This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.
কনফিডেনসিয়াল ডায়েরী
বিক্রমাদিত্য
জেনারেল জিয়াউর রহমান নিহত’ বেশ ফলাও করে রবিবারের সংবাদপত্রে এই খবরটি প্রকাশ করা হয়েছিল।
খবরটি পড়ে আমি একটুও বিস্মিত কিংবা উত্তেজিত হইনি, কিন্তু জিয়ার হত্যাকারী মেজর জেনারেল মনজুর আহমেদের নাম পড়ে বেশ অবাক হয়েছিলুম। কখনও কল্পনা করিনি যে মেজর জেনারেল মনজুর তার বিশেষ বন্ধুকে খুন করবার চক্রান্ত করতে পারে। কিন্তু নিজের মনকে এই বলে সান্ত্বনা দিলুম যে বাংলা দেশে সব কিছুই ঘটা সম্ভব। কারণ ওপার বাংলায় যে কোনদিনই শান্তি ফিরে আসবে না এই কথা আমি একদিন মেজর জেনারেল মনজুর আহমেদকে বলেছিলুম। কিন্তু সেদিন বলবার সময় কল্পনাও করিনি যে একদিন এই গৃহ বিপ্লবের ঝড়ে পড়ে জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং মনজুর আহমেদ প্রাণ হারাবেন।
দীর্ঘ ছয় বছর আগে আমার জীবনের ভাগ্য ওই দেশের গৃহ বিপ্লবের সঙ্গে জড়িত ছিলাে। কারণ ঐ বাংলার জল হাওয়ায় আমি মানুষ হয়েছিলুম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ সমাপ্ত করে যখন এপার বাংলায় চলে এলুম তখন আমাকে কেন্দ্র করে বাদানুবাদ হয়নি। আসবার জন্যে কোন ছাড়পত্রের ও প্রয়ােজন হয়নি। দীর্ঘ ত্রিশ বছর বাদে আমি আবার যখন ওপার বাংলায় গেলুম তথন বিদেশী নাগরিকের ছাড়পত্র নিয়ে ফিরতে হয়েছিল। ওখানে অবশ্যি বেশীদিন থাকবার সুযােগ হয়নি। কারণ হঠাৎ একদিন আমার বড় সাহেব সমর সেনকে ডেকে জিয়াউর রহমান বললেন, ওর এখানে আর থাকা চলবে না। এই দেশ থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে চব্বিশ ঘণ্টার সময় দেওয়া হলাে। ওকে এই সময়ের মধ্যে বাংলা দেশ ত্যাগ করতে হবে।
জিয়াউর রহমানের কিংবা বলতে পারি বাংলাদেশ সরকারের এই আদেশের বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছিলুম। কোন ফল পাইনি। বাংলাদেশ থেকে বিদায় নিয়ে চলে গেলুম অনেক দূরে য়ুরােপে।
ছন্নছাড়া যাযাবর জীবনের সব গল্প আমার খাতায় লিখে রাখিনি। আজ জীবনের অপরাহ্নে পৌছে মনে হচ্ছে জীবন কাহিনী রচনা করতে হলে এমন একটি হালখাতার প্রয়োজন আছে। হয়তো এই স্মৃতিকথা লিখে রাখলে শুধু জিয়াউর রহমান মনজুর আহমেদকে নিয়েই বাংলাদেশের এই গৃহবিপ্লবের রামায়ণ মহাভারত রচনা করতে পারতুম।
কি কারণে জিয়াউর রহমান এবং মনজুর আহমেদের নাম আমার জীবনের স্মৃতিপটে গেঁথে ছিলাে এবার সেই কথা বলা যাক।
একটি দিনের কথা আমার চিরকাল মনে থাকবে। দুপুর বেলা সবে খেতে বসেছি। এই সময়ে টেলিফোন বেজে উঠলাে। ইচ্ছে করেই টেলিফোন ধরলুম না। একটানা বেজে চলে। একটু বাদে টেলিফোনের আর্তনাদ থামলাে। ভাবলুম বাচা গেছে।
কিন্তু কিছুক্ষণ বাদেই টেলিফোন আবার বাজতে শুরু করলাে। এবার টেলিফোন না ধরে পারলুম না। টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনের কণ্ঠস্বর ভেসে এলাে।
কী ব্যাপার? টেলিফোন একটানা বেজে চলেছে, ধরছ না কেন? বেশ ভৎসনার সুরেই সেন সাহেব প্রশ্ন করলেন। তারপর আর কোন ভূমিকা
করে তিনি বললেন-এক্ষুনি আমার বাড়ি চলে এসাে।
সমর সেনের আদেশ এবং কণ্ঠস্বর শুনে আমি বেশ অবাক হলুম। এই ভরদুপুরে উনি আমাকে ওর গুলশান বাড়িতে ডাকছেন কেন? আমার বিস্ময়ের আর একটি কারণ ছিলো। সেন সাহেব অসুস্থ, মাত্র এক মাস আগে ওকে গুলী করে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছিলাে। সাধারণতঃ উনি টেলিফোনে কারাের সঙ্গে কথা বলতেন না। প্রয়োজন হলে সেক্রেটারির মারফৎ কথা বলতেন। আজ উনি কেন এই অসুস্থ শরীর নিয়ে নিজে আমাকে টেলিফোন করলেন? সমর সেনের সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠতা ছিলো। বুঝতে অসুবিধে হলো না যে বিশেষ কোন জরুরী কারণে সেন সাহেব আজ আমাকে ডাকেছেন।
গাড়ি নিয়ে সােজা গেলুম ওর গুলশানের বাড়ীতে। যতােই ওর বাড়ির কাছে এগুতে লাগলাম ততােই মনের উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগলো। কি কারণে সেন সাহেব আমাকে আজ তলব করেছেন এই নিয়ে নানা রকম চিন্তা ভাবনা করতে লাগলুম। ওঁর বাড়িতে ঢােকবার সঙ্গে সঙ্গে সেন সাহেবের সেক্রেটারি এসে আমাকে বললাে- চলুন, সেন সাহেব আপনার জন্যে বসবার ধরে অপেক্ষা করছেন।
________________________________________
কি ব্যাপার বলাে তাে? আমি সেক্রেটারির কাছে জানবার চেষ্টা করলুম। সে কিছু বলল না। শুধু দেখলুম ওর মুখ বেশ গম্ভীর। এবার বুঝতে অসুবিধে হলাে না যে ব্যাপারটা খুবই গুরুতর।
সেনসাহেব আমাকে দেখে বললেন, কেমন আছ?
ওঁর এই প্রশ্ন শুনে বেশ অবাক হলুম। এই দুপুরে উনি কি আমাকে এই মামুলি কথা জিজ্ঞেস করবার জন্যে ডেকে এনেছেন? আর শুধু তাই নয়। গতকাল অনেক রাত অবধি আমি ওঁর সঙ্গে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে আলােচনা করেছি। চব্বিশ ঘণ্টাও পার হয়নি। হঠাৎ উনি আমাকে এই প্রশ্ন করছেন কেন ?
ভালােই তাে আছি। আমি শুকনাে গলায় গতানুগতিক জবাব দেবার চেষ্টা করলুম।
কি খাবে বলো? কোনাে ড্রিংক ?
আমার মনের উৎকণ্ঠা বাড়তে লাগলো। সেন সাহেব এই সব ভনিতা করছেন কেন ? আসল কথা বলছেন না কেন?
আমি কিছু জবাব দেবার আগেই সেক্রেটারি এক মাস বিয়ার নিয়ে এলাে।
আমি বিয়ারের গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে ওর মুখের দিকে তাকালুম। মনের উত্তেজনা ক্রমেই বাড়তে লাগলাে।
জিয়াউর রহমানকে চেনাে? সেন সাহেব জিজ্ঞেস করলেন। তার এই প্রশ্ন শুনে মনে হলো যে উনি এবার জরুরী কিন্তু গােপনীয় কথাটি বলবেন।
অল্প বিস্তর। গানের আসরে এবং ককটেল পাটীতে দু’একবার দেখা হয়েছে। ক্ষণিকের পরিচয়, তবে উনি আমার পরিচয় জানেন, আমি জবাব দিলুম| ওকে তুমি বিশ্বাস করাে? সেন সাহেব এর আগেও দুএকবার জিয়াউর রহমান সম্বন্ধে এই ধরনের প্রশ্ন করেছেন। এর স্পষ্ট জবাব আমি সেন সাহেবকে বহুবার দিয়েছি। আর সেই জবাবের কারণও বলেছি। কাজেই এবার আর এই প্রশ্নের কোন জবাব দেবার প্রয়ােজন মনে করলুম না। চুপ করে বিয়ার খেতে লাগলুম।
বেশ, এবার তােমাকে একটা দুঃসংবাদ দেবাে? খবরটি খারাপ। তােমাকে চবিবশ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে হবে। আজ সকালবেলা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র দপ্তরের বিদেশ সচিব তােবারক হােসেন আমাকে ডেকে
________________________________________
পাঠিয়েছিলেন। তোবারক আমাকে বেশী কিছু বললো না। শুধু বললেন বাংলাদেশে তোমার আর থাকা চলবে না। প্রেসিডেন্ট সায়াম নিজে এই নির্দেশ তোবারক হােসেনের কাছে পাঠিয়েছেন। তাই ওর বেশি কিছু বলবার ছিলো না। অবশ্যি, প্রেসিডেন্ট সায়াম ইচ্ছে করে তােমার বিরুদ্ধে এই নির্দেশ জারী করেন নি। জেনারেল জিয়ার পরামর্শেই এই নির্দেশ দিয়েছেন। তাই তােমাকে কাল বিকেলের মধ্যে ঢাকা ছেড়ে চলে যেতে হৰে-সেন সাহেবের শেষের কথাগুলোর মধ্যে আদেশের সুর ছিলাে।
আমি কোন উত্তেজনা প্রকাশ করলুম না। প্রকাশ করে কোন ফল হত না, কারণ আমিও ঐ ধরনের একটা সরকারী হুকুমের আশংকা করেছিলুম। বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলুম।
সেন সাহেব আবার বলতে শুরু করলেন : আমি আজ বিকেলে জেনারেল জিয়ার সঙ্গে দেখা করবো, তোমাকে কেন চলে যেতে বলা হলো তার কারণ জিজ্ঞেস করবাে। দরকার হলে প্রতিবাদ করবাে। এ হলাে অন্যায় আদেশ। তবে প্রতিবাদ করে কোন লাভ হবে কিনা জানিনে, তুমি অবশ্যি কাল বিকেলেই যাবার জন্যে তৈরি থেকে। বাংলাদেশ তােমাকে বের করে দিচ্ছে, এই খবর আমি দিল্লীর কর্তাদের জানাচ্ছি। হ্যা আর একট। কথা মনে রেখে। আজকের ঘটনা এবং আমাদের এই আলােচনার কথা আর কাউকে বলাে না। তোমাকে বের করে দিচ্ছে এই খবরের কোন পাবলিসিটি আমি চাইনে, সেন সাহেব বললেন।
এবার আমার জিজ্ঞেস কররার পালা। বললুম : আমার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ সরকার কিংবা জিয়াউর রহমান কি অভিযোগ করেছেন? অর্থাৎ ওরা কেন আমাকে চবিশ ঘণ্টার মধ্যে বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বলছেন ?
কোন কারণ ওরা দেন নি। বিকেলে কারণ জানবার জন্যেই আজ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে আমি দেখা করবো:সেন সাহেব জবাব দিলেন। তারপর কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন : আমার মনে হয় তােমাকে বের করে দেবার একমাত্র কারণ হলো তুমি ঢাকার ছেলে তাই জিয়াউর চান না তুমি এদেশে থাকো।
সেন সাহেবের কথা আমাকে আতংকিত করলাে। কারণ ঐ সময়ে বাংলাদেশে কখন কি ঘটে তার স্থিরতা ছিলো না। আর আমার শত্রুর সংখ্যাও কম ছিলো না। এর মধ্যে প্রধান ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং তার ডান হাত এনায়েতুল্লা খান এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটি সার্ভিস।
________________________________________
বেশ শঙ্কিত মন নিয়েই বাড়ি ফিরে এলুম। কারণ আমি জানতুম •এবার থেকে আমার গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা হবে। শুধু তাই নয়, সেন সাহেব আমাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেবার খবর গােপন রাখলে ও জিয়াউর রহমান, বাংলাদেশ পররাষ্ট্র অফিস কিংবা এনায়েতুল্লা খান চুপ করে থাকবেন না। আর একবার যদি এই খবরটি ঢাকা প্রেস ক্লাবে ছড়িয়ে যায় তাহলে আমাকে বারাে ঘণ্টার মধ্যে এই দেশ ত্যাগ করতে হবে। বাড়ি ফিরে এসে কাউকে বললুম না যে আমাকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে এই দেশ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। চলে যাবার জন্যে জিনিষপত্র গোছাতে
এই সময়ে আমার আর একটি দিনের কথা মনে পড়লাে।
১৮ই আগষ্ট ১৯৭৫ সাল। যশাের এয়ারপােট। মুজিব হত্যার কাহিনী সারা বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে।
| বিমানবন্দরে আমি বসেছিলুম, এবং ঢাকায় ফিরে যাবার জন্যে প্লেনের অপেক্ষা করছিলুম। প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্লেন আসবার সম্ভাবনা ছিলো খুবই কম। কন্টেলি টাওয়ার বললাে প্লেন দু বার এয়ারপোটে নামবার ব্যর্থ চেষ্টা করে ফিরে গেছে। আর একবার শেষ চেষ্টা করবে। যদি প্লেন না নামতে পারে তবে রাত্রিটা আমাদের যশাের সাকিট হাউসে কাটাতে হবে। | সেদিন আমার সঙ্গী ছিলেন আর এক জন ভদ্রলোক। পেশায় তিনি ছিলেন সৈনিক এবং দিলীতে বাংলাদেশ হাইকমিশনের মিলিটারি এডভাইজার। ভদ্রলােকের নাম ছিলাে ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমেদ। তিনি ছিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমানের অন্তরঙ্গ বন্ধু এবং তারই নির্দেশে তিনি ঢাকায় ফিরে যাচ্ছেন।
এয়ারপােটে বসে থাকাকালীন এবং পরে প্লেনে বসে আমাদের দীর্ঘ সময় বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ এবং এই অঞ্চলের রাজনীতি নিয়ে আলাপ আলােচনা হলাে। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর একজন দক্ষ, কর্মঠ সৈনিক বলে মনজুর আহমেদের বেশ সুনাম ছিলাে। তাই জেনারেল জিয়া তাকে ডেকে পাঠিয়েছেন। মনজুর আহমেদকে একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ দেওয়া হয়েছে। তার নতুন চাকরি, হবে চীফ অব দি জেনারেল ষ্টাফ।
সেদিন কথা প্রসঙ্গে জানতে পারলুম যে, মনজুর আহমেদ পাকিস্থান সৈন্য
________________________________________
বাহিনীতে যােগ দেবার আগে ইকনমিক্স নিয়ে এম এ পাশ করেছিলেন। ছাত্র জীবনে তিনি কখনও দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেন নি। পরে তিনি পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীতে যােগদান করেন এবং তারপর কানাডায় ডিফেন্স সার্ভিস স্টাফ কলেজে যােগ দেন। মুক্তি যুদ্ধের সময় মনজুর আহমেদ শিয়ালকোটে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীতে কাজ করতেন। শিয়ালকোট থেকে পালিয়ে মনজুর আহমেদ ভারতবর্ষে এলেন। পরে তিনি মুক্তি যুদ্ধে যােগ দেন।
কথাবার্তায় মনজুর আহমেদ ছিলেন অতি অমায়িক ভদ্রলোক এবং তার কথাবার্তায় বুদ্ধিজীবির ছাপ বেশ পরিস্ফুট হয়ে উঠত। আলাপ আলােচনা থেকে বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলুম যে মনজুর আহমেদ খাঁটি স্বদেশ প্রেমিক এবং ঐ সময়ে এক মুহূর্তের জন্যে তিনি বাংলাদেশ সরকার কিংবা তার সৈন্যবাহিনীর নিন্দা করে কিংবা দোষারােপ করে কোন মন্তব্য করেন নি কিংবা কারাে বিরুদ্ধে কোন কথা বলেন নি। সেদিন তার মুখে ভারত বিরোধী কোন সমালােচনাও আমি শুনি নি। কারণ আমাদের আলাপআলােচনা ছিলাে পুরােপুরি বুদ্ধিজীবির আলোচনা।
মনজুর আহমেদ ছিলেন জিয়াউর রহমানের পরম ভক্ত। তিনি জিয়াউরের প্রশংসা করে তার সম্বন্ধে অনেক কথা বললেন। সব কথা আমার আজ মনে নেই। যেটুকু মনে আছে সেইটুকু লিখছি।
মনজুর আহমেদ জিয়াউর রহমানকে খাটি স্বদেশপ্রেমিক বলে গণ্য করতেন। মুক্তি যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম রেডিও থেকে সর্ব প্রথম বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা ঘােষণা করেছিলেন। কারণ মুজিব গ্রেপ্তার হবার পর আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট সদস্যরা কলকাতায় পালিয়ে এসে আস্তানা গাড়েন এবং কলকাতায় থিয়েটার রােডের বাড়ি থেকে বাংলা দেশে মুক্তি যুদ্ধ পরিচালনা করতেন। এই সময়ে মুক্তি বাহিনীর সৈন্যদের মধ্যে মত বিরােধ ঘটে। কারণ মুক্তি বাহিনীর কমাণ্ডার ইন চীফ ছিলেন জেনারেল ওসমানী। তিনি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ সৈন্যবাহিনীতে সাধারণ লেফট্যান্ট হিসেবে কাজ করতেন। দেশ ভাগ হবার পর ওসমানী পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীতে যােগদান করেন এবং কর্নেলের পদ থেকে অবসর গ্রহণ করেন। জীবনযাত্রায় কর্নেল ওসমানী ছিলেন পাকা সাহেব। | ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী যখন পূর্ব পাকিস্তানে বাঙালীদের উপর অত্যাচার শুরু করে তখন পূর্ব বাংলায় ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের সংখ্যা ছিলাে প্রায় ছয় হাজার। এই সৈন্যবাহিনীয় মধ্যে প্রায় তিন হাজার
________________________________________
লােক মারা যায়। পুর্ববাংলার আর্মাত ফোর্সের সংখ্যা ছিলো প্রায় পাঁচ হাজার। এদের মধ্যেও অধিকাংশ লােকই পাকিস্থানী সৈন্যবাহিনীর হাতে নিহত হন। বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের সংখ্যা ছিলো প্রায় ১৪। এই বাহিনীর প্রায় আট হাজার লােক পাকিস্তানীদের হাতে মারা যান। ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট আর্মড ফোর্সের এবং বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্সের অতি অল্প কয়েকজন ছাড়া সবাই মুক্তি বাহিনীতে যােগদান করেন। এদের পরিচালনার দায়িত্ব দেওয়া হয় জেনারেল ওসমানীকে।
জেনারেল জিয়াউর রহমান ছিলেন চট্টগ্রামে পৃর্ব পাকিস্থানী সৈন্যবাহিনীর নেতা। খালেদ মােশারফ কুমিল্লা বাহিনীর নেতৃত্ব করতেন এবং শফীউল্লা ছিলেন ময়মনসিংহে পূর্ব পাকিস্থানী বাঙালী সৈন্য বাহিনীর নেতা।
পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী এই সব নেতাদের বিদ্রোহী বলে ঘােষণা করলেন এবং বিনা বিচারে এদের আটক কিংবা গুলী করে মারতে লাগলেন। মুক্তি বাহিনী এবং পাকিস্থানী সৈন্যবাহিনীদের মধ্যে যুদ্ধ তীব্র হলাে। পাকিস্তানে যে সব বাঙ্গালী সৈন্য এবং এয়ারফোর্সের লােকেরা ছিলেন তারা পালিয়ে এসে মুক্তি বাহিনীতে যােগ দিলেন। এদের মধ্যে কর্ণেল তাহের কর্ণেল জিয়াউদ্দিনের নাম উল্লেখযােগ্য। ওই সময়ে মেজর মনজুর আহমেদ কর্ণেল তাহেরের সঙ্গে যােগ দিলেন। কর্ণেল তাহের মুক্তিবাহিনীর 11th sector এর দায়িত্ব নিলেন, খালেদ মোশারফ ছিলেন আগরতলা মুক্তি বাহিনীর কমাণ্ডার, এই ব্রিগেডের নাম ছিলো ‘কে’ ফোর্স। জিয়াউর রহমান ছিলেন জেড ফোর্সের নেতা। পরে হিসেব করে দেখা গেলাে যে খালেদ মােশারফের ‘কে’ ফোর্স এবং জিয়াউর রহমানের ‘জেড’ ফোস দুইটি ব্রিগেড সমস্ত শক্তি মিলিয়ে পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীকে হটাতে পারবে না। অতএব ভারতীয় সৈন্য বাহিনীর সাহায্য একান্ত দরকার হবে। জিয়াউর রহমান, কর্ণেল তাহের প্রস্তাব করলেন যে মুক্তি বাহিনীর শিবির বাংলাদেশের ভেতরে করা হোক। জেনারেল ওসমানী কর্ণেল শফিউল। এই প্রস্তাবের আপত্তি করলেন। এই সময় থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান এবং কর্ণেল তাহেরের মধ্যে বিশেষ হৃদ্যতা হয়। পরে ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিদ্রোহের দিন কর্ণেল তাহের জেনারেল জিয়াউর রহমানের জীবন রক্ষা করেন। সেই কাহিনী বারান্তরে বিস্তারিত করে বলা যাবে।
কিছুদিন পরে বাংলাদেশী সেনাবাহিনীর কমাণ্ডারদের এক বৈঠক হলাে। বৈঠকের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী জেনারেল জিয়াউর রহমানের ‘জেড ফোস’ সিলেট
১১
________________________________________
থেকে তাদের অপারেশন শুরু করলাে।
মনজুর আহমেদ আমাকে একটানা জিয়াউর রহমানের স্বদেশ প্রেমের কথা বলছিলেন। সেদিন আমি তার মুখ থেকে আগ্রহ সহকারে মুক্তি যুদ্ধের বিস্তৃত কাহিনী শুনছিলুম, কোন প্রশ্ন করিনি। কারণ মনজুর আহমেদ বেশ ভালাে গল্প করতে পারতেন।
আমাদের আলাপ আলোচনায় ভাটা পড়লাে। কারণ ইতিমধ্যে এয়ারপাের্টে প্লেন নেমে পড়েছিল। ঘােষণা শুনে আমরা উঠে দাড়ালুম।
প্লেনের অধিকাংশ যাত্রীই ছিলেন ভি, আই, পি। ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেন, বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি জাস্টিস সায়াম, মনজুর আহমেদ এবং আরাে কয়েকজন বিশিষ্ট লােক যাদের ইংরাজীতে বলা যায় ভেরী ভেরী ইম্পর্টেন্ট পার্সনস। মনজুর আহমেদ আমার পাশের সীটেই বসলেন। ঢাকা পৌছান অবধি একটানা গল্প শুরু হলাে। সেই কাহিনী পরে বলা যাবে। ঢাকায় পৌছে আমার আরও কয়েকবার মনজুর আহমেদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হয়েছিল। এই দেখা সাক্ষাৎ ছিলাে অতি মামুলী সামাজিক। তবে ৭ই নভেম্বর যখন বাংলা দেশের সৈন্যবাহিনী তাদের বারাে পয়েন্টের দাবি নিয়ে সিপাহী বিদ্রোহ ঘােষণা করলো এবং আমাদের অফিস এবং দপ্তরের কাছে ভুতের তাণ্ডব নৃত্য করতে লাগলাে তখন মনজুর আহমেদ আমাদের সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। পরে যখন জাতীয় সংসদীয় দলের কর্মীরা এবং কর্ণেল তাহেরের দুই ভাই ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে হত্যা করবার চেষ্টা করে তখন মনজুর আহমেদ ভারতীয় হাই কমিশনের দপ্তরে ছুটে এসেছিলাে।
জিয়াউর রহমানের জীবনের রহস্য এবং কি করে তিনি ক্ষমতার গদীতে বসলেন সেই কাহিনী বলতে হলে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আন্দোলন এবং মুজিব হত্যার রহস্য জানা দরকার।
এই কাহিনী শুরু হয় ১২-১৩ই নভেম্বর ১৯৭০ সালে।
কারণ ঐ তারিখে রাত্রে প্রাক্তন পূর্ব পাকিস্তানে এক প্রচণ্ড ঝড় হয় এবং ঐ ঝড়ে প্রায় দুই লাখের বেশি বাঙালী মারা যায়।
সেদিন যদি পুব বাংলাদেশে ঐ ঝড়ের তাণ্ডব নৃত্য না হতাে এবং পাকিস্তানে জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খা রিলিফের কাজ ভণ্ডুল না করতেন তাহলে
________________________________________
মুজিবর রহমান নতুন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি হতেন কিনা সন্দেহ। ওই নভেম্বর মাসে পুব বাংলাদেশে যদি ঐ প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হতাে তাহলে রাজনৈতিক ঝড়ও উঠতাে না।
মুজিব হত্যার পুরাে কাহিনী এবং কি করে জেনারেল জিয়াউর রহমান ওই হত্যার সঙ্গে জড়িয়ে ছিলেন, সেই কাহিনী বলবার আগে আমাদের অতীতে ফিরে যেতে হবে। কারণ ১৯৭৩ সালে এবং ১৯৭১-৭২ সালে সমস্ত বিশ্বব্যাপী যে গণ আন্দোলন হয়েছিলো, কী করে এবং কেন তার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতবর্ষ তথা শ্ৰমতী গান্ধী-পুর্ব বাংলার নেতাদের সাহায্য করেছিলেন সেই পুরান কাহিনী এখন রোমন্থন করা একান্ত প্রয়োজন কারণ এ ছাড়া বাংলাদেশের রাজনৈতীক পরিস্থিতি অনুধাবন করা সহজ হবে না।
১২ নভেম্বর ১৯৭০।
আমি তখন রেঙ্গুনে। দুই একদিনের মধ্যে আমি রেঙ্গুন ছেড়ে চলে যাবাে তাই নিজের কাজ নিয়ে ব্যস্ত ছিলুম। | সেই দিনটি ছিলাে বেশ গুমােট। নভেম্বর মাসে অতো গুমােট গরম দিন আমি এর আগে কখনও দেখিনি। কিন্তু বিকেলের দিকে রেঙ্গুনের বুকের উপর দিয়ে এক প্রচণ্ড ঝড় বয়ে গেলো। সারা রাত্রি ধরে ঝড় চললাে। ঝড়ের বেগ কমলাে পরের দিন বিকেলে। প্রথমে ভেবেছিলুম ঝড়টি শুধু রেঙ্গুনের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। কিন্তু দুদিন পরে কাগজ মারফত জানতে পারলুম যে ঐ ঝড়ে আসল ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে পুব বাংলা। কারণ ঐ ঝড় আকিয়াব, কক্সেস বাজার, ফেনী, চট্টগ্রাম এবং পুব বাংলার আরও বহু অঞ্চলের উপর দিয়ে বয়ে গেছে। প্রথমে ক্ষতির পরিমাণ জানা গেলো না কারণ বাঙালীদের পাকিস্তানের জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান এবং জঙ্গী বাহিনী বিশেষভাবে ঘৃণা করতাে। যদিও পাকিস্তান সরকারকে এই ঝড়ের পূর্বাভাষ দেওয়া হয়েছিলাে তবু তারা কোন সতর্কতা অবলম্বন করেন নি। শুধু তাই নয়। পরে যখন এই ঝড়ে হাজার হাজার নরনারী প্রাণ হারালেন এবং আশ্রয়হীন হলেন তখনও জঙ্গী বাহিনী কিংবা পাকিস্তান সরকার সহস্র গৃহহীন লােকদের আশ্রয় কিংবা সাহায্য করেন নি। বিদেশ থেকে এই সব গৃহহীন লোকদের সাহায্য করবার জন্যে বিভিন্ন প্রকারের সাহায্য পাঠান হলো। এই সব সাহায্য কোনাে কাজে লাগান হয় নি।
এই সময়ে বাংলাদেশের প্রধান রাজনীতিক দলের নাম ছিলো আওয়ামী লীগ। এই দলের নেতার নাম শেখ মুজিবর রহমান। মুজিবর ছিলেন অখণ্ড বঙ্গ দেশের মুখ্য মন্ত্রী শহীদ সুরাবাদ সাহেবের ভক্ত এবং সমর্থক।
অনেকদিন ধরে আওয়ামী লীগ পূর্ব পাকিস্তানের জন্যে অটোনমির দাবী করছিলেন। আওয়ামী লীগ ছয় পয়েন্টের একটি প্রােগ্রাম পাকিস্তান সরকারের কাছে পেশ করেছিলেন। কিন্তু তাদের এই দাবীকে জঙ্গী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া কিংবা দেশের সরকার আমল দিলেন না। ইয়াহিয়া এবং জঙ্গী বাহিনীর প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো।
নভেম্বরের এই ঝড়ের প্রায় তিন সপ্তাহ বাদে পাকিস্তানে নির্বাচন হলো। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ মােট ১৬৯-এর মধ্যে ১৬৭ আসন দখল করলাে। ঐদিকে বালুচিস্থান এবং ফ্রন্টিয়ার প্রদেশে ওয়ালি খানের ন্যাশনাল আওয়ামী পাটী প্রাদেশিক সরকারের প্রায় সব কয়টি আসন দখল করে। ইয়াহিয়া খান এবং জঙ্গী বাহিনী আওয়ামী লীগের জয়লাভে বিশেষ চিন্তিত হলেন। ইয়াহিয়ার চাইতেও বেশি চিন্তিত হলেন পাকিস্তান পিপলস পাটীর নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো। এই নির্বাচনে তিনি মাত্র ৮১টি আসন পেয়েছিলেন। সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তান সরকারের প্রধানমন্ত্রী হওয়া উচিত ছিলাে শেখ মুজিবর রহমানের। কিন্তু ইয়াহিয়া কিংবা জঙ্গী বাহিনী এবং তাদের বন্ধু জুলফিকার আলী ভুট্টো মুজিবর রহমান কিংবা বাঙ্গালীদের একেবারেই বিশ্বাস করতেন না। ভুট্টোর পরামর্শমুযায়ী ইয়াহিয়া খান ন্যাশনাল এসেম্বলীর বৈঠক স্থগিত রাখলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে জঙ্গী সরকারের এই সিদ্ধান্তে তুমুল আন্দোলন শুরু হলাে। এই আন্দোলনের পশ্চাতে আর একটি দাবি ছিলাে বাংলা ভাষার প্রচলন। কারণ পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার শুধু বাঙালীদের নয়, বাংলা ভাষাকেও মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। তারা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে উর্দতে শিক্ষার বন্দোবস্ত করেছিলেন।
ইতিমধ্যে জুলফিকার আলী ভুট্টো ঘােষণা করলেন যে যদি মুজিবর রহমানকে সংবিধান অনুযায়ী পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী করা হয় তাহলে তিনি পাকিস্তানের নব নির্বাচিত ন্যাশনাল এসেম্বলীকে বয়কট করবেন। ইয়াহিয়া খান ভুট্টোকে সমর্থন করলেন। এর প্রতিবাদে পূর্ব বাংলায় গণ আন্দোলন শুরু হলাে। ইয়াহিয়া খান মুজিবের সঙ্গে আপোষ মীমাংসার আলোচনার জন্যে ঢাকাতে চলে গেলেন। কিছুদিন পরে ভুট্টোও ঢাকাতে এলেন।
ভুট্টোর অবশ্যি মুজিবের সঙ্গে কথাবার্তা বলবার কোন ইচ্ছেই ছিলো না। তিনি ইয়াহিয়া খানের অনুরােধে ঢাকাতে এসেছিলেন।
২০শে মার্চের পর ভুট্টো কায়রােতে গিয়ে সাদাতের সঙ্গে দেখা করেন। এবং তাকে তার লেখা পাকিস্তানের এই রাজনৈতিক পরিস্থিতির উপর একটি বই উপহার দেন। সেই বইটি প্রায় একশাে পঁচিশ পাতার ছিল। আমি ২৪ ঘণ্টার জন্যে ভুট্টোর এই লেখা বইটি সংগ্রহ করি এবং তার ফটো কপি করে একটি কপি ইউনাইটেড নেশনসে ভারতের প্রতিনিধি সমর সেনকে এবং প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে পাঠাই। ভুট্টো এই বইতে মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং বাঙ্গালীদের প্রচুর নিন্দা করেছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে ঢাকাতে তিনি ইয়াহিয়ার অনুরােধে গিয়েছিলেন বটে তবে মুজিব কিংবা আওয়ামী লীগের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করবার কোন ইচ্ছেই তার ছিলাে
শুধু তাই নয়। ভুট্টো এই বইতে লিখেছিলেন যে পূর্ব পাকিস্তানের বাঙ্গালীদের এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার জন্যে ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়া খান তার পরামর্শে ই পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক অভিযান শুরু করেন।
ভুট্টো কায়রো শহরে গিয়ে সাদাতের সঙ্গে দেখা করেন এপ্রিল মে মাসে। অবশ্যি তিনি আরও কয়েকটি ঐশ্নামিক দেশে সফরে গিয়েছিলেন। প্রতি দেশের রাষ্ট্রপতিকে তার লেখা বইটি উপহার দিয়েছিলেন। ভুট্টো কখনও ভাবতে পারেন নি যে তার বইয়ের কপি সমর সেন কিংবা শ্ৰীমতী গান্ধী পড়বার সুযােগ পাবেন। | পরবর্তী কালে ১৯৭১ সালে নভেম্বর ডিসেম্বর মাসে ইউনাইটেড নেশনসের বক্তৃতায় সমর সেন ভুট্টোর লেখা-এর বহু অংশ থেকে পড়ে প্রমাণ করেছিলেন। যে যদিও ২৫ শে মার্চ তারিখে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীকে হামলা করবার নির্দেশ ইয়াহিয়া খান দিয়েছিলেন বটে কিন্তু আসলে ভুট্টোর লেখা বই তনুযায়ী ঐ কাজটি ভুট্টোর পরামর্শমুয়ায়ী করা হয়েছিলাে। ভুট্টো চীৎকার করে প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করেন এবং সেন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন : আপনি ঐ বই কোথায় পেয়েছেন? সেন সাহেব অবশ্যি কোন জবাব দেননি এবং ভুট্টোও অস্বীকার করেন নি যে বইটি তার লেখা নয়। কারণ বইটি খুবই সীমিত সংখ্যায় বিতরণ করা হয়েছিলাে। নভেম্বর ডিসেম্বর মাসের বহু ময়দান বক্তৃতায় ভুট্টোর সেই বই থেকে শ্রীমতী গান্ধী অনেক প্যারাগ্রাফ উদ্ধৃত করে বক্তৃতা দিয়েছিলেন।
কিছুদিন পরে বইটি ভুট্টো বাজার থেকে তুলে নেন।
১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে আমেরিকার খুব দৃঢ় বন্ধুত্ব ছিলাে। বন্ধুত্বের প্রধান কারণ ছিলাে যে আমেরিকা পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে নতুন বন্ধুত্ব স্থাপন করবার চেষ্টা করছিল। আর চীনকে বন্ধু করবার জন্যেই হেনরি কিসিংগার এবং প্রেসিডেটি নিক্সন পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর বাংলাদেশীদের উপর নির্যাতন অত্যাচারকে উপেক্ষা করলেন। আর একটি কারণ হলাে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ছিলেন ইয়াহিয়া খানের ঘনিষ্ঠ বন্ধু এবং শ্ৰমতী গান্ধীকে তিনি দু’চোখে দেখতে পারতেন না। বাংলাদেশের ঘটনা নিয়ে শ্রীমতী গান্ধী ওয়াশিংটনে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কিন্তু তাদের সাক্ষাৎ ফলপ্রসূ হয় নি। বরং নিক্সন শ্ৰমতী গান্ধীকে আরও বেশী অপছন্দ করতে লাগলেন। শ্ৰীমতী গান্ধীও তাকে অপছন্দ করতেন। | পূর্ব বাংলার সমস্যা প্রতিদিনই জটিল হয়ে দাড়াতে লাগলাে। আমেরিকান সরকার প্রথমে ঠিক করতে পারলাে না কী করে এই সমস্যার সমাধান করা যায়। ইয়াহিয়া খান একরােখা লােক, তার উপর মোটা বুদ্ধি। এছাড়া পু। বাংলার পরিস্থিতি এবং পাকিস্তানী জঙ্গী বাহিনীর অত্যাচার আমেরিকান সাংবাদিকদের বিশেষ ভাবে বিচলিত করে তুলেছিল। এছাড়া আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট, কিসিংগার এবং নিক্সনের পাকিস্তানী তােষণনীতি কোন প্রকারেই সমর্থন করতে পারলো না। অবশ্যি স্টেট ডিপাটমেন্ট জানতো না যে তাদের অজ্ঞাতসারে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কিসিংগারকে চীনের নেতাদের সঙ্গে দেখা করতে পাঠালেন। আমেরিকান সংবাদ পত্রগুলাে এবং জনগণও পাকিস্তানের অত্যাচার নীতির তীব্র প্রতিবাদ করতে লাগলাে।
কিসিংগার এবং নিক্সন অবশ্যি সহজে ইয়াহিয়া খানকে রােধ করবার কোন চেষ্টা করলেন না। যদিও আমেরিকান সরকার স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলেন সে পাকিস্তান শীগগিরই বিভক্ত হবে এবং এই সংগ্রামে আওয়ামী লীগের জয়লাভ হবে। ইতিমধ্যে একদিন জানা গেলো যে মস্কো এবং দিল্লীর মধ্যে কুড়ি বছরের জন্যে একটি বন্ধুত্বের চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। এই চুক্তি আমেরিকা এবং চীনকে বিশেষ বিচলিত করলাে।
আর একটি প্রয়ােজনীয় কথা বলা দরকার। এই সময়ে কিসিংগারের ভয় ছিলাে প্রেসিডেন্টের সাগরেদরা তাকে তার চাকরি থেকে সরাবার চেষ্টা
করবে। তাই প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে চমকে দেবার উদ্দেশ্যে চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছিলেন। আর পাকিস্তানের সাহায্য ছাড়া চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সম্ভব ছিলাে না।
কিসিংগার মুজিবর রহমানকে দুচোখে দেখতে পারতেন না। তার প্রধান। কারণ হলাে যে কিসিংগার মনে করতেন যে মুজিবর রহমান হলেন চীন আমেরিকার আঁতাতের প্রধান প্রতিবন্ধক। ইতিমধ্যে আমেরিকান সরকারের চাপে পড়ে ইয়াহিয়া খান আওয়ামী লীগকে নতুন কনসেসন দিতে রাজী হলেন। আওয়ামী লীগের নেতারা এই সব কনসেসন কিংবা তাদের মুক্তি সংগ্রাম বন্ধ করবার কোন চেষ্টা করলেন না। পুব বাংলার মুক্তিযুদ্ধের সৈন্যরা যখন দেশের অভ্যন্তরে জেনারেল নিয়াজীর সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে লড়াই করছেন তখন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী জীবন বাঁচাবার জন্যে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে আশ্রয় নিলো। শ্ৰীমতী গান্ধী পরিষ্কার করে বলে দিলেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে কোন শরণার্থীকে তারতবর্যে আশ্রয় দেওয়া সম্ভব নয়। ইয়াহিয়া খান পুর বাংলায় অত্যাচার যদি বন্ধ না করেন তাহলে ভারত সরকার। কঠোর নীতি অবলম্বন করবেন। শ্ৰীমতী গান্ধীর এই সতর্কবাণীতে আমেরিকান সরকার এনং পাকিস্তানী জঙ্গীবাহিনী একেবারেই আমল দিলে
আমেরিকান স্টেট ডিপার্টমেন্ট অবশ্যি জানতেন যদি ভারতবর্ষ পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেন তাহলে সেই যুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। অবশি নিক্সন কিসিংগার কিংবা ইয়াহিয়া খান শ্ৰমতী গান্ধীর এই সতর্কবাণী একেবারে উপেক্ষা করলেন। উলটে কিছুদিন বাদে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী ভারতের দুই সীমান্তে আক্রমণ শুরু করলাে। তারপর ভারতীয় সৈন্যবাহিনী এবং মুক্তি যোদ্ধাদের সংগ্রাম এবং কী করে মুজিবর রহমানকে মুক্তি দেওয়া হলাে এবং শেখ মুজিবর রহমান এসে নব গঠিত বাংলাদশের প্রেসিডেন্ট হলেন সেই কাহিনী বাঙালী পাঠকের অজানা নেই। তবু আজ এইখানে একটি বিশেষ উল্লেখযােগ্য ঘটনা বেশ বিস্তৃত করে লিখতে হবে। কারণ এই কাহিনীই হলাে শেখ মুজিবর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের মৃত্যুর প্রধান কারণ। আর এই কাহিনী হলো কলকাতায় আমেরিকান কনসুলেটেয় সিআই-এর সঙ্গে। পূর্ব বাংলার নেতা খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের যে আলাপ এবং যে চুক্তি হয়েছিলাে তার বিবরণী।
হেনরি কিসিংগার যখন বুঝতে পারলেন যে কোন প্রকারেই এমতী গান্ধী বাংলা দেশ এবং শেখ মুজিবর রহমানের প্রতি তার নীতির পরিবর্তন করবেন না তখন তিনি ঠিক করলেন যে আওয়ামী লীগের মধ্যে মনোমালিন্য এবং এর ভেতর দল সৃষ্টি করতে হবে। যদি কোন প্রকারে এরকম একটা দল গঠন করা যায় এবং নতুন দলের নেতা যদি আমেরিকাতে এসে ঘোষণা করেন যে তিনি পাকিস্তান সরকার এবং ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আপোষ মীমাংসা করবেন তবে আওয়ামী লীগের সংগ্রাম ব্যর্থ হবে।
আওয়ামী লীগের মধ্যে এই মনোমালিন্য সৃষ্টি করার জন্যে কলকাতার আমেরিকান কনসুলেটের সি-আই-এর একজন কর্মচারী জর্জ গ্রিফিন খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সঙ্গে গােপনে যােগাযােগ করেন।
জর্জ গ্রিফিন ছিলেন হেনরি কিসিংগারের ডান হাত হ্যারল্ড সণ্ডারসের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। হরল্ড সণ্ডারস ওই সময় ছিলেন কিসিংগারের পরামর্শদাতা এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি কাউন্সিলের ( N, S. C ) এক জন ডেপুটি । ১৯৭৫ সালে কিসিংগার যখন সেক্রেটারী অব ষ্টেট হলেন তখন হারল্ড ‘সণ্ডারসও প্রমােশন পেয়ে ষ্টেট ডিপার্টমেন্টে কিসিংগারের সহকারী হলেন। ১৯৭৫ সালে আগষ্ট মাসে মুজিবকে যখন হত্যা করা হলাে তখন সণ্ডারস ছিলেন – স্টেট ডিপার্টমেন্টের ডিরেক্টর অব ইনটেলজেন্স। ১৯৭১ সালে গ্রিফিন সণ্ডারসের সঙ্গে কাজ করেছিলেন এবং ১৯৭৫ সালে গ্রিফিন হলেন সণ্ডারসের “ডান হাত। আমেরিকান এম্বাসডার ইউজেন বােষ্টার সণ্ডারসের অধীনে কাজ করতেন।
এবার পাঠকদের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে গ্রিফিন কেন মুস্তাকের দলের সঙ্গে যােগাযােগ করলাে এবং বাংলাদেশের অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে কেন যােগাযােগ স্থাপন করেনি। খুব তলিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে দুটো কারণে গ্রিফিন খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেছিল। এই সময়ে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ ছিলেন মুজিব নগরে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী। তার পররাষ্ট্র সচিব ছিলেন মহাবুব
আলম চাষী এবং অন্য সহকারী ছিলাে তাহেরুদ্দীন ঠাকুর। মুজিব হত্যার -দিন এই দুইজনই বাংলাদেশ রেডিও স্টেশনে থােকার মুস্তাক আহমেদের – সঙ্গে বসে ছিলেন।
গ্রিফিনের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন মহাবুব আলম চাষী। কিসিংগার চাষীর ছদ্মনাম দিয়েছিলেন কোয়ায়ুম। কিসিংগার কোয়াখুমের পুরাে নাম দেননি। তবে আমি এনায়েতুল্লা এবং আরাে কয়েকজনের কাছ থেকে শুনেছিলুম যে চাষীর মাধ্যমেই কিসিংগার, হ্যারল্ড সারস এবং গ্রিফিনের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। মহাবুব আলম পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে কাজ করতেন এবং দীর্ঘকাল তিনি ওয়াশিংটনে পাকিস্তান দূতাবাসে কাজ করেছিলেন। ঐ সময়ে তিনি আমেরিকান বিশ্ববিদ্যালয়ের বহু বুদ্ধিজীবির সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন। গুজব ছিলাে মহাবুব আলম চাষী হেনরী কিসিংগারেরই বিশেষ বন্ধু ছিলেন।
পাকিস্তানী ফরেন সার্ভিস থেকে ইস্তফা দিয়ে মহাবুব আলম কৃষিকর্মের দিকে ঝোক দিলেন। আর নিজেকে পরিচয় দেবার জন্য চাষী নামটি পদবীর সঙ্গে জুড়ে দিলেন। তিনি চট্টগ্রামের নিকটবর্তী রঙ্গুনিয়া গ্রামে চাষের কাজ করতে শুরু করেন। এই কাজ করবার জন্য তিনি বিদেশ থেকে বহু অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। মুক্তি যুদ্ধের সময় মহাবুব আলম চাষী খোন্দকার মুস্তাক আহমেদের বিদেশ সচিব হিসেবে কাজ করতেন। যুদ্ধের পর মহাবুব আলম চাষী কুমিল্লায় বাংলাদেশ একাডেমী অব রুরাল ডেভেলপমেন্ট বাের্ডের ডিরেক্টর ছিলেন। এখানেও তিনি কৃষি কাজ কারবার নিয়ে গবেষণা করতেন। কিন্তু তার আসল কাজ ছিলাে শেখ মুজিবর রহমান বিরোধী চক্রান্ত করা।
মহাবুব আলমের নিকটতম বন্ধু ছিলেন তাহেরুদ্দীন ঠাকুর। তিনি মুজিব সরকারে তথ্য মন্ত্রী ছিলেন।
এদের কথা পরে বলা যাবে।
খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ এবং অন্যান্য বাংলাদেশীয় নেতাদের সঙ্গে বিশেষ বনিবনা ছিলােনা। তিনি তাজউদ্দীনকে বেশ হিংসার চোখে দেখতেন। অতএব তিনি [কিসিংগারের লেখা অনুযায়ী ] গ্রিফিনের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন।
মহাবুব আলম চাষী অর্থাৎ কায়য়ুম গ্রিফিনের সঙ্গে দেখা করে সােজাসুজি বললেন যে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ আমেরিকানদের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করতে চান। গ্রিফিন এই খবর সণ্ডারসকে পাঠাল। অন্য পক্ষের
বক্তব্য হলাে যে সি-আই-এ এজেন্ট গ্রিফিন মহাবুব আলমের সঙ্গে যােগাযােগ স্থাপন করেন। গ্রিফিনের কাছ থেকে খবর পাবার পর কিসিংগার নিক্সনের কাছে খােন্দকারের প্রস্তাবের কথা উত্থাপন করলেন। নিক্সন আপত্তি করলেন|
শুধু বললেন যে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে যেন খবর দেওয়া হয় যে আমেরিকান সরকার আওয়ামী লীগের একজন প্রধান নেতার সঙ্গে বাংলাদেশে পাকিস্তানের রাজনৈতিক সমঝোতা নিয়ে আলাপ আলোচনা করার চেষ্টা করছে। গ্রিফিনকে বলা হলো যেন তিনি কোয়ায়ুমের সঙ্গে যােগাযােগ রাখেন এবং তার মারফং খোন্দকার মুস্তাককে জানান হয় যে পাকিস্তান সরকার পুব বাংলার একটি রাজনৈতিক সমাধান করবার চেষ্টা করছে। আর এই সঙ্গে ইয়াহিয়াকে বলা হলাে যে আমেরিকান সরকার আওয়ামী লীগের অন্যান্য বিশিষ্ট নেতাদের বাদ দিয়ে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সঙ্গে মীমাংসার আলাপ আলােচনা চালাচ্ছেন। ইয়াহিয়া কোন আপত্তি করলেন না। বরং পুব বাংলা ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোন রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে এই খবর শুনে আনন্দিত হলেন।
কোয়ায়ুম এবং গ্রিফিনের সঙ্গে প্রায় সাত আটবার দেখা সাক্ষাৎ হল। কিন্তু কাজ বেশিদূর এগলাে না। পরে গ্রিফিন একবার কিসিংগারের নির্দেশানুযায়ী খােন্দকারের সঙ্গে নিজে গিয়ে দেখা করলেন। হয়তাে দেখা করাটা ভুল হয়েছিলো। কারণ ইতিমধ্যে আওয়ামী লীগের নেতারা খােন্দকার মহাবুব আলম চাষী এবং তাহেরুদ্দিন ঠাকুরের গােপন চক্রান্তের কথা জানতে পারলেন। | আমেরিকান কনসুলেটকে বলা হলাে যে ভবিষ্যতে এই ধরনের কোন আলাপ আলােচনা করতে হলে দিল্লীর কর্তাদের মাধ্যমে করতে হবে। কথা ছিলো যে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ নিউইয়র্কে ইউনাইটেড নেশনসে যাবেন এবং সেখানে গিয়ে পাকিস্তানী প্রতিনিধির সঙ্গে আলাপ আলোচনা করবেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের অন্যান্য নেতারা এই খবর পেয়ে খন্দকার মুস্তাক আহমেদকে নিউইয়র্কে যেতে দেন নি।
কিছুদিন পরে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে বিদেশ মন্ত্রীর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। তিনি হলেন বাণিজ্য মন্ত্রী।
সেদিনকার অপমানের কথা খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ, মহাবুব আলম চাষী এবং তাহেরুদ্দিন ঠাকুর সহজে ভুলে যাননি। অপমানের প্রতিশােধ নিলেন ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে।
এবার সেই দিনের হত্যাকাণ্ড নিয়ে আমাদের গল্প সুরু করা যাক।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পর আমি বাংলাদেশ থেকে যখন চলে এলাম আমাকে অনেকে জিজ্ঞেস করেছেন : বাংলাদেশে অমন একটা হত্যাকাণ্ড হয়ে গেল আর আপনারা এই খবরের কোন হদিসই আগে জানতেন না ?
এই প্রশ্নের কোন ছােট জবাব দেওয়া যায় না। পুরাে ঘটনাটা বলতে হয়।
আমরা অতি অল্প কয়েকজন মুজিব হত্যার পূর্বাভাষ পেয়েছিলুম। কিন্তু আজ স্বীকার করতেই হবে যে খবরটি সেদিন আমার কাছে এতাে অবিশ্বাস্য মনে হয়েছিল যে, প্রথমে আমার মন ঐ পূর্বাভাষ বিশ্বাস করতে চায়নি। পরে অবশ্যই বিশ্বাস করতে হয়েছিল। কিন্তু শেখ মুজিৰ কখনই নিজের জীবনকে বিপন্ন বলে মনে করেননি। আর একটি কথা বেশ স্পষ্ট করে জোর দিয়ে বলতে পারি যে, নয়াদিল্লীর কর্তারা কোনো সূত্রেই মুজিব হত্যার ষড়যন্ত্রের কোন পূর্বাভাষ পান নি। সেই কাহিনী পরে বলা যেতে পারে। এবার বলা যাক আমি প্রথমে কি করে ষড়যন্ত্রের খবর শুনেছিলুম। | দিন এবং সময় আমার এখনও বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ২৭ জুলাই ১৯৭৫ বিকেল চারটে। কিছুক্ষণ আগে জনপদ পত্রিকার সম্পাদক আবদুল গফর চৌধুরী আমাকে টেলিফোন করে বললেন : দাদা, আপনার সঙ্গে আমার এক্ষুনি দেখা করা দরকার।
সফরের কণ্ঠস্বর শুনে প্রথমে আমি একটু হকচকিয়ে গেলুম। কারণ আমি জানতুম যে, গফর তার স্ত্রীর অসুখের চিকিৎসার জন্যে লণ্ডনে গিয়েছিলেন। গফর চৌধুরীর ঢাকায় ফিরে আসবার কথা আমার কাছে অজ্ঞাত ছিল। তাই প্রথমে ভাবলুম এখন লণ্ডন থেকে কথা বলছে নাকি?
যাইহােক গফরের সঙ্গে দেখা করবার একটু অসুবিধে ছিল। বাইরে কিছু কাজ ছিল, কিন্তু গফর নাছােড়বান্দা, বললো: দেখা না করলে নয়।
কী চায় গফর?
বিকেল চারটে নাগাদ গফুর চৌধুরী এবং আর একজন ভদ্রলােক আমার বাড়িতে এলেন। আমার বাড়িতে ঢোকা সহজ কাজ ছিল না। গেটের সামনে এবং চারপাশে ছিল সশস্ত্র প্রহরীর বেড়াজাল। তবু গফর সব বাধা এড়িয়ে আমার কাছে এলাে। এর আগেও অনেকবার গফর এবং আরও অনেক বাংলাদেশ সাংবাদিক আমার বাড়িতে এসেছিলেন।
গফর তার সঙ্গীর সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় করিয়ে দিলেন। ভদ্রলােক বাংলাদেশের একজন। আমার অপরিচিত কিন্তু ওকে কখনও ঢা
দেখি নি।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে গফর হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞেস করল : দাদা, আপনার কাছে স্মেলিং সল্ট আছে তো?
গফরের প্রশ্ন শুনে আমি বেশ চমকে উঠলাম। গফরের কি মাথা খারাপ হয়েছে ? হঠাৎ স্মেলিং সল্ট চাইছে কেন?
কি হলো তােমার গফর? স্মেলিং সল্ট চাইছ কেন? আমি বেশ উৎকণ্ঠিত, উৎসুক হয়ে জিগ্যেস করলুম।
আপনাকে এমন একটা খবর দেবব, যে খবর শুনে আপনি হয়তো মুচ্ছ। যেতে পারেন। গফর বেশ গম্ভীর কণ্ঠেই জবাব দিল।
গফরের কথা বলার ভঙ্গি দেখে আমি বেশ একটু উষ্মা প্রকাশ করলুম। বলুন, এই ধরনের কথা শুনলে কার না রাগ হয় ?
গফরকে বললুম, গফর আমি নেহাৎ ছেলেমানুষ নই। তুমি বেশ নিশ্চিন্ত মনে যে কোনাে দুঃসংবাদ দিতে পার, আমি জবাব দিলুম।
বেশ তাহলে শুনুন, গফর চৌধুরী বলতে লাগল, আপনার ঐ সামনের বাড়ির ভদ্রলােককে চেনেন?
আমার বাড়ির সামনে একটা ঝিলের ধারে থাকতেন শেখ মুজিবর রহমান, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। আমার বিরক্তির রেশ বাড়ল। বললুম : গফর হেয়ালির একটা সীমা আছে। তুমি কী বলতে চাও স্পষ্ট করে খুলে বল।
শুনুন, আজ থেকে প্রায় দিন পনের বাদে ঐ জাতির পিতাকে হত্যা করা হবে। তখন দেখবেন এই বাংলাদেশে ভূতের তাণ্ডব নৃত্য শুরু হবে।
এবার বুঝতে পারলুম গফর কেন আমার কাছে স্মেলিং সল্ট আছে কি না জিগ্যেস করছিল।
সত্যিই গফরের কথা শোনবার পর আমার মাথা টলতে লাগলাে। পর মুহূর্তে মনে হলাে—গফর এই বাংলাদেশে বসে আমার কাছে দেশদ্রোহী সব কথা বলছে। কিন্তু আমি জানতুম গফর যা ইচ্ছে বলতে ও করতে পারে। মাত্র দু’দিন আগে গফর জনপদ পত্রিকায় শেখ মুজিব বিরোধী বেশ কড়া সম্পাদকীয় লিখেছে। ঐ ধরনের সম্পাদকীয় একমাত্র গফরের পক্ষেই লেখা সম্ভব।
—কী দাদা, ভাবছেন এই বান্দা মিথ্যে বলছে ? একদিন দেখবেন আমার কথা ফুলে গেছে।
গফরের শেষের কথাগুলো আমার কানে ঢুকল না। আমি শুধু ভাবভে লাগলুম, গফর কি উদ্দেশ্যে আমাকে শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার চক্রান্তের
________________________________________
কথা শােনাল ?
আমার মনের সন্দেহ দূর করবার জন্যে গফর চৌধুরী আমাকে বলল : বলেছিলুম তো দাদা, খবর শােনার আগে পকেটে স্পেলিং সল্ট রাখুন। আমার কথায় তাে আর কান দিলেন না। শুনুন, এবার আপনাকে বলছি কেন এই কথাগুলাে বললুম ? আমাদের বাংলাদেশের এই সীমান্ত অঞ্চলে বেশ কিছুদিন যাবৎ একটা ঘোঁটি পাকাবার ষড়যন্ত্র চলছে। আমাদের এই কর্তাকে হটান তেমন খুব অসুবিধার কাজ নয়। ওকে এক বার কাৎ করতে পারলেই ভারতের পার্শ্ববর্তী দেশ এবং বাংলাদেশ হবে একেবারে ডিস্টেবিলাইজড। তারপর আপনাদের ঠ্যালা। জানেন তাে কি সিংগার সাহেব বলেছেন বাংলা C7* 54 Will be an International basket.
গফরের কথাগুলাে বিশ্বাস করতে চাইছিলুম না। তবুও তর্ক করলুম না।
কিছুক্ষণ পরে গফর চলে গেল। যাবার আগে শুধু বলে গেল : আমার কথাগুলাে মনে রাখবেন দাদা। হয়তাে ভবিষ্যতে আবার একদিন দেখা হবে। তখন আজকের আলােচনা নিয়ে আরও কথাবার্তা বলা যাবে।
আমি বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলুম। কথা বলবার শক্তি ছিল । গফর ঠিকই বলেছিল যে আমার স্মেলিং সল্টের দরকার ছিল।
পরের দিন আমার অতি নিকট কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে এই কথা নিয়ে আলােচনা করলুম। সবাই প্রথমে কথাগুলাে হেসে উড়িয়ে দিলেন। শেখ মুজিবর রহমানকে যে খুন করা সম্ভব, তৎকালীন বাংলাদেশের পরিস্থিতিতে এই কথা কেউ বিশ্বাস করতে রাজি হলেন না।
এবার সমর সেনের দরবারে হাজিরা দিলুম। সেন সাহেব কথা অতি কম বলেন। ১৯৭১ সালে রাষ্ট্রপুঞ্জে উনিই বাংলাদেশের পক্ষ নিয়ে তুমুল তর্কবিতর্ক করেছিলেন। সেন সাহেব মন দিয়ে আমার কথা শুনলেন তারপর শেষ হবার পর উনি শুধু ছােট্ট একটি প্রশ্ন করলেন : গফর এই কথা তােমাকে বলেছে ? লােকটা হঠাৎ লণ্ডন থেকে এসেই তােমাকে কথাগুলো বলল কেন? ওর এই খবরটি দেবার উদ্দেশ্য কি ?
এই প্রশ্নের কোন জবাব আমি দিতে পারলাম না।
সেন সাহেব কিছুক্ষণ পরে বললেন, শেখ সাহেব কিছুতেই বিশ্বাসই করতে চান না যে, বাংলাদেশে কেউ ওঁর বিরুদ্ধে কোন চক্রান্ত করতে পারে আমি বহুবার এই সব বিরোধী দলের কাজকর্ম নিয়ে ওর সঙ্গে কথা বলেছি। উনি ‘শুধু জবাব দেন, তোমার কথাগুলাে মনে রাখব।
________________________________________
সেন সাহেব এবার আলােচনার মােড় ঘুরিয়ে দিলেন। জিগ্যেস করলেন, শুনলাম তুমি নাকি কলকাতায় একদল বাংলাদেশী শিল্পী নিয়ে যাচ্ছ ?
হ্যা ৯ আগষ্ট কলকাতা দূরদর্শনের উদ্বোধন। সেই উপলক্ষে বাংলাদেশের একদল শিল্পীকে আমন্ত্রণ জানান হয়েছে। আমি ওদের সঙ্গে খাবাে, আমি জবাব দিলুম।
বেশ কলকাতায় বেশী দিন থেকো না। এদিকে কাজ আছে, সেন সাহেব বললেন : আমি আগামী কাল দিল্লী যাবাে।
সেন সাহেব পরের দিন দিল্লী চলে গেলেন। চারদিন পরে শেখ ফজলুল হক মুনি আমাকে টেলিফোন করলেন। ফজলুল হক মনি, শেখ মুজিবর রহমানের ভাগ্নে এবং বাংলাদেশের একজন যুবনেতা। স্পষ্ট বক্তা। মনের কথা বলতে দ্বিধা-সংকোচ বােধ করে না। মুনির সঙ্গে আমার বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। অনেকদিন আমরা বাংলাদেশ ভারতবর্ষের ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা তর্ক করেছি। অনেক সময়ে আমাদের অনেক ব্যাপারে মতবিরােধ হয়েছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে কখনই বন্ধুত্বের ভাঙন ধরেনি। মুনি যখন বাংলাদেশ টাইমসে কাজ করতেন তখন ঘণ্টার পর ঘণ্ট। আমি ওর অফিসে গিয়ে আডডা দিতুম।
মুনি যখন ‘বাকশাল’-এর সাধারণ সম্পাদক হয়ে ভিন্ন একটা দপ্তরে বসতে শুরু করলেন ঐ অফিসে আমি বড়ো বেশি যেতুম না। প্রয়ােজন হলে আমি ওর পত্রিকার দপ্তরে গিয়ে দেখা করতুম। কিন্তু সেদিন টেলিফোনে মুনি বাকশাল-এর দফতরে যেতে আমাকে অনুরোধ করল। বললো কাজ আছে।
নির্দিষ্ট সময়ে আমি বাকশালের দপ্তরে গিয়ে হাজিরা দিলুম। প্রহরীদের। বেড়াজাল কাটিয়ে মুনির ঘরে ঢুকে দেখি, ঐ ঘরে আর একজন বসে আছেন ভদ্রলােকের নাম হলাে ওবায়েদুর রহমান, কমিউনিকেশন মিনিষ্টার। শুনেছি মুজিব হত্যাকারী চক্রান্তে উনিও বেশ জড়িয়ে ছিলেন।
ভদ্রলােক চলে যাবার পর মুনি আমাকে সােজাসুজি জিগ্যেস করলেন : এ সব হচ্ছে কি ? শুনছি একটা পাকিস্তানী মেয়েকে আপনারা কলকাতায় গান গাইবার জন্যে নেমন্তন্ন করেছেন?
বুঝলাম বেগম শাহী নওয়াজ খানের কলকাতায় যাবার কথা মুনির কানে পৌচেছে।
আপনি ভুল করছেন, প্রথমত মেয়েটি পাকিস্তানী নয়, আর গায় খুব ভালাে। গজলে ওর মতাে গল। আমি আর কারও শুনিনি, আমি জবাব দিলুম।
________________________________________
আমাদের আবার তর্কবিতর্ক শুরু হলাে। শেষ পর্যন্ত মুনি স্বীকার করল যে শাহী নওয়াজ খান ভালাে গায়িকা।
এবার আমার বলবার পালা। আমি কিন্তু মুনিকে স্মেলিং সন্ট নেবার জন্যে অনুরােধ করলুম না। শুধু বললুম : আপনার সঙ্গে আমার একটি বিশেষ জরুরী গােপনীয় কথা আছে। বলতে পারেন ‘টপ সিক্রেট।
‘টপ সিক্রেট’ কথাটা শুনে মুনি কান খাড়া করল। বলল, বলুন, আমাদের কথায় কেউ আড়ি পাতবে না।
আমার সঙ্গে গফরের যে আলাপ-আলোচনা হয়েছিল, সেই কথা মুনিকে বললুম।
প্রথমে মুনি কোন জবাব দিল না। মন দিয়ে সব শুনে চুপ করে রইল। তারপর বেশ কিছুক্ষণ চিন্তা-ভাবনা করবার পর শুধু জিগ্যেস করল : আচ্ছা, বলুন তাে গফর এই কথাগুলাে কেন আপনাকে বলল?
মুনির কথার কোন জবাব সেদিন আমি দিতে পারি নি। আজও দিতে পারব না।
মুজিব হত্যার পর গফুরের সঙ্গে আমার বহুবার লণ্ডনে দেখা হয়েছে। এই প্রশ্নের জবাব পাবার চেষ্টা করেছিলুম। গফর শুধু জবাব দিয়েছিল : দিল্লির কর্তাদের সতর্ক করবার জন্যে আপনাকে এই কথাগুলো বলেছিলুম। আপনি তাে আমার কথাগুলো দিল্লির কর্তাদের বললেন না। আপনাকে আর কি বলব ? তার এই জবাবে দুঃখের রেশ ছিল। কারণ দিল্লির কর্তারা আমার এবং গফুরের মধ্যে এই আলাপ-আলোচনার কিছুই জানতে পারেন নি। আগেও ময়, পরেও নয়। কারণ দিল্লির কর্তাদের খবর দেওয়া আমার কাজ ছিল না। অামার কর্তব্য ছিল বড় সাহেব সমর সেনকে জানানো। তা আমি প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই করেছিলাম।
পরে বিশ্বস্ত সূত্রে খবর পেয়েছিলাম যে মুজিব হত্যার কাহিনী আমরা জানতুম না বটে কিন্তু বাজারের অনেকেই মুজিবের জীবনেয় আশংকা করে ছিলেন। তারা মুজিবকে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু মুজিব কখনই বিশ্বাস করেননি যে বাংলা দেশের কেউ তাকে হত্যা করবার চেষ্টা করতে পারে। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বর মাসে লণ্ডনে গফর এবং আমার আর একজন বন্ধু বললেন মুজিবকে হত্যার চক্রান্ত করা হয় বেশ কয়েকমাস আগে। চক্রান্তের পেছনে ছিলে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ, মহাবুব আলম চাষী, তাহেরুদ্দীন ঠাকুর এবং এ. এম. এস শফদর। বাজারে এবং সৈন্যবাহিনীর মধ্যে গুজব ছিলাে
যে শফদর আমেরিকান এম্বাসীর সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। মুজিব হত্যার পর মুস্তাক এ. এম. এস. শফদরকে ডিরেক্টর জেনারেল অব ন্যাশনাল ইনটেলিজেন্সের পদে নিযুক্ত করেন। | শফদর পাকিস্তান পুলিশ এবং ইনটেলিজেন্স সার্ভিসে ১৯৫ সালে যােগ দেন। ১৯৫৯ সালে তার পদোন্নতি হয় এবং পাকিস্তান সরকার আই বী এ্যাসিট্যান্ট ডিরেক্টর জেনারেল অব ইনটেলিজেন্সের পদে নিযুক্ত করেন। পরে তাকে সমস্ত পূর্ব পাকিস্তানের [ বর্তমান বাংলাদেশের ] ইনটেলিজেন্স বিভাগের ডেপুটি ডিরেক্টর হিসেবে নিয়ােগ করা হয়। আয়ুবের আমলে তিনি ঢাকার বহু ছাত্র ছাত্রীর সর্বনাশ করেছিলেন। তার কাজ ছিলো বিভিন্ন লোকের সম্বন্ধে খবর সংগ্রহ করা এবং তাদের গতিবিধির উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখা। মুস্তকের আমলে শফদর আমার গতিবিধির ওপর বেশ কড়া নজর রাখতে।
মুক্তি যুদ্ধের সময় শফদর ওয়াশিংটনে পুলিশের কাজকর্মের ট্রেনিং নিচ্ছিলাে। ওই সময় থেকে সি-আই-এ শফদরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতে সুরু করে। ঢাকার সি-আই-এর ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী স্বীকার করেছিলেন যে শফদরের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠ পরিচয় ছিলাে।
মুনি এবার উত্তেজিত হয়ে ঘরের মধ্যে পায়চারি করতে লাগল। কিছুক্ষণ পরে বলল । অবশ্য গফুরের শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে একটা অভিযোগ আছে। স্ত্রীর চিকিৎসার জন্যে শেখ সাহেবের কাছে টাকা চাইতে এসেছিল। শেখ সাহেব গফরকে টাকা দেন নি, উলটে ধমক দিয়ে ঘর থেকে বের করে দিয়েছিলেন।
মুনি আবার চুপ করে বসে রইল। আমরা দুজনই চুপচাপ। ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে চলছে। শুধু তারই আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। * ঘরের নিস্তব্ধতা মুনিই ভাঙল। বলল: দাদা, ‘স্পাই থ্রিলার’ লিখে লিখে আপনার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে। আপনি শুধু চারদিকে পাই আর কু স্বপ্ন দেখেন। এই সব ছাই-ভস্ম লিখে আপনার মাথাটা গেছে। ছাইভস্ম লেখা বন্ধ করুন। সহজ, হাল্কা প্রেমের গল্প লিখতে শুরু করুন।
আমি হেসে বললুম : একটা কথা বলছি, মনে কিছু করবেন না। মুনি কিছুক্ষণ আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললেন : বলুন।
আপনারা বাংলাদেশে একদলীয় শাসন ব্যবস্থা চালু করলেন অথচ আপনাদের চারপাশে কী হচ্ছে তার খবর রাখেন না। আপনাদের খবর সংগ্রহ করবার কোন আয়ােজন নেই।
________________________________________
আপনার অভিযােগ সত্যি। শেখ সাহেব বলেন, পুরান শাসন ব্যবস্থা দিয়ে বাংলাদেশকে চালান যাবে না, এর জন্য নতুন প্রশাসনের কাঠামাের প্রয়ােজন। তাই বাকশাল বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ, গঠন করা হয়েছে। পয়লা সেপ্টেম্বর থেকে দেশকে ৬২ জেলায় ভাগ করা হবে। প্রতি জেলার শাসনকর্তা থাকবেন একজন গভর্নর। দলের ক্যাডারের লােকদের পুলিশ বাহিনীতে নেয়া হবে •••
কিন্তু ধরুন তার আগেই যদি কিছু ঘটে যায়—আমি বেশ শঙ্কিত মন নিয়েই জবাব দিলুম। গফরের সতর্ক বাণী যেন আমার মনের মধ্যে গেঁথে গিয়েছিল।
মুনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলাে। তারপর আমাকে জিজ্ঞেস করলো আচ্ছা বলুন তাে বাংলাদেশে স্পাই-এর কাজ কে করে ?
আমি জানি নে। স্পাই-এর খোজ খবর রাখা আমার কাজ নয়। আমি বেশ ছােট, কিন্তু স্পষ্ট জবাব দিলুম।
কিছুদিন যাবৎ শুনছি কতােগুলাে বিদেশী দূতাবাসে আমাদের সাংবাদিকেরা খুব যাতায়াত করছে। এম্বাসী থেকে ওদের জন্যে বিলিতি মদ আসে, আরাে কতো কী? এবার শুনুন আমি কাকে সন্দেহ করি। প্রথমত: আপনার ঐ বামপন্থী বন্ধু এনায়েতুলা, তােফায়েল আহমেদ, তাহেরুদ্দিন ঠাকুর এর সবাই বিদেশী গুপ্তচর …
আপনার কাছে কোন প্রমাণ আছে ? আমি জিজ্ঞেস করলুম। প্রমাণ ছাড়া কোন অভিযােগ করা ঠিক হবে না।
বেশ আপনি কলকাতা থেকে ফিরে আসুন। আমি আপনাকে সব প্রমাণ দেবো। কিছুদিনের মধ্যেই আমি সব প্রমাণ পেয়ে যাবাে।
সেই আলোচনার আর সুযোগ হয় নি। কারণ এর পরের ঘটনাগুলাে বেশ দ্রুত লয়ে ঘটে গেল। ১৫ আগস্ট শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে তার ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মুনিও নিহত হন।
মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে এই খবর কলকাতার অলিগলিতে আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়ল। দিনটা ছিল রবিবার, পনেরই আগস্ট, ছুটির দিন। কলকাতার নাগরিকেরা সবাই বেশ গল্প গুজব করে দিন কাটাচ্ছিলেন, এমন সময় আকাশবাণীর সংবাদ মারফৎ জানা গেল যে ১৫ই আগষ্ট ভােরবেলায়
শেখ মুজিবর রহমান এবং তার পরিবারের সকলকে খুন করা হয়েছে। সেই সঙ্গে সঙ্গে শেখ ফজলুল হক মুনি এবং তার পরিবারকেও খুন করা হয়েছে। মুনির শ্বশুর সেরনিয়াবাতও আততায়ীর হাতে প্রাণ হারিয়েছেন। এই ঘটনার পুরাে কাহিনী পরে বলা হবে।
সাংবাদিকের ভাষায় মুজিব হত্যার কাহিনী হলাে স্রেফ ডাইনামাইট।
জনসাধারণের প্রশ্ন হল শেখ মুজিবকে কী করে এবং কারা খুন করল ? এই খুনের চক্রান্তের খবর কি ভারত সরকার কিংবা তাদের ইনটেলিজেন্স সার্ভিস জানতেন না ? এই প্রশ্নের জবাব পরে দেওয়া যাবে।
আসল খবরের চাইতে গুজবই বেশি শােনা যায়। বিশেষ করে কলকাতায়। কারণ এই শহরের নাগরিকেরা গুজব শুনতে ভালােবাসেন। প্রথমে শােনা গেল যে, মুজিব হত্যার সংবাদ প্রথমে ভয়েস অব আমেরিকা প্রচার করেছিল ভাের সাড়ে পাঁচটায়। মুজিবকে হত্যা করা হয়েছিল ভাের সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে এবং ঢাকার বেতার কেন্দ্র থেকে এই খবরটা প্রথম প্রচার করে ছিলেন মেজর ডালিম, প্রায় ছয়টা দশ মিনিটে। পরে ভয়েস অব আমেরিকা এবং পাকিস্তান রেডিও একই সঙ্গে এই খবর প্রচার করেন। বাংলাদেশের নতুন শাসকরা বাংলাদেশকে কি ইসলামিক দেশ বলে ঘােষণা করেছিলেন ? পাকিস্তান রেডিও কি সেই কথা বলেছিল ? সংশয় আছে। এই মিথ্যে খবর কী করে প্রচারিত হলো সেকথাও পরে বলা যাবে। | প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী রেড ফোর্টে ১৫ই আগস্টের বক্তৃতা দেবার সময় মুজিব হত্যার খবর শুনলেন। খবর শুনে তিনি মর্মাহত হলেন। কারণ বাংলাদেশের এবং ঐ দেশের জনসাধারণের প্রতি শুধু তার ভালােবাসা নয়, বিশেষ সহানুভুতিও ছিল। বাংলাদেশের জনসাধারণকে পাকিস্তানী জঙ্গীদের অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচাবার জন্যেই তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্যে সংগ্রাম করেছিলেন।
খবরটি যখন শ্রীমতী গান্ধী শুনলেন তখন তার সামনে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী ব্রহ্মানন্দ রেডিড দাড়িয়েছিলেন। আর তার সঙ্গে ছিলেন ইনটেলিজেন্স বিভাগের কর্তা আর এন কাও। রেডিড কাওকে বেশ বিদ্রুপ করে প্রধান মন্ত্রীকে বললেন, আমাদের ইনটেলিজেন্স সার্ভিস আবার ব্যর্থ হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী কাও সাহেবকে বাঁচাবার জন্যে বললেন, না না আমরা শেখ মুজিবর রহমানকে সতর্ক করেছিলুম।
এখানে বলা দরকার যে ভারত সরকার, সেন সাহেব এবং আরো অনেকে
২৮
________________________________________
মুজিবরকে সতর্ক করেছিলেন কিন্তু মুজিব বলেছিলেন, ওরা আমার সন্তান, ওরা আমাকে হত্যা করতে পারে না।
মুজিব হত্যার কাহিনী শুনে আমরা যারা ঢাকার ঘটনার সঙ্গে জড়িত ছিলুম তারা দুঃখিত হলুম, অনুশোচনা হলাে, কাউকে আর বললুম না যে গফর আমাকে এই হত্যার পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন। কিন্তু গফরের কথায় আমরা কেউ বিশ্বাস করি নি।
কলকাতায় আমার বন্ধু-বান্ধবের আমাদের সবাইকে গালমন্দ দিতে শুরু করলেন ; ছিঃ ছিঃ অতােবড়ো একটা কাণ্ড ঘটে গেল, আর আপনারা কেউ এই খবর জানতেন না? সেদিন যদি বলতুম যে আমরা এই হত্যাকাণ্ডের পূর্বাভাষ পেয়েছিলুম তাহলে কেউ আমাদের বিশ্বাস করতেন না। আজও করবেন না জানি। আর একটি ব্যাপার নিয়ে জনসাধারণ আমাদের গালমন্দ দিতে লাগল। ঠিক হত্যাকাণ্ডের দিন ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেন চাকাতে ছিলেন
গতানুগতিক ব্যাপার। পৃথিবীর যেখানে হাঙ্গামা কিংবা ‘কু ‘ আঁতাত হয়েছে সেইখানে, সেই দিবসে ভারত সরকারের প্রতিনিধি অনুপস্থিত থাকতেন। এবারও তাই হলাে। সেন সাহেব দিল্লিতে।
একদিন পরে সেম সাহেব দিল্লি থেকে কলকাতায় ফিরে এলেন। আমি ওঁর সঙ্গে আমাদের কলকাতার দপ্তরে গিয়ে দেখা করলুম। কলকাতার অফিসের পররাষ্ট্র অধিকর্তা ছিলেন শরদিন্দু চট্টোপাধ্যায়। বাংলাদেশের প্রতি পরিবারের হাড়ির খবর চট্টোপাধ্যায় রাখতেন। আমরা ওকে বলতুম ‘এনসাইক্লোপিডিয়া বাংলাদেশ। বাংলাদেশের কেউ কলকাতায় বেড়াতে এলে চট্টোপাধ্যায় মশায়ের সঙ্গে দেখা করে খোজ খবর নিতেন। তিনি বিশেষ জনপ্রিয় ছিলেন এখনও আছেন।
চট্টোপাধ্যায় সাহেব যদি কোনদিন তার আত্মজীবনী লেখেন তাহলে সেই বই যে বাংলা সাহিত্যে বেস্ট সেলার হবে এই বিষয়ে আমার কোন সন্দেহ নেই।
চটোপাধ্যায় সাহেবের সঙ্গে আমার বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল। হত্যাকাণ্ডের খবর পেয়ে গেলুম ওর দপ্তরে। গিয়ে দেখলুম যে অনেকেই সেখানে জমায়েত হয়েছেন এবং কিছু সাংবাদিক ও খবরের আশায় বসে আছেন। চট্টোপাধ্যায় বললেন :
শুনেছেন আমাদের হেলিকপ্টারের পাইলটের মৃতদেহ নিয়ে একটি বাংলা
________________________________________
দেশী সামরিক বিমান কাল দমদমে পৌছবে?
এই খানে বলা দরকার যে অনেকেরই মনে একটি ধারণা ছিল বিশেষ করে বাংলাদেশীদের মনে যে একটি ভারতীয় হেলিকপ্টার শেখ মুজিবর রহমানকে উদ্ধার করতে ঢাকায় পাঠান হয়েছিল। এ খবর মােটেই ঠিক নয়। শেখ মুজিবর রহমানকে উদ্ধার করবার জন্যে কোনাে হেলিকপ্টার কিংবা কিছুই পাঠান হয় নি। হেলিকপ্টারটি রুটিন কাজ করবার জন্যে, বাংলাদেশের ওপর দিয়ে আসছিল এবং ঝড়ের মুখে ভেঙে পড়ে যায়। অ্যাকসিডেন্টের সঠিক কারণ অবশ্য জানা সম্ভব হয় নি। কারণ এই ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকার কোন তদন্ত কমিটি গঠন করেন নি।
পরের দিন আমি আর চাটুয্যে ছুটে গেলুম দমদম বিমান বন্দরে। নির্দিষ্ট সময়ে হেলিকপ্টারের পাইলটদের মৃতদেহ নিয়ে প্লেন এল। কিন্তু ঐ বিমানের বাংলাদেশী পাইলটরা বা আমাদের সহকর্মীরা মুজিব হত্যাকাণ্ডের ওপরে নতুন কোনো আলোকপাত করতে পারলেন না। আমি একবার চেষ্টা করলুম ওদের প্লেনে ঢাকায় ফিরে যেতে পারি কিনা। কিন্তু ওরা বেসামরিক কাউকে প্লেনে নিতে রাজী হলেন না। ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলুম।
বিকেলে চট্টোপাধ্যায় সাহেবের দপ্তরে বৈঠক বসল। কি করে ঢাকায় ফিরে যাওয়া যায়। ঢাকা বিমান বন্দর থেকে কলকাতায় কোনাে বিমান আসছে না। ঢাকা থেকে জানান হলো যে বাংলাদেশের নতুন সরকার কোনাে বিমান কলকাতা থেকে আপাতত: ঢাকায় আসতে দিচ্ছে না। অতএব আমাদের বেনাপােল দিয়ে গাড়ি করে রাজশাহীতে যেতে হবে। তারপর যশাের থেকে বাংলাদেশ বিমানে করে ঢাকায় যাব। আমাদের সঙ্গী হবেন জাস্টিস সায়াম এবং নব নির্বাচিত চীফ অব স্টাফ মনজুর আহমেদ। এর কাহিনী আগেই কিছুটা বলা হয়েছে। জাস্টিস সায়াম কোন একটি কার্যে বিদেশ গিয়েছিলেন। তিনি বাংলাদেশের কু দ্য আঁতাতে কলকাতায় আটকে পড়েছিলেন।
আমাদের ঢাকায় ফিরে যাবার দিনটি বেশ স্পষ্ট মনে আছে। ১৮ই আগষ্ট ভােরবেলা সেন সাহেব এবং আমি গাড়ি করে বেনাপােল যাই এবং সেখান থেকে বাংলাদেশ সরকারের গাড়িতে যশোর যাই।
১৮ই আগস্ট ভাের পাঁচটার সময় আমরা গাড়ি করে বেনাপােলের দিকে রওনা দিলুম। রাতদুপুর থেকে মুষলধারে বৃষ্টি ঝরছে, বিরাম নেই, রাস্তায় হাটু পর্যন্ত জল জমেছে। গাড়ি চালাবার ঘষা নেই। আমি এবং সেন সাহেব
________________________________________
দুজনেই ঘােরতর নাস্তিক। শুধু চট্টোপাধ্যায় সাহেব মৃদুস্বরে বললেন : আশা করি মা দুর্গার কৃপায় বেনাপোল পৌছুতে পারব।
কিন্তু মা দুর্গা চট্টোপাধ্যায় সাহেবের কথা শুনতে পেলেন কিনা জানিনে কারণ ড্রাইভার আমাদের মানিকতলা হয়ে যশোর রােড দিয়ে বেনাপােল নিয়ে যাবার চেষ্টা করল। কিন্তু মানিকতলার ব্রিজের নীচে গিয়ে দেখলুম যে , বৃষ্টির জলে বেশ বড়ো পুকুর হয়ে গেছে।
ড্রাইভারকে বলা হলাে গাড়ি ফেরাও। কিন্তু আমাদের নির্দেশ কানে ঢুকবার আগে শ্ৰমান ড্রাইভার আমাদের পুকুরের মাঝখানে নিয়ে হাজির করল। গাড়ি আর এগােয় না। গাড়ি নামে অ্যাম্বাসডার হতে পারে। কিন্তু আসলে কাজে সেপাই বরকন্দাজও নয়। পুকুরের মাঝখানে গিয়ে এঞ্জিন গোঁ গোঁ শব্দ করতে লাগল। না এগোয় না পেছােয়। কিছুক্ষণ আগে ড্রাইভার তার গাড়ি চালাবার এবং গাড়ির যন্ত্রপাতির বিশেষজ্ঞ বলে নিজেকে জাহির করছিল কিন্তু গাড়ির এঞ্জিনের ক্রুদ্ধ আওয়াজ শুনে স্বীকার করল যে ব্যাপারটি সে বুঝে উঠতে পারছে না। উপায়? গাড়ি ঠেলতে হবে। সামনে এগিয়ে যাবার উপায় নেই। কারণ জল সেখানে গভীর অতএব গাড়ি পেছন দিকে ঠেলতে হবে। কিন্তু পেছন দিকে তাে মানিকতলা ব্রিজ—মানে চড়াই, গাড়ি ঠেলে ওপরে তুলতে হবে।
আমি আর চাটুয্যে সাহেব জুতো খুলে প্যান্ট গুটিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়লুম এবং সবাই মিলে গাড়ি ঠেলতে লাগলুম। খালি পা, পথে কঁাকর ফুটছে, অসহ্য যন্ত্রণা। গাড়িতে একা বসে থাকতে সেন সাহেব বেশ লজ্জা অনুভব করলেন। বললেন : ওহে আমি তােমাদের সাহায্য করব নাকি ? আমরা মাথা নেড়ে বললাম : না স্যার, দরকার হবে না, আমরাই গাড়ি ঠেলে জল থেকে বের করব।
অনেক কষ্ট করে গাড়ি জল থেকে বের করা গেল। আমি ও চট্টোপাধ্যায় ভিজে চুপসে গেছি। ঠিক হল এবার অন্য পথ দিয়ে বেনাপােল যেতে হবে।
গাড়ি ঘুরিয়ে শেয়ালদা দমদম পার হয়ে বারাসতের পথ দিয়ে আমরা বেনাপােলে পৌছুলাম। | গাড়ীতে বসে প্রায় দু’ঘণ্টা ধরে সেন সাহেবের সঙ্গে আলাপ-আলােচনা হলাে। সেন সাহেব উদার প্রকৃতির মানুষ। তিনি স্বীকার করলেন যে আমরা কিছু ভুল করেছি। তবে এটাও ঠিক সেন সাহেব যখন তার বিরােধী….
ওহে বাঘে গরুতে এক ঘাটে জল খায় না।
আর একটা ব্যাপারে ভারতবর্ষ কখনই কোন হস্তক্ষেপ করেনি। সেই টি হলে বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে। আমরা জানতাম বাংলাদেশে কি হচ্ছে না হচ্ছে, কিন্তু বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। ওদের ব্যাপারে নাক গলান যায় না।
বেনাপােল পার হয়ে আমরা যখন বাংলাদেশে পৌছলাম তখনও বৃষ্টি থেমে যায় নি। চট্টোপাধ্যায় সাহেব বিদায় নিলেন। কারণ তাকে কলকাতায় ফিরে যেতে হবে। আমি এবং সেন সাহেব বাংলাদেশে ঢুকলুম। ওখানকার এস ডি পি ও ভারী ভদ্দরলােক, এসেছিলেন আমাদের অভ্যর্থনা করতে। উনি আমাদের গাড়ি করে যশোর সার্কিট হাউসে পৌছে দিলেন। সেদিন রাস্তা ছিল একেবারে নির্জন, জনমানৰ শূন্য।
কিন্তু পরের দিন কলকাতার বিশেষ সংবাদদাতার নিউজ ডেসপ্যাচে পড়লুম যে সহস্র সহস্র নরনারী সেন সাহেবকে বিদায় দিতে বেনাপােলে এসেছিল। খবরটা পড়ে আমার হাসি পেল। কারণ সেদিন বেনাপোলের বাটিতে ছিলুম মাত্র আমরা তিনজন। সহস্র সহস্র নরনারী এলাে কোথা থেকে? সেন সাহেবকে কাগজটি দেখিয়েছিলুম। তিনি হেসে জবাব দিলেন যে তােমার সাংবাদিকরা অঙ্ক জানেনা। এই কথা আরও একটু বিস্তারিত ভাবে পরে বলা যাবে।
যশাের বিমান বন্দর থেকে প্লেনে আমরা ঢাকায় এলুম। ঢাকার বিমান বন্দরে সেন সাহেবকে সামরিক সম্বর্ধনা জানান হল। পরে এই সামরিক সম্বর্ধনার তাৎপর্যর অর্থ বুঝতে পেরেছিলুম। অর্থাৎ সমর সেনকে পুনরায় হাই কমিশনার হিসাবে গ্রহণ করা হচ্ছে। অর্থাৎ অতীত মুছে গেছে, নতুন করে রাজত্ব আরম্ভ হয়েছে। | এক টু থিতিয়ে বসে আমরা মুজিব-হত্যার তথ্য সংগ্রহে সচেষ্ট হলুম। কিন্তু এত গুজব ও পরস্পর বিরােধী থবর টপকে সত্য খবর বার করা বেশ মুশকিল মনে হল।
তার ওপর আমাদের গতিবিধির ওপর বেশ তী” নজর রাখা হতো। টেলিফোনও প্রায়ই কাজ করত না। যখনই আমাদের টেলিফোন বিকল হয়ে যেতে তখনই আমরা বুঝতে পারতুম যে বাংলাদেশের কোথাও কোনো রাজনৈতিক ঘটনা কিছু ঘটছে। বহুবার আমাদের টেলিফোন বিকল হয়ে গিয়েছিল।
________________________________________
শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ির সামনেই ছিলো আমার বাড়ি। আমাক বাড়ির ব্যালকনি থেকে ওর বাড়ির সব কিছু স্পষ্ট দেখা যেতো।
আপে সন্ধ্যের পর দেখতুম যে শেখ সাহেবের বাড়ি আলোয় জগমগ করছে। লােকজন আসছে যাচ্ছে। গাড়ির সংখ্যা গুণে শেষ করা যেত না। আজ অবশ্য ঐ বাড়ি দেখে মনে হল যেন নিঃঝুম, ভূতের বাড়ি। শুধু বাড়ির সামনে দুটো প্রহরী দাড়িয়ে ছিল।
আমার বাড়িতে হত্যাকাণ্ডের সময় যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সুপে হত্যার কিছুটা বিবরণী শুনলুম। বাড়ির লােকেরা বললেন প্রায় ভাের চারটা থেকে প্রায় দেড়শো সৈনিক বাহিনী এবং বেশ কিছু ট্যাঙ্ক শেখ সাহেবের বাড়ি ঘিরে ফেলে। এই ট্যাঙ্ক বাহিনীর নেতা ছিলেন মেজর ফারুক, মেজর রশীদ, মেজর নুর। পরে শুনেছিলুম আরাে দুটি সৈনিক বাহিনী গিয়ে ছিল ফজলুল হক মুনি এবং সেরনিয়াবাতের বাড়িতে। এই কথা পরে বিস্তারিত বলা যাবে। | আমার বাড়ির লােকদের সতর্ক করে বলে দেওয়া হলো, চুপ করে থাকে। কাউকে টেলিফোন করবার চেষ্টা করােনা। সৈনিক বাহিনীদের হাতে ষ্টেন গান দেখে বাড়ির মেয়েরা চুপ করেছিলো। কথা বলবার চেষ্টা করেনি। সৈন্য বাহিনীর একদল লােক আমার বাড়ীর সামনে এসে দাড়িয়ে ছিলো।
শেখ সাহেবের বাড়িতে ছিল তার ছেলে কামাল। তার মেজো এবং ছোট ছেলে জামাল এবং রাসেল। তাছাড়া কামালের এবং জামালের বউ। এছাড়া ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের ভাই নাসের।
গুলী প্রথমে কে ছুড়েছিলাে এই কথা আমার বাড়ির লােকেরা সঠিক বলতে পারলাে না। শুধু তার বন্দুকের গুলী আর মেয়েদের ও শিশু রাসেলের ক্রন্দন শুনতে পেয়েছিলো। পরে শুনেছিলুম যে গুলী প্রথমে করেছিলো শেখ মুজিবর রহমানের সিকিউরিটি গার্ড। বিরোধী দলেরা বলেন যে গুলী সুরু করেছিলেন শেখ কামাল। কিন্তু ঐ দিনের হৈ-হল্লার মধ্যে সত্যি মিথ্যে বাচাই করা সম্ভব হয়নি। বাজারে আর একটা গুজব প্রচলিত ছিলো যে শেখ সাহেবকে গুলী করবার কোন উদ্দেশ্যই মেজরদের ছিলোনা। তারা শুধু শেখ সাহেবকে বন্দী করতে চেয়েছিলেন। শেখ আপত্তি করবার জন্যে তাকে গুলী করা হয়েছিল। আর শেখের উপর ষ্টেনগান চালিয়েছিলেন সুবেদার মুসলিমুদ্দিন। খানিক আগে মুসলিমুদ্দিন শেখ ফজলুল হক মুনিকে বেয়নেটের সাহায্যে হত্যা করে। মুনি এবং তার স্ত্রী বেশ কিছুক্ষণ বেঁচে ছিলো কিন্তু তার ভাই এবং ছেলেরা পালিয়ে যায়
সাহেবের সিকিউরিটি চীফ ব্রিগেডিয়ার জামিলকে খবর পাঠিয়েছিলেন। জামিল দৌড়ে ছুটে আসেন কিন্তু রাস্তায় তাকে গুলী করে মারা হয়।
পরে হত্যাকারীদের মধ্যে খুব সম্ভবত মুসলিমুদ্দিন [ আমার বাড়ীর প্রহরীর মুখে শোনা] এবং আরাে কয়েকজন হত্যাকারী এসে আমার বাড়ীতে জল খায় এবং এক বালতি জল দিয়ে হাত ধােয়।
এ হলো বাড়ীর লােকজনের বিবৃতি।
এবার আমি পুরান বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যোগাযোগ করবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু কেউ আমাদের সঙ্গে কথাবার্তা বলতে রাজি হলেন না। নিকট বন্ধুরা ও আমায় এড়িয়ে যাবার চেষ্টা করলেন। এক বাড়ির ভদ্রমহিলা বেশ স্পষ্ট জোর গলায় বললেন, খবরদার আপনি আমাদের আর টেলিফোন করবার চেষ্টা করবেন না।
আমার এক বন্ধু যিনি পাকিস্তানী আমলেও বাংলাদেশে ছিলেন ; বললেন আমরা আবার পূরন দিনগুলিতে ফিরে এসেছি।
ভদ্রলোকের এই মন্তব্য একেবারে অমুলক ছিল না। কারণ আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে ভারতবর্য হলাে অস্পৃশ্য। প্রকাশ্যে রাস্তায় আমাদের সঙ্গে কেউ দেখা করত না কিংবা কথা বলত না। কথা বললেও বেশ অস্ফুট স্বরে ফিস ফিস করে কথা বলতাে।
আর একদল ঐশ্লামিক ঢংয়ে কথা বলতেন। কথায় কথায় তারা কোরান • শরীফ, সৌদী আরবিয়া এবং অন্যান্য ইন্নামি দেশগুলোর কথা আওড়াতেন।
কিন্তু আমার জানবার আকাঙ্ক্ষা হল ১৫ই আগষ্ট প্রত্যুষে কি ঘটেছিল।
পরে শুনেছিলুম ভাের সাড়ে চারটার সময় হাঙ্গামা শুরু হয়েছিলো। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা দরকার। বেশ কিছুদিন ধরে মেজর ফারুক ও মেজর রশীদের দল শেখের অনুমতি নিয়ে ট্যাঙ্ক বাহিনী নিয়ে টহল দিতে বেরুত। কেউ কোন সন্দেহ করেনি। ১৫ই আগষ্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শেখ মুজিবর রহমানের একটি রাজনীতিক বক্তৃতা দেবার কথা ছিল। ১৪ই আগষ্ট * বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে একটি বােমা ফাটান হয়। সামরিক বাহিনীর কয়েকজন শেখ সাহেবের কাছে বললেন, শহরে গােলমাল হবার সম্ভাবনা আছে। অতএব শৃঙ্খলা বজায় রাখবার জন্যে তারা ট্যাঙ্ক বাহিনী নিয়ে শহর টহল . দেবার প্লান করেছেন। শেখ সাহেব ছয়টি ট্যাঙ্ক বের করার অনুমতি দিলেন। পরে শুনেছিলুম যে এই ছয়ের আগে একটি তিন বসান হয়েছিল। অতএব তিন আর পাশের ছয় মিলে হলাে ছত্রিশ। সেই রাত্রে ছত্রিশটি ট্যাঙ্ক ঢাকা
________________________________________
শহরে টহল দিয়েছিল।
বাল্যকালে পাঁচকড়ি দে’র একটি ডিটেকটিভ থ্রিলার পড়েছিলাম। থ্রিলারটির নাম ছিল, হত্যাকারী কে? এবার আমার অনুসন্ধিৎসু মন। জানবার প্রবল আকাথা হলাে যে শেখ মুজিবর রহমানকে কে হত্যা করেছে ? এই হত্যার পশ্চাতে কার হাত ছিল? পুরাে ঘটনা এই কাহিনীর শেষাংশে বলা হবে। এখন শুধু দেখা যাক হত্যাকারী কে ? | ছয়জন হত্যাকারীর নাম শুনলাম। এর মধ্যে রশিদ, ফারুক এবং ডালিমের নাম উল্লেখযােগ্য। কিন্তু আসলে যে শেখ মুজিবর রহমানকে খুন করেছিল তার নাম হলো মুসলিমুদ্দিন আহমেদ। পরবর্তীকালে মুসলিমুদ্দিন জেলখানায় তাজউদ্দিনকে বেয়নেট দিয়ে চার্জ করে গুলি করে হত্যা করেছিল। প্রতিটি হত্যার জন্যে মুসলিমুদ্দীনকে যথেষ্ট ইনাম দেওয়া হয়েছিল।
ডালিমের নাম চক্রান্তের সঙ্গে জড়াবার আর একটি বিশেষ কারণ আছে। শেখ মুজিবর রহমানকে নাকি রাজনীতিক উদ্দেশ্যে হত্যা করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছে ব্যক্তিগত আক্রোশের জন্যে। এরকম গুজবও আমরা শুনেছি।
বিদেশী কাগজে বেশ ফলাও করে প্রকাশ করা হলাে যে শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পেছনে কোন রাজনৈতিক কারণ নেই, হত্যার কারণ aufgy “It is not a political murder but a personal vendetta”
সেদিন রাত্রে ডালিম ওই ছয়জনের মধ্যে ছিল এবং মুসলিমুদ্দিন যখন শেখ মুজিবর রহমানকে গুলি করে হত্যা করে তখন ডালিম ঘটনাস্থলে হয়তাে উপস্থিত ছিল না এবং শেখ সাহেবকে হত্যা করবার ব্যাপারে সে খুব প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিল না। কেন ডালিমের নাম শেখ সাহেবের হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারে জড়ান হয়েছিল এবার সেই কথা বলা যাক।
ডালিম বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীতে কাজ করতাে এবং শেখের নির্দেশে ডালিমকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। একদিন এক বিয়ে বাড়িতে গাজী গােলাম মােস্তাফার ছেলে ডালিমের স্ত্রীকে অপমান করে। ডালিম ওই বিয়ের বাসরে উপস্থিত ছিল এবং গোলাম মােস্তাফার ছেলেকে ধরে মার দেয়। ছেলেকে ডালিম মার দিয়েছে এই খবরটি গােলাম মােস্তাফার কানে গেল। গােলাম মােস্তাফা ছিলেন শেখ মুজিবর রহমানের বিশেষ বন্ধ এবং বাংলাদেশের রেডক্রসের একজন প্রেসিডেন্ট। গাজী গােলাম মােস্তাফার বেশ দুর্নাম ছিল।
গােলাম মােস্তাফা ব্যাপারটা ছেড়ে দিল না। ছেলেকে প্রহার করা।
________________________________________
এতে তারও অপমান। প্রতিশােধ নেবার উদ্দেশ্যে গোলাম মোস্তাফা ডালিমকে সেই বিবাহ আসরেই নাকি চপেটাঘাত করে। ডালিমের বৌ গােলাম মােস্তাফাকে অনুরোধ করে, “আমার স্বামীকে ছেড়ে দিন। তারপর গােলাম মােস্তাফা ডালিমকে ধরে শেখ মুজিবর রহমানের কাছে নিয়ে গেলেন। এক তরফা নালিশ। বিচারে ডালিমের চাকরি গেল। ডালিম ব্যবসা করতে শুরু করল প্রকাশ্যে কিন্তু সেই অপমান মনে পুষে রাখল।
ছাই দিয়ে আগুন চাপা যায় না। কয়েক দিনের মধ্যে ১৫ই আগষ্টের আসল ঘটনার খবর পেলুম। এই খবরটি পেয়েছিলুম ওই ছয় হত্যাকারীদের বন্ধুদের কাছ থেকে। ডালিমের অনেক বন্ধুই আমার বিশেষ পরিচিত। বিশেষ কোন কারণে এদের নাম আজ উল্লেখ করা সম্ভব নয়। অবিশ্যি আমি আরাে বহু পুত্রে বাংলাদেশের মুজিব হত্যার চক্রান্তের আরাে অনেক খবর পেয়েছিলুন যে কাহিনী বারান্তরে বলা যাবে। তবে এই হত্যার পেছনে হাত ছিলাে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ, মহাবুব আলম চাষী এবং তাহেরুদ্দিন ঠাকুরের কিন্তু আসল হত্যার পরিকল্পনা কে করেছিল পরে বলা যাবে। কিন্তু মুজিব সরকরাকে হটানাে খুব সহজ কাজ ছিলাে না। কারণ মুজিব মস্কো থেকে ফিরে এলে বাকশাল গঠন করলেন, প্রশাসনকে আরো শক্তিশালী করবার জন্যে জেলাগুলােকে ভাগ করবার চেষ্টা করলেন। দেশের সংবাদ পত্রগুলাের উপর তার একটুও বিশ্বাস ছিলো না। অতএব মুস্তাক আহমেদ, মহাবুব আলম চাবী এবং তাহেরুদ্দিন ঠাকুর ঠিক করলেন যে আর দেরী করা উচিৎ হবে না। | ইতিমধ্যে মুজিবের খ্যাতি বেশ স্নান হয়েছিলো। তার প্রধান কারণ প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্রের দাম, দুর্ভিক্ষের ছায়া এসে দেখা দিলাে বাংলাদেশে। মুজিব ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের জনসাধারণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে বাংলাদেশে চালের দাম আধা করে দেওয়া হবে। কিন্তু এই প্রতিশ্রুতি তিনি রাখতে পারলেন না। চালের দাম প্রায় হাজার গুণ বেড়ে গেলাে। লােক অনাহারে মরতে লাগলো। লবণ পাওয়া যায় না, প্রয়ােজনীয় সব কিছুই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়। জনপ্রিয় বঙ্গবন্ধু মুজিব হলেন সবার চোখের বিষ। বাজারে মুজিবের নিন্দে ছাড়া আর কিছুই শােনা যেতাে না। সে কালে আর একটি প্রবাদ প্রচলিত ছিলো, লবণ, চাল ইত্যাদি ভারতে পাচার করা হচ্ছে। ভারত সরকার এই গুজবের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু এই প্রতিবাদে কে কান দেয়। আমাদের প্রতিবাদে বিশ্বাস না করার
________________________________________
আর একটি বিশেষ কারণ ছিলাে। বিপদের আশংকা করে মুজিব নিজেই বলতেন যে প্রয়োজনীয় জিনিষ লবণ, কাপড়, চাল ইত্যাদি ভারতে স্মাগল করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।
বাজারে আর একটি গুজব চালু ছিলো যে ১৯৭১-৭৪ সাল বাংলাদেশ সরকার বিদেশী সরকার থেকে দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্য পেয়েছে। দুই বছরে বাংলাদেশ যে আর্থিক এবং বিভিন্ন ধরণের সাহায্য পেয়েছিলো, গত তেইশ বছরে পূর্ব পাকিস্তান অর্থাৎ বাংলাদেশ পাকিস্তান সরকার থেকে এতে সাহায্য পায়নি। এই দুই বিলিয়ন ডলার সাহায্য কোথায় গেলো এবং কার পকেটে ? এইটে ছিলো ঢাকার বাজারে আলােচনার বিষয়। অভিযােগ করা হলাে যে ঢাকার আওয়ামী লীগের প্রেসিডেন্ট এবং রেডক্রসের সভাপতি গাজী গােলাম মুস্তাফা প্রচুর টাকা সরিয়ে ছিলেন। এছাড়া ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সদস্য জন ষ্টোনহাউসও বাংলাদেশের টাকা চুরি করে ফেলে গিয়েছিলেন। ইউনাইটেড নেশনসের ট্রান্সপাের্ট ডিভিশনের কর্মচারীরা বাংলাদেশের রিলিফের টাকা থেকে বেশ কিছু টাকা অপসরণ করে ছলেন।
বাংলাদেশের এই আর্থিক চরম দুর্গতির সময় খােন্দকার, মহাবুব আলম এবং তাহেরুদ্দীন ঠাকুর আমেরিকান সরকারের শরণাপন্ন হলেন। এই যোগাযােগ কোথায় করা হয়েছিলাে বলা যায় না। ওয়াশিংটন, লণ্ডন না তেহরাণে না কলকাতায় বলা যায় না। এনায়েতুল্লা অবশ্যি বলেছিলেন এই যােগাযোগ খােন্দকার মুস্তাক আহমেদই তেহরাণে আমেরিকান এম্বাসার রিচার্ড হেলমসের সঙ্গে করেছিলেন। আনােয়ার হােসেন মনজুর বক্তব্য ছিলাে যে যােগাযোগের স্থান ছিলাে কলকাতা। কলকাতার ভূতপূর্ব সি-আই-এ চীফ গ্রীফিন ছিলেন ওয়াশিংটনে বাংলাদেশের ইনটেলজেন্স ডেস্কে।
কোন দেশে কু দ্য আঁতাত করতে হলে বিদেশী শক্তি কিংবা আমির সাহায্যের প্রয়ােজন। আমির সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন মহাবুব আলম চাষী। মহাবুব আলম জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সাহায্যর জন্য অনুরােধ করেছিলেন। মার্চ মাসের শেষের দিকে একবার আমেরিকান এম্বাসডার বােষ্টার সাহেব নিজে জিয়াউর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তাদের আলাপ আলােচনার বিস্তৃত বিবরণী পাওয়া যায়নি। মার্চ মাসের শেষে মেজর ফারুক এবং রশীদ জেনারেল জিয়ার সঙ্গে এই কু দ্য আঁতাত নিয়ে আলােচনা করলেন। জিয়া অবশ্যি হ্যা কিংবা না কোন কিছুই বললেন । তিনি নেপথ্যে দাড়িয়ে নাটক দেখতে লাগলেন। তিনি বল________________________________________
তােমরা যদি কিছু করতে পারাে করাে। আমার কোন মন্তব্য করবার কিছু নেই। জিয়াউর রহমান অবশ্যি জানতেন খােন্দকারের রাজত্ব বেশীদিন টিকবে না। তাই তিনি সময় এবং সুযােগের প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। বিপ্লব যদি কোন কারণে ব্যর্থ হয় তাহলে তিনি তার গর্দান দিতে চান না। জিয়া, মহাবুব আলম এরা সবাই জানতেন যে জিয়াউর রহমানের রাজত্ব শিগগিরই শুরু হবে।
মুজিবকে হত্যা করবার দুচারদিন আগে ফারুক এবং রশীদ মহাবুব আলম চাষী এবং তাহেরুদ্দীন ঠাকুরের মাধ্যমে নাটকের প্রধান নেতা খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সঙ্গে যােগাযােগ করে।
ইতিমধ্যে ওয়াশিংটনে চার্চ-পাইক কমিটি সি-আই-এ পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যে সব হত্যাকাণ্ড করেছিলাে সেই বিষয় নিয়ে বৈঠক সুরু করলো। এই সব কারণ বশতঃ ১৯৭৫ জানুয়ারী মাসে ঢাকায় আমেরিকান দূতাবাসের কর্মচারীরা কু দ্য আঁতাতের প্রধান প্রধান নেতাদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করা বন্ধ করে দিলেন। অবশ্যি সি-আই-এর ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী এবং অন্যান্য এজেন্টরা। মহাবুব আলম, তাহেরুদ্দীন ঠাকুর এবং ইনটেলিজেন্সের কর্তা এম এস শফদরের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন।
সি-আই-এ ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরী সাংবাদিকের কাছে অস্বীকার করেছেন যে ঢাকার আমেরিকান এম্বাসী মুজিব হত্যার কাহিনীর কোন পূর্বাভাষ পেয়েছিলো। সি-আই-এ এই ঘটনার সঙ্গে কোন প্রকারেই জড়িত ছিলোনা।
তবে দু’বার ফিলিপ চেরী দু’টি মারাত্মক ভুল করেছিলেন। প্রথমতঃ একদিন বন্ধুদের কাছে বলেছিলেন যে মুজিব হত্যার পুরো কাহিনী একমাত্র তিনিই জানেন। চেরী সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে কোন কু দ্য আঁতাত করবার জন্য প্ল্যানিং এর দরকার হয়। তিনি আরো স্বীকার করেছেন যে ঢাকা শহরে গােলমাল হচ্ছে। হ্যা তিনি বন্দুকের গুলীর আওয়াজ পেয়েছিলেন।
তিনি এবং আরো কয়েকজন ডিপ্লোম্যাটিক অফিসার ভাের চারটে থেকে এম্বাসীতে ছিলেন এবং সি-আই-এর খবর পাঠাবার প্রথা এতো ভালাে ছিলাে যে কয়েক সেকেণ্ডের মধ্যে তারা মুজিব হত্যার কাহিনী ওয়াশিংটনের কাছে পাঠিয়েছেন। এইখানে স্মরণ রাখা দরকার যে মুজিবকে হত্যা করা হয় ভাের সাড়ে চারটা থেকে পাঁচটার মধ্যে অথচ সি-আই এর ষ্টেশন চীফ এবং সহকর্মীরা অতে। ভোরে মানে শেখ সাহেব খুন হবার আগেই তাদের দপ্তরে
গিয়ে বসেছিলেন এবং চেরীর বিবৃতি অনুযায়ী শেখ সাহেবের মরবার খবর তার মৃত্যুর আগেই ওয়াশিংটনে পাঠান হয়েছিল। তিনি আরও বলেন যে এম্বাসিতে বসেই বন্দুকের গুলীর আওয়াজ শুনে তিনি খবর পাঠাতে শুরু করেন যদিও তার কথানুযায়ী ঐ সব গুলী গোলার আওয়াজ হচ্ছিল। অথচ তিনি কী করে জানলেন যে ঐ গুলী গােলার একটি মাত্র অর্থ হলাে যে শেখ মুজিবর রহমানকে খুন করা হচ্ছে। ফিলিপ চেরী সাংবাদিকদের কাছে আসল কথা গােপন করে সত্যি কথা বলেন। এইখানে বলা দরকার এই সময়ের গুজব যে অ্যামেরিকান অ্যাম্বাসাডার বােষ্টারকে খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। পরবর্তীকালে বােষ্টার হয়েছিলেন গুয়েটেমালায় অ্যামেরিকান অ্যাম্বাসাডার।
মুজিব হত্যার চক্রান্তের বিস্তারিত কাহিনী পরে বলা যাবে।
১৮ই তারিখে ঢাকার বাড়িতে ফেরবার সঙ্গে সঙ্গে আর একজন গণ্যমান্য ভারত বিদ্বেষী সাংবাদিকের কাছ থেকে টেলিফোন পেলুম। মুজিবের মৃত্যুর পর এই সাংবাদিক আরও অনেক নতুন কাজের দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং পরে বহু কু দ্য আঁতাতের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। কথায় কথায় ভদ্রলােক ভারতবর্ষকে গালিগালাজ করতেন এবং তার কাগজ ‘হলিডে’ এই সৰ গালিগালাজ ছেপে প্রকাশ করত।
ভদ্রলােকের নাম এনায়েতুল্লা। এই এনায়েতুল্লার সঙ্গে আমার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিল। পরে এনায়েতুল। আমার বিশেষ ক্ষতি করেছিলেন।
যাক সন্ধ্যের পর এনায়েতুল্লা খা আমার বাড়িতে এলেন। ঘরে ঢুকেই বললেন : আপনার বাড়ির সামনে বেশ কয়েকজন টিকটিকিকে ঘুরতে দেখলুম।
জবাব দিলুম, আমি মাত্র কয়েক ঘণ্টা আগে ঢাকায় এসেছি।
এনায়েতুল্লা খাঁ বললেন : তার জন্যে কি ? এবার থেকে আপনার বাড়ির সামনে সদা সর্বদাই এই সব টিকটিকি ঘুরবে। বাংলাদেশে থাকাকালীন আপনার দরজার কাছ থেকে ওরা যাবে না।
আমি আবার হেসে বললুম : কিন্তু আমি তাে স্পাই নই। আমার ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখবার কি দরকার?
এনায়েতুল্লা হাসলেন, কথাবার্তায় এনায়েতুল্লা ভারী অমায়িক কিন্তু ভারত বিদ্বেষী। আমার মনে আছে শেখ মারা যাবার পর একদিন এনায়েতুল্লা বৌ-এর বাড়িটি আমাদের কাছে ভাড়া দেবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সেন সাহেব বাড়ি ভাড়ার ব্যাপারে উৎসাহ দেখান নি।
________________________________________
এনায়েতুল্লার সঙ্গে গল্পগুজব শুরু হল। রাত একটার পর এনায়েতুল্লা জিজ্ঞাসা করলেন : আপনারা কি এই হত্যাকাণ্ডের কোন আভাষ পেয়েছিলেন?
অস্বীকার করতে হলো, কারণ সাংবাদিকের প্রধান কাজ হল সত্যকে গােপন করে মিথ্যা বলা। গফর চৌধুরী যে আমাদের সতর্ক করেছিল সেই কথা বেমালুম চেপে বললাম : কি যে বলেন? এ হলাে আপনাদের ঘরোয়া ব্যাপার। এই ব্যাপার নিয়ে আমরা মাথা ঘামাব ?
এনায়েতুল্লা আমার এই জবাব আদৌ বিশ্বাস করলেন না। বরং বেশ মুচকি হেসে বললেন : দুনিয়ার সবাই বাংলাদেশের খবর জানবার জন্যে ব্যগ্র আর দিল্লির কর্তারা এই ব্যাপারে কিছুই আগে জানতে পারে নি, বিশ্বাস করা যায় ?
আমি হাল ছাড়বার পাত্র নই। এনায়েতুল্লাকে বােঝাবার চেষ্টা করলাম। বাংলাদেশ স্বাধীন দেশ, আপনাদের ঘরের ব্যাপারে আমাদের কি দরকার ?
আমার জবাব শুনে এনায়েতুজা বেশ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে আমি বড় কঠিন পত্র। আমার মুখ থেকে উনি কোনাে খবরই বার করতে পারবেন না। বরং ওঁকেই কথা বলতে হবে। কথা বললেনও। এনায়েতুল্লা বললেন—না, দিল্লির কর্তারা শেখের জীবন বিপন্ন হয়েছে এই কথা জানতে পেরেছিলেন। শুধু তাই নয় শেখকে বাঁচাবার জন্যে ওঁরা হেলিকপ্টার পাঠিয়েছিলেন। | আমাকে তীব্র প্রতিবাদ করতে হলাে। বললাম, ডাহা মিথ্যে কথা। শেখকে বাঁচাবার জন্যে আমরা কোনাে প্লেন কিংবা হেলিকপটার পাঠাই নি ওই হেলিকপ্টারটা ভারতীয় ছিল বটে কিন্তু গতানুগতিক কাজের জন্যে অনেক দিন আগেই ওটা বাংলাদেশে এসেছিল। ঝড়ে কিংবা অন্য কারণে ওটা ধ্বংস হয়। শেখকে বাঁচাবার জন্যে ঐ হেলিকপটার পাঠান হয়নি। | এবার এনায়েতুল্লা জিজ্ঞেস করলেন : আচ্ছা শেখ সাহেব এবং মিসেস গান্ধীর ভেতর যে ‘হট লাইন’ ছিলাে সেই হট লাইনের খবর কী বলুন তাে।
আমিও বহুজনার কাছে শুনেছিলাম যে শেখ মুজিবর এবং শ্রীমতী গান্ধীর মধ্যে কথাবার্তা বলবার জন্য একটা হট লাইন ছিল। এর আগেও আমি বহুবার এই হট লাইনের গুজবের প্রতিবাদ করেছি কিন্তু গুজব থামে নি।
দেখুন খান সাহেব আপনি বিচক্ষণ ব্যক্তি, সাংবাদিক ও ঢাকা প্রেস ক্লাবের সভাপতি। বর্তমানে আপনি বাংলাদেশ টাইমস এবং বাংলার বাণীর প্রধান সম্পাদক। আপনি যদি বাজারের গুজবে বিশ্বাস করে এই সৰ প্রশ্ন করেন তাহলে আমি কি বলব ?
________________________________________
এনায়েতুল্লা এবার বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ রইলেন। আমি বাংলাদেশের গুজবের বাজারের সঙ্গে বেশ পরিচিত ছিলাম। এর আগেও আমি বহুবার বহু রকমের গুজব শুনেছি পরে খবর যাচাই করে দেখেছি সব খবরই মিথ্যে। আর এনায়েতুল্লার পত্রিকা ‘হলিডে’ কাগজে কোনদিনই সত্যি খবর প্রকাশিত
হয় নি।
এনায়েতুল্লা কি ভেবে তারপর বলতে শুরু করলেন, শেখের মৃত্যু দিন ঘনিয়ে এসেছিল এই কথা আমরা অনেকেই জানতে পেরেছিলাম। ঐ বাকশাল এবং ওর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ছিল শেখের শনি। ওদের জন্যেই শেখের মৃত্যু হলাে। শেখ যেদিন বাকশাল গঠন করলেন সেদিন বাংলা দেশ থেকে গণতন্ত্র বিদায় নিল। তিনি আমাদের সবার ব্যক্তি স্বাধীনতা কেড়ে নিলেন এবং দেশের সংবাদপত্র গুলােকে আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন। আসলে তিনি বাংলাদেশকে এক ফ্যাসিস্ত দেশ গঠন করবার চেষ্টা করলেন।
আমি বুঝতে পারলাম যে এনায়েতুল্লার সঙ্গে তর্ক-বিতর্ক করে লাভ হবে । চুপ করে ওর কথাগুলাে শােনাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ।
এবার এনায়েতুল্লা তার নিজের অভিজ্ঞতা এবং কি করে শেখ মুজিবরের বিরুদ্ধে একহাত লড়াই করেছিলেন তার বর্ণনা দিতে লাগলেন। | শেখ সাহেব আমার হলিডে কাগজ কেড়ে নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়। আমাকে সিলেটের জেলে বন্দী করে রেখেছিলেন কারণ আমি শেখ মুজিবরের নীতির প্রতিবাদ করতাম—এনায়েতুল্লা থামলেন।
শেখ মুজিবর রহমান কি কারণে এনায়েতুল্লাকে গ্রেপ্তার করেছিলেন একথা আমার অজানা ছিল না, আমি জানতাম যে এনায়েতুল্লা বন্দী হবার পর তার স্ত্রী গিয়ে শেখ মুজিবর রহমানের কাছে ধর্ণা দেয়। শেখ এনায়েতুল্লাকে ক্ষমা করলেন। শুধু তাই নয় এনায়েতুল্লাকে ইনফরমেশন ডিপার্টমেন্টে বেশ একটা মােটা মাইনেতে চাকরি দিলেন। অথচ সেই রাত্রে আলোচনা প্রসঙ্গে এনায়েতুল। এই ঘটনার কথা একেবারেই উল্লেখ করলেন না। | এনায়েতুল্লা আমাকে মুজিব হত্যার কাহিনী শােনাতে লাগলেন। বললেন : এই হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে অনেকে জড়িত ছিল। সেসব ব্যক্তিদের নামও করলেন। কোন কারণ বশতঃ সেসব ব্যক্তিদের নাম এখানে প্রকাশ করা হলনা। শুধু তাই নয়, তার বদ্ধ ধারণা ছিল যে ‘ভারতের রাহুগ্রাস থেকে মুক্তি পেতে হলে শেখ মুজিবকে হত্যা করবার বিশেষ প্রয়ােজন ছিল। এই হল এনায়েতুর ধারণা।
________________________________________
কী করে মুজিবকে সেই রাত্রে খুন করা হয়েছিলাে এনায়েতুল্লা এবার তার কথা বললেন : তার এই কাহিনী ছিলাে কিছুটা অতিরঞ্জিত।
আমার বাড়ীর লােকদের কাছে (কারণ আমার মুজিবের পাশের বাড়ীতেই থাকতুম) হত্যাকাণ্ডের একটি বিবরণী পেয়ে ছিলুম, এনায়েতুল্লা হত্যাকাণ্ডের আর এক বিবরণ দিলেন। আনােয়ার হােসেন আর একটা বিবরণী দিয়ে ছিলেন। সেই কাহিনী বারান্তরে বলা যাবে তবে এনায়েতুল্লার কথা হলাে মুজিব হত্যার চক্রান্ত অনেকেই জানতেন। আমি মনে মনে হিসেব করে দেখলুম যে শুধু আমরা স্বপ্ন রাজ্যে বাস করছিলুম। আমরা কিছুই জানতুম না।
এনায়েতুল্লা বললেন যে খুনের কিছুক্ষণ পরেই খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ, মহাবুব আলম চাষী এবং তাহেরুদ্দিন ঠাকুর গিয়ে সােজা বেতার কেন্দ্রে হাজির হলেন। ইতিমধ্যে মেজর ডালিম আগেই বেতারে ঘােষণা করে দিয়েছেন যে মুজিবকে হত্যা করে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ নতুন শাসনতন্ত্র স্থাপন করেছেন। মুজিব বিরোধী নেতারা এবং সৈনিক বাহিনীর বড়ো নেতারা খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সঙ্গে নতুন গভর্ণমেন্টের গঠন নিয়ে আলোচনা করছেন। খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে খুনী বলে গণ্য করেন নি। সেই বৈঠকে মেজর ফারুক এবং রশীদ এবং অন্যান্য খুনী মেজরের দলও ছিলো। কিছুক্ষণ বাদে রেডিও ষ্টেশনে মেজর ডালিম এবং খালিলুর রহমান এবং কর্ণেল তাহের এলেন। বাংলা দেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে সবাই আলোচনা করলেন। একটু বাদে মেজর রশীদ কর্ণেল তাহেরকে পাশের ঘরে নিয়ে বললেন যে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ নতুন সরকার গঠন করবার পরিকল্পনা করছেন। শুধু তাই নয় সৈন্য বাহিনীর প্রধান কর্তা শফিউল্লা এবং অন্যান্যদের বদলী করেছেন। বাকশালের কোন সদস্যকেই ক্যাবিনেটে নেয়া হবে না।
কর্ণেল তাহের প্রস্তাব করলেন শেখ মুজিবর রহমান বাংলা দেশের জন্যে যে সংবিধান করেছিলেন সেই সংবিধান রদ করা হােক। দ্বিতীয়ত দেশে মার্শাল আইন জারী করা হােক। রাজনৈতিক বন্দীদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হােক এবং চার নম্বর সমস্ত গণতান্ত্রিক দলগুলোকে নিয়ে সরকার গঠন করা হোক। মহাবুব আলম চাষী এবং খােন্দকার মুস্তাক এই প্রস্তাবগুলো নিয়ে বিচার করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিলেন।
ভাের সাড়ে এগারোটার সময় খােন্দকার মুস্তাক শপথ গ্রহণ করলেন এবং নতুন মন্ত্রীসভা গঠন কয়লেন। এই মন্ত্রীসভায় কর্ণেল তাহের কিংবা জাতীয়
৪২
________________________________________
সমাজতন্ত্রী দলের অন্য কাউকে নেওয়া হলাে না।
বিকেল বেলা মন্ত্রীসভা গঠনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করবার জন্যে জাতীয় সমাজী দলের প্রতিনিধি কর্ণেল তাহের মেজর রশীদ এবং ফারুকের সঙ্গে দেখা করলেন। কিছুক্ষণ বাদে জেনারেল জিয়া এই আলোচনায় যােগ দিলেন। পরে জেনারেল শফী উল্লা এবং মেজর জেনারেল খালিলুর রহমানের সঙ্গে খােন্দকারের নীতি এবং নব গঠিত সরকার নিয়ে আলাপ আলোচনা করেন। কিন্তু তাহের এবং মেজরদের সঙ্গে যে কথাবার্তা হয়েছিল সেই কথা ফলপ্রসূ হয়নি। তাহেরও এই আলােচনা থেকে বুঝতে পারলেন যে খােন্দকারের আসল মুরুব্বি হলো এক বিদেশী শক্তি এবং তার প্রধান সহায় হলেন মহাবুব আলম চাষী। কিছুদিন পরে কর্ণেল তাহের এবং জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের অন্যতম সদস্য লেঃ কর্ণেল জিয়াউদ্দিনকে বলা হলো যদি তারা একটি রাজনৈতিক সংগঠন করেন তা হলে দলের কাজ কারবারের জন্যে অর্থ দেওয়া হবে।
এনায়েতুল্লা খা আমাকে বললেন যে বাজারে সবাই বলছে যে মেজর ডালিমের সঙ্গে শেখ সাহেবের ঝগড়া ছিলো এবং এই কারণ বশতঃ সে শেখ মুজিবর রহমানকে খুন করেছে। খবরটি ভুল। দুনিয়ার সংবাদপত্রের কাছে এই খবরটি এবং পরবর্তীকালে আর একটি গুরুত্বপুর্ণ খবরের রং ফলিয়ে ফলিয়ে চালান হয়েছিল যে মেজর ডালিম ছিলেন হত্যাকারীদের নেতা। এই খবরটি প্রচার করেছিলেন বি-বি-সি এবং রয়টারস সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের বাংলাদেশের সংবাদ দাতা আতিকুল আলম। ২০শে আগষ্ট প্রায় দুই ভজন বিদেশী সাংবাদিক ঢাকাতে একটি বিশেষ প্লেনে করে ঢুকেছিলেন। কোন কারণবশতঃ এই সাংবাদিকদের হােটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে আটকে রাখা হয়। কিন্তু আতিকুল আলম গিয়ে এদের সঙ্গে দেখা করেন এবং সবাইকে বলেন যে শেখ মুজিবর রহমানকে খুন করবার প্রধান কারণ কোন রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত।
আর এই ব্যক্তিগত কারণটি হলাে শেখ মুজিবর রহমান এবং মেজর ডালিমের ঝগড়া…
কী উদ্দেশ্যে আতিকুল আলম এই মিথ্যে খবরটি প্রচার করেছিলেন তার সঠিক কারণ জানা যায়নি। আতিকূল আলম মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তান রেডিওতে কাজ করতেন এবং আওয়ামী লীগ এবং মুক্তি যুদ্ধের বিরােধী কাজ করতেন। যুদ্ধের পর বেশ কিছুদিন তাকে জেলখানায় আটকে রাখা হয়। পরে শেখ মুজিবর রহমানের আদেশে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। মুক্তির পর
________________________________________
আতিকুল আলম বেশ কিছুদিন ঢাকার ইংরাজী সংবাদপত্র পিপলসে কাজ করতেন। কিছুদিন পরে পিপলস সংবাদপত্র বন্ধ হয়ে যায় এবং আতিকুল আলম রয়টারস ও বি-বি-সির সংবাদ দাতা হিসেবে কাজ করলেন। তিনিই কোন উদ্দেশ্য প্রণোদিত হয়ে দুনিয়ার সব সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন যে শেখের মৃত্যুর কারণ রাজনৈতিক নয়, ব্যক্তিগত। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের পর আতিকুল আলম লণ্ডনে চলে যান এবং ঢাকায় থাকাকালীন তিনি জিয়াউর রহমানের বেসরকারী মুখপাত্র হিসেবে কাজ করেন।
১৯৭৭ সালে অক্টোবর মাসে জিয়াউর রহমানের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে একটি বিদ্রোহ হয়। জিয়াউর রহমান বেশ কঠোর হস্তে এই বিদ্রোহ দমন করেন এবং সেই বিদ্রোহে বহু সৈন্য নিহত হয়। আতিকুল আলম এই সময়ে জিয়াউর রহমানের নীতির পক্ষে বহু প্রবন্ধ লেখেন।
অনেক রাত অবধি বেশ গল্প গুজব করে এনায়েতুল্লা তার বাড়িতে ফিরে গেলেন। ঘুটঘুটে অন্ধকার, কিছুই দেখা যায় না। এনায়েতুল্লা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবার পর আমি তাকে আর দেখতে পাইনি। তখন রাত প্রায় তিনটে।
পরের দিন ঢাকার পুরান বন্ধু-বান্ধবদের সঙ্গে যোগাযােগ করবার চেষ্টা করলুম। একটু বাদে বুঝতে পারলুম কাজটি বেশ জটিল। কারণ রাতারাতি আবহাওয়া পাল্টে গেছে। সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন। কেউবা নিরুত্তর, কেউবা কণ্ঠস্বরে বিরক্তির সুরের ঢেউ তুলে বললেন আমাদের কাছে আর টেলিফোন করবেন না। আজকাল রাজনৈতিক আবহাওয়া নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন। আপনি টেলিফোন করলে আমরা বিপদে পড়ব। বুঝতে পারলাম যে আমার টেলিফোনের লাইনও ট্যাপ করা হচ্ছে।
পুরান বন্ধুদের মধ্যে যারা রাতারাতি বন্ধুত্বের কথা ভুলে গেলেন এদের মধ্যে খাজা মুহম্মদ কাইসারের নাম উলেখ করতে পারি। কে এম কাইসার বর্তমানে মুনাইটেড নেশনসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি। কাইসারের সঙ্গে আমার জানাশােনা দীর্ঘকালের, অতি পুরাতন। কাইসার ছিলেন ঢাকার নবাব বাড়ির ছেলে। দেশ ভাগ হবার আগে ইম্পিরিয়াল পুলিসে কাজ করতেন। পরবর্তীকালে পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে কাজ করতেন। বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় কাইসার ছিলন পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত। কাইসার পাকিস্তানের পক্ষ
________________________________________
হয়ে চীনের নেতা মাও সে তুং, চৌ এন লাই এবং কিসিংগারের সঙ্গে মিটিং-এর আয়ােজন করেছিলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার বেশ কিছুদিন অবধি কাইসার মন ঠিক করতে পারেন নি যে তিনি কোনদিকে যাবেন, পাকিস্তান না বাংলাদেশে। বাংলাদেশের জন্যে স্বার্থ ত্যাগ করবার কোন ইচ্ছেই কাইসারের ছিল না। চীনে থাকাকালীন চৌ এন লাই-এর সঙ্গে তার হৃদ্যতা ছিল। এদিকে কাইসার ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টোর ডান হাত কাজেই কাইসারের ছিল দোটানা মন। অনেক চিন্তা ভাবনার পর কে, এম, কাইসার বাংলাদেশে ফিরে এলেন। মুজিবরের আমলে বাংলাদেশকে চীন স্বীকার করে নেয়নি। মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশকে স্বীকার করেছিলো।
মুজিব চীনের সঙ্গে বন্ধুত্ব করবার পক্ষপাতি ছিলেন। তাই চীনের সঙ্গে বেসরকারী ভাবে যােগাযােগ রাখবার জন্যে তিনি রেঙ্গুনে কাইসারকে নিযুক্ত করলেন। রেঙ্গুনে অবশ্যি কাইসারের বিশেষ কাজকর্ম ছিলনা। ঐ সময়ে তিনি প্রায়ই ঢাকায় আসতেন। ঢাকার পূর্বানী হােটেলে বেশ জাঁকিয়ে বৈঠক করতেন। বড়ো বড়ো পুলিস কর্মচারীরা এই বৈঠকে যােগ দেন। আর ঢাকাতে এলেই উনি আমাকে ডেকে পাঠাতেন।
কাইসারের বৈঠকে যারা যােগ দিতেন তাদের মধ্যে ছিলেন আব্দুর রহিম, এস. এ হাকিম, মুসা মিঞা চৌধুরী, আমির খসরু, এম. এন. হুদা, এ. কে. মুসিমুদ্দিন, আবু সৈয়দ সাহাজাহান, এ. কে. আমিনুর রহমান, গুলাম মুরেসেদ ইত্যাদি। এরা সবাই ছিলেন পাকিস্তান পুলিশবাহিনীর মহারথী। মুক্তি যুদ্ধের সময় এই সব পুলিস কর্মচারীরা বাংলা দেশের বিরােধী কাজ করতেন। | মুজিবের আমলে বাংলা দেশ ইনটেলজেন্স বিভাগের নাম ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সী হল। মুজিব শফদারকে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সীর কর্তার পদে নিযুক্ত করলেন। মুজিব হত্যার পর শফদারকে ডিরেক্টর জেনারেল, ন্যাশনাল সিকিউরিটি এবং সেক্রেটারীর পদে নিয়ােগ করা হয়। এর আগে এতো উচু পদে অন্য কোন পুলিস কর্মচারীকে নিয়ােগ করা হয়নি। অবশ্যি কে এম কাইসার ছিলেন জুলফিকার আলীর ডান হাত এবং পিকিং এ পাকিস্তানের রাজদূত। সেই কারণ বশত: অন্যান্য সহকর্মীদের উপর কে এম কাইসারের বিশেষ প্রভাব ছিলাে। এই প্রসঙ্গে ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সি এবং পূর্ব বাংলা সিকিউরিটি ফোর্স সম্বন্ধে কিছু বলা দরকার। কারণ বাংলা দেশের আসল শাসনকর্তা সৈন্যবাহিনী নয় বরং এই সব ইনটেলিজেন্স
কর্মচারীরাই বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রের সূতে টেনে থাকেন।
অধিকাংশ পুলিস কর্মচারীরা মুক্তি যুদ্ধে যােগ দেননি বটে কিন্তু মুজিবের আমলে এরা অসৎ উপায়ে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এদের মধ্যে যাদের নাম প্রথমেই করতে হয় তারা হলেন বাংলা দেশের প্রাক্তন ইনসপেক্টর জেনারেল এ এইচ মুরুল ইসলাম এবং ডেপুটি ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ই এ চৌধুরী। নুরুল ইসলামের সঙ্গে আমার সর্ব প্রথম আলাপ হয় কাইসারের পূর্বানী হােটেলের আড্ডায়। পরে আলাপ আরাে দৃঢ় করবার জন্যে আমি নুরুল ইসলামের দপ্তরে গিয়ে দেখা করেছিলুম। দেখা করবার কারণ হলাে যে আমার বাড়ীর সব প্রহরীরা বেশ হাঙ্গামা করছিলাে।
নুরুল ইসলামও আমেরিকাতে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। তিনি আই জি হবার আগে ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্টের বড় কর্তা ছিলেন আর ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাষ্টের কর্তা হিসেবে তার প্রধান কাজ ছিলো গুলশান এলাকায় জমি বিতরণ করা। গুলশান হলাে বর্তমানে ঢাকার সবচাইতে ফ্যাশনেবল এলাকা। সাধারণ লােকের পক্ষে এই অঞ্চলে কোন জমি পাওয়া ছিলাে বেশ কঠিন। এখানে জমি পেতে হলে নুরুল ইসলামকে বেশ মােটা টাকা ঘুষ দিতে হতাে। এই ভাৰে নুরুল ইসলাম প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে আর একজন পুলিস কর্মচারীর নাম উল্লেখ করতে পারি। তার নাম ছিলাে জনাব কে, সি, মহীউদ্দীন। তিনি শুধু এডিশনাল আই জি ছিলেন
তিনি ছিলেন কনজিউমার সাপ্লাই কর্পোরেশনের বড়ো কর্তাও। বাংলা দেশে শরণার্থীদের জন্যে এবং অন্যান্য জিনিস আমদানী করতে হলে কনজিউমার সাপ্লাই কর্পোরেশনের অনুমতির প্রয়ােজন হতো। পরে মহীউদ্দীনের বিরুদ্ধে অনেক গুরুতর অভিঘােগ করা হয়েছিল। কিন্তু খাজা মুহম্মদ কাইসার তাকে এই বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। আমীর খসরুকে মুজিব নিজে পাকিস্তান থেকে ডেকে আনলেন এবং রিলিফ ডিপার্টমেন্টের জয়েন্ট সেক্রেটারীর পদে নিযুক্ত করলেন। মুস্তাক ক্ষমতা পাবার পর আমীর খসরুকে রিলিফ ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারীর পদে নিয়ােগ করা হলাে। এই পদেও প্রচুর উপরি পয়সা ছিলো।
আমেরিকাতে ট্রেনিং পেয়েছিলেন এই ধরণের আরও করেকজন উচ্চপদস্থ পুলিস কর্মচারীর নাম উল্লেখ করা দরকার।
সালাউদ্দিন আহমেদ ছিলেন জুট মিলস কর্পোরেশনের চেয়ারম্যান এবং পরে তিনি সুগার মিলস কর্পোরেশনের বড়াে কর্তা হয়েছিলেন। আব্দুল খালেক ছিলেন মিনিস্ট্রি অব ফি সরিসের অধিকর্তা। এইখানে বলে রাখা দরকার যে এই সমস্ত পদগুলােতে ঘুষ খাবার সম্ভাবনা ছিলাে প্রচুর এবং এর প্রচুর অর্থ ঘুষও খেতেন।
পরবর্তীকালে ই, এ. চৌধুরী কমিশনার অব পুলিশ এবং আই জির ভাইয়ের নাম ছিলাে শফী আহমেদ চৌধুরী। তিনি ছিলেন আমেরিকান ফার্ম কন্টিনেন্টাল কোম্পানীর বাংলা দেপের প্রতিনিধি। প্রবাদ আছে যে শফী চৌধুরী ছিলেন বাংলা দেশের একজন ধনি এবং গন্যমান্যি ব্যক্তি। পরবর্তীকালে শফী চৌধুরী হয়েছিলেন জিয়াউর রহমানের ফিনানসিয়ার এবং তারই টাকা দিয়ে জিয়াউর রহমান তার বাংলাদেশ ন্যাশনাল পাটী গঠন করেছিলেন।
এবার অন্যান্য গণ্যমান্য পুলিস কর্মচারীদের কথা বলা যাক। এদের মধ্যে অনেকেই খাজা মুহম্মদ কাইসারের ঘরে এসে আডডা দিতেন। আডডা চলতে ভাের থেকে সন্ধ্যা রাত অবধি। বলবাে না যে শুধুমাত্র পুরুষেরাই এই আড্ডায় উপস্থিত থাকতেন বরং মেয়েরাও থাকতেন। কাইসার ঢাকায় থাকলে আমিও এই আডডায় যােগ দিতুম। কারণ কাইসারের এবং তার সহিদার সঙ্গে আমাদের পরিবারের বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে।
বহু বাংলাদেশী পুলিস অফিসার পাকিস্তান এবং আয়ুবখানের শাসনকালে আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল পুলিস একাডেমীতে গিয়ে তাদের ট্রেনিং নিতেন। কয়েকজন পুলিস কর্মচারীর নাম আগেই দেওয়া হয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমী এবং INPOLSE বলে আর একটি পুলিশ ইনটেলজেন্স অফিসারের দপ্তর বেশ সহযােগিতা করে কাজ করত।
প্রেসিডেন্ট কেনেডির রাজত্বকালে অফিস অব পাব্লিক সিকিউরিটিকে নতুন করে ঢেলে গঠন করা হলাে। ১৯৭৫ সালে মুজিব হত্যার পর ও-পি-এস এ বাইরের কোন বিদেশী পুলিশ কর্মচারীকে ট্রেনিং দেওয়া হোতাে না। তার কারণ ও-পি-এসের কাজকর্ম নিয়ে বাজারে বেশ আলাপ আলোচনা শুরু হয়েছিল। বলা প্রয়ােজন ছিলো কারণ ও ও-পি-এস এই কয়েক বছরের মধ্যে ৭৫০০ পুলিশ কর্মচারীকে তাদের স্কুলে ট্রেনিং দিয়েছিলেন। এই সংখ্যার মধ্যে ভিয়েতনাম, থাইল্যাণ্ড, এবং ইন্দোনেশিয়ার কর্মচারীরাও ছিলেন, তবে অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তানী পুলিস কর্মচারী এবং মুক্তি যুদ্ধের সময় এদের অধিকাংশই মুজিবর রহমানের এবং আওয়ামী লীগের বিরােধী কাজ করেছিলাে। কিন্তু আশ্চৰ্য্যর বিষয় এই সব কর্মচারীরা যে আওয়ামী লীগের বিরােধী ছিলেন একথা জানা সত্ত্বেও মুজিব তাদের বিভিন্ন
________________________________________
পদে নিযুক্ত করেছিলেন। বলা বাহুল্য পাকিস্তানের আমল থেকে এদের সঙ্গে সি-আই-এর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। শফদর নিজে সি-আই-এর কর্তাদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখতেন। আব্দুর রহিম ছিলেন সি-আই-এর বিশ্বস্ত লোক এবং ভূতপূর্ব পাকিস্তানী পররাষ্ট্র সচিব ইকবাল আথার নিজেও আমাকে বলেছিলেন যে কাইসার ছিলেন হেরী কিসিংগারের বন্ধু। | ১৯৬৩ সালে আমেরিকা পাকিস্তানে পুলিশ এবং ইনটেলজেন্স বিভাগকে নতুন করে ট্রেনিং দেবার জন্যে তিন-চারটে ডেলিগেশন পাঠিয়েছিলেন। এই ডেলিগেশনের লােকের পূর্ব পাকিস্তানে এসে এই অঞ্চলের সিকিউরিটি নিয়ে তদন্ত করেন। ১৯৬৩ সালে সর্বপ্রথম বাঙ্গালী কর্মচারীরা ওয়াশিংটনে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমী এবং ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সাভিস স্কুলে ট্রেনিং নেবার জন্যে ওয়াশিংটনে গেলেন। ১৯৬৬-৬৭ সালে ও-পি-এস-এর কর্মচারীরা ঢাকায় মোতায়েন ছিলেন। এদের মধ্যে রবার্ট জানুষ, লিও ক্লেমেন্টস, ওরভাল ডনার ঢাকায় পুলিস এবং ইনটেলীজেন্স ট্রেনিং-এর তত্ত্বাবধান করতেন। ১৯৬৭ সালে ও-পি-এস-এর উচ্চপদস্থ কর্মচারীর পূর্ব পাকিস্তানে অর্থাৎ ঢাকায় ট্রেনিং স্কীমের তত্ত্বাবধান সুরু করলেন। এদের সঙ্গে সি-আইএর বিশেষ যােগাযােগ ছিলো। এই দলের অনেকেই ভিয়েতনামে পুলিশ ট্রেনিং স্কীমের কাজকর্মে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। মুক্তি যুদ্ধের পর এবং বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর হিসেব করে দেখা গেলো যে প্রায় ১১৩ জন পুলিস কর্মচারী আমেরিকার ও-পি-এস ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন এবং ইনপােলসে কাজ করতেন। এই সংখ্যার মধ্যে প্রায় ৪০ জন লোক ছিলেন ইনটেলজেন্স অফিসার এবং আগের হিসেবনুযায়ী এদের সবারই সি-আই-এর সঙ্গে যােগাযােগ ছিলো। মুজিব এদের দেশের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করেছিলেন। পরবর্তী খবরে জানা যায় যে এই সব ইনটেলজেন্স অফিসারের মুজিবের আদেশকে অমান্য করে নিজেদের ইচ্ছানুযায়ী কাজ করতেন এবং মুজিব হত্যার সময় তার ইনটেলজেন্স অফিসার শফদর সি-আই এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন।
আজ কেউ যদি জানবার আগ্রহ প্রকাশ করেন যে বাংলাদেশের প্রকৃত শাসন কর্তা কে ? আমি না সিভিলিয়ান সরকার। তাহলে আমার জবাব হবে দেশের আসল শাসনকর্তা হলেন বাংলাদেশ ইনটেলীজেন্স বিভাগ।
এই কাহিনীর এক জায়গায় বলা হয়েছে যে ফিলিপ চেরী নিজে স্বীকার
________________________________________
করেছেন যে বাংলাদেশ টেলকমুনিকেশন ডিপার্টপেন্ট খুবই তৎপর ছিলাে।
১৯৬৩ সালে আমেরিকান সরকার পূর্ব পাকিস্তানে পুলিস কমুনিকেশন বিভাগকে আরো তৎপর করবার জন্যে ঢাকাতে এলেন। শলকাতজ পাকিস্তান ইনটেলজেন্স ডিপার্টমেন্টের সাহায্য নিয়ে পূর্ব পাকিস্তানের পুলিস কমুনিকেশনের জন্যে একটি খসড়া তৈরী করলেন। ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধের সমৃয়কালীন ও-পি-এস মাত্র দুটি পরিকল্পনা চালু করতে পেরেছিলেন। কিন্তু মুজিব সরকার ও-পি-এসের অন্য পরিকল্পনাগুলােকে কোন আমল দেন নি। পরে মুজিব হত্যার পর নির্জীব পুলিশ টেলিকম্যুনিকেশনকে আবার সঞ্জীবিত করে তােলবার প্রচেষ্টা করা হলো। কিন্তু এই সময়ে আমেরিকান সরকার ব্রিটিশ সরকারের সাহায্য চাইলেন এবং পূর্ব বাংলায় স্বরাষ্ট্র সচিব এবং ব্রিটীশ সরকার একটি ওয়ারলেস কম্যুনিকেশন সিষ্টেমকে পুনর্গঠন করবার জন্যে একটি বাহাত্তর লাখ কুড়ি হাজার পাউণ্ডের চুক্তি সই করলেন। এই বাহাত্তর লাখ টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন আমেরিকান সরকার। কিছুদিন পরে এই ব্যাপার নিয়ে পরীক্ষা করবার জন্যে ঢাকায় একটি মিলিটারী মিশন এসেছিল। সময়টা উল্লেখযােগ্য। কারণ কিছুদিন পরে ঢাকায় সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হলাে। কাজ স্থগিত রাখা হলো।
১৯৭৭ সালে জুলাই মাসে আর একটি মিলিটারী মিশন সাভারের নিকটবর্তী স্থানে একটি মিলিটারী স্টাফ কলেজ খুলবার পরিকল্পনা নিয়ে এলেন। এই ডেলিগেশনের কর্তা ছিলাে কর্নেল গিবসন। গিবসনের ঢাকায় আসবার আর একটি গৌণ উদ্দেশ্য ছিলো-সামরিক ইনটেলজেন্স সংগ্রহ করা। গিবসনের ঢাকায় আগমন নিয়ে তুমুল হৈ-হল্পা শুরু হলাে।
আমি কাইসারের আসরে গিয়ে এই সব ইনটেলীজেন্স অফিসারের দেখা পেতুম। আগেই বলা হয়েছে যে কাইসার এই সব দলের পাণ্ডা ছিল। আর আসরের সবাই ছিলেন মুজিব বিরােধী। এরা শহরের কেচ্ছা কেলেঙ্কারীর গল্প করতেন। অবশ্যি আমি চলে গেলে এরা নিশ্চয় মুজিব বিরােধী কথা বলতেন। কাইসার আমাকে বলতেন এদের সঙ্গে আলাপ পরিচয় রাখিস, কাজে দেবে। কয়েকজনার সঙ্গে আমার আলাপ পরিচয় ছিলো। তবে আমি সাধারণত পুলিসকে এড়িয়ে চলতুম।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবর রহমান রােভিং অ্যাম্বাসাডার হিসেবে ইকবাল আথারকে নিযুক্ত করলেন। আথার ছিলেন পাকিস্তানের
________________________________________
ভুতপূর্ব বিদেশ সচিব। ইকবাল কায়রােতে এলেন এবং কায়রোর বড়ো বড়াে সম্পাদক হাইকেল, আলী আমিন, এহসান আল কুদ্দসের সঙ্গে দেখা করলেন। মিশরের প্রেসিডেন্ট সাদাতের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করলেন। তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হলাে।
আমি যখন কায়রােতে ছিলুম তখন আর একটি বাংলাদেশী ডেলিগেশন কায়রােতে আফ্রো এশিয়ান সালিডারিটি সম্মেলনে যোগ দিতে এসেছিল। এই ডেলিগেশনের নেতা ছিলেন মােল্লা জালালুদ্দিন। আমাদের দলের নেতা ছিলেন মালব্যজী এবং দলের সঙ্গে ছিলেন কৃষ্ণ মেনন, সজ্জাদ জাহীর এবং সুভাষ মুখােপাধ্যায়। এদের সবাইকে আমি ব্যক্তিগত ভাবে জানতুম। মালব্যজী এবং কৃষ্ণ মেনন বেশ বুড়ো হয়ে গিয়েছিলেন, তাই ওদের দেখা শােনা করতেন আমার আর এক সহকর্মী। বাংলাদেশী ডেলিগেশন এবং ভারতীয় সদস্যদের দেখা করবার দায়িত্ব আমাকে নিতে হল।
ঠিক হয়েছিলো যে ভারতীয় দল প্রস্তাব করবে বাংলাদেশের দলকে আফ্রোএশিয়ান সলিডারিটি কনফারেন্সে গ্রহণ করা হােক। আমরা প্রস্তাব করলাম বটে কিন্তু আলজেরিয়া আপত্তি জানাল। ইজিপ্ট স্পষ্ট কিছু বলল না। কারণ ইজিপ্টের প্রতিনিধি ইউসুফ সিবাই বড়ো জটিল ব্যক্তি। দীর্ঘকাল পরে জানা গেল যে তিনি ছিলেন সি-আই-এ ম্যান ইন সলিডারিটি কনফারেন্স।
বাংলাদেশী ডেলিগেশন ওদের বক্তব্য পেশ করবার জন্যে কিছু কাগজপত্র এনেছিলেন। আমি তাড়াতাড়ি সেগুলো আরবী ভাষায় তর্জমা করে নিজের হতেই বিদেশী ডেলিগেশনদের বিলি করলুম।
একদিন দুপুরে আমার বাড়িতে এই ডেলিগেশন আর কায়রাের সাংবাদিকদের জন্যে আমি এক বড় লাঞ্চ দিলাম। মােল্লা জালালুদ্দিন তার দলবল নিয়ে এলেন। ভারতীয় দল থেকে এলেন সাজ্জাদ জাহীর এবং ইজিপ্টের সম্পাদকদের মধ্যে এলেন হাইকেলের প্রতিনিধি হামদি ফোয়াদ, ‘আল আকবর থেকে এলেন আলী আমিন এবং হামরুস। কিন্তু মােল্লা জালালুদ্দিন তার মুখ খুলতে পারলেন না। পরে শুনেছিলুম যে শেখ মুজিবর রহমান মােল্লা জালালুদ্দিনকে মন্ত্রী করেছিলেন। তবে তিনি বেশীদিন তার চাকরি রাখতে পারেন নি।
কিছুদিন পরে শেখ সাহেব মুজিবর রহমান জেনিভাতে এসেছিলেন এবং সেখানে ইকবাল আধারের সঙ্গে তার দেখা হয়। আবার শেখ সাহেবকে সতর্ক
________________________________________
করে দিয়ে বললেন—স্যর আপনার পরামর্শদাতাদের মধ্যে অধিকাংশ লােকই পাকিস্তানী পন্থী। এদের সঙ্গে সাবধানে কাজ করবেন। এরা আপনার ক্ষতি করবে। শেখ সাহেব বিশ্বাস করেন নি যে তার চারপাশে পাকিস্তানী শত্রুরা ঘিরে আছে। আথারের কথা হেসে উড়িয়ে দিয়ে শুধু বললেন-কোন চিন্তা করো না। ওরা আমার কোন ক্ষতি করতে পারবে না। ওদের আসল চরিত্র আমার অজানা নেই। ওরা যে পাকিস্তানী পন্থী আমি জানি। ওদের উপর কড়া নজর রাখবার জন্যেই তাে আমি ওদের আমার অফিসে বড়াে চাকুরী দিয়েছি।
কিছুদিন পরে এই সব পাকিস্তানী শত্রুদের চক্রান্তে ইকবাল আথারের চাকুরী গেলাে। বলা দরকার যে শেখ মুজিবর রহমানের অহমিকা এবং আত্মবিশ্বাসই তার সর্বনাশ টেনে আনলাে। শত্রুদের তিনি দাবিয়ে রাখতে পারেন নি।
শেখ মুজিবর রহমান যখন পাকিস্তানী সিক্রেট পুলিশবাহিনীকে বড়ো বড়ো চাকুরী দিতে লাগলেন তখন ঢাকার রাজনৈতিক এবং কুটনৈতিক মহলে আলােড়ন এবং গুঞ্জন উঠলাে। সবাই শেখ মুজিবর রহমানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে চিন্তিত হলেন। শেখ সাহেব প্রথমতঃ তাজউদ্দীনকে তার ক্যাবিনেট থেকে তাড়ালেন। কেন তাড়ালেন সেই কথা পরে আরাে বিস্তৃত করে বলা যাবে। শেখ সাহেবকে তার পরামর্শদাতারা গিয়ে বললেন যে তার ভাগ্নে ফজলুল হক মুনি হলেন শেখের প্রতিদ্বন্দ্বী। অতএব বিভিন্ন উপায়ে তিনি মুনির ক্ষমতাকে খর্ব করলেন। মুজিবর রহমান মুনিকে দাবিয়ে রাখবার জন্যে রজ্জাক তােফায়েল আহমেদকে প্রচুর ক্ষমতা দিলেন। মুনিকে তিনি কখনই পুরােপুরি বিশ্বাস করেননি।
কিছুদিন পরে পাকিস্তানী পন্থী সিক্রেট সাভিসের পুলিশ কর্মচারীদের বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনলেন এবং তাদের দায়িত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করলেন। এদের মধ্যে কে এম কাইসার ছিলেন জুলফিকার আলী ভুট্টো, হেনরী কিসিংগার এবং চৌ এন লাইয়ের পরামর্শদাতা, কারণ কিসিংগার যখন গোপনে চীনে সফরে যাবার পরিকল্পনা করছিলেন তখন চীনে পাকিস্তানের এম্বাসাডার ছিলেন খাজা মুহম্মদ কাইসার। কাইসারে পূর্বানী মজলিশে যে সব পাকিস্তানী পন্থীদের সঙ্গে মিলে মিশে যে সব আলাপ আলোচনা করতেন সে কথা আগেই বলা হয়েছে। পারিবারিক বন্ধু হিসেবে আমিও বহুবার কাইসারের মজলিশে গিয়ে হাজিরা দিতুম এবং ওদের গল্প শুনতুম, তখনও বাংলাদেশে কোন
________________________________________
গােলমাল দেখা দেয়নি, তবে কাইসারের আসল স্বরূপের কথা আমার অজ্ঞাত ছিলাে না। পরে কাইসারের সম্বন্ধে আমি বহু গল্প ইকবাল আবার এবং তসলিমুদ্দিনের কাছে শুনেছিলুম। আথার এক কালে ছিলেন পাকিস্তানের বিদেশ সচিব। তিনি পাকিস্তানী পন্থী শফদর ও আব্দুর রহিমের চরিত্র বেশ ভালো করেই জানতেন। কাইসারেরর চরিত্রও অজ্ঞাত ছিলাে না।
তসলিমুদ্দিন ছিলেন কাইসারের সহকর্মী। কাইসার পুলিশবাহিনী থেকে পাকিস্তানী ফরেইন সার্ভিসে যােগ দিয়েছিলেন। তসলিমুদ্দিন পাকিস্তানের ইনটেলজেন্স দপ্তরে বেশ বড়ো কাজ করতেন।
কোন এক সময়ে তিনি পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে সেন্টোর ইনটেলজেন্স বিভাগে কাজ করতেন।
তসলিমুদ্দিন ছিলেন নির্ভীক এবং স্পষ্টবাদী। ঠিক কাইসারের চরিত্রের উল্টো। তিনি তার নীতির সঙ্গে কোনদিন অন্যায়ের মীমাংসা করেননি। মুক্তি যুদ্ধের কিছু আগে তিনি বাংলাদেশে ইনসপেক্টর জেনারেলের পদে নিযুক্ত ছিলেন এবং ২৫শে মার্চের পর তিনি ঐ পদ থেকে ইস্তফা দেন। পরে শেখ সাহবের আমলে তিনি হােম সেক্রেটারীর কাজ করলেন, কিন্তু শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে কাজ কর। দুঃসাধ্যকর ছিলাে। অতএব কোন একটা সামান্য ব্যাপার নিয়ে দুজনের মধ্যে ঝগড়া হলো। তসলিমুদ্দিন তার চাকুরীতে ইস্তফা দিলেন। মৃত্যুর কিছুদিন আগে বঙ্গবন্ধু আবার তসলিমুদ্দিনকে অন্য একটি কাজে নিযুক্ত করলেন। শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ তসলিমুদ্দিনকে আবার হােম সেক্রেটারীর পদে নিয়ােগ করলেন। কিন্তু কিছুদিন পরে তার ক্যাবিনেট সেক্রেটারী সৈফুল আজম এবং মহাবুব আলম চাষীর সঙ্গে মত বিরােধ হয়। তসলিমুদ্দিন চাকুরীতে ইস্তফা দিলেন এবং তার জায়গায় রােম থেকে এফ-এ-ও কর্মচারী সালাহউদ্দীনকে ডেকে আনা হলাে। | মুক্তি যুদ্ধের সময় সৈফুল আলম ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের চীফ সেক্রেটারী। যুদ্ধ শেষ হবার কিছুদিন আগে তিনি পাকিস্তানে চলে যান। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর সৈফুল আজম ঢাকাতে ফিরে এলেন এবং খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ তাকে বাংলাদেশের ক্যাবিনেট সেক্রেটারীর পদে নিয়ােগ করলেন।
১৯৬৮-৬৯ সালে সালাহউদ্দীন পূর্ব পাকিস্তানের হােম মিনিস্ট্রিতে কাজ করতেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র আন্দোলনের সময় সালাহউদ্দীন ছাত্রদের উপর হামলা এবং বিবিধ প্রকারের অত্যাচার করেছিলেন। পরে তিনি
পাকিস্তানে চলে যান এবং সেখান থেকে রােম। সালাহউদ্দীন ঢাকাতে ফিরে এসে হােম সেক্রেটারী হলেন এবং অল্প কয়েকদিনের মধ্যে তিনি হলেন খখান্দকার মুস্তাকের ডান হাত।
জিয়াউর রহমান যখন দেশের ক্ষমতা পেলেন তিনি আবার তসলিমুদ্দিনকে তার সরকারে ফিরিয়ে আনবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু তসলিমুদ্দিন জিয়াউর রহমানের সরকারে কাজ করবার অনিচ্ছা প্রকাশ করলেন। হয়তাে তিনি জিয়াউর রহমানের আসল স্বরূপ জানতেন।
এই সময়ে বাংলাদেশে কে এম কাইসার উপস্থিত ছিলেন। খােন্দকার মুস্তাক ক্ষমতা পাবার পর কাইসারকে রেঙ্গুন থেকে ঢাকাতে ডেকে পাঠালেন এবং তাকে মুনাইটেড নেশনসে বাংলাদেশের প্রতিনিধি হিসাবে পাঠান হলো। কাইসার একদিন তসলিমুদ্দিনকে অনুরােধ করলেন : আরে আমরা হলুম সরকারী চাকুরে। আমাদের আবার কোন নীতি বলে কিছু আছে নাকি। যে সরকার দেশের গদীতে বসুক না কেন, আমরা তাকেই বিনা প্রতিবাদে গ্রহণ করবে। নীতি এবং ন্যায় অন্যায়ের বিচার আমাদের করা উচিত হবে না।
তসলিমুদ্দিন কাইসারের মতাে সুবিধাবাদী ছিলেন না এবং তিনি কাইসারের অনুরােধকে অগ্রাহ্য করেছিলেন। * শেখ মুজিবর রহমান এ-বি-এস শফরদকে তার নিজস্ব সিকিউরিটি অফিসারের পদে নিযুক্ত করলেন। শফদরের আসল চরিত্র মুজিবর রহমানের কাছে অজ্ঞাত ছিলো। হয়তাে শেখ সাহেব নিজেকে খুব বেশী বিশ্বাস করতেন এবং শফদরের অতীত জীবনী জানবার কোন চেষ্টা করেন নি।
শকদরের জীবনের কিছুটা আভাষ আগেই দেওয়া হয়েছে। কারণ তিনি যে মুজিব হত্যার চক্রান্তের সঙ্গে বিশেষ ঘনিষ্ঠ ভাবে জড়িয়ে ছিলেন এই বিষয়ে কারো দ্বিমত নেই।
১৯৬৯-এর আগরতলা চক্রান্তের কেসে শফর মুজিবের বিরােধী খবর সংগ্রহ করেছিলেন এবং মুজিবের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী সরকার, যে ব্রীফ তৈরী করেছিলেন সেইটি ছিলো শফদরের তৈরী। যারা আগরতলা চক্রান্তের কেসের সময় উপস্থিত ছিলেন তারা দেখেছিলেন যে শফদর নিজের হাতে ব্রীফ কেস নিয়ে প্রতিদিন কেটে যেতেন।
১৯৭১ সালে শফদর এবং তার আর এক সহকর্মী রহিম পাকিস্তানী ইনটেলজেন্স সার্ভিসে কাজ করতেন এবং বাংলাদেশ যুদ্ধের সময় ওয়াশিংটনে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমীতে ট্রেনিং নিতে গিয়েছিলেন। যুদ্ধের সময় ডায়েরী-৪
________________________________________
পাকিস্তান সরকার নির্দেশ দিলেন যে সব বাঙ্গালী ইনটেলজেন্স অফিসাররা যেন অবিলম্বে পাকিস্তানে ফিরে আসে। তাদের আর ট্রেনিংএর দরকার হবে
কিন্তু ব্যুরাে অফ পাব্লিক সেফটির কর্তা জোসেফ করের অনুরােধে পাকিস্তান তাদের এই আদেশটি নাকচ করেন। শফদর এবং আবদুর রহিমকে তাদের ট্রেনিং শেষ করতে দেওয়া হলাে। শফদর ও আবদুর রহিমের দল আর পাকিস্তানে ফিরে গেলেন এবং সেখানে গিয়ে পাকিস্তানের ইনটেলজেন্সে কাজ করতে শুরু করলেন। শফদর কাজ করতেন ইনটেলজেন্স বিভাগে এবং আবদুর রহিম ছিলেন কাউন্টার ইনটেলীজেন্সের একজন বিশিষ্ট কর্মচারী। তাছাড়া রজাকার সৈন্য বাহিনীর পরিচালনা করতেন আবদুর রহিম। মুক্তি যুদ্ধের পর বাংলা দেশে দাবী উঠলো, যে সব সৈন্যবাহিনী, সরকারী এবং পুলিশ বাহিনীর কর্মচারীরা পাকিস্তানের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিলেন • তাদের বিচার করা হােক এবং অপরাধ অনুযায়ী প্রতিজনকে সাজা দেওয়া হােক। বিশেষ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবর খুলে যখন বুদ্ধিজীবিদের কঙ্কাল আবিষ্কার করা হলাে তখন এই দাবী আরাে তীব্র প্রবল হলাে। কিন্তু পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলো বিশেষ করে ঐশ্লামিক দেশের শাসন কর্তারা শেখ সাহেবকে অনুরােধ করলেন যে দোষীদের সাজা মকুব করা হােক। শেখ মুজিবর রহমান বিদেশী শক্তিদের অনুরােধ অগ্রাহ্য করতে পারেননি। পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী এবং পাকিস্তানী নীতির পক্ষপাতী এবং ভক্তদের ক্ষমা করে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিবর রহমানের এই ক্ষমা নীতির সমর্থন অনেকেই সেদিন করতে পারেননি। বরং সবাই শেখ মুজিবর রহমানের নীতির প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু সেদিন শেখ সাহেব এ প্রতিবাদ কানে দেন নি। কানে না দেবার প্রধান কারণ হলাে যে শেখ মুজিবর রহমান কোনদিনই বিশ্বাস করতে পারেননি যে বাংলা দেশীরা তার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারে।
১ ৭৪ সাল বছরটা উল্লেখযােগ্য। কারণ তখন বাংলা দেশে রাজনৈতিক এবং অর্থ নৈতিক দ্রুত অবনতি হচ্ছে। শেখের বিরােধীদল প্রতিদিনই গজিয়ে উঠছে এবং তারা প্রতিদিনই শক্তিশালী হচ্ছে। বিরােধীদের দমন করবার জন্যে শেখ সাহেব এই পাকিস্তানীপন্থী ইনটেলজেন্স অফিসারদের সাহায্য নিতে সুরু করলেন এবং তাদের বহু গুরুত্বপূর্ণ পদে নিয়ােগ করা হলাে।
________________________________________
এমন কি আবদুর রহিম হলেন শেখ সাহেবের সেক্রেটারিয়েটের সেক্রেটারী। আবদুর রহিম যে এককালে রজাকার বাহিনীর নেতা ছিলেন এই কথা শেখ মুজিবর রহমান একেবারে ভুলে গেলেন।
মুজিবের মৃত্যুর পর শফদর এবং আবদুর রহিম হলেন খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের প্রধান পরামর্শদাতা। আবদুর রহিম এ সময় ছিলেন এষ্টাব্লিসমেন্ট বিভাগের সেক্রেটারী এবং সরকারী কর্মচারীদের নিয়ােগ ও বদলীর প্রধান কর্তা।
আর একজন পাকিস্তানী পন্থী পুলিশ কর্মচারীর কথা বলা যাক। এর নাম হলো আমিনুর রহমান। আমিনুর রহমান ছিলেন খুৰ উগ্রপন্থী ও রক্ষণশীল। খােন্দকার তাকে ঢাকার প্যারা-মিলিটারী ফোর্সের কর্তা করেছিলেন। তিনি ওয়াশিংটনে ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমীতে গরিলা বাহিনী দমনের ট্রেনিং নিয়েছিলেন। শুধু তাই নয় আমিনুর রহমান ছিলেন আলবদর বাহিনীর প্রধান সমর্থক।
এই প্রসঙ্গে আরাে দু-একজন পুলিশ কর্মচারীর নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। কারণ কেউ যদি মনে করেন বাংলা দেশে বিভিন্ন সময়ে মুজিবর হত্যা থেকে জিয়াউরের মৃত্যু অবধি যে সব বিভিন্ন চক্রান্ত ও খুন হয়েছিলাে তার পেছনে আছেন সামরিক বাহিনী তবে তারা মারাত্মক ভুল করবেন। কারণ সামরিক বাহিনীতে বিভিন্ন দল ছিলাে এবং তার চক্রান্ত করতেন বটে কিন্তু সামরিক বাহিনীকে চক্রান্তের পরামর্শ দিতেন এবং সাহায্য করতেন বাংলা দেশের আমেরিকার ট্রেনিং প্রাপ্ত পুলিশ বাহিনী। ১৯৭৬ সালে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের নেতা আবু তাহেরকে যখন গ্রেপ্তার করা হয় তখন তিনি বর্তমান চীফ অব দি আমি ষ্টাফ জেনারেল এরশাদের কাছে প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন কিন্তু এরশাদ কর্নেল তাহের কে স্পষ্ট বলেছিলেন : সৈন্যবাহিনী এই গ্রেপ্তারের কিছুই জানে না। পুলিশ বাহিনীর নির্দেশে তাকে গ্রেপ্তার করা হচ্ছে। | নিঃসন্দেহে বলা যায় যে বর্তমানে বাংলাদেশে সব চাইতে শক্তিশালী বিভাগ হলো এই ন্যাশনাল ইনটেলীজেন্স এজেন্সী (N. T. I), কারণ এই বাহিনীতে কোন মুক্তি যােদ্ধা নেই। সবাই পাকিস্তানী পন্থী, এবং আমেরিকার ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমীর ছাত্র। অথচ সৈন্য বাহিনীতে মুক্তি যােদ্ধার। আছেন যদিও প্রতিদিন তাদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে।
আমাদের মনে রাখা দরকার যে মুজিব হত্যার সময় শফদরই বিদেশী।
________________________________________
শক্তির ইনটেলজেন্স বাহিনীর সঙ্গে যােগাযােগ রেখেছিলেন। এখনও শফদরই ইনটেলজেন্স বাহিনীর প্রধান কর্তা এবং স্পষ্ট বলা যায় উনি হলেন সি-আই-এ ম্যান ইন ঢাকা।
এবার আর একটা কথা বলা প্রয়ােজন। বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনীর ইনটেলজেন্স বিভাগ খুবই দুর্বল। অতএব সৈন্য বাহিনীর বড় কর্তাদের ইনটেলজেন্সের জন্যে নির্ভর করতে হয় ন্যাশনাল সিকিউরিটির ইনটেলীজেন্সের উপর। মুজিবও তাই করেছিলেন। তারপরে খােন্দকার থেকে জিয়াউর রহমান সবাই শফদর ও আব্দুর রহিমের ইনটেলজেন্স বাহিনীর উপর নির্ভর করে থাকতেন।
মুজিবের পরে এবং জিয়াউরের শাসনকালের প্রথম ভাগ অবধি বাংলাদেশের শাসনতন্ত্রে যারা পাকিস্তান পন্থী ছিলেন তারা হলেন মহাবুব আলম চাষী, (খােন্দকারের শাসনকাল অবধি যদিও জিয়াউর চাষীর পরামর্শ শুনতেন) সেফুল আলম, ক্যাবিনেট সেক্রেটারী ( প্রথম দিকে , সালাহউদ্দিন, হােম সেক্রেটারী তােবারক হােসেন, বিদেশ সচিব, শফদর, ডিরেক্টর জেনারেল ইনটেলজেন্স এজেন্সী ও আব্দুর রহিম, এষ্টব্লিশমেন্ট সেক্রেটারী। এ ছাড়া আরাে বহু কর্মচারী যারা বিশেষ দায়িত্বপুর্ণ পদে কাজ করতেন এবং এখনও করে থাকেন তাদের অতীত নিয়ে বিচার করলে দেখা যাবে যে এরা শেখ মুজিবর রহমানের নীতির বিরােধী ছিলেন এবং এর মুক্তি যুদ্ধে কোনদিনই যােগ দেন নি। বরং মুক্তি যুদ্ধের বিরােধী কাজ করেছিলেন। সেই সময়ে বাংলাদেশের সরকারের উচু পদে এত পাকিস্তানী পন্থীরা কাজ করতেন এবং এখনও করে থাকেন যে এদের কাছ থেকে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রতি ভালোবাসা কিংবা দেশের প্রতি কোন কর্তব্য আশা করা যায় । এরা সদা সর্বদাই পাকিস্তানের প্রতিবন্ধকে থাকবেন।
পুলিশ দপ্তরের উচু পদে যারা কাজ করে থাকেন তাদের আজ ও আমেরিকার অফিস পাব্লিক সেফটির সঙ্গে যােগাযোগ আছে। আর ও-পিএসের কর্মচারীদের সঙ্গে সি-আই-এর বিশেষ ঘনিষ্ঠ ভাব আছে সে কথা ১৯৭৪ সালে হাউস অব ফরেইন এ্যাফেয়ার্স কমিটির রিপাের্ট পড়লেই জানা যাবে। এই প্রসঙ্গে চালির সিক্রেট পুলিশ বাহিনীর কথা উল্লেখ করা দরকার। কারণ চীলির সিক্রেট পুলিশ বিভাগ ‘দীন’র কর্মচারীরা ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ একাডেমীতে কাজ করতেন। দীনার সি-আই-এর সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। ফেডারেল ব্যুরাে অব ইনভেষ্টিগেশনের রিপাের্ট
________________________________________
থেকে আমরা এ কথা জানতে পারি।
ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তার ৭ই নভেম্বরের কু দ্য আঁতাতের পর বাংলাদেশে তাদের ইনটেলীজেন্স বিভাগকে নতুন করে ঢেলে গড়ে তুলেছিলেন। বাংলাদেশের প্রতিটি কু দ্য আঁতাতের হালখাতা খতিয়ে দেখলে জানা যাবে যে এই নতুন পুলিশ বিভাগের হাতে ছিলাে অপ্রতিহত ক্ষমতা। বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনীর সংখ্যা ছিলাে ১২,৫০০। ২৫•• করে এই সাড়ে বারাে হাজারের পুলিশ বাহিনীকে পাঁচটি ভাগে বিভক্ত করা হয়েছিল। এই পুলিশ বাহিনীকে কোন বিশেষ কাজ দেওয়া হোতো না। তবে বলা হলাে, প্রয়োজন এবং দরকার অনুযায়ী বাংলাদেশের কোথাও কোন হাঙ্গামা হলে এই পুলিশ বাহিনীকে পাঠান হবে এবং ব্যবহার করা হবে। পুলিশ বাহিনীকে নতুন করে গড়ে তুলবার দায়িত্ব দেওয়া হলাে মুসা মিয়া চৌধুরীকে। মুসা মিয়া চৌধুরী নিজেই স্বীকার করেছিলেন, সি-আই-এর অর্থে পরিচালিত ইন্টারন্যাশনাল পুলিশ সার্ভিসেস স্কুলে তিনি যে ট্রেনিং পেয়েছিলেন সেই ট্রেনিং তার বিশেষ কাজে লেগেছিল। এই একাডেমীতে দাঙ্গা, ডেমােনেষ্ট্রেশন, দমন করবার কাজ শেখান হতাে। পুলিশ অপারেশন কন্ট্রোল সেন্টার থেকে তিনি অনেক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিলেন। মুসা মিয়া চৌধুরী এবং তার সহকর্মীরা ঢাকাতে ফিরে গিয়ে ওয়াশিংটনের পুলিশ কন্টোল সেন্টারের অনুকরণে এক টি হুবহু নকল দপ্তর তৈরী করেছিলেন। এই কন্টেলি বাের্ডের দপ্তরে ঢাকা শহরের একটি ম্যাপ ছিলাে। আর উল্লেখযােগ্য বিষয় হলো শহরের বিভিন্ন কেন্দ্রের সঙ্গে কন্টে লি রুমের যােগাযােগ ছিলাে। শহরের কোথাও কোন হাঙ্গামা হলে টেলিফোনে সেই খবর কন্টোলরুমে পাঠান হতো। এই কন্টেল রুমে বসে ইনটেলজেন্স অফিসারের দাঙ্গা হাঙ্গামা দমন করবার প্ল্যানিং করতেন। এই সব ইনটেলীজেন্স অফিসারদের : প্রধান কাজ ছিলো কাউণ্টার রিভলুশন, কু দ্য আঁতাত এবং বিভিন্ন ধরনের বিশেষ করে রাজনৈতিক দাঙ্গা হাঙ্গামা দমন করা। বাংলাদেশে প্রগতিশীল কিংবা বামপন্থী দলের অভাব নেই এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তারা এদের কাজ থেকে সব সময় বিপদের আশংকা করে থাকেন।
শেখ মুজিবর রহমান ডেমােক্রেসিতে পুরােপুরি বিশ্বাস করতেন এবং তিনি চিরকালই আমেরিকা এবং অন্যান্য পশ্চিমদেশের রাষ্ট্রগুলোর সঙ্গে
________________________________________
বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রাখতে চেয়েছিলেন। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা উল্লেখ করা দরকার। ১৯৫৪-৫৮ সালে আয়ুব শাহী রাজত্ব কায়েমী হবার আগে পাকিস্তানে একদল রাজনৈতিক নেতারা আমেরিকার নীতির বিরােধী ছিলেন এবং এই দলের সদস্যরা পাকিস্তানের আমেরিকার পক্ষপাতী নীতির বিরােধিতা করেছিলেন। কিন্তু শহীদ সুরাবর্দী ও শেখ মুজিবর রহমান ছিলেন আমেরিকার নীতির পক্ষপাতী। শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সি-আটো এবং সেন্টোচক্রে যোগ দেবার পক্ষপাতী ছিলেন। তাদের এই নীতির বিরােধিতা করে আওয়ামী লীগ থেকে একদল বেরিয়ে গেলেন এবং ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি গঠন করেন। এদের মধ্যে মৌলানা ভাসানীর নাম উল্লেখ যােগ্য।
মৌলানা ভাসানী ১৯৫৭ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ঢাকা শহরে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি স্থাপন করেন। কিন্তু চীন মস্কোর ঝগড়া শুরু হবার পর ভাসানীর দলের মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। একদলের নাম হলাে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (ভাসানী) চীনপন্থী আর দ্বিতীয় দলের নাম হলাে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মুজাফর গ্রুপ)। এই নতুন দলের নেতার নাম প্রফেসর মুজাফর আহমেদ। মুজাফর আহমেদ ছিলেন মস্কো পন্থী। আমি যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তুম তখন মুজাফর আহমেদ ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ে ইকনমিকস নিয়ে পড়াশুনা করতেন। এই প্রসঙ্গে আমার আর একজন পরিচিত লোক মুহম্মদ তােহার নাম উল্লেখ করতে পারি। মুহম্মদ তােহা এবং আব্দুল হক ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান কমুনিষ্ট পার্টির (মার্কস-লেনিনবাদী) নেতা। তোহা পূর্ব পাকিস্তান কমুনিষ্ট পার্টির (মস্কো) নীতির বিরোধী ছিলেন এবং তার বক্তব্য ছিলো যে কমুনিষ্ট পার্টির নীতি মুজিবর রহমানের আওয়ামী দলকে আরাে শক্তিশালী করবে। আর মস্কো এবং দিল্লীর নীতি হলো পাকিস্তানকে দু টুকরাে করা।
তােহা খালেদ মুশারফকে এবং পরে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলকে ভারতবর্ষের এজেন্ট বলে গণ্য করতেন।
১৯৭১ সালে পচিশে মার্চ মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার পর তােহার পূর্ব পাকিস্তান কমুনিষ্ট পাটির মধ্যে ভাঙ্গন দেখা দেয়। তােহার সহকর্মী কমরেড আব্দুল হক বললেন যে মুক্তি যুদ্ধের পেছনে মস্কো এবং দিল্লীর হাত আছে। আর তাদের নির্দেশনুযায়ী আওয়ামী লীগের কর্তারা কাজ করছেন। আৰুল হক মুক্তি যুদ্ধের বিরােধিতা করলেন। তিনি নতুন দল গঠন
৫৮
________________________________________
করলেন এবং নতুন দলের নাম হলো : পূর্বপাকিস্তান কমুনিষ্ট পার্টি (মার্ক্স লেনিন বাদ)। বাংলাদেশের যুদ্ধের পর আব্দুল হকের বিরুদ্ধে অভিযােগ করা হলাে যে তিনি পাকিস্তানের সঙ্গে সহযােগিতা করেছিলেন। অতএব তাকে শাস্তি দেওয়া হােক। আব্দুল হক ফেরারী হলেন।
মুহম্মদ তােহা অবশ্যি আব্দুল হকের নীতির বিরােধিতা করলেন। পুরােপুরি নয় ; যৎকিঞ্চিৎ। তিনি স্বীকার করলেন যে মুক্তিযুদ্ধ হলো মম্বো এবং দিল্লীর চক্রান্ত তবু মুক্তি যুদ্ধের পর তিনি পাকিস্তানী সৈন্তবাহিনীদের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সুরু করলেন। তার নতুন দলের নাম হলো : পূর্ববাংলা কমুনিষ্ট পার্টি (মার্ক্স-লেননবাদী)। | পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীরা তােহার সহযােগিতা আশা করেছিলেন। কিন্তু তোহা যেমন পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন তেমনি আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধেও। শুধু তাই নয় মুক্তি যােদ্ধাদের বিরােধিতা করতেও তিনি দ্বিধা বােধ করেননি। কিছুদিন পরে তােহর ফলে ভাঙ্গন ধরলো। বদরুদ্দীন ওমর ছিলেন বিখ্যাত মার্ক্সবাদী বুদ্ধিজীবি এবং তােহার বন্ধু। তিনি তােহার নীতির প্রতিবাদ করে ঐ দল থেকে পদত্যাগ করেন। কারণ বদরুদ্দীন ওমর বিশ্বাস করতেন যে বাংলাদেশের প্রধান শত্রু হলেন পাকিস্তানী সৈন্তু বাহিনী এবং তাদের বিরুদ্ধে লড়াই করা একান্ত প্রয়ােজন।
চীন পন্থী কম্যুনিষ্ট পার্টি গুলাের মধ্যে মতভেদ এবং দলাদলি হবার প্রধান কারণ হলাে যে বাংলাদেশ এবং ইয়াহিয়া খানের প্রতি চীন কখনই সুস্পষ্ট নীতি গ্রহণ করেনি। এই সময়ে কালচারাল রিভলুশন এবং কিসিংগারের মণের ব্যাপার নিয়ে চীনের নেতারা ব্যস্ত ছিলেন। বাংলাদেশের ঘটনার প্রতি মন দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব ছিলােনা। পঁচিশে মার্চের পর থেকে চীন পাকিস্তানকে সরকারী ভাবে সমর্থন করে এসেছে। কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে চৌ এন লাই পাকিস্তানী নেতাদের কাছে বেশ খুলে বললেন যে বাংলা দেশের ভবিষ্যৎ বাঙ্গালী জনগণ ঠিক করবে। এতে পাকিস্তানী সরকারের হস্তক্ষেপ করা ঠিক হবেনা। মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার পর প্রথমে চৌ এন লাই ইয়াহিয়া খানের কাছে চীনের সমর্থন জানালেন। ইয়াহিয়া খান এই চিঠি পাকিস্তান টাইমসে প্রকাশিত করেন এবং পরে চীনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করবার জন্যে জুলফিকার আলি ভুট্টোকে চীনে পাঠালেন। প্রকাশ্যে চীনের নেতারা বললেন ধে চীন পাকিস্তানের স্বাধীনতা এবং সাবভৌমতা রক্ষা করবার জন্যে সাহায্য করবে। এই সাহায্য কি ধরণের হবে
________________________________________
একথা চীনের নেতারা কখনই স্পষ্ট করে খুলে বলেননি। বরং ভুট্টো সাহেব যখন চীনে পৌছুলেন তখন চীনের নেতারা ভুট্টোর কাছে অন্য আর একটি প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। আর এই বিষয়টি হলো যে পাকিস্তানে চীনপন্থীদের উপর যে অত্যাচার করা হচ্ছে সেই অত্যাচার অবিলম্বে বন্ধ করা হােক।
আর একটি ঘটনা এইখানে বলা উচিত। এটা জেনেছিলুম কাইসারের পূর্বানী হােটেলের মজলিশে। একদিন চৌ এন লাই ভুট্টোর সম্মানার্থে পিকিংয়ে এক ডিনার ভােজের আয়োজন করেছিলেন। ডিনারে ভুট্টো এবং এক বাংলা দেশীর মধ্যে তর্ক বিতর্ক শুরু হয়। ভুট্টো সবার সামনে বলেছিলেন যে পাকিস্তান গঙ্গা নদীতে রক্তের স্রোত বইয়ে দেবে। | বাঙ্গালী ডিপ্লোম্যাট জবাব দিয়েছিলেন আমার মনে হয় তার আগে সিন্ধু নদীতে রক্তস্রোত সুরু হবে।
চৌ এন লাই দুই পাকিস্তানীর ঝগড়া বিবাদ শুনে অপ্রস্তুত বােধ করলেন। হাজার হােক ভুট্টো তার অতিথি। তর্ক বিতর্ক থামাবার জন্যে উনি মন্তব্য করলেন, দেখুন কোন নদীতে রক্তের স্রোত বইবে ঐটে আপনারা ঢাকায় গিয়ে ঠিক করুন। পিকিং-এ বসে এই সমস্যার সমাধান করতে পারবেন না।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন এবং কিসিংগার দুজনেই পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত উদ্বিগ্ন হয়েছিলেন। এই চিন্তার প্রধান কারণ হলো যে কিসিংগার ঐ সময়ে পাকিস্তানের মাধ্যমে চীনের সঙ্গে সমঝােতা করার কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন। এই সময়ে পাকিস্তানে তারা কোন রাজনৈতিক বাধা বিঘ্ন সুরু করতে চাননি। কিন্তু ইয়াহিয়া খান তাদের কথায় কিংবা পরামর্শে কান দিলেন না। এর ফলে বাংলা দেশে মুক্তি যুদ্ধের সংগ্রাম শুরু হলাে।
এই সময়ে কিসিংগার গােপনে চীনের যুনাইটেড নেশনসের প্রতিনিধি হুয়াংহুয়ার সঙ্গে দেখা করলেন এবং একদিন আলােচনাকালীন বাংলা দেশের মুক্তি যুদ্ধের প্রসঙ্গ উত্থাপন করলেন। হুয়াংহুয়া বললেন যে তারা পাকিস্তানকে কোন প্রকারেই দুই খণ্ড হতে দেবেন না। প্রয়ােজন হলে তারা ইয়াহিয়া খানকে যথাসাধ্য সাহায্য করবেন। কিসিংগার হুয়াংহুয়ার কথাগুলাের ঠিক উল্টো মানে করলেন। অর্থাৎ তার ধারণা হলাে যে চীন প্রয়োজন হলে পাকিস্তানকে রক্ষা করবার জন্যে যুদ্ধ শুরু করবে। চীনের কাছ থেকে আশ্বাস পেয়ে নিক্সন উত্তেজিত হলেন এবং তিনি দিল্লীর এবং মস্কোর কর্তাদের
________________________________________
ভয় দেখাবার জন্যে আমেরিকান ক্রুজার এন্টারপ্রাইজকে বঙ্গোপসাগরে পাঠালেন। ফল হলো ঠিক তার উল্টো। নিক্সনের এই নির্দেশ পৃথিবীব্যাপী আলােড়ন সৃষ্টি করলো। শেষ পর্যন্ত আমেরিকান ক্রুজার এন্টারপ্রাইজ বঙ্গোপসাগরে আসেনি।
মুজিব হত্যার কাহিনী বলতে গিয়ে আমাকে অতীতের স্মৃতি রােমন্থন করতে হলো। এই সব কথা পাঠকদের কাছে বলবার দরকার ছিলো। কারণ ১৯৭১ সালে বাংলা দেশ স্বাধীন হবার পর শেখ মুজিবর রহমান সবার প্রিয়পাত্র হয়ে ছিলেন বটে কিন্তু বছর খানেকের মধ্যে তিনি তার জনপ্রিয়তা হারালেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পৃথিবীর বিভিন্ন দেশগুলো থেকে বাংলা দেশকে প্রচুর সাহায্য করা হয়েছিলাে। সব সাহায্যই অপচয় করা হলাে। ১৯৭০ সালে বাংলাদেশে প্রচণ্ড দুর্ভিক্ষ দেখা দিলাে। শেখ মুজিবর রহমান ঢাকাতে ফিরে এসে বাংলা দেশের নাগরিকদের আশ্বাস দিয়েছিলেন যে দেশে চালের দাম অর্ধেক করা হবে। এবং প্রয়ােজনীয় জিনিষ পত্রের দাম কমানাে হবে। কিন্তু অল্প কয়েকদিনের মধ্যে চালের দাম বেড়ে হাজার গুন হলাে। আওয়ামী লীগের মধ্যে এবার ভাঙ্গন ধরলো এবং শেখের বন্ধু ও আওয়ামীলীগের অনেক গণ্যমান্য নেতারা শেখের বিভিন্ন নীতির প্রতিবাদ করে পদত্যাগ করলেন। এই প্রসঙ্গে প্রথমেই তাজউদ্দীনের কথা বলা যেতে পারে।
তাজউদ্দীন এবং আমি ছিলুম বাল্যবন্ধু। তাজউদ্দীন আমাদের স্কুলে আমাদের এক ক্লাস নীচে পড়তাে। আমি যখন ঢাকাতে ফিরে এলুম তখন তাজউদ্দীন অর্থমন্ত্রী এবং ব্যস্ত মানুষ। তার সঙ্গে বেশী দেখা করবার সুযােগ সুবিধে পাইনি। এখানে একটা কথা উল্লেখ করা প্রয়ােজন বলে মনে করি :
তাজউদ্দীন ভারতের খটা বন্ধু ছিলেন। মৃত্যুর দিন পর্যন্ত তার এই অগাধ ভালােবাসার কোন ভাটা পড়েনি।
তাজউদ্দীন মন্ত্রীত্বের পদ থেকে সরে আসবার পর আমি তার সঙ্গে কয়েকবার দেখা করেছিলুম। তাজউদ্দীনের সঙ্গে প্রকাশ্যে দেখা করবার অসুবিধে ছিলো, শেখ মুজিবর রহমান কখনই তার বিরােধী দলের সঙ্গে কোন বিদেশীর দেখা সাক্ষাৎ পছন্দ করতেন না।
একদিন তাজউদ্দীন আমার কাছে দুঃখ করে বললো: তোমরা আমাকে ভুলে গেছো, তােমরা মানে ভারতবাসীরা। আর শুনছি তুমি নাকি আজকাল
________________________________________
শেখ ফজলুল হক মুনির বন্ধু হয়েছে। ওর বন্ধু হলে কবে থেকে। ও আমার বিরুদ্ধে শেখ সাহেবের কাছে প্রতিদিন নালিশ করে।
আমি জবাব দিলুম : আমাদের কাছে বন্ধুত্ব বলে কোন জিনিষ নেই। সবই স্বার্থের ব্যাপার।
তাজউদ্দীন হেসে জবাব দিলো সে কথা কী আমি জানিনে। তােমরা আমাকে ভুলতে পারে বটে কিন্তু আমি ভাবতবর্ষকে ভুলতে পারবাে না। আমি তােমাদের দেশকে ভালােবাসি এবং শ্ৰীমতী গান্ধীকে শ্রদ্ধা করি। শেখ সাহেব আবার পাকিস্তানী, রাজাকারদের এই দেশে ফিরিয়ে আনছেন। আমি শুধু আমার জীবনের নয় বঙ্গবন্ধুরও জীবনের আশংকা করছি।
এবার তাজউদ্দীন আমাকে মুজিবর রহমানের সঙ্গে তার মতবিরােধের কারণ খুলে বললাে।
তাজউদ্দীন বললো: কিছুদিন আগে শেখ সাহেব য়ুনাইটেড নেশনপে বক্তৃতা দিতে গিয়েছিলেন। উনি আশা করেছিলেন যে নিক্সন অতীতের সব ব্যাপার ভুলে গেছেন এবং তিনি তাকে ওয়াশিংটনে যাবার জন্যে নেমন্তন্ন করবেন। কারণ সাধারণতঃ কোন দেশের প্রেসিডেন্ট মুনাইটেড নেশনশে বক্তৃতা দিতে গেলে তাকে ওয়াশিংটনে যাবার জন্যে আমন্ত্রণ করা হয়। | কিন্তু এবার এই নিয়মের ব্যতিক্রম হলো। এমনকি কিসিংগার সাহেবও শেখ সাহেবের সঙ্গে ওয়াশিংটনে দেখা করেননি। ষ্টেট ডিপার্টমেন্ট অবস্থি শেখ সাহেবের সম্মানার্থে একটি ডিনারের বন্দোবস্ত করেছিল। কিন্তু প্রটোকলমুযায়ী এই নিমন্ত্রণ নিক্সন, কিংবা কিসিংগারের করা উচিত ছিলাে। অতএব শেখ মুজিবর রহমান ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের এই নিমন্ত্রণ গ্রহণ করেন নি। কিন্তু আসলে তারা জানতে শেখ সাহেব মনে প্রাণে ছিলেন আমেরিকার ভক্ত। সুরাবর্দী সাহেব বেঁচে থাকতে উনি আমেরিকার সি-অটো এবং সেন্টো গঠনের নীতিকে সমর্থন করেছিলেন। ইয়াহিয়া খান পঁচিশে মার্চ যদি ঐ মারাত্মক ভুল না করতেন তাহলে বাংলাদেশ আদৌ স্বাধীন হতে কিনা আমার সন্দেহ আছে। কারণ প্রথমে আমরা তো স্বাধীনত| চাইনি। আমাদের আওয়ামী লীগের দাবী ছিলো অটোনমি এবং ছয় পয়েন্টের প্রােগ্রাম পুরণ করা। চব্বিশে দুপুর পর্যন্ত আমরা এবং শেখ সাহেব ভেবেছিলাম যে ইয়াহিয়া আমাদের দাবী মেনে নেবেন। আর ঐ সময়ে যদি আমেরিকা পাকিস্তানের ঐ দমন নীতিকে সমর্থন না করতেন তাহলে আমাদের আমেরিকার সঙ্গে কোন ঝগড়া বিবাদ হতাে না।
________________________________________
তাজউদ্দীন কী কারণে মুজিবর রহমানের ক্যাবিনেট থেকে পদত্যাগ করেছিলাে সে কথা নিয়ে আমাদের মধ্যে কোন আলাপ আলােচনা হয় নি। পরে আমি বাজারের গুজব শুনেছিলাম যে তাজউদ্দীন এবং শেখ সাহেবের সঙ্গে মত বিরােধ দেখা দিয়েছে। ঝগড়ার প্রধান কারণ অবশি দেশের আর্থিক অবনতি এবং শেখ সাহেব দেশে কতােগুলাে আর্থিক পরিবর্তন চালু করতে চেয়েছিলেন। তাজউদ্দীন নাকি এই পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন। কারণ বিশ্ব ব্যাঙ্ক থেকে টাকা ধার পাবার জন্যে শেখ মুজিবর রহমান বিশ্ব ব্যাঙ্কের সব প্রস্তাব স্বীকার করে নিলেন। তাজউদ্দীন এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করেছিলেন।
প্রস্তাবনুযায়ী বাংলাদেশের মুদ্রার দাম কমানাে হলাে। দেশ স্বাধীন হবার পর কিছু কোম্পানীকে রাষ্ট্রীয়করণ করা হয়েছিল। শেখ সাহেব বিশ্ব ব্যাঙ্কের প্রস্তাবনুযায়ী এই সব কোম্পানীগুলোকে আবার প্রাইভেট সেক্টরের হাতে ছেড়ে দেবার প্রস্তাব করলেন।
এই সময়ে হেনরী কিসিংগার ছয় সাত ঘণ্টার জন্যে ঢাকাতে এসেছিলেন এবং মুজিবর রহমানের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। কিসিংগার বাংলাদেশে আসবার আগে পাকিস্তানী পন্থীরা এবং তাজউদ্দীনের শত্রুরা শেখ সাহেবকে পরামর্শ দিলেন যে তাজউদ্দীন যদি বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী থাকেন তবে কিসিংগার হয়তাে ঢাকাতে আসবেন না। ইতিমধ্যে শেখ সাহেবের সঙ্গে তাজউদ্দীনের মত বিরােধ শুরু হয়েছিল। তাই একদিন শেখ মুজিবর রহমান তাজউদ্দীনকে স্পষ্ট বললেন যে তিনি যেন তার ক্যাবিনেট মন্ত্রী হিসেবে পদত্যাগ পত্র পেশ করেন। আর যদি উনি পদত্যাগ করতে আপত্তি করেন তাহলে শেখ সাহেবকে বাধ্য হয়ে তাজউদ্দিনকে তার ক্যাবিনেট থেকে তাড়িয়ে দিতে হবে। এমনকি পদত্যাগ পত্রটি টাইপ করে তাজউদ্দীনের কাছে পাঠান হলো। তাজউদ্দীন আর কোন আপত্তি করলেন না। শেখ মুজিবর রহমানের ক্যাবিনেট থেকে বিদায় নিলেন।
তাজউদ্দীনকে তার ক্যাবিনেট থেকে তাড়িয়ে দিয়ে শেখ সাহেব মারাত্মক ভুল করেছিলেন। পরে শেখ মুজিবর রহমান তাজউদ্দীনকে তার নতুন রাজনৈতিক দল বাকশালের প্রধান সেক্রেটারী হবার জন্যে অনুরোধ করেছিলেন। কিন্তু ঝগড়া বিবাদ তখন অনেক দূর গড়িয়ে গিয়েছিলাে। শেখ মুজিবর রহমান এবং তাজউদ্দীন তাদের ঝগড়া বিবাদের কোন সীমাংসা শেষ অবধি করেননি।
________________________________________
শেখ সাহেব আর একটি মারাত্মক ভুল করেছিলেন।
আমির সিনিয়রিটি অনুযায়ী বাংলাদেশ আমির চীফ অব দি আমি ষ্টাফের পদটি জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রাপ্য ছিলাে। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা স্মরণ রাখা দরকার। মুক্তি যুদ্ধ শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গে জেনারেল জিয়াউর রহমান চট্টগ্রাম থেকে রেডিওতে সর্ব প্রথম স্বাধীন বাংলাদেশের কথা ঘােষণা করেছিলেন। কিন্তু কোন অজ্ঞাত কারণবশতঃ কিংবা পরামর্শদাতাদের খপ্পরে পড়ে শেখ মুজিবর রহমান ঐ পদটি জেনারেল জিয়াউর রহমানকে না দিয়ে তার জুনিয়র শফীউল্লাকে দিয়েছিলেন। তার প্রাপ্য পদ থেকে তাকে বঞ্চিত করা হয়েছে এই কথা জেনারেল জিয়াউর রহমান কোনদিই ভুলতে পারেন নি। তার প্রমাণ আমরা পেয়েছিলুম মুজিব হত্যার চক্রান্তের সময় এবং পরবর্তীকালে। কারণ জিয়াউর রহমান মহাবুব আলম চাষীর এবং মেজরদের গোপন চক্রান্তে সায় দিয়েছিলেন। এই কথা কারু অজ্ঞাত ছিলো না।
মুজিবকে হত্যা করবার কিছুদিন আগে জিয়াউর রহমান বঙ্গ বন্ধুর সঙ্গে গিয়ে দেখা করেছিলেন এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের বিরুদ্ধে নালিশ করেছিলেন। এই সময়ে শেখ মুজিবর রহমান সৈন্যবাহিনীকে স্মাগলিং বন্ধ করবার কাজকর্মে লাগিয়েছিলেন। আর আওয়ামী লীগের বহু সদস্য এই স্মাগলিং-র কাজে লিপ্ত ছিলেন।
খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হবার পর তার প্রথম চেষ্টা হলো ভারতের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা। কিছুদিন পরে ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেন গিয়ে তার সঙ্গে দেখা করলেন। খােন্দকার সেন সাহেবকে বেশ আদর যত্ন করলেন। কি মিষ্টি কথা! বললেন আমরা ভারতবর্ষের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই। সমর সেনও বেশ মিষ্টি এবং বেশ কিছুটা আন্তরিক কণ্ঠে জবাব দিলেন আমরাও বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চাই।
তাদের দুজনের সাক্ষাৎকার বেশ ফলাও করে রেডিও টেলিভিসন এবং পরের দিন কাগজে প্রকাশিত হলাে।
সেন সাহেব যখন খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সঙ্গে আলাপ আলোচনায় ব্যস্ত ছিলেন তখন পাশের ঘরে আমি বসে মুস্তাক আহমেদের প্রেস সেক্রেটারি তাজউল ইসলামের সঙ্গে কথা বলছিলাম। তাজউল ছিল বাংলাদেশের রেডিওর
৬৪
________________________________________
ঘােষক। আমি গল্প করতে করতে জিজ্ঞেস করলাম, আচ্ছা এই বিপ্লবের কথা কিছু বলুন তাে?
তাজউল আমার বন্ধু ছিল। হেসে জবাব দিল ; কি আর বলবাে বলুন? আমি বাড়িতে ঘুমুচ্ছিলাম। হঠাৎ খুব ভােরে আমার রেডিও অফিসে ডাক পড়লাে। এত ভােরে রেডিও অফিসে আমাকে কেন ডাকছে ভেবে প্রথমে বেশ অবাক হলাম। মুন্তাক সাহেবও রেডিও অফিসে বসেছিলেন। আমাকে বলা হলাে যে আমাকে ঘোেষণা করতে হবে শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকালের অবসান হয়েছে এবং খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ নতুন রাষ্ট্রপতি হয়েছেন।
আমি খবরটি রেডিওতে পড়লাম।
আচ্ছা বলুন তাে ডালিম ভাের ক’টার সময় রেডিওতে ঘােষণা করছিল যে বাংলা দেশে বিপ্লব হয়েছে ? তাজউল একটু ভেবে পরে বলল : আমার মনে হয় ভাের ছটা দশের সময়। ঐ ঘােষণায় বাংলাদেশকে ইসলামিক গণতন্ত্র বলে ঘােষণা করা হয়েছিল?
ঐ ঘোষণার মধ্যে বাংলা দেশকে ইসলামিক গণতন্ত্র বলে ঘােষণা করা হয়নি। | এই কথা বলে তাজউল ইসলাম আমাকে একটি প্রশ্ন করল : আচ্ছা বলুন তো টাইগার সিদ্দিকী কি আপনাদের দেশে গিয়ে লুকিয়েছে?
টাইগার সিদ্দিকী ? তার নাম আমি তাে কোনদিন শুনিনি—আমি টাইগার সিদ্দিকীকে না চেনবার ভান করলাম। কারণ আমি স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলাম তাজউল ইসলাম আমার মুখ থেকে গোপন কথা বের করে নিতে চায়। আর সত্যি কথা বলতে কি ভারত সরকারের কোন গােপন কথাই আমি জানতুম না।
কী যে বলেন ? কাদের সিদ্দীকীর নাম শোনেন নি ? আপনি কতদিন বাংলাদেশে আছেন ? তাজউল ইসলাম আবার বেশ কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলো।
প্রায় দেড় বছর। না সত্যি বলছি টাইগার সিদ্দিকীর নাম আমার কাছে একেবারেই অপরিচিত। আমাকে তাে রাজনৈতিক কাজকর্ম করতে হয়না। অামি তাজউলকে বােঝাবার চেষ্টা করলাম। কিন্তু তাজউল কি আমাকে বিশ্বাস করে ? একেবারে নাছোড়বান্দা। কাদের সিদ্দিকীর খবর জানবেই। আমিও বলবাে না কিংবা বলবার ক্ষমতা আমার ছিলনা।
তাজউল বলতে লাগলাে :
________________________________________
কাদের সিদ্দিকী ছিলেন শেখের প্রিয়পাত্র। কাদের সিদ্দিকী মুক্তিযুদ্ধের সময় গরিলা যুদ্ধ করে নাম করেছিলেন। জানেন তাে মরবার আগে শেখ সাহেব বাংলা দেশকে এবং তার গ্রামগুলাে বিভিন্ন অঞ্চলে ভাগ করার কথা ভেবেছিলেন। শুধু এই বিপ্লবের জন্যে তিনি এই কাজ করতে পারেননি। যদি করতে পারতেন তাহলে বাংলা দেশের আর্থিক এবং রাজনৈতিক রূপ পাল্টে যেত। কিন্তু তার সেই কাজ করবার আগেই তাকে হত্যা করা হয়। কাদের সিদ্দিকী ছিলেন অতি বিশ্বস্ত লেকি। কথা ছিলো যে তিনি হবেন। ওই কাজের গভর্নর। কিন্তু ১৫ই আগষ্ট তিনি আর ঢাকায় আসতে পারেননি। পরে শুনেছি যে উনি ভারতবর্ষে চলে গেছেন এবং ওখান থেকে বাংলা বিরােধী কাজ কর্ম চালাবেন। বলুন সত্যি কথা বলেছি কিনা?
আমি মাথা নাড়লুম। কিছুই জানিনে। কাদের সিদ্দিকি কিংবা লায়ন সিদ্দিকির খবর আমার জানা নেই।
তাজউল ইসলাম আমার জবাব শুনে নিরাশ হলো, হয়তো ভেবেছিল যে আমি ওর কাছে কাদের সিদ্দিকী সম্বন্ধে কিছু কথা বলবাে।
আমি ওর কথার কোন জবাব দিলুম না।
খোন্দকার মুস্তাক আহমেদ ভারতের বিরুদ্ধে উষ্মা প্রকাশ করেন নি। বরং বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়েছেন। এই সংবাদটি পরের দিন বেশ ফলাও করে কাগজে ছাপা হয়েছিল। টিভি এবং রেডিওতে প্রচার করা হলাে। আমরা কিন্তু একেবারেই বিশ্বাস করিনি যে বাংলাদেশ এবং ভারতের মধ্যে যে ফাটল দেখা দিয়েছে সেই ফাটল আবার জোড়া দেওয়া যাবে। কারণ খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ আমাদের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন বটে তবু আমরা জানতুম ঝড় আসন্ন। রােজই সংবাদপত্রে আমাদের বিরোধী-সংবাদ কিছু না কিছু বেরোয়। আজ হয় স্মাগলিং কাল কাদের সিদ্দিকী, এই নিয়ে প্রতি কাগজের দুই তিনটে পাতা ভারতকে গালাগালি করে বেরুতে। এই ভারত বিরােধী প্রচারের উদ্যোক্তা ছিলেন তাহেরুদ্দিন ঠাকুর, এনায়েতুল্লা এবং সর্বশেষে যার নাম আমাকে উল্লেখ করতেই হবে তিনি হলেন মৌলানা ভাসানি। এর কথা আগেই বলেছি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি প্রাণের ভয়ে ভারতবর্যে আশ্রয় নিয়েছিলেন। প্রতিমাসেই তাকে মাসােহারা দেওয়া হতাে। যুদ্ধের পরও তিনি বাংলাদেশের কাছে সাহায্য চাইলেন।
ভাসানি টাঙ্গাইলের কাছে একটি গ্রামে থাকতেন। আশি নৰই বছরেও
________________________________________
তার স্বাস্থ্য অটুট ছিল। ভাসানীর কাজ ছিলাে প্রতিদিন ভারত-বিদ্বেষী একটি বিবৃতি দেওয়া। আজ স্মাগলিং কাল অন্য কিছু। ওর ভারত বিদ্বেষী বিবৃতিতে আমরা বেশ অতিষ্ঠ হয়ে গেলাম।
বাইরে ভাসানীর আসল কাজ ছিলাে ধর্মের কাজ করা, কিন্তু প্রকাশ্যে উনি রাজনীতি করতেন। শেখ সাহেবের যুগে ওকে বেশি প্রাধান্য দেওয়া হতাে কিন্তু নতুন শাসনতন্ত্রে ভাসানী হলে সরকারের মাথার মণি। ভাসানীকে বলা হতাে যে উনি চীনাপন্থী অর্থাৎ এনায়েতুল্লার দলের লােক। ভাসানী প্রতিদিনই একটা না একটা বিষয় নিয়ে বিবৃতি দিতেন।
খােন্দকার সাহেব মুখে বলেছিলেন যে তিনি ভারতের বন্ধু ত্ব কামনা করেন কিন্তু প্রচার কাজ ছিল ভারত বিরােধী। সরকারী মহলে কারও সঙ্গে এই ব্যাপার নিয়ে আলাপ আলােচনা করা সম্ভব ছিল না। কারণ যাদের আমরা বন্ধু বলে জানতুম তারা সবাই রাতারাতি ভােল পালটালেন। যারা সত্যি সত্যি ভারতের বন্ধু ছিলেন তারা অনেকেই পালিয়ে কলকাতায় এসেছিলেন। একদিকে এনায়েতুল। অপর দিকে মৌলানা ভাসানী তীব্র উগ্র ভারত বিদ্বেষী বক্তৃতা দিতে শুরু করেন। শুধু সংবাদ পত্রগুলাে নয় রেডিও এবং টেলিভিশনও এই সব বিবৃতি প্রকাশ করতেন। | এনায়েতুল্লার বহু সম্পাদকীয়ের প্রতিবাদ করা হলো। কিন্তু কে এই বিবৃত্তি ছাপবে ? কারণ ঐ সময়ে বাংলাদেশের সমস্ত চিন্তা ধ্যান হলো। ভারতের প্রতি বিরেধিতা করা।
পশ্চিম এশিয়ার মুসলিম দেশগুলাে বাংলাদেশকে সাহায্য করতে এগিয়ে এল। কুয়েত টাকা দিল, আর ইসলাম ধর্ম প্রচারের জন্যে কর্নেল গাদাফী হাত বাড়িয়ে দিলেন। তারা সবাই নতুন বাংলাদেশকে স্বীকার করে নিলেন ঐটে ছিলাে বিশেষ তাৎপৰ্যজনক ঘটনা। পাকিস্তান শেখ মুজিবের মৃত্যুর কয়েক মিনিট পরেই খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সরকারকে স্বীকার করেছিলাে। এছাড়া ভুট্টো অর্থের প্রতিশ্রুতি দিলেন। গুজব শােনা গেল যে শীগগির ঢাকায় পাকিস্তান থেকে একটি বাণিজ্যিক ডেলিগেশন আসবে। আর এ ছাড়া শােনা গেলো যে শীগগির ঢাকা করাচী প্লেন সাভিস আবার চালু করা হবে। সবাই এই খবর শুনে আনন্দে উৎসাহিত হলেন। যাক, আবার করাচির মুখ দেখা যাবে। খােন্দকার এবার পাকিস্তানীদের সম্পত্তি ফিরিয়ে দিতে লাগলেন। বাংলাদেশের অবজার্ভারের মালিক ঢাকায় বসেছিলেন। ধানমণ্ডিতে তার প্রচুর সম্পত্তি ছিল। শেখ সাহেব এই সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
________________________________________
করেছিলেন। সম্পত্তি আবার তাকে ফিরিয়ে দেওয়া হলাে।
বাংলাদেশ বাংলা ভাষার অনেক উন্নতি করেছে এবং এই ব্যাপারে বাংলাদেশ ন্যাশনাল অ্যাকাডেমির দান অপূরণীয়। কিন্তু এবার থেকে বাংলাদেশে সবাই বাংলা ভুলে উছু বলতে লাগল। ভারতবর্ষ হলো শত্রু, বন্ধু হলেন পাকিস্তান, লিবিয়া এরা। চুপ করে থাকা ছাড়া আর কোন উপায় ছিল
আমার মনে আছে যে ১৯৭৫ সালের ইদ মিলাদ উৎসবে আমি বাইতুল করিম মসজিদে যে অসংখ্য জনরাশি দেখেছিলুম সেই জনতার কোন বিবরণী দিতে পারব না।
এবার ভারতীয় সাংবাদিকদের কথা বলা প্রয়োজন করি। গােলমালের বহু আগে থেকে ভারতবর্ষের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদপত্র ঢাকাতে তাদের প্রতিনিধি পাঠিয়ে গিয়েছিলেন। শেখ সাহেবের আমলে এদের কাজ করতে কিংবা দিল্লিতে খবর পাঠাতে কোন অসুবিধে হতাে না। অধিকাংশ ভারতীয় সাংবাদিক ছিলেন কাজে পটু কিন্তু খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের আমলে শুধু কাজ করা নয়, জীবনও দুর্বিষহ হয়ে দাড়াল। শুধু পুলিসের ফেউ নয় তাদের টেলিফোন লাইনগুলােও ট্যাপ করা হত এবং ১৫ই আগস্টের যে ঘটনার বিবরণী তারা টেলিগ্রাম করে তাদের দপ্তরে পাঠিয়ে ছিলেন সেই টেলিগ্রামগুলাে ক্লিয়ার হলাে ২৬২৭ আগস্ট। অবশ্যি এ সময়ের খবরের মূল্য আর ছিলাে না। বেচারাদের প্রেস ক্লাবে গিয়ে আড্ডা দেবার সুযোেগ ছিল বটে কিন্তু ওখানে গিয়ে ওরা শুধু ভারতের নিলে শুনতো। তবু আমাকে স্বীকার করতে হবে যে ঐ সব ভারতীয় কাগজের সম্পাদকের অম্লানবদনে তাদের কর্তব্য করে গিয়েছিল। কলকাতা থেকে কোন সাংবাদিক বাংলদেশে; আসবার কোন অনুমতি ছিল না।
আমি তাহেরুদ্দীন ঠাকুরের সঙ্গে গিয়ে দেখা করলুম। প্রতিবাদ জানালুম যে ভারতীয় জার্নালিষ্টদের প্রতি বেশ দুর্বব্যহার করা হচ্ছে। ইনফরমেশন । ডিপার্টমেন্ট এবং মন্ত্রীরা ভারতীয় সাংবাদিকদের সঙ্গে দেখা করছেন না কিংবা তাদের কোন খবর দেওয়া হয় না। উদাহরণ স্বরূপ দু’চারটে প্রেস। কনফারেন্সের কথা উল্লেখ করে বললুম যে ঐসব প্রেস কনকারেন্সগুলোতে বিদেশী সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ করা হয়েছিলাে কিন্তু আমাদের সাংবাদিকদের ওই প্রেস কনফারেন্সে ডাকা হয়নি। কেন? জবাবে বলা হলাে যে ভারতীয় সাংবাদিকদের বিদেশী সাংবাদিকদের পর্যায়ে গন্য করা হয় না।
________________________________________
১৯২০ আগষ্ট ব্যাংকক থেকে একদল ইংরেজ সাংবাদিক ঢাকাতে এলেন। এরা ঢাকাতে আসবার কোন অনুমতি গ্রহণ করেন নি। ২৪ ঘণ্টার পর জানা গেলাে যে ঐসব সাংবাদিকদের বাংলাদেশ ত্যাগ করতে বলা হয়েছে। ইতিমধ্যেই এই সাংবাদিকের দল সৈন্য বাহিনী এবং সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মচারীদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করেছিলেন এবং যা কিছু জানবার সেই খবর বার করে নিয়েছিলেন। এদের মধ্যে দু চারজন আরাে বহুবার পরে বাংলাদেশে এসেছিলেন। কেউ বহুরূপীর ছদ্মবেশে না হয় পৰ্যটক বা কেউ স্কলার ইত্যাদি সেজে।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে প্রচুর সাংবাদিক রিলিফ ওয়ার্কার হিসেব আসতে সুরু করলাে।
এবার বাংলা দেশের দুইটি উল্লেখযােগ্য সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকদের কথা বলা যাক।
প্রথমেই ইত্তেফাকের কথা বলতে হয়। কারণ ইত্তেফাক হলাে বাংলা দেশের সবচাইতে বেশি প্রচারিত সংবাদপত্র। এই পত্রিকার মালিক মানিক মিয়া ছিলেন শহীদ সুরাবর্দীর ভক্ত এবং শেখ মুজিবর রহমানের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। মানিক মিয়ার মৃত্যুর পর এই কাজের দায়িত্ব গ্রহণ করেন তার দুই ছেলে মইনুল হােসেন এবং আনোয়ার হােসেন ময়ু।
১৯৭১ সালে পাক-হানাদাররা যখন বাঙ্গালীদের উপর ঝাপিয়ে পড়লো তখন ইত্তেফাক পত্রিকার দালান এবং মেশিন গােলার আঘাতে ধ্বংস হয়ে যায়। এর ক্ষতিপূরণ বাবদ ইয়াহিয়া খান বারাে লাখ টাকা ইত্তেফাকের কর্তৃপক্ষকে দিলেন। পরে পাকিস্তান সরকার ইত্তেফাকের নতুন যন্ত্রপাতি আমদানী করৰার অনুমতি দিয়েছিলেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর ইত্তেফাক অবশ্যি প্রথমে শেখ মুজিবরের নীতিকে সমর্থন করতে লাগলাে। কিছুদিন পরে এই পত্রিকার নীতি পাল্টে গেলে এবং ইত্তেফাক তাজউদ্দীন এদের নিয়মিতভাবে সমালােচনা করতে সুরু করলাে। পরে মইনুল হোসেন আওয়ামী লীগ থেকে পদত্যাগ করে এবং প্রকাশ্যে বাকশাল ও শেখ মুজিবর রহমানের সমালােচনা শুরু করতে আরম্ভ করে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে মুজিবর রহমান বাংলা দেশের সমস্ত দৈনিক এবং সাপ্তাহিক কাগজগুলোকে
ডায়েরী-৫
________________________________________
রাষ্ট্রীয়করণ করেন। ইত্তেফাককে সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হলাে। অবস্থি শেখ মুজিবর রহমানের এই নীতির প্রতিবাদ শুধু মইনুল হােসেন এবং আনােয়ার হােসেন মজুই করেননি, মানিক মিয়ার বিধবা স্ত্রী নিজেও শেখ সাহেবের কাছে গিয়ে প্রতিবাদ করেছিলেন। এই রাষ্ট্রীয় করণের দরুণ শেখ সাহেব মানিক মিয়ার পরিবারকে প্রচুর টাকা ক্ষতিপূরণ দিয়েছিলেন। শেখের মৃত্যুর পর খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ আবার মইনুল হােসেন এবং আনােয়ার হােসেন মঞ্জুকে ইত্তেফাক পত্রিকা ফিরিয়ে দিলেন। তবে যখন ইত্তেফাক পত্রিকার পরিচালনার ভার বাংলা দেশের সরকারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছিল তখন আনােয়ার হােসেন মেধু সিনেমা বলে একটি সিনেমার কাগজ প্রকাশ করতে শুরু করেছিলন। আর এই কাগজে আমার ব্ল্যাকমেলিং বলে একটি স্পাই থ্রিলার ধারাবাহিক ভাবে ছাপা হচ্ছিল। হয়তাে এই স্পাই থ্রিলার কাহিনী বাংলাদেশে আমার জীবনে অনেক সর্বনাশ ডেকে এনেছে।
ব্যক্তিগতভাবে মইনুল হােসেন এবং আনোয়ার হােসেন মঞ্জু আমার বিশেষ বন্ধু ছিলেন। মইনুলের বাড়ীতে প্রায়ই অনেক বিদেশীরা আনাগোনা করতেন। এদের মধ্যে অনেকেই কুমিল্লার বাংলাদেশ এগ্রিকালচার রিসার্চ একাডেমীর রিসার্চের কাজ করতে আসতেন। আর এই রিসার্চ ইনষ্টিটিউটের পরিচালনা করতেন মহাবুব আলম চাষী। মইনুল হােসেন ছিলেন খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের ব্যক্তিগত বন্ধু। বাজারে গুজব ছিলাে যে মইনুল হােসেন মুজিব হত্যার চক্রান্তের কথা জানতেন। আনােয়ার হােসেনের সঙ্গে আমার দৈনন্দিন হয় তার দপ্তরে নতুবা তার বাড়িতে বাংলা দেশের রাজনীতি নিয়ে আলোচনা হতাে। বাড়ির বৈঠকে প্রায়ই এসে যােগ দিতেন এনায়েতুল্লা খান। যদিও মইনুল হোসেন এনায়েতুল্লাকে দুচোখে দেখতে পারতেন না তবু মনজু ছিলেন এনায়েতুল্লার প্রিয় বন্ধু।
এনায়েতুল্লা ছিলেন হলিডে পত্রিকার সম্পাদক কিন্তু এই পত্রিকার পরিচালক এবং সত্বাধিকারী ছিলেন এনায়েতের স্ত্রী। এনায়েতুল। বিনে পয়সায় কিংবা আরাে স্পষ্ট করে বলা যায়—কোন বিদেশী শক্তির পয়সায় ‘হলিডে কাগজ পৃথিবীর বড়ো বড়াে সংবাদ পত্রের সম্পাদক এবং রাজনৈতিক দলগুলাের কাছে পাঠাতেন। আর প্রতিটি সংখ্যায় থাকতে ভারত বিদ্বেষী দুই তিন পাতা ভতি প্রবন্ধ ! এনায়েতুল্লা দুই তিনবার শমতী গান্ধীকে ব্যক্তিগতভাবে বিশ্রী গালিগালাজ করেছিলেন। তাহেরুদ্দীন ঠাকুরের কাছে
________________________________________
প্রতিবাদ করে কোন ফল পাওয়া যায়নি। | বাংলা দেশের আরাে দুটি উল্লেখযােগ্য পত্রিকার নাম বাংলার বাজী এবং বাংলাদেশ টাইমস। এই দুটি পত্রিকার মালিক ছিলেন ফজলুল হক মুনি এবং তিনি সােনালী ব্যাঙ্ক থেকে প্রচুর টাকা ধার করে পত্রিকা দুটি প্রকাশিত করতে শুরু করেন। মুনির মৃত্যুর পর বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক হলেন এনায়েতুল্লা খান। অর্থাৎ একই সঙ্গে এনায়েতুল্লা খনি হলেন হলিডে এবং বাংলাদেশ টাইমসের সম্পাদক। এনায়েতুল্লা বাংলাদেশ টাইমসের প্রধান সম্পাদক হবার পর বহু ভারত বিদ্বেষী সম্পাদকীয় ঐ কাগজে প্রকাশিত হয়েছিলাে। এই ভারতবিদ্বেষী প্রচারকার্যে সবচাইতে দক্ষ ছিলে আনােয়ার হােসেন মঞ্জুর ইত্তেফাক এবং এনায়েতুল্লার দুইটি কাগজ। থােকার মুস্তাক আহমেদ এবং জিয়াউর রহমানের শাসনকালে বাংলাদেশ বেতার এবং টেলিভিশনেও বহু ভারত বিদ্বেষী প্রচার কাজ করা হয়েছিলো।
বাংলাদেশের আরাে কয়েকটি উল্লেখযােগ্য সংবাদপত্রের নাম হলাে জনপদ, বাংলাদেশ অবজার্ভার ও সংবাদ। এ ছাড়া আরাে বহু কাগজ ছিলাে তাদের সবার নাম আজ উল্লেখ করা সম্ভব নয়।
জনপদের সম্পাদক ছিলেন গফর চৌধুরী। গফরের বাংলা ভাষায় বিশেষ দখল ছিলাে এবং যদিও এই কাগজটির মালিক ছিলেন শেখসাহেবের ক্যাবিনেটের মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের একজন গন্যমান্য সদস্য কামারুজ্জমান, তবু সম্পাদক হিসেবে গফর চৌধুরী শেখ সাহেবের নীতির সমালোচনা করতে কুণ্ঠা বােধ করেননি। এই প্রসঙ্গে বলা যায় যে গফর শেখ সাহেবের মৃত্যুর আগে তার নীতির বিরােধিতা করে যে দু-তিনটে কড়া সম্পাদকীয় লিখেছিলেন সেগুলো বাংলা দেশের সংবাদপত্রের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। বর্তমানে গফর চৌধুরী লণ্ডন থেকে একটি কাগজ বের করছেন।
‘সংবাদ পত্রিকার মালিকের নাম হলাে, আহমাদুল কবীর। তার কাগজের নীতি ছিলো বামপন্থী। কবীরের ভাই ছিলেন সােনালী ব্যাঙ্কের প্রধান কর্মকর্তা, কিন্তু পরে তার চাকুরী যায়। আহমাদুল কবীর ছিলেন আমাদের স্কুলের ছাত্র এবং আমার সঙ্গে তার বিশেষ বন্ধুত্ব ছিলাে। ‘সংবাদ’ ভারত বিদ্বেষী প্রচার কাজ খুব বেশী করেনি। হয়তাে গা বাঁচিয়ে চলতেন।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কাগজের নাম উল্লেখ করা দরকার। এই কাগজটির নাম ছিলাে ‘গণকণ্ঠ’ এবং কাগজটি ছিলাে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের মুখপত্র।
________________________________________
ভারত বিদ্বেষী প্রচার কাজে ‘গণকণ্ঠ’ বেশ পটু ছিলাে। শেখ মুজিবর রহমান | গণকণ্ঠ কাগজ বন্ধ করে দিয়েছিলেন।
আনোয়ার হােসেন মনজুর বাড়ীতে প্রায়ই আমাদের আডড়া হতাে। একদিন গল্প প্রসঙ্গে মনজু আমাকে বললো যে ৮ই আগষ্ট কলকাতায় সে তার এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলাে। কি কারণে দেখা করতে গিয়েছিল মনজু আমাকে সে কথা কিছু বলেনি কিন্তু তার কলকাতা ভ্রমণের কথা শেখ মুজিবর রহমানের কানে গেলে। মনজু বললাে যে তার বাড়ীর সামনে প্রায়ই বিদেশী দূতাবাসের গাড়ী দাড়িয়ে থাকতাে এবং দুএকবার জেনারেল ওসমানী এবং জেনারেল জিয়াও ঐ বাড়িতে এসেছিলেন। মনি শেখ মুজিবর রহমানের কাছে গিয়ে বললেন মনজুর বাড়ীতে বড়াে বড়ো আর্মি অফিসার এবং বিদেশী দূতাবাসের লোকদের বৈঠক হচ্ছে। মনজুর প্রতি শেখ সাহেবের সন্দেহ হলো।
মনজু কলকাতা থেকে ফিরে যাবার সঙ্গে সঙ্গে তােফায়েল আহমেদ এসে মনজুকে সতর্ক করে বললেন, মনজু তুই গিয়ে একবার শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা কর। কারণ অনেক লােক মানে মুনি গিয়ে শেখ সাহেবের কাছে তোর বিরুদ্ধে কথা বলছে।
মনজু শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করতে গেলাে। মনজুকে দেথে শেখ সাহেবের মুখ গম্ভীর হলো, হয়তাে ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্র থেকে তিনি সৈন্যবাহিনীর চক্রান্তের কথার কিছু আভাষ পেয়েছিলেন। তিনি সন্দেহ করেছিলেন এই ব্যাপারে মন হয়তাে জড়িয়ে আছে।
মনজুকে দেখেই শেখ সাহেব বললেন : কী ব্যাপার আজকাল শুনছি ঘন ঘন কলকাতা যাচ্ছিস। কী জন্যে এ শহরে যাস? সিনেমা তাে বড়ো একটা | দেখিস না। এবং বউয়ের জন্যে শাড়ী কিনবার অভ্যেসও তাের নেই। তাহলে কলকাতায় গিয়েছিলি কেন? আর তাের বাড়ীতে নাকি আজকাল অনেক বড়োবড়াে লােক বেড়াতে আসে? কী ব্যাপার ? রাজনীতি করছিস নাকি ?
মনজু কী একটা জবাব দেবার চেষ্টা করলাে কিন্তু তার কথায় বাধা পড়লাে কারণ ঐ সময়ে হন্তদন্ত হয়ে ঘরে ঢুকলেন বাংলাদেশ ইনটেলীজেনসের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল ই-এ চৌধুরী। চৌধুরী সাহেব শেখ মুজিবর রহমানকে বললেন যে তার বিশেষ জরুরী কিছু কথা বলবার আছে। অতএব মনজু সেদিন কোন কথা বলবার সুযােগ পায়নি।
পরের দিন তােফায়েলের নির্দেশনুযায়ী মনজু আবার শেখ সাহেবের সঙ্গে
________________________________________
দেখা করতে গেলাে। কিন্তু সেদিনও শেখ সাহেবের সঙ্গে দেখা করবার সুযােগ পেলােনা। মনজু ফিরে এলো, অবশ্যি তারিখটি উল্লেখযােগ্য। কারণ পরের দিন শেষ রাতে শেখ মুজিবর রহমানকে খুন করা হয়।
মনজু আমাকে বললাে : প্রায় ভাের পাঁচটার সময় গুলির আওয়াজ শুনে আমি বেড়িয়ে পড়ি। একটুখানি হাটবার পর দেখলুম তাহেরুদ্দীন ঠাকুর রাস্তায় দাড়িয়ে আছেন। উনি আমাকে বললেন : মনজু-শেখ সাহেবের বাড়ির দিক থেকে গুলির আওয়াজ শােনা যাচ্ছে। কী হচ্ছে ব্যাপারটা বুঝতে পারছিনে।
অবশি এই কথা বলবার কিছুক্ষণ পরেই তাহেরুদ্দীন ঠাকুর সােজা বাংলা দেশ বেতার কেন্দ্রে চলে গেলেন। একটু বাদে বেতার কেন্দ্রে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ ও এলেন। তিনি নাকি সারারাত্রি ঘুমাননি। তার আগামী লেনের বাড়ীতে সমস্ত রাত জেগে ছিলেন। আর খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের বক্তব্য ছিলাে : তিনি শেখ মুজিবর রহমানকে যে খুন করা হয়েছে এই কথা ঐ মেজরদের কাছে প্রথম শুনতে পেলেন। আমি তাে ভেবেছিলুম যে ওরা আমাকেও খুন করবে।
কিন্তু খুন করবার পরিবর্তে খােন্দ কার সাহেবকে বাংলা দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি বলে ঘােষণা করা হলো। ঐ সময়ে বেতার কেন্দ্রে মেজর জেনারেল খালিলুর রহমান, মেজর ডালিম এবং বাকী পাঁচজন মেজর বসেছিলেন।
বাংলাদেশের নতুন সরকারকে সর্ব প্রথম স্বীকৃতি দিয়েছিলেন পাকিস্তান সরকার। ভয়েস অব আমেরিকা সর্ব প্রথম মুজিবর রহমানের হত্যার কাহিনী প্রচার করে। এবং পরে পাকিস্তান রেডিওতে ঐ কু দ্য আঁতাতের খবর শোনা গেলাে। আর ঐ সঙ্গে সঙ্গে পাকিস্তান সরকার খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের বেআইনী সরকারকে আইন সঙ্গত বলে স্বীকৃতি দিলাে।
এই স্বীকৃতি দেবার প্রয়ােজন এবং বিশেষ মূল্য ছিলাে। কারণ বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি অর্থাৎ শেখ মুজিবর রহমানের পরিবর্তে উপরাষ্ট্রপতি নজরুল ইসলামের রাষ্ট্রপতি হওয়া যুক্তি সঙ্গত ছিলাে। কিন্তু হলাে ঠিক তার উল্টো, খুনী মেজরদের দল আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন যে খােন্দকার হবেন বাংলাদেশের নতুন রাষ্ট্রপতি। খােন্দকার রাষ্ট্রপতি হবার পর আর কারু মনে কোন সন্দেহ রইলো না যে মুজিবর
________________________________________
রহমানের আসল হত্যাকারী কে?
বিভিন্ন দেশ থেকে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে স্বীকৃতি দেওয়া সত্বেও দিল্লীর কর্তারা বেশ কিছুদিন চুপ করে বসে রইলেন। বাংলাদেশের ঘটনাকে তাদের আভ্যন্তরীণ ঘটনা বলে ঘােষণা করা হলাে। অতএব নতুন করে স্বীকৃতি দেবার কোন প্রশ্ন ওঠে না। কিন্তু মুস্তাক আহমেদ এবং পররাষ্ট্র দপ্তরের নতুন বিদেশ সচিব তােবারক হােসেন প্রতিদিন সেন সাহেবের কাছে জিজ্ঞেস করেন, আপনারা আমাদের কবে স্বীকৃতি দিচ্ছেন ? | সমর সেন জবাব দিলেন যদি শেখ মুজিবর রহমানের খুনের ব্যাপার আপনাদের ঘরােয়া ব্যাপার হয়, তাহলে আপনারা নতুন করে স্বীকৃতি চাইছেন কেন? প্রতিবার রাষ্ট্রপতি পরিবর্তন হলে কী আমাদের প্রতিবারে নতুন করে স্বীকৃতি দিতে হবে ?
ঐ সময়ে ভারতবর্ষের স্বীকৃতি পাওয়া খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের একান্ত আবশ্যকতা ছিলাে। কারণ তার সরকার যে বে-আইনী এবং বেসঙ্গত একথা তিনি এবং পরামর্শদাতারা বেশ ভালাে করেই জানতেন। আর পাশের দেশ হলাে ভারতবর্ষ। তাই ভারতের স্বীকৃতি পাওয়া একান্ত আবশ্যক।
কয়েক দিনের মধ্যে সব দেশগুলােই এমনকি চীনও খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে স্বীকার করেছিলো। তারপর হঠাৎ একদিন মস্কোর কর্তারাও মুস্তাকের সরকারকে স্বীকার করে নিলেন। এবার খােন্দকার আহমেদ সমর সেনকে বললেন : আপনারা ছাড়া সবাই আমাকে স্বীকৃতি দিয়েছেন, এমন কি মস্কোও আমাকে মেনে নিয়েছেন। এবার বলুন কী করবেন?
করবার বেশী কিছু ছিলাে না। কারণ মস্কোর স্বীকৃতি দেবার পর দিৱীর কর্তারা বেকায়দায় পড়লেন। এদিকে বাংলাদেশ সরকার বলে বসলো ধে নতুন করে আমাদের স্বীকৃতি না দিলে আমরা আপনাদের সঙ্গে ব্যবসা বাণিজ্যের কথাবার্তা, ফারাক্কা জলের সমস্যা নিয়ে আলাপ আলোচনা করতে পারবাে না।
বেগতিক দেখে দিৱী সরকার প্রায় ইচ্ছার বিরুদ্ধে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের সরকারকে স্বীকৃতি দিলেন।
পরে এই স্বীকৃতির প্রশ্ন নিয়ে বিভিন্ন ধরনের বাদানুবাদ হয়েছিলো। কারণ খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ ছিলেন খুনী? খুনীর কী রাষ্ট্রপতি হবার অধিকার আছে ?
________________________________________
দীর্ঘকাল বাদে শ্ৰীমতী গান্ধীর প্রাক্তন সেক্রেটারী পি-এন হাকসার দুঃখ প্রকাশ করে বলেছিলেন, খােন্দকারকে স্বীকৃতি দেওয়া যুক্তি সঙ্গত হয়নি।
অবশ্যি খােন্দকারকে যখন স্বীকৃত দেওয়া হয় তখন হাকসার সাহেব সরকারী চাকুরী থেকে বিদায় নিয়েছেন।
খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে স্বীকৃতি দেবার পর ভারত বিরােধী প্রচার আরো তীব্র হলো। আর এই প্রচারের প্রধান নেতা হলেন হলিডের এনায়েতুৱা খান, ইত্তেফাকের আনােয়ার হােসেন মঞ্জু এবং মৌলানা ভাসানী। বিভিন্ন বিষয়—স্মাগলিং থেকে ফারাক্কার জলের সমস্যা নিয়ে ভারতবর্ষকে প্রতিদিন গালিগালাজ দেওয়া হতো। সংবাদপত্রের সম্পাদকদের কাছে নালিশ করলে জবাব দিতেন : আমরা কী করবাে বলুন ? স্বয়ং তাহেরুদ্দিন ঠাকুর আমাদের এই সব ভারত বিরােধী খবরগুলো ছাপতে নির্দেশ দিচ্ছেন। বাংলাদেশের সরকারের কাছে নালিশ করুন। আর ঐ দিকে বাংলাদেশের সরকারের কাছে কিছু বললে ওদের কাছ থেকে স্পষ্ট জবাব মিলতত: আমাদের করবার কিছু নেই। আমাদের দেশের কাগজগুলো তাদের স্বাধীন মতামত ব্যক্ত করে থাকে। ঐ মতের বিরােধী আমরা কিছু বলতে পারবাে না।
এদিকে প্রতিদিন ভারত সরকার বাংলাদেশের কাগজ গুলাের প্রকাশিত সংবাদ এবং সম্পাদকীয়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করতেন।
ধৈর্য্যের একটা সীমা আছে। বাংলাদেশের পত্রিকাগুলাে এবং বাংলাদেশের সরকারের মুখপাত্রের প্রতিদিন ভারত বিরোধী এতাে বিষােদগার শুরু করলেন যে ভারতীয় হাই কমিশন পালটা জবাব দিতে লাগলাে যে ভারতীয় সংবাদপত্র এবং সাংবাদিকেরা স্বাধীন। ভারতীয় সাংবাদিকদের ঢাকা শহরে প্রায় নজরবন্দী করে রাখা হয়েছে। খবর সংগ্রহ এবং খবর পাঠাতে দেওয়া হয় না। ওদের একটা সাধারণ টেলীগ্রাম কলকাতায় পৌছুতে প্রায় পনের দিন লাগে। অতএব কলকাতার সংবাদপত্রের বিদেশ সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের খবর ছেপে থাকে। আপনাদের যদি কোন কিছু প্রতিবাদ করবার থাকে তাহলে বিদেশী কাগজ এৰং সংবাদ সরবরাহ কর্তৃপক্ষের কাছে করুন।
একদিন আনোয়ার হােসেন আমাকে একটা ছবি দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলাে : এটা কিসের ছবি বলতে পারেন?
আমি দেখলুম ছবিতে আছে বালীর সমুদ্র। অতএব দেখে তাে মনে হচ্ছে সাহারা মরুভূমি।
________________________________________
না পদ্মা নদী। পানীর অভাবে পদ্মা নদী শুকিয়ে যাচ্ছে। আপনারা তো ফরাক্কার পানী আমাদের দিচ্ছেন না। আজ তাহেরুদ্দীন ঠাকুর এই ছবি আমাদের ছাপতে দিয়েছেন।
ছবির ক্যাপশন ছিলো: পানীর অভাবে পদ্মা নদী শুকিয়ে মরুভূমি হয়ে যাচ্ছে। ভারত সরকার বাংলা দেশেকে পানী দিচ্ছেন।
পরের দিন ইত্তেফাক পত্রিকায় বেশ ফলাও করে এই ছবিটি ছাপা হলাে। । ছবিটি ইত্তেফাক পত্রিকায় প্রকাশিত হবার সংগে সংগে বাংলা দেশে আলোড়ন এবং উত্তেজনা সৃষ্টি হলো। দেশের রাজনৈতিক হাওয়া আরো গরম হলাে। এনায়েতুল্লা খান তার দুই পত্রিকায় ভারতবিরােধী সম্পাদকীয় লিখলেন। পরে বাংলা দেশ বেতার এবং টেলিভিশন ঐ সম্পাদকীয় উদ্ধৃত করলাে। ইত্তেফাকও কড়া ভারত বিরােধী সম্পাদকীয় লিখলো। প্রতিবাদের জবাবে আনােয়ার হােসেন মঞ্জু হেসে বললো: কী আর করবো বলুন! কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশ তো আমরা অমান্য অগ্রাহ করতে পারিনে।
কারু বুঝতে অসুবিধে হলো না যে ফরাকার সমস্যা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে এক বাদানুবাদের ঝড় উঠবে। সবাই এই ঠাণ্ডা লড়াইয়ের জন্য দিনটির সময় গুণতে লাগলাে।
ইতিমধ্যে পরপর তিনটি ঘটনা ফরাক্কার সমস্যা এবং ভারত বিরােধী কাৰ্য্যকে ছাপিয়ে বাংলাদেশে তােলপাড় সৃষ্টি করলো।
এই তিনটি ঘটনা হলো ৩রা নভেম্বরে খালেদ মুশারফের কু দ্য আঁতাত, ঢাকা সেন্ট লি জেলে তাজউদ্দীন নজরুল ইসলাম ও অন্যান্য আওয়ামী লীগের বন্দী গণ্যমান্য নেতাদের হত্যাকাণ্ড এবং ৭ই নভেম্বরে সিপাহী বিদ্রোহ। এছাড়াও খালেদ মুশারফের মৃত্যু ও পরে জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা লাভ করা।
প্রথমত: খালেদ মুশারফের কু দ্য আঁতাতের কথা বলা যাক। কারণ এই ঘটনা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ রাষ্ট্রপতি হবার পর চীফ অবদি আমি ষ্টাফ শফীউজাকে মালেশিয়াতে রাজদূত করে পাঠান হলো। তার পরিবর্তে এলেন জেনারেল জিয়াউর হরমান। তার সহকর্মী হলেন খালেদ মুশারফ, চীফ অব দি জেনারেল স্টাফ। খালেদ মুশারফ মুক্তি যুদ্ধে যােগদান করেছিলেন। মুজিবের বিরোধী চক্ৰস্তকারীরা, জিয়াউর রহমানকে মুজিব হত্যার পূর্বাভাষ দিয়েছিলেন বটে কিন্তু খালেদ মুশারফের সঙ্গে তাদের কোন যােগাযোগ ছিলোনা। খালেদ মুশারফ ছিলেন এনায়েতুলার দূর সম্পর্কের
________________________________________
আত্মীয়। ৩রা নভেম্বর কু দ্য আঁতাতে ভারত বিরােধী এনায়েতুল্লা খালেদ মুশারফকে অনেক ভ্রান্ত উপদেশ দিয়েছিলেন। বাজারের গুজব ছিলাে যে তিন নম্বর রােডে কোন এক বাড়িতে প্রায়ই ওদের দুজনকে দেখা যেতো। এই বাড়িটি কার?
দিন আমার ঠিক স্মরণ নেই বাংলাদেশ সৈন্যবাহিনীর মধ্যে আবার ঝগড়া বিবাদ শুরু হবার সম্ভানা আছে তার প্রথম আভাষ পেলুম এনিয়েতুল্লা খান এবং আনােয়ার হােসেন মনজুর কাছ থেকে। একদিন মনজু আমাকে বললো ঐ ছয়জন মেজর প্রেসিডেন্টের বাড়িতে বসে মদ গিলছে আর খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ আর সৈন্য বাহিনী এবং সরকারী কর্মচারীদের হুকুম দিচ্ছে। ওর প্রেসিডেন্টের বাড়ি থেকে বেরোয় না। রাষ্ট্রপতিভবনের চারদিক ঘিরে আছে ফারুক রশীদের বেঙ্গল ল্যান্সার এবং আর্মার্ড কোর। এমন কি রমজানের দিনেও ওরা ঐ বাড়িতে বসে মদ গিলছে, নামাজ পড়া তাে দূরের কথা। বলুন কী ঘাের অন্যায়, পাপ করছে পাপ ?
তার পর এক দিন এনায়েতুল্লা বললেন : ঐ ছয়জন মেজরের আচরণ সৈন্যবাহিনীর বড়ো কর্তাদের মধ্যে ঝগড়া বিবাদ সৃষ্টি করেছে। কারণ ১৫ই আগষ্ট মুজিব হত্যার পর ঢাকার ব্রিগেড কমাণ্ডার সাক্ষাৎ জামিল চীফ অবদি জেনারেল ষ্টাফ মেজর জেনারেল খালেদ মুশারফ এবং চীফ অব দি আমিষ্টাফ শফীউল্লার কাছে প্রতিবাদ জানিয়ে বললেন : এ কী ব্যাপার, ঐ ছজন মেজর এবং যে সব সিপাইরা মুজিব হত্যায় যােগ দিয়েছিলো তাদের ব্যারাকে ফিরে আসতে আদেশ দেওয়া হােক। বাংলা দেশে দুই সৈন্যবাহিনী কোন প্রকারেই থাকতে পারে না।
এই প্রস্তাবের বিরােধিতা করলেন জিয়াউর রহমান। এই আপত্তির কী কারণ তখন জানা না গেলেও পরবর্তীকালে বুঝতে অসুবিধে হয়নি জিয়াউর রহমানের আপত্তির মূল কারণ কি ছিল? সেদিন সৈন্যবাহিনীতে ঐ আলােচনা মুলতুবী রাখা হলাে। পরের দিন ১৬ই আগষ্ট শফীউল্লার পরিবর্তে জিয়াউর রহমান হলেন চীফ অব দি আমি ষ্টাফ। অতএব বেশ কিছুদিনের জন্যে ঐ ঘটনা নিয়ে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে কোন আলাপ আলোচনা হল না। কিন্তু অক্টোবরের শেষ নাগাদ যখন ঐ ছয়জন মেজরের ভূমিকার আরো স্পষ্ট হলো। এবং বােঝা গেলে তাদের ক্যান্টনমেন্টে ফিরে আসবার কোন সম্ভাবনা নেই তখন সাফাৎ জামীল এবং খালেদ মুশারফ আবার ঐ পুরাতন প্রস্তাব উথাপন করলেন। ওদের বক্তব্য ছিলো যে ছয়জন মেজর বাংলা দেশের আমির নাম
________________________________________
ভাড়িয়ে দেশ চালাচ্ছে। এই পরিস্থিতি অসহ্ন এবং বে-আইনী। আমির ডিসিপ্লিন বজায় রাখতে হবে।
জিয়াউর রহমান খালেদ মুশারফের সঙ্গে একমত হতে পারলেন না। তিনি নিজেও বুঝতে পেরেছিলেন যে ছয়জন মেজর এবং তাদের সমর্থকদের আচরণ মিলিটারী নিয়ম কানুনের বিরোধী। তবু জিয়াউর রহমান চুপ করে রইলেন। জিয়ার এই আচরণ থেকে সুস্পষ্ট বােঝা যায় যে জিয়াউর রহমান দু নৌকোয় পা রেখে চলছিলেন। কারণ ই নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের পর জিয়াউর রহমানের আসল উদ্দেশ্য আরাে স্পষ্ট হলাে। | জিয়াউর রহমানের মৌনতা খালেদ মুশারফকে এবং সাফাৎ জামীলকে বেশ বিরক্ত করলাে। জিয়া অবশ্যি অনেক পীড়াপীড়ির পরে ছােট্ট একটা জবাব দিয়েছিলেন যে ছয়জন মেজরদের বিরুদ্ধে কোন মিলিটারী ডিসিপ্লিনারী এ্যাকশন নেবার সময় হয়নি। জিয়াউর রহমানের আসল মনােভাব এবং কী উদ্দেশ্যে তিনি ছয়জন মেজরের বিরােধী কোন এ্যাকশন নেবার বিরোধী ছিলেন এই কথা খালেদ মুশারফ এবং সাফাৎ জামীল জানতেন না।
খালেদ মুশারফ জিয়াউর রহমানকে নজর বন্দী করলেন। তারপর ঠিক হলাে যে এবার খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে স্পষ্ট বলা হবে যে ঐ ছয়জন মেজরকে বাংলাদেশ থেকে চলে যেতে বলা হোক।
মনজুর কাছ থেকে সৈন্যবাহিনীর মনােমালিন্যের খবর শুনে উত্তেজিত বোধ করলুম। ভারতীয় সাংবাদিক মহল এবং ভারতীয় হাইকমিশনের বিভিন্ন শুরে আলােড়ন শুরু হলাে। বাংলা দেশের সৈন্য বাহিনীর বিভিন্ন শাখায় ঝগড়া বিবাদ কারু কাছে অজ্ঞাত ছিলােনা।
তারপর এলো ৩রা নভেম্বর। দিনটি আমাদের স্মৃতিপটে বহুদিন গেঁথে থাকবে। কারণ ঐ দিনের পর থেকে বাংলা দেশে পর পর এতোগুলো ঘটনা দ্রুতলয়ে ঘটে গেলো যে আমরা ঐ ঘটনাগুলাের জন্যে একেবারেই প্রস্তুত ছিলুমনা।
প্রথমত: ৩রা নভেম্বর ভােরবেলাই ভারতীয় সাংবাদিক এবং হাইকমিশনের কর্মচারীদের টেলিফোনের লাইন বিকল হয়ে গেলো। আর ঐ টেলিফোন যন্ত্রটি যখনই বিগড়ে যেতো তখনই আমরা বুঝতে পারতুম যে বাংলাদেশের কোথাও কিছু গােলমাল হাঙ্গামা হচ্ছে। আমাদের এই অনুমান আন্দাজ মিথ্যা ছিলােনা। কারণ টেলিফোন লাইন খারাপ হবার কিছুক্ষণ পরেই দেখতে পেলুম যে প্রেসিডেন্টের বাড়ির কাছ দিয়ে হেলিকপ্টার উড়ছে।
________________________________________
কী ব্যাপার? টেলিফোনে কারু কাছ থেকে কোন খবর পাবার সম্ভাবনা নেই। | সমস্ত দিন ঢাকা শহরে ছিলো উত্তেজনা এবং গুজব। বহু লােকের কাছ থেকে ভােরের ঐ হেলিকপ্টার উড়বার বিবিধ ধরণের খবর শুনতে পেলুম। কিন্তু ঐ দিন আসল সত্যি খবর যাচাই করবার সম্ভাবনা ছিলােনা। আমি দুএকবার আনােয়ার হোসেন এনায়েতুল্লার সঙ্গে দেখা করবার ব্যর্থ চেষ্টা করলুম।
৪ঠা নভেম্বর শহরের উত্তেজনা আরো বাড়লো। উত্তেজনা বৃদ্ধি পাবার প্রধান কারণ ছিলাে প্রেস ক্লাবের গুজব। বাংলা দেশের প্রেস ক্লাবে যতাে উদ্ভট কাহিনী শুনেছি ঐ ধরণের গল্প আমি এর আগে কখনও শুনিনি। আর এই প্রচার কার্যের গোয়েবলস ছিলেন এনায়েতুল্লা এবং রয়টারস বিবিসির সংবাদদাতা আতিকুল আলম।
ভাের বেলা আনোয়ার হােসেন মনজু আমাকে বললো: খোন্দকারকে সৈন্যবাহিনীর কয়েক জন বড়াে বড়ো জেনারেল ক্ষমতা থেকে সরাবার চেষ্টা করছে। খালেদ মুশারফ সৈন্যবাহিনীর মধ্যে কু দ্য আঁতাতের পরিকল্পনা করছে। সেদিন বাজারে রটে গেলো যে খালেদ মুশারফ জিয়াউর রহমানকে সরিয়ে চীফ অব দি আম্মি ষ্টাফ হয়েছেন। আর ঢাকার ব্রিগেড কমাণ্ডার সফাৎ জমীল হয়েছে তার ডান হাত।
সেদিন আর একটি ঘটনা বিশেষ উল্লেখযােগ্য। কারণ প্রেস ক্লাব থেকে এক গুজব বাজারে ছড়িয়ে পড়লো যে খালেদ মুশারফ হলেন ভারতীয় এজেন্ট। ব্যস শহরে ভারত বিরােধী আবহাওয়া বেশ ঘনীভূত হলাে। আমরা বিপদের আশংকা করলুম। সেদিন আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা মনি সিংয়ের সমর্থকেরা এবং মুজাফর আহমেদের দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এক প্রসেসন শেখ মুজিবর রহমানের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাবার জন্যে শেখ সাহেবের ধানমীর বাড়ীতে নিয়ে এলো। আর ঐ প্রসেসানের মধ্যে ছিলেন খালেদ মুশারফের মা এবং তার ভাই।
৫ই নভেম্বর ইত্তেফাকের প্রথম পাতায় এই প্রসেসানের ছবি প্রকাশিত করা হলাে। ছবির ক্যাপশন ছিলো ভারত বিরােধী। ছবির প্রথম সারিতে ছিলেন খালেদ মুশারফের মা এবং তার ভাই।
ইত্তেফাকের ছবিটি প্রকাশিত হবার পর প্রেস মহলের আর একটি
৭৯
________________________________________
গুজব শুনতে পেলুম যে কলকাতার আকাশবাণী খালেদ মুশারফকে অভিনন্দন জানিয়েছেন। এই খবরটি সত্যি না মিথ্যে যাচাই করবার কোন চেষ্টাই বাংলাদেশের সাংবাদিকেরা করেননি। এমন কি বাংলাদেশের সরকারও এই খবর যাচাই করার চেষ্টা করেননি। তারাও প্রেস মহলের গুজবে পুরােপুরি বিশ্বাস করেছিলেন।
দীর্ঘকাল পরে জানা গিয়েছিলাে যে খালেদ মুশারফ তার মা এবং ভাইকে এই মিছিলে ঘােগ দেবার জন্য ভৎসনা করেছিলেন এবং ইত্তেফাকের মিছিলের ছবিটি প্রকাশিত হবার পর খালেদ মুশারফ বিপদের আশংকা করলেন। এই সময় বাংলাদেশের এই ঘটনার চিত্রনাট্যে আর এক জন নতুন নায়কের আগমন হলাে। এই অভিনেতার নাম হলো কর্ণেল আবু তাহের এবং তার জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল।
বিকেলে আনােয়ার হােসেন মনজুর আডডায় গিয়ে উপস্থিত হলুম। সেদিন আমরা চার পাচ জন ঐ আডডায় উপস্থিত ছিলুম। আনােয়ার হােসেন মনজু স্বীকার করলে যে ইত্তেফাকের প্রকাশিত ছবিটি বাংলাদেশে আলােড়ন সৃষ্টি করেছে। এ নিয়ে একটা গোলমাল হবার সম্ভাবনা আছে। আর খালেদ মুশারফ যে ঐ ছয় জন মেজরকে সৈন্যবাহিনীর ব্যারাকে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন এই কথাও অনেকে বললেন।
সেদিন আনােয়ার হােসেন মনজু বেশ গম্ভীর মুখ নিয়ে বসেছিলেন। কারণ কী জানবার চেষ্টা করলুম। মনজু জবাব দিলো : বাজারে একটা গুজব শুনছি যে ঢাকা সেন্ট লি জেলে গতকাল কিছু হত্যাকাণ্ড হয়েছে। কে হত্যা করেছে এবং কাদের হত্যা করা হয়েছে এই কথা মনজু স্পষ্ট করে বলতে পারলো না। | একটু বাদে এনায়েতুল্লা ঐ আসরে এসে উপস্থিত হলেন। তার কাছে সে দিনকার উত্তেজনা গোলমাল হাঙ্গামার বিস্তৃত বিবরণী শুনতে পেলুম। পরে জানতে পেরেছিলাম যে এনায়েতুল্লা খালেদ মুশারফের কু দ্য আঁতাতের কথা আগে থেকেই জানতেন, কারণ খালেদ মুশারফ এনায়েতুল্লার পরামর্শে এমন কতকগুলো কাণ্ড করেছিলেন যে ঘটনা থেকে পাকিস্তানী পন্থীরা বাজারে প্রচার করেছিলো যে খালেদ মুশারফ হলেন ভারতীয় অনুচর এবং ওর মাধ্যমেই ভারতীয় সরকার জিয়াউর এবং খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে ক্ষমতার গদা থেকে সরাবার চেষ্টা করছেন।
এনায়েতুল্লা অবশ্যি ঘটনার এই পরিণতি আশা করেননি। যদি করে ও
________________________________________
থাকেন তাহলে কখনও সেই কথা ভাষায় প্রকাশ করেননি। শুধু সেইদিন তার মুখে উত্তেজনার সুর শুনতে পেলুম। | শুনেছিস মনজু কাল বিকেল থেকে অনেকগুলাে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটেছে
এনায়েতুল্লা কথা বলতে বলতে এতে উত্তেজিত হয়েছিলেন যে আমার ঐ গল্পের আসরে উপস্থিতি একেবারেই নজর করেননি।
কী হয়েছে বল? আনােয়ার হােসেন মনজু বেশ উত্তেজিত হয়ে জিজ্ঞেস
তিন এবং চার নভেম্বরের পুরাে কাহিনী শুনবার জন্যে আমরা সবাই উৎকণ্ঠিত এবং ব্যাকুল হয়ে পড়লুম। সবাই জানতুম যে ঐ খুনী মেজরদের সঙ্গে এবং বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনীর সঙ্গে এনায়েতের বিশেষ হৃদ্যতা আছে। | এনায়েতুল্লা এবার গম্ভীর গলায় বললাে: প্রথম গুরুতর খবর হলাে কাল রাত্রিবেলায় ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে তাজউদ্দীন, কামারুজ্জমান, নজরুল ইসলাম প্রমুখ আওয়ামী লীগের নেতাদের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়েছে। কার নির্দেশে এই হত্যা করা হয়েছে জানিনে।
এনায়েতের কথায় বাধা দিলাে আনােয়ার হােসেন মঞ্জু। মঞ্জু বললো, আমিও আজ ঐ ধরনের একটা গুজব শুনেছি। আমার কাগজের এক রিপাের্টার এসে বললাে যে আজ সকালে তাজউদ্দীনের বাড়ি থেকে জেলখানায় যে খাবার পাঠান হয়েছিলো সেই খাবার ফেরৎ এসেছে। যে লোকটি খাবার জেলখানায় নিয়ে যেতাে সেই সর্ব প্রথম এসে বলেছে তাজউদ্দীনকে খুন করা হয়েছে। আওয়ামী লীগের অন্যান্য গণ্যমান্য নেতাদেরও খুন করা। হয়েছে। তাহলে দেখছি বাজারের এই গুজবটি সত্যি!
| তাজউদ্দীনের মৃত্যু খবর শুনে আমি স্তম্ভিত হলুম। মাত্র তিনমাস আগে আমি তাজউদ্দীদের সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলুম। সেই দিন তাজউদ্দীন বেশ অনুতাপ করে বলেছিলেন : তােমরা আমাকে ভুলে গেছ। জানাে আমি ভারতকে ভালােবাসি।
তার সেই কথাগুলাে আমার কানে বাজতে লাগলাে। তাজউদ্দীনকে যে হত্যা করা হয়েছে এবং তাকে হত্যা করা সম্ভব এই কথা আমার মন বিশ্বাস করতে চাইলাে না। আমার মনে হলাে এনায়েতুল্লা মিথ্যে কথা বলছে। কিন্তু আনোয়ার হােসেন মনজু বলছে যে আজ সকালে
৮১
________________________________________
তাজউদ্দীনের খাবার ঢাকা সেন্ট লি জেলখানার কর্তৃপক্ষ গ্রহণ করেন নি। তার কারণ কি?
এনায়েতুল্লা আবার বলতে সুরু করলেন। গতকাল বিকেল থেকে সৈন্য বাহিনীর ঐ মেজরদের নিয়ে জিয়াউর রহমান এবং খালেদ মুশারফের সঙ্গে বেশ ঝগড়া বিবাদ হয়। জিয়াউর রহমানকে ওরা ঘরের ভেতরে আটক করে রেখেছে।
তারপর •••
আমি এনায়েতুল্লাকে এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করলুম না। কারণ আমি জানতুম যে এনায়েতুল্লা প্রেস ক্লাবে গুজব রটায় বটে কিন্তু আনোয়ার হােসেন মনজুর কাছে মিথ্যে কথা কিংবা তাকে ধাপ্পা দেবার কোন চেষ্টা করে না! এনায়েতুল্লা একটা হুইস্কীর গ্লাসে লম্বা চুমুক দিয়ে আরো বললাে : তারপর গতকাল রাত্রে ব্রিগেডিয়ার সাফাৎ জামীল গিয়ে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে ধমক হুমকি দিয়ে এসেছে। বলে এসেছে আমরা জাষ্টিস সায়ামকে প্রেসিডেন্ট করতে চাই। আপনাকে প্রেসিডেন্টের গদী ত্যাগ করতে হবে।
সাফাৎ জামীলের সঙ্গে খালেদ মুশারফও উপস্থিত ছিলেন। তিনি জোর করে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে দিয়ে কাগজে সই করে নিয়েছেন যে তিনি প্রেসিডেন্টের পদ থেকে পদত্যাগ করছেন এবং জাষ্টিস সায়মকে বাংলাদেশের নতুন প্রেসিডেন্ট করা হচ্ছে। অবশি খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ অতো সহজে প্রেসিডেন্টের গদী ত্যাগ করতে চাননি। কিন্তু খালেদ মুশারফ ও সাফাৎ জমীল খােন্দকারকে বললেন যে ঐ ছয়জন মেজরকে আবার ব্যারাকে ফিরে আসতে হবে। কিন্তু খােন্দকার ঐ প্রস্তাবে রাজী হলেন না। পরে বহু আলাপ আলোচনার পর ঠিক হলাে যে ঐ ছয়জন মেজর তাদের পরিবার এবং আরাে দু’চারজনকে নিয়ে বাংলাদেশ ত্যাগ করে সেই রাত্রেই ব্যাংককে চলে যাবে।
কিন্তু সেই রাত্রে ব্যাংককে যাবার কোন প্লেন বাংলাদেশে ছিলেন। ঠিক হলে যে মেজরদের দল বাংলাদেশী বিমান করে চট্টগ্রামে যাবেন। তারপর সেখান থেকে এক বিদেশী রাষ্ট্রের প্লেনে করে তাদের সবাইকে ব্যাংককে পাঠান হবে।
উত্তেজিত কণ্ঠে এনায়েতুল্লা বললেন : বাজারে গুজব আমাকেও নাকি এই দেশ ত্যাগ করে ব্যাংককে চলে যেতে হবে। সবাই বলছে যে আমি
৮২
________________________________________
হলুম খুনী-মেজরদের পরামর্শদাতা, তার প্রধান কারণ মেজর ফারুক আমাকে নিজে বাংলাদেশ টাইমস পত্রিকার সম্পাদক নিযুক্ত করেছিলেন। দেখিস মনজু যদি আমাকে যেতেই হয় তাহলে আমার ফ্যামিলির দেখা শােনা তুই করিস। | মনজু জিজ্ঞেস করলো : মুস্তাক সাহেবের কী হলাে?
কী আর হবে? উনি বর্তমানে আর বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট নন। আজ বিকেলে জাষ্টিস সায়াম প্রেসিডেন্টের শপথ গ্রহণ করেছেন। মুস্তাক আমাকে বললো। আমিও একবার ভেবেছিলুম যে ঐ মেজরদের সঙ্গে ব্যাংককে যাবো। কিন্তু মহাবুব আলম আমাকে মানা করলো।
ঢাকা সেন্ট লি জেলখানায় ঐ হত্যাকাণ্ডের বিস্তৃত খবর জানবার আমার অপরিসীম আগ্রহ। তাই জিজ্ঞেস করলুম : তাজউদ্দীনকে কে হত্যা করলাে?
এবার এনায়েতুল্লা আমাকে লক্ষ্য করলেন। এনায়েতুল। আমার দিকে তাকিয়ে বেশ জোর গলায় বললেন : সবই আপনাদের চক্রান্ত। আকাশবাণী আনন্দের সঙ্গে খালেদ মুশারফের কু দ্য আঁতাতকে অভিনন্দন জানিয়েছে। কী ব্যাপার বলুন তাে? খালেদ মুশারফ তাহলে ইণ্ডিয়ান এজেন্টে? এনায়েতুল্ল। তারপর মনজুর দিকে ঘুরে বললেন, শুনছি তাজউদ্দীনের ডেডবডি কাল সকালে তার বাড়িতে নিয়ে আসা হবে।
আমি আবার এনায়েতুল্লাকে জিগ্যেস করলুম, আপনি আমার প্রশ্নের জবাব দিলেন না। বলুন ঢাকার জেলখানার ভেতরে গিয়ে কী করে তাজউদ্দীন এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতাদের খুন করা হলাে। পৃথিবীর ইতিহাসে বন্দীদের এমন নৃশংস ভাবে হত্যা করার কাহিনীতে আমি এর আগে তখনও শুনিনি। | সেই সময়ে এনায়েতুল্লার সঙ্গে আমার হৃদ্যতা ছিলাে। তাই এনায়েতুল্লা আমার প্রশ্ন শুনে রাগ করলাে না। বরং বললাে, আপনার প্রশ্নের জবাব দেওয়া সহজ কাজ নয়। কারণ বাংলাদেশের বর্তমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে সত্যি খবর জানা একেবারেই অসম্ভব। তবে শুনেছি যে মেজরদের দল দেশ ত্যাগ করবার আগে তাজউদ্দীন এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতাদের খুন করবার নির্দেশ দিয়েছে। আর তাজউদ্দীনকে খুন করেছে ঐ মুসলিমুল্লিন।
এনায়েতুল্লা সেদিন একটি ধ্রুব সত্যি কথা বলেছিলাে। কথাটি হলো যে বাংলাদেশের ঐ রাজনৈতিক অবস্থার মধ্যে কোন খবর সত্যি না মিথ্যে যাচাই করা সম্ভব ছিলো না। পরে আমি শুনেছিলুম যে ঢাকা সেন্ট লি জেলে
________________________________________
গিয়ে তাজউদ্দীনকে এবং অন্যান্য নেতাদের খুন করবার নির্দেশ দিয়েছিলেন খােলকার মুস্তাক আহমেদ স্বয়ং। তার কারণ তাজউদ্দীনের প্রতি তার দীর্ঘ দিনের পুরনো রাগ ছিলাে। ১৯৭১ সালে কলকাতায় তাকে যে অপমান করা হয়েছিলো, সেই কথা তিনি সহজে ভুলতে পারেননি। অবশ্যি তখন বাজারে আর একটি গুজৰ ছিলাে যে ঐ মেজরদের দল ঢাকা সেন্টাল জেলের কর্তৃপক্ষকে নাকি নির্দেশ দিয়েছিলেন যে বন্দীদের যেন মুস্লিমুদ্দিনের কাছে পেশ করা হয়।
| জিয়াউর রহমানের সময় জেলখানার একট। মামুলী তদন্ত হয়। কি তদন্তের ফলাফল প্রকাশিত হয়নি।
সাংবাদিকদের কাছে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ বলেছিলেন যে খালেদ মুশারফ খােন্দকারকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে হটাতে চায়নি। কিন্তু মেজরদের চলে যাবার পর তিনি আর প্রেসিডেন্টের গদীতে বসে থাকা নিরাপদজনক বলে মনে করেন নি। শুধু তাই নয় পরে জানা গেলাে যে খালেদ মুশারফ যে ভারতীয় এজেন্ট এই মিথ্যে অপবাদ প্রচার করেছিলেন রয়টারস এবং বি-বি-সির সংবাদদাতা আতিকুল আলম। আতিকুল আলম ঢাকার বিদেশী দূতাবাসগুলােতে ঘন ঘন যাতায়াত করতেন। তিনি বিদেশী দূতাবাস এবং বিদেশ সংবাদপত্রের কাছে খবর পাঠালেন যে খালেদ মুশারফ হলেন ভারতীয় এজেন্ট। শুধু তাই নয় বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে প্রচার করা হলাে। তারপর ইত্তেফাকে সেই ছবিটি প্রকাশিত হবার বাংলা দেশের উত্তেজিত জনতা বাজারের গুজব বিশ্বাস করলাে। ৪ঠা নভেম্বরের পর থেকে বেশ দীর্ঘকাল সবাই বিশ্বাস করতেন যে খালেদ মুশারফ হলেন ভারতীয় এজেন্ট। | আতিকুল অলম এই সময়ে পশ্চিম জার্মানীর দূতাবাসে গিয়ে একটি চিঠি দেখালাে, দূতাবাসের সবাইকে বললাে যে এই চিঠি তাজউদ্দীন ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে লিখেছিলেন। চিঠিতে তাজউদ্দীন সেন সাহেবকে লিখেছিলেন যে তিনি ভারত সরকারের সাহায্য চান। শুধু তাই নয় আতিকুল আলম আরাে বললাে যে সমর সেনও তাজউদ্দীনকে চিঠি লিখেছিলেন। অবশ্যি আতিকুল আলম সমর সেনের লেখা চিঠি কখনই বিদেশী দূতাবাসের কারু কাছে কিংবা সাংবাদিক কাউকে দেখাতে পারেন নি। আর প্রথম চিঠিটি সত্যিই তাজউদ্দিন সমর সেনকে লিখেছিলেন কিনা এই অভিযােগ যাচাই করবার চেষ্টা পশ্চিম জার্মানীর দূতাবাসের কেত কখনােই করেন নি। যেন চেষ্টা করবার কোন প্রয়োজন ছিলাে না। আসলে
৮ ৪
________________________________________
ঐ হুজুগের সময় কারু মনে কোন খবর সত্যি মিথ্যে যাচাই করবার ইচ্ছে হয়নি।
তাজউদ্দীন এবং সমর সেনের মধ্যে চিঠি পত্রের আদান প্রদান হয়েছে, ঢাকার কূটনৈতিক এবং রাজনৈতিক মহলে এই কথাটি আগুনের মতো ছড়িয়ে পড়লাে। জনসাধারণ মিথ্যে মুখরােচক কাহিনী বেশী বিশ্বাস করে। সমর সেন দু একবার এই মিথ্যে গুজবের প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু কোন ফল হয়নি। বিশেষ করে ঐ সঙ্কটময় মুহুর্তে। এই প্রসঙ্গে আর একটি ঘটনা বলা দরকার।
| কিছুদিন পরে বােম্বাইয়ের একটি সাপ্তাহিক ‘Illustrated Weekly of India তে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছিল। আর ওই প্রবন্ধে অভিযােগ করা হয়েছিল যে সমর সেন তাজউদ্দীনের কাছে একটি চিঠি লিখেছিলেন। Illustrated Weekly of India-র তথন সম্পাদক ছিলেন খুশবন্ত সিং। তিনি ছিলেন সমর সেনের অতি ঘনিষ্ঠ বন্ধু। সমর সেন খুশবন্ত সিংকে স্পষ্ট জানালেন তার কাগজের প্রকাশিত প্রবন্ধে প্রচুর তথ্যমুলক ভুল আছে। আমার মনে আছে যে বেশ কিছুদিন পরে খুশবন্ত সিং এই চিঠির জবাব দিয়েছিলেন। তার জবাব সত্যিই আমাদের আরাে কৌতুহলী এবং অভিসন্ধিৎসু করে তুললো। খুশবন্ত সিং লিখেছিলেন যে সেই উল্লিখিত প্ৰবন্ধুটি কী করে তার কাগজে প্রকাশিত করা হয়েছিলাে সেটা আদৌ তিনি জানতেন না। সেন সাহেবের চিঠি পাবার পর তিনি তদন্ত করেছিলেন এবং তদন্তের ফলাফল জানতে পেরে তিনি বিস্মিত হয়েছিলেন। কারণ প্রথমত: জানা গেলাে না কী করে এই প্রবন্ধটি তার কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল। কে এই প্রবন্ধটি এবং কার নামে পাঠিয়ে ছিলেন তাও স্পষ্ট করে জানা গেলােনা। এবং যে সহকারী সম্পাদক এই প্রবন্ধটি প্রকাশিত করে ছিলেন তিনি ওই প্রবন্ধটি প্রকাশিত হবার ঠিক পরের দিন তার কাগজ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন এবং তারপর থেকেই ওই প্রবন্ধের অরিজিন্যাল কপি খুজে পাওয়া যাচ্ছে না। | খুশবন্ত সিংয়ের এই জবাবে কতােটুকু সত্যি মিথ্যে ছিলাে আমি জানিনে, তবে খুশবন্ত সিং সেন সাহেবের এতাে ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন যে তার চিঠির বক্তব্যর মধ্যে অবিশ্বাস করবার কোন কারণ ছিলাে না।
আমরা এই চিঠির জবাব পাবার পর বুঝতে পারলুম যে আতিকুল আলমের বাহিনী শুধু মাত্র বাংলা দেশেই তৎপর ছিলনা। এদের দল ডায়েরী-৬
________________________________________
“ভারতবর্ষে ও কাজ কর ছিল। Illustrated Weekly of India-র ওই প্রবন্ধটি তার একটি নিদর্শন।
আগেই আতিকুল আলমের কাজকর্মের কিছুটা আভাষ দেওয়া হয়েছে। কারণ পাঠকদের স্মরণ রাখতে হবে যে বিশ্বের সমস্ত কাগজে প্রকাশিত হয়েছিল, মুজিব হত্যার মূল কারণ হলাে ব্যক্তিগত এবং মেজর ডালিমের সঙ্গে তার ঝগড়া বিবাদ। পরে আতিকুল আলম লণ্ডনে সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছিলন যে তার প্রচারিত ১৫ই আগষ্টের পুরাে কাহিনী ছিলাে অতিরঞ্জিত এবং মিথ্যে। কারণ ঐ দিন অতাে হাঙ্গামার মধ্যে কারু মনে কোন প্রশ্ন জাগেনি। মুজিবকে ব্যক্তিগত কারণে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে বটে কিন্তু শেখ ফজলুল হক মুনি এবং সেরনিয়াবাতকে কী কারণে হত্যা করা হয়েছিলাে? মেজর ডালিম এবং আর বন্ধুদের সঙ্গে ফজলুল হক মুনির কিংবা সেরনিয়াবাতের কোন ব্যক্তিগত ঝগড়া ছিলো না। আতিকুল আলমের এই ধরণের মিথ্যে প্রচারকে স্পাইয়ের ভাষায় বলা হয় ব্ল্যাক প্রােপাগাণ্ডা। কারণ আমরা দেখতে পেয়েছি যে শুধু বিদেশী কূটনৈতিক এবং সাংবাদিক মহলেই নয় আতিকুল আলম জনসাধারণ এবং রাজনৈতিক মহলের মনকেও বিভ্রান্ত করবার চেষ্টা করেছিল। আর লােকের মনকে বিভ্রান্ত করবার প্রধান উদ্দেশ্য হলাে, ভারত বিদ্বেষী প্রচার করা। কারণ পরবর্তী কালে আতিকুল আলম লণ্ডনের সাংবাদিকদের কাছে স্বীকার করেছিলেন যে সমর সেন তাজউদ্দীনের কাছে কোন চিঠি লেখেননি। তিনি যে খবরটি প্রচার করেছিলেন সেই খবরটি ছিল সম্পূর্ণ মিথ্যা। আতিকুল আলম এই মিথ্যা কথা কেন বাজারে প্রচার করেছিলেন সেই কথা নিয়ে পরে বিচার করা যাবে।
প্রধান প্রধান আওয়ামী লীগের নেতাদের ঢাকা সেন্ট্রাল জেলখানায় হত্যা করা হয়েছে এই কথা বাজারে আগুনের মতাে ছড়িয়ে পড়লাে। প্রথমে জেলখানার হত্যা কাহিনীর কথা কেউ বিশ্বাস করতে চাইলাে না। বাজারের আর একটি গুজব রটলাে যে খালেদ মুশারফ কিংবা তার সহকর্মীরা এই খুনের কথা একেবারেই জানত না। পুরে ঢাকা সেন্ট লি জেলখানার কর্তৃপক্ষ তাদের খবর দেয়।
পরের দিন তাজউদ্দীনের বাড়ির সামনে লােকারণ্য। তাজউদ্দীনের বন্ধুরা তার বাড়িতে গেলেন। আমিও গিয়েছিলুম। পরে আনােয়ার হােসেন মনজুর
৮৬
________________________________________
কাছে শুনেছিলুম যে আমি তাজউদ্দীনের বাড়ি গিয়েছিলুম সেই কথা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তাদের দৃষ্টি এড়ায়নি। আমার ঐ বাড়ীতে উপস্থিতি নিয়ে ঢাকা শহরে বেশ আলোড়ন হয়েছিলাে। সেদিন আমি মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছিলুম এবং আজও করি যে তাজউদ্দীন সত্যিই ছিলেন বাংলাদেশে ভারতের হিতাকাঙ্খী। আর এই কথাটি তাজউদ্দীন বেঁচে থাকাকালীন আমি ফজলুল হক মুনিকে বলেছিলুম। উনি আমার কথা শুনে বেশ রেগে গিয়েছিলেন।
হঠাৎ শুনতে পেলুম ভারতীয় হাইকমিশনের কর্তারা তাজউদ্দীনের মৃতদেহের উপর ফুলের মালা দেবেন। ভারতীয় হাই কমিশনের এই ইচ্ছার কথা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তারা জানতে পারলেন। প্রথমে কথা ছিলাে মৃতদেহ একটার পময় কবর দেবার জন্যে নিয়ে যাওয়া হবে কিন্তু একটু বাদে শুনতে পেলুম আর দেরী করা হবে না। | এগারটায় কিছু বাদে তাজউদ্দীনের মৃতদেহ নিয়ে ছােট একটা প্রসেসান বেরুল, আর ঠিক তার পর মুহূর্তে হাইকমিশনের কর্তারা ফুলের মালা নিয়ে ছুটে চলে এলেন। কিন্তু ওরা পৌছুবার সঙ্গে সঙ্গে মৃতদেহের প্রসেসান অনেকদূর এগিয়ে গেছে। কবরখানার কাছে গিয়ে যখন হাইকমিশনের কর্তারা পৌছুলেন তখন তাদের স্পষ্ট বলা হলাে : এখানে ফুল দেওয়া চলবে না।
কেন ?
আপনারা বিদেশী দূতাবাস। আপনারা যদি ওর মৃতদেহে ফুলের মালা দিতে চান তবে সেই মালা পররাষ্ট্র দপ্তরে পাঠিয়ে দিন।
ব্যর্থ হয়ে হাই কমিশনের কর্তারা ফুলের মালা নিয়ে দপ্তরে ফিরে গেলেন। এই খবরটি বেশ বিদ্রুপ করে ‘ইত্তেফাক প্রকাশ করল।
তাজউদ্দীনের মৃত্যুর খবর এবং খালেদ মুশারফের উথানের কথা বাংলাদেশে উত্তেজনা, আলােড়ন এবং আতংকের সৃষ্টি করলো। পনেরই আগষ্টের পরবর্তীকাল থেকে প্রতিদিনই বাংলা দেশে এতাে উত্তেজনামূলক ঘটনা হতে যে কোন ঘটনাই বাংলাদেশীদের উত্তেজিত করতো না। খালেদ মুশারফের ক্ষমতা অধিকার করা, ছয়জন মেজরকে দেশ থেকে বের করে দেওয়া কিংবা তাজউদ্দীনের হত্যা কাণ্ড বাংলাদেশীদের উত্তেজিত করলেও খুব বেশী বিচলিত করেনি। প্রেস ক্লাবের বক্তব্য হলাে যে বাংলা দেশে সেকেণ্ড রাউও খেলা শেষ হলো। এবার তৃতীয় কিংবা ফাইনাল রাউণ্ড খেলা হবে।
আমরা সবাই এই ফাইন্যাল রাউণ্ডের জন্য প্রতীক্ষা করতে লাগলুম। আর
________________________________________
এই ফাইন্যাল রাউণ্ডের প্রধান খেলােয়াড় হলেন জিয়াউর রহমান।
আমি কোনদিনই বিশ্বাস করিনি যে খােন্দকার মুস্তাক আমেদ বেশীদিন ক্ষমতার গদীতে বসে থাকবেন। কারণ আমি ওই অদৃশ্য ব্যক্তিটির কিংবা বলা যায় থার্ড ম্যানের আগমনের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলুম। আর তৃতীয় কিংবা ফাইন্যাল রাউণ্ড খেলা হলো প্রায় চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে অর্থাৎ ৬-৭ই নভেম্বর। কিন্তু তৃতীয় রাউণ্ডের কোন কথা বলবার আগে আমাকে আবার পুরান কাসুন্দী ঘাটতে হবে।
এই পুরান কাসুন্দী হলাে বাংলা দেশের কতোগুলাে বামপন্থী রাজনৈতিক দলের কাহিনী। এদের মধ্যে সর্বপ্রধান হলো জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল। কারণ এই দলের একজন অন্যতম নেতা কর্ণেল তাহের ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের আয়ােজন করেছিলেন এবং তাহেরের প্রচেষ্টায় জিয়াউর রহমান আবার তার ক্ষমতা ফিরে পেলেন। . এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলা প্রয়ােজন। ১৫ই আগষ্টের পর থেকে জেনারেল জিয়াউর রহমান খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ এবং জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের সঙ্গে যােগাযােগ রাখছিলেন। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন কর্নেল তাহের। কারণ মুক্তি যুদ্ধের সময় কর্নেল তাহের জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বাংলা দেশে যুদ্ধ করেছিলেন। তাহেরও কোনদিন এই ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করেন নি। ওদিকে মুস্তাক আহমেদের ডান হাত মহাবুব আলম চাষীর সঙ্গেও তার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। মুজিবর রহমানের হত্যার পর জিয়াউর রহমান প্রতিদিনই কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যােগাযােগ করতেন। ৪-৫ই নভেম্বর জিয়াউর রহমান জাসদ [ জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল ] নেতার কাছে টেলিফোন করলেন। কেন টেলিফোন করেছিলেন সেই কথা পরে বলা যাবে।
এবার ৭ই নভেম্বরের কু দ্য আঁতাতের পুরাে কাহিনী বলবার আগে জাসদের পুরাে ইতিহাস বলা যাক।
দুইটি পিকিং এবং মস্কোপন্থী দল ছাড়া বাংলাদেশে এটি আর একটি বামপন্থী দল ছিলাে। ১৯৭২ সালের প্রারম্ভে এই জাসদ দলের কাহিনী সবার কাছে অজ্ঞাত ছিলাে। মুক্তি যুদ্ধের পরে জাসদের অস্তিত্বের খবর পাওয়া গেলাে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কয়েকজন ছাত্র মিলে জাসদ দল গঠন করেন।
৮৮
________________________________________
এই দলের নেতা ছিলেন সিরাজুল আলম খান।
সিরাজুল আলম খান ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান স্টুডেন্টস লীগের নেতা। পরে তিনি চীন পন্থী পুর্বপাকিস্তান ছাত্র যুনিয়নের সঙ্গে যােগ দিলেন। সিরাজুল আলম খান এবং তার বন্ধুরা ছিলেন মার্কসবাদী। এরা সবাই পাকিস্তানী পূজিবাদীদের বিরােধিতা করতেন এবং ১৯৭১ সালে সিরাজুল আলম খান এবং তার সহকর্মীরা আওয়ামী লীগে যােগদান করে পাকিস্তানের বিরােধিতা করেন। জাসদের নেতারা মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কারণ পুর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ আওয়ামী লীগের আগেই পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেছিলেন। ৭ই মার্চ শেখ মুজিবর রহমান যখন রমনার রেস কোর্সের এক ময়দানে বাংলা দেশের পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করলেন তখন জাসদের কর্মীরা শেখ মুজিবর রহমানকে পূর্ণ সমর্থন করলেন।
১৯৭০ সালে ইলেকসনের সময় জাসদ এই নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল। এই সময় থেকে জাসদের বুদ্ধিজীবিরা বাংলা দেশের প্রতি গ্রামে গ্রামে তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করতে শুরু করে, বাংলা দেশের গ্রামবাসীদের সঙ্গে জাসদের অতি ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলো। পরে দেখা যাবে যে জাসদের নেতারা পরবর্তীকালে গ্রামবাসীদের সঙ্গে তাদের এই সম্পর্ক পুরােপুরি ব্যবহার করেছিল।
১৯৭০ সালের বারােই আগস্ট পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগের সেন্ট্রাল কমিটির এক বৈঠক হয়। এই বৈঠকের এক প্রস্তাব অনুযায়ী ছাত্র লীগের নাম পরিবর্তন করে স্বাধীন সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ দল রাখা হয়। ২রা মা এক বিরাট মিছিল বার করা হয়। রমনার মাঠে সেই মিছিল শেষ হয় এবং শেখ মুজিবর রহমান এই মিছিলের জনতাকে উদ্দেশ্য করে এক ভাষণ দিয়েছিলেন। এই মিটিংএর শেষে দলের অন্যতম নেতা আবদুর রব পাকিস্তানী ফ্ল্যাগ পুড়িয়ে দেন এবং দলের পরিকল্পিত জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। পরের দিন পাটির অন্যতম নেতা সাজাহান সিরাজ স্বাধীন বাংলা দেশের ইস্তাহার পাঠ করেন এবং শেখ মুজিবের কাছে এই ইস্তাহার পেশ করা হয়। পরে শেখ মুজিবর রহমান জাতীয় সমাজতান্ত্রিক বাংলা দেশের কর্মীদের চাপে পড়ে বাংলা দেশের জন্যে পূর্ণ স্বাধীনতা দাবী করেন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে সমাজতান্ত্রিক দল অর্থাৎ বাংলা দেশ ছাত্র লীগের মধ্যে ভাঙ্গন ধরে। পরের বছর ২১শে অক্টোবর তারিখে জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল গঠন করা হয়। প্রথমে জাসদের সেন্ট্রাল কমিটির মেম্বারদের নাম ছিলাে মুর আলম জাকু,
৮৯
________________________________________
আব্দুর রব, বিধানকৃষ্ণ সেন, সাজাহান সিরাজ, সুলতানউদ্দীন আহমেদ, মেজর জলিল ইত্যাদি। এই দলের মধ্যে কর্নেল আবু তাহেরের নাম বিশেষ উল্লেখযােগ্য। কারণ ৭ই নভেম্বর বাংলা দেশে যে সিপাহী বিপ্লব হলো সেই বিপ্লবের প্রধান নেতা ছিলেন আবু তাহের। ১৯৭৪ সালে জাসদ পাটীর সংবিধান তৈরী করে। এই সংবিধান তৈরী করবার জন্যে একটি ছােট কমিটি গঠন করা হয়েছিল। কমিটির প্রধান সদস্যদের নাম ছিলো সিরাজুল আলম খান, হারুনর রশীদ এবং হাসানুল হক হনু। ১৯৭৪ সাল থেকে জাসদ তার পার্টির ইস্তাহার প্রকাশিত করতে সুরু করে। দুইটি মুখপত্রের নাম ছিলাে ‘সাম্যবাদ’ এবং ‘লড়াই। জুলাই মাস থেকে পাট একটি শাখা স্থাপন করে। এই শাখা ছিলাে পাটীর বিপ্লবী শাখা এবং এর নাম ছিলো বিপ্লবী গণ বাহিনী। এই বিপ্লবী গণ বাহিনীর নেতার নাম হলাে কর্নেল আবু তাহের।
এই প্রসঙ্গে আর একটি বামপন্থী দলের নাম করা একান্ত আবশ্যক। এই দলের নাম হলো পূর্ব পাকিস্তান সর্বহারা পাটী অর্থাৎ ইষ্টবেঙ্গল ওয়ার্কাস মুভমেন্ট কিংবা পূর্ব পাকিস্তান প্রটোরিয়ান পাটি। দলের নেতার নাম ছিলাে সিরাজ সিকদার। এরা সর্বহারা পাটি ও বামপন্থী কমুনিজমে বিশ্বাস করতেন। মুক্তি যুদ্ধের পর সিরাজ সিকদারের দল বাংলাদেশে মুজিবরের শাসনতন্ত্রের বিরুদ্ধে গরিলা যুদ্ধ শুরু করেন। দীর্ঘকাল সিরাজ সিকদার মুজিবের ইনটেলজেন্স সার্ভিস এবং পুলিশ এড়িয়ে গােপনে কাজকর্ম করছিলেন। পরে ১৯৭৫ সালে সিরাজ সিকদার পুলিশের হাত থেকে পালিয়ে যাবার সময় তাদের গুলীতে মারা যান।
এই সময়ে মিলিটারীতে কাজ করতেন কর্নেল জিয়াউদ্দীন এবং ঢাকাতে তিনি বেশ কিছুকাল ব্রিগেড কমাণ্ডার ছিলেন। হঠাৎ একদিন ঢাকা শহরে এক ইস্তাহার •বিলি করা হলো। ইস্তাহারে বলা হলো যে কর্নেল জিয়াউদ্দীন সর্বহারা পাটিতে যােগ দিয়েছিলেন। খবরটি পড়ে শেখ মুজিবর রহমান তক্ষুণি কর্নেল জিয়াউদ্দীনকে সৈন্যবাহিনী থেকে বরখাস্ত করেন।
কর্নেল জিয়াউদ্দীনের বাংলাদেশের বিভিন্ন গ্রামাঞ্চলের বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। সর্বহারা পার্টি কর্নেল জিয়াউদ্দীনের সাহায্য নিয়ে বাংলা দেশের বিভিন্ন গ্রামের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করেন। পরবর্তীকালে কর্নেল
________________________________________
জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে কর্নেল তাহেরের বিশেষ বন্ধুত্ব হয়। দুজনকে প্রায়ই একসঙ্গে দেখা যেতাে। এই কর্নেল জিয়াউদ্দিনের মাধ্যমে কর্নেল তাহের বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনীর মধ্যে প্রভাব প্রতিপত্তি বিস্তার করেন। আশ্চর্য্যর বিষয় কর্নেল তাহের ও কর্নেল জিয়াউদ্দিনের এই গােপন কাজকর্মের খবর বাংলাদেশ সৈন্য বাহিনীর ইনটেলিজেন্সের কর্তারা একেবারেই জানতেন না। | জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল (. S. D.) গণ বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন কিন্তু সিরাজ সিকদারের দল শুধু সশস্ত্র বিপ্লবে বিশ্বাস করতেন। তাহের এবং তার সহকর্মীদের ধারণা ছিলাে যে মুজিবের হাত থেকে বাংলাদেশকে রক্ষা করবার একমাত্র পাটি হলো জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল।
১৯৭৪ সালে সিরাজ সিকদার এবং সর্বহারা দল বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্তে গরিলা যুদ্ধ শুরু করে। ঠিক এই সময়ে বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ দেখা যায়। পুলিশের সঙ্গে সিরাজ সিকদারের প্রায়ই সংঘর্ষ হতাে। একদিন চট্টগ্রামের কাছে পালিয়ে যাবার সময় পুলিশের গুলীতে সিরাজ সিকদার নিহত হলেন। বাজারে গুজব রটলো ধে সিরাজ সিকদারকে পুলিশ বন্দী করে এবং পরে জেলখানায় তাকে হত্যা করা হয়েছে।
১৯৭৪ সালের পর থেকে বাংলাদেশের বামপন্থী নেতারা মুজিবর রহমান বিরােধী আন্দোলন শুরু করলাে। জাসদ এই সময়ে সৈন্য বাহিনীতে তাদের জাল বিস্তার করতে লাগলাে। বিশেষ করে বাজারের জিনিষপত্রের দাম বাড়বার সঙ্গে সঙ্গে সিপাইদের মধ্যে প্রচার করা হলাে যে সব জিনিষই ভারতবর্ষে স্মাগল করা হচ্ছে। আর এই প্রচারের প্রধান নেতা ছিলেন কর্নেল তাহের। কারণ জাসদের অন্যতম দুই নেতা রব এবং জলীল কারাগারে অবরুদ্ধ। সিরাজুল আলম খান গা ঢাকা দিয়েছেন। কেউ জানে না তিনি কোথায় ? জাসদের মুখপত্র ‘গণকণ্ঠ’ নীরব রয়েছে। শেখ মুজিবর কিছুদিন পরে বাংলাদেশের সংবিধান বাতিল করলেন। আওয়ামী লীগের পরিবর্তে বাকশাল হলো। জাসদ এবার থেকে শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে সংগ্রাম সুরু করলেন। কারণ জাসদের সদস্যরা বলতে সুরু করলেন যে আওয়ামী লীগের অধিকাংশ সদস্যই স্মাগলার। শেখ মুজিবর রহমান এদের বিরুদ্ধে কোন কঠোর নীতি অবলম্বন করছেন না।
আর শুধু তাই নয়। জাসদ এবং বামপন্থী দলের বলতে সুরু করলাে যে বাংলাদেশে এই দুর্মূল্য এবং মূল্যবৃদ্ধির পেছনে রয়েছে বিদেশী সাহায্য এবং বিদেশ থেকে ঋণ গ্রহণ করা। এ ব্যাপার নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা
________________________________________
আগেই করা হয়েছে। শেখ মুজিবর রহমান এবার জাসদকে বেআইনী রাজনৈতিক দল বলে ঘােষণা করলেন। যদিও জাসদের নেতারা লুকিয়ে কাজ করতে লাগলাে তবু কর্নেল তাহের প্রকাশ্যেই গণ বিপ্লব বাহিনীর তকমা পড়ে সৈন্যদের মধ্যে পাটির কাজ শুরু করলেন। কর্নেল তাহের যে এক বিদ্রোহী সেনাদল গঠন করছেন এই কথা কেউ জানতে পারেন নি।
২৫ শে মার্চ ১৯৭১ সালে তাহের পশ্চিম পাকিস্তানে স্পেশাল সার্ভিস গ্রপের কাজ করতেন। তাহের কোনদিন ভাষায় কিংবা আচার ব্যবহারে সংযমী ছিলেন না। বাংলাদেশে পাকিস্তান বাহিনী হানা দেবার পর তাহের কে অবাধ্যতার এবং অসংযমী ভাষা ব্যবহারের জন্যে গ্রেপ্তার করা হলাে। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীতে তাহেরের একজন হিতৈষী ছিলেন। সেই যাত্রায় ঐ বন্ধুর কৃপায় তাহের রক্ষা পেলেন। আবু তাহেরকে ফারিয়ার ক্যান্টনমেন্ট বদলী করা হলাে।
কিছুদিন পরে তাহের এবং তার একজন বন্ধু মুহম্মদ জিয়াউদ্দিন ঠক করলেন যে তারা পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়ে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে যােগ দেবেন। তাহের তার সঞ্চিত টাকা থেকে একটি গাড়ি কিনেছিলেন। তাহের, জিয়াউদ্দিন এবং মনজুর আহমেদ পালিয়ে দিল্লীতে পৌছুলেন। সেখান থেকে সােজা মুক্তি যুদ্ধের শিবিরে গেলেন।
বাংলা দেশের সৈন্য বাহিনীর তখন প্রধান নেতা ছিলেন জেনারেল ওসমানী। তিনি তাহেরকে টাঙ্গাইল ময়মনসিংহ অঞ্চলে যুদ্ধ করতে পাঠালেন। কিন্তু তাহের মনে প্রাণে জেনারেল ওসমানীকে কোন দিনই পছন্দ করতেন না। কিছুদিন পরে তাহের এবং জেনারেল ওসমানীর মধ্যে ঝগড়া বিবাদ শুরু হলাে। ঝগড়া বিবাদের প্রধান কারণ হলাে যুদ্ধের প্ল্যানিং এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে।
সৈন্যবাহিনীতে চিরকালই তাহেরের অবাধ্য এবং দুগ্মথ বলে দুর্ণাম ছিলাে। তাহের গিয়ে জেনারেল ওসমানীকে বললেন যে বাংলা দেশের ভিতরে ঢুকে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে গেরিলা যুদ্ধ করাই হবে বুদ্ধিমানের কাজ। তাহেরকে সমর্থন করলেন মেজর জিয়াউদ্দিন। অবশি বাংলাদেশের জনসাধারণ বিশেষ করে আওয়ামী লীগের সমর্থকেরা গেরিলা যুদ্ধে আগে থেকেই লিপ্ত ছিলেন। তাই ঠিক হলো যে সৈন্যবাহিনী গেরিলা যুদ্ধ না করে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে খােলাখুলি যুদ্ধ করবে। কাদের সিদ্দিকী এবং বাংলাদেশের কম্যুনিষ্ট বাহিনীর নেতা আব্দ ল মতিন গেরিলা যুদ্ধের
________________________________________
জন্যে মুক্তিবাহিনী গঠন করলেন। বাধ্য হয়ে সেই যাত্রায় তাহেরকে জেনারেল ওসমানীর নির্দেশ শুনতে হলাে। সেই সময় তিনি কোন গরিলা বাহিনী গঠন করতে পারলেন না। ৭ই নভেম্বর কু দ্য আঁতাত এবং সিপাহী বিদ্রোহের সময় আবু তাহের আবার জেনারেল ওসমানী এবং অন্যান্য নেতাদের নির্দেশ অমান্য করেছিলেন।
তাহের ১৯৭১ সালে গরিলা যুদ্ধের পরিকল্পনা করে তার সহকর্মীদের বলেছিলেন যে সিপাহী-সৈনবাহিনীরা শুধু সাধারণ অশিক্ষিত সৈন্যদের মতাে কাজকর্ম করবে না। তাদের কাজ হবে সাধারণ শ্রমিক এবং চাষীদের মতো। তীর ধনুক এবং অন্যান্য যন্ত্র দিয়ে তারা গরিলা যুদ্ধ করবে। ৭ই নভেম্বরের বিপ্লবে তাহের শুধু সৈন্যবাহিনীদের উপর নির্ভর করেনি। দেশের অতি সাধারণ নাগরিক, শ্রমিক ও কৃষিজীবিদেরও ব্যবহার করেছিলেন। আর তাহেরের বক্তব্য ছিলাে সৈন্যবাহিনীদের রাজনৈতিক শিক্ষা দেওয়া একান্ত আবশ্যক। অশিক্ষিত সৈন্যবাহিনী দিয়ে কোন প্রকারের গরিলা যুদ্ধ করা যায় না। ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লবের সময় প্রতিটি সৈন্যদের মুখে আমরা ভারত বিরােধী শ্লোগান শুনেছিলুম।
এবার ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিপ্লব কিংবা যে বিপ্লবের সাহায্য নিয়ে। জেনারেল জিয়াউর শুধু তার জীবন রক্ষা নয় দেশের ক্ষমতার গদীতে আসীন হলেন সেই কথায় আসা যাক।
৬ই নভেম্বর ঢাকা শহরের আবহাওয়া ছিলাে থমথমে।
সবার মুখে শুধু এক কথা শােনা যায়। ভারতীয় এজেন্ট খালেদ মােশারফের শাসনকাল ক’দিন টিকবে আর। ঐ কথার সঙ্গে সঙ্গে আর একটি প্রবল গুজব শোনা গেলো, খালেদ মুশারফের বিরােধী একদল সৈন্যবাহিনী আর একটি বিপ্লবের আয়ােজন-বন্দোবস্ত করছে।
কারণ ইতিমধ্যে জেনারেল ওসমানী কর্নেল তাহেরের সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন।
ওসমানী খােন্দকারের শাসনকালীন সময়ে খােন্দকারের সামরিক পরামর্শদাতা ছিলেন। তাকে পরামর্শদাতা কবুবার প্রধান কারণ ছিলো যে ওসমানী ছিলেন মুজিবের বিরোধী এবং শুধু তাই নয় তার নীতির বিরোধিতা করে জাতীয় সংসদ থেকে তিনি ইস্তফাও দিয়েছিলেন। ওই সময়ে [ মুজিব মারা
________________________________________
যাবার আগে ] আমি জেনারেল ওসমানীর সঙ্গে দুবার দেখা করেছিলুম। তার সঙ্গে দেখা করবার প্রধান কারণ ছিলো যে ওসমানী ছিলেন আমাদের পারিবারিক বন্ধু। ওসমানী আমার কাছে স্পষ্ট বলেছিলেন যে মুজিবের এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের অনাচার বেশী দিন চলবেনা। তিনি তার আত্মজীবনী লিখছিলেন। ওই আত্মজীবনীর খানিকটা অংশ আমাকে পড়ে শুনিয়েছিলেন।
বাজারে জনশ্রুতি ছিলো যে ওসমানীর মাথায় একটু ছিট আছে। অবশ্যি দুবার সাক্ষাতের পর তার তথাকথিত পাগলামির কোন লক্ষণ ‘আমি দেখিনি।
খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ প্রেসিডেন্ট হবার পর তিনি জেনারেল ওসমানীকে তার সামরিক পরামর্শদাতার কাজে নিযুক্ত করলেন। অবশি। তার আসল কাজটি কী গােপন রাখা হলো।
পরে কয়েকজন বন্ধু বান্ধবের কাছে শুনেছিলুম যে জেনারেল জিয়াউর রহমান কিংবা তার সহকর্মীরা আদৌ জেনারেল ওসমানীকে দুচোখে দেখতে পারতেন না।
সামরিক পরামর্শদাতা হিসাবে ওসমানীর বিশেষ কোন কাজ ছিলােনা। তিনি এবার তাহেরের সঙ্গে যােগাযােগ করলেন। তাহেরকে সঙ্গে নিয়ে ওসমানী বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণে গেলেন। আলােচনা প্রসঙ্গে ওসমানী তাহেরকে রাজনৈতিক এক নতুন দল গঠন করতে বললেন এবং জিয়াউদ্দিনের সঙ্গে দেখা করবার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। এই সময়ে জিয়াউদ্দিন ছিলেন ফেরারী আসামী। কারণ মুজিব সরকার জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রাণদণ্ডের শাস্তি দিয়েছিলেন। অবশ্যি জিয়াউদ্দিন তাহেরের সঙ্গে গােপনে যোগাযােগ রাখতেন। অতএব তাহের জবাব দিলেন যে জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রাণদণ্ডের যে আদেশ দেওয়া হয়েছে সেই আদেশ মকুব না কর। পর্যন্ত জিয়াউদ্দিন প্রকাশ্যে কারু সঙ্গে দেখা করতে পারেননা।
কিছুদিন পরে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ মেজর ফারুককে তাহেরের কাছে পাঠালেন। ফারুকের তাহেরের সঙ্গে দেখা করবার প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো যে তাহের এবং জিয়াউদ্দিন যেন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন। এই দল গঠন করবার জন্যে যে টাকার দরকার হবে সেই টাকা দেবার প্রতিশ্রুতি তাহেরকে দেওয়া হলো।
এই প্রস্তাব করবার কারণ হলো যে খোন্দকার মুস্তাক আহমেদের
৯৪
________________________________________
কোন রাজনৈতিক দলের সমর্থন ছিলেন। তিনি এবং মইনুল হোসেন একটি রাজনৈতিক দল গঠন করবার পরিকল্পনা করছিলেন। কারণ মইনুল হােসেন ইতিমধ্যে প্রাক্তন তথ্যমন্ত্রী মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে এই দল গঠনের ব্যাপার নিয়ে আলাপ আলোচনা করেছিলেন।
মিজানুর রহমান চৌধুরীর আওয়ামী লীগের মধ্যে অনেক সমর্থক ছিলাে। তার হাতে কিছু ক্ষমতাও ছিলো। তথ্যমন্ত্রী থাকবার সময় জনৈকা অভিনেত্রীর সঙ্গে তার নাম জড়িয়ে বাজারে একটি গুজব রটেছিলো। শেখ সাহেব বাজারের জনশ্রুতি সম্বন্ধে মিজানুর রহমানকে প্রশ্ন করেন কিন্তু। মিজানুর রহমান তার বিরুদ্ধে যে সব অভিযোেগ করা হয়েছিলো সেগুলাে অস্বীকার করেন। শেখ সাহেব মিজানুর রহমানের জবাবে সন্তুষ্ট হতে পারেন। নি। মিজানুর সেই মূহুর্তে মন্ত্রীত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করে গণভবন থেকে হেঁটে বাড়ীতে ফিরে এসেছিলেন। কোনাে সরকারী গাড়ী ব্যবহার করেননি। মিজানুর রহমানের সবচাইতে বড় গুণ ছিলো সতত। মনে প্রাণে তিনি ভারতবর্ষকে ভালােবাসতেন।
আমার সঙ্গে মিজানুর রহমান চৌধুরীর খুবই বন্ধুত্ব ছিলাে। বন্ধুত্বের প্রধান কারণ ছিলো যে আমি বাল্যকালে দীর্ঘকাল চাঁদপুর শহরে থাকতুম। কারণ ওই শহরে আমার জন্ম হয়েছিলাে। মিজানুর চাদপুর শহরের বাসিন্দা। এবং অতীতে আমাদের বাড়ী মিজানুর রহমানের বাড়ীর সন্নিকটে ছিলো।
ঢাকাতে এসেই আমি মিজানুর রহমানের সঙ্গে দেখা করি। মিজানুর আমাকে প্রায়ই নেমন্তন্ন করে খাওয়াতো। আর খাবার সময় শেখ সাহেবের দরবারের চুটকি গল্প করতাে। কারণ যদিও মিজানুর রহমান শেখ সাহেবের কাছে যেতেন না তবু তার সমর্থকেরা মিজানুরকে এসে ঐসব গল্প বলতেন। | শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পরও আমি দু তিননার মিজানুর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে দেখা করেছিলুম। মিজানুর ওই সময়ে তার জীবন সম্বন্ধে একটু আতংকিত ছিলেন। কারণ বাজারে গুজব ছিলো যে ওই ছয়জন মের আওয়ামী লীগের নেতাদের আটক করে রাখবেন। এই সময়ে হঠাৎ একদিন মইনুল হােসেন মিজানুর রহমানের সঙ্গে যোগাযােগ স্থাপন করলেন। মইনুলের বক্তব্য ছিলাে যে আওয়ামী লীগের যে সব নেতারা শেখ মুজিবর রহমানের বিরােধী ছিলেন তাদের নিয়ে একটি নতুন দল গঠন করা হােক। আর এই নতুন দলের নীতি হবে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে সমর্থন করা। অবশ্যি মিজানুর রহমান মইনুলের প্রস্তাবে সায় দেননি। তার প্রধান কারণ ছিলো
১৫
________________________________________
যে মিজানুর রহমান শেখ মুজিবর রহমানের হত্যাকাণ্ডকে স্বীকার করে নিতে পারেন নি।
খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ শুধু মইনুলের মারফৎ মিজানুর রহমানের সঙ্গেই নয় বরং সৈন্যদের মাধ্যমে কর্নেল তাহেরের শরণাপন্ন হলেন। কর্ণেল তাহের এবং জিয়াউদ্দিনকে একটি নতুন দল গঠন করতে নির্দেশ দেওয়া হল।
কিন্তু এখানেও খোন্দকার মুস্তাক আহমেদকে বেশ নিরাশ হতে হলাে। কারণ ১৫ই আগষ্টের পর খোন্দকার মুস্তাক আহমেদকে যখন বাংলা দেশের নতুন রাষ্ট্রপতি বলে ঘােষণা করা হলো তখন জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের নেতারা কিংবা আবু তাহের খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে সহজে গ্রহণ করতে পারেন নি। অস্বীকার করবার প্রধান কারণ হলো খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ ছিলেন ডানপন্থী এবং জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল এবং আবু তাহের প্রকাশ্যে নিজেদের বামপন্থী বলে পরিচয় দিতেন। আদৌ বামপন্থী ছিলেন কিনা সেইটে হলো আলােচ্যের বিষয়। তাহের মূলতঃ ছিলেন ভারতবিরােধী এবং অবাধ্য সংযমী সৈনিক। মুক্তি যুদ্ধের সময় তিনি একটি পা হারিয়েছিলেন। এবং তিনি কাঠের পা নিয়ে চলাফেরা করতেন।
খালেদ মুশারফ জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে রেখেছেন এই কথা জানতে তাহের বেশীক্ষণ সময় নিলাে না। ৩রা নভেম্বর বিকেল চারটের সময় জেনারেল জিয়াউর রহমান তাহেরকে টেলিফোন করে তার দুরবস্থার কথা জানালেন। | আগেই বলা হয়েছে যে জেনারেল জিয়াউর রহমান দুই নৌকায় পা দিয়ে চলেতেন। একটি নৌকো ছিলাে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের, দ্বিতীয় নৌকো ছিলাে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল কিংবা বলতে পারি জাসদের। হয়তো জিয়াউর রহমান আগে থেকেই এই রকম একটি ঘটনার অনুমান করেছিলেন। তাছাড়া এই সময়ে জিয়াউর রহমান কখনও ভারতবিরােধী কথাও বলেননি। আরাে সহজে বলতে পারি সব নৌকোর মাঝি ছিলেন জিয়াউর। তিনি এ ব্যাপারে বেশ বিচক্ষণ ও চতুর ছিলেন।
জিয়াউর রহমান কর্ণেল তাহেরের কাছে সাহায্য প্রার্থনা করলেন। তিনি তাহেরকে বললেন যে তার সহকর্মী খালেদ মুশারফ প্রেসিডেন্ট খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে সরাবার চক্রান্ত করেছেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান বেশীক্ষণ তাহেরের সঙ্গে কথা বলতে পারেন নি। কারণ কিছুক্ষণ কথা বলবার পর টেলিফোনের লাইন কেটে যায়।
এই খবর শুনে কর্নেল তাহের বেশ তৎপর হলেন। কারণ ইতিমধ্যে
ఎ
&
________________________________________
আতিকুল আলমের প্রচারিত মিথ্যে সংবাদটি যে খালেদ মুশারফ হলেন ভারতীয় এজেণ্ট এবং তিনি ভারতের চক্রান্তে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে সরিয়ে ভারতের কোন অনুগত লোককে দেশের গদীতে বসাবার চেষ্টা করছেন, এই মিথ্যে গুজবটি দেশের শহরে-গ্রামে ছড়িয়ে পড়েছিলাে। সবার মুখে একই কথা
—ওই ভারত এলো আবার বাংলাদেশে। | কর্ণেল এবার তার অনুগত সিপাহীদের সঙ্গে যােগাযোগ স্থাপন করলেন। এই কথা দেশের সৈন্যবাহিনী ইনটেলজেন্স জানতে না পারলেও ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলীজেন্সের কর্তারা জানতেন। কারণ জিয়াউর রহমানকে বাংলা দেশের গদীতে বসান হবে এই কথা তাদের কাছে অজানা ছিলাে না। কিন্তু এই সময়ে খালেদ মুশারফকে ভারতীয় এজেন্ট বলে দেশের মধ্যে ভারত বিরােধী এক আবহাওয়া সৃষ্টি করার প্রয়োজনীয়তা ছিলো। এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা মনে রাখা দরকার। জাসদ এবং কর্ণেল তাহের কিছুটা চীনপন্থী ছিলেন। আর যারা চীনপন্থী ছিলেন তারা সবাই আমেরিকা এবং পাকিস্তানী পন্থী। কারণ ওই সময়ে যারা নিজেদের চীন পন্থী বলে পরিচয় দিয়েছিলেন পরবর্তীকালে দেখা গেলো তারা আসলে ভারত বিরােধী এবং আমেরিকার বিশেষ বন্ধু। উদাহরণ এনায়েতুল্লা খান।
কর্নেল তাহের সৈন্য বাহিনীর নেতাদের এক বক্তৃতায় আসন্ন সংগ্রামের জন্যে প্রস্তুত থাকতে বললেন। জাতির বিপদের সময় প্রয়োজন হলে তাদের প্রাণ বিসর্জন দিতে হবে। তিনি কয়েক জন বড়ো বড়াে সামরিক কর্মচারীদের কাজকর্মের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। আর এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি কথা বলা যায় যে চার তারিখ ভােরবেলায় এক মিলিটারী প্যারেডে নৌবাহিনীর এমএইচ খান এবং এয়ার ফোর্সের কর্তা এম-জী তােয়াব খালেদ মুশারফের বুকে মেডেল ঝুলিয়ে দিয়েছিলেন। আর সেই ছবিটি দেশের বিভিন্ন সংবাদপত্রে। বেশ ফলাও করে ছাপা হয়েছিলো।
তাহের সৈন্য বাহিনীর নেতাদের বললেন যে সামরিক উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা স্বার্থান্বেষী এবং লােভী। তিনি এম-এইচ খান এবং এম জী তোয়াবের কথা উল্লেখ করে এদের প্রচুর নিন্দা করলেন। তার বক্তব্য ছিলাে যে খালেদ মুশারফ জেনারেল জিয়াউর রহমানকে বন্দী করে রেখেছেন। এম-এইচ খান এবং তােয়াব কেন জিয়াউর রহমানকে কারাগার থেকে উদ্ধার করেননি, তার প্রধান কারণ তারা ছিলেন ভীত সন্ত্রস্ত।
ইতিমধ্যে লােক মারফৎ আরেকবার জেনারেল জিয়াউর রহমান তাহেরের
১৭
________________________________________
কাছে খবর পাঠালেন যদি তাকে অবিলম্বে উদ্ধার না করা হয় তাহলে তার জীবন বিপন্ন হবে। কারণ ঢাকা সেন্টাল জেলখানায় আওয়ামী লীগের নেতাদের হত্যাকাণ্ডের পর তিনি তার জীবন সম্বন্ধে বেশ আতংকিত হয়ে। পড়েছেন।
তাহের আবার সৈন্য বাহিনীর নন কমিশনড এবং জুনিয়র কমিশনড অফিসারদের কাছে অনুরােধ করলেন যে অবিলম্বে খালেদ মােশারফের চক্রান্তকে ব্যর্থ করে দেওয়া হােক। আর এই চক্রান্ত যদি ব্যর্থ না করা হয় তাহলে ভারতবর্ষের স্বার্থ আবার কায়েমী হয়ে বাংলাদেশের বুকে জাকিয়ে বসবে।
এই সময়ে তাহের তার প্রাক্তন পরিকল্পনা গরিলা যুদ্ধের কথা বললেন। দীর্ঘ তিন বছর ধরে তিনি এইভাবে বাংলাদেশের সৈন্যবাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক কাজ করে এসেছেন এবং তাদের নীতি এবং উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা করেছেন। বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনীকে তিনি চীনের পিপলস লিবারেশন – আমির ধাঁচে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। আজ তাদের প্রমাণ করতে হবে যে ঐ শিক্ষা সার্থক হয়েছে।
ঠিক হলো ছয় নভেম্বর রাত্রি বারােটার সময় বাংলাদেশে সিপাহী বিপ্লব কিংবা বলা যায় আর একটি কু দ্য আঁতাতের আয়ােজন করতে হবে। এই কু দ্য আঁতাতের প্রথম কাজ হবে খালেদ মুশারফকে ক্ষমতা থেকে সরানাে। দ্বিতীয় কাজ হবে জিয়াউর রহমান এবং ব্রিগেডিয়ার মীর শউকংকে কারাগার থেকে মুক্ত করা। তিন নম্বর কাজ হবে একটি বিভলুশনারী মিলিটারী কম্যাও কাউন্সিল গঠন করা। চার, রাজবন্দীদের মুক্তি দেওয়া। পাঁচ, সমস্ত রাজনৈতিক দল নিয়ে একটি সর্বদলীয় মন্ত্রীসভা গঠন করা এবং ছ’নম্বর কাজ হবে জাসদের বারাে পয়েন্ট দাবীকে গ্রহণ করা।
ছয় তারিখে শহরে এতে উত্তেজনা ছিলাে যে কোথায় কী ঘটছে সহজে জানা সম্ভব ছিলো না। তবে আমরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছিলুম যে ভারত বিরােধী প্রচার কাজ বেশ প্রবল হয়েছে। তখন এনায়েতুল্লার প্রেস ক্লাবে শুধু একটি কথা শােনা যেতাে : খালেদ মুশারফ হলেন মীরজাফর। তিনি বাংলাদেশকে ভারতের কাছে বিক্রী করেছেন। তাকে সমর্থন করে আকাশবাণী অভিনন্দন (?) জানিয়েছে। আর একটি মুখরোচক কাহিনী হলো ইত্তেফাকে প্রকাশিত সেই ছবি আওয়ামী লীগের নেতারা, খালেদ মুশারফের মা এবং ভাইয়ের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে যাচ্ছেন।
৯৮
________________________________________
গুজবে মানুষ বিভ্রান্ত হয় কিন্তু ক্লান্ত হয় না। তাজউদ্দীনের কাছে সমর সেন যে কল্পিত চিঠি লিখেছিলেন সেই চিঠি নিয়ে প্রেস ক্লাবের সাংবাদিকদের মধ্যে তুমুল বাকবিতণ্ডা হলো। কিন্তু আসল সত্যিকারের ঘটনা কিংবা কেউ ঐ লিখিত চিঠি দেখেছে কিনা বলতে পারলাে না। ঢাকা প্রেস ক্লাবে আমি যতো ভারত বিরােধী গালমন্দ শুনেছি সমস্ত জীবনে আমি তার সিকি অংশ ভারত বিরােধী প্রচার শুনিনি। এই প্রসঙ্গে আর একজন সাংবাদিকের নাম উল্লেখ করা প্রয়ােজন বলে মনে করি। ভদ্রলােকের নাম ফৈয়জ আহমেদ যার কণ্ঠে সদা সর্বদাই ভারতের নিন্দে শুনতুম ।
বিকেল ছটা নাগাদ এক বাংলাদেশী প্রৌঢ় সাংবাদিকের বাড়িতে গেলুম। ১৫ই আগষ্টের আগে প্রতিদিনই ঐ ভদ্রলােকের বাড়িতে গিয়ে আড্ডা দিতুম। তারপর আর কোনদিন ঐ বাড়িতে আমার যাওয়া হয়নি। ভদ্রলােক আমাকে প্রথমে দেখে খুশী হননি। মুখের ভাব দেখে বুঝতে পারলুম যে আমার আগমনে উনি অসন্তুষ্ট। তার জবাবে বেশ খানিকটা অপ্রস্তুতির ভাব কিছুটা বিরক্তির রেশ ছিলো। অথচ এর আগে যখনই ওর বাড়িতে গিয়েছি তখনই উনি এক গাল হাসি মুখ নিয়ে অভ্যর্থনা করতেন। বুঝতে পারলুম যে বাংলাদেশে রাজনৈতিক পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মনেরও পরিবর্তন হয়ে থাকে।
আপনি! ভদ্রলােকের কণ্ঠস্বরে এমন একটা স্বরের অভাব ছিলাে যে তিনি যেন কোন মানুষ দেখেননি, ভুত দেখেছেন। আজকে এলেন !
কেন ? অনেকদিন আপনাদের পাড়ায় আসিনি। এদিকে এসেছিলুম তাই একবার আপনাদের বাড়িতে ঘুরে গেলুম।
ভদ্রলোক তার প্রথম বিস্ময়ের ধাক্কা কাটিয়ে এবার বেশ স্পষ্ট গলায় ছোট জবাব দিলেন। বললেন : না এলেই পারতেন। আজকাল যা দিনকাল পড়েছে। কখন কী ঘটে যায় বলা যায় না…
তারপর একটু চুপ করে থেকে বললেন : আজকের খবর নিশ্চয় শুনেছেন। শহর গরম হয়ে আছে। সবাই উত্তেজিত। বলছে আপনারা খালেদের সাহায্য নিয়ে আবার বাংলাদেশে ফিরে আসবার চেষ্টা করেছেন।
আমার জবাব দেবার পালা। ইতিমধ্যে ভদ্রলােকের কণ্ঠস্বর শুনে বুঝতে পারলুম যে তিনি উত্তেজনা বিস্ময়ের রেশ কাটিয়ে উঠেছেন। দেখুন ঢাকা শহর আর ঢাকা নেই। এখন এই শহর হলো গুজবের শহর। তার পর একবার যদি প্রেস ক্লাবে গিয়ে বসেন তাহলে আপনাকে স্বীকার করতেই
________________________________________
হবে যে জার্মান প্রচার বিশারদ ডাঃ গোয়েবলস এখনও জীবিত আছেন।
এবার ভদ্রলােকের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলো। তিনি বেশ শান্ত গলায় বললেন : এনায়েতুল্লার তিন নম্বর দপ্তরের কথা বলছেন তাে?
তিন নম্বর দপ্তর ! আমার এই ছােট প্রশ্নে ছিলাে বিস্ময়ও খানিকটা উত্তেজনা!
| হ্যা, প্রথম দপ্তর হলাে হলিডে। ঐ কাগজের মালিক হলেন ওর বউ, কিন্তু আসল পরিচালক হলেন কোন এক বিদেশী রাষ্ট্র। বুঝিনে শেখ সাহেব কেন ওকে ছেড়ে দিলেন। লােকটা তো আসলে কেউটে সাপ। একবার না একবার ছােবল দেবেই। শুনেছি ভুট্টো সাহেবের সঙ্গে ওর বেশ হৃদ্যতা আছে। দুই নম্বর দপ্তর হলাে বাংলাদেশ টাইমস। সরকারী কাগজ কিন্তু ঐ ছয়জন মেজর ওকে ঐ কাগজের গদীতে বসিয়েছে। ওর লেখনীর উপর লাগাম চাপবার কেউ নেই। আর ঐ তিন নম্বর দপ্তর হলো প্রেস ক্লাব। কাগজে যা লিখতে পারে না কিংবা যে সব লাইবেলাস কথা ছাপা যায় না সেগুলাে ঐ প্রেস ক্লাবে গিয়ে বলে। সবার কাছে ওর বক্তব্য ওর বন্ধ হলাে চীনিরা। কিন্তু আসলে ওকে চেনেনা কে বলুন ? ওর বড়ো ভাই, আমেরিকায় থাকে। ব্যবসা করে প্রচুর পয়সা করেছে ••• যাক যতােদিন এনায়েতুল্লা বাংলাদেশে থাকবে ততােদিন এই দেশে কোন শক্তি থাকবে না।
আমাদের কথাবার্তায় বাধা পড়লাে। কে জানি দরজায় কড়া নাড়া দিচ্ছে। কে এসেছে ? প্রথমে ভদ্রলােক একটু হকচকিয়ে গেলেন। তারপর নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন : আপনি পাশের ঘরে চলে যান। দেখি কে এসেছে? বুঝতেই তাে পারছেন যে আজকের দিনে কেউ যদি আপনাকে এই বাড়িতে দেখে ফেলে তবে আমার বিপদ হতে পারে। বুঝলেন মশায় বেশ খারাপ দিনকাল পড়েছে।
আমি পাশের ঘরে সঢ় করে ঢুকে পড়লুম। আমার ঘর থেকে বৈঠকখানার সব আলাপ আলােচনাই শােনা যায়।
আমার পাশের ঘরে ঢুকতে একটু দেরী হয়েছিল। কারণ আমি পাশের ঘরে যাবার আগে এক ভদ্রমহিলা বাড়িতে ঢুকে পড়লেন। হয়তো দূর থেকে আমাকে দেখতে পেলেন। তারপর আমার গৃহ স্বামীকে উদ্দেশ্য করে বললেন, মনে হচ্ছে [ আমার নাম করে ) উনি তােমাদের বাড়িতে এসেছেন। কী ব্যাপার ?
________________________________________
আমার বন্ধু এই প্রশ্ন শুনে একটুও হকচকিয়ে গেলেন না। কারণ এই ধরনের প্রশ্ন তার কাছে অপ্রত্যাশিত ছিলেন। তিনি বললেন আপনি যাকে দেখেছেন উনি সেই বন্ধু নন। আমার ছেলের বন্ধু•••তারপর জিজ্ঞেস করলেন : কী ব্যাপার বলুন তাে। হঠাৎ এই সন্ধ্যায় আর এমনি দিনে আপনি আমাদের বাড়িতে আসবেন একথা আমি কল্পনাও করিনি। যা দিনকাল পড়েছে। বাড়ি থেকে বেরুতে ভয় লাগে না?
ভদ্রমহিলাকে আমি বেশ ভালাে করেই জানতুম। ১৫ই আগষ্টের আগে এর সঙ্গে আমার প্রায়ই দেখা হতাে। উনিও আমার বাড়িতে দুচারবার এসেছেন। ভদ্রমহিলার দেহে সৌন্দৰ্য্য না থাকলে ও বিশিষ্ট মহলে তার বিশেষ প্রতিপত্তি ছিলাে।
ঠিক বলেছ। আমি তাে পারলে বাড়ি থেকে বেরোতমনা। তবে আজকে এমন একটা গুজব শুনলুম যে তােমার কাছে না এসে পারলুম না।
আমি পাশের ঘর থেকে ওদের দুজনের বাক্যালাপ স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিলুম। আর আমি এই খবর ও জানতুম যে ঐ ভদ্রমহিলা ও আমার মতো গুজবে বিশ্বাস করেননি। উনি আজ যে কথাকে সাধারণ বাজারের গুজব বলে চালাচ্ছেন সেই কথা নিছক গুজব নয়, এর মধ্যে অনেকটা সত্যি খবরও আছে।
শুনি কী গুজব শুনেছেন? আমার বন্ধুটি তার কৌতুহল প্রকাশ করলেন।
চারদিকে সবাই বলছে খালেদ মুশারফ নাকি ভারতীয় এজেন্ট। আমি খালেদকে চিনি, লোকটা যদি ভারতীয় এজেন্ট হয় তাহলে আমাকে বলতে হবে এনায়েতুল্লাও ভারতীয় এজেন্ট। তবু কেন খালেদ মুশারফকে ভারতীয় এজেন্ট বলা হচ্ছে বুঝতে পারছিনে। আমার মনে হয় এই গুজবের পেছনে একটা বিরাট ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত আছে।
আপনি যে জেমস বণ্ডের খ্রীলারের গল্প বলছেন। এই ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কথা শুনেছেন নাকি?—আমার বন্ধু জিজ্ঞেস করলেন।
শােন, মুজিব হত্যার কাহিনী হলো বাংলাদেশের রাজনৈতিক অভিনয়ের প্রথম অঙ্ক। দ্বিতীয় অঙ্ক হলে খালেদ মুশারফের অভুখান। তৃতীয় তৈরী হলো ঢাকার সেন্ট লি জেলে। এবার প্রথম দৃশ্যের লাষ্ট সীন দেখান হবে।
সীনটা কী? বন্ধু জানবার আগ্রহ প্রকাশ করলেন।
এবার মহিলার গলার স্বর মিহি হয়ে এলাে। মিহি বলা ভুল হবে কণ্ঠস্বর খুবই নীচু করে বললেন : জাসদ পাটির নাম শুনেছ ?
________________________________________
হ্যা, জাতীয় সমাজতন্ত্রী দল। নেতারা প্রায় সবাই জেলে আছেন।
শুধু এদের মধ্যে কর্নেল তাহের জেলখানার বাইরে। মুক্তি যুদ্ধের সময় তাহের সবাইকে জ্বালিয়েছে। যাক শুনছি এবার এই শেষ সীনে কর্নেল তাহেরকে দেখা যাবে। আজ বিকেলে সৈন্য বাহিনীর একদল তাহেরের নারায়ণগঞ্জের বাড়ীতে গিয়ে দেখা করেছে। আসল আলােচনা কী হয়েছে জানিনে তবে পরে আমার এক সামরিক বন্ধুর কাছে শুনলুম আজ রাত্রে একটা গােলমাল হবে। আর এই গােলমালের মূলে থাকবে আবু তাহের। সৈন্য বাহিনীর সেপাইদের মধ্যে যার যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি আছে।
একটুখানি চুপ করে থেকে ভদ্রমহিলা আবার বলতে সুরু করলেন, তাহের নিজেকে বামপন্থী বলে পরিচয় দেয়। লােকটা বামপন্থী না কচু। আসলে লােকটা সুবিধাবাদী, ক্ষমতা চায়। বাংলাদেশের অধিকাংশ মার্কসবাদীরাই সুবিধাবাদী। কোন রাষ্ট্রের লােক ঠিক বুঝতে পারছিনে। মুখের বুলিতো সবই বামপন্থী তবে ওর হৃদয়টা আসলে কোথায় জানা দরকার।
কী করবে তাহের ? আমার বন্ধু আবার জিজ্ঞেস করলেন।
ভদ্রমহিলা বললেন : অতাে খবর রাখিনে। শুধু আজ রাত্রে একটা ‘হাঙ্গামা হৈ-হলার সম্ভাবনা আছে। তাই তোমাকে সতর্ক করতে এলুম। দুএকটা দিন সতর্ক থেকে। আর তােমার ঐ সব ভারতীয় বন্ধুদের বাড়িতে এনেনা। দিনকালের হালচাল জানােতো। কখন কী হয় বলা যায় না।
বন্ধু রাজী হলেন।
পাশের ঘর থেকে আমি সব কথাই শুনলুম। বন্ধুর ঐ কথাগুলো আমার কাছে পুনরাবৃত্তি করবার প্রয়ােজন ছিলােনা। ভদ্রমহিলা বন্ধুকে অনুরােধ করেছেন যেন কোন ভারতীয়র সঙ্গে সে দেখা সাক্ষাৎ না করে ! আর ভারতীয় মানেই আমি। কারণ ঐ ভদ্রলােকের আমিই একমাত্র ভারতীয় বন্ধু ছিলুম।
ভদ্রমহিলা চলে যাবার পর বন্ধু আমার কাছে এসে বললেন : সব শুনলেন ততা। এবার সরে পড়ুন। এখানে এক মুহূর্তও দেরী করবেন না। কারণ শহরের সবাই ভারতীয় নাগরিক খুঁজে বেড়াচ্ছে। আর ভারতীয় নাগরিক মানে ইণ্ডিয়ান পাই।
| আমি বেশ শঙ্কিত মন নিয়েই ঐ বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলুম। ভাবতে লাগলুম কোথায় যাই। আনােয়ার হােসেন ইত্তেফাকের দপ্তরে। এনায়েতুল্লা এখন কোথায় জানিনে। কার কাছে বলবাে যে আজই গভীর রাত্রে আর
________________________________________
একটা কু দ্য আঁতাতের পরিকল্পনা হচ্ছে। তিনমাস আগে গফর চৌধুরী আমার কাছে যখন ভবিষ্যদ্বাণী করেছিলেন যে শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হবে তখন আমি অবিশ্বাস করেছিলুম। কিন্তু আজ ঐ ভদ্রমহিলার কথা বিশ্বাস করলুম। বাংলাদেশে আবার গােলমাল হবে। আজ অবশ্যি আমাকে এই খবর দেবার কোন লােক ছিলোনা। কারণ ভারত তখন সাধারণ বাংলাদেশীদের কাছে অস্পৃশ্য।
একটা রিকসা ডেকে বাড়িতে ফিরে এলুম। রিকসওয়ালা রাত আটটার সময় গাড়ী চালাতে চায়নি। অনুযােগ করলো : হুজুর শহর ভারী গরম। আপনার বাড়িতে যেতে ভয় হচ্ছে।
তারপর আবার বলতে লাগলাে : বিকেল থেকে সিপাইরা বাংলাদেশের চারদিক থেকে ঢাকা শহরে আসছে। মনে হচ্ছে আর একটা গোলমাল হবে।
এবার আমার বুঝতে অসুবিধে হলেন যে ঢাকা শহরের অতি সাধারণ নাগরিকও টের পেয়েছে যে শহরের মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়েছে।
রাত নটার সময় বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে কোন কথা বলবার ইচ্ছে হলাে না। কারণ বিগত কয়েকদিন আমরা এতে উত্তেজনা আলােড়নের মধ্যে জীবন কাটিয়েছিলুম যে আমরা মনে মনে ভাবতুম যে এই বাংলাদেশ শহরে সব। কিছুই সম্ভব। | সেদিন রাত্রে একটার সময় বাইরে তুমুল চীৎকার হল। শুনতে পেলুম। তাহলে ভদ্রমহিলা মিথ্যে কথা বলেননি। নিশ্চয়ই খালেদ মুশারফকে হঠাবার চেষ্টা করা হচ্ছে। শহরের কোথায় কী ঘটছে জানা যায় না। আমার মনে হলাে গুলির আওয়াজ গুলশানের দিক থেকে আসছে। আমাদের টেলিফোন কাজ করছিল। আমি সেন সাহেবকে টেলিফোন করলুম। বললুম: স্তর আপনার ঐ এলাকায় বড়ো গােলমাল হচ্ছে গুলির আওয়াজও শুনতে পাচ্ছি।
হ্যা আমিও শুনতে পাচ্ছি। মনে হচ্ছে ক্যান্টনমেন্টের ঐ দিকে গােলমাল হচ্ছে। কী হচ্ছে বলতে পারাে?
আমি বিকেলে ভদ্রমহিলা যে সব কথা বলেছিলেন সেই কথা পুনরাবৃত্তি করবার চেষ্টা করলুম। আমার কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে সেন সাহেবের টেলিফোনের লাইন কেটে গেলাে।
তারপর আমি অন্যান্য বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে যােগাযোগ করবার চেষ্টা করলুম। কিন্তু সবার মুখে সেই একই কথা : কী হচ্ছে এবং কোথায় ?
আমি দু’একবার ছাদে উঠে বাইরের দৃশ্য দেখবার চেষ্টা করলুম। অন্ধকার,
________________________________________
ঘুটঘুটে রাত কিছুই দেখা যায় না। শুধু ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে উশৃঙ্খল, উন্মাদ জনতার গলার আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। চীৎকার, হৈ-হল্লা-এবং বন্দুকের গুলির শব্দ ক্রমেই বেড়ে চলছিল।
প্রায় তিনটে নাগাদ আমি আনোয়ার হােসেনকে টেলিফোন করলুম। শহরে কোথাও যদি কোন গােলমাল হাঙ্গামা হয় তবে আনােয়ার হােসেন নিশ্চয় জানবে কোথায় কী ঘটছে। আনােয়ার হোসেন মঞ্জু জেগেই ছিলো। আমি টেলিফোন করবার সঙ্গে সঙ্গে অপর প্রান্ত থেকে মঙুর গলার আওয়াজ শুনতে পেলুম। মনজু বললাে : কী হলাে দাদা। ফাইন্যাল ম্যাচে আপনারা হেরে গেলেন। গােল করেছেন হিরাে জিয়াউর রহমান….
কিন্তু মনজুর কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে আমি বিদ্রুপ করে বললুম : ফাইনাল রাউণ্ড কী শেষ হয়েছে? মনজু টেলিফোনের অপর প্রান্ত থেকে বেশ জোরে হেসে উঠলো। উল্লাস-আনন্দের হাসি। কারণ ৩রা নভেম্বর খালেদ মুশারফ জেনারেল জিয়াকে বন্দী করে ক্ষমতা গ্রহণ করেছিলেন এবং শুধু তাই নয়। যখন তােয়াব এবং এম এইচ খান খালেদের বুকে জেনারেলের পদক এটে দিয়েছিলেন তখন আনােয়ার হােসেন মনজু এবং এনায়েতুল্লাকে খুব বিষন্ন দেখেছিলুম। কারণ মনজু [ এনায়েতুল্লা নয় ] বাজারের গুজবে বিশ্বাস করেছিলাে যে খালেদ মুশারফ ছিলেন ভারতীয় এজেন্ট। এনায়েতুলার সঙ্গে খালেদ মুশারফের যে একটা ভিন্ন সম্পর্ক তিন নম্বর রােডে গড়ে উঠেছিলো এই কথা দৰকাল মনজু জানতে পারেনি।
আজ রাত্রে টেলিফোনে খুব জোরে হেসে আনোয়ার হােসেন বললাে : যাক শেষ পর্যন্ত আপনাদের মাথা নত করতে হলাে। আমি এই ধরণের একটা ঘটনার আশংকা করেছিলুম। শুনুন, এবার কয়েকটি গুরুতর মারাত্মক ঘটনা শুনুন। প্রথমতঃ সিপাহীরা যখন খালেদ মুশারফের পেছু নেয়, তখন সে পালাতে গিয়ে মারা গেছে। হ্যা, ঐ গণভবনের কাছে ওকে গুলি করে মারা হয়েছে। সবাই বলছে খালেদ ছিলাে বিশ্বাসঘাতক।
এবার আমার জবাব দেবার পালা। মিথ্যে কথার প্রতিবাদ করা একান্ত প্রয়ােজন। তাই বেশ সহজ কিন্তু একটু কর্কশ গলায় বললুম : খালেদের সঙ্গে ভারতের কোন সম্পর্ক ছিলােনা। আজ বাজারে যে গুজব শুনেছেন যে খালেদ হলো ভারতীয় এজেণ্ট এই গুজৰ একেবারেই মিথ্যে। না এই বিষয় নিয়ে আর তর্ক করে লাভ নেই। কারণ আপনারা কখনই ভারত বিদ্বেষ ত্যাগ করতে পারবেন না। এবার অন্য কিছু বলবার থাকে তাে বলুন
________________________________________
আমার এই প্রশ্নে শুধু বিরক্তির রেশ নয় কিছুটা শ্লেষও ছিলাে।
ঐ যে বললুম খালেদ মুশারফ মারা গেছেন। সাফাং জমীল গুরুতরভাবে আহত হয়েছেন। আর আপনি একটু বাড়ির ছাদের উপর উঠে দাড়িয়ে থাকুন। তাহলে দেখতে পাবেন যে জাতীয় রক্ষী বাহিনীর বড়ো কর্তা ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জমান তার পার্শ্বচরদের নিয়ে পালিয়ে যাচ্ছে।
আমি মনজুর কথা শুনে তক্ষুনি ছাদের উপর উঠে গেলুম।
একটু বাদে দেখতে পেলুম সত্যি মীরপুরের রাস্তা দিয়ে একটি জীপ গাড়ী বেগে ছুটে চলেছে। জীপের পর আর একটি গাড়ী এবং তার পর আর একটি জীপ। মঞ্জু ঠিকই বলেছে, কিন্তু কারু মনে যদি কোন সন্দেহ কৌতূহল জাগে। যে মঞ্জু এই কথা জানলে কী করে তবে আমাকে বলতে হবে যে মঞ্জুর পাশের বাড়ীতেই ব্রিগেডিয়ার নুরুজ্জমান থাকতেন।
আমি একটু বাদে আবার আনোয়ার হােসেন মঞ্জুকে টেলিফোন করলুম। তখন রাত প্রায় সাড়ে তিনটে। বাইরে ক্যান্টনমেন্টের দিক থেকে গুলি গােলার আওয়াজ আসছে। কী হচ্ছে এবার বুঝতে অসুবিধে হলো না। আর একটি টু দ্য আঁতাত করে জেনারেল জিয়াউর রহমান বাংলা দেশের ক্ষমতার গদীতে বসেছেন। আর সেজন্যই উন্মাদ সৈন্যবাহিনীরা গুলি ছুড়ে খালেদ মুশারফের পতনের জন্যে উল্লাস করছে। | বুঝতে পারলেন দাদা-মঞ্জু আবার বলতে লাগলো। এবার কথা প্রসঙ্গে মঞ্জুর মনের হিংস্রতা বেশ স্পষ্ট করে বােঝা গেলাে। বাংলা দেশ স্বাধীন, সার্বভৌম দেশ। আমাদের অতো সহজে দাবিয়ে রাখা যায় না। আমরা আমাদের হারান দেশকে খুঁজে বার করবােই।
এখানে আনােয়ার হােসেন আমাদের বলতে পাকিস্তানীদের কথা উলেখ । করেছিলেন। কারণ ইত্তেফাক সম্প্রদায় কোনদিনই বাংলাদেশের হিতৈষী ছিলেন না। তারা ছিলেন পাকিস্তানের পরম বন্ধু।
রেডিও খুলুন। জিয়াউর রহমানের বক্তৃতা শুনতে পাবেন। উনি বাংলা দেশের নাগরিকদের উপলক্ষে এক বক্তৃতা রেডি ওতে দিচ্ছেন।
ইতিমধ্যে আমার সব বন্ধুদের টেলিফোনের লাইন প্রদীপের শিখার মতাে নিভে গিয়েছিল। কিন্তু কেন জানিনে ৭ই নভেম্বর আমার টেলিফোনের লাইন তখনও কাজ করছিল। আমি রেডিও খুলবার আগেই মনজু তার রেডিও টেলিফোনের কাছে এনে বললো: শুনুন দাদা, জিয়া সাহেব কী বলছেন ? ফোনের মাধ্যমে জিয়াউর রহমানের কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম।
________________________________________
তার সারাংশ হলাে যে তিনি বাংলা দেশের শাসনভার গ্রহণ করছেন। শত্রুরা তাকে ঘরে বন্দী করে রেখেছিলাে। কিন্তু তিনি সেই বন্দী অবস্থা থেকে মুক্তি পেয়েছেন।
একই বক্তৃতা প্রায় চার পাঁচ বার পুনরাবৃত্তি করা হলাে। আমি জিয়াউর রহমান। বাংলাদেশকে এক চক্রান্তের হাত থেকে উদ্ধার করে শাসনভার গ্রহণ করেছি।
মনজু আবার টেলিফোনে বললাে : শুনলেন তত জিয়াউর রহমানের বক্তৃতা। উনি বাংলাদেশের সৈন্যবাহিনীর মাথার মুকুট। খালেদ মুশারফ ছিলেন আপনাদের বন্ধু কিন্তু জিয়া হলেন নির্ভীক স্পষ্টবাদী এবং তিনি বংলা দেশের উন্নতি এবং মঙ্গল আন্তরিক কামনা করেন। উনি একজন সত্যিকারের বীর সৈনিক এবং স্বদেশ প্রেমিক। আসবেন কাল সকালে আমাদের বাড়িতে। সমস্ত ঘটনা নিয়ে বিস্তৃত আলোচনা করা যাবে।
তারপর প্রায় সাড়ে চারটার সময় আমার এক বন্ধু টেলিফোন করলেন। জিজ্ঞেস করলেন : শহরে বন্দুক গুলির আওয়াজ শুনছি। কী ব্যাপার বলুন তাে?
কী আর হবে। বাংলাদেশে আর একটি বিপ্লব হয়ে গেলাে। দেশের শাসনগদীতে নতুন রাজা এলেন। তার নাম হলো জিয়াউর রহমান। আপনি রেডিও খুলে সংবাদ শুনুন। বাংলা দেশে কী ঘটছে সব শুনতে পারেন।
এই কথা বলবার সঙ্গে সঙ্গে আমার টেলিফোনের লাইন ডেঙ’ হয়ে গেলো। ভাের হয়ে এসেছিলাে। আমি আর ঘুমুবার চেষ্টা করলুমনা। শুধু ডায়েরীর পাতায় লিখে রাখলুম Bangladesh is an international basket. | কথাটি আমার নয়। আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি এজেন্সীর এক বৈঠকে এই কথাটি বলা হয়েছিলাে। বলেছিলেন কিসিংগার। কিন্তু কিসিংগার সাহেব স্পষ্ট বলেছিলেন : It will not be our basket.
অবশ্যি বাংলাদেশে পর পর তিন বার গােলযােগের পর একটি কথা স্পষ্ট প্রমাণিত হলাে বাংলাদেশের বােঝা আমাদের বইতে হবে। ১৯৭১ সালে মুক্তি যুদ্ধের সময় চৌ-এন-লাইও বলেছিলেন : বাংলাদেশের বােঝা দীর্ঘকাল শ্ৰীমতী গান্ধীকে বইতে হবে। পরে এই বােঝা মাথা থেকে তার পায়ে এসে পড়বে।
________________________________________
গত তিন মাসের ঘটনার পর আমার মনে হলাে যে বাংলাদেশে ভারত | বিদ্বেষ চিরকালই অটুট থাকবে।
৭ই নভেম্বর ভাের বেলায় আমি বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখেছিলুম সেই দৃশ্য কোন দিনই ভুলবাে না। আমার বাড়িটি ছিলাে মীরপুর রোডে শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ির সামনে। | ভাের প্রায় সাড়ে পাঁচটা থেকে হাজার হাজার লােক ভারত বিরােধী চীৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে রমনার দিকে ছুটে যাচ্ছিলাে। এদের মধ্যে কিছু সৈনিক, কিছু অতি সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকের দল ছিলো। কারু হাতে ছিলো বন্দুক, কারু হাতে লাঠি ভাণ্ডা•••একটু পরে বেশ কয়েকটি লরী বােঝাই সৈন্য এবং শ্রমিকের দল রমনার মাঠের দিকে যেতে লাগলো। সবাই চীৎকার করছে, ভারতকে গালমন্দো দিচ্ছে. হঠাৎ একটা লরীভক্তি সৈনিক এবং শ্রমিকের দল আমার বাড়ির সামনে এসে দাড়াল।
এটা কার বাড়ি ? একজন অর্ধ নগ্ন সৈনিক আমার বাড়ির প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলাে।
এখানে। গোলমাল করবেন না—প্রহরী জবাব দিলো।
আমরা জানতে চাই এই বাড়িতে কে থাকেন। ভারতীয় এজেন্টের কেউ নয়তাে? একটি সৈনিক তার সঙ্গীনসহ বন্দুক নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাে।
বাড়ির প্রহরী অনুনয় বিনয় করে বললাে: এখানে প্রবেশ নিষেধ, এটা বিদেশীদের বাড়ি।
আমরা বাংলাদেশের সিপাহী, জানেন তাে আজ থেকে সিপাহী বিদ্রোহ সুরু হয়েছে। বিদেশীটি কে আমরা জানতে চাই—সিপাই আবার বললো। তারা নাছোড়বান্দা। বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা না করে যাবেনা। | আমি আনােয়ার হােসেনের বাড়িতে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলুম। বাইরের চীৎকার শুনে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালাম।
কী চাও? আমি প্রকাশ্যে বেশ সাহস নিয়ে বললুম। কিন্তু আমি মনে মনে ঐ সব উগ্র উম্মাদ সৈন্য এবং কৃষক বাহিনীকে দেখে বেশ আতঙ্কিত হলুম।
আমরা চাই আপনার পরিচয়? আপনি কীভারতীয় এজেন্ট? লােকটি
________________________________________
গত তিন মাসের ঘটনার পর আমার মনে হলো যে বাংলাদেশে ভারত বিদ্বেষ চিরকালই অটুট থাকবে।
৭ই নভেম্বর ভাের বেলায় আমি বাংলাদেশে যে অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখেছিলুম সেই দৃশ্য কোন দিনই ভুলবো না। আমার বাড়িটি ছিলাে মীরপুর রোডে শেখ মুজিবর রহমানের বাড়ির সামনে। | ভোের প্রায় সাড়ে পাঁচটা থেকে হাজার হাজার লােক ভারত বিরােধী চীৎকার করতে করতে রাস্তা দিয়ে রমনার দিকে ছুটে যাচ্ছিলো। এদের মধ্যে কিছু সৈনিক, কিছু অতি সাধারণ কৃষক ও শ্রমিকের দল ছিলো। কারু হাতে ছিলো বন্দুক, কারু হাতে লাঠি ভাণ্ডা•••একটু পরে বেশ কয়েকটি লরী বােঝাই সৈন্য এবং শ্রমিকের দল রমনার মাঠের দিকে যেতে লাগলো। সবাই চীৎকার করছে, ভারতকে গালমন্দো দিচ্ছে…হঠাৎ একটা পরীভক্তি সৈনিক এবং শ্রমিকের দল আমার বাড়ির সামনে এসে দাড়াল।
এটা কার বাড়ি ? একজন অর্ধ নগ্ন সৈনিক আমার বাড়ির প্রহরীকে জিজ্ঞেস করলো।
এখানে। গোলমাল করবেন না—প্রহরী জবাব দিলো।
আমরা জানতে চাই এই বাড়িতে কে থাকেন। ভারতীয় এজেন্টের কেউ নয়তাে? একটি সৈনিক তার সঙ্গীনসহ বন্দুক নিয়ে বাড়ির ভেতর ঢুকলাে।
বাড়ির প্রহরী অনুনয় বিনয় করে বললাে: এখানে প্রবেশ নিষেধ, এটা বিদেশীদের বাড়ি।
আমরা বাংলাদেশের সিপাহী, জানেন তাে আজ থেকে সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়েছে। বিদেশী টি কে আমরা জানতে চাই—সিপাই আবার বললো। তারা নাছোড়বান্দা। বাড়ির মালিকের সঙ্গে দেখা না করে যাবেন।
| আমি আনােয়ার হােসেনের বাড়িতে যাবার জন্যে প্রস্তুত হচ্ছিলুম। বাইরের চীৎকার শুনে বাড়ির সামনে এসে দাড়ালাম।
কী চাও? আমি প্রকাশ্যে বেশ সাহস নিয়ে বললুম। কিন্তু আমি মনে মনে ঐ সব উগ্র উম্মাদ সৈন্য এবং কৃষক বাহিনীকে দেখে বেশ আতঙ্কিত
আমরা চাই আপনার পরিচয়? আপনি কীভারতীয় এজেন্ট? লােকটি
________________________________________
তার বন্দুকের সঙ্গীন উচু করে বললাে।
আপনাদের কর্তাকে ডাকুন? আমি তার কাছে আমার প্রকৃত পরিচয় দেবে—আমার জবাবে কিছুটা রুক্ষতা এবং কিছুটা ভয় মিশান ছিলাে।
সিপাই এবার তার সঙ্গীদের সঙ্গে গিয়ে ফিসফিস করে কী জানি বললাে। তারপর আর ফিরে এলােনা। শুধু চীৎকার করে বললাে : শালা, তুমি যদি ভারতীয় এজেন্ট হও, তাহলে তােমার জান খেয়ে নেবাে।
| লরী ভত্তি সেপাই শ্রমিকের দল চলে গেলাে। এদিকে রাস্তায় জনতা এবং বাসভত্তি লােকের বিরাম নেই। সব বাস, লোক রমনার মাঠের দিকে যাচ্ছে। সবাই উত্তেজিত। তাদের কথাবার্তার ঢং শুনে মনে হল যে তারা যেন কোন যুদ্ধে জয়লাভ করে বাড়ি ফিরছেন।
প্রায় সাড়ে সাতটার সময় আনােয়ার হােসেন মনজুর বাড়িতে গেলুম। চায়ের কাপ নিয়ে মনজু তখন তার গল্পের আসর জকিয়ে বসেছেন। আমি যাবার সঙ্গে সঙ্গে মনজু আমাকে বললাে : দাদা আপনারা হেরে গেলেন।
আমি বেশ হেসেই জবাব দিলুম। জীবনে আমি কখনও মনের কথা ভাষায় কিংবা ব্যবহারে প্রকাশ করিনি। মনজুর প্রশ্নের ঢং এবং সুর শুনে মনে মনে বিরক্তি হয়েছিলুম বটে তবে সেই দিন মনজুর চায়ের আসরে গিয়ে বসবার অন্য একটি উদ্দেশ্য ছিলাে। আমি গত রাত্রের কু দ্য আঁতাতের বিশদ বিবরণী জানবার চেষ্টা করলুম। বললুম : মনজু ভাই বাংলাদেশের প্রতি আমাদের কোন লোভ নেই। শ্ৰীমতী গান্ধী আপনাদের শুভাকাঙ্খী। আজ পর্যন্ত উনি বাংলাদেশের বিরোধী কোন কাজ করেননি বরং তিনি যা করেছেন আপনাদের দেশের হিতের জন্যেই করেছেন। এই দেশে আমাদের কোন এজেন্টের দরকার নেই।
প্রথমে মনজু আমার জবাবটি হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলো। কিন্তু পরে গম্ভীর কণ্ঠে বললাে : বাজারের গুজবের কথা নিশ্চয় শুনেছেন। খালেদ নাকি আপনাদের পরামর্শেই খােন্দকার মুস্তাক আহমেদকে প্রেসিডেন্টের পদ থেকে সরিয়েছেন। তবে ওর প্ল্যান সফল হয়নি, বাংলাদেশের জনগণ খালেদের ‘দেশদ্রোহিতা সহ্য করেনি। তাকে সমুচিত শিক্ষা দিয়েছে।
কিছুক্ষণ পরে এনায়েতুল্লা খান এসে আডডায় যােগ দিলো। বলাবাহুল্য আজ সে বিশেষ উত্তেজিত। কোন ভনিতা না করে এনায়েতুল্লা এক সুরে বলতে লাগলাে : আলা বাংলাদেশকে বাঁচিয়েছেন। নইলে এই ভারতীয় শকুনিদের [ পরে সেই দিন ভােরে খােন্দকার মুস্তক বলেছিলেন : ভারতীয়
________________________________________
হায়েনা] হাত থেকে রেহাই পাওয়া যেত না। খালেদ যে এমন মুখামি করবে কখনও কল্পনা করিনি। শুনেছিস তাে কাল রাত্রে কী হয়েছিলাে? শেষের কথাটি অবশ্যি আনােয়ার হােসেন মনজুকে উদ্দেশ্য করে বললো। | কী হয়েছিলাে? আডডার সবাই এক সঙ্গে এনায়েতের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাে।
কাল রাত একটার সময় বাংলাদেশের সামরিক বাহিনী সিপাহি বিদ্রোহ করেছে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে সৈনিক বাহিনী এসে জেনারেল জিয়াকে মুক্ত করেন। ঐ সময়ে তাদের উল্লাস এবং আনন্দের ধ্বনি ঢাকার সবাইকে জাগিয়ে তােলে। শূন্যে আকাশেই অবশ্যি তারা বন্দুকের গুলি চালাচ্ছিলো। তবে আজ রাস্তায় যাদের মিছিলে দেখা যায় তারা সবাই বাংলা দেশের সেনা নয়, গায়ের চাষ, ফ্যাক্টরীর শ্রমিকেরাও এদের মধ্যে আছে। এ হচ্ছে সিপাহী বিদ্রোহ এবং আমাদের কর্ণেল তাহেরই এই বিপ্লবের নেতৃত্ব করেন। কুমিল্লার ব্রিগেড কাল রাতে এসে পৌচেছে, যশাের থেকে আর এক টি ব্রিগেড আজ সকালে এসে পৌছুবার কথা।
জিয়ার সঙ্গে ছিলেন ব্রিগেডিয়ার মীর শউকৎ। জিয়াকে এবং তার বন্ধুদের বন্দীশালা থেকে বের করে নেবার পর সৈন্যবাহিনী রেডিও, টেলিফোন এবং অন্যান্য জরুরী স্থানগুলো দখল করে নেয়। সেখানে থেকে জিয়াউর রহমান গেলেন ঢাকা বেতার কেন্দ্রে। প্রায় ভাের চারটের সময় উনি বাংলাদেশের নাগরিকদের উদ্দেশ্য করে এক বক্তৃতা দেন। তুই শুনেছিলি সেই বক্ততা। শেষের কথা গুলাে মনজুকে উদ্দেশ্য করে বলা।
মনজু হেসে বললাে : হ্যা ঐ বক্তৃতা শুধু আমি শুনিনি। দাদাকেও শুনিয়েছি। | মনজু এবার আমাকে উদ্দেশ্য করে বললাে। এনায়েতুল্লা খান আরাে বললেন খালেদ মুশারফ শুধু শুধু নিজের প্রাণটি দিলেন। পালাবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু সেপাইরা ওকে ছেড়ে দেয়নি, খালেদকে হত্যা করেছে। জিয়া আর বাকী সবাই এখন বেতার কেন্দ্রে বসে আছে। আর ঐ বেতার কেন্দ্রের চারদিক ঘিরে বাংলাদেশের সেপাহিরা। যাবি একবার ? এনায়েতুলা আবার মনজুকে জিজ্ঞেস করলাে।
আমি ছিলুম শুধু শ্রোতা। চিরকালই তাই ছিলাম। কারণ শ্রোতা হবার অনেক সুবিধে আছে। বক্তারা সরল মনে তাদের কথাগুলাে শ্রোতাকে বলেন। এবার আমি খুব ছােট্ট একটি প্রশ্ন করলুম।
________________________________________
আচ্ছা মুস্তাক সাহেবের কী খবর বলুন তাে? গত পরশু থেকে ওর নাম আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না।
মুস্তাক সাহেবও ওই বেতার কেন্দ্রে আছেন। তিনি অবশ্যি সায়মকে সরিয়ে আবার দেশের প্রেসিডেন্ট হবার চেষ্টা করছেন। শুনছি নটার সময় উনি রমনার ময়দানে বাংলাদেশের সৈন্যবাহিনী এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে একটি বক্তৃতা দেবেন। অবশ্যি শুনছি জিয়াউর রহমানও ওই মিটিং-এ বক্তৃতা দেবেন। আদৌ দেবেন কিনা জানিনে•• মঞ্জু জিজ্ঞেস করলো : আচ্ছা ওই মিটিং-এর আয়োজন করছে কে?
আবার কে? জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যরা। তাদের নেতৃত্ব করছেন ওই খোড়া আবু তাহের। এতােদিন ধরে লােকটা লুকিয়ে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক কাজ করছিলাে। ওর কাজ কর্মের কথা কেউ টের পায়নি। আশ্চর্য !
আমাদের আডডা ভেঙে গেলো। এনায়েতুল্লা খান এবং আনোয়ার হােসেন এবার বেতার কেন্দ্রের দিকে রওনা হলো। মাঝপথে আমাকে এক নম্বর রােডে নামিয়ে দিলো।
এক নম্বর রােডে ছিলাে ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনের দপ্তর। সেদিন ওই দপ্তরের সামনে দাড়িয়ে হাজার হাজার সৈনিক এবং অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণীর জনতা ভারত বিরােধী চিৎকার করছিলাে। দু একবার ওই উৎশৃঙ্খল জনতা হাই কমিশনের গেট ভেঙ্গে ভেতরে যাবার চেষ্টা করছিলাে। সমর সেনের মৃত্যু চাই। সমর সেনের কলিজা চাই। সমর সেনের মুণ্ডু চাই- এই ধরণের চীৎকারে এবং বিভিন্ন ধরণের শ্লোগানে আকাশ তখন মুখরিত। হাইকমিশনের সামনে এক বীভৎস দৃশ্য, উন্মাদ জনতা হৈ-হৈ করে নৃত্য করছে আর ভারতকে গালমন্দো দিচ্ছে। এই ভারত বিরোধী মনোবৃত্তির কোন কারণ আজও খুজে পাইনি। অথচ দিল্লীর কর্তারা এবং হাই কমিশনার সমর সেন সদাসর্বদাই বাংলা দেশের মঙ্গল কামনা করতেন। তাজউদ্দীন এবং আরো কয়েকজন মুষ্টিমেয় লােক ছাড়া আমি বাংলা দেশে ভারতের প্রকৃত বন্ধ কখনও খুজে পাইনি। এই ভারত বিদ্বেষের কোন সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয়।
গোলমাল-হাঙ্গামা যখন বেশ প্রবল হলে এবং হাইকমিশনারের কর্তারা। আশংকা করলেন যে এই উশৃঙ্খল জনতা হাই কমিশনের ভেতর ঢুকতে পারে, তারা পুলিশ বাহিনী এবং পরে সৈন্য বাহিনীর শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ওই
________________________________________
আচ্ছা মুস্তাক সাহেবের কী খবর বলুন তো? গত পরশু থেকে ওর নাম আর শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না।
মুস্তাক সাহেবও ওই বেতার কেন্দ্রে আছেন। তিনি অবশ্যি সায়ামকে সরিয়ে আবার দেশের প্রেসিডেন্ট হবার চেষ্টা করছেন। শুনছি নটার সময় উনি রমনার ময়দানে বাংলাদেশের সৈন্যবাহিনী এবং জনতাকে উদ্দেশ্য করে একটি বক্তৃতা দেবেন। অবশি শুনছি জিয়াউর রহমানও ওই মিটিং-এ বক্তৃতা দেবেন। আদৌ দেবেন কিনা জানিনে.. মঞ্জু জিজ্ঞেস করলো : আচ্ছা ওই মিটিং-এর আয়োজন করছে কে?
আবার কে? জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের সদস্যরা। তাদের নেতৃত্ব করছেন ওই খোড়া আবু তাহের। এতােদিন ধরে লােকটা লুকিয়ে সৈন্যবাহিনীর মধ্যে রাজনৈতিক কাজ করছিলাে। ওর কাজ কর্মের কথা কেউ টের পায়নি। আশ্চর্য !
আমাদের আডডা ভেঙে গেলাে। এনায়েতুল্লা খান এবং আনোয়ার হােসেন এবার বেতার কেন্দ্রের দিকে রওনা হলো। মাঝপথে আমাকে এক নম্বর রােডে নামিয়ে দিলো।
এক নম্বর রােডে ছিলো ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনের দপ্তর। সেদিন ওই দপ্তরের সামনে দাড়িয়ে হাজার হাজার সৈনিক এবং অন্যান্য বিভিন্ন শ্রেণীর জনতা ভারত বিরােধী চিৎকার করছিলো। দু একবার ওই উৎশৃঙ্খল জনতা হাই কমিশনের গেট ভেঙ্গে ভেতরে যাবার চেষ্টা করছিলাে। সমর সেনের মৃত্যু চাই। সমর সেনের কলিজা চাই। সমর সেনের মুও চাই—এই ধরণের চীৎকারে এবং বিভিন্ন ধরণের শ্লোগানে আকাশ তখন মুখরিত। হাইকমিশনের সামনে এক বীভৎস দৃশ্য, উন্মাদ জনতা হৈ-হৈ করে নৃত্য করছে আর ভারতকে গালমন্দো দিচ্ছে। এই ভারত বিরোধী মনোবৃত্তির কোন কারণ আজও খুজে পাইনি। অথচ দিল্লীর কর্তারা এবং হাই কমিশনার সমর সেন সদাসর্বদাই বাংলা দেশের মঙ্গল কামনা করতেন। তাজউদ্দীন এবং আরো কয়েকজন মুষ্টিমেয় লােক ছাড়া আমি বাংলা দেশে ভারতের প্রকৃত বন্ধু কখনও খুজে পাইনি। এই ভারত বিদ্বেষের কোন সঠিক কারণ বলা সম্ভব নয়।
গোলমাল-হাঙ্গামা যখন বেশ প্রবল হলে এবং হাইকমিশনারের কর্তারা আশংকা করলেন যে এই উশৃঙ্খল জনতা হাই কমিশনের ভেতর ঢুকতে পারে, তারা পুলিশ বাহিনী এবং পরে সৈন্য বাহিনীর শরণাপন্ন হলেন। কিন্তু ওই
________________________________________
দিন পুলিস কিংবা সৈন্যবাহিনীর সঙ্গে যোগাযােগ করা সম্ভব ছিলােনা।
কিছুক্ষণ পরে ব্রিগেডিয়ার মনজুর আমেদ (তখনও মনজুর ব্রিগেডিয়ার হননি) একদল ফৌজ নিয়ৈ হাই কমিশনে এলেন। আশ্বাস দিলেন যে কোন বিবাদ হবে না। এই কথা বলে মনজুর বিদায় নিলেন।
এদিকে শহরের কোথায় কী ঘটছে আমরা তার সঠিক খবর জানিনে। নানা মুনির নানান মত। কেউ বলেন খােন্দকার মারা গেছেন, তবে আসল খবর কেউ বলতে পারলেন না। আমি অবশি এনায়েতুল্লার কাছে শুনেছিলুম যে খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ রমনার ময়দানে বক্তৃতা দেবার পরিকল্পনা করেছেন এবং শুধু তাই নয়, তিনি আবার প্রেসিডেন্ট হবার চেষ্টা করছেন। এনায়েতুল্লা আমাকে বলেছিলো যে জিয়াউর রহমানও ওই ময়দানে এক রাজনৈতিক বক্তৃতা দেবেন। কিন্তু পরে দেখা গেলো জিয়াউর রহমান ওই ময়দানের মিটীং-এ যােগ দেননি। সেইদিনই আমি স্পষ্ট বুঝেছিলুম যে জিয়াউর রহমান গভীর জলের মাছ। ওর নীতি হলো: ধরি মাছ না ছুই পানী। | হাইকমিশনের সামনে উন্মাদ জনতা বেশ কিছুক্ষণ চীৎকার করে চলে গেলাে। এক বন্ধুকে নিয়ে আমরা শহরের পরিস্থিতি যাচাই করবার জন্যে হেঁটে শহর পরিক্রমায় বেরুলুম। | যেখানেই যাই সেইখানেই দেখি জনরাশি। এদের মধ্যে অনেকেই আমাদের মতাে দর্শক এবং শ্রোতা ছিলেন। ভারত বিরােধী শ্লোগান ছাড়া উন্মাদ জনতা চীৎকার করে বলছিলো: সিপাহী-বিদ্রোহ সৈন্য এবং জনতার সহযােগিতায় সফল হয়েছে।
আমরা এই জনতার মধ্যে বেশ নিশ্চিন্ত মনে ঘুরে বেড়াতে লাগলুম। কেউ জানতে পারলো না যে আমরা কে এবং আমাদের পরিচয় কেউ জানবার চেষ্টাও করেনি। শুধু মাঝে দু’একজন সৈন্য এসে বললো : সিপাহী বিদ্রোহ শুরু হয়েছে, আপনার মুখ খুলুন, চীৎকার করুন, শ্লোগান দিন। আমাদের পরম শত্রু’ ভারতবর্ষ আমাদের দেশ দখল করবার ফিকিরে ছিলো। আমরা সেই চেষ্টা ব্যর্থ করেছি। আমরা অবশ্যি মুখ খুলিনি কিন্তু আমাদের শ্রুতিশক্তি বেশ প্রখর ছিলাে।
বেতার কেন্দ্রের কাছে গিয়ে দেখলুম বিরাট জনতা। বেতার কেন্দ্রের চারদিকে ট্যাঙ্ক বাহিনী। মাঝে মাঝে ঐ জনতার দুএকজন ট্যাঙ্কের উপর উঠে গিয়ে সৈন্য বাহিনীর লােকদের চুমু খেতে লাগলাে।
আমরা ওখানে দাড়িয়ে বিবিধ রকমের গুজব শুনতে লাগলুম। কারণ,
________________________________________
আমি জানতুম যে কোন দেশে যদি এ রকম বিশৃঙ্খলতা ঘটে তখন সর্ব প্রথম বাজারে যে জিনিষটি চালু এবং তীব্র হয় সেই টি হলো গুজব। কারণ : Truth is the first casualty of war. .
একদল বললেন যে আজ সকাল থেকে জেনারেল জিয়া, জাসদের নেতা আবু তাহের এবং সামরিক বাহিনীর আরাে অনেক উচ্চপদস্থ কর্মচারী বেতার কেন্দ্রে বসে বালাদেশের ভবিষ্যৎ সরকার গঠন এবং তার নীতি নিয়ে আলোচনা করছেন। আর একজন বললাে যে ঐ আলােচনা সভায় খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ ও উপস্থিত ছিলেন। জনতার মধ্যে আর একজন বলে উঠলো যে খােন্দকার আবার প্রেসিডেন্ট হবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাহের স্পষ্ট বলেছেন যদি খােন্দকারকে আবার প্রেসিডেন্ট করা হয় তাহলে বােমা দিয়ে বেতার কেন্দ্রকে উড়িয়ে দেওয়া হবে। খােন্দকারের প্রেসিডেন্ট হবার ঘােরতর বিরোধী ছিলেন আবু তাহের।
এভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নিয়ে যখন তুমুল তর্কবিতর্ক হচ্ছে এবং খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ আবার প্রেসিডেন্টের গদী ফিরে পাবার চেষ্টা করছিলেন তখন খােন্দকারের ডান হাত মহাবুব আলম চাষী এসে বেতার কেন্দ্রে ঢুকলেন। তিনি জিয়াউর রহমানকে অনুরােধ করলেন যেন বাংলা দেশের কর্তৃত্বের দায়িত্ব তিনি গ্রহণ করেন। মহবুব আলম চাষীর বেতার কেন্দ্রে আগমন এবং জিয়াউর রহমানকে দেশের দায়িত্ব গ্রহণ করবার অনুরোধ সবই ছিলাে পূর্বকল্পিত, কারণ আমি প্রথম দিন থেকে সন্দেহ করেছিলাম যে ১৫ই আগষ্টের মুজিব হত্যার পশ্চাতে জিয়াউর রহমানের হাত ছিলাে। তিনি যদি প্রথমেই দেশের শাসনভারের দায়িত্ব না নিয়ে থাকেন তবে তার প্রধান কারণ ছিলো যে তিনি এই বিপ্লবের গতি কোনদিকে যাবে কল্পনা করেননি। আসলে জিয়াউর রহমান মহাবুব আলম চাষী কখনই আশা করেননি যে মুজিব হত্যার পর ভারতবর্য নিশ্চপ হয়ে বসে থাকবে। যখন তারা দেখতে পেলেন যে সব বিপদের কঁাড়া কেটে গেছে তখন জিয়াউর রহমান এবং তার সহকর্মীরা মাথা চাড়া দিয়ে উঠলেন। আর খালেদ মুশারফের তিন তারিখের কু দ্য আঁতাত এবং তার সঙ্গে ভারতবর্ষ জড়িয়ে আছে এই প্রচার কাজ ও ছিলো পূর্বকল্পিত। নতুবা ৭ই নভেম্বর মহাবুব আলম চাষী যার কথা এর আগে বহু বার বলা হয়েছে ১৭ই নভেম্বর জিয়াউর রহমানকে দেশের শাসন কর্তৃত্ব হাতে নেবার জন্যে অনুরোধ করতেন না।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা বলতে হবে। জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের
১১
________________________________________
নেতারা কখনাে কল্পনা করেননি যে জিয়াউর রহমান খোন্দকার মুস্তাক কিংবা তার সমর্থকদের সঙ্গে হাত মেলাবেন। তাদের ধারণা ছিলো যে জিয়াউর রহমান ছিলেন প্রগতিশীল এবং তিনি জাসদের বারো পয়েন্টের দাবী অতি সহজেই গ্রহণ করে নেবেন। কিন্তু জিয়াউর রহমান ঠিক তার উল্টো কাজ করেছিলেন। জাসদের এই ভ্রান্ত ধারণার প্রধান কারণ যে মুক্তি। যুদ্ধের সময় জিয়াউর রহমান শুধু যুদ্ধেই যােগদান করেননি। তিনি বহু বামপন্থী নেতাদের সঙ্গেও যােগাযােগ রেখেছিলেন এবং কারু মনেই সন্দেহ হয়নি যে জিয়াউর রহমান দুই নৌকোয় পা রেখে চলছেন। আর একটা কথা জেনে রাখা ভালাে। জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে বাংলা দেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তারা বেশ তৎপর হয়ে উঠলেন। আমরা দেখতে পাবাে যে পরবর্তীকালে সৈন্য বাহিনীর চাইতে পুলিশ বাহিনী আরো বেশী তৎপর হয়েছিলাে। ৭ই নভেম্বরের একটি কথার স্পষ্ট প্রমাণিত হলো যে জিয়াউর রহমান ঐ সিক্রেট পুলিশ বাহিনীর লােক। দেশের ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্যে তিনি আবু তাহের এবং জাসদ পাটির কর্তাদের তার স্বার্থের জন্যে ব্যবহার করেছিলেন। কারণ অল্প কয়েকদিন পরেই যারা জিয়াউর রহমানকে কারাগার থেকে উদ্ধার করেছিলেন তাদের গ্রেপ্তার করা হলো। সে আর এক দীর্ঘ কাহিনী।
বেতার কেন্দ্রের সামনে বিরাট জনতা জিয়াউর রহমানকে তুমুল সম্বর্ধনা জানাচ্ছিলেন। আর ঠিক ঐ সময়ে খোন্দকার মুস্তাক এক জনসভায় অভিযােগ। করলেন যে দিল্লীর হায়নার দল বাংলাদেশের উপর ক্ষুব্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। বাংলাদেশবাসীদের সতর্ক হতে হবে। নতুবা বিপদ আসন্ন।
প্রায় এগারটার সময় সৈন্য বাহিনীর শিবির ক্যান্টনমেন্টে বড়ো বড়ো জেনারেলদের এক বৈঠক শুরু হলো। এই বৈঠকের নেতৃত্ব করলেন জিয়াউর রহমান। কিন্তু আশ্চর্য্যর বিষয় যে এই বৈঠকে খােলকারের ডান হাত মহাবুব আলম চাষীও উপস্থিত ছিলেন। ওসমানীও ছিলেন। বলা দরকার যে তিন এবং সাত তারিখের কু দ্য আঁতাতের সময় জেনারেল ওসমানী বিশেষ অংশ গ্রহণ করেছিলেন। | এই বৈঠকে ঠিক হলাে যে বর্তমান কালের জন্যে প্রেসিডেন্ট সায়ামকে ঐ পদ থেকে সরান হবে না। কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমান, আমির এডমিরাল এম এইচ খান এবং এয়ার চীফ তােয়াব হবেন ডেপুটি অব মার্শাল ল এডমিনিস্টে শন। মহাবুব আলম চাষীর ইচ্ছে ছিলাে যে সায়ামের পরিবর্তে ।
________________________________________
জিয়াকে প্রেসিডেন্ট এবং চীফ মার্শাল ল এডমিনিস্টে টর করা হােক। কিন্তু কোন কারণবশতঃ ঐ মুহূর্তে জিয়াউর রহমান প্রেসিডেন্ট সায়মকে রাষ্ট্রপতির গদী থেকে সরাতে চাননি। তবে ঐ দিনকার সভায় আর একটি প্রয়ােজনীয় এবং জরুরী সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলাে। আর সেই সিদ্ধান্ত হলাে যে জাসদের এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতাদের অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হবে। ঠিক হলাে সাধারণ নির্বাচনের দিন পরে ধার্য করা হবে।
আবু তাহেরের সৈন্য বাহিনীর সমর্থকেরা অনুরােধ করলো যে তাদের বারো পয়েনটের দাবী অবিলম্বে গ্রহণ করা হােক। সেইদিন সন্ধ্যা আটটার সময় প্রেসিডেন্ট সায়াম এবং খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ রেডিও ষ্টেশন থেকে বাংলা দেশবাসীকে উদ্দেশ করে বক্তৃতা দেবার সংকল্প করলেন। কিন্তু জিয়াউর রহমানকে সিপাহীরা সহজে বেতার ষ্টেশনে ঢুকতে দিলেন না। স্পষ্ট বললো যে ঐ ষ্টেশনে ঢুকবার আগেই তাদের বারো পয়েনটের দাবী গ্রহণ করতে হবে এবং স্বীকার করে নিতে হবে। জিয়াউর ঐ বারো পয়েনটের মেমােরাণ্ডাম গ্রহণ করলেন। সেই মেমোরাণ্ডাম অনুযায়ী জাসদের দুইজন প্রধান নেতা মেজর জলিল এবং আব্দুর রবকে মুক্তি দেওয়া হল। | ৭ই নভেম্বরের রেডিও বক্তৃতায় খােন্দকার মুস্তাক আবার ভারতবর্ষকে উদ্দেশ্য করে বক্তৃতা দিলেন। পরে আবু তাহের জেনারেল জিয়াউর রহমানের সঙ্গে বহুবার যােগাযোগ স্থাপন করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তার প্রচেষ্টা সফল হয়নি। জিয়াউর রহমান তার পুরান বন্ধু জাসদ দলের নেতা আবু তাহেরের সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক বিচ্ছিন্ন করলেন। কারণ ইতিমধ্যে মহাবুব আলম চাষী, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলীজেন্সের লােকেরা জিয়াউর রহমানকে বশীভূত করেছিলেন। এই সময়ে আবু তাহের এবং তার সহ কমীরা স্পষ্ট বুঝতে পারলেন যে জিয়াউর রহমান শুধু ক্ষমতা ফিরে পাবার জন্যে তাদের ওই নভেম্বরের বিপ্লবে ব্যবহার করেছিলেন।
কিছুদিন পরে শফদর, এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্মচারীদের পরামর্শে জাসদকে বেআইনী বলে ঘােষণা করা হলাে এবং তাহের রব এবং জলিল আবার গ্রেপ্তার হলেন।
৩রা নভেম্বরের কু দ্য আঁতাতের পর বাংলাদেশের লোকেরা বেশ বিহ্বল হয়ে পড়েছিলাে। এদিকে মুজিব হত্যার ছয় জন মেজরদের দল বাংলাদেশের বাইরে গিয়ে বিদেশী সাংবাদিকদের কাছে বিবৃতি দিলেন যে, মুজিবকে তারাই হত্যা করেছে কিন্তু এই কাজের নির্দেশ তারা খোন্দকার মুস্তাক আহমেদের
________________________________________
কাছ থেকে পেয়েছিলাে। আর মুজিব হত্যার আসল কারণটি ব্যক্তিগত নয় রাজনৈতিক। দু’একজন মেজর কোন এক বিদেশী রাষ্ট্রের নামও উল্লেখ করলেন।
ইতিমধ্যে এনায়েতুল্লা এবং আনােয়ার হােসেন মনজুর দল ফরাক্কা বাঁধ নিয়ে ভারত বিরােধী প্রচার কাজ শুরু করলেন। কিন্তু তাদের এই প্রচার বেশীদূর এগােবার আগেই পর পর আরাে তিনটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটে যে কাহিনী এখানে উল্লেখ করা একান্ত দরকার। নতুবা আমার ঢাকার ডায়েরী একেবারেই অসম্পূর্ণ থেকে যাবে।
প্রথমত: আমাদের ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের বাড়ীতে একটি মারাত্মক তেজী বোমা ফাটাবার চেষ্টা করা হলো। সেই চেষ্টা ব্যর্থ হবার পর সেন সাহেবকে গুলী করে মারবার চেষ্টা করা হলাে। তৃতীয়তঃ জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে জাসদ দলের নীতির বিরােধিতা করতে সুরু করলেন। ৭ই নভেম্বরেয় সিপাহী বিপ্লবের কথা তিনি একেবারে ভুলে গেলেন।
ঘটনাগুলো সাজিয়ে বলতে গেলে প্রথমত: সুরু করতে হবে সমর সেনের বাড়ীতে বােমা আবিষ্কার। ১৫/১৬ই নভেম্বর হঠাৎ একদিন শুনতে পেলুম যে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনের বাড়ীতে একটি তেজী মারাত্মক বােমা উদ্ধার করা হয়েছে। আমরা সবাই বেশ উৎকণ্ঠিত এবং চিন্তিত হয়ে গুলশানে ছুটলুম। ভারতীয় সাংবাদিকদের কাছে সেন সাহেব সমস্ত ব্যাপারটিকে তুচ্ছ এবং হেসে উড়িয়ে দেবার চেষ্টা করলেন। ভারতীয় সাংবাদিকদের বুঝবার অসুবিধে হলাে না যে সেন সাহেব ভারতবর্ষ এবং বাংলাদেশের সৌহার্দ বজায় রাখার জন্যে এই গুরুতর ঘটনাকে বিশেষ আমল দিচ্ছেন না।
সেন সাহেবের বাড়িতে চব্বিশ ঘণ্টাই বাংলাদেশী সশস্ত্র পুলিশ মােতায়েন থাকতাে। সবার অজ্ঞাতসারে সেন সাহেবের বাড়ীতে ঐ তেজী বােম কী করে রেখে আসা হলাে তার জবাব সেদিন কেউ দিতে পারলােনা। এই প্রসঙ্গে একটি কথা মনে রাখা দরকার যে এই ঘটনা জাসদের নেতা তাহেরের গ্রেপ্তারের আগেই হয়েছিল।
ঐ তেজী বোমা প্রথমে সেন সাহেবের মেয়ের নজরে পড়লাে। মেয়েটি চীৎকার করে ঐ বােমা আবিস্কারের কথা জানালো। সশস্ত্র পুলিশও ঘটনাস্থলে দৌড়ে ছুটে এলো। ব্যাপার কী? উঠোনে একটি জ্যাস্ত বােম পাওয়া গেছে। আর কেউ সেই জ্যান্ত বোমার ধার কাছে যাবার চেষ্টা
________________________________________
করলাে না।
তক্ষুনি বাংলাদেশের সৈন্য বাহিনীর স্যাপার বিভাগকে, যাদের কাজ হলো সব জ্যান্ত বােমাকে ফাটিয়ে দেওয়া, খবর দেওয়া হলাে। তারাও এলেন । বােমা ফাটান হলাে। তীব্র শব্দ, ধুয়াে এমনকী বাইরের একটি দেয়ালে ও বেশ ফাটল ধরলাে। কিছুদিন পরে হাইকমিশনের একজন কর্মচারী ঐ বােমার টুকরো নিয়ে কলকাতার ফোর্ট উইলিয়ামে গিয়েছিলেন। তারা বােমার টুকরাে দেখে বললেন বিদেশী তেজী ৰােম। এই বােমা যদি ঐ বাড়িতে ফাটতাে তাহলে কিছু লােক নিশ্চয় মারা যেত।
বােমা আবিষ্কারের ব্যাপার নিয়ে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্যের মধ্যে বিশেষ হৈ-হল্লা হলােনা। কারণ খবরটি খুব সংক্ষেপে ছাপা হয়েছিল। আসলে ভারত সরকার বাংলাদেশের এই সব ঘটনাকালীন সময়ে দুই দেশের মধ্যে কোন আলােড়ন বিবাদ সৃষ্টি করতে চাননি। যদিও এনায়েতুলা এবং আনােয়ার হােসেন মনজু প্রতিদিন ভারতের বিরুদ্ধে বিষােদগার করছিলেন। কিন্তু ভারতীয় সাংবাদিকেরা এবং সংবাদপত্রগুলো সংবাদ প্রকাশ এবং সম্পাদকীয়ের ব্যাপারে অনেক সংযত ছিলো। | এই পরিপ্রেক্ষিতে একটি বিশেষ ঘটনা না বললেই নয়। ঘটনাটি হলো এনায়েতুলার ভারতবর্ষ হয়ে পশ্চিম জার্মানী ভ্রমণ। খালেদ মুশারফের কু দ্য আঁতাত করবার আগেই এনায়েতুল্ল। পশ্চিম জার্মানীতে ভ্রমণের একটি আমন্ত্রণ পেয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ঐ রাজনৈতিক দ্রুত ঘটনা পরিবর্তনের জন্যে এনায়েতুল। বেশ কিছুদিন বিদেশে যাবার কোন ইচ্ছা প্রকাশ করেননি। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা পাবার পর এনায়েতুল্ল। ঠিক করলেন যে এবার নিশ্চিন্ত মনে পশ্চিম জার্মানীতে যাওয়া যায়। কারণ জিয়ার সরকার কিংবা তার শাসনকালের যে আদৌ কোন বিপদের সম্ভাবনা আছে এই চিন্তা তার মনে ঢােকেনি। এনায়েতুলা ছিলেন জিয়াউর রহমান এবং এয়ার মার্শাল তােয়াবের বিশেষ বন্ধু।
নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহ অবধি এনায়েতুল্লা খানের সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব ছিলো কিন্তু কোন আন্তরিকতা কিংবা হৃদ্যতা ছিলোনা। কারণ এনায়েতুল্লা ছিলেন ঘাের ভারত বিদ্বেষী আর এই কারণবশত: জিয়াউর রহমান এবং তোয়াব এনায়েতুল্লাকে বিবিধ কাজে ব্যবহার করতেন। পরবর্তীকালে এনায়েতুল। কিছুদিনের জন্য জিয়াউর রহমানের ক্যাবিনেটের একজন প্রধান সদস্য হয়েছিলেন এবং তখন জগদল রাজনৈতিক পার্টির প্রধান সেক্রেটারী
________________________________________
ছিলেন। পরে এনায়েতুল্লার সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঝগড়া হয় এবং এনায়েতুল্লা মন্ত্রীত্বের পদ থেকে পদত্যাগ করেন।
এনায়েতুল্লা খালেদ মােশারফের মৃত্যুর পর আমার কাছে এসে বললেন যে তাকে কিছুদিনের জন্যে পশ্চিম জার্মানীতে যেতে হবে। কিন্তু পশ্চিম জার্মানীতে তখন যাবার পথ হলাে ভারতবর্ষ দিয়ে। এনায়েতুল। নিজেও জানতেন যে ভারতবর্ষে তার বিশেষ কোন বন্ধু নেই। এক মাত্র কলকাতায় কয়েকজন ছাড়া।
এনায়েতুল্লাকে স্পষ্ট বলা হলো—যাবেন, যান। কিন্তু কলকাতা এবং বােম্বাই শহরে দুটো জায়গায় একই যাত্রায় যাবার সম্ভাবনা নেই। কারণ নিয়মানুযায়ী বাংলাদেশী বিদেশগামী যাত্রীদের ভারতবর্যের দুই শহরে যাওয়া নিষেধ। এনায়েতুল্লা বললেন যে তার কলকাতায় দু’একজন বন্ধুর সঙ্গে দেখা করা দরকার। দিল্লীর কর্তারা এনায়েতুল্লাকে ভিসা দিতে কোন আপত্তি করলেন না। কিন্তু শুধু একটি সর্তে ভিসা দেওয়া হলাে : হয় এনায়েতুল্ল। কলকাতায় যাবেন, না হয় বােম্বইতে।
এনায়েতুল। মুখে বললেন যে তিনি শুধু কলকাতায় যাবেন। বােম্বাইতে যাবার তার কোন ইচ্ছে নেই। কিন্তু যাবার সময় এনায়েতুল্লা ঠিক তার উল্টো কাজ করলেন। কলকাতা এবং বােম্বাই দুটো শহরেই নামলেন। ব্যাপারটা আইন বিরোধী, উনি যখন কলকাতায় নেমেছেন তখন বােম্বাইতে নামবার কোন প্রশ্নেই ওঠে না।
এনায়েতুল্লা বােম্বাইতে নামবার সঙ্গে সঙ্গে ইমিগ্রেশন অফিসার সবিনয়ে বললাে : স্যার আপনার বােম্বাইতে নামবার অনুমতি নেই। যাদের বাংলাদেশী পাসপাের্ট তাদের দুটো শহরে নামবার অধিকার নেই। এনায়েতুল্ল। চীৎকার হৈ-হল্লা সুরু করলেন। কিন্তু বােম্বাইয়ের পুলিস নাছোড়বান্দা। তারা বললাে আমরা নিয়মের বাইরে কোন কাজ করতে পারবাে না। তখন ঠিক হলাে এনায়েতুল্লাকে পরবর্তী প্লেনে ফ্রাঙ্কফুর্টে পাঠিয়ে দেওয়া হবে। অতএব এনায়েতুল্লাকে বোম্বাই বিমান বন্দরে প্রায় পাঁচ ছয় ঘণ্টা অপেক্ষা করতে হলো।
ইতিমধ্যে লণ্ডন থেকে জিয়াউর রহমানের কাছে একটা টেলিফোন এলাে। খবর হলাে : এনায়েতুল্লাকে বোম্বাইয়ের পুলিশ গ্রেপ্তার করেছে। সমর সেন এই গুজবের তীব্র প্রতিবাদ করলেন। কিন্তু বাংলাদেশের সরকারের কাছে তীব্র প্রতিবাদ করবার কোন মূল্য ছিলাে না। তারা চুপ করে থাকতেন এবং পরে বাংলাদেশী সাংবাদিকদের কাছে ভারত বিরােধী কথা বলতেন।
কয়েক মুহুর্তের মধ্যে ঢাকা শহরে গুজব ছড়িয়ে গেলে যে ভারত সরকার এনায়েতুল্লাকে গ্রেপ্তার করেছেন। গুজবে গারো বলা হলাে যে ঐ গ্রেপ্তারের মূলে নাকি আমি ছিলুম। ব্যাঙ্কক হয়ে এনায়েতুল্লা সহজেই ফ্রাঙ্কফুটে যেতে পারতেন। কিন্তু আমি নাকি তাকে বলেছি : খান সাহেব অতো কষ্ট করবেন কেন, কলকাতা-বােম্বাই হয়ে যান, সোজা রাস্তা। কিন্তু এ ধরণের কথা আমি কখনই এনায়েতুল্লাকে বলিনি।
জিয়াউর রহমান এবং তার সহকর্মীরা আমার বিরুদ্ধে নালিশ করলেন। আর এই নালিশই আমার কাল হয়ে দাড়ালাে। বাংলাদেশ সরকার ঠিক করলেন যে আমাকে বাংলাদেশ থেকে তাড়িয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু আমার বিরুদ্ধে অভিযোগে তালিকা বৃদ্ধি করার জন্য আরো কিছুদিন অপেক্ষা করা হলাে।
বাংলাদেশে চার নম্বর কু দ্য আঁতাতের তারিখ হলো ২৩শে নভেম্বর। এই তারিখে জিয়াউর রহমান তার বন্ধু এবং তার সহকর্মী আবু তাহেরকে গ্রেপ্তার করে এবং পরে জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের আরো বহুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। বলা প্রয়োজন যে খােন্দকার সাহেব প্রেসিডেন্ট হবার সঙ্গে সঙ্গে বহু পাকিস্তানীপন্থী রাজাকার, মুসলিম লীগ এবং জামায়েত ইসলামীদের জেল খানা থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। এদের মধ্যে কিছু রজাকার এবং আলবদরের। লোকও ছিলো। জাসদ জিয়াউর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্ত করার আগে একটি শর্ত করেছিলো যে জাসদের বন্দী নেতা এবং সদস্যদের অবিলম্বে ছেড়ে দেওয়া হবে। হিসাব করে দেখা গিয়েছিলাে যে জাসদের প্রায় দশ হাজার কমী জেলখানায় ছিলেন। এদের মধ্যে অনেকেই ছাড়া পেলেন। এছাড়াও জাসদের নেতারা বিশেষ করে রব এবং জলিল একটি সর্বদলীয় সরকার সংগঠনের দাবী করলেন। জাসদের দাবীতে নির্বাচন, সংবাদপত্রের পূর্ণ স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সভা আন্দোলন গঠন এ ধরণের আরো কিছু চাহিদা ছিল। যদিও জাসদের বহু নেতা বিশেষ করে রব এবং জলিল জিয়াকে সমর্থন করতেন না তবু আবু তাহেরের বক্তব্য ছিলো যে বর্তমান পরিস্থিতিতে জিয়াউর রহমানই বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট হবার যোগ্য। কিন্তু আবু তাহেরের কিংবা তার বন্ধুরা জানতে পারেননি যে জিয়াউর রহমান মহাবুব আলম চাষী এবং রক্ষণশীল পন্থীদের সঙ্গে ও বিশেষ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রেখেছিলেন। সোজা ভাষায় বলা
________________________________________
যায় জিয়াউর রহমান ক্ষমতা পাবার জন্যে গােপনে গোপনে সব রকম নেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা করছিলেন।
এই প্রসঙ্গে আবার বাংলাদেশের ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্স বাহিনীর কথায় ফিরে আসতে হয়। কারণ খােন্দকার মুস্তাক ক্ষমতা পাবার সঙ্গে সঙ্গে শফদর এবং আব্দুর রহিমের দল বিশেষ ক্ষমতাশালী হয়ে উঠেছিল। খােন্দকার যখনই কারু সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ আলােচনা করতেন তখনই আব্দুর ঐ মিটিং-এ উপস্থিত থাকতেন এবং আলাপ আলোচনার সারাংশ তৈরী করতেন। | ৯ই নভেম্বর ঢাকা শহরে একটি ছাত্র আন্দোলন হয় কিন্তু ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের বাংলাদেশের স্পেশাল পুলিশ বাহিনী এই ছাত্র আন্দোলনকে ভেঙ্গে দেয়। এই সময়ে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তারা জেনারেল জিয়াকে স্পষ্ট করে বললেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে জাসদের কর্মীরা হাঙ্গামা সুরু করতে পারে। অতএব কোন প্রকার বামপন্থী রাজনৈতিক দলকে সংগঠনের কাজ করতে দেওয়া যুক্তিসঙ্গত হবে না। শুধু তাই নয় ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তারা আরাে বললেন যে জিয়াউর রহমান বামপন্থী দলের সঙ্গে যেন কোন সংশ্রব না রাখেন। জিয়া শফদর এবং আব্দুর রহিমের দলের কথা মেনে নিলেন। জাসদের যেসব নেতাদের ছেড়ে দেওয়া হয়েছিলাে তাদের আবার গ্রেপ্তার করা হলো। জাসদের ছাত্র নেতা মহাবুবুন হককে পুলিশ বাহিনী গ্রেপ্তার করলাে। জাসদ নেতা এবং কর্মীদের মধ্যে চাঞ্চল্য সুরু হলো। জাসদ নেতাদের গ্রেপ্তার করার কাজকর্মে প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন মুসা মিয়া চৌধুরীর প্যারা মিলিটারী ফোর্স।
ছাত্র নেতাদের গ্রেপ্তারের পর জাসদ জিয়াউর রহমানের সঙ্গে অসহযােগিতা শুরু করলো। আর সঙ্গে সঙ্গে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্সের পরামর্শে এবং প্যারা মিলিটারী ফোসের সাহায্য নিয়ে জাসদের প্রধান নেতৃবৃন্দদের আবার বন্দী করা হলো। এই বন্দী নেতাদের মধ্যে ছিলেন হাসনুল হক চৌধুরী। তবে এই সব নেতাদের গ্রেপ্তারের কাহিনী বাংলাদেশের সৈন্যবাহিনীর কর্তারা (একমাত্র জিয়া ছাড়া) আর কেউ জানতেন
। | ন্যাশনাল ইনটেলজেন্সের কর্তাদের সঙ্গে সরাষ্ট্র সচিব সালাহউদ্দীন ও মহাবুব আলম চাষীও জিয়াউর রহমানের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে
ছিলেন যে যতােদিন জাসদের নেতা এবং কর্মীরা জেলখানার বাইরে থাকবে ততােদিন বাংলাদেশে কোন শাস্তি থাকবে না। আসলে তাদের উদ্দেশ্য ছিলো জিয়াউর রহমানকে তাদের রক্ষণশীল দলে টেনে আনা। কিন্তু এটা সবাই বিলক্ষণ জানতেন যে ৭ই নভেম্বরে জাসদের তাহের যদি জিয়াউর রহমানকে কারাগার থেকে মুক্ত না করতেন তাহলে খালেদ মােশারফকে হটান সম্ভব ছিলােনা। জিয়াউর রহমান পরে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের প্রকৃত উদ্দেশ্য বুঝতে পেরেছিলেন। তিনি তখন ওয়াশিংটনে শিক্ষিত পুলিশ বাহিনীর সঙ্গে হাত মেলালেন।
এর পর থেকে বাংলাদেশে যে সব ঘটনা ঘটলাে তার মধ্যে সৈন্যবাহিনীর খুবই কম অংশ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশে ঐ সময়ে এবং বর্তমানে সবচাইতে শক্তিশালী এবং ক্ষমতাবান বাহিনী হলাে ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলীজেন্স। এদের কথা আবার পরে বলা যাবে।
২৪ শে নভেম্বর একদল স্পেশাল পুলিশ বাহিনী এসে আবু তাহেরকে বললাে যে জেনারেল জিয়া তার সঙ্গে দেখা করতে চান। তাদের কথা শুনে আবু তাহের বেশ বিস্মিত হলেন। কী ব্যাপার? জিয়ার কাছে তাকে নিয়ে যাবার জন্যে তো কোন বিশেষ পুলিশ বাহিনীর দরকার ছিলো না? তিনি জেনারেল জিয়াকে টেলিফোন করলেন। জবাব দিলেন এরশাদ ( বর্তমানে বাংলাদেশের চীফ অব দি আমি ষ্টাফ ]। এরশাদ মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন এবং মুজিব হত্যার সময় তিনি ছিলেন ভারতবর্ষে। এরশাদ স্বীকার করলেন যে আবু তাহের রব এবং জলিলের গ্রেপ্তারের মধ্যে সৈন্য বাহিনীর কোন হাত নেই। সব গ্রেপ্তারের জন্যে স্পেশাল পুলিশ বাহিনী [ মুসা মিয়া চৌধুরীর প্যারা মিলিটারী ফোস) দায়ী। অতএব তাহেরকে জিয়ার কাছে নিয়ে যাবার পরিবর্তে সােজা জেলখানায় নিয়ে যাওয়া হলো। তাহের প্রতিবাদ করবার চেষ্টা করলেন। কিন্তু বাংলাদেশের কর্তৃপক্ষ-মুজিবর রহমান, মুস্তাক আহমেদ কিংবা জিয়াউর রহমান কখনই কোনদিন কারু প্রতিবাদ শােনেননি। কিছুদিন পরে তাহেরকে রাজশাহী জেলে নিয়ে যাওয়া হল। সেখানে একটি স্পেশাল মিলিটারী ট্রিবিউনলের অধীনে তাহেরের বিচার হয়। অবশ্য গোপনে। সেই বিচারে তাহেরের সাজা হলে প্রাণদণ্ড।
তাহেরের গ্রেপ্তারের পর আরাে একটি উল্লেখযােগ্য ঘটনা ঘটলো।
________________________________________
সেই বিশেষ ঘটনাটি হলাে ভারতীয় হাইকমিশনার সমর সেনকে হত্যা করবার ব্যর্থ চেষ্টা। | ঘটনাটি সবিস্তারে বলা যাক। এখানে বলা প্রয়োজন যে মুজিব হত্যার মূল কারণ হলাে বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষকে বিচ্ছিন্ন করা। এখন আমার মনে হয়, গফর চৌধুরী আমাকে বলেছিলেন। আমার কথাটি হেসে খেলে উড়িয়ে দেবেন না। মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশে শান্তি শৃঙ্খলা বলে কিছু থাকবে না। আর যখনই এপার বাংলায় অশান্তি হবে তখনই আপনারা বিপদে পড়বেন। হাজার হাজার লােক আপনাদের দরজায় গিয়ে ভিক্ষের পাত্র নিয়ে দাড়াবে। ঐ সব শরণার্থীদের রক্ষা করতে আপনাদের প্রাণ বেরিয়ে যাবে।
যারা বাংলাদেশের ঘটনাবলী বেশ ভালাে করে জানেন তাদের অজানা। নেই যে প্রতিদিনই বাংলাদেশ থেকে কত নরনারী এপার বাংলায় আসছে। এরা সেখানে ফিরে যাবার নাম কখনােই করে না।
| সমর সেন যখন বাংলাদেশে এসে পৌছুলেন তখন ওই দেশে আথিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির বেশ অবনতি ঘটেছে। আজ আর আমি ওই সব কথার পুনরুথাপন করবে না। শেখ মুজিবর যদিও ভারতবর্ষকে ভালােবাসতেন তবু তার চারপাশে ভারত বিরোধী প্রচারকদের একটা বৃহ গড়ে উঠেছিল। দেশের এই সঙ্কটের হাত থেকে রেহাই পাবার জন্যে আওয়ামী লীগের সদস্যরা প্রচার করলেন যে বাংলাদেশের প্রয়ােজনীয় জিনিষপত্র গুলাে কলকাতায় পাচার করা হচ্ছে। বহু চেষ্টা করা সত্বেও এই অভিযােগ প্রমাণ করা হয়নি।
সেন সাহেব এই ধরনের গােলমাল হাঙ্গামার ভেতর গিয়ে পড়লেন। সব হাঙ্গামা মেটান গেলেও মিথ্যে প্রচার বন্ধ করা সহজ কাজ ছিলো না। বিশেষ করে ভারত বিরোধী সাংবাদিকদের, ব্যবসায়ীদের মুখ বন্ধ করা ছিলাে অতি কঠিন কাজ। এই ধরনের ঝামেলা হাঙ্গামার মধ্য দিয়ে ১৯৭৫ সালের ১৫ই আগষ্ট এসে গেলাে।
শেখ মুজিবর রহমান কখনােই বিশ্বাস করেননি যে বাংলাদেশীরা তাকে খুন করতে পারে। বহুবার তিনি এই মত ব্যক্ত করেছিলেন। তবে হত্যার কিছুদিন আগে কয়েক জনের কাছ থেকে এরকম আভাষ পেয়েছিলেন যে তাকে খুন করবার একটা চক্রান্ত করা হচ্ছে। তবুও শেখ মুজিবর রহমান এর প্রতিবিধান কিছুতাে করেনই নি বরং ওই সব চক্রান্তকারীদের
________________________________________
তিনি উচ্চপদে নিযুক্ত করলেন। এ ব্যাপারে তার বক্তব্য ছিল যে এভাবে তিনি পাকিস্তানীদের চোখে চোখে রাখছেন যাতে ওরা তার সঙ্গে শয়তানি করতে না পারে।
১৫ই আগষ্টে খুনের আভাষ পাওয়া সত্ত্বেও শেখ সাহেব তার নিজের আত্মবিশ্বাসের উপর বেশী নির্ভর করেছিলেন। সবাই করেছিলাে কারণ ওই সময়ে বাংলা দেশে মুজিবর রহমানের বিরােধী চক্রান্ত কেউ যে করতে পারে এই কথা ভাবাও ছিলো কল্পনার বাইরে।
বিদেশী এবং বহু বাংলাদেশীদের ধারণা ছিলো যে সেন সাহেব শেখ মুজিবর রহমানকে গােপনে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। অথচ সেন সাহেব তার নিজস্ব মন্তব্য প্রকাশ করা ছাড়া কখনও শেখ মুজিবর রহমান কিংবা বাংলা দেশের কোন জন-নেতাকে কোন প্রকারের পরামর্শ দেন নি।
তবু বাংলাদেশীরা এবং বিশেষ করে বাংলাদেশের সংবাদপত্র এবং বামপন্থী দল গুলাের বদ্ধ ধারণা ছিলাে যে ভারত বাংলা দেশের অভ্যন্তরীন ব্যাপারে বিভিন্ন প্রকারে হস্তক্ষেপ করছে। এ ছিলো একেবারে মিথ্যে কথা। সেন সাহেব এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধীর প্রধান উদ্দেশ্য ছিলো, বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের মধ্যে একটি বন্ধুত্বপূর্ণ আন্তরিক সম্পর্ক গড়ে তােলা। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাদের এই কাজ সফল হয়নি। এই ব্যর্থতার জন্যে কাউকে দোষ দেওয়া সম্ভব নয়। তার পুরাে কারণ হয়তো পাঠকেরা ইতিমধ্যে বুঝতে পেরেছেন।
হঠাৎ একদিন ভারতীয় হাইকমিশনার সেন সাহেবকে নিয়ে বাজারে এক আলোড়ন সৃষ্টি হলো। তার প্রথম আভাষ আমরা পেলুম ৭ই নভেম্বর সিপাহী বিপ্লবের দিনে। সবাই তখন সমর সেনকে অর্থাৎ ভারতবর্যকে গালমন্দ দিচ্ছে। এর কিছুদিন পরে তাকে খুন করবার জন্যে তার গুলশানের বাড়িতে বােমা বিস্ফোরণের চেষ্টা পর্যন্ত করা হলো।
তারপর এল সেই ছাব্বিশে নভেম্বর, যেদিন সমর সেনকে গুলী করে খুন করবার চেষ্টা করা হয়। কেন, তার সঠিক কারণ আজও জানা যায়নি।
সমর সেন প্রতিদিন সকাল সাড়ে নটার সময় দপ্তরে আসতেন। তার সঙ্গে থাকতো একটি সিকিউরিটা গার্ড এবং ড্রাইভার।
বাড়ি থেকে অফিস অবধি দুটি সিকিউরিটি জীপ আগে পেছনে থাকতো। সেন সাহেবের গাড়ী দপ্তরের ভেতর ঢুকে গেলে সিকিউরিটি জীপ দুটি বাইরে দাড়িয়ে থাকতাে।
________________________________________
২৪ শে কিংবা পচিশে নভেম্বর ভারতীয় তথ্য দপ্তরে দুটি ছেলে কতােগুলো টুরিষ্ট পুস্তিকা সংগ্রহ করবার জন্যে এলাে। ছেলে দুটির বয়স তেইশ কিংবা চব্বিশ। তারা এসে দপ্তরের সরকারী কর্মচারীদের বললে আমরা ভারতবর্ষ ভ্রমণে যেতে চাই। এই ভ্রমণের জন্যে কিছু পুস্তিকা আমাদের প্রয়ােজন।
ওদের নিয়মানুযায়ী বইগুলো দেওয়া হলো। একটি ছেলে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা বলুন তো স্যর আপনাদের দেশে বেড়াতে যাবার ভিসা কী করে পাবো?
ভিসা অফিসে চলে যান। ওখানকার লোকেরা আপনাদের ভিসা পাবার সঠিক আইন কানুন বলতে পারবে। দপ্তরের এক জন জবাব দিলো।
ছেলে দুটি ভিসা অফিসে খোজ খবর নিতে গেলাে। তখনও দপ্তরের কারু মনে সন্দেহ হয়নি যে ওরা ভারতবর্ষে যাবার জন্য ভিসা চাইছে কেন? এই ভিসা চাইবার পেছনে কী অন্য কোন কারণ আছে ?
ভিসা অফিসার কিংবা হয়ত তার অন্য কোন সহকর্মী বেশ কিছুক্ষণ ছেলে দুটির মুখের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, তোমাদের বয়স কতো?
ওর বয়স চব্বিশ আমার বয়স ছাব্বিশ। দুজনের একজন জবাব দিলো।
ঐ দেশে কী কারণে যেতে চাও? ভিসা অফিসার একটি গতানুগতিক প্রশ্ন করলেন। তখনও ভিসা অফিসারের মনে সন্দেহ জাগেনি যে ছেলে দুটি অন্য কোন কারণে ভিসা চাইছে।
বেড়াতে যাবাে স্যর। আমরা সাইকেল করে ঐ দেশে বেড়াতে যাবে। সাইকেলে দেশ বেড়াবার একটি বিশেষ এ্যাডভ্যাঞ্চার আছে। আর একটি ছেলে জবাব দিলো।
কিন্তু আমরা তো তােমাদের ভিসা দিতে পারবো না। তােমাদের বয়েসের ছেলেদের কিংবা মেয়েদের হাইকমিশনার কিংবা দিল্লীর কর্তাদের বিনানুমতিতে ভিসা দেওয়া নিষেধ আছে। ভিসা অফিসার জবাব দিলেন।
স্তর হাইকমিশনার কোথায় বসেন? আমরা গিয়ে ওর সঙ্গে দেখা করবো। একজন বললাে।
পাশের দালানে। ভিসা অফিসার বললেন।
এক নম্বর রােডে পর পর দুটি বাড়ি ছিলো। একটি বাড়িতে হাইকমিশনার এবং অন্যান্য পলিটিক্যাল অফিসারেরা বসেন। আর একটি বাড়িতে ছিলাে ভিসা অফিস।
________________________________________
পাশের দালানে গিয়ে ছেলে দুটি এবার হাইকমিশনার সমর সেনের সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করলো। সময় তখন প্রায় তিনটে।
সেন সাহেব তখন অফিসে ছিলেন না। তার সেক্রেটারী জবাব দিলাে : হাইকমিশনার আজ নেই। কাল আসবেন।
পরের দিন ২৪ শে নভেম্বর।
শহরে বেশ উত্তেজনা। জাসদের বড়ো নেতাদের পুলিশ হাজতে পুরেছে। যাদের ধরতে পারেনি পুলিশ ঐ সব পলাতকদের খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাদেরকে হেলিকপ্টারে করে রাজশাহী জেলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। রব এবং জলিল জেলখানায়। জাসদের সমর্থকেরা বিশেষ বিচলিত ও উত্তেজিত। তারা জিয়াউর রহমানকে সরল মনে বিশ্বাস করে তবে মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা করেছিলাে। আজ জিয়াউর রহমান তাদের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে। নিজেকে ডানপন্থী নেতা খােন্দকার ও মহাবুব আলম চাষীর কাছে বিক্রী করেছে। বিশ্বাসঘাতকতা ছাড়া আর কী? মীরজাফর !
ঢাকা শহরের যখন এই রকম রাজনৈতিক অস্থিরতা তখন সেন সাহেব ঐ দুটি ছেলের গুলিতে বেশ গুরুতর জখম হলেন।
পরের দিন ঠিক নটার সময় দুটি অন্য ছেলে প্রহরীর তীক্ষ্ণ নজর এড়িয়ে হাইকমিশনের রিসেপশনের ঘরে ঢুকে পড়লো। ঐ ঘরে আর একজন বৃদ্ধ ভদ্রলোক হাইকমিশনারের সঙ্গে দেখা করবার জন্যে প্রতীক্ষা করছিলেন। ছেলে দুটি গিয়ে ঐ ভদ্রলােকের পাশে বসলো। তারপর টেবিলের উপর থেকে দু-একটি ম্যাগাজিন নিয়ে নাড়াচাড়া করতে লাগলাে।
বাইরের রাস্তায় অন্য দুটি ছেলে হাইকমিশনারের গাড়ির জন্যে প্রতীক্ষা করছিলো।
হাইকমিশনার অবশ্যি নির্দিষ্ট সময়ে দপ্তরে এলেন। গাড়ী দপ্তরে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে ছেলে দুটি সশস্ত্র প্রহরীর অলক্ষ্যে হাইকমিশনের ভেতরে ঢুকে পড়লো।
হাইকমিশনার বাড়ির ভেতরে ঢুকবার সঙ্গে সঙ্গে রিসেপশন রুমের দুটি ছেলে এবং বাইরের দুটি ছেলে সেন সাহেবকে ঘিরে ফেললাে। তারপর আর কথা নেই। প্রথমে একটি ছেলে চীৎকার করে বললো, মার শালাকে।
আর একটি ছেলে বললাে: চল ব্যাটাকে ধরে নিয়ে যাই।
সেন সাহেব ছেলে চারটিকে দেখে এবং তাদের এই ব্যবহারে বেশ হকচকিয়ে গেলেন। প্রথমে ব্যাপারটা কী ঠিক বুঝে উঠতে পারলেন না।
________________________________________
এমন সময় দুম করে একটি ছেলে সেন সাহেবকে তাক করে একটি গুলি ছুড়লাে। গুলিটি এসে সেন সাহেবের ডান হাতে লাগলো। সেন সাহেব মাটিতে পড়ে গেলেন। এবার সেন সাহেবের বডি গার্ড একটি ছেলের উপর ঝাপিয়ে পড়ে একটি রিভলবার ওদের কাছ থেকে উদ্ধার করলো। তারপর ওই রিভলবার দিয়ে সে একটি ছেলেকে লক্ষ্য করে গুলি চালায়। ছেলেটি মাটিতে পড়ে গেলাে। ইতিমধ্যে গুলির আওয়াজ শুনে বাইরের সশস্ত্র প্রহরীর দল ছুটে এলাে। ঘটনার পরিস্থিতি বুঝে নিতে তাদের একটুও সময় লাগলাে
। সবাই বুঝতে পারলো যে সমর সেনকে খুন করবার চেষ্টা হয়েছে। ব্যস এবার তারাও গুলি ছুড়তে লাগলাে। | সেন সাহেব জখম হয়ে মাটিতে পড়ে গিয়েছিলেন। অতএব এই সব গােলাগুলি তার গায়ে লাগলাে না। দুটি ছেলে গুলির আঘাতে ঐখানেই মারা গেলাে। আর দুজন হলাে গুরুতর আহত।
রিসেপশন রুমের ওই বৃদ্ধ ভদ্রলােকটি তখনাে বলির পাঁঠার মতো কাপছিলেন। অবশ্যি কোন গুলিই তার গায়ে লাগেনি তবে তিনি তার জীবন সম্বন্ধে তখন বেশ আতংকিত ছিলেন।
বাইরে থেকে গুলির আওয়াজ শুনে হাই কমিশনের অনেক উচ্চপদের কর্মচারীরা ছুটে হাই কমিশনের ভেতরে এলেন। এখানে বলা দরকার যে হাইকমিশনের বাড়িগুলাে ছিলাে এদিক ওদিক ছড়ানাে। সমর সেন তখনও মাটিতে পড়ে আছেন। আর পুলিশের গুলিতে নিহত দুটি ছেলেও ওইখানে পড়েছিলো। তাদের সমস্ত দেহে রক্ত মাখা। আহত দুটি ছেলেকে বাইরে নিয়ে আসা হলো।
হাই কমিশনের ভেতরে গুলি চলছে এ শব্দ আমিও শুনতে পেয়েছিলুম। কিন্তু হাইকমিশনের বাইরে থেকে ভেতরে কি ঘটছে জানা সম্ভব ছিলােনা। আমি হাই কমিশনের ভেতর ঢুকবার চেষ্টা করলুম। আমার এক বন্ধু বললেন, খাবেন না ভেতরে। বাংলাদেশী কয়েকজন হাই কমিশন আক্রমণ করেছে। গুলি চলছে।
আমি অবশ্যি ওদের কথায় কান দিইনি। কারণ গুলি গোেলা কেন চলছে সেই কথা জানবার জন্যে আমি তখন বেশ উদগ্রীব ও উৎকণ্ঠিত। হাইকমিশনের ভেতরে ঢুকবার আগে দেখতে পেলুম বেশ কিছু লােক এক নম্বর রােডে দাড়িয়ে আছে। ওদের সবার মুখে বেশ উৎকণ্ঠা ও আতংকের চিহ্ন। এদের মধ্যে আনোয়ার হােসেন মনজুও ছিলেন। আমি অবশ্যি তখন
________________________________________
মনজুর সঙ্গে কথা বলবার সুযােগ পাইনি। পরে মনজুর মুখে শুনেছিলুম ধে হাই-কমিশনের ভেতর গুলির আওয়ায় শুনে রাস্তায় থমকে দাড়িয়ে পড়েছিল সে। জানবার আগ্রহ হয়েছিলো হাই কমিশনে গুলি গােল চলছে কেন?
| প্রথমে আমি হাইকমিশনের ভেতর ঢুকতে পারিনি। সশস্ত্র প্রহরী বাধা দিলাে। বললাে : বাইরের কারুরই ভেতরে ঢুকবার অনুমতি নেই। ভেতরে গােলমাল হচ্ছে। অবশি পরে আমাকে ঢুকতে দিলাে। সেন সাহেবকে উপরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। দুটি মৃতদেহ ঘরের ভেতর পড়ে আছে আর আহত দুটি লেক গােঙাচ্ছে।
এক টু বাদে ব্রিগেডিয়ার মনজুর আহমেদ এলেন। ঘটনার পরিস্থিতি দেখে তার বুঝতে অসুবিধে হলোনা যে ঘটনাটি বেশ গুরুতর পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে। তিনি হাই কমিশনের সামনে দু’চারজন সৈন্য মােতায়েন করে। চলে গেলেন। বললেন জেনারেল জিয়াউর রহমানকে সব খবর জানাবেন।
মনজুর আহমেদ চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ঢাকার ইনসপেক্টর জেনারেল অব পুলিশ ছুটে এলেন। তার সঙ্গে আরাে কয়েকজন উচ্চপদস্থ কর্মচারী। আই জি সেন সাহেবকে অনুরােধ করলেন আমার সঙ্গে চলুন স্যার। আপনাকে হাসপাতালে নিয়ে যাবো। সেন সাহেব কোন জবাব দেবার আগেই আই-জি হাইকমিশনারকে গাড়ীতে তুললেন। তার সহকর্মীরা কোন কিছু বলবার অবকাশ পেলাে না।
কিছুক্ষণ পরে শুনতে পেলুম যে সেন সাহেবকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। হাসপাতালের আসল নাম কেউ অবশ্যি বলতে পারলাে না। অনেক খোজ খবর নিয়ে জানতে পারলুম যে সেন সাহেবকে ঢাকার মুনিভাসিটি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
| মুনিভাসিটি হাসপাতাল বলবার একটি বিশেষ কারণ আছে। আজকাল ঢাকার সবচাইতে এই বড়ো হাসপাতালটি যে দালানে অবস্থিত সেইখানে আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অবস্থিত ছিলো। আমরা ছাত্র অবস্থায় ওই দালানে গিয়ে পড়াশুনা করতুম। বিশ্ববিদ্যালয়ের আর একটি শাখা ছিলো কার্জন হল। কার্জন হলে সাধারণত: সায়েন্স পড়ান হতো। আর ছিল ঢাকা হল যেখানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতাে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ঠিক শেষ ভাগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খানিকটা অংশে আমেরিকান বেস হাসপাতাল হলাে। পরে অবশ্য আমেরিকান সৈন্য বাহিনী অর্থাৎ 14th army বেশ হাসপাতাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উঠে অন্য বাড়িতে চলে যায়।
________________________________________
আমেরিকান আমি যুদ্ধের পরবর্তীকালে ওই হাসপাতাল পুর্ব পাকিস্তান সরকারকে দিয়ে যায়। তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের হাসপাতালটি হলাে পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান হাসপাতাল এবং মেডিকেল কলেজ পুরন মিটফোর্ড হাসপাতালের খ্যাতি অনেকটা হ্রাস পেয়ে যায়।
যুনিভাসিটি হাসপাতাল অর্থাৎ আজকাল যাকে বলা হয় মেডিকেল কলেজ -ওই হাসপাতালের প্রতিটি ঘরই আমার পরিচিত। বন্ধুরা বললেন : চলো তুমি আমাদের সঙ্গে। তুমি ওই বাড়ির আনাচ-কানাচ চেনে।
অবশ্যি আমি যা জানতুম সেটা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। কিন্তু ওই দালান হাসপাতালে রূপান্তরিত হবার পর আমি ওই বাড়িতে আর ঢুকিনি। তবু বন্ধুদের অনুরােধে পড়ে ওই হাসপাতালের ভেতর ঢুকলুম। আগে যেখানে লেডীজ কমন রুম ছিলাে সেইটে হয়েছে বর্তমানে রিসেপশন রুম। প্রথমে ওখানে গেলাম। কিন্তু সেন সাহেবের সঠিক খবর ওরা দিতে পারলেন না। শুধু বললেন : একবার এমার্জেন্সীতে গিয়ে খোঁজ নিন।
| মেন গেট দিয়ে দোতলায় এমার্জেন্সীতে গিয়ে খবর নিলুম। হা হাইকমিশনার সমর সেন এখানে এসেছেন বটে কিন্তু ওকে অপারেশন রূমে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। অতএব আমরা সবাই বাইরে প্রতীক্ষা করতে লাগলুম।
প্রায় দু’বণ্টা বাদে সেন সাহেবকে অপারেশন থিয়েটার থেকে তার স্পেশাল রুমে নিয়ে আসা হলাে। তখন তার জ্ঞান বেশ টনটনে। তিনি তার ঘরে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে দরের কাজকর্মের কথা বলতে লাগলেন। আমরা সবাই স্তম্ভিত—অবাক। ভেবেছিলুম উনি যন্ত্রণায় গােঙাবেন। কিন্তু কোন প্রকার কাতর অাওয়াজ প্রকাশ করা তো দূরের কথা বরং হেসে সবার সঙ্গে জোরে জোরে কথা বলতে লাগলেন। শুধু তাই নয়, ওই অবস্থায় দপ্তরে কাজকর্ম ও সুরু করে দিলেন। একজন অফিসারের ছুটিতে যাবার কথা ছিলাে, সেন সাহেব বেশ স্পষ্ট গলায় তাকে নির্দেশ দিলেন, যাও আমার জন্য ছুটী নষ্ট করে না। বেষ্ট অফ লাক। তারপর তিনি অফিসের বিভিন্ন কর্মচারীদের সঙ্গে তাদের দপ্তরের খুটিনাটি ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করতে লাগলেন। সুস্থ অবস্থাতে ও সেন সাহেব দপ্তরের এত বিষয় নিয়ে আলােচনা করতেন না। কিন্তু এখন তিনি প্রতিটি বিষয়ে খোঁজ খবর নিচ্ছিলেন।
মেডিকেল কলেজের ডাক্তার এবং নার্সরা ছিলেন অতি ভদ্র। ওদের কাছে রাজনীতি বলে কোন কিছু ছিলোনা এবং সেন সাহেবের প্রতি তার। আদর যত্বের কোন ত্রুটি করেননি।
________________________________________
ডাক্তাররা অনুরােধ করলেন যেন বাইরের লােককে সেন সাহেবের ঘরে ঢুকতে দেওয়া না হয়। ঠিক হলাে তার ঘরের সামনে পালা করে ডিউটি দিতে হবে।
বিকেলের দিকে জিয়াউর রহমান সেন সাহেবকে দেখতে এলেন। ডিউটি অফিসার তাকে কিছুতেই ঘরে ঢুকতে দেবে না। কারণ ডাক্তারের নিষেধ। অনেক অনুনয় বিনয় করার পর জিয়াউর রহমানকে ঘরে ঢুকতে দেওয়া হলো। সাত আট মিনিট সেন সাহেবের সঙ্গে কথা বলে জিয়াউর রহমান চলে গেলেন।
এবার সমর সেনকে হত্যাকাণ্ডের চেষ্টা করবার আরাে একটু বিস্তৃত খবর পাওয়া গেলো। জানা গেলো, যারা খুন করতে এসেছিলো তারা ছিলেন জাতীয় সমাজতন্ত্রী দলের সদস্য। একজনের নাম ছিলাে বেলাল এবং এই ছেলেটি ছিলো জাসদ দলের নেতা কর্নেল আবু তাহেরের ছােট ভাই। পুলিশের গুলিতে অবশ্যি বেলাল নিহত হয়নি। আহত দুজনকে মিলিটারী হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলাে। পুলিশের কাছে তারা একটি বিবৃতি দিয়েছিলো। আর সেই বিবৃতিতে ওর স্বীকার করেছিল যে জাসদ দলের ভারতীয় হাই কমিশনার সমর সেনকে খুন করবার কোন ইচ্ছে ছিলােনা। তাদের ইচ্ছে ছিলাে সমর সেনকে ‘কিডন্যাপ করা এবং পরে তার সমর সেনের মুক্তির পরিবর্তে জাসদের নেতা আবু তাহেরের মুক্তি দাবী করতেন। এখানে বলা দরকার যে ইতিমধ্যে জাসদ পার্টির সঙ্গে জিয়াউর রহমানের ঝগড়া বিবাদ এতাে তীব্র হয়েছিলাে যে বাজারে গুজব রটে গেলে যে জাসদ নেতা আবু তাহেরের বিচার করা হবে। প্রথমে কেউ বাজারের এই গুজৰে বিশ্বাস করতে চাননি। কারণ ওই নভেম্বর জিয়াউর রহমানের জীবন রক্ষা করেছিলেন আবু তাহের।
সমর সেনকে যে হত্যা করবার চেষ্টা করা হয়েছে এই কথাটি আগুনের মতাে শহরের চার দিকে ছড়িয়ে পড়লাে। কলকাতার সাংবাদিকেরা ঘন ঘন টেলিফোন করতে লাগলেন, পুরাে ঘটনা জানবার জন্যে।
এদিকে ঢাকা শহর তখন শুধু শান্ত নয়, প্রায় জনমানবহীন। ঢাকার বাসিন্দাদের চোখে মুখে একটা চিন্তার রেখা ফুটে উঠেছিলো। ভারতীয় রাজদূতকে হত্যা করার প্রচেষ্টা করা হবে এই কথা ওদের কাছে শুধু অবিশ্বাস্য ছিল না, ছিল কল্পনার অতীত। ঢাকার বাসিন্দারা এমন কী সরকারী কর্মচারীরা পর্যন্ত আশংকা করলেন যে ভারতীয় বিমান বাহিনী এবার ঢাকা
________________________________________
শহর আক্রমণ করবেন।
| বাজারের এই গুজবের প্রধান ভিত্তি ছিল একটি খবর। দিল্লী থেকে প্রাপ্ত সেই খবরে হঠাৎ জানা গেলো যে সমর সেনের ভালাে চিকিৎসার জন্যে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী গান্ধী একটি বিশেষ প্লেন পাঠাচ্ছেন। এই প্লেনে কিছু ডাক্তার আসছেন এবং এই প্লেনে করেই সমর সেনকে স্ট্রেচারেকরে কলকাতায় নিয়ে আসা হবে।
খবরটি সেন সাহেব শুনেছিলেন। তিনি তার এক সহকর্মীকে ডেকে বললেন : ওহে দিল্লীর কর্তাদের টেলিফোন করে বলল যে আমার জন্যে প্লেন পাঠাবার প্রয়ােজন নেই। আমি বর্তমান পরিস্থিতিতে ঢাকা ত্যাগ করবাে না।
সেন সাহেবের সহকর্মীরা তাকে বােঝাবার চেষ্টা করলো : স্যর আপনি স্পেশাল প্লেন আসতে নিষেধ করবেন না। আপনার কলকাতায় গিয়ে চিকিৎসা করাই উচিত।
সেন সাহেবের জন্যে দিল্লীর কর্তারা প্লেন পাঠাচ্ছেন এই খবরটি বাংলা দেশের প্রেসিডেন্ট সায়ামের কানে গেলো। সন্ধ্যার পর বিদেশ সচিব তােবারক হােসেন এবং তার এক সহকর্মী [খুব সম্ভবতঃ চীফ অব দি প্রটোকল]. এসে সেন সাহেবের সঙ্গে দেখা করলেন।
কী ব্যাপার ? সেন সাহেব বিছানায় শুয়ে শুয়ে জিজ্ঞেস করলেন। স্তর রাষ্ট্রপতি সায়াম আপনার সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলতে চান। তােবারক হােসেন জবাব দিলেন। কেন? সেন সাহেব কৌতুহলী হয়ে প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে উনি জানতে চান আপনি কেমন আছেন? তোবারক হােসেন বললেন।
ভালােই আছি। সেন সাহেব এবার হাসবার চেষ্টা করলেন। রুগীর ঘরে একটি টেলিফোনের যন্ত্র ছিলাে। কিছুক্ষণ নাড়াচাড়া করার পর দেখা গেলাে যন্ত্রটি বিকল, কাজ করছে না।
এবার তােবারক হােসেন তার মনের কথা খুলে বললেন।
স্যর আপনি নিশ্চয় শুনেছেন আপনাকে নিয়ে যাবার জন্যে দিল্লী থেকে একটি বিশেষ প্লেন পাঠান হচ্ছে।
| হা, কিন্তু আমি ওদের মানা করে দিয়েছি যাতে ঐ প্লেন না পাঠান হয়। না আমি বাংলাদেশ ত্যাগ করে যাবাে না। সেন সাহেব জবাব
________________________________________
দিলেন।
এবার তোবারক হোসেনের মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠলাে।
তিনি সেন সাহেবকে জিজ্ঞেস করলেন : তাহলে আমরা প্রেসিডেন্টকে কী বলবাে?
বলুন গিয়ে যে সমর সেন বর্তমানে বাংলাদেশ ত্যাগ করে যাবে না। আমি ঐ প্লেন ফেরৎ পাঠাতে বলেছি।
তোবারক হোসেন এবং তার সহকর্মী এবার খুশী মনে চলে গেলেন।
আমি এতােক্ষণ ঘরের ভেতর চুপ করে বসেছিলুম। সেন সাহেব এবং তােবারক হােসেনের আলাপ আলোচনায় যােগ দিইনি। তোবারক হোসেন চলে যাবার পর একটি প্রশ্ন না করে পারলুম না : স্যার আপনি একী করলেন ? কেন কলকাতায় যাবেন না। | সেন সাহেব বেশ কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। মনে হলো তিনি কিছু ভাবছেন কিংবা তার যন্ত্রণা বেড়েছে। একটু বাদে বললেন : দ্যাখো আমি যদি এক্ষুনি প্লেনে করে কলকাতায় চলে যাই তবে বাংলাদেশের হিন্দুরা ভয় পাবে। আমার মুখের পানে ওরা তাকিয়ে আছে। আমি চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে ওরাও ভারতবর্ষে চলে আসতে শুরু করবে। অার ঐ সব লোক গুলো যদি এই দেশের ভিটেমাটি ছেড়ে আমাদের দেশে চলে আসতে শুরু করে তাহলে ফলাফল কী হবে বলতে পারে। আবার আমাদের দেশে হাজার হাজার শরণার্থীর দল এসে হাজির হবে। আমাদের দেশের শাসনত ভেঙ্গে পড়বে । আমি এই দেশের সংখ্যালঘুদের মনে সাহস দিতে চাই। আর এই সময়ে ঢাকা থেকে চলে যাওয়া হবে পলাতকের কাজ। আমি যাবাে না।
সেন সাহেবের এই জবাবের মধ্যে বেশ খানিকটা যুক্তি ছিলো। যদিও পরবর্তীকালে অনেকেই তার এই সিদ্ধান্তের বিচক্ষণতা নিয়ে প্রশ্ন করেছিলেন। সত্যিই কী বাংলাদেশের সংখ্যালঘুর দল ভয় পেতাে। আমার কিন্তু পরে মনে হলো যে সেন সাহেব ঠিকই বলেছিলেন।
. সেদিন কথা বলতে বলতে সেন সাহেবের গলা ধরে গিয়েছিলাে। আমার মনে হয় তার চোখে দুচার ফোটা জলও দেখতে পেয়েছিলুম। জীবনের এতাে বিপদ থাকা সত্বেও সেন সাহেব তার আদর্শ কিংবা বলতে পারি তার কর্মের গতি থেকে একটুও বিচ্যুত হননি।
সমর সেনের সঙ্গে আমার দীর্ঘ দিনের আলাপ পরিচয়। বেটে থাকা-কালীন আমরা দুজনে মিলে প্যালেষ্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের সঙ্গে
________________________________________
w.facebook.com
কাগতের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলবার চেষ্টা করেছিলুম। কারণ ঐ সময়ে আমরা দুজনেই বুঝতে পেরেছিলুম যে আরব-ইস্রাইলী সংগ্রামের মধ্যে পি-এল- ও একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ও অপরিহার্য অংশ। সেদিন দিল্লীর কর্তারা পি-এল- ওর গুরুত্ব বুঝতে পারেননি। আমাদের সুপারিশ অগ্রাহ করেছিলেন। যখন তারা বুঝতে পারলেন তখন আরব-ইস্রাইলী যুদ্ধের প্রথম এবং দ্বিতীয় ভাগ শেষ হয়ে গেছে।
অামাকে সেদিন সমর সেনের যুক্তির সঙ্গে সায় দিতে হলো। স্বীকার করতে হলো। ঐ ঘটনার পর সেন সাহেবের আরাে বেশ কিছুদিন ঢাকায় থাকবার প্রয়োজন আছে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মনে আতংক সৃষ্টি করা অনুচিত হবে। – কিন্তু বাধা এলো দিল্লির কর্তাদের কাছ থেকে। শ্ৰীমতী গান্ধী বেশ পরিস্কার তাষায় বললেন যে প্লেন ঢাকায় যাবেই। আর ওই প্লেনে যাবেন তিনজন ডাক্তার এবং একজন পররাষ্ট্র দপ্তরের কর্মচারী।
প্লেন পাঠান নিয়ে আর একটি গোলমাল হলো। বাধা এলাে বাংলাদেশের সরকারের কাছ থেকে। সেন সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা বলবার পর ঢাকা এয়ারপোর্টের কন্টে লি টাওয়ার ভারতীয় বিমানকে নির্দেশ দিলে যে ওদের ঢাকায় আসার কোন প্রয়ােজন নেই। কিন্তু তাদের নিষেধাজ্ঞা দিল্লির কর্তারা শুনলেন না। তারা ঢাকার কন্টেলি টাওয়ারকে স্পষ্ট জানালেন যে তারা ভারতীয় হাইকমিশনারকে দেখার জন্যে ডাক্তার এবং ওষুধপত্র নিয়ে আসছেন। এইখানে বলা প্রয়োজন যে ঢাকায় কোন মূল্যবান কিংবা প্রয়োজনীয় ওষুধপত্র তখন একেবারেই দুর্লভ ছিলাে। | রাত বারোটার সময় প্লেন এসে পৌছল। ভােরবেলার সেন সাহেবকে দিল্লির কর্তাদের অভিমত জানান হলাে। সেন সাহেব আর কোন আপত্তি করলেন না।
সকাল দশটা নাগাদ ডাক্তারদের দল এসে সেন সাহেবকে পরীক্ষা করলেন। ডাক্তারদের দল ঢাকার চিকিৎসকদের সঙ্গে একমত হলেন এবং ঠিক হলাে যে সেন সাহেব একটু ভালো বােধ করলেই কলকাতায় গিয়ে স্পেশালিষ্টদের সঙ্গে দেখা করবেন। অতএব সেই যাত্রায় সেন সাহেব কলকাতায় গার গেলেন না।
________________________________________
| সেন সাহেবকে খুন করবার জন্যে তাহেরের দুই ছােট ভাই গিয়েছিলাে। তারা অবশি সিকিউরিটি পুলিশের গুলিতে মারা যায়নি। কিছুদিন পরে তাহেরের বিচারের সময় তার দুই ছােট ভাইকেও আদালতে পেশ করা হলাে।
রাজশাহী থেকে আবু তাহেরকে ঢাকা সেন্ট্রাল জেলে বদলী করা হলাে। আবু তাহেরের বিচারের জন্যে সরাষ্ট্র সচিব সালাহউদ্দীন এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলীজেন্সের কর্তারা পীড়াপীড়ি করতে লাগলেন। কারণ ওই সময়ে জেনারেল জিয়ার জন্যে তাহেরকে কাঠগড়ায় দাঁড় করান একান্ত আবশ্যকতা ছিলো। কারণ জেনারেল জিয়াউর রহমান জানতেন যে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে এবং বিশেষ করে সেপাইদের মধ্যে তাহেরের অপ্রতিহত ক্ষমতা ছিলাে। তিনি তাহেরকে পথের কাটা বলে গণ্য করতেন। অতএব যখন ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলীজেন্সের কর্তার দাবী করলেন যে সৈন্য বাহিনীর মধ্যে অনিয়ম এবং বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করবার জন্যে তাহেরের বিচার হওয়া একান্ত আবশ্যক তিনি তার সম্মতি জানালেন। অবশ্যি বাজারের সবাই জানতো যে এই বিচারের কী সাজা দেওয়া হবে। মৃত্যুদণ্ড।
| তাহেরকে বিচার করবার জন্যে এক স্পেশাল ট্রিবিউন্যাল গঠন করা হলাে। ট্রিবিউন্যালের বিচাপতি হলেন কর্নেল য়ুসুফ হায়দার। এবং চীফ পাব্লিক প্রসিকিউটার এ-টি-এম আফজল। পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দেওয়া দরকার যে প্রধান বিচারপতি হায়দার এবং পাবলিক প্রসিকিউটার আফজল সাহেব মুক্তি যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন এবং তারা সদা সর্বদাই যুদ্ধের বিরােধী ছিলেন।
বিচার অতি গোপনে করা হলো এবং জনসাধারণ ও প্রেসকে বিচারের সময় আদালতে উপস্থিত থাকার অনুমতি দেওয়া হলাে না। ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলিজেন্সের কর্তারা জেলখানার বাইরে তীক্ষ্ণ নজর রাখলেন এবং কোন ফটোগ্রাফারকে জেলখানার ধারে কাছে আসতে দেওয়া হলাে না।
তাহেরের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযােগ হলাে যে তিনি সরকারের বিরোধী বিপ্লব করবার চেষ্টা করেছিলেন। দৃষ্টান্ত হিসেবে ৭ই নভেম্বরের সিপাহী বিদ্রোহের আয়ােজন করেছিলেন। শুধু তাই নয়, তিনি সাধারণ সিপাহীদের মধ্যে অনিয়ম বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছিলেন। এই ধরণের আরাে বহু অবাস্তব অভিযােগ করা হলাে। তাহেরের বিচারের কথা ইত্তেফাক সংবাদপত্র প্রকাশ করেছিলাে। কিন্তু সংবাদ প্রকাশের পরের দিনই আনোয়ার হােসেন মনজুর ডাক পড়লো জেনারেল জিয়াউর রহমানের দপ্তরে। তাকে শাসান হলাে যদি
________________________________________
ভবিষ্যতে কর্নেল আবু তাহেরের বিচারের কোন খবরাখবর ইত্তেফাক সংবাদপত্রে প্রকাশ করা হয় তাহলে সেই পত্রিকা বন্ধ করে দেওয়া হবে। এরপর ইত্তেফাক সংবাদপত্র তাহেরের বিচারের আর কোন সংবাদ প্রকাশ করেনি। অবশ্যি বিচারের রায় প্রকাশিত হবার পর বাংলা দেশ অবজার্ভার’ পত্রিকা শুধু একটি ছােট খবর প্রকাশিত করে লিখলাে : তাহেরকে মৃত্যুদণ্ডের সাজা দেওয়া হয়েছে।
বিচার পতির রায় প্রেসিডেন্ট সায়াম বিনা দ্বিধায় কিংবা সংকোচে স্বীকার করে নিলেন।
২১শে জুলাই ১৯৭৬ সালে তাহেরকে ফঁাসী দেওয়া হলো।
তাহেরের বিচারকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ভাবে তলিয়ে দেখবার আগে একটি প্রশ্ন করা দরকার।
প্রশ্নটি অবশ্য প্রথমেই জিজ্ঞেস করা হয়েছে। এখন তার উত্তর জানা আবশ্যক। প্রশ্নটি হলাে: মুজিবর রহমান এবং জিয়াউর রহমানের আসল হত্যাকারী কে?
মুজিবর রহমানের হত্যা এবং তার পরবর্তীকালে যে সব উল্লেখযােগ্য ঘটনা বাংলাদেশে ঘটেছিলাে সেই ঘটনার বিস্তৃত বিশ্লেষণ আমরা আগেই করেছি। আমরা জানি যে মুজিবর রহমানের হত্যাকারী ছিলেন ছয়জন মেজর এবং তাদের অন্য কিছু সহকর্মী। আর এই হত্যার পেছনে ছিলেন। অর্থাৎ ইন্ধন জুগিয়েছিলেন খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ, মহাবুব আলম চাষী, এ বি শফদর এবং ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সের কর্তারা। বাইরের কোন বিদেশী রাষ্ট্র মুজিবর রহমানের হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলাে কিনা এবার সেইটেও বিচার করে দেখবার বিষয়। কারণ মুজিবর রহমানের হত্যার পর বাংলা দেশের শাসনতন্ত্রে এবং দেশের রাজনৈতিক আবহাওয়ায় আমুল পরিবর্তন এসেছিল। এবং তার সঙ্গে অরাজকতাও দেখা দিয়েছিল। তবে জিয়াউর রহমান মুজিব হত্যার চক্রান্তের সবকিছুই জানতেন। তাই তার পক্ষে কোন রাজনৈতিক দলকে এবং সৈন্য বাহিনীর জেনারেলদের শাসন করা কিংবা তাদের ভেতর শৃঙ্খলা বজায় রাখা সহজ কাজ ছিলাে না। মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ যে তার শাসনকালের শেষ পর্যায়ে দেশে অর্থ নৈতিক এবং রাজনৈতিক পরিস্থিতির অবনতি হয়েছিলো। এই সময় যারা শেখ
________________________________________
সাহেবের বিরােধিতা করবার চেষ্টা করেছিলেন তারাই শফদরের ইনটেলীজেন্স বাহিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করলাে। মৃত্যুর কয়েকমাস আগে মুজিবর রহমান মস্কো থেকে ফিরে আসবার পর একদলীয় শাসনতন্ত্র চালু করবার চেষ্টা করেছিলেন। যাদের হাতে এই বাকশাল গঠন করবার দায়িত্ব দিয়েছিলেন তারা সত্যিই, এই কাজের উপযুক্ত ছিলেন কিনা এ বিষয়ে দ্বিমত আছে। মুজিব নিজে গণতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন বটে কিন্তু বাকশাল গঠন হবার পর বিরােধী নেতাদের তিনি বিরােধিতা করতে লাগলেন। আর শেখ মুজিবর রহমান কোন কালেই যা দমন করতে পারেননি সেটি হলাে দুর্নীতি। এই দুর্নীতি অবশি দেশের জনসাধারণের মধ্যে খুব বেশী বিস্তার না হলেও সরকারী এবং বেসরকারী উচ্চমহলে বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতাদের মধ্যে এর খুব প্রচলন হয়েছিল। বাংলাদেশের সরকারী আমলারা আয়ুব খানের শাসনকালে অবৈধ ভাবে প্রচুর অর্থ উপার্জন করেছিলেন। এর একটি দৃষ্টান্ত দেওয়া যাক। ঢাকার অতি ফ্যাসনবেল এলাকা গুলশানে অধিকাংশ সরকারী আমলাদের বাড়ি কিংবা জমি আছে। গুলশানের কোন বাড়ির মূল্যই সাত কিংবা দশ লাখের কম নয়। এর থেকে বলা যায় যে আয়ুব খানের আমলে বাংলাদেশের অধিকাংশ আমলাদের প্রচুর উপরি টাকা রোজগার হতাে। এছাড়া প্রেস ক্লাবের অনেক সাংবাদিক দেশের সরকারের কাছ থেকে বিভিন্ন উপায়ে অর্থ উপার্জন করতেন।
শেখ মুজিবর রহমানের আমলে আর এক নতুন সম্প্রদায় এই অবৈধ টাকা রােজগারের অংশীদারী হলেন। এরা হলেন আওয়ামী লীগের কর্মীবৃন্দ। অতএব আমলাদের রোজগারের অংশ কমে গেলে এবং তাদের মধ্যে প্রচুর বিক্ষোভ শুরু হলাে। আর একটি কারণে সরকারী আমলারা মুজিব বিরােধী হলেন। শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকালে ভারত এবং বাংলাদেশের মধ্যে যে বাণিজ্য চুক্তি হয়েছিল সেই চুক্তি থেকে অবৈধ উপায়ে অর্থ রোজগারের কোন পথ ছিলাে না। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বহু সরকারী কর্মচারী ব্যবসা-বাণিজ্যের পারমিট ইস্যু করে পয়সা করবার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা এই চুক্তির পর ব্যর্থ হয়েছিল।
| অতএব শেখ মুজিবর রহমানের শাসনকালে সরকারী আমলাদের পরিবর্তে আওয়ামী লীগের সদস্যরা অবৈধ উপায়ে পয়সা রোজগার করতে সুরু করলেন। এদের কলকাতার বহু ব্যবসায়ীর সঙ্গে সম্পর্ক ছিলাে। তাদের কাছে ওরা বৈধ এবং অবৈধ উপায়ে জিনিষপত্র পাচার করতে সুরু করলেন।
________________________________________
শেখ সাহেবের আমলে অনেক সাংবাদিকেরও অবৈধ রােজগার বন্ধ হয়ে | গিয়েছিলাে। তাই এবার তারা দেশের আমলাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে ভারতে বাংলাদেশের জিনিষ পাচার হয়ে যাচ্ছে এই শ্লোগান প্রচলন করলেন। ভারত বিদ্বেষী প্রচারের এই হলো একটি বিশেষ কারণ। | আগেই বলা হয়েছে যে দেশের সৈন্য বাহিনীদের মধ্যে দুটো স্পষ্ট ভাগ ছিলাে। একটি অংশে ছিলেন তারা যারা বাংলাদেশের যুদ্ধের সময় পাকিস্তানে ছিলেন। এরা প্রথম দিকে পাকিস্তানের সৈন্য বাহিনী ত্যাগ করে বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাননি। যখন যুদ্ধের পর তারা ঢাকাতে ফিরে আসলেন তখন তারা বেশ অনিচ্ছা সহকারে তাদের কাজ-কর্ম শুরু করেছিলেন। ঢাকা শহরে ফিরে এসে তাদের আর একটি অসুবিধে হলাে। শেখ মুজিবর রহমান এই সব সৈন্য বাহিনীদের প্রথমে অবিশ্বাস করতে শুরু করেছিলেন। পরে অবশ্য অনেককেই সৈন্য বাহিনীর এবং ইনটেলজেন্স বাহিনীর দায়িত্বপুর্ণ পদে নিয়ােগ করা হলাে। এরাই আমলাতন্ত্রের সঙ্গে যােগ সাজসে শেখ মুজিবর রহমানের বিরুদ্ধে চক্রান্ত সুরু করলেন। এদের পাকিস্তানের সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে এবং পাকিস্তান সৈন্য বাহিনী এবং ইনটেলীজেন্স বিভাগ এদের সঙ্গে নিয়মিত ভাবে যােগাযােগ রাখতেন। কারণ বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তানের রাষ্ট্রপতি জুলফিকার আলী বহুবার শেখ মুজিবর রহমানের কাছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের মধ্যে কনফেডারেশনের প্রস্তাব করেছিলেন। শেখ মুজিবর রহমান কনফেডারেশনের ঘােরতর বিরোধী ছিলেন। তাই ভুট্টোর কিংবা পাকিস্তানের কনফেডারেশনের প্রস্তাবকে কখনােই তিনি আমল দেননি। | জিয়াউর রহমান দেশের প্রেসিডেন্ট হবার পর ঐশ্লামিক দেশগুলো থেকে প্রচুর অর্থ সাহায্য পেয়েছিলেন। বিশেষ করে সৌদী আরবিয়া এবং লিবিয়ার কাছ থেকে। কিন্তু জিয়ার সৈন্য বাহিনীর অভিযােগ ছিলাে যে এই টাকা জিয়াউর রহমান তার রাজনৈতিক দল গঠনে ব্যয় করছিলেন কিংবা তার কোন পেয়ারের ঐশ্নামিক প্রতিষ্ঠানকে দিচ্ছেন। অর্থ লিপ্ত, সৈন্য বাহিনী এই টাকার কোন অংশই পায়নি। অতএব সৈন্য বাহিনীর মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিলাে। এখানে স্মরণ রাখতে হবে, বঙ্গবন্ধু গণতন্ত্র থেকে খানিকটা ডিক্টেরশিপের প্রচলন করবার চেষ্টা করেছিলেন বলেই তার পতন হয় এবং তার বিরােধীরা তাকে খুন করে। আর এদিকে জিয়াউর রহমান ডিক্টেটরশিপ থেকে গণতন্ত্রে ফিরে আসতে চেয়েছিলেন।
________________________________________
তার সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়। এবং তার বিরােধীরা তাকে খুন করেন।
সেই উক্তি, বাংলাদেশ হবে : An International basket। আজ। ভাই হতে চলেছে।
| মুজিব হত্যার সঙ্গে বহু বিদেশী রাষ্ট্রের নাম জড়িত করা হয়েছে। বাজারের প্রচলিত কিংবদন্তী হলাে যে এই বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে আমেরিকা হলাে প্রধান।
এই অভিযােগের বিশ্লেষণ করা একান্ত প্রয়োজন। অবশ্যি পৃথিবীর বহুস্থানে এই ধরণের কু দ্য আঁতাত কিংবা গৃহবিপ্লব হয়েছে। এবং এই সব কু দ্য আঁতাতে আমেরিকার ইনটেলজেন্স এজেন্সী কিংবা রাশিয়ান সিক্রেট সাভিস কে-জি-বি’র হাত যে আছে তাতে কোনাে সন্দেহ নেই। কিন্তু বাংলাদেশে কোন কোন দেশ কু দ্য আঁতাতের আয়োজন বন্দোবস্ত করতে পারেন? সেই নিয়ে এবার আলোচনা করা যাক। এর পরিপ্রেক্ষিতে যেসব দেশের নাম প্রথমেই মনে ভেসে ওঠে সেগুলাে হলাে—ভারতবর্ষ, রাশিয়া এবং আমেরিকা কিংবা পাকিস্তান।
প্রথমত: ভারতবর্যের কথা ধরা যাক। মুজিবকে হত্যা করার কোন প্রয়ােজন ভারতবর্ষের থাকতে পারে কি? প্রশ্নটা হাস্যাস্কর। কারণ মুজিবকে হত্যা করা মানেই ভারতবর্ষের স্বার্থ বিরােধী কাজ করা। এখানে মনে রাখা দরকার যে বাংলাদেশে কোন প্রকারের গোলমাল হলে ভারতের সীমান্ত প্রদেশগুলােই বিশেষ ভাবে আক্রান্ত হয়। ১৯৭১ সালে যে সব শরনার্থীদের দল বাংলাদেশ থেকে ভারতবর্ষে এসেছিলাে সেই কথা অনেকেই জানেন। মুজিক হত্যার পরও বাংলাদেশ থেকে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লােকেরা এসেছিলাে। অতএব ভারতবর্য নিজে থেকে এই গােলমাল সৃষ্টি করতে যাবে কেন? | কে-জি-বি অবশ্যি এই অঞ্চলের উপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলো। বাংলাদেশ যখন স্বাধীন হয় তখন চট্টগ্রাম বন্দরে যে সব জাহাজগুলাে ডুবে গিয়েছিলো সেইগুলোকে সরাবার জন্যে সােভিয়েত নৌবাহিনীকে ব্যবহার করা হয়েছিলাে। যখন সােভিয়েত নৌবাহিনী এই কাজ করছিলো তখন প্রেস ক্লাব’ থেকে এক গুজব প্রচার করা হলাে যে বন্দর পরিস্কার করা শুধু মাত্র অছিলা, আসলে সােভিয়েত নৌবাহিনী ভারত মহাসাগরে তাদের ঘাঁটি স্থাপন করবার চেষ্টা করছে। এই গুজবের সত্যি মিথ্যে যাচাই করা হয়নি। তবু এই গুজব থেকে একটি কথা প্রমাণিত হয় যে কে-জি-বি এই এলাকা
________________________________________
সম্বন্ধে একেবারে উদাসীন ছিলো না। বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পার্টি মুজিবের আমলে বেশ তৎপর ছিলেন বটে তবে তাদের জনসাধারণের উপর কিংবা আমলাতন্ত্রের ওপর কোন প্রভাব ছিলােনা। এছাড়া বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পাটিকে মুজিবেয় পার্শ্বচরেরা বিশেষ করে ফজলুল হক মুনি একেবারে পছন্দ করতেন না। এর পরিণামে বাংলাদেশ কমুনিষ্ট পাটি কিংবা কে-জি-বি’র ইনফরমারের দল শেখ মুজিবর রহমানের সরকারের কোন খবরই সংগ্রহ করতে পারেননি। মুজিব হত্যার চক্রান্ত তাদের কাছেও অজ্ঞাত ছিলাে।
এবার আমেরিকান কিংবা সি-আই-এর কাহিনী শুরু করা যাক।
প্রথমেই বলা হয়েছে যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন কিংবা কিসিংগার বাংলাদেশের লড়াইতে ভারত এবং শেখ মুজিবর রহমানের বিরােধী ছিলেন। তারা বহু প্রকারে পাকিস্তানকে রক্ষা করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু তাদের সেই চেষ্টা সফল হয়নি। হেনরী কিসিংগার বঙ্গবন্ধুকে তার অন্যতম প্রধান শত্রু বলে গণ্য করতেন। কারণ তার বদ্ধমুল ধারণা ছিলো মুজিবর রহমান যদি ছয় দফার দাবী পাকিস্তান সরকারের কাছে পেশ না করতেন এবং পরবর্তীকালে যদি পাকিস্তান সরকারের সঙ্গে আপােষ মীমাংসা করতে রাজী হতেন তাহলে পাকিস্তান বিভক্ত হতাে না। নিক্সন এবং কিসিংগার মুক্তিযুদ্ধের ঘােরতর বিরােধী ছিলেন। যদিও ঢাকায় আমেরিকান কনসুলেটের কূটনৈতিক কর্মচারীরা ষ্টেট ডিপার্টমেন্টের সেক্রেটারী অফ ষ্টেটস রজার্সের কাছে নিবেদন জানিয়েছিলেন যে অবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে ইয়াহিয়া সরকারের অত্যাচার বন্ধ করা হােক। নিক্সন এবং কিসিংগার এই আবেদনে কর্ণপাত করেননি। বরং তাদের বক্তব্য ছিলাে আমেরিকান কনসুলেটের কৃটনৈতিক কর্মচারীদের এই ব্যবহার গহিত এবং কাপুরুষজনক। এমন কী দিল্লীতে আমেরিকান রাজদূত কিটিং-এর কথায় নিক্সন কিংবা কিসিংগার কান দেননি। শুধু তাই নয় আমেরিকার জনসাধারণ-সংবাদপত্রগুলো শেখ মুজিবর রহমানকে সমর্থন করেছিলেন এবং ইয়াহিয়া খানের অত্যাচারের তীব্র নিন্দা করেছিলেন।
| নভেম্বরের চার এবং পাঁচ তারিখে শ্ৰীমতী গান্ধী ওয়াশিংটন সফরে যান এবং নিক্সনের সঙ্গে পাকিস্তানের নীতি এবং মুক্তিযুদ্ধের গতি নিয়ে আলাপ আলােচনা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে কিসিংগার তার আত্মজীবনী : White House Years (page 880–881) by Little Brown and Company C a কথা লিখেছিলেন পাঠকদের কাছে সেই কয়েকটি লাইন তুলে দেওয়া হলাে :
________________________________________
“The Nixon-Gandhi Conversation thus turned into a classic dialogue of the deaf. The two leaders failed to hear each other not because they did not understand each other but because they understood each other only too well.”
পরবর্তীকালে আমেরিকা খােন্দকার মুস্তাক আহমেদের মাধ্যমে পাকিস্তান এবং স্বাধীন বাংলা দেশ সরকারের সঙ্গে মীমাংসার চেষ্টা করেছিলেন। তাদের সেই চেষ্টা ব্যর্থ হয়।
যুদ্ধের সময় প্রেসিডেন্ট নিক্সন বিভিন্ন প্রকারে সাহায্য করবার চেষ্টা করেছিলেন। এই প্রসঙ্গে হেনরী কিসিংগার ওয়াশিংটন স্পেশাল গ্রুপ এ্যাকশন কমিটির এক বৈঠকে বলেছিলেন :
I am getting hell every half hour from the President that we are not being tough on India. He has just called me again. He does not believe we are carrying out his wishes. He wants to tilt in favour of Pakistan. | অতীতের এই ঘটনা বলবার দরকার ছিলো। কারণ হেনরী কিসিংগার বাংলা দেশের স্বাধীনতাকে রুখতে পারেননি। সেদিন থেকে কিসিংগার এবং আমেরিকান ইনটেলজেন্স সার্ভিস ঠিক করলেন যে শেখ মুজিবর রহমানকে ক্ষমতার গদী থেকে সরাতে হবে। ১৯৭১-৭৪ পর্যন্ত শেখ মুজিবর রহমানের জনপ্রিয়তার ভাঁটা কমেনি। কিন্তু এই বছরের পর থেকে বাংলা দেশের জনতার কাছে শেখ মুজিবর রহমান তার জনপ্রিয়তা হারাতে সুরু করলেন। এই সময়ে পুরান সাপ থােকার মুস্তাক আহমেদ তার মাথা ঝাকিয়ে উঠলেন। এবার খােলকার মুস্তাক আহমেদ বাংলাদেশে কু দ্য আঁতাতের পরিকল্পনা করেছিলেন। তিনি কিংবা তার পরিবর্তে মহাবুব আলম চাষী সামরিক বাহিনীর কয়েকজন সৈন্যদের সঙ্গেও যােগাযােগ করলেন। মেজর ফারুক এবং মেজর রশীদের সঙ্গে যােগাযােগ করা হলাে। তাদের বলা হলাে সুযােগ এবং সুবিধেমতাে শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করতে হবে। এবং শুধু মুজিবকে নয় তার পরামর্শ দাতা ফজলুল হক মুনিকেও হত্যা করা একান্ত প্রয়ােজন।
মুনি সেই রাত্রে বেঁচে থাকলে হয়তো বাংলাদেশের রাজনীতি এবং পরিস্থিতি পাল্টে যতাে। বহু দোষ থাকা সত্ত্বেও মুনি ছিলেন খাটী দেশপ্রেমিক এবং দেশে স্বাধীনতাকে অটুট রাখতে প্রাণ বিসর্জন দিতে কুণ্ঠা বােধ করতেন ।
________________________________________
কিসিংগার, নিক্সন এবং পরবর্তীকালে জুলফিকার আলী ভুট্টো পাকিস্তান | দু খণ্ড হবার ঘটনা কখনই সহ্য করতে পারেন নি। তাই বাংলা দেশকে ফিরে
পাবার চেষ্টা তারা বহুভাবে করেছিলেন। মুজিব এবং জিয়াউর রহমানের হত্যার পরিকল্পনাও এই সব কারণের মধ্যে ধরে নেওয়া যায়।
১৯৭৪ সালে বাংলাদেশের আর্থিক অবনতির সময় আমেরিকা প্রচুর ঋণ দিলাে। এই ঋণের পরিপ্রেক্ষিতে বহু আমেরিকান বিশেষজ্ঞ বাংলা দেশে এলেন। এদের বধ্যে সবাই বিশেষজ্ঞ ছিলেন না। অনেকেই ছিলেন ইনটেলীজেন্স সার্ভিসের লােক। এরা বাংলা দেশে এসে জোট পাকাতে লাগলেন। শেখ মুজিবর রহমানের হত্যার পর এরকম একজন বিশেষজ্ঞের সঙ্গে মইনুল হােসেনের বাড়িতে আমার দেখা হয়। দুই মিনিট আলাপ আলোচনার পর ভদ্রলােকের আসল পেশা আমার বুঝে নিতে অসুবিধে হলাে না।
আমরা জানি যে মুজিব হত্যার পর বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতিরও বহু পরিবর্তন হয়। শ্রীমতী গান্ধী ইলেকসনে পরাজিত হবার পর বাংলাদেশ এবং ভারতবর্ষের মধ্যে আবার বন্ধুত্ব হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী মােরারজী দেশাই এই বন্ধুত্বের দোহাই দিতে গিয়ে বলেছিলেন যে বন্ধুত্বের প্রধান কারণ হলাে যে ভারতবর্ষ প্রতিবেশীদের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়। আর এই বন্ধুত্বের জন্যে মােরারজী দেশাই বাংলা দেশকে অনেক সুযােগ সুবিধা দিলেন। বিশেষ করে ফরাক্কা বাঁধের পরিকল্পনায় বাংলাদেশের সমস্ত দাবীকে মেনে নেওয়া হয়েছিলাে। কিন্তু আমরা জানি যে ঐ সময়ে বাংলা দেশের শাসনকর্তাদের মধ্যে অধিকাংশই ছিলেন পাকিস্তানী পন্থী। এদের সঙ্গে বন্ধুত্ব করা সম্ভব ছিলো কিনা এইটে আলােচনার বিষয়। | বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের মধ্যে ১৯৭৫ সালের গোলযােগের জন্যে আমেরিকাকে দোষারোপ করা হয়। প্রধান কারণ আমেরিকা যে বাংলাদেশের প্রতি বিরূপ ছিলেন এই কথা আমরা আগেই পড়েছি। দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশের পুলিশ এবং ইনটেলজেন্স বিভাগ ছিলাে পুরোপুরি পাকিস্তানী। মুজিব এবং জিয়াউর হত্যার পেছনে যে ইনটেলজেন্স বিভাগের বেশ হাত ছিলাে এই বিষয়ে কারু দ্বিমত নেই। ভবিষ্যতে বাংলা দেশের অনেক হাঙ্গামায় পুলিশের ইনটেলজেন্স বিভাগ বড়াে অংশ গ্রহণ করবেন এই বিষয়ে সন্দেহ নেই। আর সৈন্যবাহিনীর মতাে পুলিশের ইনটেলজেন্স বিভাগে মুক্তি যােদ্ধা এবং পাকিস্তান ফেরৎ দল ছিলাে না। অধিকাংশ পুলিশ ইনটেলীজেন্সের কর্তারা আমেরিকাতে পুলিশ বাহিনীর ট্রেনিং স্কুলে ট্রেনিং নিয়েছিলেন। আর এই ট্রেনিং স্কুলের সঙ্গে
________________________________________
সেন্টলি ইনটেলজেন্স এজেন্সীর খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। চীলির কু দ্য আঁতাতের সময় এই কথাটি খুব ভালো করে প্রমাণিত হয়েছে। অতএব মুজিব হত্যার ব্যাপারে সি-আই-এ কিছু পুলিশ ও কিছু সৈনিকদের মারফৎ কাজ করেছিলাে।
পরবর্তীকালে জানা যায় যে খােন্দকার কিংবা তার বন্ধুরা ১৯৭৪ সালে আমেরিকান এম্বাসীর সঙ্গে যােগাযােগ করেছিলেন। আমাদের স্মরণ রাখা দরকার যে আমেরিকান দূতাবাসের মধ্যে দুটি ভাগ আছে। একটি হলাে সাধারণ কৃটনৈতিকের দল। এরা আন্দাজ অনুমান করতে পেরেছিলেন যে বাংলাদেশে বিপ্লবের ঝড় আসন্ন এবং এই হাঙ্গামার মধ্যে নিজেদের তার। জড়াতে চাননি। তাই শেখের বিরােধী হত্যাকারীদের সঙ্গে আমেরিকান দূতাবাসের সাধারণ কর্মচারীরা বিশেষ যােগাযােগ রাখেননি। যদিও শেখের বিরােধীরা প্রায়ই আমেরিকান এম্বাসীর ককটেল পাটিতে যােগ দিতেন। | বাজারে আর একটি গুজব প্রচলিত আছে যে আমেরিকান এম্বাসভার ইউজেন বাংলাদেশের কু দ্য আঁতাতে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু কিসিংগার তার আত্মজীবনীতে চিলির ঘটনা সম্পর্কে লিখবার সময় স্পষ্ট করে বলেছেন যে অনেক ক্ষেত্রেই সি-আই-এ আমেরিকান এম্বাসডারদের ডিঙ্গিয়ে কু দ্য আঁতাতের পরিকল্পনা করেছে। বাংলাদেশের ঘটনার সময় বােষ্টার হয়তাে জানতেন যে একটি কু দ্য আঁতাত হবার পরিকল্পনা আছে। কিন্তু কবে কখন? এই খবর তিনি সঠিক জানতেন কিনা আমাদের জানা নেই। কারণ আমরা জানি যে ১৫ই আগস্ট ১৯৭৫ সালে বােষ্টার তার বাড়িতে ছিলেন না। আজ পর্যন্ত কেউ সঠিক বলতে পারেননি যে ঐ সময়ে তিনি কোথায় ছিলেন। আর একটি সম্ভাবনা হলাে যে বােষ্টার হয়তো এই কু দ্য আঁতাতের খবর রাখতেন এবং ইচ্ছে করেই গা ঢাকা দিয়েছিলেন। অতএব মুজিব হত্যার ব্যাপারে বােষ্টার কী অংশ গ্রহণ করেছিলেন আজও অজ্ঞাত। তাই সঠিক প্রমাণের অভাবে বােষ্টারকে মুজিব হত্যার ব্যাপারে দায়ী করা যুক্তি সঙ্গত হবে না। কারণ চীলির কু দ্য আঁতাতের সময় এম্বাসডর কেরীও কিছুই জানতেন না।
এবার এম্বাসীর অন্য অংশ অর্থাৎ সি-আই-এর প্রসঙ্গ নিয়ে আলােচনা করা দরকার। মুজিব হত্যার সময় আমেরিকান সিনেটের সদস্য চার্চ এবং পাইক গঠিত এক কমিটি সি-আই-এর কার্যকলাপ নিয়ে তদন্ত করছিলেন। তদন্তের প্রধান বিষয় ছিলাে সি-আই-এ লুমুমবা, কাস্ত্রো, আলেনডেকে যে হত্যা করার
________________________________________
পরিকল্পনা করছিলেন সেই নিয়ে তদন্ত করা। ঠিক এই সময়ে মুজিবকে হত্যা করা হয়। আর মুজিব হত্যার কাহিনী বিশ্বব্যাপী আলােড়ন সৃষ্টি করে। তাহলে সি-আই-এ মুজিব হত্যার ব্যাপারে কতােটুকু জড়িত ছিলাে সেইটে নিয়ে আলােচনা করা দরকার।
এইখানে পাইক কমিটির খানিকটা অংশ তুলে দেওয়া হলাে।
Not all covert actions were generated by the C. I. A. In para military operations of the worst type seemed to come from outside the CIA. Some projects came from the president. Some projects came from his Assistant for National security adviser (Kissinger ) and some had their beginning at the State departamet. ( Pike Commitee report)
অনেক সময় দেখা গেছে যে আমেরিকান এম্বাসীর [ বেশীর ভাগ সময়ে ) কৃটনৈতিকেরা সি-আই-এর কার্যকলাপের কোন খবর জানতেন না। সি-আই-এ হয়তাে এই কু দ্য আঁতাতে অংশ গ্রহণ করেননি কিন্তু টাকা অস্ত্র ইত্যাদি দিয়ে বিদ্রোহীদের সাহায্য করতেন। এই প্রসঙ্গে আমাদের চীলির নির্বাচন এবং আলেনডের হত্যাকাণ্ড লক্ষ্য করতে হবে। | ঢাকার সি. আই. এ. স্টেশন চীফ ফিলিপস চেরী নিজেও অস্বীকার করেছেন যে সি-আই-এ মুজিব হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিলো। কিন্তু চেরীর কথা সহজে বিশ্বাস করা যায় না। তার প্রধান কারণ চেরী নিজেই একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন যে ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে ভাের সাড়ে চারটার সময় তিনি তার এম্বাসীর দপ্তরে উপস্থিত ছিলেন। মুজিবকে হত্যা করা হয় ভাের পাঁচটা থেকে সাড়ে পাঁচটার মধ্যে। এই সময় সম্বন্ধে আমার মনে কোন সন্দেহ নেই, কারণ আমার বাড়ির লােকেরা মুজিব হত্যা নিজের চোখে দেখেছিলেন এবং কোন সময়ে এই হত্যাকাণ্ড করা হয় সেই সময়টি তার বিশেষভাবে লক্ষ্য করেছিলেন। অতএব মুজিব হত্যার প্রায় আধঘণ্টা আগে থেকেই ফিলিপস চেরী তার দপ্তরে গিয়েছিলেন। কিন্তু কেন? আমরা তার সঠিক কারণ বলতে পারবাে না।
অনেকে মন্তব্য করেছেন যদিও সি-আই-এ ঘনিষ্ঠভাবে মুজিব হত্যার ব্যাপারে জড়িত ছিলাে না, তবু তার খােন্দকার, মহাবুব আলম চাষী এবং শফদরকে সহানুভূতি এবং সাহায্যর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাে। জিয়াউর রহমান মেজরদের বলেছিলেন : যদি তােমাদের কু দ্য আঁতাত সফল হয় তবে আমি
________________________________________
| তোমাদের সঙ্গে আছি। আর যদি ব্যর্থ হয় তাহলে আমাকে পরিস্কার ভাবে অস্বীকার করতে হবে যে আমি মুজিব হত্যার ব্যাপারে কিছু জানতুম। সি-আই-এও এই ধরনের কথা হয়তাে চক্রান্তকারীদের বলেছিলেন : If you succeed we are with you. If you fail we do not know you. অবশি সি-আই-এর সহায়তায় কু দ্য আঁতাতের আয়ােজন এততা নিখুত ভাবে হয়েছিলাে যে তাদের বিপ্লব ব্যর্থ হবার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণই ছিলাে না।
মুজিব হত্যার ব্যাপারে যারা জড়িত ছিলেন এদের মধ্যে অনেকেই ছিলেন হেনরী কিসিংগারের বন্ধু। আমরা একথা জানি যে অনেক সময়ে বরং বলা যায় হামেশাই সি-আই-এ প্রতি দেশের পুলিশ বাহিনীর সাহায্য লাভের চেষ্টা করে থাকে। তারা স্থানীয় পুলিশ বাহিনীর মধ্যে তাদের প্রভাবের জাল বি কস্তোরর থাকে। আর সি-আই-এ আজকাল অধিকাংশ দেশেই হয় স্থানীয় লােক কিংবা অন্য দেশের ইনটেলজেন্স বিভাগের মারফৎ কাজ করে থাকে। বাংলাদেশেও যে এই ধরনের কাজ করা হয়নি এই কথার কোন প্রমাণ আমাদের কাছে নেই। কু দ্য আঁতাত সি-আই-এর অনুপ্রেরণায় হয়েছিলো। তবে হয়তাে সি-আই এর কর্তারা এ ব্যপারে নিজেদের হাত ময়লা করতে চাননি।
এবার ঢাকার সি-আই এর ষ্টেশন চীফ চেরীর কথা বলা যাক।
সি-আই-এর বাংলাদেশের কাজকর্ম দেখতেন জর্জ গ্রাফিন এবং সণ্ডারস। এদের কথা আগেই বলা হয়েছে। | ফিলিপস চেরী বাংলাদেশের কু দ্য আঁতাতের সঙ্গে নিজেদের জড়িয়ে থাকার কথা অস্বীকার করে বলেছিলেন মুজিবকে যে হত্যা করা হবে এই কথা আমরা কখনই জানতুম না। এবং এর পরবর্তীকালে আরাে বহুবার বাংলাদেশে কু দ্য কিংবা গৃহ বিপ্লব করবার যে চেষ্টা করা হয়েছিলো, সেই সব কু দ্য আঁতাতেরও কোন খবরাখবর আমি জানতুম না। অবশ্যি আমরা বাজারে একটি গুজব শুনেছিলুম যে বাংলাদেশে হাঙ্গামা-গণ্ডগােল হবার সম্ভাবনা অেেছ। কিন্তু তখন আমাদের শুধু কাজ ছিলাে বাংলাদেশের এই সব গুজবগুলোকে ওয়াশিংটনে পাঠানাে। আর এই রিপাের্টিং করাটাই পলিটিক্যাল অফিসারদের কাজ। [ ফিলিপস চেরী কখনই নিজেকে সি-আই-এর ষ্টেশন চীফ বলে পরিচয় দিতেন না। আমি স্পষ্ট এবং পরিস্কার ভাবে বলতে পারি যে মুজিব হত্যা কিংবা কোন প্রকারের কু দ্য আঁতাতের সঙ্গে আমেরিকান
________________________________________
| এম্বাসী কখনই জড়িত ছিলো না।
পরে চেরী বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলোচনাকালীন | বলেছিলেন : আমরা জানতুম যে মুজিব বেশ কঠিন অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন। আমরা এই কথাও জানতুম যদি বাংলাদেশে কখনও কোন বিপ্লব কিংবা কু দ্য আঁতাত হয় [ বাংলাদেশে কু দ্য আঁতাত হতে পারে এই কথা ফিলিপস চেরী কি করে আগে থেকে আন্দাজ অনুমান করেছিলেন এইটে হলাে জিজ্ঞাসার ব্যাপার ] তাহলে জনসাধারণ আমাদের দুষবে। আমরা জানতুম যে মুজিবকে শ্ৰীমতী গান্ধী এবং মস্কোর কর্তারা সমর্থন করছেন। অতএব আমাদের বেশ সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে।
ফিলিপ চেরী সাংবাদিকদের কাছে অস্বীকার করেছেন যে মহাবুব আলম চাষী, তাহেরুদ্দীন ঠাকুর কিংবা শফদরের সঙ্গে তার কোন পরিচয় কিংবা ঘনিষ্ঠতা ছিলাে। অবশ্যি ফিলিপ চেরী আরাে বলেছিলেন যে ১৯৭৫ সালে বাংলা দেশে যে বিপ্লব হয়েছিলো ঐ বিপ্লব বাংলা দেশের সৈন্য বাহিনীই করেছিলাে। আমেরিকানরা এই বিপ্লবে কোন ইন্ধন যােগান দেননি কিংবা চক্রান্তকারীদের উৎসাহ দেখান নি।
তবে অনেক জেরার পর ফিলিপ চেরী স্বীকার করেছিলেন যে বাংলাদেশের কয়েকজন রাজনৈতিক নেতা আমেরিকান সরকারের কাছ থেকে বিপ্লব করবার জন্যে সাহায্য চেয়েছিলেন। অবশ্যি এম্বাসী এই ব্যাপারে সেই সব দেশ-নেতাদের কোন উৎসাহ দেখাননি। কিন্তু চেরী আরাে বলেন, প্রতিদেশে পলিটিসিয়ানরা বিভিন্ন এম্বাসীর এঙ্গে যােগাযােগ রেখে থাকেন। তবে এই সম্পর্ক রাখা কিংবা যােগাযােগ রাখবার অর্থ এই নয় যে দেশ-নেতাদের বিপ্লব করবার জন্যে উৎসাহ দিতে হবে। এই প্রসঙ্গে একটি কথা উল্লেখ করা একান্ত আবশ্যক যে মােসাদেশ, আলেনডে এবং কাষ্ট্রের বিরুদ্ধে বিপ্লবের যে ষড়যন্ত্র করা হয়েছিলাে, সেই চক্রান্ত সি-আই-এর কর্মচারীরা করেছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশে ১৫ই আগষ্ট যে কু দ্য আঁতাত হয়েছিলাে ঐ বিপ্লবে সি-আইএ প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করে না থাকলেও তার চক্রান্তকারীদের প্রচুর উৎসাহ এবং পরামর্শ দিয়েছিলেন।
কোন দেশের সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত করতে সি-আই-এর মৌখিক সাহায্যের প্রতিশ্রুতি কিংবা পরামর্শই যথেষ্ট। এই প্রসঙ্গে বলা দরকার যে ১৯৭০ সালে বাংলাদেশের বিক্ষোভকারী রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আমেরিকান এম্বাসীর বহুবার যােগাযােগ হয়েছিল। তবে আলােচনার বিষয়
________________________________________
জানা যায়নি।
এখানে আর একটি কথা উল্লেখ করা উচিত যে কু দ্য আঁতাতের পর আমেরিকান এম্বাসী ঢাকার এবং ওয়াশিংটনের মধ্যে প্রায় ছিয়াত্তরটি টেলীগ্রাম আদান প্রদান করা হয়েছিলাে। কিছুদিন পরে অনেকগুলো টেলিগ্রাম প্রকাশিত করা হয়। বাকী টেলিগ্রাম গুলো এখনাে গােপনীয় রাখা হয়েছে। ঐ সব টেলীগ্রাম থেকে জানা যায় যে ১৯৭৪ সালে ঢাকার আমেরিকান এম্বাসী রাজনৈতিক দলগুলাের সঙ্গে যােগাযোগ রাখবার জন্যে বেশ তৎপর ছিলাে।
অতএব বিবিধ খবর থেকে আমরা জানতে পারি যে সি-আই-এ ১৯৭৪ সালের পর থেকে তাদের কর্মতৎপরতা দেখাতে শুরু করেন। চক্রান্তকারীদের তার মৌখিক বুদ্ধি, পরামর্শ এবং হয়তাে অর্থ দিয়েও সাহায্য করেছিলেন। প্রত্যক্ষভাবে না করে থাকলেও পরােক্ষভাবে তারা মহাবুব আলম চাষী, খােন্দকারকে সাহায্য করেছিলেন। ১৫ই আগষ্ট ১৯৭৫ সালে ৩রা নভেম্বর এবং ৭ই নভেম্বর বাংলা দেশে যে কু দ্য আঁতাত ও তারপর রাজনৈতিক পরিবর্তন হবে এই কথা তাদের অজানা ছিলোনা।
বাংলাদেশের অধিকাংশ সাংবাদিকরা আমেরিকান এম্বাসীর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রাখতেন। এদের মধ্যে এনায়েতুল্লা এবং আরাে অনেকে নিয়মিত ভাবে আমেরিকান এম্বাসীর ককটেলে যােগ দিতেন। এদের কাছ থেকে বাজারের খবর ও বিভিন্ন দূতাবাসের খবর বার করা অসাধ্যজনক ছিলাে বলে মনে হয় না।
পাঠকদের বলা প্রয়ােজন যে বর্তমানে সি-সাই-এ নিজের হাতে কোনাে গােপন কাৰ্যকলাপ করে না। তৃতীয় দেশের ইনটেলজেন্স সার্ভিসের মাধ্যমে তারা বিবিধ ধরণের কাজ করে থাকেন। বাংলা দেশের ব্যাপারে তার হয়তাে পাকিস্তান ইনটেলজেন্স সার্ভিস কিংবা কোন ঐশ্লামিক দেশের সিক্রেট সার্ভিসের মাধ্যমে যােগাযােগ রেখেছিলেন।
এই প্রসঙ্গে আর একটি কথা আমার মনে পড়ছে। আমাকে ঢাকা থেকে বের করে দেবার পর আমেরিকান এম্বাসীর তিন চারজন এসে আমার বাড়িতে বার বার খোঁজ করতে শুরু করেন যে আমি কবে ঢাকা ত্যাগ করছি। আমার অনুপস্থিতিতে ফিলিপ চেরী পৰ্ষত আমার বাড়ীতে টেলিফোনে জানবার চেষ্টা করে, আমি কবে চলে যাচ্ছি।
আমেরিকান এম্বাসী কিংবা ফিলিপ চেরী আমার ঢাকা থেকে চলে যাবার জন্যে কেন এতাে আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন তার সঠিক কারণ আমি আজো
________________________________________
জানতে পারিনি।
এবার ওয়াশিংটন, ইসলামাবাদ এবং ঢাকার সংযােগের কথা উল্লেখ করতে হয়।
আমরা এই কাহিনীর প্রারম্ভেই বলেছি যে প্রেসিডেন্ট নিক্সন ও কিসিংগার কখনই পাকিস্তানকে দুটুকরাে করবার পক্ষে ছিলেন না। এাণ্ডারসন রিপাের্ট থেকে আমরা জানতে পারি যে নিক্সন কিসিংগার এবং ষ্টেটস ডিপার্টমেন্টকে প্রতিদিন অনুযােগ করতেন যে পাকিস্তানকে অখণ্ড রাখার ব্যাপারে কোন চেষ্টাই করা হচ্ছে না। পাকিস্তানকে অটুট রাখবার জন্যে তিনি চীনের প্রধান মন্ত্রী চৌ এন লাইকে অনুরােধ করেছিলেন এবং তখন সংবাদপত্র মহলে একটি খবর প্রচলিত ছিল যে চীন ভারতকে শীঘ্রই আক্রমণ করবে। কিসিংগার ও নিক্সন হয়তাে চৌ এন লাইয়ের কথা ভুল বুঝেছিলেন এবং চীনের প্রতিশ্রুতিনুযায়ী বঙ্গোপসাগরে আমেরিকান ক্রুজার এন্টারপ্রাইজকে পাঠিয়েছিলেন। নিক্সনের আন্দাজ অনুমান মিথ্যে হয়েছিলাে। কারণ চীন পাকিস্তানকে সৈন্যবাহিনী পাঠিয়ে সাহায্য করেন নি। বরং চৌ এন লাইর বক্তব্য ছিলাে পূর্বপাকিস্তানের ভবিষ্যৎ তার জনসাধারণ ঠিক করবে। | চৌ এন লাইর আর একটি কথা ছিলাে : By intervening India was picking up a great stone which would one day drop on its feet. | চৌ এন লাইর এই মন্তব্য পরবর্তীকালে বিখ্যাত ভবিষ্যদ্বাণী হয়ে দাড়িয়েছিলো। তার কারণ আমরা জানি।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পাকিস্তান বহুবার বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব কিংবা বলা যায় ‘কনফেডারেশন’ করবার চেষ্টা করেছিলাে। একবার বঙ্গবন্ধু মুজিবর রহমান পাকিস্তানে ঐশ্লামিক কনফারেন্সে যােগ দিয়েছিলেন এবং তখন বহু ঐশ্লামিক দেশের নেতারা মুজিবর রহমানকে অনুরোধ করেছিলেন যে বাংলাদেশ যেন পাকিস্তানের সঙ্গে এক নতুন সম্বন্ধ স্থাপন করে। মুজিবর তখন তাদের কিংবা জুলফিকার আলী ভুট্টোর কথায় কান দেননি।
পাকিস্তান কখনই স্বাধীন বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান বিভক্ত হওয়া সহ করেনি। বাংলাদেশে সামরিক এবং সরকারী কর্মচারীদের মধ্যে তাদের বহু বন্ধু-বান্ধব ছিলাে। এবং জীবনের শেষ ভাগে মুজিবর রহমানও এই সব
________________________________________
পাকিস্তানী সমর্থকদের কথায় অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। তিনি তখন তাদের কথানুযায়ী দেশের শাসনতন্ত্র চালাতেন।
আমরা দেখেছি যে বাংলাদেশের অধিকাংশ পুলিশ কর্মচারী ছিলেন পাকিস্তানীপন্থী। এই সব কর্মচারীদের সঙ্গে পাকিস্তানী এবং আমেরিকান ইনটেলজেন্স সাভিসের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিলাে। এদের মধ্যে প্রধান ছিলেন এ, বি, শফদর। তার সঙ্গে ঢাকার সি-আই-এ’র ষ্টেশন চীফ ফিলিপ চেরীর বিশেষ জানাশােনা ছিলো। ১৯৭৫ সালে কু দ্য আঁতাতের সময় শফদর একটি প্রধান অংশ গ্রহণ করেছিলেন। পরবর্তীকালের ইতিহাস এবং ঘটনা থেকে জানা যায় যে মুজিবর রহমানের আমল থেকে জিয়াউর রহমানের শাসন কাল পর্যন্ত ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্স সাভিস শুধু দেশের সরকারকে পরামর্শ দেওয়া নয় দেশের দাঙ্গা হাঙ্গামা থামাবার ব্যাপারেও | বিশেষ অংশ গ্রহণ করেছে। সিকিউরিটি ইনটেলজেন্স শুধু মুজিবর রহমানের নয় জিরাউর রহমানের হত্যার পেছনেও তাদের হাত ছিলাে।
আমি আগেও বলেছি এখন আবার বলছি যে বাংলাদেশের আসল শাসন কর্তা হলাে বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনী, ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলীজেন্স। এবং এজন্যই বাংলাদেশে কোন হাঙ্গামা সৃষ্টি করতে সি-আই-এর প্রত্যক্ষ ভাবে জড়ানাের কোন প্রয়ােজন নেই। তারা সদা সর্বদাই পাকিস্তানী ইনটেলজেন্স কিংবা ন্যাশনাল সিকিউরিটি ইনটেলজেন্সকেই ব্যবহার করবে, করেও ছিলেন। সি-আই-একে নিজের হাতে কোন দুষ্কর্ম করতে হয়নি। | আমরা সিআই-এর ইতিহাসে দেখেছি যে বিভিন্ন দেশে বিপ্লব কিংম্বা চক্রান্ত করতে হলে তারা বিভিন্ন পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। মােসাদেগকে ক্ষমতার গদী থেকে সরাবার সময় সি-আই-এর মধ্যপ্রাচ্যের কর্তা কেরমিট রুজভেল্ট নিজে প্রসেসনে যােগ দিয়েছিলেন। কিন্তু বাংলাদেশের ঘটনার সময় হরন্ড সাস, জর্জ গ্রীফিনকে রাস্তায় গিয়ে প্রসেসান করতে হয়নি। হয়তাে দুর থেকে তারা কলকাঠি নেড়েছিলেন এবং এর থেকে আন্দাজ করা যায় যে মুজিবকে হত্যা করবার জন্যে ব্ল প্রিন্ট হয়তাে সি-আই-এ নিজে করে দিয়েছিলেন। তারা খােন্দকার মুস্তাক আহমেদ ও মহাবুব আলম চাষীর সঙ্গে ও যােগাযােগ রেখেছিলেন তাদের হয়তো বলেছিলেন তােমরা কু দ্য আঁতাত করতে পারে। আমরা তােমাদের পেছনে আছি। এর বেশী ‘আর কোন কিছু বলবার প্রয়ােজন হয়নি।
স্মরণ রাখা দরকার যে সময়ে মুজিবর রহমানকে খুন করা হয় সেই সময়ে
________________________________________
আমেরিকান সিনেট সি-আই-এর কাৰ্যকলাপ নিয়ে তদন্ত করছিলেন। অতএব | সে মুহূর্তে নিজের হাতে তারা কাউকে হত্যা করতে চাননি। কিন্তু তাদের প্রত্যক্ষ ভাবে কিছু করবার প্রয়ােজনও ছিলােনা। কারণ মুজিবের ব্যাপারে তারা অন্যের সাহায্য নিয়েছিলেন। বাংলাদেশের এই ঘটনার জন্যে তারা পাকিস্তানী এবং বাংলাদেশী ইনটেলীজেন্স সার্ভিসের মারফৎ কাজ করেছিলেন। এতে সাপও মরলো, লাঠিও ভাঙলাে না।
মুজিব-হত্যার কাণ্ড নিয়ে যদি সত্যিকারের কোন তদন্ত হত তাহলে এসব তথ্য জানা যেতাে। কিন্তু সে তদন্ত কখনােই হবে না।
ইতিমধ্যে জিয়াউর রহমানের হত্যার তদন্তও আরম্ভ হয়েছে। তবে এই তদন্তের রায় আদৌ প্রকাশিত করা হবে কিনা সন্দেহ আছে। তাজউদ্দীন এবং অন্যান্য আওয়ামী লীগের নেতাদের ঢাকা সেন্টলি জেলে হত্যা করা নিয়েও তদন্ত করা হয়। কিন্তু সেই তদন্তের রায় আজও প্রকাশিত করা হয়নি।
এবার পুরান কথায় ফিরে আসা যাক। এনায়েতুলা বিদেশ থেকে ফিরে এসেই দেশের মধ্যে হৈ-হল। সুরু করতে লাগলেন। তার এই হট্টগােলের লক্ষ্য ছিলুম আমি। অর্থাৎ তিনি সবাইকে বললেন : আমি হলুম এ ভেরী, ভেরী ডেঞ্জারাস ম্যান। অতএব আমাকে বাংলাদেশ থেকে বের করে দেওয়া হােক। তাই করা হলাে। আমাকে বলা হলাে অবিলম্বে বাংলাদেশ ত্যাগ করাে। অতএব চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে কোন জিনিষপত্রের গােছগাছ না করেই আমাকে বাংলাদেশ থেকে চলে আসতে হলাে। | বাংলাদেশে আমার অজস্র বন্ধুবান্ধব ছিলাে। ভয়ে তারা কেউ আমার সঙ্গে দেখা করতে এলেন না। আমিও তাদের বাঁচাবার জন্যে আর কোন টেলিফোন করলুম না।
এয়ারপাের্টে এসে শেষবারের মতাে ঢাকা শহরের দিকে তাকালুম। রাস্তাগুলাে জনমানবহীন। আর আমি ছিলুম অস্পৃশ্য। এয়ারপােটে আমার পরিচিত যারা ছিলেন তারা সবাই আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগলেন।
প্লেন ছাড়বার বেশ কিছুক্ষণ বাকী ছিলো। হঠাৎ কিছুক্ষণ বাদে পেছন থেকে এক পরিচিত কণ্ঠস্বর শুনতে পেলুম। ভদ্রলোকের নাম এন্থনী ম্যাসকারিনাস, সানডে টাইমস পত্রিকার সংবাদদাতা। তিনি দীর্ঘকাল
________________________________________
পাকিস্তানে ঐ পত্রিকার সংবাদদাতা ছিলেন। পরে ইয়াহিয়ার নীতির বিরােধিতা করে লণ্ডনে চলে যান। শেখ মুজিবর রহমানের মৃত্যুর পর তিনি বাংলাদেশে চলে আসেন। আজ কলকাতায় ফিরে যাবেন। ওখান থেকে সোজা চলে যাবেন লণ্ডনে।
এন্থনী ম্যাসকারিনাস আমার দীর্ঘকালের পুরান বন্ধু। আমরা একসঙ্গে রয়টারস সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানে কাজ করতুম। ঢাকাতে এসে এন্থনী হু একবার আমার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছিলেন কিন্তু পুলিশ টিকটিকির ভয়ে আমার সঙ্গে দেখা করেনি। আজ হঠাৎ আমাকে দেখে এগিয়ে এলো: তােমার সঙ্গে দেখা করতে পারিনি। কারণ ঢাকা শহরের সবাই বলছে : ইউ আর এ ডেঞ্জারাস ম্যান।
তাই নাকি? তবে আমি কি করে ডেঞ্জারাস হলুম জানিনে। খবরটা নিশ্চয় শুনেছ ? আমাকে ওরা চাকা থেকে বের করে দিচ্ছে। আমি বেশ চাপা সুরেই একটা জবাব দেবার চেষ্টা করলুম। আমার চিন্তা ছিলাে যেন পাশের লােক আমাদের কথাবার্তা শুনতে না পারে। আমি জানতুম যে এয়ারপাের্টের টিকটিকিরা আমাদের দিকে তাকিয়ে। কিন্তু এয়ারপােটে আমার সঙ্গে দাড়িয়ে কথা বলতে এন্থনী মাসকারিনাস দ্বিধা কিংবা সংকোচ বােধ করেনি।
হ্যা এই খবরটা জানি। বলে এন্থনী জিজ্ঞেস করলে আমি সানডে টাইমসে যে সব খবর পাঠিয়েছি, ঐ খবরগুলাে তুমি পড়েছ এ সম্বন্ধে তােমার কী মতামত ?
প্লেনে বসে কথা বলা যাবে। আমি ছােট জবাব দিলুম। ।
বেশ। তুমি তো নিশ্চয় জানাে একদিন আমি ও পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গিয়েছিলুম। পালিয়ে যাবার আগে আমি দু একবার বাংলা দেশে এসেছিলুম। আমি মুজিবর রহমান, জুলফিকার আলী ভুট্টো ওদের সবাইকে বেশ ভালাে করেই চিনতুম।
এমন সময় কলকাতায় খাবার প্লেনও চলে এলাে। যাত্রীর দলের সঙ্গে আমিও ইমিগ্রেশন কাষ্টমস পার হয়ে প্লেনে উঠে বসলুম। এন্থনী ওর পাশে আমার জন্যে একটি সীট রেখেছিলাে। আমি প্লেনের দরজার সামনে দাড়িয়ে আর একবার ঢাকা শহরের দিকে তাকালুম।
ঢাকা, আমার বাল্যজীবনের নগরী আমার যৌবনের কর্মস্থল •••। শৈশবে এবং পরে (বাংলাদেশ হবার আগে) আমি কতোবার ঢাকা থেকে কলকাতায়
________________________________________
গিয়েছি কিন্তু আজকের মত এই শহর থেকে বিদায় নিতে আগে আমার চোখে জল কখনো আসেনি। আজ কেন জানি আমার চোখ দিয়ে হু হু করে জল বইতে সুরু করলো। আজ সর্বপ্রথম বুঝতে পারলুম যে জীবনে হয়তো আমি আর কোনদিন বাংলা দেশে আসতে পারবাে না। কারণ ওরা আজ আমাকে নির্বাসিত করেছে। এই শহরে আমার আর ফিরে আসবার অধিকার নেই।
একটু বাদে প্লেন আকাশে উড়বে। আকাশের বুক থেকে আমি দেখতে পাবাে শস্য শ্যামলা সুজলা বাংলা দেশ, যে দেশের বুক দিয়ে বয়ে চলেছে পদ্মা, মেঘনা, ধলেশ্বরী দেখতে পাবে। অগুনতি হাজার হাজার বাংলা দেশের নরনারীকে যাদের আমি ভালােবাসি। তারপর হঠাৎ ওরা সবাই মিলিয়ে যাবে। আমি ফিরে আসবাে এই দানব দৈত্য নগরী কলকাতায়।
যদি ও আমি চিরকালের জন্যে বাংলা দেশ থেকে বিদায় নিচ্ছি তবু কী আমি ঐ ‘সােনার বাংলা’কে ভুলতে পারবো? কখনই না।
প্লেন ছেড়ে দিলো। কিছুক্ষণ বাদে ঐ ঢাকা শহর আমার কাছে বিন্দুর মতো মনে হলো। ঐ শহরের জন কোলাহল, ঐ বাংলা দেশের মাঠ, নদী, নালা সবাই যেন আমার জীবনের স্মৃতিপটে এসে জড়ো হলো। আমার ইচ্ছে হলো আমি গান করি, আমার সােনার বাংলা আমি তােমাকে ভালােবাসি ••••..’।
আমার কথা ফুরােলো, নটে গাছটি মুড়লো। কিন্তু আমার কাহিনী শেষ হলেও নটে গাছ মুড়ােয়নি, বাংলা দেশের সমস্যা আজোও রয়ে গেছে ।
এই কাহিনীর দাড়ি টানবার আগে আমাকে এন্থনী মাসকারিনাসের কথা বলতে হবে।
সেদিন আমার প্লেনের পাশের সীটে বসে ছিলেন এন্থনী ম্যাসকারিনাস।
হঠাৎ তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন বাংলাদেশ ছেড়ে যেতে আপনার কষ্ট হচ্ছে ? | কিছুটা। আমি ছােট জবাব দিলুম।
এন্থনী এবার আমরা মুখের দিকে তাকিয়ে বললাে আপনার মনের কথা স্পষ্ট বুঝতে পারি। একদিন ঐ ঢাকা শহর দেখে আমার মনেও বেশ কষ্ট হয়েছিলাে। সেদিনকার ঘটনাগুলো যদি বলি তাহলে আপনার চোখেও জল আসবে।
বলুন। আমি আব্বারের সুরেই জিজ্ঞেস করলুম ।
বেশ শুনুন আমার কাহিনী । অবশি এই কাহিনীতে অনেক সত্যিকারের নাম গোপন করে যাচ্ছি। কারণ তারা জীবিত। আর একটা কথা মনে রাখবেন
________________________________________
এই কাহিনীর সারাংশ আমি আমার পত্রিকা ‘সানডে টাইমসে প্রকাশ করেছিলুম। আর ঐ কাহিনী প্রকাশিত হবার পর পাকিস্তান সিক্রেট পুলিশ আমার খোজ করতে থাকে। আমি পাকিস্তান থেকে পালিয়ে লণ্ডনে যাই। যাক্, গল্পের ভনিতা করে আপনার মনকে ভারাক্রান্ত করােনা। এবার শুনুন•••
এন্থনী মাসকারিনাস তার কাহিনী সুরু করলো।
ঢাকা—২৪ শে মার্চ ১৯৭১।
সন্ধ্যা। শহরের বুকে ঘন অন্ধকার নেমে এসেছে। মার্চ মাসের গুমােট গরমে শহর নীরব নিস্তব্ধ। এমন কী পুরান শহর নবাবপুর ইসলামপুরও একেবারে জন-মানবহীন। গুলশান, যেখানে সন্ধ্যায় জীবন মশগুল হয়ে ওঠে আজ সেখানেও কারু কণ্ঠ শােনা যায় না।
গুলশানের কাছেই ক্যানটনমেন্ট, সৈন্যদের শিবির। সেখানে বসে ডিনার পাচ্ছেন পাকিস্তানের জঙ্গী রাষ্ট্রপতি ইয়াহিয়া খান। ডিনারে আছেন পাকিস্তানের বড়ো বড়াে জেনারেলের দল, টিকা খান, ফরমান আলী, নিয়াজি। সবাই ইয়াহিয়া খানের মুখের দিকে তাকিয়ে আছেন। বলা যায়না, কখন জেনারেল কি কথা বলে ওঠেন। আর ওর কথার সঙ্গে সঙ্গে সবাইকে জোরে হাসতে হবে । একটু বাদেই ইয়াহিয়া খান ঢাকা ত্যাগ করে প্লেনে করে পাকিস্তান যাবেন। ওর সঙ্গে যাবেন ইয়াহিয়ার বান্ধবীদের দল ও সুন্দরী জেনারেল রাণী, বাঙ্গালী রূপসী ব্ল্যাকবিউটি।
শহর ক্লান্ত। আজ সকাল থেকে হরতাল। শহরের দোকান পাট স্কুল কলেজ বন্ধ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন। আওয়ামী লীগের ছয় পয়েন্টের দাবী নিয়ে জনগণের মিছিল। কিন্তু ক্ষমতাবান ইয়াহিয়া খানের কাছে তাদের আবেদন নিবেদন কিছুই পৌছয়নি। সেদিনকার ডিনারে তিনি তার বিবি আর গােলামদের নিয়ে আনন্দোৎসব করছিলেন। শ্যামপেনের বােতলের ছিপি খুলে সৈন্যবাহিনী গান করছিলো, হী ইজ এ জলি গুড ফেলল •• ••• ডিয়ার প্রেসিডেন্ট ডালিং প্রেসিডেন্ট… | সেদিনকার ঐ ডিনারে শুধুমাত্র একজন বাঙ্গালী সৈন্য, ক্যাপ্টেন শামসুদ্দিন উপস্থিত ছিলেন। বাকী সৈন্য বাহিনীর কর্তারা ছিলেন পাঞ্জাবী। বিবিদের মধ্যে ছিলেন জেনারেল রাণী, ইয়াহিয়ার অতি প্রিয়তমা বান্ধবী, ব্ল্যাক বিউটি । তিনি বাঙ্গালী অপূর্ব সুন্দরী মহিলা, এক রাজদূতের গৃহিণী, বর্তমানে ইয়াহিয়া খানের শয্যাসঙ্গিনী। একটু বাদে ইয়াহিয়া খান ইসলামাবাদে চলে যাবেন।
________________________________________
ক্যান্টনমেন্টের পাশেই ঢাকার বিমান বন্দর। ছুটে গেলে পনেরাে মিনিটের পথ। কিন্তু গাড়ীতে পাঁচ মিনিটের রাস্তা।
| অবশ্যি, আজ বিমানবন্দরের সড়কটি একেবারে জন-মানবহীন। অর্থাৎ আজ | গাড়ীতে গেলে তিন মিনিটের মধ্যেই বিমানবন্দরে পৌঁছান যাবে।
| ডিনারের পর সবাই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে বিমানবন্দরে গেলেন। ক্যাপ্টেন শামসুদ্দিনও ছিলেন। ঢাকার সামরিক শাসনকর্তা টিকা খান প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সঙ্গে ছিলেন। থাকবার কথাই বটে। কারণ গত দু’তিন মাস ঢাকা শহরে জনতার আন্দোলন টিকা খানকে বেশ একটু চিন্তিত করে তুলেছিলো। নােংরা বাঙ্গালীদের তিনি সমুচিত শিক্ষা দিতে চান। শুধু একবার জেনারেল ইয়াহিয়া খানের সম্মতি পেলেই হয়।
সেদিন বিমানবন্দরে টিকা খান বাঙ্গালীদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার সবুজ সঙ্কেত পেলেন। গার্ড অব অনার পরিদর্শন করার পর ইয়াহিয়া খান এবং টিকা খান বিমানের কাছে গেলেন। প্লেনে উঠবার আগে ইয়াহিয়া খান পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন কর্তাকে বললেন, ঢাকার রাস্তা পরিস্কার করে দাও।
| রাস্তা পরিস্কার করে দেবার কী অর্থ এ কথা টিকা খানের বুঝে নিতে একটুও অসুবিধে হলাে না। এ কথার একটিই মানে, পূর্ব পাকিস্তানের নােংরা বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। বাঙ্গালী ছাত্র, আওয়ামী লীগের সদস্য এবং মুজিবর রহমানকে আর কোন প্রকারেই আন্দোলন করতে দেওয়া যায় না। ইয়াহিয়া খান
–টিকা খানের দল ঢাকা শহরে আন্দোলনের চীৎকার শুনতে চাননা, তারা শুধু ঢাকা শহরে নৈঃশব্দতা চান। কেউ চীৎকার করবে না, গণ আন্দোলন হবেনা, এমন কী ঢাকা শহরে পাখীর কলরবও থাকবে না। ঢাকা হবে শ্মশান, মরুভূমি•••
‘তাই হলো। নাদিরশাহ ইয়াহিয়া খান ঢাকা থেকে চলে যাবার সঙ্গে সঙ্গে টিকা ধান নােংরা বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে তার অভিযান শুরু করলেন।
পূর্ব পাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধের সংগ্রাম শুরু হলো।
ঢাকার রাস্তা পরিস্কার করবার পরিকল্পনা ছিলো অতি পুরাতন। নির্বাচনে পরাজিত হবার পর ইয়াহিয়া ভুট্টোর বাহিনী পূর্ব পাকিস্তানের জনতাকে শায়েস্তা করবার জন্যে অন্য পথ ধরলেন। বিদেশ থেকে প্রচুর অস্ত্র আমদানী করা হলো। বিশ্বস্ত পাকিস্তানী কর্মচারীরা এসে গুরুত্বপূর্ণ পদগুলােও দখল করে নিলেন। বাঙ্গালীদের প্রায় সব দায়িত্বপূর্ণ কাজ থেকে সরান হলো। ঢাকা শহরে কোন এলাকায় প্রথম অভিযান শুরু করতে হবে তার পরিকল্পনা করা হলো। বুদ্ধিজীবি,
________________________________________
অধ্যাপক, ছাত্র লীগ এবং আওয়ামী লীগের সদস্যদের উপযুক্ত শিক্ষা দেবার নকশা তৈরী হলো। বিদ্রোহী আওয়ামী লীগের নেতা মুজিবর রহমান এবং তার সহকর্মীদের নিয়ে কী করা হবে তার আয়ােজন অবশ্য পাকিস্তানী জঙ্গীবাহিনী। আগেই করে রেখেছিলেন। ইয়াহিয়া খান—টিকা খানের দল বাঙ্গালীদের চীৎকার শুনতে ভালােবাসেন না। তাই ঢাকা সেন্টাল জেলে সব বড়াে বড়ো নতাদের ভরে রাখবার আয়ােজন করা হলো। কিন্তু এত সব আয়ােজন বন্দোবস্ত করা সত্বেও পাকিস্তানী জঙ্গীবাহিনী একটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করতে ভুলে গিয়েছিলেন। আর শুধু এই ভুলের জন্যে পরে তাদের বিস্তর খেসারৎ দিতে হয়েছিলো। তারা শহরের টেলিফোনের লাইনগুলো বিচ্ছিন্ন করতে ভুলে গিয়েছিলেন। | বিমানবন্দরে দাড়িয়ে থেকে শামসুদ্দিন দেখতে পেলেন যে ইয়াহিয়া খান টিকা খানের কানে কানে কী কথা যেন বলছেন । তারপরে দুজনে আলিঙ্গন করলেন এবং তার একটু পরেই ইয়াহিয়া খানের প্লেন আকাশে উড়ে গেলো।
| শামসুদ্দিন বিপদের আশংকা করলেন। তিনি বাড়িতে এসেই বন্ধুবান্ধবদের টেলিফোন করতে লাগলেন। পাকিস্তানী কর্তারা টেলিফোন লাইন বিচ্ছিন্ন করে নি । এক্ষুনি বাড়ি থেকে পালিয়ে যাও, শামসুদ্দিন গলার স্বর অন্য রকম করে বন্ধুদের বললেন। শামসুদ্দিনের অগুনতি বন্ধুবান্ধব ছিলো। সাংবাদিক, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবি, অধ্যাপক। তাদের সবাইকে বলা হলাে : দেরী করােনা, বিপদ ঘনিয়ে আসছে। বাড়ি থেকে পালাও। | বন্ধুরা অবাক। কে তাদের বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে বলছে? আর বাড়ি থেকে তারা পালিয়ে যাবেই বা কেন? অনেকদিন ধরে পাকিস্তানী সামরিক বাহিনী এবং ভুট্টোর সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের জনতার সংঘর্ষ চলছে। কিন্তু কেউ কল্পনাও করেনি যে সত্যি পূর্ব পাকিস্তান একদিন স্বাধীন বাংলাদেশ হবে। রাজনৈতিক ঝগড়া বিবাদ সদা সর্বদাই হয়ে থাকে কিন্তু ঐ বিবাদ-মীমাংসার সমস্যা সমাধান করবার জন্যে আজ অবধি কেউ পাকিস্তানিদের সঙ্গে হাতাহাতি, যুদ্ধেও নামেননি। | শামসুদ্দিন তার বন্ধুদের কাছে খবর পাঠিয়ে নিজেও ঘর থেকে পালিয়ে গেলেন। কারণ বিমানবন্দরে পাঞ্জাবী সৈন্যবাহিনীর আলাপ তার কানে এসেছিলো। রাত বারােটার সময় রাস্তা পরিস্কার করার অভিযান শুরু করা হবে।
অতএব বুদ্ধিমানের কাজ হলো, পলায়ন
টিকা খানের কাছ থেকে নির্দেশ পাবার পর জেনারেল হামিদ খান আবদুe?
________________________________________
| ব্রাফিং রুমে বসে পাকিস্তানী ট্যাঙ্ক বাহিনীকে সেদিনকার রাত্রের অভিযানের নকশা
বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। একটি নকশার মধ্যে ঢাকা শহরকে বিভিন্ন অংশে বিভক্ত করা হয়েছিলো। অপারেশনের কোড নেম ছিলো ‘বেলুচিস্তান। এত যত্ন সহকারে এই অপারেশনের নকশা তৈরী করা হয়েছিল যে কোথাও কোন ভূল ত্রুটী হবার সম্ভাবনা ছিল না।
ব্রীফিং শেষ হবার আগেই ট্যাঙ্ক বাহিনীর ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খান প্রশ্ন করলেন : স্যর একটা প্রশ্ন করতে চাই।
জেনারেল হামিদ খান ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খানের মুখের দিকে তাকালেন। সৈন্যবাহিনীতে ইসকান্দার খানকে সবাই গ্রীক’ বলে ডাকতেন। কারণ ইসকান্দার খান দেখতে বেশ সুপুরুষ ছিলেন এবং সহজেই মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতেন এবং তাদের মনও ভােলাতেন।
কি তােমার প্রশ্ন? জেনারেল হামিদ খান জিজ্ঞেস করলেন ।
স্তর অাপনি নকশাকে w, x, y, z-এ বিভক্ত করেছেন। এবার কোন অংশে কে থাকে একটু বুঝিয়ে দিন -ইসকান্দার বেশ সহজ গলায় এই প্রশ্ন করলেন।
z হলো অধ্যাপকদের হষ্টেল-আর নকশার যে অংশে নিশানা দেওয়া আছে A, সেই অংশ হলাে মেয়েদের হােষ্টেল জেনারেল হামিদ খানের এই জবাবে বেশ ব্যঙ্গের সুর ছিলো। জেনারেলের জবাবে উপস্থিত পাকিস্তানী সৈন্য বাহিনীদের মধ্যে হাসির আলােড়ন সৃষ্টি করলো। কারণ সবাই জানতো ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খান কী চান ? তিনি আজ রাত্রের জন্যে শিকার খুঁজছেন। আর তার রাতের শিকার হলাে নারী।
অন্যান্য , সেনাবাহিনীর সঙ্গে জেনারেল হামিদ খানও যোগ দিলেন । হাসি থেমে যাবার পর আবার সহজ গলায় বলতে সুরু করলেন : আমরা জানি যে আজকের এই রাত্রের অভিযানের জন্যে উপযুক্ত নেতা হলেন ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খান। অতি কঠিন কাজ করতেও তিনি কোন বেগ কিংবা অসুবিধে বােধ করেন
। আমার মনে হয় আজকের এই অপারেশন ‘বেলুচিস্তান সম্পন্ন করবার জন্যে চারটি আমেরিকান M-24 ট্যাঙ্কই যথেষ্ট হবে। বেশী ট্যাঙ্কের দরকার নেই। কারণ আমরা খবর পেয়েছি যে বিশ্ববিদ্যালয়, হােষ্টেলগুলাের যাবার পথে আওয়ামী লীগের সদস্য এবং ছাত্রদল গাছ উপড়ে রেখেছে, রাস্তায় গর্ত করা হয়েছে এবং শুধু তাই নয় ছােট ছােট ছােকরার দল রাস্তাঘাটে পাঞ্জাবীদের দেখলেই ঢিল ছুড়ছে। আমরা অবশ্যি ওদের ভয় করিনে এবং আমার দৃঢ় বিশ্বাস যে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার তার কাজ সুসম্পন্ন করতে পারবেন।
________________________________________
ক্যাপ্টেন ইসকান্দার আবার উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, আজকের রাত্রের। অভিযান সুসম্পন্ন করবার জন্যে আমাদের চারটি আমেরিকান ট্যাঙ্কেরও প্রয়ােজন নেই। একটি ট্যাঙ্ক এবং বারােজন সৈন্য নিয়ে আমি আজকের রাত্রের অপারেশন শেষ করতে পারি।
জেনারেল হামিদ অবশ্যি ক্যাপ্টেন ইসকান্দারের সঙ্গে একমত হতে পারলেন । তিনি এই অভিযানের ব্যাপারে ভিন্ন মত পােষণ করতেন। তিনি বললেন, যে কাজটি তুমি অতি সহজ বলে গণ্য করছে আমি ঐ কাজটি হেসে খেলে উড়িয়ে দিতে পারিনে। অবিশ্যি ট্যাঙ্কের সংখ্যা নিয়ে আমি জেনারেল টিকাকে বলেছিলুম যে দুটি ট্যাঙ্ক দিয়ে আমরা অপারেশন ‘বেলুচিস্তান সুসম্পন্ন করতে পারবো। তবে মহামান্য প্রেসিডেন্টের এই ব্যাপারে ভিন্ন মত আছে। তিনি আমার প্রস্তাবকে পরিবর্তন করে বলেছেন, এই ধরনের রাস্তা পরিস্কার প্রতি বছর করা যায় না। একেবারেই সব কাজ শেষ করতে হবে। এবার তাদের সমুচিত শিক্ষা না দিলেই নয়। আর বাহাত্তর ঘণ্টার মধ্যে অপারেশন ‘বেলুচিস্তানের কাজ শেষ করতে হবে। • ব্রীফিং শেষ হবার পর জেনারেল হামিদ খান ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খানকে ডেকে বললেন, বেস্ট অব লাক। আমার মনে হয় এই সহজ কাজ করতে তােমাকে কোন বেগ পেতে হবে না। দু’তিনঘণ্টার মধ্যে ঐ বিশ্ববিদ্যালয়ের সমস্ত হােষ্টেলগুলােকে ধ্বংস করে দাও। অবশ্যি তােমার শেষ কাজ হবে মেয়েদের হােষ্টেলে যাওয়া। মনে রেখো ক্যাপ্টেন, ঐ হোষ্টেলে অনেকগুলো সুন্দরী মেয়ে আছে। অবশ্যি ওখানে কাজ শেষ করবার আগে তুমি যদি কিছুক্ষণের জন্যে জীবন উপভােগ করতে চাও আমার কোন আপত্তি নেই। তবে আমি চাই কাজ।
রাত বারােটার পর ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খান চারটি ট্যাঙ্ক নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন হােষ্টেলের দিকে রওনা হলেন।
নির্জন নীরব রাস্তা। চারিদিকে অন্ধকার। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে পৌছবার আগেই অপারেশন রুম থেকে বেতারে খবর পেলেন- ফিফটি ফাইভ, প্রগ্রেস রিপাের্ট পাঠাও। তােমরা কী রাস্তায় কোন বাধা পেয়েছ ?
না, কোন বাধা পাইনি।
চমৎকার আমরা প্রতি পাঁচ মিনিট অন্তর তোমার কাছ থেকে প্রগ্রেস রিপাের্ট চাই, আমরা খবর পেয়েছি জগন্নাথ হলের কাছে কয়েকটি হিন্দু বাদর গােলমাল সৃষ্টি করবার চেষ্টা করছে। | কথা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে একটি ট্যাঙ্ক রাস্তায় একটি উপড়ে পড়া গাছের
________________________________________
গায়ে গিয়ে ধাক্কা খেলো। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার প্রথমে ভাবলেন যে আওয়ামীলীগের সদস্যরা, কিংবা বিচ্ছু বাহিনী অথবা হিন্দু বাঁদরের দল আক্রমণ করছে। কিন্তু কেউ আক্রমণ করলো না।
এরপর আরো বহুবার ক্যাপ্টেন ইসকান্দার বাধা পেলেন বটে তবে শত্রু বাহিনীর কেউ তাকে আক্রমণ করেনি।
জগন্নাথ হলের কাছে যেই তার ট্যাঙ্ক বাহিনী পৌছল তখন দুচারটে মলােটভ ককটেল এসে ইসকান্দারেরর ট্যাঙ্কের গায়ে লাগলো। অবশ্যি ঐ মলােটত ককটেল তার ট্যাঙ্কের কোন ক্ষতি করলাে না।
এবার ক্যাপ্টেন ইসকান্দার অপারেশন রুমকে বেতারে খবর পাঠালেন রাস্তায় কিছু গাছ কেটে ফেলে রাখা হয়েছে এবং আমার অগ্রসরে বাধা সৃষ্টি করবার চেষ্টা করা হচ্ছে।
অপারেশন রুম থেকে জবাব এলো : তােমার খবরটি আবার রিপিট করে। ঠিক বুঝতে পারছি নে••••••
কতােগুলাে ছেলে আমাদের ট্যাঙ্কের দিকে ঢিল পাটকেল ছুড়ছে ••••• অবশ্যি আমাদের কোন ক্ষতি করতে পারেনি ••••” ক্যাপ্টেন ইসকান্দার বেতারে খবর রিপিট করলেন।
এবার বেতারে জেনারেল হামিদ খানের গলার স্বর ভেসে এলো, ক্যাপ্টেন,/ আমরা জানতুম যে আওয়ামী লীগের সদস্যরা এবং ছাত্রদল গােলমাল সৃষ্টি করবার চেষ্টা করবে। ভয় পেওনা, কাজ করে যাও, আমি জানি যে তুমি কাজ ঠিক করতে পারবে। তােমার কোন অসুবিধে হবে না।
অবিশ্যি ক্যাপ্টেন ইসকান্দারও তাই জানতেন, যে কাজ আজ তাকে করতে বলা হয়েছে সেটা তার পক্ষে অতি সহজ। তাকে বলা হয়েছে : জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হল ধ্বংস করাে, তারপর ঐ এলাকার অন্য সব ‘শয়তানদের শিক্ষা দিয়ে পুলিশ লাইনে গিয়ে…ইস্ট পাকিস্তান রেজিমেন্ট এবং পুলিশ বাহিনীকে শায়েস্তা করে। পূর্ব পাকিস্তানের পুলিশরা বড়ো দুষ্টুমি শুরু করেছে। ব্যাটাদের ভালাে শিক্ষা দেওয়া চাই। পরে আবার নির্দেশ পাঠান হবে।
জগন্নাথ হলের কাছে এসে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার বেতারে খবর পাঠালেন, জগন্নাথ হল নির্জন, নিশ্চপ। তবে নিশ্চয় ছাত্ররা হলঘরে আছে। আমি ট্যাঙ্ক থেকে হলঘরের বাতিগুলােকে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি।
বেতারে জবাব এলো, চমৎকার। গােটা তিনেক ট্যাঙ্ক থেকে গুলী চালালেই যথেষ্ট। তারপর হলঘরের ভেতরে চিতা বাহিনীদের পাঠিয়ে ছাত্রদের ভালো করে
________________________________________
শিক্ষা দাও। ইমামের স্পষ্ট নির্দেশ ঐ হলের কোন ছাত্রই যেন জীবিত না থাকে। | ‘চিতা হলাে ক্যাপ্টেন ইসকান্দারের অধীনে পদাতিক বাহিনী এবং ইমাম ছিলো জেনারেল টিকা খানের কোড নেম।
একটু বাদেই ট্যাঙ্ক বাহিনীর গুলি •এবং পদাতিক বাহিনীর অটোমেটিকের গুলীতে নিস্তেজ নীরব বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা মুখর হয়ে উঠলাে। | ক্যাপ্টেন ইসকান্দার যখন জগন্নাথ হলের ছাত্রদের তাক করে ট্যাঙ্ক বাহিনী থেকে কামানের গােলা চালাচ্ছিলেন ঐ সময়ে ইসকান্দারের পদাতিক বাহিনী চীনি এ-৪৭ রাইফেলস-মেশিনগান নিয়ে অধ্যাপকদের আবাসগুলাে হানা দিচ্ছিলো। বহু বিখ্যাত অধ্যাপক ঐ পদাতিক বাহিনীর মেশিনগানের গুলীতে মারা গেলেন। একটু বাদে অধ্যাপকদের আবাসগুলাের সামনে তীব্র সার্চলাইট জ্বালান হলো এবং ইসকান্দারের সৈন্যবাহিনী অধ্যাপকদের ঘরের ভিতর ঢুকে গুলী চালাতে লাগলেন।
বন্দুকের গর্জনের চাইতে মানুষের চীৎকার অর্থাৎ নারী এবং শিশুর ক্রন্দন আরাে তীব্র হলাে।
ট্যাঙ্কের ভেতর বসে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার ঐ সব চীৎকার ক্রন্দন শুনে হাসতে লাগলেন। প্রেসিডেন্ট এবং ইমাম ঠিক কথাই বলেছেন যে নােংরা বাঙ্গালীদের ভালো করে শিক্ষা দিতে হবে, যেন ওর আর কোনদিন মাথা তুলে না দাড়াতে পারে। কিন্তু যদিও ক্যাপ্টেন ইসকান্দার ট্যাঙ্কের পেরিসকোপের ভেতর দিয়ে জগন্নাথ হলের দিকে তাকিয়ে তার কামানের নিশানা ঠিক করছিলেন তবু তার মন তখন ছিলো মেয়েদের হােষ্টেলের দিকে । জেনারেল হামিদ তাকে স্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছেন : প্রথমে জগন্নাথ হল, ইকবাল হল ইত্যাদি ধ্বংস করতে হবে। পরে পুলিশ বাহিনী মানে পিলখানা। তারপর তুমি ঐ মেয়েদের হােস্টেলের দিকে যাবে।
পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী এবার পেট্রোলের টিন নিয়ে এলো এবং প্রতিটি অধ্যাপকদের বাইরের ঘরে তালা লাগিয়ে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দিলো। দাউ দাউ করে আগুন জ্বলে উঠলো।
এদিকে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার নিশানা ঠিক করে জগন্নাথ হলের দিকে গুলী চালাতে লাগলো।
তখন অনেক ছাত্র অবশ্য জগন্নাথ হলে ছিলো না। বিপদের আশংকা করে তারা বাড়ি চলে গিয়েছিলো। যারা যায়নি তারা তাদের ঘরে ঘুমুচ্ছিলাে। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার এবার কামানের গুসী দিয়ে তাদের চিরদিনের জন্যে ঘুম
________________________________________
পাড়িয়ে দিলেন। জগন্নাথ হলঘর থেকে মাত্র দুটি ছাত্র অন্ধকারে পালাতে পেরেছিল। বাকী সবাই ট্যাঙ্কের কামানের গুলীতে প্রাণ দিলো। অনেক ছাত্র বন্দুকের গুলীতে শুধু মাত্র জখম হয়েছিলো। এবার তাদের বন্দুকের বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হলো। [ পাঠকদের স্মরণ করিয়ে দিতে চাই যে পরবর্তীকালে যে রাত্রে তাজউদ্দীন কামারুজ্জমান আওয়ামী লীগের নেতাদের খুন করা হয়েছিলাে তাদের এমনি নৃশংস ভাবে বেয়নেট দিয়ে হত্যা করা হয়।]
অধ্যাপকদের আবাসগুলােতে আগুন জ্বালিয়ে দেবার পর ইসকান্দার খান নিজে ট্যাঙ্ক থেকে বেরিয়ে জগন্নাথ হল এবং ইকবাল হলের ভেতর ঢুকলেন। প্রথমে তার আশংকা ছিলো যে দুটি ছাত্রাবাস থেকে আক্রমণের পাল্টা জবাব পাওয়া যাবে। কিন্তু প্রতি আক্রমণের কোন সাড়া শব্দ না পেয়ে তার মনে বেশ সাহস হলো। হাতে একটি ছড়ি নিয়ে ইসকান্দার খান জগন্নাথ হলের প্রতিটি ঘর ঘুরে দেখতে লাগলো। ছাত্রদের মৃতদেহ ছড়িয়ে আছে, এর মধ্যে অনেকেই অল্পবয়সী, প্রায় শিশুর বয়সী। ঘরে ঘরে রক্তের নদী বইছে। শিস দিতে দিতে ইসকান্দার খান বেতারে অপারেশন রুমকে খবর দিলো: ‘মিশন সফল হয়েছে।
এক্সেলেন্ট ! জেনারেল হামিদ খান আনন্দের কণ্ঠেই জবাব দিলেন। যা ওখানে আর্মস এ্যামুনিশন কী ছিলো?
বিশেষ কিছু ছিলো না, প্রথম মহাযুদ্ধের কয়েকটি বন্দুক । বন্দুকগুলো প্রায় অকেজো, চালান যায় না। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার জবাব দিলাে।
এবার তাহলে পুলিশ লাইনের দিকে যাও। অবশ্যি ওদের শায়েস্তা করা অতাে সহজ কাজ হবে না। কারণ ওদের কাছে বন্দুক ও অনান্য হাতিয়ার সবই আছে। ওখানে তােমাকে বেশ সতর্ক হয়ে কাজ করতে হবে। হ্যা আর একটা কথা, পুলিশ লাইনের দিকে যাবার পথে অনেক রাস্তায় গাছ কেটে রাখা হয়েছে। তবে আমাদের স্পাইয়ের দল, আই মীন রজাকার চারদিকে ঘুরছে, আর আমাদের ওয়াকি টকির মারফত কাজ করছে।
ক্যাপ্টেন ইসকান্দারের অবশ্যি প্রথমে পুলিশ লাইনের দিকে যাবার কোন ইচ্ছে ছিলাে না। বরং লেডীজ হষ্টেলের দিকে গেলে কিছু মজা করা যেতো। ব্রফিং শেষ হবার পর থেকে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার লেডীজ হােষ্টেলের মেয়েদের সম্বন্ধে কিছু খোজ খবর নিয়েছিলো। ঐ হােষ্টেলে কটি মেয়ে আছে ? কোন মেয়ে সুন্দরী, উদ্দাম যৌবনা ? এই সব খবর সংগ্রহ করতে তার কোন অসুবিধে হয়নি। রজাকার এবং পাকিস্তানী পন্থী কিছু বিহারী যারা অধ্যাপকদের বাড়ীগুলো দেখিয়ে দিয়েছে তারাই লেডীজ হােষ্টেলের সব খবর দিয়েছে। ওদের কাছ থেকে
________________________________________
ক্যাপ্টেন ইসকান্দার জানতে পেরেছে, লেডীজ হােষ্টেলের সব চাইতে রূপসী মেয়ে হলো ‘ইয়াসমিন। তার বয়স বেশী নয়, উনিশ কিংবা কুড়ি। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার ঐ বয়সের মেয়েদের খুব পছন্দ করে। ওদের সঙ্গে সহবাস করে আনন্দ পায় । কিন্তু আজ হাইকম্যাণ্ড মানে জেনারেল হামিদ খানের আদেশ অমান্য করবার যে নেই। তাকে এবার পুলিশ লাইনে যেতেই হবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকা ত্যাগ করে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার পুলিশ ব্যারাকের দিকে রওনা দিলাে। ট্যাঙ্ক বাহিনীর পেছনে সৈন্যবাহিনী আরমারড গাড়ীগুলো আসতে লাগলাে। পথের মাঝখানে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার আবার জেনারেল হামিদধানের গলা পেলাে।
ক্যাপ্টেন কনগ্রাচুলেশন ! আমরা ক্যান্টনমেন্ট থেকে বিশ্ববিদ্যালয়ের এলাকার আগুন দেখতে পাচ্ছি। আশা করি পুলিশ লাইনের আগুনও দেখতে পাবো।
থ্যাঙ্ক ইউ স্যর। আপনি কোন চিন্তা করবেন না। নােংরা বাঙ্গালীদের কাবু করতে বেশী সময় লাগবে না।
আর একটা কথা। রেডিও টেলিফোন লাইন খুলে রেখো, এরপর তােমাকে কী করতে হবে তার নির্দেশ দেবো। জেনারেল হামিদখান বললেন ।
আমি ভেবেছিলাম এর পর আমাকে লেডীজ হস্টেলের দিকে যেতে হবেক্যাপ্টেন ইসকান্দারের কণ্ঠে অনুরােধের সুর ছিলো।
বেশ জোরে হেসে উঠলেন হামিদ খান। তার সেই হাসি রেডিও টেলিফোনে স্পষ্ট শােনা গেলো। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার অপ্রস্তত বােধ করলো। এর মধ্যে হাসবার কী কারণ থাকতে পারে ?
অতাে ব্যস্ত হবার কিছু নেই মাই ডিয়ার বয়। লাইফ এনজয় করবার প্রচুর সুযােগ পাবে। প্রথমে কাজ, তারপর এনজয়মেন্ট—যাক্, পুলিশ লাইন কতদূর? জেনারেল হামিদ বললেন।
এক কিলােমিটার। জবাব দিলো ক্যাপ্টেন ইসকান্দার।
সময় নষ্ট করোনা। প্রথমে তিনটে ট্যাঙ্ক থেকে গুলি চালাও। পরে সৈন্যবাহিনী পাঠাও। আর ওখান থেকে ফিরে আসবার সময় সমস্ত ব্যারাকে পেট্রোল ঢেলে আগুন জ্বালিয়ে দেবে। আমি কাউকে জ্যান্ত রাখতে চাইনে—এবার জেনারেল হামিদের কণ্ঠে আদেশের সুর ছিলো।
আপনি কোন চিন্তা করবেন না স্যার। একটি প্রাণী ও জীবিত থাকবে না •••
ক্যাপ্টেন ইসকান্দার অবশি অতিরঞ্জিত বড়াই করেনি। কারণ যদিও পূর্বপাকিস্তানের পুলিশ বাহিনীকে কাবু করতে তার একটু বেগ পেতে হয়েছিলো
________________________________________
তবু আধঘণ্টার মধ্যে তার কাজ শেষ হয়ে গেলো। আর পুলিশ ব্যারাক থেকে, ফেরবার পথে জেনারেল হামিদের নির্দেশানুযায়ী ব্যারাকে পেট্রোল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিলাে।
পুলিশ ব্যারাকের কাজ শেষ করে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার যখন ফিরবার আয়ােজন করছে তখন রেডিও টেলিফোনে তার জেনারেল হামিদের গলা শুনতে পেলাে : ওয়েল ডান মাই ডিয়ার বয়। শুনতে পেলুম পুলিশ ব্যারাক একেবাবে ধ্বংস হয়েছে
* এবার ক্যাপ্টেন ইসকান্দারের নতুন কোনো নির্দেশ শুনবার ইচ্ছে বা সময় ছিলোনা। কারণ ঐ লেডীজ হােষ্টেলের দিকে যাবার জন্যে সে তখন ব্যাকুল হয়ে উঠেছে। তার রজাকার বাহিনীর পাইয়ের দল তাকে শুধু ইয়াসমিনের খবর দেয়নি ইয়াসমিনের একটি ছবিও দিয়েছিলাে। সেই ছবি দেখার পর থেকে ঐ মেয়েকে পাবার জন্যে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার অধৈর্য হয়ে উঠলাে। অতএব জেনারেল হামিদের নতুন নির্দেশ শুনবার মতো তার কোন ইচ্ছেই ছিলােনা। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার রেডিও টেলিফোনের লাইন বন্ধ করে তার ট্যাঙ্ক নিয়ে লেডীজ হষ্টেলের দিকে রওনা দিলো। রেডিও টেলিফোনে সে জেনারেল হামিদের অস্পষ্ট গলা শুনতে পেলাে। হামিদ তাকে ডাকছে•••
হ্যালো হ্যালো, কী ব্যাপার, জবাব দিচ্ছেনা কেন, ক্যাপ্টেন ? চুপ করে আছো কেন ? এনিথিং রং••••••। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার কোন জবাব না দিয়ে সােজা গিয়ে হাজির হলাে মেয়েদের হষ্টেলে।
জগন্নাথ হল, ইকবাল হল এবং প্রফেসরদের আবাস ভবনে তখনও আগুন দাউ দাউ করে জ্বলছে। অনেক আগে থেকে মেয়েরা ঐ আগুন দেখে ভয়ে কাপছিলো। কী করবে তারা ভেবে পাচ্ছিলো না। মেয়েদের মধ্যে অনেকে তখন কঁাদছে। এমন সময় ক্যাপ্টেন ইসকান্দারের ট্যাঙ্ক এবং আরাে দুটো সাজোয়া বাহিনী এসে হাজির হলো। মেয়েরা এবার স্পষ্ট বুঝতে পারলো বিপদ তাদের দরজার সামনে এসে হাজির হয়েছে। দু তিনটে মেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লাে। কেউ বা বারান্দা থেকে ঝাঁপ দিয়ে পালাবাৰ চেষ্টা করলো, তাদের ঐ চেষ্টা ব্যর্থ হলাে। ঝাঁপ দিতে গিয়ে দু একজন মারাও গেলাে । কয়েকজন নিজেদের ইজ্জত বাঁচাবার জন্যে আত্মহত্যা করবার চেষ্টা করলো।
লেডীজ হােষ্টেলের সবচাইতে সুন্দরী এবং অল্প বয়স্ক মেয়ে হলাে ইয়াসমিন। তার মা ছিলো হিন্দুর মেয়ে, বাবা অবশ্যি মুসলমান। দেশ বিভক্ত হবার সময়
________________________________________
ইয়াসমিনের মা সুনন্দ। বােস, বাংলা দেশে চলে আসেন এবং ঢাকাতে তার ডাক্তার নসরুলার সঙ্গে বিয়ে হয়। বিয়ের সময় সুনন্দা বােসের বয়স ছিলাে মাত্র সতেরো বছর এবং বিয়ের পর তার নাম হলাে মেহেরউন্নিা। এই বিয়ে নিয়ে মেহেরউন্নিষা এবং ডাঃ নসরুল্লাকে কম বেগ পেতে হয়নি। কারণ মেহেরউন্নিসার বাবা নাবালিকা কন্যার এই বিষেতে সম্মতি দিতে পারেননি। কোটে কেসও করে ছিলেন। কিন্তু পরে বৃদ্ধ মি: বােস হিসেব করে দেখলেন যে কলকাতায় বসে ডাঃ নসরুল্লার বিরুদ্ধে এই কেস চালান তার পক্ষে সম্ভব নয়। কিছুদিন পরে ডাঃ বােস মারা গেলেন। বাজারের সবাই বলতে সুরু করলেন যে কন্যার এই বিবাহে বৃদ্ধ বােস মারা গেছেন।
সুনন্দা বােস অর্থাৎ ইয়াসমিনের মা সুবিখ্যাত সুন্দরী ছিলেন। তার সৌন্দর্য এবং পরবর্তীকালে ইয়াসমিনের সৌন্দৰ্য্য ঢাকা শহরে শুধু আলােড়ন নয় বড়াে বড়াে মহলে গুঞ্জনও সৃষ্ট করেছিলো। ইয়াসমিনের জন্মের কিছুদিন পরে ডাক্তার নসরুল্লার মৃত্যু হয়। সুনন্দা বােসেরও তখন অল্পবয়স। আবার অনেক বিত্তশালী ধনবান ব্যক্তিরা সুনন্দা বােসকে পুনর্বিবাহ করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু ইয়াসমিনের জনেই হােক কিংবা অন্য কোন ব্যক্তিগত কারণে সুনন্দা বােস দ্বিতীয়বার বিয়ে করেননি। তিনি নারায়ণগঞ্জে একটি মেয়েদের স্কুলে মাস্টারী করে তার একমাত্র কন্যা ইয়াসমিনকে মানুষ করতে লাগলেন।
ইয়াসমিনের খ্যাতির আর একটি বিশেষ কারণ ছিলো, ওর অপূর্ব কণ্ঠস্বর । ঢাকা। শহরে সুগায়িকা বলে তার যথেষ্ট নাম ছিলাে। সুনন্দা বােস নিজেও ভালো গাইতে পারতেন কিন্তু বিয়ের পর স্বামীর অনিচ্ছার দরুন গানবাজনা করতে পারেননি। | ক্যাপ্টেন ইসকান্দার পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর একজন খ্যাতনামা বীর সৈনিক এবং বহু পশ্চিম পাকিস্তানী মেয়ের প্রেমিক। এবার সে তার সাজেয়া বাহিনী নিয়ে মেয়েদের হােস্টেলে বীরদর্পে ঢুকলো। মেয়েদের চীৎকার কিংবা তাদের কান্নাকাটি তার মনে কোন রেখাপাত করলো না। বরং তার আদিম রিপুর কামনা যেন আরাে তীব্র ও প্রবল হলাে। অন্য কোন মেয়ের প্রতি তার কোন ঝোঁক ছিলােনা। ইয়াসমিনকে তার চাইই…কিন্তু এই গােলমাল হাঙ্গামায় এতােগুলাে মেয়ের মধ্যে ইয়াসমিন কোথায় লুকিয়ে আছে ? একবার তার মনে হলাে, যে রজাকার স্পাই তাকে ইয়াসমিনের খবর এবং ছবি দিয়েছিলাে তাকে সঙ্গে করে নিয়ে এলেই হতো। তাহলে ইয়াসমিনকে এই মহিলা মহল থেকে আবিষ্কার করতে তার কোন অসুবিধে হতাে না। কেন যে সেই রজাকার শয়তানটিকে সঙ্গে
________________________________________
করে আনা হয়নি সেজন্যে তার মনে বেশ অনুতাপ হলো। ক্যাপ্টেন ইসকান্দার হাতের ঘড়ির দিকে তাকালো। রাত প্রায় দুটো। পশ্চিম আকাশ আগুনের আলােয় এখন রাঙ্গা হয়ে উঠেছে। বাইরের চীৎকার, ট্যাঙ্ক বাহিনীর শব্দ, সৈন্য বাহিনীর জুতাের আওয়াজ, মেয়েদের ভয়ার্ত আর্তনাদ প্রতি মুহূর্তে তীব্র হচ্ছে। ঢাকা শহর জেগে উঠেছে। সবাই যেন বুঝতে পেরেছে যে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী আজ পূর্ববাংলায় জাতীয় সম্মান ঐতিহ্যকে বিলুপ্ত করবার জন্যে হানা দিয়েছে।
ক্যাপ্টেন ইসকান্দার এবার হােষ্টেলের ঘরগুলাে ঘুরে দেখতে লাগলো। কোথায় ইয়াসমিন, সেই লােভনীয় বাঙ্গালী মেয়েটি। অন্ধকারের অস্পষ্ট আলােয় কোন মেয়েকে চিনে খুঁজে বার করাও যায় না। হঠাৎ তার মনে হলো, এই হােষ্টেলের সবাই যেন ইয়াসমিনের মতো দেখতে••••••• ” মেয়ের দল বাইরে ছুটে বেরিয়ে যাবার চেষ্টা করছে। কিন্তু যাবার কোন উপায় ছিলোনা। কারণ পাকিস্তানী সাজোয়া বাহিনীর দল হােস্টেল ঘিরে আছে। সবাই প্রস্তুত। একবার ক্যাপ্টেন ইসকান্দারের হুকুম পেলেই হয়। তারা অসহায় মেয়েদের উপরও গুলি চালাতে দ্বিধা করবে না। সময় যতো বয়ে যেতে লাগলাে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার ততো পাগল হয়ে উঠলো। ইয়াসমিনকে পাবার জন্যে তখন সে মাতােয়ারা। তার মনে হলাে ইয়াসমিন বলে হয়তো কোন মেয়ে এই হোটেলে থাকেই না। রজাকার স্পাই তাকে মিথ্যে খবর দিয়েছে। এবার সে একটি ছােট ঘরে ঢুকলো। প্রথমে তার মনে হলো ঘরটা শূন্য। একটু বাদে যেন কার গোঙানি শােনা গেলো। বুঝতে পারলো, এই ধরে সে একা নয়। কোন মেয়ে এই ঘরে লুকিয়ে আছে। কিন্তু কোথায় সে ? ইসকান্দার হাতের টর্চ লাইট নিয়ে ঘরটি খুজতে লাগলো।
তার অনুমান মিথ্যে নয়। একটি মেয়ে ঘরের খাটের নীচে লুকিয়ে ছিলো। ইসকান্দার মেয়েটিকে বের করে নিয়ে এলো। প্রথমে তার মনে হলো এই মেয়েটির নাম ইয়াসমিন। পরে ফটোর সঙ্গে মেয়েটির চেহারা মেলাবার চেষ্টা করলাে। অস্পষ্ট আলােয় মেয়েটিকে ভালো করে দেখা যায় না। তবে তার বুঝতে অসুবিধে হলােনা যে মেয়েটি ভয়ে কাপছে। ভয় পাবার কথাই বটে।
কী নাম তােমার? ক্যাপ্টেন ইসকান্দার উর্দতে জিজ্ঞেস করলো।
জবাব পেলো বাংলায়। কয়েক বছর ঢাকা শহরে থেকে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার বাংলা ভাষা বুঝতে পারতো। যদিও সে বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করে। শুধু সে নয় তার সহকর্মীরা—ইমাম, প্রেসিডেন্ট সবাই বাংলা ভাষাকে ঘৃণা করে। আর এই বাংলা ভাষা নিয়ে এই ঢাকা শহরে যে সব আন্দোলন হয়েছে সেই
________________________________________
সংগ্রামকে বহুবার তাকে দমন করতে হয়েছে। আজ ক্যাপ্টেন ইসকান্দার মেয়েটির ওপর কোন রাগ বা ঈর্ষা প্রকাশ করলাে না। আজ সে এই হােষ্টেলে অন্য অভিসন্ধি নিয়ে ঢুকেছে। ইয়াসমিনকে তার চাই। আর ইয়াসমিন হােষ্টেলের কোন ঘরে লুকিয়ে আছে তাকে খুঁজে বার করতেই হবে। সেই খবর এই মেয়েটির কাছ থেকে ছলে বলে বার করা যায় না? এবার সে ইয়াসমিনের ছবি দেখিয়ে মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলো এই মেয়েটিকে চেনো?
এই বলে সে ফটোর উপর টর্চ লাইটের আলো ফেলে মেয়েটির চোখের সামনে ওটা ধরলাে।
ইয়াসমিন•••! মেয়েটা প্রায় চীৎকার করে বেশ আতঙ্কের সঙ্গে ছবিটাকে দেখলাে।
হ্যা কোথায় সে? ক্যাপ্টেন ইসকান্দার এবার যেন আশা; আলো দেখতে পেলো।
ভয়ার্ত মেয়েটি এবার ইসকান্দারকে আর একটা ছােট ঘরে নিয়ে গেলো। ঘরের ভেতরে ঢুকে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার অবাক, হতভম্ব। ঘরের ভেতর সে যে এই দৃশ্য দেখতে পাবে কখনো কল্পনাও করেনি। ঘরের ভেতর একটি মেয়ে গলায় দড়ি দিয়ে ঝুলছে। মেয়েটি আত্মহত্যা করেছে।
এই তােমার ইয়াসমিন ? হ্যা, ছােট জবাব দিলো মেয়েটি।
স্তম্ভিত হতবাক হয়ে বেশ কিছুক্ষণের জন্যে ক্যাপ্টেন ইসকান্দার দাড়িয়ে রইলাে। অনেকক্ষণ তার মুখ দিয়ে কোন কথা বেরুলো না। তারপরে তার হাসি পেলো। জোরে হেসে উঠলো সে। দৌড়ে বাইরে চলে এলো। রাস্তায় তার সহকর্মীরা দাড়িয়ে আছে। তারা পরবর্তী হুকুমের অপেক্ষা করছে। বাইরে এসে সৈন্যবাহিনীদের হুকুম দিলো সে-লাগাও!
মুহূর্তের মধ্যে হোস্টেলের চারদিকে আগুন জ্বলে উঠলো।
এবার ক্যাপ্টেন ইসকান্দার প্রায় পাগলের মতাে চীৎকার করে বললো, আমার নাম ক্যাপ্টেন ইসকান্দার খান। আমি পাকিস্তানী বীর সৈনিক। আমরা আজ যা করছি তােমরা কোনদিনই তা করতে পারবে না। তােমর হলে কাপুরুষ বাঙ্গালীর জাত••• আলা আমাদের বীর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে দীর্ঘজীবি করুন।