You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

Previous

ঢাকা হোয়ে পিকিং-এর উদ্দেশ্যে যাত্রা
বেনগাজি থেকে ঢাকায় এসে কিছুদিন কাটিয়ে একদিন গণচীনের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমালাম। হংকং হয়ে বেইজিং। কস্মিনকালেও কল্পনা করতে পারিনি মাও সে তুং-এর দেশে যাবার সুযোগ হবে। তাই স্বাভাবিক ভাবেই অভূতপূর্ব এক শিহরণ অনুভব করছি নিজের ভিতরে। ছোটোকালে যখন স্কুলে পড়ি তখন থেকেই শৈশবে দার্শনিক সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটলের নাম শুনেছি আম্মার মুখেই। আম্মাই শুনাতেন রামায়ণ, মহাভারত, শকুন্তলার উপাখ্যান। শোনাতেন জুলিয়াস সিজার, হানিবল, আলেকজান্ডার, চেঙ্গিস খান, আটিলা দি হুন, হেলেন অফ ট্রয়ের ঐতিহাসিক কাহিনী, রাধা- কৃষ্ণ, সোহরাব-রুস্তম, লাইলি-মজনু, শিরি-ফরহাদ-এর মতো মর্মস্পর্শী লোকগাথা। চে গুয়েভারা, লেনিন, মার্ক্স, এঙ্গেলস, মাও সে তুং, ফিদেল ক্যাস্ট্রো, হো চি মিন, নগুয়েন গিয়াপ, আইদিত, সুভাষ বোসের মতো ব্যতিক্রম ধর্মী ব্যক্তিবর্গকে আদর্শ নায়ক হিসাবে শ্রদ্ধার সাথে মনে গেঁথে রেখেছি স্কুল জীবন থেকেই।
সময়ের সাথে সাথে যখন বড় হলাম তখন বই পড়া হয়ে উঠলো আমার নেশা, সময় কাটানোর প্রিয় মাধ্যম। এর কৃতিত্বের সবটুকুর ভাগীদার আমার বিদুষী আম্মা, যিনি আমাদের ছেড়ে অসময়ে চলে যান এক মর্মান্তিক দুর্ঘটনার শিকার হয়ে। তখন আমি মাত্র কলেজের ছাত্র! তিনি ছিলেন উচ্চ শিক্ষিতা, আত্মমর্যাদাশীল এক প্রতিষ্ঠিত মহিলা। বই পড়ার নেশা ছিল আম্মার। তাই বিভিন্ন বিষয়ে তার জ্ঞানের পরিধি ছিল বহুল বিস্তৃত। রাজনীতি এবং সমাজ সচেতনতা ছিল তার অতি প্রখর। রক্ষণশীল পরিবারের পড়ুয়া মেয়ে হয়ে একজন তরুণী রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে যোগদান করেছিলেন। তার কলম ছিল ক্ষুরধার। বিধায় তিনি একজন কলামিস্ট হিসেবে নিয়মিত লিখতেন বিভিন্ন বিষয়ে সেই সময়ের বহুল প্রচারিত সাপ্তাহিক এবং মাসিক ম্যাগাজিনগুলোতে। আজকের আমি তারই প্রভাবে এবং পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে ওঠা এক সত্তা।
প্রাপ্তবয়স্ক এক তরুণ হিসেবে আমি হযরত মুসা (আ), হযরত ঈসা (আ), শেষনবী হযরত মহাম্মদ( সা), খোলাফায়ে রাশেদিন, সাহসী বীর হামযা (রা), খালেদ বিন ওয়ালিদ, সালাহউদ্দিন আইউবী, বখতিয়ার খিলজি, ইবনে খালদুন, ইমাম গাজ্জালি র., সৈয়দ কুতুব, হাসানুল বান্না-এর জীবনী পড়ে বিমোহিত হয়েছি। রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, সুকান্ত কচি মনকে নাড়া দিয়েছে। বঙ্কিম চন্দ্র, শরৎচন্দ্র, বনফুল, তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সুবোধ ঘোষ, নীহার রঞ্জন গুপ্ত, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, বিমল মিত্র, জরাসন্ধ, শক্তিপদ রাজগুরু, মহাশ্বেতা দেবী, মনোজ বসু, আশাপূর্ণা দেবী, সমরেশ বসু, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সমরেশ মজুমদার-এর লেখা আমার উঠতি যৌবনের অন্তরে রোমাঞ্চ ও আবেগ সৃষ্টি করেছে। শেক্সপিয়ার, ম্যাক্সিম গর্কি, টলস্টয়, বায়রন, কিটস, শেলি, ওয়ার্ডসওয়ার্থ, এডাম স্মিথ, মাইলস, কারলাইল এর লেখা মনকে বিচলিত করে তুলেছে। তাদের মানবপ্রেম, নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগ, সততা, অপরিমেয় সাহস ও আত্মপ্রত্যয় কচি বয়সেই আমার মনে গভীর ছাপ ফেলেছে।
ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে নবাব সিরাজ উদ্দৌলা, মীর মদন, মোহন লাল, মীর কাসিম, হায়দার আলী, টিপু সুলতান, হাজী শরিয়তুল্লাহ, দেবী চৌধুরানী, ভবানী পাঠক, তিতুমীর, তোরাব আলি, লক্ষীবাঈ, রাজগুরু, ভগত সিং, উধম সিং, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীন, প্রীতিলতা সেন, মাস্টারদার মতো বীর নর-নারীরা জীবন দিয়ে দেশবাসীর চোখ খুলে দেখিয়ে গিয়েছেন দেশপ্রেম কাকে বলে। তাদের প্রত্যেকেই ছিলেন সত্যিকার অর্থে স্বাধীনতা ও মুক্তির পথ প্রদর্শক।
আফিমখোর নেশাগ্রস্ত একটি ঝিমিয়ে পড়া জাতিকে সচেতন করে তুলে চেয়ারম্যান মাও একদিকে জাপানি এবং পশ্চিমা অনান্য সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর বিরুদ্ধে দেশকে আজাদ করতে দুর্বার যুদ্ধ শুরু করেন- অন্যদিকে একই সাথে স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীদের প্রতিভূ চিয়াং কাইশেক এবং তার মিত্রদের অপশাসন, শোষণ, নিপীড়ন ও নিষ্পেষণের নাগপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করার জন্য চালিয়ে গেছেন জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম। দীর্ঘমেয়াদী এই সংগ্রাম ছিল অত্যন্ত দুরূহ এবং কঠিন চ্যালেঞ্জ। কিন্তু নৈতিকতা, নীতি-আদর্শ, অনমনীয় আত্মপ্রত্যয় এবং আত্মত্যাগের চেতনায় গড়ে তোলা লাল গণফৌজ এর নিবেদিতপ্রাণ বলিষ্ঠ নেতৃত্ব চিংকাং শানের দুর্গম পাহাড়ি জঙ্গল থেকে শুরু করে ইয়েনান হয়ে দীর্ঘ এগারো হাজার মাইল দূরত্বের ‘লং মার্চ’ এর মাধ্যমে দীর্ঘ আটাশ বছরের যুদ্ধের শেষে পিকিং-এর রাজপ্রাসাদে বিজয় নিশান উড়িয়ে দিতে সক্ষম হয়েছিলো চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বে। দীর্ঘকালের রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে গড়ে ওঠা পরীক্ষিত ‘লাল ফৌজ’ এবং রাজনৈতিক নেতৃত্ব স্বাধীনতার পর ঔপনিবেশিকদের সৃষ্ট রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো এবং প্রশাসন, আইন এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থাকে গুঁড়িয়ে দিয়ে সর্বেক্ষেত্রে নিজেদের ঐতিহ্য, মূল্যবোধ এবং বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা-আকাঙ্ক্ষার আলোকে এনেছিলেন আমূল বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তারই ফলে সব বাধা আর লৌহপ্রাচীর ভেঙ্গে গণচীন আজ বিশ্বের অন্যতম শক্তি হিসাবে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং সামরিক ক্ষেত্রে বিস্ময়কর অগ্রগতির মাধ্যমে।
১৯৭১ সালের স্বাধীনতা সংগ্রামের মাধ্যমেও তেমন একটি সুযোগ আমাদের জন্যও সৃষ্টি হয়েছিলো পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর হাত থেকে স্বাধীনতার সূর্য ছিনিয়ে নিয়ে জাতীয় মুক্তি অর্জনের স্বপ্ন বাস্তবায়নের। ইতিহাসের শিক্ষা নিয়েই এগুচ্ছিলাম আমরা দেশবাসীর সাথে একাত্মতার সম্পর্ক স্থাপন করে রাজনৈতিক সচেতনতার উপর ভিত্তি করে সংগঠন গড়ে তুলে সেই স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করতে। কিন্তু স্বাধীনতার পর আমাদের জাতীয় মুক্তির স্বপ্ন ভেঙ্গে গেল! এর জন্য দায়ী একজনই যাকে ‘আন্তরিকভাবে জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক’ ভেবে আমাদের সংগঠনের মধ্যমণি হিসেবে গ্রহণ করে এগিয়ে চলেছিলাম আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনের পথে। ১৫ই আগস্টে সেনা পরিষদের নেতৃতে সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর সেনা পরিষদের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সেনা প্রধান পদে নিয়োগ দেন বিপ্লবোত্তর রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ। খালেদ চক্র বিরোধী ৭ই নভেম্বরের সফল সামরিক অভ্যুত্থানের পর ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠা পাবার পরই জাতীয় মুক্তির স্বপ্নের পিঠে ছুরি চালিয়ে দিল ভেড়ার লেবাসে ধূর্ত উচ্চাভিলাষী ক্ষমতা লোভী জেনারেল জিয়াউর রহমান। দীর্ঘদিনের অক্লান্ত পরিশ্রম, আত্মত্যাগ তিতিক্ষার হল অপমৃত্যু! ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করেনি, করবেও না। যেদিন বাংলাদেশের সত্য ইতিহাস লেখা হবে সেইদিন ইতিহাসবিদগণ মুজিব এবং জিয়াকে জাতীয় বিশ্বাসঘাতক হিসেবেই মূল্যায়ন করবেন অবশ্যই। স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে হাজার হাজার দেশপ্রেমিক প্রতিবাদীদের রক্ত ঝরিয়ে স্বৈরাচারী শেখ মুজিব যেমন রেহাই পায়নি ঠিক একই ভাবে রেহাই পায়নি জেনারেল জিয়াও দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর অগুণতি সেনা সদস্যদের নিষ্ঠুরভাবে ব্যক্তিগত ক্ষমতার লোভে হত্যা করে। নিশ্চুপ বসে ভাবছিলাম এই সব কথা। নিম্মি পাশেই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায়।
এরই মধ্যে এলান হল অল্পক্ষণের মধ্যেই আমদের প্লেন পিকিং (বর্তমানে বেইজিং) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণ করবে। মাইকে এলান শুনে নিম্মি জেগে উঠলো। আমদের প্লেন গণচীনের মাটি স্পর্শ করলো। এক অভাবিত শিহরণ অনুভব করলাম। তৎকালীন গণচীনের একমাত্র এয়ার লাইন CAAC এর ফ্লাইট। প্লেনে ওঠার পর থেকেই বিশেষভাবে আমাদের দেখাশোনা করছিলো নির্মল হাসি মুখে বিমানবালারা। প্লেন তখন মাটি কামড়ে টারমাকের দিকে এগুচ্ছে। হঠাৎ একজন বিমানবালা হাসি মুখে এগিয়ে এসে ইংরেজিতে বললো, Well come to the People’s Republic of China. বলেই আমাদের দু’জনের হাতেই দুটো প্যাকেট দিয়ে বললো, Please accept these mementos on behalf of CAAC. চারিদিকে চোখ বুলিয়ে দেখলাম প্রীতি উপহার শুধু আমাদেরই দেয়া হয়েছে। তার মানে আমাদের পরিচয়টা তাদের আগেই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। ধন্যবাদ জানিয়ে গ্রহণ করলাম তার দেয়া প্রীতি উপহার। নিম্মি ইতিমধ্যেই তৈরি হয়ে নিয়েছে। আমিও তৈরি হয়ে নিলাম। প্লেনটি এসে থামলো নির্দিষ্ট স্থানে।
প্লেনের দরজা খুলতেই দেখলাম এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক সাথে একজন মহিলা, কয়েকজন চৈনিক ভদ্রলোক দাড়িয়ে আছেন আমাদের অভ্যর্থনা জানানোর জন্য। আমরা বেরিয়ে আসতেই আমাদের হ্যান্ড ব্যাগেজগুলো নিয়ে নিলেন চৈনিকরা। বাঙ্গালী ভদ্রলোক পরিচয় দিলেন তিনি বাংলাদেশ দূতাবাসের প্রথম সেক্রেটারি জনাব ফসিউল আলম। আর সাথের ভদ্রমহিলা তার স্ত্রী। চীনা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের ডিরেক্টর কমরেড চেন সে হুং এবং আরও কয়েকজন কর্মকর্তা। ফসি সাহেব সবার সাথে আমাদের পরিচয় করিয়ে দিলেন। পরিচয় পর্ব শেষে একটি তরুণী হাসি মুখে আমাদের দু’জনকেই ভারি ওভারকোট আর কম্ফোর্টার পরিয়ে দিলো। ফসি বললেন, যা পরে আছেন তাতে কুলাবে না। বাইরে অনেক ঠাণ্ডা Temperature below freezing point আর সঙ্গে হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা কনকনে বাতাস। দুটো অপেক্ষমাণ গাড়ীতে করে আমাদের নিয়ে যাওয়া হল VIP Lounge এ। মেইন বিল্ডিং এর একপ্রন্তে VIP Lounge. পুরো এয়ারপোর্ট সজ্জিত জাতীয় পতাকা দিয়ে তবে হাফমাস্ট! জনাব ফসি জানালেন, কয়েকদিন আগে চেয়ারম্যান মাও দেহত্যাগ করেছেন বিধায় সারা দেশে শোক পালিত হচ্ছে। VIP Lounge এ পৌঁছার পর কমরেড চেন বললেন
চীন সরকারের পক্ষ থেকে আপনাদের সাদর উষ্ণস্বাগতম জানাচ্ছি। আশা করি, আপনাদের অবস্থান সুখকর হবে। টুকটাক কথাবার্তা চলছিলো।
এরই মধ্যে সাথের এক চৈনিক ভদ্রলোক এসে জানালেন মালপত্র সব গাড়ীতে রাখা হয়েছে। আমরা সবাই উঠে পড়লাম। একটা গাড়ীতে কমরেড চেন আমাকে আর নিম্মিকে নিয়ে উঠে বসলেন সাথে একজন দোভাষীকে নিয়ে। অন্য গাড়ীগুলোতে বাকি সবাই। গন্তব্যস্থান পিকিং হোটেল। সেই সময় পিকিং শহরে একটি মাত্র পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল, সেটা হল পিকিং হোটেল। সেখানেই থাকার ব্যবস্থা হয়েছে। বিমানবন্দর থেকে ঘন্টা খানেকের ড্রাইভ। রাত তেমন গভীর না হলেও পথে বিশেষ লোকজন দেখা গেলো না। হোটেলে পৌঁছানোর পর অল্প সময় থেকে কমরেড চেন এবং অন্যরা বিদায় নিয়ে যাবার আগে বলে গেলেন
আগামী কাল রাতে আমাদের সম্মানার্থে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এক প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়েছে সন্ধ্যা সাতটায়। যথাসময়ে তার প্রতিনিধি আমাদের হোটেল থেকে নিয়ে যাবে।
ওরা বিদায় নেবার পর জনাব ফসি ও তার স্ত্রীর সাথে কিছুক্ষণ আলাপ করলাম। জানলাম, পিকিং এ দুইটা ডিপ্লোম্যাটিক এনক্লেভ আছে। পুরনোটি সান লি তুং- এ। সেখানে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এখন নতুন আর একটা আধুনিক এনক্লেভ গড়ে তোলা হচ্ছে অতিদ্রুত গতিতে ওয়াং ফু চিং-এ। আমাদের দূতাবাস ওয়াং ফু চিং-এ। পিকিং হোটেল থেকে পনেরো মিনিটের ড্রাইভ। ফসি জানালেন, অতি দ্রুত উন্নয়নের পথে এগুচ্ছে গণচীন। একই ভাবে বেড়ে উঠছে বহির্বিশ্বের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক। ফলে কূটনীতিকদের বাসস্থানের সংকুলানে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই আমাদেরকেও কয়েক মাস হোটেলেই হয়তো থাকতে হবে নির্ধারিত আবাসিক ফ্ল্যাটে স্থানান্তরিত হবার আগে। ওয়াং ফু চিং এর নির্মাণ কাজ খুবই দ্রুত গতিতে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে। তাতে আশা করা যায় অল্পসময়ের মধ্যেই এই সংকট কেটে যাবে। সেখানে বহুতল বিশিষ্ট সব অট্টালিকা বানানো হচ্ছে। তাতে বিভিন্ন আকারের আবাসিক ফ্ল্যাট বানানো হচ্ছে পদবী অনুসারে কূটনীতিকদের প্রয়োজনকে মাথায় রেখে।পিকিং হোটেলটি শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। সামনেই তিয়েন আন মেন স্কোয়ার, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় শান বাঁধানো চত্বর। মাঝখানে শহীদ মিনার যার সামনেই এখন প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে চেয়ারম্যান মাও এর সমাধিসৌধ। একদিকে ‘The Great Hall of the People’, অন্যদিকে ‘National Museum’. উল্টোদিকে চুন হান হাই (Forbidden City)- চীনের ঐতিহ্যবাহী রাজ প্রাসাদ। সেখানেই প্রয়োজনমত পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের সুরক্ষিত কার্যালয় এবং বাসস্থান। চেয়ারম্যান মাও-ও থাকতেন ঐখানেই। একপ্রান্তে রয়েছে গণচীনের রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের হেড কোয়ার্টার। অল্প দূরত্বে অবস্থিত রেডিও পিকিং(বেইজিং)। সেখান থেকে তখন ১৮টি বিদেশী ভাষায় প্রোগ্রাম প্রচারিত হতো। বাংলা বিভাগও রয়েছে সেখানে। জনাব জাহেদ নামের এক ভদ্রলোক পাকিস্তান আমল থেকেই বাংলা বিভাগের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। পরে আমার অবস্থানকালীন সময়ে জনাব সাযযাদ কাদির এবং জনাব মাহফুজউল্লাহকে বিকল্প হিসাবে বাংলাদেশ থেকে আনিয়ে বাংলা বিভাগের দায়িত্ব দেয়া হয়। রেডিও পিকিং থেকে অল্পদূরে অবস্থিত চীনা বিপ্লবের জাদুঘর। এখানে ঢুকলে দীর্ঘ ২৮ বছরের বিপ্লবের সমস্ত ইতিহাস জানা যায়। জীবন্ত হয়ে ওঠে প্রতিটি ঘটনা। ফসি আরো জানিয়েছিলেন, পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ে ৬/৭ জন বাংলাদেশী ছাত্র পড়ছে। তাদের মধ্যে রয়েছে এক ক্যাপ্টেন মাহবুব, ইঞ্জিনিয়ার কোরের অফিসার। তাকে আর্মির তরফ থেকে পাঠানো হয়েছে চীনা ভাষা শিখার জন্য। পরে ক্যাপ্টেন মাহবুব সেনা প্রধান হোয়ে অবসর গ্রহন কোরে বিএনপি তে যোগদান করেন। এখন তিনি বিএনপির একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা। দূতাবাসের লোকজন আর এই কয়েকজন ছাড়া চীনে আর কোন বাংলাদেশী নেই। প্রথা অনুযায়ী সৌজন্য সাক্ষাৎকার পর্ব শেষ করে পুরোদমে কাজ শুরু করে দিলাম।
কূটনৈতিক, অর্থনৈতিক, প্রতিরক্ষা, কৃষি, সেচ ব্যবস্থা, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, সংস্কৃতি, শিল্প, বাণিজ্য, বিজ্ঞান-প্রযুক্তি অবকাঠামো, যোগাযোগ ব্যবস্থা, কুটির শিল্প, প্রচার মাধ্যম প্রতিটি ক্ষেত্রেই গভীর সম্পর্ক গড়ে তুলতে হবে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ভিত মজবুত করার জন্য। একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবে বুঝতে পারলাম, বাংলাদেশের সাথে জোরদার সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য চৈনিক সরকারের পক্ষ থেকে আগ্রহের কমতি নেই। সবখান থেকেই একটি কথা সুস্পষ্ট করে আমাদের জানিয়ে দেবার চেষ্টা করা হয়, বাংলাদেশের সাথে ঐতিহাসিক ভাবে চীনের রয়েছে সুপ্রাচীন সম্পর্ক, আর সেই সম্পর্ককে দুইপক্ষের স্বার্থেই আরও জোরদার করে তোলার জন্য সার্বিকভাবে প্রস্তুত রয়েছে গণচীনের বিপ্লবী সরকার এবং নেতৃবৃন্দ। তারা আরও জানিয়ে দেন, গণচীন ঐতিহাসিকভাবে আধিপত্যবাদ এবং সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাসী নয়। তাদের কাম্য সমতা ভিত্তিক বন্ধুত্বমূলক সুসম্পর্ক। এটা তাদের পররাষ্ট্র নীতির স্পষ্ট অঙ্গিকার। তাছাড়া চীনের জনগণের কাছে আদি বাংলাদেশ একটি প্রাচীন সভ্যতার পীঠস্থান হিসাবে পরিচিত। এই দুইটি প্রাচীন সভ্যতার জনগণের মধ্যে সর্বদাই বিরাজমান থেকেছে ভাতৃত্বমূলক বন্ধুত্ব। বর্তমানের গণপ্রজাতন্ত্রী চীন বাংলাদেশকে একটি বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসাবেই গণ্য করে। গণচীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুয়াং হুয়া এক বৈঠকে একটি অতি মূল্যবান মন্তব্য করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘কোনও দেশ কিংবা জাতি তাদের প্রতিবেশী বেছে নিতে না পারলেও বন্ধু অবশ্যই বেছে নিতে পারে’। বর্ষীয়ান অভিজ্ঞ এই কূটনীতিকের এই ভাষ্য শুধু উষ্ণতাই প্রমাণ করে তাই নয়, তার এই ধরনের বক্তব্য থেকে স্পষ্ট বোঝা যায়, বাংলাদেশের সাথে আন্তরিকভাবেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী গণচীন।
সর্বক্ষেত্রেই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা চালাচ্ছিলাম, তবে ভূ-রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীকে মজবুত করে তোলার বিষয়টিকে অগ্রাধিকার এবং বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছিলাম। সামরিক বাহিনী যেকোনো দেশের মেরুদণ্ড। মেরুদণ্ড মজবুত না হলে দৈহিকভাবে শক্তিশালী হওয়া কিছুতেই সম্ভব নয়। জেনারেল জিয়াও সেটাই চাইছিলেন।
অতি অল্প সময়ের মধ্যেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, PLA (পিপলস লিবারেশন আর্মি) এবং ক্ষমতা বলয়ে অনেক প্রভাবশালী নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গের সাথে ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে। চীনের সাথে দ্রুত উন্নয়নে শঙ্কিত হয়ে ভারত CMLA জেনারেল জিয়াকে রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ জানালো। উদ্দেশ্য অতি পরিষ্কার। তাকে ডেকে বাংলাদেশ এবং গণচীন সম্পর্কে ফাটল সৃষ্টি করা তাছাড়াও এই সফরের পেছনে চাণক্যদের রাজনৈতিক আর একটি উদ্দেশ্য ছিল যেটা জিয়াকে সবচেয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলেছিলো। তিনি বুঝতে পারেন, ডঃ কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ আর ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মাধ্যমে তিনি ভারতের সাথে যে গোপন বোঝাপড়া করেছেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে সফরের পর যখন হাসিনা আর রেহানা দেশে ফিরে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে উঠবে তখন দেশবাসীর কাছে তার ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী ইমেজের মুখোশটা খুলে পড়বে। একই সাথে তার জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দর্শন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে পড়বে। জনগণ আরও বুঝতে পারবে, ‘৭৫ এর ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক চেতনার সাথে জিয়ার রাজনীতির কোনও সম্পর্ক নেই এবং ভারতের সাথে সমঝোতার পরিপ্রেক্ষিতেই হাসিনা এবং মৃতপ্রায় আওয়ামী-বাকশালীদের আবার বাংলাদেশের রাজনীতির মূল ধারায় পুনর্বাসিত হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন সয়ং জেনারেল জিয়া। জিয়া খাল কেটে অ্যানাকন্ডাদের ডেকে এনে তাদের সাথে ক্ষমতার ভাগবাটোয়ারা করেই রাজনীতি করতে চলেছেন।
এই সংকট থেকে পরিত্রাণের আশায় তিনি অনেক দেশেই ধর্না দিলেন একটি রাষ্ট্রীয় সফরের নিমন্ত্রণ যোগাড় করার, যাতে করে তার প্রথম রাষ্ট্রীয় সফর ভারতের মাধ্যমে শুরু না হয়। কিন্তু বিধি বাম, কোন দেশই CMLA জিয়াকে নিমন্ত্রণ জানালো না। হতাশ জিয়া তখন নিরুপায় হয়ে জানালেন, যে করেই হউক গণচীনে সফরের একটা ব্যবস্থা করতে। প্রস্তাবটা চীন সরকারের কাছে উথাপন করতেই তারা জানালেন, তাকে বর্তমানে সফরে আমন্ত্রণ করা সম্ভব নয়। কারণ, এই ধরনের সফরের প্রস্তুতির জন্য সময়ের প্রয়োজন। অনেক কাঠখড় পোড়ানোর পর অনেক ভেবে চিন্তে তারা জানালেন, তাকে অফিসিয়াল সফরের নিমন্ত্রণ জানানো হবে বাংলাদেশ এবং গণচীনের সম্পর্কের ক্রান্তিকালের বিবেচনায়। হাঁফ ছেড়ে জিয়া সেই নিমন্ত্রণই গ্রহণ করলেন।
সফরের প্রস্তুতির কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আলোচনায় পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছিলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের তরফ থেকে যা কিছু সাহায্য সহযোগিতা চাওয়া হবে তার পুরোটাই পর্যায়ক্রমে পূরণ করার জন্য প্রস্তুত গণচীন সরকার। তাদের এই ধরনের অভিপ্রায় খুবই সন্তোষজনক। খবরটা শুনে জেনারেল জিয়াও অত্যন্ত খুশি হলেন। হঠাৎ একদিন কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই চীনা কর্তৃপক্ষের তরফ থেকে জানানো হল, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জেনারেল জিয়া এবং তার সফর সঙ্গীদের ঢাকা থেকে নিয়ে আসার জন্য গণচীনের প্রেসিডেন্সিয়াল প্লেনটিকেই ঢাকায় পাঠানো হবে। এ এক বিরল প্রস্তাবনা! কিন্তু খবরটা যখন জেনারেল জিয়াকে জানালাম, তখন মনে হল তিনি যেনো কিছুটা অস্বস্তিতে পড়লেন। তিনি আমাকে জানালেন, যদিও প্রস্তাবটা খুবই প্রশংসনীয় কিন্তু তিনি দুই-একদিনের মধ্যেই এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত জানাবেন। তার এই জবাবে বুঝতে কষ্ট হল না এই প্রস্তাব জিয়ার পক্ষে গ্রহণ করা সম্ভব হবে না। কারণটা অতি পরিষ্কার। যেখানে জিয়া ভারতের আনুকূল্য পাবার জন্য সমঝোতা করেছেন সেই প্রেক্ষিতে গণচীনের প্রেসিডেন্সিয়াল প্লেন যার একদিকে উড়তে দেখা যেতো গণচীনের পতাকা আর অন্যদিকে বাংলাদেশের পতাকা সেই প্লেনে চরে জিয়া ও তার প্রতিনিধি দল কি করে চীন সফরে আসতে পারেন! সেটাই হল। জিয়া জানিয়ে দিলেন প্রস্তাবটা তার পক্ষে গ্রহণ করলে ভারতের সাথে সম্পর্কে টানাপড়েন সৃষ্টি হবে সুতরাং তিনি বিমানের ফ্লাইটেই ক্যান্টন পৌঁছাবেন।
জিয়ার সিদ্ধান্ত জানানোর পর আমরা সফর সূচি চূড়ান্ত করার জন্য পুরোদমে ব্যস্ত হয়ে পরলাম। কিন্তু আমি অনুভব করলাম, চৈনিকদের তরফ থেকে আগের তুলনায় সফরের ব্যাপারে আগ্রহ যেন কিছুটা কমে এসেছে! আমি শঙ্কিত মনে এর কারণ খুঁজে বের করার জন্য ভাবতে শুরু করলাম।
জেনারেল জিয়ার সিদ্ধান্ত থেকে চৈনিক শীর্ষ নেতৃবৃন্দও জিয়াকে সঠিক ভাবে মেপে নিয়েছিলেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। তবে কি তারা বুঝে নিয়েছেন, ভারতের সাথে ব্যালেন্স করার জন্য যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকু সম্পর্কই গড়ে তুলবেন জিয়া গণচীনের সাথে? তারা হয়তো আরও বুঝতে পেরেছেন জেনারেল জিয়ার পররাষ্ট্র নীতির ফোকাস হবে ভারত, মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ মুসলিম দেশগুলো এবং আমেরিকা সহ ইউরোপের শক্তিধর দেশগুলোকেন্দ্রিক। জেনারেল জিয়া বাংলাদেশকে পশ্চিমা দেশগুলোর প্রভাবে একটি পুঁজিবাদী রাষ্ট্র হিসাবে পুনর্গঠন করবেন এবং অতীতের কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রেও কোনও মৌলিক পরিবর্তন আনবেন না। পরিণামে আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ গড়ে তোলা সম্ভব হবে না। ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান কমার পরিবর্তে উত্তরোত্তর বেড়েই চলবে সময়ের সাথে। দেশে তৈরি হবে এক পরগাছা নব্য পুঁজিপতি শ্রেণী যারা তাদের অসৎ উপায়ে অর্জিত সম্পদ আর পেশীশক্তির জোরে জিয়ার তল্পিবাহক হয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজপতি বনে গোষ্ঠী স্বার্থে বিদেশী শক্তিগুলোর তল্পিবাহক হয়ে তাদের স্বার্থকে প্রাধান্য দিয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখবে নিজেদের মুঠোয়। অবশ্য এই নব্য শাসকগোষ্ঠীর গায়ে জড়ানো থাকবে গণতন্ত্র জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের নামাবলি।
লক্ষ প্রাণের আত্মদানের বিনিময়ে অর্জিত সদ্য স্বাধীন দেশের জনগণের স্বপ্ন ছিল যুদ্ধ করে দেশকে স্বাধীন করার পর প্রতিষ্ঠিত ঘুণে ধরা কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে নিবেদিতপ্রাণ একটি দেশপ্রেমিক নেতৃত্ব রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করবে। যারা আত্মপ্রত্যয়ের সাথে কঠোর হস্তে স্বচ্ছতার সাথে দেশবাসীর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করবে সার্বিক পরিসরে। কিন্তু জেনারেল জিয়া যে অপরাজনীতির সূচনা করতে চলেছেন সেখানে আবারো ক্ষমতাসীনদের শত্রুতে পরিণত হতে যাচ্ছে দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ দরিদ্র এবং নিপীড়িত জনগণ!
ফিরে চলা যাক জিয়ার সফর সংক্রান্ত বিষয়ে। চৈনিক নেতৃবৃন্দ কিছুটা হতাশার সাথে তার এই সফরটাকে যেন একটি গতানুগতিক সফর হিসাবেই পরিগণিত করছেন। এই অবস্থাতেই এলেন জিয়া নির্ধারিত দিনে। অন্যান্যদের সাথে রয়েছেন জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু মানে আমাদের শিশুভাই। সাদর সম্ভাষণই জানান হল CMLA জেনারেল জিয়া এবং তার সফরসঙ্গীদের।
দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে জিয়া তেমন বিশেষ কিছুই চাইলেন না। কেনো চাইলেন না! যদিও অগ্রিম তাকে জানানো হয়েছিলো যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্গঠনে বিশেষ করে দেশের সামরিক বাহিনীকে শক্তিশালী করে গড়ে তোলার জন্য চীন সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করতে দীর্ঘ মেয়াদী চুক্তি স্বাক্ষরে প্রস্তুত। তিনি চাইলেন, পাকিস্তান আর্মির ফেলে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র যেগুলো ভারতীয় সেনাবাহিনী নিয়ে যেতে পারেনি সেগুলোকে কার্যকরী করার জন্য কিছু নাট-বল্টু মানে স্পেয়ার পার্টস এবং গাজীপুরের স্মল আর্মস অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিটা সচল করার জন্য কারিগরি সহযোগিতা। সোভিয়েত ইউনিয়ন থেকে মুজিব আমলে আনা মিগ জঙ্গি বিমানগুলোকে সচল করার জন্য কিছু স্পেয়ার পার্টস এবং ব্যাটারি। নেভির জন্য চাইলেন কয়েকটা গানবোট।
তার চাওয়ার বহর আমাদের অবাক করে দিয়েছিলো। কারণ চৈনিক নেতারা আশা করছিলেন, জিয়া চাইবেন একটা সুদূরপ্রসারী সার্বিক বিষয়ে একটি দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করতে। কিন্তু তিনি তেমন কিছুই কেনো চাইলেন না সেটা কিছুটা আন্দাজ করতে পারলেও আসল মোজেজাটা জানার জন্য শিশুভাইকে একান্তে আমি প্রশ্ন করেছিলাম এই ব্যাপারে। তিনি কোনও জবাব না দিয়ে শুধু বলেছিলেন, বুঝে নেবার চেষ্টা করো। এই ভাবেই শেষ হল জেনারেল জিয়ার সফর।
বেশ কিছুদিন পর এক বৈঠকে PLA এর Foreign Affairs Bureau এর ডাইরেক্টর বন্ধুবর লং মার্চ ভেটেরান জেনারেল চেন সাই চেন আমাকে কথাচ্ছলে বলেছিলেন
বাংলাদেশের সাথে সম্পর্ক গড়ে তোলার জন্য আমরা যেই পর্যায় পর্যন্ত এগুতে প্রস্তুত ছিলাম তোমাদের নেতা তো তার সিকিভাগ পর্যন্তও এগুবার সাহস দেখাতে পারলেন না। তার সেই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ প্রশ্নের জবাব আমার কাছে ছিল, তবে কোনও জবাব না দিয়ে নিশ্চুপ ছিলাম।
চীন সফরের পরই জিয়া গেলেন ভারত সফরে। চূড়ান্ত বোঝাপড়া এবং রোডম্যাপ ফাইনাল করা হল হাসিনা আর রেহানার দেশে ফেরার ব্যাপারে। ১৯ দফার উপর গৃহীত হল ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোট। এতে আত্মবিশ্বাস বেড়ে গেলো জিয়ার। জাগোদল এর সূতিকাগার থেকে জন্ম নিল ভিন্নপথের বিভিন্ন মুনিদের নিয়ে তার রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (BNP)। এরপর ১৯৭৮ সালে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের মাধ্যমে তিনি হয়ে বসলেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি। এই নির্বাচনে খন্দকার মোশতাক কিংবা কর্নেল ফারুককে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হতে দেয়া হল না। হাসিনা ফিরে এসে লাইফ সাপোর্টে রাখা আওয়ামী লীগকে পুনর্জীবিত করলো জিয়ার সার্বিক সাহায্য সহযোগিতায়। কিন্তু ফারুক আর রশিদকে রাজনৈতিক দল গঠন করতে দেয়া হল না। সুযোগ দেয়া হল না খোন্দকার মোশতাককে তার দল ডেমোক্রেটিকলীগকে রাজনৈতিক ময়দানে প্রতিষ্ঠিত করার। এটাই ছিল জাতিকে বহুদলীয় রাজনীতি ফিরিয়ে দেয়ার গণতান্ত্রিক চেহারা। যেকোনো দেশে গণতান্ত্রিক রাজনীতি চর্চার মৌলিক দুইটি উপাদান হল সহনশীলতা এবং প্রতিপক্ষের প্রতি সৌহার্দমূলক আচরণ। এখন দেখা যাক জেনারেল জিয়া তার দলের শীর্ষনেতৃবৃন্দ কিংবা তার দল BNP তে এই দুইটি উপাদানের কদর কতটুকু।
খন্দকার মোশতাকের পার্টি ডেমোক্রেটিকলীগের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের স্টিম রোলার চালিয়ে দিলেন রাষ্ট্রপতি জিয়া। তার দলকে কোথাও মিটিং-মিছিল কিংবা সভা করতে দেয়া হল না। বোমাবাজি, টিয়ার গ্যাস, ওয়াটার ক্যানন, ধরপাকড়, জেল-জুলুম এমনকি সভামঞ্চে জ্যান্ত বিষাক্ত সাপও ছেড়ে দেয়া হল। এরপরও সাহসী খন্দকার মোশতাককে কাবু করতে না পেরে তাকে গৃহবন্দী করে রাখা হয়। এভাবেই তার দলকে অঙ্কুরেই শেষ করে দিয়ে নিজের দলের বিজয় সুনিশ্চিত করেছিলেন ‘৭৯ সালের নির্বাচনে জেনারেল জিয়া। অসহায় জনাব খন্দকার মোশতাককে গৃহবন্দী অবস্থাতেই দেহত্যাগ করতে হয়েছিলো। সহনশীলতা এবং প্রতিপক্ষের প্রতি সৌহার্দমূলক আচরণের এ ছিল এক অদ্ভুত নিদর্শন!
অন্যদিকে শেখ হাসিনা অ্যানাকন্ডা শাবক ও তার আওয়ামীলীগ জিয়ার বদান্যতায় ক্রমান্বয়ে অ্যানাকন্ডায় রূপান্তরিত হতে থাকলো যার বিষাক্ত নিঃশ্বাসে জিয়াকে অসময়েই হাসিনার প্রত্যাবর্তনের ১৩/১৪ দিনের মাথায় চলে যেতে হল ইহলোক ত্যাগ করে। আজ জাতি সেই অ্যানাকন্ডার নাগপাশে শ্বাসরুদ্ধ অবস্থায় ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এই অ্যানাকন্ডা কিন্তু শুধু জাতিকেই গলাঃধকরণ করেই ক্ষ্যান্ত হবে তা নয়। বিএনপি স্বৈরশাসক এরশাদের সৃষ্ট জাতীয় পার্টি এবং জামায়াতে ইসলামী যারা নিজেদের জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় চেতনার ধ্বজাধারী হিসাবে ঘোষণা দিয়ে তিরিশ বছরেরও বেশি সময় ক্ষমতা ভোগ করেছে দৈত্যসম এই সরীসৃপের সাথে সহাবস্থান করে তৃপ্তির ঢেকুর তুলে তাদেরও গিলে খাবে। সেটা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। জিয়া, এরশাদ, বেগম খালেদা, গোলাম আজম এবং নিজামীর মতো রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে এই স্বার্থপর আত্মঘাতী নীতির জন্য দেশবাসীর কাছে ইহজগতেই জবাবদিহি করতে হবে এবং পরকালের শেষ বিচারের দিনেও হিসাব অবশ্যই দিতে হবে।
১৯৭১ সালে এ মাটির মানুষেরা জাতীয় মুক্তির আশায় একটি রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ করে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠা করেছিল শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতার জন্যই নয়, তাদের প্রত্যাশা ছিল সার্বিক জাতীয় মুক্তি। অমিত সম্ভাবনা এবং সম্পদ থাকা সত্ত্বেও জাতীয় রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধোঁকাবাজি, ক্ষমতার লোভ এবং স্বার্থপরতায় আজ সেই আশা বিভীষিকায় পরিণত হতে দেখছে দেশবাসী। তাদের পাতানো খেলার রাজনীতিতে দেশের স্বাধীন অস্তিত্বই বর্তমানে হুমকির সম্মুখীন। জাতিকে পরিণত করা হচ্ছে দাসে এবং রাষ্ট্রকে আগ্রাসী ভারতের উপর নির্ভরশীল একটি করদ রাজ্যে। জিয়ার রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে সংক্ষেপে আমি কিছুটা আলোচনা করবো।
প্রেসিডেন্সিয়াল নির্বাচনে ভারতের ইঙ্গিতে আওয়ামীলীগ কোনও প্রার্থী দাড় করালো না নিশ্চিত পরাজয় এড়াবার কৌশল হিসেবে। অন্যদিকে খন্দকার মোশতাক এবং রশিদ-ফারুককেও ময়দানে নামতে দেয়া হল না। আমাদেরকে বাংলাদেশে স্বতন্ত্রভাবে রাজনীতি করতে না দেয়ার সিদ্ধান্ত অনেক আগেই জিয়া গ্রহণ করেছিলেন নিজের রাজনীতির স্বার্থেই। কারণ, এর ফলে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর এর কৃতিত্ব জিয়ার পক্ষে নেয়া সম্ভব হতো না। ফলে, প্রতিদ্বন্দ্বীহীন নির্বাচনে বৈধতার একটা সমস্যা সৃষ্টি হল। তখন কূটবুদ্ধির অধিকারী জেনারেল জিয়া হলিডে পত্রিকার সাদেক খান, ইত্তেফাকের ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনকে লাগালেন জেনারেল ওসমানীর পেছনে। ৭ই নভেম্বর পর জিয়ার আচরণে জেনারেল ওসমানী খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন, বিশেষ করে ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থ বিরোধী আপোষকামিতা, সামরিক বাহিনীতে তার বর্বর হত্যাযজ্ঞ, খন্দকার মোশতাকের প্রতি তার আচরণ, আমাদের ফেরত না আনার বিষয়গুলো তিনি মেনে নিতে পারেননি। সেই সুযোগটি গ্রহণ করে চাতুর্যের সাথে তারা জেনারেল ওসমানীকে জিয়ার বিরুদ্ধে নির্বাচন করতে রাজি করাতে পেরেছিলেন। ভারতের ইশারায় হাসিনার আওয়ামীলীগ শুধু মৌখিকভাবে জেনারেল ওসমানীকে সমর্থন দেবার এলান করে। জেনারেল ওসমানীর নির্বাচনের জন্য লন্ডনের সিলেটি প্রবাসীরা মুক্ত হস্তে বিস্তর টাকা দিয়েছিলেন সাদেক খানের হাতে। আমি সেই সময় লন্ডনে অবস্থান করছিলাম। যাই হউক, নির্বাচনে জেনারেল ওসমানী পরাজিত হলেন আর জিতলেন ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের স্বত্বভোগী জেনারেল জিয়া। এই বিজয়ের পর লোয়াড়দের পুরস্কৃত করা হল। হলিডে পত্রিকার অত্যাধুনিক প্রেস কেনার জন্য অর্থের অনুদানের ব্যবস্থা করে দিলেন জিয়া। সাদেক খানের ছোটভাই জনাব এনায়েতুল্লাহ খান হলেন মন্ত্রী, পরে রাষ্ট্রদূত। পুরস্কৃত হয়েছিলেন ব্যারিস্টার মইনুল হোসেনও।
এরপর ১৯৭৯ সালের সাধারণ নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জয়ী হয়ে সরকার গঠন করতে সমর্থ হয় অক্লেশে। আওয়ামীলীগকে সেই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার সুযোগ দিয়ে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে বসার সুযোগ করে দেয়া হয়। সবক্ষেত্রেই তখন জিয়ার জয়-জয়কার! এভাবেই সব ক্ষমতা নিজের মুঠোয় নিয়ে দর্পের সাথে রাষ্ট্র পরিচালনা করছিলেন জিয়া। ঠিক তখনই পর্দার অন্তরালে জিয়ার ড্রামার ড্রপসিন ফেলার ষড়যন্ত্রকারীরা তারই নিযুক্ত সেনা প্রধান জেনারেল এরশাদের নেতৃতে শেষ অঙ্কের দিকে এগুচ্ছে।
জেনারেল মনজুরের সাথে বৈঠক
ভেতরে একটা কামরায় নিয়ে গেলেন এক ভদ্রলোক, তাকেও চিনি না। ঘরে ঢুকে দেখি সিভিল ড্রেসে জেনারেল মঞ্জুর বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। পৌঁছে দিয়ে ভদ্রলোক রুম থেকে চলে গেলেন। কুশল বিনিময়ের পর জেনারেল মনজুর বললেন
ডালিম, ঢাকায় আসার পর তুমি অনেকের সাথেই দেখা করেছো, কিন্তু আমার সাথে দেখা করনি। তাতে আমি কষ্ট পেয়েছি। Sorry Sir, সময় ও সুযোগের অভাবে সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে আপনি ডেকে পাঠালে নিশ্চয় দেখা করতাম। আপনি যাদের দিকে ইঙ্গিত করছেন তারা সবাই ডেকে পাঠাবার পরই দেখা করেছি। তাছাড়া মাহবুব জানালো আপনি খুবই ব্যস্ত থাকেন। তাই বিরক্ত করতে চাইনি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসঘাতকতা আর একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত করছেন জিয়া। তারপরও তুমি তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করলে কোন যুক্তিতে? কঠিন প্রশ্ন বটে!
স্যার, আমি যাই করে থাকি সেটা আমার একক সিদ্ধান্ত নয়, আমাদের সবার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত। তাছাড়া যাই করা হয়েছে সেটা অবশ্যই কোনও ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে করা হয়নি, সেটা করা হয়েছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। এতে জিয়া যদি উপকৃত হয়ে থাকেন সেটা কখনোই আমাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল না। যে কারণে ৩রা নভেম্বর আমরা দেশ ছেড়ে ব্যাংকক চলে গিয়েছিলাম ঠিক সেই কারণেই ফারুককে নিরস্ত্র করতে আমি তার সাথে কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেছিল বলেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফারুক ফিরে চলে গিয়েছিলো স্বেচ্ছায়। কারণটা আপনার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্যার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এত দরদ থাকার পরও ৭ই নভেম্বরের পর জিয়া যে রকম ভাবে অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করে চলেছেন সেইক্ষেত্রে আপনার মতো একজন সচেতন প্রভাবশালী CGS এর পক্ষে কোন কিছুই করার ছিল না কি? সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত আপনি সেই পদেই জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন পার্সোনাল স্টাফ অফিসার হিসাবে তার একজন মুখ্য পরামর্শদাতা হিসাবেই চাকুরি করে চলেছেন। আমি যদি আপনার জায়গাতে থাকতাম তবে আমি কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলেও এ ধরনের অন্যায় বরদাস্ত করে অন্তত চাকুরী করতাম না।
আমি উপায়হীন। সামরিক বাহিনীতে তোমাদের যেমন একটি সংগঠিত শক্তি রয়েছে সেটা আমার নেই। আমি জানি, সেই শক্তিই জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে ৭ই নভেম্বরের পর পুনরায় অধিষ্ঠিত করেছিলো আর্মি চীফ হিসেবে। তাদের জোরেই জিয়া তাহেরকেও পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো। এবার তোমরা যদি ফারুককে সমর্থন করতে তবে অতি সহজেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারতে। CGS হিসেবে আর্মির খবরাখবর আমি রাখি। তাই নিশ্চিত হয়েই আমি এটা বললাম। আর জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক বৃহত্তর অংশই তোমাদের সমর্থন করতো। আমার বিশ্বাস এটা তোমারও অজানা ছিল না। তারপরও তোমরা জিয়াকেই বাঁচিয়ে নবজীবন দান করলে?
আপনার মতো বুদ্ধিমানের জন্য বিস্তারিত জবাব না দিয়ে অল্প কথায় বলছি।
স্যার, ঘরের শত্রু বিভীষণকে মারতে গেলে পুরো ঘরটাই বিধ্বস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ঠিক একই কারণে ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েও প্রত্যক্ষভাবে তার মোকাবেলা না করে পরোক্ষভাবে তার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার এই ছোট্ট জবাবটা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই সব কিছুই আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনি বুঝতে পারবেন তাহের এবং ফারুকের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সঠিক না বেঠিক। আপনাকে বিব্রত করার জন্য নয়, সাংগঠনিক শক্তির কথা বললেন তাই বলছি, ১৫ই আগস্টের পর আমি আমাদের পক্ষ থেকে কিন্তু আপনাকে দিল্লী থেকে ডেকে আনিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম এখানে আপনার প্রয়োজন। কিন্তু আপনি ওই সাংগঠনিক শক্তির সাথে এক হয়ে কাজ করতে কোনও আগ্রহ প্রকাশ না করে দিল্লী ফিরে গিয়েছিলেন। এতে আমরা কিছুটা হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছিলাম! তাছাড়া সব ক্রান্তিকালে চিহ্নিত কিছু লোকই সর্বদা অগ্রণীর ভূমিকা পালন করবে সেটাই বা যুক্তিসঙ্গত হয় কি করে? আপনি এবং আপনার মতো আরও অনেকেই তো ক্ষমতা বলয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। আপনাদের পক্ষেও তো পথভ্রষ্ট নেতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা কিংবা তাকে অপসারণ করে যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর কাজটি খুব একটা কঠিন নয়। শুধুমাত্র চাকুরি না করে এই বিষয়টি নিয়ে আপনি গুরুত্বের সাথে ভাববেন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিও বিশ্বাসঘাতকতা এবং চক্রান্তের ফলে বর্তমানে আমরা অনেকটাই দুর্বল তবুও কথা দিচ্ছি, দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে সময়োচিত যেকোনো সঠিক উদ্যোগে আপনার প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে। আমার মনে হয় এরপর আর আলোচনার কিছু নেই।
আমাদের সাথে যোগাযোগ থাকবে নিশ্চয়?
নিশ্চয়ই। ইচ্ছে থাকলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তো কোনও সমস্যা দেখছি না। স্যার, বিদায়ের আগে একটি কথা বলে যাই with no malice, personal interest or grievances যদি অনুমতি দেন।
বলো, অনুমতি দিলেন জেনারেল মঞ্জুর।
আজ আপনার সাথে খোলাখুলি আলাপের মাধ্যমে আপনার চিন্তাধারার কিছুটা হলেও জানতে পারলাম। দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনও তফাৎ নেই। দিল্লীতে মিলিটারি এট্যাঁ’চে হিসাবে বছর দু’এক কাটিয়ে আসার পর আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনোভাব এবং নীলনকশাটা কি। জিয়া কোন পথে হাঁটছেন সেটা ৭ই নভেম্বরের পর বুঝতে না পারলেও দেরিতে হলেও এখন আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। এখনও সময় আছে দেশ এবং জাতিকে জিয়ার সর্বনাশা খেলার হাত থেকে বাঁচানোর। এবারের সংগ্রামে অগ্রণী হবার অবস্থাতে আমরা নেই। এবারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদেরকেই বিশেষ করে অগ্রণী হতে হবে আপনাকেই। আমরা আপনাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে একাত্ম হয়ে লড়বো। ফারুক-রশিদও থাকবে আমাদের সাথেই। জিয়াকে কিছুতেই ভারতের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে হাসিনাকে দেশে ডেকে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করতে দেয়া উচিৎ হবে না। যদি তিনি জাতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কাজটি করেন তখন জনগণের কাছে তার পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হবে ভারতের দালাল হিসাবে। সেটাই হবে জিয়াকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সঠিক সুযোগ। সত্যি করে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা আপনার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। রাজনৈতিকভাবে আপনি কতটুকু সচেতন সেটাও আমাদের জানা নেই। আপনার মানশিকতা, চিন্তা ভাবনা, মূল্যবোধ কিংবা আপনি কি ধরনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন এর কিছুই আমাদের জানা নেই। তবু আমি আমাদের তরফ থেকে কেনো আপনাকে দিল্লী থেকে ডাকিয়ে এনেছিলাম জানেন কি? কারণটা ছিল, আপনার সম্পর্কে মাহবুব মানে আপনার ভাগ্নে যতটুকুই বলেছিলো তা থেকে আমাদের মনে হয়েছিলো আর কিছু না হলেও, আপনি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক এবং গণমুখী জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা। এই পদক্ষেপে মীর শওকত, নাসিম, হেলাল মোর্শেদ-এর মতো আওয়ামীলীগ পন্থী দু’চারজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছাড়া প্রায় অন্য সবারই সমর্থন পাওয়া যাবে। প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা এখনও সুসংগঠিত নয়। তাই তারা কোনও ফ্যাক্টর হবে না সেই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। বরং বলতে পারি প্রত্যাগতদের বেশিরভাগই সাপোর্ট করবে। সামরিক বাহিনীর সৈনিক এবং অফিসারদের বৃহদংশের সমর্থনও সুনিশ্চিত। আমরা ৩২ জন সিনিয়র অফিসারকে বের করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শুধুমাত্র দুর্নীতির দায়ে, ঠিক সে ভাবেই এরশাদসহ ভারত এবং আওয়ামীলীগ পন্থী চরিত্রহীন, দুর্নীতি পরায়ণ অফিসারদের বের করে দিতে হবে। এরপর যদি আমাদের আর্মিতে ফিরিয়ে আনা হয় আমরা অতি সহজেই আগামি ২০ বছরের জন্য পরীক্ষিত অফিসারদের বেছে ইউনিট পর্যায় পর্যন্ত Chain of Command তৈরি করে নিতে সক্ষম হবো। দুই বছরের মধ্যে এই কাজটা শেষ করে আমরা চাকুরি ছেড়ে আমাদের সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি ভিত্তিক দেশব্যাপী সংগঠন গড়ে তুলবো। দেশে থাকবে মাত্র তিনটি সমমনা দল। আমাদের দল ছাড়া, একটি খন্দকার মোশতাকের, অন্যটি হবে ইসলাম ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের জন্য। আমাদের রাজনীতির ভিত্তি হবে ইসলামিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বর্তমানের সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তার উপর রেফারেন্ডাম নেবে পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রেফারেন্ডামে গৃহীত সংবিধানের আওতার বাইরে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকবে না। এর জন্য দেশের সব কয়টি দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দল গ্রুপের নেতা-নেত্রীদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা সবাই ভারতের মোকাবেলায় দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে প্রগতির পথে এগিয়ে যাবার এটাই একমাত্র পথ মনে করে সমর্থন দিতে রাজি আছেন। তারাও মনে করেন অবাধ গণতন্ত্রের নামে মাছের বাজার নয়, সাংবিধানিক সীমিত গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব একটি পশ্চাদপদ অনুন্নত দেশকে স্বনির্ভর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা। পটপরিবর্তনের পর ইচ্ছে হলে আপনি আমদের গড়া রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন ইউনিফর্ম ছেড়ে। সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন পেলে আমাদের দলই হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। কিন্তু এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল, জিয়ার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবার আগেই এই পরিকল্পনা কার্যকরী করতে হবে। একবার যদি হাসিনাকে আনিয়ে তিনি রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হন, তবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক কিংবা রাজনৈতিক কোনোভাবেই সম্ভব হবে না সহসা। সেটা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণীয়ও হবে না। বিষয়টি যদি যুক্তিসঙ্গত মনে করেন তবে সতর্কতার সাথে দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে এগুবার এখনই সময়। জিয়াও দ্রুত এগুচ্ছেন তার পথে সেটাতো বুঝতেই পারছেন। তাই আপনাকে দ্রুততর হতে হবে। একমাত্র এইভাবেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে অতীতের সব ভুল-ভ্রান্তি আর রক্তক্ষরণের পরও আমাদের চেতনা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করা। অন্য আর কোনও পথ নেই। সাহসিকতার সাথে নিঃস্বার্থ হয়ে বৃহত্তর জনস্বার্থে এগুলে বিজয় আল্লাহ্পাক আপনাকে দেবেন ইন শাহ আল্লাহ। শেষ কথা, বর্তমানে আপনিই হচ্ছেন জিয়ার রাহুর গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর শেষ অবলম্বন। সময় থাকতে উপযুক্ত উদ্যোগ না নিলে আপনি এবং অন্য যারা এখনো ক্ষমতা বলয় মানে আর্মিতে রয়েছেন তাদের অবস্থাও হবে আমাদেরই মতো কিংবা এর চেয়েও শোচনীয়। বিশেষ করে আপনাকে আর্মিতে রাখবেন না জিয়া এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। আমরা জিয়ার জন্য এতো কিছু করেও তার টার্গেটে পরিণত হয়েছি। কিন্তু কিছু না করলেও আপনি তার টার্গেট হবেন। Have no misgiving about that, Sir. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিলকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার মূল হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ভূতের প্রভাবে তারা সেটা বুঝতে পারেননি। ইসলাম শুধু মাত্র একটি ধর্ম নয়, ঐশ্বরিক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মার্ক্সসিজম ধনতন্ত্রের একটি এন্টি-থিসিস। তাই চিরস্থায়ী কোনও দর্শন নয়। সময়ের সাথে এরও বিলুপ্তি ঘটবে সমাজ বিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব অনুযায়ী। সাম্যবাদ আর সমাজতন্ত্র কোনও মৌলিক দর্শন নয়, এগুলোও প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। তাই ক্ষণস্থায়ী। তাছাড়া ইসলামের সাথে সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের কোনও বিরোধ নেই। তারা বিপথগামী না হলে জিয়ার পক্ষে আমাদের শক্তিকে এভাবে খর্ব করা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। ভবিষ্যতে আপনি কি করবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে যাই করবেন সেটা করতে হবে খুবই সতর্কতার সাথে। আমি শুধু আমার সীমিত জ্ঞানে কিছু চিন্তার খোরাক দিয়ে গেলাম। পরিশেষে, আপনাকে একটি কথা জানিয়ে যাচ্ছি, ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঘটনা কোনও তাৎক্ষণিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে যুদ্ধকালীন সময় থেকে সুচিন্তিত রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি ভিত্তিক গোপন প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টাতে আপনাকে সামিল করানোর চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। আপনি আমাকে সেই সুযোগ দেননি। সেটা স্ব-ইচ্ছায় না আমার ইঙ্গিত না বুঝে সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ১৫ই আগস্টের পর আপনাকে ডেকে আনার পরও আপনি আমাদের একজন হয়ে কাজ করতে তেমন কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
ডেকে পাঠানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। এই ধরণের বৈঠক আগে হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো। তবে সবকিছুই ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়। দেরিতে হলেও আজকের বৈঠকের জন্য আল্লাহ্ পাকের শুকরিয়া অবশ্যই আমাদের আদায় করতে হবে। আল্লাহ্ দেশ ও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আপনার সহায় হউন সেই দোয়া করবো। সেনাসদরে একটা জাতসাপের ঝাঁপিতে রয়েছেন, সেটা সবসময় মনে রেখে আপনাকে চলতে হবে। শওকত, এরশাদ, নাসিম, নুরুদ্দিন, মহব্বতজান চৌধুরী, মচ্ছু সালাম, হেলাল মোর্শেদ, মইনুল হোসেন চৌধুরী, আমিনুল হককে কোনোভাবেই বিশ্বাস করবেন না। এরা সবাই জিয়ার চোখ আর কান। বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। সাচো নীরব সাক্ষী হয়েছিল পুরোটা সময়। বেরিয়ে এসে গাড়ীতে বসে বলেছিলো দোস্ত, তুই আজ আমাকে অবাক করে দিয়েছিস! এতো স্পষ্ট করে জোরালো যৌক্তিকতার সাথে নির্ভীকভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে যা বলে এলি এর প্রশংসা না করে পারছি না। আমার বিশ্বাস, তিনি তোর বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করবেন। বাসায় নামিয়ে দিয়ে সাচো চলে গেলো। সন্ধ্যায় মাহবুব এসে জানালো, দু’দিন পর আমার ফ্লাইট কনফার্ম করা হয়েছে।
স্যার, মামা আপনাকে ডেকেছিলেন?
ডাকটা কি তোমার কেরামতি নাকি? আমার কথার উত্তরে মাহবুব কিছু না বলে তার অতিপরিচিত মৃদু হাসিটাই হাসলো। হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরলাম তার সাথে বনানীর এক বাড়িতে দীর্ঘ আলাপ করে। আলাপের বিষয়ে তুমি কিছুই জানতে চাইবে না, কারণ মামাই সেটা ভাগ্নেকে বলবেন। জবাবটা দেবার পর দুইজনই জোরে হেসে উঠলাম।
আচ্ছা স্যার, একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিনা। ৭ই নভেম্বরের পর বিপ্লবীরা জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদে বসানোর পর জিয়া জনাব খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন কিন্ত মোশতাক তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেনো?
জবাবটা খুঁজে পাবার জন্য পর্দার আড়ালের কিছু তথ্য তোমাকে জানতে হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ বিরোধী বৈপ্লবিক অভ্যুথানের সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে আমাদের বোঝাপড়ার পর বঙ্গভবনে কর্নেল তাহেরের সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সফল অভ্যুত্থানের পর জিয়াকে মুক্ত করে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। তারপর জিয়া আমাদের ফিরিয়ে আনবেন সেনাবাহিনীতে। একই সাথে জিয়াই অনুরোধ জানাবেন খন্দকার মোশতাকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে। এভাবেই আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও ধারাকে এগিয়ে নেবার পথ নিশ্চিত করা হবে। তাহের সেইসব সিদ্ধান্ত মেনে নেন। বৈঠকে এটাও নির্ধারণ করা হয় সেনা পরিষদের প্রবাসী নেতারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবেন কর্নেল তাহের এবং দেশের সব কয়েকটি সেনানিবাসে সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে। বাস্তব অবস্থার নিরিখে অনুকূল সময়ে পর্যালোচনার পর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের পরই যৌথ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিপ্লব সংগঠিত করা হবে। এভাবেই ঘটানো হয়েছিল ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান যা পরে পরিণত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত সিপাহী-জনতার বিপ্লবে। দেশত্যাগের আগেই এই সিদ্ধান্তগুলো প্রতিটি সেনানিবাসের সেনা পরিষদের ইউনিট কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
সেই বৈঠকেই প্রণীত হয়েছিলো কিভাবে কন সময় খালেদ-চক্রকে উৎখাত করা হবে সেনা পরিষদ এবং তাহেরের বিপ্লবী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে। আমরা জানতাম, দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর খালেদ-চক্র নিজেরাই তাদের প্রো-আওয়ামী-বাকশালী স্বরূপটি প্রকাশ করে বিপ্লবের সুযোগটা সৃষ্টি করে দেবে। আর সেটাই হবে উপযুক্ত সময় বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর। বৈঠকে গৃহীত পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জিয়া সেনা পরিষদের নির্দেশেই খন্দকার মোশতাককে অনুরোধ জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। জবাবে জনাব খন্দকার মোশতাক জিয়াকে বলেন, কালবিলম্ব না করে ব্যাংকক থেকে আমাদের আর্মিতে ফিরিয়ে আনতে। আমরা ফিরলেই তিনি আবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তার আগে নয় সেটাও তিনি জিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া তাকে বলেছিলেন, আমাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার কিছু সময়ের প্রয়োজন। তার এই জবাবকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেননি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী খন্দকার মোশতাক। তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় তিনি বুঝতে পারেন জিয়ার মনে অন্য কন অভিলাষ গজিয়ে উঠেছে। খন্দকার মোশতাক একজন প্রবীণ ঝানু রাজনীতিবিদ।
১৫ই আগস্টের পর The Time ম্যাগাজিন তার সম্পর্কে একটি স্পেশাল প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার বিচারে তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উপরে স্থান দেয়। আমরা যুদ্ধকাল থেকেই তার রুশ-ভারত বিরোধী অবস্থান সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলাম। তাছাড়া তিনি আব্বার সহপাঠী ছিলেন। তাই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সাথে আলোচনার পরই তাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে আওয়ামী-বাকশালীদের বৃহদংশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে এনে বাকশাল এর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে সারাবিশ্বে প্রমাণিত করতে সমর্থ হয়েছিলাম যে শুধু দেশবাসীই নয়, বাকশালের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও মুজিবের এক দলীয় বাকশালী স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেয়নি। কিন্তু মুজিবের নিষ্পেষণের ভয়ে তারা প্রতিবাদ করতে পারেননি। খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্যই গণচীন, সৌদি আরব, পাকিস্তান সহ পৃথিবীর প্রায় সবদেশের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়েছিলো। যার ফলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে আমেরিকা এবং গণচীনের হুমকির মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। জিয়ার মনোভাব আমাদের জানাবার পর আলোচনার মাধ্যমেই খন্দকার মোশতাক নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সাংবিধানিক জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে।
I am simply baffled to see the maturity of you all compared to ages. Thank you very much Sir, for sharing so many sensitive information in details. বলেই মাহবুব আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল সব মহলেই আপনি একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, স্পষ্টবাদী, সাহসী, আপোষহীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত। কিন্তু আপনার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জ্ঞান যে এতো গভীর সেটা আমিও বুঝতে পারিনি কাছের মানুষ হয়েও। কিছুটা লেখাপড়া আর কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এর বেশী কিছুই নয়।
এরপর দেশত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সময়টা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর ঘনিষ্ঠজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে আনন্দেই কেটে গেলো। শিশুভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বলেছিলেন
ডালিম, তুমি আবারও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে যে অবদান লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে গেলে একদিন জাতি নিশ্চয় তার স্বীকৃতি দেবে। My hats off to you বলে আমাকে উষ্ণ আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন। ধরা গলায় বললেন, জানিনা আবার কবে তোমার সাথে দেখা হবে। তবে দোয়া রইলো যেখানেই থাকো আল্লাহ্ তোমার সহায় হউন, ফিরে গিয়ে বাকি সবাইকে আমার ভালবাসা আর দোয়া জানিও।
আপনি যেভাবে আমার খেয়াল রাখলেন স্নেহের ছায়ার আচ্ছাদনে পুরোটা সময় সেটার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করবো না।তবে জীবনে কখনও ভুলবো না আপনার এই নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসার ঋণ। ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবো সবকিছুই। You are really great, too good to be true! আমাদের নাবালক ভাই! দু’জনেই হেসে উঠলাম।
বাংলাদেশে নীতি বিবর্জিত কুটুম্বিতার রাজনীতির স্বরূপ
নীতি বিবর্জিত শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য কুটুম্বিতার রাজনীতির রূপ কতটা কদর্য এবং ক্ষতিকর হতে পারে সেটার কিছু নমুনা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় তরুণ প্রজন্মের ভাবনার খোরাক হিসাবে তুলে ধরতে চাই যাতে করে তারা বার বার প্রবঞ্চনার শিকারে পরিণত না হয়। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতা দখল করে বসলেন তারই নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানালেন। ভারতের সুতার টানে জেনারেল এরশাদ অনেক চেষ্টা করেও বেগম খালেদার জিয়ার সাথে কোনও রকম বোঝাপড়া করার সুযোগ পেলেন না।
কারণ হিসেবে বলা হয়, খালেদা জানতেন, জিয়ার মৃত্যুতে এরশাদের হাত ছিল। অবশেষে ক্ষুব্ধ এরশাদ বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত, পার্টির এবং সবগুলো অঙ্গ সংগঠনের ব্যাংক একাউন্ট তিনি জব্দ করতে আদেশ দেন। এতে পার্টির কাজ এগিয়ে নেয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। এই ক্রান্তিলগ্নে বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ, মোশাররফ হোসেন সহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা এরশাদের সাথে হাত মেলান বেগম খালেদা জিয়াকে ত্যাগ করে।
আশির দশকে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মনোভাব বুঝে খালেদা জিয়ার বিএনপি, আওয়ামীলীগ এবং জামায়াতসহ অন্যান্য কয়েকটি দলের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেন তারা। জনসমর্থনে সেই সংগ্রাম যখন বেগবান হতে থাকে ঠিক তখনই সংগ্রামের পিঠে ছুরি মেরে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত এরশাদের দেয়া ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। যদিও হাসিনা চট্টগ্রামের জনসভায় উচ্চস্বরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যারাই এরশাদের নির্বাচনে যাবে তারা সবাই হবে জাতীয় বেঈমান’। দেশবাসী হতবাক হয়ে যায় শেখ হাসিনার কুৎসিত আচরণ এবং বিশ্বাসঘাতকতায়। দুঃখজনক হলেও গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের দেয়া টোপ গিলে কর্নেল ফারুক কর্নেল রশিদের পরামর্শে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তৃতীয় স্থান দখল করে এরশাদের নির্বাচনকে বৈধতা দানে সাহায্য করে।
আমাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের অবস্থানে কোনও হেরফের হয়নি। চট্টগ্রামের জনসভায় শেখ হাসিনার ঘোষণার পর একরাতে এরশাদের নিমন্ত্রণে শেখ হাসিনা এক লং ড্রাইভে এরশাদের সফর সঙ্গিনী হয়েছিলেন। সেই লং ড্রাইভ কালেই ১৭ কোটি টাকার লেনদেনের মাধ্যমে হাসিনা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওয়াদা করেছিলেন। জামায়াতকেও কিছু উচ্ছিষ্ট দিয়ে লাইনে আনা হয়েছিলো। নির্বাচন হয়েছিলো, কিন্তু বিএনপি জোট সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় পাতানো নির্বাচন বৈধতা পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত কর্মীদের চাপে সংসদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে ফিরে আসে পালের বাতাস দেখে যাতে খালেদা জিয়া একাই সেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে না পারেন।
‘৯১-এর নির্বাচনে জামায়াত খালেদার নেতৃত্বে নির্বাচনী মোর্চায় শরিক হয়। তাদের মূল দাবি ছিল নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাদের আমীর প্রফেসর গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। নির্বাচনে হেরে গিয়ে আওয়ামীলীগ নেত্রী হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, একদিনের জন্যও খালেদা সরকারকে তিনি শান্তিতে থাকতে দেবেন না, করেছিলেনও তাই।
হাসিনার মদদে জাহানারা ইমাম এবং কর্নেল নুরুজ্জামান বীর উত্তমের নেতৃত্বে হঠাৎ করেই রাতারাতি গজিয়ে উঠল ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ সংক্ষেপে ‘ঘাদানিক’। তারা প্রকাশ্য জনসভায় গণআদালতের রায় মোতাবেক প্রফেসর গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। বিচলিত জামায়াত বিএনপি সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি করে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে। সৃষ্টি হল টানাপড়েনের। সেই মোক্ষম সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে হাসিনা গিয়ে মিলিত হলেন গোলাম আজমের সাথে ইন্দিরা রোডের এক বাড়ীতে গোপন বৈঠকে। উছিলাটা ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি তাদের দল সমর্থিত প্রার্থী জাস্টিস বদরুল হায়দার চৌধুরীর জন্য তার আশির্বাদ চান। এই প্রসঙ্গের আড়ালে আসল বিষয়টি উত্থাপন করলেন হাসিনা। তিনি বললেন, ‘ঘা দা নির্মূল কমিটি’ তারই প্রসূত। জামায়াত যদি আওয়ামীলীগের সাথে একজোটে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে রাজি হয় তাহলে তিনি ‘ঘা দা নির্মূল কমিটির’ পিঠে ছুরি চালিয়ে কোর্টের মাধ্যমে গোলাম আজম সাহেবের নাগরিকত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। জামায়াত খুশি মনে সব নীতি-আদর্শ জঞ্জালের মতো বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে হাসিনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো।
সিদ্ধান্ত হল, যুগপৎ সরকার বিরোধী আন্দোলন দুই দলের বিশেষ করে আওয়ামীলীগের পক্ষে বিব্রতকর হবে। তাই জামায়াত সরকার বিরোধী আন্দোলন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন আগামীতে নির্বাচন করার দাবিতে, আর আওয়ামীলীগ একই সাথে আন্দোলন করবে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার যেটা তার প্রয়াত পিতাই সংবিধান পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেটা নাকচ করে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবিতে। ক্রমে এই দুই ইস্যুতে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করে তোলা হবে। হাসিনা আরও জানালেন, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন সুনিশ্চিত। সুবিধাবাদী জামায়াত হাসিনার টোপটি গলাধঃকরণ করলো। RAW-এর এই কূটচালে জামায়াত বিএনপির নির্বাচনী মোর্চা থেকে বেরিয়ে আসায় আওয়ামীলীগের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেয়া হল জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের সাধারণ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার প্ররোচনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সংক্ষেপে ‘ঘাদানিক’ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বিতর্কের সূত্রপাত ঘটায়। পরবর্তী সময়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সুবিধাবাদী জামায়াতে ইসলামের সাথে আওয়ামীলীগের চূড়ান্ত সমঝোতা এবং বোঝাপড়ার পর আওয়ামী ঘরানার ধর্মনিরপেক্ষ, সুশীল সমাজের মহারথী খ্যাত প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রফেসর গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বহাল রাখার ব্যবস্থা করে দেন। এই হাবিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি থাকার সুবাদে পরবর্তীকালে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলটি পাশ করিয়ে নেয়া হয় বিএনপি সরকারের মাধ্যমে।১৯৯৬ এর ২৮শে মার্চ বিএনপি সরকার পদত্যাগ করলে আওয়ামীলীগের আশীর্বাদপুষ্ট প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পান এবং তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামীলীগ। ভোট বেশি পেয়েও বিএনপি পায় ১২০ টি সিট আর জামায়াত-এর সিট সংখ্যা ১৭ থেকে কমে ৩-এ এসে দাড়ায়। সেই সময় ক্ষমতার জন্য নিরুপায় হয়ে এরশাদের সমর্থন চেয়ে খয়রাত পেতে ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। জেলবন্দী এরশাদ ভারতের সুতোর টানে আওয়ামীলীগকেই সমর্থন দিয়ে হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জামায়াতের রাজনীতি জন্মের পর থেকেই বিভ্রান্তিকর। পাকিস্তান আন্দোলন কালে জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা মওদুদী দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থন কিংবা বিরোধিতা না করে তার জন্মভূমি ভারতের দাক্ষিণাত্যেই থেকে যান। পরে তিরিশের দশকে হিজরত করে ভারত ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাওলানা ডঃ ইকবালের আমন্ত্রনে। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কাদিয়ানীদের অমুসলমান বলে ফতোয়া জারি করায় এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-ফ্যাসাদের সূত্রপাত ঘটে পাকিস্তানে। অনেক নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটে সেই দাঙ্গায়। এই দাঙ্গায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে মাওলানা মওদুদীকে বন্দী করা হয় এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তবে কাকতালীয় ভাবে তিনি সেই যাত্রায় ছাড়া পেয়ে যান। এরপর থেকে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতি করে চলেছে। এর ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে।
ভারতের সাথে সমঝোতার ফলে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার পর ব্যালেন্সিং এ্যাক্ট হিসাবে জেনারেল জিয়া প্রফেসর গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। প্রফেসর গোলাম আজম শেখ মুজিবের মতোই পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়েই পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফেরার পর জনাব গোলাম আজম জামায়াত-এর আমীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোনিবেশ করেন।সেই প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতাগ্রাসী জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালে আওয়ামীলীগে এবং জামায়াত এর সাথে সমঝোতা করে নির্বাচনের প্রহসনের মাধ্যমে তার অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এর পেছনেও কলকাঠি নেড়েছিল ভারত। কারণ, জেনারেল এরশাদ এবং আওয়ামীলীগের গলায় বাঁধা সুতো ভারতীয় চাণক্যদের হাতে। এরশাদের আনুকূল্য এবং আওয়ামীলীগের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পাবার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে অনুসরণ করে অংশগ্রহণ করেছিলো জামায়াতে ইসলামী। ক্ষমতা গ্রহণ করেই হাসিনা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই অবৈধ ভাবে একটি সাধারণ বিলের মাধ্যমে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর অংশ ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’ টি বাতিল করে সংবিধান লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ নামে দুইটি প্রহসনমূলক মামলা দায়ের করিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেককেই কারাবন্দি করে শেখ হাসিনার সরকার। প্রথমে দুটি মামলাতেই আসামীদের তালিকায় এক নম্বর আসামী ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং দুই নম্বর আসামী ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাদের মৃত্যুর পরে মৃত বিধায় দু’জনের নামই আসামীদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। রহস্যজনক ভাবে যখন অসাংবিধানিকভাবে ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’ বিলটি সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাতিল করা হয় তখন জামায়াতসহ বিএনপি জোট কোন প্রতিবাদ না করে মুখে কুলুপ এঁটে সংসদ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রহসনমূলক এই বিচার প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হয়নি দেশের জনগণ এবং বিশ্ববাসীর কাছে। ৫ বছরের শাসনকাল সম্পূর্ণ করেও হাসিনা সরকার এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে সক্ষম হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের অধীনে লাঠি মিছিল, উচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রতি সরকারের তরফ থেকে হুমকি-ধামকি এবং নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করার পরও উচ্চ আদালতের বিবেকবান কয়েকজন বিচারক এই বিচার কাজ পরিচালনা করতে বিব্রত হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রেখেই সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছিলো। বিদায়ের আগে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গোলাম আজমের নাগরিকত্বের বিষয়টির সমাধান অবশ্য করে দিয়েছিলো শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে। ১৯৯৬ সালের শিক্ষা নিয়ে ২০০১ সালে জামায়াত আবার বিএনপি-এর জোটে যোগদান করায় বিএনপি জোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় আসীন হয়। কিন্তু ক্ষমতায় এসেও তাদের তরফ থেকে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে সংবিধান বিরোধী যে অন্যায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল তার কোনও প্রতিকার করা হল না ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’টিকে পুনর্বহালও করা হল না।‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’কে নতুন করে ইনডেমনিটি দেয়া হলেও ৫ম সংশোধনীর অংশ ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি পুনর্বহাল করা থেকে বিরত থাকলো বিএনপি জোট সরকার। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের দেয়া রাজনৈতিক আসামী হিসেবে তাদের ক্লাস দেবার আদেশটাও কার্যকর করা থেকেও বিরত থাকে বেগম খালেদা জিয়ার জোট সরকার। এভাবেই দেশপ্রেমিক জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লবী সেনা অফিসার যারা দেশ ও দেশবাসীকে বাকশালী একদলীয় স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জীবনবাজি রেখে মুক্ত করে মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের সূর্যতোরণ খুলে দিয়েছিল নির্মোহ হয়ে তাদের ফাঁসিতে ঝোলাবার পথটি খোলা রেখে পাঁচ বছর ক্ষমতা ভোগ করে মেয়াদ শেষে বিদায় নিয়েছিল ‘জাতীয়তাবাদ আর ইসলামী মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন’ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেই হাসিনা সরকার সর্বপ্রথম যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিলেন সেটা হল বিডিয়ার হত্যাযজ্ঞ। পরিকল্পিত ভাবে বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ভাড়াটে ভারতীয় কমান্ডো আনিয়ে। চাকুরিচ্যুত করা হল দুই শতেরও বেশি প্রতিবাদী সেনা অফিসারকে। এরপর বয়োজ্যেষ্ঠতার তোয়াক্কা না করে পছন্দসই জুনিয়র দু’জন উকিলকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিয়ে চীফ জাস্টিস সমেত ৫ সদস্যের একটি বেঞ্চ গঠন করা। সেই বেঞ্চের ৫ জনের মধ্যে ২ জনই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের একজন ছিল সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বেঞ্চ আসামীদের করা রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দিয়ে একই দিনে তড়িঘড়ি করে আইন বহির্ভূত ভাবে বিচার কার্যক্রম সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা না করেই ২৮ শে জানুয়ারি ২০১০ সাল, প্রত্যুষে একে একে ৪ জন সূর্যসন্তানকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়েদিয়ে হত্যা করা হয়। হাসিনার উপস্থিতিতেই তারই আদেশে কাশিমপুর থেকে আনা জল্লাদের দ্বারা নৃশংসভাবে জবাই করে মেজর বজলুল হুদাকে শহীদ করা হল কারাগারের একটি কামরায়। এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডকে বিশ্বপরিসরে শীর্ষস্থানীয় প্রচার মাধ্যমগুলো আখ্যায়িত করেছিলো, ‘Political trail, miscarriage of justice and Judicial Murder of Hasina’.
এই দুইটি ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতির মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীতে দেশপ্রেম, ’৭১ এর চেতনা, নৈতিকতা, দেশবাসীর প্রতি সহমর্মিতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবসান ঘটানো যাতে করে নতজানু সামরিক বাহিনীকে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে দেশ ও জনস্বার্থের বিপরীতে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীসমূহ এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের স্বার্থরক্ষার্থে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
এটাকে সমঝোতার রাজনীতির একটি জ্বলন্ত দেশ বিরোধী নিদর্শন বললে কি ভুল বলা হবে? এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভেবে দেখতে হবে। এই সমস্ত দল আর এদের নেতা-নেত্রীরা নিশ্চয়ই দেশের জনগণকে গরু-ছাগল ভাবেন। তারা মনে করেন, দেশের জনগণকে বেকুব বানিয়ে ফায়দা হাসিল করা অতি সহজ। কিন্তু তারা ভুলে যান সাধারণ মানুষদের কিছু সংখ্যক লোককে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো সম্ভব হলেও সর্বকাল সবাইকে বোকা বানানো সম্ভব নয়। দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিচারের কথা উঠলে, বিদেশে টাকা পাচারের বিচারের কথা উঠলে এরা সবাই থাকেন নিশ্চুপ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে তারা সভা, মিটিং মিছিল, প্রেস কনফারেন্স করে মাঠ গরম করে ফেলেন। কিন্তু দেশ এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে থাকবেন নিশ্চুপ কিংবা দেবেন একে অপরকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন যদি সেটা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থ এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের জন্য প্রয়োজন হয়!
আওয়ামী জোট ছাড়াও চারদলীয় বিএনপি জোটের এই ধরণের দ্বৈততা দেশবাসী এবং দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যে কারণে এখন মুখে মুখে শোনা যায় খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনা ‘মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’। চারিত্রিকভাবে এই দুই জোটের রাজনীতিতেও কোনও পার্থক্য নেই। এই ধরনের মনোভাবের কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে যখন তার শহীদ মইনুল রোডের বাড়ী থেকে হেস্তনেস্ত করে বিব্রতকর ভাবে উৎখাত করা হয় তখন সামরিক বাহিনীতে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি।
দেশবিরোধী এই ধরনের ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ বসে থাকা সম্ভব হয়নি সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দের পক্ষে। কয়েকজন নেতা প্রবাসে ফেরারী হয়ে থাকা অবস্থাতেও তাদেরই উদ্যোগে বিডিআর এর হত্যাযজ্ঞের পর সর্বপ্রথম তথ্যবহুল একটি লিফলেট ‘জাগো দেশবাসী বাঁচাও বাংলাদেশ’ ও একটি ভিডিও ডকুমেন্টারির সিডি দেশবাসী এবং বিদেশের মিডিয়া জগতে বিলির ব্যবস্থা করা হয়। ইমেইল করা হয় ৫ হাজারেরও বেশি অ্যাড্রেসে।বিডিআর চক্রান্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠিও পাঠানো হয় তাকে জবাবদিহি করে। সেটার কপিও দেশবাসীর মধ্যে হ্যান্ডবিল আকারে বিতরণ করা হয়। কাজগুলো খুব বড় না হলেও সেই সন্ধিক্ষণে এই দায়িত্বটি গ্রহণ করা খুব একটা সহজ ছিল না। এর জন্য অনেক তরুণ-তরুণীকে লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। ঐ সব দেশপ্রেমিকদের তাদের দুঃসাহসিকতা ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে শুধু লেখককেই নয়, দেশবাসীকেও। এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যে সমস্ত তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সবাই বর্তমান প্রজন্মের। তাই যারা হতাশায় ভোগেন আর ভাবেন বর্তমান প্রজন্মের সবাই পচে গেছে তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
বর্তমান প্রজন্মের প্রতিজনের বিবেকেই রয়েছে একটি স্ফুলিঙ্গ। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে পরীক্ষিত নেতৃত্বের অধীনে জাতীয় স্বার্থে তারাও সৃষ্টি করতে পারে দাবানল। যার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে ঘুণেধরা রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থা। একই সাথে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বিদেশী সুতোর টানে নেচে চলা নট-নটীরাও চলে যেতে পারে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এভাবেই একদিন সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি প্রতিশ্রুতিশীল নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যার ভিত্তি হবে ‘৭১-এর প্রকৃত চেতনা, স্বকীয় জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। সম্ভব হবে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের আলোকে প্রতিষ্ঠিত করা আইনের শাসন, মানবধিকার, সুষম রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ ব্যবস্থা। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে স্বকীয় ঐতিহ্যবাহী, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল, সুখী-সমৃদ্ধশালী এবং প্রগতিশীল একটি জাতি হিসাবে।
বিডিআর এর বর্বরতার পর সবকিছু জানা সত্ত্বেও বিএনপি এবং জামায়াত দু’টি দলই রহস্যজনকভাবে এই ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া থেকে বিরত থাকে। ঐতিহ্যবাহী এই বাহিনীটিকে বিলুপ্ত করে বিজিবি নামের এক নব্য ‘রক্ষী বাহিনী’ গড়ে তোলা হল দলীয় ক্যাডার দিয়ে তারও কোনও জোরালো প্রতিবাদ শোনা গেলো না বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে। তাদের এই ধরনের নীরবতায় দেশবাসীর কাছে তাদের প্রচারিত নীতি-আদর্শ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।
এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে সাংবাদিক সম্মেলনে খোলাখুলিভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা এই বলে, ‘I am not unhappy’. রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জেনারেল নাসিম যখন ক্যু’ করছিল তখনও শেখ হাসিনা তাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দেশজুড়ে লগি-বৈঠার তাণ্ডব সৃষ্টি করে জবরদস্তির মাধ্যমে জরুরী অবস্থা জারি করিয়ে ইন্দো-আমেরিকান বলয়ের প্রত্যক্ষ সমর্থনে যখন জেনারেল মইন বন্দুকের জোরে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে ফখরুদ্দিনের সরকার কায়েম করে সেই ক্ষমতা দখলকেও সমর্থন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এই পরিবর্তন নাকি তাদের সংগ্রামেরই ফসল।সরকার বদলের পর দেশে জরুরী আইনের আওতায় নির্বাচন করা হয় বিদেশী প্রভুদের অঙ্গুলি হেলনে ২০০৮ সালে। পাহাড়সম কারচুপির নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের পর ‘উদ্দিনদের’ সরকারের সব ক্রিয়াকর্মকে সাংবিধানিক বৈধতাও প্রদান করেছিলো হাসিনার সরকার। জনগণ তখন ঠিকই বুঝে নিয়েছিল কেনো এই জরুরী অবস্থা, কেনো এই সরকার পরিবর্তন এবং কাদের স্বার্থে এই নির্বাচন। কিন্তু জনগণ অবাক বিস্ময়ে দেখলেন এই সব ঘটনার মোজেজাটা বুঝতে পারলেন না খালেদা জিয়াসহ তার জোটভুক্ত শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীরা! ষড়যন্ত্রমূলক সেই নির্বাচনের বিরোধিতা না করে খালেদা জিয়ার জোট সেই পাতানো খেলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন সব বুঝেশুনেই যে এই নির্বাচনের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো। ফলে অতি সহজেই সম্ভব হয়েছিল ২০০৮ সালের পাতানো খেলার নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় ভারতের স্বার্থে। সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার জন্যই দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জিতিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই নির্বাচনের পরিণতি আজ দেশবাসী শুধু যে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাই নয়, দেশের মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীকেও নির্জীব ও পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আজ অনেকাংশে লুটিয়ে দিয়েছে ভারতের নিকট নব্য লেন্দুপ দর্জি সম্প্রদায়।সর্ববিবেচনায় একটি অপরিমেয় সম্ভাবনার দেশ ও জাতিকে সুপরিকল্পিত ভাবে ধংসের মুখে ঠেলে দিয়ে পরভৃত করদ কিংবা অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে তোলার চক্রান্ত বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে ভারতীয় চাণক্যরা প্রণীত নীলনকশা অনুযায়ী। মদদ যোগাচ্ছে তাদের বিদেশী শক্তিধর দোসররা। কিন্তু লেখকের অভিমত, ‘জাতীয়তাবাদ আর ধর্মীয় মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন’ বিরোধীজোট যদি ওই পাতানো খেলার নির্বাচনের বিরোধিতা করে নির্বাচন বয়কট করতো তাহলে কোনোক্রমেই আওয়ামীলীগকে এ ধরণের বিজয় পাইয়ে দেয়া সম্ভব হতো না। বিরোধী জোটের সেই ধরণের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভারত ও তার বিদেশী মুরব্বীরা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করতো বটে তবে সেই সরকার বৈধতা পেতো না, জনগণও মেনে নিতো না সেই উদ্ভট নির্বাচনের ফলাফল। এই সামান্য বিষয়টি বোঝার মতো প্রজ্ঞার অভাব ছিল কি বিরোধী জোটে? এটা মেনে নেয়া দুষ্কর, কারণ এই সাধারণ কথাটা বোঝার জন্য কোনও রকেট সায়েন্সের দরকার হয় না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, কোনও স্বার্থ কিংবা লেনদেনের কারণেই শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের বিজয় এবং বিজিত সরকারকে বৈধতা প্রদানের জন্যই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী জোট ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল? এই প্রশ্নের জবাবও খুঁজে পেতে হবে দেশবাসীকে।
প্রেসিডেন্ট হবার পর চরিত্রহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী জেনারেল এরশাদকে জেনারেল জিয়া নিজেই সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দিয়ে ভেবেছিলেন চারিত্রিকভাবে দুর্বল দুর্নীতি পরায়ণ এরশাদ তার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে তার অনুগত পোষা হয়েই থাকবেন। কিন্তু জিয়া বুঝতে পারেননি কিংবা তাকে বুঝতে দেয়া হয়নি যে ভারতে NDC Course করাকালেই তার রুমমেট এক ভারতীয় কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবের মাধ্যমে এরশাদ নিজেকে RAW-এর কাছে বিকিয়ে দিয়ে দেশে ফিরেছেন। জিয়া যখন দেশের একছত্র অধিপতি হয়ে ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন তখন তারই বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান এরশাদ পর্দার অন্তরালে সামরিক বাহিনীতে জিয়া বিরোধী উষ্মাকে বিভিন্নভাবে হাওয়া দিয়ে উস্কে দিচ্ছিলেন নাটের গুরু হয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এর সহায়তায়। ভারত সরকার আর RAW-এর মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী-বাকশালীদের সাথেও জেনারেল এরশাদের গাঁটছড়া বেঁধে দেয়া হয়। জিয়া ভারতের সাথে ডঃ কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মাধ্যমে গোপন সমঝোতা করার পরও, RAW তাকে হত্যা করার একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীর অনুমতিক্রমে। কিন্তু ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর শ্রী মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘জিয়া হত্যা’ পরিকল্পনা স্থগিত রাখার জন্য RAW-কে নির্দেশ প্রদান করেন। এ সমস্ত তথ্য ভারতের প্রচার মাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে RAW বেছে নেয় বিকল্প পথ এরশাদের মাধ্যমে। ক্ষমতার ঘোরে আচ্ছন্ন জিয়া এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো না।
বাংলাদেশে নীতি বিবর্জিত কুটুম্বিতার রাজনীতির স্বরূপ
নীতি বিবর্জিত শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য কুটুম্বিতার রাজনীতির রূপ কতটা কদর্য এবং ক্ষতিকর হতে পারে সেটার কিছু নমুনা বাংলাদেশের চলমান রাজনৈতিক ধারায় তরুণ প্রজন্মের ভাবনার খোরাক হিসাবে তুলে ধরতে চাই যাতে করে তারা বার বার প্রবঞ্চনার শিকারে পরিণত না হয়। জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতা দখল করে বসলেন তারই নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ। শেখ হাসিনা তাকে স্বাগত জানালেন। ভারতের সুতার টানে জেনারেল এরশাদ অনেক চেষ্টা করেও বেগম খালেদার জিয়ার সাথে কোনও রকম বোঝাপড়া করার সুযোগ পেলেন না।
কারণ হিসেবে বলা হয়, খালেদা জানতেন, জিয়ার মৃত্যুতে এরশাদের হাত ছিল। অবশেষে ক্ষুব্ধ এরশাদ বিএনপির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন। খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত, পার্টির এবং সবগুলো অঙ্গ সংগঠনের ব্যাংক একাউন্ট তিনি জব্দ করতে আদেশ দেন। এতে পার্টির কাজ এগিয়ে নেয়া দুরূহ হয়ে ওঠে। এই ক্রান্তিলগ্নে বিএনপির ব্যারিস্টার মওদুদ, মোশাররফ হোসেন সহ অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা এরশাদের সাথে হাত মেলান বেগম খালেদা জিয়াকে ত্যাগ করে।
আশির দশকে জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে জনগণের মনোভাব বুঝে খালেদা জিয়ার বিএনপি, আওয়ামীলীগ এবং জামায়াতসহ অন্যান্য কয়েকটি দলের মধ্যে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হবার পর স্বৈরাচারী এরশাদ বিরোধী সংগ্রাম শুরু করেন তারা। জনসমর্থনে সেই সংগ্রাম যখন বেগবান হতে থাকে ঠিক তখনই সংগ্রামের পিঠে ছুরি মেরে আওয়ামী লীগ এবং জামায়াত এরশাদের দেয়া ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। যদিও হাসিনা চট্টগ্রামের জনসভায় উচ্চস্বরে ঘোষণা দিয়েছিলেন, ‘যারাই এরশাদের নির্বাচনে যাবে তারা সবাই হবে জাতীয় বেঈমান’। দেশবাসী হতবাক হয়ে যায় শেখ হাসিনার কুৎসিত আচরণ এবং বিশ্বাসঘাতকতায়। দুঃখজনক হলেও গোপন বোঝাপড়ার মাধ্যমে জেনারেল এরশাদের দেয়া টোপ গিলে কর্নেল ফারুক কর্নেল রশিদের পরামর্শে জেনারেল এরশাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে তৃতীয় স্থান দখল করে এরশাদের নির্বাচনকে বৈধতা দানে সাহায্য করে।
আমাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের বিষয়ে জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের অবস্থানে কোনও হেরফের হয়নি। চট্টগ্রামের জনসভায় শেখ হাসিনার ঘোষণার পর একরাতে এরশাদের নিমন্ত্রণে শেখ হাসিনা এক লং ড্রাইভে এরশাদের সফর সঙ্গিনী হয়েছিলেন। সেই লং ড্রাইভ কালেই ১৭ কোটি টাকার লেনদেনের মাধ্যমে হাসিনা এরশাদ বিরোধী আন্দোলন ছেড়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের ওয়াদা করেছিলেন। জামায়াতকেও কিছু উচ্ছিষ্ট দিয়ে লাইনে আনা হয়েছিলো। নির্বাচন হয়েছিলো, কিন্তু বিএনপি জোট সেই নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করায় পাতানো নির্বাচন বৈধতা পেতে ব্যর্থ হয়। ফলে আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত কর্মীদের চাপে সংসদ থেকে ইস্তফা দিতে বাধ্য হয়ে আন্দোলনে ফিরে আসে পালের বাতাস দেখে যাতে খালেদা জিয়া একাই সেই আন্দোলনের ফসল ঘরে তুলতে না পারেন।
‘৯১-এর নির্বাচনে জামায়াত খালেদার নেতৃত্বে নির্বাচনী মোর্চায় শরিক হয়। তাদের মূল দাবি ছিল নির্বাচনে বিজয়ী হলে তাদের আমীর প্রফেসর গোলাম আযমের নাগরিকত্ব ফিরিয়ে দিতে হবে। নির্বাচনে হেরে গিয়ে আওয়ামীলীগ নেত্রী হাসিনা সাংবাদিক সম্মেলন করে বলেন, একদিনের জন্যও খালেদা সরকারকে তিনি শান্তিতে থাকতে দেবেন না, করেছিলেনও তাই।
হাসিনার মদদে জাহানারা ইমাম এবং কর্নেল নুরুজ্জামান বীর উত্তমের নেতৃত্বে হঠাৎ করেই রাতারাতি গজিয়ে উঠল ‘ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি’ সংক্ষেপে ‘ঘাদানিক’। তারা প্রকাশ্য জনসভায় গণআদালতের রায় মোতাবেক প্রফেসর গোলাম আযমের কুশপুত্তলিকা দাহ করে। বিচলিত জামায়াত বিএনপি সরকারের উপর চাপ বৃদ্ধি করে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব প্রসঙ্গে। সৃষ্টি হল টানাপড়েনের। সেই মোক্ষম সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে হাসিনা গিয়ে মিলিত হলেন গোলাম আজমের সাথে ইন্দিরা রোডের এক বাড়ীতে গোপন বৈঠকে। উছিলাটা ছিল রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে তিনি তাদের দল সমর্থিত প্রার্থী জাস্টিস বদরুল হায়দার চৌধুরীর জন্য তার আশির্বাদ চান। এই প্রসঙ্গের আড়ালে আসল বিষয়টি উত্থাপন করলেন হাসিনা। তিনি বললেন, ‘ঘা দা নির্মূল কমিটি’ তারই প্রসূত। জামায়াত যদি আওয়ামীলীগের সাথে একজোটে সরকার বিরোধী আন্দোলন করতে রাজি হয় তাহলে তিনি ‘ঘা দা নির্মূল কমিটির’ পিঠে ছুরি চালিয়ে কোর্টের মাধ্যমে গোলাম আজম সাহেবের নাগরিকত্ব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করিয়ে দেবার ব্যবস্থা করবেন। জামায়াত খুশি মনে সব নীতি-আদর্শ জঞ্জালের মতো বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দিয়ে হাসিনার প্রস্তাবে রাজি হয়ে গেলো।
সিদ্ধান্ত হল, যুগপৎ সরকার বিরোধী আন্দোলন দুই দলের বিশেষ করে আওয়ামীলীগের পক্ষে বিব্রতকর হবে। তাই জামায়াত সরকার বিরোধী আন্দোলন করবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীন আগামীতে নির্বাচন করার দাবিতে, আর আওয়ামীলীগ একই সাথে আন্দোলন করবে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির সরকার যেটা তার প্রয়াত পিতাই সংবিধান পরিবর্তন করে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন সেটা নাকচ করে পার্লামেন্টারি পদ্ধতির সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার দাবিতে। ক্রমে এই দুই ইস্যুতে সরকার বিরোধী আন্দোলনকে সরকার পতনের আন্দোলনে রূপান্তরিত করে তোলা হবে। হাসিনা আরও জানালেন, জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন সুনিশ্চিত। সুবিধাবাদী জামায়াত হাসিনার টোপটি গলাধঃকরণ করলো। RAW-এর এই কূটচালে জামায়াত বিএনপির নির্বাচনী মোর্চা থেকে বেরিয়ে আসায় আওয়ামীলীগের ক্ষমতায় আসার পথ সুগম করে দেয়া হল জেনারেল এরশাদের জাতীয় পার্টির সমর্থন নিয়ে ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের পর। ১৯৯৬ সালের জুন মাসের সাধারণ নির্বাচনের আগে শেখ হাসিনার প্ররোচনায় ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি সংক্ষেপে ‘ঘাদানিক’ আদালতে একটি মামলা দায়ের করে গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বিতর্কের সূত্রপাত ঘটায়। পরবর্তী সময়ে সরকার বিরোধী আন্দোলনে সুবিধাবাদী জামায়াতে ইসলামের সাথে আওয়ামীলীগের চূড়ান্ত সমঝোতা এবং বোঝাপড়ার পর আওয়ামী ঘরানার ধর্মনিরপেক্ষ, সুশীল সমাজের মহারথী খ্যাত প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মাধ্যমে শেখ হাসিনা প্রফেসর গোলাম আজমের নাগরিকত্ব বহাল রাখার ব্যবস্থা করে দেন। এই হাবিবুর রহমান প্রধান বিচারপতি থাকার সুবাদে পরবর্তীকালে সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলটি পাশ করিয়ে নেয়া হয় বিএনপি সরকারের মাধ্যমে।১৯৯৬ এর ২৮শে মার্চ বিএনপি সরকার পদত্যাগ করলে আওয়ামীলীগের আশীর্বাদপুষ্ট প্রধান বিচারপতি হাবিবুর রহমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান হিসেবে নিযুক্তি পান এবং তার অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে বিজয়ী হয় আওয়ামীলীগ। ভোট বেশি পেয়েও বিএনপি পায় ১২০ টি সিট আর জামায়াত-এর সিট সংখ্যা ১৭ থেকে কমে ৩-এ এসে দাড়ায়। সেই সময় ক্ষমতার জন্য নিরুপায় হয়ে এরশাদের সমর্থন চেয়ে খয়রাত পেতে ব্যর্থ হন খালেদা জিয়া। জেলবন্দী এরশাদ ভারতের সুতোর টানে আওয়ামীলীগকেই সমর্থন দিয়ে হাসিনাকে প্রধানমন্ত্রী বানাতে বাধ্য হয়েছিলেন।
জামায়াতের রাজনীতি জন্মের পর থেকেই বিভ্রান্তিকর। পাকিস্তান আন্দোলন কালে জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা মওদুদী দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থন কিংবা বিরোধিতা না করে তার জন্মভূমি ভারতের দাক্ষিণাত্যেই থেকে যান। পরে তিরিশের দশকে হিজরত করে ভারত ছেড়ে পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাওলানা ডঃ ইকবালের আমন্ত্রনে। পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কাদিয়ানীদের অমুসলমান বলে ফতোয়া জারি করায় এক রক্তক্ষয়ী দাঙ্গা-ফ্যাসাদের সূত্রপাত ঘটে পাকিস্তানে। অনেক নিরীহ লোকের প্রাণহানি ঘটে সেই দাঙ্গায়। এই দাঙ্গায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে মাওলানা মওদুদীকে বন্দী করা হয় এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তবে কাকতালীয় ভাবে তিনি সেই যাত্রায় ছাড়া পেয়ে যান। এরপর থেকে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতি করে চলেছে। এর ভূরি ভূরি প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক ঘটনাপ্রবাহে।
ভারতের সাথে সমঝোতার ফলে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার পর ব্যালেন্সিং এ্যাক্ট হিসাবে জেনারেল জিয়া প্রফেসর গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। প্রফেসর গোলাম আজম শেখ মুজিবের মতোই পাকিস্তানী পাসপোর্ট নিয়েই পাকিস্তান থেকে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন। ফেরার পর জনাব গোলাম আজম জামায়াত-এর আমীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোনিবেশ করেন।সেই প্রক্রিয়ার একপর্যায়ে জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতাগ্রাসী জেনারেল এরশাদ ১৯৮৬ সালে আওয়ামীলীগে এবং জামায়াত এর সাথে সমঝোতা করে নির্বাচনের প্রহসনের মাধ্যমে তার অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন। এর পেছনেও কলকাঠি নেড়েছিল ভারত। কারণ, জেনারেল এরশাদ এবং আওয়ামীলীগের গলায় বাঁধা সুতো ভারতীয় চাণক্যদের হাতে। এরশাদের আনুকূল্য এবং আওয়ামীলীগের কাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পাবার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে অনুসরণ করে অংশগ্রহণ করেছিলো জামায়াতে ইসলামী। ক্ষমতা গ্রহণ করেই হাসিনা পিতৃহত্যার প্রতিশোধ গ্রহণ করার জন্য সংসদে দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই অবৈধ ভাবে একটি সাধারণ বিলের মাধ্যমে সংবিধানের ৫ম সংশোধনীর অংশ ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’ টি বাতিল করে সংবিধান লঙ্ঘন করে বেআইনিভাবে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘মুজিব হত্যা’ এবং ‘জেল হত্যা’ নামে দুইটি প্রহসনমূলক মামলা দায়ের করিয়ে সংশ্লিষ্ট অনেককেই কারাবন্দি করে শেখ হাসিনার সরকার। প্রথমে দুটি মামলাতেই আসামীদের তালিকায় এক নম্বর আসামী ছিলেন প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং দুই নম্বর আসামী ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। তাদের মৃত্যুর পরে মৃত বিধায় দু’জনের নামই আসামীদের তালিকা থেকে বাদ দেয়া হয়। রহস্যজনক ভাবে যখন অসাংবিধানিকভাবে ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’ বিলটি সংসদে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতায় বাতিল করা হয় তখন জামায়াতসহ বিএনপি জোট কোন প্রতিবাদ না করে মুখে কুলুপ এঁটে সংসদ থেকে বেরিয়ে আসে। প্রহসনমূলক এই বিচার প্রক্রিয়া গ্রহণযোগ্য হয়নি দেশের জনগণ এবং বিশ্ববাসীর কাছে। ৫ বছরের শাসনকাল সম্পূর্ণ করেও হাসিনা সরকার এই বিচার প্রক্রিয়া শেষ করতে সক্ষম হয়নি। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নাসিমের অধীনে লাঠি মিছিল, উচ্চ আদালতের বিচারকদের প্রতি সরকারের তরফ থেকে হুমকি-ধামকি এবং নানাবিধ চাপ প্রয়োগ করার পরও উচ্চ আদালতের বিবেকবান কয়েকজন বিচারক এই বিচার কাজ পরিচালনা করতে বিব্রত হওয়ায় বিচার প্রক্রিয়া অসমাপ্ত রেখেই সরকারকে বিদায় নিতে হয়েছিলো। বিদায়ের আগে প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী গোলাম আজমের নাগরিকত্বের বিষয়টির সমাধান অবশ্য করে দিয়েছিলো শেখ হাসিনার সরকার নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে। ১৯৯৬ সালের শিক্ষা নিয়ে ২০০১ সালে জামায়াত আবার বিএনপি-এর জোটে যোগদান করায় বিএনপি জোট দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে বিজয়ী হয়ে আবার ক্ষমতায় আসীন হয়। কিন্তু ক্ষমতায় এসেও তাদের তরফ থেকে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের নেতাদের বিরুদ্ধে সংবিধান বিরোধী যে অন্যায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু করা হয়েছিল তার কোনও প্রতিকার করা হল না ‘ইনডেমনিটি এ্যাক্ট’টিকে পুনর্বহালও করা হল না।‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’কে নতুন করে ইনডেমনিটি দেয়া হলেও ৫ম সংশোধনীর অংশ ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি পুনর্বহাল করা থেকে বিরত থাকলো বিএনপি জোট সরকার। শুধু তাই নয়, উচ্চ আদালতের দেয়া রাজনৈতিক আসামী হিসেবে তাদের ক্লাস দেবার আদেশটাও কার্যকর করা থেকেও বিরত থাকে বেগম খালেদা জিয়ার জোট সরকার। এভাবেই দেশপ্রেমিক জাতীয় বীর মুক্তিযোদ্ধা বিপ্লবী সেনা অফিসার যারা দেশ ও দেশবাসীকে বাকশালী একদলীয় স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জীবনবাজি রেখে মুক্ত করে মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকারের সূর্যতোরণ খুলে দিয়েছিল নির্মোহ হয়ে তাদের ফাঁসিতে ঝোলাবার পথটি খোলা রেখে পাঁচ বছর ক্ষমতা ভোগ করে মেয়াদ শেষে বিদায় নিয়েছিল ‘জাতীয়তাবাদ আর ইসলামী মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন’ খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোট সরকার।
২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়ে ক্ষমতা গ্রহণ করেই হাসিনা সরকার সর্বপ্রথম যে বিষয়টিকে প্রাধান্য দিলেন সেটা হল বিডিয়ার হত্যাযজ্ঞ। পরিকল্পিত ভাবে বিডিআর হত্যাযজ্ঞ ঘটিয়ে ৫৭ জন সেনা অফিসারকে নির্মম ভাবে হত্যা করা হয় ভাড়াটে ভারতীয় কমান্ডো আনিয়ে। চাকুরিচ্যুত করা হল দুই শতেরও বেশি প্রতিবাদী সেনা অফিসারকে। এরপর বয়োজ্যেষ্ঠতার তোয়াক্কা না করে পছন্দসই জুনিয়র দু’জন উকিলকে সুপ্রিম কোর্টে নিয়োগ দিয়ে চীফ জাস্টিস সমেত ৫ সদস্যের একটি বেঞ্চ গঠন করা। সেই বেঞ্চের ৫ জনের মধ্যে ২ জনই ছিলেন হিন্দু সম্প্রদায়ের। তাদের একজন ছিল সুরেন্দ্র কুমার সিনহা। বেঞ্চ আসামীদের করা রিভিউ পিটিশন খারিজ করে দিয়ে একই দিনে তড়িঘড়ি করে আইন বহির্ভূত ভাবে বিচার কার্যক্রম সম্পূর্ণ হওয়ার অপেক্ষা না করেই ২৮ শে জানুয়ারি ২০১০ সাল, প্রত্যুষে একে একে ৪ জন সূর্যসন্তানকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলিয়েদিয়ে হত্যা করা হয়। হাসিনার উপস্থিতিতেই তারই আদেশে কাশিমপুর থেকে আনা জল্লাদের দ্বারা নৃশংসভাবে জবাই করে মেজর বজলুল হুদাকে শহীদ করা হল কারাগারের একটি কামরায়। এই পাশবিক হত্যাকাণ্ডকে বিশ্বপরিসরে শীর্ষস্থানীয় প্রচার মাধ্যমগুলো আখ্যায়িত করেছিলো, ‘Political trail, miscarriage of justice and Judicial Murder of Hasina’.
এই দুইটি ন্যক্কারজনক হত্যাকাণ্ডের মূল উদ্দেশ্য ছিল জাতির মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীতে দেশপ্রেম, ’৭১ এর চেতনা, নৈতিকতা, দেশবাসীর প্রতি সহমর্মিতা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের অবসান ঘটানো যাতে করে নতজানু সামরিক বাহিনীকে সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী হিসাবে দেশ ও জনস্বার্থের বিপরীতে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীসমূহ এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের স্বার্থরক্ষার্থে ব্যবহার করা সম্ভব হয়।
এটাকে সমঝোতার রাজনীতির একটি জ্বলন্ত দেশ বিরোধী নিদর্শন বললে কি ভুল বলা হবে? এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সম্পর্কে বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ভেবে দেখতে হবে। এই সমস্ত দল আর এদের নেতা-নেত্রীরা নিশ্চয়ই দেশের জনগণকে গরু-ছাগল ভাবেন। তারা মনে করেন, দেশের জনগণকে বেকুব বানিয়ে ফায়দা হাসিল করা অতি সহজ। কিন্তু তারা ভুলে যান সাধারণ মানুষদের কিছু সংখ্যক লোককে কিছুদিনের জন্য বোকা বানানো সম্ভব হলেও সর্বকাল সবাইকে বোকা বানানো সম্ভব নয়। দুর্নীতিবাজ নেতা-নেত্রীদের বিরুদ্ধে বিচারের কথা উঠলে, বিদেশে টাকা পাচারের বিচারের কথা উঠলে এরা সবাই থাকেন নিশ্চুপ। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে তারা সভা, মিটিং মিছিল, প্রেস কনফারেন্স করে মাঠ গরম করে ফেলেন। কিন্তু দেশ এবং জাতীয় স্বার্থবিরোধী কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে থাকবেন নিশ্চুপ কিংবা দেবেন একে অপরকে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সমর্থন যদি সেটা তাদের গোষ্ঠীস্বার্থ এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের জন্য প্রয়োজন হয়!
আওয়ামী জোট ছাড়াও চারদলীয় বিএনপি জোটের এই ধরণের দ্বৈততা দেশবাসী এবং দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীতে বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। যে কারণে এখন মুখে মুখে শোনা যায় খালেদা জিয়া আর শেখ হাসিনা ‘মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ’। চারিত্রিকভাবে এই দুই জোটের রাজনীতিতেও কোনও পার্থক্য নেই। এই ধরনের মনোভাবের কারণেই বেগম খালেদা জিয়াকে যখন তার শহীদ মইনুল রোডের বাড়ী থেকে হেস্তনেস্ত করে বিব্রতকর ভাবে উৎখাত করা হয় তখন সামরিক বাহিনীতে কোনও প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়নি।
দেশবিরোধী এই ধরনের ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ বসে থাকা সম্ভব হয়নি সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দের পক্ষে। কয়েকজন নেতা প্রবাসে ফেরারী হয়ে থাকা অবস্থাতেও তাদেরই উদ্যোগে বিডিআর এর হত্যাযজ্ঞের পর সর্বপ্রথম তথ্যবহুল একটি লিফলেট ‘জাগো দেশবাসী বাঁচাও বাংলাদেশ’ ও একটি ভিডিও ডকুমেন্টারির সিডি দেশবাসী এবং বিদেশের মিডিয়া জগতে বিলির ব্যবস্থা করা হয়। ইমেইল করা হয় ৫ হাজারেরও বেশি অ্যাড্রেসে।বিডিআর চক্রান্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠিও পাঠানো হয় তাকে জবাবদিহি করে। সেটার কপিও দেশবাসীর মধ্যে হ্যান্ডবিল আকারে বিতরণ করা হয়। কাজগুলো খুব বড় না হলেও সেই সন্ধিক্ষণে এই দায়িত্বটি গ্রহণ করা খুব একটা সহজ ছিল না। এর জন্য অনেক তরুণ-তরুণীকে লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিলো। ঐ সব দেশপ্রেমিকদের তাদের দুঃসাহসিকতা ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে শুধু লেখককেই নয়, দেশবাসীকেও। এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যে সমস্ত তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সবাই বর্তমান প্রজন্মের। তাই যারা হতাশায় ভোগেন আর ভাবেন বর্তমান প্রজন্মের সবাই পচে গেছে তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
বর্তমান প্রজন্মের প্রতিজনের বিবেকেই রয়েছে একটি স্ফুলিঙ্গ। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে পরীক্ষিত নেতৃত্বের অধীনে জাতীয় স্বার্থে তারাও সৃষ্টি করতে পারে দাবানল। যার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে ঘুণেধরা রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থা। একই সাথে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বিদেশী সুতোর টানে নেচে চলা নট-নটীরাও চলে যেতে পারে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস এভাবেই একদিন সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি প্রতিশ্রুতিশীল নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যার ভিত্তি হবে ‘৭১-এর প্রকৃত চেতনা, স্বকীয় জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ। সম্ভব হবে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের আলোকে প্রতিষ্ঠিত করা আইনের শাসন, মানবধিকার, সুষম রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ ব্যবস্থা। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে স্বকীয় ঐতিহ্যবাহী, স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল, সুখী-সমৃদ্ধশালী এবং প্রগতিশীল একটি জাতি হিসাবে।
বিডিআর এর বর্বরতার পর সবকিছু জানা সত্ত্বেও বিএনপি এবং জামায়াত দু’টি দলই রহস্যজনকভাবে এই ষড়যন্ত্রমূলক হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া থেকে বিরত থাকে। ঐতিহ্যবাহী এই বাহিনীটিকে বিলুপ্ত করে বিজিবি নামের এক নব্য ‘রক্ষী বাহিনী’ গড়ে তোলা হল দলীয় ক্যাডার দিয়ে তারও কোনও জোরালো প্রতিবাদ শোনা গেলো না বিরোধী জোটের পক্ষ থেকে। তাদের এই ধরনের নীরবতায় দেশবাসীর কাছে তাদের প্রচারিত নীতি-আদর্শ স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে থাকবে।
এরশাদের অবৈধ ক্ষমতা দখলকে সাংবাদিক সম্মেলনে খোলাখুলিভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন শেখ হাসিনা এই বলে, ‘I am not unhappy’. রাষ্ট্রপতি আব্দুর রহমান বিশ্বাসের বিরুদ্ধে জেনারেল নাসিম যখন ক্যু’ করছিল তখনও শেখ হাসিনা তাকে উৎসাহিত করার জন্য প্রকাশ্যে সমর্থন জানিয়েছিলেন। দেশজুড়ে লগি-বৈঠার তাণ্ডব সৃষ্টি করে জবরদস্তির মাধ্যমে জরুরী অবস্থা জারি করিয়ে ইন্দো-আমেরিকান বলয়ের প্রত্যক্ষ সমর্থনে যখন জেনারেল মইন বন্দুকের জোরে অবৈধভাবে রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিনকে ক্ষমতাচ্যুত করে দেশে ফখরুদ্দিনের সরকার কায়েম করে সেই ক্ষমতা দখলকেও সমর্থন জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেছিলেন, এই পরিবর্তন নাকি তাদের সংগ্রামেরই ফসল।সরকার বদলের পর দেশে জরুরী আইনের আওতায় নির্বাচন করা হয় বিদেশী প্রভুদের অঙ্গুলি হেলনে ২০০৮ সালে। পাহাড়সম কারচুপির নির্বাচনে বিশাল বিজয়ের পর ‘উদ্দিনদের’ সরকারের সব ক্রিয়াকর্মকে সাংবিধানিক বৈধতাও প্রদান করেছিলো হাসিনার সরকার। জনগণ তখন ঠিকই বুঝে নিয়েছিল কেনো এই জরুরী অবস্থা, কেনো এই সরকার পরিবর্তন এবং কাদের স্বার্থে এই নির্বাচন। কিন্তু জনগণ অবাক বিস্ময়ে দেখলেন এই সব ঘটনার মোজেজাটা বুঝতে পারলেন না খালেদা জিয়াসহ তার জোটভুক্ত শীর্ষস্থানীয় নেতানেত্রীরা! ষড়যন্ত্রমূলক সেই নির্বাচনের বিরোধিতা না করে খালেদা জিয়ার জোট সেই পাতানো খেলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করলেন সব বুঝেশুনেই যে এই নির্বাচনের একমাত্র উদ্দেশ্যই ছিল আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় বসানো। ফলে অতি সহজেই সম্ভব হয়েছিল ২০০৮ সালের পাতানো খেলার নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয় ভারতের স্বার্থে। সাংবিধানিক পরিবর্তন আনার জন্যই দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জিতিয়ে আনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। সেই নির্বাচনের পরিণতি আজ দেশবাসী শুধু যে হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে তাই নয়, দেশের মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীকেও নির্জীব ও পঙ্গু করে ফেলা হয়েছে। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব আজ অনেকাংশে লুটিয়ে দিয়েছে ভারতের নিকট নব্য লেন্দুপ দর্জি সম্প্রদায়।সর্ববিবেচনায় একটি অপরিমেয় সম্ভাবনার দেশ ও জাতিকে সুপরিকল্পিত ভাবে ধংসের মুখে ঠেলে দিয়ে পরভৃত করদ কিংবা অঙ্গরাজ্যে পরিণত করে তোলার চক্রান্ত বাস্তবায়নের পথে এগুচ্ছে ভারতীয় চাণক্যরা প্রণীত নীলনকশা অনুযায়ী। মদদ যোগাচ্ছে তাদের বিদেশী শক্তিধর দোসররা। কিন্তু লেখকের অভিমত, ‘জাতীয়তাবাদ আর ধর্মীয় মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন’ বিরোধীজোট যদি ওই পাতানো খেলার নির্বাচনের বিরোধিতা করে নির্বাচন বয়কট করতো তাহলে কোনোক্রমেই আওয়ামীলীগকে এ ধরণের বিজয় পাইয়ে দেয়া সম্ভব হতো না। বিরোধী জোটের সেই ধরণের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে ভারত ও তার বিদেশী মুরব্বীরা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে আওয়ামীলীগকে ক্ষমতায় বসানোর চেষ্টা করতো বটে তবে সেই সরকার বৈধতা পেতো না, জনগণও মেনে নিতো না সেই উদ্ভট নির্বাচনের ফলাফল। এই সামান্য বিষয়টি বোঝার মতো প্রজ্ঞার অভাব ছিল কি বিরোধী জোটে? এটা মেনে নেয়া দুষ্কর, কারণ এই সাধারণ কথাটা বোঝার জন্য কোনও রকেট সায়েন্সের দরকার হয় না। তাহলে কি ধরে নিতে হবে, কোনও স্বার্থ কিংবা লেনদেনের কারণেই শুধুমাত্র আওয়ামীলীগের বিজয় এবং বিজিত সরকারকে বৈধতা প্রদানের জন্যই খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিরোধী জোট ষড়যন্ত্রমূলক নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল? এই প্রশ্নের জবাবও খুঁজে পেতে হবে দেশবাসীকে।
প্রেসিডেন্ট হবার পর চরিত্রহীন, দুর্নীতিগ্রস্ত, লোভী জেনারেল এরশাদকে জেনারেল জিয়া নিজেই সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগ দিয়ে ভেবেছিলেন চারিত্রিকভাবে দুর্বল দুর্নীতি পরায়ণ এরশাদ তার ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বী না হয়ে তার অনুগত পোষা হয়েই থাকবেন। কিন্তু জিয়া বুঝতে পারেননি কিংবা তাকে বুঝতে দেয়া হয়নি যে ভারতে NDC Course করাকালেই তার রুমমেট এক ভারতীয় কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবের মাধ্যমে এরশাদ নিজেকে RAW-এর কাছে বিকিয়ে দিয়ে দেশে ফিরেছেন। জিয়া যখন দেশের একছত্র অধিপতি হয়ে ক্ষমতার দাপটে ধরাকে সরা জ্ঞান করছেন তখন তারই বিশ্বস্ত সেনাপ্রধান এরশাদ পর্দার অন্তরালে সামরিক বাহিনীতে জিয়া বিরোধী উষ্মাকে বিভিন্নভাবে হাওয়া দিয়ে উস্কে দিচ্ছিলেন নাটের গুরু হয়ে ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW-এর সহায়তায়। ভারত সরকার আর RAW-এর মধ্যস্থতায় রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী-বাকশালীদের সাথেও জেনারেল এরশাদের গাঁটছড়া বেঁধে দেয়া হয়। জিয়া ভারতের সাথে ডঃ কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মাধ্যমে গোপন সমঝোতা করার পরও, RAW তাকে হত্যা করার একটা পরিকল্পনা প্রণয়ন করে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরাগান্ধীর অনুমতিক্রমে। কিন্তু ভারতে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করায় নির্বাচনে কংগ্রেসের ভরাডুবির পর শ্রী মোরারজী দেশাই প্রধানমন্ত্রী হয়ে ‘জিয়া হত্যা’ পরিকল্পনা স্থগিত রাখার জন্য RAW-কে নির্দেশ প্রদান করেন। এ সমস্ত তথ্য ভারতের প্রচার মাধ্যমেও প্রচারিত হয়েছে। এতে বাধ্য হয়ে RAW বেছে নেয় বিকল্প পথ এরশাদের মাধ্যমে। ক্ষমতার ঘোরে আচ্ছন্ন জিয়া এতোটাই অন্ধ হয়ে গিয়েছিলেন যে এই সমস্ত ষড়যন্ত্রের কিছুই তার দৃষ্টিগোচর হচ্ছিলো না।
জিয়ার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে
বিদেশে নির্বাসিত অবস্থায় থেকেও আমরা কিন্তু এ সম্পর্কে অনেক কিছুই জানতে পারছিলাম বিভিন্ন সূত্র থেকে। জিয়ার পায়ের নিচ থেকে অতিদ্রুত মাটি সরে যাচ্ছে সেটা পরিষ্কার হয়ে উঠেছিল আমাদের কাছে। দেশের ঈশান কোণে অশনি শংকেত, আর জেনারেল জিয়া তখন সারা বিশ্বে তার ভাবমূর্তি বাড়াবার প্রয়াসে ব্যস্ত! ইতিমধ্যে বেশ কয়েকটি সামরিক, বেসামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ডেলিগেশন গণচীন সফর করে গেছে। এখনও আসছে যাচ্ছে। সেই সব ডেলিগেশনে পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত আস্থাভাজন সহযোদ্ধা এবং বন্ধুরাও আসছেন যাচ্ছেন। তারাও জানিয়ে যাচ্ছিলেন ভেতরের অনেক গোপন খবরাখবর। সবারই প্রায় একই কথা জিয়ার দিন ফুরিয়ে আসছে। ব্যক্তি হিসাবে জিয়ার পরিণাম কি হবে, ক্ষমতায় থাকবেন না ক্ষমতাচ্যুত হবেন সেটা আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়। আমাদের ভাবনা ছিল জিয়ার তিরোধানের পর দেশের রাজনৈতিক মূলধারা কোন পথে অগ্রসর হবে! স্বাধীনতা এবং জাতীয় স্বকীয়তা টিকিয়ে রাখা সম্ভব হবে কি না! দেশটিকে অঙ্গরাজ্যে কিংবা করদ রাজ্যে পরিণত করবে নাতো আগ্রাসী ভারত ১৯৪৭ সালে ‘ভারত মাতার’ অঙ্গচ্ছেদ ঘটানোর প্রক্রিয়াতে বাংলাদেশী মুসলমানরা যে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো তার প্রতিশোধ নেবার জন্য!
শেষকালে যদি বাংলাদেশকে নেপাল অথবা ভুটানে পরিণত করা হয় তবে সেই গ্লানি মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার হিসাবে আমাদের পক্ষে মেনে নেয়া কি করে সম্ভব হবে! আমাদেরই অনুপ্রেরণায় সোনালি ভবিষ্যতের স্বপ্ন বুকে লালন করে হাসিমুখে শত শত মুক্তিযোদ্ধা নির্দ্বিধায় আমাদের নির্দেশ মেনে নিয়ে শাহাদত বরণ করেছেন। তাদের লালিত সেই স্বপ্ন যদি ব্যর্থ হয়ে যায় আর আমরা নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে থাকি তবে কি জবাব দেবো আল্লাহ্‌ এবং ঐসব বিদেহী আত্মাদের কাছে? আমাদের জন্য এই বিষয়টি একটি বড় নৈতিক প্রশ্ন হয়ে দাড়াল।
পিকিং হোটেলে খাওয়া দাওয়ার কিছুটা অসুবিধে হচ্ছিলো। তাই সেখান থেকে শিফট করলাম কাছেই সিন চাও হোটেলে। তখনকার সময়ে বেইজিং-এর দ্বিতীয় বৃহত্তম হোটেল। এই ঐতিহ্যবাহী হোটেলটার একটা বিশেষ তাৎপর্য রয়েছে। চীনের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবর্গ যখন বেইজিং-এ আসেন তখন তারা এই হোটেলেই অবস্থান করেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে আগত রাজনৈতিক ডেলিগেশনগুলোকেও এখানেই রাখা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন দেশের বিপ্লবী নেতা-নেত্রীদের অনেকেই রাজনৈতিক আশ্রিত হিসাবে এখানে বসবাস করছেন বহু বছর ধরে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে। তাই বিদেশী কোন সাধারণ অতিথিদের এখানে রাখা হয় না। স্থানীয় কূটনীতিকদেরও এই হোটেলে প্রবেশ করার বিষয়ে বাছবিচার রয়েছে। আমি এবং নিম্মিই একমাত্র ব্যতিক্রম। চীনা কর্তৃপক্ষ আমাদের এখানে থাকার অনুমতি দিয়েছিলেন কেনো? এর একমাত্র উত্তর হতে পারে বিশ্বাসযোগ্যতা। তারা হয়তো বুঝে নিয়েছিলেন আমি অন্যদের মতো পেশাদার কূটনীতিক নই। আমাকে ভিন্ন চোখেই দেখতেন চীনা কর্তৃপক্ষ তার প্রমাণ আমি পেয়েছি।
সেই সময় পিকিং-এর ৪০ বর্গমাইলের বাইরে কোনও কূটনীতিক যদি যাওয়ার ইচ্ছে প্রকাশ করতো সেক্ষেত্রে তাকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে যেতে হতো চীনা কর্তৃপক্ষের তত্ত্বাবধানে। কিন্তু আমার এ ধরনের সফরের বিষয়ে তারা ছিলেন উদার। যখন যেখানে যেতে চেয়েছি সেখানেই সপরিবারে বিশেষ অতিথি হয়ে যাবার সব ব্যবস্থা সাদরে তারা করে দিতেন। শুধু তাই নয়, সাথে দেয়া হতো অভিজ্ঞ এবং জ্ঞানী সফরসঙ্গী এবং চৌকস দোভাষী। সেই সময়ের ইউনান, উইঘুর, সিনচিয়াং, তিব্বত-এর মতো স্পর্শকাতর প্রদেশগুলোতেও যেতে দিতে তারা কখনোই কোনও আপত্তি করেননি। চীন-মঙ্গোলিয়া সীমান্তে আমুর নদীর উপত্যকায় সোভিয়েতের সাথে একটা ছোটোখাটো যুদ্ধের পর আমি সেখানে যেতে চাইলে সেখানেও আমাকে যেতে দিতে চীনারা রাজি হয়েছিলো। চৈনিক নেতৃবৃন্দ অবগত ছিলেন কূটনৈতিক দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আমি ব্যক্তিগত ভাবে গণচীনের ইতিহাস, বিপ্লব, নবচীনের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক অবকাঠামোর পুনর্বিন্যাস এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের অগ্রাভিযান সম্পর্কে বিস্তর পড়াশুনা ও গবেষণা করছি চীনের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ সম্পর্কে বোঝার ও জানার জন্য। আমি যখন চীনে গিয়েছিলাম তখন সময়টা চীনের জন্য ছিল একটি ক্রান্তিকাল। সেই সময় ধনতান্ত্রিক পশ্চিমা বিশ্ব এমনকি সমাজতান্ত্রিক সোভিয়েত ইউনিয়নও চীনের বিরুদ্ধে লৌহবর্ম তৈরি করার আপ্রাণ প্রচেষ্টা করে চলেছিল যাতে গণচীনকে দুর্বল করে রাখা যায়। তারা একযোগে চেষ্টা করছিল চীনকে খণ্ডিত করার জন্যও। কিন্তু পরীক্ষিত এবং অভিজ্ঞ চৈনিক নেতৃবৃন্দ আত্মবিশ্বাস, নৈতিকতা, প্রজ্ঞা, ঐতিহ্য, ঐতিহাসিক শিক্ষা, দূরদৃষ্টি, আত্মত্যাগের নিদর্শন স্থাপন করে সক্ষম হয়েছিলেন ঐক্যবদ্ধ জনগণকে সাথে নিয়ে শত্রুপক্ষের সব চক্রান্তের জাল বানচাল করে দিতে। সব ষড়যন্ত্র ও বাধা অতিক্রম করে গণচীন ধাপে ধাপে স্বনির্ভরশীল দেশ ও জাতি হিসাবে নিজেদের অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিল করার আপোষহীন যাত্রায় এগিয়ে চলেছিলো অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। সেই সময় থেকে আজঅব্দি তাদের অগ্রযাত্রাকে বন্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়নি কোনও বহিঃশক্তির পক্ষেই। লৌহবর্মের আবর্তে ঘেরা গণচীনে নিরাপত্তার জন্য তখন সব দূতাবাসকেই স্থানীয় স্টাফদের নিতে হতো একটি চৈনিক প্রতিষ্ঠান থেকে। প্রয়োজন মতো অভিজ্ঞ এবং দক্ষ জনদেরই পাঠানো হতো দূতাবাসগুলোতে। তবে পদবীতে তাদের আসল পরিচয়টা কখনই জানা সম্ভব হতো না। তাদের মাধ্যমেই যেকোনো দূতাবাসের সব বিস্তারিত খবরাখবর এবং হাল-হকিকত পৌঁছে যেতো চৈনিক কর্তা ব্যক্তিদের কাছে সে বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। আমরা তখনও সিন চাও হোটেলেই অবস্থান করছিলাম। এরই মধ্যে ঘটে গেল এক ভয়াবহ অবিস্মরণীয় লোমহর্ষক ভূমিকম্প। এক রাতে হঠাৎ অদ্ভুত ঝাঁকুনি এবং কম্পনে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। সমস্ত ভবনটা সমুদ্রের উত্তাল তরঙ্গে দোদুল্যমান জাহাজের মতো দুলছে। ঘরের আসবাবপত্র এদিক সেদিক গড়াগড়ি খাচ্ছে! ভীষণ জোরদার এক ভূমিকম্প! অতিকষ্টে নিম্মিকে আঁকড়ে ধরে দরজা খুলে কোনোমতে সিঁড়ি ভেঙ্গে নিচের লনে পৌছাতে সক্ষম হলাম। অন্যরাও সবাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ক্রন্দনরত বাচ্চাকাচ্চাদের টেনে হিঁচড়ে কোন রকমে নিচে নামিয়ে আনতে ব্যস্ত। মধ্যরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙ্গে আচমকা দুর্যোগে সবাই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে ভয়ে আর শংকায় কাঁপছে। ভবনটা তখনও থেমে থেমে দুলছে। মাটির উপর দাঁড়িয়েও কম্পন অনুভূত হওয়ায় সবাই ভবন থেকে নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে জড়সড় হয়ে মাটিতে শুয়ে পড়লাম। কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় একে অপরের দিকে অসহায় ভাবে তাকিয়ে সান্ত্বনা দেবার চেষ্টা করছিলাম। কয়েকজন আতঙ্কে মূর্ছা গিয়েছিলেন। আমরা তাদের চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরিয়ে স্বাভাবিক করে তোলার চেষ্টা করছিলাম সাধ্য অনুযায়ী।
কয়েক মিনিটের ব্যাপার। তখনও মাঝে মধ্যে মৃদু ভূকম্পন হচ্ছে! এরই মধ্যে এ্যাম্বুলেন্স এবং ফায়ার ব্রিগেডের কর্মীরা এসে পড়েছেন। তারা আমাদের অল্প দূরে একটি মাঠে চলে যাবার জন্য অনুরোধ জানালেন। আমরা সবাই তাদের কথা মতো সেখানে চলে গেলাম। প্রায় একই সাথে এসে পৌঁছালো দুই ট্রাক PLA -এর সৈনিক বিভিন্ন প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম সাথে নিয়ে। দক্ষ কর্মীরা ধীরস্থির ভাবে পুরো ভবনটাতে তল্লাশি চালিয়ে দেখল কথাও কেউ রয়ে গেছে কিনা। কয়েকজন বয়স্ক নর-নারীকে মুমূর্ষু অবস্থায় উদ্ধার করে নিয়ে আসলো এবং তাদের এ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে পাঠিয়ে দিলো। সবাই এই অকস্মাৎ অপ্রত্যাশিত ঘটনায় বাকরুদ্ধ ও স্তম্ভিত হয়ে পড়েছিলাম। নিম্মি ক্রমাগত দোয়া-দুরুদ পড়ছে। জীবনে এক ভয়ঙ্কর লোমহর্ষক অভিজ্ঞতা! সেই রাতটা খোলা আকাশের নিচে মাঠে তাঁবুতেই কাটাতে হল। পরদিন জানতে পারলাম এই ধরনের তীব্র ভূমিকম্প চীনের ইতিহাসে আগে কখনও ঘটেনি। বেইজিং থেকে প্রায় ১৫০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত চীনের দুইটি বৃহত্তম শিল্প এবং বন্দরনগরী তিয়েন সিন ও শেন ইয়াং সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে গেছে। এই ঘটনার পর প্রায় দুই সপ্তাহ আমাদের তাঁবুতেই থাকতে হয়েছিলো। এই ভীতিকর অভিজ্ঞতা জীবনেও ভুলবার নয়। এই প্রচণ্ড ভূমিকম্পের খবর বিশ্বে প্রচারিত হলে জাতিসঙ্ঘ সমেত পৃথিবীর সবদেশই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো ক্ষতিগ্রস্তদের পুনর্বাসনের জন্য। কিন্তু চৈনিক নেতৃবৃন্দ কোনও বৈদেশিক সাহায্য নিতে অপারগতা জানায় কৃতজ্ঞতার সাথেই। চৈনিক জাতির আত্মমর্যাদা বোধ দেখে হতবাক হয়ে যায় বিশ্ববাসী! আমি সশরীরে গিয়েছিলাম ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দেখতে। অত্যন্ত মর্মান্তিক এবং হৃদয় বিদারক সেই দৃশ্য! দুটো শহরের একটিতেও কোনও অট্টালিকা দাড়ানো অবস্থায় দেখতে পেলাম না। সবই মাটির সাথে মিশে গিয়ে কংক্রিটের স্তূপে পরিণত হয়েছে। যেমনটি হয়েছিলো লন্ডনের অবস্থা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে জার্মান বোমারুদের আঘাতে। হাজার হাজার মানুষ মারা গেছে। লক্ষ লক্ষ আবাল বৃদ্ধ বণিতা হয়েছে বাস্তুহারা। কিন্তু কোনও আহাজারি নেই কোথাও। সবখানেই দেখলাম PLA এর সৈনিকদের সাথে সাধারণ নারী-পুরুষ, যুবক-যুবতী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে ত্রাণকার্যের সাথে সাথে পুনঃনির্মাণের কাজও চালিয়ে যাচ্ছে দিনরাত। সমগ্র দুনিয়াকে স্তম্ভিত করে দিয়ে চার বছরের মধ্যেই দুটো শহরকেই অত্যাধুনিক শিল্প-বন্দর নগরীতে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হয়েছিলো চীনা জাতি। এক অভাবনীয় বিস্ময়কর কীর্তি! দুঃখকে কি করে শক্তিতে রূপান্তরিত করতে হয় তারই এক বিরল নিদর্শন। সিন চাও হোটেলে থাকা অবস্থায় বিশ্বের অনেক দেশের বিপ্লবী পরিবারের সাথে আমাদের গভীর বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো। তারা সবাই ছিলেন রাজনৈতিক আশ্রয়প্রাপ্ত গণচীন সরকারের সম্মানিত অতিথি।
১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিএনপি দুই-তৃতীয়াংশের বেশী সিটে জিতে সরকার গঠন করে। সংসদে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী ভোটে প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ কর্তৃক জারিকৃত ইনডেমনিটি অর্ডিন্যান্সটি ইনডেমনিটি এ্যাক্ট হিসাবে পাশ হলে ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে সাংবিধানিক বৈধতা লাভ করে এবং সংবিধানের অংশে পরিণত হয়। এই সাংবিধানিক বৈধতা জেনারেল জিয়ার বিএনপিকে বাধ্য হয়েই দিতে হয়েছিলো। কারণ, তার রাজনীতির ভিত্তিই ছিল ১৫ই আগস্টের বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান এবং তার ধারাবাহিকতায় ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব। রাষ্ট্রপতি এবং সংসদ নির্বাচনে খন্দকার মোশতাক এবং রশিদ-ফারুককে অংশগ্রহণের কথার বরখেলাপ করার পর ফারুক দেশে ফিরে যায় প্রকাশ্যে রাজনীতি করার লক্ষে। কিন্তু জিয়া তাকে বিনা বিচারে কারাগারে নিক্ষিপ্ত করেন। এর প্রতিবাদে আমরা সবাই চাকুরিতে ইস্তফা দিয়েছিলাম। কিন্তু জেনারেল জিয়া আমাদের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করেননি। প্রায় দুই বছর কারাবন্দী করে রেখে তিনি ফারুককে মুক্তি দিয়ে দেশ থেকে বের করে দেন। এ থেকে একটা বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো, জিয়া কখনোই আগস্ট এবং নভেম্বর বিপ্লবের নেতাদের দেশে ফিরে খোলাখুলি রাজনীতি করতে দেবেন না নিজের, আওয়ামীলীগ এবং ভারতের স্বার্থেই।
এই পরিপ্রেক্ষিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় দেশে জিয়া প্রচলিত পাতানো খেলার রাজনীতির বিপরীতে ‘৭১-এর চেতনা এবং স্বপ্নকে বাস্তবায়িত করার জন্য সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির ভিত্তিতে গোপনে একটি তৃতীয় রাজনৈতিক ধারা সৃষ্টি করতে হবে। আমাদের এই সিদ্ধান্তের প্রতি অভূতপূর্ব সমর্থন পাওয়া গেলো দেশের সর্বমহলের প্রকৃত দেশপ্রেমিক, ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদীদের কাছ থেকে। এরপর আমরা পার্টি গঠনের কাজ কি করে এগিয়ে নেয়া যায় সেই বিষয়ে বিশেষ গুরুত্বের সাথে চিন্তা-ভাবনা করতে শুরু করলাম।
নিজেদের ভুল বুঝে ক্ষমা চেয়ে রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করার ইচ্ছা প্রকাশ করলো রশিদ এবং ফারুক।কর্নেল ফারুক জিয়ার আমলে তার অনুমতি না নিয়ে দেশে ফেরার মাশুল হিসাবে বছর দুয়েক জেল খাটার পর রশিদ আমাদের সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। সবার অনুমতি সাপেক্ষে আমি তার সাথে এক গোপন বৈঠকে বসতে রাজি হলাম। বৈঠকে রশিদ অতীতের সব তিক্ততার জন্য ক্ষমা চেয়ে বললো
লিবিয়া ছাড়ার আগে তোরা যা বলে এসেছিলি সেটাই একমাত্র বাস্তব পন্থা। জিয়ার মুখোশ উন্মোচনের অন্য কোনও বিকল্প নেই। বর্তমানে তার অপ-রাজনীতির মোকাবেলা করাও সম্ভব একমাত্র রাজনীতির মাধ্যমেই, সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে বর্তমানে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব নয়। এটা এখন আমি আর ফারুক বুঝতে পেরেছি। এই ধরনের কোনও উদ্যোগ তোদের পক্ষেই নেয়া সম্ভব। যদি তোরা নেবার চিন্তা-ভাবনা করে থাকিস তবে আমরাও তোদের সাথে একত্রে কাজ করতে রাজি আছি।
রশিদ, তোদের স্বীকারোক্তিতে আন্তরিকতা রয়েছে ধরে নিয়েই বলবো, তোদের দেশপ্রেম সম্পর্কে আমাদের কোনও সন্দেহ নেই। তাই আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সফল আগস্ট এবং নভেম্বরের বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়েছিলাম। ভবিষ্যতে যদি আমরা কোনও রাজনৈতিক উদ্যোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নেই তবে সেই উদ্যোগে তোদের অংশগ্রহণের সদিচ্ছাটাও প্রশংসনীয়। তোদের এই প্রস্তাবটা গ্রহণীয় কিনা সেটা সবার সাথে আলাপের পরই জানাবো। তবে এই ধরনের কোনও রাজনৈতিক উদ্যোগে প্রাথমিকভাবে প্রয়োজন বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য-সহযোগিতার। বিশেষ করে প্রচুর অর্থের দরকার যেটা দেশ থেকে যোগান দেয়া সম্ভব নয়। এর যোগানের ব্যবস্থা করতে হবে বাইরের ধনী বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোর সহমর্মী নেতাদের কাছ থেকেই। এই বিষয়ে আমাদের জন্য মোয়াম্মর গাদ্দাফিই হতে পারেন সবচেয়ে নির্ভরশীল সাহায্যকারী এবং যোগসূত্র। আমরা জানি তোদের একার পক্ষে আর্থিক সহযোগিতা পেলেও রাজনীতি করার চেষ্টা সম্ভবত ফলপ্রসূ হবে না। সেটা ইতিমধ্যে তোরা হয়তো বুঝেও থাকতে পারিস। আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের পর উপযুক্ত সময়ে এই বিষয়ে পরিষ্কার বোঝাপড়ার জন্য ত্রিপাক্ষিক বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনা করা যেতে পারে।
ঠিক আছে, ফিরে গিয়ে আমরা তোদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় থাকবো। গাদ্দাফিকেও সেটাই জানিয়ে রাখবো। এভাবেই বৈঠক শেষে ফিরে যায় রশিদ।
কয়েক দিনের মধ্যেই ঐক্যমতের ভিত্তিতে তাদের প্রস্তাব গ্রহণ করে কর্নেল রশিদকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। জবাব পেলাম, ত্রিপাক্ষিক বৈঠকের ব্যবস্থা শিগ্রি করার তাগিদ দিয়েছেন গাদ্দাফি। অল্প কয়েকদিনের ব্যবধানে বৈঠকের ব্যবস্থা করা হল।ঐ বৈঠকে বিস্তারিত আলোচনার পর গাদ্দাফি সম্মত হলেন আর্থিক জোগানসহ আনুষঙ্গিক সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদান করতে। তাছাড়া তিনি বিভিন্ন দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিশ্বাসযোগ্য নেতাদের সাথেও আমাদের পরিচয় করিয়ে দেবার অঙ্গীকারও করেন। এটা ছিল একটি বিশাল সাফল্য। এরপর থেকে নিজেদের কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে আমরা ঘন ঘন বিভিন্ন জায়গাতে গোপন বৈঠকে মিলিত হয়ে রাজনৈতিক সংগঠনের কাজকে দ্রুত গতিতে এগিয়ে নিয়ে চললাম। জনগণের মধ্যে আমাদের নীতি-আদর্শ এবং ম্যানিফেস্টোর গ্রহণযোগ্যতা এবং ব্যাপক সমর্থনের ফলে পার্টির সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে চলেছিল আশাতীত ভাবে। জিয়া আমাদের এই কার্যকলাপ সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানতে পারছিলেন না, তবে তিনি বুঝতে পারছিলেন তার ভুল পথে চলার জন্য সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তা ক্রমেই কমে আসছে। জনগণের মধ্যে তার নিজস্ব ভাবমূর্তি বাড়াবার জন্য তার নিজস্ব ক্রিয়াকর্ম সম্পর্কেও বিভিন্ন প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে।
সেই সন্ধিক্ষণে জেনারেল জিয়া জানালেন তিনি আবার চীন সফরে আসছেন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে। এই সফরকালে তিনি দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং তার রাজনীতি নিয়ে আমার সাথে বিশদ আলোচনা করতে বিশেষভাবে আগ্রহী। কিন্তু আমি সেই ধরনের কোনও আলোচনা করতে ইচ্ছুক ছিলাম না। তার সফরের ব্যাপারেও এবার আমি ছিলাম উদাসীন। এবারের সফর হবে ৪৮ ঘণ্টার। চীন সফরের পর তিনি যাবেন পিয়ং ইয়ং সফরে উত্তর কোরিয়ায়। তিনি ফোনে বিশেষভাবে অনুরোধ জানালেন এই সফরকালে আমি যেন তার এই দুই দেশ সফরে সার্বক্ষণিক সঙ্গী হই। জবাবে আমি তাকে জানিয়েছিলাম, সেটা আমার পক্ষে এই যাত্রায় সম্ভব হবে না। কারণ, এই সফরকালে পূর্ব আয়োজিত এক সফরে আমাকে পিকিং-এর বাইরে যেতে হবে অন্য একটি প্রদেশে। এই বিষয়ে সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত হয়ে গেছে বিধায় সেটা এখন বাতিল করার কোনও উপায় নেই। আমার জবাবে তিনি বুঝতে পারলেন আমি তাকে এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করছি। তাই হয়তো তিনি জানালেন এবারের সফরে তিনি আব্বাকে ডেলিগেশনের উপ-প্রধান করে নিয়ে আসছেন। সঙ্গে আন্টি এবং আমার বোনেরাও সফরসঙ্গী হয়ে আসছে যেহেতু বেগম খালেদা জিয়াকেও তিনি সাথে করে রাষ্ট্রীয় এই সফরে আসছেন। আমি আমার সিদ্ধান্তে অনড় থেকে তাকে জানালাম, এতে কোনও অসুবিধে হবে না। পরিবারের সদস্যদের দেখাশোনা নিম্মিই কোরতে পারবে, কিন্তু আমার সফরসূচি বাতিল করাটা শোভনীয় হবে না এবং আমার অনুপস্থিতিতে তার সফরে কোনও কমতি বা ঘাটতি হবে না। তিনি চীনা নেতৃবৃন্দের কাছে সুপরিচিত। এভাবেই শেষ হয় আমাদের কথোপকথন।পরদিনই আব্বা ফোন করলেন। তিনি কিছুটা উষ্মার সাথেই বললেন
এই সফরকালে জিয়া তোর সাথে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনার জন্য আমাকে সঙ্গে নিয়ে আসছেন, আর তুই তাকে জানিয়েছিস সেই সময় তোর পক্ষে বেইজিং এ থাকা সম্ভব হবে না। আমি শান্তভাবেই জবাবে আব্বাকে বললাম
হ্যাঁ, সেটাই আমি জানিয়েছি প্রেসিডেন্টকে। কারণটাও তাকে বুঝিয়ে বলেছি।
না, তোর সফরসূচি বাদ দিয়ে তার সাথে তোকে আলোচনায় বসতেই হবে। এটা আমার আদেশ হিসাবেই তোকে মেনে নিতে হবে। তিনি নিজে আমাকে বলেছেন, যে তোর সাথে তার আলোচনা করাটা নাকি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চতুর জিয়া আব্বাকে দিয়ে ফোন করিয়ে আমাকে বাধ্য করলেন যাতে আমি সফরকালে তার সাথে আলোচনায় বসি। আব্বার ফোনের পর আমার পক্ষে আর কিছুই করার ছিল না। নিরুপায় হয়ে আমার সফরসূচি বাদ দিয়ে পিকিং এই থাকতে বাধ্য হয়েছিলাম তার আগমনের অপেক্ষায়। প্রয়োজন মতো জেনারেল জিয়ার সফর সংক্রান্ত বিষয়ে যাই ঘটছিলো সেটা অন্য সাথী ভাইদেরকেও জানাচ্ছিলাম। ইতিমধ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কর্নেল শাহরিয়ার চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে জনশক্তি রফতানির ব্যবসা শুরু করেছে আবুধাবীতে একটি ট্র্যাভেল এবং রিক্রুটিং এজেন্সির অফিস খুলে। মেজর হুদা তখন কুয়েতে বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনীতিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলো। সেই সময় অহেতুক বিশেষ কারণ দর্শিয়ে হুদাকে দেশে তলব করা হয়। দেশের প্রতিকূল রাজনৈতিক অবস্থা বিবেচনা করে হুদা দেশে যাওয়া থেকে বিরত থাকে এবং চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে আবুধাবি হয়ে আত্মীয়ের নিকট কানাডা বেড়াতে চলে যায়।
রাষ্ট্রপতি হিসাবে জিয়ার গণচীনে দ্বিতীয় সফর
নির্দিষ্ট দিনে বিমানের একটি বিমান ভর্তি সফরসঙ্গী নিয়ে এসে পৌঁছালেন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান। ক্ষমতার দ্বন্দ্বে দুই দুইবার ক্ষমতা বলয় থেকে ছিটকে পড়া কমরেড দেং শিয়াও পিং চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর মৃত্যুর পর ‘গ্যাং অফ ফোর’ কে পরাস্ত করে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে এসে চীনা কম্যুনিস্ট পার্টির কাণ্ডারী হিসাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। তিনিই বিমানবন্দরে প্রেসিডেন্ট জিয়াকে অভ্যর্থনা জানান যদিও তখন চীনের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন হুয়ো গুয়ো ফেং। এয়ারপোর্টে জেনারেল জিয়া আমাকে উপস্থিত দেখে আশ্বস্ত হলেন। মনে মনে হয়তো ভেবে থাকবেন হক সাহেবের ফোনে কাজ হয়েছে। আমার সিদ্ধান্ত বদলাতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। শীতের শেষ সময় হলেও তখনো পিকিং-এর আবহাওয়া বেশ ঠাণ্ডা। কুয়াশাচ্ছন্ন হয়ে থাকে দিন-রাতের বেশিরভাগ সময়। সাথে সাইবেরিয়া থেকে আসা তীক্ষ্ন ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটা। প্রচলিত নিয়ম অনুযায়ী চীন সরকারের তরফ থেকে কমরেড দেং শিয়াও পিং সেই রাতেই রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দম্পতি এবং তার প্রতিনিধি দলকে রাষ্ট্রীয় ভোজে আপ্যায়নের নিমন্ত্রণ জানালেন ‘গ্রেট হল অফ দি পিপলস’ এ। চুন হান হাই-এর রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে ডেলিগেশনের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্রথামত দূতাবাসের সবাই এবং চীনে অবস্থানকারী সব বাংলাদেশীদের সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করা হয়েছে ঐ নৈশভোজে। আমি ও নিম্মি দু’জনই উপস্থিত। অভ্যাগত সব অতিথিদের বসানো হল একটা বিশাল হল ঘরে। আমি ও নিম্মি আব্বা এবং সফরে আসা পরিবারের সদস্যদের সাথে বসে আলাপ করছিলাম। হঠাৎ বেগম জিয়া নিম্মিকে ইশারায় ডেকে তার পাশে বসিয়ে আলাপে রত হলেন।অল্পক্ষণের ব্যবধানে জনাব দেং শিয়াও পিং, প্রধানমন্ত্রী হুয়ো গুয়ো ফেং ও অন্যান্য চৈনিক নেতাদের সাথে করে আমাদের সাথে মিলিত হলেন। উষ্ণ পরিবেশে পরিচয় পর্ব শেষ হবার পর ফটোসেশন শেষ করে চেইন স্মোকার কমরেড দেং শিয়াও পিং জিয়ার পাশে নির্ধারিত আসনে বসে দোভাষীর মাধ্যমে আলাপ শুরু করলেন। উপস্থিত সবাই আমরা নীরবে দোভাষীর বয়ান থেকে তাদের আলাপ আলোচনার বিষয়বস্তু মনোযোগ দিয়ে শুনছিলাম। ২০-২৫ মিনিট পর একজন পরিচারক সবাইকে সাথে করে খাবার ঘরে নিয়ে গেলো। অভ্যাগত সবাইকে যার যার নির্ধারিত আসনে বসিয়ে দিলো হাসিমুখে সুন্দরী পরিচারিকারা। মেইন টেবিলে গেস্ট অফ অনার রাষ্ট্রপতি জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়া। হোস্ট দেং শিয়াও পিং, প্রধানমন্ত্রী হুয়ো গুয়ো ফেং এবং আব্বার সাথে একই টেবিলে আমার আর নিম্মির বসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। খাওয়ার ফাঁকে টুকটাক কথাবার্তা চলছিল। এক সময় জেনারেল জিয়া জিজ্ঞেস করলেন
এক্সেলেন্সি, বয়স অনুপাতে আপনি নিজেকে এতটা স্বাস্থ্যবান রেখেছেন কি করে সেই রহস্যটা জানতে চাই। সবাইকে চমকে দিয়ে উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠে দেং জবাব দিলেন
মহামান্য রাষ্ট্রপতি, রহস্যটা হচ্ছে, আমি একজন চেইন স্মোকার আর আমি প্রাণ খুলে হাসি। বলেই আবার তিনি উচ্চকণ্ঠে হেসে উঠলেন। তার রসিকতাটা সবাই উপভোগ করলেন। তার এই জবাবে একটা সূক্ষ্ম ইঙ্গিত অনুধাবন করলাম আমি। বর্ষীয়ান ঝানু তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারী এই নেতা ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছেন জিয়া প্রাণ খুলে হাসতে অভ্যস্ত নন।
খাবারের শুরুতেই চীনা রীতি অনুযায়ী হোস্ট দেং শিয়াও পিং ছোট্ট একটি স্বাগত ভাষণ দিলেন। তিনি ভাষণে বললেন পরিবর্তনশীল ভৌগোলিক সীমানা অনেক ক্ষেত্রে জাতিগোষ্ঠীর মনঃপূত না হলেও তারা বিশ্বস্ত বন্ধু অবশ্যই বেছে নিতে পারে। চীনের মতোই বাংলাদেশের জনগণের রয়েছে প্রাচীন এক সভ্যতার ঐতিহ্য। এই দুই দেশের মধ্য দিয়ে বয়ে চলেছে প্রবলধারায় ব্রহ্মপুত্র নদ। এই স্রোতস্বিনীর পানি ও মহিমা চীন এবং বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী নির্বিঘ্নে উপভোগ করে আসছে অনাদিকাল থেকে। এই দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্বের সেতু গড়ে তুলেছিলেন পর্যটকরা। শ্রী অতীশ দীপঙ্কর নামের এক মনীষী বৌদ্ধধর্মের বাণী প্রচার করার জন্য চীনে এসেছিলেন প্রাচীন বাংলাদেশ থেকেই। সেই ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল লক্ষ-কোটি নাবাসী। পরবর্তীকালে ইসলাম ধর্মের বাণী নিয়ে ধর্মীয় প্রচারকরা চীনে এসেছিলেন বাংলাদেশ থেকেই। ইসলাম ধর্মের শান্তির বাণীতে আকৃষ্ট হয়ে এক সময় ৪০ কোটিরও বেশি চীনাবাসী ইসলাম ধর্মে দীক্ষিত হয়েছিল। তারা আজঅব্দি যার যার নিজস্ব ধর্ম পালন করে চলেছে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের সাথেই।গণচীন সম্প্রসারণবাদে বিশ্বাস করে না, এটা ঐতিহাসিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত সত্য। ছোট-বড় সব দেশের সাথে সমতা ভিত্তিক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গড়ে তোলা চীনা পররাষ্ট্রনীতির একটি মৌলিক নীতি। বাংলাদেশ এবং গণচীনের ঐতিহ্যবাহী সম্পর্ককে বহুমাত্রিকভাবে মজবুত করে তুলতে অতীতের মতো বর্তমান এবং ভবিষ্যতেও গণচীন আন্তরিকভাবেই চেষ্টা করে যাবে। আমাদের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক তিনটি স্তরে গড়ে তোলা হয়। ‘রাষ্ট্রের সাথে রাষ্ট্রের, জনগণের সাথে জনগণের, পার্টির সাথে পার্টির। এটা আপনার প্রথম সফরের সময়ও আমাদের পক্ষ থেকে আপনাকে জানানো হয়েছিল।
এরপর তিনি প্রেসিডেন্ট জিয়ার চীন সফরের সাফল্য এবং জিয়া দম্পতি ও সফর সঙ্গীদের এবং উপস্থিত সবার সুস্বাস্থ্য কামনা করে টোষ্টে সবাইকে যোগদানের আবেদন জানিয়ে পানীয়র গ্লাস তুলে নিয়ে বললেন, ‘কাম্বে’ মানে পাত্র খালি করুন। এর জবাবে প্রতিনিধিদলের নেতা হিসাবে জিয়া বললেন
দ্বিতীয় বারের মতো চীন সফরের সুযোগ পেয়ে তিনি আনন্দিত। আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের সাহায্য-সহযোগিতার জন্য আমরা আন্তরিক ভাবেই কৃতজ্ঞ। কিন্তু ভারতের সাথে আমাদের রয়েছে কিছু মৌলিক দ্বন্দ্ব। এইসব দ্বন্দ্বের সমাধানের জন্য বাংলাদেশকে হতে হবে আত্মনির্ভরশীল। সদ্যস্বাধীন যুদ্ধ বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে একটি স্বনির্ভর দেশ হিসেবে গড়ে তোলার জন্য মহান গণচীনের কাছ থেকে অনেক কিছুই শেখার রয়েছে। বাংলাদেশের প্রগতির জন্য চৈনিক নেতৃবৃন্দ এবং চীন সরকারের কাছ থেকে সব রকমের সাহায্য-সহযোগিতা পাওয়ার আশ্বাসকে তিনি অভিনন্দন জানাচ্ছেন। সময়ের আবর্তে দুই দেশের মধ্যে বন্ধুত্বের বন্ধন আরও জোরদার হবে বলে তিনি আশা ব্যক্ত করেন। ভারত পরিবেষ্টিত বাংলাদেশের জনগণ এবং তার সরকার গণচীনের সাথে সর্বক্ষেত্রে দৃঢ় ভিত্তির উপর সম্পর্ক জোরদার করার বিষয়টিকে বিশেষ গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করছে। এরপর তিনিও পানীয়র গ্লাস হাতে তুলে নিয়ে বললেন, ‘কাম্বে’।
এ ভাবেই শেষ হল নৈশভোজ। জিয়ার এই বক্তব্যের খসড়া আমিই লিখেছিলাম। জিয়া ভারত সংক্রান্ত কথাগুলো তার বক্তব্যে রাখতে চাইছিলেন না। কিন্তু আমার জোরালো যুক্তির জবাব দিতে না পেরে বাধ্য হয়েই তাকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও মেনে নিতে হয়েছিলো আমার লেখা খসড়াটা। এখানে সংক্ষেপে বাংলাদেশ, চীন এবং ভারতের চরিত্র নিয়ে কিছু আলোকপাত করা প্রয়োজন।
‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ নামে কোনও দেশের অস্তিত্ব ঐতিহাসিক ভাবে এই দক্ষিণ এশিয়া উপমহাদেশে কখনোই ছিল না। এই উপমহাদেশে নৃতাত্ত্বিক, ভাষা, ধর্ম, সাংস্কৃতিক ভাবে ভিন্ন ভিন্ন জাতিগোষ্ঠী তাদের নিজস্ব অঞ্চলে গড়ে তুলেছিল প্রাচীন সভ্যতা। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি এই ভূখণ্ড অস্ত্রবলে দখল করে নেবার পরই এই অঞ্চলে ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ নামের একটি দেশের জন্ম দেয়। এরপর এই উপমহাদেশ ছেড়ে যাবার সময় বহুজাতিক এই ভূখণ্ডে দ্বিজাতি তত্ত্ব ভিত্তিক ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন এবং ইসলামিক রিপাবলিক অফ পাকিস্তান নামের দুইটি রাষ্ট্র সৃষ্টি করে তারা এলান করে, দেশীয় রাজন্যবর্গের অধীন রাজ্যগুলো তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী ইন্ডিয়া কিংবা পাকিস্তানের সাথে যোগ দিতে পারে কিংবা স্বাধীন সত্ত্বা বজায় রাখতে পারে। এই ভাবেই ধুরন্ধর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এই অঞ্চলের জাতিগত সমস্যার সমাধান না করেই প্রস্থান করে। তাদের চলে যাবার পর কাশ্মীর, জুনাগড়, মানভাদার, হায়দ্রাবাদ এবং ত্রিপুরা পাকিস্তানের অংশ হতে চাইলে তাদের সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইন্ডিয়ান ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত করে নেয় ভারতের শাসকগোষ্ঠী। গোয়া, দমন, দিউও দখল করে নেয়। আসাম, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, মণিপুর, অরুণাচল, মেঘালয় স্বাধীনতা দাবি করে। সেই সময় থেকে আজঅব্দি এইসব আঞ্চলিক স্বাধীনতা সংগ্রামগুলোকে সামরিক বাহিনী মোতায়েন করে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন রেখে নির্মূল করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে আসছে সব কয়টি কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু তাদের সেই পাশবিক সামরিক অভিযানের মুখেও ওই সব জনগোষ্ঠীর স্বাধীনতার সংগ্রাম দিন দিন তীব্রতর হচ্ছে। তাছাড়া সৃষ্টি হচ্ছে আরও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতার দাবি। যেমন জবর দখল করে নেয়া জম্মু-কাশ্মীরের আজাদীর লড়াই, শিখদের খালিস্তানের দাবি, দাক্ষিণাত্যের চারটি প্রদেশ জুড়ে তামিল রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম। বিহার, ছত্রিশগড়, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, গুর্খাল্যান্ড এবং মধ্যপ্রদেশ জুড়ে মাওবাদীদের আন্দোলন। বর্তমানে ত্রিপুরাবাসীরাও লড়ছে স্বাধীনতার সংগ্রাম। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ যদিও নেপালকে স্বাধীনতা দিয়ে যায়। কিন্তু আগ্রাসী ইন্ডিয়া নেপালকে জন্মলগ্ন থেকেই একটি করদ রাজ্যে পরিণত করে রাখে অসম চুক্তির মাধ্যমে। পৃথিবীর একমাত্র ঘোষিত হিন্দুরাষ্ট্র নেপালও বর্তমানে ইন্ডিয়ার আধিপত্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। একই ভাবে সোচ্চার হয়ে উঠেছে আর একটি করদ রাজ্য ভুটান। ১৯৭৫ সালে সিকিম নামের স্বাধীন রাষ্ট্রটিকে কূটকৌশলে ক্ষমতালিপ্সু লেন্দুপ দর্জির মাধ্যমে অঙ্গীভূত করে নেয়ার পর সেখানের জনগোষ্ঠী এখন স্বাধীনতা পুনরুদ্ধার করার জন্য সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
ভারতীয় বুদ্ধিজীবী গোষ্ঠী এবং মিডিয়া বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর জোর প্রচারণা চালিয়ে বলার চেষ্টা করে যে বাংলাদেশের স্বাধীনতাতে ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ ভুল প্রমাণিত হয়েছে। কিন্তু লেখক মনে করেন, স্বাধীন বাংলাদেশ প্রমাণ করে উপমহাদেশ কখনই একক জাতিগোষ্ঠীর আবাসভূমি ছিল না, এটা ছিল বহুজাতির আবাস স্থল।
১৯৬২ সালে ইন্ডিয়া গণচীনের শক্তিকে বুঝতে না পেরে দেশটির বিরুদ্ধে সোভিয়েত প্ররোচনায় এক আগ্রাসী সামরিক অভিযান চালিয়ে শোচনীয় ভাবে পরাজিত হয়। গণচীনের সামরিক বাহিনী এই আচমকা আক্রমণকে সাফল্যের সাথে শুধু প্রতিহতই করেনি, তারা আকসাই চীন, লাদাখ এবং অরুণাচলের বর্ডার থেকে প্রায় ৪০০০ কিলোমিটারেরও বেশি ইন্ডিয়ার স্থলভাগ দখল করে নেহেরুকে জানান দেয় তিনি আলোচনায় বসতে রাজি কিনা। নেহেরু করজোড়ে গণচীনের প্রস্তাব মেনে নিলে, গণচীনের নেতৃত্ব তাদের বিজয়ী লালফৌজকে পূর্বের সীমান্তে ফিরিয়ে নিয়ে গিয়ে আলোচনায় বসেন। এখানে একটি কথা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য।
ব্রিটিশ কর্তৃক রচিত উপমহাদেশের উত্তরপশ্চিম সীমান্তের ডুরাণ্ড লাইন এবং উত্তরপূর্ব সীমান্তের ম্যাকমোহন লাইন বিতর্কিত বিধায় আজঅব্দি গণচীনের কাছে দুটোই অগ্রহণীয়। ১৯৭১ সালে ইন্ডিয়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছিল বটে, কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তারা ১৬০০০ কোটি টাকার পাকিস্তানীদের ফেলে যাওয়া যুদ্ধসম্ভার, মিল-ফ্যাক্টরি, স্বর্ণ-রৌপ্য, বন্দরে স্তূপীকৃত বিভিন্ন মালপত্র এবং কাঁচামাল লুট করে নিয়ে যায় মিত্রশক্তি হিসাবে। আগ্রাসী ভারত তৎকালীন প্রবাসী বাংলাদেশের অদূরদর্শী, নির্বোধ, দাসখত লিখে দেয়া মেরুদণ্ডহীন শাসকগোষ্ঠীর সৃষ্ট সুবর্ণ সুযোগটা লুফে নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল-
প্রথমতঃ তাদের চিরশত্রু পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দুর্বল করে তোলা।
দ্বিতীয়তঃ এরপর সদ্যস্বাধীন বাংলাদেশে একটি পুতুল সরকার বসিয়ে দেশটিকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করা। তারা তাদের পদলেহি রাজনৈতিক দলগুলোর মাধ্যমে সেই লক্ষ্য হাসিল করার চেষ্টা করে চলেছে স্বাধীনতা যুদ্ধের ঘোষণা হবার পর থেকেই।
বাংলাদেশকে তাদের অধীনস্থ রাখার প্রধান দু’টি কারণ রয়েছে।
প্রথমত- বাংলাদেশের স্থল, জল এবং আকাশ তাদের স্ট্র্যাটেজিক স্বার্থে যেভাবে খুশি ব্যবহার করার অধিকার অর্জন করা। দ্বিতীয়ত- এই ভূখণ্ডের অপরিমেয় সম্পদ কব্জা করে নেয়া। যাতে করে বাংলাদেশ কোনোক্রমেই স্বাবলম্বী হয়ে সমৃদ্ধশালী একটি রাষ্ট্রে পরিণত হতে না পারে। বাংলাদেশকে পরিণত করতে হবে সার্বিকভাবে একটি ভারত নির্ভর রাষ্ট্র হিসাবে। এমনটি না হলে, ইন্ডিয়াতে যে সমস্ত জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার লড়াই লড়ছে সেগুলো বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তাদের স্বাধীনতার সংগ্রামকে আরও বেগবান করে তুলবে। এর পরিণতিতে কৃত্রিম ‘ইন্ডিয়ান ইউনিয়ন’ এর বিলুপ্তি ঘটবে। চিরকালের মতো কবর চাপা পড়বে চাণক্যদের গ্রেটার ইন্ডিয়া (ভারত মাতা) প্রতিষ্ঠিত করার সাধ ও স্বপ্ন। এই বাস্তব সত্য সম্পর্কে প্রতিবেশী দেশগুলোর বুদ্ধিজীবী এবং রাষ্ট্রনায়কগণকে ভাবতে হবে বাস্তবতার নিরিখে। এই সম্প্রসারণবাদী আগ্রাসী শক্তিটির বিরুদ্ধে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের আবশ্যকতা একক প্রচেষ্টায় আঞ্চলিক মোড়লের আগ্রাসনের মোকাবেলা করা কোন দেশের পক্ষেই সম্ভব হবে না। এটা একটি অকাট বাস্তবতা।
গণচীন বিশ্বের সুপ্রাচীন সভ্যতার অন্যতম। এই জনগোষ্ঠীর রয়েছে ৪০০০ বছরের লিখিত ইতিহাস। প্রাচীন অন্য কোনও জাতিগোষ্ঠীর এ ধরনের লিখিত ইতিহাস আছে বলে আমার জানা নেই। তাদের ইতিহাসই সাক্ষী বহন করছে চীন কখনোই নিজ সীমানার বাইরে কোনও আগ্রাসী অভিযান চালায়নি। ‘চীন’ শব্দটি চয়ন করেছে বিদেশীরা। চৈনিক ভাষায় চীনকে বলা হয় ‘চুঙ্গয়্যো’- মানে ‘সভ্যতার’ কেন্দ্র।
এই বিবেচনায় পাঠকগণ বুঝতে পারবেন, সদা আগ্রাসী ইন্ডিয়ার বিরুদ্ধে নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রেখে স্বনির্ভরতার উপর ভিত্তি করে নিজেদের একটি সুখী-সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে গড়ে তোলার স্বার্থে গণচীনের মতো একটি উদীয়মান শক্তির সাথে ঐতিহাসিক কারণেই বর্তমানে যুগোপযোগী ভ্রাতৃসুলভ সুসম্পর্ক আরো গভীর করে তোলা ভীষণ তাৎপর্যপূর্ণ এবং অপরিহার্য প্রতিবেশী সব কয়টি দেশের জন্যই।
গণচীন বাংলাদেশকে ১৫ই আগস্ট সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর স্বীকৃতি প্রদান করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে দৃঢ়ভিত্তির উপর সর্বক্ষেত্রে এগিয়ে নেয়ার যে দ্বার খুলে দিয়েছিল কিন্তু দূরদর্শিতার অভাব, পশ্চিমা শক্তিগুলোর অনুকম্পার খায়েশ, পেট্রো ডলারের লোভ এবং ভারতের মন জুগিয়ে চলার রাজনীতির ফলে জেনারেল জিয়া সেই সুবর্ণ সুযোগের সদ্ব্যবহার করা থেকে দেশ ও জাতিকে বঞ্চিত করেছিলেন। সময়ের সাথে সেই সুযোগ পরবর্তী কালে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সদিচ্ছা এবং নানাবিধ দুর্বলতার কারণে ক্রমান্বয়ে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান পরাশক্তি গণচীন এবং বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেখা দিয়েছে আত্মঘাতী টানাপড়েন। ফিরে চলা যাক রাষ্ট্রীয় নৈশভোজে।
কমরেড দেং শিয়াও পিং সবাইকে নিয়ে খাবার ঘর থেকে বেরিয়ে গাড়ীর বহরের দিকে এগিয়ে চলেছেন বিদায় জানাতে। পথিমধ্যে আমি নিচু স্বরে আব্বাকে জিজ্ঞেস করলাম আপনি কি রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনে যাবেন নাকি বাসায়।ইতিমধ্যে আমরা হোটেল ছেড়ে ওয়াং ফু চিং-এর নির্ধারিত ফ্ল্যাটে এসে উঠেছি। জিয়া আমাদের কথাবার্তা শুনে বললেন না, হক সাহেবের সাথে তুমিও চলো অতিথি ভবনে, তোমার সাথে কিছু জরুরী আলাপ আছে। কথা শেষে হক সাহেবকে নিয়ে বাসায় যেয়ো। কমরেড দেং শিয়াও পিং আমাদের বাংলায় আলাপ করা দেখে আব্বার দিকে চাইলেন। আব্বা একটু বিব্রত ভাবেই বললেন
এক্সেলেন্সি, এ আমার বড় ছেলে। উত্তরে মৃদু হাসির সাথে সিগারেটে একটি লম্বা সুখটান দিয়ে জনাব দেং শিয়াও পিং বললেন জানি।
আপনার ছেলে দেশের একজন কৃতিসন্তান এবং জাতীয় বীর। চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্বমূলক দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ককে জোরদার করার জন্য এখানে আসার পর থেকেই আপনার যোগ্য সন্তান আন্তরিকতার সাথে আপ্রাণ প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার এই ধরণের উদ্যোগ প্রশংসার যোগ্য। চীনা নেতৃবৃন্দ তাকে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবেই মনে করে। আপনি অবশ্যই একজন গর্বিত পিতা।
আব্বার উপস্থিতিতে প্রথম রাতে জেনারেল জিয়ার সাথে আমার বৈঠক
জনাব তেং শিয়াও পিং এর বক্তব্য শুনে জিয়া খানিকটা চুপসে গেলেন বলেই মনে হল। কৌশলে তার সাথে আলোচনায় না বসার শেষ চেষ্টাটা কার্যকরী হল না। অগত্যা নিম্মির সাথে পরিবারের সবাইকে বাসায় পাঠিয়ে দিয়ে আমি আর আব্বা প্রেসিডেন্টের সাথে অতিথি ভবনেই পৌঁছালাম। জেনারেল জিয়া আমাদের দুইজনকে সাথে নিয়ে গিয়ে ঢুকলেন প্রেসিডেন্সিয়াল স্যুইটে, সাথে খালেদা জিয়া। আমাদের বসার ঘরে বসিয়ে তিনি এবং বেগম সাহেবা গেলেন পাশের বেডরুমে। অল্প সময়ের মধ্যেই তিনি ফিরে আসলেন পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে। আপনারাও টাই কোট খুলে আরামে বসুন। ঠিক সেই সময় কর্নেল অলি বীরবিক্রম কৌতূহল বশত দরজা অল্প খুলে ভেতরে উঁকি দিতেই জিয়া তার দিকে বিরক্তির দৃষ্টিতে তাকালেন। নিমিষে অলি দরজা বন্ধ করে কেটে পড়লো। এরপর তিনি তার ADC-কে ডেকে বললেন দুধ চায়ের ব্যবস্থা করে পাঠাতে। একই সঙ্গে নির্দেশ দিলেন, যতক্ষণ তিনি তার সাথে যোগাযোগ না করেন ততক্ষণ এখানে কাউকেই আসতে দেয়া হবে না। কন কল এলে সে যেনো মেসেজ নোট করে রাখে। নির্দেশ শুনে ADC দরজা বন্ধ করে দিয়ে বেরিয়ে গেলো। একটা সোফায় আমি আর আব্বা আর আমাদের বিপরীতে একটা সিঙ্গেল সোফায় মুখোমুখি জেনারেল জিয়া বসলেন। আমি আর আব্বাও টাই-কোট আর গলার বোতাম খুলে আরামে বসলাম। আমরা তিনজন ছাড়া ঘরে আর কেউ নেই, তবে পাশের ঘরে খালেদা জিয়া আড়ি পেতে আছেন কিনা জানা নেই। শুরুতেই বেশ নাটকীয়ভাবে জিয়া উঠে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে বললেন ডালিম, Can we forget and forgive and start afresh? A wired proposition indeed! অবান্তর আবদার। ক্ষণিক ভেবে বললাম
স্যার, রাজনীতি হচ্ছে দাবা খেলার মতো। এই খেলায় চাল দেবার আগে অবকাশ থাকে সময় নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করার। কিন্তু একবার চাল দেয়ার পর সেটা আর ফিরিয়ে নেয়া যায় না। যুদ্ধের সময় কোরআন শপথ করে আমরা সুস্পষ্ট নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচীর ভিত্তিতে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে স্বাধীন বাংলাদেশে আপোষহীন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে বাস্তবে রূপ দেবার জন্যই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে নিজেদের সংগঠিত করার উদ্যোগ নিয়েছিলাম। যার ফলশ্রুতিতে স্বাধীনতার পর সেই উদ্যোগের উপর ভিত্তি করেই আমরা গড়ে তুলেছিলাম গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ। আপনাকে সর্বসম্মতিক্রমে মধ্যমণি হিসাবে গ্রহণ করে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করার পর আপনি আমাদের বিস্মিত করে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমরা অপাংক্তেয় হয়ে পড়লাম। এর জন্য আপনি আমাদের দোষী সাব্যস্ত করতে পারবেন না কোনোক্রমেই। কারণ, এখনো আমরা সেই নীতি-আদর্শ এবং স্বপ্ন নিয়েই আপনার পছন্দসই নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছি। কর্নেল ফারুককে রাজনীতি করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে আপনি দেশে ফেরার পর তাকে অযৌক্তিক ভাবে জেলে পুড়লেন। এর প্রতিবাদে আমরা সবাই ইস্তফা দিয়েছিলাম, কিন্তু আপনি আমাদের ইস্তফা গ্রহণ করলেন না। এরপর আপনি হঠাৎ করেই আকস্মিক ভাবে আমাদের সেনাবাহিনী থেকে চিরস্থায়ী ভাবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে নিয়োগ দেন। এগুলো এখন ইতিহাস।
আমি আগেও আপনাকে বলেছি, আপনি ভারতের সাথে আপোষ করে বিজাতীয় শক্তিগুলোর পদলেহী জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের প্রতিভূ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে যে পথে এগুচ্ছেন সেই বিপদসংকুল পথে ক্ষমতার লড়াইয়ে দেশ এবং জনগণের কোন কল্যাণ তো হবেই না, বরং দেশ ক্রমশ সার্বিকভাবে এগুবে অরক্ষিত স্বাধীনতার দিকেই যার অপর নাম পরাধীনতা। ব্যক্তিগত ভাবে এই প্রক্রিয়াতে আপনার পরিণতিটাও হয়ে উঠতে পারে ভয়ঙ্কর। জোড়াতালি দিয়ে একটি ছিন্নবস্ত্রকে বেশীদিন পরিধান করা যায় না। তাছাড়া এককভাবে এখন পর্যন্ত আপনি যা কিছুই করেছেন সেটা যদি ইতিবাচক হয়ে থাকে তবে তার সব কৃতিত্ব একান্তভাবে আপনারই প্রাপ্য তাতে আমাদের কোনও অবদান নেই। আর যদি আপনার কৃতকর্ম নেতিবাচক হয়ে থাকে তবে তার সব দায়-দায়িত্ব শুধু আপনারই। যুক্তিসঙ্গত কারণেই এই বিষয়ে আমাদের কোনও দায়-দায়িত্ব নেবার প্রশ্ন ওঠে না। এই বাস্তবতায় সব বুঝেশুনে, অতীতের সবকিছু ভুলে গিয়ে একত্রে কাজ করার কোনও অবকাশ নেই, স্যার। আশা করি, আপনি আমার এই বক্তব্যের মর্মার্থ যথাযথ ভাবে অনুধাবন করতে পারছেন। তাছাড়া আমাদের সবশক্তি সুপরিকল্পিত ভাবে ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় আমাদের মতো কয়েকজন পঙ্গুকে সাথে নিয়ে আপনার কোনও লাভ হবে সেটা আমি মনে করিনা। তারপরও আপনি এই প্রস্তাবটা দিয়ে আমাকে কিছুটা অবাক করেছেন!তাছাড়া সহযোদ্ধাদের রক্তের উপর দিয়ে হেটে আপনার পাশে অবস্থান নেয়াটা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়! আমি কি বোঝাতে চাইছি সেটা আপনার পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। আপনি আমাদের প্রত্যেককেই খুবই ভাল করেই জানেন। আপনার অজানা নয় যে আমাদের কথা আর কাজে কোনও ফারাক নেই, সেই বিশ্বাসেই কথাগুলো বললাম। গভীর মনোযোগের সাথে গম্ভীরভাবে আমার কথাগুলো শুনছিলেন দেশের সর্বশক্তিমান কর্ণধার রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমান। পুরোটা সময় তিনি ছিলেন প্রায় নিশ্চুপ এবং বাকহীন।
আমি তো অতি আন্তরিকতার সাথেই অতীতের ভুলভ্রান্তি শুধরে নেবার জন্যই আবার তোমাদের সাথে নিয়ে কাজ করার আহবান জানাচ্ছি।
আপনার এই মহানুভবতা প্রশ্নবিদ্ধ নয় স্যার, কিন্তু যেই সমস্ত ভুলভ্রান্তি আপনি করেছেন সেগুলো শুধরে নেবার জন্য এবং যাদের পরামর্শে ভুলগুলো আপনার মাধ্যমে করানো হয়েছে তাদের মোকাবেলা করার ক্ষেত্রে ঢাল নেই তলোয়ার নেই কয়েকজন নিধিরাম সর্দার তেমন কিছুই করতে পারবে না। এর জন্য দেশের ৮-১০ কোটি জনগণের মাঝ থেকে সম্পদশালী এবং শক্তিশালীদেরই খুঁজে নিতে হবে আপনাকে। পেতে অসুবিধা হবে না। ইতিমধ্যেই পেয়েছেন অনেককেই। আরও অসংখ্য জন মধুকরের মত ভন ভন করে ঘুরপাক খাচ্ছে আপনার চারপাশে। স্যার, সাধারণ জনগণ তেমন ভাবে না জানলেও আপনি ভালভাবেই জানেন, আমরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। আমাদের বাঁচার প্রেরণা ধ্যান, জ্ঞান, সাধনা সবকিছুই দেশ ও জনস্বার্থ কেন্দ্রিক।
বুঝলাম সব, তোদের মধ্যে যেকোনো কারণেই হউক না কেন, কিছুটা Trust deficit সৃষ্টি হয়েছে। সেটা দূর করার জন্য তিনি যখন আন্তরিকভাবে আবার তোদের সাহায্য চাচ্ছেন এবং আবার একত্রিত হয়ে কাজ করার আবেদন জানাচ্ছেন, সেইক্ষেত্রে তোদের পক্ষে সেই আবেদনে সাড়া দেয়া সম্ভব নয় কেনো কথাটা আমার বোধগম্য হচ্ছে না। অনেক বিষয়ে অজ্ঞ আব্বা হঠাৎ কথার মধ্যে তার মনোভাব কিছুটা উষ্মার সাথেই প্রকাশ করলেন। জেনারেল জিয়া নিজেই আব্বাকে থামিয়ে দিয়ে বললেন
হক সাহেব, আপনি অনুগ্রহ করে ছেলে হিসাবে ডালিমের উপর কোনও কিছু চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করবেন না। He is much more matured than his age.
এরপর আব্বা চুপ হয়ে গেলেন। Well Dalim, I appreciate your straight talk to which you are used to. তবুও অনুরোধ জানাবো, অন্যদের সাথে যোগাযোগ করে আমার প্রস্তাব সম্পর্কে তোমাদের শেষ সিদ্ধান্তটা ঢাকায় এসে তুমি আমাকে জানাবে। ঢাকায় আসতে এ জন্য বললাম, যাতে সরেজমিনে আমি কি ধরনের রাজনীতি করছি সেটা পরখ করে তোমাদের সিদ্ধান্তটা জানাও। বেশ, আপনার প্রস্তাবিত অনুরোধ নিয়ে সহযোদ্ধাদের সাথে যোগাযোগ করে আলাপ করবো। তবে যোগাযোগ না করেই বলতে পারি আমি আপনাকে যা বলেছি অন্যরাও আমার বিশ্বাস তেমন ধারণাই পোষণ করে।
এভাবেই আমাদের সেই রাতের বৈঠক শেষ হল চা পর্বের সমাপ্তির পর। আব্বাকে নিয়ে বেরিয়ে আসছিলাম হঠাৎ প্রেসিডেন্ট বললেন
আগামীকাল রাতে আমরা আর একবার বৈঠকে বসবো ডিনারের পর।
ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দেখি প্রায় ৩ ঘণ্টা ইতিমধ্যেই কেটে গেছে। রাত অনেক হওয়ার পরও বাসায় ফিরে দেখলাম সবাই জেগে চুটিয়ে আড্ডা দিচ্ছে আমাদের ফেরার অপেক্ষায়। সারাদিনের ধকল, তার উপর এতো রাতঅব্দি মিটিং এ আব্বাকে বেশ ক্লান্ত দেখাচ্ছিল তাই মিটিং সম্পর্কে সবার সব কৌতূহলের অবসান ঘটালাম ছোট্ট জবাব দিয়ে। বললাম, নাটকের প্রথম পর্ব শেষ হয়েছে, শেষ অংক হবে আগামীকাল রাতে। আমার এই সংক্ষিপ্ত জবাবে সবাই কিছুটা হতাশ হয়েই যার যার ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লো।
পরদিন সকালে দ্বিপাক্ষিক অফিসিয়াল মিটিং হল। সেই মিটিং-এ কয়েকটা চুক্তি স্বাক্ষরিত হল বেসামরিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সাহায্য-সহযোগিতার। এরপর প্রতিনিধি দলকে নিয়ে যাওয়া হলো ‘গ্রেট ওয়াল অফ চায়না’ এবং ‘মিং টুমস’ দেখাবার জন্য। এরপর গাজীপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরির আকারের একটি ফ্যাক্টরি দেখানোর জন্য নিয়ে যাওয়া হল। রাতে রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবনেই নৈশ ভোজের আয়োজন করলেন PLA Foreign Relation Bureau প্রধান জেনারেল চেন সাই চিয়েন। তিনিও একজন Long March Veteran বর্ষীয়ান এবং অভিজ্ঞ নেতা। রাত ৮ টার মধ্যেই ভোজসভা সমাপ্ত হল। ভোজের পর সবাইকে লক্ষ করে জিয়া বললেন, সারাদিনের ধকলে আজ সবাই ক্লান্ত। অতএব সবাই বিশ্রাম নিন। আব্বাকেও বললেন আজকের বৈঠকে তিনি তাকে আর কষ্ট দেবেন না। তার কথায় আব্বাকে বাসায় পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা করা হল।
দ্বিতীয় বৈঠক
আমরা তার স্যুইটে গিয়ে গতরাতের মতোই রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসলাম। বুঝতে কষ্ট হল না, তিনি আজ গোপন কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলাপ করবেন। গতকালের মতোই চা পরিবেশিত হল। তিনি নিজেই চা বানিয়ে একটি কাপ আমার হাতে দিয়ে নিজের কাপটি হাতে তুলে নিয়ে মুখোমুখি বসলেন।
চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী ও বন্ধুত্ব দৃঢ় করার জন্য তোমার প্রচেষ্টা সম্পর্কে গতকাল খোদ জনাব দেং শিয়াও পিং যে ভাবে প্রশংসা করলেন সেটা আমারও গর্ব। এমনটিই ছিল আমার প্রত্যাশা। জবাবে বললাম
আমার প্রচেষ্টার চেয়ে চীনাদের দৃষ্টিভঙ্গী এবং তাদের নীতিভিত্তিক আগ্রহটাই এই ক্ষেত্রে বিশেষ ভাবে অবদান রেখেছে। আমি আমার সাধ্যমতো আন্তরিক ভাবে তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি এই অঞ্চলের স্থিতিশীলতার জন্য সুদূর প্রসারী চীন-বাংলাদেশের বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক বিশেষ তাৎপর্য বহন করে। আর একটি বিষয় আমি তাদের বোঝাতে চেষ্টা করেছি ভারতের শ্যেনদৃষ্টি এবং করাল থাবা থেকে বাংলাদেশের স্বকীয় স্বাধীন সত্তা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য চীনের সাথে বহুমাত্রিক বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ক গড়ে তোলা দুই পক্ষের জন্যই অপরিহার্য।
শোনো ডালিম, আমি অস্বীকার করবো না, যুদ্ধকালে তুমি যখন গোপনে কল্যাণীতে এসে আমার সাথে চাণক্যদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশার বিরোধিতার জন্য মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে তোমাদের গোপন সংগঠন এবং তার ভিত্তিতে স্বাধীনতার পর সেনা পরিষদ এর প্রয়োজনীয়তা এবং ভবিষ্যতে এই সংগঠনের নীতি-আদর্শ, কর্মসূচী এবং রাজনীতির রূপরেখা সম্পর্কে বিস্তারিত জানিয়েছিলে তখন আমি ভেবেচিন্তেই তোমাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করে যাবার শপথ নিয়েছিলাম। কিন্তু ৭ই নভেম্বরে এমন এক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যার ফলে অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনার জন্য আমাকে কিছু কঠিন সিদ্ধান্ত নিতে হয়। তবে আমি এখনো তোমাদের নীতি-আদর্শের ভিত্তিতেই রাজনীতি করার চেষ্টা করছি। তার প্রমাণ আমার ১৯ দফা কর্মসূচি। এটাতো সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ অনুযায়ী প্রণীত বর্তমানে এর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় পরিস্থিতির বাস্তবতায় আমাকে একটু ভিন্নপথে এগুতে হচ্ছে কিন্তু এখন আমি বুঝতে পারছি আমার কিছু পদক্ষেপ সেনাবাহিনীতে বিতর্কিত হয়ে উঠেছে। সেনাবাহিনীই আমার ক্ষমতার উৎস। সেইখানেই যদি আমি বিতর্কিত ব্যক্তি হিসাবে বিবেচিত হই আর আমার অবস্থান দুর্বল হয়ে পড়ে তাহলে জাতীয় রাজনীতিতে আমি এগুবো কি করে? মুখে কিছু না বললেও আমি বুঝতে পারছি তোমরা ক্রমশঃ আমার কাছ থেকে নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছো কেনো! চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে নিশ্চুপ হয়ে জিয়ার সাজানো বুলিগুলো শুনছিলাম আর ভাবছিলাম তিনি আসলে কি জানতে চাইছেন! চোখ তুলতেই দেখলাম জিয়া জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চেয়ে আছেন জবাবের প্রতীক্ষায়। পুরানো কাসুন্দি ঘাটছেন জিয়া তার সাফাই দিতে। আমার ঠিক প্রবৃত্তি হচ্ছিলো না, তবুও জবাব দিতে হবে। তাই বললাম
স্যার, আপনার বক্তব্যটা সঠিক নয়। আমরা নিজেদের দূরে সরিয়ে নিচ্ছি না, পরিকল্পিত ভাবে আমাদের দূরে সরিয়ে দেয়া হয়েছে। কোলকাতায় যখন আমি আপনার সাথে যোগাযোগ করি তখনই বুঝতে পারি আপনার জনযুদ্ধ এবং রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তাই আপনাকে প্রকারান্তরে কিছুটা জ্ঞান দিতে চেষ্টা করতাম। এখন আপনি দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং রাজনীতিও করছেন। তারপরও মনে হচ্ছে আপনার রাজনৈতিক জ্ঞানে কিছুটা ঘাটতি রয়ে গেছে। আজ তাই কিছু কথা বলতে চাই যদি অনুমতি দেন।
বলো।
‘রাজনীতি’ কথাটাকে দুই ভাবে রাজনৈতিক দর্শন এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানে দেখা হয়। ‘রাজার নীতি’ মানে ক্ষমতার রাজনীতি। ‘নীতির রাজা’ মানে শোষিত এবং নিপীড়িত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর রাজনীতি। আপনি যখন পাকিস্তান আর্মির ইন্টেলিজেন্স স্কুলে পড়েন তখন পাঠ্য তালিকায় একটা চটি বই ছিল। বইটি লিখেছিলেন ম্যাকিয়াভেলি। নাম ‘প্রিন্স’। ক্ষমতার রাজনীতির বাইবেল এই বইটি আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন, তাই ক্ষমতার রাজনীতি সম্পর্কে আপনাকে জ্ঞান দান করার কোনও প্রয়োজনীয়তা আছে বলে মনে করিনা। কিন্তু মনে হয়, নীতির রাজা-রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞানের কিছুটা অভাব আপনার রয়েছে। তাই সেই সম্পর্কেই বলতে চাই অবশ্য যদি আপনি এর প্রয়োজন অনুভব করেন। আমি চাইছিলাম প্রসঙ্গ পাল্টাতে। গম্ভীর জিয়া বুঝেই হউক আর না বুঝেই হউক জবাবে বললেন, তিনি জানতে ইচ্ছুক।
স্যার, আপনাকে বুঝতে হবে দেশ ও বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে রাজনীতিকে সফল করে তোলার জন্য তিনটি উপাদান মুখ্য।
১। নৈতিকতা এবং মূল্যবোধ ভিত্তিক একটি সঠিক রাজনৈতিক দর্শন ভিত্তিক দল যাতে প্রতিফলিত হতে হবে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর আশা এবং প্রত্যাশা।
২। পরীক্ষিত, নিঃস্বার্থ নিবেদিতপ্রাণ একটি নেতৃত্ব।
৩। সমাজের সব স্তর আর ক্ষেত্র থেকে তৈরি করা একদল প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী যারা জনগণের মাঝে মিশে পার্টির নীতি-আদর্শ কর্মসূচীকে যুক্তিসঙ্গত ভাবে প্রচার করে জনসমর্থন অর্জন করে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করবে বিপ্লবের পক্ষে।এই তিনটি উপাদান অর্জন করতে হয় সংগ্রামের মাধ্যমে। ক্ষমতার কেন্দ্রে অবস্থান করে এই তিনটি উপাদানের কোনোটাই হাসিল করা সম্ভব নয়। কারণ, ক্ষমতাধর ব্যক্তির আশেপাশে যারা ভিড় করে ক্ষমতা বলয়ে অন্তর্ভুক্ত হবার প্রত্যাশায়, তারা সবাই সেই ক্ষমতাধর ব্যক্তির নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচির সমর্থনে মুখে ফেনা তুলে ফেলার ক্ষেত্রে জঘন্য প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় বাহ্যিকভাবে কিন্তু তাদের বেশিরভাগই হয়ে থাকে বাস্তুঘুঘু, স্বার্থপর, সুযোগসন্ধানী, ধূর্ত শৃগাল আর হায়নার প্রতিভূ।
ক্ষমতায় আসীন হওয়ার পর তারা অতিসহজেই ‘নীতির রাজা’ রাজনীতিটাকে পালটে ফেলে ‘রাজার নীতি’ মানে ক্ষমতার রাজনীতিতে।
এই ধরনের রক্তচোষাদের কূটচক্রান্তে অনেক আন্তরিক ভাবে নীতি-আদর্শবান নেতাকে চরম মাশুল দিতে হয়েছে ইতিহাসে। সুতরাং যত বড় মাপের নেতাই হউন না কেনো, সবাইকে খুশি করে কেউই কখনো তার অভীষ্ট লক্ষ্য হাসিল করতে পারেননি। তাই সার্থক নেতা-নেত্রীদের সবাই সর্বদা সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়ে নিজেদেরকে সার্থক জাতীয় কিংবা রাষ্ট্রীয় সম্মানিত নেতা-নেত্রী হবার সৌভাগ্য অর্জন করতে পেরেছেন। শত্রুমিত্রের বাছ-বিচার না করে সহবাস করা আর পানিতে নেমে কুমিরের সাথে যুদ্ধ করার পরিণামটা হয় একই রকম। সেনাবাহিনীতে আপনার অবস্থান কি সে সম্পর্কে আমাদের তো কিছু জানার কথা নয়। সে সম্পর্কে আপনি নিজেই সবচেয়ে বেশি জানেন। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন দলছুট এবং বিভিন্ন মত ও পথের লোকদের জুটিয়ে যে দল আপনি বানিয়েছেন সেখানে স্বার্থের অন্তর্দ্বন্দ্ব একটি চিরস্থায়ী বাস্তবতা। সেই বিচারে আপনার দলটি কখনোই আপনার নিজস্ব নীতি-আদর্শ সেটা যাই হউক না কেনো, বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর মধ্যে দৃঢ়ভাবে শিকড় গাড়তে আন্তরিক হবে না। অবশ্য আপনার জনপ্রিয়তাকে কি করে ভাঙ্গিয়ে নিজেদের ভাগ্য ফেরানো যায় সেই বিষয়ে তারা হবে খুবই তৎপর, যতদিন আপনার জনপ্রিয়তা থাকবে। অতিদুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে স্যার, আইয়ুব, ইয়াহিয়া খানের ক্ষমতার রাজনীতির শোচনীয় পরিণতি যার ফলে একটি সম্ভাবনাময় মুসলিম দেশ ভাগ হয়ে গেলো, সেটা দেখার পরও আপনি সেই পথের অনুকরণ করে চলেছেন। এর পরিণতিটা কি হতে পারে সেটা বোঝার মতো ক্ষমতা আপনার আছে। তাই এ বিষয়ে জ্ঞানদান নিষ্প্রয়োজন। কাদের পরামর্শ আর উৎসাহে আপনি এই পথ বেছে নিয়েছেন জানিনা তবে এতটুকু বুঝি এর সব দায়-দায়িত্ব একান্তভাবে আপনাকেই নিতে হবে। ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না। জিয়াকে বেশ চিন্তিত দেখাচ্ছিল। মুখায়বে তার ছাপ স্পষ্টভাবেই ফুটে উঠেছিলো।
আচ্ছা, জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে তোমার কি ধারণা ?
স্যার, প্রশ্নটা আমাকে করায় কিছুটা বিস্মিত হলাম। আপনারা দু’জনই বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর সমসাময়িক অফিসার। অনেক বছর এক সাথেই চাকুরি করেছেন। তিনি আপনার পছন্দের নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান, তার সম্পর্কে তো আপনারই ভালো জানার কথা। আমার সাথে তার তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না পাকিস্তান আমলে। ১৯৭১ সালে আমরা যখন যুদ্ধে যোগদানের জন্য পালিয়ে আসি তখন তিনি পেশাওয়ারে ৬ষ্ঠ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট-এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন এটাই জানতে পেরেছিলাম। এরপর প্রত্যাগত অফিসার হিসাবে দেখা সাক্ষাৎ হতো মাঝে মধ্যে সেনাসদরে যখন ঢাকায় আসতাম। তার ব্যক্তিগত চরিত্র সম্পর্কে আমি যতটুকু জানি তার চেয়ে বেশি না হলেও আপনি কম জানেন না। স্যার, আপনি গোয়েন্দা সংস্থা ISI-তে চাকুরি করেছেন। আমি কিন্তু কোন গোয়েন্দা সংস্থাতে কখনোই কাজ করিনি। আপনি রাষ্ট্রপতি হবার পর জেনারেল এরশাদ যখন ভারতে NDC Course করছিলেন তখনই প্রথা বহির্ভূতভাবে তাকে ডবল প্রমোশন দিয়ে পরে সেনাপ্রধান বানিয়েছিলেন। বিশদ বিচার-বিবেচনার পরই আপনি এই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তেমনটি ধরে নেয়া অযৌক্তিক হবে না নিশ্চয়ই? যাই হউক, তার সম্পর্কে কিছু উড়ো কথা কানে এসেছে। সেটা শুনতে চাইলে বলতে পারি। অবশ্য কথাগুলো ইতিমধ্যে আপনার কানেও এসে থাকতে পারে।
আমি শুনতে চাই, তুমি বলো।
জেনারেল জিয়ার প্রশ্নগুলোর জবাব পাওয়ার উৎসুক্য দেখে শিশু ভাইয়ের একটা কথা মনে পরে গেলো। তিনি বলেছিলেন, যারা গোয়েন্দা সংগঠনে কাজ করে তাদের চরিত্রে সন্দেহ প্রবণতা এবং কান কথায় বিশ্বাস করার পবৃত্তি বাসা বাধে। পরে তার কোর্সমেট কর্নেল হামিদের লেখা বইতে জিয়া সম্পর্কে তিনি যা লিখেছেন সেটা শিশু ভাইয়ের বক্তব্যকেই সমর্থন করে। জিয়ার চরিত্র সম্পর্কে তিনি লিখেছেন, ‘জিয়া ছিলেন সন্দেহপ্রবণ মনের অধিকারী এবং কানকথায় বিশ্বাসী’। তাই কিছুটা সতর্কতার সাথেই বলা শুরু করলাম।
গুজবে প্রকাশ, এরশাদ যখন ইন্ডিয়াতে NDC করছিলেন তখন বিচক্ষণ ঝানু এক কূটনীতিক মুচকুন্দ দুবের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব হয়। ওই ব্যক্তিও তার সাথেই NDC করছিলেন। তার মাধ্যমে কোর্সকালীন সময় এরশাদের সাথে সাউথ ব্লকের ভারতীয় ক্ষমতা বলয়ের কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তির ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে। দুষ্ট লোকেরা বলে, ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW এবং South Block-এর শীর্ষস্থানীয় কিছু সংখ্যক ক্ষমতাধর ব্যক্তির সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন জনাব মুচকুন্দ দুবে যখন জানা গেলো দেশে ফিরে তিনি সেনাপ্রধান হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হতে যাচ্ছেন। তাদের বদৌলতে আমোদ-ফূর্তি করেই কোর্স শেষে এরশাদ দেশে ফেরার পর আপনি তাকে সেনাপ্রধানের পদে নিয়োগ প্রদান করেন। আমার কথাগুলো জিয়া শুনছিলেন আর গভীর ভাবে কি যেন ভাবছিলেন। সেনাবাহিনীতেও জিয়া Divide and Rule নীতি গ্রহণ করেছিলেন। এর ফল যে তার জন্য বিষফোঁড়া হয়ে উঠেছে সেটা চিন্তা করেই হয়েতো বা তার মুখটা একটু বেশি কালো দেখাচ্ছিল। কিছুটা অপ্রত্যাশিত ভাবেই জেনারেল জিয়া এরপর জিজ্ঞেস করলেন
আচ্ছা, জেনারেল মঞ্জুর সম্পর্কে তোমার ধারণা কি?
স্যার, এ ধরণের প্রশ্নের জবাব আমার চেয়ে শতগুণ বেশি আপনারই জানার কথা। সেই ক্ষেত্রে আমার মতামত জানতে চাচ্ছেন কেনো? তার সম্পর্কে আপনি যতটুকু জানেন তার চেয়ে বেশি কিছু আমার পক্ষে কি করে জানা সম্ভব! তবে Freedom Fighters এবং Repatriates দের মধ্যে ভারসম্যতা রক্ষার জন্য যে Divide and Rule নীতির প্রবর্তন আপনি করেছেন তার ফলে যে দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয়েছে সেটা দিন দিন গভীর থেকে গভীরতর হচ্ছে। আর এর পরিণতি কি হতে পারে সেটাও আপনার বুঝতে অসুবিধে হবার কথা নয়। একটা বাস্তবতা আপনাকে জানাচ্ছি। এতে আপনার কোনও সুবিধা হবে কিনা জানি না।
দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা সদস্যরাই সামরিক বাহিনীতে বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে সংখ্যাগরিষ্ঠ। সেক্ষেত্রে তাদের হীনমন্য এবং দুর্বল করাটা যুক্তিসঙ্গত নয় বলেই আমি মনে করি। জেনারেল পদে উন্নতি প্রদান করে এরশাদকে সেনাপ্রধান বানানোর আপনার সিদ্ধান্ত সঠিক হয়েছে সেটাও হয়তো বা বেশিরভাগ সেনাসদস্য এবং অফিসাররা মনে করছেন না বলেই আমার ধারণা। এই প্রসঙ্গে সত্যটা জানার জন্য আপনাকেই চেষ্টা করতে হবে। কারণ, এর চেয়ে বেশি কিছু আমার জানা নেই।
জেনারেল জিয়া বেশ কিছুক্ষণ চুপ থেকে আবারও অনুরোধ করলেন, সবার সাথে আলাপ আলোচনার পর তার প্রস্তাব সম্পর্কে আমাদের সিদ্ধান্ত জানাবার জন্য আমি যাতে ঢাকায় গিয়ে সরেজমিনে সবকিছু দেখেশুনে তার সাথে দেখা করে আমাদের সিদ্ধান্তটা তাকে জানাই। এভাবেই ৪৮ ঘণ্টার সফরকালে দুই রাতে প্রায় ৫ ঘণ্টার উপর তিনি আমার সাথে রুদ্ধদ্বার বৈঠক করলেন। তার এই বৈঠকের কারণটা ঠিক বোঝা না গেলেও তার বিরুদ্ধে বাংলাদেশে যে অশনি সংকেত ঘনীভূত হচ্ছে সেটা পরিষ্কার বোঝা গেলো। বাসায় ফিরে এলাম।
পরদিন তিনি তার সফর সঙ্গীদের নিয়ে উত্তর কোরিয়া সফরের উদ্দেশ্যে পিয়ং ইয়ং গিয়েছিলেন। সফরটি ছিল রাষ্ট্রীয় সফর। গ্রেট লিডার কিম ইল সুং এর সাথে সাক্ষাতের পর কয়েকটা দ্বিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। সেই সফরে আমার পূর্ব নির্ধারিত সফরের অজুহাত তুলে সঙ্গী না হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করলে জিয়া সেটা মেনে নিয়েছিলেন। এই সফরের পর জিয়ার অনুরোধে আমি বিভিন্ন দেশে অবস্থিত সহযোদ্ধাদের সাথে দেখা করি। কর্নেল রশিদ, কর্নেল ফারুক এবং মোয়াম্মর গাদ্দাফির প্রতিনিধি লেফটেন্যান্ট সালেমের সাথেও কয়েক দফা বৈঠক হয়। কর্নেল শাহরিয়ার তার এই প্রস্তাবকে একটি কূটচাল বলে অভিমত প্রকাশ করলো। তার ধারণা, মেজর হাফিজ, ক্যাপ্টেন শাহজাহান ওমর, লেফটেন্যান্ট ইকবাল প্রমুখদের যেভাবে তিনি নিজের মুঠিতে পুরেছেন ঠিক সেইভাবেই তিনি আমাদেরকেও তার মুঠিতে পুরে বেঁচে থাকা সেনা পরিষদের সদস্য এবং অফিসার আর সৈনিকদের কাছে আমাদের ভাবমূর্তি, জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধ্বংস করে দিতে চাইছেন যাতে আমরা ভবিষ্যতে আমাদের নিজস্ব রাজনীতি এগিয়ে নিয়ে তার প্রতিপক্ষ হয়ে দাড়াতে না পারি। অন্যান্যদের অভিমত, বর্তমানে জেনারেল জিয়ার অবস্থান সেনাবাহিনীর মধ্যে ক্রমশ দুর্বল হয়ে পড়ছে তার কৃতকর্মের ফলেই। সেইক্ষেত্রে তার মতো একজন প্রতারকের পাশে সেনা পরিষদের নেতাদের দাড়ানোটা হবে আত্মহত্যার সামিল। কারণ, এতে সেনা পরিষদ সহ সামরিক বাহিনীতে এবং রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলবো। এতে ইতি টানা হবে আমাদের এতদিনের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়নের সম্ভাবনা। স্বল্পভাষী মেজর নূর বললো
জেনারেল জিয়া ভরাডুবির আগে আমাদেরও শেষ করে দিতে চাইছেন। আমাদের আঁকড়ে ধরে বাঁচার চেষ্টা করছেন জিয়া এমনটি ভাবার কোনও যুক্তি নেই। তাছাড়া চাইলেও যেভাবে তিনি সেনা পরিষদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন, অতি নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছেন তিন হাজারেরও অধিক সহবিপ্লবীদের, তাদের রক্তের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াকে বাঁচানোর কোনও দায়-দায়িত্ব আমাদের পক্ষে নেয়া কোনও কারণেই ন্যায়সঙ্গত ভাবে গ্রহণ করা সম্ভব হতে পারে না। তাই আমি মনে করি, যে উদ্দেশ্যেই জিয়া এই প্রস্তাব দিয়ে থাক না কেনো, এ নিয়ে আমাদের এতোটা বিচার-বিশ্লেষণের কোনও প্রয়োজন নেই। সে আরও বললো, আমি তার সাথে আলাপ করে ভালোই করেছি। তবে একই সাথে নূর অভিমত প্রকাশ করলো, এবার ঢাকাতে গিয়ে আমাকে খুবই সতর্কতার সাথে চলতে হবে। কারণ, সে আমার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার বিষয়ে চিন্তিত। কিন্তু এরপরও আমাকে ঢাকায় যেতেই হবে এই ঝুঁকিটা নিয়েই তা না হলে জিয়া ভাববেন, তার বিরুদ্ধে যে অসন্তোষের ধূম্রজাল ঘনীভূত হচ্ছে সেখানেও সেনা পরিষদের সমর্থন রয়েছে। সন্দেহ প্রবণ মনের অধিকারী জিয়া ইতিমধ্যে এমনটি ভেবেও থাকেতে পারেন। যদি ভেবে থাকেন তাহলে এতে আশ্চর্য হবার কিছুই নেই।
আলোচনা শেষে সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গৃহীত হল, আমরা আমাদের পূর্ব সিদ্ধান্তে অটল থেকে রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করে যাবো। সবাই একবাক্যে অভিমত জানালো, জেনারেল জিয়ার প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়।এই সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতে আমি সবাইকে একটি বিষয় পরিষ্কার করে বলেছিলাম, আমাদের এই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যানের পর জিয়া আমাদের বিরুদ্ধে ক্ষিপ্ত হয়ে যেকোনো হঠকারী উদ্যোগ নিতে পারেন। তার জন্য সবাইকেই প্রস্তুত থাকতে হবে। আমাকে তো যেতেই হবে, তবে নিরাপত্তার কারণে আমি এবার বেশি দিন ঢাকায় থাকব না। জিয়াকে রিয়েক্সন টাইম না দিয়েই ফিরে আসবো। আর যদি একান্তই আমি ফিরতে না পারি তবে বাকি সবাই মিলে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তবে দেশে কেউই ফিরবে না ডাক আসলেও। সবাই এই ব্যাপারে একমত হল। সাথী সহযোদ্ধা ভাইদের সাথে সাক্ষাৎ ও আলাপ আলোচনার পর তাদের মতামত জেনে আমি ঢাকা অভিমুখে যাত্রা করলাম।
সেনা পরিষদের বেছে নেয়া নেতা-সদস্য ছাড়াও অন্যান্য মহলের পরিচিত বিশ্বস্তজনদের সাথে দুই একদিনের দেখা সাক্ষাতের পরই আমার কাছে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে গেলো। ভারতের কাছে জিয়ার প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে। সেনাবাহিনীর মধ্যেও তার পায়ের নীচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে দ্রুত। যদিও সাধারণ জনগণের কাছে তার সস্তা জনপ্রিয়তায় তখনও তেমন ধস নামেনি তবুও ক্ষমতার ষড়যন্ত্রে তার পর্বের সমাপ্তি সময়ের ব্যাপার মাত্র। আমি এই সুযোগে প্রগশের সাংগঠনিক অগ্রগতি প্রত্যক্ষ করে নিশ্চিত হলাম আমাদের টাইম ফ্রেম মোতাবেক প্রগশ জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় সহসাই আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে তৃতীয় শক্তি হিসাবে। সব দেখেশুনে ও বুঝে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার সাথে দেখা করে তাকে জানিয়ে দিলাম, সেনা পরিষদের বিদেশে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনকারী নেতারা মনে করছেন, তার প্রস্তাব মেনে নিয়ে তার সাথে একাত্ম হয়ে রাজনীতি করা এখন আর তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। সেইদিনই কাউকে না জানিয়েই ফিরে এলাম নিজ কর্মস্থল বেইজিং-এ। এরপর বেশ কয়েকটা বেসামরিক, সামরিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল চীন সফরে আসে। প্রতিনিধি দলের প্রায় সব সদস্যরাই পরিচিত। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সফরটি ছিল দেশের নব নিযুক্ত আর্মি চীফ জেনারেল এরশাদের সফর।
জিয়ার নিযুক্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের চীন সফর
সফরকালে তিনি একান্তে আমাকে জানালেন জিয়ার ভ্রান্ত রাজনীতি এবং সামরিক বাহিনীর মধ্যে অনেক ভুল সিদ্ধান্তের ফলে দেশে এক বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। যেকোনো সময়ে জিয়ার বিরুদ্ধে সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহ হতে পারে। তাই তিনি বিশেষভাবে চিন্তিত। তিনি এ ব্যাপারে জিয়াকে অবগত করার চেষ্টা করে বিফল হচ্ছেন। এই অবস্থায় তেমন কিছু ঘটলে সেনাপ্রধান হিসাবে তার কি করা উচিৎ সে বিষয়ে তিনি অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার মতামত জানতে চাইলেন। জবাবে আমি জেনারেল এরশাদকে বললাম
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশেই সামরিক বাহিনীর একজন সৈনিকের পক্ষে যেখানে রাষ্ট্রপতি হওয়ার অবকাশ রয়েছে সেখানে সেনাপ্রধান এর পদভারে আপনি তো অতি সহজেই জিয়ার গদিটা দখল করে নিতে পারবেন। এই বাস্তবতাটা আপনি ভালোভাবেই বোঝেন এবং তার জন্য আপনি প্রস্তুতিও নিচ্ছেন সেটা মনে করার যুক্তি রয়েছে তাই নয় কি, স্যার? আমার উত্তরটা শুনে জেনারেল এরশাদ সরাসরি একটা অনুরোধ জানালেন
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলেছো। জাতির ক্রান্তিলগ্নে সেনাপ্রধান হিসাবে আমার অনিচ্ছা সত্ত্বেও দেশের স্বার্থেই আমার উপর অর্পিত দায়ভার তো আমাকে নিতেই হবে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে তোমাকে বিশ্বাস করেই একটা অনুরোধ করতে চাই। আমি চৈনিক শীর্ষস্থানীয় গুরুত্বপূর্ণ নেতাদের দেশের বর্তমান আসল অবস্থাটা জানাতে চাই। যদি সেই রকমের কোনও পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটেই সেই ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে ক্রমবর্ধমান বন্ধুত্বমূলক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য তারা যাতে আমাকে তাদের বন্ধু হিসাবেই সমর্থন জানায় সে চেষ্টা তুমি করবে। তুমি নিশ্চয় আমার সাথে একমত হবে এই ধরণের স্পর্শকাতর বিষয় প্রতিনিধি দলের সাথে যে সমস্ত আনুষ্ঠানিক বৈঠক হচ্ছে সেখানে আলাপ-আলোচনা করা সম্ভব নয়। তাই শীর্ষস্থানীয় প্রভাবশালী নেতৃত্বের সাথে এই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি নিয়ে আলাপ-আলোচনার জন্য তোমাকে একটি গোপন বৈঠকের ব্যবস্থা করে দিতে হবে। আমি জানি সেই যোগ্যতা তোমার আছে।
ধূর্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ চৈনিক নেতৃবৃন্দের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা নিশ্চিত করতে চাচ্ছেন। তার মানে ড্রপসিন পড়ার দিন ঘনিয়ে এসেছে! পালাবদলের সন্ধিক্ষণে আগামীদিনের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তিকে সরাসরি মানা করে দেয়াটা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই বললাম
ঠিক আছে স্যার, আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করবো।
চেষ্টা নয়, এই বৈঠকের ব্যবস্থা তোমাকে করতেই হবে। মরিয়া হয়ে আবারও অনুরোধ জানালেন জেনারেল এরশাদ। বাংলাদেশ-গণচীনের সম্পর্কের ভবিষ্যৎ চিন্তা করেই বৈঠকটি হওয়া অতি প্রয়োজন বোধ কোরেই বৈঠকের ব্যবস্থার উদ্যোগ নেয়া যুক্তিসঙ্গত মনে হয়েছিলো। বৈঠকের আয়োজন হল। গোপন সেই বৈঠকে আমাকে উপস্থিত থাকতে অনেক পীড়াপীড়ি করেছিলেন জেনারেল এরশাদ। কিন্তু আমি তাতে রাজি হইনি। কারণ, আমি জানতাম বৈঠকের পর চৈনিক নেতারা আমাকে তাদের কথাবার্তার সবকিছু জানিয়ে এরশাদের বক্তব্যের উপর আমার মন্তব্য জানতে চাইবেন। হয়েছিল ঠিক তাই। চীনা নেতৃবৃন্দ বিশেষভাবে জানতে চেয়েছিলেন জেনারেল এরশাদের চরিত্র এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতা সম্পর্কে।জেনারেল এরশাদ চীনা নেতাদের বলেছিলেন, তিনি আন্তরিক ভাবেই বাংলাদেশ ও গণচীনের মধ্যে বহুমাত্রিক সম্পর্ক গড়ে তুলতে আগ্রহী। তবে ভারত সম্পর্কে তার মনোভাব জানতে চাইলে জেনারেল এরশাদ চীনাদের জানিয়েছিলেন, স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারতের প্রত্যক্ষ সাহায্য-সহযোগিতার জন্য বাংলাদেশের জনগণ ভারতের কাছে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞ। উপরন্তু ভারতবেষ্টিত বাংলাদেশকে ভারতের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে তোলার মাধ্যমেই আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতকরণ সম্ভব। তার এমন বক্তব্যের উপর আমার অভিমত জানতে চাওয়ায় আমি চৈনিক বন্ধুদের বলেছিলাম
জেনারেল এরশাদ পরিবারের মূল প্রোথিত রয়েছে ভারতের কুচবিহারের দিনহাটায়। এই প্রেক্ষাপটে কৃতজ্ঞতা জানানো আর সেবাদাস হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা বিসর্জন দিয়ে দেশটাকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার নীলনকশা বাস্তবায়নে ক্রিয়ানক হওয়ার মধ্যে তফাৎ রয়েছে। স্বাধীনতার আগে প্রবাসী সরকার গঠনের শর্ত হিসাবে যেই ৭দফা চুক্তি স্বাক্ষর করিয়ে নিয়েছিলো ভারত সরকার সেই চুক্তিকে পরিবর্ধন করে ২৫ বছর মেয়াদী অসম মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে একটি দাসখতই মনে করে বাংলাদেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠী একমাত্র আওয়ামীলীগ এবং বাকশালীরা ছাড়া। ভারত তার নিজের স্বার্থেই বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে বিশেষ করে শরণার্থীদের যেই পরিমাণ সাহায্য দিয়েছিল তার হাজার গুণ তারা সুদে আসলে বাংলাদেশ থেকে লুটে নিয়ে গিয়েছে। শুধু তাই নয়, তারা বিদেশ থেকে প্রেরিত সাহায্য সামগ্রীর সিংহভাগই আত্মসাৎ করে নেয় দুর্নীতিপরায়ণ প্রবাসী সরকারের সহযোগিতায়। তবে তাদের মূল দুটো সুদূরপ্রসারী লক্ষ্য রয়েছে
প্রথমটিঃ পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করে দেশটিকে দুর্বল করে তোলা।
দ্বিতীয়টিঃ বাংলাদেশ নামের একটি করদ রাজ্য কায়েম করে ভারতে চলমান বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী মুক্তি সংগ্রামীদের পয়গাম দেয়া যে, দক্ষিণ এশিয়ার কোনও ছোট স্বাধীন রাষ্ট্র কখনোই তাদের স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রেখে টিকে থাকতে সক্ষম হবে না ভারত-নির্ভরশীল হওয়া ছাড়া। অতএব, তাদের নিজস্ব স্বার্থেই উচিত হবে জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের পথ ত্যাগ করে বিশাল ভারতের অঙ্গরাজ্য হিসেবেই তাদের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখা। এর জন্য ভারতীয় চাণক্যরা প্রণয়ন করেছিলো এক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা। তাদের এই হীন নীলনকশা সম্পর্কে আমরা ছাড়াও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধাদের অনেকেই জানতে পারে এবং তখন থেকেই এর বিরুদ্ধে নিজেদের গোপনে সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় ভারতের নীলনকশার বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার লক্ষে স্বাধীন বাংলাদেশে।
জেনারেল জিয়া স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন চট্টগ্রামের কালুরঘাট বেতারকেন্দ্র থেকে একান্তভাবে তার নিজস্ব উদ্যোগে নয়। সেই ঘোষণা তিনি দিয়েছিলেন বাঙ্গালী জুনিয়র অফিসার আর সৈনিকদের চাপে অনেকটা জীবন বাঁচানোর তাগিদেই। তবুও তার সেই ঘোষণার ফলে তিনি প্রবাসী এবং ভারতীয় সরকারের চক্ষুশূলে পরিণত হন একজন উচ্চাভিলাষী সামরিক অফিসার হিসেবে। ফলে যুদ্ধের শুরুতেই তাকে সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে এনে কোলকাতার হেড কোয়ার্টারে ডাম্প করা হয়। জিয়া রাজনীতি সম্পর্কে তেমন সচেতন ছিলেন না জেনারেল এরশাদের মতোই। তাদের অল্পবিস্তর যে জ্ঞান সেটা সীমাবদ্ধ ছিল জেনারেল আইয়ুব খান থেকে জেনারেল ইয়াহিয়া খানের রাজনীতি পর্যন্ত। গণমুখী রাজনীতি সম্পর্কে তাদের কোন ধারণাই ছিল না। যাই হউক, আমাদের সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে নেবার জন্য বহুল পরিচিত সৎ জাতীয়তাবাদী একজন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের প্রয়োজন দেখা দেয় কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসাবে। বেছে নিয়েছিলাম মন্দের ভালো জিয়াকেই তারই ইচ্ছায়। ‘৭১ এর স্বাধীনতার যুদ্ধটাকে আমরা দেখেছিলাম জাতীয়মুক্তি সংগ্রামের প্রথম ধাপ হিসেবেই যাতে পরবর্তীকালে সম্ভব হয় সার্বিক মুক্তি সংগ্রামকে এগিয়ে নেয়া জিয়াকে কেন্দ্র করে। যেমনটি আপনারা এ্যাংলো-স্যাক্সন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর দখলদারিত্ব থেকে সান ইয়েত সেনের নেতৃত্বে জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন করেছিলেন দেশকে। তারপরেই আপনাদের গণমুক্তির সংগ্রামের পথ সুগম হয়ে ওঠে এবং চরম বিজয় অর্জন করা সম্ভব হয়। সব বিচারে জিয়ার সমতুল্য তখন আর কেউই ছিল না তাই সর্বসম্মতিক্রমে আমিই তার সাথে গোপনে যোগাযোগ করে ভারতীয় নীলনকশা এবং আমাদের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে বিস্তারিত বুঝিয়ে বলি। সব শুনে, তিনি আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে কাজ করতে সম্মত হন এক শর্তে। ক্ষমতার কেন্দ্রে তাকে উপবিষ্ট করার আগ পর্যন্ত তার সাথে আমাদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হবে। আমাদের তরফ থেকে তার সেই শর্ত মেনে নেয়া হয়। কিন্তু অপ্রত্যাশিত ভাবে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর যখন তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে প্রতিষ্ঠিত করা হয় তখন তিনি বিপ্লবীদের সাথে ওয়াদার বরখেলাপ করে ভারতের সাথে সমঝোতা করে ক্ষমতার রাজনীতির পথ বেছে নেন। তার এই বিশ্বাসঘাতকতার উপযুক্ত জবাব দেয়ার মতো সামরিক বাহিনীতে আমাদের সাংগঠনিক শক্তি থাকা সত্ত্বেও তখন আমরা তার বিরুদ্ধে কোন সংঘর্ষে না যাবার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। কারণ, তাতে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করা যাবে সহজেই, কিন্তু ভারতীয় আগ্রাসনের বিরোধিতা আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হবে না দ্বিধাবিভক্ত সামরিক বাহিনী ও জাতিকে নিয়ে। এরপর আমাদের শক্তি খর্ব করার জন্য তিনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না নিয়ে বিদেশে নির্বাসনে রাখার ব্যাবস্থা করলেন এবং আমাদের গোপন বৈপ্লবিক সংগঠন সেনা পরিষদের তিন হাজারেরও বেশি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী সেনা সদস্যকে ঠাণ্ডা মাথায় ম্যাকিয়াভেলির ‘প্রিন্স’ এ বর্ণিত দর্শন অনুযায়ী হত্যা করেন নিজের অবস্থানকে পাকাপোক্ত করার জন্য। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, তার এ সমস্ত ভুল পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে সেনাবাহিনীতে জিয়া আজ নিষ্ঠুর এক ঘৃণিত ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার পায়ের নিচ থেকে মাটি সরে যাচ্ছে অতি দ্রুত। আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, এবারের সফরে তিনি আমার পিতাকে ডেপুটি হেড অফ ডেলিগেশন এবং আমার নিকট পরিবারের সদস্যদেরকেও সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিলেন। তাদের মধ্যস্থতায় তিনি দুই রাতে আমার সাথে প্রায় ৫ ঘণ্টার উপর একান্তে আলোচনা করেন। প্রথম রাতের আলোচনায় আমার পিতাও উপস্থিত ছিলেন। আলোচনা কালে তিনি বলেছিলেন, তিনি অনেক ভুল করে ফেলেছেন। একই সাথে তিনি আমাদের সাহায্য চাইছিলেন তাকে বাঁচাতে। কিন্তু তিনি নিজে যে গভীর সঙ্কট সৃষ্টি করেছেন তা থেকে এখন আমাদের পক্ষেও তাকে বাঁচানো সম্ভব নয়। তার ভুলের মাশুল তাকেই গুণতে হবে। জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে বন্ধুরা জানতে চেয়েছিলেন। তাই আমি বলেছিলাম
ব্যক্তি হিসাবে জেনারেল এরশাদ একজন চরিত্রহীন এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দুর্বল চরিত্রের মানুষ। তিনি মিথ্যেবাদী এবং তার বিশ্বাসযোগ্যতাও প্রশ্নবিদ্ধ। এরশাদ যখন ভারতে NDC Course করছিলেন তখনি তিনি ভারতের কাছে নিজেকে বিকিয়ে দিয়ে এসেছেন। বর্তমানে বাংলাদেশে ভারতীয় খেলায় জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। বর্তমানে সেনাপ্রধান হিসাবে জেনারেল এরশাদ সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। RAW-এর পরামর্শ মোতাবেক এগুচ্ছেন জেনারেল এরশাদ। এরশাদ জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন হিসাবে একদিকে জিয়াকে উস্কে দিচ্ছেন জেনারেল মঞ্জুর এবং বেঁচে থাকা মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে, অপরদিকে পুরনো সহকর্মী জেনারেল মঞ্জুরকে আশ্বাস দিচ্ছেন জিয়ার বিরুদ্ধে যদি জেনারেল মঞ্জুর কোনও পদক্ষেপ গ্রহণ করেন তবে তিনি তাকে পূর্ণ সমর্থন জানাবেন বলে। এভাবেই RAW-এর পরামর্শ অনুযায়ী তিনি এক ঢিলে দুই পাখি বধ করার ষড়যন্ত্র করে চলেছেন। একই সাথে এরশাদ চেষ্টা করছেন সামরিক বাহিনী থেকে বিপ্লবী চেতনায় উদ্বুদ্ধ দেশপ্রেমিক, জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী বিশেষ করে আগ্রাসী ভারত বিরুধী অফিসার ও সৈনিকদের একই জালে আটকে নির্মূল করতে। ভারতের সুতার টানে এরশাদকে যথাসময় রাজনৈতিক সমর্থন দেবে হাসিনার আওয়ামীলীগ। এ ছাড়া প্রত্যাগত অফিসার হিসাবে জেনারেল এরশাদের পক্ষে ক্ষমতায় টিকে থাকা সম্ভব হবে না। আমার বক্তব্যের সত্যতা সময়েই যাচিত হবে। চীনা বন্ধুরা জানতে চেয়েছিলেন, রাষ্ট্রপতি জিয়ার সফরের পর আমি বেশ কিছুদিন চীনের বাইরে ছিলাম এবং পরে ঢাকাতেও গিয়েছিলাম। এর কারণটা কি? জবাবে বলেছিলাম এগুলোও জেনারেল জিয়ার ইচ্ছাতেই বাধ্য হয়েই করতে হয়েছিলো। দীর্ঘসময় আলাপের পরও যখন আমার পক্ষে অতীতের সবকিছু ভুলে গিয়ে আবার নতুন করে তার সাথে একত্রে রাজনীতি করার প্রস্তাব গ্রহণ করা সম্ভব হল না, তখন জিয়া অনুরোধ জানালেন আমি যাতে বিষয়টি নিয়ে অন্যান্য সহযোদ্ধা এবং সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ যারা বিভিন্ন দূতাবাসে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছেন তাদের সাথে আলোচনা করে দেশে গিয়ে সরেজমিনে সব দেখেশুনে সার্বিক অবস্থা বুঝে তাকে আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা জানিয়ে আসি। আমার পিতার জবরদস্তির ফলে তার সেই প্রস্তাবটা অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাকে মেনে নিতে হয়েছিলো। আমাদের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা জিয়ার মনঃপুত হবে না। পরিণতিতে রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া যাই করবেন তার জন্য আমরা সবাই তৈরি হয়েই আছি। সেই বৈঠকে সব শুনে বিশ্বস্ত চীনা অভিজ্ঞ বর্ষীয়ান নেতারা আন্তরিকভাবেই বলেছিলেন বন্ধু হিসাবে আপনি আন্তরিকভাবে আমাদের যেসব মূল্যবান তথ্য জানালেন তার জন্য ধন্যবাদ জানালে আপনাকে ছোট করা হবে। আপনি একজন দেশপ্রেমিক জাতীয় বীরই নন, পরম বন্ধুও বটে। আমাদের এই বন্ধুত্ব বংশানুক্রমে বজায় থাকবে সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। আপনার এবং আপনার অন্যান্য বীরসহযোদ্ধা সাথীদের কর্মস্থল হওয়া উচিত বাংলাদেশ। কিন্তু আমরা অবগত হলাম যে বর্তমানে আপনাদের দেশে ফেরার পথে রয়েছে অনেক প্রতিবন্ধকতা। তবে সময় বদলায়, আর তার সাথে সৃষ্টি হয় নতুন সুযোগ। সেই সুযোগের অপেক্ষায় ধৈর্য ধরে থাকুন, নিশ্চয় উপযুক্ত সময় আপনারা দেশে ফিরে আপনাদের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জন করতে সক্ষম হবেন। বিপ্লবের পথ বন্ধুর ও কন্টকাকীর্ণ একটি চলমান ধারা। এতে রয়েছে উত্থান-পতন, চড়াই-উৎরাই, এরপরই আসে বিজয়। কথাগুলো পরিণত গোধূলি বেলায়ও কানে বাজে।
এই দুষ্কর কাজটি সাধন করার জন্য চাই দাগহীন চরিত্র, জ্ঞান, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা এবং দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে নিবেদিতপ্রাণ কিছু সাহসী মানুষ যারা ভোগ-বিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের সব আকর্ষণ ত্যাগ করে এসে শামিল হতে পারে নিপীড়িত শোষিত মানুষের কাতারে। তাদের ব্যক্তিগত উদাহরণে উজ্জীবিত হয়ে তাদের নেতৃত্বে ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় ত্বরিত গতিতে আমূল পরিবর্তন আনার লক্ষ্যে লাখো-কোটি জনতা সংঘবদ্ধ হয়ে নিজেদের পরিণত করবে এক অপরাজেয় শক্তিতে। এটাই হচ্ছে বিপ্লব। এমন একটি ঐক্যবদ্ধ জাতির পক্ষেই সম্ভব সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে দেশকে রূপান্তরিত করতে একটি দুর্জয় ঘাঁটিতে। এ ধরণের বলিষ্ঠ নেতৃত্ব আর লৌহ-কঠিন জাতীয় ঐক্যকে পরাজিত করতে পারে না কোনও বিদেশী অপশক্তি। এটাই ইতিহাসের লিখন।
পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক দেশেই এ ধরনের বিপ্লবকে সফল করে তুলেছেন কিছু নিবেদিতপ্রাণ সাহসী নেতৃবৃন্দ। বাংলাদেশেও সেই সুযোগ এসেছিল ১৯৭১ সালের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধকালে। তারপর আবার সেই সুযোগের স্বর্ণদ্বার উন্মোচিত হয়েছিল ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা ও জনগনণর সম্মিলিত অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। কিন্তু সেই সুযোগ মরীচিকায় পরিণত হয় কায়েমী স্বার্থের রাজনীতির অন্ধগলিতে ক্ষমতালিপ্সু নেতৃত্বের বিশ্বাসঘাতকতা এবং অদূরদর্শিতায়।
ঢাকায় চুরান্ত সিদ্ধান্ত জানিয়ে আসার পর রাষ্ট্রপতি জিয়ার প্রতিক্রিয়া
ঢাকায় গিয়ে জিয়াকে আমাদের চূড়ান্ত যে সিদ্ধান্ত আমি জানিয়ে এসেছিলাম তাতে তার আঁতে ঘা লেগেছিল। তিনি সেটা স্বাভাবিকভাবে মেনে নিতে পারেননি। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন তার মুখোশ উন্মোচিত করে তার আসল চেহারাটা জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ে তুলে ধরতে পারে একমাত্র সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দ বিশেষ করে যারা বিদেশে অবস্থান করছে। এতে আতংকিত হয়ে তিনি তার কোর্সমেট তৎকালীন DGFI জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে হুকুম দিলেন আমার বিদেশের বিভিন্ন দেশের দূতাবাসে কর্মরত সহযোদ্ধাদের সাথে বৈঠক এবং ঢাকায় আসার পর বিভিন্ন মহলের আস্থাভাজন সুজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাতের উপর ভিত্তি করে আমাদের বিরুদ্ধে এমন একটা কেসের নাটক সাজাতে যাতে প্রমাণিত হয় বিদেশে অবস্থান করেও আমরা রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের জাল বুনে চলেছি। এই কেসের সুবাদে দেশের ভেতরে বেশ কয়েকজন সামরিক এবং বেসামরিক মুক্তিযোদ্ধাকে বিনা চার্জশিটে বন্দী করে জেলে ঢুকানো হল। কর্নেল নুরুন্নবী খান বীরবিক্রম ‘৭১ সালে জিয়ার সহযোদ্ধা, কর্নেল দিদারুল আলম বীরপ্রতীক, মুক্তিযোদ্ধা এবং রাজনৈতিক ভাবে সচেতন যুবনেতা মনির তাদের মধ্যে অন্যতম। মেজর খায়রুজ্জামান তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে কর্মরত থাকায় তাকেও সাওয়াল-জবাবের সম্মুখীন হতে হয়। চাতুর্যের সাথে কর্নেল পাশাকে Consultation এর নামে দেশে ডেকে পাঠিয়ে কারাবন্দী করা হয়। চালানো হল তাদের উপর অকথ্য শারীরিক এবং মানসিক নির্যাতন স্বীকারোক্তি আদায় করার উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে কর্নেল পাশার উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে তাকে রাজসাক্ষী বানাতে সক্ষম হয় DGFI জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী। অন্যদের অমানবিক অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাতে কর্নেল পাশা এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছিলেন। বিশেষ করে বন্দী কর্নেল দিদার গোপনে পাশার নিকট অনুরোধ জানান পাশা যেন রাজসাক্ষী হয়ে তাদের অপরাধ নিজ কাঁধে তুলে নেন যাতে তাদের শাস্তির মাত্রা কিছুটা লঘু হয়। পরবর্তীতে পাশা স্বীকারোক্তিতে শুধু বলেছিলেন, সেনা পরিষদের নির্বাসিত নেতৃবর্গ দেশে একটি গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনা করছিলেন। এর বেশি কিছু তার মুখ থেকে সরকার পক্ষ বের করতে পারেনি।
তার জবানবন্দীর উপর ভিত্তি করেই কর্নেল নুরুন্নবী বীরবিক্রম এবং অন্য সবাইকে অভিযুক্ত করা হল বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে। দেশে ডেকে পাঠানো হল সব সহযোদ্ধা কূটনীতিকদের। আর জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে গণচীনে পাঠানো হল যাতে তিনি চীনা নেতৃবৃন্দের সহযোগিতায় আমাকে চীন থেকে ধরে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। এ সম্পর্কে রাষ্ট্রপতি জিয়ার একটি আবেদন পত্রও বহন করে এনেছিলেন জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী। পত্রে জেনারেল জিয়া আবেদন জানিয়েছিলেন যাতে চীনা কর্তৃপক্ষ আমাকে জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর হাতে তুলে দেন। চীনা কর্তৃপক্ষ তার সেই আবেদন নাকচ করে দেয়। ফলে ব্যর্থমনোরথ হয়েই খালি হাতে দেশে ফিরে যেতে হয়েছিল জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে। এই ঘটনার পর আমি বেইজিং ত্যাগ করে লন্ডন চলে যাই। নূরও তাই করে। অন্যান্য সবাই চাকুরিতে ইস্তফা দিয়ে যার যার সুবিধা মতো বিভিন্ন দেশে গিয়ে বসবাস করতে থাকে। এ ভাবেই আবার আমরা ছিন্নমূল হয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে ছড়িয়ে পড়লাম বটে, কিন্তু আমাদের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন হয়নি কখনোই।
জেনারেল এরশাদের পরামর্শে সেনাবাহিনীতে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অহরহ রদবদল করা হতে থাকে। এতে করে জিয়ার পরিবর্তে নিজের অবস্থানকেই মজবুত করে নিতে সক্ষম হন চতুর আর্মি চীফ জেনারেল এরশাদ। জেনারেল জিয়ার সাথে বনিবনা না হওয়ার কারণে সেনাসদর থেকে অনেক PSO কে সরিয়ে দেয়া হয়। CGS জেনারেল মঞ্জুরকেও জিয়ার কাছ থেকে দূরে চট্টগ্রামে GOC করে পাঠিয়ে দেয়া হয়। এই পোস্টিং এ জেনারেল মঞ্জুর ভীষণভাবে ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। তিনি বুঝতে পারেন তার দিন ফুরিয়ে আসছে। ইতিমধ্যে, ভারত সরকার এবং RAW -এর চক্রান্তে চীন থেকে এক সফর শেষে মানবেন্দ্র লারমা দেশে ফিরে যাবার পর তাকে আগরতলায় সন্তু লারমার মাধ্যমে মারিয়ে সন্তু লারমাকে পার্বত্য চট্টগ্রামের জনসংহতি পরিষদের প্রধান বানিয়ে সমগ্র পার্বত্য চট্টগ্রামে সশস্ত্র ইন্সারজেন্সির মাত্রা বাড়িয়ে দেয়া হয় যাতে জেনারেল মঞ্জুরের ডিভিশনের উপর চাপ সৃষ্টি করে তাকে ব্যস্ত রাখা সম্ভব হয়।
মানবেন্দ্র লারমার চীন সফরকালে আমার সাথে তার সাক্ষাত হয়েছিলো। পুরনো বন্ধু মানবেন্দ্র লারমা পাহাড়ী জনগোষ্ঠীর রাজনৈতিক সংগঠন জনসংহতি পরিষদের প্রতিষ্ঠাতা একজন তরুণ নেতা এবং মুক্তিযোদ্ধা। আলোচনা কালে মানবেন্দ্র আমাকে বলেছিল, আগস্ট বিপ্লবের পর তার প্রত্যাশা ছিল বৈপ্লবিক সরকার শেখ মুজিবের নীতি বদলে পশ্চাদপদ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর আর্থ-সামাজিক উন্নয়নের ন্যায়সঙ্গত দাবিগুলো মেনে নেবে। ফলে তারাও বাংলাদেশের নাগরিক হিসাবে বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রামের পথ পরিহার করবে। সে বলেছিল, ১৫ই আগস্টের পর দ্রুত ৩রা নভেম্বর এবং ৭ই নভেম্বরের পরিবর্তনগুলো ঘটে যাওয়ায় সে আমার সাথে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও দেখা করতে পারেনি। কারণ, মুজিবের শাসন কালের পুরো সময়টাই তাকে আন্ডারগ্রাউন্ডে থাকতে হয়েছিলো। লারমা আমাকে অনুরোধ করেছিলো জেনারেল জিয়াকে তার পয়গামটা পৌঁছে দিতে যে সে এই বিষয়ে জিয়ার সাথে আলোচনা করতে ইচ্ছুক। আমি তাকে বলেছিলাম, এখন জিয়ার সাথে আলাপ করে কোন লাভ হবে না। এরপরই দেশে ফিরলে তাকে হত্যা করা হয়।
মানবেন্দ্র লারমার দুঃখজনক মৃত্যুর পর সন্তু লারমার নেতৃত্বে ভারতের প্ররোচনায় পার্বত্য চট্টগ্রামকে বাংলাদেশ থেকে আলাদা করার জন্য বেগবান করা হয় বিচ্ছিন্নতাবাদী সশস্ত্র সংগ্রাম। জনসংহতি পরিষদের ইন্সারজেন্সির মোকাবেলা করার অজুহাতে জেনারেল নাসিমের পরামর্শে দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী কমান্ড লেভেলের প্রায় সব মুক্তিযোদ্ধা সিনিয়র অফিসারদের কাকতালীয় ভাবে চট্টগ্রামে পোস্ট করা হতে থাকে। এই পদক্ষেপে ঢাকাসহ দেশের অন্যান্য সব কয়টি সেনানিবাসেই কমান্ড লেভেলে চীফ জেনারেল এরশাদের অনুগত পছন্দসই অফিসারদের নিয়োগ দেয়ার বিষয়টি সহজ করে দেন তার অধিনস্ত MS জেনারেল নাসিম।
ষড়যন্ত্রের এই সমস্ত সূক্ষ্ম চালগুলো লক্ষ্য করার মতো সময় তখন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়ার ছিল না। কারণ, তখন তিনি বিশ্বনেতা হওয়ার স্বপ্নে বিভোর হয়ে সারা দুনিয়া চষে বেড়াচ্ছেন। দেশের সার্বিক আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অধোগতি রোধ করার জন্য জিয়া তার বিশ্বস্ত জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে DGFI এর পদ থেকে সরিয়ে বানালেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। জিয়ার এই সিদ্ধান্তের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে জেনারেল এরশাদ তার একান্ত বিশ্বস্ত এক জেনারেল মাহমুদকে নিয়োগ দিলেন DGFI হিসাবে। জিয়া যখন আকাশে ভেসে বেড়াচ্ছেন তখন দেশে তার বিরুদ্ধে খিচুড়ি পাকানো প্রায় শেষ পর্যায়ে। ইতিমধ্যেই ভারতীয় হাই কমিশন, সোভিয়েত ইউনিয়ন দূতাবাস, RAW এবং KGB জেনারেল এরশাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে হাসিনাসহ গুরুত্বপূর্ণ আওয়ামী-বাকশালী এবং জাসদের নেতৃবৃন্দকে, সীমান্তের ওপারে অবস্থানকারী কাদের সিদ্দিকি এবং সন্তু লারমার সাথে। তাকে পরামর্শ দেয়া হল তিনি যাতে আটরশির পীর, হাফেজ্জি হুজুর, মাইজভাণ্ডারী, অন্ধ হাফেয, আমানী, বায়েতুল মোকাররমের খতিব প্রমুখদের সাথে বকধার্মিক সেজে তাদের সমর্থন আদায় করার স্বার্থে যেকোনো মূল্যেই সম্পর্ক গড়ে তুলতে। এভাবেই জিয়ার বিশ্বস্ত নিয়োগপ্রাপ্ত সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো ক্যান্টনমেন্টের বাইরে জিয়া বিরোধী শক্তিগুলোর সাথে গাঁটছড়া বাঁধা জিয়ার অজান্তেই। সেনাবাহিনীর যাদের উপর নির্ভর করে এরশাদ জিয়া বিরোধী চক্রান্তের জাল বিছাতে সক্ষম হয়েছিলেন তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নামগুলো হলঃ জেনারেল আব্দুর রহমান, জেনারেল চিশতী, জেনারেল মাহমুদ, ব্রিগেডিয়ার রফিক, জেনারেল নুরুদ্দিন, জেনারেল মীর শওকত, জেনারেল মচ্ছু সালাম, জেনারেল আতিক, ব্রিগেডিয়ার নাসিম, ব্রিগেডিয়ার মিরন, ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্‌, ব্রিগেডিয়ার আব্দুল হাফিজ, মেজর মনিরুল ইসলাম চৌধুরী, মেজর মোজাফফর, মেজর খালেদ, ক্যাপ্টেন এমদাদ, লেফটেন্যান্ট ইকবাল প্রমুখ। এদের সবাই তখন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করে চলতেন। রাষ্ট্রপতির MS জেনারেল সাদেক চতুরতার সাথে জিয়াকে আশ্বস্ত করে চলেছিলেন। যার ফলে প্রেসিডেন্টের পক্ষে চক্রান্ত সম্পর্কে কিছুই অবগত হওয়া সম্ভব হচ্ছিলো না। অন্যদিকে জেনারেল জিয়ার PS কর্নেল মাহফুজ, মঞ্জুরের সব কর্মকাণ্ড সম্পর্কে অবগত থেকেও জিয়াকে কিছুই জানাচ্ছিলো না। লন্ডনে অবস্থান করায় আমার আর নূরের পক্ষে বিভিন্ন সূত্র থেকে সব খবরা-খবরই পাওয়া সম্ভব হচ্ছিল। অত্যন্ত আশ্চর্যের বিষয়, ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের ঠিক আগে খালেদা জিয়ার পছন্দের আর্মি চীফ জেনারেল নাসিম অস্থায়ী সরকারের প্রধান রাষ্ট্রপতি বিশ্বাসের বিরুদ্ধে এক ব্যর্থ অভ্যুথানের চেষ্টা চালায় যাকে খোলাখুলি ভাবে শেখ হাসিনা সমর্থন জানায়। পরে তাকে এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গদের কাকতালীয় ভাবে রাষ্ট্রবিরোধী চক্রান্তকারী হিসাবে বিচার না করে জাতিকে হতবাক করে তাদের রাষ্ট্রপতির ক্ষমা দান করে সকল সুবিধাসহ চাকুরি থেকে অব্যাহতি প্রদান করা হয়।তারা এরপর থেকে বহাল তবিয়তেই রয়েছে, অথচ ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং পৈশাচিক ভাবে জবাই করে হত্যা করা হয় ‘৭৫-এর সফল বিপ্লবের নেতা পাঁচজন মুক্তিযোদ্ধা বীরকে যাদের দ্বারা একদলীয় স্বৈরশাসনের পতন ঘটিয়ে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক অধিকারের তোরণ খুলে দেয়া হয়। দেশবাসী আগস্ট বিপ্লবের সাফল্যে স্বস্তির নিঃশ্বাস নিয়েছিলেন। তাই তারা রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে সানন্দে গ্রহণ করে স্বতস্ফূর্ত সমর্থন জানিয়েছিলেন। বিপ্লবীদের তারা মুক্তিদাতা এবং জাতীয় বীর বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। তাদের খুলে দেয়া পথেই বিএনপি, আওয়ামী লীগ, জামায়াত, জাতীয় পার্টিসহ দেশের অন্যসব কয়টি রাজনৈতিক দলের জন্ম এবং পুনর্জন্ম সম্ভব হয়। দেশের মানুষ ফিরে পায় ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতা। প্রতিষ্ঠিত হয় আইনের শাসন।
নতুন প্রজন্মকে বুঝতে হবে, সুস্থ রাজনৈতিক প্রবাহ সৃষ্টি করে দেশকে এগিয়ে নেবার জন্য শুধুমাত্র ক্ষমতার স্বার্থে প্রচলিত সমঝোতার রাজনীতির অনৈতিকতা এবং আদর্শহীন জঘন্য কুটিলতা কতটা ক্ষতিকর। ১৯৯৬ সালে হাসিনা সরকারের ক্ষমতা গ্রহণের পর ২১শে বই মেলায় অনেক প্রতিবন্ধকতার মধ্যেও আমার লেখা ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইটির ৮ টি সংস্করণ কয়েকদিনের মধ্যেই বিক্রি হয়ে যাওয়াতে সরকার পক্ষের লোকেরা প্রথমে প্রকাশককে হুমকি দেয়, এই বইয়ের আর কোনও সংস্করণ ছাপানো চলবে না। তিনি তাদের হুমকির পরোয়া না করায় হাসিনা সরকার তাকে বন্দী করে এবং প্রেসটিকেও জ্বালিয়ে দেয়। ফলে বইটির আর কোনও সংস্করণ ছাপানো সম্ভব হয়নি। এরপরও গোপনে বইটির ইংরেজি এবং উর্দু অনুবাদ ছাপানো হয়। দুটো ওয়েবসাইট www.majordalim.com এবং www.majordalimbangla.com বন্ধ করে দেয় ইতিমধ্যে হাসিনা সরকার। ২০০১ সালে খালেদা জিয়ার জোট সরকার ক্ষমতায় আসার পর ওয়েবসাইট দুটো আবার আপ লোড করা হয় www.majordalim.net ও www.majordalimbangla.net নামে। সেই দু’টিও আবার বন্ধ করে দেয় হাসিনা সরকার দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় এসে। রণেভঙ্গ না দিয়ে তৃতীয় বারের মতো সাইট দুটো www.majordalimbu.com এবং www.majordalimbubangla.com নামে বর্তমানে ওয়েব-এ রয়েছে। ২০০৮ সালে হাসিনা তার মুরুব্বীদের আশির্বাদপুষ্ট হয়ে সারাদেশে লগি-বৈঠার তাণ্ডব চালিয়ে তদানিন্তন সেনাপ্রধান মইন উদ্দিন আহমেদকে (প্রাক্তন রক্ষীবাহিনী অফিসার) সুযোগ করে দেয় বন্দুকের জোরে দেশে রাষ্ট্রপতির মাধ্যমে জরুরী অবস্থা জারি করে ফখরুদ্দিনের সরকার কায়েম করতে। ফখরুদ্দিনের শ্যালক জনাব ইফতেখার চৌধুরী (বিএনপি পন্থী এনাম চৌধুরী এবং আওয়ামীলীগ পন্থী জনাব ফারুক চৌধুরীর ছোট ভাই) এই ক্ষমতা গ্রহণে ঘৃণ্য ভূমিকা পালন করেন। তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা হিসেবে তখন জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধির দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। তিনি SG বান কি মুনের অফিস থেকে জেনারেল মইনকে একটা ভুয়া পত্র যোগাড় করে দিয়েছিলেন যাতে লেখা ছিল বাংলাদেশের নৈরাজ্যিক অবস্থা স্বাভাবিক না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী কিংবা বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী থেকে কাউকে কোনও ‘Peace Making’ কিংবা ‘Peace keeping’ Mission এ নেয়া হবে না। এটা বর্তমানে দেশের সামরিক বাহিনীর সদস্যদের জন্য টাকা রোজগারের একটি উত্তম পন্থা। সৈনিক থেকে অফিসার সবাই সিনিয়র অফিসারদের ঘুষ দিয়ে হলেও ঐ সমস্ত Mission এ গিয়ে ২ বছরের মধ্যে বিস্তর টাকার অধিকারী হয়ে ফিরে এসে আয়েশী জীবন কাটাতে সক্ষম হচ্ছেন। গরীব দেশগুলোর সামরিক বাহিনী যাকে বলা হয় ‘জাতির মেরুদণ্ড’ সেই প্রতিষ্ঠানের নৈতিক চরিত্র হরণের এটি এক অভিনব উপায়। জেনারেল মইন ঐ পত্রটি রাষ্ট্রপতিকে দেখিয়ে তাকে জরুরী অবস্থা ঘোষণা করে পদত্যাগে বাধ্য করেন। এই পত্রের ব্যাপারটি প্রকাশ হয়ে পড়ায় বিব্রত UN SG অফিস এক বিবৃতিতে ওই ধরনের কোনও পত্র ইস্যু করার বিষয়টি অস্বীকার করে। এই চক্রান্তের আর একজন নাটের গুরু ছিলেন জেনারেল মাসুদ চৌধুরী(অব) জনাব ফারুক চৌধুরীর আত্মীয়। এরপর বিষয়টি নিয়ে আর উচ্চবাচ্য করা হয়নি কোনও তরফ থেকেই। জনাব ইফতেখার চৌধুরীও বহাল তবিয়তে ক্ষমতা উপভোগ করতে থাকেন নিজ পদে অধিষ্ঠিত থেকে।
আমার সুযোগ হয়েছিল জাতিসংঘের এইসব মিশনগুলোর লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য সম্পর্কে গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ ও বিশ্লেষণের। যুক্তির সাথেই বলা চলে এই সব মিশনগুলোর ফলে বিশ্বের কোনও দেশ কিংবা জাতির লাভ হয়নি। লাভ হয়েছে নিও-ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর আর্থিক ও ভূরাজনৈতিক ভাবে এবং বিশ্বের সেরা ধনী কংগ্লোমারেটগুলো, রসদ সরবাহকারী সংস্থা এবং অস্ত্রসম্ভার নির্মাণকারিদের। তাছাড়া শক্তিধর দেশগুলো এবং তাদের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এই সব মিশন চলাকালে সক্ষম হয় যেকোনো দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং শক্তিধর প্রতিষ্ঠানের সম্ভাবনাময় সদস্যদের বেছে নিতে যাতে করে প্রয়োজনে তাদের নিজস্ব গুঁটি হিসাবে ব্যবহার করা যায়। এরপর, পরিকল্পনা অনুযায়ী পাতানো নির্বাচনে আওয়ামীলীগকে দুই-তৃতীয়াংশেরও বেশী সিটে জিতিয়ে ক্ষমতায় বসানো হয়। ভারতের তাবেদার জেনারেল এরশাদ এবারও আওয়ামী জোটে যোগদান করেন নিজের চামড়া বাঁচানোর দায়ে। সবচেয়ে হতবাক হবার বিষয় হল- মেনন, ইনু, রব, মতিয়া চৌধুরী, সুরঞ্জিত সেন, দিলিপ বড়ুয়ার মত ডাকসাইটে তথাকথিত এবং বাম নেতারাও আওয়ামী জোটে শরিক হয়ে হাসিনার নৌকায় চড়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে লজ্জাবোধ করলেন না! নীতি-বিবর্জিত দেশের রাজনীতিতে যেন সবকিছুই হালাল। যেমন ধড়িবাজ মওদুদ জিয়ার মৃত্যুর পর এরশাদের প্রধানমন্ত্রী এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট হয়েও এখন আবার বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়ার একজন মুখ্য পরামর্শদাতা। কর্নেল অলি, বি. চৌধুরী, জমির উদ্দিন সরকারের মতো আরও অনেকেই নিজস্ব পার্টি বানিয়ে সুবিধে করতে না পেরে আবার ক্রমশ খালেদার কাছে ভিড়েছে। সত্যই বিচিত্র এই বাংলাদেশ! দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসীন হয়েই বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে হতোদ্যম এবং দুর্বল করে তোলার জন্য সর্বপ্রথম জরুরী ভিত্তিতে দুটো কাজ করে আওয়ামী জোট সরকার। বিডিয়ার হত্যাযজ্ঞ এবং আগস্ট বিপ্লবের ৫ জন বীরকে বিচারের প্রহসনের জবাহ এবং ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করা
এই জুডিশিয়াল মার্ডারের পর বিদেশের প্রায় সব প্রিন্ট এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়া এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, হিউম্যান ওয়াচসহ মানবিক অধিকার সম্পর্কিত সব প্রতিষ্ঠান এই ফাঁসির বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে এই দণ্ডকে ‘হাসিনার বেআইনি হত্যাকাণ্ড’ বলে অভিমত প্রকাশ করে। কিন্তু বিরোধী রাজনৈতিক জোটের পক্ষ থেকে কোনো উচ্চবাচ্য তো দূরের কথা, বরং তাদের বিবৃতির মাধ্যমে পরোক্ষ সমর্থন লাভ করতে পারায় হাসিনা সরকারের সাহস এবং প্রত্যয় যায়। বিডিআর এর ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞে শহীদ হয় ৫৭/৫৮ জন চৌকস সেনা অফিসার বিদেশ থেকে আনা ভাড়াটিয়া কমান্ডো বাহিনীর হাতে। লাঞ্ছিত হয়েছিলেন তাদের প্রিয় পরিবার পরিজনরা। তারই সূত্রে চাকুরিচ্যুত করা হয় শ’দুয়েক সেনা অফিসারকে যারা দেশবিরোধী চক্রান্তের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রধানমন্ত্রী হাসিনার বিরুদ্ধে সেনাকুঞ্জে উষ্মার সাথে তাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেন এবং ন্যায়বিচার দাবি করে তাকে ভীতসন্ত্রস্ত এবং বিব্রত অবস্থায় সভাকক্ষ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিলেন। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিরোধী জোট দেশবাসীকে হতবাক করে দিয়ে এই দু’টি অতি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনার ব্যাপারে রহস্যজনক নীরবতা পালন করে নিশ্চুপ বসে তামাশা দেখলেন মাত্র। ২০০১ সালে দুই-তৃতীয়াংশের চেয়েও বেশি সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করেছিল জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন খালেদার নেতৃত্বাধীন জোট। দেশের আইন শৃঙ্খলা অবস্থার উন্নতির জন্য সেই সরকার একটা অভিযান চালিয়েছিল দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসহ সামরিক বাহিনীর সাহায্য নিয়ে। অপারেশনটার নাম ছিল ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’। খালেদার জোট সরকার এই ‘অপারেশন ক্লিন হার্ট’কে বৈধতা দেয়ার জন্য একটি ইনডেমনিটি এ্যাক্ট পাশ করেন দুইতৃতীয়াংশের সংখ্যা গরিষ্ঠতার বলে কিন্তু ১৯৯৬ সালে যখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার সংসদে সাংবিধানিক নীতি না মেনে দুই তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছাড়াই ৫ম সংশোধনীর অঙ্গচ্ছেদ করে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর সংক্রান্ত ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি বাতিল করে সফল অভ্যুত্থানের নায়কদের বিরুদ্ধে সাধারণ হত্যা মামলা সাজিয়ে তাদের বিরুদ্ধে বিচারের প্রহসন শুরু করে তখন খালেদা জিয়ার বিরোধী জোট ১২০ টির অধিক আসন নিয়ে এর কোন প্রতিবাদ না জানিয়ে শুধুমাত্র সংসদ কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিল মুখে কুলুপ এঁটে।এবার দুই-তৃতীয়াংশের সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকা সত্ত্বেও তার জোট সরকার অসংবিধানিক ভাবে বাতিল করা ইনডেমনিটি এ্যাক্টটি কিন্তু পুনরায় বহাল করলো না। এভাবেই খালেদা জিয়ার জোট আওয়ামীলীগ সরকারের অসংবিধানিক কর্মকাণ্ডকে সমর্থন জানিয়ে জাতীয় বীরদের ফাঁসিতে ঝোলানোর পথটি খোলাই রেখেছিলো। এটাকে সমঝোতার রাজনীতির একটি জ্বলন্ত নিদর্শন বললে কি ভুল বলা হবে? দেশ বিরোধী এই ধরনের ন্যক্কারজনক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে নিশ্চুপ বসে থাকা সম্ভব হয়নি সেনাপরিষদের নেতৃবৃন্দের পক্ষে। কয়েকজন নেতা প্রবাসে ফেরারী হয়ে থাকা অবস্থাতেও তাদেরই উদ্যোগে বিডিআর হত্যাকাণ্ডের পর সর্বপ্রথম তথ্যবহুল একটি লিফলেট ‘জাগো দেশবাসী বাঁচাও বাংলাদেশ’ ও একটি ভিডিও ডকুমেন্টারি সিডি দেশবাসী এবং বিদেশের মিডিয়া জগতে বিলির ব্যবস্থা করা হয়। ইমেইল করা হয় ৫ হাজারেরও বেশি অ্যাড্রেসে। বিডিআর চক্রান্তের বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীকে একটি খোলা চিঠিও পাঠানো হয় তাকে জবাবদিহি করে। সেটার কপিও দেশবাসীর মধ্যে হ্যান্ডবিল আকারে বিতরণ করা হয়। কাজগুলো খুব বড় না হলেও সেই সন্ধিক্ষণে এই দায়িত্বটি গ্রহণ করা খুব একটা সহজ ছিল না। এর জন্য অনেক তরুণ-তরুণীকে লাঞ্ছনা ও নিপীড়নের সম্মুখীন হতে হয়েছিল। ঐসব দেশপ্রেমিকদের তাদের দুঃসাহসিকতা ও আত্মত্যাগের প্রতি শ্রদ্ধার সাথে কৃতজ্ঞতা জানাতে হবে শুধু লেখককেই নয়, দেশবাসীকেও। এই কাজটি সম্পন্ন করার জন্য যে সমস্ত তরুণ-তরুণী স্বেচ্ছায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এগিয়ে এসেছিলেন তাদের সবাই বর্তমান প্রজন্মের। তাই যারা হতাশায় ভোগেন আর ভাবেন বর্তমান প্রজন্মের সবাই পচে গেছে তাদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল।
বর্তমান প্রজন্মের প্রতিজনের বিবেকে রয়েছে একটি স্ফুলিঙ্গ। দেশের যেকোনো ক্রান্তিলগ্নে পরীক্ষিত নেতৃত্বের অধীনে জাতীয় স্বার্থে তারাও সৃষ্টি করতে পারে দাবানল। যার লেলিহান শিখায় পুড়ে ছারখার হয়ে যেতে পারে ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সমাজিক ব্যবস্থা। একই সাথে দেশের রাজনৈতিক মঞ্চে বিদেশী সুতোর টানে নেচে চলা নট-নটীরাও চলে যেতে পারে ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এভাবেই একদিন সুযোগ সৃষ্টি হবে একটি প্রতিশ্রুতিশীল নতুন বাংলাদেশ গড়ে তোলার যার ভিত্তি হবে ‘৭১ এর প্রকৃত চেতনা, স্বকীয় জাতীয়তাবাদ, ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং ঐতিহ্যগত সংস্কৃতি। সম্ভব হবে ঐতিহাসিক ঐতিহ্যের আলোকে প্রতিষ্ঠিত করা আইনের শাসন, মানবাধিকার, সুষম রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ ব্যবস্থা। বিশ্ববাসীর কাছে নিজেদের পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে ঐতিহ্যবাহী, আত্মমর্যাদাশীল, সুখী সমৃদ্ধশালী এবং প্রগতিশীল একটি জাতি হিসাবে।
চীন থেকে লন্ডনে নির্বাসন কালে
একদিন হঠাৎ করেই ফোন পেলাম আমাদের সবারই প্রিয় এক মুক্তিযোদ্ধা ব্যবসায়ী ছোটো ভাইয়ের। সে জানালো দেশ থেকে লন্ডন এসেছে আমার আর নূরের সাথে জরুরী ভিত্তিতে দেখা করার জন্য। দেখা করেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তাকে দেশে ফিরতে হবে। দিনক্ষণ এবং স্থান ঠিক করা হল। পিকাডেলি সার্কাসের একটি লেনে অনেক দিনের চেনা ছোট্ট একটা খাবারের দোকান আছে। সেটা চালায় এক স্কটিশ দম্পতি। প্রায়ই সেখানে দুপুরে ফ্রেশ গ্রিল্ড ট্রাউট আর গ্রীন বয়েল্ড ভেজিটেবল উইথ মাস্টারড কিংবা ইটালিয়ান সস খেতে যাই। ছোটো ভাইকে সেখানেই দুপুরের খাবারের নিমন্ত্রণ করেছিলাম। খাওয়ার ফাঁকে ফাঁকে আলাপ চলছিলো। এক কালের তুখোড় ছাত্র ছোটো ভাই উচ্চবিত্ত পরিবারের ছেলে হয়েও মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেবার পর সাধারণ বঞ্চিত মানুষের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন হয়ে আমাদের একজন হিসেবে কাজ করে আসছে। যুদ্ধের পর অনেক সুযোগ সুবিধা থাকা সত্ত্বেও সরকারী কিংবা আর্মির চাকুরি গ্রহণ না করে স্বাধীন ব্যবসা করছে। সেইসূত্রে প্রায়ই বিদেশে সফর করে থাকে। বলো ছোটো ভাই, হঠাৎ এমন কি জরুরী বিষয়ে আলাপের জন্য ঢাকা থেকে তোমাকে ছুটে আসতে হল!
অবস্থা সঙ্গিন ডালিম ভাই। জেনারেল জিয়া ক্ষমতার লিপ্সায় একের পর এক যে সমস্ত পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাতে সাংগঠনিক ভাবে শুধুমাত্র মুক্তিযোদ্ধাদের অস্তিত্বই বিপন্ন হয়ে পড়ছে তাই নয়, তার ভারত তোষণ নীতি অচিরেই দেশটাকে পরিণত করবে একটি করদ রাজ্যে, আর দেশবাসী পরিণত হবে ভারতের গোলামে। প্রকৃত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক সেনা সদস্য এবং মুক্তিযোদ্ধারা এটা মেনে নিতে পারছে না। সবার একই কথা, তাকে এই পথ থেকে সরিয়ে আনতে হবে নতুবা ক্ষমতাচ্যুত করতে হবে কালবিলম্ব না করে।
সবই বুঝলাম, তোমাদের আশংকা অমূলক নয়। তবে কথা হল বেড়ালের গলায় ঘণ্টা বাঁধবে কে? জেনারেল মঞ্জুর বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধাদের সমর্থনের উপর ভিত্তি করে এ ধরনের উদ্যোগ নেবার চিন্তাভাবনা করছেন। এই বিষয়ে আপনাদের মতামত জানতে চাওয়ার জন্যই আসতে হয়েছে আমাকে। এই ধরণের কোনও উদ্যোগ ফলপ্রসূ হবে কি হবে না সেই বিষয়ে মতামত দেবার আগে তোমাকে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা বলতে চাই।
শোন ছোটোভাই, যুদ্ধকালীন সময় থেকেই আমরা একটি সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য অর্জনের জন্য নিজেদের সংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করি স্বাধীন বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় সুদূর প্রসারী নীলনকশার বিরুদ্ধে। এই বিষয়ে তুমি অবগত। যুদ্ধের আড়ালে ওই তৎপরতায় লিপ্ত সবাই একই নীতি-আদর্শ এবং দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি নিয়ে আগুয়ান হচ্ছিলাম। আমাদের সাথে যোগদান করেন জিয়াউদ্দিন, তাহের, জলিল-এর মতো নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক কমান্ডাররা। সেই সন্ধিক্ষণে জিয়ার মতো একজন অফিসারকে সামনে রেখেই আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে হয় বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে। এভাবেই জিয়াকেই আমাদের গ্রহণ করতে হয় মধ্যমণি হিসাবে। তার তরফ থেকে একটি শর্ত ছিল যতক্ষণ পর্যন্ত জিয়াকে আমরা ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করাতে না পারি ততদিন তার সাথে আমাদের সম্পর্কটা গোপন রাখতে হবে। সংগঠনের স্বার্থেই তার সেই শর্ত আমরা মেনে নিয়েছিলাম। কিন্তু ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে যখন তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানো হল তখন তিনি আমাদের বাদ দিয়ে নিজের রাস্তায় চলার সিদ্ধান্ত নিলেন। কেনো তিনি এ ধরনের সিদ্ধান্ত নিলেন সেটা তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। কিন্তু এর ফলে আমাদের সব স্বপ্ন-প্রত্যাশা ধূলিসাৎ হয়ে গেলো! আমরা বিজয়ী হয়েও হেরে গেলাম!
এর পরিণাম এখন সুস্পষ্ট সবার কাছেই। যেই সোভিয়েত বলয়ের ভারতীয় সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম তার শিকড় কেটে তাদের সাথে আপোষ করেই এখন তিনি জাতীয়তাবাদী এবং জনস্বার্থের রাজনীতির চ্যাম্পিয়ন হয়ে উঠেছেন। তার ১৯ দফাটাও আমাদেরই কর্মসূচি থেকেই নেয়া। তার দলের ম্যানিফেস্টোটাও আমাদেরই রাজনৈতিক ম্যানিফেস্টোর অনুকরণে প্রণীত।কিন্তু এরপরও বলছি তিনি নিজে যেই মাপের বিপ্লবী নেতাই হউন আর তার নীতি-আদর্শ নকল ভিত্তিক হওয়ার পরও তার বাস্তবায়নের জন্য তার পরীক্ষিত কর্মীবাহিনী কোথায়? তিনি তো প্রায় তিন হাজারেরও বেশী দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যকে ঠাণ্ডা মাথায় হত্যা করলেন। বিভিন্ন অজুহাত সৃষ্টি করে। কর্নেল জিয়াউদ্দিন, মেজর তাহের, মেজর জলিল এদের মাথায় এক সময় মার্কসিজম আর সমাজতন্ত্রের রোমান্টিসিজমের ভূত সওয়ার হওয়া সত্ত্বেও আমরা কিন্তু নিজেদের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে ওই দ্বন্দ্বের অবসান ঘটানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলাম। তুমি হয়ত বা অবগত আছ যখন কর্নেল জিয়াউদ্দিন হলিডেতে আচমকা তার নিবন্ধ ছেপে চাকুরি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তখন আমরা তার ঐ সিদ্ধান্ত বদলাতে অনেক অনুরোধ করেছিলাম। কিন্তু তিনি জবাবে বলেছিলেন, সেনাবাহিনীর সবাই নাকি পচে গেছে, তাদের পক্ষে কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হবে না। তারা সবাই যদি ঐ ভাবে আর্মি থেকে বেরিয়ে না যেতেন তাহলে এখন জিয়া যা করছেন সেটা কি করতে পারতেন? পারতেন না। যাক, এসবই হচ্ছে বিপ্লবের পথে প্রতিবন্ধকতা।
এবার জেনারেল মঞ্জুর সম্পর্কে কিছু কথা তোমাকে বলছি। আজ তুমি যা শুনবে সে সম্পর্কে জেনারেল মঞ্জুর এবং কর্নেল মাহবুব বীর উত্তম-এর মতো কয়েকজন ছাড়া অন্য কেউই তেমন একটা জানে না।
জেনারেল মঞ্জুর একজন চৌকস সেনা অফিসার। সারগোদা পাবলিক স্কুল থেকে পড়াশুনা শেষে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন মধ্যবিত্ত পরিবারের জেনারেল মঞ্জুর। সামরিক বাহিনী, রণকৌশল, যুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞান এবং নিজস্ব বুদ্ধিমত্তার জন্য পাকিস্তান আমলেই অনেকেই তাকে ‘গুডেরিয়ান’ বলে সম্বোধন করতো। যেকোনো দেশের পেশাদার সেনাবাহিনীতে জেনারেল হবার যোগ্যতা তার আছে। তাই তিনি আজ বাংলাদেশ আর্মিতেও একজন জেনারেল। কিন্তু একজন জনপ্রিয় বিপ্লবী নেতা হওয়ার মতো মন-মানসিকতা, নিজেকে জনগণের স্তরে নামিয়ে আনার প্রস্তুতি এবং যোগ্যতা তার আছে কিনা সেই বিষয়ে আমি নিশ্চিত নই। এর কারণ রয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের শেষপর্যায়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পর দুর্নীতির দায়ে মেজর ওসমানকে সরিয়ে তাকে যখন ৮ নং সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব দেয়া হয় তখন গেরিলা এডভাইজার হিসাবে যে কয়টি সেক্টরে আমি দায়িত্ব পালন করছিলাম ৮নং সেক্টর তার মধ্যে একটি। সেই সুবাদে আমি কয়েকবার মনজুরের সাথে ভারতীয় নীলনকশা এবং আমাদের তৎপরতা সম্পর্কে আলোচনা করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু তিনি প্রতিবারই এই বিষয়ে আমাকে এড়িয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতার পর যখন ভারতীয় বাহিনী দেশের সব কিছু লুট করে নিয়ে যাচ্ছিল তখন আমরা এর বিরোধিতা করার সিদ্ধান্ত নিই। সেই সময় তাজউদ্দিন সরকারের হুকুমে ফাঁদ পেতে কনফারেন্সের নাম করে মেজর জলিলকে যশোরে ডাকিয়ে এনে মঞ্জুরই কিন্তু তাকে বন্দী করেন একজন পেশাদার সরকারের অনুগত অফিসার হিসাবে। যখন আমরা সবাই এর বিরোধিতায় সোচ্চার হয়ে উঠেছিলাম এবং আওয়ামীলীগ সরকারকে বাধ্য করেছিলাম তাকে মুক্তি দিয়ে চাকুরিতে পুনর্বাসিত করতে তিনি সেই প্রক্রিয়া থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছিলেন। স্বাধীনতার পর আমি কর্নেল মাহবুবের মাধ্যমেও তার সাথে আলাপের চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। এরপরও ১৫ই আগস্ট বৈপ্লবিক পটপরিবর্তনের পর আমি তাকে দিল্লী মিশন থেকে ডাকিয়ে আনিয়েছিলাম এবং অনুরোধ করেছিলাম বিপ্লবের স্বার্থে একযোগে কাজ করতে। কিন্তু তিনি ধরি মাছ না ছুঁই পানি গোছের জবাব দিয়ে ফিরে গিয়েছিলেন।
তারপরও কথা থাকে ছোটো ভাই, ৭ই নভেম্বরের পর জেনারেল জিয়া তার অবস্থান মজবুত করার জন্য সেনাছাউনিগুলোতে যে হত্যাযজ্ঞ শুরু করেন তার বিরুদ্ধে শিশুভাই-এর মতো একজন ভীরু মানুষও প্রতিবাদ করেছিলেন। জেনারেল মঞ্জুর কিন্তু কাকতালীয় ভাবে ওই ধরনের হত্যাযজ্ঞকে সমর্থন করে জিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণেরই চেষ্টা করেছিলেন। আমাদের হাত-পা যখন কাটা হচ্ছিলো সেনা পরিষদের শক্তি খর্ব করার জন্য তখনও মঞ্জুর সহ ক্ষমতা বলয়ের সবাই জিয়ার আস্থা অর্জনের জন্য তার পরিকল্পনাকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। আমরা এখন ল্যাংড়া, লুলা শক্তিহীন। তাই মঞ্জুরের উদ্দেশ্য যতই মহৎ হউক না কেনো আমরা কোনোভাবেই জেনারেল মঞ্জুরকে সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারি না। তাছাড়া আমরা জানিনা জেনারেল গুডেরিয়ান কি ধরনের বিপ্লবী এবং তার বৈপ্লবিক কর্মসূচিটা কি।
তুমি নিশ্চয়ই জানো, জেনারেল জিয়া আমাকে এবং রশিদকে ঢাকায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তিনি কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন সেটা জানাবার জন্য। তখন হঠাৎ ধূমকেতুর মতো কর্নেল ফারুক এসে বগুড়া ক্যান্টনমেন্ট দখল করে জিয়াকে গদিচ্যুত করতে তার সাঁজোয়া বহর নিয়ে ঢাকা আগমনের সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো। সেই সন্ধিক্ষণে জেনারেল জিয়া নিরুপায় হয়ে আমার হাত ধরে মিনতি করেছিলেন তাকে নিরস্ত্র করতে। কর্নেল মাহবুব তখন আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী। অবস্থা সামাল দেবার পর প্রথমবারের মতো জেনারেল মঞ্জুর আমার সাথে গোপনে এক দীর্ঘ বৈঠকে মিলিত হন। সেই বৈঠকে তিনি আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন জিয়াকে উৎখাত করার উদ্যোগে আমরা কেন কর্নেল ফারুক আর রশিদকে সমর্থন করিনি? জবাবে বলেছিলাম, উৎখাত যদি করতেই হতো তবে শুধু জিয়াকেই নয়- তার সাথে সব সিনিয়র অফিসারদেরই চাকরি থেকে বের করে দিতে হতো। তার মধ্যে আপনিও বাদ পড়তেন না। এদের প্রায় সবাই ক্ষমতালিপ্সু, সুযোগসন্ধানী। তারা ক্ষমতার রাজনীতির সাথে পরিচিত, জনগণের রাজনীতির সাথে নয়। ১৫ই আগস্টের পর আমরা মাত্র ৩৬ জন দুর্নীতিবাজ এবং চরিত্রহীন সিনিয়র অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করতে চেয়েছিলাম। সেটাও জিয়া করতে গড়িমসি করেছিলেন। ৩রা নভেম্বর এর প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ঘটার এটাও ছিল একটা কারণ। জিয়াসহ সবাইকে তুলে বাইরে ফেলে দেয়াটা তখন আমাদের জন্য খুবই সহজ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগে যদি ভারতীয় সামরিক বাহিনী ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় আগ্রাসন চালাতো সেটার মোকাবেলা কি আমাদের পক্ষে করা সম্ভব হতো? সুযোগ সন্ধানী অনেকেই হয়েত তখন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান তুলে আগ্রাসী বাহিনীর সাথেই মিলে যেতো। সেই সুযোগে প্রত্যাগতদের অনেকেই হয়ে যেতেন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা আর আমরা পরিণত হতাম রাজাকারে। অনেক হারিয়েছি, সব মেনেও নিয়েছি ভবিতব্য হিসাবে। কিন্তু নিজেদের গায়ে জাতীয় শত্রুর স্ট্যাম্পটা লাগানোর প্রবৃত্তি নেই। এরপর জেনারেল মঞ্জুর আর কথা বাড়াননি। বলতো, হঠাৎ কেন এত আগ্রহের সাথে সেদিন জেনারেল গুডেরিয়ান নিজেই আমাকে গোপন বৈঠকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন?
ঠিক বুঝতে পারছিনা।
ঠিক আছে, আমিই বলছি। জেনারেল মঞ্জুরের ক্যারিয়ার শেষ হতে চলেছে। আমাদের খবর অনুযায়ী জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছেন তাকে চট্টগ্রাম সেনানিবাস এর কমান্ড থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্টাফ কলেজে নিয়ে এসে কিছুদিন পর তাকে ডাইন আউট বাদ্যের সাথে বিদায় দেবেন। খবরটা আমরা যখন জানি তখন জেনারেল মঞ্জুরের পক্ষেও না জানার কোনও কারণ নেই। এটা জেনারেল গুডেরিয়ানের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই বিষয়টি নিয়ে আমাদের তেমন মাথাব্যথা নেই, কিন্তু এর পেছনে জেনারেল এরশাদ যে চিকন খেলা খেলছেন তার পরিণতিটা হবে মারাত্মক। তাই এই বিষয়টি আমাদের ভাবিয়ে তুলেছে! তার সেই খেলা সম্পর্কে জেনারেল জিয়াও অবগত নন। আমাদের জেনারেল গুডেরিয়ান বা তার সহযোগী মানে তোমরাই বা জেনারেল এরশাদের দুরভিসন্ধিমূলক পরিকল্পনা সম্পর্কে কতটুকু জানো কিংবা একেবারেই কিছু চিন্তা করছো কিনা বা বোঝার চেষ্টা করছো কিনা জানি না।
বিষয়টি একটু খুলে বলেন ডালিম ভাই।
তোমরা কি লক্ষ করেছ সরীসৃপ ব্রিগেডিয়ার নাসিম (MS) এর মাধ্যমে কমান্ড লেভেলে ছাঁকা সব মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের মঞ্জুরের ডিভিশনে নিয়োগ দেয়া হচ্ছে। এতে কিন্ত জেনারেল গুডেরিয়ানের শক্তি বৃদ্ধি হচ্ছে না যদিও আপাত দৃষ্টিতে তাই মনে হচ্ছে। বরং বলবো, এরশাদ এই কূটচালের মাধ্যমে এক ঢিলে বেঁচে থাকা সব মুক্তিযোদ্ধাদের মেরে ফেলার পরিকল্পনা করছেন ভারত এবং RAW এর ইঙ্গিতে। এদের সাথে কিছু প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসারও তার চোখ কান হিসাবে জেনারেল মঞ্জুরকে উস্কে দেবার জন্য রাখা হয়েছে। মেজর মোজাফফর এবং লেফটেন্যান্ট খালেদ দুইজনই ঐ ধরনের উস্কানি দাতা। এরা দুইজনই প্রাক্তন রক্ষীবাহিনীর অফিসার।
এই চালের পরিণামটা হবে, মনজুর-জিয়া বচসায় জিয়া থাকবে না ক্ষমতার কেন্দ্রে। অন্যদিকে সেই সুযোগে জিয়ার প্রতি জনসমর্থন দেখে মঞ্জুরসহ সব জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধাকে ছেঁকে তুলে মেরে তার রাস্তা সাফ করে নেবে জেনারেল এরশাদ বিএনপির নিয়োগপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্টের কাঁধে বন্দুক রেখে। এটা তাকে করতেই হবে। তাছাড়া একজন প্রত্যাগত অফিসার হিসাবে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে ক্ষমতায় টিকে থাকা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। ভারতের নীলনকশাকে ত্বরিত গতিতে এগিয়ে নেবার জন্য আওয়ামী-বাকশালী এবং জাসদসহ তথাকথিত বামদলগুলো এবং কয়েকটি পীর ঘরানার ধর্মীয় ব্যবসাদারদের আশীর্বাদপুষ্ট নাটের গুরু এরশাদকে ক্ষমতায় বসাবে ভারত এবং RAW. এটা আমাদের ধারণা যার কোনও মূল্যই হয়ত দেবেন না জেনারেল গুডেরিয়ান মঞ্জুর। তারপরও ইচ্ছে হলে কথাগুলো তাকে জানাতে পারো। কথা শেষ করার আগে একটি সংক্ষিপ্ত উপসংহার টেনে দিচ্ছি তোমার সুবিধার্থে।
১। আজকের জিয়া শুধুমাত্র ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর এর বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের ফসলই নয়, এখন তার অবস্থান সবদিক দিয়েই অনেক মজবুত।
২। সামরিক বাহিনী থেকে ঐসব বিপ্লবীদের নিধন করে যারা তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করেছে জিয়া অতি কৌশলে প্রমাণ করেছেন বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে বাকশালের পতন এবং বিপ্লবী প্রক্রিয়ায় স্বৈরাচারী মুজিব এবং তার পরিবারের কয়েকজনের নিহত হওয়ার ঘটনার সাথে তার কোন সম্পর্কই নেই। একই সাথে একজন মধ্যপন্থী সমঝোতার রাজনীতিতে বিশ্বাসী ব্যক্তি হিসাবেও নিজস্ব গ্রহণযোগ্যতা প্রতিষ্ঠিত করেছেন বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলো, বিশেষ করে ভারতের কাছে।
৩। ভাঙ্গা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি আর কোদাল কাঁধে খাল-খনন কর্মসূচির চমক সৃষ্টি করে জিয়া ইতিমধ্যেই ব্যক্তিগত ভাবে জনগণের মধ্যে একটা সস্তা ইতিবাচক ইমেজ বানিয়ে নিতে সক্ষম হয়েছেন।
৪। বিশ্বপরিসরেও আজ জিয়ার একটা পরিচিতি গড়ে উঠেছে।
৫। জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও উদ্যোগ নেবার সময় জেনারেল মঞ্জুর হারিয়ে ফেলেছেন।
৬। মঞ্জুর চট্টগ্রামে শক্তিধর হলেও শুধুমাত্র চট্টগ্রাম নিয়েই বাংলাদেশ নয়।
৭। চট্টগ্রাম ছাড়া দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে তার তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ নেই।
৮। গোড়া থেকেই জেনারেল মঞ্জুর অফিসার শ্রেণির কাছেই শ্রদ্ধেয়, কিন্তু আম সৈনিক এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে তার তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা কখনোই তিনি গড়ে তোলার উদ্যোগ নেননি।
৯। শৃগালের গা থেকে ভেড়ার চামড়ার আবরণ খসে পড়ার আগে জিয়ার বিরুদ্ধে কিছু ঘটালে সেটা মঞ্জুরের জন্য বুমেরাং হয়ে দাড়াতে পারে।
১০। ঠিক এইক্ষণে জেনারেল জিয়াকে তার পথ থেকে সরানো কিছুতেই সম্ভব না। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতার আলোকেই বললাম।
দেশকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনতে তাকে ক্ষমতাচ্যুতই করতে হবে, কিন্তু সেই শক্তি জেনারেল গুডেরিয়ানের আছে বলে মনে হয়ে না। কারণ, ঢাকা, জয়দেবপুর, ঘাটাইল এবং সাভারের সব ইউনিট কমান্ডে বসানো হয়েছে জেনারেল এরশাদের অনুগতজনদের।
DGFI এবং DG NSI হিসেবে পোস্ট করা হয়েছে এরশাদের বিশ্বস্তজনদের। এসব সম্পর্কে জেনারেল জিয়া কতখানি অবগত আমি ঠিক জানি না। জেনারেল এরশাদ খুবই সতর্কতার সাথে ডাবল গেম খেলছেন জেনারেল নুরুদ্দিন, জেনারেল শওকত এবং ব্রিগেডিয়ার নাসিমদের আস্থায় নিয়ে।
১১। বিশ্বপরিসরে জেনারেল জিয়ার তুলনায় মঞ্জুরের পরিচিতি খুবই নগণ্য।
১২। জেনারেল গুডেরিয়ান এখন যতবড় বিপ্লবীই হয়ে থাকুন না কেন, নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্ব, জনসমর্থন, নীতি-আদর্শ ভিত্তিক একটি সঠিক সংগঠন এবং এক ঝাঁক প্রশিক্ষিত কর্মীবাহিনী ছাড়া তার পক্ষে কোন বিপ্লবই সফল করে তোলা সম্ভব নয়। বিপ্লবের এই সংজ্ঞা অনুযায়ী জেনারেল মঞ্জুর কি কখনো কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন? জবাবটা পরিষ্কার- না।
১৩। ক্ষমতায় এসে বিপ্লব সফল করে তোলার মতো দল, নেতৃত্ব কিংবা কর্মীবাহিনী যে তৈরি করা সম্ভব নয় তার জলজ্যান্ত প্রমাণ স্বয়ং রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া।
১৪। শেষ কথা হল, যতক্ষণ না ঢাকা সম্পূর্ণভাবে নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে ততক্ষণ জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার কোনও পদক্ষেপ হবে সম্পূর্ণ আত্মঘাতী।
শেষবারের মতো জানতে চাচ্ছি, জেনারেল মঞ্জুরের প্রচেষ্টাতে আপনারা কি কোনও ভাবেই কোনও সাহায্য করতে পারেন না? মৃদু হেসে বললাম
তুমি একজন পুরনো কমরেড। তাই এতো বিস্তারিত আলাপ করলাম। অন্য কেউ হলে করতাম না। আমাদের বিশ্লেষণটাতে যদি জেনারেল গুডেরিয়ানের কোন উপকার হয় সেটাই হবে আমাদের অবদান।
দেখো ভাই, আমরা বিপ্লবী। আমাদের কাছে কোনও ব্যক্তিবিশেষ তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। আমাদের কাছে আমাদের স্বপ্ন, আদর্শ, নীতিমালা, দেশ ও জাতীয় স্বার্থটাই মুখ্য। দেশ এবং জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আমরা সবকিছুই মেনে নিতে পারি। আমাদের সংগ্রাম ক্ষমতার সংগ্রাম নয়। জেনারেল মঞ্জুরকে বলবে, Although his days are numbered but that must not lead him to take any such desperate move which would turn out to be an infantile disorder and disastrous. জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতার ফলে আমরা বর্তমানে হেরে গেছি ঠিকই, তবে দিনও বদলায়- তার সাথে নতুন সুযোগও সৃষ্টি হয়। This is the bottom line.
সত্যি ডালিম ভাই, আমি শুধু অভিভূতই হচ্ছি না- অবাকও হচ্ছি দীর্ঘকাল বিদেশে নির্বাসনে থেকেও দেশের চলমান পরিস্থিতি সম্পর্কে এত সাবলীল আর সারগর্ভ বিশ্লেষণ কি করে করতে পারলেন, My hats off to you all! উত্তরটা খুবই সহজ। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ নিয়ে ভেবে চলেছি আমরা। যতদিন আল্লাহ্‌ পাক হায়াত রেখেছেন এই ধ্যানই হবে আমাদের বেঁচে থাকার প্রেরণা। সুযোগ ও সাধ্যমতো অতীতের মতোই ভবিষ্যতেও কাজ করে যাবো দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সব চাওয়া-পাওয়ার উর্ধ্বে থেকেই। অনেক দিন পর অনেক আলাপ হল। আর কিছু জিজ্ঞেস করার না থাকলে চলো ওঠা যাক। না, আর কিছু জিজ্ঞেস করার নেই। কবে ফিরছো?
দু’ এক দিনের মধ্যেই। বিদায় নেবার আগে ছোটো ভাই জানতে চাইলো ভবিষ্যতে যোগাযোগ করতে পারবে কিনা। জবাব দিলাম অবশ্যই। সবাইকে আমাদের সালাম আর দোয়া জানিও। আমাদের জন্যও তোমরা দোয়া কোরো।
নিশ্চয়ই, ইন শাহ্‌ আল্লাহ।
আল্লাহ্‌ হাফেজ।
শেষ হল আমাদের বৈঠক।
জেনারেল মনজুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, জেনারেল এরশাদের ক্ষমতা দখল
প্রিয় কমরেড যা জানিয়ে গেলো তাতে পরিষ্কার বুঝতে পারলাম সবকিছুই পরিকল্পনা অনুযায়ী এগুচ্ছে। চীনে হাসিনাকে সমঝোতার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনার বিষয়টি জিয়া নিজেই যখন স্বীকার করেছিলেন তখন আমি তাকে বলেছিলাম, মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলো বিশেষ করে সৌদি আরব এবং পাকিস্তানের প্রত্যাশা জামায়াতে ইসলাম-এর আমীর প্রোফেসর গোলাম আজমকে বাংলাদেশে ফিরে আসার অনুমতি দিন। তাদের এই খায়েশটা পূরণ করলে রাজনৈতিকভাবে আপনি লাভবান হবেন। একদিকে জামায়াতকে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে তিনি একটি হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করতে পারবেন। অন্যদিকে ঐ সমস্ত ধনী প্রভাবশালী মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন নিয়ে OIC-তে জেনারেল জিয়া তার অবস্থান মজবুত করতে সমর্থ হবেন। এতে দেশ ও জাতির লাভ হবে। তিনি আমার এই প্রস্তাবনায় তার নিজের স্বার্থটা বুঝতে পেরে জনাব গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার সুযোগ করে দেন। জামায়াতের সাথে আমার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না। তবে জনাব মওদুদীর প্রকাশিত কিছু লেখা পড়ে তাকে একজন প্রগতিশীল ইসলামিক চিন্তাবিদ হিসাবেই গ্রহণ করেছিলাম। গণমানুষের কল্যাণে বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডকে ইসলাম সমর্থন করে। এ বিষয়ে তার যুক্তিগুলো বেশ জোরালো। মার্ক্সসীয় দর্শনের ভিত্তি হল দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদ। মানুষের জাগতিক জীবনের পরিসীমার মধ্যেই মূলত সীমিত তার দর্শন। মানুষের আধ্যাত্মিক জগতের আত্মিক চাহিদা এবং পরকাল যার সাথে ঈশ্বরের অস্তিত্ব জড়িত সেটাকে কার্ল মার্ক্স মেনে নেননি। তাই তার মতবাদকে নাস্তিকতা বলে আখ্যায়িত করা হয়।
পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের বাইরে অন্য কিছুর অস্তিত্বে বিশ্বাস করেননি কার্লস মার্ক্স। ধরা, ছোঁয়া, অনুভূতি এবং দৃষ্টির অগোচরেও যে কিছু থাকতে পারে সেটা মার্ক্স মেনে নেননি। কিন্তু এর সপক্ষে তেমন কোনও অকাট যুক্তিও দিতে পারেননি কার্ল মার্ক্স। ধরা যাক, আমাকে চোখ বেঁধে একটা কামরায় ঢোকানো হল। আমি পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে ঘরে কি আছে কি নেই কিছুই বুঝতে পারছি না, অনুভবও করতে পারছিনা। তার মানে কি ওই ঘরে কিছুই নেই? নাও থাকতে পারে আবার থাকতেও পারে। তাই মার্ক্স কি করে আবিষ্কার করলেন যে ধরা, ছোঁয়া, দেখার বাইরে কিছু থাকতে পারে না? তাছাড়া বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের জটিল মহাসৃষ্টি এবং তার নিয়ামক শক্তি সম্পর্কেও কার্ল মার্ক্স কোনও কিছুই তেমন পরিষ্কারভাবে বলেননি। একটি পরিবার চালানোর জন্য একজন গৃহকর্তার প্রয়োজন হলে এই অসীম সৃষ্টি জগতটাকে সুচারুভাবে পরিচালিত করার জন্যও যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা চলে একজন কর্তার প্রয়োজন অবধারিত। আর সেই কর্তা হবেন তিনিই যার রয়েছে সমগ্র সৃষ্টি সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান। আর সেই জ্ঞান থাকা সম্ভব কেবলমাত্র সব সৃষ্টির স্রষ্টারই।
সুতরাং মানুষের মনোজগতের সব চিন্তা-ভাবনা দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের উপর নির্ভরশীল নয়। মানুষ আত্মিকভাবে বিচরণ করতে পারে বাস্তব জগতের পরিসীমার বাইরেও। মার্ক্সের অস্বচ্ছ দিকগুলো সম্পর্কে কোরআনে স্পষ্ট ব্যাখ্যা রয়েছে। কোরআনে পরিষ্কার ব্যাখ্যা ও নির্দেশ দেয়া আছে ইহকাল, পরকাল, বস্তুজগত, মনোজগত এবং বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সবকিছু সম্পর্কে। সৃষ্টিকারী এবং সৃষ্টি রহস্য সম্পর্কে আছে স্পষ্ট নির্দেশনা, যা আজঅব্দি কোনও ব্যক্তির পক্ষে খণ্ডানো সম্ভব হয়নি যুক্তিসঙ্গত ভাবে। তাই কোরআন হচ্ছে একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। আর কিতাবটি যে ঐশ্বরিক তার প্রমাণ হচ্ছে আজঅব্দি কোনও মনীষীর পক্ষেই এই ধরনের পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান প্রবর্তন করা সম্ভব হয়নি।বর্তমান আধুনিক যুগে জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রসার ঘটার পরও যখন বলা হচ্ছে আমাদের জগতের বাইরেও অনেক কিছুই আছে যার সম্পর্কে মানুষের কোন ধারণাই নেই, তবে ইহকালের পর পরকাল আছে সেটা কেনো মানা হবে না সেটা বোধগম্য নয়। এর ফলেই বর্তমান তথ্য-প্রযুক্তির কালেও বিশ্ব মানবতার উপর নাস্তিকতার চেয়ে আস্তিকতার প্রভাবই বেশি।ইসলামের প্রকৃত নির্যাস ও মূল্যবোধগুলোকে মওলানা মওদুদী অতি সহজ ভাষায় বর্ণনা করেছেন এবং প্রমাণ করেছেন ইসলাম বিশ্বমানবতার ধর্ম। সাম্য, সত্য, ন্যায়, ভাতৃত্ববোধ এবং শান্তির দিকনির্দেশনার জন্যই নাজেল করা হয়েছে ঐশ্বরিক কোরআন। কোরআনের বিধান রক্তমাংসের মানুষের পক্ষে কি করে পালন করা সম্ভব জাগতিক এবং আধ্যাত্মিক ক্ষেত্রে তার সর্বোৎকৃষ্ট উদাহরণ ছিলেন স্বয়ং হযরত মুহাম্মদ সাল্লেল্লাহু ওয়ালাইহি ওয়াসসাল্লাম। বিশ্বনবী মোহাম্মদ-এর মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান কোরআন নাজেল হয়। কোরআনেই সৃষ্টিকর্তা বলে দিয়েছেন, কোরআন পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান। কোরআন প্রেরণের পর আর কোনও নবী পৃথিবীতে পাঠানো হবে না। তাই হযরত মোহাম্মদ সাল্লাল্লাহু ওয়ালাইহি ওয়াসসাল্লাম (তাঁর উপর শান্তি বর্ষিত হউক)-কে বলা হয় শেষ নবী।
মাওলানা মওদুদীর তত্ত্বের উপর নির্ভর করে জামায়াতে ইসলামী নামের রাজনৈতিক দল পাকিস্তানসহ বিশ্বের বেশ কয়েকটি মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রে প্রতিষ্ঠিত হয়। ঐসব দল মওলানা মওদুদীর ইসলামী রাষ্ট্র এবং রাজনৈতিক দর্শনের ব্যাখ্যা অনুযায়ী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আদর্শ ইসলামিক রাষ্ট্র এবং সমাজ ব্যবস্থা কায়েমের সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। মাওলানা মওদুদীর লেখার জনপ্রিয়তা ও গ্রহণযোগ্যতা অতিদ্রুত মুসলিম জগতে তাকে অধুনাকালের একজন শ্রেষ্ঠ ইসলামিক চিন্তাবিদ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করে। একই সাথে সম্প্রসারণ ঘটে জামায়াতে ইসলামীর। কিন্তু বর্তমানে নানা বিচ্যুতির কারণে জামায়াতে ইসলামীর অগ্রগতিতে ভাটা পড়েছে কমবেশি প্রতিটি দেশেই। জনাব মওদুদীর আপোষহীন সংগ্রামের পথ থেকে সরে এসে প্রচলিত ধারার সমঝোতার নোংরা ক্ষমতার রাজনীতির অংশ হয়ে পড়াটাও জামায়াতে ইসলামীর জনপ্রিয়তা হ্রাসের একটি প্রধান কারণ। তৃতীয় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের গণবিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদীদের দ্বারা গঠিত বিদেশী শক্তিসমূহের মদদপুষ্ট দলগুলোর পাতানো খেলার রাজনীতিরই অংশীদারিত্ব করে চলেছে জামায়াতে ইসলামী প্রায় সব দেশেই। নেতৃত্ব হয়ে পড়েছে দেউলিয়া। সেটাই সংক্রমিত হচ্ছে সর্বস্তরে। তারপরও মাওলানা মওদুদীর কদর রয়েছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। যেকোনো দেশ এবং জাতির ভবিষ্যৎ নির্ভর করে রাজনৈতিক ভাবে সচেতন তরুণ প্রজন্মের উপরেই।
লন্ডনে বসেই খবর পাচ্ছি, জিয়ার সাথে মঞ্জুরের সম্পর্কে দ্রুত অবনতি ঘটছে। তারই ফলশ্রুতিতে হঠাৎ জেনারেল মনজুরকে চট্টগ্রামের কমান্ড থেকে সরিয়ে ঢাকায় স্টাফ কলেজের প্রধান হিসাবে নিয়োগপত্র ইস্যু করা হল সেনাসদর থেকে। এতে সতর্ক ঘণ্টা বেজে উঠলো। জেনারেল গুডেরিয়ান বুঝতে পারলেন এরপর তাকে আর্মি থেকে আদবের সাথে বেড় করে দেয়া হবে। তাকে সরিয়ে দেবার পর তার আস্থাভাজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের উপর খড়গ নেমে আসবে। অপমানে ক্ষোভে মরিয়া হয়ে উঠলেন জেনারেল মনজুর। সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন জেনারেল গুডেরিয়ান, ঢাকায় স্টাফ কলেজে যাওয়ার হুকুম মানা চলবে না। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জিয়ার সাথে শেষ বোঝাপড়া করতে হবে। ইতিমধ্যেই হাসিনা এবং রেহানাকে রাষ্ট্রীয় সম্মানের সাথে ফিরিয়ে এনেছেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়া বসন্তের কোকিল হিসেবে পরিচিত ডঃ কামাল হোসেন, তোফায়েল আহমেদ এবং ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মধ্যস্থতায়। হাসিনাকে অধিষ্ঠিত করা হল পুনর্জীবিত আওয়ামীলীগের চেয়ারপার্সন হিসেবে। তাদের সব পৈতৃক সহায় সম্পত্তি এমনকি পার্টি ফান্ড সবকিছুই ফিরিয়ে দিলেন জিয়া। রাষ্ট্রীয়ভাবে তাদের নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে দিয়ে ভারতের মনোরঞ্জন করতে অতি উৎসাহী হয়ে উঠেছিলেন জিয়া। এই কাজটি একমাত্র তখনকার অবস্থায় জিয়ার মতো একজন জনপ্রিয় নেতার পক্ষেই করা সম্ভব ছিল মৃতপ্রায় আওয়ামীলীগকে পুনর্জীবন দান করে শেখ পরিবারের সদস্যদের রাজনীতিতে পুনর্বাসন করা। জেনারেল এরশাদের পক্ষে কিছুতেই সম্ভব ছিল না এই কাজ দু’টি করা। কাজ দু’টি হয়ে যাবার পর আওয়ামী-বাকশালীদের সতেজ করার জন্য প্রয়োজন জিয়ার নয়, এরশাদের। ভারতের কাছে জেনারেল জিয়ার প্রয়োজন যে ফুরিয়ে যাবে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগের রাজনীতিতে পুনর্বাসনের পর, সেটা জিয়ার মতো ধূর্ত খেলোয়াড়ও কিন্তু রাজনীতির কূট চাল আঁচ করতে পারেননি।
এমনই সন্ধিক্ষণে ২৯-৩০শে মে ১৯৮১ সালে, হাসিনার দেশে ফেরার ১৩-১৪ দিনের মাথায় প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান চট্টগ্রামে এক রাজনৈতিক সফরে যান। চট্টগ্রামের সার্কিট হাউসে অবস্থান গ্রহণ করেন প্রেসিডেন্ট জিয়া। সারাদিন পার্টির কাজে ব্যস্ত থাকেন প্রেসিডেন্ট। রাতের খাবার খেয়ে বৃষ্টি ঝরা রাতে তিনি যখন ঘুমিয়েছিলেন তখন একদল তরুণ অফিসার আক্রমণ চালায় সার্কিট হাউজে। ঘরের দরজা খুলতেই সাব মেশিনগানের গুলিতে ঝাঁজরা হয়ে মুখ থুবড়ে পড়ে যান স্লিপিং স্যুট পরা প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়া। আক্রমণকারীদের গুলিতে মারা যায় তার ADC ও কয়েকজন স্টাফ অফিসার। পাশের ঘরে অবস্থানরত বদরুদ্দোজা চৌধুরী ও বাকি সফরসঙ্গীরা কাঁকতলিয় ভাবে পালিয়ে গিয়ে প্রাণে বাঁচে। মৃত ব্যক্তিদের লাশ নিয়ে ফিরে যায় আক্রমণকারীদের দল। এরা সবাই এসেছিল চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে।
কাকতালীয় ভাবে জিয়াকে যখন গুলিতে ঝাঁজরা করা হচ্ছিল তখন হাসিনা আর সাজেদা চৌধুরী পলায়নরত অবস্থায় আখাউড়ায় ধরা পড়েন। জিয়ার মৃত্যু সংবাদ জানার পর জেনারেল মঞ্জুর চট্টগ্রাম বেতারকেন্দ্র দখল করে দেশবাসীকে জানান যে এক বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে রাষ্ট্রপতি জিয়া নিহত হয়েছেন। তিনি বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের কারণসমূহও একই সাথে দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের পক্ষে জনসমর্থনের আবেদন জানান। কিন্তু তার আবেদনে সাড়া দেয়নি জিয়ার প্রাণহানির ঘটনায় শোকাতুর দেশের আমজনতা। বরং দেশবাসী জেনারেল মঞ্জুরের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। একই ভাবে মঞ্জুর দেশের অন্যান্য সেনানিবাসগুলো থেকেও সমর্থন পেতে ব্যর্থ হন। ঢাকা থেকে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল শওকত, জেনারেল নুরুদ্দিন এবং ব্রিগেডিয়ার নাসিম এর মতো দু’মুখো সাপেরাও বাতাস বুঝে মঞ্জুরের ডাকে সাড়া না দিয়ে তার বিপক্ষেই অবস্থান নেন সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রমাণ করার জন্য। রাষ্ট্রপতি জিয়ার মৃত্যুর পর চট্টগ্রাম সেনানিবাস, বঙ্গভবন এবং সেনাসদরে ঘটনা প্রবাহ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলে। জিয়ার মৃত্যুর পর জাস্টিস সাত্তারকে নির্বাহী রাষ্ট্রপতির দায়িত্বে নিয়োগ করা হয় বিএনপি সরকারের তরফ থেকে। পরে তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন। বাস্তুঘুঘু সেনাপ্রধান গিয়ে উপস্থিত হন বঙ্গভবনে। সেখানে তিনি হতভম্ব রাষ্ট্রপতির কাছে জানতে চান বর্তমান অবস্থায় তার করণীয় কি। বিদ্রোহীদের দমন এবং দেশের স্থিতিশীলতা বজায় রাখার স্বার্থে যা কিছু করা বিবেচ্য তাই করার হুকুম দিলেন প্রেসিডেন্ট। এভাবেই নিজের ইচ্ছামতো সব কিছু করার অনুমতি আদায় করে জেনারেল এরশাদ সেনাসদরে ফিরে আসেন। অন্যদিকে বিধি বাম দেখে জেনারেল মনজুর নিজের প্রাণরক্ষার্থে ভাটিয়ারী থেকে ব্রিগেডিয়ার হান্নান শাহ্‌কে তার হেডকোয়াটার্সে ডাকিয়ে এনে সেনাসদরের সাথে যোগাযোগ করে একটা আপোষ রফা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেনাপ্রধান চতুরতার সাথে মঞ্জুরের সাথে কথা না বলে তার বিশ্বস্ত CGS জেনারেল নুরুদ্দিনের মাধ্যমে আলোচনা শুরু করেন। তিনি কুমিল্লা থেকে একটি ব্রিগেডকে শোভাপুর ব্রিজের পাড়ে পজিশন নেবার জন্য হুকুম দেন GOCকে। আলোচনা চলাকালে প্রয়োজনীয় ডেপ্লয়মেন্ট সম্পূর্ণ হবার পর চীফ জেনারেল এরশাদের পক্ষ থেকে মঞ্জুরের ডিভিশনের সবাইকে হাতিয়ার ত্যাগ করে কুমিল্লা থেকে পাঠানো কমান্ডারের কাছে মঞ্জুরসহ সবাইকে আত্মসমর্পণ করার নির্দেশ জারি করা হয়। গুডেরিয়ান জেনারেল এর পরিণাম বুঝতে পেরে তার অনুগত সব ব্রিগেড এবং ইউনিট কমান্ডারদের সবাইকে ডেকে আত্মসমর্পণের পরামর্শ দিয়ে তিনি তার পরিবার এবং কর্নেল মাহবুব ও কর্নেল মতিকে সঙ্গে নিয়ে বার্মায় পালিয়ে যাবার প্রচেষ্টায় চট্টগ্রাম সেনানিবাস ত্যাগ করেন। ইতিমধ্যে জিয়া এবং তার সাথে মৃত ব্যক্তিদের ঘটনার রাত্রিতেই সেনানিবাস থেকে কিছু দূরে এক পাহাড়ি এলাকায় কড়া নিরাপত্তায় সমাহিত করা হয়। পলায়নকালে পথিমধ্যে ইঞ্জিনিয়ার্স কোরের মেজর হাজি মন্নানের একদল সৈনিকের সাথে এনকাউন্টারে কর্নেল মাহবুব এবং কর্নেল মতি নিহত হন। মঞ্জুর তার পরিবার এবং কয়েকজন বিশ্বস্ত সঙ্গীসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। মঞ্জুরের পলায়নের পর চট্টগ্রামের বাকি সব অফিসার এবং সৈনিকরা সেনাপ্রধানের হুকুম অনুযায়ী অস্ত্র ত্যাগ করে আত্মসমর্পণ করে। মঞ্জুরের বিশেষ আস্থাভাজন প্রায় ২০ জন সিনিয়র মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে বন্দী করা হয়। পলায়নরত মঞ্জুর পরিবার কর্নেল মতি এবং কর্নেল মাহবুবের মৃত্যুতে বিশেষভাবে ভেঙ্গে পড়েন। মানসিকভাবে বিধ্বস্ত এবং শারীরিক ভাবে ক্লান্ত মঞ্জর পরিবার এবং তার সঙ্গীরা ফটিকছড়ির এক কৃষকের পর্ণকুটিরে কিছুক্ষণ বিশ্রামের জন্য যাত্রা স্থগিত করে আশ্রয় নেন। ইতিমধ্যে মঞ্জুরের ব্যর্থ অভ্যুত্থান, চট্টগ্রাম সেনাছাউনির ২৪তম ডিভিশনের সেনা সদস্যদের সারেন্ডার, প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যু এবং জেনারেল মঞ্জুরের পলায়নের খবর ক্রমাগত টিভি এবং রেডিওতে প্রচারিত হচ্ছিল। যার ফলে ঐ পর্ণকুটিরের সংলগ্ন একটি বাড়ির কোন এক ব্যক্তি সন্দেহপ্রবণ হয়ে মঞ্জুর এবং তার সঙ্গীদের আশ্রয়স্থলের খবরটি নিকটবর্তী থানায় জানিয়ে দেয়। খবর পেয়ে পুলিশ ঐ পর্ণ কুটির ঘেরাও করে সপরিবারে জেনারেল মঞ্জুরকে গ্রেফতার করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে নিয়ে গিয়ে সেনাবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। ২৪ ডিভিশনের নবনিযুক্ত কমান্ডার সঙ্গে সঙ্গে সেনাসদরে মনজুরের গ্রেফতারের খবরটি পৌছে দেন। পুলিশ যখন বন্দী অবস্থায় মঞ্জুরকে সপরিবারে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাচ্ছিল তখন জেনারেল মঞ্জুর ক্রমাগত মিনতি করছিলেন তাকে সেনাবাহিনীর হাতে সোপর্দ না করে কারাগারে প্রেরণ করার জন্য। কিন্তু পুলিশ তার সেই আকুতি মানেনি। খবর পাওয়া মাত্র জেনারেল এরশাদ হুকুম দেন বন্দী মঞ্জুর, তার পরিবার এবং অন্য সবাইকে অফিসার্স মেসে কড়া নিরাপত্তায় রাখার জন্য। এরপর জেনারেল এরশাদ তার বিশ্বস্ত DGFI কে ডেকে পাঠান। একান্তে বৈঠকের পর ক্যাপ্টেন এমদাদকে ঢাকা থেকে চট্টগ্রামে পাঠানো হয়। বিশেষ দায়িত্ব নিয়ে ক্যাপ্টেন এমদাদ আসছে সেটা চট্টগ্রামের নব নিয়োজিত ভারপ্রাপ্ত GOC কে জানিয়ে দেয়া হয়। ক্যাপ্টেন এমদাদ চট্টগ্রাম পৌঁছেই জেনারেল মঞ্জুরের সাথে একান্তে দেখা করে কয়েক মিনিট কথাবার্তার পর মঞ্জুরকে বন্দী অবস্থায় গুলি করে হত্যা করে ঢাকায় ফিরে আসে। এরপর গণমাধ্যমে জোর প্রচারণা চালানো হয় পলায়ন রত মনজুরকে সপরিবারে পুলিশ গ্রেফতার করে ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে আসার পর ক্ষুব্ধ সৈনিকদের গুলিতে জেনারেল মঞ্জুর মারা যান। এরপর প্রেসিডেন্ট সাত্তারের অনুমতি সাপেক্ষে চট্টগ্রাম জেলের ভেতরে এক ক্যামেরা ট্রায়ালের মাধ্যমে ২০ জন বন্দীর মধ্যে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধা অফিসারকে ফাঁসি দেয়া হয়। বন্দী অফিসারের মধ্যে দুইজন অফিসার মেজর মোজাফফর এবং মেজর খালেদ দুইজনই প্রাক্তন রক্ষীবাহিনী অফিসার সন্দেহজনক ভাবে বিচার থেকে অব্যাহতি পায় এবং পরে দেশত্যাগ করতে সমর্থ হয়। এই দুইজন অফিসারই জেনারেল এরশাদের অনুপ্রবেশকারী গুপ্তচর হিসাবে কাজ করছিল। ক্যাপ্টেন এমদাদকেও একই ভাবে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। এই বিচার প্রক্রিয়া দেশের আইন অনুযায়ী নিরপেক্ষ ছিল কিনা সেটা আজও প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে।
বিপ্লবী নেতা সিরাজ শিকদারকে বন্দী অবস্থায় এনকাউন্টারে মারা, কর্নেল তাহেরের ফাঁসির বিচার, আগস্ট এবং নভেম্বর বিপ্লবের শীর্ষনেতাদের বিরুদ্ধে অসাংবিধানিক ভাবে খুনের মামলা দায়ের করে তাদের মৃত্যুদণ্ড প্রদানের রায় এবং ২০১০ সালের ২৮শে জানুয়ারি মধ্যরাত্রে হাসিনা সরকার কর্তৃক ৫ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলানো ও গলা কেটে হত্যা করা এবং BDR Carnage- এর প্রহসন মূলক বিচারগুলোর আইনি বৈধতা এবং স্বচ্ছতা প্রশ্নবিদ্ধ বিধায় দেশের জনগণ এবং বিশ্বপরিসরে এগুলো স্বীকৃতি পায়নি।
ঘটনার দ্বিতীয় দিনেই জেনারেল জিয়া এবং তার সাথে মারা যাওয়া অফিসারদের মরদেহ কবর থেকে উঠিয়ে ঢাকায় নিয়ে আসা হয়। শেরেবাংলা নগর লেকের উত্তর পাড়ে মরহুম রাষ্ট্রপতি জেনারেল জিয়াউর রহমানের মরদেহ দ্বিতীয়বারের মতো জানাজা পড়ে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় দাফন করা হয়। পরে সেখানে স্মৃতিসৌধও নির্মাণ করা হয়।
এরপর খুবই অল্প সময়ের ব্যবধানে ২৪শে মার্চ ১৯৮২ সালে সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদ এক ব্লাডলেস ক্যু-র মাধ্যমে জাস্টিস সাত্তারকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রপতির গদিতে উপবিষ্ট হন। তিনি সাময়িকভাবে সংবিধান স্থগিত রেখে দেশে সামরিক শাসন জারি করে দেশ পরিচালনা করতে থাকেন। তার ক্ষমতা গ্রহণ সম্পর্কে দেশী-বিদেশী সাংবাদিকরা আওয়ামীলীগ প্রধান শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি ছোট্ট জবাবে বলেছিলেন, I am not unhappy. তার এই প্রতিক্রিয়া দেশী-বিদেশী প্রচার মাধ্যমে বিশেষ খবর হিসাবে স্থান পায়। অতীব পরিতাপের বিষয় হল, বাংলাদেশের জন্মলগ্ন থেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় যারাই এসেছেন তারা সবাই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা হরণ করে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে অতি নির্মমভাবে নির্মূল করার চেষ্টা করে এসেছেন স্বেচ্ছাচারিতার মাধ্যমে সংবিধান লংঘন করে নির্বিচারে। এই প্রক্রিয়া লজ্জাকর স্বৈরতন্ত্রেরই বহিঃপ্রকাশ। কিন্তু এই বিষয়ে কোন তরফ থেকেই কেউই উচ্চবাচ্য করছেন না। অথচ সম্পূর্ণ স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা ছাড়া কোন সমাজেই সত্যিকারের গণতন্ত্র শেকড় গাড়তে পারে না। এই ন্যক্কারজনক কলঙ্কের কালিমা জাতি আজও বহন করে চলেছে।
নিউইয়র্কের পথে জেনারেল এরশাদের সাথে লন্ডনে সাক্ষাৎ
ক্ষমতা দখলের কিছুদিন পর রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ নিউইয়র্ক এ জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগদানের পথে লন্ডনে যাত্রা বিরতিকালে আমার সাথে দেখা করার ইচ্ছে প্রকাশ করেন। হাই কমিশনারকে নির্দেশ দেয়া হয় সব ব্যবস্থা পাকাপাকি করে রাখার জন্য। তিনিই ঠিক করলেন, যে দিন প্রেসিডেন্ট লন্ডন পৌঁছাবেন তার পরদিন সকালে হিলটনে তার স্যুইটেই প্রাতঃরাশে আমাকে যেতে হবে। কারণ, মিটিং-এর পরই তাকে রওনা হতে হবে নিউইয়র্কের উদ্দেশে।
নির্ধারিত দিনের দিবাগত রাতে প্রেসিডেন্ট এসে পৌঁছালেন লন্ডনে। পরদিন হাই কমিশনার সকালে গাড়ী পাঠিয়ে দিলেন। পৌঁছালাম তার হোটেল স্যুইটে। ঢুকেই দেখি পায়জামা-পাঞ্জাবী পড়ে জায়নামাজে বসে তসবিহ হাতে ওজিফায় তন্ময় জেনারেল এরশাদ। সামনেই রাখা মাঝারি আকারের একটা কোরআন শরিফ। আমার রুমে প্রবেশের শব্দে উঠে দাড়িয়ে তসবিহ হাতেই এগিয়ে এসে আমাকে জড়িয়ে ধরে উষ্ণ সম্বর্ধনা জানালেন। এখানেই নাস্তা করতে করতে আমরা আলাপ করবো বলেই ADC-কে যথাযথ নির্দেশ দিয়ে তিনি আমাকে নিয়ে বসলেন। বললেন চীন সফরকালে তুমি যা বলেছিলে সেটাই সত্যে পরিণত হল আল্লাহ্‌র অসীম করুণায়। মঞ্জুরের ব্যর্থ সেনা অভ্যুত্থানের পর দেশ পরিচালনার দায় আমার উপরই এসে পড়লো! স্যার, পড়লো না বলে আপনার বলা উচিৎ ছিল দায়-দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হল। তুমি হয়তো বা ঠিকই বলছো! তবে ক্ষমতার লোভে নয়, দেশের সার্বিক অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ ছাড়া আর কোনও উপায় ছিল না। যাক, বলো কেমন আছ তোমরা সবাই?
আল্লাহ্‌র অসীম কৃপায় বেঁচে আছি।
জিয়া দেশটাকে সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলো। শুধু তাই নয়, তিনি তোমাদের উপরও অত্যন্ত অবিচার করেছেন। আমি দেশে ফিরেই এর প্রতিকার করবো ইন শা আল্লাহ্‌। তোমাদের সবাইকে চাকুরিতে পুনর্বহাল করবো বিগত দুই বছরের প্রাপ্য সব বেনিফিটস সহ।
স্যার, এই সংবাদটা জানাবার জন্যই কি আপনি আমাকে নাস্তা খাওয়ার নিমন্ত্রণ জানিয়ে সাতসকালে ডেকে পাঠিয়েছেন?
ঠিক তা নয়। তোমাদের চাকুরিতে পুনর্বহাল করাটা আমার নৈতিক দায়িত্ব, সেটা জানানোর জন্য তোমাকে ডেকে পাঠাইনি আমি। অতীতে তুমি আমাকে যেভাবে সাহায্য কোরেছ তার পটভূমিতে আগামীতেও আমার রাজনীতিকে এগিয়ে নেয়ার জন্য তোমাদের অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে একই ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করবে সেই প্রত্যাশাটাই তোমাকে ডেকে পাঠানোর মুখ্য উদ্দেশ্য।
স্যার, আমরা সবাই ব্যক্তিগত সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। দেশ ও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের উৎসর্গকরে দিয়েছি মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের সিদ্ধান্তের সাথে সাথেই। আমরা যেখানে যেই অবস্থাতেই থাকি না কেনো আমাদের বাঁচার প্রেরণা মাত্র একটাই।
‘৭১-এর চেতনা ভিত্তিক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের স্বপ্নের বাস্তবায়ন। জিয়ার মতোই আপনি বাঙ্গালীহয়েওদেশও মাটির সাথে তেমনভাবে পরিচিত নন। তাই, অতি সহজ ভাবেই বলা চলে জিয়ার পদাঙ্ক অনুসরণ করে রাজনীতি করা ছাড়া আপনার অন্য কোনও উপায় নেই। জিয়ার উপরে আপনার একটাই প্লাস পয়েন্ট রয়েছে। জেনারেল জিয়া বুঝেই হউক আর না বুঝেই হউক সামরিক বাহিনীতে যে বিভাজন নীতি অবলম্বন করে চলেছিলেন সেটা আপনার অনুসরণ করার প্রয়োজন আর নেই। মুঞ্জুরের হঠকারিতার সুযোগে মুক্তিযোদ্ধা-অমুক্তিযোদ্ধা দ্বন্দ্বটির পরিসমাপ্তি ঘটেছে। নীতি-আদর্শ ভিত্তিক রাজনীতিতে যে সমস্ত সেনা সদস্যরা বিশ্বাস করতো তাদের শিকড় উপড়ে ফেলে দিয়েছিলেন প্রয়াত জেনারেল জিয়া। তাই বর্তমান সেনাবাহিনীকে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই একটি পেশাদার বাহিনী হিসেবে গড়ে তুলতে আপনার পক্ষে কষ্টকর হবে না। সুশৃঙ্খল অধীনস্থ সেনাবাহিনী আপনার জন্য হবে স্বস্তিকর। এ বিষয় আমাদের তেমন কিছু করণীয় নেই। রাজনীতির ক্ষেত্রেও আমাদের একসাথে কাজ করাটা কোনও পক্ষের জন্যই সম্ভব কিংবা লাভজনক হবে না। তবে দেশও জাতীয় স্বার্থে কোনও ক্রান্তিলগ্নে যদি কিছু করার থাকে সেটা অবশ্যই আমরা বিবেচনা কোরবো, তাতে যদি আপনি ব্যক্তিগত ভাবে লাভবান হন তার প্রতিদানে আপনার কাছ থেকে আমরা কিছুই চাইবো না। এবার আপনার দোষ-গুণ সম্পর্কে কিছু বলবো যেহেতু আপনি অস্ত্রের মুখে একজন নির্বাচিত রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে ক্ষমতা ছিনিয়ে নিয়েছেন। এই অবস্থায় আপনাকে ব্যক্তিগত চারিত্র সম্পর্কে সতর্ক হতে হবে। চারিত্রিক দুর্বলতাগুলো পরিত্যাগ করতে পারলে ঐ দায়ভারটা কিছুটা কমতে পারে। আপনার সাথে আমাদের সম্পর্ক বজায় রাখাটাও সহজ হবে ভবিষ্যতে। তাছাড়া রাষ্ট্রপতি হিসেবে চারিত্রিক ভাবে জনগণ আপনাকে সর্বদাই জেনারেল জিয়ার সাথেই তুলনা করবে। এবার রাজনীতি সম্পর্কে কয়েকটি কথা, স্যার। অবশ্যই।
রাজনৈতিক কোনও ফায়দার জন্য ধর্মীয় ব্যবসায়ীদের সাথে গাঁটছড়া বাঁধবেন না, এরা শুধু ইসলামের শত্রুই নয়, দেশ ও জাতীয় শত্রুও বটে। সঠিক ইসলামিক মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাই হওয়া উচিৎ আপনার আগামী দিনের রাজনীতির প্রেরণা এবং চালিকা শক্তি কিন্তু এইভাবে রাজনীতি আপনার পক্ষে আদও সম্ভব হবে কিনা সেটা আপনাকেই ভাবতে হবে। আমার পক্ষে ধারনা করা ঠিক হবে না। তবে অভিজ্ঞতা থেকে একটা দ্রুব সত্য কথা আমি বলবোই সেটা আপনার কাছে গ্রহণীয় না হলেও।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, স্থিতিশীলতা, প্রগতি, অর্থনৈতিক সঙ্গতির প্রতি হুমকি হয়ে থাকবে প্রতিবেশি ভারত।স্বনির্ভর দেশ হিসাবে গড়ে ওঠার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে ভারত। যতদিন ভারতীয় ইউনিয়ন খণ্ডিত না হয়, ততদিন ভারত চাইবে না এই অঞ্চলের ছোট ছোট স্বাধীন দেশগুলো স্বনির্ভরতার উপর ভিত্তি করে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাক। কারণ, তাতে ভারতীয় ইউনিয়নের খণ্ডিতকরণ ত্বরান্বিত হবে। এটাও প্রমাণিত হবে, চলমান বিভিন্ন জাতির জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে পারলে তারাও নিজেদের প্রগতিশীলএবং সমৃদ্ধশালী জাতি এবং রাষ্ট্র হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষমহবে না। আগ্রাসী ভারতের হুমকির মোকাবেলায় ভারসাম্যতার প্রয়োজনেই আমাদের পররাষ্ট্রনীতির মূল হতে হবে গণচীন কেন্দ্রিক, এই কথাটা আপনি ইতিমধ্যেই চৈনিক নেতৃবৃন্দকে বলে এসেছেন। তাই নয় কি স্যার?
আমার কথায় জেনারেল এরশাদ বুঝতে পারলেন গণচীনে তার গোপন বৈঠকে আলোচিত বিষয়বস্তু সম্পর্কে আমি অবগত। আমার বিশ্বাস একটি টার্ম আপনি আওয়ামীলীগের সহযোগিতায় ক্ষমতা উপভোগ করতে পারবেন। তারপর আপনাকে হাসিনার পেটিকোটের নিচে বসিয়ে ভারত হাসিনাকে ক্ষমতায় নিয়ে আসবে। এর আগেই সম্ভব হলে প্রত্যক্ষ রাজনীতি থেকে আপনার অবসর নেয়ার সিদ্ধান্তই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। হাসিনার পেটিকোটের নিচে বসে ভারতের সেবাদাস হয়ে কাজ করে নিজেকে জাতীয় বেঈমান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করাটা সঠিক হবে বলে আমি মনে করিনা। ইতিহাসের কষ্টিপাথরে তো একদিন আপনাকেও যাচাই করা হবে।
এ ভাবেই শেষ হয়েছিল প্রাতঃরাশ বৈঠক। দেশে ফিরে প্রেসিডেন্ট এরশাদ তার কথামতো আমাদের সবাইকে আবার চাকুরিতে পুনর্নিয়োগ প্রদান করেন এবং আবার আমরা কূটনীতিক হিসেবে বিদেশে বিভিন্ন বাংলাদেশ দূতাবাসে যোগদান করি।

খালেদা জিয়া হলেন বিএনপির চেয়ার পার্সন
জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপিকে সাংগঠনিক ভাবেএকটি নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দল হিসাবে গঠন করে তোলার কোনও উদ্যোগ গ্রহণ করেননি জেনারেল জিয়া। নানামতের আর দলছুট সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদীদের নিয়ে দুর্নীতির অবাধ রাস্তা খুলে দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে এক ঝাঁক পোষা ‘ইয়েস ম্যান’তৈরি করা সম্ভব- কিন্তু একটি শক্তিশালী রাজনৈতিক দল গঠন করা সম্ভব হয় না। পরিণামে জিয়ার তিরোধানের পর জিয়া সর্বস্ব দলটিতে নেতৃত্বের কোন্দল, উপদলীয় বিভাজন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে।
সেই জটিল অবস্থা শারীরিক ভাবে অসুস্থ বর্ষীয়ান নেতা জাস্টিস সাত্তারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। ফলে CMH-এ চিকিৎ সাধীন থাকা কালেই ক্ষমতাধর জেনারেল এরশাদ অতি সহজেই তাকে পদত্যাগে বাধ্য করে নিজেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেন। ক্ষমতা গ্রহণের পরপরই তিনি বিএনপির সব ব্যাংক একাউন্ট বাজেয়াপ্ত করে ফেলার হুকুম জারি করেন। এরপর পার্টির সব কর্মকাণ্ড প্রায় বন্ধ হয়ে যায়।
পার্টির শোচনীয় অবস্থায় জেনারেল এরশাদের ঘোষিত জাতীয়পার্টিতে যোগদানের হিড়িক পরে যায় বিএনপির নেতাদের। ফলে পার্টি হিসাবে বিএনপির অস্তিত্বই প্রায় বিলীন হবার উপক্রম হয়। সেই সন্ধিক্ষণে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুর মধ্যস্থতায় গুটিকয়েক সিনিয়র নেতা, ছাত্রদল এবং যুবদলের কিছু ত্যাগী তরুণ নেতা-কর্মী গৃহবধূ খালেদা জিয়াকে অনেক চেষ্টা করে পার্টির চেয়ারপার্সন বানাতে রাজি করাতে সক্ষম হয়। এতে পার্টির অস্তিত্ব টিকে যায়। পার্টিকে পুনর্গঠনের সম্ভাবনাও সৃষ্টি হয়। শিশুভাই জেনারেল এরশাদ সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলেন বিধায় হয়তো মনে করেছিলেন জাতীয় স্বার্থে তার সিদ্ধান্তই ছিল মন্দের ভালো। মধ্যপ্রাচ্যের তেল সমৃদ্ধ কয়েকটি দেশের কর্ণধারেরা জিয়ার সাথে তাদের ব্যক্তিগত সম্পর্কের সুবাদে তার স্ত্রী খালেদা জিয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে কিছুটা আর্থিক সাহায্য ছাড়াও সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।তারা জেনারেল এরশাদকেও হেদায়েত প্রদান করেন যাতে জিয়ার দলের উপর অন্যায় অবিচার এবং জোর জুলুম না করা হয়।
সেই সময় বাংলাদেশের অর্থনীতি অনেকাংশে মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ ধনী দেশগুলোর উপর নির্ভরশীল বিধায় তাদের হেদায়েত অনিচ্ছা সত্ত্বেও জেনারেল এরশাদকে মেনে নিতে হয়। পর্যায়ক্রমে বিএনপির ব্যাংক একাউন্টগুলোও খুলে দিতে হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট এরশাদকে। এ সবের পরও ভারত জেনারেল এরশাদকে আশ্বস্ত করেছিলো, যে আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগের সহযোগিতা এবং সমর্থনে এরশাদ অবশ্যই প্রেসিডেন্সিয়াল এবং পার্লামেন্টারি নির্বাচনে জিতবেন। খালেদা জিয়া কিছুতেই এতো অল্পসময়ে ঘর সামলে জেনারেল এরশাদ এবং আওয়ামীলীগের মোকাবেলা করতে সমর্থ হবেন না। এরপরও জেনারেল এরশাদ আশ্বস্ত হতে পারছিলেন না তার ক্ষমতায় টিকে থাকার বিষয়ে। কারণ, জেনারেল মঞ্জুরের হঠকারি অভ্যুত্থান এবং প্রেসিডেন্ট জিয়ার মৃত্যুর সুবাদে কারাপ্রকোষ্ঠে তড়িঘড়ি করে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা সেনা অফিসারের ক্যামেরা ট্রায়াল সেরে তাদের ফাঁসি দেয়া এবং বিনাবিচারে জেনারেল মঞ্জুরকে বন্দী অবস্থায় সুচিন্তিত ভাবে হত্যার ফলে সামরিক বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া এবং ধূমায়িত ক্রোধক্রমশদানাবেঁধেউঠতে থাকে। সেটাই ছিল পাকিস্তান প্রত্যাগত জেনারেল এরশাদের মাথাব্যথার প্রধান কারণ।
তাই, তার আমাদের মতো মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের সাহায্যের প্রয়োজন। আমার কাছ থেকে তেমন কোনও সাড়া না পেয়ে জেনারেল একটা কূটচাল চাললেন। তিনি কর্নেল রশিদ আর কর্নেল ফারুক-এর সাথে সরাসরি যোগাযোগ করে একটা মুলো ঝুলিয়ে দিলেন তাদের নাকের ডগায়। তিনি তাদের বললেন, আগামীতে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে কর্নেল ফারুক যদি অংশগ্রহণ করতে রাজি থাকে তবে তিনি বিদেশে অবস্থানকারী আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের দেশে ফিরে নিজেদের দল গঠন করে জাতীয় রাজনীতি এবং সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণের অনুমতি দেবেন। তবে শর্ত একটাই, নির্বাচন পর্যন্ত কর্নেল ডালিম, কর্নেল পাশা, কর্নেল শাহরিয়ার এবং কর্নেল নূর দেশে ফিরবে না। নির্বাচনের পর অবশ্যই তারা দেশে ফিরতে পারবে। মুলোটা গিলে ফেললো দুই ভায়রা।
এর মূল কারণ ছিল দুইজনই এর মধ্যে বুঝে নিয়েছে, শুধু টাকার জোরে কিংবা আগস্ট বিপ্লবীদের একজন হয়েই দলীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত হবার কোন অবকাশ নেই প্রগশে। এখানে নেতৃত্বে কার কি অবস্থান হবে সেটা নির্ধারিত হবে যোগ্যতা এবংগণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতার ভিত্তিতে। আদর্শভিত্তিক দল প্রগশে ব্যক্তিগত প্রভাব, পারিবারিক আভিজাত্য, প্রতিপত্তি কিংবা অর্থবল দিয়ে নেতা কর্মীদের মূল্যায়নের কোন বিধান নেই পার্টি ম্যানিফেস্টোতে।

জেনারেল এরশাদের প্ররোচনায় রশিদ-ফারুক বানালো ফ্রিডম পার্টি
ভায়রাদ্বয় সিদ্ধান্তে উপনীত হয় নিজেদের নিয়ন্ত্রণে দল গঠন করে টাকার থলে হাতে ঝুলিয়ে আর ১৫ইআগস্টকে বেচে তারা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে নেবে অতি সহজেই আর অর্থের যোগান বন্ধ করে দিলে প্রগশ-এর হবে অপমৃত্যু। ফলে আমরা তাদের তাঁবেদার হয়ে রাজনীতি করতে বাধ্য হব। এ ভাবেই তারা দলে তাদের নেতৃত্ব নিশ্চিত করে রাখবে। এক উদ্ভট
বালখিল্য চিন্তা চেতনা! যাই হউক, একদিন ভায়রাদ্বয় আমাদের সাথে বৈঠকে এরশাদের প্রস্তাব আর তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে আলোচনায় বসলো। সব কিছু শুনে আমরা জিজ্ঞেস করলাম
প্রগশের কি হবে? জবাবে তারা বললো
জেনারেল এরশাদ যখন খোলা রাজনীতির সুযোগ দিচ্ছেন তখন গোপন রাজনীতির প্রয়োজন নেই। তাদের নতুন পার্টি, নাম ফ্রীডমপার্টি (FP)-এর সাথে প্রগশ এর মার্জ হয়ে যাওয়া উচিৎ।
কিন্তু যেখানে প্রগশের সাংগঠনিক কাজ অতিদ্রুত এগিয়ে চলেছে তখন তোমাদের নেতৃত্বে নতুন আর একটি দল গঠিত হলে সেটা নেতা-কর্মীদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে এবং একই সঙ্গে অনেক প্রশ্নেরও জন্ম দেবে। যার সঠিক উত্তর দেয়া কঠিন হতে পারে বিজ্ঞ রাজনীতিবিদের কাছে যারা আমাদের সাথে একত্রে রাজনীতি করতে রাজি হয়েছেন আমাদের উদ্দেশ্য, লক্ষ, রাজনৈতিক আদর্শ এবং ম্যানিফেস্টোতে বিশ্বাসকরে-অন্য কোনও লোভে নয়। এরপরও কথা থাকে। জেনারেল এরশাদ যেভাবে ক্ষমতা দখল করেছেন, তাকে বৈধতা দিতে কর্নেল ফারুকের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করার বিষয়টিও প্রগশের প্রেসিডিয়াম-এর সিদ্ধান্তের পরিপ্রেক্ষিতেই হওয়া উচিৎ। শুধু তোদের দুইজনের সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নাও হতে পারে পার্টির সংখ্যাগরিষ্ঠ নেতৃবৃন্দের কাছে। তাছাড়া জেনারেল জিয়াকে বিশ্বাস করে খোলা রাজনীতি করতে গিয়ে বিগত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক এবং তার পার্টির করুণ পরিণতি সম্পর্কে আমরা সবাই বিশেষ ভাবে অবগত। জেনারেল এরশাদকে বিশ্বাস করে আমাদের এবং ফ্রিডম পার্টিরও যদি তেমন পরিণতি হয় তাহলে আমাদের অবস্থা কি হবে এই বিষয়ে তোরা ভেবেছিস কি? আমরা মনে করি এরশাদ জিয়ার রাজনীতিতে তেমন কোনও পার্থক্য থাকবে না। তিনি যদি আমাদের প্রতি আন্তরিকই হতেন তবে বাকিদের বাদ দিয়ে শুধু তোদের দুই জনকেই রাজনীতি করতে দিচ্ছেন কি উদ্দেশ্যে সেটা সম্পর্কেও তদের ভাবা উচিত ছিল। রশিদ জবাবে বললো
আমরা সিদ্ধান্ত নিয়ে সেটা ইতিমধ্যেই জেনারেল এরশাদকে জানিয়ে দিয়েছি। সেই ক্ষেত্রে যারা আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে আমাদের দলে যোগদান করবে তাদের সাথে নিয়ে চলবো। বাকি যারা দ্বিমত পোষণ করবে তারা কি করবে সেটা তাদেরকেই ভেবে দেখতে হবে।
তার মানে এই দাঁড়াচ্ছে, রাজনৈতিকভাবে এতদিন সবাই জেনে এসেছে আমরা সবাই এক। কিন্তু এখন সবাইকে তোরা জানিয়ে দিতে চাচ্ছিস আমরা এক নই। এই ধরনের দ্বিধা বিভক্তি ভবিষ্যতে আমাদের সবারজন্যই ক্ষতিকর হবে। এই দিকটাও তোদের ভেবে দেখা উচিৎ ছিল। জেনারেল এরশাদকে কথা দেবার আগে অন্তত আমাদের সাথে তোদের দুইজনের আলাপ করাটা উচিৎ ছিল। প্রগশের কাজ কিন্তু আমরা সর্বসম্মতি ক্রমেই একত্রে শুরু করেছিলাম। এর কি জবাব দিবি তোরা? কর্নেল ফারুক বললো
তখন এই সুযোগটা ছিল না। এখন যখন সুযোগটা এসেছে তখন এটাকে হাত ছাড়া করা ঠিক হবে না বলেই আমরা জেনারেল এরশাদকে কথা দিয়ে এসেছি। One has to be pragmatic in politics.
অবশ্যই, তবে সেটাও করা উচিৎ পার্টির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী। আমার কথায় চুপ হয়ে গেলো দুইভায়রা ভাই। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে রশিদ বললো
আমাদের যা বলার বলে গেলাম। এখন তোরা কি করবি সেটা ভেবে জানিয়ে দিস।
তাদের কথাবার্তায় পরিষ্কার বোঝা গেলো তারা তাদের সিদ্ধান্তে অটল। তাদের এই ধরনের আচরণ আমাদের এক মহা সংকটে ফেললো।
আমরা সবাই বুঝতে পারলাম এই অবস্থায় প্রগশের কাজ আর এগিয়ে নেয়া সম্ভব হবে না টাকার অভাবে। তাই অবিলম্বে প্রগশের কাজ স্থগিত করে দিতে হবে শাহরিয়ার আর হুদাক।কারণটা নেতা-কর্মীদের বুঝিয়ে বলতে হবে। বলতে হবে স্বৈরচারী এরশাদ তার বেআইনি ভাবে ক্ষমতা দখলকে বৈধতা দেবার জন্য কর্নেল রশিদ আর কর্নেল ফারুককে প্রকাশ্য রাজনীতিতে অংশ গ্রহণের সুযোগ দিয়েছে এবং দুইজনই সেই সুযোগ গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্য সবার সাথে কোন পরামর্শ না কোরেই। কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের বেশিরভাগ নেতারা তাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করায় তারা একটি নতুন দল গঠন করছে। এই অবস্থায় প্রগশের প্রেসিডিয়াম সিদ্ধান্ত নিতে পারে প্রগশ নতুনপার্টিতে মার্জ করবে কি করবে না। প্রেসিডিয়াম সিদ্ধান্ত নেয় প্রগশ নিজের অস্তিত্ববজায় রেখে আগের মতোই গোপনে তাদের তৎপরতা চালিয়ে যাবে। একই সাথে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, স্বৈরাচারী এরশাদের সাথে প্রগশের কন সম্পর্ক থাকবে না। অর্থের সংকুলান সম্ভব না হলে প্রগশ নিজের সামর্থ অনুযায়ী অগ্রসর হবে। তবে ইতিমধ্যে কর্নেল রশিদ আর কর্নেল ফারুক যাতে দ্বিমত পোষণকারী আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন করতে না পারে সেই বিষয়ে কৌশলগত একটা পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পার্টির প্রেসিডিয়াম-এর এই সিদ্ধান্তটি ছিল বিশেষগুরুত্বপূর্ণ। সিদ্ধান্তগৃহীত হয়,
প্রথমে মেজর বজলুল হুদা পরে কর্নেল শাহরিয়ার ফ্রিডম পার্টিতে যোগ দেবে দুইভায়রাকে নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য।
রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেনারেল এরশাদ জিতলেন আওয়ামীলীগ সমর্থিত প্রার্থী হয়ে। পীর হাফেজ্জি হুজুর দ্বিতীয় এবং কর্নেল ফারুক তৃতীয় স্থান লাভ করে। সংসদীয় নির্বাচনে জেনারেলএরশাদের জাতীয়পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। জাতীয় সাধারণ নির্বাচনে ফ্রিডমপার্টি ১টি সিট লাভ করে, মেজর বজলুল হুদা (ফ্রিডম পার্টির সেক্রেটারি জেনারেল)। বিএনপি দুটো নির্বাচনই বয়কট করে। আওয়ামীলীগ এবং জামায়াতেইসলামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করে। জামায়াত ১০ টি আসনে জিততে সমর্থ হয়। শেখহাসিনা বিরোধীদলীয় নেতার আসন অলংকৃত করেন।
এভাবেই বন্দুকের জোরে ক্ষমতা দখলকারী ভারতের দালাল জেনারেল এরশাদ আওয়ামীলীগের সমর্থনে নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা উপভোগ করতে সক্ষম হন গায়ে গণতন্ত্রের লেবাস পরে। আমাদের অনুমানকে সঠিক প্রমানিত করলেন জেনারেল এরশাদ। জেনারেল জিয়া প্রণীত রাজনীতি হাইজ্যাক করে একই কায়দায় রাষ্ট্র পরিচালনা করতে থাকেন জেনারেল এরশাদ। ফলে, দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি, অপশাসন, শোষণ, নিপীড়ন তৃণমূল থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সর্বক্ষেত্রে ক্যান্সারেরমতো ছড়িয়ে পরতে থাকে দ্রুত। দূষিত হয়ে ওঠে দেশের রাজনীতি। এরশাদ আর হাসিনার চাপে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জিয়ার প্রতিষ্ঠিত বিএনপি দলের তখন খুবই করুণ হাল। সুযোগ সন্ধানী বাস্তুঘুঘুদের বিবর্জিত শূন্য খাঁচা পাহারা দিচ্ছেন তখন গৃহবধূ খালেদা জিয়া। প্রতিদিন গুটিকতক তরুণনেতা-কর্মীর সাথে পার্টি অফিসে বসে মাছি মেরে সময় কাটাচ্ছেনপার্টির চেয়ারপার্সন।
তার সেই দুঃসময়ে তারপাশে যারা ছিল তাদের মধ্যে বি চৌধুরী, সাইফুর রহমান, মীর্জা গোলাম হাফিয, যাদু মিয়া, মোস্তাফিজুর রহমান, তরিকুল ইসলাম। তরুনদের মধ্যে গয়েশ্বররায়, মীর্জা আব্বাস, খোকা, সাঈদ, বুলু, মাহফুজ, আলাল, রিজভী, খোকার নাম উল্লেখযোগ্য। বদরুদ্দোজাচৌধুরী, কর্নেল ওলি বীরবিক্রম এবং অন্যরা মাঝেমধ্যে পার্টি অফিসে আসাযাওয়া করতেন। বেগম জিয়া এবং তার দলের নিষ্ক্রিয়তা দেশের জাগ্রত জনতাকে হতাশ করতে পারেনি। দেশবাসী ক্রমশ এরশাদের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকে। দেশব্যাপী এরশাদবিরোধী আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকে জনগণের স্বতঃস্ফূর্ত অংশ গ্রহণের মাধ্যমে। জেনারেল এরশাদ এবং তার দলের জনপ্রিয়তায় দ্রুত ধস নেমে আসতে থাকে। সেইসময় দেশের ধর্মীয় মূল্যবোধেবিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদী আমজনতা বেগম খালেদা জিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো এরশাদ বিরোধী গণচেতনাকে সংগঠিত করে এরশাদ বিরোধী রাজনৈতিক গণআন্দোলন গড়ে তুলতে। এরফলে নতুনকরে জীবনীশক্তি ফিরে পায় নিষ্ক্রিয় দল বিএনপি আর এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের মাধ্যমে খালেদা জিয়া হয়ে ওঠেন দেশনেত্রী। ১৯৮৬ সালে জেনারেল এরশাদ যখন নির্বাচনের ব্যবস্থা করছিলেন তখন দেশের বড় দুইদল আওয়ামীলীগ এবং বিএনপির মধ্যে একটা সমঝোতা হয় যে এই দুই বড় দল জেনারেল এরশাদের অধীনে কোন নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করবে না। এই সমঝোতার পর লাল দীঘির ময়দানে এক জন সভায় দর্পভরে হাসিনা এলান করে, “যে এরশাদের নির্বাচনে অংশ গ্রহন করবে তাকে জাতীয় বেঈমান বলে আখ্যায়িত করা হবে”। কিন্তু নির্বাচনের ঠিক আগমুহূর্তেসেই সমঝোতা ভঙ্গ করে জেনারেল এরশাদের সাথে শেখ হাসিনা এক রাতে গোপন লংড্রাইভ থেকে ফিরে দেশবাসীকে হতবাক করে ঘোষণা দিলেন আওয়ামীলীগ নির্বাচনে অংশনেবে।নিয়েও ছিল যৌথআন্দোলনের পিঠে ছুরি মেরে।জামায়াতে ইসলামীও নির্বাচনে অংশ নেয়।
বিএনপি সেই নির্বাচন বয়কট করার সিদ্ধান্তে অটল থাকে। তখন থেকে দেশবাসী খালেদাকে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে আখ্যায়িত করে। বলা হয়ে থাকে, সেই মোহিনী রাতে লংড্রাইভে জেনারেল এরশাদ হাসিনাকে দিয়েছিলেন ১৭কোটি টাকা নির্বাচনে অংশ গ্রহণের সিদ্ধান্তের জন্য। এরশাদের নিয়োগপ্রাপ্ত বিশ্বস্ত DGFI জেনারেল আকবর তার সফর সঙ্গী হিসেবে ছিল এর প্রত্তক্ষ্য সাক্ষী। এরশাদ বিরোধী আন্দোলন যতই বেগবান হতে থাকলো ততই খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাও বৃদ্ধি পেতে লাগলো। সেই পাতানো খেলার নির্বাচনের ফলে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে নতুনমাত্রা সংযোজিত হল। আইন-শৃঙ্খলা ব্যবস্থার চরম অবনতি,লাগামহীন দুর্নীতির ফলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপর্যয় এবং সংকট, দ্রব্যমূল্যের ক্রমবর্ধমান ঊর্ধ্বগতি, রাষ্ট্রীয়সন্ত্রাস, ডাঃমিলনসহ অসংখ্য শান্তিপ্রিয় মানুষের প্রাণহানি, হয়রানি, মামলা, জেলজুলুম, অস্থিতিশীলতা, অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ ও জীবনের নিরাপত্তার জন্য শঙ্কিতমানুষ মরিয়া হয়ে ওঠে স্বৈরশাসককে ক্ষমতাচ্যুত করতে। দেশের ভিতরের এবং বাইরের খেলোয়াড়রা বুঝতে পারে এরশাদের পতন অনিবার্য। আওয়ামীলীগ এবং তাদের মুরুব্বি ভারতও সেটা বুঝতে পারে। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয় অবিলম্বে এরশাদের সঙ্গ ত্যাগ করে আওয়ামীলীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করে আন্দোলনে পুনরায় শরিক হবে। পার্টি হিসাবে আওয়ামীলীগের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই ঐ সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। জামায়াত ও আওয়ামীলীগের পদাংক অনুসরণ করে। এরশাদকে বোঝানো হল, ভবিষ্যতে খেলা চালু রাখার স্বার্থেই এই সিদ্ধান্ত। তাকে আশ্বস্তও করা হল লাইনে চললে তার কোনও ক্ষতি হবে না।
আশ্চর্যের বিষয় হল, তখনকার চলমান আন্দোলনের বিতর্কহীন একচ্ছত্র নেত্রী হয়েও খালেদা জিয়া শুভঙ্করের ফাঁকিটা ধরতে পারলেন না! সত্যই বিচিত্র বাংলাদেশের রাজনীতি!দুর্বার গণ-আন্দোলনের ফলে দেশজুড়ে অচলাবস্থার সৃষ্টি হওয়ায় জেনারেলএরশাদ সিদ্ধান্ত নিলেন খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে হুলিয়া জারি করে তাকে কারাবন্দী করার। কিন্তু ভারতীয় চাণক্যরা এরশাদকে জানান দেয় যে, শুধুমাত্র খালেদাকে জেলে পুরলে শেখ হাসিনা ও আওয়ামীলীগ সম্পূর্ণভাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে। তাই হুলিয়া জারি করতেহবে দু’জনের নামেই। তবে সরেজমিনে স্বৈরশাসকের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মূল লক্ষ্যহবে খালেদা জিয়া এবং তার সহযোগী অন্যান্য দলের নেতাকর্মীরা। এভাবেই ভারত তাদের বড়ে হাসিনাকে ভবিষ্যতের জন্য মাঠে জীবিত রাখতে সক্ষম হয়। ভারতের পরামর্শ অনুযায়ী বিশেষ আনুগত্যের সাথে রাষ্ট্রপতি এরশাদ দুইনেত্রীর বিরুদ্ধেই হুলিয়া জারি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। হুকুম জারি করা হল। হুলিয়া জারি করার পর প্রকাশ্য আন্দোলনের ময়দান ছেড়ে খালেদা জিয়া ও তার সহযোগী অন্যান্য নেতারাও আন্ডারগ্রাউন্ড যেতে বাধ্য হলেন। কিন্তু জেনারেল এরশাদের এই সিদ্ধান্ত তার জন্য বুমেরাংহয়ে উঠলো। গণ-আন্দোলন তীব্রতর হয়ে প্রায় গণবিস্ফোরণের পর্যায়ে পৌঁছালো। বিএনপির সাথে আলোচনার পর অন্যান্য দলের অতি উৎসাহী নেতৃবর্গ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন সারা দেশ থেকে জনসমুদ্র ঢাকায় সমবেত করে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করে রাষ্ট্রপতি এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করতে বাধ্য করা হবে। ফলে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচিও ঘোষিত হল।
সেই ঘোষণার সুযোগ নিয়ে প্রেসিডেন্ট এরশাদ নিজের অস্তিত্বও গদি বাঁচানোর জন্য তার হাতের শেষঅস্ত্র দেশে মার্শাল’ল জারি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন তার ঘনিষ্ঠ সহচরদের প্ররোচনায়। তার এই সর্বনাশা সিদ্ধান্তে যারা বিশেষভাবে সমর্থন জানিয়েছিলেন তাদের মধ্যে জেনারেল আতিক, জেনারেল সাদেক,জেনারেল আব্দুর রহমান, জেনারেল চিশ্তি, জেনারেল মান্নাফ, জেনারেল নুরুদ্দিন, জেনারেল মীরশওকত, জেনারেল মচ্ছু সালাম, জেনারেল মাহমুদুল হাসান, জেনারেল নাসিম, জেনারেল আশরাফ, ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ, ব্রিগেডিয়ার ওয়াহিদ,ব্রিগেডিয়ার রফিক,ব্রিগেডিয়ার আমসাআমিন, ব্রিগেডিয়ার হাফিজ, ব্রিগেডিয়ার নাসের, কর্নেল মুনিরুল ইসলাম চৌধুরী, কর্নেল মালেকের নাম উল্লেখযোগ্য।
এরা প্রায় সবাই ছিল পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসার। জেনারেল এরশাদের এইধরনের সিদ্ধান্তে দেশের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাড়াতে হবে। শুরু হবে এক প্রলয়ংকরী গৃহযুদ্ধ! দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পরবে দেশের সেনাবাহিনী সহআইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী সব বাহিনী। সেই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে রাষ্ট্রপতি অতি সহজেই আহ্বান জানাতে সক্ষম হবেন ভারতীয় সরকারের সাহায্যের জন্য ‘২৫বছরেরমুজিব-ইন্দিরা’ চুক্তির আওতায়। সেই মোক্ষম সুযোগটি লুফে নেবে ভারত। শক্তিধরভারতীয় বাহিনী ঢুকে পরবে দেশের ভেতর। তাদের প্রবল আগ্রাসনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। এরপর অন্তর্বর্তীকালীন বড়ে জেনারেল এরশাদ এবং তারসহচরদের সাথে গণ-অভ্যুত্থানের সম্ভাবনাকেও নস্যাৎ করে দিতে খুব বেশি সময় লাগবে না। ক্ষমতায় বসানো হবে হাসিনার নেতৃত্বে নব্য বাকশালীদের। তার সরকারের সহযোগিতায় গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান, সামরিক বাহিনী, বিভিন্নআইন-শৃঙ্খলা বাহিনী এবংএজেন্সি, রাজনৈতিকঅঙ্গন, আমলাতন্ত্র ও সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে জাতীয়তাবাদী এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী যারাই অবশিষ্ট আছে তাদের সমূলে উৎপাটন করা হবে। একই সাথে সব বাহিনী এবং এজেন্সিকে দলীয় বরকন্দাজ হিসেবে গড়ে তোলা হবে প্রতিপক্ষকে নির্মূল করার জন্য অতি সতর্কতার সাথে। ফলে বাংলাদেশকে পরিণত করা হবে একটি করদ রাজ্যে। অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশী মুসলমান জনগোষ্ঠীকে আবার হিন্দুদের দাসত্বের শৃঙ্খলে আবদ্ধ করা হবে। এভাবেই বাস্তবায়িত হবে ‘৭১-এর ভারতীয় চাণক্যদের প্রণীত সুদূরপ্রসারী নীলনকশা।
যেকোনো প্রকৃত দেশ প্রেমিক মুক্তিযোদ্ধার পক্ষে এই পরাজয় মেনে নেয়া কখনোই সম্ভব নয়। এই ধরনের সুযোগ না দেবার জন্যই ভারতের হাতের ক্রীয়ানক ব্রিগেডিয়ার খালেদএবংকর্নেলশাফায়াত জামিল যখন ২-৩রা নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ঘটিয়েছিলো তখন তাদের পরাজিত করার মতো শক্তি থাকা সত্ত্বেও সুচিন্তিত কৌশল গ্রহণ করে স্বেচ্ছায় সাময়িক ভাবে দেশত্যাগ করেছিলাম তাদের সাথে বোঝাপড়ার মাধ্যমে। নিজেদের শক্তি বলেই সেনা পরিষদের প্রকাশিত শীর্ষ নেতারা ব্যাংককে অবস্থান নিয়েও সক্ষম হয়েছিলেন ঐতিহাসিক ৭ই নভেম্বরের সফল সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটাতে। এই বিপ্লবে সেনাপরিষদের সাথে কর্নেল তাহেরের নেতৃত্বাধীন বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থাও যোগ দিয়েছিল সহযোগী শক্তি হিসেবে।এসম্পর্কে বিস্তারিত পরিকল্পনা দেশত্যাগের পূর্বেই করা হয়েছিল বঙ্গভবনে কর্নেল তাহেরের সাথে রুদ্ধদ্বার একদ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। এসম্পর্কে আমার পূর্বপ্রকাশিত বই ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’তে বিস্তারিত ভাবে লেখা আছে। পাঠকদেরপক্ষেএখন বইটি সংগ্রহ করা সম্ভব না হলে তারা নিম্নে দেয়া ওয়েব সাইট দুটোর যে কোনও একটি থেকে পছন্দ মতো বাংলা কিংবা ইংরেজিতে ডাউনলোড করে নিতেপারেন।ওয়েবসাইট এড্রেসঃ www.majordalimbubangla.com এবং www.majordalimbu.com
একই সুযোগ না দেবার জন্য জেনারেল জিয়ার অপ্রত্যাশিত বিশ্বাসঘাতকতার পরও সেনাপরিষদ এবং সংগঠনের নেতাকর্মীরা তার বিরুদ্ধাচরণ না করে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে নির্বাসিত জীবনকেই মেনে নিয়েছিলেন। কারণ তাদের সবাই ছিল সবচাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক। তারাকখনোই শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য ক্ষমতা লিপ্সু ছিলেন না। তাদের সংগ্রামের একমাত্র লক্ষ্য ছিল জনগণ তাদের নিজেদের ক্ষমতাশালী করে গড়েতুলুকএকটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী,ন্যায়, সাম্য এবং জাতীয় ঐক্যভিত্তিক সুখী বাংলাদেশ। এইস্বপ্ন তাদের মনের মণিকোঠায় চিরজাগরূক হয়ে থাকবে আমৃত্যুকাল।
এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের ক্রান্তিকালে খালেদা জিয়ার পাশে সেনা পরিষদ
এরশাদ বিরোধী আন্দোলন কালে আমি নাইরোবিতে রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করছিলাম। রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব ছাড়াও বাংলাদেশ থেকে আগত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে জাতিসঙ্ঘ কর্তৃক নিয়োজিত Peace Keeping or Peace Making Mission এ বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীর Contingent গুলোর দেখাশোনার দায়িত্বও প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে অর্পণ করা হয়েছিলো আমার উপর। এতেকরে একদিকে সেনা সদর, সামরিক বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে অধিষ্ঠিত পদস্থ অফিসারবৃন্দ এবং অন্যদিকে আফ্রিকায় আগত সেনা সদস্যদের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করা আমার জন্য সহজ হয়ে যায়। সেই সুবাদে পূর্বপরিচিত বিশ্বস্ত এবং আস্থাভাজন সুহৃদদের কাছ থেকে দেশের চলমান রাজনীতি এবং অবস্থা সম্পর্কে সামরিক বাহিনীতে প্রকাশ্য ও গোপন প্রতিক্রিয়ার বিষয় সব খবরাখবরই আমি জানতে পারছিলাম। বিভিন্ন সূত্র থেকে পাওয়া তথ্যসামগ্রীর সার সংকলন থেকে একটি বিষয় পরিষ্কার হয়ে ওঠে। স্বৈরতন্ত্রের বিরুদ্ধে গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের এরশাদ বিরোধী আন্দোলনকে কেন্দ্র করে এক গভীর ষড়যন্ত্র চালাচ্ছে সোভিয়েত সমর্থিত ভারত সরকার RAW-এর মাধ্যমে যাতে করে অতিসত্বর তাদের নীলনকশা বাস্তবায়িত করা যায়। গৃহযুদ্ধের দিকে ঠেলে দেয়া হচ্ছে বাংলাদেশকে। পরাধীনতার শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে আমাদের নিজস্ব স্বকীয়তা হারানোর আগেই কিছু একটা করতে হবে। ভেবে পাচ্ছিলাম না নির্বাসিত অবস্থায় আমাদের পক্ষে এই ক্রান্তিকালে গভীরষড়যন্ত্র এবং সংকট মোকাবেলা করা কি করে সম্ভব! সহযোদ্ধাদের সাথে আলোচনা হল।সবাই অভিমত জানালো, এই বিষয়ে যদি কিছু করার থাকে তবে আমাকেই অগ্রণীর ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। কারণ, বাস্তবতা এবং দৈনন্দিন কি ঘটছে সেটা জানার সুযোগ শুধু আমারই আছে। বিষয়টি নিয়ে আমার অনেকদিনের পুরনো পরীক্ষিত ভাতৃপ্রতিম বন্ধু গোলাম রব্বানি খানের সাথে আলোচনা করবো ঠিক করলাম।
রব্বানি পেশাগতভাবে একজন ব্যাংকার। পড়াশোনাশেষে পাকিস্তান আমলেই হাবিব ব্যাঙ্কে অফিসার হিসাবে যোগদান করার মাধ্যমে তার ব্যাংকিং জীবনের সূত্রপাত। এরপর মেধা আর পরিশ্রমের ভিত্তিতেই সময়েরসাথে দেশে-বিদেশে বিভিন্ন বহুল পরিচিত ইন্টারন্যাশনাল ব্যাঙ্কে শীর্ষস্থানীয় এক্সিকিউটিভ হিসেবে দীর্ঘসময় কাজ করে। অবশেষে নাইরোবিতে নিজেই Export Bank Of Africa নামে একটি ব্যাঙ্ক প্রতিষ্ঠা করে। তার ভিশন, কর্মদক্ষতা, পরিপক্ব অভিজ্ঞতা এবং সততার ফলে অতি অল্প সময়েই বিপুল সম্ভাবনাময় প্রতিষ্ঠান হিসাবে অতিদ্রুত আফ্রিকার বিভিন্ন দেশে শাখাখোলার যোগ্যতা অর্জন করতে সক্ষম হয় Export Bank Of Africa. একজনবনেদী বংশের উত্তরাধিকারী, সাচ্চা ইমানদার, সৎ এবং মানবতাবাদী গরীবেরবন্ধু হিসাবে রব্বানির পরিচিতির স্বাক্ষর পাওয়া যাবে প্রতিটি দেশেই যেখানে সে কাজ করেছে। অত্যন্ত বিনয়ীঅমায়িক, নিঃস্বার্থ জনদরদী মানুষটি আমার দৃষ্টি কেড়ে নেয় এবং প্রথম দর্শনেই তাকে ভাল লেগেছিলো। সময়ের সাথে আমাদের মধ্যে সর্বকালীন নির্ভরশীল বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। পেশাগতভাবে ব্যাঙ্কার হলেও জীবনদর্শন, বিশ্বরাজনীতি, ধর্ম এবং চলমান বিশ্বেরআর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, পরাশক্তিগুলোর আগ্রাসী মনোভাব ও তৎপরতা, মুসলিম জাহানের দুঃখজনক অবস্থা এবং রাজা-বাদশাহ, শেখ-আমীরদের অধঃপতন সম্পর্কে রব্বানির জ্ঞান ও বিশ্লেষণিক ক্ষমতা আমাকে বিস্মিত ও বিমোহিত করেছিলো। সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণ এবং তাদের তল্পিবাহক জাতীয় কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর যাঁতাকলে সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের নিষ্পেষণ, জুলুম এবং বঞ্চনার বিষয়ে একই ভাবে সচেতন রব্বানি। তাই আমাদের মধ্যে বন্ধুত্বের বাঁধন অটুট হয়ে ওঠে দীর্ঘ সময়ের চড়াই-উৎরাই এর কষ্টিপাথরে। উপমহাদেশে বহুলভাবে পরিচিত এবং শ্রদ্ধেয় কালিয়া শরিফের সূফী পরিবারের সাথে রক্তের সম্পর্কে সম্পৃক্ত রব্বানি খান এক অতি দুর্লভ ব্যক্তিত্ব। বিশেষকরে আজকের জামানায় রব্বানি খানের মতো এক অমূল্য রতন খুঁজে পাওয়া দুষ্কর।
পৃথিবীর ক্ষমতাধর দেশগুলোর ক্ষমতা বলয়ে তার পরিচিতির পরিধিও ব্যাপক। কিন্তু পরিচিতি এবং বন্ধুত্ব বেচে ব্যক্তিস্বার্থ হাসিল করাকে মনে-প্রাণে রব্বানি ঘৃণা করে এসেছে বরাবর। এটাও একটা অসাধারণ গুণ। রব্বানির বাবা জাতে পাঠান ব্রিটিশ সিভিল সার্ভিসের একজন অফিসার ছিলেন। তিনি কখনোই কোন অন্যায়ের সাথে আপোষ করেননি। পাকিস্তানের সৃষ্টির পর তিনি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে যোগদান করেন এবং বিভিন্ন দেশে কৃতিত্বের সাথে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করেন। দক্ষিণ এশিয়ার ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আমরা ছিলাম একই ভাবে চিন্তিত। আঞ্চলিক রাজনীতি, অসম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, ভারতীয় চাণক্যদের কূটকৌশল এবং দুরভিসন্ধি সম্পর্কে আমরা ছিলাম বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। তথাকথিত ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের শাসকগোষ্ঠীর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর প্রতি বিশেষ করে মুসলমানদের প্রতি বৈষম্যমূলক এবং নির্মম আগ্রাসী আচরণের কারণে এই অঞ্চলের মুসলমানদের ভবিষ্যৎ কি হবে সেটাও আমাদের শঙ্কিত করে তুলেছিলো। এই পরিপ্রেক্ষিতে, নিজ নিজ পেশাগত দায়িত্ব পালনের সাথে সাথে এই উপমহাদেশের নিপীড়িত এবং বঞ্চিত সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মুক্তি এবং ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য একত্রে আমরা অনেক কাজ করেছি নিজেদের সাধ্যানুযায়ী। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে শক্তিধর দেশগুলোর আগ্রাসন, সামরিক অভিযানের বিরুদ্ধে জনগণের প্রতিরোধ সংগ্রাম সম্পর্কেও ভাবতাম আমরা। একদিন বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট এবং ষড়যন্ত্রের সব কিছু খুলে বললাম রব্বানিকে। সব শুনে রব্বানি বললো
গভীর ক্রান্তিকালে নিষ্ক্রিয় হয়ে থাকা চলবে না ভাই। যেভাবেই হউক এই ষড়যন্ত্রের হাত থেকে বাংলাদেশকে বাচাবার একটা পথ খুঁজে বের করার চেষ্টা অবশ্যই কোরতে হবে। ফল দেবার মালিক আল্লাহ। তার উৎসাহে বেশ অনুপ্রাণিত হয়ে আমি বললাম খালেদা জিয়া এবং জেনারেল এরশাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে এই সর্বনাশা সংকট থেকে বাংলাদেশকে উদ্ধার করা সম্ভব হলেও হতে পারে। সে চেষ্টা আমি করতে পারি।
অবশ্যই সেটাই তোমাকে করতে হবে কালবিলম্ব না করে। আমি তোমার পাশে থেকে এই প্রচেষ্টায় সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতে প্রস্তুত।
রব্বানির সুচিন্তিত অভিমতের পরিপ্রেক্ষিতে আমি সিদ্ধান্ত নিলাম খালেদার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করবো।
প্রবাসী জীবনে বিভিন্ন দেশের অনেক জ্ঞানী-গুণী, ধনী, সমাজপতি, শীর্ষস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং ক্ষমতা বলয়ের অদৃশ্য অনেক ক্ষমতাশালী ব্যক্তিবর্গের সাথে পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছে নিজ উদ্যোগে এবং বিভিন্ন সূত্রে। তাদের অনেকের সাথে ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বমূলক সম্পর্কও গড়ে ওঠে ব্যক্তিগত এবং পারিবারিক পর্যায়ে। দেশেও এ ধরনের পরিচিতি, বন্ধুত্ব এবংঘনিষ্ঠতার পরিধি ব্যাপক। এইসমস্ত সম্পর্কের ভিত্তিই হচ্ছে পারস্পরিক আস্থা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা। রব্বানিকে বললাম
আমি বাসায় ফিরেই খালেদার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করছি। সে আমার কথা শুনে বললো
চলো, আমিও যাবো তোমার সাথে। দেখা যাক যোগাযোগ সম্ভব হয় কিনা।
ঠিকআছে, চলো দেখা যাক কি হয়। ইতিমধ্যেই মনে মনে ঠিক করে ফেলেছি নিজের পরিচয়টা গোপন রাখার জন্য ছদ্মনামেই খালেদার সাথে যোগাযোগ করবো। ঠিক হল ‘মোহাম্মদ’ নামেই খালেদার সাথে যোগাযোগ করা হবে বিভিন্ন নম্বর থেকে।তিনিও জানিয়ে দেবেন কখন তাকে কোন নম্বরে পাওয়া যাবে আলাপ করার জন্য। বাসায় ফিরে সাচোকে প্রথমে ফোন করলাম জানতে কার কাছ থেকে খালেদার অবস্থান সম্পর্কে খবরাখবর পাওয়া সম্ভব। সাচো জানিয়ে দিল একমাত্র শফিকুল গণি স্বপনআর জনাব মুস্তাফিজুর রহমান ছাড়া তার গতিবিধি আর অবস্থান সম্পর্কে দলের কাউকেই কিছু জানানো হয় না। যাদু মিয়ার ছেলে শফিকুল গণি স্বপন বয়সে ছোট হলেও বিশ্বস্ত বন্ধু। তাই কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। ফোনে যোগাযোগ করলাম স্বপনের সাথে। তাকে সংক্ষেপে বুঝিয়ে বললাম
আমি জরুরী ভিত্তিতে খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করতে চাই বিশেষ গোপনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে। যদি তিনি রাজি থাকেন সেই ক্ষেত্রে তাকে আমার শর্তগুলো মেনেই আলাপ করতে হবে গোপনীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে। স্বপনকে শর্তগুলো জানিয়ে দিলাম। আমার কথা বুঝে স্বপন বললো
আপনি কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন, আমি আপনাকে ম্যাডামের অভিমত জানাচ্ছি। বেশ, এইনম্বরেই আমি অপেক্ষায় রইলাম। বলে রিসিভার রেখে দিয়ে অপেক্ষা করতে করতে রব্বানিকে সব বুঝিয়ে বললাম। বাসা থেকে বেরুবার সময় থেকেই ফকিরের হাতে তসবিহ। আমরা একে অপরকে ‘ফকির’ বলেই সম্বোধন কোরতাম। সব শুনে রব্বানি বললো
আল্লাহ্‌ যা করবেন সেটা ভালোর জন্যই করবেন ইন শা আল্লাহ্‌। সেইদিন থেকে ‘৯১সালের নির্বাচন পর্যন্ত রব্বানি আমার ছায়াসঙ্গী হয়ে থেকেছে তার দেয়া কথামতো। আধা ঘণ্টা পর ফোন বেজে উঠলো। স্বপন অপর প্রান্তে। ও আমাকে জানালো
ম্যাডাম আমার সাথে যোগাযোগ করতে ইচ্ছুক আমার সব শর্ত মেনে নিয়েই। বলেই একটা টেলিফোন নম্বর দিয়ে বললো
আপনি এখনি এই নম্বরে ‘মোহাম্মদ’ নামে ফোন করন, তিনি অপেক্ষায় আছেন।
স্বপনের কাছ থেকে পাওয়া টেলিফোন নম্বর দিয়েই শুরু হল যোগাযোগ। তখনও মুঠোফোনের প্রচোলন হয়নি। প্রথমবার ডায়ালেই লাইন পাওয়া গেলো।
হ্যালো, কে কোথা থেকে বলছেন? অপর প্রান্ত থেকে ভেসে এল একটি পুরুষ কণ্ঠ।
আমি বিদেশ থেকে মোহাম্মদ বলছি। ও আচ্ছা ধরুন, দিচ্ছি।
আসসালামু আলাইকুম, আমি খালেদা বলছি।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, ভাবী কেমন আছেন?
সেটাতো বুঝতেই পারছেন ভাই।
ভাবী, একটি বিষয় প্রথমেই পরিষ্কার করে নিতে চাই। ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে মন যুগিয়ে কথা বলার অভ্যেস নেই আমার। খোলামেলা সরাসরি কথা বলতেই অভ্যস্ত আমি। সেটা মেনে নিয়ে কথা বলতে আপনি ইচ্ছুক হবেন কি হবেন না, সেটা আমার জেনে নেয়া উচিৎ।
স্বচ্ছন্দে আপনি খোলাখুলি ভাবেই আমার সাথে আলাপ করতে পারেন আপনার মতো করেই।
ধন্যবাদ। আচ্ছা, ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচির ঘোষণা দিলেন কোন বিবেচনায়? আপনাদের আন্দোলনের শরিক দল আওয়ামীলীগ বোধকরি এই বিষয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি আগ্রহী তাই নয় কি? ভাবী, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে আজঅব্দি বিভিন্ন ভাবে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা, দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসীদের পরিকল্পিতভাবে চতুরতার সাথে সমূলে উৎপাটন করা হচ্ছে বিভিন্ন মিথ্যা অজুহাত এবং ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতার সুযোগ নিয়ে। আপনার এই কর্মসূচীকে অজুহাত বানিয়ে এখন যারা বেঁচে আছে তাদেরও নির্মূল করা হবে সুপরিকল্পিত ভাবে। দেশবাসীর মোকাবেলায় দেশের সামরিক বাহিনীকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে এক আত্মঘাতী গৃহযুদ্ধের সৃষ্টির পরিকল্পনা চলছে। খালেদা জিয়া কিছুটা বিব্রত হয়ে জবাব দিলেন
শরিক দলগুলোর সাথে আলোচনার পর সর্বসম্মতিক্রমেই ঐ কর্মসূচির ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এর পরিণতিটা কি হবে সেটা সম্পর্কে আপনার আর অন্যান্য শরিকরা কি ভাবছেন সেটা আমি কি জানতে পারি?
আমাদের সবার ধারণা সারাদেশ থেকে জনতার স্রোত ঢাকায় এনে ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করলে চাপের মুখে এরশাদকে রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিতে বাধ্য করা সম্ভব হবে এবং একই সাথে বর্তমান সরকারের পতন ঘটিয়ে জাতীয় নির্বাচন করা সম্ভব হবে।
বিশ্লেষণটা একটি দিবাস্বপ্ন ছাড়া আর কিছুই নয়।
কেনো এই কথা বললেন? আপনার বিশ্লেষণটা কি ভিন্ন?
হ্যাঁ।
তাহলে বলুন, আমি শুনতে ইচ্ছুক।
বিভিন্নসূত্রে পাওয়া খবরা-খবরের ভিত্তিতেই আমার বিশ্লেষণ। আপনাদের ইচ্ছা পূরণটা এতো সহজ-সরল হবে না। শুধুমাত্র মিটিং, মিছিল আর গণ-সমাবেশের মাধ্যমে কোনও স্বৈরাশাসকের পতন ঘটানো সম্ভব হয়েছে এমন উদাহরণ মানবসভ্যতার ইতিহাসে বিরল। বর্তমান রাষ্ট্রীয় কাঠামোতে জেনারেল এরশাদ নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হিসেবে সাংবিধানিক ভাবে একজন শক্তিধর ব্যাক্তি। সামরিক বাহিনী, পুলিশ, অন্যান্যআইন-শৃঙ্খলা বাহিনীসমূহ, গোয়েন্দা সংস্থা এবং প্রশাসনের উপর থেকে নিচ পর্যন্তস্থানীয় সরকারের সব পর্যায়ে তার পছন্দসই লোকজনদের বসিয়ে তাদের তিনি তার সেবাদাস করে নিয়েছেন। জেনারেল জিয়ার অকাল মৃত্যুর ঘটনা এবং এর পরবর্তী সবকিছুর পেছনে ভারতের সেবাদাস জেনারেল এরশাদ নাটের গুরু হিসাবে আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে নিয়ে চতুর খেলা খেলে নিজেকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করতে সমর্থ একজন জেনারেল। তিনি লোক সমাগমের চাপে ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন এমনটি ভাবার কোনও অবকাশ নেই। তার হাতে এখনো তুরুপের তাসটি রয়ে গেছে। যথাসময়ে সেটা প্রয়োগের প্রস্তুতি নিচ্ছেন প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যেই। এ সম্পর্কে আপনারা কি কিছু আন্দাজ করতে পারছেন?
না, একটু খোলাসা করে বলুন।
আমি বিশ্বাস করি, আপনাদের ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও করার কর্মসূচির সুযোগেই এরশাদ তার তুরুপের তাসটি খেলবেন।
কি ধরনের খেলা হবে সেটা একটু বুঝিয়ে বলুন ভাই।
এরশাদকে ‘ভোলা বাদশাহ’ ভাবছেন কেনো? লোকটি শৃগালের মতোই ধূর্ত এবং গিরগিটির মতই বর্ণচোরা। তিনি আপনাদের কার্যকলাপ সম্পর্কে বিস্তারিত সব খবরা-খবরই রাখছেন। বঙ্গভবনে ইতিমধ্যেই একটি ‘Ops Room’ বানানো হয়েছে। স্থানীয় গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর উপরই কিন্তু নির্ভরশীল থাকছেন না জেনারেল এরশাদ। প্রাপ্ত সব খবরাখবরগুলোকে যাচাই-বাছাই করে নিচ্ছেন RAW, KGB এবং আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে। এভাবেই নির্ধারিত হচ্ছে তার প্রতিটি চাল। আপনাদের দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ঢাকায় লোকসমাগমের উদ্যোগকে অংকুরেই বিনষ্ট করে দেয়া হবে সারা দেশে সামরিক শাসন জারি করার মাধ্যমে। একই সাথে দেশজুড়ে শুরু করা হবে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস এবং টার্গেট কিলিং। ফলে গৃহযুদ্ধ হবে একটা বাস্তব পরিণতি।
আপনার সহযোগী হাসিনা এবং তার দল কিন্তু রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের টার্গেট হবে না,টার্গেট করা হবে আপনাকে এবং জনগণের মাঝ থেকে বাছাই করা পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধা এবং ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী প্রকৃত ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী নেতা-কর্মীদের। এই প্রক্রিয়ায় যদি কোনও কারণে অবস্থা রাষ্ট্রপতির নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় তখন বিরাজমান ২৫ বছরের মৈত্রী চুক্তির আওতায় এরশাদ ডেকে পাঠাবেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে। ভারতীয় হস্তক্ষেপে অতি অল্প সময়ে স্তব্ধ করে দেয়া হবে আপনাদের গণ-আন্দোলন। সাধারণ শান্তিপ্রিয় জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে ভারতীয় হস্তক্ষেপকে স্বাগতও জানাতে পারে হাসিনার প্রচ্ছন্ন তৎপরতায়। এরপর জেনারেল এরশাদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যাবে ঠিক যেমনভাবে ফুরিয়ে গিয়েছিলো জেনারেল জিয়ার প্রয়োজনীয়তা হাসিনার দেশে প্রত্যাবর্তন এবং রাজনীতিতে আওয়ামীলীগকে পুনর্বাসিত করার পর। ক্ষমতায় এরশাদের পরিবর্তে বসানো হবে হাসিনার নেতৃত্বে নব্য বাকশালী সরকার ভারতীয় নিরাপত্তায়।
তখন আপনি আপোষহীন দেশনেত্রী কি করবেন? আর একটি কালুরঘাট খুঁজে নিয়ে সেখান থেকে ঘোষণা দিবেন, ‘আমি খালেদা জিয়া বলছি……’। কথাটা বলেই হেসে উঠলাম। খালেদা একদম নিঃশচুপ! তাই নিশ্চিত হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম ভাবী লাইনে আছেন তো?
আমি শুনছি, আপনি বলতে থাকেন। আপনাকে জ্ঞান দেবার জন্য নয়, মনে হয় ‘৭১-এর ১৬ই ডিসেম্বর-এর সাথে অনেকটা মিল রয়েছে বর্তমান অবস্থার। জানিনা, আপনি এর কতটুকু জানেন তাই বলছি।
১৬ই ডিসেম্বর, জেনারেল ওসমানীর পরিবর্তে চুক্তির বরখেলাপ করে ভারতীয় বাহিনীর জেনারেল অরোরার কাছে রেসকোর্সে পাকবাহিনীর কমান্ডার জেনারেল নিয়াজি আত্মসমর্পণ করলেন।তার সাথেই হারিয়ে গেল মুক্তিযোদ্ধাদের বীরগাথা।
প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের দেশের ভেতরে প্রবেশ নিষেধ হুকুম জারি করে প্রবাসী সরকার তাদের রাখে বর্ডার সংলগ্ন বনে-বাদারে। মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারদের সরকার হুকুম দিলেন প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধা থেকে হাতিয়ার জমা নিয়ে তাদের জানিয়ে দেয়া হউক ‘দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।’ তাই তাদের কাজও শেষ। যুদ্ধ বিজয়ের পুরস্কার হিসাবে প্রত্যেকের হাতে ৫০ ভারতীয় রুপি ধরিয়ে দিয়ে পিঠ চাপড়ে তাদের সাবাশি দিয়ে বিদায় করা হউক।
অন্যদিকে তখন সারাদেশের সর্বত্র ছেয়ে যায় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর সদস্যে। ভারতীয় সেনাদের সাথে দেখা গেলো বিএলএফ এর সদস্য, অজস্র ছাত্রলীগ, যুবলীগ, শ্রমিক লীগ, কাদেরিয়া বাহিনী, স্বেচ্ছাসেবক লীগেরমাস্তানদের মাথায় বিভিন্ন রং-বেরঙের পট্টি বাধা অস্ত্রধারীদের। এরা সবাই ছিল মুক্তিবাহিনীর বিপরীতে যুদ্ধকালেই RAW সৃষ্ট। এদেরকে প্রশিক্ষণ শেষে যুদ্ধের শেষলগ্নে আগেভাগেই অস্ত্রসহ দেশের ভেতরে ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছিলো বিজয়লগ্নে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের স্থলাভিষিক্ত হয়ে ভারতীয় বাহিনীর দোসর হিসাবে তাদের অবাধ লুটতরাজে সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা করার জন্য। তুলনামূলকভাবে এদের বলা চলে ভারতীয় বাহিনী কর্তৃক গঠিত ‘রাজাকার’, ‘আল বদর’ ও ‘আলশামস’। সারা দেশে ভারতীয় লুটেরা বাহিনী মুক্তিযুদ্ধের সব কৃতিত্বই হাইজ্যাক করে নিয়ে বিজয়ী বীরের বেশে ছড়িয়ে পড়েছিলো বাংলাদেশের প্রতিপ্রান্তে। দেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা নারী-পুরুষ তাদের ফুলের পাপড়ি বর্ষণ করে উষ্ণ স্বাগত জানিয়েছিলো। অবশ্য, অতি অল্প সময়ে তাদের প্রকৃত চেহারা উন্মোচিত হয়ে পড়ে দেশবাসীর কাছে। ধরা পড়ে যায় ভারতীয় চাণক্য এবং তাদের তাঁবেদার প্রতিষ্ঠিত সরকারের শুভঙ্করের ফাঁকি! তাই দেশবাসী তাদের নামকরণ করেছিল ‘১৬ ডিভিশন।’ বিজয়ের পর প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের ভাগ্যে ফুলের পাপড়ি না জুটলেও তারা ন্যায় আর সত্যের জন্য প্রতিবাদী হওয়ায় রাষ্ট্রীয় রোষানল, সন্ত্রাস এবং দলীয়বাহিনী সমূহের নির্যাতনের হাত থেকে রেহাই পায়নি শেখ মুজিবের আওয়ামী-বাকশালি স্বৈরশাসনের আমলে। ভারতের পালিত কন্যা হাসিনা ও তার দলকে ক্ষমতায় বসানো হবে গণতন্ত্রের লেবাসেই। দেশ পরিণত হবেএকটি মেরুদণ্ডহীন করদ রাজ্যে আর জাতি হারাবে নিজ স্বকীয়তা, পরিণত হবে গোলামে অনির্দিষ্টকালের জন্য।স্বাধীনতার অর্থ হবে একটি জাতীয় পতাকা আর একটি জাতীয় সঙ্গীত, যার রচয়িতাও একজন ভারতীয় কবি যিনি লিখেছেন ভারতের জাতীয়সঙ্গীতও। কাকতালীয় ঘটনা বটে, তবে বিশ্বে এ ধরনের আরেকটি উপমা খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইতিহাস বলে, তৃতীয় বিশ্বে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর জন্য কোনও চমক সৃষ্টি করে সেটাকে যথার্থ বলে প্রতিষ্ঠিত করা যেকোনো শাসকের পক্ষে খুবই সহজ ব্যাপক প্রচারণার মাধ্যমে, কিন্তু সেটা চিরস্থায়ী করার কাজটি অসম্ভব। তৃতীয়বিশ্বের যারাই ক্ষমতায় যান তাদের বেশিরভাগই এই সত্যটাকে ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যের কারণে ঠিক অনুধাবন করতে পারেন না। যদি কখনো বুঝতে পারেন তখন তাদের শোধরানোর সময়-সুযোগথাকে না।
উদাহরণ স্বরূপ, আপনার প্রয়াত স্বামী জেনারেল জিয়াকেই ধরে নিন। তিনি তার ভুল বুঝতে পেরে চীন সফরকালে ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৫ ঘণ্টার উপর আমার সাথে খোলাখুলিভাবে আলোচনাকালে অতীতের ভুলভ্রান্তি স্বীকার করে পুনরায় আমাদের সাথে একত্রিত হয়ে রাজনীতি করার ইচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন আমার প্রয়াত পিতার উপস্থিতিতে। তার সেই আহবান সম্পর্কে বিতর্কে না গিয়ে আন্তরিক ভাবেই শুধু তাকে বলেছিলাম, সেটা সার্বিক বিবেচনায় বাস্তব সম্মত নয়। কারণ, পানি তখন অনেক গড়িয়ে গিয়েছিলো। সেই সব আলোচনা এবং পরবর্তী ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে সবকিছুই আপনার জানা আশা করি। আমি মনে করি, জাতীয় পরিসরে ক্ষমতার রাজনীতিতে শীর্ষস্থানীয় খেলোয়াড়রা ইতিহাস থেকে কেউই তেমন কোনও শিক্ষা নেন না। তাই প্রাকৃতিক নিয়মেই ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটে। এই প্রক্রিয়াতে আপনার কিংবা জেনারেল এরশাদের ব্যক্তিগতভাবে কি হবে সেটা বলা মুশকিল, তবে পরিণতিটা সুখকর হবে না সেটা বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। ব্যক্তিগত ভাবে কার কি হল সেটা বিবেচ্য বিষয় নয়, অন্তত আমাদের কাছে। তবে ক্ষমতার এই আত্মঘাতী লড়াইয়ের পরিণামে দেশ ও জাতির যে চরম অপূরণীয় ক্ষতি হবে তার দায়ভার আপনাকেও অন্যদের সাথে বহন করতে হবে ইতিহাসের বিধান অতি নিষ্ঠুর! ইতিহাসের কষ্টিপাথরে প্রতিটি কার্যক্রমই ঘষে দেখা হয় সত্য উদ্ঘাটনের জন্য। এ থেকে নিষ্কৃতি পাবার কোনও উপায় নেই। তাই বলা হয় ইতিহাস কাউকেই ক্ষমা করে না। বলা হয়ে থাকে, ৪ঠা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতার পর আমরা সবাই নাকি দেশ থেকে পালিয়ে গিয়েছিলাম! সেটাই বিভিন্ন তরফ থেকে ফলাও করে প্রচার করা হচ্ছে যদিও খালেদ ভাবী আর হুদা ভাবী আমাদের সাথেই ব্যাংকক পর্যন্ত গিয়েছিলেন। বিরোধী পক্ষ এবং জোটের তরফ থেকে এই বিষয়ে নীরবতা সেই মিথ্যাচারের প্রতি পরোক্ষ সমর্থন বললে সেটা কি ভুল হবে? দয়া করে মনে করবেন না আমি আপনাকে বিব্রত করার চেষ্টা করছি।
না, আমি তেমন কিছুই মনে করছি না, আমি আপনার বক্তব্য গুরুত্বের সাথেই শুনছি।
কিন্তু ভাই, স্বৈরশাসনের যাঁতাকলের নিষ্পেষণের অবসান করার অন্য কোন বিকল্প পথ আছে কি? আছে কি কোনও পথ যাতে করে স্বৈরশাসককে সরানো এবং দেশ ও জাতিকেও দুরভিসন্ধি মূলক চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচানো যায়?
আপনি যদি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি সাময়িকভাবে স্থগিত করেন, তাহলে জেনারেল এরশাদ যাতে কোনোক্রমেই দেশে সামরিক শাসন জারি কোরতে না পারেন এবং চাপের মুখে পদত্যাগে বাধ্য হন সেই চেষ্টা আমি কোরতে পারি। তবে আমার একটা শর্ত আছে।
কি শর্ত?
সব সমঝোতা হয় দেয়া-নেয়ার ভিত্তিতে। তাই যদি এরশাদ পদত্যাগ করে সপরিবারে প্রবাসে চলে যেতে চান সেটা আপনাকে মেনে নিতে হবে। তিনি দেশ ছাড়তে নাও চাইতে পারেন। সেই ক্ষেত্রে পদত্যাগের পর অতি সহজেই তাকে জেলে পাঠানো সম্ভব হবে আপনাদের পক্ষে। আমি ব্যক্তিগত ভাবে চাইবো তিনি দেশান্তরী হন, কিন্তু আমি জানি তার সিদ্ধান্তটি হবে ভারতের নির্দেশ মতো যাতে করে ভবিষ্যতে তাকে কাজে লাগানো যায়। ঠিক আছে, আমি আপনার শর্ত মেনে নিয়ে কথা দিলাম, সে যদি পদত্যাগের পর বিদেশে চলে যেতে চায় তবে তাকে সপরিবারে নিরাপদে বাইরে পাঠিয়ে দেবার রাস্তা করে দেয়ার সব দায়িত্বহবে আমার। ঠিক আছে, তাহলে আমিও আমার যা করণীয় সেটা শুরু করছি সব ঝুঁকি নিয়েই। তবে কথা দিতে হবে এই সমস্তকিছুই সীমাবদ্ধ থাকবে শুধুমাত্র আপনার আর আমার মধ্যে। অন্য কোনও তৃতীয় পক্ষ কিছুই জানতে পারবে না। এমনকি আপনার অতি নিকট আত্মীয়-স্বজন কিংবা বিশ্বাসভাজন পরামর্শদাতারাও না।
কথা দিলাম।
ঠিক আছে, তাহলে আজকের মতো রাখি। প্রয়োজন মতো আমি আবার আপনার সাথে যোগাযোগ কোরবো।
আমি আপনাকে বিশ্বাস করেই ঘেরাও কর্মসূচি সাময়িক ভাবে স্থগিত করে দিচ্ছি। আপনার কাছ থেকে আপডেটস জানার জন্য আমি অধীর আগ্রহের সাথে অপেক্ষায় থাকবো। দিনরাতের যেকোনো সময় আপনি সুবিধামতো আমার সাথে যোগাযোগ কোরতে পারেন। আমার অবস্থানের যদি কোন পরিবর্তন ঘটে তাহলে সেটা আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে।
ধন্যবাদ। বলে ফোন ছেড়ে দিলাম। পাশে বসা রব্বানিকে আলোচনার সার সংক্ষেপ জানিয়ে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলাম দু’জনে মিলে। এরশাদের মার্শাল’ ল জারির খবরটা পেয়েছি। এখন জানতে হবে তার কৌশলটা কি হবে সেই বিষয়ে।
দু’দিনপর সেনাসদর থেকে খবর এলো ওয়্যারলেসে, আফ্রিকার একটি দেশের বাংলাদেশ কন্টিনজেন্ট কমান্ডারকে জরুরী ভিত্তিতে দেশে ফেরত পাঠানোর জন্য UN Headquarters-এঅনুরোধ জানানো হয়েছে। আরও জানতে পারলাম দেশে ফেরার পর প্রোমোশন দিয়ে তাকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদে নিযুক্তি দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ আর্মি চীফ নুরুদ্দিনের পরামর্শে। খবরটা ইতিবাচক। তার সাথে কুমিল্লা ব্রিগেডেএকসাথে কাজ করেছি। মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলে এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত একজন অফিসার হওয়া সত্ত্বেও মনেপ্রাণে একজন সাচ্চা ইমানদার জাতীয়তাবাদী বাংলাদেশী। মুক্তিযুদ্ধে শরিক হবার জন্য অনেক চেষ্টা করেও বেচারা পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালাতে পারেনি। দেশে ফিরে বাংলাদেশকে নিয়ে ভারতীয় নীলনকশা সম্পর্কে অবগত হবার পর ও ভীষণভাবে ভারত এবং আওয়ামী-বাকশালি বিরোধী হয়ে ওঠে। ফলে সে একজন বিশ্বস্ত বন্ধু হয়ে ওঠে। জানতে পারলাম, UN Headquarters থেকে তার Release order সে পেয়ে গেছে। কিন্তু ফিরে যাবার পর তাকে কোথায় কি পদে নিয়োগ দেয়া হবে সে সম্পর্কে তাকে কিছুই জানানো হয়নি।উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়ে আমিই তাকে সুখবরটা দিলাম। তাকে ফেরার পর পদোন্নতি দিয়ে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। তাকে বললাম, খবরটা ঢাকাতে এখনও গোপনীয়। তাই সে যেন খবরটা কাউকে না বলে। একই সাথে বললাম, ফিরে যাবার পথে যাত্রা বিরতি কালে এবার সে হোটেলে নয়, থাকবে আমার বাড়িতে। কিছু বিশেষ আলাপ আছে। তাকে আর কিছু বলতে হল না। জবাবে সে বলল, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সে নাইরোবি পৌঁছানোর চেষ্টা করবে। প্রোমোশনের খবরটা জানাতেই ও খুশি হয়ে বলে উঠলো, খবরটা জানানোর জন্য সে কৃতজ্ঞ। এসে পৌঁছালো বন্ধু। প্রথম রাতে খাবারের পাট চুকিয়ে দু’জনে বসলাম একান্তে কথাবার্তা বলার জন্য।
স্যার, বলুন দেশে কি হচ্ছে? মিডিয়াতে অনেক কিছুই বেরুচ্ছে, কিন্তু আসল ঘটনা কি?
আমি আপনাকে সবই খুলে বলবো, তবে তার পেছনে একটা প্রত্যাশা নিয়ে। আপনি একজন নিখাদ দেশপ্রেমিক, স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি বলে আপনার মনের খেদ আমার দৃষ্টি এড়ায়নি। কিন্তু ভাই, এই বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে অরক্ষিত করে রাখার চক্রান্ত চলে আসছে জন্মলগ্ন থেকেই। সেই চক্রান্তের গাঁটছড়া বেঁধেছে দেশের কায়েমী স্বার্থবাদী শাসক ও শোষক গোষ্ঠী। বাংলাদেশকে একটি করদরাজ্যে পরিণত করে এদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের গোলাম বানানোর সুদূর প্রসারী নীলনকশা রয়েছে ভারতীয় চাণক্যদের। এর বিরুদ্ধে আমরা লড়ে এসেছি মুক্তিযুদ্ধকাল থেকেই। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর পর জিয়া সেনা পরিষদের মধ্যমণি হয়েও বিশ্বাসঘাতকতা করায় আমাদের সুচিন্তিত অগ্রযাত্রা বন্ধ হয়ে যায়। ভারতের সাথে আমাদের সংগঠনের মধ্যমণি জিয়া শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য আপোষ করে ভেবেছিলেন ভারতকে ছাড় দিয়ে বিলীন হওয়ার পথে হাসিনার নেতৃত্বেআওয়ামী-বাকশালিদের দেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করলেই তিনি স্বচ্ছন্দে বাংলাদেশের শাসক হয়ে থাকতে পারবেন ভারতের আশির্বাদে। কিন্তু সেটা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তার সেই অভিলাষ ভুল প্রমাণিত হয়। ভারত তাদের কাজ হাসিল করে নিয়ে জিয়াকে তাদেরই আর এক দালাল জেনারেল এরশাদের মাধ্যমে ইহধাম থেকে সরিয়ে আওয়ামী-বাকশালিদের সহযোগিতায় এরশাদকেই ক্ষমতায় বসায়। তারা এরশাদের মাধ্যমে দুইটি স্বার্থ হাসিল করতে চেয়েছিলো। প্রথমত- জিয়া এবং তার সাথে বেঁচে থাকা পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক অফিসার এবং সদস্যদের সামরিক বাহিনী থেকে শিকড়সুদ্ধ উপড়ে ফেলা। দ্বিতীয়ত- আওয়ামী-বাকশালিদের সাংগঠনিক ভাবে মজবুত করে তোলা।
এই দুইটি উদ্দেশ্য তারা হাসিল করে ফেলেছে, তাই এখন তাদের এরশাদের আর প্রয়োজন নেই মুখ্য খেলোয়াড় হিসেবে। এখন তারা চায় হাসিনাকে ক্ষমতায়।বর্তমানে দেশেএরশাদ বিরোধী আন্দোলনে ভারতের ইশারাতেই আওয়ামীলীগ খালেদার সাথে যুগপৎ আন্দোলন করছে। এই আন্দোলনের মাঝে একসময় খালেদাকে ধরাশায়ী করে আওয়ামীলীগকেই ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়া হবে। একবার যদি আওয়ামী-বাকশালিদের আবার ক্ষমতায় বসানো সম্ভব হয় তবে অনির্দিষ্ট কালের জন্য বাংলাদেশ পরিণত হবে করদ রাজ্যে আর আমরা পরিণত হবো গোলামে। এই অবস্থায় সীমিত শক্তি নিয়ে আমাদের পক্ষে অগ্রণী হয়ে কিছু করা সম্ভব নয়। কিন্তু আপনার মতো আরও যারা এখন সামরিক বাহিনী বিশেষ করে সেনাবাহিনীতে রয়েছে তারা অবশ্যই এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে পারে। সেই ক্ষেত্রে আমরা আপনাদের সহায়ক শক্তি হিসাবে যথাসাধ্য ভূমিকা রাখারচেষ্টা করতে পারি।
স্যার, আর একটু পরিষ্কার করে বলুন বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে করণীয় কি? আগ্রহপ্রকাশ করলো আগত অতিথি। তার উৎসাহে আমি আরও কিছুটা অনুপ্রাণিত হলাম।
দেশের বর্তমান এরশাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন এক বিস্ফোরক অবস্থায় এসে পৌঁছেছে। সরকারী প্রশাসন টালমাটাল। সারাদেশ প্রায় অচল। এই অবস্থায় ভারত এরশাদকে চাপ দিচ্ছে দেশে মার্শাল’ ল জারি করার জন্য। কারণ, এই অবস্থায় দেশে মার্শাল’ ল জারি করলে যে অবস্থা সৃষ্টি হবে সেটা সরকারের পক্ষে সামাল দেয়া কিছুতেই সম্ভব হবেনা। তখন বেসামাল এরশাদ চাপিয়ে দেয়া গৃহযুদ্ধের দাবানল থেকে নিজেকে বাঁচানোর জন্য ভারতীয় সামরিক বাহিনীকে ‘২৫ বছরের মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির’ আওতায় বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের জন্য আমন্ত্রণ জানাবে। সেই সুযোগে চাণক্যরা অতি সহজেই ত্রাণকর্তা হিসাবে দেশে দৃঢ় অবস্থান নিয়ে তাদের পছন্দসই হাসিনার নেত্রীত্বে নব্য বাকশালি সরকারকে ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত কোরে তাদের হারানো স্বর্গ ফিরে পাবে। গণ-আন্দোলন যাবে বানের জলে ভেসে। এইঘৃণ্য চক্রান্ত কি মেনে নেয়া যায়?
অবশ্যই নয় স্যার, কিন্তু আমরা কি করে এই চক্রান্তের মোকাবেলা করতে পারি?
সেটা পরের কথা। প্রথমে ঠিক করতে হবে এই হীন চক্রান্তের অন্ধকার থেকে দেশ ওদেশবাসীকে বাঁচানোর জন্য আমরা আন্তরিক ভাবে একে অপরকে বিশ্বাস করে একাত্মভাবে কাজ করতে রাজি আছি কিনা।
আমি আপনাদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে দেশের বৃহত্তর স্বার্থে কাজ করতে সম্মতি জানালাম। আপনি আমার উপর আস্থা রাখতে পারেন, স্যার। আপনাদের খুবই কাছ থেকে দেখার এবং বোঝার সুযোগ আমার হয়েছে। আপনারা সবাই পরীক্ষিত, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে আপনারা। মানুষ আজকের দুনিয়ায় দেশ ও জাতির স্বার্থে এতোটাও নিঃস্বার্থ হতে পারে সেটা অনুধাবন করে আপনাদের ভীষণভাবে শ্রদ্ধা করে এসেছি যদিও তার বহিঃপ্রকাশ ঘটানোর সুযোগ পাইনি। আমি নিশ্চিত এই সংকটের মোকাবেলা করার জন্য আপনি আপনার সাথীদের সাথে নিয়ে নিশ্চয়ই কোনও পরিকল্পনা করছেন, অতীতের সংকটগুলোর মোকাবেলা করার মতোই। আমাকে বিশ্বাস করে যদি কোনও বিশেষ দায়িত্ব দেন তবে সেটা পূরণ করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা আমি করবো পরিণতি যাই হউক না কেন ইন শা আল্লাহ।
আমাদের কাজ হল চেষ্টা করা, প্রতিফল দেবার মালিক আল্লাহ্‌। আমি যতটুকু জানতে পেরেছি, যাদের প্ররোচনায় জেনারেল এরশাদ দেশে মার্শাল’ল জারি করতে যাচ্ছেন তাদের মধ্যে মুখ্য ভূমিকায় রয়েছেআর্মি চীফ জেনারেল নুরুদ্দিন,জেনারেল মচ্ছু সালাম, জেনারেল মাহমুদুল হাসান, জেনারেল মীর শওকত, ব্রিগেডিয়ার মাহমুদ, ব্রিগেডিয়ার রফিক, ব্রিগেডিয়ার ওয়াহিদ, ব্রিগেডিয়ার নাসিম, ব্রিগেডিয়ার আশরাফ, ব্রিগেডিয়ার নাসের, ব্রিগেডিয়ার আ ম সা আমিন। তবে বেশিরভাগ সেনা অফিসার এবং সৈনিকরা এই পদপক্ষেপকে আত্মঘাতী মনে করে সমর্থন করছে না। বিশেষ করে ইউনিট কমান্ডারদের পর্যায়ে। কিন্তু সাহসী নেতৃত্বের অভাবে তারা সোচ্চার হতে পারছে না। ক্যারিয়ারের কথা ভেবেও অনেকে সবকিছু বুঝেও প্রকাশ্যে এর বিরোধিতা করতে পারছে না। আমার জানামতে, ইউনিট কমান্ডারদের লেভেল থেকে নিচ পর্যায়ের ৯০% মার্শাল’ ল-এর বিরুদ্ধে। ধিক্কৃত চরিত্রহীন রাষ্ট্রপতির তার বিদেশী প্রভু ভারতের স্বার্থে দেশের জনগণের উপর রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস চালানোর জন্য দেশের সামরিক বাহিনীকে ব্যবহার করার ঘোর বিরোধী তারা। আমার খবরের সত্যতা যাচাই করা আপনার জন্য কষ্টসাধ্য হবে না। গুরুত্বপূর্ণ পদে নবনিযুক্ত অফিসার হিসাবে ইউনিট কমান্ডারদের সাথে পরিচিত হবার জন্য একটিকনফারেন্স ডাকলেই আপনি তাদের মনোভাব সরেজমিনে জানতে পারবেন। সেই কনফারেন্সেই আপনি বুঝতে পারবেন আমার বক্তব্যের সত্যতা এবং বাস্তব অবস্থা। প্রথা অনুযায়ী দেশে মার্শাল’ ল ঘোষণার আদেশ সেনাসদরে পৌঁছার পর এক ঝটিকা অভিযানের মাধ্যমে আপনি প্রেসিডেন্ট এরশাদ, তার বিশ্বাসভাজনদের গৃহবন্দী করে বাইরের সাথে তাদের যোগাযোগের সব রাস্তা বন্ধ করে দেবেন। তারা যাতে একে অপরের সাথে কোনও প্রকার যোগাযোগ করতে না পারে সেই ব্যবস্থাও আপনাকে নিশ্চিত করতে হবে। এরপর থেকে আপনিই হবেন ডিফ্যাক্টো চীফ। গৃহবন্দী এরশাদের সাথে শুধুমাত্র ‘মোহাম্মাদ’ নামের ব্যাক্তিরই যোগাযোগের পথ খোলা রাখার ব্যবস্থা করতে হবে আপনাকে। খালেদা জিয়ার সাথে আমার যোগাযোগ রয়েছে। রাজনৈতিক অঙ্গনে লুকিয়ে থাকা ভেড়ার ছালে আবৃত ধূর্ত ভারতীয় পোষা শৃগালগুলোর একটা লিস্টও আপনাকে দেয়া হবে। ওদেরকেও বন্দী করে ফেলতে হবে ত্বরিতগতিতে কোন প্রতিক্রিয়ার সময় না দিয়ে। কার বিরুদ্ধে কোন চার্জ আনা হবে সেসব নির্ভরযোগ্য তথ্যও আপনি পেয়ে যাবেন। আপনার এই পদক্ষেপের প্রতি পূর্ণ রাজনৈতিক সমর্থন নিশ্চিত করবেন বেগম খালেদা জিয়া চলমান গণআন্দোলনের মুখ্য নেত্রী হিসাবে। আপনাকে সেনাবাহিনীতে সার্বিক ভাবে সমর্থন দেবে সেনা পরিষদ এবং অন্য সব দেশপ্রেমিক অফিসার আর সেনাসদস্যরা। এরপর আমি এরশাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে দুই নেত্রী খালেদা এবং হাসিনার বিরুদ্ধে জারীকৃত হুলিয়া উঠিয়ে নেবো। এরশাদকে বাধ্য কোরবো পদত্যাগ করে ক্ষমতা চীফ জাস্টিসের কাছে হস্তান্তর করে নতুন করে জাতীয় নির্বাচনের ঘোষণা দিতে। এরপর জেনারেল এরশাদ যদি সপরিবারে দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান তবে তাকে যেতে দেয়া হবে এই বিষয়ে খালেদা জিয়ার সাথে আমার ইতিমধ্যেই বোঝাপড়া হয়ে গেছে। আমার অনুরোধে তিনি ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচিও সাময়িকভাবে স্থগিত করতে রাজি হয়েছেন। বিষয়গুলো খুবই স্পর্শকাতর। তাই এইসবের গোপনীয়তা সতর্কতার সাথে রক্ষা করতে হবে ভাই। সেনাবাহিনীর ভেতরে কি ঘটবে সেই সম্পর্কে কিছুই খালেদাকে জানাইনি গোপনীয়তার স্বার্থেই।
কিন্তু স্যার, আপনি কিন্তু চীফ সম্পর্কে কিছুই বললেন না। তার অধীনস্থ হয়ে আমার পক্ষে দায়িত্বগুলো পালন করা কি সম্ভব হবে, যেখানে জেনারেল নুরুদ্দিন জেনারেল এরশাদের বিশ্বস্তদের একজন?
সম্ভব হবে, জেনারেল নুরুদ্দিনকে চীফ হিসাবে রেখেই।
কারণ, জেনারেল নুরুদ্দিন একজন উচ্চাভিলাষী ব্যক্তি কিন্তু অন্তরে খুবই ভীরু। জেনারেল জিয়া হত্যার চক্রান্তের শেষ পর্যায়ে তিনি তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য হাসিনার সাথে দেখা করে তার আনুগত্য জানিয়ে এসেছিলেন। সেই সময় হাসিনা তাকে জেনারেল এরশাদের কথামতো চলার পরামর্শ দেয়। যার ফলে জিয়া হত্যা, মঞ্জুর হত্যা ও মুক্তিযোদ্ধা অফিসারদের ফাঁসির ঘটনাগুলোতে তার একটা মুখ্য ভূমিকা থাকে জেনারেল এরশাদের নির্দেশে।
কিন্তু ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর হাসিনার আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত যখন এরশাদকে বর্জন করে সংসদ থেকে পদত্যাগ করে পুনরায় এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে যোগ দেয়, তখন থেকেই নুরুদ্দিন জেনারেল এরশাদের দিন শেষ হয়ে আসছে সেটা বুঝতে পেরে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন নিজের ভবিষ্যৎ ভেবে। তিনি এখন বাঁচার অবলম্বন খুঁজছেন। এই দুর্বলতাটাই আপনাকে কাজে লাগাতে হবে। আপনি তাকে বোঝাবেন, আপনার কথা মতো চললে ভবিষ্যতে তার কোনও ক্ষতি হবে না। সে তখন আপনাকেই বাঁচার অবলম্বন হিসাবে গ্রহণ করে নেবে নিরুপায় হয়ে। সেই অবস্থায় তাকে সামনে রেখেই আপনি সবকিছুই করতে পারবেন। এতে আপনাকে কোন কিছুর জন্য অভিযুক্ত করাও সম্ভব হবে না। একই ভাবে, সব কিছুর মূলে থেকেও আপনি থাকবেন নিরাপদ। এভাবেই, সাপও মরবে লাঠিও ভাঙবে না। একজন বীর দেশপ্রেমিক হয়েও আপনি থেকে যাবেন সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। আপনি যথেষ্ট বুদ্ধিমান, তাই এই খেলায় আপনার ভূমিকা পালন করতে বেগ পেতে হবে না, সে বিশ্বাস আমার আছে। বৃহত্তর স্বার্থে এই দায়িত্ব যদি সফলভাবে পালন করতে পারেন তবে ইতিহাসে আপনার অবদান স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। তাছাড়া পরকালে শেষ বিচারের দিনে একজন সাচ্চা ইমানদার হিসেবে আপনাকে পুরস্কৃত কোরবেন মহান আল্লাহ। কঠিন দায়িত্ব বটে, তবে অসম্ভব নয়। জুলুমকারীদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় এবং শান্তিকামীদের উপরই আল্লাহ্‌র রহমত নাজেল হয়। সময় নিয়ে ধীরস্থির ভাবে ভেবেচিন্তে যাবার আগে আমাকে স্পষ্ট করে জবাব দিয়ে যাবেন, আপনার দায়িত্ব আপনি পালন করতে রাজি আছেন কি না। যাবার আগে দৃঢ়চেতা দেশপ্রেমিক বীর শপথ নিলো
তার দায়িত্ব সে পালন করবে।
খুবি খুশি হলাম। আপনার সম্পর্কে আমরা যা ভেবে এসেছি আপনি আজ নিজেকে তার চেয়েও অনেক বড় বলে প্রমাণিত করলেন! তবে খুবই সতর্কতার সাথে চলতে হবে আপনাকে। বিচক্ষণতার সাথেই নিতে হবে প্রতিটি পদক্ষেপ।
চলে গেলো দেশপ্রেমিক অফিসার। দেশে ফেরার সাথে সাথেই তাকে পদোন্নতি দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেয়া হল। নিজ দায়িত্ব গ্রহণ করার পরই জানতে পারলাম নতুন দায়িত্ব পাবার পর আমার কথার সাথে বাস্তব পরিস্থিতির মিল পেয়ে সে তার কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে দ্রুত। জেনারেল নুরুদ্দিনকেও সহজেই তার আয়ত্তে নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে সমমনা দেশপ্রেমিক। প্রেসিডেন্ট নিজের ক্ষমতা ধরে রাখার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছেন। দিনরাত তার অনুগত সেনাপ্রধানসহ বিশ্বাসভাজনদের নিয়ে বঙ্গভবনে এবং কমান্ডার ইন চীফ এর দফতরে লাগাতার রুদ্ধদ্বার বৈঠকে বসে মার্শাল’ল জারি করার ব্লু প্রিন্ট প্রণয়ন করছেন। চীফ সেনাসদরে খুব কমই আসছেন। সেই ফাঁকে বন্ধু তার করণীয় সবকিছুই করে নিচ্ছে। ইতিমধ্যেই ফর্মেশন ও ইউনিট কমান্ডারদের মিটিং সেরে এবং প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে ভিজিট করে সরেজমিনে অফিসার আর সৈনিকদের প্রতিক্রিয়া ও মনোভাব জেনে নিয়েছে সে। অতি উত্তম! জানতে পারলাম, দেশের সব কয়টি ক্যান্টনমেন্টেই সেনাসদস্যরা দেশে মার্শাল’ল জারি করার বিপক্ষে সেটাও ভালোভাবেই বুঝে নিয়েছেন বন্ধু। সামরিকবাহিনীর সদস্যরা একজন গণধিক্কৃত স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতিকে ক্ষমতায় টিকিয়ে রাখার জন্য জনগণের বিপক্ষে দাড়াতে চায় না। তারা মনে করে, সামরিক বাহিনীর জন্য জেনারেল এরশাদ এখন একটা গলগ্রহ ভারতীয় দালাল ছাড়া আর কিছুই নয়। এইসব খবর পাবার পর আমি নিশ্চিত হলাম আমাদের পরিকল্পনা সফল হবে। বাস্তব পরিস্থিতি বন্ধুর আত্মবিশ্বাসকেও বাড়িয়ে তুলেছে খবর পেলাম।
এখন খালেদাকে সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে তিনি যেকোনো দিন ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচির ডাক দেবেন। এই কথাটা সারাদেশে ছড়িয়ে দিতে হবে তার মিত্র হাসিনার প্রতিক্রিয়ার তোয়াক্কা না করেই, তবে আনুষ্ঠানিক ভাবে নয়। এই ধরনের দেশব্যাপী বহুল প্রচারিত হুমকিতে প্রেসিডেন্ট বিচলিত হয়ে মার্শাল’ল জারির ত্বরিত সিদ্ধান্ত নেবেন আর সেটা কার্যকরী করার জন্য ট্রুপস ডেপ্লয়মেন্ট-এর হুকুম জারি করবেন চীফ। ঠিক সেই সময় পরিকল্পনা অনুযায়ী বন্ধু তার দায়িত্ব পালন শুরু করবেন। এরশাদকে ক্ষমতাচ্যুত করা পর্যন্ত তাকেই সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা বজায় রাখতে হবে ডিফ্যাক্টো চীফ হিসাবে। যতক্ষণ পর্যন্ত এরশাদ ক্ষমতা হস্তান্তর না করছে, AHQ থেকে ISPR-এর মাধ্যমে কোন বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হবে না। মিডিয়ার সাথেও কোনও রকম যোগাযোগ রাখা হবে না। People should be absolutely in dark about the whole episode so that no one can react. He should also not meet any diplomat at any level. আর একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ করা হবে। লিস্ট অনুযায়ী আওয়ামীলীগেরঃ সাজেদাচৌধুরী, নাসিম, শেখ সেলিম, আমির হোসেন আমু, জিল্লুর রাহমান, হানিফ, আইভিরাহমান, তোফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক, ডঃ কামাল হোসেন, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, গাজি গোলাম দস্তগির, মায়া, শামিম ওসমান, ডঃ ইকবাল, মিজানুর রহমান চৌধুরী, জয়নাল হাজারি, চট্টগ্রামের মহিউদ্দিন। জাতীয় পার্টিরঃ এরশাদের ভাই কাদের, রুহুল আমিন, আনোয়ার হোসেন মঞ্জু, নাজিউর রহমান, ডঃ মোশররফ হোসেন, কাজি জাফর, ব্যারিস্টার মওদুদ, আনিসুর রহমান। বিএনপিরঃ ব্রিগেডিয়ারহান্নান শাহ, বি চৌধুরী, ওবায়দুর রহমান, আব্দুল মন্নান, ব্যেরিস্টার নাজমুল হুদা, জমিরুদ্দিন সরকার, খন্দকার মোশাররফ, জেনারেল ভূঁইয়া এদের সবাইকে নিজ নিজ বাড়ীতে নজরবন্দী করা হবে। মিডিয়া, কূটনৈতিক পাড়ার কারো সাথে কিংবা পার্টির কোনও নেতা-কর্মীদের সাথে তাদের যোগাযোগ করতে দেয়া হবে না। তাদের সবার টেলিফোন লাইন কেটে দেয়া হবে। বর্ডারের উপর BDR কে বর্ডারে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণের হুকুম জারি করা হবে। বিশেষ করে কাদের সিদ্দিকিকে বিশেষ নজরদারিতে রাখা হবে। এইসব এ্যাকশন শেষ হলে আমি এরশাদের সাথে যোগাযোগ করে আলোচনার মাধ্যমে নেত্রীদ্বয়-এর বিরুদ্ধে জারীকৃত হুলিয়া উঠিয়ে নেবার নির্দেশ আদায় করে নেবো এবং তাকে পদত্যাগে বাধ্য করবো। এরশাদের সাথে যোগাযোগ কালে খালেদা জিয়ার সাথেও আমাকে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখতে হবে। সতর্কতার সাথে সবকিছুর পেছনে বন্ধুই যে প্রধান ক্রিয়ানক সেটা গোপন রাখা হবে যাতে একজন নির্লোভ দেশপ্রেমিক হিসাবে তার জীবন এবং ক্যারিয়ারের কন ক্ষতি না হয়। তার দেশপ্রেম সাহসিকতার ফলেই দেশ ও জাতিকে বর্তমান চক্রান্তের হাত থেকে বাঁচাতে সক্ষম হব আমরা ইন শাহ আল্লাহ্‌। আবেগে আমি আপ্লুত হয়ে গিয়েছিলাম। এতো প্রলয় ঘটে যাবার পরও আমাদের হাতে গড়া সেনাবাহিনীতে দেশপ্রেম ও জাতীয়তাবাদী তথা ‘৭১-এর দেশপ্রেম এখনও সম্পূর্ণভাবে নিঃশেষ হয়ে যায়নি আল্লাহ্‌র অসীম করুণায়। আমার নিরন্তর ছায়াসঙ্গী রব্বানি খান নীরবে সব কিছুই দেখছে আর শুনে বোঝার চেষ্টা করছে অবাক বিস্ময়ে! খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানালাম
ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি আপনি যেকোনো দিন দিতে পারেন এই কথাটা দেশের প্রতিপ্রান্তে ছড়িয়ে দিতে হবে তবে আনুষ্ঠানিকভাবে নয়। এই ধরনের প্রচারণা আপনার শরিক দলআওয়ামীলীগ পছন্দ না করলেও আপনি আপনার কাজ এমন ভাবে করবেন যাতে প্রেসিডেন্ট জেনারেল এরশাদ শঙ্কিত এবং ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে মার্শাল’ল জারি করার ত্বরিত উদ্যোগ গ্রহণ করেন ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য। আমার এই প্রস্তাবে খালেদা কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়লেন বলে মনে হল।
কেনো এমনটি করতে বলছেন, সেটা আমি কিন্তু ঠিক বুঝতে পারছি না?
এই কেনো-র উত্তরটা পরবর্তী ঘটনাবলী থেকেই পেয়ে যাবেন। এই মুহূর্তে বিস্তারিত আমার পক্ষে কিছুই বলা সম্ভব না। Need to know basis-এ কিছুদিন আমাদের কথাবার্তা সীমিত রাখতে হবে। তবে এতটুকু বলতে পারি, ঘটনা যাই ঘটুক সেটা আপনাদের এবং দেশ ও জাতীয় স্বার্থেই ঘটবে ইন শা আল্লাহ! সাপ ও মরবে, লাঠিও ভাঙ্গবে না।
ঠিক আছে, আপনার কথা মেনে নিয়ে আমি সব ব্যবস্থা করছি।
ধন্যবাদ। ফোন রেখে দিলাম। এরপর থেকে সব কিছুই ঘটছিলো অতি দ্রুত লয়ে। পর্দার অন্তরালে সব কিছুর চূড়ান্ত ব্যবস্থা করে ফেলা হয়েছে। ঘেরাও কর্মসূচির খবরটা নেতা-কর্মীরা ছড়িয়ে দিলো। সারাদেশে তীব্র উত্তেজনার সৃষ্টি হল। সাজসাজ রবে মুখরিত হয়ে উঠলো সচেতন জনতা। কয়েকটি জাতীয় দৈনিকে খবরটা ছাপা হল। দেশ জুড়ে এই ঘেরাও কর্মসূচির প্রতি জনসমর্থন লক্ষ করে শঙ্কিত হয়ে দেশে মার্শাল’ল জারি করার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন জনধিক্কৃত স্বৈরশাসক রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ ক্ষমতা ধরে রাখার শেষ প্রচেষ্টা হিসেবে। সশস্ত্র বাহিনী প্রধান হিসেবে জেনারেল এরশাদ তিন বাহিনী প্রধানকে ডেকে তার সিদ্ধান্ত জানিয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের আদেশ দিলেন। দেশের সামরিক বাহিনী এবং অন্যরা সম্মিলিত ভাবে এই আদেশ কার্যকরী করলেও এতে মুখ্য ভূমিকা পালন করবে সেনাবাহিনী। সেনাসদরে ফিরে আর্মি চীফ নুরুদ্দিন সংশ্লিষ্ট জনকে প্রেসিডেন্টের সিদ্ধান্ত জানিয়ে নির্দেশ দিলেন পরিকল্পনা অনুযায়ী ট্রুপ্স ডেপ্লয়মেন্টের ব্যবস্থা করতে। নির্দেশ অনুযায়ী ট্রুপ্স ডেপ্লয় করা হল বটে, তবে সেটা ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি রোধ করার জন্য নয়, দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং তার অনুগত তাঁবেদারদের গৃহবন্দী করার জন্য। একই সাথে লিস্ট অনুযায়ী সবাইকে গৃহবন্দী এবং নজরবন্দী করা হল ত্বরিত গতিতে। হতভম্ব প্রেসিডেন্ট আর্মি চীফকে যখন জিজ্ঞেস করলেন
এ সবের মানে কি? তখন জেনারেল নুরুদ্দিন প্রেসিডেন্টকে বিনীত ভাবে জানালেন
একজন Loyal officer হিসাবে প্রেসিডেন্ট সহ তার নিকটস্থ আস্থাভাজনদের বাঁচানো এবং তাদের নিরাপত্তার জন্যই তাদেরকে Protective Custody-তে নেয়া ছাড়া আর কোনও বিকল্প ছিল না। কারণ, দেশে মার্শাল’ল জারি করার হুকুম তামিল করতে গেলে সমগ্র সামরিক বাহিনীতে বিদ্রোহের বিস্ফোরণ ঘটে যেতো, আর দেশে জুড়ে জ্বলে উঠতো দাবানল। দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং সেনারা মার্শাল’ল এর বিপক্ষে। শুধু তাই নয়, তারা একজন গণধিকৃত রাষ্ট্রপতির জন্য জনগণের বিরুদ্ধেহাতিয়ার হাতে দাড়াতে সম্মত নয়। সবারই ধারণা, জেনারেল এরশাদ বর্তমানে সামরিক বাহিনীর জন্য একটি গলগ্রহ ছাড়া আর কিছুই নন। ব্যাক্তির চেয়ে দেশ বড়, তাই রাষ্ট্রপতির উচিৎ হবে দেশে আগুন না জ্বালিয়ে জনগণের দাবি মেনে নিয়ে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেশে সাধারণ নির্বাচনের ঘোষণা দিয়ে কালবিলম্ব না করে পদত্যাগ করা। তা না হলে, সামরিক বাহিনী সহ সারা দেশে যে বিস্ফোরণ ঘটবে তাতে আমরা সবাই জ্বলে ছাই হয়ে যাবো। ক্ষমতা থেকে স্যার, আপনাকে সরে দাড়াতেই হবে।
অতর্কিত এবং অভাবনীয় এই ঘটনায় বিস্মিত হয়ে গেলো দেশবাসী। বন্ধ করে দেয়া হল ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি। কিছুটা স্বস্তির সাথেই দেশবাসী প্রতীক্ষা করতে থাকল আগামীতে ইতিবাচক কিছু ঘটার প্রত্যাশায়। খালেদা জিয়াও বিস্মিত হয়ে গিয়েছিলেন এমন অপ্রত্যাশিত অভাবনীয় ঘটনায়! তিনি ফোন করলেন আমাকে
এটা কি করে সম্ভব হল?
হয়েছে পরিকল্পনা অনুযায়ী। এখন আপনার দায়িত্ব হচ্ছে দেশে যাতে আইন-শৃঙ্খলাপরিস্থিতির অবনতি না ঘটে এবং দেশে জনগণের স্বাভাবিক জীবন যাতে বিঘ্নিত কিংবা বিপর্যস্ত না হয় সেটা নিশ্চিত করা। এখান থেকে এরশাদের সাথে আলোচনা করায় কিছু অসুবিধে আছে তাই আমি গোপনে লন্ডন যাচ্ছি কয়েকদিনের মধ্যেই। পৌঁছানোর পরই প্রথমে আপনাদের দু’জনের বিরুদ্ধে জারিকৃত হুলিয়া উঠিয়ে নেয়ার আদেশ জারি করতে বাধ্য করবো বন্দী প্রেসিডেন্ট এরশাদকে। এতে করে আপনি এবং দলের শীর্ষনেতারা খোলাখুলিভাবে গণসংযোগ স্থাপন করে অবস্থাকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে সক্ষম হবেন। এরপর শুরু হবে পদত্যাগের আলোচনা। আপনার সাথে এবং সেনাবাহিনীর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা কোরেই আলোচনা করবো আমি। অগ্রগতি এবং ফলাফলও আপনি জানতে পারবেন। রাখি আজকের মতো, কিছু জরুরী কাজ শেষ করে নিতে হবে সফরের প্রস্তুতি হিসাবে। আল্লাহ্‌ হাফেজ।
ঝটিকা এ্যাকশনের পর আমাকে ফোন করলো শফিকুল গণি স্বপন বেশ কিছুটা উৎকন্ঠার সাথেই। আকস্মিকভাবে এ ধরনের একটা অপ্রত্যাশিত ঘটনা যে ঘটতে পারে সে সম্পর্কে কোন ধারণাই ছিল না তার।
ডালিম ভাই, আপনি কি কিছু জানেন কিকোরে কাদের দ্বারা এ ধরনের পদক্ষেপ নেয়া সম্ভব হল?
আমার পক্ষে কি করে জানা সম্ভব ভাই? আমিতো তোমাকেই ফোন করবো ভাবছিলাম।তুমি প্রখ্যাত সাংবাদিক, তদুপরি জাদু মিয়ার ছেলে হিসাবে বিএনপির একজন প্রতিষ্ঠিত নেতা হওয়া ছাড়াও জেনারেল এরশাদের সাথেও তোমার আত্মীয়তা আছে। সেইক্ষেত্রে তোমার চেয়ে এই বিষয় আর কে বেশি কিছু জানতে পারে?
একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেলো স্বপন।
খালেদা জিয়ার সাথেও তো তোমার ঘনিষ্ঠতা রয়েছে। আমি তো আশা করেছিলাম তোমার কাছ থেকেই আসল খবরটা জানতে পারবো। নিউইয়র্ক-এর মিশনে অবস্থিত মহিউদ্দিন ভাই এবং মুক্তি আপি, তারাও কি কিছুই বলতে পারছেন না?
দেশে-বিদেশে কেউ কিছুই জানে না, সবাই অন্ধকারে। তবে আমার একটা অনুরোধ, যদি সম্ভব হয় তাহলে দেখবেন শারীরিক ভাবে তাদের যাতে কোনও ক্ষতি না হয়। মহিউদ্দিনভাই, মুক্তি, বাবু, নেলি নিউইয়র্ক এবং লন্ডন থেকে ফোন করছে ঘন ঘন। ওরা সবাই ভয় এবং আতঙ্কে ভেঙ্গে পড়েছে। আপনাকেও তারা ফোন করতে পারে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী আপনাদের হাতে গড়া। তাই এই অনুরোধ, কিছু মনে করলেন নাতো?
মনে করার কিছুই নেই। তবে কি জানো স্বপন, আমাদের গড়া সামরিক বাহিনীর চরিত্র হনন করা হয়েছে অনেকাংশেই। বদলে ফেলা হয়েছে নৈতিকতা, নীতি-আদর্শ। তবুও আমি দেখবো, যদি আমার পক্ষে কিছু করার কোনও অবকাশ থাকে।
স্বপনের সাথে কথা বলার পরই লন্ডন থেকে বাবু আর নেলি ফোন করলো। বাবু মহিউদ্দিনের ছোট ভাই। আমি যখন হংকং এ ছিলাম তখন বাবুও হংকং এ BCCI Bank-এ চাকরি করতো। সেই সুবাদে পরিচয়। বাবু আর নেলিকে প্রথম দেখাতেই আমাদের ভালো লেগেছিল। খুবই সহজ সরল আর প্রাণখোলা দু’জনেই। প্রেসিডেন্টের সাথে ঘনিষ্ঠ আত্মীয়তা থাকলেও এই দম্পতির মধ্যে কোনও দম্ভ ছিল না। সব ব্যাপারেই তারা আমাদের পরামর্শ নিয়ে চলতো। বাবু আর নেলির কাছে আমি ও নিম্মি দুজনেই বিশেষ ভাবে শ্রদ্ধার পাত্র ছিলাম। মন থেকে দু’জনই আমাদের ভালোবাসতো। পাকিস্তান আমল থেকেই ডেইজি ভাবী, মানে বেগম এরশাদকে জেনে এসেছি। Young Officer-দের প্রতি তিনি সর্বদা ছিলেন স্নেহবৎসল। মেজর এরশাদ হাসিখুশি সৌখীন মানুষ হলেও Three Ws (Wealth Women Wine)-এর প্রতি তিনি বরাবরই ছিলেন আসক্ত।
আমি যখন গণচীনে তখন ডেইজি ভাবী প্রায় তিন মাসের উপর সেখানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তখন আমি আর নিম্মিই তার দেখাশোনা করতাম। সেই সময় তার একান্ত সান্নিধ্যেআসার সুযোগ হয়েছিলো আমাদের। তাই তাকে আরও ভালো লেগেছিলো। তিনিও আমাকে আরনিম্মিকে আন্তরিকভাবেই ভালোবেসেছিলেন। বাবু আর নেলি ফোনে অনেক কান্নাকাটি করে মিনতি জানালো যাতে আমি সেনাবাহিনীতে পরিচিত জনদের সাথে কথা বলে কোনক্রমে জেনারেল এরশাদ আর অসুস্থ ডেইজি ভাবীকে দেশ থেকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা করি। আমি আর নিম্মি দুইজনেই তাদের সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলাম, সাধ্যমত সব কিছুই করবো। প্রয়োজনে তাদের অনুরোধ রক্ষা করে লন্ডনেও চলে আসবো। এতে বেশ কিছুটা আশ্বস্ত হয়েছিল বাবু এবং নেলি দুইজনই। বাবুদের সাথে কথা বলার পর জেনারেল এরশাদের সাথে যোগাযোগ করলাম। সার্বক্ষণিক ছায়াসঙ্গী এবং বিশ্বস্ত বন্ধু গোলাম রব্বানি খান পাশে বসা একটি নোট প্যাডআর কলম হাতে। He is a very meticulous person. Rabbani is an extremely intelligent character with unbelievable photogenic memory.
আসসালামু আলাইকুম স্যার, কেমন আছেন? হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে আমার কল পেয়ে জেনারেল এরশাদ খুবই আশ্চর্য হলেন। ওয়ালাইকুম আসসালাম, ডালিম তুমি কোথা থেকে? যোগাযোগ কোরলে কি ভাবে?
এর জবাব অবান্তর। আপনি পুরো দেশটাকে একটা সর্বনাশা সংকটের দিকে ঠেলে দিচ্ছিলেন। শুধুমাত্র ক্ষমতা আঁকড়ে ধরে রাখার জন্য দেশে মার্শাল’ল জারি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন কেনো? আপনার সেই হঠকারী সিদ্ধান্তের ফলেই আজ আপনি এবং আপনার সহচররা সবাই গৃহবন্দী। আপনার দীর্ঘ ৮ বছরের স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে আজ সারা দেশবাসী জেগে উঠেছে সেই অবস্থায় আপনার এই আত্মঘাতী সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে দেশপ্রেমিক সেনা সদস্যদের বেশিরভাগই অবস্থান নিয়েছে দেশকে একটি রক্তক্ষয়ী গৃহযুদ্ধের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য। গৃহযুদ্ধে আপনার আর আপনার দোসরদের পরিণতি কি হতো সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনার সময় এটা নয়। তবে আমি আপনাকে আন্তরিকভাবে একটি বাস্তব সত্য জানাচ্ছি। সামরিক বাহিনীর এই আকস্মিক পদক্ষেপ জনগণের কাছে প্রশংসিত হয়েছে। তারা এখন অপেক্ষায় রয়েছে এর পর কি হয় দেখার জন্য। জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে সবদিক বাঁচিয়ে বিশেষ করে আপনার পরিণতির কথা ভেবেই একটা গ্রহণযোগ্য সমাধানের পথ খুঁজে বের করার জন্যই আমি আপনাকে ফোন করেছি বিবেকের তাড়নায়। ইতিমধ্যেই, ঢাকা থেকে স্বপন এবং লন্ডন থেকে বাবু আর নেলি ফোন করেছিলো। তারা সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত এবং আপনার এবং ডেইজি ভাবীর নিরাপত্তার বিষয়ে বিশেষভাবে উদ্বিগ্ন। আমাকে আপন ভেবে তারা তিনজনই মিনতি জানিয়েছে, আপনাদের ব্যাপারে কিছু করা সম্ভব হলে করার জন্য। স্যার, মোনাফেকি আমার স্বভাব বিরুদ্ধ। রাজনৈতিকভাবে আমাদের নীতি-আদর্শের ক্ষেত্রে পার্থক্য থাকলেও পারিবারিক এবং ব্যক্তিগতভাবে শেখ সাহেব, জেনারেল জিয়া ও আপনার পরিবারের সাথে আমার একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক সবসময়েই ছিল এবং আছে, আর এই সম্পর্ক সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে। এই সম্পর্ক প্রীতি, স্নেহ আর ভালবাসার সম্পর্ক। তাই আমি তাদের শান্ত করার জন্য আন্তরিকভাবেই বলেছি, আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করবো যাতে আপনাদের উপর কোনও প্রকার শারীরিক নির্যাতন কিংবা অপ্রীতিকর কিছু করা না হয়। তবে আমার চেষ্টাকে সফল করে তোলার জন্য আপনার তরফ থেকেও সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে। এখন আপনি বলুন, বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে আপনি আমার সাথে সহযোগিতা করতে রাজি আছেন কিনা? আমাকে বিশ্বাস করে যদি আপনি সহযোগিতার কথা দেন, তবেই আমি এগুবো, তা না হলে আমি আমার সব উদ্দগ থেকে সরে দাড়াবো। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে জেনারেল এরশাদ বললেন
বেশ, বলো তুমি কি ধরনের সহযোগিতা চাও।
আমি যা বলবো সেটাকে আবেগ দিয়ে বিচার না করে যুক্তি দিয়ে বিবেচনা করতে হবে।
তাই করবো। প্রথমে বলুন, আপনাদের কোনও বিশেষ অসুবিধে হচ্ছে না তো? ডেইজিভাবী কেমন আছেন?
ডেইজি ভালোই আছে। আমারও বন্দীত্ব ছাড়া তেমন কোনও অসুবিধা নেই। স্বাভাবিক অবস্থাতেই রাখা হয়েছে আমাদের। শুধু কারো সাথে যোগাযোগের কোন সুযোগ নেই। এটাতো Rules of Business সেটা আপনার ভালো করেই জানা আছে। স্যার মনোযোগ দিয়ে শুনুন এবার। খালেদা জিয়ার সাথে আমার কথা হয়েছে। আমার কথায় ক্যান্টনমেন্ট ঘেরাও কর্মসূচি তিনি সাময়িকভাবে স্থগিত করতে রাজি হয়েছেন যদিও আওয়ামীলীগ বিশেষ করে হাসিনা তার এই সিদ্ধান্তের ঘোর বিরোধিতা করছেন। কেনো সেটা আপনার বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয়। আমার বিবেচনায় এখন আপনার জন্য একটাই পথ খোলা রয়েছে। Temporary Retreat. আপনি যদি স্বেচ্ছায় রাষ্ট্রপতির পদ থেকে ইস্তফাদিয়ে পার্লামেন্ট ভেঙ্গে আগামী নির্বাচনের ঘোষণা দেন তবে খালেদা জিয়া কথা দিয়েছেন, আপনি চাইলে সপরিবারে আপনাকে দেশের বাইরে পাঠিয়ে দেবার ব্যবস্থা তিনি করবেন এবং আর্মিও সেটা মেনে নেবে। আমি জানি, হাসিনা এইসিদ্ধান্ত মেনে নেবে না সহজে। শুধু তাই নয়, ভারতের ইশারায় খালেদার চেয়ে বেশি সোচ্চার হচ্ছে হাসিনা আপনাকে জেলে পাঠিয়ে বিচার করার ব্যাপারে যাতে আপনি হাসিনার করুণার পাত্র হয়ে তার ও ভারতের স্বার্থে ব্যবহৃত হন। একটা সত্যি আপনাকে মেনে নিতে হবে স্যার, ভারতের কাছে আপনার আর তেমন কোনও মূল্য নেই। আপনাকে ৮ বছর ক্ষমতায় রেখে তাদের যা হাসিল করার ছিল সেটা তারা করে নিয়েছে। এখন থেকে হাসিনা থাকবে ড্রাইভিং সিটে আর আপনাকে থাকতে হবে তার তাঁবেদার হয়ে। জেনারেল জিয়াও ভারতের সাথে আপোষ করেছিলেন। হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের রাজনীতির মূল ধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর তার প্রয়োজনীয়তাও ফুরিয়ে যায়। ফলে তার পরিণতিটা কি হয়েছে সেই সময়ের একজন মুখ্য খেলোয়াড় হিসেবে আপনার ভালো করেই জানা আছে। ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের পর বিলুপ্ত প্রায় আওয়ামী-বাকশালিদের পুনর্জীবিত করার জন্য জেনারেল জিয়া এবং আপনি ব্যবহৃত হয়েছেন ভারতের সাথে জাতীয় স্বার্থবিরোধী সমঝোতার নীতি গ্রহণ করে। আমার অনুরোধ, আপনি আওয়ামীলীগকে যদি পলিটিক্যাল স্কোরিং-এর সুযোগটা না দেন তবে অতীতের ভুলের প্রায়শ্চিত্ত কিছুটা হলেও হবে। স্যার, শুধু সমঝোতা ভিত্তিক ক্ষমতার রাজনীতি জটিল এবং মর্মান্তিক ভাবে কুটিল।
তুমি সত্যিই বলছো ম্যাডাম কি সত্যই রাজি হয়েছেন আমাকে মুক্তি দিয়ে Safe Passage দেবার ব্যবস্থা তিনি করবেন!
জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর সাথে আপনার সম্পৃক্ততা সম্পর্কে তিনি যতটুকু জানেন তাতে আমি ভাবতে পারিনি তিনি আমার প্রস্তাবটা মেনে নেবেন। কিন্তু নিলেন আমাকে অনেকটা অবাক করে দিয়েই। স্যার, আমি মিথ্যাকে ঘৃণা করি। এটা কমবেশী পরিচিতজনরা সবাই জানে, আপনিও নিশ্চয় কিছুটা আন্দাজ করতে পেরে থাকবেন দীর্ঘদিনের পরিচয়ের পরিপ্রেক্ষিতে।আপনি ভাবুন, কয়েক দিনের মধ্যেই আমি বাবু আর নেলির সাথে যাতে আপনি সরাসরি আলাপ করতে পারেন সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করবো। এতে আপনার সিদ্ধান্ত নিতে কিছুটা সুবিধে হতে পারে। রাখি স্যার, আজকের মতো।
ফোন রেখে দিয়ে রব্বানিকে আলাপের বিষয়বস্তু বুঝিয়ে দিয়ে বললাম, এখন আমাকে লন্ডন যেতে হবে যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব। দীর্ঘদিনের সম্পর্কের দরুন রব্বানি সারবস্তুর প্রায়সবি বুঝে ফেলে আমাদের কথাবার্তা বাংলাতে হলেও। রব্বানি, কেনিয়া ভিজিটের সময় জেনারেল এরশাদের চেহারাটা দেখে তোমার কি ধারণা হয়েছে জানি না। ভীষণ পিছলে মাল, কথা পালটাতে এক মুহূর্ত লাগে না জেনারেল এরশাদের। CMLA থাকা কালে সবাই এরশাদ সম্পর্কে বলতো CMLA মানে Cancel My Last Announcement! দু’জনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। দোস্ত, আমি কিন্তু যতই তোমাকে দেখছি ততোই বিস্মিত হচ্ছি!
কেনো বলতো?
আমি পাকিস্তানের অনেক বাঘা বাঘা রাষ্ট্রদূত এবং হাই কমিশনারদের দেখেছি। দেখেছি তারা প্রেসিডেন্ট কিংবা প্রাইম মিনিস্টার এর সাথে কিভাবে আচরণ করেণ। তোমাকেও দেখলাম রাষ্ট্রপতি এরশাদের ভিজিটের সময়। যেকোনো VVIP visit এর সময় সবাইকে দেখেছি গলদঘর্ম হতে, আর তোমাকে দেখলাম জেনারেল এরশাদের রাষ্ট্রীয়সফর কালে নির্বিকার এবং সবসময় তুমি যেমন থাকো ঠিক তেমনই! এখন দেখছি, হাজার মাইল দূরে বসে একটা মানুষ কি করে পাশা উল্টে দিচ্ছে অনায়াসে! ইতিহাসের জ্ঞান আমার সীমিত, তবে এ ধরনের মানুষের কথা ইতিহাসেও বিরল। এতটা আত্মপ্রত্যয় আর বল তুমি পাও কি করে?
প্রিয়বন্ধু, উদ্দেশ্যটা যদি সঠিক হয় আর ব্যক্তিকেন্দ্রীক না হয়ে বৃহত্তর স্বার্থে হয় তবে অসীম করুণাময় আল্লাহ্‌ই প্রয়োজনীয় সাহস কিংবা আত্মপ্রত্যয় যুগিয়ে দেন। এটা আমার ব্যক্তিগত জীবনের অভিজ্ঞতা।
রব্বানি চলে যাবার পর কিছু বিষয় মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। এরশাদের কথা আর কাজের মধ্যেঅনেক ফারাক থাকে। তাই তার কোন কথাতেই অতি উৎসাহিত হওয়া চলবে না। অতএব, আলোচনার বিষয়বস্তু সম্পর্কে খালেদা জিয়া এবং সেনাসদরের সাথে খুবই সতর্কতার সাথেই আলাপ চালাতে হবে। পরদিন রাতে আবার এরশাদকে ফোন করলাম। রব্বানি রয়েছে পাশেই।
আসসালাম, আজ কেমন আছেন স্যার? কি ভাবলেন? স্যার, কিছু মনে না করলে একটা কথা খুলে বলতে চাই। কথাটা নেহায়েত আমার নিজস্ব বিবেচনা।
বলো কি বোলতে চাও। তুমি একজন শুভার্থী হিসেবে যা বলবে সেটা আমাদের ভালোর জন্যই বলবে, সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই আমার।
স্যার, জীবন বাঁচিয়ে সপরিবারে দেশছেড়ে বাইরে চলে আসুন। আপনিতো শুনি ইতিমধ্যেই ৬০০ মিলিয়ন ডলার এর মালিক হয়ে বসেছেন। সেটা বিদেশের বিভিন্ন ব্যাঙ্কের একাউন্টে গচ্ছিত রাখা হয়েছে। টাকার অংকটা যদি অর্ধেকও হয় তবে সেটা দিয়ে বিশ্বের যেকোনো পছন্দসই জায়গাতে বিলাসবহুল জীবন কাটানো আপনার পক্ষে কষ্টসাধ্য হবে না। তাছাড়া তৃতীয় বিশ্বেরপ্রায় সব কয়টি দেশেই প্রচলিত অনিশ্চিত রাজনৈতিক প্রবাহে ফিরে আসার সুযোগ যেকোনো সময় আবার সৃষ্টি হওয়া অস্বাভাবিক কিছু নয়। বাবুদেরও এই অভিমত। এমনটি তো অহরহ ঘটছে চারিদিকে। এই বয়সে জেলের ভাত আপনি হয়তো হজম করতে সক্ষম হবেন তবে, ভাবীর যেই শারীরিক অবস্থা তাতে এই ধরনের মানসিক এবং শারীরিক চাপ তার পক্ষে বরদাস্ত করাটা খুবই কষ্টকর হবে। উপরন্তু, বিদেশী প্রভুদের কথামতো না চললে আপনার বিষয়টি কিন্তু শুধুমাত্র কারাবন্দী পর্যন্ত নাও থাকতে পারে। তখন অবস্থা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে, আমি কি বুঝাতে চাচ্ছি সেটা নিশ্চয় আপনি বুঝতে পারছেন স্যার।
ঠিকই বলছো তুমি। আমি তোমার প্রস্তাবে রাজি।
তাহলে, আপনার এই সিদ্ধান্তটা ম্যাডামকে জানাতে পারি কি?
নিশ্চয়ই।
দেখবেন স্যার, কথা রাখার ব্যাপারে বাজারে আপনার যে সুখ্যাতি রয়েছে সেটা যেন এইক্ষেত্রে প্রযোজ্য না হয়। তাহলে আমার পক্ষে কিন্তু আর কিছুই করা সম্ভব হবেনা। তাই আবারও জিজ্ঞেস করছি, ভালোভাবে ভেবে চিন্তেই সিদ্ধান্তটা নিয়েছেনতো? জেনারেল এরশাদ জবাব দিলেন
সবাই তো আর ডালিম নয়।
ঠিক আছে, তাহলে আমি ম্যাডামকে আপনার সম্মতির কথাটা জানিয়ে জিজ্ঞেস করি পদত্যাগ, ক্ষমতা হস্তান্তর এবং আগামি নির্বাচনের Modalities নিয়ে তারা কি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, সেই অনুযায়ী আমাদের এগুতে হবে। আপনিও বিষয়টি নিয়ে ভাবুন। দু’পক্ষের ভাবনা চিন্তার উপর নির্ভর করেই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে। কি বলেন স্যার?
ঠিকই বলেছো তুমি।
খালেদা জিয়ার সাথে যোগাযোগ করে জানালাম জেনারেল এরশাদ রাজি হয়েছেন পদত্যাগের পর ক্ষমতা হস্তান্তর করে জাতীয় নির্বাচনেরঘোষণা দিয়ে দেশত্যাগ করতে। এমন সহজেই এরশাদ ক্ষমতা ছেড়ে দেবেন সেটা খালেদার জন্য অপ্রত্যাশিত হলেও খবরটা জেনে তিনি খুশিই হলেন। আমি তাকে আরও জানালাম, দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে জারিকৃত হুলিয়াও তুলে নেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ। সহসাই তার এই হুকুমনামা কার্যকরী হয়ে যাবে সরকারি পর্যায়ে। এরপর খালেদা জিয়াকে জিজ্ঞেস করলাম, কার কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবেন প্রেসিডেন্ট এরশাদ?
জবাবটা দুই একদিনের মধ্যেই আলোচনার মাধ্যমে চূড়ান্ত করে আপনাকে জানাচ্ছি, বললেন বেগম খালেদা জিয়া। আমি তাকে বললাম
যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জবাবটা জানানোই শ্রেয়। কারণ জেনারেল এরশাদকে মত পালটানোর সময় এবং সুযোগ দেয়াটা ঠিক হবে না। আর একটি কথা আপনাকে মনে রাখতে হবে। যদিও জেনারেল এরশাদ দেশ ছাড়তে রাজি হয়েছেন কিন্তু এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবে ভারত এবং RAW। আমি নিশ্চিত, আপনি কারণটা বুঝতে পারবেন। আপনার গুরুত্বপূর্ণ ইঙ্গিতগুলো মনে থাকবে। সেই প্রেক্ষিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমরা সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে ফেলবো ইন শা আল্লাহ্‌।
আমি আপনার ফোনের অপেক্ষায় থাকবো।
ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন রেখেদিলেন খালেদা জিয়া।
এই সব কথোপকথনের সারবস্তু সেনাসদরের বিশেষজনকেও জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো। ইতিমধ্যেবাবু আর নেলি লন্ডন থেকে অস্থির হয়ে ফোন করছে বার বার। পাবলিক টেলিফোন বুথথেকে তারা ফোন করে অবস্থার ইতিবাচক কোন অগ্রগতি হল কিনা জানতে চাইছে। প্রতিবারই আমি তাদের আশ্বস্ত করে জানাচ্ছি আলোচনা চলছে, ভয়ের কোন কারণ নেই। ভাই-ভাবী দুইজনই ভাল আছেন। আমার সাথে সবপক্ষেরই যোগাযোগ হচ্ছে। খুব শীঘ্রই সংকট কেটে যাবে ইন শা আল্লাহ্‌। তোমরাও দোয়া কর তারা যেন সহি-সালামতে দেশ থেকে বরিয়ে আসতে পারেন। পরদিনই খালেদা জানালেন চীফ জাস্টিসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে প্রেসিডেন্ট এরশাদকে। জেনারেল এরশাদকে খবরটা জানানোর পর তিনি সম্মত হলেন। জাতির উদ্দেশে তার ভাষণ রেকর্ড করানো হল। নাতিদীর্ঘ ভাষণে তিনি তার স্বেচ্ছায়পদত্যাগ, দুইনেত্রীর বিরুদ্ধে হুলিয়া প্রত্যাহার, সাধারণ নির্বাচনেরস্বার্থে চীফ জাস্টিসের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছেন বলে জাতিকে অবগত করলেন। তার এই ভাষণ প্রচারিত হওয়ার সাথে সাথেই সারাদেশে জনগণ আনন্দে ফেটে পড়লো। খুশির জোয়ারে ভাসতে থাকলো পুরো বাংলাদেশ। এভাবেই পর্দার অন্তরালের নিঃস্বার্থ প্রচেষ্টায় একআত্মঘাতী সংঘর্ষের হাত থেকে দেশ ও জাতি রক্ষা পেলো! প্রতিবেশী দেশেরচাণক্যদের চক্রান্ত ব্যর্থ হয়ে গেলো আল্লাহর অসীম করুণায়। আমি আর রব্বানিদু’জনই হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। মুখ্য খেলোয়াড় জেনারেলও পর্দার আড়ালেই রয়ে গেলো! আমি কিন্তু এরপরও শঙ্কামুক্ত হতে পারছিলাম না। শৃগালের মত ধূর্ত জেনারেল এরশাদশুধুমাত্র নিজেকে বাঁচানোর জন্য ক্ষমতা ছেড়ে দেশান্তরী হবার সিদ্ধান্তনিলেও তার বিদেশী প্রভু ভারত কি তাকে এত সহজে ছাড় দিতে রাজি হবে? এই প্রশ্নটাই ছিল আমার শঙ্কার প্রধান কারণ। যতদিন জেনারেল এরশাদ দেশ ত্যগ নাকরবেন ততদিন এই শঙ্কা থেকেই যাবে। যাই হউক, ভাষণটি জাতীয় প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হবার পর এরশাদের দেশ ছাড়ার বিষয়ে আলোচনার জন্য তাকে ফোন করলাম রব্বানির উপস্থিতিতেই।
আসসালাম স্যার, কেমন আছেন? দেশ ও জাতির স্বার্থে আপনি যে ত্যাগ স্বেচ্ছায় স্বীকারকরলেন সেটা প্রশংসনীয়। আপনাকে ধন্যবাদ জানাচ্ছি অন্তর থেকেই। এবার বলুন, কবে আপনি দেশ ছাড়ছেন? আপনার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সব ব্যবস্থা করা হবে।
আমি দেশ ছাড়বো না, নির্বাচনে জিতে আমিই আবার সরকার গঠন করবো। আগামী নির্বাচনে আমি প্রায় ১২০ টি আসনে জিতবো।
স্তম্ভিত হয়ে গেলাম! কি প্রলাপ বকছেন জেনারেল এরশাদ! আমার শঙ্কাই সঠিক বলে প্রমাণিত হল! খেলার সমাপ্তি হয়নি। কি সেই খেলা? আগামী নির্বাচনে কোনও কারচুপির অবকাশ থাকবে না। কারণ, চীফ জাস্টিস সেনাবাহিনীর সাহায্য নিয়েই বিশ্বপরিসরে একটি অবাধ এবং সুষ্ঠু নির্বাচন করাবেন। সেই ক্ষেত্রে জেনারেল এরশাদ এবং তারদল কি করে ১২০ টি সিটে জিতে সরকার গঠন করবেন সেটা কোনও পাগলের পক্ষেও বিশ্বাস করা কঠিন! এই বাস্তবতার নিরিখে খেলাটা হবে, জনপ্রিয়তার ক্ষেত্রে খালেদার তুলনায় যেহেতু হাসিনা পিছিয়ে রয়েছে তাই এরশাদের মাধ্যমে তার ভোটেভাঙ্গন ধরিয়ে পরে আওয়ামীলীগ এরশাদকে প্রয়োজনে সাথে নিয়ে সরকার গঠন করবে। তাই তাকে দেশ ছাড়তে দিচ্ছে না প্রভু ভারত। ১৯৮৬সালে এরশাদ আওয়ামীলীগ ও জামায়াত-এর সাথে সমঝোতার মাধ্যমে নির্বাচনের প্রহসনের মাধ্যমে তার অবৈধ ক্ষমতা গ্রহণকে বৈধ করতে চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন জেনারেল এরশাদ। এর পেছনে কলকাঠি ভারত। জেনারেল এরশাদ এবং আওয়ামীলীগের গলায় বাঁধা সুতো ভারতীয় চাণক্যদের হাতে। জামায়াতের রাজনীতি জন্মের পর থেকেই বিভ্রান্তিকর। পাকিস্তান আন্দোলন কালে জামায়াতের তাত্ত্বিক গুরু মাওলানা মওদুদী দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থন কিংবা বিরোধিতা না করে তার জন্মভূমি ভারতের দাক্ষিণাত্যেই থেকে যান। পরে তিরিশের দশকে হিজরত করে ভারত ছেড়েপশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবে পাড়ি জমিয়েছিলেন মাওলানা! পঞ্চাশের দশকের শুরুতেই কাদিয়ানীদের অমুসলমান বলে ফতোয়া জারি করায় এক রক্তক্ষয়ীদাঙ্গা-ফ্যাসাদের সূত্রপাত ঘটে পাকিস্তানে। অনেক নিরীহ লোকেরপ্রাণহানি ঘটে সেই দাঙ্গায়। এই দাঙ্গায় সম্পৃক্ততার অভিযোগে মাওলানা মওদুদীকে বন্দী করা হয় এবং বিচারে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়। তবে কাকতলীয় ভাবে তিনি সেই যাত্রায় ছাড়া পেয়ে যান। এরপর থেকে পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী প্রো-এস্টাবলিশমেন্ট রাজনীতিকরে চলেছে।এর ভূরিভূরি প্রমাণ রয়েছে পাকিস্তানের রাজনৈতিক প্রবাহে।
ভারতের সাথে সমঝোতার ফলে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার পর ব্যালেন্সিং এ্যাক্ট হিসাবে জেনারেল জিয়া প্রফেসর গোলাম আজমকে দেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রদান করেন। ফিরে এসে জনাব গোলাম আজম জামায়াত-এর আমীর পদে অধিষ্ঠিত হয়ে দলের সাংগঠনিক তৎপরতায় মনোনিবেশ করেন। সেই প্রক্রিয়ার এক পর্যায় জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পর ক্ষমতাগ্রাসী জেনারেলএরশাদের আনুকূল্য পাবার জন্য এবং আওয়ামী লীগেরকাছে নিজেদের গ্রহণযোগ্যতা পাবার অভিপ্রায়ে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনেওআওয়ামীলীগের লেজুড়বৃত্তি করে অংশগ্রহণ করেছিল জামায়াতে ইসলামী।
কিন্তু তাদের দ্বারা প্রতারিত হয়েও খালেদা জিয়া সেই নির্বাচন বর্জনে ছিলেন অনড়। এর মূল কারণ ছিল, খালেদা জিয়া বদ্ধমূল ধারণা পোষণ করছিলেন তার স্বামীর অকালমৃত্যুর পেছনে জেনারেল এরশাদ, আওয়ামীলীগ এবং ভারতের হাত ছিল।
তাই, বিক্ষুব্ধ খালেদা জিয়া জেনারেল এরশাদের অবৈধ ভাবে অস্ত্রের মুখে বিএনপির নির্বাচিতরাষ্ট্রপতি জনাব সাত্তারের অসুস্থতার সুযোগ গ্রহণ করে ক্ষমতা কব্জা করাকে বৈধতা না দিয়ে এরশাদ বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্বেই থেকে যাবার সিদ্ধান্ত নেন।এতে তার আশাতীত লাভ হয়। খালেদার ব্যক্তিগত ভাবমূর্তি জনগণের কাছে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে আপোষহীন নেত্রীহিসেবে।একই সাথে তার জনপ্রিয়তাও বেড়ে যায়। রাজনৈতিক ভাবে এটা ছিল তার একটি অপ্রত্যাশিত ব্যক্তিগত প্রাপ্তি। ফলে স্বৈরশাসক এরশাদবিরোধী আন্দোলনের ক্ষেত্রে খালেদা জিয়াই জনগণের কাছে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন মূলনেত্রী হিসাবে।
দেশজুড়ে গণআন্দোলন যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে থাকে ঠিক সেই সময় এরশাদের ভরাডুবি অবধারিত বুঝতে পেরে ভারতীয় চাণক্যদের ইশারায় আওয়ামীলীগ এরশাদের সাথে গাঁটছড়ায় ইতি টেনে আবারগণ-আন্দোলনে এসে শরিক হয়। জামায়াতও অবস্থা বুঝে এরশাদের প্রতি সমর্থন তুলে নিয়ে আন্দোলনে ঢুকে পড়ে আওয়ামীলীগের পদাংক অনুসরণ করে।
১৯৮৬ সালের এরশাদের পাতানো খেলার নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে আওয়ামীলীগ এবং জামায়াত উভয় দলই বিভিন্নভাবে লাভবান হয়েছিল। যাই হউক, এরশাদের কথা থেকে বুঝতে কষ্ট হলো না, আগামী নির্বাচনে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতা এবং আর্থিক সঙ্কটের সুযোগ নিয়ে চাণক্যপুরির সার্বিক সাহায্যে আবার আওয়ামীলীগ এবং এরশাদ জোট সরকার বানাবার ব্যাপারে প্রায় সুনিশ্চিত। জনসমর্থন খালেদার পক্ষে থাকলেও অনুগত কিংবা নির্দলীয় প্রশাসন, অর্থবল, সাংগঠনিক এবং পেশিশক্তির দিক থেকে এরশাদএবং আওয়ামীলীগ তুলনামূলক ভাবে বিএনপি থেকে অনেক বেশী শক্তিশালী। এই চারটি উপাদানের উপরই বেশিরভাগ নির্ভর করে তৃতীয় বিশ্বের যেকোনো দেশের নির্বাচনী ফলাফল। দীর্ঘ ৮ বছর ক্ষমতায় থেকে রাষ্ট্রীয় প্রশাসনকে দলীয় করণের কাজটি ভালোভাবেই করে নিতে সক্ষম হয়েছেন রাষ্ট্রপতি এরশাদ এবং আওয়ামীলীগ। জামায়াতও এইক্ষেত্রে কিছুটা এগুতে সক্ষম হয়েছে জুনিয়র পার্টনার হিসাবে। এই অশনিসংকেতে ভীষণ চিন্তিত হয়ে পড়লাম। খালেদা জিয়াকে এরশাদের সিদ্ধান্ত বদল ও তার বক্তব্যের তাৎপর্য এবং বিশ্লেষণ খুলে বলা উচিৎ যাতে করে খালেদা জিয়া সতর্কতার সাথে এই কঠিন বাস্তবতার মোকাবেলায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন। আমাকে বিশেষভাবে চিন্তিত দেখে ছায়াসঙ্গী রব্বানি বললো
কি ব্যাপার, এতো চিন্তিত কেনো? আমি তাকে খেলার নতুন অধ্যায় সম্পর্কে সব কিছু খুলে বললাম। সব শুনে রব্বানি বললো শোনো, এই বিষয়ে আমার একটা বিশ্লেষণ আছে।
আগামী নির্বাচনের পর এরশাদ নয়, আওয়ামীলীগই সরকার গঠন কোরবে, জেনারেল এরশাদ হবে আওয়ামীলীগের সমর্থক শক্তি। আওয়ামীলীগ এবং ভারত জামায়াতকে ব্যবহার করতে চাইবে শুধু খালেদার ভোট কাটতে, তবে ক্ষমতায় জামায়াতকে অংশীদারিত্ব কখনই দেয়া হবে না। এরপরও কথা থাকে। এরশাদকে আওয়ামীলীগের লেজুড় হয়ে বৈধতা দিতেই হবে। বৈধতা দেবার পরও জামায়াত নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকেই বুঝে নিবে তাদের বেঁচে থাকাই হয়ে উঠবে মুশকিল। তাই রাজনৈতিক অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্যই বিএনপির সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়া ছাড়া জামায়াতের আর কোনও গত্যান্তর থাকবে না। খালেদা জিয়ার নির্বাচনী মোর্চায় ঢোকার সার্বিক প্রচেষ্টা করবে তারা। বিএনপির উচিৎ হবে তাদের গ্রহণ করা। আমি দৃঢ়ভাবেই বলছি, আগামী নির্বাচনের প্রেক্ষাপট ১৯৮৬ সালের মতো হবে না। সেইসময় বিএনপি জোটের আন্দোলনকে দুর্বল করে তোলার জন্যই জামায়াতকে সরিয়ে আনা হয়েছিলো। একই সাথে আওয়ামীলীগের নির্বাচনে অংশগ্রহণ ও জেনারেল এরশাদের ক্ষমতাদখলকে বৈধতা দেবার জন্যই জামায়াতকে গুণতিতে নেয়া হয়েছিল। আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ এবং জেনারেল এরশাদের কোনও প্রয়োজন হবে না জামায়াতের। কারণ, তারা বুঝতে পেরেছে এখনঅব্দি জামায়াত-এর গ্রহণযোগ্যতা আমজনতার কাছে প্রশ্নবিদ্ধ। সেটা বিগত ১৯৮৬ এর নির্বাচনের ফলাফলেই পরিষ্কার হয়ে গেছে।
যেই বিষয়টি আমাকে বেশি ভাবিয়ে তুলছে সেটা হল, আগামী নির্বাচনে যদি আওয়ামীলীগ এরশাদকে সাথে নিয়ে ক্ষমতায় যায় তবে তথাকথিত জাতীয়তাবাদের ধ্বজাধারী বিএনপি এবং ইসলামিক মূল্যবোধের চ্যাম্পিয়ন জামায়াতকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারা থেকে ঝেঁটিয়ে বিদায় করা হবে ক্রমান্বয়ে। এই দুইটি দলই অস্তিত্ববিহীন হয়ে পড়বে সময়ের সাথে। পরিণামে দেশ পরিচালিত হবে নিও-বাকশালীদের দ্বারা।
তোমার বিশ্লেষণে ওজন আছে, সেইক্ষেত্রে এই দুইদলকে ঐক্যবদ্ধ করাটাই যুক্তিসঙ্গত হবে। এই দুইদলের নেতৃবৃন্দকে বোঝাতে হবে বর্তমান বাস্তবতা। নিজেদের অস্তিত্বের খাতিরেই উভয় পক্ষকেই অতীতের তিক্ততা ভুলে গিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভাবে আগামী নির্বাচন কেন্দ্রিক ষড়যন্ত্রের মোকাবেলা করতে হবে খালেদা জিয়ার জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে। এই সমঝোতার জন্য Common Friends দের সাহায্যও নেয়া যেতে পারে। হ্যাঁ, তা করা যেতে পারে। কিন্তু তারপরও প্রশ্ন থাকে।
কি প্রশ্ন, জিজ্ঞেস করলো রব্বানি।
ধরো, এই দুইদলকে ঐক্যবদ্ধ করা গেলো। তারপরও সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল এই জোটের পক্ষে শুধুমাত্র খালেদার জনপ্রিয়তা দিয়ে সার্বিকভাবে বেশি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষকে পরাজিত করা সম্ভব হবে কি? ভায়া, এই জনসমর্থনের বেশীরভাগই হচ্ছে Silent Majority. আওয়ামীলীগ এবং জেনারেল এরশাদের স্ট্র্যাটেজি হবে তাদের অর্থবল, অনুগত প্রশাসন এবং পেশীশক্তি দিয়ে এমন পরিবেশ সৃষ্টি করা যাতে করে ঐ Silent Majority ভোট কেন্দ্রে যেতেই না পারে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেক্ষেত্রে এই জনপ্রিয়তা প্রত্যাশা অনুযায়ী কন চমকপ্রদ ফল দেখাবার সুযোগ পাবে কি?
খুবই যুক্তিসঙ্গত প্রশ্ন। তাই নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে যাতে তারা নির্ভয়ে পোলিং বুথে গিয়ে ভোট দিতে পারে। এর জন্য সেনাবাহিনীকে মোতায়েন করতে হবে প্রতিটি পোলিং বুথে। সুষ্ঠু আর নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য এই দাবিটা জোরালো করে খালেদাকে অবশ্যই ওঠাতে হবে নির্বাচন কমিশনের কাছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে এই ধরনের দাবির বিরুদ্ধে কোনও প্রতিবাদ উঠবে না দেশে কিংবা বিদেশে। বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে নেবে না আওয়ামীলীগ, জেনারেল এরশাদ এবং তাদের প্রভু ভারত। তবে এর প্রতিবাদে নির্বাচন বর্জন করা কিছুতেই সম্ভব হবেনা। কারণ, এবারের নির্বাচনটা হবে একটি গণআন্দোলনের ফসল হিসেবে। এই বিষয়গুলোর সমস্ত কিছুই বোঝাতে হবে বেগম জিয়াকে। বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোও বাংলাদেশে একটি নৈরাজ্য সৃষ্টি করে সোভিয়েত-ভারত দেশটাকে তাদের আষ্টেপৃষ্ঠে বেধে ফেলবে সেটা কিছুতেই তারা হতে দিবে না। তাই তারাও চাইবে একটি নিরপেক্ষ সুষ্ঠ নির্বাচন কারণ তারাও পরিষ্কার বুঝতে পারছে নির্বাচন নিরপেক্ষ এবং সুষ্ঠ হলে সোভিয়েত-ভারত বিরোধী জোটেরই নির্বাচনে জেতার সম্ভাবনা বেশি।
তাহলে বিষয়টি খালেদাকে পরিষ্কার করে বুঝিয়ে দেয়া উচিৎ।
Absolutely correct! অবশ্যই যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সেই রাতেই খালেদা জিয়াকে ফোন করলাম।
হ্যালো, মোহাম্মদ বলছি।
বলুন, অপরপ্রান্তে খালেদা জিয়া।
জেনারেল এরশাদ মত পালটেছেন অদৃশ্য ইঙ্গিতে। দেশান্তরী হবেন না তিনি। জেনারেল এরশাদ সিদ্ধান্ত নিয়েছেন দেশে থেকেই আগামী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করবেন। অপ্রত্যাশিত খবরটা শুনে কিছুটা হতাশ হয়ে পড়লেন খালেদা জিয়া।কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললেন কিন্তু আপনি তো বলেছিলেন তিনি দেশত্যাগ করতে রাজি আছেন।
তবে আমি এটাও বলেছিলাম তিনি চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিবেন ভারতের মর্জি মোতাবেক। হ্যাঁ, তখন তিনি যা বলেছিলেন সেটাই আমি আপনাকে বলেছিলাম। এখন তিনি মত পাল্টে নির্বাচনে চাণক্যদের ষড়যন্ত্রের গুটি হিসাবে ব্যবহৃত হতে বাধ্য হয়েছেন। ষড়যন্ত্রটি সম্পর্কে একটা ব্যাখ্যা আমি আপনাকে দিতে চাই, যদি আপনি শুনতে চান।
বলুন।
আমি সার্বিক বিষয়ে আমার আর রব্বানির বিশ্লেষণের সারবস্তু তুলে ধরলাম। সব শুনে তিনি কৃতজ্ঞতা এবং ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন আপনার বিশ্লেষণ সম্পূর্ণভাবে যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আপনি আমাকে যেই পথে এগুতে বললেন, তার জন্য প্রচুর অর্থের প্রয়োজন। দেশের ভেতর থেকে বর্তমানে আমার জন্য সেটা যোগাড় করা সম্ভব নয়। বিত্তবানরা ইতিমধ্যেই আওয়ামীলীগ ও এরশাদের দিকেই ঝুঁকে পড়েছে। তারা ধরেই নিয়েছে আওয়ামীলীগ আর এরশাদ মিলেই আগামী নির্বাচন জিতবে। আমাদের সব একাউন্ট এরশাদ ক্ষমতা দখলের পরই বাজেয়াপ্ত করে নিয়েছিল, কি কষ্ট করে যে এতটুকু এসেছি সেটা একমাত্র আমিই জানি। নির্বাচনের জন্য সীমান্তের ওপার থেকে টাকার স্রোত বইছে। সেই স্রোতের বিরুদ্ধে একদম খালি হাতে কি টিকে থেকে মোকাবেলা করা সম্ভব ভাই?
কথাটা ঠিকই বলেছেন। তাছাড়া যাদের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া রাজনীতির জন্য টাকার ব্যবস্থা করতেন তাদের প্রায় সবাই তো জেনারেল জিয়ার মৃত্যুর পরই এরশাদের খোঁয়াড়ে গিয়ে ঢুকে পড়েছে। এখনো তারা এরশাদের সাথেই আছে সেটা আমি জানি। আমার বক্তব্য শুনে হয়তো কিছুটা বিব্রত বোধ করে থাকবেন খালেদা জিয়া।আবার অল্প সময় নিয়ে বললেন
আপনাকে একটা অনুরোধ করতে চাই, যদি কিছু মনে না করেন।
বলুন।
আপনার ছোটভাই স্বপনকে আমি নির্বাচন করার আবেদন করেছিলাম, কিন্তু সে রাজনীতিতে আসতে রাজি নয় বলে ক্ষমা চেয়ে নিয়েছে। নির্বাচনের আগে আপনি কি আমার পাশে এসে দাড়াতে পারেন না? সরকারি চাকুরে হিসাবে সেটা সম্ভব নয়। এর চেয়ে বড় কথা হল, যে কারণে জেনারেল জিয়ার চীন সফর করার সময় তার অনুরোধ রক্ষা করে তার সাথে একত্রে রাজনীতি করা আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি সেই কারণটি এখনও বর্তমান। তাছাড়া দেশে ফিরে আপনার জন্য যতটুকু সাহায্য-সহযোগিতা করতে সক্ষম হবো সেটা করার মতো মানুষ দেশেই যথেষ্ট রয়েছে। তার চেয়ে বিদেশে থেকেই ওই সমস্ত বিষয়ে আমি যদি আপনাকে সাহায্য করার চেষ্টা করি যা দেশে থেকে কারো পক্ষে করা হয়তো সম্ভব নয়, তাহলে সেটাই বেশি লাভজনক এবং শ্রেয় নয় কি? আর্থিক সঙ্গতি এবং জামায়াতের সাথে নির্বাচনী ঐক্য এই দুইটি উপাদানই আপনার জন্য আগামী নির্বাচনে মূল বিষয়। আমি চেষ্টা করে দেখবো এই বিষয়ে কিছু করা সম্ভব হয় কিনা।
আপনার এই আন্তরিক উদ্যোগ, সবকিছুর জন্যই আমি চিরকৃতজ্ঞ থাকবো ভাই।
ভাবী, আমরা কিন্তু কারো ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করছিনা। আমাদের সব প্রচেষ্টা হচ্ছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী রাজনীতিকে এগিয়ে নেবার জন্য আমরা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। যতদিন বেঁচে থাকি আমরা এই চেতনাকে বাংলাদেশের মাটিতে প্রোথিত করার জন্য সংগ্রাম করে যাবো, সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে থেকেই। আমাদের সেই চেষ্টায় কোনও ব্যক্তি বিশেষের যদি লাভ হয় সেটা আমাদের বিবেচ্য বিষয় নয়। আপনি অনুগ্রহ করে যতটুকু সম্ভব এগিয়ে যান, আমরাও আমাদের চেষ্টায় কোনও ত্রুটি রাখবো না। ফল কি হবে সেটা একান্তভাবে নির্ভর করবে আল্লাহ্‌ সুবহান ওয়া তায়ালার উপর। রাখি আজকের মতো। পরে প্রয়োজনে আবার যোগাযোগ করবো। আল্লাহ্‌ হাফেজ। রেখে দিলাম ফোন।
আমাদের কথোপকথনের বিষয়বস্তু রব্বানির মতো বিচক্ষণ ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে কোন অসুবিধাই যে হয়নি সেটা তার দু’চারটা প্রশ্ন থেকেই বুঝে নিলাম। ঠিক হল, আগামীকাল আমরা দু’জন বসবো আমাদের পরবর্তী করণীয় কর্মসূচি প্রণয়ন করতে।
সন্ধ্যার পর রব্বানি এলো নাসরিনকে সাথে নিয়ে। আমিও ক্লাব থেকে ফিরে এসেছি। Annual Inter Club Tennis Tournament চলছে পার্কলেন স্পোর্টস ক্লাবে। আমি সেখানে এবার অংশ নিচ্ছি নাইরোবি ক্লাবের পক্ষ থেকে। পার্কলেন স্পোর্টস ক্লাবেরও মেম্বার আমি। তাই আমার এই পক্ষপাতিত্বে বন্ধুদের মধ্যে মনোমালিন্যের সৃষ্টি হয়।পরে একটা সমঝোতা হয়, পরের বছর আমি পার্কলেনস্পোর্টস ক্লাবের তরফ থেকে খেলবো। নাসরিনদের আসার পর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে রাতের খাবারের পাট চুকিয়ে আমরা গিয়ে বসলাম বসার ঘরে ফায়ার প্লেসের সামনে। পরিচারিকা বিত্রেস কফি পরিবেশন করে গেলো। কফি উৎপাদনে কেনিয়া পৃথিবীর শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর একটি। চা-ও উৎপন্ন হয় কেনিয়াতে। বেশিরভাগই রপ্তানি করা হয়ে বিদেশে। ছোট ছোট পাহাড় আর নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এই দুইটি উপাদান কফি উৎপাদনের জন্য বিশেষভাবে সহায়ক। হঠাৎ হাউস কিপার আলতাফ এসে খবর দিলো লন্ডন থেকে ফোন এসেছে। বাবু সাহেব ফোন করেছেন। ফোনটা প্লাগ ইন করে রিসিভারটা আমার হাতে দিয়ে বিদায় নিলো আলতাফ। অপ্রত্যাশিত নয়, অস্থির হয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত বাবু ও নেলি আবার ফোন করেছে।
হ্যালো, আমি বাবু বলছি। কি খবর ডালিম ভাই?
খবর বিশেষ ভালো না। গতকাল জেনারেল এরশাদের সাথে কথা বলে হতাশ হয়ে পড়লাম, তিনি মত পালটে জানালেন ক্ষমতা হস্তান্তরের পর দেশ ছাড়বেন না। তিনি নির্বাচন করে নাকি ১৫০টা সিটে জিতে সরকার গঠন করবেন। প্রয়োজন হলে তিনি আওয়ামীলীগের সাথেও নির্বাচনী জোট বাঁধবেন। তার এই ধরনের ডিগবাজিতে আমি হতবাক হয়ে গেছি বাবু! এই আজগুবি হঠকারি সিদ্ধান্তের ফায়দা নিয়ে আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করবে আর জেনারেল এরশাদকে স্থান নিতে হবে শ্রীঘরে।
কি বলছেন ডালিম ভাই, দুলাভাই শেষে আওয়ামীলীগকে সমর্থন দিয়ে সরকার গঠনে সাহায্য করে জেলে যাবেন!
আমার তো তেমনটিই মনে হচ্ছে। কারণ, সরকার গঠনের পর মহিলাদের জন্য সংরক্ষিত সিট ভাগাভাগির পর এরশাদ সাহেবের আর কোন প্রয়োজন থাকবে না আওয়ামীলীগের কাছে। সেই অবস্থায় জনগণের সাবাশি পাবার জন্য দুর্নীতি ও অসাংবিধানিক ভাবে ক্ষমতা গ্রহণ এবং ক্ষমতা অপব্যবহারের চার্জে তাকে জেলে পুরতে এতটুকুও কুণ্ঠিত হবে না হাসিনা এবং তাদের প্রভু ভারত। এ সবের মধ্যে সবচেয়ে বড় যে ক্ষতিটি জেনারেল এরশাদের হবে সেটা হচ্ছে, তার পিঠে ভারতের দালাল হিসাবে একটা চিরস্থায়ী স্ট্যাম্প লেগে যাবে। যার ফলে, ভবিষ্যতে হাসিনার পেটিকোটের নিচে থেকেই একদা দেশের রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদকে থাকতে হবে আওয়ামীলীগের তাঁবেদার হয়ে ভারতের ইঙ্গিতে। ভারতের দালালী আওয়ামীলীগের তাঁবেদারী, কারাবাস এটাই হবে তার নিয়তি! আমি তার মত না পাল্টানোর ঘোর বিরোধিতা করে বলেছিলাম, ৮ বছর তো রাজত্ব করলেন, এখন শেষ বয়সে ভারতের দালালী আর হাসিনার চাকরি না করে কিংবা জেলে না পচে বাইরে চলে আসলে কিছুটা হলেও সম্মানের সাথে আগামী দিনের সুযোগের অপেক্ষায় থাকলেই ভালো করতেন। কিন্তু আমার সেই আবেদনে কর্ণপাত করলেন না জেনারেল এরশাদ। সত্যি কথা বলতে গেলে বলতে হয় বাবু, আমি জেনারেল এরশাদের চেয়ে ডেইজি ভাবীর কথাটাই বিশেষভাবে ভাবছি। শারীরিকভাবে তিনি একজন অসুস্থ মহিলা। এতসব ঝামেলা তার পক্ষে কি সহ্য করা সম্ভব হবে! ডালিম ভাই, আমার একটা অনুরোধ আপনি কি দুই-এক দিনের জন্য লন্ডন আসতে পারেন?যদি আসতেন, তাহলে দুইজনে মিলে দুলাভাইকে তার এই ধরনের আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত বদলানোর চেষ্টা করতাম। আপাকেও বলতে পারতাম চাপ সৃষ্টি করে বাইরে চলে আসার জন্য। মনে হচ্ছে তুমি ঠিক আমাকে বিশ্বাস করছো না!
না না, এটা আপনি কি করে ভাবলেন! আপনাকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই আসে না। বিশ্বাস করি বলেই অনুরোধ জানালাম, এলে সবাই মিলে একবার শেষ চেষ্টা করে দেখতাম।
ঠিক আছে, আমি গোপনে পৌঁছানোর চেষ্টা করবো। বাবু, আমার কিছু মেহমান রয়েছে তাই এখন রাখতে হচ্ছে ফোন। কিছু মনে করো না। ঠিক আছে আমরা আপনার আসার প্রতীক্ষায় থাকবো, আল্লাহ্‌ হাফেজ।
উপস্থিত সবাইকে সবকিছু খুলে বললাম।
নিম্মি স্বল্পভাষী। হঠাৎ সে বলে উঠল তোমরা বেগম জিয়াকে বাঁচানোর আর নির্বাচনে জেতানোর চেষ্টা করছো কেনো? তিনি তো তার স্বামীর রাজনীতিকেই আরও শক্তভাবে এগিয়ে নেবেন। এতে দেশ বা জাতির কি লাভ হবে বলতে পারো?
হাসিনার তুলনায় খালেদা তো Lesser Evil. বলল রব্বানি।
চরিত্রগত ভাবে হাসিনা এবং খালেদা মুদ্রার এপিঠ আর ওপিঠ। এর প্রমাণ সময়মতো আপনারা ঠিকই পাবেন। জানো নাসরিন, এদের মাথায় খালেদার যে ভূত চেপে বসেছে সেটা দূর হবার কোনও সম্ভাবনা নেই। Let them learn from their own experience. ডালিম তো বরাবরই মানুষ চিনতে ভুল করে এসেছে। এটা নিজে না মানলেও প্রমাণিত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রে, আমি সেই সমস্ত সবই জানি। জিয়াকে কেন্দ্র করে যুদ্ধকাল থেকেই যে স্বপ্ন তারা দেখে আসছিলো সেই স্বপ্নও যে নির্ঝরে ভঙ্গ হবে সেটাও আমি ওকে বলেছিলাম। একগুঁয়ে মানুষ তাই, কখনোই তর্কে যাই না। কারণ সেটা হবে অর্থহীন। Time shall prove Khaleda to be if not more but no less fraudulent and mischievous than her late husband General Ziaur Rahman. চলো, আমার ঘরে। সেখানে আরামে বসে গল্প করা যাবে বলে নাসরিনকে সাথে নিয়ে উঠে চলে গেলো নিম্মি।
আমি আর রব্বানি কফির পেয়ালা হাতে নিশ্চুপ বসে থাকলাম। স্তব্ধতা কাটিয়ে রব্বানিই মুখ খুললো
সত্যিই কি নিম্মি যুদ্ধের সময় বলেছিলো যে জিয়া বিশ্বাসযোগ্য নয়?
হ্যাঁ বলেছিলো।
তাহলে তো মেনে নিতেই হবে তার কথায় ওজন রয়েছে। কিন্তু এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে জেতানোর চেষ্টা করা ছাড়া আর কোন গত্যন্তরও যে নেই এবারের নির্বাচনে কোনোভাবে যদি আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় আসে তবে বাংলাদেশের মাটি থেকে জাতীয়তাবাদী এবং ইসলামিক শক্তিকে শিকড় সমেত উপড়ে ফেলা হবে এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহ নেই। অর্থনৈতিক এবং সামাজিক ক্ষেত্রে ভারতের আধিপত্যের নিগড়ে নিঃশেষ হয়ে যাবে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠীর স্বতন্ত্র সত্তা। ভবিষ্যৎ হয়ে উঠবে নেপাল, ভুটান কিংবা সিকিমের মতো। তাই সব জেনেও Lesser Evil-কেই সাহায্যের চেষ্টা করতে হবে। যেকোনো কারণেই হউক, বর্তমানে বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিকের কাছে খালেদা জিয়াই হয়ে উঠেছেন ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনার ধ্বজাধারী। সেই বিবেচনায়, আমি মনে করি আমাদের সর্বাত্মক চেষ্টা সেটা যত সামান্যই হউক না কেনো, চালিয়ে যেতে হবে খালেদা জিয়ার জন্য নয়- বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের স্বার্থেই।
হ্যাঁ বন্ধু তুমি ঠিকই বলছো। তাহলে, রব্বানি এই যুদ্ধের একটা রোডম্যাপ তুমিই ভাই ঠিক করে ফেলো। আমি ঠিক বুঝতে পারছিনা এখান থেকে কি ভাবে শুরু আর কোথায় গিয়ে হবে তার শেষ! রব্বানি জানালো- গত রাতে ফিরে যাবার পর এইসব নিয়েই সারা রাত ভেবে একটা রোড ম্যাপ ও ইতিমধ্যেই ঠিক করে নিয়েছে। আমি যদি সম্মত হই তবে সেই ভাবেই এগোনো যেতে পারে।
ঠিক আছে, বলো শুনি তোমার রোডম্যাপটা কেমন। রব্বানি বলা শুরু করলো
১। বাবুর মাধ্যমে শেষ চেষ্টা করতে হবে এরশাদকে আওয়ামীলীগের কাছ থেকে সরিয়ে বাইরে নিয়ে আসার। যাতে তার দল বিএনপির ভোট কাটতে না পারে।
২। খালেদার আর্থিক সঙ্গতির জন্য বন্ধুপ্রতিম দেশগুলোতে যেখানে আমাদের পূর্বপরিচিত প্রভাবশালী বন্ধু-বান্ধব রয়েছে তাদের মাধ্যমে ঐ সমস্ত দেশের ক্ষমতাসীনদের বুঝিয়ে খালেদাকে অর্থের যোগান দানের জন্য সম্মত করার চেষ্টা করতে হবে।
৩। অস্তিত্ব রক্ষার এই লড়াইয়ে অতীতের সব তিক্ততা ও ব্যবধান বাদ দিয়ে জামায়াত এবং বিএনপিকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে অন্যান্য সমমনা ভারত বিরোধী ছোট ছোট দলগুলোকে সাথে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গঠনে বাধ্য করতে হবে।
৪। আমাদের প্রচেষ্টার চারণভূমি হবে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ, গণচীন এবং পাকিস্তান। আমরা যদি যুক্তি দিয়ে আমাদের প্রস্তাবনা সংশ্লিষ্ট মহলে পেশ করতে পারি তবে পাকিস্তানই হতে পারে এই প্রজেক্টের মূল সমন্নয়কারি চালিকাশক্তি।
৫। নির্বাচন কালে ভোটারদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য সামরিক বাহিনীকে ডেপ্লয় করতে হবে নির্বাচন কমিশনকে। গভীর মনোযোগের সাথে রব্বানির উপস্থাপনা শুনে বললাম
অতি উত্তম। তোমার রোডম্যাপ সম্পর্কে কোনও দ্বিমত কিংবা প্রশ্ন নেই আমার। আল্লাহ্‌র উপর ভরসা করে কালবিলম্ব না করে আমাদের কার্যক্রম শুরু করে দেই, কি বলো?
তাই করা উচিৎ।
তা হলে, কাল পরশুর মধ্যেই আমি লন্ডন হয়ে আসি?
পরশু কেনো কালই চলে যাও বন্ধু। শুভস্য শীঘ্রম।
ঠিক আছে।
তাঞ্জানিয়াতে ট্যুরে যাচ্ছি বলে, দারুস সালাম থেকে লন্ডন এসে পৌঁছালাম। পৌঁছেই বাবুর সাথে যোগাযোগ করলাম। বাসার সবাইকে বললাম বিশেষ কাজে লন্ডন এসেছি, তাই খবরটা গোপন রাখতে হবে। বাবু খবর পেয়েই এসে আমাকে ওদের বাসায় নিয়ে গেলো। যোগাযোগ হল জেনারেল এরশাদ এবং ডেইজি ভাবীর সাথে। মোহাম্মদের মাধ্যমে পতিত রাষ্ট্রপতি জেনারেল এরশাদ এবং ডেইজি ভাবীর সাথে সরাসরি কথা বলার সুযোগ পেলো বাবু এবং নেলি। বাবু নিজেই জেনারেল এরশাদকে আমার কথাগুলোই আবার বুঝিয়ে বলল এখনো সময় আছে। আপনি আপাকে নিয়ে দেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসুন। ডেইজি ভাবীকে জোর দিয়ে বাবু এবং নেলি দুইজনই বললো, দুলাভাই-এর কোনও কথাতেই যুক্তি নেই। তাই অশুভ পরিণাম থেকে বাঁচতে হলে তাদের দেশ থেকে বাইরে আসা ছাড়া আর কোনও গত্যন্তর নেই। তাদের দেশ থেকে বেরিয়ে আসতেই হবে অবিলম্বে, তা না হলে সেই রাস্তাও বন্ধ হয়ে যাবে সহসাই। তখন আর কিছুই করার থাকবে না। আমাদের অনুরোধে ডালিম ভাই গোপনে লন্ডন পর্যন্ত এসেছেন যাতে করে দুলাভাইকে সবাই মিলে দেশের বাস্তব অবস্থা বুঝিয়ে রাজি করানো যায় দেশ ছাড়ার জন্য। বাবু, নেলি এবং ভাবীর জোরের মুখে এরশাদ কিছুটা দোটানায় পরে জানালেন
আগামীকাল তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। এরপর বাবু আমাকে বাসায় নামিয়ে দিয়ে গেলো। ফিরে এসে যোগাযোগ করলাম খালেদা জিয়ার সাথে। বললাম
এরশাদকে দেশ থেকে বের করে আনার শেষ চেষ্টা করছি। আগামীকাল তিনি তার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবেন। কিন্তু বেগম জিয়া জানালেন
এদিকে হাসিনা সেই রাস্তা বন্ধ করার জন্য প্রেস কনফারেন্স করতে যাচ্ছে জানতে পারলাম। সেখানে হাসিনা হুঁশিয়ার করে দিয়ে দেশবাসীকে বলবেন তিনি জানতে পেরেছেন কিছু লোক ক্ষমতাচ্যুত দুর্নীতিবাজ স্বৈরশাসক যাতে দেশত্যাগ করতে পারে সেই চেষ্টা করছে। সেটা কিছুতেই হতে দেবে না দেশের জনগণ এবং আওয়ামীলীগ। এরশাদকে অবিলম্বে শ্রীঘরে পাঠানোর দাবিও তুলবেন হাসিনা। এই অবস্থায় তার প্রেস কনফারেন্সের আগেই যদি এরশাদ দেশ না ছাড়েন তাহলে পরে তাকে বিদেশে পাঠানো অসম্ভব হয়ে পড়বে। বললেন খালেদা জিয়া। খুবই যুক্তিসঙ্গত কথা।
আচ্ছা, আমি দেখছি কতটুকু কি করতে পারি। অবস্থা ক্রমশ জটিল থেকে জটিলতর হতে চলেছে। খালেদা জিয়ার কথায় উদ্বিগ্ন হয়ে তক্ষুনি বাবুকে ফোন করে বললাম আমাকে তার বাসায় নিয়ে যেতে। মিনিট দশেকের মধ্যেই বাবু এসে পৌঁছালো।
কি ব্যাপার ডালিম ভাই, এত জরুরী তলব! জরুরীই বটে। এইমাত্র খালেদা জিয়ার সাথে কথা বলে বুঝতে পারলাম দেশের অবস্থায় দ্রুত পরিবর্তন ঘটছে। বাবুকে খালেদার আলাপের সার সংক্ষেপ খুলে বললাম। সব শুনে বাবু হতাশায় ভেঙ্গে পড়লো। তার অশ্রুসিক্ত চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম
ভেঙ্গে পড়ার সময় এটা নয় বাবু, রাজনীতির খেলায় এখন সময় খুবই কম। তাই সময় নষ্ট না করে জেনারেল এরশাদকে শেষবারের মতো বোঝাতে চেষ্টা করতেই হবে। সে জন্যই তোমাকে আবার ডেকে পাঠাতে বাধ্য হলাম।
আবার গিয়ে উপস্থিত হলাম বাবুদের বাসায়। ফোন করলাম জেনারেল এরশাদকে।
স্যার, হয়তোবা আপনার সাথে শেষবারের মতো কথা বলছি। আমি আপনার শত্রু নই। আমি আপনাদের দু’জনকেই শ্রদ্ধা করি ব্যক্তিগত ভাবে। তাই অতি বিনয়ের সাথেই বলছি নতুন ফাঁদে পা ফেলে কেনোও বাকি জীবনটা গোলাম হয়ে থাকতে চাইছেন? ভাবীকেও কেনো কষ্টে ফেলছেন? এই বয়সে এই ধরনের কাজ কি শোভা পায়? Enough is enough, Sir.
বাবু খালেদা জিয়া থেকে সদ্যপ্রাপ্ত খবরটা জানিয়ে আকুতি জানাতে লাগল দেশ ছেড়ে আসার জন্য।
এরশাদ সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বললেন খবরটি কিছুতেই সত্য হতে পারে না। কারণ, নির্বাচনে একক সংখ্যা গরিষ্ঠতা না পেলেও তিনি আওয়ামীলীগের সাথেই কোয়ালিশন সরকার গঠন করবেন সেটাই ঠিক হয়ে আছে। সেক্ষেত্রে আওয়ামীলীগ প্রধান হাসিনা এ ধরনের দাবি কিছুতেই উত্থাপন করতে পারে না তাদের স্বার্থেই। তিনি দেশে থেকেই রাজনীতি করবেন এবং আগামী নির্বাচনে জয়ী হয়ে তার নেতৃত্বেই সরকার গঠন করবেন তিনি। ক্ষমতার মোহ জেনারেল এরশাদকে সম্পূর্ণভাবে অন্ধ করে তুলেছে। তার একগুঁয়েমিতে এখানে বাবু নেলি আর ঐদিকে ডেইজি ভাবী কাঁদছেন। এমন একটা বিদঘুটে অবস্থায় পড়তে হবে সেটা জানা ছিল না। শেষবারের মতো রিসিভার হাতে নিয়ে আমি বললাম
স্যার, যখন থেকে আপনি আর আপনার দোসররা গৃহবন্দী হয়েছেন আপনারা তো নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ করতে পারছেন না, তাই না? সেই অবস্থায় আমি কেনো আপনার সাথে এবং খালেদা জিয়ার সাথে যেভাবেই হউক নিজ থেকেই যোগাযোগ করলাম? এতে আমার কি স্বার্থ সেটা একটু বুঝিয়ে দিলে কৃতার্থ হতাম। থমকে গেলেন এরশাদ। সত্যি, এতে তোমার কি স্বার্থ সেটা তো ভেবে দেখিনি! তাহলে এখন ভেবে বলুন। কেনই বা বাবু আর নেলির অনুরোধে গোপনে এখানে এসে আপনার সাথে এতো কথা বলছি দয়া করে তার কারণটাও বুঝিয়ে দিন।
হয়তো তুমি আমাদের ভালবাসো। তাই এ ছাড়া অন্য কোনও কারণ ভেবে পাচ্ছি না। তুমি একজন নির্লোভ, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। নিজের জন্য কখনোই তোমাকে কারো কাছেই কিছু চাইতে দেখিনি আমি।
আপনার জবাবটা আংশিক সত্য। তবে আর একটা কারণ রয়েছে। সেটা হল, এই মুহূর্তে দেশের চলমান রাজনৈতিক ক্ষেত্রে কি ঘটছে সেই সম্পর্কে আমি হয়তো আপনার কিংবা খালেদা জিয়ার চেয়ে বেশি না হলেও কিছুটা অবগত। আমি কিন্তু অনুমানভিত্তিক কোনও কিছুই বলছি না। যা বলছি সেটা তথ্যভিত্তিক। এটা খালেদা জিয়া মেনে নিয়েই আমার সাথে কথা বলছেন। আমার অনুরোধেই উনি জিয়া হত্যা সম্পর্কে আপনার ভূমিকার প্রায় সবকিছু জানার পরও আপনাকে সপরিবারে দেশের বাইরে চলে আসার ব্যাপারে সব বন্দোবস্ত করে দেবেন বলে কথা দিয়েছিলেন। এই বন্দোবস্ত করাটা খুব সহজ ছিলো না। কিন্তু আপনি দুঃখজনক হলেও বাস্তবতাকে মেনে নিতে চাইছেন না। তাহলে কি বুঝবো আপনি আমাকে বিশ্বাস করতে পারছেন না?
তোমাকে আমি অবিশ্বাস করবো সেটা তুমি ভাবলে কি করে?
ভাবতে আপনি বাধ্য করলেন, স্যার। এরপরও শেষবারের মতো অনুরোধ জানাচ্ছি, আজকের রাতের মধ্যেই বেরিয়ে আসুন। বাবু যা বলেছে তার সত্যতা কালকের মধ্যেই প্রমাণিত হয়ে যাবে। আপনি দেশে জেলবন্দী অবস্থা উপভোগ করতে চান নাকি বিদেশে মুক্তঅবস্থায় থাকতে চান- এটাই এখন আপনার বিবেচ্য বিষয় হওয়া উচিৎ। আমার কথা না হয় ছেড়েই দেন, এখানের সবাই যেভাবে আপনাকে মিনতি জানাচ্ছে, তাদের কথা আপনার মেনে নেয়া উচিৎ ছিল। এখন আমার ধৈর্যের বাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় আমি বলবো মানুষ হিসাবে আপনি অতি স্বার্থপর এবং ক্ষমতালোভী। সেনাবাহিনীর আপনার পালিত জেনারেলরা তো আপনাকে মসনদে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ হল। ফলে, আপনারা সবাই এখন গৃহবন্দী। আওয়ামীলীগ আর জামায়াত বাতাস বুঝে আপনাকে পরিত্যাগ করল। চাপে পড়ে আপনাকে ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়াতে হয়েছে। আপনার এই দুর্দিনে আপনার বিদেশী প্রভুরা কেউই এগিয়ে এলো না আপনাকে উদ্ধার করতে? তারা সবাই এখন আপনাকে কি করে Toilet Paper হিসাবে ব্যবহার করা যায় সেটাই ভাবছে। এ সমস্ত খবরাখবর জানার পরও আপনি দিবাস্বপ্নতেই বিভোর, এটা সত্যি বিস্ময়কর! আপনি অবগত নন, বর্তমানে দেশের মানুষ আপনার প্রতি এতোটাই ক্ষুব্ধ যে আপনাকে নাগালের মধ্যে পেলে তারা আপনার সুগঠিত শরীরটাকে বটি বটি করে চিল আর শকুনকে খাওয়াতো। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে যেই সুযোগটা সৃষ্টি করেছিলাম সেটার কদর যখন আপনি করলেনই না এর পরিণতিটা কি হবে সেটা আপনি অচিরেই দেখতে পাবেন। আমার এই প্রচেষ্টায় আন্তরিকতার কমতি ছিল না। অতএব ঘটনা ঘটার পরও বিকারগ্রস্ত হয়ে আপনি একই কথা বলে চলেছেন, আগামী নির্বাচনে জিতে আপনিই আবার সরকার বানাবেন। সেই কারণে আপনি দেশত্যাগের সুযোগটা গ্রহণ করবেন না!
হ্যাঁ, ঠিক তাই।
খুবই ভালো। আমিও দেখবো অদূর ভবিষ্যতে পতিত স্বৈরশাসক জেনারেল এরশাদের শেষটা কেমন হয়। এখন থেকে আমার আর কোন দায়িত্ব রইলো না। আপনার সাথে মোহাম্মদের আর আলাপ হবে না। নিয়তি থেকেই শিক্ষা নিতে হবে আপনাকে। ভাবীকে বললাম, আপনি আল্লাহ্‌র সাথে রুজু রাখবেন, তিনিই ভবিষ্যতে আপনার সহায় হবেন। আমরাও দোয়া করবো। আল্লাহ্‌ হাফেজ। বাবু বললো
ডালিম ভাই, আপনার কাছে আমরা চিরঋণী থাকবো। ধন্যবাদ জানিয়ে ছোট করবো না। আল্লাহ্‌ আপনার মঙ্গল করুন। বাবু আর নেলিকে সান্ত্বনা দিয়ে ফিরে এলাম বাসায়।
পরদিনই হাসিনার প্রেস কনফারেন্সের খবর প্রচারিত হল। এরশাদ এবং তার পরিবারকে বন্দী করা হয়েছে। তাদের গুলশানের বাড়িটাকেই ‘সাব জেল’ আখ্যায়িত করে সবাইকে সেখানে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে আওয়ামীলীগ জোর দাবি জানাচ্ছে, স্বৈরশাসক এর স্থান সাব জেল নয়, তাকে পাঠাতে হবে নাজিমুদ্দিন রোডে। ফিরে এলাম নাইরোবিতে। সব কিছু জানালাম পরম বন্ধু রব্বানিকে। সব শুনে রব্বানি ভবিষ্যদ্বাণী করলো জেলে থেকে এরশাদ নির্বাচনে তেমন বিশেষ কোনও প্রভাব ফেলতে পারবে না। তবে বিগত রাষ্ট্রপতি হিসাবে কিছু সিট পাবে বিশেষ করে রংপুর আর উত্তর বঙ্গে। সেটাই হয়তো হবে তার রক্ষাকবচ।
১৯৯১-এর নির্বাচনে খালেদা জিয়ার বিজয়ে সেনা পরিষদের অবদান
রোডম্যাপ অনুযায়ী এখন আমাদের বেরিয়ে পরতে হবে খালেদার জন্য আর্থিক যোগানের ব্যবস্থা এবং বিএনপি ও জামায়াতকে ঐক্যবদ্ধ করার প্রয়াসে। ঠিক হল, হুজুরপাকের রওজা মোবারকে হাজিরা দিয়ে সালাম জানিয়ে দুরুদ এবং নামাজ পড়ে ওমরাহ্‌ পালনের পর মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি রাষ্ট্র সফর করে আমি যাবো গণচীনে আর রব্বানি ফিরে আসবে নাইরোবিতে।
সেখানকার পুরানো বন্ধুরা বাংলাদেশের বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন সেটা জেনে নিতে। পরিকল্পনা মাফিক গিয়ে পৌঁছালাম মদিনা শরীফে। সেখানে জিয়ারত শেষে মক্কাতে ওমরাহ্‌ পালন করে গেলাম রিয়াদে। সেখানে House of Saud এ কয়েকজন পদস্থ এবং প্রভাবশালী পুরনো বন্ধু রয়েছেন। তাদের মাঝে রাজ পরিবারের একজন জেনারেল এবং প্রাক্তন গোয়েন্দা চীফও রয়েছেন। তাদের সাথে দেখা করে বাংলাদেশের রাজনৈতিক সঙ্কট নিয়ে খোলাখুলি আলাপ করলাম। আলাপকালে বুঝতে পারলাম, সেই সময়ে তাদের কাছে বিশেষ প্রণিধানযোগ্য সমস্যা হচ্ছে ইরাক আর কুয়েতের মধ্যে রমলা তেলক্ষেত্র নিয়ে ক্রমবর্ধমান মতপার্থক্য। ঘনীভূত এই সঙ্কটে তারা দেখছে অশনি সঙ্কেত। তারপরও তারা আমাদের আশ্বস্ত করল ভাতৃপ্রতিম দেশ হিসাবে বাংলাদেশের জন্য তারা সম্ভাব্য সব কিছুই করবে বেগম খালেদা জিয়ার জন্য। এতটুকুই যথেষ্ট। সেখান থেকে আরব আমিরাত, ইরাক, কাতার, লিবিয়া সফর করলাম। সেখান থেকে আমি পৌঁছালাম বেইজিং গুয়াংচাউ হয়ে।
গণচীন ইতিমধ্যেই নিজেদের একটি উদীয়মান বিশ্বশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করার লক্ষে বিস্ময়কর গতিতে এগিয়ে চলেছে। অভাবনীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ঘটছে একই সাথে। দ্রুত বদলে যাচ্ছে চীনের রাষ্ট্রীয় দর্শন এবং আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা। একই সাথে বদলে যাচ্ছে তাদের World Out Look. তাদের এই নবযাত্রার শুরু থেকেই আমি দেখে আসার সুযোগ পেয়েছি হংকং-এ থাকার ফলে। চীনের আধুনিকীকরণের দৌড় ক্রমশ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে টেক্কা দিয়ে তাদের পেছনে ফেলে এগিয়ে চলেছে নতুন আভায় উদ্ভাসিত হয়ে। পৃথিবীর কোথায় কি ঘটছে সে দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখেই এগিয়ে চলেছে উদীয়মান পরাশক্তি গণচীন। বিশ্বশক্তি হিসাবে প্রতিষ্ঠা পেতে হলে সমগ্র বিশ্বের ঘটনাবলীর সম্পর্কে সচেতন থাকতে হবে সেটাই স্বাভাবিক। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক সুপ্রাচীন। বাংলাদেশের এক বৌদ্ধ ভিক্ষু শ্রী অতীশ দীপঙ্কর চীনে গিয়ে বৌদ্ধধর্ম প্রচার করেছিলেন। আমি যখন চীনে কূটনীতিক হিসাবে দায়িত্ব পালন করছিলাম তখনই কয়েকশত বছর ধরে পোতলা প্যালেসে রক্ষিত তার দেহাবশেষের ভষ্ম বাংলাদেশকে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন চৈনিক নেতৃবৃন্দ।
হযরত শাহ জালাল(র)-এর পাঠানো ২৯ জন ধর্মপ্রচারক সারা চীনে ইসলাম ধর্মের বিকাশ ঘটায়। অধুনা কালে ১৫ই আগস্টের ঐতিহাসিক সফল সামরিক বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর গণচীন এবং সৌদিআরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ বেশিরভাগ মুসলিম দেশগুলো বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ভূ-রাজনীতি ও অর্থনৈতিক দিক দিয়েও বাংলাদেশ গণচীন সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের সাথে গভীর দ্বিপাক্ষিক সু-সম্পর্ক চীনা পররাষ্ট্রনীতির একটি স্থায়ী নির্ধারিত নীতি। তাই বাংলাদেশের সাথে রাষ্ট্রীয়, জনগণ এবং পার্টি এই তিন পর্যায়ে সমতা ভিত্তিক বন্ধুত্ব কায়েম রাখার ব্যাপারে চীনারা খুবই সচেতন।পুরানো বন্ধুদের সাথে কোনও রাখঢাক না রেখেই সর্বদা মন খুলে সব বিষয়েই আলাপ করে এসেছি। চীনা বন্ধুরাও আমাকে কখনোই শুধুমাত্র একজন কূটনীতিক হিসেবে না ভেবে পরম বিশ্বস্ত বন্ধু হিসেবে গ্রহণ করেই মিশে এসেছেন। প্রাণ খুলে আমার সাথে আলাপ করেছেন নিশ্চিন্তে সর্ববিষয়ে নির্দ্বিধায়, এমন কি তাদের অভ্যন্তরীণ বিষয় নিয়েও। বৈঠকে স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বন্ধুদের বিশ্লেষণ আর আমাদের বিশ্লেষণে তেমন কোনও তারতম্য নেই। তাদেরও প্রত্যাশা, বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামীলীগ এরশাদের সহায়তায় ক্ষমতায় না আসুক। তারাও একই ভাবে শঙ্কিত, এই জোট এবার ক্ষমতায় আসলে বাংলাদেশের স্বাধীন সত্তা ক্রমান্নয়ে হুমকির মধ্যে পরবে বিধায় দেশটাকে পরিণত করা হবে একটি ভারত নির্ভর করদ রাজ্যে। সেই পরিস্থিতি থেকে বেরিয়ে আসা হয়ে উঠবে সুদূরপরাহত। তাই মন্দের ভালো বিএনপি জোটের বিজয়ের জন্য যথাসাধ্য সাহায্য সহযোগিতা করবে বন্ধুরাষ্ট্র গণচীন। কিন্তু তাদের ধারণা, বাস্তবে জেতার কাজটি সহজ হবে না। কারণ, বিরোধী পক্ষ সবদিক দিয়েই তুলনামূলক ভাবে অনেক বেশি শক্তিশালী বিশেষ করে সাংগঠনিক ভাবে। এই শক্তি সঞ্চয় করার পূর্ণসুযোগ পেয়েছে ভারত এবং আওয়ামী-বাকশালীরা জেনারেল এরশাদের ৮ বছরের শাসনকালে। এরশাদ এবং হাসিনা দুই জনই ভারতের কাছে দাসখত দিয়ে রাজনীতি করে আসছেন একে অপরের সম্পূরক হয়ে শুরু থেকেই। ভারতের নির্দেশেই দুইজনই চলেছেন। দেশ কিংবা জনগণ নিয়ে তাদের কোনও নিজস্ব চিন্তাভাবনা নেই। ক্ষমতাই তাদের একমাত্র লক্ষ্য। দুইটি দলই ভারতের কাছে বিক্রিত। আরও একটা অতি মূল্যবান কথা জানালো বন্ধুরা। তাদের মতে প্রয়াত জেনারেল জিয়ার দূরদর্শিতা এবং রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে সব চেয়ে বড় ভুল করেছিলেন ভারতের সাথে সমঝোতা করে হাসিনাকে দেশে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করা। যদিও বাংলাদেশের ভুক্তভোগী জনগণের বৃহদংশই স্বাধীনতার যুদ্ধকালীন সময় থেকেই চরমভাবে ভারত বিদ্বেষী। এই ভারত বিরোধী চেতনায় লোকজন যদি খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে ভোটে জিতিয়েও দেয়, তারপরও বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে আত্মনির্ভরশীল জাতি এবং দেশ হিসাবে গড়ে তোলার যোগ্যতা রাখেন না খালেদা জিয়া ও তার দল বিএনপি। কারণ, জন্মলগ্ন থেকেই জিয়ারও মনোভাব ছিল একমাত্র ভারতকে খুশি রেখেই স্বচ্ছন্দে ক্ষমতায় থাকা সম্ভব। আত্মকেন্দ্রিক, ক্ষমতালিপ্সু সুবিধাবাদীদের নিয়ে গড়ে তোলা হয়েছে এই দল বিএনপি। প্রকৃত দেশপ্রেমিক এবং নিঃস্বার্থ নেতাকর্মীদের সংখ্যা নীতিনির্ধারণের পর্যায়ে খুবই কম পরিলক্ষিত হয়। উপরন্তু, পরিবারতন্ত্রের অভিশাপমুক্ত নন খালেদা জিয়া। এই বিচারে, তার দল এবং আওয়ামী লীগের মধ্যে তেমন কোনও পার্থক্য নেই। তাই শুধু পার্টি পর্যায়ে নয়, জাতীয় পরিসরেও দুর্নীতি আর স্বজনপ্রীতি ছড়িয়ে পড়ছে ক্যান্সারের মতো। দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে, বর্তমানে বাংলাদেশের রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রধান দলগুলোর সব কয়টিই নীতি-আদর্শ বিবর্জিত। সার্বিক বিবেচনায় বলা যেতে পারে, ময়দানের সব কয়টি প্রধান দলের চরিত্র কমবেশি একই। তোমরা যে পথে জিয়াকে নিয়ে এগুতে চেয়েছিলে সেই পথটিই ছিল সার্বিক মুকির সঠিক পথ। ওই পথে এগুলে তোমাদের স্বপ্নের বাস্তবায়ন অনেকাংশেই সম্ভব হতো ইতিমধ্যেই।
কিন্তু সেই সম্ভাবনাকে অঙ্কুরেই বিনষ্ট করে দেন তোমাদেরই বেছে নেয়া সংগঠনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি জেনারেল জিয়াউর রহমান, এই কথাটি তুমি কখনোই আমাদের বলোনি, কিন্তু তারপরও বিষয়টি আমাদের বুঝতে অসুবিধে হয়নি। বন্ধুরা আর একটি বিবেচনাযোগ্য কথা বলেছিলো।
তাদের ধারণা খালেদার পক্ষে কিছুতেই সম্ভব হবে না আমাদের প্রতি প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিয়া যে নীতি গ্রহণ করছিলেন সেই নীতি থেকে সরে আসা। তোমাদের দেশে ফিরে পৃথকভাবে রাজনীতি করতে দিতে পারেন না খালেদা জিয়া, তাতে বিএনপির রাজনীতিই শেষ হয়ে যাবে।
জবাবে আমি বলেছিলাম এই বিষয়টি নিয়ে ভাবছি না আমরা। এই মুহূর্তে ব্যক্তিস্বার্থের তুলনায় জাতীয় স্বার্থটাই আমাদের কাছে মুখ্য। যে করেই হউক বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার চক্রান্তের মোকাবেলা করতে হবে। আর এই লক্ষ্য নিয়েই তোমাদের পরামর্শ এবং সাহায্য সহযোগিতা পাবার আশা নিয়েই এসেছি নিজেদের আত্মার তাগিদেই, খালেদা জিয়ার নিয়োজিত দূত হিসেবে নয়। এটা আমরা বুঝতে পেরেছি পুরনো এবং প্রিয়বন্ধু হিসেবে। বিশ্বাস করো, এই ক্রান্তিকালে তুমি আসবেই আমাদের সাথে দেখা করতে যত শীঘ্র সম্ভব সেটাও আমরা জানতাম। এখনকার পরিস্থিতিতে ‘৭১-এ তোমরা যে ধরণের একটি শক্তিশালী সংগঠন গড়ে তুলেছিলে সেই ধরনের শক্তি খালেদার পক্ষে গড়ে তোলা কখনই সম্ভব হবে না। তিনি তার প্রয়াত স্বামীর পদাংকই অনুসরণ করবেন।
তবে এতে হতাশ হবার কিছুই নেই। গণচীনের ইতিহাসে ২০০ টি বিপ্লব বিফল হবার পর ১৯৪৮ সালে, দীর্ঘ ২৮ বছর বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ এবং জাপানি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সাথে সামাজিক বিপ্লবের প্রক্রিয়াকে সমুন্নত রেখে আমরা বিজয় অর্জন করেছি। বিপ্লবের পথে অনেক উত্থান-পতন থাকে। তোমরাও সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় থাকো। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, সময়ের ধারাতেই সুযোগের সৃষ্টি হয়। সেই সুযোগের সদ্ব্যবহার করে আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করে অবশ্যই তোমরা তোমাদের লালিত স্বপ্ন বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবে। কারণ তোমরা সবাই নিবেদিতপ্রাণ নিখাদ দেশপ্রেমিক।
বন্ধু, তোমাকে আমাদের অনেকেই প্রসঙ্গক্রমে আগেও অনেকবার বলেছেন, তোমাদের প্রয়োজন দেশের মাটিতে সুস্থ রাজনীতির জন্ম দেয়া। তোমাদের মতো আত্মত্যাগী, দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ দেশপ্রেমিকদের নেতৃত্বেই গড়ে তোলা সম্ভব স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, আত্মমর্যাদাশালী সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ প্রশ্ন থাকে, এই ধারণা আমদের কি করে জন্মালো? তুমি যখন চীনে ছিলে সেই সময় বিভিন্ন ক্ষেত্রের অনেক প্রতিনিধি দল গণচীনে এসেছে। একই ভাবে গণচীন থেকেও বাংলাদেশে গিয়েছে অনেক প্রতিনিধি দল। তুমি চলে যাবার পরও সেই প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকে। আমরা তাদের কাছ থেকেই জেনেছি, বাংলাদেশের জনগণ তোমাদেরকে জাতীয় বীর হিসাবেই তাদের হৃদয়ে স্থান দিয়েছে। আর সেই সম্মান, শ্রদ্ধা এবং জনপ্রিয়তা পদভারে প্রাপ্ত নয়। নিরলস দীর্ঘ সংগ্রাম, নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, ত্যাগ ও তিতিক্ষায় অর্জিত। আমরা আশায় থাকবো তোমাদের একদিন রাজনীতিতে নেতৃত্বের স্থানে দেখার। বন্ধুদের প্রত্যাশার বাস্তবায়নের সুযোগ কখনো হবে কিনা জানা নেই, তবে আল্লাহ্‌র মর্জি হলে হতেও পারে।
বন্ধুদের প্রায় সবাই ছিলেন বয়সে প্রবীণ এবং লং মার্চে অংশগ্রহণকারী। এদের সবাই ছিলেন অভিজ্ঞ, জ্ঞানী, শীর্ষস্থানীয় ক্ষমতাশালী নেতৃবৃন্দ। বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ফিরে এলাম নাইরোবিতে। ফিরে এসে চীনা বন্ধুদের সাথে আলাপের সব খুলে বলে রব্বানিকে জিজ্ঞেস করলাম কেমন বুঝলে?
এক কথায় আমি হতবাক! চীনাদের সাথে মেলামেশা করার তেমন কোনও সুযোগ হয়নি, তবে যাদের হয়েছে তারা বলেছে চীনাদের বোঝা খুবই শক্ত। বন্ধুত্ব গড়ে তোলা প্রায় অসম্ভব। আজ তাদের সেই অভিমতের উল্টোটাই শোনালে তুমি। মানতেই হবে, তুমি তাদের সাথে যে ধরনের অকৃত্রিম ঘনিষ্ঠতা গড়ে তুলতে পেরেছো সেটা খুব কম সংখ্যক ব্যক্তির পক্ষেই সম্ভব। তাদের জ্ঞান, প্রজ্ঞার গভীরতা, দূরদর্শিতা এবং সারগর্ভ বিশ্লেষণ আমাকে বিমোহিত করেছে। প্রতিটা বিষয় যে ধরনের স্বচ্ছতার সাথে তারা ব্যাখ্যা করেছে তাতে আমি আশ্চর্য হয়েছি বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের জ্ঞানের পরিধি দেখে।
তবে যে বিষয়টি আমাকে স্তম্ভিত করেছে, সেটা হল, তুমি নিজেকে যতটুকু চেনো তার চেয়ে অনেক গুণবেশি তারা তোমাকে চেনে।
এবারের গন্তব্যস্থল হল ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ পাকিস্তান। স্বাভাবিক কারণেই সে দেশের সামরিকবাহিনী, রাজনৈতিক মহল, মিডিয়া, বুদ্ধিজীবী, সুশীল সমাজ, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী মহলের অনেকের সাথেই আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। কারণ, যৌবনের একটা লম্বা সময় কাটিয়েছি পশ্চিম পাকিস্তানে। রব্বানির ক্ষেত্রে সর্বমহলে এটি আরও বিশেষ ভাবে প্রযোজ্য। সাহরানপুরের কালিয়া শরিফের খান্দানের সাথে সম্পৃক্ত রব্বানি পরিবার ভারত বিভক্ত হয়ে পাকিস্তান সৃষ্টি হওয়ার পর হিজরত করে করাচীতে মোহাজের হিসেবে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করার সিদ্ধান্ত নেয়। তখন করাচীই ছিল পাকিস্তানের সবচেয়ে বড় শহর এবং রাজধানী। সিদ্ধান্ত হল রব্বানি পৃথক ভাবে করাচী পৌঁছাবে, আমার টেলিফোন পাবার পর ইসলামাবাদে সাথে এসে যোগ দেবে।
এবারের সফরের গোপনীয়তা রক্ষার্থে ওয়াশিংটনে বসবাসকারী আমার এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু ডঃ ডিলন আমাদের Common Friend তখনকার পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী সুজাতের সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে দিলেন। নির্ধারিত দিনে মধ্যরাত্রে কনকনে ঠান্ডার মধ্যে এসে পৌঁছালাম ইসলামাবাদে। VIP Room-এ চৌধুরী সুজাতের পাঠানো প্রটোকল অফিসার তার cordless hand set এগিয়ে দিয়ে বললেন মিনিস্টার সাহেব। আচ্ছা দিন। বলে সেটটা হাতে তুলে নিয়ে বললাম আসসালাম, সুজাত ভাই। কেমন আছেন? হঠাৎ করে একটি অতি জরুরী বিষয়ে আপনাদের সাথে আলাপ করতেই এইভাবে আসতে বাধ্য হলাম।
একি বলছেন ভাই সাহেব। এটাতো আপনার নিজের দেশ। যখন ইচ্ছে আসবেন।স্বাগতম। যাত্রা কেমন হল, পথে কোনও অসুবিধে হয়নি তো? আপনার ইচ্ছেমতই সব ব্যবস্থা করা হয়েছে। আমি আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছি।
ধন্যবাদ। আমরাও বেরুচ্ছি, অল্প সময়ের মধ্যেই আপনার বাড়িতে পৌঁছে যাবো ইন শাহ আল্লাহ্‌। ফিরিয়ে দিলাম ওয়্যারলেস মুঠোফোন অফিসারকে। এরপর আমাকে নিয়ে বেরিয়ে পরলেন প্রটোকল অফিসার। VIP Motor Cade. Out Rider-দের সৌজন্যে অতি দ্রুতগতিতে অল্প সময়েই পৌঁছে গেলাম ইসলামাবাদের ব্লু এরিয়াতে মারগালা হিলস এর পাদদেশে সুজাত চৌধুরীর প্রাসাদোপম বাড়ীতে। সুজাত নিজেই বেরিয়ে এসে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানিয়ে জড়িয়ে ধরলেন। তিনি আমাকে ভেতরে নিয়ে গেলেন। He made me comfortable in a sitting room. আমাকে বসিয়ে তিনি আসছি, বলে ভেতরে চলে গেলেন। আমি চুপচাপ বসে ছিলাম। সামনে টেবিলের উপর কয়েকটি বিদেশী ম্যাগাজিন রাখা ছিল। আমি The Time টা হাতে তুলে নিলাম। ওটাতে খালিস্তান মুভমেন্ট সম্পর্কে একটি কভার স্টোরি লেখা হয়েছে। আশির দশকের কথা। আমি তখন হংকং এ পোস্টেড। সেই সময় হঠাৎ ‘আনন্দ সাহেব সনদ’-এর মাধ্যমে ভারতের শিখরা নিজেদের একটি ভিন্ন জাতি ঘোষণা দিয়ে তাদের জন্য স্বাধীন খালিস্তান রাষ্ট্রের দাবি করলে ভারতসহ পৃথিবীর সর্বপ্রান্তে এর সমর্থনে শিখ সম্প্রদায়ের মধ্যে দাবানলের সৃষ্টি হয়, বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে। তৎকালীন আন্তর্জাতিক মিডিয়া খালিস্তানের বিষয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছিলো। সারাবিশ্বের শিখদের সমর্থন দেখে লন্ডনে সান্ত চৌহানের নেতৃত্বে একটি প্রবাসী সরকার গঠন করার পর খালিস্তান রাষ্ট্রের প্রতি স্বীকৃতি প্রদান করার জন্য জাতিসঙ্ঘের সব সদস্য রাষ্ট্রের প্রতি আবেদন জানায় প্রবাসী অস্থায়ী সরকার। সাংবিধানিক ভাবে বাংলাদেশ বিশ্বের যেকোনো জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি নৈতিক, রাজনৈতিক, এবং কূটনৈতিক সমর্থন প্রদানে অঙ্গীকারবদ্ধ। তাই আমি এবং আমার অন্যান্য বিপ্লবী সহযোদ্ধারা যারা বিভিন্ন বাংলাদেশ দূতাবাসে কূটনীতিকের দায়িত্ব পালন করছিলাম তারা সবাই শিখদের খালিস্তান আন্দোলনের প্রতি বিভিন্ন ভাবে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম। ফলে খালিস্তান আন্দোলনের অনেক শীর্ষস্থানীয় নেতা-কর্মীদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ স্থাপিত হয়েছিলো অনেকেই হয়ে উঠেছিলেন পারিবারিক বন্ধু। একই প্রেক্ষিতে তামিল জাতিগোষ্ঠী সম্পর্কেও এখানে আমি কিছু ঐতিহাসিক তথ্য পাঠকদের জন্য তুলে ধরতে চেষ্টা করবো অতি সংক্ষেপে। ভারতের দাক্ষিণাত্য মানে প্রায় পুরো ভারতের একতৃতীয়াংশ জুড়ে চারটি রাজ্য মহারাষ্ট্র, অন্ধ্রপ্রদেশ, কর্নাটক, তামিলনাডুতে বসবাস একই জনগোষ্ঠীর। তাদের রয়েছে হাজারও বছরের প্রাচীন সভ্যতারঐতিহ্য। প্রাচীনকালে বর্তমানের শ্রীলংকা তামিলনাডুর সাথে সংযুক্ত ছিল। এরা নৃতাত্ত্বিক ভাবে ছিল ভেড্ডীড। তাদের ভাষা, ধর্ম, সংস্কৃতি, স্থাপত্য শিল্প, ভাস্কর্য সব কিছুই ছিল যাযাবর আর্যদের তুলনায় সমসাময়িক কালের যে কোনও সভ্যতার মতোই উন্নতমানের। তাই বহিরাগত আর্যরা ঈর্ষান্বিত হয়ে তাদের আখ্যায়িত করেছিলো রাবণ বা রাক্ষসের জাতি হিসাবে। বর্তমানে উত্তরের আর্যাবর্তের তুলনায় সবদিক দিয়েই দাক্ষিণাত্য এগিয়ে গিয়ে নিজেদের হারানো গৌরব এবং ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করার লক্ষে ‘তামিল ল্যান্ড’ নামক একটি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েমের সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছে। হংকং থাকাকালীন সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কয়েকজন শীর্ষস্থানীয় তাত্ত্বিক এবং নেতৃবৃন্দের সাথেও আমার পরিচিত হবার সৌভাগ্য হয়েছিলো দুই পদস্থ প্রকৌশলী তামিল বন্ধুর মাধ্যমে। এই দীর্ঘমেয়াদী সংগ্রামের মূল নেতৃবৃন্দও বিদেশে নির্বাসিত জীবন কাটাচ্ছেন। তামিলরাও ছড়িয়ে রয়েছে সারাবিশ্ব জুড়ে। এ দু’টি স্বাধীনতা সংগ্রামের বিষয়ে পাঠকদের জন্য প আলাদা ভাবে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে রইলো।
ফিরে এলেন সুজাত। একটু পরই খাবারের ডাক পরলো। আমরা খাবারের পাট চুকিয়ে আবার বসার ঘরে ফিরে এলাম। মধ্যরাত গড়িয়ে গেছে। তাই সুজাত বললেন
এখন আপনি বিশ্রাম করুন, কাল সকালে আলাপ হবে। তার নির্দেশে শয়নকক্ষে নিয়ে গেলো অপেক্ষারত পরিচারক। বেশ ক্লান্তি বোধ করছিলাম। তাই একে অপরকে শুভরাত্রি জানিয়ে শোবার ঘরে ঢুকে পড়লাম। হট শাওয়ার নিয়ে সোজা বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। ফজরের আজানের পর বেয়ারা বেড টি নিয়ে এসে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুললো। ঘন্টাখানেকের মধ্যে শাওয়ার নিয়ে নামাজ পড়ে ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে এসে ঢুকলাম বসার ঘরে। খবর পেয়ে চৌধুরী সাহেবও কিছুক্ষণের মধ্যেই এসে নাশতার জন্য খাবার ঘরে যেতে যেতে জানতে চাইলেন
ভাল ঘুম হয়েছে কিনা। আমি বললাম চমৎকার ঘুম হয়েছে। এরপর তিনি জিজ্ঞেস করলেন
কি ধরনের নাস্তা পছন্দ করবেন, কন্টিনেন্টাল নাকি পাকিস্তানী? জবাবে বললাম, অবশ্যই পাকিস্তানী।
চৌধুরী সাহেবের হুকুমে পরিবেশিত হল গরম লুচি, হালুয়া, লাচ্ছি, আণ্ডা ফ্রাই, পারাটা, আলু ভাজা ইত্যাদি। নাস্তাপর্ব শেষ করে আরাম করে বসলাম একটা প্রাইভেট সিটিং রুমে। সুজাত পিএসকে ডেকে বললেন তিনি না ডাকলে কেউ আমাদের ডিস্টার্ব করবে না, আর কোনও ফোন কল তাকে যেন না দেয়া হয়, যতক্ষণ আমাদের মিটিং চলে। অভিজ্ঞ পিএসনির্দেশ নিয়ে বেরিয়ে গেল।
ঘরে শুধু আমরা দু’জন, রুদ্ধদ্বার বৈঠক।চৌধুরী সুজাত বললেন
বলুন ভাই সাহেব, আপনার গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয়বস্তু। আমি সব কিছুই তাকে খুলে বললাম। সব শুনে, তিনি কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন বিষয়টির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী নওয়াজশরীফসহ National Security Council কেও On Board নিতে হবে। আমি নওয়াজ শরীফ-এর সাথে প্রথমে একান্তে একটা বৈঠক করবো। তারপর আমরা ঠিক করবো কি ভাবে অন্য সবাইকে On Board নেয়া যায়। এর জন্যই, আমি নওয়াজ শরীফ-এর সাথে বৈঠক না হওয়া পর্যন্ত আমার বাড়িতেই আপনাকে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছি শুধুমাত্র গোপনীয়তার স্বার্থেই যাতে এই কাজে আগেভাগেই কেউ বাগড়া না দিয়ে বসে। রাজনৈতিক সরকার। তাই অনেক অপছন্দসই বিভিন্ন স্বার্থের প্রতিভূ লোকজনকেও সাথে নিয়ে চলতে হচ্ছে। আর্মির ব্যাপারে আমাদের তেমন কোনও সমস্যা হবে না, হলেও সেটা আপনি নিজেই আমাদের চেয়েও ভাল করে হ্যান্ডেল করতে পারবেন সেটাও আমি জানি। আপনার বন্ধু-বান্ধবরাই তো বর্তমানে নীতি-নির্ধারণের পর্যায়ে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে অধিষ্ঠিত রয়েছেন। আমি একটা পরামর্শ দিতে চাই যদি আপনি কিছু মনে না করেন। এটা আপনি কি বলছেন সুজাত ভাই?আপনি নিঃসঙ্কোচে আপনার পরামর্শ আমাকে দিতে পারেন। নওয়াজ শরীফএর সাথে কথা হয়ে যাওয়ার পর আপনার পুরনো বন্ধুদের সাথে আপনি যোগাযোগ করলে সে দিক থেকে ইতিবাচক সাড়া পেতে সুবিধে হবে। আপনার পরামর্শ খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমি অবশ্যই সেটা করবো।
প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরীফের সাথে বৈঠক হল সুজাত ভাইয়ের। ফিরে এসে চৌধুরী সুজাত আলোচনাকালে জনাব নওয়াজ শরীফ বাংলাদেশ সম্পর্কে কি বললেন সেটা জানালেন।
বাংলাদেশের আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগই এককভাবে অথবা জেনারেল এরশাদের সাথে মিলে সরকার গঠন করবে। খালেদা জিয়ার জোটের জেতার কোনও সম্ভাবনাই নেই, এই মনোভাবই পোষণ করছে ISI এবং ঢাকায় অবস্থিত দূতাবাস। সেইক্ষেত্রে এজেন্সিগুলোর তরফ থেকে পাকিস্তান সরকারকে অনুরোধ জানানো হয়েছে যেআওয়ামীলীগের সাথে একটা ন্যূনতম কার্যকরী সম্পর্ক তৈরি করার চেষ্টা পাকিস্তানের জন্য একান্ত জরুরী হয়ে পরেছে। পাকিস্তানপররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সেই বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করছে। আপনার আগে বেগম খালেদা জিয়ার বিশেষ দূত হিসাবে জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট জনাব মুস্তাফিজুর রহমান ইতিমধ্যেই এসেছিলেন, তাকে আমাদের তরফ থেকে এই কথাই জানিয়ে দেয়া হয়েছে। তিনিও তরুণ অফিসার হিসাবে জেনারেল জিয়ার মতোই ISI-তে চাকুরি করেছিলেন। এসমস্ত বিষয় অবশ্যই আপনার জানা আছে বলেই আমার বিশ্বাস। আপনার উপস্থাপনা আমাদের বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণের সম্পূর্ণ বিপরীত।
ঠিকই বলেছেন আপনি। তবে আপনাকে একটা কথা আমি প্রথমেই বলবো। সেটা হল, আমি কিন্তু বেগম খালেদা জিয়ার অনুরোধে তার দূত হয়ে ওকালতি কিংবা সাহায্য-সহযোগিতা চাইতে আসিনি। আমি এসেছি আমাদের বিবেকের তাড়নায় দু’টি ভ্রাতৃপ্রতিম দেশের স্বার্থেই। তাছাড়া আমাদের উপস্থাপনা নিরপেক্ষ তথ্য এবং বাস্তব ভিত্তিক। তিনটি বিষয়ে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব হলে, বেগম খালেদা জিয়ার জনসমর্থনের জোয়ারে ভারত থেকে যত সাহায্য-সহযোগিতাই আওয়ামীলীগ জোট পাক না কেনো, সবই ভেসে যাবে এবং খালেদা জিয়াকে নির্বাচনে কিছুতেই হারানো সম্ভব হবে না। কি সেই তিনটি বিষয়? জিজ্ঞেস করলেন সুজাত ভাই।
১। নির্বাচনের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করা যেটা বর্তমানে খালেদা জিয়ার পক্ষে দেশের ভেতর থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব নয়।
২। বিএনপিকে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য সমমনা ইসলামিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছোট ছোট দলগুলকে নিয়ে নির্বাচনী মোর্চা গঠন কোরতে হবে।
৩। নির্বাচন কালে প্রতিটি ভোটকেন্দ্রে সামরিক বাহিনীর সদস্যদের নিয়োগ দান কোরতে হবে নির্বাচন কমিশন-এর মাধ্যমে যাতে ভোটাররা নিরাপদে ভোট দান কোরতে পারে।
দ্বিতীয় এবং তৃতীয় বিষয় দু’টি সম্পর্কে ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। এখন শুধু প্রয়োজন এই জোটকে নির্বাচনে জেতানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের সংকুলান করা। ঐক্য জোট গোড়ে তোলা।
আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা সম্ভব হলে বিএনপি জোটের বিজয় সুনিশ্চিত। আর এই বিজয়ে সবচেয়ে উপকৃত হবে ভাতৃপ্রতিম দেশ পাকিস্তান। বাংলাদেশের আগামী নির্বাচন এই উপমহাদেশের ভূরাজনীতিতে সুদূরপ্রসারী প্রভাবফেলবে সেটা বোঝার মতো সঙ্গতি আপনাদের নীতি-নির্ধারকদের রয়েছে। এই বিশ্বাসেই ঝুঁকি নিয়েও আমি আমার সহযোদ্ধাদের তরফ থেকে শুধু খালেদা জিয়ার জন্যই নয়, ভাতৃপ্রতিম বাংলাদেশ এবং পাকিস্তানের মুসলমানদের ক্রমান্বয়ে ভারতের দুর্বিষহ নাগপাশ থেকে বাচানোর তাগিদেই। ভাইদের কাছে এসেছি কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ ছাড়াই যদিও সিদ্ধান্ত নেবেন আপনারাই। তবুও আমি দৃঢ়ভাবেই বিশ্বাসকরি, গোয়েন্দাপ্রতিষ্ঠানসমূহ এবং দূতাবাসের প্রতিবেদনের পাশাপাশি আমাদের উপস্থাপনাটাও বিবেচ্য। কারণ, আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করে আপনাদের কাছে এসেছি তাদের সবারই জন্ম রাজনৈতিক পরিবারে। ছাত্র রাজনীতি, স্বাধীনতা যুদ্ধ, স্বাধীনতার পর রাজনৈতিক ধারা এবং ১৯৭৫ সালে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবী অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের ঘটনাবলী থেকে আজ অবধি দেশের বাইরে থেকেও জাতীয় চলমান রাজনৈতিক ধারার সাথে আমি এবং তারা সবাই সম্পৃক্ত এবং ঘটনাবলী সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। তাই, আমাদের প্রতিবেদনকেও গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করাটা যুক্তিসঙ্গত হবে আপনাদের নীতি-নির্ধারকদের জন্য। জনাব মুস্তাফিজুর রহমানের এখানে আসার বিষয়টি আমাদের জানা আছে। এরপরও আমি কেনও এলাম? আমাদের আত্মবিশ্বাসই আমাকে এখানে নিয়ে এসেছে। আমাদের প্রতিবেদনের যৌক্তিকতা আপনাদের কাছে গ্রহণযোগ্যতা পাবে এবং আপনারা সাহায্য-সহযোগিতার হাত অবশ্যই বাড়িয়ে দেবেন এটা আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস। আমার কথা শুনে চৌধুরী সুজাত কিছুক্ষণ হতবাক হয়ে বসে রইলেন। আমার মনে হল, তিনি আমার বক্তব্যের গুরুত্ব অনুধাবন করতে পেরেছিলেন। তাই তিনি বললেন, তারা জরুরী ভিত্তিতে National Security Council (NSC)-এর বৈঠক তলব করে আমার উপস্থাপনার উপর আলোচনা করে NSC-এর সিদ্ধান্ত আমাকে জানিয়ে দেবেন।
সেই সময় আর্মি চীফ জেনারেল আসলাম বেগ চীন সফর করছিলেন। তাকে সফর সংক্ষিপ্ত করে দেশে ফিরে আসার নির্দেশ দেয়া হল। ঢাকা থেকে জরুরী তলব করে পাঠান হল রাষ্ট্রদূতকেও। NSC-এর জরুরী বৈঠকে অংশগ্রহণের জন্যই এমনটি করা হয়। সুজাত ভাই আমাকে এই খবরগুলো জানিয়েছিলেন। কয়েকদিন এখানে থাকতে হবে। তাই দেশে-বিদেশে যোগাযোগের সুবিধার্থে আমি হোটেল ম্যারিয়ট-এ অবস্থান নিলাম। আন্তর্জাতিক যোগাযোগের বিশেষ ব্যবস্থা করে দিলেন চৌধুরী সুজাত। দেখাশোনা এবং নিরাপত্তারও বিশেষ ব্যবস্থা পরিলক্ষিত করলাম। হোটেলে অবস্থান নিয়েই রব্বানির সাথে যোগাযোগ কোরলাম। সেইদিনই রব্বানি ইসলামাবাদে এসে পৌঁছালো। গোপনীয়তার স্বার্থে আমিও যোগাযোগ করছি শুধুমাত্র প্রাসঙ্গিক পরিচিতজনদের সাথেই। হোটেল-এ শিফট করার পরদিন নাস্তার জন্য রুম সার্ভিসকে অর্ডার দিয়ে তৈরি হচ্ছিলাম আমি ও রব্বানি। হঠাৎ মেইন ডোর-এর কলিং বেল বেজে উঠলো। রব্বানি দরজা খুলে দেখলো এক কেতাদুরস্ত ভদ্রলোক দরজায় দাড়িয়ে। সালাম জানিয়ে ভদ্রলোক বললেন পিণ্ডি থেকে তিনি আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। ব্রিগেডিয়ার রফি তাকে পাঠিয়েছেন। তাকে বসার ঘরে বসিয়ে খবরটা আমাকে জানালো রব্বানি।
ব্রিগেডিয়ার রফি তখন ISI-তে ডেপুটি ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করছিলেন। কোয়েটাতে আমরা একসাথে একই ডিভিশনে পোস্টেড ছিলাম। সেই সুবাদে তাকে আমি চিনি। একমাত্র শওকত ভাই ছাড়া এখানে আমাদের অবস্থান সম্পর্কে অন্য কারো জানার কথা নয়। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গের সাথে যোগাযোগে প্রয়োজনে তিনি আমাকে সাহায্য করবেন তেমন বন্দোবস্তই করে দিয়েছেন সুজাত ভাই। পরিচিত ব্রিগেডিয়ার রফির তরফ থেকে এসেছেন ভদ্রলোক, তাই দু’জনই গিয়ে বসলাম সাক্ষাতের জন্য। ভদ্রলোক নিজের পরিচয় দিয়ে জানালেন তিনি পদবীতে একজন কর্নেল। ইতিমধ্যে রুম সার্ভিস-এর ওয়েটার নাস্তা নিয়ে এলো। আমি কর্নেল সাহেবকে আহ্বান জানালাম আমাদের সাথে যোগ দেবার জন্য। কর্নেল ধন্যবাদ জানিয়ে বললেন, তিনি প্রাতঃরাশ সেরেই এসেছেন। কর্নেলকে একটি কাপে চা ঢেলে তার দিকে এগিয়ে দিয়ে বললাম এতে নিশ্চয় আপনার আপত্তি হবে না? প্রায় চল্লিশের কোঠায় কর্নেল বিনীতভাবে বললেন, এতে আপত্তি নেই স্যার, বলে কাপটি হাতে তুলে নিলেন। আমরাও নাস্তা করতে শুরু করলাম। খাওয়ার পর্ব শেষ করে তিনজনই আরামে বসলাম।
বলুন, আপনার আসার উদ্দেশ্য? কর্নেল যে ব্রিগেডিয়ার রফির অধীনস্থ একজন কর্মকর্তা সেটা বুঝেই প্রশ্নটা করলাম। না, তেমন বিশেষ কোনও কাজে নয়, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে আলাপ করতে এলাম। বলেই অনুমতি নিয়ে ভদ্রলোক একটি সিগারেটে অগ্নি সংযোগ করছিলেন দেখে বললাম কিছু মনে করবেন না, আমাদের এখুনি বের হতে হচ্ছে একটা পূর্বনির্ধারিত এপয়েন্টমেন্ট রক্ষা করতে। তাই আলাপের তো সময় হবে না। আমার জবাবে ভদ্রলোক খানিকটা ঘাবড়ে গিয়ে থাকবেন, তার আঙ্গুলের ফাঁক দিয়ে সিগারেটটা ফসকে মেঝেতে পরে গেলো। বুঝতে অসুবিধে হয়নি কর্নেল সাহেব এসেছিলেন খবর সংগ্রহ করার জন্য। নিজেকে সামলে নিয়ে কর্নেল বললেন ঠিক আছে স্যার, আপনি ব্যস্ত। তাই আমি না হয় অন্য কোনোদিন সময় নিয়ে আসবো বলে পকেট থেকে একটি চিরকুট বের করে আমার হাতে দিলেন। খুলে দেখলাম ব্রিগেডিয়ার রফি লিখে পাঠিয়েছেন, তিনি আমাকে লাঞ্চ কিংবা ডিনারে নিমন্ত্রণ করতে চান আমার সুবিধে মতো। যদি একটু সময় করে তার নিমন্ত্রণ রক্ষা করি তবে তিনি খুবই খুশি হবেন। তার ব্যক্তিগত ফোন নম্বরটাও লিখে দিয়েছেন যোগাযোগের সুবিধের জন্য। চিরকুট পড়ে কর্নেলকে বললাম ব্রিগেডিয়ার রফিকে আমার সালাম জানিয়ে বলবেন, আমি সময় করে অবশ্যই তার সাথে যোগাযোগ করবো। এবার আমাদের উঠতে হচ্ছে বলতেইবুদ্ধিমান কর্নেল উঠে দাঁড়িয়ে বললেন স্যার, আপনার সাথে পরিচিত হয়ে খুশি হলাম। আপনাকে দেখার খুবই ইচ্ছে ছিল। আমিও খুশি হয়েছি আপনার সাথে পরিচিত হয়ে। তবে সময়ের অভাবে আলাপটা জমলো না। বেরিয়ে গেলেন গোয়েন্দা কর্নেল কিছুটা নিরাশ হয়েই। কর্নেলের প্রস্থানের পর রব্বানি মুচকি হেসে বললো
তুমি কর্নেল সাহেবকে যেভাবে বিদায় করলে সেটা অন্য কারো পক্ষে সম্ভব হতো কিনা সে বিষয়ে কিছু না বলে শুধু এতটুকুই বলছি, এই দেশে ঐ সংস্থার কোনও ক্যাপ্টেন কিংবা মেজরের সাথে কথা বলতে গিয়ে অনেক বাঘা বাঘা হোমরা-চোমরাদেরও কাপড় ভিজে যায়।
হবে হয়তো, তবে আমি তো সেই জাতের কেউ নই, খুবই সাধারণ একজন। জবাব শুনে রব্বানি উচ্চস্বরে হেসে উঠলো। দরজার কলিং বেল আবার বেজে উঠলো। রব্বানি দরজা খুলে শওকত ভাইকে দেখে সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে ভেতরে এনে বসালো। আসুন ভাই, কি ব্যাপার এত সকালে? হ্যাঁ, সকালেই আসলাম এই ভেবে যদি আপনাদের না পাই। চৌধুরী সাহেব আপনাকে জানাতে বলেছেন, দুই-চার দিনের আগে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা আপনাকে জানানো সম্ভব হবে না সেটাই তার ধারণা। তাই ইতিমধ্যে আপনি ইসলামাবাদের বাইরে কোথাও যাবার ইচ্ছে থাকলে সেই ব্যবস্থা করা সম্ভব। মারী আর নাথিয়াগলি ঘুরে আসুন না এখানে ভিড়ের মধ্যে বসে না থেকে।প্রস্তাব রাখলেন শওকত ভাই। না ভাই, ভাবছি পেশাওয়ার থেকে একটু ঘুরে আসবো। চাপলি কাবাবের লোভ ছাড়াও আমাদের এক ঘনিষ্ঠ বন্ধু আছেন। তার সাথেও দেখা করে আসা যাবে। বন্ধুবর ডঃ খালেদ মুফতির সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো রব্বানির মাধ্যমেই। বেশ, সেই ব্যবস্থাই করে দিচ্ছি। ওখানে PC-তে থাকবেন আপনারা। গাড়ীর সাথে আনুষঙ্গিক অন্যান্য সব ব্যবস্থা করে দিয়ে যাচ্ছি, যখন ইচ্ছে চলে যাবেন। এখানে কোনও অসুবিধে হচ্ছে নাতো? কোনও কষ্ট হচ্ছে না, বরং আরাম-আপ্যায়নের আতিশয্যে হাঁপিয়ে উঠছি। তবে সময় ভালই কাটছে।বাংলাদেশ আর বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগের বিশেষ ব্যবস্থাটা খুবই কাজে আসছে। আমি কিছুক্ষণের মধ্যেই সব ব্যবস্থা করে ফিরে আসছি। চলে গেলেন শওকত ভাই। অত্যন্ত অমায়িক আর বিনয়ী শওকত ভাই। কয়েক মিনিটের মধ্যেই ফিরে এলেন জবরদস্ত এক নওজোয়ানকে সাথে করে। পরিচয় করিয়ে দিয়ে বললেন যখনই রওনা হবেন এই নওজোয়ান আপনাদের পথ দেখিয়ে নিয়ে যাবে বলে মুচকি হাসলেন শওকত ভাই। তার অর্থবহ হাসিতে আমরাও হাসলাম। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন শওকত ভাই নওজোয়ানকে সাথে নিয়ে।রব্বানিকে বললাম আমার এক কোর্সমেট জেনারেল কাইউমের স্ত্রী অসুস্থ। তাইকাইউম সন্ধ্যায় নিজেএসেতার বাসায় নিয়ে যাবে।পিণ্ডির কাছাকাছি কোর্সমেটদের যারা রয়েছে তাদেরও ডেকেছে পুনর্মিলনের জন্য।ইতিমধ্যে তুমি ডঃ খালেদ মুফতি ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে জানিয়ে দাও হযরতজীর সাথে সাক্ষাত করে তার দোয়া নেবার জন্য আমরা আজ রাতেই পেশাওয়ার রওনা হচ্ছি। খালেদ ভাই যাতে মেহেরবানী করে সেই ব্যবস্থা করার চেষ্টা করেন। যে ভাবেই হউক, আমরা হযরতজীর সাথে দেখা না করে ফিরবো না। কারণ, এই উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থেই তার দোয়া ভিক্ষা চাইতে এসেছি আমরা, কোনও ব্যক্তিস্বার্থ হাসিলের জন্য নয়। ডঃ খালেদ মুফতি একজন আন্তর্জাতিক ভাবে খ্যাত সাইক্রিয়াটিস্ট এবং হযরতজীর একজন বিশেষ প্রিয় শিষ্য।এক সময়ের ডাকসাইটে জেনারেল শিনওয়ারীর সাথে সম্পর্কিত তার স্ত্রী। হযরতজী কি আমাদের দর্শন দিতে রাজি হবেন? মনে একটা সংশয় থেকেই গেলো। হযরতজী (হযরত মান শাহ্‌) একজন সূফি সাধক, রহস্য পুরুষও বটে। সারা বছর প্রতিদিন ১০/১২ বার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করেন। একটা সালওয়ার কিংবা ধোতি পরে খালি গায় কদাচিৎ একটা পাতলা চাদর জড়িয়ে ধ্যানমগ্ন হয়ে বসে থাকেন। শহরে এলে শহরের কেন্দ্রে একটি বাসায় থাকেন। তবে বেশিরভাগ সময় তিনি শহরতলীতে তার খানকায় অবস্থান করেন। জালালি মেজাজের এই সাধকের দোয়া নেবার জন্য রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, বড় বড় রথী-মহারথী, বিত্তবানরা তীর্থের কাকের মতো তার দর্শন পাওয়ার জন্য অপেক্ষায় থাকেন। কিন্তু তিনি এদের বেশিরভাগের সাথে সাক্ষাত করেন না। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, প্রধানমন্ত্রী জুলফিকার আলী ভুট্টো, প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াউল হক, বেনজির, নওয়াজ শরিফ প্রমুখ অনেক চেষ্টা করেও তার দর্শন পেতেব্যর্থহয়েছেন। এইকথাগুলো আমাদের জানিয়েছিলেন খালেদ ভাই নাইরোবিতে আমার বাসায় দাওয়াত খেতে এসে। তখন থেকেই এই সূফি সাধকের সাথে সাক্ষাতের একটা অদম্য বাসনা লালন করে এসেছি আমি ও রব্বানি দু’জনই। রব্বানি তার কাজে লেগে গেলো। আমিও বেরিয়ে পড়লাম পুরনো কয়েকজন বন্ধুর সাথে দেখা করার জন্য। সারাদিন তাদের সান্নিধ্যে কাটিয়ে সন্ধ্যার আগেই হোটেলে ফিরে এলাম। রব্বানি জানালো, খালেদ ভাইয়ের সাথে যোগাযোগ করে সব কিছুই তাকে খুলে বলা হয়েছে। তিনি সব শুনে বলেছেন, তিনি এক্ষুনি হযরতজীর সাথে দেখা করার চেষ্টা করবেন এবং জেনে নেবেন তিনি আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন কিনা। ঠিক হয়েছে, পেশাওয়ার পৌঁছেই আমরা খালেদ ভাই এর সাথে যোগাযোগ করা মাত্র তিনি হোটেলে চলে আসবেন আমাদের স্বাগত জানাবার জন্য। যথা সময়ে কাইউম এসে পৌঁছাল।আমি তৈরি হয়েই ছিলাম তার আগমনের প্রতীক্ষায়। তার গাড়িতেই গিয়ে পৌঁছালাম পিণ্ডি ক্যান্টের ভেতরে তার বাসায়। পৌঁছে দেখলাম কোর্সমেটদের কয়েকজনকে একত্রিত করেছে কাইউম। অনেকটা চুপিসারেই একত্রিত হয়েছে সবাই কাইউমের নির্দেশ অনুযায়ী। ‘৭১-এর পর সাক্ষাতে সবাই আবেগে বিহ্বল। আবগে একে অপরকে জড়িয়ে ধরে অভিভূত। সবারই চোখ অশ্রুসিক্ত। ভাবী নানা জটিল রোগে আক্রান্ত। তাকে দেখলেই সেটা স্পষ্ট বোঝা যায়। ভূরিভোজনের বিশাল ব্যবস্থা দেখে কিছুটা উষ্মার সাথেই কাইউমকে বললাম, ভাবীর এই অবস্থায় তুই এতো বিশাল আয়োজনকরতে গেলি কেনও? জবাবটা ভাবী নিজেই দিলেন ভাই, আমিতো কিছুই করিনি, চাইনিজ খাবার আপনার পছন্দ, তাই বেশিরভাগ পদ আনা হয়েছে চাইনিজ রেস্টুরেন্ট থেকেই।বাকিগুলো মেয়েরা করেছে। তাছাড়া আপনিসহ উপস্থিত সবাই তো একান্ত আপনজন, মেহমান নন। তার আন্তরিকতা হৃদয় ছুঁয়ে গেলো। যথেষ্ট ঠাণ্ডা, তাই প্রতিটি ঘরেই কোয়েটা স্টোভ জ্বলছে। খাওয়ার পর সবাই গিয়ে বসার ঘরে বসলাম। খুবই ঘরোয়া পরিবেশ। সবাই জানতে চাইল হঠাৎ এভাবে আমি এখানে কেনো? সংক্ষেপে উত্তর দিলাম। বিল্লাহ চার্জ করলো
বদমাশ, তুই আর তোর সাথীরা ডিপ্লোম্যাট হয়ে বিদেশে কি করছিস? দেশে ফিরে রাজনীতি করছিস না কেনো? রাজনীতির মানে যদি হয় একটা দল গঠন করে জনসভা, সেমিনার, প্রেস বিজ্ঞপ্তি, বক্তৃতা আর চুঙ্গা ফুঁকানো, তার জন্যও ময়দানে নামার আগে চাই প্রস্তুতি।সুযোগ একটা সৃষ্টি করেছিলাম কিন্তু জেনারেল জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতায় সেই সুযোগ থেকে আমরা বঞ্চিত হলাম। এখন আবার নতুন করে শক্তি সঞ্চয় করার চেষ্টা করছি এবং একই সাথে নিজেদের আরো পরিপক্ব করে গড়ে তোলার প্রচেষ্টায় নিয়োজিত রয়েছিসবাই। আল্লাহ্‌র ইচ্ছা হোলে, সময় সুযোগ পেলে নিশ্চয় ময়দানে অবতীর্ণ হবো ইন শাহ আল্লাহ। তাছাড়া প্রবাসে নির্বাসনে থেকেও দেশের চলমান রাজনৈতিক প্রবাহের সাথে আমরা কোনও না কোনও ভাবে জড়িততো রয়েছিই। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে বাংলাদেশে ভারতীয় চাণক্যদের আগ্রাসনের নীলনকশার বিরুদ্ধে আমরা তো জেহাদ করেই চলেছি সেই ‘৭১-এর যুদ্ধকালীন সময় থেকে। কিন্তু তোরা এখানে ভারতের সুদূরপ্রসারী দুরভিসন্ধির বিরুদ্ধে কি করছিস? কিছুই না। ঘুণেধরা ক্ষয়িষ্ণু সামন্তবাদের নিষ্পেষণের যাঁতাকল থেকে জনগণের মুক্তির জন্য কি করছিস তোরা? কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর চক্রান্তে দেশটা বিভক্ত হয়ে গেলো। কিন্তু তারপরও সবাই নির্বিকার! ১৯৫৪ সালে, পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রাদেশিক সরকার যখন জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে দিলো তখন পশ্চিম পাকিস্তানের ফিউডাল লর্ডরা আতংকিত হয়ে চক্রান্তমূলক ভাবে জেনারেল আইয়ুব খান-এর মাধ্যমে সারা দেশে মার্শাল’ ল জারি করে তাদের সাথে গাঁটছড়া বেঁধে জমিদারী প্রথা চালু রাখলো! সেই ফিউডাল মাইন্ড সেট এবং জমিদারী ও সারমায়াদারী নিজাম দেশ ভাগ হয়ে যাবার পরও এখানে অটুট রয়েছে। কাইউম, তুইতো NDC-তে একজন CI (Chief Instructor), সত্যি করে বলতুই কি কখনো সাহস করে যারা ভবিষ্যতে সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব দেবে তাদের বলতে পেরেছিস যে, Feudalism never allows to grow nationalism as it thrives on regionalism. I believe, you could never been able to utter this truth as Feudal mindset is so strongly ingrained in the state and social structure of the leftover Pakistan till this date. যেখানে এখনো এক-দুই শতাংশ শাসকগোষ্ঠীর অনুকম্পায় বৃহত্তর জনগোষ্ঠী গোলাম হয়ে রয়েছে বাঁচার তাগিদে, কারণ বিদেশী শক্তির মদদপুষ্ট এবং লালিত ঐ শাসকগোষ্ঠীর কব্জায় রয়েছে নব্বই শতাংশের বেশি জাতীয় সম্পদ। এমতাবস্থায় সামন্ত মনোভাব বজায় রেখে সামন্ত প্রভু আর মুৎসুদ্দি ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর সাথেই মিলেমিশে লুটপাটে ব্যস্ত থাকিস তাহলে শুনে রাখ, এই পাকিস্তানে জাতীয়তাবাদ কখনই শিকড় গাড়তে পারবে না। ফলেআঞ্চলিক বৈষম্যতার কারণেই দেশটির অস্তিত্বই একদিন হয়তো বিলীন হয়ে যাবে বিদেশী শত্রুদের কারসাজি এবং সহায়তায়। গোষ্ঠীস্বার্থের ক্ষমতার রাজনীতি কখনোই কোনও দেশ বা জাতির উন্নতি কিংবা ভাগ্যোন্নয়ন সাধন করতে পারে না। তাই সময় থাকতে জেগে ওঠ, না হলে আল্লাহ্‌ না করুক,এই ফকিরের কথাটাই সত্যে পরিণত হবে ভবিষ্যতে। তোদের মতো বিজ্ঞ, ক্ষমতাধর লোকদের জন্য লেকচারটা একটু লম্বাই হয়ে গেলো, কিছু মনে করিস না।
সবাই আমার কথাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনছিলো। এরপর কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে কাইউমকে বললাম, যেতে ইচ্ছে করছে না এই পরিবেশ ছেড়ে। তবুও যেতে হবে। কারণ, এখান থেকে ফিরেই পেশাওয়ার রওনা দিতে হবে এক বিশেষ জরুরী প্রয়োজনে। সবার কাছ থেকে বিদায় নেয়ার পর ভাবী আর মেয়েদের ধন্যবাদ জানিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে। কাইউমই নামিয়ে দিয়ে গেলো। যাবার আগে পুরনো বন্ধুদের সাথে দেখা করার সুযোগ করে দেয়ার জন্য কাইউমকে কৃতজ্ঞতা জানালাম। জবাবে কাইউম বললো তুই আমাদের সবার গর্ব। সবাই তোর সাথে দেখা করার জন্য কতটা উদগ্রীব সেটা তুই আন্দাজও করতে পারবি না দোস্ত। সময়ের অভাবে দূর থেকে ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও অনেকেই আসতে না পেরে দুঃখ প্রকাশ করে আমাকে বলেছে, তাদের সালাম আর ভালোবাসা তোকে পৌঁছে দিতে। শুনে তাকে বললাম
আমার তরফ থেকে সালাম ও ভালোবাসা তুইও তাদের জানিয়ে দিস। চলে গেলো কাইউম।
পেশাওয়ারের পথে
স্যুইটে পৌঁছে একটা হ্যান্ডব্যাগে নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস আর কয়েক প্রস্থ কাপড় গোছগাছ করে আমি ও রব্বানি বেরিয়ে পড়লাম পেশাওয়ারের পথে। কুয়াশাচ্ছন্ন রাত হলেও GT Road-এ ট্রাফিকের কমতি নেই। বিশেষ করে বড় বড় ট্রাক, ট্রলি এবং কনটেনার বহনকারী ট্রেইলর ছাড়াও বাস, কারগুলো সারিবদ্ধ ভাবে ছুটে চলেছে রাস্তার দু’ধার দিয়েই। আগে রাস্তাটা ছিল Narrow, এখন দেখলাম পুরো রাস্তাটাই প্রশস্ত Duel carriage Highway-এর রূপ ধারণ করেছে। খায়বার থেকে করাচী পর্যন্ত এটাই চলাচলের প্রধান সড়ক। আফগানিস্তান একটি ল্যান্ডলক্ড দেশ বিধায় ঐ দেশের সব পণ্য আনা-নেয়ার এটাই একমাত্র পথ। পথের দুই পাশেই ঘনবসতি গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠেছে ছোট বড় শহর। অভিজ্ঞ চালক সতর্কতার সাথে গাড়ী চালিয়ে নিয়ে চলেছে। হঠাৎআমার সন্দেহ হল, পেছনের গাড়িটা যেনো আমাদের অনুসরণ করছে। ড্রাইভারকে আমার সন্দেহটা জানালাম। ড্রাইভার স্মিত হেসে জবাব দিলো,
ওটা আমাদের নিরাপত্তার জন্যই সাথে চলছে। হাসান আব্দালে চা পান করার জন্য কিছুক্ষণ বিরতি। রব্বানির পুরনো অভ্যাস, কিছুক্ষণ পর পর দুধপাত্তির কড়া গরম চা খাওয়ার। বিরতির পর আবার শুরু হল যাত্রা। পথে পড়লো ওয়াহ ক্যান্ট, সেখানে রয়েছে Ordinance Factory. কামরা বেসে রয়েছেAeronautical Complex.আটক নদীর উপর নতুন একটা duel carriage সেতু বানানো হয়েছে। এখানেই কাবুল নদ আর সওয়াত নদী এক হয়ে সৃষ্টি হয়েছে সিন্ধু নদযার অববাহিকায় গড়ে উঠেছিলো Indus Valley Civilization. খরস্রোতা এই দু’টি স্রোতস্বিনীর সঙ্গমস্থলে আগে একটাই সেতু ছিল পাহাড়ের গা ঘেঁষে। সেতুটি ব্রিটিশ আমলের তৈরি।এই সেতুর উপরেই ছিল রেললাইন এবং যানবাহন চলাচলের রাস্তা। নদীর পাড় ঘেঁষেই চেরাটের বিখ্যাত আটক ফোর্ট। এই ফোর্টেই অবস্থিত কমান্ডো ট্রেনিং সেন্টার। তাই, আটক ফোর্টের পুরো এলাকাটা জুড়েই কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা। অতি পরিচিত জায়গাগুলো, অনেক স্মৃতি বিজড়িত। নওশেরা ক্যান্টনমেন্টের বিস্তৃতি ঘটেছে প্রয়োজনের তাগিদেই, তবে দেখতে অনেকটাই আগের মতই আছে। কাবুল নদের উপর নওশেরা সেতুটা আধুনিক ভাবে প্রশস্ত করে বানান হয়েছে। নওশেরাতে রয়েছে আরমার্ড স্কুল,আর্টিলারি স্কুল, সাপ্লাই ট্রেনিং সেন্টার। এর জন্য নওশেরা পাকিস্তানের একটি গুরুত্বপূর্ণ ক্যান্টনমেন্ট। নওশেরা থেকে উত্তরপূর্ব দিকে মোড় নিয়ে মর্দানের দিকে মাইল পাঁচেক গেলেই রিসালপুরে দেখা যাবে ইঞ্জিনিয়ারিং স্কুল এবং PAF Training Academy. পথের দুই পাশে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানগুলো মনে করিয়ে দিলো অনেক স্মৃতি। যৌবনকালের সেইসব স্মৃতি রোমন্থন কোরতে কোরতে পৌঁছে গেলাম পেশাওয়ার। শহরে ঢোকার পরই দেখা যায় জামরুদ ফোর্ট। সেখানে রয়েছে Frontier Force Regiment এর ট্রেনিং সেন্টার। গাড়ী এসে থামলো PC Hotel এর পোর্চে। Duty Manager সাদর সম্ভাষণ জানিয়ে নিয়ে গেলেন নির্দিষ্ট স্যুইটে। তখনকার সময় পেশাওয়ারে একমাত্র পাঁচ তারকা হোটেল। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফুলের তোড়া আর তাজা ফলের সাজি নিয়ে এলেন Deputy Manager. স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর মেহমান বলে কথা! শুভেচ্ছা বিনিময়ের পর তারা কালক্ষেপণ না করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন সবাই। রব্বানি খালেদ ভাইকে ফোন করে আমাদের আগমনী বার্তাটা জানালো। খালেদ ভাই বললেন, তিনি অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই হোটেলে পৌঁছে গেলেন তিনি। নিজের যোগ্যতা ছাড়াও জেনারেল শিনওয়ারীর সাথে তার রয়েছে আত্মীয়তা।বিধায় খালেদ ভাই সেনাবাহিনীসহ সুশীল সমাজে বিশেষভাবে পরিচিত।রুমেঢুকেই আমাদের দুই জনকেই জড়িয়ে ধরলেন আন্তরিক উষ্ণতায়।
খালেদ ভাই,নাইরোবিতে আপনার দাওয়াত কবুল করে বলেছিলাম সময় আর সুযোগ হলে নিশ্চয় আপনার ওখানে যাবো So, here we are. আমি কিন্তু এখনো বিশ্বাস করতে পারছিনা আপনারা এভাবে আচমকা এসে উপস্থিত হবেন। It is really a very pleasant surprise. I am so delighted to see you both. আপনাদের এভাবে হঠাৎ করে আসাটা কিছুটা অপ্রত্যাশিতহলেওআমিকৃতজ্ঞতা জানাচ্ছি আপনি আমার আমন্ত্রণ ভুলে যাননি বলে।
কি করে ভুলবো বলুন, প্রথম সাক্ষাতেই আপনি আমার মন কেড়ে নিয়েছিলেন। খালেদ ভাই এবার বললেন, হোটেলে থাকা চলবে না। তার বাসায় যেতে হবে। সেখানেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করে রেখেছেন ভাবী। কোনও অজুহাতই শুনবেন না খালেদ ভাই। অতিথি পরায়ণতায় পাঠানদের ঐতিহ্য সুপ্রাচীন। অতএব হ্যান্ডব্যাগটা হাতে তুলে নিয়ে তার সাথে যেতে প্রস্তুত হয়ে নিলাম। Reception-এ বলে রাখা হলো যে কনও মেসেজ এলে সেটা নোট করে খালেদ ভাইয়ের বাসার নম্বরে জানিয়ে দিতে। এসব ব্যবস্থা খালেদ ভাই যেভাবে করলেন তাতে মনে হল তিনি হোটেল ম্যানেজমেন্ট-এর কাছে সুপরিচিত।
বাসায় ভাবী খাওয়া-দাওয়ার বিশাল আয়োজন করেছেন। এক পর্যায়ে ভাবী বললেন
আমাদের গরীবখানা থাকতে হোটেলে উঠলেন কেনও! কিছুটা বিব্রত হয়ে জবাব দিলাম
স্বেচ্ছায় তো উঠিনি, ইসলামাবাদের কর্তারাই সব ব্যবস্থা করেছেন। খাওয়ার পাট শেষে ভাবী কাওয়া পরিবেশন করে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন। বসার ঘরে কোয়েটা ষ্টোভ জ্বলছে। টাকে ঘিরে বসলাম তিন বন্ধু। তা হঠাৎএ ভাবে এখানে? প্রশ্ন করলেন খালেদ ভাই।
বিশেষ প্রয়োজনের তাগিদেই আমাদের এভাবে আসতে হল। কারণটা মূলত বাংলাদেশসহ এই উপমহাদেশের মুসলমানদের সমস্যা। বিশেষ ভাবে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমানদের কঠিন সমস্যা।আগামী নির্বাচনে খালেদা জিয়াকে জেতাতে না পারলে বাংলাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে ভারতের দাসত্বের জিঞ্জিরে আবদ্ধ হয়ে পড়বে যদি আওয়ামীলীগ সরকার গঠন করে। তার জন্য হযরতজীর দোয়া চাইতে এসেছি আপনার মাধ্যমে। ঐশ্বরিক কৃপা ছাড়া শুধুমাত্র জাগতিক সাহায্য-সহযোগিতায় খালেদা জিয়াকে জেতানো প্রায় অসম্ভব। তাই নিরুপায় হয়ে তার দোয়ার জন্য আপনার দ্বারস্থ হয়েছি। জানিনা হযরতজী আমাদের সাথে সাক্ষাৎ করবেন কিনা। কিন্তু ভাই, আপনাকে বিশেষভাবে চেষ্টা করতে হবে। বিশ্বাস করুন খালেদ ভাই, এই পুরো ব্যাপারে আমি আর রব্বানি জড়িত হয়ে পড়লেও এতে আমাদের কোনও ব্যক্তিগত স্বার্থ নেই। সব শুনে খালেদ ভাই কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন অনেকটা ধ্যানমগ্ন অবস্থায়।
কি জানেন, রব্বানির ফোন পেয়েই আমি ছুটে গিয়েছিলাম হযরতজীর সাথে দেখা করতে। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হল, এই সময় তিনি সাধারণত শহরে থাকেন না কিন্তু তাকে পেলাম শহরের বাড়িতেই। যাওয়া মাত্রই তিনি স্মিত হেসে আমাকে বললেন, কি আমাকে এখানে দেখে বিস্মিত হচ্ছো তাই না? এখানে আমি বিশেষ এক প্রয়োজনেই অবস্থান করছি প্রতীক্ষায়। রহস্য সাধকের উক্তির জবাবে আমি তাকে জানালাম আমার দুই ঘনিষ্ঠ বন্ধু দেখা করে আপনার দোয়া চাইতে এসেছেন বিদেশ থেকে। কথা শেষ না করতেই তিনি বলে উঠলেন, অবশ্যই আমি তাদের সাথে দেখা করবো ঠিক হয়েছে কাল ফজরের পরই আপনাদের নিয়ে যেতে হবে তার সাথে সাক্ষাতের জন্য। তার মুরিদ হিসেবে কারও সাথে সাক্ষাৎদানের ব্যাপারেএই ধরনের উচ্ছ্বাস আগে কখনও দেখিনি। আমি বুঝতে পারলাম, তিনি আপনাদের প্রতীক্ষাতেই শহরে এসে অবস্থান নিয়েছেন।
আল্লাহ্‌পাকেরঅশেষকরুণা, তাঁর রহমতেই হযরতজী আমাদের সাথে সাক্ষাৎকোরতে রাজি হয়েছেন।
ঠিক তাই, রব্বানিও বললো। আপনারা দীর্ঘ সফরে নিশ্চয় ক্লান্ত। তাই শুয়ে পড়ুন। আমি ফজরের আজান হলে আপনাদের উঠিয়ে দেবো। নামাজের পরই আমরা গিয়ে পৌঁছাব হযরতজীর আস্তানায়। আমার কিছু এবাদত বাকি আছে। সেটা শেষ করে আমিও শুয়ে পড়বো। শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিলেন খালেদ ভাই। আধ্যাত্মিক রহস্য বোঝার মতো জ্ঞান আমাদের নেই, তবুও হযরতজী আমাদের সাথে সাক্ষাৎকরার সিদ্ধান্ত নেয়ায় আল্লাহ্‌ পাকের শুকরিয়া আদায় করে প্রশান্ত চিত্তে বিছানায় গা এলিয়ে দিলাম। সকালে ফজরের আজানের আগেই খালেদ ভাই এসে জাগিয়ে দিলেন। খালেদ ভাই বললেন, হযরতজীর হুকুম এসেছে নাস্তা তার ওখানেই করতে হবে। এটাও একটা অস্বাভাবিক ব্যতিক্রম দর্শনার্থীদের জন্য।সবি আল্লাহ্‌পাকের ইচ্ছা! আমরা তৈরি হয়ে নিলাম। যথাসময়ে পৌঁছালাম হযরতজীর বাসায়। ফজরের ওয়াক্ত, শহর এখনো জেগে ওঠেনি। রাস্তাঘাট ফাঁকা। একটা গলির ভেতরে প্রাচীর ঘেরাএকতলা বাড়ি, বসার ঘরটার মেঝে কার্পেট দিয়ে মোড়া। ঘরের মাঝখানে একটি খাটিয়াতে বসে আছেন হযরতজী। হাড়কাঁপানো ঠান্ডায় একটা ধোতি পরে খালি গায়ে বসে আছেন লম্বা সুঠামদেহী সাদা দাড়িতে মুখায়বব ঢাকা সুশ্রী এক জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ, কাঁধে সাদা পাগড়িটা রাখা। দেখে বয়েস কতো বোঝার উপায় নেই। মাথার চুল খুবই ছোট করে ছাঁটা। এই শীতেও তিনি অনবরত ঘামছেন আর কাঁধের পাগড়ির কাপড়টা দিয়ে মুছে নিচ্ছেন শরীর কিছুক্ষণ পর পর। এর আগে এই ধরনের কোনও সূফি সাধকের সংস্পর্শে আসার সুযোগ হয়নি। আমরা খালেদ ভাইকে সব ব্যাপারে অনুসরণ করে চলেছি। ঘরে ঢুকেই আমরা মেঝেতে বিছানো কার্পেটের উপর বসে পড়লাম। অর্ধনিমীলিত চোখে ধ্যানস্থ অবস্থায় বসে আছেন হযরতজী। কিছুক্ষণ পর হযরতজী আমাদের দিকে চাইলেন। His bright beaming eyes were absolutely piercing! খালেদ ভাই অত্যন্ত আদবের সাথে তার কাছে গিয়ে নিচু স্বরে আমাদের পরিচয় জানালেন। রব্বানির পরনে সালওয়ার কামিজ আর আমার পরনে পায়জামা-কুর্তা। দু’জনই উপরে চাদর জড়িয়ে নিয়েছিলাম। এতো নিচু স্বরে তারা কথা বলছিলেনযার কিছুই আমরা শুনতে পারছিলাম না। সব শুনে তিনি আমাকে ইশারায় কাছে ডেকে নিয়ে খাটিয়াতে তার পাশে বসিয়ে ডান হাত দিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। খালেদ ভাই তার পায়ের কাছে বসে রব্বানিকে তার পাশে বসতে ইশারা করলেন।আমার কাঁধে হাত রেখেইহযরতজী সস্নেহে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার কেনো এসেছো?
হুজুর, আমরা কোনও ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে আপনার কাছে দোয়া নিতে আসিনি।এই উপমহাদেশের মুসলমানদের বিশেষ করে বাংলাদেশের ১৪ কোটি মুসলমানের স্বকীয়তা বজায় রাখার স্বার্থে আপনার দোয়া চাইতে এসেছি। কি সমস্যা? হুজুর, আগামী নির্বাচনে যাতে বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বের জোট জিততে পারে তার জন্য আপনাকে দোয়া করতে হবে। কোনোক্রমে যদি ভারতের প্রতিভূ শেখ হাসিনা নির্বাচনে জিতে সরকার গঠন করতে সক্ষম হয় তবে ১৪ কোটি মুসলমান পৌত্তলিকদের গোলামির জিঞ্জিরে অনির্দিষ্টকালের জন্য শৃঙ্খলিত হয়েপড়বে।দেশটি পরিণত হবে ভারতের একটি করদ রাজ্যে। ভারত বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে সাহায্য করেছেতাদেরএক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নের মাধ্যমে তাদের লালিত স্বপ্ন ‘অখণ্ড ভারত’পুনঃপ্রতিষ্ঠার লক্ষে। যুদ্ধকালীন সময় থেকেই আমরা সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত ভাবে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের সংগঠনের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করানোর পর তার বিশ্বাসঘাতকতায় আমাদের সব পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়ে যায়। সে এক করুণ উপাখ্যান। যদিও বেগম খালেদা জিয়া তারই স্ত্রী তবুও দেশওজাতির বৃহত্তর স্বার্থে বিকল্প হিসেবে তার বিজয়ের জন্যই আপনাকে আল্লাহ্‌পাকের রহমত হাসিল করার জন্য দোয়া করতেই হবে হুজুর। আমি আমার আর্জি পেশ করার সময় হয়তো কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েছিলাম। তাই নিজের অজান্তেই চোখ দিয়ে পানি ঝরে পড়ছিলো। সব শুনে হযরতজী আমাকে আরও কাছে টেনে নিয়ে বললেন
বেটা কেঁদো না, আল্লাহ্‌ নিশ্চয় মেহেরবান। তিনি অবশ্যই আমাদের এই সাক্ষাতের সাক্ষী। তোমরা নাস্তা করো, আমি আসছি।বলেই দ্রুত উঠে ভেতরে চলে গেলেন হযরতজী।
কিছুক্ষণের মধ্যেই বিভিন্ন রকম খাবার পরিবেশিত হল। আমিও এরই মধ্যে নিজেকে সামলে নিয়েছি। মাথা নিচু করে চুপ করে বসেছিলেন খালেদ ভাই এবং রব্বানি। রব্বানির চোখও অশ্রুসিক্ত।নাস্তা পরিবেশিত হবার পর খালেদ ভাই আহ্বান জানালেন নাস্তা করার জন্য। নাস্তা শেষে আমি খালেদ ভাইকে জিজ্ঞেস করলাম, হযরতজী কি ফিরে আসবেন? অবশ্যই বিদায় জানাতে আসবেন। এখন তিনি ভেতরে ধ্যানে বসেছেন। আমাদের অপেক্ষা করতে হবে যতক্ষণ না তিনি ফিরে আসেন। যাবার আগে হযরতজী আমাকে দুই দুইবার জিজ্ঞেস করেছিলেন তুমি চাও কে জিতুক? আমি জবাবে দুইবারই বলেছিলাম বেগম খালেদা জিয়া। নাস্তা শেষে পরিচারকরা সব উঠিয়ে নিয়ে গেলো ভেতরে। আমরা নিশ্চুপ বসে থাকলাম তার ফেরার অপেক্ষায়। বেশ কিছু সময় পর পর্দা সরিয়ে হযরতজী ঘরে ঢুকলেন। তার চোখে জ্বলন্ত আগুন! সারা গা থেকে দরদর করে ঘাম ঝরে পড়ছে! তাকে দেখে স্বাভাবিক মনে হচ্ছিলো না। বললেন ইন শা আল্লাহ্‌ খালেদা জিয়াই জিতবেন নির্বাচনে। এর জন্য আল্লাহ্‌র রহমত ছাড়া প্রয়োজনীয় জাগতিক সব সাহায্য-সহযোগিতাও পাবেন তিনি আল্লাহ্‌র ইচ্ছায়। ভরাডুবি হবে ফিতনা হাসিনার। তবে বাংলাদেশ থেকে কেউ এসেছিলো এক বিয়েতে। সে বললো, বাংলাদেশের অবস্থা ভালো না। রক্তারক্তি হবে সেখানে, অনেক লোক বর্ডারের এপাশ থেকে ওপাশে যাবে আসবেও অনেকেই। এই অবস্থায় আমি তাকে বলেছি এখানেই থেকে যেতে। তোমাকেও আফ্রিকা ছেড়ে আরও কাছে অবস্থান নিতে হতে পারে। এবার তোমরা যেতে পারো। আমাকে গোসল করতে হবে।
পরে খালেদ ভাই আমাদের জানিয়েছিলেন শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা, সব ঋতুতেই দিনে ১৮/২০ বার ঠাণ্ডা পানি দিয়ে গোসল করে থাকেন এই সাধক মহাপুরুষ। আর তার শরীরের উপরের অংশ সব সময় খালি থাকে দিবারাত্রি। জীবনে এর আগে এমন একজন অলি-আল্লাহ্‌র সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়নি আমার। এক অদ্ভুত শিহরণ মূলক অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এলাম খালেদ ভাইয়ের বাসায়। বাড়িতে আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল আর এক বিস্ময়! ভিতরে প্রবেশ করা মাত্র ত্রস্তে ভাবী এসে জানালেন PC থেকে ঘন ঘন ফোন আসছে। তাদের প্রধানমন্ত্রীর অফিস থেকে বলা হচ্ছে, আমরা যেখানেই থাকিনা কেনো যোগাযোগ করে খবর দিতে আমরা যাতে অনতিবিলম্বে ইসলামাবাদ ফিরে আসি। প্রধানমন্ত্রী আমাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। অদ্ভুত যোগাযোগ! খালেদ ভাই মুচকি হেসে বললেন, সব ঠিক হয়ে যাবে। চলুন আপনাদের হোটেলে পৌঁছে দিয়ে আসি। ভাবীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে ফিরলাম হোটেলে। আমাদের দেখে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন ম্যানেজার। ঠিক সেই সময় আবার ফোন এল ইসলামাবাদ থেকে। জানিয়ে দিলাম আমরা রওনা হচ্ছি এক্ষুনি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ইসলামাবাদ পৌঁছাব। আমাকে বলা হল সোজা প্রধানমন্ত্রীর দফতরেই যেন আসি। তথাস্তু বলে ফোন রেখে দিলাম। এরপর খালেদ ভাইকে সব কিছুর জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় নিয়ে রওনা হবো- ঠিক তখন খালেদ ভাই বললেন নির্বাচনে বিজয়ের পর পেশাওয়ারে সপরিবারে আসতে যাতে না ভুলি। অবশ্যই আসবো প্রতিজ্ঞা করে বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের গাইডের সবকিছুই চেনা। তাই ঝড়ের গতিতে সতর্কতার সাথে পৌঁছালো প্রধানমন্ত্রীর দফতরে।
চৌধুরী সুজাত এবং নওয়াজ শরিফ দুইজনই অপেক্ষায় ছিলেন। আমাকে সাদর অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গিয়ে তারা জানালেন, বেগম খালেদা জিয়াকে জানিয়ে দিতে নির্বাচনের জন্য অর্থ সংকুলান এবং সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতা প্রদানের জন্য উপযুক্ত উদ্যোগ গ্রহণ করবে পাকিস্তান সমন্বয়কারীর ভূমিকা পালন করে।সেই সিদ্ধান্তই হয়েছে NSC এর বৈঠকে ISI এবং ঢাকাস্থ দূতাবাসের বিশ্লেষণের বিপরীতে আমার উপস্থাপনার অনুকূলে। দু’জনকেই কৃতজ্ঞতার সাথে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম।
করাচীর উদ্দেশ্যে যাত্রা
রব্বানির সাথে পরামর্শ করে সিদ্ধান্ত নিলাম সেই রাতেই করাচী পৌঁছে সেখান থেকেই সুখবরটা খালেদা জিয়াকে জানাবো।হোটেলে ফেরার পর ব্রিগেডিয়ার রফি স্বয়ং ফোন করেডিনারে ডাকতে চাইলেন। বিনয়ের সাথে তাকে জানালাম, সন্ধ্যার ফ্লাইটেই করাচী চলে যেতে হচ্ছে, তাই এবারের মতো ক্ষমা করতে হবে। সব শুনে তিনি বললেন, তাহলে দুপরের লাঞ্চে নিয়ে যেতে আসছেন তিনি স্বয়ং। আর না বলা ঠিক হবে না, পুরনো সম্পর্ক। তাই রাজি হলাম। তিনি আমাকে নিয়ে গেলেন পিণ্ডির ফ্ল্যাশম্যান হোটেলে। আমাদের সময় এটাই ছিল পিণ্ডিতে একমাত্র বিনোদনের জায়গা। পথে যেতে যেতে ব্রিগেডিয়ার রফি পকেট থেকে একটা ফটো বের করে দেখালেন। ফটোটা কোয়েটাতে তার বাসায় ভাবীর সাথে তোলা। ফটোটা দেখিয়ে ব্রিগেডিয়ার রফি পুরনো দিনের স্মৃতিকে তাজা করে তুললেন। খাওয়ার পর ফেরার পথে ব্রিগেডিয়ার রফি রসিকতা করে বললেন এক্সেলেন্সি, তুমি তো আমাদের নাক কেটে দিয়ে গেলে। তবে মন থেকে দোয়া কোরব তোমার প্রচেষ্টার ফলে বেগম খালেদা জিয়া যেন জয়ী হন।হোটেলে পৌঁছে দিয়ে বিদায় নিয়ে চলে গেলেন ব্রিগেডিয়ার রফি।
সন্ধ্যার ফ্লাইটে করাচী পৌঁছালাম। গোপনীয়তার জন্য ম্যারিয়ট হোটেলে রব্বানির নামে একটা রুম বুক করা হল। রাত্রিতে শুধু ঘুমাব এখানে। বাকি সময় কাটবে বন্ধু-বান্ধবদের সাথে দেখা সাক্ষাত এবং রব্বানির বাসায় তার পরিবারের সাথে। ঠিক করা হল, বিশ্বস্ত বন্ধু শেখ ওবায়েদ-এর অফিস থেকে সকালে স্পর্শকাতর খবরটা খালেদা জিয়াকে জানান হবে।রব্বানি শেখ ওবায়েদের সাথে যোগাযোগ করে সব ব্যবস্থা করে নিলো। সকালে গিয়ে উপস্থিত হলাম শেখ ওবায়েদের অফিসে নির্ধারিত সময়ে।করাচীতে একজন প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায়ী এবং শিল্পপতি ধনকুবের শেখ ওবায়েদ। অভিজাত অফিস পাড়ায় বিশাল অফিস। রুচিশীল ভাবে সাজানো। আমরা পৌঁছাতেই সাদর সম্ভাষণ জানালেন শেখ ওবায়েদ।এভাবে কোনও খবর না দিয়ে হঠাৎকরাচীতে কি ব্যাপার? এক্সেলেন্সি একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ গোপন মিশনে আমাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলো।গতরাতেই ফিরেছি ইসলামাবাদ থেকে। জবাব দিলো রব্বানি। দুই এক দিন থাকবো করাচীতে, তারপর ফিরে যাব নাইরোবিতে। কিন্তু তোমার সাথে শুধু দেখা করতে আসিনি, বিশ্বস্ত বন্ধু হিসাবে একটা বিশেষ প্রয়োজনও রয়েছে। তোমার অফিস থেকে দেশে-বিদেশে তোমার সিকিওরড লাইনে কয়েকটা ফোন করবেন বন্ধুবর এক্সেলেন্সি, যদি তোমার কোনও অসুবিধা না হয়। করাচীতে অনেক পরিচিত বন্ধু-বান্ধব থাকা সত্ত্বেও তোমার অফিসটাই সবচেয়ে নিরাপদ মনে করে এক্সেলেন্সিকে নিয়ে এলাম।
রব্বানির কথা শুনে হাস্যে ওবায়েদ বললেন Excellency, you are most welcome. পাশের ঘরেই রয়েছে আমার পার্সোনাল সিকিওরড লাইন, যখনই প্রয়োজন হবে আপনি এই লাইনটা ইচ্ছেমতো ব্যবহার করতে পারবেন। আমি অফিসে থাকি আর না থাকি তেমন ব্যবস্থাই করে দেয়া হবে।
সব শুনে আমি বললাম অপূর্ব! আমিতাহলেএখনইআপনার পাশের ঘরে যেতে ইচ্ছুক।
নিশ্চয়ই,আসুন।
তিনজনই গিয়ে ঢুকলাম পাশের ঘরে। ছিমছাম একটা প্রাইভেট চেম্বার। টেবিলে সাজানো রয়েছে ৪/৫ টা বিভিন্ন রঙের টেলিফোন সেট। একটা লাল সেটের দিকে ইঙ্গিত করে ওবায়েদ বললেন, এটাই ব্যবহার করবেন আপনি। ঘরটি সাউন্ডপ্রুফ। আমি আর রব্বানি দুটো চেয়ারে বসে পড়লাম। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী শেখ ওবায়েদ বুঝতে পারলেন আমরা কাজ শুরু করতে চাচ্ছি, তাই তিনি বললেন আমি পাশের ঘরেই থাকছি। প্রয়োজনে ডেকে পাঠাবেন। চলে গেলেন শেখ ওবায়েদ। লালফোনটার রিসিভার হাতে উঠিয়ে নিয়ে ডায়াল করলাম। প্রথম চেষ্টাতেই লাইন কানেক্ট হয়ে গেলো। অন্যপ্রান্তে কেউ একজন ফোন রিসিভ করে বললেন হ্যালো। গলার স্বর শুনে মনে হল কর্নেল মুস্তাফিজুর রাহমান।
আসসালাম, আমি মোহাম্মদ বলছি। ম্যাডামের সাথে কথা বলতে চাই।
ওয়ালাইকুম আসসালাম, প্লিজ ধরুন তাকে দিচ্ছি।
কয়েক মুহূর্তের মধ্যে অপর প্রান্ত থেকে খালেদা জিয়া সালাম জানালেন। কুশলাদি বিনিময়ের পর তাকে জানালাম নির্বাচনের জন্য যত টাকা এবং অন্যান্য যেকোনো সাহায্য-সহযোগিতার প্রয়োজন হবে সেটা আপনি পাবেন। তার ব্যবস্থা হয়ে গেছে। দু’এক দিনের মধ্যেই লোকজন সার্বিক বিষয়ে আলোচনার জন্য আপনার সাথে মোহাম্মদের রেফারেন্স দিয়ে দেখা কোরবে। আমার পক্ষে যতটুকু সম্ভব সেটা আমি কোরলাম। আশা করছি জামায়াতসহ ইসলামী মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী অন্যান্য ছোট ছোট দলগুলোও আপনার সাথে নির্বাচনী জোট বাধবে। তাদের জন্যও আর্থিক সাহায্যের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ইন শা আল্লাহ্‌ বিজয় আপনার হবেই। বিজয়ের পর ইচ্ছে হলে যোগাযোগ কোরবেন। নির্বাচনের আগে বিশেষ প্রয়োজন না হলে আমি আর যোগাযোগ কোরব না। আল্লাহ্‌র রহমতে আমাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যর্থ হবে না। কারণ, এই নির্বাচনের ফলাফলের সাথে জড়িত রয়েছে ১৪ কোটি ধর্মপ্রাণ বাংলাদেশীর ভাগ্য। শেষ করার আগে একটি কথা,
জেনারেল এরশাদকে কোনোও বিষয়েই আপনার বিশ্বাস করা ঠিক হবে না। কারণ, তিনি আওয়ামীলীগ এবং ভারতীয় বলয়ে বাঁধা। রাব্বুল আলামীন আপনাকে সুস্থ ও নিরাপদ রাখুন আর বিজয় প্রদান করুন সেই দোয়া করছি।
ভাই, আপনার নিঃস্বার্থ এই অবদান আমার চিরকাল মনে থাকবে। আমি আজীবন কৃতজ্ঞ থাকবো আপনার কাছে। তাকে কথা বাড়াতে না দিয়ে বললাম
ভাবী,আমি আমাদের সবার তরফ থেকে যাই কোরেছি সেটা আপনার ব্যক্তিগত স্বার্থে নয়, সেটা আমরা করেছি দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। আল্লাহ্‌ হাফেজ।বলে লাইন কেটে দিলাম। এরপর ইসলামাবাদে জানিয়ে দিলাম বেগম খালেদাকে সুখবরটা জানিয়ে দেয়া হয়েছে। পাশের ঘরে ফিরে দেখি বন্ধু শেখ ওবায়েদ চা-নাস্তার আয়োজন করে অপেক্ষা করছেন। চা-নাস্তা খেতে খেতে গল্প গুজব করে নিজেদের হাল্কা করে নিয়ে তাকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানিয়ে বললাম ওবায়েদ ভাই! আপনি আজ একটি ঐতিহাসিক ঘটনার একজন সাক্ষী হয়ে গেলেন। বিশ্বস্ত বন্ধু শেখ ওবায়েদ জানতে চাইলেন
কিভাবে?
যদি কোনোদিন আমার বই ছাপা হয়, সেখানে আপনার আজকের অবদানের কথাও লেখা থাকবে। শেখ ওবায়েদকে কিছুটা বিস্মিত দেখে রব্বানি বললো
ধীরেবন্ধু ধীরে, সময়মতো সবই বুঝতে পারবে। আমরা এবার বিদায় নেবো। বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম ওবায়েদের অফিস থেকে।
আমাদের মিশন এতো সহজেই ফলপ্রসূ হবে সেটা অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছিলো। বৃহত্তর স্বার্থে, ন্যায়-এর জন্য এক পা এগুলে আল্লাহ্‌ পাক সহযোগিতার জন্য দশ পা এগিয়ে আসেন। এ যেন পবিত্র কোরআনের সেই উক্তিরই বাস্তব প্রতিফলন! পরদিন ইসলামাবাদ থেকে জানানো হল, ইতিমধ্যেই সংশ্লিষ্ট লোক ঢাকায় বেগম খালেদা জিয়ার সাথে একান্তে সাক্ষাত করে টাকার যোগানসহ কি করে পরিকল্পনার সব কিছু বাস্তবায়ন করা হবে সেই বিষয়ে সব ব্যবস্থা চূড়ান্ত করে ফেলেছেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজও শুরু হয়ে গেছে। আর্থিক এবং অন্যান্য সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা হওয়ায় খালেদা জিয়ার নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন জোয়ার সৃষ্টি হল দেশজুড়ে। সৃষ্টি হল নির্বাচনী জোট। নির্বাচনী বাতাস বুঝে জেনারেল এরশাদ যাতে খালেদা জিয়ার জোটের প্রতি ঝুঁকে না পড়েন তার একটা পাকা ব্যবস্থা করার জন্য হাসিনা জোর দাবি তোলে, স্বৈরাচারী এরশাদকে সাব জেল এ রাখা চলবে না, তাকে অবিলম্বে নাজিমুদ্দিন রোডের লাল ঘরে পাঠিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করতে হবে। ফলে বিচারপতি সাহাবুদ্দীনের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এরশাদকে সাব জেল থেকে শ্রীঘরে পাঠাতে বাধ্য হন। চরম এরশাদ বিরোধী জনমতের পরিপ্রেক্ষিতে খালেদা জিয়া নির্দলীয় সরকারের এই সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা থেকে স্বাভাবিক কারণেই বিরত থাকেন।
জেলবন্দী অবস্থাতেই জেনারেল এরশাদ নির্বাচন করার সিদ্ধান্ত নেন। এ ছাড়া নিজেকে বাঁচানো এবং রাজনৈতিক ভাবে জীবিত থাকার অন্য কোনও উপায় ছিলনা তার।
আমাদের বন্ধুদের হেদায়েত মতো জামায়াত এবং অন্যান্য ইসলাম পছন্দ ও জাতীয়তাবাদী ছোট ছোট দলগুলো বিএনপির সাথে নির্বাচনী জোট বাঁধে।ফলে বিএনপির সাংগঠনিক দুর্বলতার ঘাটতিও বেশ কিছুটা দূর হয়।এই সমস্ত যোগ-বিয়োগ ছাড়াও আপোষহীন নেত্রী হিসাবে বেগম খালেদা জিয়ার যে ভাবমূর্তি সৃষ্টি হয়েছে তার ফলে জনজোয়ার যে খালেদা জিয়ার পক্ষেই যাবে সে সম্পর্কে আমি নিশ্চিত ছিলাম। সেই জোয়ারেই খালেদা জিয়ার জোটের বিজয় হবে।
ফিরে এলাম নাইরোবিতে
নাইরোবিতে আমরা ফিরে এসেছি। এখন নির্বাচনের অপেক্ষায় দিন গুণে যাওয়া ছাড়া আর কিছুই করার নেই। মাঝে একদিন সেনাসদর থেকে খবর পেলাম এরশাদের অনেক সাঙ্গপাঙ্গকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয়া হয়েছে। অনেককেই দুর্নীতির মামলায় জেলেপুরা হয়েছে। জেনারেল এরশাদের বিশ্বস্ত DGFI জেনারেল আশরাফ এবং DG NSI ব্রিগেডিয়ার নাসেরকে আর্মি থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে তাদের বিভিন্ন গর্হিত কীর্তিকলাপের জন্য। জেনারেল এরশাদের সকল কুকর্মের শিরোমণি ছিল এই দুই অফিসার। আরও জানতে পারলাম বিচারপতি সাহাবুদ্দীন নিরপেক্ষ সুষ্ঠু নির্বাচন করার লক্ষে ভোটারদের নিরাপত্তার জন্য সেনা মোতায়নের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। প্রশাসনকে নির্দলীয় করণের জন্য আমলাতন্ত্রে রদবদল করা হচ্ছে। জাতিসঙ্ঘ সহ উন্নতবিশ্বের প্রায় সবদেশই পর্যবেক্ষক পাঠাতে রাজি হয়েছে।দেশে নির্বাচনী জোয়ারের সৃষ্টি হয়েছে। সর্ববিবেচনায় খালেদা জিয়াই জয়ী হয়ে পরবর্তী সরকার গঠন করবেন বলেই সব মহলের অভিমত। বিদেশেও বিভিন্ন দেশের ক্ষমতা বলয়ে খালেদা জিয়ার প্রতিই সহানুভূতি পরিলক্ষিত হচ্ছে। সেই সময় রব্বানির এক পুরনো সহকর্মী জনাব সাইদউদ্দিন সিদ্দিকি, হাবিব ব্যাঙ্কের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ঢাকায় কান্ট্রিহেড হিসাবে পোস্টেড ছিলেন। তিনিই রব্বানিকে বলেছিলেন, ‘৯১ সালের নির্বাচনকালে বিদেশের বিভিন্ন একাউন্ট থেকে কোটি কোটি টাকা আসতো আর সেই টাকা উঠিয়ে নিতেন বেগম খালেদা জিয়া। একই ভাবে জামায়াতে ইসলামীসহ খালেদার নেতৃত্বাধীন জোটের শরিকদের জন্যও বিদেশ থেকে এসেছে হাবিব ব্যাঙ্কে মোটা অঙ্কের টাকা বিভিন্ন দেশ থেকে।
এই অর্থের সংকুলানের পর নির্বাচনী প্রচারণায় ভারতের মদদপুষ্ট আওয়ামীলীগ জোটের মোকাবেলা করা সম্ভব হয়ে ওঠে খালেদা জিয়ার জোটের পক্ষে। জনসমর্থন ক্রমশ খালেদা জিয়ার জোটের প্রতি বাড়তে থাকে। যতই দিন এগুচ্ছে খালেদার জোটের বিজয় প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠছে। সব মহল থেকে তেমন আভাসই পাওয়া যাচ্ছে। অবশেষে সব প্রতীক্ষার পর এল নির্বাচনের দিন।সকাল থেকে আমি ও রব্বানি আল্লাহ্‌র নাম নিয়ে পরদিন রাত পর্যন্ত খাতা-কলম হাতে টেলিফোনের মাধ্যমে ভোটিং প্যাটার্ন এবং সেই হিসাবে সিটের হিসাব-নিকাশ করতে থাকলাম। বাংলাদেশের ইতিহাসে এটাই ছিল সবচেয়ে ফ্রি আর ফেয়ার ইলেকশন। অনেক সিটের ব্যবধানে বিজয়ী হল বিএনপি জোট। নির্বাচনের অফিসিয়াল ফলাফল ঘোষিত হলে বিএনপি জোট সরকার গঠন করবে সেটাই বাস্তব সত্যে পরিণত হল। এই বিজয়ে বিস্মিত হয়ে গেল আওয়ামীলীগ জোট এবং ভারতের চাণক্যরা। তাদের নিশ্চিত বিজয় বিএনপি জোট এভাবে ছিনিয়ে নিতে পারে সেটা তাদের জন্য ছিল কল্পনাতীত। এই অপ্রত্যাশিত পরাজয় কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না আওয়ামীলীগ নেত্রী শেখ হাসিনা। এরশাদের সমর্থনও ছিল সুনিশ্চিত। তারপরও ভরাডুবি হল কি করে আওয়ামীলীগের! সেটাই ভাবিয়ে তুলেছিল ভারতকে। অফিসিয়াল রেজাল্ট বের হবার আগেই হাসিনা এক প্রেস কনফারেন্সে হাস্যকর অভিযোগ তুললেন নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপি’ হয়েছে। কিন্তু তার অভিযোগ ধোপে টিকল না। তখন প্রতিহিংসা পরায়ণ হাসিনা ঘোষণা দিলেন সরকারকে এক মুহূর্তের জন্যও শান্তিতে থাকতে দেয়া হবে না। গণতান্ত্রিক মানসিকতার এক বিচিত্র বহিঃপ্রকাশ!
ফোন আসা শুরু হল বেইজিং, রিয়াদ, আবুধাবি, দুবাই, ত্রিপলি, কাতার, তেহরান এবং ইসলামাবাদ থেকে। বন্ধুরা সবাই আমার বিচার-বিশ্লেষণের সত্যতা বাস্তবে প্রমাণিত হওয়ায় সানন্দে অভিনন্দন জানালেন। খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করেই আমাকে ঢাকায় জরুরী ভিত্তিতে ডেকে পাঠালেন সপরিবারে। জবাবে বললাম ঢাকায় আসার পথে বিভিন্ন দেশের বন্ধুবান্ধব যারা আন্তরিকভাবে সাহায্য সহযোগিতার জন্য কাজ করেছেন দের ধন্যবাদ জানিয়ে আসতে চাই। তিনি জবাবে বললেন অবশ্যই। নিম্মিকে সাথে নিয়ে যাবার জন্য আবারও অনুরোধ জানালেন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া। রব্বানিকে অনুরোধ করলাম আমার সাথে ঢাকা যাওয়ার জন্য। কিন্তু রব্বানি যুক্তি দিয়ে বুঝিয়ে দিলো ঠিক এই মুহূর্তে তাকে প্রকাশ্যে ঢাকায় নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না। পরে উপযুক্ত সময় ঢাকা যাবার বিষয়ে চিন্তা-ভাবনা করা যাবে। আমরা দু’জনই আমাদের সব প্রচেষ্টার সফলতায় তৃপ্ত এবং স্বস্তি বোধ করছিলাম। কিন্তু নিম্মি এই বিজয় সম্পর্কে একেবারেই ভাবলেশহীন। রব্বানি তার প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করে জিজ্ঞেস করল কি ব্যাপার নিম্মি, মনে হচ্ছে খালেদা জিয়ার বিজয়ে তুমি একেবারেই নির্বিকার! জবাবে নিম্মি তার পূর্ব অবস্থানে অনড় থেকে বললো
আমি এখনো একই কথা বলবো। নিম্মির অভিব্যক্তিতে আমরা দু’জনই কিছুটা বিস্মিত ও বিমর্ষ হলাম। স্বল্পভাষিণী নিম্মির অতীতের সব কথাই সত্য বলে প্রমাণিত হয়েছে, বিশেষ করে মানুষ চেনার ক্ষেত্রে। তাই তার সাথে বিতর্কে যাবার Moral courage আমাদের ছিলো না।
ঢাকায় পৌঁছালাম
ঢাকায় পৌঁছে বেগম খালেদা জিয়র সাথে যোগাযোগ করতেই তিনি সেই রাতেই তার ক্যান্টনমেন্ট-এর বাড়িতে রাতের খাওয়ার দাওয়াত দিলেন। নিম্মিকে তার দাওয়াতের কথা বললাম। নিম্মি পরিষ্কার জানিয়ে দিলো তার পক্ষে যাওয়া সম্ভব নয়। জানাই ছিল সে খালেদা জিয়ার দাওয়াতে যাবে না। সুতরাং যথাসময়ে আমি একাই গিয়ে পৌঁছালাম শহীদ মইনুল রোডের বাড়ীতে। সেখানে আমাকে অভ্যর্থনা জানালো কমবয়সী এক তরুণ। পরিচয় দিল সে খালেদা জিয়ার একান্ত সচিব, নাম মোসাদ্দেক ওরফে ফালু। বসার ঘরে বসিয়ে দাঁত বের করে বিগলিত ভাবে জানাল ম্যাডাম সুগন্ধার অফিস থেকে বেরিয়ে পরেছেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবেন। কেনও যেন প্রথম দেখাতেই ছেলেটাকে তেমন পছন্দ হয়নি। তাই গায়ে পড়ে যখন আলাপ জমাতে জিজ্ঞেস করলো, ‘ভাবী এলেন না?’ তখন বিরক্ত হয়েই তার কথার জবাব না দিয়ে বললাম, ‘আপনি আসুন, আমি অপেক্ষা করছি’, বলে টেবিলের উপর রাখা ম্যাগাজিনগুলো থেকে একটা তুলে নিয়ে মুখ ঢাকলাম। বেরিয়ে গেল ফালু।
কয়েক মিনিটের মধ্যেই বেগম খালেদা জিয়ার গাড়ীবহর গেট দিয়ে ঢুকছে বুঝতে পারলাম।
গাড়ী থেকে নেমে সোজা আমি যেই ঘরে বসেছিলাম সেখানেই এসে ঢুকলেন তিনি। আমি সোফা থেকে উঠে সালাম জানালাম। তিনি সালামের জবাব দিয়ে আমাকে বসতে বলে নিজেও পাশের সোফায় বসে জিজ্ঞেস করলেন, কই নিম্মি এলো না?’ কিছুটা অপ্রস্তুত হয়ে বললাম দীর্ঘসফরের ধকলে অসুস্থ হয়ে পরায় ও আসতে পারেনি। তার এই অপারগতার জন্য আমাকে ক্ষমা চেয়ে নিতে বলেছে নিম্মি আপনার কাছ থেকে। আপনারা তো বেশ কয়েকটা দেশ ঘুরে ঢাকায় এসে পৌঁছেছেন, জার্নির একটা ধকল তো থাকবেই। এবার বলুন কেমন হল আপনাদের সফর? ভালো। বন্ধু-বান্ধবদের ধন্যবাদ জানানোর দায়িত্বটা সম্পন্ন করার জন্যই ছিল এবারের সফর।আপনি যদি কিছু মনে না করেন তাহলে আলাপ-আলোচনার স্বার্থে একটি বিষয়ে আমি আপনার অভিমত জেনে নিতে চাই। আমার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে চেয়ে তিনি জানতে চাইলেন, কোন বিষয়ে? দেশের মাটিতে পা ফেলার পর থেকেই দেখছি সর্বত্র সবাই আপনাকে ‘ম্যাডাম’ বলে সম্বোধন করছে। কাকুলের দিনগুলো থেকে বরাবরই আমি আপনাকে ভাবী বলে সম্বোধন করে এসেছি। তাই বর্তমান অবস্থায় আপনাকে কি বলে সম্বোধন করবো সেটা ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার কথায় হেসে উঠলেন খালেদা জিয়া। এরপর কোনও দ্বিধাদ্বন্দ্ব ছাড়াই জবাব দিলেন আপনি আমাকে ভাবী বলেই ডাকবেন।
তার জবাবে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। ইতিমধ্যে গৃহপরিচারকদের একজন এসে জানালো খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। চলুন খাওয়ার পাটটা সেরে আসা যাক। তারপর আলাপ করা যাবে। অতি সাধারণ খাবার পরিবেশিত হয়েছে। মাছ, ভাত, ডাল, সবজি ইত্যাদি। আমার মতোই এ ধরনের সাধারণ খাবারই পছন্দ করতেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। খাওয়া শেষে আমরা ফিরে এলাম বসার ঘরে। একটা রুপোর রেকাবিতে পান ও রকমারি মশলা রাখা হয়েছে সাইড টেবিলে। বেগম জিয়া এবং আমি দুইজনই পছন্দসই মশলা তুলে মুখে দিলাম। মশলা চিবুতে চিবুতে তিনি সাইড টেবিলে রাখা কলিং বেলটি টিপলেন। ফালু এসে উপস্থিত হল। তিনি ফালুকে বললেন, যতক্ষণ আমি আছি কোনও ফোন কল যাতে তাকে না দেয়া হয়। হুকুম শুনে বেরিয়ে গেলো ফালু। আমার জন্য আপনি যা করেছেন ভাই তার জন্য আমি কৃতজ্ঞ কিন্তু তবুও ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোটো করবো না। আমি তো আপনার ব্যক্তিস্বার্থে কিছুই করিনি, যাই করেছি সেটা করেছি দেশ ও জাতীয় স্বার্থে আমাদের সবার সম্মতি ক্রমেই। ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী জনগণের বৃহত্তর অংশের ভোটে আপনি নির্বাচনে জিতেছেন। আমরাও একই চেতনায় বিশ্বাসী, সেই প্রেক্ষাপটে আপনার নির্বাচনী বিজয়ের জন্য আমরা সাধ্যমতো যতটুকু করেছি সেটা ছিল আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। তাই কৃতজ্ঞতাটা শুধু আমার একার প্রাপ্য নয়। নির্বাচনী খরচার যোগান এবং প্রাসঙ্গিক সাহায্য-সহযোগিতা দেবার জন্য যারা অগ্রণী হয়ে সক্রিয় ভূমিকা রেখেছেন তাদের মধ্যে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী মিয়া নওয়াজ শরিফ এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী চৌধুরী সুজাতের অবদান বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তারা দুইজনই আমার মাধ্যমে আপনাকে সালাম এবং আন্তরিক অভিনন্দন জানিয়েছেন। তারা আপনাকে পাকিস্তান সফরের নিমন্ত্রণও জানিয়েছেন। আমি মনে করি, আপনি সরাসরি এখান থেকেই এদের দুইজনকেই ফোনে কৃতজ্ঞতা এবং নিমন্ত্রণের জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে দিন। দুইজনেরই ব্যক্তিগত সিকিওরড হট লাইনের ফোন নাম্বার আমার কাছে আছে। তিনি রাজি হলেন। পাশে রাখা রেড টেলিফোনটির দিকে ইশারা করে বললেন- মিলিয়ে দিন নাম্বার দুটো। আমি দুটো নাম্বারই মিলিয়ে দিলাম। দু’জনের সাথেই স্বল্প আলাপের মাধ্যমে উষ্ণতার সাথেই শুভেচ্ছা বিনিময়, আন্তরিক ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানালেন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া। আলাপকালে নওয়াজ শরিফ তাকে আবারও সময়- সুযোগ মতো পাকিস্তান সফরের আমন্ত্রণ জানালেন। আমি নীরব সাক্ষী হয়ে শুনলাম তাদের কথোপকথন। আলাপ শেষে তিনি খানিকক্ষণ কি যেন ভাবলেন। পরে বললেন
একটা অনুরোধ কোরব? আমি জবাবে বললাম, নিশ্চয়ই।
আপনি সিনিয়র মিনিস্টার হয়ে আমার মন্ত্রিসভায় যোগদান করুন। প্রথমে টেকনোক্র্যাট কোটা থেকে,পরে বাই-ইলেকশনের মাধ্যমে নির্বাচিত করিয়ে নেবো। ঐ পদে অবস্থান করে আপনি আমাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করবেন। আপনার অন্য সাথীরাও বিএনপিতে যোগদান করতে পারেন। আপনাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ অভিজ্ঞ আস্থাভাজন সহকর্মীদের পাশে পেলে আমার ভীষণ সুবিধে হতো। দলে নিঃস্বার্থ, যোগ্য এবং নির্ভরযোগ্য বিশ্বস্ত লোকের প্রকট অভাব! তার আচমকা এমন অপ্রত্যাশিত প্রস্তাব আমাকে হতবাক করে দিলো! কেনও তিনি এই ধরনের একটা অগ্রহণযোগ্য প্রস্তাব করলেন! এর পেছনে যুক্তি কি হতে পারে সেটাই মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিলো। খালেদা জিয়া ভালভাবেই জানতেন সেনা পরিষদের বেঁচে থাকা শীর্ষ নেতারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই স্বাধীনতা উত্তরকালে ভারতের ষড়যন্ত্রমূলক নীলনকশা প্রতিহত করার জন্য সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক সংগঠন গঠন করতে ব্রতী হয়েছিলেন বিধায় জাতীয় রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত হয়ে পরেছিলেন। তাদের সেই প্রচেষ্টা এবং রাজনীতির সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানও।
কিন্তু ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঐতিহাসিক বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করার পর জেনারেল জিয়া সেনা পরিষদের রাজনীতি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে জাতীয় স্বার্থবিরোধী শক্তি আওয়ামী-বাকশালী এবং তাদের প্রভু ভারতের সাথে সমঝোতার রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন এবং অতি নৃশংসতার সাথে সেনা পরিষদের ক্ষমতা খর্ব করায় লিপ্ত হন, এটা প্রমাণ করার জন্য যে ১৫ই আগস্ট ‘৭৫-এর বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের নেতৃত্ব প্রদানকারী সেনা পরিষদের সাথে তিনি সম্পৃক্ত নন। কিন্তু অতি অল্প সময়েই তিনি বুঝতে পারেন সেনা পরিষদের রাজনৈতিক দর্শন, লক্ষ্য এবং পরীক্ষিত সহযোদ্ধাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে তিনি মারাত্মক ভুল করেছেন। এই হঠকারিতায় তিনি নিজের ক্ষমতার ভিতকেই ধ্বংস করে ফেলেছিলেন।
ফলে তিনি দেখতে পান ঘরে-বাইরে তার বিরুদ্ধে বিভিন্ন ষড়যন্ত্র ধূমায়িত হয়ে উঠছে। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে। সেই সন্ধিক্ষণে তিনি তার দ্বিতীয়বার চীন সফর কালে সেনা পরিষদের সাহায্য প্রার্থনা করে অতীতের ভুলভ্রান্তি ভুলে গিয়ে আবার একত্রে রাজনীতি করার প্রস্তাব দেন। কিন্তু সেই প্রস্তাব সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দের কাছে যুক্তিসঙ্গত কারণেই গ্রহণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়নি। তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যাত হওয়ায় তিনি সেনা পরিষদ এবং সংগঠনের শীর্ষ নেতাদের প্রতি আরও প্রতিহিংসা পরায়ণ হয়ে ওঠেন। নেমে আসে খড়গ। তার নিষ্ঠুর পাশবিকতায় সেনা পরিষদ সাংগঠনিক ভাবে দুর্বল হয়ে পড়ে।
কিন্তু এরপরও সেনা পরিষদের চেতনা ভিত্তিক সংগ্রামকে সম্পূর্ণ ভাবে স্তব্ধ করে দেয়া সম্ভব হয়নি। স্বৈরচারী এরশাদের পতন এবং খালেদার নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষেত্রে পর্দার অন্তরালে সেনা পরিষদের অবদান খালেদার কাছে সেটাই প্রমাণ করেছিলো। ফলে তিনি শঙ্কিত হয়ে উঠেছেন।
তিনি হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন, যথাসময়ে প্রয়োজনে দেশ ও জনস্বার্থে জেনারেল জিয়ার আসল রূপ, এরশাদের পতনের পেছনে বিশেষ অবদান ছিল কাদের এবং তার নির্বাচনে বিজয় সম্পর্কে সত্য তথ্য একমাত্র সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদের পক্ষেই প্রকাশ করা সম্ভব।তাই তিনি চেষ্টা করছিলেন ছলে-বলে-কৌশলে আমাদের তার অধীনস্থ করে রাখার। প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের চেষ্টা ছিল নিছক বাতুলতা মাত্র। কারণ ‘৭১-এর মুক্তিসংগ্রাম কালে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে যারা একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলেন প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী এবং সুখী এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষে সেই প্রত্যাশার সাথে শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে জেনারেল জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করলেও শেণা পরিষদের অন্য ত্যাগী পরীক্ষিত কোনও সদস্যদের পক্ষেই তেমনটি করা সম্ভব ছিল না। জবাব দিলাম ভাবী, আপনার অনুরোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই বলছি, বর্তমান অবস্থায় আপনার দলে যোগ দিলে কোনও পক্ষেরই বিশেষ লাভ হবে না। বরং আপনি আপনার ওয়াদা মতো মিথ্যা মামলার দায়ে সেনা পরিষদের অনেককেই এখনও যাদেরকে জেলবন্দী করে রাখা হয়েছে, তাদের আপনি মুক্ত করে দিন। একই সাথে বিদেশে যারা অবস্থান করছে তাদের স্বাধীন ভাবে দেশে ফিরে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দিন। সেটাই হবে দেশ, জাতী এবং আপনার স্বার্থে সার্বিক বিবেচনায় বেশি ফলদায়ক। মাঝপথে জেনারেল জিয়া আমাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নেবার সিদ্ধান্ত নেন যদিও মূলত তার রাজনীতি আর আমাদের রাজনীতির মধ্যে তেমন কোনও দ্বন্দ্ব নেই। যেমন ধরুন, তার ১৯ দফা, এটাও কিন্তু সেনা পরিষদের কর্মসূচি থেকেই নেয়া।আমাদের শত্রুপক্ষ অত্যন্ত শক্তিশালী এবং সুসংগঠিত।তারা শুধু আওয়ামীলীগ নয়, কয়েকটি প্ল্যাটফর্ম থেকে নিজেদের সহংগঠিত করছে। আমাদেরও সমমনা দুই-তিনটি সংগঠন গড়ে তোলা উচিৎ। আমরা আপনার নির্ভরযোগ্য সহায়ক শক্তি হিসাবে জাতীয় শত্রু ভারতীয় সেবাদাসদের বাংলাদেশের মাটি থেকে সমূলে উৎখাতকরার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে সংগ্রাম করে যাবো। সেনা পরিষদের নেতা-কর্মীদের প্রতিহিংসা পরায়ণ মনে করার কোনও কারণ নেই। ভাবী, আমি কিন্তু আন্তরিক ভাবেই বলছি, আমাদের আপনি প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করবেন না। আমাদের চিন্তা-চেতনা একই, শুধু লক্ষ্য হাসিলের পথটা ভিন্ন। অতীতের ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়ে সম্মুখে দেখতে হবে এবং ভবিষ্যতের জন্য ভাবতে হবে আমাদের। বিশেষ করে অতীতের তিক্ততা আমাদের ভুলে যেতে হবে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সুসংহত করার স্বার্থেই। এই সম্পর্কে বিশদ আর কিছু বলতে চাই না। কারণ, সংগঠন হিসাবে সেনা পরিষদ এবং এর নেতৃবৃন্দের নীতি-আদর্শ সম্পর্কে আপনি নিজেও বিশেষ ভাবে অবগত আছেন বলেই আমার বিশ্বাস। আপনি আজ দেশনেত্রী হিসাবে আখ্যায়িত, রাজনীতি সম্পর্কে জ্ঞান দান করার মতো বিজ্ঞজনের অভাব আপনার নেই। তারপরও কয়েকটা কথা বলতে চাই যদি কিছু মনে না করেন।
বলুন।
ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে কারো পক্ষেই বৃহত্তর বঞ্চিত ও শোষিত জনগোষ্ঠীর স্বার্থে কোনও দল কিংবা ত্যাগী নিঃস্বার্থ কর্মীবাহিনী গড়ে তোলা অতীতে কখনো সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। এটাই ঐতিহাসিক বাস্তবতা। নীতি-আদর্শ ভিত্তিক সংগঠন এবং কর্মীবাহিনী গড়ে তুলতে হয় সংগ্রামের মাধ্যমে। নানা মতের নানা পথের লোকজনদের নিয়ে একটি মোর্চা গঠন করা সম্ভব, তবে সাংগঠনিক ভাবে সেই মোর্চা দল হিসাবে কখনোই বলিষ্ঠ ভাবে গড়ে উঠতে পারে না অভ্যন্তরীণ মতবিরোধের কারণেই। ক্ষমতার লোভে যারা ভিড় জমায় তারা যে সবাই সুযোগ সন্ধানী সেটার অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই আপনার হয়েছে। বিগত নির্বাচনে বিএনপি বিজয় অর্জন করেছে সাংগঠনিক শক্তির বলে নয়। দেশের জনগণের বৃহত্তর অংশ বিএনপিকে নয়, ভোট দিয়েছে আপনাকে। কারণ, তারা আপনার মাঝে খুঁজে পেয়েছিলো স্বৈরাচার, ভারত বিরোধী জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের পক্ষে আপোষহীন একজন সংগ্রামী নেত্রী।
কিন্তু রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে আপনাকে আপনার দল কিংবা মোর্চার নেতা-কর্মীদের উপরই নির্ভরশীল হতে হবে। ফলে আপনাকে অনেক ক্ষেত্রেই বাধ্য হয়ে আপোষ করতে হবে। এই ভবিতব্যকে মেনে নেয়া ছাড়া আপনার গত্যন্তর নেই। এই বাস্তবতার নিরিখে একজন বিচক্ষণ দূরদৃষ্টি সম্পন্ন দেশপ্রেমিক হিসেবে আপনার দল ছাড়াও সমমনা আরও দুয়েকটা দল গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা আপনাকে অবশ্যই বুঝতে হবে।এই উদ্যোগ গ্রহণ না করলে বিদেশের তল্পিবাহক জাতীয় বেইমানদের শিকড়শুদ্ধ বাংলাদেশের মাটি থেকে উপড়ে ফেলে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ভিত্তিক রাজনীতিকে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বস্তরে প্রোথিত করা সম্ভব হবে না। ফলে সময়ের ধারায় বাংলাদেশ পরিণত হবে ভারত নির্ভরশীল একটি করদ রাজ্যে। আর দেশবাসী আবদ্ধ হবে গোলামীর জিঞ্জিরে যার নাগপাশ থেকে মুক্তি লাভ করাটা হয়ে উঠবে দুরূহ এবং সুদূর পরাহত। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশের এমন অপ্রত্যাশিত করুণ পরিণতির দায় থেকে কেউই রেহাই পাবেন না যারা রাষ্ট্রীয়ক্ষমতা এবং ক্ষমতা বলয়কে নিয়ন্ত্রণ করবেন। সমাজপতিদেরও একই ভাবে এই দায়ভার বহন করতে হবে সমষ্টিগত ব্যর্থতার মাশুল গুণতে। বেগম জিয়া মনোযোগ দিয়েই শুনছিলেন আমার কথা, কিন্তু এর কোনও প্রভাব তার উপর পড়েছিলো কিনা সেটা বোঝা গেলো না। কারণ, এই বিষয়ে তিনি কোনও মন্তব্য কিংবা প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত না করে কথার মোড় ঘুরিয়ে দিলেন।
আমার একজন যোগ্য, সৎ,বিশ্বাসযোগ্য প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি এবং পিএস এর প্রয়োজন। বেশ কয়েকজন আমলার নাম দেয়া হয়েছে আমাকে। তার মধ্যে প্রিন্সিপ্যাল সেক্রেটারি হিসাবে ডঃ কামাল সিদ্দিকি এবং পিএস হিসাবে সাব্বিহউদ্দিনের নামও রয়েছে। শুনেছি এই দু’জনকেই আপনি ঘনিষ্ঠ ভাবে চেনেন। যদি আমার খবরটা সঠিক হয় তবে তাদের সম্পর্কে আপনার মতামত জানতে চাই। প্রশ্নটা সরল হলেও এর পেছনে কনও উদ্দেশ্য থাকলেও থাকতে পারে। তাই একটু ভেবে নিয়ে জবাব দিলাম
কামাল সিদ্দিকির সাথে আমার প্রথম পরিচয় হয় ১৯৭১ সালে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পালিয়ে এসে কোলকাতায় পৌঁছানোর পর। কালুরঘাট থেকে বেতারে মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষণায় সাড়া দিয়ে নড়াইলের SDO হিসেবে বিদ্রোহ করে সে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করে। পাকিস্তান আমলের বিদ্রোহী CSP অফিসারদের মধ্যে নুরুল কাদের খান, কামাল সিদ্দিকি এবং তৌফিক এলাহী চৌধুরী এই তিনজনই মুজিবনগর অস্থায়ী সরকারের সচিবালয়ে যোগদানের পরিবর্তে সেক্টরে যুদ্ধ করার অনুমতি চেয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে আবেদন করেছিলেন। কামাল ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু বেনু(ঢাকা ভার্সিটির লেকচারার) তখন বনগাঁয়ে ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের ছাউনিতে ক্যাপ্টেন হাফিজের সাথে অবস্থান করে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলো। আমিও তখন ক্যাপ্টেন হাফিজকে সাহায্য করছিলাম ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট এর পুনর্গঠনের প্রক্রিয়ায়। এই সুবাদেই কামাল সিদ্দিকি আর বেনুর সাথে আমার পরিচয় ঘটে। ট্রেনিং শেষে তাদের পাঠিয়ে দেয়া হয় ৮নং সেক্টরের অধীন গোজাডাঙ্গা সাব সেক্টরে কমান্ডার ক্যাপ্টেন সালাহউদ্দিনের কাছে।
অল্প সময়ের ব্যবধানে শুধুমাত্র তৌফিক এলাহীর আবেদন মনজুর করেন প্রবাসী সরকার। ফলে বাকিরা বাধ্য হয় সচিবালয়ে যোগদান করতে। কামালকে প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদের পিএস হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়। সুনামগঞ্জের বিদ্রোহী SDO আকবর আলী খানের (খসরু মামা) ইচ্ছাতেই কোলকাতায় নিম্মির বাবা জনাব আর আই চৌধুরীর বাসাতেই কামালের থাকা-খাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। কামালের ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসাবে দ্বিধাহীন ভাবে বলতে পারি, রাজনৈতিক ভাবে সচেতন কামাল একজন দেশপ্রেমিক মেধাবী দক্ষ আমলা। বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে কামালের। ১৫ই আগস্ট বিপ্লবের পর প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সেক্রেটারি হিসাবে তাকেই নিয়োগ করা হয়েছিল। সার্বিক বিবেচনায় আপনি যদি কামালকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি হিসাবে বেছে নেবার সিদ্ধান্ত নেন কিংবা ভেবে থাকেন, তাহলে তার জ্ঞান, অভিজ্ঞতা, সততা, নিষ্ঠা, বিশ্বাসযোগ্যতা এবং কর্মদক্ষতা থেকে আপনি উপকৃতই হবেন বলেই আমার বিশ্বাস। সাব্বিহউদ্দিন আমার ছোটভাই স্বপনের বন্ধু সায়েলের বড়ভাই। হংকং-এ সাব্বি আমার ফার্স্ট সেক্রেটারি হিসাবে কাজ করেছে। সাব্বি আমাকে ডালিম ভাই বলেই সম্বোধন করে থাকে ঘনিষ্ঠতার কারণে। কামালের মতোই তার চারিত্রিক গুণাবলী এবং পেশাগত যোগ্যতা প্রশ্নাতীত। সাব্বিও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন দেশপ্রেমিক। সাব্বি একজন পড়ুয়া দক্ষ আমলা। তাকেও আপনি পিএস হিসাবে বেছে নিলে কামালের মতো একইভাবে উপকৃত হবেন। অনেক দেরি হয়ে যাওয়ায় উঠে দাড়িয়ে বললাম, অনুমতি দিলে আমি তবে আসি। বেগম জিয়া গাড়ী বারান্দা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, কবে ফিরে যাচ্ছেন? অনেক দিন পর দেশে আসার সুযোগ পেলাম। যদি অনুমতি দেন তাহলে সপ্তাহ দুয়েক আত্মীয়-স্বজনদের সাথেকাটিয়ে যেতে চাই।
ঠিক আছে তবে তাই করুন, আমি মুস্তাফিজকে (পররাষ্ট্রমন্ত্রী) বলে দিবো। আপনি সুবিধামতো সময়ে মিনিস্ট্রিতে গিয়ে ফর্মালিটিজগুলো সেরে নেবেন। অনেক ধন্যবাদ, আপনার অনেক মুল্যবান সময়ের অপচয় করে গেলাম। আচ্ছা, খোলামেলা আলাপ করে ফিরে যাবার আগ মুহূর্তে এ ধরনের লৌকিকতা কিংবা শিষ্টাচার প্রদর্শনের কনও প্রয়োজন ছিল কি?
ঠিক সেই মুহূর্তে প্রশ্নটার উদ্দেশ্য বোধগম্য না হওয়ায় জবাব দিলাম হয়তো ছিল না। তবুও রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনার প্রতিটি মুহূর্তই মূল্যবান।
তা হতেই পারে, আমি কিন্তু আপনাদের বাসায় দাওয়াত করেছিলাম খোলামেলা আলাপ করার জন্যই। সেই ক্ষেত্রে এই ধরনের ফর্মালিটির কোনও প্রয়োজন ছিল না বোধ করি। আন্তরিকতার সাথেই কথাগুলো বলেছিলেন বেগম খালেদা জিয়া। কথা না বাড়িয়ে বাসায় ফিরে এলাম। বাসায় ফিরে দেখি খাওয়ার পাট চুকিয়ে পানের আড্ডায় সবাই মশগুল। আমি হাজির হতেই সবাই ছেঁকে ধরলো, এতক্ষণ ধরে কি আলাপ করে এলাম প্রধানমন্ত্রীর সাথে! নিম্মি টিপ্পনী কেটে বললো,
অনেকদিন পর অতিচেনা প্রিয় দর্শনী ভাবীর সাথে একান্ত সাক্ষাৎকার বলে কথা! তার উষ্ণ সান্নিধ্যে পুরনো দিনের স্মৃতি রোমন্থন করছিলে বুঝি?
ঠিক তা নয়। তবে তিনি জানতে চেয়েছিলেনতুমি সঙ্গে নেই কেনও? তার সাফাই দিতেই তো অনেকক্ষণ লেগে গেলো। তোমার শারীরিক অসুস্থতার বিষয়টি বিবেচনা করে ভাবী দুই সপ্তাহের ছুটি মনজুর করলেন।
অবাক হয়ে নিম্মি বলল, আমার অসুস্থতা! হ্যাঁ, সেই অজুহাতটাই আমাকে দিতে হয়েছিল অনেকটা অপারগ হয়েই। আসল কারণটা বলা কি উচিৎ হতো? সবাই হেসে উঠে বললো
ভালই হলো, হৈ হুল্লোড় করে দুটো সপ্তাহ কাটানো যাবে। নিম্মি, তোমার বদ্দা কামাল সিদ্দিকিকে ফোনে মিলাও, ওকে একটা সান্টিং দিতে হবে। নিম্মি ফোনে কামালের সাথে যোগাযোগ করে আমাকে রিসিভারটা দিল। কিরে ব্যাটাচ্ছেলে, কেমন আছিস? তোর সাথে কথা বলার ইচ্ছে নেই, তোরা ঢাকায় এসেছিস এই খবরটা আমাকে অন্যের কাছ থেকে জানতে হয় কেনও? ব্যাপারটা খুবই অপমানজনক! দুপুরের আগে পৌঁছাতেই রাতে ডাক পড়লো মইনুল রোডে রাতের খাবারের দাওয়াতে। সেখান থেকে এইমাত্র ফিরেই ফোন করছি।
কি ব্যাপার? কোনও ব্যাপার নেই। তুই চেপে যাচ্ছিস। আমি না তুই? মানে? মানেটা অত্যন্ত সরল। তোমার দীর্ঘদিনের লালিত বাসনা, খালেদা জিয়ার সাথে ঘনিষ্ঠ ভাবে কাজ করার। সেই বাসনা মেটানোর সব ব্যবস্থাই জানলাম তলে তলে ইতিমধ্যেই ঠিক করে ফেলেছিস।
কি করে জানলি? উচ্চমার্গে উড়ন্ত বাজপাখির শ্যেনদৃষ্টি এড়ানো যে প্রায় অসম্ভব সেটা তোমার মতো পণ্ডিত এবং চতুর আমলার না জানার কথা নয়। তা যাই হউক, তোকে প্রিন্সিপাল সেক্রেটারি আর সাব্বিকে পি এস হিসাবে নিয়োগ দানের ব্যাপারে আমার অভিমতটা কিন্তু তোমাদের ম্যাডাম জেনে নিয়েছেন। তাই বুঝি, তুই কি বললি? যতটা প্রাপ্য নয় তার চেয়ে কিছুটা বাড়িয়ে বলে ঘনিষ্ঠ বন্ধুর দায়িত্ব পালন করেছি। তাই দুশ্চিন্তার কারণ নেই। তোর স্বপ্ন সফল হবে। আমার কথা শুনে নিম্মি আমার হাত থেকে রিসিভারটা নিয়ে বলল তাহলে তো পুরো প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়টাই আমাদের কব্জায় চলে আসবে তাইনা বদ্দা?কি ব্যাপার আপনি তো দেখছি কিছুই বলছেন না! বুঝতে পেরেছি, পদে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর আপনারা দুই জনই হয়ে উঠবেন ধরা ছোঁয়ার বাইরে। তেমনটি হলে আমরা মোটেও অবাক হব না মনে রাখবেন। আমি নিম্মির কাছ থেকে রিসিভার নিয়ে জিজ্ঞেস করলাম Jokes apart, বলতো কামাল, ঐ পদটাতে তোর এতো মোহ কেনও? ডাচ সাংবাদিক পিটার কুস্টারকে কেন্দ্র করে ৭ই নভেম্বরের পর জিয়াউর রহমানের সাথে ভুল বুঝাবুঝির কারণে তুই ৩-৪ মাস যশোরে হক ভাইয়ের শেল্টারে ভাগোরা ছিলি। এরপর সারেন্ডার করে কিছুদিন নাজিমুদ্দিন রোডের লাল দালানে থাকতে হয়েছিল। সেই ঘটনার সাথে এই সিদ্ধান্তেরসম্পর্ক নেই তো? কামাল কোনও জবাব দিলো না, তবে বিব্রত বোধ করছিল। আমি ঠিকই বুঝে নিয়েছিলাম, যোগসূত্র রয়েছে। রাত অনেক হওয়ায় বাক্যালাপ বন্ধ করার পর সেদিনের মতো আমাদের সভা সাঙ্গ হল। আমাদের ছুটি ভালোই কাটছিল। বন্ধু-বান্ধবদের পার্টি, আউটিংস, আত্মীয়-স্বজনদের দাওয়াত, ঘরোয়া আড্ডায় সময় অতি দ্রুত গড়িয়ে চলেছে।

Previous                                   Next