You dont have javascript enabled! Please enable it! Draft - সংগ্রামের নোটবুক

This is a temporary post for collecting data. Not for posting and not for publishing. Saved only as readable for the editors. Not clickable and not downloadable.

একুশে ফেব্রুয়ারী
জহির রায়হান

ভূমিকা

বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলন শুধু এদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, শিল্প সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও নতুন চেতনাপ্রবাহ সৃষ্টি করেছিলাে। এই চেতনা ছিলাে অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক মূল্যবােধসঞ্জাত। আমাদের শিল্প সাহিত্যে যারা এই চেতনার ফসল, তাঁদের ভেতর জহির রায়হানের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযােগ্য। কারণ ভাষা আন্দোলনে তিনি শুধু যে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছেন তা নয়, তাঁর সাহিত্য প্রেরণার মূল উৎস ছিলাে এই আন্দোলন। ভাষা আন্দোলনের উপর প্রথম সার্থক উপন্যাস— ‘আরেক ফাল্গুন’-সহ অজস্র ছােটগল্প ও নিবন্ধ লিখেছেন তিনি। এইসব লেখা এবং তাঁর রাজনৈতিক অঙ্গীকার থেকে এটাই প্রতীয়মান হয় যে, ভাষা আন্দোলনের আবেগ, অনুভূতি তাঁকে প্রচণ্ডভাবে আপুত করে রেখেছিলাে।
লেখক হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পর জহির রায়হান চলচ্চিত্রের সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করেন পঞ্চাশ দশকের শেষে। এই শিল্প মাধ্যমটির প্রতি তার যােগাযােগ অবশ্য আরাে আগের।
ষাট দশকের শুরুতে জহির রায়হান একজন পরিপূর্ণ চলচ্চিত্রকার হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন কখনাে আসেনি’, ‘কাঁচের দেয়াল নির্মাণের মাধ্যমে। এরপর অস্তিত্বরক্ষার তাগিদে কয়েকটি বাণিজ্যিক ছবি বানালেও তিনি তাঁর লক্ষ্য সম্পর্কে নিশ্চিত ছিলেন। বাণিজ্যিক ছবি বানাবার সময় তাঁর শিল্পসত্তা যতটুকু বিপর্যস্ত হয়েছিলাে, যে তীব্র মানসিক যাতনার শিকার হয়েছিলেন । তিনি কিছুটা লাঘবের জন্য আবার সাহিত্যের দ্বারস্থ হয়েছেন, উপন্যাস লিখেছেন হাজার বছর ধরে। ইচ্ছার আগুনে জ্বলছি’ আর ‘কতগুলাে কুকুরের আর্তনাদ’-এর মতাে গল্প লিখে জ্বালা মেটাতে চেয়েছেন।
কাচের দেয়াল’ বানাবার পর তিনি একুশে ফেব্রুয়ারী’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তবে শিল্পোত্তীর্ণ হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসায়িক দিক থেকে তিনটি অসফল ছবি (কখনাে আসেনি, সােনার কাজল ও কাচের দেয়াল) বানাবার ফলে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী প্রযােজনা করার জন্য কেউ এগিয়ে আসেনি। বাধ্য হয়ে তাঁকে বাজারচলতি ছবি বানাতে হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বানাবেন এই ইচ্ছা সব সময় সযত্নে লালন করেছেন তিনি। যখন নিজে চলচ্চিত্র প্রযােজনা করার পর্যায়ে এলেন, তখন বাধা হয়ে দাঁড়ালাে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি। তাঁর পরিকল্পিত একুশে ফেব্রুয়ারী’ ছিলাে একটি রাজনৈতিক ছবি, আইয়ুবের স্বৈরাচার আমলে সে ধরনের ছবি বানানাে ছিলাে একেবারেই অসম্ভব। এজন্যই তিনি প্রতীকের আশ্রয় নিয়ে ঊনসত্তরের গণআন্দোলনের উর্মিমুখর দিনগুলােতে বানিয়েছিলেন জীবন। থেকে নেয়া। এ ছবিতে একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরী এবং আন্দোলনের দৃশ্যে জহির রায়হানের রাজনৈতিক আবেগের যে তীব্র প্রকাশ ঘটেছে, বুঝে নিতে অসুবিধে হয় না ভাষা আন্দোলনের শেকড় তার চেতনার কত গভীরে প্রােথিত। এরপর আরাে বড় ক্যানভাসে সর্বজাতির সর্বকালের আবেদন তুলে ধরতে চেয়েছিলেন ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এ, যে ছবি তিনি শেষ করতে পারেননি। এর কিছুটা আভাষ পাওয়া যাবে স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি ‘স্টপ জেনােসাইড’-এ। তবু ‘একুশে ফেব্রুয়ারী নির্মাণের পরিকল্পনা তিনি বাতিল করেননি। ৭২-এর দুর্ঘটনায় এভাবে হারিয়ে না গেলে হয়তাে স্বাধীন বাংলাদেশে তিনি বানাতেন তার সেই স্বপ্ন আর আবেগের ছবি।

বায়ান্ন সালের ভাষা আন্দোলনে জহির রায়হানের অংশগ্রহণ কোন আকস্মিক বা নিছক আবেগতাড়িত ঘটনা ছিলাে না। তাঁর রাজনৈতিক জীবন-প্রবাহের স্বাভাবিক গতি তাঁকে যুক্ত করেছিলাে এই আন্দোলনের সঙ্গে। যে কারণে শুধু বায়ান্নতে নয়, ঊনসত্তর বা একাত্তরেও তাঁকে খােলাখুলি আন্দোলনের পক্ষে দাঁড়াতে হয়েছে। তাঁর সমসাময়িক লেখক শিল্পীদের ভেতর তিনি ছিলেন রাজনীতির প্রতি সবচেয়ে বেশি অঙ্গীকারাবদ্ধ। তাকে যারা জানেন তাঁরা সবাই স্বীকার করবেন, তিনি সব সময় খােলাখুলি তাঁর রাজনৈতিক মত ব্যক্ত করতেন। এর জন্য তাঁকে যথেষ্ট নিগ্রহের সম্মুখীন হতে হয়েছে। একথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে এই রাজনীতির জন্যই তাঁকে অকালে হারিয়ে যেতে হয়েছে।
চল্লিশ দশকের মাঝামাঝি জহির রায়হান যখন স্কুলের নীচের ক্লাশের ছাত্র, তখন অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রভাবে তিনি রাজনীতির সংস্পর্শে এসেছিলেন। শহীদুল্লাহ কায়সার তখন কোলকাতার একজন ছাত্রনেতা। প্রকাশ্যে ছাত্র ফেডারেশনের সঙ্গে এবং গােপনে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে যুক্ত। জহির রায়হান তখন পার্টি-কুরিয়ার ছিলেন। পার্টির আত্মগােপনকারী সদস্যদের মধ্যে চিঠিপত্র ও খবর আদান প্রদানের কাজ করতেন। প্রকাশ্যে কমিউনিস্ট পার্টির মুখপাত্র স্বাধীনতা বিক্রি করতেন। তখনকার দিনে পার্টি কর্মীরাই পার্টির কাগজ বিক্রি করতেন। সেই আমলের একজন প্রবীণ কমিউনিস্ট নেতা স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে জহির রায়হান সম্পর্কে বলেছেন, তখন ও ভালােভাবে হাফপ্যান্টও পরতে জানতাে না। প্রায় বােতাম থাকতাে না বলে একহাতে ঢােলা হাফপ্যান্ট কোমরের সাথে ধরে রাখতাে। রায়হান ছিল ওর ‘টেকনেম’—পার্টি পরিচয়ের ছদ্মনাম (তার পিতৃদত্ত নাম জহিরউল্লাহ)। বড়ভাইর প্রতি অত্যন্ত অনুগত ছিলাে। জহির রায়হানের পার্টি জীবনের সূচনা সম্পর্কে এর বেশি কিছু জানতে পারিনি।
বায়ান্ন সালে ভাষা আন্দোলনের সময় শহীদুল্লাহ কায়সার আত্মগােপন অবস্থায় সলিমুল্লাহ মুসলিম হলে ছিলেন। জহির রায়হান জানতেন পার্টির নির্দেশ হচ্ছে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার। তিনি পরে বলেছেন, ছাত্রদের মিটিঙেও সিদ্ধান্ত হলাে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। ছাত্রদের গ্রুপে ভাগ করা হলাে। আমি ছিলাম প্রথম দশজনের ভেতর। প্রথম দিকে যারা ১৪৪ ধারা ভেঙেছে পুলিশ। তাদের গ্রেফতার করে ট্রাকে চাপিয়ে সােজা লালবাগে নিয়ে গেছে। পরে ছাত্রদের মনােভাব দেখে পুলিশ গুলি চালিয়েছিলাে। জহির রায়হান কেন প্রথম দশজনের ভেতর ছিলেন এ প্রশ্নের জবাবে তিনি স্বভাবসুলভ স্মিত হেসে বহুবার পরিবারের সদস্যদের কাছে গল্প করেছেন, সিদ্ধান্ত তাে নেয়া হলাে ১৪৪ ধারা ভাঙা হবে। কিন্তু প্রথম ব্যাচে কারা যাবে ? হাত তুলতে বলা হলাে। অনেক ছাত্র থাকা সত্ত্বেও হাত আর ওঠে না। কারণ ক্যাম্পাসের বাইরে পুলিশ বন্দুক উঁচিয়ে পজিশন নিয়ে বসে আছে। ভাবখানা এই যে, বেরুলেই গুলি করবে। ধীরে ধীরে একটা দুটো করে হাত উঠাতে লাগলাে। গুনে দেখা গেলাে আটখানা। আমার পাশে ছিলাে ঢাকা কলেজের একটি ছেলে। আমার খুব বাধ্য ছিলাে। যা বলতাম, তাই করতাে। আমি হাত তুলে ওকে বললাম হাত তােল। আমি নিজেই ওর হাত তুলে দিলাম। এইভাবে দশজন হলাে।’
জহির রায়হান পরবর্তী সময়ে সরাসরি পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। শহীদুল্লাহ কায়সার যদিও তখন কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য। জহির রায়হানের সেই সময়ের লেখা কিছুটা রােমন্টিক ও আবেগ বহুল হলেও নিম্নবিত্ত মানুষের জীবন সংগ্রাম তিনি তখনকার গল্প ও উপন্যাসে যথেষ্ট দক্ষতা ও দরদের সঙ্গে এঁকেছেন। প্রথম ছবি কখনাে আসেনি’ এবং দ্বিতীয় ছবি ‘কাঁচের দেয়াল’-এর শহরের নিম্নবিত্ত জীবনের দারিদ্র, বেকারত্ব, ব্যবসায়ীদের ধূর্ততা, দুর্নীতি ও বৈষম্যের চিত্র রয়েছে।।
১৯৬৬ সালে চীন ও সােভিয়েত ইউনিয়নের পার্টির মতাদর্শগত বিরােধের ফলে অপরাপর দেশের মতাে এখানকার কমিউনিস্ট পার্টিও দ্বিধাবিভক্ত হয়। শহীদুল্লাহ কায়সারের অবস্থান ছিলাে মস্কোপন্থী শিবিরে। জহির রায়হান ছিলেন দ্বিধাগ্রস্ত। পার্টি ভাঙার জন্য সরাসরি পার্টির নেতৃস্থানীয় লােকজনদের সমালােচনা করতেন। তাঁর বড় বােন নাফিসা কবির পার্টির সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না থাকলেও চীনের লাইন সমর্থন করতেন এবং বড়দা শহীদুল্লাহ কায়সারের

সঙ্গে কখনাে তর্কও করতেন। নাফিসা কবির অবশ্য এই সময়ে বিদেশে থাকতেন, কখনাে দেশে এলে পার্টির নেতাদের সঙ্গে যােগাযােগ ও আলাপ আলােচনা করতেন। এই সময় নাফিসা কবির জহির রায়হানকে রাজনৈতিকভাবে কিছুটা প্রভাবিত করেছিলেন।
‘৬৯ এর অভ্যুত্থানের সময় জহির রায়হান রাজনীতির প্রতি অধিকতর আগ্রহী হলেন এবং এই সময় তিনি পিকিংপন্থী রাজনীতির প্রতি বেশ খানিকটা ঝুঁকে পড়েন। লৌহমানব হিসেবে কথিত আইয়ুব খানের সামরিক স্বৈরাচারের বিরােধিতা করতে গিয়ে তিনি রূপকের আশ্রয় নিয়ে ‘জীবন থেকে নেয়া’ নির্মাণ করেন। জীবন থেকে নেয়া’য় যথেষ্ট ভাবাবেগ ও মেলােড্রামা থাকলেও জহির রায়হানের ছবিতে এই প্রথমবার রাজনৈতিক বক্তব্য জোরালােভাবে উত্থাপিত হয়। ‘৬৯ এর গণ-আন্দোলনের কিছু প্রামাণ্য দৃশ্য তিনি এই ছবিতে সংযােজন করেছেন। এই দৃশ্যগুলি তােলার জন্য দিনের পর দিন তিনি ক্যামেরা এবং দু-তিন জন সহকারী নিয়ে মিছিলে মিছিলে ঘুরেছেন। এই ছবিতে সংযােজন ২১শে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরীর প্রামাণ দৃশ্যটি তখনকার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে যথেষ্ট দুঃসাহসিকতা পূর্ণ কাজ ছিলাে। ছাড়পত্র পেতে এই ছবিকে কি রকম ঝুঁকি পােহাতে হয়েছিলাে এ কথা সবার জানা আছে। সেন্সরবাের্ডের বাধা পেয়ে জহির রায়হান এই ছবি নিয়ে হৈ চৈ করতে চেয়েছিলেন। যে জন্যে তিনি তখনকার বামপন্থী ছাত্র নেতৃবৃন্দ ও কয়েকজন প্রতিবাদী সাংবাদিককে এ ছবি দেখিয়েছিলেন সেন্সরের ছাড়পত্র পাওয়ার আগে, যাতে তারা এ নিয়ে আন্দোলন বা লেখালেখি করতে পারেন। দেশের তৎকালীন বিস্ফোরণমুখ পরিস্থিতির কথা বিবেচনা করে সরকারী কর্তৃপক্ষ কিছু দৃশ্য কেটে রেখে ছবিটি মুক্তি দিতে বাধ্য হয়েছিলাে।
‘৭০ সালে জহির রায়হান ‘এক্সপ্রেস’ পত্রিকা বের করেন এবং এর যাবতীয় খরচ তিনি একাই বহন করতেন। পত্রিকা অবশ্য আগেও অনেক বের করেছেন তিনি। পঞ্চাশ দশকে ‘প্রবাহ’, ‘অনন্যা’ প্রভৃতি সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশের অন্যতম উদ্যোক্তা ছিলেন তিনি। তবে ‘এক্সপ্রেস’ ছিলাে রাজনীতি সচেতন পত্রিকা। প্রথম দিকে কিছুটা রম্য চরিত্র থাকলেও কয়েক সংখ্যা পরই রাজনৈতিক বক্তব্য জোরালােভাবে উপস্থিত হয়। এই সময় তিনি প্রথমবারের মতাে মাও সেতুঙের রচনা পাঠ করেন এবং এর দ্বারা দারুণ রকম প্রভাবিত হন। তখন এখানে মাও সেতুঙের চিন্তাধারার অনুসারী কমিউনিস্ট গ্রুপগুলি একাধিক দল উপদলে বিভক্ত ছিলাে। এদের প্রায় সবার সঙ্গে জহির রায়হান যােগাযােগ রাখতেন, পার্টি ফাণ্ডে মােটা অংকের চাঁদাও দিতেন। ‘৭১ এর ফেব্রুয়ারী মাসে তিনি তার মরিস অক্সফোর্ড গাড়িটিও একটি সংগঠনকে সর্বক্ষণ ব্যবহারের জন্যে দিয়েছিলেন। পিকিংপন্থীদের সঙ্গে যােগাযােগ রাখলেও জহির রায়হান মস্কোপন্থীদের অনুষ্ঠানাদিতে সময় পেলে যােগ দিতেন। তিনি তাঁর নির্মীয়মান ছবি ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ মস্কো প্রেরণ করার কথাও বলতেন। শহীদুল্লাহ কায়সারের প্রভাব তার উপর এত বেশি ছিলাে যে, তাঁর সামনে তিনি সবসময় মস্কোপন্থীদের সমালােচনা থেকে বিরত থাকতেন। তাছাড়া মস্কোপন্থী অনেক লেখক, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক নেতার সঙ্গে তার ব্যক্তিগত সম্পর্ক এমন পর্যায়ে ছিলাে যে, নিজে মাও সেতুঙের চিন্তাধারার অনুসারী হয়েও তিনি এদের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেননি। তিনি পিকিংপন্থীদের ঐক্য মনে প্রাণে কামনা করতেন।
‘৭১ এর ২৫ মার্চ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যরা এদেশে যে ভয়াবহ হত্যাযজ্ঞ আরম্ভ করে জহির রায়হান এতে এত বেশি বিচলিত বােধ করেন যে, রাতের পর রাত তিনি অস্থির ও নিঘুম অবস্থায় কাটিয়েছেন। মাও সেতুঙের সামরিক প্রবন্ধাবলীর দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে তিনি তখন দীর্ঘস্থায়ী গণযুদ্ধের কথা ভাবতেন। পার্টির কারাে সঙ্গে যােগাযােগ করতে না পেরে তিনি যুদ্ধে যােগ দেয়ার জন্যই ঢাকা ছেড়ে আগরতলা এবং পরে কোলকাতা চলে যান। কোলকাতায় তিনি প্রচার কাজ সংগঠিত করার প্রতি বিশেষ গুরুত্ব দেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি প্রবাসী আওয়ামী লীগ সরকারের রােষানলে পতিত হন এবং তাঁকে বিভিন্নভাবে নিগৃহীত হতে হয়। কোলকাতায়

নয় মাস তাঁকে দুঃসহ জীবন যাপন করতে হয়েছে। স্টপ জেনােসাইড’ ছবিটি নির্মাণের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা তাকে নানাভাবে বাধা দিয়েছে। বিভিন্ন সেকটরে সুটিং করতে দেয়নি, | এমন কি কোন কোন সেকটরে তার গমন পর্যন্ত নিষিদ্ধ ছিলাে। অবশেষে সাত নম্বর সেকটরে তিনি সুটিং এর সুযােগ পেলেন এবং অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত বাজেট ও সময়ে এই অপূর্ব ছবিটির নির্মাণ কাজ শেষ করলেন। আওয়ামী লীগ নেতারা ছবি দেখে ছাড়পত্র না দেয়ার জন্যে পশ্চিমবঙ্গের সেন্সর বাের্ডকে অনুরােধ জানিয়েছিলেন। একজন জাদরেল আওয়ামী লীগ নেতা এই বলে হুমকিও দিয়েছিলেন যে, এই ছবিকে ছাড়পত্র দেয়া হলে তিনি বাংলাদেশ মিশনের সামনে অনশন করবেন।
পশ্চিমবঙ্গ সেন্সর কর্তৃপক্ষ এ ছবিকে ছাড়পত্র দিতে অস্বীকার করায় জহির রায়হানকে দিল্লী পর্যন্ত দৌড়াতে হয়। শহীদুল্লাহ কায়সারের কয়েকজন পুরােনাে সহকর্মী ও বন্ধু যারা ভারতীয় সরকারের বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদে আসীন ছিলেন তাঁদের তদবিরে বহু কাঠখড় পােড়ানাের পর এ ছবিকে ছাড়পত্র দেয়া হলেও জনসমক্ষে এ ছবি প্রদর্শনের কোন ব্যবস্থা জহির রায়হান করতে পারেননি।
‘স্টপ জেনােসাইড’-এর প্রতি মুজিব নগর সরকারের কিছু নেতা এই কারণেই কুপিত ছিলাে যে, এ ছবি শুরু হয়েছে লেনিনের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে, আর শেষ হয়েছে আন্তর্জাতিক (জাগাে জাগাে সর্বহারা) এর সুর বাজিয়ে। তাছাড়া আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একটি অংশ তখনও আমেরিকার সাহায্য ও সমর্থন পেতে উন্মুখ ছিলাে অথচ এ ছবিতে সরাসরি মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে বক্তব্য উত্থাপন করা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতারা বাধা দিলেও জহির রায়হানের মস্কোপন্থী ভারতীয় বন্ধুরা এ ছবি মুক্তির ব্যাপারে তাঁকে যথেষ্ট সাহায্য করায়, তিনি সেই সময় মস্কোপন্থী ভারতীয় বন্ধুদের প্রতি উদার মনােভাব পােষণ করতেন। সেই সময়টা ছিলাে জহির রায়হানের রাজনৈতিক বিভ্রান্তির কাল। কারণ তিনি চীনের তখনকার ভূমিকাকে সমর্থন করেননি এবং প্রায় সর্বদাই মস্কোপন্থীদের দ্বারা পরিবেষ্টিত থাকতেন। তবু বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের বিরােধিতা করা সত্ত্বেও জহির রায়হান কয়েকজন নেতৃস্থানীয় নকশাল নেতার সঙ্গে আলাপ করেছিলেন এবং অসীম চ্যাটার্জীর সঙ্গে আলােচনাকালে চারু মজুমদারের বিরুদ্ধে বিরূপ ও অশােভন মন্তব্য করার জন্যে তিনি অসীম বাবুর উপর বিরক্তও হয়েছিলেন।
‘৭১ সালের শেষের দিকে জহির রায়হানের কার্যকলাপকে আওয়ামী লীগের পাশাপাশি মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টিও সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করেছিলাে। কোলকাতার মস্কোপন্থী। বুদ্ধিজীবীরা জহির রায়হানের প্রতি সহানুভূতিশীল হলেও মস্কোপন্থী পার্টির সঙ্গে জহির রায়হানের কোন যােগাযােগ ছিল না। অক্টোবর মাসে লণ্ডনে অবস্থিত বাংলাদেশ বিষয়ক একটি অনুষ্ঠানে যােগদানের জন্য জহির রায়হানকে আমন্ত্রণ জানানাে হয় এবং রিটার্ণ টিকিটও পাঠানাে হয়। জহির রায়হানের প্রথমেই বিড়ম্বনার শিকার হতে হয় ট্রাভেল পারমিট সংগ্রহ করতে গিয়ে। এরপর সমস্যা দেখা দেয় মস্কোর ভিসা পেতে। জহির রায়হানের অনুরােধে লণ্ডনের অনুষ্ঠানের উদ্যোক্তারা (ঢাকা যাদুঘরের অধ্যক্ষ এনামুল হক ছিলেন আমন্ত্রণকারী) তাকে লণ্ডন যাওয়ার পথে মস্কো হয়ে যাবার টিকিট পাঠিয়েছিলেন। মস্কো দেখার সখ ছিলাে জহির রায়হানের অনেক দিনের। কিন্তু শেষ পর্যন্ত দিল্লী গিয়েও তিনি মস্কোর ভিসা সংগ্রহ করতে পারেননি এবং এরই জন্য তখন তাঁর লণ্ডন যাওয়া হয়নি। জহির রায়হানের প্রতি সােভিয়েত দূতাবাসের এহেন আচরণে তার মস্কোপন্থী ভারতীয় বন্ধুরা বিস্মিত হলেও যেহেতু তিনি মস্কোপন্থী কমিউনিস্ট পার্টির সুনজরে ছিলেন না, সে জন্য এই নাজুক পরিস্থিতিতে, মস্কোতে তাদের প্রতি অবিশ্বস্ত জহির রায়হানের উপস্থিতি সােভিয়েত দূতাবাসের কাম্য ছিলাে না। মস্কোর ভিসা না পেয়ে জহির রায়হান সােভিয়েত কর্তৃপক্ষের প্রতি অত্যন্ত বিক্ষুব্ধ হয়েছিলেন।
১০

‘৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর শহীদুল্লাহ কায়সারের মৃত্যুর সংবাদ শুনে জহির রায়হান একবারেই ভেঙ্গে পড়েন। ১৭ তারিখে ভারতীয় বিমান বাহিনীর এক হেলিকপ্টারে করে ঢাকা এসে আলবদরের মরণ কামড়ের খবর বিস্তারিত জানতে পারলেন। বিভিন্ন জায়গায় ছুটোছুটি করে হানাদার বাহিনীর সহযােগী বহু চাই ব্যক্তির নাম সংগ্রহ করলেন। সাংবাদিক সম্মেলনে বললেন, তিনি শ্বেতপত্র প্রকাশ করবেন। তিনি আওয়ামী লীগ নেতৃত্বকেও দায়ী করেন। তিনি তখন। মানসিক দিক থেকে অত্যন্ত বিপর্যস্ত হয়েছিলেন। জামাতে ইসলামীর ঘাতক বাহিনী আলবদরদের দ্বারা ধৃত শহীদুল্লাহ কায়সারকে খোঁজার জন্য পীর-ফকিরেরও শরণাপন্ন হয়েছিলেন তিনি। এমন এক জনের খপ্পরে পড়ে তিনি আজমীর পর্যন্ত গিয়েছিলেন।
‘৭২ এর ৩০ জানুয়ারী মিরপুরে তার অগ্রজকে খুঁজতে গিয়েছিলেন সে স্থানটি তখনও ছিলাে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কিছু লােক ও তাদের সহযােগীদের নিয়ন্ত্রণে। তদন্ত করলে হয়তাে জানা যেতাে সেই অজ্ঞাত টেলিফোন কোত্থেকে এসেছিলাে, যেখানে তাঁকে বলা হয়েছিলাে শহীদুল্লাহ কায়সার মিরপুরে আছেন কিংবা মিরপুর থেকে কিভাবে তিনি উধাও হলেন। এটাও বিস্ময় যে, তার অন্তর্ধান সম্পর্কে কোন তদন্ত হয়নি। একথা নির্দ্বিধায় বলা চলে তার বিশ্বাসই তাকে এভাবে আমাদের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে গেছে।
জহির রায়হান মার্কসীয় দর্শনের অনুসারী হলেও বড়দার মৃত্যু সংবাদে তিনি অদৃষ্টবাদী হয়ে গিয়েছিলেন। এর একটা কারণ এও হতে পারে যে, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন, স্ট্যালিন প্রমুখের মূল রচনাবলী তিনি সামান্যই পড়েছেন। কমিউনিস্টদের প্রতি সহানুভূতিশীল ছিলেন বলেই কমিউনিস্ট আন্দোলনের বিভ্রান্তি, নেতৃত্বের দেউলিয়াপনা ও বিভক্তিতে তিনি বিক্ষুব্ধ হতেন, কখনাে বা হতাশ হয়ে পড়তেন। আন্তর্জাতিক কমিউনিস্ট আন্দোলনে মস্কো-পিকিং বিভক্তির পর তিনি পিকিংপন্থী শিবিরে অবস্থান করেও পরবর্তীকালে পিকিংপন্থীদের বিভক্তির সময় কোন বিশেষ দলের পক্ষ নেননি। তাঁর লেখা ও ছবিতে তাঁর রাজনৈতিক বিশ্বাস পুরােপুরি প্রতিফলিত
হলেও কিছু লেখা ও ছবি থেকে এটা পরিষ্কার বােঝা যায় জহির রায়হান কোন শিবিরের লােক প্রগতির না প্রতিক্রিয়ার। নিঃসন্দেহে বলা যায় প্রগতির শিবিরেই তার অবস্থান এবং এই শিবিরে অবস্থানের কারণেই প্রতিক্রিয়ার নির্মম শিকার হয়েছিলেন তিনি।


বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী তারিখে রাজনৈতিক নেতাদের নির্দেশ অমান্য করে ছাত্ররা একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙ্গে মিছিল বের করার সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন। আগেই বলেছি যে দশজন ছাত্র প্রথম মিছিল করে বেরােয় জহির রায়হান ছিলেন তাঁদের একজন। প্রথম দিকের কয়েকটি দলকে গ্রেফতার করে ট্রাকে তুলে লালবাগের কেল্লার পুলিশ ফাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর গুলি চালানাে হয়।
এই ঘটনাটি জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র কাহিনীতেও বিধৃত হয়েছে। এই কাহিনীর ছাত্র নায়ক তসলিম একশ চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙ্গার জন্য বক্তৃতা দেয়। মিছিলে গুলি খেয়ে লাশ হয়ে হাসপাতালে যায়।
‘৭১ সালের একুশে ফেব্রুয়ারীতে একটি সংকলনের জন্য আমি জহির রায়হানের কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু যারা ভাষা আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন তাঁদের এবং অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের কাছ থেকে লেখা নিয়েছিলাম। প্রত্যেকটি লেখার বিষয়বস্তু ছিলাে এক— বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারী দিনটিকে তারা কে কিভাবে দেখেছেন। জহির রায়হানের পর্যবেক্ষণের কাছাকাছি দুটি লেখার অংশ এখানে উদ্ধত করছি যা কিনা তার এই কাহিনীর প্রামাণ্যভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এর একটি অগ্রজ শহীদুল্লাহ কায়সারের অপরটি ঢাকা কলেজে তাঁর সহপাঠী বােরহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীরের।
শহীদুল্লাহ কায়সার লিখেছেন—
১১

‘একুশে ফেব্রুয়ারী। ১৯৫২। উনিশ বছর পর একটি বিক্ষুব্ধ দিনের সব কটি মুহূর্তের উত্তেজনা, দ্বিধাদ্বন্দ্ব, রােমাঞ্চ বেদনা স্মরণ করা দুরূহ। অনেক মুখ ঝাপসা হয়ে এসেছে। অনেক মুখ ঝকঝকে ছবির মত এখনও ভাসছে চোখের সামনে যা আর কোনদিন দেখা যাবে না। অনেক ঘটনা যা সেদিন মুখ্য মনে হয়েছিল আজ গৌণ হয়ে এসেছে। সেদিন যা দুর্বোধ্য মনে হয়েছিল অভিজ্ঞতার আলােকে আজ তা স্পষ্ট।
‘দেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনে আজ নতুন চেতনা এসেছে। এসেছে অনেক তীব্রতা। গণসংস্থাগুলাে অনেক বেশি সজাগ। তাই আজকের কোন আন্দোলনের সাথে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীকে তুলনা করা অনুচিত।
‘যে এলাকায় একুশের ঘটনা প্রবাহের সূচনা হয় তা আজ চেনা দুষ্কর। সেখানে অনেক পরিবর্তন হয়েছে। আজকের পােস্ট গ্র্যাজুয়েট হাসপাতালটা ছিল সেদিনের কলাভবন। যেখানে মেডিকেল হাসপাতালে আউটডাের এবং নার্সের কোয়ার্টার সেখানে ছিল কতগুলাে ব্যারাক। তলার দিকে হাত চারেক পর্যন্ত ছিল পাঁচ ইঞ্চি ইটের গাঁথনী, উপরটা কঞ্চির বেড়া। শীতের দিনে কুয়াশা এবং শীত হুড়হুড় করে ভেতরে ঢুকে বিছানায় হুমড়ি খেয়ে পড়তাে। এটাই ছিল মেডিকেল ছাত্রাবাস। এখানেই গুলি চলছিলাে, যার একাংশকে নিয়ে আজকের কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার।
অনুজ শাহরিয়ার সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে লিখতে বলেছেন। কিন্তু তা লেখা সম্ভব নয়, কেননা এত কিছু লেখার আছে এবং এত কিছু স্মৃতি থেকে খুঁচিয়ে তােলার রয়েছে যা স্বল্প সময়ে সম্ভব নয়। আর এটা এমন একটা দিন এবং এমন একটা বিষয় যা নিয়ে ভাসা ভাসা বা আংশিকভাবে কলম চালান উচিত নয়।
‘আগেই বলেছি আজ ওই এলাকাটার পরিবর্তন হয়েছে, আজকের আন্দোলনের পরিধি অনেক বিস্তৃত হয়েছে। কিন্তু যে পরিবেশে সেদিনের সংগ্রাম অনিবার্য হয়ে উঠেছিল তার পরিবর্তন এখনও, উনিশ বছর পরও দেখছি না। সেটা হল শাসককূলের স্বৈরাচারী মনােভাব।
‘একুশের হরতাল ও জমায়েতকে পণ্ড করার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারী সন্ধ্যারাত্রিতে যখন ১৪৪ ধারা জারি করা হল তখনও কেউ বুঝতে পারেনি পরদিন অর্থাৎ ২১ তারিখে কি ঘটবে ? কিন্তু মধ্যরাত্রির মধ্যেই অবস্থাটা পাল্টে গেল। মধ্যরাত্রির মধ্যেই ফজলুল হক হল, ঢাকা হল ও সলিমুল্লা হলের ছাত্ররা মিটিং করে জানিয়ে দিলেন যে তারা পিছ পা হতে রাজী নন। যদি সরকার ভয় দেখিয়ে রক্তচক্ষুর শাসানি ভাষায় রূপান্তরিত করতে চায় তবে এখনই তার ফয়সালা হয়ে যাক। এ মনােভাব এবং সিদ্ধান্ত গােটা আন্দোলনের চেহারাটা পাল্টিয়ে দেয়। তাই আমরা দেখি শুধু পুলিশ নয় মুসলিম লীগের পালা গুণ্ডারা, মহল্লার সর্দাররা স্কুলে স্কুলে ভয় দেখিয়ে বেড়ানাে সত্ত্বেও একুশে ফেব্রুয়ারী সব স্কুল কলেজে ধর্মঘট হয়। ১৪৪ ধারা ভঙ্গের সিদ্ধান্ত গৃহীত দেখি যাক। এ মনােভাকচক্ষুর শাসানি জময়ে দিলেন যে হয়।
‘মেডিকেল কলেজ ছাত্রসংসদ এবং মেডিকেল ছাত্রাবাস ছিল সেদিনের একটি দুর্ভেদ্য প্রাচীর। সারা পাকিস্তানে ঢাকা মেডিকেল কলেজই একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল যেখানে মুসলীম ছাত্রলীগ নামে প্রতিষ্ঠানে কোন কমিটি এমন কি একজন সভ্যও ছিল না। সংগ্রাম কমিটির প্রাণশক্তি ছিল মেডিকেলের ছাত্রসংসদ। সম্ভবতঃ এ কারণেই মেডিকেল ছাত্ররা পুলিশের বিশেষ আক্রমণের লক্ষ্য ছিল।
‘গুলি চালনার ধরনটাও লক্ষণীয়। প্রথম কয়েক রাউণ্ডের গুলি মেডিকেল ছাত্রাবাসকে লক্ষ্য করেই চালান হয়। এগার নম্বর, তিন নম্বর, এবং সাত নম্বর ব্যারাকের ঘরের ভেতরে পাঁচ ইঞ্চি দেয়ালে ছেদ করে পড়ার টেবিলে, শােয়ার খাটিয়ার গিয়ে বুলেট বিদ্ধ হয়। প্রথম রাউণ্ডের গুলিতেই বরকত শহীদ হন। এখানে যারা যারা আহত হন তাদের সবগুলাে আঘাতই হাঁটুর উপর। মারার জন্যই যে সেদিন গুলি ছোঁড়া হয়েছিল এবং ছাত্রাবাসে এলােপাতাড়ি গুলি ছোঁড়া হয়েছিল তাতে লেশ মাত্র সন্দেহ নেই।
(সচিত্র সন্ধানী ও একুশে ক্রোড়পত্র ফেব্রুয়ারী ১৯৭১)
১২

জহির রায়হানের সহপাঠী, তখন ঢাকা কলেজের ছাত্র বােরাহানউদ্দীন খান জাহাঙ্গীর একুশে ফেব্রুয়ারীর দিনটি সম্পর্কে লিখছেন—
বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিতর ভিড় ; বাইরে ১৪৪ ধারা ; সকাল দশটা। চিৎকার শ্লোগান। বাইরে পুলিশ। আমরা ঘুরছি, কথা শুনছি ; সবাই উত্তেজিত, সবকিছুই অনিশ্চিত, মধ্যে মধ্যে শ্লোগান ; রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই। আমরা ঘুরছি, কথা শুনছি, নেতারা ব্যস্ত, পরস্পরের উপর ক্রুদ্ধ, মধ্যে মধ্যে শ্লোগান ; পুলিশ জুলুম চলবে না। ভিড় বাড়ছে ভিতরে আর রাস্তা ফাকা, পুলিশ বাদে।
‘হােস্টেলে থাকি, ইন্টারমিডিয়েট ক্লাশের ছাত্র। আমরা ক’জন হাজির। কেন এসেছি স্পষ্ট। স্বপ্নের মধ্যে মার মুখ, তার একটি শব্দ ; বাংলা ; আমার মনে এছাড়া আর কিছু নেই। ভিড় ; চিৎকার শ্লোগান, সকাল সাড়ে দশটা।।
হঠাৎ দেখি কারা যেন লােহার গেট খুলে দিয়েছে, আর সবাই দুজন দুজন করে রাস্তায়। পুলিশ তৎপর, গ্রেফতার করছে, ভােলা গাড়িতে তুলছে, আর শ্লোগান৷ রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই; পুলিশ জুলুম চলবে না। শ্লোগান তাে নয় শব্দের প্রতিবাদ।।
‘আমি আমগাছতলায়, চোখ ঐ সব। আকাশ নির্মম নীল। শব্দ পাগল করে দিচ্ছে পুলিশদের, বেড়ির মতাে বাংলাভাষা তাদের ঘিরে ধরেছে, সেই তখন টিয়ারগ্যাস ছুঁড়তে শুরু করেছে তারা। টিয়ারগ্যাস ফাটছে, ধোঁয়ায় একাকার, অসহ্য যন্ত্রণা চোখে মুখে ; আমরা ছুটে দোতলায়, সকাল এগারােটা। আধঘন্টা বাদে নিচে এলাম। পিছনের লােহার রেলিং ডিঙ্গিয়ে সড়ক বেয়ে বেরিয়ে এলাম রাস্তায়। খিদেও পেয়েছে। এলােমেলােভাবে ঘুরে বেড়ালাম অনেকক্ষণ। পুরানা পল্টনের পুলের কাছে এক রেস্টুরেন্ট, চা আর খাবার খেলাম। যখন বেরােলাম রাস্তা থমথম করছে। কি ব্যাপার ? পুলিশ গুলি চালিয়েছে মেডিকেল কলেজের সামনে। কয়েকজন মারা গেছেন। স্বপ্নের মধ্যে মার মুখের মতাে চারপাশে বাংলাদেশ, বাংলাভাষা আর বাংলাকে গুলি করছে কারা কারা—সমস্ত চেতনায় থরথর ঐ প্রশ্ন।
‘পিছনের গেট দিয়ে মেডিকেল কলেজে এলাম। রাস্তার ধারেই ছাত্রাবাস, সেখানে জটলা চিৎকার, শ্লোগান, ইটপাটকেল ছােড়াছুড়ি। বিকেল চারটায়, দৈনিক আজাদের বিশেষ সংখ্যা, কাড়াকাড়ি করে নিলাম। কারা যেন বলল, জেলে কি আজাদ পাঠানাে সম্ভব ? বন্ধুদের জানান। উচিত নয় কি ঘটছে বাইরে ?
‘আমরা ঠিক করলাম পৌছে দেব। জেলখানার পশ্চিম দিকে উর্দু রােড, মসজিদের উল্টোদিকেই জেলখানার প্রাচীর। মসজিদের মিনারে চড়ে আজাদ ছুড়ে দেয়া হল। জেলখানার মাঠে রাজবন্দীরা ঘুরে বেড়াচ্ছেন। তাঁরা দৌড়ে এসে কুড়িয়ে নিলেন।
‘শুনলাম সান্ধ্য আইন জারী হয়েছে। বেচারাম দেউড়ীতে ছাত্রাবাস, যখন পৌঁছােলাম সান্ধ্য আইনের শুরু। পুলিশের গাড়ী রাস্তায়। কিছু একটা করা দরকার। ছাদে আমরা ও রাত্রি বিদীর্ণ করে শ্লোগান উঠছে নানাদিক থেকে। বেচারাম দেউড়ীতে ঢাকা কলেজের তিনটি ছাত্রাবাস, সেইসব ছাদ থেকে আওয়াজ উঠছে, মিলছে গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা ছাত্রাবাসে, মিলেছে গিয়ে সারা বাংলাদেশে। কোথাও থেকে গুলির শব্দ আসছে। রেডিওতে নূরুল আমীনের গলা। ঘৃণা ঘৃণা ঘৃণা !
‘ঘুমতাে নয় আশা ও হতাশার নির্যাতন। (প্রাগুক্ত)।
জহির রায়হানের ঘনিষ্ঠ দুজন, একজন তার অগ্রজ, আরেকজন সহপাঠী- ঠিক এভাবেই বর্ণনা করেছেন বায়ান্ন সালের সেই আগুনঝরা দিনটির কথা। তার অন্য বন্ধুরাও যারা তার কাছাকাছি ছিলেন, প্রায় একইভাবে দেখেছেন এই দিনটিকে। সেদিন যারা ছাত্র ছিলেন অথবা ক্যাম্পাসে ছিলেন, প্রত্যেকের পর্যবেক্ষণই একই ধরনের ছিলাে। জহির রায়হানের পর্যবেক্ষণ যে এর চেয়ে আলাদা কিছু ছিলাে না— তাঁর ‘আরেক ফরুন’ বা ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ পড়লে পরিষ্কার বােঝা যাবে।
১৩

১৯৬৫ সালের মাঝামাঝি জহির রায়হান একুশে ফেব্রুয়ারী’ ছবিটি বানাবার পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনের পটভূমিতে তিনি আরেক ফাল্গুন’ যদিও এর আগে লিখেছিলেন, কিন্তু ছবির জন্য ভেবেছিলেন সম্পূর্ণ আলাদা কাহিনী । শিল্পী মুর্তজা বশীরকে তিনি চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিয়ে বলেছিলেন, গল্পের কাঠামাে হবে এই রকম— চারটি পরিবার সমাজের চারটি অংশের প্রতিনিধিত্ব করবে। একটি উচ্চবিত্ত, একটি মধ্যবিত্ত, একটি শ্রমিক ও একটি কৃষক দম্পতি থাকবে, যারা ঘটনাক্রমে বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর দিনটিতে এমন একটি জায়গায় একত্রিত হবে যেখানে ছাত্রদের মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালিয়েছে। গুলির শব্দ। হওয়ার পরই দেখা যাবে একটি কাক আর্ত কণ্ঠে উড়ছে গােটা ঢাকা শহরের আকাশে।
মুর্তজা বশীর জহির রায়হানের মুখে বলা গল্পটির উপর ভিত্তি করে একুশে ফেব্রুয়ারীর চিত্রনাট্য লেখেন। শ্রমিক চরিত্রটির মুখে ঢাকার আঞ্চলিক ভাষা ব্যবহার করার জন্য বস্তিতে ঘুরে শব্দচয়ন করেন। চিত্রনাট্য সম্পূর্ণ হলে জহির রায়হান এটি এফডিসি স্টুডিওতে জমা দেন। নবারুণ ফিল্মস-এর ব্যানারে নির্মিতব্য এই ছবির জন্য চরিত্র নির্বাচন পর্যন্ত চূড়ান্ত হয়ে গিয়েছিলাে। এ ছবিতে অভিনয় করার কথা ছিলাে খান আতা, সুমিতা, রহমান, শবনম, আনােয়ার, সুচন্দা, কবরী প্রমুখ চিত্র তারকার। কিন্তু এ ছবি নির্মাণের অনুমতি তাঁকে দেয়া হয়নি। মুর্তজা বশীর আমাকে পরে বলেছেন একুশে ফেব্রুয়ারীর চিত্রনাট্য লেখার জন্য জহির রায়হান তাঁকে অগ্রিম একশ টাকাও দিয়েছিলেন। তাঁর মতে এফডিসিতে খুঁজলে এই চিত্রনাট্যটি পাওয়া যাবে।
এরপর জহির রায়হান বাণিজ্যিক ছবি বানাবার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েন। একুশে ফেব্রুয়ারী বানাবার সিদ্ধান্ত স্থগিত থাকে। পাঁচ বছর পর জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র চিত্ৰকাহিনী প্রথম প্রকাশিত হয় মাসিক ‘সমীপেষু’তে। আমি তখন সাহিত্য-চলচ্চিত্র বিষয়ক এই পত্রিকাটির সম্পাদনার কাজে যুক্ত ছিলাম। একুশে ফেব্রুয়ারী উপলক্ষে বিশেষ সংখ্যা বেরুবে। জহির রায়হানকে অনুরােধ করলাম একটি উপন্যাস লিখতে বিশেষভাবে বললাম ‘একুশে ফেব্রুয়ারী নামে যে ছবিটি তিনি করার কথা ভেবেছিলেন তার কাহিনীটি দেয়ার জন্য। তিনি জানালেন, চিত্রনাট্যটি হারিয়ে গেছে। পরে তাঁকে বললাম, ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নামে যে ছবিটি বানাবার কথা ভাবছেন তার কাহিনীটি দিতে। তিনি রাজী হলেন। ক’দিন পর হঠাৎ শুনলাম, সচিত্র সন্ধানীর (তখন মাসিক এবং আমাদের পত্রিকার প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী) সম্পাদক গাজী শাহাবুদ্দীন, যিনি কিনা জহির রায়হানের একজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন তাঁর অনুরােধ ফেলতে না পেরে ‘লেট দেয়ার বি লাইট’-এর কাহিনীটি আর কত দিন’ নামে তাঁকে সন্ধানীর জন্য দিয়ে ফেলেছেন। এতে স্বাভাবিকভাবেই আমি ক্ষুব্ধ হই এবং জহির রায়হানও আমার আচরণে বিব্রত হন। শেষে তিনি সম্মত হন, আমাদের পত্রিকার জন্য একুশে ফেব্রুয়ারী’র কাহিনীটি দেবেন, তবে শর্ত হচ্ছে তিনি বলে যাবেন, আমি শুনে শুনে লিখবাে।।
জহির রায়হানের ক্ষেত্রে এটি নতুন বা অভিনব কিছু নয়। আমি যখন তাঁর সহকারী হিসেবে ছবিতে কাজ করছি তখন দেখেছি তিনি বলে যাচ্ছেন আর তার দু’জন সহকারী এক সঙ্গে দু’টি ছবির চিত্রনাট্য তিলিখনে ব্যস্ত।
কখননা তিনি টেপরেকর্ডারে বলে গেছেন, সহকারীরা সেখান থেকে পাঠোদ্ধার করেছেন। তবে তখন আমার এটা মনে হয়েছিলাে এভাবে বাজারচলতি ছবির চিত্রনাট্য হয়তাে লেখা যেতে পারে, কিন্তু সৃজনশীল সাহিত্য রচনা সম্ভব নয়। ফলে তিলিখনের দ্বারা একুশে ফেব্রুয়ারী’র কাহিনী লেখার ব্যাপারে আমি খুব একটা আশাবাদী ছিলাম না। দেখা গেলাে এ ছাড়া উপায়ও নেই। তিনি ছবির স্যুটিং নিয়ে প্রচণ্ড ব্যস্ত।
১৪

তখন সম্ভবত ঈদের জন্য কয়েকদিন ছুটি ছিলাে। আমি পর পর তিনদিন বসে জহির রায়হানের কথামতাে লিখে গেলাম। তিলিখনের জন্য তিনদিন অনেক বেশি সময়, তবু লেখার ফাকে ফাকে চিত্রনাট্যের মত ছবির দৃশ্যগুরাে বিস্তারিত শুনতে চাইতাম বলে লিখতে গিয়ে সময়। বেশি লাগলাে। এই শুনতে চাওয়াটাও অস্বাভাবিক ছিলাে না। কারণ জহির রায়হানের অধিকাংশ চিত্রনাট্য খসড়ার মতাে লেখা। ছবির শট বিভাজনের সময় এমনকি স্যুটিং-এর সময়ও অনেক নতুন উপাদান যােগ হতাে। যে কারণে তার চিত্রনাট্য পড়ে বােঝা যাবে না শেষ পর্যন্ত ছবিটি কি হবে। শুধু একবার এর ব্যতিক্রম দেখেছি। সেটা তাঁর বহুল প্রশংসিত ‘স্টপ জেনােসাইড’-এর ক্ষেত্রে। মূল পরিকল্পনায় এ ছবি যেমনটি হওয়ার কথা ছিলাে বাস্তবে এর এক চতুর্থাংশও রূপায়িত হয়নি। আমার ধারণা বাজেট সমস্যায় আক্রান্ত না হলে এটি ‘গ্রানাডা গ্রানাডা মাইন’-এর চেয়ে বেশি আবেদন সৃষ্টিকারী ছবি হতে পারতাে। দুর্ভাগ্য ছবিটির মূল চিত্রনাট্য চুরি হয়ে গিয়েছে।
তার সঙ্গে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র তিলিখনের সময় আলােচনা করতে গিয়ে বুঝেছি৷ আইজেনষ্টাইনের ব্যাটেলশিপ পােটেমকিন’ আর ‘অক্টোবর তাকে প্রচণ্ডভাবে আলােড়িত করেছিলাে। লেখা শেষ করার পর তার কাছে জানতে চেয়েছিলাম ছবিটি কবে বানাবেন। তাঁর জবাব ছিলাে এখনাে সময় হয়নি।
‘৬৫ সালে মর্তুজা বশীরকে যে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র চিত্রনাট্য লেখার দায়িত্ব দিয়েছিলেন, ‘৭০-এ সেই কাহিনীতে জহির রায়হান আরাে কটি চরিত্র সংযােজন করেছেন। কাকের প্রতীকটি এখানে আছে কিন্তু মুখ্য হচ্ছে কাহিনীর শেষে নদীর প্রতীকটি। ছবি তৈরি হলে এই কাহিনীতে যে আরাে বহু প্রতীক ও উপাদান যুক্ত হতাে এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না। বিশেষ করে প্রথম ও শেষ দৃশ্যে অনেকগুলাে মন্টাজ এফেক্ট-এর কথা তিনি আমার সঙ্গে আলােচনা করেছিলেন।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী সমীপেষুতে ছাপার সময় শিল্পী হাশেম খানের কিছু স্কেচও অলঙ্করণ হিসেবে ছাপা হয়েছিলাে। জহির রায়হান স্কেচগুলাে পছন্দ করেছিলেন।
সমীপেষুতে প্রকাশিত লেখাটিতে কিছু মুদ্রণ প্রমাদ ছিলাে। তাড়াহুড়াে করে ছাপতে গিয়ে কিছু শব্দ ও বাক্য এলােমেলাে হয়ে গিয়েছিলাে। সংশােধিত কপিটি আমার কাছে থাকায় গ্রন্থাকারে প্রকাশের সময় সংশােধন করেই ছাপা হয়েছে।
শেষের দিকে জহির রায়হানের সব লেখাই ছিলাে চিত্রনাট্যের মতাে। এমনকি প্রবন্ধেও তিনি ছােট ছােট বাক্যে চিত্রকল্প নির্মাণ করতেন। একুশে ফেব্রুয়ারী’ তার একেবারে শেষের রচনা। এরপর বড় কোন লেখায় তিনি হাত দেননি। ছােটখাট কিছু স্কেচ জাতীয় লেখা (অধিকাংশই একুশের স্মরণিকাসমূহের সম্পাদকদের তাগিদে) এবং কয়েকটি ছােটগল্প ও প্রবন্ধ লিখেছেন। ৭০-৭১ সালে।
আঙ্গিকগত বিচারে ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ আর কত দিন’-এর সমশ্রেণীর লেখা এর কোনটাই ‘আরেক ফাল্গন’, বরফ গলা নদী’, বা হাজার বছর ধরে’র মতাে উপন্যাস নয়। এগুলােকে চিত্রনাট্যের রূপরেখা বা ছবির কাহিনী বলা যেতে পারে। এর ভেতর বহু সংযােজনের অবকাশ আছে। উপন্যাস আকারে লিখতে জহির রায়হান এগুলি অন্যভাবে লিখতেন। আবার ছবি করার সময়ও তিনি আরাে বহু কিছু যােগ করতেন। জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে একুশে ফেব্রুয়ারীর প্রভাত ফেরী যারা দেখেছেন তারা জানেন এই ছবির সেরা অংশ এটি। অথচ চিত্রনাট্যে শুধু প্রভাত ফেরীর উল্লেখ ছিলাে। ঊনসত্তরের অভ্যুত্থানের সময় ২১শে ফেব্রুয়ারীর রাত থেকে তিনি শহীদ মিনারে প্রভাত ফেরীর প্রামাণ্য ছবি তুলেছেন। কয়েকটি পরিকল্পিত দৃশের সঙ্গে
১৫

অনেকগুরাে প্রামাণ্য দৃশ্য সম্পাদনার টেবিলে বসে যােগ করে এর আবেদন বহুগুণ বাড়িয়েছেন। ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’র কাহিনীতে মিছিলে গুলির দৃশ্য আছে। জীবন থেকে নেয়া’ ছবিতে আমরা মিছিলে গুলির দৃশ্য দেখেছি। শেষােক্ত দৃশ্যের চেয়ে প্রথমটি অনেক বেশি শিল্পমণ্ডিত এবং ব্যঞ্জনাধর্মী।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ যদি ছবি হতাে তাহলে এটি সরাসরি একটি রাজনৈতিক ছবি হিসেবে আখ্যায়িত হতাে। রাজনৈতিক কাহিনীতে কাল একটি বড় বিষয়। রাজনীতি নির্দিষ্ট সময়ের গণ্ডীতে এক ধরনের আবেদন সৃষ্টি করে, সময়ের ব্যবধানে সেই আবেদন ফিকে হয়ে যায়, যদি প্রামাণ্যকরণ কাহিনীর প্রধান উপজীব্য হয়। বহু রাজনৈতিক বক্তব্য সম্বলিত উপন্যাস বা ছবি নির্দিষ্ট সময়ে যতটা আবেদন সম্পন্ন হয় পরবর্তী সময়ে ততােটা নাও হতে পারে। অবশ্য মহৎ শিল্পকর্মের বিষয়টি আলাদা। উদয়ের পথে’ জাতীয় ছবি এক সময় আদর্শস্থানীয় ছিলাে। এখন। এর এতটুকু আবেদন আছে বলে মনে হয় না। নিছক সময় বােঝার জন্য বা নির্দিষ্ট সময়ের ছবির চরিত্র বােঝার জন্য এ ধরনের ছবি দেখা যেতে পারে।
‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ বায়ান্ন সালের ঘটনা, মূল কাহিনী লেখা এর এক যুগ পরে। রাজনৈতিক কাহিনী হওয়া সত্ত্বেও এর চরিত্রগুলি এখনাে– এই ছিয়াশি সালেও আধুনিক, মনে হয় সমকালের। আমলা, ব্যবসায়ী, কেরানী, ছাত্র, রিকশাওয়ালা, কৃষক কিম্বা স্বামী-স্ত্রী, পিতা-পুত্র, মাতা-পুত্র, প্রেমিক-প্রেমিকা এবং সর্বোপরি শ্রেণীগত যে সম্পর্ক, সব কিছু এখনকার মতােই ক্রিয়াশীল। কয়েকটি শব্দ পরিবর্তন করলে এ কাহিনী ঊনসত্তরের কিংবা তিরাশি-চুরাশির অথবা আগামী দিনের কোন আন্দোলনের হতে পারে। শাসকের ভাষা, শােষকের ভাষা এবং আচরণ এতটুকু বদলায়নি। এ কারণেই ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ মহৎ সৃষ্টির দাবী করতে পারে, এর আঙ্গিকগত সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও।
বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে সাধারণভাবে একটি ধারণা রয়েছে এটি বুঝি নিছক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের আন্দোলন। বদরুদ্দীন উমর যদি তিনটি বিশাল খণ্ডে ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস (পূর্ববাংলার ভাষা আন্দোলন ও তৎকালীন রাজনীতি) না লিখতেন আমাদের পক্ষে জানা সম্ভব হতাে না সেই সময়কার আর্থসামাজিক-রাজনৈতিক অবস্থা বা ভাষা আন্দোলনে শ্রমিক-কৃষকসহ সাধারণ মানুষের সমর্থন ও অংশগ্রহণের বিষয়টি। জহির রায়হানের ‘একুশে ফেব্রুয়ারী’ লেখা হয়েছে এই ইতিহাস রচনার আগে। কৃষক-শ্রমিকসহ সাধারণ মানুষের আবেগ ও অংশগ্রহণের বিষয়টি তার এই লেখায় রয়েছে। যেহেতু এটি মূল চিত্রনাট্য নয়, সেজন্য বিস্তারিতভাবে না এলেও কৃষকের প্রতিনিধি গফুর এবং শ্রমিকের প্রতিনিধ সেলিম কাহিনীর শুরুতে কৌতূহলী বহিরাগত হলেও তাদের পরিণতি ছাত্রদের দ্বারা সূচিত এই আন্দোলনে ভিন্ন। মাত্রা সংযােজন করে। এটি সম্ভব হয়েছে জহির রায়হানের রাজনৈতিক অঙ্গীকারের কারণে। একুশে ফেব্রুয়ারী কাহিনী রাজনীতিকে অবলম্বন করে গড়ে উঠলেও জহির রায়হানের অপরাপর গল্প উপন্যাসের মতাে মানবিক উপাদান ও হার্দিক সম্পর্ক এতে অনুপস্থিত নয়। ফলে রাজনৈতিক হওয়া সত্ত্বেও এটি তত্ত্বগন্ধী বা শ্লোগানাক্রান্ত নয়। বর্ণানায় বরং কাব্যিক ব্যঞ্জন। রয়েছে শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত। কারণ আগেই বলেছি একুশে ফেব্রুয়ারী ছিলাে জহির রায়হানের শিল্প-মানসের সৃজনশীল আবেগের অফুরন্ত উৎস।

শাহরিয়ার কবির
১ ফাল্গন, ‘১৩৯২

১৬

কচুপাতার উপরে টলটল করে ভাসছে কয়েকফোটা শিশির।
ভােরের কুয়াশার নিবিড়তার মধ্যে বসে একটা মাছরাঙা পাখি। ঝিমুচ্ছে শীতের ঠাণ্ডায় ।
একটা ন্যাংটা ছেলে, বগলে একটা স্লেট।
আর মাথায় একটা গােল টুপি। গায়ে চাদর। পায়ে চলা ভেজা পথ ধরে স্কুলে যাচ্ছে।
অনেকগুলাে পাখি গাছের ডালে বসে নিজেদের ভাষায় অবিরাম কথা বলে চলেছে।
কতগুলাে মেয়ে। ত্রিশ কি চল্লিশ কি পঞ্চাশ হবে। একটানা কথা বলছে।
কেউ কারাে কথা শুনছে না।
শুধু বলে যাচ্ছে। কতগুলাে মুখ।
মিছিলের মুখ ।
রােদে পােড়া।
ঘামে ভেজা।
শপথের কঠিন উজ্জ্বল দীপ্তির ভাস্বর।
এগিয়ে আসছে সামনে।।
জ্বলন্ত সূর্যের প্রখর দীপ্তিকে উপেক্ষা করে।
সহসা কতগুলাে মুখ।
শাসনের-শােষণের-ক্ষমতার-বর্বরতার মুখ।
এগিয়ে এলাে মুখােমুখি।
বন্দুকের আর রাইফেলের নলগুলাে রােদে চিকচিক করে উঠলাে।
সহসা আগুন ঠিকরে বেরুলাে।
প্রচণ্ড শব্দ হলাে চারদিকে।
গুলির শব্দ।
কচুপাতার উপর থেকে শিশির ফোঁটাগুলাে গড়িয়ে পড়লাে মাটিতে।
মাছরাঙা পাখিটা ছুটে পালিয়ে গেলাে ডাল থেকে।
ন্যাংটা ছেলেটার হাত থেকে পড়ে গিয়ে স্লেট ভেঙে গেলাে।
পাখিরা নীরব হলাে।
মেয়েগুলাে সব স্তব্ধ নির্বাক দৃষ্টিতে পরস্পরের দিকে তাকালাে।
একরাশ কৃষ্ণচূড়া ঝরে পড়লাে গাছের ডাল থেকে।
সূর্যের প্রখর দীপ্তির নিচে একটা নয়, দুটো নয়।
অসংখ্য কালাে পতাকা এখন।
উদ্ধত সাপের ফণার মতাে উড়ছে।

একুশে ফেব্রুয়ারি।
সন ঊনিশ’শ বায়ান্ন।
খুব ছােট ছােট স্বপ্ন দেখতাে।
চাষার ছেলে গফুর।
একটা ছােট্ট ক্ষেত।

একুশে ফেব্রুয়ারী – ২

১৭

একটা ছােট্ট কুঁড়ে।।
আর একটা ছােট্ট বউ।
ক্ষেতের মানুষ সে।।
লেখাপড়া করেনি।
সারাদিন ক্ষেতের কাজ করতাে।
গলা ছেড়ে গান গাইতাে।
আর গভীর রাতে পুরাে গ্রামটা যখন ঘুমে ঢলে পড়তাে তখন ছােট মাটির প্রদীপ জ্বালিয়ে পুঁথি পড়তাে সে, বসে বসে।
সুর করে পড়তাে ছহি বড় সােনাভানের পুঁথি।
ছয়ফল মুলুকের পুঁথি।
আমেনাকে দেখেছিলাে একদিন পুকুরঘাটে।।
পরনে লাল সবুজ ডুরে শাড়ি।
ঘােমটার আড়ালে ছােট্ট একটি মুখ।
কাঁচা হলুদের মতাে রঙ।
ভালাে লেগেছিলাে।
বিয়ের প্রস্তাব পাঠাতে মেয়ের বাবা রাজি হয়ে গেলাে।
ফর্দ হলাে।
গফুরের মনে খুশি যেন আর ধরে না।
ক্ষেতভরা পাকাধানের শীষগুলােকে আদরে আলিঙ্গন করলাে সে।
রসভরা কলসিটাকে খেজুরের গাছ থেকে নামিয়ে এনে একনিশ্বাসে পুরাে কলসিটা শূন্য করে দিলাে সে।
জোয়ালে বাঁধা জীর্ণ-শীর্ণ গরু দুটোকে দড়ির বাঁধন থেকে ছেড়ে দিয়ে চিৎকার করে বললােযা আজ তােদের ছুটি।
গফুর শহরে যাবে।
বিয়ের ফর্দ নিয়ে।
সবকিছু নিজের হাতে কিনবে সে।
শাড়ি, চুড়ি, আলতা, হাঁসুলি।
অনেক কষ্টে সঞ্চয়-করা কতগুলাে তেল চিটচিটে টাকার কাগজ রুমালে বেঁধে নিলাে সে ।। বুড়িগঙ্গার ওপর দিয়ে খেয়া পেরিয়ে শহরে আসবে গফুর।
বিয়ের বাজার করতে।
গফুরের দু-চোখে ঘরবাধার স্বপ্ন।

বাবা আহমেদ হােসন।।
পুলিশের লােক।
অতি সচ্চরিত্র।
তবু প্রমােশন হলাে না তার।
কারণ, তসলিম রাজনীতি করে।
ছাত্রদের সভায় বক্তৃতা দেয় !

১৮

সরকারের সমালােচনা করে।
ছেলেকে অনেক বুঝিয়েছেন বাবা।
মেরেছেনও।
যার ধমকে দাগি চোর, ডাকাত, খুনি আসামিরা ভয়ে থরথর করে কাঁপতাে তাঁর অনেক শাসন, তর্জন-গর্জনেও তসলিমের মন টললাে না।
মিছিলের মানুষ সে।
মিছিলেই রয়ে গেলাে।
মা কাদলেন।
বােঝালেন, দিনের পর দিন।।
আত্মীয়-স্বজন সবাই অনুরােধ করলাে।
বললাে বুড়াে বাপটার দিকে চেয়ে এসব এবার ক্ষান্ত দাও।
দেখছাে না ভাইবােনগুলাে সব বড় হচ্ছে।
সংসারের প্রয়ােজন দিনদিন বাড়ছে।
অথচ প্রমােশনটা বন্ধ হয়ে আছে।
কিন্তু নিষ্ঠুর-হৃদয় তসলিম বাবার প্রমােশন, মায়ের কান্না, আত্মীয়দের অনুরােধ, সংসারের প্রয়ােজন সবকিছুকে উপেক্ষা করে মিছিলের মানুষ মিছিলেই রয়ে গেলাে ।।
কিন্তু এই নিষ্ঠুর হৃদয়ে একটা কোমল ক্ষত ছিলাে।
সালমাকে ভালােবাসতাে সে।
সালমা ওর খালাতাে বােন।
একই বাড়িতে থাকতাে।
উঠতাে বসতাে চলতাে।
তবু মনে হতাে সালমা যেন অনেক-অনেক দূরের মানুষ।
তসলিমের হৃদয়ের সেই কোমল ক্ষতটির কোনাে খোঁজ রাখতাে না সে।
কিম্বা রাখতে চাইতাে না।
বহুবার চেষ্টা করেছে তসলিম।
বলতে বােঝাতে।
কিন্তু সালমার আশ্চর্য ঠাণ্ডা চোখজোড়ার দিকে তাকিয়ে কিছুই বলতে পারেনি সে।

এককালে ভালাে কবিতা লিখতেন তিনি।
কবি আনােয়ার হােসেন।
এখন কেরানি আনােয়ার হােসেন।
তবু কবি-মনটা মাঝেমাঝে উঁকি দিয়ে যায়।
যখন তিনি দিনের শেষে রাতে ঘরে ফিরে এসে স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া করেন।
ঝগড়া করতে করতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন।
যখন এ দেহ মন জীবন আর পৃথিবীটাকে নােংরা একটা ছেড়া কাঁথার মতাে মনে হয়, তখন একান্তে বসে কবিতা লিখতে ইচ্ছে করে তাঁর।
আনােয়ার হােসেনের জীবনে অনেক অনেক দুঃখ।
ঘরে শান্তি নেই। স্ত্রীর দুঃখ।।
বাসায় প্রয়ােজনীয় আসবাবপত্র নেই।
থাকার দুঃখ।

১৯

সংসার চালানাের মতাে অর্থ কিম্বা রােজগার নেই। বাঁচার দুঃখ ।।
কবিতা লিখতে বসে দেখেন ভাব নেই।
আবেগের দুঃখ।
শুধু একটি আনন্দ আছে তার জীবনে।
যখন তিনি অফিস থেকে বেরিয়ে সামনে পানের দোকান থেকে কয়েকটা পান কিনে নিয়ে মুখে পুরে চিবুতে থাকেন।
আর পথ চলতে চলতে কবিতা লেখার দিনগুলাের কথা ভাবতে থাকেন।
তখন আনন্দে ভরে ওঠে তার সারা দেহ।
কবি আনােয়ার হােসেন, ঘর আর অফিস, অফিস আর ঘর ছাড়া অন্য কোথাও যান না।
যেতে ভালাে লাগে না, তাই।
কোনােদিন পথে কোনাে বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে হয়তাে একটা কি দুটো কুশল সংবাদ জিজ্ঞেস করেন। তারপর এড়িয়ে যান।
ভালাে লাগে না।
কিছু ভালাে লাগে না তাঁর।

অর্থ আর প্রাচুর্যের অফুরন্ত সমাবেশ।
অভাব বলতে কিছু নেই, মকবুল আহমদের জীবনে।
বাড়ি আছে। গাড়ি আছে। ব্যাংকে টাকা আছে।।
ছেলেমেয়েদের নামে ইনসুরেন্স আছে কয়েকখানা।
ব্যবসা একটা নয়। অনেক। অনেকগুলাে।
পানের ব্যবসা।
তেলের ব্যবসা।
পাটের ব্যবসা।
পারমিটের ব্যবসা।
সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতে হয় তাকে।
কখনাে মন্ত্রীর দফতরে।
কখনাে আমলাদের সভা-সমিতিতে।
তার জীবনেও দুঃখ অনেক।
দুটো পাটকল বসাবার বাসনা ছিলাে। একটার কাজও এখনাে শেষ হলাে না। শ্রমের দুঃখ। বড় ছেলেটাকে বাচ্চা বয়সেই বিলেতে পাঠিয়ে ভালাে শিক্ষা দেয়ার ইচ্ছে ছিলাে কিন্তু স্ত্রী তার সন্তানকে কাছছাড়া করতে রাজি না। জাগতিক দুঃখ।
তেলের কলের শ্রমিকগুলাে শুধু বেতন বাড়াবার জন্য সারাক্ষণ চিৎকার করে, আর হরতালের হুমকি দেয়। দুঃখ। উৎপাদনের দুঃখ।
কিছু ছেলে ছােকরা আর গুণ্ডা জাতীয় লােক পথে-ঘাটে মাঠে-ময়দানে মিছিল বের করে । সভা বসিয়ে সরকারের সমালােচনা করে। যাদের টাকা আছে তাদের সব টাকা গরিবদের বিলিয়ে দিতে বলে। দুঃখ। দেশের দুঃখ।
২০

এই অনেক দুঃখের মধ্যেও একটা আনন্দ আছে তাঁর। যখন সারাদিনের ব্যস্ততার শেষে রাতে ক্লাবের এককোণে চুপচাপ বসে বােতলের পর বােতল নিঃশেষ করেন তিনি। তখন অদ্ভুত এক আনন্দে ভরে ওঠে তার চোখমুখ। স্ত্রী বিলকিস বানুর সঙ্গে তাঁর কদাচিৎ দেখা হয়। একই বাড়িতে থাকেন। এক বিছানায় শােন। কিন্তু কাজের চাপে, টেলিফোনের অহরহ যন্ত্রণায় স্ত্রীর সঙ্গে বসে দু-দণ্ড আলাপ করার সময় পান না তিনি। অথচ স্ত্রীকে তিনি ভীষণ ভালােবাসেন।।
তার সুখশান্তির উপর লক্ষ রাখেন।।
এবং যখন যা প্রয়ােজন মেটাতে বিলম্ব করেন না।
স্বামীর সঙ্গ পান না, সেজন্যে বিলকিস বানুর মনে কোনাে ক্ষোভ নেই।
কারণ, সঙ্গ দেয়ার লােকের অভাব নেই তার জীবনে।

সেলিমও স্বপ্ন দেখে।
একটা রিকশা কেনার স্বপ্ন।
বারাে বছর ধরে মালিকের রিকশা চালিয়ে ক্লান্ত হয়ে পড়েছে সে।।
সারাদিনের পরিশ্রম শেষে তিনটি টাকা রােজগার হলে দুটো টাকা মালিককে দিয়ে দিতে হয়।
একটা টাকা থাকে ওর।
সেই টাকায় বউ আর বাচ্চাটাকে নিয়ে দিনের খাওয়া হয়।
মাসের বাড়ি ভাড়া।
বিড়ি কেনা।
আর সিনেমা দেখা।
পােষায় না তার।
দেশ কী সে জানে না।
সভা-সমিতি-মিছিলে লােকগুলাে কেন এত মাতামাতি করে তার অর্থ সে বােঝে না।।
পুলিশেরা যখন ছাত্রদের ধরে ধরে পেটায় তখন সে অবাক চোখে চেয়ে চেয়ে দেখে।
কোনাে মন্তব্য করে না।
তার ভাবনা একটাই। একটা রিকশা কিনতে হবে।
আরাে একটা ভাবনা আছে তার। মাঝে মাঝে ভাবে।
ছেলেটা আর একটু বড় হলে তাকেও রিকশা চালানাে শেখাতে হবে।

খেয়াঘাট পেরিয়ে শহরে এলাে গফুর।
বগলে একটা ছােট্ট কাপড়ের পুঁটলি।
পুঁটলিতে বাধা একটা বাড়তি লুঙি, জামা আর কিছু পিঠে।
শহরে নেমেই সে অবাক হয়ে দেখলাে মানুষগুলাে সব কেমন যেন উত্তেজনায় উত্তপ্ত ।
এখানে সেখানে জটলা বেঁধে কী যেন আলাপ করছে তারা।
খবরের কাগজের হকাররা অস্থিরভাবে ছুটাছুটি করছে।।
কাগজ কেনার ধুম পড়েছে চারদিকে।
২১

সবাই কিনে কিনে পড়ছে।
উর্দুই একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হবে এদেশের।

না !! না !!
চিৎকার করে উঠলেন কবি আনােয়ার হােসেন।
আমি মানি না।
উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপছিলেন তিনি।
মুষ্টিবদ্ধ তাঁর হাত।
স্ত্রী অবাক হয়ে তাকালাে তার দিকে।
স্বামীকে এত জোরে চিৎকার করতে কোনােদিন দেখেনি সে।
কেন কী হয়েছে ?
ওরা বলছে বাংলাকে ওরা বাদ দিয়ে দেবে। উর্দু, শুধু উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করবে ওরা। জানাে। সালেহা, যে-ভাষায় আমরা কথা বলি, যে-ভাষায় আমি কবিতা লিখি, সে-ভাষাকে বাদ দিয়ে দিতে চায় ওরা ।।
সে কিগাে ! আমরা তাহলে কোন ভাষায় কথা বলবাে ?
ভয়ার্ত দৃষ্টিতে স্বামীর দিকে তাকায় সালেহা।
না। না। আমি অন্যের ভাষায় কথা বলবাে না।
আমি নিজের ভাষায় কথা বলবাে। কবি আনােয়ার হােসেন চিৎকার করে উঠলেন।

বজ্র থেকে ধ্বনি নিয়ে গর্জন করে উঠলাে তসলিম।
এই সিদ্ধান্ত আমি মানি না।
আমরা মানি না।
মানি না !
মানি না !!
মানি না !!!
আমতলায় ছাত্রদের সভাতে অনেকগুলাে কণ্ঠ একসুরে বলে উঠলাে- আমরা মানি না।
বাচ্চারা কোনাে কিছুই সহজে মানতে চায় না।
তাদের মানিয়ে নিতে হয়।
আমলাদের সভায় মেপে মেপে কথাগুলাে বললেন মকবুল আহমেদ।
প্রথমে আদর করে দুধকলা খাইয়ে ওদের মানিয়ে নিতে হয়।
তবু যদি না মানে চাবুকটাকে তুলে নিতে হবে হাতে।
মানবে না কী ?
মানতে বাধ্য হবে তখন।

কতগুলাে মুষ্টিবদ্ধ হাত আকাশের দিকে তুলে শ্লোগান দিচ্ছে— রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
বাংলা চাই।।
আজ পান খাওয়া ভুলে গেলেন কবি আনােয়ার হােসেন।
সেদিকে তাকিয়ে চোখজোড়া আনন্দে জ্বলজ্বল করে উঠলাে তার।
ভুলে গেলেন—কখন পথের মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়েছেন।

২২

তিনি দেখছেন মিছিলের মুখগুলাে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।।
পেছন থেকে কে যেন ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাে তাকে।
কী সাব ! রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে কী দেখেন ? বেল বাজাই শােনেন না ?
রিকশাচালক সেলিম।
তার রিকশাটা নিয়ে এগিয়ে যায় সামনে।
ছেলেগুলাে চিকার করছে।
করুক।
ওতে তার কোনাে উৎসাহ নেই। পারবে না। তুমি দেখে নিও।
ওরা জোর করে উর্দুকে আমাদের ঘাড়ে চাপিয়ে দিতে পারবে না।
গদগদ কণ্ঠে স্ত্রীকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন কবি আনােয়ার হােসেন। ছেলেরা খেপেছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করে ওরা ছাড়বে না।
স্ত্রী পান খাচ্ছিলাে।
একটুকরাে চুন মুখে তুলে বললাে— হা গাে, রাষ্ট্রভাষা বাংলা হলে তােমার বেতন কি বেড়ে যাবে ?
কটাকা বাড়বে বলােতাে ?
কী যে হবে দেশের কিছু জানি না।
বিদেশের চর এসে ভরে গেছে পুরাে দেশটা।
স্ত্রীর সঙ্গে বহুদিন পরে আজ কথা বলতে বসলেন মকবুল আহমদ।
বাংলা বাংলা করে চিৎকার করছে ওরা।
বাংলা কি মুসলমানের ভাষা নাকি ?
ওটাতাে হিন্দুদের ভাষা ।
হিন্দুরা এ দেশটাকে জাহান্নামে নেবে।
কথাটা চিবিয়ে চিবিয়ে বললেন বিলকিস বানু।
কোথায় উর্দু আর কোথায় বাংলা। উর্দু হচ্ছে খানদানি ভাষা। আমাদের ফ্যামেলিতে বাবা মা সবাই উর্দুতে কথা বলেন।

উর্দু-বাংলা আমি কিছু বুঝি না।
আমার সােজা কথা তােমার ছেলেকে সাবধান করে দাও।
ও যদি আবার সভা-সমিতি আর আন্দোলন করে তাহলে এদ্দিন প্রমােশন বন্ধ হয়ে ছিলাে, এবার আমার চাকরিটাই যাবে।
তসলিমের পুলিশ-বাবা উত্তেজনায় থরথর করে কাঁপতে লাগলেন।
মা-ও শিউরে উঠলেন।
অনাগত ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার কথা ভাবতে গিয়ে চোখে পানি এসে গেলাে তার।
তুই কেমন নিষ্ঠুর ছেলেরে !
তসলিমকে বােঝাবার চেষ্টা করলেন তিনি।
তাের বাবা-মা ভাই-বােনগুলাের কথা ভেবেও কি তুই ওসব ক্ষান্ত দিতে পারিস না ?
চাকরিটা চলে গেলে আমরা খাবাে কী ?
তসলিম নিশ্চুপ।
সালমা বললাে— খালুজান ক’দিন ধরে আপনার চিন্তায় খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছেন।
এসব কাজ না করলেই তাে পারেন। কী হবে এসব করে ?

২৩

সালমার দিকে অবাক হয়ে তাকালাে তসলিম। এর মধ্যে সালমাকে অনেক কিছু বলতে ইচ্ছে হয়েছিলাে তার। কিন্তু কিছুই বললাে না। শুধু বললাে– তুমি ওসব বুঝবে না।

সদরঘাটে যেখানে অনেকগুলাে খেয়ানৌকা ভিড় করে থাকে তার কাছাকাছি একটা ইট টেনে নিয়ে বসে পড়লাে গফুর।
খিদে পেয়েছে। খাবে।
পুঁটলিটা ধীরেধীরে খুললাে সে।
শহরের লােকজনদের সে বলতে শুনেছে-কাল নাকি হরতাল।
শহরের সমস্ত দোকান-পাট বন্ধ থাকবে।
গাড়িঘােড়া চলবে না।
হরতাল কী গফুর বােঝে না।
পিঠা খেতে-খেতে সে নানাভাবে হরতালের একটা অবয়ব চিন্তা করতে লাগলাে।
কিন্তু হরতালের কোনাে সঠিক চেহারা নির্ণয় করা তার পক্ষে সম্ভব হলাে না।।
সে ভাবলাে, এটা হয়তাে শহরেরই বিশেষ একটা রীতি কিম্বা নীতি।
মাঝে মাঝে শহরের মানুষেরা এ-রকম হরতাল পালন করে থাকে।
উঠে গিয়ে দু-হাতে বুড়িগঙ্গার পানি তুলে নিয়ে পান করলাে গফুর।
গামছায় মুখ হাত মুছলাে।
তারপর ট্র্যাক থেকে রুমালটা বের করে টাকাগুলাে গুণে গুণে বারকয়েক দেখলাে সে।
কাল দোকান-পাট বন্ধ থাকবে।
কেনাকাটা আজকেই শেষ করতে হবে।
মুহূর্তে আমেনার মুখ মনে পড়লাে তার।
কী করছে আমেনা এখন।
হয়তাে পুকুরঘাটে পানি নিতে এসেছে।
কিম্বা চেঁকিতে পাড় দিচ্ছে।
অথবা কচুবনে ঘুরে কচুশাক তুলছে।
সাতদিন পর বিয়ে।
ভাবতে বড় ভালাে লাগলাে গফুরের।।
সহসা বিকট একটা আওয়াজ শুনে চমকে তাকালাে গফুর।
দেখলাে কয়েকটি ছেলে মুখে চোঙা লাগিয়ে চিৎকার করে বলছেকাল হরতাল।
আমাদের মুখের ভাষাকে ওরা জোর করে কেড়ে নিতে চায় ।
আমাদের প্রাণের ভাষাকে ওরা আমাদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিতে চায়।
কিন্তু আমরা মাথা নােয়াবাে না।
আমরা আমাদের ভাষাকে কেড়ে নিতে দেবাে না।
আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
আর সে দাবিতে কাল হরতাল ।
সবাই হরতাল পালন করুন।।
গফুর অবাক হয়ে শুনলাে।
সে ভাবলাে কাউকে জিজ্ঞেস করবে ব্যাপারটা কী ! কিন্তু সাহস পেলাে না।

২৪

অদূরে একটা লােক তাসের খেলা দেখাচ্ছিলাে।
নানারকম খেলা।
আজগুবি খেলা।
গফুর ভিড় ঠেলে সামনে গিয়ে খেলা দেখতে লাগলাে।

কিসের হরতাল ?
আমি হরতাল মানি না।
রিকশার ব্রেকটা খারাপ হয়ে গেছে।
সেটা ঠিক করতে-করতে আপনমনে গজগজ করে উঠলাে সেলিম।
রিকশা না চালালে আমি রােজগার করবাে কোত্থেকে ?
আমি খাব কী ?
আমার বউ খাবে কী ?
আমার ছেলে খাবে কী ?
ওসব হরতালের মধ্যে আমি নেই।
ব্রেকটা ঠিক করে সবে রিকশাটা নিয়ে সামনে এগুতে যাবে সে-—এমন সময় পেছন।
থেকে কে যেন ডাকলাে— ভাড়া যাবে ?
সেলিম দেখলাে একটা ছেলে।
বােধহয় ছাত্র।
হাতে বই।
বগলে একগাদা কাগজ।
কোথায় যাবেন স্যার?
ইউনিভার্সিটি।
ওঠেন।
তসলিম রিকশায় উঠে বসতেই সেলিম প্রশ্ন করলােআপনারা কালকে হরতাল করছেন কেন ?
রিকশা না চালালে আমরা রুজি-রােজগার করবাে কেমন করে ?
হাওয়া খেয়ে বেঁচে থাকবাে নাকি ?
মুহূর্তে-কয়েক সময় নিলাে তসলিম।
তারপর ধীরেধীরে বললাে— আমরা রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
আর ওরা উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করতে চায়।
উর্দু যদি রাষ্ট্রভাষা হয়।
তাহলে বাংলাভাষা এদেশ থেকে চিরতরে হারিয়ে যাবে।
তােমাকে আমাকে আমাদের সবাইকে উর্দুতে কথা বলতে হবে।।
উর্দু আমি কিছুকিছু জানি।
সেলিম বিজ্ঞের মতাে বললাে—
কিন্তু আমার বউ উর্দু একেবারে বােঝে না।
ও মুন্সিগঞ্জের মেয়ে কিনা তাই।
তবে ছেলেকে আমি উর্দু-বাংলা দুটোই শেখাচ্ছি।
তসলিম বললাে—
উর্দুর সঙ্গে আমাদের কোনাে বিরােধ নেই।
আমরা উর্দু-বাংলা দুটোকেই সমানভাবে চাই।
কিন্তু হরতাল করছেন কেন ?
হরতালের মাধ্যমে আমরা বিক্ষোভ জানাতে চাই।
আমাদের প্রতিবাদ জানাতে চাই।

২৫

অ।
কিছু না বুঝলেও বারকয়েক ঘাড় দোলালাে সেলিম।

সরকারের চাকুরি করি বলে কি আমরা আমাদের মতামতটাও বন্ধক দিয়ে দিয়েছি নাকি?
আমরা কি ওদের ক্রীতদাস যে, কথামতাে আমাদের চলতে হবে ?
চেয়ারে বসে ছটফট করতে লাগলেন কবি আনােয়ার হােসেন।
বড়কর্তার হুকুম এসেছে। কাল সবাইকে সময়মতাে অফিসে হাজির হতে হবে। হরতাল করা চলবে না। যে হাজির হবে না তাকে সাসপেন্ড করা হবে। কেন ? আমাদের ভাষাটাকে তােমরা জোর করে কেড়ে নিয়ে যাবে ? আর আমরা চুপ করে বসে থাকবাে ? কুকুর-বেড়ালেরও নিজস্ব একটা ভাষা আছে। দেখি ওদের মুখ বন্ধ করে দাও তাে ! তােমাদের ছেড়ে দেবে ? কামড়ে-আঁচড়ে গায়ের রক্ত বের করে দেবে না ? ওসব হুকুম আমি মানিনা। যদি চাকরি যায় যাবে। মুটেগিরি করবাে। দরকার হলে রাস্তায় খবরের কাগজ বিক্রি করবাে। কিন্তু আমাকে তােমরা ক্রীতদাস বানিয়ে দেবে সেটা চলবে না।
রাগে গজগজ করতে লাগলেন কবি আনােয়ার হােসেন।
ব্যস্ কাল হরতাল।
আমি অফিসে যাবাে না— যা হয় হােক। হিসেবের খাতাটা বন্ধ করে টেবিলের এককোণে রেখে দিলেন তিনি।
ওসব হরতালের হুমকিতে মাথা নােয়ালে দেশ চলবে না। হরতাল বন্ধ করতে হবে। সভা-সমিতি ভেঙে দিতে হবে। রাস্তায় মিছিল করা বেআইনি ঘােষণা করতে হবে।
তবে ঠাণ্ডা হবে ওরা।
আমলাদের সামনে লম্বা ভাষণ দিলেন মকবুল আহমদ। মন্ত্রীরা ছুটোছুটি করছে।।
একমুহূর্তের বিশ্রাম নেই।
নেতারা তর্ক-বিতর্কে মেতে উঠেছেন।
আলােচনা-সমালােচনার ঝড় তুলছেন।
যে করেই হােক হরতাল বন্ধ করতে হবে।
রাস্তায় মিছিল বের করা বে-আইনি করতে হবে।
পাড়ার মাতব্বরদের ডাকা হয়েছে।
তাদের সঙ্গে পরামর্শ চলছে।
যত লােক লাগে আমরা দেবাে।
যত টাকা লাগে আমরা যােগাবাে।
পুলিশের প্রয়ােজন হলে পুলিশ দেবাে।
সব কিছুই পাবেন আপনারা।
হরতাল বন্ধ করতে হবে।
মিছিল বন্ধ করতে হবে।
মাতব্বররা ঘাড় নােয়ালেন।
নামাজের সেজদা দেবার মতাে।
কতগুলাে উদ্ধত মুখ।
ঋজু।।

২৬

কঠিন।
একসঙ্গে চিৎকার করে উঠলাে।।
না।।
আমরা মানি না।
সরকার একশাে চুয়াল্লিশ ধারা জারি করে আমাদের মুখ বন্ধ করে দেবে। প্রতিবাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত করবে আমাদের। সে অন্যায় আমরা মাথা পেতে নেবাে না। আইন দিয়ে ওরা আমাদের শৃঙ্খলিত করতে চায়। সে শৃঙখল আমরা ভেঙে চুরমার করে দেবাে।
আমরা গরু ছাগল ভেড়া নই যে, প্রয়ােজনবােধে খোয়াড়ের মধ্যে বন্ধ করে রাখবে।
তর্ক-বিতর্ক চললাে অনেক অনেকক্ষণ ধরে।
আলােচনার ঝড় উঠলাে।
কেউ বললাে—
এ আইন অমান্য করা ঠিক হবে না।
কেউ বলল-
এ আইন শােষণের আইন।
এ আইন আমরা মানি না।
বুড়ােরাত বাড়তে লাগলাে ধীরেধীরে।
কাল কী হবে কেউ জানে না।
রাস্তায় পুলিশ নেমেছে।
পুলিশের গাড়ি ইতস্তত ছুটোছুটি করেছে। পথ-ঘাটগুলাে জনশূন্য।
একটা খালি রক পেয়ে তার উপরে গামছা বিছিয়ে শুয়ে পড়লাে গফুর।
দুটো শাড়ি কিনেছে সে।
একশিশি আলতা।
কিছু চুড়ি।
একটা নাকফুল।
সেগুলাে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরে নানা কথা ভাবতে লাগলাে সে।
আমেনার কথা।
বিয়ের পর কেমন করে সংসার করবে সে কথা।
আর কোনােদিন যদি ছেলেপুলে হয় তার কথা।
ইচ্ছে করলে সে আজ গ্রামে ফিরে যেতে পারতাে।
কিন্তু যায়নি।
কারণ, সে হরতাল দেখবে।
হয়তাে কোনােদিন আর শহরে আসা নাও হতে পারে।
তাই হরতাল সে দেখে যাবে।
দু-একটা কেনাকাটাও বাকি রয়ে গেছে।
একটা লাল লুঙি কিনবে ভেবেছিলাে সে।
কয়েক দোকানে ঘােরাঘুরিও করেছিলাে।
কিন্তু ওরা বড় চড়া দাম চায়।
তাই গফুর ভাবলাে, যদি কম দামে পাওয়া যায়।
আর যদি দু-একটা দোকান-পাট খােলা থাকে তাহলে সে কিনবে সেটা।
২৭

লাল লুঙি আমেনা ভীষণ পছন্দ করে।
শুয়ে শুয়ে গফুর দেখলাে দুটো পুলিশের গাড়ি ছুটে চলে গেলাে রাস্তা দিয়ে।
গফুর চোখ বন্ধ করলাে।

কবি আনােয়ার হােসেন উত্তেজিতভাবে ঘরের ভেতরে পায়চারি করলেন অনেকক্ষণ ধরে। সালেহা ডাকলাে—
কই, শােবে না ?
না।
শান্ত গলায় জবাব দিলেন কবি—
জানাে সালেহা, আজ বহুদিন পর আমার কী মনে হচ্ছে জানাে ? মনে হচ্ছে, আমার জীবনটা ব্যর্থ হয়ে গেলাে। আমি কবি হতে চেয়েছিলাম। কবিতা লিখতাম। কবিতা ছিল আমার স্বপ্ন। আমার সাধনা। ভেবেছিলাম সারাটা জীবন আমি কবিতা লিখেই কাটিয়ে দেবাে। কিন্তু আমি—সেই আমি–দেখ আজ লেজার লিখতে লিখতে ক্লান্ত।।
সালেহা সহানুভূতির সঙ্গে তাকালাে তার দিকে।
লেখাে না কেন ? মাঝে মাঝে লিখলেই তাে পারাে। তুমি তাে কবিতা লিখেই আমাকে পাগল করেছিলে, মনে নেই !
কথা শুনে সহসা শব্দ করে হেসে উঠলেন কবি আনােয়ার হােসেন।
মনে আছে সালেহা। মনে থাকবে না কেন? শুধু কী জানাে ! আমার সেই মনটা নেই, যে। মন নিয়ে একদিন আমি কবিতা লিখতাম। আমার সেই মনটা না, লেজারের চাপে দুমড়ে গেছে। মরে গেছে।
এসাে এখন শুয়ে পড়াে।।
সালেহা ডাকলাে।।
না।
আবার বললেন আনােয়ার হােসেন।
তার সারা মুখে কী এক অস্থিরতা।
স্ত্রীর কাছে এসে বসলেন তিনি সালেহা, আমি ঠিক করেছি, আমি আর ও চাকরি করবাে না। এসব সরকারি চাকরি মানুষকে ক্রীতদাস করে ফেলে। আমি ছেড়ে দেবাে। যেখানে আমার সামান্য স্বাধীনতা নেই, সেখানে কেন আমি কলুর বলদের মতাে ঘানি টেনে যাবাে ? আমি আবার কবিতা লিখবাে সালেহা। যে কবিতা পড়ে তােমার একদিন আমাকে ভালাে লেগেছিলাে—তেমনি কবিতা লিখবাে আমি। সালেহার পুরাে চেহারায় কে যেন আলকাতরা লেপে দিলাে।
না !, না ! চাকরি ছাড়া ঠিক হবে না। তাহলে সংসার চলবে কী করে? কবিতা লিখে তাে। আর টাকা পাবে না তুমি !
টাকা ! টাকাটাই কি জীবনের সব কিছু সালেহা ? মানুষের মন বলে কি কিছুই নেই ?
শােনাে। ওসব চিন্তা এখন রাখাে।।
সালেহা স্বামীর হাত ধরলাে।
এসাে এখন শুয়ে পড়া যাক।
কাল আবার ভােরে-ভােরে উঠতে হবে না !
২৮

আমি কিন্তু কাল অফিসে যাবাে না।।
কেন ?
আমি হরতাল করবাে। ওরা নিষেধ করেছে। বলেছে চাকরি যাবে, যাক। সেটা পরােয়া করি না। আমার ভাষার চেয়ে কি চাকরি বড় ?

কাল কী হবে কে জানে। হয়তাে মারাত্মক কিছুও ঘটতে পারে।
বসে বসে ভাবলাে তসলিম।
জীবনে এই প্রথম অনুভূতির জন্ম নিলাে তার মনে।।
একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতেই হবে। নইলে আন্দোলন এখানেই শেষ হয়ে যাবে।
বাংলা ভাষাকে চিরতরে নির্মূল করে দেবে ওরা।
আর একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙতে গেলে হয়তাে পুলিশ গুলিও চালাতে পারে।
হয়তাে তসলিম মারা যাবে।
নিজের মৃত্যুর কথা ভাবতে গিয়ে সহসা শিউরে উঠলাে সে।।
মনে হলাে যেন নিজের মৃত্যুকে সে এ-মুহূর্তে প্রত্যক্ষ করছে।
ভাত খাবেন না !
সালমার কণ্ঠস্বরে চমকে তাকালাে তসলিম।
সালমা বললতরকারি ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে, চলুন। বলে চলে যাচ্ছিলাে সালমা।
সহসা পেছন থেকে তাকে ডাকলাে তসলিম-
সালমা, শােনাে ! তােমার সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।
সালমা ফিরে তাকালাে।
নীরব দৃষ্টিতে প্রশ্ন করলােকি, বলুন ? সে-চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারলাে না তসলিম।।
চোখ নামিয়ে নিয়ে ধীরেধীরে বললাে কথাটা-
আমার তুমি কিভাবে নেবে জানি না, হয়তাে তুমি রাগ করবে।
বলতে গিয়ে থেমে গেলাে সে।
সালমা নীরব।
কয়েকটি নীরব মুহূর্ত।
সহসা তসলিম আবার বললাে
বহুবার ভেবেছি বলবাে তােমাকে।
বলা হয়নি।
হয়তাে কোনােদিন বলতাম না।
কিন্তু আজ কেন জানিনা বলতে ভীষণ ইচ্ছে করছে আমার !
আবার নীরব হলাে তসলিম সালমা মাটির দিকে চেয়ে চুপ করে আছে।
মনে হলাে ও মুখখানা কৃষ্ণচূড়ার রঙে ভরে গেছে।
সালমা বললাে—
চলুন, এখন খেয়ে নিন।
২৯

না না সালমা, যদি কাল কোনাে অঘটন ঘটে ? ধরাে যদি আমি মারা যাই। তাহলে ?
মেয়েটি শিউরে উঠলাে। চোখজোড়া মুহর্তে ছলছল করে উঠলাে তার।
ছিঃ। এসব কী বলছেন আপনি ! মরবেন কেন ? আপনি অনেক অনেক দিন বাঁচবেন।
আসুন, এখন খেয়ে নিন। চলুন। কথাটা শুনবে না ?
এখন না। পরে শুনবাে। উত্তরের অপেক্ষা না করেই সামনে থেকে সরে গেল সালমা।।

তুমি কি কাল বাইরে বেরুবে, না ঘরে থাকবে ?
বিছানায় শােবার আগে মুখে ক্রিম ঘষতে ঘষতে স্বামীকে প্রশ্ন করলেন বিলকিস বানু। হ্যা, বেরুবাে বৈ কী। বেরুবাে না কেন ?
না, বলছিলাম কী—যদি হরতাল হয় তাহলে ?
হরতাল মােটেও হবে না।
তুমি নিশ্চিত থাকতে পারাে।
বিজ্ঞের মতাে জবাব দিলেন মকবুল আহমদ।
হরতালের সব রাস্তা আমরা বন্ধ করে দিয়েছি।
যে হরতাল করবে তার লাইসেন্স আমরা কেড়ে নেবাে। কেউ যদি অফিসে না আসে তাকে চাকরি থেকে বরখাস্ত করবাে। আমরা জানিয়ে দিয়েছি। পরিষ্কার ভাষায় বলে দিয়েছি সবাইকে। তারপরও কি কেউ হরতাল করবে বলে মনে হয় তােমার ?
স্লিপিং স্যুটটা পরে নিয়ে বিছানায় এসে শুলেন মকবুল আহমদ।
কিন্তু ছাত্ররা হয়তাে একটু-আধটু গােলমাল করতে পারে।
তাও আমরা ভেবে রেখেছি।
ক্রিম ঘষা শেষ হলে বিলকিস বানু বাতিটা নিভিয়ে দিয়ে বিছানায় এসে বসলেন।
আমার কি মনে হচ্ছে জানাে ?
কাল কোনাে একটা কিছু হয়তাে হতেও পারে।
তুমি যেদিকে খুশি যেয়াে, কিন্তু ওই ছাত্রদের পাড়ায় গাড়ি নিয়ে যেয়াে না।
তুমি মিছেমিছি ভাবছাে ।
শুয়ে পড়াে এখন।
চোখ বন্ধ করে ঘুমােবার চেষ্টা করলেন মকবুল আহমদ।

ভাের হবার আগেই ঘুম ভেঙে গেলাে গফুরের।
চেয়ে দেখলাে পথ-ঘাটগুলাে তখনাে জনশূন্য।
দুটো কুকুর রাস্তার মাঝখানে বসে ঝগড়া করছে।
গফুর উঠে বসলাে।
পুঁটলিতে রাখা জিনিসপত্রগুলাে পরখ করে দেখলাে একবার।
পুবের আকাশে সবে ধলপহর দিয়েছে।
দু-পাশের উঁচুউঁচু দালানগুলােকে আকাশের পটভূমিতে ছায়ার মতাে মনে হচ্ছে।
দু’একটা কাক গলা ছেড়ে চিৎকার করছে।
মাঝে মাঝে রাস্তায় নেমে এসে খাবার খুঁজছে। আবার উড়ে গিয়ে বসছে টেলিগ্রামের তারের উপর।
৩০

দুটো মেয়ে রাস্তায় ধুলাে উড়িয়ে ঝাড় দিচ্ছে।
আবর্জনা পরিষ্কার করছে।
রাস্তার পাশে একটা কল থেকে হাতমুখ ধুলাে গফুর।
ততক্ষণে লােকজন পথে চলতে শুরু করেছে।
দু-একটা রিকশার টুংটাং আওয়াজ শােনা যাচ্ছে।
একটা-দুটো করে দোকান-পাট খুলছে।
টাউন সার্ভিসের বাসগুলাে মানুষ ভর্তি করে ছুটছে উর্ধ্বশ্বাসে।
হরতাল।
কোথায় হরতাল ?
গফুর অবাক হয়ে তাকালাে চারপাশে।

সেলিম তার রিকশাটা নিয়ে বেরিয়ে পড়লাে রাস্তায়।
যাবার সময় বৌকে বলে গেলাে—
কালুকে আজ রাস্তায় বেরুতে দিস না।
গােলমাল হতে পারে।
কালু ওর ছেলের নাম।

মকবুল আহমদও বেরুলেন বাইরে।
স্ত্রী বিলকিস বানুকে সঙ্গে নিয়ে।
ড্রাইভারকে নির্দেশ দিলেন রেসকোর্স ঘুরে সেক্রেটারিয়েটের দিকে যাবার জন্য।
পুরােনাে শহরেও একবার যাবেন তিনি।
কারখানায় যাবেন।
অফিসপাড়াগুলাে ঘুরবেন।
হরতাল ব্যর্থ হয়েছে কি হয়নি তাই তদারক করবেন তিনি।
বিলকিস বানু সহসা শব্দ করে হেসে উঠলেন।
ওই যে দ্যাখাে দ্যাখাে।
একটা বাস আসছে। দুটো রিকশা।
একটা ঘােড়ার গাড়ি।
ওটা একটা প্রাইভেট কার, না !
দুজনের মুখে হাসি।
চারপাশে সন্ধানী-দৃষ্টি নিয়ে কী যেন খুঁজছেন তারা।
রাস্তায় গাড়ি দেখলে কিম্বা দোকান খুলছে নজরে এলে উল্লাসে ভরে উঠছে তাদের চোখ-মুখ ।
তােমাকে বলিনি আমি।
সগর্বে স্ত্রীর দিকে তাকালেন মকবুল আহমদ।
কেউ হরতাল করবে না।
দেশের দুশমনদের সাথে কেউ যােগ দেবে না।
স্বামীর একখানা হাত নিজের হাতের মধ্যে তুলে নিলেন বিলকিস বানু।।

তুমি কি সত্যিসত্যি আজ অফিসে যাবে না ?
বাইরে বেরুবার মুহূর্তে প্রশ্ন করলাে সালেহা।।
একটা কথার আর ক’বার উত্তর দেবাে বলাে তাে ?
৩১

কবি আনােয়ার হােসেন রেগে গেলেন-
বলছি তাে যাবাে না।
তাহলে এখন বেরুচ্ছাে কোথায় ?
পথ রােধ করে দাঁড়ালাে সালেহা।
বাইরে হরতাল কেমন হলাে দেখতে যাবাে।
তারপর ? তারপর ইউনিভার্সিটিতে যাবাে। ছাত্ররা কী করছে।
না। আমি তােমাকে বেরুতে দেবাে না।
সালেহা দৃঢ়কণ্ঠে বললাে—
শেষে কোথায় গিয়ে কী করবে–পুলিশ ধরে নিয়ে যাবে। তখন আমার কী অবস্থা হবে। শুনি?
দ্যাখাে, বাজে বকো না। পথ ছাড়াে। পুলিশে ধরবে। আমি তার তােয়াক্কা করি না। আর আমার যদি কিছু হয় তাহলে তুমি বাপের বাড়ি চলে যেয়াে। উত্তরের আর অপেক্ষা করলেন না আনােয়ার হােসেন। বাইরে বেরিয়ে গেলেন তিনি।
ভােররাতে পুলিশের পােশাক পরে কোমরে পিস্তল এঁটে বাইরে বেরিয়ে গেছেন বাবা।
আজ তাঁর বড় ব্যস্ততার দিন।
তসলিমও ব্যস্ত।
তরতর করে সিঁড়ি দিয়ে নেমে আসার পথে সালমার সঙ্গে দেখা হলাে তসলিমের।
আজ বাইরে না গেলেই কি নয় ?
এই একটি কথা বলার জন্যে হয়তাে সিঁড়ির গােড়ায় অপেক্ষা করছিলাে মেয়েটি।
তসলিম থমকে দাঁড়ালাে।
তুমি তাে সবই জানাে সালমা। জানাে, আমি যাবাে। তবু কেন বাধা দিচ্ছো।
দৃষ্টি নত করলাে সালমা।।
খালু বলছিলেন আজ গােলমাল হতে পারে।
বলতে গিয়ে গলার স্বরটা কেঁপে গেলাে তার।
তসলিম সেটা লক্ষ করলাে।।
এ-মুহূর্তে অনেক কথাই বলতে ইচ্ছে করছিলাে তার।
কিছুই বলতে পারলাে না।
শুধু বললাে—
চলি সালমা। আবার দেখা হবে।
বলে সালমার দিকে আর তাকালাে না সে। নীরবে বেরিয়ে গেলাে।

এরা মানুষ !
মানুষ না সব জানােয়ার।
রাস্তার মধ্যে একরাশ থু-থু ছিটালাে কবি আনােয়ার হােসেন।
সব শালা বেঈমান।
টাকা খেয়ে হরতাল ভেঙে দিয়েছে।
বুঝবে।
যেদিন ওদের ঘাড়ে উর্দুর জোয়াল চাপিয়ে দেয়া হবে, সেদিন বুঝবে শালারা।
রাগে থরথর করে কাঁপছিলাে কবি আনােয়ার হােসেন।।
৩২

যাবেন নাকি সাব।।
তাকে রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে একটা রিকশাওয়ালা শুধালাে।
না।
সহসা বিকটভাবে চিৎকার করে উঠলেন কবি আনােয়ার হােসেন।
তার ইচ্ছে হলাে এক ঘুসিতে রিকশাওয়ালার নাক, মুখ ভেঙে দিতে !
সব শালা বেঈমান। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ।
রাস্তায় থুথু ছিটিয়ে সামনে এগিয়ে গেলেন তিনি।

তখন দুপুর।
আকাশে একটুকরাে মেঘ নেই।
সূর্যটা জ্বলছে।
ছাত্ররা সবাই স্কুল-কলেজ বর্জন করে দীর্ঘপথ পায়ে হেঁটে একে-একে এসে জমায়েত হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলায়।
মধুর রেস্তোরা।
ইউনিয়ন অফিস।
পুকুরপাড় ।।
গমগম করছে অসংখ্য কণ্ঠস্বরে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের সামনের রাস্তায় ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলাে নিচে অনেকগুলাে পুলিশের গাড়ি সার বেঁধে এসে দাঁড়িয়েছে।
পুলিশের কর্তারা পায়চারি করেছেন রাস্তায়।
আর কন্সটেবলগুলাে হুকুমের অপেক্ষায় দাড়িয়ে।
রাইফেলের নলগুলাে দুপুরের রােদে চিকচিক করছে।
ইউক্যালিপ্টাসের ডাল থেকে অসংখ্য পাতা বৃষ্টির মতাে ঝরে পড়ছে নিচে।
সহসা অসংখ্য কণ্ঠের চিৎকারে চমকে সেদিকে তাকালেন পুলিশের বড়কর্তারা।
আমতলায় ছাত্রদের সভা শুরু হয়েছে।
আমরা কোনাে কথা শুনতে চাই না।
কোনাে বক্তৃতার এখন প্রয়ােজন নেই।
আমরা একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবাে।
ভাঙবাে।
ভাঙবাে।।
অনেকগুলাে কণ্ঠ বজ্রের মতাে ধ্বনি তুললাে।
নেতারা বলছেন—
না, একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙা যাবে না।
আইন অমান্য করা ঠিক হবে না।
আমরা স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান চালাবাে।
স্বাক্ষর সংগ্রহ করেই আমরা আমাদের প্রতিবাদ জানাবাে।
না !
না !!!
না !!!
আমরা তােমাদের কথা মানবাে না।।
৩৩

বিশ্বাসঘাতক !
এরা সব বিশ্বাসঘাতক !!
তােমাদের কথা আমরা শুনতে চাই না।
আমরা একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবাে।
আইনের বেড়ি আমরা ভাঙবাে।
ভাঙবাে !
ভাঙবাে !!
ভাঙবাে !!!
অসংখ্য কণ্ঠের চিল্কারে চমকে উঠলেন পুলিশের বড়কর্তারা।
পিস্তলে হাত রাখলেন।
ছােটকর্তারা ছুটে এসে দাঁড়ালেন কন্সটেবলগুলাের পাশে।
সেপাইদের চোখেমুখে কোনাে ভাবান্তর নেই।
হুকুমের ক্রীতদাস ওরা।
কর্তাদের মুখের দিকে নির্লিপ্ত-দৃষ্টিতে চেয়ে।
সূর্য জ্বলছে।
রাইফেলের নলগুলাে চিকচিক করছে রােদে।
ইউক্যালিপ্টাসের ডাল থেকে পাতা ঝরছে।
কোনাে নেতার কথা আমরা শুনবাে না।
টেবিলে উঠে দাড়িয়ে সহসা চিৎকার করে উঠলাে তসলিম।
আমরা একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙবাে, কিন্তু বিশৃঙ্খলভাবে নয়। দশজন দশজন করে আমরা বেরিয়ে যাবাে রাস্তায়। মিছিল করে এগিয়ে যাবাে এসেম্বলির দিকে। এই আমাদের আজকের সিদ্ধান্ত। এই আমাদের আজকের শপথ।

রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।।
অসংখ্য কণ্ঠের গগন-বিদারি চিঙ্কারে দ্রুত গাড়ি থেকে নিচে নেমে এলেন পুলিশের বড় কর্তারা।
তাদের চোখের ভাষা পড়ে নিতে ছােটকর্তাদের একমুহূর্ত বিলম্ব হলাে না।
মুহূর্তে তারা ফিরে তাকালেন কন্সটেবলগুলাের দিকে।
হুকুমের দাস সেপাইগুলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের গেট লক্ষ করে এগিয়ে এলাে রাস্তার ।
মাঝখানে।।
প্রথম দশজন ছাত্রের দল তখন তৈরি হচ্ছে একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভাঙার জন্যে।
একটি ছেলে তাদের নাম-ঠিকানা কাগজে লিখে নিচ্ছে।
প্রচণ্ড শব্দে লােহার গেটটা খুলে গেলাে।
পুলিশের দল আরাে দু-পা এগিয়ে এলাে সামনে।
শপথের কঠিন দীপ্তিতে উজ্জ্বল দশজন ছাত্র।
দশটি মুখ।
মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলাে আকাশের দিকে তুলে পুলিশের মুখােমুখি রাস্তায় বেরিয়ে এলাে।
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
সেপাইরা ছুটে এসে চক্রাকারে ঘিরে দাঁড়ালাে ওদের।
সবার বুকের সামনে একটা করে রাইফেলের নল চিকচিক করছে।
৩৪

আমতলা।
মধুর রেস্তোরা।
ইউনিয়ন অফিস।
পুকুরপাড়।
চারপাশ থেকে ধ্বনি উঠলাে—
রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।
ততক্ষণে ছাত্রদের দ্বিতীয় দলটা বেরিয়ে পড়েছে রাস্তায়।
তৃতীয় দল এলাে।
চতুর্থ দল এলাে।
ধরে ধরে সবাইকে দুটো খালি ট্রাকের মধ্যে তুলে নিলাে সেপাইরা ।।
পুলিশের বড়কর্তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠা।
কত ধরবাে ?
কত নেবাে জেলখানায় ?
ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের মতাে বাইরে বেরিয়ে আসছে ছাত্ররা।
সহসা চোখ-মুখ জ্বালা করে উঠলাে ওদের।
সবকিছু ঝাপসা হয়ে আসছে।
দরদর করে পানি ঝরছে দুচোখ দিয়ে।
কে যেন চিৎকার দিয়ে উঠলাে—
কাঁদুনে গ্যাস ছেড়েছে ওরা।
চোখে পানি দাও।।
অনেকগুলাে ছাত্র হুমড়ি খেয়ে পড়লাে বিশ্ববিদ্যালয়ের পুকুরটার ভেতরে।
চোখ জ্বলছে।
পানি ঝরছে।।
কেমন যেন ধোয়াটে হয়ে গেছে পুরাে এলাকাটা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের দেয়াল টপকে ঝাঁকেঝকে ছাত্ররা এগিয়ে গেলাে মেডিক্যাল ব্যারাকের দিকে।
কবি আনােয়ার হােসেনের জামাটা একটা লােহার শিকের মধ্যে আটকে ছিড়ে গেল।
পেছন ফিরে তাকালেন না তিনি।
চোখমুখ জ্বলছে তার।
জ্বলুক।
ছাত্ররা একশাে চুয়াল্লিশ ধারা ভেঙে দিয়েছে।
আন্দোলন সবে শুরু হলাে। কাঁদুনে গ্যাসের ধোয়া দিয়ে তাকে আটকানাে যাবে না।
ভাইসব !
সহসা চিৎকার করে উঠলাে তসলিম।
আপনারা বিশৃঙ্খলভাবে ছুটোছুটি করবেন না।
আপনারা এদিকে আসুন।
আমরা মেডিক্যাল ব্যারাকে আবার জমায়েত হবাে।
পুলিশের গাড়িগুলাে ততক্ষণে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে থেকে সরে গিয়ে মেডিক্যাল ব্যারাকের মুখােমুখি এসে দাঁড়িয়েছে।
৩৫

বড়কর্তাদের কাছে হুকুম এসেছে, যেমন করে হােক এ আন্দোলনকে এখানে শেষ করতে হবে।
একটু পরে এসেম্বলি বসবে।।
এমএলএ-রা সবাই আসবেন।
তাদের আসার আগে পথ পরিষ্কার করে দিতে হবে।
ছাত্রদের সরিয়ে দিতে হবে পুরাে এলাকা থেকে।
বড়কর্তারা আরাে সেপাহি চাইলেন।
আরাে গাড়ি চাইলেন।
আরাে গাড়ি এলাে।
আরাে সেপাহি এলাে।
আরাে অস্ত্র এলাে।
সঙ্গে সঙ্গে আরাে ছাত্র এলাে।
আরাে কঠিন শপথে হলাে দীপ্ত ওদের মুখ ।
মেডিক্যাল কলেজের সামনের রাস্তাটা প্রায় যুদ্ধক্ষেত্রের অবয়ব নিয়েছে।
বিলকিস বানুর গাড়িটা ঘিরে দাঁড়ালাে একদল ছাত্র।
এদিকে কী হচ্ছে—
ঘুরে দেখবার বাসনা নিয়ে দেখতে এসেছিলেন বিলকিস বানু।
কিন্তু ছাত্রদের হাতে এভাবে ধরা পড়ে যাবেন ভাবতেও পারেননি।
তার গাড়ির চাকা থেকে বাতাস ছেড়ে দেয়া হলাে।
কাচগুলাে ভেঙে গুড়িয়ে দিলাে ছাত্ররা।
আপনার সাহস তাে কম নয়। লিপস্টিক মেখে গাড়ি হাঁকিয়ে বেড়াচ্ছেন ! জানেন না আজ হরতাল ?
আমি কিছু জানি না।
কিছু জানতাম না।
বিশ্বাস করুন।
ভয়ে আর আতঙ্কে গলাটা শুকিয়ে গেলাে বিলকিস বানুর ।
ঝড়ে ভেজা কাকের মতাে থরথর করে কাপছেন তিনি।
মেয়েমানুষ, আপনাকে মাপ করে দিলাম।
গাড়ি এখানে থাকবে।
পায়ে হেঁটে যেখানে যাবার চলে যান।
মুহর্তে গাড়ির কথা ভুলে গেলেন বিলকিস বানু।
গাড়ির চেয়ে জীবনের মূল্য অনেক বেশি।
বেঁচে থাকলে অনেক অনেক গাড়ি হবে তার।
একটা পুলিশও ছিলাে না ওখানে ?
রাগে চোখমুখ লাল হয়ে গেলাে মকবুল আহমদের।
দু-চোখে পানি ঝরছে বিলকিস বানুর।
আমার চুল টেনে দিয়েছে ছাত্ররা।
আমার মুখে থুথু দিয়েছে ছাত্ররা।
আমার গাড়িটা ভেঙে গুড়িয়ে দিয়েছে।
রাগে কাঁপতে কাঁপতে রিসিভার তুলে নিলেন মকবুল আহমদ।
পুলিশের বড়কর্তাকে ফোনে পেয়ে রীতিমতাে গালাগাল দিলেন তিনি।
৩৬

গুণ্ডা বদমায়েশরা রাস্তাঘাটে মেয়েছেলেদের ধরে-ধরে অপমান করছে। দেখতে পাচ্ছেন
? কী করছেন আপনারা ?
কাঁদুনে গ্যাস আর লাঠিতে যদি কাজ না হয়, হাত-পা গুটিয়ে বসে থাকলে চলবে ? গুলি করে ওদের খুলি উড়িয়ে দিতে পারছেন না ?
মেডিক্যাল ব্যারাকের উপর তখন অজস্র কাদুনে-গ্যাসের বর্ষণ চলছ।
স্রোত বাধাপ্রাপ্ত হয়ে দ্বিগুণ গতি নিয়েছে।
এসেম্বলির দিকে একটা মাইক্রোফোন লাগিয়ে বক্তৃতা দিচ্ছে তসলিম।
তার দিকে চেয়ে চেয়ে বিড়বিড় করে বললেন কবি আনােয়ার হােসন—
আন্দোলন সবে শুরু হয়েছে।
কার শক্তি আছে একে স্তব্ধ করে দেয় ?

মেডিক্যালের রাস্তায় অংসখ্য ইটের টুকরাে ছড়ানাে।
পুলিশ আর ছাত্রদের মধ্যে এখন ইটের যুদ্ধ চলছে।
পুঁটলিটা বগলে নিয়ে অবাক চোখে সেদিকে চেয়ে রইলাে গফুর।
কী হচ্ছে এসব ?
ভাবার চেষ্টা করলাে।
কিন্তু নিজের ক্ষুদ্রবুদ্ধি দিয়ে কারণ নির্ণয় করতে পারলাে না।
সূর্যটা ঈষৎ ঢলে পড়েছে পশ্চিম।
আকাশে তখনাে একটুকরাে মেঘ নেই।
পলাশের ডালে সােনালি রােদ লালরঙ মেখে নুয়ে পড়েছে পথের দু-পাশে।
কয়েকটা কাক তারস্বরে চিৎকার জুড়েছে মেডিক্যালের কার্নিশে বসে।
এতক্ষণ বাতাস ছিলাে।
মুহূর্ত-কয়েক আগে তাও বন্ধ হয়ে গেছে।
সহসা শব্দ হলাে।
গুলির শব্দ।
আবার!
আবার!!
মুহূর্তে বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে গেল সবাই।
ছাত্র।
মানুষ।
এক ঝলক দমকা বাতাস হঠাৎ কোত্থেকে যেন ছুটে এসে ধাক্কা খেলাে ব্যারাকের এককোণে দাঁড়ানাে আমগাছটিতে।
অনেকগুলাে মুকুল ঝরে পড়লাে মাটিতে।
কাকগুলাে চিৎকার থামিয়ে পরস্পরের মুখের দিকে তাকালাে।
তারপর একটা কাক ভয়ার্ত ডানা মেলে আকাশে উড়লাে।
আকাশে তখনাে গনগনে রােদ।
শহরের সমস্ত আকাশ জুড়ে উড়তে লাগলাে কাকটা।
কোথাও কোনাে শব্দ নেই।
শুধু একটি ভয়ার্ত কাক আর্তশব্দে উড়তে থাকলাে আকাশে।
ঈশানকোণ থেকে ভেসে এলাে একটুকরাে কালাে মেঘ।
৩৭

সহসা সেই মেঘের আড়ালে মুখ লুকালাে সূর্য।
খবরটা দাবানলের মতাে ছড়িয়ে পড়লাে পুরাে শহরে।
ওরা গুলি করেছে।
ছাত্রদের উপরে গুলি চালিয়েছে ওরা।
ক’জন মারা গেছে ?
হয়তাে একজন। কিম্বা দুজন। কিম্বা অনেক। অনেক।
দোকান-পাটগুলাে সব ঝড়ের বেগে বন্ধ হতে শুরু হলাে।
দোকানিরা নেমে এলাে রাস্তায়।
বাসের চাকা বন্ধ।
কল-কারখানা বন্ধ।
বিকট শব্দে হুইসেল বাজিয়ে ইঞ্জিন ছেড়ে নিচে নেমে এলাে ট্রেনের ড্রাইভাররা।
আজ চাকা বন্ধ।
রিকশাটা একপাশে ঠেলে রেখে খবরটা যাচাই করার জন্যে সামনের একটা পান-দোকানের দিকে এগিয়ে গেলাে সেলিম।
সে-ও আজ রিকশা চালাবে না।
ওরা নাকি ছাত্রদের উপর গুলি করেছে। কতজন মারা গেছে ?
হিসাব নেই।
সবাই খোঁজ নিতে এগিয়ে গেলাে বিশ্ববিদ্যালয়ের দিকে।
মেডিক্যালের দিকে।
এটা অন্যায়।
এই অন্যায় আমরা সহ্য করবাে না।
মেডিক্যালের কাছাকাছি এসে জনতা এক বিশাল মিছিলে পরিণত হলাে।
ক্ষুব্ধ আক্রোশ ফেটে পড়ছে মানুষগুলাে।
এ হত্যার বিচার চাই আমরা।
যারা আমাদের ভাইদের খুন করেছে তাদের বিচার চাই আমরা।

ধীরেধীরে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এলাে।
ঘন অন্ধকারে ঢেকে গেল পুরাে শহরটা।
সেই অন্ধকারকে আশ্রয় করে দুটো এম্বুলেন্স নিয়ে মেডিক্যালের পেছনে মর্গের সামনে।
এসে দাড়ালাে কয়েকজন পুলিশ অফিসার।
মৃতদেহগুলাে রাতারাতি সরিয়ে ফেলতে হবে।
ভাের হবার আগেই আজিমপুরায় কবর দিয়ে দিতে হবে ওদের।
সারাশরীর ঘামছে।
পকেট থেকে রুমাল বের করে বারকয়েক মুখ মুছলেন আহমেদ হােসেন।
লাশগুলাের নাম ধাম ঠিকানা যদি কিছু থেকে থাকে লিখে নাও।
কিছুই পাওয়া যাচ্ছে না স্যার।
জবাব দিলেন জনৈক সহকারী।
* একজনের কাছে একটা পুঁটলি পাওয়া গেছে।
তার মধ্যে দুটো শাড়ি, কিছু চুড়ি, আর একটা আলতার শিশি।
এগুলাে কী করবাে স্যার ?
৩৮
রেখে দাও। কাল অফিসে জমা দিয়ে দিয়াে। লাশগুলাে তাড়াতাড়ি তুলে নাও গাড়ির ভেতরে। এখানে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করা ঠিক হবে না।
লাশগুলাে একবার দেখবেন কি স্যার ?
আরেক সহকারী প্রশ্ন করলেন।
না। প্রয়ােজন নেই।
শান্তগলায় জবাব দিলেন আহমেদ হােসেন।
রুমালে আবার মুখ মুছলেন তিনি।
ছেলে তসলিমের মূর্খতার জন্য এতদিন প্রমােশন বন্ধ হয়েছিলাে।
এবার সরকার হয়তাে মুখ তুলে তাকাবেন তার দিকে।
মনে মনে ভাবলেন তিনি।
মৃতদেহগুলাে গাড়ির মধ্যে তােলা হচ্ছে।
সহসা একটা সিগারেট ধরাতে গিয়ে চমকে উঠলেন আহমেদ হােসেন।
সমস্ত শরীরটা মুহূর্তে যেন হিম হয় গেলাে তার।
শরীরের সমস্ত শক্তি নিয়ে অতি ক্ষীণস্বরে তিনি ডাকলেন দাড়াও।
মুহূর্তে যেন একটা ভূমিকম্প হয়ে গেলাে।
মাতালের মতাে টলতে টলতে মৃতদেহের দিকে এগিয়ে এলেন তিনি।
টর্চ ! টর্চটা দেখি!!
জনৈক সহকারী টর্চটা জ্বেলে মৃতদেহের উপর ধরলেন।
মৃত তসলিমের রক্তাক্ত মুখের দিকে চেয়ে স্তব্ধ হয়ে গেলেন আহমেদ হােসেন।
চেনেন নাকি স্যার?
একজন সহকারী প্রশ্ন করলেন তাঁকে।
আহমেদ হােসেন বােবাদৃষ্টিতে একবার তাকালেন শুধু তার দিকে।
কিছু বলতে গিয়ে মনে হলাে জিহ্বাটা পাথরের মতাে শক্ত হয়ে গেছে।
কিছুতেই নাড়াতে পারছেন না তিনি।

ডুকরে কেঁদে উঠলেন মা।
এ কী সর্বনাশ হয়ে গেলাে আমার !
আমি এবার কী নিয়ে বাঁচবাে !!
ছােট ভাইবােনগুলাে মেঝেতে গড়াগড়ি দিয়ে কাদছে।।
জানালার পাশে নীরবে দাঁড়িয়ে সালমা।
বাইরের আকাশটার দিকে তাকালাে সে।
বুকে তার এক অব্যক্ত যন্ত্রণা।
আর একটা দিনও কি বেঁচে থাকতে পারতাে না তসলিম !
কেন সে এমন করে মরে গেলাে ?

মেডিক্যালের সবগুলাে ওয়ার্ড ঘুরে ঘুরে দেখলাে সালেহা।
নেই।
এখানে নেই।
থানায় গেলাে।
জেলগেটে বন্দিদের খাতা খুলে নাম পড়লাে সবার।
৩৯

নেই।
এখানেও নেই।
শূন্যঘরে ফিরে এসে সারারাত অপেক্ষা করলাে সালেহা ।
ভােরের কাক ডেকে উঠলাে।
কেউ এলাে না।
কান্নায় ভেঙে পড়লাে সালেহা।
নেই।
সে বুঝি আর এই পৃথিবীতেই নেই।

কলসি কাঁখে পুকুরঘাটে দাঁড়িয়ে রইলাে আমনা।
দিন গেলাে।
রাত গেলাে।
লােকটা যে বিয়ের বাজার করতে সেই-যে শহরে গেলাে, কই আর তাে এলাে না।
নকশি কাঁথার কত ফুল।
কত পাখি !
রঙিন সুতাে দিয়ে আঁকলাে আমেনা।
রাতে কোনাে বাড়িতে পুঁথিপড়ার শব্দ শুনলে হঠাৎ চমকে ওঠে আমেনা।
চোখের পাতা পানিতে ভিজে যায়।

সূর্য উঠছে।
সূর্য ডুবছে।
সূর্য উঠছে।
সূর্য ডুবছে।
সুতাের মতাে সরু পানির লহরি বালির উপর দিয়ে ঝিরঝির করে বয়ে যাচ্ছে।
ধলপহরের আগে রাস্তায় নেমে এলাে একজোড়া খালি পা।
সুতাের মতাে সরু পানি ঝরনা হয়ে বয়ে যাচ্ছে এখন।
কয়েকটি খালি পা কংক্রিটের পথ ধরে এগিয়ে আসছে সামনে।
ঝরনা এখন নদী হয়ে ছুটে চলেছে সাগরের দিকে।
সামনে বিশাল সমুদ্র।
———————————————————-সমুদ্রের মতাে জনতা।
নগ্নপায়ে এগিয়ে চলেছে শহীদ মিনারের দিকে।
অসংখ্য কালাে পতাকা।
পতপত করে উড়ছে।
উড়ছে আকাশে।।
মানুষগুলাে সমুদ্রের ঢেউয়ের মতাে অসংখ্য ঢেউ তুলে এগিয়ে আসছে সামনে।
ইউক্যালিপ্টাসের পাতা বৃষ্টির মতাে ঝরে পড়ছে নিচে। মাটিতে।
ঝরে।
প্রতি বছর ঝরে।
তবু ফুরােয় না।
——————————————————————————