You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

জিয়া থেকে খালেদা তারপর
রাষ্ট্রদূত লেঃ কর্ণেল (অবঃ) শরিফুল হক ডালিম বীর উত্তম

লেখকের কথা
আমার লেখা এই বইটিতে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচিতি, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিকতায় ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, পাকিস্তান আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, স্বাধিকার আন্দোলন, স্বাধীনতার সশস্ত্র সংগ্রাম, স্বাধীনতা উত্তরকালে আওয়ামী-বাকশালি একদলীয় স্বৈরশাসনের পতনের লক্ষে ১৫ই আগস্ট বিপ্লব, ২-৩রা নভেম্বর খালেদ-চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ব্যর্থ ক্যু’দাতা এবং ৭ই নভেম্বরের মহান সিপাহী-জনতার বিপ্লব, জেনারেল জিয়া, জেনারেল এরশাদ এবং বেগম খালেদা জিয়ার শাসনকালে সেনা পরিষদের অবদান পরবর্তী পর্যায় বাংলাদেশের রাজনীতি সম্পর্কে বস্তুনিষ্ঠ ঘটনাবলি লেখার চেষ্টা করলাম ব্যক্তিগত এবং সহযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতার আলোকে, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, ইতিহাস গবেষক এবং বোদ্ধাজনদের বিচার-বিশ্লেষণের সুবিধার্থে। আমার লেখা ১৯৯৬ সালে প্রকাশিত ‘‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’’ বইটির ধারাবাহিকতাতে লেখা “জিয়া থেকে খালেদা তারপর”। তাই লেখার সারবস্তুর সঠিক উপলব্ধি এবং বিচার বিশ্লেষণের জন্য বইটি পাঠকদের পড়াটা জরুরী। যারা বইটি সংগ্রহ করতে অপারগ তারা www.majordalimbubangla.com কিংবা www.majordalimbu.com থেকে বইটি ডাউনলোড করে নিতে পারবেন সহসাই প্রকাশকের অনুমতি সাপেক্ষে।
বইটি লেখার মূল উদ্দেশ্য হল দেশবাসী বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম যাতে তথ্যভিত্তিক উপাদানগুলো থেকে সত্যকে খুঁজে নিতে পারেন। চিনে নিতে পারেন বিগত চার দশকের উপর সময়কাল ধরে যারা ক্ষমতার নাগরদোলায় পালাবদলের জাতীয় স্বার্থবিরোধী সমঝোতার রাজনীতি নিজেদের হাতে কুক্ষিগত রেখে জনগণকে দ্বিধাবিভক্ত করে অপার সম্ভাবনার দেশটাকে অনিশ্চিত অন্ধকারে ঠেলে দিয়ে নিজেদের স্বকীয়তা এবং অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন করে তুলেছেন তাদের আসল চেহারাটা। ঠিকভাবে অতীত ইতিহাসের আলোকে নেতা-নেত্রীদের চরিত্র না জানলে বর্তমান ও ভবিষ্যতে কনও জাতি কখনোই সঠিক নেতৃত্ব এবং পথের সন্ধান খুঁজে পেতে পারে না।

বাংলাদেশ
আমাদের এই ভূখণ্ড বা দেশের উৎপত্তি হয়েছে মূলত গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্র, যমুনা, মেঘনা এবং এদের হাজারও শাখা-প্রশাখা বাহিত পলিমাটি দ্বারা। আদিবঙ্গের জন্ম দিয়ে ঐ সমস্ত স্রোতস্বিনী বিলীন হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। পলিমাটি দ্বারা সৃষ্টি এই ভূখণ্ডের প্রাচীন ঐতিহাসিক নাম ছিল বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। ‘বঙ্গ’ শব্দের আভিধানিক মানে হচ্ছে সঙ্কর ধাতু দিয়ে জোড়া লাগানোর দেশ। এ থেকেই ধারণা করা যায়, প্রাচীন সমসাময়িক সভ্যতার কাতারে বঙ্গদেশের স্থান ছিল শীর্ষ পর্যায়ে। কারণ, খনিজ ধাতব পদার্থ যেমন সোনা, লোহা, তামা, কাঁসা, টিন ইত্যাদি সম্পর্কে প্রাযুক্তিক জ্ঞান ও বিভিন্ন ক্ষেত্রে ধাতুর ব্যবহারের মাত্রা আজও গণ্য করা হয় সভ্যতার মানদণ্ড হিসাবে। বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীর আদিবাসভূমি বঙ্গদেশের রয়েছে একটি ঐতিহাসিক সীমানা। উত্তরে হিমালয়ের গা ঘেঁষে নেপাল, ভুটান, সিকিম, উত্তরপূর্বে আসাম, মণিপুর, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, ত্রিপুরা, অরুণাচল, মেঘালয়, উত্তর-পশ্চিম দিকে দ্বারভাঙ্গা পর্যন্ত ভাগীরথীর অববাহিকার সমতল এবং রাঢ়ভূমি-রাজমহল, সাঁওতাল পরগণা, ছোটনাগপুর, মুর্শিদাবাদ, মালদহ, পশ্চিমবঙ্গের পুরোটাই, বিহারের বীরভূম, মানভূম, কেওঞ্জর, ময়ুরভঞ্জের অরণ্যময় মালভূমি, অঙ্গ, বর্তমানের মিথিলা ও কলিঙ্গ উড়িষ্যার অংশ হিসাবে বাংলাদেশের তথা আদিবঙ্গদেশের অন্তর্ভুক্ত ছিল। পূর্বে মিয়ানমার আর শ্যামদেশ ঘেষে দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর। এই সুবিশাল আদিবঙ্গ বা বাংলাদেশের সীমানার মধ্যেই গৌড়, পুণ্ড্র, বরেন্দ্র, রাঢ়, সুহ্ম, তাম্রলিপ্ত, সমতট, অঙ্গ, বাঙ্গাল, হরিকেল নামের ঐতিহ্যময় জনপদ গড়ে তুলেছিল বঙ্গবাসী বা বাংলাদেশীরা। কোল, ভীল, শবর, পুলিন্দ, হাড়ী, ডোম, চণ্ডাল, সাঁওতাল, মুণ্ডা, ওঁরাও, ভূমিজ, বাগদী, বাউরি, পোদ, মালপাহাড়ি প্রমুখ অন্ত্যজ জনগোষ্ঠীর মিলন এবং তাদের সাথে বহিরাগত নানা রক্তের ধারা মিশে এক হয়ে গড়ে উঠে বঙ্গবাসী কিংবা বাংলাদেশী জাতিসত্তার।
কালের স্রোতে বহিরাগত আগ্রাসী শক্তিদের দ্বারা বাংলাদেশীদের আবাসভূমি খণ্ডিত হলেও ঐতিহাসিক সীমানা একদিন অবশ্যই পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে প্রাকৃতিক নিয়মেই। রাষ্ট্রীয় সীমানা অনিবার্যভাবে অতীতের মতো পরিবর্তনশীল থাকবে আগামীতেও। আমাদের পূর্বপুরুষরা প্রাচীনকালে গড়ে তুলেছিলেন প্রসিদ্ধ জনপদগুলো। সভ্যতার বিকাশ ঘটিয়েছেন, জন্ম দিয়েছিলেন বিস্ময়কর সংস্কৃতি ও শিল্প ঐতিহ্যের। এই ঐতিহ্য আমাদের জাতীয় অধিকার। আজ রাষ্ট্রীয় সীমানা এবং জাতীয়তাবাদ নিয়ে গোষ্ঠীস্বার্থে অযথা যতই বিতর্কের অবতারণা করা হোক না কেন, বাংলাদেশের সচেতন জনগণকে বোকা বানিয়ে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করা সম্ভব হবে না চিরকাল। তারা তাদের অতীত ঐতিহ্য এবং ন্যায্য অধিকার সময় মতো আদায় করে ছাড়বেই যোগ্য উত্তরসুরি হিসাবে ইন শা আল্লাহ্‌। সমাজ জ্ঞানী এবং বিপ্লবী মাও সে তুং বলেছেন, ‘বিজাতীয়দের স্বার্থে যেসমস্ত জাতিসত্তা এবং তাদের রাষ্ট্রীয় সীমানা বিভিক্ত করা হয়েছে ছলে বলে কৌশলে, তারা একদিন আবার একত্রিত হবে এবং পুনরুদ্ধার করবে তাদের হারানো ভূখন্ড।’ এই বাস্তবতায় লেখকের বিশ্বাস, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্ম অতীত ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার করে পূর্ণমর্যাদায় একদিন প্রতিষ্ঠিত করবে প্রকৃত বাংলাদেশ এবং সারা দুনিয়াতে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হবে গর্বিত বাংলাদেশী হিসাবে। উদীয়মান সূর্য ক্রমশ পূর্ণতায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে আর তারই আলোকে স্বচ্ছ শতাব্দীকালের ধারায় গঠিত প্রকৃত বাংলাদেশ। এটা লেখকের কাল্পনিক দিবাস্বপ্ন নয়। ইতিহাসের অমোঘ নিয়মেই ভবিষ্যতে একদিন এই স্বপ্ন রূপান্তরিত হবে বাস্তব সত্যে। আমাদের এই দেশের নাম বঙ্গদেশ বা বাংলাদেশ। প্রশ্ন দেখা দেয় ‘বাংলা’ অথবা ‘বাঙ্গালা’ এবং ‘বাঙ্গালী’ শব্দের উৎপত্তি হল কি করে? ঐতিহাসিক পটভূমিকায় আবুল ফজল ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থে বাংলা বাঙ্গালা, বাঙ্গালী শব্দের যে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সেটা হল- প্রাচীন বঙ্গ শব্দের সাথে ‘আল’ শব্দ যুক্ত করে সুলতান শামসুদ্দীন ইলিয়াস শাহ্‌ বাংলা শব্দের চয়ন করেন। আল শব্দের অর্থ পানি রোধ করার ছোট বড় বাঁধ। অন্যদিকে, সুকুমার সেনের অভিমত হল- প্রথমে বঙ্গ থেকে বাঙ্গালাহ শব্দের সৃষ্টি হয়েছে মুসলিম শাসন আমলে। পারসিক শব্দ বাঙ্গালাহকে পর্তুগীজ দস্যুরা বানিয়েছে বেঙ্গল আর বঙ্গবাসীদের নামকরণ হয় বেঙ্গলী। ইংরেজরা এই পরিভাষাকেই বহাল রাখে তল্পিবাহক চাণক্যদের অনুরোধে। বর্তমান বাংলাদেশে এখনো জাতীয়তাবাদ প্রসঙ্গে বিভ্রান্তি পরিলক্ষিত হয়। সমাজের শক্তিধর গোষ্ঠী, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী, এবং রাজনীতিবিদরা এই বিভ্রান্তিকে আরও জটিল করে তুলেছেন ক্ষণস্থায়ী ফায়দা লুটার জন্য। এই বিভাজনকারী বিভ্রান্তি নিরসনের জন্য বুদ্ধিজীবীদের যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রয়োজন তাও প্রায় অনুপস্থিত। জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনে পরিষ্কার ভাবে সত্যকে আমাদের জানতে হবে, আমাদের জাতীয়তাবাদ কি? ‘বাংলাদেশী’ না ‘বাঙালী’! আদিবঙ্গ অববাহিকা ও তদসংলগ্ন অঞ্চল যে দক্ষিণএশিয়া উপমহাদেশে প্রাচীন কালে সুপরিচিত, স্ব-বৈশিষ্টে সমুজ্জ্বল একটি উন্নত বিত্তশালী অঞ্চল হিসাবে পরিগণিত হতো তার অসংখ্য সাক্ষ্য-প্রমাণ প্রাচীন বৈদিক সাহিত্যে বর্ণিত রয়েছে। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-১০০০ সালের মধ্যে ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গের কথা রয়েছে। মহাভারত ও হরিবংশেও দেখা যায় বঙ্গ প্রসঙ্গ। সুতরাং বাংলাদেশী জনগণকে অর্বাচীন বলে আখ্যায়িত করার কোনও উপায় নেই। রামায়ণেও বঙ্গের উল্লেখ আছে। এদেশের সর্বত্র ক্ষৌম কাপাশিক বস্ত্রশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ ছিল বলেও কৌটিল্য বয়ান করেছেন। বরাহ মিহির (৫০০-৫৪৩) খ্রিস্টাব্দে তার ‘বৃহৎ সংহিতা’ গ্রন্থে পূর্বাঞ্চলীয় দেশকে বঙ্গ বলে অবহিত করেছেন। সতীশচন্দ্র মিত্র যশোর, খুলনা, সংলগ্ন দক্ষিণবঙ্গের কিছু অংশকে উপবঙ্গ রূপে সনাক্ত করার প্রয়াস পান।
হিমযুগের পর থেকে বাংলাদেশ কখনো জনশূন্য থাকেনি। পৃথিবীর অন্যান্য মানব সভ্যতার মতো বাংলাদেশের জনগোষ্ঠীরও বিবর্তন ঘটে ছিল। কারণ, এখানেও প্রত্ন প্রস্তর এবং তাম্র যুগের অস্ত্র সম্ভার ও মুদ্রা পাওয়া গেছে। ভাষার ও আকৃতির ঐক্য হতে সিদ্ধান্ত নেয়া যায় বাংলাদেশের আদিম জনগোষ্ঠী একটি বিশেষ মানবগোষ্ঠীর বংশধর। এই মানবগোষ্ঠীর সাথে অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের চেহারা, গড়ন এবং ভাষার মিল পাওয়া যায় বলেই এদের বলা হয় অস্ট্রো-এশিয়াটিক অথবা অস্ট্রিক। বাংলাদেশের দোরগোড়ায় রাজমহল পাহাড়, সেখানের বনজঙ্গলে বসবাসকারী পাহাড়িদের ছোটো-খাটো গড়ন, চেহারা, গায়ের রং কালো, নাক থ্যাবড়া। বেদ ও নিষাদে যে বর্ণনা আছে তাতে বঙ্গবাসীদের সাথে সিংহলের ভেড্ডাদের হুবহু মিল রয়েছে তাই, এদের নৃতাত্ত্বিক নামকরণ হয় ভেড্ডীড। নিষাদজাতি বলেও এই দুই জনগোষ্ঠীকে আখ্যায়িত করা হয়েছে। প্রাচীন বাংলাদেশে নানা পরিবেশে এবং জল হাওয়ায় দলগত ভাবে মানুষ বসবাস করতো। পরে তাদের রক্তে বহিরাগতদের রক্তের ধারা এসে মিশেছে পর্যটন ও ব্যবসায়িক সূত্রে। বাঁচবার আলাদা আলাদা প্রক্রিয়া এবং ভিনদেশী রক্তের মেলামেশার দরুন স্থান ভেদে চেহারায় বৈচিত্র্য পরিলক্ষিত হয়। মননশীলতায়, ভাষায়, সভ্যতার বাস্তব উপাদানে তার প্রচুর ছাপও রয়েছে। বাংলাদেশের মাটি আর সেই মাটিতে নানা নৃতাত্ত্বিক জাতের মিশ্রণের ফলেই বাংলাদেশের জনপ্রকৃতির মাঝে ঐক্যের শেকড় দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে আছে।বাংলাদেশের আদিম অধিবাসীগণের বহিরাগত আর্যদের সাথে কোনও সংশ্রব ছিল না। বাংলা ভাষার বিশ্লেষণ করে পণ্ডিতগণ এই সিদ্ধান্তেই উপনীত হয়েছেন। উপরন্তু, আর্য কিংবা দ্রাবিড় আসলে নরগোষ্ঠীর নাম নয়, ভাষাগোষ্ঠীর নাম মাত্র। একই নরগোষ্ঠীর মধ্যে ভিন্ন ভিন্ন ভাষার চলন থাকতে পারে। কাজেই শুধুমাত্র ভাষা দিয়ে কোনও নরগোষ্ঠীর জাতীয় পরিচয় নির্ধারণ যুক্তিগত কারণেই সঠিক নয়। শুধুমাত্র একটি উপাদানের উপর ভিত্তি করে কোনও জাতিসত্তার বিকাশ সম্ভব নয়। জাতীয়তাবাদ গঠনে মূলত ভূখণ্ড, ভাষা, নৃতাত্ত্বিক বৈশিষ্ট, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ধর্মীয় মূল্যবোধ বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেকোনো ভূখণ্ডে ধর্ম, বর্ণ, সম্প্রদায়, জাত, কুল, নির্বিশেষে যখন কোন জনগোষ্ঠী এক সামগ্রিক চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে ওঠে তখনই জাতীয়তাবাদ প্রাণ পায়। জাতীয়তাবাদ মূলত এক ধরনের অনুভূতি, এক ধরনের আবেগ তাড়িত মানসিকতা, এক ধরনের একাত্মবোধ ও চেতনা যা সৃষ্টি হয় প্রবহমান জীবনধারায়। জাতীয় সংগ্রামের ধারায় গতিশীলতা অর্জন করার জন্য কখন কোন উপাদানটি বিশেষ ভূমিকা রাখবে সেটা নির্ভর করে সময়, বাস্তব পরিস্থিতি, সংগ্রামের লক্ষ, জনগণের প্রত্যাশা এবং নেতাদের সিদ্ধান্তের উপর। অতীত সম্পর্কে গৌরববোধ, বর্তমানের সুখ কিংবা বঞ্চনা আর ভবিষ্যতের রঙিন স্বপ্ন জাতীয়তাবাদের চেতনা জাগ্রত করে এবং জনমনে গড়ে তোলে ঐক্যবদ্ধ মূর্ছনা। এ ধরনের ঐক্যবদ্ধ চেতনা যখন সাধারণ জনগণকে একত্রিত করে তখন সামাজিক ও রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে তা হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। সামাজিক সত্তা হিসাবে সেটা বিভিন্ন মাত্রায় প্রকাশিত হলেই একটি জাতি সব চ্যালেঞ্জ মোকাবেলার জন্য নৈতিকভাবে প্রস্তুত হয়। বাংলাদেশীদের জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের এক পর্যায়ে ভাষা মুখ্য ভূমিকা পালন করেছে এ কথা সত্যি, তাই বলে বাংলাদেশের জাতীয়তাবাদকে বাঙালী জাতীয়তাবাদ বলে আখ্যায়িত করলে সেটা হবে বিভিন্ন নরগোষ্ঠীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় হাজার বছরের ঐতিহ্যে গড়ে ওঠা বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদের উপর একটি ভাষাগোষ্ঠীর আধিপত্য চাপিয়ে দেয়া। কারণ, বাংলাভাষীর সমার্থক বাঙ্গালী শব্দটি কোনও নরগোষ্ঠীর জাতিগত পরিচিতি নয়, ভাষাগোষ্ঠীর পরিচিতি মাত্র।

শ্রদ্ধেয় মওলানা ভাসানীর সাথে শেষ সাক্ষাত
বাংলাদেশের জনদরদী, মজলুমদের নেতা মওলানা ভাসানী তার মৃত্যুর মাত্র কিছুদিন আগে শেষবারের মতো বাংলাদেশের জনগণের মরণ-বাঁচন সমস্যা নিয়ে যে সুদূরপ্রসারী ইঙ্গিত দিয়ে গিয়েছিলেন তা থেকে পাঠকগণ বর্ষীয়ান নেতার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা ও ভাবনার গভীরতা সম্পর্কে জানতে পারবেন বলেই ঘটনাটির অবতারণা করলাম। এ থেকে পরিষ্কার হয়ে ওঠে বাস্তব ইতিহাস সম্পর্কে তার জ্ঞানের প্রসারতা।
‘৭০এর দশকের শেষে মওলানা লন্ডন গিয়েছিলেন একটি জটিল অস্ত্রোপচারের জন্য। আমিও তখন লন্ডনেই অবস্থান করছিলাম। খবরটা তার কাছে পৌঁছে যায়। খবরটা জানতে পেরেই তিনি আমাকে একদিন ডেকে পাঠালেন আমার বাল্যবন্ধু গাজীউল হাসান খানের মাধ্যমে। গাজী তখন স্থায়ীভাবে লন্ডনে বসবাস করছে। পেশা হিসাবে বেছে নিয়েছিল সাংবাদিকতা। একইসাথে পূর্ব লন্ডনে তার নিজস্ব প্রেস থেকে আমার প্ররোচনায় উৎসাহিত হয়ে ‘দেশবার্তা’ নামের একটি পত্রিকা প্রকাশের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত ছিলাম দু’জনেই।
সময় মতো আমরা হুজুরের ফ্ল্যাটে গিয়ে হাজির হলাম। অপারেশনের পর বাংলাদেশ দূতাবাসই এই ফ্ল্যাটটির ব্যবস্থা করে দিয়েছে। সেই বৈঠকে আমাদের সাথে বিভিন্ন বিষয়ে খোলামেলা আলাপ করেছিলেন মওলানা। প্রায় দুই ঘণ্টা ছিলাম তার কাছে। কথা প্রসঙ্গে একসময় হঠাৎ তিনি বললেন, ‘তর যায়গা লন্ডন না, দেশে ফিরা যাইতে হইবো।’ হুজুরের কথার কি জবাব দেবো, ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। সেই সময় সেনাপরিষদ এবং আমাদের সাথে প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়ার কার্যক্রম ও রাজনৈতিক উদ্যোগ প্রসঙ্গে মতবিরোধ দেখা দিয়েছিলো। এই প্রসঙ্গে যা দেখেছি ‘যা বুঝেছি যা করেছি’তে বিস্তারিত লিখেছি। ভাবছিলাম, হুজুরকে সব বিস্তারিত খুলে বলবো কিনা! ১৫ই আগস্ট বিপ্লবকে তিনি দ্ব্যর্থহীন ভাবে সমর্থন দিয়ে স্বাগত জানিয়েছিলেন। হুজুর আগস্ট বিপ্লব সম্পর্কে একটি প্রেস কনফারেন্সও করেছিলেন।
তারপর, একদিন আমি জেনারেল জিয়াকে গোপনে সন্তোষ নিয়ে গিয়েছিলাম, তাকে হুজুরের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তার কাছ থেকে দিকনির্দেশনা নেবার জন্য। ভাবনায় ছেদ পড়ল, মাওলানা বলে উঠলেন, ‘জিয়ার সাথে মতের অমিল হইছে, হেইডা আমি জানি। কিন্তু, ভুল পথেই চলছে জিয়া। ফিরা গিয়া আমি তারে বুঝামু, বুঝলে ভালো না বুঝলে আমি জানি কি করতে হইবো। তোরা তৈরি থাকিস। তবে বাবাজান একটা কথা, বুড়া মানুষের কথাডা মন দিয়া হুনিছ। যেই কাম শুরু করছস, তার শেষ বহুদূরে। বর্তমানের বাংলাদেশের মধ্যেই চোখ বন্ধ কইরা উটপাখি হইয়া বইয়া থাকলেই চলবো না। চোখ খুইল্লা চাইতে হইবো সীমানার বাইরে। কথাডা নিয়া চিন্তা করবা। নাইলে বাংলাদেশ ভাঙ্গা দেশে পরিণত হইবো।’
‘হুজুর দোয়া করেন, যাতে আমি আর আমার সহযোদ্ধারা আপনার ইশারা মতো দেশ আর মজলুম দেশবাসীর জন্য নিজেদের জীবন কোরবান করতে পারি সেই হেকমত আর সুযোগ যেন আল্লাহপাক আমাদের দেন।’
আমার জবাব শোনার পর তিনি আধশোয়া অবস্থাতেই আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরে দোয়া করলেন।
তার উষ্ণতা ও আন্তরিকতায় আমার বুক ভরে উঠে ছিল। ডাক্তার এসে গেছে চেকআপের জন্য, আমাদের বিদায় নিতে হবে। সালাম করে আমি ও গাজী বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এলাম। বুকের মধ্যে গেঁথে নিয়ে এলাম দরবেশতুল্য এক মহামানবের অমূল্য দিক নির্দেশনা। সেটাই ছিল মওলানা ভাসানীর সাথে আমার শেষ সাক্ষাৎকার। এর অল্প কয়েকদিন পরেই তিনি ইন্তেকাল করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তাঁর মৃত্যুতে জাতি হারাল একজন জনদরদী অভিজ্ঞ মুরুব্বী এবং দূরদর্শী-বিচক্ষণ নেতা!
দ্বিজাতি তত্ত্ব
স্বাধীনতার পরপরই ভারতীয় সরকার এবং তাদের আঁতেলরা জোরেশোরে প্রচারণা চালাতে শুরু করলো, বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ‘দ্বিজাতি তত্ত্ব’ যার ভিত্তিতে ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান আর হিন্দুস্তান নামের দুইটি রাষ্ট্রে ‘ভারত মাতা’ বিভক্ত হয়েছিল সেই তত্ত্ব ভুল প্রমাণিত হয়েছে।
গান্ধী, নেহেরু, গোখেল, প্যাটেল প্রমুখ কট্টর বর্ণহিন্দু নেতাদের খায়েশ ছিল ব্রিটিশ রাজ থেকে কোনোমতে ছলেবলে কৌশলে হিন্দুস্তান নামের একটি স্বাধীন রাষ্ট্র বাগিয়ে নিয়ে পুরো উপমহাদেশটাকেই গিলে খেতে এবং পরবর্তীতে ভারতমাতার পুনর্জন্ম ঘটাতে। কিন্তু তাদের সেই গুড়ে পড়লো বালি।
উপমহাদেশের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ব্রাহ্মণ্যবাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠলো। কিন্তু অন্যান্য জাতিসত্তার তুলনায় সবচেয়ে বেশি সোচ্চার হয়ে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে ব্রিটিশ-হিন্দু নেতাদের সব চক্রান্ত ব্যর্থ করে দিয়ে উপমহাদেশের মুসলমান জনগোষ্ঠী তাদের বাধ্য করে মুসলমানদের স্বাধীন আবাসভূমি পাকিস্তান রাষ্ট্র সৃষ্টি করতে। তুলনামূলকভাবে দুর্বল অন্যান্য জাতিগোষ্ঠীগুলোকে অস্ত্রের জোরে দাবিয়ে রাখতে সচেষ্ট হয়েছিলো ভারতের আগ্রাসী চাণক্যরা ব্রিটিশদের সহায়তায়। কিন্তু এই আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সেই সময় থেকেই এখনঅব্দি স্বাধীনতার সংগ্রাম চলে আসছে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর ভারতীয় ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। ক্রমান্বয়ে এই সব জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম তাদের সংগ্রামী চেতনাকে শাণিত করেছে। যদিও স্বদেশী কিছু ভারতীয় তল্পিবাহক রাজনৈতিক দল, তাদের পোষা নেতানেত্রী এবং উচ্ছিষ্টভুক্ত বুদ্ধিজীবীদের বীণার সুরে একই তান শুনে বোঝা যায় ওরা কি জাতের প্রাণী! তাদের শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টার বিরুদ্ধে যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা দ্বিজাতি তত্ত্বের সঠিকতাই শুধু প্রমাণ করেছে তাই নয়, এই স্বাধীনতা এটাও প্রমাণ করেছে যে ভারতীয় ইউনিয়ন ব্রিটিশ সৃষ্ট একটি অবাস্তবতা যা টিকিয়ে রাখা হচ্ছে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে। ১৯৪৭ সাল থেকেই একই প্রক্রিয়ায় অস্ত্রের জোরে টিকিয়ে রাখা হচ্ছে কৃত্রিম এই ভারতীয় ইউনিয়ন।
ইতিহাসের নিরিখে উপমহাদেশ বহুরাষ্ট্রিক একটি ভূখণ্ড। ঐতিহাসিক সীমানাগুলো বলপূর্বক সাময়িকভাবে বিকৃত করে দেয়া হলেও প্রাকৃতিক নিয়মেই একসময় রাষ্ট্রগুলোর প্রকৃত সীমানা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবে ঐতিহাসিক বিধানে। স্বাধীন সত্তার ঐতিহ্য বহনকারী জাতিগুলো চিরকাল চাণক্যদের অধীনস্থ হয়ে থাকবে না। বিজাতীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোই তাদের শাসন ও শোষণের স্বার্থে অস্ত্রবলে নিজেদের একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্য এই উপমহাদেশে একটি একক রাষ্ট্রকাঠামো গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছিলো। বৈদিকযুগের আর্যভাষীদের আগমনের কাল থেকে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকাল পর্যন্ত ইতিহাস ঘাঁটলে এই সত্য সহজেই অনুধাবন করা যায়। বৈদিক কালের যাযাবর বর্ণহিন্দুরা পামির মালভূমি থেকে নেমে এসে উপমহাদেশের উত্তর অঞ্চলে রামরাজ্য প্রতিষ্ঠার ধুয়া তুলে ‘অখণ্ড ভারত’ কায়েমের চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়। একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়নি শক, হুন, আফগান, পারসি, পাঠান, মুঘল, আক্রমণকারী শাসকরাও।
একমাত্র ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদই উচ্চতর মানের সমর সম্ভার এবং বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বদৌলতে পুরো উপমহাদেশকে একটি প্রশাসনিক রাষ্ট্রে পরিণত করতে সক্ষম হয়েছিলো। অতএব, যুক্তিসঙ্গত কারণেই বলা যায়, একক রাষ্ট্র হিসাবে ভারতীয় ইউনিয়নের ইতিহাস অতি সাম্প্রতিক এবং কৃত্রিম। এখানে একটি সত্য প্রণিধানযোগ্য।
ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির আগ্রাসনের আগপর্যন্ত কোন বিদেশী শক্তির পক্ষেই সম্ভব হয়নি বাংলাদেশকে পরাধীন করা। ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রধান রবার্ট ক্লাইভ এসে বাংলাদেশের উপকূলে নোঙ্গর ফেলেন ব্যবসা-বাণিজ্যের উছিলায়। বাংলাদেশ তৎকালিন দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যে ছিল সবচেয়ে সমৃদ্ধশালী। ব্যবসায়িক সূত্রেই ক্লাইভের সাথে ঘনিষ্ঠতা গড়ে ওঠে এতদঞ্চলের হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং বেনিয়া সম্প্রদায়ের। এই সখ্যতার ধারাবাহিকতায় শিখন্ডি মীরজাফরকে কেন্দ্র করে শুরু হয় বাংলার নওয়াব সিরাজদ্দৌলার বিরুদ্ধে মুসলিম বিরোধী এক গভীর ষড়যন্ত্র। এই প্রেক্ষাপটেই সংঘটিত হয়েছিলো পলাশীর যুদ্ধ। সেই প্রহসনের যুদ্ধে উমিচাঁদ, রাজবল্লভ, ঘসেটি বেগম এবং হিন্দু বেনিয়াদের বিশ্বাসঘাতকতায় পরাজিত হন বিশাল বাংলার শেষ স্বাধীন নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা।
বাংলাদেশ কব্জা করে নেয় ব্রিটিশ রাজ। এরপর পুরো ভারতবর্ষকেই ব্রিটিশ আগ্রাসীশক্তি উপনিবেশে পরিণত করে দিল্লীর শেষসম্রাট বাহাদুর শাহ জাফরকে পরাজিত করে। এই পরাজয়ের পিছনেও রয়েছে মুসলমানদের প্রতি চরম বিদ্বেষী হিন্দু রাজা-মহারাজা এবং ধনী বেনিয়া সম্প্রদায়ের বিশ্বাসঘাতকতার এক করুণ উপাখ্যান।
উনিশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে ব্রিটিশ অপশাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর স্বাধীনতার আন্দোলন যখন শৌর্যবীর্যে তেজঃদীপ্ত হয়ে দানা বেঁধে উঠছিলো তখনই পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণায় দীক্ষিত বর্ণহিন্দুদের সর্বভারতীয় নেতৃত্ব সৃষ্টি করার লক্ষে অ্যালান অক্টেভিয়ান হিউম এবং অ্যানি বেসান্ত-এর উদ্যোগে জন্ম হয় পরিকল্পনা অনুযায়ী কংগ্রেস পার্টির, ব্রিটিশ রাজের প্ররোচনায় এবং সার্বিক সহযোগিতায়। উদ্দেশ্য ছিল পরিষ্কার। জাতিগোষ্ঠীসমূহের স্বাধীনতার দাবি উপেক্ষা ও দমন করে ব্রিটিশ ইন্ডিয়ান ইউনিয়নকে অটুট রেখে স্বাধীনতার পর প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতের হিন্দু রাজন্যবর্গের বদান্যতা, সার্বিক সাহায্য সহযোগিতার সাথে ভারতবাসীকে বলির পাঁঠা বানানোর পুরস্কার স্বরূপ বর্ণহিন্দুদের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসানো। ব্রিটিশদের এই চক্রান্তের কারণ ছিল মূলত দু’টি।
১। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উপমহাদেশ দখল করতে হয়েছিল মুসলমানদের প্রচণ্ড বিরোধিতার মুখে লড়াই করে। ফলে, শুরু থেকেই মুসলমানরা হয়ে ওঠে ইংরেজদের চক্ষুশূল। পক্ষান্তরে, প্রতিহিংসার রোষানলে বিদগ্ধ বর্ণহিন্দুরা ইংরেজদের প্রতি সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলো মুসলমান সম্রাটের বিরুদ্ধে এবং বরণ করে নিয়েছিল মুসলমান শাসনের পরিবর্তে ইংরেজদের গোলামী।
২। ব্রিটিশ রাজ কায়েমের পর মুসলমানদের বিত্তহীন করে তাদের কাছ থেকে সমস্ত ধনসম্পদ, জমিজমা, ব্যবসা-বাণিজ্য ছিনিয়ে নিয়ে হিন্দুদের হাতে তুলে দেয়া হয়েছিলো চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মাধ্যমে। এভাবেই হিন্দুরা আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে রাতারাতি বিত্তশালী এবং প্রভাবশালী হয়ে ওঠে আর মুসলমানদের পরিণত করা হয় নিঃস্ব, পশ্চাদপদ সম্প্রদায়ে। সুদীর্ঘ দু’শ বছরের ইংরেজ গোলামির ইতিহাসের শেষদিন পর্যন্ত হিন্দু সম্প্রদায়কে ব্রিটিশরা দেখেছে অনুগত আস্থাভাজন হিসাবে, আর মুসলমান সম্প্রদায়কে দেখেছে সন্দেহজনক বিদ্রোহী হিসাবে।
পাশ্চাত্য সভ্যতা ও ধ্যান-ধারণায় বিশেষভাবে আকৃষ্ট বর্ণ এবং উচ্চ শ্রেণীর হিন্দুদের আনুগত্য সম্পর্কে ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী ছিল সুনিশ্চিত। তাই, তারা চেয়েছিল স্বাধীনতাত্তোর কালে ভারতের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসাতে হবে মুসলমানদের নয়-উচ্চবিত্তের হিন্দুদের, এতে পরোক্ষভাবে সম্ভব হবে তাদের কায়েমী স্বার্থ বাঁচিয়ে রাখা। এরই জন্য প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল কংগ্রেসকে সর্বভারতীয় পার্টি হিসাবে গড়ে তোলার।
কংগ্রেস গড়ে তুলতে সুপরিকল্পিত ভাবে ধর্মীয় চেতনাকে সতর্কতার সাথে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলো নব্য চাণক্যরা। ভারত মাতা, হিন্দুস্তান, বন্দেমাতরম ও জয়হিন্দ স্লোগান তুলে হিন্দু সম্প্রদায়ের আস্থা ও সমর্থন লাভে সফল হয়ে কংগ্রেসকে একমাত্র জাতীয় দল হিসাবে গড়ে তুলতে সক্ষম হন গান্ধী এবং দলীয় নেতৃবৃন্দ।
ধর্মনিরপেক্ষতার নামে কংগ্রেস যখন হিন্দুত্ববাদের নামাবলি গায়ে চড়াতে চাইলো সারা উপমহাদেশে তখন সব সংখ্যালঘু ভিন্নধর্মীয় সম্প্রদায়গুলো নিজেদের স্বকীয়তা বজায় রাখার জন্য স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হয়।
মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির দাবি জানিয়ে বাংলাদেশের ঢাকা শহরেই জন্ম নিলো মুসলিমলীগ নামের রাজনৈতিক দল নওয়াব স্যার সলিমুল্লাহর নেতৃত্বে। কংগ্রেস ও মুসলিমলীগের নৈতিক এবং দ্বান্দ্বিক বাস্তবতাই ছিল দ্বিজাতি তত্ত্ব। ক্রমান্বয়ে হিন্দুদের জন্য হিন্দুস্তান আর মুসলমানদের জন্য পাকিস্তান এই দুই দাবিতে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক মেরুকরণ ভয়াবহ সংঘাতের রূপ ধারণ করে। রক্তক্ষয়ী দাঙ্গায় বিপুল প্রাণহানি ও ক্ষয়ক্ষতি ছড়িয়ে পড়ে সারা ভারতবর্ষে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের মতো পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার আন্দোলনেও ত্যাগ ও তিতিক্ষায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলো বাংলাদেশের মুসলমানরাই। ইতিহাস তার সাক্ষী। পাকিস্তান আন্দোলনের প্রথম শহীদ সংগ্রামী ছিল খুলনার কারমাইকেল কলেজের এক তরুণ ছাত্র। সেই মিছিলের নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন আমার স্বর্গীয় পিতা আলহাজ শামসুল হক তখন সলিমুল্ল্যাহ মুসলিম হলের জেনারেল সেক্রেটারি একিসাথে মুসলিমলীগের ছাত্র এবং যুব সংগঠনের একজন শীর্ষ স্থানীয় নেতা।
রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মোকাবেলা করতে ব্যর্থ হয় ব্রিটিশ রাজ। সেই পরিপ্রেক্ষিতেই দ্বিজাতি তত্ত্ব মেনে নিতে বাধ্য হয় ব্রিটিশ সরকার। ‘ভারত মাতা’কে দ্বিখণ্ডিত করে ১৯৪৭ সালে দু’টি স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম হয় পাকিস্তান ও হিন্দুস্তান (ভারত) নামে।
কালের স্রোতে রাজনৈতিক নেতৃবর্গের অদূরদর্শিতা, অপশাসন, শোষণ-বঞ্চনা এবং দেশি-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর চক্রান্তের ফলে ১৯৭১ সালে এক রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আলাদা হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত করে।
অতএব, অখণ্ড ভারতের যৌক্তিকতা কতটুকু সেটা দিবালোকের মতোই স্পষ্ট। ইতিহাসের নিরিখে বলা যায়, যে সকল জাতিগোষ্ঠী স্বাধীনতার জন্য রক্তের আহূতি দিতে প্রস্তুত তাদের চেতনাকে অস্ত্রের মাধ্যমে পরাস্ত করা কিছুতেই সম্ভব হয় না।
স্বাধীন বাংলাদেশের সৃষ্টি সেই সত্যকেই আরেকবার প্রমাণ করেছে। উপমহাদেশের চলমান স্বাধীনতার সংগ্রামে বিজয়বর্তিকা হিসাবে বাংলাদেশ চিরভাস্বর হয়ে থাকবে।
সাংবিধানিকভাবেও বিশ্ববাসীর যেকোনো স্বাধীনতার সংগ্রামে সমর্থন দিতে অঙ্গীকারবদ্ধ বাংলাদেশ। এটাই প্রতিবেশী ভারতের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিশেষ হুমকি। রক্তের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা রক্ষার চেতনার প্রতীক শিখা অনির্বাণকে কখনোই নেভাতে পারবে না কোনও আগ্রাসী অপশক্তি। লেখক সেটাই বিশ্বাস করে।
কিছু বিভ্রান্তি এবং অপপ্রচারের জবাব
বাংলাদেশের ইতিহাসে ৭ই নভেম্বর এর সিপাহী-জনতার মহান বিপ্লব দেশপ্রেমের এক উজ্জ্বল নিদর্শন বিধায় যথাযথ মর্যাদায় স্মরণীয়। এ বিষয়ে আমার লেখা ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস ১৯৭৫ এবং অব্যাহতি আইনসমূহ’ তে ঘটনাসমূহের বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরেছি। তার পুনরাবৃত্তির প্রয়োজন নেই।
কিন্তু ঐদিনের সংঘটিত ঘটনাবলি নিয়ে যে দ্বন্দ্ব ও বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা চালানো হচ্ছে তার ব্যাখ্যা দেয়া অতি আবশ্যক যাতে করে পাঠকরা সত্য জানতে পারেন।
৭ই নভেম্বরের ঘটনা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।
‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা, জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের প্রত্যাশায় অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে এককভাবে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় আওয়ামী-বাকশালী একদলীয় স্বৈরশাসনের যাঁতাকলে জাতির শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থা, আর্থিকভাবে দেশকে তলা বিহীন ঝুড়িতে পরিণত করা, ২৫ বছরের গোলামির চুক্তি, শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য একদলীয় স্বৈরচারী বাকশালি শাসন প্রবর্তন করে জাতির মানবিক, গণতান্ত্রিক অধিকার এবং বাক-স্বাধীনতা হরণ করে বাংলাদেশকে ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার পাঁয়তারার পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের লক্ষেই সেনা পরিষদের নেতৃত্বে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী ঘটিয়েছিলো ১৫ই আগস্টের সফল সামরিক অভ্যুথান। ১৫ই আগস্টের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান, ২-৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদ-চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা এবং ৭ই নভেম্বর এর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের ঘটনাগুলো একই সূত্রে বাঁধা।
একটি বিশেষ মহলের বক্তব্য হল ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের মাধ্যমে জেনারেল জিয়া দেশের ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত হন। বলা হয়, দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠাতাও নাকি জিয়াউর রহমান। আরও বলা হয়, ১৯৭১ সালের চট্টগ্রামের সেনাবিদ্রোহের সিদ্ধান্তের সব কৃতিত্বও নাকি জেনারেল জিয়ার একার। কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে ২৬-২৭শে মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট হিসাবে স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্র গঠনের ঘোষণা দিয়ে বিশ্ববাসীর সমর্থন চাওয়ার সিদ্ধান্তটিও ছিল জেনারেল জিয়ার একান্ত সিদ্ধান্ত। এসব বক্তব্যের সত্যতা যাচাইয়ের জন্য কিছু তথ্য নিচে বর্ণিত হল।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তা পূর্ব পাকিস্তানে সার্বিক সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করার পর পরিকল্পনার অংশ হিসাবে চট্টগ্রাম থেকে সিনিয়রমোস্ট বাঙ্গালী অফিসার ব্রিগেডিয়ার মজুমদার ও তার একান্ত সচিব তদানিন্তন ক্যাপ্টেন আমিন আহমেদ চৌধুরীকে ঢাকায় ডেকে পাঠায় এবং তাদের সেখানে বন্দী করে রাখা হয়। পাক বাহিনীর মূল টার্গেট ছিল ঢাকার পিলখানার বিডিআর হেডকোয়ার্টার, শান্তিনগরে অবস্থিত পুলিশ লাইন, রাজশাহীর সারদার পুলিশ একাডেমী, চট্টগ্রামের ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টার।
সেনা অভিযানের কিছুদিন আগেই পাক আর্মি পিলখানার বিডিআর সিগন্যাল সেন্টারটি তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। দেশের রেডিও এবং টিভি কেন্দ্রগুলোও কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় নেয়া হয়েছিল অনেক আগেই।
চট্টগ্রামে ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার ছিলেন পাঞ্জাবী কর্নেল জানজুয়া। মেজর জিয়া ছিলেন সেকেন্ড ইন কমান্ড। অন্যান্য অফিসারদের মধ্যে ছিলেন মেজর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান, ক্যাপ্টেন ভুঁইয়া, ক্যাপ্টেন মহসিন, লেফটেন্যান্ট অলি, লেফটেন্যান্ট শমশের মুবিন চৌধুরী প্রমুখ। কর্নেল চৌধুরী ছিলেন ইবিআরসি এর কমানড্যান্ট। ক্যাপ্টেন রফিকুল ইসলাম তখন চট্টগ্রামের বিডিআর এর এডজুটেন্ট। ২৫শে মার্চ কালরাতে ঢাকায় বিডিআর হেডকোয়ার্টারে খান সেনাদের আচমকা আক্রমণের খবর পেয়েই ক্যাপ্টেন রফিক তার অধীনস্থ সব বিওপিতে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সবাইকে নিরস্ত্র করে বন্দী করে বিওপিগুলো বাঙ্গালীদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেবার আদেশ দিয়ে যোগাযোগ করেন ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অফিসারদের সাথে। ৮ম ইস্টবেঙ্গল তখন ষোলশহর এলাকায় ডেপ্লয়েড ছিল। শহরের আইন-শৃঙ্খলা বজায় রাখার দায়িত্ব ছিল তাদেরই।
সেই সময় মেজর জিয়া কর্নেল জানজুয়ার হুকুমে যাচ্ছিলেন বন্দরে নোঙ্গর করা জাহাজ এম ভি সোয়াত থেকে গোলাবারুদ নামানোর কাজ তদারক করার জন্য। পথে অজস্র লোকের ভিড় আর ব্যারিকেড সরিয়ে অগ্রসর হতে হচ্ছিলো তাকে।
ঠিক সেই সময়, মধ্যরাতে অপারেশন শুরু হয় ক্যান্টনমেন্টে ইস্টবেঙ্গল সেন্টারে। আচমকা হামলায় কর্নেল চৌধুরীসহ শত শত প্রশিক্ষণরত বাঙ্গালী রিক্রুট সেনাকে নৃশংস ভাবে ঘুমন্ত অবস্থায় মেরে ফেলে শহীদ করা হয়। সেই অবস্থায়, ৮ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে সমবেত হতভম্ব অফিসার ও সৈনিকরা বুঝতে পারলেন মেজর জিয়াকে মেরে ফেলার জন্যই তাকে পতেঙ্গা পাঠানো হয়েছে প্ল্যান করেই। কালবিলম্ব না করে তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামানকে পাঠানো হয় মেজর জিয়াকে ফিরিয়ে আনার জন্য। কারণ ওয়্যারলেসে মেজর জিয়ার সাথে যোগাযোগ সম্ভব হচ্ছিলো না। তার সাথের অপারেটর এবং দেহরক্ষীদের সবাই ছিল অবাঙ্গালী। সেটাই সবার জন্য ছিল মূল আশংকার কারণ।
ক্ষিপ্রগতিতে জীপ চালিয়ে আগ্রাবাদের কাছে মেজর জিয়াকে ধরতে সক্ষম হন ক্যাপ্টেন খালেকুজ্জামান। ক্যান্টনমেন্টের ঘটনাবলির সব কিছু জানার পর জিয়া এবং খালিকুজ্জামান সাথের খানসেনাদের সকলকে মেরে ফিরে আসেন ৮ম ইস্টবেঙ্গল এর হেডকোয়ার্টার ষোলশহরে।
সেখানে পৌছে ক্যাপ্টেন রফিকের বিদ্রোহ এবং ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টাল সেন্টারে আচমকা হত্যাযজ্ঞের লোমহর্ষক বিস্তারিত বিবরণ জানতে পারেন মেজর জিয়া। সবার সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় ৮ম ইস্টবেঙ্গল বিদ্রোহ করবে। সিদ্ধান্তের পর মেজর জিয়া এবং অফিসারদের একটি দল কর্নেল জানজুয়ার বাসায় গিয়ে ৮ম ইস্টবেঙ্গল বিদ্রোহ করেছে জানানোর পর তাকে এবং পাহারারত সব অবাঙ্গালী সেনাদের কাবু করে তাদের মেরে ফেলেন। এরপর, সর্বসম্মতিক্রমে মেজর জিয়া ৮ম ইস্ট বেঙ্গলের কমান্ডিং অফিসার হিসাবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
এরপরই সারা ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়ে বিদ্রোহের আগুন। শুরু হয় পশ্চিমা হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় বিক্ষিপ্তভাবে যুদ্ধকারী সেনা সদস্যদের সঙ্ঘবদ্ধ করার জন্য ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে কালুরঘাট সেতুর অপর প্রান্তে পজিশন নেবার। সম্মুখ যুদ্ধের পরিবর্তে দীর্ঘস্থায়ী সংগ্রাম গড়ে তোলার জন্যই এই কৌশলগত সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিলো। সিদ্ধান্ত নেয়া হয় কালুরঘাটে অবস্থিত বুস্টার স্টেশনের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে দেশবাসীকে জনযুদ্ধ গড়ে তোলার আহ্বান জানাতে হবে। বিশ্ববাসীকে আবেদন জানাতে হবে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়ে সার্বিক সাহায্য সহযোগিতা প্রদানে এগিয়ে আসার জন্য। আরও সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সিনিয়রমোস্ট অফিসার হিসাবে মেজর জিয়া নিজেই অস্থায়ী সুরকারের রাষ্ট্রপতি হিসাবে সেই ঘোষণা দেবেন। কালুরঘাটে ক্যাপ্টেন হারুন আহমেদ চৌধুরী কক্সবাজার থেকে তার বিডিআর কন্টিনজেন্টের সৈনিকদের নিয়ে বিদ্রোহ করে মেজর জিয়ার বাহিনীর সাথে যোগদান করেন।
২৬-২৭ মার্চের স্বাধীনতার ঐতিহাসিক ঘোষণা কালুরঘাটের বুস্টার ট্রান্সমিটার থেকে তরুণ ইঞ্জিনিয়ার সৈয়দ আবদুস শাকের ও বেতার কর্মী বেলাল মোহাম্মদ ও তার সঙ্গীদের একান্ত প্রচেষ্টাতেই প্রচার করা সম্ভব হয়েছিলো। পরে যেকোনো কারণেই হউক জিয়ার ভাষণে পরিবর্তন এনে বলা হয়েছিলো শেখ মুজিবের নির্দেশেই তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
এই ঘোষণার ফলশ্রুতিতে দেশের সর্বত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট, ইপিআর, পুলিশ, আনসার এবং মুজাহিদ বাহিনীর সদস্যদের কেন্দ্র করে। স্থানীয়ভাবে জেলা ও মহকুমা প্রশাসকদের অনেকেই উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছিলেন প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলতে।
নুরুল কাদের চৌধুরী, তৌফিক এলাহি চৌধুরী, আকবর আলি খান, কামাল সিদ্দিকি, মাহবুবুল আলম চাষি, আসাদুজ্জামান, তৌফিক ইমাম, খসরুজ্জামান, মামুনুর রশিদ, অলিউল ইসলাম, সারদা পুলিশ একাডেমির প্রধান আব্দুল খালেক, পিএসপি অফিসার মাহবুব এদের অন্যতম। এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তান আমলের প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত চৌকস সিএসপি এবং পিএসপি অফিসার।
মেজর জিয়ার কালুরঘাট থেকে দেয়া স্বাধীনতার ঘোষণা তার জন্য কাল হয়ে ওঠে। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আওয়ামীলীগ সরকার এবং ভারতের শাসকগোষ্ঠীর চক্ষুশূল ছিলেন জেনারেল জিয়া। তার স্বাধীনতার ঘোষণাকে আজঅব্দি মেনে না নিয়ে অস্বীকার করে চলেছে, মুছে ফেলার চেষ্টা করা হচ্ছে জেনারেল জিয়ার নাম দেশের সর্বক্ষেত্র থেকে ইতিহাস বিকৃতির মাধ্যমে।
এই কারণেই যুদ্ধকালীন সময় থেকেই প্রবাসী ও ভারত সরকার জিয়াকে সন্দেহের চোখে দেখেছে উচ্চাভিলাষী এক সেনা অফিসার হিসাবে। সেই কারণেই হঠাৎ করে যুদ্ধের প্রারম্ভেই তাকে ১নং সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে থিয়েটার রোডের হেডকোয়ার্টারে নিযুক্তি দেয়া হয় স্টাফ অফিসার হিসাবে। পরে যখন শফিউল্লাহ এবং খালেদ মোশাররফের নেতৃত্বে ‘এস’ ফোর্স এবং ‘কে’ ফোর্স নামে দু’টি নিয়মিত ব্রিগেড প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তখন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা সোচ্চার হয়ে ওঠে। তাদের চাপের মুখে ‘জেড’ ফোর্স নামে তৃতীয় আরেকটি ব্রিগেড বানিয়ে জিয়াকে তার অধিনায়ক বানাতে বাধ্য হয় মুজিবনগর প্রবাসী ও তাদের মুরুব্বি ভারত সরকার।
দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারাই স্বাধীনতার পর সেনা সদস্য হিসাবে গঠন করেছিলেন গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ, সামরিক বাহিনী গঠন প্রক্রিয়ায় যদিও এর সূতিকাগার ছিল ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ। জেনারেল জিয়াকে নিয়েই ধাপে ধাপে সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে নিখাদ গণমুখী জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক রাজনীতির উন্মেষ ঘটিয়ে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবার জন্য দেশব্যাপী সাংগঠনিক তৎপরতা এগিয়ে নিয়ে চলেছিল সেনা পরিষদ। জেনারেল জিয়ার সাথে সেনা পরিষদের সম্পর্কের বিষয়টি কৌশলগত কারণে সুচিন্তিতভাবে গোপন রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল শুরু থেকেই।
স্বাধীনতার পর কর্নেল পদে জিয়াকে পদোন্নতি দিয়ে মুজিব সরকার হঠাৎ করে যখন তাকে বার্মায় (মিয়ানমার), পূর্ব জার্মানি অথবা বেলজিয়ামে মিলিটারি এট্যাঁ’চে করে সেনাবাহিনী থেকে সরিয়ে দেয়ার চক্রান্তমূলক সিদ্ধান্ত নেয় তখন সেনা পরিষদই অগ্রণী ভূমিকা পালন করে সেনাবাহিনীতে এই অন্যায়ের প্রতিবাদে উত্তেজনা সৃষ্টি করে শেখ মুজিবের সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করেছিলো। প্রবল চাপের মুখে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব বাধ্য হয়েছিলেন সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে। এরপর যখন বয়োজ্যেষ্ঠতার তালিকায় জিয়াকে ডিঙ্গিয়ে শফিউল্লাহকে মেজর জেনারেল হিসাবে পদোন্নতি দিয়ে তাকে সেনাপ্রধান বানায় শেখ মুজিব সরকার তখনও প্রতিবাদী বিস্ফোরণোন্মুখ পরিস্থিতি সৃষ্টির পেছনেও অগ্রণী ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ। সেনা বিদ্রোহের ভয়ে আতঙ্কিত শেখ মুজিবকে বাধ্য করা হয়েছিলো জিয়াকে শফিউল্লাহর সমপর্যায়ে পদোন্নতি দিয়ে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ নামে একটি বিশেষ পদ সৃষ্টি করে সেখানে জিয়াকে নিয়োগ প্রদান করতে। এ ক্ষেত্রেও মূল ভূমিকায় ছিল সেনা পরিষদ। এ ভাবেই জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেয়ার প্রতিটি সরকারী প্রচেষ্টাকেই ব্যর্থ করে দিয়েছিলো সেনা পরিষদ।
এই পটভূমিকাতেই ১৫ই আগস্ট সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুথানের পর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী শফিউল্লাহকে অপসারণ এবং সেনা পরিষদের প্রতিনিধি হিসাবে জেনারেল জিয়াকে সেনা প্রধানের পদে নিয়োগ দেন প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ। একই কারণে এয়ার ভাইস মার্শাল তাওয়াব নিয়োগ প্রাপ্ত হন বিমান বাহিনী প্রধান হিসেবে। রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে রাখা হয় নৌ বাহিনীর চীফ হিসেবে। পরবর্তী সময়ে রিয়ার এডমিরাল এম এ খানকে ন্যাভাল চীফ পদে নিযুক্তি দেয়া হয় এম এইচ খানকে সরিয়ে।
২-৩ নভেম্বর খালেদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতার প্রারম্ভে সেনা প্রধান জেনারেল জিয়াকে গৃহবন্দী করা হয়। পরে তাকে বাধ্য করা হয় পদত্যাগ করতে। খালেদ নিজেই মেজর জেনারেল বনে আর্মি চীফ পদ দখল করে নেন। কিন্তু মাত্র ৩ দিনের ব্যবধানে ৭ই নভেম্বর সেনা পরিষদ ও কর্নেল তাহেরের নিয়ন্ত্রণাধীন বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সংঘটিত সফল বিপ্লবের পরিণতিতে জেনারেল খালেদ মোশাররফ এবং তার সহযোগী কর্নেল নাজমুল হুদা, মেজর হায়দার ও খালেদের বিশ্বস্ত বন্ধু এবং ভায়রা কে কিউ হুদা পলায়ন কালে ক্ষুব্ধ বিপ্লবী সেনাদের হাতে নিহত হন।
বঙ্গভবন থেকে দেয়াল টপকে পালাবার সময় কর্নেল শাফায়াত জামিলের পা ভেঙ্গে গেলে পলায়ন কালে নারায়ণগঞ্জের কাছে ক্ষুব্ধ জনতা তাকে স্থানীয় প্রশাসকের হাতে সমর্পণ করে। মেজর হাফিজকেও বিক্ষুব্ধ জনগণের হাতে বন্দী হতে হয়।
অন্যদিকে সফল বিপ্লবের পরমুহূর্তেই ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের ভারপ্রাপ্ত কমান্ডিং অফিসার মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে আর্টিলারি, ল্যান্সার, সিগন্যাল, ইঞ্জিনিয়ার, ইএমই, সাপ্লাই, অর্ডিন্যান্স, মেডিকেল কোরের প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত একটি ট্যাংকের শোভাযাত্রা বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী স্লোগান দিতে দিতে সেনা পরিষদের নিযুক্ত আর্মি চীফ জেনারেল জিয়াকে কাঁধে তুলে ২ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্টের হেডকোয়ার্টারে নিয়ে আসে।
যখন বিপ্লবীরা জিয়াকে মুক্ত করে নিয়ে আসছিল তখন জিয়াপত্নী খালেদা জিয়া সৈনিকদের হাতে-পায়ে ধরে শঙ্কিত হয়ে তাকে না নিয়ে যাবার জন্য কাকুতি-মিনতি করছিলেন আর জিয়া অনুরোধ করছিলেন শুধু তার পেনশনটা নিশ্চিত করে দেবার জন্য। তখন মেজর মহিউদ্দিন অভয় দিয়ে খালেদাকে বলেছিলো, ভাবী আপনি ভয় পাচ্ছেন কেন? স্যার আমাদের চীফ, সেই পদেই পুনর্বহালের জন্য আমরা তাকে নিয়ে যাচ্ছি। এভাবেই আশ্বস্ত করা হয়েছিল দু’জনকেই। জিয়ার নিরাপত্তার ব্যবস্থা এবং অন্যান্য করণীয় সম্পর্কে সার্বক্ষণিক নির্দেশ দিচ্ছিলেন ব্যাংকক থেকে দেশত্যাগী সেনা পরিষদের শীর্ষনেতারা। এই বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণ থাকবে লেখার ধারাবাহিকতায়।
গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা, শৃঙ্খলাবোধ, দায়িত্বজ্ঞান, গোপনীয়তা, যোগাযোগের বিষয়ে কঠিন কম্পার্টমেন্টেশন নীতিসমূহ কেন্দ্র থেকে তৃণমূল পর্যায়ের সেনা পরিষদের নেতাকর্মীদের সবাইকে আন্তরিকতার সাথে কঠোরভাবে মেনে চলতে হতো। সেনা পরিষদের মূল আদর্শিক নীতিসমূহ ছিলঃ- জাতীয়তাবাদ, সাংস্কৃতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে নিখাদ গণতন্ত্র, সুষম সমাজ ব্যবস্থা, মানবিক অধিকার, নিরপেক্ষ আইনের শাসন কায়েম করে নিজস্ব সত্তা বিকাশের মাধ্যমে স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সুখী-সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলা।
আমাদের সংগঠনের এই নীতি-আদর্শ শুধু মাত্র মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যদের কাছেই নয় দেশের সংখাগরিষ্ঠ জনগণের কাছেও গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছিলো।
জেনারেল জিয়ার নিরাপত্তার স্বার্থেই সেনা পরিষদের গঠন প্রক্রিয়া, কার্যক্রম, জনপ্রিয়তা, বিভিন্ন সমমনা রাজনৈতিক দল, ব্যক্তিত্ব, পেশাজীবী ও শ্রমিক সংগঠন, ছাত্র ও যুব সম্প্রদায়, সুশীল সমাজ ও ব্যবসায়ী মহলের বিভিন্ন নেতা-নেত্রীর সাথে সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের যোগাযোগের বিষয়ে বিস্তারিত কিছুই তেমন আলোচিত হতো না। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো সম্পর্কেই প্রয়োজন মতো তাকে অবহিত রাখা হতো।
সেনাবাহিনীর গঠন প্রক্রিয়ার শুরুতেই মেজর জলিল আর্মি থেকে পদত্যাগ করেন, চাকুরী থেকে অব্যাহতি নেন কর্নেল তাহের। দু’জনই পরে জাসদে যোগদান করেন। এক পর্যায়ে বঙ্গশার্দুল কর্নেল জিয়াউদ্দিন পদত্যাগ করে যোগ দেন সর্বহারা পার্টিতে।
জাসদের ধর্মহীনতার ভিত্তিতে রাজনৈতিক দর্শন বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র ধোপে টেকেনি ধর্মপ্রাণ বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কাছে। একই ভাবে, সর্বহারা পার্টির শ্রেণি সংগ্রামের নামে গলাকাটার রাজনীতিও প্রত্যাক্ষ্যাত হয়েছিলো সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাদেশীদের কাছে।
জাসদ মূলত আওয়ামীলীগেরই ‘বি’ টিম, সেটা মেজর জলিল এবং কর্নেল তাহেরের বুঝতে বেশি সময় লাগেনি। হতাশাগ্রস্ত জনদরদী দেশপ্রেমিক কর্নেল তাহের পরে নিজের উদ্যোগেই বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা নামের একটা সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করেন সামরিক বাহিনীর মধ্যে। তার সেই একক প্রচেষ্টাও তেমন ফলপ্রসূ হয়নি। শুধুমাত্র ঢাকা সেনানিবাসেই গুটিকতক সেল সৃষ্টি করা সম্ভব হয়েছিলো কর্নেল তাহেরের পক্ষে।
আমার এই বক্তব্যের সত্যতা লেখার ধারাবাহিকতায় পাঠকের কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠবে। শুধু মাত্র জাসদ ও সর্বহারা পার্টির সাথেই নয়, দেশের অন্যান্য দেশপ্রেমিক প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল, গোষ্ঠী, এবং বিভিন্ন পেশার সমমনা ব্যক্তিদের সাথে যুদ্ধকালীন সময় থেকেই যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো সেনা পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতৃবৃন্দ। সেই ধারাবাহিকতা বজায় রাখা হয় স্বাধীনতার পরও।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক এবং ডানপন্থী দলগুলোর কোনও অস্তিত্বই ছিল না। এরপরও ঐ সমস্ত দলের বিশ্বস্ত নেতা-কর্মীদের সাথেও যোগাযোগ রক্ষা করে চলেছিলো সেনা পরিষদ বিভিন্ন সূত্রে। এমনকি আওয়ামী-বাকশালীদের মধ্যে যে সমস্ত নেতা-নেত্রী, সচেতন কর্মীরা মুজিবের স্বৈরশাসন এবং ভারতের পদলেহী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ ছিলেন কিন্তু বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে খোলাখুলিভাবে মুজিবের বিরোধিতা করতে ছিলেন অপারগ তাদের সাথেও যোগাযোগ ছিল সেনা পরিষদের নেতাদের।
সংসদ অধিবেশনে কয়েক মিনিটের মধ্যে কাউকে কোনও কিছু বলার সুযোগ না দিয়ে শেখ মুজিব আওয়ামীলীগের মৃত্যু ঘটিয়ে একদলীয় স্বৈরশাসন বাকশাল কায়েম করে নিজেকে যখন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষণা দেন তখন শুধুমাত্র দুইজন সাংসদ এর প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে পদত্যাগ করে অধিবেশন কক্ষ ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছিলেন। তারা হলেন, বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। দীর্ঘ দিনে গড়ে ওঠা পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই সম্ভব হয়েছিলও এ ধরনের যোগাযোগ চালিয়ে যাওয়া।
এক সময় মেজর তাহেরকে সাথে নিয়ে পাকিস্তান থেকে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করতে। আমাদের সাথে আসতে না পারলেও পরে তিনি পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগদান করেন এবং সেনা পরিষদের একজন নেতাও হয়েছিলেন। কিন্তু পরে এক সময় সমাজতন্ত্রের ভূত মাথায় চেপে বসায় তিনি সেনা পরিষদ ত্যাগ করে জাসদে যোগদান করেন। একই ঘটনা ঘটে মেজর জলিলের সাথেও। পরে জাসদ ছেড়ে আবার সেনাপরিষদে ফিরে আসা সম্ভব না হলেও তাদের সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠতা ছিল তাদের অকাল মৃত্যুর আগপর্যন্ত।
একই ভাবে, রাজনৈতিক দর্শন নিয়ে মতপার্থক্য থাকলেও কর্নেল তাহের, মেজর জলিল ছাড়া সিরাজ সিকদার ও কর্নেল জিয়াউদ্দিনের সাথেও আমাদের সুসম্পর্ক বজায় ছিল বরাবরই। এর ভিত্তি ছিল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম এবং মুক্তিযুদ্ধের গণমুক্তির চেতনা। আমরা জানতাম, মত ও পথের ফরাক থাকলেও প্রয়োজনে দেশ ও জাতীয় ক্রান্তিলগ্নে একত্রিত হতে পারবো আমরা সবাই অতি সহজেই। এই প্রসঙ্গে বিস্তারিত লেখা আছে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে।
রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবের শাসনকালে বন্দী অবস্থায় বীর মুক্তিযোদ্ধা সিরাজ সিকদারকে নির্মমভাবে গুলি করে হত্যা, রাষ্ট্রপতি জিয়ার আমলে বিচারের প্রহসনের মাধ্যমে হাজার হাজার সেনা সদস্য নিধন, ক্র্যাচের কর্নেল তাহের বীর উত্তমের ফাঁসি, ১৯৮১ সালে তৎকালিন সেনাপ্রধান জেনারেল এরশাদের হুকুমে বন্দী অবস্থায় জেনারেল মঞ্জুরকে গুলি করে হত্যা এবং একই সাথে ১৭ জন বীর মুক্তিযোদ্ধাকে বিচারের প্রহসনে মৃত্যুদণ্ড দেয়া, ১৯৯৬ সাল থেকে খালেদা জিয়ার দু’-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠ জোট সরকারের আমলসহ দীর্ঘ ১৪ বছরেরও বেশি সময় সংবিধান বিরোধী খুনের সাজানো মামলার আসামী করে সেনাবাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা ৫ জন দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা- কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিন (যে জিয়াকে ৭ই নভেম্বর মুক্ত করেছিল), মেজর হুদা (প্রাক্তন সাংসদ), মেজর মহিউদ্দিনকে অমানবিক অবস্থায় ডেথ সেল এ রাখার পর, ২০১০ সালে মুজিব কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা খালেদা জোটের মুখে কুলুপ আঁটা পরোক্ষ সমর্থনে বিশ্ববাসীর তীব্র নিন্দার তোয়াক্কা না করে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং গলা কেটে হত্যা (জু্ডিশিয়াল মার্ডার) এর মাধ্যমে পিতৃহত্যার প্রতিশোধ মেটানো এবং বিডিআর হত্যাযজ্ঞের মতো ন্যক্কারজনক ঘটনাগুলোর প্রতিকার দেশবাসীকে অবশ্যই করতে হবে বিবেকের তাড়নায়।
তা না করলে নৈতিকতাহীন অসৎ, বেঈমান ক্ষমতালোভী নেতা-নেত্রীদের চাপিয়ে দেয়া কলঙ্কের অভিশাপ থেকে জাতি কখনোই মুক্ত হতে পারবে না।
যে জাতি জাতীয় বীরদের সম্মান করতে পারে না সে জাতি ধ্বংস হয়ে যায়- এটাই ইতিহাসের লিখন। তবে লেখক দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করেন বাংলাদেশীরা তেমন জাতি নয়।
স্বাধীনতার পর বিপ্লবী সিরাজ সিকদারের সর্বহারা পার্টি শেখ মুজিবের সরকারের বিরুদ্ধে ত্রাসের সৃষ্টি করে। দুই বছরের মধ্যেই ৬০টিরও বেশি থানা এবং ২০-টিরও বেশি ব্যাংক লুট করে তার দল চমক সৃষ্টি করে তরুণ প্রজন্মকে রোমাঞ্চিত করতে সক্ষম হয়। কিন্তু যেহেতু তার দলের আদর্শ ছিল শ্রেণিসংগ্রাম ও নাস্তিকতা ভিত্তিক সমাজতন্ত্র তাই বৃহত্তর জনগোষ্ঠী সর্বহারা পার্টির আদর্শ গ্রহণ করেনি।
যাই হোক, তৎকালিন ডিআইজি জনাব ই এ চৌধুরী তার শ্যালককে সর্বহারা পার্টিতে গুপ্তচর হিসাবে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে তার দেয়া খবরের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম থেকে আচমকা সিরাজ সিকদারকে বন্দী করতে সক্ষম হন। সেইদিনই তাকে ঢাকায় এনে রক্ষীবাহিনীর সদর দফতরে রাখা হয়। অকথ্য নির্মম অত্যাচার চালানো হয় তার উপর বন্দী অবস্থায়। যে রাতে শেখ মুজিবের হুকুমে তাকে মেরে ফেলা হয় সেই রাতের দ্বিপ্রহরে আমি আর গুডুভাই (কর্নেল নাজমুল হুদা) গোপনে রক্ষীবাহিনী প্রধান কর্নেল নুরুজ্জামানের অনুমতিক্রমে তাকে দেখতে যাই সেকেন্ড ক্যাপিটালের সদর দফতরে। সঙ্গে কিছু ফল ও খাবার নিয়ে গিয়েছিলাম, কিন্তু কোনও কিছু খাবার অবস্থা তার ছিল না।
মৃতপ্রায় অচেতন অসাড় অবস্থায় তাকে ফেলে রাখা হয়েছিল ঘরের মেঝেতে। গুডুভাই এর এটাই প্রথম দেখা। আমার সাথে দেখা হয়েছে বেশ কয়েকবার। কিন্তু সেই কালরাতে অতিপরিচিত কিংবদন্তির সিংহপুরুষ সিরাজ সিকদারের মুখটাকেও চেনার উপায় ছিল না। সেই লোমহর্ষক দৃশ্য বেশিক্ষণ সহ্য করতে না পেরে বেরিয়ে এসেছিলাম দুজনেই দুঃখ ও গ্লানির অবর্ণনীয় বেদনা বুকে নিয়ে।
পরদিন সংসদের অধিবেশনে দাম্ভিক প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিব স্বয়ং লজ্জাহীনভাবে উচ্চস্বরে গর্জে জানান দিলেন বন্দী অবস্থায় সিরাজ সিকদারকে গুলি করে হত্যার খবরটি। তিনি সংসদে দাঁড়িয়ে দর্পভরে বলেছিলেন-কোথায় আজ সিরাজ সিকদার? এভাবেই সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে বন্দীদের বিনা বিচারে মারার রীতি শুরু করে মুজিব এবং তার আওয়ামীলীগ সরকার।
তার এই ধরনের দাম্ভিক উক্তিতে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল দেশবাসী এবং বিশ্ববিবেক!
সত্য কহন
এ ভাবেই স্বাধীন বাংলাদেশে মানবতা বিরোধী এবং বেআইনি ভাবে বন্দী অবস্থায় হত্যার প্রচলন শুরু করা হয় আওয়ামী-বাকশালি আমলেই। দলীয় প্রধান এবং সরকারের প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান নিজেই ছিলেন হত্যাকারী। সিরাজ সিকদারের মৃত্যুর পর বঙ্গশার্দুল কর্নেল জিয়াউদ্দিন আপ্রাণ চেষ্টা করেছিলেন সর্বহারা পার্টিকে এগিয়ে নিতে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ কোন্দলে পার্টি ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে সম্পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়ে।
স্বাধীন বাংলাদেশে শেখ মুজিবের শাসনকালে রক্ষীবাহিনীসহ আওয়ামীলীগের নেতাদের নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রাইভেট বাহিনী এবং দলীয় সশস্ত্র ক্যাডারদের সীমাহীন দুর্নীতি ও জুলুমের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠা মুক্তিযোদ্ধা, বিরোধী রাজনৈতিক দল এবং সমাজের বিভিন্ন সংগঠনের ৫০,০০০ এরও বেশি নেতা-কর্মীকে আইন বহির্ভূতভাবে বিনা বিচারে হত্যা করা হয়।
শুধু জাসদেরই ৩০,০০০ এর বেশি নেতা-কর্মীকে হত্যা করা হয়েছিলো বলে দাবি করেছিলেন দলীয় নেতৃবৃন্দ যারা আজ সাথীদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে হাসিনার নৌকোয় উঠে নির্বাচনী বৈতরণী পার করে হয়েছেন আওয়ামীলীগের মন্ত্রী!
মুক্তিযুদ্ধের শুরু থেকে শেষঅব্দি যত মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হননি তার চেয়ে বেশি মুক্তিযোদ্ধাকে শহীদ করা হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে। এ ধরনের হত্যাযজ্ঞের জন্য দায়ী ব্যক্তিদের মরণোত্তর বিচার দাবি করা কি ন্যায়সঙ্গত নয়? এর দায়ভার কি করে এড়াতে পারেন মুজিব, জিয়া, এরশাদ, খালেদা, শেখ হাসিনা এবং তাদের সহযোগীরা যারা বিগত ৪৫ বছরের উপর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা উপভোগ করে আসছেন?
জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষার সাথে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে যতোই চমক ও রোমাঞ্চ কোনও রাজনৈতিক দল কিংবা সংগঠন সৃষ্টি করুক না কেনো, তার মোহ দীর্ঘস্থায়ী হয় না। জাসদ ও সর্বহারা পার্টির পরিণতি সেই সাক্ষ্যই বহন করে।
আওয়ামী-বাকশালী অপশাসন এবং নিপীড়নের যাঁতাকলে পিষ্ট জনগণ তাদের সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডে খুশি হয়েছিলেন ঠিকই, কিন্তু তাদের দলীয় নীতি-আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা ছিল সীমিত। তাই ধূমকেতুর মতোই ঘটেছিল তাদের উথান-পতন।
পক্ষান্তরে সঠিক নীতি-আদর্শ এবং কৌশল গ্রহণের ফলে সেনা অভ্যুথানের সপক্ষে জাতীয় পর্যায়ে একটি রাজনৈতিক অঘোষিত মোরচা গঠন করতে সক্ষম হয় সেনা পরিষদ।
শেখ মুজিবের বদান্যতায় যে সমস্ত পা চাটা আওয়ামীভক্ত অফিসাররা এক লাফে মেজর থেকে জেনারেল হয়েছিলেন ঐ সমস্ত কাঁধভারি নপুংসক অফিসারদের চরিত্রের কিছুটা নমুনা এবং জিয়ার সাথে লেখকের সম্পর্ক কেমন ছিল সেটা বুঝার জন্য জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট কর্নেল (অব) এম এ হামিদের (প্রত্যাগত অফিসার) লেখা গ্রন্থ ‘তিনটি সেনা অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা’ থেকে একটি অনুচ্ছেদ তুলে ধরা হল।
“১৫ই আগস্ট আটটার দিকে ক্যান্টনমেন্টের প্রায় সব পদস্থ সিনিয়র অফিসাররা নিজ নিজ ইউনিট থেকে প্রকৃত অবস্থা জানার জন্য এক এক করে সেনাসদরে এসে জড়ো হচ্ছিলেন। আমিও উপস্থিত হলাম ডিএমও কর্নেল নুরুদ্দিনের কামরায়, সেখানে ১৫/২০ জন সিনিয়র অফিসার জমায়েত হয়ে জটলা করছে। সবাই টেবিলের উপর রাখা একটা রেডিওতে খবর শুনছে উপুড় হয়ে। আমি নুরুদ্দিনের কাছে খবর জানতে চাইলাম। সে জানাল, স্যার, আপনি যতটুকু জানেন, ঠিক ততটুকুই আমি জানি, আপাতত খবর ঐ খানে, সে টেবিলে রাখা রেডিওটার দিকে ইঙ্গিত করলো। এরই মধ্যে, দেখলাম দু’টি জীপ কালো ড্রেস পরা সেপাইদের নিয়ে মেইন গেট দিয়ে শোঁ শোঁ করে দ্রুতবেগে এগিয়ে আসছে। চীফের কামরার সামনে এসে থামল জীপ দুটো। একটি জীপ থেকে নামল মেজর ডালিম এবং কারো প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সোজা চীফ এর ঘরের ভেতরে ঢুকতে যাচ্ছিলো ডালিম, পথে বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট কমান্ডার কর্নেল মোমেন আমাদের কাছ থেকে বারান্দা পেরিয়ে মেজর ডালিমের সাথে আমতা আমতা করে কিছু বলার চেষ্টা করে, আমিও তখন বারান্দা থেকে নেমে এসেছি মোমেনের পেছনে। ডালিম বিরক্ত হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠলো, স্যার! দয়া করে চুপচাপ সরে যান। তার রাগান্বিত মূর্তি দেখে আমি বারান্দার একটা ক্ষুদ্র পিলারের পেছনে নিজের শরীরটা কোনোমতে আড়াল করে নিলাম। কর্নেল ভ্যাবাচ্যাকা খাওয়া অবস্থায় ফিরে এলো আমার কাছে।
মেজর ডালিম এসেছে জানতে পেরে নুরুদ্দিনের কামরায় জমা হয়ে যেসব অফিসাররা গভীর মনোযোগ দিয়ে কান পেতে খবর শুনছিল তারা কোনও কিছু না বুঝেই মহাবিপদ আশংকায় পড়ি কি মরি অবস্থায় যে যেদিকে পারল প্রাণ নিয়ে দিল ছুট। এক নিমিষে ১৫/২০ জন সিনিয়র অফিসারের জটলা সাফ! তড়িঘড়ি করতে গিয়ে কেউ চেয়ার উল্টালো, কেউ অন্যকে মাড়ালো। একজন তো আস্ত টেবিলটাই উল্টে ফেলে দিলো। আমিও দিলাম ভোঁ দৌড়। বিপদে চাচা আগে আপনা প্রাণ বাঁচা। তখন চীফের ঘরে উপস্থিত ছিলেন জেনারেল শফিউল্লাহ, জেনারেল জিয়া, ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল নাসিম। জীপ দুটোর উপর রাইফেল হাতে উপবিষ্ট কয়েকজন সৈনিক। যেকোনো মুহূর্তে হুকুম পেলে অনল বর্ষণে প্রস্তুত। যখন দেখলাম কিছুই হচ্ছে না, তখন উঁকিঝুঁকি দিয়ে পূর্বের অবস্থানে পিলারের আড়ালে ফিরে এলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই চীফের ঘরের দরজা খুলে গেলো। বেরিয়ে এলেন চীফ শফিউল্লাহ, তার পেছনে মেজর ডালিম। শফিউল্লাহর মুখ কালো ও গম্ভীর। স্পষ্ট বোঝা গেলো একান্ত নিরুপায় হয়েই তিনি ডালিমের সাথে বেরিয়ে আসছেন। ডালিমের পেছনেই জেনারেল জিয়া, ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ। শফিউল্লাহ নিজের স্টাফ কারেই উঠলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সঙ্গে নিয়ে। আমি লুকিয়েই সবকিছু দেখছিলাম আর শুনছিলাম। জিয়া ডালিমকে সহাস্যে আমন্ত্রণ জানালেন এসো ডালিম তুমি আমার গাড়ীতে। না স্যার, জেনারেল-এর গাড়ীতে আমি কেনো! সুস্পষ্ট জবাব দিয়েই ডালিম তার জীপে চড়ে বসলো। ডালিমের পেছনে শফিউল্লাহ ও জিয়ার গাড়ী তার পেছনে দ্বিতীয় সশস্ত্র জীপ। শোঁ শোঁ করে বেরিয়ে গেলো চারটি গাড়ীই।’’
সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে স্বৈরাচারী বাকশাল সরকারের উচ্ছেদ এবং মুজিবের মৃত্যুর ঘোষণা দিয়েই আমি রেডিও স্টেশন থেকেই প্রথমে জেনারেল ওসমানীকে ফোন করে বলেছিলাম স্যার, দেশবাসীর দোয়া ও আল্লাহপাকের অসীম করুণায় মুজিবশাহীর পতন ঘটাতে সফল হয়েছি আলহামদুলিল্লাহ! রশিদ অল্পক্ষণের মধ্যেই জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদকে নিয়ে এখানে আসছে। পৌঁছেই তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণকারী হিসেবে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিবেন। আজকে সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণের অনুষ্ঠান হবে। জেনারেল জিয়ার সাথে আলাপ করে তিন বাহিনী প্রধানদের রেডিও স্টেশনে নিয়ে আসার জন্য আমি নিজেই যাচ্ছি ক্যান্টনমেন্টে। রক্ষীবাহিনী প্রধান এবং আই জি পুলিশকেও নিয়ে আসার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাহের উদ্দিন ঠাকুর, মাহবুবুল আলম চাষিও আসছেন। কালকে আমি নিজে এসে আপনাকে বঙ্গভবনে নিয়ে যাবো রাষ্ট্রপতির সাথে সাক্ষাতের জন্য। তিনিই আপনাকে অনুরোধ জানাবেন ডিফেন্স এ্যাডভাইজার হিসাবে তার সরকারে যোগ দিতে।
এরপর জিয়াকে ফোন করে তাকে বলি আপনি শফিউল্লাহকে বুঝিয়ে বলবেন, জনপ্রিয় সফল অভ্যুত্থানের বিরুদ্ধে কোন সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অবকাশ নেই। অবস্থার সামাল দিতে হবে সংবিধান অনুযায়ী পদক্ষেপের মাধ্যমেই। তবে একটি বিষয়ে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে। রাষ্ট্রপতি শপথ গ্রহণ করে শফিউল্লাহকে সরিয়ে আপনাকে চীফ অফ স্টাফ পদে বহালের হুকুম জারি করার পরও কৌশলগত কারণেই আপনার সাথে সেনা পরিষদের সম্পর্কের বিষয়টি গোপন রাখতে হবে।
এরই পরিপ্রেক্ষিতে রেডিওতে ঘোষণা শুনে ঢাকা ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল ভোরে যখন জেনারেল জিয়াকে ফোন করেছিলেন তখন নির্লিপ্ত গলায় জিয়া জবাবে বলেছিলেন, “If the President is killed then Vice President is there, let the constitution take its course”. আর জেনারেল জিয়া যখন আমাকে তার স্টাফ কারে বসার আহ্বান জানিয়েছিলেন তখন আমি তার অপ্রত্যাশিত আহ্বানে সাড়া না দিয়ে নিজের জীপেই উঠে বসেছিলাম। চীফের ঘরে আমাকে তেমন কিছুই বলতে হয়নি। জেনারেল জিয়া আর ব্রিগেডিয়ার খালেদই জেনারেল শফিউল্লাহকে যা বোঝাবার বুঝিয়েছিলেন। ব্রিগেডিয়ার খালেদ, চীফ অফ জেনারেল স্টাফ অভিমত দিয়েছিলেন “Bangabandhu is dead. The army has revolted and whole army has celebrated. So, no one can dare to do anything now.” জিয়া বলেছিলেন, “We must uphold the constitution giving allegiance to the new government.”
এ থেকে জেনারেল শফিউল্লাহ বুঝতে পারলেন পুরো সেনাবাহিনী তখন তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে। তাই আমার সাথে বেরিয়ে আসতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন। অল্প সময়ের ব্যবধানে আমি জেনারেল জিয়াসহ তিন বাহিনী প্রধানকে সাথে নিয়ে ফিরে এলাম রেডিও স্টেশনে। রক্ষীবাহিনী প্রধান ও আই জি পুলিশকেও এনে হাজির করা হয়েছে। বিডিআর প্রধানকেও তলব করে আনা হয়েছে।
রাষ্ট্রপতি মোশতাক আহমেদ রেডিও বাংলাদেশ এ পৌঁছানোর পর তাকে আমার নেতৃতেই সর্ব প্রথম ‘গার্ড অফ অনার’ দেয়া হয়। তারপর সেনা পরিষদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি জনাব খোন্দকার মোশতাক আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন। এরপর প্রতিরক্ষা বাহিনী প্রধানরা একে একে সবাই রাষ্ট্রপতি জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদের আনুগত্য প্রকাশ করে বৈপ্লবিক অভ্যুথানের সপক্ষে ভাষণ দিলেন। সেগুলো রেডিও এবং টিভিতে প্রচারিত হয়েছিলো।
ঐদিন সন্ধ্যায় এক অনাড়ম্বর অনুষ্ঠানে খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হিসাবে বঙ্গভবনে শপথ গ্রহণ করেন। ২৫শে আগস্ট সরকারি আদেশে রাজবন্দী মশিউর রহমান এবং অলি আহাদকে বিনাশর্তে মুক্তি দেয়ার সাথে বাকশাল কায়েম করার ফলে বিলুপ্ত সব রাজনৈতিক দলগুলোকে দলীয় রাজবন্দীদের তালিকা প্রদানের অনুরোধ জানানো হয়। একই দিনে জেনারেল ওসমানীকে রাষ্ট্রপতির সামরিক উপদেষ্টা পদে নিয়োগ দেয়া হয়। জেনারেল খলিলুর রহমানকে জয়েন্ট চীফ অফ ডিফেন্স স্টাফ পদে বহাল করা হয়। জেনারেল শফিউল্লাহর স্থানে জেনারেল জিয়াউর রহমান আর্মি চীফ অফ স্টাফ হিসাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। বিমান বাহিনী প্রধান হিসাবে নিযুক্তি পান এয়ার ভাইস মার্শাল এম জি তোয়াব। রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে নৌবাহিনী প্রধান রেখে দেয়া হয়। এখানে পাঠকদের জানতে হবে যেকোনো রাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী প্রধানদের শুধুমাত্র পেশাগত যোগ্যতা কিংবা জনপ্রিয়তার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয় না। এই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়োগ দেবার আগে রাজনৈতিক এবং অন্য আরও অনেক বিষয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ করা হয়ে থাকে।
১৬ই আগস্ট মওলানা ভাসানী নয়া সরকারের প্রতি সমর্থন জ্ঞাপন করে একটি তারবার্তা পাঠান। একই দিনে দৈনিক ইত্তেফাক ও দৈনিক সংবাদ পত্রিকা দু’টি মালিকদের ফিরিয়ে দেয়া হয়।
৩রা অক্টোবর প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদ জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে(রেডিও এবং টিভিতে প্রচারিত) ঘোষণা করেন, ১৯৭৬ সালের ১৫ই আগস্ট থেকে দেশে বহুদলীয় অবাধ গণতান্ত্রিক ধারার রাজনীতি পুনরায় চালু করা হবে এবং ১৯৭৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এ বিষয়ে একটি সরকারি অর্ডিন্যান্সও জারি করা হয়।
এই বাস্তবতার আলোকে, জিয়া কি করে গণতন্ত্রের পুনঃপ্রতিষ্ঠাতা হয়ে উঠলেন? তিনি তো পুনঃনিয়োগের পর প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমেদের আদেশ মোতাবেক বহুদলীয় রাজনীতি চালু করতে বাধ্য হয়েছিলেন মাত্র।
সেনা পরিষদের মধ্যমণি জেনারেল জিয়াকে ৭ই নভেম্বরের পর পুনরায় সেনাপ্রধান হিসাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর আশ্চর্যজনক ভাবে স্বয়ং জেনারেল জিয়া ও তার দোসররা জোর প্রচারণা চালাতে লাগলেন দেশে-বিদেশে যে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের যুগান্তকারী বৈপ্লবিক অভ্যুথানের মূল চালিকা শক্তি গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ, বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা এবং বিপ্লবীদের সাথে তার কোনও সম্পর্কই ছিল না। তাই যদি হয় তবে ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে বিপুল ভোটে বিজয়ী হয়ে তিনি ও তার দল রাষ্ট্রপতি মোশতাকের জারিকৃত ‘Indemnity Ordinance’ টিকে ‘Indemnity Act’ এ রূপান্তরিত করে ৫ম সংশোধনীর অংশ হিসাবে দুই তৃতীয়াংশের বেশি ভোটে নির্বাচিত সংসদে পাস করিয়ে সাংবিধানিক বৈধতা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন কোন যুক্তিতে?
অনেকেই বলার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বিশেষ করে এক ধরনের আঁতেলরা।
তাদের বক্তব্য হচ্ছে আগস্ট বিপ্লবের নেতারা নাকি প্রাণের ভয়ে দেশ ছেড়ে পালিয়েছিলেন। পালিয়ে যাওয়া আর কৌশলগত কারণে দেশত্যাগ-এর মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ বইতে এ সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা আছে, বাংলা ওয়েব সাইট www.majordalimbubangla.com -এও দেয়া আছে। পাঠক যদি সেগুলো পড়ে থাকেন তবে সত্যটা জানতে পারবেন। এবার এগিয়ে চলা যাক।
৩রা নভেম্বর রাত ৮ টা ৪৫ মিনিটে আমরা, সেনা পরিষদের প্রকাশিত হয়ে পড়া শীর্ষ নেতারা পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সপরিবারে উপস্থিত হলাম এয়ারপোর্টে ব্যাংককে যাবার জন্য। সাথে যাচ্ছেন খালেদ ভাই-এর স্ত্রী রুবি ভাবী এবং গুডু ভাই-এর স্ত্রী নিলু ভাবী। পলায়নকারী বিপ্লবীদের সাথে ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল হুদার স্ত্রীরা সহযাত্রী হবেন কন যুক্তিতে? ঢাকা সেনানিবাস থেকে অনেক অফিসার আর সেনারা এসেছিলেন প্রিয় নেতাদের বিদায় জানাতে। ভীরু, পলায়নকারী নেতাদের বিদায় জানাতে এত সেনা সদস্য এয়ারপোর্টে আসবেন কেনো? তারা এসেছিলেন, কারণ তাদের বেশির ভাগই ছিলেন সেনা পরিষদের সদস্য। তাদের জানা ছিল আমরা কৌশলগত কারণেই সাময়িকভাবে দেশত্যাগ করছি।
যথাসময়ে ফকার ফ্রেন্ডশিপ-এর স্পেশাল ফ্লাইটটি আমাদের নিয়ে উড়াল দিল। পথে চট্টগ্রামে রিফুয়েলিং এর জন্য অবতরণ করলো বিমান। আগে থেকে খবর দেয়ায় চট্টগ্রাম সেনানিবাস থেকে সেনা পরিষদের কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা টারম্যাকে অপেক্ষা করছিলেন। আমি প্লেন থেকে নেমে তাদের সাথে কিছু জরুরি আলাপ শেষে প্লেনে ফিরে এলাম। প্লেন টেক অফ না করা পর্যন্ত তারা সেখানেই দাঁড়িয়ে থেকে হাত নেড়ে আমাদের বিদায় জানিয়েছিলেন। এরপর, রেঙ্গুন হয়ে ব্যাংকক পৌঁছলাম। রেঙ্গুন এয়ারপোর্টে অভ্যর্থনা জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত খাজা কায়সার এবং মিলিটারি এট্যাঁ’চে কর্নেল নুরুল ইসলাম শিশু।
ব্যাংককে আমরা
ব্যাংককের বিমানবন্দরে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত সহ অন্যান্য স্টাফরা স্বাগত জানানোর অপেক্ষায় ছিলেন। থাই সরকারের আয়োজিত নিরাপত্তার সাথে আমাদের নিয়ে উঠানো হল সুকুম্ভিত এলাকায় ইন্ট্যারন্যাশনাল হোটেলে। সরকারি খরচায় সেখানেই আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেছিল দূতাবাস। সবকিছু ফ্রী। তারপরও প্রতিদিন ২০০ থাই ভাত হাতখরচা প্রত্যেকের জন্য। মন্দ নয়। দুই ভাবী আমাদের সাথে কিছু সময় কাটিয়ে একই বিমানে ফিরে গেলেন।
ঢাকার সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগের জন্য ডিউটি রোস্টার বানানো হল ফোন অ্যাটেন্ড করার জন্য। দেশে অবস্থানকারী সেনা পরিষদের দায়িত্বশীল নেতারা দ্রুত পরিবর্তনশীল ঘটনার সবকিছুই আমাদের জানাতে থাকেন। সব খবরাখবর এবং ঘটনাবলির চুলচেরা বিশ্লেষণ করে কি করণীয় সেগুলো তাদের জানিয়ে দেয়া হচ্ছিলো ব্যাংকক থেকে। পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী তারা কর্নেল তাহেরের সাথে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সব নির্দেশ কার্যকরী করছিলেন।
জেনারেল জিয়াকে বন্দী করার সময় একটা সাদা কাগজে কর্নেল রউফের মাধ্যমে জেনারেল জিয়ার সই করিয়ে নিয়েছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ। খবরটা জানা থাকায় ২-৩ রা নভেম্বর রাতে ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল-এ পৌঁছেই খালেদ ভাইকে প্রশ্ন করেছিলাম শুধুমাত্র চীফ হবার বাসনায় এ জাতীয় বিশ্বাসঘাতকতা কি করে করতে পারলেন একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে খালেদ ভাই?
তুমি কি মনে করো আমি চীফ হবার লোভেই এখানে এসেছি?
তা নাহলে, সাদা কাগজে জিয়াকে সই করতে বাধ্য করার কি দরকার ছিল? আমার প্রশ্নের জবাব দেয়া সম্ভব হয়নি ব্রিগেডিয়ার খালেদ মোশাররফের পক্ষে।
৪ঠা নভেম্বর প্রেসিডেন্ট-এর কাছে খালেদ প্রস্তাব রাখলেন জিয়াকে বরখাস্ত করে তাকে চীফ অফ আর্মি স্টাফ পদে নিয়োগ দেবার। প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক আহমেদ তাতে সম্মত না হয়ে রাষ্ট্রপতির পদে ইস্তফা দিয়ে নিজের আগামসি লেনের বাড়িতে চলে যান। একই সাথে নিজ নিজ পদে ইস্তফা প্রদান করে বাড়ি চলে গিয়েছিলেন বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং জেনারেল খলিলুর রহমান।
এতে সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা বজায় রাখা অসম্ভব হয়ে পড়ায় খালেদ এক অধ্যাদেশ জারি করে বিচারপতি জাস্টিস সায়েমকে রাষ্ট্রপতি পদে বসান এবং তার মাধ্যমেই এক ফরমান জারি করে নিজে আর্মি চীফ হয়ে বসেন।এরপর রাষ্ট্রপতি সায়েমের মাধমে সংবিধান বাতিল করে মন্ত্রীসভা ও পার্লামেন্ট ভেঙ্গে দিয়ে সারা দেশে মার্শাল ল’ জারি করা হয়। প্রেসিডেন্ট চীফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর এবং তিন বাহিনী চীফ ডেপুটি মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর দায়িত্ব গ্রহণ করে দেশ পরিচালনায় ব্রতী হন। পরদিন সব দৈনিক খবরের কাগজে ছবিসহ এই খবরগুলো ছাপানো হয়। রেডিও এবং টিভিতেও প্রচার করা হয় এসব কিছুই।
এই ধরনের হঠকারিতায় দেশবাসী সন্দিহান হয়ে ওঠেন! আল্লাহ্‌পাকের ইচ্ছায় দেশ ছাড়ার আগে বঙ্গভবনে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে কর্নেল তাহেরের সাথে সেনা পরিষদের নেতাদের বিশ্লেষণে যেমনটি আশা করা হয়েছিলো ঠিক তেমনটিই ঘটিয়ে চলেছিলেন ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং তার পরামর্শদাতারা অবিশ্বাস্য দ্রুততার সাথে। এই সমস্ত খবরের ভিত্তিতে কতগুলো প্রশ্ন চিন্তার খোরাক হিসাবে সব সেনাছাউনিতে এবং বড়-ছোট শহরগুলোতে লিফলেট আকারে ছড়িয়ে দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয় ব্যাংকক থেকে।
১। প্রেসিডেন্ট, বঙ্গবীর জেনারেল ওসমানী এবং জেনারেল খলিলুর রাহমান কেনো পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন?
২। সেনাপ্রধান জেনারেল জিয়াকে কেনো গৃহবন্দী করে রাখা হচ্ছে?
৩। আগস্ট বিপ্লবের নেতারা দেশ ছেড়ে চলে গেলেন কেনো খালেদ-চক্রের সাথে ঘটনার রাত এবং পরের সারাদিন আলোচনার পর?
৪। সংবিধান স্থগিত করে মন্ত্রিপরিষদ ও সংসদ কোন আইনে বাতিল করে সায়েমকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে ব্রিগেডিয়ার খালেদ নিজেকে পদোন্নতি দিয়ে চীফ হয়ে বসলেন?
৫। খালেদের মা আর ভাই রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের বিজয় মিছিল কিসের আলামত?
৬। ভারতের সাহায্যে দেশে আবার একদলীয় স্বৈরশাসন কায়েম করাই কি খালেদ-চক্রের উদ্দেশ্য?
৭। জাতীয়স্বার্থ বিরোধী এই চক্রান্তের বিরুদ্ধে আর একবার গর্জে উঠতে হবে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীকে এবং জনগণকে। এ ছাড়া অন্য কোনও বিকল্প আছে কি?
৮। ধর্মকর্ম কি আবার হুমকির মুখে পড়বে?
সেনা পরিষদ এবং বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে এবং গোপন যোগাযোগ এবং বাস্তব ঘটনা প্রবাহ থেকেই উল্লেখিত প্রশ্নগুলোর জবাব পেয়ে যাচ্ছিলেন দেশবাসী এবং সামরিক বাহিনীর অফিসার ও সৈনিকরা। ফলে সর্বক্ষেত্রে প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে অসন্তোষের বহ্নিশিখা। ক্রমান্বয়ে খালেদ-চক্রের বিরুদ্ধে চলে যেতে থাকে জনমত। এই অবস্থায় ব্যাংকক থেকে পাঠানো নির্দেশ অনুযায়ী সেনা পরিষদের এবং কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতারা খালেদ বিরোধী বিপ্লবের কৌশল-প্রক্রিয়া নিয়ে দেশের সমমনা রাজনৈতিক ও সংগঠনের নেতাকর্মীদের সাথেও মত বিনিময় করতে থাকেন চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছার জন্য। দেশের সব কয়টি সেনানিবাসে কি ঘটছিলো সে সম্পর্কে কিছুই টের পাচ্ছিলো না খালেদ-চক্রের নেতারা। কারণ তারা তখন বঙ্গভবনে ক্ষমতার নেশায় ছিল বিভোর।
৫ই নভেম্বর নতুন চীফ হিসাবে খালেদ হুকুম জারি করে বঙ্গভবন, রেসকোর্স ও ঢাকা শহরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ জায়গাতে মোতায়েন করা সৈনিক এবং ট্যাঙ্কগুলো ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসতে।
জেনারেল খালেদের এই সিদ্ধান্ত বিপ্লবীদের জন্য হয়ে ওঠে সোনায় সোহাগা। ইতিমধ্যে ৪ঠা নভেম্বর অতি উৎসাহী হয়ে খালেদ মোশাররফের মা ও ভাই রাশেদ মোশাররফের নেতৃত্বে মুজিবের ছবি ও ব্যানার সহ বাকশালীদের এক মিছিল বের করা হয় ঢাকায়। মিছিল থেকে স্লোগান তোলা হল, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার চাই, জেল হত্যার বিচার চাই, জয় বঙ্গবন্ধু জয় বাংলা ইত্যাদি।
খবরের কাগজে জনগণ এই দৃশ্য দেখে ভীত এবং আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। বাকশালীদের অতি উৎসাহী মিছিল ও খালেদ-চক্রের প্রেসিডেন্ট খন্দকার মোশতাক বিরোধী ক্যু’ এক হয়ে ধরা পড়ে দেশবাসীর কাছে। সবার মনে বদ্ধমূল ধারণা জন্মে খালেদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’ এবং মিছিল বাকশালী স্বৈরতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠারই ভারতীয় কারসাজি। খালেদ ভারতের চর। এভাবেই দেশবাসীর কাছে সম্পূর্ণ ভাবে গ্রহণযোগ্যতা হারায় খালেদ-শাফায়াত জামিলগং। এই খবর এবং ছবি খালেদের চোখে পড়ে ৫ই নভেম্বর। দেখামাত্র তিনি তার মাকে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে ফোনে বলেছিলেন, মা! তোমরা আমাকে শেষ করে দিলে, আমি আর বাঁচবো না।
একদিন বঙ্গভবনে এক বৈঠকে সেনা পরিষদের মনোনীত চীফ জেনারেল জিয়ার ধীরে চলা নীতি সম্পর্কে তার আন্তরিকতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়ে বচসা হয়। বৈঠকে মেজর হাফিজ, মেজর গফফার, লেফটেন্যান্ট ইকবাল মত প্রকাশ করে, জেনারেল জিয়া আগস্ট বিপ্লবের লক্ষ অর্জনে গড়িমসি করছেন। তাই তার জায়গায় ব্রিগেডিয়ার খালেদকে চীফ বানালে তার মাধ্যমে দ্রুত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হবে। তাদের অভিমত যুক্তিসঙ্গত মনে করেনি সংখ্যাগরিষ্ঠ উপস্থিত নেতারা। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, জেনারেল জিয়াকে চীফ হিসাবে রেখেই তার ভুলগুলো শুধরে নেবার পরামর্শ দেয়া হবে। সিদ্ধান্তটি তাদের মনঃপূত না হওয়ায় অর্বাচীনের মতো খালেদ ও শাফায়াত এর উস্কানিতে ঢাকায় অবস্থিত ১ম এবং ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের অধীনস্থ কিছু সৈনিককে মিথ্যা প্রচারণার মাধ্যমে বিভ্রান্ত করে ৩রা নভেম্বরের অঘটন ঘটায় মূলত তারাই। ৫ই নভেম্বরের পর সেই সমস্ত বিভ্রান্ত হয়ে যাওয়া সৈনিকরাও আবার সেনা পরিষদের নিয়ন্ত্রণে ফিরে আসে। এর ফলে খালেদ-চক্র বুঝতে সক্ষম হয় তাদের অবস্থান ঢাকাতেও নড়বড়ে হয়ে উঠেছে। অবস্থা সঙ্গীন বুঝে স্বঘোষিত চীফ খালেদ তার বাল্যবন্ধু কর্নেল হুদার রংপুর ব্রিগেডের ১০ম ও ১৫তম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টকে ঢাকায় তলব করে পাঠান। কর্নেল নোওয়াজিশের অধীনস্থ ১০ম ইস্টবেঙ্গল অতিদ্রুত বগুড়া থেকে এসে গণভবনে অবস্থান নেয়। কর্নেল জাফর ইমাম ১৫তম ইস্টবেঙ্গল এর কমান্ডিং অফিসার, নিজ উদ্যোগেই ২-৩রা নভেম্বরের ক্যু-এর খবর জেনে ব্রিগেডিয়ার খালেদকে সমর্থন জানানোর জন্য ঢাকায় এসে উপস্থিত হন। ১৫তম ইস্টবেঙ্গলকে ঢাকায় আনার আদেশ প্রাপ্ত জাফর ইমাম রংপুর পৌঁছালে তিনি নিজের ইউনিটের সৈনিকদের তাড়া খেয়ে প্রাণের ভয়ে রংপুর থেকে পালিয়ে নোয়াখালিতে তার গ্রামে গিয়ে লুকিয়ে থাকেন। যাওয়ার পথে নিজের ধাওয়া খাওয়ার খবরটাও ঢাকায় ব্রিগেডিয়ার খালেদকে জানিয়ে দেবার সাহসটুকুও ছিল না তার। ৬ই নভেম্বর প্রেসিডেন্ট হিসাবে জাস্টিস সায়েমের শপথ গ্রহণের আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন হয়। ঐদিনই বঙ্গভবনে সেনা প্রধান খালেদ মোশাররফ দুপুর ১১টায় কমান্ডারদের এক কনফারেন্স করলেন। কিন্তু ৬ই নভেম্বরের বাস্তব অবস্থা ঢাকাসহ অন্য সব সেনানিবাসে ছিল ভিন্ন প্রকৃতির। ইতিমধ্যে আরেক দফা লিফলেট বিতরণ করা হয়েছে সব ক্যান্টনমেন্টে এবং শহর-গঞ্জে। খালেদ যখন বঙ্গভবনে কনফারেন্স-এ ব্যস্ত তখন বনানীর এক বাড়িতে সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে মেজর মহিউদ্দিন এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার পক্ষ থেকে কর্নেল তাহের বসেছিলেন খালেদ বিরোধী বিপ্লবের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতে। সেই মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হয়-
১। ৬-৭ই নভেম্বর রাত বারোটায় বিদ্রোহ শুরু হবে।
২। বিদ্রোহ পরিচালিত হবে ২য় ফিল্ড আর্টিলারি রেজিমেন্ট থেকে মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে।
৩। ঠিক রাত বারোটায় মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে একটি গান থেকে আকাশে ফায়ার করা হবে একটা ট্রেসার গোলা। সেটাই হবে বিপ্লব শুরুর সময় সংকেত ঢাকায় অবস্থিত সব ইউনিটগুলোর জন্য।
৪। কর্নেল তাহের দায়িত্ব নেন শহরের গোপন আস্তানা থেকে বিপ্লবের পক্ষে জনসমর্থন গড়ে তোলার।
৫। বিপ্লবের লক্ষ খালেদ-চক্রের পতন ঘটিয়ে পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনা পরিষদের মনোনীত জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করে তাকে আবার চীফের পদে অধিষ্ঠিত করার পর তার মাধ্যমে খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আবেদন জানানো হবে।
৬। বিপ্লবকালে এবং পরবর্তী পর্যায়ে যেকোনো ধরনের ভারতীয় আগ্রাসনের মোকাবেলায় জনযুদ্ধ গড়ে তোলার জন্য প্রস্তুত থাকতে হবে প্রতিটি দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর সৈনিক এবং বিভিন্ন দেশপ্রেমিক দল, সংগঠনের নেতা, কর্মী ও সদস্যদের।
৭। বিপ্লবের সফলতার পর আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনতে হবে।
৮। স্লোগান সমূহঃ
(ক) নারায়ে তাকবির আল্লাহ হু আকবর।
(খ) সিপাহি-জনতা ভাই ভাই খালেদ-চক্রের রক্ত চাই।
(গ) খন্দকার মোশতাক জিন্দাবাদ বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
(ঘ) মেজর ডালিম জিন্দাবাদ কর্নেল তাহের জিন্দাবাদ।
(ঙ) রশিদ-ফারুক জিন্দাবাদ খালেদ-শাফায়াত মুর্দাবাদ।
(চ) ডালিম-তাহের ভাই ভাই বাকশালীদের রক্ষা নাই।
(ছ) জেনারেল জিয়া যেখানে আমরা আছি সেখানে।
ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো জানিয়ে দেয়া হয় সব সংশ্লিষ্ট মহলে এবং প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে সেনা পরিষদের ইউনিটগুলোর নেতাদের কাছে। এরপর থেকে রাতের আঁধারে অতি সতর্কতার সাথে সার্বিক প্রস্তুতি চলতে থাকে প্রতিটি ক্যান্টনমেন্টে। রাত ১১টা। বঙ্গভবনে খালেদ ও শাফায়াত তাদের ক্ষমতা দখলকে বৈধ করার জন্য কাগজপত্র ঠিকঠাক করায় যখন ব্যস্ত তখন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা সম্পূর্ণ ভিন্ন। রাতের আঁধারে সচল হয়ে উঠছে বিভিন্ন ইউনিট। তারা সবাই প্রস্তুত, অপেক্ষা শুধু বিদ্রোহের সংকেতের। ২ফিল্ড রেজিমেন্টের পাশেই ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। খালেদ-চক্রের দ্বারা বহিষ্কৃত অধিনায়ক কর্নেল আমিনুল হক এবং এডজুটেণ্ট ক্যাপ্টেন মুনিরুল ইসলাম চৌধুরীকে ইতিমধ্যেই চুপিসারে ডাকিয়ে আনা হয়েছে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। মেজর মহিউদ্দিনকে সার্বক্ষণিকভাবে সব বিষয়ে সাহায্য করছে সুবেদার মেজর আনিস, ক্যাপ্টেন মস্তফা, ক্যাপ্টেন কামাল, ক্যাপ্টেন জুবায়ের ও কয়েকজন বিশ্বস্ত জেসিও, এনসিও এবং সৈনিকরা। বিমান বাহিনীর সার্বিক দায়িত্বে রয়েছে ফ্লাইট সার্জেন্ট আবসার। ল্যান্সার এর ট্যাঙ্কগুলোর নিয়ন্ত্রণ করছে রিসালদার সারোয়ার। ক্যান্টনমেন্টের উত্তরপ্রান্তে বালুরঘাটে অবস্থিত সার্ভিস কোরের ইউনিটগুলো- মেডিকেল, সাপ্লাই, ইএমই ব্যাটালিয়নগুলো ইতিমধ্যেই প্রস্তুত হয়ে রয়েছে। রেলক্রসিং পার হলে অর্ডন্যান্স ডিপো। উত্তর পশ্চিমপ্রান্তে সিগন্যাল সেন্টার, ইঞ্জিনিয়ার্স ও লাইট অ্যাকঅ্যাক ইউনিটগুলো বিপ্লবের সংকেতের অপেক্ষায় সার্বিকভাবে প্রস্তুত। সশস্ত্র সবাই। ক্যান্টনমেন্টের বাইরে কর্নেল তাহের এবং সমমনা রাজনৈতিক দল ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতাকর্মীরা জমায়েত হচ্ছে বায়তুল মোকাররম, ইউনিভার্সিটি, নীলক্ষেত, মোহাম্মদপুর, কাঁটাবন, ইব্রাহিমপুর, মিরপুর, তেজগাঁও, মগবাজার, এয়ারপোর্ট, মহাখালি, বনানি, টিভি এবং রেডিও স্টেশন এলাকায়, মতিঝিল, শান্তিনগর, প্রেসক্লাব, নিউমার্কেট, শাহবাগ এলাকায়ও সমবেত হচ্ছেন জনগণ। প্রয়োজনে ২য় ফিল্ড হেডকোয়ার্টারের সাথেও যোগাযোগ করছিলেন কর্নেল তাহের। কি ঘটতে যাচ্ছে সে বিষয়ে খালেদ-চক্র এবং সাধারণ জনগণ কিছুই জানতে পারছিল না।
H-Hour চরম মুহূর্ত, রাত ১২ টায়। বিস্ময়কর এক অবিস্মরণীয় ঘটনার সূচনা হতে চলেছে! দেশবাসীকে শ্বাসরুদ্ধকর অনিশ্চয়তার হাত থেকে মুক্ত করতে দেশপ্রেমিক সেনাবাহিনী আর একটি বিপ্লব সংঘটিত করতে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে চলেছে।
দ্রুম! মেজর মহিউদ্দিনের নির্দেশে ২য় ফিল্ডের একটি কামান থেকে আকাশে ছোঁড়া হলো একটা ট্রেসার গোলা। রাতের আঁধার চিরে গোলাটা বিস্ফোরিত হওয়ায় আলোকিত হয়ে উঠলো পুরো ক্যান্টনমেন্ট এলাকা। ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবের সূচনা সঙ্কেত।
সাথে সাথেই চারদিকে শোনা যেতে লাগলো যান্ত্রিক যানবাহন এবং ট্যাঙ্ক বহরের সচল হবার শব্দ। এক এক রেজিমেন্ট থেকে অনবরত আকাশে ছোঁড়া হচ্ছে ট্রেসার। ফলে উদ্ভাসিত হয়ে উঠছে সারা ঢাকা শহর।বিভিন্ন ইউনিটগুলো থেকে বেরিয়ে পড়লো রণসজ্জায় সজ্জিত অফিসার-সৈনিকদের কাফেলা এবং ট্যাংক বহর। তারা সুশৃঙ্খলভাবে ছুটে চলেছে পূর্বনির্ধারিত গন্তব্যস্থানের লক্ষে। তাদের মুখ থেকে বেরিয়ে আসছে নির্ধারিত গগনবিদারী স্লোগানগুলো। পথিমধ্যে, তারা মাঝে মধ্যে আকাশে গুলি ছুঁড়ছে। ততক্ষণে উল্লাস-উচ্ছ্বাসে শহরবাসীর ঢল নেমেছে রাজপথে। পথের পাশের ঘর-বাড়ির ছাদে-জানালায় দেখা যাচ্ছিলো নারী-পুরুষের মুখ। সবাই হাত নেড়ে বিজয় সংকেত দেখাচ্ছিলো সেনা সদস্যদের। জনগণের মুখেও তখন উচ্চারিত হচ্ছিল সেনা সদস্যদের স্লোগানগুলো। অনেকেই উঠে পড়ছিলো চলন্ত ট্যাংকের উপর।
সামরিক বাহিনীর বিপ্লবী অভ্যুত্থান এভাবেই রূপান্তরিত হয়ে উঠল সিপাহী-জনতার বিপ্লবে। ঐ সমস্ত স্লোগান এবং সৈনিক-জনতার পদভারে প্রকম্পিত তখন সারা ঢাকা শহর। কারো বুঝতে বাকি রইলো না দেশপ্রেমিক সেনারা বিদ্রোহ করেছে কুচক্রী খালেদগংদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতার বিরুদ্ধে। দেশের বিভিন্ন শহরগুলোতেও একই ভাবে একাত্মতা প্রকাশ করেছিলো জাগ্রত জনতা।
কোথাও নেই কোনও প্রতিরোধ।সারাদেশে সৃষ্টি হল এক অভাবনীয় ঐক্যবদ্ধ বিজয় উল্লাস! দেশ জুড়ে বইছে খুশির জোয়ার। সৈনিক-জনতা করছে কোলাকুলি। এ যেন ঈদের মিলন উৎসব! দেশের সবপ্রান্ত থেকে যা কিছু ঘটছে সে সমস্ত খবর পাঠানো হচ্ছে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। আমজনতা প্রতিটি শহরের পথে-ঘাটে-অলিতে-গলিতে করছে মিষ্টি বিতরণ। একাত্মতায় বিলীন হয়ে গেছে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী ও জাগ্রত জনতা। এ ধরনের নজির পৃথিবীর অন্য কোনও দেশে দেখা গিয়েছে কিনা সেটা আমার জানা নেই। এ ভাবেই সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার নেতৃত্বে সৃষ্টি হয়েছিলো এক বিস্ময়কর নজিরবিহীন জাতীয় ঐক্যের ইতিহাস।এই ধরনের সংহতি প্রকাশ করে অকুতোভয় লড়াকু জাতি ভারতের চাণক্যদের একই সাথে তাদের পদলেহি পোষ্য দালালদের জানিয়ে দিয়েছিলো যে বাংলাদেশ একটি অপরাজেয় দুর্গ।প্রতিমুহূর্তের ঘটনাবলী ব্যাংককে আমাদের জানিয়ে দিচ্ছিলো মেজর মহিউদ্দিন।
বঙ্গভবনে কি হচ্ছিল রাত ১২ টায়!
ঘটে গেছে বিপ্লব। বঙ্গভবনে তখন নব্য চীফ জেনারেল খালেদ মোশাররফ বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত। তার সাথে রয়েছেন তার বিশ্বস্ত অফিসারবৃন্দ। ঢাকার ৪৬তম ব্রিগেড কমান্ডার কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল রউফ, কর্নেল নুরুজ্জামান, মেজর মালেক, কর্নেল মুন্নাফ, কর্নেল নাজমুল হুদা, মেজর হায়দার, মেজর হাফিজ এবং খালেদের ভায়রা ভাই কে কিউ হুদা। হঠাৎ জেনারেল খালেদের পাশে রাখা টেলিফোন বেজে উঠলো। ফোন ধরলেন খালেদ। ফোনটি সম্ভবত করেছিলেন রুবি ভাবী। খালেদ জানতে পারলেন ক্যান্টনমেন্টের সব ইউনিটগুলো বিদ্রোহ করেছে। অস্ত্রধারী সেনারা পুরো ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছে। আকাশ আলোকিত হচ্ছে ট্রেসার বুলেটে, সব দিকেই ফায়ারিং এর আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। সাথে গগন বিদারী খালেদ-চক্র বিরুধী বিভিন্ন বৈপ্লবিক স্লোগান। খবর শুনে ঘাবড়ে গিয়ে শংকিত হয়ে পড়লেন খালেদ। উপস্থিত সঙ্গীদের জানালেন কাউন্টার ক্যু’ করার চেষ্টা করছে কেউ। নির্দেশ দিলেন মেজর হাফিজকে সরেজমিনে অবস্থা দেখে আসতে।
কিন্তু মেজর হাফিজ তখন দোটানায়। ইতিমধ্যে চলন্ত ট্যাঙ্কের আওয়াজ শুনতে পেলেন খালেদ ও উপস্থিত অফিসাররা। মেজর মালেক কালক্ষেপ না করে ক্যান্টনমেন্টে তার স্ত্রীকে ফোন করলেন। ভীতসন্ত্রস্ত বেগম সাহেবা কান্নার সাথে কাঁপা গলায় জানালেন-
সর্বনাশ! এখানে তো সাংঘাতিক গণ্ডগোল শুরু হয়ে গেছে। এই কথা শুনে ফ্যাকাশে হয়ে উঠল মেজর মালেকের মুখ। হাত থেকে পড়ে গিয়ে ঝুলতে থাকলো টেলিফোনের হ্যান্ডসেট। সবাই উদগ্রীব হয়ে জানতে চাইলেন কি খবর? প্রাণভয়ে মেজর মালেক তখন কাঁপছিলেন। বললেন, সেনা বিদ্রোহ ঘটেছে। তার কথা শেষ হতেই সবাই বুঝতে পারল পাশা উল্টে গেছে। তাই মরি কি বাঁচি অবস্থায় যে যেদিকে পারলো ছুটে পালাতে লাগলো।
জেনারেল খালেদ তার একান্ত বন্ধু কর্নেল হুদা, মেজর হায়দার, কে কিউ হুদাকে সঙ্গে নিয়ে একটি প্রাইভেট কারে করে বঙ্গভবন ত্যাগ করে বেরিয়ে পড়লেন। তারা কলাবাগানে খালেদ মোশাররফের এক আত্মীয়ের বাসায় গিয়ে সবাই সিভিল ড্রেস পরে নিলেন। তারা সিদ্ধান্ত নিলেন এয়ারপোর্ট থেকে ফ্লাইং ক্লাবের একটি উড়োজাহাজ নিয়ে ভারতে পাড়ি জমাবেন। কে কিউ হুদা তখন ফ্লাইং ক্লাবের একজন পেশাদার প্রশিক্ষক। কিন্তু ফার্মগেটের কাছে পৌঁছাতেই তারা দেখতে পেলেন বিদ্রোহীদের ট্রাক, ট্যাংক-এর সাথে রাস্তায় হাজারো জনতার ঢল!হতাশায় সিদ্ধান্ত বদলাতে বাধ্য হলেন তারা। এবারের গন্ত্যবস্থল শেরে বাংলা নগরের ১০ম ইষ্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট। মুক্তিযুদ্ধের সময় এই ইউনিটটি ‘কে’ ফোর্স-এর অধীনে ছিল। তাই তারা মনে করেছিলেন সেখানে তাদের নিরাপদ আশ্রয় মিলবে। কিন্তু বিধি বাম।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী গঠিত হয়েছিলো মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। ব্যক্তিস্বার্থ নয়, দেশ ও জাতীয় স্বার্থই তাদের কাছে ছিল প্রাধান্যের বিষয়। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামের ভূমিকম্প ভেঙ্গে দিয়েছিল সমাজের মধ্যে মানুষ সৃষ্ট শ্রেণীবিভেদ। শ্রেণিগত অবস্থান ভুলে গিয়ে সমগ্র জাতি সমবেত হয়েছিলো এক কাতারে। ফলে মুক্তিযোদ্ধারা প্রায় সবাই সবাইকে চিনতো।
যুদ্ধের সময়ে কার মূল্য কতটুকু সেটা যাচাই হতো না পদমর্যাদার মাপকাঠিতে। সেটা নির্ধারিত হতো ব্যক্তি চরিত্র, দেশপ্রেম, নৈতিকতা, সাহস, সহযোদ্ধাদের প্রতি ভালোবাসা ও আন্তরিক সহমর্মিতার আলোকে। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের দুর্ধর্ষ কমান্ডার খালেদ মোশাররফ, বীর গেরিলা কমান্ডার মেজর হায়দার, সাবসেক্টর কমান্ডার কর্নেল নাজমুল হুদা আজ সৈনিকদের আক্রোশ থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ছুটছেন কিন্তু শেষ রক্ষা হল না। ১০ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকদের হাতেই করুণ ভাবে নিহত হন খালেদ ও তার সহযোগীরা। অদৃষ্টের নির্মম পরিহাস!রাত ১ টার মধ্যেই বঙ্গভবন দখল করে নেয় বিদ্রোহীরা। সশস্ত্র বিদ্রোহীদের দ্বারা তাড়িত হয়ে বিক্ষুব্ধ জনতার হাতে মেজর হাফিজ এবং কর্নেল শাফায়াত জামিল আহত অবস্থায় পলায়ন কালে ধরা পড়েন। ভিআইপি গেস্ট হাউসে অবস্থানরত যারা ফরমেশন কমান্ডারদের মিটিং-এ অংশগ্রহণের জন্য এসেছিলেন গুলির শব্দ শোনামাত্র আচমকা জেগে উঠে লুঙ্গি, গেঞ্জি কিংবা শুধু আণ্ডারওয়্যার পরা অবস্থাতেই যে যেদিকে পারলেন ছুটতে থাকলেন প্রাণের ভয়ে। ক্যান্টনমেন্টের অনান্য অফিসাররা যারা বাতাস বুঝে খালেদের পক্ষ অবলম্বন করেছিলেন তারাও বাসা ছেড়ে বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে আশ্রয়ের সন্ধানে ছুটোছুটি করতে লাগলেন দিক-বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে।
মেজর মালেক তার স্টাফ কার নিয়ে বঙ্গভবন ছেড়ে ছুটে চললেন সাভারের দিকে ১০ম ইস্টবেঙ্গলে আশ্রয়ের প্রত্যাশায়। কিংকর্তব্যবিমূঢ় মালেক এতটাই বিভ্রান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে, তিনি সম্পূর্ণভাবে ভুলে গিয়েছিলেন, ১০ম ইস্টবেঙ্গল সাভারে নয়, অবস্থান করছে শেরেবাংলা নগরে। সাভারের কাছাকাছি এসে তার মনে পড়েছিলো সেই কথা। কিন্তু সেখানে ফিরে যাবার মতো সাহস হারিয়ে ফেলেছিলেন জাঁদরেল মেজর মালেক। তিনি ড্রাইভারকে হুকুম দিলেন তার গ্রামের বাড়ির দিকে ধাবিত হতে। গন্তব্যস্থল থেকে ৩ মাইল দূরে অপ্রত্যাশিত ভাবে গাড়ী থেমে গেলো। উদ্বিগ্ন মেজর মালেক ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলেন,
ড্রাইভার গাড়ী থামালে কেনো? জোরে চালাও। ড্রাইভার জানালো- পেট্রোল শেষ। মেজর মালেক পকেট থেকে কিছু টাকা ড্রাইভারের হাতে দিয়ে বললেন, তুমি পেট্রোল এর ব্যবস্থা করো, আমি এগুচ্ছি। বলেই তিনি গাড়ী থেকে নেমে দৌড়ে ছুটে চললেন তার গ্রামের বাড়ির দিকে। আচমকা গাড়ী থেমে যাওয়ায় মেজর মালেক মনে করেছিলেন, তার অস্ত্রধারী ড্রাইভারই তাকে মেরে ফেলবে। দৌড়াতে দৌড়াতে তিনি অনুভব করছিলেন তার প্যান্ট ভিজে উঠেছে নিম্নাঙ্গ থেকে নির্গত গরম পানিতে। এভাবেই, প্রায় আধমরা ক্লান্ত মেজর মালেক পৈত্রিক ভিটা মানিকগঞ্জে পৌছে প্রাণে রক্ষা পান। পরে তিনি এলাকাবাসীর চাপে স্থানীয় প্রশাসনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
যে ধরনের প্রোপাগান্ডা আজঅব্দি চালানো হয়ে আসছে সেই পরিপ্রেক্ষিতে একটা সত্য অস্বীকার করার অবকাশ নেই। স্বাধীনতা উত্তরকালে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে যেই সামরিক বাহিনীর ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছিলো সেখানে মেরুদণ্ডহীন এবং দুর্বল চরিত্রের জেনারেলদের তেমন কোনও নিয়ন্ত্রণ ও আনুগত্য ছিল না।
বিশেষ করে পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে এক ধরনের কৌলীন্যবোধ ঢুকিয়ে দেয়া হতো প্রশিক্ষণকালেই শ্রেণিস্বার্থে। যার ফলে তারা নিজেদের আর সৈনিকদের মধ্যে একটা ব্যবধান বজায় রাখতে অভ্যস্ত ছিলেন। দেশে প্রত্যাবর্তনের পর তাদের অনেকেই সেই মানসিকতা বর্জন করতে না পারায় মুক্তিযোদ্ধা সেনা সদস্যরা মন থেকে তাদের সম্মান ও শ্রদ্ধা করতো না। জেনারেল এরশাদ যখন রাষ্ট্রপতি তখন একবার তিনি আমাকে দেশে ডেকে পাঠিয়েছিলেন।
মেজর মালেকের সাথে একই সাথে কোয়েটাতে চাকুরী করেছি। ফলে ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো। তিনি আমাদের পলায়নের ব্যপারে কিছুটা সাহায্যও করেছিলেন। এই বিষয়ে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’-তে বিস্তারিত লিখেছি। তখন তিনি কর্নেল এবং জেনারেল এরশাদের কৃপায় ঢাকার মেয়র। তিনি জানতে পারেন প্রেসিডেন্ট আমাকে ঢাকায় ডেকে এনেছেন। তাই হয়তো বিশেষ আগ্রহের সাথে তিনি আমাকে সস্ত্রীক দাওয়াত করলেন তার বাড়ীতে। সে রাতে পুরনো স্মৃতি রোমন্থন করতে করতে ৭ই নভেম্বরের অভিজ্ঞতার কাহিনী নিজমুখেই আমাদের শুনিয়েছিলেন কর্নেল মালেক।
বন্দীত্ব থেকে মুক্ত করা হল জেনারেল জিয়াকে
৭ই নভেম্বর রাত ১২ টায় বিপ্লব শুরু করার সাঙ্কেতিক ট্রেসার গোলা ছোঁড়ার পরেই, মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে একদল বিপ্লবী ট্যাংক সাথে নিয়ে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করার জন্য ক্যান্টনমেন্টের ২৭ নং শহীদ মইনুল রোডের বাড়ীতে গিয়ে উপস্থিত হল।
মেজর হাফিজ এবং তার ভায়রা লেফটেন্যোন্ট ইকবালের অধীনস্থ ১ম ইস্টবেঙ্গলের যে সমস্ত সৈনিকদের জিয়ার বাসায় গার্ড হিসাবে নিয়োগ করা হয়েছিল তারা অবস্থা বেগতিক দেখে বিপ্লবীদের আগমনের আগেই পেছনের দেয়াল টপকে পালিয়ে গিয়েছিল।
মহিউদ্দিনের নির্দেশে ছাদ লক্ষ করে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা আওয়াজ করা হল। কিন্তু ভেতর থেকে ফায়ারের কোন জবাব এলো না।
তখন রাইফেলের বাঁট দিয়ে গেটের তালা ভেঙ্গে ভেতরে ঢুকে পড়ল মেজর মহিউদ্দিনের দল। জিয়ার ড্রাইভার তাদের পশ্চিম দিকের দরজার কাছে নিয়ে যায়। মহিউদ্দিন দরজায় আওয়াজ তুলে দরজা খোলার জন্য বার বার অনুরোধ করতে থাকে। এক সময় বারান্দায় বের হয়ে আসেন জেনারেল জিয়া, পেছনে পত্নী খালেদা জিয়া। জিয়াকে দেখে মেজর মহিউদ্দিন স্যালুট করে শান্ত গলায় বলল স্যার, আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
চারদিক থেকে তখন শোনা যাচ্ছে বিভিন্ন স্লোগান আর ফায়ারিং এর শব্দ। এই বস্থায় ভীতসন্ত্রস্ত জিয়া কিছুটা সঙ্কোচের সাথেই বলে উঠলেনআমি তো রিটায়ার করেছি, আমি আর কিছুর মধ্যে নেই, আমি কোথায় যাবো! তোমরা শুধু আমার পেনশনের ব্যবস্থাটা করে দিয়ো। আমি তো কিছুই বুঝতে পারছিনা!
জেনারেল জিয়াকে একটু নিরালায় নিয়ে গিয়ে নিচু স্বরে মহিউদ্দিন বলল ব্যাংকক থেকে সেনা পরিষদের নেতাদের নির্দেশেই আমরা আপনাকে নিয়ে যেতে এসেছি। খালেদ-চক্রের পাশা আমরা উলটে দিয়েছি আর একটি সফল বিপ্লবের মাধ্যমে। আমরা আপনাকে আবার চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করবো। আপনাকে নিয়েই যাবো। দোহাই আল্লাহর, আপনি আমাদের সাথে আসুন।
দৃঢ় আহবান জানালো মেজর মহিউদ্দিন। সে সময় জিয়া সব কিছু বুঝতে পেরে আশ্বস্ত হলেন। বেগম জিয়া তখন শুকনো মুখে জড়োসড়ো হয়ে দরজার পাশে দাঁড়িয়ে সবকিছুই অবলোকন করছিলেন অবাক বিস্ময়ে!
লাগাতার গোলাগুলির মাঝে স্বামীকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে দেখে তিনি বলে উঠলেন দেখুন ভাই, আমাদের নিয়ে আর টানাটানি করবেন না, প্লিজ দয়া করে আমাদের ছেড়ে দিন।
স্যার, ভাবীকে বুঝিয়ে বলুন আপনি আমাদের মনোনীত চীফ, তাই আপনাকে যেতেই হবে।
আমি আসছি। বলে খালেদা জিয়াকে সঙ্গে করে তিনি ভেতরে চলে গিয়ে ভাবীকে বুঝিয়ে শান্ত করে কাপড় পাল্টে ফিরে আসলেন।
মেজর মহিউদ্দিনের ইশারায় বিপ্লবীরা তাকে কাঁধে তুলে নিয়ে জীপে বসিয়ে ধীর গতিতে এগিয়ে চললো। উপস্থিত বিপ্লবীরা স্লোগানে স্লোগানে আকাশ বাতাস মুখরিত করে তুললো-
নারায়ে তাকবির, আল্লাহ হু আকবর।
জিয়াউর রহমান জিন্দাবাদ।
সিপাহী-জনতা ভাই ভাই।
বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।
বেগম খালেদা জিয়া তখন বারান্দায় দাড়িয়ে আবেগ উচ্ছ্বসিত সিক্ত নয়নে অপূর্ব এক ঐতিহাসিক অভাবনীয় ঘটনার সাক্ষী হয়ে রইলেন। পথিমধ্যে নিচু গলায় মেজর মহিউদ্দিনকে জিয়া জিজ্ঞেস করলেন
কোথায় নিয়ে যাচ্ছ?
২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। সংক্ষিপ্ত জবাব।
দুর্ভেদ্য নিরাপত্তার বেষ্টনী সৃষ্টি করে রেখেছে জিয়ার জীপের চারিদিকে গোলন্দাজ ও ল্যান্সার এর সৈনিকরা। সেনা পরিষদের বীর বিপ্লবীরাই সেদিন জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে এনেছিলো। ইউনিট লাইন এ ঢোকার সাথে সাথেই আনন্দে উৎফুল্ল হয়ে উঠল ২য় ফিল্ড এবং ৪র্থ বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিক এবং অফিসাররা। জেনারেল জিয়াকে সোজা নিয়ে যাওয়া হল কমান্ডিং অফিসারের কামরায়। সেখানে মেজর মহিউদ্দিন, কর্নেল আমিনুল হক, ক্যাপ্টেন জুবায়ের, ক্যাপ্টেন কামাল, ক্যাপ্টেন মুনির, সুবেদার মেজর আনিস ছাড়া আর কাউকেই ঢুকতে দেয়া হচ্ছিলো না। বাইরে সৃষ্টি করা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা বলয়।
মূলত, স্বেচ্ছায় কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণকারী দেশান্তরী নেতৃত্বের অধীনেই পরিচালিত হয়েছিলো ৭ই নভেম্বর এর সফল সিপাহী-জনতার বিপ্লব। কর্নেল তাহেরের দায়িত্ব ছিল ক্যান্টনমেন্টের বাইরে।
ক্যান্টনমেন্টের ভিতরে বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার সেলগুলো পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী সেনা পরিষদের কেন্দ্রীয় কমান্ডের অধীনস্থ হয়েই নির্দেশ মেনে চলছিলো।
২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে পৌছে পায়জামা-পাঞ্জাবী পরা জিয়া স্বস্তির নিঃশ্বাস নিলেন। তিনি অতি সহজেই বুঝেতে পারলেন আগস্ট বিপ্লবের অগ্রণী সেনা পরিষদই ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লবের মূল চালিকা শক্তি। জিয়া যখন তার আত্মবিশ্বাস ফিরে পেলেন তখন মেজর মহিউদ্দিন তাকে অবহিত করলো স্যার, এই বিপ্লবের পরিকল্পনা গৃহীত হয় বঙ্গভবনে আগস্ট বিপ্লবের শীর্ষনেতাদের সাথে কর্নেল তাহেরের কয়েক দফা বৈঠকের পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের ফলশ্রুতিতেই। প্রকাশিত নেতারা ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে আলোচনার পর কৌশলগত কারণে দেশত্যাগের সিদ্ধান্ত নেন। দেশ ছাড়ার আগে তারা দেশের সব সমমনা রাজনৈতিক ও সংগঠনের নেতাদের সাথেও আলাপ করে যান। ব্যাংকক পৌঁছনোর পর থেকে তাদের সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। ঐ বৈঠকগুলোতে নেয়া সিদ্ধান্তগুলো ছিল
১। সেনা পরিষদ ও বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে উপযুক্ত সময় আরও একটি সামরিক অভ্যুথান ঘটিয়ে খালেদ-চক্রকে ক্ষমতাচ্যুত করা হবে যখন তারা দেশ বিরোধী ভারতীয় দালাল হিসাবে গণবিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে।
২। সফল বিপ্লবের পর আপনাকে পুনরায় আর্মি চীফের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে।
৩। আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও কর্মসূচিকে এগিয়ে নেবার জন্য জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করার জন্য আপনাকেই অনুরোধ জানাতে হবে।
৪। অবিলম্বে বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে হবে সেনাবাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে এনে পুনর্গঠনের কাজে আপনাকে সহযোগিতা করার জন্য।
৫। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার কিছু দাবি দাওয়াও বিবেচনায় নেয়া হবে যেমন- সৈনিকদের বেতন-ভাতা পুনর্বিবেচনা, ব্যাটম্যান প্রথার বিলুপ্তি, পদ ও প্রমোশন এর ব্যপারে স্বচ্ছতা।
জেনারেল জিয়া মেজর মহিউদ্দিনকে নির্দেশ দেন পালিয়ে থাকা ভীতিগ্রস্ত সব অফিসারদের ফিরিয়ে আনার জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা চালাতে। বিডিআর থেকে ব্রিগেডিয়ার খলিল, কর্নেল মহব্বতজান চৌধুরী, রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খান এবং এভিএম তোয়াবকেও ডাকিয়ে আনা হল জিয়ার নির্দেশে। ইতিমধ্যে শহরের স্ট্র্যাটেজিক সব নির্ধারিত যায়গাগুলো বিপ্লবীরা তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিয়েছে। ট্যাংক ডেপ্লয়মেন্ট এর দায়িত্বও সম্পন্ন করে ফেলেছে রিসালদার সারোয়ার। শহর নিয়ন্ত্রণের জন্য কন্ট্রোল রুম প্রতিষ্ঠিত করা হয়েছে রেসকোর্সে। হঠাৎ মেজর মহিউদ্দিন-এর কাছে মেসেজ এলো রেডিও এবং টিভি স্টেশন নিয়ন্ত্রণের জন্য পাঠানো কমান্ডারের। রেডিও স্টেশনের নিয়ন্ত্রণ কর্নেল তাহের ছাড়তে চাইছিলেন না, কিন্তু কমান্ডার নির্দেশ অনুযায়ী রেডিও স্টেশন নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়াতে কর্নেল তাহের ক্ষুব্ধ হয়ে তাকে শাসিয়ে বলেছেন, তিনি ক্যান্টনমেন্টেই যাচ্ছেন। জবাবে মহিউদ্দিন কমান্ডারকে বলেছিলো
তাকে আসতে দাও আমরা দেখবো। তুমি তোমার দায়িত্ব যথাযথ ভাবে পালন করেছো। তার জন্য ধন্যবাদই তোমার প্রাপ্য। আমার হুকুম ছাড়া অন্য কাউকেই তুমি রেডিও স্টেশন এবং টিভি স্টেশনে ঢুকতে দেবে না। বিশেষ করে কর্নেল তাহেরসহ জাসদ কিংবা বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার কাউকেও আমার অনুমতি ছাড়া ঢুকতে দেবে না। তখনই মেজর মহিউদ্দিন আমাদের সাথে যোগাযোগ করে সবকিছু জানিয়ে জানতে চাইল করণীয় কি? তাকে পরিষ্কার জানিয়ে দেয়া হল, রেডিও এবং টিভি স্টেশন একই সাথে সাভারের বুস্টার স্টেশন নিজেদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। ট্যাঙ্কও সেখানে ডেপ্লয় করতে হবে কালবিলম্ব না করে নিরাপত্তা জোরদার করার জন্য। তাকে সতর্ক করে আরও বলে দেয়া হল, কোনক্রমেই জিয়ার উপর সওয়ার হতে দেয়া চলবে না কর্নেল তাহেরকে। জিয়াকে দিয়ে তার বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের কর্মসূচি বাস্তবায়নের চেষ্টা তাহের করলে করতেও পারেন। সে ধরনের কোনও উদ্যোগ নিলে সহযোগী হলেও তার বিরুদ্ধে উপযুক্ত কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে মহিউদ্দিনকে। প্রয়োজনে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে তার বিরুদ্ধে প্রবেশ নিষেধের আদেশ জারি করতে হবে।
রাত ২:৩০ মিনিটে কর্নেল তাহের এসে পৌছালেন ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। পৌছেই তিনি মেজর মহিউদ্দিনের কাছে জানতে চান রেডিও এবং টিভি, সাথে সাভারের বুস্টার স্টেশনে সৈনিকদের কেন পাঠানোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
নিরাপত্তার স্বার্থে, ছোট্ট কিন্তু দৃঢ় জবাব মহিউদ্দিনের। মহিউদ্দিনের সাথে তাহেরের বচসা হচ্ছে জানতে পেরে জিয়া নিজেই বেরিয়ে এলেন। তাহের তোমাদের সবাইকে ধন্যবাদ, তোমরা আমার প্রাণ বাঁচিয়েছো। দেশকেও বাঁচিয়েছো।
জিয়াকে দেখে তাহের তাকে একটু নিরিবিলি জায়গাতে নিয়ে গিয়ে নিচু গলায় দাবি জানালো, কালক্ষেপ না করে এখনি তাকে রেডিওতে গিয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিতে হবে। বলতে হবে- খালেদ-চক্রের পতন ঘটেছে, বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত হয়ে তিনি আবার আর্মি চীফ এর দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন। অবস্থা সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর হাতে। অনুরোধ জানাতে হবে দেশবাসীকে যাতে তারা দেশে পূর্ণ স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য সামরিক বাহিনীর সাথে সহযোগিতা করে।
জিয়া জবাবে বললেন, প্রেসিডেন্ট মোশতাকের সাথে তার আলাপ হয়েছে। তিনি তাকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নিতে অনুরোধ করেছিলেন, কিন্তু তিনি রাজি হননি সাংবিধানিক জটিলতার জন্য। তিনি বললেন, খালেদ অর্বাচীনের মতো সংবিধান, মন্ত্রিসভা, সংসদ বাতিল করে দিয়ে মার্শাল ল’ জারি করার ফলে তার রাষ্ট্রপতি হওয়াটা আইনি ভিত্তি পাবে না। বর্তমান অবস্থায় জাস্টিস সায়েমকেই রাষ্ট্রপতি এবং চীফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে বহাল রেখে এবং তিন বাহিনী প্রধানকে উপ-মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর হিসাবে দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকার পরিচালনা করেই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে হবে। তার মতে, এর কোনও আইনি বিকল্প নেই। তিনি জেনারেল জিয়াকে আরও বলেছেন, আর্মি চীফ হিসাবে তাকেই মুখ্য ভূমিকা রাখতে হবে। সরকারের মুখ্য লক্ষ্য হবে দেশে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে এনে আগস্ট বিপ্লবের পর তার দেয়া জাতির উদ্দেশে ভাষণের অঙ্গীকার অনুযায়ী যথা সময়ে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জাতীয় নির্বাচনী ওয়াদা পূরণ করা। সেই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াতেই তিনি জনসমর্থিত রাষ্ট্রপতি হিসেবেই দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করবেন নির্বাচনে জিতলে। পরোক্ষভাবে তিনি তাদের রাষ্ট্রপরিচালনার ক্ষেত্রে সার্বিকভাবে সাহায্য সহযোগিতা করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকবেন বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
কেনো তিনি জেনারেল জিয়ার অনুরোধের পরও রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন না সেই যুক্তি ও ব্যাখ্যা তিনি জাতির উদ্দেশে তার ভাষণে ব্যক্ত করবেন। তিনিও জিয়াকে পরামর্শ দিয়েছিলেন যত সত্বর সম্ভব একটি নাতিদীর্ঘ ভাষণের মাধ্যমে দেশবাসীকে অবগত করতে যে খালেদ-চক্রের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যুদেতা ব্যর্থ করে দিয়েছে দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী। জেনারেল জিয়া কর্নেল তাহেরকে আরো জানালেন, ব্যাংককে অবস্থিত অফিসারদের সাথে তার এবং জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদের যোগাযোগ রয়েছে। তারাও তার যুক্তিসঙ্গত উপস্থাপনা ও সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছেন।
ঠিকই বলেছিলেন জিয়া। আমরা জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলাম। কারণ, তিনি একজন বিচক্ষণ পেশাদার আইনজীবীই শুধু ছিলেন না একই সাথে তিনি ছিলেন একজন সংবিধান বিশারদ।
সব শুনে তাহের বুঝতে পারলেন জিয়ার মাথায় হাত বুলানো সম্ভব নয়, কারণ ইতিমধ্যেই জেনারেল জিয়া বুঝে গেছেন ক্ষমতার কেন্দ্র কোথায় এবং খালেদের বিরুদ্ধে সফল বিপ্লব ঘটিয়ে সেনা পরিষদই তাকে মুক্ত করতে মূল ভুমিকা রেখেছে। তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা পালন করেছে সহযোগী ভূমিকা।
ইতিমধ্যেই বিভিন্ন সূত্র থেকে মেজর মহিউদ্দিন জানতে পারে কর্নেল তাহের যেকোনো ভাবে জেনারেল জিয়াকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বাইরে নিয়ে যেতে চাইছেন হত্যা করতে কিংবা কনো বিশেষ উদ্দেশ্যে। তাই সে তাহেরকে জানালো
জিয়া অবশ্যই জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেবেন। কিছুক্ষণের মধেই রেডিও এবং টিভি স্টেশন থেকে লোক আসছে জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকর্ড করার জন্য। একই সাথে মহিউদ্দিন তাহেরকে জানিয়ে দিলো প্রেসিডেন্ট জাস্টিস সায়েম এবং খন্দকার মোশতাকের জাতির উদ্দেশে ভাষণও লাইভ প্রচারিত হবে রেডিও এবং টিভি থেকে সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে।
পরিকল্পনা ব্যর্থ হওয়ায় ক্যান্টনমেন্ট ছেড়ে চলে যান কর্নেল তাহের। তার প্রাধান্য ক্রমশ কমে আসছে সেটা তিনি কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না। তার সব চিন্তা চেতনা তখন ঘুরপাক খাচ্ছে ক্ষমতাকে কেন্দ্র করেই।
সেদিনই জেনারেল জিয়ার ভাষণ রেকর্ড করা হল ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টেই, তারপর থেকেই প্রচারিত হতে থাকে জেনারেল জিয়ার ভাষণ। সেই ভাষণ প্রচারিত হবার পর জাস্টিস সায়েমের ভাষণ এবং খন্দকার মোশতাকের জাতির উদ্দেশে ভাষণ লাইভ প্রচারিত হল রেডিও এবং টিভিতে। জেনারেল জিয়ার ভাষণের সারবস্তু ছিল-
“প্রিয় দেশবাসী, আমি জেনারেল জিয়া বলছি। আসসালামু আলাইকুম। ৭ই নভেম্বর এর মহান সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুথানে ব্রিগেডিয়ার খালেদ-চক্রের জাতীয়স্বার্থ বিরোধী চক্রান্তের অবসান ঘটেছে এবং দেশ ও জাতীয় স্বার্থে এবং বিপ্লবীদের অনুরোধে আমি আবার সেনাবাহিনী প্রধান হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছি। আমি দেশবাসীকে শান্ত থেকে নিজ নিজ দায়িত্ব পালন করে যাওয়ার অনুরোধ জানাচ্ছি। আপনারা বন্ধ হয়ে যাওয়া অফিস, আদালত, বিমান বন্দর, মিল-কারখানা পুনরায় চালু করে দেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সামরিক বাহিনীকে সাহায্য করুন। বক্তব্য শেষ করার আগে জিয়া বলেছিলেন জনগণ ও সামরিক বাহিনীর একতা, দেশপ্রেম এবং আল্লাহই আমাদের সহায়। আল্লাহ্‌ হাফেজ। বাংলাদেশ জিন্দাবাদ।”
জিয়ার এই ভাষণ জনগণকে আশ্বস্ত ও উদ্দীপ্ত করে তুলেছিলো। খালেদের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’ সম্পর্কে দেশবাসী যখন বুঝতে পারে তার এই হঠকারি পদক্ষেপের প্রকৃত উদ্দেশ্য ছিল ভারতের ইঙ্গিতে দেশকে ১৫ই আগস্টের পূর্ব অবস্থায় ফিরিয়ে নিয়ে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনরায় ক্ষমতায় বসানো তখন থেকেই তারা আল্লাহপাকের কাছে দোয়া করছিলো এই দেশবিরোধী চক্রান্তের হাত থেকে জাতিকে বাঁচানোর জন্য। তারা চাচ্ছিলো একটা পরিবর্তন। তাদের সেই প্রত্যাশার প্রতিফলনে যখন গর্জে উঠলো দেশপ্রেমিক সশস্ত্রবাহিনী তখন ১৫ই আগস্টের মতই স্বতঃস্ফূর্তভাবে দেশের সর্বত্র জনতার ঢল নেমেছিলো বিপ্লবীদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে। গর্জে উঠেছিলো তাদের সম্মিলিত কণ্ঠে ‘সিপাহী জনতা ভাই ভাই’, ‘সিপাহী জনতার বিপ্লব জিন্দাবাদ’ স্লোগান।
ঐ গগনবিদারী স্লোগানগুলো বিশ্ববাসীকে জানান দিয়েছিলো বাংলাদেশের লড়াকু বীরসেনানী ও জনতার সংহতি জাতীয় স্বার্থে দুর্ভেদ্য। একই বার্তা পেয়েছিল আধিপত্যবাদী ভারত ও তাদের পোষা দেশীয় দালালরা।
৭ই নভেম্বের সকাল ৮ টার দিকে জেনারেল ওসমানী এলেন ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে। তিনি জেনারেল জিয়া এবং উপস্থিত সব বিপ্লবীদের মোবারকবাদ জানালেন। প্রথমেই জিয়াকে বললেন
জনাব খন্দকার মোশতাককেই পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেবার অনুরোধ জানাতে হবে। জবাবে জেনারেল জিয়া তাকে খন্দকার মোশতাক এবং আমাদের সাথে যে আলাপ হয়েছে তা বিস্তারিত জানালেন। সব শুনে জেনারেল ওসমানী খন্দকার মোশতাকের যুক্তিসঙ্গত সিদ্ধান্ত ও নির্দেশাবলীর সাথে একমত হলেন।
জেনারেল ওসমানীও অভিমত প্রকাশ করলেন
খন্দকার মোশতাকের অঙ্গিকার অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ধারা ফিরিয়ে আনতে হবে। এর জন্য অবিলম্বে স্বৈরশাসন বিরোধী সব রাজনৈতিক বন্দীকে মুক্তি দিতে হবে। নির্ধারিত সময়ে শুরু করতে হবে বহুদলীয় রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। তারপর সাধারণ নির্বাচন। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে সংবিধান পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে হবে প্রয়োজনীয় সংশোধনের পর।
নতুন আঙ্গিকে যে সংবিধান প্রণীত হবে তাতে দেশের ধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী নির্বিশেষে সমগ্র জাতির প্রত্যাশার প্রতিফলন থাকতে হবে। সংবিধানের ভিত্তি হবে জাতির ঐতিহ্য, কৃষ্টি, ধর্মীয়, মানবিক এবং সাংস্কৃতিক মূল্যবোধ।বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক মুসলমান তাই, সংবিধানে স্পষ্টভাবে লেখা থাকবে সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ্‌তালাই সার্বভৌম।এই বিশ্বাসই হবে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্রের সংবিধানের মূলভিত্তি।
এ সমস্ত বিষয়ে যখন আলোচনা হচ্ছিলো তখন আবার এসে হাজির হলেন কর্নেল তাহের। মুখ কালো করে বসে থাকা তাহেরের উপস্থিতিতেই সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ঐক্যমত্যের ভিত্তিতে প্রণীত সৈনিকদের দাবিনামাটি জেনারেল জিয়ার হাতে তুলে দেয়া হয়। সেটা পড়ে তিনি ওয়াদা করেন, দাবিগুলো ন্যায়সঙ্গত বিধায় সেগুলো অবশ্যই বাস্তবায়িত করা হবে। এরপর তিনি স্বেচ্ছায় সেই দাবিনামায় স্বাক্ষর করেন।
৭ই নভেম্বর জেনারেল জিয়ার জন্য ছিল একটি খুবই ব্যস্ত দিন। দুপুরে ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা পর্যবেক্ষণের জন্য জীপে করে জিয়া বের হলেন। সঙ্গে রয়েছে মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস ও বিশ্বস্ত এস্কর্ট। ১ম ইস্টবেঙ্গল, ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল, ল্যান্সার, সিগন্যাল, অর্ডন্যান্স, ইঞ্জিনিয়ার, লাইট অ্যাকঅ্যাক ইউনিটগুলো পরিদর্শন করে তারা ফিরে আসে ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে।
কর্নেল তাহের তখনো বসেছিলেন জিয়ার ফেরার প্রতীক্ষায়। ফেরামাত্র কর্নেল তাহের জিয়াকে প্রস্তাব দিলেন, বিকালে তিনি শহীদ মিনারে এক ছাত্র-জনতার সমাবেশের আয়োজন করেছেন, সেখানে জেনারেল জিয়াকে যেতে হবে ভাষণ দিতে। প্রস্তাবটি নাকচ করে দিয়ে জিয়া তাহেরকে আমন্ত্রণ জানালেন সন্ধ্যায় রেডিও বাংলাদেশে আসার জন্য। হতাশ হয়ে চলে গেলেন কর্নেল তাহের। সন্ধ্যায় জিয়া রেডিও বাংলাদেশ-এ পৌঁছালেন। কর্নেল তাহেরও এসে উপস্থিত হলেন। সেখানে জনাব খন্দকার মোশতাক এবং রাষ্ট্রপতি জাস্টিস সায়েম জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। জেনারেল জিয়া ও কর্নেল তাহের একত্রে বসেই তাদের ভাষণ শোনেন। সারাক্ষণই সেনা পরিষদের করা নিরাপত্তা বেষ্টনীর মধ্যে ছিলেন জিয়া।
এরপর তাহেরের বুঝতে বাকি রইল না সেনা পরিষদের প্রাধান্যের পরিপ্রেক্ষিতে দরকষাকষির মাধ্যমে জিয়াকে কিছুতেই কাবু করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না। বেছে নিতে হবে অন্য পথ। রেডিও বাংলাদেশ থেকে ফেরার আগে মেজর মহিউদ্দিন কর্নেল তাহেরকে পরিষ্কার করে জানিয়ে দেয়, তিনি যাতে সেনানিবাসে আর যাতায়াত না করেন। কারণ, গোয়েন্দা সংস্থাগুলো থেকে খবর পাওয়া যাচ্ছিলো কর্নেল তাহেরের লোকজনেরা জেনারেল জিয়াকে হত্যার ষড়যন্ত্র করছে।
রেডিও স্টেশন থেকে হতাশা ও ক্ষোভে কর্নেল তাহের হঠকারি সিদ্ধান্ত নেন, বৈপ্লবিক সৈনিক সংস্থার সদস্যদের মাধ্যমে শ্রেণী সংগ্রামের স্লোগান তুলে ঢাকা সেনানিবাসে অফিসার নিধনযজ্ঞ শুরু করে জিয়াসহ সেনা পরিষদকে পরাস্ত করে দখল করতে হবে ক্যান্টনমেন্ট সহ ঢাকা শহর। তার ধারণা ছিল, এই স্ফুলিঙ্গ দেশের অন্যান্য সেনানিবাসে দাবানল সৃষ্টি করবে। এভাবে সামরিক বাহিনীকে পরাস্ত করতে পারলে জনসমর্থন অতি সহজেই আদায় করা সম্ভব হবে।
এই ভ্রান্ত আত্মঘাতী পরিকল্পনা অনুযায়ী ৭-৮ নভেম্বর গভীর রাত ১২ টায় অপ্রত্যাশিতভাবে ঢাকা সেনানিবাসের কয়েকটি জায়গায় স্লোগান শোনা গেলো ‘সিপাহী সিপাহী ভাই ভাই অফিসারদের রক্ত চাই’, সাথে গোলাগুলির আওয়াজ! এমন একটা অঘটন কর্নেল তাহের ঘটাতে পারেন সে সম্পর্কে সচেতন ছিল সেনা পরিষদ। গোলাগুলির আওয়াজ ও বুক কাঁপানো স্লোগান শোনামাত্র ক্যান্টনমেন্টের বাসাবাড়ী ছেড়ে অনেক অফিসারই সপরিবারে প্রাণে বাঁচার জন্য পালাতে থাকেন। জেনারেল জিয়াকে নিরাপদ বেষ্টনীর মধে রেখে মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস এবং ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে অবস্থিত অফিসাররা মুহূর্তে অন্যান্য ইউনিটে যোগাযোগ করে পাল্টা অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে।
শুরু হয় বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্যদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম। অতি অল্প সময়ের মধ্যেই ক্যান্টনমেন্টে বিক্ষিপ্ত অবস্থায় অস্ত্রধারী ছোট ছোট কয়েকটি সক্রিয় গ্রুপকে কাবু করে বন্দী করা হয়। ফলে স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টির খায়েশ পূর্ণ হল না কর্নেল তাহেরের!
সামরিক বাহিনীর মধ্যে সশস্ত্র শ্রেণী সংগ্রামের প্রচেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর থেকে কর্নেল তাহের গা ঢাকা দিতে বাধ্য হন। তার এই ধরনের হঠকারিতায় প্রাণ হারায় বেশকিছু সেনা সদস্য এবং ১২ জন অফিসার।
রাত ভোর হবার আগেই ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে ওঠে। সাধারণ শহরবাসী এই মর্মান্তিক ঘটনার কিছুই টের পেল না।
৯ই নভেম্বর কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতাদের সাথে জাসদের রব, মেজর জলিলসহ আরও কয়েকজনকে মুক্তি দেয়া হয়। ১০ই নভেম্বর থেকে ১২ই নভেম্বরের মধ্যে পালিয়ে যাওয়া প্রায় সব অফিসার যার যার ইউনিটে যোগদান করেন। তাদের পরিবার পরিজনরাও ফিরে আসে। ইতিমধ্যেই যশোহর থেকে কর্নেল সালামের কম্যান্ডো ব্যাটেলিয়ান ঢাকায় এনে সেনা সদরের নিরাপত্তা জোরদার করে জেনারেল জিয়া ২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে নিজেকে চীফ অফ স্টাফের অফিসে অধিষ্ঠিত করেন। এরপর থেকে সেখান থেকেই তিনি সেনা প্রধানের দায়িত্ব পালন করতে থাকেন।
কর্নেল তাহেরের দুটো চালই ব্যর্থ হয়ে যাবার পর গোপনে জাসদের নেতৃত্বের সাথে আলোচনার পর সিদ্ধান্ত হয় দেশে এমন একটি অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে যাতে প্রতিবেশী দেশ ভারত তাদের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশের ভেতরে পাঠাতে বাধ্য হয়। তারা নিশ্চিত ছিলেন ভারতীয় বাহিনীর অনুপ্রবেশ ঘটাতে পারলে শুরু করা সম্ভব হবে জনযুদ্ধ। সেই যুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ী জাসদ দেশে বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র কায়েম করতে সক্ষম হবে।
সিদ্ধান্ত হল, ঢাকায় অবস্থিত ভারতীয় দূতাবাসে সশস্ত্র আক্রমণ চালিয়ে রাষ্ট্রদূতসহ সব কূটনীতিক ও স্টাফদের মেরে ফেলা হবে। এর প্রতিক্রিয়ায় ভারত সরকার অবশ্যই বাংলাদেশে সামরিক হামলা চালাবে।
উল্লেখ্য, আগস্ট সামরিক অভ্যুত্থানের পর এই ধরনের অভিযানের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে বাংলাদেশের সীমান্ত ঘিরে ভারত সৈন্য মোতায়েন করেছিলো প্যারা ব্রিগেড সহ। কিন্তু ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের প্রতি জনসমর্থন দেখে ইন্দিরা গান্ধীর সরকার বাংলাদেশ আক্রমণের সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। সম্প্রসারণবাদী ভারতের সিদ্ধান্ত বদলের আরও দুটো কারণ ছিলঃ
১। শেখ মুজিবের বাকশালী স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের পতনের পর জনাব খন্দকার মোশতাক আহমেদ রাষ্ট্রপতির পদ গ্রহণ করে বেসামরিক সরকার গঠন করার পরেই পাকিস্তান, গণচীন এবং সৌদি আরব বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান করে।
২। ভারতীয় সেনা মোতায়েনে উদ্বেগ প্রকাশ করে একই সাথে ভয়েস অফ আমেরিকা এবং রেডিও পিকিং(বেইজিং) থেকে ঘোষিত হয়, বাংলাদেশের রাজনৈতিক পটপরিবর্তন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কোন বহিঃশক্তির আগ্রাসন পুরো অঞ্চলকেই অস্থিতিশীল করে তুলবে, সেটা গণচীন এবং আমেরিকা সরকারের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে না। শুধু তাই নয়, গণচীন ভারতীয় সেনা মোতায়েনের প্রতিক্রিয়ায় অরুণাচল এবং মেঘালয় সীমান্তে চীনা সামরিক বাহিনীকে জোরদার করে তোলে। গণচীন ও আমেরিকার সতর্কবাণীকে হাল্কাভাবে নেয়া সম্ভব ছিল না সোভিয়েত ইউনিয়নের বলয়ভুক্ত ভারতের। সিদ্ধান্ত বাতিল করলেও ভারতীয় বাহিনী ডেপ্লয়েড রাখা হয়। এ সম্পর্কে জাসদ এবং কর্নেল তাহের অবগত ছিলেন।
সুযোগ সৃষ্টি করে দেবার জন্য তাহেরের অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার একটি সশস্ত্র দল ভারতীয় দূতাবাসে তার দুই ভাইয়ের নেতৃত্বে হামলা চালায়। গোলাগুলিতে রাষ্ট্রদূত সমর সেন আহত হয়ে প্রাণে বেচে যান। দুই পক্ষেই হতাহত হয় কয়েকজন। বাকিরা ধরা পড়ে নিরাপত্তা বাহিনীর হাতে। সমর সেন বেচে যাওয়ায় ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশের ভেতরে আগ্রাসনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হয়।
এই ঘটনার দায়ে জাসদের কর্নেল তাহেরসহ মেজর জলিল, রব, শাহজাহান সিরাজ প্রমুখ শীর্ষ নেতাদের পুনরায় গ্রেফতার করা হয় ১৯শে নভেম্বর।
২১শে জুলাই ১৯৭৬ সালে একটি বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রদত্ত রায়ে ফাঁসি কাষ্ঠে ঝুলে প্রাণ বিসর্জন দিয়ে তার ভুল রাজনৈতিক আদর্শ বাস্তবায়নের স্বার্থে ভ্রান্ত পদক্ষেপের সব হিসাব নিকাশ চুকিয়ে দিয়ে যান দেশ প্রেমিক, জনদরদী বীর মুক্তিযোদ্ধা পরম সুহৃদ কর্নেল তাহের।
মার্শাল ল’ এর অধীন বিশেষ ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসাবে ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকেই (জিয়ার কোর্সমেট) জেনারেল জিয়া নিযুক্ত করেছিলেন। অন্যান্য সদস্যরা ছিলেন উইং কমান্ডার রশিদ, কমোডোর সিদ্দিক আহমেদ, ম্যাজিস্ট্রেট আব্দুল আলি ও হাসান যদিও সেই বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচার প্রক্রিয়া প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে আজঅব্দি।
রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে বিচার বিভাগীয় পদ্ধতি গুরুতরভাবে লঙ্ঘন এবং তড়িঘড়ি করে কর্নেল তাহেরকে ফাঁসি দেয়া হলেও জাসদের অন্যান্য শীর্ষপর্যায়ের নেতাদের কিন্তু ফাঁসি হল না। পরবর্তী কালে দেখা গেলো তাদের অনেকেই জেনারেল জিয়ার সাথে পরে সখ্যতাও গড়ে তোলেন। এরাই আবার আজঅব্দি কর্নেল তাহেরের জন্য কুম্ভিরাশ্রু ফেলতে ফেলতে এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের সাথে জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করে মন্ত্রীসভা অলংকৃত করে ক্ষমতার হালুয়া-লুচি উপভোগ করে চলেছেন লজ্জাহীন ভাবে।
এই সমস্ত নীতি বিবর্জিত আদর্শহীন রাজনীতিকদের চরিত্র সম্পর্কে নতুন প্রজন্মকে অবশ্যই সতর্ক হতে হবে দেশে সুস্থ রাজনীতির স্বার্থেই। শুধু তাই নয়, যারা দাবি করে এবং ন্যক্কারজনকভাবে প্রচারণায় লিপ্ত যে, কিছু বিপথগামী চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসারই শেখ মুজিবের স্বৈরাচারী বাকশাল সরকারের পতন ঘটিয়েছিলো। সেটাই যদি সঠিক হতো তবে, দেশের সামরিক বাহিনীর বৃহদংশ এবং রক্ষীবাহিনী সহ অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সম্মিলিত প্রচেষ্টায় গুটিকতক বিপথগামী চাকুরিচ্যুত জুনিয়র অফিসারকে অতি সহজেই পরাস্ত করা যেতো। সেটা সম্ভব হল না কেনো?
জাসদ এবং অন্য যারা দাবি করে থাকে কর্নেল তাহের জেনারেল জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করেছিলেন এবং তিনিই ছিলেন ৭ই নভেম্বরের সিপাহী জনতার বিপ্লবের মূল নেতা। সেটাই যদি সত্য হয়ে থাকে তবে মেজর মহিউদ্দিনের হুকুম মেনে নিয়ে কর্নেল তাহের ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসতে হয়েছিলেন কেনো? প্রবেশ নিষেধ আদেশই বা মেনে নিতে তিনি বাধ্য হয়েছিলেন কেনো? উল্লেখিত যুক্তির পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের উদ্ভট বক্তব্যের সত্যতা কতটুকু সেটা যাচাই করার ভারও থাকলো পাঠকদের উপরেই।
২য় ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে নিজেকে বের করে সেনাসদরে অধিষ্ঠিত করার পর মোটামুটি স্বচ্ছন্দ বোধ করতে লাগলেন সেনা পরিষদ ও বিপ্লবীদের মধ্যমণি জেনারেল জিয়াউর রহমান। তখন তার অন্য রূপ। তাকে তখন ঘিরে রেখেছে ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত, কর্নেল অলি, ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর, ব্রিগেডিয়ার মহব্বতজান চৌধুরী, ব্রিগেডিয়ার মচ্ছু সালাম, ব্রিগেডিয়ার এরশাদ, কর্নেল মইনুল হোসেন, কর্নেল সাদেক, কর্নেল নাসিম প্রমুখ। এরাই তখন জেনারেল জিয়ার মুখ্য পরামর্শদাতা।
এই বেষ্টনীর ধারে কাছেও যাবার সুযোগ নেই মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস, রিসালদার সারোয়ার কিংবা ফ্লাইট সার্জেন্ট আফসারের। পরীক্ষিত সাথীদের দূরে সরিয়ে তিনি যাদের আস্থাভাজন মনে করে কাছে টেনে নিলেন ঐ সমস্ত ক্ষমতালিপ্সু মাকড়সার দল তখন জিয়ার অজান্তেই তার চারপাশে দৃঢ় অবস্থান গ্রহণ করে নতুন ষড়যন্ত্রের জাল বুনতে শুরু করেছে।
ব্রিগেডিয়ার মীর শওকত জিয়াকে বুঝিয়ে ঢাকায় ৯ম পদাতিক ডিভিশন দাড় করিয়ে পদোন্নতি বাগিয়ে নিজেই জেনারেল কমান্ডিং অফিসার হয়ে বসেছেন। তার পরামর্শেই ভারতে এনডিসি কোর্স কালেই এরশাদকে নিয়ম বহির্ভূতভাবে ডবল প্রমোশন দিয়ে জেনারেল পদে পদোন্নতি দেয়া হয় এবং দেশে ফেরার পর তার মতো একজন চরিত্রহীন দুর্নীতি পরায়ণ অফিসারকে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ দেন জেনারেল জিয়া।
দিল্লীর টার্ম শেষে মঞ্জুরকেও জেনারেল বানিয়ে চীফ অফ জেনারেল স্টাফের পদে নিয়োগ প্রদান করা হয় ক্ষমতার ভারসম্যতা রক্ষার স্বার্থে ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ নীতি অনুযায়ী। এই ধরনের কূট-কৌশলের পরিণাম কি ভয়ংকর হতে পারে সেটা সব ক্ষমতার অধিকারী জেনারেল জিয়া তখন বুঝতে পারেননি। বুঝেছিলেন অনেক পরে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। সে কথা পরে আসবে।
এ পর্যায়ে একটি কাকতালীয় যোগাযোগের বিষয় উল্লেখ করার প্রয়োজনীয়তা বোধ করছি। এরশাদ যখন ভারতে এনডিসি কোর্স করছিলেন, তখন মুচকুন্দ দুবে নামের ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক চৌকস অফিসারের সাথে তার ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব গড়ে ওঠে। তার মাধমেই ভারতীয় গোয়েন্দা সংস্থা RAW (রিসার্চ এন্ড এনালাইসিস উইং) এর সাথে এরশাদের সম্পর্ক স্থাপনের ঘটনাটি ঘটে। এ সম্পর্কে জিয়া বোধকরি অবগত ছিলেন না। এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের পরই সেই মুচকুন্দ দুবেকেই ভারত সরকার ঢাকায় তাদের হাই কমিশনার নিযুক্ত করে পাঠিয়েছিল।
জেনারেল এরশাদ যখন বন্দুকের জোরে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট সাত্তারকে হটিয়ে ক্ষমতা নিয়েছিলেন, তখন দেশি-বিদেশি সাংবাদিকরা শেখ হাসিনার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে তিনি বলেছিলেন,“I am not unhappy.” এই বিষয়গুলো সবই একই সূত্রে বাধা।
বার্মার বাংলাদেশ দূতাবাসে কর্মরত মিলিটারি এট্যাঁ’চে ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম শিশুকে ফিরিয়ে এনে তাকে জেনারেল বানানোর কথা হচ্ছে।৭ই নভেম্বর পালাতে গিয়ে পা ভেঙ্গে CMH-এ আশ্রয় নেয়া কর্নেল মইনুল হোসেনকেও জিয়া পদোন্নতি দেন যদিও শেখ কামালের মনোনীত পাত্রি ছিলেন তার স্ত্রী।
সমস্ত খবরই আমাদের কাছে পৌছে দেয়া হচ্ছিলো সেনা পরিষদের তরফ থেকে। বিদেশ থেকে জিয়া তার পছন্দের লোকদের দেশে ডেকে আনছেন কিন্তু আগস্ট বিপ্লবের নেতাদের ফেরত আনার বিষয়ে কোনও উদ্যগই নেয়া হচ্ছে না। এ ছাড়া বিপ্লবীদের তরফ থেকে দেয়া দাবিনামার বাস্তবায়নের বিষয়টিও ক্রমশ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছেন জেনারেল জিয়া এবং তাকে ঘিরে রাখা চাটুকার উপদেষ্টারা।
এর ফলে সেনা অসন্তোষ আবারো ধূমায়িত হয়ে উঠতে থাকে। অবস্থা বেগতিক দেখে ধূর্ত জিয়া বিপ্লবীদের এক বিশাল সমাবেশের আয়োজন করেন ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেনাকুঞ্জে। সমাবেশে সওয়াল-জবাব কালে এক বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। বিপ্লবীদের কোনও প্রশ্নেরই সঠিক জবাব দেয়া সম্ভব হচ্ছিল না জেনারেল জিয়ার পক্ষে।
বিপ্লবীদের মূল প্রশ্ন-
আগস্ট অভ্যুত্থানের নেতাদের দেশে ফিরিয়ে আনতে বিলম্বের কারণ কি? স্বাক্ষর করার পরও সৈনিকদের দাবিনামার বাস্তবায়নের কোন উদ্দগ নিচ্ছেন না কেন জেনারেল জিয়া? প্রবল চাপ ও প্রশ্নবাণে জর্জরিত অপদস্থ জিয়া এক সময়ে বলে উঠলেন
আমি তোমাদের সব দাবি কার্যকর করবো তবে সেটার জন্য তোমাদের ধৈর্য ধরতে হবে। শীঘ্রই আমি আমার দূত পাঠাচ্ছি ব্যাংককে। দাবিনামাও বাস্তবায়িত হবে নিয়ম মাফিক। এসবের জন্য সময় প্রয়োজন। তোমরা যদি আমাকে বিশ্বাস না করো আর সময় দিতে না চাও তবে আমিও আর চীফ হিসাবে থাকতে চাই না বলেই নাটকীয় ভাবে নিজের কোমর থেকে বেল্ট খুলে টেবিলের উপর রেখে দিলেন জেনারেল জিয়া। এ ধরনের অপ্রত্যাশিত আচরণে স্তম্ভিত হয়ে গেলো উপস্থিত সবাই! বিপ্লবীদেরই মনোনীত চীফ জিয়া। তাই তাকে অবিশ্বাসের প্রশ্নই ওঠে না! রিসালদার সারোয়ারই নিজ আসন থেকে উঠে গিয়ে জেনারেল জিয়ার কোমরে বেল্ট পরিয়ে দিয়ে বললো
স্যার, আপনি আমাদের মনোনীত চীফ। সেক্ষেত্রে আপনি কি করে ভাবলেন আমরা আপনাকে অবিশ্বাস করছি! আমরা শুধু চাচ্ছি, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিদেশে অবস্থানরত নেতাদের ফিরিয়ে এনে আপনার অবস্থান শক্ত করুন। এই সাথে, সৈনিকদের যুক্তিসঙ্গত দাবিগুলো মেনে নিয়ে আপনার উপর তাদের আস্থা দৃঢ় করুন। এ ভাবেই শেষ হয়েছিলো সেদিনের দরবার।
বিদেশে অবস্থান করেও আমাদের বুঝতে অসুবিধে হল না, সেনা পরিষদ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে নিজেই রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার শীর্ষস্থান দখল করার এক চতুর খেলা শুরু করেছেন আমাদেরই মধ্যমণি জেনারেল জিয়াউর রহমান। তার এই খেলায় কর্নেল তাহেরের পর সেনা পরিষদই তার প্রধান প্রতিপক্ষ। এর প্রমাণ পেতে বেশি দিন অপেক্ষা করতে হল না।
সেদিনের দরবারের পর জিয়াকে পরামর্শ দেয়া হল, ল্যান্সার এবং অ্যাকঅ্যাক রেজিমেন্টসহ লগ এরিয়ার ইউনিটগুলোকে ক্রমান্বয়ে ঢাকা থেকে সরিয়ে ফেলতে হবে ছলে বলে কৌশলে। কারণ, ঐ সমস্ত ইউনিটগুলোতেই রয়েছে সেনা পরিষদের শক্ত অবস্থান। এখনই যদি ২য় ফিল্ডকে সরানোর চেষ্টা করা হয় তবে পাশা উল্টে যেতে পারে। মূল পরামর্শদাতা জেনারেল মীর শওকত। তার সাথে একমত হন জেনারেল এরশাদ ও ব্রিগেডিয়ার মইনুল হোসেন, কর্নেল নাসিম, জেনারেল মচ্ছু সালাম প্রমুখ।
পরামর্শ অনুযায়ী অবিলম্বে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন জিয়া ল্যান্সার-এর একটি স্কোয়াড্রন সাভারে রেখে বাকি পুরো ইউনিট বগুড়াতে পাঠানো হবে। সিগন্যাল ইউনিটকে পাঠানো হবে কুমিল্লায়, আর অ্যাকঅ্যাক রেজিমেন্টকে পাঠানো হবে রংপুরে।
১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বেরের বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের তৎকালিন প্রধান ইউনিটগুলো যেখানে সেনা পরিষদের দৃঢ় অবস্থান ছিল সেগুলো হল-২য় ফিল্ড আর্টিলারি, বেঙ্গল ল্যান্সার, ১ম ইষ্টবেঙ্গল, ৩৮তম লাইট অ্যাকঅ্যাক রেজিমেন্ট, ২য় ইঞ্জিনিয়ার ব্যাটালিয়ান, সেন্ট্রাল অর্ডন্যান্স ডিপো, বেইস ওয়ার্কশপ, সিগন্যাল ব্যাটালিয়ান, সাপ্লাই ব্যাটালিয়ান, সিএমএইচ, আর্মি হেডকোয়ার্টার ব্যাটালিয়ান, এমপি ইউনিট, মেডিকেল কোর, ষ্টেশন হেডকোয়ার্টার, লগ এ্ররিয়ার অন্যান্য ইউনিটগুলো।
এর প্রায় সব কয়েটি ইউনিটই ছিল লগ কমান্ডারের অধীন। কর্নেল তাহেরের অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেলগুলো নির্মূল করার পর সেনাপরিষদ ও বিপ্লবী সৈনিকদের বিরুদ্ধে তাদেরই প্রিয় চীফ অফ আর্মি স্টাফ জেনারেল জিয়াউর রহমানের চরিত্র এবং প্রাসাদ ষড়যন্ত্র সম্পর্কে জানার জন্য পাঠকদের সুবিধার্থে জিয়ার কোর্সমেট এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু তদান্তিন লগ এরিয়া কমান্ডার কর্নেল হামিদের লেখা বই ‘তিনটি অভ্যুথান ও কিছু না বলা কথা’-র একটি অধ্যায় তুলে ধরা হল। ৭ই নভেম্বরের সিপাহি-জনতার সফল বিপ্লবের পর জিয়া আস্থাভাজন মনে করে ষ্টেশন কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে কর্নেল হামিদকে লগ এরিয়া কমান্ডার পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। কর্নেল হামিদ এই অধ্যায়ের নামকরণ করেছেন
“সংঘর্ষের পথে জিয়া”
সর্বত্র শান্তি বিরাজমান। এবার শুরু হল চক্রান্তবাজ স্বার্থান্বেষী অফিসারদের আসল খেলা।
জিয়াউর রহমানের মাথায় ঢুকানো হল ভিন্ন চিন্তা। ১২ দফার সৈন্যদের এখনই শায়েস্তা করতে হবে তা না হলে আবার তারা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে। আবার বিদ্রোহ করতে পারে। এদের শক্তি এখনি ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে দিতে হবে। তার পাশে এখন জড়ো হয়েছেন তারই নির্বাচিত পেপার টাইগার উপদেষ্টাগণ। এসেছেন যশোহর থেকে মীর শওকত আলী। তিনি ইতিমধ্যেই রাজধানী ঢাকায় নবম ডিভিশন গঠন করে হয়েছেন মেজর জেনারেল। দিল্লী থেকে উড়ে এসেছেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। তিনিও প্রমোশন নিয়ে এখন মেজর জেনারেল ও ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ। এসেছেন দিল্লী থেকে ব্রিগেডিয়ার মঞ্জুর। বার্মা থেকে ডেকে পাঠিয়ে আনা হয়েছে ব্রিগেডিয়ার নুরুল ইসলাম শিশুকে। CMH থেকে ভাঙ্গা পা নিয়েও উঠে এলেন কর্নেল মইনুল হোসেন। তারা সবাই জেঁকে ধরেছেন জিয়াকে। হালুয়া-রুটি নিয়ে কাড়াকাড়ির ধুম! জিয়াউর রহমান অনেক অপমান সহ্য করেছেন। চাপের মুখে তাকে সৈনিকদের তরফ থেকে ১২ দফায় সই করতে বাধ্য করা হয়েছে। এরই মধ্যে চাপ সৃষ্টি করে ব্যাটম্যান প্রথাসহ বেশ কিছু সুবিধা আদায় করে নেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আর নয়। এবার ১২ দফার দাবিদারদের শায়েস্তা করার পালা। ডেপুটি চীফ ও নবম ডিভিশন কমান্ডার মীর শওকত আলী এখন তাঁর প্রধান উপদেষ্টা। তাদের যাঁতাকলে আবদ্ধ জিয়া। তাদের কথামতই ওঠেন বসেন জিয়াউর রহমান। তারা নিজস্বার্থেই জিয়াকে দ্রুত বিপ্লবী সৈনিকদের সাথে সংঘর্ষের পথে ঠেলে দিচ্ছে। একদিন জিয়া বললেন, ‘আমি ঢাকা থেকে সিগন্যাল ইউনিটকে সরাতে চাই, এরা বেশি শিক্ষিত হয়ে উঠেছে। আমি বুঝিয়েছিলাম, এরকম করাটা এখন ঠিক হবে না। অসন্তোষ বাড়বে। তিনি কিছুই শুনলেন না বললেন, “দেখো কি ভাবে আমি তাদের শায়েস্তা করি”। আর্মি হেড কোয়ার্টারের হুকুমে তাদের কুমিল্লায় যেতে হলো। এ নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে বেশ উত্তেজনা সৃষ্টি হল। প্রথমে তারা যেতে অস্বীকার করলো তবে শেষপর্যন্ত সুকৌশলে কাজ সেরে নেয়া হলো। তারা অসন্তুষ্ট হলেও জিয়ার নির্দেশ মেনে নিলো। সৈনিকরা জিয়ার মতিগতি নিয়ে সন্দেহপ্রবণ হয়ে উঠলো। ২০শে নভেম্বর ছিল জিয়াকে নিয়ে আমার বেঙ্গল ল্যান্সার ইউনিট ভিজিট করার পূর্ব নির্ধারিত প্রোগ্রাম। আমি ১৯ তারিখে দুপুরে জিয়াকে ভিজিটের কথা স্মরণ করিয়ে দিতেই তিনি বললেন, “আমি ঐ বেয়াদপ ট্যাঙ্কওয়ালাদের ভিজিট করবো না।”আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কেনো কি হয়ে গেলো? এটাতো নির্ধারিত প্রোগ্রাম। তিনি বললেন, বেঙ্গল ল্যান্সার সবচেয়ে উচ্ছৃংখল ইউনিট। এদের আমি ঢাকা থেকে বগুড়া পাঠাবো। তুমি মঞ্জুরের সাথে কথা বলো, ও ব্যবস্থা নিচ্ছে। স্পষ্ট বুঝলাম, ঊর্ধ্বমার্গে নতুন চক্রান্ত শুরু হয়ে গেছে। বললাম, এদের এখন মুভ করানো ঠিক হবে না। তারা রিঅ্যাক্ট করবে। জিয়া রেগে গেলেন। বললেন, জানি you are trying to be popular. আমি সব বুঝি, কিন্তু তারা যাবেই। আমি বললাম,তাহলে লগ এরিয়া কমান্ড থেকে এই ইউনিটটি সরিয়ে নেন। আমি তাদের এই অর্ডার দিতে পারবো না। কারণ, আমি জানি এতে একটা গণ্ডগোল বাধবেই। জিয়া বললেন,হামিদ আমি সব বুঝি, সব খবর রাখি। Okay. আজ থেকে বেঙ্গল ল্যান্সার তোমার কমান্ডে নয়। আর্মি হেডকোয়ার্টারের সরাসরি কমান্ডে আসলো। তুমি চিঠি পেয়ে যাবে। পর দিনই চিঠি পেলাম। মঞ্জুর ফোন করে রসিকতা করে বললো, দাদা আপনার ঘাড়ের বোঝা কিছুটা হালকা করে দিলাম। তাকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, ব্যাপারটা আমি জানি। Thank you and wishing you best of luck with the Tankers. খুব সম্ভব মঞ্জুরের সাথে সেটাই ছিল আমার শেষ বাক্যালাপ। পরবর্তী কালে মঞ্জুর চট্টগ্রামে সেনা অভ্যুত্থানে নির্মমভাবে নিহত হন। যাই হউক, এখন শক্ত এ্যাকশন নেবার পালা। তাদের নির্দেশ দেয়া হলো ঢাকা ত্যাগ করে বগুড়ায় মুভ করার জন্য। বলা হলো, এটা ট্যাকটিকাল মুভ। কিন্তু আসল উদ্দেশ্য বুঝতে ল্যান্সারের সৈনিকদের বুঝতে কষ্ট হয়েনি। তারা জিয়ার আদেশ মানতে সরাসরি অস্বীকার করলো। শুরু হলো নতুন করে হট্টগোল।ল্যান্সার এর সৈনিকরা আবার অস্ত্র হাতে গর্জে উঠল। ট্যাংকগুলো সচল করে তারা আবার লড়াই এর জন্য তৈরি হয়ে গেলো। তারা জিয়ার সেনাসদরের বাস্তিল দুর্গ গুঁড়িয়ে দেবে।২২শে নভেম্বর ক্যান্টনমেন্টের অবস্থা খুবই নাজুক ও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলো। যেকোনো মুহূর্তে গোলাগুলি শুরু হয়ে যেতে পারে। আবার মহাসংকটে জিয়া। এই সংকট থেকে তাকে উদ্ধার করার জন্য মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস এবং রিসালদার সারোয়ারের শরণাপন্ন হতে হয় জিয়াকে। তারাই তাদের সাথী বিপ্লবী ভাইদের বুঝিয়ে শান্ত করে চীফের নির্দেশ পালনে রাজি করালো।”
পাঠকদের অবগতির জন্য যেটা সম্পর্কে কর্নেল হামিদ বা অন্য কেউ অবগত ছিলেন না সেটা লিখতে বাধ্য হলাম সত্যের খাতিরেই। এই সংকট দেখা দিলে জেনারেল জিয়া যখন মেজর মহিউদ্দিনের সাহায্য প্রার্থনা করেন, তখন মেজর মহিউদ্দিন জিয়াকে ব্যাংককে অবস্থিত সেনা পরিষদের শীর্ষনেতাদের সাথে যোগাযোগ করার পরামর্শ দিয়ে বলেছিলো,
সেখান থেকে যেই নির্দেশই আসবে সেটাই কার্যকর করা হবে। জিয়াকে সেই পরামর্শ দিয়ে মেজর মহিউদ্দিন ব্যাংককে সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ তুলে ধরে নির্দেশ চায়। সার্বিক বিবেচনায় জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তখন জিয়ার বিরুদ্ধে ক্ষমতার লড়াই যুক্তিসঙ্গত হবে না বলে অভিমত জানিয়ে মেজর মহিউদ্দিনকে অবস্থা স্বাভাবিক করে তুলতে নির্দেশ প্রদান করেছিলেন ব্যাংককে অবস্থানরত নেতারা। এভাবেই তারা অবস্থাকে সামাল দিয়েছিলেন। জেনারেল জিয়াকে রিষ্কারভাবে ব্যাংকক থেকে জানানো হয়েছিলো, তার স্বার্থে নয়- জাতীয়স্বার্থেই ল্যান্সারের বিপ্লবীরা তার নির্দেশ মেনে নেবে। তবে তার জানা উচিত, ইতিমধ্যে সেনা পরিষদের কাছ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে ক্ষমতালোভীদের খপ্পরে পড়ে বিদেশী পশ্চিমা শক্তিধর দেশসমুহ আর ভারতের সাথে আপোষ করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজের মুঠোয় কুক্ষিগত করার জাতীয় স্বার্থবিরোধী এবং আত্মঘাতী যে খেলায় তিনি মেতেছেন তার পরিণতির সম্পূর্ণ দায়-দায়িত্ব শুধুমাত্র তাকেই বহন করতে হবে।
তাকে আরও বলা হয়েছিলো যাদের ত্যাগের ফলে আজ তিনি ডাস্টবিন থেকে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত তাদের ত্যাজ্য বিবেচনা করার পরেও শক্তিশালী সেনা পরিষদ দেশের স্বার্থে কখনোই আজকের জিয়ার সাথে ক্ষমতার লড়াই করবে না আগ্রাসী ভারতকে সুযোগ করে দিতে যাতে করে বাংলাদেশকে আর একটি সিকিম কিংবা ভুটানে পরিণত হতে হয়। এ বিষয়ে জিয়া নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন। কথোপকথন শেষ করার আগে জেনারেল জিয়াকে সতর্ক করে বলা হয়েছিলো তার পথ তাকে কোথায় নিয়ে যাবে সেটা যথা সময়ে দেশবাসী দেখবে। তবে তার জেনে রাখা উচিত সেনা পরিষদ কখনো কোনও কারণেই তাদের নীতি-আদর্শের সাথে বেঈমানি করবে না।
নিশ্চুপ থেকে কথাগুলো শুনে জিয়ার কালো মুখটা হয়তোবা আরো একটু বেশি কালো হয়ে উঠেছিলো এই ভেবে যে বিদেশে থেকেও তার ক্ষমতালিপ্সা, কূটচাল, ছলচাতুরি এবং মোনাফেকির সব গোপন খবর সম্পর্কে আমরা অনেকটাই অবগত। ফিরে চলি কর্নেল হামিদের লেখায়।
‘‘২৩শে নভেম্বর ল্যান্সারের একটি স্কোয়াড্রন সাভারে রেখে বাকি সবাই বগুড়ায় চলে যায়। সেনা সদরের কাগুজে বাঘরা হাঁপ ছেঁড়ে বাঁচলো, জিয়ার মুখে মুচকি হাসি ফুটে উঠলো। এবার ক্যান্টনমেন্টে জিয়ার পূর্ণকর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হল। তাকে চ্যালেঞ্জ করার আর কেউ রইলো না। এই সময় ক্ষমতার আবর্তে জিয়া গভীরভাবে আটকা পড়েন। ক্ষমতায় বসেও শান্তিতে নেই জিয়া। চারিদিকে বিপ্লবী সৈনিকদের বিরুদ্ধাচরণ। ক্ষমতা নিরংকুশ করতে পাগল হয়ে উঠলেন জিয়া। তার অবস্থা ভালো করে বুঝতে পারে চতুর পরামর্শকরা। তারা বুঝতে পারে তার দিন ঘনিয়ে আসছে। ক্ষমতার মসনদ থেকে যেকোনো মুহূর্তে তিনি ছিটকে পড়তে পারেন। তারপর কে, কে? সেই সন্ধিক্ষণে জিয়ার পাদপার্শে থেকে এরশাদ ও মঞ্জুর ভয়ানক ক্ষমতার দ্বন্দ্বে মেতে ওঠে। দুইপক্ষেই ইন্ধন যোগাতে থাকে শওকত। প্রদীপের নীচেই চলে গোপন খেলা। জিয়া যতই ক্ষমতা নিরংকুশ করতে কঠোর হচ্ছিলো তারা তাকে ততই চরম পরিণতির দিকে ঠেলতে থাকে। তিন খলিফার মধ্যে নেপথ্যে ক্ষমতার লড়াই চলে নিরবে অতি সন্তর্পণে। জিয়া কালো চশমার আড়াল থেকে ব্যাপারটা কিছুটা অনুধাবন করলেও তখন তেমন পাত্তা দেননি। জিয়া ভেবেছিলেন, তিনি এখন শক্ত প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে। বিপ্লবীদের সাথে কোনও আপোষ নয়।বিগড়ে গেলে জিয়া নিষ্ঠুর ভয়ংকর!
জিয়ার সাথে বিপ্লবীদের আলোচনা ভেঙ্গে যায়। তাদের ভাষায়, জিয়া তাদের সাথে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকলেও বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। জিয়ার পরামর্শ দাতারা তাকে বুঝাতে সক্ষম হয় যে, দাণ্ডাতেই ঠাণ্ডা হবে সব তাই জিয়া কঠোরভাবে বিপ্লবীদের দমন করার নির্দেশ দেন। এ ব্যাপারে আমি পরে বিশদ আরও নাজানা কথা লিখব। ফিরে চলা যাক কর্নেল হামিদের লেখায়।
‘‘জিয়া তখন অস্থির এবং হিংস্র। বাছবিচার না করেই ঢালাও ভাবে বিপ্লবীদের শাস্তি দিতে বদ্ধপরিকর। তার হাতে লম্বা লিস্ট ধরিয়ে দেয় তার নিয়োজিত DGFI কোর্সমেট জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরী। জিয়া তখন বাঘের পিঠে সওয়ার। আমি কিন্তু তার কথায় অধীনস্থ অফিসার এবং সৈনিকদের বিরুদ্ধে গণ চার্জসীট তৈরি করে শাস্তি প্রদানের ঘোর বিরোধী ছিলাম। বাছবিচার না করে ঢালাওভাবে বিপ্লবীদের খতম করতে জিয়া তখন বদ্ধপরিকর। তাকে শান্ত করার কেউই ছিল না বরং চতুর পার্শ্বচররা তার মেজাজ বুঝে তাকে ক্ষেপিয়েই দিলো। কারণ, এই সমস্ত অফিসারদের মনে এমনকি জিয়ার মনেও বিপ্লবীদের প্রতি কোনও শ্রদ্ধা ছিল না, ইতিমধ্যে আমার চেয়ে জুনিয়র অনেককেই জিয়া পদোন্নতি দিলো। আমার প্রমোশন আটকে দেয়া হলো এরশাদ আর শওকতের কানকথায়। কানকথায় প্রভাবিত হওয়া বড় রকমের স্বভাবগত দোষ ছিল জিয়ার। পদত্যাগ পত্র নিয়ে আমি তার সাথে শেষ দেখা করতে গেলাম। সামনে পদত্যাগ পত্র রেখে সোজাসুজি বললাম, জিয়া যে আর্মিতে ইনসাফ নেই, আইনের শাসন নেই, চক্রান্তের শেষ নেই, যে আর্মি চীফ অফ স্টাফ অবিচার করে, বিশ্বাসের মর্যাদা দেয় না, নিজের স্বার্থকেই বড় করে দেখে, উপকারীর উপকার স্বীকার করে না, নিজের ক্ষমতার স্বার্থে রক্তের গঙ্গা বইয়ে দিতে পারে, যোগ্যতার মর্যাদা দেয় না, কান কথায় চলে সে আর্মিতে আমি আর চাকুরী করবো না।
Look Hamid, এইসব সেন্টিমেন্টাল কথা রাখো।
না জিয়া, প্রমোশন তোমার কাছে ভিক্ষা চাইতে আসিনি। If I am fit, I get it or I don’t. আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালাম। জিয়া বিগড়ে গেলো। সেও চেয়ার ছেড়ে উঠে দাড়ালো। চিৎকার করে বললো, আমার বিশ্বস্ত অফিসাররা প্রমাণসহ বলেছে, তুমি জোয়ানদের কাছে পপুলার হওয়ার চেষ্টা করছো। তোমার সৈনিকগুলিই শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার কাজে বাধা দিচ্ছে। তুমি কোনও এ্যাকশন নিচ্ছো না। শুধু প্রশ্রয় দিচ্ছো। আমি বিনীতভাবে বললাম,
দোস্ত! তুমি তোমার এসব বিশ্বস্ত অফিসারদের নিয়েই সুখে থাকো। আমাকে রেহাই দাও। তবে আমার শেষ কথাটি মনে রেখো, যারা হঠাৎ করে উড়ে এসে তোমাকে ঘিরে ধরেছে, তারাই একদিন তোমাকে ফিনিশ করবে। পদত্যাগ পত্র ছিঁড়ে ফেলেছো, আমি অফিসে ফিরে গিয়ে আবার পাঠাচ্ছি, প্লিজ গ্রহণ কোরো। শুধু আমার প্রাপ্য পেনশনটা দিয়ো।
পদত্যাগের পর আমার জীবনধারা কঠিন হয়ে পড়লো। অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে এর আগে আরো অনেক অফিসার প্রতিবাদ করেন। তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসর প্রদান করা হয়। আমিই বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম অফিসার যে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করে স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করে সরকারী চাকুরি ছেড়ে বেরিয়ে এলাম। বাইরেও আমি নিরাপদ ছিলাম না। আমাকে কড়া মূল্য দিতে হয়েছিলো। এরশাদ-শওকত চক্র আমাকে বিপদে ফেলতে বহুদিন সক্রিয় থাকে। দেখলাম, এই দেশে অন্যায় অবিচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বিপদসংকুল। তার পরিবর্তে ক্ষমতাসীনদের মন জুগিয়ে চলাতেই ফায়দা বেশী। এতে ক্ষমতাসীনদের চক্ষুশূল হতে হয় না। নিরাপত্তা, প্রোমোশন ও অন্যান্য সুখ-সুবিধা অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে, ক্ষমতাবানদের মন জুগিয়ে বন্ধু হয়ে নির্বিঘ্নে নিশ্চিন্তে বসবাস করা যায়। দরকার শুধু স্রোতের অনুকূলে গা ভাসিয়ে দেওয়া। অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে আসার সাথে সাথে সেনাবাহিনীর অভ্যন্তরে বিপ্লবী চেতনায় প্রভাবিত সৈনিক ও অফিসারদের বিরুদ্ধে ক্রমাগত নির্মম ব্যবস্থা গ্রহণ করা শুরু হল। বহিষ্কার, ট্রান্সফার ও বিভিন্ন শাস্তিমূলক ব্যবস্থার সম্মুখীন হলেন তারা। ঢাকা থেকে সব বিপ্লবী অফিসার এবং সৈনিকদের বাইরে পাঠানো হল। যদিও ঐসব বিপ্লবীদের দ্বারাই জিয়া ক্ষমতার আসনে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন।
এ সমস্ত নির্যাতনমূলক ব্যাবস্থার প্রেক্ষিতে আবার ধীরে ধীরে ধূমায়িত হতে থাকে সেনা অসন্তোষ। দুর্ভাগ্যবশত এই সময় জিয়া এমন সব সিনিয়র অফিসারদের দ্বারা প্রভাবিত হন, যাদের মনে কস্মিনকালেও বৈপ্লবিক চিন্তাচেতনা এবং বিপ্লবী সেনাদের স্বার্থ স্থান পায়নি। বিপ্লবী সৈনিকদের বুক নিংড়ানো ভালবাসা এবং বিশ্বাসের মধ্য দিয়ে জিয়ার উত্থান ঘটলেও ৭ই নভেম্বরের পর থেকে জিয়া তার অভিজাত পারিষদবর্গ পরিবেষ্টিত হয়ে অতিদ্রুত বিপ্লবীদের কাছ থেকে দূরে সরে যেতে লাগলেন। বিপ্লবীদের প্রতি প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নে ব্যর্থ হলেন বিপ্লবীদের প্রিয় সেনাপতি। অসন্তোষ ধূমায়িত হয়ে উঠল বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে।
সিগন্যাল রেজিমেন্টকে ঢাকার বাইরে পাঠানো হল। বেঙ্গল ল্যান্সারকে বগুড়ায়। ৩৮তম লাইট অ্যাকঅ্যাক এবং অন্যান্য ইউনিটগুলোর প্রতি একই রকমের অবিচার করা হল। এভাবেই ঢাকার বিপ্লবীদের বাইরে সরিয়ে দেয়া হল। ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর এর সাথে যারা জড়িত ছিল হয়রানির শিকার হল তারাই। যে সব বিপ্লবী অফিসার ও সৈনিকদের বলে জিয়ার পক্ষে ক্ষমতায় আসীন হওয়া সম্ভব হয়েছিলো তাদের উপরেই নেমে এলো খড়গ! তখন যে সব অফিসারদের জিয়া বিশ্বস্ত মনে করতো তারা অন্তর থেকে কখনই মেনে নিতে পারেনি বিপ্লবীদের কিংবা তাদের দাবি-দাওয়াকে।যদিও ১৫ই আগস্ট কিংবা ৭ই নভেম্বরের ভয়াবহ অভ্যুত্থান দিবসের সামান্যতম আঁচড়ও তাদের গায়ে লাগেনি। সর্বত্র সংগঠিত হতে দেখা গেল প্রহসনমূলক সেনাবিদ্রোহ।বিপ্লবীরা তাদের প্রিয় জেনারেলকে গদীতে সমাসীন করার পর এ ধরনের প্রায় ১৮ টি ছোট বড় সেনাবিদ্রোহের খবর প্রচারিত হল। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, যশোহর, রংপুর, সৈয়দপুর, বগুড়া কোন সেনানিবাসই বাদ পড়লো না।
কতজন প্রাণ হারালো, ফাঁসিতে ঝুললো, জেলে গেলো, গুমখুন হল, আততায়ীর হাতে মৃত্যুবরণ করলো তার কোনও হিসাব নেই। শত শত পরিবারে কান্নার রোল। দেশের প্রতিটি ইউনিট কমান্ডিং অফিসার থেকে বিভিন্ন র‌্যাঙ্কের ২০ থেকে ৩০ জনের নাম চেয়ে পাঠানোর নির্দেশ জারি করা হয়েছিলো সেনাসদর থেকে জিয়ার সম্মতিক্রমে। যাদের বিনাবিচারে ফায়ারিং স্কোয়াডে নৃশংসভাবে গুলি করে কিংবা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে মারা হয়। এই নির্দেশ পাঠানোর নাটের গুরুরা জিয়াকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলো এই যুক্তি উপস্থাপন করে যে, এ ধরনের নিষ্ঠুরতায় যে ধরনের লোমহর্ষক শক ওয়েভের সৃষ্টি হবে তাতে সব ঠাণ্ডা হয়ে যাবে। কথায় আছে, ডাণ্ডাতে ঠাণ্ডা। সেনাবাহিনীর সদস্যদের মাথা থেকে বিপ্লবী চেতনা চিরতরে উধাও হয়ে যাবে। প্রাণের দায়ে ভয়ে তারা শংকিত হয়ে ভাববে, ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। কিন্তু ইতিহাস কি সেই সাক্ষ্য বহন করে? এ ধরনের প্রতিক্রিয়াশীল বর্বরতাকে সুযোগ হিসাবে গ্রহণ করেই দেশীবিদেশী ক্ষমতালিপ্সু আস্তিনের শ্বাপদের ষড়যন্ত্রে জেনারেল জিয়া ও তার ঘনিষ্ঠ অনেকজনকে নিষ্ঠুরভাবে প্রাণ হারাতে হয়েছিলো একটি ব্যর্থ অভ্যুত্থানের পাতানো খেলায়। আগুন নিয়ে খেলতে গিয়ে নিজের প্রজ্জ্বলিত অনলেই পুড়ে মরতে হয়েছিলো প্রেসিডেন্ট জেনারেল জিয়াকে। ষড়যন্ত্রমূলক চক্রান্তে জিয়ার মৃত্যু হলেও একটি সত্য মানতেই হবে, হত্যাকারীদের সুযোগ করে দিয়েছিলেন স্বয়ং জিয়া নিজেই বিপ্লবীদের সাথে তার আত্মঘাতী বিশ্বাসঘাতকতার মাধ্যমে। কর্নেল হামিদ আরও লিখেছেন
ক্ষমতায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবার পর বিপ্লবীদের দেয়া কোনও প্রতিশ্রুতিই জেনারেল জিয়া রাখেননি এবং বাস্তবায়িত করলেন না কোনও দাবি। পরিবর্তে তাদের উপর চলে দমন নীতির স্টিমরোলার। বিদ্রোহী সেনা সদস্যদের পাকড়াও করে তাদের নির্মমভাবে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা নেয়া হল। সংক্ষিপ্ত বিচারের সুবিধার্থে মার্শাল ল’ আইনে বিশেষ সামরিক আদালত গঠন করা হল। এই সময় জেনারেল এরশাদ ছিলেন ডেপুটি চীফ। তারই তত্ত্বাবধানে এসব সংক্ষিপ্ত বিচার দ্রুতগতিতে সম্পন্ন করার ব্যবস্থা করা হয়। শুরু হল ত্বরিত গতিতে বিচারের প্রহসনের পালা। মাত্র কয়েকদিনের মধ্যে কয়েক শত সেনা এবং বিমানবাহিনীর সদস্যদের ফাঁসির আদেশ দেয়া হল। সামরিক বাহিনীর আইন-কানুন এ ক্ষেত্রে মেনে চলা হয়নি। দেশের পাঁচটি কারাগারে প্রতিদিন একসাথে ৮/১০ জনকে ফাঁসিতে ঝুলানো হয়। ফাঁসি ছাড়াও এলোপাথাড়ি ফায়ারিং এ মারা হয় শত শত। ফায়ারিং স্কোয়াডেও বহুজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। এছাড়া, ঢালাও ভাবে গ্রেফতারের পর বহু সৈনিকের মৃত্যু ঘটে অমানবিক নির্যাতনে। ৩ থেকে ৫ই অক্টোবর পর্যন্ত প্রতিরাতে ব্যারাক থেকে সেনা এবং বিমান বাহিনীর সদস্যদের ধরে নিয়ে যাওয়া হতো নির্যাতন ক্যাম্পে। তাদের কেউই আর ফিরে আসতো না। সব সেনানিবাসে বিদেহী আত্মার হাহাকার, বাতাসে বারুদ আর রক্তের মিলিত নোনা গন্ধ, সাথে পেছনে পড়ে থাকা প্রিয়জনদের বুক ফাটানো মাতমের সাথে আল্লাহ্‌র কাছে বিচার প্রার্থনা! ঠাণ্ডা মাথায় নৃশংসভাবে দুই হাজারেরও বেশি বিপ্লবী সেনা সদস্যকে হত্যা করেছিলেন জেনারেল জিয়া তার দোসরদের কুপরামর্শে। সরকারি ভাষ্যমতে, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার দুই মাসের মধ্যেই ফাঁসিতে লটকানো হয়েছিলো বিভিন্ন র‌্যাঙ্কের ১১৪৩ জন সেনাসদস্যকে। বিমান বাহিনীর সদস্যদের সংখ্যা ছিল ৫৬১ জন। ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে হত্যা করা সদস্যদের সঠিক সংখ্যা আজঅব্দি জানা যায়নি। জেল-জুলুম আর চাকুরিচ্যুতি ঘটে আরও কয়েক হাজার সদস্যের। আবেগময় বৈপ্লবিক ধারায় সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক এবং বিপ্লবী অফিসার ও সৈনিক, যারা জীবন বাজি রেখে জিয়াকে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করেছিল পরিণামে তাদের ভাগ্যে জুটলো প্রতারণা, অনাচার, অবিচার, জেল, জুলুম, ফাঁসি, গুপ্ত হত্যা এবং চাকুরিচ্যুতি! হতভাগ্যদের লাশ পর্যন্ত তাদের আত্মীয়-স্বজনদের দেয়া হয়নি। তারা আজো খুঁজে ফেরে তাদের প্রিয়জনদের। কোথায় যে এতো লাশ মাটি চাপা দেয়া হল তাও এক রহস্য! অনেকেরই ধারণা এটা ছিল পরিকল্পিত একটি নিধনযজ্ঞ। দেশের সব সেনানিবাসে সেনা সদস্যদের মেরে শহীদ করার পর জানাজার ব্যবস্থাও করা হয়েনি ধর্মীয় বিধিমতো। বুলডোজার দিয়ে বড় বড় গণকবরে ইউনিফর্ম এবং বুট পরিহিত অবস্থায়ই মৃতদেহগুলো মাটি চাপা দেয়া হয়। তাদের স্বজনরা আজো খুঁজে ফেরে প্রিয়জনদের লাশ। কেউ শোনেনি তাদের ফরিয়াদ। তারা পায়নি বিচার।”
হায়! লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে বন্ধ হয়নি রক্তের হলি খেলা। ক্ষমতার ব্যবসায়ীদের বীরদর্পে পদদলিত হয় মানবতা, দুর্বলের আর্তনাদ। এই দেশেতেই কেঁদে মরে বিচারের বাণী। এমন দেশই কি চেয়েছিল দেশবাসী, ঘোর আধারে তলিয়ে যাবে দেশ ও গোটা জাতি? একটি ফুলকে বাঁচাবার অন্য কোনও বিকল্প কি নেই? এই সমস্ত প্রশ্ন নিয়ে ভাবতে হবে সবাইকে সঠিক পথের সন্ধানে। ফিরে চলা যাক ব্যাংককে।
সেনাকুঞ্জের বিব্রতকর দরবারের পর হঠাৎ জিয়া জানালেন শীঘ্রই তিনি জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুকে ব্যাংকক পাঠাচ্ছেন খবরাখবর নিতে আর আলোচনার জন্য। শিশুভাই আমাদের সবার কাছেই বিশেষভাবে পরিচিত এবং প্রিয়। যুদ্ধকাল থেকেই তার সাথে সবার ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠলেও তার সাথে আমার পারিবারিক পুরনো ঘনিষ্ঠতা। তার ছোট ভাই কায়সারের সাথেও আমার ও স্বপনের ওঠাবসা রয়েছে। ষাটের দশকের প্রারম্ভে ক্যাপ্টেন মীর শওকত, ক্যাপ্টেন খালেদ মোশাররফ, লেফটেন্যান্ট শিশু যখন তরুণ অফিসার হিসাবে কুমিল্লায় পোস্টেড তখন আমিও ভিক্টোরিয়া কলেজের ছাত্র। গান-বাজনা, নাটক, খেলাধুলা, সমাজসেবা, রাজনীতি, মাস্তানি সবখানেই আমাদের প্রাধান্য।
কর্নেল জলিল তখন কুমিল্লাতেই কোনও একটা বেঙ্গল রেজিমেন্টের কমান্ডিং অফিসার। তার স্ত্রী আম্মার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী। সেই সুবাদে ওরা সবাই প্রায়ই আসতেন আমাদের বাসায় ঘরোয়া জলসায় কিংবা দাওয়াতে। ছুটি-ছাটায় হরহামেশাই তারা আসতেন আমাদের সাথে আনন্দমুখর পরিবেশে সময় কাটাতে। পরবর্তীকালে আবার দেখা মুক্তিযুদ্ধের ময়দানে। সেখানে ঘনিষ্ঠতা আরও গভীর হয়ে ওঠে। শিশুভাই ছিলেন প্রাণবন্ত এবং Happy go lucky type officer, তাই সবাই পছন্দ করত তাকে।
মুক্তিযুদ্ধের প্রথম দিকেই একদিন শিশুভাই সেক্টর থেকে ৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়ার্টারে এসে উপস্থিত। যুদ্ধের বিভৎসতা ও বাস্তবতার কারণে তার ব্লাড প্রেশার বেড়ে গেছে সাথে প্যালপিটেশন মানে বুক ধড়ফড়ানি। তাই তিনি কর্নেল ওসমানীকে অনুরোধ জানালেন, তাকে যেনো হেডকোয়ার্টারেই স্টাফ অফিসার হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয় এতে করে তিনি তার চিকিৎসাটাও চালিয়ে যেতে পারবেন। এরপর থেকে যুদ্ধ শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি ৮নং থিয়েটার রোডেই অবস্থান করেন। সেই সময় এলাজকালে হাসপাতালের এক নার্সের সাথে তার বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো যা নিয়ে আমরা হাসি তামাশা করতাম। সেটা ছিল একটা মুখরোচক বিষয়। যুদ্ধ শেষে সেনাসদর সর্বপ্রথম স্থাপিত হয় ২৭নং মিন্টু রোডের একটি সরকারি দ্বিতল ভবনে জেনারেল ওসমানীর নেতৃত্বে। শিশু ভাইও সেখানে একজন PSO (Personal Staff Officer). ক্যাপ্টেন নূর ও মেজর সালাহউদ্দিনও তখন সেখানে জেনারেল ওসমানীর সাথে অবস্থান করছে। স্বাধীনতার পর একদিন গোয়েন্দাপ্রধান বন্ধুবর মেজর সালাহউদ্দিন হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এলো আমার বাসায়। বললো, শিশুভাইকে পাওয়া যাচ্ছে না। লাপাত্তা হয়ে গেছেন আমাদের নাবালক ভাই কয়েকদিন ধরে। জেনারেল ওসমানী ভীষণ ক্ষেপে গিয়েছেন তার এই ধরনের হঠকারিতায়। হুকুম দিয়েছেন, যেভাবেই হউক না কেনো, শিশুভাইকে তার সামনে পেশ করতেই হবে। আমরা সবাই পুরো ঢাকা তন্নতন্ন করে গরু খোঁজা খুঁজেও পেলাম না তাকে। হঠাৎ মনে পড়ল কোলকাতায় চলে যাননি তো তার বান্ধবীর কাছে! ফোন করা মাত্রই জানতে পারলাম সেখানেই তিনি আত্মগোপন করে আছেন। অনেক বুঝিয়ে তাকে ফিরিয়ে এনেছিলাম। তার এক কথা, তিনি সেনাবাহিনীতে আর চাকুরি করতে চান না কিন্তু পাপা টাইগার তাকে রেহাই দিচ্ছেন না। তার যুক্তি, সদ্যস্বাধীন দেশে একটি সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার জন্য পর্যাপ্ত অফিসার নেই, তাই শিশুকে এখন অবসরে পাঠানো সম্ভব নয়। তার এই সিদ্ধান্তের পর আমরাই শিশুভাইকে বলেছিলাম, সময় মতো ওসমানীকে বুঝিয়ে তার সমস্যার সমাধান করে দেবো। পরে তাকেই কর্নেল পদে পদোন্নতি দিয়ে জিয়ার জায়গাতে বার্মায় মিলিটারি এটাচি করে পাঠানোর ব্যাবস্থা করা হয় সেনা পরিষদের নেতাদের প্রচেষ্টায়। জিয়ার আমলে তিনি জেনারেল পদে অধিষ্ঠিত হয়ে তার রাজনৈতিক গুরু হিসাবে ‘‘রাজপুতিন‘ নামে আখ্যায়িত হয়েছিলেন দেশের রাজনৈতিক মহলে। আমাদের সবার প্রিয়পাত্র শিশুভাই ব্যাংককের পথে রেঙ্গুন এয়ারপোর্টে যাত্রা বিরতি কালে টনি ভাবীকে নিয়ে এসেছিলেন। তখনই আমি তাকে সংক্ষেপে বলেছিলাম জিয়া মুক্ত হলে আপনার ডাক পড়বে, আপনি তৈরি থাকবেন।
আমার সাথে শিশুভাই এবং টনি ভাবীর ঘনিষ্ঠতা পারবারিক পর্যায়ের। স্বাধীনতার পর কুমিল্লাতে যখন একসাথে ছিলাম তখন তার দুই মেয়ে লাজু আর কাজু প্রায় সারা দিনরাত আমাদের বাসাতেই থাকতো। তখনো সস্তির জন্ম হয়নি, তাই নিম্মিকে নিয়েই ছিল লাজু-কাজুর স্বর্গ। সাপ্তাহিক ছুটিতে ঢাকায় এলে পাক মোটরস-এ নিজেদের বাড়িতে না থেকে আমাদের মালিবাগের বাসাতেই থাকতেন শিশু পরিবার। পারিবারিক সম্পর্কের আরেকটি বিশেষ কারণ ছিল। শিশুভাই ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সাথে যখন বিদ্রোহ করেন তখন তার স্ত্রী টনি ভাবীও বাচ্চাদের সাথে খালেদা জিয়ার মতো খানসেনাদের হাতে বন্দী হয়ে পড়েছিলেন। পরে কামরুল হক স্বপন বীরবিক্রম (আমার একমাত্র ছোট ভাই) এবং বন্ধু কাজি কামাল বীরবিক্রম এর নেতৃত্বে এক দুর্ধর্ষ গেরিলা অপারেশনের মাধ্যমে খালেদ ভাবী এবং শিশু ভাবীদের বাচ্চাসহ মুক্ত করে বর্ডারের ওপারে তাদেরকে শিশু ও খালেদ ভাইয়ের কাছে পৌছে দিয়েছিলো। গভীর এই ঘনিষ্ঠতার পরিপ্রেক্ষিতেই জিয়া তাকেই পাঠাচ্ছেন আমাদের সাথে আলোচনার জন্য। চাতুর্যের আর এক নমুনা!
৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লবের পর অপ্রত্যাশিত ঘটনাবলী আমাদের ভীষণ ভাবে ভাবিয়ে তুলেছে। দেখতে পাচ্ছি, বাংলাদেশের দিগন্তে এক অশনি শংকেত! কর্নেল তাহেরের হঠকারিতা, জিয়ার বিশ্বাসঘাতকতা এবং সেনা পরিষদের সাথে জিয়ার ষম্যমূলক আচরণের ফলে ক্রমবর্ধমান ব্যবধান অসন্তোষকে বাড়িয়েই তুলছে। চরিত্রহীন, লম্পট এবং ধুরন্ধর নামে পরিচিত সমস্ত অফিসারদের পাশে জড়ো করে তিনি সেনাসদরকে বাস্তিল দুর্গে পরিণত করে নিজের খোলস থেকে যে ভাবে স্বরূপে প্রকাশিত হচ্ছেন তাতে সেনা পরিষদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষ দানা বেধে উঠছে।মেজর মহিউদ্দিন, সুবেদার মেজর আনিস, রিসালদার সারওয়ার, সুবেদার মেজর ওহাব, ফ্লাইট সার্জেন্ট আবসারদের মতো পরীক্ষিত বিপ্লবী নেতাদের এড়িয়ে চলেছেন জিয়া। এতে করে হাজারো প্রশ্নের জন্ম হচ্ছে। এ সমস্ত প্রশ্নের উপযুক্ত জবাব পাওয়া যাচ্ছে না। জিয়ার অপ্রত্যাশিত কার্যকলাপের ফলে যে মৌলিক প্রশ্নগুলো দেখা দিচ্ছে সেগুলো হলঃ
১। এ কোন জিয়া?
২। জিয়ার অনুরোধে জনাব মোশতাক কেন পুনরায় রাষ্ট্রপতি হতে রাজি হননি তার ব্যাখ্যা দিয়ে তিনি আমাদের কাছে একটা প্রশ্ন রেখে বলেছিলেন, জিয়া সম্পর্কে আমাদের নতুন করে ভাবতে হবে বাহ্যিক জিয়া আর ভেতরের জিয়া কি একই ব্যক্তিত্ব নাকি তার চরিত্রে রয়েছে দ্বৈততা?
এ সমস্ত নিয়ে আমরা ভীষণ অস্বস্তিকর এক অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ এর চিন্তায় সারাক্ষণ ডুবে থাকতাম।
সৎ নীতিবান একজন সহযোদ্ধা হিসাবেইতো তিনি যুদ্ধকালীন সময় কোরআন শপথ নিয়ে সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি মেনে নিয়েই একাত্ম হয়ে ভারতীয় আধিপত্যবাদ এবং ভাগ্যাহত, বঞ্চিত গণমানুষের সামাজিক বিপ্লবের জন্য নিজেকে নিবেদিত করেছিলেন যার জন্যই তাকেই মধ্যমণি করে সব প্রতিবন্ধকতার মোকাবেলা করে আমরা এগিয়ে চলেছিলাম স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। তিলে তিলে গড়ে তোলা সেনা পরিষদ অনেক চড়াই-উৎরাই পাড়ি দিয়ে যখন তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসাল তখনই তিনি ভোল পাল্টে ঘরের শত্রু বিভীষণ হয়ে উঠলেন এটা বিশ্বাস করতে মন চাইছিলো না। কিন্তু সেটাই বর্তমান বাস্তবতা। তাই সেটা অস্বীকার করারও উপায় নেই।
দেশ থেকে ক্রমাগত অনুরোধ জানানো হচ্ছে, জিয়ার ডাকের অপেক্ষা না করে আমাদের অনতিবিলম্বে নিজেদের উদ্যোগে দেশে ফেরা উচিৎ।সবাই সন্দেহ পোষণ করছে, নিজের আসন পাকাপোক্ত করার পর তিনি আমাদের কখনোই দেশে ফিরতে দেবেন না। সেই অবস্থায় সেনা পরিষদ ও বিপ্লবীদের কি হবে সেটাও আমাদের ভেবে দেখতে হবে। অনেকেই অভিমত প্রকাশ করেছিলো তার অশুভ বাস্তিল দুর্গ এখনি গুঁড়িয়ে দিতে হবে, তা না হলে দেরি হয়ে যাবে আর বিফল হবে এতদিনের ত্যাগ এবং তিতিক্ষা।
যেভাবে জিয়া সেনাপরিষদের আন্তরিকতার সুযোগ নিয়ে তাদের কাঁধে বন্দুক রেখে কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে নির্মূল করেছেন বলির পাঁঠা করে ঠিক সেইভাবেই জিয়া সেনা পরিষদ এবং এই সংগঠনের বিপ্লবীদের শিকড় উপড়ে ফেলার জন্যই এখন তৈরি করেছেন তার বাস্তিল দুর্গ। ঐ দুর্গে তারই জড়ো করা নীতিবিবর্জিত চরিত্রহীন সুযোগ সন্ধানী অফিসাররা চক্রান্তের মাকড়সার জালে আটকে ফেলেছে জিয়াকে। এদের নেতৃত্ব দিচ্ছে ভারতের দালাল এরশাদ এবং চরিত্রহীন লম্পট দুর্নীতিবাজ মীর শওকত। তাদের কথায় এখন জিয়া উঠছেন আর বসছেন। অবিলম্বে যদি নেতারা দেশে ফিরে জিয়াসহ চক্রান্তকারীদের পরাস্ত না করা হয় তাহলে ভবিষ্যতে বাংলাদেশের অস্তিত্বই হুমকির সম্মুখীন হয়ে পড়বে।
এই ক্রান্তিকালে আমরা যে প্রশ্ন নিয়ে ভাবছিলাম সেটা হল, বর্তমান সংকটের সমাধান আমরা করতে পারবো নাকি আমাদের প্রত্যাবর্তন সংকটকে আরও জটিল করে তুলবে যার ফলে দেশ এবং জাতির হবে সমূহ ক্ষতি।
জিয়ার উপর কোনও জবরদস্তি ছিল না। শপথও তিনি নিয়েছিলেন স্বেচ্ছায়। সেই সময় থেকে আমাদের তরফ থেকে ওয়াদার খেলাপ হয়নি। তাহলে তিনি প্রতারণা করলেন কেনো?
অবশ্য তখনই শিশুভাই আমাদের তার চরিত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, কিন্তু আমরা যুক্তিসাপেক্ষে তার অভিমত নাকচ করে দিয়েছিলাম। বিচক্ষণ রাজনীতিক খন্দকার মোশতাক আহমেদ জিয়ার চারিত্রিক দ্বৈততা বুঝতে পেরে চতুরতার সাথেই নিজেকে সরিয়ে নিয়েছেন।কিন্তু সমস্যা হল দেশবাসী এবং সাধারণ সেনা সদস্যরা জিয়াকে বিপ্লবীদেরই একজন বলে মনে করছে সেই ক্ষেত্রে জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও সশস্ত্র বিরোধিতাকে ক্ষমতার লড়াই হিসাবেই দেখা হবে যুক্তিসঙ্গতভাবেই। ফলে সামরিক বাহিনী এবং জাতি হয়ে পড়বে দ্বিধাবিভক্ত। সেই সুযোগটা ভারত কিছুতেই হাত ছাড়া করবে না। দ্বিধাবিভক্ত জাতি আর সামরিক বাহিনীকে সম্বল করে সেনা পরিষদের পক্ষে কি সম্ভব হবে ভারত বিরোধী প্রতিরোধ সংগ্রাম গড়ে তুলে আগ্রাসী শক্তিকে পরাস্ত করা? বাস্তব ভিত্তিক জবাব হচ্ছে- না।
তাই আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম জিয়ার ইচ্ছার বিরুদ্ধে দেশে ফিরবো না দেশ ও জাতির বৃহত্তর স্বার্থে। দূর থেকেই জিয়া সম্পর্কে আমাদের ভাবতে হবে আর বুঝতে হবে তার উদ্দেশ্য আর খেলা। যদিও শিশুভাই আসছেন জিয়ার দূত হয়ে কিন্তু আমরা নিশ্চিত ছিলাম, শিশুভাই তার দায়িত্ব অবশ্যই পালন করবেন। তবে আমাদের কোন প্রশ্ন থাকলে সত্য এবং সঠিক জবাবই দিবেন। আর কোন বিষয়ে তার নিজস্ব অভিমত জানতে চাইলে অতি আন্তরিকভাবেই সেটা অকপটে তিনি আমাদের জানাবেন। তাই তার উপস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করবো আমরা। আমাদের আলোচনাও হবে খোলাখুলিভাবে। তাই তার সাথে যোগাযোগ করে অনুরোধ জানালাম যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ব্যাংককে পৌঁছনোর জন্য। শিশুভাই দিলখোলা হাসিখুশি মানুষ, কিন্তু তীক্ষ্ণ ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী। জটিল বিষয়ে তার বিচার বিশ্লেষণ সেই স্বাক্ষরই বহন করে। ঠিক হল তার কাছ থেকে প্রশ্নগুলোর জবাব জেনে নেবার চেষ্টা করবো আমরা।
যুদ্ধকালিন সময় ভারতীয় আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ এবং বৃহত্তর বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর কল্যাণে আর্থ-সামাজিক কাঠামোর পরিবর্তনের জন্য সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচির উপর সংগঠিত করা হচ্ছিলো গোপন সংগঠন। সেই সময় জিয়া সব শুনে বুঝেই স্বেচ্ছায় সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আমাদের সংগঠনের একজন হয়ে কাজ করতে। সেই সময় শিশুভাই যখন আমাদের জিয়া চরিত্র সম্পর্কে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করেছিলেন, আমিই তখন তাকে বলেছিলাম শিশুভাই, মুক্তিযুদ্ধ আমাদের অনেকের মধ্যেই পরিবর্তন এনেছে বিশেষ করে দেশ ও দেশবাসী সম্পর্কে বেশি করে বোঝার সুযোগ করে দিয়েছে। রাজনৈতিক ভাবেও সচেতন করে তুলেছে বয়সের তুলনায় অনেক বেশি। তেমনটি যে জিয়ার ক্ষেত্রে অসম্ভব সেটা যুক্তিসঙ্গত নয় বলা চলে কি?
তিনি আমার জবাব শুনে আর কিছুই বলেননি। আমরা তো তাকে নির্দিষ্টস্থানে প্রতিষ্ঠিত করেই এগুতে চেয়েছিলাম। তবে কেনো জাতি এবং গণমানুষের স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হয়েই সব নীতি-আদর্শ বর্জন করে কিছু সুযোগ সন্ধানী সুবিধাবাদী অমানুষদের পরামর্শে আইয়ুব খানের মতো দেশ ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী গোষ্ঠী স্বার্থের রাজনীতি শুরু করার চেষ্টা চালাচ্ছেন জিয়া? যাদের আত্মত্যাগের বদৌলতে তিনি আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে বসে তাদের শবের উপর উপবিষ্ট হয়ে শিবের গাজন গাইছেন, তাতে তার কি পরিণতি হতে পারে সেটাও কি তিনি বুঝতে পারছেন না? আমাদের মধ্যকার পারস্পরিক বিশ্বাসযোগ্যতা নষ্ট হয়ে গেলো কি কারণে? আমাদের ধ্যান-ধারণা, চাওয়া-পাওয়া ছিল এক ও অভিন্ন। তবে আজ কেনো আমরাই তার প্রতিপক্ষ হয়ে গেলাম! আমাদের নিঃস্বার্থ আন্তরিকতায় কি কোনও ঘাটতি ছিল?
আমরা অজান্তেই তার এতটাই চক্ষুশূল হয়ে উঠলাম যাতে মনে হচ্ছে ভবিষ্যতে দেশের মাটিতে পা রাখাও সম্ভব হবে না! আমরা কি এতই অপাংক্তেয়? এই অবস্থায় কি করা উচিৎ!
প্রতিদিনই দেশ থেকে হতাশাব্যঞ্জক খবর আসছে। প্রতিটি খবরের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণ করে যথা সম্ভব সেনা পরিষদের সদস্যদের মনোবল বজায় রাখার চেষ্টা করছিলাম। এমনই পরিস্থিতিতে এক রাতে নিজেদের একটি বৈঠক শেষে বিছানায় গা এলিয়ে দিয়েছিলাম। হঠাৎ জিয়ার সাথে আমার একটা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ গোপন বৈঠকের কথা স্মৃতির পর্দায় ভেসে উঠল।
৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়ার্টারের অধীন কোলকাতার উপকণ্ঠে কল্যাণীর নিরিবিলি পরিবেশে ভারতীয় সরকার আমাদের ব্যবহার করার জন্য কয়েকটি সেফ হাউস দিয়েছিলো। মুক্তিযোদ্ধারা কোলকাতায় এলে প্রয়োজন মতো হেডকোয়ার্টার- এর অনুমতি নিয়ে সেগুলো ব্যবহার করতো। জিয়াকে ১নং সেক্টর এর কমান্ড থেকে হেডকোয়ার্টারে আনার পর তাকে কল্যাণীতেই একটি সেফ হাউসে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিলো। কোলকাতায় এলেই তার সাথে দেখা করতে যেতাম গোপনে। সেদিনও গিয়েছিলাম। প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের সুনজরে নেই তখন জিয়া, তাই অনেকেই তাকে তখন এড়িয়ে চলতো। নিয়মিত ব্রিগেড গড়ে তোলার কথা চলছে সেই সময়।
স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার সুদুরপ্রসারী ভারতীয় নীলনকশা এবং তার বিরুদ্ধে সত্যিকারের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার মাধ্যমে সুখী-সমৃদ্ধ এক বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধাদের কি করা উচিৎ সেই সমস্ত বিষয়ে বিস্তারিত আলাপ আগেই হয়েছে। সব বুঝে শুনেই তিনি আমাদের সাথে একাত্ম হয়ে সেই ঘৃণ্য চক্রান্তের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। সে প্রেক্ষিতেই আজ আমি এসেছি তার শপথ গ্রহণ করাতে। একই সাথে তাকে জানাতে, শফিউল্লাহ আর খালেদের নেতৃত্বে যদি ‘এস’ এবং ‘কে’ ফোর্স নামে দুইটি ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয় তবে প্রবাসী সরকারকে বাধ্য করবে দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা ‘জেড’ ফোর্স নামে আর একটি ব্রিগেড গঠন করতে তার অধীনে। শপথ গ্রহণের পর বিদায় নেয়ার আগে আমি তাকে বললাম স্যার, ব্রিগেড কমান্ডার হিসাবে আপনার সাথে স্বাভাবিক কারণেই দেখাসাক্ষাত কমে যাবে। আমাদের অনেককেই প্রস্তাব দেয়া হয়েছিলো মুক্তিফৌজ ছেড়ে ঐ নিয়মিত ব্রিগেডগুলোতে যোগদান করতে। কিন্তু আমরা তাতে রাজি হইনি একটি মাত্র কারণে। সেটা হল, পরীক্ষিত মুক্তিযোদ্ধাদের আমাদের নীতি-আদর্শের আলোকে উজ্জীবিত করে সাংগঠনিক কাজকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া এবং একদল নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনী তৈরি করা। যেকোনো দীর্ঘমেয়াদী বিপ্লবকে সফল করে তোলার জন্য তিনটি উপাদান অত্যাবশ্যকীয়-
১। সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি যার ভিত্তি হবে মূলত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর প্রত্যাশা, চাহিদা ও দেশের অগ্রগতির জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপের উপর।
২। দৃঢ়চেতা আত্মত্যাগী নেতৃত্বের অধীনস্থ একটি সুশৃঙ্খল সংগঠন।
৩। একটি পরীক্ষিত নিবেদিতপ্রাণ রাজনৈতিকভাবে সচেতন কর্মীবাহিনী।
এদের নিয়েই স্বাধীনতার পর জাতির মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীতে গড়ে তুলবো গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ। আপনিই হবেন সেই সংগঠনের মধ্যমণি।
সব শুনে, জিয়া আমাকে উষ্ণ আবেগে বুকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। কিছুক্ষণের জন্য আমাদের দুটো মনে একই প্রত্যয় প্রাণ পেয়েছিলো।
আমি বেরিয়ে আসছিলাম সেই সময় জিয়া বললেন
ডালিম, একটা অনুরোধ। সংগঠনের স্বার্থেই আমাকে কথা দিয়ে যাও, আমি যে তোমাদেরই একজন সেটা উপযুক্ত সময় না আসা পর্যন্ত গোপন রাখা হবে। এর প্রধান কারণ হচ্ছে, আমার প্রতি ভারত এবং আওয়ামীলীগ সরকারের যে মনোভাব তাতে কোনও পরিবর্তন হবে না স্বাধীনতার পরও। তাই আমাদের যোগাযোগ রক্ষা করতে হবে অতি সতর্কতার সাথে। ঘুণাক্ষরেও যদি আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কোনও সন্দেহের সৃষ্টি হয় তাহলে ব্যক্তিগতভাবে আমাকে এবং সেনা পরিষদকে অঙ্কুরেই শেষ করে দেয়ার চেষ্টা করা হবে। তার বক্তব্যে জোরালো যুক্তি রয়েছে তাই তাকে আশ্বস্ত করে বেরুবার আগে বলেছিলাম
স্যার, একটা কথা জেনে রাখুন। আমরা বেঁচে থাকতে আপনার গায়ে কেউই হাত দিতে পারবে না, সরকারও না। আল্লাহর রহমতে আমরা আপনাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসাবোই দেশবাসীর দোয়াতেই ইন শা আল্লাহ্‌।
স্বাধীনতার পর জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে সরানোর জন্য মুজিবের পুতুল সরকার কয়েকবার চেষ্টা চালায়। কিন্তু সেইসব চেষ্টাই ব্যর্থ করে দিয়েছিলো সেনা পরিষদ।
সেনাবাহিনী গঠনের প্রাথমিক পর্যায় সেনা পরিষদের তরফ থেকে আমি এবং নূরই তার সাথে যোগাযোগ করে চলতাম। জিয়াকে জেনারেল পদে উন্নীত করে ডেপুটি চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ দেবার পর, ক্যাপ্টেন নূরকে তার এডিসি এবং মেজর হাফিজকে এইডডিকম হিসাবে নিয়োগ দেবার ফলে যোগাযোগে বিশেষ সুবিধা হয়েছিলো।
আল্লাহ্‌পাকের নামে শপথ গ্রহণের পর সেনা পরিষদের সদস্যরা সর্বান্তকরণে তাকে নেতা হিসাবে গ্রহণ করেছিলো। শুধু তাই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় লালিত স্বপ্ন বাংলাদেশে বাস্তবায়নে জেনারেল জিয়াকে জাতীয় নেতা হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে ব্রতী ছিল সেনা পরিষদ। তাহলে কেনো এই গাদ্দারি! ভারাক্রান্ত মন নিয়ে এক সময় নিদ্রার কোলে ঢলে পড়েছিলাম নিজের অজান্তেই।
খন্দকার মোশতাকের বিশেষ দূত হিসেবে এলেন সাদ্রে ইস্পাহানী
পরদিন জনাব মোশতাকের দূত হয়ে ব্যাংকক এলেন জনাব সাদ্রে ইস্পাহানী। দেশের একজন প্রতিষ্ঠিত শিল্পপতি তিনি। পুরো এক দিন এক রাত কাটালেন আমাদের সাথে। আব্বা, জনাব মোশতাক এবং সাদ্রে ইস্পাহানী একে অপরের বিশ্বস্ত ঘনিষ্ঠ বন্ধু। শেখ মুজিবের সাথেও তার ঘনিষ্ঠতা ছিল। তিনি আমাদের জানালেন, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের জিয়ার অনুরোধ জনাব মোশতাক উপেক্ষা করেছিলেন সাংবিধানিক যুক্তি দেখিয়ে। সেটাই তিনি তার জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণেও উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু, আসল কারণটা ছিল ভিন্ন। ৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লবের পর জিয়া যখন তোমাদের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী তাকে ফোন করে তখন মোশতাক জিয়াকে জোর তাগিদ দিয়ে বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের কথা ভাবার আগে তাকে কালবিলম্ব না করে ব্যাংকক থেকে সব অফিসারদের ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করতে, তা না হলে ক্যান্টনমেন্টে শৃঙ্খলা আর শান্তি ফিরিয়ে আনার কাজটি দুরূহ হয়ে পড়বে।জিয়া উত্তরে বলেছিলেন, চিন্তাভাবনা করে এই বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।
তার এই জবাবে বিচক্ষণ মোশতাকের মনে সন্দেহের সৃষ্টি হয়। তিনি নিশ্চিত হন, জিয়া তোমাদের ফিরিয়ে নিতে ইচ্ছুক নন। এই জবাবের পরই তিনি সিদ্ধান্ত নেন তোমাদের অবর্তমানে তিনি রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করবেন না। এতে তিনি জিয়ার হাতে জিম্মি হয়ে পড়বেন। দূরদর্শী, প্রজ্ঞাবান, অভিজ্ঞ ঝানু রাজনীতিবিদ বুঝে নিয়েছিলেন জিয়া নিজেই সব ক্ষমতা দখল করার চেষ্টা করছেন। তিনি আরও বুঝতে পারেন, ক্ষমতা কুক্ষিগত করার পর পর্যায়ক্রমে বিভিন্ন কৌশলে বিপ্লবীদের শক্তি খর্ব করে তাদের অস্তিত্বহীন করে ফেলার চেষ্টা করবেন জেনারেল জিয়া। তাই তিনি ঠিক করেছেন রাজনৈতিক ভাবেই জিয়ার মোকাবেলা করার জন্য দল গঠন করবেন। সেই দলে তোমরাও ইচ্ছে করলে তার সাথে যোগ দিতে পারো। তবে তিনি এটাও মনে করছেন, তার কোনও প্রতিদ্বন্দ্বীকেই সহজে দাড়াতে দেবেন না জিয়া। তার মতে, আওয়ামীলীগকে তিনি তার প্রতিপক্ষ না ভেবে আগামী নির্বাচনে অংশ গ্রহণের রাস্তা করে দেবেন স্বয়ং জিয়া। ইতিমধ্যেই এই ধরনের সমঝোতা করে নিতে সক্ষম হয়েছেন জিয়া ভারতের সাথে। এই পরিপ্রেক্ষিতে, বর্তমানে জিয়ার একমাত্র রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হচ্ছেন মোশতাক এবং সামরিক প্রতিপক্ষ হচ্ছে আগস্ট ও নভেম্বর বিপ্লবের নেতারা।
নিজের অভিমত প্রকাশ করে অবশ্য জনাব ইস্পাহানী জানিয়েছিলেন, যদি জিয়া নিজের দল গঠন করেন তবে জিয়া বিপ্লবীদের সাথে তার কোনও প্রকার পূর্বসম্পর্ক অস্বীকার করবেন। বিদেশী শক্তিগুলো বিশেষ করে ভারতের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার জন্য তাকে প্রচার করতে হবে মুজিবের মৃত্যুর সাথে তার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না, বর্তমানেও নেই। পেশাগত যোগ্যতা এবং সেনাবাহিনীতে তার নিজস্ব জনপ্রিয়তার কারণেই ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাকে ন্যায়সঙ্গত ভাবে সেনাপ্রধান বানানো হয়েছিলো। তিনি একজন গণতন্ত্রে বিশ্বাসী সৈনিক বিপ্লবী নন। তিনি আন্তরিকভাবে আরও বলেছিলেন,
ভবিষ্যতের কথা বলতে পারবো না, তবে বর্তমানে তোমরা জিয়ার কূটচালে পরাস্ত। এই কঠিন বাস্তবতাকে মেনে নিয়েই তোমাদের ভবিষ্যত করণীয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আমরা নির্বাক হয়ে তার বক্তব্য শুনে নিশ্চুপ বসে ছিলাম। কথা শেষে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে তাকে বিদায় জানিয়েছিলাম।
বিজ্ঞজনেরা বলেছেন, মানুষ চেনা দায়! কালো চশমাধারী অতি চালাক জিয়া সেটাই প্রমাণ করলেন। এর পরিণতি কি হবে সেটা আল্লাহ্‌ ছাড়া আর কারো পক্ষেই কিছু বলা সম্ভব না। তবে আরও একটি প্রচলিত প্রবাদ আছে, ‘অতি চালাকের গলায় দড়ি’।
শিশু ভাই এলেন ব্যাংককে
এর কয়েকদিন পর এসে পৌঁছলেন জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু, সবার প্রিয় শিশুভাই। তার সঙ্গে রয়েছেন তীক্ষ্ণ মেধার অধিকারী পাকিস্তান আমলের ঝানু কূটনীতিক খাজা কায়সার, আমার আব্বার বন্ধু ও সহপাঠী। তার চৌকস দূতিয়ালির ফলেই আয়ুব খানের পক্ষে সম্ভব হয়েছিলো ষাটের দশকে গণচীনে তৎকালীন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের গোপন সফরের ব্যবস্থা করা।
প্রথমে আমাদের খটকা লেগেছিল তাকে জেনারেল জিয়া কি চর হিসাবে শিশুভাই এর সাথে পাঠিয়েছে নাকি! না, তা নয় তিনি ফিরে যাচ্ছেন তার কর্মস্থল রেঙ্গুনে। পরদিন সকালেই তার ফ্লাইট। রাতের খাবার আমরা একসাথেই খেলাম। তিনি খেতে খেতে সবার কুশলাদি জেনে বললেন, আল্লাহ্ যা করবেন তাতেই মঙ্গল। খাওয়া শেষে বিদায় নেবার আগে তিনি আমাকে একান্তে নিয়ে পকেট থেকে একটা লেফাফা বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, শামসু মানে তোমার আব্বা এটা তোমার আর নিম্মির জন্য পাঠিয়েছেন। বাসার সবাই ভালোই আছে, তবে তোমাদের নিয়ে চিন্তিত। আমি রেঙ্গুন পৌছেই তোমাদের কুশলবার্তা উনাকে জানিয়ে দেবো। পরদিন সকালে শিশুভাই তাকে এয়ারপোর্টে বিদায় জানিয়ে হোটেল শেরাটন ছেড়ে আমাদের এখানে শিফট করলেন।
অনেকদিন পর শিশুভাইকে কাছে পেয়ে সবাই খুশি। মেয়েরা কিছুটা অখুশি। তাদের অভিযোগ, টনি ভাবীকে কেন নিয়ে আসলেন না শিশু ভাই। শিশু ভাই বললেন, ভাবীও ভীষণভাবে আসতে চেয়েছিলেন কিন্তু অফিসিয়াল কাজে এসেছেন তাই সাথে করে আনা সম্ভব হয়নি। দুপুরের খাবার খেতে তাকে নিয়ে গেলাম ছোট্ট একটা বার্মিজ রেস্তোরাঁয়। পরিবারের সবাই মিলে হোটেলটা চালায়। সবাই ভাঙ্গা ভাঙ্গা বাংলা বলতে এবং বুঝতে পারে রক্তের সংমিশ্রণের ফলে। তাই আমাদের সাথে একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠেছে। আমাদের দেশী তরিকায় মাছ-ভাত রান্না করে খাওয়ায় পরম যত্ন করে। আমরা তাদের কাছে খদ্দের নই, যেন তাদের পরিবারেরই সদস্য। আমাদের শ্রদ্ধেয় অতিথির সাথে পরিচয় করিয়ে দিতেই সবাই তাকে সাদর অভ্যর্থনা জানালো। শিশুভাই বললেন
যেখানেই যাও জমিয়ে বস দেখছি!
কি আর করি বলুন, আপনারা আমাদের আপনজন হয়েও ত্যাজ্য করে নির্বাসনে রেখেছেন। তাই এদেরকেই আপন করে নিয়েছি। সবাই মিটিমিটি হাসছিলো আমার কথার ধরনে। শাহরিয়ার তার স্বভাবসিদ্ধ কৌতুকের সাথে বললো
শিশুভাই, যেমন বুঝা যাচ্ছে, মনে হয় এখন থেকে বিদেশের সবখানেই আপনজন খুঁজে নিয়ে বেঁচে থাকতে হবে।
কেনো তোমরা কি আর দেশে ফিরবে না সেই সিদ্ধান্তই নিয়েছ নাকি?
না তা নয়। তবে স্বেচ্ছায় দেশে ফেরার এখতিয়ার এখন আমাদের আছে কি?
শাহরিয়ারের কথায় শিশুভাই কিছুটা বিব্রত বোধ করছিলেন দেখে নূর কথার মোড় ঘুরিয়ে বললো
দেশি মাছ,ভাত আর ডাল আসুন, শুরু করা যাক। সবাই খাবারে মন দিলাম। ভূরিভোজনের পর বার্মিজ পরিবারের সবাইকে ধন্যবাদ জানিয়ে হোটেলে ফিরে এলাম। মেয়েরা পান-সুপারি মশলা পরিবেশন করে কিছুক্ষণ খোশ আলাপের পর শিশুভাই-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো। এরপর শুরু হল আসল কথাবার্তা। আমিই শুরু করলাম
কি শিশুভাই, বলেছিলাম না আসার পথে রেঙ্গুনে তৈরি থাকবেন, ডাক পড়বে! তখন আপনি কিন্তু আমার কথাটা ঠিক বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করেননি তাই না? হ্যাঁ, কিন্তু বলতো কি করে সবকিছু ঘটল? এখনো বুঝে উঠতে পারলেন না এটা কি করে বিশ্বাস করি বলুনতো? আপনি এখন ক্ষমতাসীনদের একজন। যাক, এবার বলুন আপনার সাথে আমাদের কথাবার্তা কি ভাবে করা হবে, আমাদের প্রিয় শিশুভাই হিসাবে নাকি জিয়ার প্রতিনিধি হিসাবে? এখন দেশে আপনার যেই পরিচিতিই হয়ে থাক আমরা কিন্তু আমাদের শিশুভাইকেই বেশি বিশ্বাসযোগ্য মনে করবো।
তাহলে আমিও খুশি হব খোলাখুলি আলাপ করতে পেরে।
Great dear old Shishu Bhai! এবার বলেন আপনার বক্তব্য।
সেনাবাহিনীতে পূর্ণ শান্তি-শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে পারছেন না জেনারেল জিয়া। তিনি এই ব্যাপারে তোমাদের সাহায্য চান। নূরের প্রশ্ন
কেনো পারছেন না? সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তা আর পেশাগত যোগ্যতার জন্যই নাকি প্রেসিডেন্ট মোশতাক ১৫ই আগস্ট পটপরিবর্তনের পর তাকে সেনা প্রধান বানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। বিদেশের দূতাবাসগুলোতে ঘুরে ঘুরে সেটাই বেচে চলেছেন তিনি। সেটাই যদি সত্যি হয় তবে সমস্যাটা কোথায়? বিষয়টা ঠিক বুঝতে পারছি না শিশুভাই। তাই আর একটু খোলাসা করে বলুন, পাইপের তামাকে আগুন ধরাতে ধরাতে বলল স্বল্পভাষী নূর।
আমি জানি দেশের বাইরে থেকেও তোমরা দেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি না হলেও কম জান না। তাই জিয়াকে জিজ্ঞেস করেছিলাম আপনি তাদের সাথে সরাসরি কথা না বলে আমাকে কেনো পাঠাচ্ছেন? কিন্তু জিয়া আমার প্রশ্নের উত্তরে বললেন, তোমাকেই যেতে হবে। তাই কোনও গত্যন্তর না থাকায় আমাকে আসতেই হল। আমি একটা বিষয় পরিষ্কার করে দিতে চাই, আমি জিয়ার পক্ষে ওকালতি করতে আসিনি। তিনি তোমাদের যা বলতে বলেছেন, আমি সেটাই বলবো। আর তোমরা জবাবে যা তাকে জানাতে বলবে আমি ঠিক সেটাই তাকে জানাবো। এ ছাড়া পারস্পরিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে যা কিছুই আমরা আলোচনা করি না কেনো সেটা সীমিত থাকবে শুধু আমাদের মধ্যেই। এরপর নূরের কথার জবাবে শিশুভাই বললেন, জিয়ার ধারণা তোমাদের অধীনস্থ ইউনিটগুলোর বিপ্লবী অফিসার এবং সৈনিকরা মনে করছে জিয়া আগস্ট বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করছেন। কিছুক্ষণ পর পাশা বলা শুরু করলো
১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর শফিউল্লাহকে পদচ্যুত করে কারা জিয়াকে চীফের পদে অধিষ্ঠিত করেছিল প্রেসিডেন্ট মোশতাকের মাধ্যমে সেটা দেশবাসীর অজানা নয়। মোশতাক কি সেনা পরিষদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি ছিলেন না? যেই বিপ্লবীরা নিজেদের জানবাজি রেখে ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব ঘটিয়ে খালেদ-চক্রকে পরাস্ত করে জিয়াকে বন্দী অবস্থা থেকে মুক্ত করে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করলো, যারা কর্নেল তাহেরের জিয়াকে হত্যা করার সব ষড়যন্ত্র বানচাল করে জিয়াকে বাঁচিয়ে রাখলো, যাদের জোরে কর্নেল তাহের এবং তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার হঠকারি পদক্ষেপের পর তাদের শায়েস্তা করতে পারলেন, তারা সবাই সেনা পরিষদের সদস্য সেটা তিনি ভালো করে জেনেও কি করে রটাচ্ছেন যে, সেনা পরিষদের সাথে তার কোনও সম্পর্কই নেই? যুদ্ধকালীন সময় তিনি স্বেচ্ছায় আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী হয়েই তো কোরআন শপথ নিয়ে আমাদের গোপন সংগঠনের একজন হয়েছিলেন। এরপরই আমরা তাকে আমাদের মধ্যমণি হিসাবে গ্রহণ করে আমাদের সাংগঠনিক তৎপরতা এগিয়ে নিয়ে চলেছিলাম, ফলে, স্বাধীনতার পর সেনাবাহিনীতে গড়ে তুলতে পেরেছিলাম গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ। এতদিনের পুরনো সম্পর্কের পরও যদি কোনও অবিশ্বাস জন্মে থাকে তবে তার একটা যুক্তিসঙ্গত কারণ নিশ্চয়ই থাকবে সেটাই স্বাভাবিক কিনা বলেন?
খুবই স্বাভাবিক।
তাহলে কারণটা কি বলে মনে হয় আপনার?
তুমিই বলো?
ঠিক আছে আমিই বলছি। কারণটা হচ্ছে মুনাফিকাত মানে বিশ্বাসঘাতকতা।
নূর আবার মুখ খুললো
খন্দকার মোশতাক জিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সাংবিধানিক জটিলতার কারণ উত্থাপন করে যদিও আসল কারণটি ছিল ভিন্ন। অনুরোধ জানানোর পর মোশতাক জিয়াকে বলেন, তার হাতকে শক্ত করার প্রয়োজনে আমাদের অবিলম্বে দেশে ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা করার জন্য। জবাবে জিয়া তাকে কি বলেছিলেন জানেন? বলেছিলেন, এই বিষয় চিন্তাভাবনা করেই নাকি তিনি সিদ্ধান্ত নেবেন। তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী জনাব মোশতাক জবাব শুনেই বুঝতে পারেন বর্তমানের জিয়া আগের জিয়া নয়। এই জিয়া এক অন্য জিয়া। এটাই ছিল অনুরোধ প্রত্যাখ্যানের মূল কারণ। তার মনে জিয়া সম্পর্কে সন্দেহ দেখা দিয়েছিলো। জেনারেল জিয়া আমাদের দেশে ফিরিয়ে আনবেন না তার নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার স্বার্থেই। কথাবার্তার ধরনে পরিবেশ গম্ভীর হয়ে উঠেছে। প্রয়োজনে চা, কফি, স্ন্যাক্স পরিবেশন করে যাচ্ছে ওয়েটার। আমি পরিবেশটা হাল্কা করার জন্য হেসে বললাম
এসব প্রশ্নের জবাব আপনার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় সেটা আমরা বুঝতে পারি। এখানে উপস্থিত সবাই সাবালক একমাত্র আপনিই নাবালক। আমার কথায় শিশুভাই সহ সবাই হেসে উঠলো। এবার বলেন নাবালক ভাই, যেখানে জিয়া আমাদের ঘটনাস্থলেই উপস্থিতি চাইছেন না সেখানে তিনি আমাদের সাহায্য চাইছেন। এই ধরনের অদ্ভুত অনুরোধের মোজেজাটা কি?
সেটা আমি জানিনা। আমি শুধু সেটাই তোমাদের বলবো যা তিনি বলতে বলেছেন। জিয়া চাচ্ছেন তোমরা এই মুহূর্তে দেশে না ফিরো। তিনি মনে করছেন, এতে সামরিক বাহিনীতে আর একটি বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেটা হবে দেশের জন্য মারাত্মক ভাবে ক্ষতিকর। প্রতিবেশী দেশ ভারত তো বাংলাদেশ ঘিরে প্রস্তুত হয়েই আছে ঢুকে পড়ার সুযোগের অপেক্ষায়। তোমাদের এই মুহূর্তে দেশে ফিরিয়ে নিলে শুরু হতে পারে একটি ক্ষমতার লড়াই, আর সেই সুযোগেই ভারত দখল করে নেবে বাংলাদেশ। তাই জিয়া চাচ্ছেন তোমরা আরও কিছুদিন দেশের বাইরে থাকো। অবস্থা যখন স্থিতিশীল এবং স্বাভাবিক হয়ে উঠবে তখন জিয়া তোমাদের দেশে ফিরিয়ে নিয়ে যাবেন। ব্যাংককে তোমাদের অবস্থান নিরাপদ নয়, তাই একটি ভ্রাতৃপ্রতিম রাষ্ট্রের মধ্যস্থতায় তোমাদের লিবিয়ার কর্নেল গাদ্দাফি রাজকীয় মেহমান হিসাবে গ্রহণ করতে রাজি হয়েছেন। এখন তোমরা চাইলেই সব ব্যবস্থা হয়ে যাবে। এতক্ষণে জিয়ার দূত হিসাবে আসল বিষয় উত্থাপন করলেন শিশুভাই। Let me be very candid, even now, I am least interested to serve in the army and I had spelled that out to Zia in no uncertain words. I had put up a condition before accepting the responsibility that he bestowed on me that the day immigration papers to States would be in my hand that very day he shall have to release me which he agreed. May I on behalf of all present here take the liberty to ask you what assignment Zia had given you? He asked me to help to organize his political party. There you are, isn’t it a proof that Zia is up to a long haul?
Yes, you are correct. Thanks, for your frank statement.
কথায় কথায় বেলা গড়িয়ে রাত হয়ে গিয়েছে। নিম্মিরা সবাই এসে জানালো, রাতের খাবার পরিবেশিত হয়েছে। শুনে সবাই শিশুভাইকে নিয়ে পৌঁছলাম খাবার ঘরে। প্রিয় শিশুভাই এর জন্য মেয়েরা আজ বিশেষ খাবারের আয়োজন করেছে। খাবারের বহর দেখে শিশুভাই বললেন একি করেছো তোমরা!
প্রিয়জনকে আন্তরিক অভ্যর্থনা জানানোর ক্ষুদ্র প্রয়াস।
রান্নাবান্না ভালোই। তাই সবাই তৃপ্তির সাথেই খাওয়া শেষে ফিরে এলাম বসার রুমে আবার। পান সিগারেটের সাথে শুরু হল দ্বিতীয় পর্ব রিল্যাক্সড পরিবেশে। আমি শুরু করলাম এবার।
শিশুভাই, আপনি আমাদের সবারই অতিপ্রিয়। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই আপনি চাকুরি ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছিলেন। এখনও সেই সিদ্ধান্তে আপনি অটল বল্লেন, তবে বাস্তবতা হচ্ছে জিয়া আপনাকে ব্যবহার না করে রেহাই দেবেন না। ভবিষ্যতে ঘটনা প্রবাহ যেভাবেই এগোক না কেনো আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতেই হবে। আপনার উপর অর্পিত দায়িত্বের পরিপ্রেক্ষিতে কতগুলো কথা আমি বলবো যার অনেকটাই আপনি জানেন আবার অনেকটা জানেন না। অজানা বিষয়গুলো জেনে নিলে আপনার দায়িত্ব পালনে সুবিধা হবে। স্বাধীনতার পর জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে বের করে দেবার কয়েক বারই মুজিব সরকার চেষ্টা চালিয়ে ব্যর্থ হয়েছিল কাদের চাপে সেটাও আপনার জানা আছে। এরপর শফিউল্লাকে পদোন্নতি দিয়ে জিয়াকে সুপারসিড করে সেনা প্রধান বানিয়ে সরকার মনে করেছিল, এই অপমান সইতে না পেরে জিয়া নিজেই চাকুরিতে ইস্তফা দিবেন। জিয়া নিজেও তেমনটিই ভাবছিলেন। সেইক্ষণে হঠাৎ করে DCAS-এর একটি পদ সৃষ্টি করে সেই পদে জিয়াকে শফিউল্লার সমপদমর্যাদায় নিয়োগ দিতে কেনো বাধ্য হয়েছিলেন শেখ মুজিব সেটাও আপনার এবং জিয়ার জানা আছে। এরপর ঘটে ঐতিহাসিক ১৫ই আগস্টের অবিস্মরণীয় সেনা অভ্যুত্থানের ঘটনা। যার ফলে পতন ঘটে বাকশালী স্বৈরতন্ত্রের। এই রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর জিয়াকে আমরাই অধিষ্ঠিত করেছিলাম সেনাপ্রধান হিসাবে। আগস্ট বিপ্লবের ধারাবাহিকতায় খালেদ-চক্র ঘটিয়ে বসে ২-৩ নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতা, বন্দী করা হয় জেনারেল জিয়াকে। ক্যু’ শুরু হয় রাত ১২টায়। খবর পাওয়া মাত্রই আমি আর নূর গিয়ে উপস্থিত হই ৪র্থ ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টাল হেডকোয়ার্টারে। সেখানে পৌঁছেই আলোচনায় বসি ব্রিগেডিয়ার খালেদ, কর্নেল শাফায়াত, মেজর হাফিজ ও তাদের দোসরদের সাথে।
ম্যারাথন সেশনের মাধ্যমে জেনারেল জিয়ার প্রাণ এবং দেশকে একটি অনাকাঙ্ক্ষিত গৃহযুদ্ধের হাত থেকে বাঁচিয়ে স্বেচ্ছায় ৩রা নভেম্বর রাত ১০টায় রুবি ভাবী ও নিলু ভাবীকে সাথে করে দেশ ত্যাগ করেছিলাম কৌশলগত কারণে। আসার আগে কর্নেল তাহের জানালেন, খালেদের বিরুদ্ধে যে কোন উদ্যোগে তিনি ও তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে সেনা পরিষদের সাথে সহায়ক শক্তি হিসাবে যোগ দিতে ইচ্ছুক। সেই প্রেক্ষাপটে গণভবনে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে খালেদ বিরোধী অভ্যুত্থানের রূপরেখা চূড়ান্ত করা হয়েছিল দুইপক্ষের সর্ব সম্মতিক্রমে। এই পটভূমিকায় সুপরিকল্পিত ভাবেই ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার আর একটি সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান ঘটানো হয়। আপনি কি মনে করেন এ সমস্ত ঘটনাগুলোর সব কয়টি ঘটনাই ছিল দৈবক্রমে ঘটে যাওয়া ঘটনা? আপনার মতো একজন বিচক্ষণ বুদ্ধিমান মুক্তিযোদ্ধা অফিসারের পক্ষে বুঝতে কষ্ট হওয়ার কথা নয় যে এসব ঘটনাগুলো ছিল একই সূত্রে গাঁথা এবং এর পেছনে মুখ্য ভূমিকায় কাজ করেছে শক্তিশালী সংগঠন সেনা পরিষদ। মুজিবনগর সরকার যখন শফিউল্লাহ আর খালেদের নেতৃত্বে শুধুমাত্র দু’টি নিয়মিত ব্রিগেড গঠনের সিদ্ধান্ত নেয় তখন কোন শক্তির চাপের মুখে সেই সিদ্ধান্ত বদলিয়ে জিয়ার নেতৃত্বেও আর একটি ব্রিগেড গঠন করতে বাধ্য হয়েছিলো প্রবাসী সরকার? মেজর জলিলকে সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে নেবার জারিকৃত আদেশ কাদের চাপে ফিরিয়ে নিতে বাধ্য হয়েছিলো তাজুদ্দিনের সরকার? এবার একটা মজার কথা শুনুন। ৭ই নভেম্বর যখন মেজর মহিউদ্দিনের নেতৃত্বে বিপ্লবীদের একটি দল জিয়াকে মুক্ত করার জন্য ট্যাঙ্কসহ মইনুল রোডের বাসায় যায় তখন জিয়া এবং বেগম খালেদা জিয়া ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে বিপ্লবীদের কাছে মিনতি করছিলেন, তাকে নিয়ে আর টানাহ্যাঁচড়া না করতে আর অনুরোধ জানাচ্ছিলেন পদত্যাগী চীফ হিসাবে তার পেনশনের ব্যবস্থাটা করে দেয়ার জন্য।
কারণ, ২-৩রা এবং ৭ই নভেম্বরের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে তার কোনও ধারণাই ছিল না। প্রিয় শিশুভাইকে আমাদের তরফ থেকে অনুরোধ করবো এই বিষয়গুলো নিয়ে চিন্তা-ভাবনা করতে। আমাদের বিশ্বাস, আন্তরিকভাবে সত্যের অনুসন্ধান করলে সব জটিল রহস্যই উদ্ঘাটন করা সম্ভব হবে আপনার পক্ষে। শিশুভাই, আপনি একজন বুদ্ধিমান মানুষ হিসাবে নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন, পরিকল্পিতভাবে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনার ফলেই জেনারেল জিয়া আজ ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন, শুধুমাত্র তার ব্যক্তিগত জনপ্রিয়তার কারণে নয়। আপনি অবগত আছেন যে যুদ্ধের আবরণে রাজনৈতিকভাবে সচেতন আমাদের মতো মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশ নিয়ে ভারত যে সুদূরপ্রসারী নীলনকশা প্রণয়ন করেছিল তার বিরোধিতায় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য সুচিন্তিত নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে যখন সাংগঠনিক তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছিলো তখন আজকের জেনারেল জিয়া ভারতীয় এবং প্রবাসী সরকারের চক্ষুশূল হয়ে ডাস্টবিনে ছিলেন নিক্ষিপ্ত। সেই বৈরি, কোণঠাসা অবস্থায় আমাদের নীতি-আদর্শ মেনে নিয়েই জিয়া শপথ নিয়েছিলেন আমাদের সাথে একযোগে কাজ করতে। এরপর থেকে তার সাথে ওয়াদা মোতাবেক আমাদের সম্পর্কটা গোপন রেখেই আমরা সাংগঠনিক কাজ এগিয়ে নিয়ে চলেছিলাম।দেশবাসী এ সমস্ত বিষয়ে অজ্ঞ হলেও জেনারেল জিয়া কিন্তু ঠিকই জানেন, কারা তার চারপাশে বর্ম হয়ে ধাপে ধাপে তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত করেছে। একই সাথে তিনি ভালোভাবেই অবগত আছেন সেই শক্তিকে সংগঠিত করে দৃঢ়ভিত্তির উপর দাড় করিয়েছিল কারা। কি ছিল তাদের উদ্দেশ্য এবং পরিকল্পনা। জিয়া কি করছেন বা কি করবেন সে সম্পর্কে আপনাকে প্রশ্ন করে বিব্রত করবো না। তবে একটি কথা বিনয়ের সাথেই না বলে পারছিনা বলে ক্ষমা করবেন, প্রাণের দায়ে যারা ‘৭১-এ অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিলো তাদের থেকে আমরা কিছুটা হলেও ব্যতিক্রমী। আমরা সবাই পাকিস্তান আর্মিতে কাজ করেছি। তাই একে অপরের মেধা এবং যোগ্যতা সম্পর্কে অনেকটাই অবগত। ১৯৭১ সালে ২৫-২৬ শে মার্চ কালরাতে পাক আর্মি যখন আচমকা পূর্ব পাকিস্তানে ‘অপারেশান সার্চ লাইট’ শুরু করে তখন আমরা সবাই পশ্চিম পাকিস্তানে বিভিন্ন ইউনিটে চাকুরিরত ছিলাম। আমাদের কিন্তু গুলির নিশানা বানানো হয়নি। প্রত্যাগত সবাই প্রায় যুদ্ধের পুরোটা সময় বহাল তবিয়তেই চাকুরি করেছিলেন পশ্চিম পাকিস্তানে। পরে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ফিরে এসে প্রায় সবাই সামরিক বাহিনীতে পুনর্বাসিত হয়েছিলেন। আমাদের জন্যও তেমনটি করা সম্ভব ছিল।আমরা কিন্তু ভবিষ্যতে কি হবে তার তোয়াক্কা না করে যুদ্ধের প্রারম্ভেই স্বেচ্ছায় পালিয়ে এসে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়েছিলাম জীবনের ঝুঁকি নিয়েই। যুদ্ধকালীন পুরো সময়টাই আমরা কাটিয়েছি দেশের মাটি আর সাধারণ মানুষের সাথে। অতএব জেনারেল জিয়াকে বলবেন দেশ আর জনগণের স্বার্থে ভবিষ্যতে ইতিবাচক কোনও অবদানের সুযোগ না পেলেও দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কোনও হঠকারি পদক্ষেপ কখনোই আমরা নেবো না। এর প্রমাণ আজঅব্দি আমরা দিয়ে আসছি। নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থে কিংবা ক্ষমতার লোভে আমরা কিন্তু কিছুই করিনি, কখনো করবোও না। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা আমাদের শিখিয়েছে, নেয়ার চেয়ে দেয়ার আনন্দ অনেক বেশি। ব্যক্তিস্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের ফসল ব্যবহার করা মোনাফেকির সমতুল্য। আল্লাহ্ শঠতা এবং মোনাফেকি পছন্দ করেন না। যুদ্ধের সময় থেকেই যারা জিয়াকে সুরক্ষিত রেখে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়েছে আজ তিনি তাদের নিরাপত্তা দিতে উদ্যোত হয়েছেন! আমাদের নিরাপত্তার জন্য জেনারেল জিয়ার উৎকণ্ঠার কথা শুনে খুশি না হয়ে বরং অস্বস্তি বোধ করছি। এই বুদ্ধি নিয়ে তিনি দেশের ভাগ্যবিধাতা হবার চেষ্টা করছেন! এ ভাবে শাক দিয়ে মাছ ঢাকার অপচেষ্টা না করলেই তিনি পারতেন। তিনি যেখানে নিজস্ব নিরাপত্তার আতঙ্কে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে আমাদের সুদূর মরুভূমিতে নির্বাসিত করার বন্দোবস্ত করছেন সেখানে আমাদের নিরাপত্তার কথাটা মানায় না। সে যাই হোক, তাকে বলবেন আমাদের নিয়ে তার দুশ্চিন্তার কোনও কারণ নেই। তার ঘরের শত্রু বিভীষণরাই তাকে নিরাপত্তাহীন করে তুলবে এক সময়। অনেক চিন্তা-ভাবনা করে আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে লিবিয়াতে পাঠানোর যে ব্যবস্থা তিনি করছেন, সেটা আমরা গ্রহণ করবো কি করবো না, সেই সিদ্ধান্তটা আমরা পরে আপনাকে জানিয়ে দেবো। পরিবেশ হাল্কা করার জন্য বললাম শিশুভাই আমার একটা প্রস্তাব আছে। যদি অনুমতি দেন তবে বলি। নিশ্চয়ই। Guys’ attention please, tonight is very special for all of us as our dear Shishu Bhai is here us so, let’s take him to Pat Pong to enjoy Bangkok by night, what do you say? সবাই উল্লসিত হয়ে উচ্চস্বরে বলে উঠল
Great!
What do you say Shishu Bhai? Absolutely fantastic idea indeed!
তার জবাব শুনে মেয়েরা বলে উঠলো
What about us?
Sorry madams, men only. So, allow me to say on our behalf a very good night and sleep tight. আমার কথায় মেয়েরা মুখ টিপে হেসে শিশুভাই-এর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে শুভরাত্রি জানিয়ে বেরিয়ে গেলো। পরদিন বিকেলের ফ্লাইটে শিশুভাই ঢাকায় ফিরে যাবেন। তাই আমি ওই প্রস্তাবটা করেছিলাম। রশিদ এবং ফারুকের সাথে শিশুভাই-এর তেমন কোন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। তাই তাদের ব্যবহারে তেমন উষ্ণতা দেখা যায়নি। শিশুভাইকে বিদায় দিয়ে ফিরে এসে আমাদের নিজস্ব আলোচনা শুরু হল। আলোচনার শুরুতেই রশিদ আর ফারুক টিপ্পনি কেটে বললো
তোমাদের জিয়া এমন গাদ্দারি করতে পারে ভেবেছিলে কখনো? কর্নেল তাহেরের সাথে তোমাদের ঘনিষ্ঠতার ফলাফলও তো সুখকর হল না। তাহেরের সাথে আমাদের সম্পর্কের কথা ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’-তে বিস্তারিত লিখেছি।সেনা পরিষদের সাংগঠনিক তৎপরতা, জিয়ার সাথে আমাদের বিশেষ সম্পর্ক এবং দেশব্যাপী রাজনৈতিক দল গ্রুপ ও বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠনের নেতৃবৃন্দের সাথে সেনা পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের যোগাযোগ সম্পর্কে কোনও ধারণাই ছিল না দুই ভায়রার। এমনকি তারা ১৫ই আগস্টের আগ পর্যন্ত এটাও জানতো না যে, খোন্দকার মোশতাক আব্বার ছাত্রকালের বন্ধু। যুদ্ধের শেষ লগ্নে রশিদ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ছুটিতে দেশে আসার পর বর্ডার পেরিয়ে এবং ফারুক কুয়েতে ডেপুটেশনে থাকা অবস্থায় চাকুরিস্থল থেকে পালিয়ে এসে নভেম্বর-ডিসেম্বরে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিল। সেই কারণেই যুদ্ধকালীন সময়ে তাদের সাথে আমাদের তেমন ঘনিষ্ঠতার সুযোগ হয়নি। তবে তারা দু’জনই ছিল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক। স্বাধীনতার পর তাদের প্রস্তাবেই সেনা পরিষদ একটি ন্যূনতম কর্মসূচির ভিত্তিতে ১৫ই আগস্টের সফল অভ্যুত্থানের জন্যই একত্রে কাজ করতে রাজি হয়েছিলো। সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচি সম্পর্কে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না। তাদের সাথে ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থানের আগে এক মিটিং-এ আমরা পরিষ্কার করে বলেছিলাম, অভ্যুত্থান সফল হলে খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানাতে আমাদের আপত্তি নেই। তবে সেনা প্রধান হবেন জেনারেল জিয়া, নৌ বাহিনী প্রধান থাকবেন ভাইস এডমিরাল এম এইচ খান আর এয়ার চীফ হবেন এয়ার কমোডোর বাশার।এয়ার চীফের পদে রশিদ দাবি করে এয়ার কমোডোর তোয়াবকে নিয়োগ দিতে হবে। তাদের প্রস্তাবটা চিন্তাভাবনার পর মেনে নেয়া হয়েছিলো।
কর্নেল তাহেরের সাথে আমি, মতি ও নূর কোয়েটা থেকে একসাথে পালিয়ে আসার পরিকল্পনা করেছিলাম। এই ব্যাপারে বিস্তারিত আমার আগের বইতে লিখেছি। নিপীড়িত জনগণের হকের জন্য ন্যায়ভিত্তিক সুষম, প্রগতিশীল রাষ্ট্র এবং সামাজিক ব্যবস্থা কায়েম করতে হবে, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশে এ সম্পর্কে আমাদের মধ্যে কোনও দ্বীমত ছিল না। সম্প্রসারণবাদের বিরুদ্ধে নিজেদের স্বকীয়তা সমুন্নত রেখে আত্মনির্ভর একটি সুখী,সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তুলবো আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সব বাধা পেরিয়ে, এটাই ছিল সেনা পরিষদের প্রত্যয়।মুক্তিযুদ্ধের মূল লক্ষ্য ও লাখো শহীদের আত্মত্যাগ এবং দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আশা-প্রত্যাশার ব্যাপারেও আমাদের মধ্যে কোনও মতপার্থক্য ছিল না। পার্থক্য ছিল রাজনৈতিক দর্শন এবং পথের। কিন্তু এই পার্থক্য আমাদের ব্যক্তিগত সম্পর্ক এবং পারস্পরিক বিশ্বাসের ক্ষেত্রে ফাটল ধরাতে পারেনি শেষ দিন পর্যন্ত। কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিল হঠাৎ করেই আকৃষ্ট হয়ে পড়লেন ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে।’ সেনা পরিষদের রাজনৈতিক দর্শন ছিল নৈতিক এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের আলোকে বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। এই প্রেক্ষিতে কর্নেল তাহের যখন প্রস্তাব রাখেন দেশ ও জাতীয় স্বার্থে তিনি এবং তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ভারতীয় চাণক্যদের হাতে ক্রীড়নক খালেদ-চক্রের বিরুদ্ধে সেনা পরিষদের সাথে যেকোনো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত, তার সেই অঙ্গিকারের ভিত্তিতেই বঙ্গভবনে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে খালেদ-চক্রের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের রূপ-নকশা চূড়ান্ত করা হয়েছিলো। পরিকল্পনার অংশ হিসাবে কৌশলগত কারণেই সেনা পরিষদের প্রকাশিত শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দের দেশত্যাগ করে ব্যাংককে অবস্থান নেয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই প্রেক্ষাপটেই সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার যৌথ উদ্যোগে সংগঠিত হয়েছিলো যুগান্তকারী ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার সফল অভ্যুত্থান। মত ও পথের ভুল আর কিছু হঠকারি পদক্ষেপের মাশুল হিসেবে কর্নেল তাহেরকে যেভাবে ফাঁসি দেয়া হয়েছিলো সেটা একটি বিতর্কিত বিষয়।
অবশই কর্নেল তাহের ছিলেন একজন নিবেদিতপ্রাণ বীর মুক্তিযোদ্ধা, এক সাহসী দেশপ্রেমিক সৈনিক এবং নিপীড়িত বঞ্চিত বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বার্থে একজন আপোষহীন সাচ্চা বিপ্লবী। হেডকোয়ার্টারের কাগুজে বাঘরা এবং ইতিহাস তাকে যে ভাবেই মূল্যায়ন করুক না কেনো, মানুষ হিসাবে আমরা কেউই দোষ-গুণের ঊর্ধ্বে নই। এই সত্যকে মেনে নিয়েই অতিচেনা ক্র্যাচের কর্নেল তাহের, সিরাজ সিকদার, মেজর জলিল, কর্নেল জিয়াউদ্দিনকে জানাই সশ্রদ্ধ সালাম। তাদের সবাই হলেন দেশের অমূল্য রতন, নিখাদ জনদরদী দেশপ্রেমিক।
আগেই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, রশিদ-ফারুকের সাথে বৈঠকে আমাকেই হতে হবে সেনা পরিষদের মুখ্য ভাষ্যকার। আমাদের আজকের এজেন্ডাতে তিনটি বিষয়
১। জেনারেল জিয়া সেনা পরিষদের সাথে তার সম্পর্ককে অস্বীকার করার পর বিপ্লবীদের আহ্ববানে সাড়া দিয়ে জিয়ার বিনা অনুমতিতে আমাদের দেশে ফেরা উচিৎ কি উচিৎ নয়।
২। ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর সম্পর্কে জিয়ার সাথে আমাদের যে অন্তর্দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে সেটা আন্তর্জাতিক মিডিয়াতে এখনই প্রকাশ করা যুক্তিসঙ্গত হবে কিনা।
৩। জেনারেল জিয়ার ব্যবস্থাপনায় লিবিয়ায় যাওয়ার প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে, না তার ব্যবস্থা নাকচ করে দিয়ে তৃতীয় কোনও দেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করাটা কি যুক্তিসঙ্গত হবে?
প্রথম বিষয়ে রশিদ এবং ফারুকের বক্তব্য ছিল, এখনো জিয়া সামরিক বাহিনীতে তার ভিত মজবুত করতে সক্ষম হয়নি। তাই আমরা একত্রে ফিরে গিয়ে অতি সহজেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারবো। তাকে ক্ষমতাচ্যুত করে, তার স্থলে এমন একজনকে যিনি আমাদের নীতি-আদর্শে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেন তেমন কাউকে চীফ বানালে আমাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নের পথে সহজেই এগিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। তাদের এই প্রস্তাব গ্রহণ করা বাস্তবসম্মত নয়। যুক্তি হিসাবে বলা হয়-
আজকের জিয়া আর ১৫ই আগস্টপূর্ব জিয়ার মধ্যে অনেক তফাৎ। বর্তমানে জিয়া শুধু সামরিক বাহিনীর মধ্যেই জনপ্রিয় তাই নয়, তার মেকি চমকপ্রদ জনপ্রিয়তা আজ দেশব্যাপী। কোন শক্তি কোন প্রক্রিয়ায় তাকে আজ এই পর্যায়ে নিয়ে এসেছে সে সম্পর্কে দেশবাসীর বেশিরভাগ এবং সামরিক বাহিনীর অনেকেই অবগত নন। জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার পর তিনি ক্রমান্বয়ে নিজেকে সেনা পরিষদ এবং বিপ্লবীদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে নিজস্ব রাজনৈতিক খেলায় নেমেছেন। এটাও এখনঅব্দি কারো জানা নেই। এই অবস্থায় ভারতীয় আগ্রাসনের সম্ভাবনা থাকুক বা না থাকুক, এই বাস্তব পরিস্থিতিতে আমরা যদি তার প্রতিপক্ষ হয়ে তার বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হই তবে সামরিক বাহিনী এবং জনগণের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হবে। কারণ, এখনো তারা মনে করছেন জিয়া আমাদেরই একজন। এই ধারণা সত্য হলেও জেনারেল জিয়া আজ নিজেই সেটাকে মিথ্যায় পরিণত করতে চাচ্ছেন। তাদের কথায় ওজন আছে। এখনও আমরা শক্তির দিক দিয়ে জেনারেল জিয়াকে অনায়াসেই পরাস্ত করতে সক্ষম। কিন্তু ভারত যদি ‘৭১ এর মত প্রবাসে বাকশালী সরকার বসিয়ে ২৫ বছরের স্বাক্ষরিত চুক্তির আওতায় সেই সরকারের ডাকে বাংলাদেশে ঢুকেই পরে সেই আগ্রাসনের মোকাবেলা করা কি সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে বিভক্ত সামরিক বাহিনী আর জাতিকে নিয়ে? তারপরও কথা থাকে। যদি সেই প্রক্রিয়ায় দেশ ভারতের করদ কিংবা অঙ্গরাজ্য এবং জনগণ দাসে পরিণত হয় তবে তার সব দায়দায়িত্ব আমাদেরকেই নিতে হবে। আমরা চিহ্নিত হবো দেশদ্রোহী এবং জাতীয় বেঈমান হিসাবে। খালেদ আর তাহেরের চেয়েও ঘৃণ্য হব আমরা। এটাই কি আমাদের প্রত্যাশা যে দেশবাসী আমাদের জানুক ক্ষমতালিপ্সু একদল উচ্চাভিলাষী বিকৃত মস্তিষ্কের নরকের কীট হিসাবে? তাছাড়া যুক্তির খাতিরে যদি ধরেও নেয়া যায় যে আমরা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর অন্য কাউকে বিশ্বাস করে জিয়ার স্থলাভিষিক্ত করলাম। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে কোরআন ছুঁয়ে শপথ করে স্বেচ্ছায় আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী একজন হয়ে এই পর্যন্ত আসার পর জিয়াই যদি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে তাহলে নতুন করে যাকে জিয়ার স্থলাভিষিক্ত করা হবে সেও ক্ষমতায় আসীন হবার পর সময় সুযোগ পেলে তেমনটি করবে না তার নিশ্চয়তা কি? এর বিকল্প হিসেবে জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করার পর আমাদের চেয়ে সিনিয়র সব অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে অবসরে পাঠিয়ে লিবিয়ার মোয়াম্মর গাদ্দাফির মতো ২৮ বছর বয়স্ক আমাদের মধ্য থেকেই কাউকে চীফের পদে উপবিষ্ট করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা গ্রহণ করতে হবে নিজেদের। এমন পদক্ষেপ বর্তমানের বাংলাদেশে নেয়া কি সম্ভব? এমনটি লিবিয়াতে সম্ভব হয়েছিলো পার্শ্ববর্তী দেশ মিসরের শক্তিধর রাষ্ট্রপতি জামাল নাসেরের প্রত্যক্ষ সার্বিক সমর্থন ও সহযোগিতায়। আমাদের জন্য তেমন একজন জামাল নাসের আছে বলে আমাদের জানা নেই। তাই যেকোনো সশস্ত্র সংঘাত হবে আত্মঘাতী। তারপরও কথা থাকে, জিয়া তার রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য কোরআন শপথ নিয়েও কেনো আমাদের কাছ থেকে নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন? জবাবটা পরিষ্কার, তিনি কখনোই মন থেকে আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি আমাদের শুধুমাত্র সুযোগ পেয়ে সিঁড়ি হিসেবে ব্যবহার করেছেন নিজের উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য। জিয়াকে জাতীয় পরিসরে জনপ্রিয়তার সাগরে আমরা ভাসালেও তিনি আইয়ুবি স্টাইলের রাজনীতিই করবেন তার সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে ভারতের সাথে সমঝোতা করেই, আমাদের উপর নির্ভর করে নয়। এই অবস্থায় আমাদের একটি বাস্তবতাকে মেনে নিতেই হবে। সেটা হল, ভাগ্যচক্রে বর্তমানে সশস্ত্রভাবে জিয়ার মোকাবেলা করা সম্ভব নয়, রাজনৈতিকভাবেও ঠিক এই সময় জিয়া আমাদের কিংবা মোশতাককে সহ্য করবেন না ভারতের স্বার্থের অনুকূলেই। তবে সময়েতে অবস্থারও পরিবর্তন ঘটে, সৃষ্টি হয় নতুন সুযোগ। আল্লাহ্র উপর ভরসা রেখে আমাদের সেই সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে ধৈর্যের সাথে।
এর পর দ্বিতীয় বিষয়, আমাদের পক্ষ থেকেই আলোচনা শুরু করা হল। উপস্থাপনায় বলা হল, বর্তমানে আমদের পক্ষে নিশ্চুপ থেকে দূর থেকেই সব ঘটনা প্রবাহের উপর তীক্ষ্ন দৃষ্টি রেখে চলতে হবে। আমাদের মূল উদ্দেশ্য হবে সেনা পরিষদ এবং সামরিক বাহিনীতে আমাদের সমর্থকদের বাঁচিয়ে রেখে নিজেদের শক্তিকে সুসংহত করা। আজঅব্দি অর্জিত সুনাম ও সমর্থনকে মসিলিপ্ত করা চলবে না কোনও হঠকারি পদক্ষেপ নেবার মাধ্যমে। আমাদের সম্পর্কে জনগণের কৌতূহল, ভালোবাসা, দোয়া এবং প্রত্যাশা বজায় রাখতে হবে নিজেদের মেধা এবং চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের বহিঃপ্রকাশের মাধ্যমে। অসময়ে সব কৌতূহলের সমাপ্তি ঘটিয়ে ইতিহাস হয়ে যাওয়াটা সমীচীন হবে না। তাই সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, আমাদের তরফ থেকে কোনও বিবৃতি বা সাক্ষাতকার মিডিয়াকে দেয়া হবে না। এতে কোন উপকার তো হবেই না, বরং দেশে-বিদেশে আমাদের প্রতি আকর্ষণ কিংবা ঔৎসুক্য যতটুকুই আছে সেটাও খুইয়ে বসবো। অতএব, সর্ব বিবেচনায় বর্তমানে নিজেদের লোকচক্ষুর আড়ালে নিয়ে গিয়ে চুপচাপ থাকাটাই হবে যুক্তিসঙ্গত। উপস্থিত সবাই এই প্রস্তাবনা সমর্থন করে কিন্তু রশিদ আর ফারুক রহস্যজনক ভাবে নিশ্চুপ থাকে। এরপর তৃতীয় বিষয়ে আলোচনা সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে আমিই আবার শুরু করলাম।
এখনঅব্দি আমাদের দেখাশোনার সব দায়িত্ব পালন করছে বাংলাদেশ সরকার এবং ক্ষমতার কেন্দ্রস্থল সেনাসদর। সেই পরিপ্রেক্ষিতে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করার কোনও গ্রহণযোগ্য যুক্তি আমাদের নেই। তাছাড়া বিভিন্ন সূত্র থেকে যে সমস্ত খবরাখবর পাওয়া যাচ্ছে তাতে মনে করার যথেষ্ট কারণ আছে যে, এখনঅব্দি ভারত, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন, আমেরিকার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের শিকড় সন্ধানের সর্বাত্মক চেষ্টা করছে। তাই আমাদের বিশেষভাবে সতর্ক থাকতে হবে। তা নাহলে যথেষ্ট ক্ষতির সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে। এই অবস্থায় ভবিষ্যত চিন্তা করে আমাদের আসল পরিচয় এবং ভিতরের কথা গায়ে পড়ে তাদের জানিয়ে দিলে সেটা হবে মস্ত বোকামি। নিজেদের উলঙ্গ করলে ভবিষ্যতে নিজস্ব ধ্যান-ধারণা মোতাবেক কোনও কিছুই করা সম্ভব হবে না। তাদের সুতোর টানে পুতুলনাচ নাচতে হবে। সেটা কাম্য হতে পারে না। নিজস্ব বলে ক্ষমতা গ্রহণের পর বন্ধুত্ব আর বন্ধুত্বের জোরে ক্ষমতায় আরোহণের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। বিদেশী কোনও শক্তি নিজ স্বার্থ ছাড়া অন্য কিছুকে প্রাধান্য দেয় না তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে। আজকের নিও-ঔপনিবেশিকতাবাদের যুগে অনুন্নত দেশগুলোকে যে আর্থিক সাহায্য করা হয়, সেটা দেশগুলোকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে রেখে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলার লক্ষে নয়, তাদের উপর নির্ভরশীল করে তোলার জন্যই। এই কাজটি করার জন্য স্থানীয় তল্পিবাহকদের গরুখোঁজা করে মসনদে বসিয়ে দেয়া হয়। সেইসব স্বার্থপর গোষ্ঠী নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দেয় অতি অল্পমূল্যে। পুতুল খোঁজার সাথে সাথে তারা সম্ভাব্য প্রতিবাদীদেরও চিহ্নিত করে তাদের নির্মূল করে দেয় অঙ্কুরেই। অতএব কোনও বিদেশী শক্তির আশ্রিত হয়ে নিজেদের বিকিয়ে না দিয়ে জিয়ার প্রস্তাব মেনে নিয়ে সময় কাটানোর সাথে সাথে সাধ্যমতো দেশ ও জাতীয় স্বার্থে ভূমিকা রাখার চেষ্টায় ব্রতী হওয়াটাই বাঞ্ছনীয়। এই যুক্তিও সবাই মেনে নেয়। কিন্তু নিরব থাকে ভায়রাদ্বয়। তাদের নীরবতা কিসের লক্ষণ সেটা বোঝা গেলো না। আমাদের প্রথম বিষয়ের সিদ্ধান্তটিও তাদের কাছে গ্রহণীয় হয়েছিল কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ থেকে গেলো। বৈঠকের পর কথামতো আমরা শিশুভাইকে আমাদের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। জেনারেল জিয়ার প্রস্তাবে লিবিয়াতে রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে যেতে আমরা রাজি। জবাবে শিশুভাই জানালেন, অতিসত্বর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। দেশে সেনা পরিষদের নেতাদেরও জেনারেল জিয়ার প্রস্তাব এবং আমাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্তের যৌক্তিকতা বুঝিয়ে বলায় তারা আমাদের সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছিলো। এরপরই আচমকা দুই ভায়রা ঘটিয়ে বসলো অপ্রত্যাশিত বিভ্রাট!কাউকে কিছু না বলে দুই ভায়রা বৈঠকের পর অপ্রত্যাশিতভাবে ব্যাংককে আমেরিকান দূতাবাসে উপস্থিত হয়ে অর্বাচীনের মতো রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বসলো। যুক্তিসঙ্গত কারণেই তাদের সেই আবেদন নাকচ করে দেয় দূতাবাস। খবরটা তারা আমাদের কাছে চেপে গেলেও আমরা সেটা জানতে পারি। যদিও এই ধরনের কীর্তিতে আমরা ক্ষুব্ধ হয়েছিলাম তবুও এ নিয়ে তিক্ততা না বাড়িয়ে আমরা চুপ থাকি।
পরে একই ভাবে লিবিয়াতে অবস্থান কালে কারো সাথে কোনও পরামর্শ ছাড়াই লন্ডনের একটি লাইভ টিভি শো-তে দুই ভায়রা রশিদ আর ফারুকের এক সাক্ষাতকারের ব্যবস্থা করেন এক পাকিস্তানী নাগরিক ব্রিটিশ সাংবাদিক অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস। সেই সাক্ষাতকারে দু’জনই দম্ভের সাথে বোকার মতো জানান দেয়, ১৫ই আগস্ট সেনা অভ্যুত্থানের মূল নেতা ছিল তারাই। তাদের নেতৃত্বেই পতন ঘটে স্বৈরাচারী মুজিবের বাকশাল সরকারের ইত্যাদি ইত্যাদি।
তাদের এই ধরনের গোপন তৎপরতার ব্যাপারেও আমরা স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু এই বিষয়ে তাদের সাথে বাকবিতণ্ডা করা থেকে এবারও বিরত রইলাম।
s leo.
রাষ্ট্রীয় অতিথি হয়ে লিবিয়ার পথে
একদিন রাষ্ট্রদূত হন্তদন্ত হয়ে সাতসকালে এসে হাজির। স্যার, আপনাদের লিবিয়াতে পাঠানোর সব বন্দোবস্ত করার হুকুম এসেছে সেনা সদর থেকে। আমাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে আপনাদের সাথে আলোচনার মাধ্যমে আপনাদের সুবিধা মতো সব ব্যবস্থা করতে। আমাকে যখনই জানাবেন কবে যাবেন আপনারা, আমি সেই মতোই সব ঠিক করে ফেলবো।
সপ্তাহখানেকের মধ্যেই ঠিক করে ফেলুন। তাই হবে স্যার, বলে ফিরে গেলেন রাষ্ট্রদূত। সব ব্যবস্থা করে এক রাতে আল ইটালিয়ার একটি ফ্লাইটে এথেন্সের উদ্দেশে আমাদের তুলে দিয়ে বিদায় জানিয়েছিলেন রাষ্ট্রদূত। এথেন্স থেকে লিবিয়ান এয়ার লাইনের একটি স্পেশাল ফ্লাইটে আমরা পৌঁছাবো গন্তব্যস্থল বেনগাজীতে। তখনো সামরিক বাহিনীতে ষড়যন্ত্রমূলক নিধনযজ্ঞ শুরু করা হয়নি বিপ্লবীদের বিরুদ্ধে। দূরপাল্লার যাত্রায় আমাদের বহনকারী DC-10 বিমানটি নির্ধারিত সময় আকাশে উড়লো। অজানার উদ্দেশে যাত্রা! আমাদের দূরে সরিয়ে দিতে পারায় জেনারেল জিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হবেন তাতে কোনও সন্দেহ নেই। রাতের আঁধার ভেদ করে শোঁ শোঁ শব্দে উড়ে চলেছে যান্ত্রিক বলাকা। যাত্রীরা খাওয়া-দাওয়ার পাট চুকিয়ে কম্বল-বালিশ নিয়ে ঘুমাবার চেষ্টা করছে সবাই। ফার্স্ট ক্লাসের পুরো কেবিনের যাত্রী আমরাই। পাশের সিটে নিম্মি ঘুমিয়ে পড়েছে। ফার্স্ট ক্লাশের সিট রিক্লাইন করে নিলে সহজেই আরামদায়ক বিছানায় বদলে যায় সিটটা। আমার মাথায় তখন নানা ধরনের চিন্তা বিচ্ছিন্নভাবে ঘুরপাক খাচ্ছে। ভাবছি, অতীত বর্তমান ভবিষ্যৎ নিয়ে। আইলের এর বিপরীতে পাশেই বসেছে পাশা। লিজি দুধের শিশুমেয়ে লীরাকে বুকে জড়িয়ে দুটো সিটে বিছানা পেতে ঘুমোচ্ছে। আগের দিকে জায়গা করে নিয়েছে রশিদ, ফারুক আর তাদের পরিবার। পেছনে শাহরিয়ার নব দম্পতিকে নিয়ে জাঁকিয়ে বসেছে ব্যাচেলর অফিসাররা। হাসি ঠাট্টা, তামাশায় জমজমাট অবস্থা। গালগল্পও চলছে সাথে। পাশা চেইন স্মোকার। নিরবে সিগারেট ফুঁকে চলেছে। ব্যাচেলর খাইরুজ্জামান, কিসমত আর নাজমুল সুন্দরী বিমানবালাদের সাথে ভাব জমানোর চেষ্টায় ব্যস্ত। পাশা উঠে কাছে এসে বললো
স্যার, আমারও ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ ধরে লক্ষ করছি আপনি নিমগ্ন হয়ে কিছু ভাবছেন। চলুন না এই হৈ-হুল্লোড় থেকে একটু নিরিবিলিতে গিয়ে বসি।
বেশ চলো। দু’জনে ফার্স্ট ক্লাশের পেছনের স্মোকিং কেবিনের নিরিবিলি যায়গাতে দুটো খালি সিট খুঁজে নিয়ে বসলাম। একটি সিগারেট ধরিয়ে পাশা বললো
স্যার, আমি যা ভাবছি আপনিও কি তাই ভাবছেন?
কি ভাবছো তুমি সেটা না জেনে বলি কি করে!
ভাবছি we have lost the game but that’s not a big deal. What is bothering me most is the treachery of Zia. এমন বিশ্বাসঘাতকতা জিয়া করতে পারেন সেটা আমার জীবনের সবচেয়ে বড় বিস্ময়, কল্পনার বাইরে! আমি এখনো এটাকে মেনে নিতে পারছি না। আমরা সবাই এভাবে তাকে চিনতে ব্যর্থ হলাম! Truth is stranger than fiction! ঠিক তোমার মতো না হলেও আমিও কিন্তু প্রায় একই বিষয়ে ভাবছিলাম। পরাজিতরাই দেশান্তরী হয়, কিন্তু বিজেতারাও যে দেশান্তরী হতে পারে সেটা ইতিহাসে কোথাও চোখে পড়েনি। আমার জন্য সবচেয়ে চিন্তনীয় এবং বিস্ময়কর ব্যাপার হল জেনারেল জিয়াকে তো আমরা পুরোধায় রেখেই সঠিক রাজনৈতিক পথে এগুতে চেয়েছিলাম আন্তরিকভাবেই। সেইক্ষেত্রে জিয়া আমাদের সাথে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে বিপথগামী হলেন কেনো! তবে একটা কথা জেনে রাখো তার এই সিদ্ধান্তের পরিণাম হবে ভয়ংকর।
এই বিশ্বাসঘাতকতার জন্য তাকে চরম মূল্য দিতে হবে। জানি রশিদ-ফারুকের ব্যাপারে তার তেমন স্পষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু তার তো জানা ছিল অভ্যুত্থানের মূলশক্তি সুসংগঠিত সেনা পরিষদ। ওরা যে ছিল সহায়ক শক্তি সেটাও জিয়া ভালভাবেই জানতেন। আমরা তাকে শুধু সেনা পরিষদের নেতাই নয়, জাতির নেতা বানাতে চেয়েছিলাম সেখানে হঠাৎ করে তার ভোল পালটানোর আসল কারণটা কি! জিয়া হয়ত বুঝেছিলেন, নীতি-আদর্শের ব্যাপারে সেনা পরিষদ বিন্দুমাত্র আপোষ করবে না। সেইক্ষেত্রে রাষ্ট্রের কর্ণধার হবার পরও তার পক্ষে এককভাবে কোনও গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হবে না। কারণ, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রিকতা সেনা পরিষদের একটি মৌলিক নীতি। আর একটি কারণ হতে পারে, সুযোগ বুঝে ক্ষমতা লোলুপ জিয়া আমাদের বলয় থেকে বের হয়ে বিশ্ববাসীকে চতুরতার সাথে জানান দিচ্ছেন উগ্রপন্থীদের সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। তিনি বুঝতে পেরেছেন, পশ্চিমা শক্তিধর দেশগুলো, তেল সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ-আমীরদের কাছে প্রকৃত জাতীয়তাবাদী এবং প্রগতিশীল বিপ্লবীদের গ্রহণযোগ্যতা নেই। তাদের কাছে শুধুমাত্র ঐ সমস্ত বিপ্লবীরাই গ্রহণযোগ্যতা পায় যাদের তারাই মাঠে নামায় নিজেদের স্বার্থেই। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তিনি নিজেকে মুজিব হত্যার সাথে জড়াতে চাচ্ছেন না ভারতের অনুকম্পা পাবার জন্য। তার মানে তিনি ভারতের প্রতিনিধি আওয়ামী-বাকশালীদের সাথে সমঝোতা করবেন সেটা অবধারিত। সেইক্ষেত্রে যতদিন তিনি বেঁচে থাকবেন রাজনৈতিক অঙ্গনে আমাদের কিংবা মোশতাকের কোন ঠাঁই হবে না। তথাকথিত ইসলামিস্টদের নিয়ে টানাটানি করবে দুইপক্ষই। তারাও দর কষাকষির রাজনীতি করবে বিশ্ব মোড়লদের দাবার ছকের দায়রার মধ্যে থেকেই। তাই কোনও সমস্যা হবে না কারো জন্যই।
১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের বিপ্লব সম্পর্কে ভারত, আমেরিকাসহ সারা দুনিয়ার গোয়েন্দা সংস্থাগুলো রয়েছে অন্ধকারে। বিশেষ করে আমাদের মতো চাকুরিচ্যুত কিছু সেনা অফিসারের নেতৃতে এমন দুইটি যুগান্তকারী অবিশ্বাস্য ঘটনা ঘটে গেলো আর সমগ্র দেশবাসী সেই বৈপ্লবিক পরিবর্তনকে স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন জানালো সেটাও তাদের জন্য বিস্ময়কর! যারা তাদের নাকের ডগার উপর দিয়ে এমন কাজ করতে পারে তাদের সেবাদাস বানানো যাবে না সেটাই হলো তাদের মাথাব্যথা। এই ধরণের চরিত্রের অধিকারীদের তারা বিশ্বাসযোগ্য মনে করে না, তাদের গ্রহণযোগ্যতাও তাদের জন্য হয়ে পড়ে ঝুঁকিপূর্ণ। তাই তাদের সর্বদা সন্দেহের চোখেই দেখা হয়। আমাদের অনুপস্থিতির সুযোগে আজকের জিয়া যেভাবে ভারতসহ বিভিন্ন দূতাবাসে ধর্না দিয়ে সবাইকে বোঝাতে প্রাণপাত করছেন যে ঐ সব ঘটনার সাথে তার কোনও সম্পৃক্ততা নেই, তিনি বিপ্লবী নন- শুধুমাত্র একজন গণতন্ত্রমনা পেশাদার সৈনিক তাতে কিছুটা হলেও কাজ হয়েছে। অবশ্য এটা প্রমাণ করতে ভবিষ্যতে তাকে আরও অনেক কিছুই করতে হবে। তিনি অচিরেই সেনা পরিষদের সদস্য এবং বিপ্লবীদের উপর খড়গহস্ত হয়ে উঠবেন নিজের গ্রহণযোগ্যতা পাকাপোক্ত করতে। তবে সবচেয়ে মারাত্মক হবে যদি জিয়া মনে করে থাকেন যে ভারতের আশির্বাদ ছাড়া ক্ষমতায় টিকে থাকা যাবেনা তাই সমঝোতার মাধ্যমে তিনি যদি আওয়ামী-বাকশালীদের জাতীয় রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করে ফেলেন। সেইক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্নের বাস্তবায়ন তো দূরের কথা, ক্রমান্বয়ে দেশের অরক্ষিত স্বাধীনতা সময়েতে রূপান্তরিত হবে পরাধীনতায়। দেশের ৮-১০ কোটি মুসলমান আবার পরিণত হবে ভারতীয় চাণক্যদের গোলামে ঠিক যেমনটি হয়েছিল শিখণ্ডি মীরজাফরের পলাশির বিশ্বাসঘাতকতায়।
আপনার চিন্তাভাবনা ও আশঙ্কা খুবই যুক্তিসঙ্গত। কিন্তু আমার একটা প্রশ্ন আছে।
বলো।
মুজিবের পতনের পর আমেরিকা, গণচীন, সৌদি আরবসহ মুসলিম জাহানের দেশগুলো এবং প্রায় পুরো পশ্চিমা বিশ্বই তো পটপরিবর্তনকে ইতিবাচকভাবে স্বাগত জানিয়েছিল। সেটা কেন?
প্রশ্নটা গুরুত্বপূর্ণ, তবে জবাবটা খুবই সোজা।
দুই মেরুতে বিভক্ত বিশ্বে সৃষ্টিকাল থেকে বাংলাদেশকে আষ্টেপৃষ্ঠে বাঁধা হয় রুশ-ভারত বলয়ে। ১৯৭১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের সাহায্যে পাকিস্তানকে দ্বিখণ্ডিত করাটা ছিল আমেরিকাসহ পশ্চিমা বিশ্ব, মুসলিম জাহান এমনকি গণচীনের স্বার্থের পরিপন্থী। তাই মুজিবের পতনের পর খন্দকার মোশতাক প্রেসিডেন্ট হওয়ায় সবাই বুঝতে পারে বাংলাদেশ সোভিয়েত ইউনিয়ন-ভারত বলয়ের বাইরে আসার চেষ্টা করবে। মোশতাকের প্রেসিডেন্ট হওয়াটাই ছিল তার সব চেয়ে বড় ইঙ্গিত। এরপর তিনি জিয়াকে চীফ বানানোর পর বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয়ে যায়। খন্দকার মোশতাকের জায়গায় যদি আমাদের মতো অজানা অজ্ঞাত কেউ রাষ্ট্রপতি হতো তাহলে ঐ ধরনের গ্রহণযোগ্যতা এত তাড়াতাড়ি পাওয়া সম্ভব হতো না। খন্দকার মোশতাক জেনারেল জিয়াকে চীফ বানালেন সেটাই সবাই দেখল। পেছনে কার কি ভূমিকা ছিল সেটা ধর্তব্যের বিষয় ছিল না। কারণ আমরা সবাই ছিলাম ছায়া, কায়া নই। শুধু তাই নয়, প্রেসিডেন্ট মোশতাক আহমদ এবং জেনারেল জিয়ার প্রতি পূর্ণ আনুগত্য ছিল বিপ্লবীদের। সেটাই দেখলো দেশ এবং বিশ্ববাসী। ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানের পর মোশতাকের জাতির উদ্দেশ্যে যুক্তিসঙ্গত ভাষণের পর চীফের পদে জেনারেল জিয়াকে অধিষ্ঠিত দেখতে পেয়ে তাকেই ক্ষমতা বলয়ের কেন্দ্রীয় ব্যক্তি হিসাবে দেখতে থাকে দেশ ও বিদেশে সবাই।দেশে-বিদেশে ধারণা জন্মালো পটপরিবর্তনের মূলে ছিলেন মোশতাক এবং জিয়া। সেনা পরিষদ একটি গোপন সংগঠন। তাই তাদের ভূমিকা সম্পর্কে আপামর জনগণ এবং বহির্জগত কিছুই জানতে পারেনি এখনও। যদিও আমাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত তবুও আমাদের নৈতিক দায়িত্ব রয়েছে দেশবাসী এবং বহির্বিশ্বকে সেনা পরিষদ এবং স্বাধীনতার যুদ্ধকাল থেকে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে এই সংগঠনের নিঃস্বার্থ কঠিন সংগ্রাম এবং অবদান সম্পর্কে অবহিত করা যাতে যথাসময়ে ঐতিহাসিকগণ সেনা পরিষদ এবং সংগঠনের নিবেদিতপ্রাণ বিপ্লবীদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পারেন। এমনকি সামরিক বাহিনীর শুধুমাত্র সংগঠনের সদস্যরা ছাড়া সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে বে-খবর। সামরিক বাহিনীতে কর্নেল তাহের সম্পূর্ণ নিজ উদ্যোগে বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সেল তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন সেটা মোটামুটি প্রায় সর্বমহলেই জানা ছিল। কিন্তু তার কার্যকলাপ ছিল এতই সীমিত যেকারণে কোনও মহলেই তার উদ্যোগ গুরুত্ব পায়নি। বিশেষ করে বেসামরিক এবং সামরিক বাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর কাছে। তাহেরের ব্যর্থতার একটি প্রধান কারণ ছিল চাকুরি ছাড়ার পর একজন অবসর প্রাপ্ত অফিসার হিসাবে তার পক্ষে সামরিক বাহিনীতে অনুপ্রবেশের স্কোপ ছিল খুবই সীমিত। পক্ষান্তরে যেহেতু আমরা সেনা পরিষদের বীজ রোপণ করেছিলাম যুদ্ধকালীন সময়েই সেজন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে পরবর্তী সময়ে চাকুরিতে থাকা অবস্থায় সেনা পরিষদ গড়ে তোলা সম্ভব হয়েছিলো সহজেই। রিক্রুটিং অফিসার হিসাবে আমরা প্রায় ১৫ হাজারের উপর পরীক্ষিত এবং আমাদের অধীনস্থ মুক্তিযোদ্ধাকে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করেছিলাম। তাছাড়া কর্নেল তাহেরের ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে’র আদর্শের চেয়ে আমাদের আদর্শের গ্রহণযোগ্যতা দেশপ্রেমিক সকল মহলে ছিল অনেক বেশি। তাই আমাদের সংগঠন অতি দ্রুত গড়ে তুলতে পেরেছিলাম ব্যাপক পরিসরে। কিন্তু আমাদের সংগঠনের অবস্থান পর্দার আড়ালে থাকায় এবং জেনারেল জিয়াকে চিনতে ভুল করাটাই আজ আমাদের জন্য কাল হয়ে উঠেছে। বিশ্বাসঘাতকতার যূপকাষ্ঠে আজ আমরা পরাস্ত, এই সাময়িক বাস্তবতাটাকে আমাদের মেনে নিতেই হবে সাময়িক ভাবে। সাময়িক এ জন্য বললাম, আমাদের নীতি-আদর্শ সঠিক। একমাত্র এই নীতি-আদর্শের বলেই বাংলাদেশ তার স্বকীয়তা বজায় রেখে প্রগতির পথে এগুতে পারবে। এর কোনও বিকল্প নেই সেটা বুঝতে দেশবাসীর খুব বেশি সময় লাগবে না। আজ যারা রাজনীতির মাঠে জেঁকে বসেছে তারা যে সব জাতীয় স্বার্থবিরোধী বিভিন্ন বহিঃশক্তির তল্পিবাহক সেবাদাস সেটা প্রমাণিত হবে তাদের নিজস্ব কর্মকাণ্ডের মাধ্যমেই। তাই বর্তমানে আমরা একেবারে অস্তিত্বহীন কিংবা অপাংক্তেয় হয়ে গেছি তেমনটি ভাবা যুক্তিসঙ্গত নয়। আমাদের প্রয়োজনীয়তাও যে চিরকালের জন্য ফুরিয়ে গেছে সেটাও ভাবার অবকাশ নেই। আমাদের নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, দেশ ও জনগণের স্বার্থে আপোষহীন দুঃসাহসিক সংগ্রাম এবং আত্মত্যাগ এর সঠিক মূল্যায়ন এক সময় নিশ্চয় হবে। সত্য একদিন উদ্ভাসিত হবেই প্রাকৃতিক নিয়মে। এটাই ইতিহাসের শিক্ষা এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস, আমাদের ক্ষেত্রে তেমনটির ব্যত্যয় হবে না রাব্বুল আলামিনের রহমতে ইন শা আল্লাহ্। কি জানো পাশা, দুই নৌকাতে পা দিয়ে বেশিদূর এগুনো সম্ভব নয়। তাই অচিরেই জেনারেল জিয়াকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তিনি কাদের উপর নির্ভর করে রাজনীতি করবেন। বর্তমানে সেনা পরিষদের কাছ থেকে তিনি নিজেকে সরিয়ে নিচ্ছেন যারা তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়েছে। অন্যদিকে তিনি তার চারপাশে জড়ো করছেন সব বাস্তুঘুঘুদের। ভাবছেন, এদের মাধ্যমে তিনি নিজেকে একজন মধ্যপন্থী শক্তিধর ব্যক্তি হিসাবে দেশে-বিদেশে প্রমাণ করতে সক্ষম হবেন। এখন এই মাকড়সার জালে আটকে পড়া জিয়া তাদের উপর নির্ভর করেই চলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিন্তু এতে শেষ রক্ষা হবে না। সময় সুযোগ মতো তার ঘরের শত্রু বিভীষণরাই তাকে ক্ষমতাচ্যুত করবে। জিয়ার মাধ্যমে হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনর্বাসন, খন্দকার মোশতাক এবং সেনা পরিষদকে শক্তিহীন করার পরই জিয়াকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে ফেলার ঘটনাটা ঘটানো হবে বলেই আমার ধারণা। ইতিমধ্যেই ঘোষণা করা হল প্লেন বম্বে অবতরণ করছে। তাই, আমরা নিজ নিজ আসনে ফিরে গেলাম। কয়েকজন যাত্রী ওঠানামা করল। কিছুক্ষণ পর আবার আকাশে উড়ল আমাদের প্লেন। কিছু হাল্কা খাবার খেয়ে আবার আমরা পেছনের খালি জায়গাতে গিয়ে বসলাম। অনেকেই দুই তিনটা সিট এক করে কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘুমুচ্ছে, নাকও ডাকাচ্ছে কেউ কেউ।
স্যার, আপনার কথাগুলোই ঘুরপাক খাচ্ছে মাথায়। আর একটু খোলাসা করে বলেন তো আপনি কি করে ভাবলেন জিয়া ইতিমধ্যেই চক্রান্তের জালে নিজেকে আটকে ফেলেছেন ক্ষমতার খেলা শুরু না হতেই?
একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য ব্যাপারটা বোঝার জন্য। খন্দকার মোশতাকের তরফ থেকেই এসেছিলেন জনাব ইস্পাহানি। তার কথাবার্তা থেকে কিন্তু আমার মনে হয়নি তিনি আসার আগে জেনারেল জিয়ার সাথে দেখা করে এসেছেন।
আপনার এমন ধারণা আরও রহস্যের জন্ম দিচ্ছে, তার বক্তব্যের কন কথায় এমন ইঙ্গিত পেলেন আপনি?
পাকিস্তানের ২২ টি বহুল আলোচিত পরিবারের মধ্যে দুইটি সবচেয়ে ধনী পরিবার হচ্ছে ইস্পাহানী এবং হারুন পরিবার। এই দুই পরিবারের সাথেই শেখ মুজিবের ঘনিষ্ঠতা ছিল। এই দুইটি পরিবারই আমেরিকা এবং ব্রিটেনের ক্ষমতা বলয়ে বিশেষভাবে পরিচিত। হারুন পরিবার দৈনিক ডন পত্রিকার মালিক। এছাড়া শিপিং ও ইন্স্যুরেন্স ব্যবসায় শীর্ষস্থানে তাদের অবস্থান। তামাকের চাষ, সিগারেটের ব্যাবসা, টেক্সটাইল ক্ষেত্রেও তাদের আধিপত্য সর্বজন বিদিত। ইস্পাহানিদের রয়েছে পাট, চা, নানা ধরনের শিল্প প্রতিষ্ঠানে একচেটিয়া প্রাধান্য। পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হবার পর থেকেই আর্থিকভাবে তারা মুজিবকে লালন পালন করে এসেছে। নামেমাত্র পদ সৃষ্টি করে আলফা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি থেকে মুজিবকে নিয়মিত মোটা অংকের মাসোহারা দেয়া হতো। ইস্পাহানী পরিবারের প্রভাবে মুজিবকে পাকিস্তানের টি বোর্ডের কর্তাব্যক্তি হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছিলো। মূলত, তাদের আর্থিক যোগানের উপর ভিত্তি করেই মুজিব রাজনীতিতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়। পরে অবশ্য প্রাদেশিক সরকারের শিল্পমন্ত্রী হয়ে এই দুইটি পরিবারের বিনিয়োগ সুদে আসলে পুষিয়ে দিয়েছিলো শেখ মুজিব। তিনি খন্দকার মোশতাকের দূত হয়েই এসেছিলেন যদিও তার মাধ্যমে পাঠানো বার্তার সারবস্তু আমরা আগেই জানতে পারি জনাব মোশতাকের সাথে টেলিফোনে আলাপের সময়।
কিন্তু জিয়ার সাথে আলাপ না করে তিনি কি করে মত প্রকাশ করলেন, যে জিয়া আমাদের ফেরত নিতে ইচ্ছুক নন? কিছুটা হলেও তার নিশ্চই জানা আছে যে জিয়ার সাথে আমাদের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
একজন বহুল পরিচিত ব্যক্তি হিসাবে জনাব ইস্পাহানীর অনেক নির্ভরশীল সোর্স আছে। হয়তো আমেরিকান রাষ্ট্রদূত কিংবা ব্রিটিশ হাই কমিশনারের কাছ থেকেই খবরটা পেয়েছেন।
ঠিক বলেছেন, এটা সম্ভব।
তিনি আর একটা মূল্যবান খবর দিয়ে গেলেন লক্ষ্য করেছ কিনা জানিনা। তিনি বলে গেলেন গ্রহণযোগ্যতার জন্য ইতিমধ্যেই জিয়া ভারতকে বলেছেন মুজিব হত্যার সাথে তার কোনও সম্পর্ক নেই। প্রয়োজনে এটা প্রমাণ করতে তিনি আরও ছাড় দেবেন ভারতকে। এই বক্তব্যটি কিসের ইঙ্গিত বহন করে? এর মানে জিয়ার খড়গ অবশ্যই পড়বে আমাদের এবং সেনা পরিষদের উপর। I strongly feel now, Zia had been highly ambitious person all through but never believed in pro-people politics. Mind set wise, he believes in politics of power only, compromising and sharing with the vested interested different quarters. The war of independence could not bring any change in his mind set. He shall never do the politics for the majority downtrodden and persecuted lot who had been deprived from their legitimate rights since ages. He shall never take any revolutionary steps regarding the socio economic sectors to establish a just and fair Bangladesh, where every citizen would be treated equally and given equal opportunity, there shall be no fair distribution of resources as well. In short, his politics shall be just politics for power sake like most of the despotic authoritarians of the 3rd world countries having legacy like vestiges of colonialism. পাশার প্রশ্ন
তাহলে তিনি আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করে শপথ নিয়েছিলেন কেন?
ভারত এবং প্রবাসী সরকারতো যুদ্ধের প্রারম্ভেই সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে অপসারিত করে মুক্তিযুদ্ধের মূলধারা থেকে উপড়ে ফেলে কোলকাতায় এনে ডাম্প করে কোণঠাসা করে রেখেছিলো জেনারেল জিয়াকে। সেই অবস্থায় তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার অন্য কোনও পথ খোলা ছিল না ক্ষমতার কেন্দ্র পর্যন্ত পৌঁছাবার জন্য। তাই সুযোগ পেয়ে তিনি আমাদের ব্যবহার করেছিলেন। তিনি অন্তর থেকে নয়, শুধুমাত্র মৌখিকভাবেই আমাদের নীতি-আদর্শের প্রতি একাত্মতা প্রকাশ করে সময় এবং সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন। তার এই চাতুর্য আমরা বুঝতে পারিনি। প্লেনটি ইতিমধ্যে দুবাইতে টেকনিক্যাল ল্যান্ডিং করেছিলো তেল ভরে নিতে। এই প্রেক্ষিতেই আমার মনে হচ্ছে, ভবিষ্যতে খন্দকার মোশতাক কিংবা আমাদের রাজনৈতিকভাবে জিয়ার মোকাবেলা করা অতি সহজ হবে না। আর একটি বিষয়ে আমি প্রায় নিশ্চিত. জিয়ার খড়গ মোশতাক এবং সেনা পরিষদের নেতাদের উপর নেমে আসবেই এই দুই প্রতিপক্ষকে শক্তিহীন করার জন্য। এছাড়া তার পক্ষে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করা কিছুতেই সম্ভব হবে না সেটা জিয়া ভালভাবেই বুঝে নিয়েছেন। তাই এখন থেকে আমাদের জিয়ার প্রতিটি পদক্ষেপ দেখতে হবে, বুঝতে হবে তার ভবিষ্যতের প্রতিটি পদক্ষেপ। তার উপরেই নির্ভর করবে আমাদের ভবিষ্যৎ করণীয়।
আপনার বিচার বিশ্লেষণের গভীরতা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আমার মনে হয় এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের মানে সেনা পরিষদের সদস্যদের মাঝে একটা বিস্তারিত আলোচনা হওয়া উচিত।
যথাসময়ে প্রয়োজনে করবো নিশ্চয়ই।
কিছুক্ষণ পর ঘোষণা করা হল প্লেন জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে অবতরণ করছে। ভোর হয়ে গেছে। যাত্রীরা সবাই প্রাতঃক্রিয়া শেষ করে ফ্রেশ হয়ে যার যার আসনে বসতে শুরু করেছেন। আমরাও হাত-মুখ ধুয়ে বেশভূষা ঠিকঠাক করে নিলাম। এতে লম্বা সফরের ক্লান্তি কিছুটা দূরীভূত হল। পরই আসবে আমাদের গন্তব্যস্থল এথেন্স। ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমাদের প্লেন অবতরণ করল এথেন্স বিমান বন্দরে। দরজা খোলার পর একজন নাতিদীর্ঘ গড়নের নাদুস-নুদুস ফর্সা ভদ্রলোক আল ইটালিয়ার গ্রাউন্ড স্টাফ আর এয়ারপোর্টের কয়েকজন কর্তাব্যক্তিকে নিয়ে প্লেনের ভেতরে প্রবেশ করলেন। মাইকে ঘোষিত হল আমার আর রশিদের নাম। অনুরোধ জানানো হল দরজার কাছে এগিয়ে আসার জন্য। আমরা এগিয়ে গেলাম। অন্য যাত্রীদের অনুরোধ জানিয়ে স্বস্থানে বসে থাকতে বলা হল। দরজার কাছে পৌঁছে দেখলাম স্যুট পরিহিত ঐ ভদ্রলোক হাসিমুখে আমাদের আরবী কায়দায় অভ্যর্থনা জানিয়ে নিজের পরিচয় দিলেন লেফটেন্যান্ট সালেম বলে। তিনি নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফির তরফ থেকে আমাদের নিয়ে যাবার জন্য একটি বিশেষ বিমান নিয়ে এসেছেন। এরপর আমাদের সবাইকে নিয়ে যাওয়া হলো ভিআইপি লাউঞ্জে। সেখানে আমাদের পরিচয় পর্ব শেষ হল। মালপত্র সনাক্ত করে ওঠানো হল লিবিয়ান এয়ার লাইনসের প্লেনটিতে। অল্পক্ষণের মধ্যেই বোয়িং ৭২৭ বিমানটা গর্জে উঠে আকাশে উড়লো। গন্তব্যস্থল লিবিয়ার বৃহত্তম শহর বেনগাজী। স্মিতভাষী সালেম হাসিমুখে ইংরেজিতে আমাদের সুবিধা-অসুবিধার খবরাখবর নিচ্ছিলেন। ভূমধ্যসাগরের এক তীরে অবস্থিত এথেন্স ছেড়ে সাগর পাড়ি দিয়ে মেঘের সাথে পাল্লা দিয়ে আমাদের বহনকারী যান্ত্রিক বলাকা ছুটে চলেছে অপরকূলে অবস্থিত বেনগাজীর উদ্দেশে। পৃথিবীর সব মহাসাগর-উপসাগরের রঙের মধ্যে রয়েছে স্বকীয় বৈচিত্র্য। ভূমধ্য সাগরেরও রয়েছে নিজস্ব বৈচিত্র্য। নীল-সবুজের সংমিশ্রণের সফেন তরঙ্গের উপর সূর্যের কিরণ পড়ায় এক অপূর্ব দৃশ্য উপভোগ করছিলাম উইন্ডো দিয়ে। জেনারেল জিয়ার মনোভাব এবং খন্দকার মোশতাকের সিদ্ধান্ত অনেক প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে, প্রশ্নগুলো জটিল। এসব নিয়ে অনেক বিশ্লেষণ করেও আমরা এখনো নিশ্চিত হতে পারিনি সত্যিই কি জেনারেল জিয়া আমাদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে চলেছেন! রশিদ এবং ফারুকের মনে ইতিমধ্যেই বদ্ধমূল ধারণা সৃষ্টি হয়েছে জিয়া আগস্ট বিপ্লবের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। আমাদের চেতনা এবং স্বপ্নকে এগিয়ে নেয়ার জন্য এখনই জিয়ার বিরুদ্ধে রুখে দাড়াতে হবে। তাদের এই ধরনের বিবেচনাকে একদম নাকচ না করে আমরা তাদের বোঝাতে চেষ্টা করছি এই বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর জন্য আমাদের আরও কিছু সময় ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করতে হবে। এর পেছনে আমাদের দুটো জোরালো যুক্তি রয়েছে
১। খালেদ-চক্রকে পরাস্ত করে জিয়াকে মুক্ত করেছে সেনা পরিষদ। জিয়া জানতে পারেন মুক্তির পর সেনা পরিষদই ছিল ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের অগ্রণী এবং মূল চালিকা শক্তি। তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সহায়ক শক্তিমাত্র। এর প্রমাণ তিনি পেয়েছিলেন যখন তাহেরের ধৃষ্টতার মোকাবেলায় সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দ কঠিন অবস্থান নিয়ে তাহেরকে ক্যান্টনমেন্টে ঢোকার উপর নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের হয়ে যেতে বাধ্য করেন।
২। শিশুভাই-এর সাথে আমাদের যে ধরনের ঘনিষ্ঠতা সেই পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার কাছের লোক হলেও তাকে সম্পূর্ণভাবে অবিশ্বাস্য মনে করাটাও যুক্তিসঙ্গত নয়। তিনি বলেছেন, আমাদের এই প্রবাস জীবন সাময়িক এবং জিয়া কিছুদিন সময় চেয়েছেন মাত্র। নি এই বিষয়ে যাই বলেছেন সেটা জিয়ার ভাষ্য এতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই। ৩রা নভেম্বর আমরা খালেদচক্রের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে না গিয়ে খালেদ বিরোধী অভ্যুত্থানের পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে দেশ ছেড়ে ছিলাম সার্বিকভাবে প্রস্তুত আগ্রাসী ভারত যাতে অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার সুযোগ না পায়। ঠিক এই মুহূর্তে জিয়া বিরোধী কোন সশস্ত্র সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেই সুযোগটাই করে দেয়া হবে। আমাদের বুঝতে হবে, এ ধরনের যেকোনো সংঘর্ষ জাতি এবং সামরিক বাহিনীতে শুধু বিভ্রান্তির সৃষ্টিই করবে তা নয়, দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ারও আশংকা রয়েছে। কারণ, এখন পর্যন্ত সবারই ধারণা জিয়া আমাদেরই একজন। আমাদের যুক্তি খণ্ডাতে না পারলেও তাদের মনে সন্দেহ থেকেই যায়। তাই আমরা তাদের নিয়ে চিন্তিত হয়ে নজর রাখছিলাম তাদের গতিবিধির উপর যাতে তারা কোনও হঠকারি পদক্ষেপ নিতে না পারে। এ সমস্তই ভাবছিলাম। হঠাৎ জানালা দিয়ে বাইরে নজর পড়লো। সমুদ্রের অপর পার দেখা যাচ্ছে। সমুদ্র সৈকত থেকেই শুরু হয়েছে সাহারা মরুভূমি। সাহারার পরিধি এক মহাসমুদ্রের মতোই। সূর্যের আলো আর উত্তাপে লালচে রঙে রঞ্জিত বিস্তীর্ণ মরু সাহারা দৃষ্টির সীমানা ছাড়িয়ে বিস্তৃত। এতেও দেখতে পেলাম ঢেউ এর সমারোহ, তবে সেগুলো পানির নয়- বালির। তার মাঝেই ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে গুচ্ছগ্রাম, লোকালয়, ছোটবড় শহর এবং জলাশয় ঘিরে মরূদ্যান। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মরুভূমি আফ্রিকার প্রায় অর্ধেকটাই জুড়ে বিস্তৃত। বাইরের শোভা উপভোগ করছিলাম আর ভাবছিলাম, সাগরের সাথে মিল থাকাতেই বোধকরি উটকে বলা হয় মরুভূমির জাহাজ! সেইক্ষণে পাশা এসে পাশে বসলো। তরুণরা নববঁধু সালেমকে নিয়ে আসর জমিয়ে বসেছে। চুটিয়ে আড্ডা দেয়া হচ্ছে। সেই জটলা থেকেই অনুমতি নিয়ে উঠে এসেছে পাশা। অন্যদিকে মেয়েরা আপন মনে নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা, গল্প-গুজবে মশগুল। অদ্ভুত চরিত্রের এই তরুণ-তরুণীরা! অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে কেউই কিছু ভাবছে না, শংকিতও নয় কেউই।
স্যার, যদি অনুমতি দেন তবে একটা শলাকা ধরাই।
ধরাও।
সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে বললো
একা বসে বাইরে তাকিয়ে কি দেখছিলেন?
বালির মহাসাগর। আচ্ছা পাশা, একটা সাধারণ বিষয়ে তোমার অভিমত চাই যদিও বিষয়টি তেমন গুরুত্বপূর্ণ নয়। তাই আগে কারো সাথেই আলাপ করিনি। বলুন। ঘটনা ঘটেছিল বঙ্গভবনে। একদিন আমাদের পুনর্নিয়োগের আদেশ জারির আগে ড্রাফটটা দেখার জন্য প্রেসিডেন্ট আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। জেনারেল ওসমানী, জেনারেল জিয়া, জেনারেল খলিল সবাই উপস্থিত ছিলেন। সেটা দেখে কিছু আলাপ সেরে বেরিয়ে আসছিলাম। পথে মেজর আমিন, প্রেসিডেন্টের মিলিটারি সেক্রেটারি আমাকে পাকড়াও করে বললো, এম আর সিদ্দিকি তার রুমে আমার অপেক্ষায় বসে আছেন অনেকক্ষণ যাবত। বিষয়টা কি সেটা তার জানা নেই। ইতিমধ্যে জনাব সিদ্দিকিকে জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি হিসাবে নিয়োগ দান করা হয়েছে। ভাবলাম হয়তো সেই বিষয়েই কিছু বলতে চান। আমিনকে বললাম, কাটিয়ে দে দোস্ত। আজ দুপুরের খাওয়া বাসায় খেতে হুকুমজারি করেছে নিম্মি, না গেলে রক্ষে নেই বুঝতেই তো পারছিস। এমনিতেই বাসায় যাওয়া হয়ে ওঠে না, নিম্মিও বঙ্গভবনে আসতে চায় না। কিন্তু হঠাৎ সিদ্দিকি সাহেবের এমন কি প্রয়োজন হল ঠিক বুঝতে পারছিনা! হঠাৎ করে নয়, বেশ কয়দিন যাবত তিনি আমার অফিসে ধর্না দিচ্ছেন যাতে করে আমি তোর সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করে দেই। আমি তাকে বলেছি, ও কখন বঙ্গভবনে আসে যায় সেটা কারো পক্ষেই বলা সম্ভব নয়। তাছাড়া ও বেশির ভাগ সময় বঙ্গভবনের বাইরেই থাকে। কোথায় যায় কি করে বলা মুশকিল। তবে আজ বলে ফেলেছি তুই প্রেসিডেন্ট, জেনারেল ওসমানী আর চীফের সাথে মিটিং করছিস। অপেক্ষা করলে ধরা যেতে পারে, সেই আশাতেই বেচারা বসে আছেন। তাহলে চল, বলে গিয়ে উপস্থিত হলাম আমিনের অফিসে। সালাম কুশলাদি বিনিময়ের পর সিদ্দিকি সাহেব একটু ইতস্তত ভাবেই বললেন, তিনি একান্তে কিছু আলাপ করতে চান। আমিনের ইশারায় পাশের ঘরে দুইজনে গিয়ে ঢুকলাম। একটা কারণে আপনার সাথে কয়েকদিন ধরে দেখা করার চেষ্টা করছি। কি ব্যাপার? না, তেমন বিশেষ কিছু নয়, চা কিংবা ডিনারে মার্কিন রাষ্ট্রদূত আপনাকে সস্ত্রীক নিমন্ত্রণ করতে চাচ্ছেন আপনাদের সুবিধে মতো। ব্যাপারটা ব্যতিক্রমধর্মী নয় কি?
তা ঠিক, তবে এটা একটা সৌজন্য সাক্ষাতের বেশি আর কিছু নয়।
শুধু সৌজন্য সাক্ষাত হলে অসুবিধে নেই, উপেক্ষাটা অশোভন হবে। ঠিক আছে, বিকেল পাঁচটায় ঘণ্টাখানেকের জন্য যেতে পারি। তবে নিম্মি যেতে পারবে না। ওখান থেকেই আমাকে আরেকটা মিটিং-এ যেতে হবে। আমি এখুনি সব ব্যবস্থা করছি। আপনি কি নিজেই আসবেন?
বর্তমানে কোথায় থাকেন তিনি, গুলশানে নাকি ধানমণ্ডিতে?
ধানমণ্ডিতে।
তাহলে সংসদ ভবনের সামনে আমরা ৪টা ১৫মিনিটে মিলিত হবো।
ঠিক আছে।
সময় মতো সংসদ ভবনের সামনে পৌঁছে তার গাড়ীতে বসেই উপস্থিত হলাম রাষ্ট্রদূত জনাব বোস্টারের বাসভবনে। তিনি সস্ত্রীক অভ্যর্থনা জানিয়ে ড্রইংরুমে নিয়ে বসালেন। জনাব সিদ্দিকি বোস্টার দম্পতির সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দিলেন। আমি বিনয়ের সাথে জানালাম, বিশেষ কারণে নিম্মির পক্ষে আসা সম্ভব হয়নি। মিসেস বোস্টার মৃদু হেসে বললেন
আপনি এসেছেন সময় করে তাতেই আমরা সন্তুষ্ট। কিছুক্ষণের মধ্যেই কুশলাদি বিনিময় পর্ব শেষ করে মিসেস বোস্টার ভেতরে চলে গেলেন। এটাই আমার তার সাথে প্রথম এবং শেষ সাক্ষাত।
তাহলে আপনিই দেশ খ্যাত মেজর ডালিম? জবাব নিষ্প্রয়োজন, তাই পরের প্রশ্নের অপেক্ষায় থাকলাম।
মুজিব সরকারের পতন এবং তার মৃত্যুর খবর যখন রেডিওতে ঘোষণা করছিলেন তখন কি ভেবেছিলেন এর প্রতিক্রিয়া কি হতে পারে? হেসেই জবাবে বলেছিলাম
এক্সেলেন্সি, প্রতিক্রিয়ায় আপনি স্লিপিং স্যুট পরা অবস্থায় রাস্তা দিয়ে দৌড়াচ্ছিলেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে, আমার অবস্থাটা ঠিক তেমনটি ছিল না। আপনি ভালো করেই অবগত এই ধরনের ঘটনা সবদিক ভেবেচিন্তেই পরিকল্পিতভাবে করা হয়ে থাকে, তাই নয় কি? জবাবটা শুনে তিনি কিছুক্ষণ তীক্ষ্নদৃষ্টিতে আমার দিকে চেয়ে থেকে বললেন সেটা ঠিক। ইতিমধ্যে চা-নাস্তা পরিবেশন করে গেল বেয়ারা।
Anyway, what is next?
এক্সেলেন্সি, জবাব দেবার আগে প্রশ্নটা পরিষ্কার ভাবে বোঝা দরকার।
রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে আপনাদের পরিকল্পনা কি?
আমরা সবাই ফিরে যাচ্ছি আমাদের কর্মস্থলে সরকারের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী। দেশ পরিচালনার দায়িত্ব পালন করবেন সংবিধান সম্মত রাষ্ট্রপতি, তার সরকারের মন্ত্রীপরিষদ এবং সংসদ। ইতিমধ্যেই প্রেসিডেন্ট ও তার সরকার আগামীতে মানবাধিকার, আইনের শাসন, বাক স্বাধীনতা, রাজবন্দীদের মুক্তি, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং বহুদলীয় গণতান্ত্রিক রাজনীতির পুনঃর্প্রতিষ্ঠার দিনক্ষণসহ জাতির উদ্দেশে তাঁর ভাষণে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। আমার ধারণা তাঁর সেই ভাষণ সম্পর্কে আপনিও অবগত আছেন। দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের প্রত্যাশাই তার ভাষণে প্রতিফলিত হয়েছে। আপনি কি মনে করেন এক্সেলেন্সি?
হ্যাঁ, তার সেই ভাষণ আমি শুনেছি। খুবই আশাপ্রদ।
আমাদের দায়িত্ব ছিল শ্বাসরুদ্ধকর একদলীয় স্বৈরশাসনের নাগপাশ থেকে জাতিকে মুক্ত করে মানবিক এবং গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার রুদ্ধদ্বার খুলে দেয়া। এ দায়িত্ব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর পালন করা উচিৎ ছিল। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের মাধ্যমে শেখ মুজিবের স্বৈরসরকার কি করে বিলীন করে ফেলেছিল সেটাতো আপনার ভালোভাবেই জানা আছে। আমরা সফলতার সাথেই আমাদের লক্ষ অর্জন করেছি। এরপর আমাদের আর কোনও দায়িত্ব থাকতে পারে না রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে। আমি আমার বক্তব্য শেষ করার আগে আপনাকে পরিষ্কারভাবে কিছু কথা জানিয়ে যেতে চাই। বাংলাদেশের জনগণের রক্তে স্বাধীনতার চেতনা এবং গণতন্ত্র মিশে আছে। ইতিহাস কিন্তু সেই সাক্ষ্যই দেয়, জনাব রাষ্ট্রদূত।
আচ্ছা, আপনারা জেনারেল জিয়াকে সেনাপ্রধান বানালেন কেনো?
এক্সেলেন্সি, তাকে সেনাপ্রধান বানিয়েছেন প্রেসিডেন্ট তার সাংবিধানিক ক্ষমতা অনুযায়ী। এই সিদ্ধান্তের ব্যাপারে আমাদের কথা আসছে কেনো সেটা ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না? দেখলাম তার প্রশ্নগুলোর জবাব পাল্টা প্রশ্নের মাধ্যমে দেয়ায়, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ঘরেও জনাব বোস্টার বেশ কিছুটা লালচে হয়ে উঠেছেন, মুখমণ্ডলেও জমে উঠেছে বিন্দু বিন্দু ঘাম। তাই ঘড়ির দিকে তাকালাম। তিনি সেটা লক্ষ করেই বললেন
আপনার নিশ্চয়ই কোনও ব্যস্ততা রয়েছে?
হ্যাঁ, ঠিকই ধরেছেন- বলে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে এসেছিলাম। তিনি স্বয়ং গাড়ী পর্যন্ত এগিয়ে দিয়েছিলেন।
পুরোটা সময় জনাব সিদ্দিকি ছিলেন নীরব দর্শক। পাশা সব শুনে সিগারেটে শেষ টানটা দিয়ে সিটের হাতলের এ্যাসট্রেতে বাটটা ফেলে দিয়ে বললো
এ ভাবেই বিদেশী শক্তিধর রাষ্ট্রগুলো ক্ষমতাবলয়ের সবাইকে যাচাই বাছাই করে থাকে। আপনাদের বৈঠকটি সেই প্রক্রিয়ারই একটা পর্ব। তবে আপনার জবাবগুলো শোনার পর তিনি আপনার বিষয়ে আরও খোঁজ খবর নেবার চেষ্টা করবেন। আপনার সম্পর্কে আগ্রহ বাড়বে এ ব্যাপারে কোনও সন্দেহ নেই। তাই সুধী সাবধান! উচ্চস্বরে হেসে উঠল পাশা, আমিও হাসি চেপে রাখতে পারলাম না। X-Ray করা হয়েছে কিন্তু Report টা পরিষ্কার নয়। এই উপসংহারেই পৌঁছলাম দু’জনেই। উচ্চপর্যায়ের কোনও কূটনীতিকের সাথে স্বাধীনতার পর একজন সৈনিক হিসাবে সেটাই ছিল আমার প্রথম সাক্ষাতকার। তাই মানসপটে স্মরণীয় হয়ে আছে স্মৃতিটা। এ ধরনের বৈঠকের তাৎপর্য কিংবা গুরুত্ব কতটুকু সেই সময় সেটা ঠিক বুঝতে পারিনি, কিন্তু পরবর্তীকালে দীর্ঘ ২০ বছরেরও বেশি সময় কূটনীতিকের দায়িত্ব পালনের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছি এ ধরনের বৈঠকের মর্মকথা। তাই বিষয়টি উল্লেখ করলাম। দু‘জনই চুপচাপ বসে বাইরে ভেসে যাওয়া পেঁজা তুলোর মতো মেঘের খণ্ডগুলোর দিকে চেয়ে দেখছিলাম। মাঝে মাঝে খণ্ডগুলো প্লেনের গায়ে এসে লাগায় মৃদু ঝাঁকুনি অনুভূত হচ্ছিল। যান্ত্রিক বলাকা আমাদের পেটে ধরে ছুটে চলেছে বাতাসের সাথে পাল্লা দিয়ে। হঠাৎ পাশা বলে উঠল
স্যার, আমাদের কাউকে কিছু না বলে রশিদ আর ফারুক ব্যাংকক এর দূতাবাসে হাজির হয়ে রাজনৈতিক আশ্রয় চেয়ে বিফল হয়ে একটা প্রেস কনফারেন্স করে বসল কেনও, এর পেছনে কি যুক্তি থাকতে পারে বলে আপনি মনে করেন?
উদ্যোগটা হঠকারি হলেও যুক্তি একটা আছে। ওরা খন্দকার মোশতাকের সাথে আলাপ করে যখন জানতে পারল, মোশতাক জিয়ার অনুরোধে আবার রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন না এবং পরিষ্কার জানালেন তিনি নির্বাচিত রাষ্ট্রপতি হবেন তখন তারা বুঝতে পেরেছিলো তাদের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত হয়ে পরেছে। মোশতাক আরো যখন জানান জিয়া এবং তাহেরের দ্বন্দ্ব সামরিক বাহিনীকে অস্থিতিশীল করে তুলেছে যদিও সামরিক বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যদের সমর্থনে তিনি তাহেরকে পরাস্ত করতে সমর্থ হয়েছেন কিন্তু অবস্থা তখনও তরল। তার এই বক্তব্যের পর জিয়ার উপর তাদের অনাস্থা বেড়ে যায়। মোশতাক অবশ্যি কিছুই জানতেন না যে, তাহেরকে পরাস্ত করতে মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিল সেনা পরিষদ। সামরিক বাহিনীতে সেনা পরিষদ নামের কোনও সংগঠন সম্পর্কে আংশিক ভাবে রশিদ আর ফারুক জানলেও মোশতাকের বিন্দুমাত্র ধারণা ছিল না। কিন্তু আমরা জানতাম, সেই সন্ধিক্ষণে জিয়ার পেছনের মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ। জিয়াও বিষয়টি ভালোভাবেই জানতেন। সেনা পরিষদের সাথে সম্পর্ক না থাকায় মোশতাকের মতো রশিদ আর ফারুকও বিচলিত হয়ে ওঠে। নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই তারা ছুটে গিয়েছিলো দূতাবাসে। কিন্তু তারা বুঝতে পারেনি, বাংলাদেশে তখন জিয়াকেই প্রায় সব বিদেশী শক্তি তাদের ভবিষ্যতের ক্রীড়নক হিসাবে দেখতে শুরু করে দিয়েছে ভারতসহ। সেক্ষেত্রে রশিদ আর ফারুককে স্বাভাবিকভাবেই উপেক্ষা করেছে আমেরিকান দূতাবাস। কারণ, জিয়াকে যেখানে তারা বাংলাদেশে তাদের প্রধান খেলোয়াড় বলে মনে করতে শুরু করেছে সেখানে জিয়ার অভিপ্রায় না জেনে ব্যাংককের আমেরিকান দূতাবাস কেনো, কোথাও কোনও দেশের দূতাবাসই আমাদের বা তাদের এই ধরনের আবেদন মঞ্জু্র করবে না সেটাই স্বাভাবিক। প্রেস কনফারেন্সের কারণ ছিল ব্যর্থতার পরিপ্রেক্ষিতে আত্মরক্ষার প্রচেষ্টা। এরা ভবিষ্যতেও এ ধরনের অযৌক্তিক আরও অনেক কিছুই হয়তো করবে। তাই বাদ দাও ওদের কথা। চলো, জিয়াকে নিয়েই আলোচনায় ফিরে যাই। আমার মনে হয় ইতিমধ্যেই জিয়া ভারত এবং বিদেশের শক্তিধর দেশগুলোকে বোঝাতে চেষ্টা করে অনেকটাই সফল হয়েছেন যে তিনি সবার সাথে আপোষ করেই রাজনীতিতে এগুবেন। যুক্তি হিসাবে তিনি দেশবাসীকে বোঝাবেন জাতীয় ঐক্য এবং গণতন্ত্রের প্রয়োজনেই তিনি সেটা করছেন। ভারত বিরোধী জনগণের মনোভাব এবং বৃহত্তর মুসলমান জনগোষ্ঠী এবং তেলসমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর ধর্মীয় চেতনা বুঝে রাজনৈতিক সমর্থনের জন্য তিনি বাহ্যিকভাবে ভারত বিরোধী শ্লোগান তুলবেন। একই সাথে বকধার্মিকও সাজবেন। মুজিব ও আওয়ামী-বাকশালীরা রুশ-ভারত বলয়ের তাবেদার হয়ে রাজনীতি করেছে কিন্তু জিয়ার রাজনীতি হবে সবাইকে খুশি করে ক্ষমতার রাজনীতি। ডান, বাম, মধ্যপন্থীদের সমন্বয়ে যে সংমিশ্রণের রাজনীতি তিনি করতে চলেছেন তার নব্য পরামর্শদাতাদের প্ররোচনায় সেই ঘূর্ণিপাকেই একদিন তার করুণ পরিণতি ঘটবে। নীতি-আদর্শের রাজনীতি করার জন্যই আমরা দীর্ঘদিনের পরিশ্রমে গড়ে তুলেছিলাম সামরিক বাহিনীতে মজবুত সংগঠন সেনা পরিষদ। একই সাথে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে পরীক্ষিত সমমনা নেতা-কর্মীদের একত্রিত করে শক্ত ভিত্তির উপর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করে আপোষহীন বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধমে ‘৭১ এর চেতনা আর স্বপ্নকে ধাপে ধাপে বাস্তবায়িত করে তুলতে চেয়েছিলাম জিয়ার নেতৃত্বে তারই সম্মতিক্রমে। কিন্তু আমাদের সব ত্যাগ-তিতিক্ষার পিঠে ছোরা মেরে ভুলপথে চলেছেন আজকের জিয়া। তুমি দেখবে, তার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি বাধ্য হয়েই রাজনীতিতে ব্যাপকভাবে দুর্নীতির প্রচলন করবেন যাতে তার নানা মতের নানা মুনিদের বেশিরভাগ পদলেহী ‘জি হুজুরে’ পরিণত হতে বাধ্য হয়। জিয়ার সব অন্যায়কে মেনে নিয়ে কান ধরে ওঠবস করবে ঐ সব চাটার দল প্রতিবাদের ভাষা হারিয়ে। ঠিক যেমনটি করেছিলো জেনারেল আইয়ুব খান, ভুট্টো, সুহার্তো, রেজা শাহ্‌ পেহলভী, মবুতু, পিনোচেট, মারকোস-এর মতো Despotic নেতারা। অবশ্য তিনি নিজের ইমেজ বানিয়ে রাখবেন ধোয়া তুলসী পাতা করে। কি জানো পাশা, স্বচ্ছ রাজনৈতিক আদর্শ, সর্বত্যাগী নেতৃত্বের অধীনস্থ একটি সুশৃঙ্খল শক্তিশালী দল এবং পরীক্ষিত কর্মীবাহিনী ছাড়া দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনও মহৎ কল্যাণকর রাজনৈতিক উদ্দেশ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। তিনি যদি তার ওয়াদার বরখেলাপ না করে আমাদের সঙ্গেই থাকতেন তাহলে আল্লাহ্‌র রহমতে আমরা আমাদের অভীষ্ট লক্ষে পৌঁছাতে পারতাম। জিয়ার আগামী দিনের রাজনীতিতে এই তিনটি উপাদানের একটিও থাকবে না, থাকা সম্ভব নয়। কারণ করাচীতে বড় হয়ে ওঠা জিয়ার সাথে বাংলাদেশের মাটি-মানুষের কোনও সম্পর্ক কখনোই গড়ে ওঠেনি। পূর্ব পাকিস্তানের রাজনীতির ধারাবাহিকতার সাথে সম্পৃক্ততা তো দূরের কথা, তিনি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেয়া একজন সন্তান হিসাবে রাজনীতি থেকে নিজেকে সযত্নে সরিয়ে রেখেছেন বরাবর নিজের ভবিষ্যৎ ক্যারিয়ারের কথা স্মরণে রেখে। পরে হয়েছিলেন সেনাবাহিনীর অফিসার।
বিপরীতে আমরা সবাই কমবেশি ছাত্রজীবন থেকেই জাতীয় এবং ছাত্র রাজনীতির সাথে ছিলাম এবং জড়িত। আমাদের অনেকেরই জন্ম হয়েছে রাজনৈতিক, সচ্ছল বনেদী পরিবারে। ‘৭১ সালে কালুরঘাট থেকে প্রচারিত স্বাধীনতার ঘোষণার আগ পর্যন্ত জিয়ার তেমন কোনও পরিচিতি ছিল না সামাজিকভাবে বাংলাদেশের জনগণের কাছে। কিন্তু সেনাবাহিনীতে যোগদানের আগেই আমাদের কমবেশি একটা পরিচিতি সমাজের সব মহলেই রয়েছে। তাছাড়া আমাদের উপর নির্ভর করে তাকে রাজনীতি করতে হবে এটাও তার জন্য হীনমন্যতার একটি কারণ হলেও হতে পারে।
অবশ্যই হতে পারে। শিশুভাই আমাদের সবারই প্রিয়জন, কিন্তু তিনি আমাদের ফিরিয়ে নেবার জন্য জিয়ার কেনো আরও কিছু সময় প্রয়োজন সে সম্পর্কে যেই যুক্তিটা দিলেন তাতে আমি কিন্তু খুব একটা convinced হতে পারিনি। তিনি বললেন, এই মুহূর্তে আমাদের ফিরিয়ে নিতে হলে রশিদ আর ফারুককেও ফিরিয়ে নিতে হবে। যেহেতু তারা দুইজনই সেনা পরিষদের রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত নয় সেইক্ষেত্রে সংঘর্ষ অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। তাই অল্প কিছুদিনের মধ্যে জিয়া নিজের অবস্থানকে সুদৃঢ় করার পর তাদের বিচ্ছিন্ন করে তিনি আমাদের ফিরিয়ে নেবেন।
হ্যাঁ, তুমি ঠিকই বলছ। এটা একটি খোঁড়া যুক্তি। কারণ, রশিদ আর ফারুক কিন্তু কখনোই বলেনি তারা জিয়া বা আমাদের সাথে রাজনীতি করবে না। তবে শিশুভাই কিন্তু শুরুতেই বলেছিলেন, জিয়া আমাদের কি বলতে বলেছেন তিনি ঠিক তাই বলবেন সেটা যাতে আমরা তার নিজস্ব ভাষ্য বলে ভুল না করি। এখনঅব্দি যা কিছুই আমরা আলাপ করলাম তার সঠিকতা কতটুকু সেটা সম্পর্কে নিশ্চিত হবার জন্য আমাদের আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হবে ধৈর্যের সাথে। কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছে যাবো বেনগাজী। ইতিমধ্যেই তরুণরা আর মেয়েরা বিমানবালাদের সাথে অন্তরঙ্গ সম্পর্ক কায়েম করে ফেলেছে। তারা ককপিটে নির্দ্বিধায় যাওয়া আসা করছে। দুই তরফ থেকেই সাধারণভাবে ব্যবহৃত কিছু শব্দ ও বাক্য শেখাবার চেষ্টা চলছে। অন্তরঙ্গ পরিবেশে চলেছি অজানার উদ্দেশ্যে। অল্পক্ষণ পরেই পাইলট জানান দিল, ১০ মিনিটের মধ্যেই আমরা বেনগাজী আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে অবতরণ করবো। পুরো সফরকালে ক্যাপ্টেনসহ ককপিট এবং কেবিন ক্রুরা ক্ষণে ক্ষণে এসে খোঁজ নিচ্ছিলেন কোনও অসুবিধে হচ্ছে কিনা। বিমানক্রুরা সবাই সালেমকে বিশেষ সমীহের সাথেই সম্মান দেখাচ্ছিলেন। তাদের ব্যবহার থেকেই স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল পদমর্যাদায় সালেম একজন লেফটেন্যান্ট হলেও তার আসল ওজনটা ঐ পদবির চেয়ে অনেক বেশি। প্লেন ল্যান্ড করলো।
বেনগাজী বিমানবন্দরটি বেশ বড়, আধুনিক এবং পরিষ্কার পরিছন্ন। ট্যাক্সিং এর সময় যায়গায় যায়গায় বেশ কয়েটি জঙ্গিবিমান দেখলাম কংক্রিটের হ্যাঙ্গারে রাখা রয়েছে। সবই প্রায় রাশিয়ার মিগ গোত্রের। বেশ কয়েকটা হেলিকপটার গানশিপও দেখলাম ক্যামোফ্লেজড অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। উড়ো জাহাজ থেকেই দেখতে পেলাম রাষ্ট্রীয় অতিথিদের উষ্ণ সম্বর্ধনা দেবার জন্য লাল গালিচা বন্দোবস্ত করা হয়েছে। আর্মি ব্যান্ড, গার্ড অফ অনার দেবার জন্য চৌকস একটি সেনা Contingent সারিবদ্ধ অবস্থায় দাড়িয়ে আছে টারম্যাকে। অতিথিদের মোয়াম্মর গাদ্দাফির তরফ থেকে স্বাগত জানাবার জন্য স্বয়ং উপস্থিত হয়েছেন মেজর সুলাইমান। তিনি বেনগাজি এলাকার প্রজাতন্ত্রের Revolutionary Command Council এর সর্বোচ্চ কর্তাব্যক্তি। সালেম জানালেন, ‘মোয়াম্মর’ মানে ‘প্রিয় নেতা।’ জাতির প্রিয় নেতার সামরিক পদবি কর্নেল, ফলে লিবিয়া প্রজাতন্ত্রে অন্য সবার সর্বোচ্চ পদবি মেজর অব্দি। সালেম আরও জানালেন, ক্ষমতার শীর্ষে মোয়াম্মর গাদ্দাফির পরেই দ্বিতীয় স্থানে অবস্থান করছেন মেজর সুলাইমান। Revolutionary Command Council এ কর্নেল মোয়াম্মর গাদ্দাফির পরই তার স্থান। তিনি বেনগাজীর গভর্নর এবং সামরিক বাহিনী প্রধান। ত্রিপলি দেশের রাজধানী হলেও বেনগাজী শহর শুধু বৃহত্তমই নয়, সব বিবেচনায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রাজধানীতে প্রচুর বিদেশীদের অবস্থান, তাছাড়া সব দূতাবাসও সেই শহরে অবস্থিত বিধায় নিরাপত্তার জন্যই বেনগাজীতেই আমাদের রাখার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। আমাদের প্লেনটি পূর্বনির্ধারিত স্থানে এসে দাড়াল। প্লেনের দরজা খোলার পর প্লেনের দরজা থেকে টারম্যাক-এ বিছানো লালগালিচা পর্যন্ত আর একটা লাল কার্পেট বিছিয়ে দেয়া হল। নিচে চৌকস সেনা Contingent, সামনে মেজর সুলাইমানের পাশে পদবী অনুযায়ী আরও ৮-১০ জন সেনাসদস্য ও বেসামরিক পদস্থ কর্মকর্তারা সারিবদ্ধ ভাবে দাড়িয়ে। মেজর সুলাইমানের ইশারায় ক্ষুদে ছেলেমেয়েদের একটি দল হাতে ফুলের স্তবক নিয়ে এসে দাড়ালো সিঁড়ির কাছে সুশৃঙ্খল ভাবে সারিবদ্ধ হয়ে। এরই মধ্যে সালেম সিভিল ড্রেস পাল্টে আর্মি ইউনিফর্ম পরে নিয়েছেন। তিনিই প্রথমে নেমে মেজর সুলাইমানকে স্যালুট করে কচি-কাঁচাদের দলের পুরোভাগে অবস্থান নিলেন। এরপর তার ইশারায় আমরা একে একে অবতরণ করলাম। প্রতেকের হাতে একটি করে ফুলের তোড়া দিয়ে সালাম জানিয়ে স্বাগত জানাল লিবিয়ার ভবিষ্যতের ক্ষুদে নাগরিকরা। সালেম, মেজর সুলাইমান এবং তার সাথীদের সাথে আমাদের প্রত্যেককে পরিচয় করিয়ে দিলেন। সবাই আরবি কায়দায় আমাদের বুকে বুক মিলিয়ে অভিবাদন জানালেন। এরপর আমরা সবাই যার যার জায়গাতে অবস্থান নেবার পর Contingent Commander এর নির্দেশে গার্ড অফ অনারের মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় আমাদের স্বাগত জানানো হল। ব্যান্ডে বেজে উঠল বাংলাদেশের এবং লিবিয়ার জাতীয় সঙ্গীত। আমরা প্রথা মতো অভিবাদন গ্রহণ করলাম। যখন জাতীয় সঙ্গীত বাজছিল ব্যান্ডে, এক অপূর্ব মূর্ছনায় পুলকিত হয়ে উঠেছিল আমাদের মন। মার্চপাস্ট করে চলে গেল Contingent এবং ব্যান্ডপার্টি। সঙ্গেসঙ্গেই একটি গাড়ীর বহর এসে উপস্থিত হল আউট রাইডার সহ। সব কয়টাই মারসেডিজ বেঞ্জ। সামনে পেছনে BMW মোটর সাইকেল এর আউট রাইডারস এবং এস্করট। নিখুঁত ব্যবস্থা। গাড়ীর বহর ধীরগতিতে এগিয়ে চললো এয়ারপোর্ট থেকে হোটেল ওমর খৈয়ামের উদ্দেশ্যে। সেটাই ছিল তখন বেনগাজীর একমাত্র পাঁচ তারকা বিশিষ্ট হোটেল। সেখানেই প্রাথমিকভাবে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে, জানিয়েছিলেন সালেম। হোটেলকে আরবি ভাষায় বলা হয় ‘ফন্দুক।’ ভূমধ্যসাগরের কোল ঘেঁষে অতি মনোরম পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে ঐতিহ্যবাহী হোটেল ওমর খৈয়াম। সর্বোচ্চ দু‘টি তলা আমাদের জন্য সুরক্ষিত করা হয়েছে। রাষ্ট্রীয় অতিথিদের নিরাপত্তা ও আনুষঙ্গিক অন্যসবও নিখুঁত ভাবেই করা হয়েছে আর্মির তত্ত্বাবধানে। মেজর সুলাইমানের আগমনে হোটেল কর্তৃপক্ষ তটস্থ হয়ে পরলো। সুলাইমান ম্যানেজারের সাথে ঘুরে সব ব্যবস্থা পরিদর্শন করে আমাদের সাথে এসে যোগ দিলেন চা-নাস্তার বিশেষ আয়োজনে।তিনি আশা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের অবস্থান সফল এবং আনন্দদায়ক হউক। অতি বিনীতভাবে বললেন, আমরা যেন লিবিয়াকে নিজের দেশ বলেই আপন করে নেই। অতি স্বল্পভাষী এত বড় মাপের নেতার বিনয় এবং আন্তরিক উষ্ণতা আমাদের মন ছুঁয়ে গেল। পরে গণচীনেও অভিজ্ঞতা হয়েছিল, যিনি যত বড় মাপের নেতা ততই তিনি বিনয়ী। চা পর্ব শেষে ফিরে যাবার সময় তিনি বললেন, সালেম এখন থেকে আমাদের দেখাশোনার জন্য ২৪ ঘন্টাই আমাদের সাথেই থাকবেন। তিনি আরও জানালেন, অল্প কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের উপযুক্ত বাসস্থানে স্থানান্তরিত করা হবে। বিদায় নিয়ে চলে গেলেন মেজর সুলাইমান। এরপর ম্যানেজার ও তার স্টাফরা আমাদের পূর্বনির্ধারিত স্যুইটগুলোতে নিয়ে গেলেন। সালেমের জন্যও একটি স্যুইট বরাদ্দ করা হয়েছে। তিনি বললেন, সন্ধ্যার পর আমাদের তিনি শপিং-এ নিয়ে যাবেন প্রয়োজনীয় কেনাকাটার জন্য। এখন আমাদের দীর্ঘ সফরের পর বিশ্রাম প্রয়োজন। বিশাল আফ্রিকা মহাদেশের দু‘টি মুসলিম অধ্যুষিত বৃহত্তম দেশ সুদান এবং লিবিয়া। তেল, গ্যাস ছাড়াও মূল্যবান খনিজ ও ধাতব সম্পদের ভাণ্ডার দেশ দু’টি। তাই পশ্চিমা শক্তিগুলোর শ্যেনদৃষ্টি দেশ দু’টির উপর বিশেষ করে লিবিয়ার উপর। কারণ, বিপ্লবী নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফি পাশবিক শক্তির দম্ভে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বজোড়া নিষ্পেষণ ও শোষণের বিরুদ্ধে সাহসিকতার সাথে সোচ্চার। একই ভাবে মধ্যপ্রাচ্যের বিদেশী অপশক্তিগুলোর তল্পিবাহক বাদশাহী এবং আমিরাতির কঠোর সমালোচক বিধায় পশ্চিমা জগতের চক্ষুশূল। তাছাড়া এই বিপ্লবী নেতা পৃথিবীর যেকোনো জাতির সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী মুক্তিসংগ্রামে তাদের পাশে নির্ভীক ভাবে দাড়ান সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার হাত বারিয়ে। এটাও আগ্রাসী লোভী সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর গাত্র জ্বালা। তাই তার বিরুদ্ধে করা হয় ঐক্যবদ্ধ অপপ্রচার এবং প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র। কিন্তু সাহসী এই বিপ্লবী বীর সবকিছুর মোকাবেলা করেই তার নীতি-আদর্শে অটল থেকে দেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। সুদান, কেনিয়া, চাদ, নাইজেরিয়া, মরক্কো, ইথিওপিয়া, মোজাম্বিক, ক্যামেরুন, ইরিত্রিয়া, ইয়েমেন, কঙ্গো, লেবানন, ফিলিস্তিন, দক্ষিণ আফ্রিকা, জাম্বিয়া, উগান্ডা, বসনিয়া, চেচনিয়া, সোমালিয়া, আলজেরিয়া, ইরিত্রিয়া, আয়ারল্যান্ড, মিন্দানাও, মোজাম্বিক-এর স্বাধীনতা সংগ্রামে গাদ্দাফির অবদান চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে বিশ্বের মুক্তিকামী জনগোষ্ঠীর হৃদয়ে। এই সমস্ত স্বাধীনতা সংগ্রামী অনেক নেতার সাথেই ঘনিষ্ঠতা এবং বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিলো লেখকের। মুসলিম জাহানের দুর্নীতি পরায়ণ আমীর-বাদশাহদের কাছেও তার প্রগতিশীল চিন্তা-চেতনা ছিল ভীতির কারণ। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর সক্রিয় সাহায্যে ফিকরাবাজির সৃষ্টি করে মুসলিম বিশ্বের বিভক্তিকরণের ষড়যন্ত্রের ঘোর বিরোধী গাদ্দাফি আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন সারা দুনিয়ার মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করার। সেই উদ্যোগও গ্রহণযোগ্য ছিল না পশ্চিমা শক্তিগুলোর উপর নির্ভরশীল স্বৈরশাসক আমীর-বাদশাহদের কাছে। পাকিস্তান কোন দিনই পারমাণবিক শক্তি হতে পারতো না যদি মোয়াম্মর গাদ্দাফি মুক্ত হস্তে আর্থিক সাহায্য না করতেন। মরু অঞ্চলের দেশগুলোতে প্রচণ্ড তাপদাহে দিনের বেলায় রাস্তাঘাটে, বাজারে এমনকি অফিস আদালতেও তেমন একটা লোক সমাগম হয় না। শহর জীবন্ত হয়ে ওঠে আসরের পর। ঝিমিয়ে থাকা শহর পড়ন্ত বিকেল থেকেই প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। সব কিছুই খোলা থাকে রাত ১০-১২টা পর্যন্ত। আমাদের প্রতিটি স্যুইট থেকেই দেখা যায় Outer anchorage এ নোঙ্গর করা বিভিন্ন আকারের সামুদ্রিক জাহাজগুলো। এত বড় অভাবনীয় সম্পদের অধিকারী দেশ লিবিয়ার লোকসংখ্যা তখন ছিল মাত্র ২০ লক্ষ। তাই প্রতিটি নাগরিকের চাহিদা অতি হজেই মিটিয়ে চলেছিল বিপ্লবী সরকার। জনগণ ছিল খুশি এবং সন্তুষ্ট। কাছেই শহরের সবচেয়ে বড় Shopping Mall. আরবী ভাষায় ‘সুখ’। যথাসময় সালেম এসে গেলো। আমরাও তৈরি হয়েই ছিলাম। দীর্ঘ সফরের ক্লান্তি বিশ্রাম নেয়ায় কেটে গেছে, সবাই ফ্রেশ। গাড়ীর বহরে গিয়ে বসলাম সবাই। সাথে এস্করট। পথ দেখিয়ে চলেছে আউট রাইডারস। প্রশস্ত আধুনিক হাইওয়ে, স্কাই স্ক্র্যাপারস, দোকানপাট, অফিস আদালত, বাড়িঘর সবি প্ল্যানড। উজ্জ্বল আলোয় ঝলমল করছে পুরো শহর। Shopping Mall গুলোর সব দোকানেই রয়েছে বিশ্বের নামিদামি বুটিক। কার পার্কিং-এ দেখলাম সব নামিদামি গাড়ীর সারি। তবে লক্ষ করলাম স্থানীয় পুরুষ বাসিন্দাদের বেশিরভাগের পরনে ‘তুপ।’ বাংলায় যাকে বলা চলে আলখাল্লাহ। এই লেবাস সমস্ত আরবদেশের অধিবাসীদের মধ্যেই পরার চল রয়েছে। মেয়েরা ফ্যাশনেবল বোরকা পরিহিত। কেউ আবার নামিদামি বুটিকের শালীন ড্রেসের সাথে মাথায় ম্যাচিং স্কার্ফ পরে চলাফেরা করছে। অশ্লীল কাপড় পরা কোনও মেয়ে কিংবা মহিলা চোখে পরলো না। সালেম বললেন, প্রয়োজন আর পছন্দমত কাপড়-চোপড় এবং নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে নিন সবাই। কেনাকাটার খোলা ছুট দেয়া হলেও আমরা সংযতভাবেই সবাই ন্যূনতম যা কিছু প্রয়োজন তাই পছন্দ করে কিনলাম। কেনাকাটা শেষে ফিরে এলাম হোটেলে। ফেরার পর সালেমের অনুরোধে সবাই এক বৈঠকে বসলাম। প্রথমেই সালেম আমাদের প্রত্যেককে একটি কাগজের প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে সংক্ষিপ্তভাবে লিবিয়ার ইতিহাস তুলে ধরলেন আমাদের অবগতির জন্য। প্রাচীন ইতিহাসে দেখা যায়, লিবিয়া সুদীর্কাল বিভিন্ন শক্তির দ্বারা শাসিত হয়েছে। ১৫৫১ সাল থেকে দেশটি অটোম্যান শাসনাধীনে ছিল। তুরস্ক দুর্বল হয়ে পড়ার সুযোগে ১৯১১ সালে ইতালি লিবিয়ার এক অংশ দখল করে। ঔপনিবেশিক দখলদারির বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম লিবিয়ার এক নেতা ওমর মোখতার বিদ্রোহ করেন। তিনি ছিলেন কুরআন শিক্ষক, কিন্তু যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী। ২০ বছর ইতালির বিরুদ্ধে লড়াই করেন তিনি। কয়েকটি যুদ্ধে ইতালীয়রা তাঁর কাছে পরাজিত হয়। এক যুদ্ধে তিনি আহত হওয়ার পর ১৯৩১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর ইতালীয়রা তাঁকে আটক করতে সক্ষম হয়। তড়িঘড়ি করে আয়োজিত প্রহসনের বিচারের পর ১৬ সেপ্টেম্বর তাঁকে তারা ফাঁসিতে ঝুলিয়ে হত্যা করে। তারপর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ইতালির পরাজয়ের পর লিবিয়া ব্রিটিশ ও ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। ১৯৫১ সালের ২৪ ডিসেম্বর লিবিয়া স্বাধীনতা লাভ করে। ক্ষমতায় আসেন বাদশাহ ইদ্রিস। সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় বাদশাহ ইদ্রিস লিবিয়াতে সাম্রাজ্যবাদ কায়েম করেন। এর অনেক বছর পর লিবীয় সামরিক বাহিনীর কিছু তরুণ অফিসার ১লা সেপ্টেম্বর ১৯৬৯, মোয়াম্মর গাদ্দাফির নেতৃত্বে এক সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে ইসলামিক প্রজাতন্ত্রী লিবিয়া কায়েম করে। এরপর থেকে দেশ পরিচালিত হচ্ছে Revolutionary Command Council এর নেতৃত্বে। ওমর মোখতারকে লিবিয়ার ‘জাতীয় বীর’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। তার নামে মুদ্রা ও ডাকটিকেট ছাপা হয়। আজঅব্দি লিবিয়াবাসী শ্রদ্ধার সাথে তাকে স্মরণ করে থাকে। দেখি, আমাদেরকে দেয়া কাগজের মোড়কে মোয়াম্মর গাদ্দাফির লেখা সারাবিশ্বে বহুল ভাবে পরিচিত এবং পঠিত ‘গ্রীনবুক’ এর দুটি খণ্ড রয়েছে। এতে তিনি সংক্ষিপ্তভাবে বিপ্লবের পটভূমি, নীতি-আদর্শ, বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের বীরগাথা, লক্ষ্য, কি করে লিবিয়াকে একটি স্বনির্ভর, আত্মমর্যাদাশীল দেশ ও জাতি হিসাবে প্রগতির পথে ধাপে ধাপে এগিয়ে নেয়া সম্ভব তার কর্মসূচি সম্পর্কে বিস্তারিত কিন্তু অতি সরলভাবে লিখেছেন। মোটকথা, এই গ্রীনবুকের মধ্যে বর্ণিত রয়েছে বিপ্লবী কমান্ড কাউন্সিলের রাজনৈতিক দর্শন, রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সমাজ ব্যবস্থা, রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মধ্যে আদর্শিক সমন্বয়, রাষ্ট্র এবং দেশবাসীর পারস্পরিক সম্পর্ক এবং দায়িত্বের বিষয়ের সবকিছুর সারবস্তু। সালেম জানাল
গ্রীনবুক এর খন্ড দুটো পড়ার পর আমরা এই বইয়ের বিষয়বস্তু এবং বাংলাদেশ এবং আপনাদের বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান সম্পর্কে মতবিনিময় করতে ইচ্ছুক যদি আপনারা সম্মত থাকেন।
অতি উত্তম প্রস্তাব, আমরাও দ্বিপাক্ষিক অভিজ্ঞতা নিয়ে মত বিনিময় করতে একই ভাবে উদগ্রীব।
বৈঠক শেষে তিনি বিদায় নেবার আগে আশা প্রকাশ করে জানালেন, এক সপ্তাহের আগেই সম্ভবত আমরা সুরক্ষিত এলাকাতে ইন্ডিপেন্ডেন্ট ফ্ল্যাটে চলে যেতে পারবো। সালেম চলে যাবার পর প্যাকেট খুলে দেখলাম গণচীনের বিপ্লবের পর ছাপা চেয়ারম্যান মাও সে তুং- এর লেখা চীন বিপ্লবের নির্যাস হিসাবে প্রকাশিত ‘রেডবুক’ এর মতো প্রায় একই সাইজে ছাপানো হয়েছে গাদ্দাফির দুই খণ্ডের গ্রীনবুক। সাথে একটি চিরকুট আর কিছু দিনার। চিরকুটে লেখা রয়েছে, প্রতিজন প্রাপ্ত বয়স্কের জন্য মাসিক ২০০ আর বাচ্চাদের জন্য ১০০ দিনার দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে হাত খরচার জন্য, গ্রহণ করে বাধিত করবেন। সেই সময়, ১ লিবিয়ান দিনারের মূল্য ৪ ব্রিটিশ পাউন্ডেরও উপর। মানে, দিনারের উপর মুদ্রিত বীর মুক্তিযোদ্ধা ওমর মোখতারের ছবির দাম ছিল ব্রিটিশ পাউন্ডে অংকিত রানীমাতার ছবির চেয়ে তিনগুণেরও বেশি। যেখানে সব কিছুই ফ্রি সেখানে এই পরিমাণ হাত খরচা যথেষ্ট। হোটেলের অবসর জীবন, হাতে প্রচুর সময়। তাই মেয়েরাসহ যুগপৎ সিদ্ধান্ত নিলাম গ্রীনবুকের খণ্ড দু’টি যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পড়ে নিতে হবে, সাথে নোটও নিতে হবে আলোচনার সুবিধার্থে। আলোচনাকালেই গাদ্দাফির মন-মানুশিকতা, রাজনৈতিক দর্শন, মুসলিম বিশ্ব সম্পর্কে তার মূল্যায়ন, সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আগ্রাসন, নিয়ন্ত্রণ, শোষণ থেকে তৃতীয় বিশ্বের জনগোষ্ঠীর সংগ্রাম এবং মুক্তি বিশেষ করে মুসলিম জাহানের পশ্চাদপদ রাষ্ট্রসমূহ এবং জনগোষ্ঠীর ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তার কোন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা রয়েছে কিনা এ সমস্ত বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা করে নেয়া সম্ভব হবে।
সেই কালে কঙ্গোর প্যাট্রিস লুমুম্বা এবং আলজেরিয়ার বেন বেল্লাকে হত্যা করার পর এই তরুণ নেতার মধ্যেই বৈপ্লবিক ধ্যান ধারণার উপসর্গ পরিলক্ষিত হচ্ছিলো। সমগ্র মুসলিম বিশ্বে ইরাকের সাদ্দাম হুসেনের তুলনায় মোয়াম্মর গাদ্দাফি ছিলেন Comparatively more radical. তার উপর মিসরের জামাল নাসেরের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। বাকিরা ছিল দ্বিমেরু কেন্দ্রিক কোনও না কোনও বলয়ের তল্পিবাহক। পুঁজিবাদী বলয়ের মোড়ল আমেরিকা, সমাজতান্ত্রিক বলয়ের মোড়ল সোভিয়েত ইউনিয়ন। গাদ্দাফির রাজনৈতিক দর্শন মূলত ছিল ‘ইসলামিক রাষ্ট্র এবং বৈপ্লবিক সমাজ ব্যবস্থা।’ বিশ্ব-ব্রহ্মান্ডের সৃষ্টি কর্তা আল্লাহ্‌ই সর্বশক্তিমান এবং সার্বভৌম। সৃষ্টিকর্তার নির্দিষ্ট জীবন বিধানই সর্বোত্তম দর্শন ইহকাল এবং পরকালের পরিপ্রেক্ষিতে। তার মতে, মানুষের পক্ষে সৃষ্টির জ্ঞান এবং চিন্তাশক্তি কখনই স্রষ্টার সমতুল্য হতে পারে না যুক্তিসঙ্গত ভাবেই। তার মতে, ধনতন্ত্র এবং মার্ক্সসীয় সমাজতন্ত্রের মধ্যে মূলত কোনও পার্থক্য নেই। কারণ, এই দুইটি দর্শনই প্রতিক্রিয়াশীল এবং বস্তুবাদ ভিত্তিক। সমাজতন্ত্রীরা নাস্তিক আর ধনতন্ত্রীরা পথভ্রষ্ট আস্তিক। তাদের সব চিন্তা-চেতনা খুবই সীমিত। ইহজাগতিক জীবনের রিপু ভিত্তিক চাহিদাই তাদের দর্শনের ভিত্তি। আত্মিক বিষয়ে তার এই দৃঢ়বিশ্বাস ছাড়া চেয়ারম্যান মাও-এর রেডবুক এবং গাদ্দাফির গ্রীনবুকের বর্ণিত আর্থ-সামাজিক, প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, আইন বিভাগ, প্রশাসন, গণতান্ত্রিককেন্দ্রিকতার নীতি ভিত্তিক তৃণমূল পর্যন্ত প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকতার মাধ্যমে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলা, বিপ্লবী দল এবং কর্মীবাহিনী গঠন এবং দেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার স্বার্থে একটি আধুনিক সুশৃঙ্খল সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার পাশাপাশি দেশব্যাপী সমর্থ তরুণ-তরুণীদের সমন্বয়ে একটি জাতীয় মিলিশিয়া গঠনের বিষয়ে তেমন কোন বিশেষ পার্থক্য ছিল না। সাম্যবাদের দর্শনে প্রতিটি নর ও নারীর যোগ্যতা এবং কর্মক্ষমতার বিচারে সমান পরিগণিত করা এবং ধনতান্ত্রিক দর্শনে বিশাল ব্যবধানের ব্যাখ্যা কিছুটা অস্বচ্ছ ভাবেই বর্ণিত হয়েছে গ্রীন বুকে। ধনতান্ত্রিক সমাজে মানুষকে পণ্যে পরিণত করা হয়েছে প্রগতির নামে আর সাম্যবাদের বুলির আড়ালে মানুষকে পরিণত করা হয়েছে যন্ত্রে। এই ধরনের আদর্শিক কলুষতার সমালোচনা করা হয়েছে প্রচণ্ড ভাবে গ্রীনবুকে। প্রথম মহাযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে ব্রিটেন এবং ফ্রান্স সাইকস-পিকোট চুক্তির মাধ্যমে অটোম্যান সাম্রাজ্যের বিশাল অংশ নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। তারপর নিজেদের স্বার্থে তারা পাল্টে দেয় মধ্যপ্রাচ্যের মানচিত্র। সৃষ্টি করে ইরাক, সিরিয়া ও লেবানন রাষ্ট্র। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর মধ্যপ্রাচ্যের বিশাল তেল ও গ্যাসের ভাণ্ডার নিজেদের কব্জায় রাখার জন্য মূলত ব্রিটেন ও যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমা শক্তিগুলো একদিকে সৃষ্টি করে মধ্যপ্রাচ্যের বিষফোঁড়া ইসরাইলকে, অন্যদিকে কয়েকটি আশ্রিত ছোট ও মাঝারি রাজ্যকে স্বাধীন রাষ্ট্রে পরিণত করে রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্র কায়েম করে তাদের তল্পিবাহক কিছু বেদুঈন গোত্রকে ক্ষমতায় বসিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণ মজবুত করে তোলে। শুধু তাই নয়, সেই সমস্ত দেশগুলোতে ফিকরাবাজি উস্কে দিয়ে রাষ্ট্রগুলোকে দুর্বল করে ক্ষমতাসীনদের সম্পূর্ণভাবে তাদের উপর নির্ভরশীল করে রাখে। এরপর তাদের নিয়ন্ত্রণ আরও পাকাপোক্ত করার জন্য ফিলিস্তিন রাষ্ট্রকে দ্বিখণ্ডিত করে ইসরাইল নামে একটি ধর্মভিত্তিক ইহুদী রাষ্ট্র কায়েম করে। পশ্চিমা শক্তির উপর নির্ভরশীল আঞ্চলিক রাষ্ট্রপতিরা এর বিরোধিতা না করে নীরবে ইসরাইলের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেয়। এই বিষফোঁড়া সৃষ্টির একটি মাত্র কারণ ছিল গোপনে ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর একটি রাষ্ট্রে পরিণত করে মধ্যপ্রাচ্যের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোকে পশ্চিমাদের স্বার্থের অনুকূলে পদানত করে রাখা। আমেরিকাই ইসরাইলকে পারমাণবিক শক্তিধর রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করেছিলো। ফিলিস্তিনি জনগণ এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রায় এককভাবেই স্বাধীনতার যুদ্ধে লিপ্ত হয়। গত শতকে ‘৪০, ‘৬০ ও ‘৭০-এর দশকে ইসরাইলের সাথে আরবদের তিনটি যুদ্ধ হয়। এরপরই মধ্যপ্রাচ্যের জনগোষ্ঠী বুঝতে পারে যতদিন ইসরাইল নামক বিষফোঁড়াকে উৎপাটন করা সম্ভব না হবে ততদিন এই অঞ্চলে স্থিতিশীলতা আসবে না এবং এই অঞ্চলের বিশাল খনিজ সম্পদের ভাণ্ডার পশ্চিমাদের কব্জা থেকে নিজেদের নিয়ন্ত্রণে আনাও সম্ভব হবে না। পারমাণবিক প্রযুক্তির অধিকারী তখন মাত্র ৪ টি দেশ। আমেরিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং ফ্রান্স। পারমাণবিক প্রযুক্তি মধ্যপ্রাচ্যের কোনও দেশকেই দিতে অসম্মতি জানায় ৪ টি দেশই। গণচীনের নেতা চেয়ারম্যান মাও সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছে পারমাণবিক প্রযুক্তি চেয়ে ব্যর্থ হবার পর সোভিয়েত ইউনিয়নকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী দেশ হিসাবে আখ্যায়িত করেন এবং গণচীন ‘কম্যুনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল’ থেকে বেরিয়ে আসার ফলে বিশ্বজোড়া কম্যুনিস্ট আন্দোলনও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে।পরে ১৯৬৪ সালে চীন পারমাণবিক শক্তির অধিকারী হয়। এদিকে ‘৭০ দশকের গোড়ায় পাকিস্তানের জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো সৌদি আরবের বাদশাহ ফয়সাল, ইরানের রেজা শাহ পেহলভি এবং লিবিয়ার মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে প্রস্তাব দেন যে প্রয়োজনীয় আর্থিক যোগান পেলে পাকিস্তান সারাবিশ্বের চোখে ধুলো দিয়ে মুসলিম জাহানের স্বার্থে পারমাণবিক প্রযুক্তি হাসিল করে ‘ইসলামিক বম্ব’ বানাতে সক্ষম। তার ঐ প্রস্তাবে তিনজনই আকৃষ্ট হন। তবে গাদ্দাফিই সবচেয়ে বেশি উৎসাহিত হয়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে আর্থিক সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলেন। আর্থিক সহযোগিতা নিশ্চিতকরণের পরই পাকিস্তান গোপনে আণবিক বোমা তৈরির কর্মসূচি গ্রহণ করে। অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে, অনেক আত্মত্যাগের পর পরিশেষে যখন চিরশত্রু ভারত পরীক্ষামূলক পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়ে সদম্ভে জানান দেয় যে ভারত একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ তখন জবাবে পাকিস্তানও সমস্ত পৃথিবীকে চমকে দিয়ে নিজেকে একটি পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে নিজের আত্মপ্রকাশ ঘটাতে সক্ষম হয় সফল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে। একই সাথে পাকিস্তান ঘোষণা করে, পাকিস্তান শুধু পারমাণবিক শক্তির অধিকারীই নয়, বিভিন্ন পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রেরও অধিকারী। জনাব ভুট্টোর জাতীয় রাজনীতির সাফল্য এবং ব্যর্থতার বিষয়টি বিতর্কিত হলেও একটি সত্য মানতেই হবে- সেটা হল ‘ইসলামিক বম্ব’-এর স্বপ্নদ্রষ্টা ছিলেন জনাব জুলফিকার আলি ভুট্টো। তবে অদৃষ্টের নিষ্ঠুর পরিহাসের বিষয় হচ্ছে, যে সমস্ত দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়কদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় মুসলিম রাষ্ট্র পাকিস্তান একটি পারমাণবিক শক্তির অধিকারী রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় তারা পরবর্তীকালে বিভিন্ন কাকতালীয় ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন। ভুট্টোকে ঝুলতে হয় ফাঁসিকাষ্ঠে, বাদশাহ ফয়সল নিজের দরবারে তার ভাতুষ্পুত্রের গুলিতে নিহত হন, শাহ পেহলভিকে করুণ ভাবে দেশান্তরিত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করতে হয়। সর্বশেষে, লিবিয়ার বিক্ষুব্ধ জনতা নৃশংসভাবে হত্যা করে মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে। বিশ্ব মোড়লরা কখনোই এই ধরনের ধৃষ্টতা মাফ করে না পোষ্য পদলেহিদেরও। বিশ্বের আবিষ্কৃত এবং অনাবিষ্কৃত প্রাকৃতিক এবং খনিজ সম্পদের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে মুসলিম অধ্যুষিত অনুন্নত দেশগুলোর মাটির নিচে। সেক্ষেত্রে বিশ্ব এবং আঞ্চলিক মোড়লরা শংকিত হয়ে সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাকিস্তান নামক দেশটিকে ধ্বংস করার এক সুদূর প্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়নের লক্ষ্যে। এই বাস্তবতার মোকাবেলা পাকিস্তান কি করে করবে সেটা ভবিষ্যৎই বলবে। এক সময় সালেম জানিয়ে গেলেন দু’ একদিনের মধ্যেই বাংলাদেশের চার্জ দ্য এফেয়ারস জমির, বাংলাদেশ সরকারের হুকুমে সস্ত্রীক ত্রিপলি থেকে আসছেন আমাদের সাথে দেখা করে খোঁজ-খবর নিতে। জমির এবং তার স্ত্রী আমার ও নিম্মির পূর্বপরিচিত হলেও তেমন কোনও ঘনিষ্ঠতা ছিল না। সালেম আরও জানালেন, আমাদের শিফটিং এর পরই দ্বিপাক্ষিক আলোচনার মাধ্যমে লিবিয়ার বিপ্লব, গাদ্দাফির নীতি-আদর্শের আলোকে কি করে দেশ ও জাতিকে এগিয়ে নেয়া হচ্ছে Revolutionary Command Council-এর নেতৃত্বে এই সব বিষয়ে মত বিনিময় হবে। বাংলাদেশ সম্পর্কেও তারা বিস্তারিত জানতে চান। পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাথে বিশ্ব উম্মাহর সম্পর্ক বিশেষ করে ভ্রাতৃপ্রতিম দেশ লিবিয়া এবং বাংলাদেশের মধ্যে কি করে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক মজবুত ভাবে গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়টি আলোচনায় বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হবে। তাছাড়া, বাংলাদেশের বিপ্লবী ভাইরা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে কি ভাবছেন, সেই ব্যাপারেও লিবীয় নেতৃত্বের আগ্রহ রয়েছে যথেষ্ট। সালেমের বক্তব্যে যথেষ্ট আন্তরিক উষ্ণতা উপলব্ধি করলাম। গাদ্দাফি ইতিমধ্যেই শুধুমাত্র আরব কিংবা মুসলিম বিশ্বেই নয়, সারা দুনিয়ায় সাম্রাজ্যবাদী শোষণ, নিপীড়ন, একই সাথে রাজতন্ত্র এবং আমিরাত-তন্ত্রের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিপ্লবী হিসাবে পৃথিবীর প্রতি প্রান্তেই এক আলোচ্য ব্যক্তিতে পরিণত হয়েছেন। তার এই বৈপ্লবিক চরিত্র সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের এবং তাদের পদলেহী বাদশাহ, আমীর এবং রাষ্ট্রনায়কদের রাতের ঘুম হারাম করে দিয়েছে। জামাল নাসেরের ধ্যান-ধারণার চেয়ে গাদ্দাফির বৈপ্লবিক চেতনা শুধু মুসলিম জগতকেই যে প্রভাবিত করেছিল তাই নয়, তৃতীয় বিশ্বের চলমান জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতার সংগ্রামগুলোও তার পৃষ্ঠপোষকতায় দুর্বার হয়ে উঠতে থাকে। এই কারণেই তখন সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর নিয়ন্ত্রণাধীন প্রচার মাধ্যম তার বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করে অপপ্রচারণা চালাতে থাকে। বিশ্বমোড়ল এবং তার সহযোগী রাষ্ট্রগুলোর সুতার টানে পরিচালিত বিভিন্ন শাসকগোষ্ঠীর কাছে গাদ্দাফি হয়ে ওঠেন এক বিপদজনক চরমপন্থী সন্ত্রাসী, বিপরীতে বৈষম্যমূলক বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের কাছে তিনি হয়ে ওঠেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে ন্যায় প্রতিষ্ঠার বিশ্ব-বিপ্লবের একজন নির্ভীক প্রতীক।
বাংলাদেশ দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স জমির এলেন সস্ত্রীক
দু’দিনের মাথায় ত্রিপোলি থেকে এসে পৌছালো জমির দম্পতি। সবার সাথে আলাপ পরিচয়ের পর জমির জানালো, অনেক আগেই তার আসার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু হয়ে ওঠেনি। এখন নাকি তাকে নির্দেশ দেয়া হয়েছে নিয়মিত আমাদের দেখাশোনা করার জন্য। জিয়া সিদ্ধান্ত নিয়েছেন প্রতিজনকে ১০০ দিনার করে মাসিক ভাতা দেবার। এটা থেকেই কিছুটা আভাস পাওয়া গেলো আমাদের লিবিয়াতে অবস্থানের সময়টা প্রলম্বিত হতে পারে। জমির ও জেরিন দম্পতি দেখতে ভালো এবং মার্জিত রুচিশীল। অল্প সময়েই আপন করে নিলো সবাইকে। দুপরের খাওয়া সেরে সবাই বসলাম গল্পের আসর জমাতে। লিবিয়াতে পান পাওয়া যায় না, তবে লন্ডন থেকে পানের সব সরঞ্জাম আনানোর ব্যবস্থা করে নিয়েছে ইতিমধ্যে মেয়েরা সালেমের মাধ্যমে। পানের ডালি দেখে জমির দম্পতির চক্ষু চড়কগাছ! আপনারাতো বাদশাহী স্টাইলেই আছেন দেখছি।
যা দেখছেন সব কিছুই রাব্বুল আলামিনের কৃপায় আর মোয়াম্মরের বদান্যতায়। কেউ একজন বলে উঠলো
জমির ভাই, বলেন দেশের খবরাখবর কি? আপনাদের সাথে দেশের যোগাযোগ নেই? মেহমান হয়ে এতদূর থেকে কতুকুই বা জানা সম্ভব।
তা বটে। আমি আপনাদের আমার জানামতো গুরুত্বপূর্ণ খবরগুলো জানাচ্ছি। ফিরে গিয়ে আমি দেশের খবরের কাগজ পাঠাবার ব্যবস্থা করব। পাশা ও নূরের সাথে চোখাচোখি হলে দুইজনই স্মিত হেসে পাশা সিগারেট ধরাতে আর নূর তার পাইপে তামাক ঠেসে অগ্নিসংযোগে মন দিয়ে জমিরের কথা শোনার জন্য তৈরি হল। ভায়রা দুইজনই বিদায় নিয়ে নির্বিকারভাবে বেরিয়ে গেলো। জমির শুরু করলেন
জাস্টিস সায়েমকে সরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়া নিজেই এখন চীফ মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটরের দায়িত্ব পালন করছেন। কর্নেল তাহের এবং তার তিন ভাইসহ জাসদের শীর্ষপর্যায়ের নেতৃবৃন্দকে বন্দী করা হয়েছে। দেশের সামরিক বাহিনীতে বিশৃঙ্খলা, অফিসার নিধন আর ভারতীয় রাষ্ট্রদূত সমর সেনের উপর সশস্ত্র হামলার দায়ে কর্নেল তাহেরের বিরুদ্ধে স্পেশাল ট্রাইব্যুনালে বিচার শুরু হয়েছে। স্পেশাল ট্রাইব্যুনালের প্রেসিডেন্ট হিসাবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগত অফিসার জেনারেল জিয়ার কোর্সমেট ব্রিগেডিয়ার ইউসুফ হায়দারকে। মনে করা হচ্ছে, তাহেরের ফাঁসি হবে আর অন্যদের বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হবে। ক্ষণে ক্ষণে ক্যাণ্টনমেন্টে বিস্ফোরণ ঘটছে। জিয়া সে সবের মোকাবেলা করছেন দৃঢ়হস্তে। বিশৃঙ্খলাকারীরা সবাই কর্নেল তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সদস্য।
পাঠকদের এখানে ভাবতে হবে, কর্নেল তাহেরের গোপন সংগঠনের মোকাবেলা জিয়া করছিলেন কাদের সমর্থনে? জবাবটা অতি স্বচ্ছ, বিদেশে অবস্থিত সেনা পরিষদের নেতাদের নির্দেশেই জিয়াকে সর্বাত্মক সাহায্য এবং সহযোগিতা করে চলেছিলো সেনা পরিষদের সদস্যরা। বিষয়টি সেই সময় জেনারেল জিয়া এবং জেনারেল শিশু ছাড়া অন্য কেউই জানতো না। কর্নেল রশিদ এবং কর্নেল ফারুকও না। ঢাকার সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে। দেশের সেনা পরিষদের অফিসার এবং সৈনিকরা অধীর অপেক্ষায় অস্থির হয়ে পড়েছে কবে জিয়া তার ওয়াদা মোতাবেক আমাদের ফিরিয়ে আনবেন! আমরা তাদের একনাগাড়ে বুঝিয়ে চলেছি, জেনারেল জিয়া আমাদেরই একজন এবং সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত নেতা। তাই তার কথার বরখেলাপ তিনি করবেন না। প্রতিজ্ঞা তিনি অবশ্যই রক্ষা করবেন। বর্তমানের বাস্তব পরিস্থিতির মোকাবেলায় সামরিক বাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে সুশৃঙ্খল করে তোলার স্বার্থে কিছু অসুবিধার কারণে তিনি নিজেই আমাদের অনুরোধ করেছেন কিছুদিন বাইরে থাকার জন্য। আমরা তার অনুরোধ যুক্তিসঙ্গত মনে করেই বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিচলিত হবার কিংবা তার নিয়ত সম্পর্কে সন্দিহান হওয়ার কোনও কারণ নেই। সবাইকে ধৈর্যের সাথে আন্তরিকভাবে তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিতে হবে সেনা পরিষদকে। ফিরে চলি জমিরের কথায়। জমির জানালেন জিয়ার ভবিষ্যতের রাজনৈতিক ছক কাটার দায়িত্ব বর্তমানে পালন করছেন জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশু মানে আমাদের শিশুভাই। তিনিই সব কলকাঠি নাড়ছেন জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন হিসাবে। এর ফলেই নাকি রাজনৈতিক মহলে ইতিমধ্যেই তিনি পরিচিত হয়ে উঠেছেন বাংলাদেশের ‘রাজপুতিন’ হিসাবে। তার এই বক্তব্যে আমরা সবাই কৌতুক অনুভব করছিলাম। দেশবাসী না জানলেও আমরা সবাই জানতাম শিশুভাই যুদ্ধকালীন সময় থেকেই আর্মির চাকুরি ছেড়ে বিদেশে চলে যাবার চেষ্টা করে আসছেন। রাজনীতিতেও তার কোনও আগ্রহ নেই। শিশুভাই আজ বাংলাদেশের ‘রাজপুতিন!’ তিনি ঢাকার ছেলে বিধায় সবমহলেই তার কিছুটা পরিচিতি আছে। তাছাড়া তিনি আর জিয়া একই সময় পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা ISI-তে চাকুরী করেছেন। জন্মলগ্ন থেকেই ISI পাকিস্তানের রাজনীতিকে কন্ট্রোল করে এসেছে। সেই ফর্মুলাই জিয়া কাজে লাগানোর চেষ্টা করছেন। তবে আমরা যততুকু তাকে জানি তাতে শর্ত সাপেক্ষেই তিনি সাময়িকভাবে এই দায়িত্ব অনন্যোপায় হয়ে গ্রহণ করেছেন সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। সময়েতে সেটাই প্রমাণিত হবে। প্রথম সাক্ষাতের পর জমির সস্ত্রীক প্রায়ই আসতে থাকেুন। বেশীরভাগ সময় সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলো জমির দম্পতি কাটাতো আমাদের সাথে। ইতিমধ্যে ত্রিপোলিতে মোয়াম্মর গাদ্দাফি, জাল্লুদসহ অন্যান্য শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের সাথে আমাদের সাক্ষাত হয়েছে বেশ কয়েকবার। সাক্ষাতকার হতো খুবই আন্তরিক পরিবেশে। তার গ্রীনবুকসহ রাজনৈতিক দর্শন, প্রগতিশীল রাষ্ট্রীয় কাঠামো, সুষম সমাজ ব্যবস্থা, চলমান বিশ্বে সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আধিপত্যবাদী আগ্রাসন এবং চাপের মুখে অনুন্নত দেশগুলো নিজেদের স্বকীয়তা রক্ষা করে কি করে উন্নতির পথে এগুতে পারে, বিশেষ করে মুসলিম বিশ্বে কি করে ঐক্য এবং সংহতি গড়ে তোলা যায় সেই বিষয়টির উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতেন তরুণ বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফি আলোচনাকালে। আমরাও দ্বিধাহীনভাবেই সংলাপে অংশগ্রহণ করতাম। আফ্রিকাসহ পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের জনগোষ্ঠীর আত্মনিয়ন্ত্রণ এবং স্বাধীনতার সংগ্রামের প্রতি কোনরূপ ভয়-ভীতির তোয়াক্কা না করে তার আন্তরিক সার্বিক সাহায্য-সহযোগিতার ইতিহাস ছিল নির্দ্বিধায় প্রশংসনীয়। মুসলিম বিশ্বে ঔপনিবেশিক শাসকদের প্রবর্তিত রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্রের প্রকাশ্য সমালোচনা করতেন বিশাল সম্পদশালী দেশের রাষ্ট্রনায়ক গাদ্দাফি। তার মতে মুসলিম বিশ্বের বিভাজনের জন্য মূলত দায়ী এই রাজতন্ত্র এবং আমীরতন্ত্র। তার বিশ্বাস এই ফিতনাগুলোকে শেষ না করা পর্যন্ত বিশ্বের মুসলমানদের ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব হবে না। মিসরের নাসের এর ‘Pan Arabism’ এর চেয়ে ‘Pan Islamism’ এর প্রতিই তার আকর্ষণ ছিল বেশী। তার মতে প্রকৃত ইসলামে, জাত, গোত্র ও বর্ণের কোনও স্থান নেই। মোয়াম্মর গাদ্দাফিকে ঘনিষ্ঠভাবে জানার পর তাকে একজন জনদরদি, প্রগতিশীল এবং বিশ্বমানবতাবাদী হিসাবেই শ্রদ্ধার সাথেই গ্রহণ করেছিলাম আমরা অনেক বিষয়েই তার সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মতপার্থক্য থাকা সত্ত্বেও। আমাদের জানানো হয়, পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক দেশগুলো প্রথম দিন থেকেই সেপ্টেম্বর বিপ্লবকে ইতিবাচক ভাবে না দেখে নিজেদের স্বার্থে বিরূপ প্রচারণায় সোচ্চার হয়ে ওঠে। গাদ্দাফির বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গড়ে তোলার সাথে সাথে বিভিন্ন চক্রান্তমূলক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে গাদ্দাফির বৈপ্লবিক সরকারকে উৎখাতের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে তারা। লিবিয়াবাসীদের মধ্যে কায়েমী স্বার্থবাদীদের উস্কে দিয়ে নাশকতামূলক তৎপরতার মাধ্যমে Revolutionary Command Council কে অকার্যকর করে তোলার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফির প্রাণনাশের চেষ্টাও করা হচ্ছে একই সাথে। এইসব হীনচক্রান্তের নেতৃত্ব দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র এবং তাদের দোসর যুক্তরাজ্য। এ ধরনের আন্তর্জাতিক চক্রান্তের মোকাবেলার স্বার্থেই বাধ্য হয়ে গাদ্দাফিকে সোভিয়েত বলয়ের সাথে ঘনিষ্ঠতা বাড়াতে হয় মিসরের নাসের এবং ইরাকের সাদ্দামের মতো। তার বৈপ্লবিক এবং প্রগতিশীল নীতি-আদর্শের জন্য মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্রের বেশিরভাগ রাষ্ট্রপতিরাও ধনতান্ত্রিক দেশগুলোর চাপে তাকে আপন করে নিতে নারাজ যদিও সেই সমস্ত দেশের নিপীড়িত জনগণের কাছে তার গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে একজন সাহসী নেতা হিসাবে। নিরাপত্তার বিষয়টাই মুখ্য হওয়া সত্ত্বেও চলমান বিশ্বের প্রতি প্রান্তে যে সমস্ত সংগঠনই সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে নিয়োজিত তাদের প্রতি একাত্মতা জানিয়ে সব ঝুঁকি মাথায় নিয়েও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিতে দ্বিধাবোধ করছেন না তরুণ বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফি ও তার সাথী বিপ্লবীরা। তাদের সেই সাহসী উদ্যোগ এবং অবদানের ফসল আজ বিশ্বের অনেক দেশের জনগণই ভোগ করছে।
ইতিমধ্যে আমরা হোটেল ছেরে চলে এসেছি। প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে সাগরের কোল ঘেঁষে মরূদ্যানের মধ্যে অবস্থিত একটি ৪ তলা বিশাল অট্টালিকায়। সেখানে বিশটা স্বয়ংসম্পূর্ণ ফ্ল্যাট রয়েছে। সার্বিক ব্যবস্থা নিখুঁত। উঁচু প্রাচীরে ঘেরা সুরক্ষিত পুরো ভবনটি। চারিদিকে সুন্দর বাগান। টেলিফোন ইন্টারকম ব্যবস্থাও রয়েছে যোগাযোগের সুবিধার্থে। বাহির থেকে ভেতরের পরিবেশ কিছুই বোঝার উপায় নেই। সমুদ্রের ভেতরে অনেকদূর পর্যন্ত একটা সরু রাস্তা বানানো হয়েছে, মাঝে মধ্যে বসার বেঞ্চ। এটাকে Walking/Jogging Track হিসাবে ব্যবহার করা চলে। ন্যাপকিন থেকে সবকিছুই বদলে দিয়ে যায় House Keeping, গেইটে রয়েছে সার্বক্ষণিক সশস্ত্র গার্ড। পারকিং এ গাড়ীর বহর। সবার ফর্দ অনুযায়ী সব সামগ্রী চাওয়া মাত্রই পৌঁছে দেয়া হয়। আমাদের একমাত্র কাজ হচ্ছে মাঝে মধ্যে বাজারে গিয়ে ইচ্ছে মত মাছ, মাংস, শাক-সবজি এবং মশলাপাতি কিনে এনে পছন্দসই রান্না করে খাওয়া। সমস্ত বিল্ডিংটাই Centrally Air Conditioned.আমাদের প্রত্যাশার চেয়ে অনেক বেশি আরামদায়ক বাসস্থান। কোনও বিষয়েই কার্পণ্য নেই লিবীয় সরকারের পক্ষ থেকে। সালেমের জন্যও রয়েছে একটি ফ্ল্যাট। সেখানে অবস্থান করেই সালেম সব কিছুর তদারকি করছেন। আমাদের সম্পর্কটা ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্বে রূপ নিয়েছে। সালেম বিবাহিত এবং পিতাও বটে। তাই আমরা প্রায়ই ওকে বাড়িতে পাঠিয়ে দেই জোর করে। বিশেষ করে Week Ends গুলোতে, কারণ প্রায় প্রতি Week End এ আসে জমির দম্পতি। তাদের সাথে হৈ-হল্লা করে আমাদের সময় কেটে যায়। ইতিমধ্যে কয়েকজন পাকিস্তানি ডাক্তার ও অন্যান্য পেশায় নিয়োজিত পরিবারের সাথে আমাদের পরিচয় হয়েছে বাজারে। ওরা প্রায়ই আমাদের দাওয়াত করে খাওয়ান, আমরাও তাদের ডাকি পাল্টা দাওয়াতে। এই সব ব্যাপারে রশিদ আর ফারুকের তেমন উষ্ণতা পরিলক্ষিত হয় না। এই দুই ভায়রা ওদের মতই থাকে। বিদেশে এই পাকিস্তানি পরিবারগুলোই হয়ে উঠেছিলো অতি আপনজন। ঢাকার সাথে আমাদের রয়েছে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ। এ ছাড়াও লন্ডন, কানাডা, আমেরিকাতে বসবাসকারী আত্মীয়-স্বজন এবং বন্ধু-বান্ধবদের সাথেও কথা হয় প্রায়ই। জমির নিয়মিত পাঠাচ্ছিলেন বাংলাদেশী পত্রপত্রিকা, বিদেশের নামিদামি পত্রিকা এবং ম্যাগাজিন। তাই দেশ-বিদেশের সব খবরাখবর ও জানা সম্ভব হচ্ছিলো। তাছারা, প্রতিটি ফ্ল্যাটেই রয়েছে ডিশ টিভি। মধ্যপ্রাচ্যের নানা দেশগুলোর মতো লিবিয়াতেও ভারতীয় হিন্দি ছবি খুবই জনপ্রিয়। মেয়েরা সহ আমরা সবাই পছন্দমতো ছবি সিনেমা হলে দলবেঁধে গিয়ে দেখি। অত্যন্ত আনন্দমুখর পরিবেশে কাটছিল আমাদের প্রবাস জীবন। রাষ্ট্রীয় অতিথিই শুধু নয়, একজন বিপ্লবী নেতার বিপ্লবী অতিথি আমরা। তাই অন্যান্য রাষ্ট্রীয় অতিথিদের সাথে আমাদের প্রচুর ব্যবধান অনুভব করছি। মনোরম পরিবেশে আলিশান বিলাসিতায় সময় কাটলেও মন আমাদের পড়ে আছে সুদূর বাংলাদেশে। ফ্ল্যাটের নতুন আবাসিক স্থানে Shift করার পর শুরু হল Revolutionary Command Council এর সাথে আমাদের serious আলোচনা। শুরুতেই গাদ্দাফির সাথে আমাদের পরিচয় ও কয়েক দফা বিভিন্ন বিষয়ে সংক্ষিপ্ত মতামত বিনিময়ের পর Revolutionary Command Council এর তাত্ত্বিক গুরুদের সাথে আমাদের বিস্তারিত আলোচনা শুরু হল। আলোচনার বিষয় শুধুমাত্র গাদ্দাফির গ্রীনবুক নিয়েই নয়, এর পরিধি ব্যাপক। সমগ্র বিশ্বজুড়ে সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, দীর্ঘকালীন সংগ্রামের পর গণচীনের অভ্যুত্থান, আঞ্চলিক সমসা, প্যান এরাবিজম, প্যান ইস্লামিজম, সোভিয়েত ইউনিয়ন, ফিলিস্তিন, ইসরাইল, বৈরুত, বিশ্ব উম্মাহর একত্রীকরণ ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন, সঠিক পথ, তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশসমূহ, মুসলমান অধ্যুষিত প্রাকৃতিক সম্পদের বিশাল ভান্ডারের মালিক দেশগুলোর উপর পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের আধিপত্যবাদী নিয়ন্ত্রণ এবং আগ্রাসন, লিবিয়ার সেপ্টেম্বর বিপ্লবের পরিপ্রেক্ষিতে উপমহাদেশের রাজনীতি এবং পাকিস্তানের পারমাণবিক কর্মসূচি, বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং বৈপ্লবিক রাজনৈতিক পটপরিবর্তন, চলমান রাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে আমাদের মধ্যে বিস্তারিতভাবে মত বিনিময় হয় যুক্তি ও তথ্যভিত্তিক। আরব বিশ্বে গাদ্দাফি এক বিতর্কিত ব্যতিক্রমী রাষ্ট্রনায়ক। তার রাজনৈতিক দর্শনের মূল হল ইসলামিক সমাজতন্ত্র। জামাল নাসের তখন আরব জাহানের সবচেয়ে বিচক্ষণ নেতা এবং মিসর তুলনামূলক ভাবে খনিজ সম্পদে সমৃদ্ধ দেশ না হলেও সামরিক এবং জনশক্তির দিক দিয়ে ছিল একটি প্রভাবশালী দেশ। ‘প্যান এরাবিজম’ এর রাজনৈতিক দর্শনের রূপকার ছিলেন নাসের। তার উদ্দেশ্য ছিল, প্রাকৃতিক সম্পদের অধিকারী আরব দেশগুলোকে একত্রিত করে পশ্চিমা ধনতান্ত্রিক সাম্রাজ্যবাদী শক্তিগুলোর আধিপত্য খর্ব করা। গাদ্দাফি ছিলেন তার অনুসারী। তাই তিনিও প্রাথমিক ভাবে নাসেরের এই দর্শনের প্রতি অনুরাগ প্রকাশ করেন। সেপ্টেম্বর বিপ্লবের পর ‘প্যান এরাবিজম’-এর আলোকে নাসের এবং গাদ্দাফির চেষ্টায় লিবিয়া, মিসর, আলজেরিয়া, তিউনিসিয়া, মরক্কো এবং সিরিয়াকে মিলিয়ে একটি রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা ব্যর্থ হবার সাথে নাসেরের ‘প্যান এরাবিজম’ তত্ত্বের অসারত্ব প্রমাণিত হওয়ার পর নাসেরের সাথে গাদ্দাফির ‘প্যান এরাবিজম’ এর ব্যাপারে মতপার্থক্য দেখা দেয়। এরপর গাদ্দাফি ঝুঁকে পরেন ‘প্যান ইস্লামিজম’ এবং সারাবিশ্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের দিকে। তার ‘গ্রীনবুক’ আর চেয়ারম্যান মাও এর ‘লাল পুস্তিকা’-এর মধ্যে মূলত একমাত্র আল্লাহ্ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ছাড়া অনান্য বিষয় তেমন কোনও পার্থক্য ছিল না। তার তাত্ত্বিকরা বিশ্বাস করতেন, মোয়াম্মর যেভাবে মার্ক্সসীয় রাজনৈতিক দর্শনকে ইসলামের সম্পূরক হিসাবে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন সেটাই এক যুগান্তকারী সৃজনশীলতা রাজনৈতিক দর্শনের ক্ষেত্রে। তাদের মতে, গাদ্দাফির আবিষ্কৃত এই অভিনব দর্শনই বর্তমান প্রেক্ষাপটে বিশ্ববাসীকে সার্বিকভাবে মুক্ত করতে পারে প্রচলিত সব রকমের আগ্রাসন, শোষণ এবং অপশাসনের নিগড় থেকে। গাদ্দাফির রাজনৈতিক দর্শনের বিশ্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে আমরা তার সাথে সীমিত পর্যায়ে বিতর্কে যেতাম। কারণ, দুই একটা বৈঠকের পরই আমরা উপলব্ধি করেছিলাম, গাদ্দাফি কিছুটা গোঁয়ার প্রকৃতির আর তার মধ্যে সহিষ্ণুতার কিছুটা অভাব রয়েছে। তবে তার তাত্ত্বিকদের বেশিরভাগই ছিলেন বেশ receptive. তাদের নীতি-আদর্শ এবং দর্শন বিষয়ে স্ব-বিরোধী দ্বন্দ্ব যৌক্তিকতার সাথে উপস্থাপন করলে তারা সেটা মেনে নিতেন। সালেমসহ অন্যরা অকাট যুক্তিগুলো আন্তরিকতার সাথেই মেনে নিতে কার্পণ্য করতেন না। আজ মোয়াম্মর গাদ্দাফি আন্তর্জাতিক চক্রান্তে বেঁচে নেই। নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে তাকে। দোষে-গুণেই মানুষ। গাদ্দাফিও ছিলেন একজন মানুষ মাত্র, অতিমানব নন। তারপরও পৃথিবীর অগুনতি মানুষের মনে চিরজাগরূক হয়ে থাকবেন শহীদ বিপ্লবী নেতা মোয়াম্মর গাদ্দাফি। অনেকেই আজ পশ্চিমা বিশ্বের প্রচারণার সাথে সুর মিলিয়ে বলে থাকেন গাদ্দাফি নাকি ছিলেন একজন নিষ্ঠুর রক্তপিপাসু জল্লাদ! গণতন্ত্রে অবিশ্বাসী এক স্বৈরশাসক! যারা ঐ ধরণের বুলি কপচে মুখে ফেনা তুলে ফেলছেন অর্ধ কিংবা অশিক্ষিত জনগণকে বিভ্রান্ত করার জন্য সেটার পেছনে কোনও স্বার্থ কার্যকরী সেই বিতর্কে না গিয়ে পাঠকদের কাছে কিছু চিন্তার খোরাক তুলে ধরছি তাদের বিচার বিবেচনা এবং বিশ্লেষণের জন্য। নামীদামী অনেক দার্শনিক, রাষ্ট্র ও সমাজ বিজ্ঞানী এবং বিশিষ্ট রাজনীতিবিদদের অনেকেই বলেছেন, কোনও একটি দেশের রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ সেখানে যত সফলই হউক না কেনো, সেটাকে অন্য কোনও রাষ্ট্রের জনগোষ্ঠীর উপর হুবহু চাপিয়ে দিলে একই রকমের ফল লাভ করা সম্ভব হয় না। উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতে প্রচলিত গণতন্ত্রের সবক শিখে যে সমস্ত পণ্ডিত সেই ফরমুলা তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে চাপিয়ে দেন, তারা কিন্তু একটি অতি সাধারণ কথা সজ্ঞানে কিংবা অজ্ঞানে ভুলে যান যে ঐ সমস্ত উন্নত দেশগুলোর আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা এক নয়। তাদের মননশীলতা, ঐতিহ্য এবং মূল্যবোধেও রয়েছে আসমান-জমিনের ফারাক। তাই আজ পর্যন্ত ধার করা ঔপনিবেশিক ধাঁচের গণতন্ত্রের চর্চার মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের কোনও দেশের জনগোষ্ঠীরই ভাগ্যের পরিবর্তন হয়নি। যা দেখা যায় সেটা হল, গণতন্ত্রের ধূম্রজালে জনগণকে আচ্ছন্ন রেখে জাতিকে বিভক্ত করে গড়ে তোলা হয়েছে একটি ক্ষুদ্র কিন্তু অসীম শক্তিশালী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী। জনগণের ২% এই গোষ্ঠীর অবৈধ কব্জায় রয়েছে জাতীয় সম্পদের ৯০%। ফলে তারাই নিয়ন্ত্রণ করছে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, প্রশাসন, আইন বিভাগ, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী এবং দেশের সামরিক বাহিনী। অর্থবল ও পেশীশক্তির জোরে তারাই সমাজপতি। অবশ্য জাতীয় সম্পদের সিংহভাগই নিয়ে যাচ্ছে বিদেশী প্রভুরা। তাদের পদলেহী এই তল্পিবাহক গোষ্ঠী যাদের অস্তিত্ব নির্ভরশীল বিদেশী মুরুব্বীদের উপর, তারা ঢেকুর তুলে সন্তুষ্ট থাকছেন উচ্ছিষ্ট পকেটস্থ করেই। এভাবেই একটি স্বাধীন দেশের ৯৮% নাগরিককে কৌশলে পরিণত করা হয়েছে এই ২% কায়েমী স্বার্থবাদী শাসক ও শোষণকারী গোষ্ঠীর গোলামে। কারণ, তাদের অস্তিত্বই নির্ভর করে ঐ গোষ্ঠীর করুণা এবং দয়া-দাক্ষিণ্যের উপর। সার্বিকভাবে পরনির্ভরশীল, নিপীড়িত, বঞ্চিত, অসহায়, অশিক্ষিত জনগণ কখনোই নিজেদের ন্যায্য অধিকারের জন্য মেরুদণ্ড সোজা করে প্রতিবাদী হতে পারে না। তারা অর্ধমৃত অবস্থায় ভেন্টিলেটারের সাহায্যে ধুঁকছে সর্বখানে যদিও তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ প্রচুর প্রাকৃতিক, খনিজ ও মানব সম্পদের অধিকারী। বন্ধকী সত্তার পক্ষে স্বাধীন চিন্তা এবং বিবেচনার কোনও অবকাশ থাকে না। এই বাস্তবতার নিরিখে, পরাধীনতার শেকলে বাধা ব্যক্তির পক্ষে স্বাধীনভাবে চিন্তা করা কিংবা ভোট দেয়া কি করে সম্ভব? দেশে দেশে গণতন্ত্রের লেবাসে চলছে কায়েমী স্বার্থবাদীদের ক্ষমতা কুক্ষিগতকরণ পালা বদলের রাজনীতির নাগরদোলায়। ফলে প্রায় সব কয়টি দেশ হয়ে উঠছে ভঙ্গুর আর জনগণ হারাচ্ছে প্রাণশক্তি। কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী মনিবদের স্বার্থরক্ষার্থে যেখানে প্রচলিত গণতান্ত্রিক এবং সিভিল মিলিটারি স্বৈরশাসন অকেজো হয়ে পড়ছে সেখানে এই সুতিকাগার থেকে প্রসূত হচ্ছে গোষ্ঠীতন্ত্রের চেয়েও ভয়ানক বিভীষিকাময় পরিবারতন্ত্র। এ ধরনের গণতন্ত্রে অবশ্যই বিশ্বাসী ছিলেন না প্রগতিশীল বিপ্লবী নেতা গাদ্দাফি। এখানে বর্তমান বিশ্বের উদীয়মান আণবিক শক্তিধর দেশ গণচীনের রূপকার চেয়ারম্যান মাও সে তুং-এর একটা উক্তি উল্লেখযোগ্য। তিনি লিখেছেন, ‘বিপ্লব রঙিন সুতোয় কাপড়ে নকশা আঁকার মতো সরল বিষয় নয়। বিপ্লব একটি জটিল প্রক্রিয়া। অনেক চড়াই উৎরাই পেরিয়ে, অনেক ত্যাগের বিনিময়েই বৈপ্লবিক স্বপ্নের বাস্তবায়ন সম্ভব। অনেক রক্তের বিনিময়ে সফলতা পায় বিপ্লব।’ তার এই বক্তব্যের যৌক্তিকতা বুঝতে সক্ষম হয়েছিলো চৈনিক জাতি। তাই একদা আফিমখোর জাতি হিসাবে পরিচিত চৈনিক জাতিগোষ্ঠী আজ সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছে বিশ্বের অন্যতম উদীয়মান অর্থনৈতিক এবং সামরিক শক্তি হিসেবে। সিঙ্গাপুরের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী জনাব লি কুয়ান ইউ-এর সাথে লেখকের গণতন্ত্র নিয়ে কথা বলার সুযোগ হয়েছিলো এক বৈঠকে। বর্তমানের সিঙ্গাপুরের রূপকার এবং অভিজ্ঞ বিপ্লবী এই নেতার সাথে খোলাখুলি আলাপ করার সুযোগ পেয়ে তাকে প্রশ্ন করেছিলাম
এক্সেলেন্সি, আপনি দীর্ঘ ২৮ বছরেরও বেশি সময় দোর্দণ্ডপ্রতাপে দেশ শাসন করে এখন অবসর নিয়েছেন। যেদিন আপনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে পরাজিত করে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসাবে স্বাধীন সিঙ্গাপুরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা নিজ হাতে তুলে নেন সেই দিন পরাজিত ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ আপনার সরকারের পতন ঘটানোর জন্য সিঙ্গাপুরে জাতিগত রক্তক্ষয়ী ভয়াবহ এক দাঙ্গা বাধিয়ে দেয়। কিন্তু আপনি সেই দাঙ্গা কঠোর হস্তে দমন করেন। আপনার বিপ্লবী বাহিনীর হাতে নিহত হয় ১০ হাজারেরও বেশি সব জাতিগোষ্ঠীর দাঙ্গাকারীরা। এরপর আপনি কঠোর ভাষায় সবার উদ্দেশ্যে হুঁশিয়ারি জারি করে বলেছিলেন, আজ থেকে যারাই সিঙ্গাপুরে বসবাস করবে তাদের জাতিগত পরিচিতি হবে সিঙ্গাপুরীয়ান। এটা যাদের পক্ষে মেনে নেয়া সম্ভব নয় তাদের জন্য ৪৮ ঘণ্টা সময় দেয়া হল সিঙ্গাপুর ছেড়ে চলে যাবার জন্য। আপনার এই ঘোষণার পর অবশ্য খুব কম সংখ্যক লোকই সিঙ্গাপুর ছেড়ে গিয়েছিলো। শুধু তাই নয়, এরপর আজঅব্দি সিঙ্গাপুরে কোনও জাতিগত দাঙ্গা হয়নি। কিন্তু এরপরও পশ্চিমা অনেক দেশ এবং মানবতাবাদী সংগঠন সেই দিনটিকে এখনো ‘Black Day’ হিসাবে আখ্যায়িত করে থাকে। আপনার বিরুদ্ধে তাদের প্রচারণায় বলা হয়, আপনি বর্তমান আধুনিক বিশ্বের এক চরম গণতন্ত্রবিরোধী অত্যাচারী স্বৈরশাসক। পাঠকদের নিশ্চযই জানা আছে সিঙ্গাপুরে তিনটি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস। মালয়ী, চৈনিক এবং দক্ষিণ এশিয়া থেকে আগত উপমহাদেশীয়রা। এই বিষয়ে আমি তার প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে, বর্ষীয়ান নেতা বলেছিলেন
সেই দিন আমি যেই পদক্ষেপই গ্রহণ করেছিলাম সেটা ছিল সুচিন্তিত এবং জাতীয় স্বার্থে। এ নিয়ে অন্যরা কি মনে করছে না করছে সেটা ধর্তব্যের বিষয় নয়। বাকি থাকে গণতন্ত্র আর স্বৈরতন্ত্র প্রসঙ্গ। এই দুইটিই এক ধরনের অনুভূতি বা চেতনা, যা পৃথিবীর সব জাতিসত্তাতেই আদিকাল থেকেই বর্তমান। তবে এই অনুভূতি বা চেতনা সব জাতিসত্তার ক্ষেত্রে হুবহু একই রকম হতে হবে এমন ধারণা যুক্তিসঙ্গত নয়। তাই ঐ শব্দ দুইটির পশ্চিমা জগতের আভিধানিক অর্থকেই যে সর্বজনীনভাবে মেনে নিতে হবে সেটাও অযৌক্তিক। আমার শাসনকালের সার্টিফিকেট দেবার একমাত্র অধিকার রয়েছে আমার দেশবাসীর। আমি যদি কোনও অন্যায় করে থাকি সিঙ্গাপুরের অধিবাসীর যে কেউই প্রচলিত আইন অনুযায়ী আমাকে কাঠগড়ায় দাড় করাবার অধিকার রাখেন। অন্যদের সার্টিফিকেট আমার কাছে সম্পূর্ণভাবে মূল্যহীন। আলোচনা শেষ করার আগে তিনি একটি অতি মূল্যবান কথা বলেছিলেন
নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, দুর্নীতিমুক্ত, স্বচ্ছ, বিচক্ষণ এবং দূরদর্শী নেতৃত্বের অধীন কঠোর পরিশ্রমকারী জাতিকে কোনও অপশক্তিই দাবিয়ে রাখতে পারে না। স্বকীয় প্রতিভা এবং কর্মদক্ষতা তাদের উন্নতির শিখরে পৌঁছে দেবেই। তারই জলজ্যান্ত প্রমাণ আজকের সিঙ্গাপুর। অবসর গ্রহণের পর তিনি সস্ত্রীক সরকার প্রদত্ত দুই কামরা বিশিষ্ট একটি ছোট্ট ফ্ল্যাটে বসবাস করছিলেন। অবসর ভাতাই ছিল তাদের একমাত্র আর্থিক সঙ্গতি। তার মতো নেতাকেও কিন্তু ‘জাতির পিতা’ হিসাবে আখ্যায়িত করার কোনও প্রচেষ্টা কিংবা উদ্যোগ কখনোই নেয়া হয়নি। বিদায় নিয়ে ফেরার পথে ভাবছিলাম, আমাদের দেশে কি কখনো জন্ম নেবে এমন একজন লি কুয়ান ইউ! লি কুয়ান ইউ বর্তমানে গণচীনের অবিশ্বাস্য প্রগতির একজন রূপকারও বটে। এ ছাড়া শুধু অনুন্নত বিশ্বের দেশগুলোই নয় উন্নত বিশ্বের অনেক দেশও তার বাস্তব জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিচ্ছে নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য। আর একজন দূরদর্শী নেতা যাকে বলা হয়ে থাকে আধুনিক চীনের visionary. কমরেড দেং শিয়াও পিং। এক সাক্ষাতকালে সুযোগ পেয়ে লেখক তাকে প্রশ্ন করেছিল
মাননীয় কমরেড, আপনি যেভাবে চীনের দরজা অবারিতভাবে খুলে দিচ্ছেন পশ্চিমা শত্রুভাবাপন্ন দেশগুলোকে পুঁজি এবং প্রযুক্তি বিনিয়োগের আকর্ষণ সৃষ্টির চেষ্টায় যাতে করে গণচীন অতি অল্প সময়ের মধ্যে একটি অত্যাধুনিক রাষ্ট্র এবং শক্তিধর দেশ হিসেবে গড়ে উঠতে সক্ষম হয়। আপনার একটা উক্তি আজকাল প্রায় প্রতিটি চীনবাসীর মুখেই উচ্চারিত হচ্ছে, ‘It does not matter whether the cat is white or black as long as it catches the mice.’ কিন্তু আপনি কি মনে করেন না এতে চীনের রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক কাঠামোতে অবক্ষয় দেখা দেবে? কারণ আর একটা প্রচলিত উক্তিও আছে, ‘Money does not come alone but with many vices.’ Long march veteran, যিনি গণচীনের ক্ষমতা বলয়ের নেতৃত্বের শীর্ষ পর্যায় থেকে ছিটকে পড়ে পরে তৃতীয় বার ক্ষমতার শীর্ষে অলৌকিক ভাবে নিজেকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হন সেই বর্ষীয়ান নাতিদীর্ঘ নেতা দেং শিয়াও পিং সিগারেটে একটা সুখটান দিয়ে জবাব দিয়েছিলেন
তেমন সম্ভাবনা অবশ্যই রয়েছে। তবে সে সব দোষ থেকে দেশ ও জাতীয় চরিত্রকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য ব্যবস্থাও আমরা করে রেখেছি। যেকোনো পর্যায়ে যখনই কোনও পচন পরিলক্ষিত হবে তক্ষুনি তা কেটে ফেলা হবে পচন ছড়িয়ে পরার আগেই। প্রক্রিয়াটাকে বলা যেতে পারে ‘Continuous Rectification Campaign.’ তিয়েন আন মেন স্কোয়ারের ঘটনা সম্পর্কে আপনি নিশ্চয় অবগত আছেন বলেই আমার ধারণা। চক্রান্তের জাল সর্বকালেই ছিল, থাকবেও আগামীতে। প্রয়োজনীয় আত্মত্যাগের জন্য যতদিন জাতি এবং নেতৃত্ব তৈরি থাকবে ততদিন সব চক্রান্তের মোকাবেলা করা সম্ভব।
এ থেকেই পাঠক বুঝতে পারবেন তিনি কত বড় মাপের নেতা। তার দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা, প্রত্যয় ও জ্ঞানের পরিমাপ কতখানি। একবার বিশ্ববরেণ্য নেতা মাহাথির মোহাম্মদ এর সাথে এক সেমিনারে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছিলো। তাকে এক ফাঁকে জিজ্ঞেস করেছিলাম
এক্সেলেন্সি, আজকের বিশ্বব্যবস্থায় কোনও অনুন্নত দেশের পক্ষে কি স্বনির্ভরতার ভিত্তিতে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জন করা সম্ভব? জবাবে তিনি বলেছিলেন
অবশ্যই সম্ভব। তবে এর পূর্বশর্ত হচ্ছে, জাতীয় নেতৃত্বকে হতে হবে সম্পূর্ণভাবে নিঃস্বার্থ এবং দুর্নীতিমুক্ত। বিশেষভাবে পরিচিত এবং বিশ্ববাসীর কাছে শান্তির প্রতীক হিসাবে স্বীকৃত নেলসন ম্যান্ডেলাকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো
তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর প্রায় প্রতিটি দেশই প্রচুর প্রাকৃতিক সম্পদের মালিক হওয়া সত্ত্বেও তারা অর্থনৈতিক ভাবে ক্রমান্বয়ে দেউলিয়া এবং পরভৃৎ হয়ে উঠছে কেনো? জবাবে ম্যান্ডেলা বলেছিলেন
দুঃখের সাথেই বলতে হচ্ছে, দেশগুলোতে নেতা নয়, শুধুমাত্র রাজনীতিবিদ দেখছেন তিনি। রাজনীতিবিদদের দৃষ্টির প্রসারতা শুধুমাত্র নির্বাচন পর্যন্ত, নেতার দৃষ্টি প্রসারিত থাকে আগামী প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তর পর্যন্ত।
এদের বক্তব্যে অনেক চিন্তার খোরাক রয়েছে নতুন প্রজন্মের জন্য যারা সব রকমের অন্যায় এবং শোষণের বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়ে মুক্তিসংগ্রামে ব্রতী হতে আগ্রহী। জিয়ার সাথেও কথা হচ্ছে মাঝেমধ্যে। শিশুভাই এবং টনি ভাবীও প্রায়ই ফোন করে খোঁজ-খবর নিচ্ছেন। ব্যাচেলররা আমাদের সাথেই খাওয়া দাওয়া করছে, কখনো নিজেরাও রান্নাবান্না করছে। আমাদের দাওয়াতও করছে। আমরা সবাই মিলে একটি বড় পরিবার। ব্যতিক্রম শুধু দুই ভায়রা। তারা সবার সাথে সহজভাবে মিশতে পারছে না। তাই কিছুটা দূরত্ব বজায় রেখেই চলেছে। তাদের এই ব্যবহারটা অদ্ভুত হলেও সবারই গা সহা হয়ে গেছে। এই ধরনের ব্যবহার কিছুটা দৃষ্টিকটু হলেও কেউই তেমন একটা পাত্তা দিচ্ছে না। আমাদের মতোই তারাও তাদের পরিচিত লোকজনদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করে খবরাখবর নিচ্ছে। প্রয়োজনমতো আমাদের সাথে শেয়ারও করছে। তবে আমাদের যোগাযোগের গণ্ডি তাদের চেয়ে অনেক বড় এবং বিস্তৃত। সমগ্র সামরিক বাহিনী জুড়ে রয়েছে আমাদের সংগঠন সেনা পরিষদ। রাজনৈতিক মহলের সমমনা নেতানেত্রি এবং বিভিন্ন মহলেও রয়েছে আমাদের যোগাযোগ।
এ ভিএম তোয়াব আসছেন
এক সাপ্তাহিক ছুটির দিনে জমির এসে জানাল এয়ার চীফ এভিএম তোয়াব আসছেন আমাদের সাথে দেখা করতে। জমির খবরটা খুবই উচ্ছ্বসিত হয়ে দিয়েছিলো। কিন্তু আমরা এই খবরে তেমন উচ্ছ্বসিত হলাম না। কারণ, ফারুক-রশিদের মনোনীত তোয়াবের চারিত্রিক দৃঢ়তা ও সাহসের নমুনা আমরা জেনে গিয়েছিলাম ২-৩রা নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদের নেতৃত্বে প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতার পর যখন তাকে স্লিপিং স্যুট পরিহিত অবস্থায় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের হেডকোয়াটার্সে বন্দী করে আনা হয়েছিলো। আমি ও নূর যখন খালেদ ভাই এবং তার দোসরদের সাথে আলোচনার জন্য কনফারেন্স রুমের দিকে এগুচ্ছিলাম তখনই বন্দী করে ধরে আনা হয়েছিলো জনাব তোয়াবকে। আহত পাখির মতো কাঁপছিলেন এয়ার চীফ এভিএম তোয়াব। আমাকে দেখে ধড়ে প্রাণ ফিরে পেয়ে কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করছিলেন
ডালিম, তুমি এখানে! কি হচ্ছে বলতো?
তার ভীত-সন্ত্রস্ত অবস্থা দেখে অনুকম্পার সাথে বলেছিলাম পাশের ঘরে কর্নেল আমিন এবং ক্যাপ্টেন মুনিরের সাথে বসে দেখুন কি হচ্ছে।
৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সিও কর্নেল আমিন এবং এডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন মুনিরকে ইতিমধ্যেই খালেদ-চক্র বন্দী অবস্থায় ঐ ঘরে বসিয়ে রেখেছে সেটা আমরা পৌঁছেই দেখতে পেয়েছিলাম। আমরা কনফারেন্স রুমে ঢুকে আলোচনায় ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। একপক্ষে আমি আর নূর অন্যপক্ষে ব্রিগেডিয়ার খালেদ, রক্ষীবাহিনী প্রধান ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জামান, কর্নেল রউফ, কর্নেল সাব্বিউদ্দিন, কর্নেল শাফায়াত জামিল, কর্নেল মইনুল হোসেন, কর্নেল মান্নাফ, মেজর মালেক, মেজর হাফিজ, মেজর গফফার, লেফটেন্যান্ট ইকবাল, সেকেন্ড লেফটেন্যান্ট ওবায়দুল কাদের (বর্তমানে আওয়ামী লীগের মহাসচিব), ক্যাপ্টেন কবির, লেফটেন্যান্ট নাসের, লেফটেন্যান্ট তাজ এবং আরো কয়েকজন তরুণ অফিসার। ফ্লাইট লেফটেন্যান্ট লিয়াকত তখনও এসে পৌঁছায়নি। কিছুক্ষণের মধ্যেই বন্দী অবস্থায় ধরে আনা হয়েছিলো ন্যাভাল চীফ রিয়ার এডমিরাল এম এইচ খানকে। তারও অতি করুণ অবস্থা। জীবন ভয়ে ফ্যাকাশে হয়ে গেছেন। তারও পরনে স্লিপিং স্যুট। খবরটা দিতেই খানিকটা উষ্মার সাথেই তাকেও ঐ একই খোঁয়াড়ে ঢুকানোর নির্দেশ দিলেন খালেদ ভাই। পরবর্তীকালে জিয়া ভক্ত হয়ে মন্নাফ এবং মইনুল হোসেন দুইজনই পদোন্নতি পেয়ে জেনারেল এবং রাষ্ট্রদূত হয়েছিলেন। ২-৩ নভেম্বর রাতে ব্রিগেডিয়ার খালেদের ক্যুদেতা এবং ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টে আমার আর নূরের সাথে আলোচনা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা রয়েছে, ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ আমার প্রকাশিত প্রথম বইটিতে। ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ২১শে বই মেলায় প্রতিকূলতার কারণে বইটির ছয়টি এডিশন দুই সপ্তাহের মধ্যে বিক্রি হয়ে যাওয়ায় এরপর সাধারণভাবে ছাপানো এবং প্রচারণা সম্ভব হয়নি সরকারের হুকুমে। পরে বইটি ইংরেজি এবং উর্দু ভাষায়ও প্রকাশ পায়। ৭ই নভেম্বর এর সিপাহী-জনতার বিপ্লব সম্পর্কেও তথ্যবহুল ঘটনা প্রবাহ তুলে ধরা হয়েছে আমার লেখা এবং প্রকাশিত ‘জাতীয় বিপ্লব এবং সংহতি দিবস ৭ই নভেম্বর, ১৯৭৫ এবং অব্যাহতি আইনসমূহ’ বইটিতে। এই বইটিও বাংলা এবং ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়েছে। পাঠকদের পক্ষে বই দুইটি বর্তমানে বাজার থেকে সংগ্রহ করা সম্ভব হবে কিনা জানিনা। তবে প্রয়োজনবোধে হয়তো বই দুইটি প্রদত্ত ওয়েবসাইট দুটো থেকে বাংলা কিংবা ইংরেজিতে ডাউনলোড করে নিতে পারেন।
১। www.majordalimbu.com
২। www.majordalimbubangla.com
এই বই দু’টিতে এমন সব বস্তুনিষ্ঠ তথ্য এবং ঘটনার বিবরণ দেয়া রয়েছে যার থেকে পাঠক অতি সহজেই সত্য জেনে নিতে পারবেন।
বই দু’টির প্রকাশনার পর থেকে আজঅব্দি বই দু’টিতে যা কিছুই লেখা হয়েছে তার প্রতিবাদ কোনও মহল থেকেই করা সম্ভব হয়নি আলহামদুলিল্লাহ।
অবশ্য আওয়ামীলীগ সরকার ওয়েবসাইট দুটো কয়েকবার বন্ধ করে দেয় বাংলাদেশী ভিউয়ারদের জন্য।
ফিরে চলি বেনগাজীতে।
এভিএম তোয়াব এলেন জমিরকে সঙ্গে নিয়ে। তার কাছ থেকে বাস্তবে ঘটনা প্রবাহ কোন পথে এবং চলমান অবস্থায় জিয়া কি করছেন এই সমস্ত বিষয়ে সব কিছুই জানা যাবে। দু’দিন থাকবেন আমাদের সাথে। ‘৭১-এর যুদ্ধের সাথে তার কোন সম্পর্কই ছিল না। পূর্ব পাকিস্তানের সাথেও তার তেমন কোনও সম্পর্ক ছিল না। কারণ, ‘৭১-এর আগ পর্যন্ত বেশিরভাগ সময় কাটিয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানে তার পত্নী এক জার্মান মহিলার সাথে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে গ্রুপ ক্যাপ্টেন তোয়াব সস্ত্রীক জার্মানিতেই অবস্থান করছিলেন। আগস্ট বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর রশিদ আর ফারুকের অনুরোধে সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদের সাথে আলোচনা কালে সেনা পরিষদের পক্ষ থেকে যখন তাদের জানানো হয় বিপ্লব সফল হলে জেনারেল ওসমানী হবেন ডিফেন্স এডভাইজার, জেনারেল খলিল হবেন জয়েন্ট চীফ অফ স্টাফ, জেনারেল জিয়াকে বানানো হবে আর্মি চীফ, এডমিরাল এম এইচ খান থাকবেন ন্যাভাল চীফ এবং মুক্তিযোদ্ধা গ্রুপক্যাপ্টেন বাশার হবেন এয়ার চীফ- সেই সময় দুই ভায়রা বলে, আমাদের প্রস্তাবনাগুলো তাদের মেনে নিতে আপত্তি নেই। কিন্তু তাদের একটি প্রস্তাব সেনা পরিষদকে মেনে নিতে হবে। সেটা হল, গ্রুপক্যাপ্টেন বাশার এর পরিবর্তে গ্রুপক্যাপ্টেন তোয়াবকে এয়ার চীফ বানাতে হবে। আমরা তাদের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিলাম। কারণ, গ্রুপক্যাপ্টেন তোয়াব চাকুরিতে বাশারের চেয়ে সিনিয়র ছিলেন এবং পাকিস্তান এয়ারফোর্সের একজন চৌকস অফিসার হিসাবে পরিচিত। প্রেসিডেন্ট হিসাবে খন্দকার মোশতাক আহমেদ দুই পক্ষের কাছেই গ্রহণীয় ছিলেন বিধায় তাকে নিয়ে কোনও সমস্যা ছিল না। রশিদ এবং ফারুক কেনো গ্রুপক্যাপ্টেন তোয়াবকে এয়ার চীফ বানাতে চেয়েছিল সেই বিষয়টা এখনো সেনা পরিষদের শীর্ষ নেতাদের কাছে পরিষ্কার নয়!দুই দিনই এয়ার ভাইস মার্শাল এভিএম তোয়াবের সাথে আমাদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হল। সঙ্গত কারণেই জমির আমাদের বৈঠকে অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকে। এবারের সফরে জমির ছিল এয়ার চীফ তোয়াবের এস্করট। খোলামেলা আলোচনা হয়েছিলো আন্তরিক পরিবেশেই। প্রথমেই আমরা জানতে চাইলাম সামরিক বাহিনীর অবস্থা সম্পর্কে। জনাব তোয়াব জবাব দিলেন
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে বহু মত আর পথের অনুসারী আছে। ইতিমধ্যে কর্নেল তাহের এবং তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থাকে কঠোর ভাবে দমন করা হয়েছে, তবে এখনো সামরিক বাহিনীতে অস্থিতিশীলতা বিরাজমান। ক্ষণে ক্ষণেই বিভিন্ন ইস্যুতে বিস্ফোরণ ঘটছে। তবে জিয়ার নেতৃত্বে পদস্থ অফিসাররা সম্মিলিতভাবে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করছেন Chain of Command পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার জন্য। তার বক্তব্যের পর কর্নেল পাশা প্রশ্ন করলো
স্যার, এই অবস্থাতে আমাদের কি কোনও করণীয়ই নেই? এভিএম তোয়াব খোলাখুলিভাবেই বললেন আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যাবার জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে সেনাকুঞ্জের দরবারে বিপ্লবীদের তরফ থেকে জিয়ার কাছে। জিয়া তাদের দাবির জবাবে ওয়াদাও করেছেন অতিসত্বর তোমাদের ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা তিনি করবেন। কিন্তু ব্যবস্থা করার জন্য তাকে কিছুদিন সময় দিতে হবে। তার এই সময় চাওয়াটাকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিপ্লবীরা।
কর্নেল শাহরিয়ার বললো
এই ক্রান্তিলগ্নে আমরা সশরীরে যদি তাদের পাশে উপস্থিত থাকতাম তাহলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কাজে কোনও ব্যাঘাত ঘটতো বলে মনে করছেন কি জেনারেল জিয়া? জনাব তোয়াব স্পষ্ট জবাব দিলেন
তিনি ব্যক্তিগত ভাবে মনে করেন আমরা ফিরে গেলে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার কাজটা সবার জন্যই সহজ হতো। তাই জিয়ার সাথে এই বিষয়ে তার কয়েকবারই কথা হয়েছে। কিন্তু জিয়া রহস্যজনক ভাবে জবাবে তাকে জানিয়েছেন, আমাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের বিষয়টি তিনি নিজেই দেখবেন। তাছাড়া তিনি তাকে এটাও বলেছেন, আমাদের সাথে তার যোগাযোগ রয়েছে এবং সঠিক সময়ে তিনি আমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনবেন। সময় নির্ধারণের দায়িত্বটা নাকি আমরাই তাকে দিয়েছি as he is on the ground.
তার এই বক্তব্য সম্পূর্ণ সত্য না হলেও আংশিক ভাবে সত্য। তাই শাহরিয়ার এই বিষয়ে আলোচনা না বাড়িয়ে প্রসঙ্গের ইতি টানলো। রশিদ এবং ফারুক তাৎক্ষণিক উত্তেজিত ভাবে বলে উঠেছিলো, জিয়ার সাথে আমাদের তো কোনও যোগাযোগই নেই। আমরা বাকিরা সবাই ছিলাম নিশ্চুপ। কারণ, আমাদের সাথে জিয়ার যোগাযোগ ছিল। ব্যক্তিগতভাবে জিয়া আমাদের কাছে ওয়াদা করেছিলেন, তিনি আমাদের অতি অল্প সময়েই ফিরিয়ে নেবার বন্দোবস্ত করছেন। দুইপক্ষের সুবিধার জন্যই তিনি আরও কিছুদিন সময় চাইছিলেন। তার যুক্তি ছিল, তিনি সবই জানতে পেরেছেন। কর্নেল তাহের ও তার বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা সেনা পরিষদের সহযোগী হিসাবে ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থানে অংশগ্রহণ করেছিল। কিন্তু পরে তাহের বিপ্লবের সর্ব কৃতিত্ব নেবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়ে এমন সব হঠকারিতায় লিপ্ত হয় যাতে বাধ্য হয়েই তাহের এবং তার অনুসারীদের বিরুদ্ধে তাকে কঠোর পদক্ষেপ নিতে হচ্ছে। এই অবস্থায় যদি আমরা দৃশ্যপট থেকে লোকচক্ষুর আড়ালে থাকি তবে তার পক্ষে তাহেরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করা সহজ হবে। তার যুক্তিটা খোঁড়া হলেও আমরা মেনে নিয়েছিলাম। তিনি এই পরিপ্রেক্ষিতে আমাদের অনুরোধ করেছিলেন, যাতে আমরা সেনা পরিষদের বিপ্লবীদের বুঝিয়ে বলি যে তিনি আমাদেরই মনোনীত চীফ এবং আমাদেরই একজন। তাই কোনও প্রকার ভুল বোঝাবুঝির অবকাশ নেই। আমরা এক ছিলাম, আছি এবং থাকবো। জিয়া কোরান শপথটাও মনে করিয়ে দিয়েছিলেন। তার সেই ধরনের কথার পরিপ্রেক্ষিতেই আমরা তার উপর বিশ্বাস রেখেই রশিদ আর ফারুকের অগোচরে দেশে সেনা পরিষদের সদস্যদের নির্দেশ দিয়েছিলাম জিয়ার প্রতি সন্দিহান না হয়ে আন্তরিকভাবে তাকে সার্বিক সাহায্য এবং সহযোগিতা করে চলার জন্য। তাদের এটাও জানিয়েছিলাম, জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে তার সাথে আলোচনার পরই আমরা যুক্তিসঙ্গত কারণেই কিছুদিনের জন্য দেশের বাইরে থাকার সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি।এবার কর্নেল ফারুক সরাসরি প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলো জনাব তোয়াবের প্রতি
স্যার, সৈনিকদের কাছে আমাদের জনপ্রিয়তা তুঙ্গে, তারা অহরহ আমাদের বার্তা পাঠাচ্ছে অবিলম্বে দেশে ফিরে যাবার জন্য। তিন চীফই আমাদের পছন্দের মনোনীত ব্যক্তি। সেক্ষেত্রে আমাদের ফিরিয়ে নেয়ার ক্ষেত্রে এতো গড়িমসি কেনো, আপনি খোলাখুলি জবাব দিন। ফারুকের এই প্রশ্নে কিছুটা বিপাকে পড়লেন তোয়াব। সবার দিকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে তিনি বুঝতে পারলেন এই প্রশ্নের সঠিক জবাবই সবাই প্রত্যাশা করছে। তাই একগ্লাস ঠাণ্ডা পানি পান করে গলা ভিজিয়ে তিনি জবাব দিলেন
দেখো, প্রশ্নটা কঠিন, জবাবটাও সহজ নয়। জবাবে আমি আমার নিজস্ব বক্তব্যই জানাবো। তাই তোমাদের কথা দিতে হবে এই বক্তব্য যেন আমাদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে। আমরা তাকে এই বিষয়ে আশ্বস্ত করলাম। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে তোয়াব বলতে শুরু করলেন
তাহেরকে Neutralize করতে জাসদের শীর্ষনেতাদের বন্দী করা ছাড়াও সামরিক বাহিনীর অনেক সদস্যকে মেরে ফেলা হয়েছে বিনা বিচারে তাহেরের অনুগতজন সেই অনুমানের ভিত্তিতে। কিন্তু তারা যে সবাই তাহেরের অনুসারী সে বিষয়ে কোনও সঠিক প্রমাণ পাওয়া যায়নি। এতে সামরিক বাহিনীতে ক্ষোভ ও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। এই ধরণের নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিরুদ্ধে জিয়ার সামনে কেউই কিছু বলতে সাহস পাচ্ছে না, বরং কানকথায় বিশ্বাসী জিয়ার প্রিয়পাত্র সাজার জন্য তাকে ঘিরে থাকা অনেকেই তাকে উস্কে দিচ্ছে। আমার মনে হয়, জিয়া নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য আরও অনেককেই মারবেন। এই ন্যক্কারজনক হত্যাযজ্ঞের ভার জিয়া দিয়েছেন জেনারেল এরশাদ আর তারই কোর্সমেট জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীকে। এর জন্যই তাকে প্রমোশন দিয়ে বানানো হয়েছে DGFI কর্নেল লতিফের স্থানে। তাকে এইসব কর্মকাণ্ডে পরামর্শ দিচ্ছে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মঞ্জুর, জেনারেল মীর শওকত। এরাই হচ্ছে বর্তমানে সামরিক বাহিনী সম্পর্কে জিয়ার মূল পরামর্শদাতা। এতটুকু বলে আরও একগ্লাস পানি হাতে তুলে এক নিঃশ্বাসে পান করলেন এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব। সবাই গভীর মনোযোগ দিয়ে তার বক্তব্য শুনছিলাম।
আচ্ছা স্যার, এই হত্যাযজ্ঞের সাথে জেনারেল নুরুল ইসলাম শিশুও কি জড়িত? নূরের প্রশ্ন।
না, আমার মনে হয় শিশু এর মধ্যে নেই। সে নিজেকে এইসব থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে জিয়ার রাজনৈতিক দল গঠনের দায়িত্ব পালন করে চলেছে। কিছুক্ষণ ভেবে এভিএম তোয়াব আবার বলতে শুরু করলেন
আমি যতটুকু বুঝি, জিয়া চাইছে সামরিক বাহিনী থেকে উগ্র বিপ্লবী চিন্তাধারী সব অফিসার এবং সৈনিকদের নির্মূল করতে। এতে করে যত লোক মারতে হয় জিয়া মারবে, জেলে পাঠাবে আর চাকুরিচ্যুত করবে। এভাবেই জিয়া সমগ্র সামরিক বাহিনীর উপর তার একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কায়েম করতে বদ্ধপরিকর। এরপর তার সম্ভাব্য সব প্রতিদ্বন্দ্বীদের সরিয়ে তিনি তার আস্থাভাজন সেনা কমান্ডারদের হাতে সামরিক বাহিনীর দায়িত্ব দিয়ে নিজে জাতীয় রাজনৈতিক মঞ্চে অধিষ্ঠিত হবার চিন্তা ভাবনা করছেন বলেই আমার বিশ্বাস। হঠাৎ আমার দিকে চোখ ইশারা করে এভিএম তোয়াব বললেন
তোমার আব্বার সাথে জেনারেল জিয়া যোগাযোগ করছেন এবং তার মাধ্যমে শাহ আজিজ, শামসুল হুদা চৌধুরী, জাদু মিয়া প্রমুখদের তার দলে ভেড়ানোর চেষ্টা করছেন। এই ব্যাপারে কি তুমি কিছুই জানো না? তোমার আব্বার সাথে যোগাযোগটা বোধকরি শিশুর মাধ্যমেই হয়েছে। মনে হচ্ছে, জিয়ার এই রাজনৈতিক উদ্যোগের পেছনে মওলানা ভাসানীর আশির্বাদও রয়েছে। জানতে পারলাম ১৫ই আগস্টের পর তুমিই নাকি গোপনে জিয়াকে নিয়ে গিয়েছিলে সন্তোষে মওলানা ভাসানীর সাথে পরিচয় করিয়ে দিতে? আমি বিস্তারিত কিছু না বলে শুধু বললাম
আব্বা একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ, তাই তিনি যাই করছেন সেটা তার চিন্তাভাবনা মোতাবেকই করে থাকবেন, সেটা তিনি আমাকে জানিয়ে করবেন এমন ধারণাটা যুক্তিসঙ্গত নয়। এরপর কিছুটা বিব্রত অবস্থায় সার কথাটা বলবেন কিনা ভেবে নিয়ে তিনি বললেন কিছু কথা বলবো যদি তোমরা আমাকে ভুল না বোঝো।
মনে করার কিছুই নেই। আপনি মন খুলে সব কথাই বলতে পারেন। আপনি যাই বলছেন তা অত্যন্ত আন্তরিক ভাবেই বলছেন, সেটা আমরা সবাই উপলব্ধি করতে পারছি। আমার কথায় আশ্বস্ত হয়ে কোনও রাখঢাক না রেখে স্পষ্ট করেই তিনি বলতে লাগলেন
এখন যদি তোমরা জিয়ার বিরুদ্ধে কোনও সংঘাতে জড়িয়ে পরো তাহলে দেশবাসী সেটাকে সুনজরে দেখবে না। সামরিক বাহিনীতেও বিভ্রান্তির সৃষ্টি হবে। সবাই মনে করবে তোমরা ক্ষমতালিপ্সু, which you are not. I have no hesitation to say that all of you are selfless patriots of rare breed. আমার ধারণা, জিয়ার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনায় তোমাদের কোনও স্থান হবে না। তিনি যেভাবে এগুচ্ছেন তাতে তোমাদের কখনোই তিনি সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নিতে পারবেন না। তোমাদের সমর্থকরাও এটাই উপলব্ধি করেই তোমাদের তার ডাকের অপেক্ষা না করে ফিরে যেতে বলছে তাদের নিরাপত্তার জন্যই। আমার ধারণা, ইতিমধ্যেই তোমাদের অনেক সাথীদেরও জিয়া মেরে ফেলেছেন, এটাই তোমাদের ফিরিয়ে না নেয়ার প্রধান কারণ। যাদের উপর ভর করেই হউক না কেনো, তিনি একে একে খালেদ-চক্র, খন্দকার মোশতাক এবং কর্নেল তাহেরকে পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছেন চতুরতার সাথে। রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পথে এখন বাধা তোমরাই। তাই আমার মনে হয়, তিনি তোমাদেরকে সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেবেন না। শুধু তাই নয়, তিনি তোমাদের দেশেও ফিরতে দেবেন না যতদিন তিনি রাষ্ট্রপ্রধান হিসাবে নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করতে পারেন। তার এ ধরনের বক্তব্যে ফারুক ভীষণভাবে উত্তেজিত হয়ে উঠে আমাদের উদ্দেশ্য করে বললো
কি আমি বলিনি, Zia would prove himself to be a betrayer? আমরা সবাই নির্বিকার হয়ে জনাব তোয়াবের বক্তব্য শুনছিলাম। উত্তেজিত ফারুক একই ভাবে বলে উঠলো
How dare he kill our Comrades! He should not be allowed to go unchallenged. We must go back at once to confront the traitor and teach that bastard a lesson. Enough is enough. এভিএম তোয়াব ফারুককে শান্ত হতে বলে বললেন
Zia by default has been able to create an image in the country as a savior and a courageous leader. He has also by now somehow managed to establish equations with America, Britain and other world powers as well as India. He has also become a pseudo Islamist to draw attention of the oil rich Muslim countries. All this has been possible for him because, shrewdly he has been able to muster support of the members of the armed forces projecting him to be one of you all. I find it really amazing, how could he be so preposterous and could deceive you so easily! Anyway, I strongly feel, you have lost the battle for the time being and at this point of time, should you make any move against him that might not be successful. So, I humbly suggest, please, be cool and seriously ponder about the future.
আমি স্বচক্ষে দেখেছি ২-৩রা নভেম্বর রাতে ডালিম ও নূরকে অবিশ্বাস্য সাহসিকতার সাথে খালেদ-চক্রের সাথে আলোচনা করে কি করে জিয়ার প্রাণ বাঁচিয়ে ছিল নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। সেই রাতের ঘটনা প্রবাহ সারাজীবন আমার জন্য এক অমূল্য অভিজ্ঞতা হয়ে থাকবে। তাদের দেশপ্রেম এবং সাহস দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলাম আর বুঝেছিলাম তোমরা প্রত্যেকেই ঐশ্বরিক শক্তিতে বলিয়ান। তাছাড়া তোমাদের দূরদর্শিতা দেখেও আমি বিস্মিত হয়েছিলাম, যখন দেখলাম শক্তির দিক দিয়ে খালেদ-চক্রের চেয়ে অনেক বেশি বলিয়ান হয়েও তোমরা কোনও প্রকার সংঘর্ষের পথে এগুলে না, আলোচনার পর খালেদ-চক্রকে উৎখাত করার বিকল্প ব্যবস্থা করে প্রেসিডেন্টকে কি করতে হবে সেই পরামর্শ দিয়ে দেশত্যাগ করে ব্যাংকক চলে গিয়েছিলে ব্রিগেডিয়ার খালেদ আর কর্নেল হুদার স্ত্রীদের সাথে নিয়ে। আমি বুঝতে পেরেছিলাম কেনো তোমরা দেশ ছাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলে। এটা ছিল একটা কৌশলগত কারণ। সশস্ত্র সংঘাতের সুযোগে ভারত ২৫ বছরের চুক্তির আওতায় অবশ্যই আগ্রাসন চালিয়ে বাকশালীদের আবার ক্ষমতায় বসিয়ে দেশের স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্বকে বিলীন করে দিয়ে দেশটাকে সম্পূর্ণভাবে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করতো। ৭ই নভেম্বর এর অভ্যুথানের পেছনে তোমরাই ছিলে মূলশক্তি। দেশের সাধারণ মানুষ না জানলেও যারা সচেতন তাদের অনেকেই কিন্তু সেটা ইতিমধ্যেই বুঝতে পারছেন। কিন্তু আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। Image এর দিক থেকে জিয়া আর খালেদের মধ্যে রয়েছে বিরাট পার্থক্য। খালেদকে দেশবাসী এবং সৈনিকরা দেখেছিলো ভারতের দালাল হিসাবে, কিন্তু বর্তমানে জিয়ার পরিচিতি হচ্ছে একজন ভারত বিরোধী দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। এই বিষয়গুলো বিশ্লেষণ না করে কোনও হঠকারি পদক্ষেপ নিলে পরিণতি শুভ নাও হতে পারে। পরিশেষে এভিএম তোয়াব বললেন
জিয়ার সাথে মোকাবেলা করার একটাই পথ আছে। তার মোকাবেলা সম্ভব এক মাত্র রাজনৈতিক ভাবে। সশস্ত্র মোকাবেলা এই মুহূর্তে ফলপ্রসূ হবে না। এভাবেই সারগর্ভ মিটিং শেষ হল।
আমরা জানতে পারলাম ভেতরের অনেক তথ্য। আমরা সবাই খুবই মনোযোগের সাথে শুনছিলাম তার তথ্যভিত্তিক যুক্তি সঙ্গত বক্তব্য। এরপর ফারুক আর রশিদের সাথে তোয়াবের আর একটি বৈঠক হয়, সেখানে আমাদের কেউই উপস্থিত ছিল না বিধায় জানতে পারিনি তাদের মধ্যে কি কথা হয়েছিল। দু’টি মিটিং এর পর বাকি সময়টা হাল্কা পরিবেশে কাটিয়ে জমিরের সাথে ফিরে গেলেন এয়ার চীফ। যাবার প্রাক্কালে তোয়াব জানতে চাইলেন, জিয়া নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করবেন তার জন্য কি বার্তা তোমাদের তরফ থেকে দেয়া হয়েছে, তার জবাবে কি বলবেন তিনি।
আমি বললাম
জানাবেন রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে গাদ্দাফির বদান্যতায় রাজকীয় হালতেই আছি আমরা। তবে অপেক্ষায় আছি তিনি ওয়াদা মতো আমাদের কবে ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা করবেন। আরও বলবেন, বিলাসী জীবনে সময় কাটলেও মন আমাদের পড়ে আছে দেশেই, নাড়ির টান ভোলা সম্ভব নয়।
জনাব তোয়াব চলে যাবার পর হিসাব মিলাতে গিয়ে দেখলাম, বিভিন্নসূত্রে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে জেনারেল জিয়া এবং দেশের চলমান ঘটনাবলী সম্পর্কে আমাদের মূল্যায়নকেই স্বীকৃতি দিয়ে গেলেন এভিএম তোয়াব। তার বক্তব্যের চুলচেরা বিশ্লেষণের পর কয়েকটি বিষয় আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গেলো
১। জেনারেল জিয়া সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শ থেকে নিজেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে এক অবিশ্বাস্য প্রতারণার নজির স্থাপন করেছেন। শঠতা এবং কূটবুদ্ধির অধিকারী জিয়া তার উচ্চাভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য এতদিন সেনা পরিষদকে ব্যবহার করে এসেছেন। সেনা পরিষদের আন্তরিক সাহায্য সহযোগিতায় ক্ষমতার কেন্দ্রে আসীন হয়েই জিয়া ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য ন্যক্কারজনক ভাবে তার বিশ্বস্ত কোর্সমেট DGFI জেনারেল মহব্বতজান চৌধুরীর মাধ্যমে ষড়যন্ত্র মূলক ১৮টি ক্যু’দাতার (বিদ্রোহ) সাজানো নাটকের মাধ্যমে ‘মেকিয়াভেলির প্রিন্সে’র মতো নিষ্ঠুরতার সাথে সেনা পরিষদের পরীক্ষিত ত্যাগী নিবেদিতপ্রাণ দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর অফিসার এবং সৈনিকদের হত্যা করে সেনা পরিষদের শক্তি বিলীন করার চেষ্টা করছেন যাতে তার উপর আমাদের কোনও প্রাধান্য না থাকে। সবকিছু জিয়া করছেন সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অজুহাতের ধূম্রজাল সৃষ্টি করে।
২। তিনি দেশ ও জনগণের স্বার্থের পরিবর্তে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীর সাথে আপোষ করে ক্ষমতার রাজনীতির প্রবর্তন করে জাতীয় পর্যায়ে দুর্নীতির ক্যান্সারের জীবাণু ছড়িয়ে দিতে উদ্যোত হয়েছেন।
৩। যদিও জিয়ার ১৯ দফা কর্মসূচি সেনা পরিষদের ম্যানিফেস্টো ভিত্তিক, কিন্তু তিনি তার এই ম্যানিফেস্টো বাস্তবায়নে আন্তরিক নন। এর প্রচারণা শুধুমাত্র জনসমর্থন আদায় করে দেশবাসীকে ধোঁকা দেবার একটি কূটকৌশল মাত্র। কারণ, এই ধরনের বিপ্লবী কর্মসূচি বাস্তবায়নের জন্য অতি প্রয়োজনীয় সেনাবাহিনীর প্রকৃত দেশপ্রেমিক সদস্য, আত্মত্যাগী, পরীক্ষিত কর্মীবাহিনী এবং রাজনৈতিক অঙ্গনের প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদী ও ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী নেতা-কর্মীদের না মিলিয়ে তিনি একদিকে বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামী-বাকশালী এবং স্বাধীনতা বিরোধী শক্তির সাথে সমঝোতা করে ভারতের অনুকম্পা অন্যদিকে তথাকথিত মুসলিম বিশ্বের সাথে সখ্যতা গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একই সাথে আমেরিকা, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা দেশগুলোর কাছে জাতীয় স্বার্থ বিকিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে একটি আত্মনির্ভরশীল এবং প্রগতিশীল রাষ্ট্র হিসাবে এগিয়ে নেবার পরিবর্তে দেশটিকে একটি পরভৃৎ রাষ্ট্রে পরিণত করার পথ বেছে নিয়েছেন শুধুই নিজের ক্ষমতা কুক্ষিগত করার স্বার্থে।
৪। সামরিক বাহিনীতে তার একচ্ছত্র কর্তৃত্ব কায়েম করার জন্য আত্মঘাতী ‘Divide and Rule’ নীতির প্রয়োগের মাধ্যমে মুক্তিযোদ্ধা এবং পাকিস্তান থেকে প্রত্যাগতদের মাঝে সমন্বয়ের ধুয়া তুলে একটা নাজুক সমীকরণ সৃষ্টি করে জাতির মেরুদণ্ড সামরিক বাহিনীর ভিতকেই দুর্বল করে তুলেছেন জিয়া।
৫। আমাদের শক্তির উৎস হচ্ছে সেনা পরিষদ। যুদ্ধকালীন সময় কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ করে স্বেচ্ছাপ্রণোদিত ভাবে আমাদের একজন হয়ে কাজ করার অঙ্গীকার করার পরই আমরা এবং সেনা পরিষদ জিয়াকেই সংগঠনের মধ্যমণি হিসাবে গ্রহণ করে সব প্রতিকুলতার বিরুদ্ধে জীবনবাজি রেখে এগিয়ে আমাদের সুদূর প্রসারী নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচী বাস্তবায়নের লক্ষে তাকে ধাপে ধাপে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করেছিলাম। এই সত্য জানা সত্ত্বেও অভাবনীয়ভাবে জিয়া এখন সেই সংগঠনের সাথেই বেঈমানি করে যেভাবে সেটাকে নির্মূল করতে মরিয়া হয়ে উঠেছেন সেটা তার পক্ষে সম্ভব হলেও আমাদের পক্ষে নিজেদের উদ্যোগে অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষায় তিলে তিলে গড়ে তোলা সংগঠনের শহীদদের রক্তের সাথে বেঈমানি করে তাদের রক্তে রঞ্জিত ব্যক্তির হাত ধরে তার সাথে রাজনীতি করার কোনও প্রশ্নই ওঠে না। তার হত্যাযজ্ঞের কবল থেকে সাথীদের বাঁচাতে না পারলেও তাদের রক্তের সাথে মোনাফেকিতে আল্লাহর আরশ কেঁপে উঠবে, তার আদালতে আমরা কখনোই ক্ষমার যোগ্য বলে বিবেচিত হবো না।
৬। জিয়া আমাদের নৈতিকতা, ব্যাপক পরিচিতি, গ্রহণযোগ্যতা, সাহস এবং কর্মক্ষমতা সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত। তাই আমাদের হাত পা কেটে শক্তিহীন পঙ্গু করার পরও আমাদের নিজের নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য অবশ্যই চেষ্টা করবেন সেই বিষয়ে আমাদের এখন থেকেই সতর্ক থাকতে হবে।
৭। ঘটনা প্রবাহ যেভাবে এগুচ্ছে তাতে যুক্তিসঙ্গত ভাবেই বলা চলে দেশে ফিরে তার প্রতিদ্বন্দ্বী হিসাবে রাজনীতি করার সুযোগও খলনায়ক জিয়া আমাদের দেবেন না।
৮। জিয়ার বদান্যতায় খন্দকার মোশতাকের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎও যে খুব একটা উজ্জ্বল হয়ে উঠবে সে সম্পর্কেও যথেষ্ট সন্দেহের অবকাশ রয়েছে।
৯। জিয়া এবং তার ভবিষ্যৎ রাজনীতি সম্পর্কে সঠিক মূল্যায়নের জন্য আমাদের ধৈর্যের সাথে অপেক্ষা করতে হবে। জিয়ার আমলে আমাদের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ সম্পর্কে একমাত্র শিশুভাই সঠিক দিকনির্দেশনা দিতে পারেন জিয়ার মনোভাবের পরিপ্রেক্ষিতে। তাই আমার উপরই দায়িত্ব দেয়া হল সম্ভব হলে শিশুভাইয়ের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করার।
১০। সর্বসম্মতিক্রমে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হল, এয়ার চীফ তোয়াবের বক্তব্যের বাস্তবতায় জিয়ার সাথে কোনও রকমের সশস্ত্র সংঘর্ষের চিন্তা সম্পূর্ণভাবে অযৌক্তিক বিধায় বর্জনীয়।
প্রায় সব দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী নেতা-নেত্রীদের সাথে সেনা-পরিষদের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের রয়েছে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। একই ভাবে আমলাতন্ত্র, সুশীল সমাজ, মিডিয়া এবং ব্যবসায়ী মহলের অনেকের সাথেই আমাদের রয়েছে সখ্যতা। সম্পর্ক গড়ে উঠেছে বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই। এই ধরনের যোগাযোগ না থাকলে আগস্ট বিপ্লব কোনক্রমেই দেশজোড়া স্বতঃস্ফূর্ত সমর্থন পেতো না। ফারুক-রশিদের দেশব্যাপী কিংবা সমগ্র সামরিক বাহিনীতে তেমন কোন বিশেষ পরিচিতি ছিল না। বিষয়টির ব্যাপারে দুই ভায়রা ভালোভাবেই অবগত ছিল। আমাদের এই পার্থক্যটা নিজেদের অভ্যন্তরীণ বিষয় বিধায় কখনোই বাইরে প্রকাশ করা হয়নি।
শিশুভাইকে বেনগাজীতে আসার অনুরোধ
সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমি এক রাতে শিশু ভাইকে ফোন করলাম
আসসালাম শিশুভাই, ডালিম হেয়ার, এয়ার চীফ ঘুরে গেলেন। আমাদের সবার ইচ্ছে আপনিও একবার যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমাদের দেখে যাবার একটা ব্যবস্থা করে চলে আসুন। বিশেষ প্রয়োজন আপনার সাথে দেখা করার যদিও জানি আপনি ভীষণ ব্যস্ত থাকেন আজকাল, তোয়াব তাই বললেন। তার সফরের পর আপনার আসাটা বিশেষ জরুরী হয়ে পড়েছে আমাদের জন্য। I am sure, you know what I mean. Don’t you?
Walaikum Assalam, yes I do. I understand you guys are having a fabulous time out there as State Guests. What a coincidence! Zia has already asked me to visit you all to discuss a very important matter about his plan about your future. He is pressing me hard to take the trip at the earliest. তাই নাকি! তা হলে তো কোন সমস্যাই নেই। Please, come at the soonest. Wilco. I shall be with you all within a week In Sha Allah.
Oh! Shishu Bhai that would be great! We all shall be waiting anxiously for your arrival. Take care, Allah Hafez আল্লাহ্ হাফিজ জানিয়ে ফোন রেখে দিলেন শিশুভাই।
খবরটা জেনে সবাই খুবই খুশি হল, কিন্তু দুই ভায়রা ছিল নির্বিকার। আমরা সবাই উদগ্রীব হয়ে দিন কাটাচ্ছিলাম শিশুভাইয়ের আগমনের প্রতীক্ষায়। ইতিমধ্যে হঠাৎ আমাদের কাউকে কিছু না জানিয়ে দুই ভায়রা বেনগাজীর বাইরে কোথাও চলে গেলো। জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও তাদের স্ত্রীরা জানালো না তারা কোথায় গেছে। তাদের এই ধরণের ব্যবহারে আমরা কিছুটা আশ্চর্য হয়ে গেলাম। সালেমকে জিজ্ঞেস করলে উনি বললেন, দুইজনই বিশেষ প্রয়োজনে লন্ডন গেছে। তবে প্রয়োজনটা কি সেটা সে জানে না। উধাও হওয়ার তৃতীয় দিন রাতে হঠাৎ টিভিতে আমরা সবাই দেখতে পেলাম, BBCতে এক টকশোতে রশিদ আর ফারুকের Live Interview প্রচারিত হচ্ছে। Interview নিচ্ছেন অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস। তারা কথা বলছে ১৫ আগস্ট সেনা অভ্যুত্থান সম্পর্কে। তাদের এ ধরণের হঠকারি উদ্যোগে আমরা হতবাক হয়ে গেলাম! তাদের বক্তব্য শুনে সবাই শঙ্কিত হয়ে দুঃখে ক্ষোভে কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থায় বসে থাকলাম অনেকক্ষণ। ব্যাংককের ঘটনার পর তাদের কিছুটা শক্তভাবেই বলা হয়েছিলো ভবিষ্যতে যেন এই ধরনের কোনও প্রচারণা না করে। এরপরেও তাদের এই ধরনের উদ্যোগ নেয়া আমাদের জন্য ক্ষোভের কারণ হয়ে দাড়ালো। ফিরে আসার পর তাদের সাথে আমাদের এই বিষয়ে মনোমালিন্য এবং তিক্ততা সৃষ্টি হয়। দেশে-বিদেশে তাদের ওই ইন্টারভিউ নিয়ে অনেক সমালোচনা হয়েছিলো, এখনও হচ্ছে। দেশের সব রাজনৈতিক দলই তাদের এই Interview থেকে যার যার স্বার্থে ফায়দা নেবার চেষ্টা করছে সত্যের বরখেলাপ করে।
এই হতাশার মধ্যেই খবর পেলাম শিশুভাই ত্রিপোলি এসে পৌঁছেছেন। জমির তাকে নিয়ে আসছে বেনগাজীতে। ত্রিপোলিতে ট্রানজিটে কিছু সময় কাটিয়ে দুপুরে বেনগাজীতে এলেন শিশুভাই। লন্ডন থেকে আসায় কিছুটা ক্লান্ত। তাই প্রথমেই তার বিশ্রামের ব্যবস্থা করা হল লম্বা সফরের ধকল কাটিয়ে ওঠার জন্য। গোসল করে অল্প কিছু খেয়ে সন্ধ্যা পর্যন্ত লম্বা ঘুম দিয়ে ফ্রেশ হয়ে উঠলেন শিশুভাই।
স্বাধীনতার পর জিয়াকে যখন সেনাসদরে বদলী করে আনা হয়ে তখন শিশুভাই কিছুদিন কুমিল্লাতে ব্রিগেড কমান্ডার ছিলেন। শিশুভাই এর নেতৃত্বে আমরা কুমিল্লাতে ২টি আর্টিলারি ইউনিট ১ম ফিল্ড রেজিমেন্ট এবং তৃতীয় ফিল্ড রেজিমেন্ট গড়ে তুলেছিলাম। তাছাড়া Bangladesh Military Academy এবং Physical Training School গড়ে তোলার প্রক্রিয়াও তখনই শুরু করা হয়েছিলো। সবাই আমরা দিনরাত অমানুশিক পরিশ্রম করে চলেছিলাম সেই প্রতিষ্ঠান গুলো দার করাবার জন্য।
সেই সময় প্রায় প্রতিসপ্তাহে আমরা সপরিবারে ঢাকায় চলে আসতাম। শিশুভাই এবং টনিভাবী তাদের নিজস্ব বাসায় না থেকে আমাদের বাড়িতে থাকতেই স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করতেন পারিবারিক সম্পর্কের কারণে। বিত্তবান বন্ধুদের পার্টিতে যোগ দিয়ে হৈ হুল্লোড় করে কুমিল্লায় সোমবার সকালে ফিরে গিয়ে প্যারেডে উপস্থিত হতাম। রশিদ, ফারুকের সাথে আমাদের ‘নাবালক জেনারেল’ শিশুভাইর তেমন ঘনিষ্ঠতা ছিল না। পাশা, শাহরিয়ার, হুদাও তখন কুমিল্লাতেই আমাদের সাথেই। নূরের সাথে তার ঘনিষ্ঠতা ‘৭১ সালের যুদ্ধকালীন সময় থেকেই। পথে লন্ডনে তিনি খালাম্মাদের সাথেও দেখা করে এসেছেন। খালাম্মা আমাদের জন্য কিছু দেশী মাছ ও চওসা আম, পানের সরঞ্জাম পাঠিয়ে দিয়েছেন। তাছাড়া টনি ভাবী দেশ থেকে মেয়েদের জন্য শাড়ি আর ছেলেদের জন্য পায়জামা কুর্তা পাঠিয়েছেন। সাথে পাটালি গুড়, চিঁড়া-মুড়ি- আরো দিয়েছেন পোড়াবাড়ির চমচম আর নাটোরের কাঁচাগোল্লা। শিশুভাইয়ের আগমনে আমাদের ভায়রা ভাইদের প্রতি ক্ষোভ অনেকটাই প্রশমিত হল। আমরা সবাই তার আসায় খুশি হলেও রশিদ, ফারুক তার আগমনকে সন্দেহের চোখে দেখতে লাগলো। আমরা জানতাম, বর্তমানে শিশুভাই জেনারেল জিয়ার একজন আস্থাভাজন পরামর্শদাতা হলেও তিনি এখানে তার পক্ষ থেকে গোয়েন্দাগিরি করতে আসেননি। তিনি এসেছেন আমাদের পুরনো অতি আপন শিশুভাই হিসেবেই। শিশুভাই, জিয়াউর রাহমান, মীর শওকত, মুস্তাফিজুর রহমান সবাই পাকিস্তান আর্মিতে থাকা কালে Intelligence Course করা অফিসার এবং একই সময় ISI-তে তরুণ অফিসার হিসাবে চাকুরি করেছেন। এটাই শিশুভাইয়ের উপর জিয়ার আস্থার কারণ। আসার আগে শিশুভাই আব্বার সাথেও দেখা করে এসেছেন। শিশুভাই পৌঁছার আগেই আব্বা ফোনে আমাকে জানিয়ে দিয়েছিলেন-শিশু তোদের বর্তমান জটিল অবস্থা সম্পর্কে বিস্তারিত ভাবে জানাবে যাতে তোরা ভবিষ্যতে তোদের করণীয় বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পারিস। শিশুভাইকে আমাদের কাছে পৌঁছে দিয়ে জমির ফিরে গেলো ত্রিপোলিতে। আমরা ঠিক করে রেখেছি যে সমস্ত জটিল সমস্যা নিয়ে আমরা দিনরাত ভাবছি সেগুলো সম্পর্কে শিশুভাই এর বিশ্লেষণ আমাদের জেনে নিতে হবে। আমরা বলবো কম শুনবো বেশি। আমরা জানতাম রশিদ আর ফারুক আমাদের আসরে অস্বস্তির কারণেই বেশীক্ষণ থাকবে না। তারা চলে যাবার পরই শুরু হবে আমাদের সিরিয়াস আলাপ। তাদের উপস্থিতিতে শিশুভাইও খোলামেলা আলাপ করবেন না। তিনি চাইবেন আমাদের সাথেই মন খুলে আলাপ করতে। ভায়রা ভাইদের ওজন কতটুকু সেটা শিশুভাই ঠিকই জানতেন। সেনা পরিষদ সম্পর্কে বিশদভাবে না জানলেও শিশুভাই জানতেন আমাদের জনপ্রিয়তা এবং শক্তি সামরিক বাহিনীতে কতটুকু। তিনি যুদ্ধকালীন সময় থেকেই বুঝতে পেরেছিলেন একটা সমঝোতার ভিত্তিতে জিয়াকে বর্মের আবরণে রেখে কি করে সেনা পরিষদ তাঁকে Rallying person হিসাবে ক্ষমতার কেন্দ্রে নিয়ে এসেছিলো। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিশুভাইয়ের চেয়ে বেশি কেউই জানবে না, ৭ই নভেম্বর কোন শক্তি জিয়াকে মুক্ত করে তাকে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেছিলো। সেনাবাহিনীতে আইন-শৃঙ্খলা ফিরিয়া আনার নামে জিয়া ঐ শক্তির সাথে কি করছেন? তার অপ্রত্যাশিত ন্যক্কারজনক-নৃশংস এই বিশ্বাসঘাতকতার কারণটা কি! জিয়া সম্পর্কে সেনা পরিষদ এবং আমাদের মনে যে অস্বচ্ছতা দেখা দিয়েছে সেটা পরিষ্কার করে নিতে হবে শিশুভাইয়ের কাছ থেকে যাতে স্বচ্ছ ধারণার উপর ভিত্তি করে আমরা নিজেদের করণীয় সম্পর্কে সঠিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে পারি। সন্ধ্যায় শিশুভাই জেগে ওঠার পর চা-নাস্তা সেরে আমরা কনফারেন্স রুমে তাকে নিয়ে বসলাম। রশিদ, ফারুককেও ডেকে আনা হল। বৈঠকের শুরুতেই রশিদ জিজ্ঞেস করলো, শিশুভাইয়ের আগমনের এজেন্ডা কি?
জবাবে শিশুভাই বললেন
আমি মূলত এসেছি তোমাদের সাথে দেখা করে খোঁজখবর নিতে। তাছাড়া জেনারেল জিয়ার তরফ থেকে তোমাদের জন্য একটা প্রস্তাব নিয়ে এসেছি। প্রস্তাবটা কি? ফারুকের প্রশ্ন।
আমি ফিরে যাবার পর জেনারেল জিয়া ডালিম আর রশিদকে ডেকে পাঠাবেন তোমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে তার চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে আলোচনার জন্য। Why only Dalim and Rashid? ফারুক প্রশ্ন ছুঁড়ে দিল। শিশুভাই তার স্বভাবসুলভ স্মিতহাসির সাথে জবাব দিলেন
জেনারেল জিয়ার মনের খবর আমার জানার কথা নয়। তবে ধারণা করছি, দুই ভায়রার তরফ থেকে একজন আর বাকিদের তরফ থেকে একজনকে ডেকে পাঠালেই যথেষ্ট হবে বলে মনে করে থাকতে পারেন জেনারেল জিয়া। ফারুক জবাব শুনে ঠোঁট কামড়াতে থাকল। উত্তেজিত হলে ঠোঁট কামড়ানো তার একটি বদ অভ্যাস। ফারুক বলে উঠলো জিয়া আগস্ট বিপ্লব এবং আমাদেরসহ বিপ্লবীদের সাথে ক্ষমতালিপ্সু হয়ে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। আমাকে ডেকে পাঠালে আমি তাকে এই সত্যিটা সঠিকভাবে বুঝিয়ে দিতাম। শিশুভাই তাকে শান্ত করার চেষ্টা করে বললেন
যা বুঝাবার সেটাতো অ্যান্টনি ম্যাসকারেনহাস-এর সৌজন্যে বিবিসির টক শোতে লাইভ ইন্টারভিউতে প্রচার করে শুধু জিয়াকেই নয়, বিশ্ববাসীকেই বুঝিয়ে দিয়েছো। সেক্ষেত্রে একই কথা শোনার জন্য তোমাকে ডেকে পাঠাবেন কেনো জেনারেল জিয়া? Interview তে রশিদকে কথা বলার তেমন একটা সুযোগ তুমি দাওনি। তাই তার না বলা কথাগুলো হয়তো জেনারেল জিয়া শুনতে চান। বুদ্ধিমান শিশুভাই এমন একটা মোক্ষম উত্তর দেবেন সেটা অপ্রত্যাশিত ছিল না। ফারুক যথোপযুক্ত জবাবটা হজম করে কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলল As far as I am concerned, I am least interested to talk with a traitor. He can go to hell, but let me tell you his heinous injustice and crime shall not go unchallenged. You may convey this to him. I shall do that. Bloody swain bastard Zia! Have you got anything else to communicate?
No, nothing of your interest I presume. Well, then we shall beg your leave. Pleasure is yours. বলতেই রশিদের দিকে তাকাল ফারুক। উঠে দাড়ালো রশিদ। চলে যাচ্ছিলো দুই ভায়রা। হঠাৎ শিশুভাই রশিদের দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন
কি রশিদ ডাকলে যাবে তো? স্বভাবসিদ্ধ মিনমিনে গলায় একটু বাঁকা ভাবে রশিদ জানালো
Formal invitation টা এলে ভেবে দেখবো কি করা উচিৎ।
এরপর দুই ভায়রা কনফারেন্সে রুম থেকে বেরিয়ে গেলো। আমরাও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললাম! কিছুটা বিব্রতভাবেই আমি বললাম
বিশ্বাস করুন শিশুভাই, তাদের ওই Live Interview সম্পর্কে আমরা কিছুই জানতাম না। হঠাৎ দুই ভায়রাকে TV তে দেখে আমরা সবাই বেকুব বনে গিয়েছিলাম। ব্যাংককে তাদের আমেরিকান এমব্যাসিতে যাওয়াটাও ছিল degrading and we had warned them both not to act like this in future and they agreed. এরপরও এ ধরনের একটা preposterous self-defeating venture তারা করতে পারে সেটা আমরা ভাবতেও পারিনি। তাদের ঐ Interview নিয়ে আমরা সবাই ভীষণ ক্ষুব্ধ ও মর্মাহত। আমি জানি এই ধরনের হঠকারি তৎপরতার সঙ্গে তোমাদের কোনও সম্পর্ক থাকতে পারে না। ধীরে ধীরে পরিবেশ হাল্কা এবং আনন্দমুখর হয়ে উঠলো। পাশাই কথা শুরু করলো
জানতে পারলাম, জিয়ার একান্ত বিশ্বাসভাজন ব্যক্তি হিসেবে ইতিমধ্যেই দেশজুড়ে ‘বাংলাদেশের রাজপুতিন’ নামে খ্যাতি লাভ করে ফেলেছেন, তার পরিণতিটাও কিন্তু রাশিয়ার জারের চেয়েও করুণ হয়েছিলো। তাকেও বিপ্লবীরা জার পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কের কারণে গুলি করে মেরে ফেলেছিলো। পাশার কথায় সবাই অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। পাশার কথার জের ধরে আমি বললাম
আমাদের Happy go lucky type শিশুভাইয়ের পাকিস্তানের জেনারেল জিয়াউল হকের রাজনৈতিক গুরু জেনারেল জিলানীর মতো জেনারেল জিয়াউর রহমানের Political Guru হবার খায়েশ হল কেনো? নামের মধ্যে কিছুটা মিল আছে তার জন্য নাকি Rich and Famous হবার বাসনায়!
হাসির রোল উঠলো আবার।
একটা প্রশ্নের মত প্রশ্ন করেছো মানতেই হবে, তবে জবাবটা দুটোর একটাও নয়। I must clear one thing here that I still stick to what I said to you all in Bangkok. When Zia requested me that he needs me, I very frankly told him that I still maintain my earlier position that I am not at all interested to serve in the army so, I can’t help him in military affairs. Listening to my submission he requested me to help to lay the political platform for him. Considering his mind set and ruthlessness I had thought that it would not be prudent to refuse his request. Therefore, I decided to accept this assignment but on clear terms that the moment my immigration papers would be in my hand I along with my wife and children shall leave for USA to join the rest of my family. That is how got involved in the political affairs. Now, reiterating my position I feel obligatory that I must tell you guys something in confidence as I and Tony love you all and particularly, we are indebted to Dalim and Shapan and their family. The reason is well known to you all.
বুঝতে পারলাম শিশুভাই গুরুত্বপূর্ণ কিছু বলবেন। আমার বক্তব্যের অনেক কিছুই ডালিমের জানা আছে, তবে তোমাদের অনেকেরই হয়তো অনেকটাই জানা নেই। তরুণ ইন্টেলিজেন্স অফিসার হিসাবে আমি, জিয়া, মীর শওকত, মুস্তাফিজুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানে পোস্টেড ছিলাম। কোনও রাজনৈতিক দায়িত্বে আমরা কেউই নিয়োজিত ছিলাম না। তাই জাতীয় রাজনৈতিক অঙ্গন তো দূরের কথা, মাটি আর মানুষের সাথে আমাদের কোনও সম্পর্কই ছিল না। যেমনটি রয়েছে তোমাদের প্রায় সবারই। ছাত্রাবস্থা থেকেই তোমরা সবাই কমবেশি জড়িত ছিলে ছাত্র এবং জাতীয় রাজনীতির সাথে। ফলে বিভিন্ন মত ও পথের রাজনৈতিক দল, নেতা-কর্মীদের সাথে তোমাদের পরিচিতি ও ঘনিষ্ঠতার বলয় বহুল বিস্তৃত। এর জন্যই মূলত ‘৭১ সালে যুদ্ধের সময়কালে এবং স্বাধীনতাত্তোর বাংলাদেশকে নিয়ে রুশ-ভারত আধিপত্যবাদী নীলনকশার বিরুদ্ধে তোমরা গোপন সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু করার উদ্যোগ নিতে পেরেছিলে। জিয়া ছিল তোমাদের Rallying Point. তোমাদের উদ্দেশ্য ছিল স্বাধীনতার পর বৈপ্লবিক পদক্ষেপের মাধ্যমে পুরানো সমাজকে বদলিয়ে এক নতুন গণমুখী, প্রগতিশীল, স্বনির্ভর, সুখী-সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ে তোলা। Am I right? To be honest, very few of us had slightest clue about all such pious dreams. But you know something, at heart I sincerely got fascinated with the courage and commitment of you all and your cause but couldn’t be bold enough to be part of that endeavor. ওই সময় থেকেই আমি তোমাদের মনে মনে শ্রদ্ধা করে এসেছি এবং ভালবেসেছি আন্তরিকভাবে। কিন্তু জেনারেল জিয়াকে যখন তোমরা মধ্যমণি হিসাবে গ্রহণ করেছিলে তখন আমার মনে হয়েছিলো তোমরা ভুল করছো। একদিন আমি এই বিষয়টি ডালিম আর নূরের কাছে উত্থাপনও করেছিলাম, কিন্তু ওরা দু’জনই তখন আমাকে বলেছিলো
শিশুভাই, মুক্তিযুদ্ধ তো আমাদের মন-মানশিতার অনেক পরিবর্তন এনেছে। সেই ক্ষেত্রে তেমন পরিবর্তন জেনারেল জিয়ার মধ্যেও তো আসা সম্ভব। তাছারা তিনি কোরআন শপথ নিয়ে আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাসী হয়েই আমাদের সাথে ভবিষ্যতের সংগ্রামে কাজ করতে রাজি হয়েছেন। সেক্ষেত্রে তাকে কি করে অবিশ্বাস করা যায় বলুন? এর জবাব আমার কাছে ছিল না তাই চুপ করে গিয়েছিলাম। ডালিম, নূর তোমরা দু’জনেই এখানে উপস্থিত, বল আমি সত্যি বলছি কিনা।
আপনি সত্যিই বলছেন।
এতদিন যে কথাগুলো মনে চেপে রেখেছিলাম সেগুলোই আজ তোমাদের কাছে বলে নিজেকে একটু হালকা করতে চাচ্ছি যদিও আমার এই বক্তব্য তোমাদের জন্য প্রাসঙ্গিক নাও হতে পারে। Hope, I am not boring you all?না, শিশুভাই মোটেও না, বরং ভালোই লাগছে আপনার স্পষ্ট অভিব্যক্তি। আপনি বলুন নিঃসংকোচে।
Thanks. আবার বলা শুরু করলেন শিশুভাই
যদিও ১৯৭১ সাল থেকেই আমি আর্মি থেকে নিজেকে সরিয়ে নিয়েছিলাম মনেপ্রাণে তবুও আমি কিন্তু দেখছিলাম স্বাধীনতার পর কি অসাধারণ প্রজ্ঞা, বিচক্ষণতা, সাহস আর বুদ্ধিমত্তার সাথে সবার চোখকে ফাঁকি দিয়ে অবিশ্বাস্য দক্ষতার সাথে তোমরা নিজেদের সংগঠিত করছিলে। Being a man trained in intelligence I was simply dazed! এতে তোমাদের জন্য আমার মনে শ্রদ্ধা আরও বেড়ে গিয়েছিল। মনে করো না শিশুভাই তেল দিচ্ছেন, কিন্তু দেখলাম সব চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে যখন তোমরা জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসালে তখনই মানুষটি তোমাদের পিঠে ছোরা মেরে অন্য পথে যাত্রা শুরু করলো! এতে তোমাদের কোনও দোষ নেই As, it is most difficult thing to read human mind and psychology. I was simply shocked and I cried believe it or not! এ ধরনের মোনাফেকি জিয়া কেনো করলো সেটা এখনও আমার কাছে স্পষ্ট নয়। তোমরাতো তাকে একজন জনদরদী বড় মাপের জাতীয় নেতাই বানাতে চেয়েছিলে, সেই ক্ষেত্রে সে কাদের পরামর্শে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মেরে বসলো এটাও একটি রহস্য! সময়ই একদিন এই রহস্য উদ্ঘাটন করবে। আমরা উপস্থিত সবাই শিশুভাই-এর স্বগতোক্তি নিশ্চুপ হয়ে শুনছিলাম। জিয়ার একজন বিশেষ আস্থাভাজন জেনারেল হয়েও এতোটা আন্তরিকতার সাথে তিনি এত খোলাখুলি ভাবে আমাদের বিশ্বাস করে এভাবে নিজের অন্তরটাকে আমাদের কাছে মেলে ধরবেন এতোটা প্রত্যাশা আমাদের ছিল না। এ যেন এক অচিন্তনীয় বিস্ময়! তার আন্তরিকতা আমাদের সবার মন ছুঁয়ে গিয়েছিলো। আমরা আজ অজানা অন্য এক শিশুভাইকে আবিষ্কার করে আবেগে আপ্লুত হলাম। আন্তরিকভাবে শিশুভাই যা বলছিলেন তাতে আমরা অনেক জটিল প্রশ্নের জবাব পেয়ে যাচ্ছিলাম। তার বক্তব্যে অনেক গুরুত্বপূর্ণ চিন্তার খোরাকও রয়েছে আমাদের জন্য।
পাশা বললো
আচ্ছা, শিশুভাই আপনি বললেন জেনারেল জিয়া কেনো এমন বিশ্বাসঘাতকতা করলেন, তার জবাবটা এখনও আপনার কাছে স্পষ্ট নয়। আমার বিশ্বাস জেনারেল জিয়াকে আপনি যতটুকু জানেন সেই পরিপ্রেক্ষিতে এ ব্যাপারে একটা ধারণা আপনার নিশ্চয়ই আছে। আমার অনুরোধ আপনি সেটাই আমাদের বলুন।
পাশা, তুমি ঠিকই বলেছো। সহকর্মী হিসাবে জেনারেল জিয়ার চরিত্র এবং মানসিকতা সম্পর্কে আমার ব্যক্তিগত একটা মূল্যায়ন অবশ্যই আছে। জানিনা আমার এই মূল্যায়নের সাথে তোমাদের মূল্যায়নের মিল থাকতেও পারে আবার নাও থাকতে পারে। তবু পাশা যখন জানতে চাইলো তাই বলছি।
পাকিস্তান আমলে সামরিক বাহিনীতে আমরা যারা ভর্তি হয়েছিলাম তারা সবাই প্রায় উচ্চবিত্ত কিংবা মধ্যবিত্ত থেকে আগত। রাজনৈতিক সচেতনা এবং জাতীয় রাজনীতির সাথে আমাদের বেশীর ভাগ সদস্যদের কোনও যোগাযোগ তেমন একটা ছিল না। তাই সমাজিক শোষণ-বঞ্চনা সম্পর্কে আমরা ছিলাম অসচেতন। আর্মি পাকিস্তানের প্রায় জন্মলগ্ন থেকেই ছিল শাসকগোষ্ঠীর মেজর পার্টনার। তাই আমরা সবাই হয়ে উঠি Part of ruling elites. দেশের অনান্য শ্রেণী বিশেষ করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের আমরা সর্বদাই অবজ্ঞার চোখেই দেখেছি। তাইতো আমাদের সবার মুখে মুখে একটি প্রবাদ বহুলভাবে উচ্চারিত হতো ‘Damn Politician!’ আমলাতন্ত্র, বিচার বিভাগ এবং সুশীল সমাজপতিদেরও আমরা তেমন কোনও পাত্তা দিতাম না। এর জন্য চকচকে বন্দুকের নলের ভয়ে ওদের নতজানু ‘জি হুজুর’ মানসিকতাই ছিল প্রধান কারণ। আমাদের একটা জ্ঞান দেয়া হয়েছিলো, দেশের উন্নয়নে এদের তুলনায় আমরাই বেশি contribute করতে সক্ষম because, we are relatively more cohesive disciplined force, more focused about the modern world affairs and technology besides, the vested interested feudal landlords. এই complex-এর ফলেই পাকিস্তানে দীর্ঘকাল সামরিক শাসন কায়েম থাকে। জেনারেল জিয়া comes from a very humble middle class family. গাবতলিতে জন্মালেও করাচির জ্যাকব লেনে থেকে মানুষ। তার বাবা ছিলেন সরকারি চাকুরে। একজন Section Officer. করাচীর জ্যাকব লাইনের বাসিন্দা ইসলামিয়া কলেজ থেকে পাশ করে সোজা PMA তে। ছাত্র জীবনে রাজনীতির ধারে কাছেও ঘেষেননি জেনারেল জিয়া। পূর্ব পাকিস্তানে জন্ম হলেও পূর্ব পাকিস্তানের মাটি আর মানুষের সাথে তার কোন সম্পর্কই ছিল না। ঠিকমত বাংলাও বলতে অভ্যস্ত ছিলেন না জেনারেল জিয়া। রাজনৈতিক জ্ঞানের দৌড় ঐ পর্যন্ত, দেশের কল্যাণে সামরিক বাহিনীকেই হতে হবে মেজর প্লেয়ার। বাকিরা থাকবে তাদের অধীনস্থ। প্রগতিশীল কিংবা বামপন্থীদের তো আমরা জাতীয় শত্রুই মনে করতাম সে কারণেই পাকিস্তানে বাম রাজনীতি ছিল ব্যান্ড। এই পরিপ্রেক্ষিতে বলতে দ্বিধা নেই, সাম্যবাদ কিংবা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণে রাজনীতি সম্পর্কে আমাদের আকর্ষণ বা জ্ঞান ছিল শূন্যের কোঠায়। বেশিরভাগ অফিসারই ছিলাম চাকুরিতে কি করে উন্নতি করা যায় সেই প্রচেষ্টায় নিয়োজিত। ‘৭১ সালে আর্মি ক্র্যাকডউনের পর সবকিছুই ওলটপালট হয়ে যায়। মুজিব বা জিয়া কেউই জানতেন না, কি করে এ ধরনের শ্বেতসন্ত্রাস থেকে নিজেদের বাঁচানো যায়। ফলে নিজের অজ্ঞতা এবং অধীনস্থদের চাপ থেকে বাঁচার জন্য মুজিব স্বেচ্ছায় আর্মির কাছে আত্মসমর্পণ করেন। আর জিয়া অধীনস্থ অফিসার আর সৈনিকদের চাপে নিরুপায় হয়ে অনেকটা প্রাণের দায়েই স্বাধীনতার ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন। সেই স্বাধীনতার ঘোষণা রাতারাতি জিয়াকে পরিণত করে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে একজন সাহসী যোদ্ধা ও দিকনির্দেশক হিসাবে। জিয়ার এই পরিচিতি এবং জনপ্রিয়তা তাকে কোন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিলো জনগণের চোখে সে সম্পর্কে জিয়া সেই সময় নিজেও বুঝতে সক্ষম হননি, কিন্তু ভারত ঠিকই বুঝতে পেরেছিলো। পরে ভারতের চাপে তার ঘোষণায় পরিবর্তন এনে মুজিবের নামটাও যুক্ত করা হয়। জিয়া তার প্রথম ঘোষণায় নিজেকেই স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি হিসাবে প্রচার করেন। তার সেই ঔদ্ধত্যকে ক্ষমাসুন্দর দৃষ্টিতে দেখেনি রুশ-ভারত অক্ষশক্তি এবং তাদের দোসর এবং মনোনীত অস্থায়ী আওয়ামীলীগ সরকার। As a logical conclusion he was admonished and removed from the post of Sector Commander of No1 Sector thus withdrawing from the main stream of the freedom struggle and was dumped at the Mujib Nagar Headquarters at 8 Theater Rd in Calcutta. In other words, he was literally being thrown into dustbin. কিন্তু তোমাদের চাপে তাকে সম্পূর্ণভাবে শেষ করে দেয়া সম্ভব হয়নি। Rest is history. আমি যতটুকু জানি তার চেয়ে অনেক বেশি জানো তোমরা যারা মুক্তিযুদ্ধ করার সাথে সাথে সেনা পরিষদের ভিত্তি তৈরি করছিলে। যোগাযোগ বৃদ্ধি করছিলে অনান্য দেশপ্রেমিক জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের সাথে। শুধু তাই নয়, ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ভারতের উত্তরপূর্ব অঞ্চলের স্বাধীনতার যুদ্ধে রত ‘Seven Sisters’ এর নেতা-কর্মী এমনকি নকশালবাড়ি আন্দোলনের চারু মজুমদারের সাথেও তো তোমাদের যোগাযোগ ছিল। বন্ধু হিসেবে বিভিন্ন ভাবে তোমরা তাদের সংগ্রামে সাহায্য-সহযোগিতাও করেছো। এই ধরনের দূরদর্শিতা একমাত্র রাজনৈতিকভাবে সচেতন ব্যক্তিদের পক্ষেই সম্ভব হয়।
এবার স্বল্পভাষী নূর মুখ খুললো
আচ্ছা শিশুভাই! বলুন তো, আমরাও তো উচ্চ বা মধ্যবিত্ত ঘরেরই সন্তান। সেই পরিপ্রেক্ষিতে জিয়ার সাথে আমাদের তফাৎটা কিভাবে দেখেন আপনি?
এখানে তোমরা যারা রয়েছো, শ্রেণীগত ভাবে তাদের অনেকেই জিয়ার চেয়ে উচ্চতর শ্রেণী কিংবা তার মত শ্রেণী থেকেই আগত। কিন্তু তফাৎটা হল, তোমাদের সাথে মাটি ও মানুষের সম্পর্ক রয়েছে বরাবর। তাছাড়া, তোমরা পারিবারিকভাবে কিংবা ব্যক্তিগত ভাবে রাজনীতির সাথে পরিচিত কিংবা জড়িত। তাই তোমাদের সবাই শৈশব থেকেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন। এখানেই হচ্ছে তোমাদের মননশীলতা আর জিয়ার চিন্তা চেতনার তফাৎ। এ ছাড়াও আর একটি Deference আছে। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তোমরা নিজেদের যতটুকু De-class করতে পেরেছো সেটা জিয়ার পক্ষে সম্ভব হয়নি, হবেও না কখনোই। মুক্তিযুদ্ধের সময় বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর দুঃখ, কষ্ট, শোষণ, বঞ্চনা, প্রত্যাশা তোমাদের মনকে নাড়া দিয়ে তোমাদের মধ্যে যে ধরনের পরিবর্তন এনেছে, তেমন কোনও পরিবর্তন জিয়ার মধ্যে আসেনি। তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ, সব সেক্টর থেকে Careerist Officer দের সবাইতো রীতিমত পাল্লা দিয়ে গেরিলা যুদ্ধের ঝুঁকিপূর্ণ এবং কষ্টের জীবন ছেড়ে ‘Z’,’S’, ‘K’, ফোর্স নামের তিনটি Regular Brigade এ ভবিষ্যৎ চিন্তা করে ঢুকে পড়েছিলো লিন্তু কই, তোমাদের কেউই তো সাথী মুক্তিযোদ্ধাদের ত্যাগ করে গিয়ে ঢুকলে না ঐ নিয়মিত বাহিনীর খোঁয়াড়গুলোতে সব অনুরোধ-উপরোধ উপেক্ষা করে। থেকে গেলে সহযোদ্ধাদের সাথেই লুঙ্গি আর গামছা পরেই। বিভেদটা এখানেই। জিয়া নিজেকে তোমাদের মতো শ্রেণীচ্যুত করে জনতার কাতারে কখনোই সামিল করবেন না। ব্যক্তিগতভাবে জেনারেল জিয়া কোনও বিপ্লবী নন। তিনি একজন উচ্চাভিলাষী নকরিবাজ আর্মি অফিসার। চতুর এবং সুযোগ সন্ধানী জিয়া অতি সহজেই হাতের মুঠোয় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পেতে সক্ষম হয়েছেন তোমাদের বদৌলতে কিন্তু তার রাজনীতি হবে পাকিস্তানী সেনাশাসকদের মতোই। কারণ, জিয়া সেই ধরণের রাজনীতির সাথেই পরিচিত। তার রাজনীতি হবে সমঝোতা এবং দেয়ানেয়ার গণ্ডিতে, কোনোক্রমেই বৈপ্লবিক নয়। জিয়া এবং তার রাজনীতি সম্পর্কে শিশুভাই এর অভিমত যদিও হতাশাব্যঞ্জক কিন্তু সারগর্ভ। আমি জিজ্ঞেস করলাম
What about Genera Guderian Mnzoor? শিশুভাই মৃদু হেসে বললেন
You know the answer I am sure. If you have asked my opinion just to reassure then I may say, slightly better but not much difference except Manzoor being known as ‘Guderian’ is much more ambitious than Zia. Should he get any chance then he wouldn’t do anything radical as well. কি ডালিম, am I too far away from your assessment?
Really, don’t know as you yourself had said, it is hard to read any one’s mind. Besides, once bitten twice shy! সবাই আমার জবাবে অট্টহাসিতে ফেটে পড়লো। নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে একটা সুখটান দিয়ে শিশুভাই নিজের থেকেই বলতে শুরু করলেন
কি জানো, ছাপোষা পরিবারে জেনারেল জিয়া বড় হয়েছেন হিসাব নিকাশ করেই। তাই সব ব্যাপারেই তিনি লাভ-লোকসানের খতিয়ানটা খুবই গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করেই পা ফেলায় অভ্যস্ত। তার মধ্যে উদারতা, আবেগ, অনুভূতি, রোমান্টিকতা বা রোমাঞ্চ বলে কিছু নেই। পক্ষান্তরে, তোমাদের মতো Affluent পরিবারে যারা জন্মেছো তাদের মন আর হাত দুটোই থাকে অবারিত। লাভক্ষতির হিসাব করতে তাই তোমরা খুব একটা অভ্যস্ত না। তাছাড়া যারা গোয়েন্দা হিসাবে কাজ করে তাদের মধ্যে কতগুলো Character traits develop করে automatically. যেমনঃ- সন্দেহ প্রবণতা, কান কথায় বিশ্বাস করা, পারস্পরিক সম্পর্কে বিশ্বাসের ঘাটতি, মেপে কথা বলা, প্রাণখুলে হাসতে না পারা ইত্যাদি। সহজ সরল ভাবে কোন কিছুকেই তারা গ্রহণ করতে পারে না। সবকিছু মিলিয়ে তাদের অন্তরটা হয়ে ওঠে খুঁতখুঁতে এবং সংকীর্ণ। আমার নিজের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকেই কথাগুলো বললাম।
বলুন তো শিশুভাই, বর্তমানে জিয়া সামরিক বাহিনীকে কতভাগে বিভক্ত করে তার একছত্র আধিপত্য বজায় রেখেছেন? প্রশ্ন করলো নূর।
তিন-চার টি ভাগ সুস্পষ্ট। একদিকে রয়েছে Repatriated Lot, অন্যদিকে রয়েছে মঞ্জুরকে কেন্দ্র করে মুক্তিযোদ্ধারা, তৃতীয় ভাগে রয়েছে inducted Rakkhis and left over Awami Bakshalites. চতুর্থ ভাগে রয়েছে তোমাদের সংগঠনের বেঁচে থাকা সদস্যবৃন্দ এবং তাহেরের গুটিকতক অনুগামী।
এদের মধ্যে কাদের তিনি সবচেয়ে বেশী নির্ভরশীল ও বিশ্বাসী মনে করছেন? হুদার প্রশ্ন।
কাউকেই না। কারণ, তিনি মনে করছেন তাদের সবার অস্তিত্বই তার করুণার উপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে সামরিক বাহিনীতে শৃঙ্খলা এবং Chain of Command ফিরিয়ে আনার ধুয়া তুলে জেনারেল মহব্বতজানের তত্ত্বাবধানে গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর মাধ্যমে ১৮-১৯ টা অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে প্রায় আড়াই হাজারেরও বেশী অফিসার আর সৈনিক নিধন করার পর তার সেই প্রত্যয় আরও পোক্ত হয়েছে। Now he thinks he is the king of the kings. Therefore, he can easily fire any one at any time at his whims, remaining as strong as ever.
Excellent! হুদা মন্তব্য করল জবাব শুনে। এবার শাহরিয়ারের প্রশ্ন
আচ্ছা শিশুভাই, এতক্ষণ যে সমস্ত বিষয়ে খোলাখুলি আলাপ হল তাতে তো মনে হয় আজঅব্দি জিয়া আমাদের সাথে ছলনা করে আমাদের ব্যবহারই করে এসেছেন তার আখের গোছাতে। বর্তমানে ক্ষমতার শীর্ষে আরোহণের পথে তো কোনও বাধাই নেই মনে হচ্ছে। তিনি সেনা পরিষদের শক্তি প্রায় নির্মূল করে দিয়েছেন, তাহেরকে ফাঁসিতে ঝুলিয়েছেন। জাসদের অন্যান্য নেতাদের সাথে আপোষ করে ছেড়ে দেবেন কিছুদিন জেলে রেখে। তাদের অনেককেই হয়তো ভবিষ্যতে তার দলেও দেখা যাবে। কিন্তু তিনি তার রাজনীতির মূল আদর্শ জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর প্রতিষ্ঠিত বলে প্রচার করছেন এতে একটা দ্বৈততা রয়েছে না? কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিল বুঝতে পেরেছিলেন দেরিতে হলেও যে জাসদ আওয়ামী লীগেরই ‘B’ টিম, তাই তারা নিজেদের চেষ্টায় জনযুদ্ধের স্বার্থে শক্তি সঞ্চয়ের চেষ্টা করছিলেন নিজেদের উদ্যোগেই। আমাদের সাথে দুইজনেরই প্রায় নিয়মিত যোগাযোগ ছিল। আমাদের মধ্যে তাত্ত্বিক দিক দিয়ে একটাই পার্থক্য ছিল। আমরা বিশ্বাস করতাম, ইসলামিক দর্শন ঐশ্বরিক বিধায় মার্ক্সীয় দর্শনের চেয়েও উত্তম। বাংলাদেশের মানুষের কাছে ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং অনুশাসন ছাড়া অন্য কোন ‘ইজমই’ গ্রহণীয় নয় এই সত্যটা অনেক আগেই প্রমাণিত। এই দেশের ৮ কোটি মুসলমানের মন ভিজবে না কোন দর্শনের জিকির তুলে যেখানে ইসলাম থাকবে না। তাহের এবং জলিল কিন্তু আমাদের এই যুক্তি খণ্ডাতে পারেননি। যখন তারা নিজেদের অভিজ্ঞতা থেকে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন তাদের তথাকথিত ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ নামক উদ্ভট দর্শন দেশের সাধারণ জনগণ ছাড়াও মুক্তিযোদ্ধা এবং সামরিক বাহিনীর সংখ্যাগরিষ্ঠদের কাছে কোনদিনই গ্রহণযোগ্য হবে না এবং আমাদের নীতি-আদর্শই যে সঠিক ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনা আর দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর স্বপ্ন ও প্রত্যাশার রিপ্রেক্ষিতে সেটাও তারা মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিলেন সেনা পরিষদের জনপ্রিয়তা এবং সাংগঠনিক শক্তি দেখেই। ফলে এক সময় তারা আমাদের সাথে একযোগে রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণের মাধ্যমে একটি প্রগতিশীল, সুখী, সমৃদ্ধশালী, স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ে তোলার জন্য কাজ করে যেতে রাজি হয়েছিলেন। সবকিছু বিস্তারিতভাবে জানার পরও জিয়া কেনো এইভাবে নিজের পায়ে নিজেই কুড়াল মারলেন আর আমাদের এতদিনের সব প্রচেষ্টাকে পণ্ডশ্রমে পরিণত করলেন! এর পরিণতি কখনই ভালো হতে পারে না। যেদিন জিয়ার মুখোশ উন্মোচিত হবে সেদিন দেশবাসী তাকে মুজিবের চেয়েও বড় গিরগিটি আর বিশ্বাসঘাতক হিসাবে দেখবে। আল্লাহ্ পাকও মোনাফেকি পছন্দ করেন না। আপনি দেখবেন, অসৎ নিয়তের পরিণাম জিয়ার জন্য ভয়ংকর হবে, বুচ্ছেননি দাদা? জিয়ার যাই হউক না কেন সেটা আমাদের ভাবার বিষয় নয়, তবে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাস্তবায়নের যে সুবর্ণ সুযোগটা আমরা সৃষ্টি করেছিলাম তা থেকে জিয়া দেশ ও জাতিকে বঞ্চিত করলেন এই সত্যটা অবশ্যই একদিন দেশবাসী জানতে পারবে। ফলে জিয়া চিরস্থায়ী ভাবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই ঠাঁই পাবেন ইন শাহ আল্লাহ!
শিশুভাই শাহরিয়ারের খেদোক্তির পুরোটাই শুনলেন কিন্তু জবাবে কিছুই বললেন না। এবার আমি তার কাছ থেকে আর একটু পরিষ্কার ভাবে জানতে চাইলাম
শিশুভাই, আপনি কি মনে করেন না যে জিয়া সম্পূর্ণভাবেই অবগত কি করে কাদের বলে আজ তিনি ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে অধিষ্ঠিত? ১৫ই আগস্ট আর ৭ই নভেম্বর-এর অভ্যুত্থানের মূলশক্তি এবং অগ্রণী কারা? তারপরেও কেনো তিনি আমাদের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে ভিন্ন পথে চলার সিদ্ধান্ত নিয়ে নিজের, দেশ ও জাতির সর্বনাশ করতে চলেছেন! জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে এই বিষয়টা কখনো কি আপনি তাকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন?
হ্যাঁ করেছিলাম, কিন্তু ব্যর্থ হয়েছি।
কেনো?
রাজনৈতিক ক্ষমতা সম্পর্কে জিয়া উচ্চাভিলাষী, তবে তিনি কোনও ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত নন। অন্যভাবে বললে বলতে হয়, তিনি তোমাদের মতো রেডিক্যাল নন। তিনি তার রাজনৈতিক অভিলাষ চরিতার্থ করবেন তৃতীয় বিশ্বের অন্যান্য সামরিক শাসকদের মতো সমঝোতার রাজনীতির মাধ্যমেই। তার রাজনীতি নিয়ন্ত্রিত হবে পরোক্ষভাবে বৈদেশিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর দ্বারাই। সেই ক্ষেত্রে তাকে সমঝোতা করতে হবে দেশের কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের প্রসূত রাজনৈতিক দল এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের সাথে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার আলোকেই প্রণীত তোমাদের জনপ্রিয় কর্মসূচী এটা বুঝেই জিয়ার আদেশেই আমাকে তোমাদের নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচির ভিত্তিতে তার ১৯ দফা এবং পার্টি ম্যানিফেস্টো তৈরি করতে হয়েছে। সঙ্গত কারণেই তোমরা মনে করো বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছাড়া এই ম্যানিফেস্টো কার্যকরী করা সম্ভব নয়। কিন্তু তিনি মনে করেন, সেটা প্রচলিত পশ্চিমা উন্নত দেশগুলোর মতো গণতান্ত্রিক ধারায় বোঝাপড়ার রাজনীতির মাধ্যমেই করা সম্ভব। তার জন্য মূল সমস্যা হচ্ছে, এই ধরনের রাজনীতি করতে গেলে আওয়ামীলীগ এবং রুশ-ভারত চক্রের কাছে নিজের গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে একটা কার্যকরী সম্পর্ক তাকে অবশ্যই গড়ে তুলতে হবে। আর এই দুটো লক্ষ্য অর্জনের পূর্বশর্ত হচ্ছে, যে ভাবেই হউক তাকে প্রমাণ করতে হবে যে ১৫ই আগস্ট এর অভ্যুত্থান এবং মুজিব হত্যার সাথে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন এবং ছিলেন না। জোর প্রচারণা চালানো হচ্ছে, মোশতাক সরকার তার পেশাগত যোগ্যতা এবং সেনাবাহিনীতে তার জনপ্রিয়তার পরিপ্রেক্ষিতেই তাকে চীফ অফ স্টাফ পদে নিয়োগ দিয়েছিলেন। আরও প্রচারণা করা হচ্ছে ১৫ই আগস্ট আর ৭ই নভেম্বরের অভ্যুত্থান দু’টি ছিল সম্পূর্ণভাবে যোগসূত্র বিহীন বিচ্ছিন্ন দুইটি ঘটনা। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লবের সাফল্যের পর জেনারেল জিয়ার জনপ্রিয়তার কারণেই বিপ্লবীরা তাকে আবার ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করেছিলো। ঘটনা দু’টি যে একই সূত্রে গাঁথা সে সম্পর্কে সাধারণ জনগণের কোনও ধারণাই নেই। তাই তারা জিয়ার প্রচারণাকেই সত্য বলে মেনে নিচ্ছে। আমার বিশ্বাস, ভারতকে খুশি করার জন্য তিনি নিজের উদ্যোগেই ভারতে আশ্রিতা হাসিনাকে সাদরে ডেকে এনে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারায় তার নেতৃত্বে বিলুপ্তপ্রায় আওয়ামীলীগকে পুনর্বাসিত করবেন। এই বাস্তবতায় তোমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেয়া, একসাথে রাজনীতি করা কিংবা তোমাদের আলাদাভাবে রাজনৈতিক মোকাবেলা করতে দেয়া কি সম্ভব? উত্তরটা অতি সহজ, না। আমার তো ধারণা খন্দকার মোশতাককেও তিনি রাজনৈতিক ময়দানে নিজের এবং ভারত সমর্থিত আওয়ামীলীগের স্বার্থে দাড়াতে দেবেন না কোনক্রমেই। বাকি না বলা কথাগুলো বুঝবার ক্ষমতা তোমাদের সবারই আছে। আরও কিছু কথা আমি তোমাদের জানাবো আমার বিবেকের তাড়নায়। তোমাদের এইভাবে একত্রে খোলা ছুট দিয়ে রাখাটাকেও জিয়া নিরাপদ মনে করছেন না। তাই তিনি চাইছেন তোমাদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখতে তবে তার নাগালের মধ্যে। এই লক্ষ্য হাসিলের একমাত্র উপায় হল তোমাদের কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে বিভিন্ন দূতাবাসে পাঠাবার ব্যবস্থা করা। খন্দকার মোশতাকের জারি করা Indemnity Ordinanceকে নির্বাচিত সংসদের মাধ্যমে বৈধতা তাকে দিতে হবেই। এটাও তার একটি বাধ্যবাধকতা। এটাও তোমাদের আমি জানিয়ে দিলাম। এ ভাবেই সবদিকে একটা ব্যালান্স বজায় রেখে তিনি ক্ষমতায় টিকে থাকার চেষ্টা করবেন। তিনি যে দল তৈরি করাচ্ছেন সেটা কোনও নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দল হিসাবে গড়ে তুলবেন না জেনারেল জিয়া। সেটার রূপ হবে একটা জনপ্রিয় গণ-প্ল্যাটফর্ম। এই দলটির একমাত্র দায়িত্ব হবে তার গায়ে গণতন্ত্রের নামাবলি পরিয়ে দিয়ে জেনারেল জিয়ার একনায়কত্বকে বিশ্বপরিসরে বৈধতা প্রদান করা। নানামতের নানাপথের জড়ো করা বাস্তুঘুঘু এবং দুর্নীতিপরায়ণ, সুযোগ সন্ধানী রাজনীতিবিদদের একত্রিত করা হয়েছে সুচিন্তিতভাবে। জেনারেল জিয়া তাদের মধ্যে ব্যাপক দুর্নীতি ছড়িয়ে দেবেন খোলা দুর্নীতি করার রাস্তা খুলে দিয়ে। একই সাথে তিনি দুর্নীতিবাজ প্রত্যেকের নামেই একটি ফাইল বানিয়ে নিজের কাছে রাখবেন যাতে করে সবাইকে তার পোষা ‘জি হুজুরে’ পরিণত করা সম্ভব হয়। তিনি নিজেকে রাখবেন সব দুর্নীতির ঊর্ধ্বে। এ ভাবেই তিনি তার ক্ষমতাকে নিরংকুশ করে নেবেন। তারপর কর্তার ইচ্ছায় চলবে তালুকদারি আর বাকিরা পালন করবে পারিষদের ভূমিকা। সিগারেটের বাটটা ছাইদানিতে ফেলে বক্তব্য শেষ করলেন শিশুভাই। এরপর সবার তরফ থেকে আমিই বললাম
একজন একান্ত আপনজন, অন্তরঙ্গ শুভাকাঙ্ক্ষী ও সহযোদ্ধা হিসাবে আপনি যা কিছু আমাদের জানালেন কোন রাখঢাক না রেখে তার জন্য আমরা উপস্থিত সবাই আপনার কাছে আন্তরিকভাবে কৃতজ্ঞ। আলোচনার ইতি টানার আগে আমরা আপনার কাছ থেকে জানতে চাই এই বাস্তব অবস্থায় আমাদের করণীয় কি হওয়া উচিৎ? একটু চিন্তা করে নিয়ে আর একটি সিগারেট ধরিয়ে শিশুভাই বললেন
For the time being Paradise is lost but it certainly does not mean Paradise does not exist, I would say. এবারের সুযোগ হাতছাড়া হয়ে গেলেও ভবিষ্যতে আবারও সুযোগ আসতে পারে দেশ ও জনস্বার্থে ইতিবাচক অবদান রাখার। বিশেষ করে নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধা, নিঃস্বার্থ, ত্যাগী, জনদরদী, জাতীয়বাদী, ধর্মপ্রাণ সূর্যসন্তান হিসাবে দেশব্যাপী তোমাদের সুখ্যাতি সর্বমহলে তোমাদের প্রত্যেককেই পরিণত করেছে কিংবদন্তীর নায়কে। এটা তোমরা অর্জন করেছ দীর্ঘদিনের আপোষহীন সংগ্রামের মাধমে। Carefully preserve it and get yourselves more enriched and matured. একদিন দেশবাসী তোমাদের খুঁজবে দেশের কাণ্ডারি হবার জন্য। যদি এমনটি নাও হয়, আজঅব্দি তোমরা যতটুকুই অর্জন করেছো সেটাই বা কতজনের ভাগ্যে জোটে! All of you are exceptional sons of the soil. তোমরা সবাই শুধুমাত্র তিহাসের উপাদানই নও, ইতিহাস সৃষ্টিকারীও বটে। তাই ১৫ই আগস্ট অভ্যুত্থান, ২-৩রা নভেম্বরের ঘটনার মোকাবেলায় তোমাদের অবদান, ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বিপ্লব, ১৫ই আগস্ট আর ৭ই নভেম্বর-এর মধ্যে যোগসূত্র, সেনা পরিষদের এবং এই সংগঠনের সাথে জেনারেল জিয়ার সম্পর্ক এই সমস্ত বিষয়ে যেসব অবমিশ্রতা রয়েছে সেগুলো সম্পর্কে দেশবাসীর অবগতির জন্য দলিল লিখে যাও। সময়-সুযোগ মতো জনগণ যাতে সত্য জানতে পারে। এটা জাতি তোমাদের কাছ থেকে প্রত্যাশা করে। তোমাদেরও নৈতিক দায়িত্ব উপাদানগুলো ইতিহাসবিদ এবং রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের জন্য রেখে যাওয়া যাতে করে সত্য এবং বস্তুনিষ্ঠ তথ্যসামগ্রী থেকে তারা সঠিক ইতিহাস লিখতে পারেন। সত্যভিত্তিক দলিল তোমরা না লিখলেও সত্য একদিন উদ্ভাসিত হবেই ইতিহাসের কষ্টিপাথরে যাচাইয়ের পর। ভবিষ্যতে আল্লাহপাক যদি কোনও সুযোগ নাই দেন, সেটাকে ইমানদার হিসাবে মেনে নেয়ার হুকুমইতো আল্লাহ্পাক দিয়েছেন তাইনা শাহরিয়ার? তবে আমার অনুরোধ, কারো প্ররোচনায় উত্তেজিত হয়ে তোমরা কখনোই এমন কিছু করবে না যাতে কষ্টার্জিত বিশ্বাসযোগ্যতা এবং অপরিমেয় ভালবাসা আর সম্মান খোয়াতে হয়। চোখ-কান খোলা রেখে চলতে হবে তোমাদের সতর্কতার সাথে। ৮-১০ কোটি বাংলাদেশীদের মধ্যে কয়েকটি অমূল্য রতন তোমরা। তোমাদের মতো রতন তৃতীয় বিশ্বে বিরল। কথাগুলো তোমাদের খুশি করার জন্য বললাম না। এগুলো অকাট্য সত্য। যে যত চেষ্টাই করুক, যত বিরূপ অপপ্রচারই চালাক লোকজনের মনে তোমাদের যেই ভাবমূর্তি খচিত হয়ে গেছে সেটা মুছে ফেলা সম্ভব হবে না কারো পক্ষেই। তোমাদের আওয়ারা শিশুভাই আর একটা কথা বলবে। ‘আওয়ারা’ শব্দটা শুনে মনে পড়ে গেল, একবার কুমিল্লাতে Officer’s Club এ new year’s eve এর পার্টিতে Dress as you like fancy ball এর আয়োজন করা হয়েছিল। তাতে শিশুভাই সেজেছিলেন এক আওয়ারা যুবক। আমি আর নিম্মি সেজেছিলাম সাঁওতাল দম্পতি। আমাদেরই দেয়া হয়েছিল First Prize. শিশুভাই শুরু করলেন
ভবিষ্যতে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে সংগ্রাম করার যদি সুযোগ আসে তবে সেই সংগ্রাম হতে হবে রাষ্ট্রীয় পরিসরে আর একটি জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম গড়ে তোলা। শুধুমাত্র সামরিক বাহিনীকে কেন্দ্র করে কোনও মুক্তিসংগ্রামই ফলপ্রসূ হবে না। ভূটান কিংবা নেপালের মতো ভারতের করদ রাজ্যে পরিণত করার আগ্রাসী থাবা থেকে দেশকে বাঁচাতে হলে একটি পথই বেছে নিতে হবে। ভারতের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেই তোমাদের প্রণীত নীতি-আদর্শের ভিত্তিতে শুরু করতে হবে দীর্ঘমেয়াদি রাষ্ট্রীয় এবং সমাজ কাঠামোর আমূল পরিবর্তনের লক্ষ্যে আর একটি মুক্তিযুদ্ধ। ঐ বিপ্লবটা সহজ হবে না। কারণ, যদি বাংলাদেশ সত্যিকার অর্থে একটি স্বাধীন, স্বনির্ভর এবং সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয় তাহলে ভারতীয় ইউনিয়ন ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে। আমার বিশ্বাস এ ধরণের সংগ্রামে বর্তমানে যে সমস্ত দল ময়দানে রয়েছে তারা কেউই শরিক হবে না নিজেদের কায়েমী স্বার্থের খাতিরেই। সেই শক্তি তোমাদের সংগঠিত করতে হবে চলমান সংগ্রামের দুর্গম পথেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন তরুণ প্রজন্ম থেকে কর্মী সংগ্রহ করে। যদিও আমার ধারণা বর্তমানের তরুণ প্রজন্ম মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সঠিকভাবে অবগত নয়। তবে অতি অল্প সময়ে বর্তমানের সব কয়টি রাজনৈতিক দলের আপোষকামিতা, দুর্নীতি এবং অপশাসনের চরিত্র প্রকাশিত হয়ে পড়বে। একইসাথে আগ্রাসী ভারতের নীলনকশাও তাদের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠবে। সেই সময় তারা রাজনীতির মূলধারায় নতুন পরীক্ষিত এবং বিশ্বাসযোগ্য নেতৃত্বের সন্ধান করবে। সেই বিকল্প নেতৃত্ব দেবার যোগ্যতা তোমাদের সবারই আছে। আমি কিন্তু দুই ভায়রাকে সামিল করছিনা। কারণ তাদের সম্পর্কে আমি কিছুই জানিনা, তেমন কোনও ঘনিষ্ঠাও নেই।
আপনি কিছু মনে না করলে একটা প্রশ্ন করতে চাই। শাহরিয়ার আবার আবেদন জানালো।
নিশ্চয়ই!
আচ্ছা শিশুভাই, জেনারেল জিয়া যখন অতি নিষ্ঠুরতার সাথে নির্বিচারে আমাদের সংগঠনের হাজারও নেতা-কর্মীকে নির্মম এবং পাশবিকভাবে হত্যা করছিলেন ঠিক সেই মুহূর্তে আপনি পদোন্নতি নিয়ে কোন প্রতিবাদ না জানিয়ে জিয়ার একজন আস্থাভাজন উপদেষ্টা হয়ে তার পাশে দাড়ালেন। আপনার এই সিদ্ধান্তে আমি ব্যক্তিগতগতভাবে খুবই মর্মাহত হয়েছিলাম।
স্বাভাবিক এই বিষয়ে অনেকেই আমার কাছে এসে আক্ষেপ করছে। জেনারেল জিয়া যখন আমাকে তার পাশে থেকে তাকে সাহায্যের প্রস্তাব দেন তখন আমি তাকে পরিষ্কার ভাবে বলেছিলাম, আর্মির চাকরি ছাড়ার চেষ্টা করে চলেছি স্বাধীনতা যুদ্ধের কাল থেকেই। তাই সেনাসদরের ভেতরে গিয়ে আপনার পাশে বসতে পারা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। জবাব শুনে তিনি আমাকে তার রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দাড় করাবার দায়িত্ব নিতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কি শর্তে আমি সেটা গ্রহণ করেছিলাম কি পরিস্থিতিতে সেটা আগেই বলেছি। তোমাদের শিশুভাই সাহসী না হতে পারে, তবে অমানুষ নয়। জেনারেল জিয়া আজ আমার চোখে একজন ঘৃণিত প্রতারক। শুধুমাত্র ক্ষমতার জন্য যেই ব্যক্তি তার দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধাদের রক্তে নিজের হাত রঞ্জিত করতে পারে, তাকে অন্তর থেকে শ্রদ্ধা করতে পারা যায় না। আমার এই বক্তব্য তোমরা বিশ্বাস করবে কিনা জানিনা, But that’s a fact. শিশুভাই এর কথা শেষ হতেই ওয়েটার এসে আমাকে নিচু গলায় জানালো খাবার পরিবেশন করা হয়েছে। শিশুভাই আর একটা সিগারেট প্যাকেট থেকে বের করতে যাচ্ছিলেন দেখে আমি বললাম
শিশুভাই, Dinner has been layed. ডাক পরেছে উঠুন। এতক্ষণ তো অনেক Brain storming হল, এখন পেটপূজাটা সেরে আসা যাক। শিশুভাই উঠে দাঁড়ালেন সাথে আমরাও। ডাইনিং রুমে নিম্মি, লিজি, রানু, সালমা এবং রশিদ আর ফারুকের স্ত্রী জোবায়দা ও ফরিদা সবাই উপস্থিত। মেয়েদের তত্ত্বাবধানেই আজকের রান্না হয়েছে। নানা ধরণের ব্যঞ্জনে ভরা টেবিল দেখে শিশুভাই বললেন, এযে দেখছি রাজকীয় ব্যাপার স্যাপার! লিজি বয়সে সবার ছোট, তাই সবারই অতি আদরের। একটা প্রজাপতির মতো সব ফ্ল্যাটে ঘুরে বেড়ায় স্বচ্ছন্দে। উচ্ছ্বলিত এক জীবন্ত প্রাণের উচ্ছ্বাসের মূর্ত প্রতীক লিজি তাৎক্ষণিক ভাবেই ফোড়ন কেটে জবাব দিলো
শিশুভাই আপনি তো রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে বর্তমানে শুনি একজন বিশেষ VVIP. তাই আপনার প্রাপ্য সম্মানটা বজায় রাখার যথাসাধ্য চেষ্টাতো আমাদের করতেই হবে তাই না নিম্মি ভাবী?
ওরে বাবা, ইতিমধ্যেই অনেক পরিপক্ব হয়ে উঠেছো দেখছি!
এতে আশ্চর্য হচ্ছেন কেনো শিশুভাই! একদিকে লিজি হুদার বোন অন্যদিকে পাশার স্ত্রী সেটা ভুলে যাচ্ছেন আপনি।
শিশুভাই যখন আমাদের সাথে কুমিল্লায় ব্রিগেড কমান্ডার, তখনই ধুমধাম করে পাশার আর লিজির বিয়ে হয়। আমি আর নিম্মি ছিলাম কনেপক্ষের মুরুব্বী আর শিশুভাই আর শাহরিয়ার বরপক্ষের। সবাই বসে পরলাম নির্ধারিত চেয়ারে। এরপর খোশ আলাপের সাথে খাওয়া দাওয়া শেষে আমরা সবাই গিয়ে বসলাম এন্টি রুমে চা, কফি আর পানের সরঞ্জাম নিয়ে আড্ডার আসর জমাতে। ভায়রা ভাইরা বিদায় নিয়ে চলে গেলো।
হাসি, ঠাট্টা, চুটকি, রসালো Jokes, শাহরিয়ারের গানের সাথে সবার ঐক্যতানের মাধুর্যে বেশ কিছুক্ষণ কাটিয়ে শিশুভাইকে তার স্যুইটে পৌঁছে দিয়ে সবাই শুভরাত্রি জানিয়ে বিদায় নিয়ে যার যার ফ্ল্যাটে ফিরলাম। বিদায় নেয়ার আগে নিম্মি আগামী দিনের প্রোগ্রাম জানিয়ে দিল সবাইকে। নাস্তার পর ১১টায় লাঞ্চবক্স সহ Sight Seeing এ বেরিয়ে পড়বো শিশুভাইকে নিয়ে। সেই সফর শেষ হবে ফন্দুক ওমর খৈয়ামে High Tea এর মাধ্যমে। এরপর সন্ধ্যায় যাওয়া হবে হোটেলের কাছেই Shopping Mall এ কিছু কেনাকাটার জন্য। অবশেষে আস্তানায় ফিরে গার্ডেনে Bar-B-Queue Party. পরের দিন লন্ডন হয়ে ফিরে যাবেন শিশুভাই। আমাদের সাথে সালেমও যাবেন লিবীয় সরকারের পক্ষ থেকে VVIP শিশুভাইকে Airport এ See Off করতে। সবকিছুই Meticulously arranged and executed.পরিকল্পনা অনুযায়ী আমরা সবাই শিশুভাইকে বিদায় জানাতে এয়ারপোর্টে গেলাম। গেলো না দুই ভায়রা রশিদ আর ফারুক। তাদের এই ব্যবহার দৃষ্টিকটু হলেও শিশুভাই কিংবা আমরা ওদের ব্যবহারকে ধর্তব্যের মধ্যেই নিলাম না। এর মূল দুটো কারণ ছিল প্রথমতঃ তাদের বদ্ধমূল ধারণা ছিল জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন হিসেবে সব অপকর্মের নাটের গুরুদের একজন ছিলেন শিশুভাই। দ্বিতীয়তঃ তারা জানতো না যুদ্ধকালীন সময় থেকে তার সাথে বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতে আমাদের কি ধরনের আন্তরিক ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিল।
মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে কোলকাতায় পৌঁছেছিল রশিদ, ফারুক। তাই তাদের কোনও ধারণাই ছিল না আগামী দিনের বাংদেশের অরক্ষিত স্বাধীনতা নিয়ে ভারতীয় চাণক্যদের সুদূর প্রসারী নীলনকশা সম্পর্কে। আমাদের সাংগঠনিক কৌশল এবং তৎপরতার বিষয়ে এবং পরবর্তী কালে আমাদের গড়ে তোলা গোপন সংগঠন সেনা পরিষদ সম্পর্কে তারা কিছুই জানতো না। এই তথ্যও দুই ভায়রার অজানা ছিল যে যুদ্ধের সময় থেকেই শিশুভাই চাকরি ছাড়ার চেষ্টা করছিলেন। তাদের এটাও জানা ছিলনা আমার ছোটভাই স্বপন বীরবিক্রম, কাজি বীরবিক্রম, বদি বীরবিক্রম ঢাকায় খান সেনাদের হাতে বন্দী শিশুভাই এবং খালেদ ভাই-এর পরিবারকে মুক্ত করে নিয়ে এসেছিল দুঃসাহসিক গেরিলা অভিযান চালিয়ে। আমার সাথে শিশুভাইয়ের পারিবারিক সম্পর্কের ব্যাপারেও তাদের কিছুই জানা ছিল না। সর্বশেষে তাদের কোনও ধারণাই ছিল না সেনা পরিষদের সাথে জেনারেল জিয়ার সম্পৃক্ততা ছিল কতটুকু। জেনারেল জিয়াকে শিশুভাই কি চোখে দেখতেন সেই বিষয়েও তারা ছিল অজ্ঞ। আমরা ঠিকই বুঝতে পেরেছিলাম শিশুভাই এসেছিলেন নিজস্ব উদ্যোগেই। জেনারেল জিয়ার পয়গাম পৌঁছানোর বিষয়টি ছিল উপলক্ষ মাত্র। তিনি এসেছিলেন আমাদের সব ভেতরের খবর জানাতে যাতে আমরা কোনও ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে জেনারেল জিয়ার পাতা ফাঁদে জড়িয়ে না পড়ি। আমি ফোন না করলেও শিশুভাই নিশ্চয়ই আসতেন। তিনি উদ্বিগ্ন ছিলেন আমাদের নিয়ে, রশিদ কিংবা ফারুকের জন্য নয়। তার এই আন্তরিক স্নেহ ও ভালোবাসার কথা আমরা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবো আজীবন। শিশুভাই এসে পূর্বে গৃহীত আমাদের সিদ্ধান্তগুলোর যথার্থতা প্রমাণ করে দিয়ে গেলেন। জিয়া তার ভবিষ্যৎ রাজনীতির খেলাটা কি করে খেলবেন সেই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি বিশদভাবে আমাদের জানিয়ে গেলেন আমাদের প্রিয় শিশুভাই। একটা সদ্য স্বাধীন দেশকে গড়ে তোলার কোনও পদক্ষেপ না নিয়ে এক ভয়াবহ নৈরাজ্য সৃষ্টি করেছিলো ভারতের বসিয়ে দেয়া শেখ মুজিবের আওয়ামী-বাকশালী সরকার আর জিয়া রাজনীতির ক্ষেত্রে শুরু করেন Intellectual Corruption. ‘টাকা কোন সমস্যা নয়’ বলে রাজনীতিকদের দুর্নীতির অবাধ সুযোগ দিয়ে তাদের দুর্বল করে তার মুঠোয় ধরে রাখার যে কূটকৌশল গ্রহণ করেছেন, তাতে রাষ্ট্রীয় পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত সর্বক্ষেত্রে ছড়িয়ে পড়বে দুর্নীতির ক্যান্সার। যুদ্ধকালে জনগণের মধ্যে যে একাগ্রতা এবং কর্মোদ্যম সৃষ্টি হয়েছিল সেটা বিলুপ্ত হবে সেই দুর্নীতির রাহুগ্রাসে। অন্যদিকে, জেনারেল জিয়া নিজে ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙ্গা স্যুটকেস আর কোদাল কাঁধে নিয়ে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে চমক সৃষ্টি করে নিজের জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে নিজেকে রাখছেন ধরা-ছোঁয়ার বাইরে। এভাবেই ধূর্ত জিয়া নিজেকে একজন সৎ জনদরদী, কর্মক্ষম নেতা হিসাবে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি ইতিমধ্যেই সৃষ্টি করে নিতে সমর্থ হয়েছেন আমজনতার কাছে। ইচ্ছাকৃত ভাবে নানা দলের নানা মতের সুযোগ সন্ধানীদের সাদরে ঢোকানো হয়েছে ‘জাগোদল’ নামের সূতিকাগারে। সেখান থেকে যাচাই বাছাই করে ‘বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদ দল’ ওরফে বিএনপি নামে সৃষ্টি করা হবে তার রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দলের পরিবর্তে একটি প্ল্যাটফর্ম শুধুমাত্র তার একনায়কত্বের গায়ে গণতান্ত্রিক নামাবলি জড়ানোর জন্য। বিএনপি-র সুবিধাবাদী দুর্নীতিগ্রস্ত নেতা-নেত্রীরা থাকবে তার অনুকম্পার পাত্র হয়ে অনুগত পারিষদ হিসাবে। সাদামাটাভাবে উচ্চাভিলাষী জিয়ার ছলচাতুরির রাজনীতির দর্শনটা বুঝিয়ে দিয়ে গেলেন শিশুভাই।
শিশুভাই ফিরে যাবার পর কয়েকটা দিন বেশ ফাঁকা ফাঁকা লাগছিলো। যাওয়া আসাটা একটি প্রাকৃতিক নিয়ম! তাই কয়েক দিনের মধ্যেই আমরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এলাম। এরই মধ্যে হুদার নব পরিণীতা বউ নাফিজা এবং মহিউদ্দিনের স্ত্রী হেনা তার শিশু সন্তানদের সাথে এসে পৌঁছালো দেশ থেকে। এদের নিয়ে হই হুল্লোড়ে কেটে গেল কয়েক দিন। শিশু ভাইয়ের ফেরার পর দেখলাম রশিদ আর ফারুক ঘন ঘন বিদেশে যাচ্ছে। জোবায়দা কিংবা ফরিদাকে জিজ্ঞেস করলে জবাব পাওয়া যাচ্ছে কাজে জার্মানিতে যাচ্ছে দুইজনই। জবাবটা কি সে সম্পর্কে জানা থাকলেও সঠিক জবাবটা পাওয়া যাবে না সেটা আমাদের জানাই ছিল। হঠাৎ অদ্ভুত একটা খবর পেলাম দেশ থেকে। ইদানিং এয়ার ভাইস মার্শাল তোয়াব নাকি কিছু আলেম-মাশায়েখ জমা করে সামরিক বাহিনী এবং দেশের বিভিন্ন জায়গাতে ‘সিরাত মাহফিল’ এর ব্যবস্থা করে দেশবাসীকে ধর্মীয় চেতনায় উদবুদ্ধ করার চেষ্টা করছেন মাথায় টুপি পরে। এই মোজেজার সাথে দুই ভায়রার ঘন ঘন জার্মানি যাওয়ার একটা যোগাযোগ থাকলেও থাকতে পারে। জেনারেল জিয়া যে এই ধরণের উদ্যোগ নিবেন না সেটা বলাই বাহুল্য। একদিন কথাচ্ছলে সালেমই জানালেন, আমাদের সাথে দীর্ঘ আলোচনার পর গাদ্দাফি এবং Revolutionary Command Council এর নীতিনির্ধারকরা বুঝতে পেরেছেন রশিদ, ফারুক নিজেদের ১৫ই আগস্ট বিপ্লবের মূল নেতা হিসাবে জাহির করার চেষ্টা করলেও ঐ বিপ্লবের মূল শক্তি ছিলাম আমরা এবং আমাদের সংগঠন সেনা পরিষদ। তারা আরও বুঝতে পারেন, রশিদ আর ফারুকের সাথে আমাদের একটা ব্যবধান রয়েছে, সেটা আদর্শিক না অন্য কোন কারণে সেটা তাদের কাছে এখনো পরিষ্কার নয়। তবে তারা কথাবার্তা থেকে বুঝে নিয়েছিলেন আমরা তাদের তুলনায় রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি সচেতন। আমাদের উপস্থাপনার যৌক্তিকতার পরিপ্রেক্ষিতেই তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, বাংলাদেশে বিপ্লবকে এগিয়ে নিতে হলে রাজনৈতিক ভাবেই এগুতে হবে। তাই আগামীতে বাংলাদেশে রাজনৈতিক কার্যক্রমের অর্থায়নের জন্য রশিদকে কিছু থোক টাকা দিয়ে পরামর্শ দেয়া হয়েছে, ইউরোপে তাদের কয়েকজন বিশ্বস্ত Contact ব্যাক্তিদের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক পরিসরে ওই টাকা বড় বড় ব্যবসা-বাণিজ্যে যেমন- স্টক এক্সচেঞ্জ, অয়েল এক্সপোর্ট, শিপিং, রিয়াল ষ্টেট, কমোডিটি ট্রেডস ইত্যাদিতে বিনিয়োগ করার জন্য। তাছাড়া বাংলাদেশ থেকে বাছাই করে বেশিরভাগ সামরিক এবং বেসামরিক আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ৪০০০ থেকে ৫০০০ শ্রমিকও আমদানি করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়েছে। সালেমের কথা শুনে কিছুটা বিস্মিত হয়ে পাশাই তাকে জানালো এ সবের কিছুইতো রশিদ আমাদের এখনঅব্দি জানায়নি। আমি অবস্থাকে সহজ করার জন্য বললাম সবই প্রাথমিক পর্যায়ে, তাই হয়তো সে জানায়নি। উপযুক্ত সময়ে জানাবে নিশ্চয়ই। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম আগামীদিনের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, লগ্নিপুঁজি কিংবা ব্যবসায়িক ভিত্তিতে আদম সন্তান আনার ব্যাপারে আমরা কিছুই রশিদ কিংবা ফারুকের কাছ থেকে জানতে চাইবো না। সালেম আমাদের যা বলেছে সে সম্পর্কেও তাদের কিছুই বলা হবে না। আমরা দেখবো তারা এই ব্যাপারে আমাদের কি বলে। বেনগাজী ফিরে নির্বিকার রশিদ কিছুই বললো না কোনও ব্যাপারেই। আমরাও নিশ্চুপ থাকলাম। এই অবস্থায় একদিন জমির এসে জানালো, ঢাকা থেকে তাকে বলা হয়েছে আমার আর রশিদের ঢাকা যাবার সব ব্যবস্থা করার জন্য। সেই বিষয়ে আলোচনা করতেই এবারের আসা। রশিদ জানাল, ও জার্মানি হয়ে পৌঁছাবে ঢাকায়। আমি জানালাম, নিম্মিকে সঙ্গে নিয়ে লন্ডন হয়ে আমি ঢাকায় যাবো। কবে কে যাবে সেটা ঠিক করে জমিরকে জানিয়ে দেয়া হল যাতে, জমির সেইভাবেই সব ব্যবস্থা করতে পারে। জমির সিদ্ধান্ত জেনে ফিরে গেল ত্রিপোলি। আবার বিভ্রাট!দুই ভায়রা কাউকে কিছু না জানিয়ে আবার উধাও হল বেনগাজী থেকে। কর্নেল রশিদের স্ত্রী জোবায়দা জানালো তারা ত্রিপোলি গিয়েছে। ত্রিপোলি যাওয়া নিয়ে এ ধরনের রহস্য তামাশারই সমতুল্য।
জিয়ার ডাকে ঢাকার পথে
যাই হউক, জমিরের ব্যবস্থা অনুযায়ী একদিন আমি নিম্মিকে সাথে নিয়ে লন্ডনের উদ্দেশ্যে উড়াল দিলাম ঢাকার পথে। লন্ডনে পৌঁছে জানতে পারলাম রশিদ জার্মানি হয়ে ঢাকায় পৌঁছে গেছে আর ফারুক সিঙ্গাপুরে অবস্থান করছে। খবরগুলো আমাদের কাছ থেকে গোপন করে রাখায় সন্দেহ হল, এর পেছনে কিছু একটা মতলব আছে। খবরগুলো বেনগাজীতে জানিয়ে দিয়ে বললাম সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখে এলার্ট থাকতে হবে। লন্ডন থেকে ঢাকা যাওয়ার সব ব্যবস্থা লন্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ হাইকমিশন করেছিলো। নির্ধারিত দিনে বিমানের একটা ফ্লাইটে ঢাকায় যাবার জন্য হিথরো এয়ারপোর্টে পৌঁছালাম। সেই সময় আমার শ্বশুর সাহেব লন্ডনে বাংলাদেশ হাইকমিশনে কন্স্যুলার মিনিস্টারের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিলেন। Basically, he was an Ex-PSP Officer, পদবীতে ছিলেন DIG Police. মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনিও জনাব হোসেন আলীর সাথে Calcutta Mission থেকে একসাথে বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের পক্ষে Defect করেছিলেন। তার কর্মনিষ্ঠা, নীতি-আদর্শ, সততা পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল সর্বজনবিদিত। তার চরিত্র বোঝার জন্য দুই একটা ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি। ষাটের দশকের শেষার্ধে চট্টগ্রামের উপর দিয়ে বয়ে যায় এক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অপরিসীম। তখন আমার হবু শ্বশুর জনাব আর আই চৌধুরী ছিলেন চট্টগ্রামের পুলিশ সুপার। পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল ছিলেন আজম খান। জেনারেল আজম অবাঙ্গালী হয়েও ছিলেন এক অসাধারণ মানবিক গুণে গুণান্বিত ব্যাক্তি। বাঙ্গালীদের জন্য তার আন্তরিক ভালোবাসা এবং বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীর বৈরী আচরণের বিরোধিতার ইতিকথা আজো বাংলাদেশী জনগণ শ্রদ্ধার সাথেই স্মরণ করে। জনাব চৌধুরী দুঃস্থ জনগণের পুনর্বাসনের জন্য দুর্গত এলাকায় ক্যাম্প স্থাপন করে দিনরাত অক্লান্ত পরিশ্রমের সাথে ত্রাণ কাজের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তার কাজে খুশি হয়ে জেনারেল আজম খান পুরস্কার হিসাবে তাকে ঢাকার অভিজাত গুলশান আবাসিক এলাকায় দুই বিঘার দুইটি প্লট বরাদ্দ করেন। খবরটা জেনে জনাব চৌধুরী গভর্নর সাহেবের সাথে সাক্ষাত করে তাকে বলেছিলেন একজন বেতনভুক সরকারি চাকুরে হয়ে সাধ্যমত তিনি তার দায়িত্ব পালন করেছেন। তার জন্য কোন পুরস্কার গ্রহণ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। জবাবে গভর্নর আজম খান কিছুটা বিস্মিত হয়ে বলেছিলেন, ‘If you don’t take it as a free gift then pay through monthly installments.’ জনাব চৌধুরী বলেছিলেন সংসারের খরচ চালিয়ে সেটাও সম্ভব নয়। তাই কৃতজ্ঞতার সাথে তিনি গভর্নর সাহেবকে অনুরোধ করেছিলেন প্লট দুটির এলটমেন্ট বাতিল করে দিতে। ‘৭১ সালে পাকিস্তানের কোলকাতা মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হোসেন আলীর নেতৃত্বে যখন বাংলাদেশ প্রবাসী সরকারের আনুগত্য স্বীকার করে কোলকাতা মিশনের সব অফিসার ও স্টাফরা গোপন বৈঠক করছিলেন, তখন জনাব চৌধুরী ছিলেন মিশনের উপপ্রধান হিসাবে Covert Job এ নিয়োজিত। তৃতীয় সচিব ছিলেন আর. করিম জয়। বৈঠকে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় তারা সবাই ডিফেক্ট করবেন। তখন মিশনের সবাই কোলকাতায় সপরিবারে বসবাস করছিলেন, কিন্তু তখন চৌধুরী সাহেবের স্ত্রী, একমাত্র ছেলে বাপ্পি এবং কন্যা নিম্মি ঢাকায় থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করছেন। কোলকাতায় তার সাথে থাকতো সর্বকনিষ্ঠ কন্যা মানু। সে তখন Convent School এর ছাত্রী। পরিবারের নিরাপত্তার ঝুঁকি নিয়েও তিনি অন্য সবার সাথে ডিফেক্ট করার সিদ্ধান্ত নিয়ে বলেছিলেন, ভারতের সাথে যেই ৭ দফা চুক্তি স্বাক্ষর করে আওয়ামীলীগ প্রবাসী সরকার গঠন করছে সেই চুক্তির অধীনে রক্ত দিয়েও প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করা সম্ভব হবে কিনা সেই সম্পর্কে তার যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। বরং ভবিষ্যতে আওয়ামীলীগ সরকারের অধীনে বাংলাদেশ হয়তো বা ভারতের একটি করদ রাজ্যেই পরিণত হবে। তার সেই বক্তব্যের জবাব তখন উপস্থিত কারো পক্ষেই দেয়া সম্ভব হয়নি। তার Defection এর খবর প্রচারিত হবার পর তার পরিবার জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঢাকা থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হয়। সেই লোমহর্ষক পলায়নের বিস্তারিত বিবরণ পূর্বে প্রকাশিত বই ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে এবং ওয়েবসাইট দুটোতে বিস্তারিত লেখা রয়েছে। Defection এর আগেই অবশ্য ভারত সরকার জনাব হোসেন আলীকে আশ্বস্ত করেছিল তাদের বেতন-ভাতা, থাকা-খাওয়া এবং অন্যান্য কূটনৈতিক সব সুবিধাদি বহাল রাখা হবে। কোন বিষয়েই কোন ঘাটতি হবে না। প্রবাসী সরকারের মাধ্যমে মিশন চালানোর জন্য প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান দেবে ভারত সরকার। Defection এর পর ভারত সরকারের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো যখন জনাব চৌধুরীর কাছে তার Contacts দের ফাইলগুলো চেয়েছিল তখন জনাব রফিকুল ইসলাম চৌধুরী সেগুলো দিতে অস্বীকার করে গুরুত্বপূর্ণ ফাইলগুলো দিল্লীতে পাকিস্তান হাইকমিশনে পাঠিয়ে দিয়ে বাকি সব জ্বালিয়ে ফেলেন। ভারতীয় কর্তৃপক্ষকে জানিয়ে দিয়েছিলেন, ‘Such a request is beyond professional ethics.’ নৈতিকতার এক বিরল উদাহরণ! তার সেই দিনের দূরদর্শী ভবিষ্যদ্বাণীর সত্যতা বর্তমানের বাংলাদেশে কতটুকু প্রমাণিত, সেটা যাচাই করার ভার দেশবাসীর উপরই থাকল। ১৫ই আগস্টের পটপরিবর্তনের পর মোশতাক সরকার সিদ্ধান্ত নেয়, সরকারি চাকুরেদের সবাইকে যথাসময় অবসর নিতে হবে। কাউকে Extension দেয়া হবে না। এই সিদ্ধান্তের পর একদিন প্রেসিডেন্ট ডেকে জানালেন আমার ছোট শালি মানুর পড়াশোনার সমাপ্তির জন্য জনাব চৌধুরীকে আরও দু’বছর লন্ডনে থাকতে হবে অবসর নেবার পর। তাই পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সুপারিশসহ ফাইল এসেছে তার চাকুরির মেয়াদ আরও তিন বছর বাড়িয়ে দেবার। তিনি আমার মতামত জানতে চাইলে আমি পরিষ্কার বলেছিলাম, সরকারের সিদ্ধান্ত সবার ক্ষেত্রে একই ভাবে প্রযোজ্য হওয়া উচিৎ। তাই আমার শ্বশুরের ব্যাপারে ব্যতিক্রম করাটা ঠিক হবে না। প্রেসিডেন্টের পুরনো বন্ধু জনাব চৌধুরী। তাই প্রেসিডেন্ট বললেন, তার সাথে একবার আলাপ করতে। বলেছিলাম, এর প্রয়োজন ছিল না। কারণ, আমার বিশ্বাস তিনি এই সিদ্ধান্তে মনঃক্ষুন্ন হবেন না। তারপরও প্রেসিডেন্ট আমার সামনেই তাকে ফোন করলেন। আলাপ হল দুই পুরনো বন্ধুর মধ্যে। তিনি জানালেন Extension তিনি নেবেন না। কারণ, তার সমস্যার সমাধান হয়ে গেছে। প্রেসিডেন্ট জানতে চাইলেন সমাধান কি করে হল! জবাবে জনাব চৌধুরী জানালেন, তার সমস্যাটা নিয়ে তিনি ব্রিটিশ হোম অফিসের সাথে আলাপ করেছিলেন এবং ২ বছরের জন্য থাকার অনুমতি চেয়েছিলেন, তার সেই অনুরোধের পরিপ্রেক্ষিতে ব্রিটিশ সরকার তার পুরো পরিবারকে ব্রিটিশ পাসপোর্টই দিয়ে দিয়েছে। এমন ঘটনা কখনো ঘটেছে কিনা আমার জানা নেই। ধর্মের কল এভাবেই বোধ করি বাতাসে নড়ে। সততার মূল্য মানুষ দিতে না পারলেও সৃষ্টিকর্তা কার্পণ্য করেন না। তিনি যথাসময়ে সবার ন্যায্য পাওনা পরিশোধ করে থাকেন কোন না কোন উপায়ে। অফিস কামাই করে জনাব চৌধুরী এয়ারপোর্টে আসেননি। তিনি ছাড়া অন্য সবাই আমাকে বিদায় জানাতে এসেছিল। যথাসময়ে প্লেন আকাশে উড়ল। আমি একটা ম্যাগাজিনে চোখ বুলাচ্ছিলাম। কিছুটা অপ্রত্যাশিতভাবে চীফ পারসার সম্ভ্রমের সাথে এসে জানাল, আমাকে ককপিটে ডেকে পাঠানো হয়েছে। প্রথমে ভেবেছিলাম, বিমানের অনেক সিনিয়র ক্যাপ্টেনই বন্ধু। বন্ধুদের কেউই আজ বিমান উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে, তেমনই কেউ ডেকে পাঠিয়েছে। তাই উঠে পারসারের সাথে ককপিটে গিয়ে ঢুকলাম। ঢুকতেই চোখ আমার চড়ক গাছ! দেখলাম এয়ার চীফ তোয়াব প্লেন চালাচ্ছেন। কিছুটা অবাক হয়ে সালাম জানিয়ে বললাম স্যার, আপনি? আমার আগমনে কো-পাইলটের সিটটা খালি করিয়ে জনাব তোয়াব আমাকে সেইখানে বসতে বললেন। আমি বসে পড়লাম। মনে পড়ে গেলো পুরনো দিনের কথা, যখন পাকিস্তান এয়ারফোর্সের পাইলট হিসাবে ককপিটে বসে প্লেন নিয়ে আকাশে ভেসে বেড়াতাম। উড়োজাহাজ চালানোর হাতেখড়ি ও প্রশিক্ষণ আমাদের দু’জনেরই একই যায়গায়, PAF Base রিসালপুরে। ব্যবধান শুধু অভিজ্ঞতার। সেটা বয়সে বড় হওয়ার কারণে। আধুনিক বিমানগুলোর প্রায় সবগুলোই যান্ত্রিক অনুশাসনেই পরিচালিত হয়। শুধু টেকঅফ আর ল্যান্ডিং এর সময় পাইলটদেরকে হাল ধরতে হয়। বাকিটা পথে অটো পাইলট অন করে দিলেই জাহাজ ফ্লাইট প্ল্যানের কমান্ড অনুযায়ী চলতে থাকে গন্তব্যস্থলের দিকে। শুধু মাঝেমধ্যে দেখতে হয় প্রয়োজনীয় মিটারগুলোর রিডিং ঠিক আছে কিনা আর পথিমধ্যে চেকপয়েন্টগুলো থেকে জেনে নিতে হয়ে যান্ত্রিক বলাকা ঠিক পথে এগুচ্ছে কিনা। তবে কোন অস্বাভাবিক অবস্থায় ক্যাপ্টেনকেই সামাল দিতে হয় পরিস্থিতির কো-পাইলট, নেভিগেটর আর ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার এর সহায়তায়। যান্ত্রিক কোনও গোলযোগ হলে জাহাজ নিজেই জানান দেয়। গোলযোগ সারিয়ে তোলে ফ্লাইট ইঞ্জিনিয়ার। দিক নির্দেশনা উচ্চতার কোনও হেরফের কিংবা জ্বালানি সংকটের সমাধান করে নেভিগেটর। সার্বিক তদারকির ভার ক্যাপ্টেনের। আগেপিছে আশেপাশের সবকিছুই ধরা পরে রাডারে। যান্ত্রিক বলাকা এগিয়ে চলেছে, আমাদের একান্তে কথা বলার সুযোগ করে দিয়ে ককপিট ক্রুরা পাশেই রেস্টিং কেবিনে চলে গেছে। আমি ও এয়ার চীফ তোয়াব আলাপ করছি। তিনি বলছেন- বিমান এটি নতুন লিজে নিয়েছে। ফাইনাল সাইনিং সেরিমনি এ্যাটেণ্ড করতে এসেছিলাম। মাঝে জার্মানিতে কয়েকদিনের জন্য ফ্যামিলি দেখতে গিয়েছিলাম এই সুযোগে। You know, since the terrifying incident of 2-3 November, your Bhabi has decided to live in Germany with the children. এরপর থেকে দুইপক্ষই আসা যাওয়া করে থাকি সুযোগ-সুবিধা মতো। তুমিও ঢাকায় চলেছো ব্যাপার কি? তার প্রশ্নই বলে দিলো আমি ছাড়া আমাদের অন্য আরও কেউ ঢাকায় যাচ্ছে সেটা উনার জানা। বললাম কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, জেনারেল জিয়া ডেকে পাঠিয়েছেন। তাই যাচ্ছি।
কর্নেল রশিদ, ফারুকও যাচ্ছে নাকি? না, শুধু আমাকে আর রশিদকেই ডেকে পাঠানো হয়েছে।
I see! আমার জবাবে এভিএম তোয়াবকে একটু চিন্তিত দেখাচ্ছিলো। কেনো হঠাৎ ডেকে পাঠালেন জিয়া?
প্রশ্নটার জবাবটা জানা থাকলে তো যাবার প্রয়োজন ছিল না। যাক বলুন, আপনার সিরাত মাহফিল কেমন চলছে? দাওয়ার কাজে আত্মনিয়োগ করেছেন। বিষয়টি প্রশংসনীয়।
তা ঠিক। তবে আমার এই উদ্যোগটাকে অনেকেই ভালো চোখে দেখছে না। উপরন্তু উদ্যোগটাকে রাজনৈতিক রং দেবার চেষ্টাও করা হচ্ছে।
এই ব্যাপারে জেনারেল জিয়ার মনোভাব কি?
ঠিক পরিষ্কার নয়, কিছুটা রহস্যজনক। তার জবাব শুনে মুচকি হেসে বললাম স্যার, আপনি সব সময় বলে থাকেন আপনার কোনও রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ নেই। এরপরও রশিদ, ফারুকের সাথে আপনি হরহামেশাই দেখা সাক্ষাত করছেন লন্ডনে কিংবা জার্মানিতে। ত্রিপোলিতেও কয়েকবারই আসা-যাওয়া করেছেন। এই সব জেনে জেনারেল জিয়া যদি কিছুটা সন্দিহান হয়ে ওঠেন তাহলে সেটাকে কি অস্বাভাবিক বলা চলে? আমি তো বলবো সেটাই স্বাভাবিক। সন্দেহ কেনো, তিনি যদি আপনাকে তার প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবেন তবে সেটাকেও যুক্তিসঙ্গত বলা যেতে পারে।
কিছু বুঝতে পারছিনা। স্বগতোক্তি করলেন এভিএম তোয়াব।
পারবেন স্যার, সময়েতেই পারবেন। জেনারেল জিয়া একজন পাকা খেলোয়াড়। আমার কথায় চুপ করে গেলেন এভিএম তোয়াব। তিনি কতটা সাহসী তার প্রমাণ পেয়ে গিয়েছিলাম ২-৩ নভেম্বর ’৭৫ রাতেই। তাকে নিয়ে রশিদ, ফারুক গাদ্দাফির টাকায় জেনারেল জিয়ার বিরুদ্ধে যে খেলা খেলতে চাইছে সেটা কোনোদিনই সাফল্যের মুখ দেখবে না সে সম্পর্কে আমাদের মনে সন্দেহের কোনও অবকাশ ছিল না। শুধু ধর্মীয় জিকিরের আবরণে জনপ্রিয়তা অর্জন করে রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তোলা বাংলাদেশে কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশের মুসলমানরা ধর্মভীরু- কিন্তু ধর্মান্ধ নয়। তাই যদি হতো তবে অনেক আগেই জামায়াতে ইসলামী কিংবা অন্যসব ধর্মভিত্তিক দলগুলোকে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত দেখা যেতো। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম জনগণের কাছে ধর্মহীনতা এবং ধর্মান্ধতা সমানভাবে বর্জিত। এই বাস্তবতাকে না বুঝতে পারায় এই দুই অক্ষের নেতৃত্বের উস্কানি এবং ভ্রান্ত প্ররোচনায় বলির পাঁঠা হতে হয়েছে অগুণতি সাধারণ নিরীহ ধর্মপ্রাণ দেশবাসীকে।
দুঃখজনক হলেও বলতে হচ্ছে বিদেশের পেট্রোডলার পকেটস্থ করে যারাই সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভুতির সুযোগ নিয়ে ধর্মের ধারক-বাহক হয়ে লোকজনকে জিম্মি করে রেখেছেন তাদের ধর্ম সম্পর্কে জ্ঞানের পরিধি দেখে তাদেরকে ধর্ম ব্যবসায়ী ছাড়া আর কিছুই বলা চলে না। ফিকরাবাজির মাধ্যমে জাতীয় ঐক্যে ফাটল আর ফ্যাসাদ সৃষ্টি করে জাতিকে দুর্বল করে রাখাটাই তাদের মূল লক্ষ। পাঠকগণ নিশ্চয়ই অবগত রয়েছেন, ব্রিটিশরা এই উপমহাদেশকে কব্জা করে নিয়েছিল মুসলমান শাসকদের পরাজিত করে। বিশ্বাসঘাতক হিন্দু রাজন্যবর্গ এবং বেনিয়াদের প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষ সাহায্য ও সহযোগিতায় প্রতিদানে মুসলমান সম্প্রদায়ের সব সম্পদ ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত’ এবং বিভিন্ন আইনের মাধ্যমে ছিনিয়ে নিয়ে তাদের যে শুধু বিত্তহীন গোলামেই পরিণত করেছিলো তাই নয়, একই সাথে তাদেরকে অশিক্ষিত করে রেখেছিলো সমসাময়িক জ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে দেশের আলেম সমাজের কিছু প্রভাবশালী ওলামাদের কিনে নিয়ে তাদের মাধ্যমে পশ্চিমা শিক্ষাব্যবস্থা মুসলমানদের জন্য হারাম ফতোয়া জারি করে। তাদের অর্থেই ঐসব তল্পিবাহক আলেম ওলামাদের মাধ্যমে সৃষ্টি করা হয়েছিলো দেওবন্দ, বেরেলভি জাতীয় ফিকরাবাজির বিভিন্ন সূতিকাগার শুধুমাত্র মুসলমানদের বিভক্ত করে রাখার জন্যই। কুটকৌশলে তারা হিন্দু সম্প্রদায়কে অনুপ্রাণিত করেছিলো প্রগতিশীল জ্ঞান-বিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হতে আর ঐ সব ধর্ম ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে মুসলমানদের হাতে ধরিয়ে দিয়েছিলো কোরআন, হাদিস যার অপব্যাখ্যা করে সৃষ্টি করা হয়েছিলো হাজারো ফিকরা। সেই বিষফোঁড়ার বিষাক্ত কবলে বর্তমানে উপমহাদেশের সব কয়টি দেশই হয়ে উঠেছে অস্থিতিশীল এবং ভঙ্গুর। আসল অপশক্তির মোকাবেলার পরিবর্তে নানাভাগে বিভক্ত নামেমাত্র মুসলমানরা নিজেদের মধ্যে আত্মঘাতী সহিংস সংঘাত এবং অন্যান্য ধর্মীয় সম্প্রদায় একে অপরের বিরুদ্ধে নৃশংস দাঙ্গা-ফ্যাসাদে লিপ্ত হয়ে দেশগুলোকে পশ্চাদমুখী করে মধ্যযুগেই ঠেলে দিচ্ছে। ধর্মীয় উগ্রতা এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিকারীরা সুযোগ বুঝে বিশ্বপরিসরে ভ্রান্ত প্রচারণা চালিয়ে প্রকৃত ইসলামের ভাবমর্যাদাকেই ক্ষুন্ন করছে। যদিও প্রকৃত ইসলাম হল সার্বজনীন শান্তি এবং মানবতার ধর্ম, একটি পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান।
ফিরে চলি এভিএম তোয়াব এর সাথে আলাপে। পরিবেশ হালকা করার জন্য সঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম
স্যার, আপনাদের মার্শাল’ল এডমিনিস্ট্রেশন কেমন চলছে? জেনারেল জিয়ার গৃহীত রাজনৈতিক উদ্যোগকে আপনি কি ভাবে দেখছেন? নিজের কারিশমা বাড়াবার জন্য গেঞ্জি পরে কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খাল কাটার কর্মসূচির চমকে তো দেশবাসী বিমুগ্ধ। তার প্রণীত ১৯ দফাও জনগণ সাদরে গ্রহণ করেছে বলে জানতে পারলাম। এই পরিপ্রেক্ষিতে পরবর্তী পদক্ষেপ কি হবে তার? এভিএম তোয়াব আমার প্রশ্নগুলোর কোনও জবাব না দিয়ে হেসে বললেন
এই সমস্ত বিষয়ে জেনারেল জিয়া আমাদের সাথে কোনও আলাপ আলোচনা করার প্রয়োজনই বোধ করেন না। এই সব বিষয়ে জেনারেল এরশাদ, জেনারেল মহব্বতজান, জেনারেল শিশু, জেনারেল মঞ্জুর, জেনারেল শওকতই তার মূল পরামর্শদাতা। বাহ্যিকভাবে আমি এবং জিয়ার আত্মীয় এম এইচ খান ন্যাভাল চীফ ডেপুটি মার্শাল ল’ এ্যাডমিনিস্ট্রেটর বটে, তবে সব ক্ষমতা তো জিয়ার মুঠোয়। তার অঙ্গুলি হেলনেই দেশ পরিচালিত হচ্ছে। শুনেছি ‘হ্যাঁ’ ‘না’ ভোটের পর একটি রাজনৈতিক দল গঠন করছেন জিয়া। সেই প্রক্রিয়াতেও আমাদের কোনও ভূমিকা নেই।
তাহলে তো বলতে হয় কাঁধে চাকচিক্য বাড়িয়েও আপনারা হচ্ছেন নিধিরাম সর্দার, কি বলেন স্যার? কিছু মনে করবেন না একটু রসিকতা করলাম পরিবেশটাকে হালকা করতে। বড্ড গুমোট অনুভব করছিলাম। আমার কথায় জনাব তোয়াব প্রাণ খুলে উচ্চস্বরে হেসে উঠলেন।
ঠিকই ধরেছো তুমি। একটা খোঁচাও দিলেন সাথে। তোমরা সবাই গত, আর আমরা যাবার পথে, হা হা হা! তবে স্বীকার করতে সংকোচ নেই তোমরা সাহসী বীর। কিছু অর্জন করে গিয়েছো কিন্তু আমরা এলাম আর যাবো। তবে কোনও অর্জন ছাড়াই। যে ধরনের পাঁচমিশালি ককটেল সৃষ্টি করা হচ্ছে রাজনৈতিক দল গঠনের প্রক্রিয়ায় তার সেই রাজনীতিতে দেশ বা জাতি কতখানি উপকৃত হবে সেটা জানিনা। তবে রাষ্ট্রীয় সব ক্ষমতা জিয়া সংরক্ষণ করবে নিজের মুঠিতে তথাকথিত গণতান্ত্রিক লেবাসের আবরণে সেটাই স্পষ্ট বুঝতে পারছি। কম্প্রোমাইজের নীতিই হবে তার রাজনীতির আদর্শ। এই ধরনের রাজনীতি পাকিস্তানেও চলে এসেছে শুরু থেকেই। তার পরিণাম সম্পর্কে আমার চেয়ে তুমি কম অবগত নও। জাতীয় পরিসরে কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী আর তাদের বিদেশী শক্তিধর মোড়লদের সাথে কম্প্রোমাইজ করে ব্যক্তি আর গোষ্ঠীস্বার্থ হাসিল করা যায় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। কিন্তু তার বিনিময়ে বিকিয়ে দিতে হয় দেশ ও জাতীয় স্বার্থ এবং স্বকীয়তা। তৃতীয় বিশ্বের বেশিরভাগ দেশের মতোই চলবে বাংলাদেশের রাজনীতি। জিয়া এর বিপরীতে কোনও প্রগতিশীল বৈপ্লবিক রাজনীতির সূচনা করবেন তেমনটি মনে করার কারণ নেই।
ভাগ্যচক্রে ‘৭১ এ স্বাধীনতার ঘোষণা, মুক্তিযুদ্ধের সময় জিয়া একজন চতুর উচ্চাভিলাষী পাকিস্তানী সামরিক অফিসার হিসাবে ভারত এবং প্রবাসী সরকারের চক্ষুশূল, স্বাধীনতার পর তোমাদের ছত্রছায়ায় সেনাবাহিনীতে টিকে থাকা, অবশেষে আগস্ট ও নভেম্বর বিপ্লবের বদৌলতে ক্ষমতার কেন্দ্রবিন্দুতে নিজেকে আবিষ্কার! এটাই তো তার জীবন বৃত্তান্ত। এতে তার নিজের অবদান কতটুকু? বাংলাদেশের মাটি-মানুষের সাথেই বা তার নাড়ির সংযোগ কতটুকু? আমার মতোই ভালো করে বাংলা বলতে বা লিখতেও পারেন না। আমি আর জিয়া রাজনৈতিক ভাবে কতটুকু সচেতন ছিলাম কিংবা আমরা কি কখনোই ছাত্র বা জাতীয় রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলাম? সঠিক জবাবটা হবে Absolutely not. বরং বলতে হবে We were just careerists and that was our only passion.
তোমাদের কথা আলাদা। জানতে পেরেছি, তোমাদের বেশিরভাগই রাজনৈতিক পরিবার থেকে আগত। ছোটকাল থেকেই রাজনীতির সাথে জড়িত। তাছাড়া রাজনীতির উপর বিস্তর পড়াশুনা ও চর্চা তোমাদের অনেককেই রাজনৈতিক ভাবে সচেতন করে তোলে চাকুরিতে যোগ দেবার আগেই। চাকুরিতে যোগ দেবার পর শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক আচরণ তোমাদের সচেতনাকে আরও ধারালো করে তোলে। তাই তোমরা সব সময় কঠিন ও দুঃসাহসিক পদক্ষেপ নিতে পেরেছো জীবনের ঝুঁকি নিয়ে হলেও। মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতা বয়সের তুলনায় তোমাদের রাজনৈতিকভাবে অনেক বেশি পরিপক্ব করে তুলেছে সেটাই আমি বিশ্বাস করি। তোমাদের সাথে জিয়া বা আমার মতো লোকদের কোনও তুলনাই হতে পারে না। এই সত্যটা স্বীকার করে নিতে আমি মোটেও লজ্জিত নই। আমি চুপচাপ শুনছিলাম এভিএম তোয়াবের বক্তব্য। এতোটা সাহসও মানুষের হতে পারে সেটা কখনোই আমি কল্পনা করতে পারতাম না তোমাদের স্বচক্ষে না দেখলে। দেশ ও জাতিকে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ থেকে বাঁচাতে নিজেদের জীবনের তোয়াক্কা না করে তুমি ও নূর দুইজনেই ছুটে এসেছিলে খালেদের সাথে আলোচনার জন্য। তোমাদের দেশপ্রেম আর সাহস দেখে সেদিন শ্রদ্ধায় আমার মাথা নিচু হয়ে এসেছিল, মনে মনে সিনিয়র হয়েও আমি তোমাদের স্যালুট করেছিলাম যদিও ভাষায় কিছুই প্রকাশ করার সাহস হয়নি, তবে নিজের প্রতি ধিক্কার জন্মেছিল। খুব ছোট আর স্বার্থপর মনে হয়েছিলো নিজেকে।
এভিএম তোয়াবের স্বতঃস্ফূর্ত আবেগপ্রবণ বক্তব্যে সততার অভাব ছিল না। খুলে না বললেও তার কথা থেকে জিয়ার সম্পর্কে তার মনোভাব বুঝতেও বেগ পেতে হয়নি আমার। সাহস আল্লাহ্ তায়ালার একটা বিশেষ দান। অতি কঠিন ক্রান্তিলগ্নে খুব কম লোকেই সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারে। এটাও একটা প্রাকৃতিক বিধান। এই অভিজ্ঞতা লেখকের হয়েছে অনেকবার রণাঙ্গনে। জনাব এভিএম তোয়াব যখন লিবিয়াতে এসেছিলেন তখন রশিদ, ফারুক তাকে যেভাবেই হউক রাজি করাতে সক্ষম হয়েছিল যে গাদ্দাফির গ্রীনবুক এ বর্ণিত অস্বচ্ছ ‘প্রগতিশীল ইসলামিক সমাজতন্ত্র’ দর্শনের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশের ধর্মভীরু জনসাধারণের মধ্যে একটি রাজনৈতিক প্ল্যাটফর্ম দাড় করাবার চেষ্টা তাকে করতে হবে। এর জন্য যত টাকাই লাগুক তার যোগান তাকে দেয়া হবে। এর ভিত্তিতেই তিনি ফিরে গিয়ে শুরু করেছিলেন সিরাত মাহফিল। সেনা পরিষদের আমরা বিশ্বাস করতাম, গাদ্দাফির গ্রীনবুক ভিত্তিক আদর্শ এবং শুধু মাত্র জনগণের ধর্মীয় চেতনাকে ব্যবহার করে কোন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড বাংলাদেশে কার্যকরী করা সম্ভব হবে না। তাই, আমরা তাদের উদ্যোগ থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়ে দূর থেকে তাদের কার্যক্রম অবলোকন করছিলাম। জনাব তোয়াব যখন দেশে ফিরে গিয়ে সিরাত মাহফিল করা শুরু করেন তখন জিয়া তার ঘর গোছাতে ব্যস্ত। তাই সাময়িক ভাবে তোয়াব কিছুটা খোলা ছুট পেয়েছিলেন। তবে আমরা জানতাম উপযুক্ত সময়ে এভিএম তোয়াবকে বলির পাঁঠা হতে হবে জিয়ার হাতে। রশিদ, ফারুক থেকে যাবে ধরাছোঁয়ার বাইরে। এয়ার চীফ তোয়াবের কথা থেকেই বোঝা যাচ্ছিলো জিয়ার সাথে তার সহাবস্থান খুব একটা সুখকর ছিল না।
আমি একটি বিষয় নিয়েই বিশেষভাবে ভাবছিলাম। জার্মানিতে দুই ভায়রার সাথে মিলিত হয়ে তোয়াব দেশে ফিরছেন। রশিদ ঢাকায়, ফারুক সিঙ্গাপুরে! এসব আমার কাছে একটি অশনি সংকেত বলেই মনে হচ্ছিলো। ভাবছিলাম, যদি শেষকালে দুই ভায়রা মিলে কোনও অঘটন ঘটিয়েই বসে সেইক্ষেত্রে আমার এবং সেনা পরিষদের বেঁচে থাকা অবশিষ্টদের করণীয় কি হবে সে সম্পর্কে একটা সিদ্ধান্ত আমাকে জিয়ার সাথে দেখা করার আগেই নিয়ে নিতে হবে। মনে মনে ঠিক করে ফেললাম, পৌঁছেই লিবিয়াতে অবস্থিত সহযোদ্ধা এবং দেশের বিভিন্ন সেনাছাউনিগুলোতে সেনা পরিষদের ইউনিটগুলোর নেতাকর্মী এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের বিশ্বস্ত বন্ধু-বান্ধব এবং সমমনা শুভার্থীদের সাথে যোগাযোগ করতে হবে। এইসব চিন্তা-ভাবনার মধ্যেই এক সময় এভিএম তোয়াব নিজেই ল্যান্ড করলেন ঢাকা আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে। ক্যাপ্টেন তাকে সাহায্য করলেন। ল্যান্ডিংটা একটু হেভি হয়েছিলো, তবে খুব একটা বেশি না। আমার দিকে চেয়ে তিনি বললেন Bloody hell! The landing was a bit heavy isn’t it? Not much of any concern Sir. যাত্রীরা কেউই কিছুই টের পেলো না। ল্যান্ডিং এর পর আমরা দুইজনই নিজেদের জায়গাতে ফিরে এসে নামার প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। ক্যাপটেন ট্যাঁক্সিং করে প্লেন টারম্যাকে দাড় করালো। দরজা খুলতেই দেখলাম VIP Lounge এর চত্বরের রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে আছে, মিনু ফুপ্পু, স্বপন, বাপ্পি, মহুয়া, কেয়া। সাথে মেজর মাহবুব বীর উত্তম। সারগোদীয়ান মাহবুব জেনারেল মঞ্জুরের ভাগ্নে। জেনারেল মঞ্জুর ও কর্নেল জিয়াউদ্দিন (দালাইলামা) দুইজনই ছিলেন সারগোদীয়ান। বন্ধুবর মুক্তিযোদ্ধা ডঃ কামাল সিদ্দিকীও (Principal Secretary to President Mushtaq Ahmed & Begum Khaleda Zia) ছিল সারগোদীয়ান। মাহবুবের বোন মাহমুদা ছিল নিম্মির সহপাঠী। মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকেই সেনা পরিষদ গঠনের যৌক্তিকতা এবং ভবিষ্যৎ গণমুক্তি সংগ্রামের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে আমাদের নীতি-আদর্শের প্রতি পূর্ণ আস্থার সাথে সেও আমাদেরই একজন হয়ে কাজ করে চলেছিলো সাংগঠনিক ক্ষেত্রে। সেই সূত্রে মাহবুবের সাথে আমাদের বিশেষ ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছিলো। স্বাধীনতার পর আমরা সবাই কুমিল্লাতে জিয়ার নেতৃত্বে ৩৩ ব্রিগেড পুনর্গঠনে নিরলস কাজ করে যাচ্ছিলাম। অনেক দেন-দরবারের পর মুজিব সরকার ৫টি পদাতিক ব্রিগেড এবং আনুষঙ্গিক ইউনিট, বিমান বাহিনী ও নৌ বাহিনীর Nucleolus গঠনের সম্মতি দিতে বাধ্য হয়। যুদ্ধবিধ্বস্ত সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ থেকে মিত্র ভারত লুট করে নিয়ে গিয়েছিলো পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর ১৬০০০ কোটি টাকার যুদ্ধ সম্ভার এবং অস্ত্রশস্ত্র। প্রতিটি ক্যান্টনমেন্ট থেকে তারা ইলেকট্রিকাল এবং সেনেটারি ফিটিংসগুলো খুলে নিয়ে যেতে দ্বিধাবোধ করেনি। সমুদ্র বন্দর এবং স্থলবন্দরগুলোতে স্তূপীকৃত আমদানিকৃত ও রপ্তানির জন্য আনীত সব মালামাল গণিমত হিসাবে লুটে নিয়ে যায় ভারতীয় বাহিনী। দেশের বড় বড় শহরের সব দোকানপাট থেকে সমস্ত মালামাল, সোনা; মিল-ফ্যাক্টরিগুলো থেকে মেশিন, কাঁচামাল এবং স্পেয়ারপার্টস কিছুই লুটে নেয়া বাদ দেয়নি বন্ধুরাষ্ট্রের সহায়ক শক্তি বাংলাদেশের সরকারের সম্মতিক্রমে। এ ধরনের হরিলুটের বিরোধিতা করতে গিয়ে অনেক মুক্তিযোদ্ধাকে অভাবনীয় লাঞ্ছনা-গঞ্জনার শিকারে পরিণত হতে হয়েছিল। একই কারণে মেজর জলিলের মতো একজন বীর সেক্টর কমান্ডারকে গ্রেফতার করা হয়েছিল সরকারি নির্দেশে। কিন্তু পরে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রবল চাপে তাকে সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। ভারত সরকার চাইছিল মুজিব সরকারের নিরাপত্তার অজুহাতে ২৫ বছরের গোলামির চুক্তির আওতায় দীর্ঘমেয়াদী অবস্থান রাখবে বাংলাদেশে। তাই মুজিব সরকারের আদেশে দেশের সব কয়টি ক্যান্টনমেন্ট দিয়ে দেয়া হয় ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অধীনে। মুক্তিযোদ্ধাদের ব্যাপারে সরকার সিদ্ধান্ত নেয় হাতিয়ার ভারতীয় বাহিনীর হাতে জমা দিয়ে ৫০ টাকা পথ খরচা নিয়ে আপন আপন ঠিকানায় ফিরে যাবার। নিয়মিত বাহিনি ‘Z’, ‘S’, ‘K’-কে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা হয় শহর থেকে দূরে বিশেষ করে ঢাকার বাইরে। আর মুক্তিবাহিনীকে বনে-জংগলে। সেই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়নি পরীক্ষিত দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা, বিশেষ করে ঐসব মুক্তিযোদ্ধারা যারা সম্প্রসারণবাদী ভারতীয় আধিপত্য মেনে না নিয়ে আর একটি ভারত বিরোধী মুক্তিযুদ্ধের জন্য নিজেদের সংগঠিত করে তুলেছিল খানসেনাদের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার যুদ্ধের আবরণে। তারাই তখন সিদ্ধান্ত নেয় ভারতীয় বাহিনীর সদস্য এবং তাদের সহযোগীদের বিরুদ্ধে দেশের সর্বপ্রান্তে ওদের অবস্থানের উপর চোরাগোপ্তা গেরিলা অপারেশান করে তাদের উৎখাতের মাধ্যমে দেশত্যাগ করতে বাধ্য করতে হবে। প্রতি রাতে মারা পড়তে থাকে শত শত লুটেরা বাহিনী এবং তাদের মিত্রবাহিনীর সদস্যরা। নাস্তানাবুদ হয়ে পড়ে তল্পিবাহক মুজিব এবং তার মনিব ভারতীয় সরকার। এই ধরনের লুটতরাজের ফলে দেশবাসীও ভারতের উদ্দেশ্যকে সন্দেহের চোখে দেখতে থাকে। তাদের বুঝতে অসুবিধা হয়নি ভারত বাংলাদেশে ঢুকেছে রক্ষক হিসেবে নয়, ভক্ষক হয়ে। দেশের মুক্তিকামী জনগণ প্রতিবাদী লড়াকু দেশপ্রেমিক মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের প্রতি সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতার হাত বারিয়ে দেন। ফলে বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় বাহিনীর মনোবল দ্রুত ভেঙ্গে পরতে থাকে দেশবাসীর ঘৃণা এবং গেরিলাদের চোরাগোপ্তা আক্রমণে বিপর্যস্ত হয়ে। বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের মনের কথা, সহায়ক প্রতিবেশী দেশ ভারতকে আমরা শ্রদ্ধা করবো, কিন্তু ভারত যদি বাংলাদেশকে তাদের একটি করদ রাজ্যে পরিণত করতে চায় তবে প্রয়োজনে আরও রক্ত দেবো কিন্তু তাদের সেই স্বপ্ন কখনোই বাস্তবায়িত হতে দেবো না। সবারই এক কথা, ইসলামাবাদ থেকে দিল্লীর গোলামির জন্য লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে দেশ স্বাধীন করা হয়নি। রক্তের বদৌলতে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। এই স্বাধীনতা রক্ষা করবো যেকোনো ত্যাগের বিনিময়ে। এভাবেই স্বাধীনতার জন্মলগ্ন থেকেই ভারতের প্রতি বাংলাদেশীদের বিদ্বেষ ও ঘৃণা দুটোই ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেতে থাকে। একইসাথে বিদেশী সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে স্বীকৃতি দিতেও চাইছিলো না বিশ্বের সংখ্যাগরিষ্ঠ রাষ্ট্র জাতিসংঘের চার্টার অনুযায়ী। কারণ, ভারতীয় সামরিক বাহিনীর অবস্থানের ফলে বাংলাদেশকে স্বাধীন রাষ্ট্রের পরিবর্তে, অঞ্চলটাকে তখনও তারা মনে করছিল ‘Occupied Territory’ of Pakistan হিসাবে। এই উভয় সংকটে পরে মুজিব সরকারের সাথে সমঝোতার ভিত্তিতে ভারত সরকার বাধ্য হয় তাদের সেনাবাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে উঠিয়ে নিতে।
এই বিষয়েও আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ইতিহাস বিকৃতির প্রয়াসের কমতি নেই। তারা প্রোপাগান্ডা করে থাকে দেশে ফেরার পর মুজিবের হুকুমেই নাকি ইন্দিরা সরকার ভারতীয় বাহিনীকে বাংলাদেশ থেকে ফেরত নিয়ে গিয়েছিল! এটা নাকি ছিল মুজিবের একটা বিরাট সাফল্য! দেশের শীর্ষস্থানীয় নেতা-নেত্রীদের মধ্যে মিথ্যাচারের মাধ্যমে কৃতিত্ব নেবার যে জঘন্য প্রতিযোগিতা লক্ষ্য করা যায় তাতে মনে হয় তারা জনগণকে বেকুব মনে করেন। তারা এটাও ভুলে যান যে একদিন এইসব মিথ্যাচার ইতিহাসের আঁস্তাকুড়েই স্থান পাবে। ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশ ছারতে বাধ্য হবার পর মুজিব সরকারের নিরাপত্তার জন্য বিএলএফ, কাদেরিয়া বাহিনী, আওয়ামীলীগের ক্যাডার ও বিভিন্ন নেতাদের অধীনস্থ বিভিন্ন বাহিনীর সমন্বয়ে গড়ে তোলা হয় অত্যাধুনিক কুখ্যাত রক্ষীবাহিনী ভারতের সাহায্যে। কারণ, চাপের মুখে মুজিব সরকার জাতীয় প্রতিরক্ষা বাহিনী গঠন করার অনুমতি দিলেও মুক্তিযোদ্ধাদের এবং পাকিস্তান প্রত্যাগত অফিসার এবং সৈনিকদের নিয়ে গঠিত বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাস করতে পারেনি মুজিব ও ইন্দিরা গান্ধী as their character was not pro-establishment but pro-people. দেশ ও জাতীয় স্বার্থই ছিল তাদের কাছে প্রধান, ব্যক্তি-গোষ্ঠী কিংবা দলীয় স্বার্থ নয়।
বিমান বাহিনীর চীফ তোয়াবকে অভ্যর্থনা জানাতে এসেছেন বিমান বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কয়েকজন কর্মকর্তা। ভিআইপি লাউঞ্জে একই সাথে গিয়ে ঢুকলাম আমরা। অনেক দিনের অনিশ্চয়তা এবং ব্যবধানে আমাকে দেখে সবাই অশ্রুসিক্ত চোখে জড়িয়ে ধরলো। আমি একে একে সবাইকে জনাব তোয়াবের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলাম। স্বপনের সাথে পরিচয় হবার পর জনাব তোয়াব তাকে বললেন
শুনেছি তুমিও তো বীরবিক্রম খেতাব প্রাপ্ত একজন দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধা। ঢাকা শহরে খানসেনাদের বিরুদ্ধে যতগুলো লোমহর্ষক গেরিলা অপারেশন করা হয়েছে সেই গেরিলা গ্রুপটির মধ্যে তুমি অন্যতম। জানতে পেরেছি, দেরাদুন থেকে কমিশন নিয়ে দেশে ফেরার পর সবার অনুরোধ উপেক্ষা করে তুমি আর্মিতে যোগদান না করে ব্যবসা করছো? জবাবে স্বপন বললো
স্যার, আমাদের দলের সবাই ছিল সাহসী, নিবেদিতপ্রাণ মুক্তিযোদ্ধা। আমিও ছিলাম তাদেরই একজন। তাই কৃতিত্বের যদি কিছু থাকে সেটার দাবীদার সবাই, আমি একা নই। তাছাড়া যুদ্ধের আগেই বৈরুতের আমেরিকান ইউনিভার্সিটি থেকে পড়াশুনা শেষ করে জার্মানি থেকে উচ্চশিক্ষা নিয়ে দেশে ফিরে নিজের ব্যবসা শুরু করেছিলাম, আর সাথে ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে MBA কোর্সটাও শেষ করছিলাম। সেই সময় যুদ্ধ শুরু হয়, আর তাতে আমরা যোগদান করি দেশকে স্বাধীন করতে। দেশ স্বাধীন হয়েছে। তাই ফিরে এসেছি নিজের ব্যবসাতে। যুদ্ধে হারিয়েছি অনেক প্রিয় সহযোদ্ধাদের। আর্মিতে চাকুরি করার উদ্দেশ্যে যুদ্ধে আমরা কেউই যোগ দেইনি।
স্বপন, শাহাদাত চৌধুরী (সাচো), ফতেহ আলী, বদি, রুমি, কাজি কামাল, বাদল, আলম, চুল্লু, সামাদ, আজাদ, উলফাত, তৈয়ব আলি, মেওয়া, ফাজলে, বাচ্চু, মোক্তার, দস্তগির, মায়া, মূলত এদের নিয়েই ২নং সেক্টরের অধীন গঠিত হয়েছিল এই দুর্ধর্ষ গেরিলা গ্রুপটি। এরা ত্রাসের সঞ্চার করেছিলো ঢাকায় খানসেনাদের মনে দুঃসাহসিক অপারেশন চালিয়ে। তটস্থ করে তুলেছিলো কুর্মিটোলার হেডকোয়াটার্স এর বাঘা বাঘা জেনারেল সমরবিদদের। জনগণ তাদের নামকরণ করেছিলো সংক্ষেপে ‘বিচ্ছু’ হিসেবে। খানসেনাদের কাছে তারা পরিচিত ছিল ‘মুক্তি’ নামে। অবস্থা এমন পর্যায়ে নিয়ে গিয়েছিল এই দামাল জানবাজ গেরিলা গ্রুপটি যে বাতাসে গাছের পাতা নড়লেও খানসেনারা আতঙ্কে লাফ দিয়ে পালিয়ে যেতো ‘মুক্তি আগিয়া’ ‘মুক্তি আগিয়া’ রব তুলে। স্বপন জার্মানিতে পড়াশুনা করেছে জেনে, এভিএম তোয়াব স্বপনের সঙ্গে কিছুক্ষণ জার্মান ভাষায় কথা বলে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন He is very sharp and bright young man, I am impressed. জবাবে বলেছিলাম Sir, all of his Comrades were the brightest lot in the Dhaka University. All were stars in real sense of the term. Luggage have arrived, so it is time to leave. মালপত্র এসে গেছে তাই বিদায় নেবার পালা। এভিএম তোয়াব এর কাছ থেকে বিদায় চাইলে তিনি বললেন
ফিরে যাবার আগে দেখা হবে নিশ্চয়ই? Shapan, do remain in touch.
যদি সুযোগ হয়। বলে বিদায় নিয়ে আমরা সবাই মালিবাগে এসে পৌঁছালাম।
বাসায় পৌঁছে দেখি আব্বাসহ সবাই আমার প্রতীক্ষায় সময় গুণছেন। সবারই এক প্রশ্ন, নিম্মিকে কেনো সাথে নিয়ে এলাম না। সংক্ষেপে জবাবে বললাম, অবস্থা বিবেচনা করে তাকে লন্ডনে খালাম্মাদের কাছে রেখে এসেছি। কিছুক্ষণ পর মাহবুব এক ফাঁকে আমাকে বললো
স্যার, শিশুভাই এর সাথে আলাপ করে আপনার আগমন বার্তাটা জানিয়ে দিন। মাহবুব নিজেই ডায়েল করে আমাকে রিসিভার দিয়ে বললো শিশুভাই on the line.
আসসালামালাইকুম শিশুভাই, ডালিম বলছি।
ওয়াসসালাম। Nice to hear you, how was the flight? Not bad but interesting! ভালো। শোনো, সন্ধ্যায় বাসায় এসো। রাতের খাবার একসাথেই খাবো। টনি, লাজু, কাজু সবাই উদগ্রীব হয়ে আছে নিম্মির অপেক্ষায়। নিম্মিকে তো সঙ্গে আনিনি, তাকে লন্ডনেই রেখে এসেছি। কেনো, সঙ্গে করে দেশে নিয়ে আসলেও তো পারতে? তা পারতাম, তবে ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না what is on the card. তাই রিস্ক না নিয়ে লন্ডনেই রেখে এলাম। I see, anyway, তুমি আসবে সন্ধ্যায়। আর একটি কথা, মাহবুব being one of your closest has been placed at your disposal. He would be at your beak and call. যখন যা প্রয়োজন ডেকে পাঠালে সেই সেটা করবে। তাকে তোমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী হিসাবেও গ্রহণ করতে পারো। Rest over dinner.
As you desire, শিশুভাই। Thanks a lot. ফোন রেখে দিলাম। এর পর মাহবুব বললো
স্যার আমি এখন তবে আসি। বলেই একটা কাগজে দুইটা টেলিফোন নম্বর লিখে আমার হাতে দিয়ে বললো সন্ধ্যায় আমিই আপনাকে শিশুভাইয়ের বাসায় পৌঁছে দেবো, just give me a call whenever you are set to go. Okay fine, Thanks for everything. বুকের সাথে বুক মিলিয়ে বাসার সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে মাহবুব চলে গেলো। মাহবুব বাসার সবার সাথেই বিশেষভাবে পরিচিত। আব্বা বললেন
মাহবুব সার্বক্ষণিকভাবে তোর সাথে থাকবে এটা শুনে আমি অনেকটা স্বস্তি বোধ করছি। দেশের যা অবস্থা বিশেষ করে সেনাবাহিনীর মধ্যে স্থিতিশীলতা এখনো পুরোপুরি ফিরে আসেনি। ইতিমধ্যে একদিন শিশুর মাধ্যমে জিয়া আমাকে ডেকে পাঠিয়ে অনুরোধ জানালেন, তাকে রাজনৈতিক ভাবে সাহায্য করতে। তিনি তার ১৯ দফার ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক দল দাড় করাতে চাইছেন। তার আবেদনে বেশ আন্তরিকতা অনুভব করে আমি, শামছুল হুদা, শাহ আজিজ, যাদু মিয়া, ভোলা মিয়াঁ, আরও পুরনো বন্ধু-বান্ধবদের নিয়ে তার প্রস্তাবে সম্মত হয়ে কাজ করছি। তিনি বললেন, বাকশাল আর ভারত বিরোধী নীতিই হবে তার রাজনীতির মূল আদর্শ। তাই যদি সত্যি হয়, তবে তো তাকে সাহায্য করাই উচিৎ। তাছাড়া জিয়া তো তোদেরই একজন। মোশতাকও টানাটানি করছিল তার দলে যোগ দেবার জন্য। তবে আমরা মনে করি জনসমর্থনের দিক দিয়ে জিয়াই এগিয়ে। তাই নির্বাচনে জিয়াই জিতবে। তবে মোশতাক একটি শক্তিশালী দলের নেতা হিসাবে বিরোধী দলীয় নেতা হতে পারবে। আগামী নির্বাচনের আগেই পার্টি হিসাবে আওয়ামীলীগ বিলীন হয়ে যাবে। নেতৃত্বের কোন্দলে তাদের পার্টির কনভেনশন করা সম্ভব হচ্ছে না। তুই কি বলিস?
আব্বা, দেশত্যাগের পর এইতো এলাম, তাই কোনও কিছু না জেনে না বুঝে মন্তব্য করতে চাই না। তবে জিয়া একজন চতুর খেলোয়াড়। আমার মনে হয়, তিনি ভারতের সাথে সমঝোতা করেই রাজনীতি করবেন। তাই আওয়ামীলীগ বিলীন হয়ে যাবে এই ধারণাটা সঠিক নাও হতে পারে। আপনারা সবাই পুরনো রাজনীতিবিদ। তাই সব বুঝেশুনে সিদ্ধান্ত নেবার যোগ্যতা আপনাদের আছে। সেখানে আমার মতামতের উপর আপনাদের নির্ভরশীল হতে হবে সিদ্ধান্তের বিষয়ে তেমনটি আমি মনে করি না। আপনারা যা ভালো বুঝবেন সেটাই করবেন। তবে একটি কথা জেনে রাখুন, মানুষ মাত্রই পরিবর্তনশীল। জিয়ার ব্যাপারেও সেটা প্রযোজ্য। অবাক হবেন না যদি কোনোদিন দেখেন জিয়া নিজেই হাসিনাকে স্বাগত জানিয়ে ফিরিয়ে এনে আওয়ামীলীগকে দেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করছেন।
তা কি করে সম্ভব!
শুধুমাত্র ক্ষমতার রাজনীতিতে সব কিছুই সম্ভব। তাছাড়া প্রচলিত রাজনীতিতে শেষ কথা বলে তো কিছু নেই। তোদের কেনো ডেকে পাঠিয়েছেন জিয়া?
তিনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা করতে চান।
আলোচনার আবার কি আছে?
সেটাতো জানিনা, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। তিনি ডেকে পাঠিয়েছেন তাই এসেছি।
ইতিমধ্যে আব্বা একটা ফোন পেয়ে বললেন, আমাকে একটু বেরুতে হচ্ছে, তুই বিশ্রাম কর। কাল থেকে তো তোর টিকিটির নাগালও পাওয়া যাবে না। সাবধানে থাকিস। উঠে চলে গেলেন আব্বা। আব্বার কথায় সবাই হেসে উঠল। কেয়া বললো
জানো ভাইয়া, তোমাদের যাওয়ার পর অফিসার আর সৈনিক ভাইরা কিন্তু প্রায়ই এসে আমাদের খোঁজখবর নিতো আর বলতো, আপনারা স্যারদের ফিরে আসতে বলুন, জিয়ার অনুমতির জন্য তারা কেনো অপেক্ষা করছেন! তাই বুঝি?
হ্যাঁ।
এরপর দুপুরের খাওয়া শেষ করে কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে আমি মহুয়াকে বললাম এবার আমাকে উঠতে দে। জিয়ার মুখোমুখি হওয়ার আগে কিছু প্রস্তুতি নিতে হবে। মহুয়া ফোনটা আমার ঘরে লাগিয়ে দিয়ে আয়। মহুয়া নীরব কর্মী ও তীক্ষ্ণবুদ্ধির অধিকারিণী। নিম্মির মতই স্বল্পভাষী, তাই হয়তো তারা দুইজনই হরিহর আত্মা! কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে জানালো সব কিছু ঠিকঠাক করে দেয়া হয়েছে। আমি উঠতেই মহুয়া বললো
ভাইয়া, তোমার ডিউটি করার জন্য আরও একটা গাড়ী আর ড্রাইভার ২৪ ঘণ্টা থাকবে বাসায়।
এটার কোনও প্রয়োজন ছিল না।
তবুও ওটা থাকবে যতদিন তুমি দেশে থাকবে।
বলছিস যখন ঠিক আছে, থাকুক। নিজের ঘরে গিয়ে দরজা বন্ধ করে শুরু হল ফোনালাপ। বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে বেঁচে থাকা সেনা পরিষদের সদস্য অফিসার-সৈনিক, বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক অঙ্গন, সাংবাদিক মহল, আমলাতন্ত্র, ব্যবসায়ী মহল, ছাত্র ও যুব সমাজের বিশেষ আস্থাভাজন রাজনৈতিক কর্মী এবং নেতৃবৃন্দ, বিভিন্ন পেশায় নিয়জিত বন্ধু-বান্ধব, সমমনা পুরনো নিকটজনদের আমার আগমন বার্তা জানিয়ে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি এবং জিয়া ও তার সাঙ্গোপাঙ্গোদের সম্পর্কে যতটুকু সম্ভব বিস্তারিত জেনে নিলাম। জিয়া সম্পর্কে দেশের সাধারণ জনগণের মনোভাবও জেনে নিলাম। সবক্ষেত্র থেকেই মিশ্র প্রতিক্রিয়া পাওয়া গেলো। একটা বিষয়ে রাজনৈতিকভাবে সচেতন সবাই প্রায় একই অভিব্যক্তি জানাল। জিয়া গতানুগতিক সমঝোতা ভিত্তিক এবং ক্ষমতাকেন্দ্রিক পুরনো ধাঁচের পাতানো খেলার রাজনীতিই করবেন। কোনও বৈপ্লবিক কর্মকাণ্ডের মাধ্যমে আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে কোনও আমূল পরিবর্তনের দিকে জিয়া যাবেন না। Status quo-তে বিশ্বাসী জিয়া, প্রতিবেশী ভারতসহ বহির্বিশ্বের শক্তিধর দেশগুলোর বলয়ে থেকেই জাতীয় পরিসরে কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোকে খুশি রেখেই চলবেন। তাই তার রাজনীতি তেমন একটা গণমুখী হবে না জনগণের প্রত্যাশা অনুযায়ী। এতে দেশ বা জনগণের ভাগ্যের কতটুকু পরিবর্তন হবে সেই বিষয়ে সন্দেহের অবকাশ থাকলেও একটি বিষয় পরিষ্কার ভাবেই বলা চলে, জিয়া পরিবার, তার দলীয় নেতৃত্বের ভাগ্য উন্নয়নের দ্বার অবারিত হবে। তিনি সুচতু্র ভাবে নিজেকে দুর্নীতির ঊর্ধ্বে রেখে নেতা-কর্মীদের দুর্নীতি পরায়ণ করে নিজের হাতের মুঠোয় রাখবেন ‘ইয়েস ম্যান’ হিসাবে। এ ভাবেই সব ক্ষমতা কুক্ষিগত করে দেশ চালাবেন নিজের খেয়ালখুশি মতো। প্রতিবাদী কণ্ঠ কিংবা দ্বিমত বলে কিছুই থাকবে না তার দলে। গণতন্ত্রের লেবাসে জিয়া হয়ে উঠবেন এক ভয়ানক স্বৈরচারী রাষ্ট্রনায়ক। যেটাকে বলা হয় intellectual corruption. যেকোনো দেশ এবং জাতির জন্য পার্থিব দুর্নীতির চেয়ে মননশীল দুর্নীতি শতগুণ ক্ষতিকর। ক্ষমতালোভী কানকথায় বিশ্বাসী জিয়া যে কত নিষ্ঠুর হতে পারেন তার নজির ইতিমধ্যেই তিনি স্থাপন করেছেন প্রায় ৩০০০ বিপ্লবী সেনাসদস্য ও নেতাকর্মী নৃশংসভাবে হত্যা করে সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে। সেনাসদস্যদের বুট এবং উর্দিসহ গণকবরে পুঁতে দেয়া হয় রাতের অন্ধকারে কড়া নিরাপত্তায় বিভিন্ন স্থানে। বন্ধুদের বেশিরভাগের ধারণা ভাঙ্গা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি, কোদাল কাঁধে খালকাটার গণসংযোগের চাতুর্যে বর্তমানে কিছুটা বিমোহিত জনগণের নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হতে বেশি সময়ে লাগবে না। অনেকেই জানালো, ডঃ কামাল হোসেনের মাধ্যমে ইতিমধ্যেই ভারতের সাথে সমঝোতা করে তিনি হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামীলীগকে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করবেন দেশে বহুদলীয় রাজনীতি চালু হলেই। এর পরিণাম দেশ ও জাতির জন্য হবে ভয়ংকর। শুধুমাত্র ক্ষমতার লোভে এই ধরণের আত্মঘাতী পদক্ষেপ যদি নেয়া হয় তবে ‘৭১ এর স্বাধীনতার ঘোষক দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা জিয়াকে ইতিহাস মূল্যায়ন করবে এক সুবিধাবাদী, জাতীয় বেঈমান, রক্তপিপাসু এবং ক্ষমতালোভী ব্যক্তি হিসেবে। সম্ভবত তার নিজের পরিণতিও হবে অতি করুণ! সবকিছুই বেনগাজীতে জানালাম এবং আমার এবং সেনা পরিষদের করণীয় সম্পর্কে তাদের অভিমত জানতে চাইলাম। সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিল সহযোদ্ধা বিপ্লবী সাথীরা। তারা বললো, বর্তমানের অবস্থা ২-৩ নভেম্বরের চেয়ে জটিল এবং নাজুক। এই পরিস্থিতিতে, সেনা পরিষদকে জিয়া বিরোধী কোনও দ্বন্দ্বে জড়িত হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে কৌশলগত কারণেই। শুধু তাই নয়, ভায়রাদ্বয় যদি প্রতিক্রিয়াশীল কোনও হঠকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবে তাদের পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে হবে, তাদের সাথে সেনা পরিষদের কোনও সম্পর্ক থাকবে না এবং তাদের সেই ধরনের যেকোনো পদক্ষেপের বিরোধিতা করা হবে। এতে জিয়া উপকৃত হবেন। তবে আমাদের নীতি ব্যক্তিস্বার্থের ঊর্ধ্বে দেশ ও জাতীয় স্বার্থেই অটল থাকতে হবে। দেশের রাজনীতিকে যেভাবে জিয়া এগিয়ে নিয়ে চলেছেন তার মোকাবেলা রাজনৈতিক ভাবে করার সুযোগের অপেক্ষায় থাকতে হবে। অপ্রিয় সত্য হল, কর্নেল তাহের এবং তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার সামরিক বাহিনীতে হঠকারী শ্রেণিসংগ্রামের পদক্ষেপের পরিপ্রেক্ষিতে গণহারে অফিসার এবং সদস্যদের বিনাবিচারে হত্যা করাটা সামরিক বাহিনীর সাধারণ সদস্য এবং দেশবাসীর কাছে গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। আর সেই সুযোগে পরিকল্পিত ভাবে জিয়া সেনা পরিষদকে তার প্রতিপক্ষ ভেবে ১৮-১৯ টা সাজানো ব্যর্থ অভ্যুত্থানের ধুয়া তুলে প্রায় ৩০০০ সেনা পরিষদের সদস্য, সাধারণ দেশপ্রেমিক সেনা অফিসার, মুক্তিযোদ্ধা এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে সমমনা নেতা-কর্মীদের নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। কারাবন্দী এবং চাকুরীচুত করেছেন অনেককেই। এভাবেই তার পথের কাঁটা দূর করেছেন জেনারেল জিয়া চাতুর্যের সাথে ক্ষমতার স্বার্থে। এই সত্যটা সম্পর্কে সাধারণ জনগণ অবহিত নন, এই সুযোগটা ভালোভাবে কাজে লাগিয়ে জিয়া এখনো দেশবাসীর কাছে তিনি আমাদেরই একজন সেই ভাবমূর্তিটাও বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন। এই পরিপ্রেক্ষিতে তার সাথে কোনও প্রকারের সংঘর্ষে লিপ্ত হলে সেটা জনগণের কাছে গ্রহণীয় হবে না এবং এখনো সেনা পরিষদের যতটুকুই অবশিষ্ট আছে সেটুকুও ধ্বংস হয়ে যাবে। আমাদের ভাবমূর্তি এবং শক্তি দুটোই ক্ষুন্ন হবে। এই বিষয়ে শিশুভাইয়ের উপদেশটাই আমাদের জন্য বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তাদের জোরালো যুক্তি সাপেক্ষে ঢাকায় সিদ্ধান্ত নেয়া হল, এই মুহূর্তে জিয়া বিরোধী কোনও কার্যক্রমে জড়িত হবে না সেনা পরিষদ, বরং এর বিপক্ষেই অবস্থান নেবে। সন্ধ্যার পর মাহবুব আমাকে পৌঁছে দিল মইনুল রোডে শিশুভাইয়ের বাসায়। শিশুভাই তখনো বাড়ী ফেরেননি। টনি ভাবী, লাজু কাজুরা নিম্মিকে কেন সাথে করে আনিনি সে বিষয়ে অভিযোগ করলো। কারণটি তাদের সাদামাটা ভাবে বোঝালাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই মাহবুবের কাছ থেকে আমার আগমনী বার্তা পেয়ে বাসায় চলে এলেন শিশুভাই। সাধারণত তিনি মধ্যরাত্রির আগে বাসায় ফেরেন না জানিয়েছিলেন টনি ভাবী। সারাদিন জাগোদলের অফিসে বাকবিতন্ডা, সমঝোতার ম্যারাথন মিটিং, দরকষাকষির ঝকমারিতে বিধ্বস্ত ক্লান্ত হয়ে ফিরেছেন শিশুভাই। শিশুভাই, আপনাকে ভীষণ ক্লান্ত দেখাচ্ছে!
আর বলো না, জাগোদলের অফিসকে একটি মাছের বাজারের সাথেই তুলনা করা চলে। সব সুযোগ সন্ধানী, সুবিধাবাদী, দলছুট বাস্তুঘুঘু নেতাকর্মীরা নিজেদের ভাগ্য উন্নয়নের জন্য মাছির মতো ভনভন করছে। কে কার পিঠে ছোরা মেরে বা ঘাড়ের উপর দিয়ে নিজেকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে সেই Rat Race এ সবাই একইভাবে আপ্রাণ চেষ্টায় লিপ্ত। জঘন্য এদের বেশিরভাগের চরিত্র। স্বার্থের জন্য মানুষ নিজেকে কতটা ছোট করতে পারে এই দায়িত্ব না নিলে জানতে পারতাম না। আমার জন্য বর্তমানের দায়িত্বটা মানুষ চেনার একটা বিস্ময়কর অভিজ্ঞতা অর্জনের সুযোগ। তুমি একটু সময় দাও, আমি একটু ফ্রেশ হয়ে আসি। অবশ্যই।
শিশুভাই অল্পক্ষণেই ফ্রেশ হয়ে ফিরে এলেন। কেমন আছ তুমি এবং বেনগাজীর বাকিরা?
আমরা বদলে যাইনি শিশুভাই, আমরা আগের মতোই আছি। নিম্মিকে সাথে নিয়ে আসলেও তো পারতে?
পারতাম। তবে তাকে লন্ডনেই রেখে এসেছি খালাম্মাদের কাছে। মনে হচ্ছে, ভালোমন্দেই সময় কাটছে দেশের ‘রাজপুতিনের’?
বিশ্বাস করো ডালিম, আমি ইতিমধ্যেই হতাশ হয়ে পড়েছি। এই সমস্ত প্যাঁচালো অসৎ চরিত্রের নেতা-কর্মীদের মাধ্যমে দেশ কিংবা জাতির ভাগ্যের পরিবর্তন করা কি করে সম্ভব? কিন্তু বর্তমানের স্ট্রং ম্যান জেনারেল জিয়া তো আমাদের তুলনায় এদেরকেই বেশি আস্থাভাজন মনে করে তাদের সাথে নিয়েই রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলেন। আমার কথায় কিছুক্ষণ চুপ থেকে শিশুভাই বললেন
বাইরের জেনারেল ইসলামের খোলসটা দেখে লোকজন যাই মনে করুক না কেনো, তোমাদের কাছে আমার বাইরের এবং ভিতরের সত্তার কিছুই গোপন নাই, বিশেষ করে তোমার কাছে। তাই নিঃসংকোচে বলছি, I am totally frustrated with the current state of affairs, you guys had created an tremendous opportunity to build a self respecting and self reliant progressive nation but that opportunity had been lost. জিয়া যে ধরনের রাজনীতির সূচনা করতে যাচ্ছেন তাতে দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব কোনোটাই সুরক্ষিত হবে না। জাতির ভাগ্যোন্নয়নের জন্য আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে যে ধরনের আমূল মৌলিক পরিবর্তন প্রয়োজন সেটাও তার পক্ষে আনা সম্ভব হবে না, যদিও জনসম্পদ এবং প্রাকৃতিক সম্পদের দিক দিয়ে বাংলাদেশ একটি যথেষ্ট সম্ভাবনাময় রাষ্ট্র।
কারণটি হবে জিয়ার ভুল রাজনীতি। তার রাজনীতির চরিত্র হবে তৃতীয় বিশ্বের অনুন্নত দেশগুলোর মতোই। সামরিক-বেসামরিক আমলাতন্ত্রের সমন্বয়ে স্বৈরতন্ত্র কিংবা ভুয়া গণতন্ত্রের লেবাসে একনায়কতন্ত্র অথবা পরিবারতন্ত্রই হউক সেটা নিয়ন্ত্রিত হবে জনস্বার্থ এবং জাতীয় স্বার্থ বিরোধী কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের দ্বারা। ফলে সব আশা-প্রত্যাশা পরিণত হবে সোনার হরিণে এ বিষয়ে আমার কোনও সন্দেহ নেই। আমার মনে হয়, জিয়াকে তার ভুলের মাশুল দিতে হবে চরমভাবে। দেশ ও জাতির সাথে তার নিজস্ব পরিণতিটাও হবে দুঃখজনক। এই বাস্তবতাটা যদি যুদ্ধকালে পরিষ্কার বুঝতে পারতাম তবে আমার যেসমস্ত চারিত্রিক সীমাবদ্ধতা রয়েছে তারপরও হয়তো বা তোমাদেরই একজন হয়ে যেতাম। এই ব্যর্থতা আমাকে আজ কুরে কুরে খাচ্ছে। আত্মগ্লানিতে নিজেকে খুবই ছোট মনে হচ্ছে। একজন অতি বিশ্বস্ত আপনজনের কাছে সুযোগ পেয়ে নিজেকে একটু হালকা করে নিচ্ছি। বাধা দিও না। ধরা গলায় বললেন শিশুভাই। তবুও তাকে সান্ত্বনা দিয়ে বললাম
শিশুভাই, এতো মন খারাপ করছেন কেনো? জীবনের সব মায়া ত্যাগ করে, ঝুঁকি নিয়ে আজ আমরা জিয়ার হাতে ব্যবহৃত পণ্যে পরিণত হয়েছি, আপনিও তাই হতেন। ফুঁসে উঠলেন শিশুভাই
না, আমি যদি তোমাদের একজন হতাম যুক্তিসঙ্গতভাবে জিয়ার চরিত্র তোমাদের কাছে তুলে ধরতাম, তাহলে তোমরা তাকে কিছুতেই rallying figure হিসাবে গ্রহণ করতে না, আর সেইক্ষেত্রে বিশ্বাসঘাতকতার শিকারেও পরিণত হতে হতো না এতদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা। সেদিন সেই আন্তরিক সন্ধ্যায় শিশুভাই মনের দুয়ার খুলে অনেকটাই আবেগ প্রবণ হয়ে পড়েছিলেন। তার চোখে পানি জমে উঠেছিলো। কোনদিকেই তার ভ্রুক্ষেপ নেই, একনাগাড়ে বলে চলেছেন তিনি মন উজাড় করে আর আমি নীরবে একাগ্র মনে শুনছি তার কথা। দুর্বল চরিত্রের মানুষ হয়েও আজ কিছু কথা বলবো, মনে রেখো তোমাদের শিশুভাইয়ের কথাগুলো। সময়ই প্রমাণ করবে আমার হৃদয় নিংড়ানো বক্তব্যের সত্যতা। তোমাদের নজিরবিহীন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেম, প্রজ্ঞা, দূরদর্শিতা, নৈতিক এবং মানবিক চরিত্র, আত্মত্যাগের সুমহান আদর্শ, রাজনৈতিক বিপ্লবী নীতি-আদর্শ এবং নিপীড়িত এবং বঞ্চিত জনগণের ন্যায্য অধিকার সম্পর্কে আপোষহীন সংগ্রামের প্রত্যয় দ্বারাই সম্ভব সব রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে ‘৭১-এর চেতনা ও স্বপ্নের বাস্তবায়ন; একটি প্রকৃত অর্থে স্বাধীন, স্বনির্ভর, প্রগতিশীল, সুখী, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশ গড়ে তোলা। সাময়িকভাবে, অজ্ঞ সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশবাসী, বিক্রিত বুদ্ধিজীবী এবং সমাজপতি, বর্তমানে কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর প্রতিভূ সরকারের এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের উচ্ছিষ্ট ভোগের লোভে লালায়িত হয়ে তাদের অঙ্গুলি হেলনে তোমাদের সম্পর্কে যে মূল্যায়নই সরবে প্রচার করুক না কেনো একদিন এই দেশেরই জনগণ সব সত্যই উদ্ঘাটন করতে সমর্থ হবে। তখন তাদের কষ্টিপাথরের পাল্লায় একদিকে মুজিব আর জিয়া এবং অন্যদিকে তোমাদের দাঁড় করালে তোমাদেরকেই বিবেচনা করা হবে জাতীয় বীর আর মুজিব এবং জিয়া দুই জনকেই আখ্যায়িত করা হবে জাতীয় বেঈমান হিসাবে। আমি নীরবে বসেছিলাম। শিশুভাই যাকে মাঝেমধ্যে ঠাট্টা করে আমরা সম্বোধন করতাম ‘নাবালক ভাই’ হিসাবে, যার ভীরুতা নিয়েও কাছের জনরা তিরস্কার করতাম অহরহ সেই শিশুভাই আজ ঘটনাচক্রে জেনারেল জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন হিসাবে বাংলাদেশের ক্ষমতাধর ‘রাজপুতিন’ নামে খ্যাত সেই শিশুভাই আজ কোন চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে এ ধরনের স্বগতোক্তি করছেন! আমাদের সাথে শিশুভাই-এর কোনও লেনদেনের সম্পর্ক নেই, ছিলও না কখনোই। ছিল অকৃত্রিম ভালোবাসা এবং বিশ্বাসযোগ্যতার বন্ধন। তাই বোধকরি এতদিনের সুপ্ত বিবেক আজ জেগে উঠেছে প্রবহমান ঘটনা প্রবাহের পরিপ্রেক্ষিতে। তার সচেতনতা মেনে নিতে পারছে না জিয়া ও তার দোসরদের কর্মকাণ্ড। তার আন্তরিকতায় কোনও খাদ ধরতে পারিনি। তাই তার প্রতি ভালবাসা এবং শ্রদ্ধা বেড়ে গেলো নিজের অজান্তেই। আল্লাহ চাইলে যেকোনো মানুষের মন-মানসিকতা বদলে দিতে পারেন মুহূর্তে তারই জ্বলন্ত একটি নিদর্শন আজকের শিশুভাই সেটা আমাকে মেনে নিতেই হল। টনি ভাবী এসে জানালেন খাবার দেয়া হয়েছে। শিশুভাই উঠে আমাকে ডাইনিং রুমে নিয়ে গেলেন। টনি ভাবী ইতিমধ্যেই মাহবুবকে ডেকে নিয়ে এসেছেন। খাবার টেবিলে বসে দেখলাম ভাবী আমার পছন্দের ছোট মাছের বিভিন্ন ব্যঞ্জন, ভর্তা আর চাটনিতে টেবিল ভরে ফেলেছেন। খাবারের বহর দেখে চক্ষু চড়কগাছ, বললাম ভাবী একি করেছেন!জবাবে ভাবী বললেন, কুকুরের পেটে ঘি সহ্য হয় না, সেটা আমার জানা আছে, তাই এই ব্যবস্থা। হেসে শিশুভাই মশকরা করে বললেন, ভোজন রসিক ডালিম ইতিমধ্যেই খাবারের ব্যাপারেও নিজেকে De-class করে ফেলেছে সেটা জানা ছিল না।
থামো তুমি, খাওয়া শুরু কর সব জুড়িয়ে যাচ্ছে বলে সস্নেহে নিজ হাতে আমার প্লেটে পছন্দের ব্যঞ্জনগুলো তুলে দিচ্ছিলেন টনি ভাবী। খাওয়ার পর্ব শেষে আমরা আবার গিয়ে বসলাম বসার ঘরে। আসার সময় নিম্মি কিছু গিফট কিনে দিয়েছিল। আমার ডাকে ভাবী, লাজু, কাজু এলো বসার ঘরে। আমি শিশু পরিবারের জন্য দেয়া নিম্মির প্রিতি উপহারগুলো সবার হাতে তুলে দিলাম। আসার পথে স্কাইশপ থেকে শিশুভাই-এর জন্য আনা যাকিছু সেটা তাকে দিলাম। সবারই গিফটগুলো পছন্দ হল। প্রিয় টনি ভাবী বললেন, দেখো নিম্মির কাণ্ড, এসবের কি দরকার ছিল! বললাম, প্রীতি উপহার।
ও মা! তুমিতো দেখছি নিম্মির চেয়েও এক কাঠি সরেস। তবে বলতেই হচ্ছে, নিম্মির টেস্ট আছে।
সাধে কি আর তোমাকে বুদ্ধির ঢেঁকি বলি! পুরো ঢাকায় এটা স্বীকৃত, আর তুমি ডালিমকে সেটাই জানাচ্ছো। যাও, এবার তোমরা। আমরা কিছু কাজের কথা বলি। তার কথায় সবাই বিদায় নিলো।
লাজু কাজু আমাকে জড়িয়ে ধরে চুমু দিয়ে দৌড়ে তাদের ঘরে চলে গেলো।
শুনলাম, তুমি আর এয়ার চীফ তোয়াব লন্ডন থেকে একই ফ্লাইটে এসেছো?
হ্যাঁ, তিনি নিজেই তো সদ্য লিজে নেয়া বিমানটি চালিয়ে নিয়ে এলেন। ককপিটে আমরা দুইজন পুরো সময়টা বসে আলাপ করতে করতে এলাম।
কি আলাপ করলে?
সব কিছু সংক্ষেপে বয়ান করে বললাম শিশুভাই, দুই ভায়রা যদি কোনও অঘটন ঘটানোর চেষ্টা করেই তখন আমরা কি করবো বলে আপনি আশা করেন?
রশিদ তো জিয়ার অফার নাকচ করে দিয়ে পরিষ্কার বলে দিয়েছে, ওয়াদা মাফিক সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে না আনলে তারা মানে রশিদ আর ফারুক অন্য কোনও চাকুরি গ্রহণ করবে না। জিয়া সামরিক বাহিনীতে যা কিছু করেছে এরপর তোমাদের সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে আনা তার পক্ষে কোন মতেই সম্ভব না। একই সাথে পৃথিবীর যেকোনো জায়গাতে তোমরা একত্রে থাকো সেটাও জিয়ার মাথাব্যথার কারণ। রাজনৈতিকভাবে আগস্ট বিপ্লবের সাথে একাত্মতার শপথ নিলেও এখন তার পক্ষে তোমাদের সাথে নিয়ে রাজনীতি করাও সম্ভব নয়। বিশেষ করে ভারতের আনুকূল্য পাবার প্রত্যাশায় আওয়ামী-বাকশালীদের শেখ হাসিনার নেতৃত্বে নতুন আঙ্গিকে বাংলাদেশের রাজনীতির মূলধারায় পুনর্বাসিত করার ভারতীয় শর্ত মেনে নেবার পর। জিয়া এখন সবাইকে বোঝাতে চেষ্টা করছেন, ১৫ই আগস্টের অভ্যুত্থানের সাথে এবং মুজিবের মৃত্যুর সাথে তার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না যদিও জিয়া স্বয়ং মুক্ত হওয়ার পর ভালভাবেই বুঝতে পারেন, ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বিপ্লব আর ১৫ই আগস্ট এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মূলে কাজ করেছিল একই শক্তি সেনা পরিষদ। ৭ই নভেম্বর তাহেরের বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা ছিল সেনা পরিষদের সহায়ক শক্তি মাত্র। তিনি এটাও জানেন, এই দুইটি ঐতিহাসিক ঘটনা একই সূত্রে বাঁধা। ভারতীয় চাণক্যরা জিয়াকে সঠিকভাবে মূল্যায়ন করতে সক্ষম হয়েছে। তারা বুঝতে পেরেছে জিয়া চারিত্রিকভাবে বিপ্লবী নন। জিয়ার রাজনীতি হবে ক্ষমতার স্বার্থে সমঝোতার রাজনীতি। তাই ভারতের সাথে নিজের স্বার্থেই তিনি আপোষ করতে বাধ্য হবেন। একই সাথে নিজের হাতে ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য জিয়া সামরিক বাহিনী এবং অন্যান্য ক্ষেত্র থেকে বেছে বেছে ইসলামিক মূল্যবোধে বিশ্বাসী এবং জাতীয়তাবাদীদের সমূলে উপড়ে ফেলতে সচেষ্ট হবেন। তাদের মূল্যায়নই সঠিক প্রমাণিত হল! খন্দকার মোশতাক যখন পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব নেয়ার জেনারেল জিয়ার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন তখন জিয়া অতি সহজেই জাস্টিস সায়েমকেই ঠুঁটো জগন্নাথ বানিয়ে রাষ্ট্রপতি রেখে সব ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে এক সময় তাকে বঙ্গভবন থেকে বিদায় করে দেন। এরপর শুরু করেন রক্তের হোলিখেলা। ব্যর্থ সরকার বিরোধী অভ্যুত্থানের নাটক সাজিয়ে প্রায় হাজার তিনেক সেনাসদস্যকে বেছে বেছে বিনাবিচারে হত্যা করা হয় অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। রাজনৈতিক অঙ্গন এবং সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্র থেকে অগুণতি প্রগতিশীল দেশপ্রেমিক নেতা-কর্মীকে মেরে ফেলা হয় কিংবা জেলে ঢুকানো হয়। এভাবেই জিয়া মনে করছেন, সামরিক বাহিনীতে তার ক্ষমতা তিনি নিরংকুশ করতে পেরেছেন বিশেষ করে সেনা পরিষদের শক্তি দুর্বল করে দিয়ে।
শিশুভাইয়ের বক্তব্য আমদের অজানা ছিল না, তিনি আমাদের জানা সব কিছুর সত্যতাই প্রমাণ করছিলেন। জেনারেল জিয়া মনে করছেন তাকে চ্যালেঞ্জ করার মতো আর কোনও শক্তি অবশিষ্ট নেই। তিনি বোকার রাজ্যেই বাস করছেন। তার জানা নেই, বিপ্লবীদের মারা যায় কিন্তু বিপ্লবী চেতনার মৃত্যু ঘটানো সম্ভব হয় না। তার বর্বর নৃশংসতায় সামরিক বাহিনীতে আক্রোশ আর ঘৃণা যেভাবে ধূমায়িত হচ্ছে তাতে যেকোনো সময় বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। সেই জ্বলন্ত লাভায় জিয়ার কি পরিণতি হবে সেটা ভাববার বিষয় নয়। আমাদের চিন্তার বিষয় হল যদি ভারতের প্ররোচনায় কিংবা প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ সাহায্যে জিয়া এইসব করে থাকেন তবে দেশের ভবিষ্যৎ কোথায় গিয়ে ঠেকবে!
শিশুভাই, আপনি দেখছি একজন দক্ষ রাজনীতি বিশারদ এবং দার্শনিক হয়ে উঠেছেন।
আমি তেমন কিছুই নই। শুধুমাত্র চলমান ঘটনা প্রবাহের সত্যকেই যতটা বুঝি তোমার কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করলাম। এখানে লাভ-লোকসানের কোন হিসেব নেই। শ্রদ্ধা করি তোমাদের সাহস, আত্মত্যাগ, দেশপ্রেম ও আপোষহীন চারিত্রিক দৃঢ়তাকে। অন্তর থেকে ভালোবাসি তোমাদের এবং শ্রদ্ধা করি তোমাদের নীতি-আদর্শকে। আমি শুনছিলাম সব কিছু আর মৃদু মৃদু হাসছিলাম। আমার মৃদু হাসি লক্ষ করে শিশুভাই বললেন ঠাট্টা করছো? তা অবশ্য করতেই পারো।
না, আপনাকে নতুন ভাবে বোঝার চেষ্টা করছি শিশুভাই। কিন্তু কই, জবাব দিলেন নাতো আমাদের কি করা উচিৎ?
আগেও বলেছি আবারও বলছি, তোমরা প্রত্যেকেই এক একটি অমূল্য রতন। ৮-১০ কোটি দেশবাসীর মধ্যে তোমাদের মতো নিবেদিতপ্রাণ জনদরদী খুঁজলেও খুব একটা পাওয়া যাবে না এই অভিজ্ঞতা ইতিমধ্যেই আমার হয়েছে। অপশক্তিগুলোর চোখ রয়েছে তোমাদের উপর। তাই বর্তমানে কোন ফাঁদে পা দিয়ে নিজেদের শেষ করে দিও না। অনেক রাত হল, সকালেই তো আবার আপনাকে অফিসে উপস্থিত হতে হবে। তাই আজকের মত আসি বলে উঠে দাঁড়ালাম। গাড়ী পর্যন্ত আমাকে আর মাহবুবকে পৌঁছে দিলেন শিশুভাই। হাঁটতে হাঁটতে বললাম
আপনি আমাদের যেভাবে আসমানে তুলে দিলেন ভয় হচ্ছে ধপাস করে ধরণীতলে পড়ে না যাই!
সাবধানে থাকবে।
Wilco. দোয়া করবেন। আল্লাহ্ যদি সুযোগ আর তৌফিক দেন তবে আমাদের সবার কাছে Happy go lucky type শিশুভাইয়ের আজকের এই অসাধারণ রূপটা দেশবাসীর কাছে তুলে ধরার চেষ্টা নিশ্চয়ই করবো।
শিশুভাই আমাকে জড়িয়ে ধরে গাড়ীর দরজা খুলে দাড়ালেন। আমি ভেতরে ঢুকে বসলাম, মাহবুবও উঠে বসল পাশে। ড্রাইভার গাড়ী স্টার্ট করতেই শিশুভাই গাড়ীর জানালার কাছে এসে বললেন কালই হয়তো তোমাকে ডেকে পাঠাবেন জেনারেল জিয়া, তার CMLA’s Office এ। Not for Court Martial I suppose! কার বিচার কে করবে বা কেমন হবে সেটা আল্লাহ্ই জানেন, বললেন শিশুভাই।
তিনজনই উচ্চস্বরে হেসে উঠলাম। মালিবাগে পৌঁছে দিয়ে মাহবুব জিজ্ঞেস করল আমি কি থেকে যাবো স্যার?
পাগল নাকি! তুমি ফিরে যাও। এত ভয় করলে কি চলে? তাছাড়া এলাকাটা আমাদের নিজস্ব। খানসেনারাই এই বাড়ী রেইড করে স্বপনকে ধরতে ব্যর্থ হয়েছিল এই কথাটা ভুলে যাচ্ছ কেনো?
ঠিক আছে স্যার, তবে সিভিল ড্রেসে কয়েকজন বিশ্বস্ত সৈনিক থাকবে বাসার পাহারায়। এই বিষয়ে আপনার কোনও আপত্তি আমি শুনবো না। মিনতি ভরা চোখ মাহবুবের। তাই হেসে বললাম, ক্রসফায়ারে মারা না পরি। জবাব শুনে মুচকি হেসে মাহবুব বলল চীফ ডাকলে, সময় মতো ডেকে পাঠাবেন স্যার। ফোন করে দিলেই আমি এসে আপনাকে নিয়ে যাবো। ঠিক আছে, আল্লাহ হাফেজ। আল্লাহ হাফেজ, চলে গেল মাহবুব। কেয়ার ঘরে গিয়ে দেখি পানের বাটা ঘিরে স্বপন, মহুয়া, মুন্নি আর কেয়া আমার অপেক্ষায় নিজেদের মধ্যে তর্ক-বিতর্কে মুখর। আমি পৌঁছতেই কেয়া আমার মুখে একটা পান গুঁজে দিয়ে বলে উঠল
ভাইয়া, তোমার সাথে আমাদের কিছু serious কথা আছে। চলো উপরে স্বপন ভাইয়ার ঘরে। কারণ, আমরা চাইনা আব্বা আমাদের কথাবার্তা শুনুক। ঠিক আছে। কিন্তু মহুয়া তুই বাসায় ফিরবি না? অনেক রাত হয়ে গেছে। তুমি যতদিন আছো ততদিন আমি মালিবাগেই থাকবো। লিটু আর শাশুড়িকে সেটা জানিয়ে দিয়ে এসেছি। বিশালকে সাথে নিয়ে এসেছি as he remains much happier at Malibag, so no problem. তোমার দেখাশুনা করার জন্যই এই ব্যবস্থা। আন্টির পক্ষে একা সবকিছু সামলানো সম্ভব নয়। কেনও? বাসায় তো একগাদা পুরনো লোকজন রয়েছে, সবাই যার যার কাজে fully trained. Anyway চল উপরে যাই। দোতলায় স্বপনের বেডরুমের কার্পেটে কুশন নিয়ে সবাই জাঁকিয়ে বসলাম।
মহুয়াই শুরু করলো
জানো ভাইয়া, তোমরা দেশ ছাড়ার পর তোমাদের ভক্ত সৈনিক আর অফিসার ভাইরা প্রায়ই খোঁজ খবর নিতে আসতো। তাদের একটাই কথা, আমরা যাতে তোমাদের কালবিলম্ব না করে ফিরে আসতে অনুরোধ করি। কারণ, তারা জিয়া সম্পর্কে দিন দিন সন্দিহান হয়ে পড়ছেন। তাদের ধারণা, জিয়া তোমাদের ফিরিয়ে আনতে চাচ্ছেন না। ঘটনা প্রবাহে তাদের ধারণাটা উড়িয়ে দেবার মতো নয়।
পরাজিত বিপ্লবীকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছিস তাইনা?
কি বললে? পরাজিত বিপ্লবী! বিপ্লবতো শেষ হয়ে যায়নি। চলছে, চলবেও। তাই জয়-পরাজয়ের প্রশ্নটা অবান্তর। জিয়া নিজেই নিজের কবর খুঁড়ছে, ফোঁড়ন কাটল কেয়া। ঠিকই বলেছে কেয়া। মোনাফেকির মাশুল জিয়াকে দিতেই হবে। তবে সেটা আমার বিবেচ্য বিষয় নয়। জিয়ার মৃত্যুর সাথে বিপ্লবের মৃত্যু হবে না। বিপ্লব একটি সনাতন আবহমান প্রক্রিয়া।
ওরে বাবা, কোটিপতির বউ হয়ে তোর মুখে বিপ্লবের বাণী! আমিতো রীতিমতো ভিরমি খাচ্ছি!
কেনো? তুমি যদি সোনার চামচ মুখে নিয়ে জন্মগ্রহণ করে বিপ্লবী হতে পারো তবে তোমার বোন বিপ্লবী হলে দোষ কোথায়? আজ যারা ধনসম্পদের পাহাড় গড়ে নব্যবিত্তশালী বনে সমাজটাকে কিনে নিয়েছে তাদের ওই বিত্তবৈভব সবই তো দেশ থেকেই অর্জিত বৈধ-অবৈধ ভাবে। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই কৃতঘ্ন। নৈতিকতা বিবর্জিত কলুষিত মন তাদের। আমি কোটিপতির বউ হতে পারি, তবে আমার একটা স্বতন্ত্র ব্যক্তিসত্তা আছে। আমি আমার সত্তাকে কারো কাছে বন্ধক দেইনি, আমি শিক্ষিতা। আজ আমি যাই হই না কেনো, তার জন্য দেশের কাছে আমি ঋণী এতটুকু বোঝার যোগ্যতাও আমার আছে। তাই দেশ ও জনগণ নিয়ে আমাকেও ভাবতে হবে। সেটাই স্বাভাবিক, এটা কি তুমি অস্বীকার করতে পারো? তাছাড়া মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কি কোনও অবদানই ছিল না? আমরা কি নির্যাতিত হইনি? প্রাণের ঝুঁকি কি আমরা নেইনি?
সেটাতো সর্বজন স্বীকৃত।
ভাইয়া, তুমি জ্ঞানী, বিস্তর তোমার পড়াশুনা। তারপরও তোমারই বোন হিসাবে আমি তোমাকে শুধু বলতে চাই, বৈপ্লবিক প্রক্রিয়াতে উত্থান-পতন থাকবেই। তাই বলে ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সব কিছু মেনে নিয়েই যতটুকু সম্ভব এগিয়ে যেতে হবে। রণেভঙ্গ দেয়া চলবে না। তোমাদের কাছে জাতির অনেক প্রত্যাশা। সেটা আমরা বাইরে থেকে যতটুকু বুঝি ততখানি তোমরা নাও বুঝতে পারো। হোঁচট যদি খেয়েই থাকো তার মোকাবেলা করতে হবে বাস্তব ভিত্তিক বিচক্ষণতার সাথে, আবেগের সাথে নয়। দৃঢ়চেতা সাহসী কিন্তু ধীরস্থির শান্ত প্রকৃতির মহুয়ার মধ্য যে এই ধরনের স্ফুলিঙ্গ থাকতে পারে সেটা বাহ্যিক ভাবে বোঝা মুশকিল। এমনি হয়তো না জানা লক্ষকোটি প্রাণে সুপ্ত হয়ে ধিক ধিক করে জ্বলছে অঙ্গার, এই অঙ্গারকে প্রজ্বলিত করে দাবানল সৃষ্টি করার মধ্যেই রয়েছে বিপ্লবের সফলতার চাবিকাঠি। কথার মোড় অন্যদিকে ফিরিয়ে দিলাম। আধশোয়া অবস্থায় স্বপনকে জিজ্ঞেস করলাম
কিরে তোর ব্যবসা কেমন চলছে? ভালোই চলছে, ১৫ই আগস্টের পর তোর আর নূর ভাইয়ের পরামর্শ অনুযায়ী SANS INTERNATIONAL বন্ধ করে দিয়ে নিজের কোম্পানির নামে Import Export এর ব্যবসার পাশাপাশি নৌযান ব্যবসা শুরু করতে যাচ্ছি। কাঁটাতার, নাটবলটু, স্ক্রু, চাবি তৈরি করার ডিজাইনটা মোটা দামে মেহের ইন্ডাস্ট্রি কিনে নিলো। ওই টাকায় দুটো Double Decker Launch বানানো হচ্ছে আমার Design অনুযায়ী। প্রতিটি লঞ্চ ৫০০ যাত্রী বহনের ক্ষমতা রাখবে। সদরঘাট থেকে চাঁদপুর হয়ে বরিশাল এই রুটেই চালানো হবে লঞ্চদুটো। আমার বিশ্বাস ১ বছরেই ক্যাপিটাল ফিরে আসবে। এমনটি হলে আরও দুটো লঞ্চ বানাবো। ৩-৪ বছরের পর সেগুলো বিক্রি করে দিয়ে Under bonded House System, joint venture এ ready made garments factory install করার ইচ্ছে আছে with Taiwan or Korea. This is a labor intensive field and most of the workers would be female. This would be 100% export oriented business. So, earnings would be n foreign currencies. হংকং এবং সিঙ্গাপুর এ অনেক Korean and Taiwanese companies office খুলে বসে আছে, ওদের থেকেই shall chose some reputed one for the joint venture. নুরুল কাদের ভাইও তাই ভাবছেন। ব্যবসা-বাণিজ্যের বিষয়ে স্বপনের দূরদর্শিতা ও জ্ঞান অসাধারণ তীক্ষ্ণ সেই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। তাই ও যাই করুক না কেনো সেটা বুঝেশুনেই করবে সেই বিষয়ে সন্দেহের কোনও অবকাশ নেই।
১৯৭৪ সালে PO-9 এর আওতায় মুজিব সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল বেছে বেছে মোট ৬০ জন সরকার বিরোধী মনোভাব সম্পন্ন অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হবে। সর্ব প্রথম যেই ১২ জন আর্মি অফিসারকে চাকুরিচ্যুত করা হয়েছিলো তার মধ্যে আমি আর নূর ছিলাম তালিকার শীর্ষে। সেনাবাহিনী থেকে বের করে দিয়ে মুজিব নিজেই আমাকে আর নূরকে ডেকে পাঠিয়ে প্রস্তাব দিয়েছিলেন সমাজে প্রতিষ্ঠার জন্য সবকিছুই তিনি আমাদের জন্য করতে প্রস্তুত। ব্যবসা করতে চাইলে শেখ নাসেরের পার্টনার হয়ে ব্যবসা করতে পারি, যদি বিদেশে যেতে চাই তবে কূটনীতিক হিসেবে যেখানে ইচ্ছে সেখানেই তিনি আমাদের পাঠাতে রাজি আছেন। আমরা তার সেই সব প্রস্তাব বিনয়ের সাথে প্রত্যাখ্যান করে বেরিয়ে এসেছিলাম। এরপর ভাবছিলাম সংসার চালানোর জন্য কি করা যায়!তখন স্বপনই সহায় হয়ে প্রস্তাব দিল তার সাথে ব্যবসাতে যোগ দিতে। আমাদের আর একজন বিশেষ ঘনিষ্ঠ বন্ধু মুক্তিযোদ্ধা অফিসার কর্নেল আকবর হোসেন (জিয়ার আমলে মন্ত্রী) চাকুরিচ্যুত হওয়ার আগেই চাকুরি ছেড়ে আমাদের সাথে যোগ দিল। কুমিল্লার সাজেদ মোক্তারের ছেলে আকবর হোসেনের সাথে ছাত্রকাল থেকেই বন্ধুত্ব। ৪ জনের নামের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে মতিঝিলের টয়েনবি সারকুলার রোডে স্বপনের অফিসেই জন্ম নিল SANS INTERNATIONAL LTD নামের কোম্পানি। অল্প সময়েই অনেক সজ্জন এবং সহানুভূতিশীল পদস্থ ব্যক্তিদের সাহায্য এবং সহযোগিতায় আমাদের ব্যবসা ভালোই জমে উঠলো। এতে রুটি-রুজির সমস্যা রইলো না। সেই সময়, হায়দার আকবর খান রনো, রাশেদ খান মেনন, কাজী জাফর এবং কর্নেল আকবর মিলে প্রতিষ্ঠিত করে একটি নতুন রাজনৈতিক দল United People’s Party, সংক্ষেপে (UPP)। আমাদের তারা আহ্বান জানিয়েছিলেন তাদের পার্টিতে যোগদান করার জন্য। কিন্তু আমরা তাদের উদ্যোগকে স্বাগত জানিয়ে বলেছিলাম আমরা নীতি-আদর্শের দিক দিয়ে সমমনা, আপনারা আপনাদের পথে এগিয়ে চলুন। আমরা আমাদের পথে এগিয়ে যাবো। জাতীয় স্বার্থে উপযুক্ত সময়ে আমরা অতি সহজেই একত্রিত হতে পারবো। ইতিমধ্যে মেজর শাহরিয়ারও চাকুরি থেকে অবসর নিয়ে স্বপনের পরামর্শে এয়ারপোর্ট রোডে electric and electronic items repairing shop SHERRY ENTERPRISE খুলে বসেছে। তার কারবারও ভালোই জমে উঠলো অল্প সময়েই।
ডালিম শোন, আমি তোকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাই।
জিয়া তোকে কেনো ডেকে পাঠিয়েছে সেটা আমি জানিনা। তবে এখনকার বাস্তবতা হচ্ছে, জিয়া তোদের শিকড় উপড়ে ফেলার চেষ্টা করে চলেছে ক্ষমতার কেন্দ্রে অধিষ্ঠিত হওয়ার পর থেকেই বিভিন্ন অজুহাতে। তোদের মধ্যে বোঝাপড়া যাই হয়ে থাকুক সেটার কোনও মূল্য নেই আজকের জিয়ার কাছে। শুধু তাই নয়, বর্তমানে তিনি তোদেরকেই তার ক্ষমতার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতা মনে করছেন। ১৫ই আগস্টের সাথে তার কোনও সম্পর্ক কখনোই ছিল না সেই ধরনের প্রচারণা চালানো হচ্ছে তার ইশারায়। মুজিবকে ‘বঙ্গবন্ধু’ বলে সম্বোধন করতে দ্বিধা বোধ করছেন না জিয়া। উদ্দেশ্যটা পরিষ্কার, জিয়া ভারতের সাথে আঁতাত করেই রাজনীতি করবেন। প্রয়োজনে আওয়ামীলীগকে হাসিনার নেতৃত্বে রাজনীতিতে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার মতো ছাড় দিতেও প্রস্তুত জিয়া। সং সেজে গ্রামে-গঞ্জে মাদারির মতো কোদাল কাঁধে ঘুরে বেড়িয়ে জিয়া আমজনতার কাছে সাময়িক ভাবে হলেও নিজের জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা দুটোই হাসিল করতে সক্ষম হয়েছেন। আগামী নির্বাচনে আওয়ামীলীগ তাকে পরাজিত করতে পারবে না। Long term নিয়ে জিয়া এখন কিছুই ভাবছেন না। তবে গণচীন, মধ্যপ্রাচ্য এবং মুসলিম দেশগুলোর সাথে সুসম্পর্ক গড়ে তুলে ভারতের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে একটা ভারসাম্য সৃষ্টির চেষ্টা তিনি করলেও করতে পারেন, কিন্তু যত ছাড়ই জিয়া দিক না কেনো ভারত তাকে বাঁচিয়ে রাখবে না। কে জানে, হয়তো ভারতই তাকে কবরে পাঠানোর ক্ষেত্র তৈরি করে হায়েনার হাসি হাসছে সময়ের অপেক্ষায়। চাণক্যদের কূটচালের মোকাবেলায় জিয়া ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা আপোষ করে খুব বেশিদিন টিকে থাকতে পারবে না। জিয়ার উচিৎ ছিল যেই শক্তি তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করাতে সক্ষম হয়েছিলো তাদের সাথেই এগিয়ে চলা, সেটাই ছিল তার জন্য সর্বোত্তম পন্থা। কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞার অভাবে সেইপথ থেকে সরে এসে চক্রান্তের যে মাকড়সার জাল জিয়া নিজেই তৈরি করেছেন, তাতে আজ নিজেই আটকা পড়ে গেছেন। বাঁচার কোনও রাস্তাই নেই জিয়ার। জিয়ার কোদাল কাঁধের আর ভাঙ্গা স্যুটকেসের চমকের ধোঁকাবাজি অতি অল্প সময়তেই ধরা পড়ে যাবে জনগণের কাছে। প্রকাশিত হয়ে পড়বে তার নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের ইতিকথা। কিন্তু আমার মনে হয়, তার আগেই তার অপমৃত্যু হবে। সেইক্ষেত্রে কিছু সময় তার দল নিজেদের বাঁচিয়ে রাখতে পারবে প্রয়াত জিয়ার নাম ভাঙ্গিয়ে, কিন্তু পরিশেষে দলটিরও অপমৃত্যু ঘটবে। কিন্তু বেঁচে থাকবে আওয়ামীলীগ আর শেষ হাসি হাসবে ভারতের চাণক্যরা। শিশুভাই সবকিছু বুঝে চেষ্টা করছেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব কেটে পড়ার। Immigration papers হাতে পেলেই তিনি আমেরিকায় পাড়ি জমাবেন সপরিবারে। আর একটি কথা। ঠিক এই মুহূর্তে জিয়াবিরোধী যেকোনো পদক্ষেপে লাভ হবে জাতীয় শত্রুদের আর তাদের বিদেশী মোড়ল ভারতের। বাংলাদেশ পরিণত হবে একটি করদরাজ্যে। আর ১০ কোটি দেশবাসী বন্দী হবে দাসত্বের জিঞ্জিরে দীর্ঘকালের জন্য। আমার বিশ্লেষণের সাথে তোরা একমত নাও হতে পারিস। তবে অনুরোধ এই বিষয়ে খবরাখবর নিয়ে একটু ভেবেচিন্তেই যা করার করিস। এবারের প্রসঙ্গটা পারিবারিক। জিয়া যে ভাবেই হউক আব্বা, শাহ আজিজ, শামসুল হুদা চাচা, জাদু মিয়াকে তার দলে টেনে নিতে পেরেছেন। বিষয়টি অনেকটা ‘গোড়া কেটে উপর দিয়ে পানি ঢালার মতো’। এতে জিয়া মুখে কিছু না বলেও জনগণকে বোঝাতে পারবে তার সব কার্যক্রমে তোদের সম্মতি রয়েছে। সামরিক বাহিনীতে তোদের সমর্থক যারাই বেঁচে আছে তারা বিষয়টি খুব একটা ভালো নজরে দেখছে কি?
না, তা হয়তো দেখছে না তবে তারা সবাই রাজনৈতিকভাবে সচেতন। তারা জিয়ার আসল চরিত্র ইতিমধ্যেই বুঝে নিয়েছে। আমাদের মধ্যে ফাটল ধরাতে পারবেন না জিয়া। ভবিষ্যতে আমরা যাই করি সেটা আমরা করবো দেশ ও জাতির স্বার্থে, জিয়ার ব্যক্তিস্বার্থে নয় এ বিষয়ে তুই নিশ্চিন্ত থাকতে পারিস। আব্বাদের এখন জিয়ার কাছ থেকে সরিয়ে আনা সম্ভব নয়। জিয়া কানকথায় বিশ্বাসী এক প্রতিহিংসা পরায়ণ ব্যক্তি। তাই তাদেরকে জিয়াকে বুঝতে হবে নিজেদের অভিজ্ঞতার আলোকেই। এর কোনও বিকল্প নেই স্বপন। আমরা সর্বদাই বিভিন্ন বিশ্বস্ত সূত্র থেকে নির্ভরযোগ্য খবরাখবরের চুলচেরা বিশ্লেষণের পরই সব সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি। অস্বীকার করবো না, আজঅব্দি একটাই মারাত্মক ভুল আমাদের হয়েছে। সেটা হল জিয়াকে চিনতে আমরা ভুল করেছিলাম; ভুলই বা বলি কি করে! কোরআন ছুঁয়ে শপথ নিয়ে আমাদের একজন হয়েছিলো জিয়া যুদ্ধকালে। সেই জিয়ার মোনাফেকিতে আজ আমরা জিতেও পরাজিত। এর মাশুল শুধু আমাদেরই নয়, দেশবাসীকেও দিতে হবে ভবিষ্যতে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা-স্বপ্ন বাস্তবায়নের উজ্জ্বল সম্ভাবনা নস্যাৎ করে দিলো সেনা পরিষদের সাথে গাদ্দারি করে! সব সম্ভাবনার অবারিত দ্বার বন্ধ করে দিলো শুধুমাত্র নিজের ক্ষমতার জন্য ভারতের সাথে আপোষ করে। এতদিনের নিরলস পরিশ্রম, সাধনা, ত্যাগ-তিতিক্ষা সবকিছুই পণ্ড হয়ে গেলো একটি মানুষের বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ভাই! শুধু কি তাই, ঐ সমস্ত ত্যাগী সাথীরা, যারা বুক দিয়ে জিয়াকে বাঁচিয়ে রেখে সব প্রতিকূলতার মোকাবেলা করে তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট করালো তাদের রক্তেই তিনি তার হাত রঞ্জিত করলেন অতি নিষ্ঠুরতার সাথে। এর বিচার কি আল্লাহ্ করবেন না? নিশ্চয়ই বিচার করবেন তিনি।
হ্যাঁ, তার জঘন্য নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞের বিচার হবেই ইহকালে এবং পরকালে। আর একটি কথা। জানিস, কেনো শিশুভাই মাহবুবকে তোর সাথে ছায়ার মতো থাকতে বলেছেন?
কিছুটা আঁচ করতে পারি হয়তো আমার নিরাপত্তার জন্য কিন্তু আমার নিরাপত্তার হুমকিটা ঠিক কোথা থেকে সেটা বুঝতে পারছি না!
আমি তোর Threat perception টা পরিষ্কার করে দিচ্ছি। শিশুভাই তোর ব্যাপারে জিয়াকে বিশ্বাস করতে পারছেন না বলেই মাহবুবকে তিনি নিজস্ব উদ্যোগেই তোর নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব দিয়েছেন। তিনি তোদের সবাইকেই অত্যন্ত শ্রদ্ধা করেন এবং আন্তরিকভাবে ভালোবাসেন, বিশেষ করে তোকে। যা ঘুমোতে যা, অনেক রাত হল। কালকের কথাবার্তা নিয়ে চিন্তা-ভাবনা কর গিয়ে।
সবাই উঠে নিজ নিজ কামরায় চলে এলাম। কাপড় বদলে শুয়ে পড়লাম। শিশুভাই আর স্বপনের কথাগুলো নিয়ে ভাবতে ভাবতে এক সময় ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল ১০ টায় দরজায় টোকা দিয়ে মহুয়া আমাকে জাগিয়ে তুলে বলল CMLA এর অফিস থেকে জেনারেল জিয়ার ADC ফোন করেছে। উঠে গিয়ে ফোন ধরতেই ADC বললেন, চীফ আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন বিকেল ৫টায় CMLA এর অফিসে পুরনো সংসদ ভবনে। সেখানেই সাক্ষাত হবে। ঠিক আছে। বলে লাইন কেটে দিয়ে মাহবুবকে খবরটা জানিয়ে দিলাম। মাহবুব বলল, যথাসময়ে ও এসে আমাকে নিয়ে যাবে। এরপর শিশুভাইকে ফোন করলাম শিশুভাই, চীফ আমকে বিকেল ৫টায় CMLA ’s office এ ডেকে পাঠিয়েছেন। মাহবুব এসে আমাকে নিয়ে যাবে। That’s fine. একটা বিষয়ে খেয়াল রেখো, কথা বলবে কম শুনবে বেশি। Okay Sir, shall do as you said. রাখি এখন, সবেমাত্র ঘুম থেকে উঠেছি। Be polite and listen what he says. But be firm in whatever you say. Prepare well and take care. পরে সাক্ষাতে শোনা যাবে কি কথা হল। শিশুভাই, কালকের জন্য আরো একবার আমার আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানবেন। We all love you a lot with respect from the core of our hearts. We too, bye ফোন রেখে দিলেন শিশুভাই।
যথাসময় মাহবুব এলো। আমরা গিয়ে পৌঁছলাম CMLA’s Office এ। গেটের গার্ডরুম থেকে আমার আগমনী বার্তা পেয়ে ADC ক্যাপ্টেন জিল্লুর গাড়ী বারান্দা থেকেই অভ্যর্থনা জানিয়ে ভেতরে নিয়ে গেলো। মাহবুব ADC- এর ঘরে অপেক্ষায় থাকলো। আমি সংলগ্ন দরজা দিয়ে গিয়ে ঢুকলাম Chief Martial Law Administrator এর বিশাল Office এ।
উর্দি পরা জেনারেল জিয়া বিশাল টিক উডের গ্লাসটপ টেবিল এর বিপরীত দিকে বসে অপেক্ষায় ছিলেন। Bottle Green Ray Ban চশমাটা টেবিলের উপর রাখা। তার এই চশমা নিয়ে অনেক মুখরোচক গুজব বাজারে চালু আছে, কিন্তু প্রকৃত বিষয়টি হল বেশিরভাগ সময় তিনি ওটা পরে থাকতেন কারণ তিনি ছিলেন সামান্য লক্ষীট্যারা। তবে কাছ থেকে খুব সূক্ষ্মভাবে না দেখলে বিষয়টি বোঝা ছিল কষ্টকর। আমাকে ঢুকতে দেখে তিনি চেয়ার থেকে উঠে টেবিলের এপাশে এসে জড়িয়ে ধরে বললেন অনেকদিন পর তোমাকে দেখে ভালো লাগছে। How are you and others keeping? বলেই তিনি আমাকে একটি চেয়ারে সার ইশারা করে নিজে তার Revolving Chair-এ গিয়ে বসলেন। বসে হালকা ভাবে জবাব দিলাম
যেমন রেখেছেন ঠিক তেমনই আছি স্যার। জবাব শুনে একটু চিন্তা করে বললেন
কি খাবে চা না কফি? কফির কথাটা শুনে মনে পড়ে গেলো যখনই তার বাসায় যেতাম তখন লনে কিংবা ড্রইংরুমে তিনি নিজেই কফি বানিয়ে খাওয়াতেন। Inter Com-এ ADC কে নির্দেশ দিলেন জিয়া কফি পাঠিয়ে দেবার জন্য। বলো, বেনগাজীতে তোমাদের কেমন কাটছে? How do you find Gaddafi?
রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে বিলাসবহুল পরিবেশে ভালোই সময় কাটছে আমাদের। গাদ্দাফি নিজেকে একজন ইসলামিক বিপ্লবী হিসেবে মনে করেন। তার রাজনৈতিক দর্শন তিনি সারাবিশ্বে তার ‘গ্রীন বুকের’ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। একই সাথে তিনি একজন কট্টর পুঁজিবাদ ভিত্তিক সাম্রাজ্যবাদী শোষণ বিরোধী হিসাবে বিশ্বের প্রতিপ্রান্তে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী যে সমস্ত সংগ্রাম চলছে তাকে সার্বিকভাবে সাহায্য-সহযোগিতা করে চলেছেন মোয়াম্মর মানে প্রিয় নেতা গাদ্দাফি। মুসলিম বিশ্বের বেশিরভাগ নেতারা তো রাজপ্রাসাদে শুয়ে মুসলিম উম্মাহর মুক্তির আর ইসলামের পুনর্জাগরণের স্বপ্ন দেখেন। কিন্তু এই তরুণ নেতা রাজপ্রাসাদে থেকেই কিন্তু বিপ্লবের স্বার্থে তার নিজস্ব চিন্তা-ভাবনা মতো কাজ করে চলেছেন। প্রথমে নাসেরের ‘Pan Arabism’ তাকে রোমাঞ্চিত করে তুলেছিলো, পরে তিনি ‘Pan Islamism’ এর দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি বিশ্বাস করেন, একদিন বিশ্বের মুসলমানরা নিজেদের ঈমানি শক্তি ফিরে পেয়ে বৈপ্লবিক চেতনায় ঐক্যবদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদী এবং ইহুদিবাদী আগ্রাসন এবং শোষণের বিরুদ্ধে লড়ে তাদের পতন ঘটাবে। বিশ্বজোড়া নিপীড়িত জনগোষ্ঠী এবং মুসলমানদের পুনর্জাগরণের বিষয়ে, বিশেষ করে বিশ্বপুঁজিবাদ এবং সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহের মোড়ল আমেরিকার আগ্রাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যেতে গাদ্দাফি বদ্ধপরিকর। তার জন্য আয়ারল্যেন্ডের সিনফিন মুভমেন্ট, বৈরুতে হিজবুল্লাহ, ফিলিস্তিনের ফেদাইন, ইরিত্রিয়া, মিন্দানাও-এর মুসলমানদের আত্মনিয়ন্ত্রণের সংগ্রাম, বসনিয়া, হারজেগোভিনা, ক্রোশিয়াসহ বিশ্বের প্রায় সব কয়টি দেশের জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে মুক্ত হস্তে আর্থিক সাহায্য করে চলেছেন গাদ্দাফি পশ্চিমা বিশ্বের রক্তচক্ষুকে অগ্রাহ্য করেই। মধ্যপ্রাচ্যের বাদশাহ-আমীরদের প্রতি তিনি বীতশ্রদ্ধ। তার মতে, এদের সবাই সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্যে ক্ষমতাসীন হয়ে শুধু নিজের দেশবাসীরই নয় পুরো উম্মাহর সর্বনাশ করে চলেছেন। তল্পিবাহক ওইসব কায়েমী স্বার্থবাদী বাদশাহ-আমীররা তাদের বিদেশী প্রভুদের ইশারায় মুসলিম উম্মাহকে শত ভাগে বিভক্ত করে রেখেছে টাকার জোরে। তারাই বিভিন্ন ইস্যু সৃষ্টি করে মুসলিম উম্মাহর মাঝে ফ্যাকড়াবাজি আর ফ্যাসাদের জন্ম দিয়ে বিভক্তির মাত্রা বাড়িয়ে চলেছেন তাদের দরিদ্রতার সুযোগ গ্রহণ করে। গাদ্দাফির এই ধরনের চিন্তা ভাবনাতে ভীত-সন্ত্রস্ত হয়ে তেল গ্যাস সমৃ্দ্ধ ধনী বাদশাহ আর আমীররা তাকে উগ্রপন্থী এবং চরমপন্থী হিসাবে একঘরে করে রাখার চেষ্টা করে চলেছেন, তাতে মোটেও বিচলিত নন গাদ্দাফি। তার চিন্তা-চেতনা আর কার্যক্রমের সমর্থনেই বোধকরি কবি লিখেছিলেন, ‘যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলোরে’, যদিও তার আদর্শের সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে দ্বিমত থাকার অবকাশ রয়েছে তারপরও বলতে হচ্ছে, সীমাবদ্ধতা থাকা সত্ত্বেও তার মতো প্রগতিশীল নেতা সারা মুসলিম বিশ্বে দ্বিতীয়জন খুঁজে পাওয়া যাবে না। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তের অনেক সংগ্রামী নেতাদের সাথে সাক্ষাতের সুযোগ হয়েছে, দেখেছি জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার কাছেই গাদ্দাফি একজন শ্রদ্ধেয় এবং বিশ্বস্ত আপনজন। অবশ্য এদের মধ্যে অনেককেই মনে হয়েছে সুবিধাবাদী, ধড়িবাজ শৃগাল। বলেই জেনারেল জিয়ার চোখে চোখ রাখলাম। তিনি কিছুটা বিব্রত হয়েছেন বলেই মনে হল। চোখ সরিয়ে দরজার দিকে চাইলেন জিয়া। দেখলাম ADC এর তত্ত্বাবধানে বেয়ারা খাবারের ট্রলি নিয়ে প্রবেশ করছে। সাজানো ট্রে রেখে তারা ফিরে গেল জেনারেল জিয়ার ইশারায়। তিনি নিজেই দুটো কাপে কফি তৈরি করে একটা আমাকে দিয়ে অন্যটি নিজে নিয়ে বললেন Let’s start and feel free. Of course Sir, একটা প্লেটে কিছু পছন্দমতো খাবার তুলে নিলাম।
জানতে পারলাম, বাংলাদেশের প্রতি যথেষ্ট সহানুভূতিশীল গাদ্দাফি?
স্যার, গাদ্দাফি বাংলাদেশ সম্পর্কে খুবই আশাবাদী এবং তিনি লাদেশের সাথে ভাতৃপ্রতিম সম্পর্ক গড়ে তুলতে খুবই ইচ্ছুক। সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশকে গড়ে তোলার জন্য সার্বিক ভাবে সাহায্য সহযোগিতা করতেও প্রস্তুত। তিনি আমাদের নিঃসংকোচে বলেছেন তার দৃঢ় বিশ্বাস, বিপ্লবী নেতৃবৃন্দের অধীনে বাংলাদেশ পাকিস্তানসহ মুসলিম বিশ্বের যেকোনো দেশের চেয়ে দ্রুততর গতিতে প্রগতি এবং উন্নয়নের পথে এগিয়ে যেতে সক্ষম হবে। বাংলাদেশের অসম্প্রদায়িক দুনিয়ার তৃতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনগোষ্ঠী যারা রক্তের আহুতি দিয়ে স্বাধীনতা অর্জন করেছে তারা অবশ্যই স্ব-নির্ভরতার ভিত্তিতেই নিজেদের একটি আত্মমর্যাদাশীল সুখী সমৃদ্ধশালী জাতি এবং রাষ্ট্র হিসাবে বিশ্বে মাথা উঁচু করে দাড়াতে সক্ষম হবে। আমাদের সাথে বিস্তারিত আলাপ আলোচনার পর তার এই প্রত্যয় নাকি আরো জোরদার হয়েছে। বাঁকা চোখে জিয়াকে পরখ করে দেখলাম তিনি কিছুটা গম্ভীর হয়ে উঠেছেন।
আমার সম্পর্কে তার কি ধারণা?
আপনি তো আমাদেরই একজন সেটাই গাদ্দাফি জানেন। তাই আপনার বিষয়ে আলাদাভাবে কোনও আলোচনার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়নি। অবশ্য প্রয়োজন হলে সেটাও করার সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া আপনার সম্পর্কে ভালো ধারণা না থাকলে, আপনার অনুরোধে তিনি আমাদের রাষ্ট্রীয় অতিথি হিসাবে উষ্ণ আন্তরিকতার সাথে লালন করে আসছেন কেনো? সুযোগ পেয়ে একটা খোঁচা দিয়ে দিলাম। ফলে, তার কালো মুখটা আর একটু কালো হয়ে উঠলো। মন্দ লাগছিলো না বর্ণচোরা জিয়ার অস্বস্তি দেখতে।
হঠাৎ Red Telephone বেজে উঠলো। রিসিভার তুলে নিলেন CMLA জেনারেল জিয়া। অপরপ্রান্ত থেকে কে কি বলছিল শুনতে পারছিলাম না। এ তরফের জিয়া গভীর মনোযোগের সাথে ফোনের কথা শুনছিলেন আর গম্ভীর মুখে আমার দিকে চোখ তুলে বার বার চাইছিলেন। আমি নির্বিঘ্নে খাবার সাবাড় করছিলাম আর কফির কাপে চুমুক দিচ্ছিলাম। বেশ কয়েক মিনিট পর তিনি ‘Okay, I am looking into the matter’ বলে রিসিভার ক্রেডলে রেখে দিয়ে স্তম্ভিত হয়ে কিছু ভাবছিলেন। ঘন ঘন Red Telephone বাজতে থাকায় জিয়ার ভাবনায় ছেদ পড়ছিলো। ‘হুঁ’ ‘হ্যাঁ’ বলে অতি সংক্ষেপে আলাপ সারছিলেন জিয়া। তেমনই একটা কল শেষ হওয়ার পর জেনারেল জিয়া হঠাৎ Red Telephone এর রিসিভারটা ক্রেডল থেকে টেবিলে নামিয়ে ফোনটাকে engaged করে রাখলেন। একই সাথে ADC কে বললেন, তিনি না বলা পর্যন্ত যেন কোনও incoming call তাকে transfer করা না হয়। বুঝতে অসুবিধা হচ্ছিলো না বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কিছু একটা ঘটেছে।
Dalim, something totally unexpected had happened! কর্নেল ফারুক এখন বগুড়ায়। Brigade Commander has been taken under house arrest and he has taken over the Brigade. সিঙ্গাপুর থেকে যোগাযোগের পর ফারুক থাই-এর একটি ফ্লাইট-এ ঢাকায় পৌঁছানোর পর একদল সৈনিক ভারি অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে তাকে বিমান থেকেই তুলে নিয়ে প্রথমে সাভারে বেঙ্গল ল্যান্সার-এর যেই স্কোয়াড্রনটা রয়েছে সেখানে নিয়ে যায়। স্বল্পক্ষণ সেখানে থাকার পর সোজা বগুড়াতে, সেখানেই ল্যান্সারের মূল ইউনিটটা রয়েছে। এই ঘটনা আর তোমার এবং রশিদের দেশে আগমনের বার্তাটি যেভাবেই হউক দেশের সব ক্যান্টনমেন্টে ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে সবখানেই চাপা উত্তেজনার সৃষ্টি হয়েছে। রশিদকে ইতিমধ্যেই সৈনিকরা ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে নিয়ে গেছে। সব GOC-রা আমাকে চাপ দিচ্ছে যতশীঘ্র সম্ভব তোমাদের সাথে একটা সমঝোতা করার জন্য। তাদের অভিমত, তা না হলে ঢাকাসহ সব ক্যান্টনমেন্টে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়বে যা আমার কিংবা তাদের পক্ষে সামাল দেয়া সম্ভব হবে না। সীমান্তের ওপারেও Indian troops movement এর খবর আসছে। ফারুক ঢাকার উদ্দেশ্যে মার্চ করার জন্য তৈরি হচ্ছে। সাভার থেকে বেশকিছু অফিসার এবং সৈনিক ইতিমধ্যেই চলে গেছে আরিচা আর নগরবাড়ি ফেরি ঘাট secure করার জন্য to facilitate Faruk’s advance to Dhaka. বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিকরা ঢাকা-ময়মনসিংহ এবং ঢাকা-সাভার মহাসড়কে অবস্থান নিয়ে অপেক্ষা করছে ফারুককে স্বাগত জানাতে। জয়দেবপুর থেকেই গেছে তারা। কুমিল্লা ও চিটাগং থেকেও সৈনিকরা দাউদকান্দি এবং শোভাপুর ব্রিজের কাছে জমায়েত হয়েছে। সব ক্যান্টনমেন্টের GOC এবং উচ্চপদস্থ কমান্ডাররা ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে যেহেতু তাদের নির্দেশ সৈনিকরা মানছে না, তুমি কি এসবের কিছুই জানো না?
আপনার এই প্রশ্নটা আমার কাছে খুবই অদ্ভুত আর বিস্ময়কর মনে হচ্ছে! ভাবতে বাধ্য হচ্ছি, জবাব দেবো কি দেবো না। কারণ, জবাবটা শুধু আমাকেই বিব্রত করবেনা, আপনাকেও বিব্রত করবে। সন্দেহপ্রবণ মন নিয়ে প্রশ্নটা যখন করেই ফেললেন, তখন জবাবটা আমি দেবো সেটা যত কঠিনই হোক না কেনো। বিনা কারণে কাউকে অবিশ্বাস করাটা আমাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট নয়। আপনার মতো একজন বুদ্ধিমান ব্যক্তি হয়ে এতদিনের ঘনিষ্ঠতার পর সেটা আপনার না বোঝার কথা নয়। সেনা পরিষদ আর আমাদের সাথে আপনার আর রশিদ, ফারুকের কি সম্পর্ক সেটা আশা করি আপনি ভুলে যাননি। সেইক্ষেত্রে, এমন একটা প্রশ্ন আমাকে কি করে করতে পারলেন আপনি? কর্নেল ফারুকের এই পরিকল্পনাতে যদি আমি বা আমি যাদের প্রতিনিধিত্ব করছি তারা জড়িতই থাকবো তবে আমি এই মুহূর্তে আপনার সামনে বসা কেনো? অন্যরা কেনো ফারুকের সাথে দেশে উপস্থিত না হয়ে বেনগাজীতে অবস্থান করছে? এর বেশি আর কিছুই আমি বলতে চাই না। যতটুকু জানি, আপনি আমাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার জন্য ডেকে পাঠিয়েছেন। কিন্তু অবস্থা দৃষ্টে মনে হচ্ছে, সেই বিষয়ে আলোচনা আপনি এখন করতে পারবেন না। তাই যদি অনুমতি দেন তবে আমি চলি, বর্তমানের সংকট সমাধান করে পরে ডেকে পাঠালে আবার আসবো। বলে উঠতে যাচ্ছিলাম, শক্তিধর জিয়া ত্বরিত টেবিলের অন্য পাশ থেকে উঠে এসে আমার হাত ধরে বসার অনুরোধ জানিয়ে একটি চেয়ারে প্রায় জোর করেই বসিয়ে দিয়ে নিজেও পাশে আর একটি চেয়ার টেনে বসে পড়লেন।
ডালিম, ফারুক যদি তার ট্যাঙ্কবহর নিয়ে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে ঢুকে পড়ে তাহলে Chain of Command ভেঙ্গে পড়বে, সারা দেশজুড়ে এক অরাজকতা সৃষ্টি হবে আর সেই সুযোগে Indian armed forces might move in to reinstall Awami- Bakshalites again in power by force…. Please Sir, for heaven’s sake stop telling me all these. I am not here to take lessons from you in this regard. What I know is that you and your cronies wouldn’t be able to resist Faruk and he shall be ousting you all from power. This is your only concern at this moment.
স্যার, জ্ঞান দেবার চেষ্টা না করে আপনি আমার কয়েকটা কথা শুনুন। চুপসে গিয়ে জেনারেল জিয়া বললেন বলো।
অনেক দিনের ব্যবধানে আজ আপনার সাথে আমি মুখোমুখি কথা বলছি একান্তে প্রায় ঘণ্টাখানেক ধরে তাইনা?
হ্যাঁ।
এই অল্প সময়তেই একটা বিষয় আমার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেছে, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় থেকে যেই জিয়াকে বিশ্বাস করে আমরা সযত্নে লালন করে এসেছিলাম আপনি সেই জিয়া নন। নিজেকে এইভাবে বদলে ফেলার পরিণামটা ভাল হবে না খারাপ হবে সেটা সময়ই আপনাকে বুঝিয়ে দেবে। ইতিহাস কিন্তু কাউকে ছাড় দেয় না। যেকোনো কারণেই হউক, আপনি ইতিমধ্যেই অনেক সত্যকে অস্বীকার করে ফেলেছেন এবং ধামাচাপা দেবার চেষ্টা করছেন। আমার এই বক্তব্য সঠিকভাবে বোঝার জন্য আপনার স্মৃতিকে একটু স্বচ্ছ করে দিচ্ছি। ‘৭১ সাল থেকে আজ অব্দি জাতীয়-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যা কিছুই প্রকাশ্যে ঘটেছে সেটা সম্পর্কে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসী অবগত। কিন্তু পর্দার অন্তরালে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে যে সম্পর্কে সাধারণ জনগণের মতো দেশের বেশিরভাগ বিজ্ঞজনই অবগত নন। কেউ কেউ হয়তো বা কিছুটা আঁচ করতে পারেন আংশিকভাবে, এর বেশি নয়। ঐসব ঘটনার সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত বিধায় আমরা কিন্তু অজ্ঞ নই।
১৯৭১ সালে, আর্মি ক্র্যাকডাউনের পর আপনি স্বেচ্ছাপ্রণোদিত হয়ে নয়, অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে অধীনস্থ অফিসার এবং সৈনিকদের উদ্যোগেই বিদ্রোহ করে কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছিলেন। সেই ঘোষণার কৃতিত্বটার দাবিদার শুধু আপনি একা নন, সেই সময় আপনার সহযোদ্ধাদের সবাই সেই কৃতিত্বের দাবিদার। কিন্তু আপনি আজঅব্দি সেই সত্যটা সম্পর্কে নিশ্চুপ রয়েছেন। আপনার সেই ঘোষণার জন্য মুজিবনগর বাংলাদেশী প্রবাসী সরকার এবং ভারতীয় সরকারের কাছে মেজর জিয়া মানে, আপনি পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর একজন উচ্চাভিলাষী অফিসার হিসাবে তাদের চক্ষুশূলে পরিণত হন। যার ফলে যুদ্ধের শুরুতেই আপনাকে সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব থেকে সরিয়ে এনে কোলকাতার ৮নং থিয়েটার রোডের হেডকোয়াটার্স এ ডাম্প করা হয়। আপনার বাসস্থান নির্ধারিত হয় কল্যানীতে। প্রবাসী ও ভারত সরকারের মনোভাব বুঝে তখন আপনার সাথে কম লোকজনই যোগাযোগ করতো। সেই সময় স্বেচ্ছায় আমিই পূর্বপরিচিত জন হিসেবে গোপনে আপনার সাথে যোগাযোগ করে মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে প্রবাসী আওয়ামীলীগ সরকারের দাসখত, ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং আগামীদিনের স্বাধীন বাংলাদেশ নিয়ে তাদের সুদূর প্রসারী নীলনকশা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করি বিশ্বাসযোগ্যতার ভিত্তিতেই। এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমরাও নীতি-আদর্শ ভিত্তিক দীর্ঘমেয়াদী কর্মসূচি প্রণয়ন করে একটি গোপন সংগঠন গড়ে তোলার চেষ্টা করছি মুক্তিযুদ্ধের আড়ালে, সেই বিষয়ও আমি আপনাকে অবগত করে বলেছিলাম আমাদের এই কার্যক্রম আপনাকে কেন্দ্র করেই আমরা এগিয়ে নিতে চাই, যদি এতে আপনি সম্মত হন। অনেক ভেবে চিন্তে আমাদের নীতি-আদর্শে বিশ্বাস করেই, আমাদের একজন হয়ে কাজ করার জন্য আপনি কোরআন শরীফ ছুঁয়ে শপথ নিয়েছিলেন। আপনার তরফ থেকে শর্ত ছিল একটাই, উপযুক্ত সময়ের আগপর্যন্ত আমাদের সম্পর্কটা গোপন রাখতে হবে। জবাবে আপনাকে আশ্বস্ত করে কথা দিয়েছিলাম, আল্লাহ্র রহমতে দেশের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার কেন্দ্রে আপনাকে উপবিষ্ট করার আগ পর্যন্ত কেউই আমাদের সম্পর্কের বিষয়ে কিছুই জানতে পারবে না ইনশা আল্লাহ। আপনার সাথে আমাদের যোগাযোগও থাকবে ন্যূনতম পর্যায়ে। এরপর যুদ্ধকালে প্রবাসী সরকার যখন ‘S’ এবং ‘K’ ফোর্স নামে দুইটি রেগুলার ব্রিগেড গঠন করার সিদ্ধান্ত নেয় তখন কাদের চাপে ‘Z’ ফোর্স নামের ব্রিগেডটি কিভাবে গঠন করতে প্রবাসী সরকার বাধ্য হয়েছিলো সেটা আপনি ভালো করেই জানেন।
স্বাধীনতার পর আমরা একসাথেই কুমিল্লাতে ছিলাম, আপনি ছিলেন প্রথম ব্রিগেড কমান্ডার। কিন্তু অল্প সময়ের মধ্যেই মুজিব সরকার আপনাকে অ্যাক্টিভ কমান্ড থেকে সরিয়ে সেনাসদরে নিয়ে আসার পর আপনাকে কর্নেল হিসাবেই সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দেবার চক্রান্তের প্রথম পদক্ষেপ হিসেবে মিলিটারি এটাচি করে বার্মায় পাঠনোর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে পরে আপনাকে সুপারসিড করে শফিউল্লাহকে জেনারেল বানিয়ে আর্মি চীফ পদে অধিষ্ঠিত করা হয় যাতে আপনি প্রচলিত প্রথা অনুযায়ী স্বেচ্ছায় পদত্যাগ করেন সুপারসিডেড অফিসার হিসেবে। কিন্তু সরকারের সেই চক্রান্তকেও অকার্যকর করে কোন শক্তি আপনাকে যাতে শফিউল্লার অধীনস্থ PSO হয়ে থাকতে না হয়ে তার জন্য DCOAS এর একটি পদ সৃষ্টি করে সেখানে শফিউল্লার সমপদমর্যাদায় আপনাকে নিয়োগ দিতে সরকারকে বাধ্য করেছিলো সেটাও আপনার অজানা নয়। এরপর PO-9 এর প্রয়োগের মাধ্যমে আমাদের চাকুরি থেকে অসময় অবসরে পাঠানোর পর আপনি ভবিষ্যৎ নিয়ে কিছুটা অনিশ্চিত হয়ে পড়লে বলেছিলাম, চিন্তার কোনও কারণ নেই, সময়মত সব ঠিক হয়ে যাবে।
এরপর ১৫ই আগস্ট এর বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের পর আমাদের মনোনীত রাষ্ট্রপতি শফিউল্লাহকে সরিয়ে আপনাকে আর্মি চীফ পদে নিয়োগ দান করেন পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী। সেটাও আপনি ভালভাবেই জানেন। সেই সময় খন্দকার মোশতাক রাষ্ট্রপতি হলেও সরকারের পেছনে মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ, আর আপনি তাদেরই মনোনীত আর্মি চীফ হিসাবে অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন ক্ষমতার কেন্দ্রে। লক্ষ্য একটাই- ধাপে ধাপে রাষ্ট্রীয় এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে আমাদের স্বপ্ন এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে জাতীয় পরিসরে বাস্তবায়িত করা। এরপর অপ্রত্যাশিত ভাবে ঘটে ২-৩ নভেম্বের ’৭৫ এর প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতা ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াত এর প্ররোচনায়। এর জন্য আপনি কতটুকু দায়ী সেটা আপনাকে মনে করিয়ে দিতে হবে না। সেই সংকটেরও মোকাবেলা করেছিলাম আমরা আপনাকে বাঁচিয়ে রেখেই। খালেদ-চক্রের চেয়ে বেশি শক্তিশালী হওয়া সত্ত্বেও সম্মুখ সংঘর্ষে লিপ্ত না হয়ে পরোক্ষভাবে খালেদ-চক্রকে উৎখাত করার পরিকল্পনা শেষে আলোচনার মাধ্যমে কৌশলগত কারণেই খালেদভাবী এবং হুদাভাবীকে সঙ্গে করে ব্যাংকক চলে যাই। সেখান থেকেই পরিচালিত হয় ৭ই নভেম্বর-এর সিপাহী জনতার বিপ্লব, সেটা আপনি মুক্ত হয়ে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরমুহূর্তেই বুঝতে পারেন। কর্নেল তাহেরই যদি ৭ই নভেম্বর অভ্যুত্থানের মুখ্যশক্তি হতো তাহলে তো আপনাকে তার হাতের পুতুল হতে হতো তাই না স্যার? কিন্তু তেমনটি তো হয়নি। আপনাকে তাহেরের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলো সেই একই শক্তি, যখন কর্নেল তাহের আপনাকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে নেবার জন্য জবরদস্তি করছিলেন তখন কর্নেল তাহেরকে ক্যান্টনমেন্ট থেকে বের করে দিয়ে তাকে সরাসরি বলা হয়েছিলো তিনি যেন আর ক্যান্টনমেন্টে প্রবেশ করার চেষ্টা না করেন, তাই না স্যার? সেই শক্তিটি যে সেনা পরিষদ সেটা বুঝতে আপনার বেগ পেতে হয়েছিলো কি? আমাদের সাথে আলাপের পরই আপনি আমাদের কথামতো খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে অনুরোধ জানিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আপনার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেন। যুক্তি হিসাবে আপনাকে ও জাতির উদ্দেশ্যে তিনি বলেছিলেন, এতে সাংবিধানিক জটিলতা দেখা দেবে। তবে একই ভাষণে তিনি অবশ্য জাতিকে জানিয়ে দিয়েছিলেন যে ৩রা অক্টোবর ১৯৭৫, জাতির উদ্দেশ্যে তার ভাষণে তিনি অঙ্গীকার করেছিলেন ১৫ই আগস্ট ১৯৭৬ থেকে দেশে বহুদলীয় রাজনীতি শুরু করা হবে এবং ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। নির্বাচনে জনগণ যদি তার উপর আস্থাজ্ঞাপন করেন তবে ভোটে জিতেই তিনি আবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করবেন, তাই না স্যার? হ্যাঁ। কিন্তু সাংবিধানিক জটিলতাটাই কিন্তু আসল কারণ ছিল না আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করার পেছনে।
মানে?
আলাপের মাধ্যমে তিনি আপনাকে পরামর্শ দিয়েছিলেন কালবিলম্ব না করে আমাদের দেশে ফিরিয়ে এনে সেনাবাহিনীতে পুনর্নিয়োগ প্রদান করতে। জবাবে সরাসরি আপনার পক্ষে তখন তার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করা সম্ভব ছিল না। তাই আপনি বলেছিলেন, এই বিষয়ে আপনার আরও কিছু সময় প্রয়োজন। কি স্যার, ঠিক বলছিতো?
হ্যাঁ, ঠিকই বলছো।
ক্ষুরধার বুদ্ধির অধিকারী খন্দকার মোশতাক আপনার জবাব থেকে যা বোঝার বুঝে নিয়েছিলেন আর আমাদের জানিয়েছিলেন তিনি আপনার নিয়তের বিষয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েছেন। সে জন্যই তিনি পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের আপনার প্রস্তাব গ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের আপনার ব্যাপারে সতর্ক হওয়ার উপদেশ দিয়েছিলেন। তার সিদ্ধান্তে জেনারেল ওসমানী হতবাক হয়ে খন্দকার মোশতাককে ফোন করেন। কারণ জানতে চাইলে তিনি সবকিছু তাকেও খুলে বলেছিলেন। সব শোনার পর তিনি হতাশাগ্রস্ত হয়ে জনাব মোশতাককে বলেছিলেন, পৃথিবীতে মানুষ চেনা দায়! কি জানেন স্যার, জনাব মোশতাকের কথা শুনেও কিন্তু আমরা আপনাকে অবিশ্বাস করতে পারছিলাম না। যাক সে কথা। খন্দকার মোশতাকের সিদ্ধান্তের পর দেশের একচ্ছত্র অধিপতি হওয়ার পথে আর কোনও বাধা না থাকায় অতি অল্পসময়ে আপনার পক্ষে শিখণ্ডি রাষ্ট্রপতি সায়েমকে সরিয়ে নিজেই CMLA হয়ে রাষ্ট্রের কর্ণধার হয়ে ওঠা সহজ হয়ে যায়। আপনি এখনো সেই পদে অধিষ্ঠিত হয়ে বহাল তবিয়তে দেশ শাসন করে চলেছেন। ৩রা নভেম্বর থেকে ৭ই নভেম্বরের পর সামরিক বাহিনীতে যা কিছুই ঘটেছে সে সম্পর্কে দেশবাসী তেমন কিছুই জানে না। কিন্তু আপনি এবং আমরা কি তাদের মতোই অজ্ঞ? আপনার একচ্ছত্র আধিপত্যকালে যাই হয়েছে বা হচ্ছে তার সব দায়-দায়িত্বের হিসাব কিন্তু দিতে হবে শুধুমাত্র আপনাকেই। তখন কিন্তু আপনার আজকের বিশ্বস্ত আস্থাভাজন পরামর্শদাতাদের কাউকেই ধারে কাছে খুঁজে পাওয়া যাবে না, এই একই কথা আমি শেখ মুজিবকেও বলেছিলাম তার সাথে শেষ সাক্ষাতকালে যখন তিনি আমাকে আর নূরকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন তার ৩২ নম্বর ধানমণ্ডির বাসভবনে। আপনি ঠিক বলেছেন, এই ক্রান্তিলগ্নে ভারতীয় আগ্রাসন দেশ ও জাতির জন্য হবে ভয়াবহ। কিন্তু আওয়ামী-বাকশালীদের হাসিনার নেতৃত্বে জাতীয় রাজনীতির মূলধারায় পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করার সমঝোতা আপনি তো ইতিমধ্যেই ভারতের সাথে তাদের অনুকম্পা ও সহমর্মিতা পাবার আশায় করে ফেলেছেন ‘বসন্তের কোকিল’ ডঃ কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলাম আর তোফায়েল আহমেদের মাধ্যমে যখন পার্টিটি টুকরো টুকরো হয়ে বিলীন হয়ে পড়ছিলো। এ ধরনের কাজ তো ‘খাল কেটে কুমীর ডেকে আনার’ মতই আত্মঘাতী। খবরটা সত্যি না মিথ্যা স্যার?
কোনও জবাব নেই। জেনারেল জিয়া মুখ কালো করে মাথা নিচু করে বসেছিলেন।
স্যার, জানিনা আপনি কাদের পরামর্শে ভারতের সাথে সমঝোতা করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করতে চলেছেন। এতো চড়াই-উৎরাই পেরিয়েও আপনি কি করে বুঝতে অক্ষম হলেন আপনি যতই ছাড় দিন না কেনো ভারতের কাছে আপনি কখনোই গ্রহণযোগ্যতা পাবেন না, শুধুমাত্র তাদের স্বার্থে ব্যবহৃত হবেন। স্বার্থ হাসিল হওয়ার পর আপনার প্রয়োজনীয়তাও শেষ হয়ে যাবে তখন আপনার পরিণতিটা কি হবে একবার ভেবে দেখেছেন কি? তাছাড়া, বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে বিপরীতমুখী স্বার্থের যে দ্বন্দ্ব বিরাজমান সেটা চিরস্থায়ী, সেক্ষেত্রে ভারতের সাথে সমঝোতা করে ধর্মীয় মূল্যবোধের উপর ভিত্তি করে জাতীয়তাবাদী রাজনীতি করা কখনোই সম্ভব হবে না। কারণ, বাংলাদেশ যদি আত্মনির্ভর, প্রগতিশীল এবং সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে গড়ে ওঠে তবে দীর্ঘদিন যাবত ভারতের বিভিন্ন জাতিসত্তা যারা ভারতীয় কেন্দ্রীয় শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট হয়েও বীরবিক্রমে সাহসিকতার সাথে লড়ে চলেছে তাদের মনোবল বেড়ে যাবে। তারা ভাববে, বাংলাদেশ যদি পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে স্বাধীন আর সমৃদ্ধশালী দেশ হিসাবে মাথা উঁচু করে দাড়াতে পারে তবে তারা পারবে না কেনো? ফলে, স্বল্পসময়েই অযৌক্তিক ভাবে সৃষ্ট ‘ভারতীয় ইউনিয়ন’ ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে এবং এই অঞ্চল ফিরে যাবে হাজারো বছরের ঐতিহ্যবাহী আকৃতিতে। আজ যারা আপনার বিশ্বস্ত পরামর্শদাতা তাদের রাজনীতির মৌলিক সংজ্ঞা এবং ইতিহাস সম্পর্কে কতটুকু জ্ঞান আছে সে প্রশ্ন না করে শুধু এতটুকুই বলবো, তাদের কেউই এখানকার রাজনীতি তো দূরের কথা, এ অঞ্চলের মাটি-মানুষের সাথেও তেমনভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন না কখনোই। তারা দেখেছেন আইয়ুব খানের রাজনীতি, জুলফিকার আলি ভুট্টোর মতো ঠগবাজদের রাজনীতি আর দেখেছেন কূটকৌশলী ক্ষমতালিপ্সু জেনারেলদের আর আমলাদের। কিন্তু তখনকার পূর্ব পাকিস্তান আজকের বাংলাদেশের জনগণের মানুশিকতা শুরু থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠী থেকে ছিল সবদিক থেকেই আলাদা। এরপরও আত্মরম্ভি আইয়ুব খান কিংবা মাদারি ভুট্টো কিন্তু তাদের স্বরূপটি বেশিদিন লুকিয়ে রাখতে পারেননি পাকিস্তানের জনগণের কাছ থেকে। আপনিও পারবেন কিনা তাতেও সন্দেহের যথেষ্ট অবকাশ আছে। বর্তমানে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছানোর জন্য আপনার নিজস্ব অবদান কতটুকু সে বিষয়ে কিছু বলে আপনাকে বিব্রত করতে চাই না। তবে আপনাকে মধ্যমণি করে যারা তিলে তিলে অনেক আত্মত্যাগ এবং জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সেনা পরিষদ গড়ে তুলেছিলো সেই প্রক্রিয়ায় আমিই ছিলাম তাদের আর আপনার মধ্যে মূল যোগসূত্র। তাই সবার তরফ থেকে আমি আপনাকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিতে চাই, আমাদের কিংবা দেশ ও জাতির প্রতি আপনি যাই করে থাকুন তার জন্য আপনার প্রতি আমাদের বিন্দুমাত্র ক্ষোভ কিংবা অনুযোগ নেই। কারণ, আমরা সবাই বিশ্বাস করি মানুষ মাত্রই তার নিজ কর্মফলের জন্য দায়ী। একই ভাবে ইহকালে এবং পরকালে। দেশ ও জাতীয় স্বার্থে সবকিছুই সহ্য করার তৌফিক আল্লাহ্ পাক আমাদের দিয়েছেন। তাছাড়া সব চাওয়া-পাওয়ার ঊর্ধ্বে আমরা সবাই আলহামদুলিল্লাহ! এটা আপনার চেয়ে অন্য কারো বেশী বোঝার কথা নয়। যাবার আগে আর একটা কথা বলে যাচ্ছি, আজকে যেই সংকটের মোকাবেলা আপনাকে করতে হচ্ছে তার চেয়ে অনেক বেশি কঠিন সংকটের মোকাবেলা আপনাকে ভবিষ্যতে করতে হবে আপনার এই ধরনের সমঝোতার রাজনীতির পথে। শুনে রাখুন, পাশা, নূর, শাহরিয়ার, হুদা, ডলিমদের বাইরের এবং ভেতরের সত্তায় কোনও পার্থক্য নেই। মানুষ নিজেকে দিয়েই অন্যকে বোঝার এবং জানার চেষ্টা করে। আমরা মনেপ্রাণে আপনাকে আমাদেরই মতো একজন বিশ্বাস করেই গ্রহণ করেছিলাম। আপনি আমাদের বুঝতে ভুল করেছেন। এখন হয়তো আপনি আমাদেরই আপনার মুখ্য প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবছেন। কিন্তু স্যার, আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন প্রতিদ্বন্দ্বী যদি আমরা হয়েও থাকি ব্যক্তিগতভাবে আপনার কোনও ক্ষতি আমরা করবো না। কারণ, আমাদের বিশ্বাস, একদিন আপনি বুঝতে পারবেন আপনাকে ভুল পথের অন্ধকূপের অতলে নিক্ষিপ্ত করেছিলো সেনা পরিষদের নেতারা নয়, তার জন্য দায়ী সুযোগ সন্ধানী ষড়যন্ত্রকারী আপনার ঘরের শত্রু বিভীষণরা। আপনি এটাও বুঝবেন আমাদের মধ্যে মানবিকতা, নৈতিকতা, বিশ্বাসযোগ্যতা, আন্তরিকতা এবং সহমর্মিতা কিছুটা হলেও রয়েছে যার প্রমাণ আপনি নিশ্চয়ই পেয়েছেন ইতিমধ্যেই। কথাগুলো কিছুটা তিক্ত হলেও বলে গেলাম। পরে একটু খতিয়ে দেখলে তাতে আপনার কিছুটা লাভ হলেও হতে পারে। যদিও পানি ইতিমধ্যে গড়িয়েছে অনেক দূর। এখন আমি বিদায় নেবো। বলে উঠে দাড়াতেই বিচলিত ক্ষমতাধর জেনারেল জিয়া বলে উঠলেন
এখন কি আমরা আর এক নই?
অদ্ভুত প্রশ্ন! স্যার, এতক্ষণ আমি কি তবে ‘অরণ্যে রোদন’ করলাম! এত কথার পর এই ধরনের প্রশ্ন পরিহাস তুল্য। আসি স্যার, বলতেই তিনি আবার আমার ডান হাতটা দুই হাতে ধরে কাতরভাবে বললেন ফারুককে বোঝাতেই হবে তোমাকে।
ফারুক তো আমাকে জিজ্ঞেস করে আসেনি। সে তার নিজের ইচ্ছায় এসেছে।
কিছুক্ষণ ভেবে জিয়া বললেন এক কাজ করলে কেমন হয়?
কি?
চলো, তোমাকে নিয়ে আমি সব ক্যান্টনমেন্টে গিয়ে দরবারে বলি, আমরা এখনো একই সাথে আছি এবং ১৫ই আগস্টে এবং ৭ই নভেম্বর-এর চেতনা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমরা ঐক্যবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এটাও তুমি সবাইকে বুঝিয়ে বলবে যে, বিপ্লবের স্বার্থেই তোমরা কিছুদিনের জন্য বিদেশে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এটা যদি গ্রহণযোগ্য না হয় তবে সব ক্যান্টনমেন্ট থেকে প্রতিনিধি আনিয়ে সেনাকুঞ্জে দরবারের ব্যবস্থাও করা যেতে পারে।
তা হয়তো করা যেতে পারে, কিন্তু সেখানেও এই ধরনের বক্তব্য আমার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয় আপনার পাশে দাঁড়িয়ে। কারণ, সেই রাস্তাটা আপনি নিজেই বন্ধ করে দিয়েছেন। কি করে, সেটা আপনার নিজেরই জানা আছে। আমার জবাবে চুপসে গেলেন জিয়া। আমার পক্ষে কিছু করা সম্ভব হবে কিনা জানিনা, তবে দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে যদি কিছু করা সম্ভব হয় সেটা করার চেষ্টা নিশ্চয় করবো। এরপর বেরিয়ে এসেছিলাম। ADC- এর রুমে বসেই মাহবুব ঘটে যাওয়া ঘটনার সবকিছু জেনে গেছে। গাড়ীতে বসেই বললাম
ব্রিগেড মেস-এর নির্ধারিত কামরায় চলো। পথিমধ্যে লোকজনদের মধ্যে স্বাভাবিকতাই লক্ষ্য করলাম যেমনটি লক্ষ্য করেছিলাম ২-৩রা নভেম্বর রাতে। সে রাতেও তারা ছিল বেখবর আজকেও ঠিক তারা তেমনিভাবে বেখবর!
ব্রিগেড মেস-এ পৌঁছালাম
ব্রিগেড মেস-এর নির্ধারিত কামরায় পৌঁছে প্রথমেই যোগাযোগ করলাম বেনগাজীতে। সবকিছুই বিস্তারিত জানালাম সহবিপ্লবীদের। খবর পাওয়া গেছে রশিদ ইতিমধ্যেই ২য় ফিল্ড রেজিমেন্টে ঘুরে এসেছে। জিয়ার দরবারের প্রস্তাব আমি নাকচ করে দিয়েছি। জিয়ার কর্মকাণ্ডে সামরিক বাহিনীতে অসন্তোষ এবং উষ্মা থাকলেও এই মুহূর্তে জিয়ার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করলে তাকে হয়তো ক্ষমতাচ্যুত করা সম্ভব হবে, কিন্তু দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে নিয়ে ভারতীয় আগ্রাসনের মোকাবেলা করা সম্ভব হবে না। বর্তমান অবস্থা মারাত্মকভাবে ২-৩রা নভেম্বরের চেয়ে অনেক বেশি জটিল। সেই বিবেচনায় একমাত্র পথ রশিদ আর ফারুককে বুঝিয়ে নিরস্ত্র করা। এ ছাড়া আর কিছু করা সম্ভব নয়। এখন তোমাদের মতামত জানাও, আমি কি করবো। পাশাই সবার তরফ থেকে বললো
স্যার, আপনি ঘটনাস্থলে রয়েছেন, সব কূল রক্ষা করে অবস্থা সামাল দেবার জন্য যাই ভাল বুঝবেন সেটাই করুন। আপনার বুদ্ধিমত্তার উপর আমাদের সবারই আস্থা আছে। কথা শেষ হল। মাহবুবও সংক্ষেপে সবার সাথে সালাম দোয়া এবং কুশল বিনিময় করলো। রশিদের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে তাকে পেলাম না। জানতে পারলাম সে ২ ফিল্ড রেজিমেন্ট থেকে বেরিয়ে গেছে। তাই, ফারুককে ফোন করলাম। আমি ফোন করেছি জেনে ফোন ধরলো ফারুক।
তুই এ ভাবে কাউকে কিছুই না জানিয়ে এসে কি করতে চলেছিস? জিয়া বিশ্বাসঘাতকতা করেছে সেটা ঠিক, কিন্তু দেশের মাটিতে পা দেবার পর আমি যা জানতে পেরেছি তাতে কোনও সন্দেহ নেই আজকের পরিস্থিতি ২-৩রা নভেম্বর এর চেয়ে অনেক জটিল। যদি তুই শুনতে চাস তবে বলতে পারি একটু বিস্তারিতভাবে।
বল, আমি শুনবো কি বলার আছে তোর।
যাদের সাথেই আমার আলাপ হয়েছে দেশের বর্তমান অবস্থা এবং জিয়া সম্পর্কে তাদের সবার বক্তব্য প্রায় একই রকম। জিয়া আগস্ট বিপ্লবের নীতি-আদর্শ এবং বিপ্লবীদের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে নিজেকে সরিয়ে নিয়ে বিপ্লবীদের সাথে সব সম্পর্ক অস্বীকার করে সমঝোতার ভিত্তিতে ক্ষমতার রাজনীতি করতে চলেছেন। ভারতের সাথেও তিনি সমঝোতা করে নিয়েছেন তার রাজনীতির স্বার্থেই। একই লক্ষে তিনি ছেঁড়া গেঞ্জি, ভাঙ্গা স্যুটকেস আর কোদাল কাঁধে গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে খালকাটা আর রাস্তা বানানোর কর্মসূচির মাধ্যমে চমক সৃষ্টি করে নিজেকে একজন জনদরদী নেতা হিসাবে একটা ইতিবাচক ভাবমূর্তি গড়ে তুলতেও সক্ষম হয়েছেন। অপর দিকে প্রায় হাজার তিনেক সেনা সদস্য এবং বেসামরিক বিপ্লবীদের সাজানো অভ্যুত্থানের নাটকের মাধ্যমে নির্মম ভাবে হত্যা করেছেন। জেলবন্দীও করেছেন অনেককেই সামরিক বাহিনী এবং দেশে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার অজুহাতে। এতে সামরিক বাহিনী ক্ষোভ এবং প্রতিশোধ স্পৃহায় অগ্নিগর্ভ হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় জিয়া এবং তার সাঙ্গপাঙ্গদের ক্ষমতাচ্যুত করার কাজটি খুব একটা কঠিন হবে না। কিন্তু সেই সুযোগে ভারতীয় সরকার আওয়ামী-বাকশালীদের নিয়ে আর একটি প্রবাসী সরকার বানিয়ে ২৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় তাদের আহ্বানে সাড়া দিয়ে যদি দেশে আগ্রাসন চালিয়ে তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে তখন দ্বিধাবিভক্ত জাতিকে সঙ্গে নিয়ে তাদের মোকাবেলা করা কি সম্ভব হবে? ভারতকে এই বিষয়ে পূর্ণ সমর্থন জানাবে সোভিয়েত বলয়। আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে আমাদের সমর্থন দেবার মতো কাউকে কি পাওয়া যাবে? খবর হল, জিয়া পশ্চিমা শক্তিগুলো এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর কাছেও নিজের গ্রহণযোগ্যতা অর্জন করার চেষ্টায় অনেকটাই সফল হয়েছেন। আমাদের তো সেই রকম কোনও সুযোগই হয়নি এখন পর্যন্ত। এই বাস্তবতায় বলা চলে, ভারতের পক্ষে অতি সহজেই সম্ভব হবে আওয়ামী-বাকশালীদের পুনরায় ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত করা। ফলে দেশটা পরিণত হবে একটি করদ রাজ্যে আর জাতি পরিণত হবে দাসে। এইবার আওয়ামী-বাকশালী সরকারের নিরাপত্তার জন্য ভারতীয় বাহিনী বাংলাদেশে সুদৃঢ় ঘাটি গেড়ে বসবে এবং ক্রমান্বয়ে দেশের সামরিক বাহিনী, পুলিশ, বিডিআর-এর বিলুপ্তি ঘটিয়ে সেগুলোকে পুনর্গঠিত করা হবে ভারতের সাহায্যে দলীয় ক্যাডারদের সমন্বয়ে নতুন আঙ্গিকে। এভাবেই ভারতীয় সুদূর প্রসারী নীলনকশা বাস্তবায়িত হবে। আমরা তো দেশ আর জাতীয় স্বার্থেই সেই সুযোগটা না দেবার জন্যই ৩রা নভেম্বর ১৯৭৫ সালে দেশত্যাগ করেছিলাম এবং খালেদ-চক্রকে ব্যাংকক থেকে উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। বর্তমানে প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ কোনও ভাবেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয় সামরিক সংঘর্ষের মাধ্যমে। জিয়ার মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক ভাবেই। আর একটি কথা, ধরা যাক আমরা জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলাম, সেই ক্ষেত্রে আমরা বাধ্য হব আমাদের উপরের সব সিনিয়র অফিসারদের সামরিক বাহিনী থেকে বের করে দিতে। এ ধরনের পদক্ষেপে যে অবস্থার সৃষ্টি হবে সেই সুযোগটা কি ছাড়বে ভারত? অবশ্যই না। তাহলে জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করে লাভটা কি হবে সেটাও তোকে ভেবে দেখতে হবে। ফারুক নিশ্চুপ হয়ে শুনছিল আমার বক্তব্য। আমার বক্তব্য শেষে ফারুক বললো
All right then, আমি তোর বক্তব্য গুরুত্বের সাথেই শুনেছি, আমি ভেবেচিন্তেই সিদ্ধান্ত নিবো। Thanks, বলে ফোন রেখে দিলো ফারুক।
এরপর আমি জেনারেল জিয়াকে ফোন করে জানালাম, ফারুকের সাথে আমার আলাপ হয়েছে। অবিলম্বে ফারুকের বাবার সাথে যোগাযোগ করে তাকে বগুড়ায় পাঠাবার ব্যবস্থা করার পরামর্শ দিলাম। জেনারেল জিয়া আমার কথামতো ফারুকের বাবার সাথে যোগাযোগ করে তাকে অনুরোধ করেন বগুড়ায় গিয়ে ফারুককে বোঝানোর জন্য। বৃহত্তর জাতীয় স্বার্থে তিনি রাজি হন এবং আর্মির একটি হেলিকপ্টারে করে ফারুকের ছোটবোন ইয়াসমিনকে সাথে নিয়ে ফারুককে বুঝিয়ে বগুড়া থেকে ঢাকায় ফিরিয়ে আনেন। সন্ধির শর্ত হিসাবে ফারুক দাবি করেছিল, বহুদলীয় রাজনীতিতে তাদেরকে অংশগ্রহণের সুযোগ জিয়াকে দিতে হবে। তখন অবস্থার চাপে জিয়া তার সেই শর্ত মেনে নিয়েছিলেন। এরপর রশিদ আর ফারুক দুইজনই ঢাকা ত্যাগ করেছিলো।
সংকট কেটে যাবার পরই আবার আমার ডাক পড়ল CMLA ’s Office এ। সময় মতো গিয়ে হাজির হলাম। ঘরে ঢুকতেই আগের মতই জিয়া চেয়ার থেকে উঠে এসে স্বাগত জানালেন। আলোচনার বিষয় আমাদের ভবিষ্যৎ।
তোমাকে কি করে ধন্যবাদ জানাবো ভেবে পাচ্ছি না।
আমি তেমন কিছুই করিনি, ফারুকই তার বুদ্ধি-বিবেচনায় তার সিদ্ধান্ত পাল্টে ছিল।
আমি সবই জানতে পেরেছি। আমি তার কথার কোনও জবাব না দিয়ে কফিতে মনোযোগ দিলাম। জিয়াও খাবারের প্লেটে কাঁটা চামচ নাড়াচাড়া করছিলেন আর ভাবছিলেন। কিছুক্ষণ ভেবে নিয়ে বলা শুরু করলেন
ডালিম, তোমরা সবাই আমার কাছে প্রশংসার পাত্র, বিশেষ করে তোমাকে আমি স্নেহ এবং শ্রদ্ধা করি। অন্যদের সাথে আমার তেমন ঘনিষ্ঠতা না থাকলেও তোমার সাথে আমার পরিচয় সেই কাকুলের দিনগুলো থেকেই। You all are undoubtedly selfless patriots and progressive minded revolutionaries. আমি অকপটে স্বীকার করছি বয়সের তুলনায় তোমরা সবাই রাজনৈতিকভাবে বেশি সচেতন। (বাংলা ভাষায় তেমন দক্ষতা না থাকায় জিয়া বাংলা ইংরেজি মিলিয়েই কথা বলতেন। এতে তাকে দোষ দেয়া চলে না, কারণ পূর্ব পাকিস্তানের বগুড়ার গাবতলীতে পৈতৃকভিটা হলেও বাল্যকাল থেকে যুদ্ধের আগ পর্যন্ত প্রায় পুরোটা সময় তার কেটেছে পশ্চিম পাকিস্তানেই)। ৭ই নভেম্বরের পর এক চরম অস্থিতিশীল অবস্থায় আমাকে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিতে হয়। কৌশলে ১৫ই আগস্টের কথাটা উচ্চারণ করলেন না ধূর্ত জিয়া, এটাও বললেন না যে ১৫ই আগস্টের সাথে একটি যোগসূত্র রয়েছে ৭ই নভেম্বর সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের। তার জন্য আমি মনে করি কিছু সময়ের জন্য তোমাদের বাইরে রাখলে আমার সুবিধে হবে। সেই সময়টা লিবিয়ায় নিষ্কর্ম হয়ে বসে না থেকে দেশ ও জনস্বার্থে আমার প্রতিনিধি হয়ে যাতে তোমরা কাজ করে যেতে পারো তার জন্য আমি ঠিক করেছি তোমাদের সবাইকে বিদেশের ঐসব রাষ্ট্রে কূটনৈতিক দায়িত্ব দিয়ে পাঠাবো যাদের সাহায্য-সহযোগিতা বাংলাদেশের জন্য অতি প্রয়োজনীয় ভারতের মতো একটি রাষ্ট্রের হুমকির বিরুদ্ধে মাথা উঁচু করে নিজেদের অস্তিত্ব বজায় রাখার জন্য। সে ধরনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক কোনও পেশাদার আমলাদের দ্বারা গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব না, কিন্তু সেটা তোমাদের দ্বারা সম্ভব বলেই আমার বিশ্বাস। অনেক আশা নিয়ে আমি এই প্রস্তাবটা করলাম। আমার এই প্রস্তাব তোমরা গ্রহণ করবে কিনা সেটা তোমাদের সিদ্ধান্ত। তবে আমার অনুরোধ, বিষয়টি নিয়ে একটু ভেবেচিন্তে তোমরা সিদ্ধান্ত নিয়ো। আমাকে নিরাশ করো না। তার বক্তব্য শেষে তিনি আমার দিকে একটি জবাবের প্রত্যাশায় উদগ্রীব হয়ে চাইলেন। তার বক্তব্য শুনে মনে করেছিলাম কোনও জবাব দেবো না, কারণ সেটা হবে ‘উলু বনে মুক্তা ছড়ানো’র মতোই। পরে ভাবলাম এই সুযোগে তাকে কতগুলো সত্য জানিয়ে যাই, এতে কোনও লাভ না হলেও ঐতিহাসিকদের বিবেচনার বিষয় হয়ে থাকবে আমার বক্তব্য।
স্যার, আপনার প্রস্তাব গ্রহণ করা হবে কি হবে না সেটা আমি ফিরে যাবার পর সহযোদ্ধাদের সাথে আলাপের পরই আপনাকে জানিয়ে দেয়া হবে। এই বিষয় আর দীর্ঘ ব্যখ্যার প্রয়োজন নেই। যদি অনুমতি দেন তবে একজন পুরনো সাথী এবং সহযোদ্ধা হিসাবে কিছু কথা বলে যেতে চাই।
বলো, কি বলতে চাও?
৭ই নভেম্বর বিপ্লবের পর আপনাকে পূর্বসিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুনরায় চীফের পদে অধিষ্ঠিত করেছিল আগস্ট বিপ্লবীরাই। সেনা পরিষদই ছিল ওই বিপ্লবের অগ্রণী এবং মূলশক্তি। কর্নেল তাহের ও তার অধীনস্থ বিপ্লবী সৈনিক সংস্থার ভূমিকা ছিল সহায়ক শক্তি হিসাবে গৌণ। এ সত্যটা আপনি ভালো করেই জানেন। সবকিছু জেনেই আপনি ক্ষমতার কেন্দ্রে উপবিষ্ট হবার পরই সিদ্ধান্ত নেন, আগস্ট বিপ্লবের চেতনা আদর্শ এবং বিপ্লবীদের সাথে সব সম্পর্ক ছেদ করে ভিন্ন পথে অগ্রসর হওয়ার। আপনি জোর প্রচারণা চালাচ্ছেন বিপ্লব এবং বিপ্লবীদের সাথে আপনার কখনোই কোনও সম্পর্ক ছিল না, বর্তমানেও নেই। এ ধরনের মিথ্যাচারের মাধ্যমে সাময়িকভাবে হয়তো সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা সম্ভব হবে। কিন্তু সত্য একদিন সত্য হিসাবেই ইতিহাসে প্রতিষ্ঠা পাবে। এটাই সমাজ বিজ্ঞানের শিক্ষা। ‘বিপ্লব’ শব্দটার অপব্যাখ্যার মাধ্যমে মানুষের মনে ত্রাসের সৃষ্টি করার ইতিহাস সুপ্রাচীন। যদিও এই শব্দটির সহজ মানেটা হল আপোষহীন দ্রুত পরিবর্তন। মানব সভ্যতা জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার সাথে তাল মিলিয়ে এগিয়ে চলেছে, কিন্তু এই অগ্রগতির ফসল পৃথিবীর সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ঝুলিতে পরেনি। মুষ্টিমেয় কিছু লোক এবং পরিবার এর ফল ভোগ করে চলেছে জোরজুলুমের মাধ্যমে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করে। সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ কিংবা নিও-উপনিবেশবাদের কালে তাদের সেই শোষণ প্রক্রিয়াকেই টিকিয়ে রাখার জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বিভিন্ন প্রকারের রাষ্ট্রীয় অবকাঠামো, রাজনৈতিক ব্যবস্থা, আইন আদালত, প্রশাসনিক প্রতিষ্ঠান, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী এবং জাতীয় স্বার্থ রক্ষাকারী সামরিক বাহিনী এবং এক অদ্ভুত রাজনৈতিক প্রক্রিয়া। ছল-চাতুরীর মাধ্যমে পেশীশক্তি এবং অর্থশক্তির বলে বলিয়ান আগ্রাসী শক্তিগুলো বিভিন্ন দেশে গড়ে তুলেছে তাদের তল্পিবাহক একটি মুৎসুদ্দি শ্রেণি। এই সমস্ত পোষা স্বার্থবাদী বাস্তুঘুঘুরা প্রয়োজন মতো কখনো গায়ে জড়াচ্ছে গণতন্ত্র, স্বৈরতন্ত্র কিংবা একনায়কতন্ত্রের লেবাস শুধুমাত্র ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্যই। এতে সৃষ্টি হয়েছে স্বার্থের দ্বন্দ্ব নিজেদের এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের স্বার্থের সাথে বৃহত্তর জনগোষ্ঠী এবং জাতীয় স্বার্থের। তৃতীয় বিশ্বের প্রায় সবদেশেই ক্ষমতাসীন আর বিরোধীদলগুলোর মধ্যে চরিত্রগত ভাবে কোনও পার্থক্য নেই। কারণ, তাদের সবার শিকড় প্রোথিত ঐ কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠীর মধ্যেই। তারা বাহ্যিক ভাবে একে অপরের সাথে ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বটে, তবে সেটা হয়ে থাকে সমঝোতার ভিত্তিতে। জনস্বার্থের বিরুদ্ধে তারা এক হয়ে যায়। বর্তমান কালে তথ্যপ্রযুক্তির ক্ষেত্রে যে বিস্ফোরণ ঘটেছে তাতে এই শুভঙ্করের ফাঁকিটা পৃথিবীর প্রতিপ্রান্তের বঞ্চিত, শোষিত এবং নিপীড়িত জনগণ আজ কম-বেশি ধরতে সক্ষম হচ্ছেন তাতে তাদের সচেনতা বেড়ে চলেছে। এর ফলে, বর্তমানে বিশ্বজোড়া আগ্রাসী সম্প্রসারণবাদী সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধ গড়ে উঠছে। তাদের ন্যায়সঙ্গত এই প্রতিবাদী প্রতিরোধ সংগ্রামকে বলা হচ্ছে ‘সন্ত্রাসবাদ’ ‘মৌলবাদ’ ইত্যাদি এবং প্রতিবাদী এবং প্রতিরোধকারীদের বলা হচ্ছে সন্ত্রাসবাদী মৌলবাদী। কিন্তু এইসব অপপ্রচারের পরেও আজ অস্থিতিশীল হয়ে ধস নেমেছে বর্তমানের অসম শোষণমূলক বিশ্ব ব্যবস্থায়। বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ ‘৭১ এ ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন মুক্তিসংগ্রামে এক নতুন ন্যায়ভিত্তিক প্রকৃত স্বাধীনতার প্রত্যাশায়। সেই চেতনা আর স্বপ্নের বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এবং চাণক্যদের সুদূরপ্রসারী নীলনকশার মাধ্যমে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার ষড়যন্ত্রকে নস্যাত করার জন্যই যুদ্ধকালে আমরা গড়ে তুলেছিলাম একটি গোপন বৈপ্লবিক সংগঠন যার একজন সদস্য হয়েছিলেন আপনি শপথ নিয়ে স্বেচ্ছায়। আপনি হয়তো অনেক কিছুর মতোই এটাও ভুলে গেছেন, যখন আপনি ছিলেন পরিত্যাজ্য তখন আমি লোকচক্ষুর অন্তরালে আপনার কল্যাণীর নিবাসে গিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনার মাধ্যমে বুঝিয়েছি রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোকে কি করে আমরা গোপন সংগঠন গড়ে তুলবো, কি করে ধাপে ধাপে আপনাকে সবার অজান্তে বৈপ্লবিক পন্থায় শীর্ষ জাতীয় নেতার স্থানে অভিষিক্ত করে ‘৭১-এর চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়িত করবো। আমাদের নীতিআদর্শ এবং রাজনৈতিক কর্মসূচির প্রতি পূর্ণ আস্থা জ্ঞাপন করেই আপনি ওয়াদা করেছিলেন আমাদের একজন হয়ে লড়ে যাবেন আজীবন। কিন্তু অনেক ত্যাগ-তিতিক্ষা ও অক্লান্ত পরিশ্রমের দীর্ঘদিনের সংগ্রামে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে পর্বতসম জগদ্দল পাথর সরিয়ে আমরা যখন বিজয়ের দ্বার উন্মোচন করতে সমর্থ হলাম তখনই সেই সোপান দিয়েই উল্টো পথে চলার সিদ্ধান্ত নিলেন আপনি। দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সমঝোতার রাজনীতি করে জনগণের অধিকার অর্জন করা সম্ভব অতীতেও হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। সময় মতো এই সত্য আপনি বুঝতে পারবেন। স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার জন্য আপনি আমাদের বিদেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখার কৌশল অবলম্বন করছেন। কিন্তু সামরিক বাহিনীতে অস্থিতিশীলতার মূল কারণ সমূহ কিন্তু ৭ই নভেম্বরের পর আপনার নিজস্ব কর্মকাণ্ডগুলোই। বাস্তব সত্যটা আপনার কাছে এই মুহূর্তে মেনে নেয়া সম্ভব নয়। তবে অস্থিতিশীলতার যে অঙ্গার আপনি জ্বালিয়েছেন সেটা নিভে যাবার নয়। এর পরিণাম সম্পর্কে আপনার ধারণা কি সেটা আমার জানা নেই। তবে পরিণতিটা আপনার জন্য খুব একটা শুভ হবে বলে মনে হয় না। আপনি যাদের নিয়ে রাজনীতি করতে যাচ্ছেন তাদের বেশির ভাগই ক্ষমতালোলুপ। তাই সুধী সাবধান! সুবিধাবাদী সুযোগ সন্ধানীরা নিজস্ব স্বার্থের জন্য সব কিছুই করতে পারে। প্রয়োজনে পা চাটতে পারে আবার ঘাড়ও মটকাতে পারে। ছাত্রকাল থেকেই রাজনীতি করে এসেছি, তাই অভিজ্ঞতার আলোকেই কথাগুলো বলছি, কেতাবি কথা নয়। স্যার, ক্ষমতার শীর্ষে বসে মানুষের চরিত্র যাচাই করা সম্ভব নয়। চরিত্র যাচাইয়ের কষ্টি পাথর হচ্ছে দুঃসময় এবং সংগ্রামকাল। আপনি পরীক্ষিত সহযোদ্ধাদের প্রতিপক্ষ ভেবে নতুন করে যে সমস্ত আস্থাভাজন কিনে একত্রিত করছেন ক্ষমতার রাজনীতির স্বার্থে সেটা নীতির রাজা সর্বোৎকৃষ্ট গণমুখী রাজনীতির জন্য নয়। আপনার এই সমঝোতার রাজনীতিতে রয়েছে সমূহ বিপদের আশংকা। আমি আমার বক্তব্য শেষ করবো আপনাকে আশ্বস্ত করে, আমরা যে যেখানেই থাকি না কেনো দেশ ও জাতির স্বার্থেই কাজ করে যাবো, কোনও ব্যক্তিস্বার্থে নয়। সময় নিয়ে ধৈর্যের সাথে আমার বক্তব্য শুনলেন তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। কয়েকদিনের মধ্যেই দেশ ছেড়ে ফিরে যাবো বেনগাজীতে লন্ডন হয়ে। শিশু ভাইয়ের সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ থাকবে। তাই আমার গতিবিধি সম্পর্কে আপনি সবই জানতে পারবেন। চলি স্যার, আল্লাহ হাফেজ। বেরিয়ে এলাম তার অফিস থেকে।
ফারুকের দেশে আগমনের পর থেকে দেশ ছাড়ার আগ পর্যন্ত সময়ের বেশির ভাগই কেটেছে ক্যান্টনমেন্টে। মালিবাগ পৌঁছে দেখি নিকট আত্মীয়-স্বজন সবাই আমার জন্য একরাশ উৎকন্ঠায় উদগ্রীব হয়ে অপেক্ষা করছেন। কারণ, ওই সময় বাসা থেকে কাপড়-চোপড় ড্রাইভার দিয়ে আনিয়ে নিয়ে সংক্ষেপে মহুয়াকে বলতাম আমি নিরাপদেই আছি চিন্তার কারণ নেই। তারা সবাই জানতে চায় কর্নেল ফারুকের আসার পর পর্দার অন্তরালে কি ঘটেছে! আমাদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে কি সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছে! জটলার মধ্যে মহুয়াই বললো
স্যারকে একটু ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিতে দাও, তারপর সব শোনা যাবে।
ভাইয়া, তুমি এক্ষুনি লন্ডনে নিম্মির সাথে কথা বলো। বেচারি ভীষণ চিন্তিত অবস্থায় আছে।
হ্যাঁ, সেটাই করা উচিৎ। তুই ফোন মিলিয়ে আমাকে দে। মহুয়া ফোনে নিম্মির সাথে যোগাযোগ করে আমাকে রিসিভার দিলো। ফোনে নিম্মি প্রথম কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে বললো
তুমি কোথায় কি অবস্থায় আছ জানার জন্য যখনই ফোন করেছি, মহুয়া আর কেয়া বলেছে তুমি ক্যান্টনমেন্টে খুবই ব্যস্ত, তবে নিরাপদেই আছ। তাকে সান্ত্বনা দিয়ে আশ্বস্ত করে বললাম নিঃস্বার্থভাবে বৃহত্তর কোনও দায়িত্ব পালন করতে গেলে আল্লাহ্ই সহায় হন। এর প্রমাণ তো ২-৩রা নভেম্বর রাতেই তুমি পেয়েছো। রাত ১টায় বঙ্গভবনে তোমাকে বলেছিলাম, তুমি কোনও নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যাও, আমি নূরকে সাথে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে যাচ্ছি খালেদ ভাইয়ের সাথে আলোচনা করতে। বেঁচে থাকলে আবার দেখা হবে। আর তা না হলে আল্লাহ হাফেজ। তুমি দোয়া পড়ে আমাকে বলেছিলে, “তোমাকে আল্লাহ্র হাতে সোপর্দ করলাম তিনিই তোমাকে রক্ষা করবেন।’’ তোমার দোয়ায় আল্লাহর রহমতে ৩রা নভেম্বর অক্লান্ত পরিশ্রম করে দেশকে এক মহাবিপর্যয়ের হাত থেকে বাঁচিয়ে তোমার কাছেই ফিরে এসেছিলাম। লন্ডনে পৌঁছেই আমি কিন্তু আঁচ করতে পেরেছিলাম এমন একটা কিছু ঘটতে পারে। তাই জোর করা সত্ত্বেও তোমাকে ঢাকায় নিয়ে আসিনি। এসব এসে বলবো। জান, তোমাকে বিশ্বাস করতেই হবে তুমি পাশে না থাকলেও আমি জানতাম তোমার দোয়া রয়েছে। তাইতো ২-৩রা নভেম্বরের চেয়ে জটিল অবস্থার মোকাবেলা করতে পেরেছি। দু’চার দিনের মধ্যেই তোমার কাছে ফিরে আসছি ইন শাহ আল্লাহ। অতএব চিন্তার কোনও কারণ নেই। অন্য সবার সাথে এরপর সালাম এবং কুশল বিনিময় করে ফোন রেখে দিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢুকলাম গোসল করার জন্য। যেতে যেতে মাহবুবকে বললাম, দু’একদিনের মধ্যে আমার জন্য একটা সিট কনফার্ম করার জন্য। ইতিমধ্যে মহুয়া আর কেয়া দুপুরের খাবারের ব্যবস্থা করে টেবিলে সাজিয়ে দিয়েছে। সবাই মিলে খাবার পাট চুকালাম। মহুয়ার তত্ত্বাবধানে আমার প্রিয় ব্যঞ্জনে ভরা ছিল টেবিল। মহুয়া অত্যন্ত বুদ্ধিমতী, কম কথার মানুষ। কিন্তু সব ব্যাপারে তীক্ষ্ণ দৃষ্টি রেখে সবকিছু তদারকি করে। কেয়া কিছুটা চঞ্চল আর মুখরা। খাওয়ার পর যাবার আগে মাহবুব সবাইকে উদ্দেশ্য করে বললো
তোমরা স্যারকে একটু রেস্ট নেয়ার জন্য বাধ্য করার চেষ্টা কর। He has gone through extremely strenuous time all these days. সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলো মাহবুব।
সবাই মেঝেতে শুয়ে বসে গেঁজাচ্ছিলাম। হঠাৎ অতি আপনজন বন্ধুবর সাচৌ (বিচিত্রার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক) এসে উপস্থিত। কোথায় ডালিম, আওয়াজ দিয়ে ঘরে ঢুকে আমাকে দেখেই বললো
এক্ষুনি তোকে আমার সাথে এক জায়গায় যেতে হবে। তুই বাসায় ফিরেছিস খবরটা পেয়েই ছুটে এসেছি। উসকো খুসকো চুল, চোখে মোটা লেন্সের চশমা, শুকনো মুখ। বললাম
কোথায়?
কাপড় বদলে নে জলদি।
যাচ্ছি, বলে নিজের ঘরে গেলাম কাপড় বদলাতে।
বোঝাই যাচ্ছে আপনার দুপুরের খাওয়া হয়নি, আসুন একটু খেয়ে নিন।
ঠিক ধরেছিস। চল, বলে মহুয়ার সাথে সাচো খাবারের টেবিলে গিয়ে বসলো। ওর খাওয়া শেষ হওয়ার আগেই আমি রেডি হয়ে ওর কাছে এসে বললাম
তলবটা বেশ জরুরী মনে হচ্ছে?
গাড়ীতেই আলাপ হবে। খাবারের সময় কথা বলা সুন্নতের খেলাপ বলেই গোগ্রাসে খাওয়া শেষ করে কেয়ার কাছ থেকে একটা পান মুখে পুরে সিগারেট ধরিয়ে সবাইকে বললো
ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই ফিরে আসবো। আমার গাড়ীতেই যেতে হবে।
হুকুম মতো সাচোর গাড়ীতে উঠে বসলাম। সাচো গাড়ী চালাচ্ছিলো বেশ দ্রুতগতিতে। বুঝতে পারছিলাম কেউ কোথাও অপেক্ষা করছে।
কিরে, শারলক হোমসের এর মতো কোথায় নিয়ে চলেছিস বলতো?
জেনারেল মঞ্জুর তোর জন্য অপেক্ষা করছেন।
আশ্চর্য! কেনো?
পাকিস্তান আর্মির চৌকস অফিসার ‘গ্যুডেরিয়ান’ নামে খ্যাত জেনারেল মঞ্জুর তার ভারিক্কি ভাব বজায় রেখে জুনিয়র অফিসারদের সাথে তেমন একটা মিশতেন না। তার স্ত্রীতো তার চেয়েও এককাঠি সরস ছিল এই বিষয়ে। যুদ্ধকালে আমাদের অনেক পরে মেজর জিয়াউদ্দিন আর মেজর তাহেরকে সাথে নিয়ে শিয়ালকোটের ব্রিগেড মেজর সপরিবারে পালিয়ে এসে যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। কোয়েটা থেকে আমরা মেজর তাহেরকে সাথে নিয়েই পালানোর পরিকল্পনা করেছিলাম, কিন্তু হঠাৎ অপ্রত্যাশিত ভাবে তাকে এ্যাবোটাবাদ বদলি করে দেয়ায় তিনি আমাদের সাথে পালাতে পারেননি। এ সম্পর্কে ‘যা দেখেছি যা বুঝেছি যা করেছি’ তে বিশদভাবে লেখা রয়েছে। পরে যখন কর্নেল আবু ওসমানকে দুর্নীতির জন্য সেক্টর কমান্ডারের পদ থেকে সরিয়ে মেজর মঞ্জুরকে ৮নং সেক্টরের কমান্ডার বানানো হয়েছিলো তখন আমিও ঐ সেক্টরের গেরিলা এডভাইজার ছিলাম, কিন্তু তার সাথে তেমন একটা ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেনি। তিনি নিজেই যখন সবার কাছ থেকে দূরে সরে থাকতে ভালবাসতেন তখন আমরাও গায়ে পড়ে তার সাথে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করিনি। তিনি বরাবরই ক্যারিয়ার সম্পর্কে খুবই সচেতন থাকতেন। স্বাধীনতার পর থেকে ১৫ই আগস্ট পর্যন্ত সেনাবাহিনী এবং সরকারের মধ্যে যা কিছুই ঘটেছে তার থেকে তিনি সযত্নে নিজেকে সর্বদা সরিয়েই রেখেছেন। আস্থাভাজন হিসাবে স্বাধীনতার পর পরই তাকে ভারতে পাঠায় মুজিব সরকার মিলিটারি এট্যা’চে করে। এরপরও আমি তাকে ১৫ই আগস্টের পর ভারত থেকে ডাকিয়ে এনে বলেছিলাম
স্যার, এখানে আপনার প্রয়োজন। তাই দিল্লী থেকে আপনাকে ফিরিয়ে আনতে চাই। তিনি জবাবে তেমন কোন উৎসাহ দেখাননি। তার প্রতিক্রিয়ায় কিছুটা বিস্মিত হয়েছিলাম! পট পরিবর্তনের পর তোরা সবাইতো ডাকের অপেক্ষা না করে ছুটে এসেছিলি বিপ্লবকে সমর্থন করে। মুক্তিযোদ্ধা সংসদকে পুনর্গঠিত করার কাজে এবং বিভিন্ন দেশপ্রেমিক এবং প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল-গ্রুপ এর নেতা-নেত্রীদের সাথে দেশের ভবিষ্যৎ রাজনীতি নিয়ে আলোচনার জন্য যোগাযোগের ব্যাপারে তোর অবদান কম ছিল না। ৭ই নভেম্বরের পর ভারত থেকে ফিরে জেনারেল পদে উন্নীত হয়ে জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন CGS হঠাৎ আমাকে ডেকে পাঠালেন কেনো, কি প্রয়োজনে সেটাই ভাবছি!
সেটা আমারও জানা নেই তাই আমিও ভাবছি, গেলেই বোঝা যাবে। আমরা বনানীর একটা বাড়ীতে গিয়ে পৌঁছালাম। কার বাড়ি সেটা আমি জানতাম না।
‘৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে অনেকেই অনেক কথা বলার চেষ্টা করে চলেছেন। বিশেষ করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা নিয়ে। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এদের বেশীর ভাগ দিগগজ এবং বোদ্ধারা কিন্তু নিজেরা তেমনভাবে যুদ্ধের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন না। তাই তাদের শোনা কথা এবং কল্পকথায় স্বচ্ছতার যথেষ্ট বৈপরীত্য ধরা পড়ে। বর্তমান প্রজন্মের বেশিরভাগই সেই সময়ের ঘটনা প্রবাহ সম্পর্কে প্রায় কিছুই জানেন না বলেই এই সব অপপ্রচারে স্বাভাবিকভাবেই বিভ্রান্ত হয়ে পড়ছেন। এর জন্য দায়ী মুক্তিযোদ্ধারাই। বেশীরভাগ কমান্ডাররা যেকোনো সীমাবদ্ধতার কারণেই হোক মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে যোদ্ধাদের বৃহদাংশের সার্বিক মনোভাব প্রত্যাশা, ভবিষ্যতে কি ধরনের স্বাধীন বাংলাদেশ তাদের স্বপ্ন এবং কাম্য এ সম্পর্কে তেমন কোনও দলিল রেখে যেতে ব্যর্থ হয়েছেন। যারাই লিখেছেন তারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে যুদ্ধের কিছু কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনার বিবরণ সম্পর্কেই লিখেছেন যেখানে তারা ব্যক্তিগতভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। যুদ্ধের ঘটনাগুলো লিখে রাখাটা অবশ্যই প্রশংসনীয়, তবে তার চেয়েও বেশী তাদের লেখা উচিৎ ছিল জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আপামর জনগণের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা এবং স্বপ্ন বাস্তবায়ন সম্পর্কে মুক্তিযোদ্ধাদের মরণপণ অঙ্গীকার। যাকে বলা চলে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত চেতনা। আমি একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং Guerrilla Advisor to the Sector Commanders হিসেবে রণাঙ্গনের প্রতিপ্রান্তে ঘুরে মুক্তিযোদ্ধা, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণী এবং পেশা থেকে আগত আবাল বৃদ্ধ বণিতা, ইয়ুথ এবং শরণার্থী ক্যাম্পের অভিবাসী এবং সাধারণ জনগণের সাথে মিশে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা সম্পর্কে সংখ্যাগরিষ্ঠের ধারণা কি ছিল সেটা পাঠকদের কাছে বিশেষ করে নবীন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার চেষ্টা করছি।
হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করে শুধুমাত্র ভৌগোলিক স্বাধীনতা অর্জন করে একটি রাষ্ট্র, পতাকা এবং জাতীয় সঙ্গীতের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। সবারই প্রত্যাশা ছিল, রক্তের বদলে স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর নতুন যে বাংলাদেশের অভ্যুদয় হবে, সেটা গড়ে তুলতে হবে নতুন আঙ্গিকে। সেখানে থাকবে না মুষ্টিমেয় কায়েমী স্বার্থবাদীগোষ্ঠী এবং তাদের বিদেশী প্রভুদের আধিপত্য। তাদের সমাজ ও রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা বলয়, প্রশাসন, আইন-আদালত এবং রাষ্ট্রের সর্বস্তর থেকে সমূলে উপড়ে ফেলে তাদের ছুঁড়ে ফেলে দিতে হবে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে। একটি আত্মমর্যাদাশীল জাতি ও স্ব-নির্ভর, প্রগতিশীল, সমৃদ্ধশালী বাংলাদেশকে বিশ্বের মানচিত্রে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে ঐক্যবদ্ধ প্রচেষ্টায়। সংখ্যাগরিষ্ঠ নিপীড়িত বঞ্চিত জনগোষ্ঠীর ন্যায়সঙ্গত অধিকার নিশ্চিত করার মাধ্যমে একটি সুষম আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার সংগ্রামের মাধ্যমেই সৃষ্টি হবে ঐক্যবদ্ধ জনশক্তির। অগ্রণীর দায়িত্ব গ্রহণ করবেন পরীক্ষিত জনদরদী, নির্লোভ, আত্মত্যাগী, সাহসী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এবং সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা। ধর্মীয় মূল্যবোধ এবং জাতীয়তাবাদের প্রশ্নে তাদের হতে হবে আপোষহীন। বৈপ্লবিক পদক্ষেপ ছাড়া এই ধরনের বাংলাদেশ গড়ে তোলা কখনোই সম্ভব হবে না। বিগত কালের ঘুণে ধরা ক্ষয়িষ্ণু রাষ্ট্রীয় এবং সামাজিক পরিসরে আনতে হবে আমূল মৌলিক পরিবর্তন। তবেই প্রতিষ্ঠিত করা সম্ভব হবে জনগোষ্ঠীর ন্যায্য অধিকার। এই ধরনের একটি রাষ্ট্র এবং সমাজ গঠন তখনই সম্ভব হবে যখন দেশবাসীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং তাদের সৃজনশীল কর্মশক্তি এবং দক্ষতাকে কাজে লাগানোর পূর্ণসুযোগ ও সম-অধিকার নিশ্চিত করা হবে। প্রগতির পথে যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশকে নতুন আঙ্গিকে পুনর্গঠনের আর কোনও বিকল্প পথ নেই। এটাই ছিল ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং স্বপ্ন। স্বল্পকথায় জাতি চেয়েছিল এমন এক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করতে যেখানে তারা উপভোগ করবে আর্থ-সামাজিক পরিসরে সম-মর্যাদা, আইনের শাসন, জান ও মালের নিরাপত্তা, আদালত, প্রশাসন, শান্তি-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসমূহ থেকে নিরপেক্ষতা। সুখ ও শান্তির দেশ, যেখানে সর্বক্ষেত্রে শিকড় গাড়বে গণতান্ত্রিক এবং স্বকীয় মূল্যবোধ, সহনশীলতা, সহমর্মিতার ভিত্তিতে জাতীয়তাবাদী চেতনায় দেশকে প্রগতির পথে সমৃদ্ধশালী করে গড়ার ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের অঙ্গীকার।
কিন্তু এই চেতনা ও স্বপ্ন ছিল ভারতের স্বার্থবিরোধী। তাই তারা তাদের প্রসূত প্রবাসী সরকারের যোগসাজসে এই চেতনা এবং স্বপ্নের পরিপন্থী এক সুদূরপ্রসারী নীলনকশা প্রণয়ন করে বাংলাদেশকে ভারত নির্ভর একটি করদ রাজ্যে পরিণত করার লক্ষে। সেই পরিকল্পনার বিরোধিতার প্রত্যয় নিয়ে যুদ্ধকালীন সময়েই রাজনৈতিকভাবে সচেতন মুক্তিযোদ্ধারা যুদ্ধের আড়ালেই গড়ে তোলায় ব্রতী হয়েছিলেন একটি গোপন সংগঠন। স্বাধীনতার পর তাদের নিয়েই গড়ে তোলা বাংলাদেশ সামরিক বাহিনীতে সেই গোপন সংগঠনের নামকরণ করা হয় সেনা পরিষদ। যেকোনো জাতিকে আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হতে হলে তাদের অবশ্যই জানতে হবে নিজেদের ঐতিহ্য, সঠিক বস্তুনিষ্ঠ ইতিহাস, জানতে হবে তাদের সম্পদ, সম্ভাবনা এবং জাতীয় অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধকতাগুলো সম্পর্কে এবং সম্যক জ্ঞান থাকতে হবে শত্রু-মিত্র কারা। বিশেষ করে, দেশের সামরিক বাহিনীরও থাকতে হবে এই সমস্ত বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা। কারণ, সামরিক বাহিনী হচ্ছে যেকোনো দেশ এবং জাতির মেরুদণ্ড। ইতিহাস বিকৃতির জঘন্য প্রতিযোগিতায় একজন মুক্তিযোদ্ধা এবং বাংলাদেশ সামরিক বাহিনী গড়ে তোলার প্রক্রিয়ায় নিবেদিতপ্রাণ কর্মী হিসেবে নিজের অভিজ্ঞতার আলোকে কিছু তথ্য তুলে ধরছি পাঠকদের অবগতি জন্য।
বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর ইতিহাস
আমাদের দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনীর ইতিহাস তৃতীয় বিশ্বের অন্য যেকোনো দেশের সামরিক বাহিনীর মতো নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সামরিক বাহিনী গঠন করা হয় মূলত পরীক্ষিত জাতীয়তাবাদী দেশপ্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে। পরে তাতে যোগদান করেন মুক্তিপ্রাপ্ত প্রত্যাগত সেনা অফিসার আর সৈনিকরা। ফলে দেশের সামরিক বাহিনীর গুণগত মান ও শক্তি বৃদ্ধি পায়। প্রত্যাগতদের বেশিরভাগ সদস্যরাও ছিলেন জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত এবং ইসলামী মূল্যবোধে বিশ্বাসী। এই পরিপ্রেক্ষিতে অতি সহজেই সেনা পরিষদকে একটি নীতি-আদর্শ ভিত্তিক সংগঠন হিসাবে গড়ে তুলতে আমাদের বেগ পেতে হয়নি। একই ভাবে জাতীয় পরিসরে সামরিক বাহিনী তাদের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল করে তুলতে সক্ষম হয় প্রতিটি ক্রান্তিলগ্নে। প্রতিবারই সরকারের রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহৃত না হয়ে জনগণের ন্যায়সঙ্গত স্বার্থকেই সমর্থন করে এসেছিলো সাহসিকতার সাথে দেশপ্রেমিক সামরিক বাহিনী সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে। এই সাহসের উৎস ছিল নৈতিকতা এবং নিঃস্বার্থ নিখাদ দেশপ্রেম এবং জনদরদী মানসিকতা, ক্ষমতার লোভ নয়। দেশ ও জনকল্যাণের প্রশ্নে দেশের সামরিক বাহিনী ছিল আপোষহীন। তাই মুজিব সরকার ব্যর্থ হয়েছিলো সামরিক বাহিনীকে নিজস্ব লাঠিয়াল বাহিনীতে পরিণত করতে। মেজর জলিলকে যখন অন্যায় ভাবে গ্রেফতার করা হয় তখন অন্যায়ের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে সেনাবাহিনী। জেনারেল জিয়াকে সেনাবাহিনী থেকে যখন বের করে দেবার চেষ্টা করা হয় সেই ষড়যন্ত্রকেও রুখে দেয় সচেতন সেনাসদস্যরা। এরপর জিয়ার বয়োজ্যেষ্ঠতার রখেলাপ করে যখন শফিউল্লাহকে সেনাপ্রধান বানায় মুজিব সরকার তখনও গর্জে ওঠে সেনাবাহিনী সরকারের এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে। তীব্র উষ্মাকে প্রশমিত করার জন্য লেখকের মাধ্যমেই একটা সমঝোতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবর রহমান। সেনাবাহিনীর প্রস্তাবকে মেনে নিয়ে সরকারকে সৃষ্টি করতে হয়েছিল DCOAS পোস্ট আর তাতে নিয়োগ দিতে বাধ্য হয়েছিল সরকার জেনারেল জিয়াকে শফিউল্লাহর সম পদমর্যাদায় প্রধানমন্ত্রী কথা দিতে বাধ্য হয়েছিলেন শফিউল্লাহর দুই বছরের টার্ম শেষে জিয়াকেই আর্মি চীফের পদে অধিষ্ঠিত করা হবে। এর ফলেই, জিয়াকে শফিউল্লাহর অধীনস্থ স্টাফ অফিসারে পরিণত করার সরকারের অভীষ্ট লক্ষ্য ব্যর্থ হয়ে যায়। জেনারেল জিয়া তার স্বাতন্ত্র্য বজায় রেখে সেনাবাহিনীতে বহাল থাকতে সমর্থ হন সময়ের প্রতীক্ষায়। বিনীতভাবে উল্লেখ করছি, লেখক সেনা পরিষদের একজন নেতা হিসাবে এইক্ষেত্রে বিশেষ অবদান রেখেছিলো।
চোরাচালান রোধ, অবনতিশীল আইন-শৃঙ্খলা অবস্থার স্বাভাবিকীকরণ, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য যখনই বেসামরিক সরকারের সাহায্যে সামরিক বাহিনীকে সরকার তলব করে পাঠিয়েছে, প্রতিবারই নিরপেক্ষ কঠোর সাঁড়াশি অভিযানে সব অপকর্মের মূল অপরাধী হিসাবে ধরা পড়ে সরকার এবং সরকারী দলের প্রভাবশালী নেতা-নেত্রী, রুই-কাতলা এবং চাঁইরা। ফলে দলীয় চাপে সামরিক বাহিনীকে সফল অভিযানের পরও মাঝপথেই তাদের ব্যারাকে ফিরিয়ে নিয়ে নিজেদের দুর্বলতা ঢাকার অপচেষ্টা করতে হয়েছিলো প্রতিবারই প্রধানমন্ত্রীকে। পক্ষান্তরে সামরিক বাহিনীর গণমুখী দেশপ্রেম প্রমাণিত হয় দেশবাসীর কাছে। লাগামহীন দুর্নীতির ফলে তারা বুঝতে পারেন ‘শেয়ালের কাছে মুরগি বাকি’ পড়াতেই বিশ্বপরিসরে বাংলাদেশের পরিচয় হয়ে উঠেছিলো ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ হিসাবে। নৈতিক চরিত্রে বলিয়ান জাতীয় সামরিক বাহিনীকে বিশ্বাসযোগ্য না মনে করেই ভারতের প্ররোচনায় ভীত সন্ত্রস্ত মুজিব সরকার ভারতের সাহায্যে সামরিক বাহিনীর বিকল্প হিসাবে গড়ে তুলেছিলেন তার রাজনৈতিক ক্যাডার, কাদেরিয়া বাহিনী ও মুজিব বাহিনীর সদস্যদের নিয়ে কুখ্যাত ‘জাতীয় রক্ষীবাহিনী’। এ সমস্ত সত্যগুলো সম্পর্কে জানতে হবে বর্তমান এবং ভবিষৎ প্রজন্মকে। ইতিহাস বিশারদের জন্যও প্রয়োজন এই সমস্ত বস্তুনিষ্ঠ উপাদানগুলো যাতে করে তারা বাংলাদেশের সঠিক ইতিহাস লিখতে পারেন। সত্যভিত্তিক ইতিহাস এবং ঐতিহ্যই হচ্ছে যেকোনো জাতির অগ্রযাত্রার দিকনির্দেশক এবং প্রাণশক্তির উৎস। ১ম এবং ২য় বিশ্বযুদ্ধের পর সব কয়টি সাম্রাজ্যবাদী ঔপনিবেশিক শক্তি ধ্বংসের পর্যায়ে পৌঁছানোর পর পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে স্বাধীনতার দাবি প্রবলভাবে ছড়িয়ে পড়ে যা দমানোর মতো শক্তি এবং সামর্থ তাদের ছিল না। সেই প্রেক্ষাপটে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো তাদেরই সৃষ্ট স্থানীয় কায়েমী স্বার্থবাদী গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিত্বকারীদের স্বাধীনতার চ্যাম্পিয়ন বানিয়ে তাদের মাধ্যমে দাসখত লিখিয়ে নিয়ে নব্যস্বাধীন দেশগুলোর রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে বিদায় নেয়। তাদের প্রভুদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাতীয় শাসকগোষ্ঠী ক্রমান্বয়ে দেশের রাজনৈতিক প্রক্রিয়া, রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের প্রতিটি প্রতিষ্ঠান এবং আর্থসামাজিক ক্ষেত্রের সর্বস্তরে তাদের দোসরদের নিয়োগ করে দেশ ও জাতীয় সম্পদের ৯০% এর বেশি এবং উৎপাদনের উপাদানসমূহ তাদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলে এই শাসক ও শোষকগোষ্ঠী দেশের জনগোষ্ঠীর ১ থেকে ২ শতাংশের বেশি না হওয়া সত্ত্বেও আজঅব্দি তারাই হয়ে আছে দেশ ও জাতির কর্ণধার আর ৯৮% তাদের আর্থ-সামাজিক নাগপাশের নিষ্পেষণে পরিণত হয়ে রয়েছে বেঁচে থাকার ন্যূনতম অধিকার থেকে বঞ্চিত দাসে। এই সব রক্তচোষাদের অপশাসন, অবাধ দুর্নীতি, শোষণ এবং ক্ষমতার লোভে অসম চুক্তির মাধ্যমে জাতীয় সম্পদ বিদেশী প্রভুদের হাতে তুলে দিয়ে দেশগুলোকে শুধু দেউলিয়াই করে তোলা হচ্ছে তাই নয়, ক্রমান্বয়ে জাতির মেরুদণ্ডও ভেঙ্গে ফেলে দেশ এবং জাতিকে করে তোলা হচ্ছে সম্পূর্ণভাবে পরনির্ভরশীল। নিজস্ব সত্তা বিলীন হওয়ার চক্রান্তে জনগণের পক্ষে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনও সিদ্ধান্ত নেয়া সম্ভব হচ্ছে না এই দেশদ্রোহী গোষ্ঠীর বিপক্ষে। এই পরিপ্রেক্ষিতে পাতানো খেলার নির্বাচনের প্রহসন মূলক প্রক্রিয়ায় দেশ এবং জাতীয় উন্নয়নের কথা যারা সরবে উচ্চারণ করেন তারা সবাই ঐ গোষ্ঠীরই সমগোত্রীয় সেটা বলাই বাহুল্য। শেখ মুজিব প্রণীত ভাষাভিত্তিক বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদের দ্বারা জাতির মধ্যে সৃষ্টি করা হল বিভক্তি। সমাজতন্ত্রের ধুয়া তুলে রাষ্ট্রীয়করণের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেয়া হল দলীয় করণ ও অবাধ লুটপাটের জোয়ারে। গণতন্ত্রের বুলির আড়ালে ক্রমান্বয়ে মানবিক অধিকার, বাক-স্বাধীনতা, প্রচার মাধ্যমের স্বাধীনতা এবং বিচার বিভাগের স্বাধীনতাকে টুঁটি চেপে হত্যা করা হল সাংবিধানিক আইন তৈরির মাধ্যমে। যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশের পুনর্গঠনের জন্য আশাতীত আন্তর্জাতিক অনুদান এবং সাহায্য সহযোগিতার পরও মুজিবের স্বল্পকালীন শাসন আমলেই বাংলাদেশ বিশ্বপরিসরে ‘তলা বিহীন ঝুড়ি’ খেতাবে ভূষিত হয়। ১৯৭৪-এর লুটেরাদের সৃষ্ট দুর্ভিক্ষে প্রাণ হারাতে হয়েছিল অগুণতি অসহায় আবাল, বৃদ্ধ, বণিতাকে। বাসন্তীকে লজ্জা নিবারণ করতে হয়েছিলো মাছ ধরার জাল দিয়ে। দলীয়করণের ফলে নির্জীব হয়ে ভেঙ্গে পরে রাষ্ট্রীয় প্রশাসন। ধর্মনিরপেক্ষতার নামে সমাজে ধর্মহীনতার বীজরোপণ করে নৈতিকতার অবক্ষয়ের আত্মঘাতী সর্বনাশ ঘটিয়েছিলেন শেখ মুজিব। এই সমস্ত দেশ ও জাতীয় স্বার্থ বিরোধী পদক্ষেপের ফলে দেশ জুড়ে সৃষ্টি হয় এক সর্বনাশা নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি। মুজিবের কারচুপির মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার এবং রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায় দেশের সার্বিক পরিস্থিতি। এমনই ‘সোনার বাংলা’ই উপহার দিয়েছিলেন মুজিব জাতিকে তার শাসনকালে। এরপরও ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য তিনি সংবিধান পরিবর্তন করে দেশে প্রবর্তন করেন একদলীয় স্বৈরতান্ত্রিক বাকশাল। পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের পরিবর্তে দেশে চালু করেন প্রেসিডেন্সিয়াল ফর্মের গভর্নমেন্ট আর নিজেকে দেশের আজীবন রাষ্ট্রপতি হিসাবে ঘোষিত করার উদ্যোগ নেন। সেনা পরিষদের শীর্ষস্থানীয় নেতৃবৃন্দের আন্তরিক প্রচেষ্টায় দেশের জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন ক্ষেত্রের দেশপ্রেমিক নেতাকর্মী এবং রাজনৈতিকভাবে সচেতন বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, ব্যবসায়ী ও উচ্চপর্যায়ের সরকারি আমলা, সমাজপতিদের অনেকের কাছেই তারা বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। বিশ্বস্তজনদের সাথে আলোচনা করে দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে তাদের মনোভাব, বিশ্লেষণ এবং সরকার এবং সরকারী দলের অভ্যন্তরীণ অনেক গুরুত্বপূর্ণ খবর এবং তথ্য সংগ্রহ করতে সক্ষম হন সেনা পরিষদের নেতৃবৃন্দ। শুধু তাই নয়, আলোচনাকালে বেশিরভাগ জাতীয়তাবাদী রাজনৈতিক দলের বিশ্বস্ত নেতা-কর্মীরা অকপটে বলেছিলেন, এই স্বৈরতান্ত্রিক বাকশালী সরকারের পতন ঘটানোর দায়িত্ব স্বাভাবিকভাবে বর্তায় দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর উপর দুর্বার গণআন্দোলন গড়ে তোলার মাধ্যমে। কিন্তু সেই সময়ের বাস্তবতায় যেভাবে নৃশংসতার সাথে রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাসের নিষ্পেষণে সব বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোকে শক্তিহীন করে ফেলা হয়েছিলো সেই পরিপ্রেক্ষিতে সব রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টায়ও তখনকার সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করা কিছুতেই সম্ভব ছিল না। তারা বলেছিলেন, এই অবস্থায় একটি মাত্র পথেই বাকশাল সরকারের পতন ঘটানো সম্ভব যদি সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যরা দেশ ও জাতীয় স্বার্থে কোনও বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন তবে তাদের সেই উদ্যোগকে শুধু জাতীয়তাবাদী বিরোধী রাজনৈতিক দল, সংগঠন, গ্রুপই নয়, দেশের বৃহত্তর জনগোষ্ঠীও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সমর্থন জানাবেন। সেনা পরিষদের নেতারা গণসংযোগ করছিলেন বিশেষ সতর্কতা এবং গোপনীয়তা রক্ষা করে। এইভাবে অর্জিত তথ্য ও খবরাখবরের চুলচেরা বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করেই সেনা পরিষদের পক্ষে সম্ভব হয়েছিল ১৫ই আগস্টের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থানে অগ্রণীর ভূমিকা পালন করে মুজিব প্রণীত এক দলীয় বাকশালী স্বৈরশাসনের নাগপাশে আবদ্ধ শ্বাসরুদ্ধকর পরিস্থিতি থেকে জাতিকে মুক্ত করা। উন্মোচিত হয়েছিলো ‘৭১ এর চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের রুদ্ধ দুয়ার। সেই উন্মোচিত দুয়ারকে পুনরায় বন্ধ করে দেবার জন্যই ব্রিগেডিয়ার খালেদ এবং কর্নেল শাফায়াতকে ছকের গুঁটি হিসাবে ব্যবহার করে ভারতীয় ষড়যন্ত্রে ঘটানো হয়েছিলো ২-৩ নভেম্বরের প্রতিক্রিয়াশীল ক্যু’দাতা। কিন্তু সেই ষড়যন্ত্রকেও ব্যর্থ করে দেয়া হয়েছিলো ৭ই নভেম্বরের সিপাহী-জনতার বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে। এই বৈপ্লবিক অভ্যুত্থানেও অগ্রণী এবং মূলশক্তি ছিল সেনা পরিষদ। ৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লব দ্বিতীয় বারের মতো রুদ্ধদ্বার পুনরায় খুলে যায়। ধাপে ধাপে সেনা পরিষদের নীতি-আদর্শের আলোকে প্রণীত কর্মসূচির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের সুবর্ণ সুযোগ সৃষ্টি হয় আল্লাহ্তালার অসীম করুণায়। আমরা ভেবেছিলাম, দুর্গম চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে অনেক ত্যাগের মাধ্যমে বিপ্লবের পথে পাহাড়সম প্রতিবন্ধকতা শেখ মুজিবের স্বৈরচারী সরকার এবং কুচক্রী খালেদগংদের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটিয়ে সেনা পরিষদ যখন তাদের উৎখাত করতে সক্ষম হয়েছে তখন বাকি কর্মসূচি অতি সহজেই কার্যকরী করতে পারা যাবে। আমাদের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপান্তরিত করে তার ফসল পৌঁছে দেয়া সম্ভব হবে ৮ কোটি বাংলাদেশী নাগরিকের ঘরে ঘরে। এই সার্থকতায় শহীদ সহযোদ্ধাদের কাছে করা ওয়াদা পূরণ করাও সম্ভব হবে আমাদের পক্ষে।
কিন্তু জেনারেল জিয়ার অবিশ্বাস্য বিশ্বাসঘাতকতার জন্য ৭ই নভেম্বরের বিজয়ের পরই সেই আশা নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গের মতোই ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়! জেনারেল জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর পরে তিনি শুধু সেনা পরিষদের বৈপ্লবিক নীতি-আদর্শের সাথেই বিশ্বাসঘাতকতা করলেন তা নয়, তিনি আমাদের সাথে তার যে সম্পর্ক ছিল সেটাও অস্বীকার করতে কুণ্ঠিত হলেন না সমঝোতার রাজনীতির স্বার্থে। রাজনীতি এবং সমাজ বিজ্ঞানের ন্যূনতম জ্ঞানের অভাবে অর্বাচীন জেনারেল জিয়া এবং তার পরামর্শদাতারা ভেবেছিলেন কয়েক হাজার বিপ্লবী সেনা সদস্যদের হত্যা করলেই বৈপ্লবিক নীতি-আদর্শের মৃত্যু ঘটবে! বিপ্লবীরা মারা যায়, কিন্তু বিপ্লব মৃত্যুঞ্জয়ী, চিরঞ্জীব। রাজনৈতিক শাস্ত্রের এই প্রতিষ্ঠিত সত্য সম্পর্কেও তিনি ও তার দোসররা ছিলেন অজ্ঞ। ঔপনিবেশিক রাষ্ট্রীয় কাঠামো বজায় রেখে এবং তার সৃষ্ট কায়েমী স্বার্থবাদীদের সাথে সমঝোতা করে বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর কল্যাণ সাধন করা কোনও কালেই সম্ভব হয়নি। ঔপনিবেশিক শক্তিগুলোর পতনের পর স্বাধীনতা প্রাপ্ত রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে যে কয়েকটি রাষ্ট্রের জনগণ সত্যিকারের স্বাধীনতার স্বাদ উপভোগ করতে সক্ষম হয়েছেন তার মূল কারণ হচ্ছে, ঐ সমস্ত সদ্য স্বাধীন রাষ্ট্রগুলো পরিচালনা করার দায়িত্ব গ্রহণ করেছিলেন বলিষ্ঠ, পরীক্ষিত জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদবুদ্ধ আত্মত্যাগী দেশপ্রেমিক বিপ্লবীরা। তারা আপোষহীন বৈপ্লবিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ঘুণে ধরা রাষ্ট্রীয় অবকাঠামোকে সময়োপযোগী করে ঢেলে নতুন আঙ্গিকে গড়ে তুলেছিলেন সামন্তবাদের অবশেষ এবং মুৎসুদ্দিগোষ্ঠীকে ইতিহাসের আঁস্তাকুড়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে। একইভাবে তারা রাষ্ট্র এবং আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে নিয়ে আসেন বৈপ্লবিক আমূল পরিবর্তন যাতে প্রতিফলিত হয় দেশবাসীর আশা আকাঙ্ক্ষার। এরই ফলে প্রতিটি নাগরিক সক্ষম হন প্রকৃত স্বাধীনতার স্বাদ ভোগ করতে নিজস্ব মেধা এবং কর্মদক্ষতার বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার সমঅধিকার এবং সুযোগ নিশ্চিত করণের মাধ্যমে। এভাবেই স্বাধীনতা হয়ে ওঠে অর্থবহ এবং একই সাথে ঐক্যবদ্ধ জাতীয়তাবাদের শিকড় প্রোথিত হয় সমাজের সর্বস্তরে।
বাংলাদেশের জনগণের জন্য সেই সম্ভাবনার দ্বার আমরা উন্মোচিত করতে সক্ষম হয়েছিলাম সব বাধা পেরিয়ে কিন্তু চূড়ান্ত ভাবে বিপ্লবকে বিজয়ী করতে ব্যর্থ হলাম! যেদিন বাংলাদেশের সত্য ইতিহাস লেখা হবে, সেদিন ইতিহাসবিদরা বস্তুনিষ্ঠ তথ্য যাচাই করে নিশ্চয়ই বুঝতে পারবেন সেই পরাজয়ের জন্য দায়ী জেনারেল জিয়া। যুদ্ধকাল থেকে অপাংক্তেয় এবং অবহেলিত স্বাধীনতার ঘোষক জিয়াকে যেই বৈপ্লবিক শক্তি স্বাধীনতার পর সব প্রতিবন্ধকতা অপসারণ করে যেই ধারায় জেনারেল জিয়াকে আর্মি চীফ হিসেবে ক্ষমতার কেন্দ্রে পৌঁছাতে সক্ষম হয়েছিলো সেই ধারা সৃষ্টিকারী সহ-বিপ্লবীদের সাথে করা ওয়াদার বরখেলাপ না করে তাদের সাথে একাত্ম হয়ে নির্ধারিত নীতি-আদর্শ ভিত্তিক কর্মসূচি বাস্তবায়নে যদি তিনি আগুয়ান হতেন তবে বিপ্লবের লক্ষ্য হাসিল করার সম্ভাবনা ছিল সুনিশ্চিত। কিন্তু সঠিক পথ থেকে স্বেচ্ছায় জিয়া যখন নিজেকে সরিয়ে নিয়ে শুধুমাত্র ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য জাতীয় শত্রুদের সাথে সমঝোতার অসৎ রাজনীতির সূত্রপাত ঘটিয়ে ভুলপথে চলতে থাকলেন তখনই সাময়িকভাবে পরাজিত হল বিপ্লব এবং বিপ্লবীরা। দেশের মানুষকে বঞ্চিত করা হল সত্যিকারের স্বাধীনতার ফল ভোগ করার নিশ্চিত সম্ভাবনা থেকে। দেশের প্রধানমন্ত্রী ভারতের মানসকন্যা শেখ হাসিনা কিন্তু রাজনীতিতে আসার আগেই দুনিয়াকে জানান দিয়ে এসেছিলেন, ‘আমি রাজনীতিকে এবং বাংলাদেশের জনগণকে ঘৃণা করি, তারপরও আমি রাজনীতি করতে যাচ্ছি পিতৃহত্যার প্রতিশোধ নেবার জন্য’।
রক্তপিপাসু শেখ হাসিনা সেই প্রতিহিংসা সংবিধান এবং আইন বহির্ভূতভাবে মেটাতে সক্ষম হয়েছিলেন ২৮শে জানুয়ারী ২০১০ সালে ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের সফল বিপ্লবের নেতৃস্থানীয় ৫ জন বীরসেনানী কর্নেল ফারুক, কর্নেল শাহরিয়ার, কর্নেল মহিউদ্দিন, কর্নেল একেএম মহিউদ্দিনকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে এবং মেজর হুদাকে নির্মমভাবে গলা কেটে হত্যা করে। এদের সবাই ছিল অসীম সাহসী অকুতোভয় দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধা। বিশ্ববিবেকের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে হাসিনার পক্ষে এই নৃশংস হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়েছিলো খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন জোটের পরোক্ষ সমর্থনের কারণে। হাসিনার সেই বেআইনি কাজের বিরুদ্ধে মুখে কুলুপ এঁটে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সংসদে বসে থাকে জাতীয়তাবাদের চ্যাম্পিয়ন বিএনপি এবং ধর্মীয় মূল্যবোধের ধ্বজাধারী জামায়াতে ইসলামী ১২০ টিরও বেশি সিট নিয়ে এবং সংসদ থেকে কোন প্রতিবাদ না করে বেরিয়ে আসে। তারা বোধ করি ভুলে গিয়ে ছিল, নেকড়ে বাঘ আর ছাগল ছানাদের গল্পটি। এরপরও কথা থাকে। ২০০১ সালে দুই তৃতীয়াংশেরও বেশি সিটে জিতে ক্ষমতা গ্রহণ করে খালেদা জিয়ার জোট সরকার ‘অপারেশান ক্লিন হার্ট’ এর ব্যাপারে একটি সাংবিধানিক অব্যাহতি আইন পাস করে। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বর বিপ্লব সম্পর্কে যে সাংবিধানিক অব্যাহতি আইন পাস করা হয়েছিলো জেনারেল জিয়ার আমলের সংসদে যেটা ১৯৯৬ এর নির্বাচনে জিতে হাসিনার সরকার বেআইনি ভাবে বাতিল করে সফল বিপ্লবের নেতাদের বিরুদ্ধে ‘খুনের’ মামলা দায়ের ও প্রহসনমূলক বিচার শুরু করে যার ১নং আসামী ছিলেন রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমেদ এবং ২নং আসামী ছিলেন জেনারেল জিয়া, সেই বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ না করে উল্লেখিত অব্যাহতি আইনটি পুনর্বহাল করা থেকেও বিরত থাকে বেগম খালেদা জিয়ার জোট সরকার।
এরপরও প্রশ্ন থাকে, BDR Massacre-এর পর তাদের ভূমিকা কি ছিল? সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় এই ধরণের হত্যাযজ্ঞের পর কেনো এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী সরকার পতনের দুর্বার গণ আন্দোলন গড়ে তোলা হল না? একিভাবে খালেদার জোট নীরব ছিল বিডিআর হত্যাযজ্ঞের পরও তাই এখন যখন হিংস্র ও প্রতিহিংসা পরায়ণ হাসিনা এক স্বৈরতান্ত্রিক নায়িকাতন্ত্র কায়েম করে তাদের সমূলে উপড়ে ফেলার চেষ্টায় ভারতের সাহায্যে নির্দ্বিধায় মরিয়া হয়ে উঠেছেন এবং বিভিন্ন অঘোষিত চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে একটি করদ রাজ্যে প্রায় পরিণত করে ফেলার শেষপর্যায়ে পৌঁছেছেন তখন তারা ভারত সহ বিশ্ব দরবার এবং জনগণের কাছে নাকি কান্না কেঁদে তাদের বাঁচাতে আকুতি মিনতি করছেন, এমনকি দেশের সামরিক বাহিনীকেও মিনতি জানাচ্ছেন আকারে ইঙ্গিতে তাদের চামড়া বাঁচানোর জন্য। কিন্তু না জনগণ না দেশের সামরিক বাহিনী কিংবা ভারত এবং বিশ্ব মোড়লরা তাদের আবেদনে সাড়া দিচ্ছেন। এর কারণ হচ্ছে, আজ সবার কাছেই এইসব বর্ণচোরাদের আসল রূপ ধরা পড়ে গেছে। তারা এদেরকে ‘সিক্কার এপিঠ আর ওপিঠ’ ভাবছেন। এটাই হচ্ছে আল্লাহ্-র বিধান। যিনি জাতীয় শত্রু শেখ হাসিনাকে সমাদর করে দেশে ফিরিয়ে এনেছিলেন, সেই জেনারেল জিয়া ভুলের মাশুল গুণে হাসিনাকে ফিরিয়ে আনার মাত্র ১৩-১৪ দিনের মাথায় কবরে চলে যান মর্মান্তিক ভাবে। তার অনুসারী দোসররাও আজ সেই পথেরই পথিক। ব্যক্তি বিশেষের ভুলের মাশুল সবাইকেই দিতে হয়। কিন্তু ব্যক্তির ভুলের মাশুল আজ দিতে হচ্ছে পুরো দেশ আর জাতিকে এটাই প্রণিধানযোগ্য। এ প্রসঙ্গে ইতি টানার আগে একটি কথা পাঠকদের বলতে চাই, সাধারণ ভাবে বলা হয় বা প্রচারণা চালানো হয়ে থাকে, বিপ্লব মানে- বিদ্বেষ, হিংসা, সহিংসতা, মারামারি, কাটাকাটি, প্রতিহিংসামূলক রক্তক্ষরণ ইত্যাদি। কিন্তু বিপ্লবের আসল মানেটা তা নয়। বিপ্লবের মানে হচ্ছে, আপোষহীন ত্বরিত পরিবর্তন। আর সাচ্চা বিপ্লবীরা হচ্ছে সেই প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেয়ার কর্ণধার এবং ক্রিয়ানক।
জেনারেল মনজুরের সাথে বৈঠক
ভেতরে একটা কামরায় নিয়ে গেলেন এক ভদ্রলোক, তাকেও চিনি না। ঘরে ঢুকে দেখি সিভিল ড্রেসে জেনারেল মঞ্জুর বসে আছেন আমাদের অপেক্ষায়। পৌঁছে দিয়ে ভদ্রলোক রুম থেকে চলে গেলেন। কুশল বিনিময়ের পর জেনারেল মনজুর বললেন
ডালিম, ঢাকায় আসার পর তুমি অনেকের সাথেই দেখা করেছো, কিন্তু আমার সাথে দেখা করনি। তাতে আমি কষ্ট পেয়েছি। Sorry Sir, সময় ও সুযোগের অভাবে সেটা হয়ে ওঠেনি। তবে আপনি ডেকে পাঠালে নিশ্চয় দেখা করতাম। আপনি যাদের দিকে ইঙ্গিত করছেন তারা সবাই ডেকে পাঠাবার পরই দেখা করেছি। তাছাড়া মাহবুব জানালো আপনি খুবই ব্যস্ত থাকেন। তাই বিরক্ত করতে চাইনি।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সাথে সম্পূর্ণভাবে বিশ্বাসঘাতকতা আর একই সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিশ্চিহ্ন করার চক্রান্ত করছেন জিয়া। তারপরও তুমি তাকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসিয়ে রাখতে সাহায্য করলে কোন যুক্তিতে? কঠিন প্রশ্ন বটে!
স্যার, আমি যাই করে থাকি সেটা আমার একক সিদ্ধান্ত নয়, আমাদের সবার সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত সিদ্ধান্ত। তাছাড়া যাই করা হয়েছে সেটা অবশ্যই কোনও ব্যক্তিবিশেষের স্বার্থে করা হয়নি, সেটা করা হয়েছে দেশ ও জাতীয় স্বার্থে। এতে জিয়া যদি উপকৃত হয়ে থাকেন সেটা কখনোই আমাদের বিবেচ্য বিষয় ছিল না। যে কারণে ৩রা নভেম্বর আমরা দেশ ছেড়ে ব্যাংকক চলে গিয়েছিলাম ঠিক সেই কারণেই ফারুককে নিরস্ত্র করতে আমি তার সাথে কথা বলেছিলাম। আমার বক্তব্যকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেছিল বলেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে ফারুক ফিরে চলে গিয়েছিলো স্বেচ্ছায়। কারণটা আপনার মতো বুদ্ধিমান ব্যক্তির পক্ষে বুঝতে অসুবিধে হওয়ার কথা নয়। কিন্তু স্যার, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য এত দরদ থাকার পরও ৭ই নভেম্বরের পর জিয়া যে রকম ভাবে অমানুষিক নিষ্ঠুরতার সাথে মুক্তিযোদ্ধাদের নিধন করে চলেছেন সেইক্ষেত্রে আপনার মতো একজন সচেতন প্রভাবশালী CGS এর পক্ষে কোন কিছুই করার ছিল না কি? সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত আপনি সেই পদেই জিয়ার বিশেষ আস্থাভাজন পার্সোনাল স্টাফ অফিসার হিসাবে তার একজন মুখ্য পরামর্শদাতা হিসাবেই চাকুরি করে চলেছেন। আমি যদি আপনার জায়গাতে থাকতাম তবে আমি কিন্তু তার বিরুদ্ধে কোনও সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে না পারলেও এ ধরনের অন্যায় বরদাস্ত করে অন্তত চাকুরী করতাম না।
আমি উপায়হীন। সামরিক বাহিনীতে তোমাদের যেমন একটি সংগঠিত শক্তি রয়েছে সেটা আমার নেই। আমি জানি, সেই শক্তিই জিয়াকে ক্ষমতার কেন্দ্রে ৭ই নভেম্বরের পর পুনরায় অধিষ্ঠিত করেছিলো আর্মি চীফ হিসেবে। তাদের জোরেই জিয়া তাহেরকেও পরাস্ত করতে সক্ষম হয়েছিলো। এবার তোমরা যদি ফারুককে সমর্থন করতে তবে অতি সহজেই জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করতে পারতে। CGS হিসেবে আর্মির খবরাখবর আমি রাখি। তাই নিশ্চিত হয়েই আমি এটা বললাম। আর জিয়াকে ক্ষমতাচ্যুত করলে শুধু মুক্তিযোদ্ধারাই নয়, সামরিক বাহিনীর দেশপ্রেমিক বৃহত্তর অংশই তোমাদের সমর্থন করতো। আমার বিশ্বাস এটা তোমারও অজানা ছিল না। তারপরও তোমরা জিয়াকেই বাঁচিয়ে নবজীবন দান করলে?
আপনার মতো বুদ্ধিমানের জন্য বিস্তারিত জবাব না দিয়ে অল্প কথায় বলছি।
স্যার, ঘরের শত্রু বিভীষণকে মারতে গেলে পুরো ঘরটাই বিধ্বস্ত হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকে। ঠিক একই কারণে ৩রা নভেম্বর ব্রিগেডিয়ার খালেদের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী হয়েও প্রত্যক্ষভাবে তার মোকাবেলা না করে পরোক্ষভাবে তার মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। আমার এই ছোট্ট জবাবটা নিয়ে একটু চিন্তা করলেই সব কিছুই আপনার কাছে পরিষ্কার হয়ে যাবে। আপনি বুঝতে পারবেন তাহের এবং ফারুকের ক্ষেত্রে আমাদের অবস্থান সঠিক না বেঠিক। আপনাকে বিব্রত করার জন্য নয়, সাংগঠনিক শক্তির কথা বললেন তাই বলছি, ১৫ই আগস্টের পর আমি আমাদের পক্ষ থেকে কিন্তু আপনাকে দিল্লী থেকে ডেকে আনিয়েছিলাম এবং বলেছিলাম এখানে আপনার প্রয়োজন। কিন্তু আপনি ওই সাংগঠনিক শক্তির সাথে এক হয়ে কাজ করতে কোনও আগ্রহ প্রকাশ না করে দিল্লী ফিরে গিয়েছিলেন। এতে আমরা কিছুটা হতাশ এবং বিস্মিত হয়েছিলাম! তাছাড়া সব ক্রান্তিকালে চিহ্নিত কিছু লোকই সর্বদা অগ্রণীর ভূমিকা পালন করবে সেটাই বা যুক্তিসঙ্গত হয় কি করে? আপনি এবং আপনার মতো আরও অনেকেই তো ক্ষমতা বলয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে বহাল আছেন। আপনাদের পক্ষেও তো পথভ্রষ্ট নেতাকে সঠিক পথে ফিরিয়ে আনা কিংবা তাকে অপসারণ করে যোগ্য ব্যক্তিকে ক্ষমতার কেন্দ্রে বসানোর কাজটি খুব একটা কঠিন নয়। শুধুমাত্র চাকুরি না করে এই বিষয়টি নিয়ে আপনি গুরুত্বের সাথে ভাববেন সেটাই আমাদের প্রত্যাশা। যদিও বিশ্বাসঘাতকতা এবং চক্রান্তের ফলে বর্তমানে আমরা অনেকটাই দুর্বল তবুও কথা দিচ্ছি, দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে সময়োচিত যেকোনো সঠিক উদ্যোগে আপনার প্রতি আমাদের সমর্থন থাকবে। আমার মনে হয় এরপর আর আলোচনার কিছু নেই।
আমাদের সাথে যোগাযোগ থাকবে নিশ্চয়?
নিশ্চয়ই। ইচ্ছে থাকলে যোগাযোগের ক্ষেত্রে তো কোনও সমস্যা দেখছি না। স্যার, বিদায়ের আগে একটি কথা বলে যাই with no malice, personal interest or grievances যদি অনুমতি দেন।
বলো, অনুমতি দিলেন জেনারেল মঞ্জুর।
আজ আপনার সাথে খোলাখুলি আলাপের মাধ্যমে আপনার চিন্তাধারার কিছুটা হলেও জানতে পারলাম। দেশ এবং জাতীয় স্বার্থে আপনার দৃষ্টিভঙ্গির সাথে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির তেমন কোনও তফাৎ নেই। দিল্লীতে মিলিটারি এট্যাঁ’চে হিসাবে বছর দু’এক কাটিয়ে আসার পর আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন বাংলাদেশ সম্পর্কে তাদের মনোভাব এবং নীলনকশাটা কি। জিয়া কোন পথে হাঁটছেন সেটা ৭ই নভেম্বরের পর বুঝতে না পারলেও দেরিতে হলেও এখন আপনি পরিষ্কার বুঝতে পারছেন। এখনও সময় আছে দেশ এবং জাতিকে জিয়ার সর্বনাশা খেলার হাত থেকে বাঁচানোর। এবারের সংগ্রামে অগ্রণী হবার অবস্থাতে আমরা নেই। এবারের সংগ্রামে নেতৃত্ব দিতে হবে আপনাদেরকেই বিশেষ করে অগ্রণী হতে হবে আপনাকেই। আমরা আপনাদের সহায়ক শক্তি হিসেবে একাত্ম হয়ে লড়বো। ফারুক-রশিদও থাকবে আমাদের সাথেই। জিয়াকে কিছুতেই ভারতের সাথে সমঝোতার মাধ্যমে হাসিনাকে দেশে ডেকে এনে রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করতে দেয়া উচিৎ হবে না। যদি তিনি জাতির ইচ্ছার বিরুদ্ধে এই কাজটি করেন তখন জনগণের কাছে তার পরিচিতি প্রতিষ্ঠিত হবে ভারতের দালাল হিসাবে। সেটাই হবে জিয়াকে ক্ষমতা থেকে অপসারণের সঠিক সুযোগ। সত্যি করে বলতে গেলে বলতে হয়, আমরা আপনার সম্পর্কে বিশেষ কিছুই জানি না। রাজনৈতিকভাবে আপনি কতটুকু সচেতন সেটাও আমাদের জানা নেই। আপনার মানশিকতা, চিন্তা ভাবনা, মূল্যবোধ কিংবা আপনি কি ধরনের রাজনৈতিক আদর্শে বিশ্বাস করেন এর কিছুই আমাদের জানা নেই। তবু আমি আমাদের তরফ থেকে কেনো আপনাকে দিল্লী থেকে ডাকিয়ে এনেছিলাম জানেন কি? কারণটা ছিল, আপনার সম্পর্কে মাহবুব মানে আপনার ভাগ্নে যতটুকুই বলেছিলো তা থেকে আমাদের মনে হয়েছিলো আর কিছু না হলেও, আপনি একজন সাচ্চা দেশপ্রেমিক এবং গণমুখী জাতীয়তাবাদী মুক্তিযোদ্ধা। এই পদক্ষেপে মীর শওকত, নাসিম, হেলাল মোর্শেদ-এর মতো আওয়ামীলীগ পন্থী দু’চারজন মুক্তিযোদ্ধা অফিসার ছাড়া প্রায় অন্য সবারই সমর্থন পাওয়া যাবে। প্রত্যাগত অফিসারদের মধ্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা এখনও সুসংগঠিত নয়। তাই তারা কোনও ফ্যাক্টর হবে না সেই পদক্ষেপের বিরুদ্ধে। বরং বলতে পারি প্রত্যাগতদের বেশিরভাগই সাপোর্ট করবে। সামরিক বাহিনীর সৈনিক এবং অফিসারদের বৃহদংশের সমর্থনও সুনিশ্চিত। আমরা ৩২ জন সিনিয়র অফিসারকে বের করে দেবার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম শুধুমাত্র দুর্নীতির দায়ে, ঠিক সে ভাবেই এরশাদসহ ভারত এবং আওয়ামীলীগ পন্থী চরিত্রহীন, দুর্নীতি পরায়ণ অফিসারদের বের করে দিতে হবে। এরপর যদি আমাদের আর্মিতে ফিরিয়ে আনা হয় আমরা অতি সহজেই আগামি ২০ বছরের জন্য পরীক্ষিত অফিসারদের বেছে ইউনিট পর্যায় পর্যন্ত Chain of Command তৈরি করে নিতে সক্ষম হবো। দুই বছরের মধ্যে এই কাজটা শেষ করে আমরা চাকুরি ছেড়ে আমাদের সুচিন্তিত নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি ভিত্তিক দেশব্যাপী সংগঠন গড়ে তুলবো। দেশে থাকবে মাত্র তিনটি সমমনা দল। আমাদের দল ছাড়া, একটি খন্দকার মোশতাকের, অন্যটি হবে ইসলাম ভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসীদের জন্য। আমাদের রাজনীতির ভিত্তি হবে ইসলামিক মূল্যবোধ এবং বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদ। বর্তমানের সংবিধানে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন এনে তার উপর রেফারেন্ডাম নেবে পরিবর্তনের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। রেফারেন্ডামে গৃহীত সংবিধানের আওতার বাইরে কোনও রাজনৈতিক দলের অস্তিত্ব থাকবে না। এর জন্য দেশের সব কয়টি দেশপ্রেমিক এবং জাতীয়তাবাদী দল গ্রুপের নেতা-নেত্রীদের সাথে আমাদের কথা হয়েছে। তারা সবাই ভারতের মোকাবেলায় দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করে প্রগতির পথে এগিয়ে যাবার এটাই একমাত্র পথ মনে করে সমর্থন দিতে রাজি আছেন। তারাও মনে করেন অবাধ গণতন্ত্রের নামে মাছের বাজার নয়, সাংবিধানিক সীমিত গণতন্ত্রের মাধ্যমেই সম্ভব একটি পশ্চাদপদ অনুন্নত দেশকে স্বনির্ভর গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি রাষ্ট্র হিসাবে গড়ে তোলা। পটপরিবর্তনের পর ইচ্ছে হলে আপনি আমদের গড়া রাজনৈতিক দলে যোগ দিতে পারেন ইউনিফর্ম ছেড়ে। সেনাবাহিনীর পূর্ণ সমর্থন পেলে আমাদের দলই হবে সবচেয়ে জনপ্রিয় দল। কিন্তু এখানে প্রধান বিবেচ্য বিষয় হল, জিয়ার রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা পাবার আগেই এই পরিকল্পনা কার্যকরী করতে হবে। একবার যদি হাসিনাকে আনিয়ে তিনি রাজনৈতিক গ্রহণযোগ্যতা অর্জনে সক্ষম হন, তবে তাকে ক্ষমতাচ্যুত করা সামরিক কিংবা রাজনৈতিক কোনোভাবেই সম্ভব হবে না সহসা। সেটা জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক ভাবে গ্রহণীয়ও হবে না। বিষয়টি যদি যুক্তিসঙ্গত মনে করেন তবে সতর্কতার সাথে দ্রুত বাস্তবায়নের দিকে এগুবার এখনই সময়। জিয়াও দ্রুত এগুচ্ছেন তার পথে সেটাতো বুঝতেই পারছেন। তাই আপনাকে দ্রুততর হতে হবে। একমাত্র এইভাবেই আমাদের পক্ষে সম্ভব হবে অতীতের সব ভুল-ভ্রান্তি আর রক্তক্ষরণের পরও আমাদের চেতনা আর স্বপ্নকে বাস্তবে রূপদান করা। অন্য আর কোনও পথ নেই। সাহসিকতার সাথে নিঃস্বার্থ হয়ে বৃহত্তর জনস্বার্থে এগুলে বিজয় আল্লাহ্পাক আপনাকে দেবেন ইন শাহ আল্লাহ। শেষ কথা, বর্তমানে আপনিই হচ্ছেন জিয়ার রাহুর গ্রাস থেকে দেশ ও জাতিকে বাঁচানোর শেষ অবলম্বন। সময় থাকতে উপযুক্ত উদ্যোগ না নিলে আপনি এবং অন্য যারা এখনো ক্ষমতা বলয় মানে আর্মিতে রয়েছেন তাদের অবস্থাও হবে আমাদেরই মতো কিংবা এর চেয়েও শোচনীয়। বিশেষ করে আপনাকে আর্মিতে রাখবেন না জিয়া এটা আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি। আমরা জিয়ার জন্য এতো কিছু করেও তার টার্গেটে পরিণত হয়েছি। কিন্তু কিছু না করলেও আপনি তার টার্গেট হবেন। Have no misgiving about that, Sir. কর্নেল জিয়াউদ্দিন, কর্নেল তাহের এবং মেজর জলিলকে অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছিলাম আমাদের স্বতন্ত্র জাতীয় সত্তার মূল হচ্ছে ধর্মীয় মূল্যবোধ। কিন্তু সমাজতন্ত্রের ভূতের প্রভাবে তারা সেটা বুঝতে পারেননি। ইসলাম শুধু মাত্র একটি ধর্ম নয়, ঐশ্বরিক পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। মার্ক্সসিজম ধনতন্ত্রের একটি এন্টি-থিসিস। তাই চিরস্থায়ী কোনও দর্শন নয়। সময়ের সাথে এরও বিলুপ্তি ঘটবে সমাজ বিজ্ঞানের মৌলিক তত্ত্ব অনুযায়ী। সাম্যবাদ আর সমাজতন্ত্র কোনও মৌলিক দর্শন নয়, এগুলোও প্রতিক্রিয়াশীল তত্ত্ব। তাই ক্ষণস্থায়ী। তাছাড়া ইসলামের সাথে সাম্যবাদ এবং সমাজতন্ত্রের কোনও বিরোধ নেই। তারা বিপথগামী না হলে জিয়ার পক্ষে আমাদের শক্তিকে এভাবে খর্ব করা কোনোক্রমেই সম্ভব হতো না। ভবিষ্যতে আপনি কি করবেন সেটা নিতান্তই আপনার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত। তবে যাই করবেন সেটা করতে হবে খুবই সতর্কতার সাথে। আমি শুধু আমার সীমিত জ্ঞানে কিছু চিন্তার খোরাক দিয়ে গেলাম। পরিশেষে, আপনাকে একটি কথা জানিয়ে যাচ্ছি, ১৫ই আগস্ট এবং ৭ই নভেম্বরের ঘটনা কোনও তাৎক্ষণিক বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। এর পেছনে রয়েছে যুদ্ধকালীন সময় থেকে সুচিন্তিত রাজনৈতিক নীতি-আদর্শ এবং কর্মসূচি ভিত্তিক গোপন প্রচেষ্টা। সেই প্রচেষ্টাতে আপনাকে সামিল করানোর চেষ্টা করে আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম। আপনি আমাকে সেই সুযোগ দেননি। সেটা স্ব-ইচ্ছায় না আমার ইঙ্গিত না বুঝে সেটা বলা সম্ভব নয়। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, ১৫ই আগস্টের পর আপনাকে ডেকে আনার পরও আপনি আমাদের একজন হয়ে কাজ করতে তেমন কোনও আগ্রহ প্রকাশ করেননি।
ডেকে পাঠানোর জন্য আন্তরিক ধন্যবাদ জানবেন। এই ধরণের বৈঠক আগে হলে অনেক ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো সম্ভব হতো। তবে সবকিছুই ঘটে আল্লাহর ইচ্ছায়। দেরিতে হলেও আজকের বৈঠকের জন্য আল্লাহ্ পাকের শুকরিয়া অবশ্যই আমাদের আদায় করতে হবে। আল্লাহ্ দেশ ও জাতীয় বৃহত্তর স্বার্থে আপনার সহায় হউন সেই দোয়া করবো। সেনাসদরে একটা জাতসাপের ঝাঁপিতে রয়েছেন, সেটা সবসময় মনে রেখে আপনাকে চলতে হবে। শওকত, এরশাদ, নাসিম, নুরুদ্দিন, মহব্বতজান চৌধুরী, মচ্ছু সালাম, হেলাল মোর্শেদ, মইনুল হোসেন চৌধুরী, আমিনুল হককে কোনোভাবেই বিশ্বাস করবেন না। এরা সবাই জিয়ার চোখ আর কান। বুকে বুক মিলিয়ে বিদায় নিয়ে চলে এসেছিলাম। সাচো নীরব সাক্ষী হয়েছিল পুরোটা সময়। বেরিয়ে এসে গাড়ীতে বসে বলেছিলো দোস্ত, তুই আজ আমাকে অবাক করে দিয়েছিস! এতো স্পষ্ট করে জোরালো যৌক্তিকতার সাথে নির্ভীকভাবে জেনারেল মঞ্জুরকে যা বলে এলি এর প্রশংসা না করে পারছি না। আমার বিশ্বাস, তিনি তোর বক্তব্যকে গুরুত্বের সাথেই বিবেচনা করবেন। বাসায় নামিয়ে দিয়ে সাচো চলে গেলো। সন্ধ্যায় মাহবুব এসে জানালো, দু’দিন পর আমার ফ্লাইট কনফার্ম করা হয়েছে।
স্যার, মামা আপনাকে ডেকেছিলেন?
ডাকটা কি তোমার কেরামতি নাকি? আমার কথার উত্তরে মাহবুব কিছু না বলে তার অতিপরিচিত মৃদু হাসিটাই হাসলো। হ্যাঁ, এইমাত্র ফিরলাম তার সাথে বনানীর এক বাড়িতে দীর্ঘ আলাপ করে। আলাপের বিষয়ে তুমি কিছুই জানতে চাইবে না, কারণ মামাই সেটা ভাগ্নেকে বলবেন। জবাবটা দেবার পর দুইজনই জোরে হেসে উঠলাম।
আচ্ছা স্যার, একটা প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাচ্ছিনা। ৭ই নভেম্বরের পর বিপ্লবীরা জিয়াকে সেনাপ্রধানের পদে বসানোর পর জিয়া জনাব খন্দকার মোশতাককে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণের অনুরোধ করেন কিন্ত মোশতাক তার অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছিলেন কেনো?
জবাবটা খুঁজে পাবার জন্য পর্দার আড়ালের কিছু তথ্য তোমাকে জানতে হবে। ব্রিগেডিয়ার খালেদ বিরোধী বৈপ্লবিক অভ্যুথানের সব সিদ্ধান্ত নেয়া হয় ব্রিগেডিয়ার খালেদের সাথে আমাদের বোঝাপড়ার পর বঙ্গভবনে কর্নেল তাহেরের সাথে এক রুদ্ধদ্বার বৈঠকে। সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়, সফল অভ্যুত্থানের পর জিয়াকে মুক্ত করে চীফের পদে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হবে। তারপর জিয়া আমাদের ফিরিয়ে আনবেন সেনাবাহিনীতে। একই সাথে জিয়াই অনুরোধ জানাবেন খন্দকার মোশতাকে পুনরায় রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করতে। এভাবেই আগস্ট বিপ্লবের চেতনা ও ধারাকে এগিয়ে নেবার পথ নিশ্চিত করা হবে। তাহের সেইসব সিদ্ধান্ত মেনে নেন। বৈঠকে এটাও নির্ধারণ করা হয় সেনা পরিষদের প্রবাসী নেতারা সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখবেন কর্নেল তাহের এবং দেশের সব কয়েকটি সেনানিবাসে সেনা পরিষদের নেতাদের সাথে। বাস্তব অবস্থার নিরিখে অনুকূল সময়ে পর্যালোচনার পর প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা গ্রহণের পরই যৌথ সিদ্ধান্তের মাধ্যমে বিপ্লব সংগঠিত করা হবে। এভাবেই ঘটানো হয়েছিল ৭ই নভেম্বরের সফল বৈপ্লবিক অভ্যুত্থান যা পরে পরিণত হয়েছিল স্বতঃস্ফূর্ত সিপাহী-জনতার বিপ্লবে। দেশত্যাগের আগেই এই সিদ্ধান্তগুলো প্রতিটি সেনানিবাসের সেনা পরিষদের ইউনিট কমান্ডারদের জানিয়ে দেয়া হয়েছিলো।
সেই বৈঠকেই প্রণীত হয়েছিলো কিভাবে কন সময় খালেদ-চক্রকে উৎখাত করা হবে সেনা পরিষদ এবং তাহেরের বিপ্লবী সংস্থার যৌথ উদ্যোগে। আমরা জানতাম, দেশ ছেড়ে চলে যাবার পর খালেদ-চক্র নিজেরাই তাদের প্রো-আওয়ামী-বাকশালী স্বরূপটি প্রকাশ করে বিপ্লবের সুযোগটা সৃষ্টি করে দেবে। আর সেটাই হবে উপযুক্ত সময় বৈপ্লবিক সেনা অভ্যুত্থান ঘটানোর। বৈঠকে গৃহীত পূর্ব সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জিয়া সেনা পরিষদের নির্দেশেই খন্দকার মোশতাককে অনুরোধ জানাতে বাধ্য হয়েছিলেন। জবাবে জনাব খন্দকার মোশতাক জিয়াকে বলেন, কালবিলম্ব না করে ব্যাংকক থেকে আমাদের আর্মিতে ফিরিয়ে আনতে। আমরা ফিরলেই তিনি আবার রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব গ্রহণ করবেন, তার আগে নয় সেটাও তিনি জিয়াকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু জিয়া তাকে বলেছিলেন, আমাদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তার কিছু সময়ের প্রয়োজন। তার এই জবাবকে যুক্তিসঙ্গত মনে করেননি তীক্ষ্ণ বুদ্ধির অধিকারী খন্দকার মোশতাক। তার মনে সন্দেহের উদ্রেক হয় তিনি বুঝতে পারেন জিয়ার মনে অন্য কন অভিলাষ গজিয়ে উঠেছে। খন্দকার মোশতাক একজন প্রবীণ ঝানু রাজনীতিবিদ।
১৫ই আগস্টের পর The Time ম্যাগাজিন তার সম্পর্কে একটি স্পেশাল প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে রাজনৈতিক প্রজ্ঞা এবং বিচক্ষণতার বিচারে তাকে ভারতের রাষ্ট্রপতি লালবাহাদুর শাস্ত্রীর উপরে স্থান দেয়। আমরা যুদ্ধকাল থেকেই তার রুশ-ভারত বিরোধী অবস্থান সম্পর্কে বিশেষভাবে অবগত ছিলাম। তাছাড়া তিনি আব্বার সহপাঠী ছিলেন। তাই পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী তার সাথে আলোচনার পরই তাকে রাষ্ট্রপতি বানিয়ে আওয়ামী-বাকশালীদের বৃহদংশকে নিজেদের প্রভাব বলয়ে এনে বাকশাল এর মেরুদণ্ড ভেঙ্গে সারাবিশ্বে প্রমাণিত করতে সমর্থ হয়েছিলাম যে শুধু দেশবাসীই নয়, বাকশালের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশও মুজিবের এক দলীয় বাকশালী স্বৈরতন্ত্রকে মেনে নেয়নি। কিন্তু মুজিবের নিষ্পেষণের ভয়ে তারা প্রতিবাদ করতে পারেননি। খন্দকার মোশতাককে রাষ্ট্রপতি বানানোর জন্যই গণচীন, সৌদি আরব, পাকিস্তান সহ পৃথিবীর প্রায় সবদেশের স্বীকৃতি পাওয়া সম্ভব হয়েছিলো। যার ফলে, সোভিয়েত ইউনিয়ন সমর্থিত ভারত বাংলাদেশে সামরিক অভিযানের সিদ্ধান্ত নিয়েও পরে আমেরিকা এবং গণচীনের হুমকির মুখে সেই সিদ্ধান্ত বাতিল করতে বাধ্য হয়। জিয়ার মনোভাব আমাদের জানাবার পর আলোচনার মাধ্যমেই খন্দকার মোশতাক নিজের রাজনৈতিক ভবিষ্যৎকে ঝুঁকির মধ্যে না ফেলে জিয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলেন সাংবিধানিক জটিলতার অজুহাত দেখিয়ে।
I am simply baffled to see the maturity of you all compared to ages. Thank you very much Sir, for sharing so many sensitive information in details. বলেই মাহবুব আমাকে জড়িয়ে ধরে বলল সব মহলেই আপনি একজন নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমিক, স্পষ্টবাদী, সাহসী, আপোষহীন, বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে পরিচিত। কিন্তু আপনার রাজনৈতিক সচেতনতা এবং জ্ঞান যে এতো গভীর সেটা আমিও বুঝতে পারিনি কাছের মানুষ হয়েও। কিছুটা লেখাপড়া আর কিছুটা ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এর বেশী কিছুই নয়।
এরপর দেশত্যাগ করার আগ পর্যন্ত সময়টা আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধব আর ঘনিষ্ঠজনদের সাথে দেখা সাক্ষাত করে আনন্দেই কেটে গেলো। শিশুভাইয়ের সাথে দেখা করতে গেলে তিনি আমাকে বলেছিলেন
ডালিম, তুমি আবারও জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দেশ ও জাতির স্বার্থে যে অবদান লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে গেলে একদিন জাতি নিশ্চয় তার স্বীকৃতি দেবে। My hats off to you বলে আমাকে উষ্ণ আন্তরিকতায় জড়িয়ে ধরে বিদায় জানালেন। ধরা গলায় বললেন, জানিনা আবার কবে তোমার সাথে দেখা হবে। তবে দোয়া রইলো যেখানেই থাকো আল্লাহ্ তোমার সহায় হউন, ফিরে গিয়ে বাকি সবাইকে আমার ভালবাসা আর দোয়া জানিও।
আপনি যেভাবে আমার খেয়াল রাখলেন স্নেহের ছায়ার আচ্ছাদনে পুরোটা সময় সেটার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে আপনাকে ছোট করবো না।তবে জীবনে কখনও ভুলবো না আপনার এই নিঃস্বার্থ স্নেহ-ভালোবাসার ঋণ। ফিরে গিয়ে সবাইকে বলবো সবকিছুই। You are really great, too good to be true! আমাদের নাবালক ভাই! দু’জনেই হেসে উঠলাম।

Next