You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

গণমানুষের স্মৃতিতে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ
শঙ্করী দাস

মাে. দাউদ হােসেন অব, গ্যারিসন ইঞ্জিনিয়ার (এমইএস) ১৫৩ লেক সার্কাস, কলাবাগান, ঢাকা-১২০৫

সাতচল্লিশের দেশবিভাগের পর বিশেষ করে বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের মধ্য দিয়ে বাঙালিদের মনে যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছিল পাকিস্তানি শাসকরা সে ক্ষত উপশমের চেষ্টা তাে করেইনি বরঞ্চ তাদের কার্যক্রমের দ্বারা ক্ষত আরও গভীর থেকে গভীরতর করেছিল। ফলে জন্মলাভ করে বাংলাদেশ। বাঙালি অর্জন করে স্বাধীনতা। স্বাধীনতা অর্জনে বাঙালিকে দিতে হয়েছে চরম মূল্য। দীর্ঘদিনের ত্যাগ-তিতিক্ষা, জেল-জুলুম, অবিচার, অত্যাচার, আন্দোলনসংগ্রামের বিনিময়ে আসে বাংলাদেশ। প্রতিজন বাঙালি এই ইতিহাস অবগত আছেন। বাঙালিদের ওপর পাকিস্তানিদের শেষ নিপীড়ন একাত্তরের ২৫ মার্চ থেকে ১৬ ডিসেম্বর অবধি। তাে আমি ২৫ মার্চ পরিজনসহ কলাবাগানের বর্তমান বাসায় ছিলাম। রাত বারটার পর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে গােলাগুলির আওয়াজ হতে থাকে। তখন আমি আঁচ করতে পারি কিছু একটা শুরু হয়ে গেছে। আগের দিন ক্যান্টনমেন্ট এলাকা পরিদর্শনের ডিউটি ছিল আমার। সে সময় আমি ছিলাম মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ার সার্ভিসেস (এমইএস)-এ। পরিদর্শনে গিয়ে দেখি সবার মুখ থমথমে। কারাে মুখে কথা নেই। তখনই বুঝতে পারি পরিস্থিতি ঘােলাটে। ইতিপূর্বে অসহযােগ চলাকালীন বাঙালি পেশাজীবীদের পক্ষ থেকে অন্য কয়েকজনের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর সাথে দেখা করি। আমি বলি, ক্যান্টনমেন্টের সাথে আমরা যারা সংশ্লিষ্ট আছি তারা কী করবাে? বঙ্গবন্ধু বললেন, আপনারা বাইরে চলে আসেন। উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধু যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিচারাধীন ছিলেন তখন আমাকে চারদিন আটক রাখা হয় সন্দেহমূলক ভাবে। কারণ আমি নির্ভীকভাবে কথা বলতাম। পারতপক্ষে উর্দু ভাষা ব্যবহার করতাম না। বিষয়টি তারেক রহমানের শ্বশুর তৎকালীন লেফটেন্যান্ট এম এ খান সাহেব জ্ঞাত ছিলেন।
আমি কলাবাগানে অবস্থান করি মে মাস পর্যন্ত। পরিবারের সদস্যদের সরিয়ে দেবার কোনাে সুযােগ করতে পারিনি। বাসার ভেতরেই থাকতাম। আমার সহকর্মীদের যারা ক্যান্টনমেন্টের ভেতর প্রসেশন করেছিল এবং পানি, বিদ্যুৎ, গ্যাস বন্ধ করেছিল তারা আমার সঙ্গে দেখা করে কাজে যােগদানের বিষয়টি নিয়ে আলােচনা করলাে। তারা তিনজন গােপনে আমার বাসায় এলাে। আমি তাদের কাজে যােগদান করতে নিষেধ করলাম। কারণ যােগদান করলে মৃত্যু ছিল অবধারিত। এটা আমি বুঝতে পেরেছিলাম। নিষেধ সত্ত্বেও নুরুল হুদা কাজে যােগদান করলাে। নেমে এলাে তার ওপর নির্মম অত্যাচার। তবে তাকে মেরে ফেলেনি। মৃতপ্রায় করে যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত বন্দি অবস্থায় ক্যান্টনমেন্টে রেখে দিয়েছিল। এরা তিনজন বর্তমানে জীবিত আছেন। এদের নাম হলাে- মােহাম্মদ আলী, আলী ইমাম ও নুরুল হুদা।

ইতােমধ্যে কাজে যােগদানের জন্য আর্মি চাকরিজীবীদের ওপর প্রচণ্ড চাপ দিতে থাকলাে। বাধ্য হয়ে কাজে যােগদান করি। সম্ভবত তারিখটি এপ্রিলের প্রথম দিকে হবে। মহা এক আতঙ্কে অফিস করতে থাকি। ঢাকা শহর ছিল থমথমে। বহুলােক ঢাকা ত্যাগ করছিল। বিহারিদের দাপটে চলছিল ঢাকা শহর। বিহারিরা আর্মিদের সাপাের্ট বাহিনী হিসেবে কাজ করছিল। আর্মির থেকেও বিহারিরা বাঙালি নিধনে ছিল অগ্রগামী। বহু লোেক তারা হত্যা করেছিল। আমি আমার কলাবাগানের বাড়ির জমিটুকু যে দ্রলােকের কাছ থেকে কিনেছিলাম একদিন শুনলাম সেই ভদ্রলােককেও বিহারিরা হত্যা। করেছে। প্রতিদিনই গুলির শব্দ শুনতে পেতাম। আর পেতাম হত্যার খবর।
আমাদের ক্যান্টনমেন্ট অফিসের উত্তর পাশে অফিস লাগােয়া দুটো সিগন্যাল রেজিমেন্টের দুটো ব্যারাক ছিল। ব্যারাক দুটো ছিল আমার হাতে। কিন্তু আমার হাত থেকে ব্যারাক দুটো নিয়ে ঠিকঠাক করে নিলাে ওদের ব্যবহারের জন্য। আমার অফিসে বেশিরভাগ লােক অনুপস্থিত থাকে। লােকজন কম থাকায় কয়েকজন বাঙালি সেপাই ওরা আমার আন্ডারে নিয়ােগ দেয়। বাঙালিসেপাইদের সাথে খুব দুর্ব্যবহার করা হতাে। মারধর করতাে। দিনান্তে খেতে দিতাে এক-আধখান পােড়া রুটি। ইতােমধ্যে চীন থেকে অস্ত্রশস্ত্র এবং ইলেকট্রনিক্স মালামাল চিটাগাং আসে। সেখান থেকে ট্রেনযােগে সেগুলাে ঢাকায় আনা হয় এবং সেগুলাে রাখা হয় ব্যারাক দুটো ভর্তি করে। পরদিন মাঝরাতে বাঙালি সেপাইরা ব্যারাক দুটোতে আগুন ধরিয়ে দেয়। মুহূর্তে সেই সময়ের দুই হাজার কোটি টাকার অস্ত্রশস্ত্র সাকুল্যে ভস্মীভূত হয়ে যায়। সম্ভবত এটাই প্রথম ক্যান্টনমেন্টের মুক্তিযুদ্ধ। ওরা আগুন নেভাতে পারেনি। আর্মি দিশেহারা হয়ে দিগ্বিদিক ছুটোছুটি করছিল। গার্ডরুমের প্রহরীদের সাথে সেপাইদের হাতাহাতি শুরু হয়। দুজন সেপাই মারা যায়। দুজন আহত হয়। আর্মির দুজন মারা যায়। সেপাইরা দুটো বন্দুকু কেড়ে নিয়ে গুলি ছােড়ে এবং তারা বন্দুকসহ পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু চারজন ধরা পড়ে। তাদের ভাগ্যলিপি জানা যায়নি।
পরদিন অফিসে এসে ঘটনা জানতে পারি। অফিসে পৌছার অল্প সময়ের মধ্যে আমাকে ও বাঙালি এমডিও জামান সাহেবকে ডিভিশন হেডকোয়ার্টারে ডেকে নিয়ে যায়। সেখানে অনেক জিজ্ঞাসাবাদ করে। বেলা দুটো পর্যন্ত বসিয়ে রাখে। এর দু’তিনদিন পর আমাদের দুজনেরই পাকিস্তানে বদলির অর্ডার এলাে। অর্ডার পাওয়ার সাথে সাথে অফিসের চার্জ বুঝিয়ে দিতে হলাে। এ কাজটি করতে হলাে আমাকে বন্দুকের নলের মুখে। হাই ছিলেন সাব অ্যাসিস্টেন্ট ইঞ্জিনিয়ার। চার্জ উনাকে দেয়া হলাে। সই করার সময় উনার হাত থরথর করে কাঁপছিল। এরপর জিপে করে আমাকে বাসায় নিয়ে এলাে। উর্দুতে বললাে, কাপড় নিয়ে নাও। বললাম, কাপড় লাগবে না চলাে। বুঝতে পারছিলাম এই মুহূর্তে আমাকে মেরে ফেলবে না। আমাকে এয়ারপাের্টে এনে করাচির টিকেট ধরিয়ে দিলাে। প্লেনে উঠে জানতে পারলাম আমার পােস্টিং গুজরানওয়ালা ক্যান্টনমেন্টে। সেখানে কাজে যােগদান করে অফিস করতে থাকি। মহাদুশ্চিন্তায় দিন কাটে। দেশ, পরিবার-পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন। অবসাদ আমাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খায়। চিন্তা করতে থাকি কীভাবে দেশে ফেরা যায়। কাদিয়ানি চিফ ইঞ্জিনিয়ার সবরকম সুবিধা দিয়ে আমাকে একত্রে দুটো পােস্টের চার্জ বুঝিয়ে দেয়। যতদিন পাকিস্তানে ছিলাম রাজনীতি নিয়ে কারাে সাথে কোনােরকম কথা বলিনি। প্ল্যান করলাম দেশে ফেরত আসবাে, আর ফিরে যাবাে না। ওদের বললাম কয়েকদিনের ছুটি চাই। পূর্ব পাকিস্তানে যাবাে ফ্যামিলি আনতে। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে অনুমতি পাওয়া গেলাে । তখন নভেম্বর মাস। ওরা দশদিনের ছুটি মঞ্জুর করে। কিন্তু দেশে আসা মাত্র জানতে পারি জামায়াত, রাজাকার এবং আর্মির পক্ষ থেকে আমাকে হত্যার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কারণ আমি ১৯৪৯ সালে চট্টগ্রাম জে এম সেন হলে মওলানা ভাসানী, শামসুল হক এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সম্মেলনে মুসলিম আওয়ামী লীগের সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলাম।
হালিম নামে এক হায়দরাবাদী ব্যবসায়ী ভদ্রলােক ছিলেন। ভদ্রলােকের সাথে আমার পূর্ব থেকে ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমি দেশে ফিরলে তিনি তার নিজের গাড়ি দিয়ে দেশের বাড়ি পাবনা (শাহজাদপুর) পরিজনসহ পাঠানাের ব্যবস্থা করেন। গাড়ি গেটে এসেছে। এমন সময় মােটরসাইকেলযােগে হালিম খানের ভাগিনা উপস্থিত হলাে। বললাে, দাউদ ভাই, আপনি দেশে যাবেন না। মামা হালিম সাহেব আমাকে পাঠিয়েছেন। বিপদ হবে। বাধ্য হয়ে যাওয়া স্থগিত করতে হলাে। কমর নামে এক পাকিস্তানি মেজর ছিল। কমরের সাথে আমার হৃদ্যতা ছিল। অতীতে ওর অনেক সমস্যায় আমি সাহায্য করেছি। সেই কমর আমাকে ওর শেরে বাংলানগর অফিসে ডেকে নিয়ে গেলাে। সে বললাে, তুমি পাকিস্তানে চলে যাও। না হলে তােমাকে মৃত্যুবরণ করতে হবে। সে মৃত্যু হবে আমার মাধ্যমে। ওপরের নির্দেশনা অবিলম্বে তােমাকে শেষ করে দেয়া হবে। একদিন পর পাকিস্তানে চলে যাই। কমর হালিম খান সাহেবের গাড়ি দিয়ে আমাকে এয়ারপাের্টে পৌছে দিলাে।
কিছুদিন পর যুদ্ধ শেষ হলাে। আমার চাকরিটাও চলে গেলাে। কারণ ওরা অপশন চায়। আমি পাকিস্তানে থেকে যাবাে নাকি ওদের ভাষায় socalled বাংলাদেশে চলে যাবাে। ওরা লিখিত নেয়। বাংলাদেশে ফিরে যাবার অপশন দিই।
গুজরানওয়ালা ক্যান্টনমেন্টে আমি তখন একমাত্র বাঙালি। খুব সামান্য ভাতা দিয়ে রাখা হলাে আমাকে। ছয় মাইল পরিধির ভেতর আটকে পড়ে রইলাম। বাঙালি মিলিটারির জন্য আলাদা ক্যাম্প করা হয়েছিল। দুজন লােক সারাক্ষণ আমার ওপর নজরদারি করতাে। এরই মধ্যে বাঙালিরা পালিয়ে দেশে ফেরার উপায় খুঁজছিল। বন্দি অবস্থাতে আমার বাহাত্তর দিন কাটে। দিনগুলাে কেটেছে চরম উৎকণ্ঠা, বেদনা আর হতাশায়। মাঝে মাঝে মনে হতাে আমি যেন একটি ছারপােকা। টিপ দিলেই শেষ। চারদিকের বাসিন্দারা সব পাঞ্জাবি। গ্রামের নাম ছিল রাওয়ালি। তিয়াত্তর সালে লাহােরে বাঙালিদের সাথে যােগাযােগ করার সুযােগ আসে আমার। এক পর্যায়ে তাদের কাছে দালালদের মারফত সীমান্ত পার হওয়ার ঘটনা জানতে পারি। তখন আমি সিদ্ধান্ত নেই আমিও এভাবে বর্ডার ক্রস করবাে। ভাগ্যে যা থাকে হবে। দালালদের সাথে যােগাযােগের চেষ্টা করতে থাকি লাহােরের বাঙালিদের মাধ্যমে। কাপাসিয়ার সালাম নামে একটি ছেলে ছিল। ওর সাথে যােগাযােগ ছিল পাকিস্তানি দালালদের। তিয়াত্তরের মাঝামাঝি সময়ে সালাম আমার বাসায় এসে আমাকে লাহােরে নিয়ে গেলাে। দু-একদিন পর একদিন বাসে করে আমাদের ইন্ডিয়ান বর্ডারের দিকে নিয়ে যায়। সালাম মানিকগঞ্জের আরও একটি বাঙালি পরিবারকে নিয়ে আসে। দ্রলােকের নাম ছিল ফজলুল হক। উনার সাথে স্ত্রী ও একটি শিশুসন্তান। বাস গিয়ে দাঁড়ালাে শতদ্রু নদীর তীরে। ওপারে ইন্ডিয়া। এপারের বর্ডার এরিয়ার মাইলের পর মাইল জুড়ে ছিল শুধু পেয়ারা বাগান।
আমরা যখন শতদ্রু নদীর পাড়ে পৌছলাম তখন রাত আটটা বেজে গেলাে। আকাশে উকি দিলাে চাদ। কথা ছিল নৌকা দিয়ে আমাদের পার করবে। কিন্তু কথা রাখেনি। বলা হলাে নদী সাঁতরে পার হয়ে যাও। আমাদের সামনে দ্বিতীয় পথটি খােলা নেই। চিন্তা করার সুযােগ ও সময় কোনােটাই নেই। আমি প্রথমে পানিতে নামলাম। পানির পরিমাণ অনুমান করার জন্য। পানি ছিল খুব ঠাণ্ডা। তবে গভীরতা ছিল কম। প্রথমে আমি ফজলুল হকের স্ত্রী ও ছেলেকে পার করি অনেক কষ্টে। মহিলা ছিল গর্ভবতী এবং সাঁতার জানতাে না। মহিলা যখন ডুবে যাচ্ছিল তাকে চুলের মুঠি ধরে ওপরে টেনে তােলার চেষ্টা করতে থাকি। শিশুটিকে পার করি উঁচু করে তুলে ধরে। ফজলুল হক, সালাম কোনােমতে পার হলাে। নদীর ওপারে চর জেগেছিল। ভেতরে ঝাউবন। ঝাউবনের পরে আবার একটা সরু নদী। নদীতে পানি খুব একটা ছিল না। এক কোমরের মতাে হবে। তখন চাদের আলাে আমাদের ওপর ঝরে পড়ছিল। এমন সময় ইন্ডিয়ান বর্ডার ফোর্স (বিএসএফ) আমাদের দেখতে পেয়ে গুলি ছুড়ে। দালাল গুলির শব্দ শুনে পালিয়ে যায় আমাদের ফেলে। আমি তখন মৃত্যু নিশ্চিত বুঝতে পেরেও চিতকার করে বলে উঠি সারেন্ডার। সারেন্ডার! গুলি মাত করাে। আমরা বাঙালি। গুলি মাত করাে। বিএসএফ থেকে বলে ওঠে, “তােম লােক ভাই হ্যায়, ইধার আ যাও।’ বাইশ দিন অফিসিয়াল আনুষ্ঠানিকতা শেষে দিল্লি হয়ে স্বদেশের ভূমি স্পর্শ করি। এর মধ্য দিয়ে শেষ হয় আমার স্বাধীনতাযুদ্ধের স্মৃতিবহুল দিন।

মাে. সাইদুর রহমান প্রাক্তন পৌর চেয়ারম্যান (সাধু চেয়ারম্যান) ভাষাসৈনিক, আওয়ামী মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য, জামালপুর।

সত্তরের ইলেকশনের পর থেকে রাজনীতি সচেতন দেশবাসী খুব একটা স্বস্তিতে ছিল না। পরিস্থিতি কী দাঁড়ায় শেষ পর্যন্ত এ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিল অনেকে। কারণ বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বিষয়টি পাকিস্তানিদের পক্ষে সহজ ছিল না। বাঙালিদের ওরা কখনাে সম্মানের চোখে দেখেনি। ততকালীন পূর্ব পাকিস্তানকে ওরা ওদের একটি ঔপনিবেশিক ভূখণ্ড হিসেবে দেখে আসছিল। পাকিস্তানিরা সহজে ক্ষমতা ছেড়ে দেবে না। আন্দোলন – সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ক্ষমতা ছিনিয়ে আনতে হবে। এমন ধারণা সবার মধ্যে বদ্ধমূল হয়েছিল পাকিস্তানিদের ক্ষমতা হস্তান্তরের গড়িমসি দেখে। জামালপুরে আমরা বন্ধুরা মিলে আলােচনা করতাম। রাজনৈতিক কর্মপন্থা চিন্তা করতাম। এভাবে আসে ঐতিহাসিক ৭ মার্চ। ৭ মার্চে বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে মূলত স্বাধীনতার ঘােষণা দেন। এরপর বাঙালি পুরােপুরি ঐক্যবদ্ধ হয় এবং স্বাধীনতা সগ্রামের প্রস্তুতি নিতে থাকে। এমতাবস্থায় ২৫ মার্চ দিবাগত রাতে ঢাকায় পাকবাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে বাঙালিদের ওপর অঘােষিত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়। ২৫ মার্চ থেকে শুরু হয় একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ।
২৬ মার্চ ভােরে আমি আগের রাতে ঢাকায় আক্রমণের সংবাদ পাই। রেডিও বিবিসির মাধ্যমে খবরটা শুনি। তখন পরিবারের সদস্যদের নিরাপত্তার কথা চিন্তা করি। বিশেষত মহিলাদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ি। নারী নির্যাতনের বিষয়টি আমার মাথায় আসে। অবশ্য বিষয়টি আমরা বন্ধুস্থানীয়রা আগেও আলােচনা করেছি। প্রথমত সেদিনই আমি গাড়ি সংগ্রহ করে মা-বাবা, বােন ও স্ত্রীকে সরিষাবাড়ী বাউসি এলাকায় পাঠিয়ে দিই। আমার ভাইয়েরা স্ত্রী-ছেলেমেয়ে নিয়ে যে যার শ্বশুরবাড়ি শ্রীবর্দী বকশিগঞ্জ ইত্যাদি এলাকায় চলে যায়। আমি জামালপুরে থেকে যাই। পাকবাহিনী যেদিন জামালপুর প্রবেশ করে আমি জামালপুর ছেড়ে যাই সেদিন। জামালপুর শহর তখন জনশূন্য। লােকজন ২৫ মার্চের পর থেকে শহর ছাড়তে শুরু করে। লােকজনের প্রথমত ধারণা ছিল শুধু শহরগুলাে আক্রান্ত হবে। কিন্তু বাংলাদেশের প্রতিটি ইঞ্চি যে অত্যাচারিত হবে এ কেউ কল্পনাতেও আনেনি। জামালপুর ছেড়ে চলে যাবার সময় দূর থেকে লক্ষ করি পাকবাহিনী শহরে। আগুন দিচ্ছে এবং লুটতরাজ চালাচ্ছে। আমি গরুর গাড়িতে চড়ে চন্দ্রা, বগাবাইদ, ভাটারা হয়ে বাউসি পৌছি। সেখানে কয়েকদিন অপেক্ষা করে দেশের পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করি। বিভিন্ন সূত্র থেকে খবর সংগ্রহ করতে থাকি। এক পর্যায়ে সেখানে যুদ্ধের জন্য কিছু ছাত্র সংগঠিত হতে থাকে। আমার শ্যালক আব্দুল হামিদ খান ছিল ২য় বর্ষের ছাত্র। আমার শ্যালক ছিল আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র। আশেক মাহমুদ কলেজের কিছু ছাত্র এবং সরিষাবাড়ীর কিছু ছেলের সাথে ভাটারা স্কুলের কিছু ছাত্র একত্রিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধের মানসিক প্রস্তুতি নেয়। এমতাবস্থায় ওরা সিদ্ধান্ত নেয় ভারতে চলে যাবে। ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং নেবে। আমি সিদ্ধান্ত নেই ওদের সাথে চলে যাবাে। মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবাে। আমাদের দলটি ছিল ষোল জনের।
১৩ এপ্রিল সন্ধ্যায় আমরা ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। প্রথমে আমরা হাজিপুর বাজারে যাই। বাজার থেকে নৌকাযােগে নদীর ওপারে পৌছি। এরপর পায়ে হেঁটে ঝাউগড়া বাজারে গিয়ে বিশ্রাম নিই। সামান্য কিছু টিফিন করি। তখন রাত এগারটা। আবার আমরা হাঁটা শুরু করি। মেলান্দহ রেলস্টেশন পার হয়ে দূরমুট যাই। দূরমুটে অবস্থানরত ছােটভাইকে সঙ্গে নিয়ে দূরমুট নদীর পাড়ে আসি। তখন ভাের হয়ে গেছে। নৌকাযােগে নদী পার হয়ে দুই-তিন মাইল দূরে এক স্কুলে গিয়ে আশ্রয় নিই। সেখানে পাট ব্যবসায়ী হােসেন আলী সরকার নামে এক ভদ্রলােক ছিলেন। তিনি আমাদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করেন। স্কুলের ভেতরে হাঁড়ি, পাতিল, চাল, ডাল দিয়ে সব ব্যবস্থা করেন। এ সময় হাজরাবাড়ীর স্কুলের ফিজিক্যাল টিচারের নেতৃত্বে এগারাে জনের একটি দল স্কুলে আমাদের সাথে মিলিত হয়। সবাই মিলে খাওয়া-দাওয়া করি। খাওয়া-দাওয়া শেষ করে ভারতের মহেন্দ্রগঞ্জের দিকে রওনা হই। সন্ধ্যা নাগাদ আমরা বর্ডার ক্রস করি। মহেন্দ্রগঞ্জ বাজারের কাছে গাঁওঘােরা গ্রামে আব্দুর রহমানের বাড়িতে ক্যাম্প স্থাপিত হয়েছিল। আমরা সেই ক্যাম্পে আশ্রয় নিই। সেখানে জামালপুরের অনেক ছেলে ছিল। তৎকালীন এমপি হাকিম সাহেবের গ্রামের বেশ কিছু ছেলেও ছিল সেখানে। সেখানে থাকাকালীন অধিকাংশ ছেলে ট্রেনিং সেন্টারে চলে গেলাে। আমার শ্যালকসহ কয়েকজন ছেলে বাড়িতে চলে আসে বিদায় নিতে । আমি দু’মাস ওখানে অবস্থান করে চলে আসি। আমার সাথে ছিল আনসার কমান্ডার নুরুল হক ও কমান্ডার আনসার আলি। আমাদের পরিকল্পনা ছিল পরিবারের দেখভাল করে পুনরায় ভারতে ফিরে গিয়ে যুদ্ধে অংশগ্রহণ করবাে। আমাদের দেশে ফেরার তারিখটি ছিল ২৯ জুন। দেশে ফিরে বাউসিতে শ্বশুরবাড়ি যাই। সেখানে আমার পরিজনকে রেখে গিয়েছিলাম। বাউসিতে পরিবারের সাথে অবস্থানকালে ৭ জুলাই আমি ও আমার শ্যালক পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ি। রাত বারটার দিকে বাড়ি থেকে আমাদের ধরে নিয়ে আসে। আমাদের সাথে নিয়ে আসে সাবেক এমপি আব্দুল হামিদ মােক্তার এবং আরও দুজন অপরিচিত ছেলেকে।

আমাদের নিয়ে এলাে জামালপুর পিটিআই সেনা ক্যাম্পে। দশ তারিখ একজন সুবেদার মেজর একজন একজন করে নাম জিজ্ঞেস করে ঢােকালাে অন্য রুমে। হামিদ মােক্তার সাহেবকে ছেড়ে দিলাে। আমাদের বলা হলাে আগামীকাল ছেড়ে দেওয়া হবে। কিন্তু রাত বারটার দিকে মােক্তার সাহেবকে খাবার খেতে থাকা অবস্থায় তুলে গালিগালাজ করতে করতে টেনেহিঁচড়ে আবার নিয়ে এলাে ক্যাম্পে। ওরা আশপাশের গ্রামগুলাে থেকে ধরে নিয়ে এলাে আরও বহুলােক। আমাদের দুটি দলে ভাগ করা হলাে। চৌদ্দ তারিখ ক্যাম্পের সামনে সাতাশ জনের একটি দল এনে দাঁড় করালাে দিবাগত সন্ধ্যায়। নাম-পরিচয় জিজ্ঞেস করে করে সাত জনকে ক্যাম্পে রাখা হলাে। এদের মধ্যে আমি ও আমার শ্যালক ছিলাম। বাকিদের নিয়ে গেলাে ফায়ারিং স্কোয়াডে। সাবেক এমপি আব্দুল হামিদ মােক্তার সাহেব ছিলেন এদের ভেতর। ক্যাম্প থেকে আরও লােকজন বের করে নিয়ে নদীর পাড়ে নিয়ে গেলাে গুলি করার জন্য। বদর বাহিনীর কয়েকজন তখন বসা ছিল। তারা শনাক্তকারীর কাজটি করছিল নির্মমভাবে। ক্যাম্পে পাঞ্জাবি ক্যাপ্টেন শমসাদ ছিল ভয়ংকর বর্বর। নিজে সে সবাইকে পেটাতাে ও গালিগালাজ করতাে। বদর বাহিনীর ছিল আলাদা ক্যাম্প। আশেক মাহমুদ কলেজের হােস্টেলকে ওরা ক্যাম্প বানিয়ে ছিল। সেখানেও প্রতিদিন যুবকদের ধরে এনে চালানাে হতাে ভয়ংকর নির্যাতন। পরদিন হঠাৎ পনের জুলাই আমাদের জেলখানায় নেওয়ার কথা বলা হলেও নেওয়া হলাে না। বাকিদের নেয়া হলাে। আমি ও আমার শ্যালক ছাড়া। পনের তারিখ থেকে বাইশ তারিখ পর্যন্ত আরও লােকজন ধরে নিয়ে এলাে। এদের মধ্যে সবাই ছিল তরুণ থেকে মাঝবয়সী। বাইশ তারিখ রাতে আমাদের মােট চৌদ্দজন ট্রাকে করে ব্রহ্মপুত্র নদের পাড়ে শ্মশানঘাটে নিয়ে এলাে। সারিবদ্ধভাবে দাঁড় করালাে। তারপর চালালাে গুলি। আমার হ্যান্ডকাপ লুজ থাকায় গুলি করার সময় হ্যান্ডকাপ খুলে ব্রহ্মপুত্রে ঝাপ দিই। কীভাবে হ্যান্ডকাপ খুলে ঝাপিয়ে পড়েছি ডাবলে নিজে এখনাে অবাক হই। তখন ভরা ব্রহ্মপুত্র। ডুব সাঁতারে নদের অপর পাড়ে আসতে সক্ষম হই। আমার শ্যালককে বাঁচাতে পারলাম না। সে ব্রহ্মপুত্রে শহীদ হয়। জিআরপি পুলিশ ছিল একজন। সে গুলি খেয়ে শেষ পর্যন্ত বেঁচে ওঠে। বাকি সবার লাশ ভেসে চলে পবিত্র ব্রহ্মপুত্র নদে।

নদের অপর তীরে উঠে আরও ভেতরে গ্রামের দিকে হাঁটতে থাকি। ক্লান্ত হয়ে ভাগলদী নামে এক গ্রামে গিয়ে প্রবেশ করি। ভাগলদী গ্রামে এক পরিচিতের বাড়িতে গিয়ে দুদিন বিশ্রাম করি। পরিবারের সাথে দেখা করার মতাে মনােবল ছিল না। স্বচক্ষে এত অস্বাভাবিক মৃত্যু এবং শ্যালকের মৃত্যু আমাকে মানসিক দিক থেকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছিল। ভাগলদীতে দুদিন বিশ্রাম করে আবার সীমান্ত অতিক্রম করি। এরপর ধুবড়ী চলে যাই যুদ্ধের সাথে সংশ্লিষ্ট লােকের সহায়তায়। সেখানে ডাকবাংলায় আমার থাকার ব্যবস্থা হয়। সেখানে টাঙ্গাইল, জামালপুর, ময়মনসিংহের লােকজন ছিল। মতিন নামে টাঙ্গাইলের একটি ছেলে একদিন আমার কাছে রঙ, তুলি, আর্ট পেপারের আব্দার করে। সেগুলাে সংগ্রহ করে দিলে সে অদ্ভুত কিছু ছবি আঁকে। একটি হলাে জাতিসংঘের তৎকালীন সেক্রেটারি জেনারেল স্ট্রেচারে শুয়ে আছে। লন্ডন, হল্যান্ড, ফ্রান্স, স্পেন প্রভৃতি স্ট্রেচার বয়ে নিয়ে যাচ্ছে। চাবুক চালাচ্ছে তাদের ঘাড়ে নিক্সন। দ্বিতীয়টি ক্যানভাসটি বিশাল উলানের একটি গাভী। গাভীটির সেবাযত্ন করছে তকালীন পূর্ব পাকিস্তান। দুধ দোয়াচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তান। তারপর বিশাল ক্যানভাস জুড়ে শস্য-শ্যামল বাংলার অপূর্ব সব প্রাকৃতিক চিত্র। মতিন আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র ছিল। কালীকিঙ্কর রামের সহযােগিতায় মতিমের ছবিগুলোর প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। কালীকিঙ্কর বাবু ছিলেন জামালপুরের চন্দ্রা গ্রামের বাসিন্দা।
সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ডামাডােলে স্বদেশ ত্যাগ করে ধুবড়ীতে বসবাস শুরু করেন। যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত কালীকিঙ্কর বাবুর সর্বতাে সহযােগিতা আমাদের প্রত্যেকের কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণীয়।
উল্লেখ্য, আমার দুই ভাই মুক্তিযােদ্ধা। যারা সম্মুখযুদ্ধে অংশ নিয়েছে। একজন আহত মুক্তিযােদ্ধা। এখনাে শরীরে যুদ্ধের ক্ষত নিয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। আমার পরিবারে অনেক সদস্য জীবনবাজি রেখে মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছে।

আলহাজ মাহবুবুল আলম প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক ও প্রতিষ্ঠাতা ভাওয়াল চাঁদপুর উচ্চ বিদ্যালয় কাপাসিয়া, গাজীপুর।

১৯৭১ সালে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই মুক্তিযুদ্ধের সূচনা পূর্ব থেকে আমি এর সাথে যুক্ত। মূলত ষাটের দশকের শেষের দিকে যখন স্বাধীনতাযুদ্ধের ক্ষেত্র প্রস্তুত হচ্ছিল তখন থেকে আমি এই সংগ্রামের অংশীদার হই। পাকিস্তানি সামরিক শাসক দ্বারা বাঙালি জাতির শােষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন একজন শিক্ষিত, সচেতন নাগরিক হিসেবে আমার বিবেককে তাড়িত করে। বাঙালি জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতার চেতনায় আমি এই মহান মুক্তিযুদ্ধে নিজেকে সম্পৃক্ত করি।

১৯৬৯ সাল থেকে বাংলাদেশ তথা পূর্ব পাকিস্থানের অবস্থা ছিল টালমাটাল। ১৯৭০ সালে দেশে শান্তিপূর্ণ ভাবে নির্বাচন হলাে। কিন্তু ফলাফল একদিকে যেমন ছিল আশাব্যঞ্জক অন্যদিকে তেমনি ছিল শঙ্কার। আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় পাকিস্তানি শাসক গােষ্ঠী মেনে নিয়ে বাঙালিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না এ আশঙ্কা অনেকের মনেই ছিল। সে আশঙ্কা সত্যে পরিণত হলাে একাত্তর সালে। ক্ষমতা হস্তান্তরে টালবাহানার এক পর্যায়ে বঙ্গবন্ধু তার ঐতিহাসিক ভাষণ দিলেন ৭ মার্চে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ঐতিহাসিক সেই ভাষণে পরিষ্কার হয়ে গেলাে যে একটি সশস্ত্র সংঘাতের মধ্য দিয়ে আমাদের পাকিস্তানিদের সাথে রাজনৈতিক রফা করতে হবে এবং সেই সংঘাতের সর্বাত্মক প্রস্তুতি নিতে হবে বাঙালিদের।
তাই বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা যুদ্ধ ঘােষণার আগেই যুদ্ধের জন্য সংগঠিত হতে থাকি। ভাওয়াল চাঁদপুরে আমরা সংগ্রাম কমিটি গঠন করি। আমি ছিলাম এই কমিটির আহ্বায়ক মাহমুদুল হাসান বেনু সাহেব এর নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন। পূর্ণোদ্যমে ভাওয়াল চাঁদপুর কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যেতে থাকে। এর মধ্যে আসে ২৬ মার্চ। ২৬ মার্চ সকালে বিবিসি শুনে ঢাকায় শুরু হয়ে যাওয়া যুদ্ধের খবর পাই। আমরা তাৎক্ষণিক সবাই একত্রিত হয়ে কী করা যায় তাই নিয়ে আলােচনা শুরু করি। বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার খবর লােকমুখে আসতে থাকে। কিন্তু সেই খবর কতটা ভয়ঙ্কর সেটা কেউ কল্পনাও করতে পারেনি।
২৭ মার্চ আমরা খবর পেলাম জয়দেবপুর রাজবাড়ী ক্যাম্পে বাঙালি অফিসারদের গ্রেনেড চার্জ করে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। তখন আমরা জরুরি বৈঠক করে বাকি বাঙালি সৈন্যদের উদ্ধারের সিদ্ধান্ত নেই। এই উদ্দেশে প্রথমত আমরা মার্তা গ্রামে যাই। মাৰ্তা গ্রামটি জয়দেবপুরের নিকটবর্তী। মার্তা গ্রামে পৌছেই মাঠে দেখতে পাই দুজন আহত বাঙালি। সৈন্য। তারা গুলিবিদ্ধ হয়ে মাঠে পড়ে ছিল। তাদের উদ্ধার করে আমার বাড়িতে পাঠাই। জয়দেবপুরের অবস্থা এতটাই সঙ্গীন ছিল যে, নিরস্ত্র অবস্থায় আমাদের রাজবাড়ী ক্যাম্পে তাে দূরের কথা জয়দেবপুর ঢােকাও সম্ভব হলাে না। ব্যর্থ হয়ে আমরা ভাওয়াল চাঁদপুরের দিকে রওনা হই। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে আসি। বাড়িতে এসে দেখি পঁচিশ ছাব্বিশজন সৈন্য আমার বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছে। এদের বেশিরভাগই আহত। আমি এদের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করি। ওষুধ সংগ্রহ করি এবং শুশ্রুষা দিই। তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী পরদিন বরমী যাওয়ার ব্যবস্থা করি লঞ্চে করে।
তখন জয়দেবপুর রাজবাড়ী ক্যাম্পে আমার একজন ছাত্র ছিল আর্মি। তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। নাম ছিল হারুন অর রশিদ। তার গ্রামের নাম জলিশা চাঁদপুর। জয়দেবপুর ক্যাম্পে শহীদের তালিকায় তার নাম আছে কিনা জানি না। তবে হারুন অর রশিদ স্বাধীনতা যুদ্ধে একজন শহীদ বাঙালি সৈনিক।
এরপর আমরা চরমভাবে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেই। ব্যাপক সংখ্যক লােককে সংগঠিত করি। এদের মধ্যে বিভিন্ন পেশার কৃষক, শ্রমিক, ছাত্র সবাই ছিল। ছিল নানা বয়সের লােকজন। এক পর্যায়ে জানতে পারি যুদ্ধের জন্য ভারতে ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে। তখন ভারতে লােক পাঠাই খোজখবর নিতে এবং সশস্ত্র যুদ্ধে অংশগ্রহণ করার গ্রুপ ঠিক করি। এরই মধ্যে কাপাসিয়া ক্যাম্প থেকে হঠাৎ একদিন পাকসেনা আমাদের গ্রাম আক্রমণ করে। তারা প্রথমত আমার বাড়ি ও হিন্দু বাড়িগুলাে জ্বালিয়ে দেয়। ব্যাপকভাবে এলাকায় লুটতরাজ চালায়। আমি বাজারে ছিলাম। সময় ছিল নাস্তা খাওয়ার বেলা। চাঁদপুরের দিকে পাক সেনা আসছে খবর পেয়ে দৌড়ে গ্রামের সবাইকে সংবাদ পৌছাই। সেদিন গ্রামের সকলের সম্পদ ক্ষতি হলেও প্রত্যেকেই প্রাণে বেঁচে যেতে সক্ষম হয়। কিন্তু বাজার থেকে বেড়াতে আসা এক বেয়াই ও আমার বড়ভাইকে ধরে নিয়ে যায়। তাদের আটকে রাখে টঙ্গী ক্যাম্পে। সেখানে দিনের পর দিন তাদের ওপর চালায় অকথ্য নির্যাতন। ইয়াহিয়া ক্ষমা ঘােষণা করলে তারা মুক্তি পান।
তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে আমরা নিরাপদ নই। ঢাকা ম্যাসাকার এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অত্যাচারের যে খবরাখবর আসছিল তাতে এ ব্যাপারে সবাই নিঃসন্দেহ হয়েছিলাম। পাক ফৌজ চাঁদপুরে ঢােকার পর আমি আর চাঁদপুরে অবস্থান করা যুক্তিযুক্ত মনে করলাম না। তখন আমার দুই কন্যাসন্তান এবং স্ত্রী তৃতীয়বারের মতাে অন্তঃসত্ত্বা। ঠিক করি এদের একটা আশ্রয়ে রেখে ভারতে চলে যাবাে। কিন্তু সে সুযােগ হয় না। খবর আসে চাঁদপুরে আবার পাক সেনা আসবে। সেদিনই গভীর রাতে স্ত্রী-সন্তানদের নিয়ে বের হয়ে পড়ি। আমাদের বাড়ির মাইলখানেক দূরে একটি বিল ছিল। প্রথমত সেখানে যাই। সেই বিল পাড়ি দিয়ে নিরাপদ কোথাও আশ্রয়ের চিন্তা করি। নৌকা করে বিল পাড়ি দেই। বিলের পাড়ে মহিষবাথান নামে যে গ্রাম সেখানেই আমি নেমে যাই। স্ত্রী এবং সন্তানরা থেকে যায় নৌকায়। এখান থেকেই তাদের সাথে আমি বিচ্ছিন্ন হই। যুদ্ধে চললাম। আমার সন্তানদের দেখাে। স্ত্রী তখন পূর্ণ দশমাসের অন্তঃসত্ত্বা। চারদিন পর এক ছেলেসন্তান জন্ম নেয় এবং পাঁচদিন পর আমার সেই ছেলেসন্তানের মৃত্যু হয়। তার নাম রাখা হয় বিপ্লব। স্ত্রী আশ্রয় নিয়েছিল বাপের বাড়ি পাবুর গ্রামে। আমার কথামতাে পরিচিত মাঝি-মাল্লারা তাদের সে রাতে পাবুরে নিরাপদে পৌছে দিয়েছিল।
মহিষবাথান গ্রামে অবস্থান করে আমি চাঁদপুর ও আশপাশের লােকজনের সাথে গােপনে যােগাযােগ করি এবং সবাইকে মহিষবাথান বিলের পাড়ে আসতে বলি। আমার পাঠানাে সংবাদের ভিত্তিতে তারা দ্রুত বিলের পাড়ে উপস্থিত হয়। তারিখটি ছিল ৭ জুলাই। বিলের পাড়ে সবাই একত্রিত হয়ে রায়পুরার দিকে হাঁটতে শুরু করি। আমাদের সিদ্ধান্ত ছিল রায়পুরা হয়ে ভারত চলে যাবাে। আমরা খবর নিয়েছিলাম যে রায়পুরা হয়ে হাজার হাজার লােক দেশ ছেড়ে চলে যাচ্ছে। পুরাে রাস্তা আমরা পায়ে হেঁটে রায়পুরা পেীছি। মেঘনা নদীর পাড়ে রায়পুরা। নদীর পাড়ে রায়পুরা হাইস্কুল। আমরা রায়পুরা হাইস্কুলে যাই। সেখানে বহু লােকজন হাইস্কুলে আশ্রয় নিয়েছে। এরা সবাই ভারত যাবার অপেক্ষায়। বিভিন্ন বয়সের, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। ভারত গিয়ে সশস্ত্র যুদ্ধের ট্রেনিং নেবে। দেশে ফিরে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে। অভূতপূর্ব সাড়া। কারাে ভেতর এতটুকু মৃত্যুভয় নেই। নেই মাতৃভূমি ও স্বজন ছেড়ে যাবার বেদনা। একচল্লিশ বছর পরেও সেই দিনগুলাে মনে হলে গায়ের লােম দাঁড়িয়ে যায়। মাতৃভূমি মানুষের কাছে কতটা প্রিয় হতে পারে একাত্তরের সেই দিনগুলাে তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
আমরা হাইস্কুলটিতেই আশ্রয় নিই। পরদিন ভােররাতে দেখি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা একটি নৌকা ভাসালাে মেঘনা নদীতে। নৌকায় বসে দরাজ গলায় কাওয়ালি গাইতে শুরু করলাে। অন্যদিক থেকে পাকফৌজের একটি নৌকা কাওয়ালি গাইতে গাইতে এগুতে থাকে। পাকফৌজের ধারণা এরা তাদেরই লােক। ওরা মুক্তির নৌকার কাছে আসতে থাকে। এদিকে ছেলেরাও প্রস্তুতি নেয়। ওদের নৌকা কাছে আসামাত্রই ছেলেরা ঝাপিয়ে পড়ে নদীতে এবং নৌকা ডুবিয়ে দেয়। সাথে পাকফৌজও ডুবে যায়। ঘটনার আকস্মিকতায়। ওরা কোনাে প্রতিরােধের সুযােগ পায়নি। জীবিত একজন সেনাকে ছেলেরা তীরে টেনে তুলে আনতে সক্ষম হয়। তাকে জিজ্ঞেস হিন্দু। হিন্দু মেরে ফেলতে হবে। লােকটি জানায় সে পাঞ্জাবের একটি গােডাউনে প্রহরীর কাজে নিযুক্ত ছিল। মুক্তিরা তাকেও আর কিছু বলার সুযােগ না দিয়ে মেরে নদীতে ছুড়ে ফেলে। কাওয়ালির কৌশলটি নেয়া হয়েছিল ওদের ধরার জন্য। এখানে উল্লেখ্য, রায়পুরা হাইস্কুলে সে সময় আশ্রয় নেয়া স্বাধীনতা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে অপেক্ষমাণ গ্রুপগুলাের কোনাে কমান্ডার ছিল না। নিজেরাই সার্বক্ষণিক পরামর্শ করতাে। আর শনিধনে নানারকম কৌশল উদ্ভাবন করতাে।
এই ঘটনার পর আমরা নিজেদের ওখানে নিরাপদ মনে করলাম না। যেহেতু ওদের লােক হতাহত হয়েছে অতএব আমাদের বিপদ অনিবার্য। মাঝরাত থেকেই গ্রুপগুলাে বেরিয়ে যেতে শুরু করলাে। আমরা ভােরে মেঘনা নদী পাড়ি দিয়ে চারগাছ নামে একটা জায়গায় পৌছি। চারগাছ থেকে আবার নৌকা করে ইন্ডিয়ান বর্ডারের উদ্দেশে রওনা হই। তখন বেশ রাত। নৌকায় উঠতেই মাঝিরা নিচে যেতে ইশারা করলাে। আমরা পাটাতনের নিচে গেলাম। ওপরে রাখা হলাে লাকড়ি। সে সময় নৌকার চালকরা মুক্তিবাহিনী ও যুদ্ধে অংশগ্রহণেচ্ছ ছেলেদের এভাবেই পারাপার করতাে। শরণার্থীদেরও এভাবে পারাপার করা হতাে। নিচে মানুষ, ওপরে পাট অথবা লাকড়ি। আমরা ছিলাম চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ জনের একটি দল। এ দলে শুধু জয়দেবপুরের লােক ছিল না। ছিল দেশের বিভিন্ন স্থানের।
দুপুরে আমরা ইন্ডিয়ান বর্ডারের খুব কাছে আসি। জায়গাটা একটা টেকের মতাে। চারদিক নির্জন। কাছে জীবিত কোনাে জনপ্রাণী নেই বলে অনুভূত হচ্ছে। মাত্র আমরা নৌকা থেকে নেমে টেকে পা রেখেছি, হঠাৎ কয়েকজন। বন্দুকধারী আমাদের ঘিরে ফেলে। আমরা কেউ কিছুই বুঝতে পারি না। মৃত্যুর প্রহর গুনতে থাকি। বন্দুকধারীরা অস্ত্রের মুখে কাছেই একটা বাড়িতে নিয়ে গেলাে। সবাইকে আটকে রাখলাে ঘরে। প্রস্তাব দিলাে টাকা দিলে আমাদের ভাত খেতে দেবে। আমরা রাজি হয়ে গেলাম। কিন্তু ভাবিনি ভাত দেবে। সত্যি সত্যিই ভাত দেয়া হলাে। ঘরের ভেতর আটকে রেখে। এদের পরিচয় এবং উদ্দেশ্য কী ছিল ভয়ে মুখ ফুটে সেদিন জিজ্ঞেস করতে পারিনি। রহস্যজনক বিষয়টি আজও আমার অজানাই থেকে গেলাে।

সন্ধ্যার দিকে আমাদের বলা হলাে কিছুক্ষণ পর অর্থাৎ অন্ধকার হয়ে গেলে তিনটি ফায়ার হবে। ফায়ার হলে আপনারা সিএন্ডবি পার হবেন। ওরা আমাদের ছেড়ে দিলাে। কিন্তু নজরে রাখলাে। ফায়ার হলে ওদের কথামতাে আমরা রাস্তায় উঠলাম। এ ছাড়া আমাদের কোনাে বিকল্প ছিল না। আমরা ছিলাম নিরস্ত্র । রাস্তায় দাঁড়ালে ওরা আমাদের সঙ্গে সঙ্গে জলে ফেলে দিলাে। পুরাে এলাকাটাই ছিল নিচু। চারদিকে জলে থই থই করছিল। আমাদের ইশারা করলাে ইন্ডিয়ান বর্ডারের দিকে যেতে। জল ভেঙে আমরা হেঁটে যেতে থাকি। অনেকক্ষণ ধরে হাঁটি। জলে শব্দ হচ্ছিল। কাছে কোথাও পাকসেনাদের ক্যাম্প ছিল। জলের শব্দে ওরা ফায়ার শুরু করলাে। তখন মধ্যরাত। ইন্ডিয়ান বর্ডার থেকে ওরাও শুরু করে ফায়ার। মাঝখানে আমরা। জলের পরিমাণ কম থাকায় কিছুটা উপুড় হয়ে থাকতে পারি। সে ভাবেই সবাই থাকি। শেষ রাতে ফায়ার বন্ধ হয়। ওপরে উঠে আসি। তখন আর বন্দুকধারীরা কেউ নেই। তখনকার আমাদের মানসিক, শারীরিক অবস্থা অবর্ণনীয়। সামনে একটা রেলপথ দেখতে পাই। রেললাইন অতিক্রম করেআবারও একটা টেকের মতাে জায়গায় আসি। এখানে সমবেত হাজার হাজার লােক। সব অসহায় শরণার্থী আর যুদ্ধ-উন্মাদ তরুণের দল। এখান থেকে নৌকাযােগে সবাই আগরতলা ঢুকছে। আমরা সেদিন নৌকাযােগে আগরতলার মাধববাড়ি পেীছি। মাধববাড়ি থেকে আমার দলের সবাইকে বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টারে গ্রুপ করে নিয়ে যাওয়া হয়। আমাকে পাঠানাে হয় আগরতলা কংগ্রেস ভবনে।
আগরতলায় প্রতিদিন স্রোতের মতাে লােক আসছে। খােলা হয়েছে শরণার্থী শিবির। আমার পরিচিত লােকজনও পাচ্ছি। কয়েকদিন পর আমাকে পলিটিক্যাল মােটিভেটর হিসেবে নিয়ােগ দেয়া হয়। নিয়ােগটি হয় ইন্টারভিউয়ের মাধ্যমে। আমার সাথে নিয়ােগপ্রাপ্ত হন অধ্যাপক জগবন্ধু। তিনি তখন নরসিংদী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। নিয়ােগপ্রাপ্ত হয়ে জয়বাংলা ইয়ুথ ট্রানজিট ক্যাম্পে যােগদান করি। আমাদের কাজ ছিল প্রতিটি বাঙালিকে স্বাধীনতাযুদ্ধের দিকে মােটিভেট করা। সকালে ও বিকালে আমাদের ক্লাস চলতাে। সশস্ত্র ট্রেনিংয়ে যাবার আগে এখানে তাদের মানসিকভাবে প্রস্তুত করা হতাে। এখান থেকে আমি বহু ছেলেকে বিভিন্ন ট্রেনিং ক্যাম্পে পাঠাই। আমাদের লােকচারের বিষয়গুলাে ছিল যেমন: ছেলে মুক্তিযােদ্ধা, বাবা স্বাধীনতায় বিশ্বাসী না। তাকে ত্যাগ করতে হবে। অথবা তাকে হত্যা করতে হবে। আমাদের সিলেবাস দেয়া হয়েছিল। সম্পূর্ণটাই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের বিভিন্ন দিকের ওপর। মূলত ছিল দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে প্রতিটি বাঙালিকে স্বাধীনতাযুদ্ধে ধাবিত করা। নভেম্বরের শেষ পর্যায়ে ক্যাম্প বন্ধ হয়ে যায়।ভারতীয় আর্মি তখন সর্বাত্মক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলেছে। ছিল শুধু ভারতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। ক্যাম্প বন্ধ হয়ে গেলে আমি অনুমতি সাপেক্ষে দেশে ফিরে আসি। তখন দেশে আমার জন্য অপেক্ষা করছিল পুত্রশােক। আমি জানতাম না আমার সেই সন্তান আর বেঁচে নেই। মহিষবাথান বিলের পাড়ে বিচ্ছিন্ন হওয়ার পর পরিবারের সাথে কোনাে যােগাযােগ হয়নি।
যুদ্ধস্মৃতির আর একটি স্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ না করে পারছি না। আমি যখন কংগ্রেস ভবনে থাকি তখন একদিন রাতে প্রচণ্ড বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে আমার কানে এলাে এক মহিলার আর্তচিৎকার। বাইরে এসে দেখি এক বৃদ্ধা। অঝাের বৃষ্টির মাঝে মুখ থুবড়ে পড়ে কাদছে। পাঁজা কোলে করে তাকে ভেতরে নিয়ে আসি। সেবা দিয়ে কিছুটা সুস্থ করে পরদিন শরণার্থী ক্যাম্পে পাঠাই। জানতে পারি বাংলাদেশ বর্ডার পার হওয়ার সময় ব্যাপক গােলাগুলির মাঝে ছেলে মাকে ফেলে রেখে চলে যায়। পরে কীভাবে এখানে আসে মহিলা সেটুকু স্মরণে আনতে পারে না। এ থেকে প্রতীয়মান হয় কতটা নিপীড়ন, নির্মম নির্যাতন হলে ছেলে মাকে মৃত্যুর মুখে ফেলে রেখে চলে যেতে পারে!

আমাদের এই চরম বিপর্যয়ের দিনে ভারতের সর্বস্তরের জনগণ যে আন্তরিকতা দেখিয়েছেন ও সহায়তা প্রদান করেছেন তা অতুলনীয়। তারা আমাদের মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের পরিণতি দান করেছেন। আমরা তাদের কাছে চিরকৃতজ্ঞ। সর্বোপরি বাঙালি জাতি যতদিন বেঁচে থাকবে তৎকালীন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর অবিস্মরণীয় অবদানকে স্মরণ করতে হবে। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর ঋণ আমাদের অপরিশোেধ্য।

ফণিভূষণ সাহা
প্রাক্তন অধ্যক্ষ মুক্তিযােদ্ধা রহমত আলী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, শ্রীপুর, গাজীপুর।

বিশ্বের ইতিহাসে এক কলঙ্কিত রাত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ। সেই রাতে পাকিস্তানি হানাদার ইয়াহিয়ার জল্লাদ বাহিনী সুপরিকল্পপিতভাবে নিরস্ত্র দেশবাসীর ওপর ঝাপিয়ে পড়ে। হত্যা করে অগণিত ছাত্রছাত্রী, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন পেশাজীবীসহ সাধারণ মানুষকে। সেই কালরাতে আমি শ্রীপুর কলেজ হােস্টেলে রাতযাপন করছিলাম। তখন আমি শিক্ষকতার পেশায় নিয়ােজিত ছিলাম বর্তমান গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার একমাত্র উচ্চ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান শ্রীপুর কলেজে। আমার আবাসস্থলও ছিল শ্রীপুর থানার বরমী বাজারে। আমার বয়স তখন একত্রিশ বছর। রাতে বহু গােলাগুলির শব্দ পেলাম। তবে কী ঘটছে, কোথায় গুলি হচ্ছে সঠিক ধারণা করতে পারছিলাম না। রাতে ঘুম হলাে না। শঙ্কায় কাটালাম সারা রাত। ভােরে উঠে ক্রমে ক্রমে ঢাকা ম্যাসাকারের খবর জানতে পেলাম। সেদিন কলেজে ছাত্রছাত্রী ও শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল খুব কম। অধ্যক্ষ মহােদয় ও কমিটির সঙ্গে যােগাযােগ করে কলেজ বন্ধ করে দেয়া হলাে অনির্দিষ্টকাল পর্যন্ত। আমার বাড়ি গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানার বরমী বাজারে। আমি সেদিনই বাড়ি চলে যাই এবং অন্য কোনাে বিপদ কখন আসবে এ দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে দিন কাটাতে থাকি। এরই মধ্যে হঠাৎ একদিন জানতে পারলাম থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে খুঁজছে। আরও জানতে পারলাম কলেজ খােলার জন্য আমাকে তার প্রয়ােজন। কলেজ বন্ধ থাকায় অধ্যক্ষ মহােদয়ের সঙ্গেযােগাযােগ করতে পারছে না। অধ্যক্ষের ঠিকানা তার জানা নেই। তাই আমাকে দিয়ে কলেজ চালু রাখতে চায়। এসময় আমার শ্রদ্ধেয় কাকা এবং মান্নান ফকির সাহেব যিনি বরমী স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি আমাকে খুব স্নেহ করতেন। তাদের মাধ্যমে ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আমাকে খবরটা পাঠিয়েছে। আমি উনাদের বললাম যে, আপনারা একটু খোঁজখবর করে দেখেন আসলে তারা কী চায়। পরদিন তারা আমাকে বললেন, ‘ফণি, থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার মনােভাব খুব ভালাে না। তিনি আরও বললেন যে, কলেজে যাওয়া তাে দূরের কথা দিন ও রাতের বেলা কখনাে যেন বাড়িতেও অবস্থান না করি। তার কথা অনুযায়ী আমি শীতলক্ষ্যা নদীর ওপারে গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার সিংহশ্রী গ্রামে থাকতে শুরু করি।
পরবর্তী কয়েকদিনের ভেতরে জানতে পারলাম যে আগরতলায় (ভারত) এখান থেকে অনেকে যাচ্ছে এবং যুদ্ধের ট্রেনিং নিচ্ছে। ভারত সরকার মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধে ট্রেনিংসহ সব দিক দিয়ে সাহায্য ও সহানুভূতি প্রদান করছে। আরও জানতে পারলাম ১৭ এপ্রিল অস্থায়ী স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠন করা হয়েছে। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার একটি জায়গাকে করা হয়েছে রাজধানী। সেখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করা হবে। অস্থায়ী সরকারের ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট হিসেবে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেব দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন এবং একটি মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। সশস্ত্র সংগ্রামের সর্বাধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন কর্নেল এম এ জি ওসমানী সাহেব। সব কিছু জেনে আমার ছাত্র সুবেদ আলী ও সিরাজকে নিয়ে এপ্রিল মাসের শেষ দিকে আগরতলার দিকে রওনা হই। ভয়ে ভয়ে তিন জনে হেঁটে, লঞ্চে ও নৌকায় করে কুমিল্লা দিয়ে বহু কষ্টে হাপানিয়া হয়ে আগরতলা পৌছি। আগরতলা যমুনা ক্যাম্পে গিয়ে আমাদের শ্রীপুর থানার এমসিএ সফির উদ্দিন সাহেবের দেখা পাই। তখন যমুনা ক্যাম্প ও অন্য ক্যাম্পগুলাে তৈরি হচ্ছে। তিনি আমাকে পেয়ে উচ্ছসিত হয়ে উঠলেন এবং আমাকে তাড়াতাড়ি কোলকাতা গিয়ে শ্রীপুর ও কালিয়াকৈর থানার এমএনএ জনাব শামছুল হক সাহেবর সাথে দেখা করতে বলেন এবং উনার ঠিকানা দিলেন।
আগরতলা থেকে কোলকাতা যেতে আমার প্রায় তিনদিন লেগে যায়। ক্ষুধা ও মানসিক অস্থিরতায় খুব দুর্বল হয়ে পড়ি। তাই দমদমে ছােটভাইয়ের বাসায় উঠি এবং একদিন বিশ্রাম নিয়ে চৌরঙ্গী মােদে যাই। চৌরঙ্গী মােড়েরসেই ঐতিহাসিক বাড়ির দোতলায় জনাব শামসুল হক, টঙ্গীর কাজী মােজাম্মেল ও জয়দেবপুরের হাবিবুল্লা সাহেবকে পেয়ে যাই। আমাকে দেখে উনারা আনন্দিত হয়ে উঠলেন এবং বলতে লাগলেন কাজের লােক পেয়ে গেছি। শামসুল হক সাহেব বললেন, আপনি একা এসেছেন কেন? দেশে চলে যান এবং দেশ থেকে আপনার পরিবার এবং ফুলবাড়িয়া থেকে আমার পরিবার-পরিজনদের নিয়ে আসুন’। তিনি আরও বললেন যে, যদি পাকিস্তানিরা আত্মসমর্পণ না করে তবে পুরাে ঢাকা জেলা পুড়িয়ে দেয়া হবে। তাই দেশে গিয়ে যত লােক পারেন নিয়ে আসুন। উনাদের কথা অনুযায়ী আবার ট্রেনে চেপে আগরতলা চলে আসি। যমুনা ক্যাম্পে সফির উদ্দিন সাহেবের সঙ্গে দেখা করি। উনার পরামর্শে অনেক কষ্টে আমার স্নেহের ছাত্র বেলাসি নিবাসী হাইকে সঙ্গে নিয়ে ওদের গ্রামে চলে আসি।
ওখান থেকে বরমীতে বাবার কাছে হাইকে পাঠাই। বাবা হাইকে বলে দিলেন- ‘ফণি যেন বরমী না আসে’। আমি সামাদের বাড়িতেই থেকে যাই । আমার বন্ধু সামাদ। সিংহশ্রী ছিল তার বাড়ি। সে সময় সামাদ ছিল হাপানিয়ার যমুনা ক্যাম্পে। চিকিৎসক হিসেবে। সেও বলে দিয়েছিল তার পরিবার যেন নিয়ে আসি। হাই ফুলবাড়ী গিয়ে শামসুল হকের স্ত্রী ও ছেলেকে নিয়ে আসে বেলাসিতে। আমার স্ত্রী ও সন্তানরাও বেলাসী এসে আমার সাথে একত্রিত হয়। সঙ্গে আসে হারিছ উদ্দিন উকিল। আমরা প্রায় শতজন একত্রিত হয়ে বেলাসি থেকে রওনা হই। পথের শঙ্কা আর কষ্ট অবর্ণনীয়।বলতে গেলে মহাভারত ছাড়িয়ে যাবে। যা হােক প্রাণ নিয়ে আগরতলা পৌছাতে পেরেছিলাম। হাপানিয়ার যমুনা ক্যাম্পে আমরা আশ্রয় নিয়েছিলাম। চার-পাঁচদিন পর কোলকাতা থেকে শামসুল হক সাহেব এসে তার ফ্যামিলিকে নিয়ে যান। আমাকেও পরিবার নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু সফির উদ্দিন সাহেব রাজি হলেন না। বললেন, আপাতত ফণিবাবু আমার এখানে থাকবেন। প্রয়ােজন হলে পরবর্তী সময় ওনাকে পাঠানাে হবে। খবর দিলে পাঠিয়ে দেবাে।
সফির উদ্দিন সাহেব প্রায় সময়ই আমার অফিসে যেতেন। টাকা-পয়সা এনে আমার হাতে দিতেন। আমার কাজ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের সকাল, দুপুর, রাতের খাবার এবং রাতে থাকার ব্যবস্থা করা। আর প্রধান কাজ ছিল মুক্তিযােদ্ধাদের মানসিক দিক থেকে স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধমুখী করে গড়ে তােলা। এ ব্যাপারে আমাকে সাহায্য করতে দরগা চালার শওকত হােসেন,নির্মল দে’সহ আরও কয়েকজন। এভাবে অক্টোবর পর্যন্ত এখানে কাটাই। এরপর শামসুল হক সাহেব সফির উদ্দিন সাহেবকে অনুরােধ করেন আমাকে কোলকাতায় পাঠিয়ে দিতে। অক্টোবরের শেষে আমি কোলকাতায় পরিবারসহ চলে আসি। তখন হাপানিয়ায় আটটি ক্যাম্প ছিল। আমি ছিলাম যমুনা ক্যাম্পের দায়িত্বে। আমি সেখানে পলিটিক্যাল মােটিভেটর হিসেবে নিযুক্ত ছিলাম। আমার বেতন ছিল একশত পঞ্চাশ টাকা। খাওয়া-থাকা ফ্রি। হাপানিয়া ক্যাম্পে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর থানা নির্বাচনী এলাকার সাবেক মন্ত্রী, বর্তমান সংসদের সাংসদ জনাব রহমত আলী সাহেবের সাথে দেখা হয়। তখন তিনি সেখানে সাংগঠনিক কাজে নিয়ােজিত ছিলেন।

কোলকাতায় যাওয়ার পর পরিবারকে দমদমে ছােটভাইয়ের বাসায় রেখে পরদিন মুক্তিযােদ্ধা অফিসে যাই। গেট পারমিশন নিয়ে ঢুকে দেখি দোতলায় আমার সেই তিন ভাই প্রয়াত জনাব শামসুল হক (এমএনএ), কাজী মােজাম্মেল হক (বর্তমানে মন্ত্রী) ও প্রয়াত জননেতা হাবিবুল্লাহ সাহেব বসে আছেন এবং আমাকে পেয়ে খুব আনন্দ প্রকাশ করলেন। তখন থেকেই আমি তাদের সাথে অফিসিয়াল কাজে নিয়ােজিত হয়ে যাই। কাজ করছি বটে। কিন্তু সবাই বিমর্ষ। উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় কাটছে সবার দিন রাত। এরই মধ্যে কাজ করতে করতে হঠাৎ শামসুল হক সাহেবকে বলি, এখানে আছি, কিন্তু আমার পরিচিত দুই নেতার সঙ্গে একবারও দেখা হলাে না। তাদের সাথে দেখা করা কি জরুরি? শামসুল হক সাহেব বললেন তারা সব সময় ব্যস্ত থাকেন। অফিসে আসার সময় পান না। বেশিরভাগ সময় বাইরে থাকেন। অফিসে আসেন না বললেই চলে। যাদ আপনি দেখা করতে চান তবে আজ সন্ধ্যায় তাদের দুজনের সঙ্গে দেখা করতে পারবেন। তিনি আমাকে ঠিকানা দিলেন। আমি ঠিকানা নিয়ে অশােক বিল্ডিংয়ে গেলাম। অশােক বিল্ডিংয়ের পাঁচ তলায় থাকেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব, তিন। তলায় থাকেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব। প্রথমে পাঁচ। তলায় উঠে দেখি বিরাট জায়গা, অনেক ঘর, কোনাে লােক নেই। অনেক খােজার পর একটা কোনার ঘর থেকে কিছু একটা শব্দ হচ্ছে বলে মনে। হলাে। ভয়ে ভয়ে কোনার ঘরে গিয়ে দেখতে পাই তাজউদ্দিন সাহেব নিজের হাতে সাবান দিয়ে একটি শার্ট ধােলাই করছেন। আদাব দিয়ে আমি বলে উঠলাম ইংরেজিতে- Being a Prime Minister of Bangladesh, he washes his clothes by his own hand. How is it possible?
তিনি বাংলায় উত্তর দিলেন, জামা তাে একটি কালাে হয়েছে। আগামীকাল দিল্লি যেতে হবে ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করতে।
আমার বাবাকে তিনি ভালাে চিনতেন। বাবার কথা জিজ্ঞেস করলেন এবং সে সময়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে দীর্ঘক্ষণ আলােচনা করলেন। এরপর ছয় তলায় গিয়ে দেখি অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি পাজামা-পাঞ্জাবি পড়ে চিৎ হয়ে শুয়ে আছেন। বুঝতে পারলাম তিনি যেন কী নিয়ে গভীর চিন্তা করছেন। আমি যখন ময়মনসিংহে আনন্দমােহনের ছাত্র তখন তিনি সেখানে অধ্যাপনা করতেন। পরিচয় দেয়ার পর উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন। তারপর অনেকক্ষণ চললাে নানা কথা, সেই সব স্মৃতি এখনাে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়।
মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক এম এ জি ওসমানী সাহেবের সাথেও প্রায় আমার মতবিনিময় হতাে। আমি সেখানে ঢােকার সময়ই দেখতাম তিনি পায়চারি করছেন বারান্দায়। তিনি প্রতিবার আমার আদাব গ্রহণ করতেন এবং কুশল জিজ্ঞেস করতেন।
১৬ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেব পাঁচটার দিকে খবর পাঠালেন শামসুল হক সাহেবকে তিনি যেন তাড়াতাড়ি ঢাকা ফেরার রাস্তা কোথাও খারাপ থাকলে তা যেন মেরামত করে ফেলেন। ১৮ ডিসেম্বর ঢাকা বিভাগের উল্লেখযােগ্য নেতৃবৃন্দকে নিয়ে চারটি বাসভাড়া করে বিকেল চারটায় ঢাকা শহরে প্রবেশ করি।

রাত যাপন করি সফির উদ্দিন সাহেবের বাসায়। পরদিন বরমী আসি। ছুটে যাই হেলাল মেম্বারের বাড়িতে আশ্রিত বাবা-মার কাছে। ঢাকা থেকে শুধু বরমী নয় সারা দেশের এক বিপর্যস্ত চেহারা, শােকগ্রস্ত বাংলাদেশ। সারা দেশে ঘরে ঘরে স্বজন হারানাের কান্নার রােল। সম্পদ ও বাড়িঘর হারানাের। হাহাকার। ১৮ ডিসেম্বর আমি বিপর্যস্ত বাংলাদেশের রূপ প্রত্যক্ষ করি। উপলব্ধি করি স্বাধীনতা যুদ্ধ দেশবাসীর জন্য কী মর্মান্তিক অবস্থার সৃষ্টি করেছিল এবং এ যুদ্ধে বাঙালি জাতিকে কতটা মূল্য দিতে হয়েছে। পাশাপাশি লক্ষ করেছি দেশবাসীর বিজয়ের উল্লাস ও আনন্দ।

২৫ মার্চ রাতে আমি বাড়িতে ছিলাম। ২৬ মার্চ ভােররাতে সমেদ মিয়া আমার বাড়িতে গিয়ে আমাকে ঘুম থেকে ডেকে তােলে। সমেদ মিয়ার কাছেই জানতে পারি খােন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ সাহেব আমাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। খােন্দকার আবদুল মালেক শহীদুল্লাহ সাহেব তখন ময়মনসিংহ জেলার মুক্তাগাছা থানা নির্বাচনী এলাকার প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য (এমসি) ছিলেন। মালেক সাহেব ঢাকা থেকে ম্যাসেজ পেয়েছেন যে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। সমেদ আমাকে ২৫ মার্চের ঘটনা মােটামুটি জানায়। সমেদ পার্টির কর্মী ছিল। পেশায় ছিল দর্জি। সমেদের সাথে আমি তৎক্ষণাৎ মুক্তাগাছা শহরে চলে আসি এবং মালেক ভাইয়ের সাথে দেখা করি। সে সময় শিশির রক্ষিতসহ স্থানীয় দশবারােজন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী উপস্থিত হন। সবাই আলােচনা করে সিদ্ধান্ত নিই আপাতত মুক্তাগাছা শহরকে কীভাবে রক্ষা করা যায়। প্রথমত যােগাযােগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করার চিন্তা করি। ২৬ মার্চ দশ/এগারটার দিকে আমরা জনগণকে নিয়ে মনতলা ব্রিজ ভাঙার চেষ্টা করি, কিন্তু কৌশল জানা না থাকায় সেটা সম্ভব হয়নি। ফিরে এসে আর কী উপায়ে পাক আর্মিদের প্রতিরােধ করা যায় সে বিষয়ে আলােচনা করি। শহরের জমিদার বাড়িতে প্রতিষ্ঠিত কলেজ মাঠে খুব সম্ভবত ২৮ মার্চ থেকে যুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্য ট্রেনিং সেন্টার খুলি। প্রাথমিকভাবে পঁচিশ অথবা ত্রিশজন এতে অংশ নেয়।ট্রেনিংয়ে জনগণের মাঝে ভীষণ আগ্রহ লক্ষ করা যায়। এ ট্রেনিং সেন্টার পরিচালিত হতাে অবসরপ্রাপ্ত সেনা সদস্য দ্বারা। সেন্টারের কমান্ডার ছিলেন রেফাজউদ্দিন মিয়া। প্রথমত অস্ত্র সংগ্রহ করা হয় জনগণের হাতে থাকা লাইসেন্সকৃত বন্দুক। পরবর্তীতে বিভিন্নভাবে অস্ত্র সংগ্রহ করা হয়। এ অস্ত্রের মধ্যে ছিল মার্ক থ্রি ও মার্ক ফোর রাইফেল। ইতােমধ্যে পাক আর্মি টাঙ্গাইল পৌছে যায়। তখন গণপরিষদ সদস্যসহ বেশ কিছু নেতাকর্মী অতি সতুর ময়মনসিংহ পতন আঁচ করতে পেরে শহর ত্যাগ করেন। আনুমানিক তারিখটা ছিল ষােল অথবা সতের এপ্রিল। উনারা জানতে চান- ‘আমি যাবাে কি না শহর ছেড়ে। আমি চলে গেলে জনগণ ও পরিবারের মনােবল একেবারেই ভেঙে যাবে চিন্তা করে শহর ছেড়ে যেতে সম্মত হলাম না। কিন্তু অবস্থা অবনতির দিকে গেলে আমার পরিবারের সদস্যদের নান্দিনার ফতেপুর গ্রামে পৌছে দেয়ার চেষ্টা করি। সে সুযােগ আর হয়নি। কেননা, একুশ এপ্রিল পাক আর্মি ধনবাড়ি হয়ে জামালপুর শহরে ঢুকে এবং নান্দিনা হয়ে মুক্তাগাছা প্রবেশ করে। তখন সময় ছিল প্রায় দুপুর।
আমি নান্দিনা থেকে কোনাে রকমে পালিয়ে এসে মাত্র খেতে বসেছি। হঠাৎ করে শুরু হলাে শেলিং। চতুর্দিকে ব্যাপক অগ্নিসংযােগ, মানুষের চিঙ্কার, ছুটোছুটি, আহাজারি। ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে লুটতরাজ। বিভীষিকাময় দৃশ্য। সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বােঝানাের কোনাে উপায় নেই। মানুষ ছুটছে ভেতরের গ্রামগুলােতে। ছুটছে সীমান্তের দিকে। কেউ কোনােদিকে তাকাতে পারছে না। মানুষ পরিজন ফেলে রেখে অথবা পরিজনকে সাথে নিয়ে রুদ্ধশ্বাসে দৌড়াচ্ছে নিরাপদ আশ্রয়ের দিকে। আমি বাড়ি থেকে বের হলাম। আমার সাথে একটি লেপের কভার, একটি ছেড়া চাদর ও একটি পুরনাে লুঙ্গি। পকেটে পঁয়ত্রিশটি টাকা। দৌড়ে পালানাের সময় উঠোনের রােদে শুকাতে দেয়া কাপড়গুলাে পাই। সেগুলাে কতটা নেওয়া উপযােগী ছিল সেটা ভাবার সময় হয়নি। বাড়ির লােকজন কোথায় রইলাে সেটাও দেখার সুযােগ হয়নি। বাড়ির পেছন দিয়ে ছুটতে ছুটতে পাশের গ্রাম শ্রীপুর গিয়ে পেীছি। সেখানে মা ও বড়বৌদির সাথে দেখা হয় । উনারাও বাড়ি থেকে পালিয়ে এসেছেন। মা ও বড়বৌদি আমাকে দেখে বললেন, ‘তুই শিগগির চলে যা’। আমি আপত্তি করে বলি, “তােমাদের অন্তত কোথাও নিরাপদ স্থানে রেখে যাই’। কিন্তু মা ও বড়বৌদি কিছুতেই শুনলেন না। আমি চলে না যাওয়ায় কান্নাকাটি শুরু করলেন। এই মুহূর্তে আমি মহিউদ্দিন ও মােসলেম নামে দুজন আওয়ামী লীগ কর্মী পেয়ে যাই। আমরা তিনজন তখন সিদ্ধান্ত নিই সীমান্তের ওপারে চলে যাওয়ার। কারণ গণহত্যা আর আওয়ামী লীগ নিধনের ফলে দেশে থাকা সম্ভব হবে না সেটা তখন আমাদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল।
আমরা সীমান্তের উদ্দেশে হাঁটতে থাকি। কিছুদূর চলার পর হঠাৎ মােসলেম বলে, ‘আমার কাছে একটি পয়সাও নেই। এই মুহূর্তে আমি যেতে পারবো না। মােসলেমকে বিদায় দিয়ে আমি আর মহিউদ্দিন গ্রামের পথ দিয়ে হাঁটতে থাকি। রাত আটটায় দিকে আমরা হালুয়াঘাটে এক আত্মীয়ের বাড়িতে পৌছি। সেখানে রাত কাটিয়ে ভােরের দিকে সীমান্ত অতিক্রম করি । সীমান্তের ওপারেই ডালুতে ভারত সরকার শরণার্থী ক্যাম্প খুলেছে। প্রতিদিনই হাজার হাজার লােক দেশ ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছিল। আমার ট্রেনিং কোম্পানিতে ছিল একশত উনত্রিশ অথবা একশত উনচল্লিশ জন। আমাদের কমান্ডার ছিলেন ময়মনসিংহের নাজমুল হক তারা। আমাদের কাজের সক্রিয়তা দেখে বলা হতাে টাইগার কোম্পানি। ট্রেনিং চলতাে সারা দিন। ফাকে ফাকে তাবুতে বসে দেশের কথা ভাবতাম। সবাই ছিল বিষন্ন। কিন্তু মনােবল অটুট। আমরা যুদ্ধ করবাে এবং দেশকে মুক্ত করবাে এই ছিল আমাদের শপথ। জয় বাংলার ধ্বনি আর সােনার বাংলা গান ছিল আমাদের শ্লোগান এবং সঙ্গীত। এই শ্লোগান এবং গান ছিল যুদ্ধ প্রেরণার একমাত্র উৎস। গুলি শুরু হতাে জয় বাংলা স্লোগান দিয়ে। শেষ করা হতাে জয় বাংলার অন্তর্ভেদী স্লোগানের মধ্য দিয়ে। ট্রেনিংয়ের সময় ছিল ছাব্বিশ দিন। ট্রেনিং শেষে আমাদের নিয়ে যাওয়া হলাে লংরা ক্যাম্পে। লংরা থেকে আমরা একদিন বাঘমারা ক্যাম্পে কাটাই। লংরা ক্যাম্প থেকেই আমরা দেশের ভেতর গেরিলা যুদ্ধে অংশ নিই।

আমাদের অপারেশনের প্রথম টার্গেট ছিল ঠাকরাকোনা ব্রিজ। কিন্তু বরাইল অঞ্চলে পৌছে আমরা একটি অতর্কিত যুদ্ধের সম্মুখীন হই। আমার প্রথম যুদ্ধ বরাইল। যুদ্ধটা ছিল সম্মুখ এবং আকস্মিক। জায়গাটা ছিল সীমান্ত থেকে বিশ/ত্রিশ কিলাে দেশের ভেতর। এ যুদ্ধে শত্রুসেনা কয়েকজন নিহত এবং আহত হয়েছিল। মুক্তিফৌজের কোনাে সদস্য হতাহত হয়নি। সময়টা সম্ভবত হবে জুনের প্রথম সপ্তাহ। আমরা যখন বরাইল অঞ্চলে পৌছি হঠাৎ পাহাড়ি একটি খরস্রোতা নদীতে দেখতে পাই পাকসেনাদের কয়েকটি নৌকা ভাসছে। পাকসেনারা আমাকে দেখে ফেলে এবং ফায়ার শুরু করে। আমরা সঙ্গে সঙ্গে পজিশন নিয়ে পাল্টা গুলি করি। কিছুক্ষণ গােলাগুলির পর ওরা ফিরে যায়। আমরাও নিরাপদ স্থানে ফিরে আসি।

আমাদের দ্বিতীয় অপারেশন ঠাকরাকোনা ব্রিজ। এ অপারেশনে আমাদের মুক্তিযােদ্ধাদের সংখ্যা ছিল ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ। ফকিরা বাজারে আমরা গিয়ে বিভিন্ন লােকের বাড়িতে ভেঙে ভেঙে আশ্রয় নিই। জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের সাহায্যে এগিয়ে আসে। কিন্তু অপারেশন করতে গিয়ে একটি মিস ফায়ার হয়ে যায়। অপারেশন বন্ধ রেখে আমরা কয়েকদিন ফকিরা বাজারে অবস্থান করি। কয়েকদিন পর আবার আমরা ঠাকরাকোনা ব্রিজ অপারেশনে অংশ নিই এবং সফল হই। এরপর আমি আরও কয়েকটি যুদ্ধে অংশ নিই। এর মধ্যে কলমাকান্দা আটপাড়া, কেন্দুয়া উল্লেখযােগ্য। প্রতিটি যুদ্ধে আমরা অভূতপূর্ব জনসমর্থন লাভ করি।
আর একটি উল্লেখযােগ্য যুদ্ধ ছিল নাজিরপুর যুদ্ধ। এ যুদ্ধে সফলতার চেয়ে ব্যর্থতাই বেশি ছিল। ২৫ জুলাই আমাদের লংরা ক্যাম্পে ইপিআরের একটি ম্যাসেজ আসে। ম্যাসেজ ছিল নাজিরপুর অঞ্চলে পাকবাহিনী অবস্থান নিতে যাচ্ছে। আমরা বিকেল চারটা/পাচটার দিকে লংরা ক্যাম্প থেকে বের হই। পায়ে হেঁটে হেঁটে কয়েক কিলােমিটার দেশের ভেতর একটি গ্রামে প্রবেশ করি। গ্রামটির নাম সম্ভবত রাজপুর। এই রাজপুর গ্রামের এক লােকের বাড়িতে অবস্থান করি। সংখ্যায় ছিলাম আমরা সতের থেকে উনিশ জন। আমি ছিলাম স্কাউট। সারা রাত তৎপর থেকেও শত্রুসৈন্যের কাছাকাছি অবস্থান সম্পর্কে নিশ্চিত হতে পারলাম না। তখন আমার ধারণা হলাে ক্যাম্পে ফিরে যাওয়াই হবে শ্রেয়। কিন্তু কমান্ডার এবং প্লাটুন কমান্ডার রহিম খান সিদ্ধান্ত নিলেন নাজিরপুরে অবস্থিত পােস্ট অফিস অপারেশন করা। আমরা নাজিরপুর বাজারের দিকে অগ্রসর হতে থাকি। বাজারের কাছাকাছি এসে দেখি সামনের দিক থেকে একটি লােক খুব দ্রুতগতিতে এগিয়ে আসছে। তার কাছে জানতে চাই বাজারে পাঞ্জাবি আছে কি না। লােকটি ‘আছে বলেই দ্রুতগতিতে সরে গেলাে। কয়েক গজ এগিয়েই দেখি পাকবাহিনী নদীতে নৌকা নিয়ে অ্যামবুশ করে আছে। মাঝখানে আমাদের দূরত্ব মাত্র দু’শ গজের মতাে। ওরা আমাদের দেখামাত্র গুলি ছােড়া শুরু করে। আমরা গুলি ছুড়ে জবাব দিতে থাকি। এক পর্যায়ে আমি বাম দিকে ক্রলিং করে একটি ধানক্ষেত পার হয়ে কাছে কচুরিপানা ভর্তি একটি জলাশয়ে গিয়ে আশ্রয় নিই। সময় সকাল আটটা থেকে সাড়ে আটটা। তারিখ ২৬ জুলাই ১৯৭১। সারা দিন উভয় দিক থেকে গুলিবর্ষণ চলতে থাকে। আমি কচুরিপানায় ঢেকে শুধু নাকটুকু বের করে লুকিয়ে আছি। আস্তে আস্তে সন্ধ্যা। ঘনিয়ে এলাে। জল ছিল দূষিত। গা চুলকাচ্ছে। মাঝে মাঝে ধেয়ে আসছে বড় বড় জোক রক্ত চুষে নিতে। ভাবছি স্থান ত্যাগ করবাে। কিন্তু গুলির আওয়াজের কমতি নেই। সন্ধ্যার বেশ পরে গুলি থেমে গেলাে। গুলি থামলাে ঠিকই, আমি কচুরিপানার আশ্রয় থেকে সাহস করে উঠে আসতে পারছি না। মনে হচ্ছে শত্রু আমার চারপাশে। এক্ষুনি ধরে ফেলবে। যুদ্ধ এলাকা। চারপাশ থমথমে। কোথাও টু শব্দটি পর্যন্ত নেই। আনুমানিক রাত দুটোর পর আর সহ্য করতে না পেরে জল থেকে উঠে আসি। সে রাতে জ্যোত্সা ছিল। কিছু দূরে একটি কুঁড়েঘরের সন্ধান পাই। সেখানে গিয়ে উঠি। ঘরের দরজা ছিল বন্ধ। ধাক্কা দিলে দরজা খুলে যায়। দেখি এক বৃদ্ধ বসে তামাক খাচ্ছে। আমার পরিচয় দিই। সাথে রাইফেল ছিল। বৃদ্ধ আমাকে অতিযত্নে মেঝেতে বসতে দেন। বৃদ্ধের কাছেই জানতে পারি যুদ্ধে আমার কয়েকজন সহযােদ্ধা মারা গেছে। বৃদ্ধকে আমি লেংগুরা বাজারের রাস্তাটা দেখিয়ে দিতে বলি। বৃদ্ধের নির্দেশনা অনুযায়ী লেংগুরার উদ্দেশে রওনা হই। সে সময় রাজাপুরের যারা আমাদের সহযােদ্ধা তাদের সাতজন যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। গুরুতর আহত হয়েছেন কমান্ডর নিজে। আমি লংরা ক্যাম্পে ফিরে যাই।
ক্যাম্পে সবার ধারণা ছিল আমি মারা গেছি। কারণ আমি এ যুদ্ধের স্কাউট ছিলাম। স্কাউটের সাধারণত বেঁচে থাকার কথা। নয়। ইপিআর ক্যাম্প এবং বিএসএফ ক্যাম্পে রিপাের্ট দিই যুদ্ধের। উভয় ক্যাম্পই আমি বেঁচে থাকার জন্য স্বস্তি প্রকাশ করে। আমাকে আপ্যায়ন করে চা, রুটি, পিয়াজু দিয়ে। লংরা ক্যাম্পে আমি যখন গরম জলে শরীর পরিষ্কার করি তখন ক্যাম্পে খবর আসে আমাদের সহযােদ্ধাদের লাশগুলাে সীমান্তবর্তী এলাকায় নিয়ে আসা হয়েছে। স্থানীয় লােকজন লাশগুলাে লেংগুরা নামক স্থানে নিয়ে আসে। লাশ সীমান্তে রেখে তারা ক্যাম্পে খবর পৌছায়। সঙ্গে সঙ্গে আমরা লেংগুরায় চলে যাই। গিয়ে দেখি লাশগুলাে সীমান্তে ঘাঁটির কাছে ঘাসের ওপর শুইয়ে রাখা হয়েছে। চোখের জলে সবার বুক ভেসে যাচ্ছে। একজন সৈনিকের যুদ্ধে সহযােদ্ধার মৃত্যুতে কান্নার কথা নয়। কিন্তু আমরা কাদছি। এটা তাে সে যুদ্ধ নয়। এটা ছিল মুক্তিযুদ্ধ।
লাশগুলাে যথারীতি ধর্মীয় মতে আমরা সকার করি। এদের মধ্যে দুজন ছিল হিন্দু ধর্মাবলম্বী। দ্বিজেন ও ভবতােষ। আমি নিজের হাতে তাদের মুখাগ্নি করি। আটজনের দাফন ও দুজনের দাহ পাশাপাশি সম্পন্ন হয়। নাজিরপুর । যুদ্ধের কয়েকদিন পর আমরা ডালু চলে আসি। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে ডালুতে রেফাজ মিয়ার নেতৃত্বে নতুন কোম্পানি গঠিত হয়। এ সময় আমরা স্থির করি নিজের এলাকায় প্রতিরােধ গড়ে তােলার। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমরা মুক্তাগাছার দিকে রওনা হই। এ কোম্পানিতে আমরা একশ উনষাট জন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মুক্তিযােদ্ধা ছিলাম। ডালু থেকে আনুমানিক তিন/চার কিলােমিটার দূরত্বে তেলিখালি (তন্তর) নামক স্থানে আমাদের কোম্পানি দুর্ঘটনায় পড়ে। ডালু থেকে তন্তর পৌছাতেই কোম্পানির এক সদস্য শত্রুর পোতা মাইনে আহত হয়। গাইডের ভুলে অথবা ইচ্ছাকৃত (বিষয়টি আজ পর্যন্ত রহস্যাবৃত) পাকসেনাদের ক্যাম্পের কাছে চলে আসে পুরাে কোম্পানি। তখন পাকসেনারা প্রচণ্ড হামলা চালায়। আমাদের কোম্পানি এ সময় পাল্টা প্রতিরােধে ব্যর্থ হয় এবং ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। পাকসেনাদের গুলির আঘাতে পনের/ষােলজন মুক্তিবাহিনীর সদস্য শহীদ হন। গাইড মুক্তাগাছা অঞ্চলের ছিল না। ডালুর মূল ক্যাম্প থেকে আমাদের কোম্পানিতে দেয়া হয়েছিল। শহীদদের একটি লাশও আমরা নিতে পারিনি। সময় ছিল রাত নয়টা/দশটা।
ছত্রভঙ্গ হয়ে যাওয়া কোম্পানি মুক্তাগাছার কাছে নারায়ণখােলায় পুনরায় একত্রিত হই। পরদিন সন্ধ্যায় আমরা মুক্তাগাছার উদ্দেশে যাত্রা শুরু করি। আমাদের উদ্দেশ্য মুক্তাগাছা শত্রুমুক্ত করা। ভােরে আমরা ভিটিবাড়িতে অবস্থান নিই। ভিটিবাড়ি মুক্তাগাছার দক্ষিণে অবস্থিত। মুক্তাগাছা থেকে ভিটিবাড়ির দূরত্ব চার কিলােমিটার। পরের দিন শত্রুপক্ষ আমাদের অবস্থান জেনে ফেলে এবং সুসজ্জিত হয়ে ভিটিবাড়ি চলে আসে। গােপন সূত্রে জানতে পেরে আমরা প্রতিরােধের প্রস্তুতি নিয়ে ফেলি। ভিটিবাড়িতে শত্রুদের সঙ্গে আমাদের সংঘর্ষ হয়। সংঘর্ষে উনিশ জন রাজাকার মারা যায়। একজন রাজাকার আত্মসমর্পণ করে। সে পরে মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয় এবং যুদ্ধের শেষ দিন পর্যন্ত মহান স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করে। উল্লেখ্য, ভিটিবাড়ি সংঘর্ষে কোনাে পাকফৌজ ছিল না। এখানে আমরা পঁচিশটি থ্রি নট থ্রি রাইফেল পাই। সংঘর্ষের পর ভিটিবাড়ি ছেড়ে তিন কিলােমিটার দূরে ঘােষতারা থেকে মধ্যরাতে মুক্তাগাছার দিকে যাত্রা করি। শেষ রাতে শত্রুর ঘাটি চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেলি। টের পেয়ে ওরা ফায়ার শুরু করে। আমরা জবাব দিতে থাকি। দুই ঘণ্টার মতাে এ সংঘর্ষ চলে। এরপর ওরা ঘাটি ছেড়ে চলে যায়। সেখান থেকে আমরা অস্ত্রশস্ত্র, গােলাবারুদ সংগ্রহ করি। ওদের ব্যবহৃত কাগজপত্র জ্বালিয়ে দিই। সংঘর্ষের পর কোম্পানি মুক্তাগাছা থেকে চার কিলােমিটার দূরে বন বাংলা গ্রামে অবস্থান নেয়। এখানে বসে কোম্পানি পরবর্তী অপারেশনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। দুদিন পর আমরা বটতলা বাজারের রাজাকার ক্যাম্পে আক্রমণ করি। এ সংঘর্ষে পাঁচজন রাজাকার নিহত হয়। এখান থেকে আমরা দশ/বারােটি রাইফেল ও পাঁচটি গ্রেনেড উদ্ধার করি। আমাদের কোম্পানির দুজন সামান্য আহত হয়। এটাই ছিল মুক্তাগাছায় আমাদের শেষ যুদ্ধ। এ যুদ্ধের পর আমাদের অ্যামুনেশন শেষ হয়ে যায়। অ্যামুনেশন সংগ্রহের জন্য কোম্পানির তেরজন সদস্যকে ডালুতে পাঠানাে হয়। এ সময় আমরা ফুলবাড়িয়া থানা ও আশপাশের বিভিন্ন থানাগুলােতে যুদ্ধকে সংগঠিত করতে থাকি। ইতােমধ্যে ভারত বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয় এবং মুক্তি ও মিত্রবাহিনীর সাথে পাক হানাদার বাহিনীর সর্বাত্মক যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। দশ ডিসেম্বর মুক্তাগাছা পুরােপুরি শত্রুমুক্ত হয়। তারপর স্বাধীনতার পতাকা মুক্তাগাছার আকাশে বিজয় দর্পে উড়তে থাকে

তেলিখালির (তন্তর) যুদ্ধে শহীদের তালিকা:
১। সাত্তার (তন্তর) (কাটকাই, মুক্তগাছা) বয়স আনুমানিক ২৫ বছর ।
২। কাশেম (কাটকাই, মুক্তগাছা) বয়স আনুমানিক ২৫/২৬ বছর।
৩। খালেক (নন্দীবাড়ি, মুক্তগাছা) বয়স আনুমানিক ২৭/২৮ বছর ।
৪। আসগর (নন্দীবাড়ি, মুক্তগাছা) বয়স আনুমানিক ২৭/২৮ বছর ।

মাে. তাজুল ইসলাম
মুক্তিযােদ্ধা সেকশন কমান্ডার
বারিষাভ, আমরাইদ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।
আদিনিবাস- চরমান্দালিয়া, মনােহরদী ।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমরা ছিলাম সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ থানার আলাবাদী গ্রামে। আলাবাদী গ্রামে তখন দু-চারজনের রেডিও ছিল। সেই রেডিওর খবর শুনে জানতে পারি ঢাকায় পাকিস্তানি ও বাঙালিদের লড়াই চলছে। এরপর লােকের মুখে মুখে ছড়িয়ে পড়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের অত্যাচারের নানা কাহিনী। সব মানুষ দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়ে। এরই মধ্যে একদিন হানাদার বাহিনী সুনামগঞ্জে ঢুকে। সুনামগঞ্জের গ্রামগুলােতে নির্মম নির্যাতন চালাতে থাকে পাকিস্তানি সেনারা। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। যাকে যেখানে পায় পাখির মতন গুলি করে মারে। শিশু, যুবক, বৃদ্ধ কাউকে বাদ দেয় না। মেয়েদের তুলে নিয়ে যায়। এসব দেখে আমি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিই। পাকিস্তানিদের ক্ষমা কোনাে অবস্থাতেই করা যায় না। ইতােমধ্যে জানতে পেরেছিলাম চিলাকান্দির কাছে মইলম ক্যাম্পে বাঙালি সৈন্যরা যুবকদের যুদ্ধের ট্রেনিং দিচ্ছে। আলাবাদী গ্রামের ও আশপাশের চল্লিশজন যুবক আমরা একত্রিত হই। তারপর চিলাকান্দি হয়ে মইলম বাড়ি ক্যাম্পে যাই। মা-বাবা নিষেধ করেন। আমার বয়স তখন ছাব্বিশ। আলাবাদী থেকে মইলম বাড়ি ক্যাম্পের দূরত্ব ছিল তিন মাইল। আমি গােপনে বাড়ি থেকে বের হই। আমাদের চল্লিশ জনের দলে সবাই ছিলাম সিলেটের কৃষক, দিনমজুর, বেশিরভাগই নিরক্ষর। স্বাক্ষর জানা ছিল দু’একজনের। ম্যাট্রিক পাস ছিল মাত্র একজন।
মইলম ক্যাম্পে পৌছে দেখি হাজার হাজার লােক। অপেক্ষা করছে সীমান্ত অতিক্রম করার জন্য। ক্যাম্পে পৌছার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের তালিকাভুক্ত করা হলাে এবং সেদিনই ব্যবস্থা নেয়া হলাে ট্রেনিং নিতে ভারত পাঠিয়ে দেবার । আমাদের চল্লিশজনের সাথে ট্রেনিং নিতে ইচ্ছুক আরও কিছুসংখ্যক যুবক সংযুক্ত করা হলাে। মােট চারশ আটজনকে পাঠানাে হলাে ভারতের উদ্দেশে। দেশের সীমান্ত অতিক্রম করে আমরা হাঁটতে লাগলাম ভারতের মাটিতে। কিছু জংলা ও পাহাড়ি পথ হেঁটে আমরা গভীর রাতে ইয়ুথ ক্যাম্পে পেীছি। সেদিন আমাদের পায়ে হেঁটে পাড়ি দিতে হয়েছিল দীর্ঘ পঞ্চাশ মাইল পথ।
ইয়ুথ ক্যাম্পে ছিলেন ধীরাই থানার এমসিএ। তিনি আমাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করলেন। সেই খাবার ছিল আতপ চালের ভাত। ভাতে ছিল বড় বড় সাদা চালের পােকা। আমরা ক্ষুধার জ্বালায় এতটাই অস্থির ছিলাম যে পােকা কারাে নজরে আসেনি। সবাই পেট ভরে ভাত খেলাম।
এরপর আমাদের গ্রুপ করে পাঠানাে হয় গৌহাটি। গৌহাটিতে ট্রেনিং নিয়ে আমি চলে আসি আগরতলা হােল্ডিং ক্যাম্পে। আগরতলায় আমার হাতে কোনাে টাকা-পয়সা ছিল না। দেশের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটা লুঙ্গি বিক্রি করে বিড়ি খাই। আমাদের একমাসের সর্বশেষ ট্রেনিং হয় আসামের শিলচরে। শিলচরের জায়গাটার নাম লােয়ারবন। লােয়ারবনে ট্রেনিং চলে একমাস। ১২শ লােক এখানে একসঙ্গে আমরা ট্রেনিং করি। ট্রেনিং শেষে আমাদের পাঠানাে হয় দেশের অভ্যন্তরে। আমি ছিলাম সেকশন কমান্ডার। আমার গ্রুপে ছিল বত্রিশ জন মুক্তিযােদ্ধা। আমরা কুলাউড়া, লাঠিটিলা, টেংরাটিলা ও মৌলভীবাজারে ক্যাম্প করি এবং গেরিলা যুদ্ধ করে পাকিস্তানি সৈন্যদের ব্যতিব্যস্ত রাখি। কুলাউড়া বাংকার থেকে আমরা পাঁচজন মেয়েকে
উদ্ধার করে আনি- যাদের কাপড় ছিল সামান্য। যা ছিল সেটাও ছিড়া-ফাড়া। মেয়েরা আমাদের বলে, ‘তােমরা আমাদের গুলি করে মেরে ফেলাে। আমরা তাদের সান্তনা দেই এবং বলি, ‘সারা দেশের মানুষই তাে তােমাদের অবস্থায় আছে।’ আমাদের অনেকের পরিবারের মেয়েদের অবস্থাও হয়তাে বা তােমাদের মতাে হয়েছে। এই বলে তাদের সান্ত্বনা দিয়ে নির্দেশ মতাে সীমান্তের ওপারে বড় আর্মি অফিসারের কাছে তাদের পাঠিয়ে দিই। মেয়েদের সেই করুণ কান্না আজও আমাকে পীড়া দেয়। কুলাউড়াতে আমরা কয়েকজন রাজাকার মেরে ফেলতে সক্ষম হই। কুলাউড়া ক্যাম্পে আমাদের সাথে ভারতীয় সেনা ছিল। তারা সম্মুখযুদ্ধে আমাদের সব সময় পেছনে রেখেছে। সামনে যেতে দেয়নি। বলেছে, তােম লােক পিছে রাহাে’।
আমাদের সাথে তাদের ব্যবহার ছিল ভাইয়ের মতাে। আমাদের স্বাধীনতা রক্ষার্থে এ দেশে এসে তারা অকাতরে নিজের জীবন বিলিয়ে দিয়েছে।
আর একটি অবিস্মরণীয় ঘটনা উল্লেখ্য। কথায় বলে বাঙালি জঞ্জালি। ট্রেনিং শেষে যুদ্ধে দেশে পাঠানাের আগের দিন মাংস খাওয়ানাের ব্যবস্থা করা হলাে। এতদিন আমাদের খাওয়া ছিল শুধু ডাল, সবজি। সেই মাংস খাওয়া নিয়ে সূত্রপাত হলাে গােলমালের। এখানে খাসি ও পাঠার মাংসের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এখনাে আমার স্পষ্ট মনে আছে সতেরটি খাসি ও এগারটি পাঠা ছিল। হঠাৎ করে হিন্দুরা বললাে যে তারা জবাইয়ের মাংস খাবে না। সাথে সাথে মুসলমানরাও বলি দেয়া মাংস খেতে অস্বীকৃতি জানালাে। শুরু হলাে বাগবিতণ্ডা, এক পর্যায়ে প্রায় হাতাহাতি। ক্যাম্প ইনচার্জ অয়্যারলেস করলেন প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাহেবকে। তিনি কাছেই কোথায় যেন ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শনে এসেছিলেন। প্রধানমন্ত্রী দ্রুত ঘটনাস্থলে এসে উপস্থিত হলেন এবং বললেন যে, বাঙালি ভাই ভাই, জাতের কোনাে ভেদ নাই। তারপর বক্তৃতা করলেন। ওঝার সাপের মন্ত্ৰপড়ার মতাে কাজ হলাে। একদম চুপচাপ হয়ে গেলাে সব। প্রধানমন্ত্রী ঘােষণা করলেন যে, বলি ও জবাইয়ের সব মাংস একসঙ্গে এক পাতিলে রান্না হবে। তিনিও আমাদের সাথে মাংসভাত খাবেন। রান্না শেষে প্লেটে খাবার দেয়া হলাে। প্রধানমন্ত্রী খাবার পরিবেশন করা প্লেট থেকে মুরগির মতাে ঠুকরে ঠুকরে একটু একটু করে মাংস মুখে নিলেন। আমি আমার প্লেট থেকে মাংসের একটি টুকরাে উনার মুখে তুলে ধরলাম। তিনি মাংস মুখে নিলেন। তাকিয়ে রইলেন। তার বিশাল বুকে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সে স্মৃতি মনে হলে এখনাে আমার গায়ের লােম দাড়িয়ে যায়। সে স্মৃতি বড় উজ্জ্বল ও আনন্দের। পরদিন ১২শ বাঙালি যুদ্ধের সাজ-সরঞ্জামসহ দেশের ভেতরে প্রবেশ করি। আর একসঙ্গে মিলেমিশে মরণপণ লড়াই করি হানাদার শত্রুর বিরুদ্ধে।

মাে. শামসুল ইসলাম সিনিয়র শিক্ষক, সাতখামাইর উচ্চ বিদ্যালয়,
মশাখালি, গফরগাঁও, ময়মনসিংহ।

শুরু থেকেই স্বাধীনতার মন্ত্রে দীক্ষিত হয়েছিল আমাদের গফরগাঁও। ফেব্রুয়ারি থেকে গফরগাঁও ছিল আন্দোলন-সংগ্রামের তুঙ্গে। আন্দোলনে গফরগাঁও দেশের অন্য এলাকা থেকে পিছিয়ে ছিল না। বরঞ্চ অনেক অঞ্চল থেকে ছিল এগিয়ে। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ি। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনা তখনই আমার রক্তের সাথে মিশে গিয়েছিল। এতটাই উজ্জীবিত ছিলাম যে, ৭ মার্চের ভাষণ শুনতে বড়ভাই, দুলাভাই ও দুলাভাইয়ের ভাইদের সাথে উপস্থিত হয়েছিলাম রেসকোর্স ময়দানে এবং রেসকোর্স ময়দানে দাঁড়িয়ে সেই ঐতিহাসিক ভাষণ শােনার সৌভাগ্য অর্জন করেছিলাম।
২৫ মার্চ পরিবারের সাথে আমি আমার পৈতৃক নিবাসেই ছিলাম। পরদিন সবার সাথে বিবিসির খবর শুনে ও বড়দের আলােচনা থেকে বুঝতে পারি ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়েছে। তখন একমাত্র সঠিক খবরের মাধ্যম ছিল রেডিও বিবিসি। সকালে বিবিসির খবরে সবাই কেমন মুষড়ে পড়লাে। সবার মুখ হয়ে পড়লাে থমথমে। সবাই কেমন ভীতবিহ্বল। ক্রমে লােকমুখে ঢাকার নির্মম হত্যাযজ্ঞের খবর আসতে লাগলাে। আন্দোলনে যারা নেতৃত্ব দিচ্ছিলেন তারা কী করণীয় ভাবতে শুরু করলেন। সারা দেশের আতঙ্ক আর অস্থিরতার খবর আসতে লাগলাে। এভাবে কিছুদিন কেটে গেলাে। ইতােমধ্যে দেশের পরিস্থিতি চলে গেলাে ভয়াবহ অবনতির দিকে। এপ্রিলে পাঞ্জাবিরা মশাখালি বাজার ও মশাখালি বাজার থেকে চার কিলােমিটার পশ্চিমে মুখীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করলাে। এমতাবস্থায় আশপাশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র গ্রামগুলাের ছাত্র ও যুব সমাজ সংগঠিত হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করতে একদিন রাতে সবাই একত্রিত হয় আমাদের বাড়িতে। মধ্যরাতে খাওয়া-াওয়ার পর সবাই উঠে দাঁড়ায় শপথ নিতে। হাতে হাত রেখে সবাই শপথ গ্রহণ করে। শপথ ছিল এ রকম- যতক্ষণ পর্যন্ত দেশকে মুক্ত না করতে পারবে ততক্ষণ পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাবে। প্রয়ােজনে আজীবন লড়াই করবে এবং জীবন উৎসর্গ করবে। দেশকে শত্রুমুক্ত না করে ঘরে ফিরবে না। সেই শপথের ভাষা আর দৃঢ়প্রতিজ্ঞ চেহারা আজও আমার স্মৃতিতে জ্বলজ্বল করে।
ইতােমধ্যে মুসলিম লীগপন্থীরা পাকিস্তান ভাঙ্গা যাবে না বলে শপথ নিয়েছিল এবং পাঞ্জাবিদের সাথে হাত মেলানাের চিন্তা করছিল। সংগঠিত ছাত্রযুবকদের পরদিন ভারতের উদ্দেশে ট্রেনিং নিতে চলে যাওয়ার কথা ছিল। সকাল দশটায়। তারা আমাদের বাড়িতে বিশ্রাম নিচ্ছিল। এদের অবস্থান মুসলিম লীগের কেউ গােপনে জানিয়ে দেয় মশাখালি ক্যাম্পে। সকাল ন’টার দিকে পাঞ্জাবিরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। চারজন ধরা পড়ে যায়। বাকিরা পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ধৃত চারজনকে নিয়ে গেলাে মুখীবাজার ক্যাম্পে। আনুমানিক বেলা বারটার দিকে মুখী ও মশাখালির মাঝখানে শিলা নদীর পাড়ে তাদের নিয়ে আসে। আমি তখন প্রাইমারি স্কুল থেকে চাচার সাথে হেঁটে বাড়ি ফিরছিলাম। চাচা ওই স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। স্কুলে ছাত্র হাজির থাকতাে না বললেই চলে। কিন্তু ক্লাস হােক বা না হােক নির্দেশ ছিল স্কুল খােলা রাখার। আমরা নদীর কাছাকাছি এসে দেখতে পেলাম সেই চারজনকে পেছনে হাত বেঁধে নদীর পাড়ে নিয়ে এসেছে। তাদের নদীতে নামতে বলছে। বাঁচার শেষ চেষ্টায় তারা নদীর কিনার ঘেঁষে ঝােপঝাড়ে আশ্রয় নেয়। পাঞ্জাবিরা ঝােপে গুলি চালায়। বাধ্য হয়ে তারা বেরিয়ে আসে। তখন ওদের রাইফেলগুলাে গগন বিদারী আওয়াজ তুলে গর্জে ওঠে। চারজনই একসাথে নিহত হয়। রক্তে নদীর জল লাল হয়ে যায়। শিলানদীর ওপর কাঠের ব্রিজে দাঁড়িয়ে আমি আর সহপাঠী এক চাচাতাে ভাই সে দৃশ্য প্রত্যক্ষ করি। একজন শিক্ষকও ছিলেন আমাদের সাথে। যারা পালিয়ে যেতে পেরেছিলেন সবাই মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে এদের দুজন যুদ্ধের ময়দানে শহীদ হয়েছেন। চার-পাঁচজন পঙ্গুত্ববরণ করে আজও জীবিত আছেন। যারা ধরা পড়ে গিয়েছিলেন তাদের ভেতর এক জন ছিলেন দলের নেতা। তার কাছে যুদ্ধে অংশ নিতে সংগঠিত শপথ গ্রহণকারীদের নামের তালিকা ছিল। সেই তালিকা অনুসারে প্রত্যেকের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া হয়।
গ্রামের বয়স্ক পুরুষ, মহিলারা শুধু বাড়িতে থাকতাে। নজর রাখতাে পথের দিকে। পাঞ্জাবিরা গ্রামে ঢােকার বিষয় টের পেলে পালিয়ে যেতাে। আমাদের পরিবারের মতাে আরও অনেক পরিবারের মেয়েদের পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল প্রত্যন্ত অঞ্চলে। যেখানে গাড়ি যাওয়ার রাস্তা ছিল না। গ্রামের কেউ কেউ আবার বাংকারও তৈরি করেছিল। দিনের বেলায় গােলাগুলির সময় আমরা। চলে যেতাম বাংকারে । দিনে রাজাকার বাড়িতে এসে মুরগি, ছাগল, ফলমূল ও অন্যান্য খাদ্যদ্রব্য নিয়ে যেতাে। রাতে গ্রামবাসী সাহায্য করতাে মুক্তিযােদ্ধাদের। প্রস্তুত রাখতাে খাবার। মাছ, মুরগি, ডাল, ভর্তা এক এক দিন এক একরকম খাবারের আয়ােজন রাখা হতাে। যাতে যােদ্ধারা অভুক্ত না থাকে।
যুদ্ধের মাঝামাঝি সময়ে মশাখালি গ্রামে একটি মর্মান্তিক ঘটনা ঘটে। গ্রামে ঢুকে হঠাৎ একটি বাড়ি থেকে চারজন মেয়েকে তুলে নিয়ে যায় পাঞ্জাবিরা। এই মেয়েদের নিরাপদ স্থানে পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। বাড়িতে নিয়ে আসা হয়েছিল মাত্র কয়েকদিন আগে। সম্ভবত গােপন খবর পাঠিয়েছিল শত্রুদের কেউ। মেয়েদের চারজনই ছিল খুব সুন্দরী। এরা তিনজন ছিল চাচাতাে বােন। এদের বয়স ছিল পনের থেকে বিশের মধ্যে। এদের একজন ছিল বাড়ির পুত্রবধূ এবং নববধূ। এদের মশাখালি ক্যাম্পে নিয়ে আটকে রাখে। পনের দিন পর ছেড়ে দেয়। বাড়ি ফিরে কয়েকদিনের ভেতরে তারা আত্মহত্যা করে। পরিবার তাদের ভালােভাবে মেনে নেয়। কিন্তু তাদের এক কথা- এ জীবন রেখে লাভ কী? এ মৃত্যু এলাকাবাসীকে দুমড়ে-মুচড়ে ফেলে।
এসব অনাচার, অত্যাচার, আতঙ্ক, কষ্টের মধ্য দিয়ে ১৬ ডিসেম্বর আসে। ভয়ঙ্কর যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে জন্মলাভ করে বাংলাদেশ। আমার বড়ভাই মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন। আমার পরিবার মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে সর্বতােভাবে সহযােগিতা করেছে।

বীরাঙ্গনা মমতাজ বেগম
লতিফপুর, গােসিংগা,
শ্রীপুর, গাজীপুর।

স্বাধীনতাযুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে পাঞ্জাবি সেনারা গােসিংগা বাজারে ক্যাম্প করে। গােসিংগা বাজারের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে শীতলক্ষ্যা নদী। নদীর ওপারে কাপাসিয়া। পাক সেনারা ক্যাম্প করার পর নদীর ওপার থেকে মুক্তিবাহিনী ওদের ক্যাম্প লক্ষ করে গুলি চালাতাে। নদীর এপারে ক্যাম্পে বসে অজস্র গুলি ছুড়তে পাকবাহিনী। এভাবে মাঝে মাঝে চলতাে মুক্তিবাহিনী ও পাকবাহিনীর মাঝে গুলিবিনিময়। গােলাগুলির সময় আমরা বাড়ি ছেড়ে দূরে বন-বাদাড়ে লুকিয়ে থাকতাম। গােলাগুলি বন্ধ হয়ে গেলে বাড়ি চলে আসতাম। রাতেও ঘুম ছিল না। রাতেও চলতাে এ রকম গুলি। আর আমরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যেতাম। মাঝে মাঝে পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকতাে। বাড়িঘরে আগুন দিতাে আর করতাে লুটতরাজ। এভাবে চলতে চলতে আসে জুন মাসের ৭ তারিখ। সেদিন সকাল থেকে গােলাগুলি চলছিল। কী হলাে সেদিন আমরা কেউ বাড়ি ছেড়ে সরে গেলাম না। দুপুরের দিকে গুলির শব্দ থেমে গেলাে। তারপর হঠাৎ কিছুক্ষণের মধ্যে পাকসেনারা এ পাড়ায় ঢুকে পড়লাে। আশপাশের বাড়িসহ আমাদের বাড়ির সবাই দৌড়ে পালিয়ে গেলাে। আমি ছিলাম তখন ছয় মাসের অন্তঃস্বত্ত্বা। দৌড়াতে পারলাম না। পাশের বাড়ির একটা ঘরে লুকিয়ে রইলাম। পাঞ্জাবিরা সে ঘর থেকে আমাকে তুলে নিয়ে যায়। নদীর পাড়ে বর্তমান তােতা মার্কেটের পেছনে তখন আখক্ষেত আর মাষকলাই ক্ষেত ছিল। সেখানে সাত
আটজন পাক পিশাচ আর রাজাকার মিলে আমাকে ধর্ষণ করতে থাকে। অল্পক্ষণের মাঝে আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। আমাকে ধরে নিয়ে যাওয়ার খবর শুনে আমার শ্বশুর জঙ্গল থেকে ছুটে গিয়ে এক রাজাকার সদস্যের হাতেপায়ে ধরে। আমাকে ফিরিয়ে আনার জন্য। আমার স্বামী পাগলের মতাে ছুটে আসতে চাইছিল জঙ্গল থেকে। স্বজনরা তাকে আটকে রাখে।
আমার স্বামী আওয়ামী লীগ করতাে। বঙ্গতাজ তাজউদ্দিন তাকে খুব স্নেহ করতেন। সে ছিল তাজউদ্দিন মন্ত্রীর বিশ্বস্ত কর্মী। দেখা হলে তিনি আমার স্বামীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করতেন। পাকসেনারা চলে গেলে বাড়ির লােকজন অজ্ঞান অবস্থায় আমাকে নিয়ে আসে। আমার সন্তানটি মৃত প্রসব হয়ে যায়। সে ছিল পুত্রসন্তান। সে সময় আমার আরও দুটি মেয়ে ছিল। বড়টি পাঁচ বছর বয়সের। ছােট মেয়েটির বয়স ছিল তিন বছর। তাদের ভালাে বিয়ে দিতে পারিনি। বীরাঙ্গনার মেয়েকে কে বিয়ে করতে চায়? ধর্ষণের ফলে আমার পায়ুপথ ও গােপন অঙ্গ ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায়। বন্ধ হয়ে যায় পায়ুনালী। অকেজো হয়ে যায় গােপন অঙ্গ। পরদিন থেকে মলমূত্র ত্যাগে অসহনীয় কষ্ট হতাে। মলমূত্র ত্যাগের সময় জ্ঞান হারিয়ে ফেলতাম। যুদ্ধকালীন স্থানীয় ডাক্তার দিয়ে আমার চিকিৎসা করা হয়। স্বাধীনতার পর আমার চিকিৎসা হয় ঢাকা মেডিকেল হাসপাতালে। আমার দরিদ্র স্বামী জমিজিরাত বিক্রি করে হাসপাতালে চার বছর রেখে আমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন। হাসপাতালে পাঁচবার আমার অপারেশন হয়। কিন্তু আমার সুস্থতা ফিরে আসে না। বিকল্প ব্যবস্থা হিসেবে মলমূত্র ত্যাগের জন্য তলপেটে পাইপ বসিয়ে দেয়া হয়। এত বছর যাবৎ আমি সেই পাইপের সাহায্যে মলমূত্র ত্যাগ করে আসছি। বর্তমানে মাঝে মাঝে সেখানে ঘা দেখা দিচ্ছে। দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর ধরে এই নির্মম কষ্টভােগ করে আসছি এবং বীরাঙ্গনা নাম নিয়ে জীবনের শেষ দিনটির প্রহর গুনছি।

আব্দুস সামাদ মৃধা
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী
কাওরাইদ বাজার,
শ্রীপুর, গাজীপুর।

স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল মাত্র বার বছর। প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। অনেক কিছুই বােঝার বয়স তখন আমার ছিল না। তবে দেশে গণ্ডগােল চলছিল এটা বুঝতে পারতাম। কেননা ছাত্র-জনতার আন্দোলনসংগ্রাম ছিল তুঙ্গে। যা এ অঞ্চলের মানুষ কখনাে দেখেনি। দেশের প্রতিটি অঞ্চলের মতাে কাওরাইদ বাজারেও স্বাধীনতা আন্দোলনের ঢেউ লেগেছিল প্রচণ্ডভাবে। প্রতিদিন ছাত্রদের মিছিলে যােগ দিতাে সাধারণ মানুষ। বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার তাে বটেই, বেকার, কিশাের, বালক অর্থাৎ সর্বস্তরের মানুষ এতে অংশ নিতাে। মিছিলের শ্লোগান ছিল- তােমার দেশ, আমার দেশ, বাংলাদেশ বাংলাদেশ। তােমার আমার ঠিকানা পদ্মা, মেঘনা, যমুনা। এই শ্লোগানটি তখন ছিল কাওরাইদের মানুষের মুখে মুখে। তাে এভাবে আসে ২৫ মার্চ। ২৬ মার্চ সকালে ঘুম থেকে জেগে সবাই আকাশবাণী ও বিবিসির খবরের মাধ্যমে জানতে পারে ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে। বাঙালি ও পাঞ্জাবিদের মধ্যে যুদ্ধ চলছে। সবাই চিন্তিত হয়ে পড়ে। ততক্ষণে ঢাকার বিভিন্ন ধরনের খবর আসতে শুরু করে। এলাকার নেতারা কিছু বুঝে ওঠার আগেই বেলা শেষে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা ঢাকা এবং দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কাওরাইদ আসতে শুরু করে। তারা নদীর পাড়, রেলস্টেশন, বাজার, স্কুল ইত্যাদি স্থানে অবস্থান নেয়। এতদঅঞ্চলের জনগণ খাওয়াদাওয়াসহ তাদের স্বতঃস্ফূর্তভাবে সর্বপ্রকার সহায়তা প্রদান করে। বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা একত্রিত হয়ে বাংকার খনন করে যুদ্ধের প্রস্তুতি নেয়। সে সব বাংকার খননে আমি অংশ নিই। ২৬ মার্চের দু-একদিন পর পাক বাহিনী বেঙ্গল রেজিমেন্টের অবস্থান আঁচ করতে পেরে বিমান হামলা চালায়। বাংকার লক্ষ্য করে বােমাবর্ষণ করে। এবং ট্রেনে করে সৈন্যরা দ্রুত কাওরাইদ আসে। পথে যাকে দেখে তাকেই হত্যা করে। গােলাঘাট ব্রিজে পৌছলে বেঙ্গল রেজিমেন্ট প্রতিরােধ গড়ে তােলে। গােলাঘাটের যুদ্ধ হয় বিকেলের দিকে। এখানে প্রচণ্ড যুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু বিমান হামলার কারণে বেঙ্গল রেজিমেন্ট বাধ্য হয় পালিয়ে যেতে। সেদিনের যুদ্ধে পাকসৈন্য বা বেঙ্গল। রেজিমেন্টের হতাহতের সংখ্যা বলতে পারবাে না। তবে পরদিন বাজারে। ছয়জনের লাশ আমি নিজের চোখে দেখেছি। এরা সবাই সাধারণ জনগণ। কাওরাইদ আক্রমণের দিনে আমি পাঁচ কিলােমিটার দূরে খালার বাড়িতে ছিলাম। বােমিংয়ের দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার চোখে রক্ত এসে গিয়েছিল। পরের দিন সকালে খালার বাড়ি থেকে নিজের বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে এসে বাবাকে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। মা বললাে বাবাকে খুঁজে বের করে। আনতে। ধান কাটতে হবে। তখন বাবা বােরাে ধানের চাষ করতাে। ধান পেকে গিয়েছিল। মা আরও বললাে- ঘরে কোনাে চাল নেই। অন্য বাজারও কিছু নেই। বাবার খোঁজে আমি বাজারের দিকে আসি। বাজারের কাছাকাছি আসতেই দেখি পশ্চিম পাশে ধানের ক্ষেতে এক লােকের লাশ পড়ে রয়েছে। লাশটি উপুড় হয়ে ছিল। পরনে লুঙ্গি, গায়ে শার্ট। উপুড় হয়ে ছিল বলে চিনতে পারিনি। আমার সঙ্গে এলাকার আরও দুজন ছিল। ভয়ে আমরা কেউ কাছে যাইনি।

বাজারে এসে দেখি সুকুমারের বাবার লাশ। সুকুমারদের বাড়ি ছিল বাজারে। বাজারে ছিল ওদের দোকান। বাড়ির সবাই সরে গিয়েছিল। সুকুমারের বাবা। ছিল বাড়িতে। তাকে গুলি করেছিল গলার পাশে। গায়ে ছিল জড়ানাে লেপ। ভয়ে লেপ জড়িয়ে দরজার পাশে গুটি মেরে ছিলেন। ওই অবস্থাতেই গুলি খেয়ে পড়েছিলেন। খানিক সামনে এসে দেখি আরও একজনের লাশ। সে। ছিল একজন মিস্ত্রি। কাওরাইদ বাজারে সে মিস্ত্রির কাজ করতাে। আমি তখন বাবাকে খোজার কথা ভুলে লাশের খোঁজ করতে থাকি। স্টেশনের পেছনে মাঠে দেখি গলবৎ মাড়ােয়ারির মৃতদেহ। মৃতদেহটির গলা থেকে পেট পর্যন্ত ফেঁড়ে রেখে দিয়েছে। মাড়ােয়ারির হুঁড়ি ছিল বিশাল। পরে লােকে বলতাে পাঞ্জাবিরা হয়তাে ভেবেছিল গলবৎ নিশ্চয়ই পেটের ভেতরে টাকা-পয়সা জমা রেখেছিল। কাওরাইদ বাজারে প্রেমানন্দ নামে এক পাগল ছিল তখন।
প্রেমানন্দ পাগলকে হত্যা করে লাশটি অর্ধেক মাটিতে পুঁতে রেখে দেয়। গলবৎ মাড়ােয়ারি ও প্রেমানন্দের লাশ ছিল পাশাপাশি। একদিন পর প্রেমানন্দের সম্প্রদায়ের লােকেরা এসে লাশ নিয়ে যায়। নিজের গ্রামে তাকে কবর দেয়া হয়। এখন সেখানে মাজার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।
এর এক সপ্তাহ পরে পাঞ্জাবিরা ঘাটি করে কাওরাইদ বাজারে। ঘাটি করার পর অত্র অঞ্চলে চালায় নির্মম নির্যাতন। যাকে যেখানে দেখতে পায় তাকেই গুলি করে মেরে ফেলে। এখানে নারী নির্যাতনও হয়েছে বেশ কিছু। তবে সম্ভ্রম বিবেচনায় কেউ স্বীকার করেনি। ঘটনাচক্রে একটি নির্যাতনের প্রত্যক্ষদর্শী ছিলাম আমি। সেই পরিবারের লােকজনের সাথে আমিও আটকা পড়ে গিয়েছিলাম। ধর্ষিত হয়েছিল বাড়ির বৌ। মেয়েটির ভাসুর আমাকে প্রতিজ্ঞা করিয়ে নিয়েছিলেন। আমি কারাে কাছে কখনাে যেন প্রকাশ না করি। আমি তাকে কথা দিয়েছিলাম। বিয়াল্লিশ বছরে প্রকাশ করিনি। তাই নাম-পরিচয় বলতে পারলাম না। কাওরাইদ বাজারের এক মাইলের মধ্যে সব ছিল ফাকা। জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে সব ছারখার করে দিয়েছিল। পরে। মুক্তিবাহিনী ঘাঁটি করে হাসেম মৃধার বাড়িতে। এলাকার লােকজন খাদ্য সরবরাহসহ সর্বাত্মক স্বতঃস্ফূর্ত সহযােগিতা করে মুক্তিবাহিনীকে। তখন মানুষের মাঝে কোনাে দল ছিল না। সবার লক্ষ্য ছিল এক। দেশের স্বাধীনতা অর্জন। এবং শত্রু পাকিস্তানি সৈন্য নিধন। আমি গর্বিত যে সেই মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে আমার অংশগ্রহণ ছিল পরিবারের সম্মতিতে।

আমার কাজ ছিল শক্রর গতিবিধি লক্ষ রাখা। বাজারে ও আশপাশে গরুছাগল চড়ানাের অজুহাতে আমি সেই কাজটি করতাম। ময়লা ছেড়া-ফাঁড়া হাফপ্যান্ট বা লুঙ্গি থাকতাে পরনে। গা কখনাে উদোম। কখনাে বা প্যান্টের মতােই জরাজীর্ণ গেঞ্জি। গরু চড়ানাের ভান করতাম সারা দিন। শত্রুর গমনাগমনের খবর সংগ্রহ করে আমার এক মুক্তিভাইয়ের মাধ্যমে পৌছে দিতাম মুক্তিবাহিনীর কাছে। আমার আরও একটি কাজ ছিল। সংগৃহীত সকালের নাস্তা মুক্তির বাংকারে পৌছে দেয়া। তারিখটি আজ আর মনে নেই। তবে দিনটি ছিল শনিবার। মুক্তিবাহিনীর পরিকল্পনা ছিল একসঙ্গে তিনটি স্থানে তারা আক্রমণ চালাবে। স্থান তিনটি হলাে গােলাঘাট, পিঠাগৈড় ও কাওরাইদ ক্যাম্প। গােলাঘাট, পিঠাগৈড় আক্রমণ সফল হলেও কাওরাইদ ক্যাম্প আক্রমণ সফল হয়নি। কাওরাইদ পৌরসভার সামনে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরণ ঘটালে সঙ্গে সঙ্গে শত্রুসেনা প্রচণ্ড পাল্টা আক্রমণ শুরু করে। মুক্তিবাহিনী পিছু হটে। পিছু হটার সময় ক্যাম্প থেকে প্রায় দেড় কিলাে দূরে একটি ঝােপ-জঙ্গলের পাশে গুলির বাক্স ফেলে যায়। পরদিন তাদের নির্দেশনা অনুযায়ী রাতের অন্ধকারে সেই গুলির বাক্স উদ্ধার করে জমা দিই মুক্তিবাহিনীর হাতে।

মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে কাওরাইদ বাজারের আরও দুই দুঃসাহসিক যুবকের নাম উল্লেখ করতে হচ্ছে। তারা হলাে বাবুল ও মান্নান। মান্নান মারা গেছে। আবুল বর্তমানে কাওরাইদ বাজারে আবুল বাবুর্চি নামে পরিচিত। যুদ্ধের এক পর্যায়ে একদিন মান্নান টঙ্গী ব্রিজের কাছে নারী সেজে পাকসেনাদের প্রলুব্ধ করে। শাড়ি পরিহিত মান্নানকে ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে নারীলােলুপ একজন পাকসেনা মান্নানের দিকে এগিয়ে আসে। কাছে আসার সঙ্গে সঙ্গে মান্নান সৈন্যটিকে ধরে ফেলে এবং ব্রিজের অদূরে জঙ্গলে নিয়ে দা দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে। আবুল বাবুর্চি তাকে সহযােগিতা করে। পাকসেনাটির সাথে একজন বিহারিও ছিল। তাকেও তারা হত্যা করে। হত্যা করার সময় মান্নানের হাতের কজি কেটে যায়। সে কজি আর সারেনি। সম্পূর্ণ অকেজো হয়ে যায় মান্নানের হাত। তারপর পালিয়ে টঙ্গী থেকে কাওরাইদ চলে আসে। কাওরাইদ এসে তারা মুক্তিযুদ্ধের শেষ দিনটি পর্যন্ত মুক্তিবাহিনীর সর্বাত্মক সহযােগী হিসেবে কাজ করেছে। মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে তাদের অবদান অসামান্য।

হারেছা খাতুন গৃহিণী, সাতখামাইর, শ্রীপুর, গাজীপুর।

কয়েকমাস ধরে শুনতে পাচ্ছিলাম দেশে গণ্ডগােল চলছে। কিন্তু যুদ্ধ হবেকেউ বলেনি। কেউ ভাবেওনি যে দেশে যুদ্ধ হতে পারে। হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হলে আমরা তাৎক্ষণিক মামা শ্বশুরের বাড়ি সাইটালিয়া গ্রামে আশ্রয় নিই। গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ নিজের বাড়িঘর ছেড়ে ভিন্ন ভিন্ন নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলে যায়। সবার এক কথা- গ্রামে একদিন পাঞ্জাবি ঢুকবে। আর পাঞ্জাবি ঢুকলে মেয়ে-বৌদের ধরে নিয়ে যাবে। বাড়িঘর সব জ্বালিয়ে দেবে। যাকে পাবে তাকেই গুলি করে মেরে ফেলবে। এমতাবস্থায় আমরাও বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়া মনস্থির করি। গ্রামে দু’চারজন যারা থেকে যায় তারাও খুব অস্থিরতার ভেতর দিন কাটাতে থাকে।
সাইটালিয়া গ্রাম ছিল ভেতরে। রাস্তাঘাট তখন ছিল খুব খারাপ । গাড়ি চলাচলের অনুপযােগী থাকায় সে গ্রামকেই আমরা নিরাপদ মনে করি। এখানে আমরা পুরাে তিনমাস কাটাই। তখনাে সাতখামারে পাঞ্জাবি | ঢােকেনি। হয়তাে পাঞ্জাবি আর আসবে না ভেবে তিনমাস পর আমরা গ্রামে ফিরে আসি। বাড়ি ফেরামাত্র পাঞ্জাবি সেনা গ্রামে ঢােকে এবং বাড়িঘরে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। মুহূর্তে গ্রাম ছেড়ে চলে গেলাম আবার টেংরা গ্রামে। নিজের মামার বাড়ি। কাঁহাতক অন্যের বাড়ি। বাড়ি ফেরার ঠিক পরদিন রাতে পাবিরা আসে বাড়িতে। বাড়ি ঢুকে দরজা ধাক্কাতে থাকে। ভয়ে, আতঙ্কে তখন মনের কী অবস্থা হয়েছিল বলে বােঝাতে পারবাে না। দরজা খুলে দিই। দরজা খােলার সঙ্গে সঙ্গে আমরা কিছু বুঝে ওঠার আগে ঘরের জিনিসপত্র লুটপাট শুরু করে। তারপর আমাদের বের করে এনে আগুন জ্বালিয়ে দেয় সবগুলাে ঘরে। আগুনে আমার গরু, ছাগল, শস্য ও অন্যান্য জিনিস সব পুড়ে ছাই হয়ে গেলাে। আশপাশের আরও কয়েকটি বাড়িতে আগুন দেয় একসাথে। আগুন দিয়ে বাড়ির মানুষগুলােকে এনে একত্রিত করে আমাদের সাথে। একত্রিত করে আমার বাড়ির কাছে লালাবাগ নামে একটি জায়গায় বসিয়ে রাখে। আমার জ্যাঠা কলেমা পড়তে থাকে। পাঞ্জাবিরা আমার জ্যাঠাকে বন্দুকের নল দিয়ে জোরে আঘাত করতে থাকে। জ্যাঠা এক সময় উপুড় হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। ধরা পড়া আতর আলি নামের ছেলেটি মায়ের কাছে পানি খেতে চায়। আতরের মা কেঁদে ফেলে বলে, বাবারে পানি নাই। আতর আলির মার পরনের কাপড় ছিড়ে ওরা পুরুষদের চোখ বেঁধে ফেলে। কিছুক্ষণ পর মহিলাদের আলাদা করে এবং পুরুষদের বাঁধন খুলে লাইন করে দাঁড় করায়। তারপর ব্রাশফায়ার করে। আমার বােনের স্বামীও ছিল সেই লাইনে। আমার বােন চিৎকার দিয়ে ওঠে। রাজাকাররা বলে- মরেনি। কাল আসবে।
সেদিন সাতজন জলজ্যান্ত মানুষকে এক পলকে মেরে ফেলা হলাে আমার চোখের সামনে। এদের অনেকেই ছিল আমার আত্মীয়। আমার স্বামীকে তখন মেরে ফেলেনি। ধরে নিয়ে গেলাে। সাথে নিয়ে গেলাে আরও দুটি মেয়ে। একজন নতুন বিবাহিত। অন্যজন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা। আমার স্বামীকে বাঁচিয়ে রেখেছিল লুট করা গরু শ্রীপুরে ওদের ক্যাম্পে পৌছে দেয়ার জন্য। অন্তঃসত্ত্বা মেয়েটিকে পাঞ্জাবিরা সব সময় জাপটে ধরে রেখেছিল। যখন ওরা চলে যায় মেয়েটির গায়ে শাড়ি ছিল না। পাঞ্জাবিদের বাহুর মধ্য থেকে আর্তনাদ করে অনুনয় করেছিল। বড় বীভৎস সে দৃশ্য। চোখে না দেখলে কোনােক্রমে বােঝানাে সম্ভব নয়। মেয়ে দুটোকে কিছুদিন ক্যাম্পে রেখে নির্যাতন করে এবং পরে মেরে ফেলে। বিয়াল্লিশ বছর পরও সে সব স্মৃতি আমার কিছুমাত্র ম্লান হয়নি। যুদ্ধদিনের স্মৃতি এখনাে আমাকে তাড়া করে বেড়ায়। একদিন ভাত রান্না শেষ করেছি। এই মুহূর্তে খবর আসে পাঞ্জাবি আসছে। শুধু ভাতের হাঁড়ি নিয়ে দৌড়াতে থাকি। বাকি সব কিছু ফেলে। পেছনে ছােট ছােট বাচ্চারা। প্রায় একমাইল পর্যন্ত দৌড়ে পেছনে। ফিরে তাকাই। এ জায়গাটা ছিল একদম জঙ্গলের ভেতরে। জায়গাটার নাম ডালেশ্বর।
স্বামীকে সেই যে ধরে নিয়ে গেলাে আর ফিরে এলাে না। পরস্পর জানতে পারি শ্রীপুরের পাশে লােহাগাছ গ্রামে রেললাইনের পাশে গুলি করে ফেলে রেখেছিল। স্বামীর লাশটিও দেখতে পেলাম না। এদিকে পােড়া বাড়িতে থাকার অবস্থা রইলাে না। গ্রামেই অন্যের বাড়িতে আশ্রয় নিই। অর্ধাহারে অনাহারে দিন কাটাই। আমার ছােট ছেলের বয়স তখন তিন বছর। বাবাকে ধরে নিয়ে যাওয়া ও চোখের সামনে পরিচিত মানুষের হত্যাকাণ্ড দেখে আতঙ্কে পরদিন তার খালুর সঙ্গে চলে গেলাে। সেই যে গেলাে, আর আমার কাছে ফিরে এলাে না। স্বামীকে হারালাম, জীবিত ছেলের সঙ্গেও সৃষ্টি হয় আমার দূরত্ব। আজ অবধি সে আমার কাছে এসে থাকে না। মাঝে মধ্যে এসে দেখে যায় এতটুকুই। পাঞ্জাবিরা আমার সর্বস্ব ছিনিয়ে নিয়েছে। স্বামীর স্মৃতি মনে হলে বিয়াল্লিশ বছর পরেও ধৈর্যধারণ করতে পারি না। বাঁধভাঙা চোখের জলে বুক ভাসাই দিনের পর দিন, রাতের পর রাত।
আতর আলির কথা আগেই বলেছি। সেই আতর আলির বাস্তুভিটাতেই সাতখামাইর একাত্তরের গণকবর। পাঞ্জাবিরা আতর আলিসহ সাতজনের লাশ একসঙ্গে করে এখানেই কবর দিয়েছিল। এ কবরে স্বাধীনতাযুদ্ধে আত্মবলি দিয়ে আমার স্বজনরা চিরনিদ্রিত আছে।

এস এম মাহাবুব উল আলম
এফ এফ, ৮নং গ্রুপ কমান্ডার
চট্টগ্রাম শহর এলাকা

ছাত্রজীবন থেকে আমি রাজনীতিতে সম্পৃক্ত হয়ে পড়ি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা আন্দোলনে খুব বেশি উজ্জীবিত হই যদিও আরও আগে থেকে চট্টগ্রাম শহরে বিভিন্ন ছাত্র আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ আমার ছিল। মূলত যার অনুপ্রেরণায় গভীর আগ্রহে রাজনীতির প্রতি প্রবলভাবে আকৃষ্ট হই এবং মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়ি তিনি হলেন শহীদ স্বপন কুমার চৌধুরী। তার ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে আমি চট্টগ্রামে রাজনীতি আর বৃহত্তর পরিমণ্ডলে জড়িয়ে পড়ি। তকালীন আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগ নেতৃত্বের সাথে আমার পরিচয় হয়। এবং তা ক্রমশ ঘনিষ্ঠতা লাভ করে। তাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য নেতারা হলেন মরহুম জহুর আহমদ চৌধুরী, এম এ মান্নান, আক্তারুজ্জামান চৌধুরী বাবু, ইসহাক মিয়া, ইদ্রিস বিকম, এস এম ইউসুফ, শ্রমিক নেতা জামাল ভাই, জালাল আহমদ, শওকত হাফিজ খান রুণি, ফাহিম উদ্দীন আহমদ, কাজী মনিরুজ্জামান মন্টু, কাজী এনামুল হক দানু। সিনিয়র ভাইদের মধ্যে ছিলেন এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী, মৌলভী সৈয়দ আহম্মদ, ইঞ্জিনিয়ার ইব্রাহীম, ভিপি ইব্রাহিম ভাই, হারেছ আহমদ, এডভােকেট আবু মাে, হাশেম ও সাবের আহমদ আজগারী। প্রথম পর্যায়ে স্বপন চৌধুরী আমাকে আওয়ামী লীগ নেতা আজিজ মিয়ার সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। তাকে দেখে আমি মুগ্ধ। হই। এভাবে রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্রে আমার হাতেখড়ি।
এসব রাজনৈতিক নেতার সান্নিধ্যে আমি ‘৬৯-এর গণআন্দোলনসহ ৬ দফা ও ১১ দফার সগ্রামের বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় ছিলাম। পরে ‘৭১-এর ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ এবং ২৬ মার্চ স্বাধীনতার ডাকে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে সেই যুদ্ধে আমি প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধ শুরু হলে আমি রামগড়ে গিয়ে দেখতে পেলাম ঐখানে স্বপন চৌধুরী, সাবের আহমেদ আজগারী, এম এ রাব্বান, শওকত হাফিজ খান রুশ্নিদের। ওখানে আমরা এগার দিন অবস্থান করার পর বার দিনের মাথায় পাকবাহিনীর হাতে রামগড়ের পতন হলে আমরা ঐ স্থান ত্যাগ করি এবং মিত্রদেশ ভারতের সাবরুমে চলে যাই। একদিন পর স্বপনদা আমাকে সরাসরি রিক্রুট করে মেজর জিয়ার কাছে পাঠিয়ে দেন। ঐ রাতে আমি এবং বিশ/ত্রিশ জন মুক্তিসেনা একটি ফরম পূরণ করে ট্রেনিং ক্যাম্পের উদ্দেশে রওনা হয়ে যাই এবং পরদিন ভারতের বগাফা ট্রেনিং ক্যাম্পে রেজিস্ট্রিভুক্ত হই।
দশ/বারাে দিনের প্রশিক্ষণ শেষ করার পর আমাদের ওখান থেকে ওস্পিনগর ট্রেনিং ক্যাম্পে নিয়ে যাওয়া হয়। ওখানে আবার আট/নয় দিন অস্ত্র প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। সেখান থেকে আমাদের হরিণা ক্যাম্পে নেওয়া হয়। ট্রেনিং সম্পন্ন হওয়ার পর হরিনা ক্যাম্প থেকে আমরা সেক্টর কমান্ডার হেডকোয়ার্টারে মেজর জিয়ার কাছে রিপাের্ট করলে তিনি আমাকে বললেন, চট্টগ্রাম সিটির মুক্তিযােদ্ধাদের একটি তালিকা দেওয়ার জন্য। আমি তাঁকে যােলজনের একটি তালিকা দিলে তিনি আমাকে ঐ ষােলজনের গ্রুপ লিডার মনােনীত করেন। ২/৩ দিন পর উনি নিজেই আমাদের শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন এবং পাঁচদিনের ছুটি দেন বিশ্রামের জন্য। এ সময় আমাকে কিছু টাকা-পয়সা এবং তালিকাভুক্ত সহযােদ্ধাদের অস্ত্র ও গােলাবারুদ বুঝিয়ে দেন।

অতঃপর আমরা রামগড় দিয়ে বাংলাদেশে ঢুকি। তবে হরিণা থেকে রামগড় হয়ে চট্টগ্রাম শহরে ঢুকতে আমাদের সাত/আট দিন লেগে যায়। শহরে এসে প্রথম আশ্রয়কেন্দ্রে উঠলাম পাথরঘাটা আমার গ্রুপের রফিকের বাসায়। দুই/তিনদিন সে বাড়িতে সবাই ছিলাম। এরপর আমি গ্রুপ ভাগ করে মুক্তিযােদ্ধাদের বিভিন্ন শেল্টারে পাঠিয়ে দিলাম। ২য় শেল্টার ছিল আমার বাসা অর্থাৎ হাজি ইসহাক মিয়া সওদাগরের বাড়ি। ৩য় শেল্টার ছিল ঘাটফরহাদবেগ বজলুর রহমান চৌধুরীর বাড়ি। ৪র্থ শেলটার ছিল খেজুরতলা (মাস্টারপুল বাকলিয়া) শহীদ তফজল আলী সওদাগরের বাড়ি। ৫ম শেল্টার ছিল কোরবানীগঞ্জ মকবুল আলী সওদাগর (শেল্টার মাস্টার ছালামত
আলী)। ৬ষ্ঠ শেল্টার ছিল বাকলিয়া হাজি ইব্রাহিম সওদাগরের বাড়ি (শেল্টার মাস্টার মাে. ইউনুছ)। ৭ম শেল্টার ছিল চকবাজার জয়নগর সেকান্দার আলীর বাড়ি। ৮ম শেল্টার ছিল চন্দনপুরা আবু এন্ড কোম্পানিতে কাজী নুরুল আবছারের বাড়ি। ৯ম শেল্টার ছিল নন্দনকানন হাজি বাদশা মিয়া চৌধুরীর বাড়ি (শেল্টার মাস্টার ডা. মঈনউদ্দিন খান)। ১০ম শেল্টার ছিল আগ্রাবাদ ডা. জাফর আহমেদের বাড়ি (শেল্টার মাস্টার জাহেদ আহমদ) (পাঠানটুলি)। ১১তম শেল্টার ছিল জয়নগর চকবাজার শান্তনু চক্রবর্তীর বাড়ি। আমার গ্রুপের মুক্তিযোেদ্ধাদের অস্ত্রশস্ত্র ও গােলাবারুদ দিয়ে যােলজনকে ১১টি শেল্টারে ভাগ করে দিয়েছি। কিছুদিন আমরা সবাই বিশ্রামে ছিলাম। এদের মধ্যে প্রায় আটজনকে তাদের মা-বাবার সাথে দেখা করার জন্য ছুটি দেওয়া হয়।
পাকসেনাদের তৎপরতা তখন খুব একটা জোরদার ছিল না বলে আমরা প্রায় আঠারাে/বিশ দিন চুপচাপ ছিলাম এবং এখানে-সেখানে চলাফেরা করেছি। তারপর আমার গ্রুপ সদস্যরা একত্রিত হয় এবং ভারত থেকে মুক্তিযােদ্ধাদের আরও বিভিন্ন গ্রুপ দেশে ঢুকতে শুরু করে। এ পর্যায়ে ইঞ্জিনিয়ার আবছার উদ্দিন মােহাম্মদ আলী ও মৌলভী সৈয়দ আহমদ যৌথভাবে মুক্তিযােদ্ধাদের যুদ্ধ পরিচালনা করার জন্য সিটি কমান্ড গঠন করেন এবং এ দুজনের যৌথ কমান্ডের অধীনে সকল মুক্তিযোেদ্ধা সামগ্রিকভাবে বিভিন্ন অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। আমার গ্রুপের তৎপরতার উল্লেখযােগ্য দিক ছিল আমরা একই দিনে শহরে বিভিন্ন স্থানে ১২টি গ্রেনেড চার্জ করে শহরময় ত্রাস সৃষ্টি করে জানান দিয়েছিলাম যে মুক্তিযােদ্ধারা শহরে ঢুকে পড়েছে এবং অপারেশন শুরু করেছে।
চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প অপারেশন
রাজাকার বাহিনী বাংলার কলঙ্ক। ১৯৭১ সালের জুন মাসে পূর্ব পাকিস্তানে রাজাকার অর্ডিনেন্স ‘৭১ জারি হয়। এই অর্ডিনেন্স-এর ক্ষমতাবলে ১৯৫৮ সালের আনসার অ্যাক্ট বাতিল ঘােষণা করা হয়। আনসার ও মুজাহিদ বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণে সরকার নতুন করে আইন জারি করতে বাধ্য হয়। সেই আইন হলাে রাজাকার আইন। সেই আইনে পূর্ব পাকিস্তানের সকল ব্যক্তিকে রাজাকার বাহিনীতে ভর্তি করে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে অস্ত্রে সজ্জিত করা হবে বলে ঘােষণা দিলে জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের উগ্রপন্থী হানাদার দোসররা রাজাকার বাহিনীর জন্ম দেয়। চট্টগ্রামের রাজাকার বাহিনীর নেতা হয় চট্টগ্রাম কলেজের ইসলামী ছাত্রসংঘের সভাপতি এনামুল হক মঞ্জু। তার তত্ত্বাবধানে চন্দনপুরায় একটি রাজাকার ক্যাম্প স্থাপিত হয়। এই ক্যাম্পের রাজাকাররা রাস্তায় একটি চেকপােস্ট বসিয়েছিল। শুধু চেকপােস্ট বসিয়ে তারা ক্ষান্ত হয়নি। রাস্তা থেকে সাধারণ মানুষদের ধরে ক্যাম্পে নিয়ে তাদের টাকা-পয়সা ভাগবাটোয়ারা করতাে। অক্টোবরে প্রথম দিকে তারা চন্দনপুরা মসজিদে মাইকের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ঘােষণা প্রচার করতাে। চন্দনপুরার রাজাকার ক্যাম্পের রাজাকারদের অত্যাচার চরমে উঠলে মুক্তিযােদ্ধারা ক্ষেপে ওঠেন। এছাড়া প্রায় প্রতিদিন চন্দনপুরা অঞ্চল দিয়ে মুক্তিযােদ্ধাদের জন্য পটিয়া থেকে অস্ত্র আসতাে। রাজাকার বাহিনীর এ পােস্টের কারণে মুক্তিযােদ্ধাদের অস্ত্র আনা-নেয়াতে অসুবিধা হতে লাগলাে। ভাবনায় পড়লেন সবাই। এ অস্ত্র চট্টগ্রাম শহরে প্রবেশ করতে না পারলে অনেকগুলাে অপারেশন বন্ধ হয়ে যাবে। এর মধ্যে সমস্যা সমাধানে এগিয়ে এলেন আবসার উদ্দিন মাে, আলী ও কাজী এনামুল হক দানু। তারা বৈঠক করে আমাকে ডেকে নেন এবং সিদ্ধান্ত হয় যে অপারেশনটি পরিচালনা করবেন ৮নং এফ এফ গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব উল আলম। এই অপারেশনের জন্য আমি আমার গ্রুপ নিয়ে আবার পৃথকভাবে গােপন বৈঠকে বসি পরদিন জয়নগর সেকান্দার আলীর বাসায়। বৈঠকে আমার সাথে প্রস্তুত ছিলেন সেকান্দার আলী, শান্তনু চক্রবর্তী, মােহাম্মদ হােসেন (বাবুইয়া) ও শাহ আলম। তখন রমজান মাস। কোন সময় কীভাবে অপারেশনটা করলে সুবিধা হবে সে ব্যাপারে বিস্তারিত আলােচনা হয়। আলােচনায় আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম যে, ইফতারের সময় আক্রমণ হবে এবং মােহাম্মদ হােসেন বাবুইয়া অপারেশনে যাওয়ার জন্য ট্যাক্সি চালাবে। অপারেশনে আগের দিন নাসিরুদ্দিন চৌধুরী (লেখক ও সাংবাদিক) আমার বাসায় (তখন নাসির আমার বাসায় শেল্টারে ছিল) আমাকে বিনয়ের সাথে বললেন, আপনার সাথে আমি যুদ্ধে অংশগ্রহণ করতে চাই। তখন আমি তাকে জিজ্ঞেস করলাম তুমি পারবে কিনা। কারণ সে তখন বেশ ছােট ছিল। সে বললাে, আমি পারবাে। তখন আমি তাকে রিকুট করলাম। পরদিন আমরা চকবাজারে সেকান্দারের শেল্টারে উঠলাম। সেখানে আমার অস্ত্র ৯ এম এম কার্বাইন, ৪টা ম্যাগজিন নিয়ে সেকান্দারকে দিলাম। আমি বললাম, আমার সাথে নাসির অপারেশনে থাকবে। তখন নাসিরকেও একটা ৯ এম এম কার্বাইন দিলাম।
মােহাম্মদ হােসেন বাবুইয়ার ট্যাক্সি করে আমরা রাজাকার ক্যাম্প আজম ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ আক্রমণ করার জন্য রওনা দিলাম। আমরা দুজনে সন্ধ্যা ৬টায় ইফতারের সময় এ ওয়ার্কশপে অতর্কিত আক্রমণ করি। আক্রমণের অগ্রভাগে ছিল নাসিরুউদ্দিন চৌধুরী। প্রথমে তার ব্রাশফায়ারে ৩ জন রাজাকার ঘটনাস্থলে নিহত হয় এবং বহু নির্যাতনের ক্ষেত্র চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প ধ্বংস হয়ে যায়। এরপর সদলবলে আমরা আবার ঐ ট্যাক্সি করে শেল্টারে ফিরে আসি। অক্টোবরে এ অপারেশন সম্পন্ন হওয়ার পর পুনরায় চন্দনপুরা রাজাকার ক্যাম্প করার সাহস তারা আর পায়নি।
এর আগে আমরা আরেকটি বড় অপারেশন করি। কুখ্যাত রাজাকার সাকা চৌধুরীকে হত্যার অপারেশনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় তখন। এ অপারেশনের পরিকল্পনার উদ্যোক্তা হলেন যুদ্ধকালীন মহানগর কমান্ডার আবছার মাে, আলী, বর্তমান এমপি মঈনুদ্দিন খান বাদল ও মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মরহুম কাজী ইনামুল হক দানু। ৩ জনে। মিলে জয়নগরের মুক্তিযােদ্ধা আনােয়ারুল ইকবালের (পরে পুলিশের আইজি ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা) বাসায় বৈঠক করেন এবং সেখানে আমাকে ডেকে নেন। ঐ বৈঠকে আবসার উদ্দিন মাে, আলী ও অপর দুজন সিদ্ধান্ত নেন যে, এ অপারেশনটা গ্রুপ কমান্ডার মাহবুব উল আলম করবেন। তারা আমাকে অপারেশনের দায়িত্ব দেন। পরিকল্পনা বাস্তবায়নে দুই-তিনদিন পর আমি জয়নগরের সেকান্দার আলীর বাসায় সহযােদ্ধাদের নিয়ে আরেকটি বৈঠক করি। বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন সেকান্দার আলী, কাজী নুরুল আবছার, শাহ আলম, মাে, হােসেন বাবুইয়া। বৈঠকে আমি সাকা চৌধুরীকে আক্রমণের জন্য রেকি করতে কাজী নুরুল আবছারকে দায়িত্ব দেই। ৭/৮ দিন পরে খবর আসে ঐদিন সন্ধ্যায় চন্দনপুরায় ডা, ছমিউদ্দিনের বাড়িতে তার মেয়ের এনগেজমেন্ট হবে সাকা চৌধুরীর সাথে। এ উপলক্ষে সাকা চৌধুরী আসবে এবং এনগেজমেন্টের আংটি পরাবে ছমিউদ্দিনের কন্যার হাতে। কাজী নুরুল আবছার এ খবর আমাকে দেয়। সে আমাকে বললাে ডা, ছমিউদ্দিনের ছেলে আজিজ তার বন্ধু। আজিজের কাছ থেকে সে খবরটা পেয়েছে সাকা চৌধুরী আসবে। তখন আমি চকবাজার শেল্টারে বসে আবছারকে বললাম, আজিজ যখন তােমার বন্ধু, তুমি তাকে রাজি করাও যে সে আমাদের সাথে এ অপারেশনে সহযােগিতা করবে। দুদিন পর আবছার আবার খবর আনলাে যে, আজিজ ও তার বােন উভয়ে আমাদের এ অপারেশনে সহযােগিতা করতে রাজি আছে। যদিও ডা, ছমিউদ্দিনের কন্যার
সাথে সাকা চৌধুরীর বিয়ের কথা হয়েছে তথাপি মুসলিম লীগ নেতা ছমিউদ্দিনের পরিবারের সবাই জানতে সাকা চৌধুরী ইতােমধ্যে বহু নারীকে ধর্ষণ ও অত্যাচার করেছে। তাই আজিজের বােন এ বিয়ে ভেঙে দিতে ইচ্ছুক ছিল। সেপ্টেম্বরের ২০ তারখ সাকা চোধুরা ও তার পরিবারের অন্যরা। আজিজদের বাড়িতে অনুষ্ঠান করতে আসবে। এ খবর পেয়ে আমি পরবর্তী পরিকল্পনা চূড়ান্ত করে ফেলি। ঐদিন ফরহাদবেগে আমার বাসায় সাকা চৌধুরীকে আক্রমণের চুড়ান্ত পরিকল্পনা গ্রহণ করি। আমার গ্রুপের সবচেয়ে সাহসী যােদ্ধা ফজলুল হক ভূঁইয়া ও সৌরেন্দ্রনাথ সেন ওরফে কামালকে নিয়ে আমরা তিনজন মিলে অপারেশনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। সেদিন দুপুর থেকে আমার বাসায় বসে, অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত করে রাখি। তখন আমার বাবা আমাদের সবাইকে ডেকে বললেন, তােমরা যেসব অস্ত্র নিয়ে এসেছে। এগুলাে নিয়ে তােমরা এ অপারেশন সফল করতে পারবে না। তােমরা ভারী অস্ত্র অর্থাৎ এলএমজি (লাইট মেশিনগান) নিয়ে যাও। কিন্তু ফজলু ও সৌরেন্দ্র বললাে, চাচা এসব অস্ত্র দিয়ে আমরা কাজ সেরে ফেলতে পারবাে।
আমরা সন্ধ্যার ঠিক আগে আমাদের বাসা থেকে অস্ত্র ও গােলাবারুদ নিয়ে অপারেশনের গন্তব্যস্থলে রওনা হই। আমরা ডা, ছমিউদ্দিনের প্রতিবেশী আওয়ামী লীগ নেতা আতাউর রহমান কায়সারের বাড়ির পাশ দিয়ে অগ্রসর হয়ে ছমিউদ্দিনের বাসার সামনে নালার স্ল্যাবের নিচে তিনজন অস্ত্রসহ ঢুকে পড়ি। আগে থেকে আমার গ্রুপের কাজী নুরুল আবছার ও আজিজের মধ্যে কথা হয় যে, শত্রু যখন বাড়িতে ঢুকবে তখন আজিজ তার তিনতলা বাড়ি থেকে দুবার টর্চের আলাে জ্বালাবে আমাদের আগমন সংকেত দেওয়ার জন্য। আর যখন শক্ররা বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবে তখন তারা সংকেতে জানানােরজন্য ৩ বার টর্চের আলাে জ্বালাবে। তখন গুঁড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমরা শক্রর জন্য স্ল্যাবের নিচে অস্থির অপেক্ষায় ছিলাম। আনুমানিক সাড়ে সাতটার দিকে আমরা দেখলাম সাকা চৌধুরী নিজে গাড়ি চালিয়ে সদলবলে ছমিউদ্দিনের বাসায় ঢুকছে। তখন আমরা খুব উত্তেজিত, অধীর আগ্রহে শত্রু নিধনের অপেক্ষায়। রাত আনুমানিক নয়টার পর দেখলাম ছমিউদ্দিনের তিনতলা বাড়ি থেকে টর্চের আলাে তিনবার জ্বলে উঠলাে। আমাদের রেকির দায়িত্বপ্রাপ্ত নুরুল আবছারও তখন গােপনে ঐ বাড়ির তিনতলায় আজিজের সাথে ছিল। আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ। টর্চের আলাের সংকেত পেয়ে আমরা ড্রেন থেকে বের হয়ে সাকার গাড়ির সামনে এসে দাঁড়াই। সাথে সাথে একযােগে আমরা তিনজনেই গুলি চালাই, ব্রাশফায়ার করি। একই সময়ে শক্রকে লক্ষ্য করে গ্রেনেড চার্জ ও রিভলবার থেকে গুলি ছুড়তে থাকি। এ সময় গাড়ির মধ্যে একজন নিহত হয়েছে নিশ্চিত হলাম যখন নিহত ব্যক্তির মাথার মগজ ও রক্ত আমার জ্যাকেটের ওপর ছিটকে পড়েছে দেখলাম। মনে
করলাম সাকা নিহত হয়েছে। কিন্তু একটু পরেই ঝুপ করে আওয়াজ শুনলাম। আওয়াজ লক্ষ্য করে আমি রিভলবার থেকে আরও তিন রাউন্ড গুলি ছুড়লাম। পরে জানতে পারলাম সাকা চৌধুরী আহত হয়ে গাড়ির দরজা খুলে পার্শ্ববর্তী পুকুরে ঝাপ দিয়ে পালিয়ে যাওয়ার আওয়াজই ছিল ঐটি। এর পর সিরাজউদ্দৌলা রােডের দিক থেকে আরও একটা জিপ আমাদের দিকে অগ্রসর হচ্ছে দেখে আমি আবার রিভলবার থেকে সেটি লক্ষ্য করে আরেক রাউন্ড গুলি ছুড়ি। জিপটা পিছু হটে পালিয়ে যায়। আমরাও পানির ড্রেন ও মলমূত্রের নালার ভেতর দিয়ে বের হয়ে বাকলিয়ায় আমাদের শেল্টারে চলে যাই। সেখান থেকে সৌরেন্দ্রকে একটি শেল্টারে এবং ফজলুকে আরেকটি শেল্টারে পাঠিয়ে দিয়ে আমি বাকলিয়ার শেল্টারে রয়ে গেলাম।
ঐ রাতে দশটার বিবিসি সংবাদ শুনলাম বাকলিয়া শেল্টারে বসে। বিবিসির খবরে বলা হলাে কুখ্যাত রাজাকার সর্দার সাকা চৌধুরী মুক্তিযোেদ্ধাদের আক্রমণে গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি আছে। রাত ১১টায় ভয়েস অব আমেরিকার সংবাদে বলা হলাে সাকা চৌধুরীর ওপর মুক্তিযােদ্ধারা গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনায় একজন ঘটনাস্থলে নিহত হয়েছে এবং সাকা চৌধুরী। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন। পরদিন সকালে বিভিন্ন সূত্রে শহরে খবর ছড়িয়ে পড়ে যে, সাকা চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রথম দিন চিকিৎসা নেয়ার পর উন্নত চিকিৎসার জন্য পাকিস্তানের করাচি হয়ে লন্ডনে চলে গেছেন। আমরা আশ্বস্ত হলাম যে, কুখ্যাত রাজাকার সর্দার সাকা চৌধুরী অন্তত দেশছাড়া হয়েছে। তার নিপীড়ন-নির্যাতন থেকে চট্টগ্রামের মানুষ সাময়িকভাবে মুক্তি পেয়েছে।

এর ঠিক দুদিন পর পাকসেনারা আমার ঘাটফরহাদবেগের বাড়ি রেইড করে এবং মা-বাবার সাথে অপমানজনক ব্যবহার করে। আমাকে হাজির করার জন্য তারা আমার বাবাকে এরূপ অসম্মানজনক আচরণ করার পর পার্শ্ববর্তী আরেকটি শেল্টারে রেইড করে। সেই বাড়ি থেকে আমার বড়ভাই এস এম শামছুল আলম ও তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং ঐ শেল্টার মাস্টার আবু বক্কর চৌধুরীকে রাতে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়ে পাক হানাদাররা আমার বড়ভাই ও তার বন্ধুকে অকথ্য নির্যাতন করে। চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজে দুজনকে অকথ্য নির্যাতন করে চট্টগ্রাম সেনানিবাসে হস্তান্তর করে পাক
সেনারা। নির্যাতনে মারা গেছে ভেবে পাক সেনারা তাদের উভয়কে চট্টগ্রাম কারাগারে প্রেরণ করে। কারা হাসপাতালে দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর তারা জীবন ফিরে পান এবং দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আমরা তাদের কারাগার থেকে মুক্ত করে আনি।

এর দুদিন পর পাকসেনারা খেজুরতলা মাস্টারপুল এলাকার আরও একটি শেল্টারে আবার রেইড করে এবং ঐ বাড়ির শেল্টার মাস্টার শহীদ তফজল আলী, শহীদ আবু বক্কর লাবু ও শহীদ মাে, কমর আলী- এ তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। আমাকে হাজির করার জন্য তাদের ওপর অকথ্য নির্যাতন চলে। তারা বলেছিল তারা আমাকে চেনে না। আমার ব্যাপারে খোঁজখবর নেওয়ার জন্য পাক সেনারা এ তিনজনকে নির্মমভাবে নির্যাতন করে। আজ অবধি তাদের ব্যাপারে পরিবার আর কোনাে খোঁজখবর পায়নি। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের লাশও খুঁজে পায়নি পরিবারের সদস্যরা।
এসব অত্যাচার, অবিচার আর প্রতিরােধের মধ্য দিয়ে আসে স্বাধীনতা যুদ্ধের বিজয়। এ বিজয়ে জড়িয়ে আছে সাহস, বীরত্বের গৌরবগাথা। আছে এদেশের মানুষের ত্যাগ-তিতিক্ষা, লাঞ্ছনা, কষ্ট আর হারানাের অসহ্য বেদনা।
গীতা দাস :
প্রাক্তন শিক্ষক, ময়মনসিংহ।

‘৭১ সালের মার্চ মাসের উত্তাল গণজাগরণ ও বঙ্গবন্ধুর ডাকে পাকিস্তান সরকারের বিরুদ্ধে অসহযােগ আন্দোলনের মাধ্যমে উপলব্ধি করা যাচ্ছিল যে, পূর্ব পাকিস্তানে ভয়াবহ একটা কিছু ঘটবেই। আঁচ করার সঙ্গে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলাের কোনাে মিল ছিল না। দেশের মানুষ ভাবতেও পারেনি কী ভয়াবহ নির্মমতা তাদের জন্য অপেক্ষা করছে। ২৫ মার্চে আমরা ময়মনসিংহ ছিলাম। ঢাকা ম্যাসাকারের খবরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানের খবর লােকমুখে ও বেতারের মাধ্যমে জানতে পারি। কিন্তু তখনাে ভাবিনি আমাদের ময়মনসিংহ। শহর ছাড়তে হবে। যেদিন হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহে ঢুকলাে সেদিন। আমরা ময়মনসিংহ ছেড়ে গেলাম। ভাের থেকে খবর হলাে হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ আসছে। জনগণ কুড়াল, দা, বঁটি দিয়ে গাছপালা কেটে ঝুপ করে রাস্তায় ফেলে রাখলাে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরােধের জন্য। কিন্তু বেলা বাড়ার সাথে সাথে যে যেদিকে পারলাে শহর ছেড়ে পালাতে লাগলাে। আমার মা তখন আমাদের দুবােনকে অন্য পরিচিত এক লােকের সাথে গ্রামে পাঠিয়ে দিলেন। সেটা ছিল ফুলপুর থানার তারাকান্দা থেকে তিন মাইল দূরে। লাউটিয়া গ্রাম। আমার বাবা ছিলেন তখন নরুন্দিতে কর্মরত। হানাদার বাহিনী পুরাে ময়মনসিংহ শহর দখল করে নিলে বাবা মাকে নিয়ে ব্রহ্মপুত্র সাঁতরে পার হয়ে আমাদের সাথে মিলিত হন। উনারা ব্ৰহ্মপুত্র পার হওয়ার সময় হঠাৎ প্লেন থেকে গুলি শুরু হলাে। হতাহতের সংখ্যা কত কেউ আর আজ বলতে পারবে না। ব্রহ্মপুত্রে তখন শত শত লােক সঁতরে পার হওয়ার চেষ্টা করছিল। আমার মা এক কাপড়ে বের হয়েছিলেন। কিন্তু মায়ের সাথে ছিল গয়নার পোঁটলা। গয়নাগুলাে ভেঙে মা টুকরাে টুকরাে করে নিয়ে ছিলেন। হানাদার বাহিনীর গুলির হাত থেকে বেঁচে গেলেও ওনারা পড়েছিলেন লুটতরাজের মুখে। তখন পুরাে এলাকা ছিল অরাজক। কারাে কোনাে নিয়ন্ত্রণ ছিল না। লাউটিয়া যাওয়ার পথে শেলিংয়ে একটি বাস পুড়ে ছাই হয়ে গেলাে। বাসভর্তি ছিল শহর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া লােকজন। সৌভাগ্যক্রমে আমার বাবা-মা বেঁচে যান। ওনারা সে বাসে ছিলেন না। বাবা-মাকে পেয়ে আমরা দুবােন প্রাণ ফিরে পেলাম বটে, কিন্তু আমাদের শান্তি ফিরে এলাে না। লাউটিয়ায় ডাকাতি শুরু হয়ে গেলাে। প্রতি রাতেই ডাকাতের আক্রমণ চললাে। গ্রামবাসীর সামান্য সম্বলটুকুও ছিনিয়ে নিয়ে যেতে লাগলাে ডাকাত দল। অদ্ভুতভাবে বড় অসহায় অবস্থার মধ্য দিয়ে চলছিল দেশ।
আতঙ্ক, ভয়, অনিশ্চয়তাকে জীবনসঙ্গী করে সময় পার করছি আমরা। এরই মধ্যে ডাকাত এলাে আমাদের আশ্রিত বাড়িতে। আমি দৌড়ে গিয়ে বাড়ির পেছনে গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে যাই। অনেক পরে টের পাই আমি একটি গ্রামের খােলা টয়লেটে দাঁড়িয়ে আছি। আমার হাঁটু পর্যন্ত ময়লা। উহ! কী বিশ্রী গন্ধ। আমি কান্না ভুলে গেছি। এক সময় বাড়ির মালিক রামদা উঁচিয়ে ধেয়ে আসেন। উনার ধারণা ছিল আমি ডাকাতদের কেউ। আমি আর্তস্বরে। বলি, ‘দাদা আমাকে মারবেন না।’
উনি বলেন ‘আহ। গীতা, কথা বলাে না, চুপ করে থাকো’। উনিও আমার সাথেহাঁটু অবধি ময়লা নিয়ে নিজেকে লুকিয়ে রাখলেন। এ অবস্থাতেও আমরা ওই বাড়িতেই থেকে গেলাম। আমার বাবা নিরুপায় হয়ে কর্মস্থলে চলে গেলেন।
আমরা যে বাড়িতে আশ্রিত ছিলাম সে বাড়ির পাশ দিয়ে গুয়াতলার রাস্তা দিয়ে শত শত লােক সীমান্ত পার হয়ে ভারতে প্রবেশ করতাে। একদিন এক মহিলা সেখানে আসতেই প্রসব বেদনা তীব্র হয়। সে তখন পাশের পাটক্ষেতে লুকিয়ে যায় এবং বাচ্চা প্রসব করে। সাথে চলা একজন মহিলা। বাঁশের চাচাড়ি কেটে এনে নবজাতকের নাড়ি কাটা শুরু করে। এসময় হঠাৎ শত্রুসেনা এসে গেছে খবর ছড়িয়ে পড়ে। লােকজন দিগ্বিদিক ছুটতে থাকে। সদ্য প্রসবকৃত এক মহিলা বাচ্চাকে সাথে নিয়ে যাবার সুযােগ না পেয়ে নবজাতককে রেখে ছুটে পালায়। মহিলার স্বামী তখন আরও দূরে চলে গেছে। এলাকার একজন বৃদ্ধ মহিলা বাচ্চাটিকে পাটক্ষেত থেকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। দেশ স্বাধীন হলে সে মহিলা বাচ্চাটিকে তার বাপ-মার কোলে তুলে দেয় বলে জানতে পারি। ভারতে শরণার্থী শিবিরে আশ্রয়কালীন পর্যন্ত বাপ-মা শিশুটি বেঁচে আছে কি না- এ খবরটুকুও সংগ্রহ করতে পারেনি।
আগস্ট মাসে উপায়হীন হয়ে আমরা ময়মনসিংহ শহরে চলে আসি। কাজে যােগদান করতে বাধ্য হই। আমার কর্মস্থল ছিল ত্রিশাল গার্লস হাই স্কুল। ছাত্রী উপস্থিত ছিল না বললেই চলে। বাধ্য হয়ে যােগদান করা শিক্ষকদের উপস্থিতি ছিল বটে, আতঙ্ক ছিল সর্বক্ষণের সঙ্গী। আমার সহকর্মীর ভাই ইকবাল। আগস্টের শেষের দিকে ওকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে যায়। ক্যাম্পে নিয়ে নির্মমভাবে অত্যাচার করে। ওদের বাবা ছিলেন দারােগা। তিনি উর্দু জানতেন। অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে ছেলেকে উদ্ধার করে আনেন। বাসায় ফিরে এলে ইকবালকে আমি দেখতে যাই। ইকবালের চেহারা ছিল বীভৎস। মেয়ে কিংবা ছেলে এটা চেনার উপায় ছিল না। শরীরের সর্বত্র ছিল আঘাতের লােমহর্ষক চিহ্ন। ইকবালের অপরাধ সে ছিল একজন মুক্তিযােদ্ধা। একদিন কর্মস্থলে রাজাকার বাহিনী শিক্ষকদের জন্য খাবার আয়ােজন করে। খাবার সময় জাহানারা ওর খাবার প্লেট জানালা দিয়ে ছুড়ে ফেলে দেয়। তৎক্ষণাৎ শান্তি কমিটির সেক্রেটারি রশিদ বলে, এটা কী করলেন?
জাহানারা বললাে, “এ খাবারে আমার ভাইয়ের রক্ত। সেদিন ওরা কেন খাবার আয়ােজন করেছিল বলতে পারবাে না। তাছাড়া সেদিন টর্চার অথবা মৃত্যুর হাত থেকে কেন সবাই রেহাই পেলাম সে কেবল স্বয়ং ঈশ্বর জানেন।
এবার আসি বাবার কথায়। আমার বাবার নরুন্দিতে ব্যবসা ছিল। তিনি পাকফোজের কারণে দিনের বেলায় ধানের গােলায় লুকিয়ে থাকতেন। সন্ধ্যার দিকে বের হয়ে আসতেন। নরুন্দি বাজারের আশপাশে ১৭ জনের হত্যার তালিকা করা হয়। এই তালিকায় আমার বাবাও ছিলেন। হঠাৎ একদিন সবাইকে নদীর তীরে নিয়ে দাঁড় করানাে হয়। তারপর গুলি করে হত্যা করে। এরকম হত্যা ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। দীর্ঘ নয়মাস বাঙালি হত্যার মধ্যেই। ছিল ওদের আনন্দ। নয়মাস ধরেই চলছিল ওদের লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ, নারী নির্যাতন ও ব্যাপক গণহত্যা।

উম্মে সালমা জুই
প্রাক্তন শিক্ষক, ময়মনসিংহ।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতের প্রথম প্রহরে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ শুরু। সে রাতে আমি ময়মনসিংহ শহরে ছিলাম। আমাদের বাসা ছিল জিলা স্কুলের গেটের সামনে। আমি তখন নতুন বৌ। মাত্র কয়েকমাস আগে আমার বিয়ে হয়েছে। এটা ছিল আমার শ্বশুরের বাসা। ২৬ মার্চ সকাল থেকে বাসার সবার কাজ ছিল রেডিওর খবর শােনা, বিভিন্ন জায়গার খবর সংগ্রহ করা আর পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা। ময়মনসিংহ শহরজুড়েই ছিল এই একই অবস্থা। এভাবেই মার্চ শেষ হলাে। এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে এক দিন ভােরে আমার ভাসুর আতঙ্কে ছুটে বাসায় ঢুকলেন এবং হাঁপাতে হাঁপাতে বললেন, ‘পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহরে ঢুকছে। যে যেদিকে সম্ভব বাসা ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ আমরা তখন যেভাবে ছিলাম সে অবস্থাতেই বাসা ছাড়তে শুরু করলাম। আমাদের তখন মাত্র নাস্তা খাওয়া শেষ হয়েছে। আমার শাশুড়ি ঘরের কিছু জিনিসপত্র নিয়ে গফরগাঁওয়ের উদ্দেশে রওনা দিলেন। তিনি কিছু রুটিও সাথে নিলেন। আমি ও আমার স্বামী সুনীল বাবুর বাড়ির দিকে রওনা হই। সুনীল বাবু ছিলেন আমার স্বামীর সহকর্মী। সুনীল বাবুর বাড়ি ছিল শহর থেকে ১৮/১৯ মাইল দূরে ফুলবাড়ীয়া থানার রাধাকানাই গ্রামে। সুনীল বাবুর বাড়িতে আমরা এক সপ্তাহ ছিলাম। এরই মধ্যে খবর শােনা যায়, সুনীল বাবুর বাড়ি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া হবে। তখন আমরা সুনীল বাবুর বাড়ি ছেড়ে অন্য এক মুসলমান ভদ্রলােকের বাড়ি গিয়ে আশ্রয় নিই। রাধাকানাই গ্রামের এক বাড়ি থেকে অন্য বাড়ি এভাবে আমরা একমাস লুকিয়ে রইলাম। স্বাধীনতার এত বছর পরেও একবিন্দু ভুলিনি রাধাকানাই গ্রামের আশ্রয়দানকারীদের আদর-আপ্যায়ন।
রাধাকানাই গ্রামে একদিন হঠাৎ করে আমার ভাসুর এসে উপস্থিত হলেন। অনেক খোঁজের পর তিনি আমাদের সন্ধান পেয়েছিলেন। ভাসুর আমাদের নিয়ে রওনা হলেন গ্রামের আরও ভেতরে উনার শ্বশুরবাড়ি। পথে ঝড়বৃষ্টির মধ্যে রিকশায় ভিজে যাচ্ছি। ভিজে কাপড়ে ভাসুরের শ্বশুরের বাড়িতে পেীছি। সেখানে একরাত থেকে গফরগাঁও শ্বশুরবাড়ি চলে আসি। ভয়ভীতির মধ্যে থেকেও আমরা ভালাে খাবার-দাবার পাচ্ছিলাম। তখন মাছ, মাংস, দুধ, সবজি সব কিছু সস্তা। ক্রেতা নেই। নদীর মাছ তাে লাশের কারণে মানুষ খাওয়া ছেড়ে দিয়েছে। হাটবাজার বন্ধ। খাবার আছে ঠিকই কিন্তু কারাে পেটে খাবার ঢুকছে না। আতঙ্কে সবাই দিশেহারা। কে কখন আর্মির হাতে পড়ে। এর মাঝে ইয়াহিয়া দেশের সমস্ত কর্মচারীকে কাজে যােগ দেয়ার নির্দেশ দেয়। আমার স্বামী ময়মনসিংহ শহরের রাধাসুন্দরী স্কুলে শিক্ষকতা করতেন। চাকরিতে যােগদানের খবর নিয়ে আসে আমার দেবর । তখন আমাদের সিদ্ধান্ত হয় আমরা সবাই ময়মনসিংহে চলে আসবাে। শ্বশুরবাড়ির লােকজনসহ ময়মনসিংহে চলে আসি। আমার ও ননদের গায়ে ছিল বােরকা। আমার গায়ে নিরেট গাঁয়ের মেয়েদের মতন এক পেঁচে শাড়ি। মাথার চুল এলাে করা। পায়ে জুতাে নেই। গফরগাঁও স্টেশনে ট্রেন পেছলে দেখি বেশিরভাগ ট্রেনের কামরা পাকিস্তানি সেনাদের দখলে। আমার স্বামী। ভুল করে সবাইকে নিয়ে পাকসেনাদের কামরায় উঠে পড়েন। কিছু বুঝে ওঠার আগেই এক সেনা তার গালে প্রচণ্ড জোড়ে এক চড় বসিয়ে দেয়। আমরা তখন পড়ি তাে মরি করে অন্য কামরায় গিয়ে উঠি। আমরা যে কামরায় উঠি সেখানে কয়েকজন বিহারি। আমাদের তখন হাত-পা কাপছে। গলা শুকিয়ে কাঠ। বিহারিদের মধ্য থেকে একজন আমার স্বামীর হাতে পাখা তুলে দিলাে। আর আমার স্বামীরকে গফরগাঁও থেকে ময়মনসিংহ পর্যন্ত একটানা বাতাস করে যেতে হলাে তাদের। ময়মনসিংহের বাসায় এলাম। বাসার সামনের রাস্তা দিয়ে অনবরত পাকসেনাদের গাড়ি চলে। জীবন হাতে নিয়ে বসে থাকি। রাত কাটে তাে দিন কাটে না। আমি তখন অন্তঃসত্ত্বা। আজকের দু কন্যাকে পেটে ধরে আছি। এমতাবস্থায় জন্মদানের সময় এলাে।হাসপাতালে ভর্তি হই। একদিন দেখি অনেক আহত পাকিস্তানি সেনা ভর্তি করা হলাে হাসপাতালে। হাসপাতালের সবাই বুঝতে পারলাম কাছেই কোথাও আঘাত হেনেছে মুক্তিফৌজ।।
আমার পাশের সিটে ভর্তি হলাে সুরুজের বৌ। সুরুজ আমার স্বামীর বন্ধু। সুরুজ মিঞা উকিলের ছেলে। আমার কন্যাদের জন্মের পরদিন সুরুজের বৌয়ের ছেলেসন্তান জন্ম নেয়। সুরুজ মিঞা প্রতিদিন ছেলের জন্য দুধ নিয়ে আসতাে বাইরে থেকে। একদিন দুধ আনতে যে গেলাে আর ফিরলাে না। রাজাকার ধরে নিয়ে গেছে। লাশটিও স্বজনরা খুঁজে বের করতে পারলাে না। শােনা গেলাে হত্যার আগে সুরুজের চোখ দুটি আগে উপড়ানাে হয়েছিল। সুরুজের অপরাধটি কী ছিল আজ অবধি কেউ জানে না। তখন জুন মাস। আরও খবর এলাে আমার নিকটাত্মীয় যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন। এসব মৃত্যু সংবাদের মধ্য দিয়ে কেটে যাচ্ছিল আমাদের দিনগুলাে। প্রতিদিন অগণিত মানুষের মৃত্যু ঘটতে লাগলাে। যারা বেঁচে রইলাে তারা মানসিক দিক থেকে অর্ধমৃত হয়ে। আমরা কেউ বেঁচে থাকবাে বা পাকিস্তানি সেনাদের হাত থেকে রক্ষা পাবাে এ ভরসা কেউ সেদিন রাখতে পারিনি। পুরাে নয় মাস ধরে যে বর্বরতা আর নিষ্ঠুরতা চলছিল তার বর্ণনা করা সম্ভব নয়। পুরাে দেশ ছিল যেন আগুনের কুণ্ড। আগুনে হাত দিয়ে যেন আমরা বসে আছি। কখন পুড়ে ছাই হবাে শুধু তারই অপেক্ষা। অবশেষে ডিসেম্বর এলাে। এলাে আমাদের। স্বাধীনতা। মুক্তির সেই আনন্দ ভাষায় বর্ণনা করা সম্ভব নয়।

পংকজ দস্তিদার
সাংবাদিক, চট্টগ্রাম।

আমার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও গ্রামে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি চকরিয়ার বরইতলী হাই স্কুলে শিক্ষকতা করি। যুদ্ধ শুরু হলে গ্রামে চলে যাই। বাড়ি ফিরেই ভারতে চলে যাওয়ার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আমি যে বাড়িতে লজিং থাকতাম সেই বাড়ির মালিকের আমার সাথে ভারত যাওয়ার কথা ছিল তাই তার আসার অপেক্ষা করতে গিয়ে আমার চলে যাওয়াটা দেরি হয়ে গেলাে। তাে তাকে সঙ্গে নিয়ে একাত্তরের ১৭ এপ্রিল ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। প্রথমে আমরা পশ্চিমবঙ্গের হরিণা ক্যাম্পে আশ্রয় নিই। হরিণা ক্যাম্পে অবস্থান নিয়ে আমি যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের নেতাদের সন্ধানে ব্যস্ত হয়ে পড়ি। এখানে আমার যােগাযােগ হয় তৎকালীন ছাত্রনেতা স্বপন চৌধুরীর সঙ্গে। স্বপন চৌধুরী ছিলেন সে সময়ের ঢাকা ইউনিভার্সিটির ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক। তাকে বলি শিক্ষকতা ছেড়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে এসেছি। তিনি আমাকে হরিণা ক্যাম্পে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করে দেন। দুতিনদিন ট্রেনিংয়ের পর আমাকে বাছাই করা হলাে দেরাদুনে উচ্চতর ট্রেনিংয়ের জন্য। এরপর স্বপন চৌধুরী ও এম এ মান্নানের প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে দেরাদুন তাড়ুয়া মিলিটারি একাডেমিতে গেরিলা যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে পাঠানাে হয়। সেখানে ট্রেনিং চলে মে মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে জুলাইয়ের দ্বিতীয় সপ্তাহ পর্যন্ত। আমি ছিলাম চতুর্থ ব্যাচে। আমাদের ট্রেনিং করাতেন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর মেজর মাল হােতরা, ক্যাপ্টেন পি. সি ডায়াস, ক্যাপ্টেন মনমােহন সিং। পলিটিক্যাল ট্রেনিং করাতেন হাসানুল হক ইনু (বর্তমান মাননীয় তথ্যমন্ত্রী)। তিনি থাকতেন সার্বক্ষণিক। অন্যদের মাঝে সিরাজুল আলম খান, শেখ ফজলুল হক মনি, তােফায়েল আহমেদ, আব্দুর রাজ্জাক এসব নেতা মাঝে মাঝে আসা-যাওয়া করতেন। ট্রেনিং শেষ করে স্বপন চৌধুরীর নেতৃত্বে অক্টোবরে স্বদেশে প্রবেশ করি। শেখ ফজলুল হক মনির নেতৃত্বে বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স (বিএলএফ)-এর একজন সশস্ত্র যােদ্ধা হিসেবে উত্তর। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, নাজিরহাট বাজার, বরকতউল্লাহ খামার, জুইগ্যাছােলা বাজার এবং ডেবুয়া পাহাড়সহ আশপাশের বিভিন্ন অঞ্চলের বেশ কয়েকটি অপারেশনে অংশগ্রহণ করি। যুদ্ধ চলাকালীন এক পর্যায়ে ডিসেম্বরের ৮ তারিখ আমরা কয়েকটি কক্ষের এক ঝুপড়িতে বসে পরবর্তী অপারেশনের পরিকল্পনা করছিলাম। রাউজানের মুক্তিযােদ্ধা কমান্ডার নাজিম উদ্দীনের নেতৃত্বে শলাপরামর্শ চলছিল। সে সময় ওখানে ছিল সেলিম ভাইয়ের নেতৃত্বে আনােয়ারা গ্রুপ, নুরুল ইসলামের নেতৃত্বে পটিয়া গ্রুপ এবং নাজিমউদ্দীনের নেতৃত্বে রাউজান গ্রুপ। ওই সময় সেলফ লােডিং রাইফেলের একটি বুলেট নাজিমউদ্দীনের বুকের ডান পাশ এফোঁড় ওফেঁড় করে চলে গেলাে। শত্রুবাহিনীর আক্রমণ হয়েছে ভেবে আমরা পজিশন নিয়ে ফেললাম। কিন্তু মুহূর্তে অন্য কক্ষে আবিষ্কার করা গেলাে নির্বাক সুনীল চক্রবর্তীকে। তিনি রাউজানেরই একজন মুক্তিযােদ্ধা। পরক্ষণেই কান্নায় ভেঙে পড়লেন। অকপটে স্বীকার করলেন যে তার রাইফেলের গুলি বেরিয়ে গিয়ে নাজিমউদ্দীন শহীদ হয়েছেন।
ইতিপূর্বে পাকবাহিনী ২৩ এপ্রিল আমাদের গ্রামে ঢােকে এবং আমার বাড়িসহ গ্রামের ত্রিশটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়। ঐদিন তারা আমাদের ইউনিয়নের বাহুলী নামে আরও একটি গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের লােকজনদের যাকে হাতের নাগালের মধ্যে পায় তাকেই নির্মমভাবে হত্যা করে। ১৬ মে আবার পাঞ্জাবিরা আমাদের গ্রামে ঢােকে। পূর্বের জ্বালিয়ে দেয়া বাড়ি কোনােরকম পুনর্নির্মাণ করে যারা বসবাস করছিল সেগুলাে পুনরায় জ্বালিয়ে দেয়। এছাড়া ২৬ অক্টোবর পাকবাহিনী আমাদের হাইদগাঁও গ্রামের পণ্ডিত বাড়িতে অকস্মাৎ হানা দিয়ে একসঙ্গে ছয় জনকে হত্যা করে। প্রতিদিন মুক্তি ও আওয়ামীলীগের খোঁজে গ্রামে ঢুকে যেতাে। পটিয়া কলেজে পাকবাহিনী ক্যাম্প করেছিল। সেখান থেকে যুদ্ধের নয় মাস ধরে তারা এলাকায় চালিয়েছিল হত্যা, ধর্ষণ, লুটতরাজ আর অগ্নিসংযােগ। তাে আমরা একই বাড়ির দুই সন্তান ছিলাম মুক্তিবাহিনীতে। মুক্তিযােদ্ধা পুলিন দস্তিদার আমার কাকাতাে ভাই। আমরা একই সঙ্গে ট্রেনিং করি এবং দেশের অভ্যন্তরে ভিন্ন ভিন্ন রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে জীবন বাজি রেখে লড়াই করি। প্রসঙ্গত, স্বপন চৌধুরীর কিছু স্মৃতি উল্লেখ করতে হচ্ছে। স্বপন চৌধুরী দুশাের অধিক মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে দক্ষিণ চট্টগ্রাম, কক্সবাজার ও পার্বত্য চট্টগ্রামের বিএলএফ (বাংলাদেশ লিবারেশন ফোর্স) তথা মুজিব বাহিনীর আঞ্চলিক অধিনায়ক নিযুক্ত হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন স্থানে তিনি গেরিলা যুদ্ধের সফল নেতৃত্ব দেন। যুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়ে একটি জটিল অপারেশনের পরিকল্পনা নিয়ে তিনি রাঙ্গুনিয়ার চারজন মুক্তিযােদ্ধাসহ রাঙ্গামাটি চলে যান। রাঙ্গামাটির কাউখালিতে তিনি প্রথম অবস্থান নেন। তার গােপন আস্তানা পাকবাহিনী জেনে যায় এবং চারদিক থেকে অতর্কিত ঘেরাও করে ফেলে। তারিখটি ছিল ২৭ নভেম্বর। স্বপন চৌধুরী চারজন সহযােদ্ধা নিয়ে দুদিন অবিরাম দুঃসাহসিকতার সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধ চালিয়ে যান। অবশেষে ৩০ নভেম্বর আহত অবস্থায় সূর্য চাকমার বাড়ি থেকে শক্রর হাতে ধরা পড়েন। সেখান থেকে তাদের রাঙ্গামাটি সদর দপ্তরে নিয়ে আসে। এখানে তাদের ওপর চালানাে হয়। অমানুষিক নির্যাতন। বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে চালায় এ নিপীড়ন। এক পর্যায়ে মৃত ভেবে সদর দপ্তরের কাছে বাইরে ফেলে রাখে। পরে স্থানীয়রা হাসপাতালে এনে ভর্তি করে। কিন্তু ডাক্তার-নার্সদের আপ্রাণ চেষ্টা ব্যর্থ হয়। ৩ ডিসেম্বর অপর সহযােদ্ধাসহ রাঙ্গামাটি হাসপাতালে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
স্বপন চৌধুরীর সহযােদ্ধাদের নামের তালিকা- (১) মােহাম্মদ নূরুন্নবী (২) শচীন্দ্র লাল দেওয়ানজী (৩) সুব্রত সাহা (৪) শঙ্কর রায়।
স্বপন চৌধুরী ছিলেন মুক্তিবাহিনীর প্রথম ব্যাচ। তিনি বিভিন্ন ট্রেনিং সেন্টার ও শরণার্থী শিবির থেকে শিক্ষিত তরুণদের উদ্বুদ্ধ করে দেরাদুন ট্রেনিংয়ে নিয়ে আসেন। মুজিব বাহিনী গঠনে তার ছিল উল্লেখযােগ্য ভূমিকা। মহান। স্বাধীনতাযুদ্ধে স্বপন চৌধুরীর অবদান জাতির বিশেষভাবে স্মর্তব্য।

মাে. সিরাজ উদ্দিন হােসেন
মুক্তিযােদ্ধা, মুক্তিবার্তা নং- ১১৪
পরিয়াব, বারিষাভ, কাপাসিয়া, গাজীপুর।

৭১ সালে আমি ঢাকা নিউ মডেল কলেজের ছাত্র। কলেজে ভর্তির পর থেকে আমি ছাত্ররাজনীতির সাথে জড়িত হয়ে পড়ি। সে সময় পশ্চিম পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্র সমাজ ছিল অগ্রগামী। ছাত্ররা ছিল রাজনীতিকদের হাতিয়ার। আসাদের মৃত্যুর পর আন্দোলন চরমে পৌছে। ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর মূলত শুরু হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রস্তুতি। আন্দোলনের কর্মসূচিতে অংশ নেয়ার কারণে বাড়িতে যাতায়াত আমার কমে যায়। আন্দোলনের নেশা আমার জীবনের সবকিছুকে পেছনে ফেলে দিয়েছিল। আমি তখন টঙ্গীর কাছে এক বাড়িতে লজিং থেকে পড়াশােনা করতাম। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের পর থেকে বাঙালি যেমন স্বাধীনতার জন্য অধীর হয়ে উঠছিল- তেমনি পুরাে জাতির ভেতর একটা আশঙ্কাও কাজ করছিল। পশ্চিম পাকিস্তানিরা বাঙালিদের স্বাধীনতা সহজে মেনে নেবে না। নির্যাতন চালাবে। কিন্তু সেই নির্যাতনের রূপ যে এমন ভয়াবহ হবে এটা কেউ ধারণা করতে পারেনি।
২৫ মার্চের রাতের ঘটনা আমি জানতে পারি পরদিন ভােরে । লজিং বাড়িতে বসে সবার সঙ্গে রেডিও শুনে। এই লজিং বাড়িতে বসে সকাল ৭টা ৩০ মিনিটের কিছু পরে চট্টগ্রাম কালুরঘাট বেতার কেন্দ্র থেকে আওয়ামী লীগ নেতা হান্নান সাহেবের স্বাধীনতার ঘােষণা শুনি। আগের রাতের ঢাকা ম্যাসাকার ও পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস কর্মকাণ্ডের পর ঢাকায় যােগাযােগ করা সম্ভব হলাে না। এমতাবস্তায় দু’একদিন পর বাড়ি চলে আসি। বাড়িতে এসে এলাকার যুবকদের নিয়ে পরামর্শ করি এবং এক পর্যায়ে তাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের জন্য সংগঠিত করতে থাকি। ইতােমধ্যে জানতে পারি মুক্তিফৌজ গঠিত হচ্ছে। যুদ্ধের ট্রেনিং দেয়া হচ্ছে ভারতে। সিদ্ধান্ত নিই আমরা ভারতে চলে যাবাে। ভারতে ট্রেনিং নিয়ে এসে পাকিস্তানিদের ওপর আঘাত হানবাে। এর মাঝে আমার এক ছােটভাই গােপনে কাউকে কিছু না। জানিয়ে এক বন্ধুর সাথে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছিল। ও ছিল মাদ্রাসার ছাত্র। আমরা কেউ জানতাম না সে কোথায় আছে। কী কারণে বাড়ি ছেড়ে চলে গিয়েছে। আমি ভারত যাবার দিন ঠিক করে বাড়ির সবাইকে জানালাম। মা এবং বৃদ্ধ দাদা (পিতামহ) স্বতঃস্ফূর্তভাবে যুদ্ধে যাবার অনুমতি দিলেন। বাবা আগে থেকে বিষয়টি জানতেন। আমার কৃষক পিতা ছিলেন আমাদের যুদ্ধের অনুপ্রেরণা। বাবার স্বাধীনতার চেতনা সেদিন আমাদের দারুণভাবে অনুপ্রাণিত করেছিল।
আমার ছােটভাই জহির বরকত বারি, গ্রামের রিয়াজউদ্দিন খান, সিরাজউদ্দিন ভূইয়া, আতাউর রহমান ফকিরসহ আরও কিছুসংখ্যক ছেলে নিয়ে ভারতের উদ্দেশে গৃহত্যাগ করি। পায়ে হেঁটে প্রথমে আগলির চর যাই। সেখানে দেখি হাজার হাজার শরণার্থী জমা হচ্ছে। শরণার্থীদের সাথে আমরা নৌকাযােগে কজন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর পৌছি। নবীনগরে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে আশ্রয় নিই। ওখান থেকে রাত দশটার দিকে আবার নৌকা করে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। দুধসাগর (সিংগার বিল) পার হয়ে আমরা সীমান্ত অতিক্রম করি। তারপর পনের/বিশ কিলাে পায়ে হেঁটে আগরতলায় পৌছি। আগরতলায় নেতারা আগেই পৌঁছে গেছেন। নেতাদের মধ্যে ছিলেন। তােফায়েল আহমেদ, আহসান উল্লাহ মাস্টার, নুরে আলম সিদ্দিকী, আব্দুল কুদ্দুস মাখন। ছাত্রলীগ করার কারণে এদের সাথে আমার পূর্ব পরিচয় ছিল। এছাড়া অনেক ছাত্রনেতা ও আওয়ামী লীগ নেতার সাথে দেখা হলাে।আগরতলায় এক সপ্তাহ ছিলাম। সেখানে সকাল-বিকাল রুটি দেয়া হতো। দুপুরের খাবার ছিল শুধু চিড়া। সেই চিড়া সংগ্রহ করা হতাে আগরতলা থেকে পাঁচ কিলােমিটার দূরে একটা জায়গা থেকে। তখনাে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। লক্ষ লােক সীমান্তের এপারে চলে এসেছে। বিভিন্ন ক্যাম্পে রাখা হয়েছে শরণার্থী ও ট্রেনিং নিতে আসা লােকজন। তাদের কষ্ট ছিল অবর্ণনীয়। দেশত্যাগ ও ফেলে আসা স্বজনদের দুশ্চিন্তায় ছিল উদ্বেল।
টেনিং শুরু হচ্ছে না। দিন কাটছে মানসিক বিপর্যয়ের মাঝে। এক পর্যায়ে আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি। ট্রেনিংয়ের অনিশ্চয়তা দেখে কষ্ট সহ্য করতে না পেরে দেশে ফিরে আসার সিদ্ধান্ত নেই। এক বন্ধুকে নিয়ে রওনা দিই সীমান্তের দিকে। দুই কিলাে হবে আসার পর ওখানের লােকজন বললাে গত রাতে এখানে যুদ্ধ হয়েছে। সীমান্তে যাওয়া মােটেও নিরাপদ নয়। যে যাচ্ছে মুক্তিযােদ্ধারা তার চোখ বেঁধে ফেলছে। আবার ক্যাম্পে ফিরে আসি। এটা ছিল হাপানিয়া ক্যাম্প। ক্যাম্পে আসার পর শ্রীপুরের এমসি সফির উদ্দিনের সাথে দেখা হয়। তিনি আমাকে আমাদের অঞ্চলের যত যুবক এসেছে তাদের। হাপানিয়া কাম্পে নিয়ে যেতে বলেন। এ জন্য তিনি আমাকে টাকা-পয়সা দিলেন। আমি সবাইকে একত্রিত করি। দুই সপ্তাহ পরে আমরা ট্রেনিংয়ের তালিকাভুক্ত হই। বারিষাভ ইউনিয়নের দশজন ছেলে ছিল। এরা হলােরমিজ সরকার, রিয়াজ উদ্দিন খান, ফজলুল হক, হারুন, মােশাররফ হােসেন, রুহুল আমিন, নূর ইসলাম, নূর হােসেন ও শহীদ গিয়াস। হাপানিয়াতে যমুনা। ক্যাম্পের ইনচার্জে ছিলাম আমি। ট্রেনিং শেষে সবাই মনতলা হেডকোয়ার্টারে। চলে গেলাম। সেখানে আমার ছােটভাই যে বাড়ি থেকে দু’মাস আগে হারিয়ে। গিয়েছিল তাকে পেলাম। তখন এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয় । উপস্থিত অন্যরাও আবেগে আপ্লুত হয়ে পড়ে। ভাই যে বেঁচে আছে এবং আর কোনােদিন তাকে খুঁজে পাবাে এ আশা আমরা ছেড়ে দিয়েছিলাম।
পরদিন সন্ধ্যায় ছেষট্টিজন সশস্ত্র মুক্তিযােদ্ধাসহ মাহমুদুল হাসান বেনুর নেতৃত্বে দেশের ভেতরে অপারেশনের জন্য রওনা করি। তখন আমাদের গ্রুপে সাবেক এমসি শহিদুল্লাহ ভাই ও ছাত্রনেতা ফজলুল হক মােল্যা ছিলেন। বেলাব দিয়ে আমরা কাপাসিয়া আসি। রাতের আঁধারে আড়াল ভি, এল উচ্চ বিদ্যালয়ে আমরা অবস্থান নিই। ছেষট্টিজনের একটি গ্রুপ তৈরি করা হয়েছিল। এই ছেষট্টিজনের গ্রুপকে মােট ছয়টি সেকশনে ভাগ করা হয়েছিল। আমি ছিলাম এক সেকশন কমান্ডার। আমাদের হেডকোয়ার্টার ছিল চন্দ্ৰলতা। গিয়াসউদ্দিন ডাক্তারের বাড়ি। সেখান থেকে আমাদের সেকশনগুলাে বিভিন্ন জায়গায় ভাগ করে পাঠানাে হলাে। আমি প্রথমে আমার সেকশনের মুক্তিফৌজদের নিয়ে ইকুরিয়াতে ক্যাম্প করি। মুক্তিযােদ্ধা গিয়াসউদ্দিন ছিল দামুয়ার ক্যাম্পে। হঠাৎ একটা অপারেশনের জন্য আমাকে ও গিয়াসকে ভাগিয়া ক্যাম্পে বদলি করা হলাে। গভীর রাতে আমরা ভাগিয়া ক্যাম্পে যােগদান করি। ভােরে গিলামারিতে পজিশন নিই। গােপনসূত্রে খবর ছিল পাকসেনারা মেইন রােড দিয়ে ভেতরে ঢুকবে। ভেতরে ঢুকতে পারলে
গ্রামের পর গ্রাম তারা নির্যাতন চালাতে পারবে। আমাদের ওপর নির্দেশ ছিল মেইন রােডে তাদের বাধাদান করা। আমরা যথাযথভাবে হানাদারদের প্রতিহত করার চেষ্টা করছি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভােরে আমাদের মধ্য থেকে একটি মিস ফায়ার হলাে। সঙ্গে সঙ্গে পাকসেনারা চালালাে বৃষ্টির মতাে গুলি। কাপাসিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে ওদের ক্যাম্প ছিল। সার্বক্ষণিক মেশিনগান ফিট করে রেখেছিল বিদ্যালয়ের দোতলায়। গােলাগুলিতে কেউ হতাহত হয়নি। আমরা সরে গিয়ে গুদারাঘাটের কাছে এক বাড়িতে আশ্রয় নিলাম এবং পরবর্তী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া যায় সে বিষয়ে ভাবতে লাগলাম। সেই বাড়িতে দুপুরে মাত্র ভাত খেতে বসেছি তখন খবর এলাে পাকসেনারা গুদারা পার হয়ে এপারে চলে এসেছে। আমরা ছিলাম চারজন। গিয়াস, সাজ্জাদ ও হাসমত নামে একটি ছেলে। আমরা মেইন রােডের পাশে পজিশন নিয়েফোল (যে রাস্তাটি মনােহরদা চলে গিয়েছে)। আমরা যেখানে পজিশন নিয়েছিলাম তার দক্ষিণ পাশে একটি বাঁশঝাড় ছিল। বাঁশঝাড়ের পুব দিকে ছােট একটি পুকুরের পাড়ে গিয়াস ও সাজ্জাদ পজিশন নেয়। হাসমত ছিল রােডের উত্তরে আর আমি ছিলাম দক্ষিণে। পাকসৈন্য মেইন রােডে উঠতেই আমরা ফায়ার শুরু করি। গােলাগুলির এক পর্যায়ে গিয়াস ও সাজ্জাদ গুলির। আঘাতে লুটিয়ে পড়ে। আমার কানে আসে- শালা মর গিয়া। আমি ছিলাম একমাত্র দুশ গজ দূরে। এর পরের ঘটনা বলতে পারবাে না। সন্ধ্যার পর সহযােদ্ধারা আমাকে উদ্ধার করে নিয়ে যায়। গিয়াস ও সাজ্জাদের লাশ পাকসেনারা নিয়ে গিয়েছিল। তাদের লাশ আর কোথাও পাওয়া যায়নি। গিয়াস ছিল খুব প্রাণবন্ত ছেলে। আমােদ নিয়ে থাকতে পছন্দ করতাে। সে ছিল তখন সদ্য বিবাহিত। বৌ ছিল বাপের বাড়ি। তখনাে গিয়াসের বৌকে ওদের বাড়ি উঠিয়ে আনা হয়নি। যুদ্ধের মাঝে একদিন সে গিয়েছিল স্ত্রীর সাথে দেখা করতে আমাকে সঙ্গে নিয়ে। গিয়াস আমাদের সাথে ভারতে যুদ্ধের ট্রেনিং করেছে। ট্রেনিং সময়ের একটি ঘটনা উল্লেখ করছি। ট্রেনিং চলাকালে একদিন চারজন মুক্তিযােদ্ধাকে লম্বচুড়া পাঠানাে হয় (লম্বচুড়া ত্রিপুরা রাজ্যের একটি জায়গা)। তাদের পাঠানাে হয়েছিল লম্বচূড়া গােডাউন থেকে ক্যাম্পে চিনি নিয়ে আসার জন্য। এদের মধ্যে গিয়াস ছিল। ক্যাম্পে এসে গিয়াস বস্তা খুলে চিনি খেতে শুরু করে। ক্ষুধার্ত গিয়াস এতটা চিনি খেয়ে ফেললাে যে খাওয়া মাত্র সে গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লাে। কয়েকদিন চিকিৎসা আর বিশ্রামে রেখে তাকে সুস্থ করে তােলা হয়।
গিয়াসের বাড়ি ছিল আমুনার চালা। আর সাজ্জাদের বাড়ি তরগাও। হাসমতের বাড়ি ছিল সন্মানীয়া। গিয়াসের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য অত্র এলাকার নামকরণ হয়েছে গিয়াসপুর। স্থাপন করা হয়েছে শহীদ গিয়াস উচ্চ বিদ্যালয় । আমরা শুধু কাপাসিয়ার জন্য নিযুক্ত ছিলাম। আমাদের দায়িত্ব ছিল ব্রিজ, কালভার্ট ধ্বংস করে যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া। পাকফৌজের গতিরােধ করা। গেরিলা আক্রমণে ভীতি সঞ্চার করে শত্রুসেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখা।
বিয়াল্লিশ বছরের ব্যবধানে বহু স্মৃতি হারিয়ে গেছে। স্বাধীনতা যুদ্ধের নয়মাস প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে ঘটেছে নানা ঘটনা। সে সব আমাদের ত্যাগ, তিতিক্ষা, বেদনা আর গৌরবের ইতিহাস।

সত্যেন্দ্র চন্দ্র দে
প্রাক্তন কলেজ শিক্ষক

১৯৭১ সালে মাত্র নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জিত হলেও প্রকৃতপক্ষে এর পটভূমি রচিত হতে থাকে ১৯৪৭ সালে দ্বিজাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে। ১৯৪৮ সালে পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মােহাম্মদ আলী জিন্নাহ সাহেব ঢাকায় এসে উর্দুকেই পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দেন। সাথে সাথেই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মধ্যে প্রচণ্ড বিক্ষোভ ও বিরােধিতার বহিঃপ্রকাশ ঘটে। এ ঘােষণার মাধ্যমে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের মাতৃভাষা, সাহিত্য, শিল্প ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করে পাকিস্তানিরা এ দেশে বিজাতীয় ভাষা ও সংস্কৃতিকে চাপিয়ে দেওয়ার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৫৪ সালের নির্বাচন, ১৯৬৬ সালের ছয় দফা, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান ও ১৯৭০-এর নির্বাচনের মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের পটভূমি রচিত হয়েছিল। ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত পূর্ববাংলার জনগণের ওপর পাকিস্তানি কেন্দ্রীয় সরকারের আচরণ ছিল বিদ্বেষ ও বৈষম্যমূলক। সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সরকারি চাকরি ও ব্যবসা-বাণিজ্যের ক্ষেত্রে পূর্ববাংলার জনগণ বৈষম্য ও নিপীড়নের শিকারে পরিণত হয়েছিল। এ দীর্ঘ সময়ে পূর্ববাংলার জনগণের মাঝে বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে।
১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী প্রধান আইয়ুব খানের ক্ষমতাগ্রহণের পর থেকে এ ধরনের আচরণ আরও প্রকট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের ৬ দফা আন্দোলন বাঙালিদের অধিকভাবে সচেতন করে তুলে। এরই ধারাবাহিকতায় এ দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে ১৯৬৯ সালের গণআন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে। এর মধ্যে ছাত্রদের ১১ দফা আন্দোলনের। ব্যাপকতায় আইয়ুব সরকার আগরতলা মামলায় আটক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ বিভিন্ন দলের রাজনৈতিক নেতাদের মুক্তি দেন। এতে আন্দোলন স্তিমিত না হয়ে আরও বেগবান হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেলে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান পদত্যাগ করে সামরিক বাহিনীর প্রধান ইয়াহিয়া খানের হাতে ক্ষমতা ন্যস্ত করেন। ১৯৬৯ সালের ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া খান সামরিক ফরমানলে ক্ষমতা গ্রহণ করেন এবং একই সালে ২২ এপ্রিল এক ঘােষণায় অতি শিগগির জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রতিশ্রুতি দেন। পাকিস্তানের জনগণের আশা পূরণের লক্ষ্যে ১৯৭০ সালে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়।
নির্বাচনে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ ও পূর্ব পাকিস্তানের প্রাদেশিক পরিষদে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান সাহেব ১৯৭১ সালের ৩ মার্চ ঢাকার প্রাদেশিক পরিষদ ভবনে জাতীয় পরিষদের প্রথম অধিবেশন উদ্বোধনের তারিখ ঘােষণা করেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের পিপলস পার্টির নেতা ভুট্টোসহ অন্য নেতৃবৃন্দ জাতীয় পরিষদের অধিবেশন আহ্বানের প্রবল বিরােধিতা করতে থাকে। ইয়াহিয়া খান সাহেব ১ মার্চের দুপুরে এক ঘােষণায় ৩ মার্চের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত ঘােষণা করেন। সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। সারা দেশে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়। ২ মার্চ তারিখে ছাত্র নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলনের মাধ্যমে সংগ্রামের গতিকে আরও বেগবান করে তােলেন। মার্চ মাসের ৩ তারিখে সারা দেশে হরতাল আহ্বান করা হয়। দেশের প্রচলিত শাসন ব্যবস্থা অচল হয়ে পড়ে।
আমি তখন ময়মনসিংহ শহরে পণ্ডিত পাড়ায় মামার বাসা থেকে পড়াশুনা করতাম। ১৯৭১ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শেষ সপ্তাহে আমার অনার্স পরীক্ষা শেষ হয়। তখন আমি পূর্ব পাকিস্তানের অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন ‘বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন’-এর একজন সক্রিয় কর্মী ছিলাম। সার্বক্ষণিক ভাবে সম্পৃক্ত ছিলাম ১৯৬৯-এর গণআন্দোলনেও। এ গণআন্দোলনে এপ্রিল মাসে আমার বন্ধু মরহুম মাহমুদ আল-নূর (তারেক) (ময়মনসিংহ পৌরসভার প্রাক্তন মেয়র) এর সাথে এক হরতালে আটক হই এবং ঐদিন বিকেলেই ছাত্রজনতার চাপে মুক্তি পাই। ১৯৭১ সালের ৭ মার্চের জনসভা থেকে বঙ্গবন্ধু জাতির উদ্দেশে প্রদত্ত ভাষণে প্রকারান্তরে স্বাধীনতারই ডাক দিয়ে যান। পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ বঙ্গবন্ধুর হাতেই চলে আসে। অসহযােগ আন্দোলনে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সামরিক ব্যারাকে আবদ্ধ থাকতে বাধ্য হয়। ব্যাংক, বীমা, পুলিশ, বিচার ব্যবস্থাসহ সমস্ত কর্মকাণ্ড বঙ্গবন্ধুর নির্দেশেই চলতে থাকে। আমরা তখন ময়মনসিংহ শহরে অসহযোগ আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ি। প্রতিদিনই বিক্ষোভ মিছিলে শহরটি প্রকম্পিত হতে থাকে। গ্রাম থেকেও হাজার-হাজার লােক এসে শান্তিপূর্ণভাবে বিক্ষোভের মাধ্যমে জাতিকে স্বাধীনতার স্বপ্ন দেখাতে থাকে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের আন্দোলনের চাপে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে আলােচনায় বসেন। বেশ কয়েকদিনের আলােচনার মাধ্যমেও সমাধান খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২৩ মার্চ থেকেই আমরা বুঝতে পারি যে, এ আলােচনা পাকিস্তান সরকারের কূটকৌশল মাত্র। আলােচনার নামে কালক্ষেপণের মাধ্যমে ইয়াহিয়া খান বাঙালিদের দমনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। ২৫ মার্চ বিকেল থেকে আন্দোলন ব্যর্থ হওয়ার আভাস পেতে থাকি। রাত ১০টার দিকে এক অনিশ্চয়তার আশঙ্কা নিয়ে বাসায় ফিরে আসি। সারা রাত একরকম অস্থিতার মাঝে কাটে।
১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ সকালেই ২৫ মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হামলা ও ব্যাপক গণহত্যার খবর ছড়িয়ে পড়ে। পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি হবার পূর্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতির উদ্দেশে প্রচারের জন্য যে ভাষণটি তৈরি করে রেখেছিলেন- তা ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে রাত ১টার দিকে বলধা গার্ডেন থেকে ইপিআরের ট্রান্সমিটারের মাধ্যমে প্রচার করা হয়। বঙ্গবন্ধুর নির্দেশ মতাে সারা দেশে প্রতিরােধের যুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ঢাকায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও ইপিআর ক্যাম্পের প্রতিরােধব্যুহ হানাদার বাহিনীর আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়। এতে প্রচুর পুলিশ সদস্য ও ইপিআরের জওয়ান শহীদ হন। হানাদার বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাস ও শিক্ষকদের আবাসন এলাকায় আক্রমণ চালিয়ে অসংখ্য ছাত্র, শিক্ষক ও কর্মচারীদের নির্মমভাবে হত্যা করে। ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টো পশ্চিম পাকিস্তানে চলে যায়। বঙ্গবন্ধুকে বন্দি অবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানের কারাগারে স্থানান্তর করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘােষণার পর থেকে দেশব্যাপী প্রতিরােধযুদ্ধ শুরু হয়ে যায়। ময়মনসিংহ শহরে অবসরপ্রাপ্ত ও ছুটিতে থাকা বাঙালি সামরিক বাহিনীর সদস্যবৃন্দ, কর্মরত আধাসামরিক, পুলিশ বাহিনীর সদস্য ও সীমান্ত থেকে ফিরে আসা সশস্ত্র বাঙালি ইপিআর সদস্য ও ছাত্র-জনতার সমন্বয়ে গঠিত প্রতিরােধ বাহিনী গড়ে ওঠে। মার্চ মাসের সম্ভবত ২৯ আথবা ৩০ তারিখে প্রতিরােধ বাহিনীর সদস্যরা ময়মনসিংহের ইপিআর ও পুলিশ ক্যাম্পে আক্রমণ চালিয়ে প্রচুর ভারী ও অন্যান্য অস্ত্র দখল করে নেয়। এ যুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর অনেক অফিসার ও সাধারণ সৈনিক নিহত হয়। প্রতিরােধ বাহিনীর যােদ্ধারা দখলে নেয়া অস্ত্র পেয়ে আরও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। এপ্রিল মাসের প্রথম দিকেই হানাদার বাহিনী ঢাকা থেকে ময়মনসিংহ অভিমুখে রওনা দেয়। প্রতিরােধ বাহিনীর সদস্যরা হানাদার বাহিনীকে প্রাতরােধ করতে মধুপুরের বনাঞ্চলে ও কাওরাইদ রেলওয়ে ব্রিজের আশপাশে প্রতিরােধ গড়ে তুললেও শত্রুদের প্রতিরােধ করতে পারেনি। ব্যাপক ধ্বংসের আশঙ্কায় জনগণ ময়মনসিংহ শহর ত্যাগ করে গ্রামের দিকে চলে যেতে থাকে। অসংখ্য ছাত্র-জনতা ও প্রতিরােধ বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত পেরিয়ে ভারতে আশ্রয় নেয়। এপ্রিলের ২য় সপ্তাহে হানাদার বাহিনী ময়মনসিংহ শহরে প্রবেশ করে এক বর্বর হত্যায় মেতে ওঠে। তখন ময়মনসিংহ শহরটি এক ভুতুড়ে শহরে পরিণত হয়।
স্বাধীনতার চুয়াল্লিশ বছর পর মহান মুক্তিযুদ্ধের বহু স্মৃতিই আজ ঝাপসা হয়ে গেছে। তবু কিছু স্মৃতি আছে সেগুলাে কখনাে মুছে যাবার নয়। সেইসব স্মৃতিই আজ লিখতে চেষ্টা করছি। ময়মনসিংহ শহর থেকে ১৮ মাইল দক্ষিণে ফুলবাড়ীয়া থানার কেশরগঞ্জ বাজার সংলগ্ন পলাশীহাটা গ্রামে আমার বাড়ি। আমাদের এলাকা ছিল তখন এলাকার বিশিষ্টজনদের নিয়ন্ত্রণে। আমরা এলাকার ছাত্রসমাজ, যুবসমাজ, বিভিন্ন পেশার মানুষ ও জনগণ একত্রিত হয়ে এলাকায় শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখি এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের জন্য মানসিকভাবে প্রস্তুতি নিই। আমাদের এলাকা মুক্তাঞ্চল হলেও আমরা কেউ আশঙ্কামুক্ত ছিলাম না। ময়মনসিংহ থেকে দূরত্ব কম ও প্রতিবন্ধকতা না থাকায় সেনাবাহিনী যে কোনাে সময় এখানে চলে আসবে এমন ধারণা আমাদের ছিল। সে সময় আমি ও আমার বন্ধুরা মিলে স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণের সুযােগ খুঁজতে থাকি। আমার ময়মনসিংহ শহরের বন্ধু বীর মুক্তিযােদ্ধা নাজমুল হক (তারা) বন্ধুবান্ধবসহ সীমান্ত অতিক্রম করে যুদ্ধে অংশগ্রহণের জন্য ভারত চলে যায়। ইতােমধ্যে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে সীমান্ত নিয়ন্ত্রণে চলে যাওয়ায় আমি ও আমার এখানের বন্ধুরা সীমান্ত অতিক্রম করতে ব্যর্থ হই। দেশের ভেতর থেকে কীভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া যায়, সে প্রচেষ্টা চালাতে থাকি। এ উদ্দেশে আমি ও আমার বন্ধু শামসুল আলম তালুকদার ভালুকার উথুরা বাজারে যাই। সেখানে তখন মেজর আফসারের নেতৃত্বে একটি মুক্তিবাহিনী গড়ে উঠেছিল। উথুরা বাজারে আমরা ফুলবাড়ীয়ার ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাক সাহেবের দেখা পাই। তিনি অস্ত্রশস্ত্রসহ কয়েকজন মুক্তিযােদ্ধা নিয়ে ভারতে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ভালুকার নিকটবর্তী মর্চি গ্রামে ন্যাপকর্মী সন্তোষ বাবুর সাথে দেখা করি। কেন্দ্রীয় নেতাদের নির্দেশে সন্তোষ বাবু ও আমরা ফুলবাড়ীয়া এবং ভালুকা থানার বনাঞ্চলে মুক্তিযােদ্ধাদের ট্রেনিং দিতে একটি সাময়িক ট্রেনিং সেন্টার খােলার বিষয়ে আলােচনা করে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করি। দুর্ভাগ্যজনকভাবে কয়েকদিন পর সন্তোষ বাবু দুবৃত্তের হাতে নিহত হন। আমাদের সে পরিকল্পনা ভেস্তে যায় ।
১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল শনিবার। এই দিনে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চল কুষ্টিয়ার মেহেরপুর ভাবেরপাড়া বৈদ্যনাথতলার আমবাগানে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়। এ অনুষ্ঠানে ভারতসহ বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকরা উপস্থিত ছিলেন। তবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অনুপস্থিতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রীর শপথ গ্রহণ করলেন জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ সাহেব। এ খবরে দেশবাসীর মধ্যে নতুনভাবে অনুপ্রেরণা ও আশাবাদের সৃষ্টি হলাে। মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের পর থেকে আমাদের এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের আনাগােনা লক্ষ করা যায়। এতে মানুষের মনােবল আরও বেড়ে যায়। মে মাসের দিকে স্বাধীনতাবিরােধীরা সক্রিয় হয়ে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর সাথে যােগাযােগ করতে থাকে। এদেরই যােগসাজশেই জুন মাসের ২৮ তারিখ কেশরগঞ্জ বাজারে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ক্যাম্প স্থাপিত হয়। বাজার ও ক্যাম্পের আশপাশের বাড়ির অসংখ্য নারী-পুরুষ আশ্রয়ের জন্য ছুটাছুটি করতে থাকে। স্থানীয় কিছু রাজাকার নিয়ে হানাদার বাহিনী বাজারের দোকানপাট ও আশপাশের পাড়ায় লুটপাট চালায়। পরবর্তী সময়ে সবাই বাড়ি ফিরলেও হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজনদের পক্ষে বাড়ি ফিরে আসা সম্ভব হয়নি। হানাদার বাহিনীর অনুচরদের প্রখর দৃষ্টিতে থাকায় এরা আর বাড়ি ফিরতে পারেনি। আমরা সবাই পরিবার-পরিজনসহ ৩/৪ মাইল দূরের গ্রামে আশ্রয় নেই। সেখানকার জনগণ সাম্প্রদায়িক চেতনার উর্ধ্বে উঠে আমাদের পাড়ায় আশ্রিত শহরের ও এলাকার হিন্দুদের আশ্রয় দেয়। স্বাধীনতা বিরােধীদের সাম্প্রদায়িক প্রচারণার পরও সেখানকার জনগণ নিজেদের থাকার ঘর ছেড়ে দিয়ে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করেন। এলাকার মুসলিম সম্প্রদায়ের সুউচ্চ মানবিক মূল্যবােধ দেখে আমরা মুগ্ধ হয়ে যাই। এটাই। ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনার সার্থক বহিঃপ্রকাশ।
মাত্র কয়েকদিন পরই আমাদের পরিবারে দুর্যোগ নেমে আসে। জুলাই মাসের ছয় তারিখে পুনরায় আমার বন্ধু শামসুল আলম তালুকদার, আমার ছােটভাই ও আরও কয়েকজনকে নিয়ে বিরাট ঝুঁকি জেনেও ভারতে যাওয়ার প্রস্তুতি নিই। ঐ দিন সকালেই আমার বড়ভাই রমেন্দ্র চন্দ্র দে পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে ধরা পড়েন। পরবর্তীতে তার আর কোনাে খোজ আমরা পাইনি। আমার বৃদ্ধা মা, বড়ভাইয়ের দেড় বছর বয়সের কন্যা ও আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা বৌদিকে অন্যের বাড়িতে রেখে ভারত যাওয়া সম্ভব হলাে না। আমার বন্ধু শামসুল আলম ভারত চলে গিয়েছিলেন। পরিবারের সদস্যবৃন্দ ও আত্মীয়-স্বজনদের কান্নাকাটির মাঝে আমার কান্না যেন শুকিয়ে গিয়েছিল। আমি আর কাঁদতে পারিনি। কয়েকদিন পরই আমাদের বাজারের পাশে মুক্তিযােদ্ধাদের পেতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণ ঘটে। এ ঘটনার পর হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িসহ এলাকার অনেক বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দেয়।
জুলাই মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে হানাদার বাহিনী ফুলবাড়ীয়া থানার দক্ষিণাঞ্চলের বন এলাকার নিয়ন্ত্রণ নিতে রাঙ্গামাটি বাজার হয়ে টাঙ্গাইল জেলার সাগরদিঘি এলাকায় যাত্রাপথে মুক্তিযােদ্ধাদের বাধার সম্মখীন হয়। রাঙ্গামাটি ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান ফহিম উদ্দিন মণ্ডল সাহেব নিজ বাড়ির পুকুর পাড়ে পাকিস্তানি বাহিনীর গুলিতে শহীদ হন। ১৯৭১ সালের ১০ অথবা ১১ জুলাই আমাদের বাজারের সেনাবাহিনীর ক্যাম্পটি সরিয়ে ময়মনসিংহে নিয়ে যাওয়ার সময় ফুলবাড়ীয়া থানা সদরের উত্তরে লক্ষ্মীপুর বাজারের কাছে পাকিস্তানি বাহিনীর ১ ট্রাক আর্মির প্রায় সবাই মুক্তিযােদ্ধাদের গেরিলা আক্রমণে নিহত হয়। সাথে সাথে সেনাবাহিনী এসে ঐ এলাকার অসংখ্য বাড়িঘর আগুনে জ্বালিয়ে দেয় ও কয়েকজন সাধারণ মানুষকে হত্যা করে। এভাবেই ক্রমান্বয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী তাদের আধিপত্য বিস্তারের চেষ্টা চালাতে থাকে। আমাদের এলাকায় শান্তি কমিটি ও রাজাকাররা ত্রাসের সৃষ্টি করে। এ সময় আমাদের গ্রামের আরও তিনজন যুবক যথাক্রমে অবিনাশ দাশ, বলরাম কর্মকার ও আমার বন্ধু হরিমােহন দাসকে রাজাকাররা ধরে নিয়ে হানাদার বাহিনীর হাতে তুলে দেয়। পাশবিক নির্যাতন চালিয়ে ফুলবাড়ীয়া থানার ভালুকজান ব্রিজের কাছে হত্যা করে। এ ঘটনার পর আমরা যারা বিভিন্ন গ্রামে অবস্থান করছিলাম তারা সবাই আরও আতঙ্কের মাঝে দিন কাটাতে থাকি।
এ ধরনের অনিশ্চিত অবস্থায় আমরা বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর ‘কাদেরিয়া বাহিনীর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় গিয়ে বেঁচে থাকার চেষ্টা চালাই। আগস্ট মাসের ৩য় সপ্তাহে কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্যরা সীমান্ত অতিক্রম করে উন্নত অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহের জন্য ভারতে চলে যায়। আমাদের অবস্থা আরও শােচনীয় হয়ে পড়ে। এ সময় খবর আসে যে, বিভিন্ন জায়গায় হিন্দু পরিবারগুলাে বেঁচে থাকার বিনিময়ে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করছে। এলাকায় আমাদের শুভাকাক্তক্ষীরা চাচ্ছিলেন যে, আমরা যেন বেঁচে থাকার জন্য হলেও ধর্মান্তরিত হই। অবশেষে আমরা সনাতন ধর্ম ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা মন থেকে মেনে নিতে না পেরেও এ পথে আসতে বাধ্য হলেন। আমরা যারা যুবক তাদের পক্ষে বেঁচে থাকাটাই ছিল প্রধান উদ্দেশ্য। ধর্মান্তরিত হয়ে বাড়ি ফিরে আসি। হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িটি সম্পূর্ণভাবে পুড়িয়ে দিয়েছিল বিধায় পাশেই কাকার বাড়িতে আশ্রয় নিই।

মে মাসের ২৫ তারিখ থেকে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রচারণায় মুক্তিকামী জনতার মাঝে ব্যাপক সাড়া পড়ে যায়। এ কেন্দ্র থেকে প্রচারিত দেশাত্মবােধক সঙ্গীত, কবিতা, প্রবন্ধ ও বিভিন্ন অঞ্চলের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা প্রচারিত হতে থাকে। এম আর আখতার (মুকুল) সাহেবের পঠিত “চরমপত্র’ রচনাটি সবচেয়ে জনপ্রিয় অনুষ্ঠানে পরিণত হয়। অক্টোবর মাসের শেষের দিকে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী নতুন অস্ত্রশস্ত্রসহ নিজ বাহিনী নিয়ে এলাকায় আসেন। মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা ব্যাপকভাবে বেড়ে যায় । আমাদের বাজারের ক্যাম্পের পাকিস্তানি সেনাদের সরিয়ে নিয়ে রাজাকার ও পুলিশ বাহিনী নিয়ােগ করা হয়। পুলিশ ক্যাম্পের সদস্যরা মাঝে মাঝে আমাদের পাড়ায় দিনে টহল দিতে এবং তাদের মধ্য থেকে দু-একজন সদস্য গােপনে রাতে আসতেন স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের খবর শুনতে। তাদের কাছ থেকেও দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের খবরাখবর জানতে পারতাম। দু-তিন
মাসের মধ্যে স্বাধীনতা অর্জিত হবে বলে আমরা অনুমান কর ছিলাম। আমাদের পক্ষেও বাড়ি ছেড়ে কোথাও যাওয়া সম্ভব ছিল না। সব সময়। রাজাকারদের তীক্ষ দৃষ্টি ছিল আমাদের ওপর। এভাবেই কঠোর নিয়ন্ত্রণে ও ভয়ভীতির মাঝে দিন কাটছিল। এর মাঝে কাদেরিয়া বাহিনী সদস্যদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা ও বাজারের রাজাকারদের ক্যাম্পের অবস্থানসহ বিভিন্ন তথ্য সরবরাহ করতাম। আমাদের বাজারের ক্যাম্প আক্রান্ত হলে পুনরায় আমাদের অস্থিতিশীল অবস্থায় পড়ার সম্ভাবনা থেকেই গেলাে।
নভেম্বর মাসের প্রথম থেকেই আমাদের এলাকায় মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের আশঙ্কা করতে থাকি। রাজাকারদের মাঝেও ভয়ভীতি নেমে আসে। তারা সন্ধ্যার পর কোথাও বের হতাে না। এর মধ্যে নভেম্বর মাসের তৃতীয় সপ্তাহের শেষ রাতে মুক্তিবাহিনী আমাদের বাজারের ক্যাম্পে আক্রমণ চালায়। ক্যাম্পের রাজাকাররা পেছনের রাস্তা দিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযােদ্ধারা তাদের ক্যাম্পের দিকে ফিরে গেলেও দুজন কাদেরিয়া বাহিনীর সদস্য প্রচণ্ড কুয়াশায় পথ হারিয়ে ধানক্ষেতে লুকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই হানাদার বাহিনী, পুলিশ ও রাজাকারদের তল্লাশিতে দুজন মুক্তিযােদ্ধা ধরা পড়েন। মুক্তিযােদ্ধাদের বাজারে নিয়ে নির্যাতন চালিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর পরই পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের পাড়ায় প্রবেশ এবং ঘটনা সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞাসা করে আমাদের ছেড়ে দেয়। পাকিস্তানি সৈন্যরা চলে যাওয়ার পর রাজাকার কমান্ডার ঈমান আলী কিছুসংখ্যক রাজাকার নিয়ে এসে আমার ছােটভাই কৃষ্ণ চন্দ্র দে, অখিল দাম ও আমাকে ধরে নিয়ে গুলি করে হত্যার প্রস্তুতি নেয়। নৃশংস রাজাকার ঈমান আলী এলাকায় কসাই হিসেবে পরিচিত ছিল। এ সময় বাজারের পুলিশ ক্যাম্পের দুজন পরিচিত সশস্ত্র পুলিশ এসে মুক্তিযােদ্ধাদের ধরিয়ে দেয়ার কথা বলে কৌশলে আমাদের ছাড়িয়ে নেন এবং নিরাপদ দূরত্বে পাঠিয়ে দেন।
পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে কাদেরিয়া বাহিনীর দুজন সদস্য ও আমাদের এলাকার মুক্তিযােদ্ধাদের সংবাদ সরবরাহকারী যুবক মাে. রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ নির্মমভাবে নিহত হওয়ায় এলাকার স্বাধীনতাকামী জনগণের মাঝে শােকের ছায়া নেমে আসে। কিন্তু রাজাকারদের ভয়ে কারাে পক্ষে সম্ভব হচ্ছিল না এর বহিঃপ্রকাশ ঘটাতে। চাপা ক্ষোভ ও বেদনায় সবাই ছিল জর্জরিত। স্বাধীনতাকামী জনগণ একে অপরের সাথে খুব গােপনে দুঃখ প্রকাশ করতাে। এ ঘটনার পরই মুক্তিযােদ্ধাদের তৎপরতা আরও বেড়ে যায়। আমরা সামান্য সময়ের জন্য বাহিরে বের হতাম না। রাতে পাড়ার। যুবকরা একত্রিত হয়ে যুদ্ধের অগ্রগতির বিভিন্ন দিক নিয়ে আলােচনা করতাম। আরও ভয়াবহ পরিণতির সম্ভাবনা অনুভব করতাম। তবে দশ-বার। দিনের মধ্যে মুক্তিবাহিনী যে শেষ আঘাত হানবে এ ব্যাপারে আমরা নিশ্চিত। ছিলাম। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ও বিদেশী প্রচার মাধমেই সব কিছু অনুধাবন করা যাচ্ছিল। পাকিস্তানি সৈন্যরাও এলাকায় টহল দিতে আসতো না। তারা সীমান্ত এলাকা নিয়েই ব্যস্ত ছিল। রাজাকাররাও তাদের দায়িত্ব পালনের চেয়ে কীভাবে বেঁচে থাকা যায়, তারই চিন্তায় ব্যস্ত ছিল।
ডিসেম্বরের ৪ তারিখ পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে আমাদের স্বাধীনতাপ্রাপ্তি সন্নিকটে বলে মনে হচ্ছিল। ভারত সরকার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে পশ্চিম সেক্টরে যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে। এর মধ্যে বাংলাদেশ ও ভারতের সেনাবাহিনীর সমন্বয়ে গঠিত হলাে ‘মিত্রবাহিনী’। ভারত সরকার পশ্চিম পাকিস্তানের সীমান্তে আঘাত হানলাে। মিত্রবাহিনীর বিমান হামলায় পূর্ব পাকিস্তানের বিমান বাহিনী ও এর প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যায়। বাংলাদেশের আকাশ মিত্রবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। পাকিস্তানি বাহিনী জল, স্থল ও আকাশপথের আধিপত্য হারিয়ে ফেলে। স্থলযুদ্ধে বিভিন্ন সেক্টরে পরাজিত হয়ে পিছু হটতে থাকে। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আশ্রয় নেয়। ডিসেম্বর মাসের ৮ তারিখ আমাদের বাজার এলাকায় রাজাকার ক্যাম্পটি কাদেরিয়া বাহিনীর আক্রমণে রাজাকারমুক্ত হয়। ময়মনসিংহ জেলার দক্ষিণাঞ্চল সম্পূর্ণ মুক্ত হয়ে যায়। এভাবে সারা দেশে ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সর্বত্র অধিপত্য হারিয়ে ফেলে। ভারতীয় সেনাবাহিনী প্রধানের আহ্বানে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পণে বাধ্য হয় এবং সশস্ত্র যুদ্ধের অবসানের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়।
পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর আত্মসমর্পণের পর বিশ্বের মানচিত্রে নতুন রাষ্ট্র বাংলাদেশের অভ্যুদয়ে জনসাধারণ দীর্ঘ নয় মাসের নির্যাতন, হত্যা, ধর্ষণ ও অগ্নিসংযােগের আতঙ্ক থেকে মুক্ত হলাে। আমাদের এলাকায়ও এর ব্যতিক্রম ছিল না। সবার ভেতর আনন্দ-উল্লাস। স্বজনহারাদের মাঝে দুঃখ-বেদনা। থাকলেও স্বাধীনতাকে বরণ করে নিতে পিছপা হয়নি। দীর্ঘ ৪২ বছর পর মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু লিখতে বসে মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যাওয়ার ঘটনা মনে পড়ে যায়। দু-দুবার পাকিস্তানি বাহিনীর হাত থেকে অলৌকিকভাবে বেঁচে যাই। ২৯ জুন খুব ভােরে আমাদের এলাকায় আক্রমণকারী তিনজন পাকিস্তানি সেনা মাত্র ২৫ গজ দূর থেকে আমাকে হাত তুলে দাঁড়াবার নির্দেশ দেয়। আমি হাত তুলে দু-পা সামনে এগিয়েই ডান দিকের বাড়ির ছােট রাস্তা দিয়ে বের হয়ে বন-জঙ্গল পেরিয়ে চলে যাই। নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে দেখতে পাই যে চল্লিশ-পঞ্চাশ জন সেনা সদস্য পাশের ঘরবাড়ি ও পাটক্ষেতসমূহে ব্যাপক তলাশি চালাচ্ছে। এসব ভেবে আজও আতঙ্কে শিউরে উঠি। এ যুদ্ধে সাধারণ মানুষের পরস্পরের প্রতি সহানুভূতি ও অসাম্প্রদায়িক চেতনা আমাকে আজও উজ্জীবিত করে। শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা ও যুদ্ধে নিপীড়িত মানুষের দুঃখের ও লাঞ্ছনার সাথে একাত্মতাবােধ করি।
অনিল চক্রবর্তী
পেশা যাজনিক, কাওরাইদ বাজার,
শ্রীপুর, গাজীপুর।

১৯৭১ সালে আমি ময়মনসিংহ জেলার গফরগাঁও থানার গয়েশপুরে লক্ষ্মী নারায়ণ মন্দিরের সেবায়েত ছিলাম। গয়েশপুরের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে সুতিয়া নদী। মন্দিরটি ছিল নদীর তীরে। আমার জন্মস্থান ছিল নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা । এগার বছর বয়সে আমি গয়েশপুর মন্দিরে চলে আসি এবং পরবর্তীতে সেবায়েত হিসেবে নিয়ােজিত হই।
যুদ্ধের শুরুতে বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্যরা বিভিন্ন সেনানিবাস থেকে এখানে এসে জড়াে হয়। তখন গয়েশপুরে আওয়ামী লীগ নেতা ছিলেন সুলতান আহমেদ। তিনি বেঙ্গল রেজিমেন্টের সদস্য, ইপিআর ও ছাত্র-জনতা সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত করেন। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই হানাদার বাহিনী গয়েশপুর এসে ঘাঁটি করে এবং গয়েশপুর জনশূন্য হয়ে যায়। সবাই ছােটে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে। মানুষ ছুটে চলেছে এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে। এক এলাকা ছেড়ে অন্য এলাকায়। চারদিকে চলছে অস্থিরতা। প্রতিদিন জ্বলছে আগুন, চলছে লুটতরাজ আর হত্যা। দিন দিন অত্যাচারের মাত্রা বেড়েই চলেছে। এমতাবস্থায় আমি আশ্রয় নিই বাইন্যা গ্রামে। আমি প্রথম হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ি আষাঢ় মাসে যখন কোনাে এক কাজে কাওরাইদের দিকে আসছিলাম। পথে দেখা হয় পিস কমিটির আতর ব্যাপারীর সাথে। তিনি আমাকে কাওরাইদ বাজারে নিয়ে আসেন। বাজারে তখন পাকিস্তানি সৈন্যরা অবস্থান করছিল। সৈন্যদেরঅবস্থান আতর ব্যাপারী জানতাে। কিন্তু আমাকে বলেনি। ব্যাপারীর সাথে এলাকার আরও তিনজন লােক ছিল। ওখানে মেম্বার মান্নান খাও ছিলেন। সে যাত্রায় আমাদের রক্ষা করলেন মেম্বার মান্নান খা। হানাদারদের হাত থেকে ছাড়া পেয়ে সেদিনই চলে যাই মন্দিরে। মন্দির পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। লুট করা হয়েছে জিনিসপত্র। পােড়া ছাইয়ের ভেতর থেকে পেয়ে যাই নারায়ণ শিলা ও বাইরে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা জিনিসের মধ্য থেকে আমার একটি কথা ও এক জোড়া জুতা। সে সব নিয়ে চলে যাই পাইথল ইউনিয়নের নেওকা গ্রামে। তখন দিন কাটছিল খুব কষ্টে, অর্ধাহার ও অনাহারে। আতঙ্ক তাে ছিল সার্বক্ষণিক সঙ্গী। সব সময় পালিয়ে থাকাও সম্ভব ছিল না। জীবিকার তাগিদে বের হতেই হতাে। তখন আমি আবার ধরা পড়ি। ভাওয়াইল্যা বাজারে তখন যুদ্ধে চলছে। আমার সাথে ধরা পড়ে তিনজন। মুখী স্কুলে এনে আমাদের বেঁধে ফেললাে। আমি সে সময় নামাজ পড়া, সুরা, কলেমা এ সব শিখে নিয়েছিলাম। নাম দিয়েছিলাম আলাউদ্দিন খান। রাতে আমাদের নিয়ে গেলাে মশাখালি। তারপর মশাখালি থেকে গফরগাঁও স্টেশনে এনে দাঁড় করালাে। রাত এগারটার মতাে হবে। দেখি রেললাইনের স্লিপারে দাঁড় করানাে মানুষের লম্বা একটি লাইন। পরে জেনেছিলাম ওই লাইনে আটান্ন জন লােক ছিল। কিছুক্ষণ পর লাইনে ব্রাশফায়ার করলাে। লরিতে লাশগুলাে নিয়ে গেলাে নদীর পাড়ে। হঠাৎ আমার পেছন থেকে কে যেন বললাে, “ঠাহুর তুই’। চমকে দেখি আফতাব। বলি, ঠাকুর না আলাউদ্দিন খান। আফতাব ছিল হাটুরিয়া গ্রামের ছেলে। গফরগাঁও হাই স্কুলে আমি কিছুদিন ওর সাথে পড়াশুনা করেছি। পিসির বাড়ি থেকে পড়াশুনা করতাম। অবশ্য বেশিদিন আমার পড়াশুনা হয়নি। আবার চলে এসেছিলাম গয়েশপুর মন্দিরে। আফতাব পড়াশুনা করতাে। একাত্তরে সে ছিল দশম শ্রেণির ছাত্র। আফতাবকে ধরে এনে পাকিস্তানি সৈন্যরা রেলস্টেশনের পয়েন্টসম্যানের কাজে নিযুক্ত করেছিল। আমাদের কাচাপাটের আঁশ দিয়ে বেঁধে রেখেছিল। সেখানে আরও দুজন ছিল। তাদের সাথে ছিল দুটো বাচ্চা মেয়ে। আফতাব আমাদের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে তাক করে থাকা সৈন্যকে আমাকে দেখিয়ে বললাে, আলাউদ্দিন, আমার বড়ভাই। বােনের বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। আমাকে ছেড়ে দিলাে। আমি স্টেশনের পাশের সরু রাস্তা দিয়ে এগােতে থাকি। সেদিক দিয়ে কিছু জঙ্গল ছিল। আফতাব আমাকে এগিয়ে দেবার ভান করে পেছনে আসতে থাকে। তারপর জঙ্গলের কাছে এসে দুজনেই জঙ্গলের ভেতর দিয়ে দৌড়াতে শুরু করি। কয়েকদিন থেকেই আফতাব পালিয়ে যাবার পথ খুঁজছিল। কিন্তু সম্ভব হচ্ছিল না। ওর ওপর সৈন্যদের ছিল কড়ানজরদারি। আমার সাথে পালিয়ে এসে আফতাব সরাসরি মুক্তিযুদ্ধে চলে যায় এবং জানতে পারি যুদ্ধে শহীদ হয়। আফতাবের কথা মনে হতেই আমি বেদনা ও মনােকষ্টে জর্জরিত হয়ে পড়ি। কেননা আমাকে বাঁচিয়ে পরবর্তীতে নিজে আর বেঁচে থাকতে পারলাে না। আফতাবের দেশাত্মবােধের ইতিহাস কালের চাকায় পিষ্ট হয়ে অনেকের কাছেই অজানা রয়ে গেছে। পালিয়ে অনেক কষ্টে চলে আসি মনেসা গ্রামে। মনেসা গ্রামে আমার মা ও বােন এক মুসলমান পরিবারের আশ্রয়ে ছিল। এখানে আমাদের বেশিদিন থাকা সম্ভব হলাে না। আফাজ উদ্দিন নামে এক দফাদার আমাদের আড়াইল গ্রামে পৌছে দিলাে। সেখানে থেকে নৌকাযােগে আমরা কলমাকান্দা চলে যাই। যুদ্ধের শেষদিন পর্যন্ত সেখানেই কাটাই। বর্ণনাতীত দুঃখ-কষ্ট, ভয়-যন্ত্রণা সহ্য করে কাটে স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাস।
মনেসা গ্রামে থেকেই জানতে পারি আমার পিসেমশাইকে রাজাকাররা মেরে ফেলেছে। তিনি ছিলেন খণ্ড গ্রামের বাসিন্দা এবং গফরগাঁও স্কুলের হেড পণ্ডিত। যে মেরেছে সে ছিল পিসেমশাইয়ের ছাত্র। পিসেমশাইকে যেদিন মেরে ফেলে সেদিন ওই গ্রামের আরও সতেরজনকে হত্যা করে। পিসেমশাইয়ের লাশ পাওয়া যায়নি, কয়েকদিন পর সেই গ্রামে আবার ঢেকে পাকসৈন্য এবং বাইশ জনকে হত্যা করে। সবাইকে ধরে এনে রেললাইনের। স্লিপারে দাঁড় করাতাে। তারপর করতাে ব্রাশফায়ার। রেলের ধারে তখন হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের লােকের রক্তের ঢেউ বইতাে। মনে হতাে সাম্প্রদায়িকতার রটনা রটিয়ে হানাদার বাহিনী তাদের উদ্দেশ্য হাসিলের চেষ্টা চালালেও উভয় সম্প্রদায়ের রক্তধারাকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করা যায়নি। দেশ স্বাধীন হলে পিশেমশাইয়ের হত্যাকারীকে শেয়ালের গর্ত থেকে বের করে এনে গুলি করে হত্যা করে মুক্তিবাহিনী।
খন্ডগ্রামের শৈলেন্দ্র চক্রবর্তীর বাড়িতে ক্যাম্প করে রাজাকার বাহিনী। চক্রবর্তীরা পালাতে অনেক চেষ্টা করেছিল কিন্তু পারেনি। শৈলেন্দ্র চক্রবর্তীর ভাতিজা তরুণ চক্রবর্তী আঠারদানা হাই স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। রাজাকাররা বাড়ি আক্রমণ করলে সবাই জঙ্গলে গিয়ে আশ্রয় নেয়। তরুণ চক্রবর্তীকে বের করে এনে রাজাকাররা গুলির প্রস্তুতি নেয়। তখন শৈলেন্দ্র চক্রবর্তীর মেয়ে গৌরী জঙ্গল থেকে বের হয়ে এসে রাজাকারদের শর্ত অনুযায়ী ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে রাজাকারদের বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেয়। বাড়ির মেয়েদের রাজাকাররা আগেই বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে রেখেছিল। তখন রাজাকাররা তরুণ চক্রবর্তীকে ছেড়ে দেয়। গৌরী তখন নবম শ্রেণিতে

পড়তাে। আঠারদানা হাই স্কুলের ছাত্রী ছিল সে। রাজাকাররা ওই বাড়িতে ঘাঁটি গেড়ে বসে এবং চারদিকে চালায় নির্যাতন-নিপীড়ন। কার্তিক মাসে তরুণ চক্রবর্তীর সন্তানসম্ভবা স্ত্রী বিনা চিকিৎসা ও নির্যাতনে মারা যান। তাকে বাড়ির ভেতরেই কবর দেয়া হয়। পরিবারের সবার মাঝেই নেমে আসে চাপা বেদনা ও ক্ষোভ। গৌরী ছিল খুব সাহসী মেয়ে। রাজাকারদের কাছে রাইফেল চালানাে শিখতাে সে। গৌরী যেহেতু রাজাকারকে বিয়ে করবে এজন্য ওর প্রতি বিশেষ কোনাে সন্দেহ ছিল না ওদের। গৌরীর মনে ছিল অন্য পরিকল্পনা। ইতােমধ্যে এলাকায় মুক্তিযােদ্ধাদের সঞ্চালন বেড়ে যায়। এক পর্যায়ে তারা কাশীগঞ্জ বাজার থেকে ভরাইল গ্রামে পৌছে। ভরাইলে মুক্তিযােদ্ধাদের অবস্থান থেকে গৌরীদের বাড়ি ছিল কাছে। শুধু একটি খাল। খালটি গিয়েছে গৌরীদের বাড়ির পেছন দিয়ে। গৌরী গােপনে মুক্তিযােদ্ধাদের সাথে যােগাযােগ রক্ষা করে। একদিন রাতে যখন বেপরােয়া রাজাকাররা গ্রাম থেকে ধরে আনা মেয়েদের নিয়ে ফুর্তিতে মেতে ওঠে গৌরী তখন বাড়ির পেছনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে একে একে ওদের রাইফেলগুলাে খালের ধারে ওঁৎ পেতে থাকা মুক্তিযােদ্ধাদের হাতে তুলে দিতে থাকে। এভাবে সতেরটি রাইফেল তুলে দেয়ার পর একসঙ্গে মুক্তিযােদ্ধাদের রাইফেলগুলাে গর্জে ওঠে। তারা চারদিক থেকে গৌরীদের বাড়ি ঘিরে ফেলে। হতচকিত রাজাকার বাহিনী আত্মসমর্পণে বাধ্য হয়।
এসব ঘটনাবলি ও ত্যাগের মধ্য দিয়েই আসে আমাদের স্বাধীনতা। স্বাধীনতা যুদ্ধের স্মৃতি বড় বেদনাদায়ক। দীর্ঘদিনে পূর্বের বহু স্মৃতি ঝাপসা হয়ে গেছে। তবে কিছু স্মৃতি আছে যা কোনােদিন ভুলবার নয়, বরঞ্চ উজ্জ্বল হয়েই থাকবে।

মাে. রফিকুল ইসলাম
প্রাক্তন শিক্ষক, ইছরকান্দি উচ্চ বিদ্যালয়
আশুলিয়া, সাভার।

‘৭১ সালে আমি করটিয়া সা’দত কলেজের ছাত্র। বছরের শুরু থেকে ছিল আন্দোলন-সংগ্রাম তুঙ্গে। আমি প্রত্যক্ষ কোনাে রাজনৈতিক দলের সাথে যুক্ত ছিলাম না। কিন্তু তখন যে সব ছাত্র রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল না তারাও আন্দোলনের সাথে একাত্ম ছিল। পাকিস্তানি শােষণের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ছাত্র সমাজের কোনাে দ্বিমত ছিল না। আমার আদিবাড়ি বাসাইল থানার একচালা গ্রামে। ২৫ মার্চ আমরা সেই গ্রামের বাড়িতে অবস্থান করি। পরদিন সকালবেলা অন্য সবার মতাে রেডিও শুনে ঢাকা ম্যাসাকারের কথা জানতে পারি। পরে খবর আসে আমার এক আত্মীয় রাতের গােলাগুলিতে নিহত হয়েছেন। তিনি ব্যবসা করতেন। ব্যবসার কাজে ঢাকা গিয়েছিলেন। এরপর আমি আমাদের ইছরকান্দির বাড়িতে চলে আসি। তারিখ মনে নেই। তবে এপ্রিলের প্রথম দিকে পাকবাহিনী আমাদের ইছরকান্দিতে আসে। পাক সেনাদের নিয়ে আসে পাতলা খান নামে এক বিহারি । সে গাছাতে ব্যবসা করতাে। তখন গৃহস্থালির সকল কাজে নদী ব্যবহার হতাে। প্রতিদিনের মতাে সেদিনও আমার মা খুব ভােরে থালাবাসন ধুতে নদীর পাড়ে যাচ্ছিলেন। নদীর কাছাকাছি গেলে মার নজরে আসে পাকসেনারা নৌকাযােগে নদী পাড় হয়ে ঘাটে ভিড়ছে। মা দৌড়ে এসে ঘুম থেকে আমাদের ডেকে তােলেন। আমরা বের হয়ে দেখি সৈন্যরা নদীর তীরে পজিশন নিয়ে ফেলেছে। দিশেহারা হয়ে বাড়ির ভেতর চলে আসি। নদীর তীরে স্কুলঘরটিতে অত্যাচারিত এলাকা থেকে বাইরের কিছু লােক এসে আশ্রয় নিয়েছিলেন। তারা পাক সৈন্যরা এপারে আসছে আঁচ করতে পেরে দ্রুত সরে পড়ে। তবে একটি পরিবার ধরা পড়ে যায়। পরিবারটি ছিল হিন্দু। পরিবারে ছিল স্বামী, স্ত্রী ও একটি ছােট শিশু। সকাল ন’টার দিকে একদল পাকসৈন্য নিয়ে পাতলা খান আমাদের বাড়ি আসে। ওরা প্রথমেই আমাদের সমস্ত বাড়ি তল্লাশি করে। আমাদের বিশাল ধানের গােলা ছিল। ধানের গােলার পেছনে আমার ছােট বােন ও তার এক বান্ধবীকে লুকিয়ে রাখি। পাকসৈন্য গ্রামে ঢুকেছে শুনে সে আমাদের বাড়ি আশ্রয় নিয়েছিল। মেয়েটি ছিল হিন্দু পরিবারের। বাড়িতে কম বয়সী বলতে ওরা দুজনই ছিল। পাতলা খান আমাকে ধানের গােলা কেটে দিতে বললাে। আমি তাড়াতাড়ি ধানের গােলা কৌশল করে কেটে দিলাম। যাতে ওদের দিকে চোখ না পড়ে হায়েনাদের। সেদিন পাকিস্তানি সেনাবাহিনী অত্র অঞ্চলে সারা দিন ধরে লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও হত্যা চালিয়েছিল। গরু, মহিষ, ছাগল ও অন্য দ্রব্যাদি নৌকা করে নদীর ওপারে নিয়ে যায়। তুরাগের এপারের গ্রামগুলাে লুটতরাজ করে মালামাল নদী পার করে সাভারে নিয়ে যেতাে। পাতলা খান আমার গােলার ধান দুদিন পরে লুট করে নেয়। সেদিন ওরা ব্যাপক নিপীড়ন, গােলাগুলি ও হত্যাকাণ্ড চালায়। যারা পালাতে না পেরেছিল তাদেরই ঢলে পড়তে হয়েছিল মৃত্যুর কোলে। আমার বাড়ির অল্পদূরে একটি হিন্দু পরিবারের সাত জনকে মেরে ফেলে। গ্রামের সীতানাথ মাস্টারের মেয়েকে তুলে নিয়ে যায়। মেয়েটির বয়স ছিল বার-তের। সীতানাথ মাস্টারের তিনটি ছেলেকে একসাথে গুলি করে হত্যা করে। সীতানাথ মাস্টারের পাশের বাড়ির এক হিন্দু পরিবারের চারজনকে হত্যা করে। গ্রামের হাকিম আলীর একমাত্র ছেলেকে খুন করে নির্মমভাবে। সারা দিন ওরা প্রচণ্ড গােলাগুলি করে। ঝরনার মা নামে এক মহিলা দৌড়ে পালানাের সময় গুলির আঘাতে মারা যায়। ফিরে যাবার সময় সকালবেলা স্কুলঘরে যে পরিবারটি আটকে রেখে গিয়েছিল তাদের হত্যা করে ফেলে যায় স্কুলের আঙিনায়। স্কুলে আশ্রয় নেয়া মুসলিম পরিবারের এক মেয়ে ধরা পড়ে গিয়েছিল হায়েনাদের হাতে। পরিবারের সবাই পালিয়ে গেলেও মেয়েটি পালাতে পারেনি। পালাবার পথ না পেয়ে স্কুলের কাছে এক বাড়ির খড়ের পালার ভেতরে ঢুকে পড়ে নিজেকে বাঁচানাের চেষ্টা করেছিল।কিন্তু শাড়ির আঁচলের সামান্য অংশ বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছিল। পাক সেনারা সেটা দেখে ফেলে সেখান থেকে মেয়েটিকে বের করে আনে। নদীর তীর থেকে স্কুলের পাশে কিছু জংলা ছিল। সৈন্যরা মেয়েটিকে সেখানে নিয়ে গিয়ে ধর্ষণ করে। এক পর্যায়ে মেয়েটি জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। এমতাবস্থায় সৈন্যরা মেয়েটিকে আমার বাড়ি নিয়ে যেতে বলে এবং ফিরে যাবার সময় ক্যাম্পে নিয়ে যাবার কথা জানায়।
রক্তাক্ত অবস্থায় মৃতপ্রায় মেয়েটিকে পাজাকোলা করে বাড়ি নিয়ে আসি। মেয়েটি তখন হাঁটতে পারছিল না। বাড়িতে এনে মা-ভাইকে বলি সেবা দিয়ে ওকে বাড়ি থেকে বের করে দিতে। কেননা আমাকে সেদিন সারা দিন পাকসেনাদের সাথে থাকতে হয়েছিল। জীবন রক্ষার্থে আমি এটা করতে বাধ্য হই। সৈন্যরা গ্রামের অন্য দিকে সরে গেলে আমার বাড়ির লােকজন মেয়েটিকে বের করে দিয়ে বলেছিল যেদিকে তাের দুচোখ যায় চলে যা। বিকেলে ওরা চলে যাবার সময় মেয়েটিকে চাইলাে। আমি পাতলা খানকে বললাম মেয়েটি পালিয়ে গেছে। বাড়িতে কেউ না থাকায় পালিয়েছে। পাতলা খান অবশেষে দয়াপরবশ হয়ে বিষয়টি মেনে নিলাে। সৈন্যদের বােঝালাে যে আমি তাে সারা দিন ওদের সাথেই ছিলাম। তাই মেয়েটি কখন পালিয়েছে। আমার জানা নেই। আমি তখন কথা বলতাম বাংলায়। আমার কথাগুলাে। পাতলা খান ওদের উর্দুতে বুঝিয়ে দিতাে। আবার ওদের উর্দু অনুরূপভাবে আমাকে বােঝাতাে বাংলায়।
তাে এরপর পাকসৈন্য ইছরকান্দিতে ঢােকেনি। তবে লুটতরাজ চলতে থাকে। হায়নাদের আতঙ্ক থাকে চব্বিশ ঘণ্টা। তুরাগে ভাসতে থাকে বাঙালির লাশ দীর্ঘ নয়মাস ধরে। বহুমূল্যে অর্জিত হয়েছে আমাদের স্বাধীনতা।
এস এম জহির বরকত (বারিক)
মুক্তিযােদ্ধা, বারিষাভ,
কাপাসিয়া, গাজীপুর।

১৯৭১ সাল। ‘৭১ সালে আমাদের মহান স্বাধীনতাযুদ্ধ সংঘটিত হয়। তখন আমি মাদ্রাসায় পড়ি। এসএসসি সমমানের ছাত্র। মাদ্রাসায় পড়ালেখা করলেও আমার বন্ধুরা ছিল সব হাই স্কুলের। কাপাসিয়ার সন্মানীয়াতে এক পরিবারে লজিং থেকে পড়াশুনা করি। এ পরিবারের গৃহিণী খুব উপন্যাস পড়তেন। শুধু উপন্যাস নয় অন্যান্য বিষয় এবং পত্রিকা পড়তে পছন্দ করতেন। তিনি আমাকে বলতেন শুধু পাঠ্য বিষয় পড়লে হবে না। জ্ঞান অর্জন করতে হলে তােমাকে অনেক বিষয় পড়তে হবে। তিনিই আমাকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করেন।
যুদ্ধ শুরু হলে বাড়ি চলে আসি। এসে দেখি আমার অগ্রজ সিরাজ ভাই যুদ্ধের জন্য অত্র অঞ্চলের যুবকদের সংগঠিত করছেন এবং যুদ্ধে যাবার চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিয়েছেন। অতঃপর তার নেতৃত্বে এপ্রিলের ৭ অথবা ৮ তারিখ আট থেকে দশজনের একটি দল সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে ভারতের উদ্দেশে রওনা হই। আসাদনগর থেকে চান মিয়াকে সঙ্গে নিয়ে রাতে আগলিরচর যাই। ওখান থেকে নৌকাযােগে নবীনগর প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পৌছাই। বিদ্যালয়ে কয়েক ঘণ্টা অবস্থান করি। সেখানে বিলের পাড়ে লাখাে মানুষ। ভারত যাবার অপেক্ষা করছে। তাদের সাথে ছােট কুশা নৌকা দিয়ে চারজন করে সিংগাইর বিল অতিক্রম করি এবং ভােরে ভারতের মাটিতে পা রাখি। এরপর হেঁটেআমরা আগরতলা কংগ্রেস ভবনে পেীছি। ওখান থেকে জয়বাংলা ক্যাম্পে যােগাযােগ হলে আমাদের কংগ্রেস ভবনে রেখে দেয়া হয়।
কিছুদিন কংগ্রেস ভবনে থাকার পর সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে হাপানিয়া তিতাস ক্যাম্পে চলে আসি। সিরাজ ভাইরা চলে যান যমুনা ক্যাম্পে। আমি এবং আতাউর রহমান ফকির তিতাস ক্যাম্পে অবস্থান করি। ক্যাম্পে খাওয়াদাওয়ার কষ্ট ছিল। ছিল দেশ ও স্বজন হারানাের বেদনা। কিন্তু কোনাে কষ্টই আমাদের কষ্ট মনে হতাে না। কখন ট্রেনিংয়ের ডাক পড়বে। কখন যুদ্ধে যাবাে এটাই ছিল তখন একমাত্র লক্ষ্য। এরই মধ্যে সিরাজ ভাইয়ের নেতৃত্বে দশ-বারজনের একটি দল ট্রেনিংয়ে চলে যায়। তিতাস ক্যাম্পে আমি অধীর আগ্রহে দিন কাটাতে লাগলাম। ক্যাম্পের ডেপুটি ইনচার্জ ছিলেন ব্রাহ্মণবাড়িয়া কলেজের বাংলার অধ্যাপক আবু বকর সিদ্দিক। তার একটি বাণী ছিল- চাওয়া পাওয়া নয়, গন্তব্যে পৌছাই শেষ কথা। যা এখনাে আমাকে প্রভাবিত করে। ধৈর্যধারণ করে অপেক্ষা করতে তিনি আমাদের সহায়তা করেছেন। যুদ্ধে মনােবল জোগাতে তার দক্ষতা ছিল অতুলনীয়। নবীনগর থানার এসপিও আমাদের সঙ্গে ছিলেন।
মাসাধিকের বেশি অপেক্ষার পর ট্রেনিংয়ে অংশ নিতে পারলাম। আতাভাই জানতে পারিনি কী কারণে রিক্রুট হতে পারলেন না। রিকুট হওয়ার পর খাওয়া-দাওয়া করে ট্রেনিং সেন্টারের উদ্দেশে রওনা হই। ট্রাকে করে রাত দশটার দিকে পেীছি পালটোনা ট্রেনিং সেন্টারে। পালটোনা ডি কোম্পানিতে সিলেক্ট হই। ওখানে গিয়ে সাক্ষাৎ পাই কমান্ডার আবুল হাশেম ও আ, রশিদ নামে দুজন মুক্তিযােদ্ধার। এদের দুজনের বাড়িই ছিল বারিষাভ ইউনিয়নে। আমাদের ট্রেনিং হয় একুশ দিন। এখানে আমাদের ওস্তাদ ছিলেন সেকেন্ড ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের হাবিলদার মাে. মােখলেছুর রহমান। ফায়ারিংয়ের ওপর বাছাই করে আমার কোম্পানি আবার আমাকে চব্বিশ দিনের ট্রেনিংয়ে পাঠায়। এই চব্বিশ দিনের ট্রেনিং ছিল সবচেয়ে কঠিন এবং খুব কষ্টের। ট্রেনিং শেষ হলে আমাদের গ্রুপকে পাঠানাে হয় তিন নম্বর মনতলা সেক্টরের হেডকোয়ার্টারে।

মনতলায় আমাদের কিছুদন অবস্থান করতে হয়। তারপর সেক্টর কমান্ডার সেকেন্ড ইন কমান্ড নুরুজ্জামানের কাছ থেকে অস্ত্র নিয়ে দেশের ভেতরে প্রবেশ করি । নদী, নালা, খাল, বিল পার হয়ে প্রথমে ঘােড়াশালে পৌছাই। এখানে দুদিন অবস্থান করার পর পায়ে হেঁটে গেরিলা কায়দায় আক্রমণ
চালিয়ে বর্তমান পলাশ থানার চরসিন্দুর আসি। চরসিন্দুর থেকে কালিগঞ্জ বাজারে এসে অবস্থান নেই। আমাদের কোম্পানি কমান্ডার ছিলেন আবুল হাশেম ফকির। এখান থেকে আমরা কালিগঞ্জ থানার জামালপুরে সম্মুখযুদ্ধে অংশগ্রহণ করি। এরপর কাপাসিয়া থানার কমান্ডার বেনুভাই খবর পেয়ে সেকশন কমান্ডার সিরাজ ভাইকে পাঠালেন আমাকে নিয়ে আসার জন্য। সিরাজ ভাইয়ের সঙ্গে গেলেন মরহুম নুর হােসেন মেম্বার ও সহযােদ্ধা রহিম শেখ। তাদের পেয়ে কমান্ডারসহ চলে আসি। তারা তখন ইকুরিয়া ক্যাম্পে অবস্থান করছিলেন। সেখানে আমাদের নিয়ে আসেন। ইকুরিয়া ক্যাম্পে আমি ভীষণ অসুস্থ হয়ে পড়ি। সুস্থ হওয়ার পর আমাকে জয়দেবপুর অর্ডন্যান্স ফ্যাক্টরিতে পাঠানাে হয়। আমার সাথে ছিলেন ইকুরিয়া ক্যাম্পের আক্তার। উদ্দিন আকন্দ ও রিয়াজ উদ্দিন। এখানে আসার পর জয়দেবপুর রেলস্টেশনে আমাদের সাথে সম্মুখযুদ্ধ হয়। এ যুদ্ধে শহীদ হন দু’জন। কাপাসিয়া ঘাঘুটিয়া ইউনিয়নের শালদই গ্রামের সহযােদ্ধা আব্দুল হাই শহীদ হন। বাকি জনের পরিচয় আমার জানা নেই। এটাই আমার শেষ যুদ্ধ। তখন ছিল স্বাধীনতাযুদ্ধের একেবারে শেষ পর্যায়। এরপর আমরা ঘােড়াশাল জুট মিলে আশ্রয় নিই। এবং স্বাধীন হলে সাভারে নুরুজ্জামানের কাছে অস্ত্রসমৰ্পণ করি।
স্বাধীনতাযুদ্ধে পাকবাহিনীর নৃশংস বর্বরতা ভাষায় প্রকাশ করার মতাে নয়। এখনাে স্মরণ হলে ওদের নিন্দা করার ভাষা হারিয়ে ফেলি। যারা যুদ্ধ দেখেছে কেবল তারাই এর নির্মমতা নির্ধারণ করতে পারবে। ইতিহাসে যা আসছে তা অপ্রতুল। হানাদার বাহিনীর নির্যাতনের ব্যাপকতা পূর্ণাঙ্গভাবে ইতিহাসে নিয়ে আসা সম্ভব নয়। স্বাধীনতাযুদ্ধে এদেশের মানুষের ত্যাগের মাত্রাও নিরূপণ করা অসম্ভব। সেদিন বাঙালি জাতি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছিল। সে ত্যাগের কোনাে তুলনা নেই।

অঞ্জলি রক্ষিত
গৃহিণী, মুজাটি,
মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী মুক্তাগাছা শহরে প্রবেশ করলে আমরা সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কখন বাড়িতে আসে এই ভয়ে দিনরাত কাটাই। আমাদের বাড়ি থেকে মুক্তাগাছার দূরত্ব মাত্র এক কিলােমিটার। মুক্তাগাছায় ঢােকার মাত্র এক সপ্তাহ পরে হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়িতে আসছে খবর পেয়ে সবাই বাড়ি ছেড়ে চলে যাই। কিছুক্ষণ পরে বাড়ি ফিরে আসি। বাড়ি আসার তিনদিন পর পাকসেনা আমাদের বাড়িতে হামলা চালায়। তখনাে দুপুর হয়নি। আমরা রান্নাবান্নার আয়ােজন করছি। এই মুহূর্তে কাইয়্যা (আমাদের বর্গাচাষি) বাড়ির সামনে দিয়ে দৌড়ে এসে বলে যায় যে, পাকিস্তানি সেনা আসছে। তখন আমরা সব ফেলে পরিবারের সব সদস্যসহ দৌড়ে পালাতে চেষ্টা করি। কিন্তু ততক্ষণে পাকসেনারা বাড়ি ঘিরে ফেলেছে। আমরা বাড়ির পাশের জঙ্গলে লুকিয়ে যাই। আমার স্বামী ও ভাসুর পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। কিছুদূর গিয়ে আমার স্বামী পাঁচ বছরের শিশুসন্তানের খোঁজে এসে হানাদার বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যান। পাকসেনারা এক এক করে আমাদের জঙ্গল থেকে বের করে আনে। আমরা হিন্দু না মুসলমান জিজ্ঞেস করলাে ওদের ভাষায়। আমার মাথায় টোকা মেরে জিজ্ঞেস করলাে, আমি হিন্দু কি না। আমি মুসলমান বলে তাদের পরিচয় দিলাম। আমার জা ও আমাকে বাড়ির একটা ঘরে এনে আটকে রাখলাে। কোলে আমার শিশুসন্তান। জাকে প্রচণ্ড মারধর শুরু করে দিলাে। আমি তখন প্রায় জ্ঞানশূন্য হয়ে পাগলের মতাে ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে দৌড়াতে থাকি। আমার স্বামী কোথায় জানতে পারলাম না। এ জীবনে তার সাথে আমার আর দেখা হয়নি।
আমার স্বামীসহ পাড়ার কয়েকজনকে ধরে নিয়ে গেলাে। এদের মধ্যে আমাদের পাশের বাড়ির দুজনকে মুক্তাগাছা শহরের নাপিতখােলা নামক স্থানে গুলি করে মেরে ফেলে। স্বজনরা তাদের লাশও নিতে আসতে পারেনি। আমার স্বামী এবং দীনেশ ভাট নামে এক ভদ্রলােককে গাড়িতে তুলে নিয়ে চলে যায়। স্বামীর সংবাদ পরস্পর এইটুকুই জানতে পারলাম। সেদিন পাকিস্তানি সেনারা আমাদের বাড়িসহ কয়েকটি বাড়ি জ্বালিয়ে দেয় এবং পুরাে গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি ও অত্যাচার চালায়। গ্রামের বাড়ি বাড়ি ঢুকে তল্লাশি ও অত্যাচার চালায়। কাইল্যা মুহুরী, দানেশ বিহারি, আরও একজন রাজাকার মিলে তাদের এ কাজে সহায়তা করে। আমাদের বাড়ি ছিল হানাদার বাহিনীর প্রথম লক্ষ্য। কারণ আমার দুই দেবর আওয়ামী লীগ কর্মী ছিলেন এবং মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে ভারতে অবস্থান করছিলেন।
সেদিন আমরা প্রতিবেশী এক বাড়িতে আশ্রয় নিই। আমাদের বর্গচাষি (কটার বাপ) পরদিন আমাদের খাবার-দাবার দিতে আসে। খাবার খেয়ে রাজাকারের ভয়ে আমরা সেখান থেকে দূরে অন্য এক বর্গাচাষির বাড়ি চলে যাই। কিছুদিন পর বাড়ি চলে আসি। আগুনে পােড়া বিধ্বস্ত বাড়িতে থাকার মতাে অবস্থা না থাকায় বাড়ি থেকে অল্পদূরে একটা বাড়িতে আশ্রয় নিই। অবস্থার আরও অবনতি হলে আমার ভাসুর জা’কে নিয়ে মামার বাড়ি জামালপুর জেলার নান্দিনার কাছে ফতেপুর গ্রামে চলে যান। বৃদ্ধ শ্বশুর-শাশুড়িকে নিয়ে আমি দীর্ঘ ন’মাস এই বাড়িতেই কাটাই। প্রতিটি মুহূর্ত ছিল বিভীষিকাময়। কখন রাজাকার বা পাকিস্তানি সেনারা এসে কাকে ধরে নিয়ে যায় এই আতঙ্কে দিন কাটতে থাকে। নয়মাস জুড়েই ছিল রাজাকারের অত্যাচার। এক পর্যায়ে তারা আমাদের ধর্মান্তরিত করলাে। মুন্সী রেখে কালেমা শেখাতে লাগলাে। এ সময় তারা একদিন হিন্দু এক ছেলেকে সাথে নিয়ে গরুর মাংস কিনে দিলাে। এই মাংস হিন্দুদের প্রত্যেককে খাওয়ার জন্য বললাে।
গ্রামের মুসলমানরা ছিল খুব উদার ও মানবিক। তারা বুদ্ধি বের করে বাড়ি থেকে মাংস রান্না করে এনে আমরা যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই বাড়িতে বসে খেলাে। ওই বাড়িতে আরও কয়েকটি হিন্দু পরিবার আশ্রয় নিয়েছিল। লােকজন রাজাকারদের বললাে, “হিন্দুরা আমাদের সাথে বসেই মাংস খেয়েছে। এভাবে গ্রামের লােকজন আমাদের গরুর মাংস খাওয়া থেকে বাঁচালাে। এরপর একদিন তারা আমাদের আশ্রিত বাড়িতে এসে মিটিং করলাে। মিটিং করে সিদ্ধান্ত নিলাে হিন্দু ছেলেরা মুসলিম মেয়ে বিয়ে করবে এবং মুসলিম ছেলেরা হিন্দু মেয়ে বিয়ে করবে। এতে হিন্দুরা রাজি না হওয়ায় রাতে যে ঘরে বৌ-মেয়েদের রাখা হতাে সে ঘরে হামলা চালাতাে। প্রতিবেশীরা গ্রামবাসীদের নিয়ে রাজাকারদের তাড়াতাে। রােজায় প্রত্যেক হিন্দুকে রােজা রাখতে হতাে। কেউ গােপনে খায় কি না তার জন্য রাখা হতাে কঠোর পাহারা। আমরা প্রতিদিনই সেহেরী খেতাম ও নামাজ পড়তাম। নামাজ-কালেমা ইত্যাদি আমরা শিখে নিয়েছিলাম। একদিন রাজাকাররা আমার বৃদ্ধ শ্বশুরকে গুলি করে মারার জন্য রাস্তায় নিয়ে দাঁড় করালাে। আমি ও আমার শাশুড়ি কেঁদে কেটে হাতে-পায়ে ধরে সে যাত্রায় রক্ষা করি।
রাজাকাররা প্রতিদিনই পাকিস্তানি সেনা এনে হাজির করতাে। আর আমরা প্রতিদিন পালিয়ে যেতাম এক গ্রাম ছেড়ে অন্য আর এক গ্রামে। দিনের বেলা একগ্রামে কাটলেও রাত কাটাতাম অন্য গ্রামে। এভাবে চলে আমাদের। নয়মাসের জীবন। রাতে ঘুম নেই। পেটে খাবার নেই। কখনাে পয়সা জুটলেও বাজার আনা সম্ভব ছিল না। কে যাবে বাজারে বাঘের মুখে। কোনােদিন হয়তাে বা শাক আর দুমুঠো চাল চুলােয় চাপিয়েছি সে মুহূর্তে খবর এসেছে পাকসেনা বা রাজাকার আসছে। এমনি সেগুলাে ফেলে রেখে ছুটতে ছুটতে চলে গিয়েছি পরবর্তী দুই-তিন গ্রামের শেষ মাথায়।
এবার আসি আমার স্বামীর কথায়। স্বামী হারানাের বেদনা মুখে বলে বা লিখে কতটুকুই প্রকাশ করা যায়! সবই অন্তরে গাঁথা কষ্ট ও বেদনার। যিনি এ কষ্টের ভাগীদার শুধু তিনিই বােঝেন এ কষ্ট কতটা সীমাহীন, কতটা গভীর। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে স্বামীকে হারিয়ে ফেললাম। সেই থেকে অকাল বৈধব্য জীবনের বােঝা বয়ে চলেছি। কান্না আর হাহাকার আমার জীবনের নিত্যসঙ্গী। একজন নিরপরাধ মানুষকে কীভাবে বিনাবিচারে বিনা অপরাধে মেরে ফেললাে! এ যন্ত্রণা কোথায় রাখবাে। সেই যে ধরে নিয়ে গেলাে এ জীবনে আর সাক্ষাৎ মিললাে না। আমার স্বামীর সাথে যে ভদ্রলােককে ধরে নিয়ে গেলাে তার নাম দীনেশ ভাট। উনাদের বাড়ি ছিল আমাদের গ্রামের পূর্বপাশে। তাদের নিয়ে রেখেছিল মধুপুর ক্যাম্পে। তিনদিন আটকে রেখে অমানুষিক নির্যাতন চালিয়ে ছিল তাদের ওপর। দীনেশ ভাট ছিলেন মেকানিক্স। ময়মনসিংহ শহরে উনার গ্যারেজ ছিল। তিনদিন পর এক মেজর ময়মনসিংহ থেকে মধুপুর ক্যাম্পে যায়। দীনেশ ভাটকে দেখে সে চিনে ফেলে। দীনেশ ভাট পঁচিশ মার্চের কয়েকদিন আগে ময়মনসিংহ শহরে সেই মেজরের গাড়ি সারিয়ে ছিলেন। মেজর দেখেই চিৎকার করে বলে, “জারজ বাচ্চাকে খতম করাে’ দীনেশ ভাট হ্যান্ডস আপ করে এবং প্রাণভিক্ষা চায়। তখন দীনেশ ভাটসহ আমার স্বামীকে ক্যাম্প থেকে বের করে নিয়ে আসে। দীনেশ ভাটকে ছেড়ে দেয়। আমার স্বামীকে সরিয়ে নেয়। দীনেশ ভাট আস্তে আস্তে মুক্তাগাছার দিকে হাঁটতে থাকে। কিছুদূর হাঁটলে তার কানে আসে গুলির শব্দ। দীনেশ ভাটের কাছ থেকে পাওয়া আমার স্বামীর এই শেষ সংবাদ।

আমার সহজ-সরল স্বামী মানুষের এমন মৃত্যুর বিষয়টি বুঝতে পারেননি। গাড়িতে তােলার সময় ভাটকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘দাদা আমাদের কি মেরে ফেলবে?’ কী নির্মম পরিহাস! দীনেশ ভাট সে সময় মুক্তি পেলেও যুদ্ধের শেষ দিকে নিজের বাড়িতে পাকিস্তানি সেনাদের হাতে নির্মমভাবে শহীদ হন।
অপর্ণা রানী সরকার (ঝুমুর)
গৃহিণী, নামায গ্রাম, বানেশ্বর,
পুঠিয়া, রাজশাহী।

মহেশপুর আমাদের গ্রামের নাম। বৃহত্তর বগুড়া জেলার কাহালু উপজেলায়। মহেশপুর গ্রামে আমরা খুব ভালাে ছিলাম। বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মানুষ মিলেমিশে শান্তিতে দিন অতিবাহিত করছিল। ‘৭১ সালে মানুষের শান্তিপূর্ণ জীবনগুলাে একেবারে তছনছ হয়ে গেলাে। ‘৭১-এর ২৬ মার্চ রেডিওতে খবর হলাে ঢাকায় হানাদার বাহিনী অগ্নিসংযােগ ও গণহত্যার উৎসবে মেতে উঠেছে। কিছুদিন ধরে সবাই বুঝতে পারছিল দেশে একটা কিছু ঘটতে যাচ্ছে। সে ঘটনা যে এমন ভয়ঙ্কর হবে এটা কেউ আন্দাজ করতে পারেনি। ঢাকায় যুদ্ধ শুরু হবার পরেও এখানকার লােকের ধারণা ছিল- যা হবার তা। ঢাকায়ই হবে। কিন্তু এপ্রিলের প্রথম দিকে বগুড়াসহ আশপাশের শহরের লােকজন আমাদের মহেশপুর গ্রামে আশ্রয় নেয়া শুরু করলাে। কয়েকদিন পর আমার এক কাকা বাড়িতে এলেন । তিনি কাহালুতে চালের আড়তে কর্মরত ছিলেন। কাকা এসে বললেন যে বাড়িতে আর থাকা যাবে না। কারণ বগুড়া সেনানিবাস থেকে হানাদার বাহিনী ট্রেনে আসা-যাওয়া করছে। এরই মধ্যে খবর হলাে হানাদার বাহিনী কাহালুতে ক্যাম্প করেছে। তখন আমরা পালাক্রমে রাস্তা পাহারা দিতে থাকি। কাহালু থেকে পাকফৌজ বাড়ির দিকে আসতে থাকলে আমাদের নজরে আসবে। আর পাকফেীজ আসতে দেখলে আমরা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাবাে এরকম ছিল ধারণা। বাড়ি ছেড়ে যাবার চিন্তা তখনাে বড়রা করেননি। এভাবে সাত-আট দিন পার হলাে। আমার কাকার সাথে কাহালুর চালের আড়তে কাজ করতেন হাচুমুন্সী নামে এক লােক। একদিন দুপুরবেলায় আমরা রাস্তার ধারে বসে আছি। এমন সময় উনি হাঁপাতে হাঁপাতে আমাদের বাড়িতে পেীছে বাইরের ঘরের বারান্দায় বসে পড়লেন এবং বললেন যে আগামীকাল দশটার ভেতর হানাদার বাহিনী। মহেশপুর ঢুকবে। তিনি সবাইকে বাড়ি ছেড়ে অন্য যে কোনাে নিরাপদ স্থানে আশ্রয় নিতে বললেন। আপনারা যদি মনে করেন যে পাকিস্তানি সেনাদের। দেখলে পালাবেন সে সুযােগ হয়তাে বা আসবে না। বাড়িতে কান্নার রােল উঠলাে। ছুটাছুটি করতে লাগলাে পাড়ার লােকজন। আমার বাবা ছিলেন। প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। তিনি কিছুতেই বাড়ি ছেড়ে যেতে রাজি হলেন না। আমরা ছিলাম নয় ভাইবােন। বাবা বললেন, এতগুলাে বাচ্চা-কাচ্চা নিয়ে আমি কোথায় যাবো?
আজ মনে হয় হাচুমুন্সী ছিলেন স্বয়ং ভগবান। সেদিন তিনি খবর না পৌছালে আমাদের যে কী ভয়ানক পরিণতি হতাে সেটা সকলেই জানেন। হিন্দু সম্প্রদায় যারা গ্রামে ছিল তারা সীমান্ত পার হয়ে ভারতে চলে যাবার প্রস্তুতি নিতে লাগলেন। মুসলমান সম্প্রদায় তাদের কমবয়সী বৌ, মেয়ে এবং ছেলেদের বাড়ি থেকে সরিয়ে দিলাে। রাত দশটার দিকে আমার ধর্মভাই। ওসমান এলাে। সে বাজারে ডাক্তারি করতাে। সে আমার বাবাকে বােঝালাে। যে সবাই গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। পরিস্থিতি চারদিকে ভয়াবহ। কাজেই গ্রামে থেকে গেলে বেঁচে থাকার কোনাে উপায় নেই। ওসমান ভাই তার বাড়িতে আমাদের নিয়ে যেতে চাইলেন। জিনিসপত্র সব অন্য বাড়িতে স্থানান্তর করতে বললেন। আমাদের পাতানাে কুটুম ছিলেন ইজামুদ্দিন মিয়া। আমরা তাকে দাদা বলে ডাকতাম। মহেশপুরেই ছিল ওনার বাড়ি। ইজামুদ্দিন দাদা এসে কিছু চাল ও কাঁসার বাসন-কোসনগুলাে নিয়ে গেলেন। ওসমান দাদা বললেন যে অন্তত পক্ষে আজ রাতে যেন আমারা ওনার বাড়িতে গিয়ে অবস্থান নিই।
সেদিন ছিল ৮ বৈশাখ। খুব ভােরে চলে গিয়ে ওসমান দাদার পরিবারের সাথে মিলিত হলাম। বাবা বাড়িতে রয়ে গেলেন কিছু খাদ্যদ্রব্য ও একান্ত প্রয়ােজনীয় অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসার জন্য। শেষ রাতে ওসমান দাদার পরিবার-পরিজনের সাথে আমরা হাঁটতে শুরু করি। হাঁটতে হাঁটতে আমরা পাঁচ-ছয় মাইল পথ অতিক্রম করে ফেলি। সূর্য মাত্র আকাশে লাল হতে শুরু করেছে। এমন সময় খবর এলাে মহেশপুর গ্রামে হানাদার বাহিনী ঢুকেছে। একটা মাঠের মাঝে বসে আমরা কান্নাকাটি শুরু করলাম। নিশ্চয়ই বাবাকে মেরে ফেলা হয়েছে। মাঠে তখন অনেকেই কাঁদছে। যা হােক। কিছুক্ষণের মধ্যেই বাবা এলেন ভাঁড়ে কিছু জিনিস নিয়ে। সবাই মিলে তখন ওসমান দাদার শ্বশুরের আত্মীয়ের বাড়ির দিকে রওনা দিই। সেটা ছিল মাগুরা গ্রামে। মাগুরা যাওয়ার পথে দুটো পাকফৌজের জিপ আমাদের অতিক্রম করে যায়। সে সময়টুকুর বর্ণনা আজ আর আমি দিতে পারবাে না। তবে মৃত্যুর মুখােমুখি দাড়ানাের যে অনুভূতি সেটা হয়েছিল।
মাগুরা গ্রামে ওসমান দাদার শ্বশুরের আত্মীয়ের বাড়িতে আমাদের চার-পাঁচ দিন ভালােই কাটলাে। এক সময় জানাজানি হয়ে গেলাে আমরা হিন্দু। গ্রামের লােকজন এসে বাড়িওয়ালাকে ভয় দেখাতে লাগলাে। গ্রামে পাকফৌজ ঢুকলে তােমাদের জন্যই ঢুকবে। সবার বিপদ ডেকে আনবে না। তাদের বাড়ি থেকে বিদায় করে দাও। রাতে ওসমান দাদা বাধ্য হয়ে বাবাকে বললেন, ‘কিছুই আর করার থাকছে না। আপনি গ্রাম ছেড়ে চলে যান অথবা মুসলমান হয়ে যান।’ তখন আবার আমাদের ভেতর কান্নার রােল উঠলাে। বাবা ওসমান ভাইকে অন্য একটা থাকার জায়গা ঠিক করে দিতে বললেন। মাগুরা থাকতেই আমরা শুনতে পেলাম আমার কাকা ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছেন। সেই রাতেই বাবার এক ছাত্রের বাড়িতে ওসমান দাদার শ্বশুর আমাদের তুলে দিয়ে গেলেন। সে গ্রামের নাম ছিল সিন্দুরিয়া। বিকৃতভাবে বলা হতাে সিংরাগ্রাম। ছাত্রের মা আমাদের খুব ভালােভাবে গ্রহণ করলাে। বাড়িতে ঢােকা মাত্র আপ্যায়ন শুরু করলাে। আদর-আপ্যায়নে কয়েকদিন বেশ ভালােই কাটলাে। এরপর দেখা দিলে অন্য বিপত্তি। বাবার এই ছাত্ররা ছিল দুইভাই। নাম শাহজাহান ও চানমিয়া। ভাইয়ে ভাইয়ে প্রচণ্ড ঝগড়া হতে লাগলাে। তাদের ঝগড়ায় জানাজানি হয়ে গেলাে আমাদের অবস্থানের কথা। কাজেই সেখানে আর থাকা হলাে না। কিন্তু ভাইদের ঝগড়ার কারণ আমরা তখনাে জানতে পারিনি। যা হােক আবার ওসমান দাদাকে খবর দেয়া হলাে। তিনি নিয়ে গেলেন আমাদের পাশের গ্রাম মহরামনি (মরামনি)। এখানে ছিল আমার মেজদিদির সইয়ের বাড়ি। মেজদির সইয়ের বাবার নাম ছিল হারেজ আলি। মায়ের নাম ছিল রাহিলা। ওসমান দাদা আমাদের এখানেই অর্থাৎ হারেজ কাকার বাড়িতে রেখে গেলেন। হারেজ কাকার ছিল তিন বউ। বড় বউ এবং ছােট বউ আমাদের আদর-যত্ন ও দেখাশােনা করতে থাকলাে। পরদিন কাকা আমাদের খবর পেয়ে মহরামনিতে এলেন। বাবাকে মুসলমান হওয়ার জন্য বােঝালেন। ধর্মান্তরিত হতে বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। তখন সই ও হারেজ কাকা বাবাকে বােঝালেন যে বাড়ি ঘােরানাে যে দেড়তলা ঘর করা আছে সেখানে দিনের বেলা থাকতে হবে। রাতে আবার বাড়ির ভেতরে থাকা যাবে। তাে তাই হলাে। আমরা ভােরবেলা রান্না করে দেড়তলার চাতালে উঠে যাই। মই বেয়ে আমরা উঠি। আমরা উঠে গেলে মই সরিয়ে ফেলা হয়।
সেই চাতালে হারেজ কাকার পেঁয়াজ, রসুন, আলু, শুকনাে মরিচ ইত্যাদি রাখা ছিল। সেখানে গ্রামের অন্য একটি পরিবারও কিছু পেঁয়াজ রেখেছিল। চার-পাঁচ দিন পর যে মহিলা পেঁয়াজ রেখেছিল সে দেখতে এলাে। পেঁয়াজগুলাে ভালাে আছে কি না। আমরা চাতালে বসে শুনতে পাচ্ছি। মহিলার কথাবার্তা। তখন আমরা অনুভূতি শূন্য হয়ে গেছি। ভগবানকে ডাকছি শুধু। মহিলা মই লাগিয়ে ওপরে উঠে হতভম্ব হয়ে গেলাে। আমাদের চিনে ফেললাে। বাবা-মা হায় হায় করতে লাগলেন আশ্রয়টুকু শেষ হয়ে গেলাে ভেবে। আবার একই সমস্যা হলাে। হারেজ কাকা গ্রামের অন্য একটা বাড়িতে আমাদের থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই রাতেই আমরা জবেদ আলির বাড়িতে চলে এলাম। জবেদ আলি লােকটি গরিব। কিন্তু তার বিশাল হৃদয়ের কোনাে তুলনা নেই। জবেদ আলির চাতালে এবারও আমাদের। আশ্রয় হলাে। মই বেয়ে আমরা ওপরে উঠে গেলে জবেদ আলি চাতালের মুখে রেখে দিতাে লাকড়ির বােঝ। লাকড়ির বােঝা আমাদের আড়াল করে। রাখতাে। জবেদ আলির বাড়ির কিছুটা দূরে বগুড়া থেকে কাহালুর পথ। এই পথে হানাদার বাহিনী যাতায়াত করে। দিনের বেলা সবাই বাড়ি থেকে দূরে সরে থাকে। সন্ধ্যায় বাড়ি ফেরে। কিন্তু জবেদ আলির বাড়ির চাতালে আমরা অসহ্য গরমে দিন কাটাই। জবেদ আলির আতিথেয়তার কথা বলে ঋণ শােধ করা যাবে না। আমরা বাইরে যেতে পারতাম না। তার বাড়ি সংলগ্ন জঙ্গলে টয়লেট করতে হয়েছে অনেক সময়। জবেদ আলি সেগুলাে পরিষ্কার করেছে। বাইরে থেকে আমাদের সমস্ত জল এনে দিয়েছে। এখানে আমরা কিছুদিন থেকেছি। শেষের দিকে রাতে মাঠে চলে গিয়েছি। গ্রামের সবাই রাতে মাঠে নেমে আসতাে। কিন্তু আতঙ্ক থাকতাে সবার মনে। কখন বা পাকফৌজ গ্রামে ঢুকে। শুনতে পেলাম আমাদের পাশের গায়ে বগুড়া থেকে আসা আশ্রিত পরিবারের একটি মেয়ে কী কারণে শহরে গিয়ে ওদের হাতে ধরা পড়ে এবং নির্যাতনের শিকার হয়। প্রায় সবদিনই আমাদের খেতে হয়েছে আলু সেদ্ধ আর ভাত। সেটাও আবার নুন আছে তাে তেল নেই। আমার বয়স তখন চৌদ্দ অথবা পনের। আমি ছিলাম বাবা-মার তৃতীয় সন্তান।
একদিন এ অবস্থায় বাবা ভাগ্যের ওপর নির্ভর করে বাড়ি চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিতে যাচ্ছিলেন। ইতােমধ্যে মুক্তিবাহিনীর আনাগােনার খবর পাওয়া যেতে লাগলাে। বাড়িতে অনেক কিছু লুটপাট হয়ে গিয়েছে। তবে গ্রামের কাশেম পণ্ডিত আমাদের ধানগুলাে রক্ষা করতে পেরেছিল লুটপাটের হাত থেকে। আবার শুরু হলাে রাস্তা পাহারা দেয়া। পাহারা দিয়ে দিনে বাড়িতে থাকি। রাতে থাকা হয় হারেজ কাকার বাড়িতে। এভাবে দিন চলতে লাগলাে। একদিন রাস্তায় বসে আছি। মা হঠাৎ গিয়ে বলতে লাগলেন, ‘তােরা যা দেখ গিয়ে মিলিটারি বাড়ি ভরে গেছে। মার গলার স্বর শান্ত। নির্বিকার। আমরা অবাক। হানাদার বাহিনী বাড়িতে এলাে কোথা দিয়ে। আবার ভয়েও কাঁপছি। শেষ পর্যন্ত আবিষ্কার হলাে মার মাথায় গণ্ডগােল হয়েছে। বাড়িতে আদৌ কোনাে হানাদার বাহিনী ঢােকেনি।
এরই মধ্যে আবার বাবার চাকরিতে যােগদানের বিষয়টি এলাে। বাবার স্কুলের হেডমাস্টার সাহেব ছিলেন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান। তিনি বাবাকে চাকরিতে যােগদানের পরামর্শ দিলেন এবং কোনােরকম ক্ষতি হবে না বলে নিশ্চয়তা দিলেন। হেডমাস্টার সাহেব বাবাকে সবসময় পকেটে টুপি রেখে আর লুঙ্গি পরে স্কুলে যেতে বললেন। তিনি আরও জানালেন যে মিলিটারি দেখলে টুপি মাথায় দিতে হবে। বাবা ইতােমধ্যেই কলেমা পড়া শিখেছিলেন। এদিকে মায়ের মাথা আরও খারাপ হয়ে গেলাে। বাড়িতে কেউ এলেই লাঠি। দিয়ে তাড়া করতাে। খাওয়া-দাওয়া ছেড়ে দিলাে। আমাদের দিনগুলাে অসম্ভব যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে কাটতে লাগলাে। ওদিকে বাবার প্রতিদিনই স্কুলে। হাজিরা দিতে হচ্ছে। একদিন হানাদার বাহিনী হাজির হলাে স্কুলে। হেডমাস্টারের কাছে জানতে চাইলাে এখানে কোনাে হিন্দু আছে কি না। সব শিক্ষকই কোনাে হিন্দুর অবস্থানের কথা স্বীকার করলেন না। বাবা সে যাত্রায় রক্ষা পেলেন। আরেকদিন বাবা তালােরা গেলেন। ফেরার সময় ট্রেনে ফিরছিলেন। মিলিটারিরা ট্রেনে উঠে কোনাে হিন্দু লােক সেখানে আছে কিনা জানতে চাইলে সব শিক্ষকই মাথা নেড়ে অস্বীকার করলেন। বাবা আবারও রক্ষা পেলেন। এভাবেই কাটে যুদ্ধের দিনগুলাে। উদ্বেগ, ভয়, উৎকণ্ঠা ছিল তখন নিত্যসঙ্গী। জীবন ছিল প্রতি মুহূর্তে অনিশ্চিত। আজ বেঁচে আছি তাে কাল নেই। রাতটুকু পার হলাে তাে দিনে কখন গুলিতে মারা যাবাে নয়তাে বা ধরে নিয়ে যাবে ক্যাম্পে। আমাদের মহশেপুর গ্রামে হানাদার বাহিনী ঢােকার আগের দিন কাহালুতে আর একটি মর্মান্তিক দুর্ঘটনা ঘটে। কাহালুতে তখন জমিদারের শেষ বংশধর ছিলেন কালীপদ মজুমদার। কালীপদমজুমদারসহ কাহালুর আশপাশ থেকে পঁচাত্তর জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী লােক ধরে নিয়ে যায় এবং কাহালু থেকে বগুড়া যাওয়ার পথে মাঠের মাঝে ট্রেন থামিয়ে তাদের গুলি করে ফেলে রাখে। স্বজনরা লাশগুলােও নিতে পারেনি। এই ছিল স্বাধীনতা যুদ্ধের নয় মাসের দিনগুলাে। অত্যাচারের এমন খড়গ যেন কোনাে দিন কোনাে মানুষের ওপর নেমে না আসে।

আবুল হোসেন
বাবুর্চি, কাওরাইদ বাজার, শ্রীপুর, গাজীপুর।

এগার বছর বয়স থেকে আমি ঢাকায় থাকি। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমার বয়স ছিল একুশ। ঢাকায় থেকে আমি তখন বাবুর্চির কাজ শিখতাম। আমার থাকার ব্যবস্থা ছিল পুরান ঢাকার হােসেনি দালানে। ২৫ মার্চ রাত বারটার দিকে হঠাৎ রাজারবাগে গােলাগুলি শুরু হলে লােকজন বাইরে বেরিয়ে আসে এবং পালাতে শুরু করে। অন্যদের সাথে আমিও বের হয়ে দৌড়াতে শুরু করি। শান্তিনগরে আমার সঙ্গী হয় ঢাকা মেডিকেলের দুজন ডাক্তার ও চারজন পুলিশ। আমরা একসঙ্গে জয়দেবপুরের দিকে দ্রুত ছুটতে থাকি। শেষ রাতে ইজ্জতপুর স্টেশনের কাছে চলে আসি। ইজ্জতপুর থেকে আমি কাওরাইদ, বাকিরা সব যার যার সুবিধামতাে স্থানে চলে যায়।
কাওরাইদ এসে দেখি স্বাধীনতার পক্ষের লােকজন সংগঠিত হচ্ছে। আমি তাদের সাথে যােগ দিই। কিছুদিন পর এদের মধ্য থেকে একটি গ্রুপ যুদ্ধের ট্রেনিং নিতে ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়। এ গ্রুপে আমি ছিলাম। আর ছিল মৃধাবাড়ির মান্নান। মান্নান ছিল দুরন্ত ছেলে। ছিল প্রচণ্ড সাহসী। আমরা প্রথমত ত্রিমােহনী যাই। ত্রিমােহনী থেকে নৌকাযােগে বর্ডারে পৌছার কথা ছিল। পরিকল্পনা মতাে আমরা আশ্রয় নিই ত্রিমােহনী স্কুলে। আমি আর মান্নান কাছেই এক আত্মীয়ের বাড়িতে খেতে যাই। এমন সময় খবর আসে পাকফৌজ আসছে। পাকফৌজ আসার সংকেত পেয়ে স্কুলে অবস্থানরত সবাই আমাদের ছেড়ে পালিয়ে যায়। আমরা স্কুলে এসে তাদের না পেয়ে কাওরাইদ চলে আসি। আওয়ামী লীগের হাছেন মৃধা কাওরাইদের অবসরপ্রাপ্ত আর্মি এবং সর্বস্তরের জনগণ নিয়ে একটি গ্রুপ সংগঠিত করেছিলেন। আমরা সে গ্রুপে যােগ দিই। আমাদের ট্রেনিং করাতেন। অবসরপ্রাপ্ত আর্মি আলী আহমদ ও হােসেন আলী। বর্তমানে দুজনেই মৃত। তখন আমাদের কাজ ছিল চোর, ডাকাত, দুবৃত্তদের অরাজক পরিস্থিতি সামাল দেয়া এবং আড়াল থেকে ফায়ার করে পাকসৈন্যদের প্রতিরােধ জানান দেয়া। কাওরাইদ স্টেশনে আমার ভাইদের একটি চায়ের স্টল ছিল। পাকসৈন্যদের ভয়ে তারা স্টল বন্ধ করে দেয়। আমি স্টল চালু করি। পুরান ঢাকায় থাকার সময় আমি উর্দ বলতে শিখি। উর্দু জানার কারণে আমি স্টল খুলতে সাহস পাই। রাতে অস্ত্র চালনা শিখি। দিনে স্টল খুলে বসি। উদ্দেশ্য পাকফৌজের কার্যক্রম পর্যবেক্ষণ করা। উর্দু বলতে পারার কারণে ওরা আমার সাথে ঘনিষ্ঠ হয়। ওরা আমাকে জিজ্ঞেস করতে পাকিস্তান চিনি কি না। আমি বলতাম যে পাকিস্তান তাে আমার দেশ। আমার পরিচয় দিই। আমার বাবা বিহারি। মারা গেছে। মা বাঙালি। এ কারণেই এখানে থাকা। জিজ্ঞেস করতাে দিল্লি চিনি কি না। বলে দিতাম দিল্লিই তাে আমার দাদার বাড়ি। হায়েনারা মাঝে মাঝে আমার কাছে মুক্তিবাহিনীর সম্পর্কে জানতে চাইতাে। মুক্তি দেখেছি কি না এইসব। আমি বলতাম মুক্তি তাে ইয়া লম্বা। বড় বড় অস্ত্র তাদের। সাহস খুব বেশি। ওরা কিছু বলতাে না। চুপ করে থাকতাে। মনে হতাে কিছু চিন্তা করছে। ওদের সাথে সব কথা হতাে উর্দুতে।

সারা দিন পাকসেনারা গ্রামে গ্রামে ঢুকতাে। মানুষের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিতাে। যাকে ইচ্ছে হতাে মেরে ফেলতাে। অনেককে আবার মেরে ফেলার আগে নানা ধরনের নির্যাতন চালাতাে। ভয়ে লােক ত্রিসীমানায় কেউ আসতাে না। কিন্তু জীবিকার তাগিদে মানুষকে বাইরে বের হতে হতাে। একদিন রেললাইনের ধার থেকে ওরা এক মরিচ বিক্রেতাকে ধরে নিয়ে এলাে। লােকটির মাথায় ছিল ধামাভর্তি পাকা মরিচ। মরিচগুলাে ছিল পরিপুষ্ট আর টকটকে লাল। সৈন্যরা এ দেশের কোনাে ফল মনে করে মরিচের ধামা রেখে দিলাে। কী ভেবে ছেড়ে দিলাে লােকটিকে। সৈন্যরা খুশির চোটে মুঠো ভর্তি মরিচ মুখে পুরে চিবােতে লাগলাে। আমি তাকিয়ে আছি। কিন্তু খেতে বারণ করতে সাহস পাচ্ছি না। আমাকে আবার কী ভেবে বসে। মুহুর্তে সৈন্যদের মুখ লাল হয়ে উঠলাে। সঙ্গে সঙ্গে রেগে আগুন হয়ে চিৎকার করে আমাকে বলতে লাগলাে, হারামি বাচ্চা কো পাকাড়কে লে আও। আমি দৌড়ে স্টেশন। থেকে বের হয়ে পড়ি। সত্যি সত্যিই লােকটিকে খুঁজতে থাকি। ধরা পড়লে লােকটির যে নিশ্চিত মৃত্যু সে তাে আমার অজানা নয়। আমার উদ্দেশ্য লােকটিকে দ্রুত কাওরাইদ ছেড়ে যেতে বলা। ভাগ্যক্রমে লােকটিকে বাজারের কাছে পেয়ে যাই এবং ঘটনা বলি। ফিরে এসে হায়েনাদের বলি ‘ইধার নেই হ্যায়। বহুত দুশমন।’ আর একদিন কাঁঠাল খাওয়া নিয়ে এমনি এক বিপত্তি ঘটালাে। পাকা কাঁঠালের গন্ধে বেহুঁশ মতন পাকসেনারা রেলগাড়ি থেকে কাঁঠাল নামিয়ে এনে স্টেশনে জমা করলাে। সৈন্যদের দলে কয়েকজন পাঞ্জাবি মেজরও ছিল। কাঁঠাল খাওয়া শুরু করলে গোঁফে লেগে যায় আঠা। আঠা ছাড়াবার কৌশল ওদের জানা ছিল না। আঠা ছাড়াতে ব্যর্থ। হয়ে অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করতে লাগলাে বাঙালিদের। স্টলে বসে পাকিস্তানি সৈন্যদের এমন সব ঘটনা আমি প্রত্যক্ষ করি। এরপর কিছুদিনের মধ্যেই অত্র অঞ্চলে রাজাকার বাহিনী গঠিত হয় এবং তাদের কার্যক্রম শুরু হয়ে যায়। রাজাকাররা আমাকে চিনে ফেলে। একদিন এক রাজাকার কমান্ডার চা খেতে স্টলে আসে। আমাকে দেখে সে প্রচণ্ড রেগে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গে চড় বসায় গালে। চড় এতটাই জোরে ছিল যে আমার মনে হচ্ছিল যেন সমস্ত স্টেশন আমার সামনে ঘুরছে। তখনই আমি স্টেশন ছেড়ে পালাই। পালিয়ে এসে মুক্তিবাহিনীর সার্বক্ষণিক কার্যক্রমের সাথে যুক্ত হই। মুক্তিবাহিনী তখন রাজাকার নিধন, ছােট ছােট ব্রিজ, কালভার্ট উড়িয়ে দিয়ে পাঞ্জাবিদের চলাচল বিঘ্নিত করা এবং মাঝে মাঝে ফায়ার করে পাকসেনাদের ব্যতিব্যস্ত রাখার কাজে ব্যস্ত ছিল। দিন-তারিখ মনে নেই। একদিন সাতখামার থেকে চৌদ্দজন রাজাকার ধরে নিয়ে আসি। এদের চারজনকে ছেড়ে দেয়া হলাে। এরা ছিল রেলের স্টাফ। বাকিদের হত্যা করা হলাে। এরপর বর্তমান শহীদনগর জায়গাটায় নদীর ওপর ছােট একটি ব্রিজ ছিল। ব্রিজটি ধ্বংস করার জন্য আমরা সেখানে মাইন বসাই। কিন্তু মাইনটি সময়মতাে বিস্ফোরণ হচ্ছিল না। শহীদ নামে মুক্তিবাহিনীর একটি ছেলে ছিল। সে ছিল স্থানীয় । কাছেই তার বাড়ি। বয়স ছিল কম। বিশ-বাইশ। শহীদ মাইনটি পরীক্ষা করতে গেলে সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণ ঘটে। শহীদের দেহ ক্ষতবিক্ষত হয়ে চতুর্দিকে ছড়িয়ে পড়ে। বড় মর্মান্তিক সে দৃশ্য। শহীদের নাম স্মরণীয় রাখতে বর্তমানে স্থানটির নাম রাখা হয়েছে। শহীদনগর। নির্মাণ করা হয়েছে স্মৃতিসৌধ।
এ ঘটনার পর আমি পাকসেনাদের হাতে হঠাৎ ধরা পড়ে যাই। গােলাঘাট নদীর তীরে ওরা আমাকে আটক করে ফেলে। পেছন দিয়ে দুই পাক সৈন্য নিঃশব্দে আসে। আমি টের পাইনি। তখন ছিল সকাল। দাঁত মাজতে মাজতে মাত্র জলের কাছে দাঁড়িয়েছি। আমাকে চিনিয়ে দিয়েছিল দুই মুসলিম লিগার । পাকসেনারা তাদের কাছে একজন বাবুর্চি চেয়েছিল। তারা জানতাে আমি বাবুর্চির কাজ শিখেছি। তৎক্ষণাৎ গাড়িতে তুলে আমাকে নিয়ে এলাে কাপাসিয়া ক্যাম্পে। ক্যাম্পে এসে আমি সবসময় উর্দু বলতাম। পরিচয় ছিল বিহারি। ওদের পছন্দমতাে রুটি তৈরি করে দিতাম। ওরা আমাকে বিহারি ভাবলেও নজর রাখতে কড়া। পালাবার চেষ্টা করতাম। কোনাে সুযােগ ছিল না। মাঝে মাঝে আমাকে বাজারে পাঠাতাে। বাজারে একদিন হঠাৎ কাপাসিয়ার প্লাটুন কমান্ডার আনােয়ার হােসেনের সাথে দেখা হয়। হাবা গােবা আধাপাগল সেজে তিনি রেকির কাজ করছিলেন। আমার সাহায্যে তিনি ক্যাম্পে অবস্থান করেন এবং পাকসেনাদের যাবতীয় তথ্য সংগ্রহ করেন। আমি তাকে সর্বতােভাবে সাহায্য করি। এটা সম্ভব হয়েছিল আমার উর্দু ব্যবহারের কারণে। এ কারণে ওরা আমাকে বিশ্বাস করতাে। আনােয়ার হােসেনের রেকি শেষ হলে আমরা ক্যাম্প ছেড়ে পালিয়ে আসি। কীভাবে পালিয়ে আসতে সক্ষম হই তার বর্ণনা চলে না। শুধু সম্ভব হয়েছিল আমাদের প্রচণ্ড সাহস আর দেশকে ভালােবাসার কারণে।

কাওরাইদে আমাকে দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়। ধরে নিয়েছিল নির্ঘাত আমার মৃত্যু ঘটেছে। কাওরাইদ ফেরার কয়েকদিন পর মান্নানসহ আমাকে আরও কয়েকজনের সাথে টঙ্গী পাঠানাে হয়। অস্ত্র সংগ্রহ ও আওয়ামী লীগ নেতাদের সাথে যােগাযােগ করতে। আওয়ামী লীগের মেম্বার হাছেন মৃধা আমাদের সেখানে পাঠান। হাছেন মৃধা তখন কাওরাইদে মুক্তিযুদ্ধের সার্বিক দায়িত্ব পালন করছিলেন। পাউরুটির ভেতরে আমরা তিনটি গ্রেনেড নিয়ে যাই। উদ্দেশ্য ধরা পড়লে যেন আত্মহত্যা করতে পারি। আমাদের মাথায় তখন খুন চেপেছিল যে কীভাবে হায়েনাদের নাগাল পাবাে এবং শেষ করে দেবাে। এ নিয়ে আমরা নানা পরিকল্পনা করতাম। টঙ্গীতে লােকের মুখে শুনলাম টঙ্গীতে অবস্থানরত পাকফৌজ নারী দেখলে উন্মাদ হয়ে ওঠে। মান্নান বললাে সে নারী সেজেই কজা করবে। আগেই বলেছি যে মান্নান ছিল অসম্ভব সাহসী। পরিকল্পনা মতাে আমরা টঙ্গী ব্রিজ এলাকায় পেট্রল পাম্পের কাছে চলে আসি। আমাদের কাছে খবর ছিল সৈন্যরা চব্বিশ ঘণ্টাই এ পথে চলাচল করে। পেট্রল পাম্পের ওদিকটায় ছিল তখন বেশ ঘন জঙ্গল। লােকজন সেখানে মলমূত্র ত্যাগের কাজ করতাে। মান্নান শাড়ি পরে ঘােমটা টেনে পেট্রল পাম্পের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। আমরা মান্নানকে সহযােগিতার জন্য ওই জঙ্গলে গিয়ে লুকিয়ে থাকি। তখন মধ্যরাত। কিছুক্ষণের মধ্যে দেখা গেলাে এক পাঞ্জাবি টলতে টলতে বিশ্রী অঙ্গভঙ্গি করতে করতে মান্নানের দিকে এগিয়ে আসছে। পাঞ্জাবির সঙ্গী ছিল এক বিহারি। কাছে আসামাত্র মান্নান পাঞ্জাবিকে ধরে ফেলে। আমরা পাঞ্জাবি ও সঙ্গী বিহারিকে জঙ্গলে নিয়ে আসি। মান্নান পাঞ্জাবিকে নিজেই হত্যা করে। আমরা হত্যা করি বিহারিটিকে। পাঞ্জাবিকে হত্যা করার সময় উত্তেজিত মান্নানের বাম হাতের কব্জি কেটে যায়। কবজি কাটা হাতটি মান্নানের অকেজো হয়ে যায় চিরদিনের। জন্য।
এই ঘটনার পর আমরা দ্রুত টঙ্গী ত্যাগ করি। অস্ত্র নিয়ে আসা সম্ভব হল না। ফেরার পথে সাতখামাইর স্টেশনে ঘটে গেলাে আর একটি ঘটনা। স্টেশনে গাড়ি থামলে দশ বারােজন পাকসেনা নেমে পড়ে। উদ্দেশ্য মুরগি। ধরবে। ট্রেন ছাড়লে সব সৈন্য উঠে পড়ে। কিন্তু দুজন সৈন্য দূরে থাকায় উঠতে পারেনি। ট্রেন ছেড়ে যায়। পাঞ্জাবি সৈন্য দুটো দৌড়াতে থাকে। আমরা লাফিয়ে পড়ে ওদের পেছনে ছুটতে থাকি। তখন মাঠে কৃষকরা কাজ করছিল। কৃষকরাও ধানকাটা কাস্তে হাতে আমাদের সাথে সৈন্যদের ধরতে দৌড়াতে শুরু করে। কৃষক ও আশপাশে থাকা লােকজনের সহযােগিতায় আমরা ওদের ধরে ফেলতে সক্ষম হই এবং কৃষকের হাতের কাস্তে দিয়ে। ওদের হত্যা করি। লাশ দুটো গ্রামের ভেতর নিয়ে গর্ত করে পুঁতে রাখি। যেন কোনােমতে পাঞ্জাবিরা টের না পায়। এছাড়া কাওরাইদে আমরা আরও দুজনকে হত্যা করি। এরা রাজাকার ছিল না। কিন্তু পাকবাহিনীকে সহযােগিতা করতাে।
পাঞ্জাবি সৈন্যরা ছিল ভয়ঙ্কর। নয় মাসের নৃশংসতা বলে বােঝানাে সম্ভব নয়। ওদের তৈরি রাজাকারদেরও ওরা ক্ষমা করতাে না। সামান্য ভুলত্রুটি হলেও শেষ করে দিতাে গুলি করে। কাওরাইদ বাজারে একদিন এক রাজাকারকে বললাে আমিরের বাড়ি চিনিয়ে দিতে। আমির অর্থ ওদের কাছে মস্ত বড়লােক। উদ্দেশ্য আমিরের বাড়িতে লুটতরাজ চালানাে। রাজাকারটি আমিরের অর্থ বুঝতে পারেনি। বাজারের কাছেই এক গরিব লােকের বাড়ি ছিল। তার নাম ছিল আমির। আমিরের বাড়ি ছিল ছনের তৈরি। রাজাকারটি উৎসাহ নিয়ে সেখানে নিয়ে যায় পাকসেনাদের। আমিরের ছনের বাড়ি দেখামাত্র সৈন্যরা প্রচণ্ড ক্ষেপে যায়। চিৎকার করে বলে ছনকা বনকা ঘর। অর্থাৎ এই ছনের ঘর কি আমিরের বাড়ি? রাজাকারটিকে S কথা বলার সুযােগ দেয়া হয় না। মুহূর্তে গুলি চালায় বুকে। এমন এক দানব বাহিনী ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। খুব কাছে থেকে আমি এদের দেখেছি। যা অনেকেই দেখেনি। দেখেছি বাঙালিদের প্রতি এই হায়েনাদের কী চরম ঘৃণা আর। প্রতিহিংসা। যুদ্ধের নয় মাসই এই দানবরা মানুষ হত্যা করেছে। বাড়িঘর জ্বালিয়ে, লুট করে নিঃস্ব করেছে মানুষকে। অগণিত মা-বােনের সম্ভ্রমহানি করেছে। যারা স্বাধীনতার যুদ্ধ দেখেনি তাদের পক্ষে এই অত্যাচারের ধারণা করা একেবারেই অসম্ভব।

নারায়ণ পাল
ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী
লক্ষ্মীখােলা, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

সম্ভবত এপ্রিল মাস। দিন-তারিখ আজ আর সঠিকভাবে মনে নেই। তবে পাকসেনারা যেদিন ঢাকা থেকে মুক্তাগাছা হয়ে ময়মনসিংহে ঢােকে সেদিন মুক্তাগাছা শহরে এক হৃদয় বিদারক দৃশ্যের অবতারণা হয়। সে দৃশ্য চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এর পুরাে বিবরণ দেওয়া সম্ভব নয়। বলে বােঝানাে যাবে না সেই ভয়ঙ্কর ত্রাস আর মর্মান্তিক যন্ত্রণার কথা। পাকসেনারা মুক্তাগাছা আসছে খবর পাওয়ামাত্র মানুষ যে যেভাবে ছিল সেই অবস্থাতেই দিগ্বিদিক ছুটতে শুরু করে। কেউ গ্রামে কেউ আবার পরিবারপরিজন নিয়ে পিয়ারপুরের নারায়ণখােলা হয়ে ভারত সীমান্তের দিকে চলে যায়। যেহেতু মানুষ পাকসেনাদের মানুষ হত্যার বীভৎস নারকীয় খবর পাচ্ছিল তাই এতটাই ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছিল যে কোথায় ছুটছে সেদিকে কারাে হৃক্ষেপ ছিল না। প্রাণের ভয়ে ছুটছে তাে ছুটছেই। পাকসেনারা মুক্তাগাছায় নেমে প্রচণ্ড গােলাগুলি করে। আর অগ্নিসংযােগ করে নির্বিচারে। তারপর শুরু হয় লুটতরাজ। মানুষ ছিল অপ্রস্তুত। কোনাে দ্রব্যসামগ্রী সঙ্গে নিতে পারেনি। মানুষের ফেলে যাওয়া সম্পদ লুষ্ঠিত হতে থাকে দিনরাত। মুক্তাগাছার ৩নং জমিদারবাড়ি লুট হয় তিন দিন ধরে। রাতে হ্যাজাক বাতি জ্বালিয়ে। লুটের ভয়ে ইদারায় ফেলে রাখা তাদের স্বর্ণালঙ্কার, সােনার প্রতিমা, প্রতিমা হাওয়া করার সােনার পাখা, রুপা ও ব্রোঞ্জের তৈজসপত্র সমস্ত তুলে নেয়া হয়। শােনা যায় লুটের পরে পাখাটি নাকি বটতলায় পাঁচ টাকায় বিক্রি করা হয়। জমিদার বকুল আচার্য চৌধুরী পরিবার-পরিজন নিয়ে ভেতরের গ্রাম মালতীপুরে তার প্রজার বাড়িতে আশ্রয় নেন। কিছুদিন পরে তাকে মালতীপুর থেকে ধরে এনে হত্যা করা হয়। মুক্তাগাছায় ঢােকার কিছুদিন পর পাকসেনারা আমাদের গ্রামে আসে। আমি তখন বাড়িতে ছিলাম না। আমাদের বর্গাচাষি কছি শেখের বাড়িতে ছিলাম। সেখানে আমাদের গহনা, জমি সংক্রান্ত কাগজপত্র, দামি বাসনপত্রসহ সমস্ত ফসল সেখানে রাখা ছিল। কছি শেখ যুদ্ধের পরে সেই সব কানা কড়ি পাই পর্যন্ত বুঝিয়ে দিয়েছে।
পাকসেনারা গ্রামে ঢুকে অগ্নিসংযােগ এবং লুটতরাজ শুরু করে দেয়। অগ্নিসংযােগে বাড়িগুলাে ভস্মীভূত হয়ে যায় দেখতে দেখতে। সেদিন আমাদের পাড়া থেকে তিনজনকে ধরে নিয়ে যায়। এরা পালাতে পারেননি। এদের মধ্যে আমার বাবা গজেন্দ্র চন্দ্র দাস, পাশের বাড়ির পরেশ চন্দ্র দাস, মুজাটী গ্রামে আশ্রিত রবি বৈরাগী। মুক্তাগাছা নিয়ে বর্তমান ফরেস্ট অফিসের সামনে গুলি করে হত্যা করে। বাবার লাশ আমরা নিতে পারিনি। স্থানীয় লােকজন শ্মশানে কবরস্থ করেছে। পােড়াবাড়ির লােকজন আমাদের বাড়ি এসে আশ্রয় নেয়। ইতােমধ্যে রাজাকার ও পাকসেনাদের তৎপরতা বেড়ে যায়। এ পর্যায়ে তারা বলে তােমাদের সব কটাকে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করতে হবে। ধর্মান্তরের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করে রাজাকার দানেশ ও খােড়াইল্যা মুন্সী। দুজনই বর্তমানে মৃত। ধর্মান্তরিত হওয়ার পর আমাদের পুরুষদের নামাজে যেতে হতাে। কলেমা বলতে হতাে। একদিন আমাকে ঈদগাহের বাজারে নিয়ে গেলাে। এক পোটলা গরুর মাংস কিনে দিয়ে বললাে রান্না করে সবাইকে খেতে। পোটলাটি আমি বর্গাচাষি হােসেন আলীর কাছে এনে দিই। হােসেন আলী সামলে নেয়। নিজেরা রান্না করে খেয়ে বলে ওরা খেয়েছে।
প্রফুল্ল সাহা নামে এক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী আমাদের এখানে এসে আশ্রয় নেয়। পাকসেনা মুক্তাগাছা ঢােকার দিন থেকে সে স্ত্রীর সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায় । তার স্ত্রী লােকজনের সাথে দৌড়াতে দৌড়াতে বর্ডারে চলে যায় এবং বর্ডার অতিক্রম করে ভারতে পৌছে। প্রফুল্ল সাহা আটকা পড়ে যান তিন মেয়েকে নিয়ে। আমার দুই বােনও তখন কিশােরী। বড় ভয়ঙ্কর দিন পার করতে হয়েছে সে সময়। অবশ্য মুক্তিবাহিনীর সঞ্চালন বেড়ে গেলে মা, ছােটভাই ও,বােনদের রমজান ও নারায়ণ নাথ নামে মুক্তিবাহিনীর দুই সদস্যের মাধ্যমে ভারতে পাঠিয়ে দিতে সক্ষম হই। সম্পদ রক্ষার প্রয়াসে আমি মাসিকে নিয়ে থেকে যাই দেশে। আকস্মাৎ একদিন রাজাকাররা আমাকে ধরে নিয়ে যায়। এক রাজাকারের বাড়িতে লিচুগাছের সাথে বেঁধে রেখে খেতে চলে যায়। তখন রাজাকারের বাবা খড়ম পায়ে খুট খুট করে বেরিয়ে আসে। আমাকে ওই অবস্থায় দেখে রেগে যায়। আশপাশে দাড়িয়ে থাকা ছেলে-ছােকরাদের বাঁধন খুলে দিতে বলে। আমাকে একটি টুল এনে দিতে বলে বিশ্রামের জন্য। আমি তখন অনুভূতিশূন্য। খােড়াইল্যার বাবা আমার জীবনদাতা। সে রাজাকারদের বললাে, “ছেড়ে দাও ওকে। আমি বলছি।’ রাজাকাররা আমাকে ছেড়ে দিলাে বটে, কিন্তু ওদের অত্যাচারের মাত্রা দিনদিন বেড়েই চললাে। কতদিন ভাত খেতে বসেছি, খবর এসেছে পাকসেনা আসছে। ভাতের থালা নিয়ে ছুটেছি বন-বাদারে । হয়তাে বা কোনাে হাজামজা জলাশয়ের পাড়ে বসে ভাত খেয়ে পানার জলে হাত ধুয়ে, থালা ধুয়ে সেই সন্ধ্যা শেষে বাড়ি ফেরা। এমনি অবিচার, অত্যাচারের মধ্য দিয়ে কাটে মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস। ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করি- একাত্তরের সেই নয় মাসের দিনগুলাে যেন কোনাে মানুষের জীবনে না আসে।

ফাতেমা আজিজ গৃহিণী, ধামলই, কাওরাইদ,
শ্রীপুর, গাজীপুর।

একটি অন্ধকারকে ঘিরে হাজারাে গল্প, কাহিনী ও কবিতার ইন্দ্রজাল রচিত হলেও তার তাৎপর্য ও ব্যাপকতার অনেকটুকু বাকি থেকে যায়। জানি না কতটুকু বাকি থেকে যায়। জানি না কতটুকুই বা গুছিয়ে বলে বােঝাতে পারবাে। সে অনুভব একান্তই আমার নিজের। ভুক্তভােগী ছাড়া কেউ বুঝবে না এ যাতনা, ব্যথা-বেদনা কতটা অতলস্পর্শী। আমার প্রিয় জন্মস্থান পুরাতন ঢাকা। বড় হই সেখানেই। গ্রামীণ পরিবেশে অভ্যস্ত নই। কিন্তু ভাগ্যের নির্মমতা আমাকে নিয়ে আসে এক অজপাড়াগাঁয়ে। অন্য পাঁচটি মেয়ের মতাে আমকেও বেনারসি পরে আসতে হয়েছে স্বামীর গৃহে। তকালীন ঢাকা বর্তমানে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলাধীন কাওরাইদ ইউনিয়নের ধামলই গ্রামের পালােয়ান বাড়িতে। গ্রামীণ জীবনের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে চলতে আসে ১৯৭১ সাল। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে অঘােষিত যুদ্ধ শুরু করে তার প্রথম শিকার ঢাকাবাসী। সে যুদ্ধ চলে নয় মাস। বাঙালির জাতীয় জীবনে সবচেয়ে বড় ক্ষত। ভয়ঙ্কর সেই নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি কোনাে একটি অঞ্চল, কোনাে একজন। বাঙালি।
২৬ মার্চের ভােরবেলা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে ঢাকা ম্যাসাকারের ঘটনা। আমাদেরও কানে আসে ঢাকার হিংস্র হামলার কথা। আমার বাবা, মা, ভাই ও বােনসহ নিকটাত্মীয়দের অনেকে পুরান ঢাকায়। স্বামী নতুনচাকরি নিয়ে নরসিংদীতে যােগদান করেছেন। আমি তখন শ্বশুর-শাশুড়ির সঙ্গে ধামলই গ্রামে। সারাক্ষণ আমার অজানা আশঙ্কায় দিন কাটে। স্বামী, বাবা, মা কারাে খবর নেবার সুযােগ নেই। নানাদিক থেকে আসতে থাকে নানা অশুভ খবর। ২৬ মার্চ সারা দিন তাে অস্থিরতায় কাটলাে। তারপরও কয়েকদিন একই অস্থিরতায় কাটে। বেতার যন্ত্র ছাড়া অন্য কোনাে মাধ্যম নেই খবর জানার। দিন কাটতে থাকে। স্বজনরা বেঁচে আছেন কি নেই দুশ্চিন্তায় প্রায় অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়ি। চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে হানাদারদের বর্বর কর্মকাণ্ডের ঘৃণিত সব চিত্রের কাহিনী। লােকমুখে শুনতে পাই ঢাকার বুড়িগঙ্গায় হাজারাে বাঙালির লাশ ভেসে যাচ্ছে। সেই মুহুর্তের কথা বলে বা লিখে বােঝানাে যাবে না। কারণ, আমার পুরাে পরিবার ছিল পুরান ঢাকায়। বুড়িগঙ্গা রক্তে লাল। ঢাকায় খুব কমসংখ্যক লােক জীবিত ইত্যাদি খবর আসছিল প্রায় প্রতিদিন। এরই মাঝে একদিন শুনতে পেলাম ভৈরব ও নরসিংদী এলাকায় হানাদারদের হামলার কথা। আগেই বলেছি, অনুভূতিশূন্য হয়ে পড়েছিলাম। এবার পাথর হয়ে গেলাম। মাথা কোনাে কাজ করছে না। কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা কী করবাে। স্বামীর পথপানে চেয়ে কাটে দিনরাত। জানি না বেঁচে আছেন কি না। আর দেখা হবে কি না। এমনি হাজারাে ভাবনার মাঝে একদিন উঠোনে আমার স্বামীর গলা। শ্বশুর দরজা খুলে ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন, ‘বাবা বেঁচে আছিস তুই? আমরা ভেবেছিলাম’- আর বলতে পারলেন না। হঠাৎ তাকিয়ে দেখি হাত থেকে কনুই পর্যন্ত কাপড়ে বাঁধা। রাতের অন্ধকারে লুকিয়ে বাড়িতে আসতে গিয়ে খেজুর গাছের সাথে ধাক্কা। লেগে নদীতে পড়ে যান। কনুই থেকে হাত পর্যন্ত খেজুর কাটায় কেটে যায়। রক্ত বন্ধ করতে গায়ের জামা ছিড়ে ক্ষতস্থান বেঁধে রাখেন। আমার স্বামী আবদুল আজিজ মৃধা। তিনি ছিলেন শ্রীপুর থানার কাওরাইদ ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক। ভৈরব থেকে পালিয়ে এসে তিনি শ্রীপুর থানার কাওরাইদ ইউনিয়নের পশ্চিমাঞ্চলের সংগ্রাম কমিটির আহ্বায়ক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। উনার সহযােগীরা ছিলেন গিয়াস উদ্দিন মৃধা ও আরও অনেকে। আমার স্বামী ফিরে আসার কয়েকদিন পর একদিন দুপুরে মুক্তিসেনারা ভাত খাবে। রান্না হচ্ছে এমন সময় হঠাৎ খবর এলাে কাওরাইদ বাজারে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যে ক্যাম্প করেছে সেখান থেকে পশ্চিম দিকে এগােতে শুরু করেছে। এ সংবাদ পেয়ে সবাই দিশেহারা পয়ে পড়েন। গ্রামের সকল লােকজন পুরুষ-মহিলা, শিশু ও বৃদ্ধ ছুটে চলে নদীর পাড়ে, গভীর বনের ধারে। সবার সাথে আমরাও ছুটতে থাকি। জ্বলন্ত চুলাে ও ভাত ওভাবেই পড়ে খাকে। ঘরগুলােতে যে যে অবস্থায় ছিলাম সেই অবস্থায় বের হয়ে যাই। আমি খালি পায়ে হাঁটতে পারছিলাম না। তাই খড়ম পায়ে হাঁটতে থাকি। কিন্তু খড়ম পায়ে হাঁটতে গিয়ে ক্ষেতের আলে হুমড়ি খেয়ে পড়ায় পায়ে ব্যথা পেয়ে পেছনে পড়ে যাই। আবার উঠে ছুটে চলি অন্যদের পেছনে পেছনে। অনেক দূরে এক জঙ্গলে বসে অনেকেই মােনাজাত করতে থাকে। ভয়ে কান্নাকাটি শুরু করে অনেকেই। ওপরওয়ালাকে ডাকতে থাকে সবাই। কান্নারত শিশুদের মুখে আঁচল গুঁজে দেন মায়েরা। সন্ধ্যার দিকে খবর আসে শক্রসেনারা চলে গেছে। আজ আর আসার সম্ভাবনা নেই। সবাই আপাতত স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে যে যার বাড়ির পথে পা বাড়ায়। তার কয়েকদিন পরের কথা- বাড়ির একটু সামনেই খিরু নদী। নদীর ওপারেই গলদাপাড়া গ্রাম। ঘন সবুজ গজারি ও অন্যান্য গাছপালায় ঘেরা সে গ্রাম। গভীর জঙ্গলের একটু দূরে সরু পথের মাথায় ছােট্ট একটা বাড়ি। বাড়ির মালিক আমার শ্বশুরের বর্গাচাষি। ওখানে আমাকে প্রায় দুই মাস লুকিয়ে অবস্থান করতে হয়। কখনাে খেয়ে না খেয়ে অর্ধাহারে দিন কাটাই। আমার স্বামী মাঝে মাঝে আসতেন। অল্পক্ষণ থেকে চলে যেতেন। কারণ উনার আসাটা আমার জন্য মােটেই নিরাপদ ছিল না। আমার শ্বশুর পাশের একটি ঘরে থাকতেন। আমার শ্বশুরের জন্য খাবার নিয়ে গেলেও সব সময় আমার খাবার পাঠানাে সম্ভব হতাে না। আমার শাশুড়ি অন্য আর এক বাড়িতে থাকতেন। হানাদার বাহিনী আসার খবর পেলে বাকিদের নিয়ে লুকিয়ে থাকতেন। আমার চাচি শাশুড়ি ও অন্যান্য যারা ঐ বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলেন, তারা আমাকে মাঝে মাঝে খাবার পরিবেশন করতেন। যে বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছিলাম তারাও আমাকে নানাভাবে সহযােগিতা করেছেন।
প্রায় দুই মাস পর বাড়ি ফিরলাম । ঢাকা থেকে বহু কষ্টে প্রাণ হাতে করে বাবা আমাকে নিতে এলেন। কিন্তু বিভিন্ন কারণে আমার যাওয়া হলাে না। চাচাতাে ননদ ও নিজের ননদদের সাথে মিলেমিশে বিভিন্ন জায়গায় নিরাপদ স্থানে থাকতে লাগলাম। আমরা সবাই তখন যুবতী, কিশােরী। মেয়েরা তখন দেশের অভিশাপ। দেশের কোথাও এরা নিরাপদ নয়। মনে হতাে হানাদার বাহিনীর হিংস্র থাবা থেকে আর বুঝি তাদের রক্ষা করা যাবে না। এমনি অনিশ্চয়তার ও দুশ্চিন্তার মাঝে কেটে গেলাে নয়টি মাস। সে যন্ত্রণামথিত দিনগুলাে শুধু ভুক্তভােগীর। অন্য কারাে নয়।

নিয়তি রানী দাস
গৃহিণী,কুমারটেক,
কাপাসিয়া, গাজীপুর।

আমার বাবার বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া উপজেলার দস্যু নারায়ণপুর গ্রামে। এ গ্রামেই আমার জন্ম। স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমি বাবা-মা ও পরিবারের সাথে এই নারায়ণপুর গাঁয়েই ছিলাম। তখন আমার বয়স তেমন ছিল না। তখনাে ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরিনি। সে বছর শুনছিলাম দেশে গণ্ডগােল হবে। কীসের গণ্ডগােল হবে, গণ্ডগােল হলে কী হবে সেসব তখন কিছুই বুঝিনি। তবে দেখছিলাম গাড়ি, দোকনপাট মাঝে মাঝে বন্ধ থাকছে। ছাত্ররা স্কুলে যাচ্ছে না। এই গ্রামের ভেতরেও সভা-মিছিল ইত্যাদি হচ্ছিল। এভাবে চলতে চলতে হঠাৎ একদিন চৈত্র মাসের সকালবেলা শুনতে পেলাম ঢাকায় যুদ্ধ বেধেছে। লােকজনের মুখে মুখে আলােচনা হচ্ছে। বড়দের সবার মুখ শুকনাে। পরদিন থেকে লােকজন ঢাকা থেকে পালিয়ে পায়ে হেঁটে আমাদের গ্রামে আসতে শুরু করেছে। তাদের মুখে ঢাকার যুদ্ধের ভয়াবহ বর্ণনা শুনতে পাই। দারুণ আতঙ্কের ভেতর দিন কাটাতে শুরু করে গ্রামের লােকজন। কয়েকদিনের মধ্যে আমাদের গ্রামের রাস্তা দিয়ে পাকিস্তানি বাহিনী কাপাসিয়ায় ঢােকে। এরপর এই রাস্তায় ওরা চলাচল শুরু করলে সারা দিন গ্রামের মানুষ বাড়ি ছেড়ে দূরে শালবনের গভীর জঙ্গলে লুকিয়ে থাকতাে। আমরাও থাকতাম তাদের সাথে। দিনে গজারি বনে লুকিয়ে থাকি। গজারি। বন তখন খুব গহিন ছিল। ছােট বাচ্চা ছাড়া কারাে খাওয়া-দাওয়া ছিল না। ভয়ে জড়সড় হয়ে দিন-রাত কাটিয়ে দিতাম। সারা ক্ষণ এক আতঙ্ক ছিল, এই বুঝি হানাদার বাহিনী এলাে। মেয়েদের সব ধরে নিয়ে যাবে আর পুরুষদের মেরে ফেলবে এমনই আলােচনা সবার মাঝে ছিল। সন্ধ্যার পর ফিরে আসতাম গাঁয়ের সাবরুল্লার বাড়িতে। যতদিন আমরা দেশে ছিলাম এই সাবরুল্লাই আমাদের তার বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিল। আষাঢ় মাসের ১৫ তারিখ পাঞ্জাবিরা আমাদের বাড়িতে আগুন লাগিয়ে দেয়। আমরা শুনেছি রাজাকাররা বাড়ি চিনিয়ে দিয়েছিল। সাবরুল্লা মিস্ত্রি দৌড়ে গিয়ে জঙ্গলের ভেতরে আমাদের খবর দেয়। ঠাকুরমা ছুটে বাড়ির আগুন নেভাতে যায়। পথে ঠাকুরমাকে রাজাকাররা প্রচণ্ড মারধর করে। ঠাকুরমা জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। এক সপ্তাহ আগে নাথবাড়ি পুড়িয়ে দেয়া হয়। সেদিন শীতলক্ষ্যা নদীর পাড় থেকে একজনকে ধরে ফেলে। তারপর তাকে বস্তায় ভরে শীতলক্ষ্যাতে ছুড়ে ফেলে দেয়। ওই অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। কেউ কোনােদিন তার লাশের সন্ধান পায়নি। তার বৌ তখন আঁতুড়ঘরে। কয়েকদিন আগে ছেলেসন্তানের জন্ম দিয়েছে। বাড়ি পােড়ানাের পর বাবা দেশে থাকার আশা ত্যাগ করে ভারতে চলে যান আমাদের নিয়ে। কিছু পায়ে হেঁটে, কিছুটা নৌকায় করে দেশের সীমানা ছেড়ে যাই। দালালরা গােপন পথ দিয়ে আমাদের ভারত পৌছে দেয়। যেতে সময় লেগেছিল ছয়দিন। পথে কী কষ্ট! তবু তাে নিজেকে বাঁচাতে পেরেছি। এ ছয়দিনে আমরা ভাত চোখে দেখিনি। ভাত তাে খাই-ই নি, মনে পড়ে একদিন শুধু হাতের মুঠোর এক মুঠ চিড়া খেয়েছিলাম। এত বছর পরে আজ অনেক স্মৃতি ঝাপসা হয়ে এসেছে। কিন্তু মুছে যায়নি। সে সব ভয়ঙ্কর স্মৃতি মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত মুছে যাবার নয় ।

রঞ্জিত চন্দ্র বর্মন

ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী
ইছর, গাছা ইউনিয়ন, গাজীপুর।

একাত্তর সালে বছরের শুরু থেকেই আন্দোলন-সংগ্রাম চলছিল বেশ জোরেশােরে। আমার বয়স সে সময় চৌদ্দ কি পনের বছর। আমি তখন একটা মিষ্টির দোকানে কাজ করি। মার্চের মাঝামাঝি সময়ে লােকে বলাবলি করছিল মুজিব-ইয়াহিয়ার বৈঠক চলছে। সবকিছুর মীমাংসা হবে। এরই মধ্যে হঠাৎ ২৫ মার্চ মাঝরাতে গুলির আওয়াজ হতে থাকে। ক্যান্টনমেন্টে গুলির শব্দ। শব্দে সবার ঘুম ভেঙে যায়। গুলির শব্দে কানপাতা যাচ্ছিল না। বাইরে এসে দেখি আগুনের গােলা ওপরের দিকে উঠছে। কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্ট থেকে যে গুলি ছুড়ছিল সেই আলাে আমরা দেখতে পাচ্ছিলাম। সে রাতে কেউ ঘুমােতে গেলাে না। পরদিন সকালে জানতে পারি পশ্চিম পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। সবাই আতঙ্কিত হয়ে পড়লাে। আমার আতঙ্কটা ছিল সবার চাইতে অন্যরকম। যে আতঙ্কের বর্ণনা চলে না। শুধু দু’চারটি কথা এখানে উল্লেখ করছি। ‘৬৪ সালে আইয়ুব খানের শাসনামলে এ অঞ্চলে একটি ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা সংঘটিত হয়েছিল। অত্র এলাকার মানুষের কাছে সে দাঙ্গা কাটাকাটি রায়ট হিসেবে পরিচিত। কয়েকদিনব্যাপী এ দাঙ্গায় কয়েক হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল। পুরাে এলাকা অর্থাৎ কতগুলাে গ্রাম জুড়ে চলছিল লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ ও হত্যা। রক্তে তুরাগের জল লাল হয়ে গিয়েছিল। তখন আমি ছােট। বাবা-মার সাথে কাশিমপুর আত্মীয়ের বাড়ি আশ্রয় নিতে যাচ্ছিলাম। আমার পরিবারের অন্যরা পালিয়ে গিয়েছিল অন্য দিকে। বাবা ছিল অসুস্থ। অন্তঃসত্ত্বা ছিল আমার মা। আমরা নদীর পাড় ধরে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একদল লােক রামদা, ফালা, কিরিচ ইত্যাদি সহকারে বিকট ধ্বনি দিতে দিতে কাশিমপুরের দিকে এগােতে থাকে। মা-বাবা বুঝতে পারলাে কিন্তু পালাতে পারলাে না। আর মা অন্তঃসত্ত্বা থাকায় তাদের পক্ষে পালানাের চেষ্টা করাও সম্ভব হলাে না। ওরা আমাদের তিনজনকে এক পর্যায়ে ধরে ফেললাে। টেনেহিঁচড়ে আমাদের একটা সর্ষে ক্ষেতে বসিয়ে দিলাে। কিছুক্ষণ পর লাঠির আঘাতে আঘাতে মেরে ফেললাে বাবাকে। তারপর ওই দলটি কাশিমপুরের দিকে চলে গেলাে। মা আমাকে বুকে করে মৃত মানুষের মতাে পড়ে রইলাে সর্ষে ক্ষেতে। তার উঠে দাঁড়াবার শক্তি ও সাহস কোনােটাই ছিল না। বিকেলের দিকে অন্য একটি দল এসে মাকে তুলে নিয়ে গেলাে সর্ষে ক্ষেত থেকে। নদীর তীরে জলের কাছাকাছি নিয়ে মার পেটে ছুরি বসালাে। বাচ্চাসহ দু’টুকরাে করে ফেললাে মায়ের পেট। আজকের আমি সেদিন সাত বছর বয়সী শিশু। কোনাে দল আমাকে স্পর্শ করলাে না। সেই কালিমাখা সন্ধ্যায় তুরাগ নদী পার হয়ে কীভাবে নিজের গ্রামে ফিরে আসি সে কথা আজ। আর বলতে পারবাে না। তবে এসে আমি একটি মুসলিম বাড়িতে আশ্রয়। নিই। এই হত্যাকাণ্ডে এলাকার কোনাে লােক জড়িত ছিল না। ছিল টঙ্গী কারখানার নােয়াখালী থেকে আসা শ্রমিক। তাদের সাথে ছিল বিহারি । দাঙ্গা থেমে গেলাে। বড়ভাই দশরথ দাদা এসে আমাকে সেই বাড়ি থেকে আমাদের আগুনে পুড়ে অঙ্গার হয়ে যাওয়া বাবা-মা শূন্য বাড়িতে নিয়ে যায়। তাই ২৫ মার্চের রাতে কুর্মিটোলা ক্যান্টনমেন্টে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ছােড়া বন্দুকের। আগুনের গােলা দেখে চৌষট্টির দুঃসহ স্মৃতি আমার মনে ভেসে ওঠে। আমি ভয়ে প্রায় অজ্ঞান হয়ে পড়ি।

২৫ মার্চের রাতের পর থেকে আমরা সমস্ত গ্রামবাসী আতঙ্কে দিন কাটাতে থাকি। লােকের মুখে পাক সেনাদের নির্যাতনের কাহিনী জানতে পারছিলাম। ক্যান্টনমেন্ট এরিয়ার অনেক লােক আমাদের গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিল। যাদের আত্মীয় ছিল তারা রইলাে এদের বাড়িতে। অন্যরা রইলাে গ্রামের স্কুলঘরে। আজ আর তারিখ মনে নেই। তবে ২৫ মার্চের কয়েকদিন পরে হঠাৎ এক ভােরে পাকসেনা ঢােকে ইছর গ্রামে। ইছরে পাকসেনারা আসে পায়ে হেঁটে। তখন এ অঞ্চলে গাড়ি চলাচলের উপযােগী কোনাে রাস্তাঘাট ছিল না। শেষ রাতে আমি গুটিয়ারহাটে বড়ভাইয়ের সাথে জাল বাইতে গিয়েছিলাম। গুলির শব্দ শুনে বড়ভাই জালটানা বন্ধ করে। কোথায় গুলিহলাে আঁচ করতে থাকে। পাকসেনা এলে দৌড়ে পালাতে হবে এরকম চিন্তা তখন সবার মাথায় থাকতাে। কোনদিকে পালাবাে আমরা ভাবছিলাম। ইতােমধ্যে পিঁপড়ের মতাে লােকজন নদীর ঘাটে জমা হচ্ছিল। তারা আমাদের নদী পার করে দিতে কাকুতি-মিনতি করতে লাগলাে। আমরা তখন জীবন বাঁচাতে ব্যস্ত হয়ে উঠেছি। পালাবাে, ঠিক এই মুহূর্তে দুজন এলাকার লােক এসে বন্দুক তাক করে বললাে- এদের পার করাে না হলে তােমাদের মেরে ফেলবাে। অসহায় হয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করে পার করে দিলাম লােকজন। এদিকে সারা দিন ধরে গ্রামে চলল লুটতরাজ, অগ্নিসংযােগ। যারা ধরা পড়লাে তাদের মেরে ফেললাে । যারা পালাতে পেরেছিল আটদশদিন পর ঘরে ফিরলাে তারা। পাকিস্তানি সৈন্যরা নয়মাসে আর আসেনি ইছর গ্রামে। তবে লুটতরাজ ঘটেই যাচ্ছিল। তুরাগ নদীতে প্রতিদিনই ভাসছিল নরনারী, শিশুর লাশ। খাবারের স্বল্পতায় অতিকষ্টে দিন যাপন করতে হচ্ছিল। টাকা-পয়সা ছিল না কারাে হাতে। ব্যবসা, বাণিজ্য উৎপাদন সব ছিল বন্ধ। তদুপরি ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের নৃশংস নির্যাতনের আতঙ্ক। সবাই আমরা ছিলাম জীবন্মৃত। এভাবেই কেটেছে আমাদের স্বাধীনতাযুদ্ধের ভয়ঙ্কর দিনগুলাে।

পরিতােষ মজুমদার
সহকারী বিশেষজ্ঞ
কারু ও কারুকলা বিভাগ (ন্যাপ)

ময়মনসিংহ।

‘৭১ সাল। আমাদের মহান স্বাধীনতার যুদ্ধ। আমি তখন পঞ্চম শ্রেণির ছাত্র। কিন্তু যুদ্ধকালীন কোনাে স্মৃতি আমার বিনষ্ট হয়নি। দীর্ঘ বিয়াল্লিশ বছর পরে সে স্মৃতি কিছুটা ম্লান হয়েছে কিন্তু মুছে যায়নি। সে সময় বছরের শুরু থেকে দেশ ছিল জনজোয়ারে উন্মাতাল। সে জোয়ারের ঢেউ এসে লেগেছিল এই প্রত্যন্ত অঞ্চলেও। আমাদের বাগেরহাটের কচুয়া অঞ্চলেও চলছিল হরতাল, মিটিং, মিছিল, শ্লোগান। এসবের মধ্যে একদিন আসে ২৫ মার্চ। ২৫ মার্চের পর উদ্বেগ, উৎকণ্ঠায় চলছিল দিনযাপন। জনমনে ব্যাপক ত্রাসের সৃষ্টি হয়েছিল। পাকবাহিনীর নির্যাতনের ভয়ঙ্কর সব খবর আসছিল প্রতিদিন। প্রতি মুহূর্ত কাটছিল শঙ্কায়। সবার প্রতীক্ষা ছিল আগামী দিনটি কীভাবে। আসবে।
এ অবস্থায় এই অঞ্চলে শান্তিবাহিনী গঠিত হলাে। দিনতারিখ আজ আর মনে নেই। পাকিস্তানি সৈন্যদের খুশি করতে তারা এগােতে থাকলাে বিভিন্ন পরিকল্পনা নিয়ে। তারা যে ক’টি বিষয়ের ওপর গুরুত্ব দিয়েছিল তার একটি হলাে ধর্মান্তরিত করা। শান্তিবাহিনী গঠিত হওয়ার কয়েকদিন পর একদিন গ্রামের সমস্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীকে ধর্মান্তরের নির্দেশ দেয়া হলাে। দিনের শেষে মা আমাকে বললেন, ঘরের পিতলের বিগ্রহটি তুলসি গাছের নিচে পুঁতে ফেলতে। বিগ্রহটি পুঁতে ফেলার সময় মা আমার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন এবং
নীরবে চোখের জল ফেলতে লাগলেন। আমার পরিবারের অন্য সদস্যরাও চারদিক ঘিরে দাঁড়িয়ে রইলাে। বিগ্রহটি সমাধিস্ত করে ওপরে তুলসি গাছটি লাগিয়ে দিলাম। কাজটি শেষ করে পিনপতন নীরবতায় বারান্দায় সবাই বসে রইলাম কিছুক্ষণ। তারপর রওনা হলাম নরেন্দ্রপুর ভাণ্ডারখােলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের মাঠে। এখানে ধর্মান্তরের আনুষ্ঠানিকতা করা হবে। মাঠে গিয়ে দেখি সেখানে অনেক লােকের সমাগম হয়েছে। ব্যবস্থাপকবৃন্দ পুরুষ ও মহিলাদের আলাদা করে বসার ব্যবস্থা করেছেন। সেই অনুযায়ী আমরা বসে পড়লাম। দেখছিলাম আমাদের ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সাহেব উপস্থিত আছেন। যিনি শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হয়েছেন। তাছাড়া এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গসহ প্রচুর লােকের সমাগম ঘটেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের লােকজন ভীত, নিথর, নিস্পন্দ। আমার মনে আছে পশ্চিম আকাশে সূর্য গড়িয়ে পড়ছে। শুরু হলাে আনুষ্ঠানিকতা। পর্যায়ক্রমে বক্তব্য। বক্তব্যের এক পর্যায়ে পর্দার ওপাশ থেকে হিন্দু নারীদের কান্নার রােল উঠলাে। বক্তব্যের শেষের দিকে কার্তিক জ্যাঠা উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, ‘আমার অনেকদিনের সাধ আজ পূর্ণ হতে যাচ্ছে। আজ থেকে আমরা একই সমাজের বাসিন্দা। আজ থেকে আমরা একই আল্লাহর এবাদত বন্দেগিতে মনােনিবেশ করবাে।’ কার্তিক চন্দ্র মলাঙ্গী একটি কলেমার উদ্ধৃতি দিয়ে শেষ করলেন। চেয়ারম্যান সাহেব তার বক্তৃতায় দেশ ও জাতির তখনকার অবস্থা বর্ণনা করে বললেন, ‘জান বাঁচানাে ফরজ। দিন এভাবে যাবে না। এরও একটা পরিবর্তন আসবে। আগে সকলের জীবন রক্ষা হােক।’ সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে। ভেসে এলাে আজানের ধ্বনি। আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ইমাম সাহেব। তিনি প্রথমে আরবি ভাষা ও বাংলা ভাষায় কিছু ধর্মীয় কথাবার্তা বললেন। তারপর আমাদের একটি কলেমা পাঠ করালেন। এই কলেমাটিই নাকি ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রথম ও প্রধান মন্ত্র ।

সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে। ভেসে এলাে আজানের ধ্বনি। আমাদের সামনে এসে দাঁড়ালেন ইমাম সাহেব। তিনি প্রথমে আরবি ভাষা ও বাংলা ভাষায় কিছু ধর্মীয় কথাবার্তা বললেন। তারপর আমাদের একটি কলেমা পাঠ করালেন। এই কলেমাটিই নাকি ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রথম ও প্রধান মন্ত্র।
অতঃপর নামাজ পড়ার পালা। সবার সামনে ইমাম সাহেব। পরে মুসলিম কমিউনিটির লােকজন। তারপর নবদীক্ষিত ইসলাম গ্রহণকারী। নামাজ শেষে কোলাকুলি। যেন ঈদের মিলনমেলা। পরদিন সকালবেলা আমকাঠের তক্তায় আলকাতরা দিয়ে বাড়ির মূল ফটকে লিখে দেওয়া হলাে ‘নয়া মুসলিম হাউজ’। বাড়ির সদরে পাতাবাহার ঢেকে দেওয়া হলাে কলাগাছের ফাত্রা দিয়ে, (ফাত্রা কলাগাছের শুকনাে পাতা)। ধর্মান্তরিতদের নাম পাল্টে রাখা হলাে। আমার নাম দেয়া হলাে রহিম।
শুক্রবারে আমাদের জুমার নামজে নিয়ে যাওয়া হতাে। বেঁচে থাকার আনন্দে পাজামা-পাঞ্জাবি পরে টুপি মাথায় দিয়ে লম্বা লাইন দিয়ে মসজিদে যেতাম। পােশাক, টুপি আমাদের সরবরাহ করা হতাে। চেয়ারম্যান সাহেবের নির্দেশ ছিল যারা নতুন মুসলমান তারা মসজিদে উঠবে না। মসজিদের নিচে দাঁড়িয়ে নামাজ পড়বে। এখানে উল্লেখ থাকে যে, আমাদের দক্ষিণের অনেকগুলাে গ্রামের হিন্দু সম্প্রদায়কে ধর্মান্তরিত করা হয়েছিল। এবং গরুর মাংস খাওয়ানাে হয়েছিল। আমাদের চেয়ারম্যান সাহেব এই কাজটি করতে দেননি। বরং অনেক হিন্দুনারীকে তার হেফাজতে রেখেছেন সম্মানের সাথে । যা ছিল তখনকার সময় বিরল দৃষ্টান্ত।
ধর্মান্তরিত হয়ে দেড়মাস কেটে যাবার পর আমাদের দেশত্যাগ করতে হলাে। আমার মেজভাই মুক্তিবাহিনীতে যােগ দেয়ার ফলে দেশে থাকা সম্ভব হলাে না। পরিবারের সিদ্ধান্ত হলাে ভারত চলে যাওয়ার। ভারতের উদ্দেশে রওনা হয়ে আমরা প্রথমে বিশারখােলা গ্রামে দিদির বাড়িতে যাই। বিশারখােলায় তখন বহু হিন্দু আশ্রয় নিয়েছিল হিন্দু অধ্যুষিত হওয়ার কারণে। পরিস্থিতি এমন অবনতির দিকে গেলাে যে ধর্মান্তরিত হয়েও বেঁচে থাকার আশা রইলাে না। ।কাজেই দিদির পরিবার ও আশ্রিত লােকজন মিলে একটি বিশাল দল রওনা হলাে ভারতের উদ্দেশে। প্রত্যেক পরিবার সঙ্গে করে নিলাে চাল, ডাল, চিড়া, মুড়ি ইত্যাদি শুকনাে খাবার । অজানায় পাড়ি। যাত্রাপথে সহায়তা দিচ্ছিল মুক্তিবাহিনী। পথ অতিক্রম করতে হচ্ছিল কিছু পায়ে হেঁটে, কিছু নৌকা করে। পথ চলতে চলতে দেখতে পাচ্ছিলাম অসংখ্য বাড়িঘর ও স্থাপনার পােড় চিহ্ন। কোথাও মানুষের লাশ শেয়াল শকুনে খাচ্ছে কাজেই। কোথাও শবদাহের পােড়া কাঠ, ভাঙা কলসী। দিনটা এমনতরাে পার করে যেখানে সন্ধ্যা নামতাে সেখানেই আমাদের আশ্রয় নিতে হতাে। এভাবে মুক্তিবাহিনী একদিন বাহিরদিয়া নামে একটি নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থান নিলাে। যতদূর মনে পড়ে দিনটি ছিল সােমবার। তারিখ মনে নেই। পুব তীরে নদীসংলগ্ন একটি ছােট বাজার। সময় ছিল সন্ধ্যার মুখে। খাবারের স্বল্পতাহেতু আমাদের বড় যারা ছিলেন তারা গেলেন কিছু খাবার কিনতে। হঠাৎ এরই মধ্যে লােকজনের ছুটোছুটি। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। আমি, মা, দিদি, দাদা, দিদির মেয়েরা পাটক্ষেতে লুকিয়ে গেলাম। জানা গেলাে পাকসেনারা গানবােটে নদী পার হয়ে বাজারে ঢুকে পড়েছে। এবং গুলি করে মানুষ মারছে। সন্ধ্যার পর গুলিগালাজ থেমে গেলাে। কিন্তু আমাদের স্বজনদের দেখা নেই। ভয়ে-কষ্টে আমরা একটানা কেঁদে চলেছি। রাত একটু বাড়লে উনারা খাবার নিয়ে হাজির। আমরা পরস্পরকে জড়িয়ে ধরলাম। পাওয়ার সে কি আনন্দ! আজ এতদিন পরেও সে স্মৃতি অম্লান। পরদিন ভােরে আবার আমাদের পথচলা শুরু। বৃষ্টিভেজা কর্দমাক্ত পথ। মুক্তিবাহিনী আমাদের শরণার্থীর কাফেলা পথ দেখিয়ে নিয়ে চলেছে। শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় হাজার দশেক। মুক্তিবাহিনী যেখানে আশ্রয় নিতে বলেছে আমরা সেভাবেই অবস্থান নিচ্ছি। এক সন্ধ্যায় তারা বললাে, আজ গভীর রাতে যশাের সিএন্ডবি রােড পার হতে হবে। সামনের দিকে এগােতে হবে। বাধা এলেও এগােতে হবে সামনের দিকে। এমন এক নিদারুণ নির্দেশ মাথায় নিয়ে শুরু হলাে আমাদের পথচলা। আনুমানিক রাত দশটা কি সাড়ে দশটা। আমাদের নিজস্ব আত্মীয়-স্বজন মিলে বিশ/পঁচিশ জন। আমি বয়সে ছােট হওয়ায় মায়ের হাত ধরে আছি। ঘুটঘুটে অন্ধকার- হাঁটু পরিমাণ কাদা। কাদা তাে নয়, যেন জিয়াল গাছের কষ। এক পা তুলে এক পা ফেলতে হিমশিম খেতে হচ্ছে দারুণভাবে। এভাবে চলতে চলতে একসময় হয়ে গেলাম দলছাড়া। অর্থাৎ মা ছাড়া আশপাশের কোনাে লােকজনই আমাদের পরিচিত নয়। লােকজনের মধ্য থেকেও সাথীহারার মতাে চলতে থাকলাম। বিস্ময়ের ব্যাপার, বিভিন্ন বয়সের এত মানুষ অথচ কাদায় পথচলার শব্দ ছাড়া কোনাে শব্দ নেই। এভাবেই আমরা সিএন্ডবি রােড পার হয়ে এসে পড়লাম এক আমবাগানের পাশে। বাগানের পাশে কচুরিপানায় ভরা এক খাল। খালটি পার হতে হবে কলার ভেলায়। মুক্তিবাহিনী সার্বিক সহায়তা দিচ্ছে। তারাই দোল খেতে খেতে সব শরণার্থী পার করে নিয়ে আসছে খালের পশ্চিম পাড়ে। খালের পশ্চিম পাড় ভারতভূমি।

স্বদেশ ছেড়ে পালাবার কাহিনী শেষ হলাে। পরদিন থেকে শুরু হলাে পরবাসের জীবন সংগ্রাম। প্রথমেই বর্ডার স্লিপ তৈরি করা। তা নাহলে কোথাও কোনাে সাহায্য পাওয়া যাবে না। বর্ডার স্লিপ তৈরির লক্ষ্যে বর্ডারের কাছে এক গােয়ালঘরে রাতযাপন করতে হয়েছে। গৃহকর্তার কিছু করার ছিল
। এত লােককে সে কোথায় দেবে আশ্রয়? তবে দয়া-মমতার কোনাে অভাব ছিল না তার। সে করুণমুখে গরুগুলাে বাইরে বের করে নিয়ে এলাে। আমরা ঘরে ঢুকলাম। গােবর চোনা মেশানাে বাতাসে শ্বাস নিতে নিতে পাের হলাে। ভাের হতে না হতেই লাইন ধরতে হলাে হেলেঞ্চা বর্ডারের পিচঢালা। রাস্তার ওপর। সময়টা ছিল শ্রাবণের মাঝামাঝি। তাই রাস্তার ওপর বসতে না বসতেই অঝাের বৃষ্টি। আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা প্রকৃতির অঝােরধারায় স্নাত হতে হতে অপেক্ষা করছে বর্ডার স্লিপের। তখন বর্ডার স্লিপ ছিল একজন শরণার্থীর বড় হাতিয়ার। তা নাহলে পাওয়া যাবে না ইটালিয়ান টাইপের রুটি, কাকরভরা আতপ চাল, রান্নার লাকড়ি ও জীবন ধারণের একান্ত প্রয়ােজনীয় জিনিসপত্র। বৃষ্টি স্নানের মাঝে এক সময় বর্ডার স্লিপ হাতে এলাে। স্লিপ হাতে নিয়ে আবার নিরুদ্দেশ যাত্রা। একবার বনগাঁ। ২৪ পরগণার সাবডিভিশন শহর। আবার গাইঘাটা। ঘুমহীন, খাবারহীন দিনরাত যাপন চলছিল। এভাবে কয়েকদিন অবর্ণনীয় কষ্টের কঠোর সময় পার করে অবশেষে গােবরডাঙ্গা রেলস্টেশনের পাশে তখনকার স্মৃতি সিনেমা হল সংলগ্ন শেফালী নামের এক দিদির করুণাশ্রিত হয়ে তাদের ছােট বারান্দায় ঠাই মিলে আমাদের পরিবারের। পরিবারটি আর্থিক দিক থেকে সুখী ছিল না। কিন্তু তাদের ভালােবাসা ছিল অপ্রতুল।

এদের আশ্রয়ে কিছুদিন থাকার পর অনেক খোঁজাখুঁজির পর স্মৃতি সিনেমা হলের সামনে একটি পতিত বাড়িতে নামমাত্র ভাড়ায় শুরু হলাে আমাদের। পূর্ণ শরণার্থী জীবনের পালা। আমাদের রেশন কার্ড ছিল পাচপােতা নামক শরণার্থী ক্যাম্পের। আমার রাত কাটে স্মৃতি সিনেমা হলের সামনের বাড়িতে। দিন কাটে গােবরডাঙ্গা রেলস্টেশনের দেয়ালে সাঁটানাে ভারতীয়। সব বাংলা পত্রিকার জয় বাংলার খবর পড়ে। আমি তখন বাংলা খুব ভালােভাবে পড়তে এবং বুঝতে পারি। রেডিওতে প্রচারিত দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায় এবং নীলিমা সান্যাল্যের ভরাট কণ্ঠের খবরও আমাকে খুব আকৃষ্ট করতাে। সন্ধ্যা হলে বিবিসি ও ভয়েস অব আমেরিকা ছিল সবার নিত্যসঙ্গী।

ছােটবেলা থেকে আমি ছিলাম একটু উৎসুক ধরনের। তাই বড়দের সাথে শরণার্থী ক্যাম্পগুলাে দেখতে যেতাম। আমার প্রথম যাওয়া হয়েছিল সল্টলেক বা লবণ হ্রদ শরণার্থী শিবিরে। তখনকার উল্টোডাঙ্গা স্টেশন থেকে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রায় পাঁচ কিলাে দূরে অবস্থান ছিল লবণ হ্রদের। উল্টোডাঙ্গা স্টেশনে পা ফেলতে না ফেলতে ডােবা আর ডােবা। সদ্য বালু দিয়ে ভরাট কোথাও আবার জলে টইটম্বুর। চারদিকে নীল আকাশ ঘেরা ধু ধু প্রান্তর। সেই প্রান্তরে পড়ে আছে বাংলাদেশের পচাগলা মানুষের লাশ। শিশুসহ বিভিন্ন বয়সী নারী, পুরুষের লাশ পড়ে আছে সমাধিস্থ হওয়ার অপেক্ষায়। কিন্তু সকারের কোনাে উদ্যোগ নেই। পচাগলা লাশগুলাে শেয়াল, শকুনে টেনেহিঁচড়ে মারামারি করে খাচ্ছে। কী বীভৎস সেই সব দৃশ্য। এমন সব দৃশ্য বলে বা লিখে সবটুকু বােঝানাে সম্ভব নয়। শুধু লবণ হ্রদই নয় পশ্চিমবঙ্গে নাম জানা, নাম না জানা বিস্তৃত অঞ্চল জুড়ে এরকম ভয়ঙ্কর মর্মান্তিক দৃশ্য আমি প্রত্যক্ষ করেছি। দেখেছি স্বাধীনতাযুদ্ধে মানুষের হাতে মানুষের নিপীড়ন, অপমান, লাঞ্ছনা।

দীপালী ভট্টাচার্য
প্রাক্তন শিক্ষক
হালিশহর, চট্টগ্রাম।

চার দশক নেহায়েত কম সময় নয়। চার দশক আগে স্বাধীনতাযুদ্ধ হয়েছে। যুদ্ধ চলেছে নয় মাস। এই নয় মাসে ঘটেছে অংসখ্য ঘটনা। সেই ঘটনাবহুল সব স্মৃতি দীর্ঘ চল্লিশ বছর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কিছুটা হলেও স্মৃতি হয়েছে মলিন, বিবর্ণ, হয়তাে বিলুপ্ত। কিন্তু সব স্মৃতিই কি তাই? না, কিছু স্মৃতি আছে যা আমার চিরসঙ্গী। জ্বলজ্বল করে জ্বলতে থাকবে আমার মৃত্যুর দিনটি পর্যন্ত। যুদ্ধের মধ্য দিয়ে দেশ স্বাধীন হবে বা সেই যুদ্ধে নিপীড়ন-নির্যাতন, নির্মমতা এতটা ভয়ঙ্কর হবে সেটা বিন্দুমাত্র বুঝতে পারিনি। সে সময়টা আমি থাকি আগ্রাবাদ নাগ কলােনিতে। বর্তমানে শেখ মুজিব রােডের চট্টগ্রাম বেতারের বিপরীতে একটি ভাড়া বাসায়। আমার স্বামী সুবীর চৌধুরী, যমুনা ভবনে একটা ব্যাংকে চাকরি করতেন। আমার তখন দু’সন্তান। উৎপল আর শ্রাবণী। আমি একাত্তরের ১৪ ফেব্রুয়ারি প্রধান শিক্ষক হিসেবে যােগদান করি একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে। স্কুলটির নাম ছিল শিশু নিকেতন। এটা ছিল আমার প্রথম চাকরি এবং আমি একই সঙ্গে চট্টগ্রাম ইউনিভার্সিতে বাংলা বিভাগে প্রথম বর্ষে ভর্তি হই। সুবীর ব্যাংক থেকে বের হয়ে টিউশনি করতাে। সংসার আমার ভালােই কাটছিল আত্মীয়-স্বজন, বন্ধুবান্ধব নিয়ে। যদিও দেশ ছিল উত্তাল। কিন্তু এত বড় আঘাতের কথা চিন্তাও করতে কেউ পারেনি। ২৫ মার্চ আমার ছােট বােন অমৃতা এসেছিল আমার বাসায় বেড়াতে। রাত যখন ন’টা। অমৃতা উঠি উঠি করছিল। এমন সময় সুবীর হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলাে। পরনে ছিল সাদা রঙের প্যান্ট। দেখলাম রক্তে প্যান্ট লাল হয়ে গেছে। ছিড়েও গেছে অনেকখানি। ঘরের সবাই অবাক হয়ে গেলাম। সুবীর বললাে, রাস্তায় কারফিউ চলছে। বড় বড় পাথরের টুকরাে দিয়ে ব্যারিকেড সৃষ্টি করা হয়েছে। তাড়াহুড়া করে আসতে এই অবস্থা হয়েছে। রাত একটার দিকে ভগ্নিপতি মুক্তি এসে অমৃতাকে নানা খালবিল অলিগলি পার হয়ে বাসায় নিয়ে গেলাে। ওদের বাসা ছিল পাের্ট কলােনিতে। চট্টগ্রাম বেতারের সামনে খুব গােলাগুলি চলছে। শব্দ শুনতে পাচ্ছি। আতঙ্কে সবাই জেগে কাটালাম। তখন আলসারে খুব কষ্ট পাচ্ছিলাম। রাতে বসে সিদ্ধান্ত নেয়া হলাে সদরঘাটের বাসা থেকে শ্বশুর-শাশুড়িসহ বাকি যারা আছে সবাই মিলে গ্রামাঞ্চলে চলে যাবাে। চট্টগ্রাম শহরে আর থাকা ঠিক হবে না। খুব ভােরে ছেলেমেয়ে দুটোকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম। সাথে থাকলাে সামান্য সঞ্চয় এবং একটা ব্যাগে ব্যবহারিক কিছু কাপড়-চোপড়। সদরঘাট বাসা থেকে শ্বশুর-শাশুড়ি, চার ননদ, দেবর এবং এখানে পেলাম আরও দুই ভদ্রলােক। তারা ছিলেন যশােরের ব্যবসায়ী। উনাদের নাম হলাে গােপাল সাহা ও সুনীল সাহা। উনারাও চললেন আমাদের সাথে। অভয়মিত্র ঘাট দিয়ে … সােজা আমরা গ্রামের বাড়িতে চলে গেলাম। ভাবলাম বিপদমুক্ত। কিন্তু না সামনে আরও ভয়ঙ্কর বিপদ অপেক্ষা করছে তখনাে বুঝতে পারিনি। গ্রামের বাড়িতে মাসখানেক ভালােই কাটছিল। মে মাসের শেষের দিকে মিলিটারি এলাে গ্রামে। অনেকের সাথে আমাদের বাড়িও আগুন লাগিয়ে দেয়া হলাে। বাড়িটি ছিল মাটির দোতলা, টিনের চাল। সকালে রুটি খেয়ে সবে মাটির চুলায় ভাতের জল চাপিয়েছি হাঁড়িতে। লাকড়ি হিসেবে পাতা ব্যবহার করছি। হঠাৎ আওয়াজ হতে লাগলাে পাঞ্জাবি আসছে, পাঞ্জাবি আসছে। যেভাবে ছিলাম সেই অবস্থায় ছুটে বেরিয়ে পড়লাম। প্রতিবেশী সবাই বেরিয়ে পড়লাে। এভাবে আমরা পঞ্চাশ-ষাটজন একত্রিত হয়ে গেলাম। তারপর গ্রাম ছেড়ে কিছু দূরে একটা খােলা মাঠে গিয়ে দাঁড়ালাম। এত ঝড়ের ভেতরেও পিসিমা তার দুধেল গরুটি সাথে নিয়ে এসেছিল। পিসিমা গাইয়ের দড়ি ধরে দাঁড়িয়ে আছেন। এক চেনাজানা অতি পরিচিত লােক পিসিমার হাত থেকে গরুটি কেড়ে নিয়ে চলে গেলাে। বাছুরটি পেছন পেছন গেলাে। হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে দেখলাম। সবাই বুঝতে পারলাম কাছাকাছি কোথাও থাকা নিরাপদ নয়। চলে যেতে হবে দূরে। আমরা কাফেলার মতাে চলতে লাগলাম। চলতে চলতে চলে গেলাম চট্টগ্রাম থেকে পঁয়ত্রিশ মাইল দূরে। চন্দনাইশ থানার সুতিয়া নামে এক গ্রামে গিয়ে উঠলাম। এ গ্রামে আমাদের যাত্রা থামাতে হলাে। কারণ তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। আশ্রয় নিলাম এক মুসলমান যুবকের বাড়িতে। তিনি দুটো রুটি আর একমুঠ একমুঠ করে খেলন ডাল ভাজা দিয়ে আমাদের খাবারের ব্যবস্থা করলেন। থাকার জায়গা দিলেন বৈঠকখানা ঘরে। একটা ঘরে এত লােকের স্থান সঙ্কুলান হচ্ছিল না। বসে থাকতেই অসুবিধা হচ্ছিল। মেয়েকে কোলে ঘুম পাড়িয়ে দিলাম। আর ছেলের মাথাটা আমার গায়ে হেলান দিয়ে বসে বসে ঘুমােতে বললাম। সে রাতে আমার জীবনে এক স্মরণীয় ঘটনা ঘটলাে। ছেলেকে যখন রুটি খেতে দিলাম, সারা দিন খায়নি ছেলে- সে একটা রুটি খেয়ে অন্য একটা রুটি প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দিলাে। সে রুটি খেতে খেতে বললাে- কাল খিদে লাগলে খাবে কি? আজ ঘুমিয়ে পড়বে আর ক্ষিদে লাগবে না। সেদিন ছেলের মুখে যে বেদনার ছায়া দেখেছি তা মনে হলে আজও আমার চোখে জল আসে।

পরদিন আবার কাফেলার হাঁটা। বিপদ মাথায় নিয়ে অনিশ্চিতের হাঁটা হেটে চলছি। অন্যদিক থেকেও কাফেলা আসছে। সবাই নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে চলছে অনিশ্চিতের পথে। পথেই চলছে বিশ্রাম, খাওয়া, শিশুদের ঘুম পাড়ানাে। সন্ধ্যা হয়ে আসছে, হঠাৎ ওরা আসছে, ওরা আসছে বলে লােকজন দৌড়াচ্ছে। বােঝা যাচ্ছে মিলিটারি কাছাকাছি কোথাও অপারেশনে নেমেছে। কাছেই বড়য়া পাড়া ছিল। বড়য়া পাড়ার লােকেরা ছেলেমেয়েসহ আমাকে লুকিয়ে ফেললাে। যে জায়গাতে আমাকে লুকানাে হলাে সে কথা মনে হলে এখনাে গা গুলিয়ে যায়। ওদের পুকুর পাড়ে খড়ের গাদায় আমাকে রাখা হয়েছিল। কাছে ছিল কাঁচা টয়লেট। সেখান থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছিল। বাচ্চাদের বিছায় কামড়াবে বলে দু’পা টেনে এনে আমার কাছে বসালাম। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না। গা বেয়ে বিভিন্ন জাতের পােকামাকড় উঠতে লাগলাে। মনে হচ্ছিল নরক যন্ত্রণাও এর চেয়ে ভয়াবহ। এদিকে স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়িসহ নিজের লােকজন কে কোথায় পড়ে আছে নাকি যমের হাতে পড়বে ভাবতেও পারছিলাম না । সে অনুভূতি লিখে শেষ করা যাবে না। চার-পাঁচ ঘণ্টা এভাবে চলার পর বড়ুয়াদের একটি মেয়ে এসে বললাে, ‘ওরা চলে গেছে, বাড়িতে চলে এসাে।’ ওদের দেয়া খাবারে যা হােক নিজেও খানিক মুখে দিলাম। বাচ্চাদেরও খাওয়ালাম। মেঝেতে চাটাইয়ের বিছনা দেয়া হলাে। বাচ্চাদের নিয়ে শুয়ে পড়লাম। মধ্যরাত পেরিয়ে গেলাে। কিন্তু ঘুম কোথায়? দুচোখের পাতা এক হচ্ছে না। কোথায় রইলাে সবাই? এরপর কী হবে, কী করবাে, কোথায় যাবাে, কেমন হবে- এ সব ভাবতে ভাবতে রাত শেষ হয়ে গেলাে। ভােরে স্বামী ও পরিবারের লােকজনের সাথে মিলিত হলাম। উনারা কাছাকাছিই লুকিয়ে ছিলেন। আবার। কাফেলা চলছে। এবার আমরা ঠিক করলাম আমাদের বর্গাচাষিদের বাড়িতে আশ্রয় নেবাে। বর্গাচাষি আমাদের খুব ভালােভাবে গ্রহণ করলাে। আলুসিদ্ধ ও মাষকলাইয়ের ডাল দিয়ে ভাত খেতে দিলাে আমাদের। আমার শ্বশুর-শাশুড়ি ভাত খেলাে না। উনারা বাইরে ভাত খেতেন না। উনাদের জন্য চিড়ার। ব্যবস্থা করে দিলাে। আমি উনাদের চিড়া ভিজিয়ে দিলাম। একরাত একদিন। ভালােই কাটলাে। পরদিন বর্গাচাষি যে প্রস্তাব দিলাে তাতে হাত-পা একদম পেটের ভেতরে সেঁধিয়ে যাবার মতাে অবস্থা হলাে। আমার বড় ননদের যার। বয়স ছিল তখন তের-চৌদ্দ, ওর সঙ্গে চাষির এক ছেলের বিয়ে পড়িয়ে ফেলতে চাইলাে। আমরা এক মুহূর্ত দেরি না করে ওখান থেকে বেরিয়ে পড়লাম। শুনলাম পাশে একটি গ্রাম আছে মােটামুটি নিরাপদ। শ্বশুর, শাশুড়ি, দেবর, ননদ সবাই গ্রামে চলে গেলাে। আমি আশ্রয় নিলাম আমার। পাতানাে দাদা প্রিয়দর্শীদার বাড়িতে। তখন ওদের দোতলা মাটির কোঠা নির্মাণাধীন। নিচে বড় বড় মাটির ঢেলা। রাতে বসে বসে সেগুলাে ভাঙতাম। বিপদের দিনে প্রিয়দর্শীদা ও ধর্মশীলদা আশ্রয়টুকু দিয়ে যে উপকারটুকু করেছেন তাতে আমি চিরকৃতজ্ঞ। এখানে ভালােই কাটছিল। যদিও খবর পাচ্ছিলাম আশপাশের গ্রাম থেকে লােকজন ধরে ধরে গুলি করে মেরে ফেলছে। তবে মিলিটারি আতঙ্ক থেকে এক মুহূর্তও রেহাই ছিল না।
এরই মধ্যে কর্মস্থলে যােগদানের জন্য নির্দেশ দেয়া হয়েছে। অনেকে কাজে যােগ দিতে শুরু করেছে। গ্রাম থেকে কেউ কেউ অফিস করছিল। একদিন অফিসে তাদের লাইনে দাঁড় করানাে হলাে। কথা ছিল নাকি ব্রাশফায়ার করবে। কিন্তু করেনি। এ কথা শােনার পর সুবীর সিদ্ধান্ত নিলাে শহরে মােকাটুলী বড়ুয়া পাড়াতে একটা বাসা নিয়ে অফিস করবে। কারণ কাজে যােগদানের জন্য চাপ আসছিল। কাজে যােগদান না করে কোনাে উপায় ছিল না। ভাগ্যধন নামে এক লােকের এক কামরার একটি বাসা নেয়া হলাে। রান্নাঘর আলাদা। এই বাসাতেই নিয়ে আসা হলাে আমার শ্বশুরের পরিবার ও আমার মা, বাবা, ভাইবােন সবাইকে। এখান থেকে প্রথমে আমার শ্বশুর, শাশুড়ি, মা, বাবা ভাইবােন চলে গেলাে দালাল ধরে। এর তিনমাস পরে আমার বড়দাদা তার পরিবার-পরিজন নিয়ে চলে গেলাে। এভাবে একে একে সবাই দালাল ধরে চলে গেলাে নিরাপদ আশ্রয় ভারতে। আমরা অর্থের অভাবে ও চাকরির দাবিতে জীবন কাটাতে লাগলাম। তদুপরি ভারত যাবার আগ্রহও ছিল না। কিন্তু অক্টোবরের দিকে পরিস্থিতি ভয়ানক খারাপের দিকে গেলাে। এতটা খারাপ হলাে যে, অফিস থেকে সুবীরকে নিরাপত্তার ব্যবস্থা করা সম্ভব নয় বলে তাকে অফিসে না আসতে পরামর্শ দিলেন। ম্যানেজার সাহেব ছিলেন খুব ভালাে মানুষ। তিনি মাসিক বেতন ও বাড়তি কিছু টাকা দিয়ে বললেন, আমরা যেন খুব দ্রুত নিরাপদ স্থানে চলে যাই। এবার ভারত যাবার সিদ্ধান্ত নিতে হলাে। দালালদের সাহায্যে প্রথমে আমাদের যেতে হলাে ছাগলনাইয়া কাজীবাড়ি। ট্রেনে করে গেলাম। এক হুজুর দালাল তাকে স্বামীর পরিচয় দিয়ে একটা কালাে বােরখা পরে ট্রেনে চেপেছি। সুবীর অন্য বগিতে। ছেলেকে ফিসফিস করে শিখিয়ে দিয়েছি যে এখন থেকে হুজুরকে বাবা বলে ডাকবে। একে বাবা বলবে। ছেলে জোরে জোরে বলে যে আমার বাবা পাশের কামরায়। আমি বাবার কাছে যাবাে। হুজুরের সাথে তাদের দেয়া বােরখা পড়ে ছাগলনাইয়াতে গিয়ে উঠলাম। এ বাড়ির লােকেরা মুক্তিযুদ্ধে অনেক অবদান রেখেছেন। হিন্দুদের বাঁচাতে অনেক সাহায্য-সহযােগিতা করেছেন উনারা। রাতে ঘরের মুরগি কেটে আপ্যায়ন করেছেন আমাদের। আমাকে নিজের মেয়ের মতাে আদর করেছেন। সে বাড়িতে ঝর্ণা নামে এক মেয়ে ছিল। সে খুব যত্ন করেছে। আমাকে। যাওয়ার সময় বলেছে, “বৌদি তােমার বােরখাটা খুব সুন্দর আমাকে দিয়ে দাও।’
পরদিন আরেক হুজুরের বৌ সেজে বর্ডার পার হতে হয়েছিল। বেলুনিয়া দিয়ে ত্রিপুরা সীমান্তে পৌছলাম। সেখানে বর্ডারে আমাকে বােরখা পরা দেখে সীমান্ত প্রহরীরা ধরে বসলাে আমি বিহারি মেয়ে। কারণ আমার হাতে ছিল ভাইয়ের রােলেক্স ক্যামেরা। সাতদিন সেখানে থেকে বিশ্বাস অর্জনের পর ত্রিপুরার উদয়পুরে বাবা-মার কাছে চলে যাই। উদয়পুর থেকেই নিজের দেশে ফিরে আসি।
আমি মুক্তিযুদ্ধ করিনি। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধে মানুষের আত্মত্যাগ দেখেছি। পৃথিবীর ইতিহাসে এতটা ত্যাগ স্বীকার স্বাধীনতার জন্য আছে কিনা আমার জানা নেই। দিনের পর দিন মানুষ চরমভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত ও শেষ পর্যন্ত জীবন বিসর্জন দিয়েছে। কিন্তু স্বাধীনতার চেতনা থেকে একবিন্দু সরে আসেনি। দেশমাতৃকার স্বাধীনতার অনুভূতি যে মানুষের কতটা তীব্রতর হতে পারে একাত্তর তা আমাদের দেখিয়েছে। শুধু আমাদের নয়, বিশ্ববাসীকেও।

আয়েশা রহমান
গৃহিণী জামালপুর শহর।

স্মৃতিভরা একাত্তর। সে স্মৃতির সবটাই দুঃখ-বেদনায় ভরা। হানাদার হায়েনারা ঢাকা আক্রমণের পরদিন অর্থাৎ ২৬ মার্চ আমি জামালপুর শহর ছেড়ে গ্রামে বাবার বাড়ি চলে যাই। আমার সাথে শাশুড়ি, জা, ননদ সবাই। সবার ধারণা ছিল গ্রামগুলাে নিরাপদ থাকবে। শুধু আমরা নই, গােটা জামালপুর শহরের অধিকাংশ মহিলাদের গ্রামে পাঠিয়ে দেয়া হয়। সেই ২৬ মার্চ থেকেই আমরা ভয়ে-আতঙ্কে দিন কাটাতে থাকি। যুদ্ধ শুরু হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে আমার আদরের ছােটভাই আশেক মাহমুদ কলেজের ছাত্র শহীদ হন। আমার স্বামী ভারত চলে যান। প্রতিটি মুহূর্ত কাটে আমাদের আশঙ্কা আর উত্তেজনার ভেতরে। এক ঘন্টা সময় কাটলে মনে হতাে একযুগ সময় পেরিয়ে এসেছি। প্রতিটি মুহুর্তে মনে হতাে ওই বুঝি মিলিটারিরা গ্রামে ঢুকে পুরুষদের মেরে ফেলবে আর মেয়েদের ধরে নিয়ে যাবে। সেই ভয়ঙ্কর দিনের কথা মনে হলে এখনাে গাঁ কাটা দিয়ে ওঠে। বন্দুকের নলের মুখ থেকে একবার বেঁচে যাই। দিন হলেই আতঙ্ক। প্রায়ই পাকবাহিনী গ্রামে ঢুকতাে। গ্রামের লােকজন, গ্রামে ঢােকার পথগুলােতে নজর রাখতাে। মিলিটারি আসছে টের পেলে শুরু হতাে দৌড়ানাের পালা। বনবাদাড়, ক্ষেত-খামার, মাঠ-ঘাট, খাল-বিল সঁতরে যে যেখানে পারতাে সেখানে গিয়ে লুকিয়ে থাকতাে। এভাবে কেটে যায় আমাদের দীর্ঘ নয় মাস। গ্রামে পাকিস্তানি বাহিনী ঢুকে শুরু করে দেয় লুটতরাজ আর অগ্নিসংযােগের খেলা। আমাদের পাড়পাড়া নামে একটি গ্রাম তিনবার পােড়ানাে হয়। আমার বাবার বাড়ি লুটপাটের সময় আমার গয়নাগুলােও লুট হয়ে যায়। মজার ব্যাপার হলাে স্বাধীনতার দুবছর পর একটি বালা আমার হাতে আসে। বালাটি পাওয়া যায় আমাদের বাড়ির আধ-কিলাে দূরে জঙ্গলের ভেতর। সম্ভবত লুট করে নেয়ার সময় পড়ে গিয়েছিল। আমার চাচাতাে ভাইয়েরা মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিল। ওরা স্পাইয়ের কাজ করতাে। মুক্তিবাহিনীর খবরা-খবর সরবরাহ করতাে। ভারত থেকে আমার স্বামীর খবরও ওরা নিয়ে আসতাে আমার কাছে। আমার পিতৃকুল ও শ্বশুরকুলের স্বজনেরা মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। আমার অতি প্রিয় ছােটভাই মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়ার জন্য বাবা-মার কাছ থেকে বিদায় নিতে বাড়িতে এসে হায়েনাদের হাতে ধরা পড়ে এবং শহীদ হয়। অন্তত আঞ্চলিকভাবে মহান স্বাধীনতাযুদ্ধে অংশগ্রহণকারী আমার শহীদ ভাইয়ের স্মৃতিকে জাগ্রত রাখতে সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আবেদন রাখছি।
বেলা দে
গৃহিণী, পলাশীহাটা,
ফুলবাড়ীয়া, ময়মনসিংহ।

কিছুদিন থেকেই শুনছিলাম দেশে গণ্ডগােল হবে। তারপর একদিন শুনলাম ঢাকায় বাঙালিদের সঙ্গে পাঞ্জাবিদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবিরা নাকি মানুষের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছে। বাড়িঘরে আগুন দিচ্ছে। সব লুটপাট করছে। যাকে ধরতে পারছে তাকেই গুলি করে মেরে ফেলছে। ধরে নিয়ে যাচ্ছে। মহিলাদের। শিশুদেরও জীবন্ত রাখছে না। লােকের মুখে মুখে এমন খবর শুনছিলাম। এরপর হঠাৎ একদিন পাঞ্জাবিরা আমাদের কেশবগঞ্জ বাজারে ক্যাম্প করলাে এবং কয়েকদিনের ভেতরে এ গ্রামে ঢুকলাে। দিনতারিখ বলতে পার বাে না। তবে গরমের সময় ছিল। সাতটি গাড়ি বােঝাই করে বেলা দশটার দিকে পাঞ্জাবিরা বাজার থেকে আমার বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়ায়। আমরা তখন সবেমাত্র সকালের খাবার শেষ করেছি। গাড়ি দেখে আমরা তৎক্ষণাৎ বাড়ির পেছন দিয়ে দৌড় দিই। বাড়ির পেছনে খাল। খালটি এখনাে আছে। খালের ওপারে ছিল ঘন আখের ক্ষেত। গ্রামের অনেক লােক সেদিন এই আখক্ষেতে আশ্রয় নিয়েছিল। সারা দিন কাটাই আখের ক্ষেতে। আমার ছেলেরা ছিল একদম ঘােট। আখের ধারালাে পাতার আঁচড়ে আমাদের সবার গা ছিলে গিয়েছিল। সন্ধ্যার পর আখক্ষেত থেকে বের হয়ে তালুকদার বাড়ি যাই। সেখানে জানাজানি হয়ে গেলে রাজ্জাক মেম্বার তার বাড়িতে আশ্রয় দিলাে। এখানেও থাকা গেলাে না। পরের দিন সেখান থেকে সিদ্দিক আলী নামে এক গ্রামে চলে যাই। গ্রামের ইউসুফ সব সময় আমাদের গ্রামে থেকে। সাহায্য করেছে। আমার শিশুসন্তানদের সে কোলে করে পৌছে দিয়েছে। শেষ পর্যন্ত থাকতে পারলাম না সিদ্দিক আলীতেও। একদিন সেখান থেকেও চলে যেতে হলাে। রাতের অন্ধকারে ইচ্ছাখাল, ডালখােলা বিল পার হয়ে অনেকদূর হেঁটে রােয়ার চর যাই। পালাবার সময় আমার স্বামীর হাঁটুতে খেজুর কাটা ফোটে। সাত মাস পরে সেই কাটা দৃষ্টিতে আসে। আতঙ্কের ঘােরে এমনই দিন কাটছিল। আমরা যে সব মুসলিম বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি সবাই খুব ভালােভাবে রেখেছে। বলেছে, আমরা আগে মরবাে পরে আপনারা মরবেন। প্রথম যেদিন পাঞ্জাবিরা গ্রামে ঢােকে সেদিনই আমার বাড়িতে। আগুন দেয়। লুট করে নিয়ে যায় সবকিছু। সেদিন গ্রামে আরও চারটি বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। এরপর রাজাকারদের সহায়তায় গ্রামের অদ্বৈত সাহা, জগা। সাহাকে মুসলমান বানিয়েছিল। এলাকার অনেক হিন্দুকে এরা ধর্মান্তরিত করেছিল। গরুর মাংস খাইয়েছিল। এরা গ্রামের সাত-আটজন নিরীহ লােককে হত্যা করেছে। এদের নির্যাতনের শিকার হয়েছে হিন্দু-মুসলিম অনেক নারী। হিন্দু মেয়েদের জোর করে বিয়ে করতে চেয়েছে। ছােট শিশুদের পর্যন্ত এরা গাছের সাথে আছড়িয়ে মেরেছে। নয় মাস ধরেই চলেছে এদের নির্যাতনের তাণ্ডব। মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসহ স্মৃতি কেউ কোনােদিন ভুলতে পারবে না।

দ্বিজেন দে
ব্যবসায়ী
পারুলীতলা, মুক্তাগাছা, ময়মনসিংহ।

২৫ মার্চ আমি বাড়িতে ছিলাম। ২৬ মার্চ সকালে বিবিসির খবরে আমরা রাতে ঢাকা ম্যাসাকারের সংবাদ শুনি। সে সময় ফোর ব্যান্ডের একটি ট্রানজিস্টার ছিল আমার সারাক্ষণের সঙ্গী। সকালের খবর শুনেও বুঝতে পারিনি পাকবাহিনীর এত ভয়ঙ্কর নির্মমতা নেমে আসছে দেশবাসীর ওপর। পাকবাহিনীর হাতে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে মুক্তাগাছার পতন ঘটে। মুক্তাগাছা থেকে ওরা গাবতলী হয়ে মধুপুর, টাঙ্গাইল ও ঢাকার সাথে যােগাযােগ রক্ষা করতাে। আমার বাড়ি কালিবাড়ী (গাবতলী) বাজারের কাছে হওয়ায় আমি বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হই। পরিবারের সদস্যদের কাছেই বনবাংলা গ্রামে পাঠিয়ে দেই কয়েকদিন আগে। ২৫ মার্চের পর মানুষ নিরাপদ আশ্রয় খুঁজছিল। মানুষ ছিল অত্যন্ত শঙ্কিত। ছিল অসহায়। দেশ অস্থিতিশীল হবে বােঝা যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি এত জটিল হবে এবং পাকবাহিনীর নির্যাতনের মাত্রা এত ব্যাপক হবে সেটা কেউ কল্পনা করতে পারেনি। মুক্তাগাছা পতনের পর এ অঞ্চলের বহুলােক নারায়ণখােলা বাজার হয়ে গােপন পথে ভারতে আশ্রয় নেয়। অনেকের মতাে আমিও দেশত্যাগ করে। ভারতে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। কিন্তু আমার পাড়ার কতিপয় ছেলে খালেক, শামসুল ওরা এসে বলেকয়ে পরিবার-পরিজনসহ আমাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসে। ওরা বলে, কাকা আপনি যেতে পারবেন না। আমরা বেঁচে থাকলে আপনিও বেঁচে থাকবেন। মরলে সবাই মরবাে।
বাড়ি ফিরে আসি। মনে সাহস পাই। কিন্তু বাড়িতে থাকার মতাে অবস্থা না থাকায় পার্শ্ববর্তী কাকিনাটী গ্রামে গিয়ে আশ্রয় নিই। ওদের পরামর্শে আশ্রয় নিই মজী মণ্ডলের বাড়ি। মজী মণ্ডলের বাড়ি থেকে ক্ষেতখামার দেখাশােনা করি। এর মাঝে গ্রামে পাকবাহিনীর আনাগােনা শুরু হয়ে যায়। বারইপাড়া জালিয়ে দেয়। পারুলীতলা গ্রামে চালায় লুটতরাজ। সারা দিন পাহাড়, জঙ্গলে, মাঠে-ময়দানে গা-ঢাকা দিয়ে থাকতাম। সন্ধ্যার অন্ধকারে বাড়ি ফিরতাম। মহিলারা পাকবাহিনীর আসার কথা টের পেলে বা রাজাকারের আগমন টের পেলে মজী মণ্ডলের বাড়ির পেছনে গভীর বাঁশবনের ঝোপেঝাড়ে লুকিয়ে যেতাে। এখানে একজনের কথা না বললেই নয়। সে আবেদ আলী ব্যাপারী। একান্ত সহজ-সরল মানুষ। আবেদ আলী ব্যাপারী স্বাধীনতাযুদ্ধের দীর্ঘ নয়মাস আমার পাশে থেকেছে। পাকবাহিনীর আগাম খবর দিয়ে জীবনবাজি রেখে বিপদমুক্ত রেখেছে আমাকে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমি পাকবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে যাই। কোথায় মুক্তিফৌজ ধরতে পাকবাহিনী গ্রামে ঢােকে গােলাগুলি শুরু করে। আমি মাঠে ছিলাম। হঠাৎ গােলাগুলির ভেতর পড়ি। ছুটে গিয়ে পানাভর্তি একটি পুকুরে পানার দঙ্গল মাথায় দিয়ে নাকটুকু ভাসিয়ে সারা গা ডুবিয়ে রাখি। ওরা প্রথমে আমার অবস্থান টের পায়নি। পঁচিশ ত্রিশ মিনিট পর অকস্মাৎ আমার কনুই। নড়ে ওঠে। তৎক্ষণাৎ ওরা আমাকে টেনে পুকুর পাড়ে তুলে আনে এবং কষে মারধর শুরু করে। গুলি করবে এমন সময় রাজাকারদের ভেতর থেকে একজন বলে ওঠে, ভালা আদমি হ্যায়। তখন আমাকে ছেড়ে দেয়। সে যাত্রায় রক্ষা পাই।
পাকবাহিনীর অত্যাচারের মাত্রা দিন দিন বাড়তে থাকে। প্রতিদিন গ্রামে গ্রামে ঢুকে নির্যাতন চালায়। এ অঞ্চলের কিশােরী, যুবতী কেউ ঘরে থাকেনি। অনেক মেয়েকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল মধুপুরের জলছত্র মিশনে। মিশনের ফাদার হােমরিচ পিতার মতাে মমতায় সেইসব মেয়েকে পাকবাহিনীর অত্যাচার থেকে রক্ষা করেছিলেন। পাকবাহিনী একদিন চারিপাড়া গ্রামে খা বাড়ির এক বৃদ্ধ মহিলাকে ধর্ষণ করতে উদ্যত হয়। মহিলা মিনতি করে বলে, বাবা আমি বুড়া, আমাকে ছেড়ে দাও। পাকসেনাটি কুটিল হাসে। বলে, হামলােক বুড্ডা হ্যায়। নাে প্রবলেম। মহিলাটিকে ধর্ষণ করে। পাশের খুনা গ্রামে জাম, কুমুদ ও আরও কয়েকজনকে হত্যা করে। তবে পারুলীতলা গ্রামে কোনাে রাজাকার ছিল না। রাজাকাররা কালীবাড়ি বাজারে মুরগি, মাছ, ফল, দুধ যা পেতে নিয়ে যেতাে। দাম দেওয়ার প্রশ্ন ছিল না। কালীবাড়ি বাজারে একদিন পাকসেনারা এক দর্জির দোকানে কাপড় কিনতে আসে। কাপড় কাটতে গিয়ে ভয়ে দর্জির হাত কাঁপছিল। কিছুতেই সে সঠিকভাবে কচি ধরতে পারছিল না। সেনারা তখন বুটের লাথি মারতে মারতে দর্জিকে শেষ করে ফেলে। যুবকদের ধরে ধরে মেরে ফেলা এবং নারীধর্ষণ ছিল। নৈমিত্তিক ব্যাপার। আমি যে পরিবার-পরিজন নিয়ে বেঁচে থাকবাে সে ধারণা সেদিন করিনি। নভেম্বর মাসে আমাদের চাপ দেয়া হয় ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্য। আমরা প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। তবে যে রাজাকারের ওপর দায়িত্ব দেয়া হয় সে সাহস করেনি। আমাদের বলে, শালারা মাইসসা। আপনে গ মুছলমান বানাইতাম না। কেননা সে সময় মুক্তিফৌজের তৎপরতা বেশ বেড়ে গিয়েছিল।

এভাবেই অত্যাচার, নির্যাতন, ভয়, আতঙ্কের মধ্য দিয়ে কাটে আমাদের ভয়ঙ্কর দিনগুলাে। এরপর আসে স্বাধীনতা। ১৬ ডিসেম্বর সর্বত্র বাঁধভাঙা মানুষ রাস্তায়। মুক্তিবাহিনী, মিত্রবাহিনী, মুক্ত জনগণ মিলেমিশে একাকার। মানুষ কাদছে, হাসছে। একদিকে প্রিয়জন ও সর্বস্ব হারানাের বেদনা, অন্যদিকে স্বাধীনতার আনন্দ। সে এক অভাবিত, অভূতপূর্ব দৃশ্য যা বর্ণনা করা আমার পক্ষে সম্ভব নয়।

শান্তিরঞ্জন বর্মন
প্রধান শিক্ষক
মর্নিংসান কিন্ডারগার্টেন এন্ড হাই স্কুল
কামারজুরী গাজীপুর।

১৯৭১ সালে স্বাধীনতাযুদ্ধের সময় আমি খুব ছােট। নয় মাস ধরে চলা যুদ্ধের স্মৃতি আমার খুব বেশি নেই কিছু টুকরাে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ছাড়া। আমি তখন। এতটাই ছােট ছিলাম যে দেশে যুদ্ধ হচ্ছে। কেন যুদ্ধ হচ্ছে। কাদের সাথে যুদ্ধ হচ্ছে সে সব কিছুই বুঝতাম না। আমরা ছিলাম তিনভাই। তিন জনেই ছােট। একদিন শেষ রাতে মা আমাদের ঘুম থেকে তুলে কিছু খাইয়ে জামা কাপড় পরিয়ে তৈরি করে নিলেন। পোঁটলা বেঁধে সুটকেসে জিনিসপত্র ভরে আগেই গুছিয়ে রেখেছিলেন। রাত একটু ফর্সা হলে বাবা-মা আমাদের নিয়ে হাঁটা শুরু করলেন। আমি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করি, এত ভাের সকালে কোথায় যাচ্ছি মা? মা বললেন, তাের মামাবাড়ি। মাকে আবার প্রশ্ন করি কেন যাচ্ছি মামাবাড়ি? আগে বললানি তাে? মা বললেন,দেশে যুদ্ধ বেধেছে। তাই তাের মামাবাড়ি যাচ্ছি। সেখান থেকে ভারত। তাের মামাবাড়ির সবাই ভারত চলে যাবে। সেখান থেকে তাদের সাথে আমরাও চলে যাবাে। আমার মনে বিভিন্ন প্রশ্নের জন্ম হতে লাগলাে। যুদ্ধ কী? কেনই বা যুদ্ধ, কোথায় কোন দেশ ভারত, সেখানে চলে যাবাে কেন? মাকে আবার প্রশ্ন করি, কেন আমরা। ভারত চলে যাবাে মা? মা বললেন, দেশে যুদ্ধ শুরু হয়েছে। পাকিস্তানি সৈন্যবাহিনী এ দেশের সব মানুষকে মেরে ফেলছে। দেশ ছেড়ে না গেলে। আমরা কেউ বেঁচে থাকবাে না। সারা দিন পায়ে হেঁটে সন্ধ্যার আগে আমরা পৌছাই মামাবাড়ি। আমার মামাবাড়ি ছিল নরসিংদী জেলার পলাশ থানার সুলতানপুর গ্রামে। পরে শুনেছিলাম আমার দাদু (মায়ের বাবা) যুদ্ধকে খুব ভয় পেতেন। তিনি ভারত যাবার সিদ্ধান্ত নিয়ে আমাদের খবর দিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। মামাবাড়ি থেকে দাদুর আরও দুই ভাইয়ের পরিবারসহ আমরা বাড়ি থেকে বের হই। আমাদের সাথে ছিল গ্রামের আরও অনেক পরিবার। যেহেতু আমি অনেক ছােট ছিলাম তাই দিনতারিখ আমার জানা ছিল না। আমরা সবাই পায়ে হেঁটে রওনা হই। একদিন হাঁটার পর আমি আর হাঁটতে পারছিলাম না। দাদু তখন আমাকে কাঁধে নিয়ে হাঁটতে থাকেন। এই স্মৃতিটি এখনাে আমার জ্বলজ্বল করে ভাসে। রাস্তায় কী খেয়েছি বা খাইনি আজ আর সে সব মনে নেই। হাঁটতে হাঁটতে এক সময় আমরা এক নদীর ধারে আসি। তখন নদীর নাম জানতাম না। বড় হয়ে জানতে পারি নাম ছিল ব্ৰহ্মপুত্র নদ। এই নদ দিয়ে নৌকা করে আমরা যেতে লাগলাম ভারতের উদ্দেশ্যে।
আমাদের নৌকাগুলাে ভৈরব হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া দিয়ে আখাউড়া সীমান্ত অতিক্রম করতে চেয়েছিল। কিন্তু কয়েকদিন নৌকা চলার পর নৌকাগুলাে আবার যশােহর চলে আসে। সেদিন কিছু বুঝতে পারিনি। পরে জানতে পারি বর্ডার বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তাই আর আমাদের ভারত যাওয়া হলাে না। যশােহর হলাে নরসিংদী জেলার শিবপুর থানার একটি স্থান। যশােহর বাজারটি ছিল নদীর পাড়ে। বাজারের পাশে ছিল একটি স্কুল। নৌকা থেকে নেমে আমরা সেই স্কুলঘরে থাকতে লাগলাম। স্কুলঘরটিতে আরও অনেক লােক আশ্রয় নিয়েছিল। কয়েকদিন থাকার পর হঠাৎ দাদু বাজার থেকে এসে বললেন, পাকিস্তানি সৈন্যরা আসছে। সবাইকে স্কুল ছেড়ে চলে যেতে হবে।’ সবাই স্কুল ছেড়ে যে যেদিকে পারলাে সরে যেতে লাগলাে। আমরা হাঁটতে লাগলাম দাদুর শ্বশুরবাড়ির দিকে। দাদু মাকে বললাে, তােরা হাঁটতে থাক আমি স্কুলের রুমের তালাটা লাগিয়ে আসছি। দাদু আর আসতে পারলেন না। তালা লাগাতে গিয়ে একটু সময় দিতে হয়। ততক্ষণে পাকসৈন্যরা এসে পরে। এবং দাদুকে লক্ষ্য করে গুলি করে। গুলি খেয়ে দাদু লুটিয়ে পড়েন। দাদুর সাথে ছিলেন দাদুর এক ভাই। তিনি কীভাবে দৌড়ে কিছু দূরে একটা পুকুরে গিয়ে ডুব দিয়ে থাকেন। পুকুরটি ছিল কচুরিপানায় ভর্তি। পানা দিয়ে মাথা পর্যন্ত ঢেকে শুধু নাক ভাসিয়ে লুকিয়ে থাকেন। পাকসেনারা চলে যাওয়ার পর দাদু উঠে দাঁড়াতে চেয়েছিলেন। কিন্তু দূর থেকে দেখতে পেয়ে পাকসেনারা আবার ফিরে আসে। এবং দাদুকে বেয়ােনেট দিয়ে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে মারে। এ দৃশ্যটি প্রত্যক্ষ করে পানার নিচে লুকিয়ে থাকা আমার সেই দাদু।
আমরা সবাই যেখানে আশ্রয় নিয়েছিলাম সেই বাড়িতে গিয়ে আমি মাকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘মা পাকিস্তানি সৈন্যরা কী?’ আমার ধারণা ছিল পাকিস্তানি সৈন্যরা বিদ্যুতের খুঁটির তার বেয়ে আসে। পাকিস্তানি সৈন্যদের নামে মানুষের এত ভয়ভীতি আর তাদের অত্যাচারের কাহিনী শুনে তারা যে মানুষ এমন ধারণা সেই বয়সে আমার হয়নি। এখন একটা সময় বুঝতে পারি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী মানুষ হয়ে কীভাবে তারা বাংলাদেশে ধ্বংসলীলায় মেতে উঠেছিল।

লাবণী দাস
গৃহিণী , ভাওয়াল চাঁদপুর,
কাপাসিয়া, গাজীপুর।
আমার বাবার বাড়ি গাজীপুর জেলার কাপাসিয়া থানার খিলগাঁওয়ে। স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় আমি ছিলাম বাবা-মার সাথে বাড়িতে। তখন আমার বিয়ে হয়নি। আমার জ্যাঠাতাে ভাই ঢাকায় চাকরি করতেন। ২৬ মার্চ সন্ধ্যার দিকে তিনি পরিবারসহ পালিয়ে পায়ে হেঁটে খিলগাঁওয়ে চলে আসেন। দাদার কাছে যুদ্ধ শুরু হওয়ার কথা এবং আগের রাতে ঢাকার ভয়ঙ্কর অবস্থার কথা। জানতে পারি। দু’একদিনের ভেতর ঢাকা থেকে পালিয়ে আরও লােকজন। আমাদের গ্রামে আসতে শুরু করে। কিছুদিন থেকে সবাই বলাবলি করছিল, দেশে গণ্ডগােল হতে পারে কিন্তু এমনটি হবে এটা তাে কেউ ভাবতেও পারেনি। গ্রামবাসী আতঙ্কে দিন কাটাতে থাকে। এরই মধ্যে পাঞ্জাবিদের। গ্রামে ঢােকা আর তাদের অত্যাচারের কাহিনী আসতে থাকে নানাদিক থেকে। খিলগাঁওয়ে হানাদার বাহিনী আসে এপ্রিলের মাঝামাঝি সময়ে। হঠাৎ একদিন সকালবেলা পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের গ্রাম ঘেরাও করে ফেলে। একটি প্রাণীও বুঝতে পারেনি। হানাদার বাহিনী গ্রামে ঢুকে গুলি শুরু করে। গ্রামবাসী দিশেহারা হয়ে যায়। বিভিন্ন দিকে ছুটতে থাকে। সমস্ত মানুষের আর্তচিঙ্কারে এক ভয়াবহ অবস্থার সৃষ্টি হয়। আমাদের গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে নগদা নদী। সবাই নগদা পার হয়ে ওপারে চলে যায়। কে কীভাবে সেদিন নগদা পার হতে পেরেছিল সে নিজেও জানে না। নগদা নদী পার হয়ে আমরা উলুখলা যাই। সেখানে কেউ বাড়িতে, কেউ মঠখােলা গির্জায়, কেউ গাছতলায় আশ্রয় নিই। আমার বাবা আমাদের নিয়ে আশ্রয় নেন গির্জায়। পরে আমরা শুনতে পাই নগদা পার হওয়ার সময় একটি মেয়ে পাঞ্জাবিদের হাতে ধরা পড়ে। নির্যাতনের ফলে তখনই সে মারা যায়। এক সপ্তাহ আগে আমার মামার গ্রাম বাড়িয়াগ্রামে (বাইড়াগ্রামে) হানাদার বাহিনী। প্রবেশ করে। ওরা পুরাে গ্রাম জ্বালিয়ে দেয়। গ্রামের আরও কয়েকজনের সাথে আমার মামাকেও মেরে ফেলে। স্বাধীনতাযুদ্ধের দিনগুলাে আমরা মঠখােলা গির্জায় কাটাই। অর্ধাহারে, অনাহারে আতঙ্কে দিন-রাত যাপন করি। প্রতিদিনই বিভিন্ন এলাকায় হানাদার বাহিনীর ভয়ানক নিপীড়নের খবর আসে। গির্জার ফাদার করুণ মুখে কুশ আঁকেন। গির্জায় আমরা মেয়েরা শুধু আতঙ্কিত থাকতাম এই ভেবে যে, হানাদার বাহিনী যে কোনাে সময় গির্জায় ঢুকে আমাদের তুলে নিয়ে যেতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের সেই দুঃসহ দিনগুলাের স্মৃতি এখনাে গভীরভাবে বয়ে বেড়াই।

আলাউদ্দিন
ব্যবসায়ী ও কৃষক
উজিলাব শ্রীপুর, গাজীপুর।

আজ থেকে প্রায় একচল্লিশ বছর আগে সশস্ত্র মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আমরা পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে পরাজিত করি। স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। দীর্ঘদিন পর অনেক ঘটনাই ঝাপসা হয়ে গেছে। এর মাঝে আমার জীবনের উল্লেখযােগ্য ও এলাকার কিছু ভয়াবহ ঘটনা বর্ণনা করছি।
মুক্তিযুদ্ধের কিছুদিন আগে থেকে আমি গরুর ব্যবসা করি। যেদিন যুদ্ধ শুরু হলাে, আমি তখন করটিয়া বাজারে। করটিয়া বাজারে গরু বিক্রি করে জয়দেবপুর স্টেশনে আসি। আমার বাড়ি শ্রীপুর থানার উজিলাব গ্রামে। সে সময় জয়দেবপুর থেকে শ্রীপুরের যােগাযোেগ ছিল রেলগাড়ি। অন্য কোনাে যান্ত্রিক যানবাহন ছিল না। গরু-মােষের গাড়ির প্রচলন ছিল বেশি। আমরা এ অঞ্চলের বাজারগুলােতে কেনাবেচা করে জয়দেবপুরে এসে ট্রেনে করে বাড়ি ফিরতাম। সেদিনও বাড়ি ফেরার জন্য জয়দেবপুর স্টেশনে উপস্থিত হই। আমার সাথে আরও কয়েকজন গরুর ব্যবসায়ী ছিল। রাত তখন গভীর। যুদ্ধের প্রথম প্রহর চলছে। খবরটি আমরা তখনাে পাইনি। স্টেশনে পৌছে দেখি স্টেশন মাস্টার রুমের বাইরে। তিনি স্টেশনে থাকা লােকজনকে জানালেন যে, “ঢাকায় পাকিস্তানিদের সাথে বাঙালিদের যুদ্ধ শুরু হয়েছে। আপনারা সবাই যে যার বাড়ি চলে যান। বাইরে কেউ নিরাপদ নই। ট্রেন ছাড়ার কোনাে সম্ভবনা নেই। উপায়ন্তর না দেখে আমরা ত্বরিত গতিতে শ্রীপুরের দিকে রওনা হই পায়ে হেঁটে।
এরপর থেকে বাংলাদেশের প্রতিটি এলাকার জনগণের মতাে ভয়ে-আতঙ্কে দিন কাটাতে থাকি। আর পাঞ্জাবির গ্রামে ঢােকার দিনটির অপেক্ষা করতে থাকি। দিনক্ষণ মনে নেই তবে এপ্রিল মাসের শেষের দিকে পাঞ্জাবিরা আমাদের শ্রীপুর থানার উজিলাব গ্রামে ঢােকে। সেদিন ওরা লােকজনের খোজ করেনি। কারাে বাড়িতেও যায়নি। আগুনও দেয়নি। গ্রাম দেখে চলে যায়। পরে হঠাৎ করে একদিন পাঞ্জাবিরা আমাদের বাড়ি ঘেরাও করে। আমার বড়ভাই ছিলেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা। তিনি পালিয়ে কোথাও যাননি। পাঞ্জাবিরা গ্রামে ঢােকার দিনটি পর্যন্ত এলাকার জনগণের পাশে ছিলেন। পাঞ্জাবি যখন ঢােকে তখন শেষরাত। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। বাড়ি ঢুকে ওরা ফায়ার শুরু করে। ঘরের ভেতর আমরা অবর্ণনীয় মানসিক চাপে কাটাতে থাকি। প্রথমে মনে করি ডাকাত। পরে ওদের ভাষা শুনে বুঝতে পারি পাঞ্জাবি। পাঞ্জাবিরা দরজা ভেঙে ভাইকে বের করে আনে। নিয়ে আসে উঠোনে। ভাই আমাদের বললেন, তােমরা সব বেরিয়ে এসাে। বুঝতে পারছিলেন বের হয়ে না এলে উপায় নেই। সবাই বাইরে এলে ওরা আমাদের তিনভাইকে বেঁধে ফেলে এবং নিয়ে চলে। কিছুদুর গিয়ে আবার নিয়ে এলাে বাড়িতে। এসে গােটা বাড়ি তল্লাশি শুরু করে। আমাদের ধরে নিয়ে গেলে বাড়ির মহিলারা ভয়ে বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। প্রথমে আমাদের ধরে নিয়ে গেলাে শ্রীপুর ক্যাম্পে। সেদিন আরও ধরে নিয়ে গেলাে আমাদের গ্রামসহ শ্রীপুর ও কেওয়া গ্রামের সাতাশ জন লােক। সবাইকে ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে শান্তি কমিটির সুপারিশে ছয়জনকে ছেড়ে দিলাে ।
সকালে মেম্বার ক্যাম্পে গেলেন। তিনি সম্পর্কে আমার মামা, পাঞ্জাবি মেজর তাকে জিজ্ঞেস করলাে আমাকে চেনেন কিনা। পর পর তিনবার বললেন, তিন আমাকে চেনেন না। এরপর আধঘণ্টা ব্যবধান রেখে একজন একজন করে লােক সরিয়ে ফেলতে লাগলাে। কোথায় নিয়ে যাচ্ছে বুঝতে পারছি না। আমাকে ধরে নিয়ে গেলাে বিহারি এক ছেলে। যেখানে আমাকে নিয়ে যাওয়া হলাে, চেয়ারে বসা পাঞ্জাবি এক অফিসার। আমাকে জিজ্ঞেস করলাে আমি মুক্তি কিনা। আমি জানি না কীভাবে বুঝে ফেললাম। বললাম মুক্তি না। আর কী জিজ্ঞেস করলাে না বুঝে বলে ফেললাম মুক্তি না। একজন দাঁড়িয়ে থাকা পাঞ্জাবি সৈন্য তৎক্ষণাৎ আমার গালে বড় করে চড় মারলাে। এরপর একেক বার কিছু জিজ্ঞেস করে আর একটি করে বেতের আঘাত করতে থাকে। এভাবে আমাকে বার থেকে পনেরটি বেত মারে। কিছুক্ষণ পর আমাকে নিয়ে আসে শ্রীপুর ডিগ্রি কলেজ রােডের পাশে একটি বাড়িতে। বাড়িটির পাশে একটি পুকুর ছিল। এখনাে আছে, হাজামজা অবস্থায়। সে হাত-পা বেঁধে আমাকে পুকুরে নামায়। জলের নিচে আমাকে ফেলে একজন পাঞ্জাবি আমার ওপর দাঁড়িয়ে থাকে। যখন নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তখন মাথা নাড়া দিই। মাথা নাড়া দিলে পাঞ্জাবিটি সরে দাঁড়ায়। আবার সে একই কাজ করে। এক সময় আমি নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়লে আমাকে জলে রেখে পুকুর পাড়ে উঠে বসে। আমি বাঁধা হাত-পা নেড়ে নেড়ে কিনারে আসি। পাঞ্জাবিটি তখন টেনে তুলে। হাতের বাঁধনের দড়ি খুলে সেই দড়ি দিয়ে মারতে শুরু করে। এভাবে কিছুক্ষণ চলার পর আমাকে একটা ঘরে নিয়ে যায় এবং বন্দি করে রাখে। সে ঘরে দেখি আরও তিনজন লােক। আমার আগের অত্যাচারিত এরা তিনজন। এরা সবাই একই গ্রামের। এদের নাম যথাক্রমে আকাব্বর হাজি, আব্দুল আলি, সাত্তার। চারটার দিকে এক বালতি ডাল ও রুটি খাবার দিয়ে সেই বিহারি ছেলেটি বললাে, ‘শেষ খাবার খাও।’ রাত আটটার দিকে আবার এক এক করে ডাক পড়লাে। আমার ডাক পড়লাে ঘণ্টা দুয়েক পরে। আমাকে বের করে এনে প্রত্যেকটি ঘরের সামনে উঠবস করালাে অনেকক্ষণ ধরে । তারপর রাত দ্বিপ্রহর হলে বাড়ি থেকে বের করে রাস্তায় ছেড়ে দিলাে। আমি বেঁচে এলাম। কিন্তু ভাইকে রেখে এলাম। আমাকে যখন বের করে নিয়ে আসে তখন পাশের ঘরের টিনের বেড়ার ছিদ্র দিয়ে দেখি আমার ভাই অন্য হতভাগ্যদের সাথে বসে আছেন। ভাইয়ের সাথে যারা বসেছিলেন তাদের। নাম যথাক্রমে ১। আব্দুল ছামাদ ২। ওমর আলী ৩। লিয়াকত আলী ৪। সাত্তার ৫। মমতাজ উদ্দিন। মমতাজ উদ্দিন লিয়াকতের ভাই। এই ধৃত ব্যক্তিদের তিনজন ছিলেন উজিলাব গ্রামের বাসিন্দা। আর দুজন হলেন। পাশের কেওয়া গ্রামের। একদিন পর জানতে পারলাম ৫ জনকেই মেরে। ফেলেছে। ভয়ে কেউ লাশ আনতে যায়নি। ভাইয়ের লাশ কোথায় আজও আমরা কেউ জানি না। এরপর উজিলাব গ্রামে আর পাঞ্জাবি ঢােকেনি। কিন্তু চলছিল রাজাকারদের অত্যাচার। বাড়িঘরে আগুন, চুরি, গরু চুরি, জবরদস্তি করে সাধারণ মানুষকে নির্যাতন করছিল। মানুষের ফসল তুলে নেওয়ার মতাে নিপীড়ন তারা চালিয়েছিল স্বাধীনতারযুদ্ধ শেষ হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত। আমার শহীদ ভাই ছিলেন বিবাহিত। তখন তার সন্তান ছিল তিনজন। স্ত্রী ছিলেন গর্ভবতী। মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের তিনমাস পর শহীদ ভাইয়ের সে সন্তানের জন্ম হয়।
আমার অপর যে ভাইকে আমাদের সাথে ধরে নিয়ে গিয়েছিল আমার মতাে একইভাবে সে ভাইয়ের ওপরও চালিয়েছিল নির্যাতন। ভাইকে ছেড়ে দিয়েছিল বটে, কিন্তু নির্যাতনের ফলে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই তার অকাল মৃত্যু ঘটে।