You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

জয় বাংলা সাক্ষাৎকার ১৯৭০–১৯৭৫ শেখ মুজিবুর রহমান

ভূমিকা
আব্বা ১৯৪৮ সাল থেকে ভাষা আন্দোলন শুরু করেন। মাতৃভাষা বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি আদায়ের আন্দোলনের পথ বেয়েই স্বাধীনতা অর্জন। ১৯৭১ সালের ২৬শে মার্চ প্রথম প্রহরে ইপিআর-এর হেড কোয়ার্টাসের (পিলখানা) ওয়ারলেসের মাধ্যমে সকল জেলায় পুলিশের কাছে বার্তাটি পৌছে যায়।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য, বাংলার মানুষের অধিকার আদায়ের জন্য নিজের জীবনের সব আরাম-আয়েশ ত্যাগ করে দিনরাত পরিশ্রম করেছেন।
বাংলার দুখি মানুষের ভাগ্য পরিবর্তন করতে, ক্ষুধা ও দারিদ্র্য থেকে মুক্তি দিতে চেয়েছেন। বাংলার শােষিত বঞ্চিত মানুষকে শােষণের হাত থেকে মুক্ত করে উন্নত ও আধুনিক জীবনের অধিকারী করতে চেয়েছেন।
যে-সংগ্রাম ও ত্যাগের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে মর্যাদা পেয়েছে, সেই সংগ্রামে অনেক ব্যথা-বেদনা, অশ্রু ও রক্তের ইতিহাস রয়েছে। অনেক ত্যাগের মধ্য দিয়ে মহৎ অর্জন করে দিয়ে গেছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতাে পৃথিবীর আর কোনাে রাজনৈতিক নেতাকে নিয়ে বাংলা-ইংরেজি ও বিভিন্ন ভাষায় এত বই, গল্প-কবিতা-ছড়া-উপন্যাসনাটক-প্রবন্ধ-নিবন্ধ লেখা ও প্রকাশিত হয়েছে কি না আমাদের জানা নেই। পঞ্চান্ন বছরের জীবৎকালে তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন মাত্র সাড়ে তিন বছর আর জীবনের সিংহভাগ সময় কাটিয়েছেন কারাগারের গহীন অন্ধকারে। এক জীবনে তার শ্রেষ্ঠ অর্জন বাঙালির হাজার বছরের স্বপ্ন ভাষাভিত্তিক, অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ জাতিরাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে নিয়ে গবেষণা একটি চলমান প্রক্রিয়া। তাঁর জীবদ্দশাতেই তিনি যেমন জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে আলােচিত ছিলেন তেমনি ঘাতকদের নির্মম হত্যাকাণ্ডের পরেও নতুনভাবে আলােচিত হয়েছেন। আব্বা ও আমাদের পরিবারের নৃশংস হত্যাকাণ্ড নিয়ে যত বইপত্র, লেখালেখি হয়েছে তাও পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা বৈকি।

আমার পিতা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের জীবনকে নতুন করে সবার সামনে তুলে ধরেছে তাঁর রচিত অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রােজনামচা এবং আমার দেখা নয়াচীন। বই তিনটির মধ্য দিয়ে আব্বার নিজের বয়ানে তার জীবন এবং বাংলাদেশের জীবনকথারও পূর্বাপর উঠে এসেছে কারণ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মানেই তাে বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু চর্চায় যুক্ত হয়েছে SECRET DOCUMENTS OF INTELLIGENCE BRANCH ON FATHER OF THE NATION BANGABANDHU SHEKH MUJIBUR RAHMAN শীর্ষক ৪টি খণ্ড । RECORD OF PROCEEDINGS: THE AGARTALA CONSPIRACY CASE
আগরতলা মামলার বিষয়ে আরও চারটি মৌলিক গ্রন্থ এবং গণপরিষদে, সংসদে, মাঠে ও ময়দানে জনসভায় আব্বার দেওয়া সকল ভাষণ একত্র করে ভাষণসমগ্র ১৯৫৫-১৯৭৫ প্রকাশিত হয়েছে। সিক্রেট ডকুমেন্টসের বাকি খণ্ডগুলাে প্রকাশিত হলে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবগবেষণায় নবমাত্রা সঞ্চারিত হবে নিঃসন্দেহে।


বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব-গবেষণার ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান তাঁর প্রদত্ত সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতা। সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের নেওয়া বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সাক্ষাৎকারটির কথা সবাই জানি; যেখানে কোন্ মুহূর্তটি আপনাকে সবচাইতে সুখী করেছিল? এর উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন
আমি যেদিন শুনলাম আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দিনটিই ছিল আমার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন। ১৯৭০ সালে সাংবাদিক ফজলে লােহানীকে দেওয়া ‘দৈনিক পাকিস্তান’ পত্রিকায় প্রকাশিত সাক্ষাৎকারে উঠে এসেছে অঙ্গীকারদীপ্ত অনন্য এক বঙ্গবন্ধু যিনি গােটা জাতিকে স্বাধীনতার মুখােমুখি করে তুলছেন তখন। আর সে জন্যই তিনি বলতে পারেন নিজের জীবন থেকে নেওয়া এমন কথা ভুল করলে সংশােধন করতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে।
দোস হু হেসিটেট উইল বি লস্ট ফর এভার। নাগিসা ওশিমার সাথে আলাপনে উঠে আসে বঙ্গবন্ধু’ এবং জাতির পিতা’—এই দুই উপাধি সম্পর্কে তার মূল্যায়ন
বাঙালি জাতিসত্তার আন্দোলনের এক পর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে বন্দি করা হলাে। এতে কিন্তু আন্দোলন আরাে বেগবান হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর আমাকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হলাে। এর তাৎপর্য অনেক গভীর। এরপর যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলাে তখন পরিস্থিতি আরাে কঠিন হলাে। আমার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি যেমন তাদের ভালােবাসি, তারাও বাসে আমাকে। সেই ভালােবাসা থেকে নতুন জন্ম নেওয়া একটা জাতি আমাকে “পিতার আসনে সম্মান দিলাে। দুইটি উপাধিই, আমার জনগণ যেভাবে আমাকে সম্বােধন করে, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
১২

আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপােরেশন (এবিসি) টেলিভিশনে স্বাধীনতাত্তোর সময়ে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে উদ্ভাসিত হয়েছে রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধুর অবয়ব। আপনি কী ষড়যন্ত্রকারীদের মােকাবিলা করতে চান? এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি যথার্থই বলেন
আমি নিজেই সংগঠিত।… কেননা, আপনারা নিশ্চয় জানেন, দেশের জনগণ যখন কোন নেতার পিছনে থাকেন ও তাঁর প্রশাসনকে সমর্থন করেন তখন তাঁকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। সব শক্তির উৎস হলাে জনগণ। যখন দেশের জনগণ, কারও পেছনে থাকে, তাকে বিশ্বের কেউ দাবিয়ে
রাখতে পারে না। এই হলাে আমার ধারণা। শামসুজ্জামান খানের সঙ্গে আলাপে আমরা পাই সর্বস্তরে বাংলা প্রচলন সংক্রান্ত বঙ্গবন্ধুর ভাবনা-
নির্দেশ দিছি। সব ফাইল বাংলায় লিখতে হবে। যে লিখবে না তাকে বাড়ি পাঠায়া দিবার ব্যবস্থা করবাে।
‘যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তােমার শেখ মুজিবুর রহমান এই কালজয়ী কবিতার কবি অন্নদাশঙ্কর রায়ের সঙ্গে একান্ত আলাপনে উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধুর মনের মৃত্তিকায় স্বাধীন বাংলাদেশের স্বপ্লবীজ বপনের ঐতিহাসিক তথ্য।
বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এলাে?” এই প্রশ্নের উত্তরে বঙ্গবন্ধু বলেন
সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সােহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ও দর্শন পুরােপুরি বুঝতে হলে তাঁর এই ঐতিহাসিক গ্রন্থ ‘জয় বাংলা সাক্ষাঙ্কার ১৯৭০-১৯৭৫’ পড়তেই হবে।
১৩

বিভিন্ন উৎস থেকে সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতা সম্পাদনার জন্য লেখক, রাজনীতিবিদ ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ এমপি এবং কবি ও গদ্যকার পিয়াস মজিদকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই। চারুলিপি প্রকাশন বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষের নিবেদন হিসেবে ‘জয় বাংলা সাক্ষাঙ্কার ১৯৭০-১৯৭৫’ এই গ্রন্থ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন—এজন্য প্রকাশক হুমায়ুন কবীরকেও ধন্যবাদ।
‘জয় বাংলা সাক্ষাঙ্কার ১৯৭০-১৯৭৫’ গ্রন্থে সংকলনভুক্ত দেশি-বিদেশি লেখক, সাংবাদিক ও সাহিত্যিকদের সঙ্গে এই সতেরােটি আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকার পড়তে পড়তে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচিত্র-বর্ণিল-ব্যতিক্রম ও বর্ণাঢ্য জীবনের বহু অজানা অধ্যায় উন্মােচিত হবে এবং তাঁর মহৎ মানবিক, দক্ষ-দূরদর্শী রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রনৈতিক সত্তা সম্পর্কে ধারণা লাভ করা সম্ভব হবে।
জয় বাংলা বাংলাদেশ চিরজিবী হােক।
১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২০
শেখ হাসিনা
প্রধানমন্ত্রী গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার

১৫

প্রসঙ্গকথা
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর পঞ্চান্ন বছরের ঘটনাবহুল জীবনের একদিকে যেমন স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গৌরবগাথা যুক্ত অন্যদিকে আছে অসমাপ্ত আত্মজীবনী, কারাগারের রােজনামচা, আমার দেখা নয়াচীন-এর মতাে মহত্তম বই লেখার অনন্য ইতিহাস। এই বইগুলাে যেমন বঙ্গবন্ধুকে তাঁর নিজের কথায় নতুন করে চেনায়, তার জীবনী বিনির্মাণে সহায়ক হয় তেমনি অন্তরঙ্গ বঙ্গবন্ধুর পরিচয় পাওয়া যায় বিভিন্ন সময়ে তাঁর প্রদত্ত সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতায় নানাজনের সঙ্গে। তেমনি কিছু সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতার সংকলন এই বই ‘জয় বাংলা সাক্ষাৎকার ১৯৭০-১৯৭৫’।

‘জয় বাংলা সাক্ষাঙ্কার ১৯৭০-১৯৭৫’ বইয়ে সংযুক্ত সতেরােটি সাক্ষাৎকার ও আলাপনের সময়কে বইটির সূচিক্রম ধরা হলাে যাতে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও ভাবনার পরিক্রমা অনুধাবন সহজ হয়।
একজন সৃজনশীল লেখক ও সাংবাদিক যখন জননন্দিত রাজনৈতিক নেতার মুখােমুখি হন তখন তা প্রশ্নোত্তরভিত্তিক প্রথাগত সাক্ষাৎকারে সীমাবদ্ধ না থেকে রূপান্তরিত হয় সৃজনশীল রচনায়।
১৯৬৯ সালের মার্চে গণঅভ্যুত্থানের প্রচণ্ডতায় পাকিস্তানে আইয়ুব সরকারের পতন ঘটে এবং এরপর জেনারেল ইয়াহিয়া খানের

১৬

সামরিক সরকার দেশে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ঘােষণা প্রদান করে। এর কিছুদিন পর নতুন বছরের শুরুতে অর্থাৎ ১৯৭০-এর ১লা জানুয়ারি থেকে আবুল কালাম শামসুদ্দীন সম্পাদিত দৈনিক পাকিস্তান’ (প্রথম প্রকাশ-১৯৬৪, স্বাধীনতার পর পরিবর্তিত নাম ‘দৈনিক বাংলা’) জাতীয় নেতাদের সাথে সাক্ষাৎকার-আত্মা দিয়ে দেখা’ শিরােনামে ফজলে লােহানী গৃহীত সিরিজ সাক্ষাৎকার প্রকাশ শুরু করে।
১৯৭০ সালের জানুয়ারি ও ফেব্রুয়ারি জুড়ে কয়েক সংখ্যায় পাওয়া গেলাে ফজলে লােহানীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অন্তরঙ্গ আলাপচারিতার সুদীর্ঘ ভাষ্য। এই দেশেতে জন্ম আমার’ শীর্ষক বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকারটির গুরুত্ব অনুধাবন করে দৈনিক পাকিস্তান ১৯৭০ সালের ১১, ১২, ১৩, ১৪ ও ১৮ জানুয়ারি মােট পাঁচদিন এর বিজ্ঞাপন-ভাষ্য প্রকাশ করে।
১১ জানুয়ারি ১৯৭০ দৈনিক পাকিস্তানের বার্তা সম্পাদক বরাতে বলা হয়
এই দেশেতে জন্ম আমার এই পর্যায়ে পূর্ব বাংলার অগ্নিপুরুষ শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ফজলে লােহানীর সাক্ষাত্তারের বিবরণ দৈনিক পাকিস্তানে আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই প্রকাশিত হচ্ছে। এখানে প্রকাশ করা হলাে তারই
উপক্রমণিকা।
-বার্তা সম্পাদক, দৈনিক পাকিস্তান।
১৯৬৯-এর ২২শে ফেব্রুয়ারি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বন্দি শেখ মুজিবকে গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয় এবং এর পরদিন ২৩শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৯ সালে তাঁকে। ছাত্রজনতার পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধিতে ভূষিত করা হয়। এ বছরেরই ৫ই ডিসেম্বর হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর স্মরণসভায় বঙ্গবন্ধু বলেন
…জনগণের পক্ষ হইতে আমি ঘােষণা করিতেছি আজ হইতে পাকিস্তানের পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশটির নাম ‘পূর্ব পাকিস্তান এর পরিবর্তে শুধু মাত্র বাংলাদেশ।”

১৭

১৯৭০-এর ৬ই জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু পুনরায় আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচিত হন। এই প্রেক্ষিতে প্রদত্ত সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর ভাষ্যে। যেমন তৎকালীন রাজনৈতিক পরিস্থিতি ফুটে উঠেছে তেমনি তাঁর জীবনের নানা অজানা অধ্যায়ও উন্মােচিত হয়েছে গল্পের ঢঙে। একইসঙ্গে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার পূর্ব প্রেক্ষাপটও বর্ণিত হয়েছে। তাঁর জবানিতে। হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর প্রতি তাঁর অপরিসীম শ্ৰদ্ধার কথা উচ্চারিত হয়েছে বারবার। এর বিভিন্ন পর্বে আসন্ন সাধারণ নির্বাচনের প্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ দলের রাজনৈতিক দর্শন এবং আর্থ-সামাজিক পরিকল্পনার কথা উঠে এসেছে আর সবশেষে এসেছে শেখ মুজিবের জীবনের প্রায় সমার্থক শব্দ ‘কারাবরণ’-এর কথা। দেশের বিভিন্ন জেলে তার কারাভােগ, কারামুক্তি এবং মুক্তির সঙ্গে সঙ্গে নাটকীয়ভাবে পুনরায় কারাবরণের চাঞ্চল্যকর তথ্য প্রকাশের পর আসে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা।
ধারাবাহিক এই সাক্ষাৎকার ১১ই জানুয়ারি ১৯৭০ সালে রােববারের দৈনিক পাকিস্তানে উপক্রমণিকা দিয়ে শুরু হয়ে যথাক্রমে ২১, ২৩, ২৫ ও ২৭শে জানুয়ারি এবং ২রা ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত হয়। দৈনিক পাকিস্তানের প্রথম পাতায় প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর সচিত্র এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে ২রা ফেব্রুয়ারির কিস্তিতে ঘােষণা দেওয়া হয়-“এই দেশেতে জন্ম আমার” শেষাংশ আগামী পরশু দৈনিক পাকিস্তানে প্রকাশিত হবে।” কিন্তু অজ্ঞাত কারণে ‘আগামী পরশু’ অর্থাৎ ৪ঠা ফেব্রুয়ারি ১৯৭০ কিংবা এর পরের কোনাে সংখ্যাতেই ঘােষিত শেষাংশ প্রকাশিত হয়নি প্রেস ট্রাস্ট অব পাকিস্তান পরিচালিত এই পত্রিকায়।
সাক্ষাৎকার গ্রহীতা ফজলে লােহানী শেখ মুজিবুর রহমানের কাছ থেকে আহৃত তথ্যাবলি আখ্যানের আঙ্গিকে বর্ণনা করেছেন, কখনও কখনও কথাপরম্পরায় উপস্থাপিত হয়েছে শেখ মুজিবের মূল সংলাপবাক্য।
‘দৈনিক ইত্তেফাক’-এ ২৩শে মার্চ ১৯৭১ সালের সংখ্যায় প্রকাশিত ১৯শে মার্চ ১৯৭১-এ ধানমন্ডির বাসভবনে অনুষ্ঠিত

১৮

সংবাদ সম্মেলনের বিবরণটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। যেখানে তিনি বলেছেন
‘আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় কলেমা উচ্চারণের
সঙ্গে এই স্লোগানও (জয় বাংলা) বলব।’
উপমহাদেশের প্রখ্যাত সাংবাদিক কুলদীপ নায়ার (১৯২৩-২০১৮) বাংলাদেশের স্বাধীনতার অভ্যবহিত পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলেন, যার বিবরণ তাঁর বই ‘স্কুপ! ইনসাইড স্টোরিজ ফ্রম দ্য পার্টিশন ট দ্য প্রেজেন্ট (হার্পার কলিন্স, ২০০৬)-তে লিপিবদ্ধ আছে। সে সাক্ষাভাষ্যের অনূদিত অংশ ১৮ই মার্চ ২০২০ সালে দৈনিক কালের কণ্ঠ’র বঙ্গবন্ধু জন্মশতবর্ষ আয়ােজনে প্রকাশিত হয়। এই সংক্ষিপ্ত আলাপনে ভুট্টোর চাতুরী নিয়ে বঙ্গবন্ধুর পর্যবেক্ষণ ওঠে এসেছে।
বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর স্বাধীন বাংলাদেশের নেতা হিসেবে লন্ডনে আয়ােজিত প্রথম সংবাদ সম্মেলনের (৮ই জানুয়ারি ১৯৭২) অনুবাদ ভাষ্যটি দৈনিক ইত্তেফাক ৯ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে প্রকাশিত সংখ্যা থেকে সংগৃহীত।
বঙ্গবন্ধু তাঁর কথামালায় ব্যক্ত করেছেন সদ্য আবির্ভূত বাংলাদেশের নেতা হিসেবে তাঁর স্বাতন্ত্র, সাহস ও গরিমা।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯২০-১৯৭৫) ঘটনাবহুল রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসে যে কয়টি সাক্ষাৎকার পাওয়া যায় তার মধ্যে সর্বাধিক উল্লেখযােগ্য হচ্ছে ১৯৭২ সালে পাকিস্তান থেকে মুক্তি পেয়ে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর ঢাকায় ব্রিটিশ সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্টের প্রােগ্রাম ইন বাংলাদেশ অনুষ্ঠানের জন্য নেওয়া সাক্ষাৎকারটি। বর্তমান গ্রন্থে মূল ইংরেজি থেকে সরদার ফজলুল করিম অনূদিত বাংলা ভাষ্য গৃহীত হয়েছে।
এই সাক্ষাৎকার সম্পর্কে সৈয়দ শামসুল হক তার বন্ধু কূটনীতিক ফারুক চৌধুরীর বরাতে জানাচ্ছেন এমন মূল্যবান তথ্য :

১৯
সেদিনের আড্ডায় ফারুক স্মরণ করলেন বঙ্গবন্ধুর একটি কথা; বিশ্বখ্যাত টেলি-সাংবাদিক ডেভিড ফ্রস্ট এসেছেন বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নিতে; সাক্ষাৎকার ক্যামেরায় গৃহীত হবার পর ডেভিড ফ্রস্ট বঙ্গবন্ধুকে উপহার দিলেন মনীষী ফ্রান্সিস বেকনের তিন খণ্ড প্রবন্ধ সংকলন, এই তিনটি খণ্ড ছিল ঐ গ্রন্থসমৃদয়ের দ্বিতীয় সংস্করণ যা সগ্রাহকদের কাছে মহামূল্য বটে। উপহার গ্রহণ করে, ফারুক স্মরণ করলেন, বঙ্গবন্ধু ফ্রস্টকে বললেন, ‘বিনিময়ে কী দিতে পারি আপনাকে?’ তারপর এক মুহূর্ত বিলম্ব না করে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান তার বুক পকেট থেকে কলম নিয়ে ডেভিড ফ্রস্টকে বললেন, আপনার মূল্যবান উপহারের বিনিময়ে আমার সামান্য এই কলম আপনাকে দিলাম। এ কলম দিয়ে আপনি আমার দরিদ্র মানুষের কথা লিখবেন। ফারুকের আজো মনে পড়ে, বলতে বলতে বঙ্গবন্ধুর চোখ অশ্রুতে ভরে উঠেছে, শুভ্র পাঞ্জাবির হাতা দিয়ে তিনি চোখ মুছে নিলেন।
(সৈয়দ শামসুল হক : হৃংকলমের টানে ২য় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৬৭, ইউপিএল ১৯৯৭) সাংবাদিক সাহিত্যিক এম আর আখতার মুকুলের মুজিবের রক্ত লাল (লন্ডন, ১৯৭৬) বইয়ে পাওয়া যায় ৮ই ফেব্রুয়ারি ১৯৭২ সালে কলকাতায় মুজিব ইন্দিরা সংলাপের এক অনন্য ভাষ্য, যেখানে দেশের সার্বভৌমত্বের প্রশ্নে সচেতন রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবের পরিচয় ফুটে ওঠে
“আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে
ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।’ জাপানি চলচ্চিত্রকার নাগিসা ওশিমা ১৯৭২ সালে নির্মাণ করেন প্রামাণ্যচিত্র রহমান, ফাদার অফ বেঙ্গল। আটাশ মিনিট তেত্রিশ সেকেন্ডের এই ছবিতে বঙ্গবন্ধুর একটি নাতিদীর্ঘ ও খুবই তাৎপর্যপূর্ণ সাক্ষাৎকার অন্তর্ভুক্ত হয়—যাতে তার পরিবার, পিতা, পিতৃভূমি, সরকারের প্রতিনিধি, জনগণ এবং নদীমাতৃক বাংলাদেশের একটি চিরচেনা ছবি ফুটে ওঠে। বঙ্গবন্ধুর কথার সূত্র ধরে আন্দোলন, আত্মত্যাগ থেকে শুরু করে ভবিষ্যতের বন্ধুর পথ পাড়ি দেওয়ার পরিকল্পনার ছাপও পাওয়া যায়। এই সাক্ষাৎকার আহাদ আদনান কৃত অনুবাদ গৃহীত হয়েছে আবুল হাসনাত সম্পাদিত কালি ও কলম বঙ্গবন্ধু শতবর্ষ সংখ্যা (জানুয়ারি ২০২০) থেকে।

২০
১৩ই মে ১৯৭২ সালে এই সাক্ষাৎকার আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপােরেশন (এবিসি) এর পক্ষে মি. পিটার জেনিংস ও লুই শেক কর্তৃক গৃহীত হয় এবং ১৫ই মে ১৯৭২ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেলিভিশনে প্রচারিত হয়। এই সাক্ষাৎকার আবুল মাল আবদুল মুহিত এবং অন্যান্য সম্পাদিত এই দেশ এই মাটি (বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ২০০৮) সংকলন থেকে গৃহীত। স্বাধীনতার পরের বছর পাকিস্তানি দুই সাংবাদিক মাজহার আলী খান ও সৈয়দ নাজিউল্লাহর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলাপন ২৫শে অক্টোবর ১৯৭২ সালে দৈনিক ইত্তেফাক এবং ২৭ অক্টোবর ১৯৭২ সালে দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত। এই সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানি তৎপরতা তুলে ধরেছেন।
মুজিববাদ গ্রন্থের লেখক খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস-এর কতিপয় প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধুর লিখিত সাক্ষাৎকার যা ঐ গ্রন্থের প্রথম সংস্করণ (ডিসেম্বর ১৯৭২) থেকে সংগৃহীত।
সাংবাদিক এম আর আখতার মুকুল তার মুজিবের রক্ত লাল’ (লন্ডন ১৯৭৬) গ্রন্থে ১৯৭৩ সালে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাংবাদিক এ্যান্থনি ম্যাসকার্নহাস ওরফে টনিসহ তিনজন মার্কিন সাংবাদিকের কথােপকথনের বিবরণ ধারণ করেছেন যেখানে পরিস্ফুট হয়েছে তার সদা-নির্ভীক সত্তা
‘আর ভয়ের কথা বলছেন? শেখ মুজিব তার যৌবনের প্রায় অর্ধেকটাই কাটিয়েছে কারাগার অভ্যন্তরে। আর জীবনে দু’দুবার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির আসামী ছিল। তাই শেখের ডিকশনারিতে ভয় বলে কোনাে শব্দ নেই। আপনারা আমাকে
যেকোনাে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন। এম আর আখতার মুকুল তার মুজিবের রক্ত রাল’ (লন্ডন ১৯৭৬) বইয়ে ১৯৭২ সালে অনুষ্ঠিত আলজেরিয়ায় ন্যাম সম্মেলনে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানগণের সঙ্গে আলাপচারিতার অনুবাদ উপস্থাপিত হয়েছে। দুইজন বিশ্বনেতা এবং কিউবার রাষ্ট্রপ্রধান ফিদেল ক্যাস্ত্রো—সৌদী আরবের বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে বাংলাদেশের স্থপতি ও দেশনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর আলাপনের ভাষ্য লিপিবদ্ধ করেছেন; যেখানে রাষ্ট্র পরিচালনায় তার দৃঢ়তা এবং বহির্বিশ্বের নেতাদের সমুখে সম্মানজনক সম্পর্ক রক্ষার কূটনৈতিক প্রজ্ঞা পরিস্ফুট হয়েছে।

২১
একই বিষয় পরিলক্ষিত হবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জেরাল্ড আর ফোর্ডের সঙ্গে বঙ্গবন্ধু আলাপনেও; ১লা অক্টোবর ১৯৭৪ সালে ওয়াশিংটনে অনুষ্ঠিত আলাপনটি জামিল বিন সিদ্দিকের অনুবাদে দৈনিক কালের কণ্ঠ’ বঙ্গবন্ধু সংখ্যা (১৭ মার্চ ২০২০)-তে প্রকাশিত। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ, অধ্যাপক শামসুজ্জামান খানের গ্রন্থ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ এবং প্রাসঙ্গিক কথকতা (১৯৯৫) থেকে সংগৃহীত। ইন্দ্রপাত আলাপনটি যতকাল রবে পদ্মা মেঘনা গৌরী যমুনা বহমান, ততকাল রবে কীর্তি তােমার শেখ মুজিবুর রহমান’ শীর্ষক অমর কবিতার রচয়িতা অন্নদাশঙ্কর রায়ের গ্রন্থ কাঁদো প্রিয় দেশ (আষাঢ় ১৩৮৩) থেকে সংগৃহীত। মূলত ১৯৭৪ সালে বাংলা একাডেমি আয়ােজিত প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন মঞ্চে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে তার আলাপের এটি লিখিত ভাষ্য।
সর্বশেষে সংযুক্ত বাকশাল সম্পর্কে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধু (রাজীব পারভেজ সম্পাদিত, শ্রাবণ প্রকাশনী ২০১৫) থেকে সংগৃহীত যেখানে বাংলার জনগণের জন্য, মেহনতি মানুষের মুক্তির জন্য তাঁর জীবন-মৃত্যুর পরােয়া না করা ভালােবাসা ওঠে এসেছে এভাবে
হয়তাে শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরােয়া করি না ।
ও মৃত্যু আমার জীবনে অনেকবার এসেছে। একসিডেন্টলি আজো আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। তাই মৃত্যু ভয় আমার নেই। জনগণ যদি বােঝে আমার আইডিয়া ভালাে, তাহলে
একটা বড় সান্ত্বনা আছে, যুদ্ধের সময় জনগণের সাথে আমি থাকতে পারিনি। জনগণ আমারই আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আজকের এই শােষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও থাকি, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাঙালিরা যে কোনাে মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য
একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়িত করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ।’ জাতির পিতার এই সতেরােটি সাক্ষাঙ্কার ও আলাপন সংগ্রহ করে গ্রন্থভুক্ত করা হলাে। ভবিষ্যতে যদি এর বাইরে আরও আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকার আমাদের নজরে আসে, তবে পরবর্তী সংস্করণে অন্তর্ভুক্ত করবাে বলে আশা রাখছি।

২২
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার সারাজীবনের আন্দোলন ও সংগ্রামে, ভাষণ, আলাপচারিতা ও সাক্ষাৎকার শেষে ‘জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে ইতি টানতেন। আমরা তাঁর ‘জয় বাংলা’ স্লোগানকেই বইয়ের শিরােনাম করেছি। বইয়ের শেষাংশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর মহাজীবনের কিছু রেখাচিত্র সন্নিবেশিত হলাে।
বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ‘জয় বাংলা সাক্ষাৎকার ১৯৭০-১৯৭৫’বইয়ের ভূমিকা-ভাষ্য রচনা করে আমাদের কৃতজ্ঞতার-পাশে আবদ্ধ করেছেন।
অধ্যাপক হায়াৎ মামুদ বইটির বানান সংশােধন করে দিয়েছেন। তার কাছে আমরা কৃতজ্ঞ।
‘জয় বাংলা সাক্ষাঙ্কার ১৯৭০-১৯৭৫’ বইটি প্রকাশের জন্য চারুলিপি প্রকাশনের প্রধান নির্বাহী ও প্রকাশক হুমায়ুন কবীরকে ধন্যবাদ জানাই তার আন্তরিকতার জন্য।
আশা করি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান-এর সঙ্গে সাক্ষাৎকার ও আলাপচারিতা পাঠে পাঠকের মানসপটে এক চিরায়ত বাঙালির প্রতিকৃতি অঙ্কিত হবে; যিনি বলতে পারেন :
‘ফাঁসির মঞ্চে যাওয়ার সময় আমি বলব আমি বাঙালি, বাংলা
আমার দেশ, বাংলা আমার ভাষা। এবং বঙ্গবন্ধুর শতবর্ষে আমরা আবারও বলি জয় বাংলা।
১০ই ফেব্রুয়ারি ২০২০
নুরুল ইসলাম নাহিদ
পিয়াস মজিদ
পুনশ্চ: প্রথম প্রকাশের এক বছরেরও কম সময়ে ‘জয় বাংলা সাক্ষাৎকার ১৯৭০-১৯৭৫’র দ্বিতীয় পরিবর্ধিত সংস্করণ একটি আনন্দের ঘটনা। এই সংস্কণে নতুন প্রাপ্তির ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধুর সাক্ষাৎকার ও আলাপচালিতা সংখ্যা দাঁড়ালাে সতেরােতে।

২৩
এই দেশেতে জন্ম আমার
‘ভুল করলে সংশােধন করতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। দোস হু হেসিটেট উইল বি লস্ট ফর এভার।
২৫
উপক্রমণিকা
সেদিনকার কথা নিশ্চয়ই মনে আছে সবার।
কণ্ঠ আমার রুদ্ধ আজিকে বাঁশি সংগীতহারা, অমাবস্যার কারা। সারাদেশ নিস্তব্ধ।
মানুষের কণ্ঠরােধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশ লক্ষ গ্রাম অমাবস্যার কালিমায় ঢাকা পড়ে আছে। এই তাে বেশি দিন আগের কথা নয়।
ঢাকা সেন্ট্রাল জেলের সামনে এসে থামলাে একটি মিলিটারি গাড়ি। সৈন্যরা নেমে সঙ্গিন উচিয়ে দাঁড়ালাে জেলগেটের সামনে। একি দুর্যোগের ঘনঘটা।
ভেতরে নিঃসঙ্গ এক বন্দি। নিরাপত্তা আইনে তিলে তিলে দহন করা হয়েছে তাকে। এ দহন জ্বালাময়ী, কিন্তু ইস্পাতকে অঙ্গার করতে পারেনি বন্দিশালার সে দহন। নিঃসঙ্গতা এক পলকহীন প্রহরীর মতাে প্রতিদিন এসে পায়চারি করেছে লােহার গারদের বাইরে। এমনি করে কেটে গেল দুটো বছর।
তারপর একদিন এলাে জেলার। বললাে, তােমার আজ মুক্তি।
মুক্ত বিহঙ্গের মতাে যেন পাখা মেলে উড়ে যেতে চায় নিঃসীম আকাশের পানে। তবুও কোথায় যেন এতটুকু অবিশ্বাসের মেঘ ছায়া ফেলে রাখে। অর্ফিয়াসের বাঁশির মতাে বেজে ওঠে না কেন মুক্তির গান। বন্দি জেলগেটের বাইরে এসে দাঁড়ায়। সঙ্গিনধারী সৈন্য এসে বলে, এটুকু ছিল প্রহসন। তুমি আবার বন্দি হলে। চলাে এবার আমাদের সাথে।

২৬
কতদূর? কোথায়? কোন সে সীমানায় নিয়ে যাবে, সুদূরের অন্তরালে? কতদিন রাখবে সেথায়? জবাব মেলে না। সেই গাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে জেলগেটের পথের মাঝে বন্দি একটি ছােট্ট অনুরােধ জানায়।
শুধু এক মুহূর্ত সময় দাও আমায়।
তারপর কারাগারের সামনে এক মুঠি ধুলাে তুলে কপালে স্পর্শ করে মােনাজাত জানায় সবার অলক্ষ্যে যিনি আছেন তাঁর উদ্দেশ্যে।
এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতে মরি
কারাগারের ফটক বন্ধ হয়ে গেল। বন্দি শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে মিলিটারি ট্রাক ছুটে চললাে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টের উদ্দেশ্যে। প্রহসনের এখানেই শেষ নয়। যবনিকা উঠল আরেক প্রহসনের। পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচাইতে বড়াে প্রহসনের। পাকিস্তানের ইতিহাসের সবচাইতে বড়াে প্রহসন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা : শুরু হলাে।
সেদিন সারাদেশ স্তব্ধ হয়ে দেখছিল এই নাটকীয় অপমানের দৃশ্য।
কিন্তু বছর না ফুরােতে পট পরিবর্তন হলাে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে শিক্ষার্থীরা হলেন পদাতিক। ঢাকা নগরী হলাে ছাউনি। ব্যারিকেড। বার্ডঅয়্যার। মিছিল, মশাল আর সান্ধ্য আইন। সেদিন বাংলাদেশের আরেক নাম হলাে সংগ্রাম। মুক্তিপাগল ছিনিয়ে আনা প্রমত্তা বন্যার মতাে জনতা গিয়ে দুহাতে উঁচু করে নিয়ে এলাে অনেক বন্দিকে। যাত্রাপথের জয়ধ্বনি মৃদঙ্গের মতাে ডাক দিয়ে যায়।
সন্ধ্যা হয়ে গেছে তখন। সারাদিনের কর্মকোলাহলের পর নিঃশেষিত পৃথিবীতে নেমেছে আসন্ন রাত্রির নিস্তব্ধতা।
এই নিস্তব্ধতা ভেঙে শােনা যাচ্ছে শুধু একজোড়া পায়ের শব্দ। ভাঙা নদীর পাড় ধরে একটি ছােটো ছেলে দৌড়চ্ছে প্রাণপণে। ঘরে ফিরতে হবে তাকে তখুনি। সন্ধ্যের শেষ আলােটুকু আকাশে মিলিয়ে যাবার আগেই তাকে পৌছুতে হবে গায়ের সীমানায় ।

২৭
উঁচু পাড় থেকে শুকিয়ে যাওয়া নদীর মাঝখানে ক্ষীণধারা স্রোতটুকু দেখে মনে হয় লাটিমের রূপালি সুতাে কেউ ফেলে রেখে গেছে সেখানে। বিশীর্ণ নদীর ভাঙা পাড় থেকে শুরু হয়েছে অসমতল জমির বিস্তৃতি। কোথাও কলাইয়ের খেত। আবার কোথাও বুটছােলার সবুজ শস্যে মাঠ ভরে গেছে। মাঝে মাঝে খড়ের ছাউনিঢাকা রাত প্রহরীদের টুঙ্গি। শীতের পহর রাতে ঘুমজড়ানাে চোখে কিষাণ বসে এখানে পাহারা দেয়। দূরের মাঠে মাঠে ছায়ার মতাে লােকগুলাে নাড়া পােড়াচ্ছে। অতিকায় এক ঘােড়ার পেখমতােলা পুচ্ছের মতাে খড়ের ধোঁয়া আকাশ জুড়ে ভাসছে।
কাছের একটি টুঙ্গি থেকে একটি রাখাল ছেলে বেরিয়ে এলাে। কয়েক গােছা ছােলা তুলে নেয় সে খেত থেকে। নদীর ধারে চারজন লােক বসেছে খড়ের আগুন পােয়াতে।
বুড়াে একজন লােক জিগ্যেস করলাে, কিরে তুই আইজ টুঙ্গিতে থাকবি নাকি রে?
ছােলা হাতে ছেলেটি এসে পাশে বসে। আগুনে ছােলা পােড়াতে পােড়াতে বলে-“না বাজান হাটে গেছে। বাজান আইলেই আমি যামুগা।
নদীর ধার ধরে কৃশকায় ছেলেটি দৌড়তে থাকে। এর বেশি শােনবার আর সময় নেই তার। সে নিজেও গিয়েছিল হাটে। মাইল তিনেক দূরে শনিবারের হাট বসে। কত দূর-দূরান্ত থেকে লােক আসে সেখানে। চালের কারবারি। গুড়ের সওদাগর। নৌকো ঘাটে বেঁধে তক্তার ওপর দিয়ে ভারী পিপেগুলাে নামায়, কুলিরা সােরগােল করে। এসব দেখতে বড়াে ভালাে লাগে তার। পারের ওপর দাঁড়িয়ে দুচোখ ভরে দেখে ছােটো ছেলেটি এই দৃশ্য। মরশুমের সময় বড়াে বড়াে পাট বােঝাই নৌকো পাল তুলে আসে উজান দেশ থেকে। পানি ছুঁয়ে যায় বােঝাই নৌকোর গলুই। ছােটো ছেলেটি পারে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে ভাবে, এসব নৌকো ডােবে না কেন!
এমনি তাদেরও নৌকো ছিল। বুড়াে দাদার মুখে সে কত গল্প শুনেছে তাদের নৌকোগুলাের দুকুড়ি, তিন কুড়ি নৌকোর বহর। ভারী দূরপাল্লার মালটানা বজরার গল্পকাহিনি।

২৮
দাদা সাহেব দাওয়ায় বসে ফরাসি হুক্কায় তামাক খেতেন। আর গল্প করে বলতেন বিগত দিনের কথা। তাঁর প্রবল পরাক্রান্ত বাবা শেখ ওয়াসিমুদ্দিনের কথা। ছােটো ছেলেটি পাশে বসে সেইসব গল্প অবাক বিস্ময়ে শুনেছে।
শেখ ওয়াসিমুদ্দিনের নৌকো মাল নিয়ে যেতাে কলকাতায়। ইংরেজের ব্যবসার প্রাণকেন্দ্র তখন কলকাতা শহর। ঢাকা থেকে, ফরিদপুর থেকে, সিরাজগঞ্জ থেকে মাল যেতাে কলকাতায় নৌকো করে। নীল, রেশম, মসলিন, পাট, গুড়। ওয়াসিমুদ্দিনের বজরা গিয়ে ঠেকতাে উল্টোডাঙার ঘাটে। সেখান থেকে মাল উঠতাে হুগলি নদীর জাহাজে। সাগর পাড়ি দিয়ে যেতাে বিদেশের বাজারে বাংলাদেশের পণ্য। ‘একবার লাগলাে ঝগড়া ইংরেজ সাহেবের সাথে। দাদা সাহেব গল্প শুরু করেন।
শুরু হয় মােকদ্দমা। অনেক টাকা পয়সার খরচ। খুলনার আলাইপুর পুল নীলকর সাহেবের চাই। সে যুগে ইংরেজ নীলকর যা। চাইতাে, তাই পেত সে। এ পুল নিজের এক্তেয়ারে আনতে পারলে সাহেব তার ওপর ট্যাক্স বসাতে পারবে। নেটিভদের যাতায়াত বন্ধ করতে পারবে সে ইচ্ছেমতাে।
কিন্তু ওয়াসিমুদ্দিন এ ব্যবস্থা মেনে নিতে পারলেন না।
তিনি বললেন, এত বড়াে অন্যায় হতে দেবাে না। এ পুল সবার ব্যবহারে লাগবে। সুতরাং আলাইপুরের পুল সাহেবকে দেওয়া চলতে পারে না।
শুরু হলাে মামলা। উকিল-মােক্তার এলাে। চললাে সলাপরামর্শ। সাহেব ঝানু লােক। শাসিয়ে গেলেন, গােরার বিরুদ্ধে মামলা করে কখনও জিততে পারবে না।
কিন্তু ওয়াসিমুদ্দিন নাছােড়বান্দা। শেষ পর্যন্ত ঘেটে নথিপত্র দেখে হাকিম রায় দিলেন ওয়াসিমুদ্দিনের সপক্ষে। মামলায় হেরে গেল শ্বেতাঙ্গ সাহেব। ফাইন দিতে হবে তাকে। | ওয়াসিমুদ্দিন কোর্টে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘অর্থের লােভ আমার নেই। ন্যায় বিচার যে আমি পেয়েছি, তাতেই আমি খুশি। সেজন্য নমুনাস্বরূপ একটি পাই পয়সা, জরিমানা আমি দাবি করছি।’

২৯
কেঁপে উঠল ইংরেজ সাহেবের বুক। এ তাে নিদারুণ শাস্তি। ইংরেজ হয়ে একজন কালা নেটিভ-এর জরিমানা তাকে দিতে হবে। সে কী করে হয়!
সাহেব অনুরােধ জানালাে ওয়াসিমুদ্দিনকে তােমার যত টাকা পয়সা লাগে আমি দেবাে তবু আমাকে জরিমানা করাে না। আমি একঘরে হয়ে যাবাে ইংরেজ সমাজে। লজ্জায় মুখ দেখাতে পারবাে না আর কাউকে।
ওয়াসিমুদ্দিন অটল।
‘ইংরেজ সাহেবকে জরিমানা দিতে হয়েছিল শেষ পর্যন্ত। তিনি মেয়ের বিয়ে দিতে পারেননি এইজন্য। দাদা সাহেব গল্প শেষ করেন।
নদীর ধারে হাটে প্রতি শনিবারেই ছােটো ছেলেটি আসতাে। পিতলের থালা পিঠে শব্দ করে লাঠিয়ালরা খেলা করতোঁ হাটের ধারে খােলা মাঠে।
জীবন পরামানিক। সলু শেখ। হাদী দরজি। এরা সবাই লাঠি ধরতে পারতাে মরদের মতাে, মাথায় তাদের থাকতাে ঝাঁকড়া চুল। সারা গা বেয়ে দরদর করে ঘাম ঝরতাে। কালাে পাথরে খােদাই মূর্তির মতাে সুন্দর তাদের দেহ। কত রকমের লাঠির খেলা দেখাতে তারা। বনবন করে মাথার ওপর ঘুরতাে পাকা বাঁশের লাঠি। খটাখট শব্দ উঠতাে মাঠ থেকে। এ শব্দে যেন যাদু ছিল। ছােটো ছেলেটি ছুটে যেতাে এই শব্দ শুনলেই।
তবে সবার চাইতে ভালাে লাগতাে তার একজনকে। যার জন্য প্রতি শনিবার স্কুলের ছুটির পর তিন মাইল হেঁটে চলে আসত হাটে। মুকিম মুন্সি ছিল তার কাছে রূপকথার রাজ্যের যুবরাজ। মুকিম হাটুরে গায়েন। সুর করে গান ধরত সে হাটের মাঝে। হাতের একতারায় আঙুলের স্পর্শে মূছনা জাগাতাে। মাথা নেড়ে নেড়ে সে গান গাইত। অপূর্ব সে গানের সুর। সব কথা না বুঝলেও ছােটো ছেলেটির মনে মুকিম মুন্সির গানগুলাে গভীর আবেদন সৃষ্টি করতাে। _ মুকিম গাইত এ দেশের গান। এখানকার মাটির মানুষের গান। তাদের সুখ-দুঃখের গান। ধান কাটার কাহিনি থাকতাে সে গানে।

৩০
থাকত কুচবরণ কন্যা আর তার মেঘবরণ কেশের কথা, থাকতাে তেপান্তরের মাঠ আর পঙ্খীরাজ ঘােড়ার কথা।
বিভাের হয়ে শুনছিল মুকিম মুন্সির মুখের গান ছেলেটি। কখন বেলা ডুবে গেছে টেরই পায়নি সে। ঘরে ফিরতে হবে তাকে সন্ধ্যের আগে।
নদীর ভাঙা পাড় ধরে কলই খেতের পাশ দিয়ে ছেলেটি ছুটতে থাকে। সূর্য তখন নেমেছে পাটে।
চোখে তার পুরােনাে দিনের স্মৃতি।
শেখ মুজিবুর রহমান তার অতীত জীবনের হারিয়ে যাওয়া দিনগুলাে খুঁজছিলেন মনের আনাচে-কানাচে। বাইরে শীতের হিমেল সকাল। ভােরের কুয়াশায় ভরে গেছে সামনের রাস্তাটি। সকাল সাড়ে সাতটায় তাঁর বাড়িতে গিয়ে আমি উপস্থিত হলাম। ধানমন্ডির পথে দু-একটা লােক সবে বেরিয়েছে। লেকের পাড়ে গাছগুলাের পাতা ভিজে গেছে। সারারাত ধরে নিঃশব্দে শিশির পড়েছে মাঠে। লেকের ঢালু কিনারায় ।
কথা হচ্ছিল হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী সম্পর্কে। শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘শহীদ সাহেবকে অনেকে চিনতেন । কী বিরাট ব্যক্তিতুসম্পন্ন পুরুষ ছিলেন তিনি।
পুরােনাে দিনের কথা। পাকিস্তান আন্দোলনের সঙ্গে যে পুরুষের এতখানি সংযােগ ছিল, যিনি প্রায় নিঃস্ব অবস্থায় দেশ থেকে বহুদূরে মৃত্যুবরণ করেছেন, তাঁর সম্পর্কে কথা বলছিলেন শেখ সাহেব।
প্রশ্ন করলাম, অনেকে বলেন যে শহীদ সােহরাওয়ার্দী ছিলেন ওপরতলাকার মানুষ। শেখ সাহেব জবাব দিলেন, “যিনি শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে ব্যক্তিগতভাবে জেনেছেন তিনি এ ধরনের কথা বলবেন না।’ কত গভীরভাবে যে তিনি সাধারণ মানুষকে ভালােবাসতেন, সে কথা তাঁর সংস্পর্শে যে এসেছে সেই জানে। তিরিশ দশকের কলকাতার কথা। সুপুরুষ অমিততেজ যুবক শহীদকে দেখা যেতাে কলকাতার শহরতলীর বস্তি এলাকা খিদিরপুর, মেটিয়াবুরুজ, রাজা।

৩১
বাজারে। শ্রমিকদের খােলার ঘরে, বস্তির ঘিঞ্জি চা-এর দোকানে। তিনি বসে আছেন বস্তিবাসীর মাঝে। তাঁদের কথা শুনেছেন। তাঁদের বিপদে-আপদে এগিয়ে যাচ্ছেন। কাউকে হাসপাতালে নিতে হবে। কারও চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। শ্রমিকদল গঠন করতে হবে কোথাও, এসব ব্যাপারে শহীদ সােহরাওয়ার্দী রয়েছেন সর্বাগ্রে । ‘উনিশ শ সাঁইত্রিশে বাংলাদেশের মন্ত্রীসভায় শহীদ সােহরাওয়ার্দী প্রথম শ্রম দপ্তর বলে পাের্টফোলিওটি খােলেন। এর আগে সরকারের কোনাে শ্রম দফরতই ছিল না। ট্রেড ইউনিয়ন অ্যাক্ট প্রণয়নকারীদের অন্যতম ছিলেন তিনি’-শেখ সাহেব বলতে থাকেন।
শহীদ সােহরাওয়ার্দীর কথা বলতে বলতে শেখ সাহেবের চোখ দুটো আর্দ্র হয়ে আসে গভীর বেদনায়। তিনি আমাকে ছেলের মতাে ভালােবাসতেন। ১৯৪১ সালের পর থেকে আমি সব সময়েই পাশে থাকতাম।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বিভাগপূর্ব ভারতে রাজনীতি শিখেছেন। তাঁর রাজনৈতিক প্রেরণার উৎস তিনি খুঁজে পেয়েছেন ঊনবিংশ শতাব্দীর ইউরােপীয় উদারনৈতিক চিন্তাধারার মাঝ থেকে। সে যুগে বৃটিশ পণ্যের সাথে ভারতে এসেছিল স্বাধীনতার মন্ত্রবাণী। মধ্যবিত্ত ভারত বুকে টেনে নিয়েছিল সেই আগুন জ্বালানাে কথামৃত। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ইউরােপীয় শিক্ষার আলাে যারা পেয়েছিলেন, তারাই সাম্রাজ্যবাদবিরােধী আন্দোলনের পুরােধা হলেন। ব্যারিস্টার মােহনদাস করমচাঁদ গান্ধী। তার উত্তরসূরী বৃটিশ পাবলিক স্কুলের ছাত্র জওহরলাল নেহেরু। সিংহলে ছিলেন ব্যারিস্টার বন্দরনায়ক। এ যুগের সিঙ্গাপুরের প্রধানমন্ত্রী লি কিউ ইয়ন, এরা সবাই বৃটেনেই তালিম নেন উদারনৈতিক মতবাদের। এই রাজনীতিরই ধারাবাহক ছিলেন ব্যারিস্টার হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী। এরা যুগ-উত্তরণের এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করে গেছেন। শহীদ সাহেবের সঙ্গে সঙ্গে বােধ হয় সে যুগেরও পরিসমাপ্তি ঘটল।

৩২
শহীদ সাহেবের সাহস, আত্মত্যাগ আর মনােবলের প্রশংসা মওলানা ভাসানীও করেছেন।
হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী বাংলাদেশের মানুষকে ভালােবাসতেন গভীরভাবে।
শেখ সাহেব বললেন, এ মমত্ববােধ ছিল প্রাণউৎসারী। এতে কোন খাদ ছিল না।
মৃদু হেসে তিনি বললেন, একটি কবিতা শহীদ সাহেবের খুব প্রিয় ছিল। দূরে কোথাও যাবার সময় গাড়িতে একা একাই তিনি গুনগুন করে গাইতেন— এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি…
গণতান্ত্রিক আন্দোলন আজ নতুনদিকে মােড় ফিরিয়েছে- এ পথের কথা সােহরাওয়ার্দী হয়ত ভেবেছিলেন। কিন্তু তিনি জীবিত থাকতে এই নতুন উত্তরণ দেখে যেতে পারেননি।
চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের দিক দিয়ে আওয়ামী লীগ সমাজতান্ত্রিক রাজনৈতিক দল নয়। আওয়ামী লীগ আজ সমাজতান্ত্রিক আদর্শের কথা বলছে। কোন পথে সে আদর্শ বাস্তবে রূপান্তরিত হবে, তা শুধু ভবিষ্যই বলতে পারে। একথা অস্বীকার করার উপায় নেই, এককালে সমাজতন্ত্র ছিল এদেশে একটি নিষিদ্ধ শব্দ। এ নিয়ে যারা চিন্তা করতেন, তারা শাসকের তর্জনীর ভয়ে ছিলেন ম্রিয়মাণ। কিন্তু আজ সর্বসাধারণের প্রকাশ্য বক্তব্যের উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে এই শব্দটি।
আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোতে রয়েছে আওয়ামী লীগের আদর্শ স্বাধীন, শােষণহীন ও শ্রেণিহীন সমাজব্যবস্থা কায়েম করা। সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মাধ্যমেই বর্তমানের শােষণ, বৈষম্য, অবিচার ও দুর্দশার হাত হতে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব বলে আওয়ামী লীগ বিশ্বাস করে। অর্থনৈতিক ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠাকল্পে সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত লক্ষ্য।
প্রশ্ন করলাম, এই আদর্শ হচ্ছে একটি বিপ্লবধর্মী আদর্শ। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব ছাড়া এই আদর্শ নির্বাচনের মাধ্যমে বাস্তবে রূপায়িত করা যাবে কি?

৩৩

শেখ মুজিব বিশ্বাস করেন বর্তমান অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে নির্বাচনই অগ্রগতির পথ। এ মতের সপক্ষে যুক্তি দেখিয়ে তিনি বলেন যে, যুগ বদলে গেছে। দুনিয়ার পরিবর্তন হয়েছে। সােভিয়েত রাশিয়ার কুলাকের অত্যাচার, জারের দুর্জয় শাসন ছিল। অর্থোডক্স চার্চের চরম গুঁড়িতে মানুষকে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখা হয়েছিল। রাজার বিরুদ্ধে কথা বললে গর্দান যেত। সেখানেই বিপ্লব করে পরিবর্তন আনতে হয়েছে। রাশিয়ার বিপ্লব ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
আজ অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। আজ জনসাধারণ বুদ্ধিসচেতন, শেখ বললেন।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর ঐতিহাসিক যুগ পরিবর্তনের শুরু। চীনে বিপ্লবের মাধ্যমে পুরােনাে ব্যবস্থা বদলানাে হয়েছে। ভিয়েতনামে মুক্তিযুদ্ধ চলছে। সাম্রাজ্যবাদের হাত থেকে মুক্তি পেয়েছে আফ্রিকার পূর্বতন কলােনিগুলাে। আলজেরিয়ায় জনগণতন্ত্রের পরীক্ষা চলছে। কিন্তু এসব দেশগুলােতে সমাজতন্ত্র কায়েম হয়নি এখনও। কিন্তু যে রাজনৈতিক পরিবর্তনের জোয়ার এসব দেশে এসেছে তাকে ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিতে না দেখলে ভুল করা হবে। উত্তরণের যুগে এই ধারার পরিবর্তনের প্রয়ােজন রয়েছে কি না, তা যুক্তিসাপেক্ষ।

৩৪
গত এগারােই জানুয়ারি পল্টনের জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক প্রােগ্রাম পেশ করেছেন এই বলে যে, মূল শিল্পগুলাে, ব্যাংক ও বীমা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণ করা হবে।
আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোর শিল্প পর্যায়ের বক্তব্যেও বলা হচ্ছেব্যাংক, বীমা, গুরুত্বপূর্ণ যানবাহন ও যােগাযােগ প্রভৃতি প্রত্যক্ষ জনস্বার্থমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহও জাতীয়করণ করা হবে এবং বৈদেশিক বাণিজ্য রাষ্ট্রীয়ত্তাধীনে পরিচালিত হবে।
এই ব্যাপারে সুস্পষ্ট একটি ধারণার দরকার রয়েছে। বর্তমান ঘােষণার সূত্র ধরে যদি বলা যায়, পাকিস্তানের বিভিন্ন পূর্ণ স্বায়ত্তশাসিত প্রদেশ তাদের নিজস্ব আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক ব্যবস্থা বেছে নেবে। তাহলে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাঙ্ক, বীমা ও মূল শিল্প অন্যান্য প্রদেশেও সম্ভব কি না? জাতীয়করণ ব্যবস্থা কি প্রত্যেকটি প্রদেশেই বিস্তৃত হবে? যেহেতু, প্রদেশগুলাে স্বায়ত্তশাসিত এবং কোন অর্থনৈতিক ব্যবস্থা একটি প্রদেশ বেছে নেবে, তার অধিকার প্রদেশের রয়েছে। সুতরাং জাতীয়করণ ব্যবস্থা পাকিস্তানের সকল অংশের জন্য চালু করার অধিকার কি কেন্দ্রের থাকবে?
এ ব্যাপারে শেখ মুজিব মনে করেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের বিভিন্ন অঞ্চলের জনসাধারণও আজ একচেটিয়া পুঁজিপতি ও বুর্জোয়া সামন্তশ্রেণির হাতে নিগৃহীত।
সেখানেও গণতান্ত্রিক আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠেছে।
তারাও চাইবেন জাতীয়করণের সুফল ও সঙ্গতি পাকিস্তানের সকল অংশে পরিব্যাপ্ত হােক—শেখ সাহেব বললেন।
যে রাষ্ট্রের সমাজবিন্যাসে বুর্জোয়া শ্রেণি ও একচেটিয়া পুঁজিপতির অস্তিত্ব থেকে যাচ্ছে, সেই রাষ্ট্রে এই ধরনের জাতীয়করণ প্রােগ্রামের সত্যিকারে সুফল আশা করা যায় কি? শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, পাকিস্তানে একচেটিয়া পুঁজির যে কার্টেল সৃষ্টি হয়েছে, তা ভাঙার জন্যই ব্যাঙ্ক, বীমা ও মূল শিল্পগুলাে জাতীয়করণের কথা বলা হয়েছে। একচেটিয়া ধনতন্ত্রের সর্বগ্রাসী কর্তৃত্ব ভেঙে দেবার প্রথম ব্যবস্থা হবে এর মাধ্যমেই। একই ধরনের আরাে কয়েকটি প্রশ্ন মনে জাগছিল। জিজ্ঞেস করলাম, আওয়ামী লীগ ম্যানিফেস্টোতে কৃষিনীতির ব্যাপারে বলা হয়েছে, সমবায় পদ্ধতিতে দেশে যৌথ চাষাবাদের পালন করতে হবে।

৩৫
দেশে যৌথ চাষাবাদের প্রচলন করতে হবে।
পূর্ণ প্ল্যানিংয়ের মাধ্যমেই আওয়ামী লীগের কৃষি নীতির বাস্তব রূপান্তর সম্ভব হবে বলে শেখ মুজিব অভিমত দেন।
আরেকটি প্রশ্ন করলাম, আমলাতন্ত্র আমাদের দেশে একটি বিশেষ শ্রেণি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই আমলাতন্ত্রের ওপর নির্ভর করে আওয়ামী লীগের পরিকল্পনাগুলাে বাস্তবে রূপায়ণ করা কি সম্ভব হবে?
শেখ সাহেব জবাবে বললেন, যে আমলাতন্ত্র জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য কাজ করবে না, তাকে শেষ পর্যন্ত সরে পড়তে হবে। শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগের প্রাথমিক যুগ থেকে আজ পর্যন্ত দেশের রাজনৈতিক অবস্থার মােড় অনেকখানি বদলে গিয়েছে। আওয়ামী লীগের সামনে আজ একটি লক্ষ্য-ওয়েলফেয়ার স্টেট। এ লক্ষ্যে পৌছতে পার্লামেন্টারি গণতন্ত্রের হয়তােবা শেষ পরীক্ষা এখন চলছে। আশার বৃক্ষের শাখায় ফল ঝুলছে, এত ফল কে পেড়ে আনবেন, তার সঠিক উত্তর পাওয়া সম্ভব নয়। এ ফল অবশ্যি আপনা থেকে যে কখনও টুপ করে পড়বে না, তাও জানা কথা।
বাইঘা নদীর পানি অনেক জায়গায় শুকিয়ে গেছে। গিমাডাঙা স্কুলের টিনের চাল চোখে পড়ে। ছােটো ছেলেটি যখন টুঙ্গিপাড়ায় ফিরে এলাে তখন সন্ধ্যের কালাে আঁধারে ঢাকা পড়ে গেছে টুঙ্গিপাড়ার মসজিদ বাড়ি।
পিতা শেখ লুৎফর রহমান এশার নামাজ শেষে মাদুর গুটিয়ে উঠে পড়লেন। বাইরে পড়ার ঘরে লণ্ঠন বাতি জ্বলছে।
বাড়ির ছেলেরা বাতির চারপাশ ঘিরে গােল হয়ে বসে সুর করে পড়া শুরু করে দিয়েছে।
মুজিবের গলার স্বর শােনা যায়। নামতা পড়ে সুর করে। তারপর দীর্ঘ সময়ের অতিক্রমণ।
গিমাডাঙা স্কুলের পড়া শেষ। বারাে মাইল দূরে গােপালগঞ্জ । মিশন স্কুলে নিয়ে গেলেন পিতা বালক পুত্রকে ভর্তি করার জন্যে।
উনিশ শ চৌত্রিশ সাল এলাে।
সে যুগে বাংলাদেশে এক ধরনের রােগের কথা শােনা যেতাে। বেরিবেরি। ভিটামিন ‘বি’র স্বল্পতার দরুন এ রােগ হতাে। হার্ট দুর্বল

৩৬
করে ফেলতাে এ রােগ। পা ফুলে যেতাে। আর চোখ নষ্ট হয়ে যাবার সম্ভাবনা থাকতাে। মুজিব তখন মিশন স্কুলের ক্লাস সেভেনের ছাত্র। বেরিবেরির আক্রমণে শয্যাশায়ী হলাে বালক ছাত্র। বাবা নিয়ে গেলেন তাকে কলকাতায়। চোখ অপারেশন করতে হয়েছিল তাকে। তিন বছর পড়াশােনা নষ্ট হয়েছিল তাঁর।
রােগমুক্তির পর মিশন স্কুলে আবার ফিরে এলাে মুজিব। উনিশ শ’ আটত্রিশ।
বাংলার তখন নবজাগরণের শুরু। উনিশ শ’ ছত্রিশের ভারত শাসন আইন পাশ হয়ে গেছে। প্রদেশে প্রদেশে মন্ত্রীসভা গঠিত হয়েছে।
ফজলুল হক আর শহীদ সােহরাওয়ার্দী এলেন গােপালগঞ্জে। সে এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। দূর দেশ থেকে খেতচাষী, গেরস্থ আর হাটের কামলারা এলাে ফজলুল হককে দেখতে। একশ বছরের ঋণের বােঝার নিচে বাংলার গায়ের চাষী তখন মৃতপ্রায়। হক সাহেব—এই নামটি তাদের কাছে আশার ধ্রুবতারার মতাে জ্বলছে। মহাজন আর জমিদারের ঋণ চাষীর মেরুদণ্ড ভেঙে দিয়েছে।
হক সাহেবের সঙ্গে শহীদ সােহরাওয়ার্দী। বয়ােজ্যেষ্ঠের সঙ্গে বসেছেন মন্ত্রীসভার নতুন সদস্য।
ঘুরে ঘুরে তাঁরা মিশন স্কুল দেখছেন। হেডমাস্টার ছাত্রদের আগেই তালিম দিয়ে নিয়েছেন। মানপত্র পেশ, সংবর্ধনা সভা। সবই বেশ সুচারুরূপে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। এবার মাননীয় অভ্যাগতদের ফিরে যাবার পালা।
কয়েকজন ছাত্র সাথে নিয়ে এসে দাঁড়ালাে একজন ছিপছিপে কৃষ্ণাঙ্গ কিশাের। মুজিব মেহমানদের পথ আগলে দাঁড়ালাে।
‘আপনাদের যেতে দেবাে না এখন’—নির্ভয়ে কথা বলে ওঠে কিশাের ছাত্র। এত সাহস কোথা থেকে এলাে মিশন স্কুলের এই ছাত্রটির। হেডমাস্টার বিরক্ত হয়ে ওঠেন বাংলার প্রধানমন্ত্রীর সামনে।
‘কী করছাে মুজিব, সরে দাঁড়াও। দেখছাে না অতিথিরা যাবেন এখন হেডমাস্টার বলেন।
‘না।’ অস্বীকার, অগ্রাহ্যের প্রতীক এই ‘না’। মিশন স্কুলের বারান্দায় এই শব্দটি যেন এক সঞ্জীবনী নবচেতনায় স্পন্দিত হয়ে ওঠে।

৩৭
সঙ্গী ছাত্রদের প্রাণে আশার সঞ্চার করে শব্দটি। তারাও এগিয়ে এসে দাঁড়ায় মুজিবের পেছনে।
‘আমাদের হােস্টেলের ছাদ দিয়ে পানি পড়ছে। আপনারা কথা দিন ছাদ সারিয়ে দেবেন। তারপর এখান থেকে যেতে পারবেন আপনারা।
এ যে কিশাের ছাত্রের অলঙ্নীয় দাবি। এ দাবি উপেক্ষা করা যায় না। মন্ত্রী দুজন নীরবে হাসতে থাকেন। দাবি মঞ্জুর।।
অভ্যর্থনার শেষে শহীদ সােহরাওয়ার্দী ডেকে পাঠান কিশাের ছাত্রকে একান্তে। মুজিব গিয়ে দাঁড়ায় সােহরাওয়ার্দীর বাংলাের সামনে। এই প্রথম শিষ্য গুরুর সাক্ষাৎ পায়। এ যেন হঠাৎ করে দেখা। সােহরাওয়ার্দী খুঁজছিলেন এমন একজনকে যাকে সঙ্গে নিয়ে দুস্তর পারাবার অতিক্রম করা যায়।
গােপালগঞ্জের মিশন স্কুলে সেই অপরাহ্নের আশ্চর্য আলােয় একজন অভিজ্ঞ কামার খুঁজে পেলেন একটা ছােট্ট লােহার খণ্ড। একে প্রত্যক্ষ রাজনীতির আগুনে তাঁতিয়ে শাণিত অস্ত্রে পরিণত করতে হবে। সােহরাওয়ার্দী এই প্রথম তার একলব্যকে খুঁজে পেয়েছেন। একে ছাড়া যাবে না কখনও। | কলকাতায় ফিরে গিয়ে তিনি চিঠি লেখেন মুজিবকে। শুরু হয় ছাত্রের রাজনীতি পাঠ।
খণ্ড খণ্ড ঘটনা। তুলির অসংলগ্ন আঁচড়ের মতাে মনে হয়। জীবনপটে। শহরের পথে এক রুগ্ন বৃদ্ধা পড়ে আছে ধুলাের মাঝে। পথ দিয়ে কত লােক চলে যাচ্ছে। কিন্তু কেউ লক্ষ করছে না তাকে। অমন কত ভিখিরিই তাে’ পথে পড়ে মৃত্যুর অপেক্ষা করে প্রতিদিন।
কিন্তু কি হলাে সেদিন। এক নবীন কিশাের এসে দাঁড়ালাে বৃদ্ধার পাশে।
‘মা, তােমার কী হয়েছে? কেন তােমার চোখে পানি? | অস্পষ্ট দৃষ্টি নিয়ে বৃদ্ধ তাকায় সামনে দাঁড়িয়ে থাকা প্রশ্নকারীর দিকে। কিশােরের প্রশ্নে কত দরদ, কত মমতা রয়েছে ছেলেটির চোখে।
মাটি থেকে রুগ্ন বৃদ্ধাকে তুলে নেয় ছেলেটি। দুহাতে বুকের কাছে জড়িয়ে ধরে সে পরিত্যক্ত ভিখারিনীকে সযত্নে।

৩৮
‘চলাে মা তােমায় হাসপাতালে নিয়ে যাই। এখানে পড়ে থাকলে তাে আর চলবে না।’
নিঃস্ব নারী অজেয় পুত্রকে আশীর্বাদ করে। ‘আল্লাহ্, তােমার ভালাে করবেন, বাবা।
দেশ স্বাধীন হলাে। নবাব, নাজির, উজিররা এসে পাকিস্তানের তখুতে বসলেন। তদানীন্তন ভারত সরকারের নয়াদিল্লির অফিসে যাঁরা চাকরি করতেন, তাঁদের ভেতর এমন অনেকেই ছিলেন যারা লােকজন, ভিড়, জনতা মিছিল কখনই পছন্দ করতেন না। বৃটিশ সরকার বাহাদুরের অপূর্ব করুণকীর্তন করতেই যাঁদের সকাল সন্ধ্যে কাটাতাে তারা হঠাৎ এসে পাকিস্তানের রক্ষাকর্তা হয়ে দাঁড়ালেন। তাঁরাই সবার চাইতে ভালাে বােঝেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার জন্য দিল্লি কলকাতার সরকারি কামরায় বসে পাখার তলায় যারা থাকতেন, তাঁদের সে ঘাম ব্যর্থ হতে তাঁরা দেবেন না। সংকল্প করলেন সিল্কের শেরােয়ানি পরা, আদ্দির কুর্তা পরা দেশপ্রেমিকরা।
রাস্তা দিয়ে সবুজ পতাকাবাহী সাধারণ মানুষের কত মিছিল যেতাে।
জানালা দিয়ে তারা সেই দৃশ্য দেখে বলতেন, “এগেইন দোজ হুলিগানস আর আউট অন দ্য স্ট্রিট’।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এরাই এসে সামনের সারির চেয়ারগুলাে দখল করে বসলেন।
কায়েদে আজমের নেতৃত্বে ভারতের দশ কোটি মুসলমানের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার সংগ্রাম করে পেয়েছিলেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হলাে। উনিশ শ’ আটচল্লিশে কায়েদে আজম মারা গেলেন।
দেশের জননেতারা তখন কোথায়? পূর্ব পাকিস্তান থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়েছে শহীদ সােহরাওয়ার্দীকে দেশদ্রোহী বলে। মওলানা ভাসানী এখানকার রাজনীতিতে অপাঙক্তেয়।
বই বাজেয়াপ্ত করার হিড়িক পড়ে গেছে দেশে। সংবাদপত্রের বুকে পা রেখে দাঁড়িয়েছে পরাক্রান্ত পুলিশ। মিছিল নিষিদ্ধ। মানুষের মুখ বন্ধ।
কোথায় গেল উড়ে গরিব মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার? নদী শিকস্তি চরের মানুষ, বাংলার গায়ের চাষী, খেতমজুর, গঞ্জ-বাজারের

৩৯
নিঃস্ব দোকানদাররা ভালাে করে বুঝে ওঠার সময় পেলেন না তাদের সর্বনাশ কী করে হলাে!
সাতচল্লিশ থেকে সত্তর। বাইশটি বছরের শেষ। বাইশটি হৃদয় নিংড়ানাে, জ্বালাময়ী, ব্যথাদীর্ণ ক্লেশময় বছর। অত্যাচার আর অন্যায়ের একটানা ইতিহাস এ কটি বছরে লেখা হয়েছে। | শেখ মুজিবুর রহমান বললেন, ‘সােনার বাংলা নিঃশেষ হয়ে গেছে। এ কটি বছরে। বাংলার ঘরে ঘরে আজ আর বাতি দেবার লােক নেই।
কারা এ দুর্দশার জন্যে দায়ী। তিন বছর আগে বেলুচিস্তানে দেখা হয়েছিল এক পাঠানের সঙ্গে, নিঃস্ব হয়ে সে জনমজুরি করছে কোয়েটার রাস্তায়। চাখানায় বসে জিজ্ঞেস করলাম ওকে ওর জীবনের কথা। প্রথমে ও কিছু বলতে চায়নি পুলিশের চরের ভয়ে। কোয়েটার বাজারে গুপ্তচর ঘুরে বেড়ায় প্রতিনিয়ত। আশ্বাস দিলাম পাঠান বন্ধুকে।‘ভয় নেই, নির্ভয়ে বলতে পার তুমি আমাকে সব কথা।
বেলুচরা সাধারণত সুপুরুষ। উন্নতদেহ এই মানুষগুলাে পাহাড় আর শুষ্ক কঠিন মাটির বুকে জীবনের জয়ধ্বজা উড়িয়ে বেঁচে থাকে।
বলাে সে তার দুঃখের পাঁচালি ।
কোয়েটা থেকে শ’খানেক মাইল দূরে তার এক খণ্ড জমি ছিল। ছােটো জমির ওপর নির্ভর করে স্ত্রী আর দুই ছেলেমেয়ে নিয়ে বেঁচে থাকা অসম্ভব। সেই ছােট্ট জমির অংশ একটু একটু করে সে বিক্রি করতে থাকে।
ক্ষুদ্র জমির অংশবিশেষ কেনার মানুষও তাহলে বেলুচিস্তানে আছে। ডিকেড অব প্রগ্রেস-এর কি অপূর্ব মহিমা। বেলুচ পাঠান এমনি করেই তার একমাত্র আশার শেষ সম্বলটুকু নিঃশেষ করে ফেলে একদিন। হাতের টাকা ফুরিয়ে যায়। তারপর একদিন রাতের অন্ধকারে সে পালিয়ে এসেছে তার গা ছেড়ে। প্রিয়জনদের পরিত্যাগ করে।
‘তােমার ছেলেমেয়ে আর স্ত্রীর খবর কী? ‘কিচ্ছু জানি না।’ ‘কতদিন ধরে তুমি কোয়েটার বাজারে কুলির কাজ করছাে?
৪০
‘ছ মাস।
এই ছ মাসে এই নিঃস্ব পাঠানের প্রিয়জনেরা কী করছে? সংসার ভেঙে গেছে তার চিরতরে। ইতিহাসে বলা হয়েছে আদিযুগের মানুষ প্রথম তার পরিবার পত্তন করেছিল। কোয়েটার বাজারের পাঠান কুলি তার পরিবার হারিয়ে ফেলেছে বেলুচিস্তানের পাহাড়ের অপর পাশে কোন অনুর্বর ভূমিতে।ফরিদপুর, রংপুর, পদ্মার ধারের মানুষ। চাঁদপুর আর নােয়াখালীর নি। লােকেরা তাদের গাঁয়ের বধূকে ফেলে পালাচ্ছে। কিন্তু যাবার কোনাে পথ নেই।
বেলুচ পাঠান আর পলিমাটির দেশের লােক আজ ভাবছে এ কোন দেশেতে জন্ম আমার? গল্প শুনে শেখ মুজিবের চোখ ছলছল করে উঠলাে। ‘এ জুলুমের শেষ হবেই।’
গােপালগঞ্জে যে যুগে কংগ্রেসি ছাত্ররা খদ্দরের সাদা টুপি মাথায় দিয়ে ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ শ্লোগান দিয়ে বেড়াতেন, সেই যুগে শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক জীবনের শুরু। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। কলকাতায় কংগ্রেস ট্রাম-বাস পুড়িয়ে অসহযােগ আন্দোলন করছে। গােপালগঞ্জের দেয়ালে দেয়ালে পােস্টার পড়েছে ‘বৃটিশ ভারত ছাড়াে। শেখ মুজিব তখন গােপালগঞ্জ মহকুমা মুসলিম লীগ ডিফেন্স কমিটির সেক্রেটারি। আর নির্বাচিত হয়েছেন অল ইণ্ডিয়া মুসলিম স্টুডেন্টস ফেডারেশনের কাউন্সিলর হিসেবে।
শেখ মুজিব সে যুগে বাংলার মধ্যবিত্ত মুসলিম ছাত্র আন্দোলনের সাথে গভীরভাবে জড়িত। এই যুগের ছাত্র আন্দোলনের বৈশিষ্ট্য ও প্রকৃতি থেকেই শেখ মুজিবের রাজনৈতিক চেতনাবােধের উন্মেষ। তখনকার বাংলার মুসলিম লীগের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য যেমন পেশাদার উকিল, মােক্তার, ডাক্তার, শিক্ষক, সাংবাদিক এগিয়ে এসেছিলেন বিভিন্ন জেলা ও মহকুমা শহরগুলাে থেকে। মধ্যবিত্ত মুক্তি আন্দোলনের পরমার্থ খোঁজার জন্যে, তেমনি তাদের ঘরের ছেলেরাই প্রধানত ছিলেন মুসলিম ছাত্র রাজনীতির পুরােধা।

৪১
নবাব সিরাজউদ্দৌলার নাম কলঙ্কিত করে বৃটিশ ঐতিহাসিকের কল্পনাপ্রসূত ব্ল্যাকহােল ট্র্যাজেডির স্বাক্ষরবহনকারী হলওয়েল মনুমেন্ট এককালে দাঁড়িয়েছিল ইংরেজ সাম্রাজ্যের দ্বিতীয় নগরী কলকাতার আপিসপাড়া ডালহৌসি স্কোয়ারের মােড়ে। বাংলার বিক্ষুব্ধ মুসলমান ছাত্রসমাজ একদিন সকালে লালদীঘির মােড়ে এসে জমায়েত হলেন।
পনেরাে ফুট চওড়া আর পনেরাে ফুট লম্বা একটি জায়গা কালাে লােহার শেকল দিয়ে ঘেরা। তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে হােয়াইট স্টোনে গড়া হলওয়েল মনুমেন্ট। এইখানেই নাকি ছােটো কুঠুরিতে বন্দি করে নবাব সিরাজউদ্দৌলার হুকুমে ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির কয়েক শ গােরা সৈন্যকে দম আটকে মেরে ফেলা হয়েছিল। ঘটনাটি সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত। উত্তরকালে প্রখ্যাত দেশীয় ঐতিহাসিকরা যুক্তি দিয়ে এই মিথ্যাকে অস্বীকার করেছেন। পরবর্তীকালের ইউরােপীয় ইতিহাসবিদরাও সন্দেহ প্রকাশ করেন ব্ল্যাকহােল ট্রাজেডির যৌক্তিকতা সম্পর্কে।
হলওয়েল মনুমেন্ট সেদিন শেষবারের মতাে দাঁড়িয়েছিল লালদীঘির মােড়ে। সমবেত ছাত্রের দল পাথর ভেঙে কলঙ্ক মুছে ফেলার জন্যে এগিয়ে গেলেন কর্ডনরত পুলিশের দিকে।
সেই মুহূর্তে সংগ্রামী মুসলিম ছাত্র জনতার জন্ম হলাে বাংলার বুকে। আরাে অনেকের সাথে গােপালগঞ্জ থেকে এসেছিলেন নবীন। ছাত্রকর্মী শেখ মুজিব। নিজের চোখে দেখলেন সংগ্রামের শুরু কী করে হলাে।
পাকিস্তান আন্দোলন মুসলমান ছাত্রসমাজের কাছে ছিল এক অগ্নিমন্ত্র- ছাত্রসমাজ মনে করতেন, এই আন্দোলনের দুটো দিক—যারা বঞ্চিত তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার এবং এই আন্দোলনই বৃটিশবিরােধী আন্দোলনের আরেক দিক। যুদ্ধোত্তর কলকাতার রাস্তায় রশীদ আলী দিবসে মুসলমান ছাত্ররা ওয়েলিংটন পার্কে বিক্ষোভ করলেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে। তাঁরা লাভবনে গেলেন বিরাট শােভাযাত্রা নিয়ে।
মুসলমান ছাত্রদের যে অংশ অপেক্ষাকৃত উদার আর প্রগতিশীল মনােভাব নিয়ে আন্দোলন করছিলেন, তাঁদের সাথে শরিক ছিলেন শেখ

৪২
মুজিব। মুসলিম লীগের রাজনৈতিক চিন্তাধারায় যাঁরা প্রগতির কথা বলতেন তাঁদের মধ্যে সাপ্তাহিক মিল্লাত গ্রুপের কর্মীরা ছিলেন অন্যতম। শেখ মুজিবকে এসময়ে দেখা যেতাে কলকাতার রাস্তার মােড়ে ‘মিল্লাত বিক্রি করছেন।
উনিশ শ’ ছেচল্লিশের নির্বাচনে মুসলিম লীগের জয়লাভ। উনিশ শ’ সাতচল্লিশের সিলেট রেফারেন্ডাম। বৃটিশের ভারত ত্যাগ। পাকিস্তানের জন্ম। মুসলিম লীগের অভ্যন্তরে এরপর কি করে প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের প্রভাব বৃদ্ধি এবং সম্পূর্ণভাবে ক্ষমতা দখল এসব কথা ঐতিহাসিকের দলিলে লিপিবদ্ধ রয়েছে।
ঢাকার সে যুগের কথা অনেকেরই মনে আছে। সবে পাকিস্তান হয়েছে। তখনও নবস্বাধীনতালব্ধ মানুষ নতুন জীবনে রঙিন স্বপ্ন দেখছেন। সেই সময় কিছুসংখ্যক ছাত্র উপলব্ধি করেছিলেন, এ পাকিস্তান তাে তারা চাননি। কোথায় গেলাে খেতমজুর, শ্রমিক, কৃষক, মধ্যবিত্তের মুক্তির দেশ পাকিস্তান। সেই যুগে প্রকাশ্যে গণতন্ত্রের মশাল জ্বালালেন মাত্র কয়েকজন ছাত্র।
পুরােনাে ঢাকার রক্ষণশীল মহল্লার একটি ছােটো ময়দানে সভা ডাকলেন ডেমােক্রেটিক ইয়ুথ লীগ। এই দলের প্রতিষ্ঠাতাদের মধ্যে একজন ছিলেন শেখ মুজিব। মহল্লার সাধারণ নাগরিকরা সভা ভেঙে দিল। সেদিন আর আজকের সময়ের ভেতর কত ব্যবধান। নাজিরাবাজার মহল্লার নাগরিকরা আজ তাে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের অগ্রগামী সৈনিক।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর প্রথম জেলে যান শেখ মুজিব। উনিশ শ’ আটচল্লিশের এগারােই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মিনিয়ালস স্ট্রাইক উপলক্ষ্য করে। এরপর শেখ মুজিবুর রহমান অনেকবারই জেলে গিয়েছেন।
শেখ মুজিবের সমালােচকরা অভিযােগ করেন যে এই জেলে যাওয়াই শেখ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের সম্বল।
এই ধরনের সমালােচনা অর্থহীন ও অপ্রিয়। শাসকের হাতে শেখ মুজিব দীর্ঘকাল নির্যাতিত হয়েছেন একথা অস্বীকার করা রাজনৈতিক

৪৩
প্রজ্ঞার লক্ষণ নয়। যেমন শেখ সাহেব নির্যাতিত হয়েছেন, তেমনি মওলানা ভাসানীও বন্দি হয়েছেন শাসনকর্তার বন্দিশালায়। তেমনি আরাে অনেক সৎ, আদর্শবান এবং মহান আত্মাকে পাকিস্তানের কয়েদখানায় লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়েছে গত বাইশ বছরে।
শেখ মুজিবুর রহমান আমাকে বললেন, ‘আমি বলেছিলাম জেলারকে-জুলুম করতে পারে আমার ওপর। কিন্তু আমাকে মারতে পারবে না কখনও।
বহুদিন আগে মিশন স্কুলের বারান্দায় যে ‘না’ শব্দটি প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, আজও দীর্ঘকাল পরে সেই শব্দেরই অনুরণন শুনলাম শেখ সাহেবের কথায়।
শেখ সাহেবের রাজনৈতিক জীবনের দুটো ভুল হচ্ছে— ১৯৫৪ এবং ১৯৫৬ সালে এই দুবার মন্ত্রীত্ব গ্রহণ করা। যে রাজনৈতিক চেতনার ফলে তিনি দীর্ঘকাল সংগ্রাম করে এসেছেন, সেই চেতনাই তাকে বলে দিতে পারতাে, এই সময় মন্ত্রিসভায় গিয়ে অন্তর্দ্বন্দ্বে মলিন ক্ষমতালােভী মঞ্চে উঠে বসা তার উচিত হয়নি। এখানেই উকিল আর মােক্তার পরিবেষ্টিত সঙ্কীর্ণ স্বার্থবাদী রাজনীতির শিকার হয়ে পড়েন। ঐ মন্ত্রিত্ব থেকে তিনি দেশকে কী দিয়েছেন?
আমরা যেখানে বসেছিলাম, জানালা দিয়ে ভােরের আলাে এসে পড়েছে ঘরের দেয়ালে। দেয়ালে উঁচু কোণে এখনও একটি ফ্রেমে বাঁধানাে ফটোগ্রাফ ঝুলছে। উনিশ’শ বায়ান্ন সালে পিকিং শান্তি সম্মেলনে তােলা সেই ছবিটি। চীনা নেতৃবৃন্দের সাথে হাত মেলানাে শেখ মুজিব।
শেখ সাহেব ছবিটির দিকে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘ভুল করলে সংশােধন করতে হবে। এগিয়ে যেতে হবে। দোস হু হেসিটেট উইল বি লস্ট ফর এভার।
১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধের সময় পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে যখন দুই দেশের সৈন্যদল আত্মঘাতী লড়াই শুরু করে দিয়েছিল, তখন পূর্ব পাকিস্তান বাহিরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।

৪৪
সাবেক জাতীয় পরিষদের সদস্য শাহ আজিজুর রহমান সেদিন লণ্ডনে। লণ্ডনের সান্ধ্য পত্রিকায় খবর বেরিয়েছে—ইণ্ডিয়া এ্যাটাকস পাকিস্তান। টিউব স্টেশনের মােড়ে হকাররা চীৎকার করে কাগজ বিক্রি করছে—গ্রেটেস্ট ট্যাংক ব্যাটল সিন্স এল-আলামীন।
লণ্ডন থেকে যেসব পূর্ব পাকিস্তানি নাগরিকরা দেশে ফিরছিলেন তাদেরকে বিমান থেকে নামিয়ে নেওয়া হলাে। নাে মাের ফ্লাইট টু ঢাকা। টেলিফোন, টেলিগ্রাফ ঢাকার সাথে সবরকম সংযােগ বন্ধ। শাহ আজিজুর রহমান সপ্তাহখানেক পর অর্ধেক দুনিয়া ঘুরে রেঙ্গুন হয়ে ঢাকায় পৌছলেন বােধহয় শেষ পর্যন্ত। যুদ্ধ চলাকালীন পুরাে সময়টা পূর্ব পাকিস্তান বাহিরের দুনিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। লণ্ডনের পাকিস্তান হাইকমিশনে পূর্ব পাকিস্তানিরা ভিড় করতেন প্রতিদিন দেশের খবর জানবার জন্য। প্রতিদিন সেই একই জবাব আসতাে হাইকমিশন থেকে—উই হ্যাভ নাে নিউজ ফ্রম ঢাকা। অজানা আশঙ্কায় উদ্বেলিত জনতা ফিরে যেতেন মৌনমুখে।
সেদিন পাকিস্তানের সবচাইতে বড় বন্ধুজন হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন যারা, তাদের কথা ভুলে যাওয়া উচিত হবে না। চীন তিনবার স্পষ্টভাষায় ভারতকে শাসিয়ে দিয়েছিল, ভারত যদি যুদ্ধবিস্তৃতি ঘটায় পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে, তাহলে বন্ধুরাষ্ট্রের সহযােগিতায় সর্বাগ্রে ছুটে আসবে তারা। ইরান পাকিস্তানকে পেট্রোল সরবরাহ করার পূর্ণ আশ্বাস দিয়েছিল। ইন্দোনেশিয়া তার যুদ্ধজাহাজ পাঠিয়ে দিয়েছিল ভারত মহাসাগরে টহল দেওয়ার জন্য। তুর্কি সাহায্য করতে এগিয়ে আসছিল সমরসজ্জা দিয়ে। এরাই ছিলেন সেদিনকার দুর্যোগের সাথি। কেউ এসেছিলেন ধর্মীয় ভ্রাতৃবন্ধনের টানে। আবার কেউ এসেছিলেন সকল দেশের মানুষের স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টাকে সর্বকালের জন্য অটুট রাখার দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে।
বাংলার ঘরে কিন্তু সেদিন মানুষের মন যেন নির্বাক হয়ে গিয়েছিল ক্ষণকালের জন্য। কোন এক আশ্চর্য জিজ্ঞাসায় মথিত হচ্ছিল বাংলার বাতাস। মানুষের প্রাণের ডাক পলিমাটির বুক থেকে নবাঙ্কুরের মতাে

৪৫
উদিত হচ্ছিল নীল আকাশের দিকে মাথা তুলে। গগনচুম্বী একটিমাত্র বাক্য জন্ম নেবার পূর্ব মুহূর্তে মৌনতার কুঁড়িতে লুকিয়েছিল শেষবারের মতাে।
নারায়ণগঞ্জের মাঠে ১৯৬৬ সনের জনসভা। ওপারে মােগরাপাড়া, সােনাকুণ্ডা, আরাে দূরের গা থেকে এসেছেন জনতা। নতুন কথা শােনার জন্য।
মঞ্চে দাঁড়িয়ে সারা দেশের উদ্দেশ্যে শেখ মুজিব ছুঁড়ে দিলেন আগুনের জ্বলন্ত ফুলকির মতাে একটি বাক্য। আমাদের বাঁচতে দাও। যেমন করে মশালের মুখ থেকে আগুন নিয়ে আরেকটি মশাল জ্বলে ওঠে। যেমন করে শব্দ বহু প্রতিধ্বনিত হয়ে জেগে ওঠে পাহাড়ের গায়ে প্রতিবিম্বিত হয়ে। যেমন করে শিশুর কলহাস্যে বাংলার উঠোন ভরে যায়। যেমন করে মায়ের বুকের গানে গাঁয়ের বাতাস চঞ্চল হয়, তেমনি করেই জন্ম হলাে এই একটি বাক্যের।
বাঁচার অধিকার আমাকে দিতে হবে। এ ধ্রুব বাক্যের সেদিন জন্ম হলে ইতিহাস মিথ্যে হয়ে যেতাে। ইতিহাসবেত্তারা বুঝবেন, সেদিন এ বাক্যের জন্মের জন্য অপেক্ষা করছিল দেশ। মাক্সিম গাের্কি যে জন্য মাদার লিখেছিলেন, জুলিয়াস ফুচিক যে জন্য ফাঁসির মঞ্চে প্রাণ দিয়েছিলেন, গার্সিয়া লােরকা স্পেনের জেগে ওঠার গান যে জন্য গেয়েছিলেন, যে জন্য বরকত ঢাকার রাস্তায় মৃত্যুহীন প্রাণ বিলিয়ে দিয়ে গিয়েছেন, যে জন্য চাটগাঁর রমেশ শীল কবিগান গাইতেন, জসীমউদ্দীন যে মায়ের কথা কবিতায় বলেন, তার অশ্রু ছুঁয়ে এই বাক্যের জন্ম হয়েছে।
পূর্ব পাকিস্তানকে বাঁচতে দাও।
একথা এর আগেও বলে গেছেন অনেকে। কিন্তু এমন জ্বালাময়ী করে এর আগে কেউ বলেননি। তাই ইসলামাবাদ থেকে গর্জে উঠলেন আইয়ুব খান।
“দি ল্যাংগুয়েজ অব ওয়েপেন উইল আনসার দি ডিমাণ্ডস অব দি শেখ। আইয়ুব বললেন, সারাদেশে আমি গৃহযুদ্ধের আগুন জ্বালিয়ে দেবাে।’
গভর্নর মােনায়েম খাঁ কালবিলম্ব না করে শেখকে বাদী করলেন।

৪৬
উনিশ শো ছেষট্টির সাতই জুন। ঢাকা, নারায়ণগঞ্জ, টঙ্গির রাস্তায় গুলি খেয়ে লুটিয়ে পড়ল শ্রমিকরা। সংগ্রামী জনতা বেয়ােনেটের সামনে প্রাণ দিতে এগিয়ে গেলেন।
লণ্ডনের প্রগতিশীল মাসিক পত্রিকা এশিয়ান টাইড ঢাকার রক্তাক্ত সাতই জুন সম্পর্কে লিখেছিলেন, আওয়ামী লীগ কোন রিভলুশনারি পার্টি নয়। কিন্তু আজ এই দল আইয়ুব সরকারের জুলুমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে এগিয়ে এসেছে এককভাবে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছেন এদের দাবির সমর্থনে দেশের জনসাধারণ। এদের সংগ্রামী চেতনাকে অস্বীকার করা রাজনৈতিক অদূরদর্শীতারই পরিচায়ক হবে। পাকিস্তানের বামপন্থীদলগুলাে যখন পােলেমিকসের দ্বন্দ্বে ব্ৰিত, আইয়ুবের বৈদেশিক নীতিতে তথাকথিত প্রগতিশীল লক্ষণকে সমর্থন করতে গিয়ে যখন তারা নির্বাক হয়ে আছেন, তখন আওয়ামী লীগের সংগ্রামী তৎপরতা বিশ্ববাসীর কাছে লক্ষণীয় হয়ে উঠেছে।
সে সময়কার এশিয়ান টাইড পত্রিকার এই মন্তব্য চিন্তা করে দেখার প্রয়ােজন রয়েছে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার এতবড়াে একটা ভাঁওতা কোন সরকার কখনও কোন দেশের ওপর চালিয়ে দিয়েছেন, এমন নিদর্শন দুনিয়ার ইতিহাসে কম।
নাৎসি জার্মানি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ লাগিয়েছিল এমনি ধরনের এক মিথ্যে ষড়যন্ত্র কেন্দ্র করে। জার্মানিতে যুদ্ধের পাঁয়তারা চলছিল হিটলার যেদিন বার্লিনে চান্সেলর হয়ে বসলেন, সেদিন থেকেই। তারপর উনিশ শ’ উনচল্লিশ এলাে। সময় হলাে প্রতিবেশী দেশ পােল্যান্ড আক্রমণ করার।
জার্মান-পােলিশ সীমান্তে ছিল জার্মানির একটি ছােটো রেডিওস্টেশন। জার্মানির বন্দিশালা থেকে কয়েকজন কয়েদীকে গুলি করে মেরে ফেলা হলাে। তারপর তাদের পরিয়ে দেওয়া হলাে পােলিশ সৈন্যদের ইউনিফর্ম। এবারের মৃত বন্দিদের নিয়ে গিয়ে সীমান্তের কাটাতারের পাশে বিক্ষিপ্তভাবে ফেলে রাখা হলাে।

৪৭
ভাের না হতেই বার্লিন রেডিও থেকে দুনিয়ার সামনে ঘােষণা করা হয়-পােল্যান্ডের সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে জার্মান সীমান্ত অতিক্রম করে একটি বেতার কেন্দ্র আক্রমণ করেছে। এ অপমান জার্মানি সহ্য করতে পারে না। সুতরাং যুদ্ধ। দলে দলে ফটোগ্রাফার গিয়ে বিক্ষিপ্ত মৃতদেহের ছবি তুলে নিয়ে ছাপালাে জার্মানির কাগজ। পরদিন তেসরা সেপ্টেম্বর জার্মান বাহিনী সীমান্ত অতিক্রম করে পােল্যাণ্ড আক্রমণ করে। মিথ্যে অপমানের প্রতিশােধ নিতে হিটলার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ শুরু করেছিলেন।
এমনি ধরনের মিথ্যে সাজানাে মামলা আগরতলার ষড়যন্ত্র। শেখ মুজিবকে পঁচিশ বছর জেলে থাকতে হবে। পল্টনের মাঠে আর কখনও তাঁকে আসতে হবে না। শাসিয়েছিলেন সেদিনকার রক্তচক্ষু শাসকরা। কেন শেখ মুজিব তাঁদের একমাত্র দুশমন হয়ে দাঁড়ালেন? বাইশ বছর ধরে যাঁরা চক্রান্তের জাল বুনেছেন তারা আর শেখকে সহ্য করতে পারছিলেন না।
এর আগেই শেখের বিরুদ্ধে তেরােটি মামলা আনা হয়েছিল। আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়া তাঁর অপরাধ। শেখ মুজিব নিজেই এই মামলাগুলাে সম্পর্কে বলেছেন, ১৯৬৬ সালের এপ্রিল মাসে প্রথমে আমাকে যশােরে গ্রেপ্তার করা হয়। খুলনার এক জনসভায় বক্তৃতা দেয়ার পর যশাের হয়ে আমি ঢাকা ফিরছিলাম। যশােরে পুলিশ এলাে। আপত্তিকর বক্তৃতা দেয়ার অভিযােগে ঢাকা থেকে প্রদত্ত এক পরােয়ানা দেখিয়ে আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়।’
এই উপাখ্যানের শেষ এখানেই নয়।
শেখ সাহেব বলে যান, যশােরের মহকুমা হাকিমের সামনে আমাকে হাজির করা হয়। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেন। আমি ঢাকায় ফিরে এলে সদর মহকুমা হাকিম আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করেন। কিন্তু ঐ দিনই মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করায় আমি মুক্তি পাই। সন্ধে সাতটায় আমি বাড়ি পৌঁছেই। কিন্তু বিড়ম্বনার শেষ এখানে নয়। এক ঘণ্টা পর রাত আটটায় পুলিশ আরেকটি গ্রেপ্তারি পরােয়ানা নিয়ে আমার বাড়িতে গিয়ে উপস্থিত’, শেখ মুজিবুর রহমান বলতে

৪৮
থাকেন, ‘সিলেটে আপত্তিকর বক্তৃতা দেওয়ার অভিযােগে এই পরােয়ানা সেখান থেকে দেয়া হয়েছে। গ্রেপ্তার করে সেই রাতেই পুলিশ প্রহরাধীনে আমাকে সিলেটে নিয়ে যাওয়া হয়। পরদিন সকালে সিলেটের মহকুমা হাকিম আমার জামিনের আবেদন প্রত্যাখ্যান করে আমাকে হাজতে পাঠিয়ে দেন। এরপর দিন সিলেটের মাননীয় দায়রা জজ আমার জামিন মঞ্জুর করেন, আমি মুক্তি পাই।’ এ যেন রহস্যরােমাঞ্চ সিরিজের গােয়েন্দা কাহিনি। যুক্তিতর্কের অতীত চরম বিবেকহীনতার এক সুদীর্ঘ বিরতিহীন বর্ণনার মতাে শােনায় শেখ মুজিবুর রহমানের মুখের কথাগুলাে।
তিনি বলে যান, সিলেটের জেলগেটে এক নতুন পরােয়ানা বলে আমাকে আবার গ্রেপ্তার করা হয়। মােমেনশাহীর কোন জনসভায় আপত্তিকর বক্তৃতা নাকি আমি দিয়েছিলাম। সেদিন রাতেই পুলিশের পাহারায় আমাকে সিলেট থেকে মােমেনশাহী নিয়ে যাওয়া হয়।
শুরু হয় সেই পরিচিত ঘটনাগুলাের পুনরাবৃত্তি।
শেষে ১৯৬৬ সালের ৮ই মে নারায়ণগঞ্জের এক জনসভা থেকে রাতে ফিরে এলে ঢাকার পুলিশ শেখ মুজিবর রহমানকে দেশ রক্ষা আইনে গ্রেপ্তার করে।
আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার প্রথম অধ্যায়ের শুরু সেই রাতেই।
ফজলে লােহানী ১১ই জানুয়ারি ১৯৭০ থেকে ২রা ফেব্রুয়ারি ১৯৭০

৪৯
ধানমন্ডির বাসভবনে সংবাদ সম্মেলন
‘আমি তাে সবসময়েই এই শ্লোগান উচ্চারণ করি। আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় কলেমা উচ্চারণের সঙ্গে ‘জয় বাংলা’ এই শ্লোগানও বলব।

৫১
মুজিব ইয়াহিয়ার তৃতীয় দফা বৈঠক কোনােরকম পরামর্শদাতা ছাড়াই হয়ে গেছে। ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে উপস্থিত সাংবাদিকদের এ-মর্মে বলা হলাে যে, এরপর উভয় পক্ষের পরামর্শদাতারা বিভিন্ন প্রশ্নের ব্যাখ্যা নির্ণয়ের লক্ষ্যে কয়েকবার মিলিত হবেন। শেষ পর্যায়ে মুজিব এবং ইয়াহিয়া স্ব-স্ব প্রতিনিধিদের নিয়ে একই টেবিলে মুখােমুখি আলােচনা করবেন। এই প্রেক্ষিতে ৩২ নম্বর ধানমন্ডিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনের আয়ােজন করা হয়।
প্রশ্ন : এ থেকেই আমরা কি ধরে নিতে পারি যে, আলােচনায় উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি হয়েছে?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি সবসময়েই শুভ পরিণামের জন্য আশাবাদী। কিন্তু সবচেয়ে খারাপের জন্য প্রস্তুত হই।
প্রশ্ন : বিশেষ কোনাে ফর্মুলা সম্পর্কে আপনাদের দু’জনের মধ্যে আলােচনা হয়েছে কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা কী ‘ফমূলা দেয়, সেটা নিয়ে দু’পক্ষের পরামর্শদাতারা আলাপ আলােচনা করবেন।
প্রশ্ন : আপনি কি পশ্চিম পাকিস্তানের কোনাে নেতাকে সাদরে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত রয়েছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার বাসায় আমি পশ্চিম পাকিস্তানের যে-কোনাে নেতাকে অভ্যর্থনা জানাতে পারলে খুশি হবাে। আমি তাঁদের আমন্ত্রণ জানাচ্ছি-এখানে আসুন এবং আমার সঙ্গে আলােচনা করুন।

৫২
প্রশ্ন : প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনার সময় কোনাে দলিলের কথা ঘােষিত হয়েছিল কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : আজ সন্ধ্যায় আমার পরামর্শদাতারা ওদের সঙ্গে বৈঠকে ঠিক করবেন, কোন ফর্মুলার ভিত্তিতে এবং কীভাবে আলােচনার অগ্রগতি হবে।
প্রশ্ন : আজ সকালে আলােচনার সময় আপনার কোনাে পরামর্শদাতা হাজির ছিল কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : কোনাে পক্ষেই পরামর্শদাতা ছিল না।
প্রশ্ন : আপনি কি জুলফিকার আলি ভুট্টোর সঙ্গে কথাবার্তা বলতে রাজি আছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : ভুট্টোর সঙ্গে কথা বলতে আমার কোনােই আপত্তি নাই। আমার দরজা খােলা আছে। কোনাে সময়েই আমার। দরজা বন্ধ ছিল না। প্রশ্ন : তা হলে মােদ্দা কথায় আপনার সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলােচনার অগ্রগতি কতদূর হয়েছে? শেখ মুজিবুর রহমান : আমার আর কিছুই বলার নেই। আপনারা আন্দাজ করে নিতে পারেন। প্রশ্ন : আগামীকাল কি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আপনার শেষ রাউন্ডের কথাবার্তা হবে?
শেখ মুজিবুর রহমান : এটা তাে আমি বলতে পারি না।
প্রশ্ন : আগামীকালের বৈঠকে ইয়াহিয়ার সঙ্গে পরামর্শদাতা হিসাবে কারা কারা থাকবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : তা আমি জানি না।
প্রশ্ন : আপনি যখন আজ প্রেসিডেন্ট ভবন থেকে বেরিয়ে আসছিলেন, তখন ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান দিয়েছিলেন কেন? এটা কোনাে আশার ইঙ্গিত বহন করে?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি তাে সবসময়েই এই শ্লোগান উচ্চারণ করি। আমি জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করার সময় কলেমা উচ্চারণের সঙ্গে এই শ্লোগানও বলব।

৫৩
প্রশ্ন : আলােচনার অগ্রগতি সম্পর্কে আপনি কখন সাংবাদিকদের বিস্তারিত জানাবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : অপেক্ষা করুন। ইতােমধ্যে আমাদের দেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভােগ করুন। এর পাশাপাশি এদেশের দুর্ভাগা জনগণকে জানতে চেষ্টা করুন।
প্রশ্ন : কখন আপনার শেষ হাসি দেখতে পাব?
শেখ মুজিবুর রহমান : (স্মিত হাসি দিয়ে) এর উত্তর দেয়া বেশ কঠিন। আপনারাই আন্দাজ করুন।

৫৫
ভুট্টো একটা মিথুক

যা কিছু ঘটেছে সবকিছুর জন্য ইয়াহিয়াকে দায়ী করল ভুট্টো, যদিও আমি জানতাম যে সব কিছুর পেছনে সে ছিল। সে আসলে চেয়েছিল পূর্বাঞ্চল নিজের পথে চলুক, যাতে করে বাকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সে হতে পারে। ভুট্টো সরাসরি মূল প্রসঙ্গে এলাে।

৫৭
বাংলাদেশ-যুদ্ধ দিল্লি-ইসলামাবাদ কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করেছিল। (ভারতের) কাউকে পাকিস্তানে যেতে হলে তাই সুইস দূতাবাসের মাধ্যমে যেতে হতাে। আগে ভুট্টোর সঙ্গে আমার অনেকবার দেখা হয়েছে। তাই ভুট্টোকেই অনুরােধ পাঠালাম। আমার ভিসা আবেদনের] জবাব দ্রুত এলাে। প্রথমে ভুট্টোর সঙ্গে দেখা করলাম। এই সেই কথােপকথন, যা আমি টেপে রেকর্ড করি।
কুলদীপ নায়ার জুলফিকার আলী ভুট্টো : ২৩শে ডিসেম্বর আমরা [ভুট্টো ও শেখ মুজিবুর রহমান] প্রথম বসি। মুজিব কোরআন বের করে বললেন, “আমি খাঁটি মুসলমান। আমি এখনাে চাই দুই অঞ্চলের মধ্যে প্রতিরক্ষা, পররাষ্ট্র ও যােগাযােগব্যবস্থা কেন্দ্রীয় বিষয় থাকুক।’ ২৭শে ডিসেম্বর যখন আমরা দ্বিতীয়বারের মতাে বসি, তখন কিন্তু তিনি খুবই ভাসা ভাসা । তিনি বললেন, কয়টা এবং কোন কোন বিষয় কেন্দ্রকে দেওয়া হবে, আমি বলতে পারব না; তবে আমি সম্পর্ক বজায় রাখতে চাই। আমি ভুট্টো] সংশয়ী। মুজিবকে বললাম, বুঝতে পারছেন, এখানে এই কথা বলছেন আর আপনার কথাই আমি সত্য বলে ধরে নিলাম; কিন্তু আপনি যখন সেখানে যাবেন, অবস্থাটা দেখবেন, দেখবেন আপনার চারপাশে রাইফেলধারী সব যুবক। কবর থেকে ফিরে গিয়ে তখন আর এটা করতে পারবেন না। তবে আপনি যদি কোনাে ধরনের কাল্পনিক সম্পর্ক বজায় রাখেন, আমি তুষ্ট হব।
তিনি [শেখ] কিন্তু নিশ্চিত। না, না, তিনি বললেন, “আমিই নেতা-ম্যায় লিডার হু, ম্যায় ঠিক কর দুঙ্গা [আমি লিডার, আমি ঠিক করে দেবাে)’, এ ধরনের কথা। তবে জানেন, আমি তাকে পছন্দ করি। ব্যাপার হলাে, এত এত সমস্যা। মনে হয় না তার অর্ধেকের জন্যও তিনি দর-কষাকষি করেছেন।

৫৮
শেখের ভাষ্য কিন্তু ভিন্ন, ভুট্টোর পরই আমি তাঁরটা রেকর্ড করি ।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার খােদাভীরু কারাপালের কাছ থেকে আগেই আমি জানতে পেরেছিলাম যে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে গেছে।
তাই জেল থেকে যখন আমাকে সরানাে হলাে, তখন আমার সন্দেহ হয়েছিল যে নিশ্চয়ই আলােচনা অনুষ্ঠানের উদ্দেশ্যেই এটা করা হয়েছে। ভাবলাম বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার খবরটি যে আমি আগেই জানি, তেমন কোনাে আভাস আমি দেব না।ডাকবাংলােয় আসার কয়েক দিনের মধ্যেই এক বিকেলে ভুট্টো এসে হাজির। আমি তাকে বললাম, ভূট্টো, তুমি এখানে কী করে? সে বলল, ‘আমিই পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট। আমি হাসতে হাসতে বললাম, তুমি, ভুট্টো, পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট! ওই পদটা তাে আমার। তুমি জানাে পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন আমি জিতেছি।
সে যেন আমাকে ভয় দেখাতে চাইল। বলল, প্রধান সামরিক আইন প্রশাসকও সে। ভুট্টো বলল, আমি আপনার সঙ্গে আলােচনা করতে এসেছি।’ এই কথায় আমার উত্তর ছিল, আমি মুক্ত, এই কথা সে [ভুট্টো] না বলা পর্যন্ত কোনাে কথা আমি বলব না। সে বলল, হ্যা [আপনি মুক্ত]। তারপর আমরা আলােচনা করি।

৫৯
যা কিছু ঘটেছে সব কিছুর জন্য ইয়াহিয়াকে দায়ী করল ভুট্টো, যদিও আমি জানতাম যে সব কিছুর পেছনে সে ছিল। সে আসলে চেয়েছিল পূর্বাঞ্চল নিজের পথে চলুক, যাতে করে বাকি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট সে হতে পারে। ভুট্টো সরাসরি মূল প্রসঙ্গে এলাে।
পররাষ্ট্র, প্রতিরক্ষা ও যােগাযােগ-এই তিনটি বিষয় বাংলাদেশ ও পাকিস্তান যৌথভাবে ব্যবস্থাপনা করবে, আমি যেন তাতে রাজি হই, এই সে চেয়েছিল। তাকে বললাম-সম্ভব না। এর পরও যখন পীড়াপীড়ি করতে লাগল তখন বললাম, আমার লােকজনের সাথে আলােচনা না করে কোনাে সিদ্ধান্ত নেওয়া তাে আমার পক্ষে কঠিন। আরেক দফা। বৈঠক হলাে, আমাদের মধ্যে শেষ বৈঠক। সেবারও একই বিষয় নিয়ে সে পীড়াপীড়ি করতে লাগল এবং আমার সর্বোচ্চটা করতে বলল। জবাবে বললাম-দেখা যাক।
ভুট্টো কী বলেছেন, বিশেষ করে কিছু বিষয় যৌথ নিয়ন্ত্রণে থাকবে বলে কোরআন নিয়ে মুজিব শপথ করেছেন বলে ভুট্টো যে দাবি করেছেন-আমি (কুলদীপ নায়ার] মুজিবকে যখন এসব বললাম, মুজিব বললেন, ‘ভুট্টো একটা মিথুক। জীবন বাঁচানাের জন্য তার প্রতি আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু তাই বলে মিথ্যা রটানাের কোনাে অধিকার তাকে দেওয়া হয়নি।’
দুজনের ব্যক্তিত্বের মতােই ভিন্ন তাঁদের ভাষ্য। ভুট্টো জাঁকালাে, পরিপাটি, অস্থির; মুজিব চাপা, সরল, খােলামেলা। প্রথমজন স্ববিরােধী আর দ্বিতীয়জন অটল ও নির্ভরশীল।
দুজনের কথা থেকে একটি জিনিস অন্তত বেরিয়ে আসে। ১৯৭২ সালের ৮ জানুয়ারি মুজিবকে নিঃশর্ত মুক্তি দেওয়া হয়। তাঁকে অনুরােধ করা হয়, যেকোনাে আরবদেশ হয়ে ঢাকা, দিল্লি বা যেখানে ইচ্ছা তিনি যেতে পারেন। তবে নয়াদিল্লি হয়ে ঢাকা ফেরার আগে তিনি লন্ডন যাওয়াটাই পছন্দ করেন।
মুজিব-ভুট্টো আলােচনার পর ভুট্টো ও কামাল হােসেন, পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এ দুজনের মধ্যে একটি সম্পূরক সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় বলে প্রকাশ। মুজিবকে ছেড়ে দেওয়ার পর তাঁকেও পশ্চিম পাকিস্তানের একটি জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হয়। কামাল হােসেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের সংযােগ বিষয়ে মুজিবের জন্য একটি বার্তা বহন করছিলেন বলে কথিত আছে ।

৬০
খবরটি ছড়ায় ইসলামাবাদ। কিন্তু আমি মুজিবের সঙ্গে ঢাকায় যখন দেখা করি, তিনি বলেন এটি সত্য না।
‘অনর্থক একটি বুলবুলিকে আমি অক্ষত চলে যেতে দিই,’ আমাকে এভাবে বললেও মুজিবকে ছেড়ে দেওয়ার পেছনে ভুট্টোর উদ্দেশ্য ছিল, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের চোখে সামান্য হলেও পাকিস্তানের ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধার, আত্মসমর্পণের পূর্বে শত শত বুদ্ধিজীবী হত্যা করে ইসলামাবাদ সেনাবাহিনী যা চুরমার করে দিয়েছিল। তিন মাস পর ভুট্টো আমাকে বলেন, ভারতের প্রতি সদিচ্ছার নিদর্শনস্বরূপ মুজিবকে তিনি ছেড়ে দেন; তিনি জানতেন মুজিব ব্যতীত ভারতের বাংলাদেশে টেকা কঠিন হবে।
মুজিবের মুক্তি মানে কিন্তু এই না যে পাকিস্তানের বাংলাদেশ নীতিতে কোনাে ধরনের পরিবর্তন। যেন কোনাে যুদ্ধই হয়নি বা বাংলাদেশও স্বাধীন হয়নি-এমনভাবেই চলতে থাকল ইসলামাবাদ। ইয়াহিয়ার ভাষাতেই কথা বলতে থাকলেন ভুট্টো। প্রেসিডেন্ট হিসেবে তাঁর প্রথম বেতার বক্তব্যে (২০ ডিসেম্বর ১৯৭১) তিনি বললেন, পাকিস্তানের ঐক্য-সংহতি ও মর্যাদা রক্ষার লড়াই আমরা চালিয়ে যাব। পূর্ব পাকিস্তান পাকিস্তানের অবিভাজ্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ।’ রেডিও পাকিস্তানও গল্পটা জারি রেখেছিল, শুধু পশ্চিম পাকিস্তানের সময় জানিয়েই তারা দৈনিক সম্প্রচার শুরু করত না; বরং পূর্ব পাকিস্তানের সময় ঘােষণাও তারা অব্যাহত রাখে। পশ্চিম পাকিস্তানের যেসব কাগজের ঢাকা থেকে সংস্করণ হতাে, সেগুলােও অব্যাহতভাবে তাদের মাস্ট হেডে দাবি করতে থাকল যে একযােগে পূর্ব পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত।
যখনই পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসার কথা বলত রাওয়ালপিন্ডি, তাতে যােগ দেওয়া সদস্যদের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতির কথাও কষ্ট করে উল্লেখ করত। প্রধানমন্ত্রী মিসেস গান্ধী ও ভুট্টোর মধ্যে সিমলা সম্মেলনের পরই শুধু পাকিস্তান বদলায়।

৬১
বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার পর। লন্ডনে প্রথম সংবাদ সম্মেলন
‘আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যেতে আমি আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। বাংলাদেশের জনগণের মতাে এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং স্বাধীনতার জন্যে এত চরম মূল্য আর কোনাে জাতি দেয়নি। আমি আগামীকাল বা পরশু আমার দেশে ফিরে যাব। জয় বাংলা।

৬৩

(পাকিস্তান কারাগার থেকে মুক্তি পেয়ে মুক্ত মুজিব সেদিন ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালে রাওয়ালপিন্ডি ত্যাগ করেন, ঐদিন কেউ জানতেন না যে, মুজিবকে নিয়ে পাকিস্তানের বিশেষ বিমানটির গন্তব্য কোথায়। বাঙালির অবিসংবাদিত নেতা সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যেন মুক্ত বাতাসে প্রথম নিঃশ্বাসটি নিলেন অজানার উদ্দেশে পাড়ি জমিয়ে।
রাওয়ালপিন্ডিতে তখন ঘড়ির কাঁটার সময় রাত ভাের হচ্ছে প্রায়। শেখ মুজিবের জন্য পাকিস্তান সরকার ভাড়া করেছিল পিআইএ’র একটি বিশেষ বিমান। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলি ভুট্টো ভাের রাত তিনটায় শেখ মুজিবকে বিদায় জানানাের পরমুহুর্তেই আকাশে উড়ে যায় বিমান। রাওয়ালপিন্ডি বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের কাছে ভুট্টো তাৎক্ষণিকভাবে মন্তব্য করলেন, “পাখি উড়ে গেল।”
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে বিমানটি কোথায় যাচ্ছে তা না জানার আরেকটি কারণ শেখ মুজিব নিজেই। তিনি কর্মকর্তাদের কাছে এরকম মনােভাব পােষণ করেছিলেন যে, তিনি কোথায় যাচ্ছেন তা না জানানােই উচিত হবে। গন্তব্যে পৌছেই তিনি এ ব্যাপারে ঘােষণা দেবেন।
৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ সালের ঐদিন সকালে শেখ মুজিবকে বহনকারী বিমানটি লন্ডনের হিথরাে বিমানবন্দরে অবতরণ করে। নবজাত রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানকে বরণ করতে ভিআইপি লাউঞ্জে ছুটে আসেন ব্রিটেনের পররাষ্ট্র ও কমনওয়েলথ অফিসের পদস্থ কর্মকর্তারা। কিন্তু ঐখানেও শেখ মুজিব রহস্যের জাল বিস্তার করেন। কর্মকর্তাদের কাছে এখানেও তিনি তাঁর ভবিষ্যৎ গন্তব্য সম্পর্কে টু শব্দটি করেননি। সকলের প্রতি তাঁর অভিবাদন, সম্ভাষণ, শুভেচ্ছা বিনিময় সবকিছু একটি উচ্চারণেই সীমিত ছিল। বিমানবন্দরের গ্যাংওয়েতে মুজিব যখন পা রাখেন, তখন তাঁর চোখে-মুখে আনন্দাশ্রু, মুখে একটিই সম্ভাষণ “জয় বাংলা” ।)

৬৪
পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তির পর সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান, ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ লন্ডন। প্রথম সংবাদ সম্মেলন ৮ই জানুয়ারি ১৯৭২ সকাল। লােকে লােকারণ্য হয়ে গেছে লন্ডনের ক্লারিজেস হােটেলের বলরুম। অথচ অনুষ্ঠানটি সংবাদ সম্মেলন। বক্তব্য রাখবেন সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের জাতির পিতা সদ্যকারামুক্ত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। জড়াে হয়েছেন তাবৎ সাংবাদিক। কিন্তু খ্যাতনামা সাংবাদিকদের ছাপিয়ে এখানে ভিড় করছিলেন হাজারাে প্রবাসী বাঙালি তাদের প্রিয় নেতাকে এক নজর দেখতে। ক্যামেরার ক্লিক ক্লিক শব্দে কান ঝালাপালা হয়ে যাবার অবস্থা। টেলিভিশনক্যামেরার লাইটগুলাে ক্ষণে-ক্ষণে পরিবেশকে অত্যুজ্জ্বল করে তুলছে।
সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিব উপস্থিত হয়েছিলেন ২০ মিনিট দেরিতে। বাংলাদেশের কর্মকর্তারা সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, শেখ মুজিব কারান্তরালে তাঁর ৪২ পাউন্ড ওজন হারিয়েছেন। কিন্তু তাঁর শরীরের ক্লান্তিকে মুছে দিয়েছে মুক্তির উচ্ছাস।
বলরুমে ঢুকেই তিনি সাংবাদিকদের সম্ভাষণ করেন, “জয় বাংলা। আজ আমি মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে অর্জিত স্বাধীনতার আনন্দকে বরণ করছি পরম গৌরবের সঙ্গে। আমি স্বাধীনতার যুদ্ধে লাখ লাখ শহিদের পবিত্র স্মৃতির প্রতি আমার শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।”

৬৫
গাঢ় রঙের টিউনিক স্টাইল স্যুট পরিহিত শেখ মুজিবকে সংবাদ সম্মেলনে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা, একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের মুক্ত জনগণের মুক্ত রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। সাংবাদিক জেমস মারগ্যাচ লিখেছেন, ৫১ বছর বয়সী বঙ্গপিতার মধ্যে কোনাে অসুস্থতার চিহ্ন ছিল না। তাঁর দরাজ কণ্ঠ সবাইকে ছাপিয়ে বিমােহিত করেছিল সবাইকে। সংবাদ সম্মেলনে শেখ মুজিবের সঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নোত্তরের বিবরণ
প্রশ্ন : আপনি ঢাকার পরিবর্তে কেন লন্ডনে এলেন? | শেখ মুজিবুর রহমান : আমি বন্দি ছিলাম। এটি পাকিস্তান সরকারের ইচ্ছে, আমার নয়। আমি এখানে কতক্ষণ থাকব তা জানি না । তবে লন্ডন ত্যাগের আগে আমি ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে দেখা করার আশা করছি।
প্রশ্ন : পাকিস্তানের সঙ্গে ভবিষ্যৎ সম্পর্ক কেমন হবে?
শেখ মুজিবুর রহমান : ভুট্টো আমাকে বলেছিলেন, আমি যেন পাকিস্তান ও বাংলাদেশের মধ্যকার সম্পর্কের বিষয়টি বিবেচনা করি । আমি তাকে বলেছি, আমার দেশের জনগণের কাছে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত কিছু বলতে পারব না। প্রশ্ন : পাকিস্তানিদের নির্যাতনের ব্যাপারে তাদের আপনি কীভাবে অভিযুক্ত করবেন? শেখ মুজিবুর রহমান : পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন অত্যাচার-নির্যাতনে রুদ্ধ করতে চেয়েছে, তারা প্রত্যেকে গণহত্যার দায়ে অভিযুক্ত। পাকিস্তান অত্যন্ত জঘন্য খেলা খেলছে। গণহত্যার দায়ে তাদের বিচারের সম্মুখীন হতে হবে। আজ যদি হিটলার বেঁচে থাকতেন তা হলে তিনিও লজ্জা পেতেন।
প্রশ্ন : ভুট্টো সম্পর্কে মন্তব্য করুন।
শেখ মুজিবুর রহমান : এখন আমার জনগণ স্বাধীন। পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে আমার বলার কিছু নেই। তাদের আচরণের ব্যাপারে আর কী বলতে পারি? সৈন্যরা যখন আমাকে গ্রেপ্তার করেছে তখন আমার ছেলেমেয়েদেরও গ্রেপ্তার করে অন্তরীণ করেছে, আমার বাড়ি জ্বালিয়েছে। আমি ভুট্টোর সাফল্য এবং তার কল্যাণ কামনা করি।

৬৬
প্রশ্ন : যুদ্ধকালীন আন্তর্জাতিক ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে আপনার মন্তব্য কী?
শেখ মুজিবুর রহমান : বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত, সােভিয়েত ইউনিয়ন, পােল্যান্ড, গ্রেট ব্রিটেন ও ফ্রান্সের অবদানের জন্য আমার শুভেচ্ছা জানাই। শুভেচ্ছা জানাই যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের সকল স্বাধীনতাপ্রিয় জনগণের প্রতি। আমি গােটা বিশ্বের প্রতি বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের আহ্বান জানাই। আশা করি আমরা শিগগিরই জাতিসংঘে অন্তর্ভুক্ত হবাে। আমি বিশ্বের অনেক মানুষের প্রতি আমার লাখ লাখ ক্ষুধার্ত, অনাহারী মানুষকে বাঁচানাের আবেদন জানাই। বাংলাদেশ কয়েকশাে বছর ধরে শােষণ-বঞ্চনার শিকার। এজন্য ব্রিটেনও অনেকাংশে দায়ী। যদিও ব্রিটিশ সরকারের সঙ্গে ব্যক্তিগতভাবে আমার সুসম্পর্ক বিদ্যমান।
প্রশ্ন : আপনাকে জেলখানায় শারীরিকভাবে কোনােপ্রকার নির্যাতন বা খারাপ ব্যবহার করা হয়েছে?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমাকে রাখা হয়েছিল বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন এক জনমানবহীন কারাগারে। তা-ও সাধারণ কোনাে সেলে নয়, ফাঁসিতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত কয়েদীদের সেলে। কোনাে দর্শনার্থী নেই, কোনাে চিঠি নেই, বাইরের বিশ্বের সঙ্গে কোনাে যােগাযােগ নেই। আমাকে নিয়ে বিচারের আনুষ্ঠানিকতা ছিল একজন বেসামরিক নাগরিকের কোর্ট মার্শালের মতাে। আমি এখন মুক্ত মানব, কিন্তু বাইরের দুনিয়ার সঙ্গে আমার যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। আমাকে যখন জেলে নিয়ে যাওয়া হয় তখন আমি জানি না আমি মরব কি বাঁচব। কিন্তু এটা জানতাম বাংলাদেশ স্বাধীন হবেই। ঐ বিচারের প্রহসন যদি এখন চলে তা হলেও আমি মানসিকভাবে মরতে প্রস্তুত।
প্রশ্ন : ভারতের সঙ্গে পাকিস্তানের যে সংঘাত তাতে পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থনকে আপনি কীভাবে দেখেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : (কিছুক্ষণ চিন্তাক্লিষ্ট থেকে) আমি এখনও বন্দিদশায়। জানি না এরপর কী ঘটতে যাচ্ছে। আমি যখন ঢাকা ফিরে যাব তখন আমার জনগণের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলাপ করতে হবে।

৬৭
প্রশ্ন : পত্রপত্রিকার খবরে জানা গেছে, বাংলাদেশ সরকার ব্যাংক, বীমা ও বৈদেশিক বাণিজ্য জাতীয়করণ করতে যাচ্ছে-এ ব্যাপারে আপনার বক্তব্য কী?
শেখ মুজিবুর রহমান : এসব বিষয় আওয়ামী লীগের ইশতাহারে অন্তর্ভুক্ত ছিল যার ভিত্তিতে আওয়ামী লীগ ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে। আমার সহযােগীরা বাংলাদেশে যা করছে আমি সে ব্যাপারে অত্যন্ত আস্থাবান। আমি যে কোনােভাবেই আমার স্বাধীনতাকে আবার হারাচ্ছি না। এজন্যে আমি যে কারও সঙ্গে সহযােগিতা করতে রাজি আছি ।
ইতিমধ্যে শেখ মুজিব অধৈর্য হয়ে উঠছিলেন। এক পর্যায়ে তিনি ঘােষণা করলেন, “আমার দেশের মানুষের কাছে ফিরে যেতে আমি আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা করতে পারছি না। বাংলাদেশের জনগণের মতাে এত দুঃখ-কষ্ট সহ্য করা এবং স্বাধীনতার জন্যে এত চরম মূল্য আর কোনাে জাতি দেয়নি। আমি আগামীকাল বা পরশু আমার দেশে ফিরে যাব। জয় বাংলা।”
দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক পূর্বদেশ, ৯ই জানুয়ারি ১৯৭২

৬৯
প্রােগ্রাম ইন বাংলাদেশ
‘আমি ভেবেছি, এইই শেষ। কিন্তু আমার মনের কথা ছিল : আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোন কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালাে। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোন হানি না ঘটে।

৭১
ডেভিড ফ্রস্ট : সে রাতের কথা আপনি বলুন। সেই রাত, যে রাতে একদিকে আপনার সঙ্গে যখন চলছিল আলােচনা এবং যখন সেই আলােচনার আড়ালে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনী আক্রমণে ঝাঁপিয়ে পড়ার উদ্যোগ নিচ্ছিল, সেই রাতের কথা বলুন। সেই ২৫শে মার্চ, রাত আটটা। আপনি আপনার বাড়িতে ছিলেন। সেই বাড়িতেই পাকিস্তান বাহিনী আপনাকে গ্রেপ্তার করেছিল। আমরা শুনেছিলাম, টেলিফোনে আপনাকে সাবধান করা হয়েছিল, সামরিক বাহিনী অগ্রসর হতে শুরু করেছে। কিন্তু তবু আপনি আপনার বাড়ি পরিত্যাগ করলেন না ।
আপনি গ্রেপ্তার হলেন। কেন আপনি নিজের বাড়ি ছেড়ে অপর কোথাও গেলেন না এবং গ্রেপ্তার বরণ করলেন? কেন এই সিদ্ধান্ত? তার কথা বলুন।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, সে এক কাহিনি। তা বলা প্রয়ােজন। সে সন্ধ্যায় আমার বাড়ি পাকিস্তান সামরিক জান্তার কমান্ডাে বাহিনী ঘেরাও করেছিল। ওরা আমাকে হত্যা করতে চেয়েছিল। প্রথমে ওরা। ভেবেছিল, আমি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলে ওরা আমায় হত্যা করবে এবং প্রচার করে দেবে যে, তারা যখন আমার সঙ্গে রাজনৈতিক আপসের আলােচনা করছিল, তখন বাংলাদেশের চরমপন্থীরাই আমাকে হত্যা করেছে। আমি বাড়ি থেকে বেরুনাে না বেরুনাে নিয়ে চিন্তা করলাম। আমি জানতাম, পাকিস্তান বাহিনী এক বর্বর বাহিনী। আমি জানতাম, আমি আত্মগােপন করলে, ওরা দেশের সমস্ত মানুষকেই হত্যা

৭২
করবে। এই হত্যাযজ্ঞ ওরা সমাধা করবে। আমি স্থির করলাম, আমি মরি, তাও ভালাে, তবু আমার প্রিয় দেশবাসী রক্ষা পাক।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি হয়তাে কলকাতা চলে যেতে পারতেন।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি ইচ্ছা করলে যে-কোন জায়গায় যেতে পারতাম। কিন্তু আমার দেশবাসীকে পরিত্যাগ করে আমি কেমন করে যাবাে? আমি তাদের নেতা। আমি সংগ্রাম করবাে। মৃত্যুবরণ করবাে। পালিয়ে কেন যাবাে? দেশবাসীর কাছে আমার আহ্বান ছিল—তােমরা প্রতিরােধ গড়ে তােলাে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার সিদ্ধান্ত অবশ্যই সঠিক ছিল। কারণ এই ঘটনাই বিগত নয় মাস ধরে বাংলাদেশের মানুষের কাছে আপনাকে তাদের একটি বিশ্বাসের প্রতীকে পরিণত করেছে। আপনি এখন তাদের কাছে প্রায় ঈশ্বরবৎ। শেখ মুজিবুর রহমান : আমি তা বলিনি। কিন্তু এ কথা সত্য, তারা আমাকে ভালােবাসে। আমি আমার বাংলার মানুষকে ভালােবেসেছিলাম। আমি তাদের জীবনকে রক্ষা করতে চেয়েছিলাম। কিন্তু হানাদার বর্বর বাহিনী আমাকে সে রাতে আমার বাড়ি থেকে গ্রেপ্তার করল। ওরা আমার নিজের বাড়ি ধ্বংস করে দিলাে। আমার গ্রামের বাড়ি, যেখানে ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতা এবং ৮০ বছরের বৃদ্ধ জননী ছিলেন, সে বাড়িও ধ্বংস করে দিলাে। ওরা গ্রামে ফৌজ পাঠিয়ে আমার বাবা-মাকে বাড়ি থেকে বিতাড়িত করে তাদের চোখের সামনে সে বাড়িতে আগুন ধরিয়ে দিলাে? বাবা-মার আর কোন আশ্রয় রইল না। ওরা সবকিছু জ্বালিয়ে দিয়েছিল। আমি ভেবেছিলাম, আমাকে পেলে ওরা আমার হতভাগ্য মানুষদের হত্যা করবে না। কিন্তু আমি জানতাম, আমাদের সংগঠনের শক্তি আছে। আমি একটি শক্তিশালী সংগঠনকে জীবনব্যাপী গড়ে তুলেছিলাম। জনগণ তার ভিত্তি। আমি জানতাম, তারা শেষ পর্যন্ত লড়াই করবে। আমি তাদের বলেছিলাম, প্রতি ইঞ্চিতে তােমরা লড়াই করবে। আমি বলেছিলাম, হয়তাে এটাই আমার শেষ নির্দেশ। কিন্তু মুক্তি অর্জন না করা পর্যন্ত তাদের লড়াই করতে হবে। লড়াই তাদের চালিয়ে যেতে হবে।

৭৩
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনাকে ওরা ঠিক কীভাবে গ্রেপ্তার করেছিল? তখন তাে রাত ১:৩০ মি. ছিল? তাই নয় কি? তখন কী ঘটলাে? শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা প্রথমে আমার বাড়ির ওপর মেশিনগানের গুলি চালিয়েছিল। ডেভিড ফ্রস্ট : ওরা যখন এলাে, তখন আপনি বাড়ির কোনখানটাতে ছিলেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : এই যেটা দেখছেন, এটা আমার শােবার ঘর। আমি এই শােবার ঘরেই তখন বসেছিলাম। এদিক থেকে ওরা মেশিনগান চালাতে আরম্ভ করে। তারপরে এদিক ওদিক-সবদিক থেকে গুলি ছুঁড়তে আরম্ভ করে। জানালার উপর গুলি চালায়।
ডেভিড ফ্রস্ট ; এগুলি সব তখন ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, সব ধ্বংস করেছিল। আমি তখন আমার পরিবার। পরিজনদের সঙ্গে ছিলাম। একটা গুলি আমার শােবার ঘরে এসে পড়ে। আমার ছয় বছরের ছােটো ছেলেটি বিছানার ওপর তখন শােয়া ছিল। আমার স্ত্রী এই শােবার ঘরে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসেছিলেন।
ডেভিড ফ্রস্ট : পাকিস্তান বাহিনী কোন দিক দিয়ে ঢুকেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : সব দিক দিয়ে। ওরা একবার জানালার মধ্য দিয়ে গুলি ছুঁড়তে শুরু করে। আমি আমার স্ত্রীকে দুটি সন্তানকে নিয়ে বসে থাকতে বলি। তারপর তার কাছ থেকে উঠে আমি বাইরে বেরিয়ে আসি।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার স্ত্রী কিছু বলেছিলেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : না, কোন শব্দ উচ্চারণের তখন অবস্থা নয়। আমি শুধু তাকে একটি বিদায় সম্বােধন জানিয়েছিলাম। আমি দুয়ার খুলে বাইরে বেরিয়ে ওদের গুলি বন্ধ করতে বলেছিলাম। আমি বললাম : ‘তােমরা গুলি বন্ধ করাে। আমি তাে এখানে দাঁড়িয়ে আছি। তােমরা গুলি করছাে কেন? কী তােমরা চাও? তখন চারিদিক থেকে ওরা আমার দিকে ছুটে এলাে, বেয়নেট উদ্যত করে। ওদের একটা অফিসার আমাকে ধরল। ওই অফিসারই বললাে : “এই! ওকে মেরে ফেলাে না।

৭৪
ডেভিড ফ্রস্ট : একটা অফিসারই ওদের থামিয়েছিল।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, ঐ অফিসারটি থামিয়েছিল। ওরা তখন আমাকে এখান থেকে টেনে নামালাে। ওরা পেছন থেকে আমার গায়ে, পায়ে বন্দুকের কুঁদো দিয়ে মারতে লাগল। অফিসারটা আমাকে ধরেছিল। তবু ওরা আমাকে ধাক্কা দিয়ে টেনে নামাতে লাগল। আমি বললাম : তােমরা আমাকে টানছ কেন? আমি তাে যাচ্ছি। আমি বললাম : ‘আমার তামাকের পাইপটা নিতে দাও। ওরা একটু থামল। আমি ওপরে গিয়ে আমার তামাকের পাইপটা নিয়ে এলাম। আমার স্ত্রী তখন দুটি ছেলেকে নিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। আমাকে কিছু কাপড়চোপড়সহ একটি ছােটো স্যুটকেস দিলেন। তাই নিয়ে আমি নেমে এলাম। চারদিকে তখন আগুন জ্বলছিল। আজ এই যেখানে দাঁড়িয়ে আছি, এখান থেকে ওরা আমায় নিয়ে গেল। | ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার বাড়ি ৩২ নম্বর ধানমন্ডি থেকে সেদিন যখন আপনি বেরিয়ে এলেন, তখন কি ভেবেছিলেন, আর কোনদিন আপনি এখানে ফিরে আসতে পারবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : , আমি তা কল্পনা করতে পারিনি। আমি ভেবেছি, এইই শেষ। কিন্তু আমার মনের কথা ছিল : আজ আমি যদি আমার দেশের নেতা হিসেবে মাথা উঁচু রেখে মরতে পারি, তাহলে আমার দেশের মানুষের অন্তত লজ্জার কোন কারণ থাকবে না। কিন্তু আমি ওদের কাছে আত্মসমর্পণ করলে, আমার দেশবাসী পৃথিবীর সামনে আর মুখ তুলে তাকাতে পারবে না। আমি মরি, তাও ভালাে। তবু আমার দেশবাসীর যেন মর্যাদার কোন হানি ঘটে।
ডেভিড ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আপনি একবার বলেছিলেন : “যেমানুষ মরতে রাজি, তুমি তাকে মারতে পারাে না।’ কথাটি কি এমনি ছিল না?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, আমি তাই মনে করি। যে-মানুষ মরতে রাজি, তাকে কেউ মারতে পারে না। আপনি একজন মানুষকে হত্যা করতে পারেন। সে তাে তার দেহ। কিন্তু তার আত্মাকে কি আপনি হত্যা করতে পারেন? না, তা কেউ পারে না। এটাই আমার

৭৫
বিশ্বাস। আমি একজন মুসলমান। এবং একজন মুসলমান একবারই মরে, দু’বার নয়।
আমি মানুষ। আমি মনুষ্যত্বকে ভালােবাসি। আমি আমার জাতির নেতা। আমি আমার দেশের মানুষকে ভালােবাসি। আজ তাদের কাছে আমার আর কিছু দাবি নেই। তারা আমাকে ভালােবেসেছে। সবকিছুকে বিসর্জন দিয়েছে। কারণ, আমি আমার সবকিছুকে তাদের জন্য দিবার অঙ্গীকার করেছি। আজ আমি তাদের মুখে হাসি দেখতে চাই। আমি যখন আমার প্রতি দেশবাসীর স্নেহ-ভালােবাসার কথা ভাবি, তখন আমি আবেগে আপ্লুত হয়ে যাই।
ডেভিড ফ্রস্ট : পাকিস্তান বাহিনী আপনার বাড়ির সবকিছু লুট করে নিয়েছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, আমার সবকিছুই ওরা লুট করেছে। আমার ঘরের বিছানাপত্র, আলমারি, কাপড়-সবকিছুই লুণ্ঠিত হয়েছে। মি. ফ্রস্ট, আপনি দেখতে পাচ্ছেন, এ-বাড়ির কোন কিছুই আজ নেই। | ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার বাড়ি যখন মেরামত হয়, তখন এসব জিনিস লুণ্ঠিত হয়েছে, না পাকিস্তানিরা সব লুণ্ঠন করেছে?
শেখ মুজিবুর রহমান : পাকিস্তানি ফৌজ আমার সবকিছু লুণ্ঠন করেছে। কিন্তু এই বর্বর বাহিনী আমার আসবাবপত্র, কাপড়-চোপড়, আমার সন্তানদের দ্রব্য-সামগ্রী লুণ্ঠন করেছে। তাতে আমার দুঃখ নেই। আমার দুঃখ ওরা আমার জীবনের ইতিহাসকে লুণ্ঠন করেছে। আমার ৩৫ বছরের রাজনৈতিক জীবনের দিনলিপি ছিল। আমার একটি সুন্দর লাইব্রেরি ছিল। বর্বররা আমার প্রত্যেকটি বই আর মূল্যবান দলিলপত্র লুণ্ঠন করেছে। সবকিছুই পাকিস্তান হানাদার বাহিনী নিয়ে গেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : তাই আবার সেই প্রশ্নটা আমাদের সামনে আসে-কেন ওরা সবকিছু লুণ্ঠন করলাে?
শেখ মুজিবুর রহমান : এর কী জবাব দেবাে? আসলে ওরা মানুষ নয়। কতগুলাে ঠগ, দস্যু, উন্মাদ, অমানুষ আর অসভ্য জানােয়ার। আমার নিজের কথা ছেড়ে দিন। তা নিয়ে আমার কোন ক্ষোভ নেই। কিন্তু ভেবে দেখুন, ২ বছর ৫ বছরের শিশু, মেয়েরা—কেউ রেহাই

৭৬
পেলাে না। নিরীহ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। আমি আপনাকে দেখিয়েছি সব জ্বালিয়ে দেওয়া, পােড়া বাড়ি, বস্তি। একেবারে গরিব,
-খাওয়া মানুষ সব বাস করতাে এই বস্তিতে। বস্তির মানুষ জীবন নিয়ে পালাতে চেয়েছে। আর সেইসব মানুষের ওপর চারদিক থেকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : কি আশ্চর্য! আপনি বলছেন, ওদের ঘরে আগুন দিয়ে ঘর থেকে বের করে, খােলা জায়গায় পলায়মান মানুষকে মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, এমনিভাবে গুলি করে তাদের হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : কোন্ মানুষকে মারলাে, তার কোনাে পরােয়া করলাে না?
শেখ মুজিবুর রহমান : না, তারা বিন্দুমাত্র পরােয়া করেনি।
ডেভিড ফ্রস্ট : কেবল হত্যা করার জন্য হত্যা-যাকে পেয়েছে, তাকেই হত্যা করেছে?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, যাকে পেয়েছে তাকেই হত্যা করেছে। ওরা ভেবেছে প্রত্যেকেই শেখ মুজিবের মানুষ। তাই প্রত্যেককেই হত্যা করতে হবে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি যখন দেখেন, মানুষ মানুষকে এমনিভাবে হত্যা করছে, তখন আপনার কী মনে হয়? আপনি কি মনে করেন, মানুষ আসলে ভালাে? কিংবা মনে করেন, মানুষ আসলেই খারাপ?
শেখ মুজিবুর রহমান : ভালাে-মন্দ সর্বত্রই আছে। মনুষ্যত্ব আছে, এমন মানুষও আমি দেখেছি। কিন্তু আমি মনে করি, পশ্চিম পাকিস্তানের এই ফৌজ—এগুলি মানুষ নয়। এগুলি পশুরও অধম। মানুষের যে পাশবিক চরিত্র না থাকতে পারে, তা নয়। কিন্তু যে-মানুষ, সে পশুর অধম হয় কী প্রকারে? কিন্তু এই বাহিনী তাে পশুরও অধম। কারণ একটা পশু আক্রান্ত হলেই মাত্র আক্রমণ করে। তা নইলে নয়। পশু যদি মানুষকে আক্রমণ করে মেরে ফেলে, তবু সে তাকে অত্যাচার করে না। কিন্তু এই বর্বরের দল আমার দেশবাসীকে কেবল হত্যা করেনি। দিনের

৭৭
পর দিন বন্দি মানুষকে অত্যাচার করেছে। ৫ দিন, ৭ দিন, ১৫ দিন। নির্মম অত্যাচার করেছে, আর হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : পাকিস্তানে বন্দি থাকাকালে ওরা আপনার বিচার করেছিল। সেই বিচার সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা একটা কোর্ট মার্শাল তৈরি করেছিল। তাতে পাঁচজন ছিল সামরিক অফিসার। বাকি কয়েকজন বেসামরিক অফিসার।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার বিরুদ্ধে কী অভিযােগ আনলাে ওরা?
শেখ মুজিবুর রহমান : অভিযােগ-রাষ্ট্রদ্রোহিতা, পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বাংলাদেশকে স্বাধীন করার ষড়যন্ত্র-আর কত কি!
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার পক্ষে কোন আইনজীবী ছিলেন? আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনাে উপায় ছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : সরকারের তরফ থেকে গােড়ায় এক উকিল দিয়েছিল। কিন্তু আমি যখন দেখলাম, অবস্থাটা এমনি যে, যুক্তির কোনাে দাম নেই; দেখলাম, এ হচ্ছে বিচারের এক প্রহসন মাত্র, তখন আমি কোর্টে নিজে দাঁড়িয়ে বললাম; জনাব বিচারপতি, দয়া করে আমাকে সমর্থনকারী উকিল সাহেবকে যেতে বলুন। আপনারা বিলক্ষণ জানেন, এ হচ্ছে এক গােপন বিচার। আমি বেসামরিক লােক। আমি সামরিক কোনাে লােক নই। আর এরা করছে আমার কোর্ট মার্শাল। ইয়াহিয়া খান কেবল যে প্রেসিডেন্ট, তাই নয়। তিনি প্রধান সামরিক শাসকও। এ বিচারের রায়কে অনুমােদনের কর্তা তিনি। এই আদালতও গঠন করেছেন তিনি।
ডেভিড ফ্রস্ট : তার মানে তার হাতেই ছিল সব?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, সে ছিল দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার ইচ্ছাই ইচ্ছা।
ডেভিড ফ্রস্ট : তার মানে, আপনি আদালতে যাওয়া বন্ধ করেছিলেন।
শেখ মুজিবুর রহমান : তার তাে কোনাে উপায় ছিল না। আমি তাে বন্দি ।

৭৮
ডেভিড ফ্রস্ট : হ্যা, তা তাে বটেই। আপনার ইচ্ছা-অনিচ্ছার তাে কোনাে উপায় ছিল না। ওরা কি বিচার শেষ করে সরকারিভাবে কোনাে রায় তৈরি করেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ ওরা আদালতের কাজ শেষ করে। সঙ্গে সঙ্গে ইয়াহিয়া খান সব বিচারক, যথা লেফটেন্যান্ট, কর্নেল, ব্রিগেডিয়ার-এদের সব রাওয়ালপিণ্ডি ডেকে পাঠালাে রায় তৈরি করার জন্য। সেখানে ঠিক করল, ওরা আমাকে ফাঁসি দেবে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আর তাই সেলের পাশে কবর খোড়া দেখে আপনি। বুঝতে পেরেছিলেন, ওরা ওখানেই আপনার কবর দিবে?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, আমার সেলের পাশেই ওরা কবর খুঁড়ল। আমার চোখের সামনে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি নিজের চোখে তাই দেখলেন? শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, আমি আমার নিজের চোখে দেখলাম ওরা কবর খুঁড়ছে। আমি নিজের কাছে নিজে বললাম : ‘আমি জানি, এ কবর আমার কবর। ঠিক আছে। কোনাে পরােয়া নেই। আমি তৈরি। আছি।’
ডেভিড ফ্রস্ট : ওরা কি আপনাকে বলেছিল : ‘এ তাে তােমার কবর?
শেখ মুজিবুর রহমান : না, ওরা তা বলেনি। ডেভিড ফ্রস্ট : কী বলেছিল ওরা?
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা বলল : না, না। তােমার কবর নয়। ধর যদি বম্বিং হয়, তাহলে তুমি এখানে শেলটার নিতে পারবে।
ডেভিড ফ্রস্ট : সেই সময়ে আপনার মনের চিন্তা কী ছিল? আপনি কি এই সারাটা সময়, ন’মাস নিজের মৃত্যুর কথা চিন্তা করেছেন। শেখ মুজিবুর রহমান : আমি জানতাম, যে-কোনাে দিন ওরা আমায় শেষ করে দিতে পারে। কারণ ওরা অসভ্য, বর্বর।
ডেভিড ফ্রস্ট : এমনি অবস্থায় আপনার কেমন করে কাটতাে? আপনি কী প্রার্থনা করতেন?

৭৯
শেখ মুজিবুর রহমান : এমন অবস্থায় আমার নির্ভর ছিল আমার বিশ্বাস, আমার নীতি, আমার পৌনে আট কোটি মানুষের প্রতি আমার বিশ্বাস। তারা আমার ভালােবেসেছে-ভাইয়ের মতাে, পিতার মতাে। আমাকে তাদের নেতা বানিয়েছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনি যখন দেখলেন, ওরা কবর খনন করেছে, তখন আপনার মনে কার কথা আগে জাগল? আপনার দেশের কথা? না, আপনার স্ত্রী-পুত্র পরিজনের কথা? শেখ মুজিবুর রহমান : আমার প্রথম চিন্তা আমার দেশের জন্য। আমার আত্মীয়-স্বজনদের চাইতেও আমার ভালােবাসা আমার দেশের জন্য। আমার যা কিছু দুঃখভােগ, সে তাে আমার দেশেরই জন্য। আপনি তাে দেখেছেন, আমাকে তারা কী গভীরভাবে ভালােবাসে।
ডেভিড ফ্রস্ট : হ্যা, এ কথা আমি বুঝি। স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধরত বাংলাদেশের আপনি নেতা। আপনার প্রথম চিন্তা অবশ্যই আপনার দেশের চিন্তা। পারিবারিক চিন্তা পরের চিন্তা।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, জনতার প্রতিই আমার প্রথম ভালােবাসা। আমি তাে জানি, আমি অমর নই। আজ, কিংবা কাল, কিংবা পরশু আমাকে মরতে হবে। মানুষ মাত্রই মরতে হয়। কাজেই আমার বিশ্বাস, মানুষ মৃত্যুবরণ করবে সাহসের সঙ্গে।
ডেভিড ফ্রস্ট : কিন্তু ওরা তাে আপনাকে কবর দিতে পারেনি। কে আপনাকে রক্ষা করেছিল সেদিন আপনার ভবিতব্য থেকে?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার বিশ্বাস সর্বশক্তিমান আল্লাহই আমাকে রক্ষা করেছেন।
ডেভিড ফ্রস্ট : আমি একটা বিবরণে দেখলাম, আপনাকে নাকি জেলার এক সময়ে সরিয়ে রেখেছিল। ইয়াহিয়া খান যখন আপনাকে হত্যা করার উদ্যোগ নিয়েছিল, তখন আপনাকে স্থানান্তরে নিয়ে গিয়েছিল। একি যথার্থ?
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা জেলখানায় একটা অবস্থা তৈরি করেছিল, মনে হচ্ছিল কতগুলি কয়েদিকে ওরা সংগঠিত করেছিল, যেন সকালের দিকে আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে ওরা আমাকে হত্যা করে ফেলতে পারে। আমার মনে হয়, আমাকে তত্ত্বাবধানের ভার যে

৮০
অফিসারের ওপর পড়েছিল, আমার প্রতি তার কিছুটা সহানুভূতি জেগেছিল। হয়তাে-বা সে অফিসার এমনও বুঝতে পেরেছিল যে, ইয়াহিয়া খানের দিন শেষ হয়ে আসছে। আমি দেখলাম, হঠাৎ রাত তিনটার সময়ে সে এসে আমাকে সেল থেকে সরিয়ে নিয়ে তার নিজের বাংলােতে দু’দিন যাবৎ রক্ষা করল। এ দু’দিন আমার ওপর কোনাে সামরিক পাহারা ছিল না। দু’দিন পরেই এই অফিসার আমাকে আবার একটা আবাসিক কলােনির নির্জন এলাকায় সরিয়ে নিল। সেখানে আমাকে হয়তাে চার-পাঁচ কিংবা ছয় দিন রাখা হয়েছিল। এই সময়টাতে আমার অবস্থান সম্পর্কে নিম্নপদস্থ কিছু অফিসার বাদে আর কেউ জ্ঞাত ছিল না।
ডেভিড ফ্রস্ট : এ তাদের সাহসেরই কাজ। এখন তাদের কী। হয়েছে, তাই ভাবছি।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমিও জানিনে। ওদের ওপর কোনাে আঘাত হানতে ওরা পারবে বলে মনে হয় না। ওদের জন্য যথার্থ শুভ কামনা রয়েছে।
ডেভিড ফ্রস্ট ; এমন কি শেষ মুহুর্তে ইয়াহিয়া খান যখন ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়, তখনাে নাকি সে ভুট্টোর কাছে আপনার ফাঁসির কথা বলেছিল? এটা কি ঠিক?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, ঠিক। ভুট্টো আমাকে সে কাহিনিটা বলেছিল। ভুট্টোর হাতে ক্ষমতা তুলে দেবার সময় ইয়াহিয়া বলেছিল : ‘মিস্টার ভুট্টো, আমার জীবনের সবচাইতে বড়াে ভুল হয়েছে, শেখ মুজিবুর রহমানকে ফাঁসি না দেওয়া।
ডেভিড ফ্রস্ট : ইয়াহিয়া এমন কথা বলেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, ভুট্টো একথা আমায় বলে তারপরে বলেছিল : ‘ইয়াহিয়ার দাবি ছিল, ক্ষমতা হস্তান্তরের পূর্বে সে পেছনের তারিখ দিয়ে আমাকে ফাঁসি দিবে। কিন্তু ভুট্টো তার এ প্রস্তাবে রাজি হয়নি।
ডেভিড ফ্রস্ট ; ভুট্টো কী জবাব দিয়েছিল? তার জবাবের কথা কি ভুট্টো আপনাকে কিছু বলেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : হঁ্যা, বলেছিল।

৮১
ডেভিড ফ্রস্ট : কী বলেছিল ভুট্টো?
শেখ মুজিবুর রহমান : ভুট্টো ইয়াহিয়াকে বলিছিল : না, আমি তা হতে দিতে পারি না। তাহলে মারাত্মক প্রতিক্রিয়া ঘটবে। বাংলাদেশে এখন আমাদের এক লাখ তিন হাজার সামরিক বাহিনীর লােক আর বেসামরিক লােক বাংলাদেশ আর ভারতীয় বাহিনীর হাতে বন্দি রয়েছে। তাছাড়া পাঁচ থেকে দশ লাখ অবাঙালি বাংলাদেশে আছে। মিস্টার ইয়াহিয়া এমন অবস্থায় আপনি যদি শেখ মুজিবকে হত্যা করেন আর আমি ক্ষমতা গ্রহণ করি, তাহলে একটি লােকও আর জীবিত অবস্থায় বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত আসতে সক্ষম হবে না। তার প্রতিক্রিয়া পশ্চিম পাকিস্তানেও ঘটবে। তখন আমার অবস্থা হবে সংকটজনক। ভুট্টো এ কথা আমাকে বলেছিল। ভুট্টোর নিকট আমি অবশ্যই এজন্য কৃতজ্ঞ।
ডেভিড ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আজ যদি ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপনার সাক্ষাৎ ঘটে, আপনি তাহলে তাকে কী বলবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : ইয়াহিয়া খান একটা জঘন্য খুনী। তার ছবি দেখতেও আমি রাজি নই। তার বর্বর ফৌজ দিয়ে সে আমার ৩০ লাখ বাঙালিকে হত্যা করেছে। ডেভিড ফ্রস্ট : ভুট্টো এখন তাকে গৃহবন্দী করেছে। ভুট্টো তাকে নিয়ে এখন কী করবে? আপনার কী মনে হয়?
শেখ মুজিবুর রহমান : মিস্টার ফ্রস্ট, আপনি জানেন, আমার বাংলাদেশে কী ঘটেছে? শিশু, মেয়ে, বুদ্ধিজীবী, কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র-সকলকে ওরা হত্যা করেছে। ৩০ লাখ বাঙালিকে ওরা হত্যা করেছে। অন্ততপক্ষে ২৫ থেকে ৩০ ভাগ ঘরবাড়ি ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছে। এবং তারপর সবকিছু ওরা লুট করেছে। খাদ্যের গুদামগুলি ওরা ধ্বংস করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : নিহতদের সংখ্যা ৩০ লক্ষ, এ-কথা আপনি সঠিকভাবে জানেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার লােকজন তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে। এখনও আমরা চূড়ান্ত সিদ্ধান্তে আসিনি। সংখ্যা হয়তাে একেও ছাড়িয়ে যাবে। ত্রিশ লক্ষের কম তাে নয়ই।

৮২
ডেভিড ফ্রস্ট : কিন্তু এমন হত্যাকাণ্ড তাে নিরর্থক। মানুষকে ঘর থেকে টেনে এনে এনে হত্যা করা।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, কাদের ওরা হত্যা করেছে? একেবারেই নিরীহ শান্তিপ্রিয় মানুষকে। গ্রামের মানুষকে, যে-গ্রামের মানুষ পৃথিবীর কথাই হয়তাে কিছু জানত না, সে-গ্রামে পাকিস্তানি ফৌজ ঢুকে পাখি মারার মতাে গুলি করে এই মানুষকে ওরা হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আমার মনেরও প্রশ্ন : আহা! কেন এমন হলাে?
শেখ মুজিবুর রহমান : , আমি জানি না। আমিও বুঝি না। এরকম পৃথিবীতে আর ঘটেছে বলে আমার জানা নেই।
ডেভিড ফ্রস্ট : আর এ তাে ছিল মুসলমানের হাতেই মুসলমানের হত্যা?
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা নিজেরা নিজেদের মুসলমান বলে । অথচ ওরা হত্যা করেছে মুসলমান মেয়েদের। আমরা অনেককে উদ্ধার করার চেষ্টা করেছি। আমাদের ত্রাণশিবিরে এখনও অনেকে রয়েছে। এদের স্বামী, পিতা-সকলকে হত্যা করা হয়েছে। মা আর বাবার সামনে ওরা মেয়েকে ধর্ষণ করেছে। আপনি চিন্তা করুন। আমি এ কথা চিন্তা করে চোখের অশ্রুকে রােধ করতে পারি না। এরা পুত্রের

৮৩
সামনে মাকে ধর্ষণ করেছে। নিজেদের মুসলমান বলে দাবি করে কীভাবে? এরা তাে পশুরও অধম। মনে করুন, আমার বন্ধু মশিউর রহমানের কথা। আমাদের দলের একজন শীর্ষস্থানীয় নেতা ছিলেন তিনি। আমাদের সরকারের একজন প্রাক্তন মন্ত্রী ছিলেন তিনি। তাঁকে এক হাত কেটেছে। তারপরে তাঁর আর একটা হাত কেটেছে। তারপরে তার একটা কানকে কেটেছে। তার পা কেটেছে। ২৪ দিনব্যাপী চলছে। এমন নির্যাতন (শেখ মুজিব কান্নায় ভেঙে পড়েন) কিন্তু এ তাে একটা কাহিনি। আমাদের কত নেতা আর কর্মীকে, বুদ্ধিজীবী আর সরকারি কর্মচারীকে, জেলখানায় আটক করে, সেখান থেকে নিয়ে দিনের পর দিন অত্যাচার করে হত্যা করেছে। এমন অমানুষিক নির্যাতনের কাহিনি আমি ইতিহাসে কোথাও শুনিনি। একটা পশু, একটা বাঘও তাে মানুষকে হত্যা করলে এমনভাবে হত্যা করে না।
ডেভিড ফ্রস্ট : ওরা কী চেয়েছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : ওরা চেয়েছিল আমাদের এই বাংলাদেশকে একেবারে উপনিবেশ করে রাখতে। আপনি তাে জানেন, মিস্টার ফ্রস্ট, ওরা বাঙালি পুলিশ বাহিনীর লােককে, বাঙালি সশস্ত্র বাহিনীর সদস্যদের হত্যা করেছে। ওরা বাঙালি শিক্ষক, অধ্যাপক, ইঞ্জিনিয়ার, বাঙালি ডাক্তার, যুবক ছাত্র-সবাইকে হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : আমি শুনেছি, যুদ্ধের শেষ অবস্থাতেও ঢাকাতে ওরা ১৩০ জন বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, সারেন্ডারের মাত্র একদিন আগে। কেবল ঢাকাতেই ১৩০ নয়, ৩০০ মানুষকে ওরা হত্যা করেছে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে, মেডিক্যাল কলেজে, ইঞ্জিনিয়ারিং ইউনিভার্সিটিতে। কারফিউ দিয়ে মানুষকে বাড়ির মধ্যে আটক করেছে। আর তারপর বাড়িতে বাড়িতে হানা দিয়ে এইসব মানুষকে হত্যা করেছে।
ডেভিড ফ্রস্ট : তার মানে, কারফিউ জারি করে সকল খবরাখবর বন্ধ করে হত্যা করেছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, তাই করেছে।
৮৪
ডেভিড ফ্রস্ট : শেখ সাহেব, আপনার কী মনে হয়? ইয়াহিয়া খান কি দুর্বল চরিত্রের লােক, যাকে অন্য লােকে খারাপ করেছে, না সে নিজেই একটা দস্তুরমতাে খারাপ লােক?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি মনে করি, ও নিজেই একটা নরাধম । ও একটা সাংঘাতিক লােক। ইয়াহিয়া খান যখন প্রেসিডেন্ট, তখন জনসাধারণের নেতা হিসাবে, সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা হিসাবে ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আলােচনার সময়েই আমি দেখিছি।
ডেভিড ফ্রস্ট : আমাদের আজকের এই আলাপে আপনি নেতা এবং নেতৃত্বের কথা তুলেছেন। যথার্থ নেতৃতুের আপনি সংজ্ঞা দিবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি বলবাে, যথার্থ নেতৃত্ব আসে সংগ্রামের প্রক্রিয়ার মাধ্যমে। কেউ আকস্মিকভাবে একদিনে নেতা হতে পারে না। তাকে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আসতে হবে। তাকে মানুষের মঙ্গলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করতে হবে। নেতার আদর্শ থাকতে হবে, নীতি থাকতে হবে। এই সব গুণ যার থাকে, সেই মাত্র নেতা হতে পারে।
ডেভিড ফ্রস্ট ; ইতিহাসের কোন নেতাদের আপনি স্মরণ করেন, তাঁদের প্রশংসা করেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : অনেকেই স্মরণীয়। বর্তমানের নেতাদের কথা বলছি না।…
ডেভিড ফ্রস্ট : না বর্তমানের নয়। কিন্তু ইতিহাসের কারা আপনাকে অনুপ্রাণিত করেছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি আব্রাহাম লিংকনকে স্মরণ করি । স্মরণ করি মাও সে-তুঙ, লেনিন, চার্চিলকে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূতপূর্ব প্রেসিডেন্ট জন কেনেডিকেও আমি শ্রদ্ধা করতাম।…
ডেভিড ফ্রস্ট : মহাত্মা গান্ধী সম্পর্কে আপনার কী ধারণা?
শেখ মুজিবুর রহমান : মহাত্মা গান্ধী, পণ্ডিত জহরলাল নেহেরু, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসু, সােহরাওয়ার্দী, এ কে ফজলুল হক, কামাল আতাতুর্ক- এঁদের জন্য আমার মনে গভীর শ্রদ্ধাবােধ রয়েছে। আমি ঔপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে সংগ্রামী নেতা ড. সুকর্নকে বিশেষ শ্রদ্ধা করতাম। এই সকল নেতাই তাে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নেতা হয়েছিলেন।

৮৫
ডেভিড ফ্রস্ট : আজ এই মুহূর্তে অতীতের দিকে তাকিয়ে আপনি কোন দিনটিকে আপনার জীবনের সবচাইতে সুখের দিন বলে গণ্য করবেন? কোন মুহূর্তটি আপনাকে সব চাইতে সুখী করেছিল?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি যেদিন শুনলাম, আমার বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে, সে দিনটিই ছিল আমার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।
ডেভিড ফ্রস্ট : আপনার জীবনের সব চাইতে সুখের দিন?
শেখ মুজিবুর রহমান : সমগ্র জীবনের সব চাইতে সুখের দিন।
ডেভিড ফ্রস্ট : এমন দিনের স্বপ্ন আপনি কবে থেকে দেখতে শুরু করেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : বহুদিন যাবৎ আমি এই স্বপ্ন দেখে আসছি।
ডেভিড ফ্রস্ট ; স্বাধীনতার সংগ্রামে কী করে আপনি প্রথম কারাগারে যান?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার জেল গমন শুরু হয়, বােধ হয়, সেই ১৯৪৮ সনে। তারপরে আমি ১৯৪৯ সনে গ্রেপ্তার হয়ে জেলে যাই এবং ১৯৫২ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। ১৯৫৪ সালে আমি একজন মন্ত্রী হই। আবার ১৯৫৪ সালেই গ্রেপ্তার হই এবং ১৯৫৫ সাল পর্যন্ত জেলে থাকি। আবার ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খান আমাকে জেলে পাঠায় এবং তখন পাঁচ বছর অন্তরীণ থাকি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলাসহ নানা মামলায় আমাকে সরকার পক্ষ বিচার করেছে। ১৯৬৬ সালে আবার আমাকে গ্রেপ্তার করা হয় এবং ৩ বছর যাবৎ আটক রাখা হয়। তারপর আবার ইয়াহিয়া খান গ্রেপ্তার করে। এমন দীর্ঘ সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগতভাবে আমার নয়। আমার বহু সহকর্মীর জীবনই এই ইতিহাস…
ডেভিড ফ্রস্ট : মিস্টার প্রাইম মিনিস্টার, পৃথিবীর মানুষের জন্য কী বাণী আমি আপনার কাছ থেকে বহন করে নিয়ে যেতে পারি?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার একমাত্র প্রার্থনা-বিশ্ব আমার দেশের মানুষের সাহায্যে অগ্রসর হয়ে আসুক। আমার হতভাগ্য স্বদেশবাসীর পাশে এসে বিশ্বের মানুষ দাঁড়াক। আমার দেশের মানুষ

৮৬

স্বাধীনতা লাভের জন্য যেমন দুঃখভােগ করেছে, এমন আত্মত্যাগ পৃথিবীর খুব কম দেশের মানুষকেই করতে হয়েছে। মিস্টার ফ্রস্ট, আপনাকে আমি আমার একজন বন্ধু বলে গণ্য করি। আমি আপনাকে বলেছিলাম, আপনি আসুন। আপনি আমার এই বাণী বহন করুন-সকলের জন্যই আমার শুভেচ্ছা। আমি বিশ্বাস করি, আমার দেশের কোটি কোটি ক্ষুধার্ত মানুষের পাশে এসে বিশ্ব দাঁড়াবে। আপনি আমার দেশের বন্ধু। আপনাকে আমি ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আল্লাহ আপনার মঙ্গল করুন। জয় বাংলা। ডেভিড ফ্রস্ট : জয় বাংলা। আমিও বিশ্বাস করি, বিশ্ববাসী আপনাদের পাশে এসে দাঁড়াবে। আপনাদের পাশে এসে আমাদের দাঁড়াতে হবে। নয়ত ঈশ্বর আমাদের কোন দিন ক্ষমা করবেন না।
১৮ই জানুয়ারি ১৯৭২। অনুবাদ : সরদার ফজলুল করিম
৮৭
কবে সৈন্য প্রত্যাহার করছেন।
‘আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।’

৮৯
(১৯৪৫ সালে জার্মানিতে ঢুকেছিল মিত্রবাহিনী, ছিল ১৯৫৫ পর্যন্ত, এই ১০ বছরে সেখানে লাখ লাখ মার্কিন, ব্রিটিশ ও রুশ সৈন্য ঘাঁটি গেড়েছিল। সেই ঘটনারই পরােক্ষ জের ধরে এখনাে জার্মানিতে আছে পাঁচটি মার্কিন সেনানিবাস, সাড়ে ৩৮ হাজার সৈন্য। আর রুশদের তাে পূর্ব জার্মানি ছেড়ে যেতে সময় লেগেছে পাক্কা ৫০ বছর। প্রতিবেশী পােল্যান্ডে রুশরা ছিল ৪৮ বছর, হাঙ্গেরিতে ৪৬ বছর। আর সেই যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ঢুকেছিল, এখনাে জাপানের কয়েকটি দ্বীপে ঘাঁটি গেড়ে আছে মার্কিন সৈন্য। দেখা যাচ্ছে দখলমুক্ত করতে গিয়ে নিজেরাই দখলদার বনে যাওয়াটা কি সমাজতান্ত্রিক কি ধনতান্ত্রিক মােড়ল রাষ্ট্রের একটি স্বীকৃত রীতি। এদিক থেকে স্বাধীনতার ৯০ দিনের মাথায় সদ্যঃস্বাধীন একটি দেশের মাটি থেকে বিদেশি একটি দেশের সৈন্য প্রত্যাহার করিয়ে নেওয়া বিরল এক ঘটনা। শক্তিশালী দেশগুলাের কাছ থেকে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের স্বীকৃতি আদায়ে এই সৈন্য প্রত্যাহারের ঘটনা একটা প্রধান অনুঘটকের ভূমিকা পালন করে। এত দিন তারা দ্বিধাদ্বন্দ্বে ছিল। কারণ স্বাধীনতার অন্যতম প্রতীক বিদেশি সৈন্যমুক্ত দেশ। অথচ স্বাধীনতার পরও বাংলাদেশে ভারতীয় সৈন্য বর্তমান। এ রকম পরিস্থিতিতে বঙ্গবন্ধুর অনুরােধে ইন্দিরা গান্ধী প্রত্যাহার করে নিলেন ভারতীয় সৈন্যবাহিনী। অচিরেই অনেক দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলাে বা আলাপ-আলােচনা শুরু করল। এমন একটা সাফল্যের জন্য বঙ্গবন্ধুকে কৃতিত্ব দেওয়া তাে দূরের কথা, উল্টো তাঁর নামে ভারতঘেঁষা বলে দুর্নাম ছড়ানাে হয়েছে। দেশে ফেরার মাত্র ২৫ দিনের মধ্যে সৈন্য প্রত্যাহারের বিষয়ে ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর কী কথা হয়েছিল, তার কোনাে বিবরণ এখন পর্যন্ত ভারত বা বাংলাদেশ-কোনাে সরকারই অবমুক্ত করেনি। মুজিব-ইন্দিরা সংলাপের একটি বিবরণই এখন পর্যন্ত আমরা পাই, সেটি তথ্য দপ্তরের তৎকালীন মহাপরিচালক এম আর আখতার মুকুলের স্মৃতিনির্ভর প্রতিবেদন। সরকারি দলিল অবমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত এটির ওপরই আমাদের নির্ভর করতে হবে।)
৯০
১৩ই মে ১৯৭৪ সালে দিল্লিতে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।
স্বাধীন-সার্বভৌম করার অব্যবহিত পর শেখ মুজিবুর রহমান আরাে একটি ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করেছেন, তার উল্লেখ না করলে বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে মূল্যায়ন অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। শুধু আলােচনার মাধ্যমে এ দেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার একক কৃতিত্বও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের। অবশ্য এ ক্ষেত্রে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর আন্তরিক সহযােগিতা ছিল তুলনাহীন।
আমার স্থির বিশ্বাস, বাংলাদেশের অন্য কোনাে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের পক্ষে এই ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন অসম্ভব ছিল। স্বাধীনতার ঠিক ৯০ দিনের মাথায় কীভাবে বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যবস্থা হয়েছিল, আমি নিজেই তার অন্যতম সাক্ষী। এখন সেই দুর্লভ মুহূর্তের প্রতিবেদন।
দুপুরে খাওয়ার পর কলকাতার রাজভবনে আমরা জনাকয়েক শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে একান্তে আলাপ করছিলাম। আমি তখন বাংলাদেশ সরকারের তথ্য দপ্তরের মহাপরিচালক। দিন দুই আগে ঢাকা থেকে ৩৫ জন সাংবাদিককে নিয়ে কলকাতায় এসেছি। এসব সাংবাদিক কলকাতায় এসেছেন

৯১
বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফরসংক্রান্ত সংবাদ সংগ্রহের জন্য। তাঁদের থাকাখাওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে কলকাতার বিখ্যাত গ্রেট ইস্টার্ন হােটেলে। আমার মনে তখন দারুণ কৌতূহল। বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ প্রসঙ্গে বুকে সাহস সঞ্চয় করে বললাম, ‘স্যার, বাংলাদেশ ও ভারতের দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে যে আলােচনা হতে যাচ্ছে, তাতে এজেন্ডা তাে দেখলাম না? তাহলে আপনারা কী কী বিষয়ে আলােচনা করবেন?
শেখ সাহেব তাঁর পাইপটাতে ঠিকমতাে আগুন ধরিয়ে এরিনমাের তামাকের গন্ধওয়ালা একগাদা ধোঁয়া ছেড়ে কথা বলতে শুরু করলেন : ‘পাকিস্তানের কারাগার থেকে ছাড়া পেয়ে লন্ডনে গেলাম। সেখান থেকে ঢাকায়। আসার পথে দিল্লি বিমানবন্দরে জীবনে প্রথম এই মহিলাকে (ইন্দিরা গান্ধী] দেখলাম। এর আগে তাে এর সঙ্গে আমার কোনাে পরিচয়ই ছিল না।’
সঙ্গে সঙ্গে বললাম, স্যার, মিসেস ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দারুণভাবে সাহায্য করা ছাড়াও আপনার জীবন বাঁচানাের জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের দরজায় ঘুরেছেন।’
বঙ্গবন্ধু মুচকি হেসে আবার কথা শুরু করলেন, “তােদের বন্ধুবান্ধবরা তাে আমাকে অর্ধশিক্ষিত বলে। তাহলে ইতিহাস থেকে একটা কথার জবাব দে? আজ পর্যন্ত সাম্রাজ্যবাদ কিংবা কমিউনিস্ট কিংবা অন্য কেউ, যারাই অন্য দেশে সৈন্য পাঠিয়েছে, তারা কি স্বেচ্ছায় সৈন্য প্রত্যাহার করেছে? তােরা কি দেখাতে পারিস যে এমন কোনাে দেশ আছে?’
আমরা সবাই মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে লাগলাম।
উনি পাইপে পর পর কয়েকটা টান দিয়ে হালকা মেজাজে কথা আরম্ভ করলেন, কানের মাঝ থেকে সাদা-কাঁচা চুল বাইরাইয়া আছে, ভারতে এমন সব ঝানু পুরনাে আইসিএস অফিসার দেখছােস? এঁরা সব ইন্দিরা গান্ধীরে বুদ্ধি দেওনের আগেই আজ আলােচনার সময় ম্যাডামের হাত ধইর্যা কথা লমু। জানােস কী কথা? কথাটা হইতাছে, ম্যাডাম তুমি বাংলাদেশ থাইক্যা কবে ইন্ডিয়ান সােলজার ফেরত আনবা?’
বঙ্গবন্ধু প্রতিশ্রুতি রেখেছিলেন। কলকাতার রাজভবনে ফাস্ট রাউন্ড আলােচনার শুরুতে দুজনে পরস্পরের কুশলাদি জিজ্ঞেস করলেন। এরপর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করার জন্য ভারতের জনগণ, ভারত সরকার এবং প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীকে ধন্যবাদ জানিয়ে বঙ্গবন্ধু হঠাৎ করে আসল কথাটা উত্থাপন করলেন।

৯২
শেখ মুজিবুর রহমান : ম্যাডাম, আপনি কবে নাগাদ বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করবেন?
ইন্দিরা গান্ধী : বাংলাদেশে আইন-শৃঙ্খলার পরিস্থিতি তাে এখন পর্যন্ত নাজুক পর্যায়ে রয়েছে। পুরাে ‘সিচুয়েশন’ বাংলাদেশ সরকারের কন্ট্রোলে আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করাটা কি বাঞ্ছনীয় নয়? অবশ্য আপনি যেভাবে বলবেন, সেটাই করা হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান : মুক্তিযুদ্ধে আমাদের প্রায় ৩০ লাখ লােক আত্মাহুতি দিয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে আইন ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির জন্য আরাে যদি লাখ দশেক লােকের মৃত্যু হয়, আমি সেই অবস্থাটা বরদাশত করতে রাজি আছি। কিন্তু আপনারা অকৃত্রিম বন্ধু বলেই বলছি, বৃহত্তর স্বার্থে বাংলাদেশ থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করলে আমরা কৃতজ্ঞ থাকব।
ইন্দিরা গান্ধী : এক্সিলেন্সি, কারণটা আরেকটু ব্যাখ্যা করলে খুশি হব।
শেখ মুজিবুর রহমান : এখন হচ্ছে বাংলাদেশ পুনর্গঠনের সময়। এই মুহূর্তে দেশে শক্তিশালী রাজনৈতিক বিরােধিতা আমাদের কাম্য নয়। কিন্তু ভারতীয় সৈন্যের উপস্থিতিকে অছিলা করে আমাদের বিরােধীপক্ষ দ্রুত সংগঠিত হতে সক্ষম হবে বলে মনে হয়। ম্যাডাম, আপনিও বােধ হয় এই অবস্থা চাইতে পারেন না। তাহলে কবে নাগাদ ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করছেন?
ইন্দিরা গান্ধী : (ঘরের সিলিংয়ের দিকে তাকিয়ে একটু চিন্তা করলেন) এক্সিলেন্সি, আমার সিদ্ধান্ত হচ্ছে, আগামী ১৭ই মার্চ বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করা হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান : ম্যাডাম, কেন এই বিশেষ দিন ১৭ই মার্চের কথা বললেন?
ইন্দিরা গান্ধী : এক্সিলেন্সি প্রাইম মিনিস্টার, ১৭ই মার্চ আপনার জন্ম তারিখেই আমাদের সৈন্যরা বাংলাদেশ থেকে ভারতে ফিরে আসবে।
ইন্দিরা গান্ধী তাঁর প্রতিশ্রুতি রক্ষা করেছিলেন। ভারত সরকারের আমলাতন্ত্র এবং দক্ষিণপন্থী রাজনৈতিক মহলের বিরােধিতাকে অগ্রাহ্য করে যেদিন ভারতীয় সৈন্যদের শেষ দলটি বাংলার মাটি ত্যাগ করে সেদিন ছিল ১৯৭২ সালের ১৭ই মার্চ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন।

৯৩
রহমান, ফাদার অব বেঙ্গল।
‘আমি যেমন তাদের ভালােবাসি, তারাও বাসে আমাকে। সেই ভালােবাসা থেকে নতুন জন্ম নেওয়া একটা জাতি আমাকে ‘পিতার আসনে সম্মান দিলাে। দুইটি উপাধিই, আমার জনগণ যেভাবে আমাকে সম্বােধন করে, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

৯৫
নাগিসা ওসিমা : একটি ছােটো ছেলে সবসময় আপনাকে ঘেঁষে থাকে। এমনকি বিভিন্ন অনুষ্ঠানের সময়ও ও আপনার পিছু ছাড়ে না। ব্যাপারটি আমাদের বেশ লেগেছে। আচ্ছা, নাম কী ওর? কত বয়স হলাে ছেলেটার?
শেখ মুজিবুর রহমান : ও রাসেল, শেখ রাসেল। এবার সাতে পড়েছে। নাগিসা ওসিমা : ও তাে আপনার পিছু ছাড়ে না দেখছি?
শেখ মুজিবুর রহমান : ও আমাকে সঙ্গ দেয়। প্রায়ই আমার সাথে থাকতে ভালােবাসে, তবে সবসময় নয়। দাপ্তরিক কাজের সময় অবশ্য থাকে না। অন্য সময় থাকে, বিভিন্ন জায়গাতে যায় আমার সাথে। এর একটা কারণ আছে। ওর বেড়ে ওঠার সময়টা আমার কেটেছে জেলে। বারবার জেলে যেতে হয়েছে। ওর যখন পনেরাে মাস বয়স, জেল হয়ে গেল আমার। তিন বছরের জন্য। বের হওয়ার পর আবারাে জেলে যাই দেড় বছরের জন্য। ও আমার সাথে সাথে থাকে, কারণ—ওর মধ্যে ভয় কাজ করে। এই বুঝি বাবা আবার জেলে চলে যাবে। বাবাকে চোখের আড়াল করতে চায় না বলেই এই কাছে থাকা।
নাগিসা ওসিমা : বড়াে হয়ে ও কী হবে বলে আপনি মনে করেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : ও তাে বড়াে হয়ে সেনাবাহিনীতে যেতে চায়। ভয়ংকর স্বপ্ন, না! হয়তাে মুক্তিসেনাদের সংগ্রাম, লড়াই থেকে এই আগ্রহ জন্মেছে।
নাগিসা ওসিমা : মুক্তিযুদ্ধের সময় আপনি পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি। আপনার পরিবারকে রক্ষা করেছিলেন কীভাবে?
শেখ মুজিবুর রহমান : এক মাস ওরা লুকিয়ে ছিল। এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। এরপর আমার পরিবারকে গ্রেপ্তার করা হয়।

৯৬
জাপানি চলচ্চিত্র পরিচালক নাগিসা ওশিমা
নাগিসা ওসিমা : আপনি একবার বলেছিলেন, আপনার পিতৃভূমি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যুদ্ধের সাথে এর কি কোনাে যােগসূত্র থাকতে পারে?
শেখ মুজিবুর রহমান : ফরিদপুর জেলার (তৎকালীন) গােপালগঞ্জের টুঙ্গিপাড়ার সেই বাড়িতে আমার জন্ম, বেড়ে ওঠা। যুদ্ধের সময় আমার নব্বই বছরের বৃদ্ধ বাবা, আশি বছরের বৃদ্ধ মা সেখানেই ছিলেন। পাকবাহিনী তাদের টেনে বের করে দেয়। তাঁদের চোখের সামনে ছয়জনকে হত্যা করে। আর বাড়িটি, আমার জন্মের চিহ্ন যেটা, পুড়িয়ে দেয়।
নাগিসা ওসিমা : ছাত্রাবস্থায় আপনি রাজনীতির সাথে জড়িয়ে গিয়েছিলেন? শেখ মুজিবুর রহমান : সময়টাই ছিল তখন উত্তাল। ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে চলছে ব্রিটিশবিরােধী আন্দোলন। আর আমাদের বাংলাদেশ, এই ঢাকা, এটা তাে আন্দোলনের মধ্যমণি। আমরা আন্দোলন করেই অভ্যস্ত ছিলাম। তথাকথিত কয়েকটি দুঃসাহসী আক্রমণ আক্রমণ তাে খ্যাতিই পেয়েছিল। আমরা তখন তরুণ প্রজন্ম। ব্রিটিশের কবল থেকে দেশকে স্বাধীন করার চিন্তায় আমরা ব্যাকুল। রাজনৈতিক তৎপরতা ছিল তাই খুব স্বাভাবিক একটি ব্যাপার।

৯৭
নাগিসা ওসিমা : সেই সময়টাতে আপনার পড়ালেখা ছিল কী নিয়ে?
শেখ মুজিবুর রহমান : দেশে রাজনীতি নিয়ে যে বই-ই পেয়েছি, পড়েছি। অনেক বই ছিল নিষিদ্ধ; কিন্তু যেভাবেই হােক যােগাড় করেছি। ফরাসি বিপ্লবের কথা জেনেছি, মার্কস পড়েছি, মধ্যপ্রাচ্যের লড়াই, আমেরিকার স্বাধীনতার ইতিহাস জেনেছি। আরাে কত বই-ই তাে পড়েছি।
নাগিসা ওসিমা : আপনার বিয়ে তাে খুব কম বয়সেই হয়েছিল । পারিবারিকভাবেই সব ঠিক হয়েছিল মনে হয়?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার স্ত্রী ছিল আমার চাচার মেয়ে। আমার বাবা আর আমার শ্বশুর ছিলেন আবার চাচাতাে ভাই। সেই অর্থে পরিবারের মধ্যেই আমাদের বিয়ে হয়েছিল। আমার স্ত্রী আড়াই বছর বয়সে বাবাকে, পাঁচ বছর বয়সে তার মাকে আর সাত বছর বয়সে তার দাদাকে হারায়। আমার বাবাই তখন অভিভাবক। তিনিই আমাদের বিয়ে ঠিক করেন।
নাগিসা ওসিমা : আমরা প্রায়ই বলতে শুনি, বাঙালি জাতি নাকি একটি গর্বিত জাতি। জাতিসত্তার এই অহংকারের উৎস কোথায়?
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনারা জাপানিরা কি নিজেদের নিয়ে গর্বিত নন? আপনাদের নিজেদের নিয়ে এই অহংকারটা ছিল বলেই তৎকালীন (দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ) মহাশক্তিধর আরেকটি দেশকে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এটাই ছিল চরম বাস্তবতা। নিজেদের ইতিহাস জানতেন বলেই বর্তমানটাতে এত আত্মবিশ্বাস ছিল আপনাদের। আমরা বাঙালিরাও আমাদের নিজস্ব সংস্কৃতি, ভাষা, ইতিহাস, আত্মত্যাগ, সুফলা মাটি, আবেগ নিয়ে ওয়াকিবহাল। গর্ব আমরা করতেই পারি। কারাে কাছে আমরা কখনাে মাথা নত করিনি। লড়াই না করে মাঠ ছাড়িনি। হ্যা, আমাদের অনেক ত্যাগ স্বীকার করতে হয়েছে। অনেকবারই করতে হয়েছে। দুনিয়ার বিভিন্ন শকুনির শ্যেনদৃষ্টি এই সুজলা-সুফলা ভূখণ্ডটির দিকে হামলে পড়েছে বারংবার। আমাদের দমিয়ে রাখার, হত্যা করার চেষ্টা করা হয়েছে অনেকবার। কিন্তু আমরা ঠিকই অত্যাচারীর শিকল ভেঙে বের হয়ে এসেছি। দুইশাে বছরের ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন কিন্তু এই বাংলা থেকেই দানা বেঁধেছে। সিপাহি বিদ্রোহ, তিতুমীরের লড়াই, বিভিন্ন বিখ্যাত গুপ্ত-জঙ্গি হামলা এই ভূখণ্ডেরই অবদান। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু, বিদ্রোহী কবি নজরুল, রবি ঠাকুর, সােহরাওয়ার্দী, ফজলুল হক এই বাংলার সন্তান।

৯৮
আমাদের মধুর একটি ভাষা আছে। খুব সুন্দর গান আছে। আপনারা জাপানিরা শিল্পের কদর করে থাকেন। আমাদের গান, নৃত্য, সাংস্কৃতিক বহুমাত্রিকতা আপনাদের মুগ্ধ করবে।
নাগিসা ওসিমা : এখানে আপনাকে ‘বঙ্গবন্ধু বা বাংলার মানুষের বন্ধু হিসেবে সম্বােধন করা হয়। তবে আমার মনে হয় এই সম্বােধনটির চেয়ে ‘জাতির পিতা’ উপাধিটিই আপনার জন্য বেশি উপযােগী এবং মানানসই। আপনার কী মনে হয়?
শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, স্বাধিকার আন্দোলনের সময়টা মনে করুন। আমরা যেনতেনভাবে পাকিস্তানের সাথে যুক্ত আছি। আমাদের ভাষা, কৃষ্টি, স্বাতন্ত্রের সাথে জড়িয়ে থাকা বাংলা নামটা ওরা মুছে দিতে চাচ্ছে। বাংলা নামের ভূখণ্ডটাকে বলছে পূর্ব পাকিস্তান। এটা আমাদের অস্তিত্বের ওপর আঘাত। বাঙালি জাতিসত্তার আন্দোলনের এক পর্যায়ে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় আমাকে বন্দি করা হলাে। এতে কিন্তু আন্দোলন আরাে বেগবান হয়। জেল থেকে বের হওয়ার পর আমাকে বঙ্গবন্ধু’ উপাধি দেওয়া হলাে। এর তাৎপর্য অনেক গভীর। এরপর যখন মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলাে তখন পরিস্থিতি আরাে কঠিন হলাে। আমার নেতৃত্বে বাঙালি জাতি তাদের স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি যেমন তাদের ভালােবাসি, তারাও বাসে আমাকে। সেই ভালােবাসা থেকে নতুন জন্ম নেওয়া একটা জাতি আমাকে পিতার আসনে সম্মান দিলাে। দুইটি উপাধিই—আমার জনগণ যেভাবে আমাকে সম্বােধন করে, আমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ।
নাগিসা ওসিমা : যুদ্ধের পর এখন দেশ স্বাধীন। এখন কোনাে শত্রুও নেই। নতুন দেশটির নতুন পরিস্থিতিতে যত রকমের সমস্যায় পড়ার কথা, তেমন আশঙ্কা থেকেই যায়। কিছু লােক সমালােচনা করার জন্য মুখিয়ে থাকবেই। অতীতের চেয়ে ভবিষ্যৎ আরাে কঠিন হওয়ার ভয় কি আপনার মধ্যে কাজ করে না?
শেখ মুজিবুর রহমান : (ধারাভাষ্যকারের জবানিতে) আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী। পরমতসহিষ্ণুতার নামই গণতন্ত্র। যে-কোনাে সমালােচনা আমি সাদরেই গ্রহণ করব এবং মূল্যায়ন করব।
১৩ই মে ১৯৭২ অনুবাদ : আহাদ আদনান

৯৯
আমেরিকান ব্রডকাস্টিং করপােরেশন (এবিসি)-র সঙ্গে
‘আমি অত্যন্ত সুখী যে, যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বীকৃতি দিতে বেশ দেরি করেছেন। কিন্তু আমি জানি যে, মার্কিন জনগণ, সংবাদপত্র ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। তারা আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছেন। এমনকি কেহ কেহ এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে ভারতে দেখার জন্যও এসেছিলেন। আমি তাঁদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি-অবশ্য মি. নিক্সন পাকিস্তানকে সেই সময় সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমি মি. নিক্সনকে সেজন্য ধন্যবাদ দিতে পারিনি।

১০১
বৈঠকের সম্ভাবনা এবিসি : জনাব ভুট্টোর সাথে আপনার বৈঠকের সম্ভাবনা রয়েছে কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনারা জানেন, শ্রীমতী গান্ধী ও জনাব ভুট্টো বৈঠকে মিলিত হয়ে তাদের দুই দেশের সমস্যাবলি নিয়ে আলােচনা করতে পারেন। এই ব্যাপারে আমার মতামত অত্যন্ত স্পষ্ট। জনাব ভুট্টোকে সর্বাগ্রে বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি ঘােষণা করতে হবে। তিনি যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন, তার উচিত এক্ষুণি এই বাস্তব সত্যকে মেনে নেওয়া, আর তাহলে, তার সাথে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যকার সমস্যাবলি আলােচনা করতে কোন আপত্তি থাকবে না।
ভুট্টোর সাথে যােগাযােগ এবিসি : আচ্ছা এ পর্যন্ত আপনার ও ভুট্টোর মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ কোনাে যােগাযােগ হয়েছে কি না? শেখ মুজিবুর রহমান : প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষ যােগাযােগ রাখা সম্ভবপর নয়। জনাব ভুট্টোর বােঝা উচিত বাংলাদেশ ছিল পাকিস্তানের সংখ্যাগুরু জনসংখ্যার অংশ আর বাংলাদেশ পাকিস্তান ত্যাগ করে বেরিয়ে এসেছে। এখন বাংলাদেশ বাস্তব সত্য। এমনকি বিশ্বের চতুর্থ ভেটো ক্ষমতাধারী শক্তিও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। ৭০টিরও বেশি দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। জনাব ভুট্টো বাংলাদেশের প্রতি স্বীকৃতি ঘােষণা করলে তার সাথে আলােচনায় বসতে আমার কোনাে আপত্তি থাকবে না।

১০২
গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা
এবিসি : এক্ষণে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে কোন সমস্যাটিকে আপনি সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : বহু সমস্যা রয়েছে। তারা আমাদের ৪ লাখ নিরীহ মানুষকে আটক রেখেছে। তারা ওদের বন্দিশিবিরে নিয়ে অন্তরীণ দশায় ফেলেছে। এ ছাড়া আরও বহুবিধ সমস্যা রয়েছে। তারা যদি আলােচনা করতে চায়, তবে তারা তা করতে পারে।
যুদ্ধবন্দি নাগরিক বিনিময় এবিসি : প্রধানমন্ত্রী, এখন ভারতে প্রায় ৭৩ হাজার যুদ্ধবন্দি রয়েছে, আপনি ও ভারতীয়দের মতৈক্য ছাড়া তাদের ভারতীয়রা ছাড়বে না। পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের ফিরে পাবার জন্য আপনারা অত্যন্ত উদ্গ্রীব ও আকুল। যুদ্ধবন্দি এবং পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের মধ্যে যারা সত্যিই দেশে ফিরে আসতে চায়, এদের মধ্যে পারস্পরিক বিনিময়ের সম্ভাবনা কিছু আছে কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : যুদ্ধবন্দি-যুদ্ধবন্দিই, বেসামরিক নাগরিক বা সামরিক নাগরিক। তাদের লােকও এখানে রয়ে গেছে: অবাঙালি বা বিহারি ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানে জন্মগ্রহণকারী তথাকার লােক বাংলাদেশে রয়ে গেছে। যদি তারা এদের নিতে চায়, তাদের সাদর স্বাগত জানানাে হবে। আমার কোনাে আপত্তি নেই এতে। আমি আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে বলেছি, এসব লােককে নিয়ে যান এবং আমার লােকদের পাকিস্তান থেকে ছাড়িয়ে আনেন। যুদ্ধবন্দিদের মধ্যে যুদ্ধাপরাধী রয়েছে। তাদের বিচার করা হবে। দুটি দিককে জট পাকিয়ে ফেলা ঠিক হবে না। তারা বেসামরিক নাগরিক এবং এসব লােক বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছে। এরা আমার ৩০ লাখ লােক হত্যা করেছে। তারা আত্মসমর্পণের পূর্বে কারফিউ জারি করে আমার বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে। এগুলাে ছিল ধীর মস্তিষ্কে নরহত্যা। তারা আমার মানুষের ঘর ও যােগাযােগ ব্যবস্থা ধ্বংস করে ফেলেছে।

১০৩
ভুট্টোর উৎকণ্ঠা এবিসি : জনাব ভুট্টো যুদ্ধাপরাধের বিচারের ব্যাপারে অতীব উদ্বিগ্ন, আর আপনি বলছেন, এখানে এদের বিচার করতে আপনি বদ্ধপরিকর।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি সেটা করব। এ ব্যাপারে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। আপনি নিজেই কি তাদের অমনি যেতে দিতে পারেন? এরা যে ক্ষেত্রে ৩০ লাখ লোেক হত্যা করেছে, গণহত্যায় লিপ্ত হয়েছে, এমতাবস্থায় কোনও দেশ কি এদের ছেড়ে দিতে পারত?
এমন কোন পথ। এবিসি : জনাব, এমন কোন পথ আছে কি? যে পন্থায় আপনি হয় সংখ্যার দিক থেকে (যে কোন সংখ্যক লােকের বিচার আপনি করতে পারেন, তাদের অনুপস্থিতিতে বা উপস্থিতিতে) অথবা অন্যভাবে যুদ্ধাপরাধী বিচার সম্পর্কে আপনার এখনকার ভূমিকা রদবদল করতে পারেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : এটা বিস্তারিত আলােচনার প্রশ্ন। এবিসি : বিস্তারিত মানে?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, এটা বিশদ ও বিস্তারিত আলােচনার উপযুক্ত প্রশ্ন । অপরাধ সত্য যারা করেছে, যারা দোষী, বিচার তাদের হবেই। নিরপরাধ যুদ্ধবন্দিদের বিচার আমি করব না। যারা ইচ্ছাপ্রবৃত্ত হয়ে পাইকারি হত্যাকাণ্ড চালিয়েছে, আমার লােকদের খুন করেছে, আমার সবকিছু বিপর্যস্ত করেছে, আমার মেয়েদের উপর নির্যাতন চালিয়েছে—আমি তাদেরই বিচার করব। আমি বাংলাদেশ থেকে ২ লাখ মেয়ে খুঁজে পেয়েছি, যারা পাক সেনা দ্বারা নির্যাতিতা ও ধর্ষিত হয়েছে। আপনি কীভাবে আশা করতে পারেন, আমি তাদের বিনা বিচারে ছেড়ে দেব?
যুদ্ধাপরাধীর তালিকা। এবিসি : ভারত সরকারের কাছে আপনি একটি তালিকা পেশ করেছেন জনাব, আমার বিশ্বাস আপনি যে-সংখ্যক যুদ্ধবন্দির বিচার করতে চান, তদপেক্ষা বেশি লােকের নাম রয়েছে ওই তালিকায়। এ সংখ্যাটি

১০৪
১,৪০০। এটা জনাব ভুট্টোকে এতই শঙ্কিত করে তুলেছে যে, তিনি বলেছেন, তাঁর দেশে এর প্রতিক্রিয়ায় এক কুজ্ঝটিকা বয়ে যাবে। আপনি কি সংখ্যাটি কমানাের চেষ্টা করবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, এখনাে তদন্ত চলছে। এটা ১,৪০০ হতে পারে, ১,০০০ হতে পারে, এমনকি ৫০০ও হতে পারে। তদন্তের উপরই সবকিছু নির্ভর করছে। যারা অপরাধী, যারা আগুন লাগিয়েছে, নরহত্যা করেছে, ধর্ষণ করেছে, একমাত্র সেসব লােকেরই বিচার হবে, গ্রেপ্তারকৃত ৯৩,০০০ লােকের বিচার হবে না।
ভুট্টোর সাথে মতৈক্যের প্রশ্ন এবিসি : আচ্ছা, প্রধানমন্ত্রী, জনাব ভুট্টোও বলেছেন, কিছু লােক সত্যিই যুদ্ধাপরাধী আর তাদের বিচার হওয়া উচিত। আপনি কি মনে করেন—এদিক থেকে জনাব ভুট্টোর সাথে আপনার কোনরূপ সমঝােতার সম্ভাবনা আছে? শেখ মুজিবুর রহমান : কীভাবে এটা সম্ভব? এখন পর্যন্ত বাস্তবতাকে মেনে নেবার সৌজন্যটুকু ভদ্রলােকটির হলাে না। তিনি নিজের সম্পর্কে ভাবছেন কী? আপনি দেখুন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্বীকৃতি দিয়েছে, সােভিয়েত ইউনিয়ন স্বীকৃতি দিয়েছে, বন্ধুদেশ ভারত স্বীকৃতি দিয়েছে, ফ্রান্স স্বীকৃতি দিয়েছে এবং স্বীকৃতি দিয়েছে গ্রেটব্রিটেন। বিশ্বের প্রায় সকল বৃহৎ দেশ আমাদের স্বীকৃতি দান করেছে। শেখ মুজিবের সাথে স্বীকৃতির প্রশ্নে আমি আলােচনা করতে চাই না’-এটা বলে ভুট্টো কী খেলা খেলতে চাইছেন? ‘স্বীকৃতির বিষয়টি সম্পর্কে কথাটি দ্বারা তিনি কী বুঝাতে চাইছেন? আমি পাকিস্তানকে স্বীকৃতি দেই কি না, তাও তাে প্রশ্ন। কারণ, জনাব ভুট্টো আর পাকিস্তান নাম দাবি করতে পারে না।
দালাল বিচার। এবিসি : আমি বলার আগে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি প্রধানমন্ত্রী, গত জানুয়ারি মাসে এই ব্রডকাস্টিং কোম্পানির সাথে সাক্ষাৎদানকালে আপনি স্বয়ং বলেছিলেন—এমন সময় আসবে যখন অতীতকে বিস্মৃত হয়ে

১০৫
ভবিষ্যতের জন্য কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে হবে। এখন বাংলাদেশে প্রায় ৫০,০০০ দালাল কারাগারে অন্তরীণ রয়েছে, সম্ভবত একমাত্র ঢাকা জেলেই রয়েছে ১০,০০০-এর মতাে। যুদ্ধবন্দিসহ এত বিরাট সংখ্যক লােকের বিচার আপনি কীভাবে করবেন, সেই অতীত না হাতড়ে?
শেখ মুজিবুর রহমান : ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১০ হাজার লােক আটক রয়েছে, এসব তথ্য আপনারা পান কোখেকে আমি জানি না। আমি জানি, ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে সব মিলিয়ে বন্দির সংখ্যা ৭,০০০এর বেশি হবে না। আপনারা কোথায় এসব তথ্য পান, আমি জানি না। এসব কিছু জানার জন্য এখানে একটি গােয়েন্দা সংস্থা রয়েছে, মনে। হচ্ছে। আমি আপনাকে জানাচ্ছি, এমনকি দালালদের মামলাগুলােও তদন্ত কমিশন যাচাই করবে। বস্তুতপক্ষে, যারা নিরপরাধ, তদন্ত করে আমরা তাদের ছেড়ে দিচ্ছি। একমাত্র, যারা অপরাধবৃত্তি সংঘটনের জন্য। দায়ী তারাই বিচারের সম্মুখীন হবে। ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে রাতেও যে লােক এক ডাক্তারের গৃহে ঢুকে, তার স্ত্রীর সামনে ডাক্তারকে টেনে হেঁচড়ে এনে নির্মম অত্যাচার করে অমানুষিকভাবে হত্যা করেছে, আমি তাকে ছেড়ে দিতে পারি না। তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আমিই বা তাকে ক্ষমা করব কী করে? এসব লােকের অবশ্যই বিচারের সম্মুখীন। হতে হবে। তবে, আমার নিরীহ মানুষদের হত্যার জন্য পাকফৌজ যেসব লােককে ব্যবহার করেছে, কাজে লাগিয়েছে, আমি তাদের অবশ্যই ক্ষমা করে দিয়েছি। এতদুদ্দেশ্যে তাদের বিপুল অস্ত্রশস্ত্র যােগানাে হয়েছিল। আমি এসব লােককে স্পর্শও করিনি। আমি তাদের বলেছি : ‘শান্তির অনুগত হও, বাংলাদেশের জন্য কাজ কর, এখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ কর। তােমাদের সাদরে বরণ করব।’ এসব আমি কি করি নি?
বিশ্বাসের প্রশ্ন এবিসি : কথার মাঝখানে ব্যাঘাত ঘটানাের জন্য ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি, এক্ষুণি আবার শুরু করছি, (মি. মরিশাস জিজ্ঞাসা শুরু করলেন)।
জনাব প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট ভুট্টো বলেছেন, এতদঅঞ্চলের শান্তি অথবা একটি মতৈক্যের জন্য তাকে আপনার বিশ্বাস করতে হবে। আপনি কি ব্যক্তিগতভাবে ভুট্টোকে বিশ্বাস করেন?

১০৬
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনি এসব কল্পনাশ্রয়ী অনুমিত প্রশ্ন ছাড়তে পারেন জনাব? পারস্পরিক সমঝােতা ও সহযােগিতার উপর বিশ্বাসের প্রশ্ন নির্ভর করে। আমি একাকী এগুতে পারি না।।
এবিসি : মাফ করবেন, প্রধানমন্ত্রী, ওটা যে নিতান্তই অনুমাননির্ভর প্রশ্ন, এব্যাপারে আমি নিশ্চিত নই। আপনি কি ভুট্টোকে বিশ্বাস করেন? | শেখ মুজিবুর রহমান : তিনি আমাকে বিশ্বাস করেন কি করেন না, এটা কোন প্রশ্ন নয়। এটা মুজিবুর রহমান ও মি. ভুট্টোর মধ্যে ব্যক্তিগত পারস্পরিক আস্থার কোন প্রশ্ন নয়। সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হলাে—বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের এ-দুদেশের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা। সৃষ্টি হয়েছে কি না।
এবিসি : যুদ্ধ অবসান এবং বাংলাদেশের মুক্তিলাভের পর আপনাকে ছেড়ে দেওয়া এবং দেশে ফিরে আসার ব্যাপারে অনেকে ভুট্টোকে কৃতিত্ব দিচ্ছেন। অন্যেরা বলছেন, সে-সময়ে তার সাথে দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলােচনা হয়েছিল আপনার। এটা কি সত্য?

১০৭
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, আমরা আলােচনা করেছি। আমরা অনেক কিছু আলােচনা করেছি। ভুট্টো যদি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেন আমরা সর্বদাই আলােচনার জন্য প্রস্তুত। কেননা, আলােচনার মাধ্যমে মীমাংসায় পৌঁছানাে সম্ভব।
এবিসি : সমঝােতার জন্যই কি বিশ্বাস করা প্রয়ােজন?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, ভুট্টোকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে প্রথম স্বীকার করে নিতে হবে। আপনারা কেন আমাকে এ ধরনের প্রশ্ন করছেন-আমি বুঝতে অক্ষম। যিনি বাংলাদেশকে একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্ররূপে স্বীকৃতি দেননি-তাকে আমি কী করে বিশ্বাস করতে পারি। জনাব ভুট্টো এখনও বাংলাদেশকে পূর্ব পাকিস্তান অথবা পূর্ব বাংলারূপে আখ্যায়িত করছেন। তার এভাবে কথা বলার কী অধিকার রয়েছে? যখন সে এইভাবে ব্যবহার করছে-তখন তাকে কী করে বিশ্বাস করতে পারি? তাঁকে বাংলাদেশের বাস্তবতাকে অবশ্যই স্বীকার করে নিতে হবে। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। পরস্পর পরস্পরকে বােঝা ও সহযােগিতা করা বিভিন্ন পরিস্থিতির উপর নির্ভর করছে।
নিক্সনের সফর এবিসি : আমি কি বিষয়ের সামান্য পরিবর্তন করতে পারি?
আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফর করেছেন ও মস্কো যাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। তিনি কি ঐসব দেশ বাংলাদেশকে সহায়তা করার জন্য সফর করছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : মি. নিক্সন তাঁর দেশের স্বার্থের জন্য ঐসব দেশ সফর করছেন। উপরন্তু তারা বৃহৎ রাষ্ট্র। তারা যা খুশি আলােচনা করতে পারেন-আমার বলার কিছুই নেই। আমি এ প্রশ্নের উত্তর দিতে নারাজ।
মার্কিন স্বীকৃতি প্রসঙ্গে এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, মি. নিক্সন তাে কখনও আপনাকে বৃহৎ শক্তির সাথে দেখেনি, কিন্তু চীন সফর ও বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার পর তাঁর সম্বন্ধে আপনার ধারণা কি পরিবর্তিত হয়েছে?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি অত্যন্ত সুখী যে, যুক্তরাষ্ট্র অবশেষে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিয়েছে। অবশ্য প্রেসিডেন্ট নিক্সন স্বীকৃতি দিতে বেশ

১০৮
দেরি করেছেন। কিন্তু আমি জানি যে, মার্কিন জনগণ, সংবাদপত্র ও বিশিষ্ট রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে সমর্থন করেছেন। তারা আন্তরিকভাবে বাংলাদেশের জন্য কাজ করেছেন। এমনকি কেউ কেউ এক কোটি বাঙালি শরণার্থীকে ভারতে দেখার জন্যও এসেছিলেন।
আমি তাদের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি-অবশ্য মি. নিক্সন পাকিস্তানকে সেই-সময় সক্রিয়ভাবে সমর্থন করেছিলেন। আমি মি. নিক্সনকে সেজন্য ধন্যবাদ দিতে পারিনি।
আমি নিরপেক্ষ ও স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতি চাই এবিসি : কিন্তু জনাব প্রধানমন্ত্রী, বাংলাদেশকে সাহায্যদানকারী দেশসমূহের মধ্যে আমেরিকাই বাংলাদেশকে সবচেয়ে বেশি সাহায্য দিচ্ছে ও ভবিষ্যতেও দিতে থাকবে। আপনি এই পরিপ্রেক্ষিতে সাধারণভাবে এই উপমহাদেশে ও বিশেষ করে বাংলাদেশ ও আমেরিকার সাথে কী ধরনের সম্পর্ক গড়ে তুলতে চান। শেখ মুজিবুর রহমান : যুক্তরাষ্ট্র একটি বৃহৎ শক্তি-সে সাহায্য করতে সক্ষমও, আমিও সাহায্য নিতে কোন বাধা-বিপত্তি দেখছি না-অবশ্য এই সাহায্য সর্বপ্রকার শর্তহীন হতে হবে। আমেরিকা এখন পর্যন্ত শর্তহীনভাবেই সাহায্য দিয়েছে।
কিছু সাহায্য সরাসরি ও কিছু আনরডের মাধ্যমে বাংলাদেশে আসছে। এখন স্বীকৃতি এসেছে-আমরা আরও আলােচনা করব-আমি শুধু আমার দেশ সম্বন্ধেই বলতে পারি যেখানে সাড়ে সাত কোটি লােক বসবাস করছে। আমি পূর্ব বা পশ্চিমের কোন ব্লকের সাথে সংযুক্ত নই। আমার নীতি অত্যন্ত স্পষ্ট-আমি নিরপেক্ষ স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতিতে বিশ্বাসী। আমি সােভিয়েত ও ভারতের কথা শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি-কেননা, এই দুটি মহান দেশ আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে সক্রিয় সহযােগিতা করেছে।
সােভিয়েত ইউনিয়ন এবিসি : সােভিয়েত ইউনিয়নের উপস্থিতি সম্পর্কে আপনার কী মতামত? জনাব প্রধানমন্ত্রী, সােভিয়েত নৌবাহিনী এখন চট্টগ্রাম বন্দরে উদ্ধারের কাজ করছে ও এই ধরনের সংবাদ শােনা যাচ্ছে যে, সােভিয়েত ইউনিয়ন ভারত মহাসাগর ব্যবহারের জন্য অনুমতি চেয়েছে।

১০৯
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি এই ধরনের কিছুই জানি না। আপনারা কোথা থেকে এ সংবাদ পেলেন? চট্টগ্রাম বন্দরটিকে পরিষ্কার করার জন্য একটি চুক্তি অনুসারে এরা এসেছে ও বন্দরটিতে কাজ করছে। আমার মাটি বা জল ব্যবহার করার জন্য কাউকে কোন অনুমতি দেওয়া হয়নি। সােভিয়েত ইউনিয়ন এই ধরনের কোন অনুমতিও চায়নি।
আমি শান্তি চাই এবিসি : আপনি উপমহাদেশের সমস্ত দেশের কল্যাণের জন্য আপনাদের মধ্যে একটি মৈত্রী চাচ্ছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান : মৈত্রী সম্বন্ধে কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। এই উপমহাদেশের দেশগুলাের মধ্যে আমি শান্তি চাই ও কোন বৃহৎ শক্তি আমাদের অভ্যন্তরীণ ব্যপারে কোন হস্তক্ষেপ না করুক এই আমার কামনা।
তাদের নিজের ব্যাপারে সুখী থাকুক, আমরা তাদের বিরক্ত করব না।
বিরাট পরিমাণে কারাে সাহায্য এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে আবার বিরক্ত করছি। আপনি কি মনে করেন যে, কোন দেশ থেকে ব্যাপক আকারে সাহায্য কোন শর্ত ছাড়াই আপনি পেতে পারেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : ব্যাপক আকারে সাহায্য? কতটুকু আমি গ্রহণ করব ও হজম করতে পারব তার উপরই সাহায্যের পরিমাণ নির্ভর করছে। ব্যাপক আকারে সাহায্যের অর্থ এই নয় যে, আমার দেশের উপর কেউ সাহায্য চাপিয়ে দেবে। আমার জনগণের জন্য যে পরিমাণ সাহায্য প্রয়ােজন তা আমি নেব-এ একান্ত আমাদের ব্যাপার।
তিন বছর সময় এবিসি : অসংখ্য ধন্যবাদ জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি বলেছেন যে, সংঘর্ষ লাগার পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় লাগবে। আপনি কি মনে। করেন যে, পূর্বাবস্থায় ফিরে যেতে তিন বছর সময় লাগবে?
শেখ মুজিবুর রহমান : এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত। এবিসি : আরও কম সময় তাে লাগতে পারে।

১১০
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, তাই।
এবিসি : আপনি কীজন্য এত আশাবাদী?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি যেহেতু জনগণের উপর নির্ভর করি। আমার জনগণ অত্যন্ত ভালাে ও তারা আমার কথা মেনে চলে। তারা অত্যন্ত বিশ্বাসী ও কঠোর পরিশ্রম করছে।
সমালােচনা এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি নিশ্চয়ই লক্ষ্য করেছেন যে, বিগত চার মাসের কাজের জন্য আপনার সমালােচনা হচ্ছে। যারা স্বাধীনতার সময় সংগ্রাম করেছে ও সে কারণেই যারা সমস্ত দাবি-দাওয়া প্রতিষ্ঠা করতে চাচ্ছে-তাদের কী করে আগামী তিন বছর আপনি শান্ত রাখবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি তাদের স্বাধীনতা দিয়েছি-আমি তাদের জীবনে সুখ এনে দেব-তারা কখনও বিভ্রান্ত নয়।
আমি ভুল সংশােধন করতে পারব। এবিসি : আপনি কি সমালােচকদের মুখ বন্ধ করে রাখতে পারবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : সব সময় সমালােচকেরা কিছু না কিছু সমালােচনাও করেন। আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাসী, আমাকে সমালােচনা করতে আমি তাদের অনুমতি দিয়েছি। সমালােচনার ব্যাপারে আমার। কোন আপত্তি নেই। কেননা, আমি জনগণকে ভালােবাসি-জনগণও আমাকে ভালােবাসে। সামান্যসংখ্যক লােকের সমালােচনায় আমার কিছুই আসে যায় না। আমি সৎ সমালােচনাকে স্বাগতম জানাই। আপনারা নিশ্চয়ই জানেন—আমি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শে বিশ্বাসী।
আমাকে সমালােচনার অধিকার জনগণের রয়েছে। যদি দেশের কোথাও কোন অন্যায় কাজ হয়-তার জন্য সমালােচনার প্রয়ােজন রয়েছে, তাতে আমার ভুলও সংশােধন হবে।
বিরােধীদল এবিসি : আপনি কি বিরােধীদলের কাজকর্মে আস্থাবান?
শেখ মুজিবুর রহমান : যদি আর কাউকে ভােট দিতে পারবে না—এই নীতিতে আমি বিশ্বাসী হতাম, তাহলে বিরােধীদল গঠন করতে

১১১
নিশ্চয়ই অনুমতি দিতাম না। যেহেতু আমি নির্বাচনে বিশ্বাসী, সেইহেতু জনগণ যদি বিরােধীদলের কাউকে চায় ভােট দেবে ও সে বিরােধীদলের আসনেও বসবে-তাতে আমার মনে করার কিছুই নেই।
খাদ্য সমস্যা এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনি তাে খাদ্য সমস্যা সমাধানের জন্য অনেকদূর এগিয়ে গেছেন। আপনার দেশে তাে কেউ অনাহারে নেই; কিন্তু আমরা জানতে চাই যে, আপনি কী করে বেকার সমস্যা সমাধান করছেন? আপনি কী করে চাকরি সৃষ্টি করছেন? বেকার লােকদের চাকরির সংস্থান করতে আপনার কতদিন সময় লাগবে?
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনাদের কাছে সব ঘটনার বিবরণ দেওয়া আবশ্যক। আমার আড়াই কোটি বাড়ি ধ্বংস করা হয়েছে। এক কোটি লােক গৃহহারা হয়ে ভারতে চলে গিয়েছিল, তারাও ফিরে এসেছে। আমাকে তাদের বাসস্থান ও খাদ্য সরবরাহ করতে হচ্ছে। স্বভাবতই তাদের জন্য সবকিছু করা আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কিন্তু অত্যন্ত খুশির কথা এই যে, গ্রাম পর্যায়ে সাহায্য সংস্থা গঠন করা হয়েছে-যারা দরিদ্র জনগণের মধ্যে সাহায্য বিতরণ করছে। আমার যােগাযােগ ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে, রেল যােগাযােগ নষ্ট করে দেওয়া হয়েছে ও ট্রাক এবং বাস পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তবুও আমার জনগণ কাজ করে চলেছে। অবশ্য সমস্যা রয়েছে ও থাকবে। আমার জনগণ অত্যন্ত বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন ও অত্যন্ত ভালাে।
ষড়যন্ত্র
এবিসি : জনাব, আপনি এই সেই দিন দেশে ষড়যন্ত্রকে নস্যাৎ করার। জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এই ষড়যন্ত্র কী?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি জানি, পৃথিবীর সর্বত্র ষড়যন্ত্র চলে। এবিসি : আপনি আরও বলেছেন যে, এই ষড়যন্ত্রের পেছনে কতিপয় বৈদেশিক শক্তি টাকা যােগাচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি কী করে সব বলব? আপনারাই বা কী করে আশা করেন যে, আমি আপনাদের সবকিছু বলব? আমার গােয়েন্দা কর্মরত রয়েছে। আমি জানি, কারা আমার কিছু কিছু লােককে

১১২
টাকা ঘুষ দিয়ে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির চেষ্টা করছে। বাংলার প্রতিটি গৃহে আমার মানুষ রয়েছে। কোন দেশের পক্ষেই এ ধরনের কাজ করা সম্ভব নয়। তবুও কোন কোন দেশ তাদের অভিলাষ চরিতার্থ করার জন্য ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। বাংলাদেশে যতদিন আমি বেঁচে থাকব ততদিন এ কাজ হতে পারবে না।
দীর্ঘদিন ধরেই চলছে ষড়যন্ত্র এবিসি : ষড়যন্ত্র সম্পর্কে এ ধরনের খােলাখুলি আলােচনা করলে দেশের জনগণের মধ্যে ভুল বােঝাবুঝির সৃষ্টি কি হতে পারে না?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার জনসাধারণ জানে যে, বাংলাদেশে দীর্ঘ দিন ধরে ষড়যন্ত্র চলছে-এটা এক বা দুদিনের বিষয় নয়। কোন কোন দেশ মধ্যপ্রাচ্যে ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় ষড়যন্ত্র করছে।
এবিসি : আপনি কি বৃহৎ শক্তিগুলাের কথা বলছেন? শেখ মুজিবুর রহমান : আমি এই সম্বন্ধে এখনও কিছু বলতে চাই । অবশ্য যারা ষড়যন্ত্র করছে-তাদের সাবধান থাকা প্রয়ােজন-কেননা, আমি তাদের ধরতে চেষ্টা করছি।
জনতার শক্তি দিয়ে মােকাবিলা করব। এবিসি : আপনি কি ষড়যন্ত্রকারীদের মােকাবিলা করতে চান? কিন্তু আপনার তাে সংগঠিত পুলিশ বা সেনাবাহিনী নেই।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি নিজেই সংগঠিত। আমার পুলিশের বা সেনাবাহিনীর প্রয়ােজন নেই। কেননা, আপনারা নিশ্চয় জানেনদেশের জনগণ যখন কোন নেতার পিছনে থাকেন ও তার প্রশাসনকে সমর্থন করেন তখন তাকে কেউ দমিয়ে রাখতে পারে না। সব শক্তির উৎস হলাে জনগণ। যখন দেশের জনগণ কারও পেছনে থাকে, তাকে বিশ্বের কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না। এই হলাে আমার ধারণা।
খাদ্য দাঙ্গা এবিসি : জনাব, আপনার দেশের কোন কোন এলাকায় খাদ্যের জন্য দাঙ্গা হয়েছে ও বিশৃঙ্খলা বিরাজ করছে-এ সম্বন্ধে আপনার মতামত কী?
শেখ মুজিবুর রহমান : এ সম্বন্ধে আমি কিছুই জানি না, আপনারা এ খবর পেলেন কোথায়?

১১৩
এবিসি : আপনার খবরের কাগজে আমরা এ বিষয় জানতে পেরেছি। দৈনিক অবজারভার পত্রিকায় এ খবর প্রকাশিত হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : খাদ্য নিয়ে দাঙ্গা হয়েছে এমন কোন খবর আমি জানি না। বাংলাদেশের কোথায়ও এ ধরনের ঘটনা ঘটেনি।
এবিসি : এই একই সংবাদপত্রে দেশের বিভিন্ন এলাকায় রাহাজানি সম্বন্ধে খবর বের হয়েছে। আপনি পুলিশের প্রয়ােজন মনে করেন না? আপনার তাে মাত্র দুহাজার পুলিশ রয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার পুলিশ বাহিনী রয়েছে-তারা দেশে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষা করছে। আপনারা রাত ১২টায় বা ২টায় যেখানে খুশি হাঁটুন দেখবেন কোন বিপদ-আপদ নেই। নিউইয়র্কে তাে রাত দশটায় চলা যায় না। কেননা, ওখানে যে কোন সময় রাহাজানি সংঘটিত হতে পারে বা যে কেহ বিপদের সম্মুখীন হতে পারে। নিউইয়র্কের চেয়ে বাংলাদেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি অনেক ভালাে। এতবড়াে একটা সশস্ত্র বিপ্লবের পর এখানে-সেখানে কিছু কিছু দুর্ঘটনা ঘটেছে যা নিতান্তই গৌণ ব্যাপার মাত্র।
এবিসি : ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী সম্বন্ধে আপনার মতামত কী? আমরা তাে সিদ্দিকী সম্বন্ধে শুনেছি-তিনি নাকি ব্যক্তিগত সেনাবাহিনী গড়ে তুলছেন ও অস্ত্রশস্ত্র জমা দেয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমান : এ কথা সত্য নয়। এ নিছক বাজে কথা। জনাব সিদ্দিকী আমার কাছে ৫৮ ট্রাক অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছেন।
এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আমি কোন দুরভিসন্ধি নিয়ে বলছি না যে, দেশে আইন ও শৃঙ্খলার অবনতি ঘটেছে বা দেশ অবনতিতে আচ্ছন্ন হয়ে পড়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনারা কোথায় বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখতে পেয়েছেন?
এবিসি : আপনি তাে গত জানুয়ারিতে দেশের নিরবচ্ছিন্ন অগ্রগতির জন্য সমস্ত অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করতে নির্দেশ দিয়েছিলেনসম্ভবত তা হয়নি।
শেখ মুজিবুর রহমান : সবাই অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে। কে বলেছে তা হয়নি? এটা কী তামাশা যে, তারা এক লাখ পঞ্চাশ হাজার অস্ত্রসমর্পণ করেছে। তারা দু’বার অস্ত্রশস্ত্র সমর্পণ করেছে। অবশ্য অল্পসংখ্যক লােক রয়েছে যারা অস্ত্র জমা না দিয়ে কোথাও কোথাও চুরি ডাকাতি করছে, এর সাথে রাজনীতির কোন সম্পর্ক নেই।

১১৪
বিহারি
এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, বিহারিদের ভাগ্য সম্বন্ধে কিছু জানাবেন কী? তাদের সমস্যার সঠিক কোন সমাধান আছে কী?
শেখ মুজিবুর রহমান : তাদের অবস্থা সম্পূর্ণ স্বাভাবিক। সবাই এমকি জাতিসংঘের প্রতিনিধিগণ তাদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখেছেন। তারা অবাঙালিদের দু অথবা তিনটি এলাকাও প্রত্যক্ষ করেছেন।
আপনারা যদি সৈয়দপুর যান তবে দেখতে পাবেন অবাঙালিরা মিল ফ্যাক্টরিতে কাজ করছে। আপনারা মিরপুর ও মােহাম্মদপুর দেখুন-তারা ওখানে শান্তিতে বসবাস করছে। কেউ কেউ ইচ্ছাকৃতভাবে বিহারিদের বিষয়টিকে জোরালাে করে তুলছেন, কিন্তু পাকিস্তানে আটকেপড়া সাড়ে চার লাখ বাঙালিদের ভাগ্য সম্বন্ধে তারা কিছুই বলছেন না।
তারা কোনাে অন্যায় করেনি, তবুও তাদের উপর অত্যাচার করা হচ্ছে। তারা তাদের খাদ্য বন্ধ করে দিয়েছে। কিন্তু আমি আন্তর্জাতিক রেডক্রসকে যেখানে খুশি যেতে দিচ্ছি। তারা আমাদের রেডক্রসের সহায়তায় সাহায্যদ্রব্য বিতরণ করছে। অবশ্য আমার জনগণ দরিদ্র, আমি আমার জনগণকে পুরাে খাদ্য দিতে পারছি না। মানুষের পক্ষে যা সম্ভব আমি তাই করছি। কিন্তু পাকিস্তানে আমার যে সাড়ে চার লাখ লােক আটকা পড়েছে সে সম্বন্ধে বিশ্বের কোন মহল থেকে তেমন সাড়া পাওয়া যাচ্ছে না। কেউই তাদের জন্য কোন কথা বলছে না। অথচ বিহারিদের জন্য সকলেই অস্থির। বিহারিরা এখানে আরামে বসবাস করছে।
একথা আমি সুস্পষ্টভাবে বলেছি যে, বাংলাদেশকে যারা মাতৃভূমি বলে স্বীকার করবে তাদের আমি স্বাগত জানাব। বিহারিদের এখানে কাজে থাকতে দিন। আমি নিশ্চিত যে, বিহারিরা আমেরিকার নিগ্রোদের তুলনায় সুখে আছে।
এবিসি : জনাব প্রধানমন্ত্রী, আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। শেখ মুজিবুর রহমান : ধন্যবাদ।
মি. পিটার জেনিংস ও লুই শেক ২৫শে মে ১৯৭২

১১৫
পাকিস্তানের সাংবাদিকদ্বয়ের সঙ্গে
‘প্রাথমিক ব্যবস্থা হচ্ছে উপমহাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেয়া। আমাদের পশ্চাৎ দৃষ্টি পরিহার করতে হবে শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য। সমতা, সার্বভৌমত্ব এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হতে পারে।’

১১৭
প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছেন, বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে পাকিস্তান উপমহাদেশের মানবিক এবং রাজনৈতিক সমস্যাবলির সমাধানের অন্তরায় সৃষ্টি করছে। সম্প্রতি বাংলাদেশে আগত দুইজন পাকিস্তানি সাংবাদিকের সাথে ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা বলেন। বাসস’র সংবাদে প্রকাশ পাকিস্তানি সাংবাদিকদ্বয়ের কতিপয় লিখিত প্রশ্নের জবাবে বঙ্গবন্ধু বলেন, উপমহাদেশের জনসাধারণের কল্যাণের জন্য পাকিস্তানের উচিত, বর্তমান সমস্যাবলি সমাধানের ঐতিহাসিক সুযােগ গ্রহণ করা। পাকিস্তানি সাংবাদিকদ্বয় হলেন, করাচীর ডন পত্রিকার ভারপ্রাপ্ত প্রধান সম্পাদক মাজহার আলী খান এবং উক্ত পত্রিকার কলামিস্ট সৈয়দ নাজিউল্লাহ। সাক্ষাঙ্কারে উত্থাপিত প্রশ্ন ও উত্তরের বিবরণ নিম্নে দেওয়া হলাে।
প্রশ্ন : আমাদের দুই দেশের ভবিষ্যৎ সম্পর্কের প্রাথমিক রূপ কী ধরনের হওয়া উচিত বলে আপনি মনে করেন? এবং তার ফলে উপমহাদেশের জনসাধারণের সহায়তা ও বিশ্ব শান্তির ক্ষেত্রে অগ্রগতি সাধিত হবে কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : প্রাথমিক ব্যবস্থা হচ্ছে উপমহাদেশের বর্তমান বাস্তবতাকে স্বীকার করে নেওয়া। আমাদের পশ্চাৎ দৃষ্টি পরিহার করতে হবে শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য। সমতা, সার্বভৌমত্ব এবং অপরের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ না করার নীতি গ্রহণের মাধ্যমে তাৎপর্যপূর্ণ অগ্রগতি সাধিত হতে পারে। প্রশ্ন : আমাদের মনে হয় বর্তমানে অচলাবস্থার ব্যাপারে উভয় পক্ষের মনােভাবের পার্থক্য হ্রাস পেয়ে এমন পর্যায়ে আসছে, যার ফলে

১১৮
বিষয়টি প্রায় পদ্ধতিগত ও কৌশলগত প্রশ্নে এসে ঠেকছে। অভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক অসুবিধাদি এবং উভয়পক্ষ বিভিন্ন সময়ে সাধারণ্যে যেসব মতামত ব্যক্ত করছেন তা বিবেচনা করে আপনি কি একটা সমাধান নির্দেশ করতে পারেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : অবশ্য আমি মনে করি, উপমহাদেশে সমগ্র জনমণ্ডলীর স্বার্থেই সম্পর্ক স্বাভাবিক করা উচিত। আমাদের জনসাধারণ দুঃখ ও নির্যাতন ভােগ করা সত্ত্বেও মূলতঃ উদার রয়েছে এবং পাকিস্তানের সাথে আলােচনার মাধ্যমে সকল বিরােধ মীমাংসার উদ্যোগকে স্বাগত জানাবে। এখন প্রয়ােজন আন্তরিকতা, আমাদের তরফে আন্তরিকতার অভাব হবে না বলে আমি কথা দিতে পারি। আলােচনার উপযােগী পরিবেশ সৃষ্টি না করার কোনাে কারণ আমি দেখি না। প্রশ্ন : আমরা আশা করি, আপনি একথা উপলব্ধি করেন যে ভারত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ পরিবারের মানবিক সমস্যা সমাধানের জন্য কিছু করা উচিত।
শেখ মুজিবুর রহমান : বাংলাদেশের জনসাধারণের মতাে এত দুঃখদুর্দশা আর কোন দেশের মানুষ ভােগ করেনি। সাধারণভাবেই বােঝা উচিত যে ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান নির্বিশেষে সব দেশের মানুষের মানবিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আমরা বিশেষভাবে উদগ্রীব। এখন পাকিস্তানের জনগণের উপলব্ধি করা উচিত যে এমন কোন মানবিক সমস্যা নেই, যা আমাদের অজানা। বাংলাদেশ এসব সমস্যার সমাধানে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি। আমি একথা মনে করতে পারি যে আমাদের প্রতিবেশী ভারতও সমতার ভিত্তিতে এসব সমস্যা সমাধানে একান্তই আগ্রহী।
প্রশ্ন : পাকিস্তানে আমাদের বাঙালি ভাইদের যারা বাংলাদেশে কাজ করার জন্য অপশন নিয়েছেন, তাদের মনে ভুল ধারণা আছে। এই ভুল ধারণা হলাে, তারা আজ হােক, কাল হােক এখানে ফিরে এসে আদৌ কোন, চাকরি পাবার আশা করতে পারেন কি না। তাদের মধ্যে সাধারণভাবে এ ধারণা আছে যে তারা বুঝি এখানে অবাঞ্ছিত। আপনি কি কোন মন্তব্য করবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : কোন ভুল ধারণা থাকতে পারে না। এমন ভুল ধারণা সৃষ্টির পাকিস্তানি প্রচারণা সফল হতে পারে না। আমরা

১১৯
আমাদের জনসাধারণকে জানি, তারাও আমাদের জানে। যে সব বাঙালি মাতৃভূমিতে ফিরে আসতে চায়, তারা সকলেই এখানে আসতে পারবে। আপনারা সম্ভবত জানেন যে পাকিস্তানে আটক বাঙালিদের পােষ্যদের আমরা খােরাকি ভাতা দিচ্ছি। আমাদের বাঙালি ভাইদের জন্য আপনাদের উদ্বেগে আমি কৃতজ্ঞ। কিন্তু আমার প্রশ্ন, আপনাদের মতাে আপনাদের সরকার ও জনসাধারণ উদ্বিগ্ন কি না। বিস্ময়ের ব্যাপার এই যে তাদের জীবনধারণের উপায় থেকে বঞ্চিত করে, তাদের স্বদেশে ফিরে আসার অনুমতি প্রত্যাখ্যান করে তারা উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। এ এক অদ্ভুত ধরনের ভ্রাতৃপ্রতিম উদ্বেগ যে তাদের দুস্থ করে দেওয়া হয়েছে এবং তাদের উপর নানান ধরনের নির্যাতন চালানাে হচ্ছে।
প্রশ্ন : পদ্ধতিগত সমস্যার একবার সমাধান হয়ে গেলে এবং পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে শুরু করলে আমাদের দুদেশ-বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের মৈত্রীসুলভ সম্পর্ক গড়ে উঠবে বলে কি আপনি মনে করেন? যদি তাই হয়, তবে উপমহাদেশের বাস্তব রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও অর্থনৈতিক অবস্থায় সেই সম্পর্ক কেমন হবে বলে আপনি মনে করেন? শেখ মুজিবুর রহমান : এখানেই আপনার সাথে আমি একমত হতে পারি না। কোন পদ্ধতিগত সমস্যা নয়, প্রশ্নটি অতি সাধারণ। সার্বভৌমত্ব ও সমতার ভিত্তিতেই কেবল কার্যকরী আলাপ-আলােচনা হতে পারে। একবার আলােচনা শুরু হলে আমরা আমাদের সমস্যার সমাধান করতে
পারার কোন যুক্তি নেই। এভাবেই উপমহাদেশের জনসাধারণের কল্যাণে মৈত্রীসম্পর্ক প্রতিষ্ঠার দিকে আমরা অগ্রসর হতে পারি।
প্রশ্ন : দু’দেশের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার প্রতীক্ষায় থেকে আমরা দেখছি আমাদের পরস্পরের মধ্যে কোন যােগাযােগ নেই, পারস্পরিক সমস্যা উপলব্ধি ও পরস্পরকে জানার কোন সুযােগ নেই। আমি এ-কথাটার মাধ্যমে এই কথাই বলতে চাই যে। আমাদের দু’দেশের জনসাধারণের সাথে কোন যােগাযােগ নেই। দু’দেশের জনসাধারণের পরস্পরকে নতুন অবস্থায় উপলব্ধি করার সুযােগ যাতে তরান্বিত হয়, তার জন্য দু’দেশের সাংবাদিক, সংবাদপত্র প্রতিনিধি ও জননেতাদের সফর বিনিময় করতে আপনি আদৌ প্রস্তুত আছেন কি?

১২০
শেখ মুজিবুর রহমান : আগের বিষয় আগে চিন্তা করা উচিত। বাংলাদেশের পাকিস্তানের সমস্যা উপলব্ধি করার কোন অসুবিধা নেই। দুর্ভাগ্যবশত আমরা দেখছি, গত ২৫ বছরের মতাে এখনাে আমাদের উপলব্ধি না করার জন্য পাকিস্তানে একটি প্রভাবশালী মহল তৎপর রয়েছে। মূল প্রশ্ন হচ্ছে আমাদের, উপলব্ধি করার কোন ইচ্ছা পাকিস্তানের আছে কি না। অতীতে বহুবার এমন ধরনের সফর বিনিময় হয়েছে কিন্তু তাতে কি গত বছরের প্রলয়ঙ্কর ঘটনা প্রতিহত করা সম্ভব হয়েছে? বাংলাদেশে হত্যাযজ্ঞ ও নির্যাতন বন্ধ, লক্ষ লক্ষ বেসামরিক মানুষকে বর্বরােচিতভাবে হত্যা, লাখ লাখ মহিলার উপর পাশবিক অত্যাচার এবং গ্রামের পর গ্রাম নির্বিচারে ধ্বংস করার বিরুদ্ধে পাকিস্তানে বুদ্ধিজীবী, তথাকথিত প্রগতিশীল মহল এবং জননেতারা কি প্রতিবাদমুখর হয়েছেন? বস্তুত মানসিকতার সত্যিকার পরিবর্তন দরকার। এই মূল সমস্যার সমাধান যদি একবার হয় তবে আপনারা যে ধরনের সফরের কথা বলছেন, তা স্বাভাবিকভাবেই শুরু হবে।
প্রশ্ন : একথা বলা হয়ে থাকে যে ভারত ও বাংলাদেশ জেনেভা কনভেনশনের পটভূমিতে যুদ্ধবন্দিদের মুক্তি দেবে এবং তার পরে বাংলাদেশকে আইনগত স্বীকৃতি দেবার প্রশ্ন উঠবে। আন্তর্জাতিক আইনের দৃষ্টিতে এই শর্ত অনভিপ্রেত ও নৈতিক দিক থেকেও তা গ্রহণযােগ্য নয়। পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্য আপনি কি এই দুই সমস্যাকে পৃথকভাবে বিবেচনা করতে পারবেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : বাংলাদেশের জনসাধারণের উপর যখন বর্বরােচিতভাবে হত্যাযজ্ঞ চালান হচ্ছিল, তখন নৈতিক দিক থেকে কী গ্রহণযােগ্য আর কী নয়, সে কথা তােলা হয়নি। আপনারা হয়তাে একথা মেনে নেবেন না যে বাংলাদেশ স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জেনেভা কনভেনশন অনুসরণ করছে। আপনারা কি মনে করেন যে জেনেভা কনভেনশনের কথা বলছি কেবলমাত্র আমাদের দায়িত্ব এড়িয়ে যাবার জন্য। আমাদের উদ্দেশ্য সম্পর্কে কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। জেনেভা কনভেনশন বাস্তবায়ন সম্পর্কে যে সমস্যা দেখা দিয়েছে তারও আলাপ-আলােচনার মাধ্যমে সমাধান করা যায়। উপমহাদেশে স্থায়ী

১২১
শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সার্বিক পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতেই এই সমস্যা বিবেচনা করতে হবে।
বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দিয়ে পাকিস্তান এই সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে বাধা সৃষ্টি করছে। তাছাড়া বাংলাদেশের জাতিসংঘভুক্তি বন্ধ করার জন্য পাকিস্তান অন্যায় ও অযৌক্তিকভাবে জাতিসংঘে দ্বিপাক্ষিক সমস্যা তুলে ধরেছে।
পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের উপর অমানবিক ব্যবহার করে এবং তাদের স্বদেশে ফেরার ব্যাপারে জোর জবরদস্তিমূলক বাধা সৃষ্টি করে পাকিস্তান পরিস্থিতি ঘােলাটে করে তুলছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে প্রচারণা চালিয়েও পরিস্থিতির অবনতি ঘটনানাে হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রলয়ংকরী ধ্বংসযজ্ঞের পরিপ্রেক্ষিতে এই দেশের অর্থনীতি কত দ্রুত গড়ে তােলা হচ্ছে সে কথা উপলব্ধি করা হয়নি। বাংলাদেশে শীঘ্রই সংবিধান প্রণয়নের কাজ শেষ হবে এবং আগামী কয়েক মাসের মধ্যেই সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এভাবে আমাদের জনসাধারণের কল্যাণে কাজ এগিয়ে চলেছে। তাছাড়া উপমহাদেশের সমস্যাবলি সমাধানের জন্যও আমরা গঠনমূলক কাজ করে যাচ্ছি। পাকিস্তানের জনসাধারণকে বাংলাদেশের সেসব উন্নয়নমূলক অগ্রগতির কথা জানাতে হবে। তাতে হয়তাে অনেকেরই মােহমুক্তি ঘটবে। উপমহাদেশের জনসাধারণের মঙ্গলের জন্য সমস্যাসমূহের সমাধানের উদ্দেশ্যে পাকিস্তানের উচিত এই ঐতিহাসিক সুযােগের সদ্ব্যবহার করা।

১২৩
কতিপয় প্রশ্নের জবাবে
“দেখুন, ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার উপর গড়ে উঠেছে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শােষণ কাকে বলে।

১২৫
খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস : বঙ্গবন্ধু, আমরা দীর্ঘকাল আপনার রাজনৈতিক জীবনের সংস্পর্শে থেকে লক্ষ করে এসেছি যে, বাংলাদেশের নিজস্ব ঐতিহাসিক ধারার বিকাশ ও বাঙালি জাতির চেতনার স্তর বিবেচনায় রেখে আপনি এদেশের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক মুক্তির জন্যে সুনির্দিষ্ট ও সুস্পষ্ট পথনির্দেশ দিয়ে আসছেন, নিজস্ব একটি মতবাদ ব্যক্ত করে আসছেন। এখন আমার প্রশ্ন-আপনি জিন্নাবাদ, গান্ধীবাদ, নাসেরবাদ, ইহুদিবাদ, মাওবাদ, টিটোবাদ, লেনিনবাদ ও মার্কসবাদের আলােকে আপনার মতবাদের মূল্যায়ন সম্পর্কে কী ভাবছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, ছাত্রজীবন থেকে আজ পর্যন্ত আমার এই সুদীর্ঘকালের রাজনৈতিক জীবনের অভিজ্ঞতা ও সংগ্রাম কতিপয় চিন্তাধারার উপর গড়ে উঠেছে। এদেশের কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র, মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবী তথা সকল মেহনতি মানুষের জীবনে শান্তি, সমৃদ্ধি ও সাম্য প্রতিষ্ঠাই আমার চিন্তাধারার মূল বিষয়বস্তু। একটি মধ্যবিত্ত পরিবারে আমার জন্ম। কাজেই কৃষকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট থেকে আমি জানি শােষণ কাকে বলে। এ দেশে যুগ যুগ ধরে শােষিত হয়েছে কৃষক, শােষিত হয়েছে শ্রমিক, শােষিত হয়েছে বুদ্ধিজীবীসহ সকল মেহনতি মানুষ। এ দেশের জমিদার, জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউটদের চলে শােষণ। শােষণ চলে ফড়িয়া-ব্যবসায়ী ও পুঁজিবাদের। শােষণ চলে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদের। এ দেশের

১২৬
সােনার মানুষ, এ দেশের মাটির মানুষ শােষণে শােষণে একেবারে দিশেহারা হয়ে পড়ে। কিন্তু তাদের মুক্তির পথ কী? এই প্রশ্ন আমাকেও দিশেহারা করে ফেলে। পরে আমি পথের সন্ধান পাই। আমার কোন কোন সহযােগী রাজনৈতিক দল ও প্রগতিশীল বন্ধুবান্ধব বলেন, শ্রেণি সংগ্রামের কথা। কিন্তু আমি বলি জাতীয়তাবাদের কথা। জিন্নাবাদ এ দেশের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সৃষ্টি করে সাম্প্রদায়িকতাবাদের বিষবাষ্প। তার জবাবে আমি বলি, যার যার ধর্ম তার তার-এরই ভিত্তিতে ধর্মনিরপেক্ষতাবাদের কথা। সেই সঙ্গে বলি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের কথা। শােষণহীন সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় সমাজতন্ত্র চাই। কিন্তু রক্তপাত ঘটিয়ে নয়-গণতান্ত্রিক পন্থায়, সংসদীয় বিধিবিধানের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠা করতে চাই সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা।
আমার এই মতবাদ বাংলাদেশের বাস্তব অবস্থা ও ঐতিহাসিক পরিস্থিতি বিচার-বিশ্লেষণ করেই দাঁড় করিয়েছি। সােভিয়েত ইউনিয়ন, চীন, যুগােশ্লাভিয়া প্রত্যেকে নিজ নিজ পথে, নিজ নিজ অবস্থা মােতাবেক গড়ে তুলছে সমাজতন্ত্র । আমি মনে করি, বাংলাদেশকেও অগ্রসর হতে হবে জাতীয়তাবাদ, ধর্মনিরপেক্ষতাবাদ, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র—এই চারিটি মূল সূত্র ধরে, বাংলাদেশের নিজস্ব পথ ধরে।
আমার উপরােক্ত মতবাদকে অনেকে বলছেন, মুজিববাদ’। এ দেশের লেখক, সাহিত্যিক কিংবা ঐতিহাসিকগণ আমার চিন্তাধারার কী নামকরণ করবেন সেটা তাঁদের ব্যাপার, আমার নয়। নামকরণের প্রতি আমার কোন মােহ নেই। আমি চাই কাজ। আমি চাই আমার চিন্তাধারার বাস্তব রূপায়ণ। আমি চাই শােষণমুক্ত গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। আমি চাই আমার স্বপ্ন ‘সােনার বাংলা’ নির্মাণের পূর্ণ বাস্তবায়ন।
খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস : জাতীয়তাবাদ আপনার মতবাদের অন্যতম প্রধান স্তম্ভ। কিন্তু আপনি তাে জানেন, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে ফ্যাসিবাদের জন্ম দেয়? তা সত্ত্বেও জাতীয়তাবাদের প্রতি আপনি এত গুরুত্ব দিচ্ছেন কেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনি ঠিকই বলেছেন যে, জাতীয়তাবাদ উগ্রতা কিংবা সংকীর্ণতায় পর্যবসিত হলে হিটলারের জার্মানি,

১২৭
মুসােলিনির ইতালি, ডক্টর ভেরউর্ডের দক্ষিণ আফ্রিকা, পাঞ্জাবি খানদের পাকিস্তান বা ইসরাইলের ইহুদিবাদের মতাে অতি জঘন্য রূপ ধারণ করতে পারে। সে জাতীয়তাবাদ দক্ষিণপন্থী ও প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ। কিন্তু আমার জাতীয়তাবাদ বামপন্থী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ। নাৎসী জার্মানি, ফ্যাসিবাদী পাঞ্জাব, বর্ণবাদী দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইহুদিবাদের মতাে উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের চরিত্র ও তার বিকাশ ধারা লক্ষ করলে দেখতে পাবেন যে-একচেটিয়া পুঁজিবাদ, সামন্তবাদ, সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ এবং আমলাতন্ত্রবাদ ও জঙ্গিবাদ উগ্র ও সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের মূল শক্তি। তারা গণতন্ত্রেরও শক্র, সমাজতন্ত্রেরও শত্রু। তাদের জাতীয়তাবাদ শােষকদের জাতীয়তাবাদ। আমার জাতীয়তাবাদ শােষিতের জাতীয়তাবাদ। কারণ, আমার জাতীয়তাবাদের নেতৃত্বে রয়েছেন কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র ও বুদ্ধিজীবী শ্রেণির সমন্বয়ে গঠিত আওয়ামী লীগ। কাজেই যে জাতীয়তাবাদ আমার মতবাদের অন্যতম প্রধান অঙ্গ, সেই বিপ্লবী ও প্রগতিশীল জাতীয়তাবাদ ফ্যাসিবাদে রূপান্তরিত হবার কোন ঐতিহাসিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও বাস্তব কারণ নেই।
খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস : বিশ্বসমাজকে একটি সমাজ এবং বিশ্বমানবকে যদি একটি গােষ্ঠী ধরে নেই, তবে কি জাতীয়তাবাদের চেয়ে আন্তর্জাতিকতাবাদ উন্নততর পর্যায় নয়?
শেখ মুজিবুর রহমান : সাম্প্রদায়িকতাবাদ এ দেশের মাটিতে গভীর শিকড় গেড়ে বসে আছে। তাকে নির্মূল করে তবেই এ দেশের শ্রেণিচেতনার বিকাশ সাধন সম্ভবপর। আর একমাত্র শ্রেণিচেতনাই আন্তর্জাতিকতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পূর্বশর্ত। এ দেশের অভিজ্ঞতা থেকে বলছি যে, শ্রেণিচেতনা বিকাশের পথে সাম্প্রদায়িকতাবাদ প্রধান অন্তরায়। আর সাম্প্রদায়িকতাবাদ নির্মূল করার রণকৌশল হিসাবেই আমি জাতীয়তাবাদী দর্শন অনুসরণ করেছি। এই মতবাদ কার্যকরী হলে, আমার বিশ্বাস-এ দেশের ভাবীকালের মানুষ ক্রমে ক্রমে জাতীয়তাবাদের গণ্ডি পার হয়ে উত্তীর্ণ হবে বিশ্বমানবতাবাদী উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে।

১২৮
খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস : গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা বলতে আপনি কী বুঝাতে চান?
শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা প্রতিষ্ঠায় দুইটি পথের কথাই আমরা জানি। একটি হলাে-শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য মেহনতি মানুষের নেতৃত্বে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ, অপরটি-সংসদীয় গণতন্ত্রের পথ। লেনিন রাশিয়ায় এবং মাও-সে তুঙ চীনে প্রথমােক্ত লাইনে সশস্ত্র বিপ্লবের পথ বেছে নিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সমাজজীবনে সাম্প্রদায়িকতাবাদের অশুভ ভূমিকার দরুন এ দেশে শ্রেণিসংগঠন ও শ্রেণিসংগ্রাম গড়ে ওঠেনি। এমনকি সাধারণ। গণতান্ত্রিক আন্দোলনের পক্ষেও সাম্প্রদায়িকতাবাদের ভূমিকা ছিল। অতিশয় মারাত্মক। তদুপরি দেশটি শিল্পে পশ্চাৎপদ বলে এখানে শিল্পশ্রমিকও তেমন সৃষ্টি হয়নি, সংগঠিতও হয়নি। এরূপ বাস্তব অবস্থায় বাংলাদেশে শ্রেণিসংগঠন ও শ্রেণি সংগ্রামের স্থলে গড়ে উঠেছে শ্রমিক, কৃষক, বুদ্ধিজীবী ও অন্যান্য মেহনতী শ্রেণির সক্রিয় সমর্থনে বহুশ্রেণিভিত্তিক জাতীয় সংগঠন ও জাতীয় সংগ্রামী দল আওয়ামী লীগ।

১২৯
জমিদারি উচ্ছেদের পর এ দেশের সামন্তবাদ তেমন শক্তিশালী নয়। এখন রয়েছে সামন্তবাদের ভগ্নাবশেষ-জোতদার, মহাজন ও তাদের আমলা-টাউট। আইনের মাধ্যমেই তাদের উচ্ছেদ সম্পন্ন হবে। ওদিকে আওয়ামী লীগের জাতীয় সরকার ব্যাংক-বীমা, বৃহৎ ও ভারি শিল্প এবং বাণিজ্যের এক বিরাট অংশ জাতীয়করণ করার ফলে বুর্জোয়া শ্রেণি ও পুঁজিবাদের বিকাশের পথ রুদ্ধ হয়েছে। তাদের এমন ক্ষমতা নেই যে, সরকারের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম করে। শােষক শ্রেণিকে দমন করার মতাে যথেষ্ট ক্ষমতা দেশবাসীর আছে। সমাজতন্ত্র রাতারাতি হয়
-দীর্ঘদিনের ব্যাপার। শান্তিপূর্ণভাবে এবং ধীরে ধীরে অগ্রসর হতে হবে, ধাপে ধাপে অগ্রসর হতে হবে। রক্তপাত অনেক হয়েছে, আর নয়। এবার সংসদীয় গণতন্ত্রের মাধ্যমে এবং শান্তিপূর্ণ উপায়ে আমরা দেশকে ঐক্য, প্রগতি ও সমাজতন্ত্রের পথে এগিয়ে নিতে চাই। এ কাজে আমি মনে করি-শক্তির উৎস বন্দুকের নল নয়, শক্তির উৎস আমার জনগণ।
খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস : ইতিহাসের অভিজ্ঞতায় দেখা গেছে। যে, পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশই সাম্রাজ্যবাদ সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগকে ধ্বংস করার চক্রান্তে লিপ্ত থাকে। আপনি কি মনে করেন যে, বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটতে পারে?
শেখ মুজিবুর রহমান : দেখুন, পুঁজিবাদী ও সামন্তবাদী শােষণব্যবস্থার ধ্বংস সাধনের মাধ্যমেই প্রতিষ্ঠিত হয় সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থা, শােষণহীন সমাজব্যবস্থা। কাজেই সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশেই পুঁজিবাদ ও সামন্তবাদ প্রতিরােধ গড়ে তুলবার চেষ্টা করে। তাদের সঙ্গে কখনাে প্রকাশ্যে, কখনাে গােপনে যুক্ত হয় শােষকদের আন্তর্জাতিক দোসর-সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশবাদ ও নয়া-উপনিবেশবাদ। বাংলাদেশেও তার পুনরাবৃত্তি ঘটা অস্বাভাবিক নয়। বাঙালির স্বাধীনতাযুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদের বৈরী ভূমিকায় আমরা ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছি, কিন্তু বিস্ময় প্রকাশ করিনি। কারণ, জাতীয় স্বাধীনতার বিরােধিতা করাই তাদের বিঘােষিত নীতি। তবে,

১৩০
সাম্রাজ্যবাদী দেশসমূহেও প্রগতিশীল সংগঠন ও ব্যক্তি আছেন। তাঁরাও তাদের দেশে শান্তি, গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্রের জন্যে সংগ্রাম করছেন। আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা তাদের সক্রিয় সমর্থন লাভ করেছি। আশা করি, আমাদের সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র ও শান্তির সংগ্রামেও তাঁদের সক্রিয় সমর্থন আমরা লাভ করব। এ প্রশ্নে দেশের অভ্যন্তরে আমরা সকল প্রগতিশীল শক্তি ঐক্যবদ্ধ। আন্তর্জাতিকভাবেও আমরা ঐক্যবদ্ধ এবং শক্তিশালী।
খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস ১৬ই ডিসেম্বর ১৯৭২

১৩১
তিনজন মার্কিন সাংবাদিকের মুখােমুখি
‘আর ভয়ের কথা বলছেন? শেখ মুজিব তার যৌবনের প্রায় অর্ধেকটাই কাটিয়েছে কারাগার অভ্যন্তরে। আর জীবনে দু’দুবার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির আসামী ছিল। তাই শেখের ডিকশনারিতে ভয় বলে কোনাে শব্দ নেই। আপনারা আমাকে যেকোনাে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন।

১৩৩
তিনজন মার্কিনী সাংবাদিক সেদিন বিকাল ৪টা থেকে পুরনাে গণভবনের গাড়ি বারান্দায় পায়চারী করতে লাগল। ঠিক বিকাল সাড়ে চারটা শীতের পড়ন্ত রােদে একটা পতাকাবাহী গাড়িতে প্রধানমন্ত্রী শেখ মুজিবুর রহমান এসে হাজির হলেন। গাড়ি থেকে নামার মুহূর্তে সাদা চামড়ার সাংবাদিকদের দেখে তার ভ্রু দুটো কুঁচকে উঠল। ইন্টারভিউ দেয়ার আর শেষ নেই নাকি? তাই গাড়ি থেকে নেমেই তিনি বারান্দা দিয়ে হন হন করে গণভবনের পিছনের দিকে রওনা হলেন। সাংবাদিকরাও নাছােড়বান্দা। তারাও দ্রুত প্রধানমন্ত্রীর পিছু নিলেন। এরপর বারান্দায় দাঁড়িয়ে কথােপকথন ছিল নিম্নরূপ।
এম আর আখতার মুকুল
১ম সাংবাদিক : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমরা আপনাকে ইন্টারভিউ করতে চাই। কিন্তু আমরা সে সুযােগ পাচ্ছি না কেন? আপনি কি বিদেশী সাংবাদিকদের ভয় পান?
শেখ মুজিবুর রহমান : প্রথমেই আমি আপনাদের একটা পালটা প্রশ্ন করতে চাই। আপনারা কোনােরকম এপয়েন্টমেন্ট ছাড়া আমার সঙ্গে কথা বলছেন; আমাদের বাংলাদেশের কোনাে সাংবাদিক কি এভাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সন-এর সঙ্গে কথা বলা কিংবা প্রশ্ন জিজ্ঞেস করার সুযােগ পাবে? আর ভয়ের কথা বলছেন? শেখ মুজিব তার যৌবনের প্রায় অর্ধেকটাই কাটিয়েছে কারাগার অভ্যন্তরে। আর জীবনে দু’দুবার রাষ্ট্রদ্রোহিতার মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় ফাঁসির আসামি ছিল। তাই শেখের ডিকশনারিতে ভয় বলে কোনাে শব্দ নেই। আপনারা আমাকে যেকোনাে প্রশ্ন জিজ্ঞেস করতে পারেন।

১৩৪
২য় সাংবাদিক : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনি কি অস্বীকার করতে পারেন যে, বর্তমানে বাংলাদেশের আইন ও শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতি খুবই খারাপ? এর উন্নতির জন্য আপনার সরকার কী ধরনের ব্যবস্থা নিয়েছে? পরিস্থিতির উন্নতি হওয়ার আদৌ কোনাে সম্ভাবনা আছে কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি এতক্ষণ এ ধরনের একটা প্রশ্ন আশা করছিলাম। আসুন, আমরা পরিস্থিতি সঠিকভাবে বুঝবার জন্য একটা পরীক্ষা করি। আপনারা নিশ্চয়ই হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল-এ উঠেছেন? তাহলে আজ গভীর রাতে ধরুন ১১টা কিংবা ১২টা নাগাদ কোনােরকম গার্ড ছাড়াই আপনারা একাকী পায়ে হেঁটে এই গণভবন থেকে হােটেলে যাবেন। আমি দেখতে চাই, আপনাদের কেউ ছিনতাই কিংবা স্পর্শ করে কি না?
২য় সাংবাদিক : এটা আবার কী ধরনের পরীক্ষা?
শেখ মুজিবুর রহমান : শােনেন সাহেবরা। আইন-শৃঙ্খলার কথাই যখন ওঠালেন, তখন আমি আপনাদের ছােট্ট একটা প্রশ্ন করতে চাই। দুনিয়ার সবচেয়ে সভ্য দেশ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশের সবচেয়ে বড়াে দুটো মহানগরী হচ্ছে, নিউইয়র্ক আর শিকাগাে সিটি। তাহলে আমাকে বলতে পারেন এ দুটো মহানগরীতে কোনাে মহিলা তাে দূরের কথা, কোনাে দ্রলােকের পক্ষে সন্ধ্যার পর ফুটপাথ দিয়ে হেঁটে যাওয়া কি সম্ভব?
৩য় সাংবাদিক : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনি তাে আমার প্রশ্নগুলাে এড়িয়ে যাচ্ছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি কোথায় প্রশ্ন এড়ালাম? পরিস্থিতি ভালাে করে বােঝাবার জন্য আমি তাে শুধুমাত্র আপনাদের সুসভ্য দেশের সঙ্গে আমাদের দেশের আইন-শৃঙ্খলাজনিত পরিস্থিতির তুলনা করলাম মাত্র।
৩য় সাংবাদিক : এবার আমি আপনাকে একটা গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন করতে চাই।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি সানন্দে প্রশ্নের জবাব দিব। কিন্তু এটাই হবে আপনাদের শেষ প্রশ্ন। আমার জরুরি কাজ রয়েছে।
৩য় সাংবাদিক : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আপনি ‘বিহারীদের ব্যাপারে কী পদক্ষেপ নিয়েছেন? বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্পগুলােতে

১৩৫
কয়েক লাখ ‘বিহারী’ পরিবার এখন যে নারকীয় অবস্থায় জীবন যাপন করছে, তা স্বচক্ষে দেখার জন্য আপনি ফুরসৎ পেয়েছেন কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনি আমাকে একই সঙ্গে দুটো প্রশ্ন করেছেন। প্রথমটার উত্তর সােজা। এসব ‘বিহারী’রা একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর দোসর হিসাবে নির্বিচারে হত্যা, নারী ধর্ষণ, লুণ্ঠন এবং অগ্নিসংযােগের মতাে মানবতা বিরােধী কাজে লিপ্ত ছিল। তবুও স্বাধীন বাংলাদেশে এরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছে। উপরন্তু এরা আন্তর্জাতিক রেডক্রশ-এর মাধ্যমে নিজেদের পাকিস্তানি নাগরিক হিসাবে দাবি জানিয়েছে। স্বাভাবিকভাবে এদের পুরাে দায়িত্বই হচ্ছে পাকিস্তান। সরকারের। এখন সবার উচিত হবে, পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ প্রয়ােগ করে বিহারীদের পাকিস্তানে ফেরৎ নেওয়ার ব্যবস্থা করা।
দ্বিতীয়ত আপনি এদের ক্যাম্প জীবনের অবস্থা সম্পর্কে প্রশ্ন করেছেন। আমার তাে মনে হয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও নিগ্রোরা সেদেশের বস্তিগুলােতে যেভাবে জীবন যাপন করছে, সে তুলনায় বাংলাদেশে বিহারীরা অনেক ভালাে আছে। সঠিক কি না? (মুচকি হেসে) আপনাদের সংবাদপত্রে আমার জবাবগুলাে হুবহু ছাপালে আমি খুশিই হবাে। ধন্যবাদ।
মাত্র দিন কয়েকের ব্যবধানে আলােচ্য মার্কিনী সাংবাদিকদের প্রশ্নের বিষয় থেকে শুরু করে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করার স্টাইল ও ধরনের সঙ্গে এ্যান্থনী ম্যাসকার্নহাস-এর প্রশ্ন ও স্টাইল-এর হুবহু মিল দেখে চমকে উঠলাম। তাহলে কি এসব সাম্প্রতিক ঘটনাবলির মধ্যে একটা গােপন যােগসূত্র রয়েছে?
সাংবাদিক সাক্ষাঙ্কারের একেবারে শেষ পর্যায়ে এসে হঠাৎ করে ম্যাসকার্নহাসের চেহারার মধ্যে পরিবর্তন হলাে। মুহূর্তে বিলীন হলাে রাগান্বিত ভাব। চেহারায় উদ্ভাসিত হলাে এক অমায়িক হাসি। এবার কথােপকথন হচ্ছে নিম্নরূপ।
ম্যাসকার্নহাস : মি. প্রাইম মিনিস্টার, আমি আপনাকে আর বিরক্ত করবাে না। আপনার সঙ্গে আমার মাত্র দু’মিনিটের একটা গােপন কথা রয়েছে। ঘর খালি হলে বলতে পারি।
শেখ মুজিবুর রহমান : তথ্য দপ্তরের মহাপরিচালক এম আর আখতার মুকুল-এর সামনে আপনি নিশ্চিন্তে কথা বলতে পারেন। ওতাে আপনার পূর্ব পরিচিত; ঠিক কি না? আমাদের খুব বিশ্বাসী অফিসার।

১৩৬
ম্যাসকার্নহাস : মুজিব ভাই, আপনি তাে জানেন গত বছর আমি বাংলাদেশের জন্য কী দুঃসাহসিক কাজ করেছি। লন্ডনের সানডে টাইমস’ পত্রিকায় প্রকাশিত আমার এসব চাঞ্চল্যকর রিপাের্টের দরুন বিশ্ব জনমত বাংলাদেশের পক্ষে সােচ্চার হয়েছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমরা তাে আপনার এই অবদানের স্বীকৃতি বার বার করে যাচ্ছি। এখন বলুন, আপনার আসল বক্তব্য কী?
ম্যাসকার্নহাস : আপনি তাে জানেন, শুধুমাত্র এই একটি রিপাের্ট ছাপাবার উদ্দেশে আমাকে এতগুলাে ছেলেমেয়ে নিয়ে দেশত্যাগ করতে হয়েছে। আমি এখন বাস্তুহারা এবং ব্রিটেনে শরণার্থী।
শেখ মুজিবুর রহমান : ১৯৪৭ সালে প্রথমবার ভারতের গােয়া থেকে করাচীতে এসেছেন। দ্বিতীয়বার ১৯৭১-এ করাচী থেকে লন্ডনে পাড়ি জমিয়েছেন। এখন বলুন আপনি আমার কাছে কী চান?
ম্যাসকার্নহাস : সম্প্রতি পশ্চিম লন্ডনের শেফার্ড বুশ-এর কাছে একটা বাড়ি কেনার চেষ্টা করছি। এজন্য বহু অর্থের প্রয়ােজন। মুজিব ভাই, আমি আপনার কাছে হাজার বিশেক পাউন্ড চাচ্ছি। কথা দিচ্ছি এরপর কোনােদিনই আর আপনাকে বিরক্ত করবাে না।
শেখ মুজিবুর রহমান : বলেন কী? বিশ হাজার পাউন্ড? মানে আমাদের প্রায় আট লাখ টাকা? আমি হচ্ছি একটা গরিব দেশের প্রধানমন্ত্রী? এখানকার অফিসারদের সর্বোচ্চ বেতন হচ্ছে মাত্র এক হাজার টাকা। আমি এত টাকা বৈদেশিক মুদ্রায় পাবাে কোত্থেকে? না, টনি আমার দ্বারা সম্ভব হবে না। আমাকে মাফ করতে হবে।
ম্যাসকার্নহাস : বলছিলাম কি, গভর্নমেন্ট-এর তাে অনেক সিক্রেট ফান্ড থাকে। সেসব কোনাে ফান্ড…।
শেখ মুজিবুর রহমান : টনি, আমি দুঃখিত। গভর্নমেন্টের কোনাে ফান্ড থেকে এভাবে নগদ ২০ হাজার পাউন্ড দিতে পারব না। তবে ইংল্যান্ডের সিলেটিদের বিশেষ করে সেখানকার আওয়ামী লীগ সভাপতি গাউস খানকে অনুরােধ করতে পারি আপনাকে সাহায্য করার।
ম্যাসকার্নহাস : মি. প্রাইম মিনিস্টার, লন্ডনে অন্তত এলাহাবাদ রেস্টুরেন্ট-এর মালিক গাউস খানের সাহায্যের দরকার হবে না। আপনাকে এভাবে বিরক্ত করার জন্য আমি দুঃখিত। ধন্যবাদ।

১৩৭
কমরেড মুজিব, আই লাভ ইউ, আই লাভ বাংলাদেশ
‘আমার তাে এখন একমাত্র চিন্তা বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কীভাবে দ্রুত পুনর্গঠন করা সম্ভব।

১৩৯
কটেজের গাড়িবারান্দায় সাদা পায়জামা-পাঞ্জাবি আর কালাে মুজিব কোট পরে অভ্যর্থনার জন্য দাঁড়িয়ে স্বয়ং বঙ্গবন্ধু। হাতে জ্বলন্ত পাইপ। ভূমধ্যসাগরের সৈকতে তখন বিকেলের পড়ন্ত রােদ, দূর থেকে ভেসে আসছে অসংখ্য গাংচিলের আওয়াজ। বিশেষভাবে নির্মিত বুলেটপ্রুফ লিমুজিনে কাস্ত্রো এসে হাজির হলেন, তাতে জনা আটেক দেহরক্ষী। ড্রাইভারের পাশে দুজন এবং একেবারে পেছনের সিটে চারজন। আর মধ্যে যেখানে কমরেড কাস্ত্রো বসে তারও দুই পাশে দুজন। এ ছাড়া সামনে ও পেছনের অন্য গাড়িতে রয়েছে বিশেষ কমান্ডাে প্লাটুন। গালভর্তি চাপদাড়ি, মাথায় গেরিলা টুপি আর পরনে জলপাই রঙের আধাসামরিক পােশাক। প্রায় ছয় ফুট লম্বা ফিদেল কাস্ত্রো যখন চুরুট হাতে গাড়ি থেকে নেমেই সহাস্য বদন বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে, তখন অমায়িক হাসি উদ্ভাসিত হলাে তাঁর মুখে। এরপর পরস্পর উষ্ণ আলিঙ্গন আর চুম্বন। ইংরেজি ভাষায় কাস্ত্রোর বিশেষ দখল নেই। তাঁর ভাঙা ভাঙা ইংরেজি উচ্চারণে ফরাসি-স্পেনীয় প্রভাব। আর শেখ মুজিবের ইংরেজিতে উপমহাদেশীয় টান। কোনাে দোভাষী ছাড়াই শুরু হলাে দুই নেতার আলােচনা। দুজন একই সােফায় বসে। উল্টো দিকের সােফায় দুই দেশের উপদেষ্টা আর প্রতিনিধিরা। এই আলােচনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অপরিসীম। তাই কয়েক লাইনের নােট আর স্মরণশক্তির ওপর নির্ভর করে এই আলােচনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশবিশেষ পাঠকদের সমীপে উপস্থাপন করলাম।
এম আর আখতার মুকুল
ফিদেল কাস্ত্রো : এক্সিলেন্সি, আপনি বােধ হয় চিলির বিপ্লবী প্রেসিডেন্ট আলেন্দের সর্বশেষ অবস্থার কথা অবগত আছেন। বিদেশি ষড়যন্ত্রে তাঁর সরকারের পতন এখন যেকোনাে মুহূর্তে হতে পারে। এক্সিলেন্সি, এ প্রেক্ষাপটে আপনাকে অত্যন্ত আপনজন মনে করেই আজ কয়েকটা কথা বলব।

১৪০
শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, আপনি নির্ভয়ে বলতে পারেন। আমি জানি যে আপনি হচ্ছেন আমাদের অকৃত্রিম শুভাকাক্ষী এবং বন্ধু। ফিদেল কাস্ত্রো : বাংলাদেশ এবং ভারত থেকে আমরা যেসব খবর পাচ্ছি, তাতে এ দুটি দেশের অবস্থা খুব একটা সুবিধার মনে হচ্ছে না। দুটি দেশেই সাম্রাজ্যবাদী এজেন্টরা খুবই তৎপর। শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, এত ভূমিকা না করে আসল কথা বললে আমি খুশিই হবাে।
ফিদেল কাস্ত্রো : এক্সিলেন্সি, তাহলে শুনুন। চিলির প্রেসিডেন্ট আলেন্দের মতাে আমরা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবকেও খরচের খাতায় রেখে দিয়েছি।
শেখ মুজিবুর রহমান : কমরেড, হঠাৎ এ কথা বলছেন কেন?
ফিদেল কাস্ত্রো : একটি পরাজিত প্রশাসনকে আপনি বাংলাদেশে আইনসংগত করেছেন।
শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, আপনি জানেন বাংলাদেশ আয়তনে একটা ক্ষুদ্র দেশ এবং একাত্তরের যুদ্ধে ভয়ংকরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। তাই বাংলাদেশকে পুনর্গঠনের জন্য আমাদের অভিজ্ঞ ঝানু ব্যুরােক্রেট প্রয়ােজন। এ জন্যই আমি পাকিস্তানি আমলের অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের বাংলাদেশের প্রশাসনে বসিয়েছি।

১৪১
ফিদেল কাস্ত্রো : বেয়াদবি নেবেন না এক্সিলেন্সি। এদের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতার কথা বলছেন? তাদের কী অভিজ্ঞতা আছে? এসব অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শের জন্যই তাে যুদ্ধে পরাক্রমশালী পাকিস্তান হেরেছে। আপনার মুক্তি ছেলেরা? কোনাে অভিজ্ঞতা নেই। লড়াই, লড়াই আর লড়াই-বিজয় ছিনিয়ে আনল।শেখ মুজিবুর রহমান : তাহলে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশে পুনর্গঠনের কাজ করব কীভাবে?
ফিদেল কাস্ত্রো : আইনজীবীদের আনুন, সাংবাদিকদের আনুন, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের আনুন, ডাক্তারদের আনুন, প্রকৌশলীদের আনুন, অধ্যাপকদের আনুন-এদের প্রশাসনে বসান। তারা ভুল করবে, ভুল করে শিখবে, কিন্তু ষড়যন্ত্র করবে না। ঈশ্বরের দোহাই, আপনার মুক্তি ছেলেদের আরাে দায়িত্ব দিন, তাদের পুরাে বিশ্বাস করুন। না হলে আপনি শেষ। | শেখ মুজিবুর রহমান : কমরেড, সত্যি বলতে কি, গুটিকয়েক আঙুলে গােনা দালাল কর্মকর্তাকে বরখাস্ত করে বাকি অভিজ্ঞ কর্মকর্তাদের সিনিয়রিটি দিয়ে দায়িত্বপূর্ণ পদে বসিয়েছি। আমার তাে ধারণা, এদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগবে।
ফিদেল কাস্ত্রো : দুনিয়ার কোথাও যুদ্ধে পরাজিত প্রশাসনের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের নতুন প্রশাসনে আর দায়িত্ব দেওয়া হয় না। বাংলাদেশে আপনার মহানুভবতায় ওরা প্রাণে রক্ষা পেয়েছে, এই-ই তাে যথেষ্ট। যুদ্ধোত্তর দেশে তাে এ ধরনের কর্মকর্তা পুনর্বাসনের প্রশ্নই উঠতে পারে না। দেখুন না সাম্রাজ্যবাদী যুক্তরাষ্ট্রেও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দলের পরাজয় হলে উচ্চপদস্থ কর্মচারী, এমনকি রাষ্ট্রদূতদের পর্যন্ত বিদায় নিতে হয়।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার তাে এখন একমাত্র চিন্তা বিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কীভাবে দ্রুত পুনর্গঠন করা সম্ভব।
ফিদেল কাস্ত্রো : তাহলে কিউবার দৃষ্টান্ত দিয়েই বলছি। মহান বিপ্লবের অব্যবহিত পর কমরেড চে গুয়েভারা স্বয়ং কিউবার পরাজিত প্রশাসনকে নিশ্চিহ্ন করে একেবারে নতুন করে ঢেলে সাজিয়ে

১৪২
দিয়েছেন। আজকের দিনে কিউবার মাটিতে অন্তত সাবেক বাতিস্তা সরকারের কোনাে আমলার চিহ্ন মাত্র খুঁজে পাবেন না। এ জন্যই কিউবার ঠিক ঘাড়ের ওপরে মহাপরাক্রমশালী মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের অবস্থান হওয়া সত্ত্বেও আমার বিরুদ্ধে কোনাে ষড়যন্ত্রই সফল হচ্ছে না। এই যে দেখছেন, আমার কমরেড দেহরক্ষী। কেউই এঁদের কাউকে আমার বিরুদ্ধে দলে ভেড়াতে পারবে না। কিছুতেই এঁদের কিনতে পারবে না। ডিক্টেটর বাতিস্তার বিরুদ্ধে দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের সময় আমরা একই বাংকার থেকে যুদ্ধ করেছি। এ সময় খাদ্য, বিছানা-সব একসঙ্গে ভাগ করেছি। আপনি ধারণাও করতে পারবেন না এরা আমাকে কত ভালােবাসে। আমি চুরুট খাই। আমার ছেলেরা প্রথমে এটা টেস্ট করে। সিআইএর বিষক্রিয়ায় দুজন তাে মরেই গেল। বাংলাদেশে আপনি কাদের বিশ্বাস করেছেন? কমরেড আলেন্দের মতাে আপনিও নিশ্চিহ্ন হতে যাচ্ছেন কমরেড মুজিব।
এবার বিদায়ের পালা। হাতের অর্ধদগ্ধ চুরুটটা অ্যাশট্রেতে রেখে ধীর পদক্ষেপে ফিদেল কাস্ত্রো এগিয়ে এলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে। এরপর কাস্ত্রো-মুজিব উষ্ণ আলিঙ্গন আর পরস্পর চুম্বন। আলিঙ্গনের শেষ মুহূর্তে মুজিবের কাঁধে মাথা রেখে অকস্মাৎ ঘরের নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে কাস্ত্রো বলে উঠলেন, কমরেড মুজিব, আমি তােমায় ভালােবাসি তােমায় ভালােবাসি। বাংলাদেশকে ভালােবাসি।’
গাড়িবারান্দায় স্টার্ট দিয়ে রাখা লিমুজিনে উঠতে গিয়ে হঠাৎ মাথাটা একটু তেরছা করে ঘুরিয়ে কাস্ত্রো একাই স্লোগান দিলেন জয় বাংলা’।
ঝড়ের বেগে গাড়ি কটা বেরিয়ে গেল।
১৯৭৩ আলজিয়ার্স

১৪৩
আল্লাহ তাআলা তাে শুধু
আল মুসলেমিন নন। তিনি হচ্ছেন রাব্বল আলামিন
বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতাে অমুসলিম রয়েছে। সবাই একই সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পােহায়েছে। তা ছাড়া এক্সিলেন্সি, সবচেয়ে বড় কথা হচ্ছে যে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা তাে শুধু আল মুসলেমিন নন-তিনি হচ্ছেন রাব্বল আলামিন। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা।

১৪৫
প্রায় দুই বছর হয় স্বাধীন হয়েছে বাংলাদেশ, অথচ এখনাে স্বীকৃতি দেয়নি সৌদি আরব। তাই আলজিয়ার্সে পৌঁছেই বাদশাহ ফয়সালের সঙ্গে বৈঠকের আগ্রহ প্রকাশ করলেন বঙ্গবন্ধু। ব্যবস্থা করলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল-ইসলাম। এখানে রইল এম আর আখতার মুকুলের দেওয়া সেই বৈঠকের ভাষ্য।
শুরুতেই প্রধানমন্ত্রী মুজিব এবং বাদশাহ ফয়সালের মধ্যে আনুষ্ঠানিক কোলাকুলি ও পারস্পরিক চুম্বন। এরপর দুজন পাশাপাশি সােফায় বসলেন। আরেকটা চেয়ারে বসলেন বাদশাহ ফয়সালের দোভাষী। উল্টো দিকের সােফায় উভয় দেশের অন্যান্য প্রতিনিধি।
প্রথমেই শারীরিক কুশলাদি বিনিময়। এরপর দোভাষীর মাধ্যমে দুই নেতার কথাবার্তা।
বাদশাহ ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, আমি শুনেছি যে বাংলাদেশ আমাদের কাছ থেকে কিছু সাহায্য প্রত্যাশী। কিন্তু কথা হচ্ছে, আপনারা কোন ধরনের সাহায্য চান? দয়া করে বলুন, আপনারা কী চান? অবশ্য এসব সাহায্য দেওয়ার জন্য আমাদের কিছু পূর্বশর্ত রয়েছে। | শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি নেবেন না। আমি হচ্ছি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী। কিন্তু আমার তাে মনে হয় না, মিসকিনের মতাে বাংলাদেশ আপনাদের কাছে কোনাে সাহায্য চেয়েছে।
বাদশাহ ফয়সাল : তাহলে আপনারা কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : বাংলাদেশের পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র কাবা শরিফে নামাজ আদায়ের অধিকার চাচ্ছে। এক্সিলেন্সি, আপনিই বলুন, সেখানে তাে কোনাে শর্ত থাকতে পারে না। আপনি মহান, প্রতিটি

১৪৬
বাঙালি মুসলমান আপনার প্রতি শ্রদ্ধাশীল। আপনি হচ্ছেন পবিত্র কাবা শরিফের হেফাজতকারী। এখানে দুনিয়ার সমস্ত মুসলমানের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। সেখানে আবার শর্ত কেন? এক্সিলেন্সি, আমরা আপনাদের কাছ থেকে ভ্রাতৃসুলভ সমান ব্যবহার প্রত্যাশা করছি।
বাদশাহ ফয়সাল : এসব তাে আর রাজনৈতিক কথাবার্তা হলাে না। এক্সিলেন্সি, বলুন, আপনারা কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়ার কাছ থেকে কী চাচ্ছেন?
শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, আপনি জানেন এই দুনিয়ায় ইন্দোনেশিয়ার পর বাংলাদেশ হচ্ছে দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ। তাই আমি জানতে চাচ্ছি, কেন সৌদি আরব আজ পর্যন্ত স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বীকৃতি দিচ্ছে না?
বাদশাহ ফয়সাল : আমি পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা ছাড়া আর কারাে কাছে জবাবদিহি করি না। তবু আপনি একজন মুসলমান, তাই বলছি-সৌদি স্বীকৃতি পেতে হলে বাংলাদেশের নাম পরিবর্তন করে ইসলামিক রিপাবলিক অব বাংলাদেশ করতে হবে।

১৪৭
শেখ মজিবর রহমান : এই শর্তটা কিন্তু অন্তত বাংলাদেশের জন্য প্রযােজ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসংখ্যা মুসলমান হলেও এ দেশে প্রায় এক কোটির মতাে অমুসলিম রয়েছে। সবাই একই সঙ্গে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে হয় শরিক হয়েছে, না হয় দুর্ভোগ পােহায়েছে। তা ছাড়া এক্সিলেন্সি, সবচেয়ে বড়াে কথা হচ্ছে যে পরম করুণাময় আল্লাহ তাআলা তাে শুধু আল মুসলেমিন নন-তিনি হচ্ছেন রাব্দুল আলামিন। তিনি শুধু মুসলমানদের আল্লাহ নন, তিনি হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র অধিকর্তা। তিনিই হচ্ছেন সব কিছুর একমাত্র স্রষ্টা। এক্সিলেন্সি, বেয়াদবি মাফ করবেন। আপনাদের দেশের নামও তাে ইসলামী প্রজাতান্ত্রিক সৌদি আরব না। এই মহান দেশের নাম আরব জাহানের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী ও রাজনীতিবিদ মরহুম বাদশাহ ইবনে সউদের সম্মানে ‘কিংডম অব সৌদি অ্যারাবিয়া’। কই আমরা কেউই তাে এ নামে আপত্তি করিনি।
বাদশাহ ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, এ ছাড়া আমার অন্য একটা শর্ত রয়েছে। অবিলম্বে সমস্ত পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দিতে হবে।
শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, এটা তাে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের দ্বিপক্ষীয় ব্যাপার। দুটো দেশের মধ্যে এ ধরনের আরাে অমীমাংসিত প্রশ্ন রয়েছে। যেমন ধরুন, বাংলাদেশ থেকে কয়েক লাখ পাকিস্তানি নাগরিককে ফিরিয়ে নেওয়া এবং বাংলাদেশের প্রাপ্য অর্থ পরিশােধ-এমন বেশ কিছু অমীমাংসিত বিষয় রয়েছে। এসবের মীমাংসা কিছুটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। তাই শুধু বিনা শর্তে ৯১ হাজার পাকিস্তানি যুদ্ধবন্দিকে ছেড়ে দেওয়ার প্রশ্নটি পৃথকভাবে বিবেচনা করা বাঞ্ছনীয় হবে না। আর এ জন্য সৌদি আরবই বা এত উদগ্রীব কেন?
বাদশাহ ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, শুধু এটুকু জেনে রাখুন, সৌদি আরব আর পাকিস্তান একই কথা। পাকিস্তান আমাদের সবচেয়ে অকৃত্রিম বন্ধু। তাহলে এক্সিলেন্সি, আর তাে কথা থাকতে পারে না। তবে আমাদের দুটো শর্তের বিষয় চিন্তা করে দেখবেন। একটা হচ্ছে। ইসলামী প্রজাতন্ত্র ঘােষণা। আরেকটা বিনা শর্তে যুদ্ধবন্দির মুক্তি। আশা করি, বাংলাদেশের জন্য সাহায্যের কোনাে কমতি হবে না।
শেখ মুজিবুর রহমান : এক্সিলেন্সি, একটা বিষয় একটু বুঝিয়ে বললে খুশি হতাম।
বাদশাহ ফয়সাল : এক্সিলেন্সি, বলুন কী বিষয়?

১৪৮
শেখ মুজিবুর রহমান : প্রায় দুই বছর পর্যন্ত সৌদি আরব স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেওয়ায় সেখানকার পরহেজগার মুসলমানরা পবিত্র হজ আদায় করতে পারছে না। এভাবে বাধা সৃষ্টি করা কি জায়েজ? পবিত্র কাবা শরিফে তাে দুনিয়ার সমস্ত দেশের মুসলমানদের নামাজ আদায়ের হক রয়েছে। তাহলে কেন এই বাধা সৃষ্টি? কেন আজ হাজার হাজার বাঙালি পরহেজগার মুসলমানকে ভারতের পাসপাের্টে পবিত্র হজ করতে হচ্ছে?
আকস্মিকভাবে এখানেই আলােচনার পরিসমাপ্তি । কিন্তু বৈঠক শেষ হওয়ার পূর্বমুহূর্তে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব তাঁর এককালীন নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর উচ্চারিত একটা আরবি কথার পুনরুক্তি করলেন, ‘লাকুম দ্বিমুকুম অলিয়্যা দ্বিন (তােমার ধর্ম তােমার আমার ধর্ম আমার)।
মুসলিম জাহানের নেতা বাদশাহ ফয়সাল সােফা থেকে উঠে দাঁড়ালে দুজনের মধ্যে বিদায় কোলাকুলি আর পারস্পরিক চুম্বন।
৫-৯ই সেপ্টেম্বর ১৯৭৩ আলজিয়ার্স

১৪৯
পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হবাে।
‘বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটা যদি করতে পারি, আশা রাখি, পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাব। আমাদের গ্যাস আছে দেখে মনে আশা হয়, তেলও আছে। আটলান্টিক-রিফিল্ড আর ইউনিয়ন অয়েলের সঙ্গে আমরা চুক্তি স্বাক্ষরও করেছি। পরিণতিতে আমরা রপ্তানি করতে পারি।

১৫১
বাংলাদেশের কোনাে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে মার্কিন কোনাে প্রেসিডেন্টের এই প্রথম মুলাকাত। যুদ্ধ, মুদ্রাস্ফীতি, খরা ও বন্যা-উত্তর বাংলাদেশে তখন দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি। এই পটভূমিকায় বিশ্বের প্রধান দুই পরাশক্তির একটির প্রধানের সঙ্গে সদ্যঃস্বাধীন গরিব একটি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানের এই সাক্ষাঙ্কার নানা দিক থেকেই গুরুত্বপূর্ণ। তার মধ্যে দেশটি আবার যুক্তরাষ্ট্রের বিরােধিতা অগ্রাহ্য করে স্বাধীনতা লাভ করেছে। তবে দুজনের এই আলােচনায় তেমন কোনাে টেনশন, অন্তত প্রকাশ্যে পরিলক্ষিত হয়নি; বরং আধাঘণ্টারও কম স্থায়ী এই বৈঠকে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গ খুবই উপভােগ করেন প্রেসিডেন্ট ফোর্ড। অন্তত মার্কিন পররাষ্ট্র সচিব হেনরি কিসিঞ্জারের সাক্ষ্য তা-ই বলে। কেননা এক মাস পরে ঢাকা সফরকালে এই সাক্ষাৎকারের প্রসঙ্গ টেনে বঙ্গবন্ধুকে তিনি বলেছিলেন ‘আপনি তাে তাঁকে জাদু করেছেন!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড আর ফোর্ড : আপনাকে এখানে পেয়ে ভালাে লাগছে। এই প্রথম বাংলাদেশের কোনাে রাষ্ট্রপ্রধানের সঙ্গে একজন মার্কিন প্রেসিডেন্টের দেখা হলাে।
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, আমার জনগণ বিষয়ে আপনার সঙ্গে কথা বলার সুযােগ পেয়ে আমিও খুশি।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : সব দেশের জন্যই কিছু করতে পেরে আমরা খুশি।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার দেশের ইতিহাস আপনি জানেন। যুদ্ধের পরে এর অবস্থা ১৯৪৫-এর জার্মানির মতােই হয়েছিল। যে সাহায্য আপনি আমাদের করেছেন, তার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ জানাতে চাই। যুদ্ধের আগে ভারত দ্বারা আমরা বিভক্ত ছিলাম। রাজধানী ইত্যাদি

১৫২
সব ছিল পশ্চিমে। ১৯৪৭-এ বাংলাদেশ অত খারাপ ছিল না। পার্লামেন্টের ৭০ শতাংশ প্রতিনিধিই পশ্চিম থেকে এসেছে। আমিও পার্লামেন্টে ছিলাম। প্রশাসনের বেশির ভাগই যুদ্ধে ধ্বংস হয়েছে, নয় ভারতে চলে গেছে। পরেও আমরা পশ্চিমাদের থেকে বেরােতে পারিনি। প্রত্যেকেই ভুগছে, প্রথমে যুদ্ধ, তারপর খরা, তারপর বন্যা। তবে আপনাদের মতাে কিছু দেশের সাহায্যের বদৌলতে কেউ অবশ্য অভুক্ত নেই। সব কিছুই আমাদের আমদানি করতে হচ্ছে। মুদ্রাস্ফীতি, খরা, বন্যা দেখা দেওয়ার আগে অবশ্য আমরা বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে শুরু করেছিলাম। বাংলাদেশের সম্পদ আছে। বন্যাটা যদি আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি, পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাব। আমরা ধান, পাট, গম, তামাক উৎপাদন করি। গ্যাসের বিরাট মজুদ আছে ১০-২০ ট্রিলিয়ন কিউবিক ফুট। সারে আমরা প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ, তবে আমাদের কারখানাগুলাে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। নিজস্ব গ্যাস আর কারখানাগুলাে দিয়ে আমরা সার রপ্তানি করা শুরু করতে পারি, অবশ্য মুদ্রাস্ফীতিটা যদি না থাকে।

১৫৩
জেরাল্ড আর ফোর্ড : ওপেক দেশগুলােকে আমরা বলে আসছি, আপনাদের মতাে ইন্ডাস্ট্রিয়াল দেশগুলাের সমস্যার মূল যদি হয় তাদের উচ্চমূল্য, তাহলে এই উচ্চমূল্য পতন ডেকে আনবে। এটা কোনাে কাজে আসবে না।
শেখ মুজিবুর রহমান : তেলের মূল্যের কারণে আমরা ভীষণ ভুগছি।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : ওপেক দেশগুলােকে বুঝতে হবে যে তারা সংকীর্ণ দৃষ্টির পরিচয় দিচ্ছে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমাদের দুর্ভিক্ষ চলছে, এই মাত্র শুনলাম একটা ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে। আমরা খুব খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। লােকজন যাতে অভুক্ত না থাকে, তার জন্য এলাকায় এলাকায়। আমি লঙ্গরখানা খুলেছি।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : বাংলাদেশ কনসাের্টিয়ামে কিছু ধনী তেল উৎপাদককে রাখলে ভালাে হয় না? তাদেরও একটা সুযােগ হবে…
শেখ মুজিবুর রহমান : কনসাের্টিয়ামে আবুধাবি আর ইরান যােগ দিয়েছে। মি. প্রেসিডেন্ট, শস্য আর খাদ্যে আমার এখনই সংকট চলছে। | জেরাল্ড আর ফোর্ড : আড়াই লাখ টন খাদ্যশস্য আপনাকে দেওয়া হয়েছে। আমাদের খাদ্যচিত্রটা দেখার পর আর কী করা যায় আমরা দেখব। আমরা বেশি ফলন আশা করেছিলাম। কিন্তু আমাদের বসন্ত ছিল সিক্ত, তারপর গেল খরা, আর এখন চলছে আগাম ঠাণ্ডা। ফলে আমাদের ফসল হয়েছে হতাশাব্যঞ্জক। আমাদের দেখতে হবে আমাদের কী আছে, যা আছে তাই দিয়ে সবচেয়ে ভালাে কী করা যায় তা আমরা দেখব।
শেখ মুজিবুর রহমান : আপনি ভীষণ সদয়। বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে বন্যা নিয়ন্ত্রণ প্রকল্পটা যদি করতে পারি, আশা রাখি, পাঁচ বছরের মধ্যে আমরা স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়ে যাব। আমাদের গ্যাস আছে দেখে মনে আশা হয়, তেলও আছে। আটলান্টিক-রিফিল্ড আর ইউনিয়ন অয়েলের সঙ্গে আমরা চুক্তি স্বাক্ষরও করেছি। পরিণতিতে আমরা রপ্তানি করতে পারি। কিন্তু সে তাে ভবিষ্যতে, কিন্তু আমার সংকট তাে তাৎক্ষণিক।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : আন্তর্জাতিক ঋণদাতা প্রতিষ্ঠানগুলাের সঙ্গে আপনারা কাজ করছেন?

১৫৪
শেখ মুজিবুর রহমান : আমরা বিশ্বব্যাংকের সদস্য। আমাদের স্বাধীনতার পরপরই মি. ম্যাকনামারা বাংলাদেশ সফর করেছেন। আমার বেশির ভাগ মিলই এখন কাজ করছে; কিন্তু সামর্থ্য অনুযায়ী কাজ করার মতাে যথেষ্ট রসদ ও যন্ত্রাংশ নেই।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : পাটের দরের কী অবস্থা? শেখ মুজিবুর রহমান : মাত্র ১০-১২ শতাংশ বেড়েছে।
পাকিস্তানে আমরা সংখ্যাগরিষ্ঠ হয়ে জিতেছি। তাদের সঙ্গে বন্ধু থাকতে আমরা সর্বোচ্চটা করছি। যদিও লাখ লাখ নিহত, অন্তরিন বা নির্বাসিত হয়েছে, তার পরও আমরা ভুলে যেতে চাই। ১৯৫ যুদ্ধাপরাধীসহ পাকিস্তানি বন্দিদের আমরা ছেড়ে দিয়েছি। আদি পাকিস্তানের সম্পদের কিছু হিসসা আমাদের পাওয়া উচিত বলে আমরা মনে করি। তা সত্ত্বেও নতুন দেশের দায়গুলাে আমাকে নিতে হয়েছে। ভুট্টো ঢাকা এলে তাকে আমি এসব বলেছি, কিন্তু এখন পর্যন্ত কিছুই হয়নি। এ ছাড়া আমার দেশে সাত লাখ অবাঙালি আছে। চার লাখ বাংলাদেশেই থাকতে চায়। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু অন্য যারা চলে যেতে চায়, পাকিস্তান তাদের নেবে না। আমাকে তাে আমার লােককে খাওয়াতে হবে। এই সব দেখভাল করতে হলে আমার নিজের লােকের দেখভাল আমি কী করে করব? এই সমস্যাগুলাে আমি আপনার কাছে। তুলে ধরতে চেয়েছিলাম। সবার সঙ্গে আমি সুসম্পর্ক চাই।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : আপনাদের স্বাধীনতা ও জাতিসংঘের সদস্য পদ লাভের জন্য আমরা আপনাকে অভিনন্দন জানাই। দুই সপ্তাহ আগে আমি সেখানে গিয়েছিলাম। জাতিসংঘের প্রতি বর্তমান ভালাে মনােভাব দেখে উৎসাহিত হয়েছি। জাতিসংঘের প্রতি মার্কিন জনগণের মনােভাব সম্প্রতি ইতিবাচক হয়েছে। আশা করি, সবাই মিলে জাতিসংঘে ভালাে কিছু করতে পারব। এটা যদি শুধু একটা তর্কসমিতি হয়, তাহলে এটা কোনাে কাজেরই না। এটাকে আমাদের এমনভাবে ব্যবহার করা উচিত, যাতে এটা কাজ করে।
শেখ মুজিবুর রহমান : আমরা আপনার কাছে কৃতজ্ঞ। আমরা গরিব দেশ, কিন্তু আমরা আপনাদের সঙ্গে ভালাে সম্পর্ক চাই।

১৫৫
জেরাল্ড আর ফোর্ড : এককালে যা ছিল পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান, তাদের মধ্যে তুলনাটা কী রকম?
শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান সাড়ে ছয় কোটি, আমি সাড়ে সাত কোটি। পাকিস্তান আমার চেয়ে বড়াে। আমি একটা পরিবার পরিকল্পনা সংস্থা শুরু করছি। আমরা এখন কিছু বিশেষ সমস্যায় ভুগছি। আমি প্রীত যে আপনি আমাদের সমস্যাগুলাে সম্পর্কে অবহিত। আমরা টিকে থাকতে চাই।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : দেড় লাখ টন প্রস্তুত। এক লাখ টনও কার্যত নিশ্চিত, খালি আমাদের সরবরাহের ওপর নির্ভরশীল। আমরা…
শেখ মুজিবুর রহমান : ভােজ্য তেল আর তুলাটাও কি একটু বিবেচনা করবেন? এই মুহুর্তে আমার লােকেরা আপনার লােকদের সঙ্গে আলােচনা করছে।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : যতটা পারি আমরা করব।
শেখ মুজিবুর রহমান : ধন্যবাদ। আনুষ্ঠানিকভাবে আমি আপনাকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানাই।
জেরাল্ড আর ফোর্ড : ধন্যবাদ। পররাষ্ট্রমন্ত্রী কিসিঞ্জার কি সেখানে যাচ্ছে না?
শেখ মুজিবুর রহমান : হ্যা, ৩০শে অক্টোবর। কিন্তু আমি আপনাকে আমন্ত্রণ জানাতে চাই।
১লা অক্টোবর ১৯৭৪ অনুবাদ : জামিল বিন সিদ্দিক

১৫৭
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আলাপ
২৫শে মার্চ ১৯৭১ রাতে আমি গ্রেপ্তার হবার আগে স্বাধীনতার ঘােষণা দেই। পুলিশ হেডকোয়াটার্সের মাধ্যমে ওয়্যারলেসে সে ঘােষণা সব জেলা সদরে পাঠানাে হয়। আমি বিভিন্ন চ্যানেলে ভারতের সঙ্গেও যােগাযােগ করে যাই। তা না হলে তােমরা অত সহজে অস্ত্র ও সাহায্য সহযােগিতা পেতে না।

১৫৯
১৯৭৪ সাল । হঠাৎ করেই সুযােগ হয়ে গেল বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাতের। তারিখ মনে আছে, লেখাও আছে ডাইরিতে। ৩রা ফেব্রুয়ারির সকাল ন’টা। তাঁর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে সাক্ষাতের সময় নির্ধারিত হয়েছে। আমরা ঠিক সময়ে যেয়ে হাজির হলাম। বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মযহারুল ইসলাম, লেখকসাংবাদিক ও আমাদের বন্ধু রাহাত খান, আমি আর বাংলা একাডেমিরই সংস্কৃতি বিভাগের জনাব ম. জিল্লুর রহমান।
তাঁর নিচের বৈঠকখানায় তখন অনেক লােক। বঙ্গবন্ধু লুঙ্গি পরা, পাঞ্জাবি গায়ে, তার ওপরে বাদামি রংয়ের একটা শাল জড়ানাে; হাতে পাইপ আর তাঁর প্রিয় এরিনমাের তামাকের কৌটা। আমাদের দেখে প্রবল ব্যক্তিত্বসম্পন্ন বিশাল মানুষটির মুখ উজ্জ্বল হাসিতে ভরে গেল। অন্যদের বললেন, না, আজ আর কোনাে কথা নয়, তােমরা আসাে এখন, আমি এদের জন্যে সময় দিয়ে রেখেছি। এদের সঙ্গে নিরিবিলিতে কিছু জরুরি আলাপ করবাে। বৈঠকখানা ভর্তি লােক ইচ্ছায় অনিচ্ছায় নিষ্ক্রান্ত হতে থাকলেন। তিনি বললেন, না, এখানে বসবাে না। তাহলে কেউ না কেউ আসবেই। আমি মন খুলে কিছু কথা বলতে চাই।। তাকে খুব সুন্দর আর প্রাণবন্ত লাগছিল। তিনি উঠলেন। ধীরে এগুলেন ডানদিকে তাঁর পাঠকক্ষের দিকে। আমরা তাঁকে অনুসরণ করছি সম্মােহিতের মতাে। পাঠকক্ষের ভেতরে এসে একটা আলমারির সামনে দাঁড়ালেন। এবং অভ্যস্ত হাতে বের করলেন মাও-সেতুঙয়ের একটা বই। তারপর ঘুরে দাঁড়ালেন ড. ইসলামের দিকে। মুচকি মুচকি

১৬০
হাসতে হাসতে বললেন, ‘শুধু রবীন্দ্রনাথ না, আমি নজরুল, সুকান্ত এমনকি মাও-সেতুঙয়ের রচনাও মনােযােগ দিয়ে পড়ি। আমাদের মধ্যে কেউ একজন বললেন, আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামে চীনের ভূমিকা তাে…।’ তিনি সে কথা শেষ করতে দিলেন না। বললেন,
‘দুটো বিষয় তাে আলাদা। মাও একজন খুব বড়াে নেতা। জীবনে বহু সংগ্রাম করেছেন। তাঁর জীবন ও চিন্তাটা জানা ও বােঝা দরকার। একটা অনুন্নত বিশাল দেশকে তিনি স্বাধীনতা এনে দিয়েছেন। সে দেশটায় এত মানুষ হওয়া সত্ত্বেও কত উন্নত হয়েছে। এই ব্যাপারটা কীভাবে ঘটেছে
তা উপলব্ধি করার চেষ্টা করছি।’ হঠাৎ তার মুখে একটু বেদনার ছায়া পড়লাে। কিছুক্ষণ চুপ করে থাকলেন। তারপরে বললেন,
‘রাজনীতি বড়াে জটিল, নিষ্ঠুর। এর ফলে কত অস্বাভাবিক ঘটনা ঘটে। তা না হলে চীনের আমাদের সমর্থন না করার কোনাে যুক্তিই নেই। চীন খুব অন্যায় কাজ করেছে। থাকগে, আসুন প্রফেসর সাহেব, বসে বসে
কথা বলি। বঙ্গবন্ধু বসলেন, প্রফেসর ইসলাম এবং আমরাও বসলাম। তিনি বললেন, ‘বলুন প্রফেসর কী মনে করে এসেছেন। ড. ইসলাম বললেন, ‘বঙ্গবন্ধু, আমরা বাংলা একাডেমি থেকে একটি আন্তর্জাতিক সাহিত্য সম্মেলনের আয়ােজন করছি, বিভিন্ন দেশ থেকে বিখ্যাত সাহিত্যিকরা আসবেন। আপনাকে সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসাবে পেতে চাই। তিনি যেন আকাশ থেকে পড়লেন! তার প্রত্যুত্তর,
‘আমি সাহিত্যের কী বুঝি! আমি কী বলবাে! একজন প্রবীণ ও সর্বজন শ্রদ্ধেয় সাহিত্যিক বা পণ্ডিতকে দিয়ে এ কাজ করান-সম্মেলনের মর্যাদা বাড়বে। আগে তাে তাই হতাে। ছাত্রজীবনে দু’একবার সাহিত্য সম্মেলনে যােগ দিয়েছি। কই, রাজনৈতিক নেতারা তাঁর উদ্বোধন
করেছেন বলে তাে মনে পড়ে না।’ এই বলে তিনি হাসলেন, পরিস্থিতিকে একটু সহজ করার জন্য বললেন,
‘আমি রবীন্দ্রনাথ পড়ি, ভালােবাসি তাঁকে-সাহিত্যে আমার পুঁজি তাে ওইটুকুই। এই পুঁজি নিয়ে দেশ-বিদেশের বড়াে বড়াে পণ্ডিত ও সাহিত্যিক-শিল্পীদের মধ্যে যেতে আমি সংকোচ বােধ করছি।’

১৬১

তাঁকে বলা হলাে, এটা স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম জাতীয় সাহিত্য সম্মেলন। এর একটা ভিন্ন তাৎপর্য রয়েছে। আপনি সম্মেলন উদ্বোধন করলে তা আন্তর্জাতিক মর্যাদা লাভ করবে। তা ছাড়া গণতন্ত্র, মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও মানবাধিকতার প্রশ্নে আপনার ও আপনার সরকারের দৃষ্টিভঙ্গিরও প্রতিফলন ঘটবে।’ তিনি একটু ভাবলেন, বললেন,
“ঠিক আছে, যাবাে। আমার বন্ধু জসীমউদ্দীন ও শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনকেও বিশেষ মর্যাদায় আমন্ত্রণ জানাবেন। আর একটি ছােটো
ভাষণ প্রস্তুত করে আমাকে দেখিয়ে নেবেন। ড. ইসলাম, খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস, সন্তোষ গুপ্ত, রাহাত খান ও আমি সেই ভাষণটি প্রস্তুত করি। যা-হােক, সম্মেলন-প্রসঙ্গ স্বল্প সময়ে শেষ করে তিনি বললেন,
‘আপনারা সাহিত্যিক-সাংবাদিক, সংস্কৃতিকর্মী ও গবেষক। ভবিষ্যতে আপনারা হয়তাে মুক্তিযুদ্ধ বা বাংলাদেশ নিয়ে লিখবেন, তাই আমি আজ
কিছু কথা বলতে চাই।’ তিনি বাংলাদেশ’ নাম কীভাবে ঠিক করেছিলেন, দেশকে স্বাধীন করার চিন্তা তিনি যে সেই পঞ্চাশের দশক থেকেই শুরু করেন সে কথাও বললেন। সােনার বাংলা’কে জাতীয় সংগীত করবেন এ স্বপ্ন তার বুকের ভেতরে আলাের মতাে জ্বলতাে। এ গান শুনলে তিনি রােমাঞ্চিত, আবেগাপ্লুত হতেন, তাও জানালেন। ঠিক মনে পড়ছে না, রাহাত খান অথবা আমি আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার কথা তুললাম। তিনি আবার হাসলেন। বললেন,
“কিসের ষড়যন্ত্র! বল, আমাদের স্বাধীনতার প্রয়াস। এরপর এ প্রসঙ্গে বিস্তৃত বিবরণ ও ব্যাখ্যা তুলে ধরেন। তার সার কথা এরকম :
‘আগরতলায় আমি ঠিকই গিয়েছিলাম। বৃষ্টিতে ভিজতে হয়েছিল। একটু জ্বরও হয়েছিল। অনেকটা পথ হেঁটে যেতে হয়। আমার পা ফুলে গিয়েছিল। তবে নেতাদের সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ কথাবার্তা ও ফলপ্রসূ আলােচনা হয়।

১৬২

১৯৭১-এর স্বাধীনতা প্রসঙ্গে তিনি বলেন,
‘২৫শে মার্চ ১৯৭১ রাতে আমি গ্রেপ্তার হবার আগে স্বাধীনতার ঘােষণা দেই। পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের মাধ্যমে ওয়্যারলেসে সে ঘােষণা সব জেলা সদরে পাঠানাে হয়। আমি বিভিন্ন চ্যানেলে ভারতের সঙ্গেও যােগাযােগ করে যাই। তা না হলে তােমরা অত সহজে অস্ত্র ও সাহায্য
সহযােগিতা পেতে না।’ আমরা প্রশ্ন করলাম কিন্তু আপনি কেন ওদের হাতে ধরা দিলেন। তিনি বললেন,
এ ব্যাপারে আমার বেশ ক’টি চিন্তা কাজ করেছে।
এক, আমাকে ধরতে না পারলে ওরা আরাে বেশি লােককে খুন করতাে;
দুই, আন্তর্জাতিকভাবে আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতের ক্রীড়নক বলে প্রমাণিত হতাম এবং এতে আন্তর্জাতিক সহমর্মিতা কমতাে এবং আরাে বেশি দেশ আমাদের আন্দোলন সম্পর্কে সন্দেহ পােষণ করতাে। আর একটা কথা বলি, তােমরা কীভাবে নেবে জানি না, প্রফেসর সাহেব আমার সঙ্গে একমত হবেন কি না তাও বলতে পারি না-তবে আমার সুদৃঢ় বিশ্বাস আমি পাকিস্তানিদের হাতে বন্দি থাকায় আমার দুঃখী বাঙালিদের মধ্যে দুশ্চিন্তা, উদ্বেগ যেমন বেড়েছে তেমনি মানুষ আমার অনুপস্থিতিতে আমার একটা বিশাল প্রতীক মনে মনে তৈরি করে নিয়েছে। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধের খুব বড়াে একটা শক্তি। আমি প্রবাসী সরকারে থাকলে শুধু প্রমাণ সাইজের মুজিবই থাকতাম। ওদের হাতে বন্দি থাকায় আমি এক মহাশক্তিধর ও বাংলাদেশের সকল মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতার ভূমিকায় স্থান পাই। মানুষ আমার নাম নিয়ে হেলায় হেসে প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে। কী অমােঘ অস্ত্র ছিল-‘জয় বাংলা’ স্লোগান। ওরা যদি আমাকে মেরে ফেলতাে, তাহলে আমি আরাে বড়াে প্রতীকে পরিণত হতাম। বাংলার মানুষ আরাে লড়াকু হয়ে যুদ্ধ করতাে। তাছাড়া, আমার জাতি আমাকে যে মর্যাদা দিয়েছে তার প্রতি সম্মান রেখেই আমি আমার বুঝ মতাে ব্যবস্থা নিয়েছি, আর আমার দেশবাসী ও যােগ্য সহকর্মীরা মুক্তিযুদ্ধ
চালিয়েছে।’ আলাপের এ পর্যায়ে এসে আমি জিজ্ঞেস করি, আরাে খােলামেলা কথা বলার সুযােগ আমাদের আছে কি না। তিনি বললেন,

১৬৩
‘সবাইরে বিদায় করে তােমাদের নিয়া বসছি। আমার অন্তর খােলাসা করেই বসছি। তােমরা বাংলা একাডেমির লােক, তােমরা লেখ, গবেষণা কর, আমিতাে তােমাদের কাছেই প্রাণ খুলে কথা বলতে পারি। ভবিষ্যতে তােমরা ইতিহাস লিখলে এই সব কথা খুব কাজে লাগবে। তােমরা সত্য
ইতিহাস লিখতে পারবে।’ আমরা বললাম, সমাজের মূল্যবােধ ও বাধন তাে ভেঙে পড়ছে। নৈরাজ্য, হতাশা দেখা দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা বাড়ছে। ছিনতাই, রাহাজানি মানুষকে আতঙ্কিত করছে। তিনি একটু চুপ করে থাকলেন-মনে হলাে গভীরভাবে ভাবছেন। তারপর উজ্জ্বল হাসি হেসে মুখে নিলেন পাইপ-ঘন ঘন ক’টা টান দিলেন তাতে। তারপর মুখ খুললেন,
“তােমরা অনেক পড়াশােনা করছ—অনেক কিছু বােঝ। কিন্তু নিজ দেশের কতগুলি বাস্তব ব্যাপার তােমরা যেন দেখতে পাও না। দেশে এতবড়াে একটা যুদ্ধ হয়ে গেল। যুদ্ধ মানুষের মূল্যবোেধ আমূল বদলে দেয়। মানুষকে বেপরােয়া, লাগামহীন করে। আমাদের দেশেও সেটা হয়েছে। হাইজ্যাক-ডাকাতি বেড়েছে-চাটার দল বেড়েছে। এই সব একদিনে দমন করা যাবে না। এটা একটা নতুন পরিস্থিতি। অনেকে অস্ত্র জমা দেয় নাই। ইসলামী দলগুলি আগাগােড়া আমার বিরুদ্ধে গােপন প্রচার করছে-বেনামা পুস্তিকা ছাপছে। জাসদ-এর বিভ্রান্ত অংশ বিপ্লবের নামে কি না করছে? দুষ্কৃতিকারীরা পাটের গুদামগুলি পুড়িয়ে দিয়ে অর্থনীতিকে কাবু করছে। থানা আক্রমণ করে অস্ত্র লুটে নিয়েছে। আমার লােকদের হত্যা করছে। অথচ তিন বছরে আমরা যা করেছি আমাদের মতাে বিধ্বস্ত অন্য কোনাে দেশ তা পারতাে না। এজন্য আমাদেরকে প্রশংসা করে না। কী অবস্থা করে রেখে গেছে পাকিস্তানি হানাদাররা? দেশটা ছিল ভাঙাচোরা; একটা শ্মশান যেন। কী আর বলবাে, হুজুর (মওলানা ভাসানী) মুরুব্বি মানুষ, তিনি যে সব বক্তৃতা বিবৃতি দিচ্ছেন তাকে লুফে নিচ্ছে সাম্প্রদায়িক দল ও ব্যক্তিরা। তারা তাঁকে শিল্ড হিসাবে ব্যবহার করে শয়তানের হাসি হাসছে। এই সব দেখেশুনে মনে হয় তাজউদ্দীনদের হাতে
ক্ষমতা দিয়ে ভােলা বা মনপুরায় গিয়ে ছােট্ট ঘর বানিয়ে থাকি। তাঁর কণ্ঠে তখন মৃদু ক্ষোভ ও হতাশার সুর।
নেতার এই আকস্মিক বেদনা ও হতাশায় আমরাও কিছুক্ষণের জন্যে বিমূঢ় হয়ে যাই। ড. ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধু, আমরা তাে আছি, সারা

১৬৪
দেশে আপনার হাজার হাজার কর্মী ও সমর্থক আছে, আপনি হতাশ হচ্ছেন কেন? কঠোর হােন নির্দেশ দিন। তিনি বললেন,
‘ডক্টর সাহেব, বাংলাদেশ বড় কঠিন জায়গা। মনে হয় যেন বাঘের পিঠে চড়ে বসেছি। পারি, পারি সব ঠিক করে দিবার পারি। কিন্তু কী করবাে, মনে হয়-কার গায়ে হাত দেবাে, সবারই পরিবার পরিজন আছে। তখন আপনারাই আসবেন আবার তদবির নিয়ে। কিন্তু বেশি দিন তাে সহ্য করা যাবে না। শক্ত একটা কিছু করতে হবে। আমি ‘লাল ঘােড়া দাবড়াইয়া, দিতে চেয়েছিলাম। তা দিতে চেয়েছিলাম চাটার দলের ওপর, কেউ কেউ তা পছন্দ করলাে না। আমার সমালােচনা করলাে। তাহলে আমি যাই
কোথায়! এইজন্যই তাে বলি, সব ছেড়ে দিয়ে ভােলা মনপুরা চলে যাই। আমরা এবার অর্থনৈতিক প্রশ্ন তুলি। তিনি বলেন,
‘আমি দেশের সেরা অর্থনীতিবিদদের নিয়ে পরিকল্পনা কমিশন করেছিলাম। তারা তাে আমার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করতে পারলাে না। আসলে তত্ত্ব আর বাস্তবের মধ্যে পার্থক্য অনেক। ওরা (পরিকল্পনা কমিশনের সদস্যরা) ভালাে লােক, পণ্ডিত, কিন্তু আমাদের গ্রামবাংলা আর গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে বােধ হয় এদের ভালাে পরিচয় নাই। আমি ‘সােনার মানুষের কথা বলি। আমার কৃষকেরাই শুধু সােনার মানুষ। তারা সারা বছর হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে ফসল ফলায়, ঘরবাড়ি বানায়, নৌকা চালায়, তবেই না আমরা বাবু সেজে পায়ের ওপর পা তুলে আরাে কত বড় হবাে তার খােয়াব দেখি। তেমনি মুটে মজুর, জেলে, কামার কুমার-তারা আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে টিকিয়ে রেখেছে। তা না হলে সব ভেঙে পড়তাে। আমরা সমাজতন্ত্রের কথা বলেছি, সমবায়ের কথা বলেছি। দেশের যা অবস্থা, মধ্যবিত্তের যা খাই খাই ভাব তাতে সফল হবাে কি না জানি না। চেষ্টা করছি। আমি ভিয়েতনামকে দ্রুত স্বীকৃতি দিয়েছি। হােচিমিন কত বড়াে নেতা, আর খাঁটি মানুষ; তারা কী করছেন সেখান থেকে শিক্ষা নেবার চেষ্টা করছি, বড়াে বড়াে ইণ্ডাস্ট্রি করে বােধ হয় খুব সুবিধা করতে পারবাে না। শিল্পকারখানা থাকবে অর্থনীতির সহায়ক শক্তি হিসাবে দ্বিতীয় স্থানে, আমি সমবায় ও কৃষিভিত্তিক ছােটো ছােটো প্রকল্পে হাত দিতে চাই। ঔপনিবেশিক কাঠামােটা ভাঙতে চাই। তবে সে বড়াে কঠিন কাজ। আমার
কিছু এমপিই জমির সিলিং ১০০ বিঘা করার বিপক্ষে। হঠাৎ তিনি কিছুটা যেন উদ্দীপিত হয়ে ওঠেন। রাহাত আর আমার দিকে তাকিয়ে বলেন,

১৬৫
‘তােরা হতাশ হবি না। প্রফেসর সাহেব, আমার এই কথাটা খুব মন দিয়া শােনেন। বাঙালি খুব গরিব, দরিদ্র, আমার ভাষায়-দুঃখী। আমি যতটা ইতিহাস পড়েছি তাতে জেনেছি হাজার বছর ধরেই বাঙালি দুঃখী, অভাবী। তার বিত্ত নাই, বেসাত নাই। হাতে পয়সা নাই। কিছুদিন আগে একটা উপন্যাস পড়ছিলাম, কলকাতার কাছেই। তাতেও আছে বাঙালি কাঁচা পয়সার কি কাঙাল। একটা পয়সার জন্য কি ‘কেগিভেগি’ (কাকুতি-মিনতি) করতাে। মনে হয় শায়েস্তা খার আমলেও বাঙালি কাঙালিই ছিল। সস্তা হলেও কোনাে জিনিস সে কিনতে পারেনি। ডাক্তার সাহেব, এরা তাে (অর্থাৎ আমরা) সে দিনের ছাওয়াল। এরা বুঝবে না। কিন্তু, আপনি আমি জানি। বাঙালির বিশেষ করে কৃষিজীবী মুসলমান বাঙালির হাতে কোনাে কাঁচা পয়সা থাকতাে না ধান কাটার মরশুমে পেট পুরে গরম ভাত খেতাম। আর পাটের সময় হলে পাট বিক্রি করে কিছু নগদ পয়সা জুটতাে। এই টাকা দিয়ে আমাদের বাবা চাচারা ইলশা মাছ কিনে আনতেন। মা চাচীর জন্য শাড়ি আর নিজেদের জন্য কিনতেন লুঙ্গি। আমাদেরও নতুন কাপড় জুটতাে বছরে পাটের মরশুমে ওই একবারই। এই তাে বাঙালি মুসলমানের অর্থনৈতিক অবস্থা। এই অবস্থাটা মনে রেখে ভাববা স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের কথা। প্রকৃত অর্থে এই প্রথম বাঙালিরা সত্যিকার অর্থে স্বাধীন হয়েছে। এবং এই প্রথম বাঙালির হাতে কিছু নগদ পয়সা আসছে। ব্যাপারটা খুব বড়াে, তাৎপর্যপূর্ণ। এর একটা উত্তেজনা আছে। বাঙালি বিশেষ করে তরুণরা এখন বাঁধনহারা। সমাজ পরিবর্তনের প্রবল ও আকস্মিক ধাক্কায় দিশাহারা। কেউ গাড়ি কিনছে, কেউ ফাইভ ফিফটি ফাইভ ফুকছে, কেউ ছিনতাই হাইজ্যাকসহ নানা আকাম-কুকাম করছে। অবাধ স্বাধীনতার এই আকস্মিক স্বাদ ও হাতে আসা নগদ অর্থ দিশাহারা করেছে অনেককে। ধীরে ধীরে রাষ্ট্রীয় আইন-কানুন ও প্রতিষ্ঠান তৈরি করে এদের দায়িত্ব-সচেতন করা হবে; নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে। আনতে হবে। দেশটা তাে শুধু মধ্যবিত্তের না, আমার গরিব দুঃখী মানুষের। আসল ত্যাগ তাে তারাই স্বীকার করেছে। তাদের অবস্থার পরিবর্তন যদি করতে পারি তবেই অর্থনৈতিক মুক্তি আসবে। আমার দেশের মানুষ আমাকে জাতির পিতা বলে, কতজন আমার জন্য রােজা রেখেছে, জান দিয়েছে-আমার দায়িত্ব বড়াে বেশি। ডাক্তার সাহেব, আপনারা সাহায্য করেন, সােনার মানুষ দেন, আমি সােনার বাংলা গড়ে তুলি।

১৬৬
সেদিনের মতাে আমাদের সঙ্গে তাঁর আলাপ এভাবেই শেষ হলাে। তিনি তাঁর ক্যামেরাম্যান আলমকে ডাকলেন। নতুন যে ক্যামেরা কিনে দিয়েছেন তা ঠিকমতাে কাজ করছে কি না জানতে চাইলেন। পরে আমাদের সঙ্গে ছবি তুললেন। আলমকে বললেন,
‘এই ছবির কপি বাংলা একাডেমিতে এদের পৌঁছে দিবি। এই ছবির
আলাদা গুরুত্ব আছে।’ , আলম সাহেব আমাদের কোনাে ছবি দেননি। জিল্লুর রহমান বহুদিন তার কাছে ঘুরেও সে ছবি আদায় করতে পারেননি। আমরা সবাই বঙ্গবন্ধুর আদেশ নির্দেশ ও কথা এইভাবে অমান্য করেছি। মহান, সেজন্যই আন্তরিক ও সরল মানুষটি কাউকে অবিশ্বাস করতে পারেননি। তিনি বােধ হয় রবীন্দ্রনাথের ওই বিখ্যাত উক্তি, মানুষের প্রতি বিশ্বাস হারানাে পাপ’-এ প্রবল আস্থা রাখতেন। এটাই তার জন্য কাল হয়েছিল। তিনি ডালিমদেরও বিশ্বাস করেছিলেন। বাড়িতে এসে ঘুরেফিরে সবকিছু দেখতে দিয়েছিলেন।

১৬৭
বন্ধবন্ধুর সঙ্গে আমাদের দ্বিতীয়বার আলাপের সুযােগ ঘটে কিছুকাল পরেই এবং সেটাও বাংলা একাডেমির কাজেই। তখন একাডেমির মহাপরিচালক ড. নীলিমা ইব্রাহীম-আমাদের শ্রদ্ধেয়া নীলিমা আপা। তিনি নিয়ােগ পেয়ে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে যান বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে। একাডেমির কয়েকজন সিনিয়র অফিসারকেও তিনি সঙ্গে নেন। আমিও সেই দলে ছিলাম। আমাদের সাবেক সহকর্মী ও গল্পলেখক আবুল হাসানাতও ছিলেন তাতে। হাসানাত তখন বঙ্গবন্ধুর ওপর খুব ক্ষুব্ধ। তিনি তাঁর বাবাই দায়ী’ গল্পগ্রন্থে এই ক্ষোভের কিছু ছাপ দিয়েছেন। আমি তাকে বলি, Politics is a difficult game.’ ভেতর থেকে না দেখলে সবকিছু বােঝা যায় না। তিনি আমাদের কথায় আশ্বস্ত হন না। তাে, আমি তাকে বলি, “আমাদের দলের সঙ্গে তুমিও চলাে। তােমার ক্ষোভ অভিযােগ সামনা-সামনিই বলবে।’ আবুল হাসানাত বলে, “হ্যা, যেয়ে ওই সব ক্ষোভ জানিয়ে চাকুরিটা হারাই! আমি বলি, তােমার চাকুরি রাখার দায়িত্ব আমি নেব।’ তিনি শেষ পর্যন্ত রাজি হন। এবং আমরা নীলিমা আপার নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর ধানমন্ডির বাড়ির নিচের তলায় ড্রয়িং রুমে কথা বলি। প্রথমে আপা সৌজন্য বিনিময় করেন। একাডেমি কেমন চলছে বঙ্গবন্ধু জানতে চান। নিয়ম-কানুন যে আগে তেমন মানা হয়নি সে প্রসঙ্গ ওঠে। বঙ্গবন্ধু ইঙ্গিতটি বােঝেন এবং কোনাে নাম উচ্চারণ না করে বলেন,
‘হ বইন, বুঝছি সব দোষ আমার। যত দোষ নন্দ ঘােষ। তিনি একটু বিড়বিড় করে বলেন,
কী আর করবাে, যেখানে যাকে বসাই সেখানেই সে সমস্যা সৃষ্টি করে। আপা একাডেমির জন্য সাহায্য সহযােগিতা চাইলেন। তিনি বললেন,
‘বাংলা একাডেমির কোনাে সমস্যা হবে না।’ সেদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব খুব ব্যস্ত ছিলেন, শেষ দিকটায় কথা হলাে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে। আমি হাসানাতকে নিয়ে সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।

১৬৮
বঙ্গবন্ধু আমার কাঁধে একটা হাত রাখলেন। মনে হলাে পিতৃস্নেহের পরশ পাচ্ছি। অন্য একটা হাত বাড়িয়ে হাসানাতের বুকের মধ্যে মৃদু আঙুল ঠেকিয়ে কথা বলতে থাকলেন। আমি হাসানাতের চোখের দিকে তাকালাম। সে চোখে তখন কোমল, কমনীয় স্নিগ্ধতা। আবেগে সে বিনম্র হয়ে উঠেছে। কোনাে কথাই সে বলল না । বঙ্গবন্ধুর কথা শুধু শুনে গেলাে।
সাক্ষাৎকার শেষে বেরিয়ে এসে বললাম, “কই হাসানাত তুমি যে কিছুই বললে না?’ হাসানাত বলল, এ যে রাজনৈতিক জাদুকর। আমাকে মুগ্ধ, অভিভূত করে ফেললেন। কোনাে কথাই মুখ থেকে বের করতে পারলাম না। অত বড়াে ব্যক্তিত্ব আর আন্তরিকতার নিজস্ব ধরন দিয়ে আমাকে একেবারে গলিয়ে ফেললেন।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে আমার তৃতীয় সাক্ষাৎকারটি ঘটে ১৯৭৫-এর জুনে শেরে বাংলা নগরে তাঁর অফিস তৎকালীন গণভবনে। আমাকে তার কাছে। নিয়ে যান শ্রদ্ধেয় প্রফেসর কবীর চৌধুরী। কবীর স্যারের নেতৃত্বে আমরা ক’দিনের মধ্যেই মস্কো যাবাে-সে ব্যাপারেই সাক্ষাৎ করতে যাওয়া। আমরা আফ্রো-এশীয় লেখক সম্মেলনে যােগ দেবার জন্য যাচ্ছিলাম। দলটি গঠিত হয়েছিল চারজনকে নিয়ে, বাকি দুজন খােন্দকার মােহাম্মদ ইলিয়াস ও মােস্তফা সারওয়ার। এত ছােটো দেশ থেকে এত বড়াে দল সাধারণত যায় না। দু’জনই যথেষ্ট। কিন্তু ঢাকায় এই সংস্থার এশীয় সদর দপ্তর খােলার কথাবার্তা হচ্ছিলাে বলে বঙ্গবন্ধুর ইচ্ছাতেই দলটি বড়াে হয়। তৎকালীন সােভিয়েত সরকার দলটির সমস্ত খরচ বহন করে। ঢাকার তখনকার সােভিয়েত দূতাবাস নিশ্চিত হতে চাইছিল, বঙ্গবন্ধু চারজনকে পাঠাতে চান কি না। ওই দূতাবাসের দ্বিতীয় সচিব আলেকজাণ্ডার পার্সিন বঙ্গবন্ধুর সচিবালয়ে এসে এ বিষয়ে একদিন আলাপ করে যান।

১৬৯
তাে, কবীর স্যার ও আমি যখন তাঁর ঘরে ঢুকি তখন তাকে একটু উত্তেজিতভাবে পায়চারি করতে দেখি। একবার তিনি চাপা স্বরে উচ্চারণ করেন : ‘আমার সঙ্গে ডিপ্লোম্যাসি, (শুনেছি তার সঙ্গে সাক্ষাত করতে এসেছিলেন একটি প্রতিবেশী দেশের হাই কমিশনার); অবশ্য, কবীর স্যারকে দেখে খুবই আগ্রহ ও আন্তরিকতার সঙ্গে এগিয়ে এসে তাঁকে ধরে নিয়ে সােফায় বসালেন তিনি। আমিও বসি। তখন ভেতরে ছাত্রলীগের কিছু ছেলেও ছিল। তাদের মধ্যে একজন বঙ্গবন্ধুকে বলে, ‘আপনি ছাত্র ইউনিয়নের সম্মেলনেও তাে গেলেন। তিনি আবার উত্তেজিত হলেন। বললেন,
যাব না কেন? আমি কি শুধু তােমাদের নেতা? আমি সকলের। তা না হলে
তাে আমি জাতির পিতা হতে পারতাম না।’ আরাে বললেন,
‘তােমাদের কাজে আমি সন্তুষ্ট হতে পারি না সব সময়। ছাত্র ইউনিয়নের ওরা পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, ত্যাগী। ওরা সােহরাওয়ার্দী উদ্যানে সীডবেড করে উৎপাদন প্রক্রিয়ার সঙ্গে নিজেদের যুক্ত করেছে। আমি একটিমাত্র জাতীয় পার্টি করছি। ত্যাগী সৎ লােকরা কাজের মাধ্যমে সেই পার্টির সামনের কাতারে আসবে। অকর্মণ্য গলাবাজরা পিছনে পড়বে। দেখ না আমি আলতাফ সাহেবকে মন্ত্রী করেছি। অমন একটা লােক পাওয়াভাগ্যের কথা। ছেলেরা চুপ হয়ে গেল। তিনি বললেন,
‘এবার তােমরা যাও, প্রফেসর সাহেবের সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে। তিনি আমার দিকে ফিরে বললেন,
‘তিনজনকে আমি আগেই ব্রিফ করেছি। তখন তুমি ছিলে না, প্রফেসর সাহেব তােমাকে নিয়ে এসে ভালােই করেছেন। তুমি দলের বয়ােকনিষ্ঠ সদস্য। দলনেতার নির্দেশ মতাে চলবে। দেশের সুনাম যেন নষ্ট না হয়। আর আমাদের কিছু কাগজপত্র নিয়ে নেও। ফরাসরা (ফরাসউদ্দিন, তাঁর তকালীন প্রাইভেট সেক্রেটারি) ব্যবস্থা করে দেবে।

১৭০
পরে কবীর স্যারের দিকে ফিরে বললেন,
‘চৌধুরী সাহেব, ভাগ্যের কি নিষ্ঠুর পরিহাস, সারাজীবন গণতন্ত্রের জন্য আন্দোলন করলাম, কত জেল খাটলাম আর এখন এক পার্টি করতে যাচ্ছি। আগস্ট মাস থেকে বাকশালের কাজ পুরােপুরি শুরু হবে। আমি এটা চাইনি। বাধ্য হয়ে করতে হচ্ছে। পাকিস্তানপন্থী, বিভিন্ন ইসলামী দল এবং অস্ত্রধারী জাসদের গণবাহিনী, সর্বহারা পার্টি প্রভৃতি প্রশাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে ভেঙে ফেলার উপক্রম করে ফেলেছে। আমার বহু লােককে অন্যায়ভাবে হত্যা করেছে। ঈদের দিন নামাজের মধ্যে হত্যা করা হয় শুনেছেন কখনাে? অতএব, অন্য কোনাে পথ খােলা না দেখে আমি স্বাধীনতার পক্ষের লােকদের নিয়ে সমমনাদের একটি রাজনৈতিক মঞ্চ হিসাবে বাকশাল গঠন করছি। আমি সমাজতন্ত্রবিরােধী, ধর্মনিরপেক্ষতা-বিরােধী এবং সর্বোপরি মুক্তিযুদ্ধবিরােধী কোনাে দল বা ব্যক্তিকে বাকশালে নিব না। আরাে একটি কথা, আমার ক্ষমতা পাকাপােক্ত করার জন্য নয়, দেশকে বাঁচানাের জন্য এই পদক্ষেপ। আমি ক্ষমতা অনেক পেয়েছি, এমন আর কেউ পায় নাই। সে ক্ষমতা হলাে জনগণের ভালােবাসা ও নজিরবিহীন সমর্থন। প্রফেসর সাহেব শােনেন, তুমিও লিখে রেখ, আমার এই একদলীয় ব্যবস্থা হবে সাময়িক। দেশটাকে প্রতিবিপ্লবের হাত থেকে রক্ষা করে আমি আবার গণতন্ত্রে ফিরে যাবাে। বহুদলীয় গণতন্ত্রে ফিরে যাবাে। তবে চেষ্টা করবাে আমার গণতন্ত্র যেন শােষকের গণতন্ত্র না হয়। আমার দুঃখী মানুষ যেন
গণতন্ত্রের স্বাদ পায়। তিনি বলেন,
‘আমাকে পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল দালাল ও রাজাকারদের ক্ষমা না করতে। খুব কঠোর পরামর্শও দেওয়া হয়েছিল-শামসুজ্জামান জানে বােধ হয়, প্রতিবিপ্লবীদের ধ্বংস করে দিতে। আমি তা করিনি। তাদের কুর্কীতির কথা জেনেও করিনি। আমার চোখে মুখে ভেসেছে অসংখ্য মা, বাবা, স্ত্রী ও শিশুর মুখ । আমার মনে হয়েছে আল্লাহর আরশ কাঁপবে না? আমি মানবিক হতে চেয়েছি। অনেকগুলাে পরিবারকে ধ্বংস করিনি। আমি জাতির স্রষ্টা হয়ে সেটা করতে পারি না। আমি ভুল করেছি, কি

১৭১
ঠিক করেছি ইতিহাস একদিন সে বিচার করবে। তবে খুনি ও প্রকৃত
অপরাধীরা রেহাই পাবে না। তাদের বিচার করবাে।’ বঙ্গবন্ধু বললেন,
‘নির্দেশ দিছি। সব ফাইল বাংলায় লিখতে হবে। যে লিখবে না তাকে
বাড়ি পাঠায়া দিবার ব্যবস্থা করবাে।’ বাকশালে যােগদানের ব্যাপারে কোনাে বাধ্যবাধকতা ছিল না। অনেকেই এতে যােগ দেয়নি। বঙ্গবন্ধু এতে কিছুই মনে করেননি। সাংবাদিকেরা প্রতিযােগিতা করে যােগ দিয়েছেন। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান যােগ দেওয়ার জন্য লাইন ধরে ফুলের মালা নিয়ে গিয়েছে। কিন্তু কবি শামসুর রাহমান, নির্মলেন্দু গুণ, শওকত ওসমান, আবু জাফর শামসুদ্দীন এঁরা যােগ দেননি। বাংলা একাডেমি যােগ দেয়নি। মরহুম জিয়াউর রহমান ও বেগম জিয়াকে বাকশাল অফিসের একটা সভায়। দেখেছিলাম মতিয়া চৌধুরীর পাশে বসেছিলেন। মােস্তফা সারওয়ার সে সভা পরিচালনা করেন। সভা-শেষে নিচে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও তাঁরা উপভােগ করেন। পরদিন কাগজে তার ছবি ছাপা হয়।
নির্মলেন্দু গুণকে বাংলা একাডেমিতে জিজ্ঞেস করি, বাকশালে যােগ দিচ্ছেন না?’ তিনি বললেন, না। আমি বলি, ‘কেন?’ তিনি বলেন, মনে হয় গুলি আইবাে। আমি গুলি খাইয়া মরতে চাই না।’ শামসুর রাহমান যােগ দিচ্ছেন না শুনে বঙ্গবন্ধু ও শেখ মণি বলেছেন,
‘শামসুর রাহমান আমাদের সকলের প্রিয় কবি। আমরা তাকে ভালােবাসি। যােগ দেয়া না দেয়া তার ইচ্ছার ওপর নির্ভর করে। আমরা জোর করতে
চাই না।’ শেষ দিকে আমি ঘন ঘন গণভবনে যেতাম। ফরাসউদ্দিন ও সহকারী প্রেস সচিব মাহবুব তালুকদার আমার বন্ধু । কিন্তু শুধু সেজন্যই যেতাম
যেতাম অন্য একটা লােভে। বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনী’ শুনতে। তিনি ডিটেশন দিয়ে আত্মজীবনী প্রস্তুত করছিলেন। ডিকটেশন নিতেন আবদুল গাফফার চৌধুরী ও মাহবুব তালুকদার। তিনি পরে দেখে দিতেন

১৭২
এবং তাঁর নিজস্ব কিছু শব্দ ও বলবার ধরন বদলাতে দিতেন না। জাতির দুর্ভাগ্য-তাঁকে সপরিবারে হত্যা করার পর মাহবুব তালুকদার সে আত্মজীবনীর কপি গণভবন থেকে আর উদ্ধার করতে পারেননি। এরশাদের নির্দেশে সব কাগজপত্র নাকি পুড়িয়ে ফেলা হয়। শুনেছি, ওই মহামূল্যবান জীবনীর একটা কপি নাকি আবদুল গাফফার চৌধুরীর কাছে আছে। আওয়ামী লীগের অনেককে বলেছি, কেউ এটা উদ্ধারের জন্য তেমন চেষ্টা করেন না।
শামসুজ্জামান খান। সাক্ষাৎকারকাল : ১৯৭৪-৭৫ রচনাকাল : ১৯৮৬

১৭৩
ইন্দ্রপাত
“জয় বাংলা’ আসলে একটি মন্ত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম’ বা দাদাভাই নওরােজীর স্বরাজ বা গান্ধীজীর কুইট ইণ্ডিয়া’ বা নেতাজী সুভাষের ‘চলাে দিলি। এ হলাে শব্দব্রহ্ম। একটি শব্দের বা শব্দের সমষ্টির মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত। সে শক্তি অসাধ্যসাধনপটীয়সী।

১৭৫
বারাে বছর আগে জার্মানি থেকে ফেরার পথে আমার বিমানসঙ্গী ছিলেন চট্টগ্রামের ইস্পাহানী সাহেব। সেকালের নামকরা বণিক ইস্পাহানীর পুত্র। ফ্রাঙ্কফুট থেকে আমরা লুটহানসার বিমানে উঠি ও পাশাপাশি আসনে বসি।
‘ব্যবসা-বাণিজ্যের দিক থেকে পার্টিশন একটা সর্বনাশা ব্যাপার। আমাদের কারবার ছিল প্রশস্ত পরিধি জুড়ে। তাকে টুকরাে টুকরাে করতে হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের ভার পড়েছে আমার উপরে। ওইটুকু গণ্ডীর ভিতরে প্রসারণের পরিসর কোথায়? তিনি আফসােস করেন।
অর্থনীতির প্রসঙ্গ থেকে আমরা রাজনীতির প্রসঙ্গে আসি। তিনি বলেন, ‘আইয়ুব খান যে বেসিক ডেমােক্র্যাসি প্রবর্তন করতে যাচ্ছেন তার ফল ভালাে হবে না। মাত্র আশি হাজার জন ভােটার। টাকা ছড়িয়ে একচল্লিশ হাজার জন ভােটারকে হাত করা অতি সহজ।আইয়ুব চান চিরস্থায়ী হতে।
আমি জিজ্ঞাসা করি তার নিজের মতে কী করা উচিত? তিনি এর উত্তরে বলেন, রাজনীতিকদের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিলেই হয়। আগেকার মতাে প্রত্যক্ষ নির্বাচনে যারা জিতবেন তারাই সরকার চালাবেন।
“কিন্তু সরকার চালাবার মতাে যােগ্য লােক কি পূর্ব পাকিস্তানে কেউ আছেন? | ‘কেন? শেখ মুজিবুর রহমান। তিনি নিঃসংশয়ে রায় দেন।
‘শেখ মুজিবুর রহমান কি পারবেন একটা প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হতে?’ আমি তাঁর সম্বন্ধে সন্দিহান ছিলুম।
‘কেন পারবেন না? তাকে একটা সুযােগ দিলে ক্ষতি কী?’ তিনি শেখ মুজিবকে চিনতেন ও তার উপর আস্থাবান ছিলেন।

১৭৬
ইস্পাহানী বাঙালি নন। মুজিব বাঙালি। কিন্তু লক্ষ্য করলুম, তাঁর মধ্যে প্রাদেশিকতা নেই। তার কারণ বােধহয় তিনি ইরান দেশের আগন্তুক। পাকিস্তানি নাগরিক হলেও তার মানসিকতা পূর্ব পাকিস্তানি সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে। কলকাতাতেই তিনি ভালাে ছিলেন। হিন্দু মুসলমানের ঝগড়া তিনি পছন্দ করেননি।
‘আপনার সঙ্গে কলকাতা অবধি গিয়ে সেখান থেকে অন্য ফ্লাইটে চট্টগ্রাম যাওয়াই আমার পক্ষে সুবিধের। আমি ব্যবসায়ী মানুষ। আমার সময়ের দাম আছে। কিন্তু ওরা কি সেটা বুঝবে? নিয়ম করে দিয়েছে। করাচিতেই রাতের মাঝখানে নামতে হবে। করাচি থেকেই ফ্লাই করতে হবে ঢাকায়। সেখান থেকে চট্টগ্রামে। একটা দিন নষ্ট। আর রাতের ঘুমটাও।’ তিনি অসন্তোষ প্রকাশ করেন। | তখন থেকেই আমার জানা যে, শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের অদ্বিতীয় নেতা। পরে একদিন তার আরাে এক প্রকার পরিচয় পাই। আমার এক বন্ধুপুত্র ইণ্ডিয়ান পুলিশ সার্ভিসে কাজ করতেন। কিছুকাল তাকে ঢাকায় ভারতের হাই কমিশনে নিযুক্ত থাকতে হয়। সেখান থেকে বদলী হয়ে এসে আমাকে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিব ভারতের কাছে অস্ত্র চেয়েছিলেন। আর মুক্তিসৈনিকদের ভারতের মাটিতে তালিম। পণ্ডিত নেহেরু সম্মত হন না।
আমি তা শুনে তাজ্জব বনে যাই। মানুষ কী পরিমাণ মরিয়া হলে সশস্ত্র সংগ্রামের পরিকল্পনা করে! আইয়ুব খান মুজিবকে মুখ্যমন্ত্রী হতে না দিয়ে কোন পথে ঠেলে দিচ্ছেন? তখুতে বসিয়েছেন কি না মােনায়েম খানকে! ময়মনসিংহে থাকতে একদিন ওঁকে আমার আদালতে বসে থাকতে দেখেছিলুম। সিনিস্টার চেহারা। দারুণ কমিউনাল বলে ওঁর দুর্নাম । হয়তাে সেইটেই ওঁর যােগ্যতার মাপকাঠি।
আইয়ুব খানের পতনের পর শেখ মুজিবের সুদিন আসে। বেসিক ডেমােক্র্যাসী পরিত্যক্ত হয়। প্রত্যক্ষ নির্বাচন পুনঃপ্রবর্তিত হয়। সাবালকদের সবাইকে ভােটের অধিকার দেওয়া হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে যে সাধারণ নির্বাচন হয় তাতে মুজিবের দলের জয়জয়কার। শতকরা নিরানব্বইটা আসন কোন দল কবে কোন দেশের ইতিহাসে পেয়েছে? মুজিবের তাে সারা পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা।

১৭৭
সেই সময় কতকগুলি গ্রামােফোন রেকর্ড তৈরি হয় ঢাকায়। একটি ছাত্রের বাড়ি ঢাকায়। সে পড়ে শান্তিনিকেতনে। তাকে পাঠাই বই কিনে আনতে। সে বই নিয়ে আসে। উপরন্তু আনে কয়েকটি রেকর্ড। আমাকে বাজিয়ে শােনায়, কিন্তু হাতছাড়া করে না। রেকর্ড শুনে আমি চমকে উঠি। পাকিস্তান সরকার বার করতে দিচ্ছে অমন সব রেকর্ড! তাতে শেখ মুজিবের বজ্রকণ্ঠ। কণ্ঠে বিদ্রোহের সুর। পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশ ও বাংলাভাষা। সে কী উন্মাদনাভরা গান! গেয়েছে তরুণ তরুণীরা। আবার যেন সেই ১৯০৫ সালের স্বদেশী আমল ফিরে এসেছে। লােকে পাকিস্তানের জন্যে নয়, বাংলাদেশের জন্যে পাগল। যে বাংলাদেশ তাদের একান্ত আপনার।
আজ বাদে কাল রাম রাজা হবেন, কিন্তু তা তাে হবার নয়। তেমনি শেখ মুজিবের পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়া। তার বদলে তিনি পশ্চিম পাঞ্জাবের এক দুর্গম স্থানে হলেন রাজবন্দি। যখন ফিরে এলেন তখন। তিনি সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আমার সেই রেকর্ড শােনার বারাে মাস পরেই রেডিওতে তাঁর সংবর্ধনার বিবরণ শােনা। তাঁর ভাষণ শােনা। রামের মতাে তিনি ফিরে এলেন পুষ্পক বিমানে।

১৭৮
তিনি যে প্রাণ নিয়ে ফিরে এলেন এতেই আমরা কৃতার্থ। কারণ তাঁর প্রাণদণ্ডের আদেশ হয়েছিল। ঢাকায় পাকিস্তানি ফৌজ আত্মসমর্পণ না করলে, রাতারাতি ইয়াহিয়া খান পদত্যাগ না করলে, পাকিস্তানের নতুন রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী ভুট্টো তাঁকে মুক্তি দিয়ে লণ্ডনে পাঠিয়ে না দিলে লণ্ডন থেকে তিনি দিল্লি ও দিল্লি থেকে ঢাকায় পৌঁছতেন না। তার দিল্লির সম্বর্ধনার বিবরণও শুনেছি। সেখানেও তিনি বাংলায় ভাষণ দেন।একুশে ফেব্রুয়ারির অনুষ্ঠানে যােগদানের আমন্ত্রণে ঢাকা যেতে পারিনি। পরে ডিসেম্বর মাসে আসে অন্য এক আমন্ত্রণ। ততদিনে শেখ সাহেব স্বেচ্ছায় প্রধানমন্ত্রী পদ গ্রহণ করেছেন, বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবকে দিয়েছেন রাষ্ট্রপতির পদ। ইতােমধ্যে কলকাতায় চৌধুরী সাহেবের সঙ্গে আলাপ হয়েছিল। তিনি আমার পথে প্রবাসের থেকে আবৃত্তি করে আমাকে অবাক করে দেন। পরে ঢাকায় বঙ্গভবনে মধ্যাহ্নভােজনে আপ্যায়িত করেন। তখন জানতে পাই তিনি ছাত্র বয়সে তাঁর পত্রিকার জন্যে আমাকে চিঠি লিখে লেখা চেয়েছিলেন।
তারপরের একুশে ফেব্রুয়ারিতে যাওয়া হয় না। কিন্তু পরবর্তী একুশে ফেব্রুয়ারিতে সদলবলে নিমন্ত্রণ। ভারতীয় প্রতিনিধিমণ্ডলীর নেতা হয়ে বাংলাদেশের বাংলা সাহিত্য সম্মেলনে যােগ দিই। উদ্বোধন অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধুর দক্ষিণপার্শ্বে শিক্ষামন্ত্রী, তার পাশেই আমি। খুব কাছাকাছি পাই শেখ সাহেবকে। আমার অন্যতম হিরাে। কিন্তু কথা বলার অবকাশ পাই নে। পেতুমও না, যদি না সম্মেলনের উদ্যোক্তারা আমাদের প্রত্যাবর্তনের দিন তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ব্যবস্থা করতেন।
সেই অবিস্মরণীয় দিনটির কথা আমি ফিরে এসে লিখি ও তার নাম রাখি ‘ইতিহাসের সন্ধিক্ষণে। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত্তারের পূর্ণ বিবরণ তাতে ছিল না। তিনি নিজেই আমাদের বারণ করেছিলেন। আজ তিনি নেই। আমারও তাে বয়স হলাে একাত্তর । আর কতদিন আছি কে জানে! কেউ না কেউ লিখে না রাখলে ভাবীকাল জানতেই পাবে না শেখ মুজিব কী করেছিলেন ও কেন করেছিলেন। তাঁর নিষেধ তার জীবকালে মান্য করেছি। এখন তিনি সব আপদ-বিপদের উর্ধ্বে। মরণােত্তর মানহানিরও শঙ্কা নেই। তিনি অমর।

১৭৯
এ বিবরণ আনুপূর্বিক নয়। পরেরটা আগে, আগেরটা পরে, যখন যেটা মনে আসছে তখন সেটা কলমের মুখে আসছে। ভাষা ও ভঙ্গি শেখ সাহেবের নয়, তবে বক্তব্যটা তাঁরই। ভুলচুক যদি ঘটে থাকে তবে সেটা আমার স্মৃতির ভ্রম।
দেখুন, আমি দুই দুই বার মরতে মরতে বেঁচে গেছি। প্রথম বার আইয়ুব খানের বন্দিশালায়। ষড়যন্ত্রের মামলায়। আমার এক সাথী আমাকে হুঁশিয়ার করে দেয় যে সন্ধ্যাবেলা সেলের বাইরে গিয়ে নিয়মিত বেড়ানাের অভ্যাসটি বিপজ্জনক। পেছন থেকে গুলি করবে আর বলবে পালিয়ে যাচ্ছিল বলে গুলী করেছি। অন্যের বেলা ঘটেছিল ওরকম গুলী চালনা। দ্বিতীয়বার ইয়াহিয়া খানের কারাগারে। আমার সামনেই আমার কবর খোড়া হচ্ছে। বুঝতে পারছি যে আমার শেষ মুহূর্ত ঘনিয়ে আসছে। মনটাকে তৈরি করে নিই যে মরতে যখন হবেই তখন মিছে ভয় কেন?
শান্ত মনে মৃত্যুর প্রতীক্ষা করি।’ শেখ সাহেব বলে যান।
সেদিন তিনি বেশ খােশ মেজাজে ছিলেন। সাতজন আরব পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর দ্বারস্থ হয়েছিলেন তাঁকে বুঝিয়েসুঝিয়ে লাহােরে ইসলামী শীর্ষ সম্মেলনে নিয়ে যেতে। তিনি তাঁদের সাফ বলে দিয়েছেন যে আগে স্বীকৃতি, তার পরে সম্মেলনে যােগদান। এখন কী হয় দেখা যাক। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের ঘণ্টাকয়েক যেতে না যেতেই পাকিস্তান দেয় স্বীকৃতি আর রাত পােহাতে না পােহাতেই শেখ উড়ে যান লাহােরে। সেখানে পড়ে যায় সংবর্ধনার ধুম।
শেখ সাহেবকে আমরা প্রশ্ন করি, বাংলাদেশের আইডিয়াটা প্রথম কবে আপনার মাথায় এল?
‘শুনবেন? তিনি মুচকি হেসে বলেন, সেই ১৯৪৭ সালে। তখন আমি সােহরাওয়ার্দী সাহেবের দলে। তিনি ও শরৎচন্দ্র বসু চান যুক্তবঙ্গ। আমিও চাই সব বাঙালির এক দেশ। বাঙালিরা এক হলে কী না করতে পারত। তারা জগৎ জয় করতে পারত | They could conquer the world.’

১৮০
বলতে বলতে তিনি উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। তার পর বিমর্ষ হয়ে বলেন,
‘দিল্লি থেকে খালি হাতে ফিরে এলেন সােহরাওয়ার্দী ও শরৎ বােস। কংগ্রেস বা মুসলিম লীগ কেউ রাজি নয় তাদের প্রস্তাবে। তাঁরা হাল ছেড়ে দেন। আমিও দেখি যে আর কোনাে উপায় নেই। ঢাকায় চলে এসে নতুন করে আরম্ভ করি। তখনকার মতাে পাকিস্তান মেনে নিই। কিন্তু আমার স্বপ্ন সােনার বাংলা। সে স্বপ্ন কেমন করে পূর্ণ হবে এই আমার চিন্তা। হবার কোনাে সম্ভাবনাও ছিল না। লােকগুলাে যা কমিউনাল! বাংলাদেশ চাই বললে সন্দেহ করত। হঠাৎ একদিন রব উঠল, আমরা চাই বাংলাভাষা। আমিও ভিড়ে যাই ভাষা আন্দোলনে। ভাষাভিত্তিক আন্দোলনকেই একটু একটু করে রূপ দিই দেশভিত্তিক আন্দোলনে। পরে এমন এক দিন আসে যেদিন আমি আমার দলের লােকদের জিজ্ঞাসা করি, আমাদের দেশের নাম কী হবে? কেউ বলে, পাক বাংলা। কেউ বলে, পূর্ব বাংলা। আমি বলি, না, বাংলাদেশ। তারপর আমি স্লোগান দিই-জয় বাংলা। তখন ওরা বিদ্রুপ করে বলে, জয় বাংলা না জয় মা কালী! কী অপমান! সে অপমান আমি সেদিন হজম করি। আসলে ওরা আমাকে বুঝতে পারে নি। জয় বাংলা বলতে আমি বােঝাতে চেয়েছিলুম বাংলাভাষা, বাংলাদেশ ও বাঙালি জাতির
জয়। যা সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে। ‘জয় বাংলা’ আসলে একটি মন্ত্র। যেমন বঙ্কিমচন্দ্রের বন্দে মাতরম’ বা দাদাভাই নওরােজীর ‘স্বরাজ’ বা গান্ধীজীর ‘কুইট ইণ্ডিয়া’ বা নেতাজী সুভাষের ‘চলাে দিল্লি। এ হলাে শব্ৰহ্ম। একটি শব্দের বা শব্দের সমষ্টির মধ্যে অসীম শক্তি নিহিত। সে শক্তি অসাধ্যসাধনপটীয়সী।।
একটা কমিউনাল পার্টিকে ন্যাশনাল পার্টিতে রূপান্তরিত করা চাট্টিখানি কথা নয়। বারবার জেলে গিয়ে বারবার মৃত্যুর মুখােমুখি হয়ে তিনি একদিন সত্যি সত্যিই পেয়ে যান তাঁর স্বপ্নের বাংলাদেশ। যে বাংলাদেশ অবিভক্ত না হলেও সার্বভৌম ও স্বাধীন। আমাদের সঙ্গে সাক্ষাৎকারের দিনই পেলেন পাকিস্তানের স্বীকৃতি। পরে ইউনাইটেড নেশনসে আসন। একজন ব্যক্তি তার পঞ্চান্ন বছর বয়সে এর চেয়ে বেশি সার্থকতা প্রত্যাশা করতে পারে কি? আর কেউ কি পারতেন?

১৮১
সেদিন আমাদের বিশ্বাস করে আরাে একটি কথা বলেন শেখ সাহেব। সঙ্গে সঙ্গে বলিয়ে নেন, যে আমরা তা প্রকাশ করব না। আমি এখন কথার খেলাপ করছি ইতিহাসের অনুরােধে। আমি প্রকাশ না করলে কেউ কোনােদিন করবে না।
‘আমার কী প্ল্যান ছিল, জানেন? অকস্মাৎ আমরা একদিন পাওয়ার সীজ করব। ঢাকা শহরের সব ক’টা ঘাটি দখল করে নেব। আর্মিতে, নেভীতে, এয়ার ফোর্সে, পুলিশে, সিভিল সার্ভিসে আমাদের লােক ছিল। কিন্তু একটা লােকের বিশ্বাসঘাতকতার জন্যে সব পণ্ড হয়। নেভীর একজন অফিসার বিশ্বাস করে তার অধীনস্থ একজনকে জানিয়েছিলেন। সে ফাঁস করে দেয়।
তখন আমরা সবাই ধরা পড়ে যাই।’ তিনি আক্ষেপ করেন। আমি প্রশ্ন করি, ‘ঘটনাটা ঘটল কোন তারিখে?
তিনি মৃদু হেসে উত্তর দেন, ‘বলব না।’ আমি চুপ। বুঝতে পারি অশিষ্টতার মাত্রা অতিক্রম করেছি।
বহু তপস্যার ফলে মর্তের মানুষ স্বর্গের ইন্দ্র হয়। পুণ্যবল ক্ষয় হলে বা অসুররা প্রবল হলে পরে একদিন সেই ইন্দ্রের পতনও হয়। দুই দুই বার মরণের মুখ থেকে বেঁচে এসে তিন বারের বার তাকে মৃত্যুর কবলে পড়তে হলাে। পাওয়ার সিজ করল তারই স্বদেশবাসী ও স্বজাতি। অদৃষ্টের বিড়ম্বনা।
এর কি কোনাে দরকার ছিল? সাক্ষাৎকারের দিনই তাে শেখ সাহেব আমাদের বলেছিলেন যে তিনি আর ক্ষমতার আসনে থাকতে চান না, কী করবেন, তাঁর দলের লােক যে তাঁকে যেতে দিচ্ছে না। তিনি স্পষ্ট করে বলেন যে, তাঁর কাজ সারা হয়েছে। তিনি যা যা চেয়েছিলেন সব কিছুই পেয়েছেন।
ঠিক সময়ে সরে গেলে দলের মধ্যে ভাঙন ধরত। সে ভাঙন শুধু স্বার্থঘটিত কারণে নয়, মতবাদঘটিত ও পলিসিঘটিত কারণেও। সব বাঙালি কখনাে এক হতে পারে না, সব বাংলাদেশি কখনাে এক হতে পারে না, সব মুসলমানও কি কখনাে এক হতে পারে? সব মুসলমানের জন্যে পাকিস্তান একটি অনাসৃষ্টি। তার এক অংশের থেকে অপর অংশ হাজার মাইল দূরে। মাঝখানে সমুদ্র নয়, অপর এক দেশ। তার কোনাে

১৮২
স্বাভাবিক কেন্দ্রস্থল ছিল না। কেন্দ্রীয় সরকার কোনাে কালেই মেজরিটি ভােট মেনে নিত না। ভােটবল ছিল পূর্বপ্রান্তের বাঙালি মেজরিটির। অস্ত্রবল ছিল পশ্চিম প্রান্তের পাঞ্জাবি ও পাঠান মাইনরিটির। একদিন না একদিন একটা বলপরীক্ষা হতােই।
শেখ মুজিবের নেতৃত্বে সেই অবশ্যম্ভাবী ঐতিহাসিক পরিবর্তনটি সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন হয়। তিনি ছিলেন ক্রান্তিদশী পুরুষ। আপন ব্রতে নিবেদিত কর্মবীর। একটি স্বপ্ন নিয়েই তার যাত্রারম্ভ। যাত্রাশেষও সেই স্বপ্নের রূপায়ণে।
সময়ে পদত্যাগ করলে বাঁচতেন তিনি আরাে কিছুকাল নিশ্চয়ই। কিন্তু বাঁচতেন কী নিয়ে? যুক্তবঙ্গের লেশমাত্র সম্ভাবনা ছিল না। তিনিও সে আশা ত্যাগ করেছিলেন। এমনভাবে ত্যাগ করেছিলেন যে তাঁর কারবার ছিল দিল্লির সঙ্গে, কলকাতার সঙ্গে নয়। ভারত সরকারের সঙ্গে, পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সঙ্গে নয়। আমরাও বাংলাদেশে গেলে বাঙালি বলে চিহ্নিত হতুম না, হতুম ভারতীয় বলে, ইণ্ডিয়ান বলে। বাংলাসাহিত্য সম্মেলনেও আমরা বিদেশি অতিথি বলে অভ্যর্থনা পাই, যেমন পান সােভিয়েট রাশিয়ার বা পূর্ব জার্মানির প্রতিনিধিরা। বাংলাদেশ সরকার অত্যন্ত সাবধান ছিলেন যাতে কেউ কখনাে মনে না করে বাঙালিতে বাঙালিতে তলে তলে একটা একতার চেষ্টা হচ্ছে। তাই আমাদের প্রতি তাদের একটা ছাড়া ছাড়া ভাব।
ওদিকে আবার একদল সক্রিয় ছিলেন মুসলমানে মুসলমানে একতার চেষ্টায়। শেখ সাহেবকে তাঁরা বিশ্বাস করতেন না। তাঁদের অবিশ্বাস থেকেই এই ঘাতকতা।
অন্নদাশঙ্কর রায়। সাক্ষাৎকারকাল : ১৯৭৪ রচনাকাল : ১৯৭৬

১৮৩

বাকশাল প্রসঙ্গে
‘আমি স্বজ্ঞানে বিচার বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলােকে, আমার দীনদুঃখী মেহনতি মানুষের আশা-আকাক্ষা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আমি বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছি। আমি যা বলি, তাই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বাে, মুক্ত করেছি। বলেছি শােষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়বাে, তাই করে ছাড়বাে, ইনশাল্লাহ। কোনাে কিন্তুটিন্তু নাই, আপােষ নাই।

১৮৫
প্রশ্ন : আপনার রাজনৈতিক চিন্তাধারার মূলনীতি বা লক্ষ্য কী?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমার রাজনৈতিক চিন্তাচেতনা ধ্যান ও ধারণার উৎস বা মূলনীতিমালা হলাে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা। এই চার মূলনীতিমালার সমন্বিত কার্যপ্রক্রিয়ার মাধ্যমে একটি শােষণহীন সমাজ তথা আমার দেশের দীনদুঃখী শােষিত বঞ্চিত শ্রমজীবী মেহনতি মানবগােষ্ঠীর মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের সমষ্টিগত প্রকৃত ‘গণতান্ত্রিক একনায়কতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাকরণই আমার রাজনৈতিক চিন্তাধারার একমাত্র লক্ষ্য।
প্রশ্ন : গণতন্ত্র ও সমাজতন্ত্র কি একযােগে বা পাশাপাশি চলতে পারে?
শেখ মুজিবুর রহমান : যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আমাদের প্রদেশে প্রচলিত আছে তাকে সংখ্যালঘু ধনিক শােষকদের গণতন্ত্র বলাই শ্রেয়। এর সাথে সমাজতন্ত্রের বিরােধ দেখা দেয় বৈকি। তবে গণতন্ত্র চিনতে ও বুঝতে আমরা ভুল করি। কারণও অবশ্য আছে। আর তা হলাে শােষক সমাজ গণতন্ত্র পূর্ণভাবে বিকাশলাভ করুক তা চায় না। এবং গণতন্ত্রকে কীভাবে নিজেদের ব্যক্তিস্বার্থ চরিতার্থ করার হাতিয়ারে পরিণত করা যায়-এখানে চলে তারই উদ্যোগ আয়ােজন। এভাবেই প্রকৃত গণতন্ত্রকে ধামাচাপা দিয়ে রাখা হয়েছে। সাধারণ অজ্ঞ জনগণই শুধু নয়-তথাকথিত শিক্ষিত সচেতন মানুষও প্রচলিত আর্থ-সামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রকে সঠিকভাবে বুঝতে অক্ষম। এরা ভাবে যে ভােটাভুটিই হলাে গণতন্ত্র । একটু তলিয়ে দেখে না প্রাপ্তবয়স্ক মােট

১৮৬
জনসংখ্যার কত পার্সেন্ট ভােট দিলাে, কোনাে শ্রেণির লােকেরা নির্বাচনী প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হলাে, কারা রাষ্ট্র ক্ষমতায় গেলাে, ক্ষমতাসীনরা কোন পদ্ধতিতে তাদের শাসন করছে, সাধারণ জনগণ কতােটুকু কি পাচ্ছে। সুতরাং আমি আমার অভিজ্ঞতার আলােকে বলছি-প্রচলিত গণতন্ত্রের বদৌলতে সমাজের মাত্র ৫ শতাংশ লােকের বা প্রভাবশালী বনিকশ্রেণির স্বৈরাচারী শাসন ও বল্গাহীন শােষণকার্য পরিচালনার পথই প্রশস্ত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রচলিত গণতন্ত্রের মারপ্যাচে সমাজের নিম্নতম সংখ্যালঘু জনগােষ্ঠীর শাসন ও প্রভাব প্রতিপত্তি, সর্বপ্রকার দুর্নীতি শােষণ অবিচার অত্যাচার ও প্রতারণায় সমাজের সর্ববৃহত্তম অজ্ঞ দুর্বল মেহনতি কৃষকশ্রমিক সাধারণ মানব গােষ্ঠীর (শতকরা প্রায় ৯৫ ভাগ) মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার খর্ব হচ্ছে। তারা বঞ্চিত হচ্ছে।
প্রকৃত গণতন্ত্র বলতে আমি এমন একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে বুঝি, যে ব্যবস্থায় জনগণের বৃহত্তর সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের বৃহত্তর কল্যাণের নিমিত্তে

১৮৭
তাদের জন্য, তাদের দ্বারা এবং তাদের স্বশ্রেণিভুক্ত নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার প্রতিষ্ঠার ভেতর দিয়ে তাদেরই প্রকৃত শাসন ও আর্থসামাজিক মৌলিক অধিকার সংরক্ষিত হয়। কিন্তু এই ব্যবস্থা প্রচলিত গণতান্ত্রিক উপায়ে অর্জিত হতে পারে না। কারণ প্রচলিত গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে রাজনৈতিক ও আর্থ-সামাজিক ক্ষেত্রে চলে অর্থ সম্পদের অবাধ ও মুক্ত প্রতিযােগিতা। এক্ষেত্রে দরিদ্র জনসাধারনের পক্ষে এ জাতীয় আর্থ প্রতিযােগিতায় অবতীর্ণ হওয়া কোনাে প্রকারেই সম্ভব না। একমাত্র সমাজতান্ত্রিক পদ্ধতিই এদেরকে রাজনৈতিক প্রতিযােগিতায় অংশগ্রহণের কার্যকরী নিশ্চয়তা দিতে পারে-তাদের আর্থ-সামাজিক মৌলিক মানবাধিকার ও তাদের প্রকৃত গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে পারে। এজন্য আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্রের আরেক নাম সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের মধ্যেই প্রকৃত গণতন্ত্র নিহিত। এজন্যেই আমি গণতান্ত্রিক উপায়ে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার কথা বলেছি। আমি মনে করি প্রকৃত গণতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্রের ভেতর কোনাে বিরােধ নেই।
প্রশ্ন : অনেকে বলেন ‘বাকশাল’ হলাে একদলীয় বা আপনার স্বৈরতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠার একটি অপকৌশল-এ সম্পর্কে আপনি পরিস্কার মতামত দিন।
শেখ মুজিবুর রহমান : সাম্রাজ্যবাদের অবশেষ পুঁজিবাদী সমাজসভ্যতা ও শােষক পরজীবীদের দৃষ্টিতে ‘বাকশাল’ তাে একদলীয় শাসনব্যবস্থা হবেই। কারণ বাকশাল কর্মসূচির মধ্য দিয়ে আমি সাম্রাজ্যবাদের প্রতিনিধি বহুজাতিক পুঁজিবাদী শােষক, তাদের সংস্থাসমূহের লগ্নিকারবার এবং তাদের এ দেশীয় সেবাদাস, এজেন্ট, উঠতি ধনিক গােষ্ঠীর একচেটিয়া শােষণ ও অবৈধ প্রভাব প্রতিপত্তিদুর্নীতি-প্রতারণার সকল বিষদাঁত ভেঙ্গে দেবার ব্যবস্থা করেছি। এজন্য তাদের আঁতে ঘা লেগেছে, বাকশাল ও আমার বিরুদ্ধে অপপ্রচার করে বেড়াচ্ছে। সাম্রাজ্যবাদী শক্তি শাসকরা এ দেশে গােপনে অর্থ যােগান দিয়ে তাদের সেবাদাস ও এজেন্টদের মাধ্যমে সমাজতান্ত্রিক কার্যক্রমকে বানচাল করার প্রচেষ্টা চালাচ্ছে। তারা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকা, সভাসমিতি এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে আমার সরকারের বিরুদ্ধে

১৮৮
অপপ্রচারে লিপ্ত হয়েছে। কলকারখানা, অফিস-আদালত, শিল্প প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন থানায় তাদের ভাড়াটে চরদের দিয়ে অন্তর্ঘাতমূলব তৎপরতা চালাচ্ছে। বিভিন্ন স্থানে অগ্নিসংযােগ, লুটতরাজ, গণহত্যা, অসামাজিক কার্যকলাপ ও সাম্প্রদায়িক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রতিদিন তাদের ষড়যন্ত্রের খবরাখবর আমার কানে আসছে।
প্রচলিত গণতান্ত্রিক বৈষম্য, শােষণ-দুর্নীতিভিত্তিক সমাজকে, দেউলিয়া আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থা, জরাজীর্ণ প্রশাসন ও অবিচারমূলক বিচার ব্যবস্থাকে সমূলে উৎপাটিত করে একটি শােষণহীন, দুর্নীতিহীন, বৈষম্যহীন ও প্রকৃত গণতান্ত্রিক সাম্যবাদী সমাজ বিপ্লবের পথ রচনা করেছি। এই সমাজ বিপ্লবে যারা বিশ্বাসী নন, তারাই বাকশাল ব্যবস্থাকে একদলীয় স্বৈরশাসন ব্যবস্থা বলে অপপ্রচার করছেন। কিন্তু আমি এ সকল বিরুদ্ধবাদীদের বলি, এতকাল তােমরা মুষ্টমেয় লােক, আমার ব্যাপক সংখ্যাগরিষ্ঠ দুঃখী মেহনতি মানুষকে শাসন ও শােষণ করে আসছে। তােমাদের বল্গাহীন স্বাধীনতা ও সীমাহীন দুর্নীতির মধ্য দিয়ে ব্যক্তিসম্পদের পাহাড় গড়ে তােলার অবাধ ও মুক্ত প্রতিযােগিতার হােলিখেলায় আমার দুঃখীমানুষের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা-স্বপ্ন-সাধ ধুলায় মিশে গেছে। দুঃখী মানুষের ক্ষুধার জ্বালা, ব্যথা-বেদনা, হতাশা-ক্রন্দন তােমাদের পাষাণ হৃদয়কে একটুও গলাতে পারেনি। বাংলার যে। স্বাধীনতা তােমরা ভােগ করছাে, এই স্বাধীনতা, এই দেশ, এই মাটি ঐ আমার দুঃখী মেহনতি মানুষের সীমাহীন ত্যাগ তিতিক্ষা, আন্দোলন সংগ্রাম এবং জীবন মৃত্যুর বিনিময়ে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেখানে তােমাদের অবদান কতটুকু আছে, নিজেদের বুকে একবার হাত দিয়ে চিন্তা করে দেখাে। বরং অনেক ক্ষেত্রে স্বাধীনতার বিরােধিতা করেছে। বিদেশী শাসক-শােষকদের সহায়তা করেছে। নিজের ঘরে থেকে ভাইয়ের ঘর পুড়িয়েছে, মানুষকে হত্যা করেছে। মা-বােনদের লাঞ্ছিত করেছে, আরাে কি না করেছাে! এসবই করেছে ব্যক্তিস্বার্থ উদ্ধারের ঘূণ্য লক্ষ্যে।
আমার দেশের মাত্র ৫ পার্সেন্ট লােক ৯৫ পার্সেন্ট লােককে দাবিয়ে রাখছে, শাসন-শােষণ করছে। বাকশাল করে আমি এই ৯৫ ভাগ মানুষের স্বাধীনতা, গণতান্ত্রিক শাসন ও অর্থনৈতিক মুক্তির ব্যবস্থা করেছি।

১৮৯
এতকাল মাত্র ৫ ভাগ কে শাসন করেছে, এখন থেকে করবে ৯৫ ভাগ। ৯৫ ভাগ মানুষের সুখ-দুঃখের সাথে ৫ ভাগকে মিশতে হবে। আমি মেশাবােই। এজন্য বাকশাল করেছি। এই ৯৫ ভাগ মানুষকে সংঘবদ্ধ। করেছি তাদের পেশার নামে, তাদের বৃহত্তর কল্যাণে, তাদের একক দল বাংলাদেশ কৃষক-শ্রমিক আওয়ামী লীগ বা বাকশালে। মূলত বাকশাল হচ্ছে বাঙালির সর্বশ্রেণি সর্বস্তরের গণমানুষের একক জাতীয় প্লাটফর্ম, রাজনৈতিক সংস্থা, একদল নয়। এখানে স্বৈরশাসনেরও কোন সুযােগ নেই। কারণ বাঙালি জনগােষ্ঠীর সম্মিলিত বা সমষ্টিগত শাসন ব্যবস্থায় কে কার উপর স্বৈরশাসন চালাবে? প্রত্যেক পেশার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে শাসন পরিষদ গঠন করা হবে। কোনাে পেশা বা শ্রেণি অন্য পেশার লােকদের ওপর খবরদারি করতে পারবে না। যে কেউ যিনি জনগণের সার্বিক কল্যাণের রাজনীতিতে তথা সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার রাজনীতিতে বিশ্বাসী, তিনি এই জাতীয় দলে ভিড়তে পারবেন।
যারা বাকশালকে একদলীয় ব্যবস্থা বলেন, তাদের স্মরণ করতে বলি, ইসলামে ক’টি দল ছিল? ইসলামী ব্যবস্থায় একটি মাত্র দলের অস্তিত্ব ছিল, আর তা হলাে খেলাফত তথা খােলাফায়ে রাশেদীন। মার্কসবাদও একটিমাত্র দলের অনুমােদন দিয়েছে। চীন, রাশিয়া, কিউবা, ভিয়েতনাম, কিংবা অন্যান্য ইসলামী রাষ্ট্রে কতটি করে দল আছে? এইসব ইসলামী রাষ্ট্রসমূহকে বাদ দাও, ওখানে মহানবীর ইসলাম নেই। বস্তুত প্রকৃত গণতন্ত্র বা সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার স্বার্থেই একটি একক জাতীয় রাজনৈতিক সংস্থা থাকা বাঞ্ছনীয়। একটি জাতীয় কল্যাণের অভিন্ন আদর্শে, ব্যাপক মানুষের সার্বিক মুক্তির লক্ষ্যে একটি মাত্র রাজনৈতিক সংস্থার পতাকাতলে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা ছাড়া গত্যন্তর নেই। কিন্তু বহুদলীয় তথাকথিত গণতান্ত্রিক প্রতিযােগিতায় কোনােভাবেই জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করা সম্ভব নয়। সেখানে বহুদলে জনগণ বহুধা বিভক্ত হতে বাধ্য। আর বিচ্ছিন্ন, বিভক্ত, পরস্পর বিরােধী রাজনৈতিক দলের দ্বন্দ্বসংঘাত, হিংসা-বিদ্বেষ ও হানাহানির রাজনীতি দিয়ে জাতির বৃহত্তর কল্যাণ ও সমৃদ্ধি কোনােভাবেই অর্জিত হতে পারে না। ইতিহাস সে সাক্ষ্য দেয় না। আমার দীর্ঘ রাজনৈতিক অভিজ্ঞতাও তাই বলে।

১৯০
প্রশ্ন : বাকশালের মূল লক্ষ্য বা এর কর্মসূচি সম্পর্কে কিছু বলুন।
শেখ মুজিবুর রহমান : বাকশালের মূল লক্ষ্য তাে আগেই বিশ্লেষণ করেছি। তবে এক কথায় আমি যা বুঝি তা হলাে একটি শােষণহীন, দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও শােষিতের গণতান্ত্রিক শাসন প্রতিষ্ঠাকরণ । বাকশাল কর্মসূচিকে আমি প্রধানত তিনটি ভাগে ভাগ করেছি।
এক, রাজনৈতিক, দুই, আর্থ-সামাজিক, তিন, প্রশাসনিক ও বিচার ব্যবস্থা। এক, রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনায় প্রত্যেক পেশাভিত্তিক লােকদের
জাতীয় দল বাকশালে অন্তর্ভুক্ত করার ব্যবস্থা রেখেছি। এবং পর্যায়ক্রমে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রত্যেকটি নির্বাচনী এলাকার জাতীয় দলের একাধিক প্রার্থীদের মনােনয়ন দেওয়া হবে। জনগণ তাদের মধ্যে থেকে একজনকে নির্বাচিত করবেন। প্রেসিডেন্ট জনগণের ভােটে নির্বাচিত হবেন। জাতীয় দলের সদস্য যে কেউ প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রার্থী হতে পারবেন। প্রেসিডেন্ট পদাধিকার বলে জাতীয় দলের চেয়ারম্যান হবেন। প্রেসিডেন্ট জাতীয় সংসদের আস্থাভাজন একজনকে প্রধানমন্ত্রী নিয়ােগ করবেন। সংসদ সদস্যদের দুই-তৃতীয়াংশের অনাস্থায় প্রেসিডেন্টকে অপসারিত করতে পারবেন। মন্ত্রিসভা প্রেসিডেন্ট ও জাতীয় সংসদের কাছে দায়ী থাকবেন। স্থানীয় থেকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে সর্বস্তরের
জনগণের প্রতিনিধিত্ব প্রত্যক্ষভাবে বজায় থাকবে। দুই. আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার মধ্যে রয়েছে বাধ্যতামূলক বহুমুখী
গ্রাম সমবায় প্রকল্প। এর মাধ্যমে আর্থব্যবস্থায় উন্নয়ন বা স্বনির্ভর-স্বাধীন গ্রামীণ ব্যবস্থা, বিশেষ করে ভূমিসংস্কারের প্রয়ােজনীয় ও কার্যকরী ব্যবস্থার মাধ্যমে ভূমিহীন কৃষকদের পুনর্বাসন তথা কৃষকদের হাতে জমি হস্তান্তর, উৎপাদন বৃদ্ধি ও সাম্যভিত্তিক বণ্টন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ। ভারী শিল্পকারখানা, পরিত্যক্ত সম্পত্তি, বৈদেশিক বাণিজ্য, ব্যাংক, যােগাযােগ ব্যবস্থা ইত্যাদি জাতীয়করণ করে জনগণের

১৯১
যৌথ শেয়ার মূলধনে নতুন নতুন কৃষিজাত শিল্প ও অন্যান্য শিল্প কলকারখানা ও সংস্থা প্রতিষ্ঠা। সীমিত ব্যক্তিমালিকানাকে উৎসাহদানের ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ব্যক্তিমালিকানাধীন সংস্থাসমূহ যাতে জনসাধারণ ও তাদের শ্রমিকদের শােষণকরতে না পারে তার ব্যবস্থা থাকবে। তিন, প্রশাসনিক কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়,
কর্পোরেশন ও বিভাগগুলাের পুনর্বিন্যাস ও পুনর্গঠন তথা মাথাভারী প্রশাসনের উচ্ছেদ সাধন। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে জেলা গভর্নর ও থানা প্রশাসনিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এ লক্ষ্যে দেশের সকল মহকুমাকে জেলায় উন্নীত করা হয়েছে। প্রশাসনিক জটিলতা ও দীর্ঘসূত্রিতার কারণে ইউনিয়ন পরিষদ, মহকুমা ও বিভাগীয় প্রশাসনকে তুলে দেয়া হচ্ছে। জেলা ও থানাগুলাে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দ্বারা পরিচালিত হবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ সদস্যদের ভােটে থানা পরিষদ গঠিত হবে। তবে থানা পরিষদের প্রশাসক/চেয়ারম্যানরা ও জেলা গভর্নররা জনগণ, স্ব স্ব পরিষদ ও প্রেসিডেন্টের কাছে দায়ী থাকবেন। গ্রাম সমবায় পরিষদ থানা পরিষদের কাছে, থানা পরিষদ জেলা পরিষদের কাছে দায়ী থাকবে। গ্রাম সমবায় পরিষদ, থানা পরিষদ, জেলা পরিষদ এরপরই থাকবে জাতীয় সরকার। এভাবে প্রতিটি ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক প্রশাসনিক কাঠামাের মধ্যে জাতীয় সরকারের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে বিপুলভাবে বিকেন্দ্রীকরণ করে প্রশাসনকে জনগণের দ্বারপ্রান্তে পৌছে দেওয়ার ব্যবস্থা নিয়েছি। প্রশাসনিক আমলাতন্ত্র, স্টিলফ্রেম গতানুগতিক বা টাইপড চরিত্রকে ভেঙ্গে গুঁড়াে করে দেবার ব্যবস্থা নিয়েছি। সরকারি কর্মচারীরা এখন থেকে জনগণের সেবক।
বিচার বিভাগের ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টকে রাজধানীতে বহাল রেখে হাইকোর্ট বিভাগকে আটটি আঞ্চলিক বিভাগে বিকেন্দ্রীকরণের ব্যবস্থা নিয়েছি। তবে সুপ্রিমকোর্টের

১৯২
অধিবেশন বছরে অন্তত একবার করে প্রতিটি আঞ্চলিক বিভাগে (হাইকোর্টে) বসবে। জেলা আদালতসমূহ বহাল থাকবে। প্রতিটি থানাতে থাকবে একাধিক বিশেষ ট্রাইব্যুনাল। প্রত্যেকটি আদালতে যে কোনাে মামলা ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে মীমাংসা করতে হবে। গ্রামে থাকবে একাধিক সালিস বাের্ড। সালিস বাের্ড গঠিত হবে স্থানীয় মুক্তিযােদ্ধা, শিক্ষক ও গণ্যমান্য ব্যক্তিদের সমন্বয়ে। সালিস বাের্ড চেয়ারম্যান থাকবেন সরকার নিয়ােজিত বিচার বিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটরা। এভাবে সুষ্ঠ, ন্যায় ও দ্রুততর গণমুখী বিচারকার্য সম্পন্ন করার লক্ষ্যে বিচার বিভাগের ক্ষমতাকে বিকেন্দ্রীকরণ করা হয়েছে।
প্রশ্ন : অনেকে বলেন, আপনি নাকি কোনাে একটি পরাশক্তির চাপের মুখে বা তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছেন এবং এ ব্যবস্থা নাকি সাময়িককালের জন্য করেছেন—এ বিষয়ে আপনি অনুগ্রহ করে কিছু বলবেন কি?
শেখ মুজিবুর রহমান : কারাে প্রেসার বা প্রভাবের নিকট আত্মসমর্পণ বা মাথানতা করার অভ্যাস বা মানসিকতা আমার নেই। এ কথা যারা বলেন, তারাও তা ভালাে করেই জানেন। তবে অপপ্রচার করে বেড়াবার বিরুদ্ধে কোনাে আইন নেই, তাই উনারা এ কাজে আদাজল খেয়ে নেমেছেন। করুন অপপ্রচার। আমি স্বজ্ঞানে বিচার বিশ্লেষণ করে, আমার অভিজ্ঞতার আলােকে, আমার দীনদুঃখী মেহনতি মানুষের আশাআকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে আমি বাকশাল কর্মসূচি দিয়েছি। আমি যা বলি, তাই করে ছাড়ি। যেখানে একবার হাত দেই সেখান থেকে হাত উঠাই না। বলেছিলাম এ দেশকে মুক্ত করে ছাড়বাে, মুক্ত করেছি। বলেছি। শােষণহীন দুর্নীতিমুক্ত সমাজতান্ত্রিক বাংলা গড়বাে, তাই করে ছাড়বাে, ইনশাল্লাহ। কোনাে কিন্তটি নাই, আপােষ নাই।
প্রশ্ন : বাকশাল বিরােধীমহল অর্থাৎ ঐ ৫ শতাংশ সংখ্যায় অতি নগণ্য হলেও তাদের হাতেই রয়েছে বিপুল সম্পদ। তাদের সাথে রয়েছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদ ও পুঁজিবাদী শক্তির যােগসাজশ। তাদের পেইড এজেন্টরাই রয়েছে প্রশাসনিক ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ

১৯৩
ক্ষমতার কেন্দ্রে। তাদের কায়েমী স্বার্থের উপর আপনি আঘাত হানতে যাচ্ছেন, এই অবস্থায় তারা চোখ মেলে, মুখ গুঁজে বসে থাকবে বলে আপনি মনে করেন? তারা তাদের অবস্থান নিরাপদ ও সংহত করার জন্য প্রচেষ্টা চালাচ্ছে না?
শেখ মুজিবুর রহমান : আমি জানি তারা বসে নাই। ষড়যন্ত্র চলছে। প্রতিদিনই ষড়যন্ত্রের উড়াে খবর আমার কাছে আসে। সাম্রাজ্যবাদ ও তার পদলেহীরা এসব ষড়যন্ত্রে লিপ্ত রয়েছে। গােপন পথে অঢেল অর্থ এ কাজে লাগাবার জন্য বাংলাদেশে আসছে। সুকৌশলে আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করা হচ্ছে। অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ চলছে। অপপ্রচার চলছে। আমি জাতির বৃহত্তর কল্যাণে এ পথে নেমেছি। জনগণ সমর্থন দিচ্ছে। তাই ষড়যন্ত্র করে, বাধার সৃষ্টি করে, হুমকি দিয়ে আমাকে নিবৃত্ত। করা যাবে না। আমার কাজ আমি করে যাবােই। হয়তাে শেষ পর্যন্ত ওরা আমাকে মেরে ফেলতে পারে। পরােয়া করি না। ও মৃত্যু আমার জীবনে অনেকবার এসেছে। একসিডেন্টলি আজো আমি বেঁচে আছি। অবশ্যই আমাকে মরতে হবে। তাই মৃত্যু ভয় আমার নেই। জনগণ যদি বােঝে আমার আইডিয়া ভালাে, তাহলে তারা তা গ্রহণ করবে। আমার কর্মসূচি বাস্তবায়ন করবে। আমার একটা বড়াে সান্ত্বনা আছে, যুদ্ধের সময় জনগণের সাথে আমি থাকতে পারিনি। জনগণ আমারই আদেশ ও নির্দেশে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছে। আজকের এই শােষণমুক্ত সমাজতন্ত্র বা অর্থনৈতিক মুক্তির বিপ্লবে আমি যদি নাও থাকি, তাহলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস আমার বাঙালিরা যে কোনাে মূল্যে আমার রেখে যাওয়া আদর্শ ও লক্ষ্য একদিন বাংলার বুকে বাস্তবায়িত করে ছাড়বে ইনশাল্লাহ।
১৯৭৫