক্ষেপ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। ভূরাজনৈতিকভাবে বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলোর কাছে বাংলাদেশ গুরুত্বপূর্ণ হলেও বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতের স্বার্থটাই মুখ্য। অপসংস্কৃতির রাজনীতির ধারাবাহিকতায় দেশ ও জাতি আজ এসে পৌঁছেছে এক অনিশ্চিত ঘোর অমানিশার দ্বারপ্রান্তে। লাখো শহীদের আত্মত্যাগ এবং মা-বোনদের ইজ্জতের আহূতির ফলে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে ‘৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্ন, স্বনির্ভর সুখী সমৃদ্ধ বাংলাদেশ আজঅব্দি কেনও বাস্তবায়িত হলো না, সেই কারণগুলো ইতিহাসের আলোকেই অনুসন্ধান করতে হবে চেতনাকে শাণিত করার জন্য। নতুবা তারুণ্যের আবেগ সাহসিকতায় জ্বলে ওঠা স্ফুলিঙ্গ আলেয়ার মতই সাময়িকভাবে প্রজ্বলিত হয়ে মিলিয়ে যাবে ব্যর্থতার অন্ধকারে কিংবা ছিনতাই হয়ে যাবে ক্ষমতাসীনদের হাতের মুঠোয়। রাজনৈতিক ধারায় গণজোয়ার, আন্দোলন কিংবা গণবিস্ফোরণ কখনোই সফলতার মুখ দেখতে পারে না যদি সেটা ঐতিহ্যগত মূল্যবোধ, নৈতিকতা এবং নীতি-আদর্শ ভিত্তিক না হয়।
অধুনা ঘটে যাওয়া ‘শাহবাগ মঞ্চের’ ঘটনাবলীর কিছুটা বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করলেই অতি সহজেই বোঝা যাবে কি করে ধূর্ত শৃগালের মতো কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী তারুণ্যের আবেগ, রোমাঞ্চ, সাহস ও তাদের উদ্যমকে ব্যবহার করে থাকে নিজেদের স্বার্থে তরুণ প্রজন্মের অজান্তেই।
বাপ্পাদিত্য, থাবা বাবা, ইকবাল, রাজিব নামের কয়েকজন ব্লগারের উদ্যোগে ২০১৩ সালের ৫ই ফেব্রুয়ারি শাহবাগ চত্বরে বর্তমান প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের এক জমায়েত ঘটে। দৃশ্যটির সাথে চারদলীয় ঐক্য জোটের বিরুদ্ধে ম.খা. আলমগীরের নেতৃত্বে পেশাজীবী আমলাদের নিয়ে সংগঠিত ‘জনতার মঞ্চ’ এর কিছুটা সাদৃশ্য থাকলেও উদ্দেশ্যের দিক থেকে ছিল ভিন্ন। শাহবাগ থেকে দাবি ওঠে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার প্রতি আদালতের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের রায় তারা মানবে না, তাকে ফাঁসির দণ্ডে দণ্ডিত করতে হবে। দাবিটি যুক্তিসঙ্গত না হলেও স্পর্শকাতর। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিকই স্বাধীনতার পর থেকেই প্রকৃত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে এসেছে। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা এবং দেশবাসীর সেই ন্যায়সঙ্গত দাবিকে অগ্রাহ্য করেছিলেন সরকার প্রধান শেখ হাসিনার প্রয়াত পিতা শেখ মুজিবুর রহমান। পাকিস্তান থেকে স্বাধীনতার পর দেশে ফিরে প্রধানমন্ত্রী হয়েই তিনি আত্মসমর্পণকারী পাকহানাদার বাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধী সহ ৯৭ হাজার পরাজিত সেনাসদস্য ও তাদের দোসরদের ‘সিমলা চুক্তি’ মোতাবেক ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর হাতে তুলে দিয়ে গর্বের সাথে দেশবাসীকে স্মরণ করিয়ে দিলেন, ‘এই সিদ্ধান্তের মাধ্যমে তিনি বিশ্ববাসীকে জানান দিলেন বীরের জাতি হিসাবে ক্ষমা প্রদর্শনের মতো উদারতাও বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে।’ দেশের জনগণ তার সেই দম্ভোক্তিতে দুঃখিত হলেও তার বিরুদ্ধে সরব প্রতিবাদ ওঠেনি। এরপর, তিনি এক সাধারণ ক্ষমার আইন জারি করে সব যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেন। যুক্তি হিসাবে বলা হল, ‘জাতীয় ঐক্যের স্বার্থে অতীতের সব তিক্ততা, বিভেদ ও ভুল বোঝাবুঝির অবসান ঘটাতে হবে’। তার এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধেও কোনও প্রতিবাদ দেখা যায়নি সেই সময়। অদৃষ্টের পরিহাস! বর্তমানে তারই সুপুত্রী হাসিনা দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসীন হয়েই তার পিতার যুক্তি খণ্ডিত করে ১৯৯৬ সালে তার মিত্র দল জামায়াত-এর শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে যুদ্ধাপরাধী হিসাবে বিতর্কিত বিচার প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দণ্ডিত করে বিশ্বপরিসরে দেশবাসীর মুখে কালিমা লেপন করে দেশের উন্নয়নের জন্য অপরিহার্য জাতীয় ঐক্য নস্যাৎকরছেন কার স্বার্থে? ফিরে চলি শাহবাগ চত্বরে।
শাহবাগ চত্বর আমাকে মনে করিয়ে দেয় একটানা দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা মৌন গণজমায়েত হচ্ছিল লন্ডনের ট্রাফলগার স্কোয়ারের পাশেই অবস্থিত সাউথ আফ্রিকা ভবনের সামনে নেলসন ম্যান্ডেলার মুক্তি এবং এপারথেইড বা বর্ণবাদের অবসানের দাবিতে জাতি ধর্ম নির্বিশেষেসেই ঘটনার কথা। আমিও নিম্মিকে সাথে নিয়ে যখনই লন্ডন গিয়েছি তখন উপস্থিত হতাম আন্দোলনকারীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করতে। দু’একবার আমাদের শিশু কন্যা সস্তিকেও নিয়ে গেছি। তার কচি মনে জেগে ওঠা প্রতিটি প্রশ্নের জবাব দিয়ে আমাকে বোঝাতে হয়েছে ঐ গণজমায়েতের তাৎপর্য।শীত, বরফগলা বৃষ্টি, কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া, ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে এই গণজমায়েত চলেছিল দীর্ঘ ৩৫ বছর। রোবেন আইল্যান্ড ও পলস্মুর কারাগারে ২৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড কাটিয়ে ১৯৯০ সালে নেলসন ম্যান্ডেলা মুক্তি পান বিশ্ব মানবতার চাপে। ১৯৯৪ সালে সাউথ আফ্রিকায় বর্ণবাদের অবসান ঘটে। ট্রাফালগার স্কোয়ারের মৌন গণজমায়েতেরও অবসান ঘটেছিলো লক্ষ্য অর্জিত হবার পর।
পক্ষান্তরে, শাহবাগের আন্দোলনকারীরা যদিও সদর্পে ঘোষণা দিয়েছিলো লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত তারা বাড়ী ফিরবে না। কিন্তু তারা লক্ষ্য অর্জনের আগেই বাড়ি ফিরে যায়। শুধু তাই নয়, মাত্র ১৭ দিন ফাঁসির দাবির আন্দোলন করে বাড়ি ফেরার আগে নেতারা যে ৬টি দাবি পেশ করে সেখানে ফাঁসির দাবীটিই রহস্যজনক ভাবে বাদ দেয়া হয়। ট্রাফালগারের আন্দোলনের সাফল্যের কারণগুলো জানা দরকার।
১। আন্দোলনটি ছিল নির্যাতনকারী একটি ব্যর্থ সরকারের বিরুদ্ধে।
২। একজন দেশপ্রেমিক স্বাধীনতাকামী নেতার মুক্তির জন্য।
৩। ঘৃণিত বর্ণবাদের বিলুপ্তি ঘটিয়ে মানবতাবাদ প্রতিষ্ঠার জন্য। এই সমস্ত দাবিগুলোর ভিত্তি ছিল নৈতিক এবং মানবিক। তাই বিজয়ের সাথে আন্দোলন লক্ষ্য অর্জনে সফল হয়েছিল।
শাহবাগ জাগরণের সূচনাতে জনগণের মনে একটা আশা অবশ্যই সৃষ্টি হয়েছিল। তারা ভেবেছিল তারুণ্যের এই স্বতঃস্ফূর্ত স্ফুলিঙ্গ একটি দাবানলের সৃষ্টি করে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের রূপ নেবে। কিন্তু তাদের এই প্রত্যাশা অঙ্কুরেই পরিণত হল মরীচিকায়।
কারণ আন্দোলনকারীদের ৬দফাতে জনগণের আশা-আকাঙ্ক্ষা এবং ‘৭১-এর চেতনা ও স্বপ্নের কোনও প্রতিফলন দেখা গেলো না। হতাশাগ্রস্ত জনগণ দেখলো এবং বুঝলো শাহবাগ আন্দোলন চলছে স্বৈরতান্ত্রিক সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থ হাসিনার মহাজোট সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায়। শুধু তাই নয়, তারা দেখলো এই মঞ্চের নট-নটীরা নর্তন-কুর্দন করছে ভারতের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায়। তারা বুঝলো, এই আন্দোলনের নামে তামাশা সরকারের ঘৃণ্য স্বার্থে এবং এর লক্ষ্য কারও মুক্তি নয়, লক্ষ্য হল সরকারের ইচ্ছামত কয়েকজন ব্যক্তির বিচার বহির্ভূতভাবে ফাঁসি।
এই তামাশার উদ্দেশ্য মানবতাবাদের পরিবর্তে ঘৃণা ও সহিংস সন্ত্রাসবাদ। এদের আন্দোলন নৈতিকতা এবং মানবিকতা বিবর্জিত বিধায় শ্মশান ঘাটের আলেয়ার মতোই হঠাৎ প্রজ্বলিত হয়ে দপ করে নিভে যাবে। গণবিচ্ছিন্ন বিধায় এই সংগ্রাম সফলতার মুখ দেখবে না যদিও সরকার নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার মাধ্যমে জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছিলো, শাহবাগের গণজমায়েত নাকি বাংলাদেশের ‘তাহরির স্কোয়ার’, তারুণ্যের নবজাগরণ, দ্বিতীয় মুক্তিযুদ্ধ! কিন্তু দেশের সচেতন জনতার সংখ্যাগরিষ্ঠের কাছে শুভঙ্করের ফাঁকিটি ধরা পড়ে যায়। তাই তারা নিজেদের সরিয়ে নিয়েছিল পর্যায়ক্রমে। বস্তুত বিএনপিসহ বিরোধী জোটের জামায়াতে ইসলামীর উপর চাপ সৃষ্টি এবং তাদের সাথে বর্তমানের সংঘাতমূলক বিভৎস এবং অসুস্থ ক্ষমতার রাজনীতির থেকে জনগণের দৃষ্টি সরিয়ে নেবার জন্যই ব্যর্থ মহাজোট সরকার ভারতের সাহায্যে শাহবাগ চত্বরের সমাবেশের উদ্যোগ নেয়। শাহবাগের কিছু কার্যক্রমের বৈপরীত্য কল্পনাকেও হার মানিয়েছে। মোমবাতি, মঙ্গল প্রদীপ, আলপনা, গান-বাজনা মানুষের সুকুমার বৃত্তির মাধ্যম হতে পারে, কিন্তু সেখানে স্নিগ্ধ আলোর কুহেলিকা সৃষ্টি করে উস্কানিমূলক নৈরাজ্যিক স্লোগান তোলা হয়- ধরো, মারো, আগুন জ্বালো! আল্পনার সৌন্দর্যকে মাড়িয়ে দেখা গেছে ফাঁসিকাষ্ঠের দড়িতে ঝুলন্ত পুতুলের নিষ্ঠুরতা। সারল্য এবং নিস্পাপতার প্রতীক এবং আগামি দিনের ভবিষ্যৎ শিশুদের মাথায় দেখা গেলো ফাঁসির নির্মম বাণীর টুপি। তাদের খেতে দেখা গেছে ‘ফাঁসি চাই’ খচিত কেক-পেস্ট্রি। তাদের কোমল মনে জিঘাংসার বীজ বপন করে দেয়া হলও কোন অধিকারে এবং কাদের স্বার্থে! এ সমস্ত বিষয়গুলো সম্পর্কে ভেবে দেখতে হবে প্রতিটি দেশপ্রেমিক সচেতন বাংলাদেশীকে। রাজিব, ইকবাল প্রমুখ নাট্যমঞ্চের নেতারা ব্লগে যা লিখেছে এবং সেগুলোকে যেভাবে সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন প্রচার মাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়েছে তাতে ধর্মান্ধ নয়-কিন্তু ধর্মভীরু দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের ধর্মীয় বিশ্বাসে আঘাত হানা হয়। এখানে সবচেয়ে বিবেচ্য বিষয়টি হলো, তাদের এইসব গণবিরোধী কার্যক্রমকে সমর্থন জানিয়েছেন সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমান অধ্যুষিত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং এবং তার মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবৃন্দ ও দলীয় নেতা-নেত্রীরা।
এই ধরনের খোলাখুলি সমর্থন শুধু হতাশাব্যঞ্জকই নয়, বিপদজনকও বটে। গোটা দেশটাকেই সাম্প্রদায়িক আস্তিক বনাম নাস্তিকের সংঘর্ষের দিকে ঠেলে দেবার একটা সুপরিকল্পিত পদক্ষেপ গ্রহণ করেন হাসিনা। নিজস্ব রাজনৈতিক এবং ভারতের স্বার্থে ধর্মকে ব্যবহার করে আগুন নিয়ে খেলেন তিনি দুইটি লক্ষ্য হাসিল করার স্বার্থে। একদিকে ধর্মীয় চেতনায় আঘাত হেনে তার প্রতিক্রিয়ায় তিনি বৃহত্তর মুসলিম জনগোষ্ঠীর মধ্যে মৌলবাদী জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে সেটাই প্রমাণিত করার চেষ্টা করেছিলেন। অন্যদিকে ভারতকে বাংলাদেশে সংখ্যালঘু হিন্দুরা সাম্প্রদায়িক সহিংসতার শিকার বিধায়তাদের পুরনো দাবী ‘বঙ্গভূমি’ কায়েমের যৌক্তিকতা এগিয়ে নেবার রাস্তা করে দিয়েছিলেন। তার এই ঘৃণ্য অভিসন্ধি জাতীয় স্বার্থে অবশ্যই নয়, তবে কার স্বার্থে সেটাও ভাবতে হবে দেশবাসীকে।যারা সুস্থ মানুষ, যারা শান্তি, সংহতি, সহাবস্থানে বিশ্বাসী, সহনশীলতা, মমত্ব, মানবপ্রেমে আস্থা রাখে তাদের জাতির বর্তমান ক্রান্তিলগ্নে ঐক্যবদ্ধভাবে আগুয়ান হতে হবে দেশ ও জাতিকে নৈরাজ্য এবং গৃহযুদ্ধের বিভীষিকা থেকে বাঁচানোর অঙ্গীকারে।আজকের পৃথিবীতে ঘটা করে বিচার বহির্ভূত ফাঁসির দাবি তোলাটা যে কতটা অসভ্যতা ও বর্বরতা সেসম্পর্কে সচেতন হতে হবে সবাইকে যাতে বিশ্বপরিসরে বাংলাদেশ ও জাতিকে একটি ধিকৃত রাষ্ট্র এবং জাতি হিসাবে কলংকের বোঝা বয়ে বেড়াতে না হয়।
শাহবাগ মঞ্চ থেকে নাস্তিক নেতাদের তরফ থেকে স্লোগান তোলা হয়েছে, ‘ধর্ম ভিত্তিক রাজনীতি এবং দল নিষিদ্ধ করা হউক’। একই দাবি উঠিয়ে দেশের প্রধানমন্ত্রী গণতন্ত্রের মানসকন্যা হাসিনা মুখে ফেনা তুলে ফেলেন। ১৭ই ফেব্রুয়ারি কোলকাতার আনন্দবাজার পত্রিকায় শাহবাগ চত্বর সম্পর্কে একটি দীর্ঘ প্রতিবেদন ছাপা হয়। প্রতিবেদনে লেখা হয়
‘তাহরির স্কোয়ারে গণবিক্ষোভ দেখেছে মানুষ, তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের বিদ্রোহও দেখেছে। দিল্লীর গেট অফ ইন্ডিয়াতে দেখা গিয়েছে মোমবাতির মৌন গণসমাবেশ। কিন্তু গত দু’ দশকে এমন বিক্ষোভ দেখেনি কেউ।’ স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এবং সরকারি এবং দলীয় নেতা-নেত্রীদের শাহবাগে উপস্থিত হয়ে তাদের সমর্থনে বকতৃতা এবং স্লোগান দেয়ার ভূয়সী প্রশংসা করা হয় ঐ প্রতিবেদনে। হাসিনার সমর্থনের পরিপ্রেক্ষিতে হাসানুল হক ইনু, আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রী এমনকি হাসিনার আমেরিকা নিবাসী সুপুত্র জয়ের মধ্যে রীতিমতো প্রতিযোগিতা দেখতে পেয়েছে দেশবাসী শাহবাগ মঞ্চের কুশীলবদের সমর্থন প্রদানের ক্ষেত্রে
সংসদে দাঁড়িয়ে হাসিনা শাহবাগ সম্পর্কে তার সমর্থন জানাতে গিয়ে বলেন, ‘আমি এখানে, কিন্তু আমার মন পড়ে আছে শাহবাগে’। তার এই বালখিল্য উক্তির উচ্ছ্বসিত প্রশংসাও করা হয় সেই প্রতিবেদনে। বাংলাদেশ এবং ভারতের দুই পররাষ্ট্রমন্ত্রী দীপুমনি ও সালমান খুরশিদ এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে শাহবাগ নাট্যমঞ্চের গণজমায়েতকে প্রাণঢালা সমর্থন জানান।
‘সন্স অফ বাবর’ নাটকের নাট্যকার সালমান খুরশিদ শাহবাগ চত্বর থেকে ঢিল ছোঁড়া দূরত্বে তার হোটেলে মধ্যাহ্ন ভোজন করতে করতে বলেছিলেন, ‘নবীন প্রজন্মের দাবি যুক্তিসঙ্গত’।
সন্ত্রাসের বিরোধিতা করে ধর্মনিরপেক্ষতার অভিমুখে দু’দেশের এগিয়ে চলার অঙ্গিকারের কথারও পুনরুক্তি করেছিলেন তিনি। তিনি আরও বলেছিলেন, ‘আধুনিক বিশ্বে ধর্ম নিরপেক্ষতার অন্য কোনও বিকল্প নাই।’ আন্না হাজারের আন্দোলনকে দমন করার জন্য ভারত সরকার যে বর্বরোচিত রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের পথ অবলম্বন করেছিলো তার পরিপ্রেক্ষিতে শাহবাগ স্কোয়ারের প্রতি ভারতের অকুণ্ঠ সমর্থন জানাতে এতটুকুও লজ্জা পেলেন না জনাব সালমান খুরশিদ! এই বোদ্ধা ব্যক্তি আরও বলেছিলেন, ‘তরুণ সমাজকে যেকোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় যুক্ত হতে দেখাটা নাকি সর্বদাই আনন্দের বিষয়। তারা তাদের উদ্বেগ প্রকাশ করছে, ঐক্যবদ্ধ হচ্ছে, তাদের আকাঙ্ক্ষার কথা তুলে ধরছে, আমি তাদের এই মনোভাবের প্রশংসা করি। গণতন্ত্রের মাধ্যমে এভাবেই জোরালো অনুভূতি এবং বিশ্বাস প্রকাশ পায়’।
২৬শে ফেব্রুয়ারি দিল্লীর ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’ একটি সংবাদ ভাষ্যে বলেছে, ‘বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকাতে ব্যস্ততম শাহবাগ মোড়ের আন্দোলনকারীদের প্রতি ভারতের জোরালো সমর্থন রয়েছে। ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন গত শুক্রবার পুনাতে বলেছেন, উগ্রপন্থী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে শাহবাগের চলমান আন্দোলনে হাজার হাজার তরুণ-তরুণীর ‘স্বতঃস্ফূর্ত’উপস্থিতি থেকে বাংলাদেশী তারুণ্যের দৃঢ়চেতা অনুভূতি, রাজনৈতিকভাবে জনগণকে সমবেত করার ক্ষমতার মাধ্যমে তাদের মুক্তমনের পরিচয়ই ফুটে উঠেছে’। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হাসিনা এবং ভারত সরকারের যৌথ সমর্থনপুষ্ট হিংসা, ঘৃণা, বিদ্বেষ এবং ইসলাম বিরোধী উন্মাদনা সৃষ্ট এই নাট্য উৎসবকেছোট করে দেখার অবকাশ নেই। এই ঘটনাকে আমেরিকার সহযোগী আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী ভারতের সুদূরপ্রসারী ভূরাজনৈতিক লক্ষ্য হাসিলের পদক্ষেপ হিসাবেই দেশবাসীকে দেখতে হবে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসনের নগ্ন বহিঃপ্রকাশ সম্পর্কেও সচেতন হতে হবে দেশপ্রেমিকদের।
বেশকিছুদিন আগে ভারতীয় দৈনিকগুলোতে ছাপানো একটা খবরে চোখ আটকে গিয়েছিলো।খবরটি ছিলো, ‘ভারত সরকারের তরফ থেকে বিশ্ববাসীকে জানান দেয়া হচ্ছে, ফোর্ট উইলিয়ামের (ভারতের ইস্টার্ন কমান্ড হেডকোয়ার্টার) আর্কাইভ থেকে ‘৭১সালের বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত সব দলিল-দস্তাবেজ চুরি হয়ে গেছে। জনবহুল বাংলাদেশের কয়জন সেই খবরটা পড়েছেন বা এ নিয়ে ভেবেছেন সেটা আমার জানা নেই। কিন্তু একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে খবরটি আমাকে ভাবিয়ে তোলে। হঠাৎ করে এমন সুরক্ষিত একটি জায়গা থেকে সব গোপনীয় দলিল-দস্তাবেজ চুরি হয়ে গেলো কি কারণে!
বেশ কিছুদিন চিন্তাভাবনার পর কারণটা বোধগম্য হল। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে যুদ্ধোত্তর কালে দেশের ভেতরে এবং বাইরে বিভিন্ন মহল থেকে ইতিহাস বিকৃতির যে জঘন্য প্রতিযোগিতা চলে আসছে মিথ্যার উপর ভিত্তি করে সেই ধারাবাহিকতায় কোনো দলিল ভারত থেকে চাওয়া হলে ভারত যাতে নিজ স্বার্থে মনগড়া বায়াদলিল ধরিয়ে দিতে পারে সেটাই মূল উদ্দেশ্য। যুদ্ধকালে বাংলাদেশী প্রবাসী সরকার মুক্তিযুদ্ধের দলিল সংরক্ষিত করার কোনও পদক্ষেপ না নেয়ার সুযোগটাই গ্রহণ করে ভারতীয় চাণক্যরা এই খবরটি রটিয়েছে।
শিবশংকর, সালমান খুরশিদ, দীপুমনি, হাসিনা, রাজিব, বাপ্পাদিত্য, ডাঃ ইকবাল, বাবা থাবা ও শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলনকারীরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে যে ধরনের দাম্ভিক আচরণ করেছে সাজানো নাটকের মাধ্যমে তাতে যদি জনগণের মনে ধারণা জন্মায় বাংলাদেশের পরিসীমার মধ্যে আর একটি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছে সেটা দোষনীয় হবে না।
আন্দোলনকারীরা শাহবাগ থেকে জাতীয় পতাকা ওড়ানো, জাতীয় সঙ্গীত বাজানো, স্কুল কলেজ বন্ধ রাখার হুকুম জারি, আদালত অবমাননা, মানুষ হত্যার হুমকি, জবাই করার আহবান জানিয়ে সন্ত্রাস ছড়িয়ে দেবার উস্কানি দিয়ে যাচ্ছিল অবলীলাক্রমে। অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছিল তারা যেনো রাষ্ট্রীয় আইনের বাইরে। এ ধরনের হুকুম জারি করা কি কনও নাগরিক গোষ্ঠীর পক্ষে সম্ভব! তাই প্রশ্ন দেখা দেয়, শাহবাগ নামক রাষ্ট্রটি ছিল কার? কারা এই রাষ্ট্র চালাচ্ছিল? রাষ্ট্রটির মালিকানা কি দেশের ভেতরে না বাইরে? ফিরে আসি মূল প্রসঙ্গে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার। যারা এই বিষয়ে শাহবাগ চত্বর থেকে সোচ্চার হয়েছে ’৭১-এ তাদের কে কোথায় ছিলো কিংবা মুক্তিযুদ্ধের সাথে আদৌ জড়িত ছিল কিনা সেই বিতর্কে না গিয়েও নিশ্চিতভাবে বলতে পারি এদের সিংহভাগই মুক্তিযুদ্ধ কিংবা যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে কি ঘটেছিলো সে সব বিষয়ের সাথে জড়িত ছিলো না। তাদের অনেকের হয়তো জন্মই হয়নি ১৯৭১ এ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা নিয়ে যেসমস্ত চক্রান্তমূলক কূটকৌশল গৃহীত হয়েছিল সেই বিষয়েও তারা একইভাবে অজ্ঞাত। একজন বীরউত্তম খেতাব প্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে আমার প্রকাশিত বই, ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ থেকে প্রাসঙ্গিক কিছু তথ্য পাঠক, শাহবাগ মঞ্চের আন্দোলনকারী এবং তাদের সমর্থক দেশের ও ভারতের নেতা-নেত্রীদের ধূসর স্মৃতিকে স্বচ্ছ করার জন্য তুলে ধরছি।
‘মুক্তিযুদ্ধকে তার স্বাভাবিক পরিণতির দিকে এগুতে না দিয়ে শেষ পর্যায়ে হানাদার বাহিনীর অবস্থা যখন মুক্তিযোদ্ধাদের দুঃসাহসী তৎপরতায় সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত ঠিক তখনই ভারত সরকার সুযোগ পেয়ে যায় পাক-ভারত যুদ্ধ ঘোষণা করার। যুদ্ধ ঘোষণার পর সৃষ্টি করা হয় মুক্তিবাহিনী এবং ভারতীয় সশস্ত্র বাহিনীর যৌথ কমান্ড মুক্তিযোদ্ধাদের কমান্ডার ইন চীফ কর্নেল ওসমানীর নেতৃতে।
সিদ্ধান্ত হয় হানাদার বাহিনীর চূড়ান্ত পরাজয়ের পর যৌথ কমান্ডের শীর্ষনেতা কর্নেল ওসমানীর কাছেই আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণ করবে জেনারেল নিয়াজীর অধীনস্থ পাকসেনারা।
সেই অনুষ্ঠানে ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল স্যাম মানেকশ’কে উপস্থিত থাকার জন্য আমন্ত্রণ জানাবেন কর্নেল ওসমানী সহযোগী বাহিনী প্রধান হিসেবে। কিন্তু এই চুক্তির বরখেলাপ করে ইন্দিরা গান্ধীর ভারত সরকার। নিরাপত্তার মিথ্যা অজুহাত সৃষ্টি করে কর্নেল ওসমানীকে ১৬ই ডিসেম্বর রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে উপস্থিত হতে না দিয়ে ভারতীয় সরকার চাণক্যদের পরামর্শে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে জেনারেল নিয়াজী ও তার ৯৭ হাজার সেনা ও তাদের সমর্থনকারীরা আত্মসমর্পণ করবে ইস্টার্ন কমান্ডের কমান্ডার জেনারেল অরোরার কাছে। এ ভাবেই ভারত মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথাকে ম্লান করে দিয়ে বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিলো, পাক-ভারত যুদ্ধে ভারতের বিজয়ের মাধ্যমেই প্রসূত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশ নামক একটি রাষ্ট্র। এরপর ভারত শেখ মুজিবকে বাধ্য করলো চিহ্নিত ১৯৫ জন এবং বাকি আত্মসমর্পণকারীদেরকে ভারতের হাতে তুলে দিতে যাতে করে বন্দীদের জিম্মি করে ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে সম্ভব হয় জুলফিকার আলী ভুট্টোকে চাপের মুখে রেখে ভারতের ইচ্ছেমত সব দাবি আদায় করে নেয়া। সিমলা চুক্তির মাধ্যমে হয়েছিলও তাই। তারপর, ভুট্টোর অনুরোধে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবকে হুকুম দিলেন জাতসাপের ফেলে আসা খোলস নিয়ে কাঁটাছেঁড়া করা চলবে না। হুকুম তামিল করে মুজিব সব যুদ্ধাপরাধীদের মাফ করে দিয়েছিলেন একটি ‘সাধারণ ক্ষমা’ আইন জারি করে।
আজ সুদীর্ঘ চার দশক পর ঐ খোলসটাকেই কাটা-ছেঁড়া করার জন্য হঠাৎ হাসিনার মাধ্যমে ভারত কেনও এতো উঠে পড়ে লেগেছে? এর উদ্দেশ্যটা কি সেটাও ভাবতে হবে দেশবাসীকে।
স্মরণে রাখতে হবে, শাহবাগের ঘটনা কোনও একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান এবং ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের নেতাদের বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং জবাই করে হত্যা করা, হাজার হাজার বিপ্লবী নেতা-কর্মী এবং সৈনিকদের হত্যা করা, বিডিআর এর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ এবং তারই ধারাবাহিকতায় বেছে বেছে দুই শতাধিকেরও বেশি দেশপ্রেমিক অফিসারকে বিনা কারণে সেনাবাহিনী থেকে চাকুরিচ্যুত করা, কারাপ্রকোষ্ঠে ছুড়ে ফেলা শত শত সৈনিক এবং শাহবাগ চত্বরের সাজানো নাটক, বিভিন্ন অজুহাতে ক্রস ফায়ারে বিচার বহির্ভূত ভাবে সবই একই সূত্রে গাঁথা। কাদের স্বার্থে ঘটানো হয়েছে এবং এখনও হচ্ছে এই সমস্ত ঘটনা সমূহ? এই সব প্রশ্নের সঠিক জবাব খুঁজে পাবার উপরেই নির্ভর করছে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ।এবার ধর্ম সম্পর্কে কিছু চিন্তার খোরাক। সাধারণ ভাবে বলতে গেলে ধর্ম হলোসৃষ্টিকর্তা, বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি রহস্য, জন্ম মৃত্যু, পরকাল, জাগতিক জীবন ব্যবস্থায় সঞ্চিত মূল্যবোধসমূহ সম্পর্কে একটি বিশ্বাস এবং জীবন বিধান। যারা ঈশ্বর এবং ঐশ্বরিক বিধানে বিশ্বাস করে তা সেটা যেই অবয়বেই হউক না কেনও তারা হলো আস্তিক বা ধার্মিক। আর যারা ঈশ্বর এবং ঐশ্বরিক বিধানে বিশ্বাসী না হয়ে দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদে বিশ্বাস রেখে জীবন অতিবাহিত করে তারা হলো নাস্তিক বা ধর্মহীন। আস্তিক কিংবা নাস্তিক সবাই কিন্তু সমভাবে প্রাণহানীর বিপক্ষে এবং জীবনের পক্ষে, বন্দীত্বের বিপক্ষেমুক্তির পক্ষে, অমানবিকতার বিপক্ষেমানবতার পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষেন্যায়ের পক্ষে। শোষণ-বঞ্চনার বিপক্ষে, অবিচার-অনাচারের বিপক্ষে। অনৈক্য, ঘৃণা, প্রতিহিংসা, স্বৈরশাসন ও জুলুমের বিপক্ষে। গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, নৈতিকতা, ভাতৃত্ববোধ, সহমর্মিতা, সংবেদনশীলতা, সহনশীলতা, শান্তি, শৃঙ্খলা হচ্ছে আস্তিকতা কিংবা নাস্তিকতার মূলনির্যাস। বর্ণবাদ, সহিংসতা, দাঙ্গা-ফ্যাসাদ, আক্রোশ, হিংসা, লোভ, লালসা, স্বার্থপরতা, সাম্প্রদায়িকতা, অহংকার, পশুশক্তি, প্রাচুর্যের অপচয়, সন্ত্রাস এ সমস্তের কোনও স্থান নেই আস্তিকতা কিংবা নাস্তিকতায়। ধর্মনিরপেক্ষতার অভিধানিক অর্থও নিহিত রয়েছে দু’টি দর্শনেই। এবার দৃষ্টি দেয়া যাক ইসলামের দিকে। ‘ইসলাম’ এর শব্দার্থই হচ্ছে শান্তি। শান্তির ধর্ম ইসলামের সাথে গণতন্ত্র, সাম্যবাদ, মানবিক অধিকার, ধর্ম নিরপেক্ষতা, জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার এবং প্রগতিশীলতার সাথে কনও সংঘাত বা বৈপরীত্য নেই। একই সাথে সন্ত্রাসবাদ, জঙ্গিবাদ, অকারণে জীবন নাশ ও ধ্বংসাত্মক কর্মকাণ্ডকেও সমর্থন করে না ইসলাম। ইসলাম ধর্মের ঐশ্বরিক পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধানকে মেনে চলা প্রতিটি মুসলমানের জন্য একটি বাধ্য-বাধকতা। পৃথিবীর ৭০০ কোটি ধর্মবিশ্বাসীদের মাঝে খৃস্টধর্মের পরেই ইসলামের স্থান। এই ধর্ম যদি অযৌক্তিক জীবনদর্শনই হতো তবে বর্তমান সভ্যজগতে এর প্রসার অন্যান্য ধর্মের তুলনায় বেশি হতো না। পরিসংখ্যান অনুযায়ী আমেরিকাসহ ইউরোপের উন্নত দেশগুলোতে প্রতি মিনিটে ১০ জন অন্য ধর্মাবলম্বী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। এই প্রক্রিয়ায় তো কোনও জোর, জুলুম, সন্ত্রাসবাদ কিংবা অর্থলোভ কাজ করছে না। ইসলাম ধর্মের স্বীয় মহিমাকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেই সভ্য জগতের শিক্ষিত এবং আর্থিক সঙ্গতির নাগরিকরা স্বেচ্ছা প্রণোদিত হয়েই ইসলাম কবুল করছে সত্য-আদর্শ ভিত্তিক জীবন বিধান হিসাবে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ধর্মীয় চেতনা বিরোধী কর্মকাণ্ড উস্কে দিয়ে জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে রাজনৈতিক ফায়দা লোটার চেষ্টায় উন্মাদ হয়ে উঠেছে ক্ষমতাসীনরা এবং একিসাথে বলছে, ‘বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক কোনও রাজনীতির স্থান হতে পারে না, অস্তিত্ব থাকতে পারে না ধর্মের নামে কোনও রাজনৈতিক দলের। শুধু তাই নয়, যারা জোর প্রচারণা চালাচ্ছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি গণতন্ত্রের পরিপন্থী, প্রগতিশীলতার পথকে বিঘ্নিত করে ধর্মীয় চেতনা,তাদের মিথ্যাচারের পরিপ্রেক্ষিতে শুধু এতটুকু বললেই যথেষ্ট হবে, ইতিহাস থেকে শিক্ষাগ্রহণ করে সত্যকে মেনে নেয়াটাই কল্যাণকর। অস্বীকার করার উপায় নেই আধুনিক বিশ্বেও ধর্ম হচ্ছে মূল্যবোধের মূল উৎস। আদিকাল থেকেই ধর্ম সব দেশের সামাজিক সভ্যতা বিকাশের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে এসেছে এবং করছে। বিসবের উন্নত অনুন্নত সবদেশেই। রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক ক্ষেত্রে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠীর ধর্মীয় মূল্যবোধের থাকে একটি বিশেষ ভূমিকা। অধুনা প্রকাশিত সাড়া জাগানো Samuel P. Hutington এর লিখিত বইটির নাম The Clash of Civilizations and the Remarking of World Order না হয়ে ‘Clash of Religions and the Remarking of World Order’ হওয়াটাই হতো বেশি যুক্তিসঙ্গত।
একইভাবে জামায়াতকে নিষিদ্ধ করলে ভিন্ন নামে অতি সহজেই তারা নিজেদের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হবে নতুন আঙ্গিকে। ডজনদু’এক ডক্টরেট ডিগ্রীধারী মহিলা প্রধানমন্ত্রী হাসিনা, সেগুলো মেধাভিত্তিক কিংবা টাকা দিয়ে কেনাই হউক বা না হউক কেনও, ঘটে এতোটুকু বুদ্ধি থাকলেও তার বোঝা উচিৎ ছিল, মানুষ হত্যা কিংবা গুম করা চলে, বিপ্লবীদের হত্যা করা সম্ভব হয়, পার্টি অস্তিত্বহীন কোরে দেয়া যায়, কিন্তুবিপ্লব কিংবা কোনও জীবন্ত বস্তুনিষ্ঠ ন্যায়সঙ্গত আদর্শকে কখনোই চিরতরে নিঃশেষ করে দেয়া যায় না রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার অপব্যবহার করে অথবা শ্বেতসন্ত্রাস চালিয়ে।
পরিশেষে নিয়তির অমোঘ বিধানে মানুষ মাত্রইনশ্বর। সবাইকেই আগেপিছে ছেড়ে যেতে হবে পৃথিবী। আমাদের শূন্যস্থান পূর্ণ হবে নবাগতদের আগমনে। থাকবে বাংলাদেশ, থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম এবং তাদের ভবিষ্যৎ। তাদের কাছে থাকবে হাজারো বছরের সভ্যতার ঐতিহ্য, ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ। থাকবে স্বাধীনচেতা এই বীরের জাতির আত্মত্যাগী সংগ্রামী ইতিহাস। নেতা-নেত্রীদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট যার আলোকেই তারা খুঁজে নেবে সঠিক পথ ও যোগ্য নেতৃত্ব উজ্জ্বলতর ভবিষ্যতের জন্য। নিজের এবং দেশের কিছু বিপ্লবী নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক আত্মত্যাগী সহযোদ্ধাদের জীবনের অভিজ্ঞতা ঐতিহাসিক উপাদান হিসাবে লিখে রেখে গেলাম নৈতিক দায়িত্বপালনের স্বার্থে। আশা করি, যথাসময়ে বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাগুলো ইতিহাসের কষ্টিপাথরে সত্য হিসাবেই প্রমাণিত হয়ে সঠিক ইতিহাসের অংশে স্বাভাবিক ভাবেই ঠাঁই করে নেবে। শাক দিয়ে যেমন মাছ ঢাকা যায় না চিরকাল ঠিক তেমনি মিথ্যা দিয়ে সত্যকেও ধামাচাপা দেয়া সম্ভবনয়।তাই সত্য চিরভাস্বর।
শেষকথা
এখনই সময়। ভাবতে হবে দেশের প্রতিটি নাগরিককে, সে যেই প্রজন্মেরই হউকনা কেনও, দাসত্ব নাকি স্বাধীনতা। লক্ষ প্রাণের শাহাদত, অগুণতিমা-বোনের ইজ্জতের আহূতি, এক সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষা করে গর্বিত সাহসী বাংলাদেশী হিসেবে মাথা উঁচু করে নিজস্ব সত্তা বজায় রাখার তাগিদে, সবচক্রান্ত এবং রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা কোরে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনে যেকোনো ত্যাগ স্বীকার করতে তারা প্রস্তুত কিনা। ধোঁকাবাজ গিরগিটি চরিত্রের রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, স্বঘোষিতসুশীল সমাজেরমাথা, ধড়িবাজ, পোষা, বিবেক বর্জিত বুদ্ধিজীবীদের কপচানো মিথ্যার অন্ধকার চোরা গলিতে ঘুরপাকে বিগত চার দশকেরও বেশি সময় নষ্ট করে দেশ আজ বিলুপ্তির শেষ প্রান্তে। এরপরও নীরব দর্শক হয়ে থাকবে সচেতন আমজনতা? পূর্বসূরিদের কষ্টার্জিত স্বাধীনতা নামক ফুলটিকে বাঁচানোর প্রত্যয় কি শুধুমাত্র বটমূলে বসে পান্তাইলিশ খাওয়া আর ঘুম পারানি গানের মধ্যেই থাকবে সীমাবদ্ধ? এখনি ‘৭১-এর সত্যিকারের মৌলিক প্রেরণায় উদ্দীপ্ত হয়ে জেগে উঠতে হবে নবীন প্রজন্মকে আরেকবার। গর্জে উঠে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে পূর্বসূরিদের মতো আগ্রাসী অপশক্তি এবং তাদের লালিতপালিত জাতীয় তল্পিবাহক এবং সেবা
দাস-দাসীদের ষড়যন্ত্র ও আগ্রাসনের মোকাবেলায় সার্বিক মুক্তির আর একটি সার্বিক মুক্তির যুদ্ধে। যেকোনো মূল্য এবং ত্যাগের বিনিময়ে প্রমাণ করতে হবে, ঐতিহাসিক ভাবে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী সংগ্রামী ঐতিহ্যের অধিকারী। একটি পরীক্ষিত বীরের জাতি কখনোই মেনে নিতে পারেনা অরক্ষিত স্বাধীনতার নামে পরাধীনতা। তাদের প্রাপ্য প্রকৃত স্বাধীনতা এবং সার্বিক মুক্তি।
সমাপ্ত