You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

জামাতের আসল চেহারা
মওলানা আবদুল আঊয়াল

মওদুদীর ধ্যানধারণা
মওদুদী সাহেবের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা-দীক্ষা সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। কোথায় এবং কতটুকু লেখাপড়া করেছেন, তিনি নিজেও এ সম্পর্কে বিশেষ কিছু লিখেননি। এ সম্পর্কে যতুটুকু জানা যায়, মওদুদী সাহেবের পিতা হায়দরাবাদে নিজামের একজন কর্মচারী ছিলেন। সেখানে ১৯০৩ সালে মওদুদীর জন্ম হয়। অবসর গ্রহণের পর পিতা। সপরিবারে দিল্লী চলে আসেন। মওদুদী সাহেব প্রথমে ঘরে কিছু লেখাপড়া করেন। পরে তাকে দিল্লীতে একটি মাদ্রাসায় ভর্তি করিয়ে দেয়া হয়। ছােটবেলায় পিতা মারা যান। মওদুদী সাহেবের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। কেউ বলেছেন তিনি ফাজেল পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। আবার কারাে কারাে মতে তিনি মাধ্যমিক স্তরও অতিক্রম করেননি। জীবিকার অন্বেষণে তাকে বেরিয়ে পড়তে হয়। সম্ভবত ১৯১৮ সাল থেকে মওদুদী সাহেবকে রুজি-রােজগার শুরু করতে হয়। তিনি মদীনা’, ‘তাজ’, ‘মুসলিম’, ‘আলজমিয়ত’ প্রভৃতি উর্দু সাময়িকী ও সংবাদপত্রে কাজ করেন। • ১৯২৯ সালে মওদুদী সাহেবকে ‘আল-জমিয়ত’ পত্রিকার চাকরি ছেড়ে দিতে হয়। তিনি দিল্লী থেকে হায়দরাবাদ চলে যান। সেখানে তিনি আট বছর অবস্থান করেন। উর্দুভাষী বিশিষ্ট লেখক ও চিন্তাবিদ রইস আহমদ জাফরী তাঁর দিদা ও শানীদ’ গ্রন্থে মওদুদী সাহেব সম্পর্কে লিখেছেন, “১৯৩৭ সালের এক হিমেল সন্ধ্যায় বােম্বাইয়ে খেলাফত হাউসের অতিথিশালায় একজন নবাগতকে দেখতে পেলাম। দাড়ি-গোঁফ কামানাে এবং ইংলিশ কাটিংয়ের চুল। সুদর্শন ও ডাগর ডাগর চোখওয়ালা। কিছুটা একাকী ও চুপচাপ বসে ছিলেন। পরিচয় জিজ্ঞেস করতে বললেন, আমার নাম আবুল আলা মওদুদী।” সে যাই হােক, মওদুদী সাহেবের এক ভাই হায়দরাবাদে থাকতেন। তিনি নিজামের অনুবাদ বিভাগে চাকরি করতেন। এ সময় মওদুদী সাহেব কয়েকটি গ্রন্থ অনুবাদ ও রচনা করেন। সম্ভবত ভাইয়ের সুপারিশে হায়দরাবাদের ‘দারুতরজমা’ থেকে দর্শনের একটি গ্রন্থ তাঁকে তরজমা করার জন্য দেয়া হয়। অবশ্য ভাষান্তরিত গ্রন্থটি প্রকাশ করা হয়নি, কিন্তু পারিশ্রমিক হিসাবে তিনি পাঁচ হাজার টাকা লাভ করেন। এ অর্থ দ্বারা ১৯৩৩ সালে উর্দু মাসিক ‘তরজমানুল কোরআন’ বের করেন। তরজমানুল কোরআনের মাধ্যমে তাঁর বিশেষ মত প্রচার আরম্ভ করেন। এর আগে তিনি সালজুক বংশ ও হায়দ্রাবাদের ইতিহাস রচনা করেন। হায়দরাবাদের নিজামুলমুলক আসিফ জাহর জীবন চরিতও লিখেছেন। বইগুলাে আজকাল দুষ্প্রাপ্য। ফলে এসব গ্রন্থে তিনি কিরূপ দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে বিভিন্ন ঘটনার বিচার-বিশ্লেষণ করেছেন তা বলা মুশকিল। | একথা সত্য যে, এসব গ্রন্থের মাধ্যমে তিনি হায়দরাবাদের শাসকগােষ্ঠীর অনুগ্রহ দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছিলেন। ১৯৩৩ সাল, মানে তরজমানুল কোরআন প্রকাশের পর থেকে হায়দরাবাদ জীবনে মওলানার মতাদর্শ কি ছিলাে তার কিছুটা সন্ধান পাওয়া যায়। এসময় থেকে তিনি হায়দরাবাদের নিজাম শাসনপদ্ধতি তথা রাজতন্ত্রের বৈধতা প্রমাণেই তরজমানুল কোরআনের অধিকাংশ পৃষ্ঠা ব্যয় করেছেন। তাও আবার ইসলামের ‘বিশেষ ব্যাখ্যার মাধ্যমে। কারণ এছাড়া তখন নিজামদের অনুগ্রহ দৃষ্টি আকর্ষণের বিকল্প কোনাে পথ ছিলাে না। | ১৯২৯ সাল ও তার পরবর্তী কয়েক বছর সমগ্র বৃটিশ ভারতে একটা চরম উত্তেজনাময় পরিস্থিতি বিরাজ করছিলাে। এসময় একবার ইংরেজ ও কংগ্রেসের মধ্যকার সম্পর্ক জটিল রূপ পরিগ্রহ করে। পরে তা প্রশমিত হয়। গান্ধীজিকে লন্ডনে অনুষ্ঠিত গােলটেবিল কনফারেন্সে যােগদানের আমন্ত্রণ জানানাে হয়। তিনি লন্ডন থেকে ভারতে ফেরার পর। আবার ইংরেজ-কংগ্রেস সম্পর্কে মারাত্মক অবনতি দেখা দেয়। এসময় কংগ্রেস সমর্থক মুসলমান ছাড়াও জমিয়তে ওলামায়ে হিন্দু ও আহরার পার্টি কংগ্রেস জোটভুক্ত হয়। সীমান্তের গফফার খান গ্রুপও এসময় কংগ্রেসে শামিল হন। এ ছিলাে সেসময় বৃটিশ ভারতের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। ১৯৩৬ সালে ভারত শাসন আইন জারির পর কংগ্রেসের শক্তি পূর্বাপেক্ষা বেড়ে যায়।
কংগ্রেস দেশীয় রাজ্যগুলাের বিরুদ্ধে প্রচারণায় মেতে ওঠে। সর্বপ্রথম তারা রাজ্যের শাসনপদ্ধতির উপর হামলা চালায়। নিজাম শাসিত হায়দরাবাদও তখন এই হামলা থেকে নিরাপদ ছিলাে না। এর আগে ১৯২৪ সালের পর থেকে সেখানে শুদ্ধি সংগঠন ও আর্য সমাজীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতার প্রচারণা আরম্ভ হয়। তদুপরি সেখানকার ইউরােপ-ফেরত শিক্ষিত যুবক শ্রেণী সমাজতন্ত্রের প্রচারণা আরম্ভ করে। সবচাইতে হট্টগােল সৃষ্টি করে সেখানকার দেশীয় আন্দোলন। কোন কোন মুসলমান নেতা বক্তৃতামঞ্চে দাঁড়িয়ে দৃপ্তকণ্ঠে ঘােষণা করতেন, “আমাদের নিকট যদি একজন মদিনার মুসলমান ও একজন দেশীয় বাসিন্দা এসে রুটি ভিক্ষা চায়, তাহলে আমরা দেশীয়কেই প্রাধান্য দেব।” * এসব আন্দোলনে হায়দরাবাদের শাসনযন্ত্র ভীষণ উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। উত্তর ভারত, বিশেষ করে যুক্ত প্রদেশ ও দিল্লী থেকে আসা মুসলমান সরকারী কর্মচারী ও রাজ্যের বড় বড় পদে অধিষ্ঠিত মুসলমান আমলারা ঘাবড়ে যায়। কারণ দেশীয় আন্দোলন কামিয়াব হওয়ার অর্থ। নিজামের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়া। ন্তুি নিজাম ও তাঁর আরাম-আয়েশ প্লাবিত পরিবার এসব সমস্যা সমাধানের প্রতি মােটেও কর্ণপাত করেননি। সত্যি কথা বলতে কি, মধ্যযুগীয় শাসনব্যবস্থার যাঁতাকলে সেখানকার মুসলমানরাও নিষ্পেষিত হচ্ছিলাে। সাধারণ মানুষ বলতে সবারই জীবন দুর্বিষহ হয়ে পড়েছিলাে। এসময় মওলানা মওদুদী মাসিক তরজমানুল কোরআন’, বের করেন। মনে হয় সাময়িকীটি বের করার পেছনে কর্তা গােষ্ঠীর হাত ছিলাে। এরূপ ধারণা করার যথেষ্ট কারণ আছে।
সে সময় হায়দরাবাদের ধর্ম সংক্রান্ত বিভাগ তরজমানুল কোরআনের কয়েকশ’ কপি খরিদ করতাে। মওলানা সাময়িকীটির মাধ্যমে নিজামের রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার বৈধতা ও প্রয়ােজনীয়তা প্রচার করে যেতে লাগলেন। মজার ব্যাপার হলাে, পরবর্তীতে যেমন মওলানা সবকিছু ইসলামের দৃষ্টিতে বিচার-বিবেচনা ও বিশ্লেষণ করেছেন বলে দাবী করেন, হায়দরাবাদ জীবনেও তার প্রচারধারা অনুরূপ ছিলাে। ইসলামের ছদ্মাবরণে তিনি নিজাম-রাজতন্ত্রের মহিমাকীর্তন শুরু করেন। তিনি নিঃসংকোচে ঘােষণা করেন, ‘জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য—মুসলমান হিসাবে আমি এ নীতির সমর্থক নই।”১
রাজতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সাধারণ মানুষের আশা-আকাঙক্ষা প্রতিফলিত হয়েছে, এরূপ নজির ইতিহাসে খুব কমই দেখা যায়। হায়দরাবাদও এর ব্যতিক্রম ছিলাে না। সেখানে স্থানীয় বাসিন্দাদের উপেক্ষা করে বাইরের লােকদের চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার দেয়া হতাে। এক সময় সেখানে এর বিরুদ্ধে প্রবল গণ-অসন্তোষ দেখা দেয়। মওলানা এ সময়ের পুরােপুরি সদ্ব্যবহার করেন। নিজের লেখনী নিজামের সমর্থনে পরিচালনা করেন। তিনি সেখানকার শাসকগােষ্ঠীর উক্ত অন্যায় আচরণ সমর্থন করে বলেন, ‘মুসলিম সাম্রাজ্যগুলাে যােগ্য লােক সংগ্রহের ব্যাপারে কোন সময়ই বিশেষ দেশ বা জাতির সম্পদে সীমাবদ্ধ থাকেনি। সকল স্থান থেকেই জ্ঞানী ও কর্মঠ হাত তাদের জন্য জমায়েত হয়েছে। তারা প্রতিটি দারুল ইসলামকে নিজেদের ওয়াতন ও আবাসভূমি মনে করেছে।”২

আজকের সমাজ বা পরিবেশে দাঁড়িয়ে মওলানার উপরােক্ত উদ্ধৃতির প্রতি দৃষ্টিপাত করলে হয়তাে দোষণীয় বিশেষ কিছু দৃষ্টিগােচর হবে না। কিন্তু তিনি যে সময়, পরিস্থিতি ও পরিবেশে এবং যে উদ্দেশ্য নিয়ে কথাগুলাে বলেছিলেন, সেদিকে লক্ষ্য করলে তাঁর কপটতা কারাে অস্বীকার করার উপায় নেই। যে সময় হায়দরাবাদবাসী সরকারী চাকরি-বাকরির ক্ষেত্রে নিজেদের অধিকার আদায়ের আন্দোলন করছে, ঠিক সেই মুহূর্তে তিনি কিনা বললেন, ‘যােগ্য লােক যেকোন দেশ থেকেই সংগ্রহ করা চলে। উক্ত আন্দোলনের বিরুদ্ধে এর চাইতে মারাত্মক ক্ষতিকর প্রচারণা আর কি হতে পারে? ঠিক এভাবেই তিনি সেসময় ‘তরজমানুল কোরআনের মাধ্যমে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের সমর্থনে প্রচারণা চালাতেন। কর্মজীবনে, বিশেষ করে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে বিভিন্ন সময়ে মানুষের মতাদর্শের পরিবর্তন হয়। এমনকি কোনাে দল বা রাষ্ট্রও সময়বিশেষে বিভিন্ন ব্যাপারে তাদের মত ও পথের পরিবর্তন করে থাকে। এটা দোষণীয় কিছু নয়। কিন্তু যিনি একটা বিশেষ আদর্শের অনুসারী বলে দাবী করেন, সব কিছুই তিনি সে আদর্শের দৃষ্টিতে বিচার-বিশ্লেষণ করেন বলে প্রচার করেন, তাঁর পক্ষে তাে একই বিষয় সম্পর্কে পাত্র-ক্ষেত্র-সময়-কাল বিশেষে বিভিন্নরূপ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা মতামত দেয়া সম্ভবপর নয়। ইসলাম ধর্মের মূলনীতি ও আদর্শ দেড় হাজার বছর পূর্বে পবিত্র কোরআন, মহানবীর (সঃ) বাণী ও কর্মাবলী দ্বারা নির্ধারিত হয়েছে। পরবর্তীকালে বিভিন্ন যুগে ইসলামিক চিন্তাবিদগণ প্রধানত কোরআন ও সুন্নাহ দ্বারাই বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে বিচার-বিশ্লেষণ ও মতামত ব্যক্ত করেছেন।
বর্তমানে ও আগামী দিনে মুসলিম জীবনে যেসব সমস্যার উদ্ভব হবে কোরআন ও সুন্নাহর আলােকেই সেগুলাের সমাধান করতে হবে। মওলানা মওদুদী সুদীর্ঘ কর্মজীবনে ইসলাম সম্পর্কে অনেক কিছু লিখেছেন। তাঁর এসব লেখার শুদ্ধাশুদ্ধির বিচার-বিবেচনা না করলেও একটা বিষয় আমাদের ভাবিয়ে তােলে। সেটা হলাে তাঁর স্ববিরােধী উক্তি, একই বিষয় সম্পর্কে বৈসাদৃশ্য মতামত ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ১৯৩৩ সাল থেকে প্রকাশিত তরজমানুল কোরআনের সবগুলাে সংখ্যা এবং তাঁর লেখা সব ক’টি পুস্তক সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। কারণ তাঁর অনেক লেখাই আজকাল দুর্লভ। তবু যা কিছু পাওয়া যায় তাতে দৃষ্টিপাত করলেই আমাদের আক্কেল গুড়ুম হয়ে যায় । মওলানা মওদুদীর হায়দরাবাদ জীবনের পরবর্তীকালের প্রবন্ধরাজিতে দেখা যায়, ‘ইসলাম ও মুসলমানের’ তিনি একটা বিশেষ ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, “ইসলামের দৃষ্টিতে তারাই কেবলমাত্র মুসলিম সম্প্রদায় যারা গায়ের ইলাহী’ বা আল্লাহ– বিরােধী সরকার মিটিয়ে দিয়ে ইলাহী সরকার প্রতিষ্ঠা এবং মানুষের গড়া আইন-কানুনের পরিবর্তে খােদায়ী আইন-কানুন দ্বারা দেশ শাসনের জন্য সংগ্রাম করে। যে দল বা জামাত এরূপ করে না, বরং গায়ের ইলাহী শাসনব্যবস্থায় মুসলমান’ নামক একটি সম্প্রদায়ের পার্থিব কল্যাণ সাধনে সংগ্রাম করে তারা ইসলামপন্থী নয় এবং তাদের মুসলিম সম্প্রদায়। বলাও বৈধ নয়।”
সাধারণত কলমা বা একত্ববাদে যারা বিশ্বাসী তাদের তিনি মুসলমান ও মুসলিম। জামায়াত বলতে প্রস্তুত নন। কিন্তু হায়দরাবাদ জীবনে তিনি কেবলমাত্র কলমাকেই মুসলমানদের মধ্যকার ঐক্যসূত্র, অন্য অর্থে কলমায় বিশ্বাসীকেই মুসলমান বলে অভিহিত করেছেন। তরজমানুল কোরআনের উপরােল্লিখিত সংখ্যার একস্থানে তিনি বলেছেন, “ইসলাম জাতীয়তার যে বৃত্ত এঁকেছে তাঘিরে রয়েছে একটি কলমা…. লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ। এই কলমার উপরই বন্ধুত্ব আর শক্রতা। এর স্বীকার ঐক্যবদ্ধ করে, অস্বীকার বিচ্ছিন করে।” হায়দরাবাদে শাসকগােষ্ঠীর স্বার্থ রক্ষার্থে তিনি মুসলমানের এই সংজ্ঞা দিয়েছিলেন। পরবর্তীকালে পরিস্থিতি বুঝে এটা পাল্টে দিয়েছেন। অর্থাৎ, হায়দরাবাদে ‘মুসলমানের যে ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাতে সাধারণভাবে সবাই যাদের মুসলমান বলে তিনিও তাই বলেছিলেন। কিন্তু তাঁর পরবর্তীকালের ব্যাখ্যায় মুসলিম বিশ্বের শতকরা একজনও মুসলমান কিনা বলা মুশকিল। এভাবে মুসলমান শব্দটিও তাঁর স্বার্থসিদ্ধির শিকার থেকে নিষ্কৃতি পায়নি। বিভিন্ন বিষয়ের ইসলামিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতে গিয়ে তিনি অসংখ্য স্থানে এধরনের স্ববিরােধী মন্তব্য করেছেন। এসব লেখা দেখে যেকোন লােক মওলানা মওদুদী সম্পর্কে এরূপ ধারণা পােষণ করতে বাধ্য হবেন যে, ইসলাম প্রচার তাঁর উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য নয়। তিনি ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তাঁর প্রায় অর্ধশতাব্দীকালের কর্মজীবনের প্রতি তাকালে আর একটা বিষয় আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়। তিনি চিন্তাধারা ও সংগঠনপদ্ধতির ব্যাপারে কিছুসংখ্যক চিন্তাবিদের অনুকরণ করেছেন। অবশ্য তিনি | কোথাও এর স্বীকারােক্তি করেছেন কিনা আমাদের জানা নেই।
এজন্য বেশীদূর যেতে হবে না । মরহুম মওলানা আবুল কালাম আজাদ ও মিসরের ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের প্রতিষ্ঠাতা শেখ। হাসান বান্নার রচনাবলী ও চিন্তাধারা পর্যালােচনা করলেই বিষয়টি প্রতিভাত হবে। সম্ভবত মওলানা আজাদ ১৯১২ সাল থেকে তাঁর ‘আল-হেলাল’ সাময়িকীর মাধ্যমে এক নতুন পদ্ধতিতে মুসলিম ভারতকে ইসলামের প্রতি আহবান জানাতে আরম্ভ করেন। অল্পদিনের মধ্যে মুসলমানরা তাঁর এ ডাকে সাড়া দেন। বৃটিশ সরকার ‘আল-হেলাল’ বন্ধ করে দেয়ার পরও তাঁর এ বিশেষ ধরনের প্রচারে ভাঁটা পড়েনি। তিনি “আল-বালাগ” নামক আর একটি সাময়িকী বের করেন। তাঁর ক্ষুরধার লেখনী উর্দুভাষী মুসলিম ভারতে ইসলাম সম্পর্কে এক বৈপ্লবিক প্রেরণা সঞ্চার করে। তিনি ‘হেজবুল্লাহ’ দল গঠন করেন। সম্ভবত ১৯২০ সালের দিকে তাঁর চিন্তাধারার পরিবর্তন ঘটে। তিনি কংগ্রেসে যােগদান করেন। তাঁর মতের পরিবর্তন ঘটলেও লাখ লাখ উর্দুভাষী যারা মওলানার লেখা পড়ে ইসলামের প্রতি অনুপ্রাণিত হয়েছিলাে, তাদের মতাদর্শে ব্যতিক্রম দেখা দেয় না। তারা যেখানে ছিলাে সেখানেই রয়ে যায়। কিন্তু মওলানা পুরনাে দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে তাদের প্রতি মােটেও তাকাননি। পরবর্তীকালে মওলানা মওদুদী মওলানা আজাদের অনুসরণ করে তাঁর গড়া মহলকে নিজের দিকে আকৃষ্ট। করায় নিয়ােজিত হন। সম্ভবত মওলানা আজাদ ১৯১৮ কিংবা ১৯১৯ সালে একটি প্রবন্ধে বলেছেন, “, • • • • আমার প্রতি তাকাও। আমি একজন মানুষ, তােমাদের মধ্যে রয়েছি। গত দশ বছর থেকে একই আহবান ধ্বনি তুলে যাচ্ছি। কেবলমাত্র একটি কথার প্রতিই তােমাদের আহবান করছি। ফিরে ফিরে ডাকছি। কিন্তু তােমরা সব সময়ই এড়িয়ে চলেছে। •••••আমি তােমাদের প্রতিটি দল পরীক্ষা করেছি। প্রতিটি হৃদয় ও প্রাণের আনাচে-কানাচে খুঁজে ফিরেছি। যখনই কোনাে জনতার ভিড় দেখেছি ফরিয়াদ করেছি, নিজের দিকে ডেকেছি, কিন্তু সবাই আমার থেকে দূরে সরে রয়েছে। বাস্তব জ্ঞানসম্পন্ন খুব কম হৃদয়েরই সাক্ষাৎ মিলেছে। ••••আফসােস, তােমাদের ভিতর কেউ নেই যে আমার ভাষা বােঝে, আমাকে চেনে। সত্যি বলছি, আমি তােমাদের এই দেশে বন্ধু-বান্ধবহীন একজন দরিদ্র অধিবাসী।•••••”
মওলানা মওদুদী ১৯৩৯ সালে তরজমানুল কোরআনের মার্চ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে বলেছেন, “.••••এসব আকাঙক্ষা অন্তরে পােষণ করছি এবং এগুলাে হাসিল করার জন্য গত ছ’বছর থেকে শরীরের পুরাে শক্তি ব্যয় করছি। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় আমি একা। আমার শক্তি সীমিত, সম্পদহীন। যা করতে চাই, পারছি না। সঙ্গী খুঁজে ফিরছি, খুবই নগণ্য সংখ্যক পাওয়া যাচ্ছে। কোটি কোটি মুসলমানের ভিতর আমি নিজেকে অপরিচিত ও গরীব। বােধ করছি। আমি যে উন্মাদনায় পতিত হয়েছি তার প্রতি আসক্ত কোথাও পাওয়া যাচ্ছে । বছরের পর বছর ধরে যাদের নিকট নিজের চিন্তাধারা পৌছাচ্ছি, যখনই তাদের নিকটস্থ হই, দেখতে পাই তারা আমার থেকে অনেক দূরে। তাদের সুর আমার সুর থেকে স্বতন্ত্র • • আমার হৃদয় তাদের হৃদয়ের অপরিচিত। তাদের কর্ণ আমার ভাষা বােঝে না। • • • • • ” উদ্ধৃতি দু’টোতে শব্দগত পার্থক্য রয়েছে সত্য, কিন্তু একটু গভীরভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, প্রায় বিশ বছর পূর্বে মওলানা আবুল কালাম আজাদ যা বলেছেন, ১৯৩৯ সালে মওলানা মওদুদী তারই প্রতিধ্বনি করেছেন।
মওলানা আবুল কালাম আজাদ তাঁর ‘হেজবুল্লাহ’ পার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বর্ণনা করে। একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। প্রবন্ধটির নাম দিয়েছেন রােগ ও প্রতিকার’ (আদ্দাউ ওয়াদ্দাওয়াউ)। মওলানা মওদুদী “একটি সত্যবাদী দলের প্রয়ােজন” শীর্ষক একটি প্রবন্ধ লিখেছেন। মওলানা আজাদের লেখাটি সর্বপ্রথম ১৯১২ সালে ‘আল-হেলালে বের হয়। মওলানা মওদুদীর প্রবন্ধটি ‘তরজমানুল কোরআনে বের হয় ১৯৪১ সালে। মওলানা আজাদের প্রবন্ধে তাঁর কংগ্রেসে যােগদানপূর্বকালীন রাজনৈতিক চিন্তাধারা চমৎকার আলােচিত হয়েছে। মওলানা মওদুদীও তাঁর প্রবন্ধে অনুরূপ আলােচনা করেছেন। প্রবন্ধ দু’টো পড়লে যে কেউ একথা স্বীকার করতে বাধ্য হবেন, পরবর্তীকালে লেখা প্রবন্ধটিতে প্রথমটির প্রতিধ্বনি করা হয়েছে। | মওলানা আজাদ তাঁর প্রবন্ধে দীর্ঘ আলােচনার পর বলেছেন, “আজ আমাদের সামনেই আমাদের অধঃপতন উপস্থিত। নিজেদের কাফন-দাফনের সামানা আমরা নিজেদের চোখেই দেখতে পাচ্ছি। বার বার ব্যবস্থাপত্র পরীক্ষা করা ও একাধিক চিকিৎসকের নিকট যাওয়ার এখন আর আমাদের সময় নেই। এখন শুধু আমাদের একটি ব্যবস্থাপত্র ও একজন ডাক্তারেরই প্রয়ােজন। ••••সুতরাং এখন ইসলামকে আর একবার তার সেই কর্তব্য পালনের সময় এসে গেছে যা সে একবার সম্পাদন করেছিলাে। মুসলমানকে তাদের সংশােধন নিজের জন্যই নয়, বরং অন্যদের জন্যও করতে হবে। তাতে করে তাদের মাধ্যমে সমগ্র বিশ্ব সংশােধিত হবে।••••.”
মওলানা মওদুদী তাঁর “একটি সত্যবাদী দলের প্রয়ােজন” শীর্ষক প্রবন্ধের একস্থানে লিখেছেন, “একথা ন্যায়তঃই বলা যায় যে মানবতার ভবিষ্যৎ এখন ইসলামের উপর নির্ভরশীল। মানুষের গড় চিন্তাধারা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। তাদের কারাের জন্যই সফলতার কোনাে সুযােগ নেই। পুনরায় কোনাে চিন্তাধারা প্রণয়ন করা এবং তা পরীক্ষার উপর নিজেদের ভাগ্য জড়িত করার মত ধৈর্যটুকু এখন মানুষের মধ্যে নেই। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র ইসলামই এমন এক আদর্শ যা থেকে মানুষ কল্যাণের আশা-ভরসা করতে পারে।••••• মওলানা আজাদ ও মওদুদীর উল্লিখিত প্রবন্ধ দুটোর উদ্ধৃত অংশ থেকে একথা স্বভাবতই প্রতিভাত হয় যে, দ্বিতীয়টি প্রথমটির অনুসরণে লেখা হয়েছে। মূলত গােটা প্রবন্ধ দু’টোই এ ধরনের। শব্দগত পার্থক্য যতই করা হােক না কেন, এর দ্বারা ভাবের অভিন্নতা কিছুতেই ধামাচাপা দেয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, মওলানা আজাদ ১৯১২ সাল থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ নাগাদ অর্থাৎ কংগ্রেসে যােগদানের পূর্ব পর্যন্ত হেজবুল্লাহ বা আল্লাহর দল সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা বলেছেন, ‘আল-হেলাল’ ও ‘আল-বালাগ’ পত্রিকার মাধ্যেমে যেরূপ প্রচার অভিযান চালিয়েছেন, মওলানা মওদুদী তাঁর বড় বিশেষ কিছু বাদ দেননি। মওলানা মওদুদীর “সত্যবাদী জামায়াতের পরিকল্পনা ‘হেজবুলাহর প্রতিচ্ছবি বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
উপর নিজেদের ভাগ্য জড়িত করার মত ধৈর্যটুকু এখন মানুষের মধ্যে নেই। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র ইসলামই এমন এক আদর্শ যা থেকে মানুষ কল্যাণের আশা-ভরসা করতে পারে।••••• মওলানা আজাদ ও মওদুদীর উল্লিখিত প্রবন্ধ দুটোর উদ্ধৃত অংশ থেকে একথা স্বভাবতই প্রতিভাত হয় যে, দ্বিতীয়টি প্রথমটির অনুসরণে লেখা হয়েছে। মূলত গােটা প্রবন্ধ দু’টোই এ ধরনের। শব্দগত পার্থক্য যতই করা হােক না কেন, এর দ্বারা ভাবের অভিন্নতা কিছুতেই ধামাচাপা দেয়া যায় না। সত্যি কথা বলতে কি, মওলানা আজাদ ১৯১২ সাল থেকে প্রথম মহাযুদ্ধের শেষ নাগাদ অর্থাৎ কংগ্রেসে যােগদানের পূর্ব পর্যন্ত হেজবুল্লাহ বা আল্লাহর দল সম্পর্কে যে ধরনের কথাবার্তা বলেছেন, ‘আল-হেলাল’ ও ‘আল-বালাগ’ পত্রিকার মাধ্যেমে যেরূপ প্রচার অভিযান চালিয়েছেন, মওলানা মওদুদী তাঁর বড় বিশেষ কিছু বাদ দেননি। মওলানা মওদুদীর “সত্যবাদী জামায়াতের পরিকল্পনা ‘হেজবুলাহর প্রতিচ্ছবি বললেও অত্যুক্তি করা হবে না।
এ ধরনের সাযুজ্য আমরা শেখ হাসান বান্না ও মওলানা মওদুদীর মধ্যেও দেখতে পাই। শেখ হাসান বান্না ছিলেন মিসরে ইসলামিক ভ্রাতৃসংঘের প্রতিষ্ঠাতা। ১৯২৮ সালের মার্চ মাসে বান্না তাঁর ইসমাইলিয়াস্থ বাসভবনে মাত্র ছ’জন অনুসারী নিয়ে সর্বপ্রথম এই পার্টি গঠন করেন। শেখ বান্নার পার্টির গঠনপদ্ধতি, এর উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য ব্যাখ্যা করে বিভিন্ন সময়ে প্রদত্ত তাঁর বক্তৃতা-বিবৃতির সাথে মওলানা মওদুদীর জামাতের গঠন-পদ্ধতি, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তুলনা করলে প্রায় একরূপ বলে মনে হয়। অথচ উভয়ের মধ্যে সময়েরও বেশ ব্যবধান রয়েছে। * শেখ হাসান বান্না তাঁর পার্টির লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সম্পর্কে বলেছেন, “ইসলামিক ভ্রাতৃসংঘের চিন্তা, উদ্দেশ্য ও উপায় সবই ইসলামিক, কেবলমাত্র ইসলামিক । ইসলাম ছাড়া অন্য কিছুর সাথে এর বিন্দুমাত্রও সম্পর্ক নেই।” মওলানা মওদুদী তাঁর দল জামাতে ইসলামী গঠনের পর প্রথম ভাষণে বলেছেন, “আমরা খাটি এবং আসল ইসলাম নিয়ে যাত্রা করছি। পুরােপুরি ইসলামই আমাদের আন্দোলন।” | শেখ হাসান বান্না ১৯৩৮ সালে পার্টির উদ্দেশে এক ভাষণে বলেছেন, “•••• বস্তুত বিশ্বাস, ইবাদত, ওয়াতন, বংশ বা জাতি, ধর্ম, সরকার, অধ্যাত্ম, তরবারি—এ সবকিছুই ইসলাম। •••• ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের আওয়াজ হলাে, মর্তের যেকোন অংশে একজন মুসলমানও ‘লা। ইলাহা ইল্লাল্লাহু মুহাম্মাদুর রাসুলুল্লাহ’ বলিয়ে থাকবে, সেটা তাদের ওয়াতন।••••• ইসলামের রাজনৈতিক বিশ্বজনীনতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে মওলানা মওদুদীও এ কথারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, “ইসলাম যেমন বিশ্বাস ও ইবাদত তেমনি দেশ ও জাতিও। সে মানুষের মধ্যকার অন্য সব পার্থক্য ও সম্পর্ক মিটিয়ে দিয়েছে। ••••ইসলাম ভৌগােলিক সীমা-সরহদ এবং রক্ত ও বংশ বা জাতিগত পার্থক্য স্বীকার করে না, সকল মুসলমানকে এক উম্মত বা জাতি বলে মেনে নেয় এবং সকল ইসলামিক রাষ্ট্রকে এক দেশ হিসেবে গণ্য করে।” শেখ হাসান বান্না তাঁর ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের আন্দোলন তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। মওলানা মওদুদীও তাঁর আন্দোলন অনুরূপ তিন পর্যায়ে ভাগ করেছেন।
শেখ হাসান বান্না তাঁর ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের আন্দোলন তিন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন। মওলানা মওদুদীও তাঁর আন্দোলন অনুরূপ তিন পর্যায়ে ভাগ করেছেন। এ সম্পর্কে হাসান বান্না বলেন, “ইসলামী ভ্রাতৃসংঘ এরূপ বিশ্বাস পােষণ করে যে, প্রতিটি আহবানের তিনটি পর্যায় অতিক্রম করতে হয়। প্রথম : আবেদন পর্যায়। তাতে আহবানের চিন্তাধারা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্যের সাথে পরিচয় করান হয়। অধিকাংশ জনতার নিকট এর আবেদন পৌঁছান হয়। দ্বিতীয় : সংগঠন পর্যায়। এ পর্যায়ে আহবান তাঁর সাহায্যকারী বেছে নেয় এবং মানুষের মধ্য থেকে তার উদ্দেশ্য ও লক্ষের সৈনিক সংগ্রহ করে তাদের সুসংহত করে। তৃতীয় ও শেষ: বাস্তবায়ন পর্যায়। এটি হলাে আহবানের শক্তি অর্জন ও ফলশ্রুতির সময়।•••••” ১৯৩৮ সালের ভাষণে শেখ হাসান বান্না তাঁর আন্দোলনের প্রথম দু’পর্যায়ের কর্মবিবরণীর বিস্তারিত আলােচনা করেছেন। তৃতীয় পর্যায় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “… ইনশা-আল্লাহ আমরা তৃতীয় পর্যায়ের পদক্ষেপ গ্রহণ করবাে আর এ হবে বাস্তবায়ন পদক্ষেপ।” অনুরূপ রূপরেখা মওলানা মওদূদীও তাঁর আন্দোলন সম্পর্কে এঁকেছেন। তিনি লিখেছেন, জামাতে ইসলামী যে আন্দোলন নিয়ে যাত্রা করেছে, গত আঠার বছরে তার দুটি পর্যায় শেষ হয়েছে। এখন তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়েছে। প্রথম পর্যায় ছিলাে নিছক আহবান ও প্রচারের। এ ধারা আনুমানিক নয় বছর পর্যন্ত অব্যাহত রয়েছে। দ্বিতীয় পর্যায় ছিলােসংগঠন ও শিক্ষাদীক্ষার। তাতে আনুমানিক ছ’বছর অতিবাহিত হয়েছে। তৃতীয় পর্যায় হলাে সম্প্রসারণ ও বাস্তবায়ন পদক্ষেপ। আর এটা তিন বছর পূর্বে শুরু হয়েছে।৫
শেখ হাসান বান্না আইন পরিষদে একাধিক রাজনৈতিক পার্টির বিরােধিতা করেছেন। মওলানা মওদুদীও এক্ষেত্রে বান্নার অনুসরণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “আইন পরিষদে একাধিক দল গঠন করা শাসনতন্ত্রের মাধমে নিষিদ্ধ হওয়া উচিত। ৬ দেশের পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্যপদ দানে বিরােধিতার ব্যাপারেও মওলানা মওদুদী শেখ হাসান বান্নার প্রতিধ্বনি করেছেন। শেখ হাসান বান্না ও ইসলামী ভ্রাতৃসংঘের বইপুস্তক আমাদের দেশে, এমনকি মিসরেও আজকাল বড় বিশেষ পাওয়া যায় না। বিভিন্ন উপায়ে যতটুকু জানা গেছে, তাতে দেখা যায়, শেখ বান্নার মতাদর্শ ও পার্টির গঠন সম্পর্কিত নানান বিষয়ের অনেক কিছু মওলানা মওদুদীর মধ্যে রয়েছে। মওলানা মওদুদীর জনৈক অনুসারীর উদ্ধৃতিতে দেখা যায়, তিনি মলানাকে একজন উচুদরের লেখক, সাহিত্যিক, ইসলামিক চিন্তাবিদ, সংগঠনবিদ, বিপ্লবী রাজনীতিক ইত্যাকার বলে প্রশংসা করেছেন। তাঁর মধ্যে এসব গুরে কোনটিই যে নেই, এরূপ উক্তি কেউ করবে না। মওলানার মতাদর্শ সম্পর্কে অনেকেরই দ্বিমত থাকতে পারে, কিন্তু বিগত প্রায় অর্ধশতাব্দী যাবৎ সুদীর্ঘ কর্মজীবনে তিনি অনেক কিছুই করেছেন, একথা হয়তাে অনেকেই স্বীকার করবেন। তা সত্ত্বেও মওলানার চিন্তাধারার মৌলিকতা এবং প্রকাশভঙ্গির স্বকীয়তা সম্পর্কে আমাদের মনে নানান প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। তাঁর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের প্রতি সামগ্রিকভাবে দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, তিনি ইসলামের আলােকে নানান বিষয়ের বিচার-বিবেচনা করতে গিয়ে অসংখ্য স্ববিরােধী উক্তি করেছেন। তাঁর লেখা, ধ্যান-ধারণা ও সংগঠন পদ্ধতিতে এমন অনেক কিছু রয়েছে যা হুবহু তাঁর পূর্ববর্তী ইসলামী চিন্তাবিদদের মধ্যে পাওয়া যায় । একথা আমরা পূর্বেও উল্লেখ করেছি।
অথচ অন্যদের থেকে এসব যে নেয়া হয়েছে তিনি তা এড়িয়ে গেছেন। এ দু’টো বিষয়ের পরিপ্রেক্ষিতে আমরা তাঁর সম্পর্কে এই সিদ্ধান্তে পৌঁছতে পারি যে, বিভিন্ন যুগের ইসলামী চিন্তাবিদদের চিন্তাধারা ও মতামতকে নিজের মত করে নিজের ভাষায় প্রকাশ করার প্রবণতার দরুনই মওলানা মওদুদী ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে স্ববিরােধিতার দোষমুক্ত হতে পারেননি। আবার অনেক ক্ষেত্রে স্বার্থসিদ্ধির জন্যও তিনি এধরনের প্রবণতার আশ্রয় নিয়েছেন। পরবর্তীকালে দেখা গেছে, নিজের এবং তাঁর অনুসারী ও দেশী-বিদেশী কায়েমী স্বার্থবাদীদের স্বার্থরক্ষার জন্যই পবিত্র ইসলামের নামে, ইসলামের মুখােশ পরে তিনি এসব স্ববিরােধী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। তাঁর এসব উদ্ভট ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপ হচ্ছে জামাতে ইসলামী। এ সম্পর্কে সামনের অধ্যায়গুলােতে আরাে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে।
মওদুদীর বৃটিশ প্রীতি।
১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ গঠিত হলেও ১৯৩৬ সালের পূর্ব পর্যন্ত উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে দেশের অধিবাসীদের সম্মিলিত ভূমিকাই প্রবল ছিলাে। মওলানা মুহম্মদ আলী, শওকত আলী প্রমুখ নেতৃবৃন্দ, এমনকি স্বয়ং মিঃ জিন্নাহও কংগ্রেসের সদস্য ছিলেন। এই সম্মিলিত আন্দোলনের সময় মওলানা মওদুদী উল্লেখযােগ্য ব্যক্তিত্বের অধিকারী ছিলেন না। সত্য, কিন্তু তাঁর ভূমিকা ছিলাে অদ্ভুত ধরনের। তিনি মূল স্বাধীনতা আন্দোলনেরই ঘাের বিরােধী ছিলেন। এ সময়ও তিনি ইসলামের তথাকথিত ছদ্মাবরণেই বিরােধিতা করতেন। তিনি সম্মিলিত স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা প্রসঙ্গে বলেন, “বিশ্বের অন্যান্য জাতির মত আমাদের স্বাধীনতার অর্থও কি এই যে, বিজাতির শাসনমুক্ত হওয়া ? স্বজাতির শাসন কিংবা স্বদেশীর শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া কি আমাদের লক্ষ্যের জন্য প্রয়োজন ? ••• আমাদের সামনে তাে শুধু একটি উদ্দেশ্য রয়েছে, আর তা হলাে আল্লাহর বান্দার আল্লাহকে ছাড়া আর কারাে অধীন না হওয়া। মানুষের সার্বভৌমত্বের অবসান হওয়া এবং আল্লাহ প্রেরিত ন্যায়নীতির শাসন প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে মওলানা মওদুদী যে স্বাধীনতার দাবীর বিরােধিতা করেছেন, একথা কারাে চোখ এড়াবার কথা নয়। এখানে পরিষ্কারভাবে প্রতিভাত হয়, তিনি আল্লাহর হুকুমতের ছদ্মাবরণে উপমহাদেশে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন বহাল থাকার সাফাই গেয়েছেন। ধীরে ধীরে তাঁর স্বাধীনতাসগ্রামবিরােধিতা আরাে স্পষ্টরূপ ধারণ করে। তিনি আরাে বলেন, “যে আজাদী জাতীয়তাবাদীদের লক্ষ্য তার সমর্থনে সংগ্রাম করার কোনাে অর্থ নেই। আমি তাে একে ইংরেজের গােলামির চাইতেও ঘৃণ্য মনে করি। আমাদের নিকট (এই আজাদী সংগ্রামের) পতাকাবাহীরা মুসলমানদের জন্য সে পর্যায়ভুক্ত যে পর্যায়ের ছিলাে ক্লাইভ, ওয়েলেসলী। তাদের সমর্থক মুসলমানরা কোন অবস্থায়ই মীর জাফর মীর সাদেক থেকে ভিন্নতর নয়। যদিও অবস্থা ও পরিস্থিতির ভিন্নতা রয়েছে, কিন্তু শক্রতা ও বিশ্বাসঘাতকতার ধরনে এর মধ্যে কোনাে ফারাক নেই।”২ উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে মওলানা সে যুগের আজাদী সংগ্রামকে বৃটিশের গােলামির চাইতেও ঘৃণ্য বলে আখ্যায়িত করেছেন। আজাদীর পতাকাবাহীদের তিনি ক্লাইভ, ওয়েলেসলী, মীর জাফর, মীর সাদেক প্রমুখের সমগােত্রীয় বলে অভিহিত করেছেন। কিন্তু তিনি যে বিদেশী শক্তির দালালী করলেন এটা মীর জাফরী হলাে না। এইরূপে মওলানা মওদুদী বিশেষ ভঙ্গিতে উপমহাদেশের স্বাধীনতা ও স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরােধিতা করতে থাকেন। তাঁর এ প্রচারধারায় আর যাই হােক, অন্তত তিনটি মহল খুবই সন্তুষ্ট হতেন। এরা হলেন৷ ঔপনিবেশিক বৃটিশ সরকার, বৃটিশ খয়েরখাহ ভারতীয় পদস্থ মুসলিম সরকারি কর্মচারী ও নওয়াব, জমিদার, স্যার—যারা ভারতে বৃটিশ প্রভুত্ব চিরস্থায়ী না হােক আরাে দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার পক্ষপাতি ছিলেন।
মওলানা মওদুদী স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেন, “আজাদীর পুরাে সংগ্রাম যদি কেবলমাত্র এজন্যই হয় যে, রাজতন্ত্রের খােদা সরিয়ে গণতন্ত্রের খােদা সরকারী প্রতিমা ঘরে বসান হবে তবে তাতে মুসলমানদের নিকট বিশেষ কোন পার্থক্য বােধ হবে । লাত’ গেলাে মানাত’ আসলাে। এক মিথ্যে খােদা আর এক মিথ্যে খােদার স্থান দখল করলাে। বাতিলের পূজা যেমন ছিলাে তেমনই রইলাে। কোন্ মুসলমান এটাকে আজাদী বলবে?”৩ সমগ্র বৃটিশ ভারত যখন আজাদী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে, তাদের জনাগত ও ন্যায়ত অধিকার আদায়ের জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছিলাে তখন মওলানা মওদুদী আজাদীর বিরুদ্ধে তাঁর উল্লিখিত ‘বিশেষ ইসলামী দর্শন’ প্রকাশ করে বসলেন। তাঁর মতে জনগণ নির্বাচিত স্বাধীন সার্বভৌম সরকার আর বৃটিশ ঔপনিবেশিক সরকারের মধ্যে নাকি কোনাে পার্থক্য নেই। তিনি রাজতন্ত্র-গণতন্ত্র, স্বাধীনতা-পরাধীনতা, শশাষক-শােষিত ও ন্যায়অন্যায়কে একই কাঠগড়ায় নিয়ে দাঁড় করালেন। কী চমৎকার ইসলামী ব্যাখ্যা! সত্যিই কি ইসলাম তাই বলে ?
মওলানা অন্যত্র বলেছেন, .. ইসলামের এই মতবাদ অনুযায়ী ভাল সরকারের নিরিখ জাতীয় এবং আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসম্পন্ন হওয়া নয় এবং খারাপ সরকারের নিরিখও বিদেশী কিংবা আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারহীন হওয়া নয়। আসল প্রশ্ন হলাে, সরকারের ব্যবস্থাপনা ইনসাফ ও ন্যায়নীতি ভিত্তিক কিনা••• 1 * বাহ্যত মওলানার উপরােক্ত মন্তব্য খুব একটা দোষণীয় নয়। কিন্তু যে সময় ও পরিবেশে এবং যে উদ্দেশ্যে তিনি উক্ত মন্তব্য করেছিলেন সেদিক থেকে এটা অত্যন্ত আপত্তিকর। সে সময় একটা বিদেশী শক্তি এদেশ শাসন ও শােষণ করতাে। পরাধীনতার শৃংখলমুক্ত হওয়ার জন্য সমগ্র উপমহাদেশে প্রবল আন্দোলন চলছিলাে। দু’চারজন স্বার্থান্ধ ছাড়া হিন্দুমুসলিম নির্বিশেষে দেশের প্রতিটি মুক্তিপাগল নাগরিক এ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে। এ সংগ্রামের মূলনীতি ছিলাে, প্রতিটি জাতিরই নিজেদের দেশ পরিচালনার অধিকার রয়েছে। সুতরাং এদেশবাসীকেও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার দিতে হবে। এরূপ পরিস্থিতিতে মওলানা বললেন, ‘ইসলামের দৃষ্টিতে কোনাে সরকারের ভাল কিংবা মন্দ হওয়া জাতীয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকারসম্পন্ন হওয়া নয়। তাঁর এ উক্তি যে বৃটিশ-স্বার্থ রক্ষার সহায়ক ছিলাে। তা আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। বৃটিশ প্রীতিতে উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি বলেছেন, “ইসলামের দৃষ্টিতে ইংরেজ এবং ভারতবাসী উভয়েই মানুষ। সে উভয়কেই নিজের আহবানে সম্বােধন করছে। ইংরেজের সাথে ইসলামের এই জন্য দ্বন্দু নয় যে, সে এক দেশের বাসিন্দা হয়ে অন্য দেশ কেন শাসন করছে, বরং এই জন্য যে, সে খােদার সার্বভৌমত্ব এবং আইনকানুন কেন স্বীকার করছে না।” . এখানেও তিনি ইসলামের ছদ্মাবরণে ঘােলাপানিতে মাছ শিকার করতে চেয়েছেন। এদেশবাসীর স্বাধীনতা সংগ্রামকে উপেক্ষা করে বৃটিশপ্রীতির পরাকাষ্ঠা দেখাতে প্রয়াস পেয়েছেন। মওলানা মওদুদী আরাে বলেছেন, “যদি আপনার ইংরেজের সাথে শত্রুতা এজন্য যে, সে ইংরেজ, ছ’হাজার মাইল দূর থেকে এসেছে, আপনার দেশের বাসিন্দা নয়, তবে আপনার এ শক্রতা ইসলামী শত্রুতা নয়- অজ্ঞতাপ্রসূত শতা।” চিন্তা করুন, মওলানা মওদুদী সে আমলে ইংরেজ প্রীতিতে কিরূপ অন্ধ হয়ে । পড়েছিলেন। সেসময় তিনি এভাবেই নিরলসভাবেইংরেজের সমর্থনে লেখনী চালিয়েছেন। এ ধরনের অসংখ্য উদ্ধৃতি তাঁর সে আমলের রচনাবলীর প্রতি দৃষ্টিপাত করলে পাওয়া যাবে। এখানে মাত্র কয়েকটি উদ্ধৃতি পেশ করা হলাে।
হায়দরাবাদের নিজামের সমর্থনে মওলানা মওদুদীর ইসলামকে ব্যবহার করার কিছুটা যৌক্তিকতা খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ নিজাম ছিলেন মুসলমান। হয়তাে মওলানা সাম্প্রদায়িক প্রভাব কাটিয়ে উঠতে পারেননি। কিন্তু উপমহাদেশের স্বাধীনতাসংগ্রাম ছিলাে তার চাইতে সম্পূর্ণ ভিন্নতর। এক্ষেত্রে একদিকে বৃটিশ স্বার্থ, অপরদিকে দেশের স্বাধীনতার প্রশ্ন। ভারত স্বাধীন হলে মুসলমানরাও স্বাধীন হবে, একথাটা তখন একজন সাধারণ মানুষের নিকটও দুর্বোধ্য ছিলাে না। এমতাবস্থায় কেন মওলানা বৃটিশপ্রীতির এরূপ পরাকাষ্ঠা দেখিয়েছিলেন। এ ব্যাপারে তিনি ইসলামকেও পুরােপুরি ব্যবহার করেছিলেন। ব্যাপারটা সত্যি ভাববার বিষয়। সম্ভবত মওলানা মওদুদী তাঁর প্রতি বিশেষ সহানুভূতি প্রদর্শনকারী একশ্রেণীর পদস্থ মুসলিম সরকারী কর্মচারীর গুণভাজন হওয়ার জন্যই সে আমলে বৃটিশ-স্বার্থ রক্ষার সহায়ক এসব ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিতেন। এছাড়া এর পেছনে আর কোন যৌক্তিকতা আমরা খুঁজে পাই না। কারণ উপমহাদেশের স্বাধীনতা যখন অত্যাসন্ন, তখনাে এক শ্রেণীর মুসলিম সরকারী অফিসার তাদের বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট রাখার জন্য বলে বেড়াতেন, মুসলমানদের স্বার্থেই এদেশে বৃটিশের আরাে কিছুদিন থাকা দরকার। কেননা বর্তমানে প্রশাসনযন্ত্রে মুসলমানরা তাদের ন্যায্য অধিকার লাভ করে চলছে। বৃটিশরা আরাে কিছুদিন এদেশে থাকলে মুসলমানরা নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে যাবে। তাতে করে হিন্দুদের সাথে কুলিয়ে উঠতে সক্ষম হবে। জানা গেছে, মওলানা মওদুদীর সে আমলে এসব অফিসারের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ ছিলাে। | বস্তুত সাম্প্রদায়িকতা যাদের রাজনীতির ভিত্তি, তাদের পক্ষে সাম্প্রদায়িক সংকীর্ণতার উর্ধ্বে ওঠা সম্ভব নয়। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী থাকে সাম্প্রদায়িকতাদুষ্ট। তাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে সার্বজনীনতা থাকে না। তাদের দৃষ্টিভঙ্গী হয়ে দাঁড়ায় গোঁড়া, সংকীর্ণ ও সাম্রাজ্যবাদনির্ভর।
কি রাজনৈতিক, কি অর্থনৈতিক, কি সামাজিক, কি সাংস্কৃতিক—সবক্ষেত্রেই তারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধা থাকতে পছন্দ করে। তারা যে বিশেষ আদর্শে বিশ্বাসী বলে প্রচার করে, তার সঙ্গে সাম্রাজ্যবাদী শাসন-শােষণের তেমন একটা বিরােধ বা বৈরিতা তারা খুঁজে পায় না। যেহেতু তাদের বিশ্বদৃষ্টি আচ্ছন্ন, সংকীর্ণ, গােষ্ঠী স্বার্থসিদ্ধিই তাদের উদ্দেশ্য, সেজন্য শেষ বিশ্লেষণে তারা সাম্রাজ্যবাদের দোসর হিসেবেই পরিগণিত। তথাকথিত আদর্শের মােড়কে বৃহত্তর জনগােষ্ঠীর স্বার্থকে তারা বিদেশী প্রভুর . কাছে বিকিয়ে দিতে কুণ্ঠিত হয় না। আর তাই উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে মওলানা মওদুদী ইসলামের মুখােশ পরে ঔপনিবেশিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করতে দ্বিধা করেননি। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতেও মওলানা মওদুদী ও তার বাঙালি অনুসারী গােলাম আমরা একই অবস্থান গ্রহণ করে। এমনকি আজো বাংলাদেশে জামাতীদের সে ভূমিকার পরিবর্তন হয়নি, পরিবর্তন হওয়ার নয়।
১৯৩৭ সালের দিকে মওলানা মওদুদী হায়দরাবাদ থেকে পূর্ব পাঞ্জাবে চলে আসেন। এখানে পাঠানকোটে মওলবী নিয়াজ আলী নামক জনৈক অবসরপ্রাপ্ত এসডিও একটি ক্ষুদে মুসলিম উপনিবেশ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এর নাম দেয়া হয়েছিলাে “দারুল ইসলাম”। পাঞ্জাবে আসার পর এই দারুল ইসলামেই মওলানা অবস্থান করেন। মওলানা কেন। হায়দরাবাদ ছেড়েছিলেন এ সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু জানা যায় না। সেখানকার শাসকগােষ্ঠীর সাথে তাঁর মতানৈক্য দেখা দিয়েছিলাে কিনা এরূপ কোনাে তথ্যও জানা যায়। অবশ্য পাঞ্জাবে আসার পর তাঁর মতাদর্শে মৌলিক কোন পরিবর্তন দেখা দেয়নি। হায়দরাবাদে তিনি ওপরওয়ালাদের ছত্রচ্ছায়ায় ছিলেন। প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বার্থরক্ষার জন্য রাজতন্ত্র সমর্থন করেছেন। ইসলামের বিশেষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দ্বারা রাজতন্ত্রের বৈধতা প্রমাণ করেছেন। বলেছেন, জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য মুসলমান হিসেবে আমি এ নীতিতে বিশ্বাসী নই।’ পাঞ্জাবে তাঁর ‘ইসলাম প্রচারধারা’ (?) পূর্বের মতই ছিলাে। তবে লক্ষ্য ছিলাে ভিন্ন। এখানে তিনি বৃটিশ স্বার্থরক্ষায় ইসলামকে ব্যবহার করতেন। এ সম্পর্কে পূর্বে আলােচনা করা হয়েছে।’ জানা যায়, তৎকালীন ভারত সরকারের মুসলিম পদস্থ সরকারী কর্মচারীরা মওলানাকে পাঠানকোটে আসার আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। এ আমন্ত্রণ রক্ষার্থেই নাকি তিনি এখানে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে আরম্ভ করেন। এখান থেকেই ১৯৩৮ সালে পুনরায় তরজমানুল কোরআন’ বের করা শুরু করেন। মওলানা মওদুদীর এ সময়কার রচনাবলীর প্রতি তাকালে দেখা যায়, তিনি বৃটিশ-স্বার্থ রক্ষার্থে দ্বিমুখী নীতি গ্রহণ করেছিলেন। মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় পার্টিরই বিরােধিতা করেছেন। মুসলিম লীগ সম্পর্কে পরে আলােচনা করা হবে। কংগ্রেসের উপর আক্রমণকালে তিনি মুসলিম জাতীয়তা ও মুসলমানদের স্বার্থগত দিকের আশ্রয় নিতেন।
কংগ্রেসের বিরােধিতা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, তাদের প্রথম আক্রমণ হল ইসলামী জাতীয়তার উপর। তারা মুসলমানদের বলে মূলত তােমরা কোনাে জাতিই নও। এটা শুধু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীদের প্রবঞ্চনা এবং গুটিকতক সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টের প্রচারণা বই কিছু নয়।”১ “…অনুরূপ এই আন্দোলন আমাদের জাতীয় লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। এর সাথে শরিক হওয়ার অর্থ আমাদের নিজেদের জাতীয়তা ও তাহজিব-তমদ্ন নিশ্চিহ্ন করায় অংশ গ্রহণ করা।” পণ্ডিত নেহরুর প্রতি আক্রমণ করে মওলানা বলেছেন, “পণ্ডিতজী একথা ভাল করেই জানেন, জ্ঞানী মুসলমান_যাদের ইসলাম সম্পর্কে জানাশােনা আছে, যাদের মধ্যে নিজস্ব জাতীয় অনুভূতি পুরােপুরি রয়েছে এবং যারা নিজেদের তাহজিবকে সবচাইতে মূল্যবান মনে করে তারা ইসলামী জাতীয়তা পরিত্যাগ করে ভারতীয় জাতীয়তায় নিজেদের মিশিয়ে ফেলা কেয়ামত পর্যন্ত গ্রহণ করতে সম্মত হবে না। তাদের পক্ষে এরূপ করাসম্পূর্ণ অসম্ভব ব্যাপার।” ‘মার্কসের শ্লোগান ছিলাে বিশ্বের সকল শ্রমিক এক হয়ে যাও। তাঁর শিক্ষা ছিলাে কম্যুনিজম মনােভাবাপন্ন লােক যেখানেই থাকুক না কেন, তারা সবাই একই দলভুক্ত। কম্যুনিস্ট হিসেবে পণ্ডিত নেহরুও এ মতবাদে বিশ্বাসী। কিন্তু তবু তিনি ইসলামী জাতীয়তার সমালােচনা করেন। অথচ ইসলামী জাতীয়তাও উপরােক্ত নীতির উপরই প্রতিষ্ঠিত।”8 মওলানা মওদুদীর উল্লিখিত উদ্ধৃতি দেখে অনেকের মনে এরূপ ধারণার উদয় হতে পারে। যে, তিনি বােধ হয় পাকিস্তান আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হয়ে এসব উক্তি করেছেন। আসলে কিন্তু তা নয়। তাঁর এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের মূল লক্ষ্য উপমহাদেশের মুসলিম স্বার্থরক্ষা ছিলাে । তিনি বিদেশী প্রভুদের সন্তুষ্ট করার উদ্দেশ্যে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে এসব যুক্তির অবতারণা করেছিলেন। প্রতি কংগ্রেসের বিরােধিতা প্রসঙ্গে তিনি অন্যত্র বলেছেন, “মুসলমানদের পক্ষে দেশের এরূপ স্বাধীনতা সংগ্রাম করা হারাম যার পরিণামে ইউরােপীয় অমুসলিমদের হাত থেকে ক্ষমতা ভারতীয় অমুসলিমদের নিকট হস্তান্তরিত হবে।
এভাবে তিনি বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির স্বার্থে কংগ্রেসের বিরােধিতা করেছেন। অথচ এক সময়ে এই মওদুদী সাহেবই কংগ্রেসের একজন প্রবল সমর্থক ছিলেন। শুধু সমর্থকই নন, তিনি মুসলমানদের কংগ্রেসে যােগদানের জন্য উৎসাহিত করেছেন। নিজে সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অংশগ্রহণ করেছেন। গান্ধীজির জীবনী লিখেছেন। মওদুদী সাহেব বলেছেন, “১৯১৯ সালে খেলাফত ও সত্যাগ্রহ আন্দোলন শুরু হলে আমি এ দুটো আন্দোলনের পক্ষে কাজ করি। সে সময় আমি গান্ধীজির জীবনচরিত লিখি। বইটি ছাপা হচ্ছিলাে। আমার এক বন্ধু পুলিশ সুপারকে জানিয়ে দেয়। ছাপা অবস্থায় বইটি বাজেয়াপ্ত করা হয়। ••••জব্বলপুরের মুসলমানদেরকে কংগ্রেসে যােগদানে উৎসাহদানকারীদের মধ্যে আমিও একজন ছিলাম।”৬ আল-জমিয়ত’ সংবাদপত্র ছিলাে জমিয়তে ওলামা হিন্দের মুখপত্র। উপমহাদেশের আলেমদের এই প্রতিষ্ঠান সে সময় কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন জানায়। মওদুদী সাহেব এই পত্রিকায় কাজ করার সময় কংগ্রেসের রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি সমর্থন জানাতে থাকেন। তিনি সে সময় কংগ্রেসের প্রতি সমর্থন দান প্রসঙ্গে লিখেছেন, “এখন দেশের জন্য দুটো পথ রয়েছে। প্রথমটি হলাে, নিজেদের আবেগ-অনুভূতির বশবর্তী হয়ে কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করা এবং যেদিক ইচ্ছে পা বাড়ানাে। দ্বিতীয়টি হলাে, কংগ্রেসের সিদ্ধান্ত মেনে চলা। এক মুহূর্তের জন্যও অন্তরে এর বিরােধিতার মনােভাব পােষণ না করা। প্রথম। পথ অনুসরণের পরিণতি আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের পরিপন্থী। দ্বিতীয় পথ যদিও আমাদের। আবেগ-অনুভূতি বিরােধী, তবু এটাই হচ্ছে ঐক্য ও সংহতির পথ। আর ঐক্য ও সংহতি সাম্প্রদায়িকতার চেয়ে উত্তম। একতা সকল অবস্থায় বিভেদের তুলনায় শ্রেষ্ঠত্বের। দাবীদার। আর সংহতি সবদিক থেকেই বিচ্ছিন্নতা থেকে অগ্রগণ্য।”৭
আপনারা নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন, পূর্বে উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলােতে বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে মওদুদী সাহেব পবিত্র ইসলাম, মুসলিম জাতীয়তা, মুসলিম তাহজিব-তমদুন ও মুসলিম স্বাতন্ত্রের নামে কংগ্রেস ও কংগ্রেস নেতৃবৃন্দের কিরূপ নগ্ন সমালােচনা করেছেন। অথচ তার আগে তিনি যখন জমিয়তে ওলামা হিন্দের মুখপত্র ‘আল-জমিয়তে চাকরি করতেন তখন তিনি কংগ্রেসের প্রতি কিরূপ জোরালাে সমর্থন জানিয়েছেন। যে সংগঠনে যােগদান করা ইসলামের দৃষ্টিতে তখন হারাম ছিলাে না, যে ভারতীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলন মুসলমানদের স্বাতন্ত্র ও অস্তিত্বের জন্য তখন ক্ষতিকর ছিলাে না, পরবর্তীকালে একই ব্যক্তির বিচারে কেন হারাম হলাে, ক্ষতিকর হলাে, তা সত্যি। ভাববার বিষয়। আসলে মওদুদী সাহেব উপমহাদেশের মুসলমানদের স্বার্থরক্ষার প্রতি উদ্বুদ্ধ হয়ে কংগ্রেসের বিরােধিতা করেননি। বৃটিশ প্রভু ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের। কৃপাদৃষ্টি লাভের জন্যই তিনি কংগ্রেসের বিরােধিতা করেন। কারণ সে আমলে কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ ছাড়া ছােটখাট যেসব জাতীয়তাবাদী সংগঠন ছিলাে, তারা হয় কংগ্রেস নতুবা মুসলিম লীগের সমর্থক ছিলাে। এছাড়া ছিলাে ‘অল ইণ্ডিয়া কমুনিষ্ট পার্টি’। কিন্তু মওদুদী সাহেব এসবের কোনটারই সমর্থক ছিলেন না। এমনকি, তখন তাঁর নিজেরও কোন রাজনৈতিক দল ছিলাে না।
পাকিস্তান আন্দোলন ও মওদুদ
১৯৩৬ সালে বৃটিশকে সরকার পরিচালনার বেশ কিছু ক্ষমতা ভারতীয়দের হাতে ছেড়ে দিতে হয়। সেবার দেশের সব কয়টি প্রদেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নির্বাচনে কংগ্রেস অধিকাংশ প্রদেশে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে। যে কয়টি প্রদেশে মুসলিম লীগ সরকার গঠিত হয়, সেখানে কংগ্রেস শক্তিশালী, বিরােধী দলের ভূমিকা গ্রহণ করে। মুসলমানরা মুহম্মদ আলী জিন্নার নেতৃত্বে সংহত হতে আরম্ভ করে। মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ একটা শক্তিশালী রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। কিন্তু মওলানা মওদুদী কংগ্রেসের ঘাের বিরােধী হওয়া সত্ত্বেও মুসলিম লীগে যােগদান করলেন না। মওলানা কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ উভয় রাজনৈতিক পার্টির বিরােধিতা করে যেতে লাগলেন। তিনি উভয় পার্টিকেই ইসলামবিরােধী, ইসলাম ও মুসলমানদের চরম শত্রু ইত্যাকার বলতে আরম্ভ করলেন। তাঁর এসব বলার পেছনে একই নীতি কার্যকর ছিল। আর তা হলাে বিদেশী প্রভু ও তাদের এদেশীয় সমর্থকদের সন্তুষ্ট করা। নতুবা তখন অন্তত মুসলিম লীগের বিরােধিতার আর কি যৌক্তিকতা থাকতে পারে! কারণ তিনি যদি সত্যি আন্তরিকভাবে উপমহাদেশীয় মুসলমানদের স্বাতন্ত্রে অনুপ্রাণিত হতেন, নিশ্চয় মুসলিম লীগে যােগদান করতেন। এমনকি তখনাে পর্যন্ত তিনি নিজেও কোন রাজনৈতিক দল গঠন করেননি। এ সময় তিনি পরিষ্কার ঘােষণা করেন, “এই জাতি প্রথম থেকেই একটি জমিয়ত বা সংঘ। এ সংঘের ভিতর কোন পৃথক সংঘ পৃথক নামে গঠন করা, মুসলমানদের পরস্পরের মধ্যে। পরােক্ষ কিংবা প্রত্যক্ষ নিদর্শন কিংবা বিশেষ কোনাে নাম বা নীতি দ্বারা প্রভেদ সৃষ্টি করা এবং মুসলমানদের বিভিন্ন দলে বিভক্ত করে তাদের মধ্যে দল-উপদলগত কোন্দল সৃষ্টি করা মূলত মুসলমানদের সুদৃঢ় করা নয়, এতে তাদের আরাে দুর্বল করে দেয়া।’ – মওলানার উপরােক্ত মন্তব্যের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে সত্যি আমাদের হাসি পায়।
হাসি পায় এজন্য যে, পাকিস্তান আন্দোলনকারীদের বিরােধিতা করতে গিয়ে কি করে তিনি দিবালােকের মত স্পষ্ট ইতিহাসকে বিকৃত করার ব্যর্থ চেষ্টা করলেন। সে আমল তাে দূরের কথা, আজকের একজন স্কুলছাত্রও জানে, মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে মুসলিম লীগ সংগঠিত হওয়ার পূর্বে উপমহাদেশীয় মুসলমানরা সুসংহত ছিলাে না। তারা ছিলাে শতধাবিচ্ছিন্ন। ফলে রাজনীতি, অর্থনীতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, সরকারী চাকরি-বাকরি, শিক্ষা-দীক্ষা সব ক্ষেত্রেই তারা নিজেদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলাে। বস্তুত মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে। সুসংহত হওয়ার পর থেকেই তারা নিজেদের অধিকার আদায়ে সক্ষম হচ্ছিলাে। অথচ মওলানা মওদুদী কিনা বললেন, উপমহাদেশীয় মুসলমানরা এমনিই সংঘবদ্ধ। নতুন নাম দিয়ে, মানে মুসলিম লীগ’ নামে রাজনৈতিক দল গঠন করার অর্থ মুসলমানদের দুর্বল করে। দেয়া। স্বয়ং মওলানার পরবর্তীকালের একটি উদ্ধৃতির প্রতি তাকালেই তাঁর পূর্বোল্লিখিত উদ্ধৃতিটির অবাস্তবতা প্রমাণ হয়। * মওলানা বলেছেন, “সারকথা, এই নামগড়া মুসলিম সমাজে অনুসন্ধান করলে রংবেরং-এর মুসলমান আপনার নজরে পড়বে। এতাে ধরনের মুসলমান দেখতে পাবেন। যা আপনি গুনে শেষ করতে পারবেন না। এটা একটা চিড়িয়াখানা— যাতে চিল, শকুন, তিতির, ভারই এবং আরাে অনেক প্রকার প্রাণী রয়েছে। এরা সবাই পাখী, কেননা এরা চিড়িয়াখানায় রয়েছে।” মওলানা তাঁর এই উদ্ধৃতিতে পরিষ্কার স্বীকার করেছেন, মুসলমানরা সে আমলে সংঘবদ্ধ ছিলাে না। মূলত তিনি যখন প্রথম বিবৃতিটি দেন তখন বেশ ভাল করেই জানতেন , মুসলমানদের মধ্যে একতা নেই। একমাত্র মুসলিম লীগের মাধ্যমেই তারা একটা সুসংহত জাতিতে পরিণত হতে চলেছে। তবু মুসলিম লীগের বিরােধিতার নেশায়ই তিনি সত্যের অপলাপ করেছিলেন। * ১৯৩৯ সালের দিকে মওলানা মওদুদী মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের কঠোর সমালােচনা। করে লিখেছেন, “মুসলমান নিরেট অজ্ঞ হবে যদি এখনাে তারা পরিস্থিতির নাজুকতা যথাযথ উপলব্ধি করতে না পারে। তারা এখনাে এই ধোঁকায় পড়ে রয়েছে যে, বাহাড়ম্বর সভাসমিতি এবং ফাঁপা শশাভাযাত্রা তাদের জাতীয় ধ্বংস থেকে রক্ষা করবে। তারা এমন। লােকদের নেতৃত্বে আস্থা জ্ঞাপন করছে যাদের সামনে মন্ত্রিত্ব এবং ঐশ্বর্য ছাড়া আর কোন জিনিস নেই। যারা জাতির জন্য এতটুকু ক্ষতি স্বীকার করতে পারবে না, যারা কেবলমাত্র মন্ত্রিসভায় নিজেদের দখল টিকিয়ে রাখার জন্য মুসলমানদের নাম উচ্চস্বরে নিচ্ছে তাদের ভীরুতা সম্পর্কে শক্রদের পুরােপুরি বিশ্বাস রয়েছে।….
সম্ভবত মওদুদী সাহেব এ সময় ধারণা করেছিলেন, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ দ্বারা কিছুই হবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁদের হাতে জাতির তরী ডুববে বই ভাসবে না। এমনকি ১৯৪০ সালে লাহাের প্রস্তাব পাস হওয়ার ঘটনাও তাঁর মনে কোনরূপ রেখাপাত করেনি। মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ যখন মুসলিম জাতীয়তা, মুসলিম তাহজীব-তমদ্দন, মুসলিম রাষ্ট্র ইত্যাদি সম্পর্কে বক্তৃতা-বিবৃতি দিতে আরম্ভ করলেন- মওলানা তখন এসব অনৈসলামিক বলে প্রচার করতে আরম্ভ করলেন। তিনি কিনা যা বলেন সেটাই খাটি ও নিভের্জাল ইসলাম। অত্যন্ত জোরেশােরে তার খাটি ইসলামের দিকে তিনি মুসলমানদের আহবান করতে লাগলেন। খাঁটি আর ভেজাল ইসলামের প্রচারণায় তিনি এক চরম পর্যায়ে গিয়ে পোঁছেন। এই পরিস্থিতিটা মওলানার লেখা থেকে কিছুটা অনুমান করা যাবে।’ তিনি তাঁর রাজনৈতিক পুস্তক ‘সিয়াসী কাশমকাশ’ তৃতীয় খণ্ডের ভূমিকায় লিখেছেন, …আমার নিকট এই পরিস্থিতি ভয়াবহতার দিক থেকে দেশীয় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের চাইতে কম নয়। ধর্ম সম্পর্কে অজ্ঞ লােকদের নেতৃত্বে ভারতের মুসলমানরা যদি একটি বিধর্মী জাতির মত নিজেদের স্বতন্ত্র অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখে (যেমন তুর্কী ও ইরানীরা রেখেছে), তবে তাদের এরূপ জীবিত থাকা এবং কোনাে অমুসলিম জাতীয়তায় মিশে যাওয়াতে কী পার্থক্য আছে? হীরা যদি তার বৈশিষ্ট্য হারিয়ে বসে তবে হতভাগা পাথর হয়ে পড়ে থাকুক কিবা বিক্ষিপ্ত হয়ে মাটিতে মিশে যাক, জহুরীর তাতে কী আকর্ষণ থাকতে পারে ?” . সে আমলে এরূপ কঠোর ভাষায় তিনি মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে বিষােদ্গার করেছেন। আর একস্থানেলিখেছেন, “….এই জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য আপনাদের ইসলামের নাম ব্যবহার করার অধিকার নেই। কেননা, ইসলাম সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের শক্র। সেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদই হােক কিংবা নামগড়া মুসলিম জাতীয়তাবাদই হােক।”
একথা বলাই বাহুল্য, সে সময়ে মিঃ জিন্নার নেতৃত্বে পরিচালিত স্বাধীনতা সগ্রামীদের বিরােধিতা করার অর্থ ছিলাে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করা। কারণ ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুমােদিত হওয়ার পর পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাই ছিলাে মুসলিম লীগের ঈপ্সিত লক্ষ্য। বস্তুত সে আমলে যারা তাদের বিরােধিতা করেছেন তারাই পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বিরােধিতায় পঞ্চমুখ ছিলেন। মওলানা মওদুদীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। মুসলিম লীগ, মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ ও পাকিস্তান দাবীর বিরােধিতায় তিনি তাঁর লেখনীর ব্যবহারে এতটুকু কসুর করেননি। শুধু তাই নয়, এ ব্যাপারে ইসলামকে তিনি একটা প্রবল হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন। মুসলিম লীগ ও তাঁর নেতৃবৃন্দকে তিনি ইসলামের শত্রু আখ্যায়িত কবেছেন। পাকিস্তানকে ‘খোঁড়া পাকিস্তান’, ‘না-পাকিস্তান’ ইত্যাকার আরাে কত কি বলা হয়েছে! মুসলিম লীগ সম্পর্কে মওলানা বলেছেন, “কেবলমাত্র মুসলমান শব্দ দ্বারা প্রতারিত হয়ে যারা অজ্ঞতার পুজারীদের সংস্থাকে একটি সংস্থা মনে করে এবং একথা ভাবে যে, এ ধরনের কোনাে প্রতিষ্ঠান ইসলামের দৃষ্টিতে কল্যাণকর হবে, তাদের স্থলবুদ্ধি শােকজ্ঞাপনযােগ্য।”8
….যে মসজিদের বুনিয়াদ ন্যায়নিষ্ঠার উপর নয়, কোরআন সেখানে দাঁড়ানাের অনুমতি দেয় না। এখানে তাে ন্যায়নিষ্ঠাকে মস্তিষ্কের বিকৃতি মনে করা হয়।”৫ এ ব্যাপারেও আমার কোনাে কিছু বলার নেই যে, রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিতে মুসলিম লীগের ‘মুসলমান নাম ধারণ নীতি এই জাতি যারা হিন্দুস্থানে বাস করে তাদের জন্য কল্যাণকর হবে, না ক্ষতিকর হবে। আমার নিকট যে প্রশ্নটি গুরুত্বপূর্ণ তা হলাে— এসময় যে জাতিকে মুসলমান নামে ডাকার দরুন পৃথিবীতে ইসলামের প্রতিনিধি মনে করা হয়, তার সবচাইতে বড় প্রতিষ্ঠান ইসলামকে বিশ্ববাসীর সামনে কিরূপে পেশ করেছে। এই দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মুসলিম লীগের প্রস্তাবের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে আমার অন্তর কাঁদতে আরম্ভ করে।”৬ গ মওলানা মওদুদী যে আমলে মুসলিম লীগ সম্পর্কে এসব উক্তি করেছিলেন তখন উপমহাদেশের অধিকাংশ মুসলমানই মুসলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়েছিলাে। যেসব মুসলিম নেতা কংগ্রেস সমর্থক ছিলেন তাঁদের সম্পর্কে আমাদের কিছু বলার নেই; কারণ তাঁরা ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী ছিলেন। অবশ্য একথা সত্য যে, তাঁরা। উপমহাদেশের স্বাধীনতাকামী ছিলেন। এজন্য তাঁরা সংগ্রাম করেছেন। জেল খেটেছেন। কিন্তু তাঁরা মওলানা মওদুদীর মত ইসলামের ছদ্মাবরণে বিদেশী শক্তির স্বার্থরক্ষার ভূমিকা পালন করেননি— নানা ছলছুতার আশ্রয়ে মুসলমানদের স্বাধীনতা সংগ্রাম থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করেননি। সবচাইতে দুঃখের বিষয় হলাে, কোরআন নাকি তাঁকে এ সংস্থায়, যােগদান করতে অনুমতি দেয়নি। আর যাই বলুন, কোরআনকে নিজের স্বার্থে ব্যবহারের । ক্ষেত্রে মওলানা মওদুদী উপমহাদেশে শীর্ষস্থানের অধিকারী ছিলেন, একথা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। ‘ পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাকারী নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে মওলানা বলেছেন, “এই সংস্থায় যাদের প্রথম সারিতে দেখা যাচ্ছে, ইসলামী জামাতে তাদের সঠিক স্থান সবচেয়ে পেছনের সারিতে। এমনকি কেউ কেউ তাে সেখানেও অনুগ্রহেই স্থান পেতে পারে। এ ধরনের লােকদের নেতা বানান রেলগাড়ির সবচেয়ে পেছনের বগিকে ইঞ্জিনের স্থানে লাগিয়ে দেয়ার সমতুল্য। যে উচু স্থানে আপনারা যাওয়ার ইচ্ছে করছেন, এ নামসর্বস্ব ইঞ্জিন আপনাদের গাড়িকে এক ইঞ্চিও নিয়ে যেতে পারবে না। অবশ্য গাড়ি তার আপন গতিতে নিচের দিকে চলে আসবে। আপনারা কিছুকাল পর্যন্ত এভুল ধারণায় পড়ে থাকবেন যে, মাশাআল্লাহ! আমাদের ‘ইঞ্জিন’ গাড়িকে খুব উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছে। এ বাস্তব যত তাড়াতাড়ি অনুধাবন করতে পারবেন ততই মঙ্গল। কেননা প্রতিটি মুহূর্ত চলে যাচ্ছে। সে আপনাদের উপরের পরিবর্তে নিচের দিক। নিয়ে যাচ্ছে….।”৭
উপরােক্ত উদ্ধৃতিটি মওলানা মওদুদী মিঃ জিন্না ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের সম্পর্কে বলেছেন। তাঁর বিচারে এসব নেতা ইসলামী জামাতে স্থান পাওয়ারও যােগ্য নন। নেতৃত্বের আসন পাওয়া তাে অনেক দূরের কথা। এসব নেতার দ্বারা নাকি মুসলিম জাতি তাদের পতনকেই ডেকে আনবে। আশ্চর্যের বিষয়, দশ কোটি মুসলমানের মধ্যে মওলানা মওদুদী। ছাড়া সে আমলে আর কেউই এ সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেনি। তারা কেউই মওলানার এসব সতর্কবাণীতে কর্ণপাত করেনি। তাতে তারা ধ্বংস হয়েছে, না কামিয়াব হয়েছে— এ প্রশ্নের উত্তর ইতিহাসই মওলানাকে দিয়েছে। – মওলানা মওদুদী কেবলমাত্র পাশ্চাত্য শিক্ষিতদেরই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ ইত্যাকার বলে গালিগালাজ করেননি। সে আমলে উপমহাদেশের প্রখ্যাত ও সর্বজনমান্য পাকিস্তান দাবির সমর্থক আলেমরাও তাঁর এসব অশালীন সমালােচনা থেকে অব্যাহতি পাননি। তিনি একস্থানে বলেছেন, “পাশ্চাত্য ধরনের নেতাদের সম্পর্কে তাে তেমন আশ্চর্যবােধ হওয়ার নয়; কারণ বেচারাদের কোরআনের আলাে-বাতাসও লাগেনি, কিন্তু আশ্চর্য লাগে এবং হাজার বার লাগে সেসব আলেমের ব্যাপারে যাদের দিবারাতের কাজই হলাে আল্লাহ বলেছেন’ ও ‘রাসুল বলেছেন’ (কোরআন-হাদিস) পড়ান। বুঝে আসে না তাদের কী হয়ে গেছে।” উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে মনে হয় মওলানা মওদুদী একথাই বলতে চেয়েছিলেন যে, পাশ্চাত্য ধরনের নেতৃবৃন্দ যাদের কোরআন-হাদিস সম্পর্কে এতটুকু জ্ঞান নেই, তারা না হয় পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম করলাে, তাতে আশ্চর্যান্বিত হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু যেসব আলেম সব সময় কোরআন-হাদিস অধ্যাপনার কাজে নিয়ােজিত, তাঁদের এ সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান রয়েছে। তাঁরা তাে জানেন পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা কোরআন-হাদিস বিরােধী। জেনেশুনে কেন এসব আলেম, কোরআন-হাদিস বিরােধী একটা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েছেন! তাঁদের এই অনৈসলামিক ভূমিকার কথা ভাবলে সত্যি তাঁর আশ্চর্যবোেধ হয়।
মওলানা কেবলমাত্র মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান দাবীর সমর্থক নেতৃবৃন্দ ও আলেমওলামার সমালােচনা করেই ক্ষান্ত হননি, তিনি সাধারণ মুসলমানদেরও তীব্রভাবে আক্রমণ করেছেন। তাদের মুসলমানিত্বের উপরও কটাক্ষপাত করেছেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “একটি জাতির প্রতিটি ব্যক্তিকে শুধুমাত্র এজন্য যে তারা বংশগত মুসলমান, সত্যিকার অর্থে মুসলমান গণ্য করা এবং এরূপ আশা পােষণ করা, তাদের সমবেত প্রচেষ্টায় যে কাজই হবে তা ইসলামী নীতি মােতাবেক হবে—প্রথম এবং মৌলিক ভুল। এই বিরাট দল, যাদের মুসলিম জাতি বা সম্প্রদায় বলা হয়, তাদের অবস্থা এরূপ যে, প্রতি হাজারে নয় শ’ নিরানব্বই জনই ইসলাম সম্পর্কে কোন জ্ঞান রাখে না, ন্যায়-অন্যায়ের পার্থক্য করতে জানে না। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি এবং মানসিক ধ্যান-ধারণাও ইসলাম মােতাবেক পরিবর্তিত হয়নি।…..” এসব উদ্ধৃতি থেকে আপনারা সহজেই অনুমান করতে পারেন, মওদুদী সাহেব পাকিস্তান দাবীর সমর্থকদের সম্পর্কে পবিত্র ইসলামের নামে কিরূপ জঘন্য মন্তব্য করেছেন। যে সুতাের টানে মওদুদী সাহেব কংগ্রেসের বিরােধিতা করেন, পাকিস্তান দাবির বিরােধিতার পেছনেও একই সুতাের টান কার্যকর ছিলাে। সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা-পরবর্তীকালে মওদুদী সাহেব তাঁর ইসলামী মুখােশ পরা এসব ব্যাখ্যা-বিবৃতি বেমালুম ভুলে যান। তিনি পরিষ্কার ঘােষণা করেন, আমি পাকিস্তানের বিরােধিতা করিনি, মুসলিম লীগের বিরােধিতা করেছি। বর্তমান বাংলাদেশেও মওদুদীর অনুসারীরা একই পথ ধরেছে। এ সম্পর্কে সামনে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে।
জামাতে ইসলামী
মওলানা মওদুদী ইসলামের ছদ্মাবরণে উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম, কংগ্রেস, বিশেষ করে পাকিস্তান আন্দোলন, মুসলিম লীগ-এর নেতৃবৃন্দ ও সমর্থকদের বিরুদ্ধে এতােসব বিষােদ্গার করেও যখন দেখলেন কেউই তাঁর কথায় কর্ণপাত করছে না, তখন তিনি একটি নতুন পরিকল্পনা নিলেন। সম্ভবত বৃটিশভক্ত পদস্থ মুসলিম সরকারী কর্মচারীরাই তাঁকে পরিকল্পনাটি নেয়ার ব্যাপারে পরামর্শ দিয়েছিলেন। তিনি একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত নিলেন। অথচ ইতিপূর্বে তিনি একাধিকবার বলেছিলেন, “ইসলাম’ বা মুসলিম নাম দিয়ে নতুন কোনাে সংস্থা গঠন করার কোনাে প্রয়ােজন নেই। কারণ মুসলমানরা। এমনিই সংঘবদ্ধ। পার্টি গঠন করার কয়েক বছর পূর্ব থেকে তিনি প্রচার করতে আরম্ভ করলেন, এদেশে সত্যিকার ইসলাম প্রচার ও প্রসারের জন্য একটি সালেহ বা ন্যায়নিষ্ঠ দলের প্রয়ােজন। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “একথা স্পষ্ট, কোনাে অমুসলিম মিষ্টার জিন্নার ১৪ কিংবা ২৪ দফায় বিশ্বাস স্থাপন করতে পারে না। মুসলিম লীগ, আহরার পার্টি কিংবা জমিয়তে ওলামার প্রস্তাবাবলীতেও এমন কোনাে জিনিস নেই যার উপর বিশ্বাস স্থাপন করা যায়। কেউ যদি বিশ্বাস স্থাপন করে তবে একমাত্র ‘কলেমা লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহু’র উপরই করতে পারে। তবে শর্ত হলাে—একটি জামাত হতে হবে, যে এই কলেমার জন্য বাঁচতে ও মরতে প্রস্তুত। কিন্তু তা কোথায় ?” | মওলানা মওদুদী তাঁর সিয়াসী কাশমকাশ গ্রন্থে “একটি ন্যায়নিষ্ঠ জামাতের প্রয়ােজন” শীর্ষক প্রবন্ধে এ সম্পর্কে বলেছেন, “এই কাজের (হুকুমতে ইলাহী প্রতিষ্ঠার) জন্য একটি প্রবল সমালােচনামুখর, ধ্বংসাত্মক ও সংগঠিত আন্দোলনের প্রয়ােজন যা একদিকে জ্ঞানগরিমার শক্তি দ্বারা পুরনাে সভ্যতার বুনিয়াদ উড়িয়ে দেবে এবং অনদিকে জ্ঞানবিজ্ঞান ও সাহিত্যকে নিজের বিশেষ চিন্তাধারার বুনিয়াদের উপর নতুন করে গড়ে তুলবে। এমনভাবে করতে হবে, যাতে চিন্তাজগৎ পুরােপুরি প্রভাবান্বিত হয় এবং মানুষ এই
পদ্ধতিতে চিন্তাভাবনা করতে আরম্ভ করে।•••.”২ মওদুদী সাহেবের উপরােক্ত উদ্ধৃতি দু’টোও পবিত্র ইসলামের নামে স্ববিরােধিতার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। আগে তিনি বলতেন “ইসলাম’ বা ‘মুসলিম’ নাম দিয়ে নতুন কোন সংগঠন গড়ার প্রয়ােজন নেই। এমনিতেই মুসলমানরা সংঘবদ্ধ। আবার নিজেই বলে বসলেন, ও ফ্যাসি দল কখনাে এতাে শক্তি ও সফলতা অর্জন করতে পারতাে না, যদি তারা নিজেদের নীতির প্রতি অটল বিশ্বাস না রাখতে এবং নিজেদের নেতৃবৃন্দের কঠোর অনুগত না হতাে।” | জামাতে ইসলামী গঠনের পর মওলানা সমবেতদের সামনে ভাষণদান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “আমরা সত্যিকার এবং আসল ইসলাম নিয়ে যাত্রা করছি। পূর্ণ ইসলামই হলাে আমাদের আন্দোলন।••••প্রথমে রাসুলুল্লাহ প্রতিষ্ঠিত যে জামাত ছিলাে আমরাও হুবহু সেই জীবনপদ্ধতিই গ্রহণ করেছি। ….”
জামাতে ইসলামীর নীতি ও উদ্দেশ্য বর্ণনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী বলেছিলেন, “আমাদের নিকট খােদ ইসলামই আন্দোলন এবং সমগ্র বিশ্বমানবের জন্যই ইসলামের আহ্বান। সুতরাং কোনাে বিশেষ জাতি বা দেশের সাময়িক সমস্যাবলীর প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবন্ধ নয়। বরং তা সমগ্র মানবতা ও বিশ্বব্যাপী সম্প্রসারিত। ••••”3 | জামাতে ইসলামীর নীতি বিশ্লেষণী ভাষণ থেকে স্বভাবতই অনেকে ধারণা করেছিলাে যে, মওদুদীর উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরােধী ভূমিকার হয়তাে পরিবর্তন ঘটেছে। কিন্তু দেখা গেলাে তা নয়, বরং পূর্বের চাইতেও জোরেশােরে তিনি এ কাজে আত্মনিয়ােগ করেন। | সিয়াসী কাশমকাশ তৃতীয় খণ্ডের একস্থানে তিনি বলেছেন, “মুসলমান হিসেবে এ বিষয়ের প্রতিও আমার কোনরূপ আকর্ষণ নেই যে, হিন্দুস্তানের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় তাদের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হােক। আমার নিকট প্রথম প্রশ্ন হলাে, আপনাদের পাকিস্তানের শাসনব্যবস্থার বুনিয়াদ খােদাই সার্বভৌমত্বের উপর হবে, না পাশ্চাত্য গণতান্ত্রিক বিধান মােতাবেক জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের উপর হবে। প্রথমটি হলে পাকিস্তানই হবে। দ্বিতীয়টি হলে তা হবে না—পাকিস্তান যেমনটি হবে দেশের অপর অংশ—যেখানে আপনাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী অমুসলিমরা দেশ শাসন করবে। বরং খােদার দৃষ্টিতে ওটা (পাকিস্তান) হবে এর (বর্তমান ভারত) চাইতেও নাপাক বা অপবিত্র।•••• যদি জনসাধারণের মতের নিকট নত হতে হয়, তাহলে হিন্দুস্তান ও তার মাটির পুজারীরা জাহান্নামে যাক। এটা এক দেশ থাকুক কিংবা দশ হাজার খণ্ডে বিভক্ত হােক তাতে আমার কি লাভ ? • • • ‘৪ । মওলানা বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলনের বিরােধিতা প্রসঙ্গে অধিকাংশ সময় ধর্মীয় তাত্ত্বিক বিষয় জড়িয়ে ঘােলা পানিতে মাছ শিকার করার চেষ্টা করেছেন। এখানেও তিনি তাই করেছেন। পাকিস্তানকে ‘না-পাকিস্তান’ বলেছেন। তার সাথে খােদা আর জনসাধারণের সার্বভৌমত্বের প্রশ্ন জড়িয়ে দিয়েছেন। তাতে করে তিনি সে সময় সাধারণ মানুষকে। বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলন থেকে দূরে সরিয়ে রাখার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন। _ মওলানা মওদুদী জামাতে ইসলামীর মূলনীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেছিলেন, তাদের দৃষ্টি কোন বিশেষ জাতি বা দেশের সাময়িক সমস্যাবলীর প্রতি নিবন্ধ নয়। কারণ তাদের আন্দোলন ইসলামেরই আন্দোলন, আর সে সমগ্র বিশ্বমানবকেই আহবান জানায়। কিন্তু মওলানার দীর্ঘ কর্মজীবনের প্রতি সামগ্রিক দৃষ্টিপাত করলে যেকোন লােকের নিকট এ সত্য মূর্ত হয়ে ওঠে যে, তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ উক্তির বরখেলাপ করেছেন। হায়দরাবাদ জীবনে ইসলাম প্রচারের ধারা ছিলাে রাজতন্ত্র তথা নিজাম গােষ্ঠীর স্বার্থ সংরক্ষণ কেন্দ্রিক। পরবর্তীকালে পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোটে আসার পর তাঁর ইসলাম প্রচার অভিযান ছিল উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামবিরােধী ও বৃটিশ স্বার্থরক্ষামূলক। তাঁর এ ভূমিকার অনেক উদ্ধৃতি পেছনে উল্লেখ করা হয়েছে। ১৯৪৭ সাল নাগাদ তিনি এভাবে পূর্ণোদ্যমে স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরুদ্ধে তাঁর বিশেষ ইসলামী দৃষ্টিতে কলমী জেহাদ চালিয়েছেন। ১৯৩৩ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত মওলানা উপমহাদেশের মুসলমানদের যে পথে পা বাড়াতে আল্লাহ ও রাসুলের নামে বারণ করেছিলেন তারা তা শােনেনি; মওলানার নিষিদ্ধ পথে অগ্রসর হয়েছে। আর তাতে করে ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে উপমহাদেশ স্বাধীন হয়েছে।
ঔপনিবেশিক শাসনেতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, যুগে যুগে বিভিন্ন উপনিবেশে, বিশেষ করে মুসলিম অধ্যুষিত এলাকাগুলােতে জামাতে ইসলামী ধরনের অনেক ‘আমিরিয়ত’কেন্দ্রিক প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে। তারা দেশে অর্থনৈতিক লুটতরাজ, বিভিন্ন দৈনন্দিন সমস্যা, সর্বোপরি সাধারণ মানুষের অধিকার সম্পর্কে কোন কথাই বলতাে । আদর্শ বিষয়ক তর্ক-বিতর্ক ও প্রচারণা ছিলাে সেসব প্রতিষ্ঠানের মূল ভূমিকা। কোন প্রতিষ্ঠানের এরূপ ভূমিকা স্বভাবতই ঔপনিবেশিক স্বার্থহানিকর নয়। এজন্য উপনিবেশবাদীরাও এ ধরনের প্রতিষ্ঠানকে সহানুভূতির চোখে দেখতাে। মওলানা মওদুদীও ইতিহাসের এই অধ্যায়টি থেকে পুরােপুরি অনুপ্রেরণা সঞ্চয় করেছিলেন। আর তাই তিনি উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের বিরােধিতা করেছিলেন। এটা মওলানার অদূরদর্শিতাই বলুন আর অতিদূরদর্শিতাই বলুন তা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হয়েছে। তাঁর মত দু’চারজনের বিভিন্ন রূপ নিয়ে সহায়তা সত্ত্বেও ইংরেজকে এদেশ ছাড়তে হয়েছে, বিংশ শতাব্দীর অমােঘ ধারা স্বীকার করে নিতে হয়েছে, উপমহাদেশবাসী স্বাধীনতা লাভ করেছে। যায় পাকিস্তান আন্দোলনে মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল জামাতে ইসলামীর ভূমিকা কিরূপ ছিল, তা বিগত সংক্ষিপ্ত আলােচনার মাধ্যমে পরিষ্কার ফুটে উঠেছে। আজাদী-উত্তরকালে স্বভাবতই মওলানা তাঁর পাকিস্তান-বিরােধী ভূমিকার জন্য কঠোর সমালােচনার সম্মুখীন হয়েছেন। এসব সমালােচনার যে উত্তর তিনি দিয়েছেন তা অত্যন্ত হাস্যকর। তিনি যেসব জবাব দিয়েছেন তার দু’একটা আমরা এখানে উল্লেখ করছি। ” তিনি বলেছেন, “পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টায় জামায়াতে ইসলামীর অংশগ্রহণ না করার। কারণ এ ছিল না যে, জামায়াত মুসলমানদের জন্যে একটি পৃথক স্বাধীন রাষ্ট্র কায়েম করতে চায়নি। বরং এর তিনটি কারণ ছিল।•••• প্রথম কারণ হলাে, মুসলমানদের এমন একটি জামায়াত থাকা জরুরী ছিল যে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে খােদা না-খাস্তা যদি মুসলিম লীগ ব্যর্থ হয়ে যেত তাহলে যেন সেই জামায়াত জাতিকে সাহায্য করতে সক্ষম হয়।
এ কারণে এই সংরক্ষিত শক্তিকে (Reserve Force) সগ্রাম থেকে পৃথক রাখার প্রয়ােজন ছিল। দ্বিতীয় কারণ হলাে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরও অবশ্য কয়েক কোটি মুসলমানকে বৃটিশ ভারতের সেই অংশে থাকতে হতাে যা পাকিস্তান পরিকল্পনার মাধ্যমে হিন্দুদের কর্তৃত্বাধীন চলে যাচ্ছিল। দেশ বিভাগের পর সেসব মুসলমানকে সাহায্য করার জন্য অবশ্যি মুসলিম লীগ কিছুই করতে পারতাে না। এ উদ্দেশ্যে অন্য একটি সুসংগঠিত দলকে প্রথম থেকে প্রস্তুত রাখার প্রয়ােজন ছিল এবং এ দলকে পাকিস্তান সগ্রাম থেকে পৃথক রাখারও প্রয়ােজন ছিল। যাতে করে হিন্দু ভারতে সে কাজ করতে সক্ষম হয়। তৃতীয় কারণ হলাে, পাকিস্তানের জন্যে যে দলটি (মুসলিম লীগ) কাজ করছিল, তার সমস্ত দৃষ্টি একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সংগ্রামের ওপরই নিবদ্ধ ছিল। নৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে দল ও জাতিকে শক্তিশালী করার জন্য তার পক্ষে কোনাে প্রচেষ্টা চালান সম্ভব হচ্ছিল না। এ পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে স্পষ্ট অনুভূত হচ্ছিল যে, এভাবে একটি দল সংগ্রাম করে যদি দেশ লাভ করে, তাহলে তাকে ইসলামী রাষ্ট্রে পরিণত করা তাে দূরের কথা জাতীয় রাষ্ট্র হিসাবে শক্তিশালী ভিত্তিতে দাঁড় করাতেও সক্ষম হবে না। সেখানে ভীষণ নৈতিক ও আদর্শিক বিশৃংখলা সৃষ্টি হবে। এ পরিস্থিতিতে এ প্রচেষ্টা চলাকালে মুসলমানদের মধ্যে একটি সুসংগঠিত দল গঠনের প্রয়ােজন ছিল, যা পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এ রাষ্ট্রকে নৈতিক ধ্বংস হতে রক্ষার এবং একে ইসলামের পথে পরিচালিত করার জন্যে কাজ করতে পারে। প্রশ্ন এই যে, এই দূরদর্শিতাপূর্ণ পরিকল্পনাকে কার্যকরী করা কি কোনাে গুনাহ ছিল?”৫
মওলানা মওদুদী উপরােক্ত জওয়াবের প্রথম কারণে বলেছেন, জামাতে ইসলামীকে তিনি সংরক্ষিত রেখেছিলেন, মুসলিম লীগ ব্যর্থ হলে যাতে মুসলমানদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করতে পারেন। আচ্ছা ধরা যাক মুসলিম লীগ ব্যর্থ হলাে। স্বাধীনতা সংগ্রামে যে ক্ষেত্রে উপমহাদেশের মুসলমানদের বৃহত্তম দল দেশকে বিভক্ত করতে পারলাে না, স্বাধীনতা উত্তরকালে কংগ্রেসের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পর ক্ষুদে জামাতে ইসলামী কি দেশকে বিভাগ করতে পারতে? মওলানা মওদুদীর মত একজন লােক কি করে এ ধরনের মন্তব্য করলেন তা আমরা ভেবেই পাই না। তাছাড়া যে দল বা নেতার এরূপ সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা রয়েছে, মুসলিম লীগ ব্যর্থ হলে তিনি ও তাঁর দল মুসলিম লীগের স্থলবর্তী হয়ে মুসলমানদের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করবেন—এজন্য তিনি তাঁর দলকে সংরক্ষিত রেখেছেন। এরূপ সংরক্ষিত দল ও নেতা আর যাই করুন, মুসলিম লীগ ও তার দাবির বিরােধিতা করতে পারেন না। আপনারা পেছনে দেখে এসেছেন, মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল মুসলিম লীগ ও তার নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কিরূপ বিষােদ্গার করেছেন। গালিগালাজের ভদ্রোচিত এমন কোন শব্দ নেই যা তিনি ব্যবহার করেননি। মুসলিম লীগের দাবি পাকিস্তানকে ‘নাপাকিস্তান’, ‘লেংড়া পাকিস্তান’ আরাে কত কি বলা হয়েছে। এরপরও যদি বলা হয় যে, স্বাধীনতা সংগ্রামে জামাতে ইসলামীকে সংরক্ষিত শক্তি হিসেবে রাখা হয়েছিলাে, তা হাস্যাস্পদ নয় কি ? IT জওয়াবের দ্বিতীয় কারণে তিনি বলেছেন, হিন্দু ভারতের মুসলমানদের সাহায্য করার জন্য তিনি জামাতে ইসলামীকে পাকিস্তান সংগ্রাম থেকে পৃথক রেখেছিলেন। যদি তাই হয় তবে মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল কি সে দায়িত্ব পালন করেছেন? পাক-ভারতের স্বাধীনতা ঘােষণার সঙ্গে সঙ্গেই মওলানা তার সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে লাহােরে পাড়ি জমিয়েছিলেন।
এই কী ছিলাে মওলানা ও তাঁর জামাতে ইসলামীর ভারতে মুসলমানদের সাহায্য করার নমুনা ? মওলানা মওদুদীর তৃতীয় কারণটি প্রথম দু’টোর চাইতেও অবাস্তব ও আপত্তিকর। “ধান ভানতে শিবের গীত গাওয়া’ মওলানার একটা চিরাচরিত অভ্যাস। এক্ষেত্রেও তিনি তাই করেছেন। যে সময় উপমহাদেশের দশ কোটি মুসলমান মুসুলিম লীগের পতাকাতলে সমবেত হয়ে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য মরিয়া হয়ে সংগ্রাম করছিলাে, সে সময় মুসলিম লীগ নাকি জাতিকে নৈতিক ও ধর্মীয় দিক থেকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেনি। যার জন্য মুসলিম লীগ পাকিস্তানকে দৃঢ়ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সক্ষম হবে না। এজন্য মুসলিম লীগ অর্জিত পাকিস্তানকে নৈতিক ধ্বংস হতে রক্ষা করার সংকল্প নিয়ে তিনি ও তাঁর দল তৈরি হয়ে বসেছিলেন। মওলানার এ উক্তিকে কিছুক্ষণের জন্য মেনে নিলেও একথা একজন সাধারণ জ্ঞানসম্পন্ন লােকও বলবে যে, তখন রাজনৈতিক সংগঠন ও রাজনৈতিক সগ্রামে মুসলমানদের সুসংহত করাই মুসলিম লীগের প্রধান ও একমাত্র কর্তব্য ছিলাে। আর মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ তাই করেছেন। এদিকে সর্বশক্তি নিয়ােগ না করলে হয়তাে কংগ্রেসের সাথে | কুলিয়ে ওঠা যেতাে না। তাতে করে মুসলিম লীগ মারাত্মক ভুল করতাে। দ্বিতীয়ত, তাঁর উল্লিখিত মন্তব্য সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। কারণ মুসলিম লীগ ও তার দাবি পাকিস্তান তথা ভারত বিভাগ সৎগ্রামই ছিলাে ধর্মভিত্তিক, দ্বিজাতি তত্ত্বের উপর প্রতিষ্ঠিত। মুসলিম লীগ এক মুহুর্তের জন্যও এ দিকটির প্রতি উপেক্ষা প্রদর্শন করেনি। | এমতাবস্থায় মওলানা মওদুদীর উপরােল্লিখিত উক্তি মুসলমানদের নৈতিক ও ধর্মীয় অনুভূতিতে কটাক্ষপাত বই কিছু নয়। কারণ সাধারণভাবে নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধ বলতে যা বুঝায়, তা এদেশের মুসলমানদের মধ্যে তখনাে ছিলাে, এখনাে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে। বৃটিশ-বিরােধী আন্দোলনে নেতৃত্বদানকারী নেতৃবৃন্দ এই নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবােধের প্রতি কোনকালেই উপেক্ষা প্রদর্শন করেননি।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম বিরােধী জামাতীদের ভূমিকাও এর ব্যতিক্রম নয়। তারাও মুক্তিযুদ্ধের সময় পাক হানাদার বাহিনীকে সশস্ত্র সমর্থন জানিয়েছে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর জিয়ার শাসনামলে তাঁর আনুকূল্যে স্বনামে আত্মপ্রকাশ করেছে। মওদুদী সাহেবের পাকিস্তান-উত্তরকালীন ব্যাখ্যা-বিবৃতির অনুসরণে নিজেদের অতীত কলংক। ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে। বর্তমানে পবিত্র ইসলামের মুখােশ পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার অভিনয় শুরু করেছে। সংবাদপত্র খুললেই দেখা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় রাজাকার-আলবদরদের নেতৃত্বদানকারী জামাতীরা গাঁয়ে মানে না আপনি মােড়ল সেজে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষার জন্য মায়াকান্না করছে। যে দল এদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদান করেছে যেসব বীর মুক্তিযােদ্ধা এদেশকে স্বাধীন করেছে উল্টো তাদেরকেই জামাতীরা আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড় করানাের চেষ্টা করছে। যেমনটি করেছিলাে মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে। সত্যি জামাতীদের কি চমৎকার অভিনয় !
পাকিস্তান উত্তরকাল
বৃটিশ ভারত বিভাগের পর মওলানা মওদুদী যে পাকিস্তানে চলে আসবেন, তাঁর এরূপ কোন আগাম বাণী আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়নি। স্বাধীনতা ঘােষণার প্রাক্কালে ১৯৪৭ সালের জুন মাসে তরজমানুল কোরআনের যে সংখ্যাটি বের হয়, সেটাই ছিলাে বৃটিশ ভারতে সাময়িকীটির শেষ সংস্করণ। আর এ সময় পাকিস্তান ও হিন্দুস্তানের কেবলমাত্র আনুষ্ঠানিক ঘােষণা বাকি ছিলাে। ভারত যে বিভক্ত করে দেয়া হচ্ছে, একথা সবাই জানতাে। তরজমানুল কোরআনের উক্ত সংস্করণে মওলানা লিখেছেন, “আমি অধিকাংশ সময় আপনাদের একথা বলে আসছি, মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ইসলামী বিপ্লব সৃষ্টি করা যেরূপ সম্ভব, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায়ও প্রায় অনুরূপ সম্ভব। আমার একথাকে অনেকে কল্পনাতুর মানুষের স্বপ্ন মনে করেছে এবং কেউ কেউ ধারণা করে, এটা সুফীবাদের কোনাে রহস্য হবে যা আমাদের বুঝের উর্ধ্বে। মওলানার উল্লিখিত উক্তি থেকে বুঝা যায়, দীর্ঘদিন যাবৎ যে পাকিস্তান ও তার আন্দোলনকারীদের বিরােধিতা করেছিলেন, তাতে তিনি আসতে প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু বিভাগ ঘােষণার পর পরিস্থিতি এমন রূপ পরিগ্রহ করল যে, অমুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ এলাকায় ইসলামী বিপ্লব আনা দূরে থাক, সেখানে মওলানার জীবনে বেঁচে থাকাই মুশকিল হয়ে দাঁড়ালাে। শেষ পর্যন্ত পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর মওলানা মওদুদী তাঁর ঘনিষ্ঠ সঙ্গী-সাথীদের নিয়ে পূর্ব পাঞ্জাবের পাঠানকোট থেকে লাহােরে চলে আসতে বাধ্য হন। স্বাধীনতা আন্দোলনে চরম বিরােধিতা করার পরও মওলানার কথিত ‘না-পাকিস্তানেই’ তাঁকে আশ্রয় নিতে হলাে। কিন্তু পাকিস্তান সরকার বিন্দুমাত্রও প্রতিশােধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করেননি। তখন তাঁর প্রতি সহানুভূতিসুলভ ব্যবহারই করা হয়েছিলাে। সে আমলে পাকিস্তান বেতার।
থেকে তাঁকে প্রােগ্রাম দেয়া হতাে। এমনকি মওলানার জামাতে ইসলামী গঠনেও কোন প্রকার বিধি-নিষেধ আরােপ করা হয়নি। কিন্তু মওলানা পাকিস্তান সরকারের এই উদার মনােভাবের পুরােপুরি সদ্ব্যবহার করেন। এই সুযােগে তাঁর দলের শক্তি অর্জনের প্রতি। মনােযােগ দিলেন। তিনি নবগঠিত পাকিস্তান সরকারের কঠোর সমালােচনা আরম্ভ করলেন। স্বাধীনতা উত্তরকালে প্রকাশিত তরজমানুল কোরআনের প্রথম পাকিস্তানী সংস্করণের দশটি প্রবন্ধের সাতটি ছিলাে পাকিস্তান বেতারে পরিবেশিত। অবশিষ্ট তিনটি প্রবন্ধের সবগুলােই ছিলাে মুসলিম লীগ সরকার ও তাঁর নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে কঠোর সমালােচনামূলক। তখন সবেমাত্র পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তাঁর সামনে হাজারাে সমস্যা। সরকারী অফিস-আদালতের সংস্থান করা, মুসলিম কর্মচারীর অপ্রতুলতা, সেনাবাহিনী গঠন, হিন্দুস্তানের সাথে অস্থাবর সম্পত্তির ভাগ-বাটোয়ারা, হিন্দুস্তান থেকে চলে আসা লাখ লাখ অন্নহীন বস্ত্রহীন শরণার্থীর মাথা গুজবার ব্যবস্থা করা, অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক আরাে বহু সমস্যা—সর্বোপরি অর্থাভাব। এসব কিছুর মােকাবেলা করে পাকিস্তানের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখাই ছিলাে তখন এক মহাভাবনার বিষয়। এতকিছু সত্ত্বেও প্রতিটি মহল নিজ নিজ সামর্থ্যানুযায়ী দেশের নিরাপত্তা ও অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য কাজ করে যাচ্ছিলাে।
স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এ সময় মওলানা মওদুদীর ভূমিকা কী ছিলাে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, মানুষ যদি দীর্ঘদিন পর্যন্ত কোনাে একটা বিষয় অভিনয় করে সেটা তার স্বভাবে পরিণত হয়ে যায়। মওলানা মওদুদীর মধ্যেও মানুষ সে সময় এরূপ একটা অশুভ প্রবণতা প্রত্যক্ষ করেছিলাে। সূচনাকাল থেকেই তিনি পাকিস্তান দাবি ও আন্দোলনের বিরােধিতা করেছিলেন। ইংরেজ প্রীতি বা অন্য যেকোন কারণেই হােক না কেন, একথা সত্য যে, উপমহাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তিনি মুসলিম লীগ ও কংগ্রেস উভয় রাজনৈতিক দলেরই বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। সে সময় সাময়িক স্বার্থের মােহ কিংবা অন্য কোন কারণে এই বিরােধিতাটা তাঁর অভিনয় হয়ে থাকলেও এটা তাঁর স্বভাবে পরিণত হয়ে গিয়েছিলাে। যার জন্য স্বাধীনতা উত্তরকালে জাতির মনােবল বাড়তে পারে এরূপ কোন ভূমিকা তিনি নিতে পারেননি। স্বাধীনতা সংগ্রামে তাঁর যে ঘৃণ্য ভূমিকা ছিলাে, সেজন্য তাঁর পাকিস্তানে না আসাই স্বাভাবিক ছিলাে। কিন্তু তিনি নিজেই পাকিস্তানে এসেছিলেন। পাকিস্তানে আসার পর পূর্ব ভূমিকার জন্য তাঁকে যে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হবে, এ বিষয়টা হয়তাে তিনি নিজেও মনােস্থির করে রেখেছিলেন। আসার পর তাঁর এ ধারণা ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হলাে। এখানে তিনি শুধু আশ্রয়ই পেলেন না, অনক সুযােগ-সুবিধাও লাভ করলেন। কিন্তু তাঁর পূর্ব ভূমিকায় খুব একটা পরিবর্তন দেখা গেলাে না। তিনি শরণার্থীদের নানান অসুবিধাকে নিজের স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে পাকিস্তান ও তার নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণা আরম্ভ করেন। এ সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “এসব যা কিছুসংঘটিত হয়েছে এগুলাে কি আকস্মিক ঘটনা ছিলাে? যারা বিগত তিরিশ বছর থেকে এদেশের নেতৃত্ব করছে এবং যাদের নেতৃত্বে এ বিপ্লব বাস্তবায়িত হয়েছে, এই বিরাট দাঙ্গার কারণ সম্পর্কিত আলােচনা তারা কথার দ্বারা দূর করার চেষ্টা করছে। এক কবিসুলভ ব্যাখ্যা আমাদের সামনে পেশ করছে যে, খুনখারাবি ও অত্যাচার-নির্যাতনের এই দৃশ্য অস্বাভাবিক কিছু নয়, যার জন্য চিন্তান্বিত হওয়া দরকার। এ তাে একটা স্বাধীন জাতির প্রসব-বেদনা যা এরূপ সময় হয়েই থাকে। সত্যি যদি প্রসব-বেদনাই ছিলাে তবে এটা দুনিয়াকে একটি হিংস্র জন্তু জন্মের শুভ সংবাদ দিচ্ছিলাে—মানুষ জন্মের নয়। আর এজন্যই বিগত বেদনাদায়ক ঘটনাবলীর কারণ। আলােচনাকে কথার মাধ্যমে উড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে।
কেননা, যারা বিগত একচতুর্থ শতাব্দী যাবৎ আমাদের দেশের রাজনৈতিক আন্দোলনে নেতৃত্ব করেছে, এসব আলােচনা তাদের মুখ কলংকিত করে ফেলবে।”১” পাক-ভারতের স্বাধীনতার সময় লাখ লাখ মানুষের নির্মম হত্যা, তাদের ধনসম্পদ লুণ্ঠন, শেষ পর্যন্ত অগণ্য হিন্দু-মুসলমানের ভারত ও পাকিস্তানে আশ্রয় নেয়া দেখে জাতি যাতে ভেঙ্গে না পড়ে এবং যারা নিজেদের ঘর-বাড়ি বিষয়-সম্পদ ছেড়ে সর্বস্বান্ত হচ্ছে তারা যাতে ঘাবড়ে না যায় সেজন্য কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দ একাধিক ভাষণ , দিয়েছেন। এসব ভাষণে তাঁরা বলেছেন, যা কিছু হয়েছে বা হচ্ছে তা আকস্মিক ও সাময়িক ব্যাপার এবং এগুলাে অস্বাভাবিকও কিছু নয়। এজন্য ভেঙ্গে পড়লে চলবে না। সাহস ও ধৈর্য সহকারে আমাদের সামনে এগিয়ে যেতে হবে। কিন্তু নেতৃবৃন্দের এসব অভয়বাণী। মওলানা মওদুদীর পছন্দ হয়নি। উল্লিখিত উদ্ধৃতিতে তিনি এই অভিমতই ব্যক্ত করেছেন। যে, এসব আকস্মিক বা স্বাভাবিক কিছু নয়। স্বাধীনতা সংগ্রামকালীন ক্রটিপূর্ণ নেতৃত্বের জন্যই উপমহাদেশের অধিবাসীরা এ ধরনের নিদারুণ পরিস্থিতির সম্মুখীন হয়েছে। এমনকি নেতৃবৃন্দ নাকি এসব কিছু ঘটানাের জন্যে সচেষ্ট ছিলেন। মওলানার মত একজন লােক কি করে এরূপ উক্তি করলেন আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে। আমাদের মনে হয়, সে সময় মওলানা একথাই ভাবছিলেন যে, এদেশবাসী যদি স্বাধীনতা সংগ্রাম না করতাে, ইংরেজ প্রভুরা এখানে বহাল তবিয়তে থাকতাে, তাহলে এগুলাে কিছুই ঘটতাে না। তাতে করে সমগ্র বৃটিশ ভারতে তিনি তাঁর বিশেষ ধ্যান-ধারণা প্রচার করতে পারতেন। ইংরেজ প্রভুরাও তাঁর প্রতি সদয় থাকতাে। সত্যি কি অদ্ভুত ও স্কুল ছিলাে মওলানার চিন্তাশক্তি। (1 আমরা যতটুকু জানি, বিশ্বের এমন কোন দেশ বা জাতি নেই যাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে এ ধরনের জানমাল কোরবান করা হয়নি। ইন্দোনেশিয়া, আলজিরিয়া প্রভৃতি মুসলিম দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস স্মরণ করুন। তারা কি কম ত্যাগ স্বীকার করেছে? আলজিরিয়ায় প্রতি দশজনে একজন স্বাধীনতা সংগ্রামে শাহাদত বরণ করেছে। হাল আমলে।
প্যালেস্টাইনীদের ত্যাগ স্বীকারের কথাই ধরা যাক। তাদের তুলনায় উপমহাদেশের অধিবাসীদের ত্যাগ একেবারে অনুল্লেখ্য। ‘3; T. মওলানা আরাে বলেছেন, “একথা স্পষ্ট যে, এ যুগে যারা এখানকার বিভিন্ন জাতির নেতা ও নেতৃত্ব করছে, তারা এর দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পেতে পারে না….। তারা যদি জেনেশুনে এই খেলা করে থাকে তবে তারা মানবতা ও নিজের জাতির শত্রু। তাদের সঠিক স্থান নেতৃত্বের আসন নয়, আদালতের কাঠগড়া। সেখানে তাদের কর্মাবলীর হিসাবনিকাশ হওয়া উচিত।”২ চিন্তা করুন, মওলানা সে আমলে কিরূপ কঠোর ভাষায় স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃবৃন্দের। অহেতুক সমালােচনা করেছেন। অথচ জামাতে ইসলামী গঠনের এক বছর পর ১৯৪২ সালে তিনিই জনসাধারণের উদ্দেশে বলেছিলেন, “এই বিপ্লবের সংগ্রামে নিজের ধনসম্পদ উৎসর্গ করতে হবে, নিজেদের প্রিয় সময় ব্যয় করতে হবে, নিজের হৃদয়-মন ও শরীরের পুরাে শক্তির সাহায্য নিতে হবে। জেল, নির্বাসন, সম্পত্তি বাজেয়াফতি ও পরিবার-পরিজনদের ধ্বংসের আশংকাও সহ্য করতে হবে এবং দরকার হলে জীবনও দিতে হবে। এসব পথ অতিক্রম ছাড়া বিশ্বে কখনাে বিপ্লব আসেনি। এখনাে আসতে পারেনা।”৩
এ ছিলাে মওলানা মওদুদীর ১৯৪২ সালের অভিমত। তিনি জামাতে ইসলামীর মাধ্যমে। বিপ্লব অনুষ্ঠানের জন্য মুসলমানদের প্রতি এই আবেদন জানিয়েছিলেন। কিন্তু ১৯৪৮ সালে | এসে পাকিস্তানী নেতৃবৃন্দকে জনসাধারণ্যে হেয় করার জন্য মােহাজেরদের পরম দরদী। সেজে গেলেন। আর তাঁর সেসব উক্তি বেমালুম ভুলে গেলেন। আসলে কথা হলাে কি, পাকিস্তান-উত্তরকালে কথার ফুলঝুড়ি দিয়ে তিনি নিজের স্থান করে নেয়ার জন্য উঠেপড়ে লেগেছিলেন। তাতে করে স্বাধীনতা সংগ্রামবিরােধী মওলানা প্রচারের ডামাডােলে নিজেকে প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। এই নীতি গ্রহণের ফলে আর যাই হােক তিনি তাঁর ‘আমিরিয়ত ও জামাতে ইসলামীকে ভরাডুবির হাত থেকে রক্ষা করতে সক্ষম হয়েছিলেন। নতুবা পাকিস্তানে মুসলিম লীগ বিরােধী ‘খাকসার’, আহরার প্রবৃতি রাজনৈতিক দলের যে পরিণাম ঘটেছিলাে, জামাতে ইসলামীর ভাগ্যেও তার ব্যতিক্রম হতাে না। » প্রাক-স্বাধীনতা আমলে মওলানা মওদুদী পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধিতা প্রসঙ্গে প্রায়ই বলতেন, “যদি পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়, তবে তা হবে একটা ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র। সুতরাং মুসলিম হিসেবে এর সমর্থন করার কোনাে যৌক্তিকতা নেই। এমনকি তাঁকে যখন জিজ্ঞেস করা হতাে, অমুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ আর মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের মধ্যে কোন্‌টা অধিক সমর্থনযােগ্য। তিনি পরিষ্কার জওয়াব দিতেন, “খােদার নিকট মুসলিম ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র অধিক অভিশপ্ত।” পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পূর্বদিনটি পর্যন্ত তাঁর এই শ্লোগানের পরিবর্তন হয়নি। I স্বাধীনতা ঘােষণার একেবারে পূর্ব মুহূর্তে ১৯৪৬ সালে তরজমানুল কোরআনের ফেব্রুয়ারি সংখ্যায় মওলানা বলেছেন, “আহম্মকের স্বর্গে বসবাসকারীরা স্বপ্নে যত সবুজ বাগানই দেখুক না কেন, কিন্তু স্বাধীন পাকিস্তান (যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ও) নিশ্চয়ই ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রীদর্শের উপর প্রতিষ্ঠিত হবে। তাতে অমুসলিমরা মুসলমানদের সমঅধিকারী হবে। পাকিস্তানে তাদের সংখ্যা ও প্রতিনিধিত্বশক্তি এতাে নগণ্য ও দুর্বল হবে না যে, ইসলামী শরিয়তকে রাষ্ট্রের আইন এবং কোরআনকে এই গণতান্ত্রিক পদ্ধতির গঠনতন্ত্র বানানাে যাবে।
হিন্দু-ভারতের হাতে ক্ষমতা গেলে মুসলমানরা নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে বলে তিনি সে যুগে কংগ্রেস সমর্থক মুসলিম নেতৃবর্গকে গালিগালাজ করতেন। এদিকে পাকিস্তানের অবস্থা। কিরূপ হবে, তাও তিনি উপরােক্ত উদ্ধৃতিতে পরিষ্কার ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু তিনি কি করতে চেয়েছিলেন? আসলে ইংরেজরা এদেশে থাকলে তিন সবচাইতে বেশি খুশি হতেন। তাতে করে ইংরেজের অনুগ্রহ ও আনুকূল্যে তিনি এদেশে তাঁর বিশেষ ইসলাম প্রচার করতে সক্ষম হতেন। কিন্তু উপমহাদেশের কেউই তা বুঝলাে না, শুনলাে না। বৃটিশ আমলে এভাবেই মওলানা তাঁর বিশেষ ইসলাম প্রচারের ছদ্মাবরণে স্বাধীনতা আন্দোলন ও নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য প্রচারণা চালিয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতা উত্তরকালে তাঁর সুর অন্য ধারায় প্রবাহিত হলাে। অবশ্য স্বার্থসিদ্ধির প্রচারণার অস্ত্র হিসেবে তাঁর বিশেষ ইসলামই রইলাে। তিনি পাকিস্তানী জনসাধারণের উদ্দেশে বলতে আরম্ভ করলেন, “আমি আপনাদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই, পাকিস্তান সংগ্রামকালে আপনাদের বুঝান হয়েছিলাে, পাকিস্তান। প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য এমন একটি রাষ্ট্র কায়েম করা যার শাসনব্যবস্থার ভিত্তি হবে খােদার পাক কিতাব এবং আল্লাহর রাসুলের (সঃ) সুন্নত বা কর্মধারা। তাতে সকল মুসলমান ইসলামী বিধান মােতাবেক জীবন যাপন করতে পারবে। সে সময় নেতৃবৃন্দের মনে যাই থাকুক না। কেন অন্তত মুখে তারা প্রতিটি বক্তৃতামঞ্চে এবং প্রতিটি মিম্বরে এ কথাই বলেছিলেন। সাধারণ মুসলমানরা তাঁদের এসব প্রতিশ্রুতি ও প্রকাশিত ইচ্ছার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে পাকিস্তান আন্দোলনে যােগদান করেছিলাে।”
8হাসেন এ সময় মওলানা মওদুদী তাঁর স্বাধীনতা-পূর্বকালের ব্যাখ্যা-বিবৃতি বেমালুম ভুলে গেলেন। পাকিস্তান ও মুসলিম লীগের বিরুদ্ধে তিনি নতুন করে ফ্রন্ট খুললেন। মওলানা তাঁর তরজমানুল কোরআনের প্রথম পাকিস্তানী সংস্করণে মুসলিম লীগ নেতৃবৃন্দকে আক্রমণ প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “….. মুসলমানদের বৃহৎ নেতৃত্বের চাইতে অধিক অযােগ্য ও জাতির জন্য ক্ষতিকর অন্য কোন জিনিস হতে পারে না!…. পুরাে দশ বছর সময় মধ্যে সে নিজের জাতির নৈতিক ও বৈষয়িক সুসংহত শক্তি তৈরি এবং তার মধ্যে নির্ভরযােগ্য চরিত্র গঠন করার কোন চেষ্টা করেনি। .. এবং তার কারণেই পাকিস্তানের ইমারত প্রথম দিন থেকেই ভীষণ টলটলায়মান বুনিয়াদের উপর গড়ে উঠেছে।… উপমহাদের রাজনৈতিক নাটকে সবচাইতে ব্যর্থ ভূমিকা ছিলাে মুসলিম লীগের।…” ১৯৪৮ সালে মওলানা মওদুদী মুসলিম লীগ ও তাঁর নেতৃবৃন্দ সম্পর্কে এসব উক্তি করেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের শাসকগােষ্ঠী সম্পর্কে আমাদের বলার অনেক কিছুই আছে। সেসব কথা এখানে আলােচনার বিষয় নয়। কিন্তু একথা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই যে, মুসলিম লীগের নেতৃত্বে পাকিস্তান অর্জিত হয়েছিলাে। মুসলিম লীগের দাবীও ছিলাে ভারত বিভাগ। সুতরাংমওদুদী সাহেবের দাবী অনুযায়ী উপমহাদেশের রাজনীতিতে মুসলিম লীগ যদি চরম ব্যর্থতার পরিচয় দিয়ে থাকে, তাহলে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলাে কি করে? সত্যি কথা বলতে কি, মওদুদী সাহেবের অভ্যাসই ছিলাে ইসলামের মুখােশ পরে ভিত্তিহীন ও আজগুবি কথাবার্তা বলা। আর তাঁর উত্তরাধিকারী হিসেবে এই অভ্যাসটি ধরে রেখেছে বাংলাদেশের জামাতিরা। সেই একই কায়দায় একই পদ্ধতিতে এরাও পবিত্র ধর্মের নামাবলী পরে এদেশের ধর্মপরায়ণ মানুষকে বিভ্রান্ত করার তৎপরতায় মেতে উঠেছে। তথাকথিত ভারতীয় আগ্রাসনের ধুয়া তুলে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পক্ষের রাজনৈতিক শক্তির সমালােচনা করছে। তাতে করে, মওদুদী সাহেবের মত বাংলাদেশে জামাতিরা মুক্তিযুদ্ধকালীন তাদের ধর্ম ও মানবতাবিরােধী জঘন্য তৎপরতা ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করছে।
আনুগত্য প্রশ্নে জামাত
বাংলাদেশে জামাতিরা পবিত্র ইসলামের নামে যেসব কাণ্ড-কারখানা করছে এগুলাে নতুন কিছু নয়। এসব তাদের গুরু মওদুদী সাহেবেরই শিক্ষা। বর্তমানে জামাতিরা যেমন এদেশে রাজনীতি করার সুযােগ পেয়েও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও মূল্যবােধ মেনে নিতে পারেনি, তেমনি মওদুদী সাহেবও সে আমলে পাকিস্তানে আশ্রয় লাভ ও রাজনীতি করার সুযােগ পেয়েও পাকিস্তানের আদর্শকে গ্রহণ করতে পারেননি। সে সময় সুযােগ পেলেই তিনি তাঁর তথাকথিত ‘ইসলামিক খড়গ’ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতেন। তিনি ইসলামী শাসনব্যবস্থার ধুয়া তুলে সরকারী কর্মচারীদের পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ ও যুবকদের পাক সেনাবাহিনীতে যােগদান করতে বারণ করেন। ১৯৪৮ সালের দিকে এক সময় পাকিস্তানের পশ্চিম পাঞ্জাব সরকার তার কর্মচারীদের পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্যের শপথ গ্রহণ করার নির্দেশ দেন। সে সময় কোন কোন সরকারী কর্মচারীর জামাতে ইসলামীর সাথে সম্পর্ক ছিলাে। তারা এ ব্যাপারে জামাতে ইসলামীর আমীর মওলানা মওদুদীর পরামর্শ চান। তিনি অভিমত দান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “যেহেতু শপথ গ্রহণের মাধ্যমে এই শাসনব্যবস্থার প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে হয়, যা আইনত প্রতিষ্ঠিত, সেজন্য যতদিন না বর্তমান শাসনব্যবস্থা পুরােপুরি ইসলামিক হবে, ততদিন এই শপথ গ্রহণ বৈধ নয়। উল্লিখিত উদ্ধৃতিটি সে সময় নবপ্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের পক্ষে কীরূপ ক্ষতিকর ছিলাে তা আর উল্লেখের অপেক্ষা রাখে না। উর্দু দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াকত’ পত্রিকার ১৯৪৮ সালের ২ সেপ্টেম্বর সংখ্যায় পরিবেশিত তথ্য অনুযায়ী পশ্চিম পাঞ্জাব সেক্রেটারিয়েটের জনৈক এসিস্ট্যান্টকে এজন্য বরখাস্ত করে দেয়া হয় যে, তিনি পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে অস্বীকৃতি জানিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, “যখন শাসনব্যবস্থা শরিয়ত মােতাবেক হবে কেবলমাত্র তখনই আমার পক্ষে পাকিস্তানের প্রতি অনুগত থাকা সম্ভব হতে পারে।”২ রাষ্ট্রের নিরাপত্তার মূল উৎস সেনাবিভাগে যােগদান সম্পর্কেও জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে বিভ্রান্তিকর একটি বিবৃতি প্রকাশ করা হয়। জামাতে ইসলামীর সদস্যদের সেনাবিভাগে যােগদান সম্পর্কে ‘মজলিসে শুরার’ (কার্যকরী পরিষদ) ১৯৪৮ সালের ১০ এপ্রিল অনুষ্ঠিত বৈঠকে একটি সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কয়েক মাস পর জামাতের সাধারণ সম্পাদক উক্ত সিদ্ধান্তের আলােকে একটি চিঠির উত্তরদান প্রসঙ্গে লেখেন, “বর্তমান সরকার অনৈসলামিক। এই জন্য আমরা মুসলমানদেরকে তার ফৌজ কিংবা রিজার্ভ বাহিনীতে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দিতে পারি না।’ ৩
শুধু তাই নয়, সেনাবাহিনীতে যােগদান সম্পর্কে অনুরূপ বিভ্রান্তিমূলক আলােচনা করে জামাতে ইসলামী একটি পুস্তিকাও বের করে। বইটি সরকার কর্তৃক বাজেয়াপ্ত করা হয়। কী উদ্দেশ্যে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এরূপ ফতােয়া দেয়া হয়েছিলােতা বলা মুশকিল। কিন্তু তাতে পরিস্থিতিটা মওলানা ও তাঁর জামাতের সম্পূর্ণ উল্টো রূপ পরিগ্রহ করে। ইসলামের ছদ্মাবরণে সদ্য প্রতিষ্ঠিত পাকিস্তানের বুনিয়াদে এ ধরনের কুঠারাঘাত হানা দেখে দেশব্যাপী অসন্তোষের দাবানল জ্বলে ওঠে। দেশের সংবাদপত্রগুলাে জামাত ও মওলানার। বিরুদ্ধে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে আরম্ভ করে। . চারা পাকিস্তানের উর্দু দৈনিক নওয়ায়ে ওয়াকতে’ এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়, “…যতদিন এদেশে ইংরেজ ছিলাে মওলানা মওদুদীর সহগামী, সাহায্যকারী ও অনুসারী সরকারী অফিসার ও কর্মীরা পরম আনুগত্যের সাথে বৃটিশ সরকারের খেদমত করেছে। মওলানা মওদুদী তাদের বারণ করেননি। লােক-দেখানাে প্রচারণা ভিন্ন জিনিস, কিন্তু গবর্নমেন্ট অব ইন্ডিয়ার কোনাে উচ্চপদস্থ অফিসার যে মওদুদী সাহেবের সাহায্যকারী ও মুরব্বী ছিলেন এবং তাদের নিকট থেকে যে তিনি অর্থ সাহায্য পেতেন একথা কারােরই অস্বীকার করার উপায় নেই। আশ্চর্যের বিষয়, যতদিন ইংরেজ রাজত্ব ছিলাে, যুদ্ধের জন্য সৈন্যবাহিনীতে ভর্তি হওয়া হারাম এরূপ কোনাে ফতােয়া মওদুদী সাহেব দেননি। আমার অনুসারী ও শিষ্যদের ইংরেজ সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা উচিত’ এরূপ কোনাে বিবৃতিও মওলানা প্রচার করেননি।••••”৪
প্রতিরক্ষা ও সেনাবাহিনীতে ভর্তি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে ‘নওয়ায়ে ওয়াকত’ পত্রিকায় আরাে বলা হয় “. আফসােস, শত আফসােস! হিন্দুস্তানে মওলানা হােসাইন আহমদ মাদানী, মওলানা আবুল কালাম আজাদ, মওলানা হেফজুর রহমান ও মওলানা আহমদ সাঈদ মুসলমানদের মনেপ্রাণে হিন্দুস্তান সরকারের সাথে সহযােগিতা করার পরামর্শ। দিচ্ছেন, কিন্তু পাকিস্তানে ইসলামী সরকার ও ইসলামী শাসনব্যবস্থার দাবিদার শ্রেণী। মুসলমানদের এই পরামর্শ দিচ্ছেন যে, বর্তমান সরকার অনৈসলামিক এবং বর্তমান শাসনব্যবস্থা কাফেরী’ শাসনব্যবস্থা। সুতরাং ইসলামানুগ করা ছাড়া এর সাথে সহযােগিতা করা অসম্ভব। খােদা না করুন, যদি এরূপ অসহযােগিতার দরুন পাকিস্তান ‘খতম হয়ে যায়, তবে কি এখানে ইসলামী শাসনব্যবস্থা প্রবর্তিত হবে? জামাতে ইসলামী হিন্দুস্তানেও রয়েছে এবং তার আমীরও মওলানা মওদুদীই। কিন্তু তাঁর সকল ফতােয়াই যে । পাকিস্তান সম্পর্কে, এর রহস্য কী ?” এভাবে সে সময় পাকিস্তানের প্রতিটি সংবাদপত্র এবং প্রত্যেক মহল থেকেই মওলানা মওদুদী ও তাঁর দলের বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষ প্রকাশ পায়। এক্ষেত্রে জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমীর ও ১৯৭১ সালে পাক হানাদার সরকারের শিক্ষামন্ত্রী আবাস আলী খানের বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী একটি বক্তব্য উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে। তিনি ১৯৮৬ সালের ১৪ জানুয়ারি করাচীতে বলেছেন, “বাংলাদেশের জনগণ এখন পাকিস্তানের সাথে তাদের বিচ্ছেদের কারণে অনুতপ্ত। বস্তুত শঠতা, সুবিধাবাদ ও অন্তর্ঘাতমূলক নীতি সবসময় জামাতের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে আসছে। আর পবিত্র ধর্মের ছদ্মাবরণে দেশ ও জাতিবিরােধী এসব তৎপরতা মওদুদী সাহেবেরই শিক্ষা। তাঁর অনুসারীরাও বাংলাদেশে এসব অত্যন্ত যােগ্যতার সাথে ধরে রেখেছে
জামাতের ডিগবাজি
ইসলামী শাসনব্যবস্থার ধুয়া তুলে জামাতে ইসলামী পাকিস্তানের প্রশাসনযন্ত্র ও সেনাবাহিনীতে বিভ্রান্তি সৃষ্টির যে ঘৃণ্য পরিকল্পনা নিয়েছিলাে, তাতেও তাকে চরম ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। সে ভেবেছিলাে, এ পথে জনসাধারণকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়া যাবে। কিন্তু এই পরিকল্পনা পাকিস্তান সরকারের জন্য শাপেবর হয়ে দাঁড়ায়। জনসাধারণ উল্টো মওলানা মওদুদী, তাঁর বিশেষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও জামাতে ইসলামীর প্রতি চরমভাবে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এ সময় সরকার মওলানা ও তাঁর জামাতের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেন। ১৯৪৮ সালের ৪ অক্টোবর মওলানাকে গ্রেফতার করা হয়। তখন সরকারের এই কার্যক্রমকে জনসাধারণ ন্যায়সঙ্গত বলেই গ্রহণ করে। | এবার জামাতে ইসলামীর কিছুটা চৈতন্যোদয় হলাে। তারা বুঝতে পারলাে, এভাবে। পাকিস্তানের বিরােধিতা করলে জনগণ কিছুতেই তাদের ক্ষমা করবে না। নির্ঘাত তাদের ঘরে বসতে হবে। এই প্রতিকূল পরিস্থিতি অনুমান করতে পেরে তারা তাদের পূর্ব ভূমিকা থেকে অনেকটা সরে দাঁড়ালাে। এখন থেকে তারা ক্ষমতাসীন সরকারের যেকোন ভাল কাজকে জামাতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় সাধিত হয়েছে বলে জনসাধারণ্যে প্রচার করতে আরম্ভ করলাে। তারা ভাবলাে, সরকারের সমালােচনার ছদ্মাবরণে পাকিস্তানের ভাল কাজকে নিজেদের বলে চালিয়ে দিতে পারলে হয়তাে জনপ্রিয়তা লাভ করা যাবে। তাই তারা এ পথই বেছে নিলাে। এ পথে প্রথম যাত্রারম্ভ করলাে তারা ‘আদর্শ প্রস্তাবের মাধ্যমে। ১৯৪৯ সালে মওলানা মওদুদী ছিলেন জেলে। সেবার মার্চ মাসে পাকিস্তান আইন পরিষদ দেশে আইন প্রণয়নের ব্যাপারে “আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন করেন। আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন লাভের সাথে সাথেই জামাতে ইসলামীর তরফ থেকে একথা প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয় যে, এখন পাকিস্তান আদর্শগতভাবে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হয়েছে। আইন পরিষদ কর্তৃক আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন জামাতে ইসলামীর প্রচেষ্টারই ফলশ্রুতি।
এই উক্তি সম্বল করে জামাতে ইসলামী পাকিস্তান সম্পর্কে তাদের দলীয় নীতি পরিবর্তন করার সুযােগ লাভ করে। তারা একথা মেনে নেয় যে, শরিয়তের দৃষ্টিতে পাকিস্তানে চাকরি করা অবৈধ নয়। ১৯৪৯ সালের ২ অক্টোবর পাঞ্জাব প্রদেশের চীফ সেক্রেটারীর নিকট জেল থেকে পাঠানাে এক পত্রে মওলানা মওদুদী লেখেন, “….১৯৪৯ সালের ১২ মার্চ আমাদের ও সরকারের মধ্যকার মতবিরােধের পরিসমাপ্তি ঘটেছে। আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদিত হওয়ার পর কেবলমাত্র সরকারী চাকুরেদেরই নয়, বরং প্রতিটি মুসলমানের পাকিস্তান রাষ্ট্রের শুভাকাংক্ষী, নিঃস্বার্থ শুভাকাংক্ষী হওয়া একান্ত কর্তব্য এবং এটা ঈমানের আবেদন বলে। আমরা মনে করি।”১
একথা পূর্বেও বলা হয়েছে যে, সরকারি চাকরি ও সেনাবাহিনীতে যােগদান সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ভুল ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী ফতােয়া জনমনে মারাত্মক বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিলাে। মওলানা সরকারকে কাবু করার জন্য যে ফাঁদ তৈরি করেছিলেন উল্টো নিজেই তাতে ফেঁসে গিয়েছিলেন। এই পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলা এবং জামাতে ইসলামীর নাজেহাল অবস্থা দূর করার জন্য মওলানা ও তাঁর অনুসারীরা ‘আদর্শ প্রস্তাবের আশ্রয় নিলেন। তাঁরা জনসাধারণকে বুঝাবার চেষ্টা করলেন, জামাতে ইসলামীর আন্দোলনের ফলেই গণপরিষদ ‘আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদন করেছে। তাতে করে তাঁরা আর একবার নিজেদের পরাজয়কে বিজয়ে রূপান্তরিত করে জনসম্মুখে আসতে সক্ষম হন। এ সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর সে আমলের একটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। তিনি বলেছেন, “এ কথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, জামায়াতে ইসলামীই তার (আদর্শ প্রস্তাবের) আসল আন্দোলনকারী ছিলাে। যদি এই সুসংহত শক্তি তার পিছনে না থাকতাে….তবে এ দাবী একটি পুরােপুরি সমস্যারূপে দাঁড় করান এবং তা কামিয়াবীর মঞ্জিলে পৌঁছান কোনাে অবস্থায়ই সম্ভবপর ছিলাে না।”২
এক্ষেত্রে প্রশ্ন হলাে, সত্যি কি জামাতে ইসলামীর প্রচেষ্টায় পাকিস্তান গণপরিষদে ‘আদর্শ প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিলাে ? তাছাড়া পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত করার জন্য মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসারীরা যেসব দাবী-দাওয়া উথাপন করেছিলেন সেগুলাে পুরােপুরি কি ‘আদর্শ প্রস্তাবে সন্নিবেশিত হয়েছিলাে ? নীতি পরিবর্তন তথা জামাতে ইসলামীর দুরবস্থার অবসানকল্পে সে আমলে জামাত নেতারা আদর্শ প্রস্তাব অনুমােদনের কৃতিত্বের অধিকারী বলে যতাে প্রচারণাই চালিয়ে থাকুক না কেন, কিন্তু এক্ষেত্রে জামাতে ইসলামীর এতটুকু কৃতিত্ব ছিলাে না। তাছাড়া আদর্শ প্রস্তাবের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়, জামাতে ইসলামী নবীদাওয়া,তাতে সন্নিবেশিত করা হয়নি। মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসরা গােড়া থেকেই দাবী জানিয়ে আসছিলেন, আইন প্রণয়নের দায়িত্ব আলেমদের ওপর ছেড়ে দিতে হবে। তাঁরা জনপ্রতিনিধিদের আইন প্রণয়ন অধিকার দানের ঘাের বিরােধী ছিলেন। এ সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর একটি উদ্ধৃতি বিশেষভাবে লক্ষণীয়। তিনি বলেছেন, “এটা•••• কিরূপ অদ্ভুত কথা যে, অন্য সব ব্যাপারে বিশেষজ্ঞরা রায়দান করবেন, কিন্তু শরিয়ত বিষয়ে কোনাে ফয়সালাকারী বিশেষজ্ঞ থাকবে না।”৩
জামাতে ইসলামীর বিরুদ্ধ প্রচারণা সত্ত্বেও আদর্শ প্রস্তাবে আইন প্রণয়নের অধিকার জনপ্রতিনিধিদেরই দেয়া হয়েছিলাে। অবশ্য তা বাস্তবায়নের ব্যাপারে কয়েকটি শর্তারােপ করা হয়েছিলাে। এমনকি এসব শর্ত নির্ধারণের ক্ষেত্রে মতবিরােধ দেখা দিলে মীমাংসার ভারও জনপ্রতিনিধিদের ওপর ন্যস্ত করা হয়েছিলাে—আলেমদের ওপর নয়। আদর্শ প্রস্তাবে যে জামাতে ইসলামীর মতামতের কোনাে মূল্য দেয়া হয়নি, আর একটি ব্যাপার থেকে তা চমৎকার প্রতিভাত হবে। ১৯৪৯ সালের মার্চ মাসে আইন পরিষদ অধিবেশনে আদর্শ প্রস্তাব নিয়ে আলােচনাকালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মরহুম লিয়াকত আলী খান ও অন্যান্য শীর্ষস্থানীয় নেতা পরিষ্কার শুনিয়ে দিয়েছিলেন, তাদের আর জামাতে ইসলামীর দৃষ্টিভঙ্গি এক নয়। এ সময়ে পরিষদে জনৈক অমুসলিম সদস্য মওলানা মওদুদীর ‘ইসলামের রাজনৈতিক আদর্শ’ (ইসলাম কা নজরিয়ায়ে সিয়াসী) নামক গ্রন্থ থেকে অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কিত একটি উদ্ধৃতি পড়ে শুনিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের তৎকালীন যােগাযােগমন্ত্রী মরহুম সরদার আবদুর রব নিশতার এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদীর উল্লেখ করে বলেছিলেন, “আপনি কি জানেন সে ব্যক্তি এখন কোথায় ? তিনি এখন কারাপ্রাচীরে আবদ্ধ।”
জামাতে ইসলামী আইন পরিষদের অধিকারের উপর যেসব কঠিন শর্ত আরােপের দাবী করেছিলাে আদর্শ প্রস্তাবে সেসবেরও কিছু ছিলাে না। সারকথা, কোন দিক থেকেই আদর্শ প্রস্তাব সম্পর্কে জামাতে ইসলামীর আত্মপ্রসাদ লাভের সঙ্গত কোন কারণ ছিলাে না। আসল ব্যাপার হলাে, সে আমলে গণপরিষদকে জামাতে ইসলামীর মর্জিমাফিক আইন তৈরির ভিত্তি প্রণয়নে বাধ্য করার শক্তিসামর্থই ছিলাে না। তাই, আদর্শ প্রস্তাব সমর্থন করা ও পাকিস্তানকে নীতিগতভাবে মেনে নেয়াটাই জামাত নেতারা শ্রেয় মনে করেছিলেন। তাতে তাদের দু’টি সুবিধে ছিলাে। প্রথমত, পাকিস্তানের প্রতি আনুগত্য ও সেনাবিভাগে যােগদানের ব্যাপারে আনাড়ি ফতােয়া দেয়ায় যে ভয়াবহ সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিলাে, তারা তা দূর করতে সক্ষম হবে। কারণ পাকিস্তানকে ইসলামী রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার মাধ্যমে উপরােক্ত বিষয়ে পূর্বমত পরিবর্তন করার একটা বাহানা পাওয়া যাচ্ছে। দ্বিতীয়ত, জামাতে ইসলামী সরকারের সাথে যে সামর্থ্যাতীত সংঘাত বাধিয়েছিলাে তারও অবসান ঘটবে। মূলত ইসলাম বা পাকিস্তানের স্বার্থে নয়, নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্যই জামাতে ইসলামী আদর্শ প্রস্তাব সমর্থন করেছিলাে। বর্তমানে বাংলাদেশেও জামাত নেতারা সেই একই কৌশল অবলম্বন করেছে। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী ধনিক-বণিকদের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে পবিত্র ইসলামের মুখােশ পরে বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরােধিতা করেছে। মুক্তিযােদ্ধাদের ‘দুষ্কৃতকারী’ বলে গালিগালাজ করেছে। ইসলাম রক্ষার নামে লাখাে মুসলমানের রক্তে এদের হাত রঞ্জিত করেছে। এখন আবার ইসলামের নামেই বাংলাদেশের রক্ষকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
কাদিয়ানী দাঙ্গা
আদর্শপ্রস্তাব অনুমােদিত হওয়ার ছুতা ধরে জামাত নেতারা তাদের পার্টির মতাদর্শ ও কর্মতৎপরতা সংশােধন করে। তারা নতুন রূপ ধারণ করে জনপ্রিয়তা অর্জন করার প্রচেষ্টা চালাতে থাকে। মূলত এসময় থেকেই জামাত নেতারাতাঁদের বিশেষ ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ছদ্মাবরণে সরাসরি দেশ ও জাতির স্বার্থ-পরিপন্থী বক্তৃতা-বিবৃতি দেয়ার ব্যাপারে কিছুটা সংযত হওয়ার চেষ্টা করে। তারা এ কথা ভালভাবে বুঝতে পারে, আর যাই হােক স্বাধীনতা-পূর্বকালীন নীতির মাধ্যমে পাকিস্তানেকিছু করাযাবেনা। এসময়েজামাতে ইসলামীরসবচাইতেউল্লেখযােগ্য কাজ হলাে নিজেদের স্বার্থোদ্ধারের কাজে দেশের অন্যান্য দলমতের আলেমদের ব্যবহার করা। বিভিন্ন বিষয়ে শােচনীয় পরাজয় বরণের পর জামাত নেতারা বুঝতে পারলাে যে, ক্ষমতাসীন সরকারকেবাগে আনা একাতাদের পক্ষেসম্ভব নয়। তাই তারা ইসলামী শাসনতন্ত্র দাবীরনামেবিভিন্ন মতেরআলেমদের সমন্বয়ে দেশব্যাপী একটা আন্দোলন গড়ে তােলার পরিকল্পনা নেয়। অথচ জামাতে ইসলামীর ইতিহাসের প্রতি তাকালে দেখা যায়, এমনটি আর কখনাে তারা করেনি। পূর্বে জামাতে ইসলামী কারােসাথেই কোনরূপসমঝােতা করতােনা। এমনকি পুরােপুরিজামাতপন্থী না হলে কারাে ভাল কাজের স্বীকৃতিও দেয়া হতাে না। তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলাে স্বাধীনতা সংগ্রামে মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধিতা। ইসলামী তাহজিব-তমদ্মন ও ধর্মীয় আদর্ঘে আলােকে সমাজব্যবস্থা গড়ে তােলার শ্লোগান দিয়েই তাে মুসলিম লীগ পাকিস্তান দাবী করেছিলাে। এমতাবস্থায় জামাতে ইসলামীর পাকিস্তান দাবীর বিরােধিতা করার কথা নয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাতে ইসলামী সেদিন মুসলিম লীগ ও পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রবল বিরােধিতা করেছিলেন। অবশ্য এই বিরােধিতার প্রধান কারণ ছিলাে জামাতের বৃটিশপ্রীতি, বৃটিশসমর্থক এক শ্রেণীর নওয়াব ও পদস্থ সরকারী কর্মচারীর আনুকূল্য লাভ করা। একথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে।
সে যাই হােক, মওলানা মওদুদী ও তাঁর দলের প্রচেষ্টায় ১৯৫১ সালের জানুয়ারী মাসে করাচীতে নানামতের শীর্ষস্থানীয় ৩৩ জন আলেমের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে ইসলামী রাষ্ট্রের ২২টি মৌলিক নীতি প্রণীত হয়। এগুলাে সরকারের নিকট পেশকরা হয়। এনীতিমালা সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী বলেছেন, “… হয় তারা সরাসরি এসব বিধান মেনে নিন এবং দেশের শাসনতন্ত্রে এগুলাে সন্নিবেশিত করে বিস্তারিত সবকিছু যেভাবে ভাল মনে করেন প্রণয়ন করুন নতুবা পরিষ্কার বলে দিন, আমরা কোরআন-সুন্নাহ কিছুই মানি না। আমরা সে গণতন্ত্রে বিশ্বাসী যার উত্তম।
আদর্শ আমেরিকা, ইল্যান্ড ও ভারতের রাষ্ট্রতন্ত্রে আমাদের দৃষ্টিগােচর হয়।’১ পরবর্তীকালে উল্লিখিত নীতিমালাকে জামাতে ইসলামী আট দফা দাবীতে রূপান্তরিত করে। এই আট দফা দাবীতে কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করার প্রস্তাব ছিলাে না। এরপর ১৯৫৩ সালের ২১ ; ডিসেম্বর খাজা নাজিমুদ্দিন আইন পরিষদের শাসনতান্ত্রিক সুপারিশ পেশ করেন। মওলানা মওদুদী ও আলেমদের পক্ষ থেকে তাতে সংশােধনী প্রস্তাব করা হয়। এসময় কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘুসম্প্রদায়। গণ্য করার দাবি তােলা হয়। তাতে করে জামাতে ইসলামীর আট দফা দাবিতে কাদিয়ানী সম্পর্কিত ধারাটি সংযােজন করা হয় এবং তা নয় দফার রূপ লাভ করে। ১৯৫৩ সালের ৩০ জারি লাহােরে একবিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। মওলানা মওদুদী তাতে ভাষণ দেন। কাদিয়ানীদের সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “তারা (ক্ষমতাসীনরা) কাদিয়ানী, সমস্যার প্রতি পুনরায় উপেক্ষণীয় মনােভাব প্রদর্শন করছে। অথচ সকল মুসলমান একবাক্যে বলেছিলাে, কাদিয়ানীদের অমুসলিম সংখ্যালঘু গণ্য করা হােক। …পরিস্থিতি যদি এরূপ চলতে থাকে….তাহলে নির্ঘাত এদেশে কাদিয়ানী-মুসলিম দাঙ্গা আরম্ভ হবে, যেরূপ পূর্বে হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা হয়েছিলাে।”২
এ সময় পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন খাজা নাজিমুদ্দিন। জামাতে ইসলামী খাজা সাহেবের দুর্বলতা ও ধর্মপরায়ণতার পুরােপুরি সদ্ব্যবহার করে। তারা জনপ্রিয়তা অর্জন ও পূর্বে পরাজয়ের গ্লানি মুছে ফেলার জন্য উঠেপড়ে লেগে যায়। এ উদ্দেশ্যে প্রথমে তারা সকল দলমতের আলেমদের একত্র করে ইসলামী শাসনতন্ত্রের শ্লোগান তােলে। কিন্তু তাতে খুব একটা সুবিধাকরতে না পেরে কাদিয়ানী সমস্যাকে এইসঙ্গে টেনে আনে। মূলত কাদিয়ানী সমস্যা ছিলাে জামাতে ইসলামীর উপলক্ষ মাত্র। জামাত নেতারাসম্ভবত মনে করেছিলেন, এ পথে একটা বিশৃংখলা সৃষ্টি করে ঘােলা পানিতে স্বার্থোদ্ধার করা যাবে। এছাড়া জামাত নেতাদের কাদিয়ানী সমস্যা নিয়ে হৈ-হুল্লোড় সৃষ্টি করার কোনাে কারণ আমরা খুঁজে পাই না। জামাতে ইসলামীর এ তৎপরতার পেছনে যদি নিছক ধর্মীয় তাগিদ হতাে তবে জামাতে ইসলামী ও তার অনুগামীরা এতদিন ছিলেন কোথায় ? কাদিয়ানী মতবাদ তাে তখন নতুন কিছুছিলাে না। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার বেশ কিছুকাল পূর্বেই এর উৎপত্তি হয়েছে। কিন্তু মলানা মওদুদী এর পূর্বেদীর্ঘ কর্মজীবনেএসম্পর্কেকিছুই বলেননি। এমনকি শাসনন্ত্র সম্পর্কে প্রথমে যে আটদফা সুপারিশ জামাতের তরফ থেকে বের করা হয় তাতেও কাদিয়ানী সমস্যাটি স্থান পায়নি। এ থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসারীদের কাদিয়ানী-বিরােধী আন্দোলনের পেছনে। ধর্মীয় তাগিদ ছিলাে না। জামাতে ইসলামীর প্রতি জনমত আকৃষ্ট করার একটা উপলক্ষ ছিলাে মাত্র। সকল দিক থেকেচরম ব্যর্থতাবরণের পরজনমতসগ্রহের এই একটিমাত্র পথই তখন তাদেরসমানে খােলা ছিলাে। তাই তারা দেশ ও জাতীয় ঐক্যের মারাত্মক ক্ষতিকর একটি বিষয় নিয়ে তােলপাড় করে এক ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি করে।১৯৫৩ সালের ১৮ জানুয়ারি করাচীতে কাদিয়ানী-বিরােধী সর্বদলীয় কনভেনশনের সংগ্রাম কমিটির এক অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে কাদিয়ানী প্রশ্নেপ্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব অনুমােদন করা হয়।
মওলানা মওদুদী ও অন্যান্য উগ্রপন্থীদের লেখা ও বক্তৃতা-বিবৃতিতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হতে থাকে। কাদিয়ানী প্রশ্নের ছদ্মাবরণে জনসাধারণ্যে বিশৃংখলা সৃষ্টির প্রবল প্রচেষ্টা চালানাে হয়। কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করার জোর আন্দোলন আরম্ভ করা হয়। এ সময়ই মওলানা মওদুদীর কাদিয়ানী সম্পর্কিত পুস্তিকাটি উর্দু ও ইংরেজীতে প্রকাশ ব্রা হয়। বইটি প্রজ্বলিত উনুনে লে ছিটানাের কাজ করে। পাঞ্জাব, বিশেষ করে লাহােরেম ওকাদিয়ানীদের মধ্যে মারাত্মক দাঙ্গা আরম্ভ হয়। সেখানকার পথঘাট নিরপরাধ জনতার রক্তে লালে লাল হয়ে যায়। তাতে করে কাদিয়ানী প্রশে দাঙ্গাঅনুষ্ঠিত হওয়ার মওলানা মওদুদীর ভবিষ্যদ্বাণী বাস্তবায়িত হয়। কাদিয়ানী দাঙ্গাঅনুষ্ঠিত হওয়ার ব্যাপারে কেবলমাত্রউগ্রপন্থী দলগুলােই দায়ী ছিলােনা, তৎকালীন ক্ষমতাসীনসরকারের দুল প্রশাসন ব্যবস্থাও এই অপ্রতিকর ঘটনার জন্য অনেকটা দায়ী ছিলাে। কারণ সরকার প্রথমে একে শক্ত হাতে দমন করলে পরিস্থিতি এতটুকু গড়াতে পারত না। অবশেষে সরকারের চৈতন্যোদয় হয়। লাহােরে সামরিক আইন জারি করা হয়। এ ব্যাপারে মলানা মওদুদীকেও গ্রেফতার করা হয়। সামরিক আদালতে মওলানামওদুদীর বিচার আরম্ভ হয়। এদিকে ঘটনা অনুসন্ধানের জন্য লাহাের হাইকোর্টের বিচারপতিদের সমন্বয়ে একটি বিচারবিভাগীয় কমিশন নিয়ােগ কাহয়। এই কমিশনের প্রধান ছিলেন লাহাের হাইকোর্টের তৎকালীন প্রধান বিচারপতি জনাব মুনির। সামরিক আদালত ও মুনির কমিশনের সামনে মানা তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযােগগুলাের জবাবদানকালে বলেছিলেন, “তিনি কোন সময়ই প্রত্যক্ষ সংগ্রাম সমর্থন করেননি এবং তাঁর দলও তাতে অংশগ্রহণ করেনি। তিনি এবং তাঁর দল যথাসম্ভব প্রত্যক্ষ সংগ্রাম বন্ধ করার জন্য চেষ্টা করেছেন। কিন্তু সেদিন মলানার এই অস্বীকারােক্তিতে কোনই ফলােদয় হয়নি। তিনি এই সাফাই দ্বারা সামরিক আদালত কিবা মুনির কমিশন কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারেননি। কারণ ১৯৫২ সালের আগস্ট মাস থেকে মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল জামাতে ইসলামী কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করার দাবী জানিয়ে আসছিলেন। বিভিন্ন সবাদপত্র ও সভা-সমিতিতে মানার অসখ্য কাদিয়ানী-বিরােধী বক্তৃতা-বিবৃতি প্রকাশিত হয়েছিলাে।
প্রত্যক্ষ সশ্যাম প্রস্তাব সমর্থন ও অনুমােদন থেকে আরম্ভ করে প্রতিটি ক্ষেত্রে জামাতে ইসলামী সক্রিয় ছিলাে। এমনকি কাদিয়ানী-বিরােধী আন্দোলনখন পাঞ্জাবে ভয়াবহরূপ ধারণ করে তখনাে মওলানা আন্দোলনকারীদের সমর্থনেপ্রবল উত্তেজনা সৃষ্টিকারী কয়েকটি বিবৃতি দিয়েছিলেন। ৫ মার্চ মওলানার ‘কাদিয়ানী সমস্যা’ নামক পুস্তিকাটি প্রকাশ করা হয়। এ সময় কাদিয়ানী প্রলে পাঞ্জাবের একটা বিরাট এলাকায় বিভীষিকাময় পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিলাে এসব প্রমাণ মওলানা মওদুদীর পক্ষে খুন করা সম্ভব হয়নি। সামরিক আদালত মলানাকে ফাঁসি দেয়ার নির্দেশ দেন। পরে তা চৌদ্দ বছর কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। মুনির কমিশনের রিপাের্টে জামাতে ইসলামী সম্পর্কে যে রায় প্রকাশ করা হয় তার কয়েকটি সংক্ষিপ্ত উদ্ধৃতি এক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জামাতে ইসলামী ও তার প্রতিষ্ঠাতার তৎপরতা বিস্তারিতবিকৃত হওয়ার পর যেসবতথ্য জামাতে ইসলামী স্বীকার করেছেকিংবাতারবিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়েছে, তা হলাে : “(১) জামাতে ইসলামী পাঞ্জাবের প্রত্যক্ষ সংগ্রাম অনুমােদনকারী সগ্রাম কমিটির একটি পক্ষ ছিলাে। (২) নিখিল পাকিস্তান মুসলিম দলগুলােরকনভেনশন যেসগ্রাম কমিটি গঠন করে এবং ১৯৫৩ সালের ১৮ জানুয়ারী করাচীতে প্রত্যক্ষ সামপ্রস্তাব অনুমােদিত হয়, জামাতে ইসলামী সেকমিটিরও অন্যতম পক্ষ ছিলাে। (৩) মওলানা সুলতান আহমদ, যিনি ২৬ ফেব্রুয়ারি সংগ্রাম কমিটির অধিবেশনে যােগদান করেছিলেন, তিনি নিজেকে সংগ্রাম কমিটির কার্যক্রম থেকে পৃথক করেননি। তাঁর উপস্থিতিতেই গবর্নর জেনারেল ও প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে রাজাকার পাঠানাের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়, কিন্তুতিনি এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেননি। (৪) প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত জামাতে ইসলামীর কোন কোন প্রতিনিধি লাহাের ও করাচীর সগ্রাম কমিটির অধিবেশনগুলােতে সবসময়ই অংশগ্রহণ করেছেন। (৫) প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব অনুমােদন হওয়ার তারিখ থেকে দাঙ্গা চরম আকার ধারণ করা পর্যন্ত জামাতে ইসলামী এমন কোনাে সাধারণ বিজ্ঞপ্তি বাবিবৃতি প্রকাশ করেনি, সেপ্রত্যক্ষ সংগ্রামের সাথে জড়িত নেই। (৬) ৫ মার্চ গর্বর্ন হাউসে মলানা মওদুদী বক্তৃতাদানকালে বলেছেন, সরকার এবং জনসাধারণের মধ্যে গৃহযুদ্ধ লেগে রয়েছে। যে পর্যন্ত সরকার শক্তিপ্রয়ােগ পরিহার করে গণপ্রতিনিধিদের সাথে আলাপ-আলােচনা আরম্ভ না করবে, শান্তি-শৃংখলা বিধানের জন্য আবেদন করার কোনাে সুযােগ নেই। (৭) জামাতে ইসলামী তার ৫ মার্চের প্রস্তাবে এ অভিমতই পুনরুল্লেখ। করেছে।
৫ মার্চের পূর্বে ‘তসনীমে’ (জামাতের মুখপত্র) এমন একটি শব্দও নেই যাতে বুঝা যায় যে, জামাতে ইসলামী প্রত্যক্ষ সংগ্রাম পরিকল্পনার সমর্থক কিংবা সহায়তাকারী নয়। ৫মার্চগবর্নর্বহাউসে মওলানা মওদুদী যে ভূমিকাগ্রহণ করেছিলেন…..তা থেকে আমরা এ সিদ্ধান্তে পৌঁছুতে পারি যে, তিনি পুরাে শাসনব্যবস্থা ভেঙ্গে পড়ারআশাকরছিলেন। সরকাআেকাংক্ষিত দুরবস্থায়….আনন্দঅনুভব করছিলেন। ৪ মার্চ সন্ধ্যায় এক উচ্ছল জনতা সৈয়দ ফেরদাউস শাহকে (পুলিশ অফিসার) হত্যা করে। … এ ঘটনার পরও জামাতে ইসলামী কোরূপ দুঃখ প্রকাশ করেনি। এই বর্বরােচিত হত্যার নিন্দায় সে একটি শব্দও উচ্চারণ করেনি। পক্ষান্তরে জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী) রক্ত ও আগুনের এই বিভীষিকাময় ভিড়ে ‘কাদিয়ানী মাসআলার’ বােম ছুঁড়ে মারেন।” ১) পরিশেষে মুনিরকমিশনরায় দানপ্রসঙ্গে বলেছেন, “আমাদের মতে জামাতেরসত্যিকারমানসিক অবস্থা এই ছিলাে যে, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম প্রস্তাব বাস্তবায়নের জন্য যে পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছিলাে সে যদিও তাসঙ্গত মনে করেনি, কিন্তু জনপ্রিয়তা ক্ষুন্ন হওয়ার আশংকায় নিজেদের মত নির্ভীকভাবে জনসাধারণ্যে প্রকাশ করেনি। আগাগােড়াই তার এই ভূমিকা ছিলাে। সুতরাং মানসিক অবস্থা ও কর্মধারার দিক থেকে জামাতে ইসলামী (ঘটনার সাথে সংশ্লিষ্ট) অন্য কোন রাজনীতিক বা সংস্থার।
চাইতে ভিন্নতর ছিলাে না। অন্যান্যদের মত সে জনসাধারণের সমালােচনার শিকারে পরিণত হতে পারে, এরূপ যেকোন পদক্ষেপ গ্রহণে শংকিত ছিলাে।” মওলানা মওদুদী আদালতে যে সাফাই বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে সহযােগী শীর্ষস্থানীয় আলেমদের একটি বিরাট অংশও তাঁর প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়েন। দাঙ্গায় নিজেকে নির্দোষ প্রকাশকার সাথেসাথেতিনিঅপর চারটি পক্ষকে দোষারােপ করেছিলেন। তাঁরহলেন, কাদিয়ানী জামাত, কেন্দ্রীয় ও পাঞ্জাব প্রাদেশিক সরকার এবংপ্রত্যক্ষ সংগ্রামের পথপ্রদর্শক আলেমগণ। মওলানার ভাষায়, “উক্ত চার সম্প্রদায়ের কারাে অন্যায়ই অপরের চাইতে কম নয়। তাদের সবার বিরুদ্ধেই মকদ্দমা চালান। উচিত।’৪ মওলানা মওদুদীর এ ধরনের নাটকীয় অভিনয়ে শুধু একশ্রেণীর আলেম নয়, সাধারণ মানুষও মওলানা ও তাঁর জামাতের প্রতি অসন্তুষ্ট হয়ে পড়ে। কারণ যে জামাতে ইসলামী ও তার নেতার। কাদিয়ানীবিরােধী আন্দোলনে একটা বিশেষ ভূমিকা ছিলাে, তিনিই কিনা আদালতে পরিষ্কার বলে ফেললেন, তাতে তিনি বা তাঁর জামাত জড়িত ছিলাে না। এ সময় ‘খতমে নবুয়ত’ আন্দোলনকারী একটি সম্প্রদায় তাঁর প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার অভিযােগ করে। দেশের যেসব শীর্ষস্থানীয় আলেমের দস্তখত প্রদর্শন করে মওলানা এতােদিন সরকার ও জনসাধারণকে ভয় দেখিয়ে আসছিলেন, তাঁরাই এবার মলানার বিরুদ্ধে ফতােয়া প্রকাশকরতে আরম্ভ করেন। ধর্মোদ্রোহী’, ‘আল্লাহতে অবিশ্বাসী। ইত্যাকার যেসব অভিযােগ মলানা মওদুদী ১৯৩৩ সাল থেকে অন্যদের প্রতি আরােপ করে আসছিলেন, এবার খােদ মওলানাই এসবের শিকার হতে লাগলেন। নিজের তথাকথিত মতবাদের নিকট ক্ষমতাসীন সরকারকে নতি স্বীকার করানাের উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সাল থেকে নতুন ফ্রন্ট খুলে ১৯৫৩ সালের প্রথম ভাগ পর্যন্ত অধিকাংশ আলেমদের এক প্লাটফরমে জমায়েত করে যে আন্দোলন চালিয়ে আসছিলেন, কাদিয়ানীবিরােধী আন্দোলনের ফলে তা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। ফলে এ পথেও জামাতে ইসলামীকে ব্যর্থতা বরণ করতে হয়। এক্ষেত্রে উল্লেখযােগ্য যে, কাদিয়ানী দাঙ্গাকালের সামরিক আদালত মলানা মওদুদীকে প্রাণদণ্ড মওকুফ করে ১৪ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছিলেন। মাত্র পঁচিশ মাস কারাভােগের পর ১৯৫৫ সালের ২৮ এপ্রিল তাঁকে মুক্তি দেয়া হয়।
গণপরিষদ প্রশ্নে জামাত
কাদিয়ানী দাঙ্গা কেন্দ্র করে ১৯৫৩ সালের ৬ মার্চ লাহােরে সামরিক আইন জারি করা হয়। ২২ মার্চ পাঞ্জাবে দৌলতানা মন্ত্রিসভার পতন ঘটে। ১৭ এপ্রিল খাজা নাজিমুদ্দিন মন্ত্রিসভা ভেঙ্গে দেয়া হয়। ৮ মে মওলানা মওদুদীকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয় এবং পরে তা ১৪ বছর সশ্রম কারাদণ্ডে রূপান্তরিত করা হয়। এসব ঘটনার প্রতিক্রিয়া পাকিস্তানের রাজনীতিতে পুরাে এক বছর পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। তারপর আবার প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের রাজনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ হয়। এ সময় জামাতে ইসলামী ও ক্ষমতাচ্যুত নাজিমুদ্দিন গ্রুপের মধ্যে অনেকটা সমঝােতা লক্ষ্য করা যায়। উভয় দল একই সুরে ক্ষমতাসীন সরকারের সমালােচনায় তৎপর হয়ে ওঠে। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। তাতে নুরুল আমিন সরকার শােচনীয় পরাজয় বরণ করে। নির্বাচনের পর দেশের উভয় অংশ, বিশেষ করে পূর্ব পাকিস্তান থেকে আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য প্রবল দাবী জানানাে হয়। বলা হয়, বর্তমান পরিষদ সদস্যদের প্রতি জনসমর্থন নেই, নির্বাচনে মুসলিম লীগের পরাজয় বরণ করার পর তারা এখন আর জনপ্রতিনিধি নন। সুতরাং এই পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন করে আইন পরিষদ গঠন করা হােক। পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার এ দাবী ছিলাে একান্ত ন্যায্য। ‘ এ সময় জামাতে ইসলামী পরিষদ বাতিল বিরােধীদের সথে হাত মিলায়। আইন, পরিষদ বাতিলকরণ রােধ করার জন্য জামাতে ইসলামীর তরফ থেকে প্রবল আন্দোলন চালানাে হয়। তাদের গােটা প্রচার মিশন এ ব্যাপারে নিয়ােগ করা হয়। বিভিন্ন স্থানে সভাশােভাযাত্রা বের করা হয়। আইন পরিষদ বাতিল করাে না ইত্যাকার শ্লোগান লেখা পােষ্টার দ্বারা পাকিস্তানের শহর-বন্দর-নগরের প্রাচীর ও রাস্তাঘাট ভরে ফেলা হয়। জামাত নেতারা নানা স্থানে জনসভা করে তাদের বিশেষ প্রচারভঙ্গিতে’ জনমত সংগ্রহের জন্য উঠেপড়ে লেগে যান। ১৯৫৪ সালের ১৮ অক্টোবর লাহােরের মুচি গেটে এক জনসভায় জামাতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা জনাব নঈম সিদ্দিকী বলেছেন, “আপনারা বলছেন আইন পরিষদ জনপ্রতিনিধিশূন্য। কিন্তু বিগত সাত বছর থেকে আপনারা কোথায় ঘুমিয়ে ছিলেন। •আইন পরিষদ বাতিল করার শ্লোগান দেয়া খুবই সহজ কাজ, কিন্তু তা ভেঙ্গে দেয়াটা খুবই কঠিন হবে।১
জামাতে ইসলামীর মুখপত্র “তসনীম’ ১৯৫৪ সালের ১৫ অক্টোবর সংখ্যায় এ সম্পর্কে লিখেছে, “এই আইন পরিষদ আজ যদি প্রতিনিধিত্বহীন হয়ে থাকে তবে কালও তা প্রতিনিধিত্বহীন ছিলাে। কাল যদি তা প্রতিনিধিত্বহীন না হয়ে থাকে তবে আজো প্রতিনিধিত্বহীন নয়। আইন পরিষদের রূপরেখায় এমন কী পরিবর্তন সূচিত হয়েছে, যার দরুন আজ তাতে শত শত দোষ বের করা হচ্ছে ?” এ সময় জামাতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা থেকে আরম্ভ করে সাধারণ কর্মীরা পর্যন্ত আইন পরিষদ বাতিল-বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ করে। তাদের পত্রপত্রিকা ও প্রচার পুস্তিকাগুলাে নিরলসভাবে কলম চালায়। ইসলামের নাম ভাঙ্গিয়ে বিশেষ বিশেষ। ব্যাখ্যা-বিবৃতি দিয়ে আইন পরিষদ বাতিলের বিরুদ্ধে জনমত সংগ্রহ করার চেষ্টা করে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলাে, এ সময় যে পরিষদ না ভাঙ্গার জন্য জামাত নেতারা এতাে পরিশ্রম করেন, এই জামাতে ইসলামীরই আমীর মওলানা মওদুদী মাত্র চার বছর আগে সর্ব প্রথম আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার দাবি উত্থাপন করেছিলেন। ১৯৫০ সালের অক্টোবর মাসে মওলানা বলেছেন, “আপনারা যদি চান, পাকিস্তান সত্যিকার অর্থে একটি ইসলামী রাষ্ট্রে রূপান্তরিত হােক এবং এদেশের নাগরিকরা ইসলামী সাম্য ও ন্যায়নীতির প্রাচুর্যের ফল ভােগ করুক, তাহলে এসব সুপারিশের বিরুদ্ধে শুধু প্রতিবাদ করাই যথেষ্ট নয়; বরং আপনাদের কর্তব্য হলাে, অত্যন্ত ফলপ্রসূ পন্থায় একথা তুলে ধরা যে, বর্তমান আইন প্রণয়নকারী পরিষদ জাতির আস্থা হারিয়ে ফেলেছে। এই পরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে নতুন একটি আইন পরিষদ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হােক।”২ ১৯৫০ সালের ১১ অক্টোবর এক বিবৃতিতে মওলানা মওদুদী বলেছেন, “এই পরিষদের গঠন পদ্ধতি, সদস্যদের চরিত্র, তার বিগত কার্যাবলী এবং আদর্শ প্রস্তাব (অনুমােদনের) পূর্বাপর কর্মধারা দেখে আমরা প্রথম থেকেই সিদ্ধান্তে পৌছি যে, এই পরিষদ ইসলামী কিংবা গণতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র কোনটা প্রণয়নেরই যােগ্য নয়। ইসলামি ও দেশের সামগ্রিক স্বার্থের প্রতি এই পরিষদের আনুগত্য পর্যন্ত আমাদের নিকট সন্দেহজনক ছিলাে। আমরা একে বিশেষ ক্ষমতাশীল চক্রের স্বার্থের হাতিয়ার বলে মনে করতাম।
এজন্য অনেক পূর্বেই আমরা জাতিকে সতর্ক করে দিয়েছিলাম, তারা যদি একটি খাঁটি ইসলামী শাসনতন্ত্র চায়— সর্বসম্মতভাবে একটি নতুন আইন পরিষদ গঠনের দাবি উত্থাপন করতে হবে যা প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচন করা হবে।”৩ ১৪ অক্টোবর লাহােরের মুচিগেটে ভাষণদান প্রসঙ্গে মওলানা বলেছেন, “এখন সকল পাকিস্তানীর একবাক্যে এই পরিষদের উপর অনাস্থা প্রকাশ ছাড়া অন্য কোনাে কিছু করণীয় নেই। পরিষ্কারভাবে দাবি করা দরকার, এটা ভেঙ্গে দেয়া হােক। তার স্থলে অন্য আর একটি আইন পরিষদ গঠন করা হােক যা প্রাপ্তবয়স্কদের ভােটাধিকারের ভিত্তিতে সরাসরি নির্বাচিত হবে।”৪ আপনারা দেখতে পেলেন, ১৯৫০ সালে মওলানা মওদুদী কিরূপ জোরালােভাষায় ‘দাবী তুলেছিলেন আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। পরিষদের সমালােচনা প্রসঙ্গে তিনি এরূপ। উক্তিও করেছেন যে, “ইসলাম ও দেশের সামগ্রিক স্বার্থের সাথে এই পরিষদের আনুগত্য পর্যন্ত আমাদের নিকট সন্দেহজনক ছিলাে। কিন্তু এর মাত্র চার বছর পর জামাতে ইসলামী উক্ত আইন পরিষদ বাতিল না করার জন্য প্রবল আন্দোলন আরম্ভ করে। নেতাদের সকল বক্তৃতা-বিবৃতি তারা বেমালুম ভুলে গেলেন। শুধু তাই নয়, অন্য কেউ যদি তাদের সামনে সেসব উদ্ধৃতি তুলে ধরতাে, তারা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠতেন। সেসব কথার প্রতি কোনরূপ কর্ণপাতই করতেন না। আবার কোন কোন সময় সেগুলাে অন্যদের উপর চাপিয়ে দেয়ারও অপচেষ্টা করতেন। এক্ষেত্রে জামাতে ইসলামীর মুখপত্র “তসনীমের একটি উদ্ধৃতি বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। পত্রিকাটিতে ১৯৫৪ সালের অক্টোবর মাসে বলা হয়েছে, “আইন পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার শর্তহীন শ্লোগান সর্বপ্রথম কম্যুনিস্টরা তুলেছিলাে।
এখন পরিষদের কোন কোন সদস্য বিশেষ বিশেষ কারণে এ শ্লোগান কম্যুনিস্টদের নিকট থেকে, ধার নিয়েছেন। •••••পাকিস্তানে এ দাবী কোন কোন স্বার্থান্বেষী, প্রাদেশিকতায় নিমগ্ন, বেদ্বীন ও কম্যুনিস্টদের তরফ থেকে করা হচ্ছে।” » এবার মওলানা মওদুদীর উল্লিখিত বিবৃতিগুলাের সাথে ‘তসনীমের’ এ উক্তিটি একটু মিলিয়ে দেখুন, স্ববিরােধিতা আর কাকে বলে! ১৯৫০ সালে তারা ইসলামের দোহাই দিয়ে যে পরিষদ ভেঙ্গে দেয়ার দাবী তুলেছিলেন, ১৯৫৪ সালে সে পরিষদ রক্ষার আন্দোলনেও ইসলাম তাদের হাতিয়ার ছিলাে। ২ = এক্ষেত্রে হয়তাে কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সময় ও পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে অনেক সময় বিশেষ কোনাে ব্যাপারে পূর্বনীতি পুনর্বিবেচনা করতে হয়। এ প্রশ্ন যথার্থ। কারণ স্থবিরতা রাজনীতিতে অচল। কিন্তু জামাতে ইসলামীর বেলায় এ প্রশ্ন উথাপন করা চলে না। মওলানা মওদুদীর মতে জামাতে ইসলামী একটা বিশেষ আদর্শের অনুসারী (?)। আর তা হলাে ইসলাম। তাদের সবকিছুই নাকি ইসলামের ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ! খােদ মওলানা মওদুদী বলেছেন, “আমাদের সম্পর্ক সে আন্দোলনের সাথে সম্পৃক্ত যার নেতা ছিলেন নবীগণ (আঃ)। ••••আমরা যেকোন দেশ ও যুগেই হই না কেন, আমাদের আশপাশের জীবনের সমস্যাবলী যেকোন ধরনেরই হােক না কেন, আমাদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য তাই যা নবীদের ছিলাে। সে মন্‌জিলে পৌঁছার পথ তাই, যে পথে আম্বিয়া কেরাম প্রতিটি যুগে চলেছেন।”৫
মওলানা মওদুদী ও তাঁর অনুসারীদের বক্তৃতা-বিবৃতি ও গ্রন্থরাজিতে এ ধরনের অসংখ্য উদ্ধৃতি রয়েছে যাতে প্রমাণ করার চেষ্টা করা হয়েছে যে, ইসলামই জামাতে ইসলামীর একমাত্র আদর্শ। তাদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ, পার্টির নীতি-পরিকল্পনা সবকিছুই ইসলামানুগ! সুতরাং রাজনৈতিক ক্ষেত্রে মত ও পথ পরিবর্তনের সাধারণ নীতি জামাতে ইসলামীর বেলায় অবান্তর। কিন্তু এ নীতিটি জামাতে ইসলামীই সবচাইতে বেশি প্রয়ােগ করেছে। জামাতের কর্মধারার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, এ ব্যাপারে সে যেকোন রাজনৈতিক দলকে হার মানিয়ে দিয়েছে। তাও আবার ইসলামের দোহাই পেড়ে। ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এর চাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর একটি আছে কিনা সে ব্যাপারে আমাদের যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। আমরা যতটুকু জানি, সেবার জামাতে ইসলামীর আইন পরিষদ বহাল রাখার আন্দোলনের সাথে ইসলাম, ইসলামী শাসনতন্ত্র কিংবা দেশ ও জাতির স্বার্থের কোনরূপ সম্পর্ক ছিলাে না। পরিষদের কিছুসংখ্যক সদস্যের সমর্থনেই জামাতে ইসলামী আইন পরিষদ বাতিল করাে না” আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাে। তাঁরা জামাতে ইসলামীর। প্রাথমিক সদস্যও ছিলেন না। তাঁরা ছিলেন মুসলিম লীগের ক্ষমতাচ্যুত নাজিমুদ্দিন গ্রুপের। তাঁদের সমর্থনের খাতিরেই জামাতে ইসলামী তার চার বছর আগেকার নীতি, বক্তৃতাবিবৃতি ও ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ জলাঞ্জলি দিয়েছিলাে।
গণতন্ত্র ও জামাত
মওদুদী জামাত বর্তমানে বেশ বড় গলায় গণতন্ত্রের কথা বলছে। এক কথায় বলতে হয়। তারা গণতন্ত্রের প্রবক্তা সেজেছে। গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাবানমাত্র অন্তত তাদের এ ভূমিকার নিন্দা করবেন না। কিন্তু জামাতে ইসলামী কবে থেকে গণতন্ত্রের ভক্তে পরিণত হলাে, এটাই হলাে ভাববার বিষয়। ১৯৫৫ সালের ২৮ এপ্রিল মওলানা মওদুদীকে জেল থেকে মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তিলাভের কিছুদিন পরই মওলানা রাজনৈতিক তৎপরতা আরম্ভ করেন। হঠাৎ দেখা গেলাে, তাঁর বিশেষ ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে একটা পরিবর্তন সূচিত হয়েছে। এ পরিবর্তনের কারণ দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক পরিস্থিতি, কারাগারে নিঃসঙ্গ চিন্তাভাবনার ফলশ্রুতি কিংবা প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের স্বার্থরক্ষার তাগিদ যাই হােক না কেন, একথা সত্য যে, এ সময় তিনি তাঁর সুদীর্ঘ কর্মজীবনের চিন্তাধারা থেকে অনেকটা সরে পড়েন। এতদিন যে গণতন্ত্রকে তিনি তাঁর বিশেষ ইসলামের দৃষ্টিতে অবাস্তব, অবৈধ, অভিশপ্ত ইত্যাকার বলেছেন, এ সময় সে গণতন্ত্রকে তিনি বৈধ, ইসলামের সারমর্ম, সমগ্র জাতির অনুসরণীয় বলে ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ দিতে আরম্ভ করেন। এ সময় থেকে তিনি গণতন্ত্রের চরম ভক্তে পরিণত হন। সুদীর্ঘ কর্মজীবনে এ সম্পর্কে যেসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন সেগুলাে বেমালুম ভুলে যান। তিনি তাঁর বিশেষ প্রকাশভঙ্গিতে গণতন্ত্রের মাহাত্ম প্রচারে আত্মনিয়ােগ করেন। সেবার ১৮ জুন পাকিস্তানের সারগােদার এক জনসমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, “…তিনটি জিনিস এমন যার জন্য প্রতিটি দলের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সংগ্রাম করা দরকার। প্রথমত আইনের শাসন। এর মৌলিক নীতি হলাে আইনের চোখে সবাই সমান হওয়া, সবার জন্য একই রূপ আইন হওয়া, আইন ও নীতি প্রতিটি বস্তুর উর্ধে হওয়া, শাসক ও শাসিত, আমির ও গরীব সবাইকে আইনের সামনে শির নত করা, আদালতগুলাে প্রশাসন বিভাগের প্রভাবমুক্ত হওয়া এবং ইনসাফ বাবিচারের বেলায় সার্বজনীন নীতিমালা অনুসরণ করা। দ্বিতীয় বিষয় হলাে, মানুষের লেখা ও বক্তৃতা, সমাবেশ ও চলাফেরার স্বাধীনতা। এটাও আইনের শাসনের দাবি এবং গণতন্ত্র ছাড়া সম্ভব নয়। তৃতীয় বিষয় হলাে গণতন্ত্র। আর এর বুনিয়াদ হলাে দুটো জিনিসের উপর।
একটি হলাে জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী সরকার গঠিত হওয়া এবং তাদের ইচ্ছানুসারে শেষ হওয়া। দ্বিতীয় নীতি হচ্ছে নির্বাচনগুলাে সম্পূর্ণ স্বাধীন হওয়া। এ দু’টো নীতি যথাযথ কার্যকরী না হলে গণতন্ত্র একেবারে অর্থহীন। গণতন্ত্র যদি না হয় তবে স্বাধীনতা হলাে শুধু শাসকদের, জনসাধারণের স্বাধীনতা নয়।”১ সারগােদার পর আরাে অনেক জায়গায় বক্তৃতা-বিবৃতিতে মওলানা মওদুদী গণতন্ত্রের প্রয়ােজনীয়তার উপর গুরুত্ব আরােপ করেছেন। এ ব্যাপারে জামাতে ইসলামীর মজলিসে। শুরা একটি প্রস্তাবও অনুমােদন করে। তাতে বলা হয়েছে, নাগরিক স্বাধীনতা এবং নিরপেক্ষ নির্বাচন এমন দু’টো বিষয় যার দ্বারা কোনাে দেশে গণতন্ত্র জীবিত থাকতে পারে। এযাবৎ যারা ইসলাম ও গণতন্ত্রের পথ রুদ্ধ করার জন্য ষড়যন্ত্র করে চলেছে ইসলামী ভাবাপন্ন কর্মীরা খােদা চাহে ত তাদের পরাস্ত করতে সক্ষম হবে।” * ১৯৫৫ সালে তরজমানুল কোরআনের আগস্ট সংখ্যায় গণতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনা। প্রসঙ্গে মওলানা মওদুদী লিখেছেন, “দ্বিতীয় ভিত্তি, যার উপর একমত হওয়া যায়, তা হলাে। ‘গণতন্ত্র’। কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্ম এবং দেশের অধিবাসীদের ইচ্ছাও তাই। এর সরল অর্থ এই যে, দেশ কোনাে বিশেষ শ্রেণী বা গােষ্ঠীর নয়। বরং এদেশে যারা বসবাস করছে। তাদের সবার। সুতরাং এর ব্যবস্থাপনা তাদের সবার কিংবা ন্যূনতম সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছানুযায়ী চলতে হবে। এবং তাদের নীতিগতভাবে এই অধিকার ও কার্যত এ সুযােগ থাকতে হবে যে, নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী শাসক নির্বাচন ও পরিবর্তন করতে পারবে।
“দেশকে বিশৃংখলার ক্ষতিকর পরিস্থিতির হাত থেকে রক্ষা করার একটিমাত্র পথ হলাে, দেশের ভাবী বিধিব্যবস্থা রূপদানে যারা প্রভাব বিস্তার করতে পারে সর্বপ্রথম তাদের খাঁটি মনে গণতান্ত্রিক নীতি গ্রহণ করা এবং পরে সৎ উদ্দেশ্যের সাথে এরূপ একটা বিধিব্যবস্থা। তৈরি করা যাতে এই নীতি যথাযথ কার্যকর হয়। “একথা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না যে, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায়ও অনেক ক্রটিবিচ্যুতি হয়ে থাকে এবং যখন কোন দেশের অধিবাসীদের ভিতর অনুভূতির দীনতা থাকে তখন সেখানে ত্রুটি-বিচ্যুতি অধিক হারে বেড়ে যায়।….কিন্তু এসব বাস্তব স্বীকার করে নেয়ার পরও এ বৃহৎ সত্য স্বস্থানে বহাল থেকে যায় যে, একটা জাতির সেসব দুর্বলতা দূর করে তাকে সামগ্রিকভাবে পরিণত জাতি হিসেবে গড়ে তােলার একমাত্র পথ গণতন্ত্র। » “এছাড়া গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাই একমাত্র ব্যবস্থা যা একজনের ভেতর এই অনুভূতি জাগিয়ে তােলে যে, দেশ তার। দেশের ভাল-মন্দ তার নিজের ভাল-মন্দ। ভাল-মন্দ দেখা দেয়ার ব্যাপারে ব্যক্তিগতভাবে তার ফয়সালার যথার্থতা কিংবা ক্রটির দখল রয়েছে। আর এ জিনিসটিই ব্যক্তির মধ্যে জাতীয় প্রেরণা সৃষ্টি করে থাকে।” মওলানা মওদুদী উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলােতে গণতন্ত্রের কল্যাণকর দিকগুলাের যে সুন্দর ব্যাখ্যা দিয়েছেন এবং ইসলামের সাথে এর সাযুজ্যতার যে বিশ্লেষণ করেছেন, তা অনেকের পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তাঁর এ গণতন্ত্রপ্রিয়তা বেশিদিনের নয়। ১৯৫৩ সালে জেলে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত তিনি গণতন্ত্রের চরম বিরােধী ছিলেন। ১৯৩৩ সাল থেকে আরম্ভ করে ১৯৫৩ সালে জেলে যাওয়ার আগ পর্যন্ত সুদীর্ঘ কর্মজীবনে মওলানা তাঁর লেখনী ও বক্তৃতা-বিবৃতির মাধ্যমে সব সময়ই গণতন্ত্রের বিরােধিতা করে এসেছেন। ইসলাম ও গণতন্ত্র দু’টো সম্পূর্ণ পরস্পরবিরােধী বিষয় বলে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছেন। এমনকি পাকিস্তান যেহেতু একটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে, সেজন্য স্বাধীনতা সংগ্রামকালে একে ‘অভিশপ্ত’, ‘না-পাকিস্তান’ ইত্যাকার বলেছেন। বিভিন্ন ক্ষেত্রে আলােচনা প্রসঙ্গে তাঁর এ সম্পর্কিত কতকগুলাে উদ্ধৃতি পূর্বে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানে আরাে দু’একটা উল্লেখ করা যাক। তিনি বলেছেন, “বর্তমান যুগে যতগুলাে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রণীত হয়েছে, এগুলাে ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। ৩)
তাদের (মুসলমানদের উদ্দেশে আমি পরিষ্কার বলছি, বর্তমান যুগের ধর্মহীন (ধর্মনিরপেক্ষ) জাতীয় গণতন্ত্র তােমাদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। তােমরা যদি এর সামনে মাথা নত করাে তবে কোরআনের প্রতি পৃষ্টপ্রদর্শন করবে। তার প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করলে নিজের রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করবে। এর পতাকা উত্তোলনের জন্য দাঁড়ালে নিজের খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা হবে। যে ইসলামের নামে তােমরা নিজেদের মুসলমান বলছে, এর সারমর্ম (রূহ) সেই অপবিত্র পদ্ধতির সারমর্মের সাথে, এর মৌলিক নীতি তার মৌলিক নীতিমালার সাথে এবং এর প্রতিটি অংশ তার প্রতিটি অংশের সাথে সংগ্রামমুখর। ইসলাম এবং এ পদ্ধতি কোথাও। পরস্পরে সমঝােতা করে না।”৪। ” “একটা জাতির সবাইকে শুধু এজন্য যে তারা বংশগতভাবে মুসলমান, সত্যিকার অর্থে মুসলমান মনে করা এবং এরূপ আশা পােষণ করা, তাদের দ্বারা যে কাজই হবে তা ইসলামী নীতিভিত্তিক হবে, প্রথম ও মৌলিক ভূল। এই বিরাট সম্প্রদায় যাদের মুসলমান বলা হচ্ছে, তাদের প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জনই ইসলাম সম্পর্কে জ্ঞান রাখে না, ন্যায়অন্যায়ের প্রভেদ করতে জানে না। তাদের নৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি ও মানসিক ধ্যান-ধারণা ইসলামানুগ পরিবর্তিত হয়নি। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের হাতে লাগাম দেখে কেউ যদি মনে করে, গাড়ি ইসলামের পথেই চলবে, তবে তার সুধারণাকে বাহবা দিতে হয়।” যেসব জামাত কোনাে শক্তিশালী আদর্শ ও সজিব সামগ্রিক (ইজতেমায়ী) দর্শন নিয়ে আত্মপ্রকাশ করে তারা সবসময়ই লঘিষ্ঠ হয়। সংখ্যালঘিষ্ঠতা সত্ত্বেও বিরাট বিরাট সংখ্যাগরিষ্ঠকে শাসন করে থাকে। মুসােলিনীর ফ্যাসী পার্টির সদস্য হলাে মাত্র চার লাখ এবং রােমে মার্চ করার সময় ছিলাে মাত্র তিন লাখ। কিন্তু এই সংখ্যালঘিষ্ঠরা সাড়ে চার কোটি ইটালীয়ের উপর ছেয়ে গেছে। এই অবস্থা জার্মানীর নাজি পার্টিরও। একটি মজবুত ও সুসংহত দল শুধু বিশ্বাস ও শৃংখলার জোরে ক্ষমতায় আসতে পারে। তার সদস্যসংখ্যা দেশের অধিবাসীদের মধ্যে প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন।৬ , “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই।”৭ কুর “এজন্যই আমি বলি, যেসব পরিষদ কিংবা পার্লামেন্ট বর্তমান যুগের গণতান্ত্রিক নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত, সেসবের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম।
তা প্রথমে উল্লিখিত উদ্ধৃতিগুলােতে আপনারা পরিষ্কার দেখতে পেয়েছেন, মওলানা ১৯৫৫ সালে কারাগার থেকে মুক্তিলাভের পর গণতন্ত্রের কীরূপ একনিষ্ঠ ভক্ত সেজেছেন। তাঁর বিশেষ প্রকাশভঙ্গিতে গণতন্ত্র, নিরপেক্ষ নির্বাচন, জনগণের অধিকার ইত্যাদির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। তিনি স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, “জনসাধারণের ইচ্ছানুযায়ী সরকারের উথান-পতন হবে। নিরপেক্ষ ও সম্পূর্ণ স্বাধীন নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। এ দু’টো বাস্তবায়িত না হলে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। অপরদিকে মওলানাই বলেছেন, “জনগণের সরকার, জনগণের দ্বারা, জনগণের জন্য—এ মতাদর্শের আমি সমর্থক নই। বর্তমান যুগের গণতন্ত্রের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত পার্লামেন্ট কিংবা পরিষদের সদস্য হওয়া হারাম এবং তার জন্য ভােট দেয়াও হারাম।” একদিকে বলছেন, কোরআন ও সুন্নাহর সারমর্মই হল গণতন্ত্র। অপরদিকে বলছেন, গণতন্ত্র ইসলামী আদর্শের সম্পূর্ণ বিপরীত। গণতন্ত্র মুসলমানদের ধর্ম ও ঈমানের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। গণতন্ত্রের সামনে মাথানত করা কোরআনের প্রতি পৃষ্ঠপ্রদর্শনের নামান্তর। গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা ও সংরক্ষণে অংশগ্রহণ করা রাসুলের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করা। খােদার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘােষণা করা। ইসলামের সারমর্ম গণতন্ত্রের সারমর্মের সাথে সব সময়ই সংগ্রামমুখর। ইসলাম ও গণতন্ত্র পরস্পর কোথাও সমঝােতা করতে পারে না। * মওলানা একদিকে সংখ্যাগরিষ্ঠের মতামতের প্রতি সর্বাধিক জোর দিয়েছেন; অন্যদিকে বলেছেন, জনসাধারণ অজ্ঞ। তাদের মতামতের মূল্য দিলে বিপথগামিতার সম্ভাবনা রয়েছে। তিনি আরাে বলেছেন, আদর্শবান দলের অনুসারীরা সংখ্যায় কমই হয়ে । থাকে। তাদের সংখ্যা প্রতি হাজারে একজন হােক না কেন, তারাই শাসনক্ষমতা পরিচালনা করে থাকে। এজন্য তিনি মুসােলিনী ও হিটলারের অনুসারীদের দৃষ্টান্তও তুলে ধরেছেন। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, মওলানা মওদুদীর কোন্ উক্তিকে সঠিক বলে ধরে নেয়া যাবে। অথচ গণতন্ত্রের সপক্ষ-বিপক্ষ উভয় ক্ষেত্রেই তিনি ইসলামের দোহাই পেড়েছেন। ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করার এর চাইতে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর কি হতে পারে! বস্তুত যখন যেমন তখন তেমনই হচ্ছে ধর্মের মুখােশ পরা মওলানা মওদুদী ও তাঁর দল।
জামাতে ইসলামীর রাজনৈতিক কৌশল। মওলানা মওদুদী গণতন্ত্রের প্রশ্নে বিভিন্ন সময়ে ইসলামের নামে স্ববিরােধী উক্তি করলেও ইসলামে কিন্তু মানুষের মৌলিক অধিকার ও ব্যক্তি-স্বাধীনতার মূল্যমানগুলাে কখনাে উপেক্ষিত হয়নি। বিবেক ও নিজ নিজ জীবন পদ্ধতি অনুসরণের স্বাধীনতা সকল সত্যিকার গণতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মত ইসলামেও মৌল উপাদান হিসেবে স্বীকৃত। বস্তুত গ্রীক নগররাষ্ট্রগুলাের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা বিনষ্ট হওয়ার পর গণতন্ত্রের ধারণা পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিলাে। দীর্ঘকাল পর সপ্তম শতাব্দীর শুরুতে ইসলাম ধর্ম প্রবর্তনের মাধ্যমে মানব সমাজে আবার গণতন্ত্রের ধারণার বিকাশ শুরু হয়। গণতন্ত্রের প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে মহানবীর (সঃ) উদ্দেশে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “(হে মুহম্মদ ! সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়) কাজকর্মে তাদের সাথে পরামর্শ কর।” মহানবীর আমলে সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। ওহুদ যুদ্ধের সময় মহানবীর ইচ্ছা ছিলাে মদীনা শহরে থেকেই কাফেরদের প্রতিরােধ করা। কিন্তু যুবক মুসলিম সৈনিকদের প্রস্তাব ছিলাে মদীনার বাইরে গিয়ে মােকাবেলা করা। মহানবী (সঃ) সংখ্যাগরিষ্ঠের অভিমতের প্রতি সম্মান প্রদর্শন করেন। তিনি মদীনার বাইরে গিয়ে কাফেরদের মােকাবেলা করার সিদ্ধান্ত নিলেন। মহানবীর জীবনে গণতান্ত্রিক পদ্ধতি অনুসরণের সবচেয়ে বড় দৃষ্টান্ত হলাে, তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য তাঁর কোন প্রতিনিধি মনােনয়ন করে যাননি। যােগাযােগবিহীন সেকালের বিশেষ সামাজিক পরিবেশের উপযােগী গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে খােলাফায়ে রাশেদীনের নির্বাচন। অনুষ্ঠিত হয়েছে। মদীনার বিশিষ্ট নাগরিকরা চার খলিফাকে নির্বাচন করেন।
মহানবীর খলিফারা গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তাঁদের খেলাফতকালের দু’একটি ঘটনা থেকে তা সহজে অনুমান করা যায়। মুসলমানদের খলিফা নির্বাচিত হওয়ার পর হযরত আবু বকর (রাঃ) তাঁর প্রথম ভাষণদান প্রসঙ্গে বলেন, “আমি আপনাদের মতই একজন মানুষ। আপনাদের কারো থেকে আমি শ্রেষ্ঠ নই। সুতরাং আমার উপর সতর্ক দৃষ্টি রাখবেন। যতক্ষণ আমি সত্য ও ন্যায় পথে আছি, ততক্ষণ আপনারা আমাকে মানবেন। যদি আমি সত্য পথ থেকে সরে যাই আমাকে সৎপথে টেনে আনবেন।” হযরত আবু বকরের এই উক্তি মহানবীর দুটো হাদীসেরই সারকথা। তিনি বলেছেন, “পাপ কাজে আনুগত্যের দায়িত্ব নেই। শুধুমাত্র সৎকাজের বেলায়ই আনুগত্য।” মহানবীর অপর হাদীসটি হচ্ছে, “অত্যাচারী শাসকের সামনে সত্য কথা বলা উত্তম জিহাদ।”.. » মহানবীর এই হাদীস দুটো সংক্ষিপ্ত হলেও অত্যন্ত স্পষ্ট। এগুলােতে মাত্র কয়েকটি শব্দের মাধ্যমে তিনি মানবজাতিকে ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার এক অনুপম পথনির্দেশ দিয়েছেন। অপরদিকে এক্ষেত্রে মওলানা মওদুদীর অভিমত হচ্ছে, অন্যায় কাজেও আমীরের অনুগত থাকতে হবে।” চিন্তা করুন, দলে নিজের একনায়কত্ব টিকিয়ে রাখার জন্য মওদুদী সাহেব ইসলামের নামে কিরূপ অনৈসলামিক কথা বলেছেন। * দ্বিতীয় খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) ইসলামের ইতিহাসে একজন কঠোর স্বভাবের রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে পরিচিত। কিন্তু ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার প্রতি তাঁর যে শ্রদ্ধা ছিলাে তা বর্তমান আধুনিক সমাজে কল্পনাও করা যায় না। হযরত ওমরের একজন অমুসলিম ক্রীতদাস ছিলাে। অন্যান্য সাহাবারা খলিফার ক্রীতদাসকে মুসলমান হওয়ার জন্য চাপ দেন। সে ধর্মান্তরিত হতে অসম্মতি প্রকাশ করে। তারা এ ব্যাপারে খলিফার নিকট অভিযােগ করেন। হযরত ওমর (রাঃ) বললেন, “এরূপ করার তার সম্পূর্ণ অধিকার রয়েছে।”
একদিন হযরত ওমর অন্যদের চেয়ে লম্বা একটি জামা পরে মসজিদে যান। এক সাহাবী দাঁড়িয়ে বললেন, “হে খলিফা ! বায়তুল মাল থেকে আপনি যে পরিমাণ জামার কাপড় পেয়েছেন আমরাও তাই পেয়েছি। আপনার জামা এতাে লম্বা করলেন কি করে ? বাড়তি কাপড় আপনি কোথায় পেলেন?” খলিফা হযরত ওমর (রাঃ) একজন সাধারণ নাগরিকের এই প্রশ্নের জবাব দান প্রসঙ্গে বললেন, “আমাকে ইমামতি করতে হয় তাই আমার ছেলে ও আমার নিজের কাপড় একত্র করে এই জামাটি তৈরি করেছি। বর্তমান আধুনিক সমাজে কোন রাষ্ট্রনায়ককে তার পােশাক-আশাক সম্পর্কে একজন সাধারণ নাগরিকের এ ধরনের প্রশ্ন আর তার এরূপ জবাব আশা করা স্বপ্নাতীত ব্যাপার। ব্যক্তি ও বাক-স্বাধীনতার এর। চেয়ে উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আরুকি হতে পারে ? পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “তাদের কাজকর্ম পারস্পরিক পরামর্শের ভিত্তিতে সম্পন্ন হয়।” | বস্তৃত খােলাফায়ে রাশেদীনের কথা ও কাজে আমরা আল্লাহ তায়ালার উপরােক্ত বাণীর বাস্তবরূপ দেখতে পাই। হযরত ওমর (রাঃ) অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলতেন, “পরামর্শ ছাড়া খেলাফত হতে পারে না।” হযরত ওমরের সময় বর্তমান সৌদী আরব, সিরিয়া, ইরাক, ইরান, মিসর এক কথায় গােটা মধ্যপ্রাচ্য খেলাফতের অন্তর্ভুক্ত ছিলাে। এসব এলাকা বিভিন্ন প্রদেশে বিভক্ত ছিলাে। এই বিশাল রাষ্ট্র তিনি মদীনা থেকে পরিচালনা করতেন। সেকালে মদীনার মসজিদে নববী ও মসজিদ প্রাঙ্গণ ছিলাে জাতীয় সংসদ। রাষ্ট্রীয় কার্য পরিচালনায় খলিফাকে সাহায্য করার জন্য মজলিশে শূরা বা উপদেষ্টা পরিষদ ছিলাে। মুহাজির ও আনসারদের জ্ঞানী ও ন্যায়নিষ্ঠ ব্যক্তিরা মজলিশে শূরার সদস্য ছিলেন। মজলিশে শূরার অধিবেশন মসজিদে নববীতে অনুষ্ঠিত হত। যেকোন লােক তাতে যােগদান করতে পারতেন। খেলাফতের প্রতিটি কাজ এই মজলিশের পরামর্শ অনুযায়ী করা হতাে। খেলাফতের প্রাত্যহিক কাজ পরিচালনার জন্য প্রতিদিন মসজিদে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতাে। মজলিশে শূরার শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন সদস্য এই বৈঠকে নিয়মিত যােগদান করতেন। তাদেরকে বর্তমান যুগের মন্ত্রিসভার সাথে তুলনা করা যায়। আলােচ্য বিষয় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হলে খলিফা আরব ভূমির নেতৃস্থানীয় লােকদের মদীনায় আহবান করতেন। এটা ছিলাে আধুনিক রাজনৈতিক সম্মেলনের মত। প্রয়ােজন হলে খলিফা জনসাধারণের রায়ও গ্রহণ করতেন। প্রাদেশিক আমিরদের মাধ্যমে তিনি জনসাধারণের মতামত গ্রহণ করতেন। আধুনিক ভাষায় এটা গণভােট বলা যেতে পারে। এক কথায় বলতে গেলে, খেলাফত ছিলাে জনগণের, জনগণের দ্বারা এবং জনগণের জন্য।
খােলাফায়ে রাশেদীন ৩০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। তাঁদের আমলে গণতন্ত্রের মৌলিক নীতিমালা পুরােপুরি অনুসরণ করা হতাে। এরপর অবশ্য মুসলমানদের রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্রের স্থান দখল করে একনায়কতন্ত্র ও রাজতন্ত্র। মহানবী (সঃ) নিজেই বলে গেছেন, “আমার পর খেলাফত বা প্রজাতন্ত্র থাকবে ৩০ বছর। এরপর রাজতন্ত্র কায়েম। হবে।” মুসলমানদের রাষ্ট্র পরিচালনার সুদীর্ঘ ইতিহাসে মহানবীর এই বাণীরই বাস্তব রূপ আমরা দেখতে পাই। পরবর্তী মুসলিম শাসকরা নামেমাত্র খলিফা ছিলেন। কিন্তু গণতান্ত্রিক মূল্যবােধ তাঁরা মােটেও অনুসরণ করতেন না। কোরআন-হাদীস ও খােলাফায়ে রাশেদীনের রাষ্ট্র পরিচালনায় গণতন্ত্রের বাস্তবরূপ এতাে স্পষ্ট থাকা সত্ত্বেও মওলানা মওদুদী হায়দরাবাদের নিজাম ও বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির লেজুড়বৃত্তি করার দিনগুলােতে সাধারণ মুসলমানদের মধ্যে ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন~~ইসলামের দৃষ্টিতে গণতন্ত্র হচ্ছে অভিশপ্ত। আবার পাকিস্তান আমলে একই ব্যক্তি বলেছেন, গণতন্ত্র হচ্ছে ইসলামের সারমর্ম। সত্যি মওলানা মওদুদী পবিত্র ইসলামকে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন দক্ষ কারিগর ছিলেন। বর্তমানে বাংলাদেশেও জামাতীরা তাদের এই দক্ষগুরুর ধ্যান-ধারণাই অনুসরণ করে চলেছে। ইসলামের মুখােশ পরে, ইসলামের নামে যখন যেমন তখন তেমন কথাবার্তা বলছে।
পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তি
১৯৫৪ সালের ৯ মে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হয়। এ সময়ে আবদুর রব নিশতার, খাজা নাজিমুদ্দিন, ফজলুর রহমান প্রমুখ ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিকরা ক্ষমতাসীনদের বিরুদ্ধে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তিকে একটা অস্ত্র হিসেবে দাঁড় করান। তাঁরা এর কঠোর সমালােচনা আরম্ভ করেন। অবশ্য উক্ত চুক্তি যে পাকিস্তানের স্বাতন্ত্র ও আত্মমর্যাদার পরিপন্থী ছিলাে, সেজন্য তাঁরা এর বিরােধিতা করেছিলেন কিনা তা বলা মুশকিল। কারণ এসব রাজনীতিকের পূর্বাপর ভূমিকার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে যেকোন লােকের পক্ষে এরূপ ধারণা করার সঙ্গত কারণ রয়েছে, তাঁরা মার্কিন-বিরােধী ছিলেন না। তাঁরা ক্ষমতায় থাকাকালেও পাকিস্তানের পররাষ্ট্রনীতিতে মার্কিন প্রভাব পুরােপুরি বিদ্যমান ছিলাে। বস্তুত তাঁরা ক্ষমতাসীনদের বিরােধিতার জন্যই সামরিক চুক্তির কঠোর সমালােচনা করেছিলেন। এ সময় জামাতে ইসলামী ক্ষমতাচ্যুত রাজনীতিকদের সাথে সুর মিলিয়ে সামরিক চুক্তির বিরােধিতা করে। সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর ১০ জুন। জামাতে ইসলামীর ‘মজলিসে শূরা’ এ ব্যাপারে একটি প্রস্তাব পাস করে। তাতে বলা হয়, “৯ মে, ১৯৫৪ তারিখে করাচীতে পাকিস্তান ও আমেরিকার মধ্যে যে সামরিক সাহায্য চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে সে সম্পর্কে ‘মজলিসে শুরা যদি তার সত্যিকার মত প্রকাশ না করে তবে তাতে কেবল তার প্রতি দেশের কর্তব্য পালনে অবহেলার অভিযােগই আসবে না, সত্য কথা লুকানাের অপরাধে খােদার নিকটও জবাবদিহি করতে হবে। এই দায়িত্বানুভূতির প্রেক্ষিতে ‘মজলিসে শুরা’ উক্ত চুক্তি সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনা করেছে এবং বিশ্বস্ততার সাথে এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যে, এই চুক্তি শুধু পাকিস্তানের আজাদির পক্ষেই ক্ষতিকর নয়, আমাদের মূল লক্ষ্য ও তাহজিব-তমদ্দনের প্রতিও তাতে কুপ্রভাব পড়ার সম্ভাবনা লুক্কায়িত রয়েছে।” . উপরােক্ত ঘােষণায় জামাতে ইসলামী স্পষ্ট ভাষায় পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির। বিরােধিতা করেছে। সে সময় তাদের ছাড়া আরাে কোন কোন রাজনৈতিক দল এ চুক্তির বিরােধিতা করেছিলাে। তবে তারা সবাই বিষয়টি একই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে বিরােধিতা করেনি। জামাতে ইসলামী ও অন্যান্য বিরােধীদের বিচার-বিবেচনার ধারায় একটা বিরাট পার্থক্য ছিলাে। অন্যরা তাদের রাজনৈতিক দলের নীতি-আদর্শের দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে বিরােধিতা করেছে। তাদের দলের এ নীতি অবস্থার প্রেক্ষিতে যেকোন সময় পরিবর্তন হওয়ার সম্ভাবনা ছিলাে। তাতে কারাে কিছু বলার ছিলাে । অপরদিকে জামাতে ইসলামী (তাদের মতে) নিছক ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে বিষয়টির বিচার-বিবেচনা করে এর বিরােধিতা করেছিলাে। স্বভাবতই আমরা আশা করেছিলাম, জামাতে ইসলামীর সামরিক চুক্তি-বিরােধী নীতি যেকোন অবস্থায় অপরিবর্তনীয় থাকবে। কারণ মওলানা মওদুদী একাধিকবার ঘােষণা করেছেন কোরআন ও সুন্নাহই হচ্ছে জামাতে ইসলামীর আদর্শ। আর যেকোন অবস্থায় কোরআন ও সুন্নাহর নীতি-আদর্শ অপরিবর্তনীয়।
কিন্তু দুঃখের বিষয়, কিছুদিন পরই দেখা গেলাে কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী (?) জামাতে ইসলামীর সামরিক চুক্তি সম্পর্কিত সিদ্ধান্ত পাল্টে গেছে। তারা এখন সামরিক চুক্তির বিরােধিতা করতে নারাজ। এই সামরিক চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার এক বছর পর ১৯৫৫ সালের ২২ নভেম্বর করাচীর। জাহাঙ্গীর পার্কে এক বিরাট জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তাতে মওলানা মওদুদী পাক-মার্কিন । সামরিক চুক্তির সমর্থনদান প্রসঙ্গে বলেন, “…একথা এখন আলােচনার বিষয় নয় যে, এরূপ হওয়া উচিত ছিলাে কিনা। এখন দেখতে হবে, এই চুক্তির ফলে আমাদের ও মধ্যপ্রাচ্যের উপর এর কী ফলােদয় হয়। পাশ্চাত্য রাষ্ট্রগুলাে কি মুসলমানদের আশাআকাংক্ষা পিষ্ট করা ও মুসলিম দেশগুলাের প্রতিনিধিত্বহীন সরকারগুলাের সাথে ষড়যন্ত্রই করে যেতে থাকে, না মুসলিম সাধারণের জাতীয় ও ধর্মীয় আশা-আকাংক্ষা নিষ্পিষ্ট করা হতে বিরত থেকে তাদের আন্তরিক সহায়তা লাভের চেষ্টা করে।” * মওলানা মওদুদী উপরােক্ত ভাষণে পাক-মার্কিন সামরিক চুক্তির প্রতি সমর্থন। জানিয়েছেন। অথচ ১৯৫৪ সালে চুক্তিটি সম্পদিত হওয়ার পর জামাতে ইসলামী কঠোর ভাষায় এর সমালােচনা করেছিলাে। ইসলামের ছদ্মাবরণে সুবিধাবাদিতামূলক রাজনীতি আর কাকে বলে ! জামাতে ইসলামী জনসাধারণ্যে প্রচার করে বেড়ায় তাদের পার্টির সবকিছুই নাকি কোরআন ও সুন্নাহভিত্তিক। প্রতিটি বিষয়কে নাকি তারা ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার-বিবেচনা করে থাকে। যদি তাই হয়, এক বছর পূর্বে তাদের নিকট যে বিষয়টি ইসলামের দৃষ্টিতে অত্যন্ত নিন্দনীয় ছিলাে, এক বছর পর মওলানা কি করে হুবহু সে বিষয়টির প্রতি সমর্থন জানালেন ? অনেকের মতে, এ সময় থেকেই জামাতে ইসলামীর প্রতি মার্কিনদের নেক দৃষ্টি পড়া। আরম্ভ হয়। তারা জামাতকে বিরাট অংকের অর্থ সাহায্য দিতে থাকে। ১৯৫৫ সালের জুন। মাসে লাহােরের একটি দৈনিক সংবাদপত্রে এই মর্মে একটি প্রবন্ধও বেরিয়েছিলাে। এর পূর্বে লাহােরের দাঙ্গা তদন্ত কমিশনের সামনে জনৈক খাজা নাজির আহমদও জেরার জবাব ‘দান প্রসঙ্গে জামাত সম্পর্কে একই ধরনের অভিযােগ করেছিলেন। তিনি আদালতে বলেছিলেন, “জামাতে ইসলামী যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট থেকে অর্থ সাহায্য পেয়ে থাকে, আমার নিকট তার যথেষ্ট প্রমাণ আছে। কিন্তু আমি বিস্তারিত বলবাে না, এতে বিশেষ ‘ অসুবিধার সৃষ্টি হবে।”২
আবার কারাে কারাে মতে অন্য আর একটি বিদেশী শক্তির মাধ্যমে জামাতে ইসলামী মার্কিনদের কাছ থেকে অর্থ সাহায্য নিতাে। সে সময় পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্রে ফলাও করে প্রকাশ করা হয়, ‘মওলানা মওদুদী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বেতনধারী এজেন্ট। তাঁর দলের আন্দোলন মার্কিন স্বার্থরক্ষার আন্দোলন। মার্কিনদের ইঙ্গিতে মওলানা মওদুদী মুসলমানদের ধর্মচ্যুত করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছেন। তিনি নিজের মন ও বিবেক মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিকট বিক্রি করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, অর্থের বিনিময়ে মার্কিন এজেন্ট হিসেবে তিনি মুসলমানদের ধর্মবিশ্বাসে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার চেষ্টা করছেন।” সে ছিলাে পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর কর্মকাণ্ড। বর্তমানে বাংলাদেশ জামাত পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ মধ্যপ্রাচ্য থেকে বিপুল অর্থ সংগ্রহ করে থাকে। এ সম্পর্কে ‘জামাতের অর্থের উৎস’ শীর্ষক অধ্যায়ে বিস্তারিত আলােচনা করা হবে।

জমিদারী প্রথা ও জামাত
শােষণের অন্যতম বিরাট হাতিয়ার হলাে জমিদারী-জায়গীরদারী প্রথা। এর মাধ্যমে সামন্তবাদ যুগে যুগে সাধারণ মানুষের উপর নিদারুণ শােষণ চালিয়েছে। কৃষক-মজুরের হাড়ভাঙ্গা খাটুনির ফল তাদের থেকে কেড়ে নিয়ে সামন্তবাদীরা নিজেরা ভােগ করেছে। এককালে বিশ্বের প্রতিটি দেশেই এই কুপ্রথাটি প্রচলিত ছিলাে। এখনাে অনেক দেশে তা রয়েছে। পাকিস্তানও এই অভিশাপমুক্ত ছিলাে না। বৃটিশ উপনিবেশবাদীরা কিরূপ। অন্যায়ভাবে আমাদের সমাজজীবনে এই দুষ্টক্ষতটি চাপিয়ে দিয়েছিলাে তা কারাে অজানা নয়। আর তাই সূচনাকাল থেকেই উপমহাদেশের গণমনে জমিদারী প্রথার বিরুদ্ধে চরম অসন্তোষ বিরাজ করছিলাে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার প্রথম দশকেই জমিদারী জায়গীরদারী প্রথার বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রবল গণআন্দোলন গড়ে ওঠে। ফলে শেষ পর্যন্ত এ প্রথা বিলােপ করতে হয়। ১৯৪৮ সালের শেষদিকে মওলানা মওদুদী ছিলেন কারাগারে। জেলজীবনে মওলানা জমির মালিকানা সমস্যা’ (মাসআলায়ে মিলকিয়তে জমীন) শীর্ষক একখানা বই লেখেন। সম্ভবত তিনি দেশের জমিদার-জায়গীরদারদের বিশেষ অনুগ্রহ লাভের আশা নিয়েই বইখানা লিখেছিলেন। কারণ এ সময় দেশের রাজনীতিতে জমিদার শ্রেণীর বেশ প্রভাব ছিলাে। মওলানা উক্ত গ্রন্থের একস্থানে লিখেছেন, “ইসলাম পরিমাণ ও সংখ্যাগত দিক থেকে কোনাে ধরনের মালিকানার উপরই সীমা নির্ধারণ করেনি।….টাকা-পয়সা, পশু, ব্যবহারিক দ্রব্যাদি, ঘরদরজা, বাহন— মােট কথা কোনাে জিনিসের ব্যাপারেই আইনত মালিকানার পরিমাণের কোনাে সীমা নেই। এমতাবস্থায় কেবলমাত্র কৃষিজাত সম্পত্তিতে , কি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যার দরুন শরীয়তের ইচ্ছা হবে যে, এ ব্যাপারে মানুষের মালিকানা অধিকারকে দাবীদারদের প্রেক্ষিতে সীমাবদ্ধ করে দেয়া হােক ?….”
জমিদারদের স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে তিনি উক্ত গ্রন্থের অন্যত্র বলেছেন, “ইসলাম বলপূর্বক জমির মালিকদের মালিকানাস্বত্ব ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার দেয় না। শুধু তাই নয়, ইসলাম এরূপ আইন প্রণয়নেরও অনুমতি দেয় না যার মাধ্যমে কোনাে ব্যক্তি কিংবা সম্প্রদায়ের নিজের মালিকানা স্বত্বকে সরকারের নিকট বিক্রি করতে বাধ্য করা যাবে।”২ তিনি আরাে বলেছেন, “অনুরূপ ইসলাম আমাদের একথাও বলে না যে, তােমরা সর্বাধিক এতাে একর জমির মালিক হতে পারাে। কেবলমাত্র একনায়ক ব্যক্তিই এ ধরনের আইন প্রণয়ন করতে পারে। কিন্তু যিনি আল্লাহ ও রাসুলের অনুসারী, তিনি এ ধরনের কথাবার্তা চিন্তাও করতে পারেন না। অনুরূপ ইসলাম একথাও বলে না, যে নিজে জমিতে চাষবাস করে, কেবলমাত্র সেই তার মালিক হতে পারবে।” ৩ উপরােল্লিখিত কয়েকটি উদ্ধৃতি থেকে সহজেই অনুমান করা যায়, মওলানা জমিদারজায়দীরদারদের স্বার্থরক্ষার জন্য উক্ত গ্রন্থে কিরূপ আলােচনা করেছেন। পবিত্র ইসলামের নামে জমিদার-জোতদারদের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে তিনি ধনসম্পদ সম্পর্কে ইসলামের শাশ্বত নীতিরই বিকৃত ব্যাখ্যা করেছেন। পবিত্র কোরআনে ধন-সম্পদের মূলনীতি বর্ণনা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে । “তিনি (আল্লাহ তায়ালা) সেই সত্তা যিনি পৃথিবীতে যা কিছু রয়েছে, সবই তােমাদের জন্য সৃষ্টি করেছেন।”8
পবিত্র কোরআনের এই ঘােষণা ধর্ম, বর্ণ, গােত্র নির্বিশেষে সকল মানুষের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার এই বাণীর সারকথা হলাে, জীবিকা ও জীবনােপায় আল্লাহ তায়ালার প্রাকৃতিক কোষাগারের দান। তা থেকে প্রতিটি প্রাণীর উপকৃত হওয়ার সমান অধিকার রয়েছে। পবিত্র কোরআন ও হাদীসে এ ধরনের আরাে অসংখ্য বাণী রয়েছে। এসব ভাষ্য থেকে পরিষ্কার বুঝা যায়, মানুষের প্রয়ােজন মিটানাের জন্যই আল্লাহ তায়ালা পৃথিবীর সকল বস্তু সৃষ্টি করেছেন। কোন জিনিসেই কারাে মালিকানা নির্দিষ্ট নেই। সকল বস্তুর উপর সব মানুষের যৌথ মালিকানা স্বত্ব রয়েছে। অবশ্য সামাজিক শান্তি-শৃংখলা বিধানের লক্ষ্যে ইসলামে বৈধ উপায়ে অর্জিত সম্পদে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হলেও তা শর্তহীন নয়। আর সে শর্তটি হলাে, ব্যক্তিমালিকানা কখনাে অন্যদের অধিকার ক্ষুণের কারণ হতে পারবে না। ব্যক্তি তার সম্পদ নিজের ন্যায়সঙ্গত প্রয়ােজনে ব্যবহার করবে; ন্যায়সঙ্গত প্রয়ােজনাতিরিক্ত সম্পদ অন্য যাদের প্রয়ােজন তাদের প্রদান করবে। কিন্তু কুক্ষিগত করে রাখতে পারবে না। এ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে : যারা সােনা-রূপা (ধন-সম্পদ) জমা করে এবং আল্লাহর পথে ব্যয় করে না, তাদের আপনি যন্ত্রণাদায়ক শাস্তির সংবাদ জানিয়ে দিন। সেদিন এসব ধন-সম্পদ জাহান্নামের আগুনে গরম করা হবে। অতঃপর তা দিয়ে তাদের কপাল, পাঁজর আর পিঠে দাগ দেয়া হবে। (বলা হবে) তােমরা যা কিছু শুধু নিজেদের জন্য জমা করে রেখেছিলে এগুলাে তাে সেসব সম্পদ। সুতরাং তােমরা যা কিছু জমা করে রেখেছিলে, এখন তার স্বাদ ভােগ কর।”৫ পবিত্র কোরআনের এই বজ্রকঠোর ঘােষণা শুনে সেকালের মুসলমানরা দিশেহারা হয়ে । পড়েন। তারা মহানবীর (সঃ) নিকট সম্পদ ব্যয়ের পরিমাণ জানতে চান। পবিত্র কোরআনের অপর এক আয়াতে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে : “(হে মুহম্মদ!) তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করছে— কি পরিমাণ ব্যয় করবাে ? আপনি তাদের বলে দিন প্রয়ােজনের অতিরিক্ত ধন সম্পদ।”৬ ? অর্থ-সম্পদ ও তার ব্যবহার সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের উল্লিখিত ভাষ্যগুলােতে যেসব। ইঙ্গিত রয়েছে তাতে পরিষ্কার বুঝা যায়, ধন-সম্পদে সীমাহীন ব্যক্তিমালিকানার অবকাশ ইসলামে নেই। সামাজিক শান্তি-শৃংখলার স্বার্থে ইসলামে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত হলেও এর ছত্রচ্ছায়ায় শােষণ-বঞ্চনা ও প্রতারণার মাধ্যমে সম্পদের পাহাড় গড়ে তােলা ইসলাম অনুমােদন করে না। অথচ মওদুদী সাহেব পবিত্র কোরআনের এসব ভাষ্য উপেক্ষা করে সামন্তবাদী ও পুজিপতি শ্রেণীর স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে নির্দ্বিধায় বলে ফেললেন, ‘ইসলাম পরিমাণ ও সংখ্যাগত দিক থেকে কোন ধরনের মালিকানার উপরই সীমা নির্ধারণ করেনি।’ এই সীমা নির্ধারণ দ্বারা তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন আমাদের বােধগম্য নয়। কারণ সম্পদ ও অর্থের মূল্যমান এবং তার চাহিদা স্থিতিশীল নয়, সদা পরিবর্তনশীল। কাজেই ব্যক্তিমালিকানার সংখ্যাগত ও পরিমাণগত সীমা নির্ধারণের প্রশ্নই ওঠে না। কিন্তু সীমা নির্ধারণ করার অর্থ এই নয় যে, সমাজের আর পাঁচজনকে বঞ্চিত করে গুটিকয়েক লােক ব্যক্তিমালিকানার ছত্রচ্ছায়ায় সব সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখবে।
এক্ষেত্রে পবিত্র কোরআন একটিমাত্র শব্দের মাধ্যমে সকল প্রকার শােষণ-বঞ্চনার অবসান ঘটিয়েছে। আর সে শব্দটি হচ্ছে ‘প্রয়ােজন’! যুগ ও সমাজের সার্বিক মূল্যায়নের বিচারে ব্যক্তিমানুষের জন্য যে পরিমাণ সম্পদ ব্যবহার ন্যায়সঙ্গত মনে করা হবে, সেটাই হবে সঠিক প্রয়ােজন। পবিত্র কোরআনের ভাষায় এ ধরনের প্রয়ােজনাতিরিক্ত সব সম্পদ অন্য যাদের প্রয়ােজন তাদের দিয়ে দিতে হবে। এটাই ইসলাম অনুমােদিত অর্থ ব্যবস্থার সারকথা। ভূমি মালিকানার ব্যাপারে ইসলাম আরাে সােচ্চার। মানব জীবনে মৌলিক প্রয়ােজনীয় জিনিসগুলাে প্রকৃতিগতভাবেই আল্লাহ তায়ালার তরফ থেকে মানুষকে প্রদান করা হয়েছে। যেমন বায়ু, পানি, আলাে প্রভৃতি। এসবের উপর কারাে ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীর দাঁড় করানাে চলবে না। ভূমির অবস্থাও এর ব্যতিক্রম নয়। মানুষ তা বিনামূল্যে আল্লাহর তরফ থেকে লাভ করেছে। পবিত্র কোরআনে এ সম্পর্কে বলা হয়েছে, “তিনি সকল সৃষ্ট জীবের কল্যাণের জন্য ভূমি সৃষ্টি করেছেন।”৭
আল্লাহ তায়ালা সকল জীবের জন্য ভূমি সৃষ্টি করেছেন। আর এজন্যই তাতে সবার সমঅধিকার থাকতে হবে। প্রত্যেকের প্রয়ােজন মিটানাের উদ্দেশ্যে জমি সবার জন্য। সমভাবে অবারিত থাকবে। মহানবী (সঃ) প্রতিষ্ঠিত সমাজ ব্যবস্থা যা তার সত্যিকার স্থলবর্তীদের আমলে ধাপে ধাপে অগ্রগতি লাভ করে, তাতেও জীবন ধারণের এই প্রকৃতিজাত উৎসটির অবস্থা তাই ছিল। বস্তুত ইসলামের অর্থব্যবস্থার মূলনীতিটি এক্ষেত্রেও প্রযােজ্য। আল্লাহ প্রদত্ত ভূমিতে সকল মানুষের যৌথ মালিকানা থাকা সত্ত্বেও সামাজিক শান্তি-শৃংখলা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভূমিতে ব্যক্তিমালিকানা স্বীকৃত। কিন্তু কোন অবস্থায়ই এই ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীর সমাজের আর পাঁচজনের জন্য ক্ষতিকর হতে পারবে না। যে যতটুকু আবাদ করতে পারবে বা যার যতটুকু প্রয়ােজন সে তাই আবাদ করবে। অতিরিক্ত ভূমি অন্যরা আবাদ করবে। ইসলামের প্রাথমিক যুগে আরবে বিরাট বিরাট এলাকা অনাবাদী পড়ে ছিলাে। হযরত ওমর (রাঃ) অনাবাদী জমি আবাদের আওতায় আনার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। তিনি সাধারণ অনুমতি প্রদান করেন, অনাবাদী জমি কেউ আবাদ করলে তার মালিকানা স্বীকার করে নেয়া হবে। তবে জমি দখলের পর তিন বছর পর্যন্ত কেউ সে জমি অনাবাদী ফেলে রাখলে তা নিয়ে নেয়া হবে। হযরত বেলালেরও বেশ কিছু জমি অনাবাদী পড়ে ছিলাে। হযরত ওমর হযরত বেলালের প্রয়ােজনের পরিমাপ করে অতিরিক্ত জমি নিয়ে নেন। তিনি সে জমি অন্যদের মধ্যে বন্টন করে দেন। ইসলামের ইতিহাসে এ ধরনের আরাে বহু দৃষ্টান্ত রয়েছে। অর্থসম্পদ হােক আর ভূমিসম্পদ হােক, ব্যক্তিমালিকানার প্রাচীর দাঁড় করিয়ে প্রয়ােজনাতিরিক্ত সম্পদ কুক্ষিগত করে রাখা ইসলাম অনুমােদন করে না। এটাই হচ্ছে ইসলামের অর্থ ব্যবস্থার মূলনীতি। কিন্তু মওলানা মওদুদী পাকিস্তানের জায়গীরদারজমিদারদের স্বার্থ রক্ষা করতে গিয়ে তাঁর ‘ভূমি মালিকানা সমস্যা’ পুস্তকে ইসলামের এই মূলনীতির সম্পূর্ণ উল্টো ব্যাখ্যা প্রদান করেন। তিনি বলেছেন, ইসলাম নাকি জমির মালিকদের মালিকানা স্বত্ব ছিনিয়ে নেয়ার অধিকার দেয় না।’ তাঁর মতে, “যিনি আল্লাহ ও রাসুলের অনুসারী, তিনি এ ধরনের কথাবার্তা চিন্তাও করতে পারেন না।’ মওলানা মওদুদীর ইসলামের নামে এ ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যা আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে।।
সে যাই হােক, পুস্তকটি বের হওয়ার পর পাকিস্তানের জমিদারকুল তা লুফে নেয়। তারা হাজার হাজার কপি ছেপে পাকিস্তানের জনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করে। এই পুস্তকের পুরস্কার হিসেবে মওলানা মওদুদী কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করেন। ১৯৫০ সালের ২৮ মে মওলানা মওদুদীকে মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি সুর পাল্টে ফেলেন। তিনি তাঁর গ্রন্থে লিখিত সকল ইসলামিক (?) ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বেমালুম ভুলে যান। তিনি বিভিন্ন বিবৃতিতে পাকিস্তানের অধিকাংশ জমিদারীকে শরীয়তের দৃষ্টিতে অবৈধ বলে ঘােষণা করেন। জামাতে ইসলামীর মুখপত্র ‘তসনীমে’র ১৯৫৬ সালের ৭ মার্চ সংখ্যায় মওলানা এ সম্পর্কে একটি প্রস্তাব প্রকাশ করেন। তাতে তিনি বলেন, “একটি কমিশন নিয়ােগ করা হােক। দেশের সকল জমিদারী সম্পর্কে সে অনুসন্ধান করে বলবে, এসবের মধ্যে কোন্‌গুলাে ইসলামের মূলনীতির বিপরীত। মওলানার ব্যক্তিগত মতে পূর্ব পাকিস্তানের শতকরা ৯৮ ভাগ জমিদারী ইসলামের মূলনীতি-বিরােধী। পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ জমিদারীও ইসলামী বিধানের পরিপন্থী।”
জেলে থাকাকালে মওলানা জমিদারদের সপক্ষে ইসলামকে ব্যবহার করাই অধিক লাভজনক মনে করেছিলেন। তাই তিনি তা করেছিলেন। কিন্তু পরবর্তীকালে দেশে জমিদারী প্রথা উচ্ছেদ আন্দোলন প্রবল হয়ে উঠলে তিনি ভাবলেন, এখন জমিদারদের সপক্ষে ইসলামকে ব্যবহার করলে লাভের চাইতে ক্ষতিই হবে বেশী। তাই তিনিসুর পাল্টে ফেলেন। অবশ্য উভয় ক্ষেত্রে তিনি ইসলামকেই হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেন।
কোনাে স্থান নেই। খােদার শরীয়তের দৃষ্টিতে হিন্দুস্তানী জাতীয়তাবাদ যতটুকু অভিশপ্ত, মুসলিম জাতীয়তাবাদও ততটুকু অভিশপ্ত । তিনি আরাে বলেছেন, “নিজেদের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের জন্য ইসলামের নাম আপনাদের ব্যবহার করার অধিকার নেই। কেননা ইসলাম সকল প্রকার জাতীয়তাবাদের শক্র। সেটা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ হােক কিংবা নামসর্বস্ব মুসলিম জাতীয়তাবাদ হােক।”
মুসলিম জাতীয়তাবাদের সপক্ষেও তিনি নির্দ্বিধায় কলম চালিয়েছেন। তিনি বলেছেন, যেসব বুনিয়াদের উপর আমাদের জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠিত, দেড়শ’ বছরের পরাধীনতা সেগুলাে ঘুণের মত খেয়ে ফেলেছে। অভিজ্ঞতা বলছে এবং আমরাও এখন দিবালােকের মত বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি, যদি দীর্ঘদিন যাবৎ এ পরিস্থিতি বিদ্যমান থাকে, তাহলে হিন্দুস্তানে ইসলামী জাতীয়তাবাদ ধীরে ধীরে শুকিয়ে স্বভাবজাত মৃত্যুবরণ করবে এবং নামমাত্র অস্তিত্বটুকুও অবশিষ্ট থাকবে না।” মুসলিম জাতীয়তাবাদের সপক্ষে মওলানার এ ধরনের অসংখ্য উক্তি রয়েছে। বিগত অধ্যায়গুলােতেও কয়েকটি উদ্ধৃতি উল্লেখ করা হয়েছে। এখন আপনারাই বিচার করুন জামাতের প্রতিষ্ঠাতা ও তাত্ত্বিক গুরু মওদুদী সাহেবের পবিত্র ইসলামের নামে এসব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের কোনটা সত্য আর কোনটা মিথ্যা ধরে নেয়া যাবে। মওদুদী সাহেব ও তাঁর দল জামাত পবিত্র ইসলামকে কিভাবে বিভিন্ন সময়ে স্বার্থসিদ্ধির হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করেছেন, তার একটা চিত্র পাওয়া যাবে মওলানা কাউসার নিয়াজীর কয়েকটি ঐতিহাসিক চিঠিতে। পাকিস্তানের লব্ধপ্রতিষ্ঠ আলেম, সাংবাদিক ও ভুট্টো মন্ত্রিসভার ধর্মমন্ত্রী মওলানা নিয়াজী একসময় জামাতে ইসলামীর অন্যতম শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন। তিনি দীর্ঘ ১৭ বছর জামাতের সাথে জড়িত ছিলেন। এক পর্যায়ে মওলানা মওদুদী ও জামাতের পবিত্র ধর্মের নামে প্রতারণা, ধর্মকে রাজনীতি ও ক্ষমতা দখলের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারের কারসাজি তাঁর নিকট ধরা পড়ে। তিনি জনাব মওদুদী ও জামাতকে এই ঘৃণ্য তৎপরতা থেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। শেষ পর্যন্ত মওলানা নিয়াজী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। পদত্যাগ করার আগ পর্যন্ত মওলানা কাউসার নিয়াজী মওদুদী সাহেবের সাথে একাধিকবার পত্রালাপ করেন। এসব চিঠি ষাটের দশকে ভারত ও পাকিস্তানের বিভিন্ন সংবাদপত্র ও সাময়িকীতে প্রকাশিত হয়। সেসব চিঠির কিছু উদ্ধৃতি এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না।
মওলানা নিয়াজী লিখেছেন, ‘প্রথমে আমরা নিজে সংসদে প্রার্থী হওয়া হারাম মনে করতাম; কিন্তু এখন বিরােধী দলগুলাের সাথে মিলিত হয়ে নিজেরাও প্রার্থীদের নিকট থেকে দরখাস্ত আহবান করছি। প্রথমে আমরা পার্টি টিকেট প্রথাকে অভিশপ্ত বলতাম; কিন্তু এখন আমরা সম্মিলিত জোটের সাথে অসৎ লােকদেরও টিকিট বিতরণ করছি। আমরা টাকার নােটে কায়দে আজমের ছবি ছাপানাের বিরােধী ছিলাম; কিন্তু প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আমাদের সদস্যরা কায়দে আজমের বােনের ছবিযুক্ত ভাউচার অলিগলিতে বিক্রি করেছে। প্রথমে আমরা প্রেসিডেন্ট পদ্ধতি থেকেও এক ধাপ অগ্রসর হয়ে আমিরিয়াতি খেলাফতের ধারণা পেশ করেছিলাম; কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই তা গ্রহণ করেছি। প্রথমে আমরা (নারী পুরুষের) সম্মিলিত সভা-সমিতিতে যােগদান করতাম না। কিন্তু এখন আমরা নিজেরাই এ ধরনের সমাবেশে বক্তৃতা করছি, সভাপতিত্ব করছি। আমরা আগে আলেমদের ঐক্যবদ্ধ করার জন্য চেষ্টা করতাম। বর্তমান রাজনৈতিক দলগুলােকে সঙ্গে নেয়া অন্যায় মনে করতাম। কিন্তু এখন রাজনৈতিক দলগুলাের ঐক্যজোটকে শক্তিশালী করা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে কর্তব্য মনে করি। প্রথমে আমরা মহিলাদের ভােটাধিকার প্রদানের বিরােধিতা করতাম; কিন্তু এখন মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছি। প্রথমে আমরা ছাত্রদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ বারণকরতাম; এখন তাদেরকে সক্রিয় রাজনীতিতে অংশগ্রহণের আহবান জানাচ্ছি। প্রথমে আমরা মিছিল বের করা ও শ্লোগান দেয়া ইসলামবিরােধী বলতাম, এখন আমরা নিজেরাই মিছিল বের করছি, শ্লোগান দিচ্ছি, নেতাদের নামে জিন্দাবাদ ধ্বনি দিচ্ছি। প্রথমে আমরা মানব রচিত আইন-কানুনের মাধ্যমে পরিচালিত আদালতগুলােতে বিচার প্রার্থনা করা বিরাট পাপ কাজ মনে করতাম, এখন আমরা এসব আদালতকেই ইনসাফ ও ন্যায় প্রতিষ্ঠার রক্ষক সাব্যস্ত করছি। প্রথমে আমরা আইনজীবীদের শয়তানী সংঘের সদস্য মনে করতাম, এখন তাদেরকেই আমরা গণতন্ত্রের পৃষ্ঠপােষক আখ্যায়িত করছি।’ মওদুদী সাহেবের নিকট লেখা পত্রে মওলানা নিয়াজী আরাে বলেন, “ইসলামের নামে এসব নিত্যপরিবর্তিত মতামতের মধ্যে কোন্‌টি সঠিক আর কোন্‌টি ভুল তা আমি বলতে চাই না। যা বলা হলাে এসব হচ্ছে জামাত সম্পর্কে অসংখ্য অভিযােগের মধ্যে সামান্য কিছুটা দৃষ্টান্ত মাত্র। আমি অত্যন্ত দুঃখ নিয়ে জামাতের ইতিহাসের দিকে কিছু ইঙ্গিত করলাম।
আমি বলতে চাই, সময়ের দোহাই দিয়ে এতসব পরস্পরবিরােধী অভিমতকে আমরা ইসলামী ও দ্বীনি বলে গ্রহণ ও বর্জন করছি। এখন বিচার্য বিষয় হলাে, গ্রহণ ও বর্জনের এই মহড়ার পর জামাতের স্বার্থান্বেষী সদস্য ছাড়া কে আমাদের এই ধর্মীয় চিন্তাধারার প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করবে ? জামাতের চারিত্রিক অবস্থা অধঃপতনের শেষ সীমায় গিয়ে পৌঁছেছে। আমি একাধিকবার এসব ব্যাপারের প্রতি আপনার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছি। আপনি প্রত্যেক বারই এসব জানেন বলে মত প্রকাশ করেছেন।১০ | মওলানা কাউসার নিয়াজীর লেখা চিঠির অংশবিশেষে জামাতের যে কদর্য চিত্র ভেসে উঠেছে, তা দেখার পর যেকোন লােক স্বীকার করবে, জামাত হচ্ছে সামাজিক ও ধর্মীয় অপরাধের একটি ইতিহাস।
১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্র

পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই ইসলামী শাসনতন্ত্র প্রণয়ন দাবির ছদ্মাবরণে মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাত ক্ষমতাসীন সরকার, এমনকি কর্মচারীদের আনুগত্য প্রদর্শন, সেনাবাহিনীতে যােগদান প্রভৃতির ঘাের বিরােধিতা করেন। পরবর্তীকালে তাঁরা দেশের অধিকাংশ আলেমদেরও এক প্লাটফরমে সমবেত করতে সক্ষম হয়েছিলেন। অবশ্য কাদিয়ানী দাঙ্গার পর আলেমদের সে ফ্রন্ট ভেঙ্গে যায়। ১৯৫৩ সালের ১১ জানুয়ারী থেকে ১৮ জানুয়ারি পর্যন্ত কারাচীতে সর্বদলীয় আলেমদের এক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনে মওলানা মওদুদীও অংশগ্রহণ করেন। উক্ত সম্মেলন সুপারিশ করে, পাকিস্তানের ভাবী শাসনতন্ত্রে কাদিয়ানীদের সংখ্যালঘু গণ্য করতে হবে। শাসনতন্ত্র জারি করার তারিখ থেকে অনধিক তিন বছরের ভেতর আইনের মাধ্যমে সমাজদেহ থেকে মদ, জুয়া ও ব্যভিচার সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হবে। প্রচলিত আইন-কানুন পাঁচ বছরের মধ্যে কোরআন ও সুন্নাহ মােতাবেক পরিবর্তন করতে হবে। নাস্তিকতা ও ধর্মদ্রোহিতার প্রচারপ্রসার এবং কোরআন-সুন্নাহর অবমাননা ও উপহাস করা আইন করে বন্ধ করতে হবে। মুসলমান চাকরিপ্রার্থী ও সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ ও পদোন্নতির বেলায় ধর্মপরায়ণতা ও ইসলামী রীতি-নীতি অবলম্বনের শর্তারােপ করতে হবে। কোরআন ও সুন্নাহকে দেশের আইন-কানুনের মূল উৎস হিসাবে মেনে নিতে হবে। ফরজ বিধানের অনুসারী না হওয়া। ও অশ্লীলতা পরিহার না করা পরিষদগুলােয় মুসলিম সদস্যদের অযােগ্যতার শর্ত আরােপ করতে হবে। আইন পরিষদে কোরআন ও সুন্নাহর ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ সম্পর্কে যদি কোনাে আপত্তি উথাপিত হয় তবে অবশ্যই তা ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ (ওলামায়ে পাকিস্তান) বাের্ডের নিকট পাঠাতে হবে। বাের্ডের ফয়সাল আইন পরিষদ মেনে দিতে বাধ্য থাকবে। ১৯৫৬ সালের ১০ জানুয়ারি আইন পরিষদে শাসনতন্ত্রের খসড়া পেশ করা হয়। কিন্তু দেখা গেলাে, মওলানা মওদুদীসহ অন্যান্য আলেমদের উল্লিখিত সুপারিশগুলাের কোনােটিই। তাতে রক্ষা করা হয়নি। আরাে মজার ব্যাপার হলাে, শাসনতন্ত্রের খসড়া পরিষদে পেশ। করার পর ১৬ জানুয়ারি জামাতে ইসলামীর ‘মজলিসে শূরার তরফ থেকে এ সম্পর্কে একটি সমালােচনা প্রকাশ করা হয়।
কিন্তু আলেমদের দাবীগুলাে কেন শাসনতন্ত্রের খসড়ায় শামিল করা হলাে না, এ বিষয়ে কোনাে প্রতিবাদ করা হয়নি। অথচ এগুলাে ছিলাে সর্বদলীয় আলেমদের মৌলিক দাবি। সর্বদলীয় আলেমদের আর একটি দাবি ছিলাে, আইন পরিষদে প্রণীত আইন-কানুনের বিরুদ্ধে যেসব শাসনতান্ত্রিক আপত্তি কিংবা ব্যাখ্যাগত সমস্যা সৃষ্টি হবে সেগুলাে মীমাংসার জন্য সুপ্রীমকোর্টে পাঁচজন আলেম নিয়ােগ করতে হবে। রাষ্ট্রপ্রধান ধর্মপরায়ণ ও ইসলামী আইন বিশেষজ্ঞ একজন বিচারপতি মনােনীত করবেন। উক্ত পাঁচজন আলেম ও বিচারপতি মিলে ফয়সালা করবেন সংশ্লিষ্ট আইন কোরআন ও সুন্নাহ মােতাবেক কিনা। এ দাবিটিও খসড়া শাসনতন্ত্রে শামিল করা হয়নি। অবশ্য এ বিষয়টি সম্পর্কে জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরা তাদের সমালােচনায় উল্লেখ করেছিলেন। ” এ সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলা হয়েছিলাে, “এখন প্রশ্ন থেকে যায় কোনাে আইন ইসলামের অনুশাসন মােতাবেক কিনা তার শেষ মীমাংসা কে করবে ? সুপ্রীমকোর্ট, না খােদ আইন পরিষদ ? এ ব্যাপারে আমাদের বক্তব্য হলাে, সঠিক পন্থা তা-ই যা ১৯৫৩ সালে ওলামা কনফারেন্স সুপারিশ করেছিলাে। যদি তা আইন পরিষদের সদস্যদের পক্ষে কোন অবস্থায়ই গ্রহণযােগ্য না হয় তবে অন্য আর একটি ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে। আইন পরিষদই এর মীমাংসা করবেন, কিন্তু এ ব্যবস্থা আমরা শুধু এরূপ শর্তে গ্রহণ করতে পারি, আইন পরিষদের মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যরা তা মীমাংসা করবেন।’ জামাতে ইসলামী তাদের মূল দাবী থেকে অনেক দূর সরে গিয়ে বিকল্প প্রস্তাবটি পেশ করে। কিন্তু তাদের এ সুপারিশটিও বিবেচনা করা ছাড়াই শাসনতন্ত্র অনুমােদন করা হয়। তাছাড়া মওলানা মওদুদী ইসলামী শাসনতন্ত্রের বুনিয়াদ হিসাবে যেসব দাবী পেশ করেছিলেন এবং কয়েক বছর পর্যন্ত এসবের পক্ষে ঝড়-ঝঝার বেগে যে প্রচারণা চালিয়েছিলেন, শাসনতন্ত্র প্রণয়নের সময় কেউই এসব দাবীর গুরুত্ব দেয়নি। দৃষ্টান্তস্বরূপ বলা যায়, মওলানা অমুসলিমদের অধিকার সম্পর্কে যেসব কথা বলেছিলেন তার একটিও শাসনতন্ত্রে স্থান লাভ করেনি। তাতে ধর্ম, সম্প্রদায় ও গােত্র নির্বিশেষে সবাইকে সমান নাগরিক অধিকার দেয়া হয়েছিলাে। শুধু তাই নয়, এ অধিকার আদায়ের জন্য প্রত্যেক নাগরিককে সুপ্রীমকোর্টের আশ্রয় নেয়ারও বিধান রাখা হয়েছিলাে।
পাকিস্তানের একজন অমুসলিম নাগরিক রাষ্ট্রপ্রধানের পদ ছাড়া আর সকল পদের যােগ্য বলে মেনে নেয়া হয়েছিলাে। একজন অমুসলিম নাগরিককে সাধারণ পদ থেকে আরম্ভ করে প্রধানমন্ত্রী, সামরিক বাহিনীর প্রধান সেনাপতি, প্রধান বিচারপতি এমনকি অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ারও অধিকার দেয়া হয়েছিলো। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে অমুসলিমদের তাদের নিজস্ব ধর্মকর্ম পালন ও প্রচারপ্রসারের পূর্ণ স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলাে। প্রতিটি নাগরিককে যেকোন ধর্ম গ্রহণ করার স্বাধীনতা দেয়া হয়। কিন্তু মওলানা মওদুদী সুপারিশ করেছিলেন, যারা ইসলাম ধর্ম ত্যাগ করে ‘মােরতাদ হয়ে যাবে তাদের শাস্তি মৃত্যুদণ্ড দিতে হবে। শাসনতন্ত্রে একাধিক রাজনৈতিক দল গঠনের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা আরােপ করা হয়নি। রাষ্ট্রের যে কোন গুরুত্বপূর্ণ পদে পুরুষের ন্যায় নারীদের নিয়ােগ করার বিধান রাখা হয়েছিলাে। এ ব্যাপারে কোনাে প্রকার বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়নি। অথচ মওলানা তাঁর শাসনতান্ত্রিক সুপারিশে বলেছিলেন, “আইন পরিষদগুলােতে একাধিক দল গঠন করা আইনের দৃষ্টিতে নিষিদ্ধ হতে হবে। … আইন পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্যা হওয়ার অধিকার দেয়া পাশ্চাত্য জাতিগুলাের অন্ধ অনুকরণ বই কিছু নয়। ইসলামের নীতি কিছুতেই এর অনুমতি দেয় ।”
মওলানা মওদুদী ও অন্যান্য কয়েকজন আলেম দাবি করেছিলেন, যেহেতু পাকিস্তান একটি আদর্শভিত্তিক রাষ্ট্র, সুতরাং শাসনতন্ত্রে এমন একটা ধারা রাখা হােক যাতে রাষ্ট্রের মৌলিক আদর্শ ও লক্ষ্য সংরক্ষণ করা যায়। কিন্তু ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে প্রতিটি নাগরিককে সমভাবে ধর্মীয় স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিলাে। এমনকি আদর্শ বলতে তাতে কিছুই স্বীকার করা হয়নি। প্রতিটি ব্যাপারে জনমতকেই শেষ কথা হিসেবে মেনে নেয়া হয়েছিলাে। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে ১৯৫৩ সাল পর্যন্ত মওলানা মওদুদী কতকগুলাে বিষয় ইসলামী শাসনতন্ত্রের জন্য অত্যাবশ্যকীয় বলে প্রচার করে আসছিলেন। পাকিস্তানের শাসনতন্ত্রে এগুলাে সন্নিবেশ করানাের জন্য তিনি রাতদিন নিরলস অভিযান চালান। এ ব্যাপারে প্রতিবাদকারীদের এমন কোন ভদ্র গালি নেই যা তিনি দেননি। কিন্তু এতাে কিছু করার পরও শাসনতন্ত্র প্রণীত হওয়ার পর দেখা গেলাে, মওলানার সুপারিশগুলাে কোনটিই তাতে নেই। এমতাবস্থায় স্বভাবতই মনে করা হয়েছিলাে তিনি শাসনতন্ত্রের বিরূপ সমালােচনা করবেন। এ ধারণা সম্পূর্ণ ভ্রান্ত প্রতিপন্ন হলাে। মওলানা সীমাহীন সহানুভূতি ও প্রশংসচিত্তে শাসনতন্ত্রকে অভিনন্দন জানালেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে দেশের নাম ইসলামী প্রজাতন্ত্র রাখা হয়েছিলাে। এও শর্তারােপ করা হয়েছিলাে, মুসলমানই রাষ্ট্রপ্রধান হবেন। আমরা আশ্চর্যান্বিত হয়েছিলাম এজন্য যে, মওলানা তাতেই অত্যন্ত সন্তুষ্ট ছিলেন এবং এটা তাঁদের সবচাইতে কামিয়াবী বলে আখ্যায়িত করেছিলেন। পক্ষান্তরে ১৯৩৩ সাল থেকে মওলানা উপমহাদেশের মুসলমানদের একথা শুনিয়ে আসছিলেন, ‘ইসলাম’ শব্দে কোন বৈশিষ্ট্য নিহিত নেই। শুধু তাই নয়, উপমহাদেশীয় মুসলমানদের প্রতি হাজারে নয়শ’ নিরানব্বই জনই ইসলাম সম্পর্কে অজ্ঞ। তারা বংশগত ও নামের মুসলমান। আরাে কত কিছুই না তিনি বলেছেন।
কিন্তু সময়ের কি নির্মম পরিহাস, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে দেশ ও রাষ্ট্রপ্রধানের শাব্দিক । ইসলামী নামেই তিনি আনন্দে আটখানা হয়ে পড়েছিলেন। মওলানা ও তাঁর অনুসারীরা এটাকে তাঁদের বিরাট কামিয়াবী বলে অভিহিত করেছিলেন। তিনি এতটুকু তলিয়ে দেখার ফুরসত পেলেন না-রাষ্ট্রপ্রধান যে মুসলমান হবেন তিনি কি বংশগত ও নামের মুসলমানই হবেন, না তাঁর বিশেষ ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকৃত ‘সত্যিকার ও ন্যায়নিষ্ঠ মুসলমান’ হবেন। এবারে সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নে আসা যাক। সার্বভৌম ক্ষমতার প্রশ্নটা যেকোন দেশের। শাসনতন্ত্রের মৌলিক বিষয়। এ অধিকার কাকে দেয়া হয়েছে তা দেখলেই উক্ত শাসনতন্ত্রের ধরন নির্ণয় করা যায়। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছিলাে, পাকিস্তান জাতীয় পরিষদই দেশের সর্বাধিক ক্ষমতার অধিকারী। আর এর সদস্য হবেন জনসাধারণ। নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে সবাই এ পরিষদের সদস্য হতে পারবেন। ধর্মগত কারণে তাদের মধ্যে কোনরূপ পার্থক্য করা হবে না। কেবলমাত্র রাষ্ট্রপ্রধান মুসলমান হবেন। কোনাে অমুসলিম এ পদের প্রার্থী হতে পারবে না। এছাড়া আর সব বিষয়ে মুসলিম-অমুসলিম পরিষদ সদস্যদের সম-অধিকার থাকবে। তাদের সবার ভােটে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচিত হবেন। সবার ভােটে তাঁকে পদচ্যুতও করা যাবে। একজন মুসলমান যেমন প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন অনুরূপ একজন অমুসলমানও হতে পারবেন। জাতীয় পরিষদ সদস্যদের মধ্য হতে কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভা গঠন করা হবে। তাঁদের হাতে দেশের শাসনক্ষমতা দেয়া হবে। তাঁরা জাতীয় পরিষদের সামনে জবাবদিহি হবেন। কিন্তু জাতীয় পরিষদের উপর আর কেউ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী নেই। শুধু জনসাধারণ নির্বাচনের মাধ্যমে পরিষদ সদস্যদের পরিবর্তন করতে পারবে। জাতীয় পরিষদের এই মর্যাদার প্রেক্ষিতে একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, জাতিধর্ম নির্বিশেষে পাকিস্তানের জনসাধারণের সার্বভৌমত্বকেই ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছিলাে। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের একটি ধারায় একথা বলা হয়েছিলাে, জাতীয় পরিষদ কোরআন ও সুন্নাহর খেলাফ কোন আইন প্রণয়ন করতে পারবে না। বাহ্যত এ ধারাটি জাতীয় পরিষদের সার্বভৌমত্বকে সীমাবদ্ধ করে দিয়েছিলাে। এদিক থেকে যদি বলা হয়, জাতীয় পরিষদের উপরেও একটি শক্তি রয়েছে যার সামনে পরিষদকে মাথানত করতে হবে, তাহলে অযথা কিছু বলা হবে না। বস্তুত জাতীয় পরিষদের আইন তৈরি করার শক্তি ছিলাে না।
কিন্তু শাসনতন্ত্রে বিষয়টির এখানেই পরিসমাপ্তি ঘটেনি। এরপর স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, কোন্ আইনটি ইসলামানুগ আর কোন্‌টি নয়, এর ফয়সালাও জাতীয় পরিষদই করবে। সে-ই এ ব্যাপারে সর্বেসর্বা। তার ফয়সালার বিরুদ্ধে সুপ্রীমকোর্ট, ওলামা বাের্ড কিংবা অন্য কোনাে সংস্থার নিকট অভিযােগ করা চলবে না। তবে হ্যাঁ, একটি শক্তি এ ব্যাপারে জাতীয় পরিষদকে বিরত রাখতে পারে, আর তা হলাে জনশক্তি। তারা নতুন নির্বাচনকালে এরূপ আইন প্রণয়নকারী জাতীয় পরিষদের প্রতি অনাস্থা প্রকাশ করে তাদের ক্ষমতাচ্যুত করতে পারে। এক্ষেত্রেও পরিষ্কার প্রতিভাত হয় যে, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে জাতিধর্ম নির্বিশেষে পাকিস্তানের জনসাধারণের সার্বভৌম ক্ষমতাকেই মেনে নেয়া হয়েছিলাে। এ বিষয়টি এতাে স্পষ্ট ভাষায় বিবৃত হয়েছিলাে যে, শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর খােদ জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরাকেও তার রিপাের্টে স্বীকার করতে হয়েছিলাে। মজলিসে শূরা খসড়াটি সম্পর্কে মন্তব্য প্রসঙ্গে বলেছিলাে, “তাতে অনৈসলামিক প্রবণতা রয়ে গেছে।৩
তা দূর করার জন্য মজলিসে শূরা কতকগুলাে সুপারিশ করেছিলাে, কিন্তু কেউই সেদিকে নজর দেয়নি। এমনিই খসড়াটি অনুমােদন করা হয়। তাতে করে শাসনতন্ত্র প্রণেতা পরিষদ জনগণের সার্বভৌমত্বকেই বহাল রাখে। জাতীয় পরিষদের উপর কোনাে শক্তির কর্তৃত্বকে মেনে নিতে অস্বীকার করা হয়। বস্তুত জাতীয় পরিষদের অর্থই হলাে জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধি। অন্যভাবে বলতে গেলে স্বয়ং জনসাধারণ । অবশ্য শাসনতন্ত্রের ভূমিকায় উল্লিখিত আদর্শ প্রস্তাবের একটি ধারায় বলা হয়েছিলাে, ‘আল্লাহ তায়ালাই সমগ্র বিশ্বের সার্বভৌমত্বের অধিকারী। তাঁর কোন শরীক নেই। তিনি তাঁর প্রতিনিধি হিসেবে জনসাধারণকে পাকিস্তান রাষ্ট্র পরিচালনার সুনির্দিষ্ট অধিকার প্রদান করেছেন। আর এ অধিকার একটা পবিত্র আমানত।’ কিন্তু মূল শাসনতন্ত্রের অন্যান্য ধারায় সার্বভৌমত্ব সম্পর্কে যেসব কথা বলা হয়েছে, সেগুলাের প্রেক্ষিতে ভূমিকায় উল্লিখিত মন্তব্য যে অর্থহীন, তা কারাে পক্ষে অস্বীকার করার উপায় নেই। কেননা, মূল শাসনতন্ত্রে পরিষ্কার বলা হয়েছে, জাতীয় পরিষদ সার্বভৌম ক্ষমতার অধিকারী। এসব কারণে সম্ভবত শাসনতন্ত্রের খসড়া প্রকাশিত হওয়ার পর জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরাও ১৯৫৬ সালের জানুয়ারি মাসে এর বিরুদ্ধে সমালােচনা করে এবং এ ব্যাপারে তাদের অসন্তোষ প্রকাশ করে। তাছাড়া মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে যেসব মৌলিক দাবীদাওয়া ও সুপারিশ পেশ করেছিলেন, শাসনতন্ত্র প্রণেতারা তার তেমন কিছুই গ্রহণ করেননি। এত কিছু সত্ত্বেও শাসনতন্ত্র অনুমােদিত হওয়ার পর জামাত নেতা ও তাঁর দলবল এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে ওঠেন। তাঁরা শাসনতন্ত্রে বিভিন্ন ধারার মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে নিজেদের পরাজয়কে লােকচক্ষুর আড়াল রাখার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত করায় মেতে ওঠেন। এ সম্পর্কে জামাতে ইসলামীর মজলিসে শূরার একটি ঘােষণা উর্দু দৈনিক তসনিমের ১৯৫৬ সালের ২০ মার্চ সংখ্যায় প্রকাশ করা হয়। তাতে বলা হয়, “দেড়শ’ দু’শ’ বছর কুফরীর প্রভাব থাকার পর এই প্রথমবার আমাদের শাসনতন্ত্র ও আইনে। আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব ও তাঁর ধর্মের আইনানুগ প্রাধান্য স্বীকৃত হলাে।’
১৯৫৬ সালের ২৩ মার্চ মওলানা মওদুদী এক ভাষণ দেন। তাতে তিনি শাসনতন্ত্রকে স্বাগত জানিয়ে বলেন, “শাসনতন্ত্র দিবস আমাদের জাতীয় ইতিহাসে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিন। এদিন থেকে আমরা এরূপ একটি স্বাধীন জাতি হিসেবে জীবনারম্ভ করছি, যে আইনগতভাবে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়েছে, ক্ষমতা তাঁর তরফ থেকে পবিত্র আমানতস্বরূপ মেনে নিয়ে তা প্রয়ােগের জন্য তাঁর নির্ধারিত বিধিবিধান অনুসরণ করার ব্রত গ্রহণ করেছে। আর বিশ্বের সকল জাতির মধ্যে আমরাই একমাত্র জাতি, যে নিজের শাসনতন্ত্রের ভূমিকায় এ ঘােষণা সংযােজিত করেছে—আমরা গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সাম্য, ইনসাফ ও সামাজিক ন্যায়নীতির সে পরিকল্পনাই বাস্তবায়িত করবাে যা ইসলাম আমাদের দিয়েছে।” মওলানার এই বিবৃতি পাকিস্তানের জাতীয় সংবাদপত্রগুলােতে প্রকাশ। করা হয়। অসংখ্য পােস্টারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। তাতে করে জনসাধারণকে বুঝানাে হয়, সত্যি সত্যি শাসনতন্ত্রে আল্লাহ তায়ালার সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। অথচ মূল শাসনতন্ত্রে তার কোনাে উল্লেখ নেই। তাতে জনসাধারণের সার্বভৌমত্বই স্পষ্টরূপে স্বীকৃত হয়েছে। পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, যে বাক্যটি থেকে মওলানা মওদুদী ও তার অনুসারীরা এ ধরনের অর্থ নিয়েছেন তা শাসনতন্ত্রের মূল ধারার নয়। এটা আদর্শ প্রস্তাব ও শাসনতন্ত্রের ভূমিকার অংশবিশেষ। এ বাক্যটিকে নিজেদের স্বার্থের সহায়ক হিসেবে । যতই টানাহেঁচড়া করে থাকুন না কেন, কিন্তু এটা যে শাসনতন্ত্রের মূল ধারার সম্পূর্ণ বিপরীত তা মওদুদী সাহেবদের পক্ষেও অস্বীকার করার উপায় নেই। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে জামাতে ইসলামীর দাবীদাওয়া সংযােজিত হওয়া সত্ত্বেও কেন তারা একে স্বাগত জানিয়েছিলেন? প্রথমে খসড়া শাসনতন্ত্রের বিরূপ সমালােচনা করে এবং অনুমােদিত হওয়ার পর কেন তারা এর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছিলেন? মওদুদী সাহেব জেনেশুনে কেন এর অপব্যাখ্যা করেছিলেন? ১৯৫৩ সালে কাদিয়ানী দাঙ্গা, লাহােরে সামরিক আইন জারি ও তার পরবর্তীকালে মওলানার ভূমিকা থেকেই এর পরিষ্কার জবাব পাওয়া যায়। এ সময়ের পর থেকে মওলানা যেকোন বিষয়ে ক্ষমতাসীন সরকারের সাথে সরাসরি সংঘর্ষ এড়িয়ে চলার নীতি গ্রহণ করেন। ফলে ১৯৫৩ সালের পূর্বেকার দীর্ঘ কর্মজীবনের তথাকথিত অনেক ইসলামী ব্যাখ্যা-বিবৃতিই তাঁকে বিসর্জন দিতে হয়।
দৃষ্টান্তস্বরূপ উল্লেখ করা যায়, এককালে তিনি গণতন্ত্রকে ইসলামের শত্র, অভিশপ্ত-আরাে কত কি বলতেন! কিন্তু ১৯৫৩ সালের পর এই মওলানা মওদুদীই ‘গণতন্ত্র ইসলামের সারকথা’ ইত্যাদি বলতে আরম্ভ করেন। ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রের বেলায়ও মওলানা ও তাঁর জামাত হুবহু এই নীতিই অনুসরণ করেছিলেন। শাসনতন্ত্রের খসড়া পর্যায় পর্যন্ত এর কড়া সমালােচনা করেন। কিন্তু অনুমােদিত হওয়ার পর তিনি এ ব্যাপারে সকল প্রকার মতবিরােধ ধামাচাপা দিয়ে সরাসরি সংঘাত এড়িয়ে যান। শাসনতন্ত্রকে সানন্দে গ্রহণ করেন। জনসাধারণকে ধোঁকা দেয়ার জন্য শাসনতন্ত্রের মনগড়া ব্যাখ্যা দেয়ার নীতি গ্রহণ করেন। আপনারা হয়তাে স্বাধীন বাংলাদেশে বর্তমানে পাকিস্তানের মৃত শাসনতন্ত্র সম্পর্কে আলােচনার প্রয়ােজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন তুলবেন। আমিও আপনাদের সাথে এ ব্যাপারে দ্বিমত পােষণ করি না। তারপরও এই আলােচনার লক্ষ্য হচ্ছে, ইসলামের মুখােশধারী জামাতের আসল চেহারার একটা দিক তুলে ধরা। ক্ষমতাসীনদের সাথে বৈরিতা এড়ানাের জন্য জামাত কিভাবে ইসলামের মনগড়া ব্যাখ্যা করে, এই সংক্ষিপ্ত আলােচনায় তার কিছুটা চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করা হয়েছে। গত ক’বছর থেকে জামাতের যে সরকার-বিরােধী ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন, এটা তার অভিনয় ছাড়া কিছু নয়। নিজেদের কালাে অতীতকে ধামাচাপা দেয়াই হাচ্ছ, তাদের এই অভিনয়ের মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। নতুবা অতীতে যেমন ক্ষমতাসীনদের সাথে তাদের যােগসাজশ ছিলাে, আজো রয়েছে। আমাদের এই বক্তব্যের বাস্তব প্রমাণ হছে, গত ক’বছরের আন্দোলনে এতাে রক্ত ঝরা সত্ত্বেও জামাতীদের একজন কর্মীরও কিছু হয়নি। মির্টিং-মিছিলে তাদের কেউ নিহত কিংবা আহত হয়নি। হরতাল ও মিটিং-মিছিলের যেখানে সংঘর্ষ হয়েছে, জামাতীদের সেখানে দেখা যায়নি। মওলানা মওদুদী ও তার জামাত সেই সুদূর অতীত থেকে পবিত্র ইসলামের মুখােশ পরে কায়েমী। স্বার্থের লেজুড়বৃত্তি করার যে ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করে আসছিলেন, বাংলাদেশেও তা অনুসরণ করা হচ্ছে। তবে দেশের সাধারণ মানুষের চোখে ধূলা দেয়ার উদ্দেশ্যে তারা পাতানাে বিরােধিতার ভূমিকা গ্রহণ করেছে। আমাদের এই অভিমতের বাস্তব দৃষ্টান্ত হচ্ছে তৃতীয় জাতীয় সংসদ থেকে দশজন জামাতী সদস্যের একযােগে পদত্যাগ। জনশ্রুতি আছে, একটি বিশেষ মহলের ইঙ্গিতে তারা সেবার জাতীয় সংসদ থেকে একযােগে পদত্যাগ করে। নতুবা এ সময়ে পদত্যাগের কোন যৌক্তিকতা ছিলাে না।
মহিলাদের অধিকার ও জামাত
জামাতিরা সব সময় প্রচার করে বেড়ায়, দেশে ইসলামী সমাজব্যবস্থা কায়েম করাই তাদের চরম ও পরম লক্ষ্য। কিন্তু তাদের এ প্রচারণা ও কর্মধারায় কোনাে সাদৃশ্য নেই বললে অত্যুক্তি করা হবে না। মূলত তাদের নীতি বলতে কিছুই নেই। সময় ও সুযােগ বুঝে তারা যেকোন রূপ ধারণ করতে পারে। তবে এই পরিবর্তনে একটা বিষয় লক্ষণীয় হলাে, ইসলামী মুখােশটা সকল সময় ও অবস্থায় তাদের মুখে থাকে। এটা ভুলেও কোন সময় ছাড়ে না। ধর্মের তথাকথিত ছদ্মাবরণেই তারা সবসময় বাজিমাৎ করার চেষ্টা করে। আমাদের এ দাবির একাধিক প্রমাণ আপনারা বিগত অধ্যায়গুলােতে দেখতে পেয়েছেন। এ ধরনের আর একটা দৃষ্টান্ত হলাে পাকিস্তানে ১৯৬৫ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেবার মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থিনীর সপক্ষে তারা যে অভিনয় করেছে তা পূর্ববর্তী সকল রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। মওলানা মওদুদী ১৯৬৫ সালের নির্বাচনের কিছুদিন পূর্ব পর্যন্ত তাঁর একাধিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণে বলে এসেছেন মহিলা সমাজকে রাজনীতিতে টেনে আনা, আইন পরিষদের সদস্য হওয়ার অধিকার দেয়া, এমনকি কোনাে দায়িত্বপূর্ণ সরকারী পদে নিয়ােগ করাও ইসলামের মূলনীতিবিরােধী। তিনি বলতেন, এটা পাশ্চাত্য জগতের অন্ধ অনুকরণ বই কিছু নয়। | মওলানা বলেছেন, “আইন পরিষদগুলােতে মহিলাদের সদস্য হওয়ার অধিকার দেয়া হলাে পাশ্চাত্য জাতিসমূহের অন্ধ অনুকরণ। ইসলামের নীতিমালা এর এতটুকু অনুমতি দেয় না। ইসলামের রাজনীতি ও দেশের প্রশাসনিক দায়িত্ব কেবলমাত্র পুরুষের উপরই ন্যস্ত। এসব দায়িত্ব মহিলাদের কর্মক্ষেত্রের বাইরে। তিনি বলেছেন, “পবিত্র কোরআনের স্পষ্ট নির্দেশ থাকার পরও এ কথার কী অবকাশ আছে যে, মুসলিম মহিলারা কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের সদস্য হবে? ঘরের বাইরে সামাজিক তৎপরতায় দৌড়াদৌড়ি করবে, সরকারী দফতরে পুরুষের সাথে কাজ করবে, কলেজগুলােতে ছেলেদের সাথে শিক্ষাগ্রহণ করবে, পুরুষদের হাসপাতালে নার্সিয়ের দায়িত্ব পালন করবে, বিমান ও রেলকারে যাত্রীদের মনােরঞ্জনে ব্যবহৃত হবে এবং শিক্ষাদীক্ষার উদ্দেশ্যে আমেরিকা-ইংল্যান্ড যাবে ?”২ . উপরােক্ত উদ্ধৃতি দুটোর প্রথমটি তাে একেবারে স্পষ্ট। তার ব্যাখ্যা নিষ্প্রয়ােজন।
দ্বিতীয় উদ্ধৃতিটি মওলানা মওদুদী রচিত তাফহিমুল কোরআন থেকে সংকলিত। তিনি পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে বলেছেন, “মহিলাদের কাউন্সিল ও পার্লামেন্টের সদস্য হওয়া, ঘরের বাইরে সমাজসেবামূলক কাজে অংশগ্রহণ করা, পুরুষের সাথে চাকরি করা, সহশিক্ষা, নার্সিং প্রভৃতি ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে স্পষ্ট নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সুতরাং ইসলামের দৃষ্টিতে মহিলাদের এসব ব্যাপারে অংশ নেয়ার কোনাে অবকাশ নেই।” এ হলাে সকল মুসলিম মহিলার অধিকার সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ইসলামিক ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ বা অভিমত। মহিলাদের ব্যাপারে মওলানার বিভিন্ন গ্রন্থে এ ধরনের আরাে বহু উদ্ধৃতি রয়েছে। খােদ মিস ফাতেমা জিন্না সম্পর্কে ১৯৬১ সালে প্রদত্ত মওলানা মওদুদীর একটি ফতােয়া এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সে সময় পাকিস্তানে মার্শাল ল’ ছিলাে। মওলানা একটি ফতােয়ার উত্তরদান প্রসঙ্গে লিখেছিলেন, মিস ফাতেমা জিন্নাহকে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচন করা ইসলামের দৃষ্টিতে অবৈধ। পরে ফতােয়াটি “বিংশ শতাব্দীতে ইসলাম” (বিসবী সদি মে ইসলাম) শীর্ষক একটি পুস্তক আকারে বেরিয়েছিলাে। তাতে প্রশ্ন করা হয়েছিলাে … আজ যদি মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ রাষ্ট্রপ্রধান পদ গ্রহণ করেন তাহলে ইসলামের নীতি কি পাকিস্তানের ইসলামী সমাজ ব্যবস্থায় তার অনুমতি দেবে?” মওলানা মওদুদী উত্তরদান প্রসঙ্গে বলেছিলেন, “ইসলামী রাষ্ট্র দুনিয়ার কোন ব্যাপারেই ইসলামের নীতিমালা থেকে সরে গিয়ে কোন কাজ করতে পারে না এবং সে এরূপ ইচ্ছাও করতে পার না। … রাজনীতি, দেশের প্রশাসন ব্যবস্থাপনা ও সামরিক খিদমত এবং এ ধরনের অন্যান্য কাজ পুরুষের।… চোখ বন্ধ করে অন্যদের অজ্ঞতার অনুকরণ করা জ্ঞানের পরিচায়ক নয়।… ইসলাম নীতিগতভাবে যৌথ সমাজ ব্যবস্থার বিরােধী। … পাশ্চাত্য দেশগুলােতে এর অত্যন্ত খারাপ পরিণাম দেখা দিয়েছে। আমাদের দেশের জনসাধারণও যদি তা ভােগ করার জন্য তৈরি হয়ে থাকে, তবে তা যত ইচ্ছে করতে পারে। তাছাড়া কি প্রয়ােজন দেখা দিয়েছে যে, জোর করে ইসলামের নামে এমনসব কাজের বৈধতা বের করতে হবে যেগুলাে সে কঠোরভাবে নিষেধ করছে?
ইসলামে যুদ্ধক্ষেত্রে যদিও মহিলাদের দ্বারা আহতদের ক্ষতস্থানে পট্টি ইত্যাদি বাঁধার কাজ করানাে হয়েছে, কিন্তু এর অর্থ এই নয় যে, শান্তিকালীন অবস্থায়ও তাদের সরকারী দফতর, কারখানা, ক্লাব ও পার্লামেন্টে এনে দাঁড় করিয়ে দিতে হবে।”৩ ১৯৬১ সালে মওলানা মওদুদী এভাবে ফাতেমা জিন্নার রাষ্ট্রপ্রধান পদ গ্রহণ করার বিরােধিতা করে একটি দীর্ঘ ফতােয়া প্রদান করেছিলেন। তাঁর মতে মহিলাসমাজের কর্মক্ষেত্রই আলাদা। সুতরাং মিস ফাতেমা জিন্নার রাষ্ট্রপ্রধান পদ গ্রহণের প্রশ্নই ওঠে না। এটা হল পুরুষের কাজ। ১৯৬৪ সালে মিস ফাতেমা জিন্নার মনােনয়ন লাভের পূর্ব পর্যন্ত এ ছিলাে মহিলাদের সম্পর্কে মওলানা মওদুদীর ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। ১৯৬৪ সালের শেষদিকে জামাতে ইসলামী অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সাথে ঐক্যফ্রন্টে যােগদান করে। জামাতে ইসলামী প্রমাদ গনে, ১৯৬৫ সালের নির্বাচনে সম্মিলিত বিরােধীদলীয় প্রার্থিনী মিস ফাতেমা জিন্না হবেন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। তাতে করে জামাতে ইসলামীও ক্ষমতার বখড়া লাভ করবে। নিছক ক্ষমতার লােভে সেবার জামাতে ইসলামী মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রাথিনীকে সমর্থন করে। শুধু সমর্থনই নয়, মিস ফাতেমা জিন্নার সপক্ষে জামাতে ইসলামীর পুরাে মিশনারী নিয়ােগ করা হয়। এরূপে মওলানা মওদুদী অতীতে মহিলাদের ব্যাপারে যেসব ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়ে আসছিলেন সেগুলাে বেমালুম ভুলে যান। মহিলাদের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ অধিকার তিনি যে কোরআনের দোহাই পেড়ে হরণ করার প্রচারণা চালিয়ে আসছিলেন, ক্ষমতার মােহে সে কোরআনের নামেই মওলানা পুনরায় মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থী হওয়ার সপক্ষে প্রচারণা চালান।
১৯৬৫ সালে রাষ্ট্রপ্রধান নির্বাচনী প্রচারণায় মওলানা মওদুদী ও তাঁর জামাত মিস ফাতেমা জিন্নার সমর্থনে যেসব বিবৃতি ও ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ দিয়েছিলেন, বিভিন্ন সংবাদপত্র থেকে সংক্ষেপে এখানে তার কয়েকটি উল্লেখ করা যাক। তিনি বলেছেন, “মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাকে নির্বাচন করায় এছাড়া কোনাে অসুবিধে নেই যে, তিনি একজন মহিলা। এদিক ছাড়া আর সব গুণাবলীই তাঁর মধ্যে রয়েছে। যা একজন যােগ্য রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থীর জন্য বলা হয়েছে।”৫ মহিলার রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার ব্যাপারে কোনই বাধ্যবাধকতা নেই। মহিলার নেতৃত্বে যুদ্ধ করা কিংবা হজ করা অবৈধ বলাও অন্যায়।”? আমাদের রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থী মাদারে মিল্লাত মােহতারেমা ফাতেমা জিন্নাহ প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের চাইতে হাজার গুণ উত্তম।”৬ বর্তমান অবস্থা ও পরিস্থিতিতে বিরােধী দলগুলাের পক্ষ থেকে মিস ফাতেমা জিন্নার । পরিবর্তে যদি কোনাে ন্যায়নিষ্ঠ ও খােদাভীরু পুরুষকে রাষ্ট্রপ্রধান পদপ্রার্থী হিসেবে মনােনয়ন দেয়া হতাে তবে তা হতে পাপ কাজ।”৭. জনসাধারণের এ ব্যাপারে উদাসীন থাকা উচিত নয় যে, যদি তাদের অবহেলার দরুন তাদের প্রতিনিধিরা ভুল সিদ্ধান্ত করে (মিস ফাতেমা জিন্নাকে রাষ্ট্রপ্রধান মনােনীত না করে। তবে খােদাও তাদের প্রতি অনুগ্রহ প্রদর্শন করবেন না।’ আমাদের উপর ফরজ হলাে মিস ফাতেমা জিন্নাহকে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করে বর্তমান সরকারকে নিয়মতান্ত্রিক পথে ক্ষমতাচ্যুত করা। আল্লাহ তায়ালাও এর চাইতে সুবর্ণ সুযােগ আর দান করতে পারেন না।৯ এসব হলাে মওলানা মওদুদীর উক্তি। ১৯৬৫ সালে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনী প্রচারণায় তিনি মিস ফাতিমা জিন্নার সপক্ষে এসব বলেছিলেন। মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান প্রার্থিনীর সমর্থনে মওলানার এসব বিবৃতি সে সময়কার সংবাদপত্রগুলােতে ছড়িয়ে আছে। এখানে মাত্র কয়েকটি উল্লেখ করা হলাে। বিরােধী দলগুলাে যদি ফাতেমা জিন্নাকে ছাড়া অন্য কোন ন্যায়নিষ্ঠ পুরুষকেও মনােনয়ন দান করতাে তবে তা নাকি পাপ কাজ হতাে। ফাতেমা জিন্নাকে তিনি খােদার আশীর্বাদ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি মহিলার সমর্থনে তিনি খােদার সীমাহীন শক্তিতেও আক্রমণ করেছেন। তিনি বলেছেন, “খােদা নাকি এর চাইতে সুবর্ণ সুযােগ দান করতে পারেন না।’ চিন্তা করুন, স্বার্থসিদ্ধির মােহে মওলানা মওদুদী কাহাঁতক গিয়ে পৌছেন। যদি অন্য কারাে মুখ থেকে এরূপ উক্তি বেরুতাে তাহলে সবার আগে এই মওলানাই তাকে কাফের ফতােয়া দিতেন। অপরদিকে মওলানা মওদুদী ১৯৬৪ সালে ফাতেমা জিন্নাহকে বিরােধী দলের তরফ থেকে মনােনয়ন দানের পূর্ব পর্যন্ত রাষ্ট্রপ্রধান হওয়া দূরে থাক মহিলাদের সাধারণ সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার দানেরও বিরােধিতা করেছেন।
তিনি একে কোরআন-সুন্নাহ বিরােধী ও পাশ্চাত্যের অন্ধ অনুকরণ বলে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘােষণা করেছেন। তিনি বলেছেন, কোরআন, সুন্নাহ, ইসলামের ইতিহাস ও মুসলিম স্বর্ণযুগে মহিলাদের সামাজিক ও রাজনৈতিক অধিকার দানের দৃষ্টান্ত নেই। একশ্রেণীর লােক নাকি জোর করে তা কোরআন-সুন্নাহ থেকে প্রমাণ করার চেষ্টা করে। আমাদের ভাবতেও লজ্জা লাগে, মওলানা যে মুখে দীর্ঘদিন যাবৎ এসব উক্তি করেছিলেন, স্বার্থ হাসিলের মােহে সে মুখ দিয়েই এগুলাের বিপরীত উক্তি করেন। এর পরেও কারাে পক্ষে বিশ্বাস করা কি সম্ভব, ইসলামের প্রচার ও প্রসারের জন্য মওলানা মওদুদীও বর্তমান জামাতে ইসলামী দেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণ করছেন এবং ইসলামই তাদের দলের একমাত্র আদর্শ ?
স্বাধীনতা বিরােধী তৎপরতা
সত্তরের নির্বাচনে জামাতে ইসলামী পূর্ব বাংলায় আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে অংশ নেয়। সারা পাকিস্তানে দলটির মনােনীত ২শ’ প্রার্থীর মধ্যে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে মাত্র চারজন জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত হয়। পূর্ব বাংলায় অধিকাংশ আসনে তাদের জামানত বাজেয়াফত হয়। প্রাদেশিক আমীর গােলাম আযম আওয়ামী লীগের জহিরুদ্দিনের ১ লাখ ১৬ হাজার ২০৪ ভােটের বিরুদ্ধে মাত্র ৩৫ হাজার ৫২৭টি ভােট লাভ করেন। জুলফিকার আলী ভুট্টোর তৈরি জটিলতার প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন স্থগিত ঘােষণা করার পর স্বাধীনতার দাবিতে পূর্ব বাংলায় দুর্বার আন্দোলন শুরু হয়। এ সময় অন্তর্ঘাতমূলক কৌশল নিয়ে এগিয়ে আসে জামাতে ইসলামী। পূর্ব বাংলার সপক্ষে জামাতে ইসলামী যে কোনাে ভূমিকাই নেয়নি, তার বড় প্রমাণ মওদুদীর একটি বিবৃতি। এতে তিনি আওয়ামী লীগের নিন্দা করে বলেন, “কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে যারা শাসনতন্ত্র তৈরি করতে চাচ্ছেন তাদের একথা জানা দরকার, তেমন কোনাে শাসনতন্ত্র সফল হবে না এবং সেজন্য সংখ্যাগরিষ্ঠ দলকেই দায়ী থাকতে হবে।”১ পাক দখলদার বাহিনী নিধন অভিযান শুরু করলে জামাতে ইসলামীর প্রকৃত উদ্দেশ্য নগ্নভাবে উন্মােচিত হয়ে পড়ে। নূরুল আমীনের নেতৃত্বে ৪ এপ্রিল প্রথম সুযােগেই খুনী। জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে গােলাম আযম ‘অবিলম্বে সমগ্র প্রদেশে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন। দু’দিন পর ৬ এপ্রিল গােলাম আযম পৃথকভাবে টিক্কা খানের সঙ্গে আবার দেখা করেন। এই বৈঠকে অন্য দালালদের মতাে গােলাম আযম স্বাধীনতা সংগ্রামকে ‘ভারতীয় হস্তক্ষেপ ও অনুপ্রবেশ’ হিসেবে চিহ্নিত করে বলেন, “ভারতের এই অভিসন্ধি নস্যাৎ করার জন্য প্রদেশের দেশপ্রেমিক জনগণ সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধকে অংকুরেই ধ্বংস করার পাশবিক প্রক্রিয়ায় সহযােগিতা দানের উদ্দেশ্যে ১০ এপ্রিল গঠিত ‘শান্তি কমিটি’তে জামাতে ইসলামী প্রধান ভূমিকা রাখে। এরপর ১৫ এপ্রিল গঠিত প্রাদেশিক শান্তি কমিটির তিন নম্বর সদস্য মনােনীত হন গােলাম আযম। আহ্বায়ক ছিলেন কাউন্সিল মুসলিম লীগের খাজা খয়েরুদ্দিন।৩ শান্তি কমিটির প্রথম বৈঠকে ভারতীয় ও অন্যান্য ইসলামবিরােধীদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনী সময়ােচিত প্রয়ােজনীয় ব্যবস্থা নেয়ায় গভীর সন্তোষ প্রকাশ করা হয়েছিলাে। বৈঠকের এক প্রস্তাবে “দেশপ্রেমিক নাগরিক, আইনজীবী, মসজিদের ইমাম ও মাদ্রাসার মােদাররেসদের প্রতি জনসাধারণকে কোরআন ও সুন্নাহর আদর্শে অনুপ্রাণিত করে তােলার আহ্বান জানানাে হয়, যাতে জনসাধারণ ইসলাম ও পাকিস্তানের দুশমনদের মােকাবেলা করতে পারেন এবং প্রয়ােজন হলে জেহাদে যােগ দেয়ার জন্য প্রস্তুত থাকেন। গােলাম আযমদের এই শান্তি কমিটি ২২ এপ্রিল এক বিবৃতিতে সকল দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানীর প্রতি রাষ্ট্রবিরােধী লােকদের হিংসাত্মক ও নাশকতামূলক কার্যকলাপ প্রতিরােধ এবং উদ্যম ও উৎসাহের সঙ্গে সবরকমভাবে সশস্ত্র বাহিনীকে সাহায্য করার আহ্বান জানিয়েছিলাে।”
এপ্রিলেই যুদ্ধরত বাংলাদেশের সর্বত্র শান্তি কমিটি তার স্বাধীনতাবিরােধী তৎপরতা শুরু করে। প্রতিটি জেলা ও মহকুমা পর্যায়ে জামাতে ইসলামী এর নেতৃত্ব দখল করে। পিডিপি ও মুসলিম লীগের সঙ্গে একযােগে জামাতের দালালরা পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে গ্রামে গ্রামে পথ দেখিয়ে নিয়ে যেতাে। মানুষের গরু-খাসিসহ অর্থ-সম্পদ লুট করতাে, মুক্তিযােদ্ধাদের বাড়িঘর পুড়িয়ে দিতাে, নারী নির্যাতনেও সহায়তা করতাে। পাকিস্তান রক্ষায় তাদের এই ভূমিকা পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সন্তুষ্ট করে। জেলা ও মহকুমা শহরগুলােতে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সহযােগিতার জন্য জেনারেল টিক্কা খানের মতাে খুনীও তাদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়েছেন। এ প্রসঙ্গে দু’একটি উদাহরণ পরিস্থিতি অনুধাবনে সহায়ক হবে। রাজশাহীতে গবর্নর হিসেবে টিক্কা খান সফরে গেলে শান্তি কমিটির পক্ষ থেকে তাকে জানানাে হয়, সারা রাজশাহী বিভাগে গােলযােগ সৃষ্টিকারীদের নির্মূল করা হয়েছে।’ জবাবে টিকা খানও জনগণের মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে তাদের উত্তম কাজের প্রশংসা করেন। টিক্কা খান ‘গােলযােগ সৃষ্টিকারীদের উপস্থিতির কথা কর্তৃপক্ষকে জানাবার জন্য তাদের আহ্বান জানান, যাতে করে আইন ও শৃংখলা রক্ষাকারী এজেন্সীগুলাে তাদের বিরুদ্ধে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে। ৫ অন্য এক উপলক্ষে রংপুরে ‘গােলযােগ সৃষ্টিকারীদের নির্মূল এবং শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কাজে সহায়তা করার জন্য শান্তি কমিটি যে প্রচেষ্টা চালাচ্ছেন টিক্কা খান তার ‘প্রশংসা করেন। শান্তি কমিটির ভূমিকা সম্পর্কে টিক্কা খান বলেন, “তারা প্রদেশে সর্বত্র শান্তি বজায় রাখা এবং জনগণের আস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার কাজে সহায়তা করার জন্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রচেষ্টা চালাচ্ছে।” পত্রিকার একই প্রতিবেদনে রয়েছে, দিনাজপুরে শান্তি কমিটির সভাপতি গভর্নরকে জানান, সামরিক ও বেসামরিক কর্তৃপক্ষের আন্তরিক প্রচেষ্টার সুফল পাওয়া গেছে।৬
স্বাধীনতা যুদ্ধের সেই দিনগুলােতে খুনী জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলাে জামাতে ইসলামী। ১৪ আগস্ট পাকিস্তানের ‘আজাদী দিবস উদ্যাপন উপলক্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হলে নূরুল আমীনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এক সিম্পােজিয়ামে পরিস্থিতি পর্যালােচনাকালে গােলাম আযম বলেন, “কিন্তু এবার পাকিস্তানের ভেতরে হাজারাে দুশমন সৃষ্টি হয়েছে। তাই এবারের সংকট কঠিন। কারণ বাইরের দুশমনের চেয়ে ঘরে ঘরে যেসব দুশমন রয়েছে তারা অনেক বেশি বিপজ্জনক।” ( ১৬ আগস্টের দৈনিক পাকিস্তানে বলা হয়েছে, “সেনাবাহিনী ও শান্তি কমিটির মধ্যে যােগসূত্র প্রতিষ্ঠার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরােপ করে জামাত নেতা গােলাম আযম) বলেন, “বিচ্ছিন্নতাবাদীদের হাত থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য শান্তি কমিটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। শান্তি কমিটি যদি দুনিয়াকে জানিয়ে না দিত যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ দেশকে অখণ্ড রাখতে চায়, তবে পরিস্থিতি হয়তাে অন্যদিকে মােড় নিত।” তিনি বলেন, “দেশকে রক্ষা করার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর। তাই দেশের মানুষকে বােঝানাের দায়িত্ব শান্তি কমিটির হাতে তুলে নিতে হবে। এছাড়া ঘরে ঘরে যেসব ‘দুশমন’ রয়েছে। তাদেরকে খুজে বের করার ওপরও তিনি গুরুত্ব আরােপ করেন। প্রতিবেদনে আরাে বলা হয়, “দেশপ্রেমিকদের উদ্দেশ করে অধ্যাপক গােলাম আযম বলেন, পাকিস্তান টিকে থাকলে আজ হােক কাল হােক বাঙ্গালী মুসলমানদের হক আদায় হবে। কিন্তু আজাদী ধ্বংস হলে মুসলমানদেরকে শৃগাল-কুকুরের মত মরতে হবে।”
স্বাধীনতা সংগ্রাম এবং স্বাধীনতাকামী জনগণের প্রতিরােধ যত তীব্র হতে থাকে জামাতিরা মিথ্যের আশ্রয় তত বেশি নিতে থাকে। ১৯ মে পূর্ব পাকিস্তান জামাতের সাধারণ সম্পাদক আবদুল খালেক ও শ্রম সম্পাদক মােহাম্মদ শফিউল্লাহ এক যুক্ত বিবৃতিতে স্বদেশের পবিত্র মাটি থেকে পাকিস্তানবিরােধীদের উৎখাত করার আহবান জানান। তারা বলেন, “আল্লাহর মেহেরবানীতে পাকিস্তান বিরােধী দুষ্কৃতকারী ও বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ত্রাসের রাজত্ব খতম হয়েছে এবং পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে।” গণহত্যার রক্তস্রোতে যখন নদীমাতৃক বাংলা রঞ্জিত, নির্যাতিত-লাঞ্ছিত এদেশের অনেক পবিত্র মা-বােনেরা, তখন ৮ জুলাই জামাতের জেনারেল সেক্রেটারী আবদুল খালেক এক বিবৃতিতে সন্তোষ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, “সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারী ও স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানকে গ্রাস করার ভারতীয় চক্রান্ত জনগণ পুরােপুরিভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে।” থেie) | মুক্তিযােদ্ধাদের পাকিস্তানের শক্র ও দুষ্কৃতকারী’ বলে আখ্যায়িত করেন জামাত প্রধান মওলানা আবুল আলা মওদুদী। ১০ জুলাই ‘৭১ লাহােরে পাকিস্তানের এই সংকটকালে জনসাধারণকে আল্লাহ ও রাসুলে করীমের পথে অবিচল থাকার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, “অন্যথায় শক্র ও দুষ্কৃতকারীদের চক্রান্ত নির্মূল করা সম্ভব নাও হতে পারে।” ১৩ জুলাই রংপুরে জামাতের ভারপ্রাপ্ত আমীর মিয়া তােফায়েল মােহাম্মদ মুক্তিযােদ্ধাদের দুষ্কৃতকারী ও পাকিস্তানের শত্রু বলে নিন্দা করেন এবং তাদেরকে খতম করার আহবান জানান। ১৫ জুলাই মিয়া তােফায়েল পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর এবং বেলুচিস্তানের কসাই’ নামে কুখ্যাত লেঃ জেনারেল টিক্কা খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন গবর্নর হাউসে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন গােলাম আযম। এরপর ১৭ জুলাই কুষ্টিয়ায় মিয়া তােফায়েল সমাজবিরােধী ব্যক্তিদের মুক্তিকামী জনগণকে) দমন করে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে সেনাবাহিনীর উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। ১৯ জুলাই করাচী ফিরে গিয়ে মিয়া তােফায়েল বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে দ্রুত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসছে। বিদ্রোহ ও বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন সম্পূর্ণরূপে নির্মূল হয়েছে। কিন্তু ‘বিদ্রোহ’ নির্মূল হয়নি। মুক্তিযােদ্ধাদের হানা তীব্রতর হচ্ছিলাে। ২৫ জুলাই পূর্ব পাকিস্তান জামাতে ইসলামীর জেনারেল সেক্রেটারী এবং কেন্দ্রীয় শান্তি কমিটির কার্যনির্বাহক সদস্য আবদুল খালেক এক বিবৃতিতে তা স্বীকার করেন।
তিনি সীমান্ত এলাকা বরাবর ভারতের বিরামহীন উস্কানিমূলক তৎপরতার তীব্র নিন্দা করেন। এর চারদিন পরের বিবৃতিতে বােঝা যায় গােলাম আযম মুক্তিযােদ্ধাদের ওপর কি পরিমাণ রুষ্ট ছিলেন। ১৮ আগস্ট লাহােরে তিনি বলেন, “ভারত দুষ্কৃতকারীদের (‘৭১ সালে পাকিস্তানীদের ভাষায় মুক্তিযােদ্ধারা ছিলেন দুষ্কৃতকারী) সাহায্য করছে। তাই পাকিস্তানের উচিত কালবিলম্ব না করে ভারত আক্রমণ করা এবং আসাম দখল করা।” লাহােরে গােলাম আযম গিয়েছিলেন জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কমিটির অধিবেশনে দেশের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালােচনার জন্যে আহূত বৈঠকে যােগ দিতে। ১৯ আগষ্ট দলের সদর দফতরে আয়ােজিত এই বৈঠকে নায়েবে আমীর মওলানা আবদুর রহিম সভাপতিত্ব করেন। বৈঠকে ‘৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন, ‘৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রস্তাবিত উপনির্বাচন, পাকিস্তানের ভাবী শাসনতন্ত্র, পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে কতিপয় বিদেশী শক্তির হস্তক্ষেপ, পূর্ব পাকিস্তানের বাস্তুহারা (ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী) লােকদের পুনর্বাসন ইত্যাদি বিষয় আলােচিত হয়। ২০ আগস্টের অধিবেশনে জামাত ভারতের অব্যাহত উস্কানি ও শত্রুতামূলক আচরণের প্রেক্ষিতে জেহাদের জন্যে সর্বাত্মক প্রস্তুতির আহবান জানায়। অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের আমীর গােলাম আযম ও সেক্রেটারী জেনারেল আবদুল খালেক বক্তৃতা করেন। স্বাধীনতা সংগ্রাম সম্পর্কে ২৩ আগস্ট গােলাম আযম লাহােরে বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটছে তা ভারত ও তার চরদের ষড়যন্ত্রেরই ফল। একমাত্র ইসলামের শক্তিই দেশের অখণ্ডতা রক্ষা করতে পারে।” তিনি বলেন, ‘যারা জামাতে ইসলামীকে দেশপ্রেমিক সংস্থা নয় বলে আখ্যায়িত করছে তারা হয় জানে না বা স্বীকার করার সাহস পায় না যে, ইসলামের আদর্শ তুলে ধরা এবং বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরােধিতা করার জন্যই কেবল পূর্ব পাকিস্তানে জামাতের বিপুল সংখ্যক কর্মী দুষ্কৃতকারীদের হাতে প্রাণ হারিয়েছে।” জামাতের এই অধিবেশনে পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক অর্থনৈতিক জীবনধারা পুনরুদ্ধার, মিলিতভাবে ‘দুষ্কৃতকারীদের নির্মূল করার ব্যাপারে পূর্ব পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে সহযােগিতা করার জন্যে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আবেদন জানান হয়। ( ৩১ আগস্ট গােলাম আযম হায়দরাবাদের এক সাংবাদিক সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যপদে নতুন করে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দাবি জানান।
এ প্রসঙ্গে গােলাম আযম বলেন, ‘বেআইনী ঘােষিত আওয়ামী লীগের টিকেটে নির্বাচিত ও সরকার কর্তৃক বহাল ঘােষিত ৮৮জন সদস্যের অধিকাংশই পাকিস্তানে নেই। তিনি বলেন, বর্তমান মুহূর্তের আশু প্রয়ােজন হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানে দেশপ্রেমিক ও ইসলামপ্রিয় লােকজনের হাত শক্তিশালী করা। এসব লােক পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে ব্যাপকভাবে সাহায্য করছে এবং “দুষ্কৃতকারীদের রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপ ও ‘বিদ্রোহীদের দমনে সেনাবাহিনী ও প্রশাসনকে পূর্ণ সহযােগিতা দান করছে। অধ্যাপক গােলাম আযম দেশকে খণ্ড-বিখণ্ড হওয়ার হাত থেকে রক্ষার জন্যে সেনাবাহিনীর ভূয়সী প্রশংসা করে বলেন, ‘পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি দ্রুত স্বাভাবিক হয়ে আসছে। পরদিন গােলাম আযম পূর্ব পাকিস্তানের সকল বিচ্ছিন্নতাবাদী রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘােষণা করা এবং তাদের নেতৃবৃন্দকে শান্তি দেয়ার দাবি জানান। তিনি এ প্রসঙ্গে ভাসানী ন্যাপ, আতাউর রহমান খানের জাতীয় লীগ, ওয়ালী খান ন্যাপের পূর্ব পাকিস্তান শাখার নাম উল্লেখ করেন। তাঁর মতে এসব দলের সদস্যরা এখনাে পূর্ব পাকিস্তানে গােপন তৎপরতা চালাচ্ছে এবং জনগণের মধ্যে হতাশার ভাব সৃষ্টি করছে। অধ্যাপক গােলাম আযম বলেন, “কোন ভালাে মুসলমানই তথাকথিত “বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারে না।’ তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্যে একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন।’ রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছে বলে তিনি উল্লেখ করেন। ৩ সেপ্টেম্বর পাকিস্তান জামাতের ডেপুটি আমীর মওলানা মুহম্মদ আবদুর রহীম, পূর্ব পাক জামাতের আমীর অধ্যাপক গােলাম আযম ও সাধারণ সম্পাদক এক যুক্ত বিবৃতিতে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর পদে ডাঃ এ এম মালিকের নিয়ােগকে অভিনন্দিত করেন এবং সরকারকে পূর্ণ সহযােগিতার আশ্বাস দেন। ৬ সেপ্টেম্বর ঢাকা শাখা জামাতের সাধারণ সম্পাদক এক বিবৃতিতে যথাযােগ্য মর্যাদার সঙ্গে ৬ সেপ্টেম্বর পাকিস্তানের প্রতিরক্ষা দিবস’ পালনের জন্য শাখাগুলােকে নির্দেশ দেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘এদিন আমাদের পাকিস্তানের সংহতি ও অখণ্ডতার জন্য শপথ নিতে হবে।’
১০ সেপ্টেম্বর গােলাম আযম এক বিবৃতিতে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশের বিরােধিতা করার জন্যে গঠিত পাকিস্তানী প্রতিনিধিদলটি গঠনের সমালােচনা করে বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতির গুরুত্বের প্রেক্ষিতে প্রতিনিধিদলটি যথাযােগ্যভাবে গঠিত হয়নি। তিনি বলেন, ‘প্রতিনিধিদলের তালিকায় হামিদুল হক চৌধুরী, বিচারপতি (অবঃ) এ কে এম বাকের, মৌলবী ফরিদ আহমদ, বিচারপতি হামুদুর রহমান, ডঃ সৈয়দ সাজ্জাদ হােসেন, এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, খান এ সবুর, ফজলুল কাদের চৌধুরীর মত ব্যক্তিদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত ছিলাে। ১৭ সেপ্টেম্বর অপরাত্নে পূর্ব পাকিস্তানের গবর্নর ডাঃ মালেক ১০ সদস্যের মন্ত্রী পরিষদের ৯ জনের শপথ গ্রহণ করান। এরা এর আগে কখনাে মন্ত্রিত্ব করেননি। মন্ত্রীদের মধ্যে ২ জন ছিলেন জামাতে ইসলামীর আব্বাস আলী খান (বর্তমানে বাংলাদেশ জামাতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর) এবং জামাত নেতা মওলানা এ কে এম ইউসুফ। ২০ সেপ্টেম্বর অধ্যাপক গােলাম আযম এক বিবৃতিতে গবর্নরের মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের এক আন্তরিক অভিনন্দন জানান। ২৪ সেপ্টেম্বর জামাত মন্ত্রী পরিষদের সদস্যদের এক সংবর্ধনা দেয়। এখানে গােলাম আযম বলেন, ‘জামাতের কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়।’ ২১ সেপ্টেম্বর গােলাম আযম এক বিবৃতিতে উদ্বাস্তুদের (ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী পূর্ব পাকিস্তানী) জীবন নিয়ে ছিনিমিনি না খেলতে এবং তাদের দেশে প্রত্যাবর্তনের সুযােগ দানে ভারতকে বাধ্য করার
জন্যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের প্রতি আকুল আবেদন জনান। জাতীয় পরিষদের তথাকথিত উপনির্বাচনে বিনাপ্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ায় পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের বন্ধু ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের কাছ থেকে বহু চিঠি ও তারবার্তা পাওয়ার তথ্য জানিয়ে ১৪ নভেম্বর এক বিবৃতিতে অধ্যাপক গােলাম আযম বলেন, “খাঁটি গণতান্ত্রিক পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। এ পরিবেশে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা আমার দেশ শাসিত হােক তা দেখার জন্য আমি অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে অপেক্ষা করছি।” S ২২ নভেম্বর গােলাম আযম পশ্চিম পাকিস্তানের উদ্দেশ্যে ঢাকা ত্যাগ করেন। ২৩ নভেম্বর লাহােরে তিনি রাজনৈতিক দলাদলি ভুলে গিয়ে কার্যকরভাবে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্যে রাজনৈতিক দলগুলাের প্রতি আহবান জানান। লাহােরে তাঁকে দেয়া এক সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে তিনি একথা বলেন। দলের কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় যােগদানের উদ্দেশ্যে তিনি লাহােরে যান। পূর্ব পাকিস্তান থেকে গােলাম আযমের এটা ছিলাে শেষ যাওয়া—হয়তাে কর্মীদের পরিত্যাগ করে পলায়ন। তাঁর সঙ্গে ছিলেন মওলানা আবদুর রহীম ও মওলানা এ কে এম ইউসুফ। গােলাম আযম এর দীর্ঘ সাত বছর পর বাংলাদেশে প্রবেশ করতে সক্ষম হন ‘৭৮ সালের ১১ জুলাই। ২৭ নভেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে গােলাম আযম বলেন, পূর্ব পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ লােক ভারতের বিরুদ্ধে শেষ পর্যন্ত লড়ে যাবে এবং তাদের পবিত্র মাতৃভূমির এক ইঞ্চি জমিও ভারতকে দখল করে নিতে দেবে না।’ ২ ও ৩ ডিসেম্বর গােলাম আযম সম্পর্কে সর্বশেষ সংবাদ প্রকাশিত হয়। এপিপির খবরে লাহাের থেকে বলা হয়, ১ ডিসেম্বর রাওয়ালপিন্ডিতে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে লাহােরে ফিরে এসে গােলাম আযম বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ কখনাে তাদের দাবির প্রতি মিসেস গান্ধীর সমর্থন চায়নি।’ এক প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক আযম বলেন, পাকিস্তানের অস্তিত্বের জন্যে অবিলম্বে ভারতের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘােষণা করা উচিত।’
এ পর্যন্ত উপস্থাপিত তথ্য ও ঘটনাবলীর ভিত্তিতে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রশ্নে জামাতে ইসলামী কেবল বিরােধী অবস্থানই নেয়নি, একে সমূলে নস্যাতের জন্যও দলটির প্রচেষ্টা ছিলাে সর্বাত্মক। জামাতের জন্মকালে জনগণের বিরুদ্ধে শাসক ও শােষকগােষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার যে ন্যক্কারজনক নীতি মওদুদী অবলম্বন করেছিলেন তা-ই পরবর্তীকালে জামাতে ইসলামীকে প্রভাবিত রেখেছিলাে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার মধ্যেও তারা একই কারণে পেয়েছিলাে ভারতীয় আধিপত্য, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্রের আতঙ্ক। একাত্তরে দলীয় ভূমিকার কারণ ব্যাখ্যা করে ১৯৭৮ সনের মে মাসে প্রকাশিত ‘জামায়াতের আবেদন’ পুস্তিকায় জামাতে ইসলামী বলেছে, “পাকিস্তান ভেঙে যাক এটা অবশ্যই জামাত চায়নি। কেননা সে সময় জয় বাংলা ও সমাজতন্ত্রের শ্লোগানই প্রধান ছিল। ‘নারায়ে তকবীর আল্লাহু আকবর’ তখন শােনা যায়নি। আর এজেন্যই তখন ভারতের আধিপত্যের ভয়ে এবং ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ ও সমাজতন্ত্রের আতঙ্কে স্বাধীনতা সংগ্রামকে ইসলাম ও মুসলমানদের জন্য মঙ্গলজনক হবে বলে (জামাত) বিশ্বাস করতে পারেনি।”
লক্ষণীয় যে, জামাতে ইসলামী গাঁয়ে না-মানা মােড়লের মতাে ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণের ধুয়া তুলে স্বদেশের নির্যাতিত ও শােষিত জনগণের স্বার্থের প্রশ্নটিকেই এড়িয়ে গেছে। যুক্তি হিসেবে প্রাধান্যে আনতে চেয়েছে রাজনৈতিক মতপার্থক্যের বিষয়টি। আসলে বাঙ্গালী জনগােষ্ঠীর প্রতি জামাতের আদৌ মমত্ব ছিলাে না। তারা পশ্চিম পাকিস্তানকেন্দ্রিক বিজাতীয় শাসক-শােষকদের স্বার্থ রক্ষা করার মধ্য দিয়ে তল্পীবহনের মওদুদীয় নীতিকে অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলাে।sanity | স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন না করাটা অন্যায় হলেও মারাত্মক ‘অপরাধ’ নয় সত্য, কিন্তু একাত্তরে জামাতে ইসলামী তার ভূমিকাকে এমনিতর নীতিগত প্রশ্নেই শুধু সীমাবদ্ধ রাখেনি। ইতিহাসের পর্যালােচনা বরং এই সত্যই তুলে ধরে যে, বিরােধিতার নামে স্বাধীনতা সংগ্রামকে নির্মূল করার চেষ্টার পাশাপাশি নৃশংসতার সাথে জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের উৎখাতেরও ভয়ংকর কর্মসূচী নিয়ে জামাতিরা এগােতে শুরু করেছিলাে। এজন্যই তারা রাজাকার ও বদর বাহিনী তৈরি করেছে, শান্তি কমিটিতে যােগদান সহ সর্বতােভাবে সমর্থন ও সহযােগিতা দিয়েছে পাকিস্তানের খুনী সেনাবাহিনীকে। বুদ্ধিজীবী থেকে শুরু করে শিক্ষিত বাঙ্গালী মাত্রকেই হত্যা করার সুপরিকল্পিত কার্যক্রম এবং মন্ত্রিত্বের সুযােগ নিয়ে শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের উদ্যোগও ছিলাে এই দৃষ্টিকোণ থেকেই উদ্ভাবিত। শােষণ ও শাসনের স্থায়ী পদানত অঞ্চল হিসেবে বাংলাদেশকে রূপান্তরিত করার যে প্রক্রিয়া পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকে চলে আসছিলাে, ইসলাম এবং মুসলিম জাতীয়তার নামে জামাতে ইসলামী স্বাধীনতা যুদ্ধকালে তাকে চূড়ান্ত রূপ দেয়ার উদ্ধত পদক্ষেপ নিয়েছিলাে। বাঙ্গালী জাতিসত্তার বিনাশ ছিলাে জামাতের সকল আয়ােজনের উদ্দেশ্য। | শঠতা, সুবিধাবাদ, স্ববিরােধিতা এবং নাশকতার প্রবণতা সব সময় জামাতের রাজনীতিকে প্রভাবিত করে এসেছে। মুক্তিযুদ্ধকালীন ভূমিকা সম্পর্কে জামাতিরা একদিকে বলছে, “একাত্তর সালে আমরা যা করেছি, ঠিকই করেছি।”অপরদিকে বলছে, “তাই বলে টিক্কা খানের সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে রক্ষা করার নামে যতাে অমানবিক কাজ করেছে, তা কখনই জামাত সমর্থন করেনি।”৮
সত্যি, জামাতিদের মুখে এসব কথা শুনলে হাসি পায়। মূলত বাঙ্গালী জাতিসত্তাকে জামাত কোনদিনই মেনে নিতে পারেনি। একাত্তরে তাই প্রথম সুযােগেই স্বাধীনতাবিরােধী অবস্থান নেয়ার সাথে সাথে জাতি হিসেবে বাঙ্গালীদের সমূলে উৎখাতেরও সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় জামাত নিজেকে নিয়ােজিত করেছিলাে। ইসলাম এবং মুসলিম জাতীয়তাবাদের নামে প্রতিষ্ঠাকাল থেকেই দলটি জনগণবিরােধী প্রতিক্রিয়াশীল শিবিরে অবস্থান গ্রহণের ধ্বংসাত্মক নীতিকে অব্যাহত রেখেছে। ইংরেজ আমল থেকে শুরু করে পাকিস্তানী। ক্ষমতাসীনদের পদলেহন ছিলাে রাজনীতির নামে এর কর্মকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য। বিশেষ করে, বাঙ্গালীর জাতিগত ঠিকানা এবং স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধ পর্যন্ত সংগ্রামের সুদীর্ঘ প্রক্রিয়ার প্রতিটি পর্যায়েই জামাতিরা অত্যন্ত ক্ষতিকর ভূমিকা পালন করেছে। তাদের নৃশংসতা এমনকি পাক হানাদার বাহিনীকেও অনেক ক্ষেত্রে ছাড়িয়ে গেছে।
রাজাকার আলবদর বাহিনী।
শান্তি কমিটির মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধবিরােধী তৎপরতাকে সর্বাত্মক করার জন্য একই সঙ্গে জামাতে ইসলামী সশস্ত্র রাজাকার বাহিনীও গড়ে তােলে। ৯৬ জন জামাত কর্মীর সমন্বয়ে খুলনার খান জাহান আলী রােডের আনসার ক্যাম্পে মে মাসে রাজাকার বাহিনীর প্রথম দলটি গঠন করেন জামাত নেতা মওলানা এ কে এম ইউসুফ। স্বাধীনতা যুদ্ধকালে জামাতে ইসলামীর এই সশস্ত্র বাহিনী হত্যা, নির্যাতন এবং সন্ত্রাস সৃষ্টিতে পাক হানাদার বাহিনীর কেবল তল্পীবাহক হিসেবেই কাজ করেনি, অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের অত্যাচার হানাদার বাহিনীর চাইতেও অনেক বেশি ক্ষতি ও সর্বনাশের কারণ ঘটিয়েছিলাে। শত্রু কবলিত বাংলাদেশের একটি পরিবারও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যারা এই রাজাকারদের হত্যা, লুণ্ঠন, এবং নির্যাতনের শিকার হননি।জামাতে ইসলামীর নিজস্ব উদ্যোগে গঠিত রাজাকার বাহিনীকে পাকিস্তানের সামরিক সরকার অল্পদিনের মধ্যেই আধা-সামরিক বাহিনীতে পরিণত করে। পাক সেনাবাহিনীকে স্বাধীনতা যুদ্ধরত মুক্তিযােদ্ধাদের বিরুদ্ধে কার্যকর সহযােগিতা প্রদানে উপযুক্ত হিসেবে গড়ে তােলার জন্য এদের এক থেকে তিন-চার সপ্তাহের প্রশিক্ষণের সরকারী ব্যবস্থা করা হতাে। সাধারণত ৩০৩ রাইফেল দিয়ে তাদের সশস্ত্র করা হতাে। রাজাকাররাও তাদের ‘দেশপ্রেমের সরকারী স্বীকৃতি পেতে থাকে। সিলেট সফরকালে ৮ জুলাই জেনারেল নিয়াজী ‘দুষ্কৃতকারীদের নাশকতামূলক তৎপরতার বিরুদ্ধে অত্যন্ত সাফল্যের সঙ্গে লড়াই করার জন্য রাজাকারদের প্রশংসা করেন। ১১ আগস্ট রংপুরে গবর্নর টিক্কা খান একই সুরে বলেন, ‘রাজাকাররাও দুষ্কৃতকারীদের হামলার মুখে নিজ নিজ এলাকা রক্ষা এবং সেতু ও কালভার্ট পাহারা দিয়ে বিশেষ দরকারী ভূমিকা পালন করছে।’ ১৬ সেপ্টেম্বর চট্টগ্রামে। ট্রেনিং গ্রহণরত রাজাকারদের পরিদর্শনকালে জেনারেল নিয়াজী তাদের মনােবল ও উৎসাহের প্রশংসা করেন। জামাতে ইসলামী রাজাকার বাহিনীর প্রশ্নেও পাক সেনাবাহিনীর সঙ্গে সুর মিলিয়েছিলাে। ১ সেপ্টেম্বর করাচীতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে গােলাম আযম ‘পাকিস্তান রক্ষা ও মানুষের জীবনের নিরাপত্তার জন্য পাক সেনাবাহিনীর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানান। গােলাম আযম বলেন, কোন ভাল মুসলমানই তথাকথিত বাংলাদেশ আন্দোলনের সমর্থক হতে পারেনা।
তিনি বলেন, “পূর্ব পাকিস্তানের বিছিন্নতাবাদীদের নির্মূল করার জন্য একমনা ও দেশপ্রেমিক লােকেরা একত্রে কাজ করে যাচ্ছেন।’ রাজাকাররা খুবই ভালাে কাজ করছেন বলে তিনি উল্লেখ করেন। নিহত রাজাকার রশীদ মিনহাজের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে গােলাম আযম বলেন, ‘এই আত্মত্যাগের নিদর্শন থেকে তরুণরা উপকৃত হতে পারবে।’১ ২৫ সেপ্টেম্বর ঢাকার হােটেল ‘এম্পায়ার’-এ এক জামাতী সমাবেশে গােলাম আযম শান্তি কমিটি ও রাজাকার বাহিনীতে জামাতে ইসলামীর অংশগ্রহণের কারণ হিসেবে ‘পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার কথা উল্লেখ করে বলেন, ‘জামাতে ইসলামীর কর্মীরা মুসলিম জাতীয়তাবাদের আদর্শকে বিসর্জন দিয়ে বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদকে মেনে নিতে রাজী নয়।” গােলাম আযম বলেন, ‘জামাতের কর্মীরা শাহাদাত বরণ করে পাকিস্তানের দুশমনদের বুঝিয়ে দিয়েছে, তারা মরতে রাজী তবুও পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরাে টুকরাে করতে রাজী নয়।’ গােলাম আযম আরাে বলেন, “সারা দেশ সামরিক বাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে আসার পরও যে কয়েক হাজার লােক শহীদ হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই জামাতের কর্মী।”২ রাজাকার বাহিনীর প্রতিষ্ঠাতা নেতা মওলানা ইউসুফ ১১ অক্টোবর খুলনার জেলা স্কুল মিলনায়তনে এক রাজাকার সমাবেশে ‘দুষ্কৃতকারী ও ভারতীয় সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদের কার্যকলাপ দমনের জন্য রাজাকারদের ভূমিকার ভূয়সী প্রশংসা করেন। বিপুল করতালির মধ্যে মওলানা ইউসুফ ঘােষণা করেন, “দেশের সার্বভৌমত্বের ওপর হামলার যেকোন অপচেষ্টা নস্যাৎ করে দেয়ার জন্য সেনাবাহিনী ও রাজাকারদের পেছনে আমাদের সাহসী জনগণ ঐক্যবদ্ধ থাকবেন। ৩ পূর্বাঞ্চলীয় সামরিক অধিনায়ক জেনারেল নিয়াজীও রাজাকারদের সম্পর্কে একই আশা ব্যক্ত করেছিলেন। সাভারে রাজাকার বাহিনীর কোম্পানী কমাণ্ডারদের প্রথম দলের ট্রেনিংশেষে কুচকাওয়াজ পরিদর্শনের পর এক ভাষণে ২৭ নভেম্বর নিয়াজী বলেন, “একদিকে তাদের ভারতীয় চরদের সকল চিহ্ন মুছে ফেলতে হবে এবং অপরদিকে বিপথগামী যুবকদের সঠিক পথে আনার চেষ্টা করতে হবে।”৪
জামাতে ইসলামীর রাজাকার বাহিনী সাধারণভাবে পাকিস্তানপন্থী সকল রাজনৈতিক দলের সমর্থন পেয়েছিলাে। পিডিপি প্রধান নূরুল আমীন প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে ৬ নভেম্বর “পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকারদের সংখ্যা বৃদ্ধি করা ও তাদের আরাে অস্ত্র দেয়ার সুপারিশ করেন। কারণ, সেখানে রাজাকাররা খুব ভালাে কাজ করছে।” স্বাধীনতা যুদ্ধকে নস্যাৎ করার লক্ষ্যে জামাতে ইসলামীর উল্লেখযােগ্য অপর এক প্রচেষ্টা ছিলাে আলবদর নামের সশস্ত্র স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রতিষ্ঠা। বদর বাহিনী এপ্রিল মাসের শেষদিকে প্রথম গঠিত হয় জামালপুরে। শিক্ষিত জামাত ও ইসলামী ছাত্রসংঘের কর্মীদের সমন্বয়ে গঠিত বদর বাহিনীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলাে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দৃষ্টিকোণ থেকে স্বাধীনতা যুদ্ধরত বাঙ্গালী জনগােষ্ঠীকে পাকিস্তানী জীবনদর্শনে বিশ্বাসী জনগােষ্ঠীতে রূপান্তরিত করা। পাক দখলদার বাহিনীর সঙ্গে যােগসাজশে বদর বাহিনী। সার্বিকভাবে জামাতে ইসলামীর তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতাে। স্বাধীনতাকামীদের খুঁজে বের করা, হিন্দুদের বলপূর্বক মুসলমান বানানাে, সেমিনার ও প্রচারপত্রের মাধ্যমে জামাতী চিন্তাধারার প্রচার এবং প্রয়ােজনে মুক্তিযােদ্ধাদের সশস্ত্রভাবে মােকাবেলা করা ছিলাে এদের তৎপরতার উল্লেখযােগ্য দিক। বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে ঠাণ্ডা মাথায়’ বদর বাহিনীর নৃশংসতা যুদ্ধের শেষ পাঁচটি মাসে জনমনে ভয়াবহ আতঙ্কের সৃষ্টি করেছিলাে। পাকিস্তান কবলিত প্রতিটি জেলা ও মহকুমা শহরেই এদের নিজস্ব ক্যাম্প’ থাকতাে। [ এসব ক্যাম্পে ধরে আনা স্বাধীনতাকামীদের ক্রমাগত নির্যাতনের মধ্য দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হতাে। স্বাধীনতাযুদ্ধ অপ্রতিরােধ্যভাবে বিজয়াভিমুখী হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এদের। তৎপরতাও বাড়ছিলাে ভয়ঙ্করভাবে। শেষ দিনগুলােতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, চিকিৎসাবিজ্ঞানের অধ্যাপক, লেখক, সাংবাদিক এবং সরকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে নিম্নপর্যায়ের চাকরিজীবী পর্যন্ত সামান্য শিক্ষিত বাঙ্গালী বলতেই বদর বাহিনীর শিকারে পরিণত হয়েছিলেন। অন্য কথায়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে সুপরিকল্পিতভাবে– বাঙ্গালীদের সমূলে বিনাশ করার ‘বিজ্ঞানসম্মত’ হত্যাকাণ্ড ছিলাে বদর বাহিনীর কর্মকাণ্ডের প্রধান উদ্দেশ্য। পূর্ব পাকিস্তানের বেসামরিক গভর্নরের উপদেষ্টা জেনারেল রাও ফরমান আলীর নীলনকশা অনুযায়ী বদর বাহিনী এই তৎপরতা চালিয়েছিলাে।
বিশেষ করে যুদ্ধশেষের আগের কয়েকটি দিনে ঢাকায় সংঘটিত বুদ্ধিজীবী হত্যার মর্মান্তিক ঘটনাগুলাে এর প্রমাণ হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। বদর বাহিনীর সার্বিকভাবে গােলাম আযমের তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতাে। এর প্রকাশ্য নেতৃবৃন্দের মধ্যে ছিলেন বর্তমান জামাতে ইসলামীর সাধারণ সম্পাদক মতিউর রহমান নিযামী (সারা পাকিস্তান প্রধান), ঢাকা মহানগরীর আমীর আলী আহসান মুহম্মদ মুজাহিদ (প্রাদেশিক প্রধান), ঢাকা মহানগরীর নায়েবে আমীর মীর কাশেম আলী (তৃতীয় নেতা) এবং কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক মােহাম্মদ কামরুজ্জামান (প্রধান সংগঠক)। জামাতে ইসলামীর মুখপত্র দৈনিক ‘সগ্রাম’ও সে সময় বদর বাহিনীকে উত্তেজিত করা শুরু করেছিলাে। ১৪ সেপ্টেম্বর ‘আলবদর’ শিরােনামে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ‘সংগ্রাম লেখে, “আলবদর একটি নাম! একটি বিস্ময়!আলবদর একটি প্রতিজ্ঞা! যেখানে তথাকথিত মুক্তিবাহিনী, আলবদর সেখানেই। যেখানেই দুষ্কৃতকারী, আলবদর সেখানেই। ভারতীয়, | চর কিংবা দুষ্কৃতকারীদের কাছে আলবদর সাক্ষাৎ আজরাইল।” ওদিকে বদর বাহিনীর প্রকাশ্য নেতারাও একইযােগে তৎপর হয়ে উঠেছিলেন। ঢাকার আলীয়া মাদ্রাসাস্থ বদর বাহিনী ক্যাম্পের এক সমাবেশে বদর বাহিনী প্রধান মতিউর রহমান নিযামী’ ২৩ সেপ্টেম্বর বলেছিলেন, “যারা ইসলামকে ভালােবাসে শুধুমাত্র তারাই পাকিস্তানকে ভালােবাসে। এবারের উদঘাটিত এই সত্যটি যাতে আমাদের রাজনৈতিক বুদ্ধিজীবীরা ভুলে যেতে না পারে সেজন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালাতে হবে।” এ জামাতে ইসলামীর আলবদর বাহিনীর উদ্দেশ্য, দৃষ্টিভঙ্গী ও মনােভাব সম্পর্কে পরিচিত করার জন্য দৈনিক পাকিস্তানের একটি প্রতিবেদন প্রসঙ্গত উল্লেখযােগ্য। তাতে বলা হয়েছে, “ঐতিহাসিক বদর দিবস’ পালনােপলক্ষে ১৯৭১-এর ৭ নভেম্বর ঢাকার বায়তুল মােকাররম প্রাঙ্গণে অনুষ্ঠিত ইসলামী ছাত্রসংঘের এক গণজমায়েতে সংঘের ‘পূর্ব পাকিস্তান
শাখার সভাপতি আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ ‘চার দফা ঘােষণা প্রচার করেছিলেন। প্রথম ঘােষণায় বলা হয়, দুনিয়ার বুকে হিন্দুস্তানের কোন মানচিত্রে আমরা বিশ্বাস করি। যতদিন পর্যন্ত দুনিয়ার বুক থেকে হিন্দুস্তানের নাম মুছে না দেয়া যাবে ততদিন পর্যন্ত আমরা বিশ্রাম নেবাে না। দ্বিতীয় ঘােষণাটি প্রচারিত হয় লাইব্রেরীগুলাের উদ্দেশ্যে, ‘আগামীকাল থেকে হিন্দু লেখকদের কোন বই অথবা হিন্দুদের দালালী করে লেখা পুস্তকাদি লাইব্রেরীতে (কেউ) স্থান দিতে পারবেন না, বিক্রি বা প্রচার করতে পারবেন না। যদি কেউ করেন তবে পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকরা জ্বালিয়ে ভস্ম করে দেবে।’ তৃতীয় দফায় বলা হয়, পাকিস্তানের অস্তিত্বে বিশ্বাসী স্বেচ্ছাসেবকদের সম্পর্কে বিরূপ প্রচার করা হচ্ছে। যারা এই অপপ্রচার করছে তাদের সম্পর্কে হুশিয়ার থাকুন। চতুর্থ দফায় বলা হয়, ‘বায়তুল মােকাদ্দাসকে উদ্ধারের সংগ্রাম চলবে।’ ‘চার দফা ঘােষণাকে বাস্তবায়িত করার জন্য সর্বস্তরের জনগণের প্রতি আহবান জানিয়ে আলী আহসান মােহাম্মদ মুজাহিদ বলেন, “এই ঘােষণা বাস্তবায়িত করার জন্য শির ! উচু করে, বুকে কোরান নিয়ে মর্দে মুজাহিদের মতাে এগিয়ে চলুন। প্রয়ােজন হলে নয়াদিল্লী পর্যন্ত এগিয়ে গিয়ে আমরা বৃহত্তর পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন করবাে।” জমায়েতে ‘পূর্ব পাকিস্তান ইসলামী ছাত্রসংঘের সাধারণ সম্পাদক মীর কাশেম আলী “বদর দিবসের শপথ’ হিসেবে তিনটি কর্মসূচি তুলে ধরেন, ‘ক, ভারতের আক্রমণ রুখে দাঁড়াবাে, খ, দুষ্কৃতকারীদের খতম করবাে, গ, ইসলামী সমাজ কায়েম করবাে। ‘জমায়েতে সভাপতিত্ব করেন ঢাকা শহর ইসলামী ছাত্র সংঘের সভাপতি মুহাম্মদ শামসুল হক। তিনি ‘বাতিল শক্তিকে নির্মূল করার’ শপথ নিয়ে পাকিস্তানের অখণ্ডতা ও সংহতি রক্ষার জন্য দৃঢ়প্রত্যয়ের কথা ঘােষণা করেন। জমায়েত শেষে অনুষ্ঠিত মিছিলের উল্লেখযােগ্য শ্লোগানগুলাের মধ্যে ছিলাে আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে’, ‘বীর মুজাহিদ অস্ত্র ধর, ভারতকে খতম কর’, ‘মুজাহিদ এগিয়ে চল, কলিকাতা দখল কর’ এবং ভারতের চরদের খতম কর। ৬
৮ নভেম্বরের দৈনিক সংগ্রাম’ লিখেছে, “মিছিলকারী জিন্দাদিল তরুণরা ভারতীয় দালালদের খতম কর’, ‘হাতে লও মেশিনগান দখল করহিন্দুস্তান’, ‘আমাদের রক্তে পাকিস্তান টিকবে’ প্রভৃতি শ্লোগানে রাজধানীর রাজপথ মুখরিত করে তােলে।” বদর দিবসের সাফল্যে উদ্দীপ্ত হয়ে বদর বাহিনীর সর্বাধিনায়ক মতিউর রহমান নিযামী ১৪ নভেম্বর দৈনিক সংগ্রামে’ লেখেন, “.••••বদর যােদ্ধাদের যেসব গুণাবলীর কথা আমরা আলােচনা করেছি, আলবদরেরতরুণ মর্দে মুজাহিদদের মধ্যে ইনশাআল্লাহ সেসব গুণাবলী আমরা দেখতে পাবাে। সেদিন আর খুব দূরে নয় যেদিন আলবদরের তরুণ যুবকেরা আমাদের সশস্ত্র বাহিনীর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে হিন্দু বাহিনীকে পর্যুদস্ত করে হিন্দুস্তানকে খতম করে সারা বিশ্বে ইসলামের বিজয় পতাকা উড্ডীন করবে। বদর বাহিনীর অপর দুই প্রধান নেতা আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদ এবং মীর কাশেম আলী তাঁদের ২৩ নভেম্বরের বিবৃতিতে সৈনিক হিসেবে প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার জন্য সংগঠনের সদস্যদের প্রতি আহবান জানান। এই সময়কালে প্রকাশিত এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিলাে, ‘শত্রু আশপাশেই রয়েছে। তাই সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালাতে হবে। মনে রাখবেন, আপনারা পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখার জন্যই কেবল যুদ্ধ করছেন না— এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমীর (গােলাম আযমের) নির্দেশ পালন করুন।”
স্বাধীনতার পর পর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত শত শত প্রতিবেদনে বদর বাহিনীর নৃশংসতার এক ভয়াবহ চিত্র রয়েছে। এই চিত্র হিটলারের গেস্টাপাে, ভিয়েতনামের মাইলাই কিংবা লেবাননে প্যালেস্টাইনীদের সাবরা শাতিলা শিবিরের হত্যাযজ্ঞের চেয়েও হাজার গুণ ভয়াবহ। বদর বাহিনীর হাতে শুধু ঢাকার শত শত বুদ্ধিজীবী, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সাংবাদিক, সাহিত্যিক, অধ্যাপক ও শিল্পীই প্রাণ হারাননি, বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে শত শত বিশিষ্ট নাগরিকও রেহাই পাননি। শুধু অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ডাক্তার আবদুল আলিম কিংবা সাংবাদিক সিরাজউদ্দিন হােসেন, নিজামউদ্দীন আহমেদ ও শহিদুল্লাহ কায়সারই আলবদর নামধারী নরঘাতকদের হত্যাযজ্ঞের শিকার হননি— ভিন্ন মতাবলম্বী অনেক আলেমও তাদের হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। আওয়ামী ওলামা পার্টির সভাপতি মওলানা ওয়ালিউর রহমানও বদর বাহিনীর হাতে শাহাদাত বরণ করেন। এইসব মর্মন্তুদ ঘটনা লিখে শেষ করা যাবে না।
বাংলাদেশ বিরােধী অপপ্রচার।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর জামাত, রাজাকার, আলবদর, আলশামস ও পাক হানাদার বাহিনীর অন্যান্য সহযােগীরা গা ঢাকা দেয়। আব্বাস আলী খান, মওলানা ইউসুফসহ অনেকে গ্রেফতার হন। অনেকে চট্টগ্রাম সীমান্ত দিয়ে বার্মা হয়ে পাকিস্তান ও অন্যান্য দেশে পালিয়ে যায়। কিন্তু দেশে যারা গা ঢাকা দিয়েছিলাে, তারা নিষ্ক্রিয় ছিলাে না। ১৯৭২ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বহু নাশকতামূলক কার্যকলাপের সাথে জামাতিরা জড়িত ছিলাে বলে সাধারণ্যে একটা সন্দেহ রয়েছে। অনেকের ধারণা, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর মুক্তিযােদ্ধারা অস্ত্র জমা দিলেও কোন জামাতি, রাজাকার-আলবদর স্বেচ্ছায় অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়নি। জনশ্রুতি আছে, পাক হানাদার বাহিনী আত্মসমর্পণের সিদ্ধান্ত নেয়ার পর বিপুল পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক উপকরণ তাদের এদেশীয় দোসরদের নিকট হস্তান্তর করে। তারা পরবর্তীতে এসব অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য নাশকতামূলক কাজে ব্যবহার করে। স্বাধীনতার পরের বছরগুলােতে অনেক ব্যাংক ডাকাতি হয়েছে। পাটের গুদামে আগুন লাগানাে হয়েছে। বিস্ফোরণ ঘটানাে হয়েছে ঘােড়াশাল সার কারখানায়। অনেক মুক্তিযােদ্ধাকে অজ্ঞাত আততায়ীর গুলির শিকার হতে হয়েছে। শুধু আওয়ামী লীগেরই ছ’ থেকে সাত হাজার মুক্তিযােদ্ধা নেতা ও কর্মীকে প্রাণ হারাতে হয়েছে। এসব ঘটনায় বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পাক হানাদার বাহিনীর রেখে যাওয়া অস্ত্রশস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ থাকলেও জামাত, রাজাকার ও আলবদরদের গােপন তৎপরতা বন্ধ ছিলাে না। শুধু তাই নয়, এ সময়ে তাদের অনেকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনে ঢুকে পড়ে। এসব অনুপ্রবেশকারীরা কোন কোন রাজনৈতিক দল ও ছাত্র সংগঠনকে জাতীয় স্বার্থবিরােধী ও ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের প্রতি উদ্বুদ্ধ ও প্রভাবিত করে। দেশের ভেতরেই নয়, বাইরেও তারা বাংলাদেশবিরােধী অপপ্রচার অব্যাহতভাবে চালিয়ে যায়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসেই জামাত নেতা অধ্যাপক গােলাম আযমের নেতৃত্বে লাহােরে “পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটি গঠিত হয়। পুরাে এক সপ্তাহব্যাপী মিছিল, সমাবেশ ও অন্যান্য কর্মসূচী পালনের মধ্য দিয়ে এই কমিটি তথাকথিত পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলন পরিচালনা করে। বাংলাদেশকে স্বীকৃতির ব্যাপারে গােলাম। আযম পাকিস্তান সরকারের তীব্র বিরােধিতা করেন। প্রধানত তাঁর আপত্তির কারণেই জামাতের কেন্দ্রীয় কমিটি স্বীকৃতি না দেয়ার পক্ষে প্রস্তাব গ্রহণ করে।
গােলাম আযম এরপর পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার আন্দোলনকে ক্রমাগত জোরদার করার উদ্যোগ নেন। জামাতের আর এক নেতা মওলানা আবদুর রহিম ‘পাকিস্তানে আটক বাঙ্গালী’ হিসেবে দেশেফিরে এলেও ‘৭২ সালের নভেম্বরে গােলাম আযম বাংলাদেশবিরােধী আন্দোলনকে ব্যাপকতা দেয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানী পাসপাের্ট নিয়ে দেশত্যাগ করেন। ‘৭৩ সালের মার্চ পর্যন্ত সময়কালে তিনি পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির নেতা হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম দেশগুলােতে বাংলাদেশবিরােধী প্রবল মনােভাব গড়ে তােলেন। “হিন্দুরা পূর্ব পাকিস্তান দখল করে নিয়েছে। সেখানে মুসলমানদের হত্যা ও নির্যাতন করা হচ্ছে। মসজিদগুলাে মন্দিরে রূপান্তরিত করা হচ্ছে।”— এ ধরনের উদ্ভট এবং ধর্মীয় উন্মাদনা সৃষ্টিকারী বক্তব্য তুলে ধরে তিনি সাহায্যের আবেদন জানান। এই প্রক্রিয়ায় বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগ্রহ এবং সংগৃহীত অর্থের বিরাট অংশ আত্মসাতের অভিযােগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে। কিন্তু এর অংশবিশেষ তিনি বাংলাদেশের জামাতে ইসলামীকে প্রদান করায় অভিযােগটি ব্যাপকভাবে উচ্চারিত হতে পারেনি। এই সময়কালে গােলাম আযমের কার্যক্রম সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য তাঁর নিজেরই একটি বক্তব্য উল্লেখ করা যেতে পারে। ১৯৮০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি দৈনিক সংগ্রামকে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন, “যাতে সংবিধান থেকে সেকুলারিজম প্রত্যাহার করা হয় এবং ইসলামের কাজ করতে যেসব বাধা আছে তা দূর করা হয় সে উদ্দেশ্যে মুসলিম জাহান ও ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দের কাছে তদানীন্তন বাংলাদেশ সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগের আবেদন জানিয়েছি।
সংবিধানের ধর্মনিরপেক্ষতা কিভাবে ইসলামের বিরুদ্ধে, কোন্ প্রতিবন্ধকতা দাঁড় করিয়েছিলাে এবং বাংলাদেশের কোন্ ‘মুসলিম জনগণ’ গােলাম আযমকে তাদের ‘প্রতিনিধি’ হওয়ার অধিকার দিয়েছিলাে, সে প্রসঙ্গে কেউ না বললেও একথা অত্যন্ত পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, গােলাম আযমের ন্যক্কারজনক মিথ্যাচার, বিশেষ করে মুসলিম দেশগুলােতে, বাংলাদেশবিরােধী মনােভাবকে উস্কে দিয়েছিলাে। গােলাম আযম এখানে নিজের স্বাধীনতা এবং স্বীকৃতিদানের বিরােধিতা প্রসঙ্গে কিছু বলার সাহস পাননি আর ইসলামের নামে তিনি আসলে জামাতের ওপর আরােপিত নিষেধাজ্ঞারই প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। ১৯৭৩ সালের ২২ এপ্রিল নাগরিকত্ব বাতিল হওয়ার পর ক্ষিপ্ত গােলাম আযমের এই তৎপরতা আরাে ব্যাপকতা পেয়েছিলাে। সে মাসেই তিনি লন্ডনে চলে যান। সেই সাথে ‘পূর্ব পাকিস্তান পুনরুদ্ধার কমিটির সদর দফতরও প্রতিষ্ঠিত হয় লন্ডনে। ১৯৭৭ সাল পর্যন্ত তার এই তৎপরতা অব্যাহত থাকে। লন্ডনকেন্দ্রিক কর্মকাণ্ডের বিভিন্ন পর্যায়েও তিনি পৃথিবীর দেশে দেশে ইসলামী আন্দোলনের নামে বাংলাদেশবিরােধী প্রচারণা চালাতে থাকেন। ১৯৭৪ সালের প্রথমদিকে পূর্ব লন্ডনের একটি বাড়িতে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে গােলাম আযম বাংলাদেশবিরােধী তৎপরতার নীলনকশা পেশ করেন। এই বৈঠকে কয়েকজন পাকিস্তানী নাগরিকও উপস্থিত ছিলেন। লন্ডন থেকে বিভিন্ন সূত্রে পাওয়া খবর অনুযায়ী এই বৈঠকে এ টি সাদী, আলী হােসেন, ব্যারিস্টার আখতারউদ্দিন, মােহর আলী, ডঃ তালুকদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। পাকিস্তানী নাগরিকের মধ্যে মাহমুদ আলীর নাম উল্লেখযােগ্য। বৈঠকে গােলাম আযম বলেন, ‘লন্ডনে বসে আমাদের কাজ চানাে কঠিন হবে। তাই দেশে যেতে হবে। কাউকে ঝুঁকি নিতে হবে। তা না হলে কিছু হবে না। অবশ্য আপনারা দেশে গেলে তােক পাবেন, আমি যােগাযােগ করেছি। সবই ঠিক আছে। একটা ছাপানাে লিফলেট সকলের হাতে দিয়ে বলেন, “এই লিফলেট গ্রামে-গঞ্জে ছড়িয়ে দিতে হবে। আমাদের সঙ্গে জনগণ রয়েছে। উক্ত লিফলেটে পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন গঠনের কথা উল্লেখ ছিল বলে একটি সূত্র জানিয়েছে। লিফলেটসহ কয়েক ব্যক্তি সে সময় ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জে ধরা পড়ে। লিফলেটের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু জানা যায়নি। তবে একটি সূত্র জানায়, এই লিফলেটে ইসলামী বিপ্লব সংঘটিত করার জন্য মসজিদে মসজিদে তৎপরতা শুরু করার আহবান ছিল।’ গােলাম আযম সে বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যের কয়েকটি দেশ ও পাকিস্তানের সহযােগিতার কথা জানান। তিনি বলেন, ‘টাকার কোন অভাব হবে না।’ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য আপনারা কাজ করে যান।’ কিভাবে কাজ করতে হবে তার একটি পরিকল্পনা ছিল, বুদ্ধিজীবী মহলে ‘জামাত সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ধারণা দিতে হবে, ইসলামী বইপত্র ছাপাতে হবে, জনগণের যেকোন আন্দোলনে সমর্থন দিতে হবে। প্রয়ােজনে টাকা-পয়সা দিয়ে আন্দোলনকে ব্যাপক করতে হবে।
দীর্ঘক্ষণ বৈঠকের পর সিদ্ধান্ত হয়, দু’জন সদস্য কাগজপত্র ও প্রয়ােজনীয় টাকা-পয়সা নিয়ে বাংলাদেশে ফিরবেন।। জানা গেছে, বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে বিধ্বস্ত মসজিদ। পুনর্গঠনের দাবি জানিয়ে গােলাম আযম ৪৫ লাখ রিয়াল সংগ্রহ করেন। এ টাকার একটি অংশ দিয়ে গােলাম আযম যুক্তরাজ্যের ম্যানচেষ্টারে একটি বাড়ি কেনেন। ১৯৭৭ সালের ৩০ জুলাই এরা লন্ডনের হােলি ট্রেনিং চার্চ কলেজে আবার মিলিত হন। সেখানে গােলাম আযমই ছিলেন প্রধান বক্তা। এ সভায় গােলাম আযমের নাগরিকত্ব বহালের দাবি জানিয়ে বক্তৃতা করেন নােয়াখালীর লক্ষ্মীপুরের মওলানা নাসিরুদ্দীন আহমদ। ‘৭১ সালে তাকে পাকিস্তান সরকারের খরচে বাংলাদেশবিরােধী জনমত ‘সগ্রহের উদ্দেশ্যে বিভিন্ন দেশে পাঠানাে হয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর তিনি লন্ডনে গিয়ে আস্তানা গাড়েন। প্রায় একই সময়ে গােলাম আযমের পরামর্শদাতা হিসেবে কাজ করেন পাকিস্তানের এককালীন তথ্যমন্ত্রী আলতাফ গওহর ও তৎকালীন পিপিআই প্রধান মােয়াজ্জেম আলী। ডকুমেন্টেশন সেন্টার নামক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমেও বাংলাদেশবিরােধী প্রচার কাজ চালানাে হয়। এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালক ছিলেন জনৈক ডঃ তালুকদার। বিদেশী পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত বাংলাদেশবিরােধী খবরের কাটিং একসঙ্গে করে ছাপিয়ে বের করাই ছিলাে এই প্রতিষ্ঠানের কাজ। এইসব কাটিংসমৃদ্ধ কাগজপত্র বাংলাদেশের বিভিন্ন বার লাইব্রেরীতে পাঠানাে হতাে। জাতীয় প্রেস ক্লাবেও কয়েকবার এসেছে। লন্ডন ষড়যন্ত্রের সাথে আরাে যারা জড়িত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন মওলানা ইউসুফ, খাজা খয়েরউদ্দিন, কাজী কাদের প্রমুখ। তাদের কেউ কেউ দেশেও ছিলেন। এভাবে সে সময় জামাত ও তার দোসররা দেশে-বিদেশে বাংলাদেশবিরােধী অপপ্রচার চালায়।
বাংলাদেশে জামাতের অভ্যুদয়
ইসলামের প্রাথমিক যুগে যুদ্ধবন্দীদের তাদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী হত্যা কিংবা দাসদাসীতে পরিণত করা হতাে। আর যারা বিনাযুদ্ধে মুসলমানদের সাথে সন্ধি স্থাপন করতে, তাদের জিম্মি হিসেবে গণ্য করা হতাে। তাদেরকে জিজিয়া কর দিতে হতাে। বাংলাদেশে বর্তমানে যারা ইসলামিক শাসনব্যবস্থার শ্লোগান দিচ্ছে, তাদের প্রায় সবাই বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার বিরােধিতা করেছে। মুক্তিযুদ্ধে তারা পাক হানাদার বাহিনীকে সর্বতােভাবে • সহযােগিতা করেছে। ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলেও জামাত, মুসলিম লীগ প্রভৃতি স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাের বাংলাদেশে রাজনৈতিক অধিকার লাভের কথা নয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর দালালদের মধ্যে যাদের বিরুদ্ধে হত্যা, ধর্ষন, লুট, অগ্নিসংযােগ প্রভৃতি নির্দিষ্ট অভিযােগ ছিলাে বঙ্গবন্ধু বিচারের মাধ্যমে তাদের শাস্তির ব্যবস্থা করেন। আর যেসব দালালের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট কোন অভিযােগ পাওয়া যায়নি, তাদের তিনি ক্ষমা করে দেন। বঙ্গবন্ধুর এই সাধারণ ক্ষমার লক্ষ্য ছিলাে, দালালদেরকে সুনাগরিক হিসেবে বাংলাদেশে বসবাস করার সুযােগ দেয়া। এই সাধারণ ক্ষমার অর্থ কোন অবস্থায়ই রাজনৈতিক পুনর্বাসন নয়। তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ হচ্ছে, সাধারণ ক্ষমা ঘােষণা সত্ত্বেও বঙ্গবন্ধু কাউকে পবিত্র ধর্মের নামে বাংলাদেশে রাজনৈতিক ব্যবসা করার সুযােগ প্রদান করেননি। তিনি বরং আইন করে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ ঘােষণা করেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্ৰীয় চার মূলনীতির অন্যতম নীতি হিসেবে ঘােষণা করেন। ১৯৭২ সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে খসড়া সংবিধান সম্পর্কে বঙ্গবন্ধু এক ঐতিহাসিক ভাষণ দান করেন। তাতে তিনি বলেন: “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। … মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারাে নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে। কারাে বাধা দেবার মত ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খৃষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পাবে না।
আমাদের শুধু আপত্তি হলাে, কেউ ধর্মকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার। করতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শােষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যাভিচার। এই বাংলাদেশের মাটিতে | এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না।” বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে পবিত্র ধর্মকে রাজনীতি ও শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী সাধারণ দালালরা বাংলাদশে বাঁচার অধিকার লাভ করেছিলাে। রাজনৈতিক পুনর্বাসনের সুযােগ পায়নি। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট সাম্রাজ্যবাদী শক্তি ও তাদের এদেশীয় এজেন্টদের ষড়যন্ত্রে বঙ্গবন্ধুর নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পর এদেশে আবার পাকিস্তানী স্টাইলের রাজনীতি প্রবর্তন করা হয়। ১৯৭৬ সালের জানুয়ারি মাসে সামরিক সরকার একটি অধ্যাদেশ ঘােষণা করেন। ১৯৭২ সালের অধ্যাদেশের অধীন যেসব স্বাধীনতা বিরােধীর কারাদণ্ড হয়েছিলাে কিংবা বিচার চলছিলাে, সামরিক সরকারের এই অধ্যাদেশে তার অবসান হয়। লুণ্ঠন, অগ্নিসংযােগ, ধর্ষণ ও হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্ত রাজাকার আলবদর ও অন্যান্য দালালরা বেরিয়ে আসে কারাগার থেকে। চল্লিশ বছর সাজাপ্রাপ্ত আলবদর কমাণ্ডার আমিনুল হক, যাবজ্জীবন কয়েদী রাজাকার চিকন আলী প্রমুখ হাজার। হাজার রাজাকার আলবদর সগর্বে বিচরণ করতে থাকে স্বাধীন বাংলার শহর-বন্দর ও গ্রামে-গঞ্জে। এ সময় শহীদ বুদ্ধিজীবী ও মুক্তিযােদ্ধাদের পিতামাতা, বিধবা স্ত্রী ও । সন্তানদের নিভৃতে অশ্রুপাত ছাড়া কিছুই করার ছিলাে না। কিন্তু এসব ঘটনার মূল নায়ক সে সময়ের সবচেয়ে শক্তিধর ব্যক্তি মুক্তিযােদ্ধা জিয়াউর রহমান তাঁর সহযােদ্ধাদের রক্তদানের কথা একটি বারও স্মরণ করেননি। দালাল হত্যাকারীদের ছেড়ে দিলে শহীদ পরিবারগুলাের মনের কি প্রতিক্রিয়া হবে, তিনি তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করেননি। আসলে তখন তাঁর এসব ভাববার সময়ও ছিলাে না। তিনি তখন দালালদের নিয়ে দল করে দেশের সর্বোচ্চ চেয়ারটি দখল রার ষড়যন্ত্রে ব্যস্ত ছিলেন—যার জন্য শাহ আজিজ, আবদুল আলিমের মত লোেকদের স্বাধীন বাংলাদেশের মন্ত্রিসভায় নিতেও তাঁর এতটুকু বাধেনি।
তিনি শাসনতন্ত্রে পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে রাজাকার আলবদরদের হত্যা, লুণ্ঠন, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি অপরাধ শাসনতান্ত্রিকভাবে বৈধ করে নেন। দেশের বুদ্ধিজীবী মহলের তরফ থেকেও মুক্তিযােদ্ধা জিয়ার এই দালাল পুনর্বাসনের বিরুদ্ধে তেমন কোন প্রতিবাদ ওঠেনি। এমনকি কোন কোন বুদ্ধিজীবী বরং দালালদের সমর্থনে কুম্ভীরাশ্রুপাত করেছেন। এই শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীরাই বর্তমানে উদোর পিণ্ডি বুধাের ঘাড়ে চাপিয়ে বলছেন, বঙ্গবন্ধু নাকি সাধারণ ক্ষমার মাধ্যমে স্বাধীনতাবিরােধীদের পুনর্বাসন করে গেছেন। ইতিহাস বিকৃতির। অপচেষ্টা আর কাকে বলে। সে যাই হােক, ১৯৭৬ সালের আগস্ট মাসে রাজনৈতিক দল অধ্যাদেশ ঘােষিত হয়। এই সুযােগে স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলােও সামরিক সরকারের স্বীকৃতি নিয়ে বালাদেশে রাজনীতি করার সুযােগ লাভ করে। ১৯৭৭ সালের ২১ এপ্রিল জিয়াউর রহমান রাষ্ট্রপতি। হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। রাষ্ট্রপতি হিসেবে তাঁর প্রথম কাজ ছিল সংবিধান থেকে ধর্মনিরপেক্ষতাকে বিদায় দেয়া। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রাপ্ত সে সময়ের রাজনৈতিক দলের সংখ্যা ছিল মােট ২১টি। এদের মধ্যে মাত্র ৫টি দল জিয়াউর রহমানের নীতির প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানায়। এই দলগুলাে হলাে, মুসলিম লীগ, ইসলামিক ডেমােক্র্যাটিক লীগ, জামাতে ইসলামী, নেজামে ইসলাম ও খেলাফতে রব্বানী পার্টি। বলা বাহুল্য, মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গণবিরােধী ভূমকিার জন্যে ১৯৭২ সালে এসব দল নিষিদ্ধ ঘােষণা করা হয়েছিল। কাজেই দেখা যায়, জিয়াউর রহমানের আমলেই এ দলগুলাের পুনঃপ্রতিষ্ঠা হয়। তখন থেকে শুরু হয় স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে স্বাধীনতাবিরােধী ধর্মভিত্তিক রাজনীতির পুনরুথান। আজ তা ব্যাপক আকার ধারণ করেছে।
জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতা পাকাপােক্ত করার উদ্দেশ্যে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও তিরিশ লাখ শহীদের আত্মত্যাগের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে স্বাধীনতাবিরােধীদের রাজনৈদিক পুনর্বাসনের সুযােগ করে দিলেও জামাতিরা প্রথমে স্বনামে মাঠে নামার সাহস করেনি। তারা গণপিটুনি এড়ানাের কৌশল হিসেবে ‘ইসলামিক ডেমােক্র্যাটিক লীগ’ সাইনবোের্ড নিয়ে সংগঠিত হয়। তথাকথিত ইসলাম পছন্দ দু’টি দলের সমন্বয়ে ১৯৭৬ সালের ২৪ আগস্ট আইডিএল গঠিত হয়। প্রাক্তন নেজামে ইসলাম পার্টির নেতা মওলানা সিদ্দিক আহমদকে দলের সভাপতি করা হয়। মওলানা আবদুর রহিম তার জামাতের গােপন কাঠামাে ঠিক রেখে ‘আইডিএল’-এর সহ সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৭৭ সালের ১ ২০ অক্টোবর মওলানা সিদ্দিক আহমদ ও অন্যান্য অ-জামাতপন্থী দলগুলাে জামাতের হস্তক্ষেপের দরুন বেরিয়ে যান। এরূপ পরিস্থিতিতে ১৯৭৮ সালের ১১ জুলাই গােলাম আযম পাকিস্তানী নাগরিক হিসেবে পাকিস্তানী পাসপাের্ট নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। তিনি অসুস্থ মাকে দেখার জন্য তিন মাসের ভিসা নিয়ে ঢাকায় আসেন। সে সময় থেকে এখনাে তিনি বাংলাদেশে জেঁকে বসে আছেন। মুক্তিযােদ্ধা জিয়ার সরকারই গােলাম। আযমকে বাংলাদেশে আসার অনুমতি প্রদান করেন। আ গােলাম আযম ফিরে আসার পর মওলানা রহীমের সঙ্গে সংঘাত বেধে যায়। ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে আইডিএল-এর ছয়টি আসন লাভের পর গােলাম আযম অনুভব করেন, দলকে স্বকীয় রূপে নিয়ে আসতে হবে। তাছাড়া মওলানা রহীমের সঙ্গেও তার । বিরােধ তীব্র হতে থাকে। এমনকি দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার পরিচালনা নিয়ে মারপিটও ঘটে। সম্পাদক আখতার ফারুককে বের করে দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালের ২৫, ২৬ ও ২৭ মে ঢাকায় জামাতে ইসলামীর বাংলাদেশে প্রথম আত্মপ্রকাশ ঘটে। গােলাম আযমকে গােপনে আমীর নির্বাচিত করা হয় নাগরিকত্ব লাভ সাপেক্ষে। প্রকাশ্যে ইয়াহিয়া খানের শেষ গবর্নর আবদুল মালিকের অন্যতম মন্ত্রী আব্বাস আলী খানকে অস্থায়ী আমীর এবং মওলানা ইউসুফকে সেক্রেটারী জেনারেল নির্বাচিত করা। হয়।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৮০ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি প্রথমবারের মতাে বায়তুল মােকাররমে জামাতে ইসলামীর জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। ১৯৮০-র ৭ ডিসেম্বর দলের পক্ষে প্রথম সাংবাদিক সম্মেলনে আব্বাস আলী খান ৫ দফা দাবীনামা পেশ করেন। এ সাংবাদিক সম্মেলনে আব্বাস আলী খান বলেন, ১৯৭১ সালে দেশ ও জাতির মঙ্গলের জন্য যা করেছি ঠিকই করেছি।’ এ বক্তব্য নাড়িয়ে দেয় দশ বছর আগেকার জামাতের কালাে অতীতকে। নতুন করে দৃষ্টি আবদ্ধ হয় জামাতের উপর। ১৯৮১ সালের ২৯ মার্চ আব্বাস আলী খন এক সাংবাদিক সম্মেলনে আবার বলেন, “১৯৭১ সালে আমরা যা করেছি ঠিকই করেছি এবং একাত্তরে বাংলাদেশের কনসেপ্ট ঠিক ছিলাে না।” তাঁর ধৃষ্টতা ও রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বক্তব্যে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। তাতে জামাতিরা কিছুটা সংযত কৌশল অবলম্বন করে। তারা নিজেদের প্রচার মাধ্যমে কালাে অতীতকে ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করে। তারা বলে, ‘তাই বলে টিক্কা খানের সেনাবাহিনী পাকিস্তানকে রক্ষা করার নামে যত অমানবিক কাজ করেছে তা কখনই জামায়াত সমর্থন করেনি।”
এমনি ধরনের উদ্ধত বক্তব্যের পাশাপাশি বাংলাদেশকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘােষণাসহ জামাতে ইসলামী বিপ্লবের ৭ দফা কর্মসূচি তুলে ধরে, কিন্তু বাস্তবে এর সমগ্র তৎপরতা আবর্তিত হতে থাকে গােলাম আযমের নাগরিকত্বের প্রশ্নটিকে ঘিরে। এই উপলক্ষে গঠিত নাগরিকত্বের প্রশ্নটিকে ঘিরে। এই উপলক্ষে গঠিত নাগরিকত্ব পুনরুদ্ধার কমিটির ১৯৮১ সালের ৬ মার্চের এক সমাবেশে মওলানা ইউসুফসহ জামাতি নেতৃবৃন্দ ঘােষণা করেন, “বেআইনী আইন বাতিল করা না হলে গ্রামবাংলায় মিছিলের ঢল নামবে এবং তাতে শুধু নাগরিকত্ব নয়, ইসলামী বিপ্লবও সফল হয়ে যাবে।” প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানকে দেয়া স্মারকলিপিতে কমিটি স্মরণ করিয়ে দেয়, “বিষয়টি এদেশের কোটি কোটি তৌহিদী জনতার আবেগ অনুভূতির সাথে জড়িত।” এ দেশপ্রেমিকদের সােচ্ছার প্রতিবাদ উপেক্ষিত হয়। অজ্ঞাত মহলের সমর্থনে জামাতিরা তাদের কার্যক্রমকে এগিয়ে নেয়। ওদিকে গােলাম আযমও বেরিয়ে আসেন ভূতল নিবাস’ থেকে। কখনাে জানাজার নামে, কখনাে বা ধর্মীয় জলসার নামে প্রকাশ্যে তার উপস্থিতি বিভিন্ন সময়ে সংঘাতের কারণ ঘটায়। বিক্ষুব্ধ জনতা তাকে ক্রমাগত তাড়িয়ে ফিরতে থাকে। কিন্তু ৮২-র সামরিক শাসন সেদিনের দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতিতে পরিবর্তন আনে।
সামরিক সরকারের বিরুদ্ধে ‘৮৩ সালের জানুয়ারিতে ছাত্ররা আন্দোলনের সূচনা করে। বহু টানাপােড়েন ও ঘাত-প্রতিঘাত অতিক্রম করে সেই আন্দোলন চূড়ান্ত পর্যায়ে উপনীত হয়। ছাত্রদের পাশাপাশি শ্রমিকরাও আন্দোলনে নামে। বিভিন্ন পেশাজীবী ও বুদ্ধিজীবীরা আন্দোলনে এগিয়ে আসে। আন্দোলনের প্রয়ােজনে গঠিত হয় ১৫ দলীয় এবং ৭ দলীয় জোট। এ দু’টি রাজনৈতিক জোট আবার ৫ দফা সাধারণ দাবির ভিত্তিতে ঐকমত্যে উপনীত হয়ে রচনা করে ২২ দলের কাঠামাে, যার চাপ সামরিক সরকার প্রধান জেনারেল এরশাদও উপেক্ষা করতে পারেননি। গােটা দেশব্যাপী আন্দোলনের এই অনুকূল পরিবেশ লক্ষ্য করে মাঠে নামে ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীর প্রধান সহযােগী ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যার নেপথ্য নায়ক জামাতে ইসলামী। অবশ্য মাঠে তারা আগেও ছিলাে, তবে এবার কৌশল। পাল্টায়। আগে তারা রাজনীতি করতাে গণতান্ত্রিক ও অসাম্প্রদায়িক শক্তির সরাসরি বিরােধিতা করে। এবার তারা মাঠে নামে গণতন্ত্রের আন্দোলনকে সহায়তা করার কথা বলে। জামাত নেতা অধ্যাপক গােলাম আযম, বাস্তবে যিনি কিনা এখনাে পাকিস্তানের একজন বিশ্বস্ত নাগরিক, যার হাতে এখনাে লেগে আছে আমাদের স্বাধীনতা যুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের রক্তের দাগ, নরপিশাচ আলবদর আলশামসদের সেই অভিশপ্ত নেতা থাবার ভেতর ‘৭১-এর হিংস্র ধারালাে নথ লুকিয়ে রেখে কুম্ভীরাশ্রুপাত করেন সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্র কায়েমের জন্যে। গণতন্ত্রের জন্য তাঁর মায়াকান্নায় মুগ্ধ হয়ে ২২ দলের নেতারাও তাকে নিজেদের দোসর বলে ভাবতে শুরু করেন। . ১৯৮৪ সালে জেনারেল এরশাদ রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু করার কথা ঘােষণা করেন। অনেকগুলাে রাজনৈতিক দল সংলাপে অংশগ্রহণ করলেও ১৫ ও ৭ দলীয় জোট ৫ দফা পূরণের পূর্বশর্ত দিয়ে প্রথমে সংলাপে যােগদান থেকে বিরত থাকে। দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ২২ দলের অনুকূলে থাকায় প্রথম দফায় যারা সংলাপে গিয়েছিলেন। তাঁরা খুব একটা সুবিধা করতে পারেননি। জেনারেল এরশাদও বুঝেছিলেন ২২ দলকে সংলাপের টেবিলে আনতে না পারলে তাঁর উদ্দেশ্য সফল হবে না। পূর্বাপর পরিস্থিতি। বিবেচনা করে জামাতে ইসলামী ধুততার সঙ্গে প্রথম দফার সংলাপ বর্জন করে। ভাবখানা ছিলাে তারা ২২ দলের আন্দোলনের সমর্থক। আর ২২ দলও আন্দোলনের মুখােশ পরা জামাতের আসল চেহারা বেমালুম ভুলে গিয়ে ‘আছে থাক’ এমন একটা ভাব দেখাতে লাগলাে জামাতের প্রতি।
এমনকি ৭ দলীয় জোটের প্রধান শরীক দল বিএনপি জামাতকে তাদের জোটে ঢুকানাের ব্যাপারেও উৎসাহী ছিলাে। অন্যরা এই ভেবে বিরােধিতা করেছে, জামাতকে জোটে ঢুকালে ১৫ দলের সঙ্গে সমঝােতাপূর্ণ সম্পর্ক ব্যাহত হবে। তবে ৭ এবং ১৫ উভয় জোটের বেশির ভাগ শরীক দল জামাতকে তাদের গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের আন্দোলনে মিত্র ভেবে বসে। জামাতের বিগত পঞ্চাশ বছরের রাজনীতির প্রতি তাকালে দেখা যায়, পবিত্র ধর্মের নামে কায়েমী স্বার্থ রক্ষায় এই দলটি শঠতা, সুবিধাবাদ এবং অন্তর্ঘাতমূলক নাশকতার নীতি কোন সময়ই হাতছাড়া করেনি। অবশ্য ধ্বংসাত্মক উদ্দেশ্যে তারা কোন কোন সময় জনগণের অধিকারের দাবি কেন্দ্র করে আন্দোলনে জড়িত থাকার অভিনয়ও করেছে। ষাটের দশকে আইয়ুব বিরােধী আন্দোলনে জামাতের জড়িত থাকা তার জ্বলন্ত প্রমাণ। কিন্তু অপ্রিয় হলেও একথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, স্বাধীনতার পক্ষের রাজনৈতিক দলগুলাে জামাতের এই ধূর্ততা উপলব্ধি করেননি। তবে হালে তারা অনেকটা উপলব্ধি করেছেন। কিন্তু ইতিমধ্যে পানি অনেক দূর গড়িয়ে গেছে। জামাত যে লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে বর্তমান সরকারবিরােধী আন্দোলনে যােগ দিয়েছিলাে, তা সে অর্জন করেছে। ১৯৭৬ সালে যে জামাত তার কালাে অতীতের জন্য স্বনামে আত্মপ্রকাশ করার সাহস পায়নি, সে এখন পুরােপুরি প্রতিষ্ঠিত। শুধু প্রতিষ্ঠিত নয়, দেশের অন্যান্য অনেক। রাজনৈতিক দলের চেয়ে অত্যন্ত শক্তিশালী। এবার সুযােগ বুঝে সে তার সহিংস ও হিংস্র মূর্তি ধারণ করবে। এরই মধ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে তার কিছুটা আলামত দেশবাসী প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছেন।
জামাতের ব্যাপারে শুধু বিরােধী দলগুলােই নয়, ১৯৭৫ পরবর্তী সরকারগুলােও সম্পূর্ণ অদূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন এবং এখনও দিচ্ছেন। তাঁরা নিজেদের সাময়িক সুবিধার কথা চিন্তা করে জামাতকে কনসেশন দিয়ে চলেছেন। কিন্তু তাতে কনসেশন দানকারীরা নয়, জামাতই লাভবান হচ্ছে। সময়মত পবিত্র ধর্মের মুখােশধারী এই হিংস্র শক্তি মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলাের মতাে আবার গােটা জাতির জন্য বিপর্যয় ডেকে আনবে। বস্তুত • পবিত্র ধর্মের শ্লোগানধারী উগ্রশক্তি,ডান বাম মধ্যপন্থী নির্বিশেষে কোন মহলের জন্যই কল্যাণকর হতে পারে না। এমনকি কোন দেশ বা জাতির জন্যও নয়। ইতিহাসে তার বহু প্রমাণ রয়েছে। বেশি দূর যাওয়ার প্রয়ােজন নেই, বর্তমান ইরানই তার জ্বলন্ত প্রমাণ। সেখানকার বর্তমান শাসকগােষ্ঠীকে কনসেশন দেয়ার পরিণামে শাহকে যেমন নির্বাসনে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে, তেমনি বামপন্থীদেরকেও ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলতে হয়েছে। বাংলাদেশে দলমত নির্বিশেষে সবাই যত তাড়াতাড়ি এই সত্যটি উপলব্ধি করতে পারেন, দেশ ও জাতির জন্য ততই মঙ্গল।
বিভিন্ন মুখােশে জামাত
জামাত একটি কালাে শক্তি। স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি দুষ্টক্ষত। মুক্তিযুদ্ধে তার ঘৃণ্য ভূমিকা এদেশের গণমানুষ এখনাে বিস্মৃত হয়নি। তারা জামাতকে পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী দয়ামায়াহীন একটি ফ্যাসিষ্ট চক্র হিসেবে গণ্য করে। জামাত সম্পর্কে এই ধারণার প্রেক্ষিতে এখনাে রাজনৈতিকভাবে সর্বত্র বিচরণ করা জামাতের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না। তাই সে বিভিন্ন মুখােশে তার ধ্যান-ধারণা সকল স্তরের মানুষের নিকট তুলে ধরার চেষ্টা করছে। এই উদ্দেশ্যে সে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বহু অঙ্গ ও সহযােগী সংগঠন গড়ে তুলেছে। এসব প্রতিষ্ঠান হচ্ছে জামাতের একেকটা মুখােশ। জামাতের একটি মুখােশ হলাে ছাত্র শিবির। এই সংগঠন পাকিস্তান আমলের ইসলামী ছাত্র সংঘেরই উত্তরসূরী। পাকিস্তান আমলে ছাত্রসমাজে বাঙ্গালী জাতীয়তা ও ধর্মনিরপেক্ষতার বিপরীত ধারা সৃষ্টির লক্ষ্যে জামাত সমর্থিত একটি ছাত্র সংগঠন গঠন করা হয়—তার নাম ছিল ‘ইসলামী ছাত্র সংঘ’। এদের তৎপরতা সবচেয়ে বেশী ছিল ১৯৭১ সালে। এমনকি ‘ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার’ আকাঙক্ষায় ধর্মনিরপেক্ষ বাঙ্গালী জাতীয়তাবাদীদের নির্মূল করার ব্যাপারে “সংঘ’ নেতারা অনেক ক্ষেত্রে জামাতের কর্মতৎপরতাকেও অতিক্রম করে গেছে।
১৯৭১ সালে সংঘের নেতারা আলবদর বাহিনী গঠন করে বুদ্ধিজীবী হত্যার সামগ্রিক পরিকল্পনা গ্রহণ করে। স্বাধীন বাংলাদেশে ইসলামী ছাত্র শিবির প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত ছাত্র সংঘ তার গােপন অস্তিত্ব বজায় রাখে এবংসশস্ত্র তৎপরতা চালিয়ে যায়। জেনারেল জিয়ার স্বাধীনতাবিরােধী পুনর্বাসন নীতির সুযােগে ১৯৭৭ সালে পাক আমলের ইসলামী ছাত্র সংঘ কৌশলগত কারণে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। সেবার ৬ ফেব্রুয়ারী সংঘ নেতারা ঢাকার সিদ্দিকবাজারের কমিউনিটি সেন্টারে সমবেত হয়। সেখানে তারা ইসলামী ছাত্র সংঘ কৌশলগত কারণে নতুন নামে আত্মপ্রকাশ করে। সেবার ৬ ফেব্রুয়ারী সংঘ নেতারা ‘টাকার সিদ্দিকবাজারের কমিউনিটি সেন্টারে সমবেত হয়। সেখানে তারা ইসলামী ছাত্র সংঘ’ থেকে ‘সংঘ’ শব্দটি বাদ দিয়ে ‘শিবির’ শব্দ সংযােজন করে। এছাড়া দলীয় পতাকা, মনােগ্রাম ইত্যাদি সবই ছিলাে অবিকল ইসলামী ছাত্র সংঘের। এমনকি শিবির কর্মীদের মধ্যে রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ দেয়ার যে পাঠ্যক্রম রয়েছে তাও ইসলামী ছাত্র সংঘের। এক্ষেত্রে সংঘের স্থলে শিবির ছাড়া আর কিছুই পরিবর্তন করা হয়নি। ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠালগ্নে এর কেন্দ্র থেকে শুরু করে জেলা নেতৃত্বেরসবাই ছিলাে আগেকার ছাত্র সংঘের নেতা ও খুনী আলবদর বাহিনীর কমান্ডার কিংবা সদস্য। আলবদর নেতা মীর কাশেম আলী ছিলেন ছাত্র শিবিরের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। পরবর্তী সভাপতি ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক মােঃ কামরুজ্জামান। ছাত্র শিবিরের অপর একজন সভাপতি আবু তাহের ছিলেন আলবদর কমাণ্ডার এবং ১৯৭১ সালে ইসলামী ছাত্র সংঘের পূর্ব পাকিস্তান শাখার সভাপতি। মােট কথা, ছাত্র সংঘ থেকে ছাত্র শিবির এই হলাে এই প্রতিষ্ঠানটির রূপান্তরের ধারা।। * শিবিরের সাংগঠনিক কাঠামােতে ৪টি স্তর রয়েছে। এগুলাে হচ্ছে, সমর্থক, কর্মী, সাথী ও সদস্য বা রােকন। স্কুল, মাদ্রাসা ও কিণ্ডারগার্টেনকে ভিত্তিমূল ধরে ছাত্র শিবির তার সংগঠনের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। এই কাজটি তারা ‘ফুলকুঁড়ি আসর’ নামের একটি শিশু সংগঠনের মাধ্যমে সুকৌশলে করে যাচ্ছে। ইসলামী পুস্তক-পুস্তিকা পড়িয়ে, খেলাধূলা ও সাংস্কৃতিক প্রতিযােগিতায় এনে, পাঠাগার গড়ে তােলার মধ্য দিয়ে কোমলমতি শিশুদেরকে তারা সংগঠনে টেনে আনছে। ১৯৭৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর শিবিরের এই সংগঠনটি গঠন করা হয়। ১৯৮৮ সাল নাগাদ ২০টি জেলায় ফুলকুঁড়ি আসরের ৩৪টি শাখা গঠন করা । হয়েছে। এসব শাখার সদস্যসংখ্যা ৫ হাজারেরও অধিক বলে জানা গেছে।
প্রতিবছরই এই আসরের জন্য বিরাট অংকের অর্থ ব্যয় করা হয়। শুধুমাত্র ১৯৭৯- ৮০ সালে ফুলকুঁড়ি আসরের ব্যয় ধরা হয়েছিলাে ১৮ লাখ টাকা। একটি দলিলে দেখা গেছে, এই সংগঠন পরিচালনায় রয়েছেন একজন পত্রিকা সম্পাদক, বিশ্ববিদ্যালয় পাস ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশকিছু ছাত্র। তাদের সবাইকে উচ্চহারে বেতন-ভাতা দেয়া হয়। ‘ফুলকুঁড়ি’ নামে একটি মাসিক শিশু-কিশাের পত্রিকাও রয়েছে। এর প্রচার সংখ্যা ১০ হাজারের মত। – ইসলামী ছাত্র শিবিরের বিরুদ্ধে তার সংগঠন সম্প্রসারণের জন্য অন্যান্য কৌশল ছাড়া জালিয়াতির আশ্রয় নেয়ারও অভিযােগ রয়েছে। তারা ছাত্রদের ভর্তির নিশ্চয়তা প্রদান করে নিজেদের দলে নেয়ার চেষ্টা করে। এজন্য তারা ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করে ভর্তিইচ্ছুকদের মধ্যে বিতরণ করে থাকে। এই জালিয়াতিটি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে সবচেয়ে | বেশী করার অভিযােগ রয়েছে। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিবিরের একটি গােপন দলিলে। প্রশ্নপত্র ফাঁস করার একটি পরিকল্পনার উল্লেখ রয়েছে। ১৯৮৪ সালের ১৭ অক্টোবর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবিরের একটি “গােপন জরুরী সদস্য” বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্নপত্র ফাঁস করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। এই বৈঠকে প্রশ্নপত্র বের করার দায়িত্ব দেয়া হয় শিবির নেতা জনৈক ‘আমীর হােসেন’ ভাইকে। এরূপ অন্যায় ও অবৈধ পন্থায় ছাত্র শিবির অসংখ্য ছাত্র-ছাত্রীকে তাদের দলভুক্ত করে চলেছে। . পিছনে উল্লেখ করা হয়েছে, জামাতের স্থপতি মওলানা মওদুদী মহিলাদের সরকারী চাকরি করা, জাতীয় সংসদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা, এক কথায় রাজনীতি করা হারাম ফতােয়া দিয়েছেন। এসব পুরুষের কাজ। ইসলাম নাকি মহিলাদেরকে এসব কাজ করতে বারণ করেছে। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশে জামাতিরা তাদের গুরুর ফতােয়া অমান্য করে মহিলাদেরকে সক্রিয় রাজনীতিতে টেনে আনছে। তারা জামাতের মহিলা শাখা গঠন। করেছে।
সবচেয়ে বড় কথা, ডান, বাম ও জাতীয়তাবাদী নির্বিশেষে কোন রাজনৈতিক দলই পাকিস্তান কিংবা বাংলাদেশে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের নিয়ে আলাদা। কোন সংগঠন করেনি। কিন্তু মহিলাদের সরকারী চাকরি ও সক্রিয় রাজনীতি হারাম ফতােয়াদানকারী জামাতিরা ইসলামী ছাত্রশিবিরের পাশাপাশি একটি ছাত্রী সংগঠনও গড়ে তুলেছে। এটি ইসলামী ছাত্রী সংস্থা নামে পরিচিত। ১৯৭৮ সালের ১৫ জুলাই ঢাকার নাজিরাবাজারে মতিউর রহমান নিযামীর বাসায় গােলাম আযমের পরামর্শক্রমে ইসলামী ছাত্রী সংস্থা গঠন করা হয়। ৯ সদস্যবিশিষ্ট পরিচালনা পরিষদের প্রথম আহবায়িকা করা হয় জনৈকা খন্দকার আয়েশা খাতুনকে। এই সংগঠনের লক্ষ্য হচ্ছে জামাতে ইসলামীতে পুরুষ কর্মী বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ব্যাপকতর আন্দোলনের জন্য মহিলা কর্মী সংগ্রহ করা। জামাতের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্যরাই এই ছাত্রী সংস্থার সার্বিক নিয়ন্ত্রণ করে থাকেন। ইসলামী ছাত্রী সংস্থার সভানেত্রী নুরুন্নিসা সিদ্দিকা এবং অধ্যাপক গােলাম আযমের কিছু চিঠিপত্র থেকে দেখা যায়, গোলাম আযম হচ্ছেন এই সংগঠনের প্রধান উপদেষ্টা। তাঁর বিশেষ অনুমােদনক্রমে এই ছাত্রী। সংস্থার বাৎসরিক পরিকল্পনা; লক্ষ্যমাত্রা এবং বাজেট নির্ধারিত হয়। জামাতে ইসলামীর একটি দলিল থেকে দেখা যায়, এই মহিলা সংগঠনটি শক্তিশালী করার জন্য জামাতিরা সবচেয়ে বেশি অর্থ ব্যয় করছে এবং বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। জামাতে ইসলামীর জয়েন্ট সেক্রেটারী মুহম্মদ ইউসুফ জামাতের মহানগরীর আমীরের নিকট একটি সার্কুলার পাঠিয়েছেন। সাকুলার নং ১৫/৮৪-তে মুহম্মদ ইউসুফ ইসলামী ছাত্রী সংস্থা সম্পর্কে লিখেছেন, “ইসলামী ছাত্রী সংস্থার কাজকে জোরদার করা ছাড়া আন্দোলনের অগ্রগতি কিছুতেই সম্ভব নয়। … স্কুল ও কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে যারা জামায়াত ও শিবির কর্মীদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়া তাদেরকে টার্গেট করে ছাত্রীদের সংগঠনকে মজবুত করতে হবে।
এক্ষেত্রে জামায়াতের কোন উপযুক্ত মহিলা কর্মীর অভাব হলে কোন পুরুষ কর্মীকেই তদারকের দায়িত্ব দিতে হবে। জেলা কেন্দ্রে স্বয়ং জেলা আমীরকেই এ বিষয়ে যত্ন নিতে হবে।” ১৯৮৪-৮৫ সালে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার বাৎসরিক পরিকল্পনা উক্ত সার্কুলার অনুসারে প্রণয়ন করা হয়েছে। পরিকল্পনায় নির্দেশ করা হয়েছে ইসলামী ছাত্রী সংস্থার জন্য কি কি পন্থায় কর্মী সংগ্রহ করা হবে। পরিকল্পনার প্রথম দফায় উল্লেখ করা হয়েছে, “… প্রত্যেক কর্মী নিজ পরিবারের আদর্শিক হিসাবে তার শিক্ষক, শিক্ষিকা, স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিভাসম্পন্ন ছাত্রীদের মাঝে কাজ করবে এবং দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাের অন্তত ১০% ছাত্রীকে সমর্থক পর্যায়ে আনতে হবে। সম্প্রতি জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিষদ ” ছাত্রী সংস্থার নেতৃত্বকারী সদস্যাদের জন্য কয়েকটি মাইক্রোবাসেরও ব্যবস্থা করেছে। সেগুলাে ব্যবহার করে সুদূর গ্রাম পর্যন্ত তারা ছাত্রী সংস্থার তৎপরতাকে জোরদার করছে। ছাত্রী সংস্থার সদস্য সগ্রহের জন্য প্রধানত স্কুলের ছাত্রীদেরকে টার্গেট করা হয়েছে। সম্প্রতি ছাত্রী সংস্থার নাম পরিবর্তন করে ছাত্রী শিবির রাখা হয়েছে। যুব শিবির নামেও জামাতের একটি সংগঠন রয়েছে। এছাড়া রয়েছে জামাতের মহিলা, শ্রমিক ও অন্যান্য শাখা। জামাত মৌখিকভাবে ইসলামের কথা বললেও তাদের কার্যক্রমের সঙ্গে ইসলামের আদর্শের আদৌ কোন সংস্রব নেই। তাই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে তারা নিষ্ঠুরভাবে মােকাবেলা করতে কুণ্ঠিত হয় না। অন্যান্য বিরােধী শক্তি ইসলামী বা অনৈসলামী যাই হােক না কেন জামাতিদের ভাষায় তারা কাফের’। এই ‘কাফের খতম করা একজন প্রকৃত মােমিনের পবিত্র দায়িত্ব। এই কারণেই হােক বা অন্য কোন রহস্যময় কারণেই হােক একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, জামাতিরা ’৭১ সালের মতাে সশস্ত্র বাহিনী গড়ে তুলেছে। যতদূর জানা গেছে, ১৯৭৫ সালের পর কোন এক সময়ে গােলাম আযমের অক্লান্ত পরিশ্রম এবং অন্যান্য জামাত নেতাদের তত্ত্বাবধানে এই ‘আর্মড ক্যাডার’ গঠিত হয়। এদের নামকরণ করা হয়েছে ‘মােমেনীন সালেহীন’। শােনা যায়, এই ‘সালেহীনদের’ ট্রেনিং দেয়া হয় ঝিনাইদহ ও নাটোর এলাকায় এবং নড়াইলের আলবদর বাহিনী কমাণ্ডার সুলায়মান নামক এক জামাতি প্রাথমিক পর্যায়ে এই ট্রেনিং প্রােগ্রামটি পরিচালনা করেন। চট্টগ্রামে এবং দেশের অন্যান্য সুবিধাজনক এলাকার মসজিদেও ট্রেনিং দেয়ার জনশ্রুতি রয়েছে। জানা গেছে, পূর্বে এই সালেহীনদের দু’টি দল মধ্যপ্রাচ্যের কোন একটি দেশে গিয়েছিলাে সশস্ত্র ট্রেনিং গ্রহণের জন্য।
৭১ সালের আলবদরের বর্তমান সংস্করণই হলাে এই ‘মােমেনীন সালেহীন’। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, এই সালেহীনরা কারা? কি তাদের উদ্দেশ্য? এদেশে তারা কি করতে চায় ? এ দিকটির প্রতি সবার অবিলম্বে নজর দেয়া উচিত। বলে আমরা মনে করি। * জামাতে ইসলামীর আরেকটি সংগঠন ‘ফালাহ আম ট্রাস্ট’। এই ট্রাস্ট গঠন করা হয় ষাটের দশকের শেষ দিকে। কয়েকজন পাকিস্তানী ধনী তাদের বাঙ্গালী দোসরদের নিয়ে এই ট্রাষ্ট গঠন করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নতুনভাবে সে ট্রাস্ট গঠন করা হয়। পুনরুজ্জীবনের পর এই ট্রাস্টে ছিলেন এ আর লস্কর, জনৈক এইচ এম হুমায়ুন ও মওলানা আবদুল খালেক। এই তিনজনের মধ্যে একজন মারা গেছেন; পরবর্তীতে আরাে কয়েকজনকে ট্রাষ্টী নিয়ােগ করা হয়েছে। অনুসন্ধানে জানা গেছে, বর্তমান ট্রাষ্ঠীদের মধ্যে রয়েছেন জামাতে ইসলামীর ভারপ্রাপ্ত আমীর আব্বাস আলী খান, এ কে এম ইউসুফ, দেওয়ান টেক্সটাইল মিলের জনাব দেওয়ান, এ আর লস্কর, এইচ এম হুমায়ুন প্রমুখ। সব মিলিয়ে সদস্যসংখ্যা ১২। এই ট্রাস্ট পচিশ লাখ টাকা ব্যয়ে (কারাে কারাে মতে ৪২ লাখ টাকা) মগবাজারে একটি বিরাট বাড়ি ক্রয় করে। অথচ বর্তমান ট্রাস্টীদের অনেকেরই সুনির্দিষ্ট আয়ের কোন পথ নেই। অভিজ্ঞ মহল জানান, পার্টির মুখপত্র দৈনিক সংগ্রামের মালিকানা দখল করার জন্য এই ট্রাস্ট পুঁজি বিনিয়ােগ করতে থাকে। কিন্তু অন্যান্য অংশীদাররা ট্রাস্টের নামে শেয়ার কেনার কথা বললে তারা তা করতে রাজী হননি। বরং বিভিন্ন ব্যক্তির নামে শেয়ার বিক্রির জন্যে চাপ দিতে থাকেন। অংশীদাররা তাদের পুজির উৎস জানতে চাইলে ট্রাস্ট বা জামাত তা জানায়নি। এই ট্রাস্ট বর্তমানে বহু সম্পত্তির মালিক। অভিযােগ আছে, ট্রাষ্ট বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে যাকাতের (!) অর্থ সংগ্রহ করে। বর্তমানে এই ট্রাস্টের সুরম্য অট্টালিকায় দৈনিক সংগ্রামের কার্যালয়। এই ট্রাস্টের প্রেস থেকেই সংগ্রাম ছাপা হয়। অভিযােগ আছে, এই ট্রাস্টের অর্থেই পার্টি চালানাে হয়। আরাে জানা গেছে, ২৬টি চ্যানেলে জামাতে ইসলামী ঢাকায় বিভিন্ন সূত্র থেকে অর্থ।
লাভ করে। এ অর্থ দিয়ে ব্যাপকভাবে সংগঠন চালানাে হয়। তার ভেতর রয়েছে ইসলামী । ছাত্র শিবিরের প্রতিটি ইউনিটের পরিচালনাধীন মেস ব্যবস্থা। প্রতিটি মেসে ৫ থেকে ১০ জন ছাত্র থাকে। এ অর্থ দিয়ে কর্মীদের যাতায়াতের সুবিধার্থে যানবাহনও কিনে দেয়া হয়েছে। জামাতের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ‘শতাব্দী প্রেস’। এটি ছাত্র শিবিরের প্রকাশনী সংস্থা হিসেবে কাজ করে। এ ছাপাখানা থেকে প্রকাশিত হয় ‘শতাব্দী ডাইরী’। ১৯৮২ সাল থেকে ইসলামী ছাত্রশিবির জামাতের পূর্ণ অংগ সংগঠন হিসেবে নিয়ন্ত্রিত হতে থাকে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহের বিপুল পরিমাণ টাকায় তারা বিভিন্ন প্রকার সংগঠন এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান গড়ে চলেছে একের পর এক। এগুলােনিয়ন্ত্রিত এবং পরিচালিত হচ্ছে জামাত এবংশিবির কর্তৃক। এসব ব্যয়বহুল প্রতিষ্ঠানে চাকরিও পেয়ে থাকে তাদের দলীয় কর্মীরা। ১৯৮২ সালের পর থেকে এরা অর্থনৈতিক এবং সাংগঠনিকভাবে এত শক্তিশালী হয়েছে যার তুলনা বাংলাদেশের অন্য কোন রাজনৈতিক সংগঠনের সঙ্গে কোনক্রমেই চলে না। বালাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযােগে আবার মেতে উঠেছে সেই ‘৭১-এর গণহত্যার নেপথ্য নায়ক জামাতিরা। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, বর্তমান বাংলাদেশে এমন কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলাের পরিচালনার গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে এমন সব ব্যক্তিরা রয়েছেন যারা একই সঙ্গে জামাতের কেন্দ্রীয় পরিষদ, অঙ্গ সংগঠন কিংবা এর বিভিন্ন শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদে বহাল রয়েছেন। এসবের কয়েকটির বিবরণ হলাে ঃ বর্তমানে জামাতের মজলিসে শূরার একজন সদস্য একই সঙ্গে ইসলামিক সমাজকল্যাণ পরিষদের পরিচালক এবং ইসলামী ব্যাংকের বাের্ড অব ডিরেক্টর্সের সদস্য। বর্তমানে জামাতের কেন্দ্রীয় মজলিসে আমেলার একজন সদস্য একই সঙ্গে ‘ইসলামিক ইকনমিস্ ব্যুরাের সার্বিক তত্ত্বাবধায়ক এবং দৈনিক সংগ্রামের নির্বাহী পরিচালক।
বর্তমানে জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় মজলিসে শূরা’র একজন সদস্য, একই সঙ্গে তিনি বাংলাদেশ ইসলামিক সেন্টারের পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠান থেকেই মাসিক কলম’, ‘পৃথিবী এবং ‘আল-ইসলাম’ পত্রিকাগুলাে প্রকাশিত হয়। এক সময়। জামাত সমর্থিত শিবিরের কার্যনির্বাহী পরিষদের সদস্য বর্তমান জামাতের একজন কর্মী। তিনি আবার ‘বাল্লা সাহিত্য পরিষদের সার্বিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ােজিত আছেন। বর্তমান। জামাতের একজন কর্মী ‘বিপরীত উচ্চারণ’ নামক একটি সাহিত্য সংগঠনের পরিচালক। হিসাবে নিয়ােজিত আছেন। বর্তমানে জামাত নিয়ন্ত্রিত শিবিরের একজন সদস্য একই সঙ্গে। ‘সাইমুম শিল্পী, গােষ্ঠীর সভাপতি। আপাতত এর নিজস্ব কোন অফিস নেই। ৩৭, নিউ এলিফ্যান্ট রােডস্থ শিবির অফিসের মাধ্যমে, এরা সকল যােগাযােগ রক্ষা করে থাকেন। জামাতের একজন কর্মী বর্তমান ‘ফুলকুঁড়ি’ শিশু সংগঠনের সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। জামাতের একজন রােকন একই সঙ্গে ‘ইসলামিক ইন্সটিটিউটের পরিচালক। এই প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে ‘আধুনিক প্রকাশনী প্রেস’ রয়েছে। মূল্য কয়েক কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় জামাতের সাংগঠনিক সম্পাদক একই সঙ্গে ‘ফালাহ আম ট্রাস্ট’-এর প্রধান তত্ত্বাবধায়ক। এই ট্রাস্টের অধীনে দু’টো অত্যাধুনিক প্রেস রয়েছে।
জামাতের একজন রােকন, অন্যদিকে তিনি ইসলামিক এডুকেশন সােসাইটি’র সার্বিক পরিচালনায় রয়েছেন। এই প্রতিষ্ঠানটির নিয়ন্ত্রণে সারাদেশে কমপক্ষে ৭৫টি কিন্ডারগার্টেন আছে। ঢাকা শহরে অবস্থিত এই ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলাের মধ্যে কয়েকটি হলাে আয়েশা একাডেমী, বাদশাহ ফয়সাল কিন্ডারগার্টেন, কিং খালেদ কিন্ডারগার্টেন, মানারত ইন্টারন্যাশনাল, আদর্শ স্কুল (নারায়ণগঞ্জ) ইত্যাদি। প্রধানত এইসব কিন্ডারগার্টেনে আমাদের নতুন প্রজন্মদের দীক্ষিত কক্স হচ্ছে স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমত্ব বিরােধী ধ্যান-ধারণায়। রবীন্দ্রনাথ হিন্দু, তাই এইসব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অধিকাংশেই গাইতে দেয়া হয় না আমাদের জাতীয় সঙ্গীত। যতদূর জানা যায়, এখানে সেই হীরক রাজার দেশের মগজ ধােলাই প্রক্রিয়ায় শিশুদেরকে স্বাধীনতা সম্পর্কে জামাতি ধ্যান-ধারণার ব্যাখ্যা দিয়ে কোমল শিশুমনে অসুস্থ চিন্তার বীজ বপন করা হচ্ছে।
বর্তমান জামাতের সেক্রেটারী জেনারেল একই সঙ্গে ‘চাষী কল্যাণ সমিতি’র সভাপতির দায়িত্বে আছেন। জামাতের কেন্দ্রীয় মজলিসে আমেলা’র একজন সদস্য একই সঙ্গে ‘শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশনের পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। বর্তমান কেন্দ্রীয় মজলিসে আমেলা’র সদস্য এবং কেন্দ্রীয় জামাতের বিদেশ বিভাগের সেক্রেটারী একই সঙ্গে ‘দারুল ইফতা’র সার্বিক পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। জামাতে ইসলামীর নায়েবে আমীর একই সঙ্গে ‘দৈনিক সংগ্রাম পত্রিকার ম্যানেজিং ডিরেক্টর এবং “দারুল ইসলাম ট্রাস্টে’র পরিচালনার দায়িত্বে আছেন। এই ট্রাস্টের মাধ্যমে উত্তরা মডেল টাউনে প্রায় পাঁচ একর জমি কেনা হয়েছে। একটি সূত্র থেকে জানা গেছে, এই জমির ওপর বহুতলা আধুনিক ভবন নির্মাণ করা হবে। সেখানে বিভিন্ন প্রকাশনীসহ তাদের উচ্চতর ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা। থাকবে। জামাতে ইসলামীর একজন রােকন একই সঙ্গে বাংলাদেশ মসজিদ মিশনের সভাপতির দায়িত্বে আছেন। এই মিশনটির সেক্রেটারী জামাতের একজন রােকন। জামাতে ইসলামী ঢাকা মহানগরীর আমীর সাপ্তাহিক সােনার বাংলা পত্রিকার পরিচালক।
পত্রিকাটির সম্পাদক কেন্দ্রীয় জামাতে ইসলামীর প্রচার সম্পাদক। প্রাক্তন শিবির নেতা ও চাকসু ভিপি বর্তমানে ইবনে সিনা ট্রাস্টের ৭টি শাখার মধ্যে একটির দায়িত্বে রয়েছেন। ইসলামী ছাত্রশিবিরের প্রাক্তন সভাপতি ইবনেসিনা ট্রাস্টের একটি শাখার দায়িত্বে আছেন। এছাড়া এই ট্রাস্টের অন্যান্য শাখার গুরুত্বপূর্ণ পদসমূহে যারা নিয়ােজিত আছেন এক সময়। তারা সবাই ইসলামী ছাত্র শিবিরের কেন্দ্রীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন এবং বর্তমানে তারা প্রত্যক্ষভাবে জামাতের দায়িত্বশীল পদে বহাল রয়েছেন। সৌদী আরব ভিত্তিক সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠান রাবেতা আলম-ই-ইসলামের বাংলাদেশ শাখা নিয়ন্ত্রণ করছে জামাতিরা। একজন প্রভাবশালী জামাত ও আলবদর নেতা মীর কাসিম আলী এই প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের দায়িত্বে রয়েছেন। বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে হাসপাতালসহ বেশ কতকগুলাে প্রকল্প এই প্রতিষ্ঠানের রয়েছে। এসব প্রকল্পের কলাকুশলী থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীটিও জামাতের লােক ছাড়া অন্য কাউকে নেয়া হয় না। এসব কর্মচারীর মাধ্যমে সাধারণ মানুষকে জামাতে যােগদানের জন্য উদ্বুদ্ধ করা হয়। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দুর্যোগ কবলিত এলাকায় রাবেতা ত্রাণ তৎপরতা চালিয়ে থাকে।
এই প্রতিষ্ঠানের সকল অবদানকে জামাতের অবদান হিসেবে সাধারণ মানুষের মধ্যে প্রচার করা হয়। জামাতের লােকেরা কোন কোন ক্ষেত্রে রাবেতার নামটি পর্যন্ত উল্লেখ করতে চায় । ১৯৮৯ সালে মানিকগঞ্জের টর্নেডাে বিধ্বস্ত এলাকায় রাবেতার পক্ষ থেকে গৃহহীন লােকদের পুনর্বাসনের উদ্যোগ নেয়া হয়। এটি একটি সৌদী আরব ভিত্তিক আন্তর্জাতিক মুসলিম জনকল্যাণ প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে সৌদী আরব বাংলাদেশের জনসাধারণকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকা প্রদান করে। কিন্তু দলমত নির্বিশেষে সকল গরীব জনসাধারণের উদ্দেশ্যে দেয়া অর্থ নিয়ন্ত্রণ ও বিতরণের দায়িত্বে রয়েছে জামাতের লােক। স্বভাবতই এই প্রতিষ্ঠানের সকল তৎপরতার কৃতিত্বও নিচ্ছে জামাত। বলা চলে, এই প্রতিষ্ঠানের তৎপরতাকে জামাত তার দলের প্রচার-প্রসারে ব্যবহার করছে। | বাংলাদেশে জামাতিদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক সুযােগ-সুবিধা লাভের আর একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে ইসলামী ব্যাংক। এই ব্যাংকটি প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যার সবচেয়ে বেশী অবদান রয়েছে তিনি হলেন বাংলাদেশে সৌদী আরবের সাবেক রাষ্ট্রদূত ফুয়াদ আবদুল হামিদ আল খতিব। তিনি বর্তমানে মালয়েশিয়ায় সৌদী রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি অধ্যাপক গােলাম আযমের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু। জামাতে ইসলামীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক তৎপরতায় সহায়তাদানে সৌদী আরবের সমর্থন আদায়ে খতিবের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে। তিনি বাংলাদেশে রাষ্ট্রদূতের দায়িত্ব পালনকালে ইসলামী ব্যাংকের একজন ডিরেক্টর মনােনীত হন। সম্ভবত এই ব্যাংকে তাঁর বিরাট পুজিও রয়েছে। | ইসলামী ব্যাংক পরিচালকমন্ডলী ছাড়াও শরীয়া কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত হয়। পরিচালকমন্ডলী ও শরীয়া কাউন্সিলের প্রায় সব সদস্যই জামাতে ইসলামীর মজলিসে শুরার সদস্য। দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করা যায়, বর্তমান নির্বাহী সহ-সভাপতি জনাব নূরুল ইসলাম জামাতের শূরার সদস্য।
পরিচালক শামসুদ্দিন চট্টগ্রাম মহানগরী জামাতের সদস্য। শরীয়া কাউন্সিলের সদস্যদের মধ্যে মওলানা কামালউদ্দিন জাফরী, দেলােয়ার হােসেন সাঈদী, মওলানা মুহম্মদ আলী, সাবেক আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক আবদুল জব্বার শূরার সদস্য। তারা সবাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ভাতা পেয়ে থাকেন। ব্যাংকের একটি যাকাত ফাণ্ড রয়েছে। ইসলামী ব্যাংকের আয়ের শতকরা আড়াই ভাগ। যাকাত ফাওে যায়। এর প্রায় পুরােটাই জামাত তার রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে বা দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করে। ইসলামী ব্যাংকের ঋণের সুযােগ-সুবিধা তাদের মধ্যে সীমাবদ্ধ। এমনকি জামাতের বাইরের কোন লােককে কর্মচারীও বড় একটা নিয়ােগ করা হয় না।। জামাতের একটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে আধুনিক প্রকাশনী। ২৫, শিরিস দাস লেনে আধুনিক প্রকাশনীর প্রধান কার্যালয়। এখান থেকে জামাতের শত শত বই, বুকলেট, পােস্টার প্রভৃতি প্রকাশ করা হয়। কোন কোন পুস্তক একই সংস্করণে এক লাখ পর্যন্ত ছাপা হয়। এদেশের কোন প্রকাশনী একই সংস্করণে এতাে পুস্তক প্রকাশ করতে পারেনি। আধুনিক প্রকাশনীর বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে ১৩/৩, পেয়ারী দাস রােডে। এই প্রকাশনীর আর একটি বিক্রয় কেন্দ্র রয়েছে বায়তুল মােকাররমে। শিরিস দাস লেনে আধুনিক প্রকাশনীর উন্নতমানের। প্রেসটিতে কয়েক কোটি টাকার মেশিনপত্র রয়েছে। এই প্রেসের কর্মচারীরা অনেকেই। জানে না এর মালিক কে। স্থানীয়ভাবে জনশ্রুতি আছে এটি মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশের প্রেস। অথচ এখান থেকে জামাতের রাজনৈতিক তৎপরতার সবকিছু ছাপা হচ্ছে। আসলে এটি জামাত রাজনীতির একটি আখড়া। * এভাবে জামাতিরা আরাে অনেক সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের সাথে। জড়িত রয়েছে। সেসব প্রতিষ্ঠান থেকে তারা সুকৌশলে দলীয় ধ্যান-ধারণা সাধারণ্যে। প্রচার করে চলেছে।
সাংগঠনিক তৎপরতা
জামাতের সংগঠনসম্পর্কে বাইরের লােকজনের ধারণা খুব সীমিত। একটি ফ্যাসিস্ট পার্টির মতই জামাত অত্যন্ত সংঘবদ্ধ এবং নিবেদিত সংগঠন। সুচতু। কৌশলে, টার্গেট নির্ধারণ করে, প্রাথমিক প্রর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রভাব খাটিয়ে এরা সদস্য সংগ্রহের কাজে হাত দেয়। প্রাথমিক পর্যায়ে ধর্মীয় অনুভূতিকে কাজে লাগিয়ে এরা মন জয় করার চেষ্টা করে। শুরুতেই সংগঠনের সদস্য হওয়ার প্রস্তাব দেয় না। কেননা তাতে হিতে বিপরীতের সম্ভাবনা থাকে। একবার এ কাঠামাের ভেতর ঢুকে গেলে আর বেরুনাের উপায় নেই। দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে তাই মাত্র একবার জামাত দ্বিধাবিভক্ত হয়েছে। তাও বাংলাদেশে। অপরদিকে জামাত একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন। বাংলাদেশসহ বিভিন্ন দেশে এর শাখা রয়েছে। | প্রাথমিক পর্যায়ে কেউ জামাতের পূর্ণাঙ্গ সদস্যপদ পায় না। আনুগত্যের একটা পর্যায় শেষে এদের বলা হয় মুত্তাফিক বা সহযােগী সদস্য। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে রােকন বা পূর্ণাঙ্গ সদস্য। পরবর্তী পর্যায়ে সদস্য, মজলিসে আমেলা ও শােরা। পূর্ণাঙ্গ সদস্য পদ লাভের পর সদস্যরা সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে সংগঠনের কাজ করে। এজন্যে তারা সংগঠন থেকে মাসিক মাসােহারাও লাভ করে। পাকিস্তান আমল থেকেই এ নিয়ম চালু আছে। বর্তমানে এ নিয়ম ব্যাপকভাবে চালু রয়েছে। কেন্দ্র থেকে শুরু করে থানা পর্যায়ের কর্মীরা মাস শেষে বেতন পায়। ঢাকা থেকে এই বেতন পাঠানাে হয়। যারা ‘রােকন তাদের বেতন বেশি। এ জামাতে ইসলামী বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রয়ােগ করে তার কর্মী সংগ্রহ করে। কর্মী সংগ্রহের এই রকম একটি কৌশলের নাম হচ্ছে ‘চলাে গ্রামে যাই। জামাতিরা এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মফস্বল শহর এবং গ্রাম থেকে ডাকযােগে সদস্য সংগ্রহ করে। প্রথম অবস্থায়। জামাত-শিবিরের প্রতিটি কর্মী কমপক্ষে পাঁচজন পরিচিত ব্যক্তিকে টার্গেট করে অগ্রসর হয়। প্রধানত স্কুলের ছাত্র-ছাত্রীদেরকেই তারা টার্গেট করে থাকে। এই দলের সদস্যরা বছরের বিভিন্ন সময় স্কুল এবং মসজিদগুলােতে তাদের ঘােষিত দাওয়াতি সপ্তাহ পালন করে। এভাবে যে ক’জনকে তারা সমর্থক হিসাবে পায় তাদেরকে নিয়ে সাংগঠনিক সপ্তাহ পালন করে। সেমিনারের মাধ্যমে নতুন সদস্যদেরকে বক্তৃতা, পােস্টারিংসহ বিভিন্ন বিষয়ে।
শিক্ষা দেয়া হয়। রাজধানী ঢাকা শহরে তাদের তৎপরতা একটু আলাদা গােছের। এখানে ঘাটি এলাকা নামে চিহ্নিত করে তারা সদস্য সংগ্রহের কাজ করে থাকে। প্রথমে যে, অঞ্চলকে ঘাটি এলাকা হিসাবে চিহ্নিত করে সেখানে থাকার জন্য মেস-এর ব্যবস্থা করে। ঐ এলাকার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একটা যােগাযােগ গড়ে তােলে। এই ঘাটি এলাকাগুলােতে জামাতিরা বিভিন্ন ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ে তােলে এবং সেগুলাে তারা সংগঠনের কাজে ব্যবহার করে। বাংলাদেশে সম্ভবত জামাতই একমাত্র রাজনৈতিক সংগঠন যার হাজার হাজার সার্বক্ষণিক কর্মী রয়েছে। এদের কর্মতৎপরতাসমগ্র দেশব্যাপী। এইসব সার্বক্ষণিক কর্মীর থাকা-খাওয়া, যাতায়াত খরচসহ কখনাে কখনাে তাদের পরিবারের ভরণ-পােষণ ব্যয়ও জামাতের অর্থ তহবিল বহন করে থাকে। জামাতের সার্বক্ষণিক কর্মীরসংখ্যা ঢাকা শহরেই সর্বাধিক। এইসব সার্বক্ষণিক কর্মীর জন্য ঢাকার প্রতিটি ওয়ার্ডে একটি করে অফিস এবং অফিস সংলগ্ন মেসেরও ব্যবস্থা আছে। প্রথমে কেন্দ্রীয় অফিস থেকে এই কর্মীদের বিভিন্ন। এলাকাভিত্তিক কাজের নির্দেশ দেয়া হয়। এই নির্দেশ অনুযায়ী সার্বক্ষণিক কর্মীরা মসজিদ এবং শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ উক্ত এলাকা ‘জামাতীকরণ’-এর অভিযান চালায়। সার্বক্ষণিক কর্মীদের অবগতির জন্য লিখিত এক গােপন দলিলে দেখা্যায়, তারা সদস্য সগ্রহের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকে স্কুল ও কিন্ডারগার্টেনগুলোর ছাত্র-ছাত্রীদের এবং মহল্লার মসজিদগুলােতে যারা নিয়মিত নামাজ পড়তে আসেন তাদেরকে। এই গােপন দলিলের লক্ষ্যমাত্রায় উল্লেখ আছে—“ ••• জনশক্তির সর্বপর্যায়ে ব্যক্তিগত দাওয়াতী কাজের অনুভূতি বৃদ্ধি, দাওয়াতী কাজের ক্ষেত্র সম্প্রসারণ, বিশেষ করে স্কুলে দাওয়াতী তৎপরতা জোরদার করা। ••• প্রত্যেক কর্মী তিনজন করে বন্ধু টার্গেট নেবেন। টার্গেটকৃত বন্ধুদের সকলকেই স্কুলের ছাত্র রাখবেন।” দলিলে ‘দাওয়াতী’ প্রক্রিয়ার দ্বিতীয় মাধ্যম হিসেবে নির্দেশ করা হয়েছে মসজিদগুলােকে। দলিলে তারাউল্লেখ করেছে—“… মসজিদে ও প্রতি থানায় কমপক্ষে একটিতে মসজিদভিত্তিক দাওয়াতী কাজ করা হবে ••• সামগ্রিক তৎপরতার মাধ্যমে নেতৃত্বের যােগ্যতাসম্পন্ন কর্মী তৈরি করে সাংগঠনিক মজবুতি আনয়ন করা।”
এ কারণেই জামাতিরা তাদের নিজস্ব অর্থে ডজন ডজন কিন্ডারগার্টেন এবং স্কুল গড়ে তুলছে। এগুলােকে তারা সদস্য সগ্রহের ‘জামাতি ফাঁদ’ হিসাবে ব্যবহার করছে। জামাতিদের সাংগঠনিক অপকৌশলের সবচেয়ে উল্লেখযােগ্য দিক হচ্ছে পবিত্র মসজিদগুলােকে রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করা। বিগত দশ বছরে জামাতিরা তাদের ভাষায় দেশের মােট প্রায় ষাট ভাগ মসজিদের উপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে। নিয়ন্ত্রণের প্রধান কৌশল হচ্ছে বিপুল পরিমাণ আর্থিক অনুদান। জামাতের বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান এই অর্থ সরবরাহ করে থাকে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট-এর কচুক্ষেত মসজিদের সম্পাদক জামাতে ইসলামীর আমীরেরনিকট ১৯জুলাই, ১৯৮৩-তে একটি আবেদনপত্র পাঠিয়েছেন। আবেদনপত্রে তিনি মসজিদের জন্য পঞ্চাশ হাজার টাকা, ইবনে সিনা ট্রাস্ট-এর চেয়ারম্যানের মাধ্যমে চেয়েছেন। অনুসন্ধান করে জানা গেছে, আর্থিক অনুদানের অছিলায় জামাতিরা প্রথমে মসজিদ কমিটির সদস্য নির্বাচিত হয়। পরে ইমাম-মােয়াজ্জিনসহ মসজিদের অন্যান্য পদগুলােয় তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করে। স্থানীয় মসজিদগুলােকে এভাবে জামাতিরা রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার করে থাকে। তারা সাধারণত শুক্রবার দিন লিফলেট ও সংগঠনের অন্যান্য জিনিস বিতরণ করে। সংশ্লিষ্ট মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন দলীয় হলে নামাজের আগে কিংবা পরে সেদিনের কর্মসূচী সম্পর্কে সবাইকে জানিয়ে দেয়।
১৯৭৬ সাল থেকে ‘৮১ পর্যন্ত সাংগঠনিক তৎপরতার প্রথম পর্যায়ে জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন গড়ে তােলে। দ্বিতীয় কার্যক্রম হিসেবে জামাত পদস্থ সরকারী পদে নিজস্ব রাজনৈতিক কর্মী নিয়ােগের পরিকল্পনা। গ্রহণ করে। এভাবে জামাতিরা তাদের কর্মীদেরকে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলাের গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করে সেগুলােতে তাদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার পদক্ষেপ নিয়েছে। » জামাত কিংবা জামাত সমর্থিত শিবির কর্মীরা যেসব সরকারী কিংবা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের প্রশাসনিক পদে বহাল রয়েছেন জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় পরিদপ্তর সেসব কর্মীদের চাকরির বর্তমান অবস্থান সংক্রান্ত বিষয়াদির বিশেষ ফাইল রক্ষা করে থাকে। জামাতের একটি দলিল থেকে দেখা যায়, এইসব প্রশাসনিক দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা জামাতি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে সাংগঠনিক তৎপরতা এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। জামাতের এই বিশেষ দলিলে একশ’ বত্রিশজনের নামের উল্লেখ রয়েছে। তারা বর্তমানে বিভিন্ন সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের পদস্থ কর্মকর্তা। জামাতে ইসলামী, এসব পদস্থ চাকরিজীবীদের নিয়ে বছরে অন্তত একবার বিশেষ সেমিনারের আয়ােজন করে। সেমিনারে এসব চাকরিজীবী নিজ নিজ এলাকার কর্মতৎপরতা, অগ্রগতি ইত্যাদি বিষয়ে। রিপাের্ট পেশ করে থাকেন। মহিলা জামাতিদের প্রধান কাজ হচ্ছে বাড়ি বাড়ি গিয়ে মহিলা সমর্থক সংগ্রহ করা। জামাতের এই মহিলা তাবলীগ দলের তৎপরতা সমগ্র দেশব্যাপী। এইসব মহিলা জামাতি বিভিন্ন ধরনের কৌশল প্রয়ােগ করে ধর্মপ্রাণ মুসলিম মহিলাদেরকে বিশেষ কর্মী হিসাবে সংগ্রহ করছে। ছােট ছােট দলে বিভক্ত করে এদেরকে এলাকাভিত্তিক কাজের নির্দেশ দেয়া। হয়। জামাতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় অফিসের প্রত্যক্ষ তদারকিতেই এদের কর্মকাণ্ড পরিচালিত হয়। এই মহিলা জামাতিরা মহল্লার বাড়ি বাড়ি ঘুরে তাদের পূর্ব পরিকল্পনা অনুসারে একটি নির্দিষ্ট বাড়িতে মহিলাদের জড় করে। আবার কখনাে কখনাে প্রতিটি বাড়িতেই পৃথক পৃথকভাবে আলােচনার আয়ােজন করে। বাকপটু এই মহিলারা ধর্মীয় বিষয় নিয়ে শুরু করলেও শেষ পর্যন্ত বুঝিয়ে থাকে যে, জামাই ইসলাম ধর্ম কায়েমের একমাত্র পথ। ঢাকায় বিভিন্ন এলাকার কয়েকজন গৃহবধূ জানান, এই তাবলীগ নামধারী জামাতিরা বলে থাকেন, উপস্থিত মহিলারা যেন তাদের পরিবারের অন্য সদস্যদের জামাত রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেন।
জামাতের নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকল কর্মী তাদের দাওয়াতি অভিযানে অত্যন্ত সূক্ষ্ম কৌশল অবলম্বন করে থাকে। এসব কৌশলের ফাঁদ থেকে বেরিয়ে আসা অনেকের পক্ষেই সম্ভব হয় না। আমি নিজেও একদিন কয়েকজন জামাত কর্মীর দাওয়াতি অভিযানের টার্গেট হয়েছিলাম। ১৯৮৬ সালের জানুয়ারি মাসের এক শুক্রবার বিকেলে তিন/চারজন যুবক। আমার বাসায় আসে। দরজা খুলতেই তারা বলে, আপনার সাথে আমাদের কিছু কথা আছে। তাদের মধ্যে আমার সামনের বাসারও এক ছেলে আছে। সে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। মেধাবী ছাত্র। ব্যবহারও অমায়িক। ঘরে বসার পর পরিচিত ছেলেটি সবার সঙ্গে আমাকে পরিচয় করিয়ে দিলাে। সবাই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভাল ভাল বিষয়ে পড়ে। এরপর একটি ছেলে বললাে, আমরা আপনাকে দাওয়াত দিতে এসেছি। ভাবলাম, কোন অনুষ্ঠানে। বােধ হয় যাওয়ার জন্য দাওয়াত নিয়ে এসেছে। বললাম, কোথায়। একজন বললাে, ইসলামের দাওয়াত দিতে এসেছি। ইতিমধ্যে ব্যাপারটা আমি আচ করে ফেলেছি। বললাম, তােমরা কি আমাকে মুসলমান মনে করাে না? আমার এ কথায় তারা একটু বিব্রত হয়ে পড়লাে। একজন বললাে, জামাতে ইসলামীর দাওয়াত। বললাম, তাই বলাে। এ কথাটা আগে বললে তাে আর এত কথা বলতে হতাে না। তােমরা বােধ হয় আমাকে চিন না। চিনলে আসতে না। একজন বললাে, না, আপনাকে আমরা চিনি। জেনেশুনেই এসেছি। ইসলামের দাওয়াত আমরা সবাইকে দিচ্ছি। বললাম, আবারাে গােলমাল করে ফেললে। ইসলাম আর জামাতে ইসলামীকে এক করে ফেললে। আমরা কিন্তু ইসলাম আর জামাতকে এক মনে করি না। ইসলাম আমাদের ধর্ম আর জামাতে ইসলামী হচ্ছে একটি রাজনৈতিক সংগঠন। সে যাই হােক, তােমরা ছেলেমানুষ। কথা বাড়ানাে ঠিক নয়। ইসলাম প্রচারের ব্যাপারে তােমাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই। তবে তােমাদের নেতাদের আন্তরিকতা সম্পর্কে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। আমি মনে করি, তােমাদের নেতারা পবিত্র ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছেন।
তারা কি যেন বলতে চাচ্ছিলাে। বলার সুযােগ না দিয়ে বললাম, তােমাদের নেতাদের সম্পর্কে সন্দেহমুক্ত হলে কালই আমি তােমাদের দলে যােগদান করব। তবে এজন্য তিনটি বিষয়ে তােমাদের নেতাদের স্পষ্ট বক্তব্য এনে দিতে হবে। তারা জিজ্ঞেস করলাে, সেগুলাে কি কি ? বললাম, প্রথমে আমাদের দেশের কথাই বলছি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, এটা কি আল্লাহ তায়ালার ইচ্ছের বিরুদ্ধে হয়েছে, না তাঁর ইচ্ছে অনুযায়ী হয়েছে? তারা বললাে, অবশ্যই আল্লাহর ইচ্ছে অনুসারে হয়েছে। তাহলে তােমরা আমার সাথে একমত হবে, মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদার বাহিনীকে সহযােগিতা বা সমর্থনকারীরা আত্মাহর ইচ্ছের বিরােধী কাজ করেছে। এ কথাটি তােমাদের নেতাদের স্বীকার করতে হবে। বলতে হবে মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা আল্লাহর ইচ্ছের বিরােধী কাজ করেছি। আচ্ছা, ইসলাম কি শােষণমূলক অর্থনীতি অনুমােদন করে, না শশাষণমুক্ত অর্থনীতি? নিশ্চয়ই ইসলাম। শােষণমূলক অর্থনীতি অনুমােদন করে না। আর ধনতন্ত্র হচ্ছে শশাষণমূলক অর্থনীতির ফলশ্রুতি। সুতরাং ধনতন্ত্র বা পুজিবাদের বিরুদ্ধে তােমাদের নেতাদের স্পষ্ট বক্তব্য থাকতে হবে। আমার তৃতীয় বিষয়টি হলাে—গণতন্ত্র। তােমাদের কি মত ইসলাম কি গণতন্ত্র সমর্থন করে, না রাজতন্ত্র ? তারা বললাে, ইসলামে রাজতন্ত্রের কোন অবকাশ নেই। বললাম, বেশ ভাল কথা। তােমাদের নেতাদের বক্তব্যে এ কথাটা থাকবে যে, ইসলাম।
রাজতন্ত্র সমর্থন করে না। মধ্যপ্রাচ্যের সৌদি আরব, আরব আমিরাত, কুয়েত প্রভৃতি দেশের রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা ইসলামবিরােধী রাষ্ট্রব্যবস্থা। এই তিনটি ব্যাপারে তােমাদের নেতাদের বক্তব্য যত তাড়াতাড়ি আনতে পার, তত তাড়াতাড়ি আমাকে তােমাদের দলের একজন কর্মী হিসেবে পাবে। শুধু তাই নয়, আমি তাদের বক্তব্য অর্থ ব্যয় করে হলেও সংবাদপত্রে ছাপার ব্যবস্থা করব। তারা বললাে, এটা তেমন কিছু নয়, আমরা আগামীকালই নিয়ে আসব। বললাম, যখনই আনাে তখনই আমাকে তােমাদের একজন হিসেবে পাবে। ছেলেগুলাে চলে গেল। কিন্তু আজো তারা ফিরে আসেনি। তাদের চেহারা আমি ভুলে গেছি। তবে বাসার সামনের ছেলেটির সাথে মাঝেমধ্যে দেখা হয়। মনে হয় সে আমাকে এড়িয়ে চলে। এ হচ্ছে জামাতিদের ইসলামের প্রতি আন্তরিকতার একটি দৃষ্টান্ত। আমি জানি, জামাত নেতারা এই তিনটি বিষয়ে কোনদিনই সত্যিকার ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকে সঠিক অভিমত দিতে পারেন না। কারণ মুক্তিযুদ্ধে তাদের অপরাধ তারা কখনাে স্বীকার করবে না। তাদের আয়ের উৎস আরবের পেট্রো-ডলারসমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলাে সম্পর্কেও তারা টু শব্দটি করবে না। কারণ তাতে হালুয়া-রুটি বন্ধ হয়ে যাবে। অনুরূপ অর্থনীতির ব্যাপারেও একই কথা। যারা কায়েমী স্বার্থে পবিত্র ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে, তারা আর যাই হােক, শােষণমুক্ত অর্থনীতি সমর্থন করতে পারে না।

জামাত-শিবিরের সন্ত্রাস
জামাত দয়ামায়াহীন একটি ফ্যাসিস্ট চক্র। জামাতের প্রায় ৫০ বছরের ইতিহাসে ফ্যাসিজমের অজস্র প্রমাণ রয়েছে। ইসলামই দলটির আদর্শ’—একথা প্রচার করা হলেও, মহান শান্তির ধর্ম ইসলামের উদারতা, বিশালতা ও সহনশীলতার বিন্দুমাত্র চিহ্ন এদের কার্যকলাপে পাওয়া যায় না, বিশেষ করে যখন তারা রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মােকাবেলা করে। বিরােধী শক্তি ইসলামী-অনৈসলামী যাই হােক না কেন, তারা জামাতের ভাষায় ‘কাফের’। কাফের খতম করা প্রকৃত মােমিনের পরিচয়।’ পরমতসহিষ্ণুতা এ দলের রাজনৈতিক অভিধানে নেই। ইসলামী বিপ্লব এবং ইসলামী গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা এই দলের শ্লোগান হলেও জামাতের পৃষ্ঠপােষক হচ্ছে রাজতান্ত্রিক শক্তি। রাজতান্ত্রিক শক্তিগুলাে এ দলকে অঢেল পেট্রো-ডলারই নয়, সব ধরনের সহায়তা দেয়। শুধু তাই নয়, রাজতান্ত্রিক কিছু দেশ জামাতের কার্যকলাপ নির্বিঘ্ন করার জন্যে নানা ধরনের চাপও দেয়। অথচ ইসলাম রাজতন্ত্র বিরােধী ধর্ম। তাই স্বাভাবিক কারণে প্রশ্ন জাগে, জামাতে ইসলামী কি সত্যিকারের ইসলামপন্থী ? তারা কি ইসলামী প্রজ্ঞা, বিজ্ঞানমনস্কতা, উদারতা, সহনশীলতা ইত্যাদি গুণাবলীর প্রবক্তা? এই প্রশ্নে যে কোনাে জামাতকর্মী তখুনি জবাব দেবে—‘হ্যা। তাহলে জামাত নিজ ধর্মের ভ্রাতার হত্যাকারী, ভাই-বােনের ওপর জুলুমকারী হচ্ছে কেনাে ? এ প্রশ্নের উত্তরে ইসলামপন্থী দলগুলােরই মন্তব্য হচ্ছে, এ দলের স্রষ্টা মওলানা মওদুদী ইসলামের বিকৃত ও কুৎসিত ব্যাখ্যাই দিয়েছেন। ১৯৫১ সালে জামাতের ইতিহাস ফ্যাসিবাদী তৎপরতায় কলঙ্কিত। তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে জামাত ‘আহমদিয়া’দেরকে অমুসলিম বা কাফের আখ্যায়িত করে নির্বিচারে হত্যা করেছিলাে। ‘৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে জামাতে ইসলামীর ভূমিকা পাক-বাহিনীর নির্মমতা-নৃশংসতাকেও ম্লান করে দিয়েছিলাে। বদর যুদ্ধের মােজাহিদদের স্মরণে গড়া আলবদরের নাম এখনাে আতঙ্কের সৃষ্টি করে। জামাতের সর্বোচ্চ পর্যায়ের কর্মীদের নিয়ে আলবদর বাহিনী গড়া হয়। হত্যাই ছিলাে আলবদরের একমাত্র ও শেষ নীতি। নারী নির্যাতনের অজস্র করুণ ঘটনা শুনে কান্না আসে চোখে। এ সমস্ত বর্বর ও ফ্যাসিবাদী নৃশংসতা জামাত করেছিলাে। ধর্মের নামে। অধ্যাপক গােলাম আযম বুদ্ধিজীবী হত্যার অন্যতম নায়ক।
‘৭১ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথমদিকে রাও ফরমান আলীর সঙ্গে এক বৈঠকে গােলাম আযম বুদ্ধিজীবী নিধনের একটা নীলনকশা পেশ করেন। সে নীলনকশা অনুযায়ী পরবর্তীকালে ডিসেম্বর মাসে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। স্বাধীনতার পর বুদ্ধিজীবী হত্যা সম্পর্কিত যে দলিলপত্র পাওয়া যায় তাতে স্পষ্ট করে নির্দেশ ছিল পূর্ব পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখা হয়ত সম্ভব হবে না। তবে একটা কাজ করতে হবে, এখানকার সব বুদ্ধিজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার, বিজ্ঞানীকে চিরতরে ‘শেষ করে দিতে হবে যাতে পাকিস্তানকে হারালেও তারা দেশ চালাতে না পারে। অধ্যাপক গােলাম আযম এই নীলনকশা বাস্তবায়নের জন্য তাঁর দলীয় ক্যাডার, রাজাকার, আলবদর ও আলশামসকে নির্দেশ দেন। এলাকাও ভাগ করে দেয়া হয়। ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসে যে ক’জন আলবদর নেতাকে গ্রেফতার করা হয়, তাদের কাছ থেকে নীলনকশার বেশকিছু দলিলপত্র উদ্ধার করা হয়। সেসব দলিলের একটা অংশে বলা হয়েছে, “নিম্নলিখিত ব্যক্তিদেরকে ধরে এনে হত্যা করতে হবে। প্রয়ােজনে সেনাবাহিনীর সহযােগিতা নেয়া যেতে পারে। যদি কেউ আত্মগােপন করে থাকে তাহলে তার পরিবারের কাউকে ধরে এনে এমনভাবে অত্যাচার চালাতে হবে যাতে করে পলাতক ব্যক্তির সন্ধান মেলে।” উর্দুতে লেখা একটা নির্দেশনামায় ছিল, “মনে রাখবেন, দুষ্কৃতকারীরা যদি দেশে ঢুকে পড়ে তাহলে রেহাই পাবেন না। তাই নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য জীবন বাজি রেখে লড়াই চালিয়ে যান।” নভেম্বর মাসে জামাতে ইসলামীর পক্ষ থেকে এক প্রচারপত্রে বলা হয়েছিল, “শত্রু আশপাশেই রয়েছে, তাই খুব সতর্কতার সঙ্গে কাজ চালাতে হবে।” আলবদরের এক সমাবেশে জনৈক জামাত নেতা বলেন, ‘‘আপনারা পাকিস্তান টিকিয়ে রাখার জন্য কেবল যুদ্ধ করছেন না, এ যুদ্ধ ইসলামের। নমরুদদের হাত থেকে মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য আমাদের আমীরের (গােলাম আযম) নির্দেশ পালন করুন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী গা-ঢাকা দেয়। স্বাধীনতার বিরােধিতার অভিযােগে অন্যান্য স্বাধীনতাবিরােধী দলের সঙ্গে জামাতও নিষিদ্ধ হয়ে যায়। কিন্তু গা-ঢাকা দেয়ার পর জামাতিরা নিষ্ক্রিয় ছিলাে না। ‘৭২ থেকে ‘৭৫ পর্যন্ত বহু নাশকতামূলক ঘটনার সঙ্গে এরা জড়িত ছিলাে বলেও সাধারণ্যে সন্দেহ বিদ্যমান। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা, গণহত্যা ইত্যাদি অভিযােগে অভিযুক্ত জামাত গত ১৩ বছরে বিভিন্ন কৌশলে রাজনৈতিকভাবে পুনর্বাসিত ও প্রতিষ্ঠা লাভ করেছে। স্বাধীনতার পর তারা গণধিকৃত হয়ে এদেশের রাজনৈতিক মঞ্চ থেকে আস্তাকুড়ে নিক্ষিপ্ত হয়। তারপর তারা ধীরে ধীরে বিভিন্ন সংগঠনের নামে সংগঠিত হতে থাকে। এ সময়ে জামাত ছিলাে অনেকটা নমনীয় এবং রক্ষণাত্মক। বিগত কয়েক বছর, বিশেষ করে ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর জামাত স্বমূর্তিতে আবির্ভূত হয়েছে। তারা নিজেরা এবং ছাত্র শিবির ও মুমিনীন সালেহীন নামধারী বাহিনী দ্বারা দেশের বিভিন্ন স্থান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলােতে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। * জামাতের দুঃসাহসিক তৎপরতার একটি হচ্ছে শহীদ মিনার ভেঙ্গে ফেলা। তারা ১৯৮৭ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি কুষ্টিয়ার মীরপুর উপজেলার আমলা উচ্চবিদ্যালয় প্রাঙ্গণের এবং ঝিনাইদহের হাট গােপালপুর উচ্চবিদ্যালয়ের শহীদ মিনার দু’টো ভেঙ্গে ফেলে। ২০ ফেব্রুয়ারি গভীর রাতে একদল ছাত্র-জনতা আমলা স্কুল প্রাঙ্গণের শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানাতে গেলে জামাতের কর্মীরা তাদের বাধা দেয় এবং শহীদ মিনারটি ভেঙ্গে ফেলে। তারা শুধু ভেঙ্গে ফেলেই ক্ষান্ত থাকেনি, শহীদ মিনার ভাঙ্গার প্রতিবাদে আয়ােজিত সভায়ও হামলা চালায়। ঘটনার পরের দিন একুশে ফেব্রুয়ারি আমলা স্কুল প্রাঙ্গণে যখন প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হচ্ছিল, জামাতের একজন স্থানীয় নেতার নেতৃত্বে কয়েক শ’ লােক সভায় হামলা করে। এতে প্রায় ২০ জন আহত হয়। অপরদিকে হাট গােপালপুর স্কুলেও একই ধরনের ঘটনা ঘটে। জামাতিরা প্রতিবাদ সভার ওপর হামলা চালিয়ে ২০ জনকে আহত করে।
এর আগে জামাতিরা ৯ জানুয়ারি ঢাকার শাহজাহানপুর কমিউনিটি সেন্টারে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ ওয়ার্কার্স ফেডারেশনের সম্মেলনে আক্রমণ চালায়। এই আক্রমণে একজন শ্রমিক নিহত ও বহু আহত হয়। ঘটনার দিন ছিল শুক্রবার। কমিউনিটি সেন্টারে যখন সম্মেলন চলছিল, তখন পাশে অবস্থিত জামে মসজিদে জুম্মার নামাজ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল। ‘সম্মেলনের মাইকের আওয়াজ নামাজের অসুবিধা সৃষ্টি করছে, এই অজুহাতে মুসল্লীর বেশে জামাতের কর্মীরা রাজনৈতিক অভিসন্ধি চরিতার্থ করার প্রয়াস পায়। তারা লাঠিসােটা, বােমা নিয়ে সম্মেলনে আক্রমণ চালায়। তাদের লাঠির আঘাতে ইউসুফ (২৮) নামে গােয়ালন্দ টেক্সটাইল মিলের একজন দরিদ্রশ্রমিক নিহত হন। রুটি-রুজির সংগ্রামের জন্য ঢাকায় সম্মেলন করতে এসে ইউসুফলাশ হয়ে বাড়ি ফিরে গেলেন। সেদিন জামাতিরা জুমার নামাজ শেষে ঐ আক্রমণ চালায় পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী। কারণ মুসল্লীরা এতে একদম জড়িত ছিলেন না। আর যে অজুহাত তারা দেখিয়েছিল, তাও ছিল হামলা চালানাের জন্য একটি তৈরি অজুহাত।। | এক জরীপে দেখা গেছে, ১৯৮৬ সালের নির্বাচনের পর জামাত-শিবির চক্রের সন্ত্রাসী তৎপরতা ব্যাপক আকার ধারণ করলেও ১৯৭৮ সাল থেকেই তারা বিভিন্ন স্থানে হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭৮ সালে ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার ভিন্নমতাবলম্বী ছাত্রনেতা মওলানা আবদুস সােবহানকে শিবির কর্মীরা নির্মমভাবে হত্যা করে। মওলানা আবদুস সােবহান সে সময় পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। ১৯৮৪ সালের ১০ জুলাই চন্দ্রঘােনা তৈয়বিয়া ওয়াদুদিয়া মাদ্রাসার মাত্র ১১ বছর বয়সের ছাত্রকর্মী আবদুল হালিমকে শিবির কর্মীরা হত্যা করে। তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। ‘৮৬ সালে চট্টগ্রাম কুড়াইশ বুড়িশ্চর কলেজের ডিগ্রী ক্লাসের ছাত্র লিয়াকত আলী শিবির চক্রের হাতে নিহত হন। তিনি ১৯৮৬ সালের ১০ এপ্রিল চট্টগ্রাম কমার্স কলেজে ইসলামী ছাত্রসেনা আয়ােজিত নবাগত সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন।
সেখান থেকে বাড়ি ফেরার পথে তাকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। তার আগে ১৯৮৫ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি সীতাকুণ্ড কলেজের ছাত্রলীগ (মু-না) নেতা দিদারুল আলম শিবির চক্রের হাতে নির্মমভাবে নিহত হন। তাকে প্রকাশ্য দিবালােকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা। হয়। ১৯৮৬ সালের মাঝামাঝি সময়ে শিবির কর্মীরা চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাটহাজারী মাদ্রাসায় এক কমান্ডাে হামলা চালায়। তারা দু’জন মাদ্রাসা ছাত্রকে হত্যা করে। মাদ্রাসার দু’জন মুহাদ্দিসকেও লাঠিপেটা করে। ১৯৮৬ সালে শিবির কর্মীরা। চন্দনপুরা দারুল উলুম আলিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মওলানা ফখরুল ইসলামকে হাত-পা বেঁধে পিটিয়ে গুরুতর আহত করে। তাঁর বুকে পিস্তল ধরে তাঁকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করে। একই বছর চট্টগ্রামের ইসলামী ছাত্রসেনা কর্মী রফিককে শিবিরচক্র হত্যা করে। ১৯৮৮ সালের জানুয়ারি মাসে চট্টগ্রামে জামাতের হেদায়েত- শামসু বাহিনীর লােকদের ছত্রচ্ছায়ায় শিবির কর্মীরা শহরের নাসিরাবাদ ডেবারপাড়া এলাকায় প্রাক্তন ছাত্রসমাজ কর্মী ‘সাজ্জাদকে নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৯৮৮ সালের ১৮ মে পবিত্র ঈদুল ফিতরের দিনে জামাত-শিবির সন্ত্রাসীরা ছাত্রলীগ (সুর) নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে হত্যা করে। তিনি চট্টগ্রামের জমিয়াতুল ফালাহ থেকে ঈদের নামাজ পড়ে বাসায় ফিরছিলেন। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে টাইগার পাস কলােনী এলাকায় তাকে ছুরিকাঘাত করা হয়। ১৯৮৮ সালের এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে শিবিরের লােকেরা নাজিরহাট কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি আমিনুল করিমকে কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। একই বছর ৭ জুলাই সশস্ত্র শিবির কর্মীদের ছুরিকাঘাতে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডঃ মুজাহিদ হােসেন গুরুতর আহত হন। * তারা ‘৭৯ সালে চট্টগ্রাম সিটি কলেজের ছাত্র সংসদের এজিএস ও তৎকালীন ছাত্রলীগ (কা-ছু) নেতা তােরককে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে। ‘৮২ সালে চট্টগ্রাম কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী শাহাদতকে হত্যা করে। ‘৮৪ সালে আওয়ামী লীগ সমর্থিত ছাত্রলীগের * নাজিরহাট কলেজ শাখার কর্মী রশীদকে গুলি করে হত্যা করে। ‘৮৬ সালের নভেম্বর মাসে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে শিবির একটি লােমহর্ষক ঘটনা ঘটায়। তারা জাতীয় ছাত্রসমাজের বিশ্ববিদ্যালয় শাখার সভাপতি আবদুল হামিদের ডান হাতের কবৃজি নির্মমভাবে কেটে দেয়। এছাড়া কিরিচের এলােপাতাড়ি কোপে হামিদের শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। কেটে যায় তার বাম হাতের বুড়াে আঙুল।
এদিকে বর্তমানে ছাত্র শিবির চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়কে যুদ্ধসজ্জায় সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছে। তারা উঁচু একটা পাহাড়ের ওপর পর্যবেক্ষণ টাওয়ার তৈরি করেছে। সেখান থেকে গােটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর নজর রাখে। এছাড়া প্রত্যেক হলের ছাদে ও গেটে পাহারাদার বসিয়েছে। তারা সশস্ত্র অবস্থায় পালাবদল করে পাহারা দিচ্ছে, যাতে অন্যান্য সংগঠনের ছাত্র ক্যাম্পাসে ঢুকতে না পারে। জামাত-শিবির চট্টগ্রামে কিরূপ সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে, তার কিছু আভাস পাওয়া যাবে সাপ্তাহিক বিচিত্রা’র ১৯৮৭ সালের ২৮ আগষ্ট সংখ্যার ‘অভিমত’ কলামে প্রকাশিত একটি চিঠি থেকে। চট্টগ্রামের কয়েকজন বিশিষ্ট ব্যক্তি এই চিঠিটি লেখেন। তাতে বলা হয়েছে, “…. বন্দরনগরী ঐতিহাসিক চট্টলার বুকে জামাত-শিবির ইসলামী আন্দোলনের নামে ফ্যাসিবাদী কায়দার অত্যন্ত পরিকল্পিতভাবে অনেকগুলাে কনসেনটেশন ক্যাম্প স্থাপন করেছে। এই ক্যাম্পগুলােয় মওদুদীবাদের বিরােধিতাকারীদের অত্যন্ত নিষ্ঠুরভাবে নির্যাতন করা হয়। যারাই তাদের বিরােধিতা করে তাদেরকে ধরে নিয়ে এই সকল ক্যাম্পে নির্যাতন চালানাে হয়। প্রগতিশীল, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও ছাত্রকর্মীরাই কেবল তাদের দ্বারা নির্যাতিত হয় না, বরং সুন্নী মতাদর্শ পােষণকারী অনেক আলেম, ছাত্র ও শিক্ষক তাদের হাতে লাঞ্ছিত হন। তাদের ভ্রান্ত মতবাদ ও ভন্ডামির প্রতিবাদ করায় তারা অন্তত ৫/৬ জন আলেমের দাড়ি কেটে দিয়েছে। তাঁদের মধ্যে দু’জন হলেন মসজিদের ইমাম। এই হল ইসলামের লেবাসধারীদের চরিত্র। …. “১৯৭১ সালে মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের সময় আমরা কি দেখতে পাই? ইসলামী। আন্দোলনের দাবিদার জামাতে ইসলামী, নেজাম-ই-ইসলাম ও ইসলামী ছাত্রসংঘের ভূমিকা কেমন ছিল ? তারা কার পক্ষে ছিল ? জালেমের, না মজলুমের ? তারা ইসলামের নামে জালেম শাসক ইয়াহিয়া-টিকা-নিয়াজীদের যাবতীয় অপরাধমূলক কার্যক্রমকে সমর্থন করেই ক্ষান্ত হয়নি, বরং নিজেরা আলবদর, রাজাকার ও আলশামস বাহিনী গঠন করে ইতিহাসের জঘন্যতম অত্যাচার-নির্যাতন ও হত্যাকাণ্ড পরিচালিত করেছে বাঙ্গালী জাতির উপর। মুসলমানের ওপর মুসলমান নামধারী ব্যক্তিদের এরূপ অত্যাচার ইতিহাসে খুজে পাওয়া যায় না।
মানুষের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া, নারী ধর্ষণ করা, পিতামাতার সামনে কন্যার সম্ভ্রম নষ্ট করা, ভাইয়ের সামনে বােনের উপর পাশবিক নির্যাতন চালানাে, পিতার সামনে পুত্রকে হত্যা করা, পুরাে পরিবারকে লাইন ধরিয়ে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে বধ করা, পিতার সম্মুখে কন্যার স্তন কেটে দেয়া প্রভৃতি লােমহর্ষক অত্যাচার চালানাের কথা ইসলামের কোন্ জায়গায় লেখা আছে ? এই জঘন্য অপরাধ তারা করেছে ইসলামের। নাম দিয়ে। ইসলাম বিপন্ন হয়ে পড়েছিল! তাই ইসলামকে রক্ষা করার জন্যই নাকি তাদেরকে এই মহান কর্তব্য (?) সম্পন্ন করতে হয়েছে। – “এই ধরনের অপরাধ করেও তারা কিন্তু বিন্দুমাত্র অনুতপ্ত হয়নি। বরং সদম্ভে ঘােষণা করেছে, “১৯৭১ সালে আমরা ভুল করিনি।” এভাবেই তারা একের পর এক হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। তাই স্বাধীনতার ১৬ বছর পরও আমাদেরকে সন্ত্রস্ত থাকতে হয়। শুনতে হয়, ‘৭১-এর যুদ্ধ ছিল ভারতীয় ষড়যন্ত্র এবং দুষ্কৃতকারীদের কার্যকলাপ। …ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ধ্বংস করা শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম, তা যেকোন ধর্মেরই হােক না কেন। হুজুর পাক (সঃ) কিংবা খলিফা ও অলি-আওলিয়াগণ কোনদিন অন্য ধর্মের উপাসনালয় ধ্বংস করেননি। এমনকি বিদায় হজ্বের সময় তিনি অন্য ধর্মের উপাসনালয়ে আঘাত না করার জন্য মুসলমানদের বিশেষভাবে সতর্ক করে দিয়েছেন। কিন্তু জামাতের কাছে ইসলামের ব্যাখ্যা হুজুর (সঃ)-এর ব্যাখ্যা হতে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তাদের মতে হিন্দুর মন্দির ভাঙ্গা কেবল জায়েজই নয়, বরং পুণ্যের কাজ। ‘৭১ সালে আলবদর ও রাজাকার বাহিনী অসংখ্য মন্দির-বিগ্রহ ভেঙেছে, অপবিত্র করেছে, মন্দিরে ক্যাম্প স্থাপন করে গরু জবাই করেছে এবং বিগ্রহের উপর মলত্যাগ করে পুণ্য সঞ্চয় করেছে। … । ৬ “জামাত তাদের ‘৭১-এর চরিত্র মােটেও বদলায়নি, বরং তারা দিন দিন রক্তপিপাসু হয়ে উঠছে। ‘৭১ সালে তারা ভাঙতে হিন্দু মন্দির, আর বর্তমানে ভাঙে মুসলমানদের মাদ্রাসা, মাজার ও খানকাহ। সাম্প্রতিককালে তারা এদেশের সর্ববৃহৎ দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দারুল উলুম হাটহাজারী মাদ্রাসা আক্রমণ করে মাদ্রাসাকে ধ্বংস করে দিতে চায়। দু’টি ট্রাকে করে জামাত-শিবিরের প্রায় পাঁচশ’ গুণ্ডা প্রকৃতির ছাত্র রাতের আধারে মাদ্রাসা।
আক্রমণ করে। ‘৭১-এর কায়দায় মাদ্রাসার ছাত্র ও শিক্ষকগণকে হত্যা করতে চায়। কিন্তু। গ্রামবাসী, মাদ্রাসার ছাত্র, শিক্ষক ও পুলিশের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তাদের আক্রমণ ব্যর্থ হয়। এবং তাদের অধিকাংশই ধরা পড়ে। কিরিচ, রামদা, হকিস্টিক, পিস্তল, বােমা, বাঁশি ও মরিচের গুড়াে ধৃতদের নিকট পাওয়া যায়। তারা স্বীকার করে, গােটা মাদ্রাসা ধ্বংস করে দেয়াই তাদের লক্ষ্য ছিল। কারণ এই মাদ্রাসা তাদেরকে সমর্থন করে না। তা নাকি মাদ্রাসার অমার্জনীয় অপরাধ! তারা পুলিশের নিকট আরও স্বীকার করে, মােলশহরস্থ আহমদিয়া সুন্নিয়া আলিয়া মাদ্রাসা এবং পটিয়া মাদ্রাসা আক্রমণ করা তাদের পরবর্তী টার্গেট ছিল। এই সকল দ্বীনি প্রতিষ্ঠানের অপরাধ হল এসব স্থানে ইসলামের নামে মওদুদীবাদ ও গােলাম আযমবাদ চালানাে যায় না। এভাবে যে সকল প্রতিষ্ঠানে তাদের মতবাদ প্রচার করতে দেয়া হয় না সেই সকল প্রতিষ্ঠানের তালিকা করে উচ্চপর্যায়ে পাঠিয়ে দেয়া হয় এবং সবুজ সংকেত পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই এই সকল প্রতিষ্ঠানে তারা ঝাঁপিয়ে পড়ে। এভাবে তারা অসংখ্য মাজার ও খানকাহর ক্ষতিসাধন করেছে। চরিত্রগত দিক থেকে তারা চেঙ্গিস ও হালাকু খানের মতই। যে সকল সুন্নী আলেম তাদের ভন্ডামির কথা জনসমক্ষে প্রকাশ করে দেন তাদেরকে হত্যার তালিকায় লিপিবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। এদের মধ্যে জামেয়া আহমদিয়ার প্রিন্সিপাল মওলানা জালালউদ্দীন, প্রখ্যাত আলেম মওলানা হাশেমী সাহেব ও আল্লামা কারী তৈয়ব সাহেব হুজুর বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। জামাত-শিবিরের নিকট শহীদ ও গাজী শব্দ দু’টো খুবই অভিনব। জামাত-শিবির যখন কোন ব্যক্তিকে হত্যা করে তখন সেই ব্যক্তি হয় ‘দুষ্কৃতকারী’ এবং হত্যাকারী জামাতি হয় ‘গাজী’। আর যখন কোন জামাতি নিজের অপকর্মের জন্য নিহত হয় তখন সে হয় ‘শহীদ’। যেমন একাত্তরের মুক্তিযােদ্ধারা ছিল ‘দুষ্কৃতকারী’ আর নারী নির্যাতনকারী নরঘাতক আলবদর-রাজাকাররা ছিল ‘শহীদ। জামাতে ইসলামীর মত ইসলামের এরূপ অপব্যাখ্যা ইসলামের ইতিহাসে আর কোন দল দেয়নি।
“জামাত-শিবির ইসলামী আন্দোলনের নামে প্রকৃতপক্ষে সমাজের শােষক, বুর্জোয়া ও সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ সংরক্ষণ করছে। আফগানিস্তানে সােভিয়েট বাহিনীর বিরােধিতা করলেও লেবাননে মার্কিন সেনাবাহিনীর উপস্থিতির কোন প্রতিবাদ তারা করে না। তেমনিভাবে রাজতন্ত্র ইসলামবিরােধী মতবাদ হলেও সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রী সরকারগুলাের বিরুদ্ধে কোন কথা বলে না। বরং বলা হয়, সৌদি রাজতন্ত্র নাকি ইসলামী শাসনের কাছাকাছি। তাই এদের বিরােধিতা করা যাবে না। তাই তাে দেখি জামাতের কেন্দ্রীয় নেতা দেলােয়ার হােসেন সাঈদী যখন চট্টগ্রামে ওয়াজ (?) করতে আসেন তখন ‘জলসা’র প্রধান অতিথি হন সৌদি রাষ্ট্রদূত। কারণ খুবই স্পষ্ট। জামাত ও সাঈদী সাহেবরা। সৌদি রাজতন্ত্রের নেমক খেয়ে তাদের বিরােধিতা করবেন কোন্ মুখে ? তাই যেখানেই তারা বড় ‘মাহফিল’ করেন সেখানেই এই সকল দূতকে সাথে করে নিয়ে যান। এই সকল মাহফিলে যে হাজার হাজার লােকের সমাগম হয় তারা ছিল মূর্তি পূজারী! তাদের (জামাতের) অক্লান্ত পরিশ্রমে এই লােকেরা আল্লাহর দ্বীনে (নাকি জামাতের দ্বীনে?) ফিরে এসেছে। সুতরাং যে টাকা পাওয়া গিয়েছিল তা কাজে লেগেছে। এই ধরনের একটি ধারণা।
দূতদের তারা দিয়ে থাকে। আর এভাবেই তারা মিল্লাত ও কওমের সেবা করে যাচ্ছে।… বর্তমানে চট্টগ্রাম কলেজ ছাত্রাবাস, মহসিন কলেজ ছাত্রাবাস, কমার্স কলেজ ছাত্রাবাস, আলিয়া মাদ্রাসা ছাত্রাবাস, বাকলিয়া মেস, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এ এফ রহমান হল যেন এক-একটি মিনি ক্যান্টনমেন্ট। এ সকল স্থানে শিবির গুন্ডাদের সশস্ত্র পাহারা বিদ্যমান। যে কেউ রাতের বেলা এই সকল এলাকা দিয়ে হেঁটে গেলে তাদেরকে চ্যালেঞ্জ করা হয় এবং সন্দেহ হলে ধরে নিয়ে নির্যাতন চালানাে হয়। | “এমন কোন সপ্তাহ নেই যে সপ্তাহে তারা চট্টগ্রাম শহর থেকে বায়তুল মালে’র নামে অর্থ সগ্রহ করে না। ধর্মের নামে এভাবে শােষণ করে এই সকল শােষক টিকে আছে। জনগণের নিকট থেকে সংগৃহীত অর্থ দিয়ে জনগণকেই হত্যা করার জন্য তারা ক্রয় করে পিস্তল, রামদা, কিরিচ, হকিষ্টিক, বােমা, এলএমজি, মরিচের গুঁড়াে প্রভৃতি। এই অর্থ দিয়ে তারা সাপ্তাহিক বিচিত্রা’ও ক্রয় করে এবং পুড়িয়ে ফেলে। তাদের অপকর্ম যাতে জনগণের। নিকট প্রকাশ না পায় এজন্য বিচিত্রা’রসব সংখ্যা কিনে নিয়ে যায় তাদের কর্মীরা নেতাদের ‘ নির্দেশে।” এই চিঠিতে স্বাক্ষরদাতারা হলেন ঃ “মােঃসায়েদুল হক আল কাদেরী (ইসলামী ছাত্র সেনা, পূর্ব ষােলশহর শাখা), হেলালুর রহমান (যুবলীগ, ফিরিঙ্গিবাজার শাখা), এনায়েতুর রহমান (ছাত্রলীগ, আলকরন শাখা), মৃণাল কান্তি ঘােষ (যুব ইউনিয়ন, উঃ পতেঙ্গা শাখা), মৌলানা নূরুল ইসলাম (চারিয়া মাদ্রাসা, হাটহাজারী), অসিত কুমার বড়ুয়া (সম্পাদক, বিপ্লবী ছাত্র মঞ্চ, চট্টগ্রাম শহর), লেনিন আজাদ (আহবায়ক, জাতীয় ছাত্র ঐক্য, চঃ উঃ জেলা), মৌলানা রফি আহমদ (আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত, রাউজান), শফিকুল হক (সভাপতি, বিপ্লবী ছাত্র মঞ্চ, কোতােয়ালী), মােঃ শাহাবউদ্দীন (সভাপতি, জাতীয় ছাত্রলীগ, মদনহাট শাখা), চট্টগ্রাম।
জামাত-শিবির সব সময়ই জাতীয় রাজনীতির নাজুক পরিস্থিতিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। ১৯৮৮ সালের প্রথমার্ধ থেকে বিরােধীদলগুলাের অনৈক্য বেশ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই পরিস্থিতিতে তারা নির্ধারিত এলাকায় সন্ত্রাস চালিয়ে নিজেদের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিলের পরিকল্পনা গ্রহণ করে। এ সময় জামাত-শিবির চট্টগ্রাম’ ছাড়াও রাজশাহীকে তাদের অপারেশন এলাকা হিসেবে বেছে নেয়। ২৯ মে রাতে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে শিবিরের মিছিলের একটি উত্তেজিত অংশের কুঠারাঘাতে ইন্টার্নী ডাক্তার গৌতম চৌধুরী আহত হন। তিনি হাসপাতালে ডিউটি করে ফিরছিলেন। তাঁর শরীরে তিনটি আঘাত হানা হয়। ঐ রাতেই শিবিরের সশস্ত্র ব্যক্তিরা মেইন হােস্টেলের গেট অবরােধ করে। তারা বিভিন্ন সংগঠনের ছাত্রদের কক্ষে ভাঙচুর করে। আsic | জামাত-শিবির ৩১ মে দিনদুপুরে আর একটা হত্যাকাণ্ড ঘটায়। প্রায় সকল শিক্ষকের সামনে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজের পঞ্চম বর্ষের ছাত্র ও বিপ্লবী ছাত্র মৈত্রীর কলেজ শাখার সভাপতি জামিল আখতার রতনকে হত্যা করা হয়। চায়নীজ কুড়াল ও কিরিচ দিয়ে কুপিয়ে এবং ইট দিয়ে মাথায় আঘাত করে রতনকে হত্যা করা হয়। মেডিক্যাল কলেজের শিক্ষকবৃন্দ হাতবােমার শিকার হন। শিক্ষকদের গাড়ি ভাঙচুর করা হয়। অধ্যক্ষসহ শিক্ষকদের জীবন নিয়ে পালাতে হয়। জামিলকে আঘাত করার পর তার মৃত্যু সম্পর্কে নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত শিবির সন্ত্রাসীরা সেখানে দাঁড়িয়ে থাকে। রতন হত্যাকাণ্ড ও অন্যান্য সন্ত্রাসের মাধ্যমে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজে দখল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর শিবির সন্ত্রাসীরা রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী অঞ্চলের অপরাপর এলাকার দিকে হাত বাড়ায়। তার আগে ওদিকে চট্টগ্রাম এম ই এস কলেজে ছাত্রলীগ (সুর) নেতা বেলাল চৌধুরীকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। জামাত-শিবির এবার তাদের সন্ত্রাসবাদী তৎপরতা বৃহত্তর রাজশাহীর বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়ে দেয়। জামিল হত্যার পরদিন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা ছাত্রলীগ (সুর) সহ-সভাপতি রফিকুল ইসলাম এমকে হত্যার জন্য আঘাত করা হয়। তিনি নবাবগঞ্জ রেল স্টেশনে একটি রেস্তোরাঁয় চা পান করছিলেন। সৌভাগ্যবশত তিনি বেঁচে যান। এমের শরীরে সর্বমােট ১৭টি আঘাত করা হয়।
এসব আঘাত হাসুয়া ও গুপ্তির। এ সম্পর্কে এম বলেন, “পেটের কোপটির পর আমার নাড়ি-ভুড়ি বেরিয়ে গেল। আমি পড়ে গেলাম। আমি কেন যে জ্ঞান হারাচ্ছিলাম না, জানি না। একজন বলল, শেষ হয়েছে। আর একজন বলল, না টেস্ট করে দেখ। তখন ক্ষুর দিয়ে আমার উরুতে কয়েকটা টান দিল। ভাবল মরে গেছি। মরেও গিয়েছিলাম ••• আল্লাহ রেখেছেন।” রফিকুল ইসলাম এম জামাত-শিবির হত্যা প্রক্রিয়ার একটি জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। তাকে দেখলে বােঝা যাবে জামাত-শিবির কিরূপ নিষ্ঠুর ও নির্মম। ১৯৮৮ সালের ১০ জুলাই জামাত-শিবিরের হাতে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আর একজন বিশিষ্ট মুক্তিযােদ্ধাকে প্রাণ হারাতে হয়। তাঁর নাম আমিরুল ইসলাম জালাল। জালালকে ঘর থেকে টেনে বের করে এলােপাতাড়ি আঘাত করা হচ্ছিলাে। তার মা, ও তিন বােন। জালালকে বাঁচাতে এগিয়ে আসেন। জালালের মা চিৎকার করে বলেন, “দোহাই আল্লাহর, এরকম করে আমার বাবাকে মেরাে না, দোহাই আল্লাহর, দোহাই আল্লাহর।” উন্মত্তদের একজন হাতের হাসুয়া দ্বারা জালালকে আঘাত করতে থাকে এবং বলে, “আল্লাহর নামেই। চালাচ্ছি। আমাদের এ কাজ থেকে ফেরানাের কোন আল্লাহ নেই, কোন আল্লাহ নেই।” জামাত-শিবির কর্মীরা জালালের মা ও তিন বােনকে বেদম মারধাের করে। রক্তাক্ত জালালকে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পথে মারা যান। হাসপাতালে তাকে মৃত ঘােষণা করা হয়। লাশ রাজশাহী থেকে নবাবগঞ্জ নিয়ে যাওয়ার পথে জামাত-শিবিরের কর্মীরা ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। একই দিন জামাত-শিবির কর্মীরা নবাবগঞ্জ কলেজ ছাত্র লীগের (সু-র) সদস্য মিলন আজিজকে আক্রমণ করে। তাদের আক্রমণের শিকার হয় নিহত জালালের ছােট ভাই ও ছাত্র লীগ (সু-র) কর্মী টিপু, জাসদ (ইনু) সমর্থক প্রাক্তন ছাত্রনেতা মাহমুদ ও বারকি নামের অপর একজন। এদিন জামাত-শিবিরের লােকেরা নবাবগঞ্জ শহরে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বেশ কয়েকটি দোকানপাট ও মিস্ত্রীপাড়ার কয়েকটি বাড়ি লুট করে মহিলাদের উপর নির্যাতন চালান হয়। অধিকাংশ পরিবার সামাজিক কারণে নারী নির্যাতনের ব্যাপারটি চেপে যায়। স্থানীয় জামাত কার্যালয় তল্লাশী করে পুলিশ বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করে। পুলিশ সশস্ত্র মিছিল থেকে চারজন জামাত-শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে জামাত-শিবিরের এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে বিভিন্ন মহলে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। এসব দেখে সন্ত্রাসবাদীরা কিছুটা সংযত হয়।
৮৮ সালের মহাপ্লাবনে সারা দেশ ভাসছিলাে। বন্যাপ্লাবিত তিন কোটি লােককে বাঁচানাের জন্য জাতিসংঘসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এগিয়ে আসে। দেশ ও জাতির এই মহাদুর্যোগ মুহুর্তে জামাত-শিবির সন্ত্রাসী তৎপরতায় মেতে ওঠে। চট্টগ্রামে তিনজন ছাত্রকে অপহরণ করা হয়। ২৫ জন আহত হয়। সবাই জানে প্রেসিডেন্ট জিয়াই জামাতিদের পুনর্বাসন করেন। বিএনপির সাথে জামাতিদের আতাত কারাে অজানা নয়। কিন্তু সেবার চট্টগ্রামে বিএনপি’র ছাত্র সংগঠন জাতীয়তাবাদী ছাত্রদল জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসের শিকার হয়। ১৭ সেপ্টেম্বর জামাত-শিবিরের সঙ্গে ছাত্রদলের সংঘর্ষে ২৫ জন আহত হয়। তিনজন ছাত্রদল নেতা ও কর্মীকে শিবির কর্মীরা অপহরণ করে। বিএনপি’র মহাসচিব অপহৃত ছাত্রদের ছেড়ে দেয়ার আহবান জানান। তিনি জামাত-শিবিরের সন্ত্রাস প্রতিরােধের জন্য সকল গণতান্ত্রিক শক্তির প্রতি আহবান জানান। বিএনপির মহাসচিব জামাত-শিবিরের প্রতিবাদ করলেও তাঁর দলনেত্রী এ ব্যাপারে সম্পূর্ণ নীরব থাকেন। জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসের কেন তিনি প্রতিবাদ বা নিন্দা করেন না, এর কোন ব্যাখ্যা তিনি প্রদান করেননি। জামাত-শিবির সেবার ২৪ সেপ্টেম্বর হিংস্র ছােবল হানে হযরত শাহজালালের পবিত্র নগরী সিলেটে। তাদের হিংস্রতার শিকার হয় তিনটি তরুণ প্রাণ। ছাত্রলীগের (মু-না) একটি মিছিলে হামলা চালায় শিবিরের সশস্ত্র বাহিনী। মারাত্মক আহত অবস্থায় ছাত্র লীগ কর্মী মনির ও তপনকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। ২৬ সেপ্টেম্বর তারা হাসপাতালে মারা যায়। শিবিরের ধাওয়া খেয়ে ঘটনার দর্শক নবম শ্রেণীর ছাত্র জুয়েল ও তার সাথীরা আম্বরখানাস্থ শামস সুপার মার্কেটের ছাদে আশ্রয় নেয়। ছাদ থেকে তারা আর একটি বিল্ডিংয়ের ছাদে যাওয়ার সময় জুয়েল পড়ে যায়। হাসপাতালে তাকে মৃত ঘােষণা করা হয়। তার আগে ১৯৮৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর জামাত-শিবির সিলেট সরকারী কলেজে সশস্ত্র। হামলা চালায়।
এ হামলায় তারা আরমান চৌধুরী খসরু, দীপু, কনক, লস্কর ও মােনায়েম আহমদের হাত কেটে নেয়ার চেষ্টা করে। ২৮ সেপ্টেম্বর সিলেট মেডিক্যাল কলেজের শহীদ শামসুদ্দিন ও আবু সিনাহ ছাত্রাবাসে পুলিশ তল্লাশী চালায়। এ তল্লাশীতে শিবিরের নেতাকর্মীদের কক্ষ থেকে অনেক অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রের মধ্যে রয়েছে বেয়নেট, রামদা, ছেনি, কিরিচ ও আধুনিক ড্যাগার। মেডিক্যাল হােস্টেল তল্লাশীর সময় অস্ত্র বহনকারী ৫ম বর্ষের ছাত্র এহতেশামুল নামের একজন শিবির নেতাকে পুলিশ গ্রেফতার করে। অভিযোেগ রয়েছে, সিলেট মেডিক্যাল কলেজে শারীরবিদ্যা শিক্ষা দেয়ার নামে | গেরিলা ও হত্যার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। ৮৭ সালে আলীয়া মাদ্রাসার পাশের মাঠে সদর উপজেলা পরিষদ আয়ােজিত শিশুকিশাের প্রতিযােগিতায় কিশােরীদের আসার অপরাধে অনুষ্ঠানের প্যাণ্ডেল ভাংচুর ও কিশােরীদের উপর অত্যাচার করে শিবির কর্মীরা। পরিশেষে তারা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা পােড়ায়। বিয়ানীবাজার উপজেলায় শিবির জামান স্মৃতিসৌধ ভাঙ্গে। জামান ’৭১এর স্বাধীনতা যুদ্ধের শহীদ। সিলেট মহিলা কলেজে একজন ডাক্তার জামাতের ক্লাস নেন বলে ছাত্রীরা অভিযােগ করে। অথচ তিনি কলেজের কেউ নন। সিলেটের কয়েকটি স্কুলের
ব্যাপারেও এরকম অভিযােগ পাওয়া যায়। সিলেটে জামেয়া ইসলামিয়া নামে একটি স্কুল। রয়েছে। এখানে শিশুদের মিথ্যা পড়ানাে হয়, আমাদের নবী বলেছেন জামাত একমাত্র ইসলামের দল।’ সিলেটে জামাত-শিবিরের অস্ত্রাগার ও গােপন সন্ত্রাসী তৎপরতার কার্যালয় হিসেবে সিলেট সরকারী আলীয়া মাদ্রাসা ও কুদরতুল্লাহ মসজিদ ব্যবহার হয় বলে অভিযােগ রয়েছে। কুদরতুল্লাহ মসজিদেই নাকি রয়েছে জামাতের অফিস। এ বিষয়ে সিলেটের একাধিক আলেম অভিযােগ করেছেন এবং এর প্রতিকারের দাবী জানিয়েছেন। ‘জামাত-শিবিরের সেনা ও অস্ত্রকেন্দ্র’ বলে পরিচিত সিলেট আলীয়া মাদ্রাসায় বহিরাগত সন্ত্রাস বাহিনীকে রাখার ব্যবস্থা করা হয়। মাদ্রাসার যে সমস্ত ছাত্র-শিক্ষক জামাত-শিবির করেন না তারা জামাত-শিবিরের হাতে জিমি। আলীয়া মাদ্রাসায় অন্য কোন সংগঠন করা অলিখিতভাবে জামাত-শিবির নিষিদ্ধ করেছে। কয়েকদিন পূর্বে আঞ্জুমানে তালামিজের একজন কর্মীকে শিবির আক্রমণ করে। তাকে শিক্ষকের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হয়। মওলানা হাবীবুর রহমান সিলেট জামেয়া মাদানীয়া ইসলামিয়া মাদ্রাসার অধ্যক্ষ। বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক। জালালাবাদ ইমাম সমিতির সেক্রেটারি। সম্প্রতি সিলেটে জামাত-শিবিরের সন্ত্রাস ও তিনটি হত্যার বিষয়ে তিনি বলেন, “জামাত-শিবির কোন রাজনৈতিক দল নয়, ওটা সন্ত্রাসবাদী দল। ইসলামকে তারা বিন্দুমাত্র শ্রদ্ধা করে না। তারা কেবল ইসলামকে ব্যবহার করে ক্ষমতা দখল করতে চায়।” তিনি বলেন, “জামাতের হত্যা প্রক্রিয়া একটি নিয়মিত বিষয়। কিন্তু সম্প্রতি একই জায়গায় তিনটি হত্যা নজিরবিহীন। আমার মতে প্রতি বছর দেলােয়ার হােসেন সাঈদী সিলেটে এসে প্রতিপক্ষ হত্যার জন্য জামাত-শিবিরকে উস্কানি দিয়ে যায়। এ হত্যা সেই দেলােয়ার হােসেন সাঈদীর উস্কানিরই ফল।” তিনি বলেন, “ক্ষমতায় যাওয়ার আগে যারা এভাবে নির্বিচারে গণহত্যা করছে তারা কোন দিন ক্ষমতায় গেলে প্রতিপক্ষকে জীবিত রাখবে না। এটা দেশ ও জাতির জন্য কল্যাণকর নয়। এটা ইসলামের পরিপন্থী। ইসলামের স্বার্থে, দেশের সকল দেশপ্রেমিক জনগণের উচিত এ নরপিশাচকে প্রতিহত করা। আমরা। আগেও জামাত-শিবিরকে শান্তির পথে, গণতন্ত্রের পথে আসার আহবান জানিয়েছি। না আসলে দেশবাসীকে নিয়ে এদের শান্তির পথে আসতে আমরা বাধ্য করব।” তিনি বলেন, “আজকের জামাতের প্রবর্তক মওদুদীর জেনারেল লাইনে কোন উচ্চশিক্ষা নেই। মাদ্রাসা, লাইনেও কোন উচ্চশিক্ষা নেই। সুতরাং তার জ্ঞান অপরিপক্ব।
এমন লােকের তত্ত্বে ও ব্যাখ্যায় যারা কাজ করে তারা ভ্রান্ত। মওদুদী ইসলামকে বিকৃত করার চেষ্টা করেছেন।” তিনি বলেন, ‘আমাকে কয়েকবার জামাত-শিবির হত্যা করার জন্য আক্রমণ চালায়, কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়।” তিনি বলেন, “আমরা গত বছর রেজিষ্ট্রি মাঠে এক বিশাল জনসভায়। পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযমের বহিষ্কার দাবি করি। দেলােয়ার হােসেন সাঈদীর বিচার দাবী করি। ঐ সভায় জামাতের সন্ত্রাসী ও রাষ্ট্রবিরােধী কার্যকলাপের জন্য বেআইনী ঘােষণার দাবী জানানাে হয়। সিলেটের এ তিনটি হত্যাকাণ্ড আমি মনে করি, জামাতশিবির সুপরিকল্পিতভাবে করেছে।”১ সে | জামাত-শিবিরের এই সন্ত্রাস শুধু প্রতিপক্ষ পুরুষদের উপরই চালানাে হচ্ছে না, ‘৭১ সালের মত দেশের মা-বােনরাও তাদের সন্ত্রাস থেকে রেহাই পাচ্ছে না। তার একটা বাস্তব প্রমাণ হচ্ছে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীধর্ষণের ঘটনা। ‘৮৯ সালের ৩রা জুন বিকেলে শিবিরের কয়েকজন কর্মী চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় বর্ষের একজন ছাত্রীকে ধর্ষণ করে। ধর্ষিতা ছাত্রীকে সংজ্ঞাহীন অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। উক্ত ছাত্রী ও তার এক সহপাঠী বন্ধু পড়ন্ত বিকেলে বিশ্ববিদ্যালয় মিলনায়তনের পাশে বেড়াতে গেলে কয়েকজন শিবিরকর্মী ছাত্রটিকে পিটিয়ে তাড়িয়ে দেয়। তারা ছাত্রীটিকে আটকে রাখে। ছাত্রীটিকে তারা পাশের এক ঝােপের ভিতর নিয়ে যায়। সেখানে তারা তাকে উপর্যুপরি ধর্ষণ করে। ছাত্রীটির আহত বন্ধুর চীৎকারে কয়েকজন পিয়ন এগিয়ে যায়। তারা ছাত্রীটিকে অজ্ঞান অবস্থায় উদ্ধার করে বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিয়ে যায়। পরে তাকে ‘চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে স্থানান্তর করা হয়।
এই পৈশাচিক ঘটনা ঘটিয়েও শিবির কর্মীরা ক্ষান্ত হয়নি। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের হলগুলােতে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাধারণ ছাত্র-ছাত্রীরা পরদিন বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে মিছিল-মিটিং করে ঘটনার বিচার ও দোষী ব্যক্তিদের শাস্তি দাবী করে। বিকেলে একদল ছাত্রী চট্টগ্রাম প্রেসক্লাবে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে এই মর্মান্তিক ঘটনা বর্ণনা করেন। ৬/ এই ঘটনা সংবাদপত্রে প্রকাশের পর সারা দেশে নিন্দা ও প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন তীব্র প্রতিবাদ জানায়। তারা দোষী শিবির। কর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করে। বাংলাদেশ মুক্তিযােদ্ধা সংসদ কেন্দ্রীয় কমাণ্ড কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও মহাসচিব এক বিবৃতিতে বলেন, “চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন শিবির কর্তৃক লাঞ্ছিত ছাত্রীটির করুণ পরিণতি ১৯৭১ সালের কথাই আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়। ১৯৭১ সালে জামাতে ইসলামী ও শিবিরের পূর্বসূরী রাজাকার-আলবদররা এভাবেই হাজার হাজার মা-বােনের ইজ্জতহানি করে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।” বিবৃতিতে তারা ইসলামের মুখােশধারী এসব নরপশুদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করেন। ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবানে ১১ জুন সারা দেশব্যাপী প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। প্রতিবাদ দিবসে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য ফোরামের উদ্যোগে সমাবেশ ও বিক্ষোভ মিছিল অনুষ্ঠিত হয়। মহিলা পরিষদ, আওয়ামী লীগ, মহিলা আওয়ামী লীগ, বাকশাল, ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ (ইনু), বাসদ, ওয়ার্কার্স পার্টি, শ্রমিক কৃষক সমাজবাদী দল, বিভিন্ন ছাত্র সংগঠন, মােট কথা জামাত-শিবির ও তাদের দোসররা ছাড়া সারা দেশের সকল স্তরের সচেতন নাগরিকরা এই ঘটনার তীব্র প্রতিবাদ জানান। তারা দোষী শিবির কর্মীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবী করেন।। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে শিবিরের মিথ্যা মামলা দায়ের কেন্দ্র করে জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ১৯৯২ সালের ১৭ মার্চ উক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হলে এক পরিকল্পিত হামলা চালায়।
তাদের আক্রমণে বহু ছাত্র আহত হয়। জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসীরা ১৬ জন ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। একই ঘটনা কেন্দ্র করে জামাত-শিবির চক্র সেবারই ৩০ জুলাই আবার রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে হলে নারকীয় হামলা চালায়। হামলার সময় তারা বৃষ্টির মত গুলি চালায়, বােমা বিস্ফোরণ ঘটায়। এই দিন তারা শতাধিক কক্ষ লুটপাট ও ভাংচুর করে। বেশ কয়েকজন ছাত্রের হাত-পায়ের রগ কেটে দেয়। মাসুদ নামের একজন ছাত্রের উরুর মাংস শিবির সন্ত্রাসীরা কেটে নিয়ে যায়। শিবিরের এই সন্ত্রাসের পরদিন ভােররাত থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত পুলিশ ৪টা হল তল্লাশী চালায়। ১৪ জন শিবির কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়। শিবির দখলকৃত এসব হল থেকে বিপুল অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়। উদ্ধারকৃত অস্ত্রশস্ত্রের মধ্যে ছিল রকেট লাঞ্চার, চাইনিজ রাইফেল, পাইপগান, চাইনিজ কুড়াল, হাতবােমা, ভােজালি, ত্রিশূল, রামদা, ছােরা, হাসুয়া, রড, বিভিন্ন ধরনের প্রচুর গােলাবারুদ। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে জামাত-শিবির চক্রের এই সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সারা দেশে প্রতিবাদের ঝড় ওঠে। ওয়ার্কার্স পার্টি নেতা রাশেদ খান মেনন জাতীয় সংসদে প্রশ্ন উঠান— শিবিরের হাতে রকেট লাঞ্চার ও এসব অস্ত্রশস্ত্র আসলাে কোথেকে ? কিন্তু জামাত কিংবা ক্ষমতাসীন সরকারী দলের কেউই মেননের এই প্রশ্নের কোন সদুত্তর দিতে পারেননি। এই ঘটনার এক মাসও যায়নি, খােদ মেননই গুলিবিদ্ধ হন।
সবচেয়ে বিস্ময়কর ব্যাপার হলাে, জামাত-শিবির বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানসহ সারা দেশে সন্ত্রাস চালিয়ে যাচ্ছে। কোন কোন স্থানে পুলিশ তাদের কাছ থেকে অস্ত্র উদ্ধার করছে, তাদের গ্রেফতার করছে; কিন্তু এসব সন্ত্রাসের অভিযােগে কোন জামাত-শিবির সন্ত্রাসীর শাস্তি হওয়ার সংবাদ পাওয়া যায় না। জামাত-শিবির দেশের বিভিন্ন স্থানে এভাবে সন্ত্রাস ও হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। এই সংক্ষিপ্ত আলােচনায় জামাত-শিবিরের সন্ত্রাসী তৎপরতার কিছুটা দৃষ্টান্ত তুলে ধরা হলাে। জামাত নেতারা শিবির ও তাদের অন্যান্য আর্মড ক্যাডারদের মাথায় ইসলামের নামে একটা ধারণা ঢুকিয়ে দিয়েছে, প্রতিপক্ষকে মারতে পারলে গাজী হবে। আর নিজে মারা গেলে শহীদ হবে।’ এই ধারণার শিকার হয়ে জামাত ও শিবির কর্মীরা জীবন বাজি রেখে প্রতিপক্ষের উপর আঘাত হানে। তাতে কোন কোন ক্ষেত্রে নিজেরাও মারা যায়। জামাত ১৯৭১ সালে ইসলামের প্রাথমিক যুগের বদর যােদ্ধাদের নামানুসারে আলবদর বাহিনী গঠন করে পাক হানাদার বাহিনীর সহযােগিতার ছদ্মাবরণে এদেশে হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছে। জামাতের এই ঘৃণ্য ভূমিকা কারাে অজানা নয়। এদেশের ধর্মপ্রাণ লােকদের চোখে ধূলা দেয়ার জন্যই জামাত সে সময় ‘আলবদর’ শব্দটি বেছে নিয়েছিলাে। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’ শ্লোগানটিও জামাতের অনুরূপ একটা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। ইসলামের প্রাথমিক যুগে এরূপ একটি ধারণা মুসলমানদের মধ্যে প্রচলিত থাকলেও এটা প্রযােজ্য ছিলাে আক্রান্তদের জন্য, আক্রমণকারীদের জন্য নয়। কারণ সেকালে মুসলমানরা প্রতিটি যুদ্ধেই আক্রান্ত হয়েছিলেন। কোন যুদ্ধেই তারা আক্রমণকারী ছিলেন না। ইসলাম ও মুসলমানদের নিশ্চিহ্ন করার জন্য প্রতিটি যুদ্ধই তাদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়েছিলাে।
সে পরিস্থিতিতে বলা হয়েছিলাে, অমুসলিম কর্তৃক কোন আক্রান্ত মুসলমান মারা গেলে শহীদ হবে। আর বিজয়ী হলে গাজী হবে। কিন্তু জামাত বর্তমানে এই ধারণাকে অপপ্রয়ােগ করে বাংলাদেশে প্রতিপক্ষ নিধনে শ্লোগান হিসেবে ব্যবহার করছে। এই শ্লোগানের মাধ্যমে তারা ভ্রাতৃহত্যার অভিযানে জামাত-শিবির কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করছে। কিন্তু সত্যি কি শান্তি ও প্রগতির ধর্ম ইসলাম এ ধরনের সন্ত্রাসী তৎপরতা সমর্থন কিংবা অনুমােদন করে? পবিত্র কোরআনে বিশৃংখলা ও সন্ত্রাসবাদের নিন্দা করা হয়েছে। পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে, “মানুষের মধ্যে এমন লােক আছে যার পার্থিব জীবন সম্বন্ধে কথাবার্তা তােমাকে চমৎকৃত করে। তার অন্তরে যা আছে সে সম্বন্ধে সে আল্লাহকে সাক্ষী রাখে।। প্রকৃতপক্ষে সে কিন্তু ঘাের বিরােধী। যখন সে প্রস্থান করে তখন সে পৃথিবীতে ফ্যাসাদ বা অশান্তি সৃষ্টি করে …। কিন্তু আল্লাহ অশান্তি পছন্দ করেন না। ৩ | পবিত্র কোরআনের অপর এক স্থানে আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “যারা তােমাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে তােমরাও আল্লাহর পথে তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ কর, কিন্তু সীমা লংঘন করাে আল্লাহ সীমা লংঘনকারীদের ভালােবাসেন না। … ফিতনা বা সন্ত্রাস হত্যা অপেক্ষা। নিকৃষ্টতর। ৪ সন্ত্রাসবাদ সম্পর্কে পবিত্র কোরআনের বহু স্থানে এ ধরনের আরাে অনেক ভাষ্য রয়েছে। এসবের সারকথা হচ্ছে, ইসলাম শান্তির ধর্ম। ইসলাম সন্ত্রাসবাদ সমর্থন করে । কিন্তু কোন মুসলমান যদি কোথাও আক্রান্ত হয় তবে প্রতিপক্ষকে প্রতিরােধ করার ন্যায়ত অধিকার তার রয়েছে। কিন্তু এই অধিকার প্রয়ােগের ক্ষেত্রেও সীমা লংঘন না করার জন্য সাবধান করে দেয়া হয়েছে। এ তাে গেল অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের ব্যাপার। মুসলমানদের সাথে মুসলমানদের সম্পর্কের ব্যাপারে ইসলাম আরাে কঠোর। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “সে ব্যক্তিই প্রকৃত মুসলমান যার মুখ ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ। “৫ মহানবীর এই বাণীতে ‘মুখ ও হাত থেকে অপর মুসলমান নিরাপদ’ বাক্যটি অত্যন্ত ব্যাপক অর্থে ব্যবহৃত হয়েছে।
প্রকৃত মুসলমান অপর কোন মুসলমানকে অহেতুক কটু কথাও বলতে পারে না। অথচ জামাত-শিবিরের লােকেরা পবিত্র ইসলামের নামে (?) অপর মুসলমানকে নির্মমভাবে অত্যাচার করছে, তাদের হাত কেটে দিচ্ছে। এমনকি হত্যা করতেও দ্বিধা করছে না। এক মুসলমানের অপর মুসলমানকে হত্যার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে কোন মুমিন বা বিশ্বাসীকে হত্যা করলে তার শাস্তি জাহান্নাম। সেখানে সে স্থায়ী হবে এবং আল্লাহ তার প্রতি রুষ্ট হবেন, তাকে অভিসম্পাত করবেন এবং তার জন্য মহাশাস্তি প্রস্তুত রাখবেন।”৬ পবিত্র কোরআন ও হাদীসের উল্লিখিত ভাষ্যগুলাে থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়, মুসলিম-অমুসলিম নির্বিশেষে কোন ক্ষেত্রেই ইসলাম সন্ত্রাস ও হত্যাযজ্ঞ সমর্থন করে না। কোন অমুসলিম দ্বারা আক্রান্ত হলে কেবলমাত্র তখনই আক্রমণকারীকে প্রতি-আক্রমণের অনুমতি রয়েছে। কিন্তু এই অনুমতিও আজ থেকে দেড় হাজার বছর আগেকার সামাজিক পরিবেশে। তখন আরবে সমাজ পরিবর্তনের একটা ধারা চলছিলাে। কিন্তু আজকের। সামাজিক পরিবেশ সম্পূর্ণ ভিন্ন। বর্তমানে বিশেষ করে বাংলাদেশের কথাই বলছি, এখানে আইন-আদালত রয়েছে। কেউ অপরাধ করলে তার বিচারের ব্যবস্থা রয়েছে। এরূপ অবস্থায় ব্যক্তিগত বা দলগতভাবে ইসলামের নামে আইন-কানুন হাতে নেয়া ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই মহা অপরাধ।
তাছাড়া দেশের বিভিন্ন স্থানে জামাত-শিবিরের হাতে যেসব লােক প্রাণ হারাচ্ছে তারা কেউ আক্রমণকারী ছিলাে বলে প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার মওলানা আবদুস সােবহান পবিত্র কোরআন তেলাওয়াত করছিলেন। জামাত-শিবিরের লােকেরা তাকে হঠাৎ আক্রমণ করে হত্যা করে। চন্দ্রঘােনা তৈয়বিয়া মাদ্রাসার ১১ বছরের ছাত্র আবদুল হালিমকে ঘুমন্ত অবস্থায় হত্যা করা হয়। রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ চত্বরে ডাক্তার জামিলকে শিক্ষকদের সামনে হত্যা করা হয়। চাঁপাইনবাবগঞ্জে মুক্তিযােদ্ধা জালালকে ঘর থেকে টেনে বের করে হত্যা করা হয়। তারা কি জামাত-শিবিরের কোন লােককে আক্রমণ করেছিলেন? এমনি করে খোঁজ নিলে দেখা যাবে প্রতিটি হত্যাকাণ্ডে জামাত-শিবিররাই আক্রমণকারী। এসব সন্ত্রাসী তৎপরতা চালানাের সময় দু’একজন জামাত-শিবির কর্মীর নিহত হওয়ার ঘটনাও রয়েছে। এর জন্যও তারাই দায়ী। কারণ ‘৭১ সাল থেকে ইসলাম কায়েমের’ শ্লোগান দিয়ে তারাই ভ্রাতৃহত্যার অভিযান শুরু করেছে।
তাছাড়া অনেক ক্ষেত্রে আক্রান্তের চেয়ে আক্রমণকারীকেই অধিক ক্ষতি স্বীকার করতে টি হয়। ধর্মীয় ও নৈতিক যেকোন দিক থেকেই বিচার করা হােক না কেন জামাত-শিবিরের এই সন্ত্রাস, এই হত্যা অভিযান, ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’ শ্লোগান পবিত্র ইসলামের নাম একটা প্রতারণা ছাড়া কিছু নয়। সম্প্রতি কোন কোন সংবাদপত্রে দেখা গেছে, জামাত নেতারা তাদের শিবির ও অন্যান্য * সংগঠনের বাছাই করা কর্মীদের নিয়ে একটি আত্মঘাতী স্কোয়াড তৈরি করেছে। মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী’ শ্লোগান দ্বারা তাদের মগজ ধােলাই করা হচ্ছে। তাদের দ্বারা টার্গেটে অব্যর্থ আঘাত হানা হবে। এরপরও কেউ কি বলতে পারেন এই দলটি ইসলাম ও মুসলমানদের কল্যাণে কাজ করছে ?

জামাতের অর্থের উৎস।
যেকোন রাজনৈতিক কিংবা সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনার জন্য কমবেশি অর্থের প্রয়ােজন হয়। বিশেষ করে আমাদের দেশের রাজনৈতিক দলগুলাের কথাই বলছি। সাধারণত সদস্যদের নিয়মিত চাঁদা ও বিত্তবান মহলের কাছ থেকে সংগৃহীত এককালীন অনুদান দ্বারা বিভিন্ন রাজনৈতিক সংগঠনের ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে। দলের সম্মেলন, সভাসমিতি, সংসদ নির্বাচন প্রভৃতি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সাধারণ নিয়মের বাইরেও অর্থ সংগ্রহ করা হয়। এসব অর্থ সংগ্রহের সূত্র বাইরের লােকদের জানার কথা নয়। তবে অনেক সময় বাহ্যিক তৎপরতা দেখে কিছুটা অনুমান করা যায়। বাংলাদেশে জামাতের আর্থিক অবস্থা অন্য আর পাঁচটা রাজনৈতিক সংগঠন থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। জামাতের ঢাকা মহানগর কার্যালয়টি জাঁকজমকের দিক থেকে যেকোন বহুজাতিক সংস্থার অফিসকেও হার মানিয়ে। দেয়। স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, এতাে বিপুল অর্থ তারা পায় কোথেকে? কারা এবং কি স্বার্থে। তাদের এই অর্থ প্রদান করে থাকে ? পাকিস্তান আমলে জামাত-কর্মীদেরকে জাকাত ও কোরবানীর চামড়া তুলতে দেখা গেছে। সে সময় কোন কোন মহল থেকে জামাতের বিরুদ্ধে গরীবের হক জাকাত ও কোরবানীর চামড়া বিক্রিলব্ধ অর্থ রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যয় করার অভিযােগ ওঠে। কিন্তু জামাত তখন এসব অভিযােগ সম্পর্কে প্রতিবাদ করে। মূলত জামাত তখন প্রতিবাদ করলেও এই অভিযােগ ভিত্তিহীন ছিলাে না। এককালের জামাত নেতা মওলানা কাউসার নিয়াজির একটি ঐতিহাসিক চিঠিতে তার প্রমাণ রয়েছে। এটি তিনি ১৯৬৪ সালের ৩১ অক্টোবর মওদুদী সাহেবকে লেখেন। উক্ত চিঠির এক জায়গায় মওলানা নিয়াজি লিখেছেন, “আজ প্রায় দেড় বছর পর দেখছি, দোষ ক্রমে বেড়েই চলছে, কমছে না। পারস্পরিক শত্রুতা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। লেনদেনের ব্যাপারে কর্মীদের কথা না হয় বাদই দিলাম। আমাদের নেতাদের ভূমিকাও অত্যন্ত দুঃখজনক। আমানত নষ্ট হচ্ছে। ওশর ও জাকাতের অর্থ নিছক রাজনীতি, নির্বাচনী কর্মসূচী এবংসার্বক্ষণিক কর্মীদের বেতনে ব্যয় করা হচ্ছে। প্রচলিত রাজনৈতিক আলােচনা অত্যন্ত প্রাধান্য লাভ করেছে। আমাদের সভা-সমিতিতে আল্লাহ ও রাসূলের আলােচনা নামকাওয়াস্তে করা হচ্ছে।
ইবাদত-বন্দেগীর ক্ষেত্রে আমরা অলসতার শিকার হয়ে পড়েছি। এটা সম্ভবত আমাদের বই-পুস্তকের অবচেতন প্রভাবের পরিণতি। কারণ এসব বই-পুস্তকে ইবাদতকে মূল লক্ষ্যের মাধ্যম ও উপায় হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। আমরা আমাদের কর্মীদেরকে ধারণা দিয়েছি, জনসভা রাজনৈতিক ফললাভের উপলক্ষ মাত্র, আমরা সব সময় হাসপাতাল ও অন্যান্য জনসেবামূলক কাজগুলােকে জামাতের প্রভাব বিস্তার ও রাজনৈতিক ফায়দা হাসিলের মাপকাঠিতে বিবেচনা করে যাচ্ছি। তাতে করে আমরা কোন রাজনৈতিক কিংবা সাময়িক উদ্দেশ্য। হাসিলের সুযােগ ছাড়া জনসেবার কোন কর্মসূচী বাস্তবায়িত করি না।” | মওলানা কাউসার নিয়াজির এই ঐতিহাসিক চিঠিটি একটি দর্পণ। তাতে জামাতিদের। ধর্মের নামে, জনসেবার নামে কদর্য চেহারাই ভেসে উঠেছে। শরিয়তের বিধানে জাকাতের অর্থব্যয়ের নির্ধারিত খাত আছে। পবিত্র কোরআনে জাকাতের অর্থব্যয়ের খাত পরিষ্কার উল্লেখ করা হয়েছে। এসব খাতের বাইরে জাকাতের অর্থ প্রদান করলে জাকাতই আদায় হবে না। এমনকি মসজিদ নির্মাণ কাজেও জাকাতের অর্থ ব্যয় করা যাবে না। যে গরীব। মানুষটি জাকাত পাওয়ার যােগ্য, তাকে দেয়ার সময় বলে দিতে হবে, তােমাকে। জাকাতের অর্থ দিচ্ছি।’ অথচ পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী জামাত মানুষের জাকাতের অর্থ। নিয়ে সার্বক্ষণিক রাজনৈতিক কর্মীদের বেতন দিচ্ছে। নির্বাচনী প্রচারণায় ব্যয় করছে। জামাত নেতারা কি জঘন্য প্রকৃতির! আগে তাে শুধু দেশীয় বিত্তবানদের কাছ থেকে জামাত সংগ্রহ করতাে। এখন নাকি মধ্যপ্রাচ্য থেকেও কোটি কোটি টাকা জাকাত সংগ্রহ করছে। আর সেসব টাকা রাজনৈতিক কাজে ব্যয় করছে। সত্যি তাদের কি পরকালে। আল্লাহর দরবারে জবাবদিহির এতটুকু ভয় নেই ? | শােনা যায়, জামাতিরা নাকি ২৬টি চ্যানেল থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে থাকে।
এ সম্পর্কে সাপ্তাহিক বিচিত্রার ২৬ জুন, ১৯৮৭ সংখ্যায় বলা হয়েছে : “১৯৭১ সালের গণহত্যার নীলনকশা প্রণয়নকারী পাক হানাদার বাহিনীর দোসর ধর্ম ব্যবসায়ী জামাতে ইসলামী বাংলাদেশের রাজনীতিতে অত্যন্ত সক্রিয়। এদের কর্মতৎপরতা প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে শুরু করে রাজধানীর অভিজাত এলাকা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই সংগঠনের কর্মকাণ্ডের প্রধান উৎস হচ্ছে বিপুল পরিমাণ বৈদেশিক অর্থ। জামাত বাংলাদেশের একমাত্র রাজনৈতিক দল যার অর্ধশত অংগ সংগঠনসহ শতাধিক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এই সকল বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মুনাফা দিয়ে জামাত এদেশের মানুষের সমর্থন ক্রয় করছে। আমাদের বিশেষ অনুসন্ধানে জামাতে ইসলামীর বিভিন্ন অপকৌশল এবং স্বাধীনতাবিরােধী কর্মকাণ্ডের বিচিত্র তথ্য উদঘাটিত হয়েছে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের সময় আমরা জামাত এবং শিবিরের কর্মীদের সঙ্গে আলাপ করেছি। জামাতের জনৈক ফয়সাল আহমেদ আলােচনা প্রসঙ্গে আমাদের জানান, “… প্রয়ােজনের সময় ‘৭১-এর অস্ত্রগুলাে আবার ব্যবহার হবে। …. জামাত কাউকে ক্ষমা করবে না।” [ উক্ত সাময়িকীর ১৭ এপ্রিল, ১৯৮১ সংখ্যায় বলা হয়েছে, কিন্তু টাকা যােগায় কে ? কেননা এই সংগঠনে সদস্য চাঁদা বলে কিছু নেই। টাকার উৎস সম্পর্কে জামাতিরা কেউ কথা বলতে চায় না। একটি সূত্র আভাস দিয়েছে, বিদেশে লােক পাঠানাের মধ্য দিয়ে টাকা আসে। গত এক বছর ধরে গােলাম আযমের ব্যক্তিগত অনুমােদন ছাড়া কেউ মধ্যপ্রাচ্যের একটি দেশে যাওয়ার ভিসা পর্যন্ত পায় না। এর অনেক প্রমাণ আছে। সম্প্রতি দু’জন বাংলাদেশী সাংবাদিক ইসলামী সংবাদ সংস্থায় চাকরি পেয়েও এ কারণে ভিসা পাননি। জানা গেছে, ঐ দেশটি থেকে প্রতিমাসে জামাতের অনুসারীরা ১০ লাখ টাকা চাঁদা পাঠায়। এ কারণেই সম্ভব হয়েছে ৪০ লাখ টাকা ব্যয়ে সম্প্রতি সমাপ্ত ইসলামী ছাত্র শিবিরের। কেন্দ্রীয় সম্মেলনের আয়ােজন করা।” । জামাতের অর্থ সংগ্রহের উৎস উল্লেখ করে সৌদি আরবে প্রবাসী একজন বাঙ্গালী একটি চিঠি লিখেছেন। এই চিঠিটি বিচিত্রা’র ১৮ নভেম্বর, ১৯৮৮ সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। ‘মধ্যপ্রাচ্য থেকে অর্থ সগ্রহে জামাতের নতুন পদ্ধতি’ শীর্ষক উক্ত চিঠিতে বলা হয়েছে, ……কিছুদিন আগে আমাদের বাসায় বাংলাদেশের ‘খাঁটি মুসলমান পার্টি জামাতে ইসলামীর’ একজন ঈমানদার কর্মী একটি ভিডিও ক্যাসেট এনে দেখালাে।
তাতে দেখলাম, ১৯৭১ সালের নরপশু গােলাম আযম, সুন্দরভাবে পুরাে মুখে দাড়ি, গায়ে ধবধবে পায়জামা-পাঞ্জাবি পরে বন্যাদুর্গত এলাকায় তার দোসর আব্বাস আলী খানসহ খিচুড়ি বিতরণ করছেন। জামাতের ‘ঈমানদার কর্মীটি’র কাছে শুনলাম বিদেশে তাদের প্রত্যেক সহকর্মীর কাছে, বাংলাদেশ থেকে জামাতে ইসলামীর কর্তারা বহু ভিডিও ক্যাসেট পাঠিয়েছে। আমি তাদেরই একজন সমর্থক সেজে উক্ত কর্মীকে জিজ্ঞাসা করলাম ক্যাসেটগুলাে তাদের কাছে কেন পাঠানাে হয়েছে। কর্মীটি আমাকে তাঁদের ‘ঈমানদার’ কর্মীর একজন ভেবে বললাে, তাদের কাজ উক্ত ক্যাসেটগুলাে ছলে বলে কৌশলে যেমন করে হােক সৌদিবাসীদের দেখাতে হবে এবং বিদেশে অবস্থানরত বাঙ্গালীদের উক্ত ক্যাসেট দেখিয়ে তাদের পার্টির সমর্থক বানিয়ে মােটা অংকের চাঁদা আদায় করতে হবে।। যদি চাঁদা আদায় করতে কোন কর্মীর কোন ক্রটি হয় তাহলে জামাত থেকে তার সদস্য। পদ বাতিল হবে এবং বাংলাদেশে অবস্থানরত তাদের পরিবারের ওপর জুলুম করা হবে। বলে একটি হলুদ কাগজে করে নির্দেশনামা পাঠানাে হয়েছে প্রত্যেক কর্মীর কাছে। যার দরুন সৌদিয়ায় অবস্থানকারী প্রত্যেক জামাতকর্মী মরিয়া হয়ে উক্ত নির্দেশ পালন করতে বদ্ধপরিকর। এভাবে জামাত নেতারা আরব দেশগুলাে থেকে তাঁদের কর্মীদের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ টাকা আদায় করে ঐ টাকায় অস্ত্র কিনে আমাদের দশের নিরীহ সরল ছেলেদের ইসলামের দোহাই দিয়ে খুনী বানাচ্ছে। খুন করছে আমার নিস্পাপ ভাইদের। নির্যাতন করছ আমার মা-বােনদের।……দিদারুল বশর চৌধুরী দুদু, পােস্ট বক্স নং-১১০৬১, জেদ্দা, কে.এস.এ.।” ‘ ১৪ মার্চ, ১৯৮৬ সংখ্যায় বলা হয়েছে, “সাম্প্রতিক কয়েক বছরে জামাতে ইসলামী এবং জামাত সমর্থিত ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবির ধর্মের নামে ভাঁওতাবাজির রাজনীতির অছিলায় প্রচুর পরিমাণে অর্থ খরচ করেছে। তারা নতুন নতুন বাড়ি কিনছে, মােটর সাইকেল ও গাড়ি কিনছে, অত্যাধুনিক কায়দায় অফিস সাজাচ্ছে, নামে-বেনামে রয়েছে বিভিন্ন প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান, অত্যাধুনিক প্রেস।
তাদের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে সার্বক্ষণিক কর্মচারীদের খরচ বহন, লাখ লাখ টাকা ব্যয়ে কর্মী সম্মেলন, জনসভা প্রভৃতি দেখে জনমনে জামাতের টাকার উৎস সম্পর্কে ব্যাপক সন্দেহের সৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছুদিন পূর্বে ইসলামী ছাত্র শিবিরের একটি দলিল থেকে তাদের টাকা যােগানাের বিদেশী উৎসের চাঞ্চল্যকর প্রমাণ পাওয়া গেছে। দলিলটিতে দেখা যায়, দু’বছরের জন্য ইসলামী ছাত্র শিবিরের ৫টি প্রকল্পের জন্যে খরচ দেখানাে হয়েছে মােট ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৫ শ’ ৩৩ মার্কিন ডলার। বাংলাদেশের বর্তমান মুদ্রামানে এর পরিমাণ ২ কোটি ৫ লাখ ৯৮ হাজার ৬ শ’ ৯৫ টাকার মতাে। এর মধ্যে ৩৫ হাজার ৪শ’ ডলার তাদের নিজেদের সংগঠন ও শুভানুধ্যায়ীদের কাছ থেকে পাওয়া যাবে বলে দলিলে বলা হয়েছে। বাকি ৫ লাখ ৫৩ হাজার ১শ’ ৩৩ মার্কিন ডলার চেয়ে তারা সৌদি আরবের একটি উৎস জনৈক ফৈয়াজ ভাই-এর কাছে আবেদন জানিয়েছে। ইসলামী ছাত্র শিবিরের এই দ্বিবার্ষিক পরিকল্পনার দলিলের সঙ্গে তাদের তৎকালীন সভাপতি আবু তাহেরের চিঠি রয়েছে। দলিলে ৫টি প্রকল্পের বাজেটের বিস্তারিত বিবরণ ছিল নিম্নরূপ :
১। প্রচার ও প্রকাশনা – (ক) মুদ্রণ যন্ত্রপাতি বাবদ ২৭ লাখ টাকা, অন্যান্য ১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাড়ি নির্মাণ বাবদ ১২ লাখ টাকা। মােট ৪০ লাখ ৫০ হাজার টাকা। (খ) বিক্রয় কেন্দ্রসহ প্রকাশনার মােট খরচ দেখানাে হয়েছে ৩ লাখ ৯০ হাজার মার্কিন ডলার। ২। ফুলকুঁড়ি শিশুসংগঠনের মােট খরচ দেখানাে হয়েছে ৬০ হাজার মার্কিন ডলার। ৩। পত্র-পত্রিকার মাধ্যমে ইসলামী শিক্ষা কোর্স (দলিলে উল্লেখ আছে বাইবেল করেসপনডেন্স কোর্সের মত) বাবদ মােট খরচ দেখানাে হয়েছে ২০ হাজার মার্কিন ডলার। ৪। ছাত্র কল্যাণ ও বৃত্তি খাতে খরচ দেখানাে হয়েছে মােট ১৫ লাখ ৮ হাজার টাকা। ৫। সাহিত্য ও সংস্কৃতি ক্ষেত্রে মােট বাজেট দেখানাে হয়েছে ২ লাখ ৭০ হাজার টাকা। | “ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ জামাতের একটি অঙ্গ কিংবা সহযােগী প্রতিষ্ঠান। এই প্রতিষ্ঠান প্রতি বছর শুধু কুয়েতের জাতীয় অর্থ সংগ্রহ কমিটির কাছ থেকেই ২৫ লাখ টাকা পেয়ে থাকে। এরপরও অর্থ চেয়ে চিঠি ও টেলেক্স পাঠানাে হয়। কুয়েতের উক্ত কমিটি আরাে অর্থ প্রদানে অক্ষমতা প্রকাশ করে পরিষদের কাছে একটি চিঠি পাঠায়। চিঠির আরবী ও বাংলা অনুবাদ নিচে দেয়া হলাে :

কিন্তু ইসলামী সমাজকল্যাণ পরিষদ তাদের বুকলেটে আয়ের যেসব উৎস উল্লেখ করেছে, তাতে কুয়েতের এই উৎসটি উল্লেখ করা হয়নি। * “উপরােক্ত বিবরণ থেকেই বােঝা যায়, জামাতের সঙ্গে মধ্যপ্রাচ্যের রাজতান্ত্রিক দেশগুলাের অর্থনৈতিক সম্পর্ক নিঃসন্দেহে বেশ জোরালাে। এই প্রতিবেদন প্রস্তুতের পূর্বে আমরা জামাতের ঢাকা শহরের বিভিন্ন অফিসে গিয়েছি। বিস্মিত হয়েছি জামাতের ঢাকা মহানগরী অফিসে গিয়ে। মূল্যবান রেফ্রিজারেটর এবং এয়ারকুলার পর্যন্ত রয়েছে এ অফিসটিতে। আর আসবাবপত্র এমন চকচকে এবং আধুনিক যা যেকোন বহুজাতিক কর্পোরেশনের অফিসগুলােকেও হার মানায়। শােনা যায়, জামাতের বিভিন্ন অফিসের এই রমরমা অবস্থা বজায় রাখার জন্য জামাতের মােট বাজেটের সিকি ভাগ খরচ হয় আর বাকি অর্থ আসে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে।” * সাপ্তাহিক বিচিত্রার ২৬ জুন, ১৯৮৭ সংখ্যায় আরাে বলা হয়েছে : “জামাতে ইসলামী একটি প্রতিষ্ঠান যার মাধ্যমে তারা ধর্মের নাম ভাঙ্গিয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে থাকে। বাস্তব ক্ষেত্রে এসব ধর্ম ব্যবসায়ীর ব্যক্তিগত জীবনে ধর্মীয় আদর্শের কোন প্রতিফলন নেই। শুধুমাত্র এ কারণেই তারা সৌদি রাজতন্ত্রের দেয়া মােটা অঙ্কের পেট্রোডলার গ্রহণ করে ইসলামে রাজতন্ত্র বৈধ করার চেষ্টা করছে। যদিও পবিত্র ইসলামে রাজতন্ত্র সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। * অর্থ কেন্দ্র করে কখনাে কখনাে উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন জামাতিদের মধ্যে ঝগড়া বেধে যায়। আর তখন ধর্মের নামে তাদের ভন্ডামি প্রকাশ হয়ে পড়ে। অর্থ ভাগাভাগি কেন্দ্র করে দলত্যাগ করেছেন জামাতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় একজন রােকন— ঢাকা সেন্ট্রাল রােডের জনৈক সােহরাবউদ্দিন আহমেদ। পদত্যাগ পত্রটি তিনি জামাতে ইসলামীর আমীরের নিকট পাঠিয়েছেন। স্বহস্তে লিখিত পদত্যাগপত্রে তিনি উল্লেখ করেছেন : “.প্রত্যক্ষ দর্শন ও অভিজ্ঞতার আলোেক সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছি যে, এ সংগঠন ইসলামী আন্দোলন থেকে বিচ্যুত হয়ে ক্রমশ ভিন্ন পথে প্রবাহিত হচ্ছে। সংশােধনের কোন পথ এবং পদ্ধতি এর মধ্য থেকে করা সম্ভব নয় বলে আমার দৃঢ় প্রতীতি জন্মেছে।” পদত্যাগ পত্রের শেষাংশে তিনি জামাতিদের বিরুদ্ধে অর্থ আত্মসাতের অভিযােগ এনেছেন এবং তাদের অর্থ সরবরাহের প্রধান উৎস যে সৌদি আরব তার প্রতি ইঙ্গিত করেছেন। তিনি লিখেছেন : “… বর্তমানে জামাতের কিছু তরুণ নেতা জামাতকে প্রত্যক্ষ এবং পরােক্ষভাবে আল্লাহর প্রতি নির্ভরশীলতার পরিবর্তে সৌদি বাদশাহীর প্রতি বাধিত করছে। গরীব রােকন ও কর্মিগণের সরলতা ও ঝরানাে রক্তকে নিজেদের বৈষয়িক স্বার্থে লাগাচ্ছে।”
“সম্প্রতি দলত্যাগ করেছেন এমন একজন জামাত সমর্থিত শিবির কর্মী জানান, অর্থ। ভাগাভাগি কেন্দ্র করে জামাতের ভেতর বেশ কয়েকটি গ্রুপিং আছে এবং এদের মধ্যে অনেকেই দলত্যাগ করেছেন। দলত্যাগীরা যাতে দলত্যাগের আসল কারণ বাইরে প্রকাশ না করে তার জন্য নাকি তারা নানা ধরনের হুমকিও দিয়ে থাকে। তিনি আরাে জানান, যেসব কারণে ইসলামী ছাত্র শিবির আজ দু’ভাগে বিভক্ত সেগুলাের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ইস্যু হচ্ছে জামাতের আর্থিক বিষয়। সুলতান আহমেদ নেতৃত্বাধীন শিবিরের এই বিক্ষুব্ধ অংশটি সম্পূর্ণভাবে বর্তমান জামাত বিরােধী।” ” কথায় আছে, ‘পাতিলের ভাত একটা টিপলেই বুঝা যায় সবগুলাে সিদ্ধ হয়েছে কিনা। জামাতের অর্থের উৎস বা অর্থ সংগ্রহের উৎস প্রমাণাদির অভাবে উল্লেখ করা সম্ভব না হলেও তার অঙ্গ বা সহযােগী সংগঠনের অর্থের দু’একটা উৎস থেকে সহজে অনুমান করা যায় বাংলাদেশের আদর্শ-বিরােধী ইসলামের মুখােশধারী এই দলটি দেশ-বিদেশ থেকে কোটি কোটি টাকা সংগ্রহ করে থাকে। এই সঙ্গে স্বভাবতই প্রশ্নজাগে—দাতা দেশগুলাে জামাতকে কি উদ্দেশ্যে এই বিপুল অর্থ সরবরাহ করে থাকে। জামাতই বা এই অর্থ এদেশে কিভাবে ব্যয় করছে। এই অর্থ সংগ্রহে, বিশেষ করে বিদেশ থেকে অর্থ সংগ্রহের ব্যাপারে রাষ্ট্রের আইন-কানুন অনুসরণ করা হচ্ছে কিনা। দেশের অর্থনীতিতে এই অঢেল অর্থের কিরূপ প্রভাব পড়ছে। উপরে উল্লিখিত কয়েকটি তথ্য থেকে পরিষ্কার প্রমাণিত হয়, জামাত ও তার সাথে। সংশ্লিষ্ট সংগঠনগুলাের অর্থ সংগ্রহের প্রধান উৎস হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলাে। এসব দেশ অবশ্যই জানে, মুক্তিযুদ্ধে জামাতের ভূমিকা কি ছিলাে এবং আজো যে জামাত বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের প্রতি শ্রদ্ধাশীল নয়, এ বিষয়টিও সেসব দেশের অজানা থাকার কথা নয়। এরূপ পরিস্থিতিতে জামাতকে অর্থ সরবরাহ করা বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব বিরােধী তৎপরতায় সহযােগিতা করারই নামান্তর। আরব দেশগুলাের এই আচরণ আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বে হস্তক্ষেপ মনে করার সঙ্গত কারণ রয়েছে। আমরা ভ্রাতৃপ্রতিম আরব দেশগুলাের কাছ থেকে এ ধরনের ব্যবহার আশা করি না।
আর যদি বলা হয়, জামাতের সংগৃহীত অর্থ বিভিন্ন মুসলিম দেশের গরীব জনসাধারণকে সাহায্যের কর্মসূচীর অধীন জামাত ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলােকে সরবরাহ করা হয়, তাহলে প্রশ্ন থেকে যায়, এই অর্থ বাংলাদেশের আদর্শবিরােধী একটি রাজনৈতিক সংগঠনের মাধ্যমে দেয়া হবে কেন? আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয়ভাবে জাকাত তহবিল রয়েছে। ত্রাণ তহবিল রয়েছে। আরব বন্ধু দেশগুলাে রাষ্ট্রীয়ভাবে এই অর্থ হস্তান্তর করতে পারেন। তাছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশী অর্থ গ্রহণের নিয়ম-নীতি ও আইন-কানুন। রয়েছে। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলােচনায় না গিয়েও বলা যায়, কোন স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানকে এ ধরনের সাহায্য গ্রহণের পূর্বাহ্বে সরকারের অনুমতি গ্রহণ করতে হয়। ব্যয় সম্পর্কেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে বিস্তারিত তথ্য জানাতে হয়। অভিযােগ রয়েছে, জামাত ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাে বিদেশী অর্থ গ্রহণের সময় দেশে প্রচলিত আইনকানুন অনুসরণ করছে না। জামাত ও তার সাথে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান কর্তৃক মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশ থেকে জাকাতের অর্থ সংগ্রহ ও তার ব্যয় সম্পর্কে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও প্রশ্ন রয়েছে। একথা পূর্বেও উল্লেখ করা হয়েছে, জাকাতের অর্থ সবাইকে দেয়া যায় না। এই অর্থ ব্যয়ের নির্ধারিত খাত রয়েছে। যাদের বা যেসব খাতে জাকাতের অর্থ ব্যয়ের বিধান রয়েছে তার বাইরে ব্যয় করা যাবে না। অন্যথায় জাকাতই আদায় হবে না।
যাকে জাকাতের অর্থ দেয়া হবে, তাকে জানিয়ে দিতে হবে, আপনাকে জাকাতের অর্থ দেয়া হচ্ছে। জাকাতের অর্থ দ্বারা কোন রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হাসিল করা যাবে না। কিন্তু জামাত বা তার অঙ্গ ও সহযােগী সংগঠনগুলাে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সংগৃহীত জাকাতেরঅর্থ দেশের গরীবজনসাধারণের মধ্যে বিতরণ করছে কিনা কেউ বলতে পারবে না। অপরদিকে দেখা যায়, অঢেল অর্থ তারা রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যয় করছে। এ থেকে স্বভাবতই ধরে নেয়া যায়, মধ্যপ্রাচ্য থেকে জাকাত ও ইসলাম প্রচারের নাম করে সংগৃহীত অর্থ তারা রাজনৈতিক তৎপরতায় ব্যয় করছে। কারাে কারাে মতে নিজেরাও ভাগাভাগি করে নিচ্ছে। পবিত্র ইসলামের নামে জামাতিদের এই অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড সম্পর্কে দেশের আলেম সমাজও নীরব ভূমিকা পালন করছেন। এ ব্যাপারে দেশের প্রতিটি সচেতন নাগরিক, বিশেষ করে আলেম সমাজের প্রতিবাদ করা ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব বলে আমরা মনে করি। অপরদিকে সরকারের অজানা সূত্রে বিদেশ থেকে সংগৃহীত বিপুল অর্থ রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে ব্যয় করা শুধু প্রচলিত আইন-কানুন বিরােধীই নয়, দেশের অর্থনীতিতেও এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হচ্ছে দেশের মুদ্রাস্ফীতি বাড়িয়ে তুলছে, মুদ্রার অবমূল্যায়নে ইন্ধন যােগাচ্ছে। কিন্তু সরকার রহস্যজনকভাবে এ ব্যাপারে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেন। জামাত ও তার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলাের আয়-ব্যয় দেখতে পারেন। মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে আমাদের বিরাট কূটনৈতিকবহর রয়েছে। তাদের মাধ্যমে এ ব্যাপারটির প্রতি সংশ্লিষ্ট দেশগুলাের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারেন। সরকারের পক্ষে জামাতের দেশ ও জাতীয় স্বার্থবিরােধী এসব তৎপরতা বন্ধ করা খুব একটা কঠিন কাজ নয়। সরকার যদি জামাতের এসব তৎপরতা প্রগতিশীল ও গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তিকে মােকাবেলার একটা কৌশল হিসেবে বিবেচনা করে থাকেন, তাহলে এই নীতি দেশ, জাতি, এমনকি সরকারের জন্যও কল্যাণকর হবে না। আজকের ইরান তার জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। ইরানের রেজা শাহও এক সময় এই নীতি গ্রহণ করেছিলেন। পরিণামে তাঁকেও দেশ ত্যাগ। করতে হয়েছে। বিদেশে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে। তাঁর পরিবার-পরিজন ও আত্মায়স্বজনদের প্রবাসে জীবন যাপন করতে হচ্ছে।

নবী-রাসূল সম্পর্কে মওদুদীর ধৃষ্টতা
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাই মানুষের সুষ্ঠু চিন্তা, জ্ঞানের প্রসার ও পরিপকৃতার মূল ভিত্তি। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষ যতােই মেধাবী হােক না কেন তার মধ্যে স্বচ্ছ চিন্তাধারার বিকাশ অনেক ক্ষেত্রে হয় না। নিজের চেষ্টা-সাধনায় যখন যা শেখে বা জানে তখন তাই বলে। এভাবে সে অজস্র স্ববিরােধী উক্তি করে থাকে। আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাহীন মানুষটি যদি উচ্চাভিলাষী হয়, তাহলে তাে কথাই নেই। সে ধরাকে সরা জ্ঞান করে বসে। মনে করে তার মত জ্ঞানের অধিকারী লােক পৃথিবীতে আর কেউ জন্মেনি। এ জাতীয় লােকের মুখে অন্যের সমালােচনা ছাড়া প্রশংসা ভুলেও শােনা যায় না। আমাদের এই বক্তব্যের দৃষ্টান্ত হচ্ছেন জামাতের প্রতিষ্ঠাতা মওদুদী সাহেব। কর্ম ও রাজনৈতিক জীবনের পঞ্চাশ বছরে তার বক্তৃতা বা লেখায় কারাে প্রশংসা বড় একটা বেরােয়নি। তিনি উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় প্রত্যেক নেতারই সমালােচনা করেছেন। তাঁর এই সমালােচনা রাজনৈতিক ব্যাপারেই সীমিত ছিলাে না, ধর্মীয় বিষয়েও তিনি অনেক বাড়াবাড়ি করেছেন। নবীরাসূল, সাহাবা কেরাম, ইমাম-মুজতাহিদ ও মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কেও তিনি অনেক ধৃষ্টতামূলক উক্তি করেছেন। এমনকি পৃথিবীতে আল্লাহ তায়ালার নবী-রাসূল পাঠানাের ব্যাপারেও তাঁর আপত্তিকর মন্তব্য রয়েছে। আমরা এক্ষেত্রে তার বিভিন্ন লেখা থেকে কিছু উদ্ধৃতি দৃষ্টান্ত হিসেবে উল্লেখ করছি। মওদুদী সাহেব তাঁর তফসীরের এক স্থানে লিখেছেন, “আল্লাহ সর্বপ্রথম যে মানুষটি সৃষ্টি করেন তাকে তিনি একথাও বলে দিয়েছিলেন, হাকিকত বা সত্য কি এবং তােমার জন্য সঠিক পথ কোন্‌টি। কিছুকাল পর্যন্ত আদমের বংশধররাসঠিক পথে ছিলাে এবং একই উম্মত বা জাতি হিসেবে থাকে। মানুষ নতুন নতুন রাস্তা বের করে এবং বিভিন্ন মত ও পথ উদ্ভাবন করে। (এই উদ্ভাবন) এজন্য নয় যে, তাদের সঠিক পথ জানানাে হয়নি, বরংসঠিক পথ জানা সত্ত্বেও তাদের কেউ কেউ নিজের বৈধ অধিকার অতিক্রম করে আরাে ফায়দা ও মুনাফা হাসিল করতে চাচ্ছিলাে। এই মন্দ প্রবণতা দূর করার জন্য আল্লাহ তায়ালা নবীদের পাঠানাে শুরু করেন।” মওদুদী সাহেব তাঁর এই উক্তির মাধ্যমে সর্বজ্ঞ ও সর্বদ্রষ্টা মহান আল্লাহ তায়ালার অসীম জ্ঞানের উপর কটাক্ষ করেছেন। তাঁর মন্তব্যের অর্থ দাঁড়ায়, প্রথমে আল্লাহ তায়ালার নবী রাসূল পাঠানাের পরিকল্পনা ছিলাে না। মানুষকে তিনি সরাসরি সঠিক পথের জ্ঞান দিয়ে পৃথিবীতে পাঠান। এই পদ্ধতিতে আল্লাহ তায়ালা মানুষকে সঠিক পথে রাখতে ব্যর্থ হন। এরপর তিনি নবী-রাসূল পাঠানাে শুরু করেন। মওলানা মওদুদীর এই ব্যাখ্যা দ্বারা আল্লাহ তায়ালার জ্ঞানকে অসম্পূর্ণ বুঝানাে হয়েছে। জানি না, তিনি সচেতনভাবে না অবচেতন মনে আল্লাহ তায়ালা সম্পর্কে এই মন্তব্য করেছেন।
তাঁর এই উক্তি কোরআন-হাদীসের সম্পূর্ণ পরিপন্থী। / নবী-রাসূলদের নিস্পাপ হওয়া সম্পর্কে সকল ইমাম-মুজতাহিদ ও ইসলামিক চিন্তাবিদরা অভিন্ন মত পােষণ করেন। কিন্তু শুধু মওদুদী সাহেব ভিন্ন মত পােষণ করেন। তিনি বলেছেন, “ইসমত বা নিস্পাপ হওয়াটা মূলত নবীদের প্রকৃতিগত গুণ নয়। বরং নবুয়তের দায়িত্ব সঠিকভাবে পালনের জন্য আল্লাহ তায়ালা কৌশলগতভাবে তাদেরকে ভুলত্রুটি ও পদস্খলন থেকে নিরাপদ রেখেছেন। নতুবা তাঁদের উপর আল্লাহ তায়ালার হেফাজত ক্ষণিকের জন্য উঠে গেলে সাধারণ মানুষের মত তাঁরাও ভুলভ্রান্তিতে পড়তে পারেন। এখানে একটি সূক্ষ্ম বিষয় এই যে, আল্লাহ তায়ালা ইচ্ছে করেই প্রত্যেক নবীর উপর থেকে কোন না কোন সময় তাঁর হেফাজত উঠিয়ে নেন এবং তাঁকে দু’একটি গুনাহে লিপ্ত হতে দেন। তাতে করে মানুষ যেন নবীদেরকে খােদা বলে ধারণা না করে এবং জেনে রাখে এরাও মানুষ।” | মওদুদী সাহেবের এই উক্তিটি ব্যাখ্যার প্রয়ােজন নেই। অত্যন্ত স্পষ্ট। ইসলামের নামে তিনি সম্পূর্ণ ভুল ও বাতিল ধারণা প্রকাশ করেছেন। তিনি তাঁর এই অভিমত প্রমাণের জন্য উদ্দেশ্যমূলকভাবে বিভিন্ন নবী ও রাসূলের নিস্পাপ জীবনকে কলংকিত করার দৃষ্টতা দেখিয়েছেন। হযরত মুসা (আঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “নবী হওয়ার পূর্বে হযরত মূসা (আঃ) দ্বারা একটি বড় গুনাহ হয়েছিলাে। তিনি এক ব্যক্তিকে কতল করেছিলেন।’৩’ ! মূলত হযরত মুসা (আঃ) ইচ্ছাকৃতভাবে কাউকে কতল বা খুন করেননি। সেকালে মিসরে কিবতী বংশীয়রা ছিলাে শাসক। তারা বনি ইসরাইলীদের উপর অত্যাচার-নির্যাতন চালাতাে। একদিন এক কিবতী একজন বনি ইসরাইলীকে মারধাের করছিলাে। নির্যাতিত লােকটি হযরত মূসার সাহায্য প্রার্থনা করে। হযরত মূসা অত্যাচারী কিবতীকে একটি ঘুষি মারেন। তাতে ঘটনাচক্রে লােকটি মারা যায়। এই ঘটনা কেন্দ্র করে মওদুদী সাহেব হযরত মূসাকে খুনী হিসেবে চিত্রিত করেছেন। মওদুদী সাহেব পবিত্র কোরআনের একটি আয়াতের ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে হযরত ইবরাহীম | (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন, “এখানে আর একটি প্রশ্নের উদ্রেক হয় যে, হযরত ইবরাহীম (আঃ) যখন নক্ষত্র দেখে বলেছিলেন, এটা আমার প্রতিপালক’ এবং চন্দ্র-সূর্য দেখে এগুলােকে নিজের প্রতিপালক হিসেবে অভিহিত করেন তখন সাময়িকভাবে হলেও তিনি কি শিরকএ নিপতিত হননি ? …”
এরপর অবশ্য মওদুদী সাহেব এই অভিযােগ নিজেই খণ্ডন করার চেষ্টা করেছেন। কিন্তু . হযরত ইবরাহীম (আঃ) সম্পর্কে এ ধরনের প্রশ্ন ওঠানােই একটা চরম ধৃষ্টতা ছাড়া কিছু নয়। কারণ নবী-রাসূলগণ নবুয়ত লাভের আগে ও পরে নির্বিশেষে জন্মগতভাবেই নিস্পাপ। মা মওদুদী সাহেব তাঁর তফসীরে হযরত ইউনুস (আঃ) সম্পর্কে বলেছেন, “কোরআনের ইঙ্গিতগুলাে ও ইউনুসের পুস্তিকা ••• (সহিফা) বিস্তারিত পর্যালােচনা করলে এটা সুস্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, হযরত ইউনুস দ্বারা নবুয়তের দায়িত্ব পালনে কিছুটা অবহেলা বা অসতর্কতা হয়েছিলাে। সম্ভবত অধৈর্য হয়ে তিনি সঠিক সময়ের আগেই বাসস্থান ত্যাগ করেছিলেন। আশুরীয়গণ আজাবের লক্ষণ দেখে তওবা ইস্তেগফার করলে আল্লাহ তায়ালা তাদের ক্ষমা করে দেন। পবিত্র কোরআনে আল্লাহর শাস্তি প্রদানের যে সার্বিক নিয়ম-কানুন বর্ণনা করা হয়েছে, তার মধ্যে একটি সাধারণ নিয়ম হলাে, আল্লাহ তায়ালা কোন সম্প্রদায়ের নিকট তাঁর প্রমাণ বা নিদর্শন পরিপূর্ণ না হওয়া পর্যন্ত তিনি শাস্তি প্রদান করেন । …”৫ এক্ষেত্রে মওদুদী সাহেব হযরত ইউনুসের (আঃ) উপর তিনটি দোষারােপ করেছেন। প্রথমত, তিনি নবুয়তের দায়িত্ব পালনে অবহেলা করেছেন। দ্বিতীয়ত, তিনি আল্লাহ তায়ালার নির্ধারিত সময়ের আগেই অধৈর্য হয়ে বাসস্থান ত্যাগ করেন। তৃতীয়ত, তিনি । নিজের সম্প্রদায়ের নিকট আল্লাহ তায়ালার প্রমাণ (হুজ্জত) পরিপূর্ণ করেননি। মওদুদী সাহেব বলতে চেয়েছেন, হযরত ইউনুসের এসব ত্রুটি থাকায় এবং শাস্তির লক্ষণ দেখে তওবা করায় আল্লাহ তায়ালা হযরত ইউনুসের সম্প্রদায়কে শাস্তি দেয়া সঙ্গত মনে করেননি। বস্তুত মওদুদীর এসব উদ্ভট অভিযােগ সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন ও কল্পনাপ্রসূত। এসব দ্বারা শুধু হযরত ইউনুসই সমালােচিত হননি, আল্লাহ তায়ালার নবী মনােনয়নেও কটাক্ষ করা হয়েছে। কারণ তাঁর মন্তব্য থেকে বুঝা যায়, আল্লাহ তায়ালা কর্তৃক হযরত ইউনুসকে নবী নির্বাচন সঠিক হলে এই অবস্থার সৃষ্টি হতাে না।
মওদুদী সাহেব হযরত ইউসুফকে (আঃ) বিংশ শতাব্দীর ঘৃণ্য ডিকটেটর মুসােলিনীর সাথে তুলনা করেছেন। তিনি আল্লাহর নবী হযরত ইউসুফের মর্যাদাকে মুসােলিনীর সমমর্যাদার বলে মন্তব্য করেছেন। তিনি বলেছেন, “ইউসুফের (আঃ) দাবী নিছক অর্থ। মন্ত্রণালয়ের পদ প্রার্থনাই ছিলাে না, যেমনটি কোন কোন লােক ধারণা করে থাকে। বরং তা ছিলাে ডিকটেটরশীপ লাভের দাবী। এর ফলশ্রুতি হিসেবে হযরত ইউসুফের (আঃ) যে মর্যাদা অর্জিত হয়েছিলাে, তা ছিলাে অনেকটা বর্তমান মুসােলিনীর মর্যাদার অনুরূপ।”৬ পবিত্র কোরআনে হযরত ইউসুফের নামে একটি সূরা রয়েছে। উক্ত সুরাকে আল্লাহ তায়ালা সুন্দরতম কাহিনী’ আখ্যায়িত করেছেন। আর মওদুদী সাহেবের ভাষায় হযরত ইউসুফ ডিকটেটরশীপের দাবী করেছিলেন। তিনি হযরত ইউসুফকে ইতিহাসের অন্যতম ঘূণ্য ব্যক্তি মুসােলিনীর সমমর্যাদায় নামিয়ে এনেছেন। আল্লাহ তায়ালার সম্মানিত নবী সম্পর্কে এর চেয়ে ধৃষ্টতামূলক উক্তি আর কি হতে পারে ! হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “উরইয়ার স্ত্রীর ব্যাপারটির মূলতত্ত্ব শুধু এতটুকু ছিলাে যে, হযরত দাউদ (আঃ) সমকালীন ইসরাইলী সমাজের প্রচলিত রীতিনীতি দ্বারা প্রভাবিত হয়ে উরইয়ার নিকট তার স্ত্রীকে তালাক দেয়ার অনুরােধ করেছিলেন।……৭ হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে মওদুদীর এই মন্তব্য অত্যন্ত আপত্তিকর। কারণ পূতপবিত্র নবী-রাসূলগণ কোন অবস্থায়ই সামাজিক কুপ্রথা দ্বারা প্রভাবিত হননি। বিশিষ্ট তফসীরকারদের অভিমত হলাে, উরইয়ার স্ত্রীর ঘটনাটাই কাল্পনিক ও ভিত্তিহীন।
হযরত দাউদ (আঃ) সম্পর্কে জনাব মওদুদী আরাে বলেছেন, “এর দ্বারা স্বভাবতই প্রকাশিত হয়, যে কাজ তাঁর (হযরত দাউদ) দ্বারা হয়েছিলাে তাতে তাঁর কুপ্রবৃত্তির কিছু কিছু দখল বা প্রভাব ছিলাে। তাঁর শাসকসুলভ অসংগত ব্যবহারেরও কিছুটা সম্পর্ক ছিলাে। আর তা এমন কাজ ছিলাে, যা ন্যায়পরায়ণ কোন শাসকের জন্য শােভনীয় ছিলাে না। ৮ পবিত্র কোরআনে হযরত দাউদের (আঃ) প্রতি আল্লাহ তায়ালা তাঁর বিশেষ অনুগ্রহের কথা অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে উল্লেখ করেছেন। আল্লাহ তায়ালা হযরত দাউদের উচ্চ প্রশংসা করেছেন। কিন্তু মওদুদী সাহেব এই মহান মর্যাদার অধিকারী রাসূলকে ‘কুপ্রবৃত্তির বশীভূত ও ক্ষমতার অপব্যবহারকারী’ বলে মন্তব্য করার দুঃসাহস দেখিয়েছেন। সত্যি মওদুদী সাহেবের এসব বাতিল ধ্যান ধারণা দেখে যেকোন বিবেকবান লােক বিস্মিত না হয়ে পারেন না। | মওদুদী সাহেব তাঁর বিভিন্ন লেখায় মহানবী (সঃ) সম্পর্কেও সমালােচনা করেছেন, তাঁর সম্পর্কে দৃষ্টতামূলক উক্তি করেছেন। দজ্জাল সম্পর্কিত হাদীসগুলাে সম্পর্কে আলােচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “এ সম্পর্কে যেসব কথা হুজুরের নিকট থেকে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে, মূলত এগুলাে ছিলাে তাঁর অনুমান (কিয়াস)। এসব সম্পর্কে তিনি নিজেও সন্দিগ্ধ ছিলেন। এসব কথা তিনি ওহী লাভের ভিত্তিতে বলেননি, বরং অনুমান করে বলেছিলেন।……”
মহানবীর (সঃ) হাদীস সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “হাদীস কিছু লােক থেকে কিছু লােক পর্যন্ত অর্থাৎ মানুষের মুখে মুখে বর্ণিত হয়ে আসছে। এসব বড়জোর সঠিক বলে ধারণা করা যায়, কিন্তু দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করা যায় না। আর একথা স্পষ্ট যে, আল্লাহর ধর্মের যেসব বিষয় এতাে গুরুত্বপূর্ণ, যেগুলাের দ্বারা ঈমান ও কাফেরের পার্থক্য পরিষ্কার হয়ে যায়, সেগুলাে কয়েকজন লােকের বর্ণনা নির্ভর করে মানুষকে বিপদাপন্ন করা আল্লাহ তায়ালা কখনাে পছন্দ করতে পারেন না।”১০ পবিত্র কোরআনের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “কোরআন করিম হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট; কিন্তু নাজাত বা মুক্তির জন্য নয়”। ১১ ইসলামীক দৃষ্টিকোণ থেকে ইহকালের কল্যাণ এবং পরকালের নাজাত বা মুক্তিলাভই হচ্ছে হেদায়েত বা সৎপথ গ্রহণের একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। মওদুদী সাহেবের মতে পবিত্র কোরআন হেদায়েতের জন্য যথেষ্ট, মুক্তির জন্য নয়। তাঁর এই উদ্ভট উক্তি থেকে স্বভাবতই প্রশ্ন জাগে, তাহলে মুক্তির জন্য মানুষ অপর কোন্ ধর্মগ্রন্থ অনুসরণ করবে? সেসব কি মওদুদী রচনাবলী ? মনে হয় স্পষ্ট বলতে সাহস না করলেও কৌশলে তিনি তাই বুঝাতে চেয়েছেন।
নবী-রাসূলদের পরই সাহাবাদের মর্যাদা। তাঁদের সম্পর্কে মহানবী (সঃ) বলেছেন, “আমার সাহাবারা নক্ষত্রের মত। তাদের মধ্যে যাকে তােমরা অনুসরণ করবে, সঠিক পথ লাভ করবে।” আর মহানবী প্রশংসিত সাহাবা কেরামরাও মওলানা মওদুদীর সমালােচনা থেকে অব্যাহতি পাননি। তাঁদের সম্পর্কে তিনি বলেছেন, “দীর্ঘ দিনের শিক্ষা-দীক্ষার পর রাসূলুল্লাহ (সঃ) তাঁদেরকে রণাঙ্গনে নিয়ে আসেন। তাঁদের মন-মানসিকতায় মহাবিপ্লব চিত্রিত হওয়ার পরও ইসলামের প্রাথমিক যুদ্ধগুলােতে আল্লাহর রাস্তায় জেহাদের মূল তাৎপর্য অনুধাবনে সাহাবা কেরামরা বার বার ভুল করতেন।১২
মওদুদী সাহেব সাহাবাদের সম্পর্কে আরাে বলেছেন, “সাহাবায়ে কেরামের অনেকে মনগড়া হাদীস বর্ণনা করেছেন।”১৩ সাহাবাদের মধ্যে জাহিলিয়াতের বদস্বভাবের পুনরাবৃত্তি ঘটে।”১৪ অনেক সময় সাহাবাদের মধ্যেও মানবিক দুর্বলতা প্রাধান্য লাভ করতাে। তাঁরা একে অপরকে আক্রমণ করে বসতেন এবং পরস্পরে গালিগালাজ শুরু করতেন।”১৫ ইসলামের প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর (রাঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব লিখেছেন, “ইসলাম মানুষকে এই নির্দেশ দেয় যে, সে যেন কখনাে রিপুর প্রভাবে প্রভাবিত না হয়। … এটা অত্যন্ত সুক্ষ্ম ব্যাপার। একবার হযরত আবু বকর সিদ্দিকের মতাে রিপুর তাড়নামুক্ত খােদাভীরু ও আল্লাহতে নিবেদিতপ্রাণ ব্যক্তিও তা পূরণ করতে ব্যর্থ হন।”১৬ তরজমানুল কোরআনের একই সংখ্যায় হযরত ওমর (রাঃ) সম্পর্কে মওদুদী সাহেব বলেছেন, “বিশ্ব প্রতিটি উচুর সামনে মাথানত করতে অভ্যস্ত ছিলাে এবং প্রত্যেক বুজর্গ মানুষকে সাধারণ মানুষের স্তর থেকে কিছু না কিছু উর্ধ্বে ধারণা করে আসছিল। এই ধারণার প্রভাব বিলুপ্ত হওয়ার পথও কখনাে কখনাে স্পষ্ট হয়ে উঠতাে ••। সম্ভবত এই ব্যক্তি-শ্রেষ্ঠত্বের ধারণাই রাসূলুল্লাহর ইন্তেকালের সময় অনিচ্ছাকৃতভাবে হলেও কিছুক্ষণের জন্য হযরত ওমরকে পরাভূত করে ফেলেছিলাে।”১৭ খেলাফতে রাশেদার প্রতি জাহিলিয়াতের হামলার বর্ণনা প্রসঙ্গে মওদুদী সাহেব হযরত ওসমানের (রাঃ) সমালােচনা করে বলেছেন, “একদিকে ইসলামী রাষ্ট্র দ্রুত সম্প্রসারণের। দরুন কাজ দিন দিন কঠিনতর হচ্ছিলাে, অপরদিকে হযরত ওসমান যার উপর এই বিরাট কাজের বােঝা ন্যস্ত করা হয়েছিলাে, তিনি ততটা যােগ্যতা ও বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন যা তাঁর পূর্বসূরীদের ছিলাে। এজন্য জাহেলিয়াত ইসলামী সমাজব্যবস্থায় অনুপ্রবেশের পথ পেয়ে যায়।”১৮ হযরত ওসমানের (রাঃ) হত্যাকান্ডের প্রতিশােধের দাবী উঠানাে হলে হযরত মায়াবিয়ার লোেকদের উদ্দেশে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) বলেন, এখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। যথাসময়ে অবশ্যই এই হত্যাকাণ্ডের প্রতিশােধ নেয়া হবে।’ কিন্তু মওদুদী সাহেব হযরত আলীর (রাঃ) এই জবাবের সমালােচনা করে বলেন, “ইনসাফ করাে, তুমি যদি মায়াবিয়া হতে কিংবা মায়াবিয়া না হও অন্তত সিরিয়ার একজন সাধারণ নাগরিক হতে, তাহলে বর্ণিত পটভূমির প্রেক্ষিতে তুমি কি আলীর জবাবকে একটা বাহানা, গড়িমসি, ছলনা ও অস্বীকৃতি ছাড়া সৎ উদ্দেশ্যপ্রণােদিত মনে করতাে ?”১৯
এই উদ্ধৃতিতে মওদুদী সাহেব হযরত আলীকে একজন প্রতারক হিসেবে চিত্রিত করেছেন। দিগ্বিজয়ী বীর ও মহানবীর বিশিষ্ট সাহাবী হযরত খালেদ বিন ওয়ালিদের সমালােচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “ইসলামের বুদ্ধিভিত্তিক চিন্তাধারা অনৈসলামিক ভাবাবেগের সামান্যতম অনুপ্রবেশও সহ্য করতে পারে না। এ ব্যাপারে ইসলাম রিপুর এতটুকু প্রবণতাও পছন্দ করে না। হযরত খালেদের মত বিবেক-বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তির পক্ষেও ইসলামের এই পার্থক্য নির্ধারণ করা মুশকিল হয়ে পড়েছিলাে।”২০১৭ মওদুদী সাহেবের এই প্যাচানাে উক্তির সরল অর্থ এই দাঁড়ায় যে, হযরত খালেদের মত বিশিষ্ট সাহাবীও ইসলামিক ও অনৈসলামিক প্রবণতার মধ্যে পার্থক্য করতে পারেননি। p মহানবী (সঃ) বলেছেন, প্রত্যেক শতাব্দীতে আল্লাহ তায়ালা একজন কামেল ব্যক্তি সৃষ্টি করেন। তিনি আল্লাহ তায়ালার অনুগ্রহে সত্য ধর্মকে বাতিলের সংমিশ্রণ বা অনুপ্রবেশ থেকে পূত-পবিত্র রাখেন। শরিয়তের পরিভাষায় এ ধরনের শতাব্দী- শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্বকে ‘মুজাদ্দিদ’ বা সংস্কারক বলা হয়। মুজাদ্দিদদের আগমন সম্পর্কে জনাব মওদুদীর বক্তব্য হচ্ছে, ‘ইতিহাসের প্রতি দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, এ পর্যন্ত কোন কামেল মুজাদ্দিদের’ আবির্ভাব হয়নি। ওমর ইবনে আবদুল আজিজের এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা ছিলাে। কিন্তু তিনি কামিয়াব বা সফল হতে পারেননি। তাঁর পর যত মুজাদ্দিদের আগমন হয়েছে, তাদের প্রত্যেকে কোন না কোন একটা বিশেষ বিভাগ কিংবা কয়েকটি বিভাগে কাজ করেছেন। কামেল মুজাদ্দিদ বা পরিপূর্ণ সংস্কারকের স্থান এখনাে শূন্য রয়েছে।”২১
মওদুদী সাহেবের এই উদ্ধৃতিটি অত্যন্ত স্পষ্ট। তাঁর মতে এ পর্যন্ত যতাে মুজাদ্দিদ এসেছেন, তাঁরা সবাই ছিলেন নাকেস বা অসম্পূর্ণ। কামেল মুজাদ্দিদের স্থান এখনাে শূন্য। এর দ্বারা তিনি কি বুঝাতে চেয়েছেন, পাঠকরা নিশ্চয়ই তা বুঝতে পেরেছেন। কিন্তু তাঁর সে আশা পূরণ হলাে না। উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের কেউই তাঁকে মুজাদ্দিদ দূরের কথা, আলেমের কাতারে স্থান দিতেই রাজি হলেন না। . মুহাদ্দিস বা হাদীসবিদগণ প্রাণান্ত পরিশ্রম করে একটা নিখুঁত নীতিমালার ভিত্তিতে মহানবীর হাদীস সংগ্রহ ও সংকলন করেছেন। পবিত্র কোরআনের পরই হাদীসের স্থান। হাদীস হচ্ছে পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা। আর প্রধানত পবিত্র কোরআন-হাদীসের উপর ভিত্তি করেই শরিয়তের বিধি-বিধান বিন্যস্ত হয়েছে। মওদুদী সাহেব তাঁর বন্নাহীন। লেখনীর মাধ্যমে হাদীসবিদদেরও সমালােচনা করেছেন। তিনি লিখেছেন, “প্রত্যেককে হাদীসের ইমামদের অন্ধ অনুকরণ করতে হবে, কিংবা তাঁদেরকে ভুলত্রুটিমুক্ত মনে করতে হবে, এ ধারণা আমি কখনাে সমর্থন করিনি। এমনকি আমি কখনাে এই দাবী করিনি যে, প্রত্যেক কিতাবে যে বর্ণনা রাসূলুল্লাহ বলেছেন’ দ্বারা শুরু হয়েছে, চোখ বুঝে তা রাসূলের হাদীস হিসেবে মেনে নিতে হবে।… মুহাদ্দিসদের উপর ভরসা করা কতটা ঠিক হবে ? কারণ তাঁরাও তাে মানুষই ছিলেন। মানুষের জ্ঞানের যে সীমানা আল্লাহ প্রকৃতিগতভাবে নির্ধারণ করে রেখেছেন, তাঁরা তা অতিক্রম করতে পারেননি। মানুষের কাজে স্বভাবজাত যেসব ভুলত্রুটি থেকে যায় তাদের কাজও তা থেকে নিরাপদ ছিলাে না।”২২
ঘুরিয়ে ফিরিয়ে এসব বলে মওদুদী সাহেব মুসলিম সমাজে হাদীসবিদদের ভাবমূর্তি খাটো করতে চেয়েছেন। হাদীসবিদদের খাটো করার মানে হাদীসের প্রতি মানুষকে আস্থাহীন করে তােলা। সচেতন পাঠকদের নিকট মওদুদী সাহেবের এই বাকচাতুর্য রহস্য অস্পষ্ট থাকার কথা নয়। ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের সমালােচনা প্রসঙ্গে মওদুদী সাহেব লিখেছেন, “ফেকাহ শাস্ত্রবিদদের কানুন বা বিধান কঠোরতার দরুন নারী সমাজের জীবন ধ্বংসসাধনকারী এবং তাদেরকে ধর্মচ্যুতকারী।”২৩ ইসলামের গতায়ু গবেষক ও চিন্তাবিদদের সম্পর্কে বলেছেন, “ইসলামে আধুনিক চিন্তাধারার (নেশাআতে জাদিদাহ) প্রয়ােজন। কারণ পুরনাে ইসলামিক চিন্তাবিদ ও গবেষকদের অবদান এখন আর কোন কাজে আসতে পারে না। পৃথিবী অনেক এগিয়ে গেছে।”২৪ কোন মাযহাবের অনুকরণ সম্পর্কে মওদুদী সাহেবের ফতােয়া হচ্ছে, ‘‘আমার অভিমত হলাে, একজন বিদ্বান ব্যক্তির জন্য (মাযহাবের) অনুকরণ নাজায়েজ, এমনকি তার চেয়েও কঠিনতর কিছু।”২৫ হযরত ইমাম গাজ্জালীর (রঃ) সমালােচনা প্রসঙ্গে মওদুদী সাহেব লিখেছেন, “ইমাম। গাজ্জালীর সংস্কারমূলক কাজে জ্ঞানগত ও চিন্তাগত দিক থেকে কয়েকটি ক্রটিও ছিলাে। এগুলাে তিনটি শিরােনামে বিভক্ত করা যেতে পারে। প্রথমত, ইলমে হাদীসে দুর্বলতার দরুন তাঁর গবেষণায় কতকগুলাে ক্রটি দেখা দেয়। দ্বিতীয়ত, তাঁর মধ্যে দর্শনের প্রাধান্য থাকায় কতকগুলাে গবেষণায় ত্রুটিবিচ্যুতি দেখা দেয়। তৃতীয়ত, তাসাউফবাঅধ্যাত্মবাদের প্রতি তাঁর প্রয়ােজনাতিরিক্ত আকর্ষণ থাকার দরুন সৃষ্ট ত্রুটিবিচ্যুতি।”২৬ / একাদশ শতাব্দীর মুজাদ্দিদ হযরত শেখ আহমদ সারহিন্দী (রঃ) বা মুজাদ্দিদে আলফে সানী ও হযরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলবীর সমালােচনা করে মওদুদী সাহেব লিখেছেন, “হযরত মুজাদ্দিদে আলফে সানীর সময় থেকে শাহ সাহেব ও তাঁর খলিফাদের।
সময়কাল পর্যন্ত তাঁদের গবেষণা বা সংস্কারমূলক কাজে প্রথম যে বিষয়ে আমার সন্দেহ রয়েছে, তা হলাে তাসাউফ বা আধ্যাত্মিকতার ব্যাপারে তাঁরা মুসলমানদের রােগ পুরােপুরি নির্ণয় করতে পারেননি। তাদেরকে পুনরায় সে খাবারই পরিবেশন করা হয়েছে, যা থেকে তাদেরকে সম্পূর্ণ বিরত রাখার প্রয়ােজন ছিলাে।”২৭। ইসলামের বিধান অনুযায়ী পবিত্র কোরআনের মনগড়া তফসীর করা হারাম। মহানবী (সঃ) বলেছেন, “যে ব্যক্তি পবিত্র কোরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করে সে যেন তার স্থান দোযখে তালাশ করে” (তিরমিযী)। বস্তুত পবিত্র কোরআনের ব্যাখ্যা করার কতকগুলাে নিয়ম-নীতি রয়েছে। আর এসব নিয়ম-নীতি জানতে হলে সাহাবা কেরাম ও তাঁদের পরবর্তীকালের মনীষীদের তফসীর এবং আনুষঙ্গিক বিষয়াদি সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করতে হয়। এজন্য প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষার প্রয়ােজন হয়। কিন্তু মওদুদী সাহেব বলেছেন, “কোরআন ও রাসূলের সুন্নতের শিক্ষাই সবার আগে। তবে তা তফসীর ও হাদীসের পুরনাে ভাণ্ডার থেকে নয়।”২৮
মওদুদী সাহেবের ইসলামের নামে এ ধরনের ইসলামবিরােধী মন্তব্য ব্যাখ্যা করে মুসলিম বিশ্বের অন্যতম মনীষী তবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মওলানা যাকারিয়া (রঃ) লিখেছেন, ‘আমার মতে মওদুদী সাহিত্যের সবচেয়ে মারাত্মক ও ভয়ংকর দিক হলাে পবিত্র কোরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা। মওদুদী সাহেব নিজেই স্বীকার করেছেন, নিজের তফসীর লেখার সময় তিনি মনবুলাত বা হাদীস ওপুরনাে তফসীর গ্রন্থরাজির প্রতি দৃষ্টিপাত করা প্রয়ােজন মনে করেননি। তাঁর তফসীরের শুরুতে তিনি লিখেছেন, “কোরআন পড়ে আমি যা বুঝেছি, আমার মনে যে প্রভাব পড়েছে হুবহু তাই আমি নিজের ভাষায় প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি।”২৯ , পবিত্র কোরআনের মনগড়া ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মওদুদী সাহেব তাঁর তাফহিমুল কোরআনের বিভিন্ন স্থানে মারাত্মক ভুল করেছেন, তফসীরের নামে শরিয়ত-বিরােধী কথাবার্তা বলেছেন। পবিত্র কোরআনে ১৪টি সেজদার আয়াত রয়েছে। এসব আয়াতের পাঠককে পাঠশেষে একটি সিজদা করতে হয়। এই সেজদা করা শরিয়তের পরিভাষায় ওয়াজিব। এমনকি এসব আয়াতের শ্রোতাদেরকেও সিজদা করতে হয়। নামায পড়ার জন্য যেমন অযু করে পূত-পবিত্র হতে হয়, কেবলামুখী হয়ে দাঁড়াতে হয়, নামাযের সেজদায় যেমন মাটিতে মাথা রাখতে হয়, তেমনি কোরআন তেলাওয়াতের সিজদার বেলাও এসব আনুষ্ঠানিকতা সম্পন্ন করতে হয়। এ ব্যাপারে সকল তফসীরকার, হাদীসবিদ ও ফেকাহ শাস্ত্রবিদরা অভিন্ন মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু মওদুদী সাহেব তাঁর তফসীরের সূরা আ’রাফের শেষে লিখেছেন, “সজদায়ে তেলাওয়াতের জন্য মাটিতে মাথা রাখা, কেবলামুখী হওয়া বা অযু হওয়া প্রভৃতির কোন শর্ত নেই। কেবল সেজদার আয়াত শােনা মাত্র যে যেখানে যে অবস্থায় থাকে, একটু মাথা ঝোঁকালেই চলবে।”
প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাদীক্ষাহীন মওদুদী সাহেব সূরা বাকারার রােযা সম্পর্কিত আয়াতের ব্যাখ্যা করতে গিয়েও অমার্জনীয় অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। সকল তফসীরকার একমত যে, রােযাদাররা সােবহে সাদেক বা পূর্বাকাশে সাদা আভা প্রকাশিত হওয়ার আগ পর্যন্ত পানাহার করতে পারবে। এরপর করতে পারবে না। কিন্তু মওদুদী সাহেব উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় লিখেছেন, “যদি ঠিক সােবহে সাদেকের সময় কারাে ঘুম ভাঙ্গে, তাহলে তার জন্য পানাহার করে নেয়া জায়েয হবে। হাদীস শরীফে আছে, হুযুর (সঃ) বলেছেন, “তােমাদের মধ্যে যদি কেউ সেহরী খাওয়া অবস্থায় আযানের আওয়াজ ধ্বনিত হয়, তাহলে। তাড়াহুড়ো করে পানাহার বন্ধ করবে না। প্রয়ােজনমত পানাহার করে নেবে।” । বস্তুত পবিত্র কোরআন ও হাদীসভিত্তিক সিদ্ধান্ত দিতে হলে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কিত কোরআন-হাদীসের সবগুলাে ভাষ্য নিয়ে বিচার-বিশ্লেষণ করতে হয়। কিন্তু মওদুদী সাহেব এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ অজ্ঞতার পরিচয় দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে মহানবীর (সঃ) আরাে হাদীস রয়েছে। তার মধ্যে একটি হাদীস হযরত আয়েশা (রাঃ) বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেন, “হযরত বেলাল (রাঃ) রাত থাকতে আযান দিতেন। রাসূলুল্লাহ (সাঃ) বলতেন, “তােমরা ইবনে মাকতুমের আযানের আগ পর্যন্ত পানাহার করতে পার। কারণ সে সােবহে সাদেক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আযান দেয়।” (বােখারী) । এ সম্পর্কে হযরত আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রাঃ) একটি হাদীস বর্ণনা করেছেন তিনি ।
বলেন, রাসূলে করীমের (সঃ) দু’জন মুয়াজ্জিন ছিলেন। একজন হযরত বেলাল (রাঃ), অপরজন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমারাঃ)। রাসূলুল্লাহ (সঃ) বলেছেন, “বেলাল সােবহে সাদেকের আগে রাত থাকতে আযান দেয়। কাজেই তােমরা তারপরও আবদুল্লাহ ইবনে উম্মে মাকতুমের আযানের আগ পর্যন্ত পানাহার করতে পার।” (মুসলিম) _ এসব হাদীস বিচার-বিশ্লেষণ করে সকল তফসীরকার সূরা বাকারার উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় বলেছেন, সােবহে সাদেকের পূর্ব পর্যন্ত পানাহার করা যাবে, কিন্তু পরে নয়। অথচ মওদুদী সাহেব একটিমাত্র হাদীস উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট আয়াতটির ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে ফতােয়া দিয়েছেন-~~-সােবহে সাদেকের সময়ও রােযাদারের পানাহার করা বিলকুল জায়েয হবে। . এভাবে আল্লাহ তায়ালার নবী পাঠানাে থেকে শুরু করে নবী-রাসূল, সাহাবা, ইমামমুজতাহিদ, বিভিন্ন যুগের মুসলিম মনীষী, হাদীস, ফেকাহ শাস্ত্র প্রভৃতি কোন কিছুই মওদুদী সাহেবের অভিনব গবেষণা ও সমালােচনা থেকে অব্যাহতি পায়নি। তাঁর লেখা বিভিন্ন গ্রন্থ ও প্রবন্ধরাজির সর্বত্র আপত্তিকর ও ধৃষ্টতামূলক বক্তব্য ছড়িয়ে আছে। দৃষ্টান্ত হিসেবে এখানে। কিছু কিছু বক্তব্য উল্লেখ করা হলাে। এই উদ্ভট ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপ দেয়ার আকাংক্ষা নিয়ে মওদুদী সাহেব ইসলামের মুখােশধারী জামাত গঠন করেন। বর্তমানে জামাতে। ইসলামীও বাংলাদেশে ইসলাম প্রচারের নামে মওদুদী সাহেবের এসব ইসলামবিরােধী উদ্ভট ধ্যান-ধারণা প্রচার করে চলেছে। দেশের সরলমনা ও ধর্মপরায়ণ লােকেরা, বিশেষ করে স্কুল-কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের একশ্রেণীর ছাত্র ধর্মের নামে এই বাতিল ধ্যান-ধারণার শিকার হয়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে।
এক্ষেত্রে একটা বিষয়ের প্রতি পাঠক-পাঠিকাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে। সেটা হচ্ছে সালমান রুশদী ও মওদুদী রচনাবলীর একটা সংক্ষিপ্ত মূল্যায়ন। সালমান রুশদীর ‘স্যাটানিক ভার্সেস’সহ এ পর্যন্ত প্রকাশিত চারটি বইয়ের মধ্যে একটি বইও আমার দেখার সুযােগ হয়নি। আমার মত একজন সাধারণ নাগরিক দূরের কথা, দেশের শীর্ষস্থানীয় কবি-সাহিত্যিক-সাংবাদিকরাও অনেকে রুশদীর বিতর্কিত বইটি পড়ার সুযােগ পাননি। তাছাড়া বইটি আমাদের দেশে নিষিদ্ধ। তাই এই বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে আলােচনাপর্যালােচনা করা ঠিক হবে না। শুধু এটুকু বলা যায়, আমরা মানুষের বাক-স্বাধীনতার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হলেও এর অপব্যবহারের সমর্থক নই। সালমান রুশদী তার এই বইয়ের মাধ্যমে বিশ্বের শত কোটি মুসলমানের ধর্মীয় বিশ্বাসেই আঘাত হানেননি, নিজের বিকৃত রুচিরও পরিচয় দিয়েছেন। জ্ঞানপাপী রুশদী তার ‘শেম’ (লজ্জা) পুস্তকে বাংলাদেশ, বাঙ্গালী জাতি, বাংলা ভাষা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কেও অত্যন্ত আপত্তিকর মন্তব্য করেছেন। শেম’ পুস্তকে বাঙ্গালীদের ‘জারজ’ বলতেও তার বিবেকে বাধেনি। “স্যাটানিক ভার্সেস’ এই উপমহাদেশে সর্বপ্রথম ভারতে নিষিদ্ধ করা হয়। এরপর বাংলাদেশ ও পাকিস্তানে নিষিদ্ধ করা হয়। ‘শেম’ পুস্তকটি বাংলাদেশে নিষিদ্ধ করা হয়েছে কিনা কোন সংবাদপত্রে দেখা যায়নি।
স্যাটানিক ভার্সেস-এর বিরুদ্ধে, এর লেখক রুশদীর ফাঁসির দাবিতে হাজার হাজার লােকের মিটিং-মিছিল হলেও ‘শেম’ পুস্তকের বিরুদ্ধে এসব জনসমাবেশে কাউকে কোন কথা বলতে শােনা যায়নি। আমরা মনে করি, জন্মগত ও পারিবারিক সূত্রে রুশদী মুসলিম নাম ধারণ করলেও তিনি একজন বিকৃত রুচির জ্ঞানপাপী। ইহুদী চক্র ও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের ভাড়াটিয়া লেখক হিসেবে ইসলাম, মুসলমান ও উপমহাদেশের বিরুদ্ধে কুৎসা রটনাই হচ্ছে রুশদীর সাহিত্য চর্চা। সাহিত্য চর্চা একটি মহৎ কাজ। কিন্তু কোন মহামানব, কোন জাতি কিংবা কোটি কোটি মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিতে কটাক্ষ করা সাহিত্যচর্চা হতে পারে না। এটা স্রেফ ননাংরামি ছাড়া কিছু নয়। মানবাধিকারের দোহাই দিয়ে সমাজের এ ধরনের দুষ্টক্ষতদের আশকারা দেয়া মানব সভ্যতারই অবমাননা। বিশ্বের শত কোটি মুসলমানের সাথে একাত্ম হয়ে আমরা রুশদী ও তার সাহিত্যের নামে কুকর্মের নিন্দা করছি, তার বিচার দাবি করছি। এরপরও কথা আছে। রুশদীর রচনা ইতিহাস কিংবা ধর্মীয় ব্যাখ্যা নয়। এগুলাে উপন্যাস, কল্পকাহিনী। মানুষ কখনাে উপন্যাসকে ইতিহাস কিংবা ধর্মতত্ত্ব হিসেবে গণ্য করে না। অপরদিকে মওদুদী রচনাবলী কোরআন-হাদীসের ব্যাখ্যা ও ধর্মতত্ত্ব হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে। দেশের আধুনিক শিক্ষিত শ্রেণী, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সমাজ, এমনকি প্রত্যন্ত গ্রামগঞ্জের ধর্মপরায়ণ সাধারণ মানুষের মধ্যে এসব বইপুস্তক ও কোরআনের তফসীর পরিকল্পিতভাবে ছড়ানাে হচ্ছে। পত্র-পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখা যায়, জাতীয় প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ইমাম প্রশিক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে সারা দেশের ইমামদের মধ্যে মওদুদীর বই-পুস্তক পৌছান হচ্ছে। ইসলাম সম্পর্কে সীমিত জ্ঞানসম্পন্ন ধর্মপরায়ণ লােকেরা মওদুদীর ইসলামের নামে আপত্তিকর ও চটকদার ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ পড়ে বিভ্রান্ত হচ্ছে। আমাদের কথা হলাে, মহানবী (সঃ) ও তাঁর পূত-পবিত্র সহধর্মিণীদের সম্পর্কে কুখ্যাত সালমান রুশদীর কাল্পনিক ধৃষ্টতামূলক কথাবার্তার জন্য আমরা তার ফাঁসি দাবি করছি।
তার উপন্যাসটি সরকার নিষিদ্ধ ঘােষণা করেছেন। নিঃসন্দেহে এটা সরকারের সঠিক পদক্ষেপ। কিন্তু মওদুদী সাহেব, যিনি ইসলামের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের ছদ্মাবরণে নবীরাসূলদের সমালােচনা করলেন, সাহাবা কেরাম ও বিভিন্ন যুগের মুসলিম মনীষীদের সম্পর্কে আপত্তিকর মন্তব্য করলেন, কোরআন-হাদীসের মনগড়া ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ। করলেন—তাঁর রচনাবলী নিষিদ্ধ করা হবে না কেন? অথচ একথা অনস্বীকার্য যে, প্রকাশ্য। শক্রর চেয়ে ছদ্মবেশী শক্র বেশি ক্ষতিকর। এই দৃষ্টিকোণ থেকে রুশদীর মত মওদুদীরও। ফাঁসির দাবি করা প্রয়ােজন ছিলাে। কিন্তু বর্তমানে মওদুদীর ফাঁসি দাবি করার প্রয়ােজন। নেই। তিনি ইতিমধ্যে পরপারে চলে গেছেন। কয়েক বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এক হাসপাতালে পরলােকগমন করেন। অবশ্য জীবিত রুশদীর চেয়ে মৃত মওদুদী উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য বেশি ক্ষতিকর। কারণ ইতিমধ্যে মওদুদীর অনুসারীরা তাকে মুসলিম বিশ্বের শ্রেষ্ঠ মুজাদ্দিদ বলে শ্লোগান দিতে শুরু করেছে। অন্তত বাংলাদেশে মৃত মওদুদীর রচনাবলী নিষিদ্ধ ঘােষণা করাই হবে তার কৃতকর্মের সঠিক বিচার। এজন্য দেশের সচেতন নাগরিক, বিশেষ করে আলেম সমাজকে অগ্রণী ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। আর এটা করা। আলেম সমাজেরই ধর্মীয় ও নৈতিক দায়িত্ব।

আলেম সমাজের অভিমত

জামাত দাবী করছে তাদের সব কর্মকাণ্ডই নাকি ইসলাম রক্ষার জন্য। ইসলামের প্রচার প্রসার ও প্রতিষ্ঠাই তাদের চরম ও পরম লক্ষ্য। তারা সবকিছুই ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে থাকে। কিন্তু আমরা মনে করি, জামাত ইসলামের মুখােশধারী একটি ফ্যাসিস্ট চক্র। চল্লিশের দশকের শুরুতে মওদুদী সাহেবের উদ্ভট ধ্যান-ধারণার ফলশ্রুতি হিসেবে জামাতের অভ্যুদয় ঘটে। একটি বিশেষ কৌশল হিসেবে মওদুদী সাহেব তাঁর দলের নামে পবিত্র ইসলাম শব্দটি সংযােজন করেন। উপমহাদেশের ধর্মপরায়ণ মুসলমানদের জামাতের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য এই কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে। তাছাড়া যারা জামাতের বিরােধিতা করবে তাদেরকে সহজে ‘ইসলামবিরােধী’ হিসেবে চিত্রিত করা যাবে। সর্বোপরি তাতে পবিত্র ইসলামকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা সহজ হবে। বিগত পঞ্চাশ বছরব্যাপী জনাব মওদুদী ও তাঁর অনুসারীরা তাই করেছেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে পবিত্র ইসলাম রক্ষার নামে বৃটিশের প্রচ্ছন্ন দালালী করা হয়েছে। বৃটিশবিরােধী আন্দোলনকে ইসলামবিরােধী আন্দোলন বলে অপপ্রচার করা হয়েছে। একই পদ্ধতিতে পাকিস্তান আমলে পবিত্র ইসলামকে সামন্তশ্রেণী ও পুজিপতিদের স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পবিত্র ধর্মের নামে জামাতের এই উন্মাদনা আরাে উলঙ্গ রূপ ধারণ করে। জামাত পাক হানাদার বাহিনীর সহযােগিতা করে। রাজাকার-আলবদর বাহিনী গঠন করে লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ ও বাঙ্গালী নিধনে নামিয়ে দেয়। স্বাধীনতাউত্তরকালে, বিশেষ করে গত ক’বছর থেকে জামাতের সহিংসতা আরাে ভয়ংকর রূপ ধারণ করেছে। তারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার শ্লোগান দিয়ে মুসলমানদের হত্যা করছে। এরূপ পরিস্থিতিতে যেকোন সচেতন লােকের মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক, জামাতের এসব কর্মকাণ্ড এবং জামাতের স্থপতি ও তাত্ত্বিক গুরু জনাব মওদুদীর তথাকথিত ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে উপমহাদেশের আলেম। সমাজ কিরূপ দৃষ্টিতে দেখেন। তাঁরা কি এসব সমর্থন করেন? আমরা যতটুকু জানি, দলমত নির্বিশেষে উপমহাদেশের কোন খাটি আলেমই জামাতের এসব কর্মকাণ্ড সমর্থন করেন না।
শুধু সমর্থন করেন না বললে ঠিক হবে না, তাঁরা এসবের চরম বিরােধিতা করে থাকেন। বিভিন্ন সংবাদপত্র, সাময়িকী ও বই-পুস্তকের মাধ্যমে তারা জামাত ও মওদুদী সম্পর্কে তাঁদের অভিমত প্রকাশ করে থাকেন। এখানে জামাত ও মওদুদী সম্পর্কে উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় এবং সর্বজন বরেণ্য কয়েকজন আলেমের অভিমত সংক্ষেপে তুলে ধরার চেষ্টা করব। মওদুদী ও মওদুদী জামাত সম্পর্কে দারুল উলুম দেওবন্দ থেকে বিভিন্ন সময়ে একাধিক ফতােয়া প্রকাশিত হয়েছে। সেখানকার শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ ব্যক্তিগতভাবেও তাঁদের অভিমত প্রকাশ করেছেন। একটি ফতােয়ায় বলা হয়েছে, ‘মওদুদী ফেতনা নির্মূল করে দাও। মওদুদী আন্দোলন ধ্বংসসাধনকারী ও জীবন সংহারক বিষ। মওদুদীর অনুসারীরা পথভ্রষ্ট। তাদের পেছনে নামাজ পড়বে না।” দেওবন্দের ওলামা কেরামের অপর একটি ফতােয়ায় বলা হয়েছে, “মওদুদী জামাত। ও তাদের বই-পুস্তক সাধারণ মানুষের মধ্যে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করে। ইমামদের অনুসরণ থেকে মানুষকে সম্পর্কহীন করে ফেলে। আর এটা জনসাধারণের জন্য ধ্বংস ও পথভ্রষ্টতার কারণ হয়ে দাঁড়ায়। ধর্মের সাথে সঠিক সম্পৃক্ততা রাখার জন্য সাহাবা কেরাম ও ইমাম-মুজতাহিদদের সাথে যে সম্পর্ক থাকা দরকার জামাতের বই-পুস্তক তাতে বিঘ্ন সৃষ্টি করে। আর এটা নিঃসন্দেহে মুসলমানদের ধর্মের জন্য ক্ষতিকর ব্যাপার। এজন্য মওদুদীর বই-পুস্তক ও সেসবের উপর ভিত্তি করে গঠিত আন্দোলন ‘জামাত’কে আমরা ভ্রান্ত এবং মুসলমানদের জন্য ক্ষতিকর মনে করি। এজন্য আমরা এসবের সাথে সম্পর্কহীনতার কথা ঘােষণা করছি।” | অপর একটি ফতােয়ায় মওদুদীর বই-পুস্তক ও তাঁর সংগঠন জামাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, “মওদুদী জামাত ও এই দলের বই-পুস্তকের দ্বারা সাধারণ মানুষের মধ্যে ইমামদের অনুসরণের প্রতি অনীহা ও সম্পর্কহীনতার সৃষ্টি হয়।
আর এটা সাধারণ মানুষের ধ্বংস ও পথভ্রষ্টতা ডেকে আনে।—স্বাক্ষর মওলানা মুফতি কেফায়েত উল্লাহ, মওলানা হােসাইন আহমদ মাদানী, মােহাম্মদ তৈয়ব, মুহতামিম, দারুল উলুম দেওবন্দ, মওলানা আবদুল লতিফ, মুহতামিম, মাজাহেরুল উলুম, সাহারানপুর, প্রমুখ।”৩ এই ফতােয়াটিতে ভারতের সমকালীন অধিকাংশ শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ স্বাক্ষর প্রদান করেন। দারুল উলুম দেওবন্দের প্রধান মুফতি হযরত মওলানা সৈয়দ মাহদী হাসান প্রদত্ত অপর একটি ফতােয়ায় মওদুদী জামাত সম্পর্কে বলা হয়েছে, “এই আন্দোলনে মুসলমানদের শরীক হওয়া কখনাে উচিত হবে না। এটা তাদের জন্য জীবন সংহারক বিষ। মানুষকে এই আন্দোলনে শরীক হওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। নতুবা তারা গােমরাহ হয়ে যাবে। এটা তাদের জন্য কল্যাণের পরিবর্তে ক্ষতিকর। শরিয়তের দৃষ্টিকোণ থেকে এই আন্দোলনে অংশগ্রহণ মােটেও জায়েজ নয়। যে ব্যক্তি এই জামাতের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য প্রচার-প্রসার করে সে কল্যাণের পরিবর্তে পাপ কাজ করে। সে এর ক্ষতিকর প্রভাব থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারে না। এবং মানুষকে পাপের দিকে আহ্বান জানিয়ে থাকে। যদি কোন মসজিদের ইমাম মওদুদী জামাতের সদস্য হয়, তাহলে তার পেছনে নামাজ পড়া মাকরুহ ৪।
বেরেলীর ‘আল ফোরকান পত্রিকার সম্পাদক এবং জামাতের প্রাক্তন আমীর মওলানা । মনজুর নােমানী হযরত মওলানা আশরাফ আলী থানবীকে (রঃ) একখানা পত্র লেখেন। তাতে তিনি মওদুদী জামাত সম্পর্কে আলােচনা করার জন্য থানবী সাহেবের খেদমতে। যাওয়ার অনুমতি প্রার্থনা করেন। থানবী সাহেব উক্ত পত্রের জবাব দান প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘‘আমার অন্তর এই আন্দোলনকে গ্রহণ করে না। আপনি এখানে আসলেও এই দল সম্পর্কে আমি আপনাকে এই জবাবই দেব। সুতরাং শুধু একথা শােনার জন্য সফরের কষ্ট স্বীকার করা অনাবশ্যক।” ৫ আহলে হাদীস জামাতের নেতা ও বিশিষ্ট আলেম হযরত মওলানা আবদুল মজিদ বলেছেন, “আমি যতদূর পর্যন্ত মওলানা মওদুদীর বই-পুস্তক পড়েছি এবং তার ধ্যানধারণা অনুসন্ধান করেছি, তাতে তাকে পথভ্রষ্ট পেয়েছি। আমি দোয়া করি, আল্লাহ তায়ালা তাকে তার ধ্যান-ধারণা পরিত্যাগ ও তওবা করার সামর্থ্য দান করুন।” | তাবলীগ জামাতের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মওলানা ইলিয়াস সাহেবের উত্তরসূরী তাঁর পুত্র হযরত মওলানা মােঃ ইউসুফ মওদুদী জামাতের কয়েকজন সদস্যের সাথে আলােচনা প্রসঙ্গে বলেছেন, ‘মওদুদী জামাত একটি রাজনৈতিক ও ক্ষমতালােভী দল। তারা এমন জিনিসের প্রত্যাশী যা শরিয়তের দৃষ্টিতে পরিত্যাজ্য।” বেরেলবী চিন্তাধারার বিশিষ্ট আলেম হযরত মওলানা মােস্তফা খান সাহেব বেরেলবী ও মওলানা সাইয়েদ আফজাল হােসাইন, মুফতি, দারুল উলুম মানজারুল ইসলাম বেরেলবী মওদুদী জামাত ও তাঁর ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে একটি ফতােয়া প্রদান করেন। তাতে তাঁরা বলেন, কিছুদিন আগে এক ব্যক্তি মওদুদীর ভাষণের প্রথম খণ্ডটি আমাদের নিকট নিয়ে আসেন। আমরা তা গভীরভাবে দেখি। তাতে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌছি যে, তিনি ইসলামের প্রচার-প্রসার ও উন্নতি বিধানের দাবি করে থাকেন। কিন্তু মূলত তার আন্দোলন ইসলামের ছিদ্র অন্বেষণ, মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি এবং কুফরী ও কাফেরী।
ছাড়া কিছু নয়। তিনি ইসলামের ভিন্ন অর্থ করে থাকেন। সাধারণ মুসলমানদের তিনি মুসলমান মনে করেন না। তিনি জন্মগত মুসলিম সন্তান-সন্ততিকে বয়ঃপ্রাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত মুসলমান স্বীকার করেন না। তিনি বলেন, ইসলাম প্রকৃতিগত ধর্ম নয়। অজ্ঞ মুসলমানরা তাঁর মতে মুসলমান নয়। শুধু তাই নয়, তিনি বলেন, অজ্ঞদের মুসলমান হওয়া অসম্ভব ব্যাপার। … মােট কথা মওদুদী সাহেবের আন্দোলন কোন নতুন আন্দোলন নয়। পুরনাে খারেজী ধ্যান-ধারণাই নতুন রূপ ধারণ করেছে। ৮…” বেরেলবী চিন্তাধারার অপর একজন বিশিষ্ট আলেম মওলানা সাইয়েদ মােঃ রেজওয়ান মওদুদী সম্পর্কে বলেছেন, “মওলবী মওদুদী সাহেবের বিভিন্ন উদ্ধৃতি পাঠ করে আমি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছি যে, তাঁর মস্তিষ্ক সর্বজনমান্য মনীষীবৃন্দ ও আম্বিয়া কেরামের প্রতি বেয়াদবি ও ধৃষ্টতায় পরিপূর্ণ। বিশ্ব মুসলিমের প্রতি আমার অনুরােধ, তাঁর বিশ্বাস ও ধ্যানধারণা থেকে সতর্ক থাকুন। তাঁকে গােলাম আহমদ কাদিয়ানী ও গােলাম আহমদ পারভেজদের মত ইসলামের চরম শত্রু গণ্য করুন। কেউ তাঁর প্রতারণার শিকার হবেন। না। নবী করিম (সাঃ) বলেছেন, “আসল দাজ্জাল আত্মপ্রকাশের আগে তার পথ পরিষ্কার করার জন্য আরাে তিরিশজন দাজ্জাল আসবে। আমার মতে মওদুদী তাদের একজন।” | বিশেষ্ট মুহাদ্দিস মওলানা সাইয়েদ আহমদ কাজেমী মওদুদী সাহেবের সাথে দীর্ঘ আলাপ-আলােচনা করেন। এই আলােচনা পুস্তকাকারে প্রকাশিত হয়। জনাব কাজেমী মওদুদীর ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে অভিমত দান প্রসঙ্গে বলেছেন, “মওদুদী সাহেব নিজেকে একজন পূর্ণাঙ্গ মুজাদ্দিদ ও মাহদী মনে করেন। কিন্তু কৌশলগত কারণে তা প্রকাশ করছেন না। সময়মত তা প্রকাশ পাবে। তাতে করে মুসলমানদের সামনে আর একটা ফেতনার দ্বার খােলা হবে। সুতরাং এই আন্দোলনে যােগদান বা সাহায্য করা নিজের ধর্মবিশ্বাসকে বিপথে ঠেলে দেয়ার নামান্তর।” | অল ইন্ডিয়া আহলে হাদীস কনফারেন্সের সভাপতি বিশিষ্ট মুহাদ্দিস মওলানা আবদুল ওহাব বলেছেন, “আমি আহলে হাদীস ভাইদের অনুরােধ করছি, তারা যেন নিজেদেরকে এই সংক্রামক ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। নতুবা এই ব্যাধি শুধু তাদেরকে নয়, পুরাে আহলে হাদীস জামাতকে ধ্বংস করে ফেলবে। শুধু জোরে ‘আমিন’ বলা, রাফে ইয়াদাইন করাই আহলে হাদীসের কাজ নয়, যতক্ষণ পর্যন্ত নিজেদের আকায়েদ বা বিশ্বাস সংশােধন না। করবে এবং পূর্ববর্তী মনীষী ও বুজুর্গদের দ্বীনের পথ আঁকড়ে না ধরবে ততক্ষণ দ্বীন ও নাজাত লাভ করা কঠিন হবে। সুতরাং বীরত্বের সাথে জামাতে ইসলামীর মােকাবেলা করতে হবে এবং তার শক্তি নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
একসময় সরসীনার মরহুম পীর হযরত মওলানা নেসারউদ্দীন আহমদ সাহেবকে মওদুদী সাহেবের একটি প্যাফলেট পড়ে শােনান হচ্ছিলাে। কয়েক লাইন শােনার পর পীর সাহেব বললেন, ‘আর পড়তে হবে না। তাতে রূহানীয়াতের (আধ্যাত্মিকতার) অভাব রয়েছে।”১২ একই গ্রন্থে সরসীনা দারুস সুন্নাহ থেকে একটি দীর্ঘ ফতােয়া প্রকাশিত হয়েছে। উক্ত ফতােয়ায় ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মওদুদী জামাতের কতকগুলাে বাতিল ধ্যান-ধারণার প্রতি আলােকপাত করা হয়েছে। উক্ত ফতােয়ার এক স্থানে বলা হয়েছে, “জনাব মওদুদী। তাঁর বাতিল আকিদা প্রচারের উদ্দেশ্যেই জামায়াতে ইসলামী নামে মওদুদী জামায়াত কায়েম করেছেন। তদুপরি এটাও অনস্বীকার্য যে, নেতার আকায়েদ ও ধ্যান-ধারণা অজ্ঞাতসারেই কর্মীদের মধ্যে সংক্রমিত হয়ে থাকে।… এজন্য কেবলমাত্র রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেও মওদুদী জামায়াতে শামিল হওয়া জায়েজ নয়।”১৩ এই ফতােয়ায় বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় পচাত্তরজন আলেম স্বাক্ষর করেছেন। চট্টগ্রাম হাটহাজারী দারুল উলুম মাদ্রাসার মুফতি হযরত মওলানা ফয়জুল্লাহ সাহেব মওদুদী জামাত সম্পর্কে একটি ফতােয়া প্রদান করেন। তাতে তিনি বলেছেন, “মওলানা মওদুদী আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের নীতি ও মতবাদ বিরােধী বিভ্রান্তিকর ও ক্রটিপূর্ণ ধ্যান-ধারণা পােষণকারী। তাঁর অধিকাংশ লেখায় বিগত মনীষী, সাহাবা কেরাম, তাবেয়ীন, ইমাম মুজতাহিদ ও আওলিয়া কেরামের প্রতি বেআদবী প্রকাশ পেয়েছে। তাঁর ধৃষ্টতামূলক আক্রমণ থেকে মহান নবীরাও রেহাই পাননি। সুতরাং এই দলের সাথে ওঠাবসা করা, সংস্রব রাখা মুসলমানদের জন্য কোন অবস্থায়ই জায়েজ নয়।”
তাঁর এ ফতােয়ার প্রতি অভিন্ন মত প্রকাশ করে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের ১৭ জন শীর্ষস্থানীয় আলেম স্বাক্ষর করেন। এই ফতােয়ায় স্বাক্ষরদান প্রসঙ্গে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার হযরত মওলানা তাজুল ইসলাম লিখেছেন, “আমি মুফতি ফয়জুল্লাহ সাহেবের অভিমত সমর্থন করি। বস্তুত মওদুদী ফেতনা কাদিয়ানী ফেতনার চেয়ে কম নয়।” বিশিষ্ট মুহাদ্দিস হযরত মওলানা জাকারিয়া (রঃ) মওদুদী জামাত সম্পর্কে “ফিতনায়ে মওদুদীয়াত” শীর্ষক একটি তথ্যসমৃদ্ধ পুস্তক লিখেছেন। তিনি তাঁর এই পুস্তকে মওদুদী জামাতের ইসলামবিরােধী বিষয়গুলাে পবিত্র কোরআন-হাদীসের আলােকে ব্যাখ্যাবিশ্লেষণ করেছেন। তিনি তাঁর বইয়ের এক জায়গায় মওদুদী জামাত সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “আমি এই ভ্রান্ত দলে যােগদান করা হারাম মনে করি। তাদের বই-পুস্তক পাঠ করা অত্যন্ত ক্ষতিকর।” লালবাগ জামেয়া কোরআনিয়ার প্রিন্সিপাল হযরত মওলানা শামসুল হক ফরিদপুরী ইসলাম প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন জামাতে ইসলামীর সহযােগিতা করেন। তাঁর উপদেশে অনেক লােক পাকিস্তান আমলে জামাতে যােগদান করে। কিন্তু এক পর্যায়ে জামাতের আসল চেহারা তাঁর সামনে বেরিয়ে পড়ে। তিনি “ভুল সংশােধন” শীর্ষক একখানা পুস্তক লিখে জামাতের ইসলাম বিরােধী ধ্যান-ধারণা সম্পর্কে দেশবাসীকে সতর্ক করে দেন। তিনি তাঁর পুস্তকের এক জায়গায় লিখেছেন, “যাবৎ পর্যন্ত জামাতে ইসলামীর মূলনীতিতে এই ঘােষণা দিয়া না দিবেন যে, আমরা মওদুদী সাহেবের এ ভুলসমূহ সম্পূর্ণ বর্জন করিয়াছি, তাবৎ পর্যন্ত জামাতে যােগদান করা, কাজ করা কোন মুসলমানের জন্য জায়েজ হইবে না। যাহারা সাহাবায়ে কেরামের দোষ চর্চায় লিপ্ত তাহারা যে কেহই হােন না কেন—তাহাদিগকে ইমাম বানাইয়া পিছনে নামাজ পড়া কিছুতেই জায়েজ হইবে না। কারণ তাহারা সাহাবায়ে কেরামের দোষ চর্চার কারণে আহলে সুন্নত ওয়াল জামাত হইতে খারিজ হইয়া গিয়াছে।”
খেলাফত আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা হযরত মওলানা মােহাম্মদউল্লাহ হাফেজ্জী হুজুর মওদুদী জামাত সম্পর্কে সতর্কবাণী” শিরােনামে একটি পুস্তক লেখেন। তাতে তিনি মওদুদীরভ্রান্ত মতবাদ ও জামাতে ইসলামীকে মুসলমানদের ঈমান ও ধর্মবিশ্বাস ধ্বংসকারী ফিতনা হিসাবে আখ্যায়িত করেন। তিনি মুসলমানদেরকে ইসলামের মুখােশধারী এই দল থেকে দূরে থাকার আহ্বান জানান। ” হাফেজ্জী হুজুরের এই পুস্তকে বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় চার শতাধিক আলেম অভিন্ন মত প্রকাশ করে স্বাক্ষর করেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন—হযরত মওলানা আজিজুল হক, মুহাদ্দিস, লালবাগ জামেয়া, ঢাকা। মওলানা আমিনুল ইসলাম, খতিব, লালবাগ শাহী মসজিদ, ঢাকা। মওলানা শামসুদ্দীন কাসেমী, প্রিন্সিপাল, মিরপুর জামেয়া, ঢাকা। মওলানা আবদুল ওয়াহাব, প্রিন্সিপ্রাল, হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম। মওলানা মুফতি মহিউদ্দীন, বড় কাটরা মাদ্রাসা, ঢাকা।
মওলানা মুফতি আহমাদুল হক, মুফতি, হাটহাজারী মাদ্রাসা, চট্টগ্রাম। মওলানা নেসারউদ্দিন, প্রিন্সিপ্যাল, মাহমুদিয়া মাদ্রাসা, বরিশাল। মওলানা আজিজুর রহমান, প্রিন্সিপ্যাল, ননায়াখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা, বরিশাল। মওলানা আজিজুর
রহমান, প্রিন্সিপ্যাল, নােয়াখালী ইসলামিয়া মাদ্রাসা। মওলানা নুরুল ইসলাম, প্রিন্সিপ্যাল, জামেয়া আশরাফিয়া, মােমেনশাহী। মুফতি মওলানা আবদুল কাদের, প্রিন্সিপ্যাল, শামসুল উলুম মাদ্রাসা, ফরিদপুর। মুফতি মওলানা ওয়াক্কাস, প্রিন্সিপ্যাল, দারুল উলুম ইসলামিয়া (প্রাক্তন ধর্ম প্রতিমন্ত্রী), খুলনা প্রমুখ। ঢাকা আলিয়া মাদ্রাসার প্রাক্তন হেড মওলানা ও বর্তমানে বায়তুল মােকাররম মসজিদের খতিব হযরত মওলানা ওবায়দুল হক মওদুদী জামাত সম্পর্কে অভিমত দান প্রসঙ্গে বলেছেন, “একথা সত্য যে, কোন ব্যক্তি বা তার কাজকে সমালােচনার বিষয়বস্তুতে পরিণত করা ঠিক নয়। বিশেষত যখন তার ব্যক্তিত্ব এক বিশেষ পদ্ধতিতে ইসলামী আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ বিংশ শতাব্দীতে প্রসিদ্ধ হয়ে রয়েছে। তথাপি তার ভ্রান্তিপূর্ণ পুস্তকাদি দ্বারা সাধারণ ও নব্যশিক্ষিত লােকদের মধ্যে গােমরাহী বিস্তার লাভ করছে, এমন মুহূর্তে হক কথা না বলে নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করা আমার নিজের ব্যাপারে এক মারাত্মক অপরাধ মনে করি। বিশেষত যখন এ ব্যাপারে মতামত চাওয়া হয় তখন নীরবতা অবলম্বন করলে, “কিয়ামতের দিন তার গলায় আগুনের বেড়ী লাগানাে হবে’—বর্ণিত এ শাস্তির ভাগী হওয়ার আশংকা রয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে, এ ব্যাপারে তাে অনেক পুস্তকই লেখা হয়েছে। আর কি দরকার ? জবাব হলাে, প্রত্যেক পুস্তকেরই বিশেষ বৈশিষ্ট্য থাকে যা অন্যটায় পাওয়া যায় না। তাছাড়া যখন মওদুদীর পুস্তকাবলী সংগঠিত জামাতের মাধ্যমে সদাসর্বদা প্রকাশিত হয়ে চলেছে এবং সেগুলােকে কর্মীদের আবশ্যকীয় পাঠ্যসূচীতে বেঁধে দেয়া হয়েছে, তখন সাময়িকভাবে কিছু বিবৃতি বা পুস্তক দ্বারা এর মােকাবিলা করা কিছুতেই সম্ভবপর নয়। কারণ গুটিকয়েক দিনে এগুলাে নিঃশেষ হয়ে আস্তে আস্তে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়বে।
আর তখন ময়দান খালি থাকবে শুধু মওদুদী পুস্তকাদির জন্য। তাই ক্রমাগত লােকদের সতর্ক করার জন্য ব্যাপক পর্যায়ের কর্মসূচী গ্রহণ করা প্রত্যেক যুগের হাক্কানী ওলামাদের ধর্মীয় দায়িত্ব।”১৫ মওদুদীবাদ সম্পর্কে ঢাকার মালিবাগ মাদ্রাসার প্রিন্সিপ্যাল মওলানা কাজি মুতাসিম বিল্লাহ বলেন, “ইসলাম কি তা বুঝলেই মওদুদীবাদ কতটুকু ইসলামবিরােধী তা বােঝা যাবে। কোরআন-হাদিসের আলােকে ইসলাম বলতে এক আল্লাহ রাব্বল আলামীনের রুবুবিয়াত বা প্রভুত্ব স্বীকার করে নেয়া এবং হযরত (সঃ) নির্দেশিত পথে আল্লাহর ইবাদত বন্দেগী করাকে বােঝায়। অথচ মওদুদীর কাছে ইবাদত বন্দেগী বানামায-রােযা মুখ্য কিছু নয়। তার কাছে ইসলামের মূল লক্ষ্যই ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা। তিনি মনে করতেন ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হয়ে গেলেই ক্ষমতার জোরে, শক্তির জোরে ইসলামকে প্রতিষ্ঠা করা । যাবে। আর এই ক্ষমতার নেশায়ই মওদুদী এবং তার অনুসারীরা যুগে যুগে ইসলামের মনগড়া এবং কাল্পনিক ব্যাখ্যা দিয়ে আসছেন। আকিমুদিন বা তােমরা দ্বীনকে প্রতিষ্ঠা কর—বলতে যখন সমস্ত সাহাবায়ে কেরাম ও অলি-আল্লাহরা জীবনের প্রতিক্ষেত্রে দ্বীনকে প্রতিষ্ঠার কথা বলেন তখন মওদুদীবাদ একে ব্যাখ্যা করে ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হিসেবে। ইসলামের ব্যাখ্যায় সাহাবায়ে কেরাম এবং পরবর্তীতে আলেমরা যেনিরবচ্ছিন্ন ধারাবাহিকতার।
ভেতর দিয়ে এসেছেন, মওদুদী দেখলেন তার মনগড়া ইসলামকে সেগুলাের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। ফলে সাহাবায়ে-কেরাম ও আলেম-অলিদের বাহীন সমালােচনার ক্ষেত্রে ইসলামকে ব্যক্তিগত এবং দলগত সংকীর্ণতায় আচ্ছন্ন করার প্রচেষ্টা চালায় মওদুদী এবং তার অনুসারীরা। এ কারণেই তাদের ইসলামবিরােধী কথাবার্তা শুরু এবং সেটাও ইসলামের নাম দিয়েই। অথচ ইসলামের আলােকেই দেখা যায়, সাহাবায়ে কেরামরা প্রত্যেকেই পরবর্তীদের সমালােচনার উর্ধ্বে। তাঁদের প্রত্যেকেই রাসূলুল্লাহর সুন্নাতের অনুসরণ করে গেছেন। তাঁদের সমস্ত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণকে অস্বীকার করে মওদুদী নতুন ইসলামের প্রবক্তা বনে যান।” | মওলানা মুতাসিম বলেন, “মওদুদী এবং তার দল জামাতে ইসলামীর রাজনীতি পর্যালােচনা করলেও এক অদ্ভুত স্ববিরােধিতা দেখা যায়। আরাে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে এই বিরােধিতাটুকুও তিনি করেছেন ইসলামের নামে—আবার ইসলামেরই বিরুদ্ধে। কংগ্রেসের জাতীয়তা আন্দোলন ও লীগের পাকিস্তান আন্দোলনের বিরােধিতা করে তিনি প্রকারান্তরে। বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদের দালালী করে যান। পরে আবার সে পাকিস্তানেই আশ্রয় নেন এবং তাও ইসলামের দোহাই দিয়ে। ১৯৩৫ থেকে ১৯৫০ সাল পর্যন্ত তার পুস্তকাদিতে গণতন্ত্রকে কুফরী হিসেবে অভিহিত করা হত। মওদুদীর ব্যাখ্যা ছিল গণতন্ত্রে আল্লাহর সার্বভৌমত্বের বদলে জনগণের সার্বভৌমত্বের কথা বলে কাফেরের কাজ করা হয়েছে। পরে মওদুদী ও তার দল জামায়াত দেখল পাকিস্তানে ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করার জন্য প্রচলিত গণতান্ত্রিক সুবিধাগুলাে ব্যবহার ছাড়া পথ নেই, তাই বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে তারা গণতন্ত্রকে ইসলামে সম্পৃক্ত করে ইসলামী গণতন্ত্রের কথা বলতে থাকে। যে নির্বাচনকে তারা ইসলামবিরােধী বলত সেই নির্বাচনেই ১৯৫৪ সনে অংশগ্রহণ করে। অর্থাৎ, তারা নিজেরাই নিজেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী কাফেরে পরিণত হয়।
“১৯৫৪ সালের পাঞ্জাব প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনের সময় আমীন আহসান এসলাহী প্রমুখ মওদুদীর ঘনিষ্ঠজনরা তার এই বিচ্যুতির বিরােধিতা করলে মওদুদী বলেন, ইসলামী আন্দোলন করতে গিয়ে প্রয়ােজনে ইসলামের অনেক শিক্ষার পরিবর্তন করতে হয়। তার এই ব্যাখ্যা শুনে তৎকালীন অনেক নেতাই তওবা করে জামাত থেকে বেরিয়ে যান। মওদুদী এবং জামাত সারাজীবন পুঁজিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের দালালী করে আসছে। অভিযােগ রয়েছে, বিভিন্ন পুজিবাদী শক্তির অর্থ আনুকূল্যেই জামাতের সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালানাে হয়। ফলে স্বাভাবিকভাবেই ইসলামী অর্থনীতি সম্পর্কে জামাতের চিন্তাধারা পুজিবাদী ধ্যান-ধারণার দ্বারা আচ্ছন্ন। ইসলাম মানবতার ধর্ম, কৃষক-শ্রমিকসহ সকল নির্যাতিত মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে পুজিবাদের বিরুদ্ধে ইসলামই সর্বপ্রথম সােচ্চার হয়েছে। ক্ষমতালােভী জামাত সেই পুজিবাদের পৃষ্ঠপােষক রাজনীতি করে কৃষক-শ্রমিকদের দাবীর প্রতি উদাসীন থেকে, এ কোন্ ইসলামী রাজনীতি করছে ?” | মওলানা মুতাসিম বলেন, “ইসলামের বিকৃত ব্যাখ্যা প্রদান করে মওদুদী এবং তার অনুসারী জামাত মানুষের মনকে বিষিয়ে দিয়েছে। সন্ত্রাসের জোরে ইসলাম প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে তারা ইসলাম সম্পর্কে মানুষের মনে অশ্রদ্ধার সৃষ্টি করেছে। আলেম সমাজ মনে করে, এদেশে ইসলামের গ্রহণযােগ্যতা এবং ব্যক্তিজীবনে ইসলামের মাধুর্য প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে।
মওদুদী এবং জামাতের ফ্যাসিস্ট রাজনীতিই বড় বাধা। আল্লাহ-রাসূলের ইসলাম থেকে। সরে তারা এমনভাবে ইসলামকে উপস্থাপন করছে যাতে মনে হয় ইসলামে ক্ষমতা দখলই মুখ্য ব্যাপার, মানবতা প্রতিষ্ঠা বা গরীব-শােষিত মানুষের মুক্তির ব্যাপারে ইসলাম উদাসীন। এভাবে জামাত নিজেরা যেমন প্রগতিশীল মুক্তমনাদের শত্রুতে পরিণত হয়েছে তেমনি ইসলাম সম্পর্কেও তাদের মনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি করেছে। এ কারণে আমি মনে করি মওদুদীবাদ এবং জামাত রাজনীতি এদেশে ইসলামের জন্য বিরাট বিষফোঁড়া হয়ে আছে।” ৭১ সালে জামাতে ইসলামীর ভূমিকা সম্পর্কে মওলানা মুতাসিম বলেন, “৭১-এর যুদ্ধকে জামাত চিত্রিত করেছিল ইসলাম ও কুফরীর লড়াই হিসেবে। কিন্তু সেটা ছিল। রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গিগত বিরােধ। সে সময় নিরীহ গ্রামবাসীদের হত্যা, নারী নির্যাতন, লুণ্ঠনের যেসব ঘটনা ঘটেছে তা মারাত্মক পাপ-ইসলাম এসব কোন যুক্তিতেই সমর্থন করে না। এসব কাজে জামাতের সহযােগী ভূমিকা থাকার অভিযােগ আছে। সে সময় জামাতের কেউ কেউ প্রকাশ্য বিবৃতির মাধ্যমেও পাক সামরিক জান্তাকে দমনমূলক কাজে উৎসাহ যুগিয়েছে। চিরাচরিত স্বভাব অনুযায়ী জামাত তাদের সে কাজকেও ইসলাম রক্ষার কাজ বলে সাফাই গেয়েছে—যা কোনভাবেই গ্রহণযােগ্য নয় বলে আমরা মনে করি।” , মওলানা মুতাসিম বলেন, “জামাতের ক্ষমতা দখলের রাজনীতির আরেক উপসর্গ ‘ হিসেবে তাদের সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপের কথা শােনা যায়। বর্তমানে এই সংক্রান্ত খবরাখবর আরাে বেশি করে পাওয়া যাচ্ছে।
প্রসঙ্গত পাক কোরআনের চতুর্দশ পারার সূরা নাহালের একটি আয়াত উদ্ধৃত করা যায়। সেখানে বলা হয়েছে, ‘তােমরা যদি আক্রান্ত হয়ে প্রতিশােধ নিতে চাও তবে যতটুকু আক্রান্ত হয়েছ ততটুকুই প্রতিশােধ নিতে পার, কিন্তু। যদি তােমরা ধৈর্য ধারণ কর তবে সেটাই উত্তম হবে।’ জামাতের সন্ত্রাসী কার্যকলাপে ইসলামের এই নির্দেশের প্রতিফলন দেখা যায় না।” মওলানা মুতাসিম বলেন, “সবকিছু পর্যালােচনা করলে একথাই বলতে হয়, উপমহাদেশের দলমত নির্বিশেষে সমস্ত আলেম ও বুজুর্গানে দ্বীন মওদুদীবাদ ও জামাতের রাজনীতিকে যেমন ইসলামবিরােধী মনে করেন, আমরাও তেমনি মনে করি মওদুদীবাদ ও জামাত ইসলামের মূল ধারার সঙ্গে সম্পৃক্ত নয়।” মওদুদীবাদ সম্পর্কে লালবাগ জামেয়া কোরানিয়া আরাবিয়া মাদ্রাসার প্রিন্সিপাল মওলানা ফজলুল হক আমিনী বলেন, “যে মওদুদীবাদের উপর ভিত্তি করে জামাতের রাজনীতি প্রতিষ্ঠিত সেই মওদুদী আকীদাকে আমাদের বুজুর্গানে দ্বীন ও অলি-আল্লাহরা ভ্রান্ত মতবাদ বলে মত প্রকাশ করেছেন। ইসলাম যেহেতু পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা তাই তাতে রাজনীতির অবকাশ আছে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে জামাতের ব্যাখ্যা ইসলামসম্মত নয়। জামাতের রাজনীতি অনুযায়ী দ্বীন হচ্ছে রাজনীতির আওতাধীন; এটা ঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে রাজনীতিই দ্বীনের আওতাধীন। ইসলামী রাজনীতির সঠিক নাম খেলাফত অর্থাৎ একামতে দ্বীনের জন্য এমন নেতৃত্ব সৃষ্টি করা যা বিশ্বনবীর প্রতিনিধি হিসেবে কাজ করবে।
একামতে দ্বীন বলতে জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা, সর্বক্ষেত্রে ইসলাম প্রতিষ্ঠা, শরীয়তী বিচার বিভাগ, সৎকাজের আদেশ ইত্যাদিকে বােঝায়। এই ব্যাখ্যার বিপরীত হলে তা ইসলামের রাজনীতি হবে না। জামাত অনেকটা উল্লিখিত বিপরীত ব্যাখ্যার রাজনীতি করে ইসলাম থেকে সরে এসেছে।” _ তিনি বলেন, “ইসলামের নামে সন্ত্রাস করা মােটেও জায়েজ নয়। এতে ইসলামের ভুল ব্যাখ্যা হয়। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের আক্রমণের সময় ‘মরলে শহীদ, বাঁচলে গাজী ধরনের শ্লোগান জামাত রাজনীতিতে রয়েছে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে সেই মৃত্যু আদৌ ইসলামের জন্য কি, নাকি রাজনীতির জন্য ?” হল | মওলানা আমিনী বলেন, “জামাতের বিরােধিতা মানে ইসলামের বিরােধিতা এটাও ঠিক নয়। কোরআন-হাদীসের ইসলাম জামাতের ইসলামে সীমাবদ্ধ নয়। ৫০/৬০ বছর আগে জামাত প্রতিষ্ঠার আগেও ইসলাম ছিল, ইসলামের সঠিকতম অনুসারীরা ছিল। আর জামাত যে জেহাদের কথা বলে তা কোরআন-হাদীস নির্ধারিত পথেই করতে হবে, এক্ষেত্রে নতুন কোন ব্যাখ্যা গ্রহণীয় হবে না।” স্বাধীনতা যুদ্ধে জামাতের ভূমিকা সম্পর্কে মওলানা আমিনী বলেন, “এটা ছিল জালেমের বিরুদ্ধে মজলুমের যুদ্ধ—ইসলামের বিরুদ্ধে নয়। যারা ‘৭১-এর স্বাধীনতা যুদ্ধকে ইসলামের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বলেছিল তারা ভুল বলেছিল।”
জালালাবাদ ইমাম সমিতির ৬৭ জন ইমাম ও বিশিষ্ট আলেম মওলানা মওদুদী ও তার অনুসারী জামাতিদের সম্পর্কে সম্প্রতি একটি ফতােয়া প্রদান করেন। উক্ত ফতােয়ায় তারা বলেন, ‘মওদুদী সাহেব আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াতের পরিপন্থী এক নতুন ধর্ম প্রবর্তন করতে চান। তাই উপমহাদেশের সকল দলমতের হাজার হাজার ওলামা, মাশায়েখ ও মুফতী সাহেবান মওদুদী সাহেবকে পথভ্রষ্ট, তার দলে যােগদান করা হারাম এবং মওদুদী আকিদায় বিশ্বাসী ইমামদের পিছনে নামায আদায় মাকরূহে তাহরিমী বলে ফতােয়া দিয়েছেন। মওদুদী আকিদার সারসংক্ষেপ হচ্ছে—মওদুদী বলেন, প্রত্যেক নবী পাপ। করেছেন। বিশ্বনবী (সঃ) নবুয়তের দায়িত্ব পালনে ত্রুটি করেছেন। নবীগণ বহুবার কুপ্রবৃত্তির বিপদে পড়েছেন। সাহাবিগণ সত্যের মাপকাঠি নন, সমালােচনার ঊর্ধ্বে নন। সাহাবারা মিথ্যাবাদী। মনগড়া হাদীস বর্ণনা করেছেন। কাফিরদের দেবদেবীই মুসলমানদের ফিরিশতা (তাজদীদ ও এহইয়ায়ে দ্বীন, ১ম খণ্ড, ১০ পৃষ্ঠা—মওদুদী)। হিন্দুদের যােগী আর মুসলমানদের পীর এক জিনিস। ইসলাম কোন ধর্ম নয়। মুসলমান কোন জাতি নয় (তাফহিমাত, ১ম খণ্ড, ৬ পৃষ্ঠা)। দাজ্জাল সম্পর্কে রাসূলের দাবি সত্য নয়। ফজরের আযানের পরও সেহরী খাওয়া জায়েজ আছে। টাকার বিনিময়ে কয়েক দিনের জন্য অস্থায়ী। বিয়ে (মুতয়া) জায়েজ আছে, ইত্যাদি। পথভ্রষ্ট মওদুদী দলের সঙ্গে আমাদের মতবিরােধ। কেবল রাজনৈতিক কারণে নয়; বরং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা মওদুদী মতবাদকে আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত বিরােধী বলে বিশ্বাস করি।”১৬। এছাড়াও উপমহাদেশের যেসব শীর্ষস্থানীয় আলেম মওদুদী ও তাঁর জামাতের পবিত্র ধর্মের নামে রাজনৈতিক ব্যবসায় ও ভ্রান্ত ধ্যান-ধারণার বিরুদ্ধে বই লিখেছেন কিংবা ফতােয়া প্রদান করেছেন, তাঁদের মধ্যে রয়েছেন বিশিষ্ট তফসীরকার মওলানা আবদুল মজিদ দরিয়াবাদী, জামাতের প্রাক্তন নেতা মওলানা আমীন ইসলাহী, হযরত মওলানা গােলাম গাউস হাজারবী, হযরত মওলানা মুফতি মােঃ শফী, হযরত মওলানা জাফর। আহমদ ওসমানী, হযরত মওলানা আতাহার আলী, মওলানা সোলায়মান নদবী প্রমুখ।
উপমহাদেশের সকল মত ও পথের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের উল্লিখিত ভাষ্যগুলাে অত্যন্ত স্পষ্ট। এগুলাে ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়ােজন নেই। তাঁরা অত্যন্ত সহজ সরল ভাষায় জনাব মওদুদী ও তাঁর ধ্যান-ধারণার বাস্তব রূপ জামাত সম্পর্কে তাঁদের সুচিন্তিত অভিমত ব্যক্ত করেছেন। ইসলামের মুখােশধারী জামাতের আসল রূপটি এসব দেশবরেণ্য আলেমদের নিকট অস্পষ্ট নয়। তাই তাঁরা জামাতকে মুসলমানদের ঈমান-আকিদার জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর বলে অভিমত প্রকাশ করেছেন। শুধু উল্লিখিত আলেমগণই নন, উপমহাদেশের। খাটি আলেমরা সবাই জামাতের বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিমত প্রকাশ করেছেন। তাঁরা অনেকে বিভিন্ন ভাষায় জামাতের বিরুদ্ধে পুস্তক লিখেছেন। এই সংক্ষিপ্ত পরিসরে সেসব উল্লেখ করা সম্ভব নয়। আমরা মনে করি, জামাত সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ব্যাপারে যেকোন সত্যসন্ধ মুসলমানের জন্য আমাদের উল্লিখিত ওলামা কেরামের অভিমতই যথেষ্ট।

উপসংহার
পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী জামাত একটি ফ্যাসীবাদী ধ্যান-ধারণার বাস্তবরূপ। বিভিন্ন প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির লেজুড়বৃত্তির মাধ্যমে শক্তি সঞ্চয় করে ক্ষমতার মসনদ দখল করাই তার চরম লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। জামাতের রূপকার মওলানা মওদুদী ও জামাতের বিগত পঞ্চাশ বছরের কর্মতৎপরতা তা-ই প্রমাণ করে। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যে হাতিয়ার হিসেবে তারা পবিত্র ইসলামকে বেছে নিয়েছে। জামাতের স্থপতি মওলানা মওদুদী হায়দরাবাদের নিমের স্বার্থে পবিত্র ইসলামকে ব্যবহার করেছেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির দালালীর। সময়ও ইসলাম ছিল তার একমাত্র হাতিয়ার। ইসলামের নামেই তিনি কংগ্রেস ও তার নেতৃবৃন্দকে গালিগালাজ করেছেন। মুসলিম লীগ ও তার নেতৃবৃন্দ এবং পাকিস্তানের বিরােধিতায়ও তিনি একই অস্ত্র ব্যবহার করেছেন। মহিলাদের সামাজিক মর্যাদা দেয়ার বিরােধিতায় যেমন ইসলামকে ব্যবহার করা হয়েছে, আবার ষাটের দশকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ফাতেমা জিন্নার সমর্থনে ইসলামই ছিলাে জামাতের হাতিয়ার। ইসলামের নামেই মওলানা মওদুদী বলেছেন, গণতন্ত্র অভিশপ্ত। আবার এই পবিত্র ইসলামের নাম মুখে নিয়েই তিনি বলেছেন, ইসলামের সারকথাই হচ্ছে গণতন্ত্র। মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতায়ও জামাতের হাতিয়ার ছিলাে ইসলাম। লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ ও নিরীহ নাগরিকদের হত্যাযজ্ঞে জামাত পাক দখলদার বাহিনীর সহযােগিতা করেছে। ইসলামের নামে। এক পর্যায়ে নিজেদের কর্মীদের রাজাকার, আলবদরের সাইনবাের্ডে বাঙালি নিধন অভিযানে নামিয়ে দেয়। আর এসব নাকি তারা এদেশে ইসলাম প্রতিষ্ঠা ও রক্ষার জন্য করেছে। মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলােতে জামাতিদের স্লোগান ছিলাে—উপমহাদেশের এই অংশে পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে না পারলে ইসলামকে রক্ষা করা যাবে না। বাংলাদেশ ভারত দখল করে নেবে। ইসলাম ও মুসলমানদের নাম-নিশানাও এদেশে। থাকবে না। কিন্তু জামাত প্রাণপণ চেষ্টা করেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঠেকিয়ে রাখতে পারেনি। বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে। ভারত এদেশ দখল করে নেয়নি। ইসলাম ও মুসলমানরাও এদেশ থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়নি। আগে যেমন ছিলাে আজো তেমনি আছে।
এ থেকে প্রমাণিত হয়, পবিত্র ইসলামের নামে জামাতের স্লোগান কতাে অন্তঃসারশূন্য, কতাে অবাস্তব। এজন্যই উপমহাদেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমগণ একবাক্যে ফতােয়া দিয়েছেন ইসলামের নামে মওদুদীর ধ্যান-ধারণা বিভ্রান্ত ধ্যান-ধারণা। মওদুদী জামাত একটি বাতিল ফেরকা। এই জামাত থেকে দূরে থাকা মুসলমানদের ফরজ। মওদুদীর , অনুসারীদের পিছনে নামায পড়া জায়েজ নয়। জামাতের বিগত পঞ্চাশ বছরের তথাকথিত ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও কর্মতৎপরতার দিকে তাকালে দেখা যায়, বিভিন্ন সময়ে কায়েমী স্বার্থের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে পবিত্র ইসলামের নামে মওলানা মওদুদী ও তার অনুসারী জামাতিরা যেসব কথাবার্তা বলেছেন কিংবা গণস্বার্থবিরােধী যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, পরবর্তীতে তা বেমালুম ভুলে গেছেন। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বােল পালটে সামনের সারিতে আসার চেষ্টা করেছেন। বৃটিশ ঔপনিবেশিক আমলে বৃটিশের লেজুড়বৃত্তি করতে গিয়ে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ এবং এই দুটো সংগঠনের নেতৃবৃন্দ, এমনকি উপমহাদেশের এই দুই ধারার রাজনীতির সমর্থক আলেম সমাজও জামাতিদের গালিগালাজ থেকে রেহাই পায়নি। পাকিস্তানকে লেংড়া পাকিস্তান বলা সত্ত্বেও মওলানা মওদুদী ও তার অধিকাংশ অনুসারী জামাতিরা পাকিস্তানেই এসে আশ্রয় নেয়। অল্পদিনের মধ্যেই তারা পাকিস্তানের হেফাজতকারী সেজে বসে; পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থের লেজুড়বৃত্তি আরম্ভ করে। আর পাকিস্তানের স্বার্থরক্ষা করতে গিয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়। পাক-হানাদার বাহিনীর সাথে একাত্ম হয়ে বাঙালি নিধনে অংশগ্রহণ করে। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে অবস্থানকারী। জামাতিরা ঘাপটি মেরে থাকে এবং গােপনে ধ্বংসাত্মক তৎপরতা চালাতে থাকে। অপরদিকে গােলাম আযমসহ যারা পাকিস্তানে গিয়েছিল, তারা বিদেশে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাতে থাকে। তারা মধ্যপ্রাচ্যের পেট্রো-ডলার সমৃদ্ধ রাজতান্ত্রিক দেশগুলাের সাথে নিবিড় সম্পর্ক গড়ে তােলে।
জিয়াউর রহমানের স্বাধীনতাবিরােধীদের পুনর্বাসন নীতির সুযােগে জামাতিরা পরাজিত শক্তি হয়েও পুনরায় স্বনামে আত্মপ্রকাশের সুযােগ লাভ করে। বর্তমানে পাইপ লাইনে পেট্রো-ডলার আসছে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র থেকে। বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্যে, জামাতিরা মায়াকান্না করছে। কিন্তু অর্থ সরবরাহকারী রাজতান্ত্রিক দেশগুলােতে যে মানুষের মৌলিক অধিকার বলতে কিছু নেই, সে সম্পর্কে টু শব্দটিও করছে না। জামাত যে ইসলামের মুখােশধারী একটি ফ্যাসিস্ট চক্র, তাদের এই দ্বিমুখী ভূমিকা থেকেই তা পরিষ্কার প্রমাণিত হয়। জামাত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার স্লোগানের সাথে ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী শাসনতন্ত্রের স্লোগানও দিয়ে থাকে। মূলত শেষােক্ত স্লোগান দুটোই জামাতিদের সবচেয়ে বড় ‘হাতিয়ার। তারা জানে, বাংলাদেশের মানুষ ধর্মভীরু। তাই জামাত এই ভাবাবেগকে রাজনৈতিক পুজি করে এগুতে চাইছে। সেইসঙ্গে ব্যবহার করছে অঢেল পেট্রো-ডলার। অর্থের জোরে তারা কিরিচ বাহিনী ও অন্যান্য অস্ত্রধারী বাহিনী তৈরি করে প্রতিপক্ষের উপর হামলা চালাচ্ছে। জামাতের এসব ঘৃণ্য তৎপরতার দরুন যেকোন লােক স্বীকার করবেন, তারা পবিত্র ইসলামের মুখােশধারী ফ্যাসিস্ট শক্তি ছাড়া কিছু নয়। জামাতিরা ইসলামী রাষ্ট্র ও ইসলামী আইন-কানুন প্রতিষ্ঠার কথা বললেও তারা নিজেরাই ইসলাম-বিরােধী ভূমিকা গ্রহণ করেছে। জামাত যে বাংলাদেশের পরাজিত শক্তি এই বাস্তব সত্য তারা নিজেরাও অস্বীকার করতে পারবে না। স্বাধীন হওয়ার পূর্ব মুহূর্তেও জামাত বাংলাদেশকে ‘তথাকথিত’ বলে সম্বােধন করেছে। স্বাধীনতা লাভের দশ বছর পর ১৯৮১ সালেও জামাত নেতারা বলেছেন, “৭১ সালে যা করেছি তা সকলের জানা, আমরা ভুল করিনি।
আমাদের ৭১ সালের ভূমিকা সম্পর্কে জনগণের মধ্যে কোন রিজার্ভেশন আছে বলে আমরা মনে করি না।” জামাত নেতা পাকিস্তানী নাগরিক গােলাম আযম স্বাধীন বাংলাদেশে বসে ঘােষণা করেছেন, “বাংলাদেশ মাটির নাম, আদর্শের নাম নয়।” সারকথা, জামাতের অতীত ও বর্তমান ভূমিকার জন্যে যেকোন সাধারণ মানুষও নির্দ্বিধায় বলবে, জামাত বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি। আর ইসলাম পরাজিত শক্তিকে জীবনে বেঁচে থাকার সুযােগদান করলেও কোন অবস্থায়ই রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করেনি। ইসলামের বিগত দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে পরাজিত শক্তিকে রাজনৈতিক অধিকার দেয়ার একটি দৃষ্টান্তও কেউ দেখাতে পারবে না। ইসলামের প্রাথমিক যুগে মহানবীর (সঃ) আমলে পরাজিতদের অপরাধের ধরন অনুযায়ী হত্যা কিংবা দাস-দাসীতে পরিণত করা হতাে। পরবর্তীকালে পরাজিতদের জিম্মি হিসেবে গণ্য করা হতাে। তাদের নিকট থেকে জিজিয়া কর আদায় করা হতাে। কিন্তু রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে পরাজিতদের মতামতের কোন মূল্য দেয়া হতাে না। তাদের কোন প্রকার রাজনৈতিক অধিকার ছিলাে না। সুতরাং বাংলাদেশেও পরাজিত শক্তি জামাত ইসলামিক দৃষ্টিকোণ থেকেই রাজনৈতিক অধিকার পেতে পারে না। * এদিক থেকে বলা যায়, বাংলাদেশে পরাজিত শক্তি জামাতের রাজনৈতিক তৎপরতা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই অবৈধ। অথচ ইসলামের নামেই জামাতিরা বাংলাদেশে এই ইসলাম-বিরােধী কাজটি করে যাচ্ছে।
আমরা আমাদের এই বক্তব্য ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকে ভিত্তিহীন প্রমাণ করার জন্যে জামাতিদের চ্যালেঞ্জ করছি। আমরা বেশ ভাল করেই জানি, ইসলামের মুখােশধারী জামাত আমাদের এই চ্যালেঞ্জ সঠিক ইসলামী ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণের আলােকে মােকাবেলা করতে পারবে না। বস্তুত ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে স্বাধীনতাবিরােধী ও ইসলামের মুখােশধারী রাজনৈতিক দলগুলাে নিষিদ্ধ ঘােষণা ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি সঠিক পদক্ষেপ ছিল। কিন্তু জিয়াউর রহমান নিজের ক্ষমতা পাকাপােক্ত করার জন্যে পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে জামাতিদের রাজনৈতিক অধিকার প্রদান করে শুধু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার প্রতিই বিশ্বাসঘাতকতা করেননি, ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকেও একটি অবৈধ কাজ করেছেন। জামাতিদের ইসলামী হুকুমত’ ও ‘ইসলামী রাষ্ট্র’ শ্লোগান দুটো যতই আকর্ষণীয় হােক কেন, এর কোন ঐতিহাসিক ভিত্তি নেই।
হাল আমলের পাকিস্তান, ইরান ও অপর দু’একটি দেশ ছাড়া ইসলাম ও মুসলমানদের দেড় হাজার বছরের ইতিহাসে এই নামের কোন রাষ্ট্রের অস্তিত্ব আমরা খুঁজে পাই না। মহানবীর (সঃ) পর তাঁর চার খলিফা ৩০ বছর রাষ্ট্র পরিচালনা করেন। হযরত মাবিয়া থেকে উমাইয়ারা ৯১ বছর এবং আব্বাসীয়রা সাড়ে পাঁচশ’ বছর রাজত্ব করেন। মিসরে ফাতেমীয় খলিফারা রাজত্ব করেন। তুরস্কে করেন। ওসমানীয়রা। এছাড়াও স্পেন, মধ্য এশিয়া, উত্তর আফ্রিকা ও ভারতে মুসলমানরা বেশ কয়েক শতাব্দী রাজত্ব করেন। এসব রাষ্ট্র, এমনকি বর্তমানে মধ্যপ্রাচ্যে মুসলিম শাসিত কোন রাষ্ট্রের নামের আগেও ইসলাম শব্দটি সংযুক্ত করা হয়নি। | হিজরতের পর মহানবী (সঃ) মদীনার ইহুদী-মুশরিকদের সাথে সম্মিলিতভাবে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিলেন, তা ছিল স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের মত ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র। তাতে তিনি ইসলামী বিধি-বিধানকে রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করেননি। সে সময় অমুসলিমদের সাথে মুসলমানদের একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তিটি ইসলামের ইতিহাসে মদীনার সনদ’ নামে খ্যাত। তাতে চুক্তির অন্তর্ভুক্ত প্রতিটি সম্প্রদায় ও তাদের বন্ধুগােত্রের ধর্ম, সংস্কৃতি ও নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। স্বাধীনভাবে প্রত্যেক সম্প্রদায়ের ধর্মকর্ম করার অধিকার স্বীকৃত হয়। প্রতিপক্ষ থেকে চুক্তি লংঘনের আগ পর্যন্ত মুসলমানরা এই চুক্তি ভঙ্গ করেননি। এ ব্যাপারে পবিত্র কোরআনে পরিষ্কার ভাষায় মুসলমানদের বারণ করা হয়েছে। এমনকি কোরাইশ প্রতিনিধির আপত্তির প্রেক্ষিতে মহানবী (সঃ) হােদায়বিয়ার সন্ধিপত্রে তাঁর নামের আগে ‘আল্লাহর রাসূল’ বিশেষণটিও মুছে দেন। সংক্ষেপে বলতে হয়, পবিত্র ইসলামের নামে কোন এলাকা বিজয় তথা রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের আগ পর্যন্ত মহানবী (সঃ) জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সবার জন্য ইসলামী বিধান রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করেননি।
মহানবীর পর তাঁর চার খলিফার আমলেও ‘ইসলামী হুকুমত’ বা ইসলামী রাষ্ট্র’ নামে কোন ভূ-খণ্ডের সন্ধান পাওয়া যায় না। তাঁদের সময়ে রাষ্ট্রকে বলা হতাে ‘খেলাফত। ইসলামী চিন্তাবিদ ও সমাজবিজ্ঞানীরা খেলাফতের অর্থ করেছেন রিপাবলিক বা প্রজাতন্ত্র। পবিত্র কোরআনের ভাষায়, এই খেলাফত আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদের আগে একাধিক সম্প্রদায়কে দান করেছেন। খােলাফায়ে রাশেদীনের পর উমাইয়া আমল থেকে নামকাওয়াস্তে খেলাফত থাকলেও সেগুলাে ছিল রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থা। এ সম্পর্কে মহানবী (সঃ) নিজেই বলে গেছেন, “আমার পর খেলাফত বা প্রজাতন্ত্র থাকবে ৩০ বছর। এরপর রাজতন্ত্র কায়েম হবে।” সুতরাং খােলাফায়ে রাশেদীন-পরবর্তী মুসলিম শাসন আমল সম্পর্কে আলােচনা করাই অর্থহীন। এ প্রেক্ষাপটে আমরা বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত বা ইসলামী রাষ্ট্র কায়েম সম্পর্কে আলােচনা করতে পারি। সবাই জানেন, আমরা ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে ছিলাম, পাকিস্তান আমলে শুধু সাইন বাের্ডটাই ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্র’। এছাড়া আর কিছুই ছিল না। তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানে মদ, জুয়া, হাউজি প্রভৃতি অনৈসলামিক কর্মকাণ্ড সবই চলতাে। সবচাইতে বড় কথা, ইসলামের নামে দেশের বৃহত্তর জনগােষ্ঠীকে তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত রাখা হতাে। আমরা মুসলমান, হিন্দু, খ্রীষ্টান ও বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের লােকেরা ইসলামের নামে এই অন্যায়-অত্যাচার ও শােষণের বিরুদ্ধে সম্মিলিতভাবে রুখে দাঁড়াই। বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে সশস্ত্র সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আর জামাতসহ ইসলামী হুকুমতের শ্লোগানধারী কয়েকটি দল সেদিন হানাদার শক্তিকে মদদ যােগায়। সে সংগ্রামে আল্লাহ তায়ালা আমাদের কামিয়াব করেন। তাদের করেন পরাজিত ও লাঞ্ছিত। এ থেকেই প্রমাণিত হয় যে, সেদিন আল্লাহ পবিত্র ইসলামের নামে তাদের গণবিরােধী ভূমিকা পছন্দ করেননি।
সেদিন আমাদের চারটি সম্প্রদায়ের সম্মিলিত সংগ্রামের পিছনে একটি যৌথ চেতনা ও মূল্যবোেধ কার্যকর ছিল। যাকে আমরা মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবোেধ নামে অভিহিত করি। আর তা হচ্ছে, স্বাধীন বাংলাদেশ হবে গণপ্রজাতন্ত্রী। বাংলাদেশে জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে কেউ শােষিত-বঞ্চিত হবে না। তথাকথিত ইসলামী প্রজাতন্ত্র পাকিস্তানের মত কোন সম্প্রদায়ের ধর্মকে শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা হবে না। প্রকৃতপক্ষে “মদীনার সনদের মতই মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ বাংলাদেশের চারটি সম্প্রদায়ের জন্যে একটি ঐতিহাসিক সনদ। অন্য তিনটি সম্প্রদায়ের কারাে পক্ষ থেকে এই সনদ লংঘন না। করা পর্যন্ত আমাদের মুসলমানদের পক্ষ থেকে তা লংঘন করা হবে ইসলামী দৃষ্টিকোণ। থেকেই সম্পূর্ণ অবৈধ পদক্ষেপ। এ কথার প্রতি ইঙ্গিত করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “তবে মুশরিক বা অমুসলিমদের মধ্যে যাদের সাথে তােমরা চুক্তিতে আবদ্ধ ও পরে যারা তােমাদের সাথে চুক্তি রক্ষায় কোন ত্রুটি করেনি এবং তােমাদের বিরুদ্ধে কাউকে সাহায্য করেনি, তাদের সাথে নির্দিষ্ট মেয়াদ পর্যন্ত চুক্তি পালন করবে, আল্লাহ সাবধানীদের পছন্দ। করেন।” (৯৪) পবিত্র কোরআনের এই ভাষ্যটি অত্যন্ত স্পষ্ট। এর ব্যাখ্যা করার কোন প্রয়ােজন নেই। এই ভাষ্য অনুযায়ী মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী অপর তিনটি সম্প্রদায়ের তরফ থেকে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ লংঘন না করা পর্যন্ত আমরা মুসলমানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে তাদের উপর মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধবিরােধী কোন শাসন ব্যবস্থা চাপিয়ে দিতে পারি না। এরূপ করা হলে সেটা হবে ইসলামের নামে একটা অনৈসলামিক পদক্ষেপ এবং বাংলাদেশের অন্যান্য সম্প্রদায়ের সাথে চরম বিশ্বাসঘাতকতা। আর বিশ্বাসঘাতকদের প্রতি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আল্লাহবিশ্বাসভঙ্গকারীদের পছন্দ করেন না।” (৮ ঃ ৫৮)
এই প্রেক্ষাপটের আলােকে ইসলামী দৃষ্টিকোণ থেকেই বাংলাদেশে ইসলামী হুকুমত’ কায়েম করা জায়েজ হবে না। সত্যিকার অর্থে বর্তমান যুগে ইসলামী হুকুমত কায়েমের ক্ষেত্রে দুর্লংঘ্য সমস্যাও রয়েছে। কারণ রাষ্ট্রব্যবস্থার সাথে ইসলামী আইন-কানুনের সম্পর্কহীনতার ব্যবধান প্রায় দেড় হাজার বছরের। বর্তমানে হাজারাে শাখা-প্রশাখায় পল্লবিত বিভিন্ন রাষ্ট্রীয় সমস্যার ইসলামী সমাধান রাতারাতি সম্ভব নয়। এজন্যই পঞ্চাশের দশকে পাকিস্তানের খ্যাতনামা আইনবিদ জনাব এ.কে. ব্রোহী চ্যালেঞ্জ প্রদান করে বলেছিলেন, “কেউ যদি তাকে একটি ইসলামী শাসনতন্ত্র তৈরি করে দিতে পারেন, তিনি তাকে পাঁচ হাজার টাকা পুরস্কার দেবেন।” সে আমলের পাঁচ হাজার টাকার মূল্যবান আজকের পাঁচ লাখ টাকারও বেশি। কিন্তু জনাব ব্রোহীর এই চ্যালেঞ্জ তখন পাকিস্তানের মওলানা মওদুদীসহ কোন আইনবিদ কিংবা আলেম গ্রহণ করতে পারেননি। এ থেকেই জামাতিদের ইসলামী হুকুমত প্রতিষ্ঠার শ্লোগানের অন্তঃসারশূন্যতা প্রমাণিত হয়। বস্তুত সত্যিকার ইসলামিক বিচার-বিশ্লেষণ ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা উপেক্ষা করে কোন শক্তি যদি বাংলাদেশকে ইসলামিক রাষ্ট্র ঘােষণাও করে তবে তা ‘ইসলামী হুকুমত পাকিস্তানের মত নামসর্বস্ব ছাড়া কিছুই হবে না। তাতে ইসলামী মূল্যবােধ তথা আল্লাহ তায়ালার সঙ্গে চরম প্রতারণা করা হবে। এরূপ প্রতারণা পবিত্র কোরআনের ভাষায় অত্যন্ত নিন্দনীয় কাজ।
তাছাড়া বর্তমানে মুসলমানদের মধ্যে শিয়া-সুন্নী, আহলে হাদীস প্রভৃতি দল-উপদল রয়েছে। পবিত্র কোরআন-হাদীস সম্পর্কে তাদের প্রত্যেকের নিজস্ব ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রয়েছে। স্বভাবতই তারা প্রত্যেকে চাইবেন নিজেদের ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ রাষ্ট্রীয় আইনে পরিণত করা হােক। তাতে দেশের শাসনতান্ত্রিক ও আইনগত সমস্যা আরাে জটিল আকার ধারণ করবে। | এ প্রসঙ্গে ১৯৫৩ সালে লাহােরে কাদিয়ানী দাঙ্গা সম্পর্কিত বিচারপতি মুনির কমিশন রিপাের্টের উল্লেখ করা যায়। বিচারপতি মুনির পাকিস্তানের শীর্ষস্থানীয় ১৮ জন আলেমের নিকট মুসলমানের সংজ্ঞা জানতে চেয়েছিলেন। বিচারপতি মুনির এ সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, মুসলমানের সংজ্ঞা নিয়ে ১৮ জন আলেম একমত হতে পারেননি। তাহলে ইসলামী রাষ্ট্র গঠনের ব্যাপারে সবাই কি করে একমত হবে! সত্যি কথা বলতে কি, জামাত ও অন্যান্যদের ‘ইসলামী হুকুমত’ দাবী দেশে হানাহানি ও রক্তপাতের পথ প্রশস্ত করে দিচ্ছে। তার আরাে জ্বলন্ত প্রমাণ হলাে, সিলেটে ‘দোয়াল্লীন’ আর জোয়াল্লীন’ নিয়ে সংগঠিত দাঙ্গায় দু’জনের প্রাণহানি। এতাে দূরে যাওয়ার দরকার নেই। ১৯৮৭ সালের কথা, রােজার শেষদিকে ফেত্রা সম্পর্কিত একটি সংবাদ অনেকেরই দৃষ্টি এড়ায়নি। একটি প্রতিষ্ঠান ঘােষণা করেছে, এবার রােজার ফেত্রা জনপ্রতি ১১ টাকা।
দিতে হবে। আর একটি প্রতিষ্ঠানের মতে দিতে হবে ১২.৭৫ টাকা। কেউ বলেছে ২২ টাকা। আবার একটি প্রতিষ্ঠান ঘােষণা করেছে ৯০ টাকা করে দিতে হবে। এখন আপনারাই বলুন, কোন্‌টা রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত হিসেবে মেনে নেয়া হবে ? ফেরার ব্যাপারেই যদি এরূপ । মতভেদ হয়, তাহলে ‘ইসলামী হুকুমতে’ররাষ্ট্রীয় বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়ার | ক্ষেত্রে কিরূপ ভয়াবহ পরিস্থিতির সৃষ্টি হবে, তা ভাবতেও ভয় হয়। এসব কারণেই ১৯৭২ সালের শাসনতন্ত্রে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাভিত্তিক রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির অন্যতম নীতি হিসেবে ধর্মনিরপেক্ষতা গ্রহণ করা হয়। জামাতিরা মুক্তিযুদ্ধের। চেতনার প্রতি সরাসরি আঘাত না হেনে তার নীতিমালা, বিশেষ করে ধর্মনিরপেক্ষতার উপর আঘাত হানছে। তারা ইসলামী হুকুমতের দাবীর সাথে সাথে বলছে, ধর্মনিরপেক্ষতা, বা পরমতসহিষ্ণুতা নাকি ইসলাম-বিরােধী। এটা নাকি ধর্মহীনতা। এ সম্পর্কে ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে মূল্যায়নের আগে বাংলাদেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধর্মনিরপেক্ষতা সম্পর্কিত একটি উদ্ধৃতি এ ক্ষেত্রে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। ১৯৭২। সালের ১২ অক্টোবর গণপরিষদের অধিবেশনে বঙ্গবন্ধু খসড়া সংবিধান সম্পর্কে একটি ভাষণদান করেন। তাতে তিনি রাষ্ট্রীয় চার মূলনীতির ব্যাখ্যা দান করেন। ধর্মনিরপেক্ষতা।
সম্পর্কে তিনি বলেন, “ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। তাতে বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার নিশ্চিত করা হয়েছে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করব না। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের বাধা দেবার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারাে নেই। হিন্দুরা তাদের ধর্ম পালন করবে। কারাে বাধা দেবার ক্ষমতা নেই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে, খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে। তাদের কেউ বাধা দিতে পারবে না। ২৫ বছর আমরা দেখেছি ধর্মের নামে জুয়াচুরি, ধর্মের নামে শােষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, খুন, ব্যভিচার—এই বাংলাদেশের মাটিতে এসব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করেছি।” বঙ্গবন্ধু গণপরিষদে তাঁর ভাষণে মাত্র কয়েকটি বাক্যের মাধ্যমে বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ, একে মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য এবং এদেশে ধর্ম নিয়ে ব্যবসায়ের একটি নিখুত চিত্র তুলে ধরেছেন। এরপরও ধর্মনিরপেক্ষতাকে | বাংলাদেশে ধর্মহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ হিসেবে অপপ্রচার করা ইতিহাসের কিরূপ বিকৃতি তা যেকোন সচেতনপাঠকের নিকট ব্যাখ্যার অপেক্ষা রাখে না। আসলে জামাতের মত ধর্ম ব্যবসায়ী রাজনৈতিক সংগঠন ও তাদের ব্যবহারকারী শােষক শ্রেণীর ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি ক্ষুব্ধ হওয়ার মূল কারণ হলাে, ধর্মনিরপেক্ষতাকে রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণের মাধ্যমে তাদের রাজনীতির পুজি ও শশাষণের বেদী চুরমার করে দেয়া হয়েছিলাে। এরপর জনগণকে শােষণের জন্য রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে ব্যবহারের আর কোন হাতিয়ারই তাদের ছিলাে না।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের কালরাতে সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রে দেশীয় এজেন্টদের হাতে বঙ্গবন্ধু সপরিবারে নিহত হলেন। তারা এর পরবর্তী আঘাত হানলাে রাষ্ট্রীয় মূলনীতিমালার উপর। এক ঘােষণা দ্বারা তারা পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক শ্লোগান হিসেবে ব্যবহারের ‘পাকিস্তানী স্টাইল পুনরায় প্রবর্তন করলাে। পরবর্তীকালে রাষ্ট্রপ্রধানের আসন জবুর দখলকারী জিয়াউর রহমান কলমের এক খোঁচায় জনগণ নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রণীত শাসনতন্ত্র থেকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দিলেন। এরপর পঞ্চম সংশােধনীর মাধ্যমে তিনি তার এই পরিবর্তনের উপর বৈধতার প্রলেপ দিলেন। তাতে করে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও চেতনায় প্রথম আঘাত হানলেন মুক্তিযােদ্ধা জিয়া। এদিকে জামাতসহ স্বাধীনতাবিরােধী দলগুলাে জিয়ার এই পদক্ষেপের প্রতি সমর্থন জানিয়ে তালি বাজাতে লাগলাে। বস্তুত যে সাম্রাজ্যবাদী চক্রের অঙ্গুলী সংকেতে বঙ্গবন্ধু ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহকর্মী চার জাতীয় নেতাকে হত্যা করা হলাে, তাদের ইঙ্গিতেই ধর্মনিরপেক্ষতাকে । শাসনতন্ত্র থেকে বিদায় দেয়া হলাে। ধর্মনিরপেক্ষতাকে বাদ দেয়ার প্রধান কারণ হলাে, আন্তর্জাতিক ও দেশী শশাষক শ্রেণী এখনাে পবিত্র ধর্ম ও সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকেই তাদের শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। এখনাে এর বিকল্প কার্যকর কোন শ্লোগান তারা আবিষ্কার করতে পারেনি। পৃথিবীর মুসলিম জনসংখ্যা অধ্যুষিত এলাকাগুলােতে তারা স্থানীয় এজেন্টদের মাধ্যমে পবিত্র ইসলামকে শােষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। খ্রীষ্টাপ্রধান এলাকায় ব্যবহার করছে খ্রীষ্ট ধর্মকে, বৌদ্ধপ্রধান এলাকায় করছে বৌদ্ধ ধর্মকে, হিন্দু ও শিখ অধুষিত এলাকায় ব্যবহার করার চেষ্টা করছে এই দুটো ধর্মকে। তাতে করে মানবজাতির কল্যাণের জন্য প্রবর্তিত ধর্ম। মানুষকেই শােষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা ছিলাে । ধর্মের শ্লোগানধারী বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও শশাষক শ্রেণীর জন্য এক দুর্লংঘ্য বাধা। তাই তারা বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তীকালে এই প্রতিবন্ধকতার উপর প্রথম আঘাত হানে।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ধর্মনিরপেক্ষতা বা, পরমতসহিষ্ণুতা আমাদের জাতিসত্তার অখণ্ডত্ব ও সার্বভৌমত্বের রক্ষাকবচ। এমনকি আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের যৌক্তিকতার মানদণ্ড। আর এজন্যই ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিলাে। | প্রকৃতপক্ষে গণতন্ত্রের মত ধর্মনিরপেক্ষতাও পবিত্র ইসলামের মহান শিক্ষা। গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। গণতন্ত্রের ক্ষেত্র ধর্মনিরপেক্ষতার তুলনায় অনেক ব্যাপক। বলা চলে গণতন্ত্রেরই পরিপূরক বিষয় হচ্ছে ধর্মনিরপেক্ষতা। সত্যিকার গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বা সমাজ ব্যবস্থায় প্রতিটি নাগরিক অবাধে তাদের ধর্মকর্ম পালন করতে পারে। এছাড়া গণতন্ত্রের ধারণা একটা প্রহসন ছাড়া কিছু নয়। মূলত বিবেক ও নিজ নিজ জীবন পদ্ধতি অনুসরণ করার স্বাধীনতা সকল প্রকার সত্যিকার গণতন্ত্রেরই মৌল উপাদান। আর তা ইসলামেরও শিক্ষা। ইসলাম বিশ্বাস করে, জোর করে কারাে উপর চাপিয়ে দেয়া। কোন সত্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির নিকট তা আর সত্য থাকে না। সত্যের অন্বেষণ এবং তা। অনুসরণের অপরিহার্য শর্ত হলাে বিবেকের স্বাধীনতা। বিবেকের ব্যাপারে কোন বাধ্যবাধকতা নেই। পবিত্র কোরআনে মহানবীকে (সঃ) উদ্দেশ করে বলা হয়েছে : “এবং যদি তােমার প্রতিপালক ইচ্ছে করতেন তাহলে নিশ্চয়ই পৃথিবীর সবাই একযােগে বিশ্বাস, স্থাপন করতাে। তা সত্ত্বেও কি মুমিন বা বিশ্বাসী না হওয়া পর্যন্ত তুমি মানুষের উপর বল প্রয়ােগ করবে ?” (১০ ও ১৯) | বিবেক এবং নিজের মনােনীত জীবন পদ্ধতি অনুসরণের স্বাধীনতার প্রতি গুরুত্বারােপ করে পবিত্র কোরআনে আরাে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে : “ধর্ম সম্পর্কে কোন প্রকার বলপ্রয়ােগ নেই।” (২৪ ২৫৬)
পরমতের প্রতি সহিষ্ণু হওয়ার জন্য মুসলমানদের উপদেশ দান প্রসঙ্গে পবিত্র কোরআনে বলা হয়েছে ঃ “যারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে মিথ্যে মাবুদকে ডাকে, তাদের তােমরা গালি দিও না। তাহলে তারাও শত্রুতাবশত না জেনে আল্লাহকে মন্দ বলবে।” (৬। ৪ ১০৮) এরূপে পবিত্র কোরআনের বহু আয়াতে মানুষের বিবেক ও জীবন পদ্ধতির স্বাধীনতার কথা অত্যন্ত পরিষ্কার ভাষায় বলা হয়েছে। ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে পবিত্র কোরআনে একাধিক সাবধান বাণী রয়েছে। এক স্থানে বলা হয়েছে ৪ ‘আলাহ যদি মানবমণ্ডলীর এককে অপরের দ্বারা প্রতিনিবৃত্ত না করতেন, তাহলে আলাহর নাম যেখানে অধিকমাত্রায় স্মরণ করা হয় সেসব ধ্যানালয় ও গীর্জা এবং ভজনালয় ও মসজিদগুলাে ধ্বংস হয়ে যেতাে।” (২২ ও ৪০)। | পবিত্র কোরআনের উপরােক্ত ভাষ্যে পরিষ্কার বলা হয়েছে, আল্লাহ তায়ালা যদি মানুষের ধর্মীয় স্বাধীনতার উপর আক্রমণকারীদের প্রতিহত না করতেন তাহলে সকল ধর্মমতের ধর্মীয় স্থানগুলােই বিধ্বস্ত হয়ে যেতাে। আর এটাই তােইসলামের দৃষ্টিতে ধর্মনিরপেক্ষতা। বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের অনুসারীরা বসবাস করে। তাদের সবার সম্মিলিত সংগ্রামের ফলশ্রুতি হচ্ছে বাংলাদেশ। সুতরাং বাংলাদেশে যাতে ধর্মীয় সম্প্রীতি অক্ষুন্ন থাকে এবং পাকিস্তান আমলের মত জনসাধারণের ধর্মীয় অনুভূতিকে যাতে কেউ রাজনীতির পুঁজি হিসেবে ব্যবহার করতে না পারে, এই মহান লক্ষ্য সামনে রেখে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু ধর্মকে রাজনীতির পুজি হিসেবে গ্রহণকারী জামাত ও অন্যরা ইসলামের এই মহান শিক্ষাকে ইসলামবিরােধী ও ধর্মহীনতা বলে আখ্যায়িত করছে।
তারা একদিকে গণতন্ত্রের বুলি আওড়ায়, অপরদিকে গণতন্ত্রের পরিপূরক ধর্মনিরপেক্ষতার সমালােচনা করছে। তাদের এই ভূমিকা শান্তি, মৈত্রী ও প্রগতির ধর্ম ইসলামকে একটি লড়াকু ধর্ম হিসেবে চিত্রিত করার ব্যর্থ প্রয়াস ছাড়া কিছু নয়। পবিত্র ইসলামকে শশাষণের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহারকারী জামাত ও তাদের দোসরদেরকে মহানবীর (সঃ) একটি হাদীস স্মরণ করিয়ে দিতে চাই। তিনি বলেছেন, “শেষ যুগে কিছু প্রতারক সৃষ্টি হবে। তারা ধর্মের নামে দুনিয়া শিকার করবে। তারা মানুষের নিকট নিজেদের দরবেশী ও দীনতা জাহির করা এবং মানুষকে প্রভাবিত করার জন্য ভেড়ার চামড়ার পােশাক পরবে (মানুষের কল্যাণকামী সাজবে)। তাদের রসনা হবে চিনির চেয়েও মিষ্টি। কিন্তু তাদের হৃদয় হবে নেকড়ের হৃদয়ের মত হিংস্র।” (তিরমিজী)। ইসলামী হুকুমতে’র দাবীদার জামাতিদেরকে মহানবীর (সঃ) এই বাণীর সাথে। নিজেদের ভূমিকার মূল্যায়ন করার জন্য অনুরােধ করছি।