This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
চারু মজুমদারের কথা
সৌরেন বসু
ভূমিকা
ষাটের দশকের শেষ দিকে ভারতীয় সমাজ এক গভীর সংকটের সম্মুখীন হয়। সাম্রাজ্যবাদের উপর নির্ভরশীলতা বজায় রেখে, সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আপস করে, সীমিত পুঁজিবাদী বিকাশের যে নীতি নেহরুর সময় গ্রহণ করা হয়, তারই বিষময় পরিণতিতে সে সময় ভারতীয় অর্থনীতিতে দেখা দেয় চরম বিপর্যয়। ১৯৬৫ এবং ১৯৬৬ সালে ভারতবর্ষে খাদ্যশস্যের উৎপাদন নেমে গিয়েছিল যথাক্রমে ৬ কোটি ৩৩ লক্ষ এবং ৬ কোটি ৪৯ লক্ষ টন-এ। পরপর দুবছরে পর্যায়ক্রমে ১ কোটি এবং ৮৬ লক্ষ টন খাদ্যশস্য আমদানি করেও মাথাপিছু দৈনিক খাদ্যশস্যের সরবরাহের ব্যবস্থা সেই দু বছর ৪০৮.২ এবং ৪০১.৪ গ্রাম-এর ঊর্ধ্বে তােলা যায়নি। পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের গােড়ায় খাদ্য পরিস্থিতি এতটা ভয়াবহ ছিল না; এমনকি তখনও খাদ্যশস্যের মাথাপিছু নিয়মিত সরবরাহের ব্যবস্থা ছিল দৈনিক ৪৫০ গ্রাম-এর কাছাকাছি।
খাদ্য সংকট তথা কৃষির সংকট বহুবার মুলতুবি রাখা কৃষি প্রশ্নটিকে আবার সামনে নিয়ে এলাে; কৃষি প্রশ্নে শাসক দলের অনুসৃত নীতির উপর জনগণের আস্থার অভাব দেখা দিল। গণ অসন্তোষ বৃদ্ধি পেল। পরিণামে গােটা ভারতবর্ষ জুড়ে দেখা দিল গণ আন্দোলন। গণ আন্দোলনের পীঠস্থান পশ্চিমবঙ্গ খাদ্য আন্দোলনে উত্তাল হয়ে উঠল। শাসক শ্রেণির পক্ষে পুরানাে সংসদীয় শাসক পার্টির সাহায্যে শাসন চালিয়ে যাওয়া অসম্ভব হয়ে উঠল। জনগণও পুরানাে ধরনের শাসন মানতে অস্বীকার করলেন। পরিণামে ১৯৬৭ সালে সাধারণ নির্বাচনে মােট ৯টি রাজ্যে কংগ্রেস পার্টি পরাজিত হলাে। ১৯৪৭ সালের পর এই প্রথমবার কংগ্রেসের রাজনৈতিক ই চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হলাে।
কংগ্রেসের কোনাে স্থায়ী বিকল্প না থাকায় শ্রেণি শাসন বজায় রাখার তাগিদে শাসক শ্রেণির স্বার্থেই কংগ্রেস দলটিকে নতুন করে গড়ে তােলা হলাে। সংস্কারের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী বিকাশ দ্রুততর করে এবং নানা ধরনের রিলিফ দানের ব্যবস্থা করে কাঠামােটিকে টিকিয়ে রাখার উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়ােজনীয়তা যাঁরা বুঝতে অস্বীকার করলেন, তাঁদের বাদ দিয়ে জাতীয়তাবাদ, সমাজতন্ত্র ও ফ্যাসিবাদ, এই তিন মতাদর্শের এক বিষম সমন্বয়ে নতুন এক শাসক পার্টির জন্ম হলাে। এই পার্টির নেতৃত্বে ছিলেন ইন্দিরা গান্ধী। একদিকে অসম্পূর্ণ সংস্কার, অন্যদিকে গণ আন্দোলনের উপর বর্বর সন্ত্রাস নতুন পার্টির এই হলাে কাজের ধারা। এদেশের ব্র্যাকেট-যুক্ত এবং ব্রাকেটহীন দুই মার্কসবাদী পার্টিই প্রত্যক্ষ বা পরােক্ষভাবে ইন্দিরা গান্ধী পরিচালিত এই কংগ্রেস দলটির উত্থান ও ক্ষমতা সংহত করার কাজে সাহায্য করল। ইন্দিরার সংস্কারগুলােকে তাঁরা দুইহাত তুলে সমর্থন করলেন। সামন্ততন্ত্রের সঙ্গে আপসের মধ্য দিয়ে পুঁজিবাদী বিকাশের বিকল্প নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সাহায্যে দ্রুত এবং অবাধ অর্থনৈতিক বিকাশের পথ, ইন্দিরা-নির্দেশিত সংস্কারমুখী পথের বিরুদ্ধে বিকল্প পথে কৃষি বিপ্লবের সাহায্যে সংকট-মােচনের যে সম্ভাবনা আছে এবং এই সম্ভাবনা যে জনগণের পক্ষে মঙ্গলজনক— এই সত্যের প্রতি তাঁরা বিশ্বাসঘাতকতা করলেন। এই বিশ্বাঘাতকতারও ভ্রষ্টাচারের জাল ছিল বহুদূর বিস্তৃত। এমনকি সােভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির নেতা ঘােষণা করলেন যে, এদেশের ইন্দিরা গান্ধীর কংগ্রেস পার্টির বিকল্প কোনাে পার্টির প্রয়ােজনীয়তাই নেই।
মানবসমাজের ইতিহাস শেষ হয়ে যায় না কারণ বিশ্বাসঘাতকতা ও ভ্রষ্টাচার, এ দুইয়ের পাশাপাশি থাকে আদর্শ ও নীতির প্রতি অবিচল থাকারও উদাহরণ। সরকারি কমিউনিস্টদের বিশ্বাসঘাতকার ইতিহাসের পাশাপাশি এদেশের ষাট এবং সত্তরের দশকে গড়ে উঠল আর এক ইতিহাস। সংস্কারের মধ্য দিয়ে সাময়িকভাবে সংকট সমাধানের কর্মসূচির বিপরীতে বলা হলাে- খাদ্য সংকট তথা অর্থনৈতিক সংকটের উৎস সাম্রাজ্যবাদ, দেশীয় বৃহৎ বুর্জোয়া এবং সামন্ততন্ত্র। বিপ্লবের মধ্য দিয়ে তাদের উৎখাত সাধনের এক কর্মসূচিও এর পাশাপাশি হাজির করা হয় এবং রক্তের মূল্যে এই কর্মসূচিকে রূপদান করার চেষ্টা করা হয়। যে রাজনৈতিক মতবাদ এই রক্তাক্ত ইতিহাসের সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে যুক্ত হয়ে যায়, এদেশে তার পরিচয় নকশালপন্থা; যে রাজনৈতিক মানুষটির নাম এই মতবাদের সঙ্গে নিরপেক্ষভাবেই যুক্ত হয়ে যায় তার নাম চারু মজুমদার।
আপাতদৃষ্টিতে চারু মজুমদার ব্যর্থ হয়েছেন, সফল হয়েছেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। গােপীবল্লভপুর, শ্রীকাকুলাম কিংবা নকশালবাড়িতে মুক্তাঞ্চল গড়ে ওঠেনি। গণফৌজের বেয়নেটের দাগে ভূমির নতুন সীমানা নিরূপণ করা যায়নি। সশস্ত্র কৃষি বিপ্লবের লক্ষ্যে যে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তা আজ বহু বিভক্ত। পক্ষান্তরে কৃষি বিপ্লবের বিপরীতে ‘সবুজ বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষ সাময়িকভাবে হলেও খাদ্য সংকটের আংশিক সমাধান করেছে’; শতাব্দীর সবচেয়ে ভয়াবহ খরার বছরেও এদেশের ১৯৬৫ বা ১৯৬৬-তে যে খাদ্য উৎপাদন হতাে তার দ্বিগুণেরও বেশি খাদ্যশস্য উৎপন্ন হয়েছে, নানা সীমাবদ্ধতা ও স্ববিরােধিতা সত্ত্বেও আই.আর.ডি.পি, এন.আর.ই.পি., আই.টি.ডি.পি. ইত্যাদির মধ্য দিয়ে কিছুটা রিলিফ দরিদ্র মানুষের কাছে পৌঁছে যাচ্ছে। কংগ্রেস শাসিত রাজ্যগুলােতে ইন্দিরা গান্ধীর ‘বিশ দফা কর্মসূচি এবং জনতা-সি পি এম-সি পি আই-মাসিত রাজ্যগুলােতে ‘পঞ্চায়েতের মাধ্যমে গ্রামােন্নয়ন’ নামক গান্ধীমার্কা সাম্রাজ্যবাদী কর্মসূচির জোয়ার দেখা দিয়েছে। যে কৃষক নেতা জমি দখলের লড়াই করত, সেই কৃষক নেতা এখন রিলিফ-এর হিসাবপত্র রাখে। ‘কৃষি বিপ্লব’, ‘সশস্ত্র সংগ্রাম’ ইত্যাদি শব্দপুঞ্জ দৃশ্যত অর্থহীন হয়ে পড়েছে। চারু মজুমদার নামটিও কিছুটা অবহেলিত, ধিকৃত। নিজের মতবাদের পক্ষে দাঁড়ানাের মূল্য হিসেবে যে মানুষটি রাষ্ট্রযন্ত্রের নিপীড়নের শিকার হয়ে প্রাণ বিসর্জন দিতেও সংকোচ বােধ করেননি, রাষ্ট্রপ্রদত্ত স্বাচ্ছন্দ্য আর নিরাপত্তার লালিত স্নিগ্ধতনু সমাজ গণতন্ত্রীরা তার নিন্দা করতেও আর অস্বস্তি অনুভব করেন না।
এসবই সত্য, তবে শেষ সত্য নয়। যে আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট নকশালপন্থা ও চারু মজুমদারের জন্ম দিয়েছিল, বর্তমান সময়ের বিচারে তাতে সামান্যই পরিবর্তন হয়েছে। ১৯৬০ সালে এদেশের দৈনিক মাথাপিছু খাদ্যের জোগান ছিল ৪৬৮.৭ গ্রাম, দুই দশকের সবুজ বিপ্লবের পরও এই জোগানের পরিমাণ ৪৮০ গ্রামের উর্ধ্বে ওঠেনি। যে খাদ্যের জোগান আছে তার বন্টনেও আছে চূড়ান্ত অসাম্য। তিরিশ কোটি ভারতীয় এখনও দুবেলা মুঠো অন্নের সংস্থান করতে পারে না। সাতটি পরিকল্পনার পরেও এদেশে নথিভুক্ত বেকারের সংখ্যা ৩ কোটি, বন্ধ কারখানার সংখ্যা ১ লক্ষ ৮০ হাজার। প্রতি একশ জন ভারতীয়র মধ্যে ৬৪ জন নিরক্ষর। এদেশে এখনও সতীদাহ হয়, ধর্মের উন্মাদনায় দাঙ্গা হয়। কৃষক জমি চাইলে এদেশে এখনও সংঘর্ষ ঘটে।
চারু মজুমদার ব্যর্থ হয়েছেন। কিন্তু চারু মজুমদারের প্রয়ােজনীয়তা শেষ হয়নি।
চারু মজুমদার তথা নকশালবাড়ির আন্দোলনের মূল্যায়ন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। যেহেতু আমাদের সমাজে চারু মজুমদারের প্রয়ােজন ফুরিয়ে যায়নি, সেহেতু, সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা ফুরিয়ে যায়নি, এ বিতর্ক তাই প্রয়ােজনীয়।
একথা ঠিক যে চারু মজুমদারের বহু ধারণা ভুল ছিল। তাঁর ‘খতন অভিযান’-এর রাজনীতি ছিল ব্যক্তি সন্ত্রাসের রাজনীতি, তাঁর আন্তর্জাতিকতাবােধে ভারতীয় জাতীয়তাবােধকে আহত করার উপাদান ছিল। যে পদ্ধতিতে তিনি পার্টি তৈরি করেছিলেন এবং যেভাবে পার্টিতে তিনি একদিকে অতিকেন্দ্রিকতা এবং অন্যদিকে অতিগণতন্ত্রের প্রশ্রয় দিয়েছিলেন তা এই পার্টির ভাঙনের অন্যতম কারণ হয়েছিল। এজন্য এই আন্দোলনকে অশেষ ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছিল। এসবই সত্যি। এগুলাে অস্বীকার করার কোনাে কারণ নেই।
কিন্তু ভারতীয় সমাজে চারু মজুমদার যে ইতিবাচক প্রভাব রেখে গেছেন তার তাৎপর্য অপরিসীম। চারু মজুমদার বিদ্রোহ করেছিলেন আমাদের দেশে সংসদীয় বামপন্থার যে কালচার আছে, তার বিরুদ্ধে। এদেশের বামপন্থার শেষ লক্ষ্য সংসদ। এদেশের বামপন্থির শেষ লক্ষ্য সংসদ কিংবা মন্ত্রী হওয়া। এই বামপন্থা, যা পদে পদে এই প্রতিক্রিয়াশীল (চারু মজুমদারের ভাষায় ‘মানুষখেকো’) সমাজব্যবস্থার সঙ্গে আপস করে, তা সমাজ থেকে আহরণ করে দক্ষিণপন্থার সুবিধা এবং বামপন্থার সম্মান। সংসদীয় রাজনীতিই পারে এই দুই লক্ষ্যের মিলন ঘটাতে। এই দেশে তাই বামপন্থি পার্টিগুলাে দুর্গাপূজা বা ঈদের তারিখ লক্ষ রাখার মতাে করে নির্বাচনের তারিখ লক্ষ করে। ভােটার লিস্টে কারচুপি থেকে বুথ দখল— সব কিছু করে তারা ভােটে জেতে। ভােটে না জিততে পারলে চিত করে রাখা কচ্ছপের মতাে নিষ্ফল হাত-পা ছোঁড়ে।
চারু মজুমদার বিদ্রোহ করেছিলেন এই বামপন্থার ভ্রষ্টাচারের বিরুদ্ধে। কাজটা যখন তিনি করেছিলেন, তখন এ কাজ করা আজকের চেয়ে অনেক বেশি কঠিন ছিল। সিপিএম তখন সদ্য বিভাজন ঘটিয়েছে সিপিআই-এর সাথে। সিপিআই-কে ‘সংশােধনবাদী’ হিসেবে চিহ্নিত করে তারা তখন সংসদ-সর্বস্বতার রাজনীতির বিপরীতে বিপ্লবী রাজনীতির কথা বলছেন। তাঁদের এই বিপ্লবীয়ানা যে ভঙ্গিসর্বস্বতা মাত্র, বর্তমান সময়ের দিক থেকে তাদের সঙ্গে সিপিআই-এর কোনাে তফাত নেই, আজ সিপিএম-এর ত্রয়ােদশ কংগ্রেসের পরে তা বােঝা যতটা সােজা সে সময় তা ততটাই কঠিন ছিল। চারু মজুমদার এবং তাঁর সহযােগীরা কিন্তু এটা গােড়াতেই বুঝেছিলেন। তাঁদের উপলব্ধি যে ভুল ছিল না, নকশালবাড়ির কৃষক বিদ্রোহের পরিপ্রেক্ষিতে সিপিএম নেতৃত্বের ন্যাক্কারজনক ভূমিকা তা প্রমাণ করল। নকশালবাড়ি শুধু কৃষি-প্রশ্নটিকেই সামনে নিয়ে আসেনি। কৃষি-প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে এসে চারু মজুমদার যে ভুল করেননি, গত দুই দশকের ঘটনাবলি তা প্রমাণ করেছে। সিপিএম-কে সংসদ-সর্বস্ব মেকি বাম হিসেবে চিহ্নিত করেও চারু মজুমদার যে ভুল করেননি, পরবর্তী ইতিহাস তা প্রমাণ করেছে।
রাজনীতিতে চারু মজুমদার এমন একটি মূল্যবােধ নিয়ে আসার চেষ্টা করেন, আজ যার প্রয়ােজনীয়তা তীব্রতর হয়েছে, বাম বা দক্ষিণপন্থি যেকোনাে রাজনীতিই আজ হয়ে দাঁড়িয়েছে কেরিয়ার গড়ার উপায়। ভালাে চাকরি বা সফল ব্যবসায়ের মতােই রাজনীতি আজ জাগতিক যাবতীয় সুখ ও সমৃদ্ধি অর্জনের পথ হয়ে উঠেছে। বামপন্থি পার্টিগুলাের অফিসেও আজকাল এমন মানুষদের আনাগােনা, ধান্দাবাজি ও স্বার্থসিদ্ধির যাবতীয় উপায় যাদের নখদর্পণে। রাজনীতির জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করতে হয়, কেরিয়ার বিসর্জন দিতে হয়, দুঃখ স্বীকার করতে হয়, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে হয়, কারাবরণ করতে হয়- এ ধারণা ক্রমশ বাতিল হয়ে যাচ্ছে।
‘গান্ধারীর আবেদন’-এ গান্ধারীকে ধৃতরাষ্ট্র জিজ্ঞেস করেছিলেন— কী দিবে তােমারে ধর্ম? উত্তরে গান্ধারী বলেছিলেন- ‘দুঃখ নব নব’। নব নব দুঃখকে স্বীকার করে নিয়েই ধর্মে অটল থাকতে হয়। জনগণের জন্য যে রাজনীতি, তারও মূলকথা তাই। স্ব-রাজনীতিতে অচল থাকার জন্য দুঃখ পেতে হয়, স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করতে হয়, প্রয়ােজনে প্রাণ বিসর্জন দিতে হয়। রাজনীতি জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য পাওয়ার মাধ্যম নয়, রাজনীতি জাগতিক সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ত্যাগ করার মাধ্যম। বিস্মৃত এই রাজনৈতিক মূল্যবােধকেই ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করেছিলেন চারু মজুমদার। এদেশে অগ্নিযুগের বিপ্লবীদের পরে রাজনৈতিক কর্মীদের কাছে রাজনীতির জন্য সর্বস্ব ত্যাগের আহ্বান চারু মজুমদার ছাড়া আর কেউ দেননি। শ্রমিক ও কৃষকদের কাছে জমে থাকা ঋণ শােধের দায়বদ্ধতায় তিনি উদ্বুদ্ধ করেছিলেন হাজার হাজার মধ্যবিত্ত তরুণ-তরুণীদের। মৃত্যুঞ্জয়ী নতুন মানুষ গড়ার কাজে তিনি নেমেছিলেন। দুঃখবরণ, আত্মত্যাগ ও বীরত্বের এক মহাকাব্য তৈরি হয়েছিল ভারতে।
এখন নিস্তরঙ্গ ‘বাম’ রাজত্বে সাজানাে চেম্বারে বসে ‘বাম’ মন্ত্রী কফি এবং কাজু সহযােগে সেই উত্তাল দশকের ‘বিপথগামী তরুণদের ‘পেটি বুর্জোয়া’ উন্মাদনা নিয়ে বিদ্রুপ করেন। চারু মজুমদারের ধ্বংসাত্মক রাজনীতির বদলে তরুণ সমাজকে আজ ‘গঠনমূলক কাজে উদ্বুদ্ধ করা হয়। সেই ‘গঠনমূলক কাজের হাত ধরে একদিকে আসে ‘হােপ ৮৬ কিংবা ‘নব আনন্দ’; কফি-হাউসের আশেপাশে গজিয়ে ওঠে ড্রাগের আখড়া। অন্যদিকে এমপ্লয়মেন্ট এক্সচেঞ্জে লাইন দীর্ঘতর হয়, শীর্ণদেহ বিষন্ন তরুণের সংখ্যা বাড়ে, কড়িকাঠে ঝােলে বেকার শ্রমিকের তরুণ সন্তানের দেহ।
চারু মজুমদার ব্যর্থ হয়েছেন, কিন্তু চারু মজুমদারের প্রয়ােজন আজ ব্রিতর হয়েছে।
চারু মজুমদারের প্রয়ােজন আছে বলেই চারু মজুমদারের চারু মজুমদার হয়ে। ওঠার ইতিহাস অধ্যয়ন করা প্রয়ােজন। প্রয়ােজন তার রাজনৈতিক জীবনের ইতিবাচক ও নেতিবাচক শিক্ষাগুলাের সার-সংকলন করা। চারু মজুমদার নিয়ে এদেশে বহু বিতর্ক হয়েছে, কিন্তু দুঃখের কথা, তাঁর রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসটিকে আজ পর্যন্ত গ্রন্থিত করা হয়নি। তাঁর নিজের রচনাবলি সামান্যই, সেগুলােও এক বিশেষ সময়ে, বিশেষ প্রয়ােজনে লেখা। সেগুলাে থেকে তাঁর এক পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়ন করা সম্ভব নয়। চারু মজুমদারের একটি পূর্ণাঙ্গ মূল্যায়নের জন্য দরকার তাঁর জীবনের বিভিন্ন ঘটনাবলি পর্যালােচনা করা, তাঁর চিন্তাভাবনার বিকাশের ইতিহাসটি অনুসন্ধান করা। তাঁর ঘনিষ্ঠ কোনাে সহযােগী ছাড়া অন্য কেউ এ কাজ করতে পারেন না।
চারু মজুমদারের রাজনৈতিক জীবনের এক বড় পর্যায় জুড়ে সৌরেন বসু ছিলেন তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগী। চারু মজুমদারকে নিয়ে কোনাে কিছু লেখার অধিকার যাঁদের আছে তিনি তাঁদের অন্যতম। সৌরেন বসু রচিত ‘চারু মজুমদারের কথা সে কারণেই একটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ।
গােত্রের বিচারে সৌরেন বসু রচিত গ্রন্থটি একটি রাজনৈতিক ব্যক্তির রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাস। সৌরেন বসু কিন্তু শুধু ইতিহাস লেখেননি। তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে চারু মজুমদারের রাজনৈতিক জীবনের ইতিহাসের সাথে সাথে তিনি ফুটিয়ে তুলেছেন চারু মজুমদার নামক ব্যক্তিমানুষটির চরিত্রের বিভিন্ন দিক, প্রয়ােজনে সেগুলাের বিশ্লেষণও তিনি করেছেন।
চারু মজুমদারের জীবন-ইতিহাসের অনেকটা জুড়ে আছে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান ও তৎপরবর্তীকালের বিপ্লবী সংগ্রামের ইতিহাস। সামসময়িক ঘটনাবলির সঙ্গে ওতপ্রােতভাবে যুক্ত থাকার সূত্রে সৌরেন বসু সেই ইতিহাসের সঙ্গে পরিচিত। তার রচনায় আছে সেই ইতিহাস, তার খুঁটিনাটি নানা দিকের বর্ণনা, এবং তার বিশ্লেষণ।
চারু মজুমদার তথা নকশালবাড়ির আন্দোলনের মূল্যায়ন নিয়ে নানা বিতর্ক আছে। বিতর্ক আছে বলেই সৌরেন বসুর কলমে চারু মজুমদারের যে ছবি ফুটে উঠেছে, সৌরেন বসুর দৃষ্টিতে নকশালপন্থি আন্দোলনের যে বৈশিষ্ট্যগুলাে ধরা পড়েছে, তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে। এ বিতর্ক অপরিহার্য। কারণ আমাদের সমাজে চারু মজুমদারের প্রয়ােজন ফুরিয়ে যায়নি। ফুরিয়ে যায়নি সংস্কারবাদের বিরুদ্ধে বিপ্লবী আন্দোলনের প্রয়ােজনীয়তা।
প্রকাশকের কথা
এই বই-এর লেখক সৌরেন বসু ১৭ই আগস্ট, ১৯৯৭ সালে আকস্মিকভাবে প্রয়াত হন। তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানাের জন্যই বইটি প্রথম আকাশ সংস্করণ।
নকশালবাড়ির ষাট দশকে প্রকাশক-এর নিবেদন
স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতে যে রাজনৈতিক ঘটনা সবচেয়ে বেশি গােটা দেশকে আলােড়িত করেছে তা হলাে নকশালপন্থিদের আসমুদ্র হিমাচল সশস্ত্র বিপ্লব প্রচেষ্টা। আর যে রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বটি এই বিপুল কর্মকাণ্ডের পুরােধা তার নাম চারু মুজমদার। এই বছরই নকশালবাড়ি আন্দোলনের ষাট দশক হতে চলছে শতসহস্র শহিদের রক্তসিঞ্চিত এই আন্দোলন একদিকে যেমন চরম আত্মবলিদান, বীরত্ব ও উত্তাল সংগ্রামে সংসদসর্বস্ব মূলধারার বাম আন্দোলনের মরাগাঙ-কে ভাসিয়ে নিয়ে গেছে, অন্যদিকে আবার নেতৃত্বের হঠকারিতার কারণে এমন সব ভুল করেছে, এমন বেশি অপ্রয়ােজনীয় মূল্য দিতে হয়েছে যে সমগ্র আন্দোলনটি কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যের থেকে আজও পর্যন্ত অনেক দূরে রয়ে গেছে। অর্ধ শতাব্দীর উত্থানপতন সমৃদ্ধ এই আন্দোলনটিকে আজ অনেক নির্মমভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করে তার কীর্তিগুলাে ও ভ্রান্তিগুলাে থেকে শিক্ষা নিয়ে নতুন উদ্যমে পথ চলার কথা যারা ভাবছেন তাদের কাছে এই আন্দোলনের নায়ক চারু মজুমদারের জীবনকথা জানা খুবই প্রয়ােজনীয়। তাঁর রাজনৈতিক বিকাশের ইতিহাসের মধ্যে অনেকটাই খুঁজে পাওয়া যাবে এই আন্দোলনের অন্তর্নিহিত শক্তি ও দুর্বলতার উৎস। আর সে ইতিহাস যদি আমরা জানতে পারি তাঁরই দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহযােদ্ধার কলম থেকে উঠে আসলে তা হবে সবচেয়ে বিশ্বাসযােগ্য।
এই পরিপ্রেক্ষিতটি মাথায় রেখে আমরা সৌরেন বসুর ‘চারু মজুমদারের কথা গ্রন্থটি প্রথম সংস্কার করলাম। নকশালবাড়ির ষাট দশক পূর্তিতে এটি এই আন্দোলন ও তার প্রধান সৃষ্টিকর্তার প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য। সৌরেন বসুর এই লেখাটি একাধারে ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের, নকশালবাড়ি কৃষক আন্দোলনের ও চারু মজুমদারের কথা। এতে যেমন আছে চারু মজুমদারের ভুলগুলাের সমালােচনা তেমনি রয়েছে তাঁর অসামান্য ব্যক্তিত্বের উজ্জ্বল উদ্ভাস। মনে করিয়ে দেয় রােজা লুক্সেমবুর্গ সম্পর্কে লেনিনের বিখ্যাত উক্তিটি- “ঈগল পাখি কখনাে কখনাে মুরগির চেয়েও নিচে নেমে উড়তে পারে, কিন্তু মুরগি কখনই ঈগলের উচ্চতায় উড়তে পারে না।”
“… তার মধ্যে গড়ে উঠেছিল ডিসেম্বর ১৪-এর কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়ানাে বীরের দল, রমলাস আর রেমাস-এর মতাে বাঘের দুধ পানে সঞ্জীবিত, তারা ছিল আসুরিক শক্তিধর টিটানেরা, নিখাদ ইস্পাতে মাথা থেকে পা পর্যন্ত গড়া, হাতে হাতে ধরা কমরেডরা। যারা জেনে বুঝে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে গিয়েছিল নতুন প্রজন্মকে নতুন জীবনের জন্য জাগ্রত করতে আর পৈশাচিক নিপীড়ন ও দাসত্বের মধ্যে জন্মানাে শিশুদের পাপমুক্ত করতে।”
–আলেকজান্ডার হাজেন,
“এন্ডস অ্যান্ড বিগীনিংস”
(লেনিনের নির্বাচিত রচনাবলি ২য় খণ্ড থেকে সংগৃহীত)
এরকম বীরদের দ্বারা গড়ে তােলা নকশাল আন্দোলনের মানবিক মহাকাব্যের রূপকার চারু মজুমদার- কী সমর্থক, কি সমালােচক, কী মিত্র, কি শত্রু সবার কাছেই এক ঐতিহাসিক চরিত্রে পরিণত হয়ে গিয়েছেন ইতিহাসের পাতা থেকে তাঁর নাম মুছে দেওয়ার আজ আর কোনাে উপায় নেই।
এক একজন লােক থাকেন যারা ইতিহাসের সন্ধিক্ষণগুলাের মধ্যে সেতু রচনা করেন- চারু মজুমদার ছিলেন সেইরকম একজন। বিশের দশকের শেষ ভাগ, তিরিশের দশক আবার ইতিহাস আলােড়নকারী চল্লিশের দশক। চারু মজুমদারের কৈশাের, বাল্যকাল আর যৌবন কেটেছে ইতিহাসের এই যুগসন্ধিক্ষণের সময়ে তাই বিভিন্ন ছাপ ফেলে ইতিহাস তাঁর বিভিন্ন বয়সকালে সংবেদন সৃষ্টি করেছে। আরও কতজনেরই তাে জীবনে ইতিহাস এভাবে গিয়েছে। কিন্তু চারুর মতাে করে অনেকেই অনুভব করেননি। সেখানেই একটা বৈশিষ্ট্য ছিল চারু মজুমদারের।
১
অবাক পৃথিবী
একেবারে ছােটবেলা থেকেই একটা ছন্নছাড়া ভাব ছিল চারু মজুমদারদের গােটা সংসারটার মধ্যেই। মাঝারি জমিদার দাদুর একমাত্র সন্তান চারু মজুমদারের মা পাড়ার সব ছেলেমেয়েদের ‘হারু পিসিমা’ হলেও, চারুর জন্ম থেকে শিশুকাল কেটেছে বেনারসের শিক্ষকের আয়ের অসংকুলান সংসারে। একমাত্র মেয়েকে কাছে কাছে রাখবেন বলে চন্দ্রমােহন রায় মশায় ঘরজামাই করে এনেছিলেন সুপুরুষ সংস্কৃত ভাষায় পণ্ডিত ওকালতি পাশ বেনারসবাসী বীরেশ্বর মজুমদারকে। মিথ্যে কথা বলতে পারি না’ বলে বীরেশ্বর ওকালতি করলেন না। শিক্ষকতা পেশা হিসেবে নিতে গিয়ে শিলিগুড়িতে অসফল হলেন। জমিদার শ্বশুর গঞ্জনা দিতে লাগলেন এবং সম্পত্তি মেয়ের নামে উইল করা থাকলেও, নিজের দুই শ্যালকদের দেখাশােনার ভার দিলেন। বীরেশ্বর মজুমদার শ্বশুরঘর ছেড়ে বেনারসে এক স্কুল মাস্টারি জোগাড় করে স্ত্রীকে ডেকে পাঠালেন। পিতার তীব্র আপত্তি সত্ত্বেও হারু পিসিমা বেনারসের দরিদ্র স্কুল মাস্টারের সংসার পাততে চলে গেলেন। পরপর সাতটি সন্তানের মৃত্যুর পর ১৯১৫ ও ১৯১৭ সালে জন্মানাে যে দুই পুত্র জীবিত থাকল তারই ছােটটি চারু মজুমদার।
বীরেশ্বর মজুমদার ছিলেন এক অদ্ভুত ‘স্বপ্নবিলাসী’। পরাধীনতার গ্লানি তাঁর পাঠ-জীবন থেকেই। রাজনীতিতে অংশগ্রহণ না করেই শুরু করেছিলেন খদ্দর পরা। খাওয়া জুটল, কি না জুটল তা নিয়ে তাঁর কোনাে সময়েই মাথাব্যথা ছিল না, কিন্তু সংসার ও স্ত্রী-পুত্রকে ছেড়ে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েননি আবার পরবর্তীকালে কংগ্রেসের স্থানীয় নেতা হিসেবে জাতীয় আন্দোলনে যখন জেলে গিয়েছিলেন, তখন স্ত্রীর কী হবে তা নিয়েও মাথাব্যথাই থাকত না। তিনি মার্কসবাদ পড়তেন, প্রচণ্ড পাঠস্পৃহা ছিল কিন্তু বারবারই বলে এসেছেন ভারতের মুক্তি তাে ভারতীয় পথেই হতে হবে। এই দ্যাখনা, মার্কসবাদ নিয়ে যিনিই যে দেশের মুক্তির লড়াই করে থাকুন না কেন, নিজের দেশের ট্র্যাডিশনকে এড়িয়ে যেতে পেরেছেন?’ পরবর্তীকালে ছেলে চারুকে বলতেন- ‘বুঝলি, গান্ধী ট্র্যাডিশনটা বুঝেছে, তােরা ঐখানেই ফেল্ করছিস।’
আবার হারু পিসিমা আর এক প্রান্তের মানুষ ছিলেন। সব সময়ে তাঁর একটিই বিশ্বাসকে প্রকাশ করতেন- ‘আমার আর অন্য কী কাজ বাবা? স্বামী-ছেলের কাজে যেন বাধা না হয়ে দাঁড়াই আর ওরা কাছে থাকলে ওদের খাওয়া-থাকাতে যেন শান্তি দিতে পারি, এটাই তাে আমার কাছে ওরা আশা করে।’ “ও হারু পিসিমা, তােমার কি কারাে কাছে কিছু আশা নেই গাে?”—এই প্রশ্নের উত্তর বােধ হয় কেউ কখনও পায়নি। কারণ ‘নিজের আশা’ বস্তুটা কী তা বােধ হয় তাঁর জানাও ছিল না।
পিতার হঠাৎ নিখোঁজ হওয়ার সংবাদ পেয়ে হারু পিসিমা বিশের দশকের প্রথম দিকে স্বামী ও দুই পুত্রসহ শিলিগুড়িতে ফিরে এলেন। ‘সুযােগ্য’ শ্যালকরাই চন্দ্রমােহন। রায়কে নিখোঁজ করে সম্পত্তির বেশিরভাগটাই হারু পিসিমার নাম জাল করে ‘বেনামা’ করে ফেলেছিলেন।
গান্ধী-নেতৃত্বে জাতীয় আন্দোলন জনজাগরণ এনেছে। কংগ্রেস নেতা বীরেশ্বর মজুমদার তাই নিয়ে ব্যস্ত, চিন্তিত। কিন্তু যুব-শ্রেণির সন্ত্রাসবাদের আসক্তিতেও তাঁর। বিরােধিতা নেই- সবই তাে কংগ্রেসের মধ্যেই, পথের মতান্তর তাে থাকতেই পারে। এর মধ্যেই চারুর জ্ঞানােন্মষ। সুস্থ, সবল বড় ভাই নদীতে স্নান করতে গিয়ে জলে ডুবে মারা যায়। ক্ষীণকায়, রক্তহীনের মতাে ফরসা চারু অসম্ভব বড় বড় চোখ তুলে অবাক বিস্ময়ে চারদিক দেখে। জীবিত একমাত্র সন্তান হিসেবে মা-বাবার অতিরিক্ত আদর-আপ্যায়নও যেমন নেই, আবার শাসনে কড়াকড়িও কিছু নেই। বাবার একমাত্র উপদেশ—“পড়াশুনাে ঠিক মতাে কর দিকিনি!”
ছােটবেলা থেকেই অসাধারণ মেধাবী, কিন্তু বন্ধুদের সাথে হুল্লোড়বাজিতেও কমতি নেই। স্কুলে সব বিষয়ের পড়ার সময় কেন হলাে? প্রশ্নে মাস্টারমশায়রা যথেষ্ট বিরক্ত হলেও এবং কোনাে কোনাে সময়ে শাস্তি দিলেও অসাধারণ মেধাবী এই ছাত্রটির প্রতি গভীর আকর্ষণবােধ করেছেন। অতি ছােট বয়সেও সকালে বন্ধুর বাড়ি গিয়ে বন্ধুকে অঙ্ক বা অন্য পড়া বােঝানাের ঝোঁক সব সময়েই থেকেছে। বন্ধুরা বলত- “তাের পড়া?” “সে তাে রাতেই ফিনিস”- বলত একেবারে বালক চারু। বাবা মাঝে মাঝে পড়াতেন, তবে তা শেষ হতে এসে দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তির কথায়। একটু বড় হলে চারু জিজ্ঞেস করত- ‘স্বাধীনতা ব্যাপারটা কী বােঝাও তাে?’ বাবা বলতেন- “আরে ব্রিটিশকে তাড়াতে পারলে, দেশটা নিজেদের হলে খাওয়া, পরা, শিক্ষাদীক্ষা। কোনােটার কি আর অভাব থাকবে?” একথা বন্ধুদেরও বােঝাত বালক চারু, ছুটির দিনে অন্যের গাছের আম ঢিল মেরে পাড়তে পাড়তে। ক্লাস সেভেনে এক ঘণ্টার মধ্যে অঙ্কের পরীক্ষা শেষ করে চারু বেরিয়ে যায় খাতা জমা দিয়ে। মাস্টারমশায় বলেন“আরে! সব প্রশ্নের তাে উত্তর লিখিসনি? যা, যা, বসে সব উত্তর লিখে তবে খাতা দিস।” একটু বিদ্রুপের ভঙ্গিতে চারু বলে- “আর উত্তরের আমার দরকার নেই স্যার! চল্লিশ মার্কের উত্তর লিখেছি, চল্লিশই পাব। বেশি নিয়ে কী হবে?” শিক্ষক সহপাঠী যার মেধায় সব সময়ে সম্ভ্রম রাখত, সেই চারু মজুমদার কিন্তু কখনও ক্লাসে স্ট্যান্ড করেননি। অনেক পরে আক্ষেপ করে হেডমাস্টার শচীন সরকার মশায় বলতেন- “একটু মাথা ঠান্ডা করে পড়াশুনা করলেই চারুর পরীক্ষায় চূড়ান্ত কৃতিত্ব ঠেকায় কে? ও
পৃষ্ঠা: ২১
তাে আমাদেরই গৌরবের পাত্র। কিন্তু বলবে কে? নিজে যা বুঝবে তার উপর কারও কথা তাে গ্রাহ্যই করে না!” সত্যিই একশ থেকে পঁচানব্বই নম্বর সমস্ত বিষয়ে পাওয়া যার কাছে অনায়াস ছিল, সে পঞ্চাশের উপর নম্বর নিয়ে কখনই মাথা ঘামায়নি। একটাই তার জবাব ছিল- “স্ট্যান্ড করলে কি জ্ঞানবুদ্ধিটা বেশি হবে?”
ত্রিশের দশক। আইন অমান্য, সত্যাগ্রহে চারদিক উদ্বেল আবার গভর্নরকে গুল করা, চট্টগ্রাম অস্ত্রাগার লুণ্ঠন, সব মিলিয়ে বালক চারুকে উৎসাহিত করে গােপন সূত্র খোঁজার আকাক্ষা জন্মায় সব খবর জানার জন্য। কিছু বয়ােজ্যেষ্ঠ পরিচিত যুবকেরা তখন পুলিশের মার খাচ্ছে। নজরুল তখন ‘কাজী সাহেব’ বলে যুবকদের প্রাণ! গাইতে না পারলেও ‘দুর্গম গিরি কান্তার মরু’ আর ‘কারার এ লৌহ কপাট’ যুবকদের বড় প্রিয় জিনিস। দুর্গম গিরি’ পার হওয়ার সাথে ‘কারাগারের লৌহ কপাট ভাঙার যােগসূত্রের রহস্য বালক চারুকে উদৃবিগ্ন করে তােলে। বঙ্কিমের ‘আনন্দমঠ’ থেকে শরৎচন্দ্রের ‘চরিত্রহীন’ পড়া শেষ- শেলীর কবিতা কণ্ঠস্থ, তবু ওয়ার্ডস্ওয়ার্থের ‘ইয়ারা ভিজিটেড’ যেন এক মায়ার হাতছানি দেয়। অর্ধেক কালাে হয়ে যাওয়া চিমনির হ্যারিকেনের আলােয় অনুচ্চ স্বরে দুলে দুলে চারু শেলীর ‘প্রমিথিউস আনবাউন্ড’ কবিতার শেষ পঙতিটা আবার পড়ে চলে-
“ঘৃণ্য মুখােশ খসে গেছে, মানুষ হয়েছে
রাজদণ্ডশূন্য, মুক্ত, বন্ধনহীন,
কিন্তু মানুষ সমান,
শ্রেণিহীন, গােষ্ঠীহীন আর জাতিহীন।
(সে) মুক্তি পেয়েছে ভয় থেকে, উপাসনা, নিয়ম।
আর রাজা থেকে, যা চেপে ছিল তার ‘পরে।
মানুষ ফিরে পেয়েছে নিজেকে।”
ছােটবেলাতেই বিড়ি খাওয়ার অভ্যাস করে ফেলল চারু নিতান্তই কৌতূহলে। ‘কেন মানা করে?’ এটাই কৌতুহল। দোকানদার ভবিষ্যৎ খদ্দের তৈরি করতে কয়টা বিড়ি এমনিতেই দেয় আর বন্ধুদের কাছ থেকে বা বাড়ির বাজারের থেকে পয়সা মেরে বিড়ির খরচ জুটল। বাড়িতে বাবা নির্বিকার, মার বুঝ নেই- মাস্টারমশায়রা দেখলেও বিশ্বাস করবেন না যে চারুর মতাে ছেলে বিড়ি খেতে পারে। প্রচলিত নিয়ম ভাঙার এ যেন চারুর প্রথম পদক্ষেপ। ‘৩৬ সালের মার্চে জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে পরীক্ষার্থীদের মধ্যে শিলিগুড়ির কয়টি ছেলে সিগারেট খাচ্ছে দেখা গেল। ডােমারের (রংপুর জেলার) এক যুবক মাস্টারমশায় হােস্টেলের টেবিলে কার্লটন সিগারেটের পঞ্চাশটার টিন দেখে বললেন- “ব্রাদার্স হােস্টেলে সিগারেট খেতে মানা করলে আপত্তি আছে?” দুজন চোখ নত করে সিগারেটের টিন মাস্টারমশায়ের হাতে তুলে দিয়ে বলল- “আমরা আর খাব না, স্যার।” “হােয়াট অ্যাবাউট ইউ, চারু?” বলতে, চারু জবাব দিল- “ওদের স্যার দুদিনের শখের নেশা, আমি ক্লাস থ্রি থেকে বিড়ি খাই। আমার কাছে ওটা ডাল-ভাতের মতােই প্রয়ােজনীয়। ওয়েল, আপনাদের সামনে খাব না, কথা দিতে পারি।”
প্রথম বিভাগে ম্যাট্রিক পাশ করে রীতি অনুযায়ী কলেজে ভর্তি হওয়ার কথা ভর্তি হতেও হলাে। কিন্তু রীতিমাফিক পড়াশুনার তখন বেশ অনীহা এসে গিয়েছে সদ্য যুবক চারু মজুমদারের। চারদিকে আলােড়নের রাজনৈতিক প্রভাব বেশ পড়েছে তার উপর।
শিলিগুড়ি শহরেই যুবক সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার, অনুশীলন দলের সদস্য হিসেবে আন্তঃপ্রাদেশিক ষড়যন্ত্র মামলায় আন্দামানে দ্বীপান্তরিত হয়েছেন- সত্যেন্দ্রের কয়েক বন্ধু পুলিশি নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। আবার বাবা বীরেশ্বরের গণআন্দোলনের, বিদেশি দ্রব্য বর্জনের কথা সব সময়ে কানের কাছে। রাজনৈতিক হাতছানি আসে। কিন্তু চারুর তার্কিক মন বলে হঠাৎ করে কিছু করলে হবে না— একটু বুঝে নেওয়া দরকার।
পাশ করার পর আড্ডা যেমন চলতে থাকে, তেমন তারই ফাঁকে ফাঁকে জলপাইগুড়ির কংগ্রেস অফিসে যাতায়াত একেবারে অপরিচয়ের সূত্রে নেতা বীরেশ্বর মজুমদারের ছেলের পরিচয়ে নয়। সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি গভীর সহানুভূতি পােষণ করেও বালক বা যুবক চারু সন্ত্রাসবাদের প্রতি কখনই আকর্ষণ বােধ করেনি। তাই একেবারে বাড়ির কাছের লােক হয়েও সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদার চারুকে তাঁদের কোনাে কাজেই টানতে পারেননি। তার স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপাত্মক জবাব মুখে লেগেই থাকত- “এই সব খুচখাচ করে কী হবে?” বিশেষ করে গ্যারিবল্ডি, ম্যাটসিনীর ইতালিয়ান বিপ্লবের কাহিনি, ফরাসি বিপ্লবের কাহিনি, রুশাের কথা তাকে এক গণ-অভ্যুত্থানের স্বপ্ন দেখাত- ঐ ছােট বয়সেও একা একা পথ চলতে চলতে, ডান হাতের আঙুল নেড়ে নেড়ে, নিজেকেই যুক্তি দিয়ে বােঝাতে চাইত।
পাবনা শহরের এডােয়ার্ড কলেজে পদার্থ, রসায়ন নিয়ে বিজ্ঞান পড়তে ভর্তি হলাে চারু ‘৩৬ সালেরই শেষ ভাগে।
ইতােমধ্যে শিলিগুড়ির নিস্তরঙ্গ রাজনৈতিক জীবনে বালক আকারে যুবক চারু কৌতূহল ও বিস্ময়ের বস্তু। “আপন মনেই কথা বলে। কী রে বাবা?”—মন্তব্য করে অনেকে। তার এক মামা ছিলেন প্রবল গঞ্জিকাসেবী— সকলের কাছে ‘গাদলা পাগলা বলে পরিচিত। বড় বড় ঈষৎ লাল চোখের জন্য অনেকেই চারু মজুমদারকেও- ‘গাঁজা খায়’ বলে অভিহিত করত। তবে কূট-তার্কিক বলে সামনাসামনি কেউ কখনও বলেনি। পাড়ার মহিলারা হারু পিসিমাকে এসে শােনাত- “বাপটা তাে আত্মভােলা, দেশ দেশ করে আর কোনাে কিছুতে মাথা ঘামাল না, ছেলেকে অন্তত মানুষ করার চেষ্টা করাে, যাতে মায়ের দুঃখ বুঝতে পারে।” হারু পিসিমা সর্বংসহার হাসি হেসে বলতেন- “আমার চারু কীসে ভালাে কীসে মন্দ ভালােই বােঝে!” কলেজ থেকে ছুটিছাটায় এলে মায়ের জিজ্ঞাস্য থাকত— “খাওয়া ঠিকমতাে হয় কি না, শরীরের যত্ন নেয় কি না।” বাবার কথা তখন- “মহাত্মা গাঁদি (গান্ধীকে উনি ঐভাবে উচ্চারণ করতেন) জেদ করতে গিয়ে লিডারশিপে ফেল করেছে বলে তাের মনে হয় না? জওহরলালদের মতাে লােকের দরকার এখন কিন্তু ওদের কি ওল্ডগার্ডরা উঠতে দেবে?” আইন অমান্য করে পিতা বীরেশ্বর তখন এক প্রস্থ জেল খেটে এসেছেন। চারুর স্বভাবসিদ্ধ জবাব হতাে- “ও যেমন তােমরা গান্ধী তেমনই তােমার জওহরলাল, সব সমান।” কতখানি বুঝে বলত তা বলা মুশকিল। তবে কথার জবাব দেওয়ার ধরনটাই ছিল ঐরকম, বিশেষত বড়দের কথায়। বয়ােজ্যেষ্ঠ আত্মীয়স্বজনদের প্রণাম করায় ঘােরতর আপত্তি ছিল- প্রণাম না করে ঘর থেকে বেরিয়ে যেত। বয়ােজ্যেষ্ঠরা বলতেন- “বড়দের সম্মান করলে নিজেরও মান বাড়ে, বুঝলে চারু?” চারুর কাটাকাটা জবাব- “সম্মানের জন্য তাে আর বয়সে বড় হওয়ার দরকার পড়ে না?” “অল্প বয়সেই বড় পাকা হয়ে গিয়েছে। আসলে মাথার উপর অভিভাবক তাে নেই। আমার ছেলেকে— “ইত্যাদি মত প্রকাশ করতেন বড়রা, অবশ্যই চারুর অসাক্ষাতে।
‘উদ্ধত’, ‘জেদি’- বলে যে যেভাবেই ভেবে থাকুক, একটা জিনিস ছােটবেলা থেকেই ছিল, তা হচ্ছে কিছু করার কথা ভাবলে, যেমন করেই হােক করে ফেলা।
নিচের ক্লাসে থাকাকালীন, পাড়ার এক বন্ধু যখন তৃতীয়বার বাৎসরিক পরীক্ষায় অকৃতকার্য হলাে, তখন তার সামনে স্কুল থেকে বিতাড়ন ছাড়া আর পথ নেই। বালক চারু ক’টি বন্ধুকে নিয়ে হেডমাস্টারমশায়কে অনুরােধ করল ক্লাসে তুলে দিতে এই দায়িত্ব নিয়ে উপরের ক্লাসে ভালাে করে পড়তে চারু নিজেই সাহায্য করবে। হেডমাস্টার বললেন, “আরে, ওইতাে ইংরেজি, অঙ্ক আর বাংলায় বরাবরই ফেল করে, এবার তাে সংস্কৃতেও ফেল শুনছি!” তখনও ক্লাস প্রমােশন ঘােষণা করা হয়নি এবং পণ্ডিতমশায় সংস্কৃতের নম্বরও অফিসে জমা দেননি। পরদিনই সকালে আরেক বন্ধুকে নিয়ে পণ্ডিতমশায়কে চারু মার কাছে পাঠিয়ে দিল ফলার খেতে, আর খাতায় নম্বর বাড়িয়ে সাত-এর জায়গায় করল সাঁইত্রিশ। উপকার কিছুই হলাে না, কারণ খাতার ভিতরে তাে সাতই থেকে গেল।
পৃষ্ঠা: ২৪
২
পাঠশালায়
পাবনার এডােয়ার্ড কলেজ অনেকখানি খােলামেলা জগতে নিয়ে গিয়ে ফেলল চারু মজুমদারকে। কলেজের ক্লাসের লাইব্রেরির সাহিত্য, ইতিহাসের বই পড়ায় উৎসাহ, একটানা সিগারেট খাওয়া, কয়েকজন মিলে হােস্টেলে চায়ের ব্যবস্থা করে ক্রমাগত চাখাওয়া; চারুর প্রতি ছেলেদের আকর্ষণ বিভিন্ন বিষয়ে জ্ঞানের জন্য, নিজের বক্তব্যকে জোর দিয়ে বলার জন্য। সদ্য ভর্তি হওয়া ছেলেটিকে অঙ্ক, ফিজিক্স বােঝায়, সাহিত্যের কচকচি করে।
এখানে চারু মজুমদার কিছু অন্য ধরনের ছেলেমেয়ে দেখল- কমিউনিস্ট ছেলেমেয়ে। পড়াশােনায় ভালাে, খুব দৃঢ়চিত্ত সুযােগ পেলেই ক্লাসে সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার কথা বলে, পূর্ণ স্বরাজ দাবি করতে বলে কংগ্রেস নেতাদের জমিদারের বিরুদ্ধে কৃষকের কথা বলে। ছাত্রদের সংগঠিত করে কলেজের নানা অসুবিধার বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে। খুব সংগঠিত শক্তি না ছাত্রদের বেশিরভাগ নিয়েও চলাফেরা না, কিন্তু ছেলেমেয়েগুলাের যেন এক ধরনের অন্য প্রাণ, এক স্থিরপ্রতিজ্ঞ ধরনের, নিষ্ঠাবান, শৃঙ্খলাপরায়ণ। ছাত্র চারুর এদের ভালাে লাগে কিন্তু কথাবার্তা হলেও যেচে সব জানতে চাওয়া বা ওদের কাজের সাথে মেলার চেষ্টা একেবারেই নেই- স্বভাবসিদ্ধ বিদ্রুপের দৃষ্টিতে এদের দেখে আপন মনেই বলে- “যা বলছে, কাজে পারবে কি?” ওরা অবশ্য বলে না যে ওরা কমিউনিস্ট, তবে প্রায় সবাই জানে। ওরা চারুর ঘনিষ্ঠ হতে চায়, নিজেদের রাজনীতির দিকে টানতে চায়।
এমনই টানাটানির মধ্য দিয়ে এক বছর পরে খেটে খাওয়া মানুষের পাঠশালায় প্রবেশের দুয়ার খুলে যায় চারু মজুমদারের সামনে। আধিয়ার (ভাগচাষি) আন্দোলনের জন্য জোর কদমে প্রচার চলছে উত্তর বাংলা জুড়ে। তখন উত্তর বাংলা বলতে পদ্মানদীর উত্তর পাড়ের রাজশাহী, বগুড়া, পাবনা, রংপুর, দিনাজপুর ও জলপাইগুড়িকেই প্রধানত বােঝাত। কৃষক আন্দোলনের সূত্রে ঘােষিত বে-আইনি কমিউনিস্ট পার্টির জেলা প্রতিনিধিদের সম্মিলিত গােপন সভা চলছিল পাবনাতে। পাবনারই যুবক, যারা জলপাইগুড়ি জ্যাকশন মেডিকেল স্কুলে পড়ত, তারা ছিল কৃষক আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী। এদের সাথে যােগাযােগ হতেই চারু মজুমদারের আত্মকেন্দ্রিকতার গণ্ডি ভেঙেচুরে গিয়ে, কৃষকদের সভায় যােগদানের উৎসাহ সৃষ্টি করে দিল।
আইএসসি-র দ্বিতীয় বর্ষ প্রায় শেষ হয়ে ফাইনাল পরীক্ষা এসে গেল। পড়া চালিয়ে গেলেও পরীক্ষার কোনাে প্রস্তুতি নেই চারু মজুমদারের। বইপত্র নেই বললেই চলে আগে যাও ছিল গরিব ছাত্রদের তা বিলিয়ে দেওয়া সারা। এ ছাত্রজীবন তার আর ভাললা লাগছে না— সব পিছুটানকে ঝেড়েঝুড়ে ফেলে বিশ্বজগতে বেরিয়ে পড়ার এক প্রবল আকর্ষণ তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলছে। বাবার অনুনয়পূর্ণ চিঠি- “ফাইনালটা ভালাে করে দেওয়ার সব প্রস্তুতি চালিয়ে যা”– টেবিল খােলা পড়ে থাকে। হঠাৎ একদিন অবশিষ্ট বইপত্র বিলি করে দিয়ে, একটা ক্যাম্বিসের ঝােলায় জামাকাপড় ভরে, কাউকে কিছু না বলে চারু মজুমদার বেরিয়ে পড়ল, খেটে খাওয়া মানুষের মধ্যে যাওয়ার জন্য। জলপাইগুড়ি জেলার দেবীগঞ্জ থানার (বর্তমানে বাংলাদেশ) পঞ্চগড়ে এসে কলেজ ছেড়ে ভর্তি হলাে পৃথিবীর পাঠশালায়। পথপ্রদর্শক হলেন মাধব দত্ত, মধ্যবিত্তের ছেলে একেবারে কৃষক বনে যাওয়া। একে তামাশা করে শহরের কমরেডরা বলত- “মাধবদা শুধু ডিক্লাড় নয়, একেবারে ডিকালচার্ড হয়ে গিয়েছে।” মাধবদার কাছ থেকে কমিউনিস্ট পার্টির কথা, রুশ বিপ্লবের কথা, কৃষক-শ্রমিক বুনিয়াদী জনগণের কথা যা জানতে পারল যুবক চারু, গােগ্রাসে গিলতে লাগল যেসব বইপত্র মাধবদা দিলেন। আবার কৃষকদের কাছে মাধবদার সহজ ভঙ্গিও লক্ষ করতে লাগল। অতি অল্পদিনেই ধীরস্থির, মৃদুভাষী মাধব দত্তকে ছাপিয়ে কৃষকদের কাছে প্রিয় হয়ে উঠল জ্বালামুখী চঞ্চল যুবক চারু মজুমদার। যুবক কর্মীদের জমায়েত করা, তাদের সাথে আড্ডা দেওয়া, মেয়েদের ঠাট্টা-তামাশায় অংশগ্রহণ চারুকে একেবারে রাজবংশী কৃষকদের ঘরের মানুষ করে দিল।
আধিয়ার আন্দোলনে উদ্বেল হয়ে উঠল ভাগচাষি প্রধান উত্তর বাংলার সব জেলার গ্রামাঞ্চল। ‘কর্জার সুদ নাই’, ‘হাটে হাটে জোতদারের তােলা বন্ধ’, ‘ভাগচাষি উচ্ছেদ চলবে না আওয়াজ দিয়ে মেয়ে, পুরুষ, কৃষক ময়দানে নেমে পড়ল।
কৃষি সমস্যা ও কৃষকের সমস্যার প্রতি বােধ গড়ে উঠেনি চারু মজুমদারের- অনুভূতি ছিল “খেটে খাওয়া মানুষ খাটুনির ফল ভােগ করতে পারে না।”—কমরেডরা সাবধান করত- “একেবারেই মুক্তি, বিপ্লব এসব বলবেন না, নির্দিষ্ট কৃষকদের সমস্যার উপরে বলুন, তবে তাে ওরা বুঝবে?” চারুর এক কথা- “আরে সমস্যার খুঁটিনাটি তাে যে যেখানে কাজ করে সেখানকার। মূল কথাটা তাে হচ্ছে শােষণ থেকে মুক্তি। কৃষক, শ্রমিক, মধ্যবিত্ত আজও আছে, কালও থাকবে- সকলের মধ্যেকার যােগসূত্রটা তাে মুক্তি?”—এই ছিল তার তখনকার উপলব্ধি, যার প্রধান সুর ছিল মানবতাবাদ।
আধিয়ার আন্দোলনের মধ্যে জলপাইগুড়িতে পার্টির মিটিং-এ গিয়ে প্রথম গ্রেপ্তার হতে হলাে চারু মজুমদারকে। জলপাইগুড়ি শহরের রাস্তায় হাফপ্যান্ট, ফুলশার্ট পরা চারু মুজমদারকে কোমরে দড়ি ও হাতে হাতকড়া দিয়ে নিয়ে গেল পুলিশ। জেলে কংগ্রেসের আন্দোলনে অংশগ্রহণের ফলে কারারুদ্ধ বাবা বীরেশ্বর মুজমদারের সাথে দেখা। তুমুল তর্ক লেগে থাকত বাপ-ছেলেতে কংগ্রেস-কমিউনিস্ট প্রশ্ন নিয়ে। বাবার কিন্তু ছেলের বাড়ি ছেড়ে দেওয়া, পড়া ছেড়ে দেওয়া নিয়ে কোনাে অনুযােগই নেই- কেবল আক্ষেপ যেটা তা হচ্ছে- “রাজনীতিই যখন বেছে নিলি তখন কংগ্রেসই করলে পারতিস। মার্কসবাদের বিদেশি ভাবধারা কি ভারতের মাটিতে ফসল ফলাতে পারবে?” ছেলে বলে-“তােমরাও তাে গান্ধীবাদকে অন্য দেশে নিতে বলছ, তখন?”
ছয় মাস পরে ছেড়ে দিয়ে ব্রিটিশ সরকার স্বগৃহ শিলিগুড়িতে অন্তরীণ করে রাখল বাপ-বেটা দুজনকেই। ১৯৩৪ সালে ব্রিটিশ সরকার কর্তৃক প্রকাশ্যভাবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিকে (যদিও তখনও সারা ভারতে একটিই কেন্দ্রীয় কমিটির অধীনে পার্টি পরিচালিত হতাে না) বেআইনি ঘােষণা করায়, কঠোর গােপনীয়তার মধ্যে কমিউনিস্টদের কাজ করতে হচ্ছিল। সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনের আবহাওয়া অবশ্য এই কাজে বাংলাদেশে খুবই সাহায্য করেছিল।
চারু মজুমদারের সাথে গােপন যােগাযােগের সূত্র ধরে সংগঠনের কাজে যােগ দেওয়ার ব্যবস্থা হয়ে গেল।
বেঙ্গল আসাম রেলের মধ্যে তখন উত্তর বাংলার রংপুর, দিনাজপুর এবং জলপাইগুড়ির অংশবিশেষ পড়ত। আবার রেলকর্তৃপক্ষের পরিচালনাধীনেই কিছু স্থানীয় রেল চলাচল ব্যবস্থা ছিল, যেমন জলপাইগুড়ি জেলার চা-বাগান এলাকায় ‘বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে’ সংক্ষেপে বি.ডি.আর বা শিলিগুড়ি, দার্জিলিং ও কালিম্পঙের গেলখােলা পর্যন্ত দার্জিলিং হিমালয়ান রেলওয়ে সংক্ষেপে ডি.এইচ.আর.।
জলপাইগুড়ির বি.ডি.আর-এ সংগঠন গড়তে শুরু করেছে তখন কমিউনিস্টরা আধিয়ার আন্দোলনেরই প্রভাবের সূত্র ধরে। ডুয়ার্সের অধিবাসী কৃষকদেরই আত্মীয়স্বজন কাজ করত রেলের গ্যাঙম্যান হিসেবে তারাই প্রথম যােগাযােগ করে দিয়েছিল কমিউনিস্টদের। কেবল বেআইনি পার্টির সদস্য বলেই নয়, নানা আইনকানুন ও কর্তৃপক্ষের হামলার মধ্যে প্রথম প্রথম সাংগঠনিক যােগাযােগ করতে হতাে খুবই গােপনীয়তার সাথে। বি.ডি. রেলের দোমহনি জংশনে এইভাবে গড়ে উঠেছিল রেল শ্রমিক সংগঠনের কেন্দ্র।
অন্তরীণ চারুর সাথে পার্টির যােগাযােগ হলাে এবং সেই ‘ঘরবন্দি অবস্থা থেকে বৃষ্টি মাথায় করে এক সন্ধ্যায় ‘অন্তর্ধান’ করলেন চারু মজুমদার রেল শ্রমিক সংগঠক হিসেবে কাজ করার জন্য। ঘরছাড়ার ঘটনাটা বেশ নাটকীয়। সরকারি নিষেধাজ্ঞা অগ্রাহ্য করে বেরিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত একুশ বছর বয়সের চারুকে খুব ভাবপ্রবণ করে তুলেছিল। সন্ধ্যার অন্ধকারের সাথে নেমে এলাে মুষলধারার বৃষ্টি। যে কর্মীর শিলিগুড়ি শহরের উত্তর-পূর্বে পাঁচ মাইল দূরে সঙ্গে করে নিয়ে যাওয়ার কথা তার বাড়ি যেতেই সে বলল—“পাগল নাকি, এই ঝড়জলে কোথায় যাবেন? বাড়ি ফিরে যান, পরে যােগাযােগ করে আবার যাওয়া যাবে।” স্বভাবসিদ্ধ জিদ ও ভাবপ্রবণতা চারুকে বর্ষণমুখর সন্ধ্যার অন্ধকারে অজানার আকর্ষণে অভিভূত করে ফেলেছে। সেই কর্মীর দিকে বিদ্রুপের চোখে চেয়ে একাই চলে গেল- সেটা তখন ‘অজানার দিকেই যাওয়া ছিল, কারণ গন্তব্যস্থলের সম্বন্ধে কোনাে কিছুই জানানাে হয়নি। ঝমঝমে বর্ষার অন্ধকারে পা গুনে গুনে হাঁটতে হাঁটতে চারুর বারবার মনে পড়েছিল তার অতিপ্রিয় রবীন্দ্রসংগীতটি-
“যদি তাের ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলাে রে…”
সেবারই প্রথম চারু মজুমদারের মনে এসেছিল ‘বার্নিং দি ব্রিজ’ কথাটি অর্থাৎ বিপ্লবের কাজে যখন যেতেই হবে তখন পিছুটানের শেষ সেতুটিকেই জ্বালিয়ে দিয়ে যাও যাতে ফেরার পথ একেবারেই বন্ধ হয়ে যায়। কথাটার মধ্যে খুবই রােমান্স আছে, আর চারু মজুমদারের মধ্যে ভরপুর থাকত রােমান্টিক অনুভূতি।
‘মানবাে না এ বন্ধনে’ তা সে সামাজিক রীতিনীতির বন্ধনই হােক আর প্রিয়জনের মেহের বন্ধনই হােক, চারু মজুমদারের বরাবরের এই মনােভাব প্রায় সব সময়ই পরবর্তী জীবনে তাঁকে সহকর্মী, স্বজন-বান্ধবদের কাছে সমালােচনার পাত্র করেছে। বলা হয়েছে ছন্নছাড়া বােহেমিয়ান, অ্যানার্কিক। আত্মপক্ষ সমর্থনে বাগাড়ম্বর করতে তাকে কখনও দেখা যায়নি, আবার নিজের চলার ধরন পরিবর্তন করতেও দেখা যায়নি। পাড়াপড়শীরা যেমন বরাবর বলে এসেছে- “ঘরসংসারের দায়িত্ব তাে কোনােদিন নিল না?” পঞ্চাশের দশক পর্যন্ত চারু তাে শহরে এলেই বসে যাবে যার-তার সাথে আড্ডায়।”– ছিল পার্টিতে অভিযােগ। সমস্ত প্রকারের সামাজিক সম্পর্কহীন হয়ে পার্টির নীতিকে আপ্তবাক্য করে নেতাদের সদাআজ্ঞাধীন থাকার ‘সৎ’ কমিউনিস্টের যে মানদণ্ড, তাকে চারু মজুমদার কখনই মানেননি। বন্ধন ছিন্ন করব কিন্তু সমাজের মানুষ হিসেবেই চলব এই দ্বান্দ্বিক চলার পদ্ধতি আপনা থেকেই রপ্ত হয়ে গিয়েছিল তাঁর। পরিণত বয়সেও পার্টির কমরেডদের বিরাগের কারণ হয়ে অনেক সময়েই তাকে দেখা গেছে। সারা দিনের কৃষক বা চা-শ্রমিকদের মিটিং সেরে রাত আটটার পর ক্লাবে তাস খেলতে যেতে। ‘৬০ সালের দিকে একবার তৎকালীন পার্টির এক বিশিষ্ট প্রাদেশিক নেতাকে জিজ্ঞাসা করে কোনাে সদুত্তর পাননি যে “বিভিন্ন দেশের পার্টির কথায় আছে যে কমিউনিস্টরা সময়ে সময়ে অবসর অবকাশে চিত্তবিনােদন করে, আমাদের দেশে নেতাদের সে সুযােগ কিছু থাকলেও সাধারণ কর্মীদের থাকে না কেন?” আবার খেটে খাওয়া অতি সাধারণ মানুষ এবং পার্টির বাইরের মধ্যবিত্তদের এক বিপুল সংখ্যক মানুষের মধ্যে তার স্নেহ, ভালােবাসার মন্তব্য থাকত— “লােকটার সবচেয়ে বড় গুণ যে নেতা হিসেবে নিজেকে আলাদা করে রাখে না।”
রেল শ্রমিকদের মধ্যে কাজ করতে গিয়ে কৃষক আন্দোলন থেকে এক উন্নত ধরনের আন্দোলনের মধ্যে গিয়ে পড়তে হলাে চারু মজুমদারকে, ফলে মানবতাবাদের সাধারণ ধারণার মধ্যে শ্রেণি প্রশ্নগুলাে সৃষ্টি হতে শুরু করল। কমিউনিস্ট মতবাদ সম্বন্ধে জানার আগ্রহ অনেক বেড়ে গেল- এখানে আর একটু উপরের স্তরের কমিউনিস্ট নেতাদের সংস্পর্শে আসার সুযােগ হলাে। চারু মজুমদার তখন একটি ক্যাম্বিসের ঝােলা, খাকি হাফ প্যান্ট ও ঝুলিয়ে দেওয়া ফুলশার্ট পরে কাঁধে কম্বল ঝুলিয়ে জনগণের কাছে পাঠ নেওয়ার জন্য একবার শ্রমিক একবার কৃষকদের কাছে যাতায়াত করতে লাগল। হিন্দি পত্রিকা পড়ার অভ্যাস করে হিন্দি শিখে ফেলল বক্তা হিসেবে তৈরি হলাে।
৩
চলার ঠিকানা
‘৪০-এর দশক থেকেই জলপাইগুড়ি জেলার শ্রমিক, কৃষক অঞ্চলে চারু মজুমদার একটি সুপরিচিত নাম হয়ে গেল। চারু মুজমদারের উপস্থিতি শ্রমিক, কৃষক ও মধ্যবিত্ত যুবক-যুবতিদের মধ্যে বেশ সাড়া সৃষ্টি করে। তাকে ঘিরে নানা গল্প, হাসিতামাশা চলে। তার চলাফেরার ধরনে প্রকাশ্যে পার্টির অনেকেরই আপত্তি ও বাধা দেওয়ার চেষ্টা থাকলেও মনে মনে সন্ত্রম প্রায় সার্বজনীন। তাই প্লুরিসি বা নিউমােনিয়ায় শয্যা নিলে চারুর সেবা করার ললাকের অভাব হয় না, মধ্যবিত্ত মহিলারা তাকে সােয়েটার বুনে দেওয়ার প্রতিযােগিতা লাগিয়ে দেয়- রাজবংশী কষক মেয়েরা প্রকাশ্যেই বলে—“তােক্ অ্যাকদিন ধরিয়া ঘরটুকি করিয়া দিম।” অর্থাৎ গান্ধর্ব বিবাহ করিয়া ফেলব। সবার সাথে এমন মধুর সম্পর্ক, রাজবংশীর যে বাড়িতে তাড়ি খাওয়ার রেওয়াজ সেখানেও ভাগ বসাতে চারুর যেমন জুড়ি নেই, আদিবাসীর বাড়ি হাঁড়িয়াতেও তেমনই রুচি, আবার শহুরে বন্ধুবান্ধবদের অবসরে মদ্যপানেও বিরাগ নেই। অথচ পার্টির কাজে বিচ্যুতি কেউ পাবে না- রাজনীতির বিতর্কে সকলেই চমৎকৃত।
‘২০-এর দশক থেকে ‘৪০-এর দশক ভারতবর্ষের রাজনীতিতে বিরাট আলােড়ন চলেছে— হয়েছে প্রচণ্ড ভাঙাগড়া। বিশ শতকের প্রথম ভাগ থেকেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে সমগ্র জনগণের দ্বন্দ্বই ভারতীয় সমাজের প্রধান দ্বন্দ্ব থাকলেও ২০-এর দশক অবধি সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা খণ্ড খণ্ড ভাবে হয়েছিল।
‘২০-এর দশক থেকে অনেকগুলাে নতুন উপাদান সংযুক্ত হলাে সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতার সাথে। একদিকে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা গণ-বিরােধিতার সাথে। একদিকে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির প্রতিনিধিরা গণ-সংগ্রামের পথ নিলাে, অন্যদিকে শ্রমিক এবং কৃষক নিজ নিজ শােষক শ্রেণির বিরুদ্ধে শ্রেণি সংগ্রামে অবতীর্ণ হলাে। জনগণের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্বের তীব্রতা বৃদ্ধির সাথে সাথে বিভিন্ন শােষক শ্রেণির সাথে শােষিত শ্রেণিগুলাের দ্বন্দ্বের এমনই তীব্রতা এসে পড়ল যে গান্ধীর নেতৃত্বে কংগ্রেসে অহিংস অসহযােগ আন্দোলনের মধ্যেও উত্তর প্রদেশের (তখন যুক্তপ্রদেশের) চৌরিচৌরায় সশস্ত্র কৃষক ক্ষমতা দখল করে ফেলল।
ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী নিরংকুশ শােষণের সাথে প্রথম মহাযুদ্ধের (১৯১৪-১৮) আর্থিক সংকটের বিপুল বােঝা ভারতীয় জনগণের উপর প্রচণ্ড চাপ দিল- সেজন্যই ১৯১৮ সালে ভারতের বিভিন্ন স্থানে শ্রমিক ধর্মঘট হলাে একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। ১৯১৯ সালে ঘটল পাঞ্জাবের জালিয়ানওয়ালাবাগের বীভৎস হত্যাকাণ্ড। ঐ সময়েই ইংরেজ সরকার কর্তৃক এক শাসন সংস্কারে কোনাে অধিকার না পাওয়া বিক্ষুব্ধ ভারতবাসীর মনের বারুদের আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। ১৯২২ থেকে ১৯২৯ সাল পর্যন্ত বােম্বে (বর্তমান নাম মুম্বাই), লাহাের, কানপুর ও কলকাতায় অল্প সময়ের বিরতির পর একটানা শ্রমিক ধর্মঘট চলেছে এবং ১৯২৭ সালে কলকাতার হাওড়া, হুগলি ও ২৪ পরগনার বিভিন্ন চটকল শ্রমিকদের এক সাধারণ ধর্মঘট হয়, বােম্বের সুতাকল ও কানপুরের সুতাকল এবং লাহােরে রেলধর্মঘট হয়। ১৯২৭ থেকে ১৯২৯ সময়কালে কৃষকদের আন্দোলন বিশেষত বাংলা ও বিহারে জোরদার হয়ে ওঠে।
এই আন্দোলনগুলাের বৈশিষ্ট্য ছিল যে এগুলাে নিজ নিজ শােষকশ্রেণির বিরুদ্ধেও বটে আবার ভারতের সাম্রাজ্যবাদী শােষণের থেকে মুক্তির আকাঙ্ক্ষাও এর মধ্যে ছিল। ইতঃপূর্বের আন্দোলনকে বিশেষত কৃষক বিদ্রোহগুলােতে পুরানাে ব্যবস্থা ফিরিয়ে দেওয়ার এমনকি পুরানাে শাসকদের ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি ছিল- যার থেকে পরবর্তী এই আন্দোলন ও সংগ্রামগুলাের একটি নির্দিষ্ট প্রভেদ ছিল।
বিশের দশকের এই সময়ের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক উপাদান ছিল ভারতের মাটিতে কমিউনিস্টদের আত্মপ্রকাশ। ১৯২১ থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত যদিও বিভিন্ন গােষ্ঠী ও ব্যক্তির কখনাে সংযােগ কখনাে বিয়ােগ নিয়ে কমিউনিস্টরা চলেছিল, কিন্তু নিজ নিজ অঞ্চলে সমাজতন্ত্রের ভাবধারা নিয়ে শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলতে তারা সক্ষম হয়েছিল, রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সম্বন্ধে বলিষ্ঠ বক্তব্য উপস্থিত করেছিল- সাম্যবাদের ধ্যান-ধারণার প্রচারে মার্কসবাদকে ভারতের মাটিতে উপস্থিত করেছিল, সরকারি, কংগ্রেসি ও অন্যান্য বাধার মধ্যেই। প্রত্যেক কমিউনিস্ট গােষ্ঠীর মধ্যেই কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল বা তৃতীয় আন্তর্জাতিকের সাথে যােগাযােগের চেষ্টা চলেছিল। ১৯২১ সাল থেকেই। (এই ইন্টারন্যাশনালের গঠন হয়েছিল ১৯১৯ সালে)। ১৯২১ সালেই কলেজে পড়ার সময় ছাত্র আন্দোলনের জন্য বহিষ্কৃত বােম্বের এস.এ. ডাঙ্গে ‘গান্ধী ভার্সাস লেলিন’ নামে বই লিখে রীতিমতাে সাড়া জাগিয়েছিলেন। ঐ
পৃষ্ঠা: ৩০
সময়েই গান্ধীর সমালােচনা করে। ১৯২৯ সালের ১৫ই মার্চ মিরাটের জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে ভারত গভর্নমেন্টের গােয়েন্দা দপ্তর মিরাট ষড়যন্ত্র মামলার অভিযােগ হিসেবে যে রিপাের্ট দাখিল করেছিল তাতে বলা হয়েছিল- “১৯২১ সালে উল্লিখিত কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল ব্রিটিশ ভারতে তার একটি শাখা স্থাপন সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নিল এবং আসামি শ্রীপাদ অমৃত ডাঙ্গে, শওকত ওসমানী ও মুজফ্ফর আহমেদ অন্যদের নিয়ে এইরূপ শাখাসমূহ স্থাপনের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হলাে এই উদ্দেশ্য নিয়ে যে তার দ্বারা রাজা সম্রাটকে (King Emperor) ব্রিটিশ ভারতের আধিপত্য হতে বঞ্চিত করা হবে।”
ইংরেজ সরকারের ষড়যন্ত্র মামলা, কংগ্রেসের পক্ষ থেকে প্রচার যে ‘সমাজতন্ত্রে নারীকে সামাজিক সম্পত্তি করা হবে এবং বৃদ্ধদের মেরে ফেলা হবে যা নাকি হয়েছে। রাশিয়ায়।’ কিন্তু তা সত্ত্বেও কমিউনিস্ট প্রভাব বেড়ে চলছিল। ১৯২৭ সালে কানপুরে অল ইন্ডিয়া রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের প্রথম মহাসভায় যে সংগঠন গঠিত হয়, তার নেতৃত্বে প্রধানত ছিল কমিউনিস্টরা। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি নামে সংগঠন ‘২৭ সালেই আত্মপ্রকাশ করলেও, পেজান্টস্ অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির দুটি সংগঠন বাংলা ও বােম্বাইতে শ্রমিক, কৃষক আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। পেজান্টস অ্যান্ড ওয়ার্কার্স পার্টির উদ্যোগেই ১৯২৭ সালে নদীয়ায় একটি কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়, যা বােধ হয় কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বাংলার প্রথম কৃষক সংগঠন। পাঞ্জাবে গঠিত হয়েছিল “কীরতি কিসান পার্টি” ঐ ১৯২৭ সালেরই ভিতর- এঁরা সকলেই মার্কসবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, পরবর্তীকালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে অধিকাংশ যােগ দিয়েছিলেন ১৯২৯ সালে ১০ই মার্চ মিরাট বলশেভিক ষড়যন্ত্র মামলা করে ইংরেজ সরকার ভারতের কমিউনিস্টদের শায়েস্তা করতে গিয়ে অজান্তেই এমন এক মর্যাদা দিয়ে ফেলল যে কমিউনিস্টদের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল আদালতে কমিউনিস্টদের “বিপ্লবী দীর্ঘজীবী হােক”, “রুশ বিপ্লব জিন্দাবাদ”, “সাম্রাজ্যবাদের উচ্ছেদ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করাে” প্রভৃতি স্লোগানের কথা চারদিকে প্রচার হয়ে গেল— আন্দামানে বন্দি সন্ত্রাসীদের মধ্যে রেষারেষি পড়ে গেল মার্কসবাদ গ্রহণ করার জন্য।
বিদেশেও ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলেছিলেন এক গােষ্ঠী এবং ঘটনাটি বেশ রােমাঞ্চকর। ১৯২০ সালেই মাঝামাঝি সিন্ধু ও পাঞ্জাব প্রদেশের কিছু শিখ ও মুসলমান যুবক ব্রিটিশ অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরােধ গড়ে তােলার মানসে আফগানিস্তানে চলে যান। আফগান সরকার এঁদের আশ্রয় দিতে না চাইলে এঁরা তুরস্কের পথে হিন্দুকুশ পর্বত পার হয়ে উজবেকিস্তানে প্রবেশ করেন সীমান্ত এলাকায় ব্রিটিশ অর্থে পরিপুষ্ট একদল তুর্কমেন এদের আক্রমণ করে। লালফৌজের সহযােগিতায় এরা রক্ষা পেয়ে তুর্কেমেনিস্তানে অবস্থিত কির্কির দুর্গ বিদ্রোহীদের হাত থেকে রক্ষা করেন লালফৌজের সাথে অস্ত্র ধরে। এঁদেরই এক অংশ প্রথমে তাসখন্দে সামরিক শিক্ষা পান এবং পরে মস্কোয় প্রাচ্যের মেহনতী মানুষের বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষা নেন। মস্কোতেই এঁরা ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি গঠন করেন যার সম্পাদক নয়না সিং পরে দেশে ফিরে কমিউনিস্ট পার্টিতে যােগ দেন।
১৯৩০ সালে খসড়া কর্মসূচি প্রস্তুত হওয়া সত্ত্বেও ঐক্যবদ্ধ সর্বভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে ওঠেনি, বরঞ্চ বিচ্ছিন্নতা প্রকট হতে থাকে। ১৯৩২ সালে চীন, জার্মানি ও গ্রেট-ব্রিটেনের কমিউনিস্ট পার্টিগুলাের যুক্ত স্বাক্ষরিত এক চিঠিতে ভারতের কমিউনিস্টদের মধ্যে বিভেদ বিচ্ছিন্নতার তীব্র সমালােচনা করে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য আবেদন করা হয়। ১৯৩৩ সলের জুলাই মাসে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আবার আর একটি চিঠিতে পার্টিকে একটি সর্বভারতীয় ঐক্যবদ্ধ রূপ দেওয়ার আহ্বান জানান। ১৯৩৪ সালে কমিউনিস্ট পার্টি প্রকৃত সর্বভারতীয় রূপে আত্মপ্রকাশ করে আর এই বছরেই ইংরেজ সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টিকে বেআইনি ঘােষণা করে।
এম.এন. রায় বা মানবেন্দ্রনাথ রায় (প্রকৃত নাম নরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য) সম্বন্ধে যা জানা যায় তা হচ্ছে ১৯২৭ সাল পর্যন্ত তিনি মেক্সিকান কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য হলেও কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল গঠিত হওয়ার পর থেকেই ইন্টারন্যাশনালের প্রাচ্য ব্যুরাের ভারপ্রাপ্ত সদস্য ছিলেন। তবে তার পক্ষ থেকে ভারত কমিউনিস্ট পার্টি গড়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণ করতে কখনও শােনা যায়নি, বরঞ্চ, ১৯২৭ সালের পর কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনাল থেকে বহিষ্কৃত (কারণ আজও সম্পূর্ণ জ্ঞাত নয়) হওয়ার পর ভারতে ‘কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের সংগঠন’-এর প্রতিনিধি হিসেবে কমিউনিস্ট ইন্টারন্যাশনালে পুনঃপ্রবেশের চেষ্টায় কিছু সই সংগ্রহ করছিলেন, যার উদ্দেশ্য সফল হয়নি।
ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে আদর্শবান যুবকেরা প্রচুর আত্মত্যাগ ও গভীর নিষ্ঠার সাথে চৌদ্দ বছরের অক্লান্ত চেষ্টায় কমিউনিস্ট পার্টি গড়ে তুলেছিলেন, কারাবরণ ও ঔপনিবেশিক সরকারের অত্যাচারের সম্মুখীন হয়ে মেহনতী মানুষের গভীর আস্থা অর্জন করেছিলেন তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন করেও যে কথ বারবার মনে হয় হয় তা হচ্ছে তারা একটি ঔপনিবেশিক, আধা-সামন্ততান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থার মধ্যে ইউরােপের পুঁজিবাদী দেশগুলাের অনুকরণে এক কমিউনিস্ট আন্দোলনের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। এই আদর্শবান যুবকেরা প্রায় সকলেই ছিলেন পশ্চাৎপদ গ্রামীণ আবহাওয়ার উপর চাপিয়ে দেওয়া বােম্বে, লাহাের, কানপুর, কলকাতা শহরের ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির।
কোন্ সেই ১৯২৯ সালে কমিউনিস্টরা কলকাতায় সাইমন কমিশনের বিরুদ্ধে যে বিশাল শােভাযাত্রা বের করে ভারতের মাটিতে প্রথম ‘বিপ্লব দীর্ঘজীবী হােক’ স্লোগান দিয়েছিলেন তা বিশ্বের বড় কমিউনিস্ট পার্টিগুলাের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিল। ১৯২৬ সাল থেকেই কমিউনিস্টরা কংগ্রেসের কার্যনির্বাহক কমিটির সদস্য ছিলেন এবং ত্রিশের দশকে কমিউনিস্টরাই কংগ্রেস অধিবেশনে ‘পূর্ণস্বরাজ’-এর দাবির প্রস্তাব উত্থাপন করেছিল। (নেহরু পূর্ণ-অধিবেশনে অনুপস্থিত থাকেন এবং সুভাষচন্দ্র বসু সাবজেক্টস্ কমিটিতে ‘পূর্ণ-স্বরাজ’ সমর্থন করেও পূর্ণ অধিবেশনে প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিলেন।) এতসব সত্ত্বেও ভারতের কমিউনিস্টদের মাথায় ছিল সােভিয়েত বিপ্লবের মতাে ‘অভ্যুত্থান’ (insurrection) এবং ‘শ্রমিকশ্রেণির সাধারণ রাজনৈতিক ধর্মঘট’। ফলে জনযুদ্ধের পদ্ধতির প্রশ্ন নিয়ে তারা মাথা ঘামাননি- মােগলের বিরুদ্ধে শিবাজীর বা ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে টিপু সুলতানের সংগ্রামের ধরনকে বা সশস্ত্র কৃষকবিদ্রোহগুলাের পদ্ধতিগুলােকে অনুধাবনের কোনাে চেষ্টাই করেননি। চতুর ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ তাদের ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার মধ্যেও উনিশ শতকেই আইনানুগ ট্রেড ইউনিয়নের সুযােগ, তাদের তথাকথিত ‘আইনের শাসন (Rule of law)-এর মধ্যেই রাজনৈতিক কার্যকলাপ করতে দিয়েছে, মিরাট ষড়যন্ত্র মামলাতেও আত্মপক্ষ সমর্থনের সুযােগ দিয়েছে এবং কমিউনিস্টদের ‘নিয়মতান্ত্রিক পথের আবহাওয়ায় বেড়ে উঠতে হয়েছে। তাই দেখা গেছে যে জংগি গণআন্দোলনে যখনই সরকারি আঘাত এসেছে তখন তা স্তিমিত হয়ে গিয়েছে, বড়জোর কিছু অর্থনৈতিক দাবি-দাওয়া আদায়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থেকে গেছে। কংগ্রেসের মধ্যে কাজের সময়েও বলিষ্ঠ রাজনৈতিক বক্তব্য বলা সত্ত্বেও একটি সমান্তরাল বিকল্প নৃেতত্বে গড়ে তুলতে পারেনি মূল লক্ষ্য ‘ইউরােপীয় পদ্ধতিতে বিপ্লব’ থাকার ফলে কুওমিন্টাঙের মধ্যে থেকেও চীনের কমিউনিস্ট পার্টির যে স্বাধীন কার্যকলাপ গড়ে তুলতে পেরেছিল, ভারতে তা হতে পারেননি। ভারতের ইতিহাসে তাই দেখা গিয়েছে যে এক বিরাট রাজনৈতিক সংকটের যুগে সাংগঠনিক দিক থেকে কমিউনিস্ট পার্টি প্রভূত গণ-সমর্থনের অধিকারী হয়েও রাজনৈতিক নেতৃত্ব বর্তে গেছে আপসকামী ভারতীয় বুর্জোয়াদের উপর। তাই চমৎকার সব কমিউনিস্ট কর্মীদের রাজনৈতিক জীবনের পদক্ষেপে বারবার দেখা গেছে দ্বিধা, অনিশ্চয়তা যা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই মধ্যেকার অন্তর্বিরােধের ফল।
কমিউনিস্ট আন্দোলনের এই স্বআরােপিত সীমাবদ্ধতার মধ্যেও মার্কসবাদের আহ্বানে শত শত কর্মী আত্মত্যাগ, নিষ্ঠা নিয়ে এই স্বপ্নবিলাসী মুক্তির জন্য লড়াই করে গেছে— চারু মজুমদার তাদেরই একজন। ‘৪০-এর দশকের শুরু থেকেই গণআন্দোলন যেমন সারা ভারত জুড়েই ছড়িয়ে পড়তে লাগল, উত্তর বাংলাতেও আন্দোলন দানা বেঁধে ওঠার লক্ষণ দেখা দিল। আসাম রেলে সংগঠন জোরদার হয়ে উঠল। লালমণিরহাট জংশনে (দিনাজপুর জেলার) রেলের ইঞ্জিন ড্রাইভার ও ফায়ারম্যানরা ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় হয়ে উঠল। চারু মজুমদারকে সেখানে সংগঠক হিসেবে কিছুদিন কাজ করতে হয়েছিল। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ভয় দেখিয়ে ও অপপ্রচার করে ইউনিয়ন ভাঙার চেষ্টা হচ্ছিল। এক শীতের রাতে ‘শান্টিং ইয়ার্ডে চারু বসে ‘লােকো’ রেলকর্মীদের সাথে আলােচনা করছিল, কাঁচা কয়লার আগুনের সমানে ধোঁয়ায় চোখ মুছতে মুছতে, কংগ্রেসের অপপ্রচারের কথাই হচ্ছিল, হঠাৎ উত্তর প্রদেশের মুসলমান। ড্রাইভার উঠে ইঞ্জিনে কয়লা দেওয়ার বেলচাটা জ্বলন্ত বয়লারের মধ্যে ঢুকিয়ে দিয়ে বলছিল- “এই দিয়েই দালাল শায়েস্তা করব!” রেলশ্রমিকের আগুনের আভায় রক্তিম সেই প্রতিজ্ঞা-দৃঢ় মুখের ছবি চারু মজুমদার কখনও ভুলতে পারেনি।
‘৪০-এর দশকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সর্বভারতীয়রূপে পরিচালিত হলেও, কেন্দ্রীয় কমিটি ও তার পরবর্তী উচ্চতর কমিটিগুলােতে শ্রেণিদ্বন্দ্বগুলাে ও সমাজের বিভিন্ন দ্বন্দ্বের ক্ষেত্রে বিশ্লেষণের অভাব থেকেই যাচ্ছিল, আবার নিচুতলার কর্মীরা জনগণের বিভিন্ন অংশের বিক্ষোভের চাপ অনুভব করছিলেন, সাধ্যমত হস্তক্ষেপও। করছিলেন এবং সামগ্রিকভাবে পার্টির নেতৃত্ব ও সাধারণ কর্মীদের মধ্যে একটা ব্যবধান রচিত হয়ে যাচ্ছিল, তিন বছর পরেই যা খুবই প্রকট হয়ে পড়ল গণসংগ্রামগুলাে পরিচালনার মধ্যে দিয়ে।
সারা দুনিয়া জুড়ে চলছে জার্মান, ইতালিয়ান ও জাপানি ফ্যাসিবাদের আগ্রাসী আক্রমণ। ভারতের জনগণের মধ্যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বিক্ষোভ ফুটে উঠেছে। গণআন্দোলগুলাের মধ্য দিয়ে। কমিউনিস্টরা শ্রমিক, কৃষকের এই আন্দোলনগুলাের সর্বত্রই স্থানীয়ভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কংগ্রেসের পক্ষ থেকে স্বয়ং গান্ধী ব্রিটিশ রাজকে ব্ৰিত না করার জন্য কোনাে আন্দোলন না করার কথা ঘােষণা করেছেন, ব্রিটিশদের যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সর্বপ্রকার সাহায্যের আহ্বান জানিয়েছেন। কংগ্রেসের বামপন্থায় নেতা জওহরলাল নেহেরু ঘােষণা করেছেন জাপান যদি সুভাষচন্দ্র বসুকে নিয়েও ভারতের সীমান্তে উপস্থিত হয় তাহলে আমিই সবার আগে অস্ত্রহাতে গিয়ে বাধা দেবাে। ‘৪১ সালের জুন মাসে হিটলার সােভিয়েত ইউনিয়ন আক্রমণ করার সাথে সাথে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এক অন্য পর্যায়ে চলে গেল বিশ্বের নিপীড়িত জনগণের আশার আলাে, সােভিয়েত ইউনিয়নকে ধ্বংসের আক্রমণ থেকে বাঁচানাের প্রচেষ্টাকে অত্যন্ত সঠিকভাবে জনযুদ্ধ আখ্যা দিয়ে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলন দুনিয়ার শ্রমিক শ্রেণির কাছে আহ্বান জানাল। ‘৪২ সালে ভারতের কংগ্রেস নেতারা ফ্যাসিস্টদের হাতে সােভিয়েতের পরাজয় সুনিশ্চিত ধরে নিয়ে রাতারাতি ফ্যাসিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল হয়ে পড়লেন। ৯ই আগস্টের ‘কুইট ইন্ডিয়া’ প্রস্তাব তারই ফলশ্রুতি। আগস্ট আন্দোলনের কোনােরকম কর্মসচি না দিয়েই কংগ্রেস নেতারা গ্রেপ্তার হলেন- জনগণের ব্রিটিশবিরােধী বিক্ষোভ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ফেটে পড়ল ইতস্তত বিক্ষিপ্তভাবে প্রায় সমগ্র ভারতবর্ষ জুড়ে মহারাষ্ট্রের সাতার ও বালিয়ার কৃষক জনগণ সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে ক্ষমতা দখল করে ফেলেছিলেন।
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই সময়ে চরম দ্বিধায় ভুগেছেন। একদিকে জনযুদ্ধ’ বলে কোনাে বড় আন্দোলন না করার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল, অন্যদিকে কংগ্রেস নেতাদের দায়িত্বজ্ঞানহীন ‘কুইট ইন্ডিয়ার আওয়াজের বিরােধিতা কমিউনিস্টরা এ, আই সি সি-এ মধ্যে নীতিগতভাবে করে (এস জি সারদেশাই পার্টির ঐ বক্তব্য রেখেছিলেন) গণআন্দোলনেরও বিরােধিতা করল। অথচ নিচুতলার পার্টির কর্মীরা বহু জায়গায় আন্দোলনে জনগণের সাথে থেকেছে সারা ভারতেই অজস্র কমিউনিস্ট কর্মী গ্রেপ্তার হয়েছে।
চারু মজুমদারকেও আগস্ট আন্দোলন উপলক্ষ্যে পুলিশ গ্রেপ্তার করেছিল।
১৯৪২ থেকে ১৯৪৪- এই সময়টা ভারতবর্ষের জীবনে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা জগদ্দল পাথরের মতাে চেপে বসেছিল। ‘৪২ সালে সম্পূর্ণ নেতৃত্বহীন অবস্থায় আগস্টের গণআন্দোলন পুলিশি অত্যাচারে পর্যুদস্ত হয়ে গেল, কমিউনিস্টদের বড় আন্দোলন না করার নীতি ব্রিটিশের বিরুদ্ধে গণসংগ্রাম গড়ে তােলার সুযােগ তাে দিলই , বরং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ফরাসি বিরােধী মিত্রশক্তির শরীক হিসেবে ব্রিটিশ তার সরকারি অফিস থেকে কমিউনিস্টদের ‘ন্যাশনাল ফ্রন্ট কাগজ বিক্রয় করার ব্যবস্থা করে দিয়ে ভারতের কমিউনিস্টদের ভাবমূর্তির যথেষ্ট ক্ষতি করেছিল— ‘৪১ সালেই পার্টিকে সরকার আইনসংগত বলে ঘােষণাও করে দিয়েছিল। ‘৪৩ সালের এক ভয়াবহ দুর্ভিক্ষে। লক্ষ লক্ষ কৃষক প্রাণ দিল, এক নতুন শশাষণ পদ্ধতি এই সময়েই প্রচলিত হলাে, তার নাম ‘ব্ল্যাক মার্কেট’। সারা দেশ জুড়ে এই ‘ব্ল্যাক মার্কেট জন্ম দিয়েছিল এক নীতিবিহীন ব্যবসায়ী মহাজন শ্রেণি যারা টাকার জোরটাকেই সামাজিক মর্যাদার একমাত্র মানদণ্ড করে দিয়েছিল কংগ্রেসের আপসনীতিতে যার পড়েছিল প্রচণ্ড প্রভাব, সংগ্রামী গণচেতনার সামনে যা সৃষ্টি করেছিল এক চূড়ান্ত হতাশার- যা পরবর্তীকালে প্রথা তৈরি করল মানুষের মর্যাদা টাকা দিয়ে কিনে নেওয়ার। চারু মজুমদারের মতাে কর্মীদের সামনে দুর্ভিক্ষজনিত সমস্যায় পার্টির কেন্দ্রীয় নির্দেশের অভাব রীতিমতাে হতাশার সৃষ্টি করেছিল। সারা গায়ে ঘা নিয়ে মাসখানেক বাড়িতে এসে থাকতে হলাে চারু মজুমদারকে। অনশন, অর্ধাশনে কেটেছে প্রায় পুরাে বছর। বলে “দাও বাবা, পেট ভরে যতটা পারি খেয়ে নিই।” একটি কন্যার জন্ম দিয়ে মা ‘হারু পিসিমা’ শেষ নিঃশ্বাস ফেলেছেন- বীরেশ্বর মজুমদারের নির্বিকার ভাবের কোনাে পরিবর্তন অন্তত বাইরে থেকে বােঝার উপায় নেই। এর ওপর পরিচিত বাড়িতে আরও থাকলে দাও’ করে খেয়ে বেড়ায় চারু। বিয়ে, উৎসবে পরিচিত বাড়ি হলেই হলাে, নিমন্ত্রিত হওয়ার ধার ধারে না। একেবারে শেষ প্রকাশ্য জীবন পর্যন্তও কেউ কখনও দেখেনি বা শােনেনি চারু মজুমদারকে এই ধরনের নিমন্ত্রণে উপহার দিতে। এটি কোনাে আলােচ্য বিষয় বলেই তার কখনও মনে হয়নি।
পৃষ্ঠা: ৩৫
এই স্বল্প অবসর চারুকে পড়াশুনায় খুব সাহায্য করেছিল। কৃষি সমস্যা নিয়ে সরকারি, বেসরকারি দলিলপত্র পড়া ছাড়াও মার্কস, লেলিনের রচনাবলি, গর্কি, রমা রলা, ওয়াশিংটন আর্ভিং, লুই সিনক্লোয়ার, টলস্টয়ের ‘ওয়ার অ্যান্ড পিস’, তুর্গেনেভ ও ডস্টয়েভস্কি আর তাঁর অতি প্রিয় লরেন্স উইশার্ট প্রকাশনার শলােকভের ‘ডন নভেলস’ পড়া অবশ্য অর্ধরাত্রে উঠে রবীন্দ্রনাথের কবিতা পাঠ- ‘বন্দরের কাল হলাে শেষ’ বা শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ পড়াও থাকত তার পাঠক্রমের মধ্যে।
চারু মজুমদার তখন এক পরিণত কমিউনিস্ট। চায়ের আড্ডায় বা বাড়িতে বসে লালফৌজের সাময়িক শক্তি, কৃষক আন্দোলনের ক্ষেত্রে ভাগচাষ সমস্যা, কৃষকের সংগ্রামী কায়দায় উদ্ভাবনী শক্তি, রেল শ্রমিকদের মধ্যে লােকেরা শ্রমিকরা অধিক জঙ্গি এইসব বিষয়ে উপস্থিতদের বােঝাত। এই ‘ছুটির মধ্যেও কয়েকজনের সহযােগিতায় দার্জিলিং-এর পাহাড়ে চা-বাগান সংগঠনের চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু নিজে নেপালি ভাষা জানায় কাজ এগােতে পারেনি।
যত পরিণতই হােক পার্টির সামগ্রিক সীমাবদ্ধতা চারুকে ভারতের মুক্তির প্রশ্নে নতুন ধ্যানধারণা আনতে সাহায্য করেনি। জনযুদ্ধ তত্ত্বকে দ্বান্দ্বিকভাবে না দেখার জন্য ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির যে দুর্গতি, আন্দোলনের সম্বন্ধে পরিষ্কার নীতি গ্রহণে যে দ্বিধা যে ব্যাপারে এই সময়ে চারু মুজমদারের কোনাে প্রকাশ্য মতের কথা জানতে পারা যায় না। নিজের এলাকায় আন্দোলনের প্রশ্নে কিন্তু পার্টির নির্দেশ আছে কি নেই তা নিয়ে তার চিন্তা ছিল না। মেহনতী জনগণের প্রতি অগাধ আস্থা প্রকাশ করে বলত—“একবার লড়াই শুরু করলে আর ঠেকানাে যাবে না!”
৪
তরঙ্গের রথে
তরঙ্গের ‘পরে তরঙ্গের মতাে সংগ্রামের জোয়ার এলাে। ১৯৪৩ সালের দুর্ভিক্ষে মানুষ মরেছে রাস্তায় পড়ে, শােষণের দড়ি ছিড়ে কেড়ে খাওয়ার কথা ভাবেনি। সেই মানুষই ‘৪৪ সালের শেষ ভাগ থেকে সচেতন হয়ে উঠতে লাগল নিজেদের অধিকার সম্বন্ধে। প্রায় দুই বছর ধরে পিছু হটার পর সােভিয়েত ইউনিয়নে লালফৌজ তখন পালটা আক্রমণ শুরু করেছে, ‘৪৪-এর গােড়া থেকে ‘অজেয়’ নাৎসি বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হয়েছে। এক বিজয়ের আনন্দ যেন দুনিয়ার মজদুরের চোখে-মুখে। ফ্রান্সে, ইতালিতে, আলবেনিয়ায় ‘পার্টিজান’ বাহিনীর কমিউনিস্ট গেরিলারা অন্তর্ঘাত কার্যকলাপ দিয়ে দখলকারী নাৎসি বাহিনীকে সন্ত্রস্ত করে ফেলছে— জয়া, শুরা আর জুলিয়াস ফুচিকেরা ইতিহাসের প্রথম সারিতে স্থান পাচ্ছে। চীনা কমিউনিস্ট অষ্টম রুট ও নব চতুর্থ বাহিনীর কাছে জাপানি ফ্যাসিস্টরা একেবারে পর্যদস্ত হয়ে গিয়েছে। ভিয়েতনাম, কোরিয়া, ইন্দোনেশিয়া, লাওস, কম্বােডিয়া এমনকি বার্মাতেও ফ্যাসি-বিরােধী সশস্ত্র সংগ্রাম, শােষণ মুক্তির সংগ্রামে পরিণত হচ্ছে। ভারত জুড়ে নবযুবক-যুবতিদের মুখে গান-
“বলিষ্ঠ দুই হাতে তুলে নাও হাতিয়ার,
মুক্তির নিশান উড়াও,
মহাচীন আর বার্মার পথে আজ
মুক্তির কদম বাড়াও।”
১৯৪৪ সাল থেকেই সারা ভারতেই শ্রমিক সংগ্রাম চলতে থেকেছে— উত্তর বাংলার কৃষকের মধ্যে আন্দোলনের মেজাজ চড়ছে। ভাগচাষি অধ্যুষিত সমগ্র উত্তর বাংলায় কৃষক সভা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে। চারু মজুমদার আরােহণ করেছেন সেই আন্দোলন প্রস্তুতির তরঙ্গের রথে। ভাগচাষির ধানের ভাগ নিয়ে আন্দোলনের আওয়াজ দেওয়া হচ্ছে কিন্তু ক্রমশই জমির অধিকারের কথা ভাগচাষি কৃষক তুলতে লেগেছে। ‘৪৩ সালের দুর্ভিক্ষের অনাহারের মধ্য দিয় কৃষক তার জীবনের অভিজ্ঞতায় বুঝেছিল যে জমির অধিকার না পেলে, জমিদারি প্রথাটাকেই উচ্ছেদ করে না ফেলতে পারলে বারবার দুর্ভিক্ষ কৃষকের জীবনকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। চারু মজুমদারের কিছুদিন থেকেই বক্তব্য যে ভাগচাষি আসলে মধ্য কৃষক, টাকায় না দিয়ে ধানে খাজনা দেওয়াটাই তার ভাগচাষের আসল রূপ। তার আন্দোলনে জমির অধিকারের প্রশ্ন অপরিহার্য মতান্তর ছিল এ নিয়ে কৃষক সভার মধ্যে। কিন্তু তা সত্ত্বেও অক্লান্তভাবে কৃষক আন্দোলনের কমিউনিস্ট কর্মীরা প্রচার আন্দোলন চালাচ্ছে। সপ্তাহের এক একদিন এক একটা হাটে পথসভা। গণসংগীত গেয়ে পথসভা করার সমযে নতুন এলাকায় তােক জমায়েত হয়ে বলত- “এটা কোনাে বিড়ি কোম্পানি?” ‘বােতল মার্কা’ বিড়ির এক কোম্পানি তখন হাটে হাটে প্রচার করত নাচ-গানের দল নিয়ে। এই পথসভাগুলাের মধ্যে শহর, বন্দরের (ছােট বাজার) মধ্যবিত্ত যুবকেরা পার্টির দিকে আকৃষ্ট হতে লাগল। তারা অল্প দিনেই আকৃষ্ট হতে লাগল চারুর দিকে, বলতে লাগল- “দারুণ, তাই না? যেন একটা জীবন্ত বিপ্লব।” চারুর ঝাঁকড়া চুল, বড় বড় চোখ থেকে হাফপ্যান্ট, খালি পা এবং প্রায়শই মুখে পাইপ খুবই রােমান্স জোগাত এই নতুন ছেলেমেয়েদের মনে। অতি সহজভাবে চারু মজুমদার তাদের বক্তৃতার নির্দেশ দিত, প্রথম আলাপেই ‘তুই’! সম্বােধন, পথসভা হয়ে গেলে “নে এবার বের কর দিকি কার পকেটে কয় পয়সা, চা খেতে হবে!” নিজেদের মধ্যে ছেলেগুলাে বলত, “চারুদার পাল্লায় পড়া চলবে না-নিজের যেমন এক কানাকড়িও সঙ্গে থাকে না, আমাদেরও সব খরচ করিয়ে দেবে।” কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রথম এসেই তারা চারুদাকে খুঁজে বেড়াত।
সেই যুগে মধ্যবিত্ত পরিবারের সমাজতান্ত্রিক গোঁড়ামি ভেঙে বেরিয়ে আসার আকাক্ষা জুগিয়েছিল কমিউনিস্ট মতবাদ যুবক, যুবতি এক স্বপ্নবিলাস নিয়েই ভেঙে ফেলত পারিবারিক শাসন। সব বন্ধনের ঘাের বিরােধী চারু মজুমদারকে তাই এদের ছিল বড়ই পছন্দ।
১৯৪৪-এর শেষ থেকেই শহরগুলােতে এক বড় আন্দোলন গড়ে উঠল ‘বন্দিমুক্তি’– বিশেষ করে আন্দামানে প্রেরিত ‘সন্ত্রাসবাদী’ বন্দিদের মুক্তির দাবিতে বড় বড় সভা, শােভাযাত্রা চলতে লাগল শহরগুলােতে। শিলিগুড়ি শহরে এই সর্বপ্রথম কমিউনিস্ট পার্টির একটি শাখা গঠন করে বন্দিমুক্তির দাবিতে দার্জিলিং জেলা পার্টির সহযােগিতায় এক বিশাল জনসভার প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন চারু মজুমদার। ‘আন্দামান। বন্দিদের মুক্তি চাই’, ‘অনন্ত সিংহ, গণেশ ঘােষকে ছাড়তে হবে এই আওয়াজের মধ্যে সভায় প্রথম বক্তা চারু মজুমদার সেদিন মুগ্ধ করে দিয়েছিলেন সভার মানুষদের। শিলিগুড়িরই ছেলে চারুর এই মূর্তি শিলিগুড়ির মানুষ আগে কখনও দেখেনি।
১৯৪৫ সালের মে মাসেই লালফৌজ কর্তৃক বার্লিন দখল ফ্যাসিস্ট শক্তির পূর্ণ পরাজয় সূচিত করল। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসান ফ্যাসিস্ট-সহ সব সাম্রাজ্যবাদকেই দুর্বল করে দিল- পূর্ব ইউরােপের আটটি রাষ্ট্র সাম্রাজ্যবাদের জোয়াল ছিন্ন করে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করল। (পােল্যান্ড, চেকোস্লোভাকিয়া, হাঙ্গেরি, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া, যুগস্লাভিয়া, আলবেনিয়া ও পূর্ব জার্মানি।) দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মুক্তি সংগ্রাম বিপুল বেগে এগিয়ে চলল। আফ্রিকার আলজিরিয়া, আবিসিনিয়া, নাইজিরিয়া, তানজানিয়া, কেনিয়া প্রভৃতি মধ্যপ্রাচ্যের লিবিয়া ও লাতিন আমেরিকার বিভিন্ন দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম প্রবল আকার ধারণ করল।
এই মুক্তি সংগ্রামের প্রভাব সারা ভারত জুড়ে এক গণআন্দোলনের গণ-অভ্যুত্থানে পরিণত হওয়ার রসদ জোগাল।
কংগ্রেস নেতৃত্বের জেলে থাকাকালীনই ব্রিটিশের পক্ষ থেকে সমঝােতা মারফত ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রস্তাব করা হয়েছে। উভয় পক্ষই দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের অবসানের যুগসন্ধিক্ষণকে নিজেদের পক্ষে অনুকূল নয় বুঝতে পেরেছে বিশ্বের মুক্তির সংগ্রামের জোয়ার দেখে ব্রিটিশ বুঝল তার পক্ষে ভারতবর্ষ দখল করে আর থাকা সম্ভব না। কংগ্রেস নেতারাও ‘অহিংস অসহযােগ’ দিয়ে জনসাধারণকে আন্দোলনে এনে ব্রিটিশের কাছে সুযােগ আদায় করবেন সে সম্ভাবনা যে আর নেই তা বুঝলেন, কারণ তখন কোনাে আন্দোলনের ডাক দিলে তাকে পিছু টেনে রাখা যেত না। এখন কার কোলে কতটা ঝােল থাকবে সেটাই হয়ে গেল টানাটানির বিষয়বস্তু। মােহাম্মদ আলী জিন্নাহর মুসলিম লীগ মারফত পাকিস্তানের দাবিতে ব্রিটিশ উসকানি দিল, ওদিকে কংগ্রেস নেতাদের বােঝাল “জিন্নাহকে আপনারাই রাজি করান, তাহলে আপনাদের হাতেই ভারত ছেড়ে দিয়ে যাব।” কংগ্রেস নেতারা ‘৪৫ সালে জেল থেকে বেরিয়ে আর জনগণকে দেখতে পেলেন না, কেবল উপদেশ- “চুপচাপ থাক, দ্যাখাে অহিংস উপায়ে কেমন স্বরাজ আনছি আমরা।” হাওয়া একটু গরম রাখার জন্য নেহরু চিৎকার করতে লাগলেন- “আমাদের হাতে ক্ষমতা এলেই ল্যাম্পপােস্টে চোরাকারবারিদের ফাঁসি দেব।” আর সেই সাথে তারা কমিউনিস্টিদের বিরুদ্ধে ব্রিটিশের দালাল’, ‘আগস্ট আন্দোলনে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে বলে জিকির তুলে গুন্ডাদল লেলিয়ে দিলেন। জায়গায় জায়গায় কমিউনিস্টদের খুন করতে।
সুভাষচন্দ্র বসুর ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির (INA) কয়েক লক্ষ ফৌজকে বার্মায় বন্দি করে ব্রিটিশ সরকার ভারতের বিভিন্ন কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে রাখে। এঁদের নেতৃবৃন্দকে দিল্লির লালকেল্লায় আটকে গােপনে বিচার চলতে থাকে। ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের বিচার চলবে না’, ‘ক্যাপ্টেন রশীদ আলির মুক্তি চাই!’ বলে কলকাতার ছাত্ররা ‘রশীদ আলি দিবস’ পালন করল। নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে মিছিল বের করল। যুদ্ধোত্তর যুগের বিপ্লবী সংগ্রামের একটি সূচনা সেদিন করেছিল কলকাতার ছাত্ররা। ধর্মতলায় পুলিশের বিরুদ্ধে ব্যারিকেড করে লড়ল ছাত্ররা গান গেয়ে-
“আগে চলাে আগে চলাে দুন্দুভি বাজে
চলাে চূর্ণ করি জীর্ণ কারাগার,
আঘাত হানেনা শেষ আঘাত
মিলিত কণ্ঠে বজ্রাঘাত,
বণিক রাজ নিপাত, যাক নিপাত।”
দুটি ছাত্র রামেশ্বর ব্যানার্জী আর কদম রসুল সেদিন শহিদ হলাে পুলিশের গুলিতে। বেধড়ক গ্রেপ্তার চলল কমিউনিস্টদের। এক মাসের মধ্যেই ‘আজাদ হিন্দ ফৌজে’র মামলা তুলে নিতে বাধ্য হলাে ব্রিটিশ। এই সমস্ত সংগ্রাম যজ্ঞে কংগ্রেসের কিন্তু প্রায় কোনাে ভূমিকাই ছিল না। যদিও কমিউনিস্ট পার্টি শ্রমিক ধর্মঘট করে যে মিছিল বের করেছিল তাতে কংগ্রেস, মুসলিম লীগ ও লাল, তিন ঝান্ডাই রাখা হয়েছিল।
উত্তর বাংলায় কংগ্রেসের কমিউনিস্ট বিরােধী প্রচার প্রথম থেকেই বাধা পেতে লাগল। কমিউনিস্ট কর্মীরা সাধারণ কৃষকের মধ্যে কংগ্রেসের সকল অপপ্রচারের জবাব সার্থকভাবেই দিতে পেরেছিল। শীঘ্রই কংগ্রেসের মুখােশ খুলতে লাগল যখন তারা। জোতদারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে বারণ করতে লাগলাে। জলপাইগুড়ি শহরের পার্টি অফিসে একটানা তিনদিন ধরে সভা করতে হয়েছিল চারু মজুমদারকে, শুকনাে চিড়ে খেয়ে থেকে, ছাত্রদের কংগ্রেসি অপপ্রচারের জবাব জুগিয়ে দিতে। পার্টির তখন। সামগ্রিকভাবে যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতিকে বােঝা বা নীতি ও কৌশল ঠিক করার কোনাে প্রচেষ্টা নেই। পার্টির কাগজপত্রে গণআন্দোলনের সংবাদগুলাে দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সব সংগ্রামের গতিমুখ কী করে সাম্রাজ্যবাদবিরােধী সংগ্রামে গিয়ে মিলবে তার কোনাে ব্যাখ্যা নেই, আবার কংগ্রেসি অপপ্রচারের বিরুদ্ধে কংগ্রেস নেতাদের কাছেই আবেদন থাকছে— “আমাদের ভুল বুঝবেন না।” ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক গুরুতর রাজনৈতিক সংকট এই সময়ে প্রকট হয়ে পড়ল। কংগ্রেসের অপপ্রচারের বিরুদ্ধে যখন সাধারণ কর্মীরা নানা প্রতিরােধ গড়ে তুলছে তখন পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলেছে নানা বিভ্রান্তি। সাধারণ সম্পাদক পি.সি. যােশী (১৯৩৬-৪৮)-সহ নেতৃত্বের কয়েকজন কংগ্রেস নেতৃত্বের সাথে সরাসরি কোনাে বিরােধে যেতে চাইছিলেন না, অন্য এক অংশ মনে করেছিলেন ক্রমবর্ধমান আন্দোলনগুলােতে বলিষ্ঠভাবে নেতৃত্ব দেওয়া উচিত। উভয় পক্ষেরই আবার এক জায়গায় মিল ছিল যে, ভারতবর্ষের জাতীয় মুক্তি কী ধরনের বিপ্লবের মারফত হবে, তার কর্মসূচি কী হবে তা নিয়ে পরিষ্কার ধারণার অভাব। ফলে একদিকে গান্ধীর কাছে পার্টির জমা-খরচের খাতা পাঠানাে হলাে ‘বিদেশি টাকা কমিউনিস্টরা যে পায় না তার প্রমাণ দিতে, অন্যদিকে যখন যেমন আন্দোলন স্বতঃস্ফূর্তভাবে শুরু হলাে তার তাৎক্ষণিক নেতৃত্ব দেওয়ার চেষ্টা হতে লাগল।
‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ মুক্তির দাবিতে সাথে সাথেই রাজকীয় নৌবাহিনীর ভারতীয় সৈনিকরা ব্রিটিশ সৈনিকদের সমান অধিকারের দাবি করে বােম্বে শহরে তিন ঝান্ডা নিয়ে মিছিল করল। এই মিছিলে ‘আজাদ হিন্দ ফৌজের’ মুক্তির দাবি করা হলাে। ব্রিটিশ অফিসাররা মিছিলের নেতাদের কোর্ট মার্শাল করে জেলের সাজা দিল। এই অত্যাচারের বিরুদ্ধে ‘৪৬-এর ফেব্রুয়ারি মাসে নৌবাহিনীর ভারতীয় সৈনিকরা বিদ্রোহ করে বােম্বে, মাদ্রাজ, কলকাতা, বিশাখাপত্তনম বন্দরে জাহাজ দখল করে কামানের জবাব কামান দিয়ে দিতে লাগল বােম্বে, কলকাতায় শ্রমিক ধর্মঘট হলাে নৌবিদ্রোহের সমর্থনে। বল্লভভাই প্যাটেল কংগ্রেসের পক্ষ থেকে ধমক দিয়ে নৌবিদ্রোহীদের আত্মসমর্পণ করতে বললেন। জওহরলাল নেহেরু সরসারি আত্মসমর্থনের কথা না বললেও এই ধরনের ‘হিংসাত্মক কার্যকলাপের নিন্দা করলেন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব নৌবিদ্রোহের পূর্ণ সমর্থন জানিয়েও নেতৃত্ব গ্রহণ করলেন না। নৌবিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করতে বাধ্য হলাে- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ এটুকু বুঝল যে জনগণ যত বিক্ষুব্ধই হােক, কোনাে রাজনৈতিক দলই বিপ্লবের পথে নেতৃত্ব দেবে না।
নৌবিদ্রোহের সাথে সাথেই রাজকীয় বিমানবাহিনীর এক অংশ ধর্মঘট করল, জব্বলপুরে সৈনিকদের ধর্মঘট হলাে, দেরাদুনে অফিসারদের অপমানকর মন্তব্যের বিরুদ্ধে গুখাসৈন্য ধর্মঘট করল, দিল্লি এবং এলাহাবাদের পুলিশ বাহিনীতে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে হলাে অনশন ধর্মঘট, বিহারে দশ হাজার পুলিশ ধর্মঘট করল। সর্বত্রই ব্রিটিশ সামরিক বাহিনীর ব্যবহার করে হাজার হাজার ধর্মঘটিদের হত্যা করল; দেশ জুড়ে শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবক নতুন যুগের সূচনায় বিশ্বাস করে অকুণ্ঠ সমর্থন জানাল এই
পৃষ্ঠা: ৪০
সংগ্রামগুলাের প্রতি। ‘৪৬ এর এপ্রিলে সারা ভারতেই রেল শ্রমিকদের স্ট্রাইক ব্যালেট শতকরা আশি ভাগের বেশি রেল শ্রমিক ধর্মঘটের পক্ষে মত দিল। এলাে সেই ঐতিহাসিক ২৯শে জুলাই- পােস্ট ও টেলিগ্রাফ কর্মীদের সমর্থনে ২৯ জুলাই বঙ্গীয় প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেসের ডাকে সারা বাংলা জুড়েই ধর্মঘট পালিত হয়। কলকাতায় সেদিন তিন লাখের উপর শ্রমিকের এক বিশাল শােভাযাত্রা কলকাতার ব্রিটিশ শাসন সম্পূর্ণ অচল করে দিয়েছিল ময়দানের বক্তৃতায় ‘স্বাধীনতা লড়াই করে নিতে হবে’, ‘রক্ত দিয়ে দেশের মুক্তি আনতে হবে’, ‘এই পচাগলা সরকারকে আর এক ধাক্কা দাও’ প্রভৃতি আওয়াজে সংগ্রামী চেতনা যেন উঠে গেল তুঙ্গে। কিন্তু কাল অর্থাৎ ৩০শে জুলাইতে কী করতে হবে তার কোনাে কর্মসূচি নেই। অনেক প্রবীণ কমিউনিস্টই বলেছেন এই ২৯শে জুলাইয়ের পর পরই গ্রামাঞ্চলে কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তােলা যেত, গেরিলাযুদ্ধ মারফত বিভিন্ন এলাকা মুক্ত করে ভারতে এক সশস্ত্র মুক্তি সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়তে পারত ১৯৪৬ সালের ৩০শে জুলাই থেকে। এক চূড়ান্ত রাজনৈতিক সংকটের সময়ে জনগণের সংগ্রামী মেজাজের সামনে এগিয়ে যাওয়ার নির্দিষ্ট কর্মসূচি না থাকায় অবশ্যম্ভাবী ফল ফলল মাত্র ১৭ দিন পরে। হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় কলকাতার সংগ্রামী ঐতিহ্য ধুয়ে মুছে গেল। ২৯শে জুলাই-এ এই মিছিলে মুক্তির আওয়াজ দেওয়া হিন্দু-মুসলমান শ্রমিক ১৬ই আগস্ট থেকে পরস্পরকে ছুরি মারতে লাগল।
কী সুপরিকল্পিত ছিল এই দাঙ্গা- ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় পুঁজিবাদের প্রতিনিধি কংগ্রেস ও মুসলমান পুঁজিবাদীদের প্রতিনিধি মুসলিম লীগের চক্রান্তে! হিন্দুমুসলমান খেটে খাওয়া মানুষের কাছে তখনও মুক্তির সংগ্রাম বড় হয়ে আছে। সেপ্টেম্বর থেকেই উত্তর বাংলায় তােড়জোড় পড়ে গেল তেভাগা সংগ্রামের।
চারু মজুমদার স্বভাবসিদ্ধভাবেই কখনই পার্টি বা গণসংগঠনের সভাপতি, সম্পাদক ধরনের নেতৃতৃপদ নিতে চাননি। জলপাইগুড়িতে রেলশ্রমিক সংগঠন বা কৃষক সভায় এই ধরনের পদে অধিষ্ঠিত হওয়া তাঁর পক্ষে কোনাে অসুবিধার তাে ছিলই না। বরং এক বড় অংশের কর্মীরাই তা চাইতেন। কিন্তু চারু মজুমদারের এক কথা— “প্রেসিডেন্ট, সেক্রেটারি হলে কি আর বেশি দায়িত্ব নিয়ে কাজ করবাে” অনেক সময়েই এই ধরনের পদাধিকারীর অধিক যােগ্যতার কাজ তাঁকে করতে দেখা গিয়েছে। রেল ইউনিয়নের সম্মেলনে অল ইন্ডিয়া রেলওয়েমেন্স ফেডারেশনের সম্পাদক এসেছেন। তাঁর ইংরেজি বক্তৃতা হিন্দি তর্জমা যেমন চারুকে করতে হবে, আবার প্রতিনিধি সম্মেলনের সারসঙ্কলন করে বক্তৃতাও ঐ চারুকেই দিতে হবে। কৃষক সভার গুরুত্বপূর্ণ অধিবেশনে বহু সময়ে সিদ্ধান্তমূলক বক্তব্য চারু মজুমদারকেই বলতে দেখা গিয়েছে।
তেভাগা আন্দোলনের সিদ্ধান্ত নির্দিষ্টভাবে বলতে গেলে উত্তরবঙ্গের জেলাগুলাের কৃষক সভারই সিদ্ধান্ত। প্রচারে প্রচারে যখন উত্তরবঙ্গের গ্রামাঞ্চল তােলপাড় হয়ে উঠেছে তখন বিভিন্ন থানার অতিরিক্ত সশস্ত্র পুলিশ সমাবেশে কমিউনিস্ট পার্টির প্রাদেশিক কমিটি ও বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভার পক্ষ থেকে আন্দোলন পিছিয়ে দেওয়ার কথা বলা হলাে। এই উপদেশের বিরুদ্ধাচরণ করার জন্য দিনাজপুরে উত্তরবঙ্গের সকল জেলার কৃষক নেতারা মিলিত হওয়ার সিদ্ধান্ত করেছিলেন। ইতােমধ্যে অনেক নেতাই আত্মগােপন করেছিলেন মাধব দত্ত বুকে, পিঠে “আধি নাই, তেভাগা চাই” লেখা পােস্টার এঁটে দিনাজপুরে যাওয়ার পথে পার্বতীপুর জংশনে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হলেন। এই গ্রেপ্তারের প্রতিবাদে সব জেলাতেই কৃষকের বিশাল বিশাল বিক্ষোভ মিছিল, সমাবেশ হলাে- উত্তরবঙ্গের জেলাগুলাের কৃষক সভা ‘তেভাগা আন্দোলন চলবে’- সিদ্ধান্ত করলেন এবং ৬০ লক্ষ কৃষকের তেভাগা সংগ্রাম শুরু হয়ে গেল। সংগ্রামের জোয়ার দেখে অবশ্য প্রাদেশিক নেতৃত্ব আন্দোলন সমর্থন করল এবং পরিচালক দায়িত্বও গ্রহণ করল।
তেভাগার উত্তাল রূপ চলেছিল ‘৪৬-এর নভেম্বর থেকে ‘৪৭-এর ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত। এক বিপ্লবী সংগ্রামে মেহনতি মানুষ যে এক নতুন সত্তা পেয়ে যায় তেভাগা সংগ্রামে তার নিদর্শন পাওয়া গিয়েছে। কোথায় চলে গিয়েছিল জাতপাতের ভেদ, চরম সাম্প্রদায়িক উসকানির সামনে মিটে গিয়েছিল হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ। চারু মজুমদারেরই জবানীতে- “প্রতিটি গ্রামেই তৈরি হয়ে গিয়েছিল এক ধরনের সামরিক কমান্ড যা আবার থানা কমান্ডের অধীন। বর্শা, বল্লম, ভােজালি, তির-ধনুক অস্ত্র। গ্রামের সীমানায় পাহারার ব্যবস্থা, পুলিশ এলেই গ্রামে খবর চলে মেয়েরা শঙ্খ বাজিয়ে সবাইকে জানান দেয়। ধান কেটে তােলা হয় পঞ্চায়েত খামারে, সেখান থেকে ভাগ হবে, তেভাগা। পুলিশ ব্যাপক অত্যাচার শুরু করল গ্রামে ঢুকে ঢুকে গ্রাম ছেড়ে সব রাতে থাকতে লাগল জঙ্গলে। চাষিরা বলত মানুষ এখন জঙ্গলে, আর বাঘ, শেয়াল গ্রামে থাকছে। মেয়েদের হলাে গায়েন কমিটি- উখলিতে ধান কোটার গায়েন (দণ্ড) হাতে মেয়েদের প্রতিরক্ষা বাহিনী। খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা সব এক জায়গায় হিন্দুমুসলমান, নিম্নবর্ণ-উচ্চবর্ণ সব একাকার।” পঞ্চগড়ের এক নামি ডাকাত গ্রুপের নেতা। অথচ নিজে কখনও দাবি কিছু করেনি- ধানের ভাগও নেয়নি। শ্রেণি ঘৃণা এমনি যে জোতদারের এক দালাল এক কৃষক মেয়ের উপর অত্যাচার করলে এক মুসলমান কৃষক যুবক সকলের সামনে দালালটির ঘাড় মুচড়ে ভেঙে দিয়েছিল।
পুলিশি অত্যাচার চরমে উঠতে শুর করল ‘৪৬-এর ডিম্বের মাসে; শ-এ শ-এ গ্রেপ্তার, গুলি করে, বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে হত্যা, মেয়েদের গণ-ধর্ষণ। ওদিকে জোতদাররা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় ফসলের ভাগের আন্দোলন জমি দখলের সংগ্রামে পরিণত হয়ে গেল। পুলিশের সাথে গ্রামীণ অস্ত্র নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় সংঘর্ষ হচ্ছে, মেয়েরা দল বেঁধে পুলিশের হাত থেকে বন্দিদের ছিনিয়ে নিচ্ছে জলপাইগুড়ির চা-শ্রমিকেরা, রেল শ্রমিকেরা কৃষক মিছিলে তেভাগার ধ্বনি দিচ্ছে। চা-বাগানের হাটে চা-শ্রমিকেরা তেভাগার পক্ষে মিছিল করতে পুলিশের গুলিতে এগারােজন নিহত হলাে, আহত প্রায় ত্রিশ। দোমহনী জংশনে খবর পেয়ে রেল শ্রমিকরা একটি মালবাহী ট্রেন প্রস্তুত করে ফেললেন, গুরুতর আহতদের নিয়ে ট্রেন বার্ণিশঘাট গেল, সহানুভূতিশীল মাঝিরা সন্ধ্যার আঁধারের আড়ালে আহতদের দুরন্ত তিস্তা নদী পার করে পৌছে দিল জলপাইগুড়ি শহরের ঘাটে জ্যাকসন মেডিকেল স্কুলের ছাত্ররা আহতদের জলপাইগুড়ি হাসপাতালে ভর্তির ব্যবস্থা করে দিল। ঘটনার বিবরণ দিয়ে চারু মজুমদার সেদিন বলেছিলেন- “আমাদের চিন্তাভাবনায় বাইরেই এইভাবে সংগ্রামের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে কৃষক-শ্রমিক-ছাত্রদের ঐক্য গড়ে উঠল।”
‘পুলিশি আক্রমণ প্রতিরােধ’– তখন সংগ্রামী কৃষকের এই ভাবনা। পুরাে নেতৃত্ব চমকার আত্মগােপনের সংগঠন প্রস্তুত করেছে, যােগাযােগ রাখছে পরস্পরের সাথে, আবার প্রকাশ্য সংগঠনের একটি কাঠামােও রাখা হয়েছে। আক্রমণ প্রতিরােধও পালটা আক্রমণ করার প্রশ্ন নিয়ে ব্যাপক আলােচনা হয়েছে, গেরিলা পদ্ধতির কথা উঠেছে— প্রাদেশিক কমিটির কাছে কিছু অস্ত্রশস্ত্র ও সামরিক প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করার কথা জানানােও হয়েছে। কৃষকরা বিভিন্ন অঞ্চলে পুলিশফাঁড়ি আক্রমণ করছে, কিন্তু প্রায় নিরস্ত্র অবস্থায় পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিচ্ছে। এক ফকির বলেছিলেন যে, সে মন্ত্র দিয়ে পুলিশের গুলিকে জল করে দেবে। লােকে তা বিশ্বাস করে আরও প্রাণ দিল।
পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের মধ্যে বিভ্রান্তি তখন চরমে। প্রতিপত্তিশালী নেতাদের এক অংশ ভাবছেন কংগ্রেস ও মুসলিম লীগ নেতৃত্বের মধ্যে ঐক্য গড়ে তােলাটাই মূল রাজনৈতিক কাজ। তাঁদের মতে গণ সংগ্রামগুলাের সামনে ঐ ঐক্য গড়ে তােলার কথাটাকেই রাখতে হবে। নেতৃত্বের যে অল্প কয়েকজন সংগ্রামে নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ভেবেছেন তারাও ভারতের মুক্তির সংগ্রামের দৃষ্টিভঙ্গিতে না ভেবে আলাদা আলাদা করে সংগ্রামগুলােতে যতদূর জনগণ যায় ততদূর’ নেতৃত্ব দেওয়ার কথা ভেবেছেন। তেভাগা সংগ্রাম নিয়ে শহরগুলােতে জনসভা হয়েছে, বাংলা, ইংরেজি পত্রিকায় সংগ্রামের ধারাবাহিক রিপাের্ট বেরিয়েছে। সংগ্রাম ও পুলিশি অত্যাচারের ফটো ছাপা হয়েছে। চৎকার গল্প, কবিতা নিয়ে আত্মপ্রকাশ করেছেন তরুণ সাহিত্যিকরা। কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে ‘অভ্যুত্থানের ভারত’ নামে সংগ্রামের ঘটনা, ব্রিটিশ চক্রান্ত, কংগ্রেস লীগের আপস পন্থা, সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার বীভৎসতা দিয়ে পুস্তিকা বের হয়েছে। শেষ সংগ্রামের আহ্বান’ নামে প্রবন্ধ বের হয়েছে কিন্তু কোথাও কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের ভূমিকার উল্লেখ থাকেনি। সংগ্রামগুলাের স্বতঃস্ফূর্ততার জয়গান থেকেছে সর্বত্র, কমিউনিস্টদের ঐ স্বতঃস্ফূর্ততার অংশীদার হিসেবেই উল্লেখ করা হয়েছে।
চারু মজুমদারসহ তেভাগার প্রত্যক্ষ নেতৃত্বের মাথায় পুলিশ প্রতিরােধের মাধ্যমে সশস্ত্র সংগ্রাম করার চিন্তা ছিল, কিন্তু সবটাতেই তারা নির্ভর করেছিলেন ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের উপর, যে নেতৃত্ব অস্ত্র পাঠানাের এবং সামরিক শিক্ষার ব্যবস্থার প্রতিশ্রুতি দিয়েও আবার তাদের ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের বিরাগভাজন হওয়ার ভয়ে প্রতিশ্রুতি পালনে চেষ্টা করেননি। বাংলার তকালীন মুসলিম লীগ মন্ত্রিসভার ভাগচাষ বিলের উপর ভরসা করে তেভাগা সংগ্রাম তুলে নেওয়ার সিদ্ধান্ত করেন প্রাদেশিক নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে কংগ্রেস-লীগের বুর্জোয়া নেতৃত্বের রাজনীতির কাছে আত্মসমর্পণ ছাড়া একে আর কিছু বলা যায় না। আবার প্রাদেশিক নেতৃত্বের সাথে মতান্তর হলাে উত্তর বাংলার জেলাগুলাের কৃষক নেতৃত্বের সাথে এবার তেভাগা সংগ্রাম তুলে নেওয়ার প্রশ্নে।
আশা ভঙ্গের এক বেদনা ছেয়ে ফেলেছিল জেলা স্তরের পার্টি কর্মীদের মন। চারু মজুমদার সমালােচনা করে ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের, নিজেদের মধ্যে কথা কাটাকাটি করে সংগ্রামে কী হতে পারত তাই নিয়ে। যুদ্ধোত্তর বিপ্লবী অভ্যুত্থানের তরঙ্গের রথ সারথিবিহীন হয়ে মাঝপথেই থেমে গেল। কানপুরের গায়ক-শ্রমিকের গানের ভাষায়“চৌরাহে পর পাংচার হাে গেয়ি আজাদী কি লরি” (চৌরাস্তার উপর পাংচার হয়ে গেল স্বাধীনতার ট্রাক গাড়িটি)। প্রাদেশিক কমিটি এক আত্মসমালােচনামূলক বক্তব্য দিয়ে নিচুতলার কর্মীদের ক্ষোভ প্রশমন করতে লেগেছিলেন। বঙ্গদেশে ঢাকা, নােয়াখালি, বােম্বে, এলাহাবাদ, মিরাট, বিহারের প্রায় সর্বত্র, পাঞ্জাবের প্রায় সর্বত্র হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গায় বিধ্বস্ত হয়ে যেতে লাগল। গান্ধী হিন্দু-মুসলমানকে ভাই ভাই হয়ে থাকতে বলতে লাগলেন, বল্লভভাই প্যাটেল জয়প্রকাশ নারায়ণকে চিঠিতে জানালেন ব্রিটিশের বিরুদ্ধে আমরা এখন আর সংগ্রাম করতে পারি না।’
‘৪৭-এর জুলাই পর্যন্ত নানা টানাটানি, মান-অভিমানের পর মে মাসের মধ্যেই কংগ্রেস, লীগ দেশ বিভাগ মেনে নিয়ে ব্রিটিশ কর্তৃক স্বাধীনতা হস্তান্তরের প্রস্তাব মেনে নিয়েছিল। কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে তখন বঙ্গদেশ, মাদ্রাজ (অন্ধ ও কেরালার অংশসহ) ত্রিবাঙ্কুর-এর কোচিন রাজ্যের এবং মহারাষ্ট্রের কেউ কেউ সংগ্রাম চালিয়ে যেতে চাইছিলেন উত্তর প্রদেশ, মহারাষ্ট্রের আর কেউ কেউ একদিকে কংগ্রেস নেতৃত্বের প্রগতিবাদী ভূমিকা এবং পার্টির ক্ষমতার স্বল্পতা নিয়ে বিশ্লেষণ করতে চাইছিলেন।
এই সময়কার বিভ্রান্তি সব কমিউনিস্টদেরই গ্রাস করেছিল- পূর্ববঙ্গের এবং কলকাতার, পাঞ্জাব, বিহার, ইউপির কমিউনিস্টরা হতাশ্বাসে এবং সভয়ে দেখছিলেন যে মুসলমান জনগণ যেমন হিন্দু কমিউনিস্টদের সহ্য করতে রাজি নয় আবার ঠিক তেমনই হিন্দুরা নামি মুসলমান কমিউনিস্টদেরও খাতির দেখাতে প্রস্তুত নয়; কলকাতার একজন বিশিষ্ট মুসলমান শ্রমিকনেতার পরিবারের সব লােকজনকে বিহারে নৃশংসভাবে হত্যা করল হিন্দু সাম্প্রদায়িকেরা, ঠিক তেমনই ঢাকা, ময়মনসিংহ, বরিশাল, কুমিল্লা, শ্রীহট্টে হিন্দু কমিউনিস্টরা বিতাড়িত হতে লাগল। লাহােরের দুর্ধর্ষ শ্রমিক আন্দোলন তছনছ হয়ে গেল।
চারু মজুমদার আরও অনেকের সাথে বিভ্রান্তির মধ্যেও পার্টির নীতি পরিবর্তনের গুজব শুনে একটু আশার আলাে দেখতে পাচ্ছিলেন— অথচ যারা নেতৃত্বের উপরের স্তরে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেছিলেন তাঁরাও সংগ্রামের লক্ষ্য এবং প্রস্তুতি সম্বন্ধে নির্দিষ্ট কোনাে বক্তব্য দেননি।
‘৪৭-এর ১৫ই আগস্টে সব বিতর্ককে ডুবিয়ে গিয়ে ডামাডােলের মধ্য দিয়ে ‘স্বাধীনতা’ উৎসবে সমস্ত মানুষ মুখর হয়ে পড়ল, কমিউনিস্টরাও এক রকম বাধ্য হলাে উৎসবের অংশ হয়ে যেতে। এমন আবহাওয়া হলাে যে একমাত্র কয়েক মাস আগে যে কংগ্রেস নেতৃত্ব সংগ্রামী জনগণের ঘৃণার পাত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল, রাতারাতি তারা স্বাধীনতার’ বাহক হিসেবে স্বীকৃত হয়ে গেল। সুচতুর কংগ্রেসিরা যে আন্দোলগুলাের বিরােধিতা করেছিল, সেগুলােরই জয়গান করে বলতে লাগল। “জনগণের এই সংগ্রামের জন্যই স্বাধীনতা আনতে পারলাম।”
দেশবিভাগ, পারস্পরিক গণহত্যা, চরম ধর্মান্ধতা ‘৪৬-৪৭ এর সংগ্রামের ঘটনাগুলােকে বিস্মৃতির আবরণে ঢেকে দিয়েছিল। চারু মুজমদারের প্রধান কর্মস্থল দেবীগঞ্জ, পঞ্চাগড় পূর্ব পাকিস্তানের ভাগে চলে গেল। অন্যান্য সংগ্রামী কৃষক অঞ্চলে মুসলমান কৃষকেরা চলে গেল ওদিকে, হিন্দুরা ওদিক থেকে চলে এলাে নতুন করে আবার সংগঠন করার সমস্যা দেখা দিল। অথচ পুরানাে দাবির পরিবর্তন হয়ে গিয়েছে ইতােমধ্যে, প্রত্যক্ষ সাম্রাজ্যবাদীবিরােধী সংগ্রাম যেমন নেই, তেভাগাকে আইসংগত করার প্রতিশ্রুতি যেমন বর্তমান সরকার দিয়েছিল, তেমনই দেশ বিভাগের জ্বালায় হতভম্ব কৃষক ও অন্যান্য মেহনতি মানুষের মনে এক নতুন আশা- ‘স্বাধীনতা যখন হলাে তখন কী কী পাওয়া যায় তার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। আশা, আকাঙ্ক্ষায় বাধা পেয়ে লাল ঝান্ডার নিরঙ্কুশ প্রভাবও সে সময়ে যথেষ্ট ক্ষুন্ন হয়েছে।
চারুদের সামনে তখন নতুন সংগঠনের খোঁজ। ‘৪৬ সালেই রেলের গ্যাঙম্যানরা চা-শ্রমিকদের সংগঠনের কথা বলেছে। রেশনের দাবিতে ঐ গ্যাঙম্যানরাই মালবাজারের কাছে দুই-তিনটি চা-বাগানে হরতাল করছিল। কিন্তু চা-শ্রমিকরা হরতাল কী বস্তু তা না বুঝে বাগান ছেড়ে সব জঙ্গলে আশ্রয় নিল। হঠাৎ একদিন দেখা গেল ছেড়া কাপড়, খাকি ছেড়া শার্ট সব লাঠির ডগায় ঝুলিয়ে কয়েকশ আদিবাসী, ‘দেনে হােগা’, ‘দেনে হােগা করে এসে জমা হচ্ছে মালবাজার রেল ইউনিয়ন অফিসের সামনে। সঙ্গে থাকা আদিবাসী, নেপালী গ্যাঙম্যানেরা বলল- “নাও কমরেড, চা-শ্রমিকদের এনে দিলাম; এখন যা করার করাে।”
চা-শ্রমিক সংগঠন সেই থেকে ছড়িয়ে পড়ছিল। রেলের, বিশেষত আসাম রেলের সংগঠনে দেশ বিভাগের সমস্যা যথেষ্ট ক্ষতি করল- বিডিআর-এর সংগঠনটি তখনও টিকে আছে।
চারু মজুমদারকে ব্যস্ত থাকতে হলে, চা-বাগান, তার সংলগ্ন আদিবাসী কৃষক এলাকা, পুরানাে এলাকার যেটুকু অবশিষ্ট ছিল তাই আর রেলের অংশ নিয়ে অন্যান্য কমরেডদের সাথে। নতুন কাজ একটি হলাে উদ্বাস্তু পুনর্বাসনের সংগ্রাম। এক করুণ দৃশ্যের অবতারণা হয়েছিল- পূর্ববঙ্গের সংগ্রামী জনগণ, কমিউনিস্ট পার্টির সভ্য, কৃষক আন্দোলনের নেতা, এক সারিতে হতাশ নয়নে তাকিয়ে আছে তাদের নতুন উদ্বাস্তু বা রিফিউজি পরিচয় নিয়ে আর ‘ভবিষ্যতে কোথায় যাবাে সেই ভাবনা নিয়ে।
পৃষ্ঠা: ৪৫
চারু মজুমদারের এতদিনকার ভাবনা চিন্তা একেবারেই এক চৌরস্তার মােড়ে এসে থমকে দাঁড়িয়ে যায়। মনের মধ্যে এক জ্বালা- “এ কী ধরনের স্বাধীনতা?” কিন্তু করণীয় কী তা পরিষ্কার নেই। ব্রিটিশ মালিকানার চা-বাগানগুলােতে সংগ্রাম গড়ে তােলার প্রস্তুতি চলে, ধানের তিন ভাগ করা নিয়ে কোনাে কোনাে জায়গায় জোতদার কৃষকের সংষর্ঘ হয় প্রধান রাজনৈতিক আওয়াজ দেওয়া হয় ‘চোরাকারবার বন্ধ কর। কৃষকের ভলান্টিয়ার বাহিনী করে চালের চোরাচালান ধরার চেষ্টা হয়। চারু মজুমদারদের চিন্তা এই পদ্ধতি দিয়ে জোতদার, মহাজনদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম একটা তােলা যায় কি না। কিন্তু ডা. বিধান রায় মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার পরই সরকার ভলান্টিয়ারদের বাধা দিয়ে বলে- ‘ওটা পুলিশের কাজ!’
৫
আলাের ঝলকানি
‘৪৭-এর ডিসেম্বর থেকেই ‘আটক আইন’ প্রভৃতি করে শিশু স্বাধীনতা নখ-দন্ত বের করে ফেলল। আটক আইনের বিরুদ্ধে সারা পশ্চিমবাংলা জুড়েই কমিউনিস্টরা প্রতিবাদ মিছিল সংগঠিত করল এই আওয়াজ দিয়ে- ‘যে দেশে কালা কানুন, সে দেশ স্বাধীন না।’
আওয়াজের মধ্য দিয়ে পার্টি নীতিতে পরিবর্তনের আভাস পেল সাধারণ কর্মীরা। ডান হাত মুঠ করে বাঁ হাতের তালুতে মেরে মুজমদার বলল “এবার একটা লড়ায়ের অবস্থা তৈরি হবে।” নতুন করে জোশ আসতে লাগল- জলপাইগুড়ি শহর খালি করে কর্মীদের পাঠানাে হলাে চা-বাগানে ও আদিবাসী কৃষক অঞ্চলে। জোতদারদের মধ্যে স্বাধীনতার প্রকৃত রূপ সম্বন্ধে বিভ্রান্তি এসেছে, তারা বুঝতে পারছে না পুলিশি মদত তারা আগের মতাে পাবে কি না। তাই কৃষকের পক্ষে তেভাগা করা এবং ধানের ভাগের দুই ভাগ নিয়ে নেওয়া অনেকটাই অনায়াস হচ্ছে।
চারু মজুমদার আবার সব জায়গায় বক্তার ভূমিকায়। রাত জেগে ক্যাডার্স মিটিং চলে। সাড়ে তিন হাজার শ্রমিকের কর্মস্থল লক্ষ্মীপাড়া চা-বাগানে ধর্মঘটের প্রস্তুতি চলছে।
পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বে চলছে প্রবল আলােড়ন। দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস ডাকার তােড়জোড় চলছে। এই স্বাধীনতা মিথ্যা’ (Sham-independence), “ভারতীয় বিপ্লবের পথ নির্দিষ্ট করে নতুন কর্মসূচি ও রণকৌশল নিতে হবে”, “পার্টির প্রকাশ্য সংগঠনকে গৌণ করে আত্মগােপনকারী বেআইনি সংগঠন গড়ে তুলতে হবে” প্রভৃতি বক্তব্যগুলাের পিছনে কেন্দ্রীয় কমিটির অধিকাংশ সদস্য মত প্রকাশ করতে লাগলেন- পশ্চিম বাংলা থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যরা এ রাজ্যের পার্টির সদস্যদের সভায় স্পষ্টভাবেই নিজেদের মত ব্যক্ত করে বলতে লাগলেন-“এতদিন পার্টি এক সংস্কারপন্থি লাইন নিয়ে চলেছে।” পার্টি কেন্দ্রে সমস্ত আক্রমণ পুঞ্জীভূত হতে লাগল পার্টির সাধারণ সম্পাদক পি সি যােশীর বিরুদ্ধে।
‘৪৮ সালের মার্চ মাসে কলকাতার দ্বিতীয় পার্টির কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলাে। নতুন কর্মসূচিতে কংগ্রেস নেতৃত্বকে ব্রিটিশের তাঁবেদার (comprador) বুর্জোয়া নেতৃত্ব হিসেবে চিহ্নিত করা হলাে, স্বাধীনতাকে বলা হলাে ‘ঝুটা’, জনগণের প্রতি বিশ্বাসঘাকতা; দেশবিভাগকে নাকচ করে বলা হলাে ভারত ও পাকিস্তানে এক সাথে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলে দুই দেশকে আবার এক করতে হবে- বিপ্লবের স্তরকে সমাজতান্ত্রিক বলে অভিহিত করা হলাে। রণনীতির ক্ষেত্রে প্রধান জোর দেওয়া হলাে শহরগুলােতে শ্রমিকশ্রেণির সশস্ত্র অভ্যুত্থানের (insurrection) উপর, গ্রামের কৃষকের সশস্ত্র ক্ষমতা দখলকে কৃষি বিপ্লবের কর্মসূচি না বলে শহর অভ্যুত্থানের পরিপূরক শক্তি বলা হলাে এবং শহরে ও গ্রামে একই সাথে (simultaneous) অভ্যুত্থান করার বিষয়ে জোর দেওয়া হলাে। মােহাম্মদ আলী পার্কে অনুষ্ঠিত কংগ্রেসের প্রতিনিধি অধিবেশনের প্রকাশ্য ও গােপন দুটি ধরনই রাখা হলাে, ফলে খবরের কাগজে বিস্তারিত কিছু প্রকাশ করা হলাে না। ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধি হিসেবে অস্ট্রেলিয়ার শ্রমিক নেতা সার্কে, যুগােস্লাভ কমিউনিস্ট লীগ নেতা ম্লাদিমির দেদিরার ও বার্মার কমিউনিস্ট নেতা থাকিন থানটুন উপস্থিত ছিলেন। প্রাদেশিক কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী জলপাইগুড়ির জেলা কমিটির পক্ষ থেকে চারু মজুমদারও এই পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধি ছিলেন। পার্টি কংগ্রেস থেকে নতুন সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হলেন, বি টি রণদিভে।
কংগ্রেসের অনুষ্ঠানের বেশ কিছু আগে থেকেই বড় বড় শহরগুলােতে পার্টির গােপন অফিসের জায়গা, পার্টির নেতাদের আস্তানা, পার্টির কাগজ ছাপার গােপন প্রেস প্রভৃতি নিয়ে এক পুরােদস্তুর আত্মগােপনকারী সংগঠন গড়ে তােলা হয়েছিল। পার্টি কংগ্রেসের প্রকাশ্য সমাপ্তি ঘােষণার আগের দিনই প্রতিনিধিরা যে যার এলাকায় রওনা হয়ে গিয়েছিলেন। পার্টি কংগ্রেস শেষ হতে না হতেই পশ্চিমবাংলার কমিউনিস্ট পার্টি বেআইনি ঘােষিত হলাে, জেলায় প্রচুর ধরপাকড় হলাে- সিকিউরিটি অ্যাক্ট ইন্ডিয়ান ক্রিমিন্যাল ল অ্যামেন্ডমেন্ট অ্যাক্ট ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হতে লাগল। ব্রিটিশের তৈরি গােয়েন্দা দপ্তরকে পুরােদমে চালু করা হলাে। মূল নেতৃত্বকে পুলিশ গ্রেপ্তার করতে পারল না। ধরপাকড় সত্ত্বেও বিপুল উদ্দীপনা পার্টি সদস্যদের মধ্যে। আট বছর ধরে প্রকাশ্য সংগঠনের অভ্যাস রাতারাতি ঝেড়ে ফেলে দিল সাধারণ সদস্যরা। বিশ্ববিদ্যালয়, কলেজ, মেডিকেল কলেজের অতি উজ্জ্বল ছাত্রছাত্রী লেগে পড়ল গণ সংগঠনে। একদল ছাত্রছাত্রী বিপ্লব করতে চলে গেল কাকদ্বীপ, বড়া-কমলাপুর, হাসনাবাদ প্রভৃতি অঞ্চলে।
জলপাইগুড়ির পার্টি অফিসে সাধারণ সভা ডাকা হয়েছে। চারু মুজমদার প্রমুখ পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা কংগ্রেসের রিপোের্ট দেবেন, আর চা-বাগানের ধর্মঘট নিয়ে আলােচনা হবে। এঁদের জানা নেই ইতােমধ্যে পার্টি বেআইনি হয়েছে। রাতের অন্ধাকারে পার্টি অফিস ঘিরে পুলিশ গ্রেপ্তার করল প্রায় পুরাে পার্টিকেই। একজন কেবল, চা-শ্রমিক নেতা দেবপ্রসাদ ঘােষ ওরফে পটল বাবু পালিয়ে বেঁচেছিলেন।
দমদম সেন্ট্রাল জেলে স্লোগান দেয়, বিক্ষোভ প্রদর্শন করে চারু মজুমদাররা। বিভিন্ন জায়গায় ‘অ্যাকশান’ করতে গিয়ে প্রায় রােজই গ্রেপ্তার হয়ে কেউ না কেউ আসে। ভারতের অন্যান্য রাজ্যের পার্টি বেআইনি ঘােষিত না হলেও সরকারি হামলায় সর্বত্রই পার্টি আত্মগােপন করেছে।
পার্টি বেআইনি হওয়ার তিন মাস পর প্রগতিশীল আইনজীবীদের প্রচেষ্টায় কলকাতা হাইকোর্ট সিকিউরিটি অ্যাক্ট অচল বলে ঘােষণা করল। চারু মজুমদার, যিনি এই আইনে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন সকলের সাথে, মুক্ত হলেন।
শিলিগুড়ির বাড়িতে অনেক দিন পর ফিরে এলেন চারু মজুমদার জেল থেকে বেরিয়ে।
জলপাইগুড়ি জেলার যােগাযোেগ প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল সকলে গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পর। বেরিয়ে এসে সেই যােগাযােগ পুনঃসংস্থাপন করা এক কঠিন কাজ। চারু মজুমদারের কাছে প্রাদেশিক কমিটি গােপনে বেরিয়ে আবার যােগাযােগ করার প্রস্তাব দিল। চারু ভাবতে লাগল কীভাবে আবার সব গুছিয়ে নেওয়া যাবে। গণসংগঠনের নেতা হিসেবে পার্টি সংগঠনকে চালানাের অভ্যাস না করার অসুবিধা এখন বেশ বােধ হতে লাগল। ‘একটু যােগাযােগ করেননি’, ‘যাচ্ছি, যাবাে’ করতে করতে সময় আর পাওয়া গেল না। বিনা বিচারে আটক অর্ডিন্যান্স করে পশ্চিমবাংলা সরকার মধ্য রাতের হামলায় আবার সবাইকে গ্রেপ্তার করল। চারু মজুমদার আবার দমদম জেলে বন্দি জীবনযাপন করতে চলে গেলেন।
‘৪৯ সালের ৯ই মার্চ দিন ধার্য করা হলাে পার্টি থেকে সারা ভারতে একই সাথে বিপ্লবী অভ্যুত্থান ঘটানাের। রেল, ইঞ্জিনিয়ারিং, চটকল, সুতাকল প্রভৃতি মূল শিল্পে ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলাে- পার্টির সভ্যদের আহ্বান জানানাে হলাে রাশিয়ার ‘পেট্রোগ্রাদ অভ্যুত্থান’-এর মতাে করে কেরােসিন তেল, ন্যাকড়া ও দেশলাই সঙ্গে নিয়ে সরকারি যানবাহন ও অফিসে আগুন লাগাতে বলা হলাে সব নিষেধাজ্ঞা অমান্য করতে। জেলের কমরেডদের বিদ্রোহ করতে ডাক দেওয়া হলাে। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৮ই মার্চ প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়ন কংগ্রেস, কিষান সভা, মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি ও ছাত্র ফেডারেশনে প্রভৃতি গণ সংগঠনকে বেআইনি ঘােষণা করল কর্মকর্তাদের যথাসম্ভব গ্রেপ্তার করা হলাে- স্থানে স্থানে ১৪৪ ধারা জারি করা হলাে। কলকাতায় ১৪৪ ধারা অমান্য করে মিছিল বের করলেন মহিলারা। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিলেন তিন জন মহিলা নেত্রী লতিকা, প্রভিতা ও গীতা। জেলে ‘লক আপ’-এর বিরােধিতা করা হলাে- বাইরে থেকে ঢুকে সশস্ত্র পুলিশ দমদম জেলে তিনজন ও প্রেসিডেন্সি জেলে চারজনকে খুন করল; দমদম জেলে শহিদদের দেহ আগলে রেখে তিনদিন ধরে সশস্ত্র পুলিশের মােকাবিলা করল কমিউনিস্টরা। গুলি চালানাের পর পরই ছাপ্পান্ন দিন ধরে অনশন ধর্মঘট চালিয়ে গেল বন্দিরা। পূর্ব-পাকিস্তানেও বিপ্লব সংঘটনের চেষ্টা হলাে। রাজশাহী, ঢাকা জেলে গুলিতে প্রাণ দিল হিন্দু-মুসলমান কমিউনিস্ট। ধর্মান্ধ মুসলিম ঠ্যাঙাড়ের দল প্রকাশ্য দিবালােকে খুন করতে লাগল আত্মগােপনকারী মুসলমান ও হিন্দু কমিউনিস্টদের।
অভ্যুত্থানের চেষ্টা প্রকৃতপক্ষে ব্যর্থ হলাে। রেল ও অন্যান্য শিল্পে ব্যাপক ধরপাকড় ও ছাঁটাই প্রচণ্ড ধাক্কা দিল লাল ঝান্ডা ইউনিয়নে।
জেলের অনশন ধর্মঘটে গণতান্ত্রিক আন্দোলনে ধৃত সকলের জন্য জেলে প্রথম শ্রেণির সুবিধা আদায় করে ধর্মঘটের অবসান হলাে।
ওদিকে শহরে অভুত্থানের প্রচেষ্টার উপর নৃশংস পুলিশ হামলায় আন্দোলন ঝিমিয়ে আসাতে লাগল। পার্টির মধ্যেও বিপ্লবী অভ্যুত্থান সঠিকভাবে পরিচালিত করতে না পারার জন্য ‘পেটিবুর্জোয়া’ মনােভাবকে দায়ী করা হলাে, এবং প্রাদেশিক কমিটি থেকে নিচুস্তরের সমস্ত কমিটি পর্যন্ত শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার জন্য শ্রমিকদের সম্পাদক করা হতে লাগল। কাকদ্বীপে গ্রাম-সােভিয়েত প্রতিষ্ঠা করে কৃষকের সশস্ত্র গেরিলা বাহিনী গঠন করা হচ্ছিল সুন্দরবনের জলপথে পুলিশ হামলা শুরু করল; ফলে কাকদ্বীপ ও অন্যান্য সশস্ত্র বিদ্রোহগুলাে দুমিত হয়ে গেল। ‘৪৯ সালের শেষ ভাগ থেকেই পার্টির ভিতরে বির্তক হতে আরম্ভ করল- পার্টির নেতৃস্থানীয় সদস্যের মধ্যেই ‘পার্টি লাইন উগ্র বামপন্থি’ বলে অভিযােগ হতে লাগল। পার্টির ঊর্ধ্বতন নেতৃত্ব এইসব সমালােচকদের কী জেলের মধ্যে, কী বাইরে ‘শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযােগে’ সাসপেন্ড ও বহিষ্কার করতে লাগল। জেলে প্রতিবাদীদের আলাদা করে দিয়ে জেল কর্তৃপক্ষকে ‘আমাদের লােক না বলে জানিয়ে দেওয়া হলাে— অনেকে নিজেরাই আলাদা হলাে- উৎকট সমালােচনায় মানসিক চাপে কেউ কেউ মুচলেকাও দিল। জেলের বাইরে নিচুতলার পার্টির সদস্যদের মধ্যে পরস্পরের প্রতি অভিযােগ করতেই থাকল— অনেক সুযােগসন্ধানী, নেতৃত্বের বিশ্বাসভাজন হওয়ার ভান করে পার্টির প্রচুর টাকা, ওষুধপত্র আত্মসাৎ করল। রাজনৈতিক বির্তক ও বিরােধের মীমাংসা অনেক সময়েই মারপিট, এমনকি খুনােখুনির পর্যায়েও চলে গিয়েছিল।
আবার একদিকে এতদিন রাজনৈতিক উদ্যোগ নিজেদের হাতে না রাখার পর এই সময়ে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণে কমিউনিস্টদের নানা গুণাবলি বিকাশের উৎসমুখ খুলে গিয়েছিল। মানুষের সংগ্রামের কথা, মুক্তির আকাঙ্ক্ষার কথা নিয়ে গল্প, কবিতা প্রচলিত রাবীন্দ্রিক ভাবধারাকে কাটিয়ে উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল। সংগীতে যেন এলাে এক নতুন প্রাণ। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এই প্রথম মার্কসবাদী বিশ্লেষণ করার চেষ্টা হলাে। ভারতের কমিউনি পার্টির পক্ষ থেকে এই প্রথম ভারতীয় সমাজ সম্বন্ধে মৌলিক বক্তব্য বলার চেষ্টা হলাে, বিপ্লবের স্তর, শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামী মৈত্রী, সশস্ত্র সংগ্রামের পদ্ধতি, চীনা বিপ্লব সম্বন্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি প্রকাশনার ভারতীয় ভাষায় অনুবাদ প্রকাশিত হলাে, যেমন- ‘নূতন গণতন্ত্র’, ‘জাপ বিরােধী যুদ্ধে গেরিলাযুদ্ধের নীতি ও কৌশল’, ‘যুক্তফ্রন্ট প্রসঙ্গে’ প্রভৃতি। এই প্রথম কৃষিতে ধনতন্ত্রের বিকাশ নিয়ে আলােচনামূলক বক্তব্য পার্টি থেকে উপস্থিত করা হলাে। সারা ভারত জুড়েই কমিউনিস্টদের সংগ্রামী চেতনা ও আত্মত্যাগের ভাবনার এমন বিকাশ হয়েছিল যে কমিউনিস্টরা যে এক বিশেষ ধরনের উপাদান’ তার প্রমাণ বারবার একই সময়ে পাওয়া গিয়েছে।
১৯৪৬ সালের শেষ ভাগ থেকে অন্ধের (তখন নিজামের রাজত্ব) তেলেঙ্গানা অঞ্চলে (নালগােন্ডা, ওয়ারেঙ্গেল, আদিলাবাদ, রয়ালসীমা জেলায়) কৃষক সংগ্রাম চলছিল। কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে এই সংগ্রাম নিজামের রাজাকার বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরােধ করতে প্রথম থেকেই সশস্ত্র সংগ্রাম চালাতে থাকে। ‘৪৮-৪৯ সালে রীতিমতাে গেরিলা যুদ্ধের রূপ নিয়ে নেয় তেলেঙ্গানার সংগ্রাম। ৩০ লক্ষ কৃষক অধ্যুষিত ৩০০০ গ্রামে ১৬০০০ বর্গমাইল এলাকা মুক্তাঞ্চলে পরিণত হয় এবং ১০০০০ গ্রাম্য স্কোয়াড এবং ২০০০-এর নিয়মিত গেরিলা স্কোয়াড সমন্বিত গণফৌজ তৈরি হয়। সংযুক্ত মাের্চা অন্ধমহাসভা গঠন করে এই সংগ্রাম পরিচালিত করতে থাকে। আবার গেরিলাযুদ্ধ পরিচালনার জন্য একটি সামরিক কমান্ডও গঠন করা হয়। যুদ্ধবিদ্যা শিক্ষা, রাইফেলের ব্যবহার, অস্ত্র সংগ্রহ ও গেরিলাযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার যাবতীয় দায়িত্ব থাকে এই সামরিক কমান্ডের উপর। এখানেও কমিউনিস্টদের যােগ্যতা প্রমাণ করে অন্ধের কমিউনিস্টরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে ভারতের কমিউনিস্টরাও সশস্ত্র সংগ্রামে কারও চেয়ে কম নয়। অন্ধ্রের কমিউনিস্টরা ভারতীয় বিপ্লবে সশস্ত্র সংগ্রামের ভূমিকাকে গুরুত্ব দিয়ে ‘অন্ধ দলিল’ নামে রাজনৈতিক বক্তব্য উপস্থিত করে ভারতীয় বিপ্লবের স্তর জনগণতান্ত্রিক’ এবং চীনের বিপ্লবের পথই ভারতীয় বিপ্লবকে গ্রহণ করতে হবে বলে মন্তব্য করেন। এটি পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটিতে মতানৈক্যের সৃষ্টি করে। কেন্দ্রে বিশেষ করে সাধারণ সম্পাদক বি. টি, রণদিভে ভারতীয় বিপ্লবের স্তরকে সমাজতান্ত্রিক বলেছিলেন এবং চীনা বিপ্লবের পথে বিরােধিতা করতে গিয়ে তিনি মাও সে তুঙকে ‘সংস্কারবাদী’ ‘অমার্কসীয়’ আখ্যা দিয়ে বসলেন।
পৃষ্ঠা: ৫০
পার্টির ‘বিপ্লবী লাইন’ দ্বিধাহীনভাবে গ্রহণ করতে চারু মুজমদারের প্রথম থেকেই কোনাে অসুবিধা হয়নি। জেলের সংগ্রামের ক্ষেত্রে অনেক পরে অনেকে অভিযােগ করেছেন যে, জেলে সরকারি আক্রমণের সময়ে চারু সবার আগে এমন সব বক্তৃতা করত বা রীতিমতাে উসকানিমূলক। পার্টির লাইনকে ‘উগ্রপন্থা হিসেবে চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে চারুর পূর্ণ সমর্থন ছিল না কিন্তু লাইনের পক্ষে দাঁড়ানাের ব্যাপারেও একটু ইতস্তত ছিল- দমদম জেলে পার্টির প্রাদেশিক নেতৃত্বের অনেকেই থাকায় (মুজফফর আহমেদ, রণেন সেন, নৃপেন চক্রবর্তী, ইন্দ্রজিত গুপ্ত প্রমুখ) চারুর মতাে জেলা নেতৃত্বের লােকদের পক্ষে মতামত ব্যক্ত করার সুযােগও কম ছিল। ‘৫০ সালের মাঝামাঝি থেকেই অন্ধ দলিল নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়ে গেলে জেলে যারা চাইছিলেন যে বিপ্লবী সংগ্রাম চলুক চারু তাদের অন্যতম। স্বভাবতই রণদিভের লাইনের সাথে এঁদের প্রভেদ হলাে। ‘কাকের বাসার মতাে’ অনিয়ন্ত্রিত এক মাথা চুল নিয়ে কী বিতর্কে, কী তাস খেলায় চারু সবার প্রিয়, আবার মাঝে মাঝে গা জ্বালানাে কথায় সমালােচনার পাত্র। চীনা বিপ্লব সম্পূর্ন হওয়ার কথা সকলের কাছেই এক অভূতপূর্ব ব্যাপার, মাও সে-তুঙ এই সর্বপ্রথম প্রকাশ্যভাবে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের স্বীকৃতি পেলেন কমিনফর্মের মুখপত্র ‘ফর অ্যা লাস্টিং পিস, ফর পিপলস্ ডেমােক্রেসি’তে প্রতিকৃতিসহ তাঁর প্রবন্ধ ‘ডেমােক্রেটিক ডিক্টেটরশিপ অভ ওয়ার্কিং ক্লাস অ্যান্ড পেজেন্ট্রি’ প্রকাশে। মাও সে তুঙ-এর চেলা বলে যারা যারা আখ্যাত হতে লাগলাে তার মধ্যে চারুর একটি প্রধান স্থান। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কিছু কিছু দলিল জেলেও আসছে। সেসব নিয়ে ইউরােপে কমিউনিস্টদের ‘পার্টিজান যুদ্ধ’ ও চীনের ‘গেরিলা যুদ্ধের’ মিল ও গরমিল নিয়ে তুমুল তর্ক চলে জেলে যুবকদের মধ্যে। দীর্ঘ অনশন ধর্মঘটে আরও দুর্বল চারু মজুমদারের বড় চোখ দুটো যেন আরও বড় হয়ে ওঠে, কমিউনিস্ট ও শ্রমিক নিয়ে গঠিত ফ্রান্স ও ইতালির পার্টিজান বাহিনী ও চীনের কৃষকদের নিয়ে গঠিত গেরিলা যােদ্ধার সমস্যা বােঝাতে। এক মুদ্রাদোষ তার তখন সব কথায় ‘মরগে যাঃ’ বলা। এটা আবার যুবকদের মধ্যে একটা স্টাইল হয়ে গেল। নিজেদের মধ্যে তর্কের সময়ও তারা ‘চারুদা এই বলল’, ‘চারুদা ওরকম মােটেই স্বীকার করে না’ প্রভৃতি মন্তব্য করে চারু মুজমদারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করতে থাকল।
জেলের বাইরে পার্টির সর্বস্তরে ‘৫০ সালের মাঝামাঝি থেকে বিতর্ক গালাগালি ও ছাপ মেরে দেওয়ার পর্যায়ে পৌছে গেল। পার্টির রাজনৈতিক বক্তব্য ট্রটস্কিবাদী এবং টিটোবাদী লাইন বলে প্রকাশ্যেই মন্তব্য করা হতে লাগল- পার্টি ছেড়ে দেওয়ার বেশ একটা প্রবল ঝোঁক দেখা গেল। প্রাদেশিক নেতারা একে একে গ্রেপ্তার হতে থাকলে জেলে তাঁদের প্রবল বিক্ষোভের সামনে পড়তে হলাে। কাকদ্বীপে নৌকা পাঠাননি কেন?’ থেকে শুরু করে ওমুককে কেন শ্রেণিশত্রু বলে তার দাদাকে খুন করতে বলেছিলেন?’ প্রভৃতি সমালােচনার বিষয় হয়ে দাঁড়াল। কমিউনিস্ট আন্দোলনের এক অতি গৌরবময় অধ্যায় বিরাট ঘা খেতে লাগল অপরিণত হঠকারী রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের জন্য। পার্টির নেতাদের অনেকেই আত্মসমালােচনার নামে একেবারে সংগ্রামকেই পরিহাস করার বক্তব্য রাখতে লাগলেন। যুবাগগাষ্ঠীর মধ্যে একে ঠাট্টা করে বলা হতে লাগল একেবারে স্টেগান থেকে ভূদান।
তেলেঙ্গানার সংগ্রামের সামনে নতুন সমস্যা এসে পড়ল। নিজামকে পর্যুদস্ত করার নামে ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে তেলেঙ্গানায় নিয়ােজিত করা হলাে। কমিউনিস্টদের সংগ্রামের ধাক্কায় নিজাম যথেষ্ট পর্যদস্ত হয়ে পড়েছিল। সুতরাং ভারতীয় বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করতে তার আর কী অসুবিধা? তার অধিকার ও সম্পত্তি অনেকাংশে বজায় রেখে ভারতীয় বাহিনী নিজামের স্বার্থ রক্ষায় কমিউনিস্ট দমনে ব্রতী হলাে। তেলেঙ্গানার সংগ্রামে ভারতীয় বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া বস্তুগত দিক দিয়েও যেমন কঠিন হয়ে পড়েছিল আবার তেলেঙ্গানার নেতৃত্বের মধ্যে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া এবং ‘ভারতীয় বাহিনী যখন সেই নিজামকেই দমন করল তখন আর আমাদের লড়াই চালানাের কী দরকার? এ প্রশ্ন নিয়ে মতভেদ গুরুতর হয়ে পড়ল এবং সাধারণ কর্মীদের প্রভাবিত করল। শেষ পর্যন্ত ‘৫১ সালে ভারত সরকারের কাছে কমিউনিস্টরা সশস্ত্র শক্তির আত্মসমর্পণের ভিত্তিতে তেলেঙ্গানার সংগ্রাম তুলে নিল।
তেলেঙ্গানার সংগ্রামের ভিত্তিতে যে রাজনৈতিক বক্তব্য এসেছিল তা নিয়ে পার্টিতে ব্যাপক আলােচনা ও বিতর্ক হলেও তেলেঙ্গানার সংগ্রামকে সারা ভারতে জনপ্রিয় করার, অন্যান্য এলাকায় কৃষকের সশস্ত্র বিদ্রোহ গড়ে তােলার এবং পার্টির মধ্যে তেলেঙ্গানা সংগ্রামের খুঁটিনাটি বিষয় প্রচার করার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটি প্রকৃতপক্ষে কোনাে প্রচার আন্দোলনের ব্যবস্থাই করেননি। পার্টির গােপন পত্র-পত্রিকায় ‘তেলেঙ্গানা এগিয়ে চলছে’ বলে কিছু উদ্দীপক সংবাদ প্রকাশিত হওয়া ছাড়া আর কিছু হয়নি। স্বভাবতই তেলেঙ্গানার সংগ্রাম তুলে নেওয়ার সেই সময়ে অন্তত পার্টির মধ্যে কোনাে উচ্চবাচ্য প্রকৃতপক্ষে হয়নি। এরপর বহুদিন পর্যন্ত চারু মজুমদারেরও এ সম্বন্ধে প্রতিক্রিয়া জানা যায়নি।
‘৫১ সালে ব্রিটিশ আমলের বক্সা অন্তরীণ শিবিরের আবার উদ্বোধন হয় এবং প্রথমে যে দলটিকে ‘উগ্রপন্থি’ বলে বাছাই করে সেখানে পাঠানাে হয় তার মধ্যে চারু মজুমদারও একজন। জলপাইগুড়ি জেলার ডুয়ার্স অঞ্চলে ভুটানের পাদদেশে জঙ্গলে ঘেরা এই অন্তরীণ শিবিরে এসে বেশ রােমাঞ্চ লাগল চারু মজুমদারের। দেওয়ালের বাঁধা নেই, কাঁটাতারে ঘেরা, সশস্ত্র সান্ত্রীদের অতন্দ্র পাহারা ভেদ করে সবুজ পাহাড় দেখা যায়, রাতে জঙ্গলের ঝিঝির ডাক এবং ফেউ বা পাহাড়ি ভালুকের খাও খাও শব্দ গতানুগতিক জেল জীবনের চেয়ে যেন স্বতন্ত্র। এখানে অনেকেই যখন একটু ঠাট্টাচ্ছলে ‘বিপ্লব করতে গিয়ে কী ছেলেমানুষি হলাে?’ –বলতে থাকে তখন চারু গম্ভীর হয়ে যায়, ‘ভুল হলেও বিপ্লবের চেষ্টাতে অন্যায় কী আছে? ভুল থেকে শিখে আবার মাথা তুলে দাঁড়ানাে যাবে না? পারুক না পারুক রান্নায় পরামর্শ দেওয়া, কাজের ফালতুদের সাথে ভাব জমানাে- কমরেডদের ভুল হিন্দি শুধরে দেওয়া (যেমন- কাঠ অর্থাৎ লকড়ি আনার কথা বলতে গিয়ে একজন ‘লেড়কি লে আও’ বলেছিলেন) তাস খেলায় চেঁচামেচি, ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাবার চাল দিয়ে চিন্তার সাথে সাথে রাজনীতির তর্ক দিয়ে বক্সা শিবির মাতিয়ে রাখে চারু মজুমদার।
‘৪০ সালের শেষ ভাগেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের তিনজন পি, সুরাইয়া; এস, এ, ডাঙ্গে ও সি, রাজেশ্বর রাও সােভিয়েতে চলে যান গােপনে। সােভিয়েত থেকে ফিরে ‘৫১ সালে তারা “থ্রি পি ডকুমেন্ট’ (তাদের তিনজনেরই গােপন নামের আদ্যক্ষর ছিল প) নামে এক দলিল প্রকাশ করেন পার্টির মধ্যে আলােচনার জন্য। এটিই ছিল ৫১ সালের পার্টি কর্মসূচির ভিত্তি।
বন্দিমুক্তি আন্দোলন তখন পশ্চিম বাংলায় শক্তিশালী রূপ নিয়েছে। পার্টির নীতির পরিবর্তনের আভাস পেয়ে কংগ্রেস সরকার বন্দিদের মুক্তি দিতে আরম্ভ করেছে কিছু কিছু করে। তৃতীয় পার্টি কংগ্রেসের প্রয়ােজনীয়তার কথা ঘােষণা করে ‘৫১ সালে খসড়া কর্মসূচি বের করা হয়েছে। পশ্চিম বাংলার বাইরে ও বম্বে কেন্দ্রীয় দপ্তরে অনেকখানি আইনি অবস্থা ফিরে এসেছে।
নতুন খসড়া কর্মসূচিতে দ্বিতীয় পার্টি কংগ্রেস গৃহীত কর্মসূচিকে ‘উগ্রবামপন্থি ও ‘সংকীর্ণতাবাদী’ বলা হলাে এবং ভারতে ‘৪৭-এর ১৫ই আগস্টের পর কোনাে পরিবর্তনই হয়নি’ এই বক্তব্যকে, ভারতীয় বিপ্লবের স্তরকে ‘সমাজতান্ত্রিক’ বলা এবং ‘শহর অভ্যুত্থানকে বিপ্লবের প্রধান পথ ও পাশাপাশি গ্রামাঞ্চলে অভ্যুথান সংগঠিত করার’ ধ্যানধারণাকে হঠকারী আখ্যা দেওয়া হলাে। পরিবর্তে বলা হলাে- যে ‘৪৭ সালের পর ভারতে প্রত্যক্ষ ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের অবসান হলেও, ভারত প্রকৃতপক্ষে পরাধীন এবং আধা-ঔপনিবেশিক (dependent and semi-colonial)। ভারতের সরকার সম্বন্ধে বলা হয় যে, এটি বুর্জোয়া-জমিদারদের সরকার যা ব্রিটিশ ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের কাছে নতি স্বীকার করে এবং বিশ্বে পুঁজিবাদী ও সমাজতান্ত্রিক শিবিরের মধ্যে ছলচাতুরী করে চলে। এই খসড়ায় ভারতীয় বিপ্লবের স্তরকে জনগণতান্ত্রিক বলা হয় এবং কৃষি বিপ্লবকেই বিপ্লবের অক্ষশক্তি হিসেবে অভিহিত করা হয়। বলা হয় যেহেতু প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণি কখনই সমাজ বিপ্লবকে শান্তিপূর্ণভাবে ঘটতে দেবে না এবং সশস্ত্র ক্ষমতা দিয়ে দমন করবে, তাই বিপ্লবী শক্তিরও অস্ত্র ধরার প্রয়ােজন হবে যা সংগ্রামী জনগণের প্রয়ােজন অনুযায়ীই ঘটবে।
দ্বিতীয় কংগ্রেসের কর্মসূচির বক্তব্য মাথায় নিয়ে অনেকেরই এই কর্মসূচিকে ‘ব্রিটিশ গােয়েন্দা বিভাগের দলিল’ বলে অভিহিত করল (An Anderson Document)। আবার দলিলের সমর্থকরা স্তালিন এবং এর খসড়া প্রস্তুত করেছেন বলে বলতে লাগল। সমস্ত সন্দেহ ও প্রচারের নিরসন করে কমিনফর্মের মুখপত্রে এই কর্মসূচি সংক্রান্ত দলিল ছেপে সম্পাদকীয় মন্তব্য করা হলাে যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি সদস্যদের মতামতের জন্য এই দলিল প্রচার করেছে। পার্টির মধ্যে একটা আলােচনার মনােভাব এনে দিল এই প্রকাশন।
‘৫১ সালের শেষ ভাগ থেকেই সর্বজনীন ভােটাধিকারের ভিত্তিতে প্রথম লােকসভার গঠন কমিউনিস্টদের অনেক জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটাল; তাদের পায়ের নিচের মাটি অনেকটাই যেন সরে গেল। ‘৫২ সালের প্রথম লােকসভা নির্বাচনে সারা ভারতের শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনের কেন্দ্রগুলাে থেকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির প্রার্থীরা বিপুল ভােটে নির্বাচিত হলেন। তেলেঙ্গানা এলাকা থেকে রবিনারায়ণ রেড্ডির ৭৮% ভােটে, (জওহরলাল নেহরু ঐ নির্বাচনে এলাহাবাদ কেন্দ্রে পেয়েছিলেন ৬৮% ভােট) এবং কাকদ্বীপ কেন্দ্রে কংসারী হালদারেরও প্রায় ৭০% ভােটে জয়লাভ এই সংগ্রামগুলাের বিশ্লেষণের কাজটিকে প্রায় মুলতুবি করে দিয়েছিল। ঐ লােকসভায় পার্টি বৃহৎ বিরােধী গ্রুপ হিসেবে স্বীকৃত হলাে এবং কেরালা থেকে আসাম পর্যন্ত ছােট ছােট এলাকায় শ্রমিক-কৃষকের মধ্যে কাজ করা কমিউনিস্টদের সামনে দিল্লির দরবার’ অভিজাত মহলের যেন এক পিচ্ছিল পথের দ্বার খুলে দিল।
‘৫১ সালেই আধা বেআইনি অবস্থার মধ্যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত দ্বিতীয় কংগ্রেসে নির্বাচিত কমিটিগুলােকে ভেঙে দেওয়া হলাে এবং তৃতীয় কংগ্রেসের প্রস্তুতিকে সমানে রেখে নতুন খসড়া কর্মসূচির ভিত্তিতে সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হলাে। কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির সম্পাদক করা হলাে সি. রাজেশ্বর রাওকে। পুরানাে সম্পাদক বি.টি. রণদীভেকে পার্টি কংগ্রেসের অনুমােদন সাপেক্ষে দুই বৎসরের সভ্যপদ থেকে সাসপেন্ড করা হলাে। কেন্দ্র ও রাজ্য স্তরের অনেকেই, যাঁরা দ্বিতীয় কংগ্রেসের লাইনের কট্টর সমর্থক ছিলেন, এখন ঐ লাইনের কঠোর সমালােচক হয়ে পড়ে সভ্যপদ রক্ষা করলেন।
বক্সা দুয়ারের বন্দি শিবিরে স্থায়ী বসবাসের ব্যবস্থা-বন্দোবস্ত শুরু হতে না হতেই চারু মজুমদারদের আবার ফেরত পাঠানাে হলাে কলকাতার জেলগুলােতে। সারা ভারতে সাধারন নির্বাচনের প্রাক্কালে পার্টিকে খােলাখুলি কাজ করতে দিলেও নির্বাচন। শেষ না হওয়া পর্যন্ত পশ্চিম বাংলায় আনুষ্ঠানিকভাবে পার্টির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তােলা হলাে না। কংসারী হালদার আত্মগােপন অবস্থায় নির্বাচিত হলেন এবং সরকারের চোখে ধুলাে দিয়ে লােকসভার ভিতরে ঢুকে সই করে সকলের অলক্ষ্যে বেরিয়ে এসেছিলেন। চারু মজুমদারের চিন্তা-ভাবনায় বেশ ছেদ পড়ে যায় নির্বাচন, তার বিজয় সমারােহ, পার্টির মধ্যে ‘৫১ সালের কর্মসূচিকে যারা ‘বামে ঘেষা’ বলছিল তাদের নেহরু প্রশস্তির প্রভাব, শ্রেণিসংগ্রামের কথাবার্তার জায়গায় দায়িত্বশীল বিরােধিতা’ প্রভৃতিতে। ইতােমধ্যে জলপাইগুড়ির জেলা নেতৃত্বের বিশেষ কয়েকজন ‘পার্টি’ একেবারেই ছেড়ে দেওয়া বা আংশিক সময়ের জন্য পার্টি করা, এভাবে ভাবতে লেগেছিলেন। ছাত্র, যুবকদের মধ্যে পড়াশুনাটা শেষ করি, তারপর আবার উপার্জনের কথাও তাে ভাবতে হবে’ প্রভৃতি শুরু হয়ে গিয়েছিল। চারু মজুমদারের পুরানাে এলাকা কৃষক ও রেল তাে আগেই চলে গিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে। নতুনভাবে জেলায় কাজের কর্মী জেলে অন্তত দেখা যাচ্ছে না।
‘৫২ সালের মার্চে জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার পর জলপাইগুড়িতে চারু মজুমদারকে পার্টির জেলা কমিটির সম্পাদক করে কমিটির পুনর্গঠন হলাে।
কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লাগে। দুরন্ত ঝড়ের পরে ভাঙাচোরা ঘরবাড়ির মতাে লাগে সবকিছু- গত পাঁচ-ছয়টি বছর আশা, স্বপ্নের যে সৌধ ক্রমে ক্রমে গড়ে উঠেছিল— তরঙ্গের রথে চড়ে যে সৌধের দিকে ধেয়ে যেতে মনে হয়েছিল পথের শেষ বােধ হয় হয়ে আসছে!—মুক্তি, স্বাধীনতা, সমাজতন্ত্রের যে বাস্তব সম্ভাবনায় চোখে-মুখে আগুনের আভা ফুটত তা হঠাৎ আলাের ঝলকানির মতােই আজ মনে হতে লাগল চারু মজুমদারের। ঘর, বাড়ি, নিজের একটি ছােট্ট পরিবার!-বন্ধু, কমরেড ছাড়াও অতি আপনজন, নিজের স্ত্রী,—আজ ভাবনার মধ্যে উঁকি দিতে লাগল এই চারুর, একেবারে ছােটবেলা থেকেই যার এইসব ভাবনা উড়ে গিয়েছিল এক বর্ষার রাতে যে সম্পর্কের সেতু জ্বালিয়ে দিয়ে চলে যেতে চেয়েছিল জনসমুদ্রের ঢেউ-এ মিলেমিশে যাওয়ার জন্য।
পার্টি করার প্রথম জীবনে পঞ্চগড়ের যে সহৃদয় ডাক্তারবাবুর চারু, মাধবদের মতাে ঘরছাড়া কমিউনিস্টদের আশ্রয় দিতেন, সময়ে অসময়ে খাবার যােগাতেন তাঁরই কন্যা লীলা সেনগুপ্তা দেশভাগের পর জলপাইগুড়ি শহরে শিক্ষকতা করে ভাইবােনদের মানুষ করেছিলেন একেবারে পার্টি অফিসের গায়ে লাগা একটি ঘর ভাড়া নিয়ে। শ্যামবর্ণা বলিষ্ঠদেহিনী লীলার ঘরে কমরেডদের অবারিত দ্বার পার্টি অফিসে মিটিং আড্ডার মধ্যে এসে চায়ের ফরমায়েশ, বাইরের কর্মীরা এলে ভাত রাধার হুকুম সব লীলার কাছে। ‘৪৯ সালে মহিলা আত্মরক্ষা সমিতি বেআইনি হয়ে যাওয়ার পর জেলে যেতে হলাে লীলাকে।
ঐ ‘৫২ সালেই চারু মজুমদারের সাথে বিয়ে হলাে লীলা সেনগুপ্তার। দুজন দুজনকে বহুদিন থেকেই চেনে, কিন্তু কিছুদিন আগেও দুজনের কেউ ভাবেননি যে তাদের বিয়ে হবে। দুজনেরই যেন হঠাৎ সিদ্ধান্ত।
পৃষ্ঠা: ৫৫
৬
নিজেকে খুঁজে ফেরা
অনেক কাল পরে শিলিগুড়ির বাড়িতে ফিরে এসে মাথার উপর হাত তুলে আড়মােড়া ভেঙে স্ত্রীকে বলে চারু– “বসবাস যখন করতেই হবে তখন একটু গােছগাছ করতে। হয়, না কি বলাে?” লীলা বলে- “তােমার তা ভাবতে হবে না, আর তােমার দ্বারা হবেও না। সেসব ব্যবস্থা করা যাবে।” দুদিনেই ফিরে এলাে ঘরের শ্রী। সেই কোন মান্ধাতার আমলের চন্দ্রকান্ত রায়ের তৈরি টিনের-ছাদওলা-কাঠের-দেওয়ালের-রংঝং না-করা একতলা বাড়ি। বাইরে থেকে মনে হয় এখুনই উলটে পড়বে কিন্তু গােছানি মেয়ে লীলার করস্পর্শে ভিতরটা হয়ে উঠল মনােরম। পিতা বীরেশ্বরের আনন্দ ধরে না। পাড়ার লােক ডেকে ডেকে বলেন— “চারু তাে বিয়ে করেছে হে, কী লক্ষ্মী আমার বউমা!” শত বলা সত্ত্বেও বউমাকে তিনি ‘আপনি’ বলেন। “ঘরের শ্রী তাে বেশ ফিরিয়ে এনেছেন বউমা আপনি!” শাশুরি, হারু পিসিমা, কেমন করে গােছাতেন, আর কী কী করতেন সব ইনিয়ে-বিনিয়ে বলেন পুত্রবধূকে লীলা সব মন দিয়ে শােনে আর শ্বশুরের মনে আনন্দ দেওয়ার জন্য পুরানাে দিনটাকে যথাসাধ্য ফিরিয়ে আনতে চায়। শাশুরির আমলের মরচে পড়া শােয়ানাে লােহার সিন্দুকটা ঝেড়েমুছে চোখে পড়ার মতাে করে রাখে। এতকাল এক বিহারি পাচকের আধসিদ্ধ আলুর ঝােল আর ভাত খেয়ে এখন বীরেশ্বর বউমার রান্না চেয়ে চেয়ে খান। বরিশালের মেয়ে লীলার এমনিতেই রান্নার হাত চমৎকার! খেয়ে হাত চাটতে চাটতে অনুনয়ের সুরে বীরেশ্বর একদিন বলেছিলেন- “বউমা, আপনাদের ঘরের ঐ কালীর ছবিটা আপনার শাশুরির বড় প্রিয় জিনিস। ওটা ওখানেই থাকতে দেবেন, চারুকে বলে।” চারু তাে মহা খাপ্পা- “না না, ওসব পূজাআচ্চা নেহি চলেগা।” লীলা ধমকের সুরেই বলে- “পূজা-আচ্চা কেউ করছে না। মায়ের তাে কোনাে চিহ্নই নেই। ওটা বাবাকে একটু শান্তি দেবে। থাক না!” ঐ ছবিটা দিয়ে নকশাল আন্দোলনের সময়ে কত গবেষণা হয়েছে কাগজপত্রে। এমন কথাও লেখা হয়েছে যে, “আসলে চারু মজুমদাররা কালীসাধক। বীরেশ্বর মেয়ে বেলাকে নিয়ে থাকতে লাগলেন বাইরেরর ঘরে। “বাড়ির গিন্নি এসে গেছেন এখন আর কী?” বলে টোটো করে ঘুরে বেড়ান চারদিকে। ‘৪৭-এর পর থেকে বীরেশ্বর কংগ্রেসে আর সক্রিয় রইলাে না এবং ‘৫২ সালে এসে একেবারে ছেড়েই দিয়েছিলেন।
বিয়ের পরই শিলিগুড়ি এসে চারু মজুমদার প্রাদেশিক কমিটির কাছে তাঁর সভ্যপদ দার্জিলিং জেলায় বদলি করার আবেদন করেছিলেন। দার্জিলিং জেলার পার্টি নেতা ও সভ্যরা ভীষণ খুশি চারুকে পেয়ে। চারু মজুমদার স্পষ্টই বলে দিলেন- “আমার সাধ্যমতাে কাজ আমি করব, কিন্তু সর্বক্ষণে কর্মী থাকা আর আমার পক্ষে সম্ভব না।” এতকাল হলে টাইমারি করে একটা চিন্তা তাঁর ছিল যে, পারিবারিক জীবন ও পার্টির কাজে সমন্বয় করি কীভাবে? কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল কাজ যখন এসে পড়ল, তখন মাঝে মাঝে গ্রামাঞ্চলে গিয়ে থাকতেও বাধা হলাে না।
পারিবারিক চিন্তা কোনােদিন করতে হবে এই মানসিকতাই যার ছিল না তিনি প্রথমে বেশ ফাঁপরে পড়লেন সংসারের আয়-ব্যয়ের সামঞ্জস্য করতে। খাতা-কলমে, দলিল ও খতিয়ানে যেসব জমি মায়ের অবর্তমানে বর্তেছে চারুর নামে তার বেশিরভাগই বেনামায় বিক্রি হয়ে গিয়েছে, বিশেষত শহরের জমির উপর দিয়ে রেল লাইন পাতার সময়ে চারু মজুমদারেরই জমি অন্য দুই ব্যক্তি রেলকে দিয়ে লক্ষাধিক টাকা ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। নকশাল আন্দোলনের সময়ে দেশ পত্রিকায় ইনিয়ে-বিনিয়ে খতিয়ান নম্বর দিয়ে এক লব্ধপ্রতিষ্ঠ সাংবাদিক (?) চারু মজুমদার যে কত জমির মালিক তা লিখেছিলেন। তাঁর কাল্পনিক দুই বােনের নামে জমি বেনামার কথা বলেছিলেন। চারু মজুমদারের প্রত্যক্ষভাগে যে জমি ছিল, তা ঐ ‘৫৩ সাল থেকেই খাওয়ার সংস্থান করতে জলের দামে বিক্রি করতে হলাে।
সাংসারিক সমস্যার মধ্যেও পার্টির কাজে বেশ গভীরভাবেই আত্মনিয়ােগ করে ফেললেন চারু মজুমদার। শিলিগুড়িতেও জেল, পুলিশ আক্রমণের ফলে পার্টির পুরানাে নেতৃস্থানীয় কর্মীদের কয়েকজন বসে গেলেন বা অর্থোপার্জনের আশায় অন্যত্র চলে গেলেন। চারুকে পেয়ে কর্মীরা ভরসাও পেল এবং অল্পদিনেই খুব নির্ভরশীল হয়ে পড়ল। এখানে গণসংগঠন বলতে তখন সবে কৃষক অঞ্চলে যােগাযােগ হতে শুরু করেছে শহরের কয়েকশ কাঠকল শ্রমিক ও ছােট ইঞ্জিনিয়ারিং কারখানায় কিছু কিছু সংগঠন আছে। বলতে গেলে পার্টি থেকে গণসংগঠন সবকিছুই নতুন করে তৈরির প্রশ্ন রয়েছে। সব ক্ষেত্রেই চারু মজুমদার সমান সহায়ক— আবার ওখানকারই সন্তান বলে ক্লাব প্রতিষ্ঠানের যথেষ্ট সমাদরে অভ্যর্থিত হলেন। পার্টির সংগঠনকে গুছিয়ে নেওয়ার জন্য প্রাদেশিক কমিটি থেকে সভ্যপদ পুনঃনবীকরণের এক ‘ফর্ম দেওয়া হলাে। তাতে প্রতিটি সভ্যের পুরাে ইতিহাস দিতে হবে এবং তার ঊর্ধ্বতন পার্টি সংগঠন সম্বন্ধে মন্তব্যও করতে হবে। চারু মজুমদার এই ফর্মে জেলার প্রধান সংগঠনকে আমলাতান্ত্রিক আখ্যা দিয়ে জেলা কমিটির কার্যকলাপের তীব্র সমালােচনামূলক মন্তব্য করলেন। এতে জেলা কমিটি চারুকে সাসপেন্ড করল পার্টির সভ্যপদ থেকে। শিলিগুড়ির কমরেডরা প্রায় ক্ষেপে গেল জেলা কমিটির এই পদক্ষেপে। প্রাদেশিক কমিটি হস্তক্ষেপ করে জানাল যে, এই ক্ষেত্রে যেকোনাে সভ্য যেকোনাে সমালােচনামূলক মন্তব্য করতে পারে, তা কোনােক্রমেই দোষের নয়। চারু মজুমদারের জনপ্রিয়তা আরও বেড়ে গেল পার্টি কর্মীদের মধ্যে। প্রাদেশিক স্তরের এক নেতারা (‘৪৮ সাল থেকে দার্জিলিং ও জলপাইগুড়ি জেলা সংগঠনের দায়িত্ব দিয়ে গােপনে প্রাদেশিক কমিটি এঁকে ঐ এলাকায় থাকার নির্দেশ দিয়েছিলেন) এক সন্তানবতী বিধবা মহিলাকে বিবাহ নিয়ে পার্টির স্থানীয় সভ্যরা বেশ হইচই শুরু করতে লাগল। চারু প্রথমে ঐ নেতাকে বললেন- “এটা তাে আপনার ব্যক্তিগত ব্যাপার। অযথা কেন পার্টির কমিটির অনুমতি নিতে যাচ্ছেন?” পার্টির সাধারণ সভায় চারু মজুমদার একেবারে চ্যালেঞ্জের সুরে বললেন- “কোন নিয়ম বা তত্ত্ব অনুযায়ী আপনারা দুজন কমরেডের বিষয়ে বিচারক হয়ে বসেছেন? আপনাদের তাে কোনাে অধিকারই নেই এ বিষয়ে কিছু বলার। আর তা ছাড়া কমিউনিস্ট হিসেবে প্রচলিত অভিভাবকদের ঠিক করা বিয়ের আমরা ঘােরতর বিরােধী হওয়ার সুবাদে আমাদের তাে এই বিয়েতে অভিনন্দন জানানাে উচিত।” চারুর উত্তেজিত ভাষণের সামনে সব গুঞ্জন চুপ হয়ে গেল।
১৯৫৩, ৫৪, ‘৫৪ সালগুলােতে আন্দোলনের বড় বড় ঢেউ খেলে গেল ঐ এলাকা জুড়ে। খাদ্য সংকট বিক্ষোভ ফেটে পড়ল শহর ও গ্রামাঞ্চলে নতুন করে উদ্বাস্তু সমস্যা মাথা চাড়া দিয়ে উঠল। খাদ্যের দাবিতে শহরের মানুষ মিছিল করছে। সিভিল পাই অফিস ঘেরাও করেছে, কৃষকেরা কৃষি ঋণের দাবিতে কোর্ট ঘেরাও করছে, উদ্বাস্তুরা গৃহ নির্মাণ ঋণ বা পুনর্বাসনের দাবিতে সরকারি অফিস ঘিরে বসে থাকছে।
‘৫০ সালেই চুণিলাল গােয়ালা ও যােগেন মুখার্জী খড়িবাড়ি থানা এলাকায় কৃষক সংগঠন গড়ে তােলার চেষ্টা করছিল। চুণিলাল ছিল আদিবাসী এক পার্টি নেতার গৃহভৃত্য। ঐ নেতাই ওকে রাজনীতিতে নিয়ে আসেন এবং পার্টির মিটিংগুলােতে সমমর্যাদা দিতেন। চুণিলালের ‘৪৯ সালে জেল হয়। জেল থেকে বেরিয়ে সে চলে যায়। গ্রামে আর যােগেন মুখার্জী এক দেউলিয়া পাইস হােটেলওয়ালা পার্টির বেআইনি সময়ে নেতাদের থাকার জায়গা দিত। এরা সাধ্যমতাে সামান্য যােগাযােগই করতে পেরেছিল, তবে এদের কৃতিত্ব জঙ্গল সাঁওতাল ও কিছু পরে কদমলাল মল্লিক ও খুদনলাল মল্লিককে কৃষক আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ করা। কৃষক আন্দোলন ছড়িয়ে পড়তে থাকে ‘৫১ সালের পর ২১ বছরের যুবক কানু সান্যালের (ভালাে নাম কৃষ্ণ কুমার সান্যাল) আগমনে। কানু স্থায়ীভাবে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের ঘরে থাকতে শুরু করে। এখনকার কৃষক আন্দোলনে চারু মজুমদার যেমন নির্ভরশীল হলেন কানুর উপর, কানুরও তেমনি প্রতিটি খুঁটিনাটি সমস্যায় চারুদার সাথে পরমার্শ না করলে চলে না। কৃষি-ঋণের দাবিতে ‘ডেপুটেশন’ চারুদাকে চাই, আবার শহরের জোতদারের কাছ থেকে ধান-কর্জ করতে চিঠি লিখে পাঠানাে- ‘চারুদা, এ কাজ আপনাকে করতে হবে।’ শহরে চিরকাল লালিত-পালিত কানু সান্যালের নির্দ্বিধায় গ্রামে গিয়ে পড়ে থাকা, প্রবল ম্যালেরিয়া জ্বরে গ্রামের গাছতলায় রাত কাটিয়ে দেওয়া চমৎকৃত করে চারু মজুমদারকে। কিন্তু কারাে সম্পর্কেই নিন্দে-মন্দ করা যেন চারুর স্বভাব নয়, আর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পিঠে চাপড়ানােও কখনও তার স্বভাব ছিল না। দল পাকানাে যেটা কমিউনিস্ট পার্টিতে বেশ রেওয়াজ হিসেবে চলে এসেছে, সে ব্যাপারটি চারুর মধ্যে কখনও আসেনি। কমরেডরা অনেক সময়েই অভিযােগ করত চারুদার কোনাে ব্যাপারেই যেন কোনাে খেয়াল নেই। বহিঃপ্রকাশ না থাকলেও কমরেডদের প্রতি তাঁর গভীর দরদ প্রকাশ পেত প্রয়ােজনের সময়ে। এক কমরেডের যক্ষ্মার পুনরাক্রমণে তার জন্য অর্থ সংগ্রহ, মিউনিসিপ্যালিটিতে চাপ দিয়ে স্যানাটোরিয়ামে নিখরচায় ভর্তি করা প্রভৃতি করতে তাঁকে দেখে অনেকে অবাক হয়েছেন- “বাব্বা, চারুদার আবার এ কোন রূপ!”
নিজে এতকাল ‘হােলটাইমারি’ করেও কানুকে বললেন- “পার্টি ওয়েজের হােলটাইমার পদ্ধতির মধ্যেই যাবে না। কৃষকের বাড়ি খাও, প্রয়ােজনীয় অর্থ তাদের কাছ থেকেই নাও। তাতে ওরা অনেক আপন করে নেবে। আর পার্টির কাছে হাত পাতলে পার্টির নেতারা কর্মচারীর দৃষ্টিতে দেখবে।” সেই থেকে শিলিগুড়ি মহকুমায় প্রায় তিন দশক অবধি ‘হােলটাইমার’ প্রথা রাখা হয়নি।
‘৫১ সালের অক্টোবরে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হয়ে অজয় ঘােষকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হয় এবং ‘৫১ সালে পার্টির কর্মসূচিকে গ্রহণ করা হয়। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে মাদুরাইতে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। প্রাদেশিক সম্মেলন থেকে এই কংগ্রেসে চারু মজুমদার প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেন- আবার একটা উৎসাহ নতুন করে শুরু হলাে পার্টির মধ্যে। আংশিক দাবির সংগ্রামে শ্রমিক, কৃষক, উদ্বাস্তু, শিক্ষক সংগঠন গড়ে উঠেছে। পার্টি কংগ্রেস অধিবেশন থেকে ফিরে চারুর মনে বেশ খুশি খুশি ভাব- “লড়াইটা আবার জমবে।” শিলিগুড়ি থেকে সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার তখন কেন্দ্রে রাজ্যসভার সদস্য। চারু বলেন“সত্যেন বাবুকে বিভিন্ন অঞ্চলে মিটিং বক্তৃতা করাও। এমপি হিসেবে অসংগঠিত এলাকায়ও তিনি যেতে পারবেন, আমাদের যােগাযােগও বাড়বে।” পার্টির নেতাদের। চারু বরাবর ‘বাবু’ বলেই সম্বােধন করে এসেছেন জ্যোতিবাবু, প্রমােদবাবু, মুজর সাহেব (আর সবাই ‘কাকাবাবু’ বলত) প্রভৃতি। একমাত্র গণেশ ঘােষকেই ‘দাদা’ বলতে শােনা গিয়েছে।
কৃষক সংগঠন বেড়ে চলেছে। চারু বলেন- ‘ক্যাডার, ক্যাডার ক্যাডার গড়ে তােল, রাজনীতি দাও ক্যাডারদের।’ ক্যাডার মিটিং-এ চারু মজুমদারকে থাকতেই হবে- হিন্দি ও রাজবংশী ভাষায় চারুর সমান দখল। রসিয়ে রসিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কর্মী সভা চলে। ফিকা নুন চা খেতে খেতে, বিড়িতে সুখটান দিয়ে চারু মজুমদার বক্তব্য পেশ করেন- “এতনা দিন গাঁওমে খালি একঠো তাগদ থা, ও জোতদারকা তাগদ। আভি দোসরা তাগদ বানাও, কিসানকা তাগদ।” তাগদের কথায় কানুর খুব উৎসাহ, বলে- “চারুদা, আমাদের এলাকায় কিন্তু আমরা ছাড়া আর কাউকে মিটিং করতে দেব না।” চারু বললেন—একদম ঠিক। লাগাও দিকিনি!’ হঠাৎ কোনাে যুবক আদিবাসী কৃষককে চোখে লেগে গেলে বলে উঠবেন- “আরে! কী চেহারা দেখছ। দেখ তাে ওদের গান জানে কি না!” হয়তাে দেখা গেল সত্যিই গাইতে পারে। “ওকে আমাদের সব মিটিং-এর আগে গান গাইতে লাগিয়ে দাও।”
গান, নাটক বিয়ে চারুর উৎসাহ- কিন্তু আলাদা করে গণনাট্য গঠনে ঘাের আপত্তি। “ধুর, ঐ গণনাট্য যেই বানাবে, তখন সেটা শহরের মধ্যবিত্তদের এক কচকচির আড্ডা হবে। গান গাইতে, নাটক করতে যারা পারে তাদের আমাদের সংগঠনের মিটিং, আন্দোলনের সময়ে গান, নাটক করিতে লাগিয়ে দাও। আর তাদের দিয়ে শহরের ক্লাবে অনুষ্ঠান করাও।” ওখানে সুবিধা ছিল যে পার্টির নেতৃস্থানীয় পুরুষ ও মহিলারা, শহরের ক্লাবে নিয়মিত নাটক করতেন। চারু মজুমদারের উদ্যোগে শহরের প্রধান ক্লাবে ‘রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত দিবস’, ‘পয়লা বৈশাখ’ প্রভৃতি উপলক্ষ্যে আবৃত্তি-গান-নাচ মিলিয়ে অনুষ্ঠান করা শুরু হলাে। প্রােগামও তাঁরই পরমার্শ মতাে হতাে। সলিল চৌধুরীর ‘হেই সামালাে’, ‘ধিতাং ধিতাং বলে’ খুব পছন্দ চারুরবললেন- “ঐ দুটো গান লাগাও বাচ্চা মেয়েদের নাচের সাথে।” আর একটি সলিল চৌধুরীর গান ছিল সবচেয়ে পছন্দ, তা হলাে- ‘ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে, প্রাণ জাগছে,… আজ হরতাল, আজ চাকা বন্ধ।’ গানের মহল্লার সময় চারু উপস্থিত থাকলে গায়কদের বিপদ। মুখের সামনে দুহাতে তুড়ি বাজিয়ে বললেন- “কুই, কুইক্রিদমে, ওরকম ঢিমে প্যানপ্যানে ভাবে গাইলে গণ-সংগীত হয় না। হঠাৎ একবার চারুর খেয়াল সুকান্তর ‘রাণার’ গানের সাথে নাচ করতে হবে। অপূর্ব সুরেলা কণ্ঠের দুই ভাইবােন কেবল উচ্চাঙ্গ সংগীত গায়। কীভাবে যে চারু মজুমদার নিজে তাদের বাড়ি গিয়ে ‘রাণার গান গাইতে রাজি করালেন! তাদের বাড়ির পাশের লােক বলল- “লে বাবা! রােজ ওদের হা হা শুনে কান ঝালাপালা হতাে। এখন দেখছি রেকর্ড বাজিয়ে ‘রাণার চলেছে তাই ঝুমঝমু ঘণ্টা বাজে রাতে’ রেয়াজ করছে তাে ভালােই?” জলপাইগুড়িতে শম্ভু ভট্টাচার্যের এক ছাত্র ‘রাণার’ নাচে। চারুর সাথে তার ‘তুই, তােকারি। চারু খবর দিয়ে তাকে আনিয়ে বললেন- “এখানে তাের দিদির বাড়ি থাকবি আর ফাংশান শেষ হলে যাবি।” ‘আমি এই করেছি’- বলে বাইরে কিন্তু চারুর কোনাে আত্মপ্রচার নেই। উচ্চাঙ্গ সংগীতে চারুর আকর্ষণ বড়ে গােলাম আলির গান। ‘৬৯-‘৭০ সালে আত্মগােপন করে থাকাকালীন কলকাতায় অনেক সময়ে দেখা গিয়েছে এক হাতে বাঁদিকের বুক চেপে এক মনে গুনছেন বড়ে গােলাম আলির রেকর্ড “বাজুবন্ধ খুলু খুলু যায়।”
‘৫৪ সালের জানুয়ারিতে মাদুরাইতে তৃতীয় পার্টি কংগ্রেস হয়ে যাওয়ার পর থেকেই কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে জাতীয় নীতি সম্পর্কে মতানৈক্য হতে থাকে। পার্টি কংগ্রেসের সময়েই ‘৫১ সালের কর্মসূচি ও কৌশলের কতকগুলাে বক্তব্য সম্বন্ধে কথা উঠেছিল যেমন- “এই (ভারত) সরকার ব্রিটিশ কমনওয়েলথের ইচ্ছা দ্বারা নিয়ন্ত্রিত”, “এর সবকিছু বাগাড়ম্বরে আসল উদ্দেশ্য যুদ্ধনীতিকে সাহায্য করা।” এইভাবে বক্তব্য রাখা উচিত নয় সে বিষয়ে প্রায় সবাই একমত হয়েছিল। কিন্তু এতেই দুটি ঝোক তখন থেকেই সৃষ্টি হতে থাকে। সাধারণ সম্পাদকসহ এক প্রধান অংশের ঝোঁক ছিল, ঐ বক্তব্য এই কারণে মানা যায় না- (১) শাসকশ্রেণির মধ্যকার জাতীয় বুর্জোয়ার সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব এতে অস্বীকৃত হয়; (২) জাতীয় স্বাধীনতা ও অর্থনীতির পােক্ত ভিত্তির জন্য জনগণের যে আগ্রহ সরকারের উপর তার প্রতিফলন স্পষ্ট হয় না; (৩) বিশ্ব সমাজতন্ত্রের বিশ্বব্যাপী প্রভাবের প্রতিফলনের ফলে আমাদের দেশের সরকার পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় স্বাধীনভাবে শিল্পায়ন ও ভূমিসংস্কার-এর নীতি নিচ্ছে তা লিপিবদ্ধ হয় না প্রভৃতি। এই মতের বিরােধীরা বললেন— ভারত সরকারের নেতৃত্বে যে বৃহৎ পুঁজিপতিরা আছে তাদের শ্রেণিস্বার্থে তারা বিশ্বের দুটি শিবিরের মধ্যে সুযােগ সন্ধান করে এবং দেশের পরিকল্পনা, শিল্পায়ন প্রভৃতিতে নিজেদের শ্রেণিস্বার্থেই সাম্রাজ্যবাদের সাথে সহযােগিতা করছে- এই কথাগুলােই পরিষ্কার হয় না ‘৫১ সালের দলিলের ঐ বক্তব্য নিয়ে চললে। স্বভাবতই দুটি ঝোক সমান্তরাল রেখা পার্টির মধ্যে তখন থেকেই চলতে থাকল। মাঝামাঝি যে জায়গায় তখন সমঝােতা হয়েছিল তা হচ্ছে ভারত সরকারকে একেবারে ব্রিটিশ কমনওয়েলথের দালাল বলা ঠিক না আর সরকার যে ভূমি সংস্কার ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদের আইন করতে যাচ্ছে তারা সেখানে সামন্তশ্রেণির সাথে আপস করবে। আমাদের ঐ দাবিগুলােই পূর্ণ প্রয়ােগের জন্য সংগ্রাম করতে হবে সরকারের জনবিরােধী নীতির বিরুদ্ধে। পশ্চিমবাংলার প্রাদেশিক কমিটি ও কৃষক সংগঠনের মধ্যে এই দুটি ধারার প্রতিফলন ভালােভাবেই হচ্ছিল।
শিলিগুড়িতে নতুন কৃষক সংগঠনের ফলে জোতদারদের প্রতিরােধের মুখে সংগঠনে সংগ্রামী মনােভাব প্রবলই ছিল পুলিশি হামলা, অজস্র মামলা দায়ের প্রভৃতির জন্য
পৃষ্ঠা: ৬১
সামগ্রিক পার্টির আদর্শগত প্রশ্ন নিয়ে মাথা ঘামানাের বড় একটা সুযােগ ছিল না। তাহলেও চারু মজুমদাররা দ্বিতীয় মতের পক্ষে চলছিলেন। তবে পার্লামেন্টারিবাদের পক্ষে পার্টিতে যে ঝোঁক বাড়ছিল তাতে সবাই সহমত ছিলেন সরকারের ভূমি সংস্কার ও জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ আইনের খসড়া সম্বন্ধে চারু বলেছিলেন- “খসড়া আইনকে আমাদের সমর্থনে বাধা নেই। তবে কার্যকরী করার জন্য আমাদের লড়াই করতে হবে।”
কৃষি ঋণ, ফসলের ভাগ, জমিতে অধিকার প্রভৃতি দাবি আদায়ের মধ্য দিয়ে ‘৫৪ সালেই কৃষক আন্দোলন বেশ দানা বেঁধে উঠতে থাকার মুখে পাশাপাশি চা-বাগানে সংগ্রামের প্রভাব পড়তে থাকে অনেক ক্ষেত্রে আদিবাসী কৃষকেরাই চা-বাগানের আত্মীয়স্বজনের সাথে যােগাযােগের ব্যবস্থা করতে লাগল। বীরেন বােস ও অতীন। বােসের সহযােগিতায় চারু মজুমদার আওয়াজ দিলেন- “একদিনের ধর্মঘট করে চাশ্রমিকদের জনসভা কর, ইউনিয়ন বানাও।’ চারটি বাগানে এক একদিন ধর্মঘট করে ইউনিয়ন হলাে। অবশ্যই প্রধান বক্তা চারুদা, তার সাথে বীরেন, কানু ও কৃষক কমরেডরা। দালালের হাতে কমলা চা-বাগানের সংগঠককে মারও খেতে হলাে। চাবাগান সংগঠনের জন্য অচিরেই তিনখানা সাইকেল কেনার টাকা শহর থেকেই জুটে গেল। সাইকেলে চেপে চারু, বীরেন ও অতীনকে সাথে নিয়ে বেরিয়ে পড়েন দুপুরে, ফিরতে ফিরতে কোনাে কোনােদিন রাত বারােটাও হয়। এত রাতে ফেরা ঠিক নয়, চামালিকরা হামলাও তাে করতে পারে?’ সাইকেল থেকে নেমে হাঁফ ছেড়ে ধূলি-ধূসরিত ক্ষীণ দেহ চারু বলেন, “আরে, এই রাতে সাইকেল চালিয়ে আসার যে কী থ্রিল না। গেলে বুঝবে না!” সাইকেল-সফর এক একদিন পঞ্চাশ মাইলেরও উপর হয়ে যেত। বাগান মিটিং বা গ্রামের বৈঠকে আলােচনাতে চারুই মুখ্য বক্তা- কিন্তু বার্ষিক সম্মেলনে (৫৭ সাল পর্যন্ত একই সাথে বাগান শ্রমিক ও কৃষক সম্মেলন হয়েছে) চারুর কাজ জনতার মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়ানাে। সংগঠকদের বলতে দাও, অভ্যেস হােক!’ মন্তব্য করে ময়দানের বক্তৃতা এড়িয়ে যেতেন।
জুন মাসে দার্জিলিং পাহাড়ের ৫৬টি চা-বাগানে ধর্মঘট শুরু হয়েছিল। ২৫শে জুন পুলিশের গুলিতে পাহাড়ের মার্গারেটসন হােপ চা-বাগানে দুজন নারী ও এক কিশােরসহ ছয়জন নিহত হয়। শিলিগুড়ির তরাই অঞ্চলে এর প্রতিবাদে একদিনের চা-বাগান ধর্মঘট হয়। প্রায় সারাদিন ঘুরে ঘুরে চা-শ্রমিকদের জমায়েতে চারু মজুমদার বলেন“এর বদলা নিতে হবে এখানেও লড়াই করে।” দার্জিলিং-এর ধর্মঘট শেষ হয় ২৯শে জুন। ১লা জুলাইতেই খড়িবাড়ি চা বাগান নিয়ে কোর্টের মধ্যে এসডিও-কে গালাগাল করার জন্য ১০৭ ধারায় চারু গেপ্তার হলেন ৭ দিনের জন্য।
‘৫৫ সালের ২৯শে আগস্ট থেকে চা-বাগান শ্রমিকদের বােনাসের দাবিতে সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলাে সব কয়টি বামপন্থি ট্রেড ইউনিয়ন মিলে, (তখন অবশ্য এআইটিইউসি ও আরএসপি-এর ইউনিয়ন) আইএনটিইউসি ও সমর্থন জানালাে। শিলিগুড়ি মহকুমায় বামপন্থী ইউনিয়ন বলতে ৪৪টি চা-বাগানের মধ্যে এআইটিইউসিএর চারটি বাগান। আইনএনটিইউসি-র সভাপতি (নিজেই দুটি বাগানের মালিক) বললেন- “চারু বাবু, ধর্মঘট যখন একসঙ্গে ডাকা হয়েছে, তখন প্রচার মিটিং-ও একসঙ্গেই করা যাক। আমরা গাড়ি, মাইক দিচ্ছি, আপনারা বক্তা দিন। তবে আপনাকে সব সময়ে থাকতে হবে।” চারু বললেন “তথাস্তু। কিন্তু একটা শর্ত যে আছে?” খৈনি টিপতে টিপতে চা-মালিক আইএনটিইউসি নেতা বললেন। “আমার বাগান দুটিতে ধর্মঘট হবে না এই শর্ত।” চারু বললেন- “রাজি আছি, তবে আমাদের শর্ত হলাে- ‘’ধর্মঘট যদি ভেঙেও যায় তাহলেও আপনার বাগান দুটির শ্রমিকদের বােনাস দিতেই হবে।’ আর আপনাদের ইউনিয়নগুলােতে প্রধান বক্তব্য আমরাই রাখব। এটা লিখিত চুক্তি করতে হবে।” মালিক লিডার ভাবলেন- ‘আমার কথাই তাে থাকছে’- বলে উভয়পক্ষের সই করা চুক্তি প্রস্তুত হলাে। কমরেডরা, কানু ও বীরেন, খুঁতখুঁত করল। চারু বলেন- “কানুর ব্যাপার কি জানাে? ওর যদি কোনাে কথা পছন্দ না হয় তবে একদম চুপ করে থাকবে। আর এই চুক্তি তাে পছন্দ হওয়ার মতাে না। মাত্র চারটে বাগানের ছােট ছােট ইউনিয়ন নিয়ে ধর্মঘটে নামতে যাওয়া রিস্কি না? আমার বিশ্বাস এই চুক্তিতে আমাদের লাভ!” চা-শ্রমিকের সাধারণ ধর্মঘট যেন এক উৎসবে পরিণত হলাে- ভাের থেকে গভীর রাত পর্যন্ত সবাই পথে পথে মিছিলে। চারু মজুমদার সকাল নয়টার মধ্যে স্নান সেরে দুটি ভাত নাকে-মুখে গুঁজে জিপে উঠে পড়ে বলেন, “কংগ্রেসে ইউনিয়নের বাগানে চল।” আর ফেরা সেই রাতে। কয়দিনেই বক্তৃতা করতে করতে গলা গেল বসে। কয়েকদিন যেতে না যেতেই হরতাল না হওয়া বাগান দুটির শ্রমিকদের বিরুদ্ধে ধর্মঘটি শ্রমিকরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠতে লাগল। পার্টির কর্মীদেরই কেউ কেউ উসকানিও দিতে লাগল যে চারুবাবুর এতে স্বার্থ আছে। হঠাৎ একদিন প্রায় হাজার পাঁচেক চা-শ্রমিক ওর মধ্যে একটি বাগানের সামনে দাঁড়িয়ে স্লোগান দিতে থাকে— “কাম বন্ধ নেহি হেনেসে পিটাই হােগা।” “চারু-কানু মালিককা পয়সা খায়া হ্যায়।” সঙ্গে সঙ্গে ডিএসপি-র নেতৃত্বে পাঁচশ সশস্ত্র পুলিশ ধর্মঘটিদের পথ রােধ করে দাঁড়াল। ধর্মঘটিরাও তির-ধনুকে সশস্ত্র। চারুর কাছে খবর গেল। তক্ষুনি চলে এলেন অকুস্থলে যেখানে কানু সান্যাল আপ্রাণ চেষ্টা করছে উত্তেজিত শ্রমিকদের শান্ত করতে। চারু আসতেই পিছনের উসকানিতে আওয়াজ উঠল ‘দালাল চারু, কানু মুর্দাবাদ।’ বাগানের ভিতরে ঢােকার কাঠের নড়বড়ে সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে চারু মজুমদার সমস্যা বােঝাতে লাগলেন যে, কেন দুটি বাগানে হরতাল না হওয়াকে মেনে নেওয়া হয়েছে। এই মালিক বােনাস না দিলে সব বাগানে যখন কাজ চলবে তখন এই দুটি বাগানে আমরা ধর্মঘট করব। সব উত্তেজনা নিমেষে থেমে গেল। কানু সান্যাল আওয়াজ দিল সিদ্ধান্ত ঠিক আছে, চারু মজুমদার জিন্দাবাদ। পাঁচ হাজার কণ্ঠে প্রতিধ্বনিত হলাে স্লোগান। পরে কানু বলেছিল- “এতটুকু বিচলিত না হয়ে চারুদাকে সেদিন যখন দেখলাম তখন বুঝলাম ‘গাটস’ আছে বটে।”
ধর্মঘটে শ্রমিকরা মাথাপিছু ১০০-১৩০ টাকা বােনাস আদায় করল, চা-বাগিচায় মজুরি ও বাসস্থানের ব্যাপারে বিশেষ বাগিচা আইন করার প্রতিশ্রুতি আদায় করল, আরআইএনটিইউসি-র পাঁচটা বাগানের ইউনিয়ন লাল ঝান্ডায় যােগ দিল। বােনাস দেওয়ার সময়ে করুণ মুখে চা-মালিক আইএনটিইউসি-র নেতা বলেন- “আপনার বুদ্ধির কাছে হেরে গেলাম চারুবাবু।”
‘৫৫-এর ৭ই সেপ্টেম্বর ধর্মঘট মীমাংসার ঠিক আগে, ঘটনা হচ্ছে যে, মালিকপক্ষ সােজাসুজি ইউনিয়নের সাথে আলােচনায় বসতে নারাজ হয়ে (তখনও চা-বাগান ইউনিয়নকে চা-মালিকরা স্বীকৃতি দেয়নি) লেবার কমিশনারকে বলল, “ওরা আগে ধর্মঘট তুলে নিক, তারপর আমাদের বক্তব্য জানাব।” সেদিন এই সমস্যার সমাধানের জন্য প্রাদেশিক ও জেলা দুটির (দার্জিলিং, জলপাইগুড়ি) ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের সারারাত ধরে আলােচনা হলাে চারু মজুমদারেরই বাড়িতে। প্রায় সকলেই বললেন যে, কিছুই না পেয়ে ধর্মঘট তুলে নেওয়া তাে মুশকিল, অথচ ধর্মঘট আর চালানও মুশকিল, আড়াই লক্ষ শ্রমিককে তাে রিলিফ দেওয়া যাবে না। আলােচনার উপসংহার সেদিন শেষ রাতে করেছিলেন চারু– “দাবি আদায় হইবে- এই বক্তব্য নিয়ে ধর্মঘট তুললে শ্রমিকদের বিজয়ের মনােভাব থেকেই যাবে। সাথে সাথে একথাও বলতে হবে যে, দাবি নিয়ে টালবাহানা হলেই আবার লড়াই শুরু হবে।”
স্ত্রী লীলা শহরে মহিলা সংগঠন করেন। চারু বললেন- “শহরে ঘুরে সংগঠনের কী বুঝবে- গ্রামে, বাগানে, কৃষক, শ্রমিক মেয়েদের নিয়ে মিটিং করে।” লীলা বলেন“হিন্দি তাে জানি না!” বােনাস পাওয়ার চাঁদা তুলে একটি পুরানাে জিপ কেনা হলাে ইউনিয়নের। শ্রমিকরা বলল- “ক্যা একঠো ছােটা গাড়ি লিয়া হ্যায়, একঠো সার্বিস (অর্থাৎ বাস) কিননে কা কাম থা!” জিপে মহিলাদের বাগানে বাগানে বা গ্রামাঞ্চলে যাওয়ার সুযােগ হলাে।
চারু মজুমদারের প্রথমা কন্যা অনীতা তখন দুই বছরের। বাপের মতাে রাঙা রং আর ছােট্টখাট্ট– টরটর করে কথা বলে। চারু বলেন-“আঃ মেয়ে আমার একদম বাপের রং পেয়ে গেছে।” কথাটা স্ত্রীর গায়ের রং নিয়ে ঠাট্টা! বলেন- “বুঝলে, রাতে যত শালা মশা মশারির মধ্যে আমাকে কামড়ায়, তােমাদের লীলাদিকে তাে অন্ধকারে দেখতে পায় না?”
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির চতুর্থ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলাে ‘৫৬ সালের এপ্রিল মাসে পালঘাটে। ‘৫৫ সালের মাঝামাঝি থেকেই পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির মধ্যে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে ‘৫১ সালে কর্মসূচির কতকগুলাে সূত্র নাকচ হয়ে যায়। এই চিন্তাধারার ভিত্তিতে গুরুতর মতবিরােধ শুরু হয়ে যায়। ‘৫৪-৫৫ সালে আন্তর্জাতিক ঘটনাবলি ভারতের কমিউনিস্ট নেতৃত্বের উপর যথেষ্ট প্রভাব বিস্তার করে এবং একে কেন্দ্র করেই ভারত সরকার বিশেষত নেহরুর ভূমিকা ও কর্মসূচি বিতর্কের প্রধান বিষয় ছিল। ‘৫৫ সালের জুন মাসে চতুর্থ পার্টি কংগ্রেসের খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাব হিসেবে পলিট ব্যুরাে বিতর্কে রত উভয়পক্ষের মধ্য সামঞ্জস্য আনার জন্য যে বক্তব্য উপস্থিত করল- মতানৈক্য তাতে আরও জোরদার হয়ে উঠল। আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির মধ্যে ‘৫৪ সালে পঞ্চশীলকে বিধিবদ্ধ করে চৌ-নেহরু চুক্তি, ‘৫৫ সালে বান্দুং সম্মেলন, ঐ বছরেই সােভিয়েত ইউনিয়নে জওহরলাল নেহরুকে বিপুল সংবর্ধনা এবং ক্রুশ্চেভ ও বুলগানিনের ভারত সফর আলােচনার প্রধান স্থান পাচ্ছিল এবং এই সূত্রেই ভারতে দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও নেহরু সরকারের জাতীয় নীতি বিশ্লেষণে দুটি স্পষ্ট মত প্রকাশ হতে লাগল। ভবানী সেন; এস. এস. ইউসুফ; পি.সি. যােশী; রবিনারায়ণ রেড্ডি প্রমুখেরা বললেন- “ভারতের সার্বভৌমত্ব অর্জন করানাে এবং বৈদেশিক নীতিতে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক শিবিরে অংশগ্রহণ, দেশের মধ্যে শিল্পায়ন ও সমাজতন্ত্রকে খর্ব করার ব্যাপারে সরকারের মধ্যে নেহরুর নেতৃত্বে জাতীয় বুর্জোয়ার প্রগতিশীল অংশ যে ভূমিকাগুলাে নিচ্ছে, সরকারের মধ্যেকারই প্রতিক্রিয়াশীল বুর্জোয়া শিবির তাকে বানচাল করতে বদ্ধপরিকর। পার্টিকে তার নিজস্ব অবস্থান শক্তিশালী করে। জনগণতান্ত্রিক সরকারের পথে যাওয়ার জন্য প্রগতিশীল বুর্জোয়ার সাথে কোয়ালিশান সরকার গঠনের দিকে যেতে হবে। এই নতুন প্রশ্নগুলাের জবাব ‘৫১ সালের কর্মসূচির সূত্রগুলােতে অনুপস্থিত, তাই ঐ কর্মসূচি সংশােধন প্রয়ােজন।” অন্যদিকে পি, সুন্দরায়া, হনুমন্থ রাও, বাসবপুন্নায়া, মুজফফর আহমেদ প্রমুখের বক্তব্য ছিল— “১৯৪৭ থেকে ১৯৫৫ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে অনেক নতুন উপাদানের সৃষ্টি হয়েছে যার ফলে ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণি নিজেদের স্বার্থেই সমাজতান্ত্রিক ও সাম্রাজ্যবাদী শিবিরের মধ্যে সুবিধামতাে স্থান নিচ্ছে অথচ ব্রিটিশ কমনওয়েলথে অবস্থান, সাম্রাজ্যবাদের কাছে সুযােগ সুবিধা গ্রহণ ও নতুন করে মার্কিন পুঁজির আমদানি, দেশের অভ্যন্তরে জনবিরােধী নীতি গ্রহণ সর্বক্ষেত্রেই সরকারের বৃহৎ বুর্জোয়ারা শ্রেণি হিসেবেই করছে, তার মধ্যে প্রগতি, প্রতিক্রিয়ার ভাগাভাগি করতে যাওয়া ভুল। নতুন প্রশ্নগুলাের আলােকে ‘৫১ সালের কর্মসূচির পুনর্মূল্যায়ন হওয়া উচিত। কিন্তু ঐ কর্মসূচির ব্যাপক পরিবর্তনের কোনাে প্রয়ােজন দেখা দিচ্ছে না।”
অজয় ঘােষের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটির কর্মসূচিগত ভিত্তি বা নির্দিষ্ট কর্মনীতির উপর চতুর্থ কংগ্রেস করার দিকে না গিয়ে বলল- “পরিবর্তনগুলােকে লিপিবদ্ধ করে একটি রাজনৈতিক প্রস্তাবের ভিত্তিতে পার্টি কংগ্রেস হবে।” রাজনৈতিক প্রস্তাবে উভয়পক্ষের মতামতের আপস করে একটি মধ্যপন্থি অবস্থান নেওয়া হলাে এই বলে
পৃষ্ঠা: ৬৫
যে, “আন্তর্জাতিক ঘটনাবলির গতি সমাজতন্ত্রের বিজয়ের দিকে এবং একটি স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বিশ্ববাজারের আবির্ভাবের ফলে সদ্য স্বাধীন দেশগুলাের জাতীয় বুর্জোয়ারা বৈদেশিক নীতির ক্ষেত্রে প্রগতিশীল ভূমিকা নিতে বাধ্য। ভারতের বুর্জোয়া শ্রেণি সমপ্রকৃতিরও (homogeneous) যেমন নয়, আবার তার মধ্যে প্রগতি ও প্রতিক্রয়ারও স্থায়ী সীমারেখা নির্দেশ করা যায় না। তবে একথা বলা যায় যে, ‘৪৭ সালের পর বুর্জোয়ার কোনাে অংশই সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে যায়নি। পার্টিকে সরকারের জনবিরােধী নীতির বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে শ্রমিক, কৃষক সংহতির ভিত্তিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের দিকে এগােতে হবে। প্রকৃতপক্ষে চতুর্থ কংগ্রেসে পার্টির মধ্যেকার দক্ষিণ ও বামশক্তির একটা সমঝােতা করা হলাে। ‘৫৬-এর ফেব্রুয়ারিতে সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে ক্রুশ্চেভ কর্তৃক ক্ষমতা দখল ও স্তালিন-ধ্বংসের প্রশ্নটি চতুর্থ কংগ্রেসে একেবারেই উহ্য থেকে গেলে- তবে কেন্দ্রীয় কমিটির প্রস্তাবের উপর ক্রুশ্চেভীয় নীতির প্রভাব লক্ষ করা গেল। সাধারণ সম্পদক অজয় ঘােষ পার্টির কাগজে বিংশতি কংগ্রেসের প্রশংসা করে প্রবন্ধাদি লিখলেন।
চতুর্থ কংগ্রেস উপলক্ষ্যে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পার্টির সম্মেলনে চা-বাগান ধর্মঘটে শিলিগুড়ি মহকুমায় চা-মালিকের সাথে চুক্তির প্রশ্নটি রাজনৈতিক বিতর্কের একটি অংশ হয়েছিল। প্রগতিশীল বুর্জোয়ার’ প্রবক্তারা চারু মজুমদারের প্রশংসা করে বললেন- “জাতীয় বুর্জোয়ার সাথে ঐক্যের নীতি নিয়ে চারুবাবু প্রমাণ করে দিলেন যে শ্রমিকশ্রেণির এই ঐক্য কত প্রয়ােজন।” প্রায় হতভম্ব চারু মজুমদার পরস্পরের কথা ছােড়াছুড়ির স্রোতের মধ্যে বলার চেষ্টা করেছিলেন যে আরও তাে অনেক তথাকথিত জাতীয় বুর্জোয়া চা মালিক ছিল, কিন্তু এই চুক্তিটি সেরকম কোনাে চিন্তা নিয়ে হয়নি। চুক্তিটি হয়েছিল আসলে আইএনটিইউসি-র সাথে।
ভারত থেকে সাংস্কৃতিক প্রতিনিধিদল, পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদল প্রভৃতি চীনে যাওয়া, ভারত-চীন মৈত্রী সঙ্গের তরফ থেকে পণ্ডিত সুন্দরলাল, সর্দার গুরুবক্স সিং-এর শিলিগুড়িতে জনসভা, আবার চা-বাগিচা তদন্ত কমিশনের চা-শ্রমিকদের জীবনযাত্রা সম্বন্ধে অনুসন্ধান, জমিদারদের বেনামা জমি ধরিয়ে দেওয়ার জন্য আইনানুগ আবেদনের ব্যবস্থা, ভাগচাষ বাের্ড থেকে তেভাগা ও ভাগচাষির অধিকার অর্জনের ব্যবস্থা, রাজ্য পুনর্গঠন কমিশনের বৈঠক, মূল শিল্প কারখানার পত্তন, বাঁধ, জলাধার নির্মাণ সবকিছু মিলিয়ে ভারতে এমন এক আবহাওয়ার সৃষ্টি হলাে যা এতদিন ধরে চলে আসা গণসংগ্রাম ও শ্রেণি সংগ্রামের পদ্ধতিকেই বেশ নাড়া দিল। এই সমস্যা চারু মজুমদারকেও যথেষ্ট ভাবিত করে তুলল। পুরাে কৃষক আন্দোলনই হয়ে দাঁড়াল আইনমুখী। চারু মজুমদারের বেশিরভাগ সময় ব্যয় হতে থাকল ভাগচাষ বাের্ড ও ভূমি সংস্কার দপ্তরে কৃষকদের মামলাগুলাের তদারক করতে। পারিবারিক অবস্থাও এই সময়ে তাঁর খুব অসচ্ছল হয়ে পড়েছিল। জমিজমা যেটুকু ছিল জমিদারি উচ্ছেদ আইন অনুযায়ী তা সবই সরকারের কাছে ন্যস্ত করে দেওয়া হয়েছিল। সে সময় এক মহকুমা হাকিম এক প্রতিনিধি মন্ডলীর সাথে সাক্ষাৎকারের সময়ে চারুকে বলেছিলেন“চারুবাবু, আপনাদেরই পার্টির অনেক বড়লােক কত কায়দায় জমি রেখে দিল, আর আপনি সবই কেন দিয়ে দিলেন?” এই ভদ্রলােক এক সময়ে কানুনগাে থাকার সুবাদে জমিদারি সংক্রান্ত ঘোজঘাজ বেশ ভালােই বুঝতেন। এই সময়ে এমনও হয়েছে যে, জমির মামলার জন্য কৃষকের জমা টাকা চারুর কাছ থেকে সংসারে ব্যয় হয়ে গেছে। লজ্জিত, ক্ষুব্ধ হয়ে চারু মজুমদারকে বলতে হয়েছে- “এখন কোথা থেকে জোটাই প্রায় এগারােশ টাকা।” অবস্থা বুঝে কানু সান্যালরা টাকাটার বিকল্প ব্যবস্থা করেছেন। রতনলাল ব্রাহ্মণ বললেন- ‘চারু, তুমি মাসে পনেরাে দিন পাহাড়ে থেকে পার্টির ক্লাশ নাও, জেলা অফিস থেকে দুশাে করে টাকা দেব। শিলিগুড়ির কমরেডরা বলল— ‘আমরা আরও একশ টাকা দেব।’ হঠাৎ চটে উঠেছিলেন চারু মজুমদার- “আমাকে কি পার্টিতে বিশেষ সুবিধাভােগী বানাতে চাও? প্রাদেশিক নেতা সর্বক্ষণের কর্মী হিসেবেও তাে এত টাকা মাসে পায় না। আর আমাকে তিনশ টাকার হােলটাইমার বানানাের মানে?” রতনলালকে পরে ঠান্ডাভাবে বললেন- “পাহাড়ে মাসে পনেরাে দিন থাকার জন্য টাকার দরকার হয় না। আসলে আমি তাে নেপালি ভাষা বলতে পারি না। বরং জেলা কমিটি মিটিংগুলােকে কেবল চা-বাগান ইউনিয়নের সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য ব্যবহার নাকরে, কিছু কিছু রাজনৈতিক আলােচনায় সময় দিলে আর আলাদা করে পাহাড়ে গিয়ে থাকার দরকার হয় না।’
চারু মজুমদারেরই উদ্যোগে ‘৫৫ সালের শেষ ভাগে শিলিগুড়ি এলাকায় চা-শ্রমিক ও কৃষক পার্টি কর্মীদের শিক্ষা শিবিরের অনুষ্ঠান আরম্ভ করা হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলে কোনাে একটি এলাকা বেছে নিয়ে দুদিন ধরে দিন ও রাতে কিছুক্ষণ এই শিবির চলত। খাওয়ানাের দায়িত্ব এলাকার কৃষক ও চা-শ্রমিকদের। প্রথম শিবিরে চারু মজুমদার নিজে “ভারতের মুক্তি সংগ্রামের ইতিহাস” ও “কমিউনিস্ট পার্টি কী?”–এর উপর ক্লাস নেন। কানু সান্যালের উপর বর্তাল “ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাস”, বীরেন বােসের উপর “পুঁজিবাদ কী?” এবং সৌরেন বােসের উপর “সমাজতন্ত্র কী?” দুই মাস পরে দ্বিতীয় শিবিরে আলােচ্য বিষয়ের দায়িত্ব এইভাবে ভাগ হলাে; চারু মজুমদার ‘পার্টি কর্মসূচি’, কানু সান্যাল- লেনিনবাদ ও কৃষি সমস্যা, বীরেন- লেনিনের ‘সােশ্যাল ডেমােক্রেসির দুই কৌশল’ ও সৌরেন- লেনিনের কী করিতে হইবে। ক্লাসের বিষয়গুলাে চারু মজুমদারই বাছাই করেছিলেন। এই শিবির অবশ্য আর চলেনি। চারু মজুমদারের বক্তব্য ছিল- “প্রায় সব সময়েই পার্টি মিটিংগুলােতে আদর্শগত রাজনৈতিক বিষয়গুলাে আলােচনা করা উচিত। আলাদা করে ক্লাস করতে গেলে দেখা যাচ্ছে সব ক্যাডারদের মাথার উপর দিয়ে চলে যায়। তােমরা তাে গণ সংগঠনের সমস্যা পার্টি মিটিং-এ এনে সব একাকার করে দাও- পার্টি ট্রেনিং-এর ব্যাপারটা আর হয় না!” এই প্রসঙ্গে দার্জিলিং-এর মিটিং-এ গেলেই চারুর সব সময়ে মন্তব্য হতাে- “পার্টি অফিস আর চা-বাগান ইউনিয়ন অফিস এক জায়গায় করে, সবই কেবল ইউনিয়নের কাজ হচ্ছে। এরা পার্টি করবে কখন।” রতনলাল ব্রাহ্মণকে বলতেন- “বুঝলে বাজে, (নেপালিতে সম্মানজনক সম্বােধন) তােমরা পাহাড়ের পার্টিটাকে নামিয়ে ট্রেড ইউনিয়নে নিয়ে ফেলেছ!”
বাগানে বা গ্রামের সভায় তখন প্রায়ই জিপগাড়িটি নিয়ে যাওয়া হতাে। তিন বছরের অনীতাকে নিয়ে চলতেন চারু–“আমার মেয়েটা এখন থেকেই খেটে খাওয়া মানুষ দেখুক।” মেয়েও বাগান বা গ্রামের মহিলাদের সবার কাছে যায়। প্রচণ্ড রােদ লেগে মাঝে মাঝে যখন জ্বরে পড়ত, চারু একেবারে উড়িয়ে দিয়ে বলতেন- “আরে বাবা, মধ্যবিত্তের ঘরের মেয়ে, প্রথম প্রথম জ্বর হবেই। কয়দিন যেতে দাও, সিজিন্ড হয়ে যাবে!” সকালে বাড়ির সামনে জিপ এসে দাঁড়ালেই অনীতা হাততালি দিয়ে বলত- “আমাদের গালি এতেতে।” এই কথা নিয়ে কবি সুভাষ মুখােপাধ্যায় তাে ‘আমাদের গাড়ি’ নামে এক রচনাই লিখলেন পত্রিকায়।
‘৫৫-৫৬ সাল জুড়ে ভারতব্যাপী ভাষার ভিত্তিতে রাজ্য গঠনের আন্দোলন জোরদার হয়ে ওঠে, তার মধ্যে আবার ছিল পর্তুগিজ অধিকার থেকে গােয়ার মুক্তি ও চন্দননগরের ফরাসি অধীনতার থেকে উদ্ধার পাওয়া। পশ্চিম দিকে গুজরাট ভেঙে মহাগুজরাট ও সংযুক্ত মহারাষ্ট্র গঠনের দাবি, মাদ্রাজ ভেঙে অস্ত্র ও মাদ্রাজ (তামিলনাড়ু) এবং ত্রিবাঙ্কুজ-কোচিন রাজ্যে ভেঙে মাদ্রাজের অংশ নিয়ে কেরালা রাজ্যের পত্তন; তার উপর কাশ্মীর ও মহীশূরের ভারতভুক্তি। সর্বত্রই গণআন্দোলন জোরদার হচ্ছিল এবং রাজ্যের সীমারেখার প্রশ্নে এবং পুনর্গঠনে ভাষার প্রশ্নই মুখ্য হয়ে দাঁড়িয়েছিল। পাটনায় গুলি চলল, গােয়ার মানুষ মরল, সারা ভারতেই গােয়া মুক্তি সমিতি গঠিত হলাে। এতে কমিউনিস্টদের প্রধান ভূমিকা ছিল প্রায় সারা ভারত জুড়েই। চারু মজুমদারের বক্তব্য ছিল এই জাতীয়তাবাদী প্রশ্নে কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য আলাদা করে না রাখলে আখেরে গিয়ে শাসকশ্রেণিই এর থেকে লাভ তুলবে। জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের প্রশ্নে তাঁর পরিষ্কার আলাদা ভাবনা প্রকাশ পায়নি বলতেন ভারতের জনগণের হাতে ক্ষমতা এলে তখন জাতি সমস্যার সমাধান নির্দিষ্টভাবে করা যেতে পারে।
‘৫৭ সালে নির্বাচিত হিড়িক এসে গেল। “কেন্দ্রে ও রাজ্যগুলােতে কমিউনিস্ট পার্টিকে প্রধান সংসদীয় বিরােধী দল করতে হবে” পার্টি কেন্দ্র এটিকেই মুখ্য রাজনৈতিক আওয়াজে দাঁড় করাল। পুরাে পার্টিই এই আওয়াজে মেতে উঠল। নির্বাচনের মধ্য দিয়ে কেরালায় কমিউনিস্ট পার্টি সরকার গঠন করল, কেন্দ্রে, অন্ধ্রে ও পশ্চিমবাংলায় প্রধান বিরােধী গ্রুপ হিসেবে গণ্য হলাে। “পালামেন্টারি সংগ্রামই আজ প্রধান রাজনৈতিক সংগ্রাম”– এই আওয়াজ পার্টিতে প্রায় একটি সর্বজনীন রূপে পরিণত হলাে।
গণআন্দোলনে মানুষ চারু মজুমদারের মনের দ্বন্দ্ব-“আন্দোলন চলছে বেশ। কথা! পরিকল্পনাগুলােকে কার্যকরী করাে, ভূমি-সংস্কার সম্পূর্ণ করাে, নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার দখল করাে- এগুলাে গণ-আন্দোলনকেই এগিয়ে দেবে। কিন্তু এর দ্বারা সরকার বিরােধী সংগ্রাম দানা বাঁধবে কীভাবে?” “লড়ে যাও, তারপর দেখা যাবে!”-বলে ঝাকড়া চুল মুঠো করে ধরেন। স্পষ্ট করে না বললেও প্রগতিশীল বুর্জোয়া বা জাতীয় বুর্জোয়া বলে চিহ্নিত করার প্রশ্নে তাঁর আপত্তি হতাে। প্রাদেশিক ট্রেড ইউনিয়নের এক নেতা যখন ব্রিটিশের চা-বাগানেই প্রধানত সংগ্রামের জোর দেওয়ার কথা বলেছিলেন তখন চারু বেশ চটে গিয়ে বলেছিলেন- “চা-এর মতাে মূল শিল্পে শ্রমিক আন্দোলনে যদি একই রকম ইউনিফর্ম নীতি না নেন, যদি বিদেশি মালিকের বাগানে এক রকম আর দেশি মালিকের বাগানে অন্য নরম পদ্ধতি নিতে থাকেন তাহলে শ্রমিক আন্দোলন চালাবেন কী করে? আপনাদের ঐ জাতীয় বুর্জোয়ার প্রতি সহানুভূতির নীতি দিয়ে ওয়ার্কিং ক্লাসের মুভমেন্টে কোনাে সিদ্ধান্তই নেওয়া যাবে না, বুঝেছেন স্যার?”
সত্যেন্দ্রনারায়ণ মুজমদার এমএলএ হওয়ার পর যখন জলপাইগুড়ি ও শিলিগুড়ির চা-বাগান ইউনিয়নদ্বয়ের সভাপতি নির্বাচিত হলেন, তখন জরুরি মিটিংগুলােতে অবশ্যই চারুকে নিয়ে যেতেন।
শিলিগুড়ি শহরে ছাত্র আন্দোলন বেশ শক্ত হয়েছে, কলেজ ইউনিয়নের ছাত্র। ফেডারেশনের প্রাবল্য- এদিকে প্রায় সাড়ে তিনশ বিড়ি শ্রমিকেরও শক্ত সংগঠন উদ্বাস্তুদের মধ্যেও কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাব প্রচুর। সর্বক্ষেত্রেই জরুরি মিটিং-এ চারুদাকে নিয়ে টানাটানি। ছাত্রদের বলেন- “শুধু কলেজ ইউনিয়ন আর চিপ ক্যান্টিন নিয়ে থাকলে হবে না বাপু। জনসাধারণের সমস্যা নিয়ে স্ট্রিট কর্নার মিটিং করাে, হালের রাজনীতি নিয়ে ক্লাস মিটিং করাে, কালচারাল অ্যাক্টিভিটি চালাও মাঝেমধ্যে শ্রমিক, কৃষকদের কাছে দলবেঁধে যাও ছাত্রদের প্রতিনিধি হিসেবে।” কলেজ ইউনিয়ন নির্বাচনে কলেজে পার্টির নেতাদের গিয়ে বক্তৃতা দেওয়ার ব্যাপারে চারু মজুমদারের কড়া নিষেধ ছিল। বিড়ি ইউনিয়ন সম্বন্ধে বলতেন “দেখ, আদতে তাে এরা মধ্যবিত্তেরই এক অংশ- এদের শ্রমিক আন্দোলনের চোখের না দেখে, ক্যাডার সংগ্রহের উপর জোর দাও অন্যান্য আন্দোলনে ক্যাডারদের টেনে নিয়ে যাও।” মহিলা পার্টির সদস্যদের বলতেন, “মধ্যবিত্ত মহিলাদের সংগঠন কংগ্রেস, কমিউনিস্ট সব মিলিয়ে করুন। সত্যিকারের মহিলা সংগঠন করতে গেলে শ্রমিক-কৃষক মহিলাদের সংগঠিত করুন।”
চা-শ্রমিক ও কৃষকদের মধ্যে সম্মেলন উপলক্ষ্যে যখন ক্রীড়া প্রতিযােগিতার আয়ােজন করা হলাে তখন চারু মহাখুশি বলেন—“গান-বাজনা, নাচ, তির ছােড়া সব লাগাও!” পার্টি নীতি তখন সামগ্রিকভাবে “শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণ”-এর দিকে দ্রুত এগিয়ে চলেছে এবং মধ্যপন্থা ছেড়ে প্রগতিশীল বুর্জোয়াকে সাহায্য করার জন্য “নেহরুর হাত শক্তিশালী করার প্রবণতা জোরদার হচ্ছে। চারু মজুমদার শহর ও গ্রামে কংগ্রেস সংগঠন “দালাল ছাড়া আর কিছুই না” বলে সম্বােধন করতেই থাকলেন। শিলিগুড়ির মিউনিসিপাল নির্বাচনের পার্টির বাইরের প্রগতিশীলদেরও পার্টির নামেই নির্বাচন করালেন। এস সম্পর্কে নাগরিক সমিতি করার প্রশ্নটিকে একেবারেই নাকচ করে দিলেন। জেলা পার্টির বা স্থানীয় কমিটির সম্পাদক অন্যেরা হলেও বিশেষ রাজনৈতিক বিষয়ের ক্ষেত্রে চারু মজুমদারের জোর দিয়ে বলার ভঙ্গিতে সকলেই তার কথা মানতে বাধ্য হতাে। ঐ নির্বাচনে শােচনীয় পরাজয়ের পর পার্টিতে প্রচণ্ড অভিযোেগ “চারুবাবুর সংকীর্ণতাবাদের জন্যই হেরে গেলাম।” চারু মজুমদারের সাফ জবাব- “এমনিতেই আমরা হারতাম। এক্ষেত্রে তাে পার্টির সরাসরি বক্তব্য আমরা বলতে পেরেছি। সমিতি-ফমিতি তাে ডিফারেন্সিয়েট করতে পারত না লােকে।”
কৃষক ফ্রন্টের এক সর্বক্ষণের কর্মী এক উদ্বাস্তু মেয়েকে বন্ধুদের সহযােগিতায় বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে এসে গান্ধর্ব মতে বিয়ে করে ফেলল। কয়েকদিন পরেই মেয়েটি বাপের বাড়ি গেলে তাকে জোর করে সাক্ষী দিয়ে অপহরণের দায়ে কর্মীটির তিন বছর জেল হলাে। বদনামের ভয়ে পার্টির বেশিরভাগ নেতাই কর্মীটিকে পার্টি থেকে সাসপেন্ড করল। চারু বললেন, “তােমাদের সিদ্ধান্তে তাে বাধা দিতে পারলাম না। তবে উইল দিয়ে আমি ওর কেস ডিফেন্স করব। মেয়েটাকে ও ভালােবেসেছিল, তােমরা তাে হােলটাইমারের মানবিক দিকটাকে দেখলে না?” “সাত্ত্বিকতা’, ‘ব্রহ্মচর্যকে মার্কসবাদের অঙ্গীভূত করে এক ‘নৈতিক মানা এদেশের পার্টিতে দৃঢ়ভাবে গেঁথে আছে। বন্ধুবান্ধবদের সাথে মাঝে মাঝে যখন মদ খেতেন, তখন তরুণ নেতা কমরেডরা নাক সিঁটকে বলত—“চারুদা, এটা ঠিক হচ্ছে না!” বড় চোখ দুটো আরও বড় করে বলতেন— “দ্যাখ বাপু, মদ খেলেই যদি নৈতিক অধঃপতন হয়, তবে সেটা তাে শুরু হয়েছে মার্কসবাদের গােড়া থেকেই। আমার গুরুরা মাকর্স সাহেব, স্ট্যালিন সাহেব তাে মদ্য ভক্ষণের রাজা ছিলেন হে। আর মাও সে তুঙ? রােজ ব্রেকফাস্টে একটি পুরাে বােতল লাগে!” কমরেডরা মাথা চুলকে বলত- “ওটা তাে ওসব দেশের রেওয়াজ? আমাদের দেশের মানুষের তাে সংস্কার অন্য রকম।” চারু হা-হা করে হেসে বলতেন“তাহলে লেংটি পরে, গায়ে ছাই মেখে পার্টি করাে না কেন? লােকে ভক্তিতে গলে যাবে! ঐ সংস্কারের সাথে খাপ খাইয়ে বিপ্লবী রাজনীতি করার ব্যাপারটাকে আমি গান্ধিবাদ ছাড়া আর কিছু ভাবি না। আমি মার্কসবাদী, -আউট অ্যান্ড আউট।” সেই চিরাচরিত মন্তব্য হতাে- “চারুদার তাে সব ভালাে, কিন্তু এত একগুঁয়ে! নিজের বুঝটাকেই সব সময়েই থিওরাইজ করে দেবে।
পৃষ্ঠা: ৭০
‘৫৮ সালের প্রথম দিকে অমৃতসরে কমিউনিস্ট পার্টির বিশেষ পঞ্চম কংগ্রেস ডাকা হলাে। চতুর্থ কংগ্রেস ‘৫১ সালের কর্মসূচি সংশােধনগুলােকে আরও বিস্তৃত করাও যেমন এই কংগ্রেসের লক্ষ্য ছিল তেমনি সাংগঠনিক দিক থেকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রে উত্তরণের’ ধ্যানধারণার পক্ষে বহুমতের জন্য ঢেলে সাজানােটাই ছিল মূল উদ্দেশ্য। এই কংগ্রেসে একটি নতুন গঠনতন্ত্র গ্রহণ করা হলাে যার মুখবন্ধে ‘শান্তিপূর্ণ পথের কথা ‘আমাদের লক্ষ্য বলে উল্লেখ করা হলাে এবং পুরানাে কেন্দ্রীয় কমিটি ও পলিট ব্যুরাের জায়গায় বড় মাপের জাতীয় পরিষদ (National Council) ও তার উপরে জাতীয় কার্যকরী কমিটি (National Executive) গঠনের বিধি স্থির করা হলাে। রাজনৈতিক প্রস্তাবের মােদ্দা বক্তব্য হলাে-“পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, ভূমি সংস্কার, যুদ্ধের বিপক্ষে এবং শান্তিও স্বাধীনতা সংহত করার জন্য নেহরুর নেতৃত্বে ভারত সরকার যে পদক্ষেপ নিয়েছেন তাতে জাতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির স্বাধীন আকাঙ্ক্ষা ও সাম্রাজ্যবাদের সাথে দ্বন্দ্ব প্রকাশ পাচ্ছে। কিন্তু বুর্জোয়ারা নিজেদের মধ্যেকার বিরােধের জন্য ও পুঁজিবাদী কায়দায় অগ্রসর হওয়ার জন্য সংকট দেখা দিচ্ছে। কমিউনিস্ট পার্টির দায়িত্ব এই কাজগুলােকে সমাজতন্ত্র গঠনের কাজের জন্য নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসা। একদিকে শ্রমিক-কৃষক ও বুদ্ধিজীবীকে সংগ্রামে নিয়ে আসা, উৎপাদন বৃদ্ধির কাজেও ব্যবহার করা এবং কেরালার মতাে রাজ্যে রাজ্যে গণতান্ত্রিক সরকার গঠন করে জাতীয় উন্নতি ও স্বাধীনতাকে সংহত করার কাজে জাতীয় বুর্জোয়াদের প্রগতিশীল অংশের হাত শক্তিশালী করার কাজে পার্টিকে প্রধান উদ্যোগ নিতে হবে।” ক্রুশ্চেভের ‘শান্তিপূর্ণ পথের’ পুরােপুরি প্রভাব অজয় ঘােষ পার্টিতে নিয়ে এলেন। অথচ অল্প কিছুদিন আগে ‘৫৭ সালের ডিসেম্বর মাসে মস্কোতে যে বারাে পার্টির যুক্ত ঘােষণা (আলবানিয়া, বুলগেরিয়া, হাঙ্গেরি, ভিয়েতনাম, জার্মানি, চীন, কোরিয়া, মঙ্গোলিয়া, পােল্যান্ড, রুমানিয়া, সােভিয়েত ইউনিয়ন ও চেকোস্লোভাকিয়ার কমিউনিস্ট পার্টিগুলাে) প্রস্তুত করা হয়েছিল তাতে বলা হয়েছিল শান্তিপূর্ণ বা অশান্তিপূর্ণ উপায়ে জাতীয় মুক্তি ও সমাজতন্ত্রের প্রশ্ন নির্দিষ্ট দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে। বিশেষ অগ্রসর দেশেই কেবল কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে শ্রমিকশ্রেণি নিয়মিত সংগ্রামের মারফত প্রতিক্রিয়াশীল শক্তিগুলােকে পর্যুদস্ত করে পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে। এবং সেই সব দেশেই শান্তিপূর্ণ পথের কথা ভাবা যায়। সেটাও নির্ভর করে শাসকশ্রেণির প্রতিবিপ্লবী আক্রমণের ক্ষমতা কতটা খর্ব করা যাবে তার উপর।”
পঞ্চম কংগ্রেসেই পার্টির মধ্যে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত একটি স্পষ্ট ভাগ হয়ে যায় ‘শান্তিপূর্ণ উপায় ও সহাবস্থান’-এর প্রশ্নে। প্রায় প্রত্যেক রাজ্যের প্রতিনিধিদের এক অংশ শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে বামপন্থি পার্টিগুলাের সংযুক্ত গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের বক্তব্য রাখলেন সাম্রাজ্যবাদ সমান্ততন্ত্রের অবশেষকে উচ্ছেদ করার জন্য বৃহৎ বুর্জোয়া ও বৃহত জমিদারদের কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে, আর পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের শক্তিশালী অংশ ও রাজ্যগুলােতে এঁদের সমর্থকরা জাতীয় বুর্জোয়াকে সাথে নিয়ে শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠনের বক্তব্য রাখলেন। তখন থেকেই ইউডিএফ-ওয়ালা এবং এনডিএফ-ওয়ালা বলে পার্টিতে দুটি ভাগ এলাে। ইউডিএল-এর প্রবক্তাদের মধ্যে থেকে (পশ্চিম বাংলা, অন্ধ্র ও কেরালায় প্রধানত) ক্রুশ্চেভের নীতিকে সংশােধনবাদ আখ্যা দেওয়া হতে লাগল, তবে প্রকাশ্যে নয়। পশ্চিম বাংলায় প্রমােদ দাশগুপ্তের উৎসাহে সরােজ দত্ত সােভিয়েত পার্টির বিংশতি কংগ্রেসে ও পরে আলবানিয়ার পার্টি অভ লেবার প্রকাশিত এনভার হােজার সংশােধনবাদ-বিরােধী দলিগুলাে গােপনে ছেপে বিলি করার ব্যবস্থা করলেন। এর যে ফাইলটি ছিল তাকে সরােজ দত্ত বলতেন-“বাপের ব্যাটা ফাইল।”
চারু মজুমদার ইউডিএফ-এর পক্ষে দৃঢ়ভাবে দাঁড়ালেন। দার্জিলিং-এর সমগ্র পার্টিতেই ক্রুশ্চেভ বিরােধী মনােভাব জোরদার হয়ে উঠছিল। পঞ্চম কংগ্রেস থেকে ফিরে আসার পর চারু মজুমদারকে যখন তাগাদা করা হতে লাগল জেলা কমিটির কাছে রিপাের্ট করতে তখন গেল খাতায় কিছুই নােট করা নেই। কেবল এক একজন বক্তার নামের পাশে গালাগালি সূচক মন্তব্য। যেমন—“অজয় ঘােষ-ডুবিয়ে দিল”; “ভূপেশ গুপ্ত অসহ্য” প্রভৃতি। মস্কোতে অনুষ্ঠিত ‘৫৭ সালের বারাে পার্টির দলিল সম্বন্ধে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্য টুকরাে টুকরাে ভাবে এসে পৌছাচ্ছিল। একটা কথা শােনা গেল যে ভারতের কমিউনিস্টদের চীনের কমরেডরা জিজ্ঞাসা করেছিলেন“কেরালায় তােমারা যে সরকার গড়েছ তাতে তােমাদের সৈন্যবাহিনীর শক্তি কত? কেন্দ্রীয় সরকারের হামলা রুখতে পারবে?” ভারতের কমরেডরা বললেন-“কী যে বলে? ইন্ডিয়ার সিচুয়েশানটাই এরা বােঝে না। শুধু ফৌজ আর লড়াই ছাড়া আর কোনাে বুঝ নেই।”
বারাে পার্টির দলির সম্বন্ধে চীনের পার্টির যা বক্তব্য পাওয়া গিয়েছিল তা হচ্ছে-
(১) শান্তিপূর্ণ উপায়ে মুক্তির সাথে অশান্তিপূর্ণ উপায়টিও পরিষ্কার না থাকলে বিপ্লবের ধ্যানধারণাই পালটে যায়। (২) শান্তিপূর্ণ উপায়ে অর্থে কখনই পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতাকে ধরা উচিত না। (৩) শান্তিপূর্ণ উপায় ধারণাটিকে মনােভাবের পর্যায়ে রাখা উচিত। আমরা নিশ্চয়ই চাই শ্রেণি-শােষণ থেকে মুক্তি শান্তিপূর্ণ উপায়েই হােক— কিন্তু চাওয়া কার্যকরী করার মধ্যে প্রভেদ রাখতে হবে। (৪) আজ পর্যন্ত পৃথিবীতে কোথাও শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাজতন্ত্রের পথে সামাজিক বিপ্লব সম্পন্ন করার ঘটনা জানা যায়নি। (৫) এ সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে ঐক্যের খাতিরে আমাদের অন্যদের মতামত সম্বন্ধে সহনশীল হতে হবে প্রভৃতি।
‘৫৮ সালের মধ্যভাগ থেকেই চারদিকে আন্দোলন দানা বেঁধে উঠতে থাকল। খাদ্য সংকট দেখা দিলে লাগল, বেতন বৃদ্ধির দাবিতে মাধ্যমিক শিক্ষকদের মিছিলে লাঠি চলল কলকাতায়। বেনামা জমি আন্দোলনের জোরে আদায় করা প্রশ্ন কৃষকদের মধ্যে উঠতে লাগল। পার্টির মধ্যে একদল আন্দোলন করে সরকারি পরিকল্পনাকেই কার্যকারী করাও’ বললেন, আর একদল ‘জোর আন্দোলনের দ্বারাই জনগণের দাবি আদায় ও ভূমি সংস্কার হবে’ বললেন কিন্তু আন্দোলন কতদূর যাবে তা কেউ বলেন না। শেষােক্ত পক্ষে সম্পূর্ণভাবে থাকলেও আন্দোলনের লক্ষ্য সম্বন্ধে চারু মজুমদারও পরিষ্কার না। এদিক কেরালা সরকার জমিতে নিম্নতম সীমা বেঁধে, ভূমি হস্তান্তরকে বেআইনি বলে এবং বাগিচা, বাগান, গাে-পালন কেন্দ্র প্রভৃতির নামে জমিদারের বিশেষ জমি রাখা বন্ধ করে এক ভূমি সংস্কার বিল আনল। কেরালার খেতমজুর ও ঠিকা শ্রমিকের ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ, কলকারখানায় মজুরি বৃদ্ধি, পুলিশের গণতন্ত্রীকরণ ও সকলের জন্যই আন্দোলন ও সংগঠনের অধিকার প্রদান করা হলাে। এগুলােকেই সংবিধানের মধ্যে সীমিত ক্ষমতাতেও ‘শ্রমিক-কৃষকের গণতান্ত্রিক সরকার কী করতে পারে বলে দেখানাে হতে লাগল এবং একমাত্র কমিউনিস্ট ছাড়া সংবিধানকে জনগণের পক্ষে এমনভাবে ব্যবহার ভারতে আর কোনাে শ্রেণির পার্টিই করতে পারবে না বলে পার্টির বক্তব্য হাজির করা হলাে। কেরালায় ক্যাথলিক চার্চ ও নায়ার সার্ভিস সােসাইটির কেরালা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকে চরম প্রতিক্রিয়াশীলদের ‘গণতান্ত্রিক কাঠামাে ভেঙে ফেলার চক্রান্ত বলে বলা হতে লাগল সংগ্রামী মনােভাবের কমিউনিস্টদের উপর এর একটি নেতিবাচক প্রভাব পড়ল যার বাইরে চারু মজুমদারও যেতে পারেননি।
‘৫৯ সালে শুরু হলাে ভারতব্যাপী গণ-আন্দোলন দিয়ে। সারা ভারতেই তখন খাদ্য সংকট বিকটরূপ ধারণ করেছে। তামিলনাড়ু, ইউ.পি, বিহারে হাজারে হাজারে মানুষ খাদ্যের দাবিতে বিধান সভা অভিযান, সত্যাগ্রহ করতে লাগল। এর মধ্যে ফেব্রুয়ারি মাসে জলকর বৃদ্ধির বিরুদ্ধে পাঞ্জাবে বিশাল এক কৃষক আন্দোলন ফেটে পড়ল। পুলিশের গুলিতে আটজন কৃষক নিহত হলাে, তার মধ্যে দুজন নারী। আঠারাে হাজার কৃষককে গ্রেপ্তার করা হলাে, তাদের মধ্যে আট হাজারের সাজা হলাে কোর্ট থেকে। জুলাইতে কেন্দ্র কেরালা সরকারকে বরখাস্ত করল। এই প্রশ্নে প্রথম যখন কেরালা সরকার বিরােধী আন্দোলন হচ্ছিল তখন পার্টি নেতৃত্ব বলেছিল প্রতিক্রিয়াশীলরা বৃথাই কেন্দ্রের হস্তক্ষেপের আশায় পথ নিচ্ছে। সরকারের বরখাস্ত হওয়ার পর প্রথমে বেশ হতভম্ব হয়ে ভাবছিল নেতৃত্ব। তারপর বলা হলাে প্রতিক্রিয়াশীলরা কেন্দ্রেও চাপ সৃষ্টি করছে।”
কেরালা সরকারের বরখাস্তের বিরুদ্ধে সারা ভারতেই কমিউনিস্ট নেতৃত্বে বিক্ষোভ হলাে। সারা পশ্চিম বাংলায় বিক্ষোভ মিছিল হলাে। শিলিগুড়িতে মিছিলে বৃষ্টিতে ভিজে চারু সকলের সাথে শহর পরিক্রমা করলেন। পশ্চিম বাংলায় খাদ্য আন্দোলন কিছু দেরিতে হলেও সারা পশ্চিম বাংলায় ঢেউ বইয়ে দিল কলকাতার শহর ও গ্রামের সব মিলিয়ে প্রায় তিন লক্ষের মিছিল হয়েছিল। ২৯শে আগস্ট শহিদ দিবস উপলক্ষ্যে ছাত্র, শহরবাসী ও কৃষকের এক বিশাল মিছিলের উপর আক্রমণ করে পুলিশ ৮০ জনকে হত্যা করেছিল। খাদ্য মন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে আবার সারা বাংলায় বিক্ষোভ হলাে।
শিলিগুড়ির তরাই অঞ্চলে বেনামা জমি উদ্ধারের আন্দোলন এক জঙ্গিরূপ নিয়ে ফেলল— কানু সান্যালসহ কৃষক নেতাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরােয়ানা বের হলাে। বেনামা জমির ধান জব্দ করতে কোনাে সময়ে ২-৩ হাজার কৃষকও জমা হয়, আবার পুলিশ আসার আগেই সরে পড়ে। চারু মজুমদার নিয়মিত যােগাযােগ রাখেন। আন্দোলনের সাথে। গ্রেপ্তারদের জামিন নেওয়ার ব্যবস্থা, আহতদেরকে শহরে এনে চিকিৎসা করানাে, সব ব্যাপারেই তাঁর নজর। সরকার কর্তৃক সমস্ত বেনামা জমি অধিগ্রহণের আশ্বাসের ভিত্তিতে প্রাদেশিক কমিটি আন্দোলনের সমাপ্তি ঘােষণা করতে বলল। প্রায় তিন হাজার কৃষক সভায় চারু মজুমদার আন্দোলন তুলে নেওয়া হচ্ছে। কেন জানলেন। সাথে সাথে দখলিকৃত, বেনামা জমির অধিকার রাখতে বললেন কৃষকদের। সভার শেষে চারু মন্তব্য করলেন- দেখলে তাে? কানু কিছুই বলল না? আসলে এই সিদ্ধান্ত ওর পছন্দ হয়নি। পছন্দ না হওয়াটা খুবই স্বাভাবিক। আন্দোলন যখন জঙ্গি হয়ে ওঠে তখন মাস লিডাররা জানে সেই আন্দোলন বন্ধ করে দেওয়া কত বেদনাদায়ক।
পার্টির কেন্দ্রয়ী কমিটির তরফ থেকে জাতীয় পরিষদে পক্ষে সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘােষ বললেন-“সাম্রাজ্যবাদী ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে জাতীয় অর্থনীতির পুনর্গঠনের জন্য জনগণের যে আকাঙ্ক্ষা সেটাই আজ সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব এবং এর মধ্য দিয়েই জাতীয় বুর্জোয়াদের সাথে সাম্রাজ্যবাদের দ্বন্দ্ব প্রকাশ পাচ্ছে।” চারু মজুমদার এতে মন্তব্য করেছিলেন ‘বােগাস’!
ভারতের জাতীয় বুর্জোয়া সরকার ‘৫৮ সালের শেষ ভাগ থেকেই চীনের সাথে সীমানা নিয়ে গােলমাল করতে শুরু করেছে। ঠিক তখন চীনের সরকার আমেরিকার বিরুদ্ধে ‘খাম্পা’ যাযাবরদের সশস্ত্র করে তিব্বতের সীমানায় ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযােগ করলেন তখনই ভারত সরকার চীন এলাকায় ‘অ্যাডভান্সড পোেস্ট করার প্রচেষ্টা চালাতে লাগল। নেহরুর গােপন উপদেষ্টা ও বিসিআই-এর তৎকালীন বড় কর্তা ভােলা মল্লিক তার চাইনিজ বিট্রেয়াল’ বইটিতে স্পষ্ট লিখেছে যে, নেহরু আমাকে চীনের এলাকা পর্যবেক্ষণ শিবির ক্রমাগত এগিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেছিলেন। বি. মল্লিকের মতে নেহরু ভেবেছিলেন যে চীন সমাজতন্ত্রী বলে প্রতিবাদ করে যাবে, কিন্তু সংঘর্ষ করতে ভরসা পাবে না। চীন সরকার দুবার সাবধান করে দিয়ে তৃতীয়বার ‘অ্যাডভান্স পােস্ট উড়িয়ে দিয়ে তিব্বত এলাকার মধ্য থেকে চারজন ভারতীয় সৈন্যের মৃতদেহ নিয়ে যেতে বললেন। এই নিয়ে ভারতের লােকসভায় স্বয়ং নেহরু উগ্র জাতীয়তাবাদী বক্তব্য রাখলেন পশ্চিমবাংলায় অতুল্য ঘােষ, ডা. বিধান রায় চীনের বিরুদ্ধে বিষােদগার করে বেড়াতে লাগলেন। কমিউনিস্ট পার্টির সম্পাদক বললেন-‘ব্যাপারটা দুঃখের। কিন্তু পশ্চিম বাংলার সর্বত্র কমিউনিস্টরা মিটিং, পােস্টার ও পুস্তিকা মারফত চীনের মাটিতে ভারতীয় প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে ব্যাপক প্রচার চালাল। অনেক সভায় কংগ্রেসিরা হামলাও করল। শিলিগুড়ির সভার আগেই চারু মুজমদার বললেন-“কিছু সমানে আর কিছু পিছনে দিয়ে আমাদের ছেলেদের বসিয়ে রেডি থাকতে বলল। আর কিছু বাইরে থাক লাঠি-ডান্ডা ইত্যাদির চার্জে। দরকার হলে ঝাড়বে। অবশ্য কংগ্রেসিরা এখানকার মিটিং-এ হামলা করার শক্তিও রাখত না।
কয়েকজন কর্মী এসে বলল ‘চারুদা, রিকশাওলাদের সাথে যােগাযােগ হয়েছে।’ চারু বললেন— “মিউনিসিপ্যালিটির আর পুলিশ জুলুমের বিরুদ্ধে এবং মালিকের কিস্তি কমানাের দাবিতে স্ট্রাইক ডেকে দাও।” আওয়াজ দিতেই হাজার দেড়েক রিকশা শ্রমিকের জমায়েত। চারু মজুমদার মেতে গেলেন— সকাল ৯টার মধ্যেই স্নান করে কিছু খেয়ে, কোনােদিন না খেয়েও সারাদিন হরতালি রিকশা শ্রমিকের সাথে কাটাল। বেশিরভাগই বিহারি শ্রমিক, বিহারের জেলা হিসেবে তাদের আস্তান। চারুবাবুর ডাক পড়ে এক একদিন সন্ধ্যায় এক এক আড্ডায়। চারু তাদের সাথে আলােচনা করেন। তাদের তেজপাতা, গােলমরিচ দেওয়া চা কলাই-করা গ্লাসে খেতে খেতে, “কেন কৃষক তারা রিকশা চালাতে শহরে এলাে, কোন জায়গায় বাঙালি কৃষক বিহারি কৃষক এক; শােষণ বস্তুটা কীভাবে আসে ইত্যাদি।” একমনে শােনে রিকশাওয়ালা মাঝে মাঝে এক একটা চারুকে এগিয়ে দিতে দিতে! পার্টির মধ্যে তাে দুই লাইনের বিতর্ক জোর। ‘জাতীয় ফ্রন্ট’-ওয়ালারা কেউ কেউ প্রবীণ হলেও জানে এই চারু মজুমদার লােকটাকে ঠেকিয়ে না রাখলে লাইন চালানাে যাবে না। তারা ইতােমধ্যেই গুনগুনানি শুরু করেছিল যে চীন একটু চুপচাপ থাকত তাহলে কংগ্রেসি আমাদের জাতীয়তা বিরােধী বলে লােককে ভ্ৰিভান্ত করতে পারত না। রিকশা আন্দোলনে তারা প্রথম যােগাযােগকারী তরুণদের ধরে বলতে লাগল- “দেখছাে! তােমরাই সব করলে আর চারুবাবু কেন। নেতা হবেন।” কর্মীরা সব দেখেও ভাবে “চারুদা সব সুযােগটাই নিয়ে নিচ্ছে।” কিন্তু রিকশাওয়ালারা সব সময়ে চারুবাবুকেই চায়। হরতালে জয়লাভ করে বিজয় মিছিলে প্রথমে গলায় মালা চারু মজুমদারের। চারুবাবু কী জয়” আওয়াজ “জাতীয় ফ্রন্ট”ওয়ালাদের নিরাশ করে দেয়। এই ‘৫৯ সালেই দালাই লামার দলবল নিয়ে পালিয়ে আসা উপলেক্ষ্য শিলিগুড়িতে আমেরিকা, ব্রিটিশ, ফরাসি, পশ্চিম জার্মানির সাংবাদিকের ভিড়, ভারত সরকারের প্রতিরক্ষা সচীবের লেখা বিবৃতি, দালাইলামা কর্তৃক জনসভায় পাঠ প্রভৃতিতে ভারত সরকার চীন বিরােধী ভূমিকা আরও প্রকট হলাে।
গণ আন্দোলন টুকটাক করে চলছেই- আবার স্থানীয় পার্টিতে খেয়ােখেয়িও বেড়ে গেল। চারু মজুমদারের কাছে পরিষ্কার লাইন কিছু আসছে না, অথচ পার্টির দিশা
পৃষ্ঠা: ৭৫
সম্বন্ধে প্রচুর বিরাগ। ‘জাতীয়তাবাদের নামে দুনিয়ার বেনাে জল ঢুকছে পার্টিতে- এই তার ধারণা। “উপরে, নিচে দুদিকেই নজর রেখে চল। কমরেডদের বিক্ষোভ বাড়তে দিও না- ওগুলাে নেতৃত্ব বিরােধী বিক্ষোভে নিয়ে যাবে ধান্দাবাজরা।” মনমেজাজ খারাপ, ক্লাবে আড্ডা দেওয়া বেড়ে যায় চারু মজুমদারের, মাঝেমধ্যে নেশা করার বন্ধুরাও জুটে যায়। এদেরই কেউ কেউ পার্টির মধ্যে গুঞ্জন তােলে- “চারুবাবুর মতাে স্ট্যাচারের লােকের কি নেশা করা উচিত?”
‘৬০ সালে বড় বড় ধর্মঘটের ঢেউ এলাে, রেল ধর্মঘটের ডাক দেওয়া হলাে, ইন্ডিয়ান এয়ার লাইনস্-এ পােস্ট অ্যান্ড টেলিগ্রাফে ধর্মঘটের প্রস্তুতি চলতে লাগল। শিলিগুড়ি রেলে তখন মজদুর ইউনিয়নে পার্টির প্রাধান্য। ‘৫৬ সালে ডাঙ্গে ও অজয় ঘােষ মিলে রেলে লালঝান্ডা ইউনিয়ন না করার স্বপক্ষে এক দলিল দিয়েছিলেন। ডাঙ্গে চা বাগানেও লালঝান্ডা ইউনিয়নকে ‘ইনকিলাব জিন্দাবাদ’ আওয়াজ দিতে মানা করেছিলেন। এঁদের বক্তব্য ছিল ‘৪৯ সালে পার্টির ‘উগ্র বামপন্থি লাইনের জন্য লাল ঝান্ডা সম্বন্ধে শ্রমিকদের মধ্যে ভীতির সঞ্চার হয়েছে এবং রেলে আমাদের ইউনিয়নের উপর সহজেই হামলা আসতে পারে। পিএসপি-র মজদুর ইউনিয়নের মধ্যে পার্টির লােকজন কাজ করতে অনিচ্ছুক হচ্ছিলেন। চারু মজুমদার তাদের বললেন ‘ঢুকে গিয়ে দখল করুন। কেউ কেউ পিএসপি-র প্রতি বিরক্ত হয়ে আইএনটিইউসি ইউনিয়নে ঢুকে গেল। রেলে হরতালের প্রচারে পার্টির লােকদের বিরুদ্ধেই গ্রেপ্তারি পরােয়ানা বেরােল। চারু মজুমদার কাছাকাছি একটি চা-বাগানে এদের আত্মগােপন করে থাকার ব্যবস্থা কররেন। চা-বাগানের বাবুরাই থাকার জায়গা দিল চারুবাবুর কথায়, অবশ্য রেলের টিকিট ও অন্যান্য সুযােগ সুবিধার জন্য বাগানের বাবুরাও রেল কর্মচারীদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিল। সংগ্রামগুলাের মধ্যে দিয়ে যতই পার্টির প্রভাব বাড়ছে, ততই পার্টি কর্মসূচি ও নীতি সম্বন্ধে পার্টির মধ্য দ্বিধা, সংশয় বাড়ছে। ওদিকে সমস্ত বুর্জোয়া পার্টিগুলাে চীনের বিরুদ্ধে জেহাদ চালিয়ে যাচ্ছে।
এই ‘৬০ সালেই পৃথিবীর ৮১টি পার্টির সম্মেলন হলাে মস্কোতে এবং একটি মিলিত ঘােষণাপত্রও প্রকাশিত হলাে। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের এটিই ছিল শেষ বৈঠক। এই ঘােষণাপত্র এক ধরনের ঐক্য রক্ষার দলিল হওয়ায় যেকোনাে পক্ষই যেকোনাে অর্থ করতে পারছিল। ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এই দলিলকে “কমিউনিজমের দিকে বিরাট পদক্ষেপ’ বলে আখ্যা দিলেও, নিচুতলার কর্মীদের মনে কোনাে নতুন আশার সঞ্চার হয়নি। পার্টির মধ্যে দক্ষিণপন্থি, ঝোঁকের প্রাবল্যে হিন্দিভাষী এলাকার পার্টি সংগঠন কংগ্রেসের সাথে মিলে কর্মসূচি করতে গিয়ে স্বাতন্ত্র হারাচ্ছিল।
চারু মজুমদার একবার পৌরসভার কমিশনার নির্বাচিত হলেন। কিন্তু এ কাজে যে ধরনের জনসংযােগ করতে হয় তাতে তার বিরক্তির ফলে অচিরেই পার্টিতে সমালােচনা হতে লাগল। মেথর ধর্মঘটে কর্যবিরতির সময়কার মুজরি দেওয়ার প্রশ্নে পৌরসভাপার্টির জন্য ‘বিরােধীরা’ আওয়াজ দিল চারু মজুমদারকে- “আপনি কেন এটা মেনে নিলেন।” চারু মজুমদার রেগে গিয়ে বললেন- “মিউনিসিপ্যালিটি তাে আমার বাপের সম্পত্তি না। প্রশ্ন তাে তােলা হয়েছিল, কিন্তু হেরে গেলাম। এখন গাঁটের থেকে তাহলে পয়সা দিতে হয়!” পৌরকর্মীরা বলে ‘চারুদার মতাে সরল লােক এখানে বদনামই কিনবে।’ পৌর মিটিং-এ যাওয়া বন্ধ করে তিনি একরকম ইস্তফাই দিয়ে রাখলেন।
পার্টির লাইন, ওদিকে দেশে চীন বিরােধিতা প্রাবল্য- সব মিলিয়ে নতুন ভাবনাচিন্তা করতে হবে” বলে কাজে ঢিলা দিতে থাকেন চারু। বাইরে মিটিং থাকলে প্রায়ই টালবাহানা করে এড়িয়ে যান। ট্রেড ইউনিয়ন নেতাদের বিরুদ্ধে টাকা পয়সার হিসাব না দেওয়ার অভিযােগ ওঠে। চারু মজুমদার বলেন- “এই আবহাওয়ায় এর চেয়ে অন্য আর কী আশা কর?” পার্টির মধ্যে দলবাজিতে কানু সান্যালও কৃষক সমিতির সম্পাদক পদে অন্যকে প্রতিষ্ঠিত করেন। চারু বলেন- “সেক্রেটারি যেই থাক কন্ট্রোল ছাড়বে না- না হলে ওরা সব বিকিয়ে দেবে।”
বাড়িতে অভিযােগ হয়- “বেশিরভাগ চুপচাপ বসে থাকো কেন? মিটিং এ না যাও, ক্লাবেই যাও! আরাে নেশাই যদি কর বাড়িতে কর।” চারু পা নাড়াতে নাড়াতে মাও সে-তুঙ এর রচনাবলি পড়তে থাকেন, লেনিনের “এক পা আগে, দুপা পিছনে” প্রবন্ধ বারবার পড়েন। মাঝে মাঝে ঘন চুল, এখন একটু পাক ধরা, মুঠো করে টানতে থাকেন। নেশা বেশ হয় মাঝে মাঝে। এই নেশা নিয়ে এক হ্যাঙ্গাম হলাে ‘৬১ সালে। বাইরের লােকের অভিযােগ এলাে “চারুদা মাতাল হয়ে রাস্তায় আবােল-তাবােল বকছিল।” পার্টিতে হইহই। নেতৃস্থানীয় একজন তাে পার্টি ছেড়েই দিতে চাইলেন, কানু সান্যাল তাকে বুঝিয়ে বলল- “বরঞ্চ চারুদার সাথে কথা বলা যাক।” এরই উপর জি. বি. মিটিং ডাকা হলাে। প্রথম মিটিং-এ চারু এলেন না। অসাক্ষাতে অনেক নিন্দা-মন্দ হলাে চারুর। দ্বিতীয় মিটিং-এ উপস্থিত হয়ে বললেন- “মদ খাওয়া না খাওয়ার সাথে কমিউনিস্ট হওয়ার সম্পর্কটা কেউ আমায় বুঝিয়ে দেবেন? পার্টির সংবিধানে মদ্যপান নিষিদ্ধ বলে কোথাও আছে কি? তবে মাতলামাে করা নিশ্চয়ই অন্যায় এবং আমারও তা করা উচিত নয়। মদ খেতেই হবে এটাকেও আমি কোনাে মানদণ্ড মনে করি না, আবার মদ খেলেই নৈতিকতা গেল সেটাও আমি বিশ্বাস করি না। আমি কমিউনিস্টদের মতােই ফিউডাল বা বুর্জোয় নৈতিকতায় বিশ্বাস করি না। পদে পদে সেই নৈতিকতাকে ভেঙে না চললে কোনাে না কোনাে সময়ে ঐ জালে জড়িয়ে পড়তে হবে।” অভিযােগকারীরা। নীরবে শুনেছিল।
পৃষ্ঠা: ৭৭
৭
কে দেবে সেই ভেরি
নিজেকে খুঁজে ফেরা তাে চারুর কাছে একেবারেই একটা নিজস্ব ব্যাপার না! এই খোঁজার মধ্যে আন্দোলনের, সংগ্রামের দিশা খোঁজা থেকে গিয়েছে, থেকেছে কমিউনিস্ট পার্টির দিক-নির্দেশের প্রশ্ন, থেকেছে জিজ্ঞাসা যে মুক্তির তূর্যনিনাদের সেই ভেরিকে কে তুলে দেবে সংগ্রামী কমিউনিস্টদের হাতে হাতে?
চারদিকে অসন্তোষ, খেটে খাওয়া সব মানুষই যেন কোনাে একটা কিছু বলতে চায়- তা দাবির লড়াই হােক আর ভাঙচুরই হােক। ডাক তাে কেউ দিচ্ছে না।-দাঙ্গা হাঙ্গামা লেগে যেতে থাকে। জব্বলপুর, আলিগড়, মীরাট, দিল্লিতে একপ্রস্থ হিন্দুমুসলমান দাঙ্গা হয়ে গিয়েছিল। শােষক শ্রেণির প্রতিনিধিরা জনগণের লড়াইয়ের মেজাজ বুঝতে পারছিল। তাই কী জামশেদপুর, কী মােরাদাবাদ সব জায়গাতেই কৰ্মীপ্রার্থী হিন্দুদের উসকাচ্ছিল যে তােমাদের রুজিরােজগারে তাে দখল নিয়েছে মুসলমান শ্রমিক, কারিগররা, ওদের মেরে ভাগাও পাকিস্তানে কী সরল যুক্তি আর তাতেই হানাহানি। ৫৯, ‘৬০ সালে যেন সমান্তরালভাবেই গণ আন্দোলনের সাথে পাল্লা দিয়ে চলেছে ভ্রাতৃঘাতী দাঙ্গা। এই ‘৬১-তে এসে বর্ণান্ধতা, প্রাদেশিকতা জুটে গেল সাম্প্রদায়িকতার সাথে। আসামে আসামী বাঙালি দাঙ্গায় শিলিগুড়িতে কয়েক হাজার বাঙালি পরিবার এলাে উদ্বাস্তু হয়ে। গাে-হত্যা নিয়ে শিলিগুড়িতে মুসলমানদের উপর হামলা করল জনসষ্মী মারােয়াড়িরা। গরুর মাংস বিক্রয় বহুদিন থেকে চলে আসছিল ওখানে। সেদিন পূর্ব পরিকল্পনা মতাে জনসঙ্রে কিছু লাঠিধারী “স্বেচ্ছাসেবক” এক দরিদ্র মুসলমানকে একটি ঝুড়িতে গাে-মাংস তুলে মাথায় নিয়ে এক প্রদর্শনী করাল রাস্তায়। একদিকে শুরু হলাে মুসলমানদের দোকানে হামলা আর জনসঙ্ঘের একটি বিরাট মিছিল বেরােল “মুসলমান সব পাকিস্তানে যাও, এদেশ হিন্দুদের” আওয়াজ দিতে দিতে। এক অদ্ভুত ঘটনার দাঙ্গার চেষ্টা অঙ্কুরেই ভেস্তে গেল। কমিউনিস্ট সমর্থক এক নামি ডাক্তার নিজের গাড়িতে যেতে গিয়ে ঐ মিছিলের সামনে পড়লেন। মিছিলের আওয়াজ শুনে তিনি গাড়ি থেকে নেমে একটি লাঠি কুড়িয়ে অসীম সাহসে মিছিলের সামনের সারির লােকদের পেটাতে শুরু করলেন। মুহূর্তে মিছিল ছত্রখান হয়ে গেল। পার্টি অফিসে খবর যেতেই কমিউনিস্টরা দলবেঁধে এসে পালটা মিছিল বের করল- মুসলমানদের আশ্বস্ত করল। কিন্তু কংগ্রেসি মাস্তানরা বেশ কয়দিন ধরেই মুসলমান পাড়ায় লুটপাট চালালফলে সন্ত্রস্ত মুসলমানরা স্থায়ীভাবে কংগ্রেসের ভােট কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
চারু মজুমদার আসাম উদ্বাস্তুদের পুনর্বাসনে, শিলিগুড়ির হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গা ঠেকানাের কাজে এগিয়ে আসতে আসতে বলতে থাকেন- “দাঙ্গা এক জায়গায় ঠেকালেই কি দাঙ্গা বন্ধ হবে? রাজনৈতিক দাঙ্গা- লেনিন পড়নি? ১৯০৫ সালে রাশিয়ায় ডাকাতি, দাঙ্গা-হাঙ্গামা যখন খুব চলছিল লেনিনের বক্তব্য ছিল বিপ্লবী পরিস্থিতিতে এমনটিই হতে থাকে!”
‘৬১ সালের এপ্রিল মাসে বিজয়ওয়াদায় ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেস ডাকা হলাে। অথচ কংগ্রেসের সামনে দেওয়ার জন্য কী জাতীয় পরিষদে, কী জাতীয় কার্যকরী কমিটি কোথা থেকেও কোনাে ঐক্যমতের দলিল প্রস্তুত করা গেল না- সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘােষ আক্ষেপ করে বললেন-“আমাদের মধ্যে মতবিরােধ এতদূর পর্যন্ত পৌঁছেছে যে মস্কোর ৮১টি পার্টির সম্মেলন এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির ‘বিরাট সাফল্যের মতাে ঐতিহাসিক ঘটনাবলিও আমাদের পক্ষ থেকে পার্টির সমানে একটি দিক-নির্দেশক (guide-line) উপস্থিত করতে অনুপ্রাণিত করলাে না!” কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের মধ্যে অনেক বাদানুবাদের ফলে ঠিক হলাে যে পার্টির কংগ্রেস চলাকালীন সাধারণ সম্পাদক একটি রাজনৈতিক রিপোের্ট উপস্থিত করবেন, যার উপর আলােচনা করে পার্টির কংগ্রেস চলতে থাকবে।
এই কংগ্রেস উপলক্ষ্যে বর্তমানে অনুষ্ঠিত রাজ্য সম্মেলনে শিলিগুড়ি থেকে কেবল একজন প্রতিনিধি গেলেন- চারু মজুমদার গেলেন না এবং তার অনুপস্থিতিতে পার্টি কংগ্রেসের প্রতিনিধি নির্বাচিত হলেও সেখানেও যেতে নারাজ হলেন। তাঁর বক্তব্য “গিয়ে তাে ঐ সব ‘ট্রাস’ শুনতে হবে বসে বসে, তার চেয়ে না গিয়ে অনেক শান্তিতে থাকা যাবে।”
রিকশা ইউনিয়নের সদস্য এক বিহারি রিকশাওয়ালা এক ব্যবসায়ীর পুত্র মারােয়াড়ি যুবককে মেরে বসল ভাড়া নিয়ে গােলমাল করার জন্য। রাস্তার বাঙালি যুবকরা হামলে পড়ল রিকশাওয়ালার উপর এত বড় সাহস রিকশাওয়ালার যে ব্যবসায়ীর ছেলের গায়ে হাত দেয়?’ ছেলেটি আবার এক বাঙালি ক্লাবে আজীবন সদস্য। চা-শ্রমিক নেতা বীরেন বােস প্রথম হামলা ঠেকিয়ে রিকশা শ্রমিকটিকে নিরাপদ জায়গায় সরিয়ে দিল। চারু শুনেই চলে এলেন অকুস্থলে। বললেন- “একশবার মারবে। ইউনিয়ন হয়েছে, এখন আমাদের দায়িত্ব রিকশাওয়ালাদের আত্মমর্যদা রক্ষা করা শেখানাে।” শহরের পার্টিতে মতবিরােধ হলাে এতে বাঙালি বিহারি হাঙ্গামা বাধবে কি না। কিন্তু চারু মজুমদারের বক্তব্যের কাছে সবাইকে নতি স্বীকার করতে হলে রিকশা শ্রমিকের পক্ষে বিড়ি শ্রমিকরা মিছিল করল! ওদিকে ঐ ক্লাবের সদস্য হিসেবে কিছু পার্টি সমর্থক বাঙালি যুবকও কংগ্রেসের সাথে ভিড়ে গিয়ে বিহারী-বিরােধী প্রচারপত্র বের করলাে আড্ডায় ঘুরে রাতে রিকশাওয়ালাদের উপর হামলা করার চেষ্টা করল। প্রায় মাসখানেক এভাবে চলার পর রিকশাশ্ৰমিকটি অবশ্য নিজেই গােপনে সমঝােতা করে ফেলেছিল।
নিজের রেডিও নেই। বন্ধু বন্ধাবদের বাড়ি গিয়ে সন্ধে সাতটার পর থেকে পিকিং রেডিও শােনার খুব ঝোঁক শুরু হলাে চারুর। ভারত সরকারের চীন বিরােধিতা উগ্র আকার ধারণ করেছে তখন। “ভালাে চা খাওয়াও দকিনি?”_“চীনা সাহেবরা কী বলেছেন এবার দেখা যাক”- বলে রেডিও খুলে বসলেন রাত নটা অবধি, তারপর একটু ক্লাবে তাস খেলে বাড়ি ফেরা। এমনিতেই বারবার বলে এসেছেন— “পার্টি অফিসে আমার রােজ না গেলেও চলেবে- টাউনের কাজের দায়িত্বে যারা, তারাই অফিস করুন!” “চারুদা অফিসে এলে কমরেডরা আলােচনারও সুযােগ পায়।” চারুর সাফ জবাব–“কাজকম্মাে, আন্দোলন নেই, পাঁচ বছর অন্তর ভােট করাে, তা পার্টি অফিসে গিয়ে কীসের আলােচনাটা, শুনি?” ছাত্ররা পার্টি অফিসের পাশেই ছাত্র ফেডারেশনের অফিস করল। মাঝে মাঝে সিগারেটের টান দিতে দিতেই ছাত্রদের অফিসে উঁকি দিয়ে দেখতেন যে একটি ছাত্রই মােমবাতির শিখাটাকে হাতের আড়াল দিয়ে হাওয়া বাঁচিয়ে বসে আছে। “কি একাই ধুনি জ্বালিয়ে রাখছাে?” ছাত্রদের একদিকে ডেকে বললেন- “শােনাে বাপু ‘ছাত্র অফিসে আসুন’ বললেই ছাত্ররা আসবে না। নাটকের রিহার্সাল, আড্ডা লাগাও, ছাত্রীদেরও বলাে সন্ধেয় একবার অফিসে আসতে। এতে ওদের বাড়ির বাধন আলগা হওয়ার সুযােগ হবে আর মেয়েরা অফিসে আসছে শুনলে ছেলেগুলােও ভিড় লাগাতে থাকবে। এতে লজ্জারও কিছু নেই, অন্যায়ও নেই। মেয়েরা অফিসে এলে ছেলে-মেয়ে দুই-ই গােল্লায় যাবে এই ভাবনা নিয়ে সমাজ পালটানাের লড়াই হয় না, বুঝলে?” ছেলেগুলাে মনে মনে খুশি হয় অনেক কমরেডকে দেখেছে তাে হাত মুঠ করে বিড়িতে টান দিয়ে গম্ভীর গলায় বলতে- “এ সবের ফল ভালাে হয় না।”
এক স্বচ্ছল পরিবারের মহিলা, তিন সন্তানের জননী, বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এলেন। ইনি মহিলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যাও ছিলেন, আবার সুনামও তেমন ছিল না। চারু বললেন- “তবু পুরুষ শাসনের বিরুদ্ধে এও এক বিদ্রোহ, মহিলাকে একটা থাকার ব্যবস্থা করে দাও। প্রায় পুরাে পার্টিতেই এ নিয়ে বিরাগ, আর- ‘চারুদার খামখেয়ালি’ বলে অভিযােগ। যিনি মহিলাকে আশ্রয় দিয়েছিলেন, তিনিই এক্ষেত্রে চারুর একমাত্র সহযােগী। চারু বলেন, “মজা দেখছাে আমরা মার্কসবাদী সব, ছােট্ট একটা ঘটনা নিয়ে রাতারাতি তত্ত্ব ছেড়ে কেবলমাত্র পুরুষ হয়ে গেলাম। এবার বুঝছাে নারীমুক্তি ব্যাপারটা কত কঠিন? এক্ষেত্রেও সকলেরই সব রকম যুক্তিকে অগ্রাহ্য করে চারু বললেন- “আমি মহিলাকে সাপাের্ট করছি মহিলা বিদ্রোহের সমর্থনে। যে যদি স্বামীর কাছে নিজে থেকে ফিরে যেতে চায়, নিশ্চয়ই বাধা দেবাে না, কিন্তু আমি কখনই
পৃষ্ঠা: ৮০
বুঝিয়ে-বাঝিয়ে পাঠাবাে না, এটা পরিষ্কার বলে রাখছি।” মহিলা কলকাতায় চলে যেতে চাইলে কলকাতার এক কমরেডের সাথে তাকে পাঠিয়ে দেওয়া হলাে। বছরখানেক পরে সে আবার বাড়ি ফিরে গেল।
এপ্রিল মাসে বিজয়ওয়াদায় অনুষ্ঠিত ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির ষষ্ঠ কংগ্রেসে কেন্দ্রীয় কমিটি অর্থাৎ জাতীয় পরিষদের পক্ষ থেকে কোনাে রাজনৈতিক প্রস্তাব দিতে সক্ষম না হয়ে সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘােস কংগ্রেস শুরু হলে পর একটি বক্তৃতা লিখিতভাবে উপস্থাপন করেন, যাতে কংগ্রেসের রাজনৈতিক রিপাের্ট ধরে নিয়ে আলােচনা হয়। এই বক্তৃতায় অজয় ঘােষ পার্টিকে আলােচনা ও পথনির্দেশের ক্ষেত্রে ‘৬০ সালে মস্কোয় অনুষ্ঠিত ৮১টি কমিউনিস্ট পার্টির যুক্ত ইস্তাহারের সেই অংশটিকেই মুখ্য বলেন যেখানে উল্লেখ আছে যে, এই যুগ হচ্ছে ‘সমাজতন্ত্রে আরও বিজয়ের যুগ, এবং সাম্যবাদের দিকে এগিয়ে যাওয়ার যুগ’ এবং তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তির জন্য ব্যাপক জমায়েত ও আন্দোলনই মূল আন্তর্জাতিক দায়িত্ব’; মস্কো ঘােষণার ‘সংশােধনবাদই আজ প্রধান বিপদ এবং জাতীয় মুক্তির জন্য সগ্রাম তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে একটি প্রধান সংগ্রামের উপায় বলে উল্লিখিত অংশগুলাের কোনাে কথা বললেন না।
পার্টি নেতৃত্বের মধ্যে মতবিরােধের জায়গাগুলাে কোথায় কোথায় বলতে গিয়ে বললেন- “আমাদের মধ্যে সরকারের সাথে বিরােধের বিষয়গুলাের উপরই জোর দিয়ে আন্দোলন করার এক সংকীর্ণ ধারণার ফলে শান্তি আন্দোলন, সরকারের প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতিকে সুসংহত করার জন্য আন্দোলন, দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিক প্রতিক্রিয়াশীলদের হাত থেকে রক্ষা করার আন্দোলন প্রভৃতি যেগুলােতে জাতীয় বুর্জোয়ার অংশকে টেনে আনা সম্ভব, তা হচ্ছে না। ফলে পার্টি তার জাতীয় ভূমিকা পালন করতে পারছে না।” দুদিকেই তাল রাখার জন্য তিনি যদিও বলেন- “আবার সংস্কারবাদী এক ধারণা পার্টিতে রয়েছে যে, উপরিউক্ত বিষয়গুলােতে নিজেদের উদ্যোগ নেওয়ার বদলে সবকিছুই নেহরুর নেতৃত্বের উপর ছেড়ে দেওয়ার ঝোঁক রয়েছে।” দেশের রাজনৈতিক অবস্থার বিশ্লেষণ করতে গিয়ে বলেন যে, সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক প্রগতিশীল নীতিকে বানচাল করার জন্য স্বতন্ত্র পার্টি, প্রজা সােশ্যালিস্ট পার্টি প্রভৃতি চরম প্রতিক্রিয়াশীল পার্টিগুলাে জনসমর্থন বাড়াচ্ছে- সান্দ্রায়িক শক্তি বেড়ে উঠছে, “জাতীয় সংহতির” বিপদ দেখা দিয়েছে। জাতীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার আকাক্ষা এবং সাম্রাজ্যবাদবিরােধিতা, যেটি জনগণের আজ মূল আশা, সেটি জাতীয় বুর্জোয়াদেরও আশা; কিন্তু সেই আশাকে শক্তিশালী করার জন্য দেশে গণতন্ত্রকে বলিষ্ঠ করার আন্দোলনে পার্টি পিছিয়ে থাকছে।”
অজয় ঘােষ স্পষ্ট করে বলেননি যে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কাজ নেহরুর হাতকে শক্তিশালী করা কিন্তু উপসংহারে তাঁর যে আক্ষেপ তাতে বিপজ্জনকভাবেই এটি প্রকাশিত হয়ে পড়েছিল। দ্বিতীয় সাধারণ নির্বাচনে পার্টির প্রতি বিপুল সমর্থন, ৫৯, ৬০, ‘৬১ সালগুলাের গণআন্দোলনের আশাব্যাঞ্জক বিবরণ দিয়ে তিনি বললেন, “গণতন্ত্রের শক্তিও যেমন বেড়েছে তেমনি চীনের সাথে সম্পর্কের অবনতিতে পার্টির ক্ষতিও প্রচুর হয়েছে। এই সুযােগে প্রতিক্রিয়াশীলরা ভারত সরকারের প্রগতিশীল নীতির বিরুদ্ধেই শুধু আক্রমণ করেছে তাই নয়, ভারতের কমিউনিস্টদের জাতীয়তাবিরােধী বলছে। সমাজতন্ত্রের ধ্যান ধারণাকেও এরা আক্রমণ করছিল কিন্তু সােভিয়েত ইউনিয়নের বুদ্ধিমত্তাকে ধন্যবাদ যে তা পারেনি। …চীনের সাথে সীমান্ত বিরােধের প্রশ্নে পার্টিতে উপর থেকে নিচ পর্যন্ত এতই তীব্র মতবিরােধ যে পার্টির পক্ষে এক্ষেত্রে কোনাে একমতের প্রস্তাব নেওয়া সম্ভব হয়নি বলে অজয় ঘােষ শেষ আক্ষেপ করেছিলেন যে, এই মতবিরােধের জন্যই নাকি নেহরুর প্রগতিশীল বৈদেশিক নীতির পক্ষে প্রচার সম্ভব হচ্ছে না এবং সােভিয়েত ইউনিয়নের নানা প্রভাবের ‘সমাজতান্ত্রিক’ সাহায্যের ফলে জাতীয় বুর্জোয়াদের সাম্রাজ্যবাদ বিরােধিতা যে আরও বাড়ছে সেটিও জনসাধারণকে জানানাে যাচ্ছে না।
আন্তর্জাকিত কমিউনিস্ট আন্দোলনের যে আদর্শগত বিরােধ, তার প্রভাব ভারতের কমিউনিস্টদের উপর এই ষষ্ঠ কংগ্রেসের আগে থেকেই স্পষ্টভাবে পড়তে শুরু করেছিল, এই কংগ্রেসের পর প্রকৃতপক্ষে পার্টির মধ্যেই সেটি চীনাপন্থি ও রুশপন্থি এই দুই ভাগে ভাগ করে দিল।
পশ্চিম বাংলার ভারত সরকারের চীনবিরােধী ভূমিকাকে প্রকাশ করে জনসভা হলাে সর্বত্র, প্রায় সবগুলােতেই বক্তা ছিলেন হরেকৃষ্ণ কোঙার। কিন্তু শ্রমিক-কৃষকের মিছিল সংগঠিত করার কাজ একেবারেই তা হলাে না, ফলে ভারত সরকার এবং প্রত্যেকটি অবামপন্থি দল যে উগ্র জাতীয়তাবাদের প্রচারে নামছিল তাকে সঠিকভাবে মােকাবিলা করা হলাে না। তবে এই প্রচার আন্দোলনের পশ্চিম বাংলায় অন্তত কমিউনিস্টদের মধ্যে একটি সংগ্রামী মেজাজ গড়ে উঠতে শুরু করল। আবার পশ্চিমবাংলার পার্টির মধ্যেকার বুদ্ধিজীবীরা পার্টি নেতৃত্বের কয়েকজন বিশিষ্ট নেতার, সােমনাথ লাহিড়ী, চিন্মােহন সেহানবীশ প্রমুখদের ‘সােভিয়েত পন্থায় প্রচারে বিভ্রান্ত হতে লাগলেন। পশ্চিমবাংলার পার্টির রাজ্য পরিষদে চীনের পক্ষে খুবই দৃঢ় মত যারা পােষণ করেছিলেন তার মধ্যে ছিলেন মুজফফর আহম্মদ, প্রমােদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার, ডা. রণেন সেন, বিজয় মােদক, সুশীতল রায়চৌধুরী, সরােজ দত্ত প্রমুখ। প্রমােদ দাশগুপ্তেরই প্রচেষ্টায় পার্টির নাম না দিয়ে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্কে আলবেনিয়ার দলিল এবং চীনের বিভিন্ন দলিলগুলাে প্রকাশনার ব্যবস্থা করতে লেগেছিলেন সরােজ দত্ত সেই ‘৫৬ সালের পর থেকেই।
তবু চারু মজুমদারের মন ভরে না। পার্টি নেতৃত্ব থেকে নিচুতলা পর্যন্ত শ্রেণি দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে, সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বিংশতি, একবিংশতি কংগ্রেস ক্রশ্চভ কর্তক সমগ্র কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংশােধনবাদের পঙ্কে নিমজ্জিত করার বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে এবং দুঃসাহসিকতার সাথে প্রকাশ্যে চীনের বিরুদ্ধে ভারত সরকারকে আগ্রাসী প্রতিপন্ন করে পার্টির মধ্যে দুই লাইনের লড়াইকে যারা জিইয়ে রাখছিলেন তাঁদের সমস্ত কাজই ছিল নেতিবাচক সমালােচনামূলক। ভারতের মুক্তির, ভারতীয় সমাজের পরিবর্তনের প্রশ্নে তাঁদের কোনাে বক্তব্য ছিল না। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে ‘জাতীয় বুর্জোয়া’র সাথে ঐক্যের নামে সমগ্র আন্দোলকেই ভারতীয় বুর্জোয়া শ্রেণির লেজুড়ে পরিণত করার যে কাজটি ১৯৪৬ সাল থেকে পি. সি. যােশী হাতে নিয়েছিলেন তা সম্পূর্ণ হতে চলেছিল ‘৬১ সালে, বেশি করে সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির মদতে। এই কানাগলি থেকে কমিউনিস্ট আন্দোলনকে বের করে নিয়ে আসার চেষ্টা তৎকালীন চীনা পন্থিরাও করার চেষ্টা করলেন না। এখানেই চারু মজুমদারের ছিল ক্ষোভ, অথচ তখনও তাঁর নিজের কাছেও পথের সুষ্ঠু ধারণা নেই, চারু বলেন- “সব বুঝেও তাে পথের খোঁজ করে চলেছি। আরে আমিও তাে এই কমিউনিস্ট আন্দোলনেরই শরীক; এর চাপ, গৌরব এবং বিচ্যুতির প্রভাব আমার উপরে পড়বে না?”
সন্ধ্যায় পিকিং রেডিও শােনা ছেড়ে হঠাৎ চারুর ঝোঁক হলাে নাটকের পরিচালক হওয়ার আসলে তার ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হলাে। ক্লাবের শিল্পীরা ‘চারুদা’ও বলে আবার ‘বুড়াে’ও বলে। তারাই বললাে- ‘বুড়াে’, এবার আমাদের নাটকে তুমিই ডাইরেকশান দাও।” পরিচালনা না করলেও, নাটক সম্বন্ধে তাঁর মন্তব্য, মহড়ার সময়ে শিল্পীদের পরমার্শ দেওয়াতে সকলেই নাটক সম্বন্ধে তাঁর জ্ঞানকে সমীহ করত। চারু বলে- “আমি কি ডাইরেকশান দেব রে ভাই! একবার “বন্ধু” নাটকে হাফপ্যান্ট পরে ছাত্রের পার্ট করতে গিয়ে তাে দুই হাঁটুতে ঠোকাঠুকি লেগে গেল ভয়ের চোটে!” নাটকের মহলায় সবাই খুব খুশি। কিন্তু মঞ্চস্থ হওয়ার আনন্দের আতিশয্যে নেশার মৌজ করেই হলাে বিপদ। ক্লাবে তার জনপ্রিয়তায় যাদের এতদিন গাত্রদাহ হচ্ছিল তারা সুযােগ নিয়ে বলল- “চারুবাবুকে বাড়ি পাঠিয়ে দিন। কেলেঙ্কারি হবে না হলে।” নাটক পরিচালকের ভূমিকার সেখানেই ইতি হলাে। নাটকের প্রতি আকর্ষণ তার বরাবরের। বিয়ের পর পরই কলকাতার শিশির ভাদুড়ীর ‘ষােড়শী’ নাটকের শেষ অভিনয় দেখতে গিয়েছিলেন ‘হানিমুন’-এর আনন্দ ফেলে রেখে। নিজের বাড়ির চালের টিন ফুটো ও সামনেটা মাটিতে বসে যাওয়া বাইরের ঘরে ‘কথা ও কলম’-এর ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ নাটকের মহড়ায় একমনে বসে বিড়ি টানতেন, হঠাৎ কোনাে সময়ে উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞাসা করতেন ‘হােসেন মিয়া আর ময়নাদ্বীপের সিগনিফিক্যান্স বােঝ?”- বলে হােসেন মিয়ার তথা মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্বপ্নের সমাজতন্ত্র ‘ময়নাদ্বীপ’-এর কথা অনর্গল বলে যেতেন।
‘৬১ সালের অক্টোবর মাসে সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির দ্বাবিংশ কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলাে মস্কোয়। ভ্রাতৃত্বমূলক প্রতিনিধি হিসেবে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক অজয় ঘােষ এই কংগ্রেসে বলেন যে, সােভিয়েত পার্টির খসড়া কর্মসূচি কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোরই মতাে মানবসমাজের ভবিষ্যৎ পথনির্দেশ করেছে, কুড়ি বছরের মধ্যে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করবে বলে। ১৯১৭ সালে সােভিয়েত বিপ্লবের পর সােভিয়েতের কমিউনিস্ট পার্টির বিজয়ের পর বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে বলে অজয় ঘােষ মন্তব্য করেন। ঐ কংগ্রেসেই চীনের কমিউনিস্ট পার্টির প্রতিনিধি হিসেবে চৌএন-লাই বলেন, “বিংশতি কংগ্রেসে সােভিয়েত পার্টি ‘শান্তিপূর্ণ উত্তরণ’, ‘শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান ও শান্তিপূর্ণ প্রতিযােগিতা’-এর যে সংশােধনবাদী লাইন গ্রহণ করেছিল এই কংগ্রেসে এসে তা পূর্ণ রূপ পেল। কমিউনিস্ট পার্টিকে ‘সমস্ত জনগণের পার্টি এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে সমস্ত জনগণের রাষ্ট্র’ আখ্যা দিয়ে মার্কসবাদ-লেনিনবাদের মূলনীতিকেই বিসর্জন দেওয়া হলাে। সােভিয়েত পার্টি নেতা ক্রুশ্চেভের মতে শ্রমিকশ্রেণির পার্টি ও শ্রেমিকশ্রেণির একনায়কত্বের প্রয়ােজনই ফুরিয়ে গেল। বিংশতি কংগ্রেসে স্টালিনকে নাকচ করার মধ্য দিয়েই শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের ধ্যানধারণাকে নাকচ করা হয়েছিল, এই কংগ্রেসে সেটি তত্ত্বাকারে উপস্থিত করা হয়েছে। এই কংগ্রেসে আলবেনিয়ার পার্টি অভ লেবারকে প্রকাশ্যভাবে আক্রমণ করে ক্রুশ্চেভ ঐ পার্টির নেতৃত্বকে উৎখাত করার আহ্বান জানিয়ে একটি কমিউনিস্ট পার্টির কংগ্রেস ভ্রাতৃমূলক পার্টির উপর আক্রমণের এক নজীর তৈরি করলেন।” বলাই বাহুল্য, যে অজয় ঘােষের অকুণ্ঠ প্রশংসার বক্তৃতার মধ্যে এইসব বিষয়গুলাে একেবারেই উহ্য থেকে গিয়েছিল!
চৌ-এন-লাই-এর বক্তব্য ভারতের কমিউনিস্টদের বাম অংশকে উৎসাহিত করল। তারা প্রকাশ্যেই অভিমত ব্যক্ত করতে লাগলেন যে, অজয় ঘােষের মস্কোতে এইভাবে একপেশে মতকে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি অভিমত বলে ব্যক্ত করা মােটেই উচিত হয়নি। ক্রুশ্চেভ কর্তৃক আলবেনিয়ার পার্টিকে প্রকাশ্যে গালাগাল করা এবং চীনের পার্টির প্রতিনিধিকে আর আমাদের ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টির সাহায্যের প্রয়ােজন নেই, বলার ফলে আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যকার আদর্শগত বিরােধ প্রকাশ্যেই এসে গেল। লেনিনের সময়ে বিংশ শতাব্দীর গােড়ার দিকে দ্বিতীয় আন্তর্জাতিকের পতনের সময়ের মতােই ছিল প্রায় একদশক ধরে এই দুই লাইনের লড়াই।
বিপ্লবের তূর্যনিনাদের ভেরিটি সংগ্রামী কমিউনিস্টদের হাতে তুলি দেবে ‘৬১ সালের শেষ ভাগ থেকেই তার এক আভাস পাওয়া যেতে লাগল। স্টালিনােত্তর যুগে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে একটি নাম আশা উৎসাহ জুগিয়েছিল, সব দেশের সংগ্রামী কমিউনিস্টদের মনে সে নামটি মাও সে-তুঙ।
পৃষ্ঠা: ৮৪
ভারতে সংকট তীব্র হচ্ছিল- খাদ্য সংকট ‘৬১ সালের শেষ থেকে নতুন করে দেখা দিতে লাগল। শ্রমিকরা সর্বত্রই মজুরি, মাগৃগীভাতা বৃদ্ধির লড়াইয়ে এগিয়ে আসতে লাগল। কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষ থেকে আন্দোলনের ডাক দেওয়ার পেছনে প্রচুর দ্বিধা কাজ করতে লাগল। আমরা কেন্দ্রীয় সরকারের জাতীয় পুনর্গঠন ও জাতীয় সংহতির নীতিকে সমর্থন ও সাহায্য করি’ বলে কতখানি আন্দোলন কতদূর পর্যন্ত করা যাবে তা নিয়ে চিন্তাভাবনা করতে গিয়ে আন্দোলনই প্রায় স্থগিত হয়ে গেল। তার ওপর ভারত সরকারের উগ্র চীন বিরােধী নীতির সাথে ‘৬২ সালে এলাে ‘পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করবে এই রব।
চারু মজুমদারের এই সময় থেকেই মাথায় ঢুকতে শুরু করে যে যে ধরনের প্রকাশ্য পার্টি ও গণসংগঠনে আমরা অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি সংকটের সময়ের তীব্র সরকারি আক্রমণের সামনে সেগুলাে তাে কোনাে রকম প্রতিরােধেই সমর্থ হবে না, তার অস্তিত্বই তাে বিপন্ন হয়ে পড়বে। ব্রিটিশ আমলে জনগণের উপর আক্রমণের বিভিন্ন পদ্ধতিকে সহজেই সাম্রাজ্যবাদী অপকৌশল বলে চালিয়ে দিতে কোনাে অসুবিধা হতাে না, কিন্তু ঐ একই ধরনের অপকৌশল দিয়ে দেশি সরকার কত সহজে মানুষকে বুঝিয়ে দিচ্ছে কমিউনিস্টদেরও জাতীয়তাবাদের মধ্যে কী সুন্দরভাবে ফাঁসিয়ে দিচ্ছে!
‘স্বাধীনতা’ পত্রিকায় শিল্পী চিত্ত প্রসাদের একটি উড়কাটের ঢং-এর কৃষকদের মাথাল মাথায় ধানকাটার ছবি বের হলাে। পার্লামেন্টে তাই নিয়ে সাংঘাতিক হইচই যে চীনদের টুপির ছবি ছেপে চীনপন্থা চলানাে হচ্ছে। রাজ্য সভার কমিউনিস্ট নেতা ভূপেশ গুপ্ত একেবারে উড়ােজাহাজে কলকাতায় এসে গাঁটের কড়ি খরচ করে একটি ‘মাথাল’ বর্ধমান থেকে কিনে নিয়ে পার্লামেন্টের দুই সভায় স্পিকারের কাছে উপস্থিত করলেন ‘চীনাপন্থি অপবাদ’ অপনােদনের জন্য। বরঞ্চ লােকসভায় এস. এ. ডাঙ্গে জওহরলাল নেহরুকে বলেছিলেন—“আপনাদের চীনের এলাকায় ঢুকে বেরিয়ে আসার রসিকতা চীনারা নাও বুঝতে পারে। তারা যদি পালটা হামলা করে তখন তাে চিৎকার করবেন চীনা আক্রমণ বলে?”
৮
যাত্রা শুরু
১৯৬২ সালের অক্টোবর মাসে চীনের সাথে সম্পর্কের গুরুতর অবনতি হতে থাকে। হঠাৎ শ্রীলঙ্কায় যাওয়ার আগে জওহরলাল নেহরু ভারতীয় সৈন্যবাহিনীকে হুকুম দিলেন ‘আক্রমণকারীদের হটিয়ে দাও। নেহরুরই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় পূর্বাঞ্চলীয় বাহিনীর তৎকালীন অধিনায়ক তাঁর ‘আনটোল্ড স্টোরি’ বইটিতে পরে লিখেছেন ‘চীনের এলাকায় হামলা করতে যে সামরিক প্রস্তুতি প্রয়ােজন আমাদের তা নেই। তা সত্ত্বেও নেহরুর এই আদেশ ভারতীয় বাহিনীকে অস্বভাবিক পরিস্থিতিতে ফেলেছিল। এতে সীমান্ত সংঘর্ষ কে প্রথম শুরু করেছিল তা খুব স্পষ্টই ছিল। যাই হােক, কয়েকদিনের মধ্যেই চীনা গণফৌজের পালটা আক্রমণে সাড়ে তিনহাজার ভারতীয় ফৌজ অফিসারসহ আসামের বমডিলায় প্রায় বিনা যুদ্ধেই আত্মসমর্পণ করল, সঙ্গে সঙ্গে চীনা গণফৌজ পশ্চাদপসরণ করে তথাকথিত ম্যাকমেহন লাইনের সাড়ে বারাে কিলােমিটার উত্তরে সরে গিয়ে একতরফাভাবেই যুদ্ধের অবসান ঘােষণা করে দিল। যাকে বিখ্যাত মনীষী বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন- “এক বিজয়ী বাহিনীর নিজে থেকেই পিছু হটে যুদ্ধের অবসান ঘােষণা পৃথিবীর যুদ্ধের ইতিহাসে আর কখনাে ঘটেনি।” ভারত সরকারের সব রাগটাই গিয়ে পড়ল ভারতের কমিউনিস্টদের উপর। ভারতরক্ষা আইনে ব্যাপক গ্রেপ্তার শুরু হলাে। সব এম. এল. এ. পার্টির রাজ্য কমিটির সদস্য, জেলা কমিটির সদস্য, এমনকি এলাকার ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকারী সমিতির সদস্যরাও গ্রেপ্তার হলাে। চারু মজুমদারকে ২১শে নভেম্বর গ্রেপ্তার করে প্রথমে জলপাইগুড়ি জেল, পরে দমদম সেন্ট্রাল জেলে পাঠানাে হলাে।
পশ্চিম বাংলার পূর্ব দিকে তখন চূড়ান্ত অরাজকতা। বমডিলার ঘটনা ঘটার সাথে সাথে তেজপুর, ধুবড়ি প্রভৃতি আসামের এলাকা থেকে প্রধানত অবাঙালি ব্যবসায়ীরা পালাতে শুরু করল জিনিসপত্র সব নিয়ে। তারা দক্ষিণ বাংলার দিকে নিজেদের গাড়ি, ভাড়া করে বাস, রেলে বােঝাই হয়ে যেতে থাকে আর চঁাচাতে থাকে ‘চীনা ফৌজ পেছন পেছন আসছে।” দক্ষিণ বাংলার, কলকাতায় অনেক স্থলে কংগ্রেসিরা কমিউনিস্ট অফিসের উপর হামলা করতে লাগল। কিন্তু শিলিগুড়িতে পার্টি অফিস পাহারা দেওয়ার ব্যবস্থা করতেই কংগ্রেস সভাপতি বললেন-“আরে ভাই কোনাে দরকার নেই। আমরা তাে লাল আর তিরঙ্গা দুইটা ঝান্ডাই দুই পকেটে রাখছি- যখন যে আইব হ্যারে দেখাইমু।”
ঠিক তিনজন ছাড়া পশ্চিম বাংলার কমিউনিস্ট পার্টিতে চীনাপন্থি বলে যারা পরিচিত ছিল তাদেরই কেবল বেছে বেছে গ্রেপ্তার করা হলাে, নেতৃত্বস্থানীয়দের মধ্যে ডা. রণেন সেন ও জলি কাউল ছাড়া।
ধরপাকড়ের কয়েকদিন আগেই পশ্চিম বাংলা রাজ্য পরিষদের যে সভা হয়েছিল। তাতে চীনাপন্থি ও রুশপন্থির মধ্যে স্পষ্ট ভাগাভাগি হলাে— অনেককে আত্মগােপন করতে বলা হলেও ‘পার্টির ভিতর থেকেই খবর বেরিয়ে যাওয়ার ভয়ে অনেকেই আত্মগােপনের পরিকল্পনা ত্যাগ করেছিলেন। জেলা স্তরে বেশকিছু নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি আত্মগােপন করে যােগাযােগ রাখতে লাগলেন। প্রাদেশিক অফিস ও ‘স্বাধীনতা’ কাগজ চলে গেল রুশপন্থিদের দখলে। গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই প্রাদেশিক কার্যকরী সমিতির নেতৃত্ব আলাদা গােপন প্রাদেশিক অফিস ও জেলের সাথে যােগাযােগ ব্যবস্থা করেই রেখেছিলেন।
দমদম সেন্ট্রাল জেলের চার নম্বর ওয়ার্ডের তিনতলার একটি সেলে চারু মজুমদারের অবস্থান। প্রথম প্রথম তাে কারও সাথে কথা নেই, সারাদিন বসে বসে তাসের পেসেন্স খেলা।
তিনতলার সেল বাড়িগুলাের মধ্যে পাঁচ, ছয়, সাত নম্বরে এন. সি. এল অর্থাৎ নিরপরাধ পাগলেরা বন্দি থাকে। সারা রাত তাদের চিৎকার-চেঁচামেচিতে অস্থির। আট নম্বরে বিবর্তনমূলক আটক আইনে বন্দি ওয়ার্কার্স পার্টির দুজন, তাদের পার্টির কাগজে চীনের পক্ষে লিখে ‘অপরাধ করেছেন। নয় নম্বরে তিন-চারজন ছাড়া সকলেই প্রাদেশিক নেতৃত্বের পর্যায়ে মুজফ্ফর আহম্মদ, প্রমােদ দাশগুপ্ত, জ্যোতি বসু, হরেকৃষ্ণ কোঙার, মনােরঞ্জন রায়, মহম্মদ ইসমাইল, গণেশ ঘােষ, কৃষ্ণপদ ঘােষ প্রমুখ। আর চার নম্বরে চারুর সাথে আর যারা ছিলেন তারা হচ্ছেন- রতন লাল ব্রাহ্মণ, সরােজ দত্ত, বিজয় মােদক, কানু সান্যাল, আনন্দ পাঠক, গােপাল আচার্য প্রমুখ। চারু মাঝে মাঝে যান নয় নম্বরে প্রমােদ দাশগুপ্তর সেলে প্রমােদ দাশগুপ্ত বাইরে এবং জেলেও কারা কারা সংশােধনবাদের পথে নিচ্ছে তাই আলােচনা করেন- দার্জিলিং জেলার কমরেডদের কী অবস্থা জিজ্ঞাসা করেন। চারু মজুমদারের আর একটি কাজ হলাে রাজ্যের ডিটেকটিভ বই জোগাড় করে পড়া এবং সন্ধ্যায় বিজয় মােদকের সাথে দাবা খেলা। ‘৬৩ সাল থেকে জেলে আন্তর্জাতিক বিতর্কের দলিলগুলাে আসতে আরম্ভ করল চীনা পার্টির বক্তব্যের সাইক্লোস্টাইল করা কপি, অবশ্যই গােপনে। দলিলগুলাে সন্ধ্যার পর সম্মিলিতভাবে পড়া হতাে।
এক হিসেবে বলতে গেলে সীমানা সংঘর্ষও সেই উপলক্ষ্যে কমিনিস্টদের গ্রেপ্তার ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অচলায়তন ভেঙে আপসের লাইন আর সংগ্রামের লাইনের মধ্যে তীক্ষ বিভাজন এনে দিয়েছিল— সংগ্রামী কমিউনিস্টদের মধ্যে এক নতুন উৎসাহের সঞ্চার হয়ে গিয়েছিল। জেলের বাইরে কমিউনিস্টদের মধ্যে পরাজিতের মনােভাব ভেঙে গণ-আন্দোলনে নেতৃত্ব দেওয়ার মনােভাব গড়ে উঠেছিল। উগ্র জাতীয়তাবাদের কমিউনিস্টদের বিরােধিতাকে ভেঙেচুরে পার্টির সাধারণ কর্মীরা জমায়েত শুরু করেছিল প্রকাশ্যে। জমায়েতগুলাে যে প্রয়ােজনেই হােক আওয়াজ উঠছিল, “সােভিয়েত সংশােধনবাদীরা নিপাত যাক।” পশ্চিমবঙ্গ, কেরালা, অন্ধ, জম্মুকাশ্মীর, উত্তর বিহার ও উত্তর ইউপি-র পার্টির সদ্যদের মধ্যে সংশােধনবাদের থেকে সম্পূর্ণ পৃথকভাবে পার্টিকে সংগ্রামের পথে নিয়ে আসার ঝোঁক প্রবল হয়ে উঠেছিল।
জেলের মধ্যে, বিশেষত দমদম জেলে, প্রাদেশিক থেকে জেলা স্তর পর্যন্ত সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে যারা ছিলেন, তাদের মধ্যে একটা মনােভাব এসেছিল যে পার্টিকে ভাগ করা ছাড়া আর পথ নেই, অন্য মনােভাব ছিল ভাগাভাগি না করে পার্টির মধ্যেই আদর্শগত সংগ্রাম চালানাে সম্ভব কি না। সমস্ত আবহাওয়ার মধ্যে বিভ্রান্তি বেশ ভালােভাবেই বিরাজ করেছিল- উপরি স্তরের নেতৃত্বের মধ্যে বেশ বড় একটি অংশ মধ্যপন্থা নিয়ে বসেছিলেন সােভিয়েতেরও কথার কিছু যুক্তি আছে, চীনের কথাতেও যুক্তি আছে’, ‘স্টালিনেরও ত্রুটি ছিল’ প্রভৃতি বলে তারা কোনাে অবস্থানই নিতে চাইছিলেন না।
চারু মজুমদার এঁদের কারােরই সাথে মতের মিল করতে পারছিলেন না এই ভেবে যে, “এদের পার্টি ভাগ করা বা না করার পেছনে সংগ্রামের পথের কথা স্পষ্ট নয়, কেবল সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার নেতিবাচক আহ্বান। পার্টি ভাগ করলেও এঁদেরই মধ্যে যারা নতুন নেতৃত্বে আসবে তারাও ঘুরেফিরে আবার একই জায়গায় চলে যাবে, রেভােলিউশানের লাইন যদি না দেয়।” স্টালিনের পক্ষে, সংশােধনবাদের সমালােচনায় ক্রুশ্চেভকে আক্রমণ করে জি. বি. মিটিং হতে লাগল। এই জি. বি. গুলােতে প্রধানত সরােজ দত্ত ও প্রশান্ত শূর বক্তা থাকতেন- চারু মিটিং-এ চুপচাপ থাকতেন। এই অবস্থা ছিল সুশীতল রায়চৌধুরীরও। ক্রমে অবশ্য জি. বি. মিটিংগুলাে মধ্যপন্থিদের বিরুদ্ধে ব্যক্তিগত আক্রমণে পর্যবসিত হচ্ছিল। এই মধ্যপন্থি হিসেবে তখন ছিলেন জ্যোতি বসু, মনােরঞ্জন রায়, রবীন মুখার্জি, নিরঞ্জন সেনগুপ্ত, গােপাল আচার্য, সত্যেন্দ্র নারায়ণ মজুমদার, এন. এস. ফারুকি, ভদ্রবাহাদুর হামাল প্রভৃতি।
বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যে মহাবিতর্কের (Great debate) ক্ষেত্রে মাও সে-তুঙ এর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম দুটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন এনেছিল। (১) সংশােধনবাদ বিশ্বের প্রথম শ্রমিক রাষ্ট্রের যন্ত্রটিই আজ দখল করেছে। (২) বিপ্লবের কেন্দ্রস্থল আজ ইউরােপ থেকে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশে এসে গেছে। চীনের কমিউনিস্ট পার্টি খুব দৃঢ়তার সাথেই ঘােষণা করল যে, তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি আন্দোলনের সবচেয়ে শক্ত ভিত্তি সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন-আমেরিকার দেশগুলাের জাতীয় মুক্তির আন্দোলন, সমাজতন্ত্রকে সংহত করতে সংশােধনবাদী শ্রেণি সমন্বয়ের আদর্শের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে সমাজতান্ত্রিক দেশগুলাের কমিউনিস্ট পার্টিগুলাের মধ্যে সুদৃঢ় ঐক্য সাধন এবং ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলাের সংগ্রামে সক্রিয় সাহায্যের মধ্য দিয়েই সমাজতান্ত্রিক শিবির সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
চারু মজুমদারের চিন্তার মধ্যে চীনের পার্টির বক্তব্য গেঁথে গিয়েছিল, তাই তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস জন্মে গিয়েছিল যে ভারতীয় সমাজ পরিবর্তনের জন্য বিপ্লবী কর্মসূচি ছাড়া পার্টিকে ভাগ করে বা এক রেখে আদর্শগত সংগ্রামের মূল্য তেমন কিছু নেই। ছাব্বিশ বৎসরের কমিউনিস্ট আন্দোলনের অভিজ্ঞতা, চল্লিশের দশকের গৌরবময় কৃষক বিদ্রোহের অভিজ্ঞতা তাঁকে এই সিদ্ধান্তে নিয়ে যাচ্ছিল। সব দেখে বিরক্তি তার মনে এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছিল যে তিনি কাটাকাটা মন্তব্য করে সকলকেই প্রায় উত্যক্ত করে ফেলছিলেন। একদিন হঠাৎ বলে বসলেন-“আপনাদের এইসব ব্যাপারে আমার বলার কিছু নেই, কারণ আমি নিজেকে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির মেম্বার বলে মনে করি!” “এ আবার কী কথা?” “চারু বাবুর তাে মাথাটা একেবারেই গ্যাছে!”–এইসব মন্তব্য ছড়াতে লাগল জেলের মধ্যে।
স্ত্রী লীলা এসেছিলেন জেলে দেখা করতে। প্রমােদ দাশগুপ্ত বললেন-“কে কে সংশােধনবাদী তার নাম উল্লেখ করে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার কথা জানিয়ে কটা চিঠি দিয়ে দিন চারু বাবু, আপনার স্ত্রীর হাত দিয়ে। সেই মতােই করলেন চারু মজুমদার- কমরেডদের কাছে চিঠিতে সই করলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ, আনন্দ পাঠক বীরেন বােস, চারু মজুমদার, কানু সান্যাল ও সৌরেন বােস। চারু এ. আই. টি. ইউ. সি কর্তৃক বন্দিদের পরিবারকে ত্রিশ টাকা করে দেওয়ার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করতে বললেন লীলাকে। টাকাটা ডাঙ্গের নামে পাঠানাে হয়েছিল। এদিকে চারু মজুমদারের কোনাে উপার্জন ছিল না বলে চারু পারিবারিক ভাতাও পেলেন না। শিলিগুড়িতে বাড়ির সংলগ্ন জমিতে ভাড়া দেওয়ার জন্য একখানা টিনের ঘর তােলার চেষ্টা তখন করেছিলেন লীলা, টাকা ধার করে। সহৃদয় বন্ধু, টাকা ও বাড়ির সরঞ্জাম দিতে চেয়েছিলেন, চারু লীলাকে বলেছিলেন—“টাকাটা ধার হিসেবে নিতে পার, নট অ্যাজ এ গিফট।”
পিতা বীরেশ্বর মজুমদার গুরুতর অসুস্থ হওয়ার সময়েই চারুর জন্য প্যারােলের দরখাস্ত করেছিলেন লীলা, কিন্তু বীরেশ্বরের মৃত্যুর পরে প্যারােল পাওয়া গেল। সকালে হঠাৎ খবর এলাে চারু মজুদারকে প্লেনে শিলিগুড়ি পুলিশ প্রহরায় পাঠানাে হবে। তাড়াতাড়ি প্রস্তুত হয়ে যাওয়ার মুখে বড় বড় জল ভরা চোখে চারু বলেছিলেন- “দ্যাট ওল্ড ম্যান ওয়াজ মাই বেস্ট ফ্রেন্ড!” প্যারােলের পর ফিরে কোনাে বাহ্যিক চিহ্নই দেখা গেল না পিতৃবিয়ােগের পরের।
হরেকৃষ্ণ কোঙার জেলে দুটো ক্লাস নিলেন জার্মানি, ব্রিটেন ও আমেরিকার বুর্জোয়ারা, সামন্ততন্ত্রকে কীভাবে উচ্ছেদ করেছিল তার উপরে। চার নম্বর ওয়ার্ডে ক্লাস হওয়ায় সকলেই উপস্থিত থেকে নীরবে শুনতেন। কানু সান্যাল জিজ্ঞেস করলেন, “সামন্ততন্ত্রকে খর্ব করেও যেখানে জিইয়ে রাখা হচ্ছে সেখানে কৃষক সংগ্রাম গড়ে উঠবে কী করে?” “সামন্ততন্ত্রকে সম্পূর্ণ উচ্ছেদ করার সংগ্রামই সেখানে প্রধান হবে”। হরেকৃষ্ণ বললেন। কিন্তু চারু মজুমদার যখন প্রশ্ন করলেন যে- “কৃষকের সংগ্রামলব্ধ অধিকার ও জমির উপর অধিকার রক্ষার জন্য কৃষকেরই হাতে অস্ত্র দেওয়ার বিষয়ে আপনারা কী ভাবেন?”—তখন হরেকৃষ্ণ এই প্রশ্নের জবাব একেবারে এড়িয়ে গেলেন।
১৯৬৩ সালের সেপ্টেম্বরের শেষে চার নম্বর ওয়ার্ডের কমরেডদের এক সভায় চারু বললেন- “পয়লা অক্টোবর চীন-বিপ্লব দিবস পালনের কথা আপনারা কী ভাবছেন?” সকলেই চুপ। এতে তাে চীনাপন্থি বলে সব গ্রেপ্তার হয়েছে, তার উপর চীন বিপ্লব দিবস, বাপরে আর তাহলে রক্ষে থাকবে না। এই প্রায় সকলের মনােভাব। চারু বলেন- “বেশ তাে, প্রকাশ্যভাবে না করেন, ঘরােয়া মিটিং করেও তাে করা যায়?” কেউ বললেন সকলে একমত হবে না, আবার কেউ বললেন নেতারা মত দেবেন না! চারু মজুমদার ভীষণ চটে গিয়ে বললেন- “ধত্তোরি নিকুচি করেছে! আমি নিজের পয়সায় মিষ্টি এনে খেয়ে অক্টোবর দিবস পালন করব, একা একাই।”
ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নিচুতলার ব্যাপক অংশে সংশােধনবাদী নেতৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা হয়ে যাওয়ার মানসিকতা প্রবল রূপ ধারণ করছিল এই সময়ে। যখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের প্রধান অংশ ‘জওহরলাল নেহরুর নেতৃত্বে জাতীয় বুর্জোয়ার সাথে জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট’ গঠনের কথা ভাবতে লেগেছিলেন, তখন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির রেনমিন রিবাও’ পত্রিকার ২৭শে অক্টোবর ‘৬২-এর সংখ্যার সম্পাদকীয় প্রবন্ধ “নেহেরু দর্শন প্রসঙ্গে আরও কয়েকটি কথা” (More on Nehru’s Philosophy) পার্টির কর্মীদের সামনে নেহরু সরকারের চরিত্র সম্বন্ধে সঠিক মূল্যায়নের রূপরেখা তুলে ধরেছিল। কঠোর সেন্সরশিপের মধ্যে প্রবন্ধটি এদেশে আসতে দেরি হয়েছিল এবং পার্টির গােপন দপ্তর থেকে বাংলায় অনুবাদ হয়ে বেরােতে আরও দেরি হয়ে গেল। (সরােজ দত্ত জেলে থাকায় নিজের এ কাজ দেখতে পারছিলেন না।)।
এই প্রবন্ধে বলা হয়েছিল- “ব্রিটিশ পুঁজিপতি শ্রেণির সাথে ভারতীয় পুঁজিপতি ও জমিদার শ্রেণির রক্তের সম্পর্ক বিদ্যমান, কিন্তু নিজের শ্রেণি স্বার্থেই সে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন পর্যায়ে ভারতীয় জনগণের ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছে…. একদিকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শাসনের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলন পরিচালনা করেছে, অপরদিকে গণ-সংগ্রাম ও বিপ্লবী আন্দোলনকে খর্ব করার জন্য অহিংসার শ্লোগান ব্যবহার করেছে। নেহরু… লিখেছেন সামাজিক ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার জন্য নয়, রাজনৈতিক স্বাধীনতার জন্য।… একথা অনর্থক যে নেতারা জনগণের প্রতি বিশ্বাঘাতকতা করেছেন, কেননা তারা ভূমি ব্যবস্থাকে অথবা পুঁজিবাদী ব্যবস্থাকে পরিবর্তন করার চেষ্টা করেননি। তারা কখনাে এ কাজ করবেন বলে দাবিও করেননি। (আত্মজীবনী, পৃ. ৩৬৬-৬৭)।
“…ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি ও জমিদারদের সঙ্গে এক আপস মীমাংসায় উপনীত হয় এবং এই শর্তে ক্ষমতা হাতে তুলে দেয় যে তারা ব্রিটিশ উপনিবেশবাদীদের অর্থনৈতিক স্বার্থ অক্ষুন্ন রাখবেন। এইভাবে ভারতীয় জনগণের ব্রিটিশ বিরােধী সংগ্রামের অর্জিত ফল ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি ও জমিদারদের হাতে চলে যায়।”
পৃষ্ঠা: ৯০
“ভারতের স্বাধীনতা ঘােষিত হওয়ার পর নেহরু যিনি এক সময়ে কিছু পরিমাণে ভারতের জাতীয় বুর্জোয়াদের স্বার্থের প্রতিনিধিত্ব করেছিলেন, তিনি ঘরে ও বাইরে শ্রেণিসংগ্রাম তীব্রতর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ক্রমে ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি ও জমিদারদের বিশ্বস্ত প্রতিনিধিতে পরিণত হলেন। সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্র বিরােধী বিপ্লবের পরিবর্তে নেহরু সরকার প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করলেন এবং আরও ঘনিষ্ঠভাবে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্ততান্ত্রিক শক্তির সাথে গাঁটছড়া বাঁধলেন। অবশ্য ভারতের বৃহৎ পুঁজিপতি, জমিদার এবং বিদেশি একচেটিয়া পুঁজির পারস্পরিক স্বার্থ হুবহু এক নয়, তাই তাদের মধ্যে কিছুর বিরােধও আছে।”
“বৃহৎ পুঁজিপতি ও জমিদাররা নিজের হাতে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত করতে পারে সেজন্য নেহরু সরকার ভারতের স্বাধীনতা লাভের প্রথম দিকে কিছু সংখ্যক আঞ্চলিক সামন্ততান্ত্রিক রাজন্যের রাজনৈতিক সুবিধাবিশেষ ও কিছু সংখ্যক জমিদারের জমিদারির সুবিধাবিশেষ লােপ করেছিলেন। কিন্তু সামগ্রিকভাবে ভারতের সামন্ততান্ত্রিক ভূমি ব্যবস্থা অক্ষুন্ন রাখা হয়েছিল।…ফলে জমির মালিকানার কেন্দ্রীভবন আরও বৃদ্ধি পেয়েছে এবং দরিদ্র চাষি ও খেতমজুরের সংখ্যাও বেড়েছে।”
“…ভূতপূর্ব রাষ্ট্রপতি ডা. রাজেন্দ্রপ্রসাদ ৯ই নভেম্বর, ১৯৬০ সালে দিল্লিতে রাজ্যপাল সম্মেলনে স্বীকার করেন যে, গত তেরাে বছরে পুলিশ যত সংখ্যক গুলি চালিয়েছে তা গােটা ব্রিটিশ রাজত্বের গুলির সংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে।”
“… নেহরুর ‘সমাজতন্ত্র সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে মার্কিন একচেটিয়া-গােষ্ঠীর মুখপাত্র হ্যারিম্যান ১৯৫৯ সালের ৪ঠা মে বলেন- আমার মনে হয় তারা যে এই শব্দটি ব্যবহার করেন এটা খুব ভালাে। এটি এশীয় জনগণের কাছে খুব ভালাে। এটি এশীয় জনগণের কাছে খুবই জনপ্রিয়, সেখানে ধনতন্ত্র শব্দটি প্রায় একই অর্থে উপনিবেশবাদের সাথে ঘনিষ্ঠভাবে জড়িত হয়ে গেছে। নেহরু ও তাঁর মতাে লােকেরা কমিউনিস্টদের কাছ থেকে এটা কেড়ে নিয়েছে।”
“এক সময়ে নেহরু সরকারের কতকগুলাে কাজ বিশ্বশান্তির পক্ষে সহায়ক হয়… এ সত্ত্বেও শ্রীনেহরু কদাচিৎ… মার্কিন সাম্রজ্যবাদের মারাত্মক আক্রমণমূলক কাজের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলেছেন।”
ক্রুশ্চেভীয় সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে মহাবিতর্ক, ভারতে প্রতিক্রিয়াশীল জাতীয়তাবাদী সরকারের মূল্যায়ন সব মিলিয়ে ভারতের সংশােধনবাদী পার্টি নেতৃত্বকে উৎখাত করে একটি বিপ্লবী চিন্তাধারার মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি গড়ে ওঠার সম্ভাবনা দেখা দিল এবং আন্তর্জাতিক ও জাতীয় ক্ষেত্রে বিপ্লবী চিন্তাধারার বক্তব্য উপস্থিত করার জন্য মাও সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে চীনের পার্টির প্রতি প্রবল আকর্ষণ। স্বাভাবিকভাবেই নিচুতলার পার্টি কর্মীদের কাছে প্রবল হতে থাকল। চারু মজুমদারের মনের চরম বিরক্তি কিছুটা কেটে গিয়ে মনে হতে লাগল- ‘যাত্রা শুরু করার একটা পদক্ষেপ তাহলে বােধ হয় পাওয়া যাচ্ছে।
শিলিগুড়ির কংগ্রেস এম. এল. এ-র অকস্মাৎ মৃত্যুতে উপনির্বাচন ঘােষিত হলাে ঐ ‘৬৩ সালেরই নভেম্বর মাসে। রুশপন্থি পার্টি নেতা, যারা বাইরে ছিলেন, তাঁরা সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারকে (‘৬২ সালের সাধারণ নির্বাচনে ইনিই পার্টির প্রার্থী হিসেবে পরাজিত হয়েছিলেন) পার্টির প্রার্থী করতে চাইলেন। জেলের প্রাদেশিক নেতারা সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে দার্জিলিং জেলা পার্টিতে সংগ্রাম শুরু করার জন্য সত্যেন্দ্রনারায়ণ মজুমদারের নাম নাকচ করে চারু মজুমদারের নাম প্রস্তাব করলেন প্রার্থী হিসেবে। উপনির্বাচনে প্রার্থী হলে জেল থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে বলে কাউকে না জানিয়েই রতনলাল ব্রাক্ষণ শিলিগুড়ির ভােটার লিস্টে নিজের নাম লিপিবদ্ধ করিয়ে রেখেছিলেন, তবে তাঁর ইচ্ছাকে কেউ আমল দেয়নি। ভবানী সেন এসে চারু মজুমদার সহ দার্জিলিং-এর পার্টি নেতাদের (ভদ্র বাহাদুর হামাল, রতনলাল ব্রাক্ষণ, আনন্দ পাঠক, বীরেন বােস, কানু সান্যাল, সৌরেন বােস) সাথে দেখা করে বললেন, যেহেতু নির্বাচনি চিহ্ন ‘কাস্তে ধানের শীষ’-এর সুপারিশ তাঁদের করতে হবে তাই উপনির্বাচনি প্রথম জনসভায় বিশ্বনাথ মুখার্জীই প্রধান বক্তা থাকবেন। উপনির্বাচনে পার্টির প্রার্থী হওয়ার সুবাদে চারু মজুমদারকে জেল থেকে সরকার মুক্তি দিল।
নির্বাচনে চারু মজুমদারের পরাজয় অবধারিত ছিল। এক বৎসর পার্টি প্রায় অনুপস্থিত, ‘৬২ সালের ধরপাকড়ের সময়ে শহরের বেশ কিছু মধ্যবিত্ত পার্টি সদস্য খবরের কাগজে বিবৃতি দিয়ে পার্টি ছেড়ে দিয়েছিল পুলিশের লােক গ্রামে “তােমার নাম লিস্টে আছে” বলে আতঙ্ক ছড়িয়েছে, আবার টাকা-পয়সাও নিয়েছে। সারা পশ্চিম বাংলাতেই পার্টির মধ্যেকার বুদ্ধিজীবীদের বেশ বড় অংশই উগ্র জাতীয়তাবাদে ভেসে গিয়েছিল- ‘হিন্দি-চীনি ভাই ভাই’-এর আমলে যে সমস্ত শিল্পী-সাহিত্যিক চীন থেকে ফিরে এসে উচ্ছ্বসিত হয়ে বই-পুস্তক লিখেছিলেন, তাঁদের অনেকেই সেই সব লেখা অস্বীকার করে বিবৃতি দিয়েছিলেন। এই অবস্থায় শহরের মধ্যবিত্ত অধ্যুষিত নির্বাচন কেন্দ্রে ‘চীনপন্থি’ আখ্যায় গ্রেপ্তার হয়ে সদ্য জেলমুক্ত চারু মজুমদারের প্রতি সহানুভূতি থাকেলও সাহস করে তাঁর পক্ষে ভােটের প্রচার করতে বা ভােট দিতে অনেকেই এগিয়ে আসতে ভরসা পেল না। চারুরও এই মধ্যবিত্তদের কাছে যাওয়ার কোনাে মানসিকতা ছিল না। বিশ্বনাথ মুখার্জীর নির্বাচনি জনসভাও ছিল কেবল দুঃখ, অনুশােচনা প্রকাশের বক্তব্য নিয়ে। এ সত্ত্বেও সাড়ে তিন হাজার ভােট পড়েছিল চারু মজুমদারের বাক্সে তাঁর জীবনের প্রথম ও শেষ প্রার্থী হওয়ার সুবাদে। নির্বাচনি প্রচারের পরিবর্তে চারু সংশােধনবাদ বিরােধী আবহাওয়াটি পার্টির মধ্যে, শহর, গ্রাম ও চা-বাগানে এতই ভালােভাবে করতে পেরেছিলেন যে ‘৬৪ সালে পার্টি ভাগ হওয়ার সময়ে কৃষক, শ্রমিক পার্টি সদস্যের একজনও সি. পি. আই-তে যাননি।
পৃষ্ঠা: ৯২
৯
মরীচিকার মধ্য দিয়ে
১৯৬৩ সালের আগস্ট মাসে “হাওড়া হিতৈষী” নামে স্থানীয় পত্রিকার নাম পালটে “দেশ হিতৈষী” নামে এক সাপ্তাহিক প্রকৃতপক্ষে সংশােধনবাদ বিরােধী কমিউনিস্টরাই বের করেন। “বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের মতাদর্শগত সংগ্রামের এক সংকটময় মুহুর্তে, প্রধান বিপদ সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে দেশ হিতৈষী’র প্রকাশ” বলে পত্রিকাটির উদ্যোক্তরা বলেছিলেন। এই কাগজ পার্টির সাধারণ কর্মীদের মধ্যে বিপুল সাড়া জাগাল এবং পশ্চিম বাংলার সর্বত্রই কর্মীরা কাগজ বিক্রিতে লেগে গেল, যদিও পার্টির নামে এর প্রকাশনা ছিল না। সংশােধনবাদীরা, যাদের ইতােমধ্যেই পার্টিকর্মীরা ‘ডাঙ্গেপন্থি’ বলে অভিহিত করছিল, এই পত্রিকা প্রকাশনা পার্টি বিরােধী বলায় পার্টির মধ্যে নিচ তলায়ও আপনা আপনিই বেশ ভাগাভাগি হয়ে গেল।
ইতােমধ্যে পার্টি সমর্থক কিছু সমীক্ষক জাতীয় মহাফেজখানা থেকে কিছু পুরানাে দলিল প্রকাশ করলেন যা নাকি মীরাট ষড়যন্ত্র মামলার সময়ে ও পরে এস. এ. ডাঙ্গে কর্তৃক ব্রিটিশ সরকারকে লেখা এবং যাতে ডাঙ্গের আত্মসমর্পণের নজীর পাওয়া যাচ্ছিল। পার্টির মধ্যে, বিশেষত পশ্চিম বাংলায় আদর্শগত সংগ্রামের ভিত্তিটা বেশ শিথিল হয়ে গেল এই ‘ডাঙ্গে পত্রাবলি’র প্রকাশে এবং জেলবন্দি প্রাদেশিক নেতৃবৃন্দের পক্ষ থেকে আওয়াজ উঠল ব্রিটিশের এজেন্টের সাথে পার্টি করা চলে না”- এই অবস্থানের ফলে আদর্শগত ভিত্তিতে যাঁরা একমত হচ্ছিলেন, বিশেষত প্রাদেশিক স্তরে, তাঁদের মধ্যে পার্টি ভাগ বা আলাদা করে পার্টি গঠন নির্দিষ্ট ব্যক্তির প্রতি আনুগত্যের ব্যাপারে দাঁড়িয়ে গেল।
১৯৬৪ সালের জানুয়ারি মাসের শেষ থেকে বন্দিমুক্তি শুরু হয়ে গেল। বিভিন্ন এলাকায় পার্টি কর্মীরা ‘ডাঙ্গেপন্থিদের আলাদা করে দেওয়া আরম্ভ করল। শিলিগুড়ি মহকুমা পার্টি মহলে চারু মজুমদার বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে আদর্শগত প্রশ্ন মাও সে-তুঙ-এর নেতৃত্ব ও চীনা পার্টির ভূমিকার কথা বেশ ভালােভাবেই কর্মীদের মধ্যে প্রচার করেছিলেন এবং বেশ কয়েকজন যুবক পার্টির কাজে উৎসাহ দেখাতে লেগেছিল। আগস্ট মাস নাগাদ সপ্তম পার্টি কংগ্রেসের খসড়া কর্মসূচি সি. পি. আই নাম দিয়েই প্রচারে দেওয়া হলাে। এই কর্মসূচি আলােচনার জন্য দার্জিলিংয়ের রতনলাল ব্রাক্ষণের বাড়িতে ভদ্রবাহাদুর হামালকে বাদ দিয়ে জেলা কমিটির মিটিং ডাকা হলাে নতুন পার্টির জেলা সম্মেলনের সময় নির্ধারণকে সামনে রেখে। এই মিটিং শেষে পরের দিন সকালে রতনলালের বাড়ি থেকে বড় রাস্তায় ওঠার সময় (পঁচিশ ফিটের মতাে উঠতে হয়) চারু বুকে প্রবল যন্ত্রণা অনুভব করে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। একটু জিরিয়ে, ধরাধরি করে তাঁকে বড় রাস্তায় এনে তাড়াতাড়ি গাড়ি ঠিক করে শিলিগুড়ি নিয়ে এলেন কানু সান্যাল, বীরেন বােস প্রমুখ। ডাক্তার দেখেই বললেন গুরুতর হার্টের অসুখ এবং পূর্ণ বিশ্রাম করা দরকার। সেই দিন থেকে জীবনের শেষ অবধি বেশিরভাগ সময়টা তার কেটেছে বিছানায় শুয়েই।
নতুন পার্টি গঠনের যে খসড়া কর্মসূচি দেওয়া হলাে তাতে ‘স্বাধীনতা লাভ’ পরিচ্ছেদে বলা হলাে যে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে ভারতের জনগণ ব্রিটিশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করলে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ ও বৃহৎ বুর্জোয়ারা উভয়েই শঙ্কিত হয়ে আপস করল এবং ব্রিটিশ ক্ষমতা হস্তান্তর করল। ফলে ভারতীয় বিপ্লবের প্রথম পর্যায় অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংযুক্ত জাতীয় মাের্চার যুগ শেষ হলাে। বলা হলাে- ‘আমাদের জনগণ আশা করেছিলেন যে নবগঠিত জাতীয় রাষ্ট্র দেশের ঔপনিবেশিক অতীতের কুৎসিত অবশেষগুলােকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে, আমাদের উৎপাদিকা শক্তি সমূহের উপর থেকে সকল শৃঙ্খলকে বিলুপ্ত করে দেবে এবং জনগণের সৃজনী শক্তিকে বাধামুক্ত করে দেবে। … তাদের আশা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয়েছে।
বলা হলাে- ‘আমাদের কালের ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা এই যে বুর্জোয়া শ্রেণি যদি স্বাধীনতা সংগ্রামের শীর্ষে থাকে, তাহলে তারা জাতীয় গণতান্ত্রিক বিপ্লবকে পরিপূর্ণতার দিকে এগিয়ে নিয়ে যায় না। উলটে…যতই সামাজিক দ্বন্দগুলাে তীব্রতর হয়, ততই তারা সাম্রাজ্যবাদের সঙ্গে আপসের দিকে ঝুঁকে পড়ে এবং স্বদেশের সামন্ততান্ত্রিক প্রতিক্রিয়ার সাথে মৈত্রীবদ্ধ হয়। বর্তমান ভারতের ভবিষ্যৎ হিসেবে প্রস্তাবে মন্তব্য করা হয় ‘ধনতন্ত্রের দেউলিয়া পথের পরিণতি- একচেটিয়া কারবারের বিকাশ ও নয়া উপনিবেশবাদের বিপদ।’ কংগ্রেস সরকারের কৃষি নীতিকে বুর্জোয়া কৃষি সংস্কার আখ্যা দিয়ে বলা হয়- ‘জমির জোতের সর্বোচ্চ সীমা বেঁধে… আইন এমনভাবে প্রণয়ন করা হয়েছে যাতে বড় বড় জোতের মালিকেরা হয় তাদের জোতগুলােকে অক্ষতভাবেই রক্ষা করতে পেরেছে, আর নয়তাে, তাদের নিজেদের পরিবারবর্গের নাম ভুয়া হস্তান্তর মারফত সেগুলােকে সােল্লাসে এমনভাবে খণ্ড খণ্ড করে দেখাতে পেরেছে যাতে সেগুলাের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সীমার আইনগুলাে প্রয়ােগ না করা যায়। বলা হয়- ‘আজ প্রায় দুদশকের স্বাধীনতার… পরেও, কৃষি-সংস্কার আইন পাশ হওয়া সত্ত্বেও জমির কেন্দ্রীভবনের পরিস্থিতি যেমন ছিল তেমনি থেকে গিয়েছে; গ্রামঞ্চলের শতকরা ৫ ভাগ। উপরতলার পরিবার মােট কর্ষিত জমির শতকরা ৩৭.২৯ ভাগ দখল করে আছে আর শতকরা ৭০ ভাগ চাষি পরিবারের হাতে রয়েছে খুব বেশি হলেও মাত্র ২০ ভাগ জমি।
‘গ্রামাঞ্চলে মুদ্রা অর্থনীতির দ্রুত প্রসারের সঙ্গে সঙ্গে ব্যাংকের ক্রেডিটেরও প্রসার ঘটেছে এবং তার ভিত্তিতে ও অন্যান্য পন্থায় অগ্রিম ক্রয়-বিক্রয় এবং খাদ্যশস্যের ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের ফাটকা মজুত দারুণভাবে বেড়ে গিয়েছে। কৃষিপণ্যে ভারতীয় ও বিদেশি একচেটিয়া ব্যবসায়ীদের মুষ্টি দৃঢ়তর হয়েছে, আর সেই কারণে অসম বিনিময় ও দামের প্রচণ্ড ওঠানামার দরুন কৃষকদের উপর শােষণও তীব্রতর হয়েছে। ফলে কৃষক কৃষিজাত পণ্যের বিক্রেতা হিসেবে এবং শিল্পজাত পণ্যের ক্রেতা হিসেবে লুণ্ঠিত হচ্ছে।’
ভারত সরকারের বৈদেশিক নীতি সম্বন্ধে প্রস্তাবে বলা হলাে- যদিও সরকারের বৈদেশিক নীতি এখনও জোট-নির্লিপ্ততা ও বিশ্বযুদ্ধের বিরােধিতার ব্যাপক কাঠামাের মধ্যেই রয়েছে তবু ধনতান্ত্রিক বিকাশ সাধনে পঞ্চবর্ষ পরিকল্পনাগুলাে পরিপূরণের জন্য পশ্চিমী একচেটিয়া সাহায্যের উপর ক্রমবর্ধমান নির্ভরশীলতা, বিদেশি ফিন্যান্স মূলধনের মালিকদের সঙ্গে তার ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সহযােগিতা ব্রিটিশ কমনওয়েলথ-এ তার সদস্য হিসেবে অবস্থান এবং এই সমস্ত কারণে সাম্প্রতিক কালের উপনিবেশবাদ বিরােধী অনেক প্রশ্নে তার দ্ব্যর্থসূচক বক্তব্য বাস্তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়া উপনিবেশবাদী ও আক্রমণমূলক চক্রান্তকে সাহায্য করে… ইত্যাদি। কর্মনীতি সংক্রান্ত প্রস্তাবে ১৯৫১ সালে কর্মনীতির- “কৃষি বিপ্লবই ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের অক্ষ” বলে বলা হলাে যে- “বর্তমান সরকারকে অপসারিত করেই শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্বে জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।”
খসড়া কর্মসূচি ও কর্মনীতি সম্বন্ধে চারু মজুমদার মন্তব্য করলেন-“সংশােধনবাদ থেকে বেরিয়ে এসে নতুন পার্টি গঠনের ক্ষেত্রে একটি নিখুঁত প্রােগ্রাম ও ট্যাক্টিকাল লাইন আশা করা যায় না। এই ড্রাফট-এ স্বাধীনতার ব্যাখ্যা, সরকারের শ্রেণি চরিত্র, বিপ্লবের স্তরকে সাম্রাজ্যবাদ-সমাজতন্ত্র বিরােধী জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা, কৃষি বিপ্লবকে প্রধান গুরুত্ব দেওয়া ও এই রাষ্ট্র কাঠামােকে অপসারণ করা, এই পাঁচ পয়েন্টে আমরা সাধারণ সমর্থন করতে পারি। যদিও ‘হিংসা না অহিংসা’, ‘সশস্ত্র না শান্তিপূর্ণ, এইসব কথা, তথা জনগণ প্রস্তুত’ গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতিতে সশস্ত্র সংগ্রামের অবস্থা বলাকে হঠকারী এবং ‘জনগণের মধ্যে রয়েছে বিভেদ ও হতাশা তাই কোনাে সংগ্রামই সম্ভব না এই মনােভাবকে সংস্কারবাদ আখ্যা দিয়ে একটা মধ্যপন্থার সুযোেগ রেখে দেওয়া হয়েছে, তাকে ফাইট করা সম্ভব হলে এই পার্টিই বিপ্লবের ভেহিক হতে পারত।”
ইতােমধ্যে এই খসড়ার সাথে সাথেই বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে আদর্শগত বিতর্কের প্রশ্নে দুটি পুস্তিকা প্রকাশ করা হলাে। একটি লিখনের বাসব পুন্নাইয়া, পি, সুন্দরাইয়া, প্রমােদ দাশগুপ্ত, হরেকৃষ্ণ কোঙার যারা ক্রুশ্চেভ সংশােধনবাদকে আক্রমণ করে মােটামুটি চীনা পার্টির বক্তব্যকে সমর্থন করলেন, অন্য পুস্তিকাটি লিখলেন- ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ, জ্যোতি বসু, হরকিষেণ সিং সুরজিত যারা সােভিয়েত ও চীন উভয়েরই বক্তব্যের কিছু সঠিক ও কিছু বেঠিক বললেন। এই পুস্তিকা দুটি নতুন করে। পার্টি গঠনের প্রাক্কালে গুরুতর বিভ্রান্তির সৃষ্টি করল। আন্তর্জাতিক মহাবিতর্ককে পাশ কাটিয়ে দেশের সমস্যার সমাধানের মতনৈক্যের ভিত্তিতে দলত্যাগী ডাঙ্গেচক্রান্তকারীদের (Dange renegade clique) তাড়িয়ে সি.পি.আই, নেতৃত্ব দখল করা’র আওয়াজে সম্মেলন ও পার্টি কংগ্রেসের কাজ চলতে থাকল। পার্টি কংগ্রেসের শেষ মুহূর্তের কিছু আগ পর্যন্ত আমরাই ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিআই)’ এইটিই ছিল কর্মীসাধারণের মনােভাব ও উদ্দীপনারও উৎস।
অসুস্থতার জন্য জেলা সম্মেলনে চারু মজুমদার যােগ দিতে পারলেন না। তবুও তাঁরই অভিপ্রায় অনুযায়ী শিলিগুড়ি মহকুমার অন্তর্গত বাগডােগরার কৃষক সমিতির অফিসে অনুষ্ঠিত দার্জিলিং জেলা পার্টি সম্মেলনে শর্তাধীনে পার্টির খসড়া কর্মসূচি গ্রহণ (চারুর কথিত পাঁচটি বিষয়ের কথা আগে উল্লেখ করা হয়েছে) করা হলাে এবং বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য চীনের কমিউনিস্ট পার্টিকে অভিনন্দন জানিয়ে ও মাও সে-তুঙ-এর দীর্ঘ জীবন কামনা করে প্রস্তাব নেওয়া হলাে। শেষােক্ত প্রস্তাব সমন্ধে যদি প্রতিবাদ ওঠে, বলায় চারু মজুমদার বলেছিলেন- “পার্টির কনফারেন্সগুলােতে চিরকালের রেওয়াজ স্ট্যালিনের দীর্ঘ জীবন কামনা করে প্রস্তাব নেওয়া। আজকের স্ট্যালিন কমরেড মাওএর ক্ষেত্রেও তার ব্যতিক্রম কেন হবে? অবশ্য প্রতিবাদ কিছু হয়নি। এই জেলা পার্টি সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেছিলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ। (১৯৬৫ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী গুলজারিলাল নন্দ চীন-ভারত সীমান্ত প্রশ্নে এক সরকারি শ্বেতপ্রত পার্লামেন্টে দাখিল করেন, তাতে দার্জিলিং জেলা পার্টি সম্মেলনের ঐ প্রস্তাবগুলাে উল্লেখ করে বলা হয়েছিল এরা “কী পরিমাণে চীনের অনুগত”,-। বন্ধ দুয়ার সম্মেলনের সংবাদ গােয়েন্দা দপ্তরে পৌছানাের হদিশ অবশ্য করা যায়নি।)
মাঝে মাঝে বুকে একটু একটু ব্যথা ছাড়া সারাক্ষণ চারু মজুমদারের শুয়ে কাটানাে। “অনেকদিন পর নিশ্চিন্তে পড়াশুনা করার বেশ সময় পাওয়া যাচ্ছে”-বলে পড়াশুনার ফাঁকে ফাঁকে বন্ধু ডাক্তারের সাথে আলােচনা। ডাক্তার উত্তেজিত হতে মানা করে আবার নিজেই বলেন- “এই পার্টি ভাগাভাগিতে আসলে কিছু কি এগােবে, না সেই নতুন বােতলে ভরে পুরানাে মদই দেওয়া হবে?”—চারু গম্ভীরভাবে বলেন—“দেখুন, মার্কসবাদ সব জিনিসেরই দুই দিক দেখতে বলে, অর্থাৎ ডায়ালেক্টিক্যালি দেখা। নতুন পার্টির পিছনে লিডারশিপের একটা অংশের ধান্দা। আদর্শগত প্রশ্নে আজ যে আলােড়ন, র্যাঙ্কের সেই অংশটিকে বােতলজাত করে পুরানাে পথেই আবার নিয়ে যাওয়া। গভর্নমেন্ট-এর কায়দাটা দেখছেন ঠিক সময়মতাে গ্রেপ্তার আবার সময়মতাে ছেড়ে দেওয়া অর্থাৎ টেরােরাইজ কর, আবার লিবারেল হও। এই করে সমস্ত প্রক্রিয়াটাকে কন্ট্রোল করা। আবার আর একটা দিক দেখুন নতুন পার্টির প্রশ্নে পুরাননাকে বাদ দিয়ে নতুন কিছু করায় যে উদ্যোগ খুলে যাচ্ছে তার ঢেউ-এ নেতৃত্ব যা খুশি করতে পারবে না এবং পার্টির র্যাঙ্ক অ্যান্ড ফাইল একটা বিজয়ের ভাবনা নিয়েই এগােবে। এ বিষয়ে আমাদের একেবারে গুরুদেব চেয়ারম্যান মাও তিনি বলেছেন বিষাক্ত আগাছাকেও প্রয়ােজনীয় বস্তুতে পরিণত কর।”
কমরেডরাও আসে খবর নিতে আবার আসন্ন প্রাদেশিক পার্টির সম্মেলন নিয়েও আলােচনা করতে। ডাক্তাররা বলতে লাগলেন—“লাে ব্লাড প্রেসার থেকে হার্টের অসুখ, চিকিৎসা ভালাে হওয়া দরকার!” অর্থের অনটনে চিকিৎসা করাই সমস্যা, জেলা বা প্রাদেশিক দপ্তরের এ নিয়ে কোনাে মাথাবাথা দেখা গেল না। একেবারেই প্রায় স্থানীয় একজন কমরেডের দায় হয়ে দাঁড়াল অর্থ সংস্থান-এর। কথা ও কলম’ সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান শাে করে কিছু টাকা দিল, কিছু দিলেন মুখ্য সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান, যার কার্যকরী সমিতির সদস্য ছিলেন চারু অবশ্য প্রতিষ্ঠানের নামে না দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে দিলেন। স্ত্রী লীলা সঙ্গে করে কলকাতায় নিয়ে গেলেন হৃদরােগ বিশারদকে দেখানাের জন্য। ডাক্তারের ব্যবস্থা স্থানীয় ডাক্তার বন্ধুই করে দিলেন, তিনি ওখানকার লব্ধপ্রতিষ্ঠ চিকিৎসক।
১৯৬৪ সালের অক্টোবর মাসে কলকাতায় প্রাদেশিক পার্টির সম্মেলনেও স্বভাবতই চারু মজুমদার যােগ দিতে পারলেন না। দার্জিলিং জেলার পক্ষ থেকে শিলিগুড়িরই একজন প্রতিনিধি সম্মেলনে খসড়া কর্মসূচি সম্বন্ধে চারু মজুমদারেরই বক্তব্য রাখলেন। এবং বললেন যে খসড়াতে বক্তব্যগুলাে ও বিপ্লবের পথ হিসেবে কর্তব্যকে এমন এমন ভাবে রাখা হয়েছে যে, স্বচ্ছন্দে অন্য অর্থ করা যায় এবং আদর্শগত বিতর্কে আমরা কোন পক্ষে তার কোনাে উল্লেখ না থাকায় বা তার জন্য স্বতন্ত্র প্রস্তাব না থাকায় পার্টির সামনে সব বিষয়কে বেশ ধোয়াটে করা হয়েছে। তবুও এই খসড়াকে ভিত্তি করে পার্টির মধ্যেই সঠিক লাইনের জন্য সংগ্রামের সুযােগ আছে। দার্জিলিং জেলার প্রতিনিধি যখন। প্রশ্ন তােলেন যে, সম্মেলনে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের অন্যান্য নেতাদের সাথে মাও সে তুঙ-এর ছবিটিও রাখা হলাে না কেন তখন সমস্ত সভাগৃহ ফেটে পড়েছিল তার সমর্থনে। কোনাে কোনাে প্রতিনিধি মন্তব্য করেছিলেন যে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টিতে মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে ব্যক্তিরা আসায় সংশােধনবাদের প্রাবল্য হয়েছে। দার্জিলিংয়ের প্রতিনিধি এর জবাব দিয়ে যখন বলেছিলেন যে, বিপ্লবী রাজনীতিটিই হচ্ছে আসল। মার্কস এঙ্গেলস লেলিন এসেছেন মধ্যবিত্ত শ্রেণি থেকে, চীনের পার্টির নেতারা। বেশিরভাগই মধ্যবিত্ত বা মধ্যকৃষক শ্রেণি থেকে এসেছেন। আবার ফ্রান্সের পার্টির নেতা মরিস থােরে খনি শ্রমিকের সন্তান হয়েও সংশােধনবাদের পাঁকে পা ডুবিয়েছেন, তখন আবার সভাগৃহ থেকে বিপুল সমর্থন আসে। কট্টর চীনাপন্থি’ বলে দার্জিলিং-এর প্রতিনিধিরা বেশ স্বীকৃতি পেয়ে গেলেন এবং হুগলি ও ২৪ পরগনার অনেক নেতৃস্থানীয কর্মীরা আপনারাই তাে আমাদের ভরসা!’— বলে পরে ঐ প্রতিনিধিদের অভিনন্দন জানান।
৩০শে অক্টোবর পশ্চিমবাংলার বিভিন্ন জেলা নেতৃত্বের অংশসহ প্রাদেশিক নেতৃত্বের প্রধান অংশকে গ্রেপ্তার করা হলাে, জ্যোতি বসু ছাড়া। দার্জিলিংয়ের রতনলাল ব্রাহ্মণ বা পাহাড়ের কেউ গ্রেপ্তার হলেন না। শিলিগুড়িতে তখনকার মতাে কানু সান্যাল ও বীরেন বােস গ্রেপ্তার হলেন— বাকিরা ‘৬৫-এর ২রা জানুয়ারি জেলে গেলেন।
‘৬৪-এর ৭ই নভেম্বর কলকাতার ত্যাগরাজ হলে ৭ম পার্টি কংগ্রেস নাম দিয়ে নতুন পার্টির প্রথম কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হলাে। ধরপাকড়ের ফলে আবার এক সন্ত্রাসের আবহাওয়া ছড়িয়ে পড়ল। ৩৩নং আলিমুদ্দীন স্ট্রিটের প্রাদেশিক পার্টির দপ্তরে আবদুল্লাহ রসুল সাহেব আশ্বাস দিয়ে বললেন যে, আর ধরপাকড়ের সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। তবুও বেলা ১টায় পার্টি কংগ্রেসের শুরুতেই পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিদের যেতে মানা করে বললেন সন্ধ্যায় যেন তারা কংগ্রেসে উপস্থিত হন। পশ্চিম বাংলার গ্রেপ্তার না হওয়া প্রতিনিধিদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন সুশীতল রায় চৌধুরী, মােহিত মৈত্র। দার্জিলিং জেলার দুজন প্রতিনিধিই যােগ দিয়েছিলেন রতনলাল ব্রাহ্মণ ও সৌরেন বােস। অন্ধের প্রতিনিধিদের মধ্যে টি নাগিরেড্ডি, ভি ডি রাও, চৌধুরী তেজেশ্বর রাও ও পঞ্চাদ্রি কৃষ্ণমূর্তি ছিলেন, উড়িষ্যার মধ্যে ছিলেন ডি বি এম পট্টনায়ক, বিহারের সত্যনারায়ণ সিংহ ও বি কে আজাদ এবং ইউপি-এর শিবকুমার মিত্র ও ইউএন উপাধ্যায়। কাশ্মীরের আর পি স্রফ তখনও সিদ্ধান্ত নেননি যে কোন দিকে যাবেন অবশ্য পার্টি কংগ্রেসের অব্যবহিত পরেই কাশ্মীরের পুরাে ইউনিটই আর পি শ্রফের নেতৃত্বে যােগ দেন, স্রফ কেন্দ্রীয় কমিটিতেও স্থান পান।
পার্টি কংগ্রেসের মধ্যাহ্নকালীন অধিবেশনে সভাপতিমণ্ডলীর পক্ষে সভাপতিত্ব করলেন জ্যোতি বসু। (জ্যোতি বসু প্রাদেশিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন না।) বন্দিমুক্তির দাবিতে প্রস্তাব গ্রহণ করে কংগ্রেসের প্রতিনিধিরা একটি শােভাযাত্রা করেন। তারপর কিছু শােক প্রস্তাব নেওয়া হয়, যার মধ্যে উল্লেখযােগ্য জহওরলাল নেহরুর মৃত্যুতে শােক প্রকাশ। এই শােক প্রস্তাব উত্থাপন করতে গিয়ে পি রামমূর্তি মন্তব্য করেন যে, “আমাদের অনেকেই জহওরলাল নেহরুর কাছে সমাজতন্ত্র শিখেছি।” এই প্রস্তাবে উৎসাহিত হয়ে বিহারের প্রতিনিধিদের কয়েকজন ডা. রাজেন্দ্র প্রসাদ সম্বন্ধেও একটি শােক প্রস্তাব দেওয়ার দাবি জানান।
পার্টি কংগ্রেসের পূর্ণ অধিবেশনে সাধারণ কর্মীদের, বিশেষত পশ্চিম বাংলার কর্মীদের সংশােধনবাদ বিরােধী সংগ্রামের স্বীকৃতি কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব কর্তৃক না দেওয়ার জন্য তীব্র সমালােচনা হয়। এই সমালােচনা প্রধানত কেরালার সুশীলা গােপালন ও ইউপি-র ইউএন উপাধ্যায় করেন। পি সুরাইয়াকে সাধারণ সম্পাদক করার প্রস্তাব সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত হলাে। ই এম এস নাম্বুদিরিপাদ দক্ষিণ দিক থেকে খসড়া প্রস্তাব সমর্থন করছিলেন না বলে তাকে আধ ঘণ্টা সময় দেওয়া হয় তাঁর বক্তব্য বলতে নাম্বুদিরিপাদ-এর নাম কেন্দ্রীয় কমিটির জন্য প্রস্তাবিত হলে কেরালার প্রতিনিধিরা তীব্র বিরােধিতা করেন। পরে অন্যান্য রাজ্যের প্রতিনিধিদের ভােটে তিনি নির্বাচিত হন।
কলকাতার স্বেচ্ছাসেবকদের দলপতি দীনেশ মজুমদার দর্শক হিসেবে উপস্থিত হয়ে পশ্চিম বাংলার প্রতিনিধিদের বলেন- ‘পার্টি নেতাদের অনেকে পার্টির নাম পালটানাের ধান্দা করছে। আপনারা প্রস্তাব এলেই আমাদের জানাবেন, আমরা সিপিআই ছাড়া অন্য নাম দিতে দেব না।’
সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হওয়ার পর এবং আমরাই সিপিআই-এই ঘােষণার পর পি সুরাইয়া আসন্ন কেরালা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার ক্ষেত্রে স্বতন্ত্র নির্বাচনি প্রতীকের জন্য একটি প্রস্তাব আনেন এবং বলেন যে, “নির্বাচন কমিশনের কাছে প্রতীকের জন্য আবেদন করার প্রয়ােজনে আমাদের সিপিআই (এম) অর্থাৎ ব্র্যাকেটে মার্কসবাদী শব্দটি না দিলে কাস্তে ধানের শীষ প্রতীকের সাথে প্রভেদ দাবি করতে পারব না।” সরলভাবেই প্রতিনিধিরা বুঝে নিলেন যে কেবল নির্বাচনের জন্যই পার্টির নাম পরিবর্তন, দীনেশ মজুমদারদেরও সেদিন সেই বুঝই দেওয়া হয়েছিল আর সুরাইয়ার প্রতি সকলের তখন অগাধ আস্থা।
১৯৬৫ সালের জানুয়ারি মাস থেকে সারা ভারতব্যাপি আবার সরকারি সন্ত্রাস সৃষ্টি করে কেন্দ্রীয় তথা, বাছাই করে বিভিন্ন রাজ্য নেতৃবৃন্দকে গ্রেপ্তার করা হলাে। সাধারণ সম্পাদক সুরাইয়া পেটের আলসার-এ ভুগছিলেন। তিনি সরকারি অনুমতি নিয়ে সােভিয়েত ইউনিয়নে গেলেন অস্ত্রোপচারের জন্য। ফিরে এলে তাকে সােজা জেলেই নিয়ে যাওয়া হলাে। সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত সুরাইয়ার সাথে জেলে দেখা করার অনুমতি পেলেন। সুরাইয়া ভূপেশ গুপ্তর হাতে একটি চিঠি তার পার্টির দপ্তরে পৌঁছে দেওয়ার জন্য দিলেন। ভূপেশ বাবু সিপিআই (এম) দপ্তরে চিঠিটা পৌছে দিলেন ঠিকই, তবে তার আগে নিজেদের পত্রিকায় অংশবিশেষ ছেপে দিলেন। চিঠিতে সুরাইয়া তার পার্টি দপ্তরকে জানিয়েছিলেন যে, সােভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট পার্টির বক্তব্যের পক্ষেও যুক্তি আছে এবং সােভিয়েত নেতৃত্বকে তিনি যতটা খারাপ ভেবেছিলেন, দেখলেন ততটা নয়। পার্টি কংগ্রেসেই প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল যে বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে আদর্শগত বিতর্কের প্রশ্ন একটি নির্দিষ্ট দলিল আকারে দেওয়া হবে। তার আগেই সুরাইয়ার ঐ মন্তব্যে এবং ভূপেশ গুপ্ত মারফত চিঠিটি দেওয়া, সর্বোপরি অস্ত্রোপচারের জন্য রাজবন্দি অবস্থাতেই সােভিয়েতে যাওয়া সব ব্যাপারটাকেই জেলে ও বাইরে সাধারণ কর্মীদের কাছে কেমন সাজানাে ব্যাপারের মতাে লাগল। রহস্য আরও ঘনীভূত হলাে যখন এর বেশ কিছু পরে, সবাই জেল থেকে ছাড়া পেলে ছাত্র যুবক আন্দোলনের এক উত্তাল জোয়ারের সময়ে কলকাতার জিবি মিটিং-এ প্রশ্নের উত্তরে সুরাইয়া ভূপেশ গুপ্তকে চিঠি দেওয়া ঠিক হয়নি বললেন, সােভিয়েতে যাওয়ার জন্য কৈফিয়ত দিলেন না এবং একই মিটিং-এ পি রামমূর্তি যখন ছাত্র-যুবকদের “বেশি বিপ্লবী শ্লোগান দেওয়ার জন্য, “তােমার নাম আমার নাম ভিয়েতনাম” বলার জন্য তিরস্কার করলেন, সুরাইয়াও সম্মতিসূচক অভিমত প্রকাশ করলেন।
১০
মরীচিকার কুয়াশা ভেদি
১৯৬৪ সালেই রােগশয্যায় শুয়ে চারু মজুমদার যখন রাজ্য সম্মেলনের প্রতিনিধির কাছ থেকে সম্মেলনের রিপাের্ট শুনেছিলেন তখনই তার মাথার চুলে হাত বুলিয়ে বলেছিলেন-“ভিয়েররি গুড”-জোশ এসে গেলে সব ব্যাপারেই এইভাবে ‘ভেরি গুড’ বলার অভ্যাস ছিল তাঁর—তা সে স্ত্রীর ভালাে রান্নাই হােক, পিকিং রেডিও শুনেই হােক আর আন্দোলনের খবর শুনেই হােক। পার্টি কংগ্রেসের রিপাের্ট শুনে প্রথমে গম্ভীরই হয়ে গেলেন—উঠে পড়ে একটু টলে ধীরে পায়চারি করতে লাগলেন। গম্ভীর স্বরে বললেন-“আলাদা যে একটা পার্টি হলাে এটিই হিস্টোরিক্যালি সিগনিফিক্যান্ট। আদর্শগত দলিল দিক বা না দিক সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে স্ট্যান্ড যে একটা নিতে হলাে এতেই বিপ্লবী র্যাঙ্ক ফ্যান্ড ফাইলের ইনিসিয়েটিভ রিলিজ হয়ে যাবে যে কাঠামােটা হলাে। তার মধ্যেই বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তােলার সুযােগ এসে যাবে হে, কিচ্ছু ভেবাে না!”
১৯৬৫ সালের জানুয়ারির শুরু থেকেই সারা ভারত জুড়েই কমিউনিস্টদের যে বেধড়ক গ্রেপ্তার চলেছিল, চারু মজুমদারকে তখন গ্রেপ্তার হতে হয়নি প্রধানত অসুস্থতার জন্য সভা সম্মেলনে তার অনুপস্থিতির কারণে। (রাজ্য সম্মেলনের সময়ে লক্ষ করা গেছে যে বিভিন্ন জেলা গােয়েন্দা বিভাগের লােক হলের সামনে পঁড়িয়ে কলকাতার পুলিশকে জেলার কমিউনিস্টদের চিনিয়ে দিচ্ছে। এটাকে খুবই হালকাভাবে নেওয়া হয়ে এসেছে)।
পার্টি কংগ্রেসে সিপিআই (এম) গঠিত হওয়ার (তখনও পর্যন্ত অবশ্য সকল কর্মীই ‘এটিই প্রকত বিপ্লবী ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি এইভাবেই ভাবছিল, মাকর্সবাদী কথাটি তাদের কাছে কেবল নির্বাচনি প্রতীকের জন্য) পর থেকেই চারু মজুমদারের মনে আলােড়ন শুরু হয়েছিল হঠাৎ হঠাৎ বিছানা থেকে উঠে পায়চারি করা, শরীরটাকে অনেক সুস্থ বােধ হচ্ছিল তার, আর মনের মধ্যে বারবার গুনগুনিয়ে উঠছিল তার আর একটি প্রিয় সংগীত- “ঢেউ উঠছে, কারা টুটছে প্রাণ জাগছে, জাগছে…।” উদ্দীপ্ত চেতনায় তার মনে হয় নতুন পার্টি হয়ে কর্মীদের যে উদ্যোগ খুলে গিয়েছে তার সমানে বিপ্লবী পার্টির সংগঠন গড়ে তােলা প্রশ্নটি আজ বড় জরুরি দেশব্যাপী কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তারের পর প্রকৃতপক্ষে পার্টির কর্মীদের সামনে নির্দেশও নেই, আবার পার্টির কর্মসূচি। ও কর্মনীতির ছকের বাইরে তৎকালীন পরিস্থিতিকে বিচারের কোনাে বক্তব্যও অনুপস্থিত। শুরু হলাে চারু মজুমদারের একক দলিল লেখা, ‘৬৫ সালের জানুয়ারির শেষ ভাগ থেকেই। ২৮শে জানুয়ারিতে লেখা প্রথম দলিলে চারু পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দিলেন যে কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করে এবং নির্বাচনি রায়কে অগ্রাহ্য করে গণতন্ত্রের উপর কংগ্রেস সরকারের যে আক্রমণ তা ধনতন্ত্রের আভ্যন্তরীণ ও আন্তর্জাতিক সংকটেরই ফলে হচ্ছে এবং ভারতের সরকার মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার প্রভুত্ব বিস্তারে মূল অংশীদার হয়েছে। স্থায়ী খাদ্য সংকট, ক্রমবর্ধমান মূল্যমান পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। তাই সরকারকে ক্রমাগত ইঙ্গ-মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দারস্থ হতে হবে। সাম্রাজ্যবাদের প্রতি নির্ভরশীলতা সংকটকে আরও বাড়িয়ে দেবে। সম্ভাব্য গণ-বিক্ষোভ দমনের জন্যই কমিউনিস্টদের গ্রেপ্তার করা হচ্ছে… জনসাধারণের বিক্ষোভ বাড়তে বাড়তে সংগ্রামে রূপান্তরিত হবে… সুতরাং আগামী যুগ শুধুমাত্র বিরাট সংগ্রামের যুগই নয়, বৃহৎ জয়েরও যুগ। আগামী যুগে বিপ্লবী সংগ্রাম পরিচালনার দায়িত্ব কমিউনিস্টদেরই নিতে হবে এবং তা সম্ভব তখনই যখন পার্টি সংগঠনকে বিপ্লবী সংগঠনে রূপান্তরিত করা যাবে। বিপ্লবী সংগঠনের প্রধান ভিত্তি বিপ্লবী কর্মী, আর এই বিপ্লবী কর্মী হচ্ছে সে, যে নিজের উদ্যোগে অবস্থার বিশ্লেষণ করতে পারে এবং তদনুযায়ী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে পারে।
পরিস্থিতির বিশ্লেষণ দিয়ে প্রথম দলিলে একজন পার্টির সভ্য পাঁচ জনের একটি গােপন সক্রিয় কর্মী দল (activist group) গঠন করবে বলে গােপন বিপ্লবী সংগঠনের একটি ছক চারু দেন যাতে গােপন সভার জায়গা, গােপনে আশ্রয়স্থলের ব্যবস্থা প্রভৃতির কথা বলেন এবং রাজনৈতিক শিক্ষার প্রশ্নে ‘কৃষি বিপ্লব সফল কর’ আওয়াজের ভিত্তিতে কৃষি সমস্যাকে রাজনৈতিক শিক্ষার প্রধান বিষয় করার কথা বলেন।
লেখায় ছিল চারুর চিরকালের আলস্য। এ যাবৎ প্রচারপত্রই হােক আর রিপাের্ট বা রিপাের্টাজই হােক অন্যদের পয়েন্ট বলে দিতেন, লেখা হয়ে যাওয়ার পর সংশােধন করেও দিতেন, কিন্তু নিজে বড় কিছু লেখা ‘ওরে বাবা আমার দ্বারা হবে না বলে কাটিয়ে দিতেন। কলমের চেয়ে তরবারি ধরার চিন্তাই ছিল তার এতদিনের প্রধান। চিন্তা। সবাই তাে জেলে, বলে যাবাে লিখে যাবে, হাতের কাছে তেমন তাে কেউই নেই’– তাই অসি ছেড়ে মসি ধরতে হলাে ভারতীয় বিপ্লবের প্রস্তুতিকরণ পর্বে! প্রথমে পাঁচটি দলিল তিনি লিখেছিলেন ‘৬৫ সালের সেপ্টেম্বরের মধ্যে, পঞ্চম দলিল সম্পূর্ণ করার আগেই তাকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পৃষ্ঠা: ১০১
দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম দলিল পর্যন্ত একটি ধারাবাহিকতা বজায় রেখে চারু মজুমদার তাঁর মূল রাজনৈতিক বক্তব্যকে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন যা নকশাল বাড়ির কৃষক সংগ্রাম থেকে শুরু করে সিপিআই (এমএল) পার্টি গঠন পর্যন্ত একটি রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক কার্যক্রমকে সামনে এনেছে।
এই দলিলগুলােতে তিনি একদিকে দেখালেন রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকে বাদ দিয়ে বা এড়িয়ে গিয়ে কমিউনিস্ট পার্টি বিপ্লবী থাকতে পারে না। কৃষক সভা ও ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলনের কাজকে একমাত্র কাজ হিসেবে নিয়ে অর্থনীতিবাদের পঙ্কে পার্টি নিমজ্জিত হয়। রাজনৈতিক আন্দোলনের কর্তব্য কেবল কিছু দাবি-দাওয়ার মধ্যে সীমাবদ্ধ রেখে দিলে পার্টি সংস্কারবাদ ও শােধনবাদের পথে যায়। রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নেও যেমন করে হােক কেন্দ্র দখলের কথাই অনেক সময়ে ভাবা হয় যা সঠিক নয়, ক্ষমতা দখলের প্রশ্নটিকে নির্দিষ্টভাবে আনতে গেলে এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখলের বিষয়ই ভাবতে হবে (দ্বিতীয় দলিল)।
আবার অন্যদিকে দেখালেন যে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ফ্যাসিবাদের উপর বিজয় ও তারপর চীন বিপ্লব সম্পূর্ণ হওয়ার পর জনগণের মধ্যে সংগ্রামের উৎসাহ ও বিজয়ের মনােভাব থাকায় ১৯৪৯ সাল থেকেই ভারতের মানুষ সংগ্রাম করে চলেছে, নিরস্ত্র জনতা সরকারি সশস্ত্র-শক্তির সামনে মার খেয়েছে, কমিউনিস্ট পার্টি সেটাকে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে সরকার দখলের দিকে নিয়ে যেতে চেয়েছে। তাতে মানুষ খুশি হয়নি। বুর্জোয়ারা জনগণের মনােভাব বুঝে প্রথমে বান্দুং সম্মেলন প্রভৃতিতে অংশগ্রহণ করে সমাজতন্ত্রের দিকে ঝোঁক দেখাতে চেয়েছে কিন্তু তাতেও বুঝ দিতে যখন পারেনি তখন চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘােষণা করেছে। চীনের কাছে ভারত সরকারের পরাজয় ও চীনের নিজের থেকেই পিছু হটে যাওয়া জনগণকে সংগ্রামে আরও উদ্বুদ্ধ করেছে। ‘সাম্রাজ্যবাদের পদলেহী ডাঙ্গের চিঠি নতুন বিপ্লবী পার্টি গড়ে তুলতে সাহায্য করল। কমিউনিস্টদের উপর থেকে ক্রুশ্চেভ সংশােধনবাদ হটে যেতে বাধ্য হলাে। এসবই ঘটেছে স্বতঃস্ফূর্তভাবে। সচেতন নেতৃত্ব এখানে আনতে হলে সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখলের আওয়াজটাই সবার আগে সামনে আনতে হবে (তৃতীয় দলিল)।
বিপ্লবের কর্মসূচিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য চারু মজুমদার “দৈনন্দিন সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার কথা বলেন। এই সংগ্রামের নির্দিষ্ট রূপ দেখিয়ে বললেন যে, সােভিয়েত সংশােধনবাদ যে ভারতের প্রতিক্রিয়াশীল শাসক শ্রেণিকে পূর্ণ সমর্থন ও সাহায্য করছে, একচেটিয়া পুঁজিকেই মদত দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে মজবুত করতে দিচ্ছে তার মুখােশ খুলে দিতে হবে এবং বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামও সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে কারণ এই উগ্র জাতীয়তাবাদ চীন, পাকিস্তান ও অন্যান্য প্রতিবেশী দেশের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক ভূমিকা নেওয়ার ফলে সংগ্রামী জনতার মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে দেয়, বিভেদ আনে।
একই সঙ্গে এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখলের কর্মসূচিতে কৃষি বিপ্লবকে প্রধান স্থান দেওয়ার কথা বলে বলেন যে কৃষকরা সকলেই একই শ্রেণিভুক্ত নয় বলে গ্রামাঞ্চলে শ্রেণি বিশ্লেষণের কাজ অতীব গুরুত্বপূর্ণ। প্রতিক্রিয়াশীল হিংসার বিরুদ্ধে বিপ্লবী হিংসাকে ‘মারের বদলে মারের সংগ্রাম’ বলে তিনি দেখালেন যে, বারবার গণসংগ্রামের উপর সরকারি হামলার ফলে সংগ্রামী জনগণ নিরুপায় হয়ে যায়। প্রথম প্রথম পালটা মারে সাফল্য কমই হবে, তবুও প্রচেষ্টাটাই জনগণকে উৎসাহ যােগাবে। বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তােলার ক্ষেত্রে গােপন সংগঠনের বিষয়টিকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দেখাতে গিয়ে বললেন যে, শুরু থেকে সক্রিয় কর্মীদলের গােপন সংগঠন গড়তে থাকলে পুলিশের সম্পূর্ণ অপরিচিত বিপুল সংখ্যক কর্মী যে পাব তার দ্বারা ভবিষ্যৎ তৈরি হবে (চতুর্থ দলিল)।
পঞ্চম দলিলে তিনি সরাসরি সিপিএম নেতৃত্বের ভূমিকা বিশ্লেষণ করলেন যে, ৭ম কংগ্রেসে কর্মসূচি ও নীতি নিয়েই এঁরা ভাবলেন বিপ্লবের কর্তব্য শেষ হয়ে গেল। তাঁরা ‘সশস্ত্র সংগ্রামের ভূত এর মধ্যেই দেখতে লেগেছেন— অথচ নতুন পার্টি হওয়ার পর জনগণের উদ্যোগ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং সংগ্রাম শুরু হয়েছে। নেতৃত্বের কোনাে পরিকল্পনা না থাকায় নিরস্ত্র জনতাকে গুলর মুখে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এই নিগড় ভাঙার জন্য আওয়াজ দিতে হবে- (১) সশস্ত্র হও, (২) সংঘর্ষের জন্য সশস্ত্র ইউনিট তৈরি কর, (৩) প্রত্যেকটি ইউনিটকে রাজনৈতিক শিক্ষায় শিক্ষিত কর।
চারু মজুমদার প্রথম দলিল লিখেই তার কপি দার্জিলিংয়ের জেলা দপ্তরে পাঠিয়েছিলেন রাজ্য কমিটিকে দেওয়ার জন্য। রাজ্য কমিটি বরাবরই অস্বীকার করে বলেছেন, তারা কোনাে কপি পাননি’- জেলা কমিটির সম্পাদক তথা রাজ্য কমিটির সদস্য রতনলাল ব্রাহ্মণের কাছে ঐ কপি দেওয়া হলাে। অথচ ইউএনআই সংবাদ প্রতিষ্ঠান ‘স্টেটসম্যান’ কাগজে দলিলের অংশবিশেষের উদ্ধৃতি দিয়ে জানায় যে, চারু মজুমদার পার্টির বিরুদ্ধে এই সব করছেন। আবার ‘স্টেটসম্যান’-এ প্রকাশিত রিপাের্টের ভিত্তিতে জেলের পার্টি কর্মী, বিশেষত দার্জিলিং জেলার কর্মীদের মধ্যে দলিল পড়ার উৎসাহ সৃষ্টি হয়। চারু গ্রেপ্তার হওয়ার আগেই কানু সান্যাল বহরমপুর সেন্ট্রাল জেল থেকে বােনের বিয়েতে যােগ দিতে এলে জেলের দার্জিলিং জেলার পার্টি কর্মীদের চিঠি এনে চারুকে দিতে সক্ষম হন এবং চারুও তৃতীয় দলিলটি কানুর হাতে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করেন।
প্রবল উত্তেজনা তখন চারু মজুমদারের মনে। অসুস্থতা ভুলে যাওয়ার অবস্থা! প্রায় অন্ধকারে ঢিল ছুড়েছিলেন প্রথম দলিল লিখে, এখন মনে হচ্ছে একটা নেতৃত্বের দায়িত্ব এসে পড়ছে। গণ-আন্দোলনের লােক তিনি, তাই কেবল দলিল লিখে দিয়েই ক্ষান্ত হওয়ার পাত্র তাে তিনি নন। বক্তব্যকে কার্যকরী করার রাস্তা বের করতে হবে!’—প্রথম কয়টা দিন চলে যায় একথা ভাবতে ভাবতে হাত একবার মুঠো বেঁধে ওঠে, আবার খুলে যায়। মুখ্য কর্মীরা সব জেলে নতুন যুবা কর্মী চাই, রাজনীতির জ্ঞান দিতে হবে, বিপ্লবের স্বপ্ন দেখতে শেখাতে হবে। তিনটি যুবক পেলেন তার মধ্যে দুজন ছাত্র। এদের দ্বারাই দুজন যুবক বিড়ি শ্রমিককে টেনে আনলেন। প্রথম তিন যুবকের হাতে চিঠি দিয়ে পাঠালেন বুড়াগুঞ্জে, কদম মল্লিকের কাছে। যুবক তিনটিকে বলে দিলেন“সংগঠিত কৃষক এলাকা পাঁচ, পাঁচজনের অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপ করতে খুব বেশি বেগ পেতে হবে না!” সত্যিই বেগ পেতে হলাে না সশস্ত্র সংগ্রামের নেশা যেন কৃষকদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়ল। “সব বারুদ হয়ে আছে, শুকনাে খটখটে, আগুন ছোঁয়ালেই হবে, এ আগুন বিপ্লবী রাজনীতির আগুন। স্বপ্ন দেখাও কৃষকদের রিপাবলিক হবে, তােমার জমি হবে, সরকার তােমার হাতে, কিন্তু লড়তে হবে আর লড়তে গিয়ে তুমি নিজেও হয়তাে আর বেঁচে থাকবে না।” জনগণকে সশস্ত্র করার প্রথম পাঠ হিসেবে বন্দুক সংগ্রহের চেষ্টা চালায় ছােট ছােট গ্রুপগুলাে। “বন্দুক লুঠ করে গােপনে রাখার সাহস, সশস্ত্র সংগ্রামের পােস্টার দিয়েই পালিয়ে গিয়ে আবার দূরে দাঁড়িয়ে দেখা কী রিঅ্যাকশান মানুষের এভাবেই বিপ্লবী সাহস সঞ্চয় হবে, আবার এর মধ্য দিয়েই কর্মীদের মধ্যে কে ভীরু আর কে সাহসী তা প্রমাণ হবে। মনে রাখবে এক একজন মানুষ, যে শ্রেণিরই হােক, দীর্ঘ সংস্কারের প্রভাবে বেসিক্যালি ভীতু হয়, তার সাহস জাগাতে হয়, সেটাই রাজনীতির কাজ।” কর্মীদের উপদেশ দেন চারু। একেবারে আনকোরা ছেলেগুলাে যেন এক নেশার উন্মাদনায় আত্মগােপন জীবনযাপন করতে থাকে অনভ্যস্ত গ্রামাঞ্চলের পরিবেশে। জোতদারের বাড়ি থেকে দোনলা বন্দুক একটা লুঠও করে ফেলে। বন্দুক হাতে আসার সাথে সাথেই নতুন প্রতিক্রিয়া শুরু হয়, এক একজনের মনে এক এক ভাবে। কারও দ্বিগুণ সাহস বাড়ে, বলে- “আর কাকে ভয়?” একজনের স্নায়ুর দুর্বলতা শুরু হয়, তার পা কাঁপতে থাকে, চারু শুনে জানান- “ওকে ফেরত পাঠিয়ে দাও। আপাতত ওর দ্বারা কিছু হবে না?”
খুশি, বিস্ময় মিলিয়ে জেলে দলিলটিকে দেখে দার্জিলিং জেলার কমরেডরা। সব কথা স্পষ্টও হয় না মাঝখানের একটিমাত্র দলিলে। দলিলটা একজনের হাত দিয়ে রাজ্য দপ্তরে চলে যায়, আগেই জানা থাকলেও এক শঙ্কিত জিজ্ঞাসা আসে ‘গােপন রাজ্য দপ্তর থেকে এ দলিল কোথায় পেলে?’—তারপর ইংরেজিতে টাইপ করা নাম না দেওয়া সাদা কাগজে দুটি লাইন- “লােকটি মানসিক সুস্থ নয়। নিজেই এক বিপ্লব শুরু করতে চায়।”
পৃষ্ঠা: ১০৪
১১
ধরণির উত্তাল
সবকিছুকে তছনছ করে যেন এক প্রবল ঝড় সারা দুনিয়াটার উপর দিয়ে বয়ে যেতে লাগল ‘৬৫ সালের মধ্য ভাগ থেকে। ‘৬৬ সালে এসে তা আরও প্রবল আকার ধারণ করল— এই ঝড় ছিল দুনিয়াব্যাপী তরুণের বিদ্রোহ। ফ্রান্সের তরুণ আর আমেরিকার তরুণ, কিম্বা জাপান, কামপুচিয়া বা দক্ষিণ ভিয়েতনামের বা ভারতের তরুণ সব যেন একাকার প্রচলিত সমাজব্যবস্থাকে সে সহ্য করবে না! ফ্রান্সে সে বিশ্ববিদ্যালয় দখল করে পুলিশের সাথে খণ্ড যুদ্ধ করে, আমেরিকার সৈন্য বাহিনীতে যােগদানের ড্রাফট কার্ড রাস্তায় স্থূপীকৃত করে ব্যুৎসব করে, ভিয়েতনামে লড়ে আমেরিকান আধুনিক অস্ত্রের সাথে, জাপানের ওয়াকিনাওয়ায় মার্কিন হাওয়াই আড্ডা বন্ধ করার জন্য লাখে লাখে দুর্ভেদ্য প্রাচীর করে ঘিরে রাখে, ভারতে খাদ্য আন্দোলন পশ্চিম বাংলার মজুতদারদের দমদম দাওয়াই দিতে থাকে, ইস্পাত কারখানার দাবিতে অস্ত্রের বিজয়ওয়ারা স্টেশন চুরমার করে দেয়, সারা তামিলনাড় তােলপাড় করে দেয় ভাষার দাবিতে। চারু মজুমদারেরই ভাষায়- “গত দুই বৎসর ধরে মধ্যবিত্ত শ্রেণির যুব ছাত্রদের স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রাম ভারতবর্ষের একপ্রান্ত থেকে অপর প্রান্ত পর্যন্ত আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। শুরুতে যদিও খাদ্যের দাবিই প্রধান ছিল, কিন্তু ক্রমশ কংগ্রেস সরকারের উচ্ছেদের দাবি প্রধান হয়ে উঠেছে। চেয়ারম্যান মাও বলেছেন- “মধ্যবিত্ত ছাত্র ও যুবকেরা জনতারই অংশ এবং তাদের সংগ্রামের অনিবার্য পরিণতিতে শ্রমিক ও কৃষকের সংগ্রাম উত্তাল হয়ে উঠবে।” (সপ্তম দলিলের উদ্ধৃতি)।
ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে, চটকলে শ্রমিকদের মালিক ম্যানেজার ঘেরাও লেগেই আছে। দিনাজপুরের কৃষক দারােগার পিস্তল ও পুলিশের পাঁচটি রাইফেল ছিনিয়ে নিল। এদিকে কলকাতার রাস্তায় ছাত্ররা ব্যারিকেড করে পুলিশের সাথে লড়ছে। প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্ররা, যারা এতকাল উন্নাসিক বলে কথিত ছিল, সবার আগের সারিতে এসে দাঁড়িয়েছে লড়াইয়ে। আত্মগােপনকারী পার্টি-নেতৃত্ব [সিপিআই (এম)] যদিও প্রয়ােজন বােধ করেছেন ছােট সশস্ত্র ছাত্রদল গঠনের কিন্তু জেলের প্রধান নেতৃত্বের সাড়া পাচ্ছেন না। সেখান থেকে কেবল নির্দেশ আসছে “সমস্ত সংগ্রামকে সারা পশ্চিমবাংলা ‘বন্ধু’ এর দিকে নিয়ে যাও।” মার্চের শুরুতেই একটি সফল হরতাল এবং সর্বত্রই হলাে পুলিশের সাথে সংঘর্ষ- ইটপাটকেল ছুড়ে কী কলকাতায় কী মফসসলে শ্রমিক, ছাত্র, কৃষক পুলিশের বন্দুকের মােকাবিলা করতে থাকে। মার্চের প্রথমেই অন্যসব বামপন্থি দলের নেতৃবৃন্দও গ্রেপ্তার হলেন। ১৫ই মার্চ আর একটি বাংলা বন্ধ’ এর ডাক দেওয়া হলাে সকল বামপন্থি দলের সংযুক্ত ফ্রন্টের পক্ষ থেকে। মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্ল চন্দ্র সেন পুলিশকে প্রস্তুত থাকার প্রকাশ্য আহ্বান জানিয়ে বলেন- “বামপন্থি নেতৃবৃন্দ যদি প্রতিশ্রুতি দেন যে, কোনাে রকম শান্তি ভঙ্গ হবে না, বন্ধু সম্পূর্ণ অহিংস থাকবে, তাহলে পুলিশ কিছু করবে না।” সঙ্গে সঙ্গে বামপন্থিদের পক্ষ থেকে জ্যোতি বসু (তিনি, রতনলাল ব্রাহ্মণ, মনােরঞ্জন রায় গ্রেপ্তার হননি) প্রকাশ্যে প্রতিশ্রুতি দিলেন যে শান্তি ভঙ্গ হবে না। শান্তিপূর্ণ হরতালে জনগণ খুশি না হলেও, সরকার পক্ষ খুশি হলেন যে সহিংস সংগ্রামে অন্তত বামপন্থি নেতৃবৃন্দ যাবে না। এপ্রিল থেকেই বন্দি মুক্তি শুরু হলাে- ৭ই মে-এর মধ্যে সকলেই জেল থেকে মুক্ত হয়ে এলেন।
‘৬৫ সালের সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার হয়ে প্রথমে জলপাইগুড়ি ডিস্ট্রিক জেলে থাকাকালীন চারু মজুমদারের অসুস্থতা বেড়ে যায়। খবরের কাগজে সংবাদ দেখে বহরমপুর সেন্ট্রাল জেলে কানু সান্যাল, সৌরেন বােস, বীরেন বােসের উদ্যোগে বহরমপুর জেলে বন্দিরা অবিলম্বে চারু মজুমদারের মুক্তি দাবি করেন। চারুকে তখন আলিপুর সেন্ট্রাল জেলে বদলি করে পিজি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন রাখা হয়। ‘৬৬ সালের ৭ই মে ওখান থেকেই মুক্তি পান।
জেল থেকে ফিরে আসতেই কানু সান্যাল সহ ঐ এলাকার পুরানাে কমরেডদের সাথে আলােচনা হলাে চারু মজুমদারের। বলেন- “তােমরা যদি মনে কর আমার বক্তব্য সঠিক নয়, তােমাদের মতামত নিয়েই তােমরা চলতে পার। এমনি কোনাে প্রশ্ন থাকলে আলােচনা করে ঐক্যমতে আসতেও কোনাে সমস্যা নেই।” সকলেরই মনে তখন দুটি প্রশ্ন- এক. সংগ্রাম ছাড়া অন্য পথ নেই। দুই. বরাবরের মতাে সংগ্রাম গড়ে তুললেই হবে না, একটি লক্ষ্য নিয়ে গােতে হবে। এখনই সশস্ত্র সংগ্রামের আওয়াজ দেওয়া ঠিক হবে কি না এবং পার্টি সংগঠন যেমন আছে তার ভিত্তিতেই সংগ্রাম সংগঠিত না করে নতুন সক্রিয় কর্মীদল-এর (activist group) সংগঠন করার প্রয়ােজন কী? প্রশ্নগুলাে এসে পড়ল। চারু মজুমদার বললেন- “কেবল সংগ্রামের কথা বলে, পুলিশি হামলা প্রতিরােধের জন্য জনগণের উপায়ের কথা না বললে নিরস্ত্র জনতাকে নির্বিচারে হত্যার মুখে ঠেলে দেওয়া হবে না? ‘সশস্ত্র হয়ে সংগ্রামে নামাে আওয়াজে তার আত্মবিশ্বাস অনেক বেশি হবে নাকি? আর পুরানাে পার্টি সংগঠনটাই তাে খােলামেলা অর্থনীতিবাদী আন্দোলন ও ভােট করার সংগঠন। তা থেকে লড়াই-এর সিদ্ধান্ত নিলেও কিছুদূর গিয়ে অনেকেই তাে ভেঙে যাবে? সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই করে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তুলতে গেলে পার্টি সংগঠনকে তাে সংশােধনবাদী কায়দায় চলার সংগঠন থেকে বিপ্লবী সংগঠনে পরিণত না করলে বিপ্লব, ‘সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে লড়াই’– সব কথার কথা থেকে যাবে না?”
চারু মজুমদারের বক্তব্য প্রচারের কাজ নকশাবাড়ি এলাকার গ্রামাঞ্চলে তাে ভালােভাবেই হয়েছিল, বন্দুকও তাে একটি দখল করা হয়েছিল। নতুন যুব সংগঠন ও পুরানাে কৃষক অঞ্চলের অগ্রণী কর্মীদের সাথে যােগাযােগের ব্যবস্থা হয়েছিল তাঁর জেলে থাকার আট মাসে সশস্ত্র সংগ্রাম ও গােপন সংগঠন গড়ার আওয়াজ পুরানাে সংগঠিত এলাকার বাইরে চটের হাট এলাকাতেও পৌঁছে গিয়েছিল। তবুও চারু মুজমদারের মনে হয়েছিল পুরানাে কর্মী বিশেষত কানু সান্যাল যদি আসে তাহলে ভাগাভাগি হয়ে যাওয়ার সমস্যা আর থাকেই না। ইতঃপূর্বে একটি মাত্রই চিন্তা তাঁর ছিল যে পুরানাে সংশােধনবাদী পার্টিতে দীর্ঘদিন অবস্থান পুরানাে কর্মীদের বিপ্লবী চিন্তাধারা গ্রহণে বাধা দিতে পারে। কার্যক্ষেত্রে কাজ অনেক সহজই হলাে। জুন মাসের মধ্যেই লােকাল কমিটি মিটিং-এ (সমগ্র মহকুমায় একটিই লােকাল ছিল তখন) উনিশজন সদস্যের মধ্যে একজন বীরেন বােস ছাড়া সকলেই ‘এলাকা ভিত্তিক ক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র কৃষক সংগ্রামের রাজনীতি বিনা প্রতিবাদে মেনে নিলেন, এবং বলা যায় নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের ক্ষেত্রে পার্টির-সিদ্ধান্ত সেইদিনই গৃহীত হলাে।
নতুন উচ্ছ্বাস তখন চারুর মনে। ‘একলা চলরে’-র সমস্যা কেটে গেছে। একজন। বাদে পুরানাে কমরেড সবাইকে পেয়ে গেছেন। যুবকদের বলেন— পুরানাে কমরেডদের প্রতিষ্ঠা ও পরিচিত বিপ্লবী বক্তব্যকে ছড়াতে অনেক তাড়াতাড়ি সাহায্য করবে। তােমরা যতই উদ্বুদ্ধ হও, তােমাদের তাে রাজনৈতিক পরিচিতি নেই, এখনও তাে সব কৃষক তােমাদের বিশ্বাসই করে উঠতে পারেনি। সত্যিই এই যুবকেরা গ্রামে যাওয়ার পর ফাঁসি দেওয়া, চৌপুখুরিয়ার অনেক কৃষক সরাসরি চারুর সাথে এসে দেখা করেছে, ঐ যুবকদের সম্বন্ধে জানতে।
এই সময় ষষ্ঠ দলিল লিখে তিনি সরাসরি এই পার্টির তথাকথিত ‘ফর্ম’ বা ‘গণতান্ত্রিক কাঠামােকে ভেঙে নেতৃত্বের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করার আহ্বান জানালেন। ষষ্ঠ দলিলে চারু মজুমদার সিপিআই (এম) গঠনের সময় ও ‘৬৬ সালের প্রথম কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং-এ পরিবর্তনকে উল্লেখ করে বললেন- “শােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে যে পার্টি গঠিত হলাে সেই পার্টির কেন্দ্রীয় ভাবাদর্শগত প্রস্তাব গ্রহণ করে। সােজাসুজি ঘােষণা করলেন মহান চীনা পার্টি ভারত সরকার সম্বন্ধে যেসব সমালােচনা। করেছেন সবগুলােই ভুল। সাথে সাথেই তারা প্রস্তাবে বলেছেন সােভিয়েত শােধনবাদী নেতৃত্বের এখন সমালােচনা করা চলবে না, তাতে সমাজতন্ত্রের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।” তিনি আরও বললেন যে, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি ও তার নেতা চেয়ারম্যান মাও বিশ্ব শ্রমিকশ্রেণি ও বিপ্লবের নেতৃত্ব করে লেনিনের স্থান গ্রহণ করেছেন। তাঁদের বিরােধিতা করে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামে এই পার্টি নেতৃত্ব সহযােগী হতে পারে না। এই দলিলে তিনি দেখালেন যে, সােভিয়েত সংশােধনবাদ আজ বিশ্বে বিপ্লবী ও মুক্তি আন্দোলনে বিভেদ সৃষ্টিকারী ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের সহযােগী হয়ে পড়েছে সে সােভিয়েতের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকে আজ ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রে পরিণত করে চলেছে। সুতরাং সােভিয়েতের কেবল ‘কিছু ভুল আছে’ বলে সিপিআই (এম) নেতৃত্ব প্রকৃতপক্ষে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকেই খাটো করে দিচ্ছেন সােভিয়েত সংশােধনবাদীদের আড়াল করে।
এই পার্টি নেতৃত্ব ‘দুই বৎসরের সংগ্রামের যে নতুন বৈশিষ্ট্য অর্থাৎ প্রতিবিপ্লবী হিংসার বিরুদ্ধে বিপ্লবী হিংসার প্রকাশ গণ আন্দোলনের এই বিকাশউলুখ দিক সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নীরব। গণ আন্দোলনের প্রশ্নগুলাে এমনভাবে তারা পেশ করলেন যা থেকে সহজ সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসে যে আগামী নির্বাচনে আমাদের সরকার গঠনই মূল লক্ষ্য।
পার্টি নেতৃত্বের সংগ্রামের ক্ষেত্রে চাতুর্যের বিশ্লেষণ করে এই দলিলে চারু বলেন যে, একদিকে বিপ্লবী প্রতিরােধ বা সশস্ত্র সংগ্রামের আওয়াজকে এঁরা হঠকারী আখ্যা দিচ্ছেন, অন্যদিকে ঘেরাও লাগাতার ধর্মঘট বলে আবার নিরস্ত্র জনতাকে উস্কেও দিচ্ছেন, আবার নির্বাচনি ঐক্যের আকুল আহ্বান জানাচ্ছেন। এগুলাে মধ্যবিত্তসুলভ উগ্র বামপন্থি বক্তব্য রেখে বুর্জোয়াশ্রেণির লেজুড়বৃত্তি ছাড়া আর কিছু নয়।
স্বতঃস্ফূর্ত সংগ্রামকে সচেতন নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য তিনি যে পদ্ধতি নিতে আহ্বান জানান তা হচ্ছে- (১) পার্টি ফর্মকে অগ্রাহ্য করে পার্টির ভিতরে পার্টি গড়ে তােলা। (২) অ্যাক্টিভিস্ট গ্রুপগুলােকে রাজনৈতিক প্রচার ও শত্রুর বিরুদ্ধে আঘাত হানার জন্য কমব্যাট গ্রুপে রূপান্তরিত করা, যার কাজ হবে রাষ্ট্রযন্ত্রের প্রতিভূ পুলিশ ও মিলিটারির উপর আঘাত হানা, শ্রেণিশত্রুর কাছ থেকে অস্ত্র সংগ্রহ, ঘৃণিত আমলার উপর আঘাত হানা। তিনি কৃষক অঞ্চলকেই বিপ্লবী কাজের প্রধান ভিত্তি করতে বলেন। শত্রুর আক্রমণ প্রতিরােধ করতে গিয়েই কৃষকের গণফৌজ গড়ে তােলার কথা বলেন এবং চীনের কৌশলে গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরার প্রশ্নকে লক্ষ্য হিসেবে মাথায় রাখতে বলেন। সেই সময়কার আন্দোলনকে নজরে রেখে তিনি প্রস্তাব দেন স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের পিছনে না ছুটে পার্টিজান সংগ্রাম গড়ে তুলতে। তিনি বলেন যে, ছয় মাসের মধ্যে পার্টিজান সংগ্রাম গড়ে তুলতে না পারলে সাম্রাজ্যবাদের আক্রমণের সামনে সংগঠিত হওয়া দুরূহ হয়ে পড়বে।
পার্টির মধ্যে একটি আলােড়ন তােলার ব্যাপারটা তখন মাথায় ঘুরছিল চারুর। কলকাতায় পাঠালেন এক পুরানাে কমরেডকে যােগাযােগের জন্য। সুশীতল রায় চৌধুরী, সরােজ দত্ত, পরিমল দাশগুপ্ত, অসিত সেন প্রমুখ, আন্তঃপার্টি সংশােধনবাদ বিরােধী কমিটি গঠন করে আদর্শগত বক্তব্যগুলােকে প্রবন্ধের মারফতে তুলে ধরেছিলেন এবং পার্টির মধ্যে প্রচার কার্য চালিয়ে যাচ্ছিলেন। চারু মজুমদারের পাঠানাে কমরেডের সাথে এদের যােগাযােগও হলাে এবং মতামত বিনিময়ের জন্য একটি রাজ্য সংযােগ কমিটিও গঠিত হলাে। “পার্টির মধ্যে পার্টি” আওয়াজটি পশ্চিম বাংলার অনেকগুলাে জেলায় ছড়িয়ে পড়তে লাগল। কলকাতায়, যাদবপুর-টালিগঞ্জ অঞ্চলে, হুগলির বিভিন্ন অঞ্চলে সংশােধনবাদ বিরােধিতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল বিভিন্ন গ্রুপে আত্মপ্রকাশ করছিল এবং আদর্শগত ক্ষেত্রে তীব্রভাবে মহাবিতর্কে চীনের পার্টির বক্তব্যকে তুলে ধরা হচ্ছিল। এর মধ্যে কেউ কেউ ১৯৬৪ সাল থেকেই সংশােধনবাদ বিরােধী বক্তব্য রেখে আসছিলেন। ওদিকে অন্ধ্র, ইউপি ও বিহারেও পার্টি সদস্যদের মধ্যে আদর্শগত প্রশ্ন নিয়ে জোট বাঁধা শুরু হচ্ছিল। তবে সবগুলােই ছিল ছাড়া ছাড়া, পারস্পরিক ঐক্য গড়ে তােলার চাড় কারাে মধ্যে দেখা তাে যাচ্ছিলই না বরং প্রত্যেকের মধ্যেই আমরাই সঠিক এই অহমিকার ভাবটাই প্রকট ছিল।
দার্জিলিং-এর সিপিআই (এম)-এর জেলা কমিটি গঠিত হলাে এবং ছাব্বিশ জন কমিটি সদস্যের মধ্যে কমবেশি উনিশ জনের সমর্থন চারুর বক্তব্যের দিকে পাওয়া গেল।
১৯৬৫ সালে চারু মজুমদার গ্রেপ্তার হওয়ার পর পরই জেলা সম্পাদক রতনলাল। ব্রাহ্মণ শিলিগুড়ির একজন পার্টি থেকে বহিষ্কৃত সদস্যকে সঙ্গে নিযে নকশালবাড়ি এলাকার বিভিন্ন অঞ্চলে পার্টি সদস্য ও দরদি কৃষকদের মিটিং করে চারু মুজমদারের ‘লাইন-এর ‘সর্বনাশকর পরিণতি সম্বন্ধে সাবধান করতে গেলে উলটে কঠোরভাবে সমালােচিত হন এবং পরে রেগে গিয়ে তাড়িয়ে দেওয়ার ভয় দেখান। রতনলাল এক অদ্ভুত যুক্তি দেখান যে, পার্টিতে ‘সংগ্রামী লােকদের দরকার নেই, তারা উগ্রপন্থি বরঞ্চ ‘যারা টাকা দেবে তাদেরই পার্টিতে রাখলে পার্টি ভাঙার ভয় নেই।’ রতনলালের বক্তব্যের পর চারু মজুমদারের প্রতি সমর্থন আরও বেড়ে যায়। রতনলাল ব্যর্থ হয়ে ফিরে যাওয়ার পর জলপাইগুড়ির অনিল মুখার্জী নকশালবাড়ি এলাকার কয়েক জায়গায় চারু মজুমদারের দলিলগুলাে হাতে নিয়েই আলােচনা করে দেখান রতনলালরা আসলে সংশােধনবাদকে জিইয়ে রাখতে চায়।
১৯৬৬-এর সেপ্টেম্বরে মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে উত্তরবঙ্গে চা-শ্রমিকদের সাধারণ ধর্মঘট হয়। ঘুম-এর কলেজভ্যালি চা-বাগানের নারী চা-শ্রমিকরা পাঞ্জাব সশস্ত্র পুলিশের ব্যাটালিয়নকে ঘিরে ফেলে রাইফেল কেড়ে নিতে যায়, ধস্তাধস্তির পর পুলিশ পলায়নপর অবস্থায় গুলি চালালে একজন চা-শ্রমিক নিহত হন। দার্জিলিং পাহাড়ে যেন আগুন জ্বলে ওঠে। পঁচিশ হাজারেরও অধিক চা-শ্রমিক প্রবল বৃষ্টির মধ্যে দার্জিলিং শহরের ১৪৪ ধারা ভেঙে শহিদ দিবস পালন করতে রওনা দিল পাহাড়-পর্বত ভেঙে। পুলিশ তটস্থ সুপারিনটেন্ডেন্ট অভ পুলিশ রতনলাল ব্রাহ্মণ ও গােখা লীগের সম্পাদক দেওপ্রকাশ রাইকে এসে বলল মিছিল বন্ধ করতে। পুলিশের চেয়েও আতঙ্কিত ঐ দুজন নেতা ছুটে গিয়ে দার্জিলিং শহরের প্রবেশ দ্বারে চা-শ্রমিকদের দৃপ্ত মিছিল ঠেকিয়ে দিল হাতজোড় করে। পুলিশের কাছে রতনলালদের মান বাঁচল, কিন্তু শ্রমিকদের উদ্দীপনায় ঠান্ডা জল পড়ে গেল।
নকশালবাড়ি এলাকার চা-শ্রমিক ধর্মঘটে আদিবাসী কৃষকরাই নিয়েছে জঙ্গি ভূমিকা। ধর্মঘটের শুরু থেকেই প্রবল বর্ষণ মাথায় করে মিছিলে তির, ধুনক, বল্লম নিয়ে সর্বাগ্রে রয়েছে কৃষকরাই। ধর্মঘটের শেষের দিকে গঙ্গারাম চা-বাগানে ইংরেজ ম্যানেজার ক্রেগ, দালাল ঢােকানাের পরিকল্পনা করল। কিন্তু বিকেলের দিকে লাঠিসোঁটা নিয়ে বিহারের যে একদল বেকার কৃষককে আনিয়ে রেখছিল, তাদের হই হই করে ঢােকাতে গেল বাগানে, ম্যানেজার নিজে দাঁড়িয়ে থেকে। তখন এক নারী শ্রমিক সুমিতি রবিদাস এদের দেখে একটা লাঠি নিয়ে এক বিকট চিৎকার দিয়ে হামলা করলাে দালালদের উপর, তার চিৎকারে সচকিত হয়ে গেল বাগানের শ্রমিক আর নদীর উত্তর পাড়ের কৃষকেরা। কানু সান্যালের নেতৃত্বে কৃষকরা তির, ধনুক, লাঠি নিয়ে খরস্রোতা নদীটি মুহূর্তে পার হয়ে পেটাতে শুরু করলাে দালালদের মারের চোটেই পালিয়ে গেল দালালরা। হঠাৎ সশস্ত্র পুলিশ স্বয়ং ডিএসপি-র নেতৃত্বে গাড়িতে করে হাজির ম্যানেজার। সাহেবের ফোন পেয়ে। বাগানের ভিতরের রাস্তায় রাইফেল তুলে সার দিয়ে দাঁড়াল। পুলিশ। হঠাৎ কৃষক নেতা মুন্সি টুড় এক চিৎকার দিল- “এইবার চারুবাবুর লাইনে। লড়াই হবে পুলিশের সাথে”, বলে ধুনকের তির জুড়ে ছিলা টান টান করে চা-গাছের আড়ালে বসে পড়ল— তার দেখাদেখি অন্য কৃষকরাও এভাবে ধনুকের তির জুড়ে বসে পড়ল। বেশ আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল পুলিশের মধ্যে, চা-গাছের আড়ালে কৃষকযযাদ্ধাদের তারা একদম দেখতে পারছে না। প্রচণ্ড উত্তেজনায় কয়েকটি মুহূর্ত, কানু সান্যালও বুঝতে পারছেন না ব্যাপারটা কী দাঁড়াবে। কিন্তু তার মনেও প্রবল উত্তেজনা সকলেই মুন্সি টুডুকেই অনুসরণ করতে প্রস্তুত। দার্জিলিং পাহাড়ের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হয়ে গেল এখানেও। চা-শ্রমিক নেতা বীরেন বােস হঠাৎ এসে হাজির হলেন পুলিশ অফিসারকে অনুনয় করলেন এবং শ্রমিক কৃষকদের বললেন যে দালাল তাে হটে গেছে শুধু শুধু রক্ত ক্ষয় করে কী লাভ? ম্যানেজারকে যাতে গ্রেপ্তার করা হয় তার জন্য পুলিশকে তিনি বললেন। কৃষকেরা তির নামিয়ে দিল। ম্যানেজার গ্রেপ্তার হয়ে ওখানেই জামিন পেয়ে গেল— কৃষক ও শ্রমিক কয়েকজনকে পুলিশের গাড়িতে তুলে নিয়ে গেল শিলিগুড়ি—এই আশ্বাস দিয়ে যে, ওখানে গিয়ে বীরেন বাবু জামিন নেবেন। জামিন তখন হলাে না এবং এক সপ্তাহ সবাইকে জেলে থাকতে হবে। অথচ এই ঘটনায় অন্যান্য অঞ্চলে চাশ্রমিকদের মধ্যে উৎসাহ সঞ্চার হলাে। জলপাইগুড়ির পার্টির জেলা সম্পাদক সুবােধ সেন। মন্তব্য করেছিলেন– “আমাদের জলপাইগুড়ি এলাকায় একেবারে শান্তিপূর্ণ ধর্মঘট করতে গিয়ে দালালরাই ধর্মঘটটি শ্রমিকদের মেরে কাজ চালু করে দিচ্ছে। তােমরা ধমর্ঘটে মিলিট্যান্সি দেখিয়ে শ্রমিকদের উৎসাহ বাড়িয়ে দিলে।”
পৃষ্ঠা: ১১০
১৯৫৫ সালের মতাে একেবারে চা-শ্রমিক ধর্মঘট নেতারা চারু মজুমদারের সাথে কোনাে পরামর্শ করলেন না। অসুস্থ মানুষকে বিরক্ত করার কী দরকার?’- বলে পাশ কাটালেন, কিন্তু কানু সান্যাল বা শিলিগুড়ির আর যারা এই ধর্মঘটে গভীরভাবে লিপ্ত ছিল তাদেরও ডাকা হলাে না ধর্মঘট অবসান করার সমালােচনা সভায়। শ্রমিকদের সাথেও কোনাে পরমার্শ না করে বিনা শর্তে ধর্মঘট তুলে নেওয়া হলাে। চারু মজুমদার বললেন- “মালিক ও পার্টির নেতারা উভয়েই লড়াই-এর মেজাজ দেখে ভয় পেয়ে গেল। আসল কথা হচ্ছে শ্রমিক-কৃষকের লড়াই করার মনােভাব। সেখানে আমরা পুরােপুরি সফল হয়েছি।”
হরতাল তুলে নেওয়ার পর পরই পাহাড়ের তিনটি অঞ্চলে প্রায় সমস্ত পার্টি সদস্যের মিটিং হলাে— গােপনে, পৃথক পৃথকভাবে, ছায়া-জেলা কমিটির আহ্বানে। আসন্ন জেলা কমিটির মিটিং-এ চা বাগান ধর্মঘটের বিশ্লেষণ এই জেলা কমিটির প্রতিনিধিই রাখবেন আর পরের বছর অর্থাৎ ‘৬৭ সালে চা-শ্রমিক ইউনিয়ন সম্মেলনে জেলা নেতৃত্বকে আক্রমণ করার জন্য শ্রমিক সদস্যদের রাজনৈতিকভাবে প্রস্তুত করা হবে, এই দুইটি সিদ্ধান্ত হলাে।
শিলিগুড়ি মহকুমার বাগডােগরায় জেলা কমিটি মিটিং হলাে কেবল চা-বাগান ধর্মঘটের পর্যালােচনার জন্য। রতনলাল ব্রাহ্মণের সভাপতিত্বে আনন্দ পাঠক পর্যালােচনার খসড়া উপস্থিত করলেন, যেটি চারু মজুমদারের সাথে পরমার্শ করে তৈরি করেছিলেন ছায়া-জেলা কমিটিরই একজন যিনি আবার নিয়মিত জেলা কমিটির সম্পাদকমণ্ডলীরও সদস্য। এই পর্যালােচনায় বলা হলাে যে, ‘চা-শ্রমিক ধর্মঘটে দেখা গেল যে শ্রমিকদের মুজরি আদায় করতে গেলেও সরকারি সশস্ত্র শক্তি পুলিশের সাথে লাইন করতে হয়। চা-শ্রমিক এই সময়ে বারবার অনুভব করেছে যে, তার হাতে অস্ত্রের প্রয়ােজন। অস্ত্র হাতে থাকলে সে অনেক ভরসা নিয়ে মজুরি বৃদ্ধির সংগ্রামেও বিজয় আনতে পারে। নারী শ্রমিকরা যে পুলিশের রাইফেল কেড়ে নিতে গিয়েছিল তা কেবল পুলিশকে নিরস্ত্র কার জন্যই নয়, নিজেরাও তারা সশস্ত্র হতে চেয়েছিল। মিছিল প্রতিরােধ, পুলিশের সাথে লড়াই— এ বাধা দিয়ে কিছু কিছু নেতা দুর্বলতার পরিচয় দিয়ে নেতৃত্বেরই অবমাননা করেছেন।
এই প্রস্তাব সর্বসম্মতভাবে হাত তুলে পাশ হলাে।
কিছুদিন পরেই রতনলাল প্রথমে আনন্দ পাঠককে বকাবকি করলেন এরূপ প্রস্তাব উপস্থিত করার জন্য। আনন্দ তখনও বুঝতে পারেননি প্রস্তাবটিতে অন্যায় কী লেখা হয়েছে?
‘৬৬-এর অক্টোবরে এলেন রাজ্য কমিটি তথা কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য হরেকৃষ্ণ কোঙার। শিলিগুড়িতে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর সভায় তিনি চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে অভিযােগ করে বললেন যে, চারুবাবু পার্টি বিরােধী কাজ করেছেন। অসুস্থ বলে তাঁর বিরুদ্ধে পার্টি এতদিন কিছু করেনি, তবে এখন আর সহ্য করা হবে না। তাকে পার্টি থেকে সাসপেন্ড করা হবে। সাতজন সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্যের মধ্যে চারু সহ দুজন অনুপস্থিত ছিলেন। এর মধ্যে চারুর পক্ষে কানু সান্যাল ও সৌরেন বসু। কানু সান্যাল বললেন- “পার্টির লাইনের বিরুদ্ধে মত প্রকাশের স্বাধীনতা সব পার্টির সদস্যেরই আছে। সােভিয়েতের পার্টিতেও লেনিন অটুজোভিস্টদের সমালােচনা করলেও ‘কমরেড’ সম্বােধন করেছেন, সাসপেন্ড করার কথা বলেননি। চারু মজুমদারের মতাে কমরেডকে এভাবে সাসপেন্ড করাটাই তাে নিয়ম বিরুদ্ধ।” অল্পেতেই উত্তেজিত হয়ে যাওয়ার অভ্যাস ছিল হরেকৃষ্ণ কোঙারের। তিনি হঠাই উত্তেজিত হয়ে বললেন- “দরকার হলে দার্জিলিং জেলা কমিটিই খারিজ করে, জলপাইগুড়িতে বসে আমরা দার্জিংয়ের পার্টি চালাব।” কানু সান্যালও উত্তেজিত হয়ে বলেছিলেন- “পার্টি সংবিধানের কেন্দ্রীয় বা রাজ্য কমিটির সদস্যের কোনাে বিশেষ ক্ষমতা দেওয়া নেই। সুতরাং ঐসব কমিটির সিদ্ধান্ত ছাড়া আপনি ব্যক্তিগতভাবে এসব কথা বলতে পারেন না, বলার আপনার। কোনাে অধিকারও নেই।” হরেকৃষ্ণ আর কথা না বাড়িয়ে সেদিন চুপ করে গিয়েছিলেন। চারু মজুমদারের বাড়িতে গেলেন হরেকৃষ্ণ চারু বললেন- “আপনারা আমার বক্তব্যের কোনাে জবাব দিচ্ছেন না, নিজেরাও কিছু করেছেন না। এক কমিউনিস্ট হিসেবে আমি তাে ঐ ফর্ম-এর দোহাই দিয়ে চুপ করে বসে থাকতে পারি না?” সেখানেও হরেকৃষ্ণ নীরবই থেকে ছিলেন। পরে মন্তব্য করেছিলেন, “চারুবাবু তাে নিজের স্ট্যান্ড সম্বন্ধে অসম্ভব অ্যারােগ্যান্ট।” চারু শুনে হেসে বললেন- “উদ্ধত, দুর্বিনীত না হলে বিপ্লবী হতে পারা যায় কি?”
উত্তাল-উদ্বেল বিশ্বজগৎ। চারু মুজমদার বলেন- “বিপ্লবের স্বপ্ন দেখ, আকাশ পর্যন্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে তুলে দাও- ইতিহাস তােমার সামনে এনে দিয়েছে স্বপ্নকে বাস্তব করার দায়িত্ব।”
আকাশ থেকে ঝরছে যেমন অঝাের বর্ষণ, সমাজের তলা থেকে হচ্ছে যেন আগ্নেয়গিরির উদগীরণ। উড়িষ্যার জনসভা করতে গিয়ে ইন্দিরা গান্ধীর নাকের উপর এসে আঘাত করল ইটের টুকরাে,-পাটনায় জনসমুদ্র বেষ্টন করে রাখল প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ওয়াই বি চৌহানের সভায় যাত্রাপথে। শঙ্কিত ভারতের শাসকশ্রেণি, ত্রস্ত কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ। শাসকশ্রেণি নামাল পুলিশ, মিলিটারি কাকে রুখবে, মৃত্যুভয় তুচ্ছ হয়ে গেছে আপামর শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, যুবকের মনে। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ পরােক্ষে আশ্বস্ত করলেন শাসকশ্রেণিকে ভােটের মধ্যে দিয়ে বিকল্প সরকারের আওয়াজ দিয়ে। পরিস্থিতির উত্তেজনা সংসদীয় পথে পরিচালিত করার জন্য ৪৮ ঘণ্টার বাংলা বন্ধ করলেন তাঁরা, পশ্চিম বাংলার বিধানসভা ‘দখল’-এর তােড়জোড় পড়ে গেল।
চারু মজুমদার হাতে তুড়ি মেরে বললেন—“কৈ বাত নেহি! নির্বাচনের মধ্যে বিক্ষুব্ধ মানুষ রাজনীতি শুনতে চায় নির্বাচনের সুযােগ নিয়ে আমাদের ‘অকংগ্রেসী গণতান্ত্রিক সরকার’-এর ভুয়া আওয়াজে বিভ্রান্ত না হয়ে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের রাজনীতি, সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়ােজনীয়তা, শ্রমিক-কৃষকের সংগ্রামী ঐক্য ও বিপ্লবে পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার কথা বলতে হবে।”
শিলিগুড়ি মহকুমার ফাঁসি দেওয়া ও শিলিগুড়ি এই দুটি কেন্দ্রে যথাক্রমে জঙ্গল সাঁওতাল ও সৌরেন বােসকে সিপিআই (এম)-এর প্রার্থী নির্ধারণ করা হলাে। চারু বলতে লাগলেন—“চান্স একেবারে হাতে এসে গেছে ধুম প্রচার চালাও বিপ্লবের।” নির্বাচনি প্রচার চলতে লাগল গ্রামে, পাহাড়ের ঐ কেন্দ্রগুলাের নির্বাচনি-‘বিপ্লব যারা চান তারা আমাদের ভােট দিন।
‘পার্টির মধ্যে পার্টি’ আওয়াজ ছড়িয়ে পড়ছে এবং এই ছায়া কমিটিগুলাের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পুরাে দার্জিলিং জেলাতেই কাজ চলতে লাগল। জলপাইগুড়ি জেলার শহর ও আলিপুরদুয়ারের সক্রিয় পার্টি কর্মীরা এসে দেখা করেন চারুর সাথে, চারু বলেন-“জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিপ্লবী প্রতিরােধ গড়ে তুলছে। আমাদের কাজ পার্টির সচেতন নেতৃত্বের অধীনে এই স্বতঃস্ফূর্ততাকে নিয়ে আসা তা করতে গেলে প্রয়ােজন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে প্রাকশ্যে সংগ্রাম করা। সেই সংগ্রাম কতখানি কার্যকরী হলাে তা প্রমাণ হবে নিজ নিজ এলাকায় কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম কতখানি গড়ে তুলেছ তার উপর।”।
নির্বাচনের ঠিক আগে দিয়ে চারু মজুমদার লিখলেন তাঁর সপ্তম দলিল। এই দলিলে ‘৬৫ সাল থেকে যে স্বতঃস্ফূর্ত ছাত্র-যুব, শ্রমিক ও কৃষক সংগ্রাম চলে এলে তার চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে, বিভিন্ন শ্রেণির দাবির ভিত্তিতে হলেও এগুলাে সবই সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এবং সবগুলােই প্রতিরােধ সংগ্রামের রূপ নিয়েছে, যেখানে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই রাজনৈতিক ক্ষমতার প্রশ্ন এসে পড়েছে। এই পরিস্থিতিতে তিনি ‘আমাদের কাজ’ বলে তাঁর ভারতীয় বিপ্লবের সম্বন্ধে মােট চিন্তাধারার একটি রূপরেখা দিলেন। তাতে বললেন যে, ভারতের মতাে আধা ঔপনিবেশিক ও আধা সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় কৃষকই প্রধান সামাজিক শক্তি— সুতরাং কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে ক্ষমতা দখলই এখানকার প্রদান রাজনৈতিক কাজ। এই কাজের জন্য শ্রমিক ও কৃষকের সুদৃঢ় মৈত্রী গড়ে তুলতে হবে। শ্রমিক ও মধ্যবিত্ত যুবকদের কাজ কেবল কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রামে নৈতিক সমর্থন নয়— কাজ হচ্ছে কৃষকদের ‘পার্টিজান সংগ্রাম গড়ে তােলার সাহায্য করা ও সমাজের অন্য অংশে কৃষি বিপ্লবের প্রয়ােজনীয়তা প্রচার। পুরানাে ধরনের ট্রেড ইউনিয়ন ও কৃষক সংগঠনের আন্দোলন পরিচালনার কাজ এখন অচল। আবার তার অর্থ ট্রেড ইউনিয়ন বা কৃষক সভাই অচল তা বললেন না। বরং বললেন ঐ সংগঠনগুলাের উপযােগিতা এইখানে যে ঐগুলাে মার্কসবাদীলেনিনবাদীদের সাথে সাধারণ শ্রমিক ও কৃষকের ঐক্যের স্থল।
তিনি সশস্ত্র পার্টিজান সংগ্রাম গড়ে তােলার কাজকেই এই সময়ের প্রধান রাজনৈতিক কাজ বললেন এবং পার্টি কর্মীদের এই সংগ্রামের কৌশল আয়ত্ত করার ও জনসাধারণের মধ্যে প্রচারের দ্বারা সংগ্রামী মনােবল বাড়িয়ে দেওয়ার কাজই প্রধান কাজ বলে বললেন।
এইসব কাজের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ কাজ হিসেবে চারু মজুমদার এই দলিলে বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার কথা বললেন। “বর্তমানে ভারতবর্ষের এই বিপ্লবী অবস্থায় নেতৃত্ব দেওয়ার পক্ষে আমাদের পার্টি সংগঠন উপযুক্ত নয়। তত্ত্বগতভাবে দৃঢ়, রাজনীতিতে স্পষ্ট এবং সংগঠনের ক্ষেত্রে গণভিত্তি ছাড়া আজকের এই বৈপ্লবিক যুগে নেতৃত্ব দেওয়া অসম্ভব।” এই বক্তব্য দিয়ে তিনি বিপ্লবী পার্টির তিনটি শর্ত বিশ্লেষণ করে দেখালেন যে শােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের ভিত্তিতে নতুন পার্টি অর্থাৎ সিপিএম গড়ে উঠেছে কিন্তু তার নেতৃত্ব শােধনবাদই অনুসরণ করছে- (১) আন্তর্জাতিক শােধনবাদের বিরুদ্ধে চীনের পার্টি নেতৃত্বকে স্বীকার না করে, (২) নতুন বিকাশমান শক্তিকে স্বীকার না করে, (৩) শ্রমিক শ্রেণিকে এই নতুন উপলব্ধিতে সচেতন না করে, (৪) শ্রমিক শ্রেণির প্রধান মিত্র কৃষককে সংগ্রামে সাহায্য না করে। এই শােধনবাদী নেতৃত্বের বিরুদ্ধে নির্দিষ্ট জায়গায় সংগ্রাম করতে হবে বলে তিনি প্রথম শর্ত চিহ্নিত করলেন। দ্বিতীয় শর্ত হিসেবে বললেন যে, রাজনীতির প্রধান অঙ্গ হবে জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবকে এই মুহূর্তের কাজ হিসেবে দেখে ক্ষমতা দখলের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম। সাধারণ মানুষ স্বতঃস্ফূর্তভাবে যে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলেছে তাকে সচেতন নেতৃত্ব দিয়ে গণভিত্তিতে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তার জন্য শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী প্রতিষ্ঠা করতে হবে, পার্টি নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তৃতীয় শর্ত হিসেবে দেখালেন যে গত কয়েক বৎসর ধরে যে বিপুল সংখ্যক জঙ্গি কর্মীরা সংগ্রাম করে চলেছে তাদের পার্টির আওতায় টেনে আনতে হবে গােপন গ্রুপ গঠন মারফত। আর এইগুলােকে সশস্ত্র সংগ্রামের ইউনিট হিসেবে গড়ে তুলতে হবে এবং এই গ্রুপগুলােকেই আত্মনির্ভরশীল পার্টি নেতৃত্ব হিসেবে গড়ে তুলতে হবে।
এই দলিলেই চারু মজুমদার নির্বাচনকে বিপ্লবের প্রচারের কাজে ব্যবহার করার আহ্বান জানিয়েছিলেন।
নির্বাচনে পশ্চিমবাংলায় অকংগ্রেসী যুক্তফ্রন্ট সরকার গঠিত হলেও, শিলিগুড়ি মহকুমায় পার্টির দুজন প্রার্থীই পরাজিত হলাে। কিন্তু পরাজয়ের প্রভাব না প্রার্থীদের উপর না পার্টির প্রভাবে প্রভাবান্বিত জনগণের উপরে পড়ল। উপরন্তু বিশাল বিশাল মিছিল হলাে নতুন এলাকায় এরূপ একটি মিছিলে কৃষকরাই আওয়াজ তুলল- “কৃষক সব জোট বাঁধে, আপন হাতে রাজ নাও।” বিপ্লবী কর্মীদের চা-শ্রমিকরা ডেকে পাঠাতে লাগল- “আপলােককা মাফিক টাইট পার্টিকা দরকার হ্যায়” বলে লােহাগড়, মাকা, দাগপুর, শুকনা চা বাগানগুলাের শ্রমিকরা নতুন করে লড়াকু চা-বাগান ইউনিয়ন গড়ার কাজ চালাতে লাগল। আজামাবাদ প্রভৃতি কয়েকটি বাগানে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছিল— চারু মজুমদারের লাইনের প্রবক্তাদের নির্বাচনের মধ্যে তীব্র শ্রেণি বক্তব্য বলার ফলে মালিকশ্রেণিও বেশ শঙ্কিত হয়েছিল- নির্বাচনের পর পরই সব চা-বাগানেই ছাঁটাই চাশ্রমিক কাজে পুনর্বহাল হয়ে গেল।
নির্বাচনােত্তর সময়ে সমগ্র তরাই জুড়ে এক থমথমে ভাব- এ যেন বিশাল ঝড়তুফানের পূর্বাভাস। এ ঝড়ের ক্ষেত্রে প্রস্তুতের পিছনে রয়েছে দুবছর ধরে চারু মজুমদারের রাজনৈতিক বক্তব্যের প্রচার, যা কি না কর্মীদের বিপ্লবী উদ্যোগের দ্বার খুলে দিয়েছিল। রামুলাস আর রেমাসের মতাে বাঘের দুধ খাওয়া যে বীরেরা নকশালবাড়ির মহাকাব্য রচনা করল,-ই নতুন প্রজন্মকে জীবনের জন্য জাগ্রত করতে উদ্বুদ্ধ করার কাজে চারু মজুমদারের ভূমিকাকে অস্বীকার করল বিপ্লবে সচেতন রাজনৈতিক নেতৃত্বের ভূমিকাকেই অস্বীকার করা হয়।
পরিস্থিতির বিশ্লেষণের ক্ষেত্রে, ভারতের সাধারন কমিউনিস্টদের বিপ্লবী প্রতিভার প্রতি আস্থার ক্ষেত্রে, ভারতীয় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের প্রশ্নে, কৃষককে একটি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক শক্তি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে চারু মজুমদার যে কত সঠিক ছিলেন অল্পদিন পরেই নকশালবাড়িতে তা প্রমাণিত হয়ে গেল।
পৃষ্ঠা: ১১৪
১২
আহ্বান : খেতখামার পেরিয়ে
নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলন চাষির খেতখামারের গণ্ডি ছাড়িয়ে ঘূর্ণিঝড়ের মতাে বাধাধরা চিন্তাভাবনার রাজ্যে এক আলােড়ন এনে দিল।
১৯৫৯ সাল থেকেই, জোতদার বেনামা জমি উদ্ধারের আন্দোলন দিয়ে সংগ্রামের ধারাবাহিকতা বজায় রেখেছিল নকশালবাড়ির কৃষক জনগণ। ‘৬২ সালে ভারত সরকার কর্তৃক চীনের সাথে সীমানা সঘর্ষতাকে উগ্র জাতীয়তাবাদীদের শিকার হওয়ার বদলে, তার শ্রেণি সংগ্রামের উপর আক্রমণ হিসেবেই সচেতনতা জুগিয়েছিল। ‘৬২ সালেই তার উপলব্ধি হচ্ছিল সংগ্রাম আরও জোরদারভাবেই করতে হবে কেবল চিন্তা ছিল পথ কি?” ‘৬৪ সালে এসে খাদ্যের জন্য, গণতান্ত্রিক অধিকারের দাবিতে সারা দেশে সংগ্রাম, কমিউনিস্ট আন্দোলনে বিপ্লবী ও সংশােধনবাদী লাইনের বিতর্ক প্রকাশ্য ময়দানে এসে যাওয়া, ক্রমাগত শাসক শ্রেণির হামলা, তাকে রাজনীতিতে সচেতন হয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার মুখােমুখি এনে দাঁড় করাল। ক্রমাগত সরকারি আক্রমণ তাঁকে বেশি বেশি করে প্রধান শত্রু সরকার’- এই মনােভাবকে যেমন নিয়ে যাচ্ছিল তেমনই ১৯৬৪ সাল থেকে পার্টি ভাগ হওয়ার সময় আদর্শগত মহাবিতর্কের ভিত্তিতে বিপ্লবের কথাবার্তা শােনা এং ‘৬৫ সাল থেকে চারু মজুমদারের পাঁচটি দলিলকে ভিত্তি করে ‘জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের জন্য সশস্ত্র সংগ্রাম’ গড়ে তােলার জন্য সাংগঠনিকভাবে সশস্ত্র ইউনিট’ সংগঠন নকশালবাড়ির কৃষকদের একেবারেই সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার মানসিকতায় পৌছে দিল।
‘জমি সব দখল করে নেবাে’, ‘গ্রামে আমরা রাজত্ব করবাে’–এই মনােভাব প্রকাশ পেতে লেগেছিল কৃষকদের ‘৫৫ সাল থেকেই। ‘৬৬-র সেপ্টেম্বরে চা-শ্রমিক সংগ্রামের সময়েই পুলিশের সাথে তির-ধনুকের লড়াই-এর ঝোঁক এসে গিয়েছিল। কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল অক্টোবর নিবর্তনমূলক আটক আইনে হঠাৎ গ্রেপ্তার হয়ে যাওয়ার পর কৃষকরা নিজেরাই মহকুমা কৃষক কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত নেয় সমস্ত জমির ধান কেটে তুলে নেওয়ার। নেতৃস্থানীয় কেউ কেউ যখন বলতে চেয়েছিলেন যে, যে জমি জোতদারের রেকর্ডভুক্ত আর সেই জমিরই ধান কাটা উচিত, তখন তাঁদের প্রতি মতানৈক্য ব্যক্ত করে কৃষক কর্মীরাই হাতিয়ার হাতে ‘সব মালিকের সব জমির ধানই কেটে নেবাে’ বলে সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত করল।
‘৬৭-এর মার্চের শেষ থেকেই দার্জিলিং জেলার তরাই অঞ্চলের কৃষক সংগ্রাম, যা সেইদিন থেকেই ভারতের মাটিতে সংগ্রামী কমিউনিস্টদের ‘নকশালপন্থি’ বলে একটি নির্দিষ্ট নামে চিহ্নিত করে দিয়েছিল, তার প্রস্তুতি পর্বটি চলেছিল যেন এক বছর আগে। থেকেই। ‘৬৭-এর নির্বাচনের সময়ে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রচার ও নির্বাচনের পর ‘রাজ নাও’ বলে বিজয় মিছিল প্রস্তুতিকে আরও এগিয়ে দিয়েছিল।
‘৬৭-এর মার্চেই, নির্বাচনের পর পরই ‘মহকুমা কৃষক সমিতি’র সম্মেলনের প্রস্তুতি নেওয়া হলাে। কানু ও জঙ্গল ছাড়া পেয়ে গেছে তখন। প্রথম এলাকা সম্মেলনটিতেই “সশস্ত্র শক্তির সাহায্যে” জমি দখলের প্রস্তাব পাশ হয়ে যায়, আজামাবাদ বাগানের সীমানায়। সম্মেলনে উপস্থিত মহকুমা কমিটির প্রতিনিধির রিপাের্ট ছিল- “সবাই উত্তেজিত হয়েই এই প্রস্তাব পাশ করে দিল, আমার আর কিছু বলার সুযােগই হলাে না।”
ঠিক এই সময়টিতে সন্ন্যাসীস্থান (তখন হিন্দু টি এস্টেট নাম ছিল) চা-বাগানের মালিকপক্ষ বাগানের দক্ষিণ দিকে জাবর আলী বলে জোতটিকে তাদের বাগানের অংশ বলে দাবি করে পুলিশের সাহায্যে সেখানে বসবাসকারী কৃষকদের উচ্ছেদ করার চেষ্টা করল। সঙ্গে সঙ্গে আড়াইশ-তিনশ কৃষক ঐ এলাকা ও চৌপুখুরিয়া এলাকা থেকে এসে পুলিশকে ঘিরে ফেলল এবং নারী কৃষকরা পুলিশকে ধাক্কাধাক্কিও করল। পুলিশ বেশি ঝামেলা না করে কৃষক জমায়েত দেখে ফিরে গেল— চা-বাগান মালিকও নিরাশ হলাে। কিন্তু এই ঘটনার পর পরই মালিক জোতদারদের হামলার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে জায়গায় জায়গায় কৃষক মিছিল হতে লাগল।
চারু মজুমদার এই ঘটনাকে ‘জমির মালিকের হামলার বিরুদ্ধে কৃষকের প্রতিরােধ। গড়ে উঠছে বলে একটি প্রচারপত্র পশ্চিম বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানাের কথা বললেন। প্রচার পত্রটির খসড়া চারুই বলে দিলেন, কিন্তু তাতে ঐ ঘটনার উল্লেখ না করে, নকশালবাড়ির হাটের পশ্চিমে বিগুল কিসান নামে এক গরিব কৃষকের জমি কীভাবে জোতদার দখল করে নিয়েছে এবং সংগ্রাম ছাড়া আজ আর কৃষকের পথ নেই, এই কথা বলে মহকুমা সমিতির সভাপতি জঙ্গল সাঁওতালের নামে প্রচারপত্র ছাপানাের কথা বলে দিলেন। প্রচারপত্রের দুই-চারটি গিয়ে পৌঁছাতে লাগল দক্ষিণ বাংলায় এবং সিপি (এম)-এর কৃষক ফ্রন্টের কর্মীরাই বেশি করে ছাপিয়ে ওটি বিলি করতে লাগলেন। ঐ প্রচারপত্রই ‘লাল লিফলেট’ নামে বিখ্যাত হয়ে আছে এবং সি পি (এম)-এর সাংস্কৃতিক মুখপত্র “নন্দনে”ও সেটি কেউ ছেপে দিয়েছিলেন।
‘৬৭-এর এপ্রিল মাসে চারু মজুমদার তাঁর অষ্টম দলিল লিখলেন যার শিরােনামা দিলেন ‘সংশােধানবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই কৃষক সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যেতে হবে। দলিলে তিনি বললেন যে, পার্টির নেতৃত্ব (সিপি এম-এর) অকংগ্রেসী মন্ত্রীসভাকে প্রতিক্রিয়ার হাত থেকে রক্ষা করার আহ্বান দিয়ে শ্রেণি সংগ্রামের বদলে সংসদীয় পথকেই প্রধান পথ হিসেবে ঘােষণা করে দিয়েছে। শিল্পে শান্তিচুক্তি করে, কৃষকদের সরকারি জমি জোর করে দখল করতে বারণ করে এর অর্থনীতিবিদ থেকে শ্রেণি সমন্বয়ে রাজনীতিতে চলে গেছে। মাও-সে-তুঙ এরা শিক্ষার উল্লেখ করে তিনি বলেন যে, আন্তর্জাতিক আদর্শগত বিতর্কে যে কমিউনিস্টরা নিরপেক্ষ থাকে তারা প্রথমে সংশােধনবাদী এবং তারপরে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে যেতে বাধ্য। কেবল কৃষককে জমি বিলি’র মনােভাবকে অর্থনীতিবাদ বলে তিনি এই দলিলে দেখান যে, ভূমিহীন কৃষককে জমি দিয়েই ক্ষান্ত থাকলে সে মধ্য কৃষকে পরিণত হয় এবং আন্দোলনের মনােভাব হারিয়ে ফেলে। তিনি বলেন-‘সুতরাং আমাদের নেতারা লেনিনের বিপ্লবী পথ থেকে দূরে সরে গেছেন।
‘ভারবর্ষে বারবার কৃষক বিক্ষোভ ফেটে পড়েছে, কিন্তু কমিউনিস্ট পার্টি সশস্ত্র সংগ্রামের রাজনীতি আর বন্দুক সংগ্রহ অভিযানই একমাত্র পথ বলে বলেনি’ বলে তিনি দলিলে আক্ষেপ প্রকাশ করেছেন।
এই দলিলে কৃষি বিপ্লব সম্বন্ধে তাঁর ধারণাকে স্পষ্ট করতে চারু মজুমদার বলেন ‘কৃষি বিপ্লব এই মুহূর্তের কাজ… কিন্তু কৃষি বিপ্লবের আগে চাই রাষ্ট্র শক্তির ধ্বংস সাধন’। এর রূপ সম্বন্ধে তিনি বলেন-‘মাসৰ্কবাদী-লেনিনবাদ-মাও সে তুঙ চিন্তাধারা আমাদের শিখিয়েছে যে, যদি কোনাে এলাকার কৃষককে রাজনৈতিক চিন্তাধারায় উদ্বুদ্ধ করা যায়, তাহলে সেই এলাকায় রাষ্ট্রযন্ত্রকে ভাঙার কাজে সে এগিয়ে আসবে। মুক্ত অঞ্চল কাকে বলে বলতে গিয়ে তিনি জানান যে, যে অঞ্চল থেকে শ্রেণি শত্রু উচ্ছেদ হয়েছে। আংশিক বা অর্থনৈতিক দাবি নিয়ে সংগ্রাম করতে বলে তিনি মন্তব্য করেন। ‘যে সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য কৃষককে কতটা উদ্বুদ্ধ করা যায় তার উপরই এই সংগ্রামের ফলাফল নির্ভর করবে। শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্ব প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে শ্রমিকরা গ্রামঞ্চলে গিয়ে কৃষকের সঙ্গে মিলিত হয়ে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলবে।
‘সংশােধনবাদ বিপ্লব চায় না একথা বলে দলিলে তিনি dogmatism বা গোঁড়ামির মনােভাবকেও আক্রমণ করে বললেন যে, এই মনােভাবের কমিউনিস্টরা বিপ্লবের প্রয়ােজনীয়তা স্বীকার করে, কিন্তু সারা ভারতে গণআন্দোলন ব্যাপক করে তবে সশস্ত্র সংগ্রামে যাওয়ার কথা বলে। ভারতে যুক্তফ্রন্টের রূপ বলতে বলেন, ‘নাগা, মিজো সংগ্রামের পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্বের সাথে যুক্তফ্রন্ট গড়ে তুলতে হবে।’ তিনি এই দলিলে কৃষক জনগণকে আত্মত্যাগের গুরুত্ব বােঝাতে আহ্বান জানান এবং বলেন যে, ‘শ্রেণি সংগ্রামের আগুনে পুড়ে তবেই খাঁটি সােনা, অর্থাৎ কমিউনিস্ট হওয়া যায়।’
এপ্রিলেও কৃষক বিদ্রোহ পুরােপুরি শুরু হয়নি। চারু মজুমদারের মনে প্রবল উত্তেজনা যে ‘লাইনটা কাজে লাগতে শুরু করেছে। একজন নেপালি কমরেডকে ডাকিয়ে নিয়ে বললেন- “যেমন করে হােক তােমায় চীনে যেতে হবে, দলিলগুলাে সাহেবদের দিতে হবে।” দুঃসাহসিক অভিযান করল ঐ কমরেডটি জুলাই-এর শেষে চীনে পৌছতে। নেপাল থেকে তিব্বতের বরফের পাহাড় ভেঙে যাওয়ার সময়ে নেপালে ধরা পড়লে প্রায় একমাস জেলে থাকল। তারপর জেল থেকে পালিয়ে আবার ধরল তিব্বতের হাঁটা পথ। জামাকাপড় নেই, সামান্য পয়সা, অসহনীয় শীত। খাম্পা, ডাকাতদের পাল্লায় পড়ে কয়দিন তাদের মােট বইল। একটি ব্লেড দিয়ে এক খাম্পা সর্দারের দাড়ি কামিয়ে দিয়ে চামরী গরুর দুধের জমানাে মাখন পেল কেজি খানেক। খাম্পাদের হাত থেকে পালিয়ে সেই মাখনই হলাে তার একমাত্র খাদ্য। দীর্ঘ চার মাস পর তিব্বতের সীমানায় সে যখন চীনের গণমুক্তি সেনার দল দেখল তখন ক্লান্তি ও অনাহারে হাউ হাউ করে কেঁদে হাত তুলে আত্মসমর্পণ করল। চীনা সৈনিকরা বুঝতে পারে না লােকটিকে। ভাষা বােঝা যায় না, কেবল কাদে আর আঙুল তুলে সৈনিকদের গায়ে মাও-সে-তুঙ এর ব্যাজ দেখায় আর হাত মুঠ করে লাল সেলাম দেয় দার্জিলিংয়ের শ্রমিক নেতা কমরেড শর্মা। চীনা সামরিক অফিসার ওকে জড়িয়ে ধরলেন, নিয়ে গেলেন শিবিরে ‘সিউ শি’ অর্থাৎ ‘বিশ্রাম করাে’ বললেন- গরম জল এলাে স্নানের জন্য, নতুন পােশাক, এলাে মাও থাই মদ্য আর প্রচুর পরিমাণে শুয়ােরের মাংসসহ ভাত তরকারি। শর্মাকে চীনের কমিউনিস্টরা ভারতীয় সংবাদপত্র থেকে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থানের খবর জানান।
তার তাে সেই এপ্রিল মাস পর্যন্ত নিজের এলাকা সম্বন্ধে জ্ঞান। সিনহুয়া সংবাদ এজেন্সির পক্ষ থেকে শর্মাকে সংবর্ধনা জানানাে হয়। এক মাস পরে সেই হাঁটা পথেই রওনা দেয় সে, চীনের কমরেডরা একটি বড় প্লাস্টিকের চাদর, গরম জামা-কাপড় ও শুকনাে মাংস, আপেলের মদ, শুকনাে বিস্কুট, মােজা, কাপড়ের বুট জুতাে দিয়েছিলেন আসার পথে আর বললেন-“চাই চিয়েন”, আবার দেখা হবে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি, পনেরাে দিনেই সবটা পথ পাড়ি দিয়ে ফিরে এলাে চার মজুমদারের প্রথম দুত।
কৃষক সংগ্রামের ঘূর্ণিঝড় ঘুরে ঘুরে এক একটি এলাকায় পুরানাে পার্টি, পুরানাে চিন্তাকে উড়িয়ে দিচ্ছিল। মার্চ মাসেই নকশালবাড়ি থানার অধীন মনিরাম জোতে সব জমির ধান কেটে নিয়ে চলে গেল প্রায় দেড়শ কৃষক। দ্রুত ঘটে যেতে লাগল সংগ্রাম। আর সম্মেলন; ১৭ই এপ্রিল নকশালবাড়ি থানা কৃষক সম্মেলনে আওয়াজ উঠল— ‘কোনাে বাধা আর মানছি না, মানবাে না’। ৭ই মে বুড়াগঞ্জের বাঁদরঝুলি মাঠে খুবই অনাড়ম্বরভাবে অনুষ্ঠিত হলাে মহকুমা কৃষক সম্মেলন। চীনের বিপ্লব, ভিয়েতনামের সংগ্রামের কথা চুপ করে শুনল কৃষক, চা-শ্রমিক প্রতিনিধরা, বিভিন্ন বক্তার মুখ থেকে। শেষে উঠলেন কানু সান্যাল। প্রচণ্ড উত্তেজনা চোখে-মুখে। মাইকবিহীন সম্মেলনে গলার শিরা ফুলিয়ে কানু সান্যাল বললেন দুটি কথা— “কাল থেকে জমিদারি, জোতদারি উচ্ছেদ হয়ে গেল এই এলাকায়, কাল থেকে লাঙলের ফালের দাগ দিয়ে জমির নতুন সীমানা তৈরি করে জমি বিলি করবে মহকুমা কৃষক সমিতি।” বজ যেন ফেটে পড়ল সমস্ত মাঠটাতে – “ঠিক হ্যায়, একেবারে ঠিক, এমনই হবে” -বলে সমবেত আওয়াজ উঠল আদিবাসী, রাজবংশী কৃষকদের মুখ থেকে।
৮ই মে সকাল থেকেই শুরু হলাে খড়িবাড়ি, নকশালবাড়ি থানা, ফাসি-দেওয়া ও শিলিগুড়ি থানার কিছু অংশ জুড়ে নকশালবাড়ির কৃষক অভ্যুত্থান। জমি দখল, ফসল কেটে নেওয়া শুরু হলাে একধার থেকে, মাঝারি গােছের জোতদার পালিয়ে গেল অনেকে। খবরের কাগজে বড় বড় হেড লাইন শুরু হয়ে গেল— মানচিত্র দেওয়া হতে লাগল ‘নকশালবাড়ি এলাকা’ শিলিগুড়ি মহকুমার, যার উত্তর-পশ্চিমে নেপাল, দক্ষিণপূর্ব দিকে পূর্ব পাকিস্তান আর একেবারে সরাসরি না হলেও সিকিম পাহাড়টা পেরােলেই তাে চীনের এলাকা তিব্বত। কেউ বলল যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বেকায়দায় ফেলার এ এক চক্রান্ত, কেউ আবার চীনা গণফৌজের পােশাক পরা একজনকে কৃষকদের সভায় বক্তৃতাও করতে দেখে ফেলল। খবরের কাগজগুলােই গেল গেল রব ছড়িয়ে দিল। পশ্চিম বাংলার অনেক এলাকায় জেলা নেতাদের জিজ্ঞাসা করতে লাগল সিপি (এম)এর সাধারণ কর্মীরা যে, “ব্যাপরটা আসলে কী?” জেলা স্তরের নেতারা আর কী বলবে? রাজ্য দপ্তরের কাছে জানতে চায়—রাজ্য দপ্তর থেকে গেল, গেল করে বলা হয়—‘সিআইএ-এর এজেন্ট আর কংগ্রেসীদের চক্রান্ত হতে পারে, তবে ঘটনা তেমন একটা কিছু নয়! ১৫ই মে পর্যন্ত একদিকে জমিদখল ও অন্যদিকে জোতদারদের দ্বারা পুলিশের কাছে নালিশ দায়ের চলছিল। ইতােমধ্যে খবরের কাগজের কল্যাণে চারু মজুমদারের নাম ও তার সাথে কানু স্যানাল ও জঙ্গল সাঁওতালের নাম সারা ভারতেই ছড়িয়ে পড়ল এবং সব জায়গারই কমিউনিস্ট মহলে পরিচিত নাম হয়ে উঠতে লাগল।
১৬ই মে সিপি-(এম) নেতা এবং যুক্তফ্রন্ট সরকারের ভূমিরাজস্ব মন্ত্রী হরেকৃষ্ণ কোঙার শিলিগুড়ি এলেন। নকশালবাড়ির ভূমি সংস্কার অফিসে জোতদারদের এক অংশ কংগ্রেসীরা তাঁকে ঘিরে ফেলে ঘটনাকে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলতে লাগলে- “ছােট জমির মালিকের জমি দখল করছে আপনাদের লােকেরা।” হরেকৃষ্ণ কোঙার সকলকে আশ্বাস দিলেন ‘কারও প্রতি অন্যায় হবে না। তবে আবার এও বললেন যে, “সত্যি সত্যিই যদি খুব অন্যায় মনে করেন তাে নিজেরাই প্রতিরােধ করুন না?” ঐ দিনই রাত্রে তিনি কানু সান্যাল ও আরেকজন নেতৃস্থানীয় কর্মীর সাথে রাত্রি আড়াইটা পর্যন্ত আলােচনা করেন, কিন্তু কৃষি বিপ্লব সম্বন্ধে তাঁর নিজের বক্তব্যই তুলে ধরা হলে, সরকারের দ্বারা সেক্ষেত্রে কতটুকু করা যাবে জানতে চাওয়া হলে তিনি বােঝাতে পারলেন না। বারবার কেবল বলতে থাকেন যে আমাদের একটু চেষ্টা করতে দিন না? পরদিন সকালে অর্থাৎ ১৭ই মে শুকনার ফরেস্ট রেস্ট হাউসে কানু সান্যালদের আবার দেখা করতে বলে তখনকার মতাে চলে গেলেন। ১৭ই মে খুব ভােরে কানু সান্যালরা চারু মজুমদারের সাথে দেখা করে সব জানালে চারু বললেন- “শুকনার রেস্ট হাউসে গিয়ে দেখােই-না কী হয়। আসলে করতে তাে কিছুই পারবে না, কেবল সময় নিতে চাইবে!’ সরকারি গাড়িতে ওদের দুজনকে শুকনার রেস্ট হাউসে নিয়ে যাওয়ার পর কানু সান্যালরা দেখেন যে পুলিশের এসপি ও ডিআইজি সেখানে উপস্থিত। হরেকৃষ্ণ বললেন, “পুলিশ তােমাদের লিস্ট দেবে যাদের যাদের নামে ওয়ারেন্ট আছে, সেই অনুযায়ী কিছু কিছু করে আত্মসমর্পণ করিয়ে দাও, তাহলে মামলা তুলে নেওয়ার সুবিধা হবে।” পরে একান্তে কানু সান্যালদের ডেকে বললেন-“কানু, জঙ্গল এরা যেন সারেন্ডার এখন না করে, আমি গিয়ে চিঠি দিলে তবেই কী করবে ঠিক করবে।” হরেকৃষ্ণ কোনাে চিঠি আর দিলেন না। পুলিশও কোনাে লিস্ট দিল না। ১৮ই মে থেকেই অল্প অল্প করে ধরপাকড় চলতে লাগল।
পৃষ্ঠা: ১২০
১৭ই মে-তে চৌপুখুরিয়া একটি মিটিং ডাকা ছিল। মজুমদারের সাথে আলােচনা করে ঐ মিটিং-এ একটি প্রস্তাব রাখা হলাে যে জমি দখলের সময় অল্প কয়েকজন ছাড়া সকলের হাতে অস্ত্র (তির-ধুনক, বল্লম প্রভৃতি) না রাখা চলতে পারে কি না। অন্তত আপাতত পুলিশকে মামলা তৈরির সুযােগ না দেওয়ার জন্য। ঐ অঞ্চলের কৃষক নেতা রােপনা রাজগোঁড় একেবারে চিৎকার করে বলে উঠল- “তা কখনই হতে পারে না।” এই মতেই সেখানে সিদ্ধান্ত হয়ে গেল। হরেকৃষ্ণ কোঙারের সাথে সাক্ষাৎকার, মিটিংএর মধ্যে সংগ্রাম চলছিল। পুলিশের কোনাে বাধা তখনও সরাসরি আসেনি ৮৩টি ক্ষেত্রে জমি দখল, তিনজন বড় জোতদারেরা বাড়িতে হামলা করে বন্দুক দখল, দলিলপত্র ছিড়ে ফেলা, গােলা থেকে ধান নিয়ে বিলি করে দেওয়া এইসব চলছিল। এলাকা হিসেবে কৃষক কমিটিগুলােই এলাকায় আন্দোলন পরিচালনা করছিল। জোতদারদের চৌদ্দটি বন্দুক সংগ্রহ করতে সর্বত্রই জোরাজুরি করতে হলাে না। বুড়াগঞ্জের দুটি ক্ষেত্রে জোতদারের বাড়ির কাছে জমায়েত করে কৃষক কমিটির পক্ষ থেকে জোতদারকে ডেকে পাঠিয়ে বলা হলাে তার বন্দুকটি জমা দিয়ে যেতে দুজন জোতদার তাই করল। শিলিগুড়ি থানার আঠার খাই এলাকায় এক ডাকাত যুবক, সাইবু থারু ছােরা দেখিয়ে এক জোতদারের বাড়ি থেকে বন্দুক নিয়ে এলাে। উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষক বিপ্লবীদের অনর্গল আসা-যাওয়া, কোনাে কোনাে দল আবার ধান লুট করে এনে জমাও রাখে সেখানে। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলেরা জোতদারের বাড়িতে হামলায় যােগ দিল।
চারু মজুমদারের অসুখ যেন সেরে গেছে। ইজি চেয়ারে বসে থাকেন প্রায় সব সময়ে লােকের ভিড় তাঁর কাছে। বসে যাওয়া পুরানাে পার্টির লােকেরা বলে—“কী হচ্ছে চারু বাবু? কাগজ দেখে তাে মনে হয় কোনাে কিছুর মানদণ্ড বলে তাে কিছু নেই?” মহাখুশির ভাব নিয়ে চারু বলেন-“বিপ্লব, ফেস্টিভ্যাল অব দি মাসেস হচ্ছে, বুঝলেন? জনগণের বিপ্লবী ভাবনাকে স্থিতাবস্থা বজায় রাখার জন্য আপনাদের নেতারা গভর্নমেন্ট বানানাের পথে নিয়ে গেলেন। জনগণ কি তা মানে? তাই সব বাধন ছুড়ে ফেলে তারা নিজেদের হাতে রাষ্ট্র ক্ষমতা নিয়েছে।”
সংগ্রামী এলাকার সাথে সংগ্রামের নেতৃত্ব কানু সান্যাল, কদম মল্লিক, খােকন মুজমদার, জঙ্গল সাঁওতাল, দীপক বিশ্বাসের সাথে নিয়মিত যােগাযােগ চারুর, আলাদা আলাদা কুরিয়ার মারফত। প্রধানত কুরিয়ার আসে এলাকা থেকেই মাঝে মাঝে চারু লােক পাঠান হাতিঘিসার স্কুলডাঙ্গিতে পাঞ্জাব রাও-এর স্ত্রী কৃষ্ণ কুমারী বা পঞ্চানন সরকারের কাছে।
হরেকৃষ্ণ কোঙার চলে যাওয়ার আগে নকশালবাড়ি বাজারের বাস স্ট্যান্ডে একটি জনসভা করে কৃষক সংগ্রামী নেতাদের “হঠকারী” বলে তীব্র সমালােচনা করেন। সভার আগে শিলিগুড়ি শহরের মস্তান গােছের এক পার্টি দরদিকে বলেছিলেন- “আমি যখন বক্তৃতা করব তখন তুমি আমার পেছনে দাঁড়িয়ে থেকো যাতে কেউ হামলা না করে।” বলা বাহুল্য সেই ব্যক্তি সেইদিনই সংবাদটি চারু মজুমদারের কাছে পাঠিয়ে দেয়। হরেকৃষ্ণ সভার কৃষক শ্রোতাদের বেশিরভাগই ছিল সংগ্রামীরা, তাই তারা আরও দৃঢ়চিত্ত হলাে সংগ্রামের প্রশ্নে। চারু মন্তব্য করলেন- “এ তাে হরেকৃষ্ণ বাবু বাংলা কংগ্রেসমুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জী ও জোতদারদের আশ্বস্ত করলেন সিপি (এম)-এর ভূমিকা সম্বন্ধে।” হরেক কোঙার ফিরে যাওয়ার সাথে সাথেই পুলিশ ধরপাকড় চালাতে শুরু করল। দার্জিলিং-এর প্রশাসনিক কর্তারা প্রকাশ্যেই বলতে লাগল “হরেকৃষ্ণ কোঙারকে দিয়ে আমরা দরকার হলে গুলি চালনাের অর্ডার সই করিয়ে নিয়েছি।”
২৪শে মে এনফোসমেন্টের দারােগা সােনাম ওয়াদিং ও নকশালবাড়ি থানার সেকেন্ড অফিসার এর নেতৃত্বে সশস্ত্র পুলিশের একদল হাতিঘিসার বড় ঝড় জোতে ‘আত্মগােপন করে নেতারা ওখানে আছে’ খবর পেয়ে হামলা করতে এলাে সকালের দিকে। এক সাধারণ মহিলা, পুলিশ আসতে চেঁচিয়ে ডাকতে লাগল সবাইকে “পুলিশ পুলিশ” বলে। চক্ষুর নিমিষে প্রায় আড়াই, তিন হাজার মানুষ বুড়াগঞ্জ, আজামাবাদ চাবাগান, শিবদাল্লা জোত ও বিজয়নগর চা-বাগান থেকে তির-ধনুক হাতে এসে ঘিরে ফেলল পুলিশকে। প্রবল তিরের বর্ষণের মুখে পুলিশ পালাতে লাগল—দারােগা সােনাম ওয়াদিং ও নকশালবাড়ি থানার সেকেন্ড পুলিশ অফিসারের বুকে তিন চারটি তির বিধে ধরাশায়ী হলাে। পলায়নপর পুলিশের কিছু অংশ আহত অফিসারদের তুলে নিয়ে চলে গেল। হাসপাতালে সােনাম ওয়াদিংর মৃত্যু হয়। কৃষকদের এই সমাবেশে নেতৃস্থানীয় কেউই ছিলেন না।
চারু শুনে কানু সান্যালকে চিঠিতে জানালেন, “স্বতঃস্ফূর্তভাবেই শ্রমিক, কৃষক রাষ্ট্রের সশস্ত্র বিরুদ্ধে হামলা করে রাজনৈতিক পরিপক্বতার লক্ষণই দেখিয়েছে কিন্তু এভাবে তাে সবাই মিলে প্রস্তুত শক্তির সামনে লড়তে পারবে না। গেরিলা দলের সংগঠন ও কার্যকলাপের উপর এখন থেকেই জোর না দিলে সংগ্রাম এগিয়ে যেতে বাধা পাবে।”
চারু মজুমদারের কাছে দেশি, বিদেশি সাংবাদিক আসতে আরম্ভ করল। হিন্দুস্থান টাইমসের সাংবাদিক চারুকে বললেন- “এখন তাে এদেশে তিনটে কমিউনিস্ট পার্টি, যথা—সিপিআই, সিপি (এম) আর সিপি(এন)।” চারু বললেন –“আগে দুটো তাে বুঝলাম কিন্তু সিপি (এন)-টা কী?” উত্তর হলাে- “কমিউনিস্ট পার্টি (নকশালিস্ট)!” ইতিহাসে এমনভাবেই নামকরণ হয়ে যায়। নকশালবাড়ি একটি ছােট বাজার, ওখানকার লােকে বলে ‘বন্দর। কৃষক সংগ্রাম ঐ থানার খুব কম অঞ্চলেই ছড়িয়ে ছিল তবুও সমস্ত আন্দোলনটাই পরিচিত হলাে নকশালবাড়ির নামে, আন্দোলনকারী আর সংগ্রামের রাজনীতি আজও অমর হয়ে রয়েছে ‘নকশালপন্থি’ নামে। খবরের কাগজ ও বুদ্ধিজীবী মহল বােধ হয় ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন থেকে একে আলাদা করেই উপস্থিত করতে চাইছিলেন। কিন্তু তাঁদের দুর্ভাগ্য যে এই আন্দোলনের পুরাে নেতৃত্বে ছিল দীর্ঘদিনের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কর্মী।
২৫শে মে ঘটল পুলিশের বীভৎস হত্যালীলা। নকশালবাড়ি বাজারের উত্তর পশ্চিম দিকে প্রসাদ জোতে একটি ছােটখাটো মহিলা সমাবেশ করছিল বেঙাই জোতের প্রাদ সিং আগের দিনের বড় ঝড় জোতের ঘটনাটা তার জানাও ছিল না। সেদিন সকাল থেকেই আবার পুলিশি তৎপরতা শুরু হয়েছিল চতুর্দিকে, সশস্ত্র পুলিশের গাড়ির টহলদারি দিয়ে। মহিলা সমাবেশ ছিল আন্দোলনের কথা বলার জন্য এবং ওদিকটা প্রধানত অসংগঠিত অঞ্চল হওয়ায় যােগদানকারিণীদের মধ্যে কোনাে সংগঠনেরই না এমন অনেক মহিলা পুলিশ ছিলেন। পুলিশের একটি কালাে গাড়ি হঠাৎ করে সমাবেশের পাশ দিয়ে যেতে যেতে আসাম ফ্রন্ট্রিয়ার রাইফেলস্-এর বাহিনীর পুলিশ গাড়ি থেকে নেমে কাছাকাছি বাঁশ ঝাড়ের আড়ালে চলে যায় এবং সেখান থেকে অনর্গল রাইফেল-এর গুলি চলতে থাকে। সমাবেশের এগারােজন সাথে সাথেই নিহত হন, তার মধ্যে সাতজন মহিলা ও দুটি শিশু। একটি শিশু ছিল প্রহ্লাদ সিং-এর স্ত্রীর পিঠে বাঁধা অবস্থায় রাইফেলের গুলি প্রাদ-এর স্ত্রীর বুক ভেদ করে পিঠের বাচ্চাটিকে মেরে বেরিয়ে যায়। স্থানীয় রেলের বাঙালি গ্রাঙ্গম্যানের স্ত্রীও মারা যান।
চারদিকে প্রতিবাদের ঝড় উঠল এই হত্যাকাণ্ডে। শিলিগুড়িতে রেল ও রাজ্য বিদ্যুৎ দপ্তরের শ্রমিক-কর্মচারীরা এক বিশাল প্রতিবাদ মিছিল বের করল, মাধ্যমিক শিক্ষকদের রাজ্য কমিটির বৈঠক, যা শিলিগুড়িতে হচ্ছিল, তার থেকে নিন্দাসূচক প্রস্তাব নেওয়া হলাে, সিপি (এম)-এর রাজ্য দপ্তর থেকে সংবাদপত্র মারফত গুলি চালনার নিন্দা করা হলাে- তরাই-এর লালঝান্ডা ইউনিয়নের চা-শ্রমিকরা ২৭শে মে একদিন ধর্মঘট পালন করল।
২৬শে মে শিলিগুড়ি শহরের প্রমােদ দাশগুপ্ত পার্টির জি. বি মিটিং করছিলেন। একজন মিটিং-এ প্রশ্ন করল-“নকশালবাড়ির আন্দোলন সম্বন্ধে আপনার মত?” প্রমােদ দাশগুপ্ত জবাব দিয়েছিলেন—“প্যারি কমিউন সম্বন্ধে মার্কসের যে অভিমত ছিল, এ ক্ষেত্রে আমারও তাই।” ১৮৭১ সালের প্যারি কমিউন গঠিত হলে মার্কস ব্লাকি ও প্রুধোপন্থিদের সমালােচনা করেছিলেন তড়িঘড়ি করে ঘটনা ঘটানাের জন্য, কিন্তু অবশেষে মার্কস প্যারি কমিউনের বিশ্লেষণ থেকে শ্রমিকশ্রেণির একনায়কত্বের প্রকৃত রূপ-এর ব্যাখ্যা এনেছিলেন।
খেতখামারের গণ্ডি পেরিয়ে যে আহ্বান দিল নকশালবাড়ির সংগ্রাম, ২৫শে মেএর প্রসাদ জোতের ঘটনার পর তার শাখা-প্রশাখা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল আর নির্দিষ্ট সীমারেখা টানা হতে লাগল সংসদীয় পথ ও বিপ্লবের পথের পার্টি সমর্থকদের মাঝখান দিয়ে। কলকাতায় রামমােহন লাইব্রেরি হলের ঠাসাঠাসি জমায়েতে গঠিত হলাে নকশালবাড়ি ও কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি। এই সমিতির সভাপতি হলেন প্রমােদ দাশগুপ্ত, সম্পাদক পরিমল দাশগুপ্ত, সহ-সভাপতি সুশীতল রায়চৌধুরী ও সত্যানন্দ ভট্টাচার্য। এই সমাবেশেই অবিলম্বে তরাই অঞ্চল থেকে পুলিশ প্রত্যাহার, গ্রেপ্তার কৃষকদের মুক্তি, সস্তায় চাল সরবরাহের দাবি করা হলাে। “কৃষকের জমির জন্য ন্যায়সংগত দাবির” ক্ষেত্রে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পুলিশ মােতায়েনের তীব্র সমালােচনা করা হলাে সমাবেশ থেকে।
ইতঃপূর্বে কোনাে বড় কৃষক সংগ্রামের ক্ষেত্রেই বুদ্ধিজীবীদের পক্ষ থেকে স্বতঃস্ফূর্ত সহায়ক সংগঠন গঠিত হয়নি। সংগ্রামই এক যােগসূত্রে কাজ করে দিচ্ছিল বিভিন্ন সংগ্রামী শ্রেণির মধ্যে। অথচ সমস্তটিই হচ্ছে প্রতিষ্ঠিত পার্টি নেতৃত্ব ও সংগঠনকে আগ্রাহ্য করে। এই সহায়ক কমিটি গঠিত হওয়ার সাথে সাথেই সিপি (এম)-এর সংগঠনভুক্ত পার্টির কর্মী, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে শিল্পী, লেখক, শিক্ষক একটি দাঁড়ানাের জায়গা পেয়ে গেলেন নকশালবাড়িকে সমর্থন করার জন্য ও পার্টি নেতৃত্বের সংশােধনবাদকে আক্রমণ করার জন্য।
সহায়ক কমিটি গঠিত হওয়ার সাথে সাথেই “সত্যযুগ” দৈনিক পত্রিকায় একটি বিবৃতি সিপি (এম)-এর রাজ্য কমিটি চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী এবং সৌরেন বােসকে বহিষ্কারের কথা ঘােষণা করেন। কোনাে কৈফিয়ত তলব না করে, কোনাে কারণ না দেখিয়ে খবর কাগজ দ্বারা পার্টি থেকে বহিষ্কারের এই নজিরবিহীন ঘটনায় চারু হেসে বললেন- “পার্টি পদ্ধতি অনুযায়ী বহিষ্কার করতে গেলে তাে যাদের খুশি করার জন্য এ কাজ করা হলাে, সেই শােষকশ্রেণির লােকজন জানতে পারত না যে, সিপি (এম) নেতারা সংগ্রামের বিরােধিতায় কত স্থির-সঙ্কল্প? পার্টির মধ্যে কোনাে প্রতিক্রিয়া হবে না মনে কর?” অবশ্যই প্রতিক্রিয়া হলাে। পার্টি সদস্যদের প্রশ্নবাণে কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালকে প্রকাশ্যভাবে বিতাড়িত করা গেল না। এই বিতাড়ন অনেক পার্টি সদস্যকে পার্টি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সুযােগ জোগাল। মহাদেব মুখার্জী এই প্রশ্নেই এক জি.বি মিটিং থেকে পদত্যাগ ঘােষণা করেছিল।
নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম নিয়ে রােমাঞ্চ, উত্তেজনা ইতােমধ্যেই নানা গালগল্পের স্থান করে দিয়েছে। শিলিগুড়ি থেকে নকশালবাড়ি পর্যন্ত বড় রাস্তা ধরে সব সময়ে লােকের ভিড়। সাদা চোখে কিছু দেখা যায় না, কিন্তু মানুষের কল্পনার রাজ্য চা-বাগিচার সবুজ-গালিচা পেরিয়ে দক্ষিণ দিকটায় যেন কত কী ঘটে যাচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর যেন পৌষ মেলা। অগুণতি লােকজন সব সময়ে ছেলে-মেয়েগুলাে ভাবছে- “সব। আমাদের, আমরাই আমাদের ভাগ্য নিয়ন্তা!”
হঠাৎ মুখে মুখে এক গুজব ছড়াল নকশালবাড়ি বাজারে যে জঙ্গল সাঁওতাল একটা ঘােড়ায় চড়ে দুহাতে দুটো তলােয়ার নিয়ে জোতদারদের মুণ্ডু কাটতে কাটতে আসছে, ঘােড়ার পিঠে কাটা মুণ্ডুও দেখা গেছে। ভিড় জমে গেল চারদিকে নকশালবাড়ির হাইস্কুলের পুলিশ ক্যাম্প খালি করে কেটে পড়ল সশস্ত্র পুলিশ এই গুজবের চাপে।
ঘরের চার দেওয়ালের মধ্যে কল্পনা চারুকে পাখা মেলে অনেক উপরে যেন স্বপ্নের রাজতে নিয়ে যায়- কমরেডদের চিঠি লিখে জানান “ মিছিল ও হরতাল শ্রমিককৃষকের মনােবল বাড়ায় ঠিকই কিন্তু সেই মনােবল স্থায়ী হয় না। স্থায়ী হয় তখনই যখন আমরা বদলা নিতে পারব।… মনে রাখা দরকার কৃষি বিপ্লব শুরু হয়ে গিয়েছে, এই বিপ্লবে কে জিতবে তা নির্ভর করছে কত দৃঢ়ভাবে আমার আঘাত করতে পারছি তার ওপর। গ্রাম থেকে জোতদারশ্রেণিকে উৎখাত করতে হবে। সংগ্রাম এখন নতুন স্তরে তােলার সময় সেই কাজ করতে পারলে আমরা হবাে সারা ভারতবর্ষে প্রথম গণতান্ত্রিক বিপ্লব শুরু করার নেতা।” ৭ই জুন এই চিঠি লেখার পর পরই বাড়ি থেকে তেরাে কিলােমিটার বাসে গিয়ে, দুই কিলােমিটার গ্রামের পথে হেঁটে চারু কৃষক কর্মীদের এই প্রথম সরাসরি সম্বােধন করে এক মিটিং করে এলেন। তাঁর প্রধান কথা ছিল—“বৃষ্টির জল মাটির তলায় চলে গিয়ে ক্রমে ক্রমে প্রবল দাহ্য পেট্রোলে পরিণত হয়। তােমরাও জীবন যুদ্ধে পােড় খেয়ে খেয়ে আজ ঐ পেট্রোল হয়ে গিয়েছ। শুধু আগুন ছোঁয়ানাের ওয়াস্তা।” চারুর ছেলে ছােট্ট অভি ছিল সাথে। বাড়িতে পরদিন সকালে উঠোনে একটি কাঠি পুঁততে পুঁততে অভি বলে- “বাবা, এখানটায় খুঁড়লে পেট্রোল বেরােবে? এখানেও তাে বৃষ্টির জল খুব পড়ে?”
চারদিন পর ১১ই জুন কানু সান্যালকে এক চিঠিতে তিনি পাহাড়ের মিরিক এলাকায় চা-বাগনের জমি দখল, জলপাইগুড়িতে জোতদারের সাথে সংঘর্ষ, কলকাতায় নকশালবাড়ির সমর্থনে দুটি লিফলেট প্রভৃতির কথা জানিয়ে কানুরা যুক্তফ্রন্ট মন্ত্রী মিশনের সাথে আলাপ-আলােচনার ক্ষেত্রে “কৃষি বিপ্লবের মাধ্যমে জমিদারি প্রথা উচ্ছেদ”-এর শর্ত দেওয়ার বিষয়টিকে সমর্থন করে আলাপ-আলােচনাকেও একটি ‘টিট ফর ট্যাট’ সংগ্রাম পদ্ধতি বলে জানান। তিনি লেখেন- “…এখন adventurist deviation-এর ভয় অনেক কম… তবে সেই বিপদ আসবে ধনী কৃষক-মধ্য কৃষকের কাছ থেকে।” কীভাবে তা আসবে সেটা ব্যাখ্যা করে লেখেন যে ওরা পুলিশ আর গুলি চালাবে না বলে প্রচার করতে থাকবে। ফলে “… কৃষক শত্রুর শক্তির হিসাব না নিয়েই বাধা দিতে যাবে কোনাে রকম cover না দিয়ে। ফলে অনেক মূল্য দিতে হবে।” আরও
পৃষ্ঠা: ১২৫
লিখলেন “….দিল্লির খবর পেলাম এক ভদ্রলােকের কাছ থেকে সেখানে যেটা প্রচারিত হয়েছে তা হলাে এ অঞ্চল মুক্ত হয়ে গিয়েছে এবং কেউ কেউ প্রচার চালাচ্ছে যে কানু সান্যাল সরকার ঐ অঞ্চলে চীনকে রুখবার জন্য যে অস্ত্রপাতি ও টাকা দিয়েছিল, সেগুলাে হস্তগত করে এলাকাকে মুক্ত করে ফেলেছে। সুতরাং তােমরা আর কেবল বাংলাদেশের নেতা নও- তােমরা আজ সারা ভারতের নেতা।”
চারু গােপনে সভায় গিয়ে যােগ দিলেন সংগ্রামের নেতাদের সাথে আলােচনার জন্য এক চা-বাগান ইউনিয়ন নেতাদের বাড়িতে। রুগ্ন, শুষ্ক দেহ কানু সান্যাল, কদম মল্লিক, খুদন মল্লিকদের দেখে চারুর চোখ জলে ভরে গেল- কানুর গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন-‘ভালাে আছাে তাে?’ আর বললেন-“সশস্ত্র সংগ্রামের মারফত ক্ষমতা দখল করতে হবে এই শিক্ষায় উদ্বুদ্ধ হয়েছে ভাতবর্ষের অগ্রণী শ্রেণির বিপ্লবী অংশ। তাই সব শ্রেণির লােক আজ নকশালবাড়ির দিকে তাকিয়ে আছে। নিজেদের achivement-কে ছােট করে দেখাে না। কখনাে ভবিষ্যতের উজ্জ্বল সম্ভাবনার উপর বিশ্বাস হারিও না। আমাদের দায়িত্ব হচ্ছে তির-ধনুক নিয়ে যাতে কৃষক জোয়ানরা ambush করতে পারে তার জন্য initiative rouse করা। এটাই চেয়ারম্যানের ভাষা massline.” চারু মজুমদার তখন মাও-সে-তুঙ-কে কেবল ‘চেয়ারম্যান’ বা ‘আমার চেয়ারম্যান বলতে লেগেছিলেন। পিকিং রেডিওর সংবাদের ক্ষেত্রে বলতেন- “সাহেবরা কী বলছেন শােনাে।”
‘৬৭ সালের জুন মাসে নকশালবাড়ির ফরেস্ট অফিস থেকে শুরু করে সমস্ত অঞ্চল জুড়েই কৃষক গেরিলা দল, কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, প্রভৃতির নেতৃত্বে জোতদারদের বাড়িতে হামলা চালাতে লাগল। জুনের প্রথম দিকে মাত্র দুইতিন জন। কৃষকের একটি দল নগেন রায় চৈৗধুরী নামে এক জোতদারকে হত্যা করে তার মাথাটি কেটে নিয়ে চলে গেল। তৃতীয় সপ্তাহে গ্যাব্রিয়েল মিন নামে এক আদিবাসী জোতদারের বাড়ি ঘেরাও করল প্রায় আড়াই হাজার কৃষক। চার ঘণ্টা ধরে উভয়পক্ষে বিনিময় হলাে। জোতদারের কন্যা গুলিতে আহত হলাে আবার একজন কৃষকের পাঁজরায়ও জোতদারের গুলি লাগল। এই ঘটনাকে-“আড়াল থেকে সফল আক্রমণ (যদিও জোতদারের বাড়ির ভিতরে কেউ ঢুকতে পারেনি) মনে করে ২১শে জুন চারু মজুমদার কানু সান্যালকে লিখলেন “… নকশালবাড়ির সশস্ত্র সংগ্রামকে অভিনন্দিত করেছে Australia-র Vanguard কাগজ। বলেছে, ভারতবর্ষের বিপ্লবী কমিউনিস্টরা Thoughts of Mao Tse-Tung-এর সঠিক পথ নিয়েছে, তারা বুঝেছে ‘Freedom comes through the barrel of gun.’ শত্রু সৈন্য নতুন ঘাঁটি তৈরি করছে লােহসিং জোতে। চেয়ারম্যান বলেছেন যে- ওরা যতই শক্তি বৃদ্ধি করবে, জনতা তত বড় বড় জয় হাসিল করবে, ওদের ক্ষতি হবে তত বেশি।… চীনের মহান পার্টি আজ ঘােষণা করেছেন যে- যদিও দার্জিলিং জেলার সশস্ত্র সৈন্য আমদানি করা হচ্ছে তা সত্তেও সংগ্রামকে নিভিয়ে দিতে পারবে না। ছােট এলাকা বড় বড় হয়ে কোটি কোটি মানুষ এই সংগ্রামের অংশীদার হচ্ছে।… তােমরা টিকে আছ, কোনাে নেতা ধরা পড়েনি। এ ঘটনা সাধারণ নয়। কাজেই আমরা আঘাত করতে পারি।… তােমরা যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ সেগুলােকে concretise করার চেষ্টা কর।… কমরেডরা cover সম্বন্ধে কতখানি সচেতন হয়েছে এটা concretely যাচাই করতে হবে। দ্বিতীয়ত, আমরা কতটা close-এ যেতে পারি শত্রুর।”
এর আগে ১২ই জুন মন্ত্রীমিশন নামে খ্যাত এক ক্যাবিনেট সাব-কমিটি শিলিগুড়িতে এলাে। হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিশ্বনাথ মুখার্জী, বাংলা কংগ্রেসের সুশীল ধাড়া প্রভৃতি এই সাব-কমিটির সদস্য ছিলেন। এঁরা চারু বা কানু কারাে সাথে দেখা করতে পারলেন না, ১৬ই জুন নকশালবাড়ির এক জনসভায় জোতদাররা ও তাদের লােকেরাই এঁদের প্রায় ঘেরাও করে গ্রামে পুলিশকে সমস্ত ক্ষমতা দিয়ে দেওয়ার জন্য দাবি জানাতে থাকে। সুশীল ধাড়া এই দাবি তখনই মেনে নিতে চাইলেও কোঙার ও মুখার্জী আরও কিছুদিন অপেক্ষা করার কথা বলেন। তখন সাব-কমিটি জেলা পুলিশ দপ্তরের অভিযানের প্ল্যানটি অনুমােদন করে দেন সর্বসম্মতভাবেই। প্ল্যানটি ছিল যে ‘দুষ্কৃতিকারীরা ১৯৬৭-এর ২৪শে জুনের মধ্যে আত্মসমর্পণ না করলে এবং বে-আইনি কার্যকলাপ চলতে থাকলে পুলিশ (১) নেপাল, পূর্ব পাকিস্তান ও বিহারে পলায়নের পথ বন্ধ করবে, (২) বিরাট বাহিনী নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টিকারীদের ঘিরে আত্মসমর্পণে বাধ্য করবে, (৩) দুই-একটি ঘাঁটিতে কড়া হাতে দমন চালিয়ে দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করবে যাতে অন্য এলাকার আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনজন মন্ত্রী এই প্ল্যানে সই করেন, যারা হলেন, হরেকৃষ্ণ কোঙার, বিশ্বনাথ মুখার্জী ও ননী ভট্টাচার্য। কলকাতায় ফিরে গিয়ে অবশ্যই এ সাব-কমিটির পক্ষ থেকে দার্জিলিংয়ের প্রশাসনকি কর্তৃপক্ষকে জানানাে হয় যে, ২৪শে জুনের পর এক প্রস্থ আত্মসমর্পণ হয়ে গেলে অবস্থা বিবেচনা করে তখন ব্যবস্থা করা যাবে। আবার মুখ্যমন্ত্রী অজয় মুখার্জীর চাপে ৫ই জুলাই সাব-কমিটি পুলিশকে এগিয়ে যেতে দিয়ে সম্মত হলেন। ক্যাবিনেট সাব-কমিটির একটি লিফলেট ইতােমধ্য নকশালবাড়ি এলাকায় দেওয়া হলাে যাতে বলা হলাে— কৃষকরা যেন হিংসা পরিহার করে। তাদের অভিযােগ ও দাবি-দাওয়াগুলাে স্থানীয় ভূমি সংস্কার দপ্তরের মধ্যে দিয়েই সমাধান করার চেষ্টা করা হবে এবং ২২শে জুনের মধ্যে যদি হিংসাত্মক কার্যকলাপ বন্ধ না হয় তবে ২৪শে জুন থেকে পুলিশি অভিযান শুরু হবে।
সরকারে অধিষ্ঠিত কমিউনিস্টরা- অর্থনীতিবিদ, সাংবাদিক, লেখক সকলেই ভাবছেন এবং পরেও ভেবেছেন জমি বিলি করে দিলেই সামন্ত প্রথারও উচ্ছেদ হয়ে যাবে, আবার কৃষক ভূমি সংস্কারের সুফলগুলাে পেয়ে যাবে আন্দোলনকারীরা ভাবছেন—এ ক্ষমতা দখলেরই লড়াই, এলাকাতে শ্রমিক-কৃষক রাজ স্থাপন করতে হবে।’ চিন্তা-ভাবনার দণ্ডের দুই প্রান্তের দুই মত। চারু মজুমদারও ভাবছেন ‘ক্ষমতা দখল হয়েছে এখন অধিকার বজায় রাখতে রাইফেল চাই, পুলিশ গ্রামে ঢুকতে দেওয়া যাচ্ছে সুতরাং রাইফেল গ্রামে যাচ্ছে, কেবল তা নেওয়ার অপেক্ষা। অ্যামবুশ চালিয়ে যাও, রাইফেল এসে যাবে!’ শুরুর স্বতঃস্ফূর্ত কৃষক বিদ্রোহ ক্রমে ক্রমে চারুকে তাঁর নিজের মনের মধ্যে আবদ্ধ করে ফেলছে— শ্রেণির দাবি, কৃষি কর্মসূচি, উৎপাদন সবকিছু বাদ দিয়ে- “শ্রেণিশত্রুকে তাড়াও, শত্রুসৈন্যের মােকাবিলা কর” –একমাত্র আওয়াজ তাঁর কাছে। আন্দোলনের মধ্যেকার নেতাদেরও চিন্তাধারা চারুকেই অনুসরণ করে চলেছে। জমি বিলি ব্যবস্থা, চাষবাসের ব্যবস্থা ও সেই সাথে অর্জিত অর্থনৈতিক অধিকার রক্ষার প্রশ্নগুলাে আড়ালে চলে গেছে। এক একটা জোতদারের বাড়ি অ্যাকশান হয়, আবার সভা হয়, প্রায় সকলেই সেখানে। কৃষকের মনের ভাব- “এলাকাটা আমাদেরই, কারণ যুক্তফ্রন্ট বদনামের ভয়ে তেমন একটা পুলিশি হামলা নাও করতে পারে!” যারা গ্রেপ্তার হয়েছে তাদের পরিবার-পরিজনই জামিনের ব্যবস্থাদি করছে, কারণ- “বিপ্লবীদের মধ্যে আবার কোর্ট-কাচারি কী?” নেতাদের সকলেরই এই মনােভাব।
নকশালবাড়ির অঞ্চলে কী কী ঘটেছে সেটা কৌতূহলের বিষয় না হয়ে গ্রামাঞ্চলে কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তােলার প্রশ্নটিই নকশালবাড়ির আদর্শগত আহ্বানে পরিণত হয়ে গেল যা নকশালবাড়ি অঞ্চলের খেতখামারের গণ্ডি ছাড়িয়ে দেশব্যাপী ছড়াল।
১৩
নয়া ইতিহাস লিখেছে নকশালবাড়ি
১৯৬৭ এর জনু-জুলাই-এর ভেতরেই ভারতের নানা জায়গা থেকে জমি দখল, ফসল কাটা নিয়ে জমির মালিকদের সাথে সংঘর্ষের সংবাদ বেরােতে লাগল। এর মধ্যে কিছু স্বতঃস্ফূর্ত, কিছু আবার সিপি (এম), সিপিআই সংযুক্ত সােশ্যালিস্ট পার্টির স্থানীয় কর্মীদের দ্বারা সংগঠিত। নকশালবাড়িতে রাইফেল সংগ্রহ হচ্ছে না এতে যেমন চারুর একটু খুঁতখুতানি রয়েছে, আবার নকশালবাড়ির আওয়াজে সাড়া পাওয়ার সংবাদে তাঁর স্বগতােক্তি—“নকশালবাড়িই হতে যাচ্ছে ভারতীয় বিপ্লবের নেতা।” কলকাতায় নানা গ্রুপের পক্ষ থেকে যে কাগজ বেরােচ্ছিল তাদের ছেড়ে আকর্ষণ নকশালবাড়ি ও কৃষক সহায়ক সমিতির প্রতিই বেশি, বিশেষত তরুণদের সমর্থন এর পিছনে থাকার জন্য। সিপি (এম)-এর দেশহিতৈষী কাগজে সুশীতল রায়চৌধুরী নিয়মিত নকশালবাড়ির খরব দিয়ে যাচ্ছিলেন, সিপি (এম) ‘জঙ্গি’ কর্মী জুটিয়ে অফিস থেকে নকশালপন্থীদের বার করে দিল। সুশীতল রায়চৌধুরীকে সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি করে বেরােল সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘দেশ্বতী’। সাথে সাথেই সরােজ দত্ত, প্রমােদ সেনগুপ্ত, সত্যানন্দ ভট্টাচার্য এবং অনেক কমিউনিস্ট ভাবাপন্ন লেখক-সাংবাদিক একটি কেন্দ্র পেয়ে গেলেন চারু বললেন—“নকশালবাড়ির কথা প্রচারের পাকাপাকি জায়গা হয়ে গেল।”
নিয়মিত ওষুধ খেতে হয় চারুকে, পেথিড্রিন ইনজেকশান নিতে হয়, মাঝে মাঝে বুকে প্রচণ্ড যন্ত্রণাও হয় স্ত্রী লীলা থেকে আরম্ভ করে ছেলে-মেয়েরা সকলেই পা টিপে টিপে হাঁটে, নিম্নস্বরে কথা বলে। চারুর কিন্তু ভ্রুক্ষেপ নেই। লােকজন আসছে, কত রকমের সাংবাদিক আসে। চারুকে শিলিগুড়ির সেই পাগলাটে চারু আর কেউ ভাবে না, সসম্ভমে কথা বলে। আড়ালে বলে—“লােকটার ক্ষমতা আছে, আমাদের গৌরব!” সিপি (এম)-এর নেতারা কর্মীদের জানান—“চারু বাবু, কান ও অন্যান্যদের সম্বন্ধে ব্যক্তিগত কুৎসা করাে না। এদের আত্মত্যাগের তুলনা নেই।” এদিকে ২০শে জুনের পলিটব্যুরাে (সিপিএম) মিটিং থেকে ঘােষণা করা হয়-“কিছু গােয়েন্দা বিভাগের লােক ঢুকিয়ে কংগ্রেস এই উগ্রপন্থাকে আরও উস্কিয়ে দিচ্ছে।”
ফ্রান্স থেকে এক সাংবাদিক চারু মজুমদারকে ভাঙা ইংরেজিতে বললেন – “ফ্রান্সেও নকশালপন্থি তৈরি হয়ে যাচ্ছে।” ধর্মযুগ হিন্দি কাগজে সাংবাদিক এসে প্রথম গালগল্প শুরু করে তারপর চারুকে বললেন, “আপনার ঘরে রবীন্দ্রনাথের ছবি দেখেছি! রবীন্দ্রনাথকে আপনারা মানেন?” চারু মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বলেন “প্রশ্নটা তাে মানা না মানার নয়? প্রশ্নটা হচ্ছে এক মহান শিল্পীর ইতিবাচক দিক দেখার। আমি তাে মনে করি তার অনেক কবিতার তুলনা নেই। এই যেমন ধরুন ‘মৃত্যুঞ্জয়’ কবিতাটি”—একথা বলে চারু আবৃত্তি করতে থাকেন অনুচ্চস্বরে—
‘যখন উদ্যত ছিল তােমার অশনি
তােমারে আমার চেয়ে বড়াে বলে নিয়েছিনু গণি।
তােমার আঘাত সাথে নেমে এলে তুমি
যেথা মাের আপনার ভূমি।
ছােটো হয়ে গেছ আজ।
আমার টুটিল সব লাজ।
যত বড়াে হও
তুমি তাে মৃত্যুর চেয়ে বড়াে নও।
“আমি মৃত্যুর চেয়ে বড়াে” এই শেষ কথা বলে
যাব আমি চলে।”
কবিতা শেষ করতে করতে চারুর গলা ধরে আসে, চোখে জল এসে যায়। সাংবাদিক নােট করে ফেলে কবিতাটি চারু মজুদারের লুঙ্গি পরা পুরাে পাতা জোড়া এক ছবির সাথে কবিতার অংশটি হিন্দি অক্ষরে ছেপে দিয়ে চারুর মন্তব্য উল্লেখ করা হলাে- “পৃথিবীতে আর কোনাে কবি এই ধরনের কবিতা লিখেছেন কি?”
ঘটনা অতি দ্রুত ঘটে যেতে লাগল। জুলাই মাস থেকেই শুরু হলাে যুক্তফ্রন্ট সরকারের পুলিশি অভিযান। সুচতুর পরিকল্পনা ছিল এই অভিযানের সন্ধ্যার অন্ধকারে নিকটবর্তী চা-বাগান এলাকা দিয়ে ছাড়াছাড়াভাবে রাইফেলধারী পুলিশ গ্রামে ঢুকল এবং ‘কমরেড বলে নরম সুরে ডেকে একই সাথে বিভিন্ন বাড়িতে ঢুকতে লাগল এবং একধার থেকে গ্রেপ্তার চালাতে লাগল। পুলিশের কাছে এবং সংগঠকদের কাছেও আশ্চর্য লাগল যে পুলিশের প্রথম অনুপ্রবেশে কোনাে প্রতিরােধই কোথাও হলাে না। বুড়াগঞ্জের কালীঘাটায় প্রথম পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের সংবাদ পেয়ে চৌপুখুরিয়ায় রাতে এক কর্মীসভা হলাে একেবারে জুলাই-এর প্রথমে, চারু ও কানু উভয়েই উপস্থিত ছিলেন ঐ সভায়। সারারাত ধরে সভা চললেও কোনাে সিদ্ধান্ত হলাে না পুলিশ ক্যাম্পের উপর হামলা হবে কি না তার উপর যে রাতে কানু সান্যাল ও কদম মল্লিককে চারু মজুমদার বললেন- “আগে গিয়ে দ্যাখাে ক্যাম্পের অবস্থা কী, তারপর কমরেডদের সাথে কথা বলে যেটা বুঝবে, তাই করাে।” পুলিশের দ্বিতীয় অভিযান শুরু হতেই সম্পদ রায়ের নেতৃত্বে জোতদারদের প্রতিরােধ বাহিনী পুলিশের সহযােগিতায় চটের হাট এলাকার হরদিগছ, ভাটাগছ অঞ্চলগুলােতে সশস্ত্র হামলা করতে থাকে। এক সােভান আলী সহ তিনজন তাদের প্রতিরােধ করতে গেলে জোতদারদের ঠাঙারে বাহিনী তিনজনকেই গুলি করে মারে। ১০ই জুলাই বুড়াগঞ্জের ধুলিয়া জোতের স্কুলের মাঠে প্রায় দেড় হাজার কৃষকের সমাবেশে কানু সান্যাল সহ সমস্ত নেতারা পুলিশি অভিযান প্রতিরােধের বিষয়। যখন আলােচনা করছিলেন তখন পাহাড়ে গুমিয়া বাগানের দিক থেকে একদল পুলিশ নদী পার হয়ে ঢােকার সময় কানুর ঘরের সামনে প্রতিরােধ পেল একা ত্রিবেণীর কাছে। প্রৌঢ় ত্রিবেণী একটি বালুয়া নিয়ে (এক ধরনের টাঙ্গি) কোনাে এক পুলিশের হাত নামিয়ে দিল, আতঙ্কিত পুলিশ বাহিনীর সকলে মিলে বেয়নেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মেরে ফেলল বিহারের জমি থেকে উৎপন্ন কৃষক “ভুজাওয়ালা’ নামে পরিচিত ত্রিবেণীকে। অন্যদিক থেকে পুলিশের একটি বড় দল ঘিরে ফেলল ধুলিয়ার স্কুলডাঙ্গি। কোনাে প্রতিরােধ নেই, পিছন দিক থেকে নেতারা বেরিয়ে যেতে সক্ষম হলেন আর পুলিশ বারাে’শ কৃষককে গ্রেপ্তার করে নিয়ে গেল। ফাঁসি দেওয়া এলাকাতেও ধরপাকড় চলতে লাগল— চারদিকে কৃষকদের মধ্যে বেশ পুলিশি আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। ১৫ই জুলাই-এর চিঠিতে চারু মজুমদার কানু সান্যালকে ‘ত্রিবেণী কানু ‘জিন্দাবাদ’ বলে উল্লেখ করে “মধ্য কৃষক ও ছােট জোতদাররাই প্রধানত গ্রেপ্তার হয়েছে, তাই জামিনের চেষ্টা দেখছে” বললেন এবং গরিব ও ভূমিহীন কৃষকের প্রতিরােধ-গেরিলা-দলের কাজ শুরু করতে বললেন। চারু লিখলেন- “প্রথম প্রথম কিছু ক্ষতি ও পিছু হটা তাে হবেই, তবে জয়ের প্রতি আস্থা রেখে চলতে থাকলে কৃষকের উদ্যোগই অত্যাচারের মােকাবিলায় আমরা যেতে পারব।’ কাকদ্বীপে ১৪৪ ধারা ও ধানবাদের খনি শ্রমিক কর্তৃক মহকুমা শাসককে আক্রমণের উল্লেখ করে চারু এই চিঠিতে জানান—“নকশালবাড়ির নেতৃত্ব ছড়িয়ে পড়ছে চারদিকে। ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের সবদিক হরেকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করলেন-“সােনাপুরে আপনারাই জমি দখল করছেন আর নকশালবাড়িতে জমি দখলের অপরাধে কৃষককে খুন করেছেন।” চারু আরও জানালেন যে, “জুন-এ সিপিএম-এর মধ্যে যে বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এখন তা আরও ঘন হয়ে উঠেছে এবং আমাদের লাইনের বিজয়ই সূচিত হচ্ছে।”
চারুর লাইন, নকশালবাড়ির আহ্বান, নকশালবাড়িতে অনুষ্ঠিত ঘটনাবলিকে পিছনে ফেলে সারা ভারতে বিপুল সাড়া জাগিয়ে দিল ৫ই জুলাই, পিকিং-এর পিপলস ডেইলি কাগজে সম্পাদকীয় “ভারতের মাটিতে বসন্তের বজ্রনির্ঘোষ” Spring Thunder over India প্রকাশিত হওয়াতে। চীনের পার্টির বক্তব্য কি বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনের আদর্শগত বিতর্কে, কি জাতীয় মুক্তির সংগ্রামের ক্ষেত্রে ভীষণ আকর্ষণ করছিল ভারতের কমিউনিস্টদের। এই সম্পাদকীয় নকশালবাড়িকে ভিত্তি করে ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের ঐক্যবদ্ধ হওয়ার একটা জায়গা তৈরি করে দিল।
পিকিং রেডিও নকশালবাড়ি সম্বন্ধে কিছু ‘কাল্পনিক সংবাদও প্রচার করেছিল। যখন পুলিশি ধরপাকড় প্রচণ্ড চলছে তখনই জুলাই-এর শেষে পিকিং রেডিও বলল“প্রতিক্রিয়াশীর ও সংশােধনবাদীদের সশস্ত্র ফৌজ নকশালবাড়িতে ঘেরাও ও নিশ্চিহ্ন encirclement and annihilation করার অভিযান চালিয়ে গেলেও কমিউনিস্টদের বিপ্লবী অংশ জলের মধ্যে মাছের মতাে নিজ নিজ এলাকায় জনগণের মধ্যে প্রতিরােধ গড়ে তুলছে।” পিকিং রেডিও শােনা তাে চারু মজুমদারের কাছে দৈনন্দিন কাজের মধ্যেও অবশ্য করণীয়। ঐ বক্তব্য তিনি বললেন-“আসলে সাহেবরা ঘুরিয়ে বলেছেন। কৃষক নেতারা যেন এলাকা ছেড়ে না যায়। এটা আমাদের প্রতি চীনা পার্টির নির্দেশ।” সঙ্গে সঙ্গে তিনি কানুকে লিখলেন জঙ্গল সাঁওতালকে তার নিজ এলাকা হাতিঘিষার শিবদাল্লা জোতে পাঠিয়ে দিতে। জঙ্গল তখন জাবর আলি গ্রামে জলবসন্ত রােগে শয্যাশায়ী! কানুর মারফত চারু মজুমদারের নির্দেশ শুনে সে তখনই অসুখে কাতার অবস্থাতেই পুলিশ ঘেরাও-এর মধ্যেই শিবদাল্লায় গেল এবং কয়দিন পর ১০ই আগস্ট গ্রেপ্তার হয়ে গেল। চারু মজুমদারের এই নির্দেশের সমালােচনা জঙ্গল ছাড়া সকলেই করলেন। জঙ্গল তাে সব ব্যাপারেই নির্বিকার। প্রথমা স্ত্রী গাঙ্গীর সন্তান না হওয়ায় তারই অনুমতি সাপেক্ষে দ্বিতীয়বার বিয়ে করেছিল। দ্বিতীয়া স্ত্রী শিশুপুত্র নিয়ে জঙ্গলের দুই পত্নী অসহনীয় দারিদ্রে দিন কাটায়। পুলিশের নির্দেশে চা-বাগানে তাদের কাজ নেই, রাস্তা মেরামতের জন্য পাথর ভাঙতে গেলে, সেখানেও পুলিশের নির্দেশ, ঠিকাদার বলে- “জঙ্গল সাঁওতালের বউদের কাজ দিলে আমার হাতে হাতকড়া পড়বে ভাই, তাই মাফ করাে।” এই অবস্থাতেও জঙ্গল নির্বিকার!
আগস্টের শেষভাগে কানু সান্যাল, কদম মল্লিক, খােকন মজুমদার, খুদন মল্লিক প্রভৃতি আজামাবাদ চা-বাগানের জঙ্গলের ঘেরা টিলার শ্রমিক বস্তিতে পুলিশের ঘেরাওএ পড়ে গেলেন। পুলিশ ঠিক বুঝত না এদের হাতে অস্ত্র কেমন আছে, তাই সােজাসুজি চার্জ করতে ভয় পাচ্ছে। তবুও সন্ধ্যায় অন্ধকারে একবার হামলা করল কিন্তু সরে যেতে সক্ষম হলেন নেতৃবৃন্দ। কানু সান্যাল অবস্থা জানিয়ে কষ্টকর উপায়ে চিঠি পাঠালেন চারু মজুমদারের কাছে যে, “তাদের সরে যাওয়ার ব্যবস্থা না হলে যেকোনাে সময়েই পুলিশের হাতে নিহত হতে পারেন।” নকশালবাড়ি এলাকার কোনাে অঞ্চলেই তখন নেতৃবৃন্দের পক্ষে থাকা সম্ভব হচ্ছে না। চারু চিঠি পেয়েই শহরের ঘনিষ্ঠ কমরেডকে বললেন একটি জিপের ব্যবস্থা করতে। একেবারে নিখরচায় জিপ মিলে গেল। দীপক বিশ্বাসকে ইসলামপুরে চারু জানিয়েছিলেন কানু সান্যালদের জন্য আশ্রয়ের ব্যবস্থা করতে। কানু সান্যালকে কোথায় জিপে তুলবেন জানাতে লিখলেন। কানুর চিঠি পাওয়ার পর ২৮শে আগস্ট রাত ৯টা বাগডােগার অদূরে জিপে কানুদের তুলে আনলেন চারু নিজে গিয়ে। কামাক্ষ্যা ব্যানার্জী ও ফণী দাস নামে আরও দুজনও এদের সাথে ছিল। ঐ দুজনকে নিয়ে চারু প্রবল আপত্তি করলেন। কানু সান্যাল যুক্তি দিলেন যে ওদের ছেড়ে গেলে পুলিশের হাতে ধরাও পড়বে আর এই বেরিয়ে পড়ার ঘটনা বলেও দেবে। তবুও চারু বললেন – “তােমরা যেখানে যাচ্ছ সেখানে পরদিনই ওদের আলাদা করে দিও।” ঐ দুজনকে আলাদা করে দেওয়ার সাথে সাথেই ফণী দাস পুলিশের কাছে আত্মসমর্পণ করে এবং কামাক্ষ্যা বিভিন্ন লােকদের কাছে থেকে টাকা-পয়সা আদায়ের চেষ্টা করে যেতে লাগল এককভাবে এবং পরে ধরাও পড়ল। দুজনেই সমস্ত ঘটনা জানিয়েছিল পুলিশকে।
৩১শে আগস্ট রাতে শহরের একদল গুন্ডা প্রকৃতির যুবক দল উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয় হামলা করতে গিয়ে প্রচণ্ড মার খেল এবং বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্ট কালের জন্য বন্ধ করে দেওয়া হলাে। পুলিশ ছাত্রনেতা কিষালাল চ্যাটার্জীকে গ্রেপ্তার করল। কানু সান্যালের ইচ্ছা অনুযায়ী ২রা সেপ্টেম্বর চারু মজুমদার কিছুদিনের জন্য ঐ এলাকা ছেড়ে দূরে চলে গেলেন। কানুও খােকন মুজমদার, খুদন মল্লিক ও দীপক বিশ্বাসকে নিয়ে এলাকা ছেড়ে চলে গেলেন। কয়েকদিন পর কলকাতা থেকে মনােরঞ্জন রায় এসে চারু মজুমদারের সাথে দেখা করতে চেয়ে বললেন যে, ‘মুজফফর সাহেব এক জরুরি বার্তা তার মারফতে পাঠিয়েছেন।’ কথাটা প্রথমে অবাক লাগল যে ‘৬২ সালের নভেম্বরে মনােরঞ্জন রায় জেলে গিয়ে পার্টি ছেড়ে দিয়েছিলেন, ‘৬৪ সারে সিপিএম, গঠনের সময়ও তিনি কোনাে পার্টিতেই যােগ দেননি এবং ‘৬৬ সালের নভেম্বর মাসে বর্ধিত রাজ্য নেতৃত্বের পক্ষ থেকে তার মারফত জরুরি বার্তা পাঠানােতে চারুও বেশ অবাক হলেন। মনােরঞ্জন রায় চারুকে বললেন-“কানু সান্যাল যদি কলকাতায় গিয়ে অজয় মুখার্জীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে পুলিশ তাকে গুলি করে মারবে না।” নকশালবাড়ির সকল কৃষক নেতা সম্পর্কেই যুক্তফ্রন্টের মুখ্যমন্ত্রীর আদেশ ছিল : ‘দেখামাত্র গুলি করা।’
বার্তা শুনে চারু হা হা করে হেসে উঠে বললেন—“মুজফফর সাহেবকে বলবেন কানু সান্যাল আত্মসমর্পণের চেয়ে গুলি খেয়ে মরাটাকেই বড় মনে করে।” চারুর হাসির কারণ— “কানুকে এখন পাচ্ছ কোথায়?” মনােরঞ্জন রায় ম্লানমুখে বললেন- “আমাকে যা বলতে বলা হয়েছে তাই বললাম, এখন আপনাদের যা করার করবেন।”
‘নকশালবাড়ি শেষ’-আওয়াজ দিলেন সিপি (এম)-এর নেতারা, পুলিশ কর্তারা, যুক্তফ্রন্ট সরকারের সব মন্ত্রী। আর গােপনে দীর্ঘশ্বাস সকলেরই এ যাত্রায় বাঁচা গেল!’ চারুর আশাবাদে কোনাে ভাটা পড়েনি। ইতােমধ্যে জেনে গেছেন উত্তর প্রদেশের পার্টি সম্পাদক সিপি (এম)-এর কেন্দ্রিয় কমিটির সদস্য শিবকুমার মিত্র পশ্চিম বাংলায় যুক্তফ্রন্ট সরকারের পুলিশি আক্রমণের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রকাশ করে পদত্যাগ করেছেন, জম্মু কাশ্মীরে পার্টি নেতৃত্ব সমালােচিত হচ্ছে, বিহারে রাজ্য কমিটির সদস্য সত্যনারায়ণ সিং প্রকাশ্যে বিবৃতি দিয়েছিলেন-“ভূমি সমস্যার সমাধান না হলে সর্বত্রই নকশালবাড়ি হয়ে যাবে।” অন্ধ্রে, কেরালায়, পাঞ্জাবে পার্টির মধ্যে বিক্ষোভের খবর পাওয়া যাচ্ছে। কলকাতার ছাত্র-যুবক বিশ্বাস করে না ‘নকশালবাড়ি শেষ’-পিকিং রেডিও শােনে, আর চারু মজুমদারের বক্তব্য পড়ে—“সংগ্রাম নতুন পর্যায়ে উঠেছে।”
পৃষ্ঠা: ১৩৩
সুশীতল রায় চৌধুরী কলকাতা থেকে যােগাযােগ করতে লেগেছেন সারা ভারতে নভেম্বরে কলকাতায় আসার জন্য। চারু মজুমদারকেও জানালেন কলকাতায় আসার জন্য।
ভারতের রাজনৈতিক আন্দোলনে, বিশেষ করে কমিউনিস্ট আন্দোলনে এক নজির তৈরি হতে চলল, একেবারে জেলা স্তরের একজন নেতা চারু মজুমদারকে কেন্দ্র করে বিপ্লবী চিন্তার কমিউনিস্টদের ভারতব্যাপী ঐক্যের মধ্যে দিয়ে। জনগণের মধ্যে থেকে উঠে আসা সংগ্রামের আহ্বান সংগ্রামের সর্বভারতীয় কেন্দ্র গড়ে তােলাকে অপরিহার্য করে দিল। ঘটনাটি ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে অভিনবও বটে এবং অদ্বিতীয়ও। ১৯২১ থেকে ১৯৩৭ পর্যন্ত কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ার প্রথম যুগে আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলাের উপদেশ সত্ত্বেও ষােলােটি বছর লেগেছিল একটি কেন্দ্রের রূপ নিতে জনগণের সংগ্রামের প্রয়ােজনীয়তার চেয়েও সেখানে ব্যক্তি প্রাধান্য মুখ্য হয়ে পড়েছিল। অথচ ‘নকশালবাড়ি’ কত সহজেই এই ঐক্যবদ্ধ কেন্দ্রের পথ প্রস্তুত করে দিয়েছিল চারু মজুমদারেরই বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম না করে সমাজ পরিবর্তনের সংগ্রাম করা যায় না’, ‘পুরানাে ধ্যানধারণা ও অভ্যাসকে বিসর্জন দিয়ে ক্ষমতা দখলের রাজনীতিকে সামনে না নিয়ে এলে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম হয় না’, ‘ভারতীয় বিপ্লবকে কৃষক সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জনশক্তি এবং কৃষককে সামন্ত প্রথার সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্ত হতে গেলে অস্ত্র হাতে নিতেই হবে।’
‘৬৭ সালের নভেম্বর চারু মজুমদারকে প্রধান বক্তা ঘােষণা করে মনুমেন্ট ময়দানে (বর্তমানে শহিদ মিনার) এক জনসভা ডাকলেন সুশীতল রায়চৌধুরীরা। আকুল আগ্রহে ছাত্র, যুবা, বিক্ষুব্ধ কমিউনিস্টরা এলেন চারু মজুমদারের কথা শুনতে। অবাক বিস্ময়ে সকলে ভাবে “কে এই লােক?” যুবকদের মধ্যে কথা হয়-“এতদিন চীনে ছিলেন নিশ্চয়ই।”
শীর্ণকায় চারু বক্তৃতা দিতে ওঠেন— দুদিক দিয়ে তাকে ধরে থাকেন সুশীতল রায়চৌধুরী ও সরােজ দত্ত। ভাবপ্রবণতা যেমন চারুর মনে, তেমনই শ্রোতাদের মনে। চারু প্রথমেই বলেন- ‘নকশালবাড়ির নেতা আমি নই, নকশালবাড়ির নেতা কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল, কদম মল্লিক, খােকন মজুমদার।” তারপর নকশালবাড়ির সংগ্রামের সম্পর্কে তার নিজের ব্যাখ্যা দেন। স্তব্ধ বিস্ময়ে নির্ণিমেষ চেয়ে থাকা শ্রোতাদের সম্বােধন করে অসুস্থ শরীরে সমস্ত জোরটুকু দিয়ে চারু মজুমদার বলে চলেন- “নকশালবাড়ির কৃষক জমি বা ফসলের জন্য লড়াই করেননি, তারা লড়াই করেছে রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্য, নিজেদের তৈরি প্রচলিত অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে তারা প্রতিবিপ্লবী, সশস্ত্র রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে, কারও জন্য তারা অপেক্ষা করেনি, লড়েছি নিজেদের পায়ের উপর দাঁড়িয়ে। এই সংগ্রাম কৃষকরা গড়তে পেরেছিল। কেবলমাত্র সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেই। মনে রাখতে হবে যে, আজ সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চেয়ারম্যান মাও-এর চিন্তাধারাকে কৃষক জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েই কেবল করা যায়। ভারতীয় জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব জিন্দাবাদ, নকশালবাড়ি লাল সেলাম, চেয়ারম্যান মাও-এর চিন্তাধারা জিন্দাবাদ’-বক্তৃতা শেষ করে হাঁফাতে থাকেন চারু। এক মুহূর্তের নীরবতার পর সমস্ত ময়দান ফেটে পড়ে শ্রোতাদের সম্মিলিত আওয়াজে-“কমরেড চারু মজুমদার জিন্দাবাদ, নকশালবাড়ি লাল সেলাম, নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম চলছে, চলবে।”
১৩ই নভেম্বর পাঞ্জাব, অন্ধ্র, গুজরাট, আসাম, উড়িষ্যা ও জম্মু-কাশ্মীর ছাড়া প্রায় প্রত্যেক রাজ্যের সিপি (এম)-এর বিদ্রোহী সদস্যদের প্রতিনিধিদের নিয়ে এক কনভেনশান করেন নকশালবাড়ি ও কৃষক সংগ্রাম সহায়ক কমিটি। এই কনভেনশান থেকে গঠিত হলাে ‘নিখিল ভারত সিপি (এম)-এ মধ্যেকার কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কোঅর্ডিনেশান কমিটি”(A.I.C.C.C.R of CP (M)। কমিটির ঘােষণাপত্রের প্রধান বক্তব্য ছিল—“..নয়া সংশােধনবাদী পার্টি নেতৃত্ব বিপ্লবের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেছে।…তারা পার্টিকে ভাগ করেছে আদর্শগত প্রশ্নে নয়, ডাঙ্গে-চিঠির ভিত্তিতে। …পার্টির কর্মসূচির মধ্যে এর চতুরতার সাথে মাকর্সবাদ-লেনিনবাদ-মাও-তুঙ চিন্তাধারা বিরােধী বক্তব্য ঢুকিয়ে দিয়েছে। স্বাধীন বিশ্লেষণের নামে এরা ভারতের আধা ঔপনিবেশিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে আগ্রহ করেছে।…. একথা আজ স্মরণ করা প্রয়ােজন যে আমাদের পার্টির গঠন সময় থেকেই বিভিন্ন পর্যায়ে সংশােধনবাদী, হঠকারী এবং সুবিধাবাদীরা নেতৃত্ব দখল করেছে, ফলে পার্টি পতাকার তলে আমাদের বিপ্লবী কমরেড ও জনগণের গৌরবময় সংগ্রামগুলাের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা হয়েছে।…নকশালবাড়ি আমাদের পার্টির ও দেশের ইতিহাসের মােড় ঘুরিয়ে দিয়েছে, পশ্চিবঙ্গের দার্জিলিং জেলার বিপ্লবী কমরেডরা পার্টির নেতৃত্বের সংশােধনবাদী রাজনীতি ও সাংগঠনিক দাসত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্য বিদ্রোহ করেছেন। এই বিদ্রোহ আগের মতাে কেবল আন্তঃপার্টির সংগ্রামের মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে বিপ্লবী প্রয়ােগের দ্বারা হয়েছে। দার্জিলিং জেলার কৃষকদের এই মহান শ্রেণির সংগ্রাম আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট নেতা চেয়ারম্যান মাও সে-তুঙ-এর নেতৃত্বে পরিচালিত চীনের কমিউনিস্ট পার্টির উষ্ণ ভ্রাতৃত্বমূলক সমর্থন সাথে সাথেই পেয়েছে।…কমরেডরা লক্ষ করে থাকবেন যে, কৃষকদের বিপ্লবী সংগ্রাম চর্তুদিকে ফেটে পড়ছে। শ্রমিকশ্রেণির অগ্রগামী অংশ হিসেবে পার্টির মধ্যের এবং বাইরের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের আজ দায়িত্ব এই সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা সম্মত এক বিপ্লবী পার্টি গড়ে তােলার মানসে মিলিত হওয়া।”
‘৬৮ সালের শুরু থেকেই নকশালবাড়ির আহ্বান দুর্বার গতিতে ভারতের রাজ্যে রাজ্যে ছড়িয়ে পড়তে লাগল— কো-অর্ডিনেশন কমিটি এই আহ্বানকে সংঘবদ্ধ করতে লাগল। কো-অর্ডিনেশান কমিটির ইংরেজি মুখপত্র “লিবারেশান হয়ে দাঁড়াল সর্বত্র বিদ্রোহী কমিউনিস্টদের বক্তব্য প্রচারের মধ্যমে। লিবারেশানে বেরােল যে নভেম্বর মাসেই বিহারের সিপি (এম)-এর বিক্ষুব্ধ অংশ নিজেদের মধ্যে আলােচনা করে সি পি (এম)-এর বিপ্লবী কমরেডদের কাছে এক আবেদন করেছেন যে- “নকশালবাড়ির সংগ্রাম কার্যত প্রমাণ করেছে যে, ভারতের বর্তমান পরিস্থিতি বিপ্লবী রাজনৈতিক সংগ্রাম ছড়িয়ে দেওয়ার পক্ষে এবং গ্রামীণ আঁধার এলাকা (Base area) গড়ে তােলার পক্ষে পরিপক্ব। নকশালবাড়ি প্রমাণ করেছে যে এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়ােজনে কমিউনিস্ট পার্টিকে পুনর্গঠিত করার জন্য সিপি (এম)-এর মধ্যকার বিপ্লবী কমরেডদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সমবেত প্রচেষ্টা চালানাের গুরুত্ব কতখানি।”
‘৬৮-এর মার্চ মাসে সিপি (এম)-এর তামিলনাড়ুর রাজ্য কমিটির চৌদ্দ সদস্যের বিবৃতি ছাপল লিবারেশন’-“বুর্জোয়া শাসক শ্রেণির রাষ্ট্রযন্ত্রটিকে দখলের প্রশ্নে রাষ্ট্র যন্ত্রকে ধ্বংস না করে দখল করার কথা বলা কল্পনা বিলাস ছাড়া আর কিছু নয়। শ্রেণি শােষণের এই যন্ত্রটিকে ধ্বংস করার কোনাে সংক্ষিপ্ত পথ নেই। ভারতীয় বিপ্লবীদের সাধারণ কর্মসূচিই হচ্ছে নকশালবাড়ির পথ, যা মাও-সে-তুঙ চিন্তাধারা দ্বারা পরিচালিত।
কো-অর্ডিনেশান কমিটির রাজ্য কমিটিগুলাে তখন গঠিত হয়েছে। ইতােমধ্যে এপ্রিল মাসে সিপি (এম)-এর বর্ধমান প্লেনাম হলাে। প্লেনামে আদর্শগত প্রস্তাবে বলা হলাে যে আন্তর্জাতিক আদর্শগত বিতর্কে সােভিয়েত নেতৃত্বের অনেক বক্তব্য যেমন সংশােধনবাদী তেমনই চীনা পার্টির দৃষ্টিভঙ্গিও সংকীর্ণ এবং বিশেষ করে সিপি (এম) সম্বন্ধে চীনের বক্তব্য সবই ভুল। এই বক্তব্যের বিরােধিতা করে এবং ‘জনযুদ্ধই ঔপনিবেশিক ও আধা ঔপনিবেশিক দেশগুলাের মুক্তির একমাত্র পথ, একথা স্বীকার না করায় ও কৃষি বিপ্লবের সম্বন্ধে কোনাে গুরুত্ব না দেওয়ায় বিক্ষোভ প্রকাশ করে অন্ধের প্রতিনিধিরা প্লেনাম ছেড়ে বেরিয়ে আসেন। জম্মু-কাশ্মীরের প্রতিনিধিরা সরকারি প্রস্তাবের বিরােধিতা করেন।
চারু মজুমদার দার্জিলিং জেলার কমিউনিস্ট নেতার স্থান থেকে সারা ভারতের বিপ্লবী কমিউনিস্টদের নেতৃত্বের পর্যায়ে উঠেছেন। তাঁর আলাপ-আলােচনার সাথিদের মধ্যে এখন প্রবীণ কমিউনিস্ট সুশীতল রায়চৌধুরী, সরােজ দত্ত, পরিমল দাশগুপ্ত, অসিত সেন; দৃপ্ত বক্তৃ ট্রেড ইউনিয় নেতা বিহারের সত্যনারায়ণ সিং; কেন্দ্রিয় কমিটি পর্যায়ের ইউপির শিব কুমার মিশ্র। সকলের অভিমত—“এতদিনে একটি উপযুক্ত রাজনৈতিক নেতা পাওয়া গেল।” সরস চুটকিতে দড়, সরােজ দত্ত মন্তব্য করেন—“আপনি যেদিন পাবলিক মিটিং করেছিলেন সেদিন বেশ কিছু ছেলে পিছনে বসে মন্তব্য করছিল ‘গুরুর চেহারাটা তেমন মজবুত না, কিন্তু ভিতরে একেবারে আগুন; এবার বােধ হয় একটা ঠিক ঠিক নেতা পাওয়া যাবে গুরুর মধ্যে। একটু ফিসফিস করে ওরাই মন্তব্য করেছিল ‘গুরু যেন চীন ঘুরে আসা মনে হয়।”
চারুর আনন্দ এই মন্তব্যে না, তাঁর উল্লাস যে বিপ্লবী প্রয়ােগের মধ্যে দিয়ে কমিউনিস্টদের অবসাদ ভেঙে গেছে, তার কল্পনা, স্বপ্ন সফল হওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। খুব আস্তে আস্তেই বলতে থাকেন— “সাত আট মাস আগে যখন হতাশাবাদীদের সমালােচনায় বলেছিলাম নকশালবাড়ি মরেনি, মরতে পারে না- এক নকশালবাড়ি শত শত নকশালবাড়ির জন্ম দেবে ভারত জুড়ে, তখন নিজের মনে হয়েছে ঠিক বলছি তাে? কিন্তু এখন মনে হচ্ছে না, তখন আমি দিবাস্বপ্ন দেখিনি। যদিও আমি মনে করি কিছু স্বপ্নও বিপ্লবীদের দেখতে হয়, তবে তার পা মাটিতে রেখেই।”
‘৬৮ সালের ১৪ই মে নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের প্রথম বার্ষিকী উদ্যাপন উপলক্ষ্যে কো-অর্ডিনেশান কমিটির দ্বিতীয় অধিবেশনে কো-অর্ডিনেশান কমিটির নাম থেকে সিপি (এম)-এর মধ্যকার অংশটি বাদ দিয়ে নিখিল ভারত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কো-অর্ডিনেশন কমিটি রাখা হয়। প্রথম ঘােষণার বক্তব্য সঠিক প্রমাণিত হয়েছে বলে এই অধিবেশনে কমিটির একটি সাধারণ ঘােষণাপত্র ও নির্বাচন সম্পর্কে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয়। সাধারণ ঘােষণাপত্রে যে নতুন সংযােজন হয় তা। হচ্ছে—এই যুগ চেয়ারম্যান মাও সে-তুঙ-এর যুগ এবং চেয়ারম্যান মাও-এর চিন্তাধারাই এই যুগের মার্কসবাদ-লেনিনবাদ… মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তাদের ঘনিষ্ঠ সহযােগী সােভিয়েত নয়া উপনিবেশবাদীরাই বিশ্ব প্রতিক্রিয়াশীল নেতা আর তার বিরুদ্ধে সংগ্রামী জনগণের নেতৃত্ব করেছেন চেয়ারম্যান মাও।” ঘােষণার জোর দিয়ে বলা হয় যে, “সাম্রাজ্যবাদের ও সংশােধনবাদের চূড়ান্ত ধ্বংসের দিন আর দূরে নয় এবং নিশ্চিত বিশ্বাসে একথা বলা যায় সকল রকমের উপনিবেশবাদ ও শােষণের অবসানের ও নিপীড়িত জনগণের মুক্তির দিন বেশি দূরে নেই।” ঘােষণায় ‘চেয়ারাম্যান মাও-সে-তুঙ-এর চিন্তাধারায় যারা বিশ্বাসী, সংশােধনবাদ ও নয়া সংশােধনবাদীদের বিরুদ্ধে যারা বিদ্রোহ করেছেন তাঁদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলা হয় যে, “পৃথক পৃথক গােষ্ঠী হিসেবে না থেকে তাদের উচিত পৃথক মনােভাব কাটিয়ে কো-অর্ডিনেশান কমিটিতে যােগ দেওয়া। তাঁদের মনে রাখা উচিত যে পৃথক অস্তিত্ব ভারতীয় বিপ্লবের ক্ষতি করে।”
নির্বাচন সংক্রান্ত প্রস্তাবে বলা হয়- “চীনা বিপ্লবের বিজয়ের পর জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের জোয়ার সব দেশেই বেড়ে উঠেছে। এবং সাম্রাজ্যবাদের দ্রুত পতন ও সমাজতন্ত্রের দ্রুত বিজয়ের এই যুগের মাসৰ্কবাদ-লেনিনবাদ হিসেবে চেয়ারম্যান মাও সে-তুঙ-এর চিন্তাধারার আবির্ভাব হয়েছে। ফলে বুর্জোয়া পার্লামেন্টীয় প্রথা যে কেবল।
অপ্রচলিত obsolete হয়ে গেছে তাই নয়, সাধারণভাবে সব বিপ্লবের পথেই এবং বিশেষত উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশের বিপ্লবের পথে প্রচণ্ড বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। ….নকশালবাড়ির কৃষকদের বিপ্লবী সংগ্রামের পার্লামেন্টারি প্রথাকে আঁকড়ে ধরা সংশােধনবাদীদের বিশ্বাসঘাতকতার থেকে স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, ভারতের মতাে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার দেশের পক্ষে নির্বাচন একেবারেই অচল। তাই, কমরেডগণ, আমাদের আহ্বান নির্বাচন নিপাত যাক। নির্বাচন বয়কট’-এর এই আওয়াজ নেতিবাচকভাবে দিলে হবে না। সাথে সাথে চেয়ারম্যান মাও-এর চিন্তাধারায় জনগণ সুশিক্ষিত করে নকশালবাড়ির পথে কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে।”
ঘােষণা ও প্রস্তাবের প্রধান স্থপতি চারু মজুমদার, সরােজ দত্ত, সত্যনারায়ণ সিং ছিলেন। তবে শব্দচয়নের মধ্যেও চারুর প্রভাব সুস্পষ্ট, মূল বক্তব্যে তাে বটেই।
সামগ্রিকভাবেই স্বতঃস্ফুর্ত অভ্যুত্থানের সেই যুগে, বস্তুবাদী তাত্ত্বিক নেতৃত্বের যে প্রয়ােজনীয়তা স্বয়ং চারু মজুমদারই সবচেয়ে বেশি অনুভব করেছিলেন, সেক্ষেত্রে নীতি ও তত্ত্বের জায়গায় যুক্তিবাদ reasoning প্রাধান্য লাভ করছিল। আর সেই কারণেই নকশালবাড়ি ক্রমে পরিণত হচ্ছিল একটি ভাবমূর্তিতে।-নকশালবাড়ির হাত দিয়ে যে নয়া ইতহাস লেখা হচ্ছিল তার কথা নকশালবাড়ির কৃষক স্পষ্ট করে জানতে পারছিল না। এলাকার মধ্যে আত্মগােপনের জায়গা কমে আসছিল— ক্রমাগত এক জায়গা থেকে আর এক জায়গায় ছুটে বেড়াতে হচ্ছিল কানু সান্যালদের। পুলিশ ঘরবাড়ি ভেঙেছে— বুড়াগঞ্জের কদমলাল, ঝাইল সিং-দের বাড়ি পুড়িয়ে দিয়েছে, কদমলালের দাদা প্রেমলালকে প্রায় বুকে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করে মেরেছে। নকশালবাড়ির কৃষক পুরােদস্তুর সন্ত্রাসের রাজত্বের মধ্যে বসবাস করছে।
ওদিকে নকশালবাড়ির নাম আগুনের মশাল নিয়ে ছুটে চলেছে ভারতের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্তে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের আর সমাজ পরিবর্তনে সশস্ত্র বিপ্লবের বাণী ধ্বজা উড়িয়ে, প্রকৃতপক্ষে, স্বতঃস্ফূর্ততাকেই আরাে প্রসারিত করে।
চারুর কল্পনার রাজ্যে বাধা, বন্ধনহীন বিপ্লবের অগ্রগতির প্রশস্ত পথ মেলে ধরা। শত্রুপক্ষের আদর্শগত ও সশস্ত্র শক্তি তার কাছে ক্রমেই কেবল কাগুজে বাঘ’-এর মূর্তিতেই প্রতিভাত- দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর যুগে হাওয়ার্ড ফাস্ট-এর শিশুদের কাছে সেই বক্তৃতার মতাে যে “তােমরা বাঁচবেই কারণ স্টালিন বেঁচে আছেন”–চারুর মনের সব চিন্তার মূল কথাও একই রকম। চেয়ারম্যান মাও তাে মাথার উপরে আছেন। সুতরাং জয় নিশ্চিত।
অন্ধে টি, নাগী রেড্ডি, ডি,ভি, রাও, চন্দ্র পুল্লা রেড্ডিদের নেতৃত্বে বর্ধমান প্লেনামের প্রায় পর পরই কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের রাজ্য কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠিত হলাে। এঁদের পক্ষ থেকে নিখিল ভারত কো-অর্ডিনেশান কমিটির সাথে যােগাযােগের প্রথম বৈঠকেই ‘সশস্ত্র সংগ্রামের আওয়াজই সব আন্দোলনে দিতে হবে এবং সব সময়ের জন্য নির্বাচন বয়কট’–এই দুটি বিষয়ে মতান্তর হয়। নাগী রেড্ডিদের বক্তব্য ছিল জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য নিয়েই গণসংগ্রাম গড়ে তুলতে হবে অর্থনৈতিক দাবির ভিত্তিতে এবং জনগণের প্রয়ােজন অনুযায়ীই তাকে সশস্ত্র করতে হবে। নির্বাচন প্রসঙ্গে ওঁরা বললেন যে, কৌশলগতভাবে নির্বাচনকে ব্যবহার করার পথ বন্ধ হয়ে যায়, যদি সব সময়ের জন্যই নির্বাচন বয়কটের আওয়াজ দেওয়া হয়। বিতর্কের বিষয়গুলাের মধ্যেও মতৈক্যের জায়গা খুঁজে একসঙ্গে কাজ করার মনােভাবের অভাব উভয় পক্ষেই দেখা গিয়েছিল। চারু মজুমদার নাগী রেডিকে বলেছিলেন যে, পরে তাঁদের পরবর্তী সভার খবর দিয়ে মতামত বিনিময়ের আরও সুযােগ সৃষ্টি করা যাবে। তা অবশ্য আর হয়নি। কারণ চারু মজুমদার যােগাযােগ পেয়ে গেলেন শ্রীকাকুলাম জেলার ভেস্পটাপু সত্যনারায়ণ, আদিবাটলা কৈলাশন, পঞ্চাদ্রী কৃষ্ণমূর্তি ও চৌধুরী তেজেশ্বর রায়-এর।
‘৬৭ সাল থেকেই অন্ধ্রের শ্রীকাকুলাম জেলার পার্বত্য এলাকার সবর ও যাতপ আদিবাসী গিরিজন (পবর্তবাসী)-দের সাথে সমতলের মহাজনদের বিরােধ চলছিল। ঋণের দায়ে জমি দখল করা, তেঁতুল, আম, মাড়ােয়া প্রভৃতি ফলস নাম মাত্র দামে নিয়ে নেওয়া প্রভৃতি জুলুমের বিরুদ্ধে। প্রাইমারি স্কুল শিক্ষক ভেস্পটাপু সত্যনারায়ণ তাঁর সহযােগী শিক্ষক আদিবাটলা কৈলাশকে নিয়ে এই গিরিজন আন্দোলন সংগঠন করেন এবং জঙ্গি মিছিল করতে থাকেন- ভেম্পটাপু ও কৈলাশন উভয়েই ছিলেন তখন সিপিএম সদস্য। এঁরা সহযােগী হিসেবে পেয়েছিলেন জনকবি সুব্বারাও পানিগ্রাহীকে, যিনি ওড়িয়া হলেও অন্ধ্রের কৃষক আন্দোলনের সাথে জড়িত ছিলেন এবং কবিতাও লিখতেন তেলেগু ভাষায়। ‘৬৭ সালের অক্টোবর মাসে গিরিজনদের এক মিছিলের উপর মহাজনরা গুলি চালায় এবং দুজন আদিবাসী হত্যা করে। সিপিএম এই অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করে প্রতিবাদ মিছিল সংগঠনের কথা বলে। নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের সময় থেকেই ঐ এলাকায় পুলিশ ক্যাম্প ও পুলিশের টহলদারী বসানাে হয়েছিল। ভেম্পটাপু ও অন্যান্য নেতৃবৃন্দ সিপিএম নেতাদের জানিয়েছিলেন যে মিছিল করতে গেলেই পুলিশি আক্রমণের মুখে পড়তে হবে। প্রতিরােধের ব্যবস্থা না থাকলে মিছিল করার কোনাে দরকার নেই। এই নিয়ে সিপিএম নেতৃত্বের সাথে বিরােধ বাধে গিরিজন নেতাদের। ‘৬৮ সালে বর্ধমান প্লেনামের পর এই বিরােধ ভাগাভাগিতে পর্যবসিত হয় এবং শ্রীকাকুলামের বিপ্লবী কমিউনিস্টরা পৃথক জেলা কমিটি গঠন করেন এবং নাগী রেডিদের রাজ্য কো-অর্ডিনেশানের সাথে ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রেখে চলতে থাকেন। ‘৬৬ সালে অন্ধ্রে ইস্পাত কারখানার জন্য যে গণবিক্ষোভ হয় তাতে তরুণদের ভূমিকাই ছিল প্রধান। এই তরুণদের মধ্যে ছিল গুন্টুর মেডিকেল কলেজের ছাত্ররা যাদের মধ্যে ডা. ভাস্কর রাও, ডা. মল্লিকার্জুন-এর নাম অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বিশাখাপত্তন-স্থিত-অন্ধ বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃতী ছাত্র পঞ্চাদ্রী কৃষ্ণমূর্তি, চৌধুরী তেজেশ্বর রাও, ওয়াই কোটেশ্বর রাও প্রমুখ ঐ ইস্পাত কারখানার আন্দোলনে পরিচিত হয়েছিলেন গুন্টুরের তরুণদের সাথে। এঁরা ভেটাপুর সাথে যােগাযােগ করে শ্রীকাকুলাম জেলা কমিটির (আসলে তাঁরা এই কমিটির নাম দিয়েছিল কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের শ্রীকাকুলাম জেলা সংগঠন) নামে একটি প্রস্তাব গ্রহণ করে বলেন যে-নাগী রেড্ডিরা নয়া সংশােধনবাদীদের বিরােধিতা করেছেন তাত্ত্বিকভাবে, কিন্তু তাদের সাথে সব সম্পর্ক ছিন্ন করে, জনগণকে সশস্ত্র করে সংগ্রামের পথ নিতে তারা ইতস্তত করেছেন। অথচ অবস্থা এমনই যে পুলিশি আক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরােধের ব্যবস্থা না করে আজ সংগ্রাম গড়ে তােলা সম্ভব আর সংগ্রাম গড়ে তুললে কোনাে অধিকারই রক্ষা করা সম্ভব না।
শ্রীকাকুলাম জেলা সংগঠন থেকে চৌধুরী তেজেশ্বর রাও পঞ্চাদ্রী কৃষ্ণমূর্তি চলে গেলেন শিলিগুড়িতে, চারু মজুমদারের সাথে কথা বলতে। ব্যাঙ্গালােরের এক বাঙালি মহিলা ডাক্তারের পুত্রের সাথে যােগাযােগের সূত্রে সরােজ দত্ত ও সুনীতি কুমার ঘােষ ইতপূর্বেই অন্ধের তরুণ বিপ্লবীদের সাথে যােগাযােগ করেছিলেন। তাই চারুর পূর্বাহ্নেই খবর ছিল যে অন্ধ্র থেকে লােক আসছে।
ছয় ফুটের উপর লম্বা তেজেশ্বর রাও ও তীক্ষ্ণ বুদ্ধিদীপ্ত পঞ্চাদ্রিকে দেখেই তাে চারু উচ্ছ্বসিত। বললেন-“এরা রাজনীতিক ও সামাজিক সমস্ত পুরানাে সংস্কার থেকে মুক্তমন তরুণের দল। এদের পিছুটান হবে না- এরাই হবে আমার সশস্ত্র সংগ্রামের প্রধান হােতা। একেবারে কথাবার্তা পাকা হয়ে গেল যে স্বাস্থ্যান্বেষণের অছিলায় চারু সস্ত্রীক যাবেন বিশাখাপত্তনমের সমুদ্র তীরে, তারপর সেখান থেকে তাঁকে নিয়ে যাওয়া হবে গােপন সভাস্থলে।
ওরা বিপুল আশা বুকে নিয়ে ফিরে গেল— উত্তেজনার চাপে রীতিমতাে অসুস্থ হয়ে পড়লেন চারু মজুমদার। “উহুঃ, অসুস্থ হলে তাে বিপ্লবের কাজই পিছিয়ে যাবে!”-বলে একমুঠো যন্ত্রণানিরােধক আর ঘুমের বড়ি খেয়ে অবস্থা সঙ্গীন হয়ে পড়ল দুইতিন জন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দুদিন অক্লান্ত চেষ্টা করে অবস্থা আয়ত্তে আনলেন। স্বাস্থ্যান্বেষণে যাওয়াতে বিশেষজ্ঞদের ঘাের আপত্তি কিন্তু চারুর বন্ধু ডাক্তার তাে ভালােই চেনেন তার রােগীকে আর এই যাত্রার কারণও জানেন। তিনি নিজে বাধা দিলেন না আর তা দিলেও নিষ্ফল হতাে।
পৃষ্ঠা: ১৪০
বিশাখাপত্তনম থেকে গুন্টুরে। পাহাড়ি এলাকার এক জঙ্গলের মধ্যে প্রাচীন মন্দিরে চলেছে বিপ্লব করার শপথ গ্রহণ। মন্দিরের সেবাতে নির্বিকার ছেড়ে দিয়েছেন মন্দিরের প্রশস্ত কক্ষ। নিস্তব্ধ জঙ্গলে দিনের বেলাতেও ঝিঝির ডাক শােনা যায়,-সূর্য নিস্তেজ।
সভায় যােগ দিল শ্রীকাকুলাম, গুন্টুর, নালগােন্ডা, ওয়ারেঙ্গেল, আদিলাবাদ, রয়ালসীমা, কষ্ণা জেলার তরুণ বিপ্লবীরা। “অন্ধের জেলায় জেলায় শ্রীকাকুলাম গড়ে তুলব, যার যা সম্পত্তি আছে, বিক্রি করে দেব বিপ্লবের কাজে, এখন থেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আত্মদানের সংকল্প নিয়ে লেগে যাব বিপ্লবের প্রস্তুতিতে”-বলে সভা শুরু করল অন্ধ্রের তরুণেরা। গলা ধরে আসে চারুর। অনেক পরে লিখলেন-“মনে হয়েছিল তেলেঙ্গানার সংগ্রাম তাে ব্যর্থ হয়ে যায়নি। চারদিকের জঙ্গল আর এই দৃপ্ত তরুণদের দেখে মনে হচ্ছিল তাহলে কি শ্রীকাকুলামই ভারতের ইয়েনান হবে?”
‘৬৮ সালে এদিকে শুরু হয়েছিল মেদিনীপুর জেলার ডেবরা ও গােপীবল্লভপুর এলাকার কৃষক সংগ্রাম। ডেবরায় নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের প্রভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে ওখানকারই দুজন মুখ্য কৃষক সংগঠক ভবদেব মণ্ডল ও গুণধর মুম্ কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের জেলা কো-অর্ডিনেশন কমিটি গঠন করে কৃষদের ফসল দখল ও জমি দখলের আন্দোলন শুরু করেন। গােপীবল্লভপুর ডেবরা থেকে অনেক দূরে দুটি নাম দুই যমজ ভাই-এর মতাে হয়ে গেছে গােড়া থেকেই। কলকাতার কলেজে পড়া গােপীবল্লভপুরেরই মেধাবী ছাত্র সন্তোষ রাণা ‘৬৭ সালে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের কথায় উদ্বুদ্ধ হয়ে গ্রামে ফিরে গিয়ে একটি স্কুলে শিক্ষকতার কাজ নেন এবং নবযুবক সমিতি নামে এক স্টাডি গ্রুপ স্থানীয় যুব-ছাত্রদের নিয়ে গড়ে তােলেন। শীঘ্রই প্রেসিডেন্সি কলেজের বেশ কিছু সংখ্যক ছাত্রদল অসীম চ্যাটার্জীর নেতৃত্বে সন্তোষের সাথে এসে যােগ দেন। সন্তোষের ভাই কৃষক সংগঠক মিহির রানাও এঁদের সাথে যােগ দিলেন। নকশালবাড়ির মতাে সংগ্রাম’-এর আওয়াজ দিয়ে এই তরুণেরা কৃষকের বাড়িতে থেকে তাদের সাথে কাজ করার মধ্য দিয়ে ‘৬৮ সালের মধ্যেই যথেষ্ট জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। ডেবরার সাথে এরা ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ রেখে চলছিল এবং নিকটবর্তী বিহার-এর বহরাগােড়া এলাকায় সিপিএম ছেড়ে আসা মণি চক্রবর্তীর সাথে যােগাযােগ করে সেখানেও সংগ্রামের এলাকা তৈরিতে সচেষ্ট হয়।
বিহারে মজফফরপুর জেলার মুশাহারীতে সত্যনারায়ণ সিং প্রমুখ কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের প্রচেষ্টা ও নেতৃত্ব এই ‘৬৮ সালেই কৃষকদের সশস্ত্র সংগ্রাম মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। মুশাহারীর কৃষক সংগ্রাম সহর্ষ ও চম্পারণ জেলাতেও ছড়িয়ে পড়ে। বিহারের গরিব কৃষক ও খেতমজুরদের উপর অর্থনৈতিক শােষণ ছাড়াও নিম্নবর্ণ হিসেবে সামাজিক অত্যাচারও ছিল প্রবল। আইনানুগ কৃষক আন্দোলনে সামাজিক অত্যাচারের বিরুদ্ধে কৃষকরা কোনাে পথ পায়নি। মুশাহারীর কৃষক সংগ্রামে গরিব ও ভূমিহীন কৃষকদের সশস্ত্র অভ্যুত্থান ও জমিদারের গুন্ডাদের এবং পুলিশকে প্রতিরােধের জন্য গেরিলা দল গঠন নিম্নবর্ণের কৃষকদের মনে সর্বপ্রথম সমজাটাকেই চ্যালেঞ্জ জানানাের সাহস জোগাল।
উত্তরপ্রদেশের নেপাল সীমান্তের লক্ষ্মীমপুর খেরি অঞ্চলে, মধ্য ইউপি-এর ভূমিহীন কৃষক গিয়ে জঙ্গল কেটে জমি বের করেছিল। জমিতে ভালাে ফসল হতে শুরু করতেই জমিদার, মহাজন এক এক করে জমি দখল করতে লাগল। উত্তর প্রদেশের কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা শিবকুমার মিশ্র প্রমুখদের নেতৃত্বে সশস্ত্র কৃষক সংগ্রাম গড়ে তােলার সহজ জায়গা পেয়ে গেল। লক্ষ্মীপুরের লড়াই-এর কথা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। উনাও ও নৈনিতাল জেলায়ও কৃষক সংগ্রাম হলাে সিপিএম ও সিপিআই নেতৃত্বকে আগ্ৰহ্য করে। নৈনিতাল জেলায় আবার পেশাদার ডাকাতরা কয়েকটি অঞ্চলে বড় বড় জমিদার বাড়িতে ডাকাতি করল ‘নকশালবাড়ি জিন্দাবাদ’ বলে। নেপালের দক্ষিণ অঞ্চলের পুলিশ প্রধান অভিযােগ করলেন যে নেপালের ভদ্রপুর এলাকায় কৃষকরা নকশালবাড়ির কায়দায় জমিদাদের ফসল কেটে নিচ্ছে।
রাজনৈতিক বিতর্ক শুরু হলাে নিখিল ভারত কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের কোঅর্ডিনেশান কমিটির মধ্যে। বিতর্ক প্রধানত হচ্ছিল দ্বিধাহীনভাবে চারু মজুমদারের লাইনের সমর্থক ও তাঁর লাইন সম্বন্ধে কিছু সন্দেহ প্রকাশর মধ্যে। ‘৬৮ সালের মধ্যভাগে এসে সমালােচনামূলক মতের প্রতি অসহিষ্ণুতার ঝোঁক বেশ দৃঢ়ভাবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল কো-অর্ডিনেশান কমিটির মধ্যে। চেকোস্লোভাকিয়ায় সােভিয়েত হস্তক্ষেপ উপলক্ষ্য করে পরিমল দাশগুপ্তের সাথে বির্তক হয়। পরিমল দাশগুপ্ত এই হস্তক্ষেপের পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন, কো-অর্ডিনেশান কমিটির অন্যান্য সদস্য চারু মজুমদারের সম্মতিতে এক সােভিয়েত আগ্রাসন-নীতি বলে সামলােচনা করার পর চারু মজুমদার পরিমল দাশগুপ্তের মতামতের একটি ধারাবাহিকতা দেখাতে চান পরিমলবাবু একজন ট্রেড ইউনিয়ন নেতা বলে। চারু ‘পরিমল দাশগুপ্তের রাজনীতি শীর্ষক প্রবন্ধে খুব স্পষ্টভাবেই গণসংগঠন গড়ার বিরােধিতা করে বলেন—“.. প্রত্যেকেই যদি গণসংগঠন করতে যায় তাে গােপন পার্টির সংগঠন গড়বে কে? আমরা কি তাহলে এই আশা নিয়ে চলব যে গণসংগঠন কৃষি বিপ্লব সংগঠিত করবে? গ্রামাঞ্চলে গণসংগঠন করার ঝোঁক শুরু হলেই প্রকাশ্যে গণআন্দোলনের দিকেই সমস্ত প্রচেষ্টা চলে যাবে এবং তা অবশ্যম্ভাবীভাবেই আমাদের আর একটি সংশােধনবাদী গণ-সংগঠনের নেতৃত্বে পরিণত করবে। আজ আমাদের দায়িত্ব প্রকাশ্য গণসংগঠন গড়া নয়, দায়িত্ব গােপন পার্টি সংগঠন গড়ে তােলা। শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে গােপন পার্টি সংগঠন গড়ে তুলতে না পারলে শ্রমিকশ্রেণি নেতা হিসেবে তার দায়িত্ব পালন করতে পারবে না।” কৃষক আন্দোলনে ‘চে-গুয়েভারা-বাদ চলছে’ পরিমল দাশগুপ্তের এই অভিযােগের উত্তরে চারু লেখেন- “খুব স্বাভাবিকভাবেই গেরিলাযুদ্ধে সমস্ত কৃষকের পক্ষেই অংশগ্রহণ সম্ভব না, কিন্তু যেহেতু গেরিলাদল কৃষকদের দ্বারাই গঠিত, পেটিবুর্জোয়াদের দ্বারা নয় এবং যেহেতু অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্রের পরিবর্তে একেবারে ঘরােয়া অস্ত্র তারা ব্যবহার করে তাই ব্যাপক কৃষক জনগণের থেকে সে বিচ্ছিন্ন তাে নয়ই, বরং তার কাছে। উদ্বুদ্ধ করে তাকে গণসমর্থন দেবে, এখানেই চেগুয়েভারাবাদের সাথে এর প্রভেদ।”
‘৬৮ সালের নভেম্বরে কেরালার ওয়াইনাদ জেলার পুলপল্লি পুলিশ থানার উপর আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র, হাতবােমা নিয়ে এক আক্রমণ পরিচালনা করেন কেরালার পুরানাে কমিউনিস্ট নেতা কুন্নিকল নারায়ণন। কুন্নিকলের পত্নী মন্দাকিনী ও কন্যা অজিথাও এই আক্রমণে অংশ নিয়েছিল। এই ঘটনা নিয়ে কো-অর্ডিনেশান কমিটির মধ্যে একটা মৃদু বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছিল। চারু মজুমদার ঘটনাটি জানার সাথে সাথে মন্তব্য করলেন “রাজনৈতিক প্রচার ছাড়া এই রকমের ব্যক্তি প্রাধান্যের উদ্যোগ অ্যাডভেনচারিজম ছাড়া আর কিছু নয়!” পরে ‘দেম্প্রতী’তে তিনি এই ঘটনাকে ‘ভারতীয় বিপ্লবের অগ্রগতিরই এক লক্ষণ’ বলে লিখলেন-‘এটি কেরালার নিপীড়িত জনগণেরই বীরত্বের প্রকাশ… কেরালার বীর কৃষক বিপ্লবীরা পুন্নাপ্রা-ভায়ালারেরই গৌরবময় ঐতিহ্যকে ধরে চলেছে।” উক্তি ও বিবৃতির এই পার্থক্যে এক বিভ্রান্তির সৃষ্টি হয়েছিল, যদিও শীঘ্রই তার অবসান হলাে পিকিং রেডিও কর্তৃক ওয়াইনাদ-এর ঘটনাকে—পুলিশি বেতার কেন্দ্রের উপর মহাবীরত্ব ব্যঞ্জক “আক্রমণ” বলে অভিহিত করাতে। ‘৬৯ সালের বিশেষ নির্বাচনে পশ্চিম বাংলার বিপুল সমর্থনে যুক্তফ্রন্টের বিজয়ে চারু মজুমদার আবার সমালােচনার সম্মুখীন হলেন। কো-অর্ডিনেশান কমিটিরই সদস্য প্রমােদ সেনগুপ্ত অভিযােগ করলেন যে “নির্বাচন বয়কট’-এর আওয়াজকে জনসাধারণ গ্রাহ্যই করেনি, উপরন্তু এই আওয়াজ দিয়ে নির্বাচন থেকে আমরা দূরে সরে যাওয়ায় সংশােধনবাদীরা সহজেই জিতে গিয়েছে!
নকশাল আন্দোলনের অভ্যুত্থানের ঐতিহাসিক গতি প্রকৃতি বিপ্লব গড়ে ওঠার পথে বাধা হিসেবে কমিউনিস্ট আন্দোলনের পুরানাে রাজনৈতিক সাংগঠনিক ধ্যান-ধারণার মূলে আঘাত করে স্বতঃস্ফূর্তভাবেই পুরানাে সংগঠনকে অপর্যাপ্ত সাব্যস্ত করে নতুন ধরনের সংগঠনের দাবি জানাচ্ছিল— চারু মজুমদার ও তাঁর ঘনিষ্ঠ সহযােগীরা একে চারুর রাজনীতিরই অভিব্যক্তি মনে করেছিলেন— ফলে ‘চারু মুজমদার অভ্রান্ত এই মানসিকতা প্রবল থেকে প্রবলতর হচ্ছিল। সমালােচনার প্রতি অসহিষ্ণুতাকে বিপ্লবের প্রতি গভীর আস্থা এবং বিপ্লবী মনােভাবের সাথে চারু মজুমদারের নেতৃত্বের প্রতি অনড় আনুগত্যকে এক করে দেখা হচ্ছিল। বিভিন্ন সমালােচনাকে ‘পেটিবুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের দোদুল্যমানতা ও বিপ্লব-ভীতি’ বলে দৃঢ় নিশ্চিত হতে লাগলেন কো-অর্ডিনেশান কমিটির বেশিরভাগ নেতৃত্ব অর্থাৎ সরােজ দত্ত, সুশীতল রায়চৌধুরী, সত্যনারায়ণ সিং, শিবকুমার মিশ্র প্রমুখ। চারুর নিজের একটি বীতশ্রদ্ধা বরাবরই ছিল কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে। পরিমল দাশগুপ্ত থেকে প্রমােদ সেনগুপ্ত পর্যন্ত সমালােচনা বা রাজনীতির নির্দিষ্ট প্রয়ােগ সম্বন্ধে সন্দেহ চারুকে ‘এঁদের দ্বারা বিপ্লব হবে না এই সিদ্ধান্তে নিয়ে এলাে। কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীদের বেশ একটি বড় অংশ অল্প কিছুদিন পরেই যখন আবেদন করেছিলেন যে তাঁদের পক্ষে বিপ্লবের সমর্থনে প্রকাশ্য পত্রপত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব তখন সরােজ দত্ত এঁদের স্পষ্টভাবে বলেছিলেন- ‘বিপ্লবের কাজে সরাসরি অংশগ্রহণ যারা করতে পারেন না সেই সব কাপুরুষদের কোনাে কাজই বিপ্লবকে সাহায্য করবে না।’
শুরু থেকেই কেন্দ্রীয় বা রাজ্য কো-অর্ডিনেশান কমিটির সাথে কানু সান্যালের কোনাে সরাসরি যােগাযােগ না থাকায় চারুর ঘনিষ্ঠ সহযােগীদের মধ্যেও কেউ কেউ প্রশ্ন করেছিলেন যে- “কানু সান্যাল দ্বিমত পােষণ করেছেন কি-না? নকশালবাড়ি এলাকা থেকে রাজ্য কো-অর্ডিনেশানের দুই সদস্যের মধ্যে কানু সান্যাল নকশালবাড়ি এলাকার এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্ত পর্যন্ত পুলিশের তাড়নায় ছুটে বেড়াচ্ছিলেন স্থায়ী আশ্রয়ের অভাবে, আর সৌরেন বােস চারুরই নির্দেশে দার্জিলিং-এর পাহাড়ি অঞ্চলে ঘুরছিলেন। সুশীতল রায়চৌধুরী পরে বলেছিলেন- “প্রতিটি সভার খবর তাে পাঠিয়েছি, ওরা আসে না কেন?” ‘৬৮-এর জানুয়ারি থেকে ‘৬৯-এর এপ্রিল পর্যন্ত দুজন রাজ্য কো-অর্ডিনেশানের কোনাে সভাতেই উপস্থিত হননি। খবর দেওয়ার দায়িত্ব ছিল স্বয়ং চারু মজুমদারের তিনি ঐ দুইজনের সভাগুলােতে যােগদানের প্রয়ােজন অনুভব করেননি। এমনকি তরাই অঞ্চলের পুলিশি সস্ত্রাস সম্বন্ধেও কোনাে বক্তব্য চারু কোঅর্ডিনেশান কমিটিতে রাখেননি। নকশালবাড়ির ভাবমূর্তি তুলে ধরার একদেশদর্শী মানসিকতায় চারু ভেবেছেন যে পুলিশি সন্ত্রাস ও কানুদের নিরাপত্তার অভাবের কথা বললে ‘বন্ধননীন আশাবাদে যদি ভাটা পড়ে?’ কানু সান্যালের সাথে মতান্তর’-এর গুজব কাটাতে চারু পীড়াপীড়ি করলেন কানু সান্যালকে নকশালবাড়ি আন্দোলনের পর্যালােচনামূলক একটি রিপাের্ট লেখার জন্য। সুশীতল রায়চৌধুরী শিলিগুড়ি এলেন কানু সান্যালদের সাথে বসে আলােচনা করতে এবং ঐ পর্যালােচনাটি প্রকাশের জন্য নিয়ে যেতে। কিন্তু সভাগৃহটি পুলিশ কর্তৃক আক্রান্ত হওয়ায় আর সুশীতলের সাথে কানুর সাক্ষাৎ হলাে না। তবুও শেষ পর্যন্ত কানু সান্যাল পর্যালােচনা প্রস্তুত করে চারুর কাছে পাঠিয়ে দিলেন।
সেই পর্যালােচনাটিই ‘তরাই-এর কৃষক আন্দোলনের রিপাের্ট’ নামে খ্যাত। পর্যালােচনাটি মাও সে-তুঙ রচিত ‘হুনানের কৃষক আন্দোলনের রিপাের্ট দ্বারা প্রচণ্ডভাবে প্রভাবিত এবং হুনানের কৃষক আন্দোলনের বক্তব্যের সাথে সমতা রক্ষা করতে অতিকথনে ভুগেছে, কিন্তু সশস্ত্র জমি দখলের সংগ্রাম রাষ্ট্র দখলেরই সংগ্রাম এই বক্তব্যের উপর জোর দেওয়ায় এবং চারু মজুমদারের শিক্ষার গুরুত্বকে বিশেষভাবে তুলে ধরায় সারা ভারত জুড়েই এটি একটি উৎসাহ-উদ্দীপক দলিল হিসেবে বিপ্লবীদের দ্বারা গৃহীত হলাে এবং কো-অর্ডিনেশান কমিটির নেতৃবৃন্দকেও আশ্বস্ত করল যে, চারু মুজমদারের সাথে কানু সান্যালের কোনাে বিরােধ নেই। পর্যালােচনাতে নকশালবাড়ির কৃষক আন্দোলনের ত্রুটিগুলাে সম্বন্ধে বক্তব্যও যথেষ্ট আগ্রহের সাথে গৃহীত হলাে। এই বক্তব্যে কানু স্যানাল (১) একটি মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির অবর্তমানে কী আন্দোলন পরিচালনায়, কী সুষ্ঠু ভূমি বণ্টনে, কী সামরিক কার্যকলাপে কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের অনুপস্থিতির প্রশ্নটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছিলেন; (২) কৃষক জনগণের প্রতি গভীর আস্থার ক্ষেত্রে পুরানাে সংশােধনবাদী ধ্যান ধারণা কীভাবে প্রতিপদে বাধার সৃষ্টি করেছে তার ব্যাখ্যা করে বললেন যে, আন্দোলনের জোয়ারের সময়ে শত্রুর শক্তিকে একেবারেই নস্যাৎ করা আবার পুলিশি সন্ত্রাস শুরু হলে প্রতিরােধের প্রশ্নে শত্রু শক্তিকে বড় করে দেখে একটি আইনানুগ চিন্তা অর্থাৎ প্রতিরােধ করতে গেলে ফৌজদারি মামলাগুলােতে আইনের কড়াকড়ি কেমন হবে সেই ধ্যান ধারণা; (৩) শ্রেণি শত্রু মুক্ত অঞ্চলকেই এলাকাগত মুক্তাঞ্চল বলে মনে করা; (৪) সর্বোপরি সামরিক বিষয়ে একেবারেই অজ্ঞতা। অন্য ত্রুটি সম্বন্ধে কানু সান্যাল উল্লেখ করেন যে, সংগ্রামলব্ধ ফলগুলােকে প্রচার করা, সংগ্রামের লক্ষ্য সম্বন্ধে রাজনৈতিক প্রচার এবং শহিদদের আত্মদানকে বলিষ্ঠভাবে উপস্থিত করার কাজে নেতৃত্ব বিফল হয়েছে।
নকশালবাড়ি এলাকায় অবস্থাটাকে একটু গুছিয়ে নিতে একটি প্রচেষ্টা ‘৬৮ সালের দ্বিতীয় ভাগে কানু সান্যাল ও দীপক বিশ্বাস করেছিলেন মিরিকের পাহাড়ি এলাকায় একটি পশ্চাদভাগ গড়ে তােলার চেষ্টা করে। পাহাড় ও সমতলের সমস্ত কর্মীদের অস্ত্রশস্ত্রসহ সেখানে জমায়েত করা হলাে, সে কিন্তু রসদের অভাবে, জনমনুষ্যহীন জঙ্গলে বাসের অনুপযুক্ত অবস্থায় ও পরবর্তী পরিকল্পনার অনুপস্থিতিতে প্রচেষ্টাটি পণ্ডশ্রমে পরিণত হলাে।
নকশালবাড়ি অঞ্চলের অবস্থা যাই থাক না কেন, নকশালবাড়ির ভাবমূর্তি বিজয়কেতন উড়িয়ে সারা ভারতেই এ যাবকালের বাধাধরা ছকের সীমাবদ্ধ আন্দোলনের হিমগিরিতে সূর্যের প্রখর আলাের ছোঁয়া লাগিয়ে বিপ্লবী সংগ্রামের জোয়ার বইয়ে দিল নয়া ইতিহাসই দাবি করতে লাগল কেন্দ্রীয় সংঘবদ্ধ নেতৃত্বের।
পৃষ্ঠা: ১৪৫
১৪
আলাের পথযাত্রীর বাতিঘর
চারু মজুমদারের চিন্তা ‘বিপ্লবের কেন্দ্র ছাড়া বিপ্লব পরিচালিত হবে কী করে? কোঅর্ডিনেশান তাে একটি ঢিলেঢালা যােগাযােগ কেন্দ্র মাত্র পার্টির তাে নিতান্তই প্রয়ােজন।’ ‘৬৮ সালে মাঝামাঝি থেকে চারু বলতে লেগেছিলেন পার্টি গড়ার এই কথা। সত্যনারায়ণ সিং-সহ কারাে কারাে মত আরও সময় নিয়ে পার্টির গড়া উচিত। চারু বলেন –‘একেবারে সকলে আদর্শগতভাবে একমত হলে তবে পার্টি গড়ব এই ধারণা তাে অবাস্তব। পার্টি তাে আদর্শগত ঐক্যের প্রকাশ না, পার্টি বিপ্লবের পরিচালক। নানা মতানৈক্য নিয়েই পার্টি, তাই তার মধ্যে আদর্শগত সংগ্রামের প্রশ্ন, যার দ্বারা পার্টির ক্রমােন্নতি!’ তরাই রিপাের্টে কানু সান্যালও মাকর্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির প্রয়ােজনীতার উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। আবার কো-অর্ডিনেশান কমিটির মধ্যে যে বিতর্ক উঠছিল বা চারুর লাইনের বিরুদ্ধ মত প্রকাশিত হচ্ছিল তার ছেদ টানার জন্যও পার্টির প্রয়ােজনীয়তার কথা সকলেরই মনে হচ্ছিল।
সংগ্রাম এদিকে ছড়াচ্ছে তরুণদের দল বেশি বেশি করে যােগ দিচ্ছে। মুশাহারীতে গরিব কৃষকের গেরিলাদল বিজনী সিং-এর মতাে দুর্ধর্ষ জমিদারকে খতম করেছে। শ্রীকাকুলামে নারী-পুরষের গেরিলাদল একের পর এক ‘অ্যাকশান করে চলেছে- ডেবরা গােপীবল্লভপুরে কৃষকদের গণজাগরণ হচ্ছে। তলা থেকে দাবি উঠছে বিপ্লববের কেন্দ্র চাই, কঠোর শৃঙ্খলাবদ্ধ এক নেতৃত্ব চাই।
ঘটনার গতিতে যেন আবেগ সঞ্চার করল নকশালবাড়ি এলাকার বাবুলাল বিশ্বকর্মকার। ছাব্বিশ বছরের যুবক বাবুলাল শিকারের বন্দুক দিয়ে চার ঘণ্টা ধরে পুলিশি আক্রমণ রুখে দিল। পুলিশ বাঁশঝাড়ের আড়ালে চলে গেল। অনেকক্ষণ চুপচাপ থাকার পর পুলিশ ফিরে গেছে মনে করে বাবুলাল ঘর থেকে বেরিয়ে যেই মাঠে পড়েছে, তখন ফুটফুটে চাঁদনি রাতে বাঁশঝাড়ের আড়াল থেকে পুলিশ রাইফেল তার তরুণ দেহটিকে ঝাঁঝরা করে দিল। বাবুলালের আত্মদানে এক দুরন্ত সাহসিকতার উদাহরণ উপস্থিত করল ভারতের সংগ্রামী কমিউনিস্টদের কাছে। বাবুলালই নতুন পার্টি গড়ার কথা যেন বলে গেল— এমনভাবেই গৃহীত হলাে এই ঘটনা। চারু লিখলেন—“বাবুলাল বিশ্বকর্মকার আত্মদান করে নকশালবাড়ির সংগ্রামকে দ্বিতীয় পর্যায়ে অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধের পর্যায়ে উন্নিত করে দিয়ে গেল।” চারু মজুমদারের ব্যাখ্যাগুলাের স্বাতন্ত্র, সামরিক বিষয়ে সম্পূর্ণ অজ্ঞ কর্মীদের সমানে তার সামরিক শব্দ ব্যবহার তাকে বিশেষজ্ঞ হিসেবে প্রতিপন্ন করার প্রভৃতিতে চারুর বক্তব্য কর্মীদের কাছে নীতিগত বক্তব্য হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছিল।
বাবুলাল শহিদ হয়ে নকশালবাড়ির কৃষকদের মধ্যে তেমন কোনাে নতুন পরিস্থিতি আনতে পারেনি। দুই মাসের মাথায় সদলে কানু সান্যাল গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন। সিঙ্গিঝােরা অঞ্চলের একটি গ্রাম থেকে, বিনা প্রতিরােধে। এই ঘটনা ‘৬৮ সালের অক্টোবরের। জঙ্গল সাঁওতাল তাে সেই ‘৬৭-এর আগস্ট মাস থেকেই জেলে, কমলাল মল্লিক আচমকা গ্রেপ্তার হয়েছিলেন ‘৬৮-এর জুন মাসে।
দেশের অন্য অঞ্চলে এর জন্য বেদনা ছিল, কিন্তু কোথাও নিরাশা আসেনি। জঙ্গল রাজনৈতিক বন্দির মর্যাদার দাবিতে অনশন ধর্মঘট চালাচ্ছিলেন দার্জিলিং জেলে, কানুরাও তার সাথে যােগ দিলেন। ‘৬৯-এর জানুয়ারিতে যখন ওদের শারীরিক অবস্থা উদ্বেগজনক বলে খবর বেরােল তখন হাউমাউ করে কেঁদে ফেলে চারু মন্তব্য করেছিলেন—“ওরা বােধ হয় বাঁচবে না, আমার তাে তাহলে সব গেল। পুরাে একশ দিন অনশন করে জেলে অনশন ধর্মঘটের রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন সে সময়ে জঙ্গল সাঁওতাল। চারু মজুমদার শিলিগুড়ির ছেলেদের বলেছিলেন—“দেওয়ালে দেওয়ালে লিখে দাও ‘নয়া ভারতের নতুন নেতা জঙ্গল সাঁওতালের মুক্তি চাই।” আত্মগােপনকালীন বড় বড় গোঁফ খালি গায়ে জঙ্গলের যে ছবি কাগজে বেরিয়েছিল তার থেকেও অনেক বড় এক ছবি এঁকে দিল আমেরিকান মেয়ে গ্রে। সে ছবি মিছিলে ও দেওয়ালে ঘুরে বেড়াল ভারতের বহু স্থানে।
চারু মজুদারের উদ্যোগে ‘৬৯ সালের ৮ই ফেব্রুয়ারি কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের নিখিল ভারত কো-অর্ডিনেশন কমিটি ‘পার্টি’ গড়ার সময় হয়েছে বলে এক প্রস্তাব গ্রহণ। করল। প্রস্তাবে বলা হলাে যে, ‘নকশালবাড়ির বিপ্লবী কৃষক সংগ্রাম শুরু করার পর আঠারাে মাসের কিছু বেশি সময়ের মতাে অল্প সময়ের মধ্যেও কো-অর্ডিনেশান কমিটির গুরুত্বপূর্ণ কৃতিত্ব হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীল আদর্শ ও সংশােধনবাদ এবং নয়া সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিরােধ ও কৃষি বিপ্লবের আগুন ছড়িয়ে দেওয়া। ..এই চমৎকার বিপ্লবী পরিস্থিতিতে যখন ভারতের জনগণ শেষ পর্যন্ত বিপ্লবের পথে পা বাড়িয়েছেন তখন সংশােধনবাদী পার্টিগুলােসহ সবকয়টি শাসক পার্টিই সংসদীয় পথে মােহ ছড়িয়ে চলেছে। …বিশেষ উৎসাহের ব্যাপার যে গত এক বছরে আসাম থেকে মহারাষ্ট্র পর্যন্ত বিপ্লবীরা কো-অর্ডিনেশান কমিটির পতাকাতলে সমবেত হয়েছেন এবং কৃষক সংগ্রামের সমস্ত কেন্দ্রগুলাে একের সাথে অপরের যােগসূত্র স্থাপন করেছে কোঅর্ডিনেশান কমিটির মারফতে। …সংশােধনবাদ নয়া-সংশােধনবাদসহ সব রকমের প্রতিক্রিয়াশীলদের বাধা সত্ত্বেও বিপ্লবীদের ক্রমবর্ধমান ঐক্য প্রমাণ করছে যে আমার ভারতের এক বিপ্লবী পার্টি গড়ার পথে প্রধান প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করতে পেরেছি। কো-অর্ডিনেশন কমিটি ভারতে মার্সবাদী-লেনিনবাদী পার্টির গঠন প্রক্রিয়ার ধারায় প্রথম অপরিহার্য সংযােগ কেন্দ্রের কাজটি করেছে।’
“সাথে সাথে এক বছরের অভিজ্ঞতায় একথাও পরিষ্কার বােঝা গেছে যে, দ্রুত বিকশিত বিপ্লবী সংগ্রামের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক প্রয়ােজন কো-অর্ডিনেশান কমিটির দ্বারা পর্যাপ্তভাবে মেটানাে সম্ভব নয়।…পার্টি গঠনের প্রশ্নে পার্টির ভিতরে সংগ্রাম চালানাের প্রয়ােজনকে স্বীকার না করার মধ্যে দিয়ে ভাববাদী বিচ্যুতি দেখা দেয়। সবরকম সুবিধাবাদ, বিরুদ্ধ ঝোঁক এবং অবাঞ্ছিত লােকজনকে শ্রেণি সংগ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে ফেলে তবেই পার্টি গঠন করা উচিত বলে ধারণাটি আধ্যাত্মিক ভাববাদ ছাড়া আর কিছু না। অন্তর্দ্বন্দ্ব ছাড়া, বিপরীতের মধ্যে সংগ্রাম ছাড়া বিশুদ্ধ ও ক্রটিশূন্য পার্টির কোনাে বাস্তব রূপ নেই।…বিপ্লবী ও প্রতিবিপ্লবী আদর্শের মধ্যে পার্টির ভিতরে সংগ্রাম ততদিন ধরেই চলে যতদিন সমাজে শ্রেণির অস্তিত্ব থাকে।…এখনই পার্টি গঠন করা উচিত, যে সমস্ত বিপ্লবীরা সংগ্রাম করে চলেছেন তাদের ভিত্তি হিসেবে গ্রহণ করে। বিপ্লবী কর্মীদের দ্বারা গঠিত এই পার্টি, শ্রেণি সংগ্রামে পােড় খেয়ে শক্তি সঞ্চয় করে ভারতের জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব দিয়ে বিজয়ী করে, সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবে নিয়ে গিয়ে সমাপ্ত করে এবং সাম্রাজ্যবাদ ও সংশােধনবাদের চূড়ান্ত ধ্বংসে সাহায্য করে তার ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালন করবে।”
অভ্যুত্থানের স্বতঃস্ফূর্ততার ঐতিহাসিক সত্য জোর তাগিদ দিচ্ছিল তত্ত্বগত নেতৃত্বের পরিচালকদের কৃতিত্ব ছিল এখানে যে তাঁরা এই তাগিদ অনুভব করতে পারছিলেন, তাই পার্টি গঠন সংক্রান্ত বক্তব্যের মূল সুরটি সঠিকভাবেই বিবৃত হলাে। আবার নেতাদের আঞ্চলিক ও শ্রেণিগত সীমাবদ্ধতা একদেশদর্শীভাবে ‘কেবল কৃষকের জন্য, চীনা বিপ্লবের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে গ্রামাঞ্চলে আঁধার এলাকাই সবকিছু একমাত্র চিন্তা এবং বিপ্লবী রােমাঞ্চকতায় বিপ্লবের সহজ এবং বাধাহীন বিজয়, শত্রুর শক্তি, শত্রু-মিত্রের শ্রেণিসমাবেশ সব একাকার করে একমাত্র আমাদেরই বিপ্লবের নেতৃত্ব দিতে হবে’ ভাবনাটি পার্টি গঠনের বক্তব্যে একটি সীমারেখা শুরু থেকেই টেনে দিচ্ছিল। কো-অর্ডিনেশানের বক্তব্যের মধ্যেই সীমাবদ্ধতার ঐ দিকগুলাে ছিল। যেমন “…ভারতীয় জনগণের বিপ্লবী সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েত সংশােধনবাদ, সামন্তবাদ ও মুতসুদ্দি-আমলাতান্ত্রিক পুঁজির জোয়াল থেকে মুক্তির এক নতুন উচ্চ পর্যায়ে পৌছে গেছে।” যেমন…“ কো-অর্ডিনেশান কমিটির দেওয়া নির্বাচন বয়কটের আওয়াজে সংসদীয় পথের ফাঁপা চেহারায় ও সংশােধনবাদী নয়া-সংশােধনবীদের প্রতিবিপ্লবী চরিত্রের মুখােশ খুলে দিয়েছে;” “গ্রামাঞ্চলে আঁধার গড়ে উঠেছে, “বিপ্লবীদের ঐক্যে প্রতিক্রিয়াশীলরা ফাটল ধরাতে পারেনি”; যেমন “আমাদের সৌভাগ্য যে আমরা এমন একযুগে বাস করছি যখন মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা বিজয়ের পর বিজয় অর্জন করে চলেছে, যখন স্বয়ং চেয়ারম্যান মাও-এর ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত মহান সর্বহারা সাংস্কৃতি বিপ্লব চীনে বিজয় লাভ করেছে এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদের রত্ন ভান্ডারকে সমৃদ্ধ করেছে, যখন চেয়ারম্যান মাও জীবিত আছেন এবং বিশ্ব-সর্বহারা শক্তিকে নেতৃত্ব দিচ্ছেন দুনিয়াব্যাপী সমাজতন্ত্রের পরিপূর্ণ বিজয়ের এই চুড়ান্ত সংগ্রামে।” এই সবকিছুকে স্বতঃসিদ্ধ (absolute) হিসেবে ধরে নিয়ে পার্টি গঠনের আদর্শগত বক্তব্যের মধ্যে শুরু থেকেই এই শর্ত প্রস্তুত করে ফেলেছিলেন চারু মজুমদারের অনুগত সব কয়জন কো-অর্ডিনেশানের নেতৃবৃন্দ আর এর মধ্যে দিয়ে তাত্ত্বিক দিক থেকে একটি অপরিপক্বতার ঝোঁকও প্রকাশ পাচ্ছিল গােড়া থেকেই।
নকশালবাড়ি এলাকায় সন্ত্রাস কমেছে, সাধারণ কৃষক বেশিরভাগই জামিন নিয়ে বেরিয়ে এসেছে জেল থেকে। নির্বাচনি আবহওয়া-যুক্তফ্রন্ট আওয়াজ দিয়েছে— “আমরা ক্ষমতায় আবার এলে কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতালদের জেল থেকে মুক্ত করব।” নির্বাচনের ঠিক আগেরদিন ফুলবাড়ি চা-বাগানের গায়ে বুড়াগঞ্জের দুধা জোতে আত্মগােপণকারী নেতৃস্থানীয় কর্মীকে আদিবাসী আশ্রয়দাত্রী মহিলা বললেন-“কমরেড, কাল তােমার জন্য কিছু চিড়ে আর নুন দেওয়া ফিকা চা রেখে ঘরে তালা দিয়ে ভােরে কিন্তু বেরিয়ে যাব!” কমরেড বলে, “কোথায় যাবে গাে, অত সকালে?” ঘােট জবাব“ভােট দিতে, সকালে না গেলে ভিতরে ঢুকতে দেরি হবে যে গাে!” কমরেড কিছুক্ষণ আগে ভােটবয়কটের বক্তৃতা করে এসেছে কয়েক জায়গায়!
“নির্বাচন বয়কট শ্লোগান নিল না তাে চারুদা?” চারু মজুমদার বলেন-“আরে বাবা, একটা-দুটো জায়গায় না নিলে কি শ্লোগানটা অকেজো হয়ে গেল আর এই এলাকায় তাে কানু, জঙ্গলের মুক্তির প্রশ্ন রয়েছে সেটাকেও নকশালবাড়ি আন্দোলনের অ্যাচিভমেন্ট ধরবে না?”
কো-অর্ডিনেশান কমিটির অধিবেশন সেরে চারু আবার ফিরে এলেন শিলিগুড়িতে। মানসিক উদ্দীপনা শারীরিক যন্ত্রণাকে বুঝতে দিচ্ছে না- ওষুধ খাওয়া নিয়মিতই চলে, কিন্তু ডাক্তারের বিশ্রামের নির্দেশ মানতে পারেন না চারু। যেতে হচ্ছে। রেলে, বাসে। ভারত জুড়েই দাবি- “দেখি না লােকটাকে।” ‘সব জায়গায় তাে যেতে পারব না?” ভাবেন চারু, সহকারী নেই কেউ, যাকে পাঠাবেন। নতুন নতুন কমরেড, কমিউনিস্ট পার্টির পুরানাে কর্মী কতই তাে এসেছেন, নেতৃত্বে রয়েছেন কো-অর্ডিনেশান কমিটির, কিন্তু কেউই কর্মের সূত্রে চারুর পূর্ব পরিচিত নন। সুপরিচিত কমরেডরা কেউ জেলে আর বাইরে গােপনে আছে কিন্তু এদের কাউকেই সারা ভারতের অংশ করা হয়নি তাদের বিভিন্ন জায়গায় সাংগঠনিকভাবে পাঠানাে যাবে না। আমার নিজের লােক চাই’- চারুর এই ধারণা বদ্ধমূল হতে থাকে দিন দিন। “ঠিক আছে, পার্টি তৈরি হলে এরা নেতৃত্বেও থাকবে, আমারও কাজ হবে।” সুপরিচিত পুরানাে কমরেডদের দীর্ঘকাল সংশােধনবাদী পার্টিতে অবস্থানে দোদুল্যমানতা দেখা দিতেই পারে বলে সারা ভারতের কমিটিতেও যেমন নিতে চাননি, আবার রাজ্য কমিটির মিটিং-এ তাদের যােগদানের ব্যাপারেও উৎসাহ দেখাননি। আজ তাদের প্রয়ােজন বােধ করছেন তাঁর চিন্তাভাবনার নিজস্ব ধারাটি থেকে যে ‘বিপ্লব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে আর তা হচ্ছে। আমারই লাইন-এর দ্বারা। এই লাইন চালিয়ে যেতে গেলে কেবল পার্টি করলেই তাে হবে না, এক ঘনিষ্ঠ সহকারীবৃন্দেরও দরকার।’ সরােজ দত্ত মহা উৎসাহী সমর্থক, তরুণদের বলেন—“চারু মজুমদারের কাছে নাড়া বাঁধতে হবে, বুঝলে, যেমন নাড়া বাঁধে গুরুর কাছে সাধকরা!” চারুর এ কথায় খুব উৎসাহ হয় না। শান্ত স্বভাব সুশীতল রায়চৌধুরী সভা পরিচালনায় খুব মুখাপেক্ষী চারু মজুমদারের। “উহুঃ এতেও চলবে না” চারু ভাবতে থাকেন।
দ্বিতীয় যুক্তফ্রন্ট সরকার আসার পর ‘৬৯ সালের এপ্রিল মাসে জেল থেকে ছাড়া পেলেন কানু সান্যাল, জঙ্গল সাঁওতাল প্রভৃতি সকলে। নকশাবাড়ি এলাকায় চলাফেরায় খােলামেলা আবহওয়া এলাে, তবে পুলিশ ক্যাম্প প্রায় সব জায়গাই থেকে গেল। জামিন নেওয়ার সূত্রে বেশ কিছু সংখ্যক কৃষকদের সিপিএম-এর সাথে যােগাযােগ হয়ে গেল, চা-বাগানগুলােতে সিপিএম-এর প্রভাব পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হলাে, একেবারে কট্টরভাবে যে অল্প সংখ্যক চা-শ্রমিক নকশালপন্থি হয়েছিল তাদের অনেকেই কংগ্রেসের ইউনিয়নে গেল।
ছাড়া পেয়ে দেখা করতে গেলে চারু কানুকে কলকাতায় কো-অর্ডিনেশান কমিটির সভায় যােগ দেওয়ার জন্য যেতে বললেন। কানু বললেন- ‘ভদুদা যদি যান তবেই আমি যাব।’ চারু উৎসাহও যেমন দেখালেন না, আপত্তিও করলেন না। কথায় কথায় কামাক্ষ্যা ব্যানার্জীর কথা উঠতে চারু কানুকে বলেছিলেন- “কেবল নেতার প্রতি আকর্ষণের ভিত্তিতে যেকোনাে লােককেই সিরিয়াস কাজের মধ্যে নিলে কী বিপদ দেখলে তাে? এখন বুঝছাে তােমাদের উদ্ধার করে নিয়ে যাওয়ার সময় কেন কামাক্ষ্যাকে আমি বাদ দিতে চেয়েছিলাম।” কানু কিছুক্ষন চুপ করে থেকে বলেন- “কামাক্ষ্যা দার্জিলিং
পৃষ্ঠা: ১৫০
জেলে গিয়ে ভুল স্বীকার করেছে, সে খুব অনুতপ্ত এখন।” চারু হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বলেন- “তােমাকে এর জন্য পরে পস্তাতে হবে দেখে নিও।”
কো-অর্ডিনেশান কমিটির মিটিং-এর তারিখ ছিল পঁচিশে এপ্রিল। নেতৃস্থানীয় কয়েকজন ছাড়া এই মিটিং থেকেই পার্টি গঠন করতে হবে তা কেউ জানতেন না- কানু সান্যালকেও সে কথা জানানাে হয়নি। সকলে কলকাতায় পৌঁছেছিল-মহাত্মা গান্ধী রােডের উপর শিয়ালদাহ স্টেশনের কাছে টাওয়ার লজে সকলের থাকারও ব্যবস্থা। হলাে, সভারও স্থান হলাে ওখানকারই একটি বড় ঘরে। লজের কর্তৃপক্ষ চারু মজুমদার সহ সকলকেই সাধারণ খদ্দের হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন।
প্রথম দিনে অধিবেশনের অনেকটাই ব্যয়িত হলাে পারস্পরিক পরিচয় ও কুশল আদান-প্রদানে। শিব কুমার মিশ্র কানু সান্যালের পিঠ চাপড়িয়ে বললেন-‘চারুর সাথে তােমার মতপার্থক্যের কথা তাহলে ঠিক না। পরিষ্কার বাংলাতেই বললেন মিশ্রজী। সত্যনারায়ণ সিং ইংরেজিতে বললেন –“চারুদা, আপনার জন্য একটা জমিদারের মাথা এনেছি।” বলে ‘সার্চলাইট’ কাগজের একটি দাগ দেওয়া অংশ দেখালেন। তাতে ছিল বিপুল জমির মালিক জমিদার বিজনী সিং-কে খতম করার সংবাদ। বিভিন্ন অঞ্চলের রিপাের্ট শােনার পর সুশীতল রায়চৌধুরীর সভাপতিত্বে চারু মজুমদার প্রস্তাব দিলেন। এই সভা থেকেই পার্টি গঠনের। ইউপি-এর শ্রীনারায়ণ তেওয়ারী প্রস্তাবের বিরােধিতা করলেন এই বলে যে, পার্টি গঠনের এখনও সময় হয়নি। কো-অর্ডিনেশান কমিটিকে আরও কিছুদিন থাকতে হবে বিপ্লবীদের আকৃষ্ট করার জন্য, সে পথ বন্ধ হবে পার্টি গঠন এখনই সেরে ফেললে। তাঁর কথা গৃহীত হলাে না। যে রাজনৈতিক প্রস্তাবের ভিত্তিতে পার্টি গঠিত হতে চলল তা প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হলাে চারু মজুমদার, সরােজ দত্ত ও সত্যনারায়ণ সিং-এর উপর। সাংগঠনিক প্রস্তাব লিখলেন সুশীতল ও শিবকুমার।
কলকাতার কো-অর্ডিনেশান কমিটির আহ্বায়ক শ্যামল নন্দী জানালেন যে তাঁরা আগে থেকেই মে দিবস উপলক্ষ্যে একটি প্রকাশ্য সমাবেশ ডেকেছেন মনুমেন্ট ময়দানে (তখনও পর্যন্ত এই নামই চলছিল); তাতে প্রধান বক্তা হিসেবে তাঁরা কানু সান্যালকে চান। কানু সান্যাল আপত্তি করলেন যে, পাবলিক মিটিং-এ তিনি বলতে পারেন না। চারু কানুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন-“ঠিক আছে, কানুই বক্তৃতা দেবে।” পরে নিজেদের মধ্যে চারু বললেন-“ভালােই হলাে। কানুকে দিয়েই ওপেন মিটিং-এ পার্টি গঠনের কথাটা ডিক্লেয়ার করানাে যাবে। তার এফেক্টও ভালাে হবে।”
চারুর গর্ববােধের যেন সীমা নেই, আর সেই সাথে গভীর আত্মবিশ্বাস। তাঁর স্বপ্ন সফল হচ্ছে তিন বছর আগে তিনি দলিলে লিখেছিলেন পুরানাে সব কিছুকেই ঝেড়ে ফেলে, সংশােধনবাদের সাথে পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটিয়ে বিপ্লবী সংগ্রাম গড়ে তােলা যায়। সেই বিচ্ছেদ সম্পূর্ণ হলাে নতুন পার্টি গঠন দিয়ে। নকশালবাড়ির সংগ্রাম থেকে বিপ্লবী অভ্যুত্থানের যে নয়া ইতিহাস শুরু হয়েছিল তারও দাবি স্বতঃস্ফূর্তভাবেই উঠে আসছিল যে ‘বিপ্লবের একটি বাতিঘর চাই’—সিপিআই (এম-এল) রাজনীতি আর বাস্তব সংগ্রামের মিলনের অবদান রূপেই আবিভূর্ত হলাে। বিশ্ব কমিউনিস্ট আন্দোলনে তথা ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের দশকের পর দশক ধরে যে উত্তরাধিকার প্রথা ও নেতৃত্বের স্বার্থ প্রথার সৃষ্টি হয়েছিল তাকে ভেঙে বিপ্লবী রাজনীতির প্রাধান্যের ভিতর দিয়ে উঠে আসা নতুন নেতৃত্বের দ্বারা গঠিত সিপিআই (এম-এল) এক ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করেছিল।
‘৬৯ সালের সাতাশে এপ্রিলের অধিবেশনে সিপিআই (এম-এল)-এর সাংগঠনিক কমিটি গঠিত হলাে এগারােজন সদস্য নিয়ে, যারা ছিলেন—১। চারু মজুমদার, ২। সুশীতল রায়চৌধুরী, ৩। শিবকুমার মিশ্র, ৪। সরােজ দত্ত, ৫। সত্যনারায়ণ সিং, ৬। আর, পি স্রফ, ৭। কানু সান্যাল, ৮। পঞ্চাদ্রি কৃষ্ণমূর্তি, ৯। চৌধুরী তেজেশ্বর রাও, ১০। এল, আঙ্গু, ১১। সৌরেন বােস।
সাতাশে এপ্রিলেই পার্টি গঠনের তারিখ হলেও সিদ্ধান্ত করা হলাে যে ঐ বছর বাইশে এপ্রিল লেনিনের শতবর্ষ পূর্তি বলে বাইশে এপ্রিলকেই পার্টি গঠনের দিন বলে ঘােষণা করা হবে।
সিপিআই (এম-এল)-এর রাজনৈতিক প্রস্তাবে বলা হলাে যে ভারতীয় জনগণের উপরে চেপে বসে আছে যে চার পর্বত মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, ভারতীয় মুতসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজি ও সামন্তবাদ তাকে উৎখাত করে তবেই মুক্তি আসতে পারে। আধা-ঔপনিবেশিক, আধা সামন্ততান্ত্রিক ভারতীয় সমাজে সাম্রাজ্যবাদের সাথে জনগণের, মুতসুদ্দি ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদের সাথে শ্রমিকশ্রেণির ও সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনগণের মৌলিক দ্বন্দ্বগুলাের মধ্যে সামন্তবাদের সাথে কৃষক জনগণের দ্বন্দ্বই প্রধান দ্বন্দ্ব। জনগণতান্ত্রিক বিপ্লব ভারতীয় বিপ্লবের বর্তমান স্তর যার মূল উপাদান হচ্ছে কৃষি বিপ্লব। সাম্রাজ্যবাদের পরিপূর্ণ পতন ও সমাজতন্ত্রের চূড়ান্ত বিজয়ে এই যুগে, মাও সে-তুঙ-এর এই যুগে সংসদীয় ও প্রকাশ্য গণসংগঠনের দেউলিয়াপনা প্রকাশিত হওয়ায় জনগণের সশস্ত্র সংগ্রাম ও জনযুদ্ধই সংগ্রামের একমাত্র ধরন হিসেবে প্রতিপন্ন হয়েছে এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মূল রূপ একমাত্র গেরিলা যুদ্ধ। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে বরাবরই বিশ্বাসঘাতক বুর্জোয়া নেতৃত্বের সাথে সর্বহারা সাধারণ কর্মীদের দুই লাইনের লড়াই চলে এসেছে, কিন্তু সবসময়েই নেতৃত্বে না চাতুরী দিয়ে আন্তঃপার্টি সংগ্রামকে ধামা চাপা দিয়েছে। সপ্তম কংগ্রেসেও (সিপি-এম গঠিত হওয়া) তেমনই হয়েছে। তাই আজ নতুন ধরনের পার্টি গঠনের প্রয়ােজন হয়ে পড়েছে।
সাংগঠনিক প্রস্তাবে পার্টিকে গােপনে সংগঠন হিসেবে গড়ে তােলা, গ্রামভিত্তিক পার্টি, সদস্য সংগ্রহের মানদণ্ড, গণতান্ত্রিক কেন্দ্রীয়করণ পদ্ধতিতে কঠোর শৃঙ্খলা আরােপের পূর্বে পার্টি সদস্যের গণতান্ত্রিক অধিকার বােধ জাগরুক করা, সঠিক কর্মীনীতি, যাতে ‘রােগ সারিয়ে রােগীকে মুক্ত করার পদ্ধতি নেওয়া যায় প্রভৃতি বিষয় উল্লেখ করা হলাে এবং ঘােষণা করা হলাে যে এটি একটি সশস্ত্র সংগ্রামের পার্টি (A party of armed struggle)।
১লা মে মুনমেন্ট ময়দানে বক্তৃতা মঞ্চে দাঁড়িয়ে পার্টি গঠনের ঘােষণা করলেন কানু সান্যাল। চারু মজুমদার বলেছিলেন- “কানু যেন লিখিত বক্তব্য পড়ে দেয়।” বক্তৃতা লিখলেন অন্যে এবং কানু তা আগে আর না পড়ে বললেন- “যা আছে, ঠিক আছে।” লিখিত বক্তৃতায় ‘প্রিয় নেতা ও শ্রদ্ধেয় কমরেড চারু মজুমদারের দ্বারা মাও সে-তুঙ চিন্তাধারায় শিক্ষার কথা বলা হলাে, কানু সান্যালদের জেল থেকে মুক্তিকে ‘জ্যোতি বসু’ হরেকৃষ্ণ কোঙারদের অনুগ্রহ নয়-বা কোনাে মন্ত্রীর দয়ায় নয়; এটি ঘটেছে ইতিহাসের নিয়মানুযায়ীই বলা হলাে। পার্টি গঠনের ঘােষণাকে বিপুল হাততালি দিয়ে সংবর্ধনা জানালেন কয়েক হাজার শ্রোতা, যাদের বেশিরভাগই ছিলেন তরুণ। লিখিত বক্তৃতায় একথাও বলা হলাে যে, বিভিন্ন ধরনের পেটি বুর্জোয়ার বিপ্লববাদের প্রকাশ হচ্ছে ব্যক্তি অথবা গােষ্ঠীর মাধ্যমে। তাঁরা যাই করুন, একটা জিনিস খুব পরিষ্কার যে বিপ্লবী পার্টির কর্তৃত্বের স্বীকার না করে তারা বিপ্লবী করার প্রধান শর্তকেই অস্বীকার করেছেন, সুতরাং সচেতন বা অচেতনভাবে তারা বিপ্লবী সংগ্রাম এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পথে বাধার সৃষ্টি করেছেন। এটি বিপ্লবী সংগ্রামের মধ্যে একটি প্রতিবিপ্লবী ঝোঁক।
মিটিং-এর জন্য দক্ষিণ কলকাতা থেকে যখন একটি বড় মিছিল আসছিল তখন সিপি (এম)-এর একটি মিছিলও পাশাপাশি চলতে থাকে (সিপিএম-এরও প্যারেড গ্রাউন্ডে জনসভা ছিল) এবং দুই মিছিলে সংঘর্ষ হয়। সঙ্গে সঙ্গে ময়দানের চর্তুদিক ঘিরে রাখা পুলিশ বাহিনী মিটিং স্থলে টিয়ার গ্যাস ছুড়তে থাকে। বেশ কয়েকটি গন্ডগােলের সূচনা হয়। সকলকে ফিরিয়ে এনে মিটিং স্থলে জড়াে করার ক্ষেত্রে কলকাতা কোঅর্ডিনেশান কমিটির ভলান্টিয়াররা খুব কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিলেন। ভলান্টিয়ারদের নেতা হিসেবে শ্যামল নন্দী, মলিন রায়, শিবাংশু মুখার্জীর নাম উল্লেখযােগ্য। মিটিং শেষে কানু সান্যালদের প্রায় টেনেহিঁচড়ে ভলান্টিয়াররা ভিড় পার করে নিয়ে গেল মলিন রায়ের বাড়ি, দক্ষিণ কলকাতায়। সকালে সরােজ দত্ত এসে কানুকে বললেন-‘এই যে কানু, তােমার এই বিবৃতিটা দেশ্বতীতে ছাপা হচ্ছে। বিবৃতিটির শিরােনাম ছিল ‘হিংসার জবাব আমরা হিংসা দিয়েই দেব।’ বিবৃতিতে কলকাতার বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি হওয়া সভার আহত শ্রোতাদের কানু সান্যালের রাতেই দেখতে যাওয়ার এক কাল্পনিক কাহিনি ছিল। দেশ্বতীতে এই বিবৃতি বেরিয়ে যাওয়ার প্রায় সাথে সাথেই কলকাতার অনেক দেওয়ালে লেখা হলাে “হিংসার জবাব আমরা হিংসা দিয়েই দেব।”
জনসভায় কী হলাে না হলাে তা নিয়ে চারু মজুমদারের মাথাব্যথা নেই। দক্ষিণ কলকাতার বাড়িতে দুপুরে বালিশে হেলান দিয়ে ভাবতে থাকেন। চারপাশে সকলে কথা বলে চলেছে। সরােজ দত্ত বলতে থাকেন—‘যুবা, মস্তান সকলেরই মনে দারুণ উত্তেজনা যে পার্টি গঠিত হয়েছে। একটা লাইন ওদের দিয়ে দিলাম কানুর নাম করে যে, ‘হিংসার বদলে হিংসা।’ সিপি (এম)-কে টাইট দেওয়ার একটা কায়দা হলাে।’ চারুর কানে কিছু যায় না। তিনি দেখছেন মুক্তির দিকে এগােনাের পথে বড় একটা কাজ হলাে পার্টি গঠন, ভাবলেন আর কী কী এখনই করতে হবে! হঠাৎ স্বভাবসিদ্ধ তুড়ি মেরে বললেন –“চীনা সাহেবদের কাছে পার্টি গঠনের সমর্থন যত তাড়াতাড়ি হয় নিতে হবে।” খবর ও অনুরােধ পাঠানাের ব্যবস্থা তখনই করে ফেললেন চারু। মে মাসে খবর পেলেও পিকিং রেডিওতে সিপিআই (এম-এল)-এর প্রতি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সমর্থন ঘােষণা করতে দেড় মাস সময় লাগল—’৬৯ সালের ২রা জুলাই এই ঘােষণা করা হয়েছিল। চারু ভালােভাবেই বুঝেছিলেন যে, চীনের পার্টির সমর্থন বিপ্লবীদের, বিশেষ করে তরুণদের সিপিআই (এম-এল)-এর প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট করবে।
চারুর হিসাবে খুব ভুল ছিল না। আগস্টের মধ্যেই মেদিনীপুরের ডেবরাগােপীবল্লভপুর ও বিহারের বহড়াগােড়ায় প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রদের সহযােগিতায় যে কৃষক সংগ্রাম গড়ে উঠেছিল সেখান থেকে অসীম চ্যাটার্জী, সন্তোষ রাণা, ভবদেব মণ্ডল, গুণধর মুর্মু প্রমুখদের নেতৃত্বে সিপিআই (এম-এল)-এ যােগদানের কথা ঘােষণা করলেন। পার্টি গঠনে সংগ্রামের সব এলাকাতেই পূর্ণ উদ্যমে কাজ শুরু হয়। চারু মজুমদারেরও নিজের বক্তব্য ও ধারণা জোর দিয়ে বলার সুযােগ সৃষ্টি হলাে।
তরুণের যে বিদ্রোহ ‘৬৬ সাল থেকে বারবার মাথা চাড়া দিয়ে উঠছিল ‘৬৮ সাল থেকে প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্র বিক্ষোভ দিয়ে তা চীনের পথ ও মাও সে-তুঙ চিন্তাধারার খাতে বইতে শুরু করেছিল। এর পিছনে মধ্যবিত্ত জীবনের উপর অর্থনৈতিক চাপের প্রশ্ন যতই থাক, প্রধানত ছিল ভাবের রাজ্যে আলােড়ন, বিশ্বমানবের মুক্তির প্রশ্নে যুক্তিবাদের এক প্রাবল্য। গতানুগতিক ছাত্র সংগঠনের বাইরে বেরিয়ে বিপ্লবী ছাত্র সংগঠন গড়ার প্রচেষ্টা, ‘৬৯ সালে এসে এরূপ সংগঠনের জন্য কর্মসূচি ও সাংগঠনিক প্রস্তাব তৈরি হলাে। কিন্তু ছাত্র-যুব তরুণদের দলের এতে সন্তুষ্টি নেই। সে তাে চায় পুরানাে চিন্তাভাবনা সংগঠন সব চুরমার করে মহামানবের মুক্তির এক তীর্থক্ষেত্র গড়ে তুলতে। তার পথ সে জানে না, তারপরও তার কাছে স্পষ্ট নেই। নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রাম তরুণদের ভাবরাজ্যে যে নাড়া দিয়েছিল তাতেই তাদের অগ্রণী অংশের মধ্যে মানবমুক্তির পথের দিশা কৃষকের সংগ্রামের মধ্যে পেতে শুরু করেছিল- মেদিনীপুরের সংগ্রাম, পরবর্তীকালে ২৪ পরগনা, নদীয়া ও বিশেষভাবে বীরভূমের কৃষক গেরিলা। সংগ্রামে তরুণরাই এগিয়ে এলাে। সিপিআই (এল-এল) গঠনের ঘােষণা তরুণদের সামনে যেন বিপ্লবের আলােক স্তম্ভ বা লাইট হাউজের উপর থেকে ঘােষণা করল-
‘বন্দরের কাল হলাে শেষ
যাত্রা করাে যাত্রীদল।’
চারু মজুমদারের নামে অভিযােগ ও তীব্র সমালােচনা হয়েছে যে ছাত্র-যুবকদের কলকাতার সমাবেশে প্রথমে অভিনন্দন জানালেন। পরে সমাবেশের সময়ে উত্তর বাংলার প্রতিনিধিদের মারফত চিঠি দিলেন তাতে ছাত্র-যুবকদের নিজস্ব সংগঠন নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে কৃষকদের সাথে একাত্ম হতে গ্রামে যেতে বললেন। প্রশ্ন হলাে ঐ পরিস্থিতিতে তরুণদের নিজ সংগঠনের মধ্যে থেকে গতানুগতিক পদ্ধতি নিতে বললে তারা চারু মজুমদারের কথা শুনত কি?—চারু ছাড়া আর সবাই তাে ঐ উপদেশই দিয়েছিলেন, তাঁদের কথায় কেউ কর্ণপাত করেনি কেন? ‘ছাত্র যুবকদের প্রতি আহ্বানে চারু যখন লিখলেন, “একজন মানুষের জীবনে ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সই হচ্ছে সেই সময় যখন সে সবচেয়ে কঠোর পরিশ্রম করতে পারে, সবচেয়ে বলিষ্ঠভাবে উদ্দীপ্ত হতে পারে, হতে পারে সব থেকে সাহসী আর আদর্শের প্রতি সবচেয়ে নিষ্ঠাবান। আর এই। বয়সেই ভারতের ছাত্র-যুবকদের বাধ্য করা হয় এক জনবিরােধী শিক্ষার অনুশীলন করতে এবং পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে। আমি সত্যিই আনন্দিত হবাে যদি দেখি যে তােমরা বিপ্লবী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়াে পরীক্ষা পাশের নিষ্ফল কাজে শক্তিক্ষয় না করে”-তখন তাঁর কোথা থেকে বিশ্বাস এসেছিল যে অন্যান্য বিজ্ঞজনদের কথায় কান না দিয়ে তাঁর কথাতেই স্কুল-কলেজ ছেড়ে ছেলে-মেয়েরা বিপ্লবে ঝাপিয়ে পড়বে?
‘৬৯ সালের মে মাস থেকে মুশাহারী, শ্রীকাকুলামে ছােট ছােট গেরিলা দলের শ্রেণিশত্রু-খতম অভিযান, গণআদালত গঠন ব্যাপক আকারে শুরু হয়ে গেল। সেপ্টেম্বরের লিবারেশান কাগজে সত্যানারায়ণ সিং লিখলেন- “মুশাহারীর গেরিলারা দেড় মাসের মধ্যেই তিনটি আক্রমণ পরিচালনা করে পাঁচজন শ্রেণিশত্রুকে খতম করেছে, পনেরাে জনকে ঘায়েল করেছে, জমির বন্ধকি কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে। কয়েক লক্ষ টাকার। আমাদের কাজগুলাে থেকে কী উপলব্ধি হচ্ছে? এক শ্রেণিরশত্রুকে। খতম করার সাথে সাথেই রাষ্ট্র অর্থাৎ পুলিশ এসে হাজির হচ্ছে, আমাদের লড়াই তখন রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তির গেরিলাযুদ্ধে চলে যাচ্ছে। আমাদের বর্তমান বিপ্লবী সংগ্রামের লক্ষ্য মুশাহারী অঞ্চল শক্ত বিপ্লবী মুক্ত ঘাঁটি এলাকা গড়ে তােলা। এ কাজ এক এক করে এক একটি জমিদারকে আক্রমণ ও তাকে খতম না করে কি সম্ভব?” কৃষক সংগ্রাম সমিতির নেতৃত্বে বিহারের কয়েকটি অঞ্চল ভূমি বণ্টন কমিটি, গণ আদালত গঠিত হয়েছিল, গ্রাম রক্ষীদল গড়ে উঠেছিল গেরিলা দলের সহযােগিতায় ও নেতৃত্বে।
২৭শে মে কলকাতায় কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির মিটিং সেরে ফেলার পথে সােমপেটা স্টেশনে তাঁকে নিতে আসা ছয়জন সঙ্গীসহ পঞ্চাদ্রী কৃষ্ণমূর্তি গ্রেপ্তার হলেন এবং পুলিশ জঙ্গলের মধ্যে নিয়ে গিয়ে এদের সকলকেই গুলি করে মারল। তখন থেকেই বড় বড় দলের বদলে ১০ থেকে ১৫ জনের গেরিলা দল গঠন করা হলাে এবং আগস্ট মাসের মধ্যেই হত্যাকারী ঐ পুলিশ ক্যাম্পে আক্রমণ করে একজন পুলিশকে খতম করে গেরিলাদল সরে পড়ল। শ্রীকাকুলামের সমতল অঞ্চলেও ছড়িয়ে পড়ল গেরিলা কার্যকলাপ। অন্ধ্রের কৃষ্ণা ও গুন্টুর জেলাতেও সংগ্রাম ছড়াল-তেলেঙ্গনার লড়াই-এর সময়কার লুকিয়ে রাখা এক রাইফেল এসে গেল গেরিলাদের হাতে।
উড়িষ্যার কোরাপুট জেলা সিপি (এম)-এর সময়কার রাজ্য কমিটির সদস্য ডি.বি.এম পট্টনায়ক ও তরুণ উকিল নাগভূষণ পট্টনায়কের নেতৃত্বে খতম অভিযান আরম্ভ হলাে।
‘৬৯ সালের শেষ ভাগ থেকেই কেন্দ্রীয়ভাবে এবং রাজ্যগতভাবে বিহার, উড়িষ্যা, উত্তর প্রদেশ ও পাঞ্জাব সরকার বিভিন্ন এলাকাকে উপদ্রুত এলাকা ঘােষণা করল ও কেন্দ্রীয় তথা রাজ্য সশস্ত্র পুলিশ ক্যাম্প বসাতে শুরু করল। নকশাল আন্দোলনকে রাষ্ট্রশক্তি তাদের পক্ষে বিপদের কারণ বলে স্বীকার করতে বাধ্য হলাে।
আসামের কামরূপ, গােয়ালপাড়া, নলবাড়ি, শিলচরে সংগ্রাম ছড়িয়ে পড়তে লাগল। সংগ্রাম ছড়াল ত্রিপুরায়।
ওদিকে পাঞ্জাবে ও জম্মুকাশ্মীর সীমান্ত অঞ্চলে গেরিলা অ্যাকশান শুরু হলাে— পাঞ্জাবের ঘটনা ইংল্যান্ডের পাঞ্জাবি শ্রমিকদের এতই উৎসাহিত করল যে তারা গুরুমুখী ভাষার নকশাল আন্দোলনের সমর্থনে পত্রিকাও প্রকাশ করতে লেগেছিলেন।
‘৬৯ সালের শেষের দিকে সংগ্রামের যে জোয়ার চলছিল তার একটি গুণগত পরিবর্তিত চরিত্র ছিল নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের চেয়ে গেরিলা দলই এই ক্ষেত্রে ছিল সংগ্রামের প্রধান উদ্যোক্তা, এবং এই সময়ে জমিদারদের ও গ্রামীণ শােষকদের উপর আক্রমণ শােষকশ্রেণিকেও যেন আতঙ্কিত করে দিয়েছিল জনগণের দরদ, সহানুভূতিও তেমন ব্যাপক হয়েছিল। এমনকি জমিদার বাড়িতে সাধারণ ডাকাতিতেও মানুষের উদ্দীপনা সৃষ্টি হচ্ছিল, সংবাদ ছড়িয়ে পড়ছিল চারদিকে— তা সে অন্ধ্রে, পশ্চিম বাংলাতেই হােক আর বিহার, উড়িষ্যা, আসামেই হােক। শাসক শ্রেণির গেল গেল রবঅন্ধে, উড়িষ্যায়, বিহারে সরকারি প্রশাসনের পুলিশি নৃশংসতা ইতঃপূর্বেই ভারতের ইতিহাসে সন্ত্রাসবাদীদের উপর ব্রিটিশের নৃশংসতাকেও ছড়িয়ে গিয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধীকে দিল্লির লােকসভায় শােষক শ্রেণির প্রতিনিধিদের আশ্বাস দিয়ে বলতে হয়েছিল—“অতি শীঘ্রই নকশালদের একেবারে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে।
নকশালদের গ্রেপ্তার করার সাথে সাথে হত্যা করা ছাড়া ওরা আর কোনাে পথ দেখছিল না। ভারতের বিরােধী রাজনৈতিক আন্দোলনে, কমিউনিস্ট আন্দোলনেও ব্রিটিশ থেকে শুরু করে দেশীয় শাসকরা ইতঃপূর্বে কেবল জেলে পুরে ও জেলে মর্যাদা দিয়ে নিশ্চিন্ত থেকেছে যে, এরা যতই সংগ্রাম করুক আইনের শাসনের (Rule of law) বাইরে যাবে না! নকশাল আন্দোলনে তারা বুঝেছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যতিক্রম। এর থেকে বােঝা যায় যে ‘মুক্ত হবে প্রিয় মাতৃভূমি’ আওয়াজ মুখে নিয়ে যে মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রাম তার পিছনে সত্য সত্যই ছিল প্রকৃত এক বিপ্লবী প্রেরণা। এখানেই ছিল আন্দোলন ও সংগ্রামে পুরানাে গতানুগতিকতা থেকে বেরিয়ে আসার তাগিদ, এটিই ছিল নকশাল আন্দোলনের সবচেয়ে বড় বৈশিষ্ট্য।
১৫
মুক্তির দশকে
পার্টি গঠনের পর থেকেই শুরু হয়েছে চারু মজুমদারের আত্মগােপনকারী জীবন। ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় থাকা শরীরের উপর বেশ চাপ দিচ্ছে। বুকে ব্যথা হঠাৎ হঠাৎ হয়, ডাক্তার কাউকে হাতের কাছে থাকতে হয় ইসিজি মাঝে মাঝেই করতে হয়। বেদনা, জ্বালা-যন্ত্রণা উপশমের জন্য পেথিড্রিন ইঞ্জেকশানের মাত্রা দিন দিন বেড়ে যেতে থাকে। চারু বলেন- “একটু ভালাে থাকব, আবার অসুস্থ হবাে, এইভাবেই চলবে!” শরীর নিয়ে তত ভাবনা নেই- ভাবনা যত বিপ্লব নিয়ে। চারু বুঝেছেন সংগ্রামের নতুন ধরন আসছে, পরিস্থিতিটা বুঝতে তেমন ভুল করছেন বলে মনে করছেন না। একটা অহংকারও গড়ে উঠেছে মনের মধ্যে, কারণ পার্টি গঠনের আগে বা গঠনের পরে যারা সরে গেলেন- “তাঁরা পুরানাে সাংগঠনিক কাঠামাের মধ্যে দাঁড়িয়ে প্রকাশ্য গণসংগঠনগুলােরই প্রসার ঘটিয়ে চলতে চাইলেন সেই পুরানাে পদ্ধতিতেই ধাপে ধাপে এগােয়েনাের চিন্তাধারায় তফাত কেবল তত্ত্বটা হচ্ছে বিপ্লবের। তাঁরা যত সৎ-ই হােন, নিষ্ঠাবান হােন, অভ্যুত্থান সে সবকিছু নতুনভাবে করতে চায় সেটিই তারা বুঝলেন না।” বস্তুগতভাবে এবং চিন্তাগত উভয়দিকেই নতুনভাবে ভাবতে হবে এটি চারুই সব থেকে আগে অনুভব করেছিলেন, এটিই ছিল অহংকারেরও কারণ- আর নেতস্থানীয় অন্য সকলের কাছে এটিই ছিল চারুর প্রতি গভীর আনুগত্যের কারণ।
‘৭০ সাল শুরু হতেই চারু আহ্বান জানালেন, “সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত কর।” শ্রীকাকুলামের সংবাদ শুনে লিখলেন- “একেবারে প্রাথমিক পর্যায়ে লাল রাজনৈতিক ক্ষমতার জন্ম হয়েছে। গ্রামাঞ্চলের সংগ্রামী এলাকা নিয়ে কিছুদিন যাবতই তাঁর কতকগুলাে চিন্তাভাবনা মনের মধ্যে গড়ে উঠেছিল। নেতৃস্থানীয়দের মধ্যে কাছাকাছি যাদের পাচ্ছিলেন, তাঁদের কারও সাথেই আলাপ-আলােচনা করে চারুর তৃপ্তি হচ্ছিল না, ‘কেউই যেন অবস্থাটা বুঝতে পারছে না বলে মনে হচ্ছিল তার আবার নিজের ভাবনার বস্তুগত দিকেই যেমন সমস্যার প্রতি অভিজ্ঞতালব্ধ যথেষ্ট জ্ঞানের পরিচয় ছিল তেমনই আবার কল্পনার একপেশে ধারায় নিরবচ্ছিন্নভাবে দ্রুত মুক্তির দিকে এগিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন বাস্তবের সাথে একাকার হয়ে যাচ্ছিল।
পার্টি কর্মীদের কাছে নির্দেশ হিসেবে চারু লিখলেন—“গেরিলা দলগুলাের সংগঠন সম্বন্ধে চরম গােপনীয়তা রাখতে হবে, অ্যাকশান সম্বন্ধেও অনুরূপ গােপনীয়তা রাখতে হবে, কিন্তু শ্রেণি শত্রুর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ জাগিয়ে তােলার জন্য রাজনৈতিক প্রচারের কাজটি আগে করা চাই এবং সেটি পার্টি কমিটির দায়িত্ব। শ্রেণি শত্রু বাছাই-এর কাজে অনেক সময়েই ভুল হয় ঘৃণিত শ্রেণিশত্রুর বিষয়ে যথাসাধ্য গােপ খোঁজখবর করাটাকে অবশ্যদায়িত্ব করে নিতে হবে। একটি শ্রেণিশত্রু খতম হলে, বাইরের লােক। হিসেবে খোজ নিতে হবে গ্রামবাসীদের মনের প্রতিক্রিয়া কী? জমিদার, মহাজন গ্রাম ছেড়ে পালাতে আরম্ভ করলেই গ্রামে কর্তৃত্বের ফাকা (vacuum) অবস্থার সৃষ্টি— এই সময়ে একদিকে যেমন ফসল কেটে নেওয়া, জমি দখলের আওয়াজ দিতে হবে তেমনি গ্রামজীবন সুষ্ঠুভাবে নিয়ন্ত্রণের জন্য বিপ্লবী গ্রাম কমিটি গঠন করতে হবে সকলেরই মত নিয়ে। বিপ্লবী কমিটি ভূমি বণ্টন কমিটি, শিক্ষার প্রসার কমিটি, নারী অধিকার কমিটি প্রভৃতি গঠন করবে এইভাবেই আঞ্চলিকভাবে রাজনৈতিক ক্ষমতা পরিচালনার প্রাথমিক পর্যায়গুলাে শুরু হবে। যত ব্যাপকভাবে গেরিলা অ্যাকশানকে ছড়িয়ে দিতে পারব, শত্রুর ঘেরাও থেকে বাইরে বেরােনােরও তত সুযােগ হবে, শত্রুর শক্তিকে ছড়িয়েও দেওয়া যাবে।” এই নির্দেশের বেশ কিছু বাস্তব রূপ দেখা গেছে ডেবরা, গােপীবল্লভপুরে, মুশাহারী, চম্পারণে, আসাম, ত্রিপুরায়, অন্ধ্রপ্রদেশ, কেরালায় ও পাঞ্জাবে।
‘সত্তরের দশক হবে মুক্তির দশক এই আওয়াজে নতুন করে গণজাগরণ হলাে তরুণদের মধ্যে বেশিরভাগ পশ্চিম বাংলা— তারপর অন্ধ্র, পাঞ্জাব ও কেরালায়। তবে পশ্চিম বাংলাতেই এর রূপ ছিল সর্বাত্মক। কলকাতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণির লােকদের বাসস্থান সমস্যা, নদীয়ায় উদ্বাস্তু সমস্যা বা মধ্যবিত্ত জীবনের অর্থনৈতিক নিরাপত্তার অভাব প্রভৃতি হিসেব নিকেষকে ছাপিয়ে বালিগঞ্জের বড় বাড়ির ছেলেমেয়ে আর বস্তিবাসী সব জায়গা থেকে তরুণদের দল রাস্তায় নেমে এসেছিল। তাদের আক্রমণের লক্ষ হলাে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, ‘মনীষীদের প্রতি চূড়ান্ত অবজ্ঞা। স্কুলের বাড়ি, আসবাবপত্র মাল গাড়িতে আগুন লাগল, ‘মনীষী’ নেতৃবৃন্দের মর্মর মূর্তিগুলাে ধুলােয় লুটিয়ে পড়ল। দেওয়ালে দেওয়ালে লাল, কালাে, নীল কালিতে ‘গ্রামে গ্রামে জোতদার, জমিদার খতম চলছে, চলবে’, ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান ‘চীনের পথ আমাদের পথ’ বড় বড় অক্ষরে লেখা চলতে লাগল। লেখা হলাে “বন্দুকের নল-এর মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক ক্ষমতা জন্মগ্রহণ করে।”
চারুর বিপ্লবী ভাবনার শুরু থেকেই তরুণদের বিপ্লবের কাজে লাগানাের চিন্তা। সেই ‘৬৫ সালেই তিনি তাঁর বিপ্লবের বার্তা গ্রামাঞ্চলে পৌছে দেওয়ার জন্য বেছে নিয়েছিলেন পাঁচটি তরুণকে দীপক, শান্তি, অশােক, পবিত্র আর সিকান্দারকে, ওদের দিয়েই টেনেছিলেন বিড়ি শ্রমিক দুলাল আর রেলকর্মচারীর ছেলে হুসেন মিয়াকে বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ কর্মীদের। তখন থেকেই বারবার চারু বলে এসেছেন- “এরা তাে আমাদের মতাে সমাজ, রাজনীতি, পার্টির রক্ষণশীলতার মধ্য দিয়ে আসনি, বা আসছে না—তাই অনেক মুক্তমন এদের, আমাদের মতাে সবকিছুরই মধ্যে ভালাে আর মন্দের ভাগাভাগি করতে গিয়ে এরা নিষ্ক্রিয়তায় চলে যায় না- সােজাসুজি চ্যালেঞ্জ করে বসে। আজকের দিনে তাে এটা আরও প্রকট।” বিদেশি হিপ্পিদেরও চারু বলতেন—‘পুঁজিবাদী সাংস্কৃতির বিরুদ্ধে এও তাে এক বিদ্রোহ।”
সত্তর দশকের তরুণের বিদ্রোহে চারু মজুমদার বললেন-“এই ঔপনিবেশিক শিক্ষাব্যবস্থা এবং মৎসুদ্দি পুঁজিবাদীদের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত মূর্তিগুলােকে ধ্বংস না করে নতুন বিপ্লবী শিক্ষাব্যবস্থা ও সংস্কৃতি গড়ে তােলা যায় না। কিন্তু এই সংগ্রাম প্রতিক্রিয়াশীল সংস্কৃতির পুরাে উপরিতলটিকে সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস করার কাজ করবে না, যেমন হচ্ছে চীনের সংস্কৃতিক বিপ্লবে আর আমাদের বিপ্লবের এই স্তরে তা করা সম্ভবও। এই সংগ্রাম চলছে কারণ সশস্ত্র কৃষি বিপ্লব আজ বাংলায় আবির্ভূত হয়েছে বাস্তবরূপে। সমাজের ভিতটা নড়বড়ে হয়ে উঠেছে কৃষকের সশস্ত্র বিপ্লবী সংগ্রামের আঘাতে। তাই এই সমাজের উপরের কাঠামােতেও ধাক্কা লাগছে, ভাঙন ধরেছে তাতে স্বাভাবিকভাবেই। কৃষি বিপ্লবের স্বার্থেই আজ ছাত্র-যুবকরা অশান্ত হয়ে উঠেছে, সেই জন্যই তারা সেসব লােকের মূর্তিগুলােকে আঘাত করছে যারা সব সময়ইে কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রামকে শান্তি আর সংস্কারের বাণী শুনিয়ে সংগ্রামের পথ থেকে টেনে আনতে চেয়েছেন। তরুণদের এই সংগ্রাম কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রামেরই অংশ।”
তরুণদের বিদ্রোহ একটি নির্দিষ্ট ছক নিতে শুরু করেছিল পূর্ব পরিকল্পনা ছাড়াই। তা হলাে—(ক) শহরে আলােড়ন সৃষ্টি করে, গ্রামের সংগ্রামের প্রতি সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে গ্রামের কৃষকের সাথে একাত্ম হতে চলে যাওয়া; (খ) ঔপনিবেশিক শিক্ষা, সংস্কৃতির প্রতি প্রবল আঘাত দেওয়া, (গ) রাষ্ট্রের স্তম্ভ পুলিশের উপর হামলা করে ‘লাল সন্ত্রাস সৃষ্টি করা, (ঘ) রাইফেল ছিনিয়ে অস্ত্র সংগ্রহ করা।
চারু মজুমদারেরই অতি প্রিয় কবিতা ‘মৃতুঞ্জয়’-এর ধারা বেয়েই যেন এই তরুণের ‘আমি মৃত্যু চেয়ে বড়’ বলে নিঃশেষে প্রাণবলি দিয়েও নিজের কাজ করে যেতে লাগল। ইতিহাস হয়তাে তার ইচ্ছেমতাে হচ্ছিল না, তবুও সে তাে ইতিহাস সৃষ্টি করতে লাগল! কেউ বলেছেন ‘লুম্পেন সর্বহারার কাজ ছিল এসব!’ কেউ ওয়াগান ব্রেকারদের কেবল দেখলেন। কারা ছিল এই তরুণের দলে? লব্ধপ্রতিষ্ঠ ডাক্তারের ছেলে, শ্রদ্ধেয় বাম রাজনৈতিক নেতার একমাত্র পুত্র, ধনীর দুলালী মেয়ে, ইনঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, প্রেসিডেন্সি, মেডিকেল কলেজের কৃতী ছাত্ররা কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে দাঁড়িয়েছিল মস্তান নামে পরিচিত পাড়ার ত্রাস তরুণ, ‘লুম্পেন’ বলে চিহ্নিত বস্তিবাসী মজুরের ছেলে এবং অনেক ওয়াগান ব্রেকারের সাথে সংগ্রামের সময়ে কেউ কারও চেয়ে কম যায়নি সংগ্রামের সমুদ্রের বিস্তীর্ণ বেলাভূমিতে সবার সমস্ত রকম পারিবারিক পরিচয়ের বাইরে সবারই একটিই মাত্র পরিচয়ে পরিচিত হয়েছিল বিপ্লবী তরুণ। সব কিছু তাে ভেঙে ফেলেছিল এরা! শােষক শ্রেণির প্রতিষ্ঠিত কথাকথিত ন্যায়-নীতিবােধ, ধর্মীয় কুসংস্কার, জাত-পাতের বাঁদরামির সবকিছুই। রেডবুক হাতে নিয়ে বিয়ে করেছে, মতে-মনে মেলেনি, আবার ছেড়েছেও পরস্পরকে; কেউ কেউ তাে কোনাে রকম অনুষ্ঠান না করেই স্বামী-স্ত্রী হিসেবে বসবাস করেছে, চাষির সাথে মদ, হাঁড়িয়া খেয়ে আনন্দ করেছে আবার চাষির সাথে মাঠে সবরকমের কাজ করেছে, কোনাে কোনাে শহরের ছেলে রাজবংশী কিম্বা ওঁরাও চাষির মেয়েকে বিয়েও করেছে।
‘৭০ সালের মার্চ-এপ্রিলে সিপিআই (এম-এল)-এ পক্ষে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় পার্টি শাখা একটি প্রচারপত্র বিলি করল-“প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণি যে শিক্ষাব্যবস্থার প্রচলন করেছে তা মূলত ঔপনিবেশিক। ব্রিটিশ সরকার এই ব্যবস্থার প্রচলন করেছিল
পৃষ্ঠা: ১৬০
দালাল ও দাস মনােবৃত্তির মানুষ তৈরি করার জন্য, তারপর এলাে ‘৪৭ সালের তামাশা। যে জাতি আপসের দ্বারা স্বাধীন হলাে বিশ্বাসঘাতকদের পরিচালনায় সে জাতির শিক্ষাব্যবস্থা কখনই জঙ্গি এবং উপনিবেশবাদ বিরােধী হতে পারে না। মুতসুদ্দি শাসকেরা ঐ শিক্ষা-ব্যবস্থাকেই ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে চারু রেখেছে- যা ছাত্র আর যুবাদের জীবিকা নির্বাহের তাগিদের পেশার আফিমে আচ্ছন্ন করে রেখেছে আর শ্রেণি সংগ্রামের বিরােধিতা করতে শিখিয়েছে। কখনাে কখনাে এই আগল ভেঙে শিক্ষা পদ্ধতির বিরুদ্ধে, সামাজিক অবিচারের বিরুদ্ধে পথে নেমে এসেছে সে কথা ঠিক, কিন্তু তা সংস্কারবাদী সংগঠন ও কলেজ ইউনিয়নের চোরাবালিতে বিলীন হয়ে গেছে। নকশালবাড়ির সংগ্রাম থেকে আরম্ভ করে সিপিআই (এম-এল)-এর নেতৃত্বে কৃষকের মুক্তি সংগ্রাম যখন সমাজের মূলে আঘাত করল, সমাজের উপরের কাঠামাে নড়ে উঠতে লাগল, তখন বিপ্লবী ছাত্র ও যুবাদের কাছে পথের দিশা পরিষ্কার হয়ে গেল।”
সিপিআই (এম-এল) থেকে বাংলার একটি প্রচারপত্রে বলা হলাে—“স্পষ্টই দেখা যাচ্ছে যে শাসকশ্রেণি নির্লজ্জভাবে অতীতের সব ‘মনীষীদের বাণীগুলাে দেওয়ালে, ট্রামে, বাসে, রেডিও, পত্র-পত্রিকা ও সিনেমার মাধ্যমে প্রচার করেছে, জনগণের মনে। বিপ্লব ও সিপিআই (এম-এল) সম্বন্ধে বিদ্বেষ জাগিয়ে তােলার উদ্দেশ্যে। কাজেই আমাদের পক্ষ থেকে ঐসব মনীষীদের বিরুদ্ধে শ্রেণিঘৃণা জাগিয়ে তােলা ছাড়া গত্যন্তর নেই। বিপ্লবী ছাত্র-যুবকেরা যাদের মূর্তি ভাঙছে সেইসব জাতীয় নেতারা হয়তাে মহান ব্যক্তিত্ব ছিলেন, ভারতীয় সংস্কৃতি ও সভ্যতায় এঁদের কিছু কিছু ভূমিকা নিশ্চয়ই, অবশ্যই বিদেশি শক্তির স্বার্থের পক্ষে। কিন্তু প্রত্যেক ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের প্রশ্নটি তাঁর শ্রেণিভিত্তিক বাদ দিয়ে বিচারের সময় এখনও আসেনি।”
চারু মজুমদার ছাত্র-যুবকদের একথাও বললেন যে-“নিজস্ব গণ্ডির মধ্যে থেকে কেবল শহরে অ্যাকশন করলেই হবে না- শ্রমিক এবং গরিব ও মধ্য কৃষকের সাথে একাত্ম হতে না পারলে তােমাদের বিপ্লবী চরিত্র বজায় রাখা কঠিন হবে।”
চারু মজুমদারের বক্তব্যকে তাঁর খুরধার লেখনীতে প্রাঞ্জল করে সরােজ দত্ত লিখলেন –“গণতান্ত্রিক সাংস্কৃতিক বিপ্লব চলেছে নয়া-গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পাশাপাশি। বিপ্লবে কিছু অতিশয় হবেই। অতীতকে ভুলে যাও, অতীতের কবিদেরও ভুলে যাও। নতুন কবিতা আবৃত্তি করাে চারু মজুমদারের স্লোগানগুলাে দিয়ে, তা হচ্ছে আজ অনুশােচনার দিন নয়, আজ আগুনের মতাে জ্বলে ওঠার দিন, ‘সত্তরের দশককে মুক্তির দশকে পরিণত করাে।’ সরােজ দত্ত ব্যাখ্যা দিলেন-“যারা মূর্তি ভাঙছে তারা সবাই সিপিআই (এম-এল)-এর সদস্য নয়। পার্টির ছাত্র, যুবকেরা পার্টির নির্দেশের অপেক্ষা না রেখেই পার্টি লাইন ও জনতার মেজাজ অনুযায়ীই এই আন্দোলন শুরু করেছে যা আজ তরুণদের বিশাল বিদ্রোহের রূপ নিয়েছে। প্রশ্ন উঠতে পারে যে রাজনৈতিক ভাবার্থ বুঝেই কি এরা কাজ করেছে? বিপ্লবী জনগণ সবসময়ে তার কাজের রাজনৈতিক ভাবার্থ বুঝে সংগ্রাম করে না। যাদের মূর্তি যুবকেরা ভাঙছে, তাঁদের অতীতের কার্যকলাপ কি এরা জেনেছে? না, জানেনি। তা সত্ত্বেও এরা ঠিক কাজই করেছে। তারা বিপ্লবের বিজয়ের যুগেই জন্মেছে ও বেড়ে উঠেছে। তারা তাদের বয়ােজ্যেষ্ঠদের মতাে সংশােধনবাদী অতীত থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া যন্ত্রণা ভােগ করতে হয় না যে মূর্তিগুলাের সবদিক ওজন বিচার করবে? তাদের দৃষ্টিও তাে বয়ােজ্যেষ্ঠদের মতাে কুসংস্কারে আচ্ছন্ন নেই।”
চারু, সরােজ বা তরুণেরা ব্রিটিশ প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থা ও ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিতদের মনােভাব নিয়ে খুঁটিনাটি বিচার করে সিদ্ধান্তে আসেননি, কিন্তু ঘটনা তাে সত্যই যে ইংরেজি শিক্ষার মুখ্য ব্যাখ্যাকার লর্ড টি.বি. মেকলে বলেছিলেন-“বর্তমানে আমাদের আপ্রাণ চেষ্টা করতে হবে এমন এক শ্রেণি তৈরি করার যারা আমাদের ও যে কোটি কোটি মানুষদের আমরা শাসন করছি তাদের মধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। এরা এমন এক শ্রেণি হবে যারা রক্তে এবং বর্ণে হবে ভারতীয় আচার-আচরণে, মতেনৈতিকতায় এবং বুদ্ধিবৃত্তিতে হবে ইংরেজ।” এই ইংরেজি শিক্ষিতরাই তাে সাঁওতাল বিদ্রোহ, অন্য কৃষকদের বিদ্রোহের প্রতি চোখ বন্ধ করে রেখেছিলেন— এদের অনেকের সমাজ সংস্কারের কাজগুলাে যে ব্রিটিশের পণ্য অর্থনীতির উৎপাদন ও বিনিময়ের লােকবল জুগিয়েছিল এ বিষয়ে তাে কোনাে সন্দেহ নেই?
অভ্যুত্থানের এই সময়ে বিভিন্ন ঘটনার মধ্যে দেখা গেছে চারু মজুমদারের দূরদর্শিতা ঘটনা বােঝা ও নির্দেশ দেওয়ার যােগ্যতা যা গতানুগতিকতা থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। তার ঘটনা অনুধাবন করার অদ্বিতীয়তার মধ্যে আবার নির্দেশ দেওয়ার ক্ষেত্রে অনেক সময়েই যান্ত্রিকতা বা পরস্পর বিরােধিতার আবির্ভাব হয়েছে। তার সবচেয়ে বড় কারণ ছিল ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের আইনানুগতার মধ্যে দিয়ে আসা চারু মজুমদারের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার অভাব। সামরিক বিষয়গুলােতে চারুর নির্দেশ তার প্রমাণ। পুলিশ, সৈন্যবাহিনীর আক্রমণের সময়ে চারু বললেন-“ফ্যাসিস্ট শক্তির বিরুদ্ধে পালটা গেরিলা আক্রমণ করতে পারলেই ভাড়াটে সৈন্যের মনে ভয় ঢুকিয়ে দেওয়া যাবে।” সামরিক শিক্ষাবিহীন, রাইফেল চালানােতে অপটু ‘গেরিলা’রা এই আক্রমণ করবে কী করে? চারু সামরিক শিক্ষার গুরুত্ব কোনাে সময়েই উপলব্ধি করেননি। ফলে মাও সে-তুঙের সামরিক বক্তব্যের মূলকথা বাদ দিয়ে চারুকে অনুকরণ করতে হয়েছে গেরিলা দলের “তিনটি শৃঙ্খলা নীতি” ও “আটটি মনােযােগ দেওয়ার বিষয়”কে মুখস্ত করার কথা,‘শত্রুকে তার দুর্বল অবস্থায় আক্রমণ কর” প্রভৃতি কথা। অথচ ‘বন্দুক সংগ্রহকে প্রধান রাজনৈতিক কাজ’ বলে আবার ‘রাইফেল এখন রেখে দিয়ে প্রচলিত অস্ত্র ব্যবহার কর, না হলে মানুষের শক্তির চেয়েও অস্ত্রের উপর। নির্ভরশীল হতে হবে’ বলেছেন। এইসব বক্তব্যের মধ্যে যেমন অসাধারণ বাস্তববােধের পরিচয় আছে তেমনি সামরিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে একেবারেই অজ্ঞতার নিদর্শন রয়েছেচারু অনুগামী সমালােচক অথবা প্রথমে অনুগামী ও পরে সমালােচক কেউই সামরিক অজ্ঞতার বাইরে তাে ছিলেনই না, বাস্তব বােধেও আবার ছিলেন চারুর অনেক পিছনে।
সংগ্রামী এলাকার রাজ্য সরকারগুলাে ও কেন্দ্রীয় সরকার ‘৭০ সালের গােড়া থেকেই নকশাল বিপদ’কে রুখার জন্য সশস্ত্র পুলিশ, সিআরপি এমনকি সেনাবাহিনীকেও ব্যবহার করতে শুরু করল। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র দফতর স্পষ্টই ঘােষণা করল- “চম্বল উপত্যকার ডাকাতদের চেয়েও গুরুতর বিপদের এই নকশাল আন্দোলন।” মার্চে যুক্তফ্রন্ট সরকারকে বরখাস্ত করেই রাষ্ট্রপতি শাসন মেদিনীপুরে ইস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার রাইফেলস্ ও সিআরপি সম্মিলিত অভিযান শুরু করল। শ্রীকাকুলামে এক একটি তালুককে উপদ্রুত এলাকা ঘােষণা করে সিআরপি আক্রমণ শুরু করল। নকশালপন্থিদের গ্রেপ্তার করেই গুলি করে মারার এক নতুন সাফাই চালু করা হলাে ‘এনকাউন্টার’। ওরা নাকি পুলিশের সাথে লড়াই করার সময়ে মরেছে। শহর কলকাতায় এভাবে গ্রেপ্তার করা ছেলেদের গাড়িতে নিয়ে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ করে গাড়ি দাঁড় করিয়ে পুলিশ অফিসার বলত—“ছেড়ে দিলাম, যা পালা!” যেই কেউ ছাড়া পেয়ে দৌড়াতে থাকত, অমনি পিছন থেকে গুলি করে মেরে কাগজে খবর দেওয়া হতাে পুলিশের সাথে ‘এনকাউন্টার’।
‘বাঁধন যত শক্ত হয়, ততই বাঁধন ছেড়ার জোয়ার চলতে থাকে’। নতুন নতুন গান সৃষ্টি হয়। নাটকের দল জনবহুল রাস্তায় বিপ্লবী পথনাটিকা দেখিয়েই সরে পড়ে। কবিতায় আসে নতুন ধার।
এই সবগুলােই চারুকে অত্যাচার ও শত্রুর আক্রমণ একেবারে ভুলিয়ে দেয়। বিপ্লবের পথ নিয়ে স্বপ্ন বিলাস আসে চারুর মনে।
চুয়ান্ন বছর বয়সেও দেখায় কত বৃদ্ধ। গাল ভেঙে গেছে, তাই চোখ দুটো আরও বড় দেখায়। খাটের উপর কিল মেরে বলেন- “৭২-এই রিপাবলিক ডিক্লেয়ার করব, সমস্ত ভারত জ্বলে উঠল বলে— তা আমি স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। অসংকোচে ঘােষণা করে দিতে পারেন যে, “আমি বলছি ৭৫ সালে ভারত মুক্ত হয়ে যাবে।”
সরােজ দত্ত আরও এগিয়ে দেন স্বপ্ন-কল্পনাকে। “ক্যাডারদের মধ্যে ক্রমাগত উৎসাহ জাগাতে সবসময়ে বিজয়ের খবর জানিয়ে যেতে হবে। ঘটনাকে বাড়িয়ে বলতে হবে। প্রতিক্রিয়াশীলরা মানুষকে ধোকা দেওয়ার জন্য নিজেদের কাজ বাড়িয়ে বলে, ইয়েলাে জারনালিজম দিয়ে আমাদের কথা বাড়িয়ে বাড়িয়ে কুৎসিত করে দেখায়, আমরাও তার জবাবে রেড জারনালিজম-এ সত্যকার সংগ্রামের কথাও একটু বাড়িয়ে বললে দোষ নেই।” সরােজ দত্ত ঘােষণা করে দেন- “আমাদের লিবারেশন রেডিও শীঘ্রই হবে।” বলেন- ‘পিপলস্ লিবারেশন আর্মি মার্চ করবে, লঙ মার্চ, দেশের এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত পর্যন্ত।
ভাবনার রাজ্যে প্রবল গতি আসে অনেকের মধ্যেই ভাবনার জোয়ারকে স্থায়ী করতে দরকার হতে থাকে চারু মজুমদারের কর্তৃত্বের কথা ঘােষণা করার। এপ্রিল মাসের লিবারেশান পত্রিকায় সৌরেন বােস এক প্রবন্ধ লেখেন অবজারভার ছদ্ম নামে, চারু মজুমদারের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার পক্ষে যুক্তি দিয়ে। যুক্তিটি প্রধানত ছিল যে, ‘বিপ্লবে সৃষ্টিশীল মার্কসবাদ প্রয়ােগের দূরদৃষ্টির ফলে লেনিন, স্টালিন ও মাও সে-তুঙ-এর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই একই কারণে ভারতীয় বিপ্লবের স্বার্থে চারু মজুমদারের কর্তৃত্বসুলভ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা হওয়ার প্রয়ােজন আছে। এই প্রবন্ধ নিয়ে কোনাে মন্তব্য সে সময়ে পার্টির মধ্যে কোথাও হয়নি। এপ্রিলেই পার্টি কংগ্রেসের প্রস্তুতি উপলক্ষ্যে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির মিটিং হয়। তিন দিন ধরে এই মিটিং-এ সুশীতল রায়চৌধুরী কর্তৃক উপস্থিত সাংগঠনিক প্রস্তাব এবং চারু মজুমদার কর্তৃক অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত কর্মসূচি সংক্রান্ত প্রস্তাব নাকচ হয়ে সত্যনারায়ণ সিং, শিবকুমার মিত্র ও সৌরেন বােসের উপর পার্টির কর্মসূচির খসড়া ও সুশীতল রায়চৌধুরী, আর,পি, স্রফ ও সরােজ দত্তের উপর রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রস্তাব প্রস্তুত করার দায়িত্ব দেওয়া হয়।
‘৭০ সালের ১৫ ও ১৬ই মে কলকাতার গার্ডেনরিচ এলাকায় পার্টি কংগ্রেস অনুষ্ঠিত হয়। পশ্চিম বাংলা, বিহার, ইউ পি, আসাম, ত্রিপুরা, অন্ধ, তামিলনাড়, কেরালা, পাঞ্জাব ও জাম্মু-কাশ্মীর থেকে প্রতিনিধিরা কংগ্রেসে যােগ দেন। সুশীতল রায়চৌধুরী, সরােজ দত্ত ও কানু সান্যালকে নিয়ে গঠিত হয় সভাপতিমণ্ডলী।
পার্টির খসড়া কর্মসূচিতে বলা হয় যে- “মুৎসুদ্দি চরিত্রের ভারতীয় বুর্জোয়ারা জাতীয় মুক্তির সংগ্রামকে আপস ও আত্মসমর্পণের পথে নিয়েছিল। মহান অক্টোবর বিপ্লব মার্কসবাদ-লেনিনবাদের আদর্শ ভারতে পৌছালেও নানা সুযােগ সত্ত্বেও ভারতের। কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ মুক্তি সংগ্রাম গড়ে তুলতে পারেনি, জাতীয় আন্দোলনে শ্রমিক শ্রেণির নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠায় তারা অপরাগ হয়েছে; গান্ধীবাদের বিরুদ্ধে আদর্শগত সংগ্রাম করতে অস্বীকার করে। এরা বিপ্লবী কৃষক সংগ্রামের সাথে পার্টিকে একাত্ম করতে অস্বীকার করেছে, চীনা বিপ্লব থেকে শিক্ষা গ্রহণ করেনি। কমিউনিস্ট নেতৃত্ব কংগ্রেস নেতৃত্বের লেজুড়বৃত্তি করেছে। পার্টির নেতারা প্রকৃতপক্ষে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের দালাল। তা সত্ত্বেও পার্টির সাধারণ সদস্য অনেক সংগ্রাম করেছে। অনেক শ্রেণি সংগ্রামে নেতৃত্ব দিয়েছে এবং শ্রমিকশ্রেণির স্বার্থে অনেক প্রাণপাত করেছে।
‘যুদ্ধোত্তর যুগের অভূতপূর্ব বিপ্লবী অভ্যুত্থান দেখে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদীরা কংগ্রেস, লীগ ও সিপিআই-এর দালালদের কাজে লাগায় বিপ্লবী সংগ্রামকে বিপথে পরিচালিত করার জন্য। সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে দেশ বিভাগ করে ১৯৪৭-এ সালে আপসের দ্বারা মেকি স্বাধীনতা। মেকি স্বাধীনতা এই সময়ে মুৎসুদ্দি-আমলাতান্ত্রিক বুর্জোয়া ও বড় জমিদার গােষ্ঠীর শাসক শ্রেণি তাদের সাম্রাজ্যবাদী প্রভুদের সেবা করে চলেছে। বিশ্বস্তভাবে। তারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের কাছে আমাদের দেশ বিকিয়ে দিয়েছে। স্বভাবতই ভারত আজ ঐ সাম্রাজ্যবাদীদের নয়া উপনিবেশে পরিণত হয়েছে।’
খসড়ায় ভারতের মুক্তির পথে প্রধান বাধা হিসেবে বলা হয় চারটি বিশাল পর্বত অর্থাৎ আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদের নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ, সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও মুৎসুদ্দি আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ।
ভারতের জাতি সমস্যায় বলা হয় যে, ‘তথাকথিত জাতীয় সংহতির নামে জনগণের এই শত্রুরা সমস্ত জাতি, জাতীয় এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের অধিকারগুলাে দাবিয়ে রাখছে। কাশ্মীরিদের, নাগা ও মিজোদের আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকারকে অস্বীকার করা হচ্ছে। সমস্ত জাতীয় ভাষাগুলাের সমান অধিকারকে পদদলিত করে এরা জোর করে হিন্দি চাপিয়ে দিচ্ছে।
ভারতীয় সমাজে প্রধান দ্বন্দ্ব হিসেবে বলা হয় যে, অন্য সমস্ত দ্বন্দ্বের মধ্যে সামন্তবাদের সাথে ব্যাপক জনসাধারণের দ্বন্দ্বই প্রধান। রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্রকে বলা হয়। ‘রাষ্ট্রীয় একচেটিয়া পুঁজি (State monopoly capitalism) অর্থাৎ আমলাতান্ত্রিক পুঁজিবাদ।
বলা হয় যে আমেরিকান ও সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদের নির্দেশে ভারতীয় শাষকশ্রেণি পৃথিবীর সর্বত্রই সাম্রাজ্যবাদী হস্তক্ষেপে সাহায্য করেছে এবং চীনের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আবহওয়া জিইয়ে রাখছে। এসবেতেই প্রমাণ হয় যে, আমাদের সমাজ আধা সামন্ততান্ত্রিক অবস্থার সাথে সাথে আধা ঔপনিবেশিকও।
ভারতীয় বিপ্লবের স্তরকে গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলা হয় এবং কৃষি বিপ্লবকেই তার মর্মবস্তু বলা হয়।
‘শ্রমিকশ্রেণিই তার পার্টি সিপিআই (এম-এল)-এর দ্বারা জনগণতান্ত্রিক বিপ্লবে নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠা করবে। শ্রমিক তার অগ্রণী ভূমিকা পালন করবে রাজনৈতিক সমস্যায় সংগ্রাম গড়ে তুলে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে, কৃষকের বিপ্লবী সংগ্রামে। সংহতিমূলক কর্মসূচি নিয়ে এবং নিজের শ্রেণি সচেতন অগ্রণী অংশকে কৃষকের সংগ্রাম সংগঠিত করতে গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে। ভারতীয় মুক্তির পথ জনযুদ্ধের পথ। এক্ষেত্রে গেরিলা যুদ্ধই একমাত্র পারে জনগণের সংগ্রামী উদ্যোগ উন্মুক্ত করতে।
পৃষ্ঠা: ১৬৫
‘বিপ্লবের প্রধান শক্তি শ্রমিকশ্রেণির দ্বারা পরিচালিত কৃষক শ্রমিকশ্রেণি ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের উপর পূর্ণ আস্থা রেখে মধ্যকৃষকের সাথে দৃঢ় মৈত্রীতে আবদ্ধ হবে এবং ধনী কৃষকেরও একটি অংশকে টেনে আনবে (win over) তার দিকে। ধনী কৃষকের এক অতি ক্ষুদ্র অংশই প্রতিক্রিয়ার দিকে যাবে। শহরের মধ্যবিত্ত ও বিপ্লবী বুদ্ধিজীবী বিপ্লবের মিত্রই থাকবে। ছােট এবং মাঝারি বুর্জোয়ারা, ব্যবসায়ী ও বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীরা দোদুল্যমান এবং তারা খুব নির্ভরযােগ্য মিত্র নয়। তা সত্ত্বেও এই সকলের সাথে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার স্বার্থে বিপ্লবের জন্য গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন করতে হবে। কিন্তু এই গণতান্ত্রিক ফ্রন্ট গঠন তখনই সম্ভব যখন শ্রমিক-কৃষক মৈত্রী প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এবং দেশের অন্তত কয়েকটি জায়গায় লাল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
এরপর খসড়ায় জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র বিপ্লব সফল হওয়ার পর কী করবে তার কর্মসূচি দেওয়া হয় যাতে ‘বিদেশি পুঁজির বাজেয়াপ্তকরণ, জমিদারের জমি দখল করে কৃষকদের বিলি করা, কাজের নিরাপত্তা, বেকার ভাতার প্রচলন, সমান কাজে সমান মজুরির ক্ষেত্রে সব বাধার অবসান, বেকারী দূরীকরণ ও জীবনযাপনের জন্য উপযুক্ত বাসস্থান, নয়া গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির প্রচলন, জনগণতান্ত্রিক দেশের উপযুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা পুরানাে ব্যবস্থার অবসান ঘটিয়ে।
‘আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার স্বীকারের মধ্য দিয়ে ঐক্যবদ্ধ ভারত গঠন ও প্রত্যেকটি ভাষার সমানাধিকার দান।’ খসড়ায় বলা হয় যে ‘জনগণের রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতি স্তরে জনগণের বিপ্লবী কাউন্সিল দ্বারা পরিচালিত হবে এবং আন্তর্জাতিক সর্বহারা ও নিপীড়িত জাতিগুলাের সাথে মৈত্রী করতে হবে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পরিচালিত হয়ে।
উপসংহারে বলা হয়—‘মাও সে-তুঙ-এর যুগে ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হচ্ছে- যখন বিশ্ব সাম্রাজ্যবাদ সম্পূর্ণ ধ্বংসের মুখে এগিয়ে চলেছে এবং সমাজতন্ত্র। বিশ্বব্যাপী বিজয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের বিপ্লব মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবেরই অংশ যা চীনে সমাজতন্ত্রকে এবং সর্বহারা একনায়কত্বকে সংহত করে চীনকে বিশ্ববিপ্লবের ভরসামূলক ঘাটি এলাকায় পরিণত করেছে। আমাদের বিপ্লব এমন সময়ে সংঘটিত হচ্ছে যখন মহান গৌরবময় নির্ভুল চীনা পার্টির ঐক্যের এবং বিজয়ের মহান নবম কংগ্রেস আন্তর্জাতিক সর্বহারাকে দারুণভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে। আমাদের বিপ্লব এমন সময়ে সংঘটিত হচ্ছে যখন চেয়ারম্যান মাও ও ভাইস চেয়ারম্যান লিন পি আও-এর নেতৃত্বে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি আন্তর্জাতিক সর্বহারাকে সমগ্র মানব জাতির মুক্তির ঐতিহাসিক দায়িত্ব পালনে নেতৃত্ব দিচ্ছে। আমরা এই মহান আন্তর্জাতিক সর্বহারা বাহিনীরই একটি অংশ।’
রাজনৈতিক সাংগঠনিক প্রস্তাবের মূল কথাগুলাে ছিল—‘সিপিআই (এম-এল) পার্টির আবির্ভাব বিপ্লবী ভারতীয় জনগণেরই বিজয় এবং ভারতের মাটিতে সর্বশক্তিমান চেয়ারম্যান মাও-এর চিন্তাধারার বিজয়। কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম যে ভারতের সর্বত্র বিনা বাধায় ছড়িয়ে পড়বে তা কেবল ঐতিহাসিক সত্যই নয়, বাস্তব ইতিহাসও। আমাদের পার্টিকে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের মধ্যেই গড়ে তুলতে হবে এবং এর উপরই পার্টি আঘাত করার ক্ষমতা নির্ভর করে। আমাদের পার্টির ভিতরের সংগ্রামের ইতিহাস দেখিয়েছে যে মধ্যপন্থাই হচ্ছে সংশােধনবাদের ঘৃণিত অস্ত্র, সর্বশক্তি দিয়ে আমাদের মধ্যপন্থার বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে হবে। মধ্যপন্থা বিপ্লবী রাজনীতিকেই খাটো করে দেয় এবং যােদ্ধাকে আত্মরক্ষাহীন করে ফেলে। যখন সংশােধনবাদকে সারা ভারতে অজেয়। মনে হচ্ছিল তখন কমরেড চারু মজুমদার নকশালবাড়ির সংগ্রাম সংগঠিত করে সঠিকভাবে ভারতীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের চরিত্র বিশ্লেষণ করলেন এবং ভারতের গণতান্ত্রিক বিপ্লবে কৃষকের বিরাট ভূমিকার গুরুত্ব উপলব্ধি করলেন। তিনিই— “রাজনৈতিক ক্ষমতা বন্দুকের নলের মধ্য দিয়েই জন্মগ্রহণ করে”– চেয়ারম্যান মাও-এর মহান শিক্ষা উর্ধ্বে তুলে ধরলেন। কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে পরিচালিত নকশালবাড়ির সংগ্রাম ভারতের সংশােধনবাদের অবসানের সূচনা করল। তাঁর নেতৃত্বেই শ্রীকাকুলাম তথা অন্যান্য স্থানে বিপ্লবের আগুন জ্বলেছে।’
‘কো-অর্ডিনেশানের যুগে দুই লাইনের সংগ্রাম তীব্র হয়ে উঠেছিল নির্বাচন বয়কট, সােভিয়েত সংশােধনবাদকে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বলা নিয়ে এবং অর্থনীতিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রশ্নে। কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বে এই বিষয়গুলাে নিয়ে সংগ্রাম বিপ্লবী কর্মীদের ঐক্য দৃঢ় ও সংহত করেছে এবং মুশাহারী ও লক্ষ্মীমপুর খেরীতে সংগ্রামে ছড়িয়ে পড়তে সাহায্য করেছে। পার্টি গঠনের প্রশ্নেও কো-অর্ডিনেশান কমিটির মধ্যে সংগ্রামের করতে হয়েছে। পার্টি গঠনের পর দুই লাইনের লড়াই নতুন স্তরে পৌছেছে। ভ্রান্ত রাজনীতির বিরুদ্ধে সফল সংগ্রাম কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রামকে এক রাজ্য থেকে আর এক রাজ্যে ছড়িয়ে দিয়ে শ্রমিক শ্রেণি ও মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীদের উদ্বুদ্ধ করেছে।… আমাদের নির্দিষ্টভাবে এই নীতি প্রয়ােগ করতে হবে যে, গেরিলা যুদ্ধই জনগণকে জমায়েত করার একমাত্র পথ এবং উপলব্ধি করতে হবে শ্রেণিশত্রু খতমই (Battle of annihilation) গেরিলাযুদ্ধ ও জনযুদ্ধ আরম্ভ করার আগে শ্রেণিসংগ্রামের উচ্চতর স্তর। এই শ্রেণিশত্রু খতমের লড়াই আমাদের সম্মুখের সমস্যাগুলাের সমাধান। করতে পারে, জনগণের রাজনৈতিক চেতনাকে উচ্চতর পর্যায়ে তুলতে পারে এবং নতুন। ধরনের মানুষ, চেয়ারম্যান মাও-এর যুগের মানুষের আবির্ভাবের অবস্থা প্রস্তুত করতে পারে, যে কষ্ট ও মৃত্যু কোনােটাকেই ভয় পায় না, গণফৌজ গড়ে তােলার অবস্থা ও স্থায়ী ঘাটি এলাকা গঙার অবস্থা প্রস্তুত করতে পারে।…আমাদের পার্টির আওয়াজ ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান, চীনের পথ আমাদের পথ’; আমাদের আওয়াজ ‘চীনের বিরুদ্ধে আগ্রাসী যুদ্ধকে প্রতিরােধ করার এবং আমাদের আওয়াজ ‘৭০ এর দশককে মুক্তির দশকে পরিণত কর’ জনগণের মনে বিশেষত বিপ্লবী যুবকদের মনে সাড়া জাগিয়ে দিয়েছে এবং উগ্রজাতীয়তাবাদ ও সংশােধনবাদের উপর বিজয় অর্জন করে নতুন নতুন জয়ের পথ উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমাদের খতম-এর সংগ্রাম আমাদের দুটি পবিত্র কর্তব্যের মধ্যে যােগসূত্র স্থাপন— তা হচ্ছে আমাদের দেশের এবং জনগণের মুক্তি ও আমাদের আন্তর্জাতিক কাজ স্ৰামাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধের অবসান ঘটানাে এবং নতুন মানুষ তৈরির বস্তুগত ভিত্তি প্রস্তুত করা।
“কাজেই আমাদের পার্টিকে প্রচলিত অস্ত্র যা ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের উদ্যোগ। খুলে দেয় তা ব্যবহার করে খতমের সংগ্রামকে চালিয়ে যেতে হবে এবং নতুন নতুন এলাকায় ছড়িয়ে দিতে হবে।” প্রস্তাবে পার্টির কর্মীদের কাজকে ‘এক এলাকা এক ইউনিট, এক স্কোয়াড’ হিসেবে ভাগ করতে বলা হলাে এবং ভূমিহীন ও গরিব কৃষকদের রাজনৈতিক মান উন্নয়নের জন্য মাও সে-তুঙ-এর উদ্ধৃতি পুস্তক ও তাঁরই ‘তিনটি প্রবন্ধ পড়তে বলা হলাে।
‘সাম্রাজ্যবাদ, সামাজিক-সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় প্রতিক্রিয়াশীল আমাদের উপর হামলা করার পরিকল্পনা করছে বলে বলা হলাে এবং তার প্রতিকার হিসেবে ‘জনগণের গভীরে প্রবেশ করার নির্দেশ দেওয়া হলাে। এ পরিশেষে আহ্বান জানানাে হলাে যে, ‘বিশ্ব রুদ্ধনিশ্বাসে দ্রুতগতিতে চেয়ারম্যান মাও-এর নেতৃত্বে মনুষ্যজাতি চূড়ান্ত মুক্তির দিকে এগিয়ে চলেছে। আমাদের সংগ্রামও অকল্পনীয় গতিতে বিকশিত হয়ে চলেছে। ভারতীয় বিপ্লবের বিজয় পৃথিবীর বুক থেকে। সাম্রাজ্যবাদ ও সাম্রাজ্যবাদী যুদ্ধকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন করে দেবে। আমাদের কমরেডদের সব সময়েই এই মহান দায়িত্বের কথা মনে রেখে আন্তর্জাতিকতার মনােভাবকে জাগিয়ে তুলতে হবে।’
উত্তর প্রদেশ রাজ্য কমিটি রাজ্য সম্মলনে পার্টি কংগ্রেস খসড়া রাজনৈতিক প্রস্তাবের সমালােচনা করে যে বক্তব্য গৃহীত হয় তা আর, এন, উপাধ্যায় পার্টি কংগ্রেসে রাখেন। এঁদের সমালােচনা ছিল, ‘গেরিলা সংগ্রামই একমাত্র ধরন এই বক্তব্যের, নির্বিচারে খতম নীতির, এবং চীন-এর কমিউনিস্ট পার্টির প্রতি আনুগত্যই বিপ্লবীদের সাথে ঐক্যের শর্ত-এর বিরুদ্ধে। সত্যনারায়ণ সিং উত্তর প্রদেশ রাজ্য কমিটির সমালােচনার জবাবে পার্টির খসড়া প্রস্তাবের বক্তব্যের সব সঠিক বলে স্টিয়ারিং কমিটির পক্ষ থেকে বক্তব্য রাখেন।
সৌরেন বােস কর্তৃক চারু মজুমদারের ব্যক্তিগত কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার প্রস্তাবের ক্ষেত্রে অসীম চ্যাটার্জী বলেন যে, কেন্দ্রীয় কমিটি ও চারু মজুমদারের মধ্যে বিরােধ হলে আমি চারু মজুমদারকেই সমর্থন করব।’ কানু স্যানাল বলেন-‘তরাই-এর কৃষক আন্দোলনের রিপাের্টে চারু মজুমদারের নেতৃস্থানীয় ভূমিকার আরও উল্লেখ থাকা উচিত ছিল। এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করে সত্যনারায়ণ সিং বলেন যে, এতে কেন্দ্রীয় কমিটির উপরে ব্যক্তিকে স্থান দেওয়া হবে।’ সুশীতল রায়চৌধুরীর প্রস্তাবের সমালােচনা করে বলেন যে, চারু মজুমদারের নেতৃত্বের ভূমিকাকে অবশ্যই যথেষ্ট গুরত্ব দিতে হবে কিন্তু তা ব্যক্তি কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে নয়। আলােচনায় হস্তক্ষেপ করে চারু মজুমদার বলেন—“এই ধরনের আলােচনাই উচিত না। আমার ভূমিকার উল্লেখ রাজনৈতিক-সাংগঠনিক প্রস্তাবে থাকতে পারে তার চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া ঠিক না।” শিবকুমার মিত্র ও আর,পি, স্রফ এ ধরনের প্রস্তাব গড়ে তােলা উচিত না মনে করেছিলেন।
কংগ্রেসের রাজনৈতিক বাদানুবাদের বাইরে ছিল এক গভীর ভ্রাতৃত্ববােধের আবহাওয়া—স্বেচ্ছাসেবকরা, কয়েকজন কমরেডের পরিবারের মেয়েরা খাবার পরিবেশন করেছিলেন— চারদিক ঠাট্টা তামাশায় শােরগােল। সরােজ দত্তের হাস্যরসাত্মক টিপ্পনি, সত্যনারায়ণ সিং-এর বিরাট বপুর প্রতি চারুর কটাক্ষ একেবারে আসর জমিয়ে রেখেছিলেন। নেতা, প্রতিনিধি, স্বেচ্ছাসেবকের সম্পর্ক সমান সমান, বােধ হয় ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনের কোনাে কংগ্রেসেই এমন হয়নি।
কংগ্রেসের আলােচনার সমাপ্তি ভাষণ দেন চারু মজমুদার রাজনৈতিক-সাংগঠনিক রিপাের্টের ব্যাখ্যা উপলক্ষ্যে। তাঁর বক্তব্যের মূল কথা ছিল—“বিশ্ব পরিস্থিতির দুটি গুরত্বপূর্ণ ঘটনা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ কর্তৃক কম্বােডিয়া আক্রমণ এবং ভিয়েতনাম, লাওস ও কম্বােডিয়ার মুক্তি সংগ্রামীদের ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠন। ভারতের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা সিপিআই (এম-এর)-এর আবির্ভাব এবং সশস্ত্র শ্রেণি সংগ্রামে নেতৃত্ব দান- যা এমন এক দিক ঐতিহাসিক ঘটনা যে একে মুছে ফেলা যায় না।”
তিনি বলেন-“পার্টিকে শক্তিশালী করতে একে দৃঢ়ভাবে ভূমিহীন ও গরিব কৃষকের মধ্যে প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। দুই লাইনের লড়াই পার্টির মধ্যে চালাতে গিয়ে সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে আক্রমণ প্রধান হলেও, মধ্যপন্থা (centrism)-কে চিহ্নিত করতে হবে, যা সংশােধনবাদেরই লুক্কায়িত রূপ।” তাঁর মতে–পার্টিকে দুই লাইনের লড়াই ও মধ্যপন্থার বিরােধের ক্ষেত্রে বিজয়ের দিকে নিতে গেলে ভূমিহীন ও গরিব কষকের সংগ্রামকে তীব্রতর করতে হবে যাতে সে তার পরিচিত প্রচলিত অস্ত্র নিয়ে শ্রেণি শত্রু খতম করতে করতে মুক্ত এলাকা গঠন করতে পারে। তবে মাত্রই তার হাতে উঠবে বন্দুক যা নিয়ে বিশ্বকে চ্যালেঞ্জ করবে।”
চারু মজুমদারের বক্তৃতার পর বিশ জনের কেন্দ্রীয় কমিটি নির্বাচিত হয়। বিহারের কৃষক নেতা রাজকিশাের সিং জমিদারের গুন্ডার হাতে নিহত হওয়ায় তাঁর নামের পরিবর্তে সত্যনারায়ণ সিং অসীম চ্যাটার্জীর নাম প্রস্তাব গ্রহণ করেন। এছাড়া আর সব নাম সহ কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটির উপস্থিত করা তালিকাই গৃহীত হয়। এই তালিকায় ছিল–পশ্চিম বাংলার চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, সরােজ দত্ত, কানু সান্যাল, সৌরেন বােস, সুনীতি ঘােষ ও অসীম চ্যাটার্জী; বিহারের সত্যনারায়ণ সিং ও গুরুবক্স; উত্তর প্রদেশের শিবকুমার মিশ্র এবং মহিন্দর সিং; অন্ধের ভেস্পটাপু সত্যনারায়ণ, আদিবাটলা কৈলাশন, নাগভূষণ পট্টনায়ক ও আপ্পালা, শূরি; তামিলনাড়ুর এল, আপ্প ও কোদনরাম; কেরালার আম্বাডি; জম্মু-কাশ্মীরের আর,পি, স্রফ এবং পাঞ্জাবের সােহল। চারু মজুমদারকে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়।
পরদিন সকালে কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকে বসে পলিটব্যুরাে গঠন করার জন্য। অন্ধের প্রতিনিধিরা আগের দিনই চলে গিয়েছিলেন, পাঞ্জাবের প্রতিনিধি কংগ্রেসে উপস্থিতই হতে পারেননি। সুশীতল রায়চৌধুরী সভাপতিত্বে এই বৈঠকে কতজনকে নিয়ে অর্থাৎ পাঁচজন না সাতজন এই নিয়ে বির্তক ওঠে। তখন সত্যনারায়ণ সিং চারু মজুমদারকে অনুরােধ করেন পলিটব্যুরাে সদস্যের সংখ্যা ও নামের প্রস্তাব দিতে। চারু মজুমদার পাঁচজনের নাম বলেন— চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, শিবকুমার মিশ্র, সত্যনারায়ণ সিং ও সৌরেন বােস। সরােজ দত্ত এতে তীব্র আপত্তি করেন এবং বলেন যে, কেন্দ্রীয় কমিটির নেতৃত্বের কাজকে এগিয়ে নিয়ে যেতে এই পলিটব্যুরাে সক্ষম হবে না। অন্যান্যরা পাঁচজনের কমিটিই চেয়েছিলেন এবং সত্যনারায়ণ সিং ও সৌরেন বােস নিজ নিজ নাম প্রত্যাহার করে নিতে চান সরােজ দত্ত ও অন্য একজনের নামের পরিবর্তে। অবশেষে এই নিয়ে বিতর্কের অবসান করে চারু মজুমদার প্রস্তাব করেন যে, যে এগারােজন নিয়ে কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক কমিটি ছিল তাদের নিয়েই পলিটব্যুরাে হােক। তার মধ্যে অন্ধের পঞ্চাদ্রি নিহত ও তেজেশ্বর জেলে থাকায় ঠিক হলাে যে, অন্ধের কমরেডদের কাছে তাদের প্রতিনিধির নাম চেয়ে পাঠানাে হবে। কারণ নাগভূষণ ও আপ্পালা শূরী উভয়ে নামেই ভেম্পটাপু এবং মল্লিকার্জুনের আপত্তি তাঁরা অগেই জানিয়ে রেখেছিলেন। পলিটব্যুরাে গঠিত হলাে— চারু মজুমদার, সুশীতল রায়চৌধুরী, সরােজ দত্ত, কানু সান্যাল, সৌরেন বােস, সত্যনারয়ণ সিং, শিব কুমার মিশ্র, আর,পি, সুফ, এল, আঞ্জু এবং অন্ধ্রের দুজন।
পৃষ্ঠা: ১৭০
পলিটব্যুরাে সদস্যদের স্বাধীনভাবে কাজ করার জন্য এবং সশস্ত্র সংগ্রাম সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার উদ্দেশ্যে সদস্যদের আঞ্চলিকভাবে দায়িত্ব বণ্টন করা হয়। পশ্চিমাঞ্চলে অর্থাৎ দিল্লি, পাঞ্জাব, জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলের সদস্য-কমিটির আহ্বায়ক হলেন আর,পি, স্রফ; মধ্যাঞ্চল অর্থাৎ উত্তরপ্রদেশে ও বিহার-এর আহ্বায়ক সত্যনারায়ণ সিং, পূর্বাঞ্চল অর্থাৎ পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরার সৌরেন বােস। দক্ষিণাঞ্চলের আহ্বায়ক পরে ঠিক করার কথা হলাে।
কেন্দ্রীয় কমিটির এই বৈঠকে একটি বিষয় নিয়ে আলােচনা হয় যে, চারু মজুমদার অনেক সময়ে কমিটির সাথে পরমার্শ না করেই ব্যক্তিগত অভিমত পার্টির অভিমত হিসাবেই ব্যক্ত করে ফেলেন। পার্টি গঠনের পরপরই ছাত্র-যুব সংগঠনের ক্ষেত্রে এরূপ হয়েছে বলে সত্যনারায়ণ সিং মন্তব্য করেন। চারু মজুমদার বলে যে, সব সময়েই কেন্দ্রীয় কমিটি বা পলিটব্যুরাের সাথে আলােচনা করেই সাধারণ সম্পাদকের অভিমত ব্যক্ত করা উচিত। কিন্তু এমন এক এক পরিস্থিতি আসে যখন বৈঠক ডাকার সময় থাকে না। এসব ক্ষেত্রে উচিত হচ্ছে ব্যক্তির অভিমতকে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব পার্টির বৈঠকে হাজির করে সমর্থন গ্রহণ করা।
বিপ্লবী অভ্যুত্থানের স্বতঃস্ফূর্ততার সামনে মার্কসবাদী আদর্শগত নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার তাগিদে জন্ম হয়েছিল সিপিআই (এম-এল)-এর সেই তাগিদের ঐতিহাসিক গতির ধারা বেয়েই পার্টি কংগ্রেস (কমিউনিস্ট আন্দোলনের ধারাবাহিকতা বজায় রাখার জন্য নাম দেওয়া হয়েছিল অষ্টম কংগ্রেস) অনুষ্ঠিত হয়েছিল। কিন্তু পার্টি গঠন ও তার বর্ধন প্রক্রিয়ার সবটুকু ভিত্তিই ছিল চারু মজুমদারের একেবারে নিজস্ব কল্পিত বিপ্লবের লাইনের উপর, তাই ব্যক্তির প্রাধান্যের প্রশ্ন ও সমষ্টিগত নেতৃত্বের মধ্যে একটি বিরােধ থেকে যাচ্ছিল- এটিই ছিল সিপিআই (এম-এল)-এর স্বসৃষ্ট অন্তর্বিরােধ। তাই বিপ্লবী পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে উঠে আসা প্রশ্নের মীমাংসার পরিবর্তে সিপিআই (এম-এল) নতুন নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করে ফেলেছিল।
‘৭০ সালের জুন মাস থেকেই শ্রীকাকুলামে শুরু হয়েছিল প্রচণ্ড সরকারি আক্রমণ। উত্তর প্রদেশ স্পেশাল আমর্ড পুলিশ ও সিআরপি সম্মিলিত অভিযান চালিয়ে শয়ে শয়ে গিরিজনদের গ্রেপ্তার করল। পুরাে আদিবাসী অঞ্চল ভাগ ভাগ করে ভিয়েতনামের মতাে ‘স্ট্যাটেজিক হ্যামলেট’ গড়ে তুলল, সেখান থেকে বেরিয়ে বিভিন্ন কাজের জন্য লাল, হলুদ কার্ড দেওয়া হতে লাগল এবং সূর্যাস্তের সাথে সাথেই ঘরে ফিরে আসতে বাধ্য করা হতে লাগল। পুলিশ ঘেরাও থেকে বেরিয়ে আসার জন্য বিপ্লবীরা সমতলে খতম অভিযান শুরু করল। কিন্তু গণভিত্তিহীন সম্পূর্ণ অপরিচিত অঞ্চলে নির্বিচার খতম অভিযান অতিদ্রুত তাদের পুলিশের নজরে এনে ফেলল। জুলাই মাসের মধ্যেই ভেম্পটাপু, সত্যনারায়ণ, কৈলাশন, মল্লিকার্জুন, সুব্বারাও পানীগ্রাহী, পঞ্চাদ্রি, নির্মলা নেতৃবৃন্দ পুলিশের হাতে প্রাণ দিলেন, আর গ্রেপ্তারের প্রায় সীমা সংখ্যাই রইল না।
সরকারি আক্রমণের তীব্রতা দেখে চারু মজুমদারের মনে হতে লেগেছে এ হচ্ছে। পরাজিত শত্রুর মরণ কামড়। মাও সে তুঙ-এর ‘৭০-এর ২০শে মে বিবৃতি তার কাছে নিশ্চিত ভবিষ্যত্বণী। মাও-এর বিবৃতিতে ‘বিপ্লবই আজকের দুনিয়ার প্রধান ঝোঁক এবং একটি পার্টি যত ছােটই হােক তা জনগণের হাতে অস্ত্র নিতে উদ্বুদ্ধ করলে জয়লাভ করবেই, বলে যে বক্তব্য ছিল চারু তাকেই একমাত্র রাজনৈতিক লাইন মনে করে বলতে লাগলেন—“ভারতের সর্বত্রই বিপ্লবী পরিস্থিতি এমন যে তিনজনের একটি গেরিলা দল খতম অভিযান চালিয়ে যেকোনাে স্থানেই মুক্তাঞ্চল সৃষ্টি করতে পারে।” এই সময়ে খুব জোর দিয়েই তিনি বলতে লাগলেন যে, গণসংগঠন ও গণআন্দোলনের কোনাে প্রয়ােজ নেই- সেগুলাের একটি কাজ তাে জনগণকে প্রস্তুত করার জন্য, জনগণ তাে প্রস্তুত হয়েই আছে। “এখানে টুক, ওখানে টাক এইভাবেই গেরিলাদের খতম অভিযান চালিয়ে যাও, দেখবে ঢেউ এরপরে ঢেউ এর মতাে জনসমুদ্র (human sea) শত্রুকে গ্রাস করে ফেলবে।”
এই দুশ্চিন্তা চারুর মনে। ‘৭০ সালের মার্চ মাসে থেকে পিকিং রেডিও থেকে চারু মুজমদারের রচনা এবং নকশাল আন্দোলনের খবরাখবর একেবারেই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। চারু ভাবছেন “এটা কেন হলাে?” ইতােমধ্যে তামিলনাড় আপ্পর মারফত সিংহলের মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির নেতা সম্মুখদাশনের লেখা এক সমালােচনামূলক পত্র হাতে এলাে। এতে কোথায় ভারতের ইয়েনান হবে তা নিয়ে পার্টির প্রকাশ্য কাগজে বিবৃতি দিয়ে সরকারকে সচেতন করা, নিজেদের বক্তব্য উপস্থিত করতে পার্লামেন্টকে একেবারেই ব্যবহার না করা, ট্রেড ইউনিয়ন প্রথাকে একেবারেই নাকচ করে শ্রমিক শ্রেণি থেকে বিচ্ছিন্ন হওয়া প্রভৃতি অভিযােগ ছিল সিপিআই (এমএল) ও তার নেতা চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে। পিকিং রেডিওর বিষয়, এই সমালােচনা, সব মিলিয়ে চারু মজুমদার বললেন-“সাহেবদের সাথে যােগাযােগ জরুরি হয়ে পড়ছে।” লােক পাঠালেন যােগাযােগ করতে, চীনের পার্টির পক্ষ থেকে খবর এলাে—“নেতৃস্থানীয় কমরেড পাঠাও নিজেদের দায়িত্বে।” প্রথমে যে দুজনকে পাঠাতে মনস্থ করেছিলেন চারু মজুমদার তার মধ্যে একজন পাসপাের্টই করতে চেষ্টা করলেন না, আর একজন প্রস্তুত হয়েও শেষ পর্যন্ত আটকে গেলেন, ফলে চীনে গেলেন তৃতীয় একজন, অবশ্য তাঁকেও চারু মজুমদার পাসপাের্ট করে রাখতে বলেছিলেন।
‘৭০ এর ২০শে আগস্ট নকশালবাড়ি এলাকায় দলবলসহ গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন কানু সান্যাল। ২৫শে আগস্ট ইউরােপ ঘুর চীনের পথে রওনা হয়ে গেলেন সিপিআই (এম-এল)-এর প্রতিনিধি,—পলিটব্যুরাের একজন সদস্য।
পৃষ্ঠা: ১৭২
১৬
অধ্যায়ের শেষে
‘কী তীব্র গতি বিপ্লবের?’—ভাবছেন চারু। “১৯৭২ সালেই রিপাবলিক ঘােষণা করে দেব, তারপর ১৯৭৫ সালে তাে মুক্তি। মুক্ত ভারতের বুকে দাঁড়িয়ে সারা দুনিয়ার প্রতিক্রিয়াশীলদের চ্যালেঞ্জ জানাব।”–এর থেকে কমিয়ে ভাবা চারুর মধ্যে নেই। “আরে বাবা, এই গতির মুখে পরপর নির্দেশ দিতে গেলে অনেক সময়ে অসংগতিপূর্ণ মনে হতেই পারে! তাতে কী হয়েছে? দেখছ না, শ্রেণি সংগ্রাম সব অসংগতি, সংস্কার, অসমতা ধুয়ে মুছে দিচ্ছে?” চারুর শ্রেণি সংগ্রাম হলাে “শ্রেণিশত্রু খতম অভিযান’।
একটি রেডিও স্টেশনের বড় প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করতে লেগেছেন তিনি। রেডিও মারফত খবরটা কত সহজে একেবারে চারদিকে ছড়িয়ে দেওয়া যায়? পিকিং রেডিও শুনে শুনে এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে চারুর। “একটু আদটু বাড়িয়ে তাে বলতেই হবে! বিপ্লবী অতিকথনে দোষ নেই।” প্রতিনিধিকে চীন যাওয়ার সময়ে তাই বারবার বলে দিয়েছেন-“প্রথমেই গিয়ে সাহেবদের বলবে একটি ওয়েল ইকুইপট রেডিও স্টেশন যেন আমাদের দেওয়া হয়। কোথায় বসবে স্টেশন জিজ্ঞাসা করলে বােল কোথাও জায়গা না পেলে সমুদ্রের বুকে বােটে ঘুরে ঘুরে ব্রডকাস্ট করে বেড়াব।” চারুর বলার ভাবে উত্তেজিত হয়ে সরােজ দত্ত সুব্বারাও পানীগ্রাহী লিখিত—“কমিউনিস্টলম্ মেন কষ্টজীবু লম্” তেলেগু সংগীতটি টেপ করে ফেলেন এবং নিজেই তিনবার—“রেডিও লিবারেশন” বলে রেডিও প্রচার শুরু করার পূর্ব প্রস্তুতি পর্ব সেরে রাখলেন।
সংগ্রামের ধরন, পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন উঠতে লেগেছে পার্টির উপর ও নিচু মহলে। ‘৭০-এর আগস্টেই সুশীতল রায়চৌধুরী মূর্তি ভাঙা, স্কুল পােড়ানােকে উপলক্ষ্য করে এক সমালােচনা-প্রবন্ধ পেশ করলেন পার্টির কাছে। শ্রীকাকুলাম থেকে কর্মীরা জানাচ্ছেন—“শ্রেণিশত্রু খতম অভিযানের মধ্য দিয়ে মুক্ত এলাকা গঠিত হয়ে যাওয়া স্বপ্নবিলাস (utopia) ছাড়া আর কিছু নয়।” মেদিনীপুর থেকে সমালােচনা আসে মৃত্যুভয় তুচ্ছ করে একটার পর একটা খতম অভিযান চালিয়েছি। ব্যাপক গণজাগরণ তাে দূরের কথা, শত্রুর আক্রমণের সামনে আশ্রয়হীন অবস্থায় আজ আমরা ভ্রাম্যমাণ দলে (Roving bands) পরিণত হলাম কেন?” মুশাহারীর সাড়া নেই লক্ষ্মীমপুর খেরী স্তব্ধ। সব শুনে একটিই জবাব দিয়েছেন চারু মজুমদার-“তােমরা পেটি বুর্জোয়া নেতৃত্ব ভূমিহীন ও গরিব কৃষককে নেতৃত্বে আনতে পারনি, তাই এই ধাক্কা খাওয়া। চেয়ারম্যান বলেছেন ধাক্কা খাওয়া ভালাে। শিক্ষা পাওয়া যায়।
‘ভারতীয় বিপ্লবের সমস্যা ও সংকট’ শীর্ষক এক দলিল সুশীতল রায়চৌধুরী পার্টির কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে উপস্থিত করলেন। পার্টি উগ্র বামপন্থার শিকার হয়ে পড়েছে’ এই অভিযােগ করে সুশীতল দলিলে বললেন-‘১৯৬৯ সালে ভারত কর্তৃক চীন আক্রমণের সময় থেকেই ভারতে কমিউনিস্ট পার্টির বহু সদস্য পুরানাে পার্টির নেতৃত্বের জাতীয়তাবাদ ও সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ হয়ে পড়েছিলেন। ফলে আমাদের অধিকাংশই মনে করেছিলেন যে, সশস্ত্র সংগ্রাম আমাদের শুরু করতেই হবে। নকশালবাড়ির কৃষক সংগ্রামের আবির্ভাব সশস্ত্র সংগ্রামের মনােভাবকেও দৃঢ় করল এবং সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামকেও উচ্চ পর্যায়ে তুরে দিল। সারা দেশে কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সংশােধনবাদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করল, গ্রামে চলে গেল কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে এবং একটি সত্যকার কমিউনিস্ট পার্টি গঠনের কাজে সারা ভারতে যােগাযােগ শুরু করেছিল। এই প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই গড়ে উঠল সিপিআই (এম-এল)। এই পার্টির বাইরেও কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বজায় রাখলেন এবং তাঁদের সাথে আমাদের পার্টি বন্ধুত্বমূলক বিরােধের সম্পর্কের কথা বলে রাখল। নকশালবাড়ির সংগ্রামে চীনা পার্টির সমর্থন, সিপিআই (এম-এল)-কে স্বীকৃতি দেওয়া প্রভৃতিতে স্বাভাবিকভাবেই দার্জিলিং জেলার কমিউনিস্ট বিপ্লবীরা সারা ভারতে বিশেষ পরিচিতি লাভ করলেন এবং এই সমস্ত সংগ্রামী বিকাশে কমরেড চারু মজুমদারের নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পার্টির মধ্যেও দ্বিধাহীন স্বীকৃতি লাভ করল।
পার্টি গঠন তথা পার্টি কংগ্রেস সদস্য ও সমর্থকদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ জোগাল, ছাত্র-যুবদের উদ্বুদ্ধ করে তুলল এবং গেরিলা যুদ্ধ আরম্ভ করার অবস্থার সৃষ্টি করল এই কথা বলে সুশীতল রায়চৌধুরী দলিলে উল্লেখ করলেন যে, মাও সে-তুঙ চিন্তাধারাকে বিকশিত করার নামে এই রাজ্যের এক উগ্র বামপন্থি নীতি গ্রহণ করা হচ্ছে। এই নীতির লক্ষণ উল্লেখ করে তিনি দেখালেন যে ৬৮-৬৯ সালেও ‘দেশ্বতী’র প্রবন্ধে বলা হয়েছে যে, ভারতবর্ষের মতাে বিশাল দেশে বিপ্লবী যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য, অথচ হঠাৎ এখন বলা হচ্ছে যে ততটা দীর্ঘস্থায়ী হওয়ার দরকার নেই এবং জ্যোতিষীর মতাে ভবিষ্যদ্বাণী করে বলা হচ্ছে যে, ১৯৭৫ সালেই ভারত শােষণ মুক্ত হয়ে যাবে। ‘শ্রমিক, কৃষক, পেটিবুর্জোয়া এমনকি ছােট এবং মাঝারি বুর্জোয়ারা ভারতীয় জনগণকে বিপুল সংখ্যা’, পার্টি প্রােগ্রামের এই বক্তব্য উল্লেখ করে তিনি বললেন যে, সঠিকভাবেই পার্টি প্রােগ্রামে এই সমস্ত শ্রেণির যুক্তফ্রন্ট গঠনের প্রশ্নে বলা হয়েছে যে, সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক-কৃষকের ঐক্য প্রতিষ্ঠা হলে এবং অন্তত কয়েকটি স্থানে লাল ঘাঁটি এলাকা প্রতিষ্ঠিত হলে এই যুক্তফ্রন্ট গঠিত হবে। কিন্তু এখন হঠাৎ হঠাৎ বলা হচ্ছে যে, ওরা আমাদের সাথে আসতে বাধ্য হবে, তাদের পরােয়া আমার করি না প্রভৃতি। এমনকী প্রায়ই অগ্রপশ্চাৎ না ভেবে এই ধরনের বক্তব্যকে কার্যকরী করতে গিয়ে ব্যবসায়ী, শিক্ষক প্রভৃতিকে খতম করা হচ্ছে।’
তিনি বললেন—‘মাও সে-তুঙ চিন্তাধারা অনুযায়ী কৃষকের সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলতে গেলে জনযুদ্ধের বিভিন্ন দিকগুলাের ক্ষেত্রে কৃষকের উদ্যোগ জাগিয়ে তুলতে হবে। দেম্প্রতী পত্রিকার ১৯৬৭ সালের ১লা আগস্ট সংখ্যায় আমাদের সম্বন্ধে বক্তব্য খুব ভালােভাবেই রাখা হয়েছিল যে, গেরিলাযুদ্ধ মূলত শ্রেণিসংগ্রামের উচ্চতর পর্যায় এবং শ্রেণিসংগ্রাম হচ্ছে অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংগ্রামের সংযুক্ত মােট ফল রাজনীতি প্রচারের সময়ে কৃষক অঞ্চলের কমরেডদের সাধারণ অর্থনৈতিক দাবির প্রশ্নটিকে খাটো করে দেখলে চলবে না। ব্যাপক আন্দোলন না হলে পশ্চাদপদ অংশকে রাজনৈতিকভাবে সচেতন করা যাবে না।’
তিনি দেখান যে এই ধারণাকে অস্বীকার করে যে তাত্ত্বিক যুক্তি উপস্থিত করা হচ্ছে তা হচ্ছে সম্পূর্ণ গােপনভাবে গেরিলা ইউনিট গঠন করতে হবে এবং ‘ষড়যন্ত্রমূলকভাবে তা করতে হবে’, গেরিলা আক্রমণের আগে ব্যাপকভাবে প্রচার কাজ চালানাের প্রয়ােজন নেই’ প্রভৃতি। নকশালবাড়ির সংগ্রামের সময়ে বলা হয়েছিল যে, শ্রেণিসংগ্রাম বিকশিত করতে পার্টি ইউনিট গঠন করতে হবে, এবং সংগ্রাম গড়ে উঠলে এই পার্টি ইউনিটকেই গেরিলা ইউনিটে পরিণত করতে হবে। কিন্তু এখন বলা হচ্ছে গেরিলা ইউনিট ষড়যন্ত্রমূলক (conspiratorial) পদ্ধতিতে গঠন করতে হবে।’
দলিলে সুশীতল রায়চৌধুরী শহরে পার্টির কাজ সম্বন্ধে বলতে গিয়ে বলেন‘আমাদের কর্মসূচিতে আমরা বলছি যে, শ্রমিকশ্রেণি তার নেতৃত্বের দায়িত্ব পালন করবে রাজনৈতিক প্রশ্নে, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক উভয় ক্ষেত্রের, বিপ্লবী শ্রেণিগুলাের প্রতি সংহতিমূলক আন্দোলন করে বিশেষত কৃষকের বিপ্লবী সংগ্রাম সমর্থন জানিয়ে এবং তার সচেতন অগ্রণী অংশকে সশস্ত্র সংগ্রাম সংগঠিত করতে ও নেতৃত্ব দিতে গ্রামাঞ্চলে পাঠিয়ে। এর থেকে এই কৌশলই বেরিয়ে আসে যে, শহরাঞ্চলে শ্রমিকের অংশগ্রহণভিত্তিক সংহতি আন্দোলন; শ্রমিকশ্রেণির মধ্যে ব্যাপক গণকাজ করে তাদের অগ্রণী অংশকে গ্রামে পাঠানাে; নির্বাচিত কর্মীদের দ্বারা দীর্ঘস্থায়ী প্রচার কাজ চালানাের জন্য শহরের গােপন পার্টি সংগঠন তৈরি করা।
কিন্তু কার্যক্ষেত্রে আমাদের দেশে চীনের মতাে দীর্ঘদিন অপেক্ষা করার দরকার নেই’ বলে শহরে লাল সন্ত্রাস সৃষ্টি করাকেই শহরের একমাত্র কাজ হিসেবে গ্রহণ করা হলাে।
পৃষ্ঠা: ১৭৫
পার্টির কর্মসূচি ও কর্মকৌশলকে এড়িয়ে কাজ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবেই পার্টি ও পার্টি কমিটিগুলাের মধ্যে আলােচনা ও পার্টির মধ্যে গণতন্ত্র চালানাে যায় না, ব্যক্তি নেতৃত্বকেই প্রাধান্য দিতে হয়। গণফৌজ গঠিত হয়ে গেল’, ‘কমরেড চারু মজুমদারের লাইন’, ‘কমরেড চারু মজুমদারের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব প্রভৃতি বক্তব্য পার্টির পত্র-পত্রিকার মধ্য দিয়ে পলিটব্যুরাে, রাজ্য কমিটি কারও সাথে আলােচনার দিকে না গিয়ে প্রচলিত করে দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সত্যনারায়ণ সিংহ বিভিন্ন কেন্দ্রীয় কমিটি ও রাজ্য কমিটির সদস্যদের প্রতিবাদ পত্রকে গ্রাহ্যও করা হয়নি। উপরন্তু আপত্তিকারীদের ‘সংশােধনবাদী বা ‘মধ্যপন্থি’ আখ্যা দিয়ে পার্টি কর্মীদের কাছে হেয় প্রতিপন্ন করার হয়েছে।” সুশীতল রায়চৌধুরীর এই দলিল পার্টির মধ্যে প্রচারের কথা বলা হলেও, আসলে প্রচারিত হয়নি। কোনাে কোনাে ক্ষেত্রে দলিল পার্টির মিটিং-এ রাখা হলেও বিস্তারিত আলােচনার আগেই ‘চারু মজুমদারের লাইনের বিরুদ্ধে, সুতরাং নাকচ করা হােক এইভাবেই মনােভাব ব্যক্ত করা হয়েছে।
‘৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সত্যনারায়ণ সিং-এর নেতৃত্বে বিহার রাজ্য কমিটি তাদের সমালােচনামূলক দলিলের উপর কেন্দ্রীয় কমিটির আলােচনার দাবি করলেন। এই দলিলের প্রধান অভিযােগ ছিল পার্টিতে ‘কর্তৃত্ববাদ’ চলেছে এবং শহরের কাজে সুশীতল রায়চৌধুরীর অনুরূপ বক্তব্যই রাখা হলাে। কৃষকের সংগ্রাম ক্ষেত্রে বলা হলাে ‘আমাদের অভিজ্ঞতায় দেখেছি নির্বিচারে ধনী কৃষকদের খতম করা সঠিক নয়। তার মধ্যে অনেকেই সংগ্রামের চাপে আমাদের দিকে চলে এসেছে। আমেরিকা কর্তৃক কম্বােডিয়ায় হস্তক্ষেপকে তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের শুরু বলে পার্টি কংগ্রেসে চারু মজুমদার যে বক্তব্য রেখেছিলেন এই দলিলে মাও সে তুঙ-এর ২০শে মে’-এর বিবৃতি উল্লেখ করে দেখানাে হয় যে, এই বক্তব্য সঠিক নয়। দলিলে এও বলা হয়, সারা ভারতের সর্বত্র বিপ্লবী অবস্থা একই রকম পার্টি নেতৃত্বের এক অংশের এই বক্তব্য অসম বিকাশকেই নাকচ করেছে।
এই দলিলের উপর আলােচনা করতে চারু মজুমদার, সরােজ দত্ত, সত্যনারায়ণ সিং, শিবকুমার মিত্র ও সুশীতল রায়চৌধুরী বসেন। চারু মজুমদার ও সরােজ দত্ত দলিলটিকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করেন। দলিলটিকে সমর্থন করে শিবকুমার ও সুশীতল এবং এরপর থেকেই পশ্চিবাংলার বাইরে পার্টি ভাগ হয়ে যাওয়ার অবস্থার সৃষ্টি হয়।
২৮শে নভেম্বর সিপিআই (এম-এল)-এর প্রতিনিধি ফিরে এলেন চীনের কমিউনিস্ট পার্টির মতামত দিয়ে। চারুর শরীর তখন খুব খারাপ চলছে। প্রায় বুকে ব্যথা হয়। ২৯শে নভেম্বর সন্ধ্যায় চীনের পার্টির বার্তা নিয়ে যখন প্রতিনিধি দেখা করতে গেলেন, তখন চারু মজুমদারকে হাতপাখা দিয়ে বাতাসরত গৃহকর্মী বললেন-“আমাদের উনি বলেছিলেন রাত্রে আমি কেঁপে কেঁপে উঠবাে, ঘুমও ভেঙে যাবে, কারণ আমি অনুভব করছি সে আসছে।” একটু আশ্চর্যই লাগল, এ রকম অলৌকিক ধরন তাে চারুদার আগে ছিল না? যাইহােক,—চারুর তখন আকুল আগ্রহ রেডিও স্টেশানের ব্যাপারটা কী হলাে? সে ব্যাপারটা চীনের নেতারা প্রায় হেসেই উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন- রেডিও স্টেশান তাে বিশাল ব্যাপার, গােপনে পাঠানাে হবে কী করে? আর তােমাদের তাে স্টেশন স্থাপনের কোনাে জায়গাও নেই। ওটাতাে সরকারই নিয়ে নেবে সাথে সাথেই। চারুর এতে বুঝ হয় না, একেবারে আর্তনাদের সুরে বলেন- ‘জাহাজে করে মাদ্রাজের উপকূলে কোথাও তাে পাঠানাে যেত?’-আর্তচিৎকারে বুকে ব্যথা শুরু হয়ে গেল। জল, পাখা নিয়ে সকলে ছুটাছুটি করতে লাগল। সব জিনিসটাই কেমন একটু করুণ মনে হতে লাগল বিদেশ ফেরত পার্টি প্রতিনিধির কাছে। তার অস্বস্তিও লাগছিল সকলের সামনে এইসব গােপন কথাবার্তা বলতে। সরােজ দত্ত বুঝলেন, বললেন-“সংকোচের কোনাে কারণ নেই, সবাই জানে। পার্টির নিচের কমিটিতে ফাংশানের পূর্ণ গণতন্ত্র ও স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে, নিজের নিজের কাজ সব নিজেরাই ঠিক করবে।”—একথা বলে সরােজ দত্ত সংকোচ কাটানাের জন্য বললেন-‘বিদেশ থেকে কী সিগারেট এনেছ দেখি!
চারু একটু সুস্থ হলেন। “চীনের কমরেডরা সমালােচনা করেছেন’ বলতেই চারু বললেন ওসব পরে হবে, সব লিখে দাও।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কেন্দ্রীয় কমিটির পক্ষ থেকে চৌ-এন-লাই ও কাং শেঙ সিপিআই (এম-এল)-এর প্রতিনিধির সাথে আলােচনা করেন ১৯৭০ সালের ২৯শে অক্টোবর। আলােচনার উদ্বোধন করে চৌ-এন-লাই বলেছিলেন- “আমরা তােমাকে স্বাগত জানাই এবং তােমাদের পার্টির গঠনকে অভিনন্দন জানাই। তােমাদের পার্টি সাম্রাজ্যবাদ, সামন্ততন্ত্র, মুৎসুদ্দি, পুঁজিবাদ এবং আধুনিক সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামের মধ্য দিয়ে জন্ম লাভ করেছে।… ভারতের কমরেডদের অবগতির জন্য জানাতে চাই যেন আমার মার্কসবাদ-লেনিনবাদকে আমাদের পার্টিকে সমৃদ্ধ করতে কেমনভাবে ব্যবহার করেছি। আমরা মার্কসবাদ-লেনিনবাদের সর্বজনীন সত্য চীনা বিপ্লবের বিশেষ অবস্থা সাথে খাপ খাওয়ানাের কাজ করেছি। চেয়ারম্যান মাও এই। ক্ষেত্রে সর্বশ্রেষ্ঠ কাজ করেছেন এবং বিরাট বিকাশ সাধন করেছেন।
তাই প্রত্যেকটি ঐতিহাসিক সন্ধিক্ষণে চীনা বিপ্লবের বিভিন্ন মােড়ে চেয়ারম্যান মাও অসাধারণ কৃতিত্বের সাথে চীনা বিপ্লবের বিকাশ, তাকে রক্ষা ও তার ত্রুটি সংশােধনের কাজ করে বিপ্লবের সাধারণ দিশাকে ঠিক পথে পরিচালিত করেছেন। সর্বজনীন সত্য হলেও (মার্কসবাদ-লেনিনবাদ) তাকে যেকোনাে দেশেরই প্রকৃত অবস্থার সাথে যুক্ত হতে হবে, এবং সেটি হতে হবে সেই সেই দেশের বিপ্লবী কমরেডদের বিপ্লবী প্রয়ােগের মধ্য দিয়ে। এইভাবেই এক এক দেশের বিপ্লবী কর্মসূচি রূপ পরিগ্রহ করে। এই ভাবের যে সর্বজনীনতা তা কিন্তু এক দেশ থেকে আর এক দেশে হুবহু আরােপ করা যায় না।” কমরেড চৌ সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের উদাহারণ দিয়ে বলেন-“এই মহান সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লব চীনা বিপ্লবেরই ধারাবাহিক রূপ, সর্বহারার একনায়কত্বের অধীনে যা সংঘটিত হচ্ছে। সর্বহারার একনায়কত্বের সময় ছাড়া এই বিপ্লব করা যায় না। প্রত্যেকটি দেশের বিপ্লবেরই একটি নিজস্ব বৈশিষ্ট্য আছে। তাই বলছি যে ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টির ভূমিকা ভ্রাতৃত্বমূলকই দুটো পার্টি এক নয়, প্রত্যেক পার্টিরই একটি নিজস্ব ঐতিহাসিক বিকাশের দিক রয়েছে।… আমরা মনে করি ভারতীয় বিপ্লবকে ভারতের বামপন্থি কমরেডদের উপরই নির্ভর করতে হবে যারা নিজেদের বিপ্লবী প্রয়ােগের মধ্য দিয়ে নিজেদের নেতৃত্ব প্রস্তুত ও লৌহদৃঢ় করে তুলবেন। তাঁদের এই কাজ অন্য কোনাে পার্টিই তাঁদের হয়ে করতে পারে না। মার্কস, এঙ্গেলস্, লেনিন, স্তালিনের পর বর্তমান সময়ে চেয়ারম্যান মাও মার্কসবাদ- লেনিনবাদের সত্যের উপর নির্ভর করেছেন, উচ্চতম পর্যায়ের নীতিকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন এবং সাম্রাজ্যবাদ, সংশােধনবাদ ও বিশ্ব প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে সংগ্রামের উপর পরিপূর্ণভাবে নির্ভর করে চীনের মতাে এক বিরাট দেশে সর্বহারার বিপ্লবকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। বিশ্বের জনগণ এতে খুশি হয়েছেন এবং চীনের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছেন। কিন্তু আমার যদি এর চেয়ে বেশি করে চেয়ারম্যান মাওকে উপস্থিত করতে চাই তা ঠিক হবে না। যেমন চীনা বিপ্লবের ও চীনা পার্টির প্রতি চেয়ারম্যান মাও-এর অনেক নির্দেশ আমরা যদি ভারতীয় পরিস্থিতিতে চাপিয়ে দিই, তা কিন্তু সঠিক হবে না।… এখন তােমরা যদি বলাে যে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি এবং চেয়ারম্যান মাও তােমাদের পার্টির নেতা তা ঠিক হবে না। স্পষ্টত বলতে গেলে এই ধারণা মাও চিন্তাধারার সাথে খাপ খায় না এবং এই ধারণাকেই চেয়ারম্যান মাও ক্রমাগত বাধা দিয়ে এসেছেন। ১৯৫৭ সালে ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টিগুলাের মস্কো সম্মেলনে চেয়ারম্যান মাও বলেছিলেন, আমরা কোনাে পার্টির পিতৃতন্ত্রের (Patriarch) বিরােধী। এটা কেবল ক্রুশ্চেভের বিরুদ্ধেই নয়, স্তালিনের বিরুদ্ধেও মন্তব্য ছিল। তাঁর জীবদ্দশায় স্তালিন চীনা বিপ্লবের ক্ষেত্রে এমন কিছু নির্দেশ দিয়েছিলেন যা ভুল ছিল। অবশ্য স্তালিন ছিলেন মহান আন্তর্জাতিকতাবাদী কমিউনিস্ট এবং তার গুণাবলি তাঁর ভুলের চেয়ে অনেক বেশি ছিল। কোনাে পার্টির পিতৃতান্ত্রিকতা নিয়ে আমাদের বক্তব্যকে অনেকে সমর্থন করেছিল আবার কেউ কেউ বিরােধিতাও করেছিল। ক্রুশ্চেভের মতাে লােকেরাই বিরােধিতা করেছিল।…সােভিয়েত ইউনিয়ন চেকোস্লোভাকিয়ায় দখলদারী ফৌজ পাঠানাের পর তাদের পিতৃতান্ত্রিক ভূমিকায় মাথা নত করে করে আসছে। সােভিয়েত ইউনিয়ন কর্তৃক চেকোস্লোভাকিয়া দখলের প্রশ্নে দাশগুপ্তর (পরিমল-লেখক) সাথে তােমাদের পার্টিতে এক বিতর্ক ওঠে। তােমরা যা করেছিলে তা ঠিকই ছিল। ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টিগুলাের মধ্যে সম্পর্কের প্রশ্নে এটিই আমাদের বক্তব্য। এই প্রশ্নে চেয়ারম্যান মাও আর একটি বিষয়ের অবতারণা করেছেন তা হচ্ছে কমিউনিস্টদের আন্তর্জাতিক সংগঠন সম্বন্ধে। প্রথম কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল কমিউনিস্ট ইস্তাহার প্রকাশিত হওয়ার পর এবং আরম্ভের দিনগুলােতে কমিউনিস্ট আন্দোলনে উদ্যোগ জুগিয়েছিল, তবে প্রতিটি দেশের শ্রমিকশ্রেণি নিজেদের নেতৃত্ব দেশে দেশে গড়ে তুলেছিল। প্যারি কমিউন্ বিশ্বের প্রথম কমিউনিস্ট-বিপ্লব, কিন্তু তা প্রথম আন্তর্জাতিকের নেতৃত্বে হয়নি। রাশিয়ার সমাজতান্ত্রিক অক্টোবর বিপ্লব বিজয় অর্জন করেছিল দ্বিতীয় কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক সংশােধনবাদী হয়ে যাওয়ার পর, তার ভূমিকা যখন হারিয়ে ফেলে। অক্টোবর বিপ্লবের পর এক নতুন কমিউনিস্ট আন্তর্জাতিক গঠিত হয়েছিল বিশ্ব জুড়ে কমিউনিস্ট আন্দোলন গড়ে তােলার জন্য এবং কমিউনিস্ট আন্দোলনকে সংশােধনবাদ ও সােশ্যাল ডেমােক্র্যাসির কবল থেকে মুক্ত হওয়ায় সাহায্য করার জন্য। এর চেয়ে বেশি করা যায় না এবং আমরা যদি (আন্তর্জাতিককে) এক উচ্চতর পার্টি দ্বারা অন্যান্য সব দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনে নেতৃত্ব করাতে যাই তাহলেই ভুল হবে। তার কারণ এই পৃথিবীটা এত বড় যে এর কোনাে একটি অংশের পক্ষে অন্যান্য অংশের সমস্যা জানা সম্ভব না, তাছাড়া প্রত্যেকটি পার্টিরই তার নিজস্ব ঐতিহাসিক অবস্থা আছে। প্রত্যেক দেশের বিপ্লবের পৃথক স্তর আছে এবং তার চরিত্রের বিভিন্নতা আছে। ভিন্ন ভিন্ন দেশের বিভিন্ন পার্টিই কেবল পারে তার নিজ দেশের নির্দিষ্ট পরিস্থিতির সাথে মাসকাদ- লেনিনবাদের সর্বজনীন সত্যকে মেলাতে।…আধুনিক সংশােধনবাদের বিরুদ্ধে বর্তমান সংগ্রামের ঐতিহাসিক শিক্ষা থেকে আজ প্রয়ােজন যে তােমাদের পার্টি ও আমাদের পার্টি এবং অন্যান্য ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলাে মতামত বিনিময় করুক এবং একে অন্যকে সাহায্য করুক। কিন্তু অনিচ্ছা। সত্ত্বেও যদি এর জন্য একটি আন্তর্জাতিক সংগঠন করতে যাই তবে তা হবে ভুল। অক্টোবর বিপ্লবের যুগের দিনগুলাে থেকে আজকের যুগের প্রভেদ অনেক। আজ পরিস্থিতি ক্রমে ক্রমে জটিলতর হচ্ছে।…ভ্রাতৃপ্রতিম পার্টিগুলাের পরস্পরের সাথে যােগাযােগ সমানে সমানে হওয়া উচিত এবং সমস্ত পার্টিগুলােরই সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতার ও স্বাধীন উদ্যোগের অধিকার থাকা উচিত; এর উপরই বিপ্লবের জয়-পরজায় নির্ভর করে। পৃথিবী আজ বিভিন্ন দেশ ও জাতিতে বিভক্ত। সর্বহারার আন্তর্জাতিকতা সব কমিউনিস্ট পার্টিগুলােরই সাধারণ দিশা হলেও বিপ্লব করার ক্ষেত্রে আমাদের নিজ দেশের বৈশিষ্ট্যগুলাে থেকেই শুরু করতে হবে; জাতীয় চরিত্রকে পুরােপুরি অনুধাবন করতে হবে। একজন নেতা যিনি অন্যান্য দেশের বিপ্লবের নেতৃত্ব দিচ্ছেন তাকে আমার দেশের পার্টির নেতা হিসেবে গ্রহণ করলে দেশের জাতীয় চেতনায় আঘাত করা হবে এবং দেশের শ্রমিকশ্রেণি একে ভালােভাবে নেবে না।…এটি একটি নীতিগত প্রশ্ন।”
চৌ-এন-লাই বলে চলেন -…বিপ্লবের বিজয়ের আগে আমাদের অনেক অভিজ্ঞতা ও শিক্ষা হয়েছে এবং আমরা বহুক্ষেত্রে রাজনৈতিক লাইনের প্রশ্নে বিচ্যুতি করেছি। চেন-তু-শিউর দক্ষিণপন্থি সুবিধাবাদিদের লাইনের জন্য বিপ্লব ব্যর্থ হয়েছিল। কৃষি বিপ্লবের সময়ে আমরা তিন তিনবার বামপন্থি সুবিধাবাদী বিচ্যুতি করেছি। অর্থাৎ আমরা জনগণের ব্যাপক অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলাম।…আমরা কারখানায় শ্রমিকদের কাছে বা স্কুলে ছাত্রদের কাছে যেতে অস্বীকার করেছি; কষ্টসাধ্য সাংগঠনিক কাজে বিমুখ হয়েছি। সাংহাইতে তথাকথিত ঝটিকা সভা সংগঠিত করতাম, বড় শহরগুলােতে উৎসব অর্থাৎ মে দিবস প্রভৃতিতে বড় বড় ব্যানার নিয়ে ছাত্রদের কিছু অগ্রণী অংশকে দিয়ে মিছিল করতাম। প্রথম প্রথম লােক জমত। কিন্তু শীঘ্রই কর্মীরা পরিচিত হয়ে পুলিশের শিকার হয়ে গেল। প্রতিক্রিয়াশীল শাসকশ্রেণি যখন দমনপীড়ন চালাতে লাগল, তখন আমরা গােপন সশস্ত্র দল গঠন করে অত্যাচারী অফিসারদের হত্যা করলাম। এতে প্রথম দিকে লােককে কিছু উদ্বুদ্ধ করা যায়, কিন্তু গণজমায়েতের কাজে এই পদ্ধতি চলে। প্রতিক্রিয়াশীলরা আমাদের চেয়ে অনেকগুণে শক্তিশালী ছিল।”
“প্রথম বিপ্লবের পরজায়ের পর গ্রামাঞ্চলেও এরকম অবস্থা হয়েছিল। তার দুটি চরিত্র ছিল। একটি সশস্ত্র সংগ্রাম- যেখানে জনগণের গভীরে আমরা গেছি, খেতমজুর ও গরিব কৃষকদের খাদ্যের জন্য, মুজরি বৃদ্ধির দাবিতে এবং গেরিলা যুদ্ধের জন্য উদ্বুদ্ধ ও সংগঠিত করেছি। দরকার পড়লে খুব কম সংখ্যক স্থানীয় অত্যাচারীদের খতম করেছি যাদের প্রতি জনগণের ছিল তীব্র ঘৃণা; তবে খতমের আগে জনগণের মতামত নেওয়া হয়েছে এবং জনসভায় তাদের বিচার হয়েছে। জনগণ যখন পুরােপুরি জমায়েত হয়েছে এবং আমাদের ফৌজ যখন অর্জিত অধিকারগুলােকে রক্ষা করতে সাহায্য করেছে তখন জনগণ নিজেরাই জমি ও খাদ্য বিলি করেছেন- গেরিলা ইউনিটগুলাে তখন ছােট থেকে বড় বড় দলে পরিণত হয়েছে। এমন অবস্থাতেই কৃষক আন্দোলন ঢেউ-এর পরে ঢেউ-এর মতাে বেড়ে উঠেছে।… গ্রামাঞ্চালে কাজের আর একটি চরিত্র ছিল অল্পসংখ্যক সশস্ত্র লোেক গ্রামে গিয়ে কয়েকজন জমিদারকে হত্যা করে। প্রথম প্রথম এখানেও লােক জমত কিন্তু জনগণকে আমরা উদ্বুদ্ধ করতাম না, কেবল জমিদার খতমের উপরই নির্ভর করতাম। শীঘ্রই শত্রুসৈন্য এসে যেত, আমাদের অগ্রণী কর্মীর এই দল হয় গ্রেপ্তার হতাে, নয় নিহত হতাে, কিংবা কেউ কেউ পালিয়ে যেত। তাই গ্রামাঞ্চলে সশস্ত্র সংগ্রাম পরিচালনার ক্ষেত্রে পার্টির রাজনৈতিক লাইন, নীতি ও কৌশলই হচ্ছে মূল এবং এও দেখতে হবে যে আমরা জনগণকে জমায়েত করতে পেরেছি কি-না। তাদের উপর নির্ভর করতে পেরেছি কি না। তা না হলে আমাদের দাঁড়ানাের জায়গা থাকে না।… আমরা যদি আত্মসমালােচনা ও অভিজ্ঞতার সারসংকলন করতে অস্বীকার করি তাহলে উগ্র বামপন্থা আরও বেশি করে দেখা দেয়। আমাদের ব্যাপারে তিনটি উগ্র বামপন্থি লাইনের সময়ে এই অবস্থা হয়েছিল, বিশেষত শেষেরটা, যার নেতা ছিল ওয়াং মিঙ্গ। তখন আমরা লংমার্চ করতে বাধ্য হয়েছিলাম। কুওমিনতাং অধিকৃত অঞ্চলে আমাদের তখন শক্তিক্ষয় হয়েছিল শতকরা ১০০ ভাগই, আর ঘাঁটি এলাকায় শতকরা ৯০ ভাগ। আমাদের যেখানে তিন লক্ষ সৈন্যের বাহিনী ছিল, লংমার্চ-এর পর উত্তর শেনসি প্রদেশে আমরা যখন পৌছলাম তখন আমাদের সৈন্য সংখ্যা দাঁড়িয়েছিল তিরিশ হাজারে। শতকার ৯০ ভাগই আমরা হারালাম। ভ্রান্ত লাইন চালাতে থাকলে পার্টি শৃঙ্খলাও ভেঙে পড়ে এবং কেউই পার্টির কথা আর শােনে।”
“…তৃতীয় অস্ত্র বিভিন্ন বিপ্লবী শ্রেণি ও গােষ্ঠীর পার্টির নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট। এ ব্যাপারে ভারতের অবস্থা আমাদের চীনেরই মতাে এবং আমাদের উভয়কেই সাম্রাজ্যবাদ, সামন্তবাদ ও আমলাতান্ত্রিক পুঁজির বিরুদ্ধে লড়াই করতে হবে তাহলে বুঝতে হবে যে আমার বিপ্লবের একই স্তুরে আছি অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তরে।…এটি বুর্জোয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের স্তর হওয়ার ফলে এই স্তরে বুর্জোয়াদের বিলােপসাধন হবে না, শােষণ ব্যবস্থা ও ব্যক্তিগত সম্পত্তিও বিলুপ্ত হবে না। কাজেই বুর্জোয়াদের বিষয়টিকে অনুধাবন করা প্রয়ােজন। বুর্জোয়াদের মধ্যে যেমন জাতীয় বিশ্বাসঘাতকেরা আছে তেমন দেশপ্রেমিকও আছে। তারা তাই দুই ভাগে বিভক্ত। তাদের মধ্যে দেশপ্রেমিকেরা মুসুদ্দিদের মধ্যে থেকে এলেও নিজেদের কলকারখানা যখন করে তখন সাম্রাজ্যবাদের সাথে তাদের বিরােধ দেখা দেয় এবং দেশপ্রেমিক ভাবনা রূপ গ্রহণ করে। তাই আমরা তাদের জাতীয় বুর্জোয়া চরিত্র বলে থাকি। ছােট ও মাঝারি শিল্পের বুর্জোয়াদের একচেটিয়া শিল্পপতিদের সাথে বিরােধ থাকে।…পুরানাে দিনে গ্রামাঞ্চলে সব শিল্পই ছিল ছােট ও মাঝারি। কিন্তু আমরা সবই বাজেয়াপ্ত করেছিলাম নির্বাচারে। আমাদের ভ্রান্ত নীতির ফলে কৃষকেরাও বিক্ষুব্ধ হয়ে গিয়েছিল।… চেয়ারম্যান মাও এই নীতির বিরােধিতা করেন।…জাপ বিরােধী প্রতিরােধ যুদ্ধের সময়ে চীনা বিপ্লব অপরিবর্তিত ছিল। তবে বৈদেশিক আক্রমণ প্রতিরােধ করার জন্য যুক্তফ্রন্টের রূপ পরিবর্তন হলাে।…সমগ্র গণতান্ত্রিক বিপ্লবের সময়গুলাে বিভিন্নভাবে ভাগ হয়, যুক্তফ্রন্ট তদানুযায়ী গড়ে ওঠে।…শ্রমিকদের মধ্যে বামপন্থি, মধ্যপন্থি ও দক্ষিণপন্থি মনােভাব থাকায় শ্রমিক সংগঠনেও যুক্তফ্রন্টের প্রশ্ন থেকে যায়।” আলােচনায় কিছু বিরতির পর চৌ-এন-লাই বিশ্রাম নিতে থাকেন এবং কং শেঙ তখন বক্তব্য রাখেন- তােমরা বলেছ যে তােমাদের পার্টি আমাদের পার্টিকে নেতৃস্থানীয় পার্টি বলে মনে করে এবং চেয়ারম্যান মাওকে তােমাদের চেয়ারম্যান বলে মনে করে। আমরা বারবার বলেছি যে আমরা এই দৃষ্টিভঙ্গির সাথে একমত নই। এটা মমাটেই নম্রতার প্রশ্ন নয়। এটা মার্কসবাদী-লেনিনবাদী নীতির প্রশ্ন। কেবল যখন আমরা দুটি পার্টিকে সমান সমান ভাবতে পারব তখনই পরস্পরের কাছ থেকে শেখার দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে মতামত বিনিময় করতে পারব।” কাং শেঙ বলতে থাকেন—“… আমাদের পার্টির ভারতীয় পরিস্থিতি সম্বন্ধে বিশেষ কিছু জানা নেই। নকশালবাড়ির আন্দোলনের উত্থান ও সিপিআই (এম-এল)-এর গঠন পর্যন্ত আমাদের পার্টির পক্ষে যতখানি সম্ভব আমরা সমর্থন করেছি। আমার মনে হয় কমরেডের [সিপিআই (এমএল)-এর প্রতিনিধির] মনে আছে যে জাতীয় দিবসের দিন-রাতে যখন তিনি চেয়ারম্যান মাও-এর সাথে দেখা করেছিলেন তখন চেয়ারম্যান মাও তাকে বলেছিলেন—তােমাদের পার্টি ভারতের জনগণের আশার প্রতিনিধি। আমাদের পার্টি তােমাদের পার্টি সম্বন্ধে এই মনােভাবই রেখে এসেছে। নকশালবাড়ির আন্দোলনের অব্যবহিত পরেই তােমরা আনুষ্ঠানিক এক মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টি (a formal Marxist-Leninist Party) গঠন করেছিলে; তারপর সেই পার্টি অনেকগুলাে রাজ্যে তার সংগঠন বিস্তার করেছে। তােমাদের পার্টি গঠন বেশি দিন আগে হয়নি বলে এটি একটি নবীন পার্টি এবং এটি এখনও তার শৈশবেই রয়ে গেছে। তাই সংগ্রামের মধ্যে নীতিগত প্রশ্নে এর পক্ষে ভুল এড়ানাে সম্ভব না। সেটা বুঝতে অসুবিধা হয় না।”
“পেটি বুর্জোয়া ও বুর্জোয়া বুদ্ধিজীবীদের সম্বন্ধে বলা হয়েছে সিপিআই (এমএল)-এর বক্তব্য যে সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা শ্রমিক-কৃষক ঐক্য প্রতিষ্ঠার পর এবং দেশব্যাপী লাল রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠিত হলে পরে এই সমস্ত শ্রেণির সাথে যুক্তফ্রন্ট শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে হতে পারে। এই বক্তব্য আমাদের অনুধাবনের অপেক্ষা রাখে। আমাদের অভিজ্ঞতার আলােকে বলা যায় যে এই সমস্যা ‘এক বিভক্ত হয়ে দুই (one divides into two)’-এর দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করা উচিত। পেটি বুর্জোয়ার উপরের স্তরের এক অংশ প্রতিক্রিয়াশীল, কিন্তু অন্য অংশ, বিশেষত শহরাঞ্চলে, বিপ্লবের সাথে থাকতে পারে এবং যখন তােমাদের সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদবিরােধী তখন এই শক্তিকে অবহেলা করা উচিত নয়। আমাদের অভিজ্ঞতায় দেশপ্রেমিক বুদ্ধিজীবীর এক বিরাট অংশের অস্তিত্ব আছে। পশ্চিমী সংবাদ প্রতিষ্ঠানগুলাের সংবাদ থেকে দেখা যাচ্ছে যে এরকম বুদ্ধিজীবীদের সংখ্যা ভারতবর্ষে আছে যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদও সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী।…”
পৃষ্ঠা: ১৮২
“ভারতীয় বিপ্লবের প্রধান মর্মবস্তু কৃষি বিপ্লব। কৃষি বিপ্লব, আমরা মনে করি, রাষ্ট্রক্ষমতা প্রতিষ্ঠতার লড়াই-এর সাথে সংযুক্ত। এই দুটি বিষয় পরস্পরের সাথে যুক্ত এবং একটির থেকে আর একটিকে পৃথক করা যায় না। সুতরাং যদি তােমরা বলবেনা যে ‘কৃষকরা জমির জন্য লড়াই করছে না, তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখলের লড়াই করছে’ তবে, মনে হয়, সেই নীতি তেমন সঠিক হবে না। প্রবন্ধতে আর একটি কথাও উল্লেখ করা হয়েছে। (চারু মজুমদারের লেখা) যে ‘গণআন্দোলন এবং গণসংগঠন প্রকাশ্য ও অর্থনীতিবাদী আন্দোলনের ঝোঁক বাড়িয়ে দেয়। তাই প্রকাশ্য গণআন্দোলন ও গণ সংগঠন গেরিলাযুদ্ধের বিকাশে বাধাস্বরূপ।’ কিন্তু আমাদের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী গণ আন্দোলন ও গণ সংগঠন গেরিলা যুদ্ধের ভিত্তিস্বরূপ, মােটেই বাধার সৃষ্টি করে না। গণআন্দোলন, গণসংগঠন না থাকাটাই গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে বাধাস্বরূপ। এটি তাে নীতিগত প্রশ্ন।”
“লিবারেশান পত্রিকার জুলাই সংখ্যায় প্রকাশিত একটি প্রবন্ধ থেকে আমরা বুঝতে পারলাম আেমাদের পার্টির শ্রেণিশত্রু খতম নীতির প্রকৃত অর্থ। আমরা গেরিলা যুদ্ধ বলতে যা মনে করছি এটি তার থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন। গেরিলা অ্যাকশান সম্বন্ধে কয়েকটি কথা’ এই নামের প্রবন্ধ থেকে আমরা বুঝলাম যে চীনা বিপ্লবের পরাজয়ের দিনে আমরা যা করতাম তােমরা তাই করছ অর্থাৎ ছােট স্কোয়াড দ্বারা গােপনে জমিদার হত্যা। এটি তাে একটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ধরনের সংগঠন—জনগণের ব্যাপক অংশের উপর নির্ভর করা। থেকে ভিন্ন। শুধু ধরনেই নয়, চরিত্রেও এটি প্রকৃত গেরিলা ইউনিট থেকে স্বতন্ত্র। আমরা মনে করি, যে গেরিলা যুদ্ধের পক্ষে জনগণ ও পার্টি সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্নভাবে থাকা বিপজ্জনক।” চৌ এন-লাই মাঝখানে মন্তব্য করেন-“তার অর্থ গেরিলা স্কোয়াড স্থানীয় জনগণ ও স্থানীয় পার্টি সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন।” কাং শেঙ বলতে থাকেন—“আবার প্রবন্ধে এক সূত্র করা হয়েছে যে, যে শ্রেণিরশত্রুর রক্তে হাত লাল করেনি সে কমিউনিস্ট নামের যােগ্য নয়। এটি তাে উপযুক্ত বক্তব্য নয়। এভাবে ভাবতে থাকলে তাে পার্টি সংগঠনের চরিত্রই পালটে যাবে। উপরিউক্ত কারণেই আমরা তােমাদের অনেক প্রবন্ধ প্রকাশ করিনি আর অনেক প্রবন্ধও তাে কমরেড চারু মজুমদারের লেখা নয়।”
“আমাদের মনে হয়েছে যে তােমাদের সাধারণ দিশা ঠিক আছে, কেবল কয়েকটি নীতি (Policy) উপযুক্ত নয় এবং মার্কসবাদ-লেনিনবাদ-মাও চিন্তাধারা সম্মত নয়। কৃষকদের মৌলিক স্বার্থ ও তার কৃষি সংগ্রামকে অগ্রাহ্য করে সশস্ত্র সংগ্রামের কোনাে ভিত্তি থাকে না, তাই তা সফলও হয় না। জনগণের চেতনাকে নিম্ন থেকে উচ্চতর স্তরে সব সময়ে তােলা হয়ে থাকে এবং যখন আমরা মৌলিক স্বার্থ, জনগণের অর্থনৈতিক স্বার্থ থেকে এগােতে শুরু করি তখনই কেবল তাদের চেতনার স্তরকে উন্নত করতে পারি এবং সশস্ত্র সংগ্রামে জমায়েত করতে পারি। জনসাধারণ থেকে নিজেদের বিচ্ছিন্ন রেখে তা কখনই করা যায় না।”
“তােমাদের শহরের কাজকর্ম সম্পর্কে প্রবন্ধতে কিছু বলা হয়নি। তােমরা প্রবন্ধে বলেছ যে চীনের সর্বহারা সাংস্কৃতিক বিপ্লবের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সমস্ত গণসংগঠনের পরিবর্তন করতে হবে। তােমাদের এ রকম অনুকরণ-প্রবৃত্তি ঠিক নয়। তােমাদের প্রবন্ধগুলাে থেকে দেখতে পাচ্ছি যে তােমাদের পার্টির ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকলাপ সম্বন্ধে কোনাে সক্রিয় মনােভাব নেই। এই সময়ে চৌ-এন-লাই যােগ দেন—“তােমরা বলেছ যে ট্রেড ইউনিয়নের কাজ আত্মরক্ষামূলক এবং অর্থনীতিবাদী। শুধু পার্টি সংগঠনই কেবল আক্রমণাত্মক ও জঙ্গি। এভাবে এই দুটিকে পরস্পরের মুখােমুখি দাঁড় করানাে উচিত না। তােমরা মনে করেছ যে ছােট ছােট গােপন স্কোয়াড দ্বারা গুপ্তহত্যা আক্রমণাত্মক কাজ আর ব্যাপক মানুষের অর্থনৈতিক সংগ্রাম আত্মরক্ষামূলক। প্রশ্নটি আমাদের অনুধাবনের অপেক্ষা রাখছে এবং এটি একটি নীতিগত প্রশ্ন।”
এরপর আবার কাং শেঙ বলেন-“আর একটি সমস্যা আছে তা হচ্ছে মাঝারি কৃষকদের প্রতি মনােভাবের প্রশ্নে। বলা হচ্ছে যে মাঝারি কৃষকের গােপন গেরিলা কাজকর্মে যােগ দেওয়া উচিত না। আমাদের মনে হচ্ছে ভারতের মাকর্সবাদীলেনিনবাদী পার্টি এখনও পর্যন্ত কৃষি সংগ্রাম ও গেরিলা যুদ্ধের মধ্যেকার সম্পর্কের প্রশ্নটির সমাধান করে উঠতে পারেনি।… যখন আমাদের কমরেডরা এই প্রতিনিধি কমরেডকে জিজ্ঞাসা করল যে তােমরা জমি বিলির কাজ কীভাবে করলে? তােমাদের নির্দিষ্ট ভূমিনীতি কিছু আছে? উনি তখন জবাব দিয়েছিলেন যে, আমরা এখনও এ কাজ শুরু করিনি। কারণ এখন পর্যন্ত আমাদের কোথাও রাজনৈতিক ক্ষমতা ও সৈন্যবাহিনী নেই।’ এভাবে কী করে হবে? প্রথমে তাে আমাদের একটি ভূমিনীতি ঠিক করতে হবে যার ভিত্তিতে কৃষককে জমায়েত করব, তারপর সশস্ত্র বাহিনী তৈরি হবে রাজনৈতিক ক্ষমতা দখলের প্রশ্নে। তাছাড়া তাে সব উলটো প্রক্রিয়া (Reverse process)’। এটিও আর একটি বিষয় যার অনুধাবন প্রয়ােজন।”
“…সম্প্রতি অক্টোবর মাসে ‘হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ড’ পত্রিকার একটি সংখ্যায় দেখলাম মার্কসবাদী-লেনিনবাদী পার্টির চেয়ারম্যান বলেছেন-‘আমরা যদি ভুল করি আমাদের তা শুধরানাের চেষ্টা করতে হবে কারণ ভ্রান্ত রাজনৈতিক চিন্তা ও কার্যপদ্ধতি বিপ্লবী কাজের শত্রু। আমাদের এগুলাে বাড়তে দেওয়া উচিত না। তাই একথা যদি বলে থাকেন তবে কমরেড চারু মজুমদার ঠিকই বলেছেন। তবে ভ্রম সংশােধন করতে হবে ধাপে ধাপে যাতে জনগণ ও পার্টি সদস্যদের বিপ্লবী উৎসাহে ধাক্কা না লাগে।”
“দ্বিতীয় বিষয়টি হচ্ছে যে নীতির সংশােধনে গঠনমূলক সিদ্ধান্ত দিয়ে ভুল সিদ্ধান্তের পবিরর্তন করতে হবে। উদাহরণস্বরূপ আমাদের (অর্থাৎ ভারতের পার্টির) একটি পরিষ্কার কৃষিনীতি থাকা উচিত। আর এই নীতি প্রস্তুতের সময় জনগণের মনােভাবের সাথে খাপ খাইয়ে তা করতে হবে। তার অর্থ আমরা জনগণের ধ্যানধারণার সার-সংকলন করব, তারপর নীতি বা প্রস্তাবে পরিণত করব এবং জনগণের মধ্যে কার্যকরী করব। ভুল বা অনুপযুক্ত নীতিগুলােকে সংশােধন করতে হবে বাস্তব গঠনমূলক কাজের প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়ে।”
চৌ-এন-লাই মন্তব্য করেন—“আমি কমরেড কাং-এর মতকে পূর্ণ সমর্থন জানাই। কঠোর জীবনযাপন, মৃত্যু, বলিদান সবই দেখতে হবে দ্বান্দ্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে (dialectical)। মৃত্যুতে আমরা ভয় পাই না। কিন্তু মৃত্যু প্রয়ােজনীয় হওয়া চাই। হঠকারী এবং বৃথা মৃত্যু অপ্রয়ােজনীয়।”
“আমরা, কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা, এরকম অ্যানার্কিস্ট কার্যকলাপের সাথে একমত হতে পারি না।”
চীন প্রত্যাগত প্রতিনিধি চৌ এবং কাং-এর বক্তব্য আলাদা করে লিখে দিলেন চারুর কাছে। প্রায় সাথে সাথেই চারু মজুমদারকে ডাক্তারের উপদেশ মতাে পুরীতে পাঠানাে হলাে।
‘৭০-এর নভেম্বর থেকেই পুলিশের উপর আক্রমণ সংগঠিত ভাবেই শুরু হলাে। কলকাতা শহরে ‘মূর্তি ভাঙার আন্দোলন শুরু হওয়ার সময়েই চারু মজুমদার বললেন–‘আমাদের পার্টির কেন্দ্রীয়করণ থাকবে লাইনের বেলায়, অ্যাকশানে স্কোয়াডগুলােকে পূর্ণ স্বাধীনতা দিতে হবে।” উর্দিবিহীন কনস্টেবল হত্যা, স্কুলে আগুন দেওয়া, পতাকা। তােলা, শিক্ষক ও বিরােধী রাজনৈতিক নেতার উপর হামলা প্রভৃতি অ্যাকশান চলতে থাকল একেবারেই স্থানীয় স্কোয়াডগুলাের উদ্যোগে। স্থানীয় উদ্যোগ খুলে দিতে গিয়ে নতুনত্ব যেটি দেখা গেল তা হচ্ছে তরুণদের মধ্যে দুঃসাহসী হিসেবে এককালীন। মস্তানরাই সবার আগে এসে গেল এবং স্কোয়াডগুলাের নেতৃত্বেও চলে যেতে লাগল। অনেক অঞ্চলে অন্যান্য রাজনৈতিক দল (অনেক সময়েই কংগ্রেস) পুরানাে বিবাদের সমাধানের কাজে স্কোয়াডগুলােকে ব্যবহারও করতে লাগল। সিপিআই (এম-এল) থেকে একটি প্রচারপত্র দেওয়া হয়েছিল পুলিশকে উদ্দেশ্য করে যে ‘পুলিশও গরিব এবং জনগণের ঘর থেকেই এসেছে। পুলিশের উচিত সশস্ত্র সংগ্রামে সাহায্য করা। আমরা পুলিশের উপর আক্রমণ ততক্ষণ চালিয়ে যাব যতক্ষণ পুলিশের চৈতন্যোদয় না হয়, প্রভৃতি।
‘৭০ সালের অক্টোবর মাসে দার্জিলিং জেলা ও পশ্চিম দিনাজপুর জেলার সীমানায় অবস্থিত পশ্চিম দিনাজপুরের মাগুরজানে নকশালপন্থিরা ‘ডাক’ নদীর রেলের পুল। পাহারারত হােমগার্ডের ক্যাম্প থেকে পাঁচটি রাইফেল দখল করে। এই ঘটনা ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে সিপিআই (এম-এল) কর্মীদের মধ্যে এক নতুন উৎসাহের সঞ্চার করে।
পৃষ্ঠা: ১৮৫
পার্টির পত্র-পত্রিকর বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সারা ভারতের সংগ্রামের মধ্যে যােগসূত্রের কারণেই ‘মাগুরজানের ঘটনা এবং নকশালবাড়ি এলাকায় গেরিলা যুদ্ধ’ নতুন করে শুরু হলাে এমন এক ধারণা পার্টি কর্মীদের মধ্যে বলবৎ হলাে।
কলকাতায় ‘৭০ সালের মাঝামাঝি থেকেই পুলিশের ধরপাকড় চলছিলসেপ্টেম্বরের পর থেকে কয়েকটি অঞ্চলে পুলিশ গুলি করে হত্যা শুরু করে দিল। ডিসেম্বর পর্যন্ত সারা দক্ষিণ-বাংলা পুলিশ ব্যাপক অভিযান চালাতে লাগল।
‘৭০ সালের ডিসেম্বর মাস থেকে বীরভূম ও মুর্শিদাবাদ এবং সাঁওতাল পরগনার বারহাওরা প্রভৃতি অঞ্চল নিয়ে পশ্চিমবঙ্গ-বিহার সীমান্ত আঞ্চলিক কমিটির নেতৃত্বে বীরভূম জেলার প্রায় সর্বত্র ও মুর্শিদাবাদ এবং সাঁওতাল পরগনার কিছু অংশে গেরিলা অ্যাকশান ও খতম অভিযান শুরু হলাে। বীরভূম, মুর্শিদাবাদের কলেজ ছাত্র ও উত্তর কলকাতার তরুণ কয়েকজন স্কুল শিক্ষক এই সংগ্রামের নেতৃত্ব দেয়। ‘৭১ সালের মার্চ মাস পর্যন্ত এই অভিযানে জমিদার খতম ও প্রায় ১২৬টা জেতদারের বন্দুক দখল হয়ে যায়। জমিদার অধ্যুষিত বীরভূম জেলার জমিদাররা গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়। অন্যসব জায়গার মতােই প্রথম প্রথম কৃষকদের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহের সৃষ্টি হয়, জমিদারবিহীন গ্রামকে মুক্তাঞ্চল মনে করে বিপ্লবী কমিটিগুলাে গঠিত হয় এবং কিছু জমি বণ্টনও হয়।
এই সংগ্রাম মতানৈক্যে জর্জর সিপিআই (এম-এল)-এর মধ্যে চারু মুজমদারের সমর্থকদের মধ্যে নতুন উৎসাহ জোগালচারুর লাইন সঠিক’ বলার একটা জোরও উপস্থিত হলাে। বীরভূমের ‘কমরেডদের প্রতি চারু লিখলেন-“তােমরা সংগ্রামকে উচ্চস্তরে নিয়ে গিয়েছ। কেবল খতম অভিযানে আবদ্ধ থাকলে তা হবে সংশােধনবাদ, তােমরা গরিব ও ভূমিহীন কৃষককে রাজনীতি দাও, চেয়ারম্যানের কোটেশান ও গেরিলা বাহিনীর নীতিগুলাে শেখাও এবং সৈন্যবাহিনী গড়ে তােলার প্রস্তুতি করতে থাকো।” দেম্প্রতী পত্রিকা ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বীরভূমের সংগ্রামকে প্রকাশ করতে থাকে। একটা কথা রটে যায় যে ঐ অঞ্চলে স্থানীয় পুলিশ বিপ্লবীদের সাহায্য করে চলেছে। একথাও শােনা গেল যে, বহু ক্ষেত্রে মহাজনরা সংগ্রামীদের টাকা-পয়সা দিয়ে সমঝােতা করে নিচ্ছে। ‘৭১-এর জুলাই থেকে প্রায় আট হাজার কেন্দ্রীয় রিজার্ভ পুলিশ বাহিনী নিয়ে এবং কিছু পরে সরাসরি সামরিক বাহিনীর সাহায্যে এই অঞ্চল আক্রমণ করল সরকার এবং প্রায় কোনাে প্রতিরােধের সম্মুখীন না হয়েই তারা অভিযান চালাল। গ্রামের মানুষ বলল বাইরের লােক এসে এসব করেছে। গ্রামের মানুষ পুলিশের কাছে জবানবন্দিকেও ‘জনগণের বিপ্লবী চেতনা’ আখ্যা দিয়ে দেব্ৰতীতে লেখা হলাে—‘জনগণ বিপ্লবীদের প্রকৃত পরিচয় গােপন রাখার জন্যই তাদের সংখ্যা বাড়িয়ে বলছে। বিপ্লবী সংগ্রামের কী প্রভাব!
ওখানকার আঞ্চলিক কমিটিও সমালােচকমূলক বক্তব্য রাখল-‘জনগণের মিলিশিয়া গঠন করে সশস্ত্র করায় ব্যর্থতা, গেরিলাদল, পার্টি ও বিপ্লবী কমিটির সম্পর্কে বিন্যাসের অভাব, শত্রুর শক্তিকে খাটো করে দেখা, মুক্তাঞ্চল সম্পর্কে এক কাল্পনিক ধারণা ও পাহাড়-জঙ্গলের মতাে উপযুক্ত ‘টেরেন’-এ ঘাঁটি এলাকা স্থাপনের চেষ্টা না করায় রাষ্ট্রের সশস্ত্র শক্তি অতি সহজেই আমাদের সংগ্রামের ফলকে ছিনিয়ে নিতে পারল।
এই বক্তব্যে চারু অসন্তুষ্ট হলেন। বললেন-“পাহাড়-পর্বত দেখে বেস্ এরিয়া করতে গেলে তাে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকতে হবে। চেয়ারম্যানের চীনের মতাে সুড়ঙ্গ যুদ্ধের সময় এসে যাচ্ছে। মাটির উপর শত্রু, তার তলায় আমাদের নিশ্চিন্তে চলাফেরা।” দুই-এক জায়গায় সুড়ঙ্গ খোড়ার হাস্যকর চেষ্টাও হলাে। পুলিশের চোখ এড়িয়ে খোঁজার কাজও যেমন অসম্ভব, আবার ছােট মুখের সুড়ঙ্গ খানিক খুঁড়তেই ধ্বসে পড়তে লাগল, উপরের মাটির স্তর আগলা বলে। চারুর মনে হতে লাগল ‘রাণীগঞ্জ এলাকার কয়লাখনিগুলােতে সুড়ঙ্গযুদ্ধ শুরু করলে কেমন হয়? কথাটার চরম অবাস্তবতাটা অনেকে বুঝলেও আপত্তি কেউ করতে পারে না।
‘৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে পুরীতে চীনা পার্টির বক্তব্য বিষয়ে আধঘণ্টার মতাে কথা হয় চারু মজুমদারে সাথে চীন প্রত্যাগত কমরেডের। চারু শুধু মন্তব্য করেন-“কিছু একপেশে কাজ তাে আমাদের হচ্ছেই।’ একটি প্রশ্ন উঠতে থাকে যে চীনা পার্টির সমালােচনা ও পরমার্শ পার্টিতে জানানাে প্রয়ােজন। সুশীতল রায়চৌধুরীর সাথে সম্পর্ক তিক্ততম পর্যায়ে তখন। তাঁরা মতামত না নিয়ে তাকে পার্টি পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ‘৭১-এর জানুয়ারির এক রাজ্য কমিটির বর্ধিত সভায় দুই-তিনজন সদস্য ঐ সভা থেকেই সুশীতলকে বহিষ্কার করতে চায়। চারু মজুমদার বলেন-‘সুশীতল বাবু পলিটব্যুরাের সদস্য, তােমরা বহিষ্কার করার কে?’ সুশীতল সভায় উপস্থিত ছিলেন তিনি রাজ্য কমিটির সম্পাদক পদ থেকে অব্যাহতি চান। চারুর পরমার্শ মতাে সভায় সিদ্ধান্ত হয় যে সুশীতল রায়চৌধুরী হুগলী জেলায় নিজের পছন্দমতাে এলাকা বেছে নিয়ে নিজের ‘লাইন’ চালাবেন- সভায় একজন বলেন-“কিন্তু মুখ খুলতে পারবেন না।” চারু বলেন-“তা কী করে হবে? আমরা তাে ওঁর বক্তব্য নিয়ে কাজ করার জন্যই ওঁকে একটা এলাকা দিচ্ছি!” সুশীতল সেই থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন, তার সাথে দেখা করা সম্ভব ছিল না, এবং মাসে দুশাে টাকা পার্টি বেতনও তাঁর বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল ‘৭০ সালের শেষ ভাগ থেকেই- এটা আবার চারু মজুমদারের জানা ছিল না। সুশীতল রায়চৌধুরী চীনা পার্টির বক্তব্য পর্যন্তও জানতে পারেননি।
‘৭১-এর ফেব্রুয়ারির শেষে চারু মজুমদার, সরােজদত্ত, সুনীতি দত্ত, সুনীতি ঘােষ ও চীন প্রত্যাগত প্রতিনিধির মধ্যে এক আলােচনায় ঠিক হয় এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি আগ্রা অথবা দিল্লিতে কেন্দ্রীয় কমিটির এক সভা ডাকা হবে, সেখানে চীনা পার্টির বক্তব্য রাখার পর তা পার্টির সাধারণ সদস্যদের জানানাের জন্য কেন্দ্রীয় কমিটির রিপাের্ট হিসাবে প্রস্তুত করা হবে। সরােজ দত্ত মন্তব্য করেন—“চীনের কমরেডরা তাে বলেছেন যে ভ্রম সংশােধনের কাজ তড়িঘড়ি করে করা চলবে না। সইয়ে সইয়ে ধীরে ধীরে করতে হবে। অবশ্য সেই কেন্দ্রীয় কমিটির সভা আর হয়নি। চীনা পার্টির বক্তব্যের লিখিত রিপাের্ট চারু মজুমদারের কাছে ছিল—তা আর কোনােদিনই কপি করে পার্টি নেতৃত্বের বা সাধারণ সদস্যদের কাছে দেওয়া হয়নি। অসীম চ্যাটার্জী মৌখিকভাবে কিছু শুনেছিলেন আর সুনীতি ঘােষ নিজে একটি কপি করে নিয়েছিলেন। যে প্রতিনিধি গিয়েছিলেন চীনে তিনি ‘৭১ সালের ৬ই মার্চ গ্রেপ্তার হয়ে যান। তিনি গ্রেপ্তার হওয়ার কয়েকদিন আগে ২৬শে ফেব্রুয়ারি পুরী থেকে চারুর একটি বিশেষ মৌখিক বার্তা পান—“তুমি খুবই সাবধানে থেকো। পার্টির নেতৃত্বে আর কোনাে লােক নেই। সুশীতল বাবু পৃথক হয়ে গেলেন, সরােজবাবুর গণআন্দোলনের অভিজ্ঞতা না থাকায় সাংগঠনিক নেতৃত্ব তেমন কার্যকরী হবে না।” এই বার্তায় চারুর মানসিকতা প্রতিফলিত হয়েছিল আর বার্তাটি সত্যি সত্যিই চারুর, কারণ এটি এসেছিল পুরী প্রত্যাগতা চারু মজুমদারের স্ত্রী লীলার মারফত।
‘৭০ সালের শেষ ভাগ থেকে পাঞ্জাবেও শুরু হয়েছিল সশস্ত্র সংগ্রাম-শ্রেণিশত্রু খতম, গেরিলা অ্যাকশানের মাধ্যমে। পাঞ্জাবে গরিব ও ভূমিহীন কৃষকের গেরিলা দলে বেশি সংখ্যায় যােগদানের ঘটনা ঘটেছিল। সরকারি আক্রমণে ব্যাপক হত্যাকাণ্ড, ধরপাকড় অত্যাচারে ‘৭১ সালের মধ্য ভাগেই পাঞ্জাবের আন্দোলনে প্রবল ধাক্কা লেগে যায়, এবং পাঞ্জাবে সিপিআই (এম-এল) কর্মীরাও আত্মসমালােচনা করতে গিয়ে সশস্ত্র সংগ্রামের ধরন সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেন। চারু মজুমদারের বার বার মনে হতে থাকে পেটিবুর্জোয়াবাদ-এর পার্টি নেতৃত্বের প্রাবল্যই সব ভুলের মূল সূত্র।
চীনের পার্টির বক্তব্য প্রচার না করা হলেও ছাড়া ছাড়া ভাব কতকগুলাে অদ্ভুত প্রচার করতে লাগল, যার উৎস কখনই স্পষ্ট হয়নি। ‘৭১ সালেই পার্টির মধ্যে অনেক স্থান থেকে প্রশ্ন উঠতে থাকে—“চীন থেকে নাকি বিশেষ বক্তব্য এসেছে, তা কী?”—এই প্রশ্নকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্যই বােধ হয় একটি প্রচার হয় যে-একজন ব্যক্তিই যাওয়ার ফলে ঠিক কী বলেছেন চীনের কমরেডরা তা স্পষ্ট নয়।” আবার আর এক প্রচার হয় যে “সিপিআই (এম-এল) প্রতিনিধি লন্ডনে ফিরে এসে দোদুল্যমান হয়ে পড়েন।”
তৃতীয় প্রচারটি হয় যে, “চেয়ােমর্যান মাও স্বয়ং ভারতের প্রতিনিধিকে বলেছেন যে তােমরা আমার লাইনে আছ, চালিয়ে যাও।”
‘৭১ সালে কলকাতার জেলগুলাে ভরে উঠেছে, কলকাতা জুড়ে চলেছে সামরিক বাহিনীর চিরুনি-অভিযান, হত্যাকাণ্ড, বরানগরের মতাে বীভৎস খুনের কাণ্ড যেখানে কংগ্রেস, সিপি (এম) ও পুলিশ মিলে ১৫০ জনেরও উপর তরুণকে প্রকাশ্য দিবালােকে খুন করেছিল। নকশাল-সিপি (এম) খুনােখুনিও চলেছে বিশেষত কলকাতায়, কোথাও খুন হয়েছে সিপি (এম) কর্মী, কোথাও নকশালপন্থি কর্মী।
জেলে নকশাল বন্দিদের সম্বন্ধে পার্টির নির্দেশ ছিল (নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সরােজ দত্তর নামে) যে ‘সংশােধনবাদীদের মতাে জেলে শান্তিতে বসবাস করার জন্য শাসকশ্রেণির কাছে বিক্রীত হওয়া, প্রথম শ্রেণির সুবিধা গ্রহণ, আইনের সাহায্য নেওয়ার জন্য মামলা চালানাে, জামিন নেওয়া প্রভৃতি আমাদের জন্য নয়। জেলের জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে সেখানেও গেরিলা সংগ্রাম চালাতে হবে এবং জেল ভেঙে বেরিয়ে আসতে হবে। এই নির্দেশের পর পশ্চিম বাংলার জেলাগুলােতে বীভৎস হত্যাকাণ্ডে অসংখ্য নকশাল-কর্মী জীবন দিয়েছে, জেল থেকে পালাতে গেলে পিটিয়ে মেরেছে। পুলিশ। আবার কয়েকটি জেল থেকে সফলভাবে পালিয়ে ও এসেছে কর্মীরা।
‘৭১ সালে বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) ঘটনাবলি সিপিআই (এমএল) এর মধ্যে আর এক প্রস্থ মতবিরােধ সৃষ্টি করল, আর চারু মজুমদারের সমর্থক কর্মীদের মধ্যে নতুন এক উৎসাহও সৃষ্টি করল।
‘৭০ সালের মধ্যভাগের দিকে পূর্ব পাকিস্তানে মােহাম্মদ তােহার মতাে বামপন্থি কমিউনিস্ট শ্রমিক নেতাদের (তােহা মৌলানা ভাসানীর আওয়ামী লীগেরও সম্পাদক ছিলেন) নেতৃত্বে পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী-লেনিনবাদী) বা EPCP (M-L) গঠিত হয়েছিল। চীনের সাথে নিয়মিত যােগযােগ, পিকিং রেডিও মারফত নকশালবাড়ির আন্দোলন ও সিপিআই (এম-এল)-এর বক্তব্য শুনে এরাও গ্রামে। জমিদার খতম (Battle of annihilation) এবং ‘গেরিলা অ্যাকশান’ শুরু করে দেন। ‘৭১ সালে চারু মজুমদারই ইপিসিপি (এম-এল)-এর প্রতি এক অভিনন্দন বার্তায় বলেন-“আপনারা উগ্রজাতীয়তাবাদ, ধর্মান্ধতার ও শ্রেণিশােষণের কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রাম শুরু করে পূর্ব বাংলার মুক্তির পথ তৈরি করেছেন।” মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খাঁর শাসনের বিরুদ্ধে যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছিল চারু তাকে সংস্কারবাদী ও কায়েমি স্বার্থরক্ষাকারী আখ্যা দিয়েছিলেন এবং পূর্ব পাকিস্তানের সশস্ত্র সংগ্রামের উপর ভরসা করেছিলেন যে, এই শ্রেণি সংগ্রামই দুই বাংলাকে এক করে আবার শ্রেণিশােষণমুক্ত সােনার বাংলা’ গঠন করবে।
পার্টির মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের ঘটনা নিয়ে যে তুমুল বিতর্ক উঠেছিল তা ছিল মূলত ‘সােভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ ও ভারতীয় সম্প্রসারণবাদী’ কর্তৃক পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদের বিরুদ্ধে সিপিআই (এম-এল)-এর কর্তব্য সম্বন্ধে। বিতর্কে কোনাে পক্ষই পূর্ব পাকিস্তানের জাতীয় আত্মনিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষায় পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার বিষয়টিকে হিসাবের মধ্যেই আনেননি। যারা বলেছিলেন যে ভারতের সােভিয়েত আগ্রাসনের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের শাসকবর্গের সাহায্য করা উচিত (চীনেরও একই বক্তব্যই ছিল, এঁদের প্রধান বিবেচ্য ছিল পূর্ব পাকিস্তানে সােভিয়েত প্রভাব বেড়ে যাবে) তাঁদের জবাবে চারু মজুমদার বললেন-“ইয়াহিয়া খাকে বাঁচিয়ে রাখার দায়িত্ব আমাদের নয়। তবে পাকিস্তানের অঙ্গচ্ছেদের ষড়যন্ত্রের প্রশ্নে আমরা ইয়াহিয়া খাকে সমর্থন করব, কিন্তু আমাদের প্রধান কাজ সশস্ত্র শ্রেণিসংগ্রামের দ্বারা এই সুযােগে পূর্ব পাকিস্তানে বিদেশি আক্রমণ পর্যদস্ত করে প্রকৃত মুক্তি নিয়ে আসা।” চারু মজুমদারের নির্দেশে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির নামে সরােজ দত্ত বক্তব্য রাখলেন যে-“সমাজতন্ত্রের বিশ্ব বিজয়ের যুগে আজ কোনাে জাতীয় বুর্জোয়ার পক্ষেই জাতীয় মুক্তি আনা সম্ভব না। বিশেষত পাকিস্তান ভারতের মতােই উপনিবেশ থেকে এখন আধা উপনিবেশ। সেখানকার মুৎসুদ্দি বুর্জোয়ারা সাম্রাজ্যবাদের সাথে আপসই করবে। সুতরাং ‘বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম’কে সমর্থন করতে গেলে ক্রুশ্চেভের তত্ত্বকেই বিশ্বাস করতে হবে যে উপনিবেশ ও আধা উপনিবেশে জাতীয় বুর্জোয়ারা স্বাধীন সরকার গঠন করতে পারে কেবল সমাজতান্ত্রিক দুনিয়ার প্রভাবের দ্বারাই। ভারতের উপর মার্কিন প্রভাবের বিরুদ্ধে পাকিস্তানের অপেক্ষাকৃত দুর্বল শাসকশ্রেণি নিছক আত্মরক্ষার জন্যই চীনের সাথে বন্ধুত্বের সম্পর্ক রেখেছে। এটা ঠিকই যে মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ভারতে ঘাঁটি করে চীনের উপর আক্রমণ করতে চায়। সেক্ষেত্রে ভারতীয় সম্প্রসারণবাদীদের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়া খার ন্যায্য সংগ্রামে আমরা সমর্থন করব, কিন্তু তার সাথে যুক্তফ্রন্ট গঠনের কোনাে প্রশ্নই ওঠে না।” শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে সিপিআই (এম-এল)-এর কোনাে পক্ষের তরফ থেকে কার্যকরী কিছু হয়নি-ইপিসিপি (এম-এল)-এর একটি বড় অংশই বাংলাদেশ মুক্ত করার সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেছিল।
বাংলাদেশ গঠিত হওয়ার সময়েই পার্টিতে যে মতবিরােধ তীব্র হয়ে উঠল তাতে পশ্চিমবাংলার মালদহ-পশ্চিম দিনাজপুর, বীরভূম থেকে যেমন আত্মসমালােচনামূলক বক্তব্য ও ‘খতম অভিযান’ এবং ‘গেরিলা যুদ্ধ’ সম্বন্ধে পার্টিনীতির সঠিকতা সম্বন্ধে প্রশ্ন উঠতে লাগল, মেদিনীপুর থেকে সরাসরি চারু মজুমদারের প্রতিই কর্তৃত্ববাদ’, ‘উগ্র বামপন্থি লাইনের প্রবক্তা প্রভৃতি অভিযােগ করে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডাকার ও চীনা পার্টির সমালােচনা পার্টির মধ্যে প্রকাশ করার দাবি করা হলাে। মেদিনীপুরের নেতৃবৃন্দের সাথে আলােচনায় বসলেন সরােজ দত্ত। চীনা পার্টির সমালােচনার প্রশ্নটিকে সরাসরি স্বীকার না করে সরােজ দত্ত বললেন-“আত্মসমালােচনার মধ্য দিয়ে যদি আমাদের কিছু ত্রুটি থাকে তাে ধীরে ধীরে তা শােধরানাে হবে। যারা পিকিং রেডিও শুনে ঠিক করে চারু মজুমদারকে সমর্থন করা উচিত কি না তারা বাইরের উত্তাপ দিয়ে চেতনা বাড়াতে চায়, সমাজের আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দেখে না। চীনের পার্টি ভ্রাতৃত্বমূলক পার্টি, বিশ্ব বিপ্লবের নেতা নয়, নেতা চেয়ারম্যান মাও। চীনা পার্টির বক্তব্যের সাথে আমাদের বক্তব্য না মিললে আমরা আমাদের বক্তব্যের উপরেই দাঁড়াব, কারণ তা ভারতীয় সমাজের বাস্তব থেকে বেরিয়ে এসেছে। লেনিন যেমন বলশেভিক পার্টি গড়েছিলেন, চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যেমন চেয়ারম্যান মাও-এর হাত দিয়েই গড়ে উঠেছিল, তেমনই ভারতের ইতিহাস কমরেড চারু মজুমদারের উপর সেই দায়িত্বই পালন করার ভার দিয়েছে। তাই ভারতের আজকের পরিস্থিতিতে কমরেড চারু মজুমদারই কেন্দ্রীয় কমিটি।”
‘৭১ সালের ১৩ই মার্চ আত্মগােপন অবস্থায় হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেলেন সুশীতল রায়চৌধুরী। ঐ সালেরই ৪ঠা আগস্ট গভীর রাতে গ্রেপ্তার করে সরােজ দত্তকে পুলিশ কলকাতা ময়দানে নিয়ে গিয়ে গুলি করে মারে।
হত্যাকাণ্ডগুলাে চারুকে গভীরভাবে ব্যথিত করে। এক একজনের খবর যখন পান চোখ দিয়ে তার অঝােরে জল ঝরে। নিজের মনে বলেন-“আমরা তাে মানুষ। এত ভালাে ভালাে কমরেডের বিয়ােগে কষ্ট তাে পাবই। কিন্তু বিপ্লবী হিসেবে বুঝতে হবে বিপ্লবীদের মধ্যে এগুলাে ঘটবে। এই দধীচিদের হাড় দিয়েই জয়ের অস্ত্র তৈরি হবে।” তার কল্পনার রথ থামতে জানে না, এগিয়ে চলে। কমরেডদের জানান—“অত্যাচারীদের অত্যাচার বেড়ে যাওয়া মানেই তারা ভীত হয়ে পড়েছে। অত্যাচারিত মানুষ যখন অত্যাচার সহ্য করতে পারবে না তখন আপনা থেকে বিদ্রোহ শুরু করবে।”
কলকাতায় নিচের পার্টি কমিটিগুলােতেও বিতর্ক উঠতে থাকে। চারু মজুমদারের কর্তৃত্বের বিরােধিতা করার জন্য দুজনকে প্রাণও দিতে হলাে। চারু মজুমদার শুনে। বললেন, “এভাবে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা হয় না। বিরােধী মতের প্রতি আরও সহনশীল হতে হয়।” কিন্তু রাজ্য কমিটির নামে ঐ হত্যাকাণ্ডের স্বপক্ষে যে সার্কুলার দেওয়া হলাে তার সম্বন্ধে তার কোনাে মন্তব্য পাওয়া গেল না।
‘৭১-এর নভেম্বরে বিহারে সত্যনারায়ণ সিং এক কেন্দ্রীয় কমিটির মিটিং ডাকলেন। পশ্চিম বাংলার অবশিষ্ট কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের মধ্যে চারু, ও সুনীতি ঘােষ ঐ মিটিং-এ গেলেন না, অসীম যেতে গিয়ে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন মাঝপথে। কেন্দ্রীয় কমিটির অন্য অঞ্চলের সদস্যদের মধ্যে অন্ধ্রের অবশিষ্টরা জেলে, তামিলনাড়ুর এল, আপ্প নিহত ও কোদরামের খোঁজ নেই, কেরালার আম্বাডি ইতােমধ্যেই কংগ্রেসে যােগদান করেছেন, জম্মু-কাশ্মীরের আর, পি, স্রফও কারাগারে, শিবকুমার মিশ্রও তাই—কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যদের অবশিষ্ট চারজনের মধ্যে বিহারের দুইজন ছাড়া পাঞ্জাবের ও উত্তর প্রদেশের একজন এই মিটিং-এ ছিলেন কি না জানা যায়নি। যাই হােক, এই মিটিং থেকে চারু মজুমদার ও জেলে বন্দি অন্যান্য ‘চারুপন্থিদের পার্টি থেকে বহিষ্কার করা হয় এবং সত্যনারায়ণ সিং-কে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত করা হয়। একটি প্রস্তাবে পার্টির কর্মসূচি কার্যকারী করার জন্য চারু মজুমদারের সংকীর্ণতাবাদী’ লাইনের সংশােধন কাজ শুরু করার সিদ্ধান্ত করা হয়। ধনী কৃষকদের সম্বন্ধে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় যে, ‘সব ধনী কৃষককে শ্রেণিশত্রু গণ্য করা উচিত নয়’, সিপি (এম)-এর সাধারণ কর্মীদের কাছে গণআন্দোলনে ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার জন্য এক আহ্বানও জানানাে হয়। চারু মজুমদারের সংকীর্ণতাবাদ’-এর বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য যেসব প্রস্তাব নেওয়া হয় তাতে কৃষি কর্মসূচি বা শ্রমিক আন্দোলনের ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট কোনাে প্রস্তাব নেওয়া হয়নি। চারু মজুমদারের জীবিতকাল পর্যন্ত ঐ সিদ্ধান্তগুলাের কার্যকারিতা অনুভব করা যায়নি।
‘৭২ সালের প্রথম থেকেই চারু তাঁর পুরানাে বক্তব্যের কিছু কিছু পরিবর্তন করতে থাকেন। এই পরিবর্তনে মধ্যে ফসল দখল, জমি বিলির কথাও উল্লেখ করেন। তবে সেগুলাে এলাকাভিত্তিক ক্ষমতা দখলের অবস্থায় করার কথা বলেন এবং প্রধানত জোর দেন ‘গণফৌজ গঠনের উপর। মাগুরজানের রাইফেল ছিনতাই ও ভূমিহীন কৃষকের অংশগ্রহণের ইতিহাসের মােড় ঘােরানাের ঘটনা বলে উল্লেখ করে বলেন—“কেবল শ্রেণিশত্রু খতমের অভিযান চালানাে এখন অর্থনীতিবাদ। রাইফেল দখলের কথা, গেরিলাযুদ্ধের নীতিগুলাের কথা ও মাগুরজানের জ্বলন্ত উদাহরণ দিয়ে ভূমিহীন ও গরিব কৃষককে রাজনীতি দিতে হবে। এটিই এখন ‘মাস লাইন। ভেবে দেখাে একজন। ভূমিহীন খেতমজুরের হাতে যদি রাইফেল আসে তবে দুনিয়ায় সে কাউকেই পরােয়ান করবে না। সে শ্রেণিশত্রু খতম করল কি না তাতে কিছু এসে যায় না। মাগুরজানই গণফৌজ গঠনের প্রথম পদক্ষেপ। এইভাবে কিছু রাইফেল হাতে পেলে ঐ ভূমিহীন কৃষকই গণফৌজ মার্চ করিয়ে দেবে ভারতের বুকের উপর দিয়ে। ব্যক্তিকর্তৃত্বের বিরােধীরা পার্টিতে নেই, তাই কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা এখন শ্রদ্ধেয় নেতা’ আখ্যায় পৌঁছেছে। শ্রদ্ধেয় নেতার এই কথাকে আরও ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে ২৬শে ডিসেম্বর ভারতের বুকে গণফৌজের লং মার্চ দিবস বলে ঘােষণা হয়ে গেল মুখে মুখে।
চারুর শরীর আরও খারাপ। বিছানায় শুয়েই প্রায় থাকতে হয়। আশ্রয়স্থলও কমে যায় ধীরে ধীরে। পুলিশ-মিলিটারির অত্যাচার, কংগ্রেস, সিপি (এম)-এর হামলা, পাড়া-প্রতিবেশীর উপর পুলিশি ও দলীয় জুলুম-এর চাপে এবং স্বপ্নভঙ্গের হতাশায় নিচুতলার তরুণদের বেশ একটা অংশ কংগ্রেসে যােগ দিয়েছিল। শয্যায় শুয়েও চারুর কল্পনার আশাবাদে ছেদ পড়ে না। বলেন—“৭৫ সালে ভারত মুক্ত হবে বলা জ্যোতিষ বিচারের ব্যাপার না। ‘৭৫-এর পরেও সংগ্রাম চলবে। তবে ‘৭৫-এ আমরা একটি শক্তি হিসেবে ভারতে গণ্য হবাে। কলকাতা দখল করার পরিকল্পনা আমাদের না। যে গণজাগরণের দরকার ছিল তা করেছি। এখন রাষ্ট্রশক্তির আক্রমণের সমানে আমাদের শ্রমিকদের মধ্যে পার্টি ইউনিট গঠন করা। তাদের সামনে রাজনীতি দিতে হবে যে তারাও মানুষ, তাদের মর্যাদা লড়াই করে আদায় করতে হবে। আর সাধারণভাবে আজ আওয়াজ আত্মদানের লড়াই-এ কে কত এগিয়ে যেতে পারে। এভাবেই তাে তৈরি হবে নতুন মানুষ, যাঁরা চেয়ারম্যানের উপযুক্ত শিষ্য।”
পাঞ্জাবের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যসহ পাঞ্জাবের কমরেডরা এসে চীনা পার্টির বক্তব্যের বিষয় জানতে চান চারুর কাছে। অন্ধ থেকে এবং পূর্ব পাকিস্তানের এম-এল পার্টির তরফ থেকেও অনুরূপ প্রতিনিধিরা এসে একই বিষয় জানতে চান। এই আলােচনা সম্বন্ধে মুখে মুখে প্রচারিত যতটুকু জানা যায় তাতে প্রকাশ যে, চারু মজুমদার চীনের পার্টির এই সমালােচনার সাথে একমত ছিলেন না। তিনি কেবল ‘চীনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’ এই বক্তব্যটি তুলে নিতে ইচ্ছুক ছিলেন। তিনি নাকি সময়মতাে ঐ সমালােচনা পার্টিতে প্রচার করার বিষয়ে বলেছিলেন যে, চীনের কমরেডরাই চাননি যে তা তাড়াতাড়ি করা হােক। এইসব বক্তব্যের মধ্যে ‘৭১ সালের এপ্রিল মাসে যে কেন্দ্রীয় কমিটির সভা ডাকার কথা হয়েছিল তার কোনাে উল্লেখ পাওয়া যায় না। অথচ অন্ধ্রের বার্তাবহকে লিখিতভাবে তখন ঐ কথা জানানাে হয়েছিল। চারুও কখনাে ঐ ঘটনা কাউকে বলেছেন বলে জানা যায় না।
১৯৭২ সালের ১৬ই জুলাই কলকাতার এক আশ্রয়স্থল থেকে গ্রেপ্তার হয়ে গেলেন চারু মজুমদার! তার গ্রেপ্তারের কিছু আগে যে দুজন রাজ্য কমিটির সদস্য গ্রেপ্তার হয়েছিল, তারা প্রবল অত্যাচারের মুখে চারুর আশ্রয়স্থলের কথা প্রকাশ করে ফেলে বলে শােনা যায়। পরবর্তীকালে ঐ দুজনের বক্তব্য ছিল এমন কিছু অত্যাচার তাদের উপরে হয়নি। তারা ইচ্ছা করেই চারু মজুমদারকে ধরিয়ে দিয়েছিল। কারণ, তাদের ধারণা বদ্ধমূল হচ্ছিল যে আত্মসমালােচনার নামে একটি গণ আত্মসমর্পণের চিন্তাভাবনা নাকি চারু মজুমদার করেছিলেন, যাতে এদের ঘাের আপত্তি ছিল। প্রকৃতপক্ষে এদের সকলের কাছেই চারু মজুমদার ভারস্বরূপ হয়ে পড়েছিলেন এক সময়ে আত্মদানের বক্তব্য যারা সবাইকে বলছিল আত্মরক্ষার তাগিদে তারা স্বয়ং চারু মজুমদারকেই বলি দিল।
গ্রেপ্তারের পর লালবাজারের সেন্ট্রাল লক-আপে ১২ দিন ধরে ক্রমাগত একটি হৃদরােগীকে অনর্গল জেরা করে তার জীবনীশক্তি নিঃশেষ করতে পুলিশের খুব বেগ পেতে হলাে না। ২৮শে জুলাই চারু মজুমদার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন।
নিশ্চিন্ত হলাে পুলিশ, সরকার, বিভিন্ন সরকারপন্থি রাজনৈতিক দল আর প্রতিক্রিয়াশীলরা। বিশাখাপত্তনম জেলের নকশালবন্দিরা ২৮শে জুলাই কোর্টে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছিলেন। বন্দিদের পক্ষে কানু সান্যাল বলেন-“ভারতের সশস্ত্র সংগ্রামের দ্বারা সমাজ পরিবর্তনের দিকে পথ দেখিয়ে দিলেন চারু মজুমদার।”
১৭
শেষের কথা
ভারতীয় সমাজের তলা থেকে যখন শুরু হয়েছে তুমুল আলােড়ন আর ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন যখন শ্রেণিসমন্বয়ের রাজনীতি আঁকড়ে ধরে সােশ্যাল ডেমােক্রেসির চোরা বালিতে আটকে গেছে, ইতিহাসের সেই সন্ধিক্ষণে ভারতের রাজনৈতিক মঞ্চে চারু মজুদারের আবির্ভাব।—বিশ্ব রাজনৈতিক ইতিহাসের যুগসন্ধিক্ষণের নেতৃবৃন্দের মতােই তাই তিনি হয়ে গেছেন বহু বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব। ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনকে এক সময়ে যে মুষ্টিমেয় ব্যক্তিরা নাড়া দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সবচেয়ে উজ্জ্বল হয়ে আছে চারু মজুমদারের নাম। এক প্রবীণ কমিউনিস্ট ঠিকই মন্তব্য করেছেন, “পি,সি, জোশী, বি,টি, রণদিভে আর চারু মজুমদার- ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে এই তিনটিই তাে উল্লেখযােগ্য নাম!”
নকশাল আন্দোলনের মহাযজ্ঞের মধ্যে দিয়ে জনগণের সাথে আত্মিক যােগাযােগ, সংগ্রামের প্রয়ােজনে অক্লেশে জীবনদানের প্রকৃত কমিউনিস্টসুলভ মানসিকতার প্রকাশ ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলনে যে নতুন প্রাণ সঞ্চার করেছিল তার হােতা হিসেবে চারু মজুমদারই সশস্ত্র বিপ্লবের ভূমিকা, এই বিপ্লবে কৃষি ও কৃষক সমস্যার গুরুত্ব, বিদ্রোহী ছাত্র-যুবকদের সংগ্রাম কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের গণ্ডিতে আবদ্ধ না রেখে কৃষকের সংগ্রামের সাথে সংযুক্ত করার আশু প্রয়ােজনীয়তাকে সকলের সামনে সজোরে উপস্থিত করেছিলেন, যারই ফলশ্রুতিতে কমিউনিস্ট আন্দোলনের সাধারণ সংগ্রামী কর্মীদের মধ্যে সব কিছুই কী ও কেন’ বলে যাচাই করার পদ্ধতি প্রচলিত হয়ে গেছে, কমিউনিস্ট আন্দোলনের মধ্যেই সংগ্রামী ধারা স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়ে গেছে, যা ইতপূর্বে আর কারােরই নেতৃত্ব সম্ভব হয়নি। তাই চারু মজুমদার কেবল একজন কমিউনিস্ট নেতাই ছিলেন না, এক সমাজ সংস্কারকের ভূমিকাও তার উপর বর্তেছিল। বাঙালির সমাজ সংস্কার সম্বন্ধে এক প্রবন্ধে তার উল্লেখও করা হয়েছে। প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা অজিত রায় ঐ প্রবন্ধের নামকরণই করেছেন রামমােহন থেকে চারু মজুমদার।
স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লবী অভ্যুত্থানের সম্মুখে কৃষি বিপ্লবকে কেন্দ্র করে সশস্ত্র বিপ্লবের দ্বারা সমাজ পবিরর্তনের যে দিকনির্দেশ চারু করেছিলেন, তার ফলে এদেশের সমাজের মধ্যে জনজীবনের সমস্ত অমীমাংসিত সমস্যাগুলাে প্রকাশ হয়ে পড়েছিল সামাজিক এই গুরুত্বপূর্ণ সমস্যাগুলাের মীমাংসায় গণআন্দোলন, গণসংগঠন ও রাজনৈতিক নেতৃত্বের আমূল পরিবর্তন দাবি করেছিল। চারুর উপলব্ধিতে এটি আসছিল তার জন্যই তিনি পুরানাে ধরনের সংগঠন ও আন্দোলনকে পরিপূর্ণ বর্জনের ডাক দিয়েছিলেন।
অথচ নকশাল আন্দোলন পুরানাের অপর্যাপ্ততা বর্জন করে নতুন বিকল্প সংগঠন ও আন্দোলনের হদিশ দিতে পারেনি, পারেনি কৃষি বিপ্লবকে ব্যাপকতর কৃষক জনগণের গণসংগ্রামে পরিণত করতে। বরঞ্চ সমস্ত সমস্যার একমাত্র সমাধান হিসেবে এসে গেছে ‘গােপন গেরিলা দল’ দ্বারা খতম’ অভিযান।
আদর্শগত ক্ষেত্রে আর্থনীতিক ও সাংস্কৃতিক বিপ্লবের এক বিশাল পটভূমির উদ্বোধন করে প্রয়ােগের ক্ষেত্রে চূড়ান্ত সংকীর্ণ দৃষিভঙ্গি সমগ্র নকশাল আন্দোলনকে যে স্ববিরােধিতায় নিমজ্জিত করে ফেলেছিল তার উৎস খুঁজতে গেলে এই আন্দোলনের হােতা চারু মজুমদারের রাজনৈতিক-আদর্শগত চিন্তাধারার বিকাশকে অনুধাবন করার প্রশ্ন স্বভাবতই এসে পড়ে।
আশৈশব বিদ্রোহী চারু দিশার ঠিকানা পেয়েছিলেন কমিউনিস্ট আন্দোলনে যােগ দিয়ে। প্রথম যৌবন থেকেই সর্বক্ষণের পার্টি কর্মী হয়ে কৃষক আন্দোলনের মধ্যে জনগণের সাথে ঘনিষ্ঠ হওয়ার সুযােগ পেয়েছিলেন, পার্টির কাজের প্রয়ােজনেই মার্কসবাদের শিক্ষার মধ্য দিয়ে সমাজ সচেতনতাও পেয়েছিলেন। বড় বড় সংগ্রামের একেবারে ভিতরে থেকে যেমন জনগণের, বিশেষত কৃষক সমাজের রাজনৈতিকআর্থনীতিক সমস্যাগুলাের উপলব্ধি হচ্ছিল তাঁর, তেমনই কৃষকের সংগ্রামী মনােভাবকে দেখেছিলেন অতি নিকট থেকে। কিন্তু ভারতের কমিউনিস্ট আন্দোলন তাকে এই অভিজ্ঞতার পূর্ণরূপ অর্জন করতে সুযােগ দেয়নি, এই আন্দোলনেরই নিজের দুর্বলতার জন্য। চল্লিশের দশকে কংগ্রেস নেতৃত্বের আপসকামী মনােভাবে বীতশ্রদ্ধ জনগণ যখন কমিউনিস্ট পার্টির কাছ থেকে নেতৃত্ব প্রত্যাশা করেছে তখন ভারতের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্ব তুমুল আন্দোলনের মধ্যে থেকেও আন্দোলনের গুণগত বিপ্লবী রূপান্তরে সাহায্য করেনি, স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের সামনে ভারতীয় সমাজ বিপ্লবের ভাবাদর্শগত নেতৃত্ব দিতে ব্যর্থ হয়েছে। চারুর মতাে সংবেদনশীল বিপ্লবী কমিউনিস্টরা এমন সব সংগ্রামের উদ্ভিদৎ পরিণতিতে প্রবল ধাক্কা খেয়েছে। অথচ পথের প্রকৃত দিশা না পেয়ে নিষ্ফল আক্রোশে ভুগেছেন। ক্রমাগত ব্যর্থতা ও ভারতের বিভিন্ন সময়ের রাজনৈতিক পরিবর্তনের ব্যাখ্যা করতে অপরাগতাসঞ্জাত পুঞ্জীভূত নিষ্ফল আক্রোশ উত্তর-ষষ্ঠ দশকের দিকে চারুকে ‘একলা চলাে রে’-এর মনােভাব নিয়ে গিয়েছে, তার ভাবাদর্শগত চিন্তার মধ্যে কিছু সমাজ-সচেনতনার সাথে যুক্ত হয়েছে মধ্যবিত্ত চরিত্রের ব্যক্তিগত প্রতিহিংসার মানসিকতা। ষাটের দশকে এসে চারু তেভাগা আন্দোলনের জনজাগরণের দিকটিকে বাদ দিয়ে দলিলের মধ্যে দেখান এক ব্যক্তি-কৃষক কী করে ‘শ্রেণি শত্রুর ঘাড়টা মুচড়ে ভেঙে দিল। “একলা চল রে’র মনােভাব অনড় একগুঁয়েমিতেও নিয়ে গেছে চারুকে। যার জন্য তার মুখ থেকে বেরিয়েছে-‘আমি চীনের কমিউনিস্ট পার্টির পশ্চিমবঙ্গ কমিটির সদস্য।’
একলা চলার ও শিশুকাল থেকে সবকিছু না মানার ভাবনা-চিন্তার পিছনে যেমন ছিল চারুর পারিবারিক ‘বােহেমিয়ানবাদ’-এর প্রভাব, তেমনি বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবনের বিকাশে এক ঐতিহাসিক ধারার প্রভাবও তাকে প্রচণ্ড প্রভাবিত করেছে রাজনৈতিক জীবনের প্রারম্ভ থেকেই।
বাংলার কমিউনিস্ট আন্দোলন (এক হিসেবে বলতে গেলে সারা ভারতেরই) নিয়ন্ত্রিত হয়েছে অষ্টাদশ শতাব্দীতে ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত যে ‘বাবু’ মধ্যবিত্তের আবির্ভাব, তাঁদের বংশধরদের দ্বারাই। পাশ্চাত্য শিক্ষার প্রভাবে এরা যেমন বুর্জোয়া উদারনীতিবাদ থেকে অনায়াসেই মার্কসবাদী ভাবধারা গ্রহণ করেছেন তেমনি এক শতক ধরে গ্রামীণ উৎপাদন ব্যবস্থার সাথে যােগসূত্র ছিন্ন হয়ে এঁদের চিন্তাধারায় বৈজ্ঞানিক সমাজচেতনার অপেক্ষা কেতাবি বিদ্যা ও মনােগত সিদ্ধান্তের উপর অতিশয় আস্থাই প্রধান হয়ে উঠেছে। বাংলার শ্রমিক ও কৃষক আন্দোলনেই তথা রাজনৈতিক চিন্তার ক্ষেত্রে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের পর্যালােচনা করলেই দেখা যাবে যে সংগ্রামী বুনিয়াদ জনগণের নিজস্ব প্রতিনিধিদের দাবিতে রেখে উচ্চ শিক্ষিত মধ্যবিত্তরাই সংগ্রামে সুবিধামতাে রাশ টেনে থামিয়েছেন, নিচ থেকে নেতৃত্বে আনেননি, এবং রাজনৈতিক বক্তব্য যা রেখেছেন তা বাস্তবের চেয়ে কল্পিত চিত্ৰণই বেশি। এঁরাই চল্লিশের দশকের উত্তাল শ্রমিক, কৃষক সংগ্রামকে কাগজে-কলমে বলেছেন- “সাম্রাজ্যবাদ বিরােধী বিপ্লবী সংগ্রাম” আর প্রতি পদে রাশ টেনে ধরেছেন সংগ্রামগুলােতে কিছু দাবি আদায় হচ্ছে’ বলে।
চারু মুজমদারের মধ্যেও যে বাঙালি মধ্যবিত্তের এই চরিত্রের উপাদান ছিল তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। নকশাল আন্দোলনের নেতৃত্বে থাকাকালীন পার্টি ও আন্দোলনের ক্ষেত্রে চারুর আমলাতান্ত্রিকতার উৎস তাে এখানেই।
ষাটের দশকের সামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতির তাগিদে চারু এই প্রভাবগুলাে। থেকে বেরিয়ে আসার প্রয়ােজনীয়তা অনুভব করেছিলেন। এখানে তার ইতিবাচক দিকগুলাের বিকাশের সূত্র। পরিস্থিতির চাপ যতদিন তেমনভাবে ছিল না ততদিন অর্থাৎ প্রায় পুরাে পঞ্চাশের দশকেই পার্টি সিদ্ধান্তগুলাে মানার কাজগুলােই করেছেন চারু (যেমন ‘৬৫ সালে অন্ধ নির্বাচনের প্রাক্কালে চা-শ্রমিকদের এক সভায় বলেছিলেন‘তােমরা এখানে মুজরি বাড়াবার আন্দোলনের কথা বলছ আর ওদিকে অন্ধে আমরা সরকার বানাতে চলেছি)। আন্দোলন না থাকার সময় বিভ্রান্তিতে ভুগে খুবই হতাশার মধ্যে দিন কাটিয়েছেন।
পরিস্থিতি যখন তাঁকে তাগিদ দিয়েছে তখনও আবার পুরানাে প্রভাবগুলােকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে সমাজ-বৈজ্ঞানিক চিন্তার দিকে যেতে পারেননি বলে তাঁর বিপ্লব-জিজ্ঞাসার মধ্যে আবেগপ্রবণতা ও কল্পনাবিলাস এক গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে রেখেছে। এখানেই চারুর সীমাবদ্ধতা, আর এখান থেকেই তাঁর নেতিবাচক দিকের যাত্রা শুরু।
এই পরিপ্রেক্ষিতকে বাদ দিয়ে চারু মজুমদারকে বুঝতে গেলে কখনই ধারণা করা যাবে না, যে ব্যক্তি সশস্ত্র শক্তির দ্বারা ক্ষমতা দখলের কথা বলেছেন তিনি সমর বিজ্ঞানের দিকটিকে একেবারেই বিচারের মধ্যে আনছেন না, কৃষি বিপ্লবকে কেন্দ্রবিন্দু করতে চাইছেন অথচ তার কোনাে কৃষি কর্মসূচি (Agrarian Programme) থাকছে , শ্রমিক সংগঠনকে সংশােধনবাদের আধার বলে শ্রমিকশ্রেণির ভূমিকাকেই একেবারে অস্বীকার করে ফেলেছেন। কৃষক গেরিলা দলে’ পূর্ণ গণতন্ত্রের কথা যিনি ক্রমাগত বলে এসেছেন, তিনি নির্দ্বিধায় নিজেকে ‘শ্রদ্ধেয় নেতা’, ‘একমাত্র কর্তৃত্ব’ আখ্যায় ভূষিত হওয়ার সুযােগ দিয়েছেন। তাঁর ‘অহং’ চেতনা বাড়িয়ে দেওয়ার সুযােগ ‘৬৯ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টি যথেষ্ট করে দিয়েছিল পিকিং রেডিওতে এবং পিকিং রিভিউ-এ তার লেখা প্রচার করে ও ছেপে দিয়ে। যদিও পরে ওঁরা এর দায়িত্ব অস্বীকার করেছেন।
সব মিলিয়ে আবেগ প্রবণতার স্বপ্নবিলাস এমনই পেয়ে বসেছিল চারুকে যে সমাজ বিকাশের নিয়মাবলির, শ্রেণি সচেতনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার তােয়াক্কা না রেখে এক জায়গায় স্বতঃস্ফূর্ত বিক্ষোভকে সারা ভারতের একটি শাশ্বত বা অ্যাবসলিউট অবস্থা। ধরে নিয়ে শত্রুর শক্তিকে একেবারেই হিসাবে আনতে চাননি। যেমন তার উক্তিগুলাে‘এক ভূমিহীন কৃষকের হাতে যদি রাইফেল তুলে দাও তবে সে বিশ্বজয় করতে পারবে’ বা ‘ভারতের সব পয়েন্টই এমন বিপ্লবী সম্ভাবনায় ভরপুর যে তিনজন কৃষকের গেরিলা দল গঠনেই এক এক এলাকায় বিজয় যাত্রা শুরু হবে।’ (যা থেকে আর একটু এগিয়ে সরােজ দত্ত জেল-দলিল দিলেন যে বিপ্লবী পয়েন্টের মধ্যে জেলও পড়েছে, সুতরাং জেল ভাঙো)। মাগুরজানের রাইফেল দখলকেই চারু বললেন গণফৌজের সৃষ্টি।
কল্পনাবিলাস মানুষকে কোথায় নিয়ে যায়! যখন চারদিকে ধরপাকড় আর পুলিশ ও ঠ্যাঙাড়েদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড চলছে তখনও চারু বলেছেন, “না, না, আসল ক্যাডাররা ঠিকই জনগণের মধ্যে রয়েছে। পুলিশ ও সুযােগ সন্ধানীরা যখন প্রতিহিংসা চরিতার্থ করছে নকশালদের নামে তখন চারু হাতে তুড়ি দিয়ে বলেছেন, ‘লড়াই এগিয়ে চলেছে। সত্তর সালের শেষের দিকে চারুর মাথায় এলাে—‘শত্রু পক্ষের মিথ্যা প্রচারে পার্টির (?) মধ্যে বিভ্রান্তি আসতে পারে যে পিছিয়ে পড়ছি। তাই তিনি নিজেদের রেডিও স্টেশনের কথা ভাবতে লাগলেন। সরােজ দত্তকে বললেন-“ব্যাপক প্রচার করতে হবে, বলতে হবে আমাদের গণফৌজ বিজয় পর্বে এগিয়ে যাচ্ছে।” (দেশ্বতীতেও একথা ছাপা হয়ে গেল যে ফৌজ শীঘ্রই লংমার্চ করবে।)।
চীনের পার্টির নেতাদের কোনাে রেডিওর যন্ত্রপাতি চাওয়া হয়েছিল। তারা সহাস্যে বলেছিলেন-“এটা তাে কোনাে খেলনা নয় যে-কেউ পকেটে নিয়ে যাবে। এত বড় জিনিস বসানাের জন্য কোনাে আধার এলাকাই তাে তােমাদের নেই?” উত্তরে চারু খুবই ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন এবং বলেছিলেন, “দরকার নেই এতে কারাে সাহায্যের। আমরা বড় নদীতে নৌকার উপর বা মাটির নিচে কোনাে বাড়ির নিচু তলা থেকে রেডিও ব্রডকাস্ট করব ‘রেডিও লিবারেশান’ নামকরণ করা হয়েছিল।
এসব উল্লেখ করতে মনে বেদনাও জাগে। কিন্তু এই মহান বিপ্লবীর জীবনে সীমাবদ্ধতাগুলাে কীভাবে বাধা হয়ে দাঁড়ায় তা না জানলে ঐ জীবন থেকে শিক্ষা নেওয়ার জায়গা যে থাকে না।
চারু মজুমদারের সহযােগীদের মধ্যে তাঁর সমালােচকেরা এই ঐতিহাসিক দিকের সীমাবদ্ধতা বিচারে আনতে পারেননি, কারণ তারা নিজেরাও এই সীমাবদ্ধতার মধ্যে ছিলেন। তাই তাদের সমালােচনা ইতিহাসের বস্তুনিষ্ঠ বিশ্লেষণের বদলে চারুকে ব্যক্তিগতভাবে দোষী সাব্যস্ত করার দিকে চলে গেছে।
মার্কসবাদী সমাজ-বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে ভারতীয় সমাজের বিশ্লেষণ এবং ভারতীয় বিপ্লবের রণকৌশল প্রস্তুত করতে অপরাগতা চারুকে ধারণা জুগিয়েছিল যে ভারতের সমাজব্যবস্থা প্রাক্ বিপ্লবী চীনেরই অনুরূপ আধা-সামন্ততান্ত্রিক আধা ঔপনিবেশিক। চারুর বক্তব্য ছিল—“এই জন্যই চেয়ারম্যানের ‘নয়া গণতন্ত্র প্রবন্ধেই আমাদের রণনীতি এবং লিন পিআও-এর ‘জনযুদ্ধের জয় দীর্ঘজীবী হােক’ প্রবন্ধ আমাদের রণকৌশল।’ সমালােচকেরা ‘২০-এর দশকের চীনা সমাজের সাথে ‘৬০-এর দশকের ভারতীয় সমাজের তুলনাকে চ্যালেঞ্জ তাে করেনইনি, বরং স্বীকার করে নিয়েই এগিয়েছিলেন। চীন বিপ্লব যে শুরুই হয়েই হয়েছে সশস্ত্র প্রতিবিপ্লবী আক্রমণকে প্রতিরােধ করে বিপ্লবী শক্তির অস্তিত্ব রাখা সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তা করাও আলােচনায় আসেনি। চারু বলেছিলেন, “সামন্ততন্ত্রের সাথে সমস্ত জনগণের দ্বন্দ্বই ভারতীয় সমাজের মুখ্য দ্বন্দ্ব। এর সমালােচনায় ‘সাম্রাজ্যবাদের সাথে জনগণের দ্বন্দ্ব’ কে মুখ্য বলা হলাে, কিন্তু চারুর মতাে তাঁর সমালােচকেরাও ভারতীয় একচেটিয়া ধনীক গােষ্ঠীর অস্তিত্বটিকে অস্বীকার করে গেলেন। ফলে ভারতীয় রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে এদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা অস্বীকৃত হলাে- এরাই যে সাম্রাজ্যবাদ ও সামন্ততন্ত্রের এদেশের ধারক, গণসংগ্রামের বর্ষামুখ যে এদেরই বিরুদ্ধে থাকবে সে কথাটিও তেমনি দৃষ্টির বাইরে থেকে গেল, আর বরাবরের মতাে রাজনৈতিক উদ্যোগটিও এদেরই হাতে থেকে গেল। যার দ্বারা সংদসীয় বিরােধী পক্ষকে শাসক শ্রেণি ইচ্ছামতাে উঠিয়েবসিয়ে আসছে।
চারু মজুমদারের প্রচেষ্টা অন্যায়ভাবে হলেও এই বৃহৎ বুর্জোয়ার হাত থেকে রাজনৈতিক উদ্যোগ কেড়ে নেওয়ার এক অবস্থা নিঃসন্দেহে সৃষ্টি করেছিল, শাসক শ্রেণি তাই নকশাল আন্দোলনের বিরুদ্ধে এত হিংস্র আক্রমণ চালিয়েছিল। রাষ্ট্রশক্তির বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রসঙ্গ যখন এসে পড়েছিল তখন কিন্তু সম্ভাবনা ছিল শাসকশ্রেণির বিরুদ্ধে গণ উদ্যোগ সৃষ্টি করার, চারুর সীমাবদ্ধতা যে সংকীর্ণতার মধ্যে তাকে আটকে ফেলেছিল, সেদিকে অন্যদের দৃষ্টি পড়লে চারু মজমুদারকেও তাঁর ত্রুটিগুলাের সম্বন্ধে সচেতন করে তােলা একেবারে অসম্ভব ছিল না। কিন্তু কে তা করবে? পার্টির মধ্যে সংগ্রামের বদলে ভাঙন ধরানাে যে দেশের কমিউনিস্ট আন্দোলনের উত্তরাধিকার, সেখানে সমগ্র পার্টিকে সঠিক পথে আনার সংগ্রামের চেয়েও চারুর সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করাটাই প্রধান উদ্দেশ্যে পরিণত হয়ে দাঁড়াল শেষ অবধি।
এই মহান বিপ্লবী, যিনি গুরুতর হৃদরােগে আক্রান্ত হওয়ার পরও আট বছর ধরে ভারতের মুক্তির জন্য সংগ্রাম করে আত্মাহুতি দিলেন, তাঁর ও তাঁর সৃষ্ট নকশাল আন্দোলন থেকে শিক্ষা নেওয়ার আজও অনেক বাকি রয়েছে— বাকি রয়েছে স্বতঃস্ফূর্ত গণ অভ্যুত্থানের কারণ বিশ্লেষণ, অভ্যুত্থানের মধ্য দিয়ে নৈরাজ্যবাদ বা অ্যানার্কিজ-এর স্বাভাবিক উদ্ভব, আদর্শগত নেতৃত্ব ও পার্টি নিয়ন্ত্রণের মধ্যকার সম্পর্ক, ভারতের মতাে বহুত্বের (pluralistic) সমাজে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বের অগ্রগামী বাহিনীর (advenced detachment) ভূমিকার পুনর্বিচার বিশ্লেষণ; সর্বোপরি চারু মজুমদারের বক্তব্যের সূত্র ধরে ভারতীয় সমাজের রাজনৈতিক-অর্থনীতিক মূল্যায়ন প্রভৃতি বিষয়।
সব কথার শেষে একটিই বলতে হয় যে গজদন্তে যত চিড়ই থাক গজদন্ত যেমন গজদন্তই থেকে যায় তেমনই চারু মজুমদার চারু মজুমদারই। সুকান্তের কবিতা দিয়ে বলতে হয়—
“সফল ! সফল ! সেদিনের কলকাতা-
হেঁট হয়েছিল অত্যাচারী ও দাম্ভিকদের মাথা।”
পৃষ্ঠা: ১৯৯
———X———