This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
জামায়াতের জন্ম ও উত্থান
জামায়াত-শিবিরের প্রকৃত চেহারায় ষড়যন্ত্রের ৪০ বছর
দীর্ঘ লড়াই-আন্দোলন এবং অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে ১৯৭১ সালে অর্জিত মহান বিজয়ের ৪০ বছরের সুদীর্ঘ পথ পেরিয়ে এসেছে। বাংলাদেশ। একাত্তরের স্বাধীনতাবিরােধী সেই অপশক্তির বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তবে ইতােমধ্যেই প্রশ্ন উঠেছে, স্বাধীন-সার্বভৌম একটি দেশে মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কেন এই দীর্ঘসূত্রতা? কীভাবে সম্ভব হলাে মূলধারার রাজনীতিতে দেশবিরােধীদের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ? মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রতিহত করার জন্য কোন ষড়যন্ত্রে ক্ষিপ্ত হয়েছে তারা?
জামায়াতের জন্ম
কট্টর সাম্প্রদায়িক ও ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক দলের লেবাস। নিয়ে জামায়াতে ইসলামী’ নামের রাজনৈতিক দলটির আবির্ভাব ঘটে। ১৯৪১ সালে। প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরপরই তারা ভারতীয় উপমহাদেশে (বাংলাদেশ, পাকিস্তান, ভারত, শ্রীলংকা) এবং আফগানিস্তানে তাদের ধর্মান্ধ কার্যক্রম বিস্তৃত করে। তবে বর্তমানে প্রধানত বাংলাদেশ ও পাকিস্তানেই এই দলের রাজনৈতিক তৎপরতা লক্ষ করা যায়। জামায়াত প্রচলিত আধুনিক গণতান্ত্রিক ধারার অনুসারী রাজনৈতিক দলের দাবিদার হলেও দলটির মূল লক্ষ্য হলাে, প্রশিক্ষিত নেতা-কর্মীসমর্থকদের সমন্বয়ে কট্টর ইসলামী রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। জামায়াত সে অভীষ্ট লক্ষ্য সাধনেই ক্রমশ অগ্রসর হচ্ছে। জামায়াতে ইসলামী প্রতিষ্ঠার পর বিগত প্রায় সত্তর বছরের অধিককাল ধরে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের অন্তরালে দলটি ফ্যাসিবাদ ও কট্টর। সাম্প্রদায়িকতা অনুসরণ, জঙ্গি লালন ও মদদদান, কাদিয়ানিবিরােধী সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সৃষ্টি, প্রতিপক্ষ রাজনীতিকদের হত্যা, হাত-পায়ের রগকাটা, কোরান হাদিসের ভুল ব্যাখ্যা ও মনগড়া মতবাদ প্রচার, ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টি এবং রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের সুবিধাবাদী অবস্থান গ্রহণ করে দেশে-বিদেশে বিতর্কিত হয়েছে। এর মধ্যে জামায়াত বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে পাকিস্তানের দোসর ও স্বাধীনতাবিরােধী হিসেবে সবচেয়ে ন্যাক্কারজনক ভূমিকা পালন করেছে। একাত্তরে জামায়াতের স্বাধীনতাবিরােধী ভূমিকা ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের বিরােধিতা করেই জামায়াত ক্ষান্ত থাকেনি, দলটি মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছিল। ‘৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে গণহত্যা, বুদ্ধিজীবী হত্যা, মুক্তিবাহিনীদের ধরিয়ে দেওয়া, ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণ, লুটতরাজের মতাে মানবতাবিরােধী। কর্মকাণ্ডের সাথে দলটির জড়িত থাকার বিষয়টি সর্বজনবিদিত। মুক্তিযুদ্ধকালে রাজাকার, আলবদর, আল শামস নামে তারা সশস্ত্র বাহিনীতে সম্পৃক্ত থেকে দখলদার হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া বিগত বছরসমূহে দেশবাসী একাত্তরের ঘাতক-দালাল ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সােচ্চার হয়ে ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে বিগত নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোটের অন্যতম প্রধান অঙ্গীকার ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করা। দায়িত্ব গ্রহণের পর বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিক আইন অনুসরণ করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করলে অভিযুক্ত জামায়াত-শিবির দেশব্যাপী অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির প্রয়াস শুরু করেছে। জামায়াত-শিবিরচক্র কথিত ইসলামী বিপ্লবের নামে বাংলাদেশকে জঙ্গি তালেবানি রাষ্ট্রে পরিণত করার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বর্তমান মুহূর্তে ধর্মীয় রাজনীতি নিষিদ্ধ প্রতিরােধের ধুয়া তুলে জামায়াত অপরাপর মৌলবাদী উগ্র ধর্মান্ধ রাজনৈতিক দলগুলােকে ঐক্যবদ্ধ করে সরকারের বিরুদ্ধে মাঠে নামানাের প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে।
মুক্তিযুদ্ধকালে জামায়াতের কর্মকাণ্ড
১৯৭০-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে সমগ্র পাকিস্তানে। সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে জয়ী হলেও সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুর কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি ও সামরিক হস্তক্ষেপের প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকে। এ সময় বাংলাদেশের সমগ্র জনগােষ্ঠী আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের স্বাধিকারের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হলেও জামায়াত এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। ২৫ মার্চ ১৯৭১ সালে ‘অপারেশন সার্চ লাইট’ নামে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী এ দেশে গণহত্যা শুরু করলে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। এরপর দখলদার বাহিনীর সাথে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে জামায়াত পাকহানাদার বাহিনীর পক্ষ নেয়। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান জামায়াতের আমির গােলাম আযম গভর্নর জেনারেল টিক্কা খানের সাথে দেখা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গণহত্যা, লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগসহ মানবতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের প্রতি সমর্থন ব্যক্ত করে। ৯ এপ্রিল ১৯৭১ পাকিস্তান বাহিনীর সহযােগী ১৪০ সদস্যের কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির ৩ নম্বর সদস্য হিসেবে জামায়াত নেতা গােলাম আযম সকল কার্যক্রমে সহযােগিতা দান করে। জামায়াতে ইসলামী ও তাদের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের নেতা-কর্মীরা রাজাকার, আলবদর ও আল-শামস বাহিনী গঠন করে। জামায়াতে ইসলামীর বর্তমান নায়েবে আমির ইউসুফ আলী ২৫ মে ১৯৭১ খুলনার শাহজাহান আলী রােডে আনসার ক্যাম্পে ৯৬ জুন জামায়াত ইসলামী ও ছাত্র সংঘ কর্মীকে নিয়ে প্রথম রাজাকার বাহিনী গঠন করে। (সূত্র: ঘাতকের দিনলিপি, লেখক: রমেন বিশ্বাস, ১৯৭৩)। এরপর পাকিস্তান বাহিনীর পরাজয় অত্যাসন্ন ভেবে অধ্যাপক গােলাম আম ২২ নভেম্বর ১৯৭১ পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। পাক বাহিনীর পরাজয়ের পূর্বক্ষণে ১৪ ডিসেম্বর আল-বদর বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে প্রায় দুইশ বুদ্ধিজীবী অপহরণের পর নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তান বাহিনীর দোসর রাজাকার বাহিনী গঠনে গােলাম আযম, আব্বাস আলী খান, মাওলানা মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মুজাহিদ, মীর কাশেম আলী, কামারুজ্জামান, আশরাফুজ্জামান খান, এবিএম মালেক মজুমদার প্রমুখ জামায়াত ইসলামী ও ছাত্র সংঘ নেতৃবৃন্দ অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। নয় মাসের মুক্তিসংগ্রামের সময়ে গোলাম আযম তার বিভিন্ন বক্তব্যভাষণে বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত বাংলাদেশ এবং মুক্তিবাহিনীকে ‘ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী-দুষ্কৃতকারী হিসেবে আখ্যায়িত করে । মুক্তিযুদ্ধকালে অধ্যাপক গােলাম আযম এবং সংগঠনটির বর্তমান আমির ও সাবেক ইসলামী ছাত্র সংঘ নেতা মতিউর রহমান নিজামীসহ অন্যান্য নেতৃবৃন্দের কিছু বক্তব্য ও কার্যক্রমে নিচে তুলে ধরা হলাে:
এক
২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী ঢাকায় গণহত্যা শুরুর পর ৬ এপ্রিল ১৯৭১ গোলাম আযম ‘বেলুচিস্তানের কসাই’ খ্যাত গভর্নর টিক্কা খানের সাথে সাক্ষাৎ করে পাকিস্তান বাহিনীর অভিযানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ও তার দলের পক্ষ থেকে সব ধরনের সহযােগিতার আশ্বাস দেয় (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান ৭ এপ্রিল, ১৯৭১)।
দুই
১৯ জুন ১৯৭১ গোলাম আযম তদানীন্তন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার সাথে সাক্ষাৎ করে পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনার ব্যাপারে কিছু প্রস্তাব সুপারিশ প্রদান করে। ২০ জুন ১৯৭১ লাহােরে সংবাদ সম্মেলনে গোলাম আযম জানায়, পাকিস্তানী সেনাবাহিনী সকল দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) উৎখাত করছে।’ গোলাম আযম মুক্তিবাহিনীকে মােকাবিলার জন্য সরকারের কাছে অস্ত্র সরবরাহের দাবি জানায় (সূত্র: একাত্তরের ঘাতকদের কেন বিচার চাই, আমান-উদ-দৌলা, পৃষ্ঠা ৪২ এবং দৈনিক সংগ্রাম, ২১ জুন, ১৯৭১) তিন ৩১ আগস্ট ১৯৭১ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলের এক অনুষ্ঠানে গােলাম আযম বলে, কোনাে ভালাে মুসলমান তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলন সমর্থন করতে পারে না (সূত্র: সাপ্তাহিক বিচিত্র, ১৭ এপ্রিল, চার ১২ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ঢাকার এক অনুষ্ঠানে গোলাম আযম মুক্তিবাহিনীকে সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করার আহ্বান জানায় (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৩ সেপ্টেম্বর, ১৯৭১)। পাঁচ ১৯৭১ সালে ঢাকার মােহাম্মদপুর ফিজিক্যাল ট্রেনিং কলেজ ছিল আল বদর বাহিনীর হেড কোয়ার্টার এবং রাজাকার বাহিনীর প্রশিক্ষণ কেন্দ্র। ১৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ গোলাম আযম উক্ত কেন্দ্র পরিদর্শনকালে রাজাকার-আলবদরদের উদ্দেশ্যে বলে, রাজাকার-আলবদররা পাকিস্তান ও ইসলামে অবিশ্বাসী দুশমনদের (মুক্তিযােদ্ধাদের ঐক্যবদ্ধভাবে মােকাবিলা করবে (সূত্র: দৈনিক সংগ্রাম, ১৮ সেপ্টেম্বর ১৯৭১)।
২৫ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ঢাকার এম্পেয়ার হােটলে জামায়াতের কর্মীসভায় গােলাম আযম বলে, পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই জামায়াতে ইসলামী শান্তি কমিটি এবং রাজাকার বাহিনীতে যােগ দিয়েছে। (সূত্র: দৈনিক পাকিস্তান, ২৬ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ এবং ‘৭১ ঘাতক-দালালদের বক্তৃতা বিবৃতি, সাইদুজ্জামান রওশন) ।
১৫
সাত
বাংলাদেশ জামায়াতের বর্তমান আমির ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মতিউর রহমান নিজামী ১০ এপ্রিল ১৯৭১ এক বিবৃতিতে বলে, ভারত পাকিস্তানে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী (মুক্তিযােদ্ধা) পাঠিয়ে অভ্যন্তরীণ সমস্যার সৃষ্টি করেছে। স্বাধীন বাংলা আন্দোলন পাকিস্তানকে গােলামে পরিণত করার ষড়যন্ত্র ছাড়া আর কিছুই নয় (সূত্র: ঘাতকের দিনলিপি, রমেন বিশ্বাস)।
আট
১৪ নভেম্বর ১৯৭১ দৈনিক সংগ্রামে প্রকাশিত এক নিবন্ধে জামায়াতের বর্তমান আমির মতিউর রহমান নিজামী লেখে, পাকিস্তানি বাহিনীকে সহযােগিতার জন্য আলবদর বাহিনী গঠিত হয়েছে। পাক সশস্ত্র বাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে আলবদর বাহিনী তথাকথিত মুক্তিবাহিনীকে পর্যুদস্ত করবে (সূত্র: একাত্তরের ঘাতকদের েবিচার চাই, আমান-উদ-দৌলা, পৃষ্ঠা ৪৯)। নয়। জামায়াতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক সংগ্রাম ১৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ ‘আলবদর দিবসে প্রকাশিত এক নিবন্ধে উল্লেখ করে, যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী সেখানেই আলবদর। ভারতীয় অনুপ্রবেশকারী। দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযোদ্ধা) জন্য আলবদর বাহিনী হচ্ছে সাক্ষাৎ আজরাইল’ (সূত্র: ঘাতকের দিনলিপি, পৃষ্ঠা ১৮৪)।
জামায়াতের তৎপরতাঃ ১৯৭২-১৯৭৫
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ স্বাধীন বাংলাদেশের বিজয় অর্জিত হলে পাক বাহিনীর দোসর ও দালাল জামায়াতের বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী গ্রেফতার হয় এবং রাজাকার ও আলবদর ক্যাডারদের একাংশ আত্মগোপনে চলে যায়। প্রত্যক্ষভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করা, যুদ্ধাপরাধে জড়িত থাকা এবং সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ হবার ফলে দলীয় কার্যক্রম প্রকাশ্যে বন্ধ থাকলেও জামায়াত এ সময়ে ওয়াজ মাহফিল, তাফসির মাহফিল, তবলিগ জামাতে সম্পৃক্ত থেকে নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। এ সময়ে গােলাম আযম এবং বিভিন্ন দেশে নির্বাসিত জামায়াত নেতারা সংঘবদ্ধভাবে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিতে মধ্যপ্রাচ্যসহ মুসলিম বিশ্বে প্রচার চালাতে থাকে। ১৯৭২-এর জানুয়ারিতে গােলাম আযম পাকিস্তানে অবস্থান করে পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার সপ্তাহ পালন করে। বাংলাদেশ সরকার ১৯৭২ সালে গােলাম আযমের নাগরিকত্ব বাতিল করে। গােলাম আযম পাকিস্তান থেকে ১৯৭২ সালে হজ করতে সৌদি আরবে যায় এবং ডিসেম্বরে রিয়াদে অনুষ্ঠিত ‘মুসলিম যুব সংস্থা’র আন্তর্জাতিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান পুনঃপ্রতিষ্ঠার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার জন্য সারা বিশ্বের মুসলমানদের আহ্বান জানায়। গােলাম আযম ১৯৭২ সালে সৌদি আরব, দুবাই, আবুধাবি, কুয়েত, বৈরুত, লিবিয়া হয়ে ১৯৭৩ সালের এপ্রিলে লন্ডন গমন করে এবং উল্লিখিত দেশসমূহে বাংলাদেশবিরােধী প্রচারণা চালায়। লন্ডনে বসে গােলাম আযম বাংলাদেশবিরােধী কার্যক্রম চালিয়ে যায়। এ সময় তার তত্ত্বাবধানে জামায়াতের মুখপত্র সংগ্রাম পত্রিকা লন্ডন থেকে সাপ্তাহিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। অন্যদিকে ১৯৭২-এর পর থেকে বিভিন্ন সময়ে গােলাম আযম লন্ডন, মধ্যপ্রাচ্য ও পাকিস্তানে অবস্থান করে “পূর্ব পাকিস্তান উদ্ধারের নামে বাংলাদেশবিরােধী তৎপরতায় নিয়ােজিত থাকে। ১৯৭৩ সালের মার্চে লিবিয়ার বেনগাজিতে অনুষ্ঠিত ইসলামী পররাষ্ট্র সম্মেলনে আমিত না হয়েও গােলাম আযম সেখানে উপস্থিত হয় এবং স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ার কার্যক্রম চালিয়ে যায়। একই বছর জুলাই মাসে গােলাম আযম বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে ‘গােলামির জিঞ্জির’ বলে উল্লেখ করে এর পুনরুদ্ধারে ইসলামী উম্মাহর সাহায্য কামনা করে। ১৯৭৩-এর পর গোলাম আযম মােট সাত বার সৌদি বাদশাহ ফয়সালের। সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেবার অনুরােধ করে। সে সময় থেকে সৌদি শাসকদের সাথে জামায়াতের একটি সুসম্পর্ক প্রতিষ্ঠিত হয়।
জিয়াউর রহমানের আমলে জামায়াতের অপতৎপরতা
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যার পর এ দেশে আবার পাকিস্তানি স্টাইলের রাজনীতি প্রবর্তিত হয়। ১৯৭৬ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান দালাল আইন বাতিল করেন এবং হাজার হাজার কারাবন্দি জামায়াত ও পাকিস্তান বাহিনীর দালালদের জেল থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়। ১৯৭৬ সালে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘােষিত হলে জামায়াতের নেতা মওলানা রহিমের নেতৃত্বে জামায়াত ও কয়েকটি দক্ষিণপন্থী ইসলামী দলের নেতারা একত্র হয়ে ইসলামিক ডেমােক্রেটিক লীগ (আইডিএল) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করে। নবগঠিত আইডিএল দলের ছত্রছায়ায় জামায়াতের ক্যাডাররা। নিজেদের সংগঠিত করতে থাকে। কিন্তু মওলানা রহিমের সাথে কট্টর জামায়াতিদের দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হলে মওলানা রহিম আইডিএল থেকে বেরিয়ে যান। এ সময়ে লন্ডনে অবস্থানকারী গােলাম আযম ১৯৭৬, ১৯৭৭ ও ১৯৭৮ সালে তিন দফায় তার নাগরিকত্ব ফিরে পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন করে। ২০ মার্চ ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশ। সরকার তাকে নাগরিকত্ব প্রদানে অস্বীকৃতি জানায়। ১১ জুলাই ১৯৭৮ গােলাম আযম পাকিস্তানি পাসপাের্টে তিন মাসের ভিসা নিয়ে অসুস্থ মাকে দেখতে বাংলাদেশে আসে। তিন মাসের ভিসার মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও গোলাম আযম বাংলাদেশে অবস্থান করে এবং দেশজুড়ে গোপন সফর কর্মসূচিতে দলকে সংগঠিত করতে থাকে। ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ১৯৭৯ ঢাকায় তিন দিনের সম্মেলনে জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ দলের আত্মপ্রকাশ ঘটে এবং গােলাম আযমকে গােপনে আমির নির্বাচিত করা হয় নাগরিকত্ব লাভ সাপেক্ষে। দলের ভারপ্রাপ্ত আমির নির্বাচিত হয় আব্বাস আলী খান। ফেব্রুয়ারি ১৯৮০ থেকে জামায়াতে ইসলামী তৎকালীন জিয়া সরকারের মদদ ও পৃষ্ঠপােষকতায় দেশব্যাপী জোরালাে তৎপরতার মাধ্যমে দলকে দৃঢ় সাংগঠনিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করাতে সমর্থ হয়। এ সময়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতৃত্বে গোলাম আযমের নাগরিকত্ব পুনর্বহাল কমিটি’ দেশব্যাপী ব্যাপক কার্যক্রম পরিচালনা করে। ৭ ডিসেম্বর ১৯৮০ জামায়াতের প্রথম সংবাদ সম্মেলনে দলের ভারপ্রাপ্ত আমির আব্বাস আলী খান বলে, ‘১৯৭১ সালে দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য যা করেছি ঠিকই করেছি। ভারতীয় আগ্রাসন থেকে জনগণকে হেফাজত করার জন্য কাজ করেছি।’ তার এ ধরনের ঔদ্ধতৃপূর্ণ বক্তব্যের পর মুক্তিযােদ্ধা সংসদ দেশব্যাপী ‘রাজাকার প্রতিরােধ সপ্তাহ’ কর্মসূচি পালনকালে রংপুরে জামায়াতের সন্ত্রাসীরা মুক্তিযােদ্ধা অফিস আক্রমণ করে। ২৯ মার্চ ১৯৮১ আব্বাস আলী খান সংবাদ সম্মেলনে আবারাে বলে, ‘১৯৭১ সালে। আমরা যা করেছি তা ঠিকই করেছি এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের কনসেপ্ট সঠিক ছিল না। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি তার এ ধরনের অবজ্ঞাসূচক বক্তব্য দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় তােলে এবং অনেক স্থানে মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে জামায়াত কর্মীদের সংঘাত-সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে।
এরশাদের আমলে জামায়াতের ভূমিকা
১৯৮২ সালে তদানীন্তন সেনাপ্রধান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ রক্তপাতহীন এক অভুত্থানের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন। ১৯৮৬ সালে তৃতীয় সংসদ নির্বাচন বিএনপি বর্জন করলেও জামায়াত নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে কয়েকটি আসনে জয়লাভে সমর্থ হয়। অবশেষে ১৯৮৮ সালে আওয়ামী লীগ সংসদ থেকে পদত্যাগ করলে এ সময় জামায়াতও সংসদ থেকে পদত্যাগ করে এবং এরশাদবিরােধী আন্দোলনে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সাথে যুগপৎ কর্মসূচি পালন করতে থাকে। তঙ্কালীন রাষ্ট্রপতি এরশাদ সরকারের আমলে জামায়াত-শিবির অনেকটা অপ্রতিরােধ্য অবস্থায় দলকে গুছিয়ে নেয় এবং সারা দেশে শক্তিশালী সাংগঠনিক অবস্থান দাঁড় করাতে সমর্থ হয়।
১৯৯১-১৯৯৬ সালে জামায়াতের তৎপরতা
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেবার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য একাত্তরের স্বাধীনতাবিরােধী চক্রের সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধাবােধ করেননি তিনি। এরশাদ সরকারের পতনের পর ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে বিএনপির সাথে একাত্ম হয়ে ৮৪টি আসনে বিএনপি প্রার্থীদের সমর্থনে জামায়াত তাদের নিজেদের প্রার্থীদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরিয়ে নেয়। ফলে নির্বাচনে বিএনপি ১৩৮ আসনে জয়ী হলে জামায়াত ১৭ আসনে বিজয়ী হয়ে সরকার গঠনে বিএনপিকে সমর্থন দিয়ে সংসদের সংরক্ষিত নারী আসনের দুটি সংসদ সদস্য পদ লাভ করে। এ ঘটনার মধ্য দিয়ে আবারাে জামায়াতের সুবিধাবাদী চরিত্রের বহিঃপ্রকাশ সকলের কাছে প্রতিভাত হয়। ১৯৯২ সালে গােলাম আযম আদালতের রায়ে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ফিরে পেলে প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড শুরু করে। স্বাধীন বাংলাদেশের বিরােধিতাকারী গােলাম আযম জামায়াতের আমির নিযুক্ত হলে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এ সময় শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয় এবং ১৯৭১এর যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে দেশব্যাপী আন্দোলন তুঙ্গে ওঠে। ২৬ মার্চ ১৯৯২ গণআদালতে গােলাম আযমকে ফাসির প্রতীকী রায়। দেওয়া হয়। ১৯৯১-১৯৯৬ সালে বিএনপি সরকারের পৃষ্ঠপােষকতায় সারা দেশে
২০
জামায়াতের সাংগঠনিক কার্যক্রমের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। বিএনপি ক্ষমতা আঁকড়ে থাকার জন্য ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৯৬ প্রহসনের নির্বাচন দিলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দেশব্যাপী ব্যাপক গণআন্দোলন সৃষ্টি হলে জামায়াত বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে জনগণের সহানুভূতি অর্জনের প্রয়াস চালাতে থাকে। এভাবে জামায়াত বার বার নিজেদের সুবিধামতাে রাজনৈতিক অবস্থান পরিবর্তন করে দেশের রাজনীতিতে নিজেদের প্রতিষ্ঠিত করার প্রয়াস অব্যাহত রাখে।
আওয়ামী লীগ আমলে (১৯৯৬-২০০১) জামায়াতের ভূমিকা
দীর্ঘ একুশ বছর পর ১৯৯৬ সালে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের সরকার গঠনের বিষয়টি জামায়াতকে ভাবিয়ে তােলে। জামায়াত আবারাে অতীতের মতাে নিজ মূর্তিতে আবির্ভূত হয়। এ সময়ে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারকে ‘ভারতের দালাল’ এবং ইসলামবিরােধী শক্তি’ আখ্যা দিয়ে জামায়াত প্রচারণা চালাতে থাকে। আওয়ামী লীগ সরকারকে বেকায়দায় ফেলার লক্ষ্যে দেশব্যাপী জামায়াতি ক্যাডাররা নানা রকম নাশকতা চালাতে থাকে। ইসলামী ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে এককালে যুক্ত শেখ আব্দুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই এবং আফগান যুদ্ধফেরত হুজি নেতা মুফতি হান্নান প্রমুখ কট্টর তালেবানপন্থী নেতারা গােপনে বিভিন্ন সশস্ত্র জঙ্গি বাহিনী গঠন করে। জঙ্গিরা কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জীবননাশের চেষ্টা চালায়। তারা রমনা বটমূলে নববর্ষের অনুষ্ঠানে, সিনেমা হলে, মাজার-দরগাহ-গির্জায় বােমাবাজি, জবাই করে মানুষ হত্যার মতাে নৃশংসতায় মেতে ওঠে। জঙ্গিরা দিন দিন বেশি মাত্রায় তৎপরতা জোরদার করতে থাকলেও জামায়াতি নেতারা এগুলােকে আওয়ামী লীগের ইসলামবিদ্বেষী প্রচারণা বলে জঙ্গিদের আড়াল করার প্রয়াস চালাতে থাকে। এ সময়ে জামায়াত নেতা মাওলানা দেলাওয়ার হােসাইন সাঈদী দেশজুড়ে তাফসির মাহফিলের নামে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের প্রগতিশীল রাজনৈতিক দল ও তাদের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিষােদগার এবং ধর্মনিরপেক্ষ মতবাদকে ‘কুফুরি মতবাদ’ আখ্যা দিয়ে উগ্র জ্বালাময়ী বক্তব্যের মাধ্যমে সরলপ্রাণ ধর্মপ্রাণ যুবসমাজকে উগ্রবাদী হতে উজ্জীবিত করতে থাকে। তার ওয়াজ মাহফিলে অনুপ্রাণিত হয়ে অনেকে শেখ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে জেএমবি জঙ্গি দলে সম্পৃক্ত হয়ে কথিত জেহাদি কার্যক্রমে অংশ নেয়। বলে পরবর্তীকালে গ্রেফতারকৃতদের কেউ কেউ স্বীকারােক্তি দিয়েছে। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে জামায়াতের সুযােগ-সুবিধা ২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্যজোট মিলিত হয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে নির্বাচিত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে জামায়াতে ১৮ আসন জয়লাভ করে। ২০০১ সালে অষ্টম সংসদ নির্বাচনে চারদলীয় জোট সরকার গঠন করলে জামায়াতের আমির মতিউর রহমান নিজামী শিল্পমন্ত্রী ও সেক্রেটারি। জেনারেল আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ সমাজকল্যাণ মন্ত্রী হিসেবে মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত হয়। স্বাধীনতার পর চারদলীয় জোট সরকারের মেয়াদকালে (২০০১-২০০৬) জামায়াত-শিবির দলকে গোছানাের জন্য। সবচেয়ে বেশি সুযোগ পায়। এ সময়ে তাদের দুজন মন্ত্রীর সুবাদে জামায়াতিরা সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরিলাভ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে দলীয় শিক্ষক নিয়ােগ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে নিয়ােগসহ রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে নিযুক্ত ও অনুপ্রবেশে সমর্থ হয়। চারদলীয় জোট সরকারের আমলে শেখ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে জেএমবি দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রকাশ্যে এবং গােপনে সশস্ত্র জঙ্গি তৎপরতা জোরালােভাবে শুরু করে। দেশি-বিদেশি প্রচার মাধ্যমে জঙ্গি তৎপরতার সংবাদ প্রকাশিত হলেও জামায়াত বরাবরই দেশে জঙ্গিবাদের অস্তিত্ব নেই বলে জঙ্গিদের আড়াল করে এবং নিরাপদে তাদের কার্যক্রম পরিচালনার সুযােগ করে দেয়। জামায়াতের আমির নিজামী ২২ জুলাই
২০০৪ সংবাদমাধ্যমে সাক্ষাৎকারে জেএমবির দ্বিতীয় শীর্ষ নেতা বাংলাভাই মিডিয়ার সৃষ্টি’ বলে আখ্যায়িত করে। এ সময়ে জামায়াত জঙ্গিদের আড়াল ও রক্ষা করতে সর্বাত্মক প্রয়াস চালাতে থাকে। অবশেষে ১৭ আগস্ট ২০০৪ দেশজুড়ে ৬৩ জেলায় একযােগে বােমা হামলা করা হয় এবং পরে গাজীপুর, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম, ঝালকাঠিতে বিচারালয়ে বােমা মেরে পুলিশ-বিচারক ও আইনজীবী হত্যা করা হয়। জেএমবি নেতা শেখ আব্দুর রহমান ও বাংলা ভাইকে ধরিয়ে দিতে চারদলীয় জোট সরকার ৫০ লক্ষ টাকা পুরস্কার ঘােষণা করে। পরবর্তী সময়ে র্যাব ব্যাপকভিত্তিক অভিযান চালিয়ে জেএমবির শীর্ষ নেতাদের গ্রেফতারে সমর্থ হয়। জঙ্গি সম্পৃক্ততার পাশাপাশি জামায়াতের সশস্ত্র ক্যাডাররা চারদলীয় জোট সরকারের আমলে সারা দেশে নৃশংসতা চালিয়েছে। এ সময়ে জামায়াতের হাতে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের অনেকেই প্রাণ হারিয়েছে । চট্টগ্রামের সাতকানিয়া থেকে নির্বাচিত জামায়াতের তৎকালীন সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী এলাকায় তার সশস্ত্র বাহিনী দিয়ে মুক্তিযােদ্ধা নুরুল কবীর, ইউসুফ কাদরী, ছাত্রলীগ নেতা ইয়ামীন, যুবলীগ নেত গোলাম হােসেন ও নজীর আহমেদকে হত্যা করে। তার বিরুদ্ধে খুন ও অন্যান্য অপরাধের ৬৩টি মামলা ছিল। জামায়াতের সাবেক সংসদ সদস্য শাহজাহান চৌধুরী ১৫ মে ২০০৬ সাতকানিয়ায় কর্মীসভায় বলে, “পত্রিকা কী বলে তা দেখে অভ নেই। ইসলামী আন্দোলন করতে হলে মানুষকে হত্যা, পঙ্গুকরণ ইত্যাদি সবই করতে হয়। যারা এগুলাে করতে পারে না রাজনীতি তাদের জন্য নয়, তাদের মসজিদের ইমামতি করাই ভালাে।’
জামায়াত-শিবিরের জঙ্গি সম্পৃক্ততা
বিগত কয়েক বছরে দেশজুড়ে ইসলামী জঙ্গিবাদের উত্থান বাংলাদেশের সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনকে কঠিন সংকটে ফেলে দেয়। এ সময়ে বাংলাদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহের প্রকাশ্য তৎপরতা বৃদ্ধির পাশাপাশি জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ, জয়শ-ই-মােহাম্মদ, আল্লাহর দল, হিজবুত তাহরীর, শাহাদত-ই-আল হিকমা, হিজবুত তৌহিদ ইত্যাদি মৌলবাদী ও জঙ্গিবাদী দলের তৎপরতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামীসহ অপরাপর ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দলসমূহের এবং জঙ্গি তৎপরতায় জড়িত সংগঠনগুলাের আদর্শ, উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য অভিন্ন। তারা সকলেই দেশে তথাকথিত ইসলামি রাষ্ট্র ও শাসনব্যবস্থা কায়েমের লক্ষ্যে কাজ করছে। শুধু কৌশল প্রয়ােগের ক্ষেত্রে তাদের মধ্যে ভিন্নতা ও কিছু মতপার্থক্য রয়েছে। জেএমবির প্রতিষ্ঠাতা শেখ আব্দুর রহমানের পিতা ফজল মুন্সি ছিল ‘৭১এর আলবদর কমান্ডার ও জামায়াত নেতা। শেখ আব্দুর রহমান ১৯৮০ সালে জামায়াত নেতা অধ্যাপক গোলাম আযমের সুপারিশে মদিনা ইউনিভার্সিটিতে পড়াশােনাের সুযােগ পেয়েছিল। জেএমবির দ্বিতীয় শীর্ষনেতা সিদ্দিকুল ইসলাম বাংলাভাই ছাত্রজীবনে শিবিরকর্মী ছিল। বিগত বছরসমূহে দেশজুড়ে জেএমবির জঙ্গিবিরােধী। অভিযানে আটক অনেক জেএমবি ক্যাডার জামায়াত-শিবিরের সঙ্গে তাদের সম্পৃক্ততার কথা স্বীকার করেছে। আটককৃত জেএমবি ক্যাডারদের গােপন আস্তানা থেকে জামায়াত নেতা গােলাম আযম, নিজামীদের লিখিত বই, মাওলানা সাঈদীর জেহাদি বিষয়ের উগ্র জ্বালাময়ী ওয়াজের ক্যাসেট উদ্ধার জামায়াতের সঙ্গে জেএমবির সম্পৃক্ততা প্রমাণ করে। জেএমবি মূলত দুটো প্রধান উৎস থেকে সদস্য সংগ্রহের কাজ করে থাকে। প্রথম উত্সটি হলাে আহলে হাদিসের সাথে। কট্টরপন্থীদের সম্পর্কযুক্ত মসজিদ, মাদ্রাসা ও ইসলামী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং দ্বিতীয় উৎস হলাে ছাত্রশিবির। এক্ষেত্রে নিকট আত্মীয়-স্বজনের সূত্র ধরে সদস্য সংগ্রহ করা হয়ে থাকে। জেএমবি ছাড়াও লন্ডনে। উগ্রবাদী সংগঠন ইসলামিক ফোরাম ইউরােপ (আইএফই)-এর সাথেও জামায়াতের সম্পর্ক রয়েছে। উক্ত সংগঠনটির প্রতিষ্ঠাতা ‘৭১-এ অভিযুক্ত ঘাতক লন্ডনপ্রবাসী বাঙালি চৌধুরী মইনুদ্দিন। তার বিতর্কিত সংগঠন আইএফই-এর সাথে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর ঘনিষ্ঠ যােগাযােগের বিষয়টি ১ মার্চ ২০১০ লন্ডনের চ্যানেল ফোর-এর একটি অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়েছিল। এছাড়া মিয়ানমারের সশস্ত্র জঙ্গি সংগঠন ‘রােহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-র সাথে জামায়াত শিবিরের বিশেষ সম্পর্ক রয়েছে বলে অভিযােগ রয়েছে।
কলঙ্কিত সৃষ্টি ইসলামী ছাত্রশিবির
স্বাধীনতার পর ১৯৭৯ সালে জামায়াতে ইসলামী আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পূর্বেই ছাত্র সংগঠন গড়ে তােলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় এবং ৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৭ তারিখে ইসলামী ছাত্রশিবির’ প্রতিষ্ঠিত হয়। এতে করে মাঠ পর্যায়ে জামায়াতের শক্ত রাজনৈতিক ভিত গড়ে ওঠে। ছাত্রশিবির গঠনের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলা হয়েছে, “আল্লাহর জমিনে সকল প্রকার জুলুম-নির্যাতনের মূলােচ্ছেদ করে আল-কোরআন ও আল-হাদিসের আলােকে ভ্রাতৃত্ব ও ন্যায়ের ওপর এক আদর্শ ইসলামি সমাজ গড়ে তােলার মহান লক্ষ্যকে সামনে রেখেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইসলামী ছাত্রশিবির’। ছাত্রশিবিরের উল্লিখিত চমক লাগানাে কথামালা সংগঠনের আদর্শ, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য হিসেবে ঘােষিত হলেও শিবির কাজ করছে ঠিক তার উল্টো। প্রতিষ্ঠার পর থেকেই দেশের গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাঙ্গনে নিজেদের একক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা ও প্রতিপক্ষ ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে প্রকাশ্য সংঘাতে লিপ্ত হয়ে পড়ে। তারা বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে প্রতিপক্ষ ছাত্রদের উপর বর্বরােচিত হামলার মাধ্যমে নারকীয় তাণ্ডবলীলা চালিয়েছে। তাদের আক্রমণে অনেক শিক্ষার্থী প্রাণ হারিয়েছে, শত শত তরুণ চিরতরে পঙ্গু হয়ে গেছে। ১৯৮০-এর দশকে ছাত্রশিবির জবাই এবং হাত-পায়ের রগ কেটে প্রতিপক্ষের মধ্যে ভীতি সঞ্চার করে। প্রতিষ্ঠার পর থেকে অদ্যাবধি তাদের হাতে প্রতিপক্ষ দলের অনেক ছাত্র নির্যাতনের শিকার হয়েছে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ছাত্রশিবির প্রতিষ্ঠার পর সংগঠনটির উল্লেখযােগ্য কার্যক্রমের সংক্ষিপ্ত বিবরণ নিচে দেওয়া হলাে ।
২৫
শিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রম পদ্ধতি
দরিদ্র, অভাবী, মেধাবী, ধর্মানুরাগী ছাত্রদের টার্গেট করে চমকপ্রদ কথাবার্তা এবং পরকালে বেহেশত প্রাপ্তির প্রলােভন দেখিয়ে কোমলমতি শিক্ষার্থীদের দলে ভেড়ানাে হয়ে থাকে। স্কুল পর্যায়ে ‘ফুলকুঁড়ি আসর সংগঠনের মাধ্যমে শিশু-কিশােরদের শিবিরের প্রতি আকৃষ্ট করে তােলা। হয়ে থাকে। শিবির প্রথমেই কোনাে শিক্ষার্থীকে দলের সদস্য হওয়ার | প্রস্তাব দেয় না। ধাপে ধাপে টার্গেটকৃত শিক্ষার্থীর মগজ ধােলাইয়ের পর শিবিরের প্রতি অনুরাগী হওয়ার জন্য পুস্তক, লিফলেট, বুকলেট, ক্যালেন্ডার ও ডায়েরি উপহার দেওয়া হয়ে থাকে। দরিদ্র শিক্ষার্থীদের ফ্রিহাৈসকৃত মূল্যে কোচিং সেন্টারে ভর্তি করে শিবিরভুক্ত করা হয়ে থাকে। পরিকল্পনা ও কর্মকৌশলের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রশিক্ষণ ও মােটিভেশনের ধাপে ধাপে শিবিরের সমর্থক থেকে কর্মী করা হয়। পরবর্তী পর্যায়ে সাথী এবং দলের মতাদর্শের প্রতি ব্যক্তির আনুগত্য নিশ্চিত হলেই চূড়ান্তভাবে শিবিরের সদস্য করা হয়ে থাকে। মেধাবী শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন শেষে ইসলামী ব্যাংক, বীমা, হাসপাতাল এবং জামায়াত নিয়ন্ত্রণাধীন অন্যান্য বাণিজ্যিক ও শিল্পপ্রতিষ্ঠানে ভালাে কর্মসংস্থানের প্রলােভন দেখিয়ে দলভুক্ত করা হয়ে থাকে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিবিরের আধিপত্য বিস্তার
প্রতিষ্ঠার পর আশির দশকের প্রারম্ভে সর্বপ্রথম শিবির খুলনা বিএল কলেজ, রংপুর কারমাইকেল কলেজ এবং পর্যায়ক্রমে চট্টগ্রাম ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট আলিয়া মাদ্রাসায় আধিপত্য বিস্তারে সমর্থ হয়। পরবর্তীকালে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়, সিলেট শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়, বগুড়া আজিজুল হক বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিলেট মদন মােহন কলেজ, চট্টগ্রাম কলেজ, বরিশাল বিএম কলেজ, রাজশাহী সরকারি কলেজ, ঢাকা সরকারি আলিয়া মাদ্রাসা এবং অধিকাংশ সরকারি চিকিৎসা মহাবিদ্যালয়ে শক্তিশালী সাংগঠনিক কাঠামাে গড়ে তুলতে সমর্থ হয়। তবে সর্বদলীয় প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনসমূহের প্রবল
প্রতিরােধের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুপ্রবেশের মাধ্যমে কাজ করে যাচ্ছে। ছাত্রশিবিরের সদস্য-ক্যাডাররা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সন্নিহিত আবাসিক এলাকায় ভাড়া করে মেসে অবস্থান করে থাকে। বিভিন্ন হলে ছদ্মবেশধারী শিবিরকর্মীরা মাঝে মাঝে গােপন বৈঠক করে থাকে। উচ্চতর বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং কিছু আলিয়া মাদ্রাসায় ছাত্রশিবিরের সাংগঠনিক কার্যক্রম রয়েছে। তবে ইসলামী শিক্ষার কেন্দ্রস্থল কওমি মাদ্রাসায় ছাত্রশিবির সংগঠন করতে পারে না। এর কারণ জামায়াত-শিবির ইসলামের মৌল বিশ্বাসের সাথে সাংঘর্ষিক মনগড়া ও ভ্রান্ত মতবাদ অনুসরণের কারণে কওমিধারার অনুসারী ওলামাবৃন্দ বহু পূর্ব থেকেই জামায়াতকে বাতিলপন্থী দল আখ্যা দিয়ে এর। সাথে সম্পর্ক না রাখার জন্য সতর্ক করে দেন। ফলে জামায়াত-শিবির কওমি মাদ্রাসার ছাত্র-শিক্ষকদের সমর্থন কখনও পায়নি।
আর্থিক আয়ের উৎস
সাংগঠনিকভাবে শিবিরের প্রত্যেক সদস্য মাসিক হারে চাঁদা প্রদান করে। থাকে। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীর নিয়ন্ত্রিত ব্যাংক-বীমা-ব্যবসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠান থেকে অর্থ পেয়ে থাকে। রাজধানীসহ সারা দেশে ছাত্রশিবির পরিচালিত প্রায় দুইশ কোচিং সেন্টার থেকে বছরে ২৫-৩০ কোটি টাকা উপার্জিত হয়ে থাকে। সৌদি আরবভিত্তিক রাবেতা আল ইসলামী এবং পাকিস্তানের আইএসআই থেকেও শিবির আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে বলে অভিযােগ রয়েছে। শিবিরের আনুগত্য নিশ্চিত হলে সদস্যপদে নিযুক্তির পর ক্যাডারদের প্রশিক্ষিত করা হয়ে থাকে। প্রশিক্ষণে তাদেরকে ইসলামি বিপ্লবের মাধ্যমে বাংলাদেশে একটি খাটি ইসলামি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের কথা বলা হয়। প্রতিপক্ষকে হত্যা, শারীরিকভাবে পঙ্গু করার (হাত-পায়ের রগ কাটা, কজি কাটা) প্রশিক্ষণের পাশাপাশি ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার নামে জীবন দিয়ে শহীদের মর্যাদালাভের জন্য উজ্জীবিত করে তােলা হয়। ইসলামী ছাত্রশিবিরে ছেরাজুস সালেহীন (ছােটখাট সন্ত্রাস সৃষ্টি ও দমনে পারদর্শী) এবং হেদায়েত বাহিনী (বড় ধরনের সন্ত্রাস সৃষ্টি ও
দমনে পারদর্শী) নামক দুই ধরনের ক্যাডার প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা রয়েছে। ‘আল্লাহর সন্তুষ্টি লাভের উদ্দেশ্যেই তাদেরকে প্রতিপক্ষের ওপর আক্রমণের যৌক্তিকতা বুঝানাে হয়ে থাকে। ফলে প্রতিপক্ষের সাথে সংঘর্ষকালে এটাই পরিলক্ষিত হয় যে, শিবিরকর্মীরা ময়দানে জীবন দেয়ার চেষ্টা করে থাকে। মূলত জেহাদি উদ্দীপনা ও শহীদের মর্যাদালাভের আশায় শিবির কর্মীদের ধর্মান্ধ করে তােলার কারণে তাদের মধ্যে এ ধরনের উন্মাদনার সৃষ্টি হয়ে থাকে।
কথিত ইসলামী বিপ্লব ও রাষ্ট্রক্ষমতা দখলে জামায়াতের সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা
রাজনৈতিক দল পরিচালনার পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামী বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠন ও সামাজিক সংগঠনের ছত্রছায়ায় প্রশিক্ষিত দলীয় ক্যাডারদের রাষ্ট্র ও সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে জামায়াতি রাষ্ট্রব্যবস্থা কায়েমের পরিকল্পনা নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে। ১১ এপ্রিল ১৯৮১ জামায়াতের উলামায়ে ইসলামের তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক মাওলানা শামসুদ্দিন। কাশেমী এক বিবৃতিতে বলে, ‘জামায়াতিরা ইরানের খােমেনী স্টাইলে বিপ্লব ঘটিয়ে এ দেশের ধর্মপ্রাণ মুসলমান ও রাজনৈতিক কর্মীদের রক্তগঙ্গা প্রবাহিত করার নীল নকশা করেছে। শিক্ষিত মেধাবীদের সরকারি, সামরিক-বেসামরিক প্রশাসনে চাকরিতে নিয়ােগ, উচ্চতর শিক্ষালয়ে শিক্ষকতা, আইনজীবী-প্রকৌশলী-চিকিৎসাবিদ-ব্যবসাবাণিজ্যসহ সমাজ ও রাষ্ট্রজীবনের সর্বত্র নিয়ােজিত করছে। এর পাশাপাশি ছাত্র-শ্রমিক-কৃষক-মহিলাদের জামায়াতের সহযােগী সংগঠন হিসেবে গড়ে তুলে সমাজ জীবনের প্রতিটি শাখায় ছড়িয়ে পড়ছে। এসবই জামায়াতের রাষ্ট্রক্ষমতা দখল ও ইসলামী শাসনব্যবস্থা কায়েমের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অংশ বলে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা ধারণা করছেন। কারণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহে জামায়াতিদের অনুপ্রবেশ দিনে দিনে বেড়েই চলছে। এদের অনেকেই জামায়াতের সাথে সংশ্লিষ্টতার বিষয়টি গােপন রাখে, যাতে কর্মক্ষেত্রে অবস্থানে কোনাে সমস্যার সম্মুখীন হতে না হয়। সেজন্য অনেক প্রতিষ্ঠানেই তাদের সঠিকভাবে চিহ্নিত করা সম্ভব হয়ে ওঠে না।
জামায়াতের আর্থিক উৎস
জামায়াত শুধু রাজনৈতিকভাবেই সুসংহত হচ্ছে না, তার ব্যাংকিং, স্বাস্থ্য, বীমা, শিল্প-বাণিজ্য বিনিয়ােগ, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, স্থাপনাসহ আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলে নিজেদের প্রশিক্ষিত লােকদের কর্মসংস্থানের সাথে সাথে দলের আর্থিক অবস্থানকে সুদৃঢ় করছে। জামায়াত-শিবির নেতাকর্মীরা মামলায় জড়িয়ে পড়লে ইসলামী ব্যাংকের প্রতিষ্ঠান ‘ইসলামী ব্যাংক ফাউন্ডেশন লিগ্যাল এইড কমিটি থেকে জনকল্যাণের নামে। আর্থিক সহযােগিতা প্রদান করা হয়। ইসলামী ব্যাংক জামায়াতের আর্থিক আয়ের প্রধান উৎস। ইসলামী ব্যাংকে কর্মরত প্রত্যেক অফিসার-কর্মচারীকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট হারে জামায়াতে ইসলামীকে ‘ইয়ানত’ নামক ফান্ডে বাধ্যতামূলক চাঁদা প্রদান করতে হয়। এছাড়া বিভিন্ন অনুষ্ঠান পালনকালে জামায়াতের প্রতি সহানুভূতিশীল ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে চাঁদা সংগ্রহ করা হয়। দেশীয় উৎস ছাড়াও জামায়াত বিদেশি বিশেষত মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশের। এনজিওর মাধ্যমে বিপুল পরিমাণ আর্থিক সহায়তা পেয়ে থাকে। যে সকল এনজিও জামায়াতকে আর্থিক সহায়তা দেয় সেগুলাে হলাে:
১. মক্কাভিত্তিক এনজিও: রাবেতা আলমে আল ইসলামী
২. অ্যাসােসিয়েট মুসলিম ওয়েলফেয়ার অ্যাসােসিয়েশন
৩. দাওয়াতুল ইসলাম
8. Revival of Human Heritage Society, Kuwait
৫ Saudia Revival Foundation
৬ Islamic Aid Association
৭ Muslim Aid UK
৮. হিলফুল ফুজুল সমাজকল্যাণ সংস্থা।
৯. বাংলাদেশ ইসলামিক ইকোনমিক রিসার্চ ব্যুরাে, পল্টন, ঢাকা।
জামায়াতে ইসলামীর সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানসমূহ
১, ইসলামী ছাত্রশিবির।
২. জামায়াতে ইসলামী মহিলা শাখা
৩. ইসলামী ছাত্রী সংস্থা।
৪. শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন
৫, চাষী কল্যাণ সমিতি
৬. ইসলামী আইনজীবী পরিষদ
৭, ফোরাম অব ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যান্ড আর্কিটেক্টস
৮. ফোরাম অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স
৯, ডক্টরস ফোরাম
১০. কৃষিবিদ ফোরাম
১১. ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ
১২. মাদ্রাসা শিক্ষক পরিষদ।
১৩. বাংলাদেশ মসজিদ মিশন।
১৪. জাতীয় মুক্তিযােদ্ধা পরিষদ
১৫, বাংলাদেশ রিক্সা শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন।
১৬, তামিরুল মিল্লাত ট্রাস্ট
১৭. আল-ফালাহ ট্রাস্ট।
১৮, সাইমুম শিল্পী গােষ্ঠী
১৯. ফুলকুঁড়ি আসর।
২০. শিশুকন্ঠ শিল্পী গােষ্ঠী।
২১. আল-হাফিজ যুব সংঘ।
২২. দারুস সুফা ট্রাস্ট, বগুড়া।
ছাত্র শিবির কর্তৃক পরিচালিত কোচিং সেন্টারসমূহ
১. ফোকাস (ঢাবি)
২. রেটিনা (মেডিকেল কলেজ ভর্তি)
৩. ইনডেক্স, কনক্রিট (বুয়েট)
৪. রেডিয়াম (শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়)
৫, কনটেস্ট (রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়)
৬. সােনালিকা (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়)
৭, রেডিয়েন্ট (খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়)
৮. কনসেপ্ট (জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়)
৯. সৃজন কোচিং সেন্টার (স্কুল ভর্তি) জামায়াত পরিচালিত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ।
১. আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজ।
২. ইবনে তাইমিয়া একাডেমী
৩. শাহ ওয়ালিউল্লাহ ইনস্টিটিউট
৪. বেসরকারি ইসলামী ক্যাডেট মাদ্রাসা
৫. মানারত ইন্টারন্যাশনাল স্কুল/কলেজ
৬, তামিরুল মিল্লাত মাদ্রাসা
৭. ইসলামী ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি (ঢাকা, চট্টগ্রাম)
৮, আল হেরা, বাদশাহ ফয়সাল একাডেমী স্কুল।
৯, ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী
১০. ইসলামী ব্যাংক ইন্সটিটিউট অব টেকনােলজি (ঢাকা, চট্টগ্রাম,সিলেট ও বগুড়া)
১১. ইসলামী ব্যাংক ইন্টারন্যাশনাল স্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা জামায়াত পরিচালিত ব্যাংক, হাসপাতাল, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের তালিকা।
১. ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
২. ইসলামী ব্যাংক হাসপাতাল।
৩, ইবনে সিনা ট্রাস্ট পরিচালিত প্রতিষ্ঠান (ইবনে সিনা। ফার্মাসিউটিক্যালস লি., ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা।ডায়াগনস্টিক ল্যাব, ইবনে সিনা কনসালটেন্ট সেন্টার)
৪, রাবিতা আল-আলম ইসলামী হাসপাতাল (কক্সবাজার)
৫. কেয়ারী টুরস অ্যান্ড সার্ভিসেস লি.
৬. বিডি ফুডস লি.।
৭, কেয়ারী ডেভেলপ কোম্পানি
৮, সৌদি-বাংলাদেশ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড এগ্রিকালচার ইনভেস্টমেন্ট কোম্পানি লি, ৯, “মনােরম’ ইসলামী ব্যাংক ক্রাফটস অ্যান্ড ফ্যাশন, ঢাকা।
গণমাধ্যম ও প্রকাশনা
১. দৈনিক নয়াদিগন্ত, দৈনিক সংগ্রাম, আমার দেশ
২. সাপ্তাহিক সােনার বাংলা, কিশােরকণ্ঠ, পৃথিবী (মাসিক), ঢাকা ডাইজেস্ট, অন্য দিগন্ত
৩. আধুনিক প্রকাশনী
৪. দিগন্ত টিভি চ্যানেল
৫. নতুনবার্তা,কম (অনলাইন)
৬. সােনার বাংলা ব্লগ
ইসলামী ছাত্র শিবিরের জন্ম ও হত্যার রাজনীতি সংঘ থেকে শিবির
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের শাসনকালে প্রণীত ‘১৯৭২ সালের দালাল আইন ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে বাতিল করে দেন প্রয়াত প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান। দালাল আইন বাতিলের ফলে জেলে আটক প্রায় সাড়ে ১০ হাজার রাজাকার সে সময় মুক্তি পেয়ে যায়। তথাকথিত বহুদলীয় গণতন্ত্রের নামে স্বাধীনতাবিরােধীদের তখন মুক্তি দিয়েছিল। জিয়ার সামরিক সরকার। দালাল আইন বাতিলের কারণে রাজাকারদের। অনেকেই জেল থেকে বের হয়ে এসে শুরু করে আনন্দ-উল্লাস। যেসব। রাজাকার পাঁচ বছর ধরে পালিয়ে ছিল তারাও তখন বুক ফুলিয়ে বেরিয়ে আসে। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের রাজনীতিতে তখন সক্রিয় হয়। জামায়াত। পাকিস্তান আমলের ছাত্রসংঘকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে ১৯৭৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের ৬ তারিখে রাজধানীর সিদ্দিক বাজারে। জামায়াতের শীর্ষস্থানীয়রা মিলিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই সংগঠনটির কার্যক্রম প্রায় নিষ্ক্রিয় ছিল। কিন্তু এ সুযােগে আবার। রাজনীতির মাঠে প্রকাশ্যে নামার প্রস্তুতি নেয় ইসলামী ছাত্রসংঘ নামের দেশবিরােধী সংগঠনটি। ১৯৭৭ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় জামে মসজিদে ছাত্র সংঘের নতুন নাম হয় বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির। ‘সংঘ’ বাদ দিয়ে ‘শিবির যুক্ত করা। হলেও সবকিছু একই থাকে। পতাকা, মনােগ্রাম সবই এক। প্রশিক্ষণ ব্যবস্থা, এমনকি জেলা থেকে কেন্দ্র পর্যন্ত বিস্তৃত নেতৃত্ব কাঠামাে সবই এক থাকে। ঘাতক ও রাজাকার মীর কাসেম আলীকে সভাপতি ও মােহাম্মদ কামারুজ্জামানকে সাধারণ সম্পাদক করে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘ শিবির নামে আভির্ভূত হয়।
নাম পরিবর্তনের কারণ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীনতাবিরােধী জামায়াতের মূল শক্তি ছিল। ইসলামী ছাত্র সংঘের হাতে। জামায়াতের মূলশক্তিই ছিল ছাত্র সংঘ; কারণ ছাত্র সংঘ মানেই তরুণ রাজাকারদের শক্তি। ‘৭৬ সালে যখন জামায়াত রাজনীতিতে পুরােদমে প্রবেশ করে তখন জামায়াতের। নীতিনির্ধারকদের মনে এই ভয় ছিলাে, ছাত্র সংঘ নামটাকে হয়তাে এ দেশের মানুষ একাত্তরে তাদের জঘন্য কর্মকাণ্ডের জন্য ভুলে যাবে না। এই চিন্তা থেকেই তারা ছাত্র সংঘের ‘সংঘ কেটে সেখানে ‘শিবির’ যােগ করে দেয়। দ্বিতীয়ত, জামায়াত ও ইসলামী ছাত্র সংঘের হিংস্র এবং পৈশাচিক কার্যকলাপ বাংলাদেশের মানুষের মনে একটা স্থায়ীভাবে ঘৃণার। ভাব সৃষ্টি করেছে। জামায়াত তখন ভালাে করেই জানত এই ঘৃণাটা। কখনাে দূর হবে না। ইসলামী ছাত্র সংঘের কথা উঠলেই অবধারিতভাবে আলবদর বাহিনীর কথা চলে আসবে। ফলে সংগঠনের প্রচার-প্রচারণা। বাধাগ্রস্ত হবে। তৃতীয়ত, যদি কখনাে স্বাধীনতাবিরােধীদের বিরুদ্ধে। ব্যবস্থা নেওয়ার মতাে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটে তখন আইনগতভাবে ফেঁসে যেতে পারে ইসলামী ছাত্র সংঘ। সেক্ষেত্রে যাতে সংগঠনের কাজ। ক্ষতিগ্রস্ত না হয় সেজন্য জামায়াতের নেতৃবৃন্দ সংঘ নামটি কেটে ফেলে। শিবির রূপে আসার পর নতুন করে শুরু হয় সংগঠনটির বাংলাদেশবিরােধী কার্যকলাপ। নতুনভাবে এলেও তাদের কার্যকলাপ। আগের মতােই থাকে। এক বছরের মধ্যেই তারা শুরু করে তাদের প্রথম। অভিযান। ১৯৭৮ সালে তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবনের সামনে। প্রতিষ্ঠিত মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ‘অপরাজেয় বাংলা’ ভেঙ্গে ফেলার জন্য স্বাক্ষর সংগ্রহ শুরু করে। এতে ছাত্রসমাজ ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলে রাতের অন্ধকারে তারা অপরাজেয় ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। কিন্তু সচেতন ছাত্রসমাজের প্রতিরােধের মুখে তারা পিছু হঠে এবং সেদিনের পর থেকে আজ পর্যন্ত তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে পারেনি। এরপর একইভাবে তারা জয়দেবপুরে মুক্তিযুদ্ধের ভাস্কর্য ভেঙে ফেলার চেষ্টা করে। সেখানেও ব্যর্থ হয়। তারপর ঢাকা ছেড়ে নিজেদের সারা দেশে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে। শুরু করে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান দখলের লড়াই। একাত্তরে মুক্তিবাহিনীর হাতে যেসব আলবদর-রাজাকার নিহত হয় তাদের নামানুসারে বিভিন্ন সেল গঠন করে সাংগঠনিক তৎপরতা চালাতে শুরু করে। তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতির পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে তারা একদিকে যেমন অস্ত্র ও অর্থভাণ্ডার গড়ে তােলে, অন্যদিকে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক যে কোনাে স্মৃতি মুছে ফেলার জোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যায়। শুরু হয় বিশ্ববিদ্যালয়ে তাদের দখলদারিত্বের রাজনীতি। এ দেশে আবার নতুন করে শুরু হয় আলবদর-রাজাকার স্টাইলে তাদের খুনের রাজনীতি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখলের অপচেষ্টা
নতুনভাবে ছাত্র সংঘ শিবির নামকরণের পর থেকেই তাদের প্রধান টার্গেট ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দখল করা। ছাত্র সংঘ থেকে শিবির নামে | প্রবর্তিত হওয়ার পরই কেন্দ্রীয়ভাবে নেতারা বৈঠক করেন কীভাবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় তাদের আয়ত্তে আনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের কাছে কোরআন-হাদিসের দাওয়াতের নামে সাংগঠনিক কার্যক্রম চালাতে অগ্রসর হলেই প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠনের প্রবল বাধার মুখে পড়ে মৌলবাদী এই সংগঠনটি। ছাত্র সংঘ নাম পরিবর্তন করেও শিবিরের খুব একটা লাভ হয় না। সাধারণ শিক্ষার্থীরা তাদের একাত্তরের ঘাতকআলবদরদের পূর্বসূরি হিসেবেই দেখতে শুরু করে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
নব্বইর দশকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির তাদের কার্যক্রম চালাতে গিয়ে ব্যর্থ হয়। জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশে বিয়ের। মাধ্যমে আত্মীয়তা করলেও শেষ পর্যন্ত সচেতন মহল ও প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের প্রচেষ্টায় বেশিদূর এগােতে পারেনি তারা। ছাত্রসমাজের কাছে তারা মৌলবাদ আর রাজাকারের উত্তরসূরির মর্যাদা পায়। তাদের ইসলামের ডাককে সবাই ভাওতাবাজি মনে করে।
৩৫
দেশব্যাপী নেটওয়ার্ক গড়ার পরিকল্পনা
রাজধানী ঢাকায় নানা কার্যক্রমে ব্যর্থ হয়ে জামায়াতের নীতিনির্ধারণী মহল শিবির নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে। জামায়াতের কার্যকরী পরিষদের সভায় ১৯৭৮ সালে এই সিদ্ধান্ত হয় যে, ছাত্র সংঘ নাম বদলেও যেহেতু শিবিরের কোনাে লাভ হয়নি, তাই এ দলটি নিয়ে নতুন করে ভাবতে হবে। তখন জামায়াত নেতৃত্ব শিবিরকে ঢাকাকেন্দ্রিক না রেখে দেশব্যাপী ছড়িয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। তারা শিবিরকে শহরকেন্দ্রিক না রেখে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এবং মফস্বল আর গ্রামকেন্দ্রিক রাজনীতিতে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করে। এই বিষয়টি পরবর্তী সময়ে শিবিরের উত্থানে সবচেয়ে বড় টার্নিং পয়েন্ট হিসেবে কাজ করে।
চট্টগ্রামে নতুন মিশন
১৯৭৭ সালে শিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হয় মীর। কাসেম আলী আর সেক্রেটারি কামারুজ্জামান। ঢাকায় কার্যক্রম চালাতে ব্যর্থ হয়ে ছাত্রশিবিরকে চট্টগ্রামে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করে এই দুই সভাপতি ও সেক্রেটারি। মীর কাসেম আলী পাকিস্তান আমলে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের চট্টগ্রামের সভাপতি ছিল, তাই সত্তরের দশকের শেষ দিকে শিবির যখন চট্টগ্রামে তাদের রাজনীতির সূচনা করে তখন মীর কাসেম আলী চট্টগ্রামের শিবিরের রাজনীতিতে তার বাহিনীর লােকজনকেই প্রাধান্য দেয়। যাদের একাত্তরে এ দেশের মানুষের রক্তে হাত রাঙানাে ছিল, সেই বর্বর পিশাচ বাহিনীর অনেকেই নিজেদের বাঁচাতে এবং একটি নিশ্চিত রাজনৈতিক আশ্রয়ের আশ্বাসে ছাত্রশিবিরে যােগ দেয়। চট্টগ্রামে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে শুরুতেই তারা মানুষের। মনে একটা আতঙ্ক ঢুকিয়ে দিতে একাত্তরের মতাে বর্বরতার আশ্রয় নেয়। মূলত বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে নিজেদের অস্তিত্বের ঘােষণা দিতে এবং নিজেদের অবস্থান তৈরি করতে তারা চট্টগ্রাম থেকেই শুরু করে তাদের হত্যার রাজনীতি।
এই হত্যার রাজনীতি শুরু করা হয় এ উদ্দেশে যে, শিবির নামটি শুনে মানুষ যাতে ভয় পায়, মানুষ যাতে শিবিরকে সমীহ করে, বিভিন্ন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র সংগঠনগুলাে যাতে শিবিরকে রাজনীতির মাঠে প্রবেশের সুযােগ দেয়, ইসলামী ছাত্র শিবির নাম শুনে যাতে ভয়ে ছাত্ররা। শিবিরে যােগ দেয়। এসব কারণেই। শিবিরের খুনিরা মৃত্যুর আগে তবারকের মুখে প্রস্রাব করে!
আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে চট্টগ্রামে শুরু হয় শিবিরের হত্যার রাজনীতি। বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র শিবিরের হাতে ১৯৮১ সালে প্রথম খুন হন চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের নির্বাচিত এজিএস ও ছাত্রলীগ নেতা তবারক হােসেন। ক্যাম্পাসে প্রকাশ্য দিবালােকে শিবির। কর্মীরা রামদা ও কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে তবারক হােসেনকে। জানা যায়, মৃত্যুর মুখােমুখি দাঁড়িয়ে তবারক যখন পানি পানি বলে। চিক্কার করছিলেন তখন এক শিবির কর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দিয়ে বলে- ‘খা, পানি খা।’ সেদিন ছাত্রশিবিরের নির্যাতন একাত্তরের ওদের পূর্বপুরুষদেরদের বর্বরতাকেও হার মানিয়েছিলাে। এই একটি খুনের মাধ্যমেই শিবির হিংস্রতার পরিচয় দিয়ে মানুষের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেয়। যারা এ খুনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন, পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে অনেক পত্রপত্রিকায় তারা এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে কথা বলেছেন। তারা জানিয়েছেন শিবিরের সেদিনের বর্বরতা ও পৈশাচিকতার কথা। প্রত্যক্ষদর্শীদের মধ্যে একজন হলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। সংসদের সাবেক ভিপি নাজিমউদ্দিন। এ বিষয়ে একটি দৈনিককে তিনি বলেন, ‘শিবিরের সন্ত্রাসীরা সেদিন তবারক হােসেনকে উপর্যুপরি রামদা দিয়ে কোপাতে কোপাতে নির্মমভাবে হত্যা করে। কিরিচের এলােপাতাড়ি কোপে মুমূর্ষ অবস্থায় তবারক যখন পানি পানি বলে চিল্কার করছিলেন তখন এক শিবিরকর্মী তার মুখে প্রস্রাব করে দেয়। পরবর্তী সময়ে সাক্ষীর অভাবে এই হত্যাকাণ্ডে জড়িত সবাই বেকসুর খালাস পেয়ে যায়। কারণ, এ বর্বর পশুদের বিরুদ্ধে ভয়ে তখন কেউই মুখ খুলতে রাজি হয়নি।’
এ ঘটনার পর ছাত্রশিবির সাধারণ ছাত্র ও অন্য ছাত্র সংগঠনগুলাের নেতা-কর্মীদের মনে ভয় ঢুকিয়ে চট্টগ্রামে নিজেদের একটা অবস্থান তৈরি করতে সক্ষম হয়। তারপর তারা তাদের রাজনীতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে বিস্তৃত করার পরিকল্পনা গ্রহণ করে। সেই লক্ষ্যে নিজেদের মতাদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রদের দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ইসলামী ছাত্র শিবিরের কার্যক্রম পুরােদমে শুরু করে। অন্যদিকে চট্টগ্রাম নগরীতে কাজ করতে থাকে ছাত্র শিবিরের ভিন্ন ভিন্ন ইউনিট। নগরীর কলেজগুলাের দখল নেওয়ার জন্য তারা দফায় দফায় সংঘর্ষে লিপ্ত হয় ছাত্রলীগ আর ছাত্র ইউনিয়নের সাথে। তখন তারা চট্টগ্রাম নগরীর কলেজগুলােতে শুরু করে রগ কাটার রাজনীতি। তাদের বিরুদ্ধে যারাই কথা বলতাে তাদের হাতপায়ের রগ কেটে দিতে শুরু করলাে শিবিরের ক্যাডাররা। ছাত্র শিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় টার্গেট করে তকালীন সময়ে একটি নেটওয়ার্ক গড়ে তােলে। তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকে নিজেদের আস্তানা গড়ে তােলে। শিবিরের অনেক কর্মী ও নেতা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে বিশ্ববিদ্যালয়ের আশেপাশের এলাকায় বিয়ে করে সংসার করতেও শুরু করে। তারা স্থানীয় অধিবাসীদের নানা ধরনের আর্থিক সুযােগ-সুবিধা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্দিকের গ্রামগুলােতে মেস ও ছাত্রাবাস গড়ে তােলে। তারপর সেখানে শিবির দরিদ্র কর্মীদের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেয়। প্রথমদিকে তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের বাধার সম্মুখীন হলেও এরশাদ সরকারের আমলে বিশ্ববিদ্যালয়ে পুরােপুরি নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করে ফেলে। আশির দশকে তারা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে “সিরাজুস-সালেহীন’ বাহিনী গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাণ্ডবলীলা চালায়। এই বাহিনীর নাম শুনলেই তখন দেশের মানুষের চোখে ভাসত এক হিংস্র বর্বর কাহিনীর কথা। যারা কোনাে কারণ ছাড়াই তখন শুধু মানুষের মনে আতঙ্ক ঢােকানাের জন্যই যার-তার হাত পায়ের রগ কাটতে শুরু করে। এই বাহিনীর তাণ্ডবের কাছে অসহায় হয়ে পড়ে সাধারণ ছাত্রছাত্রীরাও। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের রাজনীতি থেকে সরে আসা সাবেক এক ছাত্র বলেন, বিশ্ববিদ্যালয়ে যদি রগকাটার রাজনীতি শুরু না করতাে তাহলে শিবির কখনােই নিজেদের অবস্থান। তৈরি করতে পারতাে না। শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের মনে তাদের হিংস্র কার্যকলাপের মাধ্যমে ভয় ঢুকিয়ে দিতে সক্ষম হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ক্যাম্পাসে তারা খুব সহজেই নিজেদের অবস্থান নিয়ে ফেলে। তাছাড়া তখন যারা ছাত্রলীগ বা বাম রাজনীতি করতেন, তাদের অনেকেই চট্টগ্রাম নগরীতে থাকতেন। অন্যদিকে শিবির বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলােতে নিজেদের জনবল ও শক্তি বাড়ায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশের এলাকায় বাড়ি-ঘর-মেস-ছাত্রাবাস করে পুরাে বিশ্ববিদ্যালয়। এলাকাকে নিজেদের অভয়ারণ্য হিসেবে গড়ে তােলে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রে রেখে বৃত্তাকারে তারা একটি প্রতিরক্ষা দুর্গ গঠন। করে। এর ফলেই চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের শক্ত একটা অবস্থান তৈরি হয়ে যায়।’ ১৯৮৮ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দুপুরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় রেল স্টেশনে জামায়াত-শিবির নিষিদ্ধ করার দাবিতে ছাত্রলীগ প্রতিবাদ-সমাবেশ করে। সমাবেশে সশস্ত্র জঙ্গি ছাত্র শিবির হামলা চালালে শতাধিক ছাত্রছাত্রী আহত হয়। আট ঘণ্টাব্যাপী ছাত্র শিবিরের এসব সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চলাকালে পুলিশের ভূমিকা ছিল নীরব দর্শকের। তাণ্ডব চলাকালে শিবিরকর্মীরা হলে ফেরার পথে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক রফিকুল ইসলাম হিলালীকে রিকশা থেকে নামিয়ে জবাই করে হত্যার চেষ্টা করে। শিবিরের অভিযােগ, ছাত্রদলও ছাত্রলীগের সাথে একাত্মতা পােষণ করে শিবির নিষিদ্ধের দাবি করেছে। এ সময়ে ছাত্রদলের কর্মীরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগিয়ে এলে শিবিরের কর্মীরা তাকে জবাই করতে না পেরে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছুরিকাঘাত করে। রক্তাক্ত রফিকুল ইসলাম হিলালীকে বিশ্ববিদ্যালয় মেডিকেলের একটি অ্যাম্বুলেন্সে নেওয়ার চেষ্টা করলে শিবিরকর্মীরা অস্ত্রের মুখে ফিরে যেতে বাধ্য করে। পরে একটি প্রাইভেট কারে চট্টগ্রাম শহরে নিয়ে এসে আশঙ্কাজনক অবস্থায় হলি ক্রিসেন্ট হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ছাত্রদল বিশ্ববিদ্যালয় শাখা সন্ধ্যায় প্রেসক্লাবে সংবাদ সম্মেলন অভিযােগ করে যে, জামায়াত-শিবির সারা দেশে ধর্মের দোহাই দিয়ে মানুষ হত্যায় নেমেছে। তারা একাত্তরের পরাজিত শক্তি জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি বন্ধের দাবি জানায়।
ফারুক হত্যার মধ্য দিয়ে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার
শিবির চেয়েছিল ক্যাম্পাসে শিবির ছাড়া আর কোনাে সংগঠনের কার্যক্রম চলবে না। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ কেবল তাদেরই থাকবে। ১৯৯০ সালের ২২ ডিসেম্বর ক্যাম্পাসে শান্তিপূর্ণ এক মিছিল বের করে প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রী। মৌলবাদমুক্ত ক্যাম্পাসের দাবিতে ছিল এই শান্তিপূর্ণ মিছিল। শুরু হয় মিছিলে শিবিরের গুলিবর্ষণ। নিহত হন ছাত্রমৈত্রী নেতা ফারুক। ফারুক হত্যার মধ্য দিয়েই বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের খুনের রাজনীতির শুরু। ১৯৯৩ সালে শিবির ক্যাম্পাসে তাদের আধিপত্য টিকিয়ে রাখার জন্য চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এনামুল হকের ছেলে ছাত্রদল নেতা মােহাম্মদ মুছাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে। ২২ আগস্ট ১৯৯৮ সালে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্রকে নির্মমভাবে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয় শিবির। বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেকগুলাে হল দখলে নেওয়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের আশপাশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা গ্রামগুলােতে মেস ও ছাত্রাবাসের সংখ্যা বাড়াতে থাকে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আশপাশের গ্রামগুলাে শিবিরের মিনি ক্যান্টনমেন্টে পরিণত হয়। বিএনপি ও জামায়াত সরকারের আমলেও ক্যাম্পাসে ছাত্রদল শিবিরের কারণে প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। বর্তমানে ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ প্রভাব বিস্তার করলেও শিবিরও সক্রিয় রয়েছে। ছাত্রলীগের কারণে প্রকাশ্যে মিছিল-সমাবেশ করতে না পারলেও গােপনে চলছে তাদের নেটওয়ার্ক।
৪০
চট্টগ্রামের কলেজগুলােতে টার্গেট
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তারের পর আশির দশকের মাঝামাঝিতে শিবিরের টার্গেটে পরিণত হয় চট্টগ্রামের বিখ্যাত কলেজগুলাে। তাদের প্রথম টার্গেট হয় চট্টগ্রাম কলেজ, দ্বিতীয় সরকারি মহসিন কলেজ ও তৃতীয় চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট। সন্ত্রাস ও হত্যার রাজনীতির মাধ্যমে চট্টগ্রাম কলেজ ও সরকারি মহসিন কলেজ পুরােপুরি নিজেদের দখলে নিয়ে নেয় শিবির। নিয়মিত মিছিল-মিটিং করে কলেজে আতঙ্ক সৃষ্টি করে শিবির। ১৯৯৭ সালে চট্টগ্রাম পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট দখল করার জন্য ছাত্র শিবিরের ক্যাডাররা ছাত্র সংসদের ভিপি মােহাম্মদ জমির ও ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক ফরিদউদ্দিনকে গুলি করার পর তাদের হাত-পায়ের রগ কেটে হত্যা
শাহাদাত যখন ঘুমিয়ে ছিল..
১৯৮৪ সালের ২৮ মে। শাহাদাত হােসেন সে রাতে তার উচ্চমাধ্যমিকের ব্যবহারিক পরীক্ষার প্রস্তুতি নিয়ে ঘুমােতে যান। গভীর রাত। শাহাদাত গভীর ঘুমে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘুমের মধ্যে শাহাদাতের হাত-পা ও মুখ চেপে ধরে তার গলায় ধারালাে অস্ত্র চালায়। শিবিরের সন্ত্রাসী হারুন ও ইউসুফ। চট্টগ্রাম কলেজে নিজেদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে শিবিরকর্মীরা ওই কলেজের মেধাবী ছাত্র শাহাদাত হােসেনকে ঘুমের মধ্যে জবাই করে হত্যা করে। শাহাদাতের অপরাধ ছিলাে সে হারুন ও ইউসুফের কথায় ছাত্র শিবিরে যােগ দেয়নি! পরে শাহাদাত হত্যাকাণ্ডের জন্য এই দুজনের সাজা হয়। কিন্তু দু বছর পরই উচ্চ আদালতের রায়ে দুজনে শাহাদাত হত্যা মামলায় সাজাপ্রাপ্ত অবস্থায় জামিনে জেল থেকে বের হয়ে আসে। পরবর্তী সময়ে এ মামলা থেকে হারুন ও ইউসুফ বেকসুর খালাস পেয়ে যায়! শাহাদাত হত্যাকাণ্ডের পর আবার আঁতকে ওঠে ছাত্রসমাজ। বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্র শিবির নামের সংগঠন, যারা ইসলামের পতাকা উড়িয়ে সৎ লােকের শাসনের ডাক দেয়, তারাই হত্যা আর রগকাটার রাজনীতি শুরু করে ততদিনে চট্টগ্রামে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করে নেয়।
ইতিহাসের ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশে নৃশংস হত্যাকাণ্ডের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট ট্রাজেডি’। শিবির দেশের সবচেয়ে আলােচিত ও ভয়ংকর হত্যাকাণ্ড ঘটায় চট্টগ্রামের বহদ্দারহাটে। ২০০০ সালে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতায় থাকাকালে শিবির চট্টগ্রামের বহদ্দারহাট মােড়ে একটি মাইক্রোবাসে থাকা ছাত্রলীগের আটজন নেতা-কর্মীকে ব্রাশফায়ারে হত্যা করে। এই হত্যাকাণ্ড দেখে দেশের মানুষ আবার তাদের বর্বরােচিত নারকীয়তার সাথে নতুন করে পরিচিত হয়। এই হত্যাকাণ্ডের কারণ অনুসন্ধানে গিয়ে জানা যায়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকাকালীন শিবিরের অবস্থান যখন হুমকির মুখে পড়ে গিয়েছিলাে তখনই তারা ছাত্রলীগের শীর্ষ নেতৃত্বকে সরিয়ে দেওয়ার পরিকল্পনা করে। এরই ধারাবাহিকতায় একেবারে পরিকল্পিতভাবে | শিবির ক্যাডাররা গুলি করে নির্মমভাবে হত্যা করে ছাত্রলীগের এই আটজন নেতা-কর্মীকে। এরপর ২০০১ সালে ২৯ ডিসেম্বর ফতেয়াবাদের হুড়ারকুল এলাকায় শিবির ক্যাডাররা ব্রাশফায়ারে হত্যা করে ছাত্রলীগ নেতা আলী মর্তুজাকে। এরপর শিবির ক্যাডাররা ২০১০ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি নগরীর ষােলশহর রেলস্টেশনে কুপিয়ে হত্যা করে রাজনীতিবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র এ এম মহিউদ্দিনকে। তিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের আলাওল হলের আবাসিক ছাত্র ছিলেন। মহিউদ্দিন খুন হওয়ার পর শিবির মহিউদ্দিনকে নিজেদের কর্মী বলে দাবি করে! এছাড়া চট্টগ্রামের ইতিহাসে আরেকটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড গােপাল কৃষ্ণ মুহুরী হত্যাকাণ্ড। ২০০১ সালের ১৬ নভেম্বর শিবির ক্যাডাররা গোপাল কৃষ্ণ মুহুরীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। দুর্গম এলাকা ফটিকছড়িতে নিজেদের। আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে তারা পর্যায়ক্রমে ছাত্রলীগের বেশ কজন নেতা-কর্মীকে হত্যা করে। তাদের এই হত্যা ও রগকাটা রাজনীতির, সন্ত্রাসী ও জঙ্গিবাদী কার্যকলাপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা কর্তৃপক্ষ ইসলামী ছাত্র শিবিরকে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে আখ্যায়িত করে। ইউএস ডিপার্টমেন্ট অব হােমল্যান্ড সিকিউরিটি অধিভুক্ত ন্যাশনাল কনসাের্টিয়াম ফর স্টাডি অব টেরােরিজম অ্যান্ড রেসপন্স টু টেরােরিজমের তৈরি ফাইলে ছাত্র শিবিরের ব্যাপারে বলা হয়, ভয়ংকর জঙ্গি সংগঠন। বাংলাদেশের অভান্তরে জঙ্গি তৎপরতা চালানাে ছাড়াও শিবির আন্তর্জাতিক পর্যায়ের জঙ্গি সংগঠনগুলাের সাথে নিজেদের একটা নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে।
শিবিরের ক্যান্টনমেন্ট রাজশাহী?
রাজশাহীতে শিবির বিশাল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলেছে। গ্রাম থেকে শহরে। বিস্তৃত রয়েছে তাদের নেটওয়ার্ক। শিক্ষাঙ্গন দখলের রাজনীতি শুরু করে শিবির তার ধারাবাহিকতায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের কার্যক্রম শুরু করে। ১৯৭৮ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলা চত্বরে। এক জনসভার মাধ্যমে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবির প্রকাশ্যে। রাজনীতি শুরু করে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শুরুতেই তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাম ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রী আর জাসদ ছাত্রলীগের বাধার মুখে পড়ে। কিন্তু হত্যা আর রগকাটার রাজনীতি শুরু করে শিবির সেই বাধাকেও তুচ্ছ করে ফেলে। একপর্যায়ে শিবির রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও নিজেদের আধিপত্য বিস্তারে সক্ষম হয়। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে শিবির চট্টগ্রামের মতাে একই কায়দায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্রে রেখে বিশ্ববিদ্যালয়ের চারপাশে তাদের শক্তিমত্তা বাড়িয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রামগুলােকে তারা বানিয়েছে তাদের মিনি ক্যান্টনমেন্ট। বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী গ্রাম বিনােদপুর, বুধপাড়া, মেহেরচণ্ডী গ্রামে শিবিরের অনেক কর্মী ও ক্যাডার স্থানীয় মেয়েদের বিয়ে করে এসব গ্রামে নিজেদের শক্তি বাড়িয়েছে। এছাড়া আত্মীয়তা সূত্রে আবদ্ধ হওয়ার কারণে শিবিরের এসব কর্মী ও ক্যাডারদের কথায় স্থানীয় অনেকেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ে। একে একে শিবির বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার পুরােটাই নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নিয়ে নেয়। অন্যদিকে গােটা রাজশাহী মহানগরজুড়ে প্রগতিশীল ও বাম সংগঠনগুলাের ব্যর্থতা, অদক্ষতা, কর্মহীনতা ও অসততা যত বেড়েছে, শিবির বিপুল উদ্যোগে সেই ফাকা জায়গায় তাদের শক্তি ও সক্ষমতা বাড়িয়েছে। মহানগরীজুড়ে কোচিং সেন্টার, মেস, ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ নানারকম ক্ষুদ্র ব্যবসায় তারা লগ্নি করেছে। এই অর্থলগ্নির একটা বড় অংশ শিবির সংগঠনের পেছনে খরচ করে। এই আর্থিক প্রণোদনা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে আসা গ্রামের সাধারণ শিক্ষার্থীদের অনেক সমস্যা লাঘব করেছে। টিউশনি, লজিং ইত্যাদি জুগিয়ে ছাত্রজীবনে আর্থিক সহায়তার সঙ্গে সঙ্গে শিক্ষাজীবন শেষে কর্মজীবনে জামায়াত নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠানগুলােতে চাকরির নিশ্চয়তার ধারাবাহিক পথ তৈরি করে জামায়াত তাদের ছাত্র সংগঠনকে মজবুত করার কাজে লাগিয়েছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়জুড়ে যে আর্থিক কর্মকাণ্ড তার অনেকটাই এখনও শিবিরের নিয়ন্ত্রণে। শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারী, বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন দোকান, বাজার, পার্শ্ববর্তী গ্রামে দীর্ঘদিনের শ্রমে শিবির সমর্থকদের জুটিয়ে জামায়াত তাদের একটি শক্ত ঘাঁটিতে পরিণত করেছে।
রাজশাহীতে শিবিরের তাণ্ডব ও হত্যার খতিয়ান
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আধিপত্য বিস্তার করতে গিয়ে শিবির নৃশংসতার পথ বেছে নেয়। প্রতিষ্ঠার পর রাজধানী ঢাকায় বাধা পেয়ে শিবির মফস্বল, গ্রাম আর শিক্ষাঙ্গন টার্গেট করে যে রাজনীতির পরিকল্পনা করে চট্টগ্রামের পর তারা এই হিংস্র ও খুনের রাজনীতির সফল প্রয়ােগ করে রাজশাহীতে। সর্বপ্রথম ১৯৮২ সালের ১১ মার্চ শিবির ক্যাডাররা চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে বাসভর্তি বহিরাগত সন্ত্রাসী নিয়ে এসে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্রদের ওপর হামলা চালায়। এই সহিংস ঘটনায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘােষণা করে। ১৯৮৮ সালের ৩ মে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ মেইন হােস্টেলের সামনে প্রকাশ্য দিবালােকে শিক্ষার্থীদের সামনে ছাত্রমৈত্রী নেতা ডাক্তার জামিল আক্তার রতনকে কুপিয়ে ও হাত-পায়ের। রগ কেটে হত্যা করে শিবিরের ক্যাডাররা। ১৯৮৮ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করতে গিয়ে মুক্তিযােদ্ধা ও জাসদ নেতা জালালকে তার নিজ বাড়ির সামনে কুপিয়ে | হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। ১৯৮৮ সালের ১৭ জুলাই ভােররাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্ররা যখন ঘুমিয়ে ঠিক সেই সময়ে, বহিরাগত শিবির ক্যাডাররা বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে জাসদ ছাত্রলীগের রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সহ-সভাপতি ও সিনেট সদস্য আইয়ুব আলী খান, বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক ও সিনেট সদস্য। আহসানুল কবির বাদল এবং হল সংসদের ভিপি নওশাদের হাত-পায়ের | রগ কেটে দেয়। একই বছরের আগস্টে বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক অধ্যাপক মাে. ইউনুসের বাসভবনে শিবির বােমা। হামলা করে। ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির সন্ত্রাসীদের হাতে জাসদ ছাত্রলীগ নেতা ইয়াসির আরাফাত খুন হন। এদিন তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিনটি ছাত্র হল আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়। ১৯৯২ সালের ১৯ জুন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে রাজাকারদের অন্যতম প্রধান গােলাম আযমের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্দোলনে হরতাল কর্মসূচি সফল করার লক্ষ্যে জাসদ আয়ােজিত মিছিলে শিবিরের সশস্ত্র সন্ত্রাসীরা হামলা চালায়। শিবিরের হামলায় ওই দিন সাহেববাজার জিরাে পয়েন্টে জাসদ নেতা মুকিম মারাত্মক আহত হন এবং ২৪ জুন তিনি মারা যান। একই বছরের আগস্ট মাসে শিবির নিয়ন্ত্রিত বিশ্ববিদ্যালয়ের পার্শ্ববর্তী নতুন বুধপাড়া গ্রামে শিবির ক্যাডার মােজাম্মেলের বাড়িতে বােমা বানানাের সময় শিবির ক্যাডার আজিবরসহ অজ্ঞাতনামা অন্তত আরও তিনজন নিহত হয়। ১৯৯৩ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় তাণ্ডবলীলা চালায় শিবিরের ক্যাডাররা। শিবিরের সন্ত্রাসীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীদের ওপর সশস্ত্র হামলা
৪৫
চালায়। ছাত্রদল ও সাবেক ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ মিলে গঠিত সর্বদলীয় ছাত্র ঐক্যের ওপর শিবিরের হামলায় ছাত্রদল নেতা বিশ্বজিৎ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নতুন এবং ছাত্র ইউনিয়নের তপনসহ পাঁচজন ছাত্র নিহত হন। একই বছরের ১৯ সেপ্টেম্বর বহিরাগত সশস্ত্র শিবিরকর্মীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় শেরেবাংলা হলে হামলা চালিয়ে ছাত্রমৈত্রী নেতা। বিশ্ববিদ্যালয় ক্রিকেট দলের ক্রিকেটার জুবায়েদ চৌধুরী রিমুকে হাতপায়ের রগ কেটে নৃশংসভাবে কুপিয়ে হত্যা করে। ১৯৯৫ সালের ১৩ ফেব্রুয়ারি শিবিরকর্মীরা বিশ্ববিদ্যালয়-পার্শ্ববর্তী চৌদ্দপাই নামক স্থানে। রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী একটি বাসে হামলা চালিয়ে বাংলাদেশ ছাত্রমৈত্রী নেতা দেবাশীষ ভট্টাচার্য রূপমকে বাসের যাত্রীদের সামনে। কুপিয়ে হত্যা করে। ১৯৯৬ সালে জাসাস বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সাধারণ সম্পাদক আমানউল্লাহ আমানকে কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির সামনে প্রকাশ্য দিবালােকে কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। ২০০১ সালে রাবি অধ্যাপক সনৎ কুমার সাহাকে শিবিরকর্মীরা হাত-পা বেঁধে জবাই করে হত্যা করার চেষ্টা চালায়। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মচারীদের হস্তক্ষেপে ওই দিন তিনি প্রাণে বেঁচে যান। ২০০৪ সালে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক মাে. ইউনুসকে ফজরের নামাজ পড়তে যাবার সময় কুপিয়ে হত্যা করে শিবির ক্যাডাররা। এর আগে ১৯৮৮ ও ১৯৯৮ সালে দুই দফায় ছাত্র শিবির অধ্যাপক ইউনুসকে হত্যার চেষ্টা করেছিল। ২০০৬ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি বিশ্ববিদ্যালয়ের জামাতপন্থী শিক্ষক মহিউদ্দিন এবং ছাত্র শিবির সভাপতি মাহবুব আলম সালেহীসহ আরও দুজন শিবির ক্যাডার মিলে একযােগে হামলা চালিয়ে রাবির ভূতত্ত্ব ও খনিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক আবু তাহেরকে হত্যা করে। ২০১০ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ে হামলা চালিয়ে ছাত্রলীগ কর্মী। ফারুক হােসেনকে কুপিয়ে হত্যা করে তার লাশ ম্যানহােলে ফেলে রাখে শিবিরের ক্যাডাররা।
বায়তুল মাল: চাঁদাবাজির ভিন্ন নাম! বায়তুল মাল আরবি শব্দ। এর অর্থ রাষ্ট্রীয় কোষাগার। বায়তুল মালের নামে ছাত্র শিবির সংগঠনের কোষাগারের জন্য চাদা তুলে আসছে বছরের পর বছর। শিবিরের চাঁদা আদায়ের রশিদে বায়তুল মাল লেখা থাকে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ফারুক হত্যাকাণ্ডের পরপরই শিবিরের বেশ কিছু গােপন নথি উদ্ধার করে পুলিশ। উদ্ধার করা গোপন নথিপত্রে মিলেছে। এসব চাঁদাবাজির নজির। বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র শিবিরের চাদাবাজি থেকে রেহাই পায়নি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বল্প বেতনের মালি-ঝাড়ুদার থেকে শুরু করে ক্যাম্পাসের ক্ষুদ্র দোকানির কেউই। রাবি শহীদ সােহরাওয়ার্দী হলের ছাত্র শিবির নিয়ন্ত্রিত রুমগুলােতে কয়েক দফায় তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ উদ্ধার করেছে তাদের চাঁদাবাজির তালিকা। শিবিরের নির্বিচার চাঁদাবাজি থেকে বাদ পড়েনি ওই হলের কর্মচারীরাও। সােহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদাবাজির তালিকায় দেখা যায়, তারা হলের ২৬ জন কর্মকর্তা-কর্মচারীর কাছ থেকে নিয়মিত ধার্য করা চাদা তুলত। এদের মধ্যে হলের মালি জাবের ও লােকমানের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে, চান মিয়ার কাছ থেকে ১০০ টাকা, ঝাড়ুদার সাইদুরের কাছ থেকে ১০০ টাকা, প্রহরী আলাউদ্দিন, চান মিয়া, মােহাম্মদ আলী ও রাজ্জাকের কাছ থেকে ৫০ টাকা করে, প্রহরী আমজাদের কাছ থেকে ৩০ টাকা, ক্যান্টিন ম্যানেজার আবুল হাশেমের কাছ থেকে ১০০ টাকা, লাইব্রেরি কর্মচারী আজহার আলীর কাছ থেকে ১০০ টাকা, ডাইনিং কর্মচারী ইসমাইলের কাছ থেকে ৫০ টাকা, গেমরুমের কর্মচারী আলী ও আশরাফের কাছ থেকে ১০০ টাকা করে, ক্রীড়া শিক্ষক মন্টু সিংয়ের কাছ থেকে ৩০০ টাকা এবং ডাইনিং কর্মচারী হকের কাছ থেকে প্রতি মাসে ১০০ টাকা করে চাঁদা আদায় করেছে শিবির। সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেও চাঁদাবাজি করেছে শিবির। সোহরাওয়ার্দী হল থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদা আদায়ের একটি রসিদে দেখা গেছে, তারা নানা প্রক্রিয়ায় হলের সাধারণ শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে ৫ থেকে ৫০ টাকা পর্যন্ত নিয়মিত চাঁদা আদায় করেছে। সােহরাওয়ার্দী হলের কাছেই বিশ্ববিদ্যালয় স্টেশন বাজার এলাকা। হলের আশপাশেও রয়েছে বেশ কিছু ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর দোকান। স্বল্প পুঁজির এসব ব্যবসায়ীর কাছে থেকেও নিয়মিত চাঁদা নিত শিবির। হল। থেকে উদ্ধার করা শিবিরের চাঁদাবাজির তালিকায় দেখা গেছে, গত বছরের জানুয়ারি মাসে স্টেশন বাজার এলাকার সেলুন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে ১০০ টাকা, চা-দোকানি আজিজের কাছ থেকে ১০০ টাকা, ফল ব্যবসায়ী চান মিয়ার কাছ থেকে ১০০ টাকা, হাবিব ভ্যারাইটির কাছ থেকে ৩০০ টাকা, বটতলা হােটেল থেকে ২০০ টাকা, ফটোকপি ব্যবসায়ী লিখনের কাছ থেকে ১০০ টাকা, ক্ষুদ্র দোকানি মিন্টুর কাছ থেকে ৫০ টাকা, মনােহারী দোকানি মামুনের কাছ থেকে ৬০০ টাকা এবং মােবাইল ব্যবসায়ী আনিসুরের কাছ থেকে ৫০ টাকা চাঁদা আদায় করেছে শিবির ক্যাডাররা। এ চিত্র যে শুধু রাজশাহীতে তা নয়, প্রায় সারা বাংলাদেশে শিবির বায়তুল মালের নামে চাঁদাবাজি করে চলেছে। গােয়েন্দা সংস্থার তথ্য মতে, এসব চাঁদাবাজির টাকায় শিবির সংগঠনের জন্য অস্ত্র ক্রয়, মিটিং-মিছিল ও সভা-সেমিনারের আয়ােজন করে। শিবিরের নৃশংসতা: সিলেটে আশির দশকের মাঝামাঝি থেকে সিলেটে শিবিরের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়। সিলেটে প্রথম খুনের রাজনীতিরও সূচনা করে শিবির। একেবারে কোণঠাসা জামায়াত-শিবির সিলেটে নিজেদের অবস্থান করে নিতে ১৯৮৮ সালের একই দিনে খুন করে জাসদ ছাত্রলীগের তিন অকুতােভয় সৈনিক মুনির, তপন ও জুয়েলকে। এই তিনজনের অপরাধ ছিলাে, তারা মৌলবাদের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। জাসদ ছাত্রলীগ সিলেট শহর থেকে শিবির উত্থাতের পরিকল্পনা নেয়। কিন্তু শিবিরের নারকীয় তাণ্ডবলীলার কাছে তারা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। জাসদ ছাত্রলীগের দুর্গে চরম আঘাত করে সিলেটে খুনের রাজনীতির শুরু ও নিজেদের অবস্থান করে নেয় শিবির ১৯৮৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে। একদিনেই জাসদ ছাত্রলীগের নিবেদিতপ্রাণ তিন কর্মী মুনির, তপন ও জুয়েলকে নির্মমভাবে হত্যা করে। সেই সময়ে শিবিরের তাণ্ডবে সিলেট নগরীতে আহত হয়। অনেকেই।
১৯৯৮ সালের ২৪ মে শিবির হত্যা করে সিলেট ওসমানী মেডিকেল কলেজের চতুর্থ বর্ষের মেধাবী ছাত্র ও ছাত্রলীগ নেতা সৌমিত্র বিশ্বাসকে। শামসুদ্দিন ছাত্রাবাসে ক্রিকেট খেলা দেখা নিয়ে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হলে শিবির ক্যাডাররা নগরীর ব্লু-বার্ড স্কুলের সামনে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে সৌমিত্রকে। হামিদ আহমদ খান দোয়েল নামের এক ছাত্রদল কর্মীকে ২০০২ সালে ৯ সেপ্টেম্বর সিলেটের মদনমােহন কলেজের ক্যাম্পাসে কুপিয়ে হত্যা করে শিবিরের ঘাতকরা। সিলেট ভেটেরিনারি কলেজের মেধাবী ছাত্র রফিকুল হাসান সােহাগকে ২০০৪ সালের ৩১ আগস্ট নৃশংসভাবে খুন করে শিবির ক্যাডাররা। সােহাগ কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিলেন এবং কলেজ ছাত্রদলের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন। এই ছয় খুনের জন্য শিবিরের অনেক নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়ে জেলে গেলেও কারাে সাজা হয়নি। খোজ নিয়ে জানা গেছে, খুনিরা আজ ব্যবসা করে সিলেটে প্রতিষ্ঠিত। এই হত্যাকাণ্ড গুলাের বিচার না হওয়ার কারণে শিবির সিলেটে বেপরােয়াভাবে তাদের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সিলেটে শিবিরের ঘাটি মহাজোট সরকার ক্ষমতায় আসার পরও সিলেটের শিবির ক্যাডাররা বহাল তবিয়তে আছে। তাদের সাংগঠনিক কাজও চলছে ঠিকমতােই। সিলেট শহরে শিবিরের প্রধান ঘাটি হচ্ছে নগরীর পায়রা আবাসিক এলাকা ও আলিয়া মাদ্রাসা। পায়রা আবাসিক এলাকায় অনেক জামায়াত-শিবিরের নেতা বসবাস করে। অভিযােগ আছে, এখান থেকে মারামারি করার জন্য শিবিরের অস্ত্র বিভিন্ন জায়গায় পৌছে দেওয়া হয়। পায়রা আবাসিক এলাকার বেশ কটি বাসাকে মেস হিসেবে ব্যবহার করে শিবির তাদের ক্যাডারদের এসব মেসে স্থায়ীভাবে বাস করার সুযােগ করে দিচ্ছে। এছাড়া হত্যা বা অন্য কোনাে বড় ধরনের হামলা-হাঙ্গামার সাথে জড়িত শিবির ক্যাডাররা পায়রা আবাসিক এলাকায় এসে জামায়াত নেতাদের বাসায় আত্মগােপন করে থাকে। শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয় নামকরণ আন্দোলনে শিবিরের ক্যাডারদের হাতে প্রকাশ্যে পায়রা আবাসিক এলাকা থেকে অস্ত্র পৌছে দেওয়া হয়। এককালে চট্টগ্রামের শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ ও নাসির বিভিন্ন অপরাধ করে সিলেটে পায়রা আবাসিক এলাকার জামায়াত-শিবিরের বাসাগুলােতে এসে অবস্থান নিত। সিলেটে শিবিরের যত সন্ত্রাসী আছে তার অর্ধেক বাস করে পায়রা আবাসিক এলাকায়। এরা শিবিরের বিভিন্ন ইউনিটের দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি বিপক্ষ ছাত্র সংগঠন ও সাধারণ ছাত্রদের উপরে শিবির যেসব হামলা চালায় সেগুলাে পরিচালনা করে থাকে। আলিয়া মাদ্রাসা হচ্ছে সিলেটে শিবিরের মিনি ক্যান্টনমেন্ট। এখানে শিবির সদস্যদের মারামারি ও অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় বলে অভিযােগ আছে। নগরীর মদিনা মার্কেটের ধানসিড়ি, পল্লবী এবং শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (শাবি) পূর্ব পাশে ধামালিপাড়ায় শিবিরের বড় তিনটি আস্তানা আছে। বিজিবি সেক্টর হেড কোয়ার্টারের দ্বিতীয় গেটের বিপরীতে একটি কটেজ, আখালিয়া নয়াবাজারের দুটি বাসা, শাবি গেটের বিপরীতে একটি বাসা, শাবি দ্বিতীয় হল সংলগ্ন একটি বাসা, আখালিয়া সুরমা আবাসিক এলাকা, সুবিদবাজার পল্লবী আবাসিক এলাকার একটি টাওয়ার, আখালিয়াস্থ যুগীপাড়া, শাবির পেছনে দুটি মেসে শিবির নিজেদের আস্তানা গড়ে তুলেছে। এই আস্তানাগুলাে মূলত শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে গড়ে তােলা হয়েছে। ২০১০ সালের এক গােয়েন্দা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সিলেটে শিবিরের ৭৫০ সাথী ও প্রায় ২০০ কিলার আছে। এরা যে কোনাে সময় সংগঠনের জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত থাকে।
কেন সাধারণ পরিবারের ছেলেরা শিবির করে?
২০০১ সালে ফেনী সরকারি কলেজ থেকে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দেয় পারভেজ। তার বাবা একটি টেক্সটাইলের শ্রমিক। দুই ভাই ও দুই বােনের পড়ালেখার খরচ ও সংসারের ভরণপােষণ চালাতে পারভেজের বাবাকে বেশ বেগ পেতে হয়। ভর্তি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয় পারভেজ। কিন্তু হলে কীভাবে উঠবে? সিট কি পাৰে? বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকা-খাওয়ার খরচ চালানাের সামর্থ যে তার দরিদ্র পিতার নেই। ভীষণ ভাবনায় পড়ে সে। ভর্তি হওয়ার পরদিনই বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন বড় ভাই তার সাথে পরিচিত হয়। পারভেজের উপকার করতেই তারা নিজ উদ্যোগে এগিয়ে আসে! পারভেজের সব কথা শুনে তারা তাকে আপাতত থাকার জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে শেয়ারে এক সিটের ব্যবস্থা করে দেয়। এক সপ্তাহ পর দুটো টিউশনিরও ব্যবস্থা করে দেয়। পারভেজ বড় ভাইদের ওপর ভীষণ খুশি। তারা পারভেজকে বলে, “তুমি আমাদের সাথে। চলাফেরা করলেই চলবে। আমাদের নির্দেশ মেনে চললে ক্যাম্পাসে তােমার কোনাে অসুবিধা হবে না।’ বড় ভাইদের সাথে নিয়মিত চলাফেরা করে সে। শিবিরের একজন সমর্থক থেকে কর্মীতে পরিণত হয় পারভেজ। নিয়মিত মিছিল-মিটিংয়ে অংশ নেয়। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায়। প্রতিপক্ষকে ইট-পাটকেল ছােড়ে। ধীরে ধীরে শিবিরের একজন সক্রিয় কর্মীতে পরিণত হয় পারভেজ। পারভেজের মতাে এভাবে অনেকেই ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় শিবিরের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায়, সাধারণ দরিদ্র পরিবারের ছেলেরাই শিবিরের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে। শিবিরের দরিদ্র পরিবারের কর্মীদের জন্য বেতন-ভাতার ব্যবস্থা আছে। শিবিরের যারা একনিষ্ঠ কর্মী তাদের থাকা-খাওয়া ও পড়ালেখার যাবতীয় দায়িত্ব নিয়ে থাকে সংগঠনটি।
সমর্থক থেকে সদস্য
শিবিরে যােগ দেয়ার কতগুলাে প্রক্রিয়া রয়েছে। সমর্থক’ থেকে ‘সদস্য পদ পর্যন্ত যেতে কয়েকটি ধাপ অতিক্রম করতে হয়। শিবির তাদের কর্মী-সমর্থকদের আলাদা আলাদা চারটি ভাগে বিভক্ত করেছে। কেউ শিবির করতে চাইলে প্রথমে তাকে শিবিরের সমর্থক হতে হয়। এজন্য সমর্থক ফরম পূরণ করতে হয়। সমর্থকের পরের ধাপ কর্মী। কর্মী হতে হলে শিবিরের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মুখস্থ করে শীর্ষ কোনাে নেতাকে শােনাতে হয়। লক্ষ্য-উদ্দেশ্য মুখস্থ করে বলতে পারলে তাকে কর্মী। বানানাে হয়। এরপর পরীক্ষিত কর্মীদের বিভিন্ন পরীক্ষার মাধ্যমে সাথী করা হয়। সাথী হওয়ার আগে শিবিরের কয়েকটি বই এবং সংগঠনের নিয়ম-কানুন বিস্তারিত জানতে ও বুঝতে হয়। সাথী হতে হলে শিবিরের কেন্দ্রীয় অনুমােদনেরও প্রয়ােজন হয়। শিবিরের পরীক্ষিত কর্মীরাই কেবল সাথী হতে পারে। সর্বশেষ ধাপ হচ্ছে সদস্য। সদস্য হতে হলে জিহাদি বই-পুস্তক এবং জামায়াতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদির বইয়ের বিস্তারিত পাঠ থাকতে হয়। অনেক যাচাই-বাছাই করার পর কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমােদন নিয়ে সাথী থেকে সদস্য করা হয়। সাথী ও সদস্যরা সংগঠনের গােপনীয় বিষয় রক্ষায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকে। মূলত সাথী ও সদস্য হবার পরই একজন সদস্যকে শিবির তাদের প্রশিক্ষণে নিয়ে যায়। অভিযােগ রয়েছে, সাথী ও সদস্যদের অস্ত্র প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। সংগঠনের গােপন দলিল, হিসাবপত্র, কর্মপরিকল্পনাসহ সংগঠনের গােপনীয় কার্যাদির সব কিছু সাথী ও সদস্যরা করে থাকে।
চেইন অব কমান্ড
প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই শিবির চেইন অব কমান্ড মেনে চলছে। নেতার আনুগত্য পুরােপুরি মেনে চলতে হয় এ সংগঠনে। এজন্য অন্যান্য সংগঠনের তুলনায় সংগঠনটিতে বিদ্রোহ খুব কমই দেখা দিয়েছে। শিবিরের তৃণমূল পর্যায়েও কিছু করতে হলে কেন্দ্রের অনুমােদন নিতে হয়। এছাড়া কোন সাথী কোন এলাকায় থাকবে, কোন সদস্য কোন এলাকায় দায়িত্ব পালন করবে, কর্মীদের কী কী কাজ করতে হবে, সমর্থকদের কীভাবে দলে পুরােপুরি জড়িয়ে ফেলতে হবে—এসব নির্দেশনা কেন্দ্র থেকেই দেওয়া হয়। শিবিরের দায়িত্ব দিয়ে কাকে কোন কলেজে পাঠানাে হবে, শিবিরের সাথী ও সমর্থকদের এইচএসসি পাস করে কোন বিশ্ববিদ্যালয় বা কলেজে ভর্তি হতে হবে—এটাও কেন্দ্র থেকে ঠিক করে দেওয়া হয়। এছাড়া কোনাে একটা হত্যাকাণ্ড ঘটানাের
পর যারা হত্যাকাণ্ডের সাথে জড়িত থাকে তাদেরকে আত্মগােপনে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। যেমন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে কেউ হত্যার সাথে জড়িত থাকলে তাকে রাজশাহী পাঠিয়ে দেওয়া হয় এবং তার খাওয়াদাওয়া আবাসনসহ সবকিছুর ব্যবস্থা সংগঠন থেকে করা হয়। এরপর হত্যা মামলা শেষ হয়ে গেলে অথবা মামলা আইনিভাবে দুর্বল হয়ে পড়লে ওই ঘটনার সাথে জড়িতরা প্রকাশ্যে বের হয়ে আসে। তখন যে এলাকায় তারা ঘটনা ঘটিয়েছে ওই এলাকা থেকে সরিয়ে অন্য এলাকায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে একজন খুনি খুব সহজেই নিজেকে সাধারণের সাথে মিশিয়ে স্বাভাবিকভাবে চলাফেরা করতে পারে। এছাড়া একজন সদস্য জেলে থাকাকালে তার সব আইনি খরচ বহন করা ছাড়াও পরিবারের ভরণপােষণও শিবির করে থাকে। অনেক সময় দেখা যায়, আলােচিত কোনাে হত্যাকাণ্ড ঘটানাের পর যখন দেশজুড়ে তােলপাড় শুরু হয় (যেমন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফারুক হত্যাকাণ্ড) তখন হত্যার সাথে জড়িতদের বিদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এজন্য শিবিরের সাথী হবার সাথে সাথেই একজন কর্মীকে সংগঠন থেকে পাসপাের্ট করে। দেওয়া হয়। যারা বিদেশে চলে যায়, তারা ওখানে গিয়ে বিভিন্ন সংগঠনের নামে শিবিরের কার্যক্রম পরিচালনা করে এবং প্রতি মাসে বিপুল পরিমাণ টাকা শিবিরের ফান্ডে অনুদান হিসেবে পাঠায়। বিভিন্ন সংগঠনে ছড়িয়ে পড়ছে শিবির। বর্তমানে বিভিন্ন সংগঠনে ঢুকে পড়েছে শিবির। এদের মাধ্যমে তারা খুব সহজেই অন্য সংগঠনগুলাের পরিকল্পনা ও কার্যক্রম সম্পর্কে আগে থেকেই সবকিছু জেনে যায়। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বকর নিহত হওয়ার পর খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বকরের হত্যার সাথে জড়িত ছাত্রলীগ নেতা ফারুক একসময় শিবিরের রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। এছাড়া দেশে এখন এই কথাটা প্রায়ই শােনা যাচ্ছে, ছাত্রলীগ এবং অন্যান্য ছাত্র সংগঠনের ভেতরে শিবির ঢুকে গেছে। এ বিষয়ে সরাসরি কোনাে প্রমাণ থাকলেও শিবিরের সংগঠন পরিকল্পনার স্বার্থে অন্য ছাত্র সংগঠনে তাদের কর্ম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়। এছাড়া তাদের বেশ কিছু অন্য ধর্মের বন্ধুও থাকে, অন্যান্য ধর্মের এসব ছাত্রদের নিয়ে শিবির প্রায়ই চাইনিজ রেস্তোরায় পার্টি দিয়ে থাকে। এছাড়া এদের বিভিন্ন ধরনের সুযােগসুবিধা দিয়ে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। যখন কোনাে ক্যাম্পাসে বড় ধরনের সংঘাতে অথবা সংকটময় অবস্থায় পড়ে যায় তখন শিবির তাদের অন্য ধর্মাবলম্বী এসব বন্ধুদের কাজে লাগায়। শিবিরের শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতি। শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন সংগঠনসহ শিবিরের নিজস্ব সাংস্কৃতিক সংগঠন। রয়েছে। বর্তমানে শিবির পরিচালিত অনেক ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে। এগুলাের মধ্যে যেমন আছে কিন্ডারগার্টেনসহ বিভিন্ন স্কুল, তেমনি আছে মাদ্রাসা, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। আরও আছে শিবির পরিচালিত কোচিং সেন্টার। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তিও জন্য আছে “ফোকাস’, মেডিকেলে ভর্তির জন্য রয়েছে ‘রেটিনা”। নিজেদের স্বার্থ হাসিলের জন্য তারা কোমলমতি শিশু-কিশােরদের হাতে তুলে দেয় রঙ-বেরঙের স্টিকার ও কিশােরকণ্ঠ” নামের একটা ম্যাগাজিন। কিশােরকণ্ঠ ম্যাগাজিনটি দিয়েই তারা প্রাথমিকভাবে বশীভূত করে শিশু-কিশােরদের। এছাড়া শিশু-কিশােরদের জন্য আছে ‘ফুলকুঁড়ি আসর’ নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন। ফুলকুঁড়ি নামের শিবিরের এই সংগঠনটি গড়ে ওঠে ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর। শিবিরের কার্যক্রমের সাথে এই সংগঠনটির কার্যক্রমও দেশব্যাপী বিস্তৃত করে শিবির। ফুলকুঁড়ি শিশু-কিশােরদের নিয়ে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান করে থাকে। ‘মাসিক ফুলকুঁড়ি’ নামে এদের একটি পত্রিকাও আছে। এই ফুলকুঁড়ির মাধ্যমে তারা কোমলমতি শিশু-কিশােরদের নিজেদের সংগঠনের দিকে টেনে আনে। সাইমুম শিল্পী গােষ্ঠী নামে একটি সাংস্কৃতিক (!) সংগঠন রয়েছে তাদের। শিক্ষার্থীদের জন্য ছাত্র সংবাদ’ নামে একটি ম্যাগাজিন প্রকাশিত হয় প্রতি মাসে। জামায়াতের মুখপত্র “দৈনিক সংগ্রামের শিশুদের পাতা ‘শাহিন শিবিরও শিবির তৈরির ভাবাদর্শ প্রচারে ভূমিকা। রাখে।বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে শিবির
দেশের বাইরেও ভিন্ন ভিন্ন নামে ছাত্র শিবিরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। জানা যায়, বিদেশের এসব সংগঠন শিবিরের দেশের বাইরে নিরাপদ আস্তানা। দেশে বড় ধরনের অরাজকতা এবং হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে। এসব সংগঠনের ছত্রছায়ায় বিদেশে আশ্রয় নেয় শিবিরের ক্যাডাররা।
একটি সূত্রে জানা যায়, এসব সংগঠন থেকে প্রতি মাসে বাংলাদেশে শিবিরের ফান্ডে লাখ লাখ টাকা পাঠানাে হয়। এই নাম পরিবর্তনের কারণ হিসাবে জানা যায়, সাধারণত সংশ্লিষ্ট দেশের ভাষা ও জাতীয়তাকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন নামে শিবিরের কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। আন্তর্জাতিক গােয়েন্দা সংস্থার চোখ এড়াতে এবং বিশ্বব্যাপী শিবিরের নেটওয়ার্কের বিস্তৃতি লুকাতে একেক দেশে একেক নাম দেওয়া হয়েছে এ সংগঠনের। এছাড়া যারা হত্যা বা মামলাসংক্রান্ত কামেলায় জড়িয়ে যায় তাদেরও বিদেশে পাঠিয়ে এসব সংগঠনের দায়িত্ব দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে বাংলাদেশ থেকে শিবির ও জামায়াতের কোনাে কোনাে নেতা গিয়ে বাইরের দেশের নেতাদের দিকনির্দেশনা দিয়ে থাকে। সেখানে বসবাস করা নেতারা সে দেশের নাগরিকদের সঙ্গে মিশে সাংগঠনিক এসব নির্দেশনা সুকৌশলে বাস্তবায়ন করে। দেশের বাইরে সংগঠনের কার্যক্রম পরিচালনা করে সে দেশের নাগরিকরাই।
এবার জেনে নেওয়া যাক কোন দেশে কী নামে শিবির রয়েছে। ভারতে রয়েছে ‘স্টুডেন্ট ইসলামিক অরগানাইজেশন অব ইন্ডিয়া। একইভাবে। শ্রীলংকায় শ্রীলংকা ইসলামিক মুভমেন্ট’, পাকিস্তানে ‘ইসলামি জামায়াতই তালাবা’, সিঙ্গাপুরে ‘দ্য মুসলিম কনভার্টস অ্যাসােসিয়েশন, মিয়ানমারে ‘ইত্তিহাদ আল-তুল্লাব আল মুসলিমিন, ইন্দোনেশিয়ায় ‘এল-ইসলামি লিল-তুল্লাব’, তাইওয়ানে ইসলামিক কালচার ইনস্টিটিউট’, মালয়েশিয়ায় মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট অব মালয়েশিয়া, ফিজিতে ফিজি মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট’, নেপালে ‘ইসলামি ইউয়া সান’, কোরিয়ায় কোরিয়া মুসলিম ফেডারেশন, জাপানে ‘মুসাতে সি’,
৫৫
থাইল্যান্ডে ‘দ্য মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশন, কাজাখস্তানে ‘ডিরেক্টর অব ইফসাে ইন সেন্ট্রাল এশিয়া, ঘানায় ‘ইত্তিহাদ ইল-তালিবি ইলমুসলিমিন, আলজেরিয়ায় ন্যাশনাল স্টুডেন্ট ইউনিয়ন’, ‘জর্দানে জর্দানিয়ান স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, তুনুসে ‘ই-ইত্তিহাদ ই এম লিল-তালিবি’, সুদানে ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশন ফর মুসলিম ওমেন’ ও ‘ইলইত্তিহাদ লিল তুল্লাব’, মৌরিতানিয়ায় ‘ক্লাব ফর ইয়ুথ মৌরিতানিয়া’, আইভরি কোস্টে অ্যাসােসিয়েশন দেস ইলেভেস’, মরিশাসে ‘মুসলিম স্টুডেন্ট মুভমেন্ট’, কেনিয়ায় ‘ইয়ং মুসলিম অ্যাসােসিয়েশন, দক্ষিণ আফ্রিকায় ‘মুসলিম ইয়ুথ মুভমেন্ট’ ও ‘ইসলামিক দাওয়াহ মুভমেন্ট, তানজানিয়ায় মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশন, নাইজেরিয়ায় *এমএসএস ইসলামিক সেন্টার’, উগান্ডায় মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশন’, বেলজিয়ামে ‘ইউনিয়ন ইসলামিক’, ফ্রান্সে ‘অ্যাসােসিয়েশন দ্য মুসলমা’, জার্মানিতে ‘মুসলিম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, ইউরােপে ‘ইয়ুথ মুসলিম অ্যাসােসিয়েশন’, ইতালিতে ‘হােল্লাদ সেনত্রো ইসলামিকা দ্য মিলাননা’, স্পেনে ‘অ্যাসােসিয়েশন ইসলামিকা আলআন্দালুস’, সুইজারল্যান্ডে ‘অ্যাসােসিয়েশ কালচারেললাই ডেস’, সাইপ্রাসে ‘ইয়ুথ ফাউন্ডেশন’, আলবেনিয়ায় ‘ইত্তিহাদ ইল-তালিবি দ্য মুসলিমিন, পােল্যান্ডে ‘মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশন’, হাঙ্গেরিতে মুসলিম স্টুডেন্ট ইউনিয়ন, সুইডেনে ‘ফেডারেশন অব ইসলামিক স্টুডেন্ট অ্যাসােসিয়েশন, যুক্তরাষ্ট্রে ফেডারেশন অব অস্ট্রেলিয়ান মুসলিম স্টুডেন্ট অ্যান্ড ইয়ুথ, ইংল্যান্ডে ‘এফওএসআইএস’ এবং ইউক্রেনে স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ সেন্টার’। দেশের মতাে শিবিরের বিদেশের এসব শাখাও নিয়ন্ত্রণ করছে জামায়াত।
সহায়কসূত্র
দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক সংবাদ, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক সংগ্রাম, সামহােয়ারইনব্লগ, নাগরিক ব্লগ, সচলায়তন ব্লগ
পরিশিষ্ট-১
জামায়াতের আরাে হাঁড়ির খবর যুদ্ধাপরাধের বিচারপ্রক্রিয়া ঠেকাতে মরিয়া জামায়াত মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচার ঠেকাতে মরিয়া হয়ে উঠেছে অভিযুক্ত রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামী এবং এর নেতারা। রাজনৈতিকভাবে বিষয়টি মােকাবিলা করতে না পেরে তারা যুক্তরাষ্ট্রে লবিস্ট নিয়ােগ দিয়েছে। লবিস্ট প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে চুক্তি করেছে ২৫ মিলিয়ন ডলারের। বাংলাদেশি মুদ্রায় এর পরিমাণ প্রায় ১৮২ কোটি টাকা। বাংলাদেশ ব্যাংকের চোখ ফাঁকি দিয়ে একটি বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে চুক্তির অর্থও পাঠিয়েছে জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী। মীর কাসেম আলী জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ ও কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদের সদস্য। মানিলন্ডারিং নীতিমালা অনুযায়ী বাংলাদেশ সরকারের অনুমতি, বিশেষ করে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়া কোনাে অর্থ বিদেশে প্রেরণ করা হলে তা মুদ্রা পাচার হিসেবে গণ্য। কিন্তু মীর কাসেম আলী বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমতি ছাড়াই ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বৈদেশিক মুদ্রা যুক্তরাষ্ট্রের লবিস্ট প্রতিষ্ঠান কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটস-এর একাউন্টে প্রেরণ করেছে, যা। সম্পূর্ণরূপে অবৈধ এবং মুদ্রা পাচারের শামিল। এ ঘটনা প্রকাশের পর বিষয়টি খতিয়ে দেখতে শুরু করেছে বাংলাদেশ ব্যাংক। একাধিক গােয়েন্দা সংস্থাও বিষয়টি তদন্ত করছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭১ সালে সংঘটিত মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচার বাধাগ্রস্ত করতে লবিস্ট নিয়ােগের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের একটি কনসালট্যান্সি ফার্মের (CASSIDY & ASSOCIATES, INC) সঙ্গে ২৫ মিলিয়ন ডলারের চুক্তি করেন জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলী। ২০১০ সালের ১০ মে ছয় মাসের জন্য তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কনসালট্যান্সি ফার্ম কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটসের সঙ্গে এ চুক্তি করেন। ওই চুক্তি অনুযায়ী ২৫ মিলিয়ন ডলার অগ্রিম পরিশােধ করতে হয়েছে মীর কাসেম আলীকে। সিটি ব্যাংক এনএ-এর মাধ্যমে ইলেকট্রনিক ট্রান্সফার পদ্ধতিতে চুক্তির অর্থ কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটসের হিসাব নম্বরে (৩০৭১৭২৪৮, সুইফট কোড : সিটি ইউএস ৩৩) পাঠানাে হয়েছে। কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটসের প্রধান। নির্বাহী কর্মকর্তা ও সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান হলেন যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কংগ্রেসম্যান মার্টি রুশাে। অনুসন্ধানে পাওয়া নথি অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানটির ঠিকানা হচ্ছে ৭০০ থাটি স্ট্রিট, এনডাব্লিউ, সুইট-৪০০, ওয়াশিংটন ডিসি। যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের ওপর চাপ প্রয়ােগ ও লবিংসহ মীর কাসেম আলীর উদ্দেশ্য সফল করাই এই চুক্তির লক্ষ্য বলে চুক্তিপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে সই করেন মীর কাসেম আলী এবং কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটসের পক্ষে জেনারেল কাউন্সেল অ্যান্ড্রু জে, ক্যামেরস। মীর কাসেম আলীর উদ্দেশ্য সফল করতে ২০১০ সালের ৬ অক্টোবর থেকে গত ৫ এপ্রিল পর্যন্ত ছয় মাস যুক্তরাষ্ট্র ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে লবিং করার জন্য এ চুক্তি করা হয়। প্রয়ােজনে। আরও ২৫ মিলিয়ন ডলার (১৮২ কোটি টাকা) দিয়ে চুক্তির মেয়াদ ছয়। মাস বাড়ানাে যাবে বলে চুক্তিপত্রে উল্লেখ রয়েছে। এছাড়া চুক্তির বাইরে মামলা খরচসহ অন্যান্য খরচের ব্যয় বহন করতে আরও অর্থ দেওয়ার কথা কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটসকে। গত বছরের ৬ অক্টোবর মীর কাসেম আলীকে লেখা এক চিঠিতে কেসিডি অ্যান্ড অ্যাসােসিয়েটসের আন্তর্জাতিক কার্যক্রমবিষয়ক নির্বাহী ভাইস প্রেসিডেন্ট আমােস জে হােকস্টাইন উল্লেখ করেন, তার (কাসেম) স্বার্থ রক্ষার জন্য যুক্তরাষ্ট্র সরকার ও বাংলাদেশ সরকারের উচ্চপর্যায়ে লবিং চালিয়ে যাচ্ছে তারা। উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ক্ষমতায় আসার পর একাত্তরে সংঘটিত মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। এ লক্ষ্যে গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। নিয়ােগ দেওয়া হয় তদন্ত সংস্থা ও প্রসিকিউশন। তদন্ত সংস্থার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের মানবতাবিরােধী অপরাধে জড়িত থাকার অভিযােগে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্রসংঘ ও আল বদর বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বে ছিলেন মীর কাসেম। জামায়াতের সাংগঠনিক সূত্রে আরও জানা যায়, কেন্দ্রীয় নেতাদের রক্ষার জন্য দলের পক্ষ থেকে ইউরােপ ও আমেরিকার শতাধিক আইনজীবীকে প্রস্তুত রেখেছে জামায়াত। এজন্য প্রতি মাসে কয়েক কোটি টাকা জোগান দিচ্ছে জামায়াতে ইসলামীর প্রবাসী নেতা-কর্মীরা। শুধু তাই নয়, লন্ডনে বসে পুরাে কাজের সমন্বয় করছেন জামায়াত নেতা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি কামাল আহমেদ শিকদার এবং ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র শিবিরের সাবেক সভাপতি নজরুল ইসলাম। জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কামাল আহমেদ শিকদার ও নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে পড়াশােনা শেষ করে স্কলারশিপ নিয়ে বর্তমানে লন্ডনে আইন। বিষয়ে অধ্যয়ন করছেন। এরা দুজন প্রবাসে অবস্থানরত অন্য জামায়াতশিবিরের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে নিয়ে দলের শীর্ষ নেতাদের রক্ষার জন্য। আইনজীবী নিয়ােগসহ আন্তর্জাতিক পর্যায়ে লবিং করছে। এ ব্যাপারে। জামায়াতের কেন্দ্রীয় সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ব্যারিস্টার আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, শতাধিক আইনজীবীর বিষয়ে জানি না, তবে জামায়াতের পক্ষ থেকে লন্ডনে আন্তর্জাতিক মানের তিনজন আইনজীবীকে প্রস্তুত রাখা হয়েছে। তারা হলেন স্টিভেন কে, টবিক এডম্যান ও জন ক্যানেক। আইনজীবী নিয়ােগ করার বিষয়ে বাংলাদেশ থেকে প্রবাসী নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ রক্ষা করছেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় কর্ম পরিষদ সদস্য ও দলের আন্তর্জাতিক বিষয়ক নেতা মতিউর রহমান আকন্দ। তিনি বর্তমান আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালকে আন্তর্জাতিক মানের নয় বলে দাবি করেন। মতিউর রহমান বলেন, এ ট্রাইব্যুনালের বিচারক ও আইনজীবী সবাই দেশি। তাই এটা কীভাবে আন্তজাতিক মানের হয়? আমরা বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধ বিষয়ক ট্রাইব্যুনাল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধাপরাধবিষয়ক বিশেষ দূত স্টিফেনের সুপারিশ সমর্থন করি। দেশের বাইরে জামায়াতের প্রচারণার সাক্ষী স্বয়ং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম। তিনি লন্ডন সফরকালে জামায়াত নেতাদের লবিংয়ের অনেক প্রমাণও পেয়েছেন। লন্ডনের হাউস অব লর্ডসের সদস্যরা জামায়াতের পাঠানাে যুদ্ধাপরাধের বিচারবিরােধী বিভিন্ন ডকুমেন্টও দেখিয়েছেন সৈয়দ আশরাফকে। আর দেশে যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুকে ঘােলাটে করতে নানা নেতিবাচক প্রচারণার জন্য প্রাথমিকভাবেই জামায়াত ব্যয় করেছে প্রায় পৌনে এক কোটি টাকা। গােয়েন্দা কর্মকর্তারা এর বিভিন্ন আলামত জব্দ করেছেন। যেখানে রয়েছে বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনার সঙ্গে নিজামীদের ছবিসংবলিত পােস্টার, বিভিন্ন সিডি, নিজেদের তৈরি আওয়ামী লীগের ৭৭ নেতার নামসম্বলিত যুদ্ধাপরাধীদের তালিকাসহ ডকুমেন্ট।
মীর কাসেম আলী
একাত্তরে চট্টগ্রাম গণহত্যার নায়ক রাজাকার মীর কাসেম আলী এখন শত শত কোটি টাকার মালিক। দিগন্ত মিডিয়া ও ইবনে সিনা ট্রাস্টের কর্ণধার হিসেবে তার পরিচিতি রয়েছে। আজকের এই ধনকুবের রাজাকারের সূচনা একেবারে দীনহীন অবস্থা থেকে। মানিকগঞ্জের হরিরামপুর থানার চালা গ্রামের পিডব্লিউডি কর্মচারী তৈয়ব আলীর চার ছেলের মধ্যে দ্বিতীয় মীর কাসেম। ডাক নাম পিয়ারু, সবাই চেনে মিন্টু নামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের আগে পিতার চাকরির সুবাদে চট্টগ্রাম গিয়েছিল পড়তে। চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র থাকার সময় জড়িয়ে পড়ে মওদুদীর মৌলবাদী রাজনীতিতে। জামায়াতের অঙ্গসংগঠন ইসলামী ছাত্র সংঘের দায়িত্ব পায় স্বাধীনতার আগে। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় জামায়াত পক্ষ নেয় পাকিস্তানের। রাজাকার অর্ডিন্যান্স জারির পর জামায়াতে ইসলামী তাদের ছাত্র সংগঠন ছাত্র সংঘের নেতাদের স্ব স্ব জেলার রাজাকার বাহিনীর প্রধান নিযুক্ত করে। সেই সুবাদে মীর কাসেম আলী চট্টগ্রাম জেলার প্রধান নির্বাচিত হয়। ১৯৭১ সালের ২ আগস্ট চট্টগ্রাম মুসলিম ইন্সটিটিউটে তার নেতৃত্বে স্বাধীনতাবিরােধী সমাবেশ
৬০
আয়ােজন করা হয়। মীর কাসেম আলীর স্বাধীনতাবিরােধী তৎপরতার সময় ছাত্র সংঘের নতুন প্রাদেশিক পরিষদ গঠন হয়। মীর কাসেম সে পরিষদের সাধারণ সম্পাদক হয়। ছাত্রসংঘের নেতারা শুরু থেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকে। ১৯৭১ সালের ৪ ডিসেম্বর ইয়াহিয়া খান জরুরি অবস্থা জারি করার পর মীর কাসেম এক বিবৃতি দিয়ে বলে- হিন্দুস্তানকে হুঁশিয়ার করে দিতে চাই পাকিস্তান ভাঙতে এলে হিন্দুস্তান নিজেই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এরপর শুরু হয় বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা। মীর কাসেমের নির্দেশে চট্টগ্রামের টেলিগ্রাফ অফিসের লাগােয়া ডালিম হােটেলে রাজাকার বাহিনীর বন্দি শিবির খােলা হয়। বহু লােককে ওখানে এনে খুন করা হয়। ১৭ ডিসেম্বর সেখান থেকে সাড়ে তিনশ বন্দিকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। বুদ্ধিজীবী হত্যার তালিকা প্রণয়নকারীদের অন্যতম ছিল মীর কাসেম আলী। স্বাধীনতার পর মীর কাসেম পালিয়ে ঢাকা চলে আসে। তখন সে সবার কাছে তার নাম মিন্টু এবং নিজেকে একজন মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে পরিচয় দিত। কিন্তু একাত্তরের ঘাতক হিসেবে চিহ্নিত হওয়ার পর আরেক ঘাতক মঈনুদ্দিনের সঙ্গে সে পালিয়ে চলে যায় লন্ডন। সেখান থেকে সৌদি আরব। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান নিহত হওয়ার পর আবার দেশে ফিরে আসে মীর কাসেম। এখনে উল্লেখ্য যে, তখন মােশতাক সরকার শেখ মুজিবের ঘাতকদের বাঁচাতে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারির পাশাপাশি প্রত্যাহার করে নিয়েছিল দালাল আইন। এরপর জিয়াউর রহমানের শাসনামলে নতুন করে সংগঠিত হয় ইসলামী ছাত্র সংঘ। নাম বদলে রাখা হয় ইসলামী ছাত্র শিবির। ছাত্র শিবিরের প্রথম কেন্দ্রীয় সভাপতি হয় মীর কাসেম আলী। এরপর রােহিঙ্গা পুনর্বাসনের নামে সে ‘রাবেতা আল ইসলামী’ গড়ে তােলে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলাের টাকায় ধীরে ধীরে আরও গড়তে থাকে ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা ট্রাস্ট ও ইবনে সিনা ফার্মাসিউটিক্যালস। জামায়াতে ইসলামী ও শিবিরের আয়ের এবং কর্মসংস্থানের বড় উৎস হয়ে দাঁড়ায় এসব প্রতিষ্ঠান।
জামায়াতের অর্থের উৎস কোথায়?
জামায়াতে ইসলামীর অর্থনৈতিক ব্যবস্থার চালিকাশক্তি হিসেবে ব্যাংক, বীমা, লিজিং কোম্পানি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান (স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, কোচিং), ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠান, যােগাযােগব্যবস্থা (বাস, ট্রাক, লঞ্চ, জাহাজ, সিএনজি), রিয়েল এস্টেট, নিউজ মিডিয়া, আইটি, প্রকাশনা সংস্থা ইত্যাদি মুখ্য। ভূমিকা পালন করে। এগুলাে সবই নিট মুনাফা থেকে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে জামায়াতকে অর্থের জোগান দিচ্ছে। জামায়াত নিয়ন্ত্রিত অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলাে থেকে বছরে প্রায় এক হাজার থেকে দেড় হাজার কোটি টাকার নিট মুনাফা হয়। এর মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান সরাসরি জামায়াতের তহবিল উন্নয়ন করে; আবার কিছু আছে, যেগুলাে থেকে ফুলটাইমার সংগঠকদের অর্থ উপার্জনের ব্যবস্থা করা হয়। ইসলামী ঐক্যজোটের চেয়ারম্যান মওলানা মিছবাহুর রহমান চৌধুরীর মতে, জামায়াত প্রথম দিকে টাকার উৎস তৈরি করে সৌদি আরব থেকে। মুক্তিযুদ্ধের পর বাংলাদেশে ইসলামি ব্যবস্থা ও ইসলাম চর্চার সব উপায় বন্ধ হয়ে গেছে, এমন মিথ্যা অভিযােগে সৌদি আরবের কাছে। জামায়াত টাকা চায় মসজিদ নির্মাণ, মাদ্রাসা খোলা, আল কোরআন চর্চার কথা বলে। ২০০৫ সালে প্রকাশিত এশিয়া টাইমস-এর সূত্র মতে, বাংলাদেশে ইসলামী এনজিওগুলােকে অর্থ সরবরাহকারী দাতা। সংস্থাগুলাে হলাে রাবেতা আল ইসলামি, সােসাইটি অব সােশ্যাল রিফর্ম, ইসলামিক হেরিটেজ সােসাইটি, কাতার চ্যারিটেবল সােসাইটি, আল মুনতাদা আল ইসলামী, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফোরকান ফাউন্ডেশন, ইন্টারন্যশনাল রিলিফ অর্গানাইজেশন, মুসলিম এইড বাংলাদেশ, কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি। এসব অর্থের জোগানদাতা মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সংগঠনের টাকায় বাংলাদেশে আদর্শ শিক্ষা পরিষদ, আল আমিন ট্রাস্ট, আল মুরতাদা ডেভেলপমেন্ট সােসাইটি, কৃষি কল্যাণ সমিতি, দারুস সালাম সােসাইটি, আল হেরা একাডেমীসহ জামায়াত নেতাদের কর্তৃত্বে অনেক সংগঠন পরিচালিত হয়। এগুলাের বেশির ভাগই জঙ্গি কাজে সম্পৃক্ত রয়েছে বলে গােয়েন্দা সংস্থার কাছে তথ্য আছে।
ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড
জামায়াতের সবচেয়ে বড় এবং লাভজনক প্রতিষ্ঠান ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড। ইসলামী ব্যাংকের নিজেদের সুদমুক্ত ব্যাংক বলে দাবি করলেও গ্রাহকদের ঠিকই লভ্যাংশ দেয়। এই ব্যাংকটির মূল কাজ হচ্ছে, যারা জামায়াত-শিবির করে তাদের ঋণসহ নানা ধরনের আর্থিক সুবিধা | দেওয়া। ইসলামী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ থেকে শুরু করে সব কর্মকর্তাদের অতীত ইতিহাস ঘাটলে দেখা যাবে এরা সবাই পরীক্ষিত জামায়াত কর্মী। ইসলামী ব্যাংকের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু নাসের মােহাম্মদ আবদুজ জাহের আল বদর হাইকমান্ডের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিল। একাত্তরের ঘাতক দালালরা কে কোথায় বইটিতে আছে একাত্তরে তার ভূমিকার বিবরণ। এই ব্যক্তি আলবদর বাহিনী চট্টগ্রাম | জেলা প্রধানের দায়িত্বেও ছিল। ইসলামী ব্যাংকের সাবেক পরিচালক মরহুম মােহাম্মদ ইউনুসও ছিল আল বদর হাইকমান্ড-এর একজন সদস্য এবং জামাতের মজলিসে শুরার সদস্য। আরেক পরিচালক ছিল মীর কাসেম আলী। ইবনে সিনা ট্রাস্ট ইবনে সিনা ট্রাস্ট জামাতের ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান। এখান থেকে আয়ের বড় অংশ আসে। এই ট্রাস্টের নামে আছে ইবনে সিনা হাসপাতাল, ইবনে সিনা ডায়াগনস্টিক সেন্টার, ইবনে সিনা ফার্মাসহ ৬টি প্রতিষ্ঠান। কর্মীদের লালনপালন করার আরেকটি বড় উদ্যোগ এই ট্রাস্ট। জামায়াতের গণমাধ্যম দৈনিক সংগ্রাম জামায়াতের মুখপত্র হওয়াতে সাধারণ পাঠক কখনােই পত্রিকাটি পড়তাে না। তাই জামায়াতের পরিকল্পনার অংশ হিসেবে চালু করা হয় দৈনিক নয়াদিগন্ত। এছাড়া দিগন্ত টেলিভিশনের মাধ্যমে টেলিকাস্টিংয়ের কাজ শুরু করে জামায়াত। এছাড়া পরােক্ষভাবে জামায়াতের হয়ে কাজ করছে দৈনিক আমার দেশ এবং ইসলামিক টিভি। দৈনিক আমার দেশ-এ জামায়াতের অংশীদারিত্ব থাকায় এবং ইসলামিক টিভির সাথে জামায়াতের আদর্শগত মিল দেখে অনেকেই অভিযােগ করেন এই মাধ্যম দুটি সম্পর্কেও। কিশাের কণ্ঠ, মাসিক মদিনা প্রভৃতি প্রকাশনাও জামায়াতের তহবিল গােছাতে সাহায্য করে। এছাড়া জামায়াতের নিজস্ব প্রডাকশন থেকে বিভিন্ন ইসলামি সিডি, ইসলামি বই, সাইমুম শিল্পী গােষ্ঠীর অ্যালবাম বিক্রি করেও জামায়াত একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে। এছাড়া সম্প্রতি চালু হওয়া অনলাইন মিডিয়া নতুনবার্তাডটকমও জামায়াতের প্রতিষ্ঠান বলে জানা গেছে। শুধু তাই নয়, বিভিন্ন সাংবাদিক সমিতি এবং সাংবাদিক সংঘগুলােতেও জামায়াতপন্থী সাংবাদিকচক্র লক্ষণীয়। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু করে রিপাের্টার্স ইউনিটি, ফটোসাংবাদিক সমিতি, ঢাকা। বিশ্ববিদ্যালয় সাংবাদিক সমিতি সবখানেই জামায়াতের গণমাধ্যমকর্মীর সংখ্যা লক্ষণীয়।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান
জামায়াতের অনেকগুলাে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। এর মধে আছে চট্টগ্রামের ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ইউনিভার্সিটি, ঢাকার মানারত বিশ্ববিদ্যালয়, সাঈদীর বাংলাদেশ ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়। এর বাইরে। আরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, যেগুলাের মূল বা সিংহভাগ মালিকানা জামায়াতে ইসলামী নেতাদের। যেমন, নর্দান ইউনিভার্সিটি ও ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলে প্রতিষ্ঠিত সিলেট উইমেন্স মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল জামায়াতের কেন্দ্রীয় কমিটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল ডা. শফিকুর রহমান এবং আরও কয়েকজন জামায়াত নেতার সম্পত্তি।
কোচিং সেন্টার
বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির জন্য ফোকাস’, মেডিকেলে ভর্তির জন্য রেটিনা এবং ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ভর্তির জন্য কনক্রিট’, ‘কনসেপ্ট’ ও ‘এক্সিলেন্ট” কোচিং সেন্টারগুলাে মূলত জামায়াত-শিবিরের বিভিন্ন ফাউন্ডেশনের নামে প্রতিষ্ঠিত ও পরিচালিত। এসব কোচিং সেন্টার আবার প্রশ্নপত্র ফঁসের সঙ্গেও জড়িত। এখানে জামায়াত পরিবারের সন্তানদের এবং শিবির ও ছাত্রী সংস্থার কর্মীদের প্রায় বিনামূল্যে কোচিং করানাে হয়। এই কোচিং সেন্টারগুলােকে কেন্দ্র করে জামায়াতের বেশ কিছু মেস এবং হােস্টেল রয়েছে রাজধানীতে। এগুলাে জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে কাজ করে। জামায়াতের এই কোচিং সেন্টারগুলাে ঢাকার নটর ডেম কলেজের মতাে সেকুলার কলেজের ছেলেদের নিয়মিত নবীনবরণ পর্যন্ত করে থাকে। কলেজ পড়ুয়াদের আকৃষ্ট করার জন্য তারা বিভিন্ন সময় খুবই স্বল্প খরচে ভ্রমণের আয়ােজন করে। এরকম টুরের নামে ছেলেমেয়েদের জোর করে রাতে মসজিদে থাকতে এবং নামাজ পড়তে বাধ্য করে বলেও অভিযােগ আছে জামায়াত নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে।
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান
জামায়াতে ইসলামী নেতা মীর কাসেম আলীর কেয়ারি গ্রুপ রিয়েল এস্টেটের সঙ্গে জড়িত। টেকনাফ থেকে সেন্টমার্টিন যাওয়ার জন। কেয়ারি সিন্দবাদ জাহাজটিও জামায়াত নেতা মীর কাসেম আলীর। আবুল কাশেম হায়দার চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় শিবিরের নেতা ছিলেন। তার ইয়ুথ গ্রুপ থেকে তৈরি হতাে ভার্জিন ড্রিংকস। রিয়েল এস্টেট মিশন গ্রুপ, হেরােইন পাচারের দায়ে অভিযুক্ত বিডি ফুডসের বিডি গ্রুপসহ বেশ কিছু বড় ব্যবসা প্রতিষ্ঠান থেকে উপার্জিত লভ্যাংশের একটা বড় অংশ যােগ হয় জামায়াতের তহবিলে। এছাড়া এলাকাভিত্তিক বেশ কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে জামায়াতের। এর মধ্যে সিলেট, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার। এবং পাবনাতেও জামায়াতের কিছু প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
৬৫
আবুল বারাকাতের মৌলবাদের অর্থনীতি
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এবং জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড, আবুল বারাকাত ২০০৫ সালে জামায়াতের অর্থনীতি নিয়ে একটি গবেষণা করেছিলেন। বিষয় ছিল ‘মৌলবাদের রাজনৈতিকঅর্থনীতি। সেখানে তিনি বলেছেন, মৌলবাদীদের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার সাড়ে ৭ থেকে ৯ ভাগ। তারা প্রতি বছর প্রায় ৩০০ কোটি টাকা। ব্যয় করে শুধু রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে। এর মধ্যে আছে জঙ্গি কর্মকাণ্ড ছাড়াও সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা ব্যয়, রাজনৈতিক কর্মীদের বেতন, জনসভা আয়ােজন ও অস্ত্র প্রশিক্ষণ। তাদের দেড় হাজার কোটি টাকা মুনাফার ২৭ শতাংশ আসে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে যার মধ্যে রয়েছে, ব্যাংক, বীমা ও লিজিং কোম্পানি। ২০ দশমিক ৮ শতাংশ আসে বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থা থেকে, ১০ দশমিক ৮ ভাগ আসে বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান থেকে। ১০ দশমিক ৪ ভাগ আসে ওষুধ শিল্প ও ডায়াগনস্টিক সেন্টারসহ স্বাস্থ্য প্রতিষ্ঠান থেকে ৯.২ শতাংশ আসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে ৮৩ শতাংশ আসে রিয়েল এস্টেট ব্যবসা থেকে। যােগাযোগ ব্যবসা থেকে আসে ৭.৫ শতাংশ এবং তথ্যপ্রযুক্তি ও সংবাদ মাধ্যম থেকে আসে ৫.৮ শতাংশ।
জামায়াতে ইসলামীর অতীত
১৯৪১ সালের ২৬ আগস্ট ভারতের হায়দারাবাদে প্রতিষ্ঠিত হয়। আজকের এ জামায়াতে ইসলামী। মাওলানা আবুল আলা মওদুদি। প্রতিষ্ঠিত এ দলের নাম ছিল জামায়াতে ইসলামী হিন্দ। ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে ভারতের স্বাধীনতা যখন প্রায় নিশ্চিত, সেই সময়েও এ মওদুদি বলেছিলেন, ভারতের স্বাধীনতার চেয়ে এ মুহুর্তে বেশি জরুরি হলাে এখানে হুকুমতের আইন প্রতিষ্ঠা করা। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর পূর্ব পকিস্তানে জামায়াত শাখার আহ্বায়ক করা হয় খুররম শাহ মুরাদকে মাওলানা আব্দুর রহীম, ব্যারিস্টার কোরবান আলী ছিলেন যুগ্ম আহ্বায়ক আব্দুর রহীম কারমাইকেল কলেজ থেকে জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ে আসে গােলাম আযমকে পরবর্তী সময়ে পূর্ণাঙ্গ কমিটি গঠনের মাধ্যমে কার্যক্রম শুরু করে দলটি। পাক-ভারত স্বাধীনতার কয়েক মাস আগে ১৯৪৭ সালের এপ্রিল মাসে পাটনায় জামায়াতের সম্মেলন করেন মওদুদি। আগস্টের স্বাধীনতার পর মওদুদি পাকিস্তানের লাহােরে একটি বস্তিকে ‘দারুল ইসলাম ঘােষণা করে সেখানে অবস্থান নিতে থাকেন। এখান থেকেই দল পরিচালনার কাজ আর উগ্রবাদী সব বইপুস্তক প্রকাশ শুরু করেন। ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগের আগে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকার প্রায়। সবাই (৯০ ভাগ বাঙালিসহ) দেশবিভাগ এবং মুসলমানদের জন্য একটি আলাদা রাষ্ট্র পাকিস্তান সৃষ্টির পক্ষে ছিল। কিন্তু জামায়াতে ইসলামী ছিল পাকিস্তান তত্ত্বের ঘাের বিরােধী। জন্মের শুরু থেকে জামায়াতে ইসলামী চলেছে উল্টো স্রোতে। মাওলানা মওদুদি এমন একজন ইসলামী দলের রাজনৈতিক প্রধান যিনি সর্বপ্রথম বলেছিলেন, “মুসলমানদের জন্য আলাদা রাষ্ট্রের কোনাে প্রয়ােজন নেই।’ অথচ পাকিস্তান সৃষ্টির কিছুদিনের মধ্যেই জামায়াত হয়ে গেল চরম পাকিস্তান-প্রেমিক। মওদুদি তার পার্টি জামায়াতে ইসলামীকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ধর্মের নামে একাধিক দাঙ্গা সৃষ্টিতেও দ্বিধাবােধ করেননি। তার নির্দেশ এবং মদদে পাকিস্তানে হাজার হাজার লােক প্রাণ হারিয়েছে। ১৯৫৩ সালে মাওলানা মওদুদি তার লেখা Qadiani Problem’ বইয়ে। ‘আহমদিয়া সম্প্রদায়কে অমুসলিম ঘােষণা করে। পাশাপাশি পাকিস্তানের জুলফিকার আলী ভুট্টো সরকারকে আহমদিয়া সম্প্রদায়কে ‘অমুসলিম ঘােষণা করার জন্য চাপ প্রয়ােগ করতে থাকে। পরবর্তীকালে এই বিষয়টিকে পুঁজি করেই মাওলানা মওদুদি সারা পশ্চিম পাকিস্তানে। সুন্নি মুসলিম এবং আহমাদিয়াদের মধ্যে এক রক্তাক্ত দাঙ্গা বাধিয়ে দেন। শুধু পাঞ্জাব প্রদেশেই সেই রক্তাক্ত দাঙ্গায় দুই হাজার আহমদিয়া সম্প্রদায়ের মানুষ মারা গিয়েছিল। এই নির্মম হত্যাকাণ্ডের মদদদানের অভিযােগে পাকিস্তানের মিলিটারি কোর্ট মাওলানা মওদুদির মৃত্যুদণ্ড ঘােষণা করেছিল। কিন্তু আইনকে বুড়াে আঙুল দেখিয়ে মৃত্যুদণ্ডকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে পরিণত করে ১৯৫৫ সালে বহাল তবিয়তেই জেল থেকে বেরিয়ে আসেন মওদুদি। গণহত্যার বীজ বপনকারী সেই নরপিশাচের শাস্তি দিতে পারেনি পাকিস্তান। আর এভাবেই উপমহাদেশের ইতিহাসকে কলঙ্কিত করে উত্থান ঘটেছিল আজকের এই জামায়াতে ইসলামীর।
একাত্তর ও একাত্তর পরবর্তী জামায়াতে ইসলামী
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয় পাকিস্তানের প্রথম সাধারণ নির্বাচন। কট্টর মৌলবাদী জামায়াতে ইসলামী নির্বাচনের আগে অনেক বড় বড় কথা বললেও নির্বাচনী ফলাফলে স্পষ্ট হয়ে ওঠে জামায়াতে ইসলামীর ভরাডুবি। জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পাঞ্জাব প্রদেশে একটি, সিন্ধু প্রদেশে দুটি এবং পেশওয়ারে একটি আসনসহ মাত্র ৪টি আসনে কোনােরকমে জয়লাভ করে জামায়াত। অপরদিকে নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ১৯৭০ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের ৩০০ আসনের মধ্যে পেয়েছিল ১৬৭ আসন। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করলেও পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগােষ্ঠী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে রাজি হয়নি। বরং জুলফিকার আলী ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে অবৈধভাবে পাকিস্তানের ক্ষমতার আসনে বসানাের এক হীন চক্রান্তে মেতে উঠেছিল তারা। সেই ষড়যন্ত্রকে প্রতিহত করে বাঙালির স্বাধীনতা ছিনিয়ে নিয়ে আনার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সাড়া দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি মানুষ ঝাপিয়ে পড়েছিল মুক্তির সংগ্রামে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ অপারেশন সার্চলাইটের নামে এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপরে পাকিস্তানি হানাদাররা এক নারকীয় গণহত্যা চালিয়েছিল। তারপর থেকেই শুরু হয় জামায়াতে ইসলামীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ। তকালীন মুসলিম লীগ নেতা ফজলুল কাদের চৌধুরী (সাকা চৌধুরীর পিতা) পাকিস্তানি হানাদারদের সাহায্য করার জন্য প্রতিষ্ঠা করেন শান্তিবাহিনী। কিন্তু জামায়াতে ইসলামীর তাতে মন ভরল না। তারা চেয়েছিল মানব ইতিহাসের সব থেকে বড় গণহত্যা। জামায়াতে ইসলামীর নেতা-কর্মীরা পাকিস্তান সেনাবাহিনীকে সাহায্যের নামে রাজাকার, আল-বদর, আল-শামস ইত্যাদি বাহিনী গড়ে তুলতে থাকে। মুক্তিযুদ্ধের পুরাে সময়জুড়ে তারা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর পক্ষে কাজ করে। স্বাধীনতা যুদ্ধের শেষদিকে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করে এ দেশকে পঙ্গু করে দেওয়ার নােংরা কৌশল অবলম্বন করতেও দ্বিধা করেনি একাত্তরের এই যুদ্ধাপরাধীরা। বর্তমান জামায়াতে ইসলামীর বেশির ভাগ শীর্ষ নেতাই একাত্তরে ছিল রাজাকার। ১৯৭১ সালের ৩০ জুন লাহােরে সাংবাদিকদের কাছে গােলাম আযম বলে, তার দল পূর্ব পাকিস্তানে দুষ্কৃতকারীদের (মুক্তিযােদ্ধা) তৎপরতা দমন করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করছে এবং এ কারণেই দুষ্কৃতকারীদের হাতে বহু জামায়াত কর্মী নিহত হয়েছে।’ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের সরকারি দলিলে সন্নিবেশিত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে সব রকমের সহযােগিতা করতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের দলীয় নেতা-কর্মীদের ঝাপিয়ে পড়ার নির্দেশ দিয়েছিল। নিজামী। এছাড়া তাদের দালালির বিভিন্ন তথ্যপ্রমাণ সেই সময়ে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বীরশ্রেষ্ঠ মতিউর রহমান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হওয়ার পর তাকে ভারতীয় এজেন্ট বলে আখ্যয়িত করে জামায়াত নেতা নিজামী। শুধু গণহত্যাই নয়—এ দেশের নিরীহ মানুষের ওপর অমানুষিক অত্যাচার, সম্পত্তি লুটপাট করেছে তারা। লাখ লাখ বীরাঙ্গনা তাদের দালালিতে সম্ভ্রম হারিয়েছেন। অনেক যুদ্ধশিশুকে মুক্তিযুদ্ধের পর বিদেশে পাঠানাে হয়েছে। দেশে ফিরে এত বছর পরও তাদের অনেকেই খুঁজে ফিরছেন তাদের অস্তিত্বকে—তাদের বাবা-মা ও স্বজনদের। কিন্তু কে স্বীকার করবে সেই অপমান!
স্বাধীন বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামীর উত্থান
মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম দিকে পালিয়ে বেড়াচ্ছিল সব রাজাকার, আল-বদর। জামায়াতের গােলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামীসহ অনেক নেতা একাত্তরের পর প্রাণভয়ে পাকিস্তানে পালিয়ে যায়। কিন্তু ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার পর জামায়াত নেতারা আবার ফিরে আসতে শুরু করে স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে। এই সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার আগে মাত্র একজন রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর করা সম্ভব হয়েছিল। পরবর্তীকালে ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু হত্যার পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হন জিয়াউর রহমান। তখনও পর্যন্ত বাংলাদেশের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানে ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ছিল। কিন্তু ক্ষমতার মসনদে বসেই ১৯৭৫ সালে জিয়াউর রহমান সংবিধান সংশােধনের মাধ্যমে ছাড়পত্র দিলেন ইসলামী ডেমােক্রেটিক ফ্রন্টকে (আইডিএফ)। আর এই আইডিএফের ব্যানারে চিহ্নিত রাজাকার-যুদ্ধাপরাধীরা একে একে আবির্ভূত হতে শুরু করল এ দেশের রাজনীতির প্ল্যাটফর্মে। গােলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আব্বাস আলী খান মিলে। প্রতিষ্ঠা করল যুদ্ধাপরাধীদের রাজনৈতিক সাইনবাের্ড বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। জিয়াউর রহমান এ দেশের মাটিতে স্বাধীনতাবিরােধী শক্তিকে মেনে নিলেও দেশের সাধারণ মানুষ মেনে। নিতে পারেনি। বায়তুল মােকাররমে নামাজ পড়তে গিয়ে মুসল্লিদের জুতাপেটা খায় গােলাম আযম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রদের হাতে একইভাবে লাঞ্ছিত হয় মতিউর রহমান নিজামী। জামায়াতে ইসলামীর অনুগত ছাত্র সংস্থা ইসলামী ছাত্রশিবির বহু বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রকাশ্যে মিছিল করতে পারেনি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে নিষিদ্ধ ঘঘাষিত হয়েছে ছাত্রশিবিরের কার্যক্রম। ১৯৮৬ সালে জামায়াত একটি ছােট ইসলামী দল হিসেবে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে। কিন্তু তারপরও জামায়াত ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে ১০ আসনে জয়লাভ করে চমকে দিয়েছিল দেশের মানুষকে। ১৯৯১ সালের
৭০
নির্বাচনে জামায়াত জয় পেয়েছিল ১৮টি আসনে। নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত জামায়াত নেতা গােলাম আযম ছিল পাকিস্তানের নাগরিক। কিন্তু তারপরেও স্বাধীন বাংলাদেশের একটি রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীর কর্ণধার সেজে বিশ্বে এক অনন্য(!) নজির স্থাপন করে এই যুদ্ধাপরাধী।
গণআদালতে গােলাম আযম
১৯৯১ সালে খালেদা জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভ করে। সেবার রাজনৈতিক স্বার্থ হাসিলের জন্য একাত্তরের স্বাধীনতবিরােধী চক্রের সঙ্গে হাত মেলাতেও দ্বিধাবােধ করেনি বিএনপি। জামায়াতে ইসলামীকে আরও উসকে দিতে তারা রাজাকার গােলাম আযমকে এ দেশের নাগরিকত্ব দেয় ১৯৯৪ সালে। সারা দেশের মানুষ। যখন যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে রাস্তায় নেমেছিল তখন পুলিশ দিয়ে লাঠিচার্জ করে তাদের ছত্রভঙ্গ করার ব্যবস্থা করেছিল খালেদা জিয়ার সরকার। তখন শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গণআদালত থেকে বাংলাদেশে প্রথমবারের মতাে স্বাধীনতা বিরােধীদের বিচারের দাবি জানিয়েছিলেন। কিন্তু খালেদা জিয়া তখন তার সরকারি বাহিনী নিয়ে জামায়াতে ইসলামীকে রক্ষা করার চেষ্টা করেন। এ দেশের লাখ লাখ মানুষ সেই ঐতিহাসিক দিনে সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণআদালতে গােলাম আযমের ফাঁসির রায় ঘােষণা করেছিলেন।
চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে বিএনপি, জাতীয় পার্টি এবং ইসলামী ঐক্য জোট মিলিত হয়ে চারদলীয় ঐক্যজোট গঠন করে। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি-জামায়াত জোট নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে নির্বাচিত হয়। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনে জামায়াতে ইসলামী মাত্র তিনটি আসনে জয়লাভ করলেও ২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনে ১৮টি আসনে জয়লাভ করেছিল। নির্মম হলেও সত্য যে, বাংলাদেশই সম্ভবত পৃথিবীর একমাত্র দেশ যেখানে দেশের স্বাধীনতাবিরােধী অপশক্তি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দেশের শাসনক্ষমতা দখল করতে সক্ষম হয়েছিল। চারদলীয় সে সরকারে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী হয়েছিল শিল্পমন্ত্রী, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ হয়েছিল সমাজকল্যাণ মন্ত্রী। বুকের রক্ত দিয়ে অর্জন করা লাল সবুজ পতাকার এর চেয়ে বড় অপমান আর কী হতে পারে!
বাংলাদেশে জঙ্গিবাদ সৃষ্টিতে জামায়াতের অপচেষ্টা
বাংলাদেশে ইসলামের নামে প্রকাশ্যে জঙ্গিবাদের শুরু ২০০৩ সাল থেকে। জিহাদি আন্দোলন পরিচালনার নামে ছাত্র শিবির প্রতিষ্ঠা করেছিল জামায়াতে ইসলামী। কিন্তু তাদের ব্যবহার করেই একসময়। জঙ্গি হামলা চালাতে শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। ছাত্রশিবিরের পাশাপাশি জামায়াত নেতারা গােপনে আরও অনেক জঙ্গি সংগঠনকেই মদদ দিয়ে আসছিল। সারা দেশে একযােগে বােমা হামলা চালিয়ে অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে ফেলে দেওয়া তথাকথিত ইসলামপন্থী দল জেএমবি নিঃসন্দেহে এ তালিকায় সবার ওপরে। জেএমবির আটককৃত বেশ কয়েকজন জঙ্গি পূর্বে ছাত্র শিবির বা জামায়াতের সঙ্গে জড়িত ছিল বলেও স্বীকারােক্তি দিয়েছে। এছাড়া সিলেটের মাজারে বােমা হামলা, রমনার বটমূলে বােমা হামলা, ২১ আগস্টে বােমা হামলার অভিযােগে অভিযুক্ত জঙ্গি সংগঠনগুলাের প্রত্যক্ষ মদদদাতা ছিল জামায়াতে ইসলামী নামে এই যুদ্ধাপরাধীর দল। ধর্মের নামে সন্ত্রাসবাদ কায়েম করাই ছিল এই স্বাধীন বাংলাদেশে যাদের একমাত্র লক্ষ্য। শীর্ষ জঙ্গি মুফতি হান্নানের জবানবন্দিতে উঠে এসেছে অনেক চাঞ্চল্যকর তথ্য। সেই তথ্য ধরে অগ্রগতি হওয়ার কথা ছিল অনেক কিন্তু হয়নি কিছুই। জঙ্গিবাদ সবচেয়ে বেশি আলােচনায় আসে গত জোট সরকারের সময়ে। জামায়াত জঙ্গিবাদকে মিডিয়ার সৃষ্টি বলে দাবি করলেও পরে জঙ্গিবাদের সঙ্গে জামায়াতেরই সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। জামায়াত জঙ্গিবাদকে পৃষ্ঠপােষকতা করে, বিএনপি জামায়াতকে পৃষ্ঠপােষকতা করে। এভাবেই এগিয়ে চলছে জঙ্গিবাদ। মুফতি হান্নানের জবানবন্দি থেকে জানা যায় বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির এক কালাে অধ্যায়ের কথা। বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের সময় হরকাতুল জিহাদ’ জেলাভিত্তিক এবং থানাভিত্তিক কার্যক্রম পরিচালনা করত বলে হরকাতুল জিহাদের প্রাক্তন কর্মী হাসান রফিক জানায়। এই হরকাতুল জিহাদের কর্মীদের দিয়েই ২১ আগস্ট আওয়ামী লীগের জনসভায় গ্রেনেড ছােড়া। হয়। পার্শ্ববর্তী দেশ বার্মার উগ্রবাদী সংগঠন রােহিঙ্গা সলিডারিটি অর্গানাইজেশন (আরএসও)-এর কর্মীরাও জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় হরকাতুল জিহাদ, জামায়াতে ইসলামী, আইটিএম বা ইতহাদাতুল মুসলিম এবং আরএসওর নেতা-কর্মীরা মিলে সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণ করত। তাদের ট্রেনিংয়ে জামায়াতের ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরের অনেক কর্মীও ছিল বলে জানায় আরএসওর সাবেক নেতা মোহাম্মদ শাকিল জিহাদী। বাংলাদেশের চট্টগ্রাম এবং সিলেট ছিল প্রশিক্ষণের সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। পাকিস্তানভিত্তিক জঙ্গি সংগঠন লস্কর-ই-তৈয়বার নেতা মুফতি ওবায়দুল্লাহ নিজেও এই প্রশিক্ষণের কথা স্বীকার করে বলে, তাদের অধীনেই পাঁচ হাজার জনকে জঙ্গি প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। এই পাঁচ হাজার আরও এক লক্ষ মানুষকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। প্রশিক্ষণপ্রাপ্তদের বেশির ভাগই জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি করে। জামায়াতের সাবেক এমপি দেলাওয়ার হােসাইন সাঈদীর ওয়াজ শুনে জিহাদে দীক্ষিত হতাে বলেও আদালতে জবানবন্দিতে অনেকেই জানিয়েছে। সাঈদীর একটি ওয়াজের ভাষা—’আমি আল্লাহর দ্বীন কায়েম করতে চাই। এই আন্দোলনকে পরিচালিত করতে গিয়ে যদি সশস্ত্র হামলার মােকাবিলা করতে হয় তাহলে সশস্ত্রভাবে মােকাবিলা করাই হচ্ছে জিহাদের চূড়ান্ত রূপ। ঈমানকে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে পৃথিবীর বুকে। সেজন্য সংগ্রাম করতে হবে। সে সংগ্রাম যত প্রকারেরই হােক সব জিহাদের অন্তর্ভুক্ত। জামায়াতের নেতাদের সরাসরি জঙ্গি সম্পৃক্ততার কথাও জানা যায় উগ্রবাদী সংগঠন আরএসওর আরবি ভাষায় প্রকাশিত মুখপত্র ‘আল তাদাম থেকে। ১৯৯১ সালের আল তাদাম পত্রিকায় সচিত্র প্রতিবেদনে। দেখানাে হয়েছিল, জামায়াতের চৌদ্দগ্রামের এমপি ডা. আব্দুল্লাহ মাে. তাহের এবং আমীরউল ইসলাম বকুল ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ফেডারেশন অব স্টুডেন্ট (আইআইএফএস)-এর সাথে নিয়মিত যােগাযােগ করত। ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই সাবেক সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক আইআইএফএস-এর সাথে মিলে অস্ত্রের লেনদেন করত। গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়—শায়খ আব্দুর রহমান, বাংলা ভাই, সানি, আব্দুল আওয়াল এরা সবাই একসময় ছাত্র শিবির করত। ছাত্র শিবির থেকে পরে শায়খ আব্দুর রহমানের নেতৃত্বে। দেশের বাইরে পাড়ি জমায় তারা। গন্তব্য ছিল মদিনা ইউনিভার্সিটি, মাধ্যম জামায়াত। জামায়াতের কয়েকজনের সাথে কথা বলে জানা যায়, মদিনা ইউনিভার্সিটিতে বাংলাদেশ থেকে পড়তে গেলে জামায়াতে ইসলামীর পক্ষ থেকে অনুমতি লাগে।
জঙ্গি হামলার খতিয়ান
হরকাতুল জিহাদ এবং অন্য জঙ্গিদের হত্যা ও বােমা হামলার খতিয়ানে দেখা যায়, ৬ মার্চ ১৯৯৯ যশােরে উদীচীর সম্মেলনে বােমা বিস্ফোরণ, সেখানে নিহত হয় ১০, আহত শতাধিক। ৯ অক্টোবর ১৯৯৯ খুলনায় আহমদিয়া মসজিদে বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭, আহত ৫০। ২০ জুলাই ২০০০ গােপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনার জনসভাস্থলে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন বােমা স্থাপন কিন্তু সভা আরম্ভের পূর্বে নিরাপত্তা বাহিনী এই বােমা অকেজো করে দেয়। ২০ জানুয়ারি ২০০১-এ ঢাকার পল্টন ময়দানে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সমাবেশে বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৭, আহত শতাধিক। ১৪ মার্চ ২০০১ রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১১, আহত শতাধিক। ৩ জুন ২০০১-এ গােপালগঞ্জের বানিয়ারচরের গির্জায় বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ১০, আহত ৩০। ১৭ জুন ২০০১ নারায়ণগঞ্জের আওয়ামী লীগ অফিসে বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ২১, আহত শতাধিক। ২৩ সেপ্টেম্বর ২০০১ বাগেরহাটে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার সভায় বােমা বিস্ফোরণ, নিহত হয় ৯, আহত শতাধিক। ২৬ সেপ্টেম্বর ২০০২ সিরাজগঞ্জে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আলােচনা সভায় বােমা বিস্ফোরণ, সেখানে নিহত হয় ৪, আহত ১৫। ২৮ সেপ্টেম্বর ২০০২-এ সাতক্ষীরার গুরপুকুরের রক্সি সিনেমা হলে এবং সার্কাস প্রাঙ্গণে বােমা বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে নিহত হয় ৩, আহত ২০০। ৭ ডিসেম্বর ২০০২ ময়মনসিংহের তিনটি সিনেমা হলে বােমা বিস্ফোরণ ঘটে, নিহত ১৯, আহত ৪৫। ১৭ জানুয়ারি ২০০৩-এ টাঙ্গাইলের সখীপুরের ফালুচাদ ফকিরের মাজারের মেলায় বােমা বিস্ফোরণ ঘটে, নিহত হয় ৭, আহত হয় ৮। ১ মার্চ ২০০৩ খুলনায় আন্তর্জাতিক বাণিজ্যমেলায় কর্তব্যরত পুলিশের ওপর বােমা হামলা হয়, নিহত হয় ১, কিছুসংখ্যক আহত হয়। ১২ জানুয়ারি ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটে, নিহত হয় ৭, আহত ৭০। ১ ফেব্রুয়ারি ২০০৪ খুলনায় সাংবাদিক মানিক সাহা বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয়। ২১ মে ২০০৪ সিলেটে হজরত শাহজালালের মাজারে ব্রিটিশ হাইকমিশনারের ওপর আর্জেস গ্রেনেড হামলা হয়, তাতে নিহত হয় ২, হাইকমিশনারসহ আহত হয় ৭০। ২৭ জুন ২০০৪ খুলনায় দৈনিক জন্মভূমির অফিসে বােমা বিস্ফোরণে সাংবাদিক হুমায়ুন কবির বালু নিহত হন। ৭ আগস্ট ২০০৪ সিলেটের গুলশান হােটেলে আর্জেস গ্রেনেড বিস্ফোরণে ১ জন নিহত ও ৪০ আহত হন। ২১ আগস্ট ২০০৪ আওয়ামী লীগের জনসভায় আর্জেস গ্রেনেড ও বােমা হামলায় কেন্দ্রীয় নেত্রী আইভি রহমানসহ নিহত ২৪, শেখ হাসিনাসহ আহত ৫০০-ও বেশি। ১৬ নভেম্বর ২০০৪ মৌলভীবাজারে যাত্রা প্রদর্শনীতে বােমা বিস্ফোরণে আহত হয় ১০ জন। ১৭ জানুয়ারি ২০০৫-এ গােপালগঞ্জে ব্র্যাক-এর অফিসে বােমা বিস্ফোরণে আহত হয়। ২১ জন। ৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ খুলনা প্রেসক্লাবে বােমা বিস্ফোরণে নিহত
৭৫
১ জন সাংবাদিক, আহত হন ৩ জন। ১৪ ফেব্রুয়ারি ২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালােবাসা দিবসের অনুষ্ঠানে বােমা বিস্ফোরণে আহত ৮ জন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী আলোচনা সভায় বােমা বিস্ফোরণ। ২০০৫-এর ১৭ আগস্ট জঙ্গিরা সারা দেশের তেষট্টিটি জেলায় একসঙ্গে পাঁচশ বােমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে জানিয়ে দিয়েছিল তারা কত শক্তিশালী। ৩ অক্টোবর ২০০৫ সালে লক্ষ্মীপুর, চাঁদপুর এবং চট্টগ্রামের কোর্টে বােমা বিস্ফোরণে নিহত হয় ৩ জন, লক্ষ্মীপুর কোর্টের ১ জন বিচারকসহ আহত হন ৩৮ জন। ১৪ নভেম্বর ২০০৫ সালে ঝালকাঠি জেলা কোর্টে বােমা। বিস্ফোরণ ঘটে। সেখানে নিহত হন ২ জন বিচারক, আহত হন ৩ জন। এভাবে ২৯ নভেম্বর ২০০৫, ১ ডিসেম্বর ২০০৫, ৮ ডিসেম্বর ২০০৫ এর। তিনটি বােমা হামলায় নিহত হন ১৯ জন আর আহত হন ১৫৮ জন।
জামায়াতে ইসলামী নিষিদ্ধ আইনি সুযােগ
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের স্বাধীনতাবিরােধী এক অশুভ গােষ্ঠীর রাজনৈতিক পরিচয় এখন ‘জামায়াতে ইসলামী!’ স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশে ‘জামায়াতে ইসলামী নামের পাকিস্তানের সেই দোসররা আজও প্রবল ষড়যন্ত্রের নেশায় মত্ত। এ দেশকে পরাধীনতার শেকলে আটকে রাখা ছিল যাদের একমাত্র লক্ষ্য, তারাই আজ দোর্দণ্ড প্রতাপের সঙ্গে এই স্বাধীন বাংলাদেশে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। আর সেই একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী নরপিশাচদের হীন চক্রান্তের প্রত্যক্ষ মদদদাতা রাজনৈতিক দল ‘বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী’। ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে একের পর এক ষড়যন্ত্র আর জঙ্গিবাদের বীজ বপন করে চলছে তারা। স্বাধীনতার চল্লিশ বছর পরেও এসব চিহ্নিত যুদ্ধপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। অবশেষে ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়লাভের পর একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যকর করার উদ্যোগ নির্বাচনী ওয়াদা অনুসারে দৃঢ়ভাবে গ্রহণ করে বর্তমান আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। সরকারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ঘােষণার পরপরই প্রচণ্ড চাপের মুখে পড়ে জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মীরা। একাত্তরের মানবতাবিরােধী অপরাধ, বাংলাদেশে বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র, জঙ্গি হামলার প্রত্যক্ষ মদদ দেওয়াসহ অনেক অপকর্মের মাশুল গােনার সময় হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর। জামায়াতের এই ভয়াবহ দুর্দিনে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে পুরনাে মিত্ররাও। ফলে বরাবর ক্ষমতার ছত্রছায়ায় থেকে সন্ত্রাসনির্ভর রাজনীতি করে অভ্যস্ত জামায়াত বর্তমান বিরূপ পরিস্থিতিতে দিশেহারা হয়ে পড়েছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া যতই সমাগত, ততই আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ছে নেতা-কর্মীদের ভেতর। কারণ জামায়াতের সাবেক আমির গোলাম আযম, নিজামী ও সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল মুজাহিদসহ দলটির শীর্ষ নেতৃত্বই যুদ্ধাপরাধের দায়ে কারারুদ্ধ। কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদের ১৫ সদস্যের ১৪ জনই সরাসরি যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত। মতিউর রহমান নিজামী, আবুল কালাম মুহাম্মদ ইউসুফ, মকবুল আহমদ, অধ্যাপক একেএম নাজির আহমদ, আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ আব্দুস সােবহান, দেলওয়ার হােসাইন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আব্দুল কাদের মােল্লা, এটিএম আজহারুল ইসলাম, আবু নাসের মুহাম্মদ আবদুজ্জাহের, মীর কাসেম আলী, মাওলানা রফিউদ্দিন আহমদ, ব্যারিস্টার আব্দুর রাজ্জাক ও রফিকুল ইসলাম খান-এদের ১১ জনের বিরুদ্ধেই সরকারের হাতে আছে যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার দালিলিক নানা প্রমাণ। বাকি ৩ জন নাজির, রফিউদ্দিন ও রাজ্জাকের বিরুদ্ধেও আছে মানবতাবিরােধী অপরাধের নানা অভিযোগ। মানবতাবিরােধী এসব অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া সম্পন্ন করার মাধ্যমে যুদ্ধাপরাধীদের সমূলে বিনাশ করা এ সময়ের বাংলাদেশে অপরিহার্য হয়ে দাড়িয়েছে। আর সে লক্ষ্যে বর্তমান সরকার এ দেশের সংবিধানেও এনেছে সংশোধন। সর্বশেষ সংশােধিত সংবিধানে প্রতিস্থাপিত ১২ অনুচ্ছেদের আলােকে যে কোনাে সময় নিষিদ্ধ হতে পারে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি। নতুন প্রতিস্থাপিত অনুচ্ছেদটি কার্যকর করতে ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ২০ (১) ধারাটি ব্যবহারই যথেষ্ট। সংবিধানে। নতুন করে প্রতিস্থাপিত ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে ১২।
ধর্মনিরপেক্ষতা ও ধর্মীয় স্বাধীনতা-ধর্মনিরপেক্ষতা নীতি বাস্তবায়নের জন্য (ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা, (খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান, (গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মীয় অপব্যবহার, (ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর। নিপীড়ন, বিলােপ করা হইবে।’ ১৯৭২ সালের সংবিধানের এই অনুচ্ছেদের আলােকেই ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছিল।
মানবতাবিরােধী অপরাধে অভিযুক্ত জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষ নেতাদের তালিকা
গােলাম আযম।
মতিউর রহমান নিজামী।
আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ।
দেলওয়ার হােসাইন সাঈদী
মােহাম্মদ কামারুজ্জামান।
এটিএম আজহারুল ইসলাম।
মাওলানা মােহাম্মদ সুবহান
মীর কাসেম
আলী আবু সালেহ
মােহাম্মদ আবদুল আজিজ মিয়া।
মােহাম্মদ আবদুল খালেক
এম রিয়াসত আলী বিশ্বাস।
শাহ মাহাম্মদ রুহুল কুদ্স ।
মাওলানা আবদুল হাকিম
মাওলানা হাবিবুর রহমান।
ফরিদউদ্দিন চৌধুরী
হাবীবুর রহমান।
এনামুল হক মঞ্জু
পরিশিষ্ট-২
যুদ্ধাপরাধ বনাম মানবতাবিরােধী অপরাধ
যুদ্ধাপরাধ না মানবতাবিরােধী অপরাধ এই নিয়ে বিতর্ক থাকতে পারে, তবে উভয় প্রকারই যে অপরাধ তা নিয়ে বিতর্ক থাকার কোনাে অবকাশ নেই। তাই যুদ্ধাপরাধ বনাম মানবতাবিরােধী অপরাধের বিষয়টি পরিষ্কার হওয়া প্রয়ােজন: লন্ডন চার্টার: প্রথমেই নাম নিতে হয় লন্ডন চার্টার-এর (London Charter of the International Military Tribunal), যেখানে প্রথম সংজ্ঞা সহকারে বিষয়গুলাে বর্ণিত হয়েছে। লন্ডন চার্টার ডিক্রি আকারে প্রথম আসে ৮ আগস্ট ১৯৪৫ সালে। এটি তৈরি হয় মূলত ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনালের বিচারকাজ সম্পন্ন করার জন্য। লন্ডন চার্টার প্রথম রাষ্ট্রীয় অথবা গােত্রগত অপরাধগুলােকে চিহ্নিত এবং বর্ণিত করে। লন্ডন চার্টার অপরাধগুলােকে মূলত তিন ভাগে ভাগ করে। যুদ্ধাপরাধ, শান্তিবিরােধী অপরাধ এবং মানবতাবিরােধী অপরাধ। এখন দেখা যাক এগুলােকে কীভাবে ভাগ করা হয়েছেঃ যুদ্ধাপরাধ (War crimes): War crimes are violations of the laws or customs of war”; including “murder, the ill-treatment or deportation of civilian residents of an occupied territory to slave labor camps”, “the murder or ill-treatment of prisoners of war”, the killing of hostages, “the wanton destruction of cities, towns and villages, and any devastation not justified by military, or civilian necessity”. War crimes include such acts as mistreatment of prisoners of war or civilians. War crimes are sometimes part of instances of mass murder and genocide though these crimes are more broadly covered under international humanitarian law described as crimes against humanity. অর্থাৎ যুদ্ধাপরাধ হলাে মূলত যুদ্ধের নিয়মকানুন ভঙ্গ করা। যেটা প্রথম। হেগ কনভেনশনে (১৮৯৯ এবং ১৯০৭) বলা হয়েছে। যুদ্ধের নিয়ম ভঙ্গ করা বলতে আছে খুন, দখলকৃত এলাকার মানুষকে শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার, যুদ্ধবন্দিদের হত্যা অথবা খারাপ ব্যবহার, জিম্মিদের হত্যা, অগ্রহণযােগ্য পন্থায় অথবা উদ্দেশ্যে শহর, গ্রাম ধ্বংস অথবা যে কোনাে ধ্বংসযজ্ঞ যা গ্রহণযােগ্য নয়, তাই যুদ্ধ অপরাধ । ব্যাখ্যা করলে এটা মনে হয় যুদ্ধাপরাধ মূলত সেনাবাহিনীর জন্য প্রযােজ্য। কারণ এখানে অভিযুক্ত মানুষ বা গােষ্ঠী হিসেবে তেমন কিছু বর্ণিত নেই, যেমনটা আছে মানবতাবিরােধী অপরাধের ব্যখ্যায়। যুদ্ধাপরাধ তাই মিলিটারি বা প্যারামিলিটারি বাহিনীর জন্য বিশেষায়িত বলে মনে করা যায় যেটা আরও পরিষ্কার হয় মানবতাবিরােধী অপরাধের ব্যাখ্যা পড়লে। মানবতাবিরােধী অপরাধ (Crime against humanity): as defined by the Rome Statute of the International Criminal Court Explanatory Memorandum, “are particularly odious offences in that they constitute a serious attack on human dignity or grave humiliation or a degradation of one or more human beings. They are not isolated or sporadic events, but are part either of a government policy (although the perpetrators need not identify themselves with this policy) or of a wide practice of atrocities tolerated or condoned by a government or a de facto authority. Murder; extermination; torture; rape, political, racial, or religious persecution and other inhumane acts reach the threshold of crimes against humanity only if they are part of a widespread or systematic practice. Isolated inhumane acts of this nature may constitute grave infringements of human rights, or depending on the circumstances, war crimes, but may fall short of falling into the category of crimes under discussion.
৮০
এমন যে কোনাে কাজ বা ব্যবহার যার দ্বারা মানুষ অসম্মানিত হয় যার অন্যতম খুন, হত্যা, অত্যাচার, ধর্ষণ, রাজনৈতিক, জাতিগত, ধর্মীয় যে | কোনাে ধরনের হয়রানি এবং যে কোনাে অসদাচারণ মানবতাবিরােধী অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এখানে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার দুটি। প্রথমত, অপরাধ কোনাে ব্যক্তি কর্তৃক নয় বরং কোনাে সরকার অথবা কোনাে সংস্থা কর্তৃক সংঘটিত হতে হবে এবং দ্বিতীয়ত, কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয় বরং সংগঠিত অপরাধ যা বিস্তৃত অঞ্চলজুড়ে সংঘটিত হতে হবে। এখানে ‘de facto’ শব্দটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কারণ এটি যে কোনাে দল বা সংগঠনকে, তাদের কার্যক্রমকে মানবতাবিরােধী অপরাধের আওতায় ফেলে যেমন: কন্ট্রা বিদ্রোহী, এলটিটিই, খেমারুজ বা আল-বদর, রাজাকার এদের মানবতাবিরােধী অপরাধে বিচারের সম্মুখীন করে। কারণ এরা রাষ্ট্র অধীন বা সমর্থিত কোনাে বাহিনী নয়। (রাজাকার বা আলবদর বাহিনীকে পৃষ্ঠপােষকতা করার কথা পাকিস্তান কখনােই স্বীকার করেনি)। একাত্তরের যুদ্ধাপরাধ বা মানবতাবিরােধী অপরাধের বিচারে সমস্যা কোথায়? ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের লড়াই খুব সাধারণ কোনাে যুদ্ধ নয়। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হওয়া পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানের এই যুদ্ধ ওই বছরেরই ৩ ডিসেম্বর থেকে ভারত বনাম পাকিস্তান যুদ্ধে রূপ নেয়। ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে যে। আত্মসমর্পণ চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছিলাে তাতে পাকিস্তান ভারতের কাছে। আত্মসমর্পণ করেছিলাে এবং যুদ্ধাপরাধীদের ব্যাপারে কিছু করার স্বাধীনতা ছিলাে শুধু লে. জেনারেল জগজিৎ সিং অরােরা তথা ভারতের। ১৯৭২ সালের সিমলা চুক্তির মাধ্যমে পাকিস্তান বাংলাদেশকে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেয় এবং ভারত তার আন্তরিকতার | নিদর্শনস্বরূপ যুদ্ধবন্দি ৯০,৩৬৮ জন পাকিস্তানি সৈনিককে বিচারের সম্মুখীন না করে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। উল্লেখ্য যে, | পাকিস্তানের আত্মসমর্পণ চুক্তি (INSTRUMENTS OF SURREN DER OF PAKISTANI FORCES IN DACCA) অথবা সিমলা চুক্তির (Simla Agreement, July 2, 1972) কোথাও বাংলাদেশ শব্দটি নেই। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের যে বাহিনী যুদ্ধ করেছিলাে তাদের বিচার করার ক্ষমতা ছিলাে শুধু ভারতের। কিন্তু পাকিস্তান কখনােই তাদের এ দেশীয় সহযােগীদের কথা স্বীকার করবে না। তাই এক্ষেত্রে মানবতাবিরােধী অপরাধের জন্য কারাে বিচার করতে কোনাে প্রকার আইনগত বাধা থাকা উচিত না। বহু বছর ধরেই এই সিমলা চুক্তি নিয়ে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরির মাধ্যমে বলা হচ্ছে যে, এ চুক্তির মাধ্যমে ‘৭১-এর যুদ্ধাপরাধীদের ক্ষমা করে দেওয়া হয়েছে এবং ব্যাপারটি চূড়ান্ত মীমাংসা করা হয়েছে। ১৯৭৪ সালের ত্রিদেশীয় চুক্তি যা ‘সিমলা চুক্তি’ নামে পরিচিত, সেই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন বাংলাদেশের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. কামাল হােসেন, ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রমন্ত্রী শরণ সিং এবং পাকিস্তানের তকালীন পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষাবিষয়ক প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ। চুক্তিতে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, একাত্তরের স্বাধীনতা যুদ্ধে। ১৯৫ জন মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করেছে। আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী তাদের বিচারের বাধ্যবাধকতা রয়েছে। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে তখন এ ব্যাপারে বলা হয়, যদি এ ধরনের অপরাধ হয়ে থাকে, তার জন্য পাকিস্তান গভীরভাবে অনুতপ্ত। দু দেশের মধ্যে নতুন সম্পর্কের সূচনা করতে বাংলাদেশের জনগণের কাছে আমাদের আবেদন, তারা যেন বিষয়টি ক্ষমা করে এবং ভুলে যায়। চুক্তির ১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়, পাকিস্তানের এই ক্ষমা চাওয়ার বিষয়টি পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ঢাকায়। এসে আবার বলবেন। এখানে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বলা হয়, কীভাবে ক্ষমা করতে হয় বাংলাদেশের জনগণ তা জানে। ১৯৭৪ সালের ১০ এপ্রিল বঙ্গবন্ধু অনেকটা চাপের মুখে সেই ত্রিপক্ষীয় চুক্তি অনুমােদন করেন যাতে পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীরা মুক্ত হয়ে ভারত থেকে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে। এই চুক্তির মাধ্যমে যুদ্ধবন্দিদের বিনিময় হয়েছে। কিন্তু এ চুক্তিতে কোথাও বলা নেই যে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হবে না। জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তানি যুদ্ধাপরাধীদের নিজ দেশে আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী বিচার করবে, এ ধরনের একটি অলিখিত অঙ্গীকার ত্রিপক্ষীয় সমঝােতার অন্তর্গত ছিল। এই কারণে বিচারের ব্যাপারে পাকিস্তানের বাধ্যবাধকতা ছিল। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে সমগ্র বিশ্ব ও সভ্য সমাজেরও বাধ্যবাধকতা ছিল। পরবর্তী সময়ে বঙ্গবন্ধু তার ভুলটি অনুধাবন করেন এবং পাকিস্তান কর্তৃক প্রতারিত হওয়ার কথাটি জনসম্মুখে উচ্চারণ করে অনুতাপ প্রকাশ করেন। (সূত্র: বাংলাদেশের অভ্যুদয়: যুদ্ধাপরাধ ও গণহত্যা, ডা. এম এ হাসান) ভারতের বিখ্যাত কুটনীতিক মি, জে এন দীক্ষিত তার ‘Liberation and Beyond’ গ্রন্থের ১৫৪ পৃষ্ঠায় উল্লেখ করেন, “ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে ফেব্রুয়ারি ‘৭২ থেকে জুন ‘৭২-এর মধ্যে চার দফা বৈঠক হয়। পাকিস্তানের পক্ষে নেতৃত্ব দেন বৈদেশিক সচিব আজিজ আহমেদ এবং ভারতের পক্ষে নেতৃত্ব দেন মি, পি এন হাকসার। এতে যুদ্ধবন্দি এবং যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ব্যাপারে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের অবস্থান ও মনােভাব আলােচিত হয়। এপ্রিল নাগাদ বঙ্গবন্ধু যুদ্ধবন্দির সংখ্যা ৪০০ থেকে কমিয়ে ১৯৫ এবং অতঃপর ১১৮ জনে নামিয়ে আনেন এবং এই অল্পসংখ্যক যুদ্ধবন্দির বিচারের ক্ষেত্রেও যথাযথ সাক্ষ্যপ্রমাণ সংগ্রহ এবং দ্রুততার সাথে যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে কেসগুলাে দাঁড় করাতে অক্ষম হন”। যেহেতু পাকিস্তান বাংলাদেশের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি এবং শর্ত মােতাবেক সে ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীদের আন্তর্জাতিক অপরাধ আইন অনুসরণ করে বিচারের সম্মুখীনও করেনি, সেহেতু সার্বিক বিচারে পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যে ওই চুক্তিটি বাতিল বলে গণ্য করা হয়। তাছাড়া মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ক্ষমা করার অধিকার কোনাে ব্যক্তির বা রাষ্ট্রের নেই। আবার এটি বাংলাদেশ সংসদে আলােচিত এবং অনুমােদিত না হওয়ায় এটি মানতে সরকার বাধ্য নয়। এ চুক্তিটি ছিল পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিদের সম্পর্কে এখানে দেশীয় যুদ্ধাপরাধী ও দেশদ্রোহীদের ব্যাপারে কোনাে কিছু বলা হয়নি। অতএব এ চুক্তির ধুয়া তুলে দেশীয় রাজাকার, দালাল, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হওয়ার কোনাে কারণ নেই। জামায়াত বলে থাকে, বঙ্গবন্ধু যুদ্ধাপরাধী দালাল-রাজাকারদের ক্ষমা করে দিয়েছেন। বিরােধীদলীয় নেত্রী খালেদা জিয়াও তাদের সঙ্গে সুর। মিলিয়ে চলছেন। এটিও একটি মিথ্যাচার। তথ্য প্রমাণে দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধ-পরবর্তী সরকার পাকিস্তান সেনাবাহিনীর এ দেশীয়। সহযােগীদের বিচারের জন্য ১৯৭২ সালের ২৪ জানুয়ারি বাংলাদেশ। দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনালস) আদেশ, ১৯৭২ এবং ১৯৭৩ সালের ২০ জুলাই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ জারি করে। ১৯৭২ সালের ২৯ আগস্ট পর্যন্ত বাংলাদেশ দালাল (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশে তিনটি সংশােধনী আনা হয়। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত সারা বাংলাদেশ থেকে এ আদেশের অধীনে ৩৭ হাজার ৪৯১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়, যাদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযােগ ছিল। গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের দ্রুত বিচারের লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধু সরকার ৭৩টি বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে। যেসব মামলা দায়ের করা হয়েছিল এর মধ্যে ১৯৭৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত দুই হাজার ৮৪৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছিল। এর মধ্যে অভিযুক্তদের মধ্যে ৭৫২ জন দোষী প্রমাণিত এবং দুই হাজার ৯৬ জন ছাড়া পেয়েছিল। ১৯৭৩ সালের ৩০ নভেম্বর দালাল আইনে আটক যেসব ব্যক্তির বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের সুনির্দিষ্ট অভিযােগ নেই, তাদের জন্য সরকার সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা করে। তবে সাধারণ ক্ষমার প্রেসনােটে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, ধর্ষণ, খুন, খুনের চেষ্টা, ঘরবাড়ি অথবা জাহাজঅগ্নিসংযােগের দায়ে দণ্ডিত ও অভিযুক্তদের ক্ষেত্রে ক্ষমা প্রদর্শন প্রযােজ্য হইবে না।’ সাধারণ ক্ষমা ঘােষণার পরও দালাল আইনে আটক ১১ হাজারেরও বেশি ব্যক্তি এসব অপরাধের দায়ে কারাগারে আটক ছিল এবং তাদের বিচার কার্যক্রম অব্যাহত ছিল। ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করা হয়। (সূত্রঃ আতিক প্রেক্ষাপটে যুদ্ধাপরাধের বিচার: তানজিম আল ইসলাম) তাছাড়া মানবতাবিরােধী অপরাধ ও গণহত্যার সাথে সংশ্লিষ্ট অপরাধীদের ক্ষমা করার অধিকার কোনাে ব্যক্তি বা রাষ্ট্রের নেই। তাই বঙ্গবন্ধু যদি সবাইকে ক্ষমা করে যেতেন তাহলেও তাদেরকে বিচারের সামনে দাঁড় করানাে যেতাে; কারণ এদের ক্ষমা করার অধিকার স্বয়ং বঙ্গবন্ধুরও নেই। বিরােধীদলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া প্রায় চার দশক পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। বিরােধীদলীয় নেত্রী,
এতদিন পরে যুদ্ধাপরাধের বিচারের প্রক্রিয়াকে ‘রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি বলে জল ঘােলা করতে চাইছেন। কিন্তু তার কাছে বাংলাদেশের জনগণের একটাই জিজ্ঞাসা যে, আসলে কোনটি রাজনৈতিক দুরভিসন্ধি? দেরিতে হলেও বিচার শুরু করা নাকি চার দশক ধরে শুধু রাজনৈতিক হীন উদ্দেশ্যে এমন ঘৃণ্য অপরাধের বিচারকে জিইয়ে রাখা? আর চার দশক ধরে বিচার না হওয়ার ব্যর্থতার দায় সব রাজনৈতিক দলের হলেও সবচেয়ে বড় দায় কিন্তু তার দল বিএনপির কাঁধেই। কারণ:
১. স্বাধীনতার পর সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল বিএনপি।
২, ১৯৭৫ সালের ৩১ ডিসেম্বর জিয়াউর রহমানই দালাল আইন বাতিল করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম বন্ধ করে দেন।
৩, ১৯৭১ সালে জামায়াতের পরিষ্কার রাষ্ট্রবিরােধী অবস্থান এবং বিভিন্ন মানবতাবিরােধী অপরাধের পরও জিয়াউর রহমানই।
তাদেরকে স্বাধীন বাংলাদেশে রাজনীতি করার অধিকার দেন।
৪. ১৯৭৭ সালে গােলাম আযম তাদের শাসনামলেই বাংলাদেশে ফিরে আসার সুযোগ পায় ।
৫. বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরােধী শাহ আজিজুর রহমানকে ১৯৭৯ সালে বিএনপি প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করে।
৬. গােলাম আযম বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পায় ‘৯০-এর দশকে, বিএনপির আমলে। তখন এ নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে অত্যন্ত আপত্তিকর বক্তব্য রাখেন তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রী ও পরে জাতীয় সংসদের স্পিকার জমির উদ্দিন সরকার। বিএনপির সহযােগিতা এবং তাদের পৃষ্ঠপােষকতায় জামায়াতের স্বাধীনতাবিরােধী কুখ্যাত রাজাকারেরা বাংলাদেশের মন্ত্রী হয়। তাদের গাড়িতে বাংলাদেশের পতাকা উড়ানাের ব্যবস্থা করে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ ও চেতনার চরম অবমাননা করেছিলাে চারদলীয় জোট। এগুলােকে অতীতের ভুল বলে ভুলে যাওয়ারও কোনাে সুযােগ নেই। কারণ এ দলের বর্তমানের কার্যকলাপেও স্বাধীনতাবিরােধীদের মদদ
৮৫
দেওয়ার ইঙ্গিত স্পষ্ট। বিএনপি কাউন্সিল করে তাদের গঠনতন্ত্র থেকে ৭ অনুচ্ছেদের ক উপধারা বাতিল করে সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতাে নিন্দিত স্বাধীনতাবিরােধীকে নতুন করে দলের স্থায়ী কমিটিতে অন্তর্ভুক্ত করেছিল। গােয়েন্দা জিজ্ঞাসাবাদে জামায়াতের অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী কামারুজ্জামান তথ্য দেয় যে, যুদ্ধাপরাধের বিচার ঠেকাতে জামায়াতকে কৌশলী ভূমিকার আশ্বাস দিয়েছিল বিএনপি। এদিকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে প্রধান বিরােধী দল বিএনপি শুরু থেকে কৌশলী অবস্থান গ্রহণ করে। এরই ধারাবাহিকতায় যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কার্যক্রমে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে যুদ্ধাপরাধী। জামায়াতি নেতাদের বিচারের দাবিতে গড়ে ওঠা আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রতি অনাস্থা জানিয়ে অবিলম্বে এর কার্যক্রম বন্ধের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। এই ট্রাইবুনালকে একটি আজ্ঞাবাহী রাবার স্ট্যাম্প সংগঠন’ বলে দাবি করে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার। মওদুদ আহমেদ বলেন, এই ট্রাইব্যুনাল অভিযুক্তদের মৌলিক অধিকার কেড়ে নিয়েছে। তিনি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত সাকা চৌধুরীর মুক্তি দাবি করেন। অবশ্য এর আগে রােড মার্চে খালেদা জিয়াও অভিযুক্ত যুদ্ধাপরাধী নিজামী, সাঈদী, কামারুজ্জামানের মুক্তি দাবি করেছিলেন। খালেদা জিয়া আরও বলেছিলেন, সাকা চৌধুরী যুদ্ধাপরাধী নয়। খালেদা জিয়ার দাবিকে সম্প্রসারিত করে তখন বিএনপির পক্ষ থেকে ট্রাইব্যুনাল বাতিলের দাবি তােলা হয়। এছাড়া সরকারের আমন্ত্রণে তিনবার বাংলাদেশ সফর করে। যাওয়া যুদ্ধাপরাধ সংক্রান্ত বিশেষ দূত স্টিফেন র্যাপের ছয়টি সুপারিশ বাস্তবায়িত না হলে সাকা চৌধুরী ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম বর্জন করার সিদ্ধান্ত নেবেন বলেও জানিয়েছেন মওদুদ। বাংলাদেশে সফরকালে স্টিফেন র্যাপ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধের সংজ্ঞা, সরকারপক্ষ যতটুকু সময় পায় আত্মপক্ষ সমর্থনে অভিযুক্তদের জন্য ততটুকু সময় নির্ধারণ, অন্য মামলায় অভিযুক্তদের মতাে বিচার প্রক্রিয়াকে চ্যালেঞ্জ করার জন্য এ মামলায় অভিযুক্তদের জন্য সেই পরিমাণ সময় ও সমর্থন পাওয়ার সুযােগ নিশ্চিত করা এবং বিচারিক কার্যক্রম টেলিভিশন ও রেডিওতে প্রচার ও বিদেশি আইনজীবীদের বিচারিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযােগ সৃষ্টিসহ মােট ছয়টি সুপারিশ করেছেন। বিএনপির পক্ষ থেকে ইতােমধ্যেই বলা হয়েছে, অভিযুক্তদের জন্য যে সময় বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে তা খুবই কম। দলের পক্ষ থেকে এর আগে অবশ্য বলা হয়েছিল, বিএনপি সত্যিকার অর্থে যারা যুদ্ধাপরাধী তাদের বিচার চায়। তবে সেই বিচার হতে হবে দেশের প্রচলিত আইনে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এই দলটিই সবচেয়ে বেশি সময় ক্ষমতায় ছিল। চিহ্নিত যুদ্ধাপরাধীদের দেশে ফিরিয়ে এনে রাজনীতি করার সুযােগ করে দেওয়া হয়েছিল বিএনপির নেতৃত্বে। বিএনপি যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতিতে এনেছে, তারা কীভাবে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে এই প্রশ্নের জবাবে মওদুদ বলেছেন, বিএনপি যখন গঠন করা হয়েছিল তখন এমন অনেককেই দলে নেওয়া হয়েছিল, যাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধাপরাধের অভিযােগ রয়েছে। তারা যদি সত্যিকারের অর্থে যুদ্ধাপরাধ করে থাকে তাহলে তাদের বিচার করতে অসুবিধা নেই। তবে রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করেতে গিয়ে কিছু করলে তা কোনােভাবেই গ্রহণযােগ্য হবে না। মুক্তিযুদ্ধের সময় যুদ্ধাপরাধ ও মানবতাবিরােধী অপরাধের দায়ে বর্তমানে আটক রয়েছেন জামায়াতে ইসলামীর প্রধান ছয় নেতা গোলাম আযম, মতিউর রহমান নিজামী, আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ, দেলাওয়ার। হােসাইন সাঈদী, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ও আব্দুল কাদের মােল্লা এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সাকা চৌধুরী। ‘জামায়াতে ইসলামী নামক এই অপশক্তি প্রতিষ্ঠার পর বিগত প্রায় সত্তর বছরের জামায়াতের রাজনৈতিক ইতিহাস, কর্মকাণ্ড, দলীয় মতাদর্শ, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দলটির ভূমিকা ও স্বাধীনতার পর দেশে-বিদেশে বাংলাদেশবিরােধী তৎপরতা, রাজনৈতিক অঙ্গনে প্রতিষ্ঠার জন্য নিজেদের মতাদর্শের পক্ষে রাজনৈতিক বক্তব্য ও স্ব-বিরােধী অবস্থান। গ্রহণ, প্রতিপক্ষদের দমনে নৃশংসতা ও হিংস্রতার আশ্রয় গ্রহণ ইত্যাদি বিষয় পর্যালােচনায় এ বিষয়টি অত্যন্ত স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, জামায়াতশিবির একটি চরম ফ্যাসিবাদী শক্তি। ইসলামের নামে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখলই দলটির প্রধান লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জামায়াত শিবিরের রাজনীতিকে অপ্রতিরােধ্য গতিতে সক্রিয় থাকতে দেওয়া হলে হানাহানির সমূহ সম্ভাবনা রয়েছে, যার প্রমাণ গত কিছুকাল ধরে তাদের তৎপরতায় স্পষ্ট। জামায়াত-শিবির আরও শক্তি সঞ্চয় করে আগামীতে যদিও কোনাে সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার হওয়ার সুযােগ পায় সে ক্ষেত্রে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্যই চ্যালেঞ্জ হয়ে দেখা দিতে পারে। হুমকির মুখে পড়তে পারে এ দেশের স্বাধীনতাও। অনেক সংশয় ও অনিশ্চয়তার পর অবশেষে বহুদিনের দাবি যুদ্ধাপরাধের বিচারের আইনগত প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবার পথে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলাের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, অঙ্গীকার করে ভুলে যাওয়ার সংস্কৃতি, সংশ্লিষ্টদের পরস্পরবিরােধী কথাবার্তা এবং আজকাল করে শুরুর সময়টাকে ক্রমাগত পিছিয়ে দেওয়ার কারণে এ বিচার আদৌ হবে কিনা তা নিয়ে একসময় জনমনে সন্দেহের দানা বাঁধতে শুরু করেছিল। অবশেষে সব সন্দেহের মেঘ দূর করে বিচারপ্রক্রিয়া সম্পন্ন করায়। আওয়ামী নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারকে অভিনন্দন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার নিয়ে সরকারি দল এবং বিরােধী দল এখনও মুখােমুখি। যুদ্ধাপরাধের অভিযােগে অভিযুক্ত কয়েকজন বর্তমানে বিএনপি-জামায়াতের প্রথম শ্রেণীর নেতা। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হলে জাতি কলঙ্কমুক্ত হবে, কিন্তু বিএনপি জামায়াত রাজনৈতিক অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে, এমনটাই মনে করছেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা। এই বিচারিক কাজ শেষ করতে না পারলে আওয়ামী লীগও তাদের অন্যতম নির্বাচনী অঙ্গীকার পূরণে ব্যর্থ হবে। তাই সরকারি দল ও বিরােধী দলের • বিপরীতমুখী অবস্থানের কারণে বিচারিক কার্যক্রম ব্যাহত না হলে সেটাই হবে বাঙালি জাতির বহুকাঙিক্ষত প্রাপ্তি।
৮৮